Monday, July 14, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 357



চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪১+৪২

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
একচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখার ঘরের দরজা বন্ধ সকাল দশটার পর থেকে। সাথী বার কয়েক দরজায় ঠকঠক করেও কোনো লাভ হয়নি। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। সাথী খানিকটা হলেও ভয় পাচ্ছে। অনিককে ইতোমধ্যে কল করেছে সে। এইচএসসির রেজাল্ট নিয়ে চিত্রলেখা মন খারাপ করেছে তা সাথীও বুঝতে পারছে। জিপিএ ফাইভ পাওয়াটা চিত্রলেখার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, সেখান থেকে ৪.৮০ পাওয়াটা সে কোনোভাবেই আশা করেনি। একরকম মন ভেঙেছে তার। চিত্রলেখা ঠিকই উপলব্ধি করছে এখানে নওশাদের দোহাই দিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও কি কেউ ভালো ফলাফল করেনি? করেছে! এখানে ব্যর্থতা তার। ইন্টার লাইফের শুরুর সময়টা নষ্ট না করলে বোধহয় এখন আফসোস করতে হতো না। চিত্রলেখার চোখ ভিজে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। মনে অদ্ভুত রকমের সব কুচিন্তা খেলা করছে। তার সাথেই এমন কেন হলো? সব স্বপ্ন যেন চোখের সামনে ধূলিসাৎ হতে দেখছে সে!

সাথী প্রায় আধঘণ্টার দরজা ধাক্কা দিয়েও চিত্রলেখার সাড়াশব্দ পেল না। এদিকে অনিকের নম্বর বন্ধ। কোনো উপায় না পেয়ে সে রঙ্গনের নম্বরে কল করলো। রঙ্গন অফিসে ছিল, ফোনের দিকে খেয়াল করেনি সে। একটু পর সাথীর নম্বর থেকে মিসড কল দেখে তৎক্ষণাৎ সাথীর নম্বর ডায়াল করলো সে। রিসিভ হতে সময় লাগলো না।

-আপা বলো, কী হয়েছে? আজ তো রেজাল্ট দিয়েছে, লেখা…

-লেখা দরজা খুলছে না রঙ্গন, প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে ওকে ডাকছি কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

-আপা তুমি নক করতে থাকো। আমি আসছি। আর ভাইয়াকেও কল করো। দরকার পড়লে দরজা ভাঙাও আপা প্লিজ। আ..আমি আসছি।

রঙ্গন আর কিছু বলতে পারলো না, কল কেটে দিল। সাথী দরজায় শব্দ করেও লাভ হচ্ছে না। অনিকের অফিস কাছেই কিন্তু সাথী চিত্রলেখাকে রেখে সেখানে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। যদি মেয়েটা কিছু একটা করে বসে? সাথী কেবল আল্লাহ আল্লাহ করে চলেছে। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

_________________________

রঙ্গনের আসতে কাঁটায় কাঁটায় সাত মিনিট লাগলো। ঠিক কোন স্পিডে বাইক চালিয়ে সে এসেছে তা সে নিজেও মনে করতে চাইলো না। অনিকও ততক্ষণে সাথীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরে আসার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। রঙ্গন কোনো কথা না বলেই জোরে জোরে দরজায় শব্দ করতে লাগলো। চিত্রলেখার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রঙ্গন দেরি করলো না। বেশ জোরেই দরজায় ধাক্কা দিতে থাকলো। অনেকটা জোরে ধাক্কা দেওয়াতে ভেতরের ছিটকিনি ভেঙে যেতে সময় লাগলো না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রঙ্গনের চোখ পড়লো চিত্রলেখার উপর। দেয়ালের সাথে মিশে মেঝেতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে মেয়েটা। আশেপাশের কোনো শব্দই যেন তার কানে যাচ্ছে না। রঙ্গন কিংবা সাথীর ভেতরে প্রবেশেও যেন সে মোটেও অবাক হয়নি। রঙ্গনের কেন যেন মনে হচ্ছে চিত্রলেখা এখনো রেজাল্টের বিষয়টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সে নিঃশব্দে চিত্রলেখার পাশে বসলো। তাতেও চিত্রলেখার মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। রঙ্গন চিত্রলেখার গালে হাত রাখলো। নোনা জল চিত্রলেখার চোখ বেয়ে গড়াতে সময় নিলো না। রঙ্গনের তখন পরিস্থিতি বিবেচনার সময় নেই। সে তড়িঘড়ি করে চিত্রলেখাকে বক্ষপিঞ্জরে আগলে ধরলো শক্ত করেই। চিত্রলেখার কান্না তখন বাঁধ ভাঙলো। আর্তনাদের করুণ স্বরে সাথীরও করুণা হতে লাগলো। জিপিএ ফাইভ জিনিসটাকে এ সমাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে ফেলেছে তা যেন সাথীর চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানো হলো। চিত্রলেখা কবে থেকে এ প্রচলিত সমাজের বাধাধরা মানতে লাগলো? সে তো বরাবরই নিয়ম ভঙ্গকারী হতে চাচ্ছে তবে কেন এখন এ সামান্য শিকলে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার অভিপ্রায়?

রঙ্গন ধীরে ধীরে চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। চিত্রলেখাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো সে।

-লেখা শান্ত হও, কিচ্ছু হয়নি। এভাবে কান্না করার মতো কিচ্ছু হয়নি!

-আমি পারবো না রঙ্গন। আমি যেখানে এইচএসসিতেই পারলাম না সেখানে এডমিশনে কিভাবে পারবো? আমার দ্বারা হবে না! আমি ব্যর্থ।

-লেখা! তুমি পাগল হয়েছো? এইচএসসি আর এডমিশন এক হলো? তুমি ভালোমতো প্রস্তুতি নিয়েছো, তুমি পারবে। তুমি এইটার চিন্তা বাদ দাও। কত মার্ক কাটা যাবে? ৫ বা ৬? এটা বাদেও তুমি পারবে। আমি বিশ্বাস করি তুমি পারবেই।

-আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না রঙ্গন। আমি পারবো না।

-আমি এইচএসসিতে ৪.৪৮ পেয়েছিলাম। সেই দুঃখে পাবলিক পরীক্ষায় দিইনি। দিলে কি আমি পেতাম না চান্স? আমি ভয় পেয়েছিলাম আর এই ভয়টাই আমাকে দুর্বল করেছে। ভয়কে নিজের উপর ভারি হতে দিও না লেখা। আমি, আপা, ভাইয়া সবাই আছে তোমার পাশে। তুমি পারবেই। তোমাকে জবাব দিতে হবে সবাইকে। তোমার স্বপ্ন তোমায় পূরণ করতেই হবে!

চিত্রলেখা শান্ত হলো খানিকটা। চোখের পানি মুছতেই খেয়াল হলো সে এখনো রঙ্গনের বুকের মাঝে আবদ্ধ। সাথীও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখা তৎক্ষণাৎ রঙ্গনের বুক থেকে সরে গেল। রঙ্গন মাথা চুলকাতে চুলকাতে উঠে দাঁড়ালো।

-রঙ্গনা, তোমার রেজাল্টের চিন্তা একদম বাদ এখন। তুমি শুধু এডমিশনে মন দিবা আর এখন থেকেই। রাগ আর মন খারাপের সময় পড়াশোনা সবসময় ভালো হয়। সুতরাং এখন থেকেই পড়তে বসো আর আমি এই সময়টাতে দূরে থেকেই প্রতিমুহূর্তে পাশে থাকবো। তুমি শুধু লড়ে যাও, রঙ্গন আছে আর তোমারই থাকবে।

চিত্রলেখার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। তার চোখের দ্যুতি বলে দিল সে নিজেকে প্রস্তুত করছে ভবিষ্যতের যুদ্ধটার জন্য। রঙ্গন বেস্ট অফ লাক জানালো কেবল। চিত্রলেখার চাহনি আর কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে পাগল করতে উদ্যত হবে, আপাতত সে উন্মাদের কোঠায় নাম লেখাতে চায় না।

অনিকের আসার আগেই রঙ্গন বেরিয়ে গেল। অনিক এখনো জানেনা রঙ্গন চিত্রলেখার সাথে এখনো যোগাযোগ রেখেছে। বিষয়টা এমন হুট করে না জানাটাই ভালো। অনিক এসে দেখল বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সে যারপরনাই অবাক হলো। সাথী যেভাবে ভয় দেখিয়ে তাকে বাড়িতে এনেছে তাতে সে অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে সে আর সেসব কথা তুললো না।

_______________________

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। চিত্রলেখা তখনো পড়ছে। রঙ্গন ঠিকই বলেছিল। রাগ আর মন খারাপ এ দুইটা জিনিস মানুষের পড়াশোনায় মনোযোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘসময় ধরে পড়ার ফলে চিত্রলেখার ঘাড়ে খানিকটা ব্যথা শুরু হলো। বিশ্রামের জন্য বিছানায় হেলান দিয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে। অনেকদিন সুবহার সাথে কথা হয়না ভেবে সুবহার নম্বর ডায়াল করলো সে। বারকয়েক রিং হওয়ার পর সুবহা কল রিসিভ করলো।

-কেমন আছিস লেখা?

-আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোর খবর বল।

-আমিও ভালো। বাবা আগের থেকে একটু সুস্থ। এখানে নিয়ে এসেছি। বলা যায় নতুন সংসার এটা। রেজাল্ট কেমন আসছে তোর?

-৪.৮০। তোর কী অবস্থা?

-৪.১৭! তুই তো ভালোই করেছিস। সামনে তো মেডিকেল এক্সাম তোর, ভালোমতো প্রস্তুতি নে।

-তুই তো ঢাবিতে পরীক্ষা দিবি?

-আমার রাবিতে পড়ার শখ রে এখন। এত সুন্দর জায়গা রাজশাহী। এটা ছেড়ে ঐ ঢাকার কোলাহলে যেতে ইচ্ছে করবে বল।

-তাও তো কথা। তুমি তো এখন সংসারী নারী। তোমার কি আর ইচ্ছে করে সংসার ফেলে কোথাও যেতে?

-জুতো চিনিস?

-হ্যাঁ চিনি তো। কেন তুই চিনিস না?

-ধূর! এত রাতে জেগে আছিস? পড়ছিস তাইনা?

-হুহ। তুইও পড়তেছিস?

-হ্যাঁ।

-আচ্ছা পড়, পরে কথা হবে।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখা কল কেটে ফোন রাখবে ঠিক সে সময় লক্ষ করলো হোয়াটসঅ্যাপে আবার একটা মেসেজ এসেছে। তবে এবার আননোন নম্বর থেকে। মেসেজ ওপেন করলো চিত্রলেখা। টাইপিংটা বডি চেনা চেনা লাগছে। লেখাটা পড়তে শুরু করলো সে,

“এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ মিস করেছো? ব্যাপার না সোনা, ভাব যা বেশি তোমার এইটুকু নিচে নামা দরকার ছিল। বেশি উড়ো না বাবু, আচ্ছা? মেডিকেলে তোমার চান্স পাওয়া আমি নিশ্চিত করবো শুধু আমার হও একবারে। তুমি মেডিকেলে সীট পাবে আর আমি তোমাকে। ডিল খারাপ না। ভেবে দেখো বেবি ডল!”

চিত্রলেখার গা গুলিয়ে উঠলো মেসেজটা দেখে। সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে এই নোংরা মেসেজটা তাকে কে করতে পারে।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
বিয়াল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

“দেখো তোমার কাছে কোনো সলিড প্রমাণ নেই। কেবলমাত্র তোমার একটা কথার উপর ভিত্তি করে আমরা একজন রেসপেক্টিভ টিচারকে কেন কোচিং থেকে বের করবো?” এ প্রশ্নের সম্মুখে চিত্রলেখা সত্যিই বলার মতো কিছু পেল না। সে একজন সাধারণ শিক্ষার্থী, তার কাছে পাকাপোক্ত কোনো প্রমাণ নেই। আগের নম্বরের মেসেজগুলোও সে ডিলিট করে ফেলেছে। বাস্তবিক অর্থে সে কোনো প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ দায়ের করছে। আর কিছু বললো না চিত্রলেখা। বোকামিটা সে করেই ফেলেছে। এখন তা শোধরানোর সময় নয়। আহাদ লোকটাকে পরাস্ত করার সময় সামনে সে আরো পাবে তবে এই দুই মাস তাকে ভর্তিযুদ্ধ জয় করতে হবে। সাদা এপ্রোন আর তার মাঝে এখন যত বাধা আছে সব অতিক্রম করতে হবে তাকে। চিত্রলেখা টিচার্স কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো চিত্রলেখা। আহাদও সেখানে উপস্থিত ছিল। এবার তার কর্কশ রূপটা খানিকটা ফুটে উঠলো কথাবার্তায়।

-স্যার, এই মেয়েটা আমার উপর মিথ্যা দোষারোপ করেছে। অবশ্যই আমার উপর তার কোনো রাগ রয়েছে। আপনার অনুমতি থাকলে আমি তার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।

চিত্রলেখা ভ্রু কুঁচকালো। সিনিয়র লোকটা মাথা নেড়ে চলে গেল। চিত্ কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোকটা সব বুঝেও কিছু বলছে না অসম্মান হবে এই ভয়ে। আহাদের অগ্নিদৃষ্টি চিত্রলেখার বড্ড বিরক্ত লাগলো। কথা বলার রুচিটুকুও অবশিষ্ট নেই তার। এমনিতেই রেজাল্টের পর থেকে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে মারাত্মকভাবে। এখন এসব বিষয়গুলোতে জড়ানোর ইচ্ছেও নেই তার। চিত্রলেখা চলে যেতে উদ্যত হলো আহাদ শক্ত করে তার হাতটা ধরলো এবং অপর হাতটা দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। চিত্রলেখা বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকালো সেদিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহাদের নোংরা হাত তাকে বিশ্রিভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। চিত্রলেখা ছিটকে সরে গিয়ে পরক্ষণেই সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল আহাদের গালে। শব্দটা এতটাই তীব্র শোনালো যে কেবিনের বাইরে থেকে সিনিয়র শিক্ষকটির আসতে সময় লাগলো না। কেবিনের পরিস্থিতি দেখে তিনি যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন।

-আহাদ কী হয়েছে তোমার?

-স্যার, এই মেয়ে পাগল! আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করাতে আমায় থাপ্পড় মেরেছে। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার মতো বেয়াদবি যে করতে পারে সেই মেয়ের কথা আপনি বিশ্বাস করবেন স্যার?

-আমি তো প্রথমেই বুঝেছি এই মেয়ের সমস্যা আছে। এই মেয়ে! পড়াশোনা না করে এডমিশনে ভালো করতে চাও? বাপরে শখ! এসবের জন্য শিক্ষকদের নোংরা অপবাদ দিয়ে তাদেরই দোষ দাও, তোমার মতো মেয়ের কোথাও চান্স হবেনা।

চিত্রলেখার হাত পা যেন জমে গেছে। তোকে কেবিনে বেশ ভীড় জমেছে। চিত্রলেখা তখন আড্ডার বিষয়বস্তুতে রূপ নিয়েছে। অন্তর্মুখী চিত্রলেখার কাছে এত ভীড় স্বাভাবিক নয়। বরাবরই তার চিরায়ত দুর্বল রূপটা এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। চিত্রলেখা কোনো উত্তর দিল না। আহাদের মুখের বিশ্রি হাসি বলে দিচ্ছে লোকটা কতটা নোংরা একটা চাল চেলেছে। চিত্রলেখা কেবল নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

-লেখা তুই কেন কিছু বললি না? তোর কি একটাবার সব ক্লিয়ার করা উচিত ছিল না?

-বাদ দাও ভাবী। ঐ রকম নোংরা লোকের নাম নিতেও আমার নিজের উপর ঘৃণা লাগছে। ওরা নাকি শিক্ষক! ছিঃ!

সাথী কথা বাড়ালো না। চিত্রলেখার মনের অবস্থা অল্প হলেও বুঝতে পারছে সে। রঙ্গনকে এসব ঘটনা জানাবে কি? জানানো উচিত হবে। ভাবতে ভাবতেই সে ফোনের দিকে তাকালো। তৎক্ষণাৎ চোখ কপালে উঠলো তার। রঙ্গন কল করেছিল। ফোন ইয়ারফোনের সাথে কানেক্টেড থাকায় অটোম্যাটিক রিসিভ হয়েছে। সাথী ভয়ে ঢোক গিলল। ইয়ারফোনটা খুলে ফোন কানে ধরলো সে। কিছু বলার পূর্বেই কলটা কেটে গেল। সাথী বুঝতেই পারলো না কী হলো একটু আগে। রঙ্গন কতটুকু কথা শুনেছে তা আন্দাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।

_________________________

চিত্রলেখার বিষয়টা কোচিংয়ে ভালোই ছড়িয়েছে। স্টুডেন্টরাও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছে। অবশ্য আলোচনার মুখ্য কালপ্রিট চিত্রলেখাই। আহাদ নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করছে। কাউকে ফাঁদে ফেলা বোধহয় তার থেকে ভালো কেউ পারবেনা। মনে মনে নিজেই নিজের কাঁধ চাপড়ালো। ক্লাস নিতে নিতে এসবই ভাবছিল সে। স্টুডেন্টদের মধ্যে কিছুক্ষণ ফিসফাস চললেও আহাদ এবার তাদের চুপ করিয়ে দিল। ক্লাসে মনোযোগ দিতে বললো সবাইকে। মুহূর্তেই সারা কক্ষে পিনপতন নীরবতা সৃষ্টি হলো। আহাদ হোয়াইট বোর্ডের দিকে তাকাতেই অনুভব করলো কেউ একজন তার কলার ধরে তাকে পেছনে টানছে। বিব্রত হয়ে পেছনে ফিরলো সে। লম্বা-চওড়া এক ছেলে তার কলারে হাত দিয়েছে। ক্লাসে আবারো শোরগোল পড়ে গেল। “সাইলেন্স” বলে চেঁচিয়ে উঠলো আহাদ কিন্তু সামনে থাকা ব্যক্তিটি তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই আহাদের মুখ বরাবর ঘুষি হাঁকালো। তীব্র রাগের আঁচটা যেন স্পষ্ট টের পেল আহাদ। ছেলেটার পরিচয় জানেনা সে। অপরিচিত একজন ছেলে তারই ক্লাসে ঢুকে তাকেই মারছে এ যেন দুঃসাহসিক ব্যাপার। কতিপয় স্টুডেন্ট ইতোমধ্যে ভিডিও করতে শুরু করেছে। আহাদ কিছু বলার সুযোগই পেল না। যতগুলো চড় থাপ্পড় সে খেয়েছে তাতে তার দাঁত অবধি নড়ে উঠেছে। ক্লাসে শোরগোল শুনে শেষমেশ সকলে আহাদের ক্লাসে ঢুকলো। অপরিচিতের ছেলেটাকে আহাদের থেকে সরানোর চেষ্টা চালাতে লাগলো। টানাটানিতে আহাদের কলার ছিঁড়ে ছেলেটার হাতেই রয়ে গেল। তবুও যেন তার রাগ কমলো না। আহার এবার যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

-কে তুই? তোর সাহস তো কম না! আমার ক্লাসে ঢুকে আমার গায়েই হাত দিস!

-তোর মতো নোংরা কীটের গায়ে হাত দিছি এইটা আমার জন্য লজ্জাজনক। তোর মতো কীট শিক্ষক হওয়ার যোগ্যই না। তোদের জন্য শিক্ষকতার মতো একটা মহান প্রফেশনের অপমান হচ্ছে এখন।

-তুই কে এসব বলার? কী প্রমাণ আছে তোর কাছে?

রঙ্গন এবার খানিকটা শান্ত হলো। নিজের পরিচয় জানালো না আগেই বরং উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। কিছু কথা যে সে বলবে তা স্পষ্ট বোঝা গেল।

-তোমরা সবাই একটু আগের ঘটনা দেখেছো। আমায় ভুলও বুঝতে পারো তবে কাজটা আমি কেন করেছি তা তোমাদের জানা প্রয়োজন। একটা মেয়ের উপর অপবাদ দেওয়া খুব সোজা। মেয়েদের দোষ দেওয়াটাও খুব সোজা। তোমরা যেমন আজ দুপুরের ঘটনার জন্য নিশ্চয়ই মেয়েটাকে দায়ী করেছো! একবারো ভেবেছো মেয়েটা আদতে সত্যি বলতেও তো পারে! তোমাদের বোনের উপর এমন এলিগেশন আসলেও মেনে নিতা? আর এই নোংরা লোকের তো চেহারা দেখলেও বোঝা যায় শালা লুচ্চা! তোমাদের মনে হয়তো একে নিয়ে অনেক রেস্পেক্ট আছে কিন্তু বি অনেস্ট, এই লোকটা তোমাদের মধ্যে কোনো মেয়েকে বিরক্ত করেছে? এখনই সময়, নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করো!

ক্লাসের কেউই দাঁড়ালো না। রঙ্গন জানতো এত সাহস কেউ দেখাবে না। তবে রঙ্গনের এ আশাহত হওয়াটা যেন ভালো লাগলো আহাদের। ঠোঁট বেয়ে তার রক্ত গড়াচ্ছে তবুও কুৎসিত হাসিটা ঠোঁটের কোণে বহাল তবিয়তে রয়েছে। রঙ্গনের রাগ যেন আরো কয়েক গুণ বাড়লো। ইচ্ছে করলো হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েই লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। চিত্রলেখার কথাগুলো শোনার পর থেকে তার ঠিক কী পরিমাণ রাগ হয়েছে তা সে কাউকেই বোঝাতে পারবে না। আহাদকে খুন করলেও হয়তো এখন তার মন শান্ত হবে না কোনভাবেই।

“দেখো আজ যদি তোমরা চুপ থাকো, লোকটা কয়েক মাস পর তোমাদের জুনিয়রদের সাথেও সেইম কাজ করবে। হতে পারে ভবিষ্যতে তোমার বোনের সাথেও এমন করবে! আজ চুপ থাকার মানে হচ্ছে লোকটাকে প্রশ্রয় দেওয়া!” রঙ্গন শেষবারের মতো চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো। এতে যদি কারো বোধবুদ্ধি ফেরে! এতেও যদি কেউ কিছু না বলে তবে রঙ্গন আর এসবের ধার ধারবে না। সোজা ঐ লোকটার কান ধরে টেনে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে মারবে।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৩৯+৪০

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা ইদানিং ঘর থেকে মোটেও বের হয়না তবে আজ রাদিফের পরীক্ষার খাতা দেখাবে, গার্ডিয়ান ছাড়া যাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়েই অপর্ণা গায়ে কালো বোরকা জড়িয়ে রাদিফের স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। মিনিট পনেরো লাগবে যেতে। রিকশা নিল অপর্ণা। কিছুসময় সব ঠিকঠাক থাকলেও একটু পর অপর্ণা লক্ষ করলো দুইটা বাইক তাকে দুইপাশ থেকে ফলো করছে। অচিরেই তার মনে ভয় ধরলো। না জানি কোন বিপদ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য! অপর্ণা রিকশাওয়ালাকে বললো দ্রুত যেতে। তাতে অবশ্য লাভ হলো না। বাইকে থাকা লোকগুলো রিকশার সামনে বাইক থামালো। রিকশাওয়ালা না পারতে রিকশা থামালো একপাশে। লোকগুলো এসে সোজা অপর্ণার দিকে ছুরি তাক করলো।

-চুপচাপ নেমে আমাদের সাথে চল!

-কারা আপনারা? আমার রাস্তা কেন আটকেছেন?

-বেশি কথা বললে কথা বলার মতো অবস্থাতেই থাকবি না, কোনো কথা না বলে আমাদের সাথে আয়।

-দেখুন আমার বাচ্চা স্কুলে অপেক্ষা করছে, আপনারা টাকা নিয়ে যান। আমায় ছেড়ে দিন প্লিজ।

-তোর আসলেই প্রাণের মায়া নাই!

লোকগুলোর একজন অপর্ণার বোরকা ধরে টানাটানি শুরু করলো। সরু রাস্তা হওয়ায় এদিকে গাড়ি খুব কম। অপর্ণা চিৎকার করারও সাহস পাচ্ছে না। আচমকা পুলিশের হুইসিল শোনা গেল। লোকগুলো ছুরি ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালালো। অপর্ণা যেন জমে গেছে। সে কোনভাবেই নড়তে পারছে না। কোনোরকম রিকশাওয়ালাকে বললো রিকশা ঘুরিয়ে আগের জায়গায় নামিয়ে দিতে। রিকশাওয়ালাও যথেষ্ট ভয় পেয়েছে। সেও সময় না নিয়ে রিকশায় টান দিল।

________________________

অর্ণব অপর্ণার বাড়ির সোফাটাতে বসেও খানিকটা সংকোচবোধ করছে। আগেরবার এখানে এসেছিল ডিভোর্স লেটারে সই করতে, এখন তাকে কেন এত জরুরি তলব দেওয়া হয়েছে জানা নেই তার। অবশ্য অতীব দরকারি কোনো কথা না থাকলে তার শাশুড়ির মতো মানুষ কখনো তাকে অনুনয় করে এখানে ডাকতো না তা সে জানে। অর্ণবের ডিভোর্সের পেছনে অন্যতম কলকাঠি নাড়ানো ব্যক্তিটিও তার শাশুড়ি মা। বিষয়গুলো অল্পবিস্তর বুঝতে পারে অর্ণব কিন্তু এসব প্রকাশ করতে চায় না। অপর্ণার বাবা-মা, পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে। বাচ্চারা বোধহয় অপর্ণার সাথে ঘরে রয়েছে। অর্ণব বোঝার চেষ্টা করছে তাকে কেন ডাকা হয়েছে।

-অর্ণব বাবা, তোমায় খুব গুলো কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছি।

-তা বুঝতে পেরেছি। বলুন।

-নওশাদ লোকটা যে অপর্ণাকে বিরক্ত করছে তা আমি আগেও লেখাকে জানিয়েছি। আমার মেয়েটা ঘর থেকে বের অবধি হয়না। আজ বের হয়েছে, কিছু লোক এসে তার গলায় ছুরি ধরেছে। তুমি বুঝতে পারছো ব্যাপারটা কত সিরিয়াস?

-জ্বী বুঝতে পারছি।

-দেখো বাবা, অপর্ণাকে তো তুমি চেনোই। মেয়েটার অযথা জেদ, ওকে তুমি মাফ করে দাও বাবা। আর দেখো নওশাদের ক্ষমতা আছে, লোকটা তো এমনি এমনি চুপ করবে না। চিত্রলেখাকে ওর সাথে বিয়ে দিলে কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না। যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে, বিয়েতে অমত করার কী আছে? বিয়েটা হয়ে গেলে সব সমস্যা মিটে যাবে।

-আপনার লজ্জা করেনা? আপনি তো একজন মেয়ে, আপনি দেখতেই পারছেন নওশাদ লোকটা কতটা ভয়ঙ্কর তারপরেও আপনি এই কথা বলার সাহস পেলেন কী করে?

