চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১৭+১৮

0
303

#চিত্রলেখার_কাব্য
সপ্তদশ_পর্ব
~মিহি

হাসপাতালের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। অনিকের জ্ঞান ফিরেছে। পুলিশি তদন্তের মানসিক চাপ নিতে পারেনি সে। অনিকের ছোট থেকেই এ সমস্যা আছে। চাপ সহ্য করতে পারে না সে, মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। অর্ণব সাথীকে কিছু জানায়নি। অনিকের এ অবস্থা জানিয়ে মেয়েটাকে আরো দুর্বল করতে চায়নি সে। তৌহিদের সাথে কথা হয়েছে তার। বেইল রেডি হয়েছে। পুলিশের সাথে কথাও বলেছে সে তবে অনিকের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকেই। বাহ্যিক চোট না লাগলেও তার মস্তিষ্কে বেশ ভয়ানক প্রভাব পড়েছে। ডাক্তাররা অনিক পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি তাকে রিলিজ করতে পারবেন না। অর্ণবের কিছু করার নেই। বেইল সম্পর্কে মিথ্যে বলতে হবে সাথীকে, আবার একইসঙ্গে তাকে পুলিশ স্টেশনেও যেতে দেওয়া যাবে না। এসব ভাবতে ভাবতে অনিকের কেবিনের দিকে তাকালো সে। এখন ঘুমাচ্ছে সে। অর্ণব বিগত বাইশ ঘণ্টা ধরে অনিকের অসুস্থতার খবর লুকিয়ে আসছে। অনিক সুস্থ হওয়া অবধি তাকে এ কাজ করতেই হবে। অর্ণব বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হতেই তৌহিদের কল আসলো তার ফোনে। অর্ণব রিসিভ করলো।

-হ্যাঁ তৌহিদ বলো, পুলিশ স্টেশনে কিছু হয়েছে?

-ভাইয়া, কিছু সূত্র পেয়েছি। সাথী ভাবীকে তো অনিক ভাই সব বলেছে। ওনার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো।

-আচ্ছা আমি বাড়িতে ফিরে দেখছি তবে সাথী যেন ভুলেও অনিকের অসুস্থতার কথা না জানে।

-আচ্ছা ভাইয়া।

অর্ণব ফোনটা পকেটে রাখলো। সাথীর উপর বড্ড মায়া হয় তার। মেয়েটা তার আরেক বোনের মতো। সাথীর মতো মেয়ে পাওয়া আসলেই ভার। যেমন সংসারী, তেমনি আদর্শ স্ত্রী। অপর্ণার সাথে সাথীর তুলনা সে কখনোই করেনি তবে ইদানিং অপর্ণার উপস্থিতি তাকে যতটা যন্ত্রণা দেয় ততটা আর কোনোকিছু দেয় না। রিক্সাতে উঠেও এসবই ভাবছে সে। সন্ধ্যের আঁধারিতে রোড লাইটের আলোয় শহরটা অন্যরকম লাগছে। অর্ণব ঠিক করলো সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে একদিন সে আর অনিক এমন রিক্সা করে সন্ধ্যেবেলা ঘুরবে। এটা হবে শুধু তাদের ‘ব্রাদার্স ইভনিং আউট’। অনিকের বেহুশ অবস্থা অর্ণবকে যতটা ভীত করেছে তার এক অংশও সে বাহিরে প্রকাশ করতে পারছে না অথচ ভেতরটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে তার।

____________

সাথীকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটু খাইয়ে সবে ঘরে ঢুকেছিল চিত্রলেখা। এরই মধ্যে অপর্ণা চেঁচামেচি শুরু করলো।

-আমার চা কই লেখা?

-ভাবী, চা বানানোর কথা খেয়াল ছিল না। তুমি ঘরে যাও, আমি বানিয়ে আনছি।

-তোকে সব মনে করানো লাগে কেন? একটা কাজে মন নাই।

চিত্রলেখা চুপচাপ থাকলো। কথার পিঠে কথা বাড়ে। তার নীরবতা অপর্ণাকে ঝগড়া থামাতে বাধ্য করলো। রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে এগোলো সে। রান্নাঘরে যেতেই দেখলো গ্যাসের চুলার পাশেই ফোন রেখে গেছে সে। ফোনটা একপাশে রেখে চা বানাতে লাগলো সে। চা বানানো শেষ করতেই ফোন বেজে উঠলো। চিত্রলেখা স্ক্রিনে দেখলো রঙ্গনের নম্বরটা। চায়ের পাতিল রেখে ফোনটা রিসিভ করলো সে।

-হ্যালো।

-হ্যাঁ বলুন, হঠাৎ কল?

