Monday, July 14, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 358



চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২৩+২৪

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
ত্রয়োবিংশ_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা বেশ অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে নওশাদকে কল করলো। নওশাদ তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো না। একটু বাদে নওশাদ নিজেই কল ব্যাক করলো অপর্ণাকে।

-অপর্ণা?

-জ্বী। তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে। তুমি আমার অফিসে এসে দেখা করতে পারবে?

-আজকেই?

-তোমার সুবিধামতো সময়ে আসলেই হবে। আজকে তো তোমার দেবর জেল থেকে ফিরেছে, আজ থাক। তুমি দিন দুয়েকের মাঝে দেখা করো।

-আচ্ছা কিন্তু কী বিষয়ে কথা বলতে চান?

-অবশ্যই তোমার লাভের বিষয়ে। এখন রাখো, আমি একটু ব্যস্ত আছি।

-আচ্ছা।

অপর্ণা ফোন রেখে গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলো। এর মধ্যেই অর্ণব এসে বসলো পাশে।

-রূপসা আর রাদিফকে নিয়ে আসবো কবে? এখন তো বাড়িতে সব ঠিক আছে।

-কী ঠিক আছে? আশেপাশের মানুষ এখনো কেমন করে তাকাবে! আমার বাচ্চারা ভয় পাবে।

-আমার কথার বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা সবসময় করবে না অপর্ণা। যেটা বলেছি ঐটা করবে।

-তুমি আমাকে ধমকানোর সাহস কী করে পেলে? আমি আজকেই চলে যাবো বাড়ি ছেড়ে।

-দ্বিতীয়বার এই কথা বললে আমি নিজেই সসম্মানে তালাক দিয়ে রেখে আসবো। তোমার রাগটা লেখার উপর ঝেরেছি বলে ভেবো না তোমাকে কিছু বলবো না। তোমাকে যখন আনতে পেরেছি ঠিক সেভাবেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসবো।

অপর্ণা চুপ হয়ে গেল। অর্ণবের অগ্নিচক্ষু তাকে এক মুহূর্তে নীরব করে দিল। বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না সে। অর্ণব তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অপর্ণার বাঁকা কথাগুলো অর্ণব আর কোনোভাবেই নিতে পারছে না। সহ্যসীমা তার অবশিষ্ট নেই আর। অপর্ণাও বুঝতে পেরেছে অর্ণব মারাত্মক রেগে আছে তবুও তার জেদ কমলো না। সে ভাবলো এ রাগের কারণ চিত্রলেখা! রাগটা আবারো চিত্রলেখার উপর গিয়েই পড়লো।

____________

চিত্রলেখাকে রান্নাঘরে দেখে ভ্রু কুঁচকালো সাথী। মেয়েটার উপর কাজ চাপিয়ে অপর্ণা আবারো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে নির্ঘাত!

-তুই কেন কাজ করছিস এখন? উনি কাজ চাপিয়ে পালিয়েছে?

-বাদ দাও তো ভাবী।

-আর কত বাদ দিবি তুই? তোর মধ্যে একটুও রাগ জেদ জাগে না?

-আল্লাহর উপর ছেড়ে দিছি ভাবী, বিচারের মালিক তো তিনিই। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।

-ধৈর্য রাখা ভালো তবে অন্যায় মুখ বুঁজে মেনে নেওয়া নয়। দিনরাত ও তোকে অপমান করে, তোর কি একটুও প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করেনা?

-করেছিলাম তো ভাবী, দেখলে তো ভাইয়া কেমন ব্যবহার করলো। এখন প্রতিবাদ কথায় করবো না, কাজেই প্রতিবাদ করবো।

-মানে?

-বুঝতে পারবে ভাবী, ধৈর্য রাখো।

চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি লক্ষ করলো সাথী কিন্তু বুঝে উঠতে পারলো না সে কী করতে চাইছে। চিত্রলেখা রান্না শেষ করলো। পেঁয়াজু ভেজেছে সে। অপর্ণার ঘরে পেঁয়াজুর বাটি রাখতে গেল সে। অপর্ণা তখনো রেগে ছিল। চিত্রলেখাকে দেখে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো তবে অকস্মাৎ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চিত্রলেখা বাটি রেখে চলে গেল। অপর্ণা কেবল রক্তচক্ষু মেলে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। চিত্রলেখাকে এত সহজে সে ছাড়বে না তা স্পষ্ট বয়ান হলো তার চাহনি দ্বারা।

_______________

চিত্রলেখা ঘরে এসে বইখাতা গোছাতে শুরু করলো। হোস্টেলে যাওয়ার সময় সন্নিকটে তার। এতদিন অনিকের আসার অপেক্ষায় ছিল। এখন সব যখন ঠিকই হয়েছে, তখন আবার হোস্টেলে ফিরতে পারে সে। ওখানে চাইলেও অপর্ণা তাকে বিরক্ত করতে পারবে না। চিত্রলেখাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে অনিক ঢুকলো তার রুমে। অনিককে দেখে খানিকটা বিস্মিত হলো সে। অনিক সচরাচর যেচে তার সাথে কথা বলতে আসে না অথচ আজ এসেছে! কৃতজ্ঞতাবোধ নাকি দায়িত্ববোধের জন্ম?

-কোথায় যাচ্ছিস তুই?

-হোস্টেলে ভাইয়া। অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে, এখন হোস্টেলে থেকে দিনরাত পড়েই কভার করতে হবে।

-বাসায় কী অসুবিধা?

-সবসময় বাচ্চারা থাকে, ওদের রেখে আমার পড়তে বসতে মন চায় না।

-হোস্টেলের রুমমেট কী রকম? সমস্যা করে? তোর সাথে ভালো ব্যবহার করে?

-কোনো সমস্যা হয়না ভাইয়া।

-আচ্ছা আমিই রেখে আসবো কাল তোকে।

চিত্রলেখা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অনিক আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল। চিত্রলেখা মুচকি হাসলো। সময়ের পরিক্রমায় চরিত্রগুলোর বিপরীত রূপ তার সামনে আসছে, কেবল সবসময় সাথী ভাবীকেই পাশে পেয়েছে সে। মানুষটাকে চিত্রলেখা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে শুধুমাত্র তার ব্যবহার এবং ভালোবাসার জন্য। অপর্ণার অত্যাচারের মাঝে খানিকক্ষণের প্রশান্তি হয়ে আছে সাথীর আদর-স্নেহ। এসব না থাকলে হয়তো সে অনেক আগেই মরে যেত অনাদরে।

_________________

রাতের জার্নি সচরাচর সহ্য না হলেও সিয়ামের কিছু করার নেই। চাচার শরীর খারাপ, এমতাবস্থায় নিজের কমফোর্ট নিয়ে ভাবার অবকাশ তার নেই। আর বোধহয় দেড় ঘণ্টার মতো লাগবে পৌঁছাতে। সিয়াম আগামীকাল যাবে ভেবেছিল কিন্তু আজ আচমকা চাচার শরীর বেশি খারাপ হওয়াতে লাস্ট বাসটার টিকিট সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে সেটাতেই চড়ে বসেছে সে।

ঘণ্টা দেড়েক পর বাস থেকে নেমে সোজা হাসপাতালের উদ্দেশ্যেই রওনা দিল সে। তার চাচাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সন্ধ্যা নাগাদ। হার্ট এটাকের আশঙ্কা সন্দেহে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিয়ামের সেখানে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না। হাসপাতালের কেবিনের একপাশের চেয়ারে সুবহা বসে কাঁদছে, অন্যপাশে তার চাচী বিলাপ করছে। সিয়াম কার কাছে কী সান্তনা দিবে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। সিয়ামকে দেখামাত্র সুবহার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। সিয়ামের বুকের কাছাকাছি আশ্রয় নিয়ে সে আর্তনাদ করতে লাগলো।

-ভাইয়া, আমার বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো? আমার বাবা কেন এমন করছে? ভাইয়া বাবার কিছু হবে না তো?

-তুই একদম চিন্তা করিস না। বোস এখানে চুপচাপ, কিচ্ছু হবেনা চাচ্চুর।

সুবহাকে বসিয়ে সিয়াম তার চাচীর পাশে বসলো। তিনিও চিৎকার করে আর্তনাদ করে উঠলেন। সিয়াম তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।

-চাচী, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। চাচ্চুর কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।

-বাবা, ভালো মানুষ খাইতে বসছিল। কিসের না কিসের কল আসলো, কথা বলার পর থেকেই মানুষটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো! আল্লাহ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা কেন নিতেছে রে বাবা! লোকটারে কেন এত কষ্ট দিচ্ছে?

-শান্ত হোন চাচী, সব ঠিক হয়ে যাবে।

সিয়ামের মনেও ভয় খেলা করছে। এই চাচ্চুই তাকে দীর্ঘতম ধরে লালন পালন করেছেন। বলতে গেলে বাবার মতো ছায়া হয়ে ছিলেন সবসময়। সিয়ামের আদর্শ, নৈতিকতা সবই তার এ চাচ্চুর গড়ে দেওয়া। আজ সেই মানুষটাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে সিয়ামের ভেতরটাও দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। ডাক্তাররা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছেন তবুও সিয়ামের মনের ভয় একটুও কমছে না।

ঘণ্টাখানেক পর তার চাচা শাহজাহান আলীর জ্ঞান ফিরলো। ডাক্তাররা যেকোনো একজনকে দেখা করার অনুমতি দিলেন। সিয়ামের চাচী ভেতরে যেতে চাইলো কিন্তু ডাক্তার বললেন তিনি বেশ কয়েকবার ‘সিয়াম’ নাম ধরে ডাকছিলেন। শেষমেশ সিয়ামই গেল তার চাচ্চুর সাথে দেখা করতে।

শাহজাহান আলীর শক্ত সামর্থ শরীরটা মুহুর্তেই রোগা হয়ে গেছে যেন। যমে মানুষে টানাটানির পর যে কঙ্কালসার অবশিষ্ট রয়েছে তা চোখে দেখেও সিয়ামের বুক চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। বেডের পাশে থাকা ছোট টুল সিস্টেম জায়গাটাতে বসলো সে। চোখ পিটপিট করে শাহজাহান আলী সিয়ামের উপস্থিতি দেখলেন।

-সিয়াম এসেছো তুমি?

-জ্বী চাচ্চু, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। ডাক্তার বলেছেন আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন।

-আ..আমার তো..তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ক..কিছু কথা আছে সিয়াম। আমি যদি তোমার লালন পালনে কোনো অবহেলা না করে থাকি, আমি আশা করি তুমি আমার কথা রাখবে।

-কী কথা চাচ্চু?

-তোমার আগামী সপ্তাহের আগেই সুবহাকে বিয়ে করতে হবে।

সিয়ামের মনে হলো তার পায়ের নিচের জমিন যেন কেঁপে উঠলো। এ কেমন অদ্ভুত শর্তের মুখোমুখি তাকে করা হলো? সুবহাকে সে সর্বদা বোনের নজরে দেখে এসেছে। চিত্রলেখার জন্য তার অনুভূতিও মিথ্যে নয়। তবে কী করে অন্য একজনকে সে বিয়ে করে ফেলতে পারে?

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
চতুর্বিংশ_পর্ব
~মিহি

সিয়াম একমনে বসে আছে। কিছু বলার কিংবা কাউকে কিছু জানানোর ক্ষমতা তার নেই, বিশেষ করে সুবহাকে। শাহজাহান আলীকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। আপাতত তার সাথে সকাল অবধি কাউকে দেখা করতে দেওয়া হবে না। সিয়ামের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আচমকা তার চাচা এমন সিদ্ধান্ত কেন নিতে চাইছেন বুঝে উঠতে পারলো না সে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিয়াম বুঝতে পারলো তার উচিত তার চাচী এবং সুবহাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসা। এভাবে সারারাত এখানে বসিয়ে রাখা উচিত না তাদের।

-চাচী, রাত তো অনেক হচ্ছে। আমি আছি এখানে, সুবহা আর আপনাকে পৌঁছি দিয়ে আসি?

-না সিয়াম। আমি এখান থেকে সরবো না। আমি আছি, তুমি সুবহাকে দয়া করে রেখে এসো।

-কিন্তু চাচী।

-ওর জেগে থাকার অভ্যেস নেই, মাইগ্রেন বাড়বে। ওকে রেখে আসো তুমি।

সিয়াম না করতে পারলো না কিন্তু সুবহার আশেপাশে থাকতেও তার ইচ্ছে করছে না। অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে পড়েছে সে। চাচীকে নিষেধও করতে পারলো না সে। সুবহা হ্যাঁ না কিছু বললো না। সে মূর্তির ন্যায় হয়ে আছে। কান্নাও করছে না। সুবহার এ নীরবতা ভয়ঙ্কর লাগছে সিয়ামের কাছে।

সুবহা বাড়িতে ঢোকামাত্র যথারীতি নিজের ঘরে ঢুকলো চুপচাপ। সিয়াম ভাবলো সে হয়তো ঘুমোনোর জন্য গেছে। চাচীকে কল দিল সে।

-চাচী, আমি সুবহাকে পৌঁছে দিয়েছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি অল্প সময়ের মধ্যেই আসছি।

-সুবহা একা ভয় করতে পারে, তুমি ওখানেই থাকো সিয়াম। ভোরে চলে এসো বাবা। আমার সমস্যা হবে না।

সিয়াম আবারো অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। পৃথিবীর সব সূত্র কি আজ তার বিপক্ষে? যাই হোক, সে আপাতত এসব ভাববেই না। পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিংয়ে আসতেই সিয়াম দেখলো সুবহার ঘরের আলো এখনো জ্বালানো। তার মানে কি সে এখনো ঘুমায়নি? সিয়াম সুবহার ঘরের দিকে এগোল। ঘরের দরজায় আসতেই অবাক হলো সিয়াম। সুবহা একদম পাথরের ন্যায় মেঝেতে বসে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে আছে। চোখ নির্জীব, ঠোঁট খানিকটা কাঁপছে। সিয়ামের ভয় বাড়লো। মেয়েটা কি বড়সড় শকের মধ্যে আছে এখনো। সিয়াম সুবহার পাশে বসে সুবহার কাঁধে হাত রাখলো।

-চাচ্চুর কিছু হবেনা, সুবহা। চিন্তা করিস না তুই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

-বাবা ঠিক হবে? আবার আগের মতো?

-হুম, একদম ঠিক হয়ে যাবে চাচ্চু।

-আমার জন্য সব হয়েছে। সব আমার দোষ ভাইয়া, সব আমার দোষ।

চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সুবহা। সিয়াম আলতো করে সুবহার মাথায় হাত রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। সুবহা কোনোক্রমেই থামতে চাইলো না। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠতে শুরু করলো তার। সিয়াম আলতো করে সুবহাকে ধরে বিছানায় বসালো।

-সুবহা, শান্ত হ। তুই না চাচ্চুর স্ট্রং মেয়ে? তুই এতটা ভেঙে পড়ছিস? নিজেকে স্বাভাবিক কর। তোকে শক্ত থাকতে হবে। এখন চুপচাপ ঘুমা, সকালে উঠে দেখতে যেতে হবে না?

-হু।

সুবহার কান্নার গতি কমলো। বিছানায় হেলান দিল সে। সুবহার গায়ে কাঁথা দিয়ে আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিল সিয়াম। সুবহা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করলো। লাইট অফ করে নিজের ঘরের দিকে এগোলো সে। আচমকা সিয়ামের মাথায় একটা কথা খেলতে লাগলো, সুবহা কেন বললো সব দোষ ওর? কিছু কি হয়েছে? প্রশ্নটা মাথায় আসলেও সিয়াম ভাবলো সুবহা শোকে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাই নিজেকে দোষ দিচ্ছে। এটা মনুষ্য স্বভাব। কাছের মানুষজনের বিপদ হলে মানুষ নিজের ছোট ছোট কাজগুলোর দোষ দিতে থাকে সেই বিপদের কারণ হিসেবে। সুবহাও তার ব্যতিক্রম নয়। সিয়ামের ঘুম হলো না। চাচার বলা কথায় সে চিন্তিত। এত বছরে এমন কোনো বিষয় ঘটেনি যার জন্য তার চাচা তাকে এমন শর্ত দিতে পারে! নির্ঘুম, চিন্তিত রাত কাটলো সিয়ামের ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।

___________________

অনিক চিত্রলেখাকে বেশ সকালেই হোস্টেলে রেখে গেছে। অনিক বাড়তি কথা না বললেও চিত্রলেখার প্রতি অনিকের সামান্য হলেও স্নেহ অনুভব করতে পেরেছে চিত্রলেখা। নিজের ভাগ্যের উপর করুণা হচ্ছে তার। এক ভাই ভালোবাসে তো আরেক ভাই মুখ ফিরিয়ে নেয় অথচ সে তো চাইতো দুই ভাইয়ের নয়নের মণি হয়ে থাকতে। এ আশা বোধহয় তার কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কলেজের ক্লাস বারোটায়। চিত্রলেখা বেশ তাড়াহুড়ো করেই ক্লাসে গেল। আশেপাশে সুবহাকে খুঁজলো, না আসেনি মেয়েটা। সুবহাকে ছাড়া ক্লাসে চিত্রলেখার নিজেকে এতিম মনে হয়। একটাই বন্ধু তার, সেও আসেনি। আগের ক্লাসগুলোও মিস করেছে চিত্রলেখা। কেইস চলার কয়েকদিন সে কলেজে আসেনি, সুবহাকে জানানোও হয়নি এসব ঘটনা। এখন জানালেও রাগ করবে। চিত্রলেখা ঠিক করলো কলেজের পর সুবহার বাড়িতে গিয়ে দেখা করবে আর নোটগুলোও নিয়ে আসবে। দুইটার পর আর ক্লাস হলো না। কলেজ থেকে বেরিয়েই সুবহাকে কল করলো সে।

-সুবহা কই তুই? বাসায় আছিস? আমি আসবো একটু তোর ওখানে।

-লেখা…

-তোর কণ্ঠ এরকম কেন? কী হয়েছে তোর?

-লেখা বাবা..হা..হাসপাতালে।

-আঙ্কেলের কী হয়েছে? তুই কোন হাসপাতালে? আমি আসছি দাঁড়া।

-সেন্ট্রাল হাসপাতাল।

-আচ্ছা তুই নিজেকে সামলা, আমি এসে সব শুনবো।

চিত্রলেখা কল রেখে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হলো। সুবহা এমন সমস্যায় আছে কল্পনাও করেনি সে। না জানি আঙ্কেলের কী হয়েছে! অবশ্যই সিরিয়াস কিছু বোধহয়। চিত্রলেখার মনটাও বিমর্ষ হয়ে উঠলো। সুবহার বাবা তাকে নিজ মেয়ের মতোই দেখতেন। তার অসুস্থতা চিত্রলেখাকেও পীড়িত করছে।

হাসপাতালে আসতে মিনিট পনেরো লাগলো। চিত্রলেখা হাসপাতালে ঢুকে রিসেপশনে থাকা মহিলার থাকা কেবিন নম্বরের খোঁজ নিল। হার্টের ওয়ার্ডে! খানিকটা ভয় পেল চিত্রলেখা। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগোলো।

চিত্রলেখাকে দেখেই সুবহা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কান্নাগুলো আবারো বাঁধ মানলো না তার। চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারলো না কী ফলে সুবহাকে শান্ত করবে। বাবার ভালোবাসা সে পায়নি তবুও লোকটার মৃত্যুতে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল সেখানে মেয়েটার সবচেয়ে কাছের মানুষ তার বাবা আর সেই বাবাই এখন এ অবস্থায় আছে! চিত্রলেখা সুবহাকে ছাড়ালো না, কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকুক তাতে যদি যন্ত্রণা কিছুটা কমে।

দুপুরের দিকে সুবহার মাকে এলাও করা হলো। শাহজাহান আলীর জ্ঞান আছে তখন, তিনিই দেখা করতে চেয়েছেন। চোখের পানি মুছে সুবহার মা রেহানা সুলতানা কেবিনে ঢুকলো। নিজের স্বামীর শরীরের দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে উঠে তার। অসুস্থতা যেন তাকে কাবু করে ফেলেছে। শাহজাহান আলী বেশ কষ্টেই একটু কথা বলার চেষ্টা করলেন।

-রেহানা, তো..তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে। তুমি একটু শোনো আমার কথা।

-বলো আমি শুনছি।

-তোমার দুর্জয়ের কথা মনে আ..আছে?

-এমপির ভাইপো? যার উপর তুমি তোমার এক ছাত্রকে খুন করার সাক্ষী দিয়েছিলে?

-হ্যাঁ, সে আগামী মাসে ছাড়া পাচ্ছে। ওর লোক আমাকে কল করেছিল, এতদিন নাকি দুর্জয়ের জেল থেকে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সুবহার উপর নজর ওদের।

-সুবহা? ওরা সুবহার ক্ষতি করতে চায়?

-ওরা সুবহাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো চেষ্টা বাকি রাখবে না। আমি চাই সুবহাকে সিয়াম বিয়ে করে রাজশাহী নিয়ে যাক। দুর্জয়ের নাগালের বাইরে নিয়ে যাক।

-সিয়াম কি রাজি হবে?

-সিয়ামকে বোঝাও রেহানা, ও যেন আমার মেয়ের ক্ষতি হতে না দেয়। সুবহার অন্য কোথাও বিয়ে হলে আমার দুশ্চিন্তা থাকবেই তবে সিয়ামের কাছে সে নিরাপদ। ও…ওকে..বো…বোঝাও …

-তুমি শান্ত হও, শান্ত হও তুমি।

শাহজাহান আলীর হৃদস্পন্দন দ্রুত চলতে লাগলো। রেহানা বেগম চেঁচিয়ে ডাক্তার-নার্সকে ডাকলেন। পরিস্থিতি ক্রমাগত হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। রেহানা সুলতানা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সুবহা আবারো পাথরের ন্যায় হয়ে পড়লো। সিয়াম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখার দিকে তাকানোর সাহস সে পাচ্ছে না আর না পারছে সুবহার আশেপাশেও থাকতে। এ কেমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে বাঁধা পড়েছে সে?

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২২

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
দ্বাবিংশ_পর্ব
~মিহি

কোর্টে অপ্রত্যাশিত মুখগুলো চিত্রলেখাকে অপ্রস্তুত করছে বারংবার। তৌহিদের উপস্থিতি যেমন তাকে কাঁটা দিচ্ছে তেমনি রঙ্গনের দৃষ্টিও! সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে নজর তা হলো নওশাদের। চিত্রলেখা ভুলেও নওশাদের উপস্থিতি কামনা করেনি তবে অদ্ভুতভাবে সাথীর মা এবং ফুপু, কাকা এসেছে। রঙ্গন চিত্রলেখার দিকে তাকিয়েছে বেশ কয়েকবার। তৌহিদ যে অনিকের উকিল তা জানার পর থেকে সে সংকোচবোধ করছে। চিত্রলেখাকে অযথাই ভুল বুঝেছিল সে। আশফিনা আহমেদের উপস্থিতিতে চিত্রলেখার সাথে কথা বলার চেষ্টা করাও বৃথা। চুপচাপ নত মুখে বসে রইলো সে।

কোর্টের কার্যক্রম শুরু হলো। দীতির পক্ষের উকিল বেশ বড়সড় যুক্তির পসরা পেশ করলেন তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না। তৌহিদ গতকালকের রেকর্ডিংটা শোনানোর ব্যবস্থা করলো এবং সমস্ত ঘটনা যৌক্তিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করলো। এমতাবস্থায় দীতির উকিল কী করবে কিছুই বুঝলো না। যেখানে তার মক্কেল নিজের দোষ স্বীকার করেছে সেখানে সে কোন যুক্তি দেখাবে! তবুও ফেক ভিডিও বলে সম্বোধন করার চেষ্টাতেও ডাহা ফেইল করার পর দীতিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চাইলো তৌহিদ। অনুমতি দেওয়া হলো। দীতি ভয়ে ভয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ালো।

-মিস.দীতি, আপনি যে অনিক মাহমুদকে ফাঁসিয়েছেন তা তো স্পষ্টত দৃশ্যমান কিন্তু এ কাজের পেছনে আপনার অপর সহযোগী কে?