অর্ণব চলে যাওয়ার জন্য উঠলো। অপর্ণার বাবা আটকালেন তাকে।

-বাবা অর্ণব, আমাদের কথায় রাগ কোরো না। আমাদের মেয়েকে নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমাদের বোধবুদ্ধি কাজ করছে না অর্ণব।

-আপনার মেয়ের বোধবুদ্ধি সময়মতো কাজ করলে এখন এ পরিস্থিতিতে পড়তেন না। যাই হোক, আমি আমার বাচ্চাদের সাথে একটু দেখা করতে চাই।

-অপর্ণার সাথে একবার…

-আমার বাচ্চাদের একটু বাইরে ডেকে নিবেন? আমি দেখেই চলে যাবো।

উপস্থিত সবাই থ মেরে গেল। অর্ণবের কথার কাঠিন্য সকলে উপলব্ধ করতে পারলো। মানুষ কতটা কষ্ট পেয়ে এতটা কঠোর হতে পারে তা বোধহয় তারা অনুভব করার চেষ্টা করলো।

রূপসা-রাদিফের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে এলো অর্ণব। বাচ্চা দুটো এখনো বাবার থেকে দূরত্ব মেনে নিতে পারেনি। পরিস্থিতি বোঝানো তো এতটা সহজ নয়! অপর্ণার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অর্ণব তৌহিদের সাথে দেখা করার জন্য গেল। তৌহিদের সাথে তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

-অর্ণব ভাই? এখনি আসলেন যে? অবশ্য আমিই আপনার ওখানে যেতাম আজ।

-লেখার সাথে কথা হয়েছে তোমার? কাজ কতদূর? সময় তো বেশি নাই।

-কাজ বেশি বাকি নাই ভাইয়া তবে অপর্ণা ম্যামের উপর নজর রাখছিলাম আজকে। ঠিকঠাক টাইমে পুলিশের সাইরনটা বাজিয়েছিলাম বলে বেঁচে গেছে! যতদূর বুঝলাম গুণ্ডাগুলো প্রফেশনাল না, নওশাদ বোধবুদ্ধি ভাড়া করেছে। নিজের ইমেজ ক্লিন রাখতে চায় আর কী!

-এসব জেনে কাজ নাই তৌহিদ আমার, অপর্ণার যা হয় হোক। ও মরে গেলেও আমার যায় আসে না।

-এটা আপনার মুখের কথা ভাই, আপনি যে কষ্ট পাচ্ছেন তা আপনার চোখ বলে দিচ্ছে। মাফ করে দিয়ে নতুন করে সব শুরু করলেই পারেন!

-তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো তবে অবশ্যই তাকে আমৃত্যু ভালোবাসবে কিন্তু তার সমস্ত অন্যায় ক্ষমা করার মতো বড় অন্যায় কখনো করো না। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিণাম জানো? না পাবে ভালোবাসা আর না পাবে শান্তি!

-অপর্ণা ভাবীকে কখনো ক্ষমা করবেন না ভাইয়া?

-না।

-ভাবী অনুতপ্ত হলেও না?

-না। একটা ভুল করার পর অনুতপ্ত হলেই কি সেই ভুলের মাশুল দেওয়া হয়ে যায়? ভুল ভুলই থাকে। তাছাড়া ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত অপর্ণারই ছিল। এখন তার অনুতপ্ত হওয়ার কারণ নেই। সেসব তোমার ভাবতে হবে না, তুমি তোমার কাজ করো।

-আচ্ছা ভাইয়া। আমার আরো কিছুদিন দেখা লাগবে। তাছাড়া এবার ভোটে হেরে লোকটা ক্ষ্যাপা শেয়াল হয়ে আছে। একটু সামলে কাজ করতে হবে।

-করো। সময়মতো যেন সব হয়।

__________________________

চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারছে না এই আহাদ লোকটার সমস্যা কী। হোয়াটসঅ্যাপে আবারো মেসেজ করেছে লোকটা। বিরক্তির ভঙ্গিতে ফোনটা দূরে ছুঁড়লো লেখা। সে অপেক্ষায় আছে তৌহিদের কলের। কল আসছে না মানে এখনো কাজ হয়নি। এতে অবশ্য বিরক্ত হয়ে লাভ নেই। যে দায়িত্ব সে তৌহিদকে দিয়েছে তাতে সময় লাগা স্বাভাবিক। তৌহিদের অযথা এ উকিলগিরিতে সময় ব্যয় না করে পার্মানেন্টলি গোয়েন্দাগিরিতে জয়েন করা দরকার।

চিত্রলেখা ফোন হাতে নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকলো। রঙ্গনের একটাই ছবি আছে তার কাছে। প্রোফাইলে যে ছবিটা দেওয়া ছিল আগে, সেটাই সেভ করে রেখেছিল সে। ঢাকায় আসার পর থেকেই রঙ্গনের স্মৃতি মারাত্মক পোড়াচ্ছে তাকে। মন চাচ্ছে একটু দেখা করতে কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক ঘোষণা করছে যে রঙ্গনের সাথে দেখা হলেই সে মনোযোগ হারিয়ে ফেলবে। অবশ্য কথাটা মিথ্যে নয়। রঙ্গনের বলা একটা বাক্যও চিত্রলেখার মনে উত্তাল ঢেউ আনতে সক্ষম।

সাথী চিত্রলেখার ঘরে উঁকি দিয়ে ভালোমতো দেখলো মেয়েটা কী করছে। চিত্রলেখার বিরক্ত হয়ে বসে থাকা দেখে সাথীরও বিরক্ত লাগলো। কানে ধরে রাখা ফোনটা হাত দিয়ে আড়াল করলো।

-আপা, কী হয়েছে? কিছু বলছো না যে?

-তোমার বউয়ের মন খারাপ রঙ্গন।

-লে কেন!

-আমি কিভাবে বুঝবো? তুমি কল রাখো। আমি দেখি কেন এমন বাংলার পাঁচের মতো করে বসে আছে।

-আপা শোনো না, আমি তোমার বাড়িতে আসি আচ্ছা? ভাই হিসেবে প্রথমদিন বোনের বাড়িতে যেতে চাইছি, মানা করো না প্লিজ।

-আমি কিছু বলবো না কিন্তু তোমার বউ যদি আরো রাগ করে তবে আমার দোষ নেই।

-আচ্ছা আপা। চিত্রলেখাকে এখন কিছু বলতে যেয়ো না। ওকে একটু একা থাকতে দাও।

-দুপুর থেকে খায়নি। এখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে। অনিকটারও আজ মিটিং আছে, আসতে আসতে দশটা বাজাবে। আমি দেখি ওকে কিভাবে খাওয়ানো যায়।

-আপা প্লিজ তুমি কিছু করো না। আমাকে দেখতে দাও।

-কী করবে তুমি?

-কিছু একটা।

রঙ্গন কল কেটে দিল। মাঝেমধ্যে নিয়ম ভাঙাই যায়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন বিশেষ একজন থাকে যার জন্য আমরা সকল নিয়ম একবার করে হলেও ভাঙি।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
চল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

“মনে পড়লে অকারণ, কাউকে বলা বারণ
রিমঝিমঝিম বরষায় তুই আজ ভেজার কারণ
মেঘেদের ডাকবাক্সে তোর চিঠি পৌঁছে দিলাম…” চিত্রলেখা বিভ্রান্ত চোখে চারিদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে শব্দটা কোথা থেকে আসছে। রেকর্ডেড ভয়েস তবে তার মন জানান দিচ্ছে রঙ্গনের উপস্থিতি। উদভ্রান্তের মতো এলোমেলোভাবে সব ঘর খুঁজলো সে। এখনো গানটা বাজছে কোথাও একটা। রঙ্গনের স্বর যেন চিত্রলেখার মনকে আরো এলোমেলো করে তুলছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। ঘর ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়ালো চিত্রলেখা। ঠিক তখনি চোখে পড়লো নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। এখন রাতের দশটা। অন্যান্য দিনের তুলনায় কুয়াশাও বেশি পড়েছে। সবে শীত আসি আসি ভাব হলেও ঠাণ্ডার প্রকোপ মারাত্মক এবার অথচ ছেলেটা কিনা শুধু একটা হুডি গায়ে জড়িয়ে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো তার ঘরের বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখার প্রচণ্ড রাগ উঠলো। আশেপাশেও কোনোকিছু আর ভাবলো না সে। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে নিচে নামলো।

চিত্রলেখার উদ্বেগ লুকিয়ে রাখতে পারলো না সে। রঙ্গনকে দেখামাত্র তার সমস্ত রাগ যেন জল হয়ে গেল। ইচ্ছে করলো রঙ্গনকে কষে একটা চড় দিতে। বেয়াদব ছেলেটা ফাজলামি শুরু করেছে। শরীর খারাপ হলে কে দেখবে?

-এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ কী?

-তোমার উপরের ফ্ল্যাটের মেয়েটার জন্য এসেছি। মেয়েটা খুব কিউট তো!

-ওহ আচ্ছা।

চিত্রলেখার শান্তস্বরে বলা ‘ওহ আচ্ছা’র ভয়াবহতা বুঝতে সময় লাগলো না রঙ্গনের। চিত্রলেখা ফিরে যাওয়ার জন্য পিছু ফিরেছিল, রঙ্গন পেছন থেকে তার হাতটা ধরলো বেশ শক্ত করেই।

-এ জীবন ফুরিয়ে যাবে তুমি চলে গেলে, ভবলীলা সাঙ্গ হবে তোমায় না পেলে।

-আজ বড্ড গান শোনাচ্ছেন যে গায়ক সাহেব। কাহিনী কী?

-কাহিনী হচ্ছে আমার রঙ্গনা আজ বড্ড উদাসী বিকেলের মতো নিষ্প্রভ হয়ে আছে। তার একটু রঙ্গনের প্রয়োজন।

-আচ্ছা?

-হুম অনেকগুলো আচ্ছা। আমি জানি তোমার পড়াশোনার অনেক চাপ এখন, আমি বেশি সময় নিব না। আমাকে শুধু পাঁচ মিনিট সময় দিতে আপত্তি আছে?

-আপত্তি করলে কি আপনি শুনবেন?

-না।

-তবে?

-আমি চাই তুমি আমাকে অনুমতি দাও তোমার মন ভালো করার।

-অনুমতি দেওয়া হলো।

রঙ্গন পকেট থেকে বেলিফুলের গাজরা বের করলো। চিত্রলেখার বেলিফুল পছন্দ কথাটা সে সাথীর থেকে জেনেছে। রঙ্গনের অবশ্য এ ফুল খুঁজতে অনেকটা সময় লেগেছে। সব জায়গায় লাল গোলাপ সহজলভ্য হলেও শুধু বেলির গাজরাটা খুঁজে পাওয়া ভারি দুঃসাধ্য হয়েছে তার জন্য। রঙ্গন ফুলটা নিয়ে নিজের ডানহাতের সাথে চিত্রলেখার বামহাতটা আলতো করে বাঁধলো।

-কী হলো এটা?

-ফুলেল বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।

-তুমি আসলেই পাগল!

-উফ! কতদিন পর তুমি করে ডেকেছো। শেষ আমি, বুকে ব্যথা করছে।

-নাটকবাজ কোথাকার!

-তুমি নাটক হও প্রিয়, আমি নাটকবাজ হতে দ্বিধা করবো না।

-আপনাকে কে বললো আমার মন খারাপ?

-ভালো কথা মনে করিয়েছো। তোমার কেন মন খারাপ সেটাই শুনিনি এখনো। কী হয়েছে বলো তো।

-ওহ, ঐটা তেমন কিছু না।

-কেমন কিছু সেটাই জিজ্ঞাসা করছি।

-কোচিংয়ের একটা স্যারের পড়ানো ভালো লাগছে না আর কী! ঐটা নিয়েই একটু মন খারাপ।

-হে আল্লাহ, আমার মতো ব্যাকবেঞ্চারের কপালে তুমি এ কেমন আঁতেল রাখলা!

-এই আমি আঁতেল?

চিত্রলেখার ডানহাত দিয়ে সমানে রঙ্গনের ডানহাতে আঘাত করতে লাগলো। রঙ্গন হাসতে হাসতে চিত্রলেখার ডানহাতটাও বাহুবন্দি করে ফেললো।

ফাঁকা রাস্তায় হেডলাইটের অল্প আলোতে রঙ্গনের চোখে দুরন্তপনা দেখলো চিত্রলেখা। এ দুরন্তপনা যে কতদিন তাকে পড়তে বসতে দিবে না তাও উপলব্ধি করতে চাইছে না চিত্রলেখা। এ চাঞ্চল্য উপভোগের করতে ইচ্ছে করছে তার। রাস্তার অপর পাশে পেরিয়ে অল্প দূরত্বে একটা পার্কের লেকের ধারে বসলো দুজন। চিত্রলেখার এক হাত এখনো রঙ্গনের হাতে বন্দি।

-আমার যাওয়া উচিত। ভাবী চিন্তা করবে।

-আপা জানে তুমি এখানে এসেছো।

-ভাইয়া তো জানে না। ভাইয়া রাগারাগি করবে।

-অপেক্ষা জিনিসটা এতটা কষ্ট দেয় কেন বলো তো। আমি চাইলেও কেন তোমায় হুটহাট দেখতে পারবো না? খুব কাছে থেকেও কেন কাছে আসতে পারবো না? অন্তত এক প্রহর কেন কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারবো না? আমি তোমার বিরহে পুড়ছি রঙ্গনা। তুমি জল হয়ে এসে শীতল করো এ দহন যন্ত্রণা।

-বিরহ কাব্য শিখিয়ে দিয়েছে?

-হুম। আচ্ছা পাঁচ মিনিট তো শেষ। চলো তোমাকে রেখে আসি।

রঙ্গন চটজলদি উঠে পড়লেও চিত্রলেখা আলতো করে রঙ্গনের টি-শার্টের কোণা আঁকড়ে ধরলো। চিত্রলেখার চোখজুড়ানো যেন বলছে,”না গেলে হয় না?” রঙ্গনের বুকে তৎক্ষণাৎ ঝড় বয়ে গেল। মেয়েটা আর কতভাবে ঘায়েল করবে তাকে?

-রঙ্গনা, তোমার চাহনি আমায় যেভাবে মাতাল করছে তাতে যদি আমি কোনো ভুল করে বসি তবে তুমি আগামী কতদিন যে পড়াশোনায় মন দিতে পারবে না তা আমিও জানি না।

-আপনি এতটা নির্লজ্জ কবে হলেন?

-তোমার প্রেমে পড়ার পর থেকেই।

রঙ্গন হাসতে লাগলো যেন সে বড়সড় কোনো ডিবেট জিতে গেছে। চিত্রলেখা মুগ্ধ হয়ে সে হাসির দিকে চেয়ে রইলো। এ হাসির স্নিগ্ধতা পরিমাপযোগ্য? মোটেও না! এ হাসি চিত্রলেখার কত রাতের ঘুম কাড়তে চলেছে তা সে নিজেও অনুধাবন করতে পারছে না।

________________________________

-ভাইয়া এখনো আসেনি ভাবী?

-নাহ। রঙ্গন ভেতরে এলো না?

-তুমি ডেকেছিলে ওকে?

-না, ঐ আসতে চেয়েছিল।

-কেন?

-তার রঙ্গনার মন খারাপ ছিল তাই।

চিত্রলেখা আর কিছু বলার উপায় পেল না। রঙ্গনের বাচ্চামির কারণে এখন ভাবীও তার দিকে অদ্ভুত রকমের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। চিত্রলেখা মাঝেমধ্যে ভুলে যায় আসলে ছোট কে। সে নাকি রঙ্গন!

ঘরে ঢুকতেই চিত্রলেখার ফোনটা বেজে উঠলো। তৌহিদের কল দেখে খানিকটা ব্যতিব্যস্ত হয়েই রিসিভ করলো চিত্রলেখা।

-তৌহিদ ভাইয়া, কোনো প্রমাণ পেয়েছেন?

-প্রমাণ আছে লেখা তবে জোরদার নয়। আমাদের আরো সময় নিতে হবে। অপর্ণা ভাবীর উপর হামলা লোক্যালদের দিয়ে করানো, ওদের ধরলেও নওশাদের কিছু করা যাবে না।

-ভাবীর উপর হামলা হয়েছে?

-হ্যাঁ, অনেক লম্বা কাহিনী। তবে আমার মনে হয় রঙ্গনকে জানানো উচিত। সে বোধহয় আমাদের সহায়তা করতে পারবে।

-না ভাইয়া। রঙ্গন কোনো ঝুঁকির মধ্যে থাকুক আমি চাইনা। তাছাড়া রঙ্গন এসব থেকে যতটা আড়ালে থাকবে ততটাই ভালো। সময় বেশি লাগুক, সমস্যা নেই।

-আচ্ছা আমি আমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি পুরোদমে। আশা করি কোনো না কোনো প্রমাণ তো হাতে আসবেই। এখন রাখছি আমি।

-আচ্ছা ভাইয়া।

চিত্রলেখা কল কেটে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো। রঙ্গনকে এসব জানানোর ভুলও করা যাবে না। চিত্রলেখার সব ভয় এখন রঙ্গনকে ঘিরে। রঙ্গন যদি এসবে জড়িয়ে ভুলেও কখনো জানে সে আশফিনা আহমেদের আসল সন্তান নয় তখন চিত্রলেখা নিজেকে কিম ক্ষমা করবে? আশফিনা আহমেদ এত বছর ধরে যে সত্য রঙ্গনের থেকে আড়াল করেছেন, সে সত্য আড়ালে থাকাই ভালো। চিত্রলেখা নওশাদকে যতদূর চেনে, তাতে নওশাদ নিজের বেলায় রঙ্গনকেও পরোয়া করবে না এটাই স্বাভাবিক। চরম মাত্রার নিকৃষ্ট একটা লোক সে।

হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ টোনে ঘোর কাটলো চিত্রলেখার। আহাদের ক্রমাগত টেক্সট এবার তাকে বিরক্ত করছে। সমস্যা কি এই লোকটার? চিত্রলেখা যে বিরক্ত এটা বুঝতে তার এতক্ষণ সময় লাগছে? মানুষটার সাধারণ জ্ঞান নাই নাকি কাজে লাগাতে পারছে না? চিত্রলেখা এবার আর কিছু ভাবলো না। তৎক্ষণাৎ নম্বরটা ব্লক করে দিল। মানুষকে কোনোকিছুর সুযোগ দেওয়াই উচিত না বরং সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার আগেই প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি করে ফেলা উচিত তাকে। একটু ষুযোগ পেলে মানুষ যে মাথায় চড়ে বসে এর প্রমাণ তো চিত্রলেখা আগেও পেয়েছে। এখন আগের সেই চিত্রলেখাটা তার মাঝে আর নেই। আগ্নেয়গিরির সুপ্ত সময় এখন শেষ, এখন কেবল প্রচণ্ড লাভা প্রতিমুহূর্তে প্রস্তুত হচ্ছে তার মাঝে। কখন কোন সময় এ লাভা কোন ব্যক্তির উপর বিস্ফোরিত হবে তার ধারণা চিত্রলেখার নিজেরও নেই।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৩৭+৩৮

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
সাঁইত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

সময় বহমান। বস্তুত সবচেয়ে দ্রুতগামী জিনিস বোধহয় এটাই। চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করলেই যেন সময় উড়ে চলে যায়। পাঁচ মাসের মতো হলো তার ভাই-ভাবীর ডিভোর্স হয়েছে। বাচ্চাগুলোর কাস্টাডিও ভাবীর কাছে। অর্ণব অবশ্য এতে খুব একটা মন খারাপ করে না। যত যাই হোক, অপর্ণা মায়ের দায়িত্ব ঠিকই পালন করবে সে জানে। হয়তো মাসে একদিন বাচ্চাদের দেখা পায়, তাতেই সে খুশি। চিত্রলেখা এসব নিয়ে কখনো বেশি কথা বলতে যায় না। তার পৃথিবীটাই একরকম বদলে গেছে এ কয়েক মাসে। রঙ্গন ঢাকা ফিরেছে সেদিনই। অনিকেরও ঢাকায় চাকরি হওয়ার পর সাথীও সেখানে। চিত্রলেখাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ জোর করেছিল দুজনে তবে চিত্রলেখা যায়নি। অর্ণবকে একা ফেলে তার যেতে ইচ্ছে হয়নি। তাছাড়া যে এলাকায় সে অপমানিত হয়েছে সেখান থেকে পালানোর মতো মানসিকতা তার তখন হয়নি। উপযুক্ত জবাব দিয়েই সে যেতে চায়।

সন্ধ্যে হতে চললো। অর্ণব ফিরবে বেশ রাত করেই। বাড়িতে ‘সায়রা’ নামের এক বৃদ্ধা আছেন, রান্নাবান্নার কাজসহ সব কাজ মোটামুটি তিনিই দেখেন। চিত্রলেখাও তার কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করে। সায়রা সন্ধ্যে হতেই রান্না শেষ করে বসে থাকেন। এশার নামাযের পর দীর্ঘসময় ধরে কুরআন তেলাওয়াত করেন। এই মানুষটার আশেপাশে থাকলেও চিত্রলেখার মনে প্রশান্তি বজায় থাকে। চিত্রলেখাকে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে। অনেকটা গ্যাপ পড়েছিল পড়াশোনায়, এখন সব গুছিয়ে পড়ছে সে। আচমকা ফোনটা বেজে উঠলো চিত্রলেখার। খানিকটা বিরক্তবোধ করলো সে। নম্বরটা অপর্ণার মায়ের। মহিলা গতকাল থেকে চিত্রলেখাকে ফোন করে যাচ্ছেন। চিত্রলেখা ইচ্ছে করেই রিসিভ করেনি। মুরুব্বি হলেও এ মহিলার মধ্যে নূন্যতম সৌহার্দ্যবোধ নেই, তার সাথে কথা বলা মানে নিজেকে ছোট করা। ফোন ক্রমশ বেজেই চলেছে। চিত্রলেখা না পারতে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো।

-আসসালামু আলাইকুম।

-ওয়ালাইকুম সালাম, মা আমার মেয়েটাকে বাঁচাও মা। ও মরে যাবে। নওশাদ লোকটা ওকে বিরক্ত করছে। লোকটার ক্ষমতা তো তুমি জানো মা। ঐ লোকটার হাত থেকে আমার মেয়েকে বাঁচাও।

-ঐ লোকটার সাথে সখ্যতা গড়তে কি আমি গিয়েছিলাম আন্টি? আমার কিছু করার আছে এখানে? যে বিপদ আপনার মেয়ে ঘাড়ে নিয়েছে, সে বিপদের সমাধান আমি কী করে হবো? আমায় দয়া করে বিরক্ত করবেন না।

চিত্রলেখা কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিল। নওশাদ লোকটা ভয়ঙ্কর তা সে জানে কিন্তু অপর্ণা যে গর্ত খুঁড়েছে, তাতে তার পড়া অনিবার্য ছিল। চিত্রলেখা অপর্ণার বিষয়টা মাথা থেকে বের করে পড়ায় মনোযোগ দিল। মনোযোগ একবার বিচ্যুত হলেই রঙ্গনের খেয়ালগুলো মস্তিষ্কে আনাগোনা করতে শুরু করে। চিত্রলেখা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও পারেনা সেসব থামাতে। চিত্রলেখা জানে রঙ্গনকে পাশে রেখেও সে স্বপ্ন পূরণে এগোতে পারতো কিন্তু আদৌ কি সে তার স্বপ্নের জন্য সর্বোচ্চ সাধনা করতে পারতো তখন? প্রেম এবং পড়াশোনা দুইটা একসাথে কখনো হয়না। চিত্রলেখা রঙ্গনের থেকে দূরে আছে মানে এই না যে তার ভালোবাসা প্রতিমুহূর্তে কমছে, আদতে ভালোবাসার মাত্রা যে চক্রবৃদ্ধির হারে বাড়ছে তা সে সর্বদাই অনুভব করতে পারে।

___________________________________

চিঠি লেখা শেষ করে রঙ্গন নিচে তারিখ দিয়ে ‘৩১৭’ লিখলো। এটা তার লেখা ‘৩১৭’ তম চিঠি। চিত্রলেখার জন্য জমানো কথাগুলো সে চিঠিবদ্ধ করছে সেই কয়েক মাস আগে থেকে। কথা না হোক, অনুভূতিগুলো জমা হোক চিঠির পাতায়। আচমকা ফোন বেজে উঠাতে ধ্যান ভাঙলো রঙ্গনের। মনে পড়লো ব্যস্ততায় গতকাল থেকে মায়ের ফোন রিসিভ করতে মনে নেই তার। চটজলদি কল রিসিভ করলো।

-এত কিসের ব্যস্ততা রঙ্গন? গতকাল থেকে তুমি আমার কল রিসিভ করছো না!

-স্যরি মা, নতুন জব তো। কাজের একটু চাপ থাকেই।

-তোমার চাকরিটা করার কোনো দরকার আছে রঙ্গন? তুমি এখানে এসে তোমার বাবার অফিস জয়েন করলে কী সমস্যা?

-আমার নিজের যোগ্যতায় কিছু তো করা উচিত মা, ভবিষ্যতে কী হবে বলা তো যায় না।

-কী বলতে চাইছো?

-মা তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো, তাই না?

-এটা কি বলতে হয়?

-আমার সাথে একদিন কথা না বলতে পেরে তুমি এতটা উৎকণ্ঠা! ভালোবাসার মানুষের সাথে কথা না হওয়ার যন্ত্রণা কেমন মা? খুব বেশি কষ্ট হয়? আমার কেন যেন অনুভূতি শক্তি হারিয়ে গেছে।

রঙ্গন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। আশফিনা আহমেদ কল কেটে দিয়েছেন। রঙ্গন ফোনের সিক্রেট ফোল্ডারে ঢুকলো। এখানে চিত্রলেখার হাতে গোণা কয়েকটা ছবি আছে। বেশ কয়েকটা ওর কলেজের গ্রুপ ফটো যেটা রঙ্গন কলেজের পেইজ থেকে সংগ্রহ করেছে আর একটা ছবি সে তুলেছিল লুকিয়ে। চিত্রলেখা যখন বিলে পা ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিল তখনকার তোলা। রঙ্গনের কাছে এ ছবিগুলো ছাড়া আর কিছু নেই। চিত্রলেখার স্মৃতিগুলো ইদানিং বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে সুযোগ ছিল ভার্সিটিতেই লেকচারার হওয়ার। রঙ্গনের সেদিকে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। শিক্ষকতাটা তার দ্বারা হবে না এটা সে অনেক আগেই বুঝেছে। চিত্রলেখার অপেক্ষায় প্রহর গুণতে গুণতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ঢাকা শহরে তার শান্তির খোঁজ নেই। প্রচণ্ড ব্যস্ততম একটা দিন শেষ করে সে অনুভব করে সময়গুলো কেবল তার সাথে প্রতারণাই করে চলেছে। চিত্রলেখার স্মৃতিগুলোও তাকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে প্রতিমুহূর্তে। তবুও রঙ্গন নিজেকে সামলায়। মাস তিনেক পরেই এইচ.এস.সি পরীক্ষা। এ সময়টাতে চিত্রলেখার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না সে। চিত্রলেখার থেকে দূরে থেকেও তার স্বপ্ন পূরণের অংশ হয়ে থাকতে চায় সে। রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুনগুন করতে থাকে,”সখী ভাবনা কাহারে কয়, সখী যাতনা কাহারে কয়…”

________________________________

-রূপসার নানিবাড়ি থেকে কল করেছিল।

-কী বলেছে?