-হঠাৎ না, সাথী আপু কেমন আছে জানতে কল করলাম।

-খুব একটা ভালো না তবে চেষ্টা করছি ভাবী যেন অসুস্থ না হয়।

রঙ্গন একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। চিত্রলেখা কল কাটার কথা বলার অবকাশ পাচ্ছে না। ওদিকে চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এখন চা না দিলে বড় ভাবীর চেঁচামেচি কানে তোলার মতো অবস্থা থাকবে না। ফোন কানের সাথে ঘেঁষে পাতিল থেকে কাপে চা ঢালছিল চিত্রলেখা। অসাবধানতাবশত খানিকটা গরম চা তার হাতের কব্জিতে পড়লো। তীব্র যন্ত্রণায় ক্ষীণ অর্তনাদ করে উঠলো সে। রঙ্গনের কানে তা ঠিকই পৌঁছল।

-কিছু হয়েছে? চেঁচালে যে?

-না আসলে চা পড়েছে অসাবধানতাবশত। আমি পরে কল করছি।

চিত্রলেখা তৎক্ষণাৎ কল কেটে দিল। দ্রুত হাত পানিতে ভিজিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে অপর্ণার ঘরের উদ্দেশ্যে এগোলো। অপর্ণা বিছানায় শুয়ে আছে। রূপসা, অনিককে আজ সকালে তার নানা এসে নিয়ে গেছে। অপর্ণা চায় না তার বাচ্চারা পারিবারিক ঝামেলার মধ্যে থাকুক। তার এ বিষয়টা অবশ্য যৌক্তিক। চায়ের কাপ সাইড টেবিলে রেখে চলে আসার সময় আটকালো অপর্ণা।

-দাঁড়া তো।

-কিছু বলবে ভাবী?

-হ্যাঁ।

-বলো।

-মা যে তোকে কল করে হোস্টেলে যেতে বলেছিল, এটা তোর ভাইকে বলেছিস নাকি?

-না।

-আচ্ছা ভালো। যা কাজ কর।

চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে এলো। স্বার্থ ছাড়া ইনি কখনো তাকে ডাকেনা তা চিত্রলেখা জানে তবুও তার মন চায় অপর্ণা ভাবীও তাকে একটু ভালোভাবে ডাকুক। আকাশসম সম্মান কিংবা ভালোবাসা সে চায় না, সামান্য একটু যা তাকে মনে করাবে তার পরিবারটা আসলেই সুখী পরিবার।

_____________

রঙ্গনের দুশ্চিন্তা কমছে না। চিত্রলেখার ক্ষীণ আর্তনাদটুকুও তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। আশফিনা আহমেদ এখনো এ বাড়িতে আসেননি। রঙ্গন চাইলেই এখন বেরোতে পারবে কিন্তু এখন বেরোলে বাবার প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। রঙ্গন একটা ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।

__________

অর্ণব বাড়ি ফিরেই সাথীর খোঁজ করতে লাগলো। বিষয়টা অপর্ণার মোটেও ভালো লাগলো না তবুও সে চুপ রইলো। সাথী শান্ত ভঙ্গিতে বাইরে এসে বসলো। তৌহিদকে কল করে ফোন সাথীকে দিল অর্ণব।

-আসসালামু আলাইকুম।

-তৌহিদ, আমি সাথী বলছি।

-ভাবী, অনিক ভাইয়ের বেইল হতে আর কিছুদিন সময় লাগবে। আপনার একটু সাহায্য দরকার। আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আপনি একদিন অনিক ভাইকে কল করার পর দীতি রিসিভ করেছিল। এখন আমাদের এটা প্রমাণ করতে হবে অনিক ভাইয়ের আইডি থেকে ঐ মেসেজগুলো দীতি নিজেই পাঠিয়েছিল।

-এটা কিভাবে করবো আমরা?