-আমার আর কোনো সহযোগী নেই। আমি একাই করেছি।

-এখনো মিথ্যের আশ্রয় নিলে আপনার শাস্তি বাড়বে মিস.দীতি। সুতরাং চুপচাপ সত্যটা বলুন। কোম্পানির তথ্য আপনি কার কাছে বিক্রি করতেন? কোনো সহযোগী ছাড়া এত গভীর প্ল্যান করা আপনার পক্ষে সম্ভব না।

-আমি একাই করেছি।

-আচ্ছা, তাহলে ভিডিও অনুযায়ী আপনি তিন লাখ টাকা রেখে গিয়েছিলেন। এত টাকা কোথায় পেলেন আপনি?

-আমি কোম্পানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের রাইভালের কাছে বিক্রি করেছি।

-আর এই ডিলটা কিভাবে হলো? কে এই রাইভাল?

দীতি থতমত খেয়ে গেল। এসব তার জানা নেই। সে কেবল তথ্য চুরি করতো এবং তার সহযোগীকে দিতো। তার সহযোগীই সব ডিল করতো। তাদের পরিকল্পনা ছিল কোনোভাবে ধরা পড়লে অনিককে যেন ফাঁসানো যায়।

-উত্তর নেই তাই না মিস.দীতি? আমি দিচ্ছি উত্তর। আপনার ফোন আমি ট্যাপ করিয়েছিলাম। কল রেকর্ডস অনুযায়ী আপনি একটা আননোন নম্বরে কিছুদিন হলো রেগুলার কল করেছেন। নম্বরটার কোনো ডিটেলস নেই তবে সেটার লোকেশন আমরা পেয়েছি? লোকেশন কোথাকার বলবো? আচ্ছা একটু পরে বলি। তার আগে আমার অনিককে কিছু প্রশ্ন করার আছে। আপনি আসুন। মে আই ইউর অনার?

জজসাহেব সম্মতি দিলেন। তৌহিদ বেশ বিচক্ষণ ভঙ্গিতে অনিকের মুখোমুখি দাঁড়ালো। অনিকের শরীর মোটামুটি অসুস্থ হলেও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।

-মিস.অনিক, আপনার কর্মজীবনের কত বছর হলো?

অনিক উত্তর দেওয়ার আগেই প্রতিপক্ষ উকিল অবজেকশন দেখিয়ে বসলো। এটা নাকি অবান্তর! তৌহিদ শুধু বললো তাকে প্রশ্নগুলো শেষ করতে দিতে। জজসাহেব অনুমতি বজায় রাখলেন।

-আমার কর্মজীবন পাঁচ বছরের।

-এর মধ্যে আপনি কর্মক্ষেত্রে বেশ খ্যাত! দুইবার প্রমোশন পেয়েছেন। আপনার মনে হয়না আপনার এই বিষয়টা ঈর্ষণীয়?

-হতে পারে তবে কর্মক্ষেত্রে আমরা সবাই বন্ধুর মতো, ঈর্ষা করার প্রশ্ন আসেনা।

-আপনি তোফায়েল সরকারকে তো চেনেন?

-হ্যাঁ, আমাদের আসার এক বছর আগে জয়েন করেছিলেন। আমরা ওনাকে বড় ভাই হিসেবে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ওনার কিছু সমস্যার কারণে আমাদের প্রমোশন হলেও ওনার হয়নি।

-কী সমস্যা জানতে পারি?

তৌহিদের প্রশ্নে বিব্রত হলো অনিক। অন্য কারো দোষত্রুটি সর্বসম্মুখে বলতে সে অভ্যস্ত নয়।

-আপনাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে মিস.অনিক।

-উনি হঠাৎ হঠাৎ জুনিয়র স্টাফদের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতেন, আবার কখনো কখনো তাদের উপর অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দিতেন।

-ওনার এ বিষয়ের কমপ্লেইন করেছিলেন আপনি কখনো?

-জ্বী, একবার করেছিলাম।

-উনি জানতে পেরেছিলেন?

-জ্বী এবং তারপর আমাদের মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। উনি ওনার মতোই ছিলেন।

-আচ্ছা ধন্যবাদ।

তৌহিদ অনিকের সাথে কথা শেষ করে দীতির কল রেকর্ডের ডিটেলস পেশ করলো। যে আননোন নম্বরে দীতি কথা বলতো তার লোকেশন তোফায়েল সরকারের বাড়ির সন্নিকটে। তৌহিদের এ তথ্য বের করতে কিছুটা সময় লেগেছে বটে তবে তথ্য নির্ভুল প্রমাণ পেয়ে তবেই সে কোর্টে পেশ করেছে। তৌহিদ আবারো দীতিকে কাঠগড়ায় ডাকলো।

-দীতি, এখন বলবেন সত্যিটা?

-তোফায়েল স্যার অনিক স্যারকে অপছন্দ করতেন। উনিই কোম্পানির তথ্য বিক্রি করার প্ল্যান করেন এবং এর জন্য আমাকে দশ লাখ টাকা দেন। তবে অনিক স্যারের আমার সত্যিটা জানতে পারাও ওনার প্ল্যান ছিল। উনি চেয়েছিলেন অনিক স্যার যেন একইসাথে রেইপ এবং জালিয়াতির কেসে ফেঁসে যান। এসব না করলে উনি আমাকে পুলিশে ধরানোর ভয় দেখিয়েছেন।

-দ্যাটস অল ইউর অনার।

তৌহিদের নৈপুণ্যে উপস্থিত সকলে হতবাক হলো। এতটুকু বয়সের একটা তরুণ এত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হতে পারে কেউ কল্পনা করেনি।জজসাহেব অনিককে বেকসুর খালাশ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তোফায়েল সরকারকে এরেস্ট করার নির্দেশ দিলেন।

_______________________

সাথীর চোখ থেকে অবিরত অশ্রু ঝরছে। অনিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সে। কোনোভাবেই অনিককে ছাড়ছে না। সাথীর পরিবার সেখানে উপস্থিত তবুও সাথীর মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। অনিককে ছাড়লেই যেন সে বহুদূর চলে যাবে।

-সাথী ছাড়ো, সবাই দেখছে তো।

-দেখুক! সবার চোখ আছে তাই দেখছে।

-বাকি ভালবাসাটা বাসায় গিয়ে দেখায়ো।

সাথী চোখ মুছলো। তার বিশ্বাসের প্রতিদান সে পেয়েছে। আশফিনা আহমেদের একটুও ইচ্ছে করছে না সেখানে থাকতে। নিজের ভাবীকে ফেলেই তিনি সামনে এগোলেন। রঙ্গনের না চাইতেও চিত্রলেখার সাথে কথা না বলেই সামনে পা বাড়াতে হলো। তৌহিদকে বেশ ঘটা করেই ধন্যবাদ জানালো সবাই। এত সব খুশির মুহুর্তের মাঝে চিত্রলেখা চুপচাপ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো।

বাড়িতে ফেরার পর থেকে চিত্রলেখা ঘর থেকে বেরোলো না। দরজা লাগিয়ে চুপচাপ জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ফোনের ভাইব্রেশনে বিরক্ত হলো সে। নম্বর না দেখেই রিসিভ করে কানে ধরলো ফোনটা।

-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।

-ওয়ালাইকুম সালাম। তুই ঠিক কতদিন পর আমার কল রিসিভ করলি! আগের যখন কল করেছিলাম কই ছিলি?

-ওহ সিয়াম ভাইয়া তুমি! আমি আসলে ফোনের দিকে তেমন নজর দেইনা তো।

-ভালো ছাত্রী বলে কথা! আচ্ছা শোন, চাচার শরীরটা নাকি ভালো নেই। আমি কাল বাড়িতে ফিরবো। তুই আসিস তো একটু।

-তুমি বাড়িতে ফিরবে দেখে আমার আসতে হবে?

-আজব তো, আসতে বলছি আসবি। এত বাড়তি কথা কিসের তোর?

-আচ্ছা ঠিক আছে।

সিয়াম কল কাটতেই চিত্রলেখার ফোনে আবারো কল আসলো। চিত্রলেখা ভেবেছিল সিয়াম বোধহয় আবার কল করেছে। কিন্তু নাহ! রঙ্গন কল করেছে তাকে। চিত্রলেখা রঙ্গনের কথাই ভাবছিল। রঙ্গনকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনাগুলো ইদানিং অনাবশ্যক তার মনে জায়গা করে নিচ্ছে।

-ভালো আছো চিত্রলেখা? সব তো ঠিক হলো, বলেছিলাম না?

-হুম ভালো আছি।

-সাথী আপু নিশ্চয়ই এখন আগের মতো হয়ে গেছে, অনেক খুশি তো আপু।

-বিশ্বাসের প্রতিদান পেয়েছে।

-আমি কখনো ভাবিওনি সাথী আপু এই খারাপ সময়টাতে ভাইয়াকে এতটা সাপোর্ট করবে। মেয়েরা সচরাচর একটু সন্দেহবাতিক হয় কিনা!
আসলে ভালোবাসায় হারানোর ভয় থাকলে বিশ্বাসটাও থাকেই। আর বিশ্বাস যেখানে আছে ষেখানে ভালোবাসা হারানোর ভয় কাজ করেনা।

-সবার ক্ষেত্রে এমন হয়না। কেউ কেউ তীব্র ভালোবাসা আর বিশ্বাসের প্রতিদানে ধোকাও পায়!

-তোমার অভিজ্ঞতা আছে?

-নিজের মাকে দেখেছি তো তীব্র ভালোবাসায় নিঃস্ব হয়ে যেতে।

-আমি দুঃখিত! আমি আসলে…

-ফরমালিটি মেইনটেইন করতে আসতে হবে না। আপনি অযথা অনুতপ্ত হচ্ছেন।

-চিত্রলেখা, তোমার কিছু হয়েছে? তুমি এভাবে কথা বলছো যেন তুমি বড়সড় কোনো মানসিক চাপে আছো। তোমার মনে কিছু একটা নিয়ে যুদ্ধ চলছে।

চিত্রলেখার বুক কেঁপে উঠলো। তার মনে চলতে থাকা কথাগুলো যেন কেউ সামনে থেকে জেড করছে তাকে। চিত্রলেখার ইচ্ছে করলো রঙ্গনকে উত্তর দিয়ে দিতে কিন্তু সে পারবে না। অর্ণবের ব্যবহারে পাওয়া কষ্টের পরিমাপ করা তার পক্ষে সম্ভব নয় আর না সে কষ্ট অন্য কাউকে ব্যক্ত করা। চিত্রলেখা কিছু বলার আগেই দরজায় টোকা পড়লো।

“বাইরে কেউ ডাকছে, পরে কথা হবে।” চটজলদি কল কেটে দরজা খুললো চিত্রলেখা। অপর্ণা ভ্রু কুঁচকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

-সবসময় দরজা লাগায়ে থাকা লাগে কেন তোর? কী করিস একা ঘরে?

-কোনো কাজ ছিল ভাবী?

-হ্যাঁ, সবার জন্য একটু নাস্তা বানা তো, আমার শরীরটা কেমন যেন লাগছে।

অপর্ণা মাথায় হাত দিয়েই নিজের ঘরের দিকে এগোলো। চিত্রলেখা বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মানুষ এত বাহানা কী করে করতে পারে অপর্ণাকে না দেখলে সে বিশ্বাসই করতো না। চিত্রলেখা চুলগুলো হাতখোপা করে রান্নাঘরে ঢুকলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে জিনিসপত্র একত্র করতে লাগলো।

অপর্ণা গভীর চিন্তায় ব্যস্ত। নওশাদ নামক লোকটার কথাবার্তা তার মাথায় ঘুরছে। অনিকের বের হওয়ার পরপরই লোকটা তাকে নিজের পারসোনাল নম্বর দিয়েছে এবং কল করতে বলেছে। অপর্ণা চেনে একে। চেয়ারম্যান, ভালোই টাকা-পয়সা আছে। অপর্ণা সিদ্ধান্ত নিল নওশাদের সাথে কথা বলবে সে। অবশ্যই নওশাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলেই নম্বর দিয়েছে সে!

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২১

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
একবিংশ_পর্ব
~মিহি

“চিত্রলেখা ভয় পেয়ো না, আমরা তোমার আশেপাশেই থাকবো। পুলিশের দুজন অফিসার সবসময় তোমার দিকে নজর রাখছে। তুমি চুপচাপ শুধু ওখানে যাবে এবং যতটা সম্ভব সত্যি কথা ওর মুখ থেকে বের করাবে।” তৌহিদের কথায় কেবল মাথা নাড়লো সে। এমনিতে যথেষ্ট সাহসী হলেও এ মুহূর্তে অনেকটা ভীত হয়ে পড়েছে সে। দীতি কি একা আসবে? কোনো পরিকল্পনা নিশ্চয়ই আছে তার! চিত্রলেখা জোরে শ্বাস নিয়ে সামনে তাকালো। তৌহিদ তখনো ফোনে তাকে নানারকম পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। চিত্রলেখা সেসব এখন কানে নিচ্ছে না। তার যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। চোখ বন্ধ করলো সে। ‘কায়া’ সত্তাটা যেন তার সামনে প্রতীয়মান হলো।

-ভয় পাচ্ছো চিত্রলেখা? তুমি যা করছো নিজের পরিবারের জন্য, ভয়কে স্থান দিও না মনে।

-আমি কি পারবো?

-তুমি অবশ্যই পারবে।

চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। সে পারবে, তাকে পারতেই হবে। সামনে তাকালো চিত্রলেখা। নেকাবে আবৃত সমস্ত শরীর তার। দীতির তাকে চেনার কথা না, আর এ অবস্থাতে তো মোটেও না।

দীতি নির্ধারিত সময়েই উপস্থিত হলো। ক্যাফের পেছনের অংশটা নির্জন তবে খানিকটা বন-জঙ্গলের মাঝখানে একটা রাস্তার মতো সামনে এগিয়েছে। জঙ্গলের ঝোপঝাড়ে তৌহিদ এবং দুজন পুলিশ লুকিয়ে আছে। রাস্তার একপাশে একটা ডাকবাক্সের মতো বাক্স রাখা। চিত্রলেখা সেখানেই অপেক্ষা করতে বলেছিল দীতিকে। দীতি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। দীতিকে অপেক্ষা করতে দেখে চিত্রলেখা তাকে কল দিল। দীতি তৎক্ষণাৎ রিসিভ করলো।

-আ..আমি এসেছি, আপনি কোথায় আছেন?

-টাকার ব্যাগ বাক্সে রেখে সামনে এগোও।

-আপনি মেয়ে?

-ছেলে মনে হয়? চুপচাপ সামনে আয়।

চিত্রলেখার ধমক শুনে দীতির ভয় বাড়লো। তার হাত পা কাঁপতে লাগলো। এ মুহূর্তে চিত্রলেখারও মনে হলো এ মেয়ে একা কিছু করতে পারবে না কখনোই, অবশ্যই এর পেছনে কেউ আছে। দীতি সামনে এগোলো। চিত্রলেখা তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।

-তো দীতি, তিন লাখ আছে তো?

-হ..হ্যাঁ, এখন প্রমাণটা ফেরত দিন আমাকে।

-দাঁড়াও, এত সহজে না! অনিক মাহমুদকে তো তুমি একা ফাঁসাওনি, সাথে যে ছিল সে কোথায়?

-আ..আপনি কী করে জানলেন?

-চুপচাপ প্রশ্নের উত্তর দাও!

-ওনার কথা বললে উনি আমাকে মেরে ফেলবে, উনি ভয়ঙ্কর লোক। দয়া করে আপনি টাকাটা নিয়ে আমাকে প্রমাণ দিয়ে দিন।

-এটেম্পট টু রেপের যে মিথ্যা কেস করেছো, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে তো ভালোই টাকা পাবে। আরো দুই লাখ তোমার কাছে চাওয়াই যায়, কী বলো?

-দেখুন আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। আপনি তিন লাখ বলেছেন, আমি দিয়েছি। এখন আমাকে প্রমাণ দিন।

-অনিক মাহমুদকে ফাঁসিয়ে কী লাভ হলো? বড়সড় পজিশনের কাউকে ফাঁসালে ক্ষতিপূরণ বেশি পাইতা!

-আমার কিছু করার ছিল না। তাছাড়া অনিক সহজ সরল, ওকে ফাঁসানো সহজ ছিল! এখন আপনি প্রমাণ দিবেন?

চিত্রলেখা একটা ছোট বক্স দীতির দিকে বাড়িয়ে দিল। দীতি বক্সটা খুলে একটা মেমোরি কার্ড পেলো।

-এটাতে তোমার কীর্তিকলাপের রেকর্ডিং আছে। অনিকের রুমের হিডেন সিসিটিভি ফুটেজ এটা। এখন চুপচাপ এখান থেকে যাও। আশেপাশে তাকাবে না আর পিছনে তো ভুলেও না।

দীতি বোকার মতো মাথা নাড়লো। সে চটজলদি দ্রুত পায়ে মেমোরি কার্ডটা নিয়ে চলে যেতেই তৌহিদ এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার বাইরে এলো। এতক্ষণের দৃশ্য ভিডিও করেছে তারা। আর চিত্রলেখা দীতির বলা সমস্ত কথা ফোনে রেকর্ড করেছে। আপাতত তাদের কাজ শেষ। বাকিটা কাল কোর্টে দেখা যাবে।

যাবতীয় প্রমাণাদি নিয়ে বাড়িতে ফেরার উদ্দেশ্যে বের হলো চিত্রলেখা এবং তৌহিদ।

-আচ্ছা ভাইয়া, আমাদের কাছে তো কোনো সিসিটিভি ফুটেজ ছিল না, তাহলে ঐ মেমোরি কার্ডটাতে কী আছে?

-ইমরান হাশমির গান।

-কীহ!

-আরে মজা করছি, ঐটা একটা ভাইরাসযুক্ত মেমোরি কার্ড। ওটা যে ডিভাইসে তুলবে সেটা আর অনই হবে না। পরে আবার যখন তোমাকে কল করবে তুমি বলবে কোর্টের পর দেখা করতে। ততক্ষণে তো সব প্রমাণ হয়েই যাবে।

-আচ্ছা!

চিত্রলেখাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তৌহিদ চলে গেল। চিত্রলেখা বাড়িতে ঢুকতেই অপর্ণার মুখোমুখি হলো। তৌহিদ যে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে এটাও দেখেছে সে।

-তৌহিদ তোকে কেন নামিয়ে দিয়ে গেল? কোথায় গিয়েছিলি ওর সাথে?

-ভাবী, কাজ ছিল। সবসময় সন্দেহ করা বন্ধ করো।

-তোর এক ভাই জেলে, তার উকিলের সাথে একা কী কাজ তোর?

-অদ্ভুত তো! কাজ থাকতে পারেনা? অনিক ভাইয়ের বিষয়েই কথা বলতে গিয়েছিলাম।

-অন্ধকে হাইকোর্ট চিনাও? কী ফস্টিনস্টি শুরু করছিস? খবরদার আমার বাড়িতে এসব চলবে না।

-বাড়ি তোমার একার না ভাবী।

অপর্ণার ইগোতে লাগলো কথাটা। চুপচাপ ঘরের দিকে এগোলো সে। চিত্রলেখা বিরক্ত হয়ে সাথীর ঘরের দিকে পা বাড়ালো। এ বাড়িটা তার আর বাড়ি মনে হয়না। অপর্ণার প্রতিনিয়ত চেঁচামেচি, আগে সহ্য করতো কিন্তু একটা মানুষ কতই বা সহ্য করতে পারে যখন কিনা প্রতি পদে তার চরিত্রের উপর আঙুল তোলা হয়!

_________________

অর্ণব মাত্র বাড়িতে ফিরেছে। ব্যবসা নিয়ে একরকম দুশ্চিন্তায় আছে সে, ব্যবসার কাজে মনই দিতে পারছে না। সন্ধ্যের আগে আগে অনিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। অনিকের শরীর দুর্বল এখনো। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে মাত্র বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছিল সে। অপর্ণা তৎক্ষণাৎ গজগজ করতে করতে এলো।

-তোমার বোন বাড়িটাকে কী পেয়েছে? কোঠা? যখন তখন যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়ে ঘুরবে! আমাদের তো মান সম্মান আছে, ওর কি একটুও লজ্জা হয়না?

-কী হয়েছে অপর্ণা? বাড়িতে না ঢুকতেই কী শুরু করেছো?

-তোমার বোন তৌহিদের সাথে রঙঢঙ করে বেড়াচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করাতে বলেছে ওর বাড়ি, ওর যা ইচ্ছে করবে।

এমনিতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে অর্ণবের মেজাজ সপ্তম আসমানে ছিল। তার উপর অপর্ণার কথাবার্তায় আরো বিরক্ত হয় সে। অপর্ণার উপর জমে থাকা ক্রোধ আগ্নেয়গিরি মতো বেরিয়ে আসতে চায়। চেঁচিয়ে চিত্রলেখাকে ডাকে সে। বড় ভাইয়ের ডাক শুনে চিত্রলেখাও ধড়ফড় করে বসার ঘরে আসে। অর্ণবের অগ্নিদৃষ্টি দেখে খানিকটা ভীত হয়ে পড়লো সে। অপরদিকে অর্ণবের অপর্ণার উপর করা রাগের ঝাঁঝ গিয়ে পড়লো চিত্রলেখার উপর।

-তুই তৌহিদের সাথে বেরিয়েছিলি?

-হ্যাঁ ভাইয়া কিন্তু …

-ও তোকে রেখে গেছে?

-হ্যাঁ।

-তুই তোর ভাবীকে বলেছিস তোর বাড়ি, যা ইচ্ছে করবি তুই!

-ভাইয়া তুমি ভুল বুঝছো!

চিত্রলেখা আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। অর্ণবের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো সজোরে একটা চড়ের মাধ্যমে। চিত্রলেখা ছিটকে দূরে সরে গেল। যে বড় ভাই তাকে আগলে রাখতো, আজ সে-ই তার গায়ে হাত তুলেছে। সাথীও তৎক্ষণাৎ ছুটে এলো সেখানে। অর্ণবের চোখ দিয়ে তখন আগুন ঝরছে।

-এত সাহস তোর! ছেলে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে বাসায় এসে দাপট দেখাস? কী সম্পর্ক তোর তৌহিদের সাথে?

চিত্রলেখা কিছু বললো না। কষ্টে, যন্ত্রণায় সে কথাও বলতে পারছে না। সাথী বুঝতে পারছে সবটাই। সে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই চিত্রলেখা হাতের ইশারায় তাকে আটকালো। অর্ণবের এই রূপের ষাথে কেউই পরিচিত নয়। অপর্ণাও ভাবেনি অর্ণব এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তবে তার বিষয়টা দেখতে ভালোই লাগছে।

-তোর তৌহিদের সাথে কী সম্পর্ক বল!

-কোনো সম্পর্ক নেই।

-আমাকে ছুঁয়ে তুই প্রতিজ্ঞা কর আমি যার সাথে বিয়ে ঠিক করবো, তুই তাকেই বিয়ে করবি!