-নওশাদ লোকটা নাকি ভাবীকে বিরক্ত করছে।

-ঐ মহিলা আর তোর ভাবী নেই। যাই হোক, বিরক্ত করছে তাতে আমরা কী করতে পারি? নম্বর ব্লক করিসনি কেন তুই এখনো? ব্লক কর এখনি। আর শোন, অনিক কল করেছিল। তোর টেস্ট পরীক্ষা তো শেষ। এইচএসসির আগে একবার ঘুরে আসতে বললো।

-এখন কোথাও গেলে গোছানো পড়াশোনার আবার সমস্যা হবে। পরীক্ষা শেষ হোক, এডমিশন কোচিংয়ের জন্য তো যাবোই ভাইয়া।

-আচ্ছা ঠিক আছে। খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাস। কাল দেখলাম টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিস। পড়াশোনা ভালোমতো করতে হলে আগে শরীরের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যা।

-আচ্ছা ভাইয়া আর তোমার ঐ বন্ধুর খোঁজ পাওয়া গেল?

-না, পুলিশ খুঁজছে। ভাগ্যিস ওর কথা শুনে টাকাগুলো ইনভেস্ট করিনি, আমার টাকাও নিয়ে যেত শয়তানটা!

-বিশ্বাস জিনিসটা আসলেই বুঝে শুনে করতে হয় ভাইয়া। আসি আমি।

চিত্রলেখা চলে গেল। অর্ণব চিত্রলেখার কথার অর্থ ঠিকই বুঝতে পারছে। এক ছাদের নিচে থেকেও যেন ভাইবোনের দূরত্ব কমছে না। অর্ণবের সবসময় মনে হয় তার বোন কখনো তাকে আগের মতো বিশ্বাস কিংবা শ্রদ্ধা করতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবার শেষ করে উঠলো সে। “সায়রা খালা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে, তিনি তো আবার আটটার আগেই খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলেন।” ভাবতে ভাবতে অর্ণব প্লেটটা ধুয়ে রেখে নিজের ঘরে এসে বসে। ফোনের ভাইব্রেশন বুঝতে পেরে ফোন হাতে নিল অর্ণব। অচেনা নম্বর থেকে কল আসছে। অর্ণব বুঝতে পারলো না রিসিভ করবে কি করবে না। ইমার্জেন্সি ভেবে শেষমেশ কল রিসিভ করলো সে।

-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?

-অর্ণব, আমি অপর্ণা বলছি। প্লিজ আমার কথা শোনো।

-তোমার কথা শোনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই অপর্ণা। তুমি আমার সন্তানদের মা, সেই সূত্রে তোমাকে যতটুকু সম্মান এখন দিই সেটুকুও কেড়ে নিতে বাধ্য করিও না!

-অর্ণব, আমি এভাবে থাকতে পারছি না। ঐ নওশাদের লোকজন আমাকে প্রতিমুহূর্তে বিরক্ত করছে। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। এই সময়ে তুমি আমাকে একা ফেলে যেতে পারো না!

-আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে অপর্ণা, তোমার প্রতি আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই। ভেবো না ডিভোর্স হয়েছে বলে এমন বলছি, আদতে তোমার মতো একজন জঘন্য মানসিকতার মানুষকে আমি আমার আশেপাশেও দেখতে পারবো না। তাছাড়া এখন আফসোস করে কী লাভ? নিজের পায়ে কুড়ালটা তো তুমি নিজেই মেরেছো।

-অর্ণব প্লিজ…

অর্ণব কলটা কেটে দিল। চিত্রলেখা একটা কথা প্রায়শই বলতো,”আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না!”। অর্ণবের আজ মনে হচ্ছে কথাটা কতটা খাঁটি! অপর্ণার এ দুরবস্থা তার স্বীয় কীর্তিকলাপের ফল।

____________________________________

ঘুমোনোর জন্য মাত্র বিছানায় বসেছে এরই মধ্যে ফোনটা আবার বেজে উঠলো। চিত্রলেখা খানিকটা বিরক্ত হলো। ফোন সে সর্বদা বিছানা থেকে দূরে রাখে ঘুমোনোর আগে। এখন আবার গিয়ে দেখতে হবে কে কল করলো।

আশফিনা আহমেদের নম্বরটা ট্রু কলার চিনিয়ে দিল তাকে। দোনোমনা ভাবেই কলটা রিসিভ করলো সে।

-আসসালামু আলাইকুম।

-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো লেখা?

-আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ যেমন রেখেছেন। আপনি ভালো আছেন?

-হুম আছি। কিন্তু আমার ছেলে ভালো নেই লেখা। একসময় আমিই চাইতাম সে তোমার থেকে দূরে থাকুক কিন্তু এখন ওর কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারছি। তুমি দয়া করে ওর সাথে একটু কথা বলো।

-আমার পক্ষে তা সম্ভব না আন্টি। আমরা দুজন দূরে থেকেও মানিয়ে নিয়েছি। এখন যোগাযোগ করলে দুজনের জীবনই এলোমেলো হয়ে যাবে।

-ওর কষ্টটা তুমি বুঝতে পারছো না একটুও?

-আ’ম স্যরি আন্টি!

চিত্রলেখা কল কাটলেও তার মন আজ বড্ড উতলা হয়ে আছে। খুব স্বাভাবিক জীবনটা কেন যেন সকাল থেকে অন্যদিকে রূপ নিচ্ছে। না পাওয়া সবকিছু যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে,”এসো স্পর্শ করো আমায়!” চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করতেই অনুভব করলো একটা সাদা এপ্রোন গায়ে জড়াতে পারার তৃপ্তিটুকুর উদ্বেগ। কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে স্বপ্নের খাতিরে তবে ক্ষণিক মুহূর্তের কথা কি বড্ড বেশি সাধনাচ্যুত করবে তাকে? একটু কথা বোধহয় রঙ্গনও চায়!

রাত প্রায় এগারোটা। সারা বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। এখন ঘরে বসে কথা বলা অসম্ভব। সাবধানে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে উঠলো চিত্রলেখা। কাঁপা কাঁপা হাতে রঙ্গনের নম্বর ডায়াল করলো। রিসিভ হতে বোধহয় তিন সেকেন্ডও লাগলো না।

-হ্যালো…

-ফোনের কাছেই ছিলেন বুঝি?

-হুম। কেমন আছো?

-ভালো আছি।

-তোমার মুখে অনেকদিন পর আপনি শুনতেও ভালো লাগছে! তোমার জন্য অনেকগুলো চিঠি লিখেছি। দেখা হলে দিবো।

-আপনি ভালো আছেন?

-তোমায় ছাড়া ভালো থাকাটা ঠিক জমছে না আমার। তাড়াতাড়ি ডাক্তার হও আর এই মুমূর্ষু রোগীটার প্রাণ বাঁচাও প্লিজ।

-আহারে!

-তুমি ছাদে তাইনা?

-কী করে বুঝলেন?

-ঘরে থাকলে প্রাণখোলা হাসিটা শুনতে পেতাম না। এভাবে হাসছো মানে ছাদে আছো।

-ভালো এনালাইসিস! তো আমায় মিস করেছেন?

-শাহরুখ খানের মতো ফিল্মেটিক ওয়েতে বলা আমার দ্বারা হবে না। আমি প্রচণ্ড মিস করছি তোমায়, প্রচণ্ড বেশি! দেখা হলে হাতদুটো বেঁধে আমার বুকের সাথে মিশিয়ে রাখবো যেন কোনভাবেই নিজেকে ছাড়াতে না পারো।

-রঙ্গন, আমার আসলে আরো কিছু বলার ছিল।

-বলো।

চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। আশফিনা আহমেদের কল করার কথাটা কেন যেন বলতে মন চাইলো না। রঙ্গনের যদি মন খারাপ হয়ে যায় এই ভেবে যে সে রঙ্গনের মায়ের জোরাজুরিতে কল করেছে? যদি ভুল বোঝে রঙ্গন! চিত্রলেখা এখন বড্ড ভয় পায়, রঙ্গনকে হারানোর ভয়।

-কী হলো? কিছু বলবে বলছিলে!

-আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি রঙ্গন।

-রঙ্গনও তার রঙ্গনাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। আরো অনেকটা সময় ধরে কথা বলতে ইচ্ছে করছে রঙ্গনা কিন্তু তুমি ছাদে থেকো না প্লিজ। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। নিচে যাও। আর শোনো আমায় মিস করলে তুমি কল করতেই পারো! একটুখানি কথা সবসময় যে তোমাকে ডিসট্র্যাক্ট করবে তা না, কখনো আমাদের কথা তোমায় মোটিভেটও করবে। বুঝেছো?

-হুম।

-ঢাকা শহর তোমার অপেক্ষায় আছে।

-আর আপনি?

-সে তো জনমভর ধরে তোমার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত!

-পাগল প্রেমিক!

-ডাক্তার হবে তো, চিকিৎসা কোরো।

-আচ্ছা, ভাইয়া উঠেছে বোধহয়। আমি রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।

-আচ্ছা।

-শোনো…

-কী?

-কিছুনা!

-পাশে থাকলে নাহয় বাহুতে জড়িয়ে রেখে সমস্ত মন খারাপ দূর করতে পারতাম কিন্তু বড্ড দূরে আছি প্রেয়সী! পাশে থাকলে যতবার না এ শীতের হাওয়া তোমায় ছুঁতো, তার চেয়ে বেশি আলিঙ্গনে আমি বাঁধতাম তোমায়।

-রা…রাখছি আমি।

চিত্রলেখা কল কাটলো তৎক্ষণাৎ। রঙ্গনের একেকটা কথা তার মস্তিষ্কে ঝংকার তুলছে যেন। ছেলেটা এত কেন বোঝে তাকে? চিত্রলেখার এখন বড্ড আফসোস হয়। না চাইতেও ছেলেটাকে কতটা দূরে সরিয়ে রেখেছে সে! সময়গুলো আরেকটু দ্রুত পেরোলো হতো না?

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
আটত্রিশতম_পর্ব
~মিহি
______________________

-লেখা তুই অযথা চিন্তা করছিস! তোর পরীক্ষা যথেষ্ট ভালো হয়েছে, তুই এডমিশনের প্রিপারেশনে মন দে।

-আমি পারছিনা ভাবী। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। নওশাদ লোকটা আমার পরীক্ষার সময়টুকুতে এত ঝামেলা করবে আমি ভুলেও ভাবিনি। বিশ্বাস করো ভাবী এক্সাম হলে যতবার আমায় হ্যারাস করা হয়েছে তার হিসেব করে আমি শেষ করতে পারবো না। ঐ লোকটার শাস্তি না হওয়া অবধি আমি কিভাবে ভালো থাকবো বলো। মেডিকেল আমার স্বপ্নের চেয়েও দামি কিছু, যেখানে আমি আমার ভালোবাসাকেও উপেক্ষা করেছি সেখানে ঐ লোকটা কেন আমার সাথে এমন করলো?

-দেখ, ক্ষমতা ব্যবহার করে আর কতদূরই বা যাবে! তাছাড়া এইচএসসির খাতা তো আর ঐ লোক দেখতেছে না। তোর না ক্লাস ছিল আজ বিকালে? আমি রেখে আসবো?

-ক্লাস অনলাইনে নিবে আজ, জানানো হয়েছে।

-রঙ্গনের সাথে কথা হয়েছে তোর? দশদিন হলো ঢাকায় এসেছিস, ওকে একবার জানানো উচিত না?

-চার মাস ধরে কথাই হয়নি আমাদের আর তো জানানো। ওর সাথে একদিন কথা বললে পরের এক সপ্তাহ আমার আর পড়ায় মন বসে না ভাবী! তোমার এই ফুপাতো ভাইটা এমন কেন বলো তো।

-উহুম উহুম…প্রেম জমে ক্ষীর?

-ধূর! যাও তো তুমি। খালি কেমন কেমন করো!

-আচ্ছা স্যরি। অর্ণব ভাইয়া তোকে রেখে যাওয়ার পর থেকেই দেখতেছি তোর মন খারাপ। বাদ দে তো আমার চাচার কথা। ঐ লোকটা মানুষের কাতারেই পড়ে না।

-এত সহজে তো ছাড়বো না ভাবী। ওনার শাস্তির ব্যবস্থা না করে আমি এসেছি ভেবেছো? সময় আসলেই বুঝতে পারবে।

-আচ্ছা বুঝেছি। ফালুদা বানাবো ভাবছি। তুই বসে থেকে পড়, আমি বানিয়ে আনছি।

সাথী চলে যেতেই চিত্রলেখার মন আবারো খারাপ হয়ে গেল। ঢাকা শহর তার মোটেও ভালো লাগছে না। কেমন যেন দম বন্ধ করা শহর। সেই পরীক্ষার আগে একবার সুবহার সাথে কথা হয়েছিল, তারপর থেকে তারও খোঁজ নেই। রঙ্গনকে তো কল করারই সাহস পায়নি চিত্রলেখা। আগের কলের লজ্জা কাটিয়ে উঠতেই বোধহয় তার বছর দেড়েক লাগবে আরো।

চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করলেই নওশাদ লোকটার কুৎসিত চেহারা ভেসে উঠে। এমন একটা পরীক্ষা যায়নি যেখানে পরীক্ষার হলে তার পাঠানো লোক এসে চিত্রলেখাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে এক্সপেল করার চেষ্টা করেনি! একমাত্র সে-ই জানে কোন যুদ্ধে সে নেমেছে। নওশাদকে তো সে ছাড়ার পাত্রী মোটেও নয়। নিজের শহর ছাড়ার আগেই সে সব বন্দোবস্ত করে এসেছে, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সময় জিনিসটাই ইদানিং চিত্রলেখার সাথে শত্রুতায় মেতে উঠেছে। মেডিকেল পরীক্ষার সময় আর কয়েক মাস মাত্র। আগামী চল্লিশ দিনের মধ্যে বোর্ডের রেজাল্ট আসবে। তার এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে মেডিকেল এক্সাম হবে। সরকারের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েও লাভ নেই। চিত্রলেখা জানে সে এক অভাগা ব্যাচের স্টুডেন্ট। এখন সময়কে দোষারোপ না করে তাকেই যথাসাধ্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

অনলাইন ক্লাস করতে বসে আজ খানিকটা বিরক্ত হলো চিত্রলেখা। আজকে এক নতুন টিচার ক্লাস নিচ্ছে। ফিজিক্সের ক্লাস চলছে, বুয়েটিয়ান টিচার সম্ভবত তবে তার কথাবার্তার মাঝে চিত্রলেখার অদ্ভুত একটা অস্বস্তির রেশ রয়ে যাচ্ছে। চিত্রলেখা ক্লাস না করেই ডিসকানেক্ট করে বেরিয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ মনে হলো ভুল করে ফেলেছে। মাঝ ক্লাস থেকে লিভ নিলে ব্যাপারটা আরো বেশি দৃষ্টিগোচর হবে আর কোচিং থেকে এলার্ট আসবে এটার। চিত্রলেখা নিজের কাজের উপরই বিরক্ত হলো। পরিকল্পিত সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফালুদা খেতে খেতে আবার বই হাতে নিল সে।

__________________________

-করতেছে টা কী এখন?

-পড়া ছাড়া তার আর কোনো কাজ আছে?

-তোমার ননদ পড়তে পড়তে পাগল হয়ে যাবে আপা, আমি বিয়ের আগেই বউহারা হতে চাই না!

-রঙ্গন! তুমি এখনো বাচ্চাই আছো, আচ্ছা শোনো।

-কী?

-সামনের সপ্তাহের রবিবার কী বলো তো।

-রবিবার!

-গাধা! ঐদিন তোমার প্রেমিকার জন্মদিন।

-কী! অবশ্য তোমাদের কৃপায় যতসময় পাইছি প্রেম করার, তাতে জন্মদিন জানবো ভাবলা কেমনে? সব খাটাশ তোমরা!

-বেয়াদব, বড় আপার সাথে এইভাবে কথা বলে?

-আচ্ছা স্যরি। সামনের সপ্তাহে জন্মদিন তো! আচ্ছা ঠিক আছে। আমার সাথে প্রথম জন্মদিনটা সেরা জন্মদিন হবে রঙ্গনার।

-আয়হায়!

-আহা আপা, লজ্জা দিও না। আমি রাখছি, তোমার ননদকে একটু কম পড়তে বলো। ডিএমসির সব সীট কি একাই দখল করতে চায়?

-গুণী-জ্ঞানী বউ পাচ্ছো, শুকরিয়া আদায় করতে শিখো ছেলে।

-আলহামদুলিল্লাহ। এখন তুমি একটু আমার বউয়ের খেয়াল রাখো আপা, আমি পরে কথা বলবো।

-আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ।

সাথী কল কেটে দিয়ে হাসতে থাকলো। অবশেষে চিত্রলেখার জীবনে একটুখানি সুখের আভাস তো পাওয়া যাচ্ছে! রঙ্গন ছেলেটা মারাত্মক ভালোবাসে চিত্রলেখাকে। মানুষ আর কী-ই বা চায় জীবনে? চিত্রলেখা তো সারাজীবন একটুখানি ভালোবাসাই চেয়েছিল, একটুখানি নিখাদ ভালোবাসা। সাথী মুচকি হাসতে হাসতে চিত্রলেখার ঘরের দিকে এগোলো। সারাদিন ধরে পড়ছে মেয়েটা! ঠিকমতো একটু গল্পও তো করা দরকার।

-এই লেখা, ফালুদা শেষ করেছিস?

-হুম ভাবী, অনেক সুন্দর বানিয়েছো।

-তোর তো ক্লাস ছিল এখন, করলি না যে?

-আর বলো না ভাবী, আজ যে স্যারটা ক্লাস নিতে এসেছিল কেমন জানি করে কথা বলে। মানলাম স্যার ইয়াং, হয়তো আমাদের চেয়ে বড়জোর বছর তিনেকের বড় কিন্তু স্যার তো! তার কথাবার্তা যদি অতিরিক্ত ফ্র্যান্ক হয়, সেটা দৃষ্টিকটু না?

-হুম। তোদের সময়টা বড্ড অদ্ভুত রে। এখন শিক্ষক হতে খুব বেশি নীতিবান হতে হয়না। তাই শিক্ষকরাও নিজেদের সম্মানের জায়গাটা ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তোদের জেনারেশনে তাল মিলাতে গিয়ে তারা নিজেদের সম্মান খুইয়ে ফেলছে।

-ভালোই বলেছো ভাবী।

মিনিট বিশেক গল্প করলো চিত্রলেখা। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেকটা ক্লান্তি যেন দূর হলো। এখন একটু ঘুমিয়ে শেষরাতে উঠে আবার পড়তে হবে। ঘুমোনোর জন্য টেবিল থেকে উঠতেই ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। চিত্রলেখা বিরক্তিতে চ’কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করলো। ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ফোন বেজে উঠার মতো কর্কশ কাকের ডাকও নয়! চিত্রলেখার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ফোনটাকে ব্লেন্ডারে ঢুকিয়ে একদম গুড়ো গুড়ো করে ফেলছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে। চিত্রলেখা ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া কিছুই রাখেনি। হোয়াটসঅ্যাপেই এসেছে মেসেজটা। মেসেজ ওপেন করলো সে।

“আসসালামু আলাইকুম আপু। তুমি আজকে আমার ক্লাসটা করোনি। কোনো অসুবিধা? আসলে আমি স্টুডেন্টদের সাথে খুব বেশি ফ্রি। কোধো সমস্যা থাকলে দয়া করে আমাকে জানিয়ো।”

মেসেজটা পড়ে চিত্রলেখার মাঝে বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না তবে চিত্রলেখা বুঝতে পারলো সে বোধহয় অযথাই ভুল বুঝেছিল লোকটাকে। চিত্রলেখা নাম মনে করার চেষ্টা করলো স্যারটার। বোধহয় আহাদ নাম। চিত্রলেখা বুঝতে পারলো না রিপ্লাই করবে কি করবে না। আর রিপ্লাই করলেই বা কি রিপ্লাই করবে! বাড়তি ভাবনাচিন্তা এবং ফোন উভয়ই রেখে চিত্রলেখা ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন সকাল নয়টায় ক্লাস আছে কোচিংয়ে।

________________

নয়টার ক্লাসের কথা ভেবে সাড়ে আটটায় বেরিয়েছিল চিত্রলেখা কিন্তু ঢাকার জ্যাম তাকে ঠিকই দশ মিনিট লেইট করালো। প্রথমে আবার সেই আহাদ স্যারের ক্লাস! দশ মিনিট পর ক্লাসে ঢোকার পারমিশন চাইছে সে। কত জোড়া চোখ যে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছে তা অনুভবও করতে চায় না সে। আহাদ বিশেষ কোনো বাক্য উচ্চারণ না করে কেবল নাম জিজ্ঞাসা করে তাকে বৃতরে আপার অনুমতি দিল। চিত্রলেখার নাম বলতেও খানিকটা সংকোচবোধ হচ্ছিল। যে বিষয় থেকে মানুষ পালিয়ে বেড়াতে চায়, তা-ই যেন বারবার মূর্তির মতো সামনে এসে উপস্থিত হয়। চিত্রলেখা আহাদকে যত বেশি উপেক্ষা করতে চেয়েছিল ঠিক ততটাই তার চক্ষুর সম্মুখে আসতে বাধ্য হচ্ছে চিত্রলেখা।

চলবে..

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৩৫+৩৬

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঁয়ত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

“চাচা…” সাথীর যেন মাথা ঘুরে উঠলো। তার ছোট চাচা চিত্রলেখাকে দেখতে এসেছে? আসলেই? অপর্ণার কি নূন্যতম জ্ঞানবুদ্ধি নেই? সাথী চিত্রলেখাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। কাচের টুকরোগুলো মেঝেতেই পড়ে রইলো। নওশাদ কেবল অগ্নিদৃষ্টিতে সাথীর প্রস্থান দেখলো। অর্ণবও খানিকটা বিব্রতবোধ করছে। নওশাদ দেখতে বয়স্ক মনে না হলেও বয়সটা তো তার বেশিই। তাও আবার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। অপর্ণা এমন প্রস্তাব কী করে আনলো ভেবে পেল না সে।

“ভাইয়া, আমার কথা আছে তোমার সাথে।” কথাটুকু বলে চিত্রলেখা আবারো ঘরের ভেতরে চলে গেল। অর্ণব মাত্র উঠেছে ঘরে যাওয়ার জন্য, নওশাদ তাকে আটকালো।

-আপনার সাথে কিছু কথা বলে রাখি। যদিও সম্পর্কটা বেমানান ঠেকবে তাও ভাই-ই ডাকলাম। চিত্রলেখা আপনাকে কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছে। সে কী বলবে আমি জানি। চিত্রলেখা একটা ছেলেকে ভালোবাসে। ছেলেটা কে জানেন? রঙ্গন আহমেদ, আমার ভাগ্নে। চিত্রলেখাকে পছন্দ করার কথা বলেছিলাম বলে সে আমায় মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। ছেলেটার আচরণের কথা আমি না বলি, শুধু এটা জেনে রাখুন সে আমাদের আপন কেউ না। এখন একজন জন্মপরিচয়হীন ছেলের আচরণ কেমন হবে তা আপনার অজানা নয়। এ বিয়ে আটকাতে চিত্রলেখা হয়তো আমার নামে অনেক নোংরা কথাই বলতে পারে তবে আমি রাজনীতিতে থাকলেও নিতান্তই সহজ সরল মানুষ। শত্রুর অভাব নেই তা তো জানেন, কয়েকদিন আগেও আমাকে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। চিত্রলেখাও সেরকম কোনো মিথ্যেরই আশ্রয় নিবে। আমি তাকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম বিধায় প্রস্তাব এনেছি। আপনি চাইলেই আমাকে না করে দিতে পারেন, আমার আপত্তি নেই।

-আপনি বসুন, আমি লেখার সাথে কথা বলে আসছি। যেহেতু আপনি একা এসেছেন, আজকে বোধহয় কথা না বাড়ানোই ভালো। আপনি খাবার খান। আমি আসছি একটু পর।

_______________________

অর্ণব ঘরে প্রবেশ করতেই সাথী বেরিয়ে গেল। অর্ণব চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ালো। চিত্রলেখার ভয় ক্রমশ বাড়ছে। লোকটার চেহারা দেখলেও তার গা গুলিয়ে আসে। তার ঐ নোংরা চাহনি আবারো মনে ভেসে উঠে চিত্রলেখার।

-বল কী বলবি।

-ভাইয়া, তুমি ঐ লোকটার সাথে আমার বিয়ের কথা ভাবছো?

-দেখতে এসেছে, বিয়ে হয়ে যায়নি। তাছাড়া বয়স একটু বেশি ছাড়া আর কীই বা দোষ আছে ওনার? তোকে পছন্দ করে বলেই প্রস্তাব দিতে এসেছে।

-ভাইয়া …ঐ লো..লোকটা..

চিত্রলেখার শ্বাসকষ্ট অনুভব হচ্ছে। চেয়েও যেন কথাগুলি বলতে পারছে না সে। অর্ণবের সাথে দূরত্বটা যেন কদিনেই কয়েকগুণ বেড়েছে।

-তুই বলবি কিছু? এভাবে চলে আসাটা মোটেও ভালো দেখায় না।

-ভাইয়া, ঐ লোকটা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার দিকে নোংরা…

-তুই রঙ্গনের কথায় এসব অপবাদ দিচ্ছিস ওনার নামে? তোর লজ্জা করেনা? লোকটা তো বয়সে বড় তোর! এত নোংরা চিন্তা কী করে করতে পারিস তুই? রঙ্গনের উপর খুব টান? ঐ ছেলেটা যে জন্মপরিচয়হীন তা নিশ্চয়ই বলেছে সে তোকে? বলেনি?

চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। নওশাদ লোকটা নিম্নমানের তা সে জানতো কিন্তু এতটা নিচু তা সে বুঝতে পারেনি। নিজের স্বার্থে নিজের বোন কিংবা ভাগ্নে কাউকেই পরোয়া করলো না সে!

-চুপ করে আছিস কেন লেখা? তুই ভাবলিই বা কী করে ঐরকম ছেলেকে আমি মানবো? টাকা থাকলেই সব হয়না লেখা। তোর জন্য ভালো হবে ঐ ছেলের কথা ভাবা বাদ দে। আশফিনা আহমেদকে তুই ভালোমতোই চিনিস। ঐ মহিলা তোকে কোনোদিন সুখে থাকতে দিবে? নওশাদের সাথেই তোর বিয়েটা করতে হবে এমন কথা নেই তবে রঙ্গনের চিন্তা বাদ দে।

অর্ণব চিত্রলেখার কথার অপেক্ষা করলো না। ঘর ছেড়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। চিত্রলেখা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। আসলে হচ্ছেটা কী তার সাথে? তার জীবন নিয়ে কি সিনেমা চলছে? যে যা পারছে করেই যাচ্ছে তার সাথে! এবার সিদ্ধান্তটা নিতেই হবে তার। ভালো থাকার অভিনয় অনেক করেছে, এবার ভালো থাকার সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।

_________________________________

-লেখা, তোর কি উচিত না রঙ্গনকে সবকিছু জানিয়ে দেওয়া?