-আমরা আননোন আইডি থেকে দীতিকে মেসেজ করবো এটা বলে যে ওর সত্যটা আমরা জানি। আমাদের টাকা না দিলে আমরা সব সত্যি কোর্টে বলে দিব। নিশ্চিত ভয় পাবে।

-আচ্ছা আপনি কাল আসুন, তারপর দেখছি আমরা।

চিত্রলেখা পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। এখনো ষাট দিন হয়নি, ‘কায়া’ আইডিটা এখনো একটিভ করা যাবে। চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি এবং চোখে পূর্বের জ্যোতি পরিলক্ষিত হলো।

_____________

ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে বারোটা। নিস্তব্ধ চারপাশ তবে চিত্রলেখাকে চোখে ঘুম নেই। অদ্ভুত একটা অশান্তি তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে নাহ, হাতটাও জ্বলছে। ওষুধ লাগানোর কথা মনেই নেই তার। আচমকা ফোন ভাইব্রেট হলো তার। চিত্রলেখা ভয়ে কেঁপে উঠলো। এত রাতে তাকে কে কল করতে পারে? ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রঙ্গন। চিত্রলেখার অশান্তি ভাব কমলো। অদ্ভুত রকমের শীতল মন্দ মধুর বাতাস তাকে ছুঁয়ে গেল। চিত্রলেখা কল রিসিভ করে আলতো করে কানে রাখলো।

“হ্যালো…”রঙ্গনের শীতল কণ্ঠস্বর চিত্রলেখার বুকের মধ্যে ঝংকার তুললো। সে যেন কথা বলতে ভুলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলালো।

-বলুন।

-একটু জানালার কাছে এসে দাঁড়াও তো।

-কেন?

-আসো আগে।

চিত্রলেখা জানালা খুলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। নিচে রঙ্গন বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখা ভয়ে আঁতকে উঠলো। এটা রক্ষণশীল এলাকা। আশেপাশে কেউ দেখলে কথা ছড়াতে সেকেন্ড কতক সময় লাগবে।

-আপনি কেন এসেছেন?

-নিচে আসতে পারবে?

-নাহ!

-বেশি সময় নিব না।

-আচ্ছা একটু থামেন।

চিত্রলেখা ঢোক গিলল। আলমারি থেকে মায়ের চাদরটা বের করে নিজেকে আবৃত করে নিলো। ঘর থেকে বেরিয়ে আশেপাশের ঘরগুলো দেখলো। লাইট অফ, তার মানে সবাই ঘুম। সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে গেল সে।

হুডি পড়েও শীতের প্রকোপ অনুভব করতে পারছিল রঙ্গন। দুহাত পকেটে গুঁজে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। চিত্রলেখা এলো চাদরে নিজেকে আবৃত করে। রঙ্গনের মনে হলো সে যেন কয়েকটা হৃদস্পন্দন মিস করলো। শীতের প্রকোপের মাঝেও উষ্ণ হাওয়া তার সর্বাঙ্গে শিহরণ তুললো। মেয়েটার ভীত চোখজুড়ানো রঙ্গনের মনে ব্যাকুলতা বাড়িয়ে তুললো। ধীর পায়ে সে যখন রঙ্গনের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ালো, রঙ্গন যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল।

“এত রাতে এখানে কেন এসেছেন আপনি?” চিত্রলেখার ধীরস্বর রঙ্গনকে ঘোর থেকে বের করতে পারলো না। দু-তিনবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে চিত্রলেখা রঙ্গনের হাতে খানিকটা ধাক্কা দিল। ঘোর কাটলো রঙ্গনের। চিত্রলেখাকে মুখোমুখি দেখে নিজেকে ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছিল তার। হুডির পকেট থেকে অয়েন্টমেন্ট বের করে চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিল।

-আমার মন বলছিল একটা বোকা মেয়ে হাতের যন্ত্রণা সত্ত্বেও ওষুধ লাগাতে ভুলে যাবে।

-তার জন্য আপনি এখানে আসবেন এত রাতে?

-ওষুধটা লাগাও।

চিত্রলেখা ওষুধটা হাতে নিয়ে রঙ্গনের সামনেই আঁচ লাগা অংশে ওষুধ লাগালো। অতঃপর তা রঙ্গনের হাতে ফেরত দিল।

-ওষুধ লাগিয়েছি, এখন আসি? আপনিও যান!

কথাটুকু বলে রঙ্গনকে বলার সুযোগই দিল না চিত্রলেখা। চটজলদি সামনে এগোতে লাগল। আচমকা এক যুবকের ব্যাকুল মনের ব্যাকুলতা বোধহয় তাকে স্পর্শ করলো। পিছু ফিরে সে প্রশ্ন করলো,”কিছু বলবেন?”