চিত্রলেখা পাথরের ন্যায় জমে গেল। এতটা অবিশ্বাস! চোখ ছলছল করে উঠলো তার তবুও অর্ণবকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলো সে। পরক্ষণেই নিজের ঘরের দিকে ছুটলো। অর্ণবের ব্যবহার তাকে আজ ভেঙে চুরে ফেলেছে। আজ প্রথমবার অর্ণবও তাকে উপলব্ধি করালো সে তার সৎ বোন। চিত্রলেখার অশ্রুকণাগুলোও যেন চোখ বেয়ে গড়াতে চাইলো না, অভিমান হয়ে বুকে জমা থাকতে চাইলো। যন্ত্রণা এবং প্রচণ্ড মনোকষ্টে চিত্রলেখার দুর্বল সত্তাটা আবারো যেন সক্রিয় হতে চাইলো। চুপচাপ, নিরীহ, দুর্বল চিত্রলেখা ফিরলো বোধহয় তার মধ্যে।

চলবে…

[বড় করে দেওয়ার কথা ছিল তবে ফেসবুক অ্যাপের ঝামেলা নিয়ে বড় পর্ব পোস্ট করতে খানিকটা ভয়ই লাগলো, রেস্ট্রিকশনে না ফেলে দেয় আবার!]

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১৯+২০

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনবিংশ_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। ক্রমাগত নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। ভয়ে এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে ছিল। কিছু মুহূর্ত এতটা স্মরণীয় হতে পারে তা সে কখনো ভাবেনি। হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসতেই ফোনটা বেজে উঠলো। চিত্রলেখা রিসিভ করলো তড়িৎ গতিতে।

-ঠিকঠাকভাবে পৌঁছেছো?

-হুম।

-আচ্ছা ঘুমাও। অনিক ভাইয়ার বেইল করা হয়েছে?

-না, কিছু জটিলতা আছে।

-আচ্ছা চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

-হুম। আপনি ফিরেছেন বাড়িতে?

-না। এখন গেলে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাবা শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে বই-টই পড়েন। একেবারে সকালে বাবা অফিসে গেলে বাড়িতে ঢুকবো।

– আপনি কোথায় থাকবেন আর বাইক কোথায় রাখবেন রাতে?

-বাইক বন্ধুর, ওকে সকালে ফেরত দিয়ে দিব। এখন আমি আর বাইক আরো কিছু মুহূর্ত উপভোগ করবো। তুমি ঘুমাও। টা টা।

চিত্রলেখার ফোন রাখতে ইচ্ছে করলো না তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় জানালো। কণ্ঠে নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট।

-তুমি কি আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে চাইছো?

-ন..না তো।

-সত্যি?

-হ্যাঁ।

-তার মানে কথা বলতে চাও আরো?

-কখন বললাম?

-এই তো হ্যাঁ বললে।

-সেটা তো সত্যির জন্য বললাম।

-তার মানে আগেরবার মিথ্যে বলেছিলে!

-ধূর! কথার প্যাঁচে ফেলছেন।

-আচ্ছা স্যরি। মজা করছিলাম। তোমার ঘরের পিছনের জানালাটা রাস্তার উল্টো পাশে হওয়ায় ভালো হয়েছে। এদিকে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ টের পাবে না।

-মানে?

-পিছনের জানালাটা খোলো বোকা মেয়ে।

চিত্রলেখা দ্রুত জানালাটা খুললো। এ জানালা সবসময় বন্ধ থাকে। জানালাটা খুলতেই ক্যাচ ক্যাচ ধরনের একটা শব্দ হলো। চিত্রলেখা ভয়ে আঁতকে উঠলো। নিস্তব্ধ পুরীতে শব্দটা যেন আতঙ্কের ন্যায় শোনালো। জানালার নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গনের হাস্যোজ্জল চেহারা মুহূর্তেই তাকে আতঙ্ক ভুলিয়ে দিল।

-কী ম্যাম? শকড?

-না, সারপ্রাইজড যে এখনো যাননি!

-নিশ্চিত হলাম যে তুমি ঠিকমতো ফিরেছো।

-এখন তবে চলে যান।

-বিদায় করার সবচেয়ে কঠোর তরিকা ব্যবহার করলে! একটু ভালোমতোও বলতে পারতে, এভাবে অর্ধচন্দ্র দেখিয়ে বিদায় করা ঘোরপাপ।

-আপনি কি লিটারেচারের স্টুডেন্ট? এত ড্রামাটিক কথা কী করে বলেন?

-আমি এমনই। তুমিও আমার সাথে বেশি বেশি মেশার চেষ্টা করো, দেখবে মুখের ম্লান ভাব কমবে।

-একটু পর আযান দিবে, যাতায়াত বাড়বে এ রাস্তায়। এখন আপনার যাওয়া উচিত।

-আচ্ছা নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ।

চিত্রলেখা বিদায় জানিয়ে কল কাটলো। বিছানায় বসতেই যেন জগতের সমস্ত ঘুম তার চোখে নেমে এলো। ঘুমে চোখই খুলতে পারলো না সে।

________________

হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙলো চিত্রলেখার। লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে। ফোনে সময় দেখলো। নয়টা বাজে। মাথায় হাত দিয়ে বসলো সে! নির্ঘাত বড় ভাবী চেঁচামেচি করছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলো সে। বাইরের পরিবেশ আশঙ্কাজনক। অর্ণব চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। অপর্ণা রান্নাঘরে কিছু একটা করছে আর সমানে চেঁচাচ্ছে। চিত্রলেখাকে দেখে তার রাগের মাত্রা আরো বাড়লো।

-এসেছে মহারানি! তো রানীসাহেবা, শাহী ভোজ আনি আপনার জন্য? জমিদারের ঘরে জন্মাইছেন, কাজ কামে তো মন থাকবে না। হোস্টেলে থেকে এখন নিজের বাড়িতে রান্নাও করতে মন চায় না?

-স্যরি ভাবী, তুমি সরো আমি করছি।

-কী এমন রাজকার্য করছিস রাতে যে ন’টা অবধি ঘুমাস? খুব ভাব হইছে সবার! একজন দরজা লাগায়ে বসে আছে কাল থেকে, আরেকজন ঘুমাচ্ছে! সব আমার করা লাগে!

চিত্রলেখা অবাক হলো। সাথী এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কখনোই থাকেনা।

-ভাইয়া, ছোট ভাবী তো এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কখনো থাকেনি। একটু দেখবে?

-হ্যাঁ চল! আমিও অনেকক্ষণ দেখিনি ওকে।

চিত্রলেখা অর্ণবকে সাথে করে সাথীর দরজার বাইরে দাঁড়ালো। দরজায় বার কয়েক শব্দ করলো।

“ভাবী? দরজা খোলো!” অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরেও সাড়াশব্দ না পেয়ে চিত্রলেখার মনে ভয় ঢুকলো। সে অর্ণবকে বললো দরজা ভাঙতে। অর্ণবেরও মনে হলো এছাড়া উপায় নেই। অপর্ণা ভ্রু কুঁচকে কেবল দৃশ্রগুলো অবলোকন করছে। অর্ণব সজোরে দরজার দিকে এগোতে যাবে এমন সময় সাথী দরজা খুললো। সাথীর চোখেমুখে রক্তিম আভা। চিত্রলেখা সাথীর এ রূপ দেখে ভয় পেল।

-ভাবী কী হয়েছে তোমার? এমন লাগছে কেন তোমাকে?

-আমি কি খুব দুর্বল লেখা? আমার সহ্যক্ষমতা নাই? আমার স্বামীর এ পরিস্থিতিতেও আমি ধৈর্য রেখেছি। আর কী চাস তোরা আমার থেকে? আমার স্বামী হসপিটালাইজড, কথাটা জানলে কি আমি নিজেকে শেষ করে ফেলতাম? অনিকের অসুস্থতায় ওর পাশে থাকার অধিকার আমার নাই?

-ভাইয়া হসপিটালাইজড! মানে? কেন? কী হয়েছে ভাইয়ার?

-সেটা তোর বড় ভাইয়া বলতে পারবে। অর্ণব ভাইয়া, হসপিটাল থেকে কল করে আপনার নম্বরে যোগাযোগ করতে না পেরে আমাকে কল করেছিল। অনিকের সকালে জ্ঞান ফিরেছে। আমি এতটা দুর্বল নই ভাইয়া যতট আপনি ভেবে নিয়েছিলেন। দয়া করে পরেরবার আমার স্বামী সংক্রান্ত কিছু আমার থেকে লুকোবেন না।

সাথীর শান্ত কথায় অর্ণব মাথা নত করলেও অপর্ণার মনে যেন আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে।

-তোর স্বামী হওয়ার আগে সে আমার স্বামীর ভাই! নিজের ভাইয়ের জন্য চিন্তা করা ভুল নাকি? অর্ণব ঠিকই করেছে। আমার স্বামীকে দোষারোপ করা বন্ধ কর।

-আমি দোষ দিচ্ছি না ভাবী, শুধু আমার মনের কথাটা বলেছি।

-তুই স্পষ্টত আমার স্বামীকে অপমান করেছিস!

সাথী চুপ করলো। এ মুহূর্তে অপর্ণার সাথে ঝগড়া করার সময় তার নেই। হসপিটালে যেতে হবে তার। অর্ণব এ মুহূর্তে নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারলো না। অপর্ণার দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকালো সে।

-নারীজাতির প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান। তুমিও সেই নারীজাতির অন্তর্ভুক্ত। নিজের ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিজেকে আরো নীচ প্রমাণ করার চেষ্টা না করলেও চলবে।

অপর্ণা রাগে জ্বলে উঠলো কিন্তু অর্ণব সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে চুপচাপ সাথীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরোলো। চিত্রলেখা তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। অপর্ণার রাগ সরাসরি চিত্রলেখার উপরেই পড়লো।

-তুই ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো নাটক দেখছিস কেন?

– গৃহপালিত ছাগলের বাচ্চা তো তাই কখনো বনের গাধার হাঁকডাক দেখিনি। তাই দেখছিলাম আর কী!

বলেই আর সেখানে দাঁড়ালো না চিত্রলেখা। একদৌড়ে রান্নাঘরে জুট লাগালো। যতক্ষণে অপর্ণা চিত্রলেখার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছে, ততক্ষণে সে আর তার হাতের নাগালে নেই। অপর্ণা রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরের দিকে এগোলো।

_____________

অনিকের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে উন্নত। কেস কোর্টে যেতে আর চারদিন সময় আছে। অনিককে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করবে আজ তবে তার সাথে সর্বদা একজন পুলিশকে রাখা হবে কেননা বিষয়টা এখন সাধারণ কেইস থেকে তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে পৌঁছেছে। অনিককে ইতোমধ্যে জব থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সাথীকে হাসপাতালে দেখামাত্র অনিক কান্নায় ভেঙে পড়লো। পুরুষ মানুষের কান্না নাকি দুর্লভ অথচ অনিক মনের সমস্ত যন্ত্রণা অবাধে কিছু অশ্রুকণা দ্বারা সাথীর নিকট প্রকাশ করলো। সাথী চুপচাপ অনিকের বুকে আলতো করে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বুঝিয়ে দিল সে সবসময় তার পাশে আছে।

“তোমার সত্যটা আমি জানি। যদি নিজেকে বাঁচাতে চাও, চুপচাপ তিন লাখ টাকা আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। ভুলেও পুলিশকে হাবিজাবি বোঝানোর চেষ্টা করো না। তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণও আছে আমার কাছে। টাকা নিয়ে জায়গামতো এসো, নিজের বাঁচার প্রমাণ নিয়ে দূর হও।” মেসেজটা দেখামাত্র দীতির পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গেল। ভয়ে নখ কামড়াতে লাগলো সে। স্বভাবতই সে ভীতু। অনিককে ফাঁসানোর সাহসও তার মধ্যে ছিল না। দীতির ভয় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। দীতির সত্য কে জানতে পারলো? এটা তো দীতি নিজের সহযোগীকেও জানানোর সাহস পাচ্ছে না। সে যদি জানে তবে সর্বপ্রথম দীতিকে মেরে ফেলবে। একটা টেক্সট দীতির পুরো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেছে!

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
বিংশ_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা ছাদের প্রাচীরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মাঝে মাঝে তার ওষ্ঠজোড়ার ফাঁকে শিসের ন্যায় শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথী তার সামনে বসে। চিত্রলেখার এমন রহস্যময়ী রূপ আগে দেখেনি সে।

– তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারোনি ভাবী?

– তুই কাউকে না জানিয়ে এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ একা কেন করতে গিয়েছিস? তাছাড়া দীতির পরবর্তী পদক্ষেপ আমরা জানবো কী করে?

– আমি যতদূর জানি দীতি একা এসব করেনি। হয় সে নিজের সহযোগীর সাহায্য নিবে অথবা আমাদের আগে কল করবে। দেখা যাক কোন জুয়াটা সে খেলে!

– ওর উপর নজর রাখাটা দরকার।

– পুলিশের সহায়তা নেওয়া যাবে না। তৌহিদ ভাইকে বললে কাজ হবে বোধহয়।

– তুই কোথায় ডেকেছিস দীতিকে?

– এখনো ডাকিনি। আগে তৌহিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ভাইয়াকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করলো না?

– শরীরের আবার অবনতি হয়েছে। অনিক প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব পুলিশি অত্যাচার ওকে পুরোপুরি শেষ করে দিচ্ছে লেখা।

– চিন্তা কোরো না ভাবী, আমি এখনি বের হচ্ছি। তৌহিদ ভাইকে কল করে কোথাও আসতে বলছি। বাসায় ডাকা যাবে না, অপর্ণা ভাবী চেঁচামেচি করতে পারে অযথা। তুমিও যাবে আমার সাথে।

– তুই আগে বের হ, আমি একটু পরে যাবো। তোর বড় ভাবীর মতো মানুষকে আমি এতদিন শ্রদ্ধা করে আসছি! এখন আমার খারাপ সময়েও তার ব্যবহার জঘন্য। তুই বাড়ি ছাড়লি ঐ মহিলার জন্য! তোর কি মনে হয় আল্লাহ এসব দেখতেছে না?

– ভাবী শান্ত হও। আমি বের হচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো, আমি মেসেজ করে জানাবোনি জায়গার কথা।

সাথী মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। চিত্রলেখা নিচে নামলো। অপর্ণা নেই আশেপাশে। চটজলদি বোরকা পড়ে নিল সে। অপর্ণার চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত বেরোল।

তৌহিদের পরিচিত একটা ক্যাফেতে বসেছে তারা। চিত্রলেখা ইতোমধ্যে সাথীকে জানিয়েছে জায়গার কথা। তৌহিদ চিত্রলেখার কথা এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো।

– চিত্রলেখা, তুমি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছো! তবে এখনো সবটা ঠিক করা যাবে। কোর্টের ডেইটের আগে দুদিন সময় আছে হাতে। আমি আজকেই দীতির পেছনে একটা গোয়েন্দা লাগানোর ব্যবস্থা করছি। আগামীকাল বিকালে তুমি ওকে দেখা করতে ডাকো। এই ক্যাফের পেছন পাশে একটা পরিত্যক্ত বাড়ির মতো আছে। ঐখানেই আসতে বলবে।

– আচ্ছা ভাইয়া।

আচমকা চিত্রলেখার ফোনটা বেজে উঠলো। চিত্রলেখা স্ক্রিনে রঙ্গনের নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকালো। এ সময় রঙ্গনের কল? তৌহিদ ভাইয়ের সামনে কলটা রিসিভ করা মোটেও উচিত হবে না। কল কেটে দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করলো সে।

– কার কল? রিসিভ করো!

– কলেজের ফ্রেন্ড। রিসিভ করলে অযথা গল্প শুরু করবে। ভাবী যে কেন আসছে না এখনো!

– একটু বসো, আমি কফি আনছি। এর মধ্যে হয়তো ভাবীও চলে আসবে।

চিত্রলেখা হালকা হেসে সম্মতি জানালো। রঙ্গন চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যগুলো দেখলো। চিত্রলেখার ঠোঁটের হাসি আর খুব সন্তর্পণে তার কল ইগনোর করা! রঙ্গন অনুভব করতে পারলো চিত্রলেখার জীবনে আসলে তার কোনো জায়গাই নেই। সে কাছের বন্ধুও নয় চিত্রলেখার। এক মুহূর্তের জন্য তৌহিদ নামক মানুষটার উপর রঙ্গনের ক্রোধ যেন আকাশ ছুঁলো। সেখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না রঙ্গনের। দ্রুত ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল সে।

_________________

বিকেলের দিকে আশফিনা আহমেদ ফিরলেন। রঙ্গনকে দেখে তিনি অবাক হলেন না তবে তার চোখেমুখে কাঠিন্য স্পষ্ট।

– মা কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা?

– সাথীর ডিভোর্সের জন্য বড় ভাইয়া উঠে পড়ে লেগেছে তবে আমার মনে হচ্ছে অনিক নির্দোষ। যতই ঐ ফ্যামিলিকে দোষারোপ করি, সাথী অনিককে ছাড়া থাকতে পারবেনা এটাও সত্য।

– এখন?

– এখন আবার কী? জোর জবরদস্তি করে কী আর করতে পারবে?

– তুমি মামাকে সাহায্য করতে চাচ্ছো?

– নাহ! যখন বিয়ের সময় আটকেছিলাম তখন তারা আমার কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। এখন তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার হস্তক্ষেপ ঘটবে না।

আশফিনা আহমেদ আর কথা বাড়ালেন না। নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। রঙ্গন মাঝেমধ্যে অবাক হয় নিজের মায়ের একেক রূপ দেখে। সব রূপেই একটা বস্তু কমন, তার প্রগাঢ় আত্মসম্মানবোধ! তার মায়ের মতো আত্মসম্মানবোধ সে তার পরিবারে অন্য কারোর দেখেনি। রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ঠিক সে সময় অহম এসে পথ আটকালো তার।

– তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো ভাইয়া!

– নাহ! পালাবো কেন? তোর না পরীক্ষা চলছে? তাই বিরক্ত করছি না।

– ওহ! ভালো, সবাই আমাকে একা করে দাও।

– ছ্যাঁকা খাওয়া কথাবার্তা বলছিস কেন?

– কারণ আমি ছ্যাঁকা খাইছি। আমার গার্লফ্রেন্ডটা যে আস্ত গাধা! যে যা বলে বিশ্বাস করে ফেলে। একটা সম্পর্কে যদি আমার উপর তার বিশ্বাসই না থাকে, তবে সম্পর্ক কী করে টিকবে বলো তো!

রঙ্গনের কানে অহমের বলা কথা বাজতে থাকলো। সেও তো চিত্রলেখাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে কিন্তু তার আর চিত্রলেখার মধ্যে আদতে কোনো সম্পর্ক নেই যার ভিত্তিতে সে কিছু বলতে পারবে। ছেলেটা সত্যিই চিত্রলেখার খুব কাছের কেউ হতে পারে। যদি সত্যি তাই হয় তবে চিত্রলেখা কেন তার সাথে সময় কাটাতে রাজি হলো? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে রঙ্গনের মাথায়। সরাসরি চিত্রলেখাকেই প্রশ্ন করবে সে! অহম উদাসী মন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়েছে ততক্ষণে। রঙ্গনও এগোলো ছাদে যাওয়ার জন্য।

ক্যাফে থেকে বাড়িতে ফিরেই রঙ্গনকে কল করলো চিত্রলেখা। রঙ্গন রিসিভ করলো একটু পরেই।

– কল করেছিলেন যে?

– হুম। ব্যস্ত ছিলে?

– একটু।

– কোথাও গিয়েছিলে?

– হ্যাঁ, এক বন্ধুর সাথে বেরিয়েছিলাম।

– ওহ।

রঙ্গনের আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। ছেলেটা তবে সত্যিই চিত্রলেখার বন্ধু কিন্তু আদতে এটা বন্ধুত্ব নাকি অন্যকিছু? রঙ্গন কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। চিত্রলেখার উপর তো তার কোনো অধিকার নেই তবে চিত্রলেখার জীবনে কেন সে অধিকার ফলাতে চাইছে? নিজের প্রশ্নে নিজেকেই জড়িয়ে ফেলছে সে।

– আর কিছু বলবেন?

– না!

রঙ্গন আচমকাই কল কাটলো। চিত্রলেখার কণ্ঠস্বরও তাকে দগ্ধ করছে। অদ্ভুত এক আকুতি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে যেন! কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছেনা সে।

___________________

দীতি কী করবে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। তার কাছে আবারো টেক্সট এসেছে। টাকা নিয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে তাকে। দীতি এখন অবধি নিজের সহযোগীকে কথাটা জানায়নি। জানলে লোকটা তাকে মেরেই ফেলবে! দীতি লোকটার থেকে প্রায় দশ লাখ টাকা নিয়েছে। সেখান থেকে লাখ তিনেক টাকা নিয়ে এসব চাপা রাখতেই হবে। দীতির ভয় কোনভাবেই কমছে না। অনিককে ফাঁসানোটা সহজ ছিল বোধহয় তাকে এই কাজটা দেওয়া হয়েছিল। অনিকের ফোন ব্যবহার করাটাও কঠিন ছিল না। প্যাটার্ন সিম্পল, আইডি ব্যবহার করতেও অসুবিধা হয়নি। কাজ শেষ করে সমস্ত প্রমাণ অনিকের আইডি থেকে ডিলিট করাটাও কঠিন ছিল না কিন্তু অসুবিধেটা অনিক বাঁধালো দীতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

____________________

চিত্রলেখার অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত এ অশান্তির কারণ দীতিকে নিয়ে ভয় নাকি রঙ্গনের কারণে বুঝতে পারছে না সে। রঙ্গনের কথার ধরন তাকে পীড়া দিচ্ছে। চিত্রলেখা বুঝতেও পারছে না রঙ্গনের হঠাৎ কী হলো! চিত্রলেখা রঙ্গনকে কল করবে ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। ‘ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ সমস্যাটা তার বেশ পুরনো। এ মুহূর্তে রঙ্গনকে কল করার সাহসও তার হচ্ছে না। বারংবার মনে হচ্ছে রঙ্গনের সাথে এ ঘনিষ্ঠতা তার জন্য সঠিক নয়। এ ঘনিষ্ঠতার পরিণতি কী? রঙ্গন কি কেবল তাকে বন্ধুই মনে করে? অজস্র প্রশ্ন মনে, উত্তর চাওয়ার সাহস করতে পারছে না সে।

দু প্রান্তে দুজন, একই মুহূর্তে অলস ভঙ্গিতে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে অজস্র প্রশ্নের ভীড়ে নিজেদের নাম না জানা সম্পর্কের উত্তর তালাশ করে বেড়াচ্ছে।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১৭+১৮

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
সপ্তদশ_পর্ব
~মিহি

হাসপাতালের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। অনিকের জ্ঞান ফিরেছে। পুলিশি তদন্তের মানসিক চাপ নিতে পারেনি সে। অনিকের ছোট থেকেই এ সমস্যা আছে। চাপ সহ্য করতে পারে না সে, মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। অর্ণব সাথীকে কিছু জানায়নি। অনিকের এ অবস্থা জানিয়ে মেয়েটাকে আরো দুর্বল করতে চায়নি সে। তৌহিদের সাথে কথা হয়েছে তার। বেইল রেডি হয়েছে। পুলিশের সাথে কথাও বলেছে সে তবে অনিকের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকেই। বাহ্যিক চোট না লাগলেও তার মস্তিষ্কে বেশ ভয়ানক প্রভাব পড়েছে। ডাক্তাররা অনিক পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি তাকে রিলিজ করতে পারবেন না। অর্ণবের কিছু করার নেই। বেইল সম্পর্কে মিথ্যে বলতে হবে সাথীকে, আবার একইসঙ্গে তাকে পুলিশ স্টেশনেও যেতে দেওয়া যাবে না। এসব ভাবতে ভাবতে অনিকের কেবিনের দিকে তাকালো সে। এখন ঘুমাচ্ছে সে। অর্ণব বিগত বাইশ ঘণ্টা ধরে অনিকের অসুস্থতার খবর লুকিয়ে আসছে। অনিক সুস্থ হওয়া অবধি তাকে এ কাজ করতেই হবে। অর্ণব বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হতেই তৌহিদের কল আসলো তার ফোনে। অর্ণব রিসিভ করলো।

-হ্যাঁ তৌহিদ বলো, পুলিশ স্টেশনে কিছু হয়েছে?