-রঙ্গন যখন সব জানতে পারবে, তখন সে এটাও জানবে যে সে আশফিনা আন্টির আসল ছেলে নয়। এ সত্যটা আন্টি লুকিয়ে রেখেছে এত বছর ধরে। আমার কারণে রঙ্গন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সঙ্কটে পড়ুক তা আমি চাইনা ভাবী।

-তো এখন কী করবি? অনিকের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছি না, ফোনটা যে কী করেছে! কোন বন্ধুর ওখানে উঠেছে তাও বলেনি। অর্ণব ভাইয়ের কথাবার্তাও কেমন জানি ঠেকছে। লেখা, তুই আদৌ ভেবেছিস কী করবি?

-হুম। ঘুমাবো।

চিত্রলেখা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সাথী কথা বাড়ালো না। দুপুরের পর থেকেই চিত্রলেখা এমন করছে। অপর্ণা বেশ খুশি, অর্ণবের হাবভাব বোঝা যাচ্ছে না। সাথী কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। ফোন হাতে নিয়ে রঙ্গনকে কল করবে কি করবে না ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো। চিত্রলেখা মেয়েটার জীবনে দুঃখ এত বেশি কেন ভেবে পায়না সাথী। বাবা থাকা সত্ত্বেও বাবার আদর পায়নি, এক ভাইয়ের স্নেহ যখন পেয়েছে তখন অন্যজন মুখ ফিরিয়েছে। একসাথে সুখ কখনো ধরা দেয়নি মেয়েটাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাথী। সেও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

সকাল সকাল অর্ণব তৈরি হচ্ছে। বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে সে, ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। চিত্রলেখা ঘর থেকে বেরোয়নি। অর্ণবও কথা বাড়ায়নি। নওশাদের সাথে চিত্রলেখার বয়সের গ্যাপটা সেও বুঝতে পেরেছে। জেনেবুঝে এমন ছেলের হাতে তো আর মেয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া সম্পর্কটাও গোলমেলে হয়ে যায়। ভাবীর চাচা হবে কিনা দুলাভাই! বলতেও অন্যরকম শোনায়। এসব নিয়ে আপাতত ভাবতেই চাইছে না অর্ণব। চিত্রলেখাকে খানিকটা ভয় দেখাতে চেয়েছিল সে যেন মেয়েটা ভালোবাসার মায়াজাল থেকে সরে আসে। জীবনের অন্যতম দুইটা বছরের মূল্য যেন বুঝতে শিখে। চিত্রলেখার বিয়ের আলাপ করে রঙ্গনের কথাটা জানতে পেরেছে সে। এতে অবশ্য সুবিধেই হলো। রঙ্গনের থেকে চিত্রলেখাকে যতটা পারা যায় দূরে রাখতে হবে। এসব ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো। আশেপাশে কাউকে না দেখে অর্ণব নিজেই গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই অপর পাশে রঙ্গনকে দেখে খানিকটা চমকালো সে। এত সকালে রঙ্গনকে নিজের বাড়ির সামনে মোটেও আশা করেনি সে। ভালোবাসা তবে এতটাও ঠুনকো নয় দুজনের, খানিকটা জটিলই বিষয়টা!

-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, ভেতরে আসতে পারি?

-কী দরকার তোমার? এখানে কেন এসেছো?

-ভাইয়া, বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে আলাপ করলে বিষয়টা ভালো দেখাবে না।

-ভেতরে এসো।

রঙ্গন আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকেই চোখজোড়া যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লো চিত্রলেখাকে খুঁজতে। বিষয়টা অর্ণবেরও নজর এড়ালো না।

-বোসো, কী দরকার বলো।

-ভাইয়া, আমি চিত্রলেখার সাথে একটু দেখা করতে চাই।

-ওর সাথে কী দরকার তোমার?

-ভাইয়া, আমি ওকে ভালোবাসি।

-তো?

-আমি বিয়ে করতে চাই ওকে। আপনার অনুমতি থাকলে..

-আমার অনুমতি নেই, তুমি আসতে পারো।

-কারণ জানতে পারি? এতটা অযোগ্য বোধহয় আমি নয়।

‘রঙ্গন!’ অর্ণব কিছু বলার আগেই চিত্রলেখা খানিকটা জোরেই চেঁচিয়ে উঠলো। রঙ্গন চাতক পাখির মতো সেদিকে তাকালো। চিত্রলেখার চোখ লাল। রঙ্গনের বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। সে ভাবতো এসব যন্ত্রণা বোধহয় কাল্পনিক তবে এ প্রথম সে অনুভব করলো অন্য কারো চোখের পানি তার বুকে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে।

চিত্রলেখার অর্ণবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রঙ্গনকে কিছু বলার সাহস না হলেও সে বাধ্য আজ। অর্ণবকে না আটকালে সে অবশ্যই রঙ্গনের জন্মপরিচয়ের কথা তুলবে যা রঙ্গনকে কোনোভাবেই জানতে দেওয়া যাবে না।

-ভাইয়া, আমি রঙ্গনের সাথে একটু কথা বলতে চাই শেষবারের মতো।

‘শেষবারের মতো’ বাক্যাংশটা রঙ্গনের কর্ণকুহরে কুৎসিত কোনো ঘণ্টার আওয়াজের ন্যায় বিশ্রি শব্দের ঝংকার তুললো। চিত্রলেখা শেষবারের মতো বলতে কী বোঝাতে চাইলো? চিত্রলেখা কি বিয়েতে রাজি? রঙ্গনের ব্যাকুলতা যেন ক্ষণিকেই বেড়ে গেল আকাশসম।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
ছত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

আশফিনা আহমেদ বিরক্ত বোধ করছেন তা তার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে। চিত্রলেখার কথায় তিনি এখানে আসার পাত্রী মোটেও নন তবে রঙ্গনের খাতিরে তাকে আসতে হয়েছে।

-চিত্রলেখা, যা বলার বলো। এভাবে ঘটা করে সবাইকে এক জায়গায় এনে বসিয়ে রেখেছো কেন?

-হিসাব মিলাচ্ছিলাম আন্টি। যাই হোক, কিছু কথা বলার ছিল আপনাদের উদ্দেশ্যে। আপনার সাথেই প্রথমে আলাপ সেরে নেই তবে।

চিত্রলেখার কণ্ঠস্বরে খানিকটা বিব্রতবোধ করলেন আশফিনা আহমেদ। অদ্ভুত এক তেজী স্বর! এটা কি চিত্রলেখার কণ্ঠস্বর? নাকি অন্য কেউ ভর করেছে তার মাঝে?

অপর্ণা এবার বেশ খানিকটা রেগে গেল। অর্ণব না থাকলে সে নির্ঘাত কষে একটা থাপ্পড় লাগাতো চিত্রলেখার গালে। আশফিনা আহমেদ আশেপাশের পরিস্থিতি বিবেচনায় বিচক্ষণতা ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

-কী বলতে চাও সাফ সাফ বলো।

-আপনার ছেলেকে আমি ভালোবাসি এ কথা আপনি জানেন আন্টি। আমায় আপনি পছন্দ করেন না সেটাও আমি জানি। আপনার ইচ্ছেটা আংশিক পূরণ হবে কারণ আগামী তিন বছরের জন্য আমি আপনার ছেলের থেকে একেবারে দূরে সরে যাচ্ছি। তিন বছর পর আমার সাথে সাক্ষাৎ করে যদি আপনার আপত্তি থাকে তবে আমি রঙ্গনকে বিয়ে করবো না।

-এটা কি তুমি ভেবে বলছো?

-জ্বী। আপনি রাজি?

-হ্যাঁ!

-বেশ তাহলে আপনার সাথে আমার কথা শেষ। আপনি এখন এই জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে ফিরতে পারেন।

আশফিনা আহমেদ চিত্রলেখার স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথায় অনেকটাই ঘাবড়ে গেছেন। মেয়েটা যে এতটা কাট কাট কথা বলবে তা তিনি ভেবে আসেননি।

“এসো রঙ্গন” আশফিনা আহমেদ রঙ্গনকে তার সাথে যেতে বললেন। রঙ্গন তখনো চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে আছে। তার নিজেকে পুতুল মনে হচ্ছে এখন।

-রঙ্গনের সাথে আমার কথা হয়নি আন্টি, ও একটু পরে আসুক? শেষদিন তো!

-বেশ।

আশফিনা আহমেদ কথা বাড়াতে চাইলেন না। এ বাড়ির পরিস্থিতি তার দম বন্ধ লাগছে। রঙ্গনকেও নিয়ে আসতেন তবে চিত্রলেখার কথায় অদ্ভুত একটা মায়া অনুভব করে আর বাড়তি কথা বললেন না। রঙ্গন মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। সাথী সবকিছু দেখছে কেবল। সে বোঝার চেষ্টা করছে রঙ্গনকে সব জানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা কতটুকু সঠিক ছিল। চিত্রলেখা এবার অপর্ণার মুখোমুখি দাঁড়ালো।

-ভাবী, যে লোকটার বিয়ের প্রস্তাব আপনি এনেছেন তাকে আপনি কিভাবে চেনেন?

-না চেনার কী আছে? উনি তো সাথীর চাচা হন। সেই সূত্রে…

-তাহলে ভাবীর চাচা মানে আমারও চাচা? তার সম্বন্ধ আপনি কেন আনলেন?

-আজব তো, উনি তোকে পছন্দ করে তাই..

-উনি আমাকে পছন্দ করে এ কথা আপনি জানলেন কী করে?

-কোর্টে যখন দেখা হয়েছিল তখন বলেছিলেন।

-কোর্টে যখন সবাই ছোট ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত ছিল তখন আপনি ওনার সাথে কথা বলেছেন? তাও আবার এ বিষয়ে? এতক্ষণ সময় ধরে তো কথা বলতে দেখিনি আপনাকে।

-তুই বলতে কী চাইছিস? আমি পরে ওনার সাথে কথা বলেছি। তখন উনি প্রস্তাব দিয়েছেন।

-এটা আপনি ভাইয়াকে জানিয়েছিলেন?

-ওকে জানাতে হবে কেন?

-সেটাই তো। ভালো কথা বলেছেন। আমিই কথা বলছি ভাইয়ার সাথে।

চিত্রলেখা অপর্ণার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। অপর্ণা আসলে চাইছে টা কী?

-ভাইয়া, আমি ভাবতাম তুমি আমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করো। পরিস্থিতি যেমনই হোক তুমি আমার পাশে থাকবে। হোস্টেলের ঘটনার সত্যতা একবারো আমার কাছে তুমি জানতে চাওনি। সে রাতে আদৌ আমার কাছে কেউ এসেছিল নাকি ঘটনা অন্যকিছু একবারো জানতে চেয়েছো? তোমার দোষ আমি দিচ্ছি না। সে রাতে আমার রুমমেটের বন্ধু এসেছিল এবং খুব সুনিপুণভাবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে যার প্রমাণ আমার কাছে নেই। এখন সবটা তোমাদের বিশ্বাসের উপর। রঙ্গন, আপনারও মনে হয় আমি কোনো ছেলেকে এনেছিলাম রুমে?

-আমি তোমাকে বিশ্বাস করি চিত্রলেখা তবে ভাইয়া শুধুমাত্র পরিস্থিতির কারণে…

-ব্যাখ্যা চাইনি রঙ্গন। আমার ব্যাখ্যা কেউ জানতে চায়নি একবারও, আমিও চাইনা। ভাইয়া, আমি কেন হোস্টেলে গিয়েছি জানো? তোমার বউয়ের মা আমাকে কল করে যা নয় তা বলেছে। আমি লজ্জায় এ বাড়িতে আর থাকতে পারিনি। এ কথা আমি বলতাম না কিন্তু আমার ধৈর্য শেষ। আমার সহ্যক্ষমতাও অবশিষ্ট নাই আর।

-মানে? এসব আগে বলিসনি কেন তুই?

-আগে বললে কী করতে? বিশ্বাস তো হারিয়েই ফেলেছি! ঐ নোংরা লোকটা আমায় রেপ করার চেষ্টা করেছিল এটা বিশ্বাস করেছো? করোনি! রঙ্গন বিশ্বাস করেছে ভাইয়া। আমার এক কথায় সে বিশ্বাস করে নিজের মামাকে আঘাত করেছে। ওর মাঝে আমি তোমার প্রতিচ্ছবি দেখি যে আমাকে আগলে রাখতে জানে। আমার ভালোবাসা কী ভুল ভাইয়া?

-লেখা, তুই ভুল বুঝিস না আমাকে। আমি পরিস্থিতি অনুযায়ী যা সঠিক মনে হয়েছে তাই ভেবেছি। আমি এখনো তোকে বিশ্বাস করি বলেই তোর সাথে হোস্টেলের ঘটনা নিয়ে কোনো কথা বলিনি।

-তোমার বউ বাকি কাজ করে দিয়েছে, তাইনা ভাবী? এলকায় খবর ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি তো? কষ্ট হয়েছে ভাবী? তুমিও তো একটা মেয়ে! আমার ভাবী হও তুমি? একটুও খারাপ লাগলো না?

অপর্ণা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার সাপের ন্যায় ফোঁস করে উঠলো। নিজের উপর আনীত অভিযোগ কাঁটার ন্যায় চুবছে তার শরীরে।

-একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবি না! নিজে কুকর্ম করে আমার ঘাড়ে দোষ চাপানো? লজ্জা করেনা?

-ভাইয়া, ভাবী যে একটা নতুন নেকলেস কিনেছে তা কি তোমায় দেখিয়েছে? দাঁড়াও আমি দেখাই।

চিত্রলেখা রূপসাকে ডাকলো। রূপসা ভেতরের ঘরে খেলছিল। চিত্রলেখার ডাকে দৌড়ে বাইরে আসলো।

-রূপ, আমাকে যে সুন্দর মালাটা দেখিয়েছিলে না ঐটা আনো তো পাখি।

-ঐ তো সুন্দরটা?

-হ্যাঁ।

-দাঁড়াও।

রূপসা দৌড়ে অপর্ণার ব্যাগ থেকে নেকলেসটা বের করে এনে চিত্রলেখার হাতে দিয়ে দৌড় দিল। অপর্ণার মুখ চুপসে যেতে সময় লাগলো না। অর্ণবের চোখ লাল হয়ে এসেছে। এসব যদি সত্যি হয় তবে আজ অপর্ণার সাথে সে কী করবে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে না।

-অপর্ণা, এটা তুমি কিনেছো?

-না, মা…মা দিয়েছে আমাকে। বাড়িতে গিয়েছিলাম না তখন মা…

-মিথ্যে বললে তোমাকে এই মুহুর্তে তালাক দিব আমি। কল দিব তোমার বাড়িতে? তোমার মাকে না, তোমার বাবাকে কল করবো। তিনিই বলবেন সত্যিটা!

-না…এ…এটা ন…নওশাদ চাচা দি..দিয়ে…

অপর্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে থাপ্পড় পড়লো অর্ণবের। একটা থাপ্পড়ে অর্ণবের রাগ ক্ষান্ত না হলেও সে নিজেকে স্থির করলো। আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি এখনো।

চিত্রলেখার এই প্রথম কাউকে কষ্ট পেতে দেখে আনন্দ হচ্ছে। অপর্ণা নামক মানুষটার প্রতি সে এতদিন ছোটখাটো ক্রোধগুলো জমিয়ে রাখতো যা আজ আগ্নেয়গিরিতে রূপ নিয়েছে। অপর্ণা আসলে ভুলে গিয়েছিল আগ্নেয়গিরি সুপ্ত থাকে ঠিকই তবে চিরকাল নয়। অর্ণব অপর্ণার দিকে পুনরায় হাত তোলার আগেই থামালো চিত্রলেখা।

-দাঁড়াও ভাইয়া, কথা তো শেষ হতে দাও। তারপর তোমার বউকে যা ইচ্ছে কোরো। আমার বলার তেমন কিছু নেই। আগামী তিন বছর সময় দরকার আমার। তোমার কাছে দুইটা রাস্তা খোলা। প্রথমত আমার মায়ের সমস্ত গয়না এবং আমার নামে লিখে দেওয়া মায়ের জমি আমাকে দেওয়া অথবা তিন বছরে আমার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ দেওয়া। আমি জানি তুমি এমনিতেও আমার পড়াশোনার খরচ দিতে অস্বীকার করতে না কিন্তু তোমার বউয়ের সমস্যা থাকতেই পারে আর কী!

-লেখা, তুই শান্ত হ। তারপর আমরা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবো।

-আমার শান্ত থাকার সময় আমি পার করে এসেছি ভাইয়া। তুমি কোনটা চাও বলো। আমার জমিজমা ফেরত দিতে নাকি পড়াশোনার খরচ?

-খরচ আমি দিব এবং জমিও তোর থাকবে। তুই নিজেকে শান্ত…

অর্ণবের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলো না চিত্রলেখা। রঙ্গন এতক্ষণ নোনা চোখে সবটা দেখছিল। চিত্রলেখা তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই সে খানিকটা ভীত হলো। অন্য সকলের মতো তার জন্যও কি অভিযোগ বাক্স ভরেছে চিত্রলেখা?

“আমার জন্য অপেক্ষা করবেন রঙ্গন? আগামী তিনটা বছর? আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি আপনাকে অপেক্ষা করাচ্ছি। আমার উপর ভরসা থাকবে তো আপনার? তিন বছর পর আপনার সামনে দাঁড়ালেও আপনার রঙ্গনা হয়েই থাকবো তো?” চিত্রলেখার আকুতি যেন রঙ্গনের বুকে এসে ধাক্কা দিল। রঙ্গনের ইচ্ছে করলো চিত্রলেখাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,”আমি জনমভর অপেক্ষা করবো, তুমি শুধু আমারই থেকো।”

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৩৩+৩৪

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
তেত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা এবং সঞ্চারী মাথা নিচু করে প্রিন্সিপাল ম্যামের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অহনা বাড়িতে চলে যাওয়ায় সে আপাতত নিরাপদে আছে। প্রিন্সিপাল আঞ্জুমান নাহার দুজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। চিত্রলেখার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। তিনি চিত্রলেখাকে বাইরে যেতে বললেন। চিত্রলেখা দ্রুত পায়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। ভয়ে তার হাত পা ক্রমাগত কাঁপছে। গতকাল রাতে তাদের রুমে কোনো একটা ছেলে ঢুকেছিল। চিত্রলেখা তখন গভীর ঘুমে। আচমকা দারোয়ানের চেঁচামেচি শুনে সে এবং সঞ্চারী বাইরে গিয়ে দেখলো দারোয়ান একটা ছেলেকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে আছে কিন্তু বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। ছেলেটা একদৌড়ে দেয়াল টপকে অপর পাশে চলে গেল। দারোয়ান নাকি দেখেছে ছেলেটা তাদের ঘর থেকেই বেরিয়েছে। হোস্টেল ইনচার্জ বিষয়টা প্রিন্সিপাল ম্যামকে জানিয়েছেন। চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারছে না ছেলেটা রঙ্গন কিনা। গত রাত থেকেই রঙ্গনের নম্বর বন্ধ। এ ঘটনার পর থেকে চিত্রলেখা বেশ কয়েকবার রঙ্গনের নম্বরে কল দিয়েছে। চিত্রলেখা না চাইলেও তার মুখে ভয় ফুটে উঠছে। যদি ছেলেটা রঙ্গন হয়ে থাকে তবে চিত্রলেখার জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।

-সঞ্চারী, গতকাল রাতে কী ঘটেছিল?

-ম্যাম, আমি ঘুমিয়েছিলাম। দারোয়ান চাচার চিৎকারে ঘুম ভেঙেছে। আমি উঠার পর লেখাকে দরজার কাছে দাঁড়াতে দেখে ওর কাছে যাই। বারান্দায় এসে দুজন দেখি দারোয়ান চাচার হাত থেকে একটা ছেলে দৌড়ে পালালো।

-তোমার কী মনে হয় লেখা ছেলেটাকে চিনতো?

-হয়তো ম্যাম। আগেও একটা ছেলে লেখার জন্য হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল রাতে। তাছাড়া গতকালকেও ওকে একটা ছেলে নামিয়ে দিয়ে গেছে ম্যাম।

-আচ্ছা তুমি যাও। আমি লেখার সাথে কথা বলবো।

সঞ্চারী বের হয়ে চিত্রলেখার পাশে দাঁড়ালো। চিত্রলেখা তখন দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। রঙ্গনকে নিয়ে চিত্রলেখার ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে চিত্রলেখার মন বলছে রঙ্গন আসেনি সে রাতে। রঙ্গন আসলে অন্তত তাকে জানাতো একবার। তবে কে এসেছিল? ভাবতে ভাবতেই প্রিন্সিপালের কেবিন থেকে ডাক পড়লো চিত্রলেখার। চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

-চিত্রলেখা বসো। তোমার সাথে কথা বলাটা দরকার এখন। হোস্টেলের কিছু নিয়ম নীতি রয়েছে। তুমি একটা স্বনামধন্য কলেজের শিক্ষার্থী। এ ধরনের আচরণ তোমার বেলায় শোভা পায়না। কল ইওর গার্ডিয়ান রাইট নাও।

-ম্যাম আমি কিছু জানিনা। আমি সত্যিই জানিনা ছেলেটা কে এবং কোথায় থেকে এসেছিল।

-সেই আলাপটা আমি তোমার অভিভাবকের সাথে করবো। তোমাকে যে বিকালে একটা ছেলে নামিয়ে দিয়ে গেছে এটা নিশ্চয়ই তোমার পরিবার এখনো জানেনা? একটা ছেলে তোমার জন্য হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে তা জানে তো?

-ম্যাম, এসব…এসব…

-মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই। যাও বাইরে যাও। তোমার অভিভাবক আসুক, আমি তার সাথেই কথা বলবো। আমিই তোমার অভিভাবককে জানাচ্ছি।

চিত্রলেখাকে আর কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হলো না। চিত্রলেখা বুঝতে পারলো না রঙ্গনের হোস্টেলের বাইরে দাঁড়ানোর কথা ম্যামের কানে গেল কী করে। এ কথা তো সঞ্চারী ছাড়া কেউ জানে না। তবে কি সঞ্চারী?

-সঞ্চারী? তুই কেন করলি এসব? রঙ্গন আসেনি রাতে! কে এসেছিল?

-আমি কীভাবে জানবো? তোর কোন প্রেমিক এসেছিল তুই জানিস!

-ছিঃ সঞ্চারী! তুই এতটা খারাপ হতে পারিস আমি ভাবতেও পারিনি। তুই এভাবে আমাকে কেন ফাঁসালি?

-তো নিজে ফাঁসতাম? অভিক এসেছিল আমাকে বার্থডে উইশ করতে। গাধার মাথায় তো বুদ্ধি নাই-ই। দেখ আমার নিজেকে বাঁচাতে হতো। এখন তুই কী করবি দেখ।

-তোকে আমি ভালো বন্ধু ভেবেছিলাম সঞ্চারী!

-আমি বলেছিলাম ভাবতে?

চিত্রলেখা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। এত বড় অপবাদ থেকে কিভাবে এখন নিজেকে বাঁচাবে সে? সঞ্চারীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে মরে গেলেও নিজের দোষ স্বীকার করবে! চিত্রলেখার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। সে এতটা দুর্বল কেন? পরিস্থিতিগুলো সবসময় তারই বিপরীতে কেন যায়? অর্ণবের কানে গেলে চিত্রলেখা কী করবে? সে কিভাবে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করবে?

____________________________

-মি.অর্ণব, আপনার বোনের সম্পর্কে যা যা শুনেছিলাম সব তো বললাম। বয়সটা তো ভালো নয়। এখন বরং ওকে কিছুদিন বাড়িতেই রাখুন। হোস্টেলের রুলস আমরা অমান্য করাটা উপেক্ষা করতে পারিনা। নেহাতই ও ভালো স্টুডেন্ট নাহলে হয়তো কলেজ থেকেও সাসপেন্ড করতাম। ওকে বাড়িতে নিয়ে যান।

-আচ্ছা ম্যাম। যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত।

-সমস্যা নেই, ওকে ভালোমতো বোঝান। অল্প বয়স তো, ভুলের দিকে যেতে সময় লাগেনা। আপনি আসতে পারেন। ধন্যবাদ।

-ধন্যবাদ ম্যাম আপনাকেও।

অর্ণব আঞ্জুমান নাহারের সাথে কথা বলে বাইরে গেল। চিত্রলেখার জিনিসপত্র গোছানোই ছিল। হোস্টেল ছাড়ার নোটিশ সে আগেই পেয়েছে। সঞ্চারী তার সামনে আসেনি আর। চিত্রলেখার ইচ্ছে করছিল সঞ্চারীকে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা একজন মানুষ কী করে করতে পারে? চিত্রলেখা কতটা বিশ্বাস করেছিল তাকে!

“চল!” অর্ণবের কণ্ঠে অভিমানের রেশ স্পষ্ট টের পেল চিত্রলেখা। চোখের জল বাঁধ মানতে চাইলো না তার। তবুও নিজেকে সামলে অর্ণবের পিছু পিছু চললো। তার এখন কিছুই করার নেই।

বাড়িতে পৌঁছে অর্ণব চিত্রলেখাকে নিজের ঘরে যেতে বললো। কলেজের ঘটনা কাউকে জানালো না অর্ণব। চিত্রলেখা একটা ভুল করে ফেলেছে, কথা বাড়ালে সে ভুল তো আর শুধরাবে না। অর্ণবের প্রচণ্ড রাগ হলেও সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে।

চিত্রলেখাকে জিনিসপত্র সহ ঘরে ঢুকতে দেখল অপর্ণাও। চিত্রলেখার আচমকা ফিরে আসা তার মনে খটকার সৃষ্টি করলো। চিত্রলেখাকে তার মা যেভাবে বলেছিল তাতে চিত্রলেখার তো হোস্টেল থেকে ফেরার কথা নয়। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। অর্ণবও কিছু বলছে না। অপর্ণা ঠিক করলো চিত্রলেখার হোস্টেলে খোঁজ নিবে সময় করে। আপাতত চিত্রলেখার গতিবিধির উপর নজর রাখতে হবে।

চিত্রলেখা ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র বিছানার উপর রেখে মেঝেতে বসে পড়লো। এতক্ষণের জমে থাকা কষ্টগুলো কান্না হয়ে ঝরছে অনবরত। আচমকা মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চিত্রলেখা মাথা তুললো। চোখ লাল হয়ে এসেছে তার। চিত্রলেখার এ রূপ সাথীর মনে ভয় ধরালো। এভাবে কাঁদছে কেন মেয়েটা? কী হয়েছে ওর?

-তুই এভাবে কাঁদছিস কেন লেখা? আর সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিস মানে তুই একেবারে বাড়িতে চলে এসেছিস! কাঁদছিস কেন তবে?

-ভাবী! আমার সাথেই কেন এমন হয় ভাবী? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে আল্লাহ? আর কত? আমি আর পারছি না ভাবী! আমার মৃত্যু হয়না কেন?