রঙ্গনের চোখে কাব্য ভর করলো যেন। অদ্ভুতভাবে হাতটা ঠিক বুকের বা পাশে অবস্থান নিল। ঠোঁট নড়লো কতক সময়। বাতাসে শায়েরী ভেসে উঠলো,

“Tum kaho to phool se khushbuh,
Chand se roshni,
Tum se tum na ho to
kamse kam bura na mano,
to ek tumhara shaam churaalu?”

চিত্রলেখা কেবল বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো রঙ্গনের পানে। শুধুই কি কিছু মুহূর্ত চেয়েছে রঙ্গন?

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
অষ্টাদশ_পর্ব (রঙ্গন-চিত্রলেখা স্পেশাল)
~মিহি

চিত্রলেখার হাত পা কাঁপছে। রঙ্গনকে কী জবাব দিবে সে? রঙ্গন ব্যাকুলতা তার জন্য অস্থিরতা হয়ে ধরা দিচ্ছে। রঙ্গন বোধহয় ঘোর ছেড়ে বেরোলো। হন্তদন্ত হয়ে চিত্রলেখার দিকে এগোলো।

-স্যরি, এরকম পরিস্থিতিতে আমার আসলে তোমাকে এসব বলা উচিত হয়নি। আমি জানিনা কেন বললাম। তোমার চোখ দেখে মনে হলো তোমার সাথে আরো কিছুক্ষণ থাকলে তোমার ভালো লাগবে।

-সবকিছু নিজে নিজেই ভেবে ফেলেন নাকি?

-তুমি যাও। আমরা পরে কথা বলবো।

-আপনাকে ভোর চারটে অবধি সময় দেওয়া হলো। আমার শহরে আমাকেই ঘোরাতে রাজি আছেন?

রঙ্গনের মনে হলো সে বোধহয় স্বপ্ন দেখলো। চিত্রলেখা সত্যিই তার কথায় রাজি হয়েছে? চোখ বড় বড় করে তাকালো সে। চিত্রলেখার মুখে তখন বিরক্তি ভেসে উঠলো।

-আশেপাশের কেউ দেখার অপেক্ষা করছেন?

-না না, আসো।

চিত্রলেখা চাদরটা আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। রঙ্গন বাইকে বসলো। চিত্রলেখা বেশ সাবধানে এক পাশ হয়ে বসে আলতো করে রঙ্গনের কাঁধে হাত রাখলো। রঙ্গন বাইক স্টার্ট করলো।

এলাকার রাস্তা পেরোনোর পর চিত্রলেখা খানিকটা স্বস্তি পেল। রাস্তা যথেষ্ট নিরিবিলি। মানুষজনের সমাগম নেই। রাতের নিস্তব্ধতা ছুঁয়েছে দিনের ব্যস্ততাকে।

-আমরা কোথায় যাচ্ছি?

-‘আফটার’ মুভি দেখেছো?

-না।

-আচ্ছা তাহলে জায়গাটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ থাকুক।

চিত্রলেখা চুপ করে বাতাসের শব্দ শুনতে লাগলো। গভীর রাতে এভাবে লুকিয়ে রাস্তায় ঘোরার স্পর্ধা তার কোনোকালেই ছিল না কিন্তু মোটেও খারাপ লাগছে না। জীবনের টানাপোড়েনের মাঝে এ ক্ষণিকের মুহূর্তটুকু তাকে প্রশান্তি দিচ্ছে।

-তুমি কখনো এভাবে রাতে লুকিয়ে বের হওনি তাইনা?

-আমার প্রাণের ভয় আছে। একবার কেউ জানতে পারলে কেটে ফেলে দিবে।

-এত ভয় পাও কেন?

-জানিনা। অভ্যাস হয়ে গেছে হয়তো এমন রেস্ট্রিকশনের কারণে।

-ভুল অভ্যেস বানিয়েছো। রেস্ট্রিকশনের শিকলে পড়ে লাইফটা মিস করতেছো। ভার্সিটি লাইফ চলে আসলে জীবনের অর্ধেক সুখ এমনেই কমে যাবে।

চিত্রলেখা জোরে নিঃশ্বাস নিল। মন্দ মধুর ঘ্রাণ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। চাদরের আবরণেও শীতল হাওয়া তাকে স্পর্শ করছে ঠিকই। চিত্রলেখা খেয়াল করলো তারা মেইন রাস্তা পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় এসেছে।

-এদিকে কোন জায়গায় যাচ্ছি আমরা?