-ভাইয়া, কিছু সূত্র পেয়েছি। সাথী ভাবীকে তো অনিক ভাই সব বলেছে। ওনার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো।

-আচ্ছা আমি বাড়িতে ফিরে দেখছি তবে সাথী যেন ভুলেও অনিকের অসুস্থতার কথা না জানে।

-আচ্ছা ভাইয়া।

অর্ণব ফোনটা পকেটে রাখলো। সাথীর উপর বড্ড মায়া হয় তার। মেয়েটা তার আরেক বোনের মতো। সাথীর মতো মেয়ে পাওয়া আসলেই ভার। যেমন সংসারী, তেমনি আদর্শ স্ত্রী। অপর্ণার সাথে সাথীর তুলনা সে কখনোই করেনি তবে ইদানিং অপর্ণার উপস্থিতি তাকে যতটা যন্ত্রণা দেয় ততটা আর কোনোকিছু দেয় না। রিক্সাতে উঠেও এসবই ভাবছে সে। সন্ধ্যের আঁধারিতে রোড লাইটের আলোয় শহরটা অন্যরকম লাগছে। অর্ণব ঠিক করলো সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে একদিন সে আর অনিক এমন রিক্সা করে সন্ধ্যেবেলা ঘুরবে। এটা হবে শুধু তাদের ‘ব্রাদার্স ইভনিং আউট’। অনিকের বেহুশ অবস্থা অর্ণবকে যতটা ভীত করেছে তার এক অংশও সে বাহিরে প্রকাশ করতে পারছে না অথচ ভেতরটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে তার।

____________

সাথীকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটু খাইয়ে সবে ঘরে ঢুকেছিল চিত্রলেখা। এরই মধ্যে অপর্ণা চেঁচামেচি শুরু করলো।

-আমার চা কই লেখা?

-ভাবী, চা বানানোর কথা খেয়াল ছিল না। তুমি ঘরে যাও, আমি বানিয়ে আনছি।

-তোকে সব মনে করানো লাগে কেন? একটা কাজে মন নাই।

চিত্রলেখা চুপচাপ থাকলো। কথার পিঠে কথা বাড়ে। তার নীরবতা অপর্ণাকে ঝগড়া থামাতে বাধ্য করলো। রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে এগোলো সে। রান্নাঘরে যেতেই দেখলো গ্যাসের চুলার পাশেই ফোন রেখে গেছে সে। ফোনটা একপাশে রেখে চা বানাতে লাগলো সে। চা বানানো শেষ করতেই ফোন বেজে উঠলো। চিত্রলেখা স্ক্রিনে দেখলো রঙ্গনের নম্বরটা। চায়ের পাতিল রেখে ফোনটা রিসিভ করলো সে।

-হ্যালো।

-হ্যাঁ বলুন, হঠাৎ কল?

-হঠাৎ না, সাথী আপু কেমন আছে জানতে কল করলাম।

-খুব একটা ভালো না তবে চেষ্টা করছি ভাবী যেন অসুস্থ না হয়।

রঙ্গন একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। চিত্রলেখা কল কাটার কথা বলার অবকাশ পাচ্ছে না। ওদিকে চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এখন চা না দিলে বড় ভাবীর চেঁচামেচি কানে তোলার মতো অবস্থা থাকবে না। ফোন কানের সাথে ঘেঁষে পাতিল থেকে কাপে চা ঢালছিল চিত্রলেখা। অসাবধানতাবশত খানিকটা গরম চা তার হাতের কব্জিতে পড়লো। তীব্র যন্ত্রণায় ক্ষীণ অর্তনাদ করে উঠলো সে। রঙ্গনের কানে তা ঠিকই পৌঁছল।

-কিছু হয়েছে? চেঁচালে যে?

-না আসলে চা পড়েছে অসাবধানতাবশত। আমি পরে কল করছি।

চিত্রলেখা তৎক্ষণাৎ কল কেটে দিল। দ্রুত হাত পানিতে ভিজিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে অপর্ণার ঘরের উদ্দেশ্যে এগোলো। অপর্ণা বিছানায় শুয়ে আছে। রূপসা, অনিককে আজ সকালে তার নানা এসে নিয়ে গেছে। অপর্ণা চায় না তার বাচ্চারা পারিবারিক ঝামেলার মধ্যে থাকুক। তার এ বিষয়টা অবশ্য যৌক্তিক। চায়ের কাপ সাইড টেবিলে রেখে চলে আসার সময় আটকালো অপর্ণা।

-দাঁড়া তো।

-কিছু বলবে ভাবী?

-হ্যাঁ।

-বলো।

-মা যে তোকে কল করে হোস্টেলে যেতে বলেছিল, এটা তোর ভাইকে বলেছিস নাকি?

-না।

-আচ্ছা ভালো। যা কাজ কর।

চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে এলো। স্বার্থ ছাড়া ইনি কখনো তাকে ডাকেনা তা চিত্রলেখা জানে তবুও তার মন চায় অপর্ণা ভাবীও তাকে একটু ভালোভাবে ডাকুক। আকাশসম সম্মান কিংবা ভালোবাসা সে চায় না, সামান্য একটু যা তাকে মনে করাবে তার পরিবারটা আসলেই সুখী পরিবার।

_____________

রঙ্গনের দুশ্চিন্তা কমছে না। চিত্রলেখার ক্ষীণ আর্তনাদটুকুও তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। আশফিনা আহমেদ এখনো এ বাড়িতে আসেননি। রঙ্গন চাইলেই এখন বেরোতে পারবে কিন্তু এখন বেরোলে বাবার প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। রঙ্গন একটা ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।

__________

অর্ণব বাড়ি ফিরেই সাথীর খোঁজ করতে লাগলো। বিষয়টা অপর্ণার মোটেও ভালো লাগলো না তবুও সে চুপ রইলো। সাথী শান্ত ভঙ্গিতে বাইরে এসে বসলো। তৌহিদকে কল করে ফোন সাথীকে দিল অর্ণব।

-আসসালামু আলাইকুম।

-তৌহিদ, আমি সাথী বলছি।

-ভাবী, অনিক ভাইয়ের বেইল হতে আর কিছুদিন সময় লাগবে। আপনার একটু সাহায্য দরকার। আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আপনি একদিন অনিক ভাইকে কল করার পর দীতি রিসিভ করেছিল। এখন আমাদের এটা প্রমাণ করতে হবে অনিক ভাইয়ের আইডি থেকে ঐ মেসেজগুলো দীতি নিজেই পাঠিয়েছিল।

-এটা কিভাবে করবো আমরা?

-আমরা আননোন আইডি থেকে দীতিকে মেসেজ করবো এটা বলে যে ওর সত্যটা আমরা জানি। আমাদের টাকা না দিলে আমরা সব সত্যি কোর্টে বলে দিব। নিশ্চিত ভয় পাবে।

-আচ্ছা আপনি কাল আসুন, তারপর দেখছি আমরা।

চিত্রলেখা পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। এখনো ষাট দিন হয়নি, ‘কায়া’ আইডিটা এখনো একটিভ করা যাবে। চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি এবং চোখে পূর্বের জ্যোতি পরিলক্ষিত হলো।

_____________

ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে বারোটা। নিস্তব্ধ চারপাশ তবে চিত্রলেখাকে চোখে ঘুম নেই। অদ্ভুত একটা অশান্তি তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে নাহ, হাতটাও জ্বলছে। ওষুধ লাগানোর কথা মনেই নেই তার। আচমকা ফোন ভাইব্রেট হলো তার। চিত্রলেখা ভয়ে কেঁপে উঠলো। এত রাতে তাকে কে কল করতে পারে? ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রঙ্গন। চিত্রলেখার অশান্তি ভাব কমলো। অদ্ভুত রকমের শীতল মন্দ মধুর বাতাস তাকে ছুঁয়ে গেল। চিত্রলেখা কল রিসিভ করে আলতো করে কানে রাখলো।

“হ্যালো…”রঙ্গনের শীতল কণ্ঠস্বর চিত্রলেখার বুকের মধ্যে ঝংকার তুললো। সে যেন কথা বলতে ভুলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলালো।

-বলুন।

-একটু জানালার কাছে এসে দাঁড়াও তো।

-কেন?

-আসো আগে।

চিত্রলেখা জানালা খুলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। নিচে রঙ্গন বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখা ভয়ে আঁতকে উঠলো। এটা রক্ষণশীল এলাকা। আশেপাশে কেউ দেখলে কথা ছড়াতে সেকেন্ড কতক সময় লাগবে।

-আপনি কেন এসেছেন?

-নিচে আসতে পারবে?

-নাহ!

-বেশি সময় নিব না।

-আচ্ছা একটু থামেন।

চিত্রলেখা ঢোক গিলল। আলমারি থেকে মায়ের চাদরটা বের করে নিজেকে আবৃত করে নিলো। ঘর থেকে বেরিয়ে আশেপাশের ঘরগুলো দেখলো। লাইট অফ, তার মানে সবাই ঘুম। সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে গেল সে।

হুডি পড়েও শীতের প্রকোপ অনুভব করতে পারছিল রঙ্গন। দুহাত পকেটে গুঁজে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। চিত্রলেখা এলো চাদরে নিজেকে আবৃত করে। রঙ্গনের মনে হলো সে যেন কয়েকটা হৃদস্পন্দন মিস করলো। শীতের প্রকোপের মাঝেও উষ্ণ হাওয়া তার সর্বাঙ্গে শিহরণ তুললো। মেয়েটার ভীত চোখজুড়ানো রঙ্গনের মনে ব্যাকুলতা বাড়িয়ে তুললো। ধীর পায়ে সে যখন রঙ্গনের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ালো, রঙ্গন যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল।

“এত রাতে এখানে কেন এসেছেন আপনি?” চিত্রলেখার ধীরস্বর রঙ্গনকে ঘোর থেকে বের করতে পারলো না। দু-তিনবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে চিত্রলেখা রঙ্গনের হাতে খানিকটা ধাক্কা দিল। ঘোর কাটলো রঙ্গনের। চিত্রলেখাকে মুখোমুখি দেখে নিজেকে ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছিল তার। হুডির পকেট থেকে অয়েন্টমেন্ট বের করে চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিল।

-আমার মন বলছিল একটা বোকা মেয়ে হাতের যন্ত্রণা সত্ত্বেও ওষুধ লাগাতে ভুলে যাবে।

-তার জন্য আপনি এখানে আসবেন এত রাতে?

-ওষুধটা লাগাও।

চিত্রলেখা ওষুধটা হাতে নিয়ে রঙ্গনের সামনেই আঁচ লাগা অংশে ওষুধ লাগালো। অতঃপর তা রঙ্গনের হাতে ফেরত দিল।

-ওষুধ লাগিয়েছি, এখন আসি? আপনিও যান!

কথাটুকু বলে রঙ্গনকে বলার সুযোগই দিল না চিত্রলেখা। চটজলদি সামনে এগোতে লাগল। আচমকা এক যুবকের ব্যাকুল মনের ব্যাকুলতা বোধহয় তাকে স্পর্শ করলো। পিছু ফিরে সে প্রশ্ন করলো,”কিছু বলবেন?”

রঙ্গনের চোখে কাব্য ভর করলো যেন। অদ্ভুতভাবে হাতটা ঠিক বুকের বা পাশে অবস্থান নিল। ঠোঁট নড়লো কতক সময়। বাতাসে শায়েরী ভেসে উঠলো,

“Tum kaho to phool se khushbuh,
Chand se roshni,
Tum se tum na ho to
kamse kam bura na mano,
to ek tumhara shaam churaalu?”

চিত্রলেখা কেবল বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো রঙ্গনের পানে। শুধুই কি কিছু মুহূর্ত চেয়েছে রঙ্গন?

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
অষ্টাদশ_পর্ব (রঙ্গন-চিত্রলেখা স্পেশাল)
~মিহি

চিত্রলেখার হাত পা কাঁপছে। রঙ্গনকে কী জবাব দিবে সে? রঙ্গন ব্যাকুলতা তার জন্য অস্থিরতা হয়ে ধরা দিচ্ছে। রঙ্গন বোধহয় ঘোর ছেড়ে বেরোলো। হন্তদন্ত হয়ে চিত্রলেখার দিকে এগোলো।

-স্যরি, এরকম পরিস্থিতিতে আমার আসলে তোমাকে এসব বলা উচিত হয়নি। আমি জানিনা কেন বললাম। তোমার চোখ দেখে মনে হলো তোমার সাথে আরো কিছুক্ষণ থাকলে তোমার ভালো লাগবে।

-সবকিছু নিজে নিজেই ভেবে ফেলেন নাকি?

-তুমি যাও। আমরা পরে কথা বলবো।

-আপনাকে ভোর চারটে অবধি সময় দেওয়া হলো। আমার শহরে আমাকেই ঘোরাতে রাজি আছেন?

রঙ্গনের মনে হলো সে বোধহয় স্বপ্ন দেখলো। চিত্রলেখা সত্যিই তার কথায় রাজি হয়েছে? চোখ বড় বড় করে তাকালো সে। চিত্রলেখার মুখে তখন বিরক্তি ভেসে উঠলো।

-আশেপাশের কেউ দেখার অপেক্ষা করছেন?

-না না, আসো।

চিত্রলেখা চাদরটা আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। রঙ্গন বাইকে বসলো। চিত্রলেখা বেশ সাবধানে এক পাশ হয়ে বসে আলতো করে রঙ্গনের কাঁধে হাত রাখলো। রঙ্গন বাইক স্টার্ট করলো।

এলাকার রাস্তা পেরোনোর পর চিত্রলেখা খানিকটা স্বস্তি পেল। রাস্তা যথেষ্ট নিরিবিলি। মানুষজনের সমাগম নেই। রাতের নিস্তব্ধতা ছুঁয়েছে দিনের ব্যস্ততাকে।

-আমরা কোথায় যাচ্ছি?

-‘আফটার’ মুভি দেখেছো?

-না।

-আচ্ছা তাহলে জায়গাটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ থাকুক।

চিত্রলেখা চুপ করে বাতাসের শব্দ শুনতে লাগলো। গভীর রাতে এভাবে লুকিয়ে রাস্তায় ঘোরার স্পর্ধা তার কোনোকালেই ছিল না কিন্তু মোটেও খারাপ লাগছে না। জীবনের টানাপোড়েনের মাঝে এ ক্ষণিকের মুহূর্তটুকু তাকে প্রশান্তি দিচ্ছে।

-তুমি কখনো এভাবে রাতে লুকিয়ে বের হওনি তাইনা?

-আমার প্রাণের ভয় আছে। একবার কেউ জানতে পারলে কেটে ফেলে দিবে।

-এত ভয় পাও কেন?

-জানিনা। অভ্যাস হয়ে গেছে হয়তো এমন রেস্ট্রিকশনের কারণে।

-ভুল অভ্যেস বানিয়েছো। রেস্ট্রিকশনের শিকলে পড়ে লাইফটা মিস করতেছো। ভার্সিটি লাইফ চলে আসলে জীবনের অর্ধেক সুখ এমনেই কমে যাবে।

চিত্রলেখা জোরে নিঃশ্বাস নিল। মন্দ মধুর ঘ্রাণ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। চাদরের আবরণেও শীতল হাওয়া তাকে স্পর্শ করছে ঠিকই। চিত্রলেখা খেয়াল করলো তারা মেইন রাস্তা পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় এসেছে।

-এদিকে কোন জায়গায় যাচ্ছি আমরা?

-বিশ্বাস রাখতে পারো একটু।

চিত্রলেখা বলার মতো কোনো উত্তর পেল না। রাস্তাটা সুন্দর। অর্ধচাঁদ আকাশে ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। রাস্তাটা যেন অসীম। মাথায় একটা গান ক্ষণে ক্ষণে বাজছে,”এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।”

রঙ্গন বাইক সাইড করলো। চিত্রলেখা কল্পনার জগত থেকে বেরোল যেন। সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো রাতের নিকষ কালোতে ঝিলের পাড়ে জোনাকিদের বিচরণ। এত সুন্দর জায়গা সে আদৌ আগে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে পারছে না সে। চোখজোড়ায় মুগ্ধতা খেলা করছে।

-এত সুন্দর এ জায়গাটা! এটার কথা তো আমি জানতামও না।

-অনেকেই জানেনা। এ জায়গাটা ‘আফটার’ মুভির একটা দৃশ্যের মতো। তুমি যেহেতু মুভিটা দেখোনি, তাই বুঝবেনা। তুমি বরং জায়গাটার সৌন্দর্য উপভোগ করো।

চিত্রলেখা ধীরে ধীরে ঝিলের পাড় ঘেঁষে বসলো। টলটলে জলে অর্ধচাঁদের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। চিত্রলেখার চোখে মুগ্ধতার রেশ বিন্দুমাত্র কমলো না। শীতল জলে হাত স্পর্শ করতেই সর্বাঙ্গ ঝনঝন করে উঠলো তার।

-এই ঝিলে কি সাপ আছে?

-আরে নাহ, তাছাড়া পানিতে সাপ কামড়ায় না। তুমি সাপ ভয় পাও?

-মারাত্মক ভয় পাই। বাঘ ভাল্লুক থেকেও বেশি ভয় পাই।

-আরে সাপ নেই এখানে।

চিত্রলেখা যেন এ কথারই অপেক্ষা করছিল। সে ঝিলের আরো কাছাকাছি বসলো। রঙ্গনের একবার ভয় হলো মেয়েটা বেশি নিকটে যাচ্ছে না তো! চিত্রলেখা ঝিলের পানিতে পা ভেজালো। বরফের মতো শীতল সে পানি। তবুও চিত্রলেখার মোটেও খারাপ লাগলো না বরং সে মুহূর্তটাকে ভালোবেসে ফেললো।

-ঠাণ্ডা লাগবে চিত্রলেখা, এখন পানি যথেষ্ট ঠাণ্ডা।

-কিছু মুহূর্তের আনন্দের জন্য একটূখানি রোগে জড়ালে কিচ্ছু হয়না।

চিত্রলেখার কথাটা বোধহয় ভালো লাগলো রঙ্গনের। সেও ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো।

-জীবনের অজস্র ঝামেলার মধ্যে কিছু মুহূর্ত নিজস্ব থাকা দরকার, চিত্রলেখা।

-আপনার অভ্যেস আছে এভাবে রাতে পালিয়ে ঘুরে বেড়াবার, তাইনা?

-ঠিক অভ্যাস না, হঠাৎ হঠাৎ ভালো লাগে এসব করতে।

অতঃপর নীরবতা। রঙ্গনও আজ নীরব। পাশাপাশি বসে কথা বলার মতো কিছু যেন আর মুখে আসছে না তার অথচ জমানো কথাগুলো মনে ঠাঁই দেওয়ার জায়গা নেই। রঙ্গন গুনগুনিয়ে করতে লাগলো।

-আপনি গানও জানেন?

-টুকটাক।

-শোনার অনুমতি পেতে পারি?

রঙ্গন হাসলো। মেয়েটার কাব্যিক কথার ফোয়ারা তাকে মাঝে মাঝে অভিভূত করে। ‘নিশ্চয়ই..” মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল রঙ্গন। ক্ষীণ স্বরেই গেয়ে উঠলো,

“তুমি বৃষ্টি চেয়েছো বলে
কত মেঘের ভেঙ্গেছি মন
আমি নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি

তুমি যাওনি কিছুই বলে
আজও পাল্টে ফেলিনি মন
শুধু নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি

তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি
ও, তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি”

চিত্রলেখা অভিভূত হলো। এত সুন্দর কণ্ঠস্বর বুঝি হয় কারো! রঙ্গনের কণ্ঠে মোহিত হলো সে।

-আমি কিন্তু খুব একটা খারাপ গাই না, বলো চিত্রলেখা!

-আপনি প্রফেশনাল গায়কদের মতো গান গাইতে পারেন! আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। এত সুন্দর কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে গড-গিফটেড বা জেনেটিক্যাল!

-আমার বংশের কেউ গায়ক নাই, আমিই বোধহয় গড-গিফটেড।

-আমাদের বোধহয় এখন যাওয়া উচিত।

-হ্যাঁ চলো।

রঙ্গন চটজলদি উঠে বাইক স্টার্ট করলো। চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলা করছে। এতটা ‘বিশেষ’ কেউ তাকে কখনো অনুভব করায়নি। কিছু মুহূর্ত যে মানুষকে এতটা প্রশান্তি এনে দিতে পারে তা সে কখনোই বোঝেনি। বাইকের গতি স্বাভাবিক হলেও তার কাছে মনে হচ্ছে বাইকটা যেন জোরে চলছে। আরো আস্তে কেন চালাচ্ছে না রঙ্গন? চিত্রলেখার তো বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। মুহূর্তগুলো আরেকটু দীর্ঘায়িত হলে মন্দ হয় না।

-আপনি এই ঝিল খুঁজে পেলেন কিভাবে?

-জানিনা। হঠাৎ একদিন খুঁজে পেয়েছি। আমার ভাগ্য খুব ভালো, আমি সবসময় ভালো ভালো জিনিস খুঁজে পাই।

-তা বোধহয় সত্যি।

-তুমি কখনো রাত তিনটায় ফাঁকা রাস্তায় আইসক্রিম খেয়েছো?

-রাত তিনটায় আইসক্রিম কোথায় পাওয়া যায়?

-সামনে একটা দোকান খোলা, বসো একটু।

চিত্রলেখাকে কিছূ বলার সুযোগ দিল না রঙ্গন। বাইক সাইড করে ঝড়ের গতিতে আইসক্রিম আনতে গেল। চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি তখনো বহাল। অদ্ভুতভাবে তার অপ্রত্যাশিত সবকিছু যেন আজ ঘটছে। সে কি কখনো ভেবেছিল রাত বিরাতে এভাবে বাইরে বেড়াবে তাও রঙ্গনের সাথে? সে কতটুকুই বা চেনে রঙ্গনকে? ছেলেটা তো তার ক্ষতিও করতে পারতো! এতটা অবলীলায় কী করে বিশ্বাস করতে পারলো সে? একবারও তো চিত্রলেখার মনে হলো না ছেলেটা তার ক্ষতি করতে পারে কিংবা ছেলেটার দৃষ্টি তার জন্য অসুবিধের।

রঙ্গন দুই হাতে দুইটা কোণ আইসক্রিম আনলো। বাইক থেকে নেমে সেখানেই হেলান দিয়ে দাঁড়ালো চিত্রলেখা। রঙ্গন তার দিকে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও আরেকটা প্যাকেট খোলা শুরু করলো।

-শীতের রাতে তিনটের কাছাকাছি সময়ে এভাবে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়া, অনেকটা সিনেম্যাটিক না চিত্রলেখা?

-পুরোটাই সিনেম্যাটিক।

-তোমার ঠাণ্ডা লাগবে বোধহয়। স্যরি।

-মানুষ যখন মন থেকে শান্তি পায়, তখন এসব ঠাণ্ডা লাগার আক্রমণ হয় না।

-তুমিও দেখি আমার মতো কথা বলতে শিখে গেছো। তাড়াতাড়ি শেষ করো, তোমাকে রেখে আসি। নাহলে দেখা যাবে তোমার বাড়িতে তোমাকে খুঁজতে হট্টগোল পড়ে যাবে।

-হুম।

রঙ্গনের খানিকটা মন খারাপ হলো। এতক্ষণ চিত্রলেখার সঙ্গ বেশ উপভোগ করছিল সে। এখন যেন পৃথিবীর সমস্ত একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরবে।

খুব সাবধানে চিত্রলেখাকে মেইন রাস্তার কাছে নামিয়ে দিল সে। অতঃপর বিদায়ের প্রহরটা নীরবেই কাটলো তাদের।

-ধন্যবাদ একটা সুন্দর সন্ধ্যার জন্য।

-যাও সাবধানে। আল্লাহ হাফেজ।

-আল্লাহ হাফেজ। আপনিও সাবধানে যাবেন।

চিত্রলেখা সামনে এগোলো। চিত্রলেখা চোখের আড়াল হওয়া অবধি রঙ্গন সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১৫+১৬

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চদশ_পর্ব
~মিহি

“আমরা অনিক মাহমুদের সাথে দেখা করতে চাই। তার উপর এটেম্পট টু রেপের চার্জ আছে। তিনি একজন মেয়েকে মলেস্ট করার ট্রাই করে পালিয়ে এসেছেন।” অফিসারের কথাটা সাথীর কানে ভ্রমরের ভোঁ ভোঁ শব্দের ন্যায় ধাক্কা দিল। এক মুহূর্তে বাড়ির পরিস্থিতি বদলে পরিণত হলো সঙ্কটারণ্যে।

অনিক চমকে তাকালো সাথীর দিকে। মেয়েটার চোখে কি অবিশ্বাস দেখা যাচ্ছে? অনিক আচমকা সাথীর দুহাত চেপে ধরলো। অনিকের চোখ ছলছল করছে।

-সাথী বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু করিনি।

-আমি বিশ্বাস করি তোমাকে। পুরো পৃথিবী তোমার বিপক্ষে থাকলেও আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো।

“আপনাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্যাচাল পরে হবে। আপনি চলুন আমাদের সাথে।” বলেই অনিককে আর সময় দিলেন না পুলিশ অফিসার । অনেকটা টেনেই নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসালেন। অন্তরের বাবা মা তখনো সেখানে উপস্থিত। সুযোগটা হারালো না তারা, অপমানের প্রতিদান দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে বলে কথা।

-যেমন পরিবার, তেমন শিক্ষা! ভাই আরেকজনের ইজ্জত কেড়ে পালিয়ে আসে, তার বোন আবার কেমন হবে? দেখা যাবে বিয়ের পর আমার ছেলেকে লুকিয়ে আরেকজনের সাথে…

-আমার বোনের চরিত্রে আঙুল তোলার আগে নিজেদের পারিবারিক শিক্ষার দিকে নজর দিন এবং সম্মানসমেত বের হোন।

চিত্রলেখা অর্ণবকে আটকানোর চেষ্টা করলো। এখন এসবের সময় নয়। আজ শুক্রবার। রবিবারের আগে বেইল করানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাস্তবতা বুঝে বিবেচনা করতে হবে তাদের।

-আমরা কি পুলিশ স্টেশনে যাবো না?

-সাথী, শান্ত হও। আমি যাচ্ছি পুলিশ স্টেশনে। আমি কথা বলে আসি।

-ভাইয়া আমিও যাবো।

-আচ্ছা ঠিক আছে, চলো। বাকিরা বাড়িতে থাকো।

সাথী অর্ণবের কথায় সায় দিল। মনে মনে প্রচণ্ড ভেঙে পড়লেও সে প্রকাশ করছে না। নিজেকে শক্ত রেখেছে সে। সাথী অনিককে অবিশ্বাস করেনা। অনিক আর যাই করুক কখনো কোনো মেয়ের সভ্রমে আঘাত হানার মতো অন্যায় করতে পারেনা।

_______________

পুলিশ স্টেশনের পরিবেশের সাথে ঠিকমতো পরিচিত নয় সাথী, অর্ণবও বেশ অপ্রস্তুত। দায়িত্বরত অফিসারের ব্যবহার যথেষ্ট রূঢ় মনে হচ্ছে তবুও অর্ণব গেল কথা বলতে।

-স্যার আমার ভাই অনিক মাহমুদকে একটু আগে এটেম্পট টু রেপ কেসে এরেস্ট করা হয়েছে। আমরা তার সাথে দেখা করতে চাই।

-উকিল ছাড়া দেখা করতে পারবেন না। কেস যথেষ্টই সিরিয়াস, ভিক্টিম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

-প্রমাণাদি ছাড়া শুধুমাত্র কথার ভিত্তিতে আপনি কিভাবে একজন মানুষকে জেলে ঢোকাতে পারেন?

-আইন শেখাচ্ছেন? ভিক্টিম নিজে সাক্ষী দিয়েছে, আপনার ভাই তাকে ফোনে আজেবাজে মেসেজ করতো সেসব দেখিয়েছে। আপনার ভাইয়ের এ শহরে আসার আগে লাস্ট লোকেশন মেয়েটার বাড়িতে। আরো কোনো প্রমাণ দরকার?

-আমরা ওর সাথে দেখা করতে চাই অফিসার, প্লিজ।

-একজনকে এলাও করতে পারবো। যেকোনো একজন যান।

সাথী করুণ দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব না বলতে পারলো না। সে সাথীকেই ভেতরে যেতে বললো। সাথী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কনস্টেবলের সাথে ভেতরে গেল।

সাথীকে দেখে অনিক একটু হলেও প্রাণ ফিরে পেল। সাথী এগিয়ে আসতেই সে সাথীকে জড়িয়ে ধরলো। চোখ বেয়ে অশ্রুকণা বেহিসেবি গতিতে ঝরে পড়ছে।

-অনিক, তুমি চিন্তা কোরো না। কী হয়েছে আমাকে সবটা বলো।

-আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা সাথী। আমার পি.এস দীতি করেছে এসব।

-ও কেন করছে এসব অনিক?

-এটা তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল, স্যরি সাথী। আমি যা বলছি শোনো এবং প্লিজ আমাকে বিশ্বাস কোরো।

-আমি কখনোই তোমাকে অবিশ্বাস করিনা। তুমি বলো কী হয়েছে।

-দীতি নতুন হওয়াতে ওকে মোটামুটি সব কাজ আমাকেই শেখাতে হতো। আর শেষ দুই মাসের ব্যস্ততা তোমাকে বলেছিলাম। মিটিং আর কাজের চাপে বাসায় আসার সময়টুকু পেতাম না। আর মিটিংয়ের সময়টুকু আমার ফোন ওর কাছে থাকতো। আমি জানতাম না ও আমার ফোন থেকে আমার ইমেইল মিসইউজ করতো। অফিসের দরকারি তথ্যগুলো ও অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রি করতো। এটা আমি জানতে পারি গত সপ্তাহে। আমি ভেবেছিলাম আগে ওর সাথেই এটা নিয়ে কথা বলবো।

-আর ও এজন্য তোমাকে বাড়িতে ডাকে?

-হ্যাঁ কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ও সব অস্বীকার করে, এমনকি আমার কাছে তখন কোনো প্রমাণ নেই কেননা ও আমার ফোন ব্যবহার করতো। ও আমাকে হুমকি দেয়। আমি কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। তাই আমি বসের কাছে ছুটির মেইল করে এখানে আসি। আমি ভুলেও ভাবিনি ও আমার উপর এরকম একটা মিথ্যে মামলা চাপিয়ে দিবে। এমনকি আমি চলে আসার পর ও আমার ইনবক্সে উল্টোপাল্টা মেসেজ, নিজের ছবি পাঠিয়েছে। আমি বিরক্ত হয়ে ব্লক করে দিয়েছিলাম ওকে।

-বুঝতে পেরেছি।

-তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছো না তো সাথী?

-না অনিক, তোমার উপর আমার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে। আমি সত্যিটা জেনেই ছাড়বো। তুমি শুধু একটু ধৈর্য রেখো।

অনিকের চাহনি বলে দিচ্ছে সে কতটা অসহায় অনুভব করছে। কনস্টেবল আর সাথীকে থাকতে দিল না। অনেক সময় হয়ে গিয়েছে বিধায় তাকে বের হয়ে যেতে হলো। অর্ণব বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সাথী তৎক্ষণাৎ কিছু বললো না। পুলিশ অফিসার তাদেরকে আর কিছু বললেন না। সাথী এবং অর্ণব বেরিয়ে আসলো।

-ভাইয়া, আজ তো বেইল করার উপায় নাই।

-তুমি বাসায় যাও। আমার এক বন্ধুর ভাই আছে, ও জুনিয়র উকিল। ওর সাথে পরামর্শ করে দেখি আমি। যেতে পারবে?

-হ্যাঁ ভাইয়া। পারলে উকিল নিয়ে বাসাতেই আসুন। অনিক আমাকে যা যা বলেছে, সেসব উকিলেরও জানা দরকার।

-আচ্ছা।

______________

সাথী বাসায় এসে নিজের ঘরে ঢুকলো। অপর্ণা এখন পর্যন্ত সাথীর সাথে এ বিষয়ে কথা বলেনি। তবে অপর্ণার বাড়ির লোকজনকে ইতোমধ্যে সে সবই জানিয়েছে। সাথীর বাড়ির লোকজন এখন পর্যন্ত কিছু জানে না। জানলে কী হবে সেটা ভেবেও ভয় পাচ্ছে সে।

অর্ণব উকিল নিয়ে আসলো বিকেলের পর। সাথী যা যা জানতো সবটাই জানালো। উকিলের নাম তৌহিদ। বয়সে যুবক, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। সে মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো এবং সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য কিছুটা সময় চাইলো। অর্ণব কথাবার্তা শেষ করে তাকে বিদায় জানালো।

ঝামেলার সূচনা হলো সন্ধ্যের পরপর। সাথীর মা তার ফুপু আশফিনা আহমেদকে সাথে করে নিয়ে আসলেন। বাড়ির পরিবেশ তখন থমথমে। আশফিনা আহমেদ সোজা গেলেন সাথীর সাথে কথা বলতে। অর্ণব কিংবা বাড়ির অন্য কোনো সদস্যদের তিনি কোনোরকম পাত্তা দিলেন না। সোজা সাথীর পাশে বসলেন।

-সাথী, তুই এখনি কাপড়-চোপড় নিয়ে চল।

-ফুপু, কোথায় যাবো আমি?

-নিজের বাড়িতে। আমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবো। তুই ওই ছেলেকৈ ডিভোর্স দিবি যত দ্রুত সম্ভব।

-আমি এটা কখনোই করবো না। তোমরা যদি আমাকে জোর করার চেষ্টা করো আমি বিষ খেয়ে মরে যাবো। মা, তুমি কেমনে পারলা নিজের মেয়ের এ সময়ে তাকে এরকম পরিস্থিতিতে ফেলতে?

-সাথী, তোর মাকে দোষারোপ করবি না অযথা। তোর স্বামী যা করেছে, এরপর আমি কোনোভাবেই তোকে এখানে রাখতে পারবো না। যার বাবার রক্তেই সমস্যা, সে কিভাবে ভালো হবে?

-ফুপু, তুমি যাও দয়া করে। আমাকে দয়া করো তোমরা। আমাকে আমার সংসারটা বাঁচাতে দাও। তোমরা প্লিজ চলে যাও।

কথাগুলো বলে একদণ্ড দাঁড়ালো না সাথী। ছুটে গিয়ে বাথরুমে নিজেকে আটকে ফেললো। আশফিনা আহমেদ বাইরে থেকে চেঁচামেচি করলেও ভেতর থেকে সাথী কিছুই বললো না। শেষমেশ তিনি বিরক্ত হয়ে সাথীর মাকে নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে কেবল একবার অগ্নিদৃষ্টিতে চিত্রলেখাকে দেখে গেলেন। চিত্রলেখা তাতে প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে কেবল নিজের ভাবীর কথা ভাবছে। একজন মানুষ কতটা শক্ত হলে এমন পরিস্থিতিতেও নিজেকে এভাবে সামলাতে পারে? এ পরিস্থিতিতে কতজন স্ত্রী পারবে নিজের স্বামীর প্রতি বিশ্বাস রাখতে?

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
ষোড়শ_পর্ব
~মিহি

রঙ্গন এসেছে মিনিট দশেক হয়েছে কেবল। নির্বাচনের ঝামেলার কারণে তার পরীক্ষা দেড়মাস পিছিয়েছে, ক্লাসও বন্ধ। ভেবেছিল এখানে এসে সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে কিন্তু এখন সে নিজেই সারপ্রাইজড। ফুপাতো ভাই হিসেবে সাথীর সাথে রঙ্গনের বিশেষ সখ্যতা নেই। রঙ্গন বরাবরই শহরেই বড় হয়েছে, নানিবাড়িতে খুব কমই যাওয়া হয়েছে তার। কিন্তু সাথীর সাথে জুড়ে থাকা আরেকটা নাম চিত্রলেখা। রঙ্গন সাথীর কথা জানতে পারার পর থেকেই খানিকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। তারপর যখন শুনলো তার মা তার মামীসমেত সাথীকে জোর করে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনার চেষ্টা করেছে, এতে সে আরো উদাস হয়ে পড়লো।

-রঙ্গন, তোর মা কল করেছিল। সাথী আসেনি, এখন ও সাথীর মাকে নিয়ে ও বাড়িতেই আছে।

-সাথী আপু যখন আসবেই না, তখন তাকে জোর করে লাভ কী বাবা?

-সেটা তোর মা বুঝলে তো হতোই। এ বিয়েটা শুরু থেকেই মানেনি সে, এমনকি বাড়ির প্রতিটা সদস্যকে অপছন্দ করতো সে। চিত্রলেখা এখানে আসাতে তার প্রতি তোর মায়ের অপছন্দ বেড়েছে। এখন সুযোগ পেয়েছে নিজেকে সঠিক এবং সাথীর বরকে ভুল প্রমাণ করার। এ সুযোগ সে কী করে ছাড়বে সে?

-ও বাড়িতে তাহলে যাওয়া উচিত বাবা।

-রঙ্গন, তুমি এসব থেকে দূরে থাকো।

-কিন্তু বাবা…

-যা বলছিলাম করো। বাইরে থেকে এসেছো, যাও ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।

রঙ্গন কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে এগোল। বাড়ির পরিবেশ বেশ শান্ত। নির্ঘাত অহম ঘুমিয়েছে। রঙ্গন ঘরে ঢুকেও স্বস্তি পেল না। চিত্রলেখার জন্য মন কেমন করতে থাকলো তার। অদ্ভুত রকমের অস্বস্তিতে তার আর খাওয়াও হলো না রাতে।

ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা। সাথী নিজের ঘরে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করছে। অপর্ণা, অর্ণব ঘুমিয়েছে। চিত্রলেখা নিজের ঘরে বসে সাথীর কথা ভাবছে। অনিকের থেকে যথাযথ স্নেহ না পেলেও সে তাকে সর্বদাই সম্মান করে এসেছে কিন্তু গতদিন নিজের ভাইয়ের মেসেঞ্জারে আসা ছবিটা তার মনে সন্দেহ বাড়িয়ে তুলেছে। তার মনে ভয় হয় কেবল নিজের ভাবীকে নিয়ে। যে মানুষটা প্রেমের টানে নিজের পারিবারিক সুখ বিসর্জন দিয়ে এসেছে, সে যেন দিনশেষে কষ্ট না পায়। চিত্রলেখার ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। রঙ্গন কল করেছে। চিত্রলেখা কল রিসিভ করবে কিনা ভেবে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করলো। ঘরের দরজা লাগানোই আছে তবে শব্দ বাইরে যেতে পারে ভেবে সে শীতের মধ্যেও ফ্যানের সুইচ অন করলো।

-আসসালামু আলাইকুম।

-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো চিত্রলেখা?

-আল্লাহ যেমন রেখেছেন তেমনই আছি। আপনি এতো রাতে কল করলেন?

-আসলে আমি খুব দুঃখিত। মা তোমাদের ওখানে গিয়েছিল শুনলাম। সাথী আপুকে জোর করে আনার চেষ্টাও করেছে নাকি।

-আপনার দুঃখিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি তো কিছু জানতেনও না। তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে পড়লে অনেক সময় স্ত্রীরাই স্বামীকে বিশ্বাস করতে পারে না, আর তো শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

-সাথী আপু তো বিশ্বাস করছে, ভালোবাসার টান এটাই হয়তো।

-ভালোবাসার টানেই সবসময় এমন হয়না, অনেক ভালোবাসার সম্পর্কেই বিশ্বাস থাকে না।

-আমার মন বলছে অনিক ভাইয়া কিছু করেনি, তুমি দুশ্চিন্তা করো না চিত্রলেখা।

-আমার ভাইকে আমিই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না, আপনি কিভাবে পারছেন?

-আমার মন বলছে। আমার পরিচিত একজন উকিল আছে।

-আমরা কথা বলেছি উকিলের সাথে। উনি সব কাগজপত্র রেডি করছেন বেইলের জন্য।

-ওহ আচ্ছা। চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

-হুম ইনশাআল্লাহ। আর কিছু বলবেন আপনি?

-না, মনে হলো বন্ধু হিসেবে বিপদের সময় পাশে থাকা দরকার।

-আমরা বন্ধু?

-বন্ধু নই?

চিত্রলেখা কিছু না বলেই কল কেটে দিল। রঙ্গনের থেকে দূরে থাকার চেষ্টাটা সে বরাবরই করে। আশফিনা আহমেদের দৃষ্টি ভয় পায় সে। ভদ্রমহিলা তার গোটা পরিবারকে অপছন্দ করে আর চিত্রলেখা যেন অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে। সে জায়গা থেকে রঙ্গনের সাথে বন্ধুত্ব করা আশফিনা আহমেদের কাঠগড়ায় মৃত্যুদণ্ড সমপরিমাণ পাপ। তবুও রঙ্গনকে অবহেলা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ। একটু বাদেই রঙ্গনের দ্বিতীয়বার কল আসলো। রিসিভ করলো চিত্রলেখা।

-এমন পরিস্থিতিতে এসব বলা আমার সত্যিই উচিত না। দুঃখিত, তবে আমি বন্ধু হিসেবে এতটাই অযোগ্য? চিত্রলেখা, আমার খারাপ সময়ে যখন আমি মানসিকভাবে অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম তখন তোমার সাথে কাটানো কিছুটা মুহূর্ত আমাকে ভালো রেখেছে। আমি তাই ধরেই নিয়েছিলাম আমরা বন্ধু। তুমি সত্যিই আমার জন্য খুব ভালো একটা বন্ধুর জায়গা দখল করে আছো। আমরা কি সত্যিই বন্ধু না?

-হ্যাঁ আমরা বন্ধু। এখন কল রাখুন।

চিত্রলেখা কেন যেন না বলতে পারলো না রঙ্গনকে। মুখের উপর বলে দিতে পারলো না যে আমরা বন্ধু না আর না কখনো বন্ধু হতে পারবো। এই না বলতে না পারাটা বোধহয় ভবিষ্যতে তাকে আরো বিপদে ফেলবে।

_______________

শনিবার আশফিনা আহমেদ আর এলেন না চিত্রলেখার বাড়িতে তবে সাথীর বাবা আলতাফ হোসেন এলেন। তিনি অবশ্য আশফিনা আহমেদের মতো সবাইকে উপেক্ষা করলেন না। সকলের সাথে বসে কথা বলে তবে সাথীর সাথে কথা বলার জন্য এগোলেন। সাথী নিরুত্তাপ ভাবলেশহীন হয়ে এক কোণে বসে আছে। এক টুকরো বিশ্বাসের ভেলায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে নেমেছে সে। সারা রাত নির্ঘুম থাকার ফলে চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে।

-সাথী, মা আমার। এ কী অবস্থা তোর?

-আমি ঠিক আছি বাবা। তুমি কেন এসেছো এখানে?

-আমি অনিককে বিশ্বাস করি মা। ওকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে যা করতে হয় আমি করবো। তুই চিন্তা করিস না।

-ধন্যবাদ বাবা।

-কিন্তু তুই নিজের এ অবস্থা করলে অনিককে কিভাবে সামলাবি মা? তোকে আমি এ অবস্থায় এখানে রেখে যেতে পারিনা। তোকে আমি ভরসা করতে পারছি না। তুই যদি নিজের ক্ষতি করে বসিস? তোকে আমি নিজের কাছে রেখে যা করার করবো। তুই চল আমার সাথে।

-বুদ্ধিটা খারাপ না বাবা। এটাও কি আমার ফুপুর বুদ্ধি? সাবাশ! কী তীক্ষ্ম বুদ্ধি!

-সাথী, তুই আমাকে বিশ্বাস করছিস না?

-বিশ্বাসের একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ আছে বাবা। তোমার নিকট থেকে আমি সেটা পাচ্ছি না।

আলতাফ হোসেনের মুখের ভাব তৎক্ষণাৎ পাল্টে গেল। সাথীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

-এরপর যদি তোমরা আমাকে জোর করো তবে তোমাদের নিজের মেয়েকে হারাতে খুব বেশি সময় লাগবে না বাবা।

-যার জন্য এতটা পাগল হয়েছিস, সে রেখেছে ভালোবাসার মর্যাদা? ও দোষী সাব্যস্ত হলে কী করবি তখন? কাউকে এতটা বিশ্বাস করিস না যেন বিশ্বাস ভাঙলে জীবনটাও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়।

-বিশ্বাসের বিশেষত্বই এটা বাবা। আমি না আমার বিশ্বাস ভাঙতে দেব আর না আমার জীবন।

আলতাফ হোসেন রেগে বেরিয়ে গেলেন। সাথী মেঝেতে বসে হাঁটু মুড়ে সেখানে মাথা রাখলো। চিত্রলেখা সাথীর পাশে গিয়ে সাথীকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। সাথী ভেঙে পড়লো না। শক্ত ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ় সে কেবল প্রার্থনা করলো,”আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিও আমি যেন আসন্ন সব বিপদ মোকাবিলা করে আমার বিশ্বাস অটুট রাখতে পারি।” সাথীর চোখ শুষ্ক অথচ যাবতীয় যন্ত্রণা সে জমিয়ে রেখে বুকে এ মুহূর্তে। চিত্রলেখার চোখ ভিজে উঠে। মানুষটা এতটা দৃঢ় কী করে? এতটা বিশ্বাস? শুধুই কি ভালোবাসার কারণে?

অর্ণবের ফোন বেজে উঠলো। পুলিশ অফিসারের নম্বর ভেসে উঠছে স্ক্রিণে। আচমকা স্টেশন থেকে কল পেয়ে খানিকটা ভীত হলো সে। চটজলদি ফোন রিসিভ করলো। সেকেন্ড তিরিশেক সময় লাগলো অর্ণবের অপর প্রান্তের কথা বুঝতে। অতঃপর তার চোখের সামনে অন্ধকার ছেঁয়ে গেল। সামনে বসে থাকা সাথীকে কিভাবে কথাটা বলবে ভেবে তার বুক কাঁপতে লাগলো। কান্নাগুলো আটকে আছে কোনোরকম, সাথীর সামনে কাঁদতে পারবে না সে আর না সাথীকে এ মুহূর্তে কিছু জানানোর সামর্থ তার আছে।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১৩+১৪

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
ত্রয়োদশ_পর্ব
~মিহি

“তুমি চিত্রলেখা, তাই না?” রঙ্গনের মেসেজে অনেকটাই বিস্মিত হলো চিত্রলেখা। রঙ্গন কীভাবে জানলো এটা? চিত্রলেখা কি অস্বীকার করবে বিষয়টা?

-অস্বীকার করে লাভ নেই চিত্রলেখা, তুমি ধরা পড়েছো।

-কিভাবে চিনলেন?

-তোমার ডিটেইলস ফ্রেন্ডস করা ছিল কারণ তোমার লিস্টে কোনো ফ্রেন্ড নাই কিন্তু আমাকে এড করার পর সেসব তুমি হাইড করতে ভুলে গেছো।

-ওহ আচ্ছা। কলেজের নাম দেওয়া আছে শুধু, তাতেই চিনলেন?

-না, ইমেইল আইডি দিয়ে রেখেছো। যাই হোক, আমি যে চালাক তা প্রমাণ হলো।

-আপনি যে দুঃখী চালাক তা বুঝতে পারলাম।

-দুঃখ ভাগ করে নেও। কেউ তো মানা করেনি!

-আমার জীবনে যেন দুঃখের খুব অভাব পড়েছে।

-অহম কল করেছিল। তোমাকে নাকি মিস করছে।

-আসলে আমার পরীক্ষা তাই পড়াতে নিষেধ করেছে ভাইয়া।

-বুঝতে পেরেছি।

-আচ্ছা আমার ক্লাস আছে ভাইয়া, টা টা।

-বাই!

চিত্রলেখা ফোন রাখলো। মিথ্যে বলেছে সে। এখন তার ক্লাস নেই তবে রঙ্গনের সাথে কথা বাড়াতে অপরাধবোধ হচ্ছে তার। আশফিনা আহমেদ তাকে নওশাদের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাকে দেখেই বোঝা যায় তিনি চান না চিত্রলেখা ভুলেও রঙ্গনের আশেপাশে থাকুক। এ জিনিসটা আশফিনা আহমেদের চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছিল সে। রঙ্গনের সাথে কথা বাড়ানো তার জন্য ক্ষতিকারক। চিত্রলেখা ফোন পাশে রেখে বই নিয়ে বসলো। একটু বাদেই সঞ্চারী এলো তার কাছে।

-কী পড়ছিস?

-রসায়ন। তুই কোথায় গিয়েছিলি?

-এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।

-বন্ধু? ছেলে বুঝি?

-হুম।

-বাব্বাহ!

-ধূর! উল্টোপাল্টা ভাববি না একদম!

-আচ্ছা বেশ। নাম কী আপনার বন্ধুর?

-অভিক।

-ভালোই।

সঞ্চারীর মুখের লাজুক আভা নজর এড়ালো না চিত্রলেখার। মেয়েটা নিশ্চিত অভিককে পছন্দ করে মনে মনে। চিত্রলেখা সেসব ভাবার সময় পেল না। দুদিন বাদে পরীক্ষা অথচ পড়াশোনার অবস্থা বেহাল। বইয়ে মনোনিবেশ করলো সে।

________________

সাথী বেশ অনেকক্ষণ ধরে অনিকের ফোন নম্বরে কল করছে। ফোন বারবার ওয়েটিং বলছে। সাথী বেশ বিরক্ত হলো। ছেলেটা ইদানিং নিজে থেকে কল করেনা একদম। অনিকের ব্যস্ততা বোঝে সাথী কিন্তু তবুও তার মন মানতে চায় না। প্রেমের বিয়ে, টানটা একটু বেশিই খাটে। এসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণার চেঁচামেচি কানে আসলো সাথীর। ফোন বিছানায় রেখে বাইরে আসে সে।

-কী হয়েছে আপা? এত চেঁচামেচি করছো কেন?

-আমার কাপড় ধুয়ে রেখেছিলাম ছাদে মেলতে দেওয়ার জন্য। রূপসার অত্যাচারে ভুলেই গেছি। তুইও তো একটু দেখতে পারতি!

-আমি রান্না করছিলাম আপা।

-ঐ এক রান্নার বাহানা! কাজ আমিও করি, সংসার করতে হলে সবদিকে মন ঠিক রাখতে হয়। প্রেম করে বিয়ে করছো তো সংসারে মন টেকে না।

-সকাল থেকে সব কাজ করলাম আমিই অথচ সংসারে মনও আমারই টেকেনা? আপনি ঠিক কোন কাজটা করে সংসারে মন বসাচ্ছেন আপা?

সাথীর ঝাঁঝালো প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো অপর্ণা। সাথী কখনো এভাবে কথা বলে না তার সাথে। সাথীর মন এমনিতেই বিক্ষিপ্ত অনিকের কারণে, তার উপর অপর্ণার চেঁচামেচি সে কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি। খানিকটা উগ্র স্বরেই উত্তর দিয়েছে।

-সাথী, বাড়াবাড়ি করবি না একদম।

-কী করবেন? মাকে দিয়ে আমাকেও নোংরা গালিগালাজ করবেন? আমি চিত্রলেখা নই আপা। অর্ণব ভাই সত্যিটা জানলে আপনার সংসার বাঁচবে তো? আমার সাথে লাগতে আসিয়েন না।

সাথী চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকলো। অপর্ণার সাথে সে কখনো উচ্চবাচ্য করেনি তবে অপর্ণার কীর্তিকলাপে সে এখন বিরক্ত। চিত্রলেখাকে যতটা বাজেভাবে অপমানিত করেছে তার মা, এরপরও কোন মুখে সে এ বাড়িতে কর্তৃত্ব ফলাতে চায় বুঝে উঠতে পারে না সাথী। অনিকের নম্বরে আরেকবার কল করলো সে। এবার কল রিসিভ হলো। ঊপর পাশ থেকে মোলায়েম স্বরে একটি মেয়ে কণ্ঠ সালাম দিল।

-ওয়ালাইকুম সালাম। আপনি কে? অনিকের কল কেন রিসিভ করেছেন?

-স্যার মিটিংয়ে আছেন, আমি ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট।

-কিন্তু ওনার পি.এস তো জাহিদ ভাই ছিল।

-উনি রিজাইন করেছেন ম্যাম।

-আচ্ছা অনিক আসলে আমাকে বলবেন কল করতে।

-আচ্ছা ম্যাম।

সাথী কল কাটলো। বিরক্তি আরো বেড়েছে তার। একজনের কল কেউ এভাবে রিসিভ করে যতই পি.এস হোক! স্বভাবসুলভ হিংসেটা জেগে উঠে তার মনে। পরক্ষণেই গ্যালারিতে ঢুকে তার এবং অনিকের আগেকার ছবিগুলো দেখতে থাকে।

_____________________________

সময় বড্ড দ্রুত অতিবাহিত হয়। চোখের পলকেই সপ্তাহ দুয়েক পেরোলো। এর মধ্যে চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢোকেনি আর। নওশাদের বিষয়টাও ধামাচাপা পড়েছে। সিয়াম অবশ্য প্রতিদিন পরীক্ষার খোঁজ নিয়েছে। চিত্রলেখার মাঝে মাঝে মনে হয় সিয়াম তাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই করুণা করে।

পরীক্ষা শেষ হওয়ায় এক সপ্তাহের ছুটি দিল কলেজ থেকে। চিত্রলেখা ভেবেছিল বাড়িতে যাবে না কিন্তু কেউই থাকবে না হলে, সঞ্চারীও চলে যাচ্ছে। শেষমেশ বাধ্য হয়েই চিত্রলেখাকে বাড়িতে ফিরতে হলো। অনিকও ছুটি নিয়ে এসেছে। বাড়ির পরিবেশ বেশ ঠাণ্ডা। সবাই আছে কিন্তু কিছু একটা নেই এমন অবস্থা। চিত্রলেখা কিছু বুঝতে পারে না। সাথীর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে সে। সাথী লক্ষ করলো।

-কী হয়েছে তোর?

-আশেপাশে এভাবে ঘুরঘুর করছিস কেন?

-বাড়ি এমন শান্ত কেন ভাবী? মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে।

-অনেকদিন পর এসেছিস তাই এমন ভাবছিস। কিছু হয়নি। তাড়াতাড়ি বাড়িতে পিরে আয়। তোকে ছাড়া বাড়িটা মরুভূমি হয়ে গেছে।

-হয়েছে পাম দিও না এতো।

দুজনে খিলখিল করে হেসে উঠলো। চিত্রলেখাকে হাসতে দেখে মনের ভার কমলো সাথীর। সে দুশ্চিন্তায় ছিল হলে না জানি কেমন করে থাকছে চিত্রলেখা।

-তোর হলে অসুবিধা হচ্ছে নাকি?

-একদম না। একটা বান্ধবী আছে, খুব ভালো। সবসময় খেয়াল রাখে আমার আর আরেকজনের সাথে কথাবার্তা হয়নি তেমন তবে দুডনেই যথেষ্ট ভালো।

-বাড়ির মতো পরিস্থিতি নাকি ওখানে শান্তি খুঁজে পাস?

চিত্রলেখা উত্তর দিতে পারলো না। যত যাই হোক, বাড়িতে সে যে স্বস্তি পায় তা কি আদৌ হলে পাওয়া সম্ভব? বোধহয় না! নীরব থাকলো সে।

-তোর ভাইয়াকে চা দিয়ে আয় যা।

-ছোট ভাইয়া আমাকে দেখলে বিরক্ত হবে ভাবী।

-বেশি বুঝবি না! যাহ!

চিত্রলেখা চুপচাপ চায়ের ট্রে হাতে নিল। তার ছোট ভাবী যে তাকে এবং তার ভাইকে মেলানোর এ ব্যর্থ প্রচেষ্টা কতবার করেছেন হিসাব নেই।

চায়ের ট্রে বেডসাইড টেবিলে রেখে আশেপাশে তাকালো চিত্রলেখা। আশেপাশে অনিক নেই। বাথরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে। সেখানেই গেছে বোধহয়। আচমকা চিত্রলেখার চোখ পড়লো বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটার উপর। কারো ইনবক্স ওপেন করা। একটু পরেই একটা ছবি আসলো সেখানে, একটা মেয়ের হাস্যোজ্জল ছবি। চিত্রলেখা খানিকটা বিস্মিত হলেও কিছু বললো না।

-আরে লেখা তুই? হঠাৎ আমার রুমে?

-হ্যাঁ চা দিতে এসেছিলাম ভাইয়া।

-ওহ, বস। পড়াশোনার খবর কী?

-এইতো ভালোই।

-তোদের বয়সী মেয়েদের মাথায় সমস্যা আছে বুঝলি? দুদিন ধরে একজন খুব জ্বালাচ্ছে। ভেবেছিলাম অল্পবয়সী, বকাঝকা করবো না। এখন দেখ ছবি পাঠিয়েছে। এখন রাগারাগি করলে দোষ তো আমার দিবে।

-ব্লক করে দাও ভাইয়া। অযথা ঝগড়া করে কী হবে?

অনিক মাথা নেড়ে সায় জানালো। চিত্রলেখার সংকোচ কিছুটা দূর হলো। অনিক আর সাথীর প্রেমময় দিনগুলির কথা চিত্রলেখা জানে। ভাবী তাকে সব স্মৃতি হুবহু বলে রেখেছেন। চিত্রলেখা এই দুজনের দিকে তাকায় আর ভাবে, তারা যেন সুখী হয় সর্বদা।

“তোমার বোনকে আবার কেন এনেছো? আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।” অর্ণব অপর্ণার কথার উত্তর দিল না। অযথা এই মেয়ের প্রলাপ শোনার ধৈর্য দেখিয়ে লাভ নেই। কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করার ইচ্ছে শেষ হলে নিজে থেকেই চুপ করবে। অপর্ণা দেখলো অর্ণব তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছে না। এবার সে খানিকটা সাহস পেল। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে বলে উঠলো,”চিত্রলেখার জন্য একটা ভালো পাত্রের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে যথেষ্ট বড়লোক। ওকে সুখে রাখবে। সময় থাকতে বিয়েটা পেরে ফেলি চলো নাহলে আবার কার না কার হাত ধরে চলে যাবে আমাদের চুনকালি মাখিয়ে!”

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
চতুর্দশ_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা শুক্রবারের দুপুরে ঘুম থেকে উঠেই জানলো তাকে একটু পর দেখতে আসবে। ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে। অপর্ণার কথা বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হলো তার। উপস্থিত কেউই যেন বিশ্বাস করতে চাইলো না অপর্ণার কথা। সবচেয়ে বেশি ক্রোধ ফুটে উঠলো অর্ণবের মুখে।

-অপর্ণা, তোমাকে আমি অনুমতি দিয়েছিলাম কি আমার বোনের জন্য সম্বন্ধ দেখতে? কেন তাদের ডেকেছো তুমি?

-তো বোনকে কতদিন বসে খাওয়াবা? কয়দিন পর পালায়ে গেলে? ছেলে ভালো, এসে দেখে যাক আগে।

-তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।

অর্ণবের উচ্চস্বরে দমলো না অপর্ণা। ঝগড়া সেও পাল্টা করেই গেল। অনিক বিরক্তির চোখে দৃশ্যগুলো অবলোকন করছিল। শেষমেশ দুজনকে থামালো সে।

-দেখো ভাইয়া, ভাবী যেহেতু তাদের ডেকে ফেলেছে তারা আসুক। লেখাকে দেখে যাক, পছন্দ না হলে আমরা রিজেক্ট করে দিব। কাউকে বাড়িতে ডেকে নিষেধ করে দেওয়াটা ভালো দেখাবে না।

-আচ্ছা ঠিক আছে। অপর্ণা যাও নাস্তার আয়োজন করো।

চিত্রলেখা কিছুই বললো না। সে যেন জীবিতই নেই। তার মতামত কেউ নেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করলো না। সাথী বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। সকলে রুম ত্যাগ করতেই সে চিত্রলেখার পাশে বসলো।

-মন খারাপ করছিস যে কেউ তোর কথা জানতে চাইল না?

-মন খারাপ করে কী হবে ভাবী? যা হওয়ার তা হবেই।

-তুই বারবার হতে দিস বলেই হয়। অপর্ণা আপা সম্পর্কে আমার বড় হলেও তার প্রতি আমার মনে আর সম্মান অবশিষ্ট নাই শুধু তোর কারণে কিছু বলা যায় না। তুই এত নরম হলি কেন? তোকে দেখলে আমার ভয় হয়। অন্যের কথায় যে সব ছেড়ে দিতে পারে তার অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে।

-আমার অস্তিত্ব কোথায়? আমিও তো অনুভব করতে পারছি না। তুমি যাও, আমি রেডি হই।

-শাড়ি পড়তে হবে না, জামা পড়। তোর সাধের বড় ভাবীর পছন্দে আমার তিল পরিমাণ বিশ্বাস নেই। তার জন্য সঙ সাজতে হবে না তোকে।

-আচ্ছা যাও।

সাথী বের হতেই দরজা লাগিয়ে দিল চিত্রলেখা। আলমারি থেকে একটা নতুন জামা বের করে পড়লো। এসব বড় ভাবী কিনে দিয়েছিল তাকে, এখানেই রেখে গেছে সে। আলমারির এক কোণে পড়ে আছে চিত্রলেখার মায়ের চাদর। মায়ের কিছুই সে পায়নি। শাড়ি, গয়না সব বড় ভাবীর দখলে। সামান্য এ চাদরটা সে নিজের কাছে যত্নে রেখেছিল। মায়ের কথা তেমন মনে পড়ে না তার। দুর্বিষহ সে দিনগুলো ভোলাই ভালো। চিত্রলেখার ফোন বেজে উঠে। সিয়াম কল করেছে। রিসিভ করবে কিনা ভাবতে ভাবতেই কল কেটে যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চিত্রলেখা। কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। জীবনের এই পরিস্থিতিটাকে কী বলা যায় যেখানে সে থমকে আছে অথচ চোখের পলকে চারপাশ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে? দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত কিছুই যেন আপন মনে হচ্ছে না তার। সিয়াম আবারো কল করলো। চিত্রলেখা এবারো রিসিভ করলো না। সিয়ামের তার প্রতি অতিরিক্ত চিন্তা চিত্রলেখার জন্য অমঙ্গলের। দরজায় শব্দ করলো সাথী।

-লেখা হয়েছে তোর?

-হ্যাঁ ভাবী, খুলছি দরজা।

চিত্রলেখা দরজা খুললো। মুখে ম্লান হাসি, অবশ্য এখন চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি আশা করাটাই বেমানান। সাথীর বড্ড মায়া লাগে মেয়েটার প্রতি। মনে হয় একটু যদি মেয়েটাকে হাসিখুশি রাখা যেত।

-কী ভাবছো ভাবী?

-ওনারা চলে আসবে একটু পর। তুই আমি না আসা অবধি বের হবি না।তোর বড় ভাবীর পছন্দ আগে পরখ করি তার আগে তোকে ওদের সামনে আনবো না।

-এত সন্দেহ করো না তো ভাবী। যা হবে দেখা যাবে।

সাথী চুপ করলো। চিত্রলেখা মেয়েটা বেশি চিন্তামুক্ত হয়ে পড়েছে নাকি জীবনের প্রতি আর কোনো মায়াই অবশিষ্ট নেই তার? কত সহজে সবকিছু মেনে নিচ্ছে!

_______________

অন্তর বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। তার মা বেশ রসিয়ে আলাপ করলেও সে এসবে সায় দিতে পারছে না। সে এসেছে মেয়ে দেখতে, এসব দুনিয়ার প্যাঁচাল শুনতে কী আর ভালো লাগে?

-অনেক সময় তো হলো, মেয়েকে ডাকলে ভালো হতো।

-আরে একটু বসুন। মেয়ে আসছে।

অন্তরের উতলা ভাব বেশ বুঝতে পারে সাথী। লোকটাকে তার মোটেও সুবিধের মনে হচ্ছে না। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। থাকেও প্রবাসে, বিয়ে করে সেখানেই চলে যাবে আবার। এই ছেলেকে দেখামাত্র না বলা যায়। তার সামনে চিত্রলেখাকে আনার ভুল সাথী করবে না। অর্ণবকে বিষয়টা আড়ালে বলার জন্য উদ্যত হলো সে। এরই মধ্যে অপর্ণা সঙ্কট হয়ে দণ্ডায়মান হলো।

-আরে সে কী? এতক্ষণ ধরে সাজছে নাকি লেখা? আমাদের মেয়ে এমনিই সুন্দর। অন্তর, তুমি এক কাজ করো। ওর ঘরে গিয়ে কথা বলে ওকে নিয়ে এসো। এইতো সোজা গিয়ে ডানপাশের ঘরটাই ওর।

-ধন্যবাদ।

অন্তর অনেকটা লাফ দিয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠলো। অন্তরের মায়ের এত উতলা ভাব পছন্দ হলো না তবুও চুপ রইলেন তিনি।

অন্তর চিত্রলেখার ঘরের দরজায় টোকা দিল। সাথী ভেবে দরজা খুললো চিত্রলেখা। চোখের সামনে অপরিচিত মানুষকে দেখেই খানিকটা বিব্রতবোধ করলো সে। অদ্ভুত তো! লোকটা সোজা তার ঘরে এসেছে কেন?

-এত অবাক হচ্ছো যেন আমাকে আশাই করোনি।

-না আসলে..

-তুমি কিন্তু মারাত্মক সুন্দর।

চিত্রলেখা বিরক্ত হলো। প্রথমত লোকটা তার অনুমতি ছাড়াই তার ঘরে প্রবেশ করেছে। দ্বিতীয়ত লোকটার তাকানোর ভঙ্গি বেশ অস্বস্তিকর।

-তো তুমি এখনো পড়াশোনা করছো?

-জ্বী।

-বেশ ভালো। বিয়ের পরও কন্টিনিউ করতে পারবা, আমার সমস্যা নাই।

চিত্রলেখা লোকটার দিকে তাকালো। তার চোখ অন্য কথা বলছে। চিত্রলেখা স্পষ্ট বুঝতে পারলো লোকটার চাহনি বলছে, একবার পায় তোমায়, বেঁধে রাখবো সংসারে। চিত্রলেখার উত্তর না পেয়ে আবারো কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলো অন্তর।

-তো তোমার শখ কী?

-তেমন শখ নেই।

-ওহ।

অন্তর আর কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে ডাক পড়লো দুজনের। চিত্রলেখা স্বস্তি পেল। অন্তরকে রেখে সে আগে আগেই বেরিয়ে এলো। চিত্রলেখার তড়িৎ গতিতে আসাটা পছন্দ হলো অন্তরের মায়ের। মেয়েমানুষ এত দ্রুত হাঁটবে কেন? ভ্রু কুঁচকালেন তিনি।

-তো মেয়ে, এত জোরে হেঁটে তো আসছো, দেখি এখন কাজেকর্মে জোর কতো। রান্না পারো?

চিত্রলেখাকে বলার সুযোগই দিল অপর্ণা। সেই উত্তর করতে লাগলো।

-পারে? আরে আমাদের রান্না তো বেশিরভাগ ওই করে। এত সুন্দর রান্নার হাত খালাম্মা, আপনি একবার খেলে আর কারো হাতের রান্না খেতেই পারবেন না।

-ভালো তো। চাকরি বাকরির ইচ্ছে আছে নাকি?

চিত্রলেখা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে নীরব থেকে বোঝার চেষ্টা করছে বিষয়টা কতদূর গড়ায়।

-ও মা মেয়ে বোবা নাকি?

-বোবা হলেই বোধহয় ভালো হতো তাইনা? এই যে হাঁটার খোঁটা, চাকরি সংক্রান্ত প্রশ্ন এসবের উত্তর দিতে হতো না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিয়ের পর আপনার কথার উপরে কথা বলার ক্ষমতাই থাকতো না! আপনার ছেলেকে একটা সুন্দরী বোবা দেখে বিয়ে দেন খালাম্মা।

চিত্রলেখার শান্ত স্বরে বলা বাক্যটা অন্তরের মায়ের মগজ চিরতে সময় নিল না। অগ্নিচোখে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন চিত্রলেখাকে।

-বেয়াদব কোথাকার! বড়দের প্রতি সম্মান নাই। ছিঃ ছিঃ!

এতক্ষণে অর্ণবেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। এতক্ষণ ধরে অন্তরের মা নিজের ছেলের নামে যে সমুদ্রসম প্রশংসার ফোয়ারা ছোটাচ্ছিল তাতেই এদের পারিবারিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা হয়েছে তার। এবার সেও প্রত্যুত্তর করলো।

-জ্বী, আমার বোনকে আদবের শিক্ষা দেইনি। আপনি এবং আপনার শিক্ষিত ছেলে সসম্মানে বেরিয়ে যান।

-এতবড় অপমান! এ মেয়েকে কেউ যদি বিয়ে করে!

অর্ণব কিছু বলার আগেই কলিং বেলের শব্দ হলো। সাথী দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলতেই অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারদের দেখে ভ্রু কুঁচকালো সে।

“আমরা অনিক মাহমুদের সাথে দেখা করতে চাই। তার উপর এটেম্পট টু রেপের চার্জ আছে। তিনি একজন মেয়েকে মলেস্ট করার ট্রাই করে পালিয়ে এসেছেন।” অফিসারের কথাটা সাথীর কানে ভ্রমরের ভোঁ ভোঁ শব্দের ন্যায় ধাক্কা দিল। এক মুহূর্তে বাড়ির পরিস্থিতি বদলে পরিণত হলো সঙ্কটারণ্যে।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১১+১২

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
একাদশ_পর্ব
~মিহি

“ভাবী, এসব কথা যেন ভাইয়া না জানে প্লিজ। তোমাকে আমার কসম ভাবী।” সাথী নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো। এক ভাই বোনের স্বার্থে কথা গোপন রাখতে বলেছে তো অন্যদিকে বোন ভাইয়ের সংসারের স্বার্থে কথা গোপন করতে বলছে।

-ভাবী, আমার কথা রাখবে তো তুমি?

-তুই অন্যায় আবদার করছিস লেখা।

-বাড়িতে থেকে আমার আসলেই পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে ভাবী। এত হইচইয়ের মধ্যে আমার মনোযোগ বসে না।

-এই কালো পর্দা তোমার ভাইয়ের জন্য রাখো, আমার জন্য না।

-তুমি আমার কথা না মানলে ঐ মহিলার কথা সত্যি হবে ভাবী। তোমার ননদের উপর আনা অপবাদ সত্যি হোক তুমি সেটা চাও?

-লেখা!

-তাহলে আমার কথা মেনে নাও ভাবী, দোহাই লাগে তোমার।

সাথী আবারো অসহায়ের মতো তাকালো। চিত্রলেখা আর কথা না বাড়িয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলো। আজ কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু এ মুহূর্তে বাড়িতে থাকলে তার মন আরো বিষণ্ণ হয়ে পড়বে।

চিত্রলেখা বাড়ি থেকে বেরোতেই অর্ণবের কল আসলো সাথীর ফোনে।

-সাথী, লেখা কোথায়?

-কলেজে গেছে ভাইয়া।

-অনিক কবে আসবে?

-ও এই মাসে আসতে পারবে না, কাজের চাপ আছে।

-আচ্ছা। আমি সরাসরি মার্কেটে যাচ্ছি। আর অপর্ণা বা ওদের ওখান থেকে কি কল করেছিল কেউ?

সাথী নীরব রইলো। কী বলবে বুঝতে পারছে না। চিত্রলেখার কথা অমান্য করলে সে আর কখনো সাথীর প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারবে না।

-কী হলো সাথী? কল আসছিল?

-না ভাইয়া।

-আচ্ছা, রাখো।

-আল্লাহ হাফেজ।

সাথী কল কাটলো। সে এখন উভয় সঙ্কটে পড়েছে। অর্ণবের কথা চিত্রলেখাকে বলতে পারছে না আবার চিত্রলেখার কথা অর্ণবকে বলতে পারছে না। সাথী একবার ভাবলো অনিককে কল করে জানাবে কিন্তু অনিক এসব বিষয়ে বড্ড ভাবলেশহীন। বোনের ব্যাপারে তার যেন কোনো ভাবনাই নেই। অনিক বাড়িতে থাকলেও চিত্রলেখার সাথে তেমন কথা বলে না। আবারো ভাবনায় পড়লো সাথী। বড়সড় ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে।

কলেজে এসে আরো বিরক্ত হলো চিত্রলেখা। সুবহা আসেনি আজ। কলেজের বড় রুমটাতে শত শত স্টুডেন্টের মধ্যে একাকীত্ব অনুভব করার মতো যন্ত্রণা বোধহয় আর হয়না। শেষের দিকের কর্ণারের একটা বেঞ্চে বসলো সে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। রঙ্গনের মেসেজ চেক করার ইচ্ছে গতকাল হয়নি। দুদিনে যা হয়েছে তাতে যথেষ্ট মানসিক অবসাদে পড়েছে সে তবুও এখন রঙ্গনের মেসেজটার রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করছে তার। রঙ্গন লিখেছে,”অপরিচিতা ভাববো নাকি পরিচিত কোনো ব্যক্তির হাস্যরসের প্রচেষ্টা?”

-যার জীবনে এত দুঃখ, তাকে হাসানোর প্রচেষ্টা নিছক মজা নয় কি?

রঙ্গন অনলাইনেই ছিল। রিপ্লাই আসতে বড়জোর দু’মিনিট লাগলো।

-কথা মন্দ বলেন নি, অপরিচিতা তবে দুঃখ শেয়ার না করে বারবার খোঁচা দেওয়া কিন্তু মন্দ অভ্যেস।

-আমি মানুষটাই মন্দ, অভ্যেস কী করে ভালো হয়?

-আপনি মানুষটা রহস্যময়ী।

চিত্রলেখা সিন করলো না। তার চোখে অদ্ভুত একটা জ্যোতি খেলা করলো। এ জ্যোতির রহস্য অনুভব করে সে আপনাআপনি পুলকিত হলো। ফোনটা ব্যাগে রেখে ক্লাসে মনোযোগ দিল।

_______________

চিত্রলেখা সন্ধ্যের পর থেকে নিজেকে প্রস্তুত করছে, বারবার ভয় এসে জেঁকে ধরছে তাকে। বড় ভাইকে কিভাবে রাজি করাবে ভাবতে ভাবতে অস্থির সে। অর্ণব বাড়িতে ফিরলো নয়টার পর। মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। সাথী খাবার বাড়লো। অর্ণব হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসেছে। চিত্রলেখা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সে অপেক্ষায় আছে কখন তার ভাইয়ের খাওয়া শেষ হবে। অর্ণব বেশ ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করে চিত্রলেখাকে ডাকলো। ভয়ে আড়ষ্ট চিত্রলেখা অর্ণবের সামনে দাঁড়ালো।

-কিছু বলবি? এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছিস!

-আসলে একটু কথা ছিল ভাইয়া।

-হ্যাঁ তো বল সেটা।

-আমি আসলে কলেজের হলে শিফট করতে চাচ্ছি ভাইয়া।

-কেন?

-বাড়ি থেকে যেতে আসতে অনেকটা সময় লাগে, তার উপর এখানে একটু নিরিবিলিতে পড়াও যায়না। পরীক্ষার সময়টুকু হলে থাকলে ভালো হতো।

-আমি সবাইকে বলে দিব তোকে পড়ার সময় বিরক্ত না করতে। যা ঘরে যা।

-ভাইয়া আমার এখানে পড়াশোনায় মনোযোগ বসেনা, সবসময় বাচ্চাদের সাথে খেলতে মন চায়।

-মনকে নিয়ন্ত্রণ করে পড়।

-হলে থাকলে এমনিতেই মনোযোগ বসবে।

-হলের খাবার খেতে পারবি তুই? ওখানে এক রুমে তিনজনের সাথে ম্যানেজ করতে পারবি?

-ভাইয়া, তুমি কি ভাবছো খরচ বেশি হয়ে যাবে? আমি আমার জভানো টাকা থেকে খরচ দিব, তোমার দিতে হবে না।

-বেশি বকিস না, ইচ্ছে যখন হয়েছে যাও তবে পড়াশোনার জন্য যাচ্ছিস। এটা মনে রাখিস।

-জ্বী ভাইয়া। ভাবী কবে আসবে? আমি তো পরশুর মধ্যে শিফট করবো। বাচ্চাদের সাথে দেখা করে যেতাম।

-কাল নিয়ে আসবোনি।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। এখনো অনেক কাজ বাকি তার।

অর্ণব খানিকটা চিন্তায় পড়লো। চিত্রলেখা হঠাৎ হলে যাওয়ার জেদ করছে কেন? অপর্ণা কি কিছু বলেছে? সাথীকে ডাকলো সে।

-সাথী, অপর্ণা কি লেখাকে কিছু বলেছে যার জন্য ও হলে যেতে চাইছে?

-না ভাইয়া, তবে আপা সারাক্ষণ ওকে এটা সেটা করতে দেয়। হলে গেলে হয়তো বেচারার পড়ায় কোনো বাধা থাকবে না।

-আচ্ছা যাও।

সাথী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কথাটা যদিও মিথ্যে নয় তবুও ভয় করছে সাথীর। অপর্ণার মায়ের কলের বিষয়টা অর্ণবকে জানাতে পারলে বোঝ কমতো তার কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।

চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢুকলো। রঙ্গনকে এক্টিভ দেখে মুচকি হাসলো সে।

-আপনার পরিবারের সবাই কি আপনার মতো ফুল? রঙ্গনের বোন কি গোলাপ?

-না না, আমার বোন নেই। ভাই আছে ছোটো।

-ওহ আচ্ছা। আপনার পরিবারের ছবি দেখলাম অনেক আগের, আপনার পাশে একজন যুবক। উনি আপনার বড় ভাই?

-না, উনি আমার মামা। বয়স্ক কিন্তু বয়স বোঝা যায় না।

-ওহ আচ্ছা। নায়কের মতো হাবভাব।

-তা বলা যায় তবে উনি আপাতত রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান।

-ওহ আচ্ছা।

-আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন এবার অপরিচিতা।

-আমার পরিবারে কেউ নেই।

-স্যরি টু আস্ক ইউ।

-সমস্যা নেই। পরে কথা হবে।

ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এলো সে। যা দরকার ছিল তা জেনে গেছে। এখন শুধু কাজটা করার অপেক্ষা।

_________________

চিত্রলেখা পরশুদিন হলে চলে গেল। অপর্ণার মুখ দেখেই বোঝা গেল সে বড্ড খুশি। অর্ণব আজ সকালেই তাকে এনেছে। চিত্রলেখা রূপসা রাদিফকে আদর করে অর্ণবের সাথে বেরোলো। কোনোরকম কান্না আটকে রেখেছে সে। অর্ণব যদি একবার জানতে পারে চিত্রলেখা কেন এসব করছে তবে বাড়িতে আর শান্তির চিহ্নটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না।

-লেখা, তুই থাকতে পারবি তো হলে?

-পারবো ভাইয়া, খুব পারবো।

-বেশ। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।

-সব সমস্যা তুমি সমাধান করলে আমি কী করে সমস্যা মোকাবিলা করতে শিখবো?

-সমস্যা মোকাবিলা শিখতে হয় না। পরিস্থিতিই তোকে শিখিয়ে দিবে কখন কী করতে হয়। আর তুই জানিস সেটা, জানিস বলেই হলে যাওয়ার জেদ করেছিস।

চিত্রলেখা কথা বাড়ালো না। অর্ণবের কথায় সে বুঝতে পারছে অর্ণব কিছুটা আন্দাজ করেছে। অর্ণব আর বেশি কিছু বললো না। চিত্রলেখাকে হলে রেখে সব বুঝিয়ে ফিরে গেল। চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একটা যুদ্ধ এখনো বাকি আছে, নিজের সাথে যুদ্ধ। নিজের অস্তিত্বকে জাগ্রত করার সে যুদ্ধ!

____________

নওশাদ মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। ইদানিং মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে তার। চিত্রলেখার উপর না মেটাতে পারা ঝাঁঝটা এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। ফোনের মেসেজ টিউন শুনে ঘোর কাটলো তার। ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকলো সে।

-আপনি দেখতে তো বেশ সুদর্শন, বিয়ে করেননি কেন?

-আপনার মতো কখনো কেউ সুদর্শন বলেনি তাই।

নওশাদের মনে জ্বলতে থাকা আগুনে পানির ছিটে পড়লো। অবশেষে কেউ স্বেচ্ছায় তার জালে পা বাড়াতে এসেছে। চিত্রলেখার উপর না মেটানো ঝাঁঝটা এর উপরেই মেটানো যায়।

-আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি বেশ শক্তসামর্থ্য পুরুষ।

-সন্দেহ আছে?

-থাকতেই পারে।

নওশাদ বুঝতে পারলো মেয়েটা তাকে কী ইঙ্গিত করছে। এসব মেয়েদের সে ভালোমতো চেনে। ভদ্রবেশী প্রস্টিটিউটের মতো আচরণ এদের। মুখে কিছু বলবেনা অথচ ইঙ্গিতে সব চায় তাদের। নওশাদ খানিকটা ঝোঁকের মধ্যেই ছিল তখন, আগে-পিছে কিছু ভাবলো না। নিজের একটা ছবি মেয়েটির ইনবক্সে পাঠালো সে, অপ্রীতিকর সে ছবিটি যে তার জন্য কাল হয়ে আসতে চলেছিল তা তখনো অনুভব করেনি সে।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
দ্বাদশ_পর্ব
~মিহি
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদেরদের জন্য উন্মুক্ত]

“নির্বাচন পূর্ব সময়ে *** এলাকার চেয়ারম্যানের অশ্লীল কৃতকর্মে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব।” ফেসবুকের পোস্টগুলো দেখে ঠোঁটে হাসি খেলা করছে মেয়েটার। অবশ্য সে ধারণা করতে পেরেছিল লোকটা সহজেই তার জালে ধরা দিবে। বাকি কাজ গার্লস গ্রুপ করে দিয়েছে। গার্লস গ্রুপের একটা মারাত্মক ফায়দা হলো একটু ইমোশনাল কথাবার্তা দিয়েই কাজ হাসিল করানো যায়।

‘কায়া’ আইডি থেকে গার্লস গ্রুপে নওশাদের অশ্লীল ছবিসহ কিছু অশ্লীল কথাবার্তার স্ক্রিনশট পোস্ট করা হয়েছে। উপরে বেশ আবেগী বাক্যে লেখা,”এই লোকটা আমার এলাকার চেয়ারম্যান। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি আমাকে শারীরিক নির্যাতনের চেষ্টা করেছেন।” কমেন্টবক্সের ক্ষুদ্র একাংশ সহমত পোষণ করলো। নওশাদকে তারাও চেনে, লোকটা তাদের সাথেও খারাপ আচরণ করেছে। ব্যস! পোস্ট ভাইরাল হতেই কায়া আইডিটার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। এতে যুক্তি আরো প্রখর হলো যেন নওশাদই ধমকে আইডি বন্ধ করাতে বাধ্য করেছে। ফেসবুক জুড়ে এ বিষয় নিয়েই চর্চা চলছে। নওশাদ এখনো এসব নিয়ে মুখ খোলেনি। দ্রুত তাকে সব খোলাসা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

_______________

হলের বাথরুমের ছোট আয়নাটা বড্ড নোংরা। হলদেটে একটা দাগ আছে আয়নাটাতে। চিত্রলেখার বমি বমি ভাব হচ্ছে। নিজের উপর আবারো একটা বিতৃষ্ণা চলে এসেছে তার। চোখেমুখে পানি দিতেই আয়নায় নিজের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি লক্ষ করে সে। হলদেটে আয়নাতেও প্রতিচ্ছবিটি শুভ্র স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। প্রতিচ্ছবিটি যেন ডেকে উঠলো চিত্রলেখাকে।

-নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে চিত্রলেখা?

-হুম। কুকুরকে কামড়েছি মনে হচ্ছে।

-কুকুর তোমার সভ্রমে হাত দিয়েছিল আর তুমি তার সভ্রম এবং ক্ষমতা ভরাবাজারে নিলামে তুলেছো। নিজের সাথে এর চেয়ে বড় ইনসাফ কী হতে পারতো? নিজের ‘কায়া’ পরিচয় ভুলে যাও।

-আমি কি ঠিক করেছি? লোকটার অশ্লীল মেসেজগুলো আমার চোখে ভাসছে দুঃস্বপ্ন হয়ে।

-কায়ার অস্তিত্ব মিটিয়ে লেখা হয়ে বাঁচো।

চিত্রলেখা কিছু বলার আগেই দরজায় শব্দ শুনতে পায়। সামনে তাকিয়ে প্রতিচ্ছবিটিকে আর দেখতে পায় না সে তবে কথাগুলো তার মনে ভাসে। সে অবশ্যই সঠিক কাজটাই করেছে। এরকম একজন পুরুষের সাথে এটাই হওয়া উচিত!

“মরে গেছিস নাকি ওয়াশরুমে? বের হ!” চেঁচামেচির শব্দে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বের হয় চিত্রলেখা। তাকে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে আর্টসের একজনের সাথে। মেয়েটা বেশ উগ্র। চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢুকলো না আর। ফেসবুক ডিলিট করে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করলো। হোয়াটসঅ্যাপ আনইনস্টল করেছিল দিন কয়েক আগে। হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করতেই সিয়ামের গতকালের মেসেজ ভেসে উঠলো,”নোটখাতাটা যত্নে রাখিস।” চিত্রলেখা মৃদু হাসলো। সিয়ামকে অনলাইনে দেখে রিপ্লাই দিল।

-এতই যখন নোটখাতার চিন্তা, তো দিলে কেন আমায়?

-সাহায্য তো করতে নাই মানুষকে!

-সাহায্য করে বারবার খোঁটা দেওয়া উচিত?

-আচ্ছা স্যরি। পরীক্ষা তো কয়েকদিনের মধ্যে। পড় মনোযোগ দিয়ে।

-আচ্ছা।

ফোন রেখে বসতেই ওয়াশরুম থেকে তার রুমমেট বেরোলো। মেয়েটির নাম সঞ্চারী, হিন্দু সম্প্রদায়ের। আরেকজন রুমমেট আছে, অহনা নাম। অহনা সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে। সঞ্চারীর চোখজোড়া সবসময় অদ্ভুত এক রাগে রাগান্বিত থাকে। সে এসে বসলো চিত্রলেখার ঠিক মুখোমুখি।

-তুই সায়েন্সের?

-হ্যাঁ। আমার বাংলা নোটটা করে দে তো।

-আমার পড়া আছে।

-তো? তোর পড়া আছে পরে পড়বি। আমার কাজটা কর আগে, বেশি কথা বলিস না।

চিত্রলেখার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করলো না তার উপর এই মেয়ে এসেছে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে। কী লাভ তাকে খেপিয়ে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঞ্চারীর জন্য নোট করতে বসলো সে।

_______________

-ভোটের আগে এসব ফাজলামি করার কোনো মানে হয় নওশাদ? যেভাবে পারো এসব বন্ধ করো।

-আমি দেখছি বিষয়টা।

নওশাদ ফোনটা দূরে আছাড় মারলো। আসলেই সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চিত্রলেখাকে দেখার পর থেকে তার মধ্যে যে আগুনের শিখা জ্বলতে শুরু করেছে তা কেবল চিত্রলেখার নরম শীতল স্পর্শেই দূর হওয়া সম্ভব। নিজের লোকদের কাজে লাগিয়ে ভাইরাল পোস্টগুলো সরানোর ব্যবস্থা করেছে নওশাদ আর পাবলিককে ভুজুংভাজুং বোঝানোর ফন্দি আঁটাও শেষ। ‘এডিট’ বলে পুরো ব্যাপারটাই ধামাচাপা দেওয়া যাবে তবে চিত্রলেখার ঝড় তার মনে তখনো বহমান। এ ঝড় থামানো আবশ্যক। নওশাদ মির্জাকে এখনো চেনেনি চিত্রলেখা। নওশাদ জীবনে প্রথম কাউকে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখেছে, এ স্বপ্ন এত সহজে ভাঙতে তো সে দেবেনা তবে আপাতত পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওয়া অবধি নীরব থাকবে সে। নীরবেই চিত্রলেখার দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করতে হবে।

আশফিনা আহমেদ নওশাদের অবস্থা বুঝতে পারছেন। তবে তিনি কিছু বলছেন না। ঘটনাটা আকস্মিক মনে হচ্ছে না তার। যদিও চিত্রলেখা বেশ সরল তবুও তার সন্দেহের তীরটা কেন যেন চিত্রলেখার দিকেই ঠেকছে। এ কথা তিনি নওশাদকে জানাবেন না। তার ভাই ভুল করেছিল এবং শাস্তি পাওয়াটা উচিত। যতটুকু অসম্মান তার হয়েছে তা একজন মেয়ের অসম্মানের নিকট তুচ্ছ মাত্র।

অহমের ইদানিং মন ভালো থাকেনা তবুও পড়ায় মন বসিয়েছে সে। চিত্রলেখার কথা মনে পড়ে তার আবার পরক্ষণেই মনে পড়ে ম্যামের কলেজে চান্স পেতে হলে পড়তে হবে। রসায়ন স্যারের মেয়েটা তাকে আর বিরক্ত করে না। অবশ্য তার ব্রেক আপ হয়েই গেছে, এখন আর বিরক্ত না করলেই কী? বড় ভাইকেও বড্ড মিস করছে সে। সব মিলিয়ে জীবনটা বেশ বিষণ্ণ কাটছে তার।

-অহম, কী ভাবছো এতো?

-মা, ভাইয়া আর কিছুদিন থাকতে পারতো না?

-পরীক্ষা শেষ হলেই আসবে।

-আমি একদিন চিত্রলেখা ম্যামের সাথে দেখা করতে যাবো ভাইয়ার সাথে।

-ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে যাও।

-না আমি ভাইয়ার সাথেই যাবো।

আশফিনা আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছু বিষয় না চাইতেও সামনে উপস্থিত হয়। এসব বিষয় যেমন ছুঁড়ে ফেলা যায় না তেমন প্রতিবাদও করা যায় না। রঙ্গনের ব্যাপারে তিনি কখনো চিত্রলেখাকে নিয়ে আপোস করতে পারবেন না। রঙ্গনের মনে যে ক্ষণিকের অনুভূতি জন্মেছে তা অচিরেই বিনাশ হওয়াটা আবশ্যক ছিল। তার জন্য নিজের ছেলের সাথে রুক্ষ্ম ব্যবহার তার কাছে অযৌক্তিক নয়। রঙ্গনের জন্য তিনি সেরা ছাড়া কিছু নির্বাচন করবেন না কখনোই।

_______________

চিত্রলেখার লেখা শেষ করতে অনেকটা সময় লাগলো। অতঃপর সঞ্চারীকে নোটটা দিল। সঞ্চারী অনেকটা রুক্ষভাবে সেটা নিল। চিত্রলেখার বিরক্ত লাগলেও কিছু বললো না। অযথা অশান্তি করার ইচ্ছে তার নেই। যে অশান্তি থেকে বাঁচতে সে এখানে এসেছিল, সে অশান্তি বোধহয় এত সহজে তাকে ছাড়বে না।

-তুই নোটে কাটাকাটি করেছিস কেন? দেখে লিখতে পারিস না?

-এত সমস্যা হলে নিজে লেখতে পারো। কেউ সাহায্য করলে ধন্যবাদ দিতে শেখো।

-তোকে কেন ধন্যবাদ দিতে হবে?

-তোমার নোটটা আমি করে দিয়েছি। ধন্যবাদ না দিতে পারলে ভুল ধরিও না অযথা।

-ভুল করলে ভুল ধরবো না?

-নিজে লেখো তাহলে।

চিত্রলেখার কণ্ঠস্বর উচু হলো। সবসময় নীরব থাকা যায় না। চিত্রলেখার উচ্চ কণ্ঠস্বরে বোধহয় দমে গেল সঞ্চারী। মুচকি হাসলো সে। নোটখাতাটা বিছানায় ফেলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে চিত্রলেখার বাহু ধরে তাকে বিছানায় বসালো।

-আসার পর থেকে দেখতেছি চুপচাপ, যে যা বলে তাই শুনতেছিস। এই যে তোর মধ্যে বাকশক্তি আছে এটাই পরখ করলাম।

-মানে?

-মানে প্রতিবাদ করতে শিখ। সবার কথা মাথায় রেখে কাজ করলে নিজের ভালো থাকার সবটুকু অংশ বিসর্জন দিতে হবে আর অন্যের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে কেউ ভালো থাকে না।

-অযথা ঝগড়া বাড়ে প্রতিবাদ করলে।

-তার জন্য সব মেনে নিবি? শোন, জীবনে লড়াই না শিখলেও কৌশলী হতে হয়। মুখে ঝগড়া না করলেও সুচতুরভাবে পরাজিত করতে হয় শত্রুকে। যুক্তিবাদী হ, তোকে আমি প্রতিবাদ করতে বলেছি তোর কাজের মাধ্যমে। সডার হা’তে হা মিলাস না। পরে যেন পস্তাতে না হয়। জীবন বড্ড কঠিন।

সঞ্চারী আবারো হাসলো। চিত্রলেখা লক্ষ করলো মেয়েটার হাসি অদ্ভুত সুন্দর। এতক্ষণ যাকে উগ্র মনে হচ্ছিল তাকে একমুহূর্তেই যেন খুব ভালো মনে হচ্ছে তার। চিত্রলেখার চোখে আবারো সেই জ্যোতি অনুভব করলো সে। ভুল কিছু সে করেনি, সে লড়েছে নিজের জন্য তবে নীরবে।

“ইন্ট্রোভার্টরা সচরাচর লোকসমাগম ভয় পায় তবে ভার্চুয়াল জগতটা তাদের জন্য কমফোর্ট জোন। এখানে তারা নিজেদের রাজত্ব চালায়। ইন্ট্রোভার্টদের জন্য এই ভার্চুয়াল জগতে যুদ্ধ জয় করাও বড্ড সহজ। এরা বাস্তবতা ভয় পায়, কল্পনার আশ্রয়ে আশ্রিত এরা কল্পলোকে বাস করতে ভালোবাসে।” চিত্রলেখা আনমনে আওড়ালো কথাগুলো। ঠিক সে সময় রঙ্গনের টেক্সট আসলো। টেক্সট ওপেন করতেই ভীতি গ্রাস করলো চিত্রলেখাকে। রঙ্গনের থেকে এই টেক্সট মোটেও প্রত্যাশা করেনি সে।

চলবে..

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১০

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
দশম_পর্ব
~মিহি

“এসব লেখাকে জানানোর দরকার নেই সাথী। যা হবে আমি সামলে নিব, তুমি ভুলেও ওকে কিছু বলতে যেও না।” সাথী অর্ণবের কথায় মাথা নাড়ায়। এছাড়া উপায় নেই। চিত্রলেখা অপর্ণার বলা কথাগুলো কিংবা ঘটনাটা জানতে পারলে মানসিকভাবে আঘাত পাবে। এমনিতে শক্ত দেখালেও চিত্রলেখা মানসিকভাবে মারাত্মক দুর্বল। পরিস্থিতি অনুযায়ী সামলে চলার সামর্থ্য তার খুব কম। হয়তো অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য কিংবা নিষ্ঠুর শৈশবের বদৌলতে সে নিজেকে খুব দুর্বল ভাবে।

চিত্রলেখা গোসল সেরে বেরিয়ে সোজা শুয়ে পড়লো। বাইরে কী ঘটলো না ঘটলো সে খোঁজ নিতেও আসলো না। রাতের খাবার খেতেও ইচ্ছে করলো না তার। আনমনে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো রঙ্গনের মেসেজ। সেদিকে ধ্যান দেওয়ার রুচিটুকুও হলো না। রঙ্গন নামটা মাথায় আসতেই তার নরপশু মামার দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে চিত্রলেখার। ফোন পাশে রেখে কাঁথা মুড়ি দিল সে।

___________________

-তুই যাস না রঙ্গন, আমি সত্যিই দুঃখিত।

-দেখ রাহাত, আমি তোদের জন্য যাচ্ছি না এটা বিশ্বাস কর। আমার একটা জবের অফার এসেছে। আমার ওদিকে শিফট হওয়াটা দরকার।

-তুই ভুল বুঝিস না আমাকে।

-বন্ধুত্বে ভুল বোঝাবুঝি থাকে না, থাকলে সেটা বন্ধুত্ব থাকে না।

-আমাদের মাঝে কোনটা থাকবে না? ভুল বোঝাবুঝি নাকি বন্ধুত্ব?

রঙ্গন উত্তর দিতে পারলো না। শত চেষ্টা করলেও কিছু ক্ষত মিটানো যায় না। রাহাত এবং অবনী যেভাবে তাকে অবহেলা করেছে তারপর এসব কাণ্ড সে আদতে ভুলতে পারবে? রাহাতকে মিথ্যে আশা দিয়ে লাভ নেই। রঙ্গন চুপ থাকলো। ফোনের দিকে গভীর মনোযোগ দিল। অলকানন্দা অনলাইনে এসেছিল কিন্তু তার টেক্সট সিন করেনি। রঙ্গনের এবার মনে হলো এটা নিশ্চিত ফেইক আইডি তবুও কৌতুহল কিংবা কোনো এক টানে মেয়েটার প্রোফাইল ঘাঁটতে লাগলো। বিশেষ কিছুই নেই। দু-চারটে গানের ভিডিও শেয়ার করা আর কিছু কবিতা। গানগুলো একের পর এক শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করলো রঙ্গন।

________

-লেখা, চুপচাপ খেতে চল।

-ভাবী, আমার ভালো লাগছে না। খাবো না।

-তুই উঠবি নাকি অর্ণব ভাইয়াকে ডাকবো?

-আসছি।

চিত্রলেখার সম্মতি পেয়ে সাথী বেড়িয়ে গেল। চিত্রলেখা উঠে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছলো। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লক্ষ করলো চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। চশমাটা ভালোভাবে পড়ে খাবার টেবিলের দিকে এগোলো সে।

অর্ণব এক চেয়ারে বসেছে। বাকি সবগুলো চেয়ার ফাঁকা। চিত্রলেখা খানিকটা অবাক হলো। রূপসা তো বাবাকে ছাড়া খেতে বসে না আর অপর্ণা ভাবীও বাচ্চাদের ছাড়া খেতে বসেন না। বাড়ির পরিবেশটা অন্যদিনের তুলনায় বেশ থমথমে। বাচ্চাদের হইচইও নেই। চিত্রলেখার মন ভারাক্রান্ত। খাবার গিলতেও অসুবিধে হচ্ছে তার। কোনরকম ভাত নাড়াচাড়া করছে। বাচ্চারা না থাকায় আরো বিষণ্ণ অনুভব করছে।

-ভাইয়া, রূপসা রাদিফ কোথায়?

-আমার শ্বশুর একটু অসুস্থ। অপর্ণা বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে গেছে।

-তুমি যাওনি ভাইয়া? সন্ধ্যেবেলা ভাবী একা গেল!

-অপর্ণার চাচা নিতে আসবে রাস্তায়।

চিত্রলেখা আর কিছু বললো না। বিষয়টা খানিকটা গোলমেলে। অপর্ণা ভাবীর বাবা অসুস্থ হলে তার চাচা নিজের ভাইকে রেখে ভাতিজিকে নিতে নিশ্চয়ই রাস্তায় আসবেন না! অর্ণবের মুখ দেখেই মিথ্যে ধরতে পারছে চিত্রলেখা। কিন্তু আজ বাড়তি কথা তার মুখে আসছে না। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। নওশাদ নামক লোকটাকে যথাসময়ে শাস্তি দিতে না পারার যন্ত্রণা ভয়ানক। একটা পুরুষ তাকে বিশ্রিভাবে স্পর্শ করলো আর সে অসহায়ের মতো কাঁদলো? কেন? একটা চড় দেওয়ার সামর্থ্যও তার ছিল না? চোখ অশ্রুজলে ভরে আসে চিত্রলেখার। ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে নিজের ঘরের দিকে এগোয়। সাথী কিছু বলতে চেয়েও পারেনা। চিত্রলেখার বিষণ্ণতা তার চোখের আড়াল হয়নি। সাথী ভাবলো অহমের সাথে সখ্যতা জন্মানোয় টিউশনি ছেড়ে চিত্রলেখা কষ্ট পাচ্ছে তাই তাকে আর ঘাটলো না বেশি। অর্ণবের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। অপর্ণার চলে যাওয়াতে তার যেন কিছুই যায় আসছে না। নিজের মতো খাবার খেয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেল সে।

_________

সকাল হতেই অপর্ণার বাপের বাড়িতে ব্যস্ততা শুরু হয়। প্রত্যেকে ব্যবসায়ী মানুষ, তাই ন’টার মধ্যেও সকালের নাস্তা খাওয়া হয় সচরাচর কিন্তু আজ বাড়ির পরিস্থিতি ভিন্ন। গতকাল রাতে অপর্ণা রাগ করে বাচ্চাদের নিয়ে এ বাড়িতে এসে উঠেছে। অপর্ণার মা নিজের মেয়ের পাশ থেকে সরছেন না। অর্ণব অপর্ণার গায়ে হাত তুলেছে শুনে তিনি ক্ষুব্ধ। তাও কিনা সৎ বোনের জন্য বউয়ের গায়ে হাত! অপর্ণার বাবা একটু বিচক্ষণ মানুষ। তিনি অর্ণবকে সকাল সকাল আসতে বলেছেন বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য। অপর্ণা যদিও ও বাড়িতে ফেরা নিয়ে বিরোধ প্রকাশ করছে তবে নিজের বাবার সিদ্ধান্তের উপর কিছু বলার অধিকার তার নেই। অর্ণব যথাসময়ে এসে উপস্থিত হলো। অপর্ণার মা বিশেষ কোনো খাতিরদারির ব্যবস্থা করলেন না। অপর্ণার চাচীরা অর্ণবকে নাস্তা দিল। অর্ণব সেদিকে গুরুত্ব দিল না। সে এসেছে কথা বলতে, নাস্তা করতে নয়।

-আসসালামু আলাইকুম বাবা।

-ওয়ালাইকুম সালাম। কী শুনছি অর্ণব? তুমি অপর্ণার গায়ে হাত তুলেছো?

-ক্ষমা করবেন। অপর্ণা যা করেছে তার প্রেক্ষিতে আমি এটা করতে বাধ্য হয়েছি।

-কী করেছে সে? তোমার বোন কমবয়সী। তার জন্য চিন্তা করা অপর্ণার ভুল?

-অপর্ণা চিন্তা করেনি বাবা, সে আমার বোনের দিকে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছে। আমার বোনের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

-দেখো অর্ণব, এসব টুকটাক সব সংসারেই হয়। তুমি ওকে মাফ করে দাও এবং ঝামেলাটা মিটিয়ে নাও।

গুরুজনদের সামনে অর্ণব দ্বিমত প্রকাশ করলো না। বড়দের সিদ্ধান্ত মেনে নিলো কিন্তু বাঁধ সাধলো অপর্ণা।

-যদি তুমি তোমার বোনকে হোস্টেলে পাঠাও, তবেই আমি তোমার সংসারে ফিরবো। অন্যথায় যাবো না।

-অপর্ণা বাড়াবাড়ি করো না।

-বাড়াবাড়ি তূমি করছো। আর তোমার বোন, ঐ মেয়ে তো আরেক শয়তান। আমার টাকায় ফুর্তি করে বেড়ায়।

-তোমার টাকা? আর এই টাকা তোমাকে কে দেয়? আমিই তো! আমার টাকায় আমার বোন যা ইচ্ছে করবে, তুমি বলার কে?

-থাকো তোমার বোন নিয়ে। বাচ্চাদের আমি আমার কাছে রাখবো, ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবে। এখন তুমি ভাবো সৎ বোন নাকি বউ বাচ্চা!

অর্ণব কখনো ভাবেনি অপর্ণা ডিভোর্সের কথা তুলবে। রাগে তার মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো। উপস্থিত সকলকে উপেক্ষা করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অর্ণব এভাবে বেড়িয়ে যাবে তা অপ্রত্যাশিত ছিল অপর্ণার। সে ভেবেছিল এভাবে ভয় দেখালে কাজ হবে কিন্তু হিতে বিপরীত হলো বুঝতে পেরে সে কাঁদতে শুরু করলো। অপর্ণার মা মেয়ের কান্না সহ্য করতে পারছেন না। অর্ণব কিনা নিজের সৎবোনের জন্য তার মেয়েকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলবে! কিসের এত দায়িত্ব ঐ মেয়ের প্রতি? নিজের বউয়ের চেয়ে বোনের প্রতি কেন দায়িত্ব বেশি থাকবে? নিজের বউ বাচ্চা আগে। মোটামুটি ভয়ঙ্কর একটা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

গতকালের ঘটনায় জ্বর এসেছে চিত্রলেখার। কলেজ যায়নি আজ আর। বিছানায় শুয়ে মাথা যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিল সে। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। ফোন একটু দূরে ড্রেসিংটেবিলের উপর। চিত্রলেখা উঠার আগেই সাথী এলো।

-তুই অসুস্থ, তোর উঠতে হবে না। আমি নিয়ে আসছি।

-লাউড স্পিকারে দাও। সুবহা ফোন করেছে হয়তো।

-আচ্ছা।

সাথী ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিতেই অপর পাশ থেকে কেউ একজন অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে লাগলো। চিত্রলেখা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

-আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

-এই ডাইনী! তোর শরম নাই? সালাম দিচ্ছিস? খুব সতী না তুই? নিজের ভাইয়ের সংসার ভেঙে আজীবন ঘাড়ে বসে খাইতে চাস? বেশরম বেহায়া! বাইরে রঙঢঙ করো ,খাও ভাইয়ের টাকায় আবার তার সংসারেই বিষ ঢালো। চুপচাপ হোস্টেলে চলে যাবি নিজের ভাইকে বুঝিয়ে। তোর জন্য যদি আমার অপর্ণার সংসার ভাঙে তোকে আর তোর ভাইকে আমি কী করবো তুই ভাবতেও পারবি না!

চিত্রলেখা কিছু বলার সুযোগ পেল না। আবারো কেউ একজন তাকে চরম দুর্বল প্রমাণ করে ছাড়লো। সামান্য প্রতিবাদের শব্দটুকু তার মুখ দিয়ে বেরোলো না। সাথী পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। স্তব্ধ সে। চিত্রলেখার চোখ বেয়ে নোনা জলগুলো গড়িয়ে পড়ছে। আর কত ভাবে অপমানিত হতে বাদ আছে তার? কেউ তার সভ্রমে হাত দেয় তো কেউ চরিত্রে আর সে নগন্য প্রজাতির মতো চুপচাপ শোনে? সে কি আদৌ মানুষ নাকি পাথর?

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৯

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
নবম_পর্ব
~মিহি

“হাত ছাড়ুন আমার নাহলে আমি চেঁচাতে বাধ্য হবো।” চিত্রলেখার কথায় নওশাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না বরং সে আরো চড়াও হতে চাইলো চিত্রলেখার উপর। বুদ্ধিটা অবশ্য মন্দ করেনি সে। অহমকে খেলার ছলে ঘরে আটকেছে আর নিজের বোনকে কফির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে, চাকর-বাকরদেরও বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে বেশ মতলব করেই। এখন চিত্রলেখার তীক্ষ্ম চোখ কোন কাজেই আসবে না। নওশাদের চোখজুড়ে লালসা। হিংস্র দানব ভর করেছে তার সর্বাঙ্গে। চিত্রলেখার চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে চলেছে। শেষবারের মতো এ বাড়িতে আসা তার জন্য এমন ভয়ানক বিপদ বয়ে আনতে পারে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে। নওশাদ প্রচণ্ড জোরে হাত চেপে ধরায় চিত্রলেখার হাতে ব্যথা অনুভূত হলো কিন্তু চিৎকার করা বৃথা।

-অযথা চেঁচিয়ে কী লাভ বলো তো? যা চাচ্ছি দিয়ে দাও, দরকার পড়লে টাকা নাও।

-আপনি আমার বাবার বয়সী। দয়া করে আমার হাত ছাড়ুন।

-বাবা? তোমার বাবাও তো সাধু পুরুষ নন। তোমার মা কি তার স্ত্রী ছিলেন নাকি রক্ষীতা? এমন বাবার মেয়ে হয়ে সতী হয়ে কী করবে বলো? তার চেয়ে আমার আবদার মানো। আর যদি আমার ভালো লাগে তবে তোমাকে স্ত্রী করতেও তো আমার আপত্তি নেই। তারপর থেকো রাজরানী হয়ে।

চিত্রলেখার ঘৃণায় সারা শরীর কেঁপে উঠে। একজন মানুষ এতটা নোংরা কী করে হতে পারে? চিত্রলেখা সরানোর চেষ্টা করে নওশাদকে। বিশেষ কোনো লাভ হয়না। সুঠামদেহী নওশাদের সামনে বড্ড অসহায় চিত্রলেখা। শেষমেশ নওশাদের ধস্তাধস্তিতে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে সে। নওশাদের বিভৎস দৃষ্টি গভীর হচ্ছে। চিত্রলেখার ঠোঁটের দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করতেই লাঠির আঘাত পড়লো নওশাদের হাতে। ছিটকে খানিকটা দূরে সরে গেল সে। লাঠির উৎস খুঁজতে গিয়ে চোখ পড়লো তার বোন আশফিনা আহমেদের দিকে। আশফিনার হাতে হকিস্টিক। তার মানে আশফিনা আঘাত করেছে তাকে! নওশাদ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আশফিনার চোখ থেকে যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে।

-বনু, তুই আমাকে মারতে পারলি?

-আমি একটা পশুকে আঘাত করেছি যার মাথায় হিংস্রতা ভর করেছিল।

-চিত্রলেখা তোরও অপছন্দের। ওর সাথে আমি কিছু করলে তোর খারাপ লাগবে কেন? তাছাড়া আমি ওকে বিয়ে করবো।

-অপছন্দের বলে আমি তার সভ্রমহানির দৃশ্য দেখে তৃপ্ত হবো? তুই চুপচাপ বের হ এখনি। আমাকে পুলিশ ডাকতে বাধ্য করিস না।

-একটা বাইরের মেয়ের জন্য তুই নিজের ভাইয়ের সাথে এরকম করতে পারিসনা।

-তুই যাবি নাকি ঘাড় ধাক্কা…?

নওশাদের আত্মসম্মানে বড়সড় আঘাত লাগলো। গটগট করে বেরিয়ে গেল সে। চিত্রলেখা এতক্ষণের দৃশ্যে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নওশাদ চলে যেতেই সে মেঝেতে বসে কাঁদতে শুরু করলো। এতটা ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি সে কখনো হয়নি। বাবার ভালোবাসা না পেলেও তাকে আগলে রাখার কেউ না কেউ ছিল কিন্তু আজকের এ পরিস্থিতি চিত্রলেখাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তার চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে সে কতটা দুর্বল। আশফিনা আহমেদ হকিস্টিক ফেলে চিত্রলেখাকে ধরে সোফায় বসালেন। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে ওষুধ বের করে চিত্রলেখার হাতে লাগাতে থাকলেন। চিত্রলেখার কান্না তখন থেমেছে তবে কণ্ঠে কান্নার রেশ বিদ্যমান।

-আমার বড় ভাই পছন্দ করেন না আমার এখানে আসা। তাই আজ শেষবারের …

-তোমার এ মাসের টাকা আমি পাঠিয়ে দিব আর ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

-টাকার প্রয়োজন নেই, আমি তো একমাস সম্পূর্ণ পড়াইনি।

-সেটা আমার হিসেব, তোমার ভেবে কাজ নেই। আর শোনো, এতটা দুর্বল হয়ো না যে রাস্তার কুকুরও তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। নিজেকে রক্ষা করতে যদি কোন নরপশুকে হত্যাও করতে হয় তবুও সে সাহস থাকা দরকার।

চিত্রলেখা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এ এক নতুন আশফিনা আহমেদ যার চোখে তার প্রতি রাগ নেই।

-আপনাকে ধন্যবাদ।

-কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার অনেক সময় পাবে। যাও বাসায় ফিরতে হবে তোমার।

চিত্রলেখা আর কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। তার কেবল চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। লোকটা যখন তার হাত স্পর্শ করে নোংরা ইঙ্গিত করছিল, কেন সে নিজের ক্রোধ দেখাতে পারলো না? কেন সে প্রতিবাদী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলো না? মায়ের মতো সেও কি দুর্বল সত্তা? নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে কি সে? হয়তোবা।

চিত্রলেখার এখনো মনে পড়ে মায়ের করুণ দিনগুলি। চিত্রলেখার মা চারুলতা। বেশ শৌখিন জমিদার পরিবারের বংশধর তবে কালগর্ভে এখন সম্পদের ছিটেফোঁটাও নেই। অনেকটা অসচ্ছলই ছিল তারা। চিত্রলেখার বাবা আমিন শেখ তখন উঠতি ব্যবসায়ী। চারুলতার মোহে পাগল হয়ে পরিবারের বিরুদ্ধে বিয়ে করেন। বিয়ের তিন বছরেও তাদের কোনো সন্তান হয়না। আমিন শেখের ব্যবহারে পরিবর্তন আসে। প্রতিনিয়ত চারুলতার উপর অত্যাচার করতে থাকেন তিনি। বিয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিবাহ করেন সাহেরা বানুকে। সাহেরা বানুর থেকেই বিয়ের বছর না ঘুরতেই বড় সন্তান লাভ করেন। চারুলতার গল্প তখন থমকে দাঁড়ায়। বাবার ঘরে আশ্রয় নেওয়ার মতো সাহস সে করতে পারেনি। অর্ণবের জন্মের পরের বছরেই তার ছোট ভাই অনিকের জন্ম হয়। তারপর থেকেই সাহেরা বানু অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবারো শারীরিক চাহিদার দংশনে চারুলতার মোহে ডোবেন আমিন শেখ। গর্ভে আসে চিত্রলেখা। প্রথম সন্তান মেয়ে, এটা মানতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় আমিন শেখের। চারুলতাকে তিনি স্ত্রীর মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করেন। জন্মের পর থেকেই নিজের মাকে কতরকম ভাবে অত্যাচারিত হতে দেখেছে হিসেব নেই চিত্রলেখার। মাও কেমন বেহায়ার মতো সব সহ্য করতে করতে মরে গেল। চারুলতার সেই বেহায়া রক্তই চিত্রলেখার শরীরে তাই সে এতটা দুর্বল। কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে সে। চিত্রলেখার বয়স অল্প, আমিন শেখ তখন কঠিন অসুখে পড়েন। বাড়ির লোকজন মুখ ফিরিয়ে নেয়। চারুলতা বেহায়ার মতো সেবা করে তবুও লোকটা অপরাধবোধে অথবা অনুতাপেই মারা যায়। তার মৃত্যুর পর চারুলতা এক মাসও বাঁচেনি। ভালোবাসার কাঙাল যাকে বলে। তবুও ভুল মানুষের ভালোবাসায় কাঙাল। চিত্রলেখার কান্না বাঁধ মানতে চাইছে না। সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়া প্রলয় তার মাঝে বয়ে চলেছে। এ প্রলয়ের রেশমাত্র সে ঐ নওশাদকে দেখাতে পারেনি এ দহনে পুড়ছে সে।

________________

-তোমার বোন এসেই বাথরুমে ঢুকলো কেন? কী করে এসেছে?

-তোমার লজ্জা হয়না অপর্ণা? তুমি কতটা নিচ যে আমার বোনকে নিজের পড়াশোনার কথা ভেবে টিউশনি করতে হয় এখন আবার সেটা নিয়েই প্রশ্ন তোলো?আমার দেওয়া টাকা কী করো তুমি?

-হ্যাঁ সব দোষ আমার। তোমার বোন যে নতুন ফোন কিনেছে তা দেখেছো? রঙঢঙ বদলে গেছে ওর। দেখো কার সাথে শুয়ে এসেছে। বিয়ে দিয়ে দাও কোনো দুই বাচ্চার….

অপর্ণা কথা শেষ করতে পারলো না। অর্ণবের হাতের চড়ে সে স্তব্ধ। তাদের মাঝে ঝগড়া-কথা কাটাকাটি হলেও অর্ণব কখনো তার গায়ে হাত তোলেনি। আজ প্রথম এ কাণ্ড ঘটেছে। রাগে আগুন ধরে যাচ্ছে অপর্ণার মাথায়। হাতে থাকা টিভির রিমোটটা দূরে ছুঁড়ে মারলো সে। তৎক্ষণাৎ রূপসা এবং রাদিফকে নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেল। অর্ণবের রাগও তখন সপ্তম আসমানে। সেও প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

ঝর্ণার পানি যতবার চিত্রলেখার শরীর স্পর্শ করছে ততবার কেঁপে উঠছে সে। অজানা আতঙ্কে তার মনে দাগ পড়ে গেছে। বিশ্রি একজোড়া হাত সে চোখ বন্ধ করলেই প্রত্যক্ষ করছে। পানির শব্দের আড়ালে কান্নার শব্দগুলো কারো কানে পড়ছে না, ঠিক তেমনি বাইরের ঝড় সম্পর্কেও অবগত নয় সে। তাকে কেন্দ্র করে বাইরে তার ভাই এবং ভাবীর মধ্যে যে ঘূর্ণিঝড়ের আগমন ঘটেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে।

চলবে…