সাথী চিত্রলেখার ঠোঁটে হাত চাপা দিল। এসব কথা কেন বলছে মেয়েটা? সাথী কিছুই বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। চিত্রলেখাকে কোনোরকমে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে চিত্রলেখার। সাথীর স্নেহময়ী হাতের স্পর্শে চিত্রলেখার ক্ষত খানিকটা কমলো। চিত্রলেখা ফোঁপাতে ফোঁপাতে সবটা বললো। কলেজে কী কী হয়েছে আর সঞ্চারীর করা কাজটাও বললো সে। সাথী কী করবে বুঝতে না পেরে চিত্রলেখাকে বুকের সাথে লাগিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। মেয়েটার জীবনে দুঃখগুলো শেষ হয়না কেন? এতটুকু বাচ্চা মেয়ে, তার জীবনে কেন এত কষ্ট বারেবারে ফিরে আসে? মায়ের মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে মেয়েটা! হাহুতাশ করে সাথী।

দরজার আড়ালে থাকাটা লাভজনক হলো অপর্ণার। ঘটনাটা ঠিকই জানতে পারলো। এতে অবশ্য তার লাভটাই বেশি হয়েছে। এ ঘটনাটা ঘুরিয়ে প্যাঁচায়ে এলাকায় ছড়াতে পারলেই তার এবং নওশাদের পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। অপর্ণার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। চিত্রলেখাকে পথ থেকে সরানোর এর থেকে ভালো উপায় সে আর কখনো পাবে না। অপর্ণা ঠোঁটের হাসিটা লুকিয়ে একটা বাটি হাতে করে পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। পাশের বাড়িতে এক মধ্যবয়সী মহিলা থাকেন। রমনা নাম। মহিলার কাজই হচ্ছে এর বাড়ির খবর ওর বাড়িতে পৌঁছানো। নিকট ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তা স্পষ্ট দেখতে পারছে অপর্ণা। এখন আপাতত রমনাকে টোপটা গেলালেই তার কার্য সম্পন্ন!

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
চৌত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

“দেখো অর্ণব, আমি লেখার জন্য একটা পাত্র দেখেছি। ওকে বিয়ে দাও। এভাবে আমরা এলাকায় থাকবো কিভাবে? বিকেল থেকে দশ-বারোজন এসে রসালাপ করে গেছে চিত্রলেখার ঘটনা নিয়ে। আমরা বাড়ির মানুষ জানার আগে সমস্ত এলাকা জেনে বসে আছে যে চিত্রলেখা একটা ছেলেকে হোস্টেলে এনেছিল। এ কথা আরো পাঁচকান হলে কী হবে ভাবতে পারছো তুমি?” অপর্ণার কথাগুলো কাকের বিরক্তিকর ডাকের ন্যায় শোনাচ্ছে তবে কথার যৌক্তিকতা রয়েছে। চিত্রলেখার উপর অর্ণবের রাগ যেন ক্রমশ বাড়ছে। সৎ হওয়া সত্ত্বেও নিজ বোন অপেক্ষা একটুও কম যত্ন কি সে করেছিল? করেনি তো! হঠাৎ করে তার বোন এতটা কী করে বদলে গেল? অর্ণব একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিল।

-অপর্ণা, ছেলেকে আগামীকালই আসতে বলো। আমার পছন্দ হলে কালকেই বিয়ে পড়াবো। ছেলের নম্বর দাও, আমি কথা বলবো।

-ছেলেকে তুমি চেনোই, কথা বলতে হবে না। আমি জানিয়ে দিব, কাল দেখো।

-বেশ।

-লেখাকে কি জানাবো?

-না! ওর জানার প্রয়োজন নেই।

অর্ণব ঘুমোতে গেল। অপর্ণা অর্ণবকে খেতে ডাকলো না আর। অর্ণবের না খাওয়াটা খাবার টেবিলে খানিকটা প্রভাব তো ফেলবে। আজ আবার অনিক নেই বাড়িতে। সে থাকলে অবশ্য বিষয়টা জটিল হতো। বোনের প্রতি তার দরদ ইদানিং বেড়েছে। অনিক একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য ঢাকায় বন্ধুর বাসায় গেছে। তার ফিরতে কমপক্ষে দুদিন তো লাগবেই। এ সুযোগে নওশাদের বিয়ের প্রস্তাবটা পাকাপোক্ত হয়ে গেলে আর চিন্তার বালাই নেই। নওশাদ লোকটা টাকার কুমির। একবার শুধু বিয়েটা হোক। অপর্ণার ঠোঁটের হাসি ক্রমশ প্রশস্ত হয়। চিত্রলেখার এখন ঘর থেকে বের অবধি হতে পারবে না। বিকেল থেকে যত মহিলা এসে তার চর্চা করে গেছে, লাজ থাকলে এতক্ষণে গলায় দড়ি বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়া উচিত। তবে সাথী বোধহয় মেয়েটাকে একা ছাড়বে না আজ। আজ রূপসাও চিত্রলেখার কাছে যায়নি। সেও ফুপুর কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। বিষয়টা বেশ মজা লাগছে অপর্ণার। কূটবুদ্ধি থাকলে আসলেই দুনিয়া জেতা যায়।

_____________________________

-লেখা একটু খেয়ে নে।

-খাওয়ার মতো জায়গা অবশিষ্ট নেই ভেতরে ভাবী।

-আরো শখ আছে সহ্য করার? আমি নিশ্চিত এই কাজটাও তার! একটা মহিলা কতটা নির্লজ্জ …

-ভাবী ছাড়ো, পরচর্চা করে কী লাভ?

-তোর মধ্যে কি কিছুই নাই লেখা? মানে সিরিয়াসলি? তুই যে ঐ মহিলাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলি তার ফল দেখতেছিস? নাকি কানা হয়ে গেছিস?

-আল্লাহর উপর ভরসা রাখো ভাবী। সময়টা তার ভালো চলতেছে, আমার সময় কি আসবে না? আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। আমার একটু সাহায্য প্রয়োজন ভাবী। এখন আমার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই।

-কী হয়েছে? বল।

-ভাইয়া আমার ফোন নিয়ে নিয়েছে। আমার একবার রঙ্গনের সাথে কথা বলতে হবে ভাবী। আমি এখন ওকে এটুকু জানাতে চাই সে যদি আমার অপেক্ষা করতে পারে তবেই যেন আমার আশা করে। আমি এখন আমার স্বপ্নের সাথে আর প্রতারণা করতে পারবো না ভাবী।

-দেখ লেখা, তোকে কিছু কথা বলি। রঙ্গনের জন্ম লন্ডনে যতদূর আমরা জানি। ফুপু হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে ফুপার সাথে সেখানে পাড়ি জমান। বছর ঘুরে ফিরে আসেন রঙ্গনকে কোলে করে। যাওয়ার আগেও আমরা এসবের কিছু জানতাম না। রঙ্গনের জন্মের সময়কার কোনো ঘটনাই আমরা জানিনা। পরিবারের সবাই মুখে বিশ্বাস করে রঙ্গন আমার ফুপুর চেলে কিন্তু আদতে কেউই তা মানেনা। তুই বুঝতে পারছিস আমি কী বলতে চাইছি?

-ভাবী, আমি রঙ্গনের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই। আমার শৈশবটা যেন ওর জীবনের প্রতিচ্ছবি। তবে এসব নিয়ে আমি কিছু বলবো না। আমায় একটু সময় দাও। যদি সঠিক সময় আসার পর তোমরা অমত জানাও আমি এ সম্পর্কে আগাবো না।

-নে আমার ফোন থেকে কল কর কিন্তু সাবধান। ঐ ডাইনিটা জানলে আবার কেলেঙ্কারি বাঁধাবে।

চিত্রলেখা কিছু বললো না। চুপচাপ ফোনটা নিয়ে রঙ্গনের নম্বর ডায়াল করলো। মনে মনে খুব করে চাইলো রঙ্গনের নম্বরটা যেন খোলা থাকে। চিত্রলেখার মনের আশা পূরণ হলো না। রঙ্গনের নম্বর এখনো বন্ধ। চিত্রলেখার চোখ ছলছল করে উঠলো। প্রয়োজনের সময় কাউকে পাশে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা কি এমনই? রঙ্গনের উপর বিশাল অভিমান জন্মালো তার। রঙ্গনের নম্বরে একটা টেক্সট করে রাখলো চিত্রলেখা,
“ফোন অন করা মাত্র এই নম্বরে কল দিও। আমার নম্বরে কোনো কল বা মেসেজ করার দরকার নেই।
(রঙ্গনা)”

অতঃপর ফোনটা সাথীকে ফেরত দিল সে।

-নম্বর বন্ধ?

-হুম।

-সকালে চেষ্টা করিস। তুই ঘুমা এখন। খেতে বলরাম খেলিও না।

-তুমি যাও আমি ঘুমাচ্ছি।

-তুই ঘুমা, আমি এখানেই থাকবো আজ।

চিত্রলেখা কথা বাড়ালো না। সে বুঝতে পারছে তার ভাবী তাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে কিন্তু এ ভয়টা অযৌক্তিক। সে এত সহজে মরে যাবে না। এখনো তো অনেক কিছু বাকি আছে, অনেককে তাদের জায়গা চেনাতে হবে। চিত্রলেখার চোখ বন্ধ করলো।

_______________________

-ভাবী, সকাল সকাল এত রান্নাবান্না? কেউ আসবে?

-হ্যাঁ। তুই তাড়াতাড়ি গোসল করে তৈরি হ।

-মানে?

-সাথীকে বল তোকে রেডি করিয়ে দিতে। তোকে আজ দেখতে আসবে!

-আমাকে দেখতে আসবে? আমি তো জানিনা কিছুই এসবের।

-তোর ভাইয়া নিষেধ করেছে জানাতে, যা তৈরি হ তুই তাড়াতাড়ি।

চিত্রলেখার কী পরিমাণ অসহ্য লাগছে সে ব্যক্তও করতে পারবে না। তার ভাই শেষমেশ এতটাই অবিশ্বাস করলো তাকে? চিত্রলেখা সাথীর কাছে এসে বসলো।

-ভাবী, এসব কী হচ্ছে?

-আমিও সকালে উঠে জানলাম। সঙ সেজে কিছুক্ষণ বসে থাকিস, রিজেক্ট করে দিবনি আমরা পরে।

-আমার মন কু-ডাকছে ভাবী। প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে আমার।

সাথী কিছু বলার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। চিত্রলেখার বুক ঈষৎ কেঁপে উঠলো। রঙ্গন কল করেছে? সত্যিই রঙ্গন কল করেছে। চিত্রলেখা ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই তার গলা মিইয়ে আসলো। সে যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল।

-রঙ্গন কোথায় ছিলে তুমি? একটাবার আমার কল রিসিভ করা যেত না?

-স্যরি রঙ্গনা। আশ্রমে আগুন লেগেছিল গতকাল রাতে। ফোনের দিকে একদম নজর দিতে পারিনি।

-আশ্রমের সবাই ঠিক আছে?

-হ্যাঁ। কিছু জিনিসপত্রের ক্ষতি হয়েছে এই আর কী। তুমি বলো, কোনো সমস্যা হয়েছে?

-আমি সবকিছু এখন বলতে পারবোনা। তুমি শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে?

-তুমি যত সময় বলবে আমি অপেক্ষা করবো রঙ্গনা।

-আমি সিরিয়াস রঙ্গন। হতে পারে এটাই আমাদের শেষ কথা, এরপর ঠিক কত বছর পর আমি তোমার সাথে আবার কথা বলবো তা জানা নেই।

-লেখা কী হয়েছে? আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বলবে।

-আমি জানাবো তোমাকে। এখন যে ঝামেলা দুয়ারে এসেছে, তাকে বিদায় করতে হবে। রাখো।

চিত্রলেখা ফোন কান থেকে নামিয়ে রাখলো। সাথীর চোখেমুখে চিন্তার ভাঁজ।

-তোর রঙ্গনকে বলে দেওয়া উচিত। আল্লাহ না করুক অন্য কারো থেকে এসব জেনে তোকে ভুল বুঝলে?

-আমি রঙ্গনকে বিশ্বাস করি ভাবী। সে যদি অপেক্ষা করতে পারে তবে বিশ্বাসও রাখতে পারবে।

-তুই তৈরি হ। ছেলে আসলো বলে। এভাবে গেলে ভাইয়াও রাগ করবেন। বুঝতেই পারছিস বাড়ির যে অবস্থা!

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে সায় দিল। সাথীর মেলে রাখা শাড়িটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো সে। পরিস্থিতি বিপরীতে চলার বোধহয় কোনো সীমা অবশিষ্ট নেই। পৃথিবী কি তার বিপরীতে ঘুরছে এখন?

সবুজ বর্ণের শাড়িটা গায়ে মেলে বেরোলো চিত্রলেখা। অপর্ণা তাড়া দিচ্ছে। ছেলে নাকি আসলো বলে। চিত্রলেখা খানিকটা বিরক্ত হয়েই রান্নাঘরে ঢুকলো। অপর্ণার শকুনের মতো কণ্ঠটা তার কানে ঠোকর মারছে যেন।

-ভাবী, কিছু হেল্প লাগবে?

-হ্যাঁ, ছেলে আসছে বুঝছিস! এই চায়ের কাপটা নিয়ে যা। ছেলে একাই আসছে, এক কাপই নিয়ে যা।

-আচ্ছা।

চরম অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিত্রলেখা চায়ের কাপটা নিয়ে বসার ঘরের দিকে এগোলো। শাড়ির কুঁচি বারবার পায়ের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। বাধ্য হয়েই মাথা নিচু করে হাঁটতে হচ্ছে চিত্রলেখার। বসার ঘরে আসতেই চেনা এক কণ্ঠস্বরে বুক কেঁপে উঠলো চিত্রলেখার। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো সেই নরপশুর দৃষ্টি! সাথে সাথে চিত্রলেখার হাত থেকে চায়ের কাপ মেঝেতে পড়ে মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৩২

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
বত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

“কোনো এক সময় আমি তোমায় ভালোবেসেছিলাম চিত্রলেখা তবে তা একতরফা। একতরফা ভালোবাসাটা আমি আড়ালেই রেখেছি সবসময় কিন্তু মনের গহীনে তোমায় আর স্থান দিব না আমি। আজ এই একটা সইয়ের সাথে সাথে তোমার প্রতি আমার যে অনুভূতি ছিল, তাও আমি দাফন করলাম।” কথাগুলি মনে মনে আওড়ে কাবিননামায় সাক্ষর করলো সিয়াম। এখন থেকে সুবহাই তার জন্য হালাল, অন্য সকল অনুভূতিকে সে আর স্থান দিতে চায় না মনে। অন্তত চিত্রলেখার প্রতি নিজের অনুভূতিগুলোকে তো নয়ই, সে অনুভূতির কথা না সুবহা জানবে আর না চিত্রলেখা।

বিয়ে সম্পন্ন হতে হতে সাড়ে চারটা বাজলো। চিত্রলেখা প্রতিটা মুহূর্তে সুবহার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সুবহার চাহনিতে বুঝেছে সে, সিয়ামকে সুবহা একটু হলেও পছন্দ করে। বিয়ের সমস্ত দৃশ্য সুবহার বাবা ভিডিও কলে দেখলেন। তার চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়ালো। মেয়েটাকে তিনি অনেক শিক্ষিত করে তবেই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তবে সিয়ামের উপর তার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।

বিয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন হলেও চিত্রলেখার জন্য ভালোই বিপদ হলো। হোস্টেলে টাইমের আগে না ঢুকতে পারলে তো আর ঢুকতেই দিবে না। এখন রিকশায় গেলেও অনেক সময় লেগে যাবে। চিত্রলেখা গেল সুবহার কাছে বিদায় নিতে।

-সুবহা শোন, রাগ করিস না। আমার ফিরতে হবে। তোরা কাল চলে যাওয়ার আগে আমি এসে দেখা করে যাবো।

-কাল তো আমরা ভোরে চলে যাবো রে। তুই আজ থাক আমার সাথে।

-হোস্টেল থেকে বাড়িতে কল করবে তাহলে, ঝামেলা হবে রে। তাছাড়া আবার আসলে দেখা তো হবেই। নিজের খেয়াল রাখিস।

-তুই একা এখন রিকশায় গেলে সময়মতো পৌঁছাতে পারবি? তার চেয়ে ভাইয়া তোকে বাইকে রেখে আসুক।

-গাধার বাচ্চা, বর হয় তোর! ভাইয়া ডাকতেছিস তাকে! তাছাড়া আজ তোদের বিয়ে হয়েছে, আজকে তোরা সময় কাটা। আমি যেতে পারবো।

-তোকে রেখে আসতে ওনার বাইকে দশ মিনিট লাগবে। তুই চুপচাপ ওনার সাথে যা।

চিত্রলেখার কোনো কথাই শুনলো না সুবহা। সিয়াম তখন মাত্র বসেছিল। সুবহা তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।

-লেখাকে একটু রেখে আসো তো। বাইকে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবে।

-তাও ভালো ভাইয়া ডাকোনি! আচ্ছা সমস্যা নেই, রেখে আসছি। তুমি অপেক্ষা করো, আমি রেখেই আসবো। ভয় করবে না তো?

-আজব! বাচ্চা নাকি আমি?

-বাচ্চাই!

সিয়াম হাসতে হাসতে উঠে চলে গেল। চিত্রলেখার মুখোমুখি না হতে চেয়েও বারবার মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারটা বিব্রতকর হলেও কিছুই করার নেই তার, মানবিকতার খাতিরে হলেও সে চিত্রলেখাকে একা ছাড়তে পারে না।

সিয়াম বাইক স্টার্ট করলো। চিত্রলেখা খানিকটা দূরত্ব রেখেই বসলো। চিত্রলেখার হোস্টেলের সামনে এসে বাইক থামালো সিয়াম। অনেক কথা জমা থাকলেও তা আর কখনো বলা হবে না চিত্রলেখাকে, সে চায়ও না বলতে। তবে চিত্রলেখা বিদায়বেলায় একটা কথাই বললো সিয়ামকে।

-ভাইয়া, সুবহার খেয়াল রেখো। ও অনেক পাগলাটে স্বভাবের তবে ওর মতো ভালো তোমায় কখনো কেউ বাসবে না। আর হ্যাঁ ও কান্নাকাটি করলে আমার সাথে দেখা করাতে নিয়ে এসো, কেমন?

-অবশ্যই। তুইও নিজের খেয়াল রাখিস, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর আমি সুবহার টিসির জন্য বলেছিলাম কলেজে। বললো সামনের সপ্তাহে দিবে। টিসির পেপারটা তুই নিয়ে স্ক্যান করে পাঠাস আমাকে।

-আচ্ছা ভাইয়া।

-আচ্ছা এখন যা। আল্লাহ হাফেজ।

-আল্লাহ হাফেজ।

_______________________________

অপর্ণা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মায়ের বুদ্ধিটা ভালো তবে যথেষ্ট রিস্কি।তাছাড়া নওশাদ লোকটার ভরসা নেই। চিত্রলেখাকে তুলে নিয়ে গিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু করে যদি বলে আর বিয়ে করবে না তখন ঐ বোঝা নিজের ঘাড়েই বইতে হবে। অপর্ণা এই মতলবটা বাদ দিল। অন্য কোনোভাবে আগে অর্ণবকে রাজি করানোর চেষ্টা করতে হবে। সে রাজি না হলে তখন এইটা ব্যাক-আপ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আজ সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। অপর্ণা ঠিক করলো আগামীকাল বাচ্চাদের নিয়ে ফিরবে। অর্ণবকে জানানোর জন্য কল করলো সে কিন্তু অর্ণবের ফোন ক্রমাগত ওয়েটিং পেয়ে অপর্ণার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। রাগে জেদে ফোনটা বিছানার উপর ঢিল দিয়ে ছুঁড়লো সে।

বন্ধুর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা শেষ করে খানিকটা স্বস্তি পেল অর্ণব। ব্যবসার লস নিয়ে আলাপ করছিল। এর মধ্যে বন্ধু নয়ন বেশ ভালো একটা বুদ্ধি দিল। অল্প কিছু টাকা তার বন্ধুর কোম্পানিতে ইনভেস্ট করলে সে অনেক প্রফিট দিতে পারবে। অর্ণবের বেশ বিশ্বস্ত বন্ধু নয়ন। অর্ণব দুশ্চিন্তা করলো না। অবশেষে বোধহয় একটা সমস্যার সমাধান হতে চললো। ফোনের মিসড কল লিষ্টে অপর্ণার নম্বর দেখে ভ্রু কুঁচকালো অর্ণব। অপর্ণা এতক্ষণ ধরে কল করছিল তাকে! এখন কল ব্যাক করলে কী যুদ্ধ বাঁধাবে কে জানে তবুও অর্ণব কল ব্যাক করলো।

-হ্যালো অপর্ণা?

-কোন প্রেমিকার সাথে এতক্ষণ আলাপ করলে?

-বন্ধু কল করেছিল।

-মেয়ে নিশ্চয়ই?

-নাহ ছেলে! সবকিছু নিয়ে সন্দেহ করা বন্ধ করো। বেশি সন্দেহ করলেই অশান্তি বেশি!

-আমি কাল ফিরবো আর তোমার আসতে হবে না। আমি নিজেই যেতে পারবো।

বলেই খট করে কল কাটলো অপর্ণা। অর্ণবের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার। চিত্রলেখার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে তার আর চিন্তা থাকে না। আগে শুধু চিত্রলেখা ঘাড়ের উপর বসে খেতো, এখন অনিকও। টাকা জমানোর জায়গাই নেই আর। কোনদিন যে থালা নিয়ে রাস্তায় বসতে হয়! নানান ভাবনা চিন্তা করতে করতে টিভি অন করলো সে।

__________________________________

রাত সবে আটটা অথচ চিত্রলেখার ঘুম পাচ্ছে। বই হাতে নিলেই এখন তার ঘুম ধরে। চিত্রলেখার ইদানিং না পড়া রোগ ধরেছে, মোটেও পড়তে ইচ্ছে করে না। এরই মধ্যে আবার ফোনে মেসেজের শব্দ ভেসে উঠলো। ব্যস! পড়াশোনা রসাতলে। ফোন হাতে নিয়ে মেসেজটা চেক করতে লাগলো সে। রঙ্গনের মেসেজ।

-তুমি দেখিয়াও দেখলা না, তুমি শুনিয়াও শুনলা না! জ্বালায়া গেলা মনের আগুন, নিভায়া গেলা না।

-ফায়ার বিগ্রেড ডাকো।

-তুমিই সেই ফায়ার ব্রিগেড। এখন আগুন নেভাতে তুমি আসবা না আমি আগুনসমেত যাবো?

-পুড়তে থাকো। ফায়ার ব্রিগেড এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত।

-স্যরি স্যরি, পড়ো তুমি। ঘুমানোর আগে আমাকে জানিয়ো।

-স্যরি বলা লাগবে না। এমনিতেও পড়াশোনা হচ্ছে না আমার, মনোযোগই বসতেছে না। বই হাতে নিলেই ঘুম ধরে।

-এটার একটা সল্যিউশন আমার কাছে আছে। কতটা ইফেক্টিভ হবে তা জানিনা।

-কী?

-শোনো যখন ঘুম ধরবে তখন ঐ সাবজেক্টের যেকোনো একটা চ্যাপ্টারের খুব টাফ কোনো থিওরি বা ম্যাথ করার চেষ্টা করবা।

-এতে লাভ?

-আমরা যখন অল্পবিস্তর জানা জিনিস পড়তে যাই, তখন স্বভাবতই ঘুম ধরে তবে কোনো টাফ কিছু সামনে আসলে আমাদের ব্রেইন আরো এক্টিভ হয়। সবার ক্ষেত্রে আবশ্যক না এটা। আমার মতো অলস আবার টাফ প্রবলেম দেখেই ঘুমায়ে যায়। এজন্যই পাবলিকে হয়নি। এই দুই বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এরপর থেকে খুব বুঝে-শুনে তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবো। এখন সময় নষ্ট করা একদম উচিত না তোমার।

-আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। আমি পড়া শেষ করে ঠিক ঠিক দুই ঘণ্টার পর নক দিচ্ছি।

-আচ্ছা আমি অপেক্ষা করবো।

চিত্রলেখা ফোন রেখে পড়ায় মনোযোগ দিল। বেশ কিছুদিন ধরেই পড়া ঠিকমতো হচ্ছে না, আজ যে করেই হোক মনোযোগ রাখতে হবে। রঙ্গনের বুদ্ধিতে কাজ হলো। টাফ একটা থিওরি বুঝতে গিয়ে দু ঘণ্টার জায়গায় কখন তিন ঘণ্টা পেরিয়েছে খেয়ালই হলো না চিত্রলেখার। ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে পড়লো সে রঙ্গনকে অপেক্ষা করতে বলেছিল! চটজলদি ফোন হাতে নিল সে।

-রঙ্গন? ঘুমিয়ে পড়েছো?

রিপ্লাইয়ের আশা করলো না চিত্রলেখা। দুঘণ্টা পেরিয়ে তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে। এতক্ষণ নিশ্চিত রঙ্গন ঘুমিয়ে পড়েছে বা ব্যস্ত। চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে দেড় মিনিটের মাথায় রঙ্গনের রিপ্লাই আসলো।

-ভালোই মনোযোগ বসেছে বুঝলাম। এখন এগারোটা বেজে গেছে। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

-আপনি খেয়েছেন?

-তোমার তুমি, আপনি মিক্সড করে বলার অভ্যেস যাবে না? আমি খাবো এখন। তুমি খেয়ে ঘুমাও। শুভ রাত্রি।

-শুভ রাত্রি।

চিত্রলেখা কল রেখে সোজা ঘুমিয়ে পড়লো। খেতে ইচ্ছে করছে না তার। সুবহার ওখানে খেয়েছিল, তাতেই পেট ভরেছে। রঙ্গনের সাথে আজকের কাটানো দিনটা বারবারই মানসপটে ভেসে উঠছে তার। চোখ বন্ধ করলেই রঙ্গনের হাত ধরার মুহূর্তটা তার চোখের পাতায় ভেসে উঠছে। অস্বস্তি অথবা ভালো লাগা কোনো একটা অনুভূতি তাকে ক্ষণে ক্ষণে পীড়িত করছে।

রাত বারোটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। কালোরঙা হুডিতে আবৃত ছেলেটা দারোয়ানকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করলো। গার্লস হোস্টেলের দারোয়ান অথচ বারোটা বাজার আগেই ঘুম! একে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ভাবতে ভাবতে ছেলেটা খুব সাবধানে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো। কোনোরকম শব্দ না করে নীরবে এগোতে লাগলো তার প্রেয়সীর ঘরের দিকে।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৩০+৩১

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
ত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা তার মায়ের মুখোমুখি বসেছে। বাচ্চাদের খাইয়ে জোর করে ঘুমিয়ে দিয়ে মায়ের কাছে এসেছে সে। দুপরের রোদ খুব একটা কড়া না হলেও আজ অন্যদিনের তুলনায় শীত কম। অপর্ণার মা আনজুমান কিছুক্ষণ পর পর ঠাণ্ডা পানি খাচ্ছেন। মায়ের এ আচরণে বিরক্ত অপর্ণা। সে এসেছে শলা-পরামর্শের জন্য সেখানে তার মা কিছু বলছেই না!