-বিশ্বাস রাখতে পারো একটু।

চিত্রলেখা বলার মতো কোনো উত্তর পেল না। রাস্তাটা সুন্দর। অর্ধচাঁদ আকাশে ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। রাস্তাটা যেন অসীম। মাথায় একটা গান ক্ষণে ক্ষণে বাজছে,”এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।”

রঙ্গন বাইক সাইড করলো। চিত্রলেখা কল্পনার জগত থেকে বেরোল যেন। সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো রাতের নিকষ কালোতে ঝিলের পাড়ে জোনাকিদের বিচরণ। এত সুন্দর জায়গা সে আদৌ আগে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে পারছে না সে। চোখজোড়ায় মুগ্ধতা খেলা করছে।

-এত সুন্দর এ জায়গাটা! এটার কথা তো আমি জানতামও না।

-অনেকেই জানেনা। এ জায়গাটা ‘আফটার’ মুভির একটা দৃশ্যের মতো। তুমি যেহেতু মুভিটা দেখোনি, তাই বুঝবেনা। তুমি বরং জায়গাটার সৌন্দর্য উপভোগ করো।

চিত্রলেখা ধীরে ধীরে ঝিলের পাড় ঘেঁষে বসলো। টলটলে জলে অর্ধচাঁদের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। চিত্রলেখার চোখে মুগ্ধতার রেশ বিন্দুমাত্র কমলো না। শীতল জলে হাত স্পর্শ করতেই সর্বাঙ্গ ঝনঝন করে উঠলো তার।

-এই ঝিলে কি সাপ আছে?

-আরে নাহ, তাছাড়া পানিতে সাপ কামড়ায় না। তুমি সাপ ভয় পাও?

-মারাত্মক ভয় পাই। বাঘ ভাল্লুক থেকেও বেশি ভয় পাই।

-আরে সাপ নেই এখানে।

চিত্রলেখা যেন এ কথারই অপেক্ষা করছিল। সে ঝিলের আরো কাছাকাছি বসলো। রঙ্গনের একবার ভয় হলো মেয়েটা বেশি নিকটে যাচ্ছে না তো! চিত্রলেখা ঝিলের পানিতে পা ভেজালো। বরফের মতো শীতল সে পানি। তবুও চিত্রলেখার মোটেও খারাপ লাগলো না বরং সে মুহূর্তটাকে ভালোবেসে ফেললো।

-ঠাণ্ডা লাগবে চিত্রলেখা, এখন পানি যথেষ্ট ঠাণ্ডা।

-কিছু মুহূর্তের আনন্দের জন্য একটূখানি রোগে জড়ালে কিচ্ছু হয়না।

চিত্রলেখার কথাটা বোধহয় ভালো লাগলো রঙ্গনের। সেও ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো।

-জীবনের অজস্র ঝামেলার মধ্যে কিছু মুহূর্ত নিজস্ব থাকা দরকার, চিত্রলেখা।

-আপনার অভ্যেস আছে এভাবে রাতে পালিয়ে ঘুরে বেড়াবার, তাইনা?

-ঠিক অভ্যাস না, হঠাৎ হঠাৎ ভালো লাগে এসব করতে।

অতঃপর নীরবতা। রঙ্গনও আজ নীরব। পাশাপাশি বসে কথা বলার মতো কিছু যেন আর মুখে আসছে না তার অথচ জমানো কথাগুলো মনে ঠাঁই দেওয়ার জায়গা নেই। রঙ্গন গুনগুনিয়ে করতে লাগলো।

-আপনি গানও জানেন?

-টুকটাক।

-শোনার অনুমতি পেতে পারি?

রঙ্গন হাসলো। মেয়েটার কাব্যিক কথার ফোয়ারা তাকে মাঝে মাঝে অভিভূত করে। ‘নিশ্চয়ই..” মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল রঙ্গন। ক্ষীণ স্বরেই গেয়ে উঠলো,

“তুমি বৃষ্টি চেয়েছো বলে
কত মেঘের ভেঙ্গেছি মন
আমি নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি

তুমি যাওনি কিছুই বলে
আজও পাল্টে ফেলিনি মন
শুধু নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি

তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি
ও, তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি”

চিত্রলেখা অভিভূত হলো। এত সুন্দর কণ্ঠস্বর বুঝি হয় কারো! রঙ্গনের কণ্ঠে মোহিত হলো সে।

-আমি কিন্তু খুব একটা খারাপ গাই না, বলো চিত্রলেখা!