-মা, তুমি কিছু তো বলো। কিভাবে কী করবো একটু তো বুদ্ধি দাও আমাকে। চিত্রলেখার বিয়ে ঐ লোকের সাথে না দিলে শেষে আমার নেকলেসটাও হাতছাড়া হবে।

-আহা চুপ কর তো অপু, বেশি অধৈর্য তুই। আমাকে ভাবতে দে আগে। ঐ বুড়োটার সাথে তোর বর জীবনেও বিয়ে দিতে রাজি হবে? কোনো চাল চালতে হবে যেন ও নিজে রাজি হয় বিয়ে দিতে।

-সেইটাই বলো। কি চাল চালবো বলো।

আনজুমান আবার ঠাণ্ডা পানির গ্লাসে ঠোঁট ঠেকালেন। মতলব তো তার মাথায় আছে তবে বিষয়টা জটিল হয় কিনা এ ভয়ে তিনি বলতে পারছেন না।

-শোন, বুদ্ধি একটা আছে তবে এটার দায়ভার তোর উপর। তুই কাজটা করবি কিনা তুই ভেবে দেখ!

-আগে বলো তো কী বুদ্ধি।

-লোকটা তো প্রভাবশালী বললি, তো ঐ বুড়োকে বর লেখাকে একরাতের জন্য তুলে নিয়ে যেতে আর পরেরদিন ভোরবেলায় যেন বাড়ির সামনে ফেলে যায়। মহল্লার মানুষ একবার এ ঘটনা দেখলে ঐ বুড়ো ছাড়া কেউই লেখাকে বিয়ে করতে আসবে না।

-বুদ্ধি তো খারাপ দাওনি মা কিন্তু ঐ বুড়ো রাজি হবে?

-সেটা তোর বোঝার ব্যাপার। বুদ্ধি চেয়েছিস দিয়েছি। এখন যা, তোর বাবা আসলো বলে।

অপর্ণা মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। নওশাদকে কোনভাবে রাজি করাতে হবে এই প্ল্যানটাতে। ফুরফুরে মেজাজে নিজের ঘরের দিকে চললো সে।

______________________

চিত্রলেখার অদ্ভুত রকমের সংকোচ বোধ হচ্ছে। আশফিনা আহমেদ মানুষটা বড্ড আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। তার সামনে চিত্রলেখার নিজেকে বড্ড দুর্বল মনে হয়। এমনিতে সে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে আর আশফিনা আহমেদের সামনে এ সমস্যাটা বোধহয় আরো বাড়লো। ভয়ে তার হাত পা কাঁপতে লাগলো। আশফিনা আহমেদ না চাইলে সে কখনো রঙ্গনকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখবে না। মায়ের অসম্মতিতে ছেলের হাত ধরার মতো কাজ সে করতে চায় না।

-কেমন আছো চিত্রলেখা?

-জ..জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

-ভয় পেয়ো না। তোমায় আমি কিছু বলতে চাই এবং তোমার জন্য কিছু প্রশ্ন আছে আমার কাছে।

-জ্বী।

-তুমি রঙ্গনকে ভালোবাসো?

চিত্রলেখা উত্তর দিতে পারছে না। এখন অবধি রঙ্গনকেই সে নিজের মনের কথা বলতে পারেনি। সে ভয় পায়, মারাত্মক ভয়। রঙ্গন আর তার কোনো মিল আছে? আকাশ-পাতাল তফাত! সেখানে জমিনে থেকে রঙ্গনকে ছুঁতে চাওয়ার সাধ্য কি তার আছে? সে কখনো পারবে না এ প্রশ্নের উত্তর দিতে।

-পারিপার্শ্বিক চিন্তা বাদ দিয়ে বলো চিত্রলেখা। তুমি শুধু তোমাকে মনের কথাটুকু আমাকে বলো।

-আমি রঙ্গনের উপস্থিতিতে ভালো থাকি। এ অনুভূতির নাম আমার জানা নেই। আমার পক্ষে রঙ্গনকে চাওয়া বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার মতো। সে আমার ভাগ্যে নেই আমি বুঝি।

-আমি বুঝতে পেরেছি তুমি রঙ্গনকে ভালোবাসো। এখন তোমার সাথে আমি এমন কিছু কথা শেয়ার করবো যা রঙ্গনও জানে না। আমি চাইবো এ কথা যেন আমাদের মধ্যেই থাকে। রঙ্গন যদি ভুলেও এ কথা কোনদিন জানতে পারে, সে দিনটা হবে তোমার জীবনের শেষ দিন।

আশফিনা আহমেদ বেশ শান্তস্বরে কথাটুকু বললেও চিত্রলেখার অন্তরাত্মায় কম্পন সৃষ্টি হলো। নিউক্লিয়ার বোমার মতো এ মহিলার মুখনিঃসৃত কথা। ঠিক কিভাবে আহত করবে আর কতটা আহত করবে তার নিশ্চয়তা নেই।

-চিত্রলেখা তুমি একটু স্বাভাবিক হও যেন আমি নির্দ্বিধায় কথাগুলো বলতে পারি।

-জ্বী জ্বী বলুন।

-রঙ্গনের বয়স এখন চব্বিশ, একেবারে বেশিও না। ম্যাচিওরিটি ওর মধ্যে আছে তবে সময় আর মানুষভেদে ওর আচরণগুলো বদলে যায়। আমার বিয়ের পর প্রায় ছয় বছর আমি নিঃসন্তান ছিলাম। তখন রঙ্গন আমার জীবনে আসে খুব অদ্ভুতভাবে। আমরা ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরছিলাম। তিনি বলেছিলেন আমার মা হওয়ার সম্ভাবনা পাঁচ শতাংশেরও নিচে। মারাত্মক ভেঙে পড়েছিলাম। ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার সময় একটা রাস্তার ধারে হঠাৎ আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। সে মুহূর্তেই একটা বাচ্চার কান্নার স্বর আমার কানে আসে। মাতৃত্বের তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত অভাগী আমি গাড়ি থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকালাম। তখনো ডিসেম্বরে মাস ছিল। একটা নবজাতক শিশুকে কাপড়ে মুড়ে রাস্তার এককোণে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল। আমি সেদিন বাচ্চাটাকে কোলে জড়িয়ে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম তার ইয়ত্তা নেই। মাশরুর সাহেব আমাকে পরবর্তীতে দেখানোর জন্য মুহূর্তটার ছবি তুলেছিলেন। ছবিটা আমি অ্যালবামে রাখলেও কখনো রঙ্গনকে দেখাতে পারিনি। আমার ছয় বছর কান্নার পর আল্লাহ তাআলা আমার বুকে রঙ্গনকে পাঠিয়েছিলেন।

চিত্রলেখা স্তব্ধ হয়ে গেল। রঙ্গন তাদের আসল সন্তান নয়? তবে রঙ্গন কে? কি তার পরিচয়? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলেও চিত্রলেখা যেন একটু স্বাভাবিক হলো। রঙ্গনের জন্য তার অনুভূতিতে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়লো না বরং প্রখর হলো তার অনুভূতির ভাণ্ডার।

-আমি কী বললাম বুঝতে পেরেছো?

-জ্বী আন্টি বুঝেছি।

-এখন বলো, এ সত্যি জানার পরেও তুমি রঙ্গনকে ভালোবাসো? বিয়ে করতে পারবে তাকে? তোমার পরিবার মানবে?

-আমি রঙ্গনকে অনেক বেশি ভালোবাসি। উনি যেমনই হোক, ওনার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমবে না।

আশফিনা আহমেদ খেয়াল করলেন চিত্রলেখা প্রতিটা শব্দ জোর দিয়ে বলছে। রঙ্গনের প্রতি তার ভালোবাসা যেন অকস্মাৎ বেড়ে গেছে। যে উদ্দেশ্যে তিনি এসেছিলেন, তা সফল হলো না বুঝতে পেরে আশফিনা আহমেদের চোখের চাহনি বদলাতে থাকলো। চিত্রলেখার উপর তার ক্রোধের আগুন মিশ্রিত দৃষ্টি পড়লো। তাতে অবশ্য চিত্রলেখার যায় আসলো না। সে এখন নিশ্চিত রঙ্গন নামক মানুষটার পাশে সে থাকবেই তবে তাকে তার সত্যিটা না জানিয়ে।

-এ কথাগুলো রঙ্গন যেন না জানে।

-আমি রঙ্গনকে কখনো এসব জানতে দিব না আন্টি, বিশ্বাস রাখুন আমার উপর।

আশফিনা আহমেদের মন গললো না। রুক্ষ মেজাজেই তিনি চিত্রলেখার সামনে থেকে চলে গেলেন। চিত্রলেখা তখন একাকী ক্যাফের টেবিলটাতে বসে। আচমকা সে ফোন বের করে রঙ্গনের নম্বরে ডায়াল করলো।

মানসিক অবসাদে জর্জরিত রঙ্গন চিত্রলেখার কলে খানিকটা প্রাণ ফিরে পেল। নওশাদের কথা এখনো চিত্রলেখাকে জানায়নি সে। চিত্রলেখার প্রতিক্রিয়াটা সামনাসামনি দেখতে চায় বিধায় জানানোতে বিলম্ব করছে সে।

-হ্যালো চিত্রলেখা, কিছু বলবে?

-হুম। আপনি একটু ‘ক্যাফেকাপ’ এ আসতে পারবেন কিছু সময়ের জন্য?

-আসছি। অপেক্ষা করো একটু।

-একটু শুনুন।

-বলো।

-সাদা রঙের শার্টটা পড়ে আসতে পারবেন?

-হুম। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি। রাখো।

-আচ্ছা রাখলাম।

রাখলাম বলার পরে চিত্রলেখা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। রঙ্গন কল কাটলো না। শেষমেশ চিত্রলেখা নিজেই কল কেটে দিল। রঙ্গনের এই ছোট ছোট বিষয়গুলোও এখন তার মনে অনুভূতির ফোয়ারার সৃষ্টি করছে। রঙ্গন কি বুঝতে পেরেছে চিত্রলেখা তাকে কেন ডাকলো এভাবে? বুঝতে পারার তো কথা না!

ক্যাফেতে আসতে রঙ্গনের কাঁটায় কাঁটায় ত্রিশ মিনিট লাগলো। একে তো জ্যাম তবুও রঙ্গন সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তাড়াতাড়ি আসার। চিত্রলেখার মুখোমুখি বসলো সে। চিত্রলেখা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। শুভ্র রঙটা বড্ড মানায় রঙ্গনকে। ছেলেটা কি জানে সৃষ্টিকর্তা তাকে কতটা মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী করেছেন! রঙ্গনের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। নিঃশ্বাসের ক্রমশ উঠা-নামার মাঝখানে চিত্রলেখা তার এক হাত রঙ্গনের হাতের উপর রাখলো। রঙ্গনের মনে হলো সে বোধহয় ছোটখাট একটা বৈদ্যুতিক শক খেল। চিত্রলেখার দিকে তাকানোর মতো অবস্থাতেও নেই সে। নিজেকে প্রচণ্ড অস্থির লাগছে তার। পরবর্তী ধাক্কাটা বেশ জোরেসোরেই লাগলো চিত্রলেখার বলা বাক্যটাতে।

“আমি সারাজীবন তোমাকে তুমি বলে ডাকতে চাই, রঙ্গন!” বাক্যটুকু রঙ্গনের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে দেরি হলো তবে রঙ্গনের হৃদস্পন্দন থেমে যেতে সময় লাগলো না। মাথা ঘুরাচ্ছে তার। এই বোধহয় সে পড়ে যাবে। রঙ্গন অনুভব করলো চিত্রলেখা ব্যতীত সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
একত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

“স্যার কী অর্ডার করবেন আপনারা?” ওয়েটারের কথায় ঘোর কাটলো রঙ্গনের। চিত্রলেখার ঘোরে সে মোহিত ছিল এতক্ষণ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ক্ষণিকের মুহূর্তটা সে উপভোগ করছিল এতক্ষণ। রঙ্গনের এখন এই ক্যাফের চার দেয়ালে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

-দুই কাপ কফি তবে ওয়ান টাইম মগে দিয়েন ভাইয়া।

-স্যরি স্যার তাহলে আপনাদের কফি কাউন্টার থেকে নিতে হবে।

-আচ্ছা ধন্যবাদ।

রঙ্গনের চোখের ঔজ্জ্বল্য বলে দিচ্ছে সে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে। নিজেকে শান্ত করার কোনো সঠিক পদ্ধতি যেন সে খুঁজে পাচ্ছে না।

-তুমি বসো, আমি কফি আনছি।

চিত্রলেখা উত্তর দেওয়ার অবকাশ পেল না। রঙ্গন তড়িৎ গতিতে কাউন্টারের দিকে এগোলো। চিত্রলেখা রঙ্গনের কীর্তিকলাপে হাসছে। এতটা অস্থির রঙ্গনকে কখনো কি দেখেছিল সে?

কাউন্টারে এসেও রঙ্গনের অস্থিরতা কমলো না। বারবার নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করছে সে।

-স্যার এনি প্রবলেম?

-না না, দুই কাপ হট কফি প্লিজ।

-নাম কী লিখবো স্যার?

-একটাতে রঙ্গন আর…আরেকটাতে ‘রঙ্গনা’ লেখো।

দুই কাপ কফি নিয়ে বিল পে করে রঙ্গন চিত্রলেখার মুখোমুখি বসলো। চিত্রলেখা মগের উপর ‘রঙ্গনা’ লেখাটা খেয়াল করে মুচকি হাসলো।

-বাইরে হাঁটতে হাঁটতে কফি খাই আমরা?

-হ্যাঁ চলুন।

চিত্রলেখা রঙ্গনের উচ্ছ্বাস দেখে কেবল মুগ্ধ হচ্ছে। তার বলা একটি বাক্যে ছেলেটা এতটা অস্থির হয়ে উঠবে সে ভাবেইনি।

-চিত্রলেখা, তোমার একটা কথায় আমি এতটা অস্থির হইনি। আমি অস্থির হয়েছি তোমার চোখের চাহনিতে।

-আপনি কী করে বুঝলেন আমি এটাই ভেবেছি?

-আমি উত্তর দিব না। তুমি আপনি করে বলেছো।

-আচ্ছা স্যরি। তুমি কী করে বুঝলে আমি এটাই ভেবেছি?

-তোমার মুখের হাসি বলে দিয়েছে। তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি রঙ্গনা!

‘রঙ্গনা’ ডাকটা শুনে খানিকটা শিওরে উঠলো চিত্রলেখা। উষ্ণ এক মধুর হাওয়া যেন তার কানের কানে এসে স্পর্শ করলো।

-কী কথা?

-মামা হাসপাতালে আছে। গতকাল কে যেন তাকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।

-ওহ আচ্ছা।

রঙ্গন ভাবলেশহীনভাবে বললো কথাটুকু। চিত্রলেখা হাসলো। এই কেউ একজনটা কে তা বুঝতে তার সময় লাগেনি। রঙ্গনকে কি বলা উচিত তার এ কথা?

-একটা কথা কী জানো রঙ্গন? আমি অন্যদের মতো বলবোনা তুমি কখনো মারামারি করো না, ঝামেলায় জড়িয়ো না। আমি চাইবো তুমি প্রতিবাদ করো। নওশাদ নামক লোকটার প্রাপ্য শাস্তি সে পেয়েছে। আমি কখনোই তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলবো না সে তোমার মামা হয়, তার সাথে এমন করা অনুচিত।

-তুমি বড্ড আলাদা রঙ্গনা। সবসময় এমন থেকো আর আমার পাশে থেকো।

চিত্রলেখা মুগ্ধ দৃষ্টিতে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে তার এক হাত নিজের এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো। রঙ্গনের মনে হলো সে বোধহয় ক্ষণিকের জন্য জমে গেল। এ মুহূর্তটা কি কোনোভাবে থামানো যায়? রঙ্গনের মাথায় সে চিন্তা ভর করলো।

_______________________

-সুবহা, আমি ঠিক করেছি আঙ্কেল হাসপাতালে থাকা অবধি আমরা রাজশাহীতে থাকবো এবং সব গুছিয়ে নিব। আঙ্কেল সুস্থ হয়ে ফিরলে আঙ্কেল আন্টিকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবো।

-আচ্ছা। আমাদের বিয়ের কথাটা লেখাকে জানালে হতো না একবার?

-জানাও, অসুবিধা নেই তো। তবে আন্টি যেহেতু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বলতে বলেছে, আন্টিকে এটা জানানোর প্রয়োজন নেই যে তুমি লেখাকে ডেকেছো আজ।

-আচ্ছা। থ্যাংকস কিন্তু তুমি আমাকে তুমি করে ডাকছো কেন ভাইয়া?

-তুই যাতে ভাইয়া না ডাকিস সেজন্য। আর ঘণ্টা দেড়েক পর বিয়ে আর তুই আমাকে ভাইয়া ডাকতেছিস!

সুবহা মুখ টিপে হাসলো। রেহানা সুলতানা হাসপাতালে আছেন। সুবহার বাবার শরীরটা আগের চেয়ে একটু ভালো। বিয়ের দৃশ্যটুকু যেন ফোনের স্ক্রিনে হলেও তিনি দেখতে পারেন তাই সুবহার মা হাসপাতালেই আছেন। সুবহা চিত্রলেখার সাথে কথা বলার জন্য ফোন হাতে নিল। সিয়াম নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে এ মুহূর্তে। যত যাই হোক, চিত্রলেখার সামনে নিজের পূর্ব অনুভূতির বিন্দুমাত্রও প্রকাশ করতে চায় না সে। সুবহার সাথে নিজের নতুন জীবনের সূচনালগ্নে প্রাক্তন অনুভূতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করা শোভা পায় না।

রাস্তার এক পাশে ব্রিজের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রঙ্গন এবং চিত্রলেখা। আচমকা চিত্রলেখার ফোন বেজে উঠলো। চিত্রলেখার ধ্যান ভাঙলেও রঙ্গন বেমালুম চিত্রলেখার দিকেই তাকিয়ে রইলো। চিত্রলেখা ফোন রিসিভ করলো।

-সুবহা, আঙ্কেল সুস্থ আছেন?

-হ্যাঁ শোন। রাগ করিস না, একটা খুব সিরিয়াস কথা আছে।

-বল।

-না ফোনে না, তুই আধঘণ্টার মধ্যে আমার বাড়িতে আয়।

-তুই ঠিক আছিস তো? তোর কিছু হয়নি তো?

-আমি ঠিক আছি, তুই প্লিজ আয়।

খট করে কলটা কেটে দিল সুবহা। চিত্রলেখার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত মুখে রঙ্গনের দিকে তাকাতেই দেখলো রঙ্গন ফোনে কিছু একটা করছে। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তাকানোর পর বুঝলো রঙ্গন তার ছবি তুলছে। বুঝতে পেরেই দুহাতে মুখ লুকালো সে।

-আরে! ছবিটা সুন্দর আসছে, এটা আমার সিক্রেট ফোল্ডারে থাকবে।

-আচ্ছা শোনো, সুবহা ডেকেছে আমাকে। আমার যেতে হবে একটু। তাছাড়া এখন আড়াইটা বাজে। তুমিও বাসায় যাও।

-চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি রিকশা করে।

-আমি যেতে পারবো তো।

-প্রথম প্রেমের পর প্রথম রিকশায় ওঠার দিনটা একই হোক। একটু প্রোটেক্টিভ তো হতে দাও!

রঙ্গনের ছেলেমানুষের মতো আবদারে চিত্রলেখার মুখে হাসি ফুটলো। আজ একদিনে সে যতটা খুশি হয়েছে, তা কি সে এত বছরের জীবনে কখনো হতে পেরেছিল? প্রথম প্রেমের অনুভূতি কি এমনই হয়?

রঙ্গন রিকশা ডাকলো। চিত্রলেখা সাবধানে রিকশায় বসলো। রঙ্গন আগের মতোই কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো। চিত্রলেখা এখন তার প্রেমিকা তবুও সে চিত্রলেখার কমফোর্ট জোনের খেয়াল রাখতে চায়। সে তো প্রেমিক হওয়ার আগে চিত্রলেখার প্রিয় বন্ধু হয়ে থাকতে চায় সবটা সময়।

-রঙ্গন, আপনার বোধহয় বাড়িতে ফেরা উচিত ছিল।

-আপনি?

-হুম। সবসময় তুমি বললে ‘তুমি’ শুনতে আর ভালো লাগবে না।

-কে বলেছে তোমাকে? তোমার মুখে ‘তুমি’ শব্দটা আমি জনমভরে শুনলেও বিরক্ত হবো না। বুঝেছো রঙ্গনা?

-বুঝলাম। অহম কেমন আছে?

-তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। কবে নিয়ে আসবো বলো।

-আজকে যেহেতু দেখা হলো, এ সপ্তাহে আমার বেশি বেরোনো ঠিক হবে না। সামনের সপ্তাহে দেখা করি?

-মানে এক সপ্তাহ তুমি দেখা করবে না? আমি ঢাকা ফিরে গেলে মিস করবা দেখো!

-দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসা কমে?

-আমার ভালোবাসা তোমার ফিজিক্সের নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ বলের মতো না যে দূরত্ব বাড়লেই কমে যাবে! আমার ভালোবাসা তিনটে সূত্রে সীমাবদ্ধ না, আমার ভালোবাসা সাহিত্যের মতো বিস্তর।

-আপনার নিজেরই তো সাবজেক্ট ফিজিক্স!

বলেই জিভ কাটলো চিত্রলেখা। মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। এবার নিশ্চিত রঙ্গন জেরা করবে সে কিভাবে জানলো।

-তো তুমি স্টক করতে আমাকে?

-না স্টক না ঠিক…একদিন দেখেছিলাম আর কী!

-বুঝেছি ম্যাম।

চিত্রলেখা লজ্জা পেল। এভাবে ধরা না পড়লেও তো পারতো! বেশি কথা বলা এজন্যই উচিত না। সুবহার বাড়ির গলিতে এসে রঙ্গন নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল। চিত্রলেখার থেকে বিদায় নিলো চোখে চোখে। রঙ্গনের চোখে বিদায়ের বিষাদটা বোধহয় আজ একটু বেশিই দেখলো চিত্রলেখা।

সুবহার বাড়ির সামনে রিকশা থামলো। চিত্রলেখা নেমে কলিং বেল বাজাচ্ছে। ভেতর থেকে কারো সাড়াশব্দ নেই।

-দরজাটা খোলো তো ভা….

-ভাইয়া বলা লাগবেনা খুলতেছি। রেডি হ তুই।

সিয়াম চাইছিল না দরজা খুলতে তবে আজ হোক কিংবা কাল মুখোমুখি তো হতেই হতো। সিয়াম যত তাড়াতাড়ি চিত্রলেখাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে, ততটাই ভালো তার জন্য। দরজা খুললো সে।

সিয়ামকে পাঞ্জাবি পড়া দেখে চিত্রলেখা খানিকটা হতভম্ব হলো। এভাবে বর সেজেছে কেন সে? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরলেও বলতে সংকোচবোধ হলো। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই সুবহা ছুটে এলো। সুবহাকে দেখে চিত্রলেখার বিস্ময় আরো বাড়লো।

চলবে..

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২৮+২৯

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
আটাশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা খানিকটা বিরক্তবোধ করছে। নওশাদের অফিসে সে এসেছে তাও ঘণ্টা দুয়েক হবে অথচ তাকে এখনো হলে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু বলতেও পারছে না। এবার অপর্ণা খানিকটা বিরক্ত হয়েই নওশাদের নম্বরে কল দিল।

-এসব কী নওশাদ সাহেব? আমাকে অফিসে ডেকে এভাবে বসিয়ে রাখার মানে কী? আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।

-আপনি ভেতরে আসুন। কেউ আটকাবে না।

অপর্ণা খট করে কল কেটে বেশ রাগী ভঙ্গিতে নওশাদের কেবিনে ঢুকলো। নওশাদ অপর্ণার আসার অপেক্ষায় ছিল তবুও অপর্ণাকে বাইরে বসিয়ে রেখেছিল ইচ্ছে করেই। অপর্ণা নওশাদের মুখোমুখি বসলো।

-ভালো আছেন অপর্ণা ভাবী?

-ভালো আর কই থাকলাম ভাই। যার দেবর কয়দিন আগে জেল থেকে বেরোলো তার কী আর ভালো থাকা যায়? মানুষ থাকতে দেয় ভালো?

-অযথা চিন্তা করতেছো অপর্ণা! অনিককে দুয়েকদিন এসব ঝামেলা সহ্য করতে হতে পারে। তোমাকে যে কারণে ডাকছি সেটা শোনো।

-জ্বী বলেন!

-লেখাকে আমার পছন্দ। বলতে গেলে বিয়েতে আমার আপত্তি নেই। বুঝতেই পারতেছো। এখন চিত্রলেখার আপত্তি থাকতে পারে। সেসব দেখার বিষয় তোমার। বিয়েটা যদি ঠিকমতো হয়, তাহলে লেখা সুখেই থাকবে। পাশাপাশি তোমাদেরও সুখের অভাব হবে না। বোঝোই তো।

-সব ঠিকই আছে কিন্তু আপনার বয়সটা..বুঝতেই পারছেন। এসব ম্যানেজ করতে হবে তো। আপাতত ভাবী হিসেবে কিছু উপহার তো পেতেই পারি।

নওশাদ হাসলো। এই মহিলা যে লোভী তা সে আগেই বুঝেছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও করেছে। ড্রয়ারে থাকা নেকলেসটা বের করে অপর্ণার হাতে তুলে দিল।

-ভাবীসাহেবা, আরো উপহার কিন্তু অপেক্ষা করছে। আপনি শুধু বিয়ের বাজনাটা বাজানোর ব্যবস্থা করুন।

অপর্ণা হাসিমুখে নেকলেসটা নিয়ে আরো কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা করলো। অতঃপর নওশাদের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে ভাবলো কী করা যায়। অর্ণবকে কিছু একটা বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। অপর্ণা নানান চিন্তাভাবনা করতে করতে বাড়ি ফিরলো। নেকলেসটা ব্যাগে বেশ যত্নে রেখেছে সে। আজ মায়ের বাড়িতে যাবে সে। নিজের মায়ের থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ নিবে। চিত্রলেখা নামক আপদটা যখন ভালোই ভালোই ঘাড় থেকে নামছে তখন অযথা তাকে পোষার কোনো দরকারই নেই।

________________

ক্লাসটা বড্ড বিরক্ত লাগছে চিত্রলেখার। ম্যাথ ক্লাসে এসে স্যার ইতিহাস বোঝাচ্ছেন। কী আজব! চিত্রলেখার বারবার হাই উঠছে। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ফোন বের করলো সে। রঙ্গনকে কি একবার টেক্সট করবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে শেষমেশ করেই ফেললো টেক্সট।

-ব্যস্ত?

রঙ্গনের রিপ্লাই আসলো না। চিত্রলেখা আবারো মন খারাপ করে ক্লাসে মনোযোগ দিল। কোনমতে ক্লাসে মন বসাতে পারছে না সে। অদ্ভুতভাবে রঙ্গনের উপরেই তার মন পড়ে আছে। রঙ্গনের বলা কথাগুলো তার কানে বাজছে। যতবার সে রঙ্গনের কথা মনে করছে, ততবার ঠোঁটের কোণে এক প্রসারিত হাসি ঝুলছে।

রঙ্গন বাড়িতে আসার পর থেকে আশফিনা আহমেদ তার সাথে একটাও কথা বলেননি। রঙ্গনও কিছু বলতে যায়নি। বাড়িতে ঢুকেই মাথাব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে সে। আপাতত কোনোরকম হৈহৈ-রৈরৈ এর মধ্যে সে থাকতে চায় না। কিন্তু অহমের ডাকাডাকিতে ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তার।

-এই ভাইয়া, ভাবী টেক্সট করছে উঠ!

রঙ্গন লাফ দিয়ে উঠলো। অহম কী বলছে এসব! চটজলদি উঠে নিজের ফোনটা অহমের হাতে দেখে খানিকটা ঘাবড়ালো সে। তড়িৎ গতিতে ফোনটা কেড়ে নিল।

-তো শেষমেশ আমার কথাই সত্যি হলো ভাইয়া!

-অহম, বিরক্ত করিস না তো যা।

-ভাবীর সাথে দেখা করাও তো। অনেকদিন হলো দেখিই না, এখন তো পরীক্ষাও ভালো দিয়েছি। এখন দেখা করাই যায়।

-তোর ভাই-ই দেখা করতে পারতেছে না আর তো তুই! তার চেয়ে বড় কথা তোর ভাবী এখনো আমাকে এক্সেপ্ট করেনি।

-আহারে বেচারা, করে নিবে নাও। মুখে না বললেও বুঝে নিও। এখন গেলাম আমি। তোমাদের কাবাবে হাড্ডি হয়ে আমার লাভ নাই।

অহম চলে যেতেই চিত্রলেখার নম্বর মেসেজ করলো রঙ্গন।

-না আসলে ঘুমিয়েছিলাম, মাথাব্যথা করছিল।

চিত্রলেখার হাতেই ফোন ছিল। সে চটজলদি রিপ্লাই করলো,

-ওহ, শরীর কি বেশি খারাপ?

-না। কিছু বলবে?

-আপনার অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রহর থেকে কিছু তুচ্ছ মুহূর্ত ধার নিতে পারি?

-যা বলবেন আপনি!

-আর এক ঘণ্টার মধ্যে আমার ক্লাস শেষ। কলেজের বাইরে অপেক্ষা করতে পারবেন?

-হ্যাঁ। তুমি ক্লাস শেষ করে কল দিও। আমি ফাইরে অপেক্ষা করবো।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখার একেকটা টেক্সট রঙ্গনের বুকে আঘাত করছে যেন। চিত্রলেখা তার দুঃসময়ের বন্ধু থেকে কি তবে প্রেয়সী হতে চললো?

_____________

অর্ণব দুপুরের খাবার বাড়িতে বসেই খাচ্ছে। ব্যবসার অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। বিক্রি নেই বললেই চলে, অদ্ভুতভাবে তাদের দোকানের ডিমান্ড যেন একেবারে তলানিতে মিশে গেছে। এ অবস্থায় কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না অর্ণব। তার উপর এখন অনিকেরও চাকরি নেই। সব মিলিয়ে দায়িত্বটা অর্ণবের কাঁধেই পড়েছে। এ বিষয় নিয়ে সে কারো সাথে কথাও বলতে পারছে না। অপর্ণাকে বললে সে বাড়াবাড়ি করবে নিশ্চিত আর অনিককে বললে সে দুশ্চিন্তা করবে। একাকী খেতে খেতে নানান প্রশ্ন অর্ণবের মাথায় এসে জট পাকাচ্ছে।

-অর্ণব শোনো।

-হ্যাঁ বলো কী হয়েছে।

-আমি একটু মায়ের ওখানে যাবো আজ, বাচ্চাদের নিয়ে আসতে।

-আমি রেখে আসবো?

-না আমি যেতে পারবো।

-আচ্ছা যাও।

-কিছু টাকা দাও তো। বাড়িতে যাচ্ছি, কিছু নিয়ে যাবো।

-গত পরশুই তো তিন হাজার টাকা নিলে, ওখান থেকে কিছু কেনো।

-ওটা খরচ হয়ে গেছে।

-কোথায়?

-ধূর! এত জেরা করার কী আছে আজব, লাগবে না তোমার টাকা। টাকার উপর শুয়ে থাকো ভাইকে নিয়ে।

অপর্ণা খানিকটা রূক্ষভাবেই বললো। অর্ণবের ইচ্ছে করছে না অপর্ণার সাথে তর্কে জড়াতে, অযথা যাওয়ার আগে ঝামেলা করতে চাইছে! অর্ণব চুপচাপ খেতে লাগলো। অপর্ণাও আর কথা বাড়ালো না তবে সাথী দূর থেকে এই দৃশ্যটা দেখলো। রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তরকারির বাটিটা এনে টেবিলে রাখলো সে।

-ভাইয়া কিছু হয়েছে? আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে খুব।

-না সাথী, কিছু হয়নি। অনিকের শরীরের কী অবস্থা? সকালে তো দেখলাম ঘুমোচ্ছিল।

-ওর কী হয়েছে বুঝতে পারছি না ভাইয়া। চাকরিটা চলে যাওয়ার পর থেকে খুব ভেঙে পড়েছে, কোনোভাবেই বোঝাতে পারছি না কিছু।

-চিন্তা করো না। যাও ওর কাছে থাকো।

সাথী মাথা নেড়ে চলে গেল। বাড়িতে সুখ শান্তির ছিটেফোঁটাও যেন নেই। চিত্রলেখা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে একটা কিছুও ভালো হচ্ছে না। এর দায়টা অপর্ণার! তবুও মুখ ফুটে সেসব বলতে পারেনা সাথী।

______________

ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে আছে চিত্রলেখা। রঙ্গন পাশে বসে চিত্রলেখাকে দেখছে। মেয়েটার চোখেমুখে আজ অন্যরকম দ্যুতি। সদ্য প্রেমে পড়া একটা আভা জ্বলজ্বলে করছে তার চাহনিতে তবুও মেয়েটা স্বীকার করছে না ভেবে খানিকটা মনোঃক্ষুণ্ন হয় রঙ্গন।

-আপনি জিজ্ঞাসা করলেন না তো কেন আপনাকে এখানে ডেকেছি।

-কেন ডেকেছো?

-আপনাকে একটা সত্যি কথা বলবো। তারপর যদি আপনার মনে হয় আমি আপনার যোগ্য তবেই আমাদের আগানো উচিত হবে।

-বলো।

-আপনার মামার যেসব ছবি ভাইরাল হয়েছিল সেসব আমি করেছিলাম।

-কিন্তু কেন?

-আপনার মামা আমায় বাজেভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন।

-এসব তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?

-আগে বললে কী হতো? প্রেমের শখ জাগতো না আপনার? প্রপোজ করতেন না? নাকি নিজের মামার এ রূপটা মেনে নিতে পারতেন? আপনি পারতেন বিশ্বাস করতে এটা এত সহজে? আপনার মা না থাকলে হয়তো আমি সেদিন বাঁচতাম না। উনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। উনি যদি না চান তাহলে আমি কখনোই আপনার সাথে জড়াবো না রঙ্গন।

-তুমি আমাকে ভালোবাসো চিত্রলেখা?

চিত্রলেখা নিশ্চুপ হয়ে গেল। রঙ্গনকে সে কেন বোঝাতে পারছে না এসব কিছুর পরিণতি কতটা অনিশ্চিত! তার বলা সামান্য একটা বাক্য দুটো পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সে চায় না তার জন্য তার ভাবীর জীবনে নতুন করে কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হোক।

-আমি তোমাকেই বিয়ে করবো চিত্রলেখা। তুমি শুধু রাজি থেকো। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাকে আমি ভালোবাসার মানুষ হিসেবেই পাশে রাখতে চাই সবার অনুমতি নিয়েই। তখন নিষেধ করো না যেন।

চিত্রলেখা জানে এটা কখনো সম্ভব না। আশফিনা আহমেদ মরে যাবেন তবুও তাকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে মানবেন না।

চলবে …

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

রঙ্গনের অসহ্য লাগছে। কোনোভাবে নিজেকে স্থির করতে পারছে না। চিত্রলেখার সাথে কথা শেষ করে আসার পর থেকে সে নিজেকে শান্ত করতে পারতেছে না। নিজের মামা নামক পশুটার উপর যে ক্রোধ সে অনুভব করছে তা কোনোক্রমেই কমানো সম্ভব না। চিত্রলেখার বিষয়ে আপাতত বাড়িতে নতুন করে কথা তুলতে চাচ্ছে না সে তবে নওশাদকে সে শিক্ষা দিবেই। চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো রঙ্গনের। এতে সে নওশাদকে শিক্ষাও দিতে পারবে আবার বাড়িতে কোনো ঝামেলাও হবে না। মনে মনে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে নওশাদকে কল করলো রঙ্গন।

-হ্যালো মামা, কোথায় তুমি?

-বাড়িতে যাচ্ছি। বল কী হয়েছে।

-একা আছো?

-হ্যাঁ।

-আসলে একটা লোক আমাকে হুমকি দিচ্ছে। তুমি কি একটু আসতে পারবা?

-তোকে হুমকি দিচ্ছে? এত সাহস? আমার নাম বললেই তো কাজ হওয়ার কথা। তুই এড্রেসটা মেসেজ কর, আমি দশ মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি। দেখি কত বড় সাহস!

-আচ্ছা মামা, থ্যাংকস।

কল কেটে রঙ্গন মুচকি হাসলো। মার্কেটের কাছাকাছিই আছে সে। চটজলদি একটা লোকাল দোকান থেকে একটা হুডি কিনে রাখলো। নওশাদকে যে পাশে ডেকেছে ঐ পাশটা অন্ধকার। তাছাড়া রঙ্গন বেশ ভালো করে দেখে রেখেছে, নওশাদ আসলে কী করতে হবে তা ইতোমধ্যে কণ্ঠস্থ করে ফেলেছে সে।

নওশাদের আসতে মিনিট পনেরো লাগলো। রঙ্গনের ফোনে টেক্সট করে আসার জানান দিল সে। রঙ্গন এই মুহুর্তের অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। নিজের হাতে থাকা হুডিটা দিয়ে নওশাদের মুখের সামনের অংশ আষ্টেপৃষ্টে আবৃত করে ফেলল। অতঃপর কোনো শব্দ ছাড়া টানা পাঁচ মিনিট ধরে বেধড়ক মারতে থাকলো নওশাদকে। অন্ধকার তার উপর হুডির কারণে ঠিকমতো কিছু দেখতে না পায়ে ঘাসের উপর পড়ে থেকে কাঁতরাতে লাগলো নওশাদ। বেশ কিছুক্ষণ পর রঙ্গন নওশাদকে ছেড়ে ফেলে রেখে গেল। নওশাদ ধীরে ধীরে উঠে বসলো। মুখ থেকে হুডি সরাতেই রঙ্গনের কল আসলো।

-মামা কোথায় তুমি? এই লোকটা বলছে এ নাকি তোমায় ধরে মেরেছে। কী যা তা বলতেছে! তোমাকে কেউ মারতে পারে? এ বোধহয় গাঁজা খাইছে মামা। তুমি কোথায় বলো তো।

-ভাগ্নে, আ..আমি একটু কাজে আটকে পড়েছি। তুই বিষয়টা সর্ট আউট করে নে। আমি পরে দেখবো।

-আচ্ছা মামা। তাহলে তো তুমি আসোইনি আর এই রামছাগল বলছে তোমায় নাকি কুকুরের মতন মেরেছে আবার বলতেছে এসব নাকি সবাইকে বলে বেড়াবে। এইটাকে পরে ধোলাই দিও তো মামা।

নওশাদ কোনোরকম সম্মতি জানিয়ে ফোনটা কাটলো। রঙ্গন হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে এগোলো। উচিত শিক্ষা দিতে পেরেছে। সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না। রঙ্গন বেশ খোশমেজাজেই বাড়িতে ফিরলো। তখন অবধি সে বুঝতে পারেনি তার জন্য কী অপেক্ষা করছে বাড়িতে। সে ভেবেছিল তার মামার বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু রঙ্গন রাগের মাথায় যে আঘাতগুলো করেছে তা নওশাদের জন্য কাল হয়েই আসলো। নওশাদের ডান হাতের একটা হাড় ভেঙে গেছে এবং কপালের কাছে একটা গভীর ক্ষত হয়েছে। এসব রঙ্গন জানতে পারশো বাড়িতে ফেরার পর। রঙ্গনের বাবা মাশরুর আহমেদ তাকে জানালেন। নওশাদ তখনো স্বীকার করেনি মার খাওয়ার কথাটা, সে বলেছে এক্সিডেন্টের কারণে হয়েছে এসব। নওশাদের এ অবস্থা দেখে রঙ্গনের মোটেও খারাপ লাগছে না বরং না চাইতেও একটা আত্মতৃপ্তি তার চোখের চাহনিতে ফুটে উঠছে। মাশরুর সাহেব নওশাদকে দেখতে যাওয়ার কথা বলছিলেন রঙ্গনকে।

-রঙ্গন, আমাদের একবার নওশাদকে দেখতে যাওয়া উচিত। আশফিনার যে কী হয়েছে, যাবেনা বলছে। ভাইয়ের উপর কিসের এত রাগ বলতো যে এক্সিডেন্ট করেছে তবুও দেখতে যাবে না!

-মায়ের কথা থাক, আমরা যাবো চলো।

-হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। চল আমরা বের হই।

রঙ্গন নিজের চোখে দেখতে চাইছিল নওশাদের যন্ত্রণা। এখন সে সুযোগটাই সে হাতের নাগালে পেয়েছে তবে সুযোগটা লুফে নিতে দ্বিধা কোথায়?

সুযোগটা লুফে নেওয়ার সৌভাগ্য রঙ্গনের হলো না। আশফিনা আহমেদের কড়া স্বরে তাকে মলিন মুখে যেতে হলো উপরের ঘরের দিকে। অগ্নিচোখে তিনি বাড়ির সকলকে নিষেধ করলেন নওশাদের সাথে দেখা করতে যেতে। রঙ্গন এসবে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তার চোখজোড়া উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করেছে। তৃপ্তি তার চোখে ভাস্যমান। আশফিনা আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে। আজ যদি তার মা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তবুও সে সবটা সত্যিই বলবে। সে ভুল নয়, মিথ্যা বলার প্রয়োজন তার নেই।

-নওশাদকে তুমি মেরেছো?

আশফিনা আহমেদের প্রথম প্রশ্নেই ভড়কে গেল রঙ্গন। সে কখনোই ভাবেনি তার মা তাকে সরাসরি এ প্রশ্ন করবে। করার কথাও নয়।

-হ্যাঁ আমি মেরেছি।

-তাহলে চিত্রলেখা তোমায় বলেছে সেদিনের কথা। যা হয়েছে সেটা নিয়ে নতুন করে ঝামেলা করার দরকার ছিল রঙ্গন? নওশাদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? আঘাতটা যখন চিত্রলেখার উপর গিয়ে পড়বে তখন? কিভাবে আটকাবে তুমি?

-চিত্রলেখাকে বাঁচানোর জন্য আমি আছি সবসময় মা।

-অধিকার কী তোমার ওকে বাঁচানোর? ও কি তোমায় ভালোবাসে? ও বলেছে তোমায়? বাড়াবাড়ি করো না রঙ্গন। চিত্রলেখার জন্য আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করেছি। কিন্তু তুমি যা করছো সেটা পাগলামি। চিত্রলেখাকে বাঁচাতে গিয়ে ওর ক্ষতি করে বসো না।

-মা আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।

-চিত্রলেখা একবারো বলেছে সে তোমাকে ভালোবাসে?

-সব কথা মুখে বলতে হয় না, মা। আমি অনুভব করতে পারি। তুমি শুধু একবার ওর পরিবারের সাথে কথা বলো, চিত্রলেখা যদি রাজি না থাকে আমি কোনদিন আর এই বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে আসবো না।

-কথা আমি বলবো তবে আগে চিত্রলেখার সাথে। চিত্রলেখা যদি রাজি থাকে তবেই ওর পরিবারের কাছে যাবো আমি।

রঙ্গন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে কি ভুল শুনলো নাকি তার মা সত্যিই তার বিষয়টা বুঝতে পেরেছে?

-মা সত্যি?

-হুম। এটা নিয়ে এখন লাফিয়ো না, চুপচাপ নিজের ঘরে যাও আর চিত্রলেখাকে এসব এখনি বলতে হবে না। আমি কাল ওর সাথে দেখা করতে যাবো ওর কলেজে।

রঙ্গন মাথা নেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। আশফিনা আহমেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। আলমারির লকার থেকে একটা অ্যালবাম বের করলেন তিনি। অ্যালবামটা রঙ্গনের ছোটবেলার। রঙ্গনের নানান রকম বয়সের ছবি শোভা পাচ্ছে সেখানে তবে প্রথম ছবিটা থেকে চোখ সরাতে পারছেন না আশফিনা আহমেদ। চিরপরিচিত রাস্তাটা, রঙ্গনের হাসিমুখ। আশফিনা আহমেদের চোখের কোণে জল আসে। বহুদিন আগলে রেখেছেন সবকিছু তিনি। কখনো এসব স্মৃতিবিজড়িত হয়ে কথা বলেননি। তবে কাল বলতে হবে। চিত্রলেখাকে মিথ্যে বলার কোনো কারণ তার কাজে নেই। সত্যিটা বললে হয়তো চিত্রলেখা নিজেই রঙ্গনকে অপছন্দের করা শুরু করবে। এতে পরোক্ষ আশফিনা আহমেদের কাজ হয়ে যাবে। তিনি মরে গেলেও চিত্রলেখাকে মানতে পারবেন না। এখন যা করার কালকেই করবেন তিনি। অ্যালবামটা বেশ যত্নে রাখা। প্রথম ছবিটা এখনো বের করা। রঙ্গনকে কোলে নিয়ে কান্না করছেন আশফিনা আহমেদ। পরের ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে রঙ্গনের গালে চুমু খেয়ে তাকে কোলের মধ্যে আড়াল করছেন। ছবিগুলো রঙ্গনের প্রথম ছবি, চিরচেনা একটা রাস্তার পাশে তোলা। এই দুইটা ছবি আশফিনা আহমেদের মনের খুব কাছের। এ ছবি দুটো তিনি রঙ্গনকেও দেখাননি কখনো। পাছে যদি রঙ্গন কিছু একটা আন্দাজ করে দূরে চলে যায় এ ভয় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। রঙ্গনকে তিনি যতটা যত্নে বড় করে তুলেছেন, তার প্রতিদানে রঙ্গন নিশ্চয়ই তাকে একা ফেলে যাবে না! আর তা নিশ্চিত করতেই আশফিনা আহমেদ নিজের পছন্দের কোনো মেয়ের সাথেই রঙ্গনের বিয়ে দিবেন যেটা চিত্রলেখা কখনোই নয়, ভুলক্রমেও না!

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২৭

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
সপ্তবিংশ_পর্ব
~মিহি

-মা আসবো?

-এসো।

-ডেকেছিলে আমাকে?

-হুম। তোমার কী হয়েছে রঙ্গন? এতটা অবাধ্য কবে হলে তুমি? আমি নিষেধ করেছিলাম ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করতে অথচ তুমি তাকে আশ্রমে নিয়ে গেলে!

-তুমি আমার উপর নজর রাখছো মা?

-তোমার মা আমি, তোমার ভালো মন্দ বোঝার দায়িত্ব নিশ্চয়ই অন্য কারো নয়।

-আমার ভালো সময়টুকু চিত্রলেখার সাথে কাটে মা। দয়া করে এটা আমার থেকে কেড়ে নিও না।

-তুমি ঐ মেয়েটাকে ভালোবাসো?

রঙ্গন নিশ্চুপ হয়ে যায়। সে এখনো চিত্রলেখাকে বলেনি কথাটা। মাকে কী করে বলবে সে? চিত্রলেখা যদি তাকে ভালো না বাসে?

-চুপ করে আছো কেন রঙ্গন? কারণ তুমিও জানো মেয়েটা তোমার মোহ ছাড়া কিছুই নয়। দুয়েকদিন ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগা আর সারাজীবন একসাথে থাকার বিষয়টা ভিন্ন। তোমাকে ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনা আমার দায়িত্ব।

-মা আমি চিত্রলেখাকে ভালোবাসি।

-ঐ মেয়ের নম্বর এখনি ব্লক করো, আমার চোখের সামনে।

-না মা, আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।

রঙ্গন আশফিনা আহমেদকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। অনেকটা ছুটেই সে বাড়ি থেকে বেরোলো। এখন চিত্রলেখার হোস্টেলে যেতে হবে তার। চিত্রলেখাকে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা জানাতে হবে অন্যথায় সে দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে। রঙ্গনের মনে হলো সমস্ত শহরটা আজ রঙিন তবে সময়টা যেন ধীর গতিতে চলছে। সে যতই এগোচ্ছে, ততই যেন দুরত্ব বেড়ে চলেছে। এটাই কি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র? রঙ্গনের মাথা কাজ করছে না। অদ্ভুত এক দৈব শক্তি যেন ভর করেছে তার মাথায়।

_________________

-তুমি কী চাইছো আশফিনা? রঙ্গনকে সত্যি জানালে ও কতটা ভেঙে পড়বে ভেবেছো একবার?

-আমি রঙ্গনকে সত্যি জানাবো না, চিত্রলেখাকে জানাবো। সে যখন জানবে তার স্বপ্নের রাজপুত্রটা মেকি তখন সে নিশ্চিত পিছু হটবে। রঙ্গনকে আমি কখনোই ওর কাছে যেতে দিতে পারি না মাশরুর। সব দোষ তোমার, তোমার কারণেই ঐ মেয়েটার ছায়া এ বাড়িতে পড়েছে!

-রঙ্গন চিত্রলেখাকে ভালোবেসে ফেলেছে আশফিনা! রঙ্গনকে আমরা জোর করতে পারি না।

-তুমি কী চাচ্ছো মাশরুর? আমার ছেলেকে আমি ঐ মেয়ের সাথে বিয়ে দিব? কখনোই না। রঙ্গনের বিয়ে আমার পছন্দের মেয়ে ছাড়া কখনোই হবে না।

মাশরুর আহমেদ আশফিনার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আশফিনা ভয় পাচ্ছে, সন্তান হারানোর ভয়। তার ধারণা চিত্রলেখা এলে সে রঙ্গনকে কেড়ে নেবে। আশফিনা আহমেদকে কি আদৌ বোঝাতে পারবেন তিনি? বোধহয় না।

-রঙ্গন ভুল করছে, আমি ওকে এখানে রাখবো না। ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিব।

-আশফিনা! রঙ্গন বাইরে গেলেই ভালো থাকবে? ওর ভালো থাকার জায়গাটা চিত্রলেখা!

-নাহ! এটা শুধুই ওর মোহ, চিত্রলেখা রঙ্গনকে ভালোবেসে মরে গেলেও ওদের বিয়ে আমি কখনো মানবো না। তুমি কেন ভুলে যাচ্ছো ও কেমন ফ্যামিলিতে বিলং করে? ওর মায়ের চরিত্র নিয়ে অবধি আমার বাপের বাড়িতে প্রশ্ন ওঠে। সেই মেয়েকে আমার ছেলে কী করে পছন্দ করতে পারে?

মাশরুর আহমেদ তর্ক করার চেষ্টা করলেন না। আশফিনা আহমেদের মাথা গরম, উল্টোপাল্টা বলবেন এখন। তার সাথে তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই তবে রঙ্গন যদি সত্যিই চিত্রলেখাকে ভালোবেসে থেকে, এটা একটা চিন্তার বিষয়। চিত্রলেখার পরিবারের সাথে ইতোমধ্যেই একটা মনোমালিন্য তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের রয়েছে। আশফিনা তো চিত্রলেখাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না। রঙ্গন জেনে বুঝে চিত্রলেখাকে অগ্নিপরীক্ষার মাঝে এনে ফেলছে। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে জীবনে। ও একটা স্বাভাবিক জীবন ডিসার্ভ করে। এই শ্বশুরবাড়ির ঝামেলা কিংবা পারিবারিক মনোমালিন্য তার ভাগ্যে আর থাকা উচিত নয়। রঙ্গন আজীবন তাকে রক্ষা করে চলতে পারবে? এ ভালোবাসা স্থায়ী নাকি রঙ বদলাবে? মাশরুর আহমেদের মনে রঙ্গনকে নিয়ে প্রশ্নের ভাণ্ডার সৃষ্টি হয়। ছেলেটা তার মায়ের হাতে গড়া, এখন সৃষ্টিকর্তা ভালো জানে সে কী করতে চলেছে।

___________________

চিত্রলেখার হোস্টেলের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে রঙ্গন। শীতে হাত পা মনে হচ্ছে জমে আছে। হুডিতে মোটেও উষ্ণ অনুভব হচ্ছে না। চিত্রলেখার নম্বর ডায়াল করলো সে। চারবার রিং হলো তারপর সে রিসিভ করলো।

-চিত্রলেখা, একটু বারান্দায় আসবে?

-কেন? তাও এত রাতে?

-আসবে একটু?

রঙ্গনের আকুতিতে মন গললো চিত্রলেখার। চাদরে আবৃত করলো নিজেকে। অতঃপর বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। রঙ্গন নিচে দাঁড়িয়ে।

-আপনি এত রাতে এখানে এসেছেন কেন?

-খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলার জন্য যেটা ঝিলে পা ডুবিয়ে বসে বলতে চেয়েছিলাম।

-কী কথা? বলুন।

-আচ্ছা তুমি কি সবসময় আমাকে আপনি আপনি করে বলবে? আমায় তুমি করে কবে বলবে? আমার ‘ফরেভার বন্ধু’ হবে চিত্রলেখা যার কোলে মাথা রেখে আমি রাতের আঁধারে আলো খুঁজে বেড়াবো?

-এত রাতে এসব বলার জন্য ….

-এখনি উত্তর দিও না। সময় আছে তোমার কাছে, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো চিত্রলেখা। এখন ভেতরে যাও, ঠাণ্ডা লাগবে তোমার।

চিত্রলেখা গেল না। রঙ্গন চোখের আড়াল হওয়া অবধি সে গভীর নয়নে কেবল দেখে গেল এ পাগল প্রেমিকের পাগলামি। মানুষ নাকি প্রেমে পড়লে সব ভুলে যায়। রঙ্গনকে দেখে কথাটা সত্যিই মনে হচ্ছে চিত্রলেখার। ছেলেটা আদৌ এত ভালোবেসে ফেলেছে তাকে? চিত্রলেখা কি বিশ্বাস করতে পারে রঙ্গনকে? সেও যদি একসময় চিত্রলেখার বাবার মতো হয়ে যায়! কেন যেন ভয় হয় চিত্রলেখার। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে সে।

চিত্রলেখা ঘরে ঢুকতেই সঞ্চারী সন্দিহান চোখে তাকালো। চিত্রলেখা এড়িয়ে যেতে চাইলো। সঞ্চারী তা হতে দিল না। চিত্রলেখার পাশে বসে মুচকি হাসতে লাগলো।

-তা কবে দেখা করাচ্ছিস জামাইবাবুর সাথে?

-কিসের জামাইবাবু? সঞ্চারী তুই বেশি ভাবিস কেন এতো?

-এত রাতে বারান্দায় তবে কার জন্য গেলি? তাও আবার ফোন আসার সাথে সাথে? কিছু বুঝি না তাইনা? তলে তলে টেম্পু চালাও আর আমরা বললেই হরতাল? এই অহনা উঠ! কী মরার মতো পড়ে আছিস? দেখ লেখার ….

চিত্রলেখা সঞ্চারীর মুখ চেপে ধরলো। এই মেয়ে পারলে এখনি পুরো হোস্টেলবাসীকে মাইকিং করে জানিয়ে দিবে।

-বোন আমার, চুপ কর। সেরকম কিছুই না।

-তো কেমন কিছু?

-এখন না, কাল বলবোনি। ঠাণ্ডা মাথায় বলবো কাল, এখন তুই যা পড়তেছিলি, পড়।

-আমি এখনি শুনবো। বল তুই।

-তুই যেমন ভাবছিস তেমন না!

-তার মানে তোরা প্রেম করতেছিস না….এই তোরা বিয়েও করে ফেলছিস? তোর বিয়ে খাওয়ার কত শখ ছিল আমার! তুই আমার সাথে এমন করতে পারলি লেখু?

-বইন চুপ! ড্রামাকুইন রে। আমার বিয়ে তো দূর প্রেমও হয়নি। উনি আজ শুধু আমাকে তার মনের কথাটুকু বলেছে।

-তুই কী উত্তর দিলি?

-উত্তর দিইনি। উনি সময় দিয়েছেন, এখনি উত্তর দিতে হবে না।

-ছেলে তো ভালোই বোঝে আপনাকে ম্যাডাম। এখন তাড়াতাড়ি তার সাথে সাক্ষাৎ করান। আমি কিন্তু ট্রিট নিবোই, জামাইয়ের টাকা বাঁচাতে আসবি না একদম।

-তুই একটু থাম, যা তো ঘুমা।

-হ্যাঁ হ্যাঁ নাও, কথা বলো তার সাথে। আমি আর কাবাবে হাড্ডি হচ্ছি না।

সঞ্চারী উঠে গেল। চিত্রলেখা হালকা হাসলো। অদ্ভুত একটা অনুভূতি তার সমগ্র মনকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে চলেছে। এ অনুভূতির নাম কি তবে ভালোবাসা? ফোন ভাইব্রেট করে উঠাতে ঘোর কাটলো চিত্রলেখার। রঙ্গন টেক্সট করেছে,

“তুমি আমায় ভালো না বাসলেও আমরা বন্ধু থাকবো। আমি তোমায় নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবেই দেখি এখনো। ভালোবাসতে গেলে আগে বন্ধুই হতে হয়। তাই বন্ধুত্বটা যত্নে রেখে দিও। ভালোবাসা যদি নাই দিতে পারো, বন্ধুত্বটা কেড়ে নিও না যেন।”

রঙ্গনের আবেগী মেসেজে চিত্রলেখা আরেক দফা হাসলো। এ ছেলেটা আসলেই পাগল প্রেমিক। তবে মারাত্মক সত্য এটা যে চিত্রলেখার মনের আঙিনাতে একটা ছেলে ধীর পায়ে এক্কা দোক্কা খেলছে।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২৫+২৬

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চবিংশ_পর্ব
~মিহি

“আমি বিয়েতে রাজি, চাচী। আমার কোনো অসুবিধা নেই, সুবহার যদি সম্মতি থাকে তবে আমারও আর কোনো আপত্তি থাকবে না।” সিয়ামের কথায় রেহানা সুলতানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সিয়ামকে সব জানানোর পর যে সে বুঝেছে তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।

-সিয়াম, বাবা এটা ভেবো না তোমার উপর সুবহাকে আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি। তোমার চেয়ে ভালো ছেলে আমরা খুঁজে পেতাম না। চোখের সামনে তোমাকে বড় করেছি, আমার মেয়ের জন্য তোমার চেয়ে ভালো আর কাকে পাবো আমি?

-চাচী, এসব কথা থাক। চাচ্চুর শরীরের যা অবস্থা তাতে আমরা এসব পরে ভাববো।

-তোমার চাচ্চু বিয়ের কথাটা জানলেই স্বস্তি পাবেন সিয়াম। উনি চান তোমরা যেন এই মাসের মধ্যেই বিয়ে করো।

-চাচ্চুর এ অবস্থায় আমরা কিভাবে…তাছাড়া সুবহার মতামতেরও একটা ব্যাপার আছে চাচী।

-তুমি সুবহার সাথে একবার কথা বলো সিয়াম। আমি নিশ্চিত ও তোমার কথা শুনবে এবং বুঝবে।

সিয়াম মাথা নাড়লো। সুবহাকে এ মুহূর্তে কিছু বোঝানো কী সম্ভব তার পক্ষে। তাছাড়া চিত্রলেখা আছে সেখানে। সিয়াম কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। চিত্রলেখার সামনে সুবহাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কথা বলাটা তার ভালো লাগবে না। চিত্রলেখার দিকে তাকাতে অবধি পারছে না। নিজেকে বারবার দোষ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন সে যাওয়ার আগে একটাবার চিত্রলেখাকে মনের কথা বলে গেল না। অবশ্য চিত্রলেখা কি তাকে ভালোবাসতো কখনো? উত্তরটা স্পষ্টত না বোধহয়। মেয়েরা নাকি ক্রোশ দূর থেকেও বুঝে যায় ছেলেরা কোন চাহনিতে তাদের পর্যবেক্ষণ করছে। চিত্রলেখারও বোঝার কথা, হয়তো সে ভালোবাসে না বলেই বুঝতে চাইছে না।

সুবহা শান্ত থাকলেও তার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে চিত্রলেখা। মেয়েটার মনের উপর দিয়ে কী এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

-আঙ্কেল একদম সুস্থ হয়ে যাবে। তুই এতটা ভেঙে পড়িস না।

-আমি পারছি না রে লেখা। আমার মনের অবস্থা আমি কী করে বোঝাবো তোকে? আমি যদি কাউকে একটু বোঝাতে পারতাম!

-সুবহা তুই..

-তুই..তুই তো অনেকক্ষণ এসেছিস। হোস্টেলে ফিরতে হবে তো তোর। চিন্তা করিস না আমার, তুই ফিরে যা। বাবা সুস্থ হলে আমি তোকে জানাবো।

-কিন্তু …

-তুই একা যেতে পারবি?

-হুম।

চিত্রলেখা বুঝতে পারলো সুবহা একা থাকতে চাইছে। এখন ওকে বেশি কিছু বোঝানোর চেষ্টা করা যাবে না। বন্ধুত্ব মানেই যে সবসময় বোঝাতে হবে তা নয়, মাঝেমধ্যে একটু স্পেস, একটু একা ছাড়তে হয় বন্ধুকে। সুবহাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে চিত্রলেখা ফেরার জন্য বেরোলো। চিত্রলেখাকে যেতে দেখলো সিয়াম। অন্য সময় হলে হয়তো সেও পৌঁছে দেওয়ার বাহানায় দুয়েকটা বাক্য বিনিময়ের নানান কৌশল বের করতো কিন্তু আজ যেন পরিস্থিতিই থমকে গেছে। যার সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজতো সে, আজ তাকেই এড়িয়ে চলতে চাইছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুবহার দিকে এগোলো সে। এখন সুবহাকে বোঝাতে হবে তার।

-সুবহা, একটু শোন তো।

-বলো ভাইয়া।

-একটু ছাদে চল তো, এখানে বলার মতো সিচ্যুয়েশন নেই।

-চলো।

সুবহা ওঠার চেষ্টা করতেই নিজেকে সামলাইতে পারলো না। দুর্বল শরীর, কান্নাকাটি করে আরো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে সে। উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো। পড়তে গিয়েও পড়লো না সিয়ামের আগলে নেওয়াতে।

“ঠিক আছি আমি।” সুবহা নিশ্চয়তা দিলেও সিয়াম ছাড়লো না। আলতো হাতে সুবহাকে ধরে ধরেই সিঁড়ি বেয়ে উঠলো। হাসপাতালের ছাদের পরিবেশ থমথমে। আজ আকাশটাও মেঘলা। কিছুক্ষণ পর পর বৃষ্টি হচ্ছে। শীতে এমন টুপটাপ বৃষ্টি খুব একটা হয়না তবে হিমশীতল বাতাসের স্পর্শে সুবহা খানিকটা কুঁকড়ে ফেলল নিজেকে।

-কিছু বলবে ভাইয়া?

-হুম।

-আমারো কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি কাউকে বলতে পারছি না। আমি একদম পাথর হয়ে যাচ্ছি ভেতর থেকে। আমার কথা একটু শুনবে?

-বল।

-বা..বাবার এ অবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমি যদি বাবাকে কথাগুলো না বলতাম, বাবা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতো না। এসব কিছু হতো না।

-কী কথা? কী বলছিস তুই?

-গত রবিবার আমি একা ফিরছিলাম কলেজ থেকে। কলেজের মূল রাস্তা পার হতেই কয়েকটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরে আমার মুখে পানি ছুঁড়ে মারে এবং বলে পরেরবার এসিড মারবে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি সোজা গিয়ে বাবাকে সব বলে দিই। এ কারণেই বাবার এ অবস্থা।

কথাগুলো বলতে বলতে সুবহার চোখ ভিজে উঠলো, অবারিত অশ্রুধারা গুলো সুবহার গাল বেয়ে গড়াতে লাগলো। কান্না করতে করতে সিয়ামের বুকে ঢলে পড়লো সুবহা। সিয়াম এবার শক্ত করেই সুবহাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রথমবারের মতো সিয়ামের মনে হলো মেয়েটার তাকে প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন।

_________

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল চিত্রলেখা। বৃষ্টির কারণে এখন গাড়ি পাওয়া একটু মুশকিল। আচমকা একটা রিকশা এসে থামলো চিত্রলেখার সামনে। চিত্রলেখা মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পেল রঙ্গনের হাস্যোজ্জল মুখখানা।

-এখন গাড়ি পাবেনা, এসো আমিই পৌঁছে দিই।

-আমি যেতে পারবো, আপনি যান।

রঙ্গন আর কিছু বললো না। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে রিকশাওয়ালাকে বিদায় করলো। চিত্রলেখা রঙ্গনের কাজের কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

-মানুষ চাক বা না চাক, আল্লাহ চাইলে সাক্ষাৎ তিনি করায়েই দেন।

-আপনার মনে হয়না আপনি ফিল্মি ডায়লগ মারতেছেন?

-আমরা তো বন্ধু ছিলাম, হঠাৎ এত রুক্ষ ব্যবহার! আচ্ছা আমি স্যরি, আমিই একটু বেশি পাগল টাইপের তো। এহ শোনো, আজ তো ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। তোমার ঘণ্টা তিনেক সময় হবে?

-কেন?

-ঐ সুন্দর জায়গাটা বৃষ্টির সময় আরো সুন্দর হয়। ‘আমার আশিয়ানা’ টা।

-অন্য কোনোদিন। আজ আমার এক ফ্রেন্ডের বাবা অসুস্থ, তাকে দেখতে এসেছিলাম।

-চিত্রলেখার তবে আজ মন খারাপ। আচ্ছা চলো আজকে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। একটু সময় হবে কি? অতি সামান্য?

-আপনি এত জেদী কেন? মাত্র ত্রিশ মিনিট, এর বেশি না।

-যথা আজ্ঞা রানীসাহেবা। আসুন এখন রিকশা খুঁজতেই না ত্রিশ মিনিট পেরিয়ে যায়। এসো রাস্তা পেরোতে হবে।

আনমনেই চিত্রলেখার হাতটা ধরে দুপাশে তাকিয়ে সামনে এগোলো রঙ্গন। চিত্রলেখা অবাক বিস্ময়ে আবদ্ধ হাতজোড়া আর রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটাকে প্রথম দেখাতে যথেষ্ট ম্যাচিউর ভেবেছিল সে। এ তো অহমের চেয়েও ছোট বাচ্চা।

__________

-মামা যাবেন?

-কোথায় যাবেন?

-সামনের রাস্তার মোড়ে যে ‘আরশিনগর’ আশ্রম আছে সেখানে। কত নিবেন?

-বৃষ্টির দিন, কী আর বলবো মামা! চল্লিশ দিয়েন।

-আচ্ছা ঠিক আছে। চিত্রলেখা উঠো।

চিত্রলেখা খানিকটা বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। সামনের রাস্তার মোড় হেঁটে গেলে মাত্র দশ মিনিট লাগবে। সেখানে এই ছেলে চল্লিশ টাকা দিয়ে রিকশা ঠিক করলো? আল্লাহ যখন জ্ঞানবুদ্ধি বিতরণ করতেছিল, তখন এ নিশ্চিত ভিডিও গেম খেলতেছিল! অবশ্য কীসব ভাবছে চিত্রলেখা! রঙ্গন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ছেলে, তার কাছে টাকার কী-ই বা মূল্য।

“তুমি যা ভাবছো তা কিন্তু ঠিক না চিত্রলেখা।” ফিসফিসিয়ে চিত্রলেখার কানের কাছে বলে উঠলো রঙ্গন। চিত্রলেখার শরীর শিউরে উঠলো। এভাবে আচমকা কানের কাছে এসে বলায় তা শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। চিত্রলেখা ফিসফিসিয়েই উত্তর দিল।

-কী ভাবছি আমি?

-এই যে আমি খুব টাকা ওড়ায়ে বেড়ায়, আসলে তা না। আশ্রমে আমরা হেঁটেও যেতে পারতাম। তবে এই বৃষ্টির মাঝে তোমাকে ভিজায়ে সর্দিজ্বরে ফালানোর চিন্তা আমার নাই। জিনিসটা দেখতে খুব এস্থেটিক লাগে তবে অসময়ের বৃষ্টি সেইফ না বুঝছো?

-হুম বুঝেছি।

-কী বুঝেছো?

চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। অতঃপর এক অদ্ভুত মোহনীয় স্বরে বলে উঠলো,”অসময়ের বৃষ্টি সেইফ না।”

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
ষড়বিংশ_পর্ব
~মিহি

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রিকশায় খানিকটা দূরত্বেই বসেছে চিত্রলেখা। আকাশের ঘনঘটা আর ঝুম বৃষ্টির শব্দে রিকশায় বসে রাস্তা দেখার মতো সুন্দর অপরাহ্ন বোধহয় সে আগে এভাবে উপভোগ করেনি।

-হুড তুলে দিব, তোমার অসুবিধা?

-আপনার বৃষ্টির সাথে কোনো শত্রুতা আছে? হালকা বৃষ্টিই তো হচ্ছে, হুড তুলতে হবে না।

-আমার এক্সের নাম বৃষ্টি ছিল তো তাই।

-আসলেই?

-আরে না। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাঁচি ফেলতে ফেলতে যে আমাকে গালি দিবা, তার বেলায়? তোমাকে অসুস্থ হতে তো দিতে পারিনা!

-চুপচাপ বসে থাকেন। আর একটা কথা বললে ত্রিশ মিনিট থেকে দুই মিনিট করে মাইনাস করবো।

রঙ্গন চ’কারান্ত শব্দ করে মুখ বন্ধ করলো। রিকশা চলছে ধীর গতিতে। রিকশাওয়ালা তেমন কথা বলছে না। এক অদ্ভুত রকম নীরবতায় রঙ্গনের কানে আসে বৃষ্টির শব্দ। এবার সে অনুভব করতে পারে চিত্রলেখা কেন তাকে চুপ থাকতে বলেছিল। ব্যস্ত রাস্তার কোলাহলেও যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে শব্দটা। বৃষ্টির একটা অদ্ভুত ঘ্রাণও আছে যা অচিরেই রঙ্গনের নাকের কাছে এসে দোল খাচ্ছে। অসময়ের বৃষ্টি বোধহয় খুব একটাও খারাপ না। এই বৃষ্টির নাম আসলে প্রেম, অসময়ে হঠাৎ আসে আর যখন আসে মানুষের মনকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।

মিনিট দশেক পর রিকশা থামলো আরশিনগর আশ্রমের সামনে। রঙ্গন রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটালো। চিত্রলেখা ততক্ষণে নেমে সামনে তাকিয়েছে। খোলামেলা একটা জায়গা, ভেতরে দোতলা একটা বাসার মতো দেখা যাচ্ছে তবে যথেষ্ট প্রশস্ত জায়গা।

-চলো ভেতরে।

-এটা কি বৃদ্ধাশ্রম?

-না এটা ইচ্ছেমহল। এখানে ইচ্ছে পূরণ করা হয়।

-মানে?

-এটা আসলে এমন একটা আশ্রম যেখানে বৃদ্ধা, তরুণ সবাই থাকে। সবাই কোনো না কোনোভাবে অসহায় হয়ে এখানে এসেছে। ওনারা এখানেই থাকেন এবং প্রতিদিন অসংখ্য শিশুরা এখানে আসে তাদের হাতে খাবার খাওয়ার জন্য, একটু গল্প করার জন্য। তারা যেন মনে না করে যে তারা কারো দয়া নিয়ে বাঁচছে। তাদের রান্না করা খাবার যে একটা শিশুর ক্ষুধা নিবারণ করছে এটা ভেবে যেন তারা প্রশান্তি পায়।

-এটার ফাউন্ডার কে? আপনি?

-নাহ, এটা আমার মায়ের তবে আমি আসি তাদের সাথে আনন্দ ভাগ করতে। আগে কয়েকজন বন্ধুরা মিলে আসতাম, ওনাদের সাথে আমরাও রান্না করতাম, বাচ্চাদের পড়াতাম। এখন তো সবাই আলাদা শহরে তাই যোগযোগ নেই।

-ভেতরে যাই?

-হ্যাঁ এসো কিন্তু তুমি আমার সাথে আসছো, ওনারা অন্য কিছু ভাবতে পারেন। এসব নিয়ে রাগ করোনা যেন, এডভান্স স্যরি বলে রাখলাম আমি।

চিত্রলেখা উত্তর দিল না। চুপচাপ ভেতরে প্রবেশ করলো সে। দোতলা বাড়িটার একপাশে বিশালাকার গাছ। তার নিচে বসে একজন বৃদ্ধ বাচ্চাদের সবাইকে কী যেন বলছেন। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে। চিত্রলেখা আগ্রহী দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

-ঐটা আজাদ চাচা। উনি রিটায়ার্ড শিক্ষক। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর একেবারেই একা হয়ে পড়েছিলেন। এখন এখানে তার বাচ্চার অভাব নেই।

-উনার মেয়ে?

-যার কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন, সে যৌতুকের লোভে মারধোর করতো মেয়েটাকে। রিটায়ার্ড অসুস্থ বাবাকে না জানিয়ে নিজেকেই শেষ করে ফেলে মেয়েটা। আজাদ চাচা নিজের সমস্ত টাকা সে ছেলের মুখে ছুঁড়ে মেয়ের লাশ আনেন।

চিত্রলেখা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। নিয়তি এত নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে? মানুষই বা এত পাষাণ হয় কী করে?

-এখানে সকলের জীবনের গল্পে বিষাদ মিশে আছে চিত্রলেখা তবে সে বিষাদে ডুব দিও না। তাদের আনন্দটাকে দু চোখ ভরে দেখো তবেই জীবনের আসল মানে বুঝতে পারবে।

-আমি আগে কখনো এ আশ্রমের নাম শুনিনি।

-না শোনাই স্বাভাবিক। এখানকার কথা কেবলমাত্র অসহায় মানুষ আর পথশিশুরাই জানে কারণ তাদেরই প্রত্যহ যাতায়াত এখানে। লোক কোলাহল থেকে একটু দূরেই তো জায়গাটা তাই।

-আমি তো আগে কখনো আসিনি এখানে, ওনারা রাগ করবেন কি?

-করতেই পারে, মানিয়ে নিও তুমি। এসো পাগল, ওনারা খুশি হবে।

রঙ্গন একদৌড়ে গাছের দিকে এগোলো। চিত্রলেখা রঙ্গনের পেছনে পেছনে সেদিকে চলতে লাগলো।

____________________

-তুমি আমাকে বিয়ে করে আফসোস করবে না?

-কেন? তুই রান্না করতে পারিস না বলে?

-মজা করো না সিয়াম ভাইয়া, হুটহাট বিয়ে করে পরে যদি আমরা দুজনেই আফসোস করি! আমাদের তো একটু সময় নেওয়া উচিত হতো কিন্তু সত্যি বলতে বাবাকে নিয়ে আমি খুব ভয় পাচ্ছি। তুমি বাবাকে বলো আমরা রাজি।

-শোন, বিয়ে আমরা পারিবারিকভাবেই করবো। তোকে নিয়ে রাজশাহী চলে যেতে বলছে চাচ্চু। রাজশাহীতে তো বন্ধুদের সাথে থাকি। এসব নিয়ে একটু ভাবতে হবে।

-নিচে চলো, বৃষ্টি জোরে আসছে।

সিয়াম মাথা নাড়ালো। সুবহা বড্ড সরল, কোনো প্যাঁচ ছাড়াই মনে যা ছিল বলে ফেলেছে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে সিয়ামের মনে হলো সে অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। এখন তার সামনের পথটুকু সুবহার হাত ধরে তাকে আগলে রাখার পথ। চিত্রলেখাকে হয়তো সে অনেক বেশিই ভালোবেসেছে তবে তা একতরফা। সে ভালোবাসা মনের কোনো এক কোণে চাপা পড়ে থাকুক। সুবহা তার দায়িত্ব, সুবহাকে আগলে রাখতে হবে তাকে।

-তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসতে সিয়াম ভাইয়া?

-বউ হওয়ার আগে থেকে এত জেরা? তোর প্রতি আমার অবহেলা থাকবে না সুবহা। তোর দায়িত্বটা আমার কাছে গুরুদায়িত্ব, আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করিস না। তোর খেয়াল আমি এমনিতেও রাখতে পারতাম তবে চাচ্চুর দেওয়া দায়িত্বের ভারটা অনেক বেশি। তোর মানিয়ে নিতে কষ্ট হলে দয়া করে আমার থেকে আড়াল করিস না। আমি সবটুকু মন থেকে চাই তুই ভালো থাক। তুই কিসে ভালো থাকবি তা একটু বুঝে নেওয়ার সুযোগটা আমায় দিস।

সুবহার চোখের কোণ সজল হয়ে উঠে। আসলেই তার বাবা কখনো ভুল ছিলেন না, তিনি তার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত কখনো নেননি। সিয়ামের প্রতি সুবহার হয়তো অনুভূতিরা এখনো ঘর বাঁধেনি তবে সুবহার প্রতি যে সম্মান সে সিয়ামের চোখে দেখেছে তা যথেষ্ট দুজনের একসাথে চলার পথে।

রেহানা সুলতানা শাহজাহান আলীর কেবিনের বাইরেই আছেন। তিনি এখন ঘুমাচ্ছেন। ডাক্তাররা আর কোনোভাবেই কাউকে এলাও করবেন না। একে তো হার্টের পেশেন্ট তবুও জোরাজুরিতে এলাও করেছিলেন। এখন রোগীর অবস্থা খারাপ হলে দোষ তো ডাক্তারের হবে। রেহানা বুঝতে পারছে না সে কী করবে। সিয়াম যদি সুবহাকে রাজি করাতে না পারে? মেয়েটাকে কিভাবে বাঁচাবেন তিনি? একা লড়তে পারবেন? এ শহরের আইন কি আদৌ সুবহার নিষ্পাপ অস্তিত্বটা বাঁচাতে পারবে? পারবে না! শাহজাহান আলী জানেন সেটা। জানেন বলেই সিয়ামকে বেছে নিয়েছেন তিনি। সিয়াম পরিস্থিতি বোঝে, তার মধ্যে যে দায়িত্ববোধটুকু আছে তার সর্বোচ্চ দিয়ে সে সুবহাকে আগলে রাখবে।

________________

-রঙ্গন তোমায় পছন্দ করে?

আঁতকে উঠলো চিত্রলেখা। মনোয়ারা বেগম চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে আবারো কাঁথা সেলাই করতে লাগলেন। চিত্রলেখা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রঙ্গন আছে কিনা। না নেই, ভাগ্যিস নেই!

-লজ্জা পেয়ো না মেয়ে। মনের কথা মনে চেপে রাখতে হয় না সবসময়।

-আমরা বন্ধু শুধু।

-তোমার বয়স কত?

-উনিশ।

-রঙ্গনের বাইশ। তোমরা বন্ধু?

চিত্রলেখা লজ্জা পেল। মনোয়ারা বেগম যে তাকে খোঁচা দিল তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে। যদিও সে এবং রঙ্গন আসলেই বন্ধু তবুও এ কথা অতি সহজে যে কেউ বিশ্বাস করবে তা মানার মতো নয়।

-তুমি এতো লজ্জা পেয়ো না। আমরা তো অভিজ্ঞ মানুষজন, সবকিছু বুঝি। রঙ্গন ছেলেটা বেশ অদ্ভুত। এক মুহূর্তে তোমার মনে হবে এ ছেলে শান্ত, আবার কখনো মনে হবে মারাত্মক চঞ্চল। বন্ধুদের নিয়ে কখনো মুখর আবার কখনো বন্ধুহীন নির্জীব।

-হুম অদ্ভুত।

-চলো এখন সবাই খাবার খাবে।

-এখন তো বিকেল।

-আমরা বিকেলে একসাথে বসে নানান খাবার খাই, ভারি খাবার না, হালকা কিছু। চলো আজ তুমিও উপভোগ করো।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। মনোয়ারা বেগম তাকে নিচে নিয়ে এলেন। রঙ্গন ততক্ষণে বড় একটা গামলাতে মুড়ি মেখেছে, আশেপাশে আরো কিছু ভাজা খাবারদাবার রয়েছে। মানুষের সংখ্যা বেশি না এখানে। কুড়ি-পঁচিশজনের মতো। সকলে একসাথে গোল হয়ে বসেছে। মনোয়ারা চিত্রলেখাকে নিজের পাশে বসালেন। রঙ্গনও কিছুক্ষণ পর চিত্রলেখার পাশে এসে বসলো।

-খুব বেশি সময় ব্যয় করে ফেললাম বোধহয়।

-কিছু সময়ের হিসাব রাখতে হয় না।

-তোমার হোস্টেলে ফিরতে হবে তো! আমরা একটু পরেই উঠবো কিন্তু।

চলে যাওয়ার কথা শুনে চিত্রলেখার মনটা অল্প হলেও খারাপ হলো। বাচ্চাদের সাথে কিছু মুহূর্ত অতঃপর পড়ন্ত বেলায় সবার হাসিমুখ- সবকিছু তাকে মুগ্ধ করছে। এ মুহূর্ত ফেলে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না তার কিন্তু যেতে তো হবেই।

চিত্রলেখার হোস্টেলে ঢোকার লাস্ট টাইম সন্ধ্যে সাতটা। এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। সকলের থেকে বিদায় নিতে নিতেই মিনিট দশেক লেগেছে। রঙ্গন আশ্রম থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তার দিকে হাঁটছে।

-এটুকু হাঁটতে হবে, অসুবিধা হবে তোমার?

-না।

-তো সময় খারাপ গেল?

-না, এতটা ভালো সময় শেষ কবে কাটিয়েছি তাই মনে পড়ছে না। ধন্যবাদ আপনাকে।

-তোমায় কিছু কথা বলা বাকি আমার।

-কী কথা?

-তার জন্য আরেকদিন সময় নিব, ঐ বিলের পড়ে পা ভিজিয়ে বসে বলবো।

চিত্রলেখার মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন স্পষ্ট চোখে পড়লো রঙ্গনের। সন্ধ্যের আলো আঁধারিতে চিত্রলেখার মুখের সে চিহ্ন যেন জ্বলজ্বল করছে। রঙ্গনের ডুবে যেতে ইচ্ছে করলো চিত্রলেখার চোখের চাহনিতে।

চলবে…