-আপনি প্রফেশনাল গায়কদের মতো গান গাইতে পারেন! আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। এত সুন্দর কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে গড-গিফটেড বা জেনেটিক্যাল!

-আমার বংশের কেউ গায়ক নাই, আমিই বোধহয় গড-গিফটেড।

-আমাদের বোধহয় এখন যাওয়া উচিত।

-হ্যাঁ চলো।

রঙ্গন চটজলদি উঠে বাইক স্টার্ট করলো। চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলা করছে। এতটা ‘বিশেষ’ কেউ তাকে কখনো অনুভব করায়নি। কিছু মুহূর্ত যে মানুষকে এতটা প্রশান্তি এনে দিতে পারে তা সে কখনোই বোঝেনি। বাইকের গতি স্বাভাবিক হলেও তার কাছে মনে হচ্ছে বাইকটা যেন জোরে চলছে। আরো আস্তে কেন চালাচ্ছে না রঙ্গন? চিত্রলেখার তো বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। মুহূর্তগুলো আরেকটু দীর্ঘায়িত হলে মন্দ হয় না।

-আপনি এই ঝিল খুঁজে পেলেন কিভাবে?

-জানিনা। হঠাৎ একদিন খুঁজে পেয়েছি। আমার ভাগ্য খুব ভালো, আমি সবসময় ভালো ভালো জিনিস খুঁজে পাই।

-তা বোধহয় সত্যি।

-তুমি কখনো রাত তিনটায় ফাঁকা রাস্তায় আইসক্রিম খেয়েছো?

-রাত তিনটায় আইসক্রিম কোথায় পাওয়া যায়?

-সামনে একটা দোকান খোলা, বসো একটু।

চিত্রলেখাকে কিছূ বলার সুযোগ দিল না রঙ্গন। বাইক সাইড করে ঝড়ের গতিতে আইসক্রিম আনতে গেল। চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি তখনো বহাল। অদ্ভুতভাবে তার অপ্রত্যাশিত সবকিছু যেন আজ ঘটছে। সে কি কখনো ভেবেছিল রাত বিরাতে এভাবে বাইরে বেড়াবে তাও রঙ্গনের সাথে? সে কতটুকুই বা চেনে রঙ্গনকে? ছেলেটা তো তার ক্ষতিও করতে পারতো! এতটা অবলীলায় কী করে বিশ্বাস করতে পারলো সে? একবারও তো চিত্রলেখার মনে হলো না ছেলেটা তার ক্ষতি করতে পারে কিংবা ছেলেটার দৃষ্টি তার জন্য অসুবিধের।

রঙ্গন দুই হাতে দুইটা কোণ আইসক্রিম আনলো। বাইক থেকে নেমে সেখানেই হেলান দিয়ে দাঁড়ালো চিত্রলেখা। রঙ্গন তার দিকে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও আরেকটা প্যাকেট খোলা শুরু করলো।

-শীতের রাতে তিনটের কাছাকাছি সময়ে এভাবে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়া, অনেকটা সিনেম্যাটিক না চিত্রলেখা?

-পুরোটাই সিনেম্যাটিক।

-তোমার ঠাণ্ডা লাগবে বোধহয়। স্যরি।

-মানুষ যখন মন থেকে শান্তি পায়, তখন এসব ঠাণ্ডা লাগার আক্রমণ হয় না।

-তুমিও দেখি আমার মতো কথা বলতে শিখে গেছো। তাড়াতাড়ি শেষ করো, তোমাকে রেখে আসি। নাহলে দেখা যাবে তোমার বাড়িতে তোমাকে খুঁজতে হট্টগোল পড়ে যাবে।

-হুম।

রঙ্গনের খানিকটা মন খারাপ হলো। এতক্ষণ চিত্রলেখার সঙ্গ বেশ উপভোগ করছিল সে। এখন যেন পৃথিবীর সমস্ত একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরবে।

খুব সাবধানে চিত্রলেখাকে মেইন রাস্তার কাছে নামিয়ে দিল সে। অতঃপর বিদায়ের প্রহরটা নীরবেই কাটলো তাদের।

-ধন্যবাদ একটা সুন্দর সন্ধ্যার জন্য।

-যাও সাবধানে। আল্লাহ হাফেজ।

-আল্লাহ হাফেজ। আপনিও সাবধানে যাবেন।

চিত্রলেখা সামনে এগোলো। চিত্রলেখা চোখের আড়াল হওয়া অবধি রঙ্গন সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে