Sunday, July 13, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 356



প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৪

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চতুর্থ

নয়ন তারার গাল চেপে ধরে আছে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। তারার মনে হচ্ছে ওর গাল ভেঙে দাঁতের সাথে মিশে যাচ্ছে। ব্যাথায় বার বার কুকিয়ে উঠছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে। তারা নয়নের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে, আর্তনাদের স্বরে বলে উঠল,
“নয়ন ভাই, ছাড়ো। আমার ব্যাথা লাগছে।”
নয়ন চ্যাঁচিয়ে বলতে লাগল,
“লাগুক। তুই আমাকে যেই আঘাত দিয়েছিস, তার কাছে এই আঘাতটা সামান্য। এই আঘাত তুই প্রাপ্য। কিন্তু আমাকে যেই আঘাত দিয়েছিস সেই আঘাতটা কি আমি প্রাপ্য ছিলাম, তারা?”
তারা চুপ করে রইল। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগল। নয়নের চ্যাঁচামেচি শুনে জাহানারা বেগম ভেতর থেকে দৌড়ে আসলেন। অবাক হয়ে বলে উঠলেন,
“একি, নয়ন! কী করছিস? মেয়েটাকে ছাড়।”
বলতে বলতে তিনি নিজেই তারাকে ছাড়িয়ে নিলো। চোখ গরম করে নয়নের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি আজকাল খুব সহজেই মেয়েদের গায়ে হাত তুলো দেখছি, নয়ন। এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমাকে? আমার শিক্ষার অপব্যবহার করছো তুমি।”
নয়ন রাগে থরথর করে কাঁপছে। কথা বলতে অব্দি পারছে না। দুই হাতে নিজের চুল গুলো খামচে ধরে বলে উঠল,
“এই মেয়েটাকে আমার চোখের সামনের থেকে এক্ষুনি চলে যেতে বলো, আম্মু। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। ”
তারা অশ্রু ভর্তি চোখে নয়নের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই জাহানারা বেগমকে ঝাপটে ধরে বলে উঠল,
“তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো, ফুপ্পি। তুমি আমার কথাগুলো একটু শুনো। বিশ্বাস করো, কাল আমি যা করেছি, যা বলেছি সব বাধ্য হয়ে বলেছি। আমার নিজের মুখে সব স্বীকার করা ছাড়া উপায় ছিলো না। প্লিজ, আমার সব কথাগুলো একটু শোনো। তোমরা ছাড়া আমাকে বিশ্বাস করার কেউ নেই, ফুপ্পি।”
তারার কান্না করতে করতে হেচকি উঠে গেছে। তারার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে নয়নের যন্ত্রণা আরো বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাগের চোটে কিছু বলতে পারছে না। নয়ন ভেবেই পাচ্ছে না, তারা মতো বুদ্ধিমান মেয়ে কী করে কালকে এত বড় একটা বোকামি করল? নয়ন আগের থেকেই জানত যে, ফাহিম তারাকে বিগত কয়েকদিন ধরে ব্লাকমেইল করছে। ঠিক কী নিয়ে ব্লাকমেইল করছে তা জানার জন্যই, নয়ন কালকে সবার সামনে এনেছিল বিষয়টা। ভেবেছিল তারা কালকে নিজের সম্মান বাঁচাতে সবটা স্বীকার করবে। তারপর নয়ন বাকি প্রমাণসহ ফাহিমের কীর্তিকলাপের কথা সবাইকে জানাবে। কিন্তু তারা কালকে নিজের হাতে নিজের সম্মান নষ্ট করবে, এটা নয়ন কিছুতেই ভাবতে পারছেনা। যতবার ভাবছে ততবার মাথা হ্যাং মে’রে যাচ্ছে। এখন যেহেতু তারা আর ফাহিমের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেহেতু এই বিষয়টা নিয়ে নয়ন আর ভাবতে চায়না। নয়নের বাবা নেই৷ মা’কে কাল কথা দিয়েছে আর কোনো ঝামেলা করবেনা। তাই নয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বারকয়েক নিঃশ্বাস নিলো জোরে জোরে। তারপর শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“তারা, বাড়ি যা। তোর সাথে আমরা কেউ কোনোরকম কথা বলতে চাচ্ছি না।”
বলেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তারা তৎক্ষনাৎ নয়নের পা জড়িয়ে ধরল। বলতে লাগল,
” প্লিজ, নয়ন ভাই। চলে যেও না। আমার কথাটা একটু শুনো। তুমি এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিলে আমি বাঁচতে পারব না, বিশ্বাস করো।”
নয়ন ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তারার কথা যত শুনছে তত রাগ বাড়ছে। নিজের সব কালকে শেষ করে আজকে এসব করার মানে খুঁজে পাচ্ছে না নয়ন। তারাকে ও কিছুতেই সহ্য করতে পারছেনা। আজকে ও যত যা বলুক, সবাই যতই বিশ্বাস করুক। কিন্তু কালকে যেই মানুষ গুলো উপস্থিত ছিল, সেই মানুষগুলো তো আর এসব বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার কথাও না। যা রটার তাতো এক রাতেই রটে গেছে। জাহানারা বেগম তারাকে নয়নের থেকে ছাড়িয়ে এনে বললেন,
“কী করছিস এসব? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?”
তারা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলতে লাগল,
“হ্যাঁ, মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। তোমরা কেউ আমার কথাটা শুনছো না। আমি দোষ করেছি, অন্যায় করেছি। ‘কিন্তু কেনো করেছি?’ এটা কেউ শুনতে চাচ্ছো না। পৃথিবীর কোনো মেয়ে কি চায় তার চরিত্রে দাগ লাগুক? ‘সমাজের লোক মেয়েটাক চরিত্রহীন, নোংরা মেয়ে বলুক’ এটা কেউ চায়? তোমরা কেনো বুঝতাছো না? আমি পরিস্থিতির স্বীকার। আমার কাছে ওই মুহূর্তে সব স্বীকার করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। চাচ্চু আর ফাহিম ভাইয়া আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছে। তারা বাবা-ছেলে মিলে আমাকে আর আমার পরিবারকে ধ্বংস করার খেলায় নেমেছে।”
তারার কথা শুনে জাহানারা বেগম আর নয়ন দুজনেই অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো। ফাহিমের কথা না হয় জানত ওরা। কিন্তু ‘মোস্তফা সাহেব’ তার নাম কেন আসছে এখানে? জাহানারা বেগম বেশ অবাক স্বরে বলে উঠলেন,
“ছোটভাইজান! কী বলছিস তুই এসব? পাগল হয়ে গেছিস? ছোট ভাইজানের নাম কেনো আসছে এখানে?”
বলেই থামলেন। তারা পুনরায় বলে উঠল,
“হ্যাঁ, তোমার ছোটভাইজান! যার ভদ্র মুখোশের আড়ালে নোংরা রুপটা তোমরা কেউ দেখোনি।”
জাহানারা বেগম এবার ধমকে উঠলেন,
“তারা! আর একবার তুই আবোল-তাবোল বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না৷ যে মানুষটা তোকে নিজের মেয়ের মতো ভাবে, সেই মানুষটাকে নিয়ে তুই এসব বলছিস? তোর কি বিবেক, বুদ্ধি বলতে কিছু নেই?”
জাহানারা বেগম ভাইয়ের নামে এসব শুনে নিজেকে শান্ত রাখতে পারছেন না কিছুতেই৷ নয়ন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু এখন মুখ খুলল। শান্ত বানীতে বলল,
“আম্মু, তারাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে দাও। তারা তুই বল। আমি শুনছি।”
নয়নের অভয়বাণী পেয়ে তারা কিছুটা সাহস পেলো এবার। শান্ত স্বরে বলতে লাগল,
“চাচ্চু, আমাকে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায়। আমার বাবার নামের শেষ সম্পত্তির ও ব্যবসার অংশ তাদের নামে করে নিতে চায়৷ তোমরা হয়ত জানো না, চাচ্চু বাবার কাছে প্রস্তাব ও রেখেছিল। কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না বলে বাবাও প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। সেই থেকে চাচ্চুর আমার আর আমার বাবা দুজনের উপরেই রাগ ছিল। তোমাদের লোক চক্ষুর আড়ালে সে আমাকে প্রতিদিন হুমকি দিতো। বাজে ভাবে ভয় দেখাতো। কিন্তু আমি কখনোই তার হুমকিতে ভয় পেতাম না। উল্টো প্রতিবাদ করতাম। বাড়ির কাউকে এই বিষয় বলার সাহস হয়নি। কারণ, আমি চাইনি আমাদের পরিবারটা ভেঙে যাক। আমি ঘুমের যে কিছু টের পাইনা তা তোমরা খুব ভালো করেই জানো। আমি তো রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে ঘুমাই। কিন্তু সেদিন আমরা সবাই অনেক রাত অব্দি জেগে ছিলাম। নয়ন ভাই, তুমিও তো ছিলে আমাদের সাথে, বলো? ফাহিম ভাইয়াও তো ছিলো আমাদের সাথে। আমরা সবাই মিলে তো ছাদে আড্ডা মে-রে প্রায় ভোররাতে দিকে যে যার রুমে গিয়েছিলাম৷ আমার চোখে এত ঘুম ছিল যে, আমি দরজা বন্ধ না করেই সুয়ে পড়েছিলাম। হুট করে ঘুমের মধ্যে টের পেলাম কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরে সুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারছিলাম না কে সে? যখন ভয় পেয়ে চোখ খুললাম তখন দেখলাম ফাহিম ভাইয়া আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে…।”
এইটুকু বলে থামল তারা। এর পরের ঘটনাটা নয়নের জানা। সকাল নয়টা বেজে গিয়েছিল, কিন্তু তারা তখনো ঘুমে ছিল। বিয়ে বাড়িতে কেউ এত বেলা অব্দি ঘুমায় না। সবাই যখন যে যার কাজে ব্যস্ত তখন নয়ন খেয়াল করল তারা নেই৷ তাই তারাকে ডাকতে ওর রুমে গিয়েছিল৷ আর তখনেই তারা আর ফাহিমকে নয়ন এক বিছানায় দেখে নিয়েচিল। কিছু সময়ের জন্য নয়ন তারাকে অবিশ্বাস করলেও যখন দেখল তারা ফাহিমকে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দিয়েছিল, তখন নয়ন বুঝতে পেরেছিল এটা ফাহিমের কাজ। তারা কিছুসময় থেমে আবার বলতে শুরু করল,
“সেদিন যখন আমি সবার সামনে সত্যিটা বলার জন্য মুখ খুললাম তখন বার বার ফাহিম ভাই আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে৷ যখন ফাহিম ভাইকে তুমি মা’রতে ছিলে, তখন সবাই তোমাকে থামানোর জন্য ব্যস্ত ছিল। ওই টাইমে চাচ্চু আমার কাছে এসে সবার আড়ালে বলেছিল ‘আমি যদি ওই মুহূর্তে সবটা নিজের মুখে না স্বীকার করি, তাহলে সে…। ”
তারার কথার মাঝেই নয়নের মনে পড়ল, ‘ফাহিম তারাকে কেন ব্লাকমেইল করছে?’ প্রশ্নটা মাথায় আসতেই নয়ন সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল,
“তুই এসব কথা বাদ দে। আসল কথাটা বল এখন।”
“কোনটা?”
তারার পাল্টা প্রশ্নে নয়ন দাঁত মুখ খিচে প্রশ্ন করল,
“এত কথার মাঝে তুই তো আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেলি। ফাহিম তোকে কেন ব্লাকমেইল করে?”
তারা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমার ড্রেস চেঞ্জ করার একটা আপত্তিকর ভিডিও আছে তার কাছে…।”

#চলবে

[বানান ভুলগুলো ক্ষমা করবেন। অনেক তাড়াহুড়োয় লিখেছি। রি-চেক দেওয়া হয়নি]

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৩

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তৃতীয়

রাস্তার মাঝে ফাহিম পেছন থেকে তারার কাঁধে হাত দিতেই, তারা ফাহিমের দিকে অগ্নী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হাতটা নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে নিয়ে গর্জন করে বলে উঠল,
“আর একবার যদি আমার গায়ে আপনি হাত দেন, আমি ভুলে যাব আপনি আমার বড়। পায়ের জুতো খুলে মা’রব আপনার মুখে। অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি আর না।”
তারার কথা শেষ হতেই ফাহিম হাসল। শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“তুই রাগলে তোকে দেখতে খুব মিষ্টি লাগে রে, তারা।”
তারার রাগটা এবার তরতর করে বেড়ে উঠল। ফাহিমের প্রতি ঘৃণায় চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল। এতটা বেহা’য়া হয় কী করে মানুষ! তারা দাঁতে দাঁত চে’পে বলে উঠল,
“আপনি কোন মাটি দিয়ে তৈরি বলুন তো? আপনার ভেতর কি সামান্য পরিমাণ লজ্জাবোধ নেই? একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন আপনি। একটুও অনুশোচনা হচ্ছে না?”
ফাহিমের মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে গেলো। নিম্ন স্বরে বলে উঠল,
“বিশ্বাস কর, আমি এসব কিছু চাইনি। আমি কখনো তোর সম্মান নষ্ট করতে চাইনি। কিন্তু, কী করব বল? চোখের সামনে তোকে অন্য কারোর হতে দেখতে দিতে পারব না আমি।”
ফাহিমের কথা শেষ হতে না হতেই তারা শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“তাইলে মে’রে ফেলুন আমাকে।”
ফাহিম আঁতকে উঠল। চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভয়ে বুকটা ধক করে উঠল। ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল,
“তারা! কী বলছিস এসব?”
তারার চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে এক রাতেই। তারা এবার শব্দ করে কান্না করে উঠল। কান্নারত স্বরে বলতে লাগল,
“হ্যাঁ! মে’রে ফেলুন আমাকে। এমনিতেও আমি বাঁচতে পারব না। এত বড় কলঙ্কের বোঝা নিয়ে কেউ বাঁচতে পারে বুঝি? আমি তো এক রাতেই হাঁপিয়ে গেছি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল বার বার। আমি হয়ত পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট মেয়ে যে, নিজের গায়ে নিজে দাগ লাগিয়েছি। আপনার হুমকিতে ভয় পেয়ে আমি সবথেকে বড় ভুল করেছি। আমি আর বাঁচতে পারছিনা ফাহিম ভাই? আমাকে মে’রে ফেলুন প্লিজ। আ’ত্ম’হত্যা মহাপাপ না হলে কাল রাতেই নিজেকে শেষ করে দিতাম। চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি বিশ্বাস করুন। আমাকে প্লিজ মে’রে ফেলুন। এতটা যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। হয় আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন, নয়তো মে’রে ফেলুন। মে’রে ফেলুন আমাকে। মে’রে ফেলুন।”
কথাগুলো বলতে বলতে তারা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ল। পাগলের মতো শব্দ করে কান্না করতে লাগল। ফাহিম নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে তারাকে এভাবে কাঁদতে দেখে নিজের ভেতরে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে৷ সত্যি বলতে ফাহিমের ভেতরে ভেতরে অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারছেনা। কারণ ও যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তারাকে নিজের করে নিবেই। ফাহিম হাঁটু ভেঙে বসল। তারার গালে হাত রাখার জন্য হাত বাড়াতেই, তারা ছিটকে হাত সরিয়ে ফেলল। চিৎকার করে বলল,
“ছোঁবেন না আমাকে।”
ফাহিমের হাত কাঁপছে। তবুও শান্ত স্বরে বলল,
“এভাবে কাঁদিস না প্লিজ। আমি সব ঠিক করে দিব। সবটা ঠিক করে দিব। আমি ভুল করেছি। অন্যায় করেছি। আমি নিজের সব দোষ মানছি। কিন্তু, বিশ্বাস কর আমি তোকে ভালোবাসি। সত্যিই অনেক ভালোবাসি, তারা। আমি সব ঠিক করে দিব, আমার জান। তবুও এভাবে কাঁদিস না।”
তারা অশ্রুসিক্ত নয়নে ফাহিমের দিকে তাকাল। কান্নারত স্বরেই বলতে লাগল,
“সব ঠিক করে দিবেন! সিরিয়াসলি? কী ঠিক করবেন আপনি? পারবেন আমার হারানো সম্মান আমাকে ফিরিয়ে দিতে? পারবেন আমার শরীর থেকে কলঙ্কের দাগ মুছে দিতে? পারবেন, বলেন?”
ফাহিম উত্তরে নিশ্চুপ হয়ে রইল। তারা কিছু বলল না। দুই হাতে চোখের পানিগুলো মুছে নিলো। উঠে দাঁড়াল। শক্ত স্বরে বলল,
“যদি আমাকে এক বিন্দু পরিমান সত্যি ভালোবাসেন, তাহলে দয়া করে আমাকে আটকাবেন না। ”
বলেই এগিয়ে চলল সামনের দিকে। ফাহিম সেখানেই বসে রইল। ফাহিমের চোখের কোনেও অশ্রুকণা চিকচিক করছে। কিছুক্ষণ অনেক ভাবনা চিন্তা করে, পরক্ষণেই চোয়াল শক্ত করে নিজে নিজেই বলে উঠল,
“আমি তোকে কিছুতেই অন্যের হতে দিব না। কিছুতেই না। এতে যদি আমাকে পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হতে হয়, তাহলে আমি তাতেই রাজি৷ ভালোবেসে না হয়ে নিকৃষ্ট হলাম। দোষ কী তাতে?”




নয়ন সারারাত ঘুমাতে পারেনি। বিছানার উপর ছটফট করছে। কাল রাতে জাহানারা বেগম জানিয়েছেন, তারা আর ফাহিমের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। তনয়াদের বিয়ের পরেই তারা আর ফাহিমের বিয়েটা সেরে ফেলবেন। এসব শুনে নয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও এখানে থাকবে না। মা’কে নিয়ে চট্রগ্রাম চলে যাবে। সেখানেই নিজের জীবনটা নিজের মতো করে সাজাবে। নিজের ভেতরের যন্ত্রণা কমাতে ফজরের নামাজ পড়ে নয়ন ছাদে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করে চোখ গেলো বাড়ির মেইন গেটের দিকে। সেখান দিয়ে তারা হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে আসছে। তারাকে দেখেই নয়নের বুকের যন্ত্রণাটা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলে। আবার এত সকালে তারাকে এখানে দেখে অবাক হলো বটে। তারা বাড়ির ভেতর ঢুকে আসতেই নয়ন ছাদের থেকে নেমে এলো। দরজার সামনে আসতেই তারার মুখোমুখি পড়ে গেলো। নয়নকে হুট করে এভাবে সামনে দেখে তারা ঘাবড়ে গেলো কিছুটা। তারার মুখের দিকে তাকিয়ে নয়নের বুকটা মুচড়ে উঠল। মেয়েটা একদিনেই ভেঙে গেছে পুরো। চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। তাই আরো বেশি মায়াবী লাগছে। গায়ের ওড়নাটা মাথায় প্যাঁচানো। বেশি কান্না করায় গাল দুটো ফুলে আছে। ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। নয়নের খুব ইচ্ছে করছে তারাকে বুকের ভেতর ঝাপটে ধরতে। ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে হাত বাড়াল তারার দিকে। পরক্ষণেই আবার গুটিয়ে নিলো নিজেকে। তারা এখন অন্যের আমানত। ভেবেই নয়ন দু-কদম পিছিয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,
“তুই এখানে কেন?”
তারা যেন ওই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে এসেছে। তাই দেরি না করে উত্তর দিলো,
“তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে, নয়ন ভাই।”
নয়ন মুখ ফিরিয়ে নিলো। কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,
“আমার তোর সাথে কোনো কথা নেই। চলে যা এক্ষুনি।
তারা এগিয়ে আসল। নয়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসহায় স্বরে বলে উঠল,
“প্লিজ, নয়ন ভাই আমাকে এভাবে তাড়িয়ে দিও না। আমার কথাগুলো একবার শুনো।”
নয়নের সাহস নেই তারার চোখে চোখ রাখার। কেন জানিনা মন বলছে তারার কথাগুলো শোনা দরকার। তাই দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে বলল,
“কী কথা আছে, শুনি?”
তারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কাঁপা-কাঁপি হাতে হাত রাখল নয়নের দুই গালে। অসহায় চোখ তাকাল নয়নের দিকে। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে তুমি ভালোবাসো, তাইনা?”
….
“বলো না আমাকে ভালোবাসো?”
….
নয়নকে প্রতিউত্তরে এবারও চুপ থাকতে দেখে তারা অধৈর্য্যের স্বরে বলল,
“প্লিজ, চুপ করে থেকো না। বলো না, ভালোবাসো?”
নয়ন তারার হাত দুটো সরিয়ে নিলো। শক্ত স্বরে বলে উঠল,
“এ সমস্ত আজাইরা কথা বলার থাকলে তুই এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। নয়ত আমি কী করব নিজেও জানিনা।”
তারার চোখ বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। থেমে থেমে বলতে লাগল,
“আমি যদি তোমাকে কিছু বলি, বিশ্বাস করবে আমাকে?”
“বিশ্বাস করার মতো হলে করব।”
তারা পুনরায় বলে উঠল,
“ফাহিম ভাই, আমাকে ফাসিয়েছে, নয়ন ভাই। আমি কালকে যা যা বলেছি সব কিছু বাধ্য হয়ে বলেছি। আমার কথাগুলো একটু শুনবে, প্লিজ। আমার অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। প্লিজ, একটু শুনো।”
“এখন এসব কথা বলার মানে কী?”
নয়নের প্রশ্নে তারা জবাব দিলো,
“কারণ আমি জানি, আমাকে আর কেউ বিশ্বাস না করলেও তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে। তা…”
তারার কথা শেষ হতে না হতেই নয়ন সজোরে গালে একটা থা’প্পড় মে’রে, তারার গাল শক্ত করে চেপে ধরল। ব্যাথা তৎক্ষনাৎ তারা শব্দ করে উঠল। নয়ন রাগে, চিৎকার করে বলে উঠল,
“কালকে এতগুলো মানুষের সামনে নিজের সাথে, নিজের পরিবারের সম্মান নষ্ট করার আগে একথাটা মাথায় আসেনি? কালকে নিজের হাতে তুই তোর সাথে, তোর পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে, এখন এসেছিস নাটক করতে?”

#চলবে

[ভুল গুলো ক্ষমা করবেন। খুব তাড়াহুড়োয় লিখেছি।]

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০২

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দ্বিতীয়

নিজের চরিত্রে নিজেই দাগ লাগানোর মতো বিষাক্ত অভিজ্ঞতা কোনো মেয়ের জীবনে না আসুক। সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে চারদিকে। চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পরিবেশ৷ উত্তর দিকের জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া রুমের ভেতরে ঢুকছে। তারা মেঝেতে বসে আছে। মাথাটা খাটের এক কোনে ঠেকানো। চোখ থেকে পানি পড়তে পড়তে গালের এক পাশে দাগ বসে গেছে। চোখ দুটোও ভয়ংকর ভাবে ফুলে, লাল হয়ে আছে। সারাদিন কিছু না খাওয়ায় শরীরটাও এবার বড্ড দূর্বল লাগছে। সারাদিনে তনয়া, রুবিনা বেগমসহ অনেকেই ডাকাডাকি করে গেছে। কিন্তু কেউ তারাকে ঘর বের করতে পারেনি। বাড়ি জুড়ে নিরবতা চলছে। মেহেন্দীর অনুষ্ঠানটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারা আজ বড্ড শান্ত। যে মেয়ে সারাদিন পুরো বাড়ি লাফিয়ে বেড়ায়, সে মেয়ে আজ শান্ত। তারার চোখের সামনে শুধু নয়নের চেহারা ভেসে উঠছে। নয়ন সেই যে বেরিয়েছে এখন অব্দি কোনো খোঁজ মেলেনি৷ তারা এবার ডুঁকরে কেঁদে উঠল। কান্নারত স্বরে বলতে লাগল,
“তুমি আমাকে অবিশ্বাস করলে, নয়ন ভাই। তুমি তো জানতে আমি কেমন? তবুও অবিশ্বাস করলে? একটু ভরসা করতে পারলে না আমাকে? তুমি কেনো বুঝলে না যে, তোমার তারা বাধ্য হয়েছে মিথ্যাটা বলতে?
তারার বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কী এক নিদারুণ যন্ত্রণায় ভুগছে মেয়েটা! এ যন্ত্রণার থেকে মুক্তি মিলবে কবে?



ফাহিমের ক্ষত স্থানে রিমা বেগম মলম দিতেই ফাহিম ব্যাথায় নড়েচড়ে উঠল। বিরক্তির স্বরে বলল,
“আস্তে দাও, মা।”
রিমা বেগম অসহায় মুখে বললেন,
“আস্তেই তো দিচ্ছি। কী অবস্থা করেছে আমার ছেলেটার? বলি, তোর কী হাতে শক্তি নেই? তুই কেন শুধু শুধু মা’র খেলি, বল তো?”
ফাহিমের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। হাস্যজ্বল কন্ঠে বলে উঠল,
“আমার ক্ষত তো কিছুদিন পরেই সেরে যাবে, মা। কিন্তু নয়নের বুকে যে ক্ষত দিয়েছি, সে ক্ষত যে জীবনেও সারবে না।”
রিমা বেগম ছেলের কথার মানে বুঝল না। অবুঝের মতো প্রশ্ন করলেন,
“তুই কিসের কথা বলছিস?”
ফাহিম উত্তর দিলো না। শুধু বলল,
“কিছুনা। তুমি বুঝবে না। তুমি বরং এখন নিজের ছেলের বউকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা করো। তোমাকে যেভাবে বলেছি সেভাবে গিয়ে চাচ্চুকে বুঝাও। বাকি কাজ চাচ্চু নিজেই করবে।”
রিমা বেগমের মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো। অসন্তোষ স্বরে বললেন,
“তারাকে আমার একদম পছন্দ না। কেমন সারাদিন ডিঙ্গি মেয়ের মতো সারা বাড়ি লাফিয়ে বেড়ায়। বকবক করে কানের মাছি উড়িয়ে ফেলে। বিরক্তিকর!”
রিমা বেগমের কথা শেষ হতে না হতেই ফাহিম ধমকের স্বরে বলে উঠল,
“মা। আমি তারাকে ভালোবাসি। তারাকে আমার যে করেই হোক চাই। তারার নামে একটাও বাজে কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। যাও এখান থেকে।”
ছেলের এমন ধমকে রিমা বেগম আর কথা বলার সুযোগ পেলো না। বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। ফাহিম মোবাইলের ওয়ালপেপারে তারার হাস্যজ্বল ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“স্যরি, আমার জান। বিশ্বাস কর, তোকে এভাবে কাঁদতে দেখে আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। আমি তোকে এভাবে কাঁদাতে চাইনি। কিন্তু, কী করব বল? আমি যে তোকে বড্ড ভালোবাসি। তোকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার চোখের সামনে তুই নয়নের সাথে ঘুরে বেড়াবি। অন্য একজনকে ভালোবাসবি। এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। তাই তোকে সারাজীবন আমার কাছে রাখার জন্য এই জঘন্য খেলায় নামতেই হলো। আমাকে ক্ষমা করে দিস, প্লিজ সোনা। কথা দিচ্ছি আজকেই শেষ। একবার তোকে পেয়ে যাই আর কখনো তোর চোখে পানি আসার সুযোগ দিব না। প্রমিস।”
বলেই তারার ছবিতে শব্দ করে চুমু খেয়ে, মোবাইলটা বুকের ভেতর আগলে রাখল। ফাহিমের চোখের কোনেও পানি। যতই হোক তারার প্রতি ওর ভালোবাসাটা তো সত্যি। ভালোবাসার লোভে যে ফাহিম অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেটা ও নিজেও জানেনা।



দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই জাহানারা বেগম দেখলেন নয়ন সিগারেট হাতে নিয়ে বেলকনির চেয়ারে বসে আছে। মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে আছে। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে৷ মুখটা মলিন।চোখ দুটো ফুলে আছে। ছেলেটাকে দেখেই জাহানারা বেগমের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আলতো করে হাত রাখল নয়নের কাঁধে। মায়ের ছোঁয়া পেতেই নয়ন তড়িঘড়ি করে চোখ খুলল। হাতের সিগারেট তাড়াতাড়ি ফেলে দিল। আমতা আমতা করে বলে উঠল,
“তুমি কখন এসেছো, আম্মু?”
জাহানারা বেগম উত্তর না দিয়ে পাশের চেয়ারে বসল। ছেলের এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললেন,
“ভালোবাসি, তারাকে?”
নয়ন চোখ ঘুরিয়ে নিলো। প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল,
“আমার একটু কাজ আছে, আম্মু। আমি আসি ”
বলেই উঠে দাঁড়াতে চাইল। জাহানারা বেগম ছেলেকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠলেন,
“মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়না, বাবা। তুই তো নিজের মুখেই তখন সবার সামনে বলেছিস।তাহলে এখন আমাকে বলতে প্রবলেম কোথায়?”
নয়ন সময় নিলো না। মাকে ঝাপটে ধরল দুইহাতে। বলতে লাগল,
“আমার তারা আমাকে ঠকিয়েছে, আম্মু। আমার বুকে ছু’ড়ি চালিয়েছে। বিশ্বাস করো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি আর পারছিনা সহ্য করতে। এই যন্ত্রণার থেকে ম’রে যাওয়াই ভালো।”
জাহানারা বেগম ছেলেকে আরো শক্ত করে বুকে আগলে নিলেন। তার চোখেও পানি। তার এমন শক্তপোক্ত ছেলেটা এমন ভাবে ভেঙে পড়েছে, তা সে মানতে পারছেনা। নিঃশব্দে নয়নের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ছেলের যন্ত্রণা কমার জন্য দোয়া করতে লাগলেন।



তারা কাল সারারাত ঘুমায়নি। সকাল সকাল বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। আজকে তাকে নয়নের মুখোমুখি হতেই হবে। সত্যিটা জানাতেই হবে। কালকে ভয় পেয়ে এত বড় অন্যায় মেনে নেওয়াটা তারার জীবনের সবথেকে বড় ভুল। সবার সামনে কালকে সত্যিটা বলে দিলে হয়ত আজকে তারাকে এভাবে কাঁদতে হতোনা। সবার চোখে খারাপ হতে হতো না। তারা অনেক ভেবে শপথ নিয়েছে ওর যা হওয়ার হবে, কিন্তু সব সত্যি নয়নকে জানাতেই হবে। নিজের গায়ে এর বড় একটা মিথ্যা কলঙ্কের দাগ নিয়ে তারা সারাজীবন বাঁচতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না। বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। কিন্তু এত সকালে কোনো গাড়ি পাচ্ছে না। দূরে একটা রিকশা দেখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একজন পেছন থেকে তারার হাতটা চেপে ধরল। তারার পা জোড়া থেমে গেলো। অবাক নয়নে পেছনে ঘুরে দেখল ফাহিম দাঁড়িয়ে আছে। ফাহিমকে দেখেই তারার রাগটা যেন মাথা নেড়ে উঠল। ঘৃণায় অঙ্গপ্রতঙ্গ শিরশির করে উঠল। এক টানে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। ফাহিমের দিকে তর্জনী আঙ্গুল তাঁক করে গর্জে বলে উঠল,
“আমাকে ছোয়ার বিন্দু মাত্র সাহস করলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না, ফাহিম ভাই।”
ফাহিম হাসল। হাস্যজ্বর স্বরে বলে উঠল,
“আমি তোকে ভালোবাসি, তারা। আ…।”
ফাহিম কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই তারা ফাহিমের গালে সপাটে একটা থা’প্পড় মে’রে বসল। ফাহিমের কলার দুই হাতে খাবলে ধরল। চিৎকার করে বলতে লাগল,
“ভালোবাসেন! সত্যি ভালোবাসেন! ভালোবাসার মতো পবিত্র শব্দটা আপনার মুখে মানায় না। যাকে ভালোবাসেন তার সম্মানে এতবড় একটা দাগ লাগাতে যে একবার ভাবল না, সে কোন মুখে ভালোবাসার কথা বলছে? আমারেই ভুল আমি কালকে আপনার মতো জঘন্য মানসিকতার একজনের কথায় ভয় পেয়ে মিথ্যা বলেছিলাম। নিজের প্রতি অন্যায় হওয়ার পরেও প্রতিবাদ করেনি। নিজের সম্মান নিজের হাতে নষ্ট না করে, সবার সামনে আপনার দুই গালে সপাটে থা”প্পড় মা’রা উচিত ছিল। আপনার সব কুকর্মের কথা বলে দেওয়া উচিত ছিল জোর গলায়। আর কেউ না হোক অন্তত নয়ন ভাই আমাকে বিশ্বাস করতো। আমি অনেক চুপ থেকেছি। অনেকদিন ধরে আপনার ভয়ে অনেক অন্যায় মুখ বুঝে মেনে নিয়েছি। কিন্তু আর না। কালকে আপনি সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন। এবার আমি সবাইকে সব সত্যিটা বলব। আজকেই বলব৷”

#চলবে

[ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০১

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#সূচনা_পর্ব

বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত সব আত্মীয়ের সামনে তারার গালে পর পর দুইটা থাপ্পড় মে’রে নয়ন চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“বিয়ে বাড়ির সবার চোখের আড়ালে একটা ছেলের সাথে একা রুমে কি করে যেতে পারলি তুই, তারা? এতটা নির্লজ্জ হয়ে গেছিস! ছিহ! ভাবতেই আমার তোর প্রতি ঘৃণায় গা শিরশির করে উঠছে।”
নয়নের কথা শেষ হতে না হতেই তারার দুই চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। লজ্জা আর ব্যাথায় তারা ঠিক কোথায় মুখ লুকাবে বুঝতে পারল না। গাল দুটো ব্যাথায় জ্বলছে। গালে হাত দিয়ে,অশ্রুসিক্ত নয়নে সবার দিকে একবার নজর দিলো। বাড়ির সবাই নয়ন আর তারার দিকে চেয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। তারা এবার শব্দ করে কান্না করে উঠল। তাতে নয়নের রাগটা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“চুপ! একদম চুপ! একদম আমার সামনে ন্যাকা কান্না কাঁদতে আসবি না। তোর মতো নির্লজ্জ মেয়ে একটাও দেখিনি। এই শিক্ষা দিয়েছে তোকে, মামা আর মামনি? ছিহ!”
বাড়ির সবাই এখনো নিরব। তারার বাবা সোফায় বসে আছে শান্ত হয়ে। নয়নের মা এবার নয়নের দিকে তেড়ে গেলো। ধমকের স্বরে বলতে লাগলেন,
“নয়ন, তোর স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার ভাইয়ের বাড়িতে দাঁড়িয়ে, আমার ভাইয়ের মেয়ের গায়ে হাত তুলছিস? তাও আবার এতগুলো লোকের সামনে! কোন সাহসে তুই ওর গায়ে হাত দিলি?”
নয়ন রাগে দাঁত কটমট করতে করতে বলল,
“তার আগে তুমি তোমার আদরের ভাইঝিকে জিজ্ঞেস করো, ও একটা ছেলের সাথে একা রুমে দরজা বন্ধ করে কি করছিল?”
কথাটা শুনেই উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। তারার বাবা এখনো কিছু বললেন না। কিন্তু তারার মা রুবিনা এবার গর্জে উঠে বললেন,
“নয়ন! কী বলছিস এসব তুই? তারা কেমন মেয়ে সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস, তবুও কেন এসব বলছিস?”
নয়ন প্রতি উত্তরে কড়া স্বরে বলল,
“ভুল চিনতাম, মামনি। তারাকে আমি ভুল চিনেছিলাম। নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কিভাবে, বলো?”
আহসান সাহেব এবার মুখ খুললেন। শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করলেন,
“নয়ন, আমি তোর কথা এখনো বুঝতে পারছিনা। কী হয়েছে সেটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বল তো বাবা। ”
নয়ন সোজাসাপটা উত্তর দিলো,
“তারা আর ফাহিমকে আমি একই রুমে, একই বিছানায় ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছি, মামু।”
কথাটা শুনেই আহসান সাহেব সোজা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। বাড়ির সকলের চক্ষু যেন চড়ক গাছে। তারা কথাটা শোনার সাথে সাথে দুই হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“চুপ করো, নয়ন ভাই। কীসব বলছো তুমি? তুমি যা দেখেছো তা সত্যি নয়। ফাহিম ভাই আর আমি…।”
তারার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার আগেই, একজন বলে উঠল,
“তারা আর আমি কাল সারারাত একসাথে ছিলাম।”
কথাটা তারার কানে পৌঁছাতেই তারা পেছনে ফিরে দেখল ফাহিম দাঁড়িয়ে আছে। উপস্থিত সবাই এখনো সব কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ফাহিম কথাটা বলে সামনে এগিয়ে আসল। নয়ন চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে ফাহিমের দিকে। তারা অবাক স্বরে বলে উঠল,
“এসব আপনি কী বলছেন, ফাহিম ভাইয়া? আমি আপনার সাথে কাল রাতে ছিলাম না। আপনি…।”
ফাহিম তারাকে থামিয়ে দিলো। বলে উঠল,
“তারা মিথ্যা কেন বলছো? ভয় পেও না। আমি তোমার পাশে আছি। সত্যিটা সবার সামনে স্বীকার করে নাও। কেউ তোমাকে বকবে না। আমি আছি তো।”
তারার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। থম মে’রে গেলো মুহূর্তেই। ফাহিম এবার সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আমি আর তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসি, চাচ্চু। আমরা নিজেদের ইচ্ছায় দুজন দুজনের কাছাকাছি এসেছি, এটা বলতে আমার কোনো লজ্জা নেই। এবার আপনাদের যা করার আপনারা করে নিন।”
তারার এবার চুপ করেই রইল। কোনো উত্তর দিলো না। নয়ন আর সহ্য করতে পারল না। দুই হাতে ফাহিমের শার্টের কলার খাবলে ধরল। ফাহিমের নাক বরাবর ঘু-ষি মে’রে বলে উঠল,
“তুই কোন সাহসে আমার তারার দিকে হাত বাড়িয়েছিস? কোন সাহসে আমার তারাকে ভালোবাসার কথা বলছিস?”
বলেই আরো কয়েকদফা ঘু’ষি মারা শুরু করল। ফাহিমও কম যায় কিসে? দুজনে মিলে মুহূর্তেই এক্টা ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেলো। বাড়ির বাকি সবাই মিলে ওদের দুজনকে থামানোর চেষ্টা করছে। তারা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নয়ন একাধারে ফাহিমকে ঘু’ষি মে’রেই যাচ্ছে। ফাহিমের নাক দিয়ে ইতোমধ্যে রক্ত পড়া শুরু হয়ে গেছে। তবুও নয়ন থামছে না। পরিস্থিতি খারাপ দেখে আহসান সাহেব জোরে চ্যাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“নয়ন, ফাহিমকে ছেড়ে দে। আমার সম্মান এভাবে আর নষ্ট করিস না তোরা।”
নয়ন ছাড়ল না। ওর কানে এখন আর কোনো কথা ঢুকছে না। তারা আর চুপ করে থাকতে পারল না৷ তারা খুব ভালো করেই নয়নকে চিনে। নয়ন কিছুতেই থামবার পাত্র নয়৷ তারা এবার জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“নয়ন ভাই, থামো প্লিজ। আমি ফাহিমকে ভালোবাসি। ওকে আর মে’রো না।”
নয়ন থেমে গেলো। বিস্মিত চোখে তাকাল তারার দিকে। ফাহিমকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চুপে উঠে দাঁড়াল। ফাহিমের মুখে জয়ের হাসি। পরিস্থিতি কয়েক মুহূর্তের জন্য থমথমে হয়ে গেলো। এক বিষাক্ত নিরবতা ছেয়ে গেলো পুরো বাড়িতে৷ নয়ন কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হনহন করে চলে বাড়ির বাইরে। নয়ন চলে যেতেই তারা হাউমাউ করে কান্না করে উঠল। তনয়া দৌড়ে এসে তারাকে জড়িয়ে ধরল। তনয়া হলো তারার বড়বোন৷ সৈয়দ বাড়ি জুড়ে আজ থেকে তনয়ার বিয়ের উৎসব শুরু হয়ে ছিল। সকাল সকাল তনয়ার মেহেন্দীর তোড়জোড় চলছিল। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেলো। কেউ বুঝতে পারছেনা। তনয়া তারার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠল,
“কাঁদে না বোন আমার। কী হয়েছিল সত্যি করে বল? সবটা খুলে বল। আর কেউ বিশ্বাস না করলেও আমি তোকে বিশ্বাস করি। আমার বোন কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না৷ প্লিজ বোন, চুপ করে থাকিস না বল আমাকে।”
তারা একাধারে কান্না করেই চলেছে। ফাহিমকে জুড়ে ফাহিমের মায়ের কান্নাকাটি চলছে। তনয়ার কথা শেষ হতেই ফাহিমের রিমা বেগম চ্যাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“ও আর কি বলবে রে, তনু? ওর সেই মুখ আছে নাকি?”
তনয়া ঝাঝালো স্বরে বলে উঠল,
“আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি,চাচি। আপনি চুপ থাকুন৷”
তনয়ার এমন ঝাঁঝালো স্বর শুনে রিমা বেগম চুপসে গেলেন। ফাহিম চুপ করে সোফায় বসে আছে। রুবিনা বেগম এবার তারাকে শান্ত স্বরেই বলে উঠলেন,
“তারা, আর চুপ করে থাকিস না। বল না, মা। ভয় পাস না। আমরা আছি তো।”
তারার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। এতক্ষণ পরে মুখ খুললেন ফাহিমের বাবা মোস্তফা। তারার সামনে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তারা, মা। তুই ভয় পাস না। আমরা সবাই তোর পাশে আছি। তুই সবটা খুলে বল তো। ফাহিমকে কি তুই সত্যিই ভালোবাসিস? নাকি ফাহিম তোর সাথে খারাপ কিছু করেছে?”
মোস্তফা সাহেবের কথা শেষ না হতেই রিমা বেগম গর্জে উঠলেন। বললেন,
“নিজের ছেলেকে অবিশ্বাস করে, অন্যের মেয়ের মুখের থেকে তুমি সত্যি শুনতে চাচ্ছো?”
মোস্তফা সাহেব চোখ রাঙিয়ে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,
“তারা অন্যের মেয়ে না। আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। আমাদের মধ্যে তোমার বা তোমার ছেলের কথা না বলাই মঙ্গল। চুপচাপ ফাহিমকে নিয়ে ঘরে যাও। ”
রিমা বেগম স্বামীর রাগে চুপ হয়ে গেলেন। ফাহিম বসে বসে তামাশা দেখছে। কোনোরকম রিয়েক্ট করছে না। রুবিনা বেগম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
“আর চুপ করে থেকে ঝামেলা বাড়িয়ে দিস না, মা। সত্যিটা বল।”
তারা এবার কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। মেয়েটা যে খুব ভয় পেয়ে আছে তা তনয়া খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। তাই বলে উঠল,
“এখন এসব ছাড়ো, মা। পরে সব জানা যাবে। যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। আমি এখন ও’কে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। বাকি আলোচনা পরে হবে। ”
তনয়া কথাটা বলেই তারাকে নিয়ে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আহসান সাহেব চ্যাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“সত্যিটা না বলা অব্দি, তারা এক পাও এখান থেকে নড়তে পারবে না।”
তারা থেমে গেলো। এবার চুপ করে রইল না। আহসান সাহেবের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। খুব শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
“এতক্ষণ এখানে যা যা শুনেছো সব সত্যি, বাবা। আমি ফাহিম ভাইকে ভালোবাসি। আর কাল সারারাত আমি তার সাথেই, তার ঘরে এক বিছানায় ছিলাম। বাকিটা আশা করি তোমাদের ব্যাখা দিতে হবে না। আমা…।”
তারা সম্পূর্ণ কথা শেষ না হতেই তারার গালে সজোরে থাপ্পড় মে’রে বসলেন আহসান সাহেব। তারা ঘাবড়ালো না। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এই থাপ্পড়টার অপেক্ষায় ছিল। আহসান সাহেব পর পর দুটো থা’প্পড় মে’রে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
“আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে তুই আমার মেয়ে। তোকে আমি জন্ম দিয়েছি। ছিহ! আজ থেকে আমার কাছে তুই মৃত৷ আজ থেকে আমার একটাই মেয়ে।”
বলেই তিনি নিজের ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করল। রুবিনা বেগম মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর পেছনে দৌড়ে গেল। রিমা বেগম ফাহিমকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য তারাকে কিছু বাজে কথা শুনাতে ছাড়েনি। মোস্তফা সাহেব অন্যান্য লোকজনদের বিদায় দিতে ব্যস্ত। তনয়াও পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে, বাবাকে বুঝানোর জন্য আহসান সাহেবের রুমের দিকে গেলো। একে একে সবাই চলে গেলেও থেকে গেলো। তারা ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বসে আছে। নিশ্চুপ হয়ে৷ চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শান্ত ভঙ্গিতে বসে বসে চোখের পানি বির্সজন দিচ্ছে। হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠল। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
“একটা ভুলের শাস্তি এতটা ভয়ানক কেন হলো? কেন আমাকে এভাবে একা করে দেওয়া হলো? কেনো? কেনো? শুধুমাত্র ভালোবাসার অপরাধে?”

~ইন_শা_আল্লাহ _চলবে~

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৫১ এবং শেষ পর্ব

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
অন্তিম_পর্ব
~মিহি

বিয়ের বিষয়টা একান্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসলো চিত্রলেখা। একরকম জেদই ধরলো সে অপর্ণার বাবা মাকে বিয়েতে আনার। তাদের কাছে ক্ষমা না চেয়ে সে নিজের দাম্পত্য জীবন শুরু করতে চায় না। পরিস্থিতির কারণে হলেও অপর্ণার মৃত্যুতে খানিকটা দায়ভার তো চিত্রলেখারও। অর্ণব এ যুক্তি খণ্ডাতে পারলো না। বাধ্য হয়েই অপর্ণার বাবা মাকে ডেকে পাঠালো সে। তাদের মেয়ের মৃত্যুর তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে তারা এ বাড়িতে আসেননি। অর্ণব দুয়েকবার রূপসা রাদিফকে ও বাড়িতে রেখে এসেছে। এমন অবস্থায় তারা এখানে আসবেন কিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে অর্ণব তবুও সে বোনের খাতিরে তাদের ডেকেছে ঠিকই। অর্ণব বিয়ের যাবতীয় কাজকর্ম দেখছে। খাবার দাবারের ব্যবস্থা বাইরে থেকে করা হয়েছে। সাথীর এখন প্রেগ্ন্যান্সির সাড়ে তিন মাস চলছে। সে এসেছে গত পরশু। অনিকও অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে বোনের বিয়ে উপলক্ষে। সাথীকে পুরোপুরি বিশ্রামেই রেখেছে সবাই। তার প্রেগ্ন্যান্সিতে কিছু জটিলতা আছে বিধায় সবসময় তাকে নজরে রাখতে হয়। সায়রা খালা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ, তিনি সর্বদা সাথীর আশেপাশেই থাকেন। রূপসা রাদিফও আজ বেশ খুশি। রঙ্গন বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেই তাদের মন জিতে নিয়েছে। বাচ্চা দুজন এসবের মাঝে নিজের মাকে ভুলে থাকার চেষ্টায় করে চলেছে। তারা জানে তাদের মা কোথাও লুকিয়ে থেকে তাদের দেখছে, বাস্তবতা বোঝার মতো ক্ষমতা তাদের এখনো হয়নি।

চিত্রলেখা লাল শাড়ি পড়েছে। রঙ্গনের পছন্দ করা শাড়ি আর রঙ্গন তার পছন্দ করা পাঞ্জাবি পড়বে। সাজসজ্জার দিকে বিশেষ নজর দিল না চিত্রলেখা। ঘরোয়াভাবে বিয়ে, সেহেতু বাড়তি সজ্জা সেজে নিজের বিবাহপূর্ব ঔজ্জ্বল্য আড়াল করার মানে হয়না। সাথী পাশে বসে দেখছে। এই মেয়েটাকে খুশিতে দেখার জন্য সে সর্বদা সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া চাইতো। সৃষ্টিকর্তা অবশেষে তার দোয়া কবুল করেছেন।

_______

অপর্ণার বাবা-মা যখন চিত্রলেখার ঘরে এলেন তখন চিত্রলেখা মাত্র আয়নার সামনে থেকে উঠতে ধরেছে। ঘরে একা সে, সাথী একটু আগেই বাইরে গিয়েছে। চিত্রলেখা বিব্রতবোধ করলেও নিজেকে সামলে তাদের সালাম দিল। অপর্ণার মা আন্তরিক ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন।

-ভালো আছো মা? বিয়ের জন্য অনেক শুভকামনা।

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি। আপনারা এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনাদের দোয়া না পেলে আমি আমার নতুন জীবন শুরু করতে পারবো না। আমি জানি ভাবীর মৃত্যুর শোক আপনারা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, আমায় দেখে খুব রাগও হতে পারে। আমি আপনাদের কাছে কিভাবে ক্ষমা চাইবো তাও জানা নেই আমার। আপনারা আমায় দয়া করে দোষী ভাববেন না।

-লেখা, ক্ষমা আমার চাওয়া উচিত। তোমাকে আমি অনেক বাজে কথা বলেছি, অপর্ণাকে অনেক কুবুদ্ধিও আমি শিখিয়েছি। এসব নিয়ে আমার মৃত মেয়ের উপর রাগ জমিও না। মাফ করে দিও মা।

-ভাবীর প্রতি আমার কোনো রাগ নেই আন্টি। আপনারা আমার জন্য দোয়া রাখবেন এটাই আমার চাওয়া শুধু।

-ফি-আমানিল্লাহ। সুখী, দীর্ঘজীবী হও এবং সংসারে আলো বয়ে নিয়ে আসতে পারো যেন।

অপর্ণার বাবা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখ নিচের দিকে। তিনি কিছু বলতে পারছেন না। অপর্ণার মায়ের চোখ ছলছল করছে। চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলেন তিনি। অতঃপর চিত্রলেখার হাতে একটা ডায়েরী ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”শেষ পৃষ্ঠাটা পড়ো সময় হলে।” চোখের জল আর বাধ মানলো না তার। মুখে আঁচল গুঁজে তিনি তৎক্ষণাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। পিছু ডাকতে গিয়েও পারলো না চিত্রলেখা। একজন মায়ের কান্না মানে তার মেয়ের জন্য জমানো শত অনুভূতি, সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তার নেই। চিত্রলেখা ডায়েরীটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে এক সন্তানহারা পিতা মাতার নীরব আর্তনাদ প্রত্যক্ষ করলো। ডায়েরিটা খোলার জন্য তার মন আনচান করতে লাগলো। ধৈর্যধারণ করতে না পেরে সে শেষ পৃষ্ঠাটা বের করলো,

“অনুষ্ঠানগুলোতে আর আমার প্রয়োজন পড়ে না। বাবা-মাও খোঁজ নিলো না। সবার আদরের মেয়ে থেকে বোঝা হয়ে যাওয়ার অনুভূতিটা দারুণ। রক্তের সম্পর্কেও এমন করে পর করে দেওয়া হয়! আমি তাদের আপন হয়েও বোঝা হয়ে রইলাম। প্রতিপদে আমাকে, আমার বাচ্চাদেরকে পরোক্ষভাবে কটাক্ষ করা হয়। কেন যেন আজ চিত্রলেখার কথা বড্ড মনে পড়ছে। কতটা অত্যাচার করেছি তাকে তার ভয়াবহতা মনে পড়ছে। কখনো সুযোগ পেলে ক্ষমা চেয়ে নিব। দুঃখিত চিত্রলে…”

এরপর আর লিখতে পারেনি অপর্ণা। শেষ পৃষ্ঠাটা বেশ কুঁচকানো। চিত্রলেখার চোখের সামনে সেদিনের নারকীয় দৃশ্যের এক ঝলক কল্পনায় ভেসে উঠতেই তার আত্মা চমকে উঠলো। সৃষ্টিকর্তার কাছে সে কেবল অপর্ণার শান্তি কামনা করে দোয়া করলো। মানুষটা অনুতপ্ত ছিল, ক্ষমাও চাইতে চেয়েছিল তবুও কী নির্মম মৃত্যু! এর চেয়ে কঠিনতম মৃত্যু কামনা করলো চিত্রলেখা নওশাদের জন্য। আশেপাশে তাকালো সে। ডায়েরিটা ফিরিয়ে দিতে হবে। মেয়ের শেষ স্মৃতিটুকু চিত্রলেখা তার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে চায়। অতঃপর সে সব অতীত ভুলে নবজীবনে পা ফেলবে।

____________________

-অন্যায় হিসেবি লোকটার শাস্তি কম হয়ে গেল না মা?

-তুমি যা দেখতে পাও, সেটুকুই কি সবসময় সত্য?

-মানে?

-তোমার মা কখনো কাউকে প্রাপ্যের কম শাস্তি দেয় না রঙ্গন। নওশাদের সাথে এখন কী হচ্ছে তা বাইরের কেউ জানেনা। যে সেলে সে আছে, সেখানে সে প্রতিরাতে কামনা করে এ রাতটাই যেন তার শেষ রাত হয় কিন্তু প্রতিদিন সকাল হয় এবং সে কী অত্যাচার সহ্য করে তা আমি বলবো না। এসব নিয়ে আজকের দিনে ভেবো না। আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিচে অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি এসো।

আশফিনা আহমেদের রহস্যজনক হাসির আড়ালে চাপা পড়ে থাকে কিছু রহস্য যার খোলাসা হয় না। রঙ্গন মুচকি হাসে, মায়ের এ স্বভাবের সাথে সে পরিচিত। রঙ্গন চুপিসারে নিজের বিছানার নিচ থেকে একটা ছবি বের করে। এই ছবিটা তার অ্যালবামের প্রথম ছবি যেটা তার মা সবসময় তার থেকে আড়াল করে এসেছে। রঙ্গন এ সত্য প্রথম জেনেছিল বছর দুইয়েক আগে। বন্ধুত্বের টানাপোড়েন নিয়ে বাড়িতে ফিরে এটা জেনে আরো অশান্তিতে পড়েছিল। অতঃপর চিত্রলেখার আগমন, মায়ের সাথে স্নায়ুযুদ্ধ। সব মিলিয়ে জীবনটা একটা এডভেঞ্চার বলা চলে। আশফিনা আহমেদ তাকে এতবছরে বুঝতে দেননি সে তার নিজের ছেলে নয়। রঙ্গনও বুঝতে দিবে না সে এ সত্য জানে। ছবিটা আবার অ্যালবামে রেখে নতুন একটা জীবন শুরু করতে চলেছে সে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল রঙ্গন।

_________________________________________

“কবুল বলতে এত সময় নিলে যে? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।” চিত্রলেখার কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলল রঙ্গন। চিত্রলেখা দূর আকাশে তাকিয়ে আছে। নিজের মা-বাবার কথা আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে তার। বিয়ের সময়টাতে মেয়েরা কেন যেন বাবা মাকেও সবচেয়ে বেশি মনে করে। রঙ্গন বোধহয় চিত্রলেখার উদাসীনতা বুঝতে পারলো।

-এই শীতের মধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে জমে যাচ্ছি অথচ আমার রঙ্গনার ঠোঁটে এখনো বসন্ত এলো না, আমারো মনে রঙ লাগলো না।

-বসন্ত আসেনি কে বললো? কবুল বলে বসন্ত বরণ করেছো না?

-বসন্ত এখনো আমাকে বরণ করেনি।

রঙ্গনের দৃষ্টি চিত্রলেখার ঠোঁট বরাবর। চিত্রলেখার মনে হলো কোনো কিছু যেন তাকে জমিয়ে ফেলছে চারদিক থেকে। সারা শরীর শিরশির করে উঠলো তার। রঙ্গন খানিকটা এগিয়ে চিত্রলেখার দু’ গালে হাত রেখে কাছাকাছি আসার কেন করলো। ঠিক সেসময় ছাদের দরজা খোলার শব্দ হলো। ছিটকে সরে গেল চিত্রলেখা। অহম ‘স্যরি স্যরি’ বলতে বলতে চোখ বন্ধ করলো। রঙ্গন চোখ কটমট করে তাকালো সেদিকে। নিষ্পাপ শিশুর মতো মুখ করলো অহম।
“ভাইয়া, তোমার তো লাইন ক্লিয়ার কিন্তু আমারটা এখন আমার সাথে চাঁদ দেখতে চাইতেছে সেটা আমার দোষ? এত সুন্দর করে বাসরঘর সাজাইছি তোমাদের, সেটা ছেড়ে ছাদে কী? যাও নিচে যাও!” অহমের কথায় রঙ্গন তেড়ে যেতে নিল তার দিকে। অহম আর মার খাওয়ার অপেক্ষা না করে নিচে দৌড় দিল। চিত্রলেখা রঙ্গনের হাত শক্ত করে ধরে তার বুকে মাথা রাখলো।

“আমি নিঃশব্দ নীরব প্রেমিকা হয়ে,
উষ্ণ আলিঙ্গনে তোমায় বাঁধবো।
আমি স্বচ্ছ চঞ্চল সরোবর হয়ে,
নীলরঙা জলে তোমায় ভাসাবো।
আমি অমানিশার চাঁদ হবো না,
দিবালোকের সূর্য হয়ে তোমায় রাঙাবো।”

চিত্রলেখার কথায় রঙ্গনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। পূর্ণতার সংজ্ঞা সে উপলব্ধি করেছে। এ পূর্ণতার প্রতীক্ষা সে করেছিল। অবশেষে চিত্রলেখাকে নিয়ে তার এক অশেষ কাব্য রচিত হলো।

সমাপ্ত

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৫০

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চাশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণার লাশ কবর দেওয়া হলো ভোরবেলা ফজর নামাযের পর। দূরের আত্মীয় স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করা হয়নি। চিত্রলেখাকে এসবের মাঝে আসতে দেয়নি অর্ণব আর না রূপসা এবং রাদিফকে আসতে দিয়েছে। বাচ্চা দুটোকে এত বড় একটা মানসিক কষ্টের মধ্যে ফেলার সাহস তার নেই। এখানে উপস্থিত সকলে পরিবারের সদস্য হলেও সবাই সবসময় ভালো কথাই বলে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেউ ভুলক্রমেও যদি বিরূপ কোনো মন্তব্য কেউ করে ফেলে তার ক্ষত নিতান্তই সামান্য হবে না। তার চেয়ে বরং চিত্রলেখা ও বাচ্চারা অপর্ণার মৃত্যুর খবর একটু দেরিতেই জানুক।

লাশ দাফনের পর অপর্ণার বাবা এলেন অর্ণবের কাছে। অর্ণব তখন এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল। পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি থাকতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না।

-অর্ণব, বাচ্চা দুটোকে এখানে রেখে যাবে কি? অপর্ণা তো নেই, অন্তত…

-অপর্ণার সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে কিন্তু রূপসা, রাদিফ এখনো তো আমার সন্তান। বাবা হিসেবে তাদের প্রতি আমার যে দায়িত্ব তা আমাকে পালন করতে দিন।

-আমি তোমাকে দায়িত্ব নিতে মানা করছি না অর্ণব কিন্তু বাচ্চা দুটো আমাদের কাছে কিছু সময় থাকলে আমাদের ভালো লাগতো।

-এ বাড়ির পরিস্থিতি কেমন আপনিও দেখতে পারছেন, সবকিছু স্বাভাবিক হলে আমি ওদের কিছু সময়ের জন্য এখানে রেখে যাবো। আমি এখন আসি।

-এসো।

অর্ণব আর দাঁড়ালো না। আগের মতো আবেগগুলো আর কাজ করে না। ডিভোর্সের সময়টুকুতে কিংবা বাচ্চাদের কাস্টাডি নেওয়ার লড়াইয়ের সময় এই মানুষগুলোই বড্ড নির্মম হয়ে উঠেছিল। তখন থেকেই আবেগ অনুভূতি অনেকখানি কমে এসেছে অর্ণবের। এখন সে শুধু তার বাচ্চাদের নিয়ে ভাবতে চায়।

চিত্রলেখার ঘুম ভাঙার পর থেকে সে অস্থির হয়ে আছে। অর্ণব আশেপাশে কোথাও নেই, কোথায় গিয়েছে বলেও যায়নি। নিজের ভাইয়ের এ হেন আচরণ চিত্রলেখাকে বড্ড বিরক্ত করছে। রূপসা-রাদিফের ম্লান মুখ দেখে চিত্রলেখার মন যেন আরো খারাপ হয়ে আসে। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে সে। রাদিফ বরাবরই একটু শক্ত স্বভাবের ছিল তবে রূপসার মলিন মুখটা বড্ড পীড়া দিচ্ছে চিত্রলেখাকে। শত চেষ্টা করেও মেয়েটার মুখে আগের মতো হাসি ফেরানো যাচ্ছে না। চিত্রলেখা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এখানকার কথা এখনো ভাবীকে জানায়নি সে। জানাতে ইচ্ছেও করছে না, ওখানে বসে চিন্তা করবে। ইদানিং চিত্রলেখার মনে হচ্ছে তার ছোট ভাবী মা হতে চলেছে। এ অবস্থায় এসব কথা কেন যেন তাকে জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার।

চিত্রলেখার ফোন বাজছে। রূপসা রাদিফকে নাস্তা দিয়ে উঠে এলো সে। রঙ্গন কল করেছে। চিত্রলেখার মনে পড়লো গতকাল ফেরার পর থেকে রঙ্গনকে একবারও কল করেনি সে। কল রিসিভ করলো সে।

-বাড়িতে ফিরে একটাবার জানাবে তো! এমনিতেই একা ফিরেছো, জানালে কী হতো?

-রঙ্গন, আসলে একদম খেয়াল ছিল না। ক্লান্ত ছিলাম খুব, এসেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ফোনের দিকে তাকানোর সময়ই পাইনি।

-ভাইয়া কেমন আছে?

-আছে একরকম। আসার পর বাড়ির পরিস্থিতি অন্যরকম দেখছি, কোথা থেকে কী হলো কিছু বুঝতে পারছি না।

-নওশাদের এরেস্ট হওয়ার কথা বলছো?

-ওটাও আবার ভাবীর হসপিটালাইজড হওয়ার ব্যাপারটাও।

-অপর্ণা ভাবী হাসপাতালে? কী হয়েছে?

-নওশাদ লোক পাঠিয়েছিল। অনেক কাহিনী এসব, দেখা করে বলবোনি। আপাতত আমার ভাবীর সাথে দেখা করা প্রয়োজন। আমি একবার ভাবীর সাথে কথা বলতে চাই।

-মাথা খারাপ তোমার? এখন এই অবস্থায় তুমি ভাবীর ওখানে যাবে? ওনার বাড়ির লোকজনের মানসিক অবস্থা ভাবো একবার! তুমি জানো তোমার দোষ নেই কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তারা কি বুঝবে সেটা? স্বাভাবিকভাবেই তাদের রাগটা তোমার উপর এসে পড়বে।

-আমার কি তবে সত্যিই যাওয়া উচিত না একবার?

-না, এখন তো ভুলেও না। ভাইয়া কখনোই তোমাকে যেতে দিবে না দেখো। সো ঐ চিন্তা বাদ দাও।

-আচ্ছা। ঘুম থেকে উঠেছো কখন?

-ঘুমালাম কখন? সারা রাত টেনশনে রেখে ঘুমের খোঁজ নিচ্ছো! এখন ঘুমাবো।

-আচ্ছা ঘুমাও। আমি বাচ্চাদের নাস্তা দিয়ে এসেছি, ওদের কাছে যাবো।

-তুমিও খেয়ে নাও। পরিস্থিতি একটু ঠিকঠাক হলেই আমি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যাবো।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখা একরাশ লজ্জার ভারে নুইয়ে পড়ে কলটা কেটে দিল। রঙ্গনের কথাগুলো তার মাথায় তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। আসলেই রঙ্গনের কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত। এমন সে কেন চিন্তা করলো না? চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে নিশ্চিন্তের হাসি ফুটে উঠে।

________________________________

অর্ণব বাড়ি ফিরলো রাত নয়টা নাগাদ। বাড়িতে দীর্ঘসময় সে থাকতে পারতো না আজ। অপর্ণার মৃত্যুতে বাইরে থেকে আবেগহীন ভাব দেখালেও মনে মনে সে কতটা ব্যথিত তা সে বোঝাতে পারবে না কাউকেই। অপর্ণার প্রতি তার মনে যে ক্ষীণ ভালোবাসা এখনো বহাল তার বহিঃপ্রকাশ সে কিভাবে ঘটাবে? অপর্ণার প্রতি তো তার কোনো অধিকার অবশিষ্ট নেই। দুজনের সম্মতিতেই এ সম্পর্ক শেষ হয়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছে এ সম্পর্কে আর ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই তবে একটা সইয়েই কি ভালোবাসা চিরতরে মুছে ফেলা যায়? দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্ণব। অতঃপর কলিং বেলটা বাজালো। তড়িৎ গতিতে দরজা খুললো চিত্রলেখা। সে যেন অর্ণবের প্রতীক্ষাতেই বসে ছিল। অর্ণব কিছু না বলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো।

-ভাইয়া!

-বল।

-এত দেরি হলো যে?

-কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

-দোকান থেকে কল এসেছিল। তুমি যাওনি দোকানে। তবে ব্যস্ততা কোথায় ভাইয়া? হাসপাতালে গিয়েছিলে বলতে পারো আমায়। আমি আর যেতে চাইবো না। আমি বুঝেছি আমার এখন যাওয়া উচিত না।

-অপর্ণা আর নেই লেখা। গতকাল রাতেই ও মারা গেছে। ওর জানাযা ছিল ভোরে।

চিত্রলেখার হাত পা শিরশির করে উঠলো। মাথাটা ঠিক চক্কর দিয়ে উঠলো নাকি ভূমিই কম্পিত হলো বুঝতে সময় লাগলো তার। নিজের ভাবীর প্রতি তার হয়তো জমানো রাগ ছিল ঠিকই তবে তার মৃত্যু কামনা সে কোনোক্ষণেই করেনি। আজ তার মৃত্যুর খবর চিত্রলেখার অন্তর কিছুক্ষণের জন্য হলেও নাড়িয়ে তুললো। চিত্রলেখা বারবার নিঃশ্বাস নিয়ে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। বাচ্চা দুটো ঘুমাচ্ছে। ওদের কথা ভেবে চিত্রলেখার চোখ ভিজে এলো।

-লেখা, বাচ্চাদের জানাস না এসব। আমিও জানিনা কিভাবে কী বোঝাবো ওদের। আমি শুধু চাই আমার বাচ্চারা কোনোরকম মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে না যাক। ওদের দায়িত্বটা আমি ভালোভাবেই পালন করতে চাই।

-আ..আচ্ছা ভাইয়া। তুমি বোসো, আমি খাবার বাড়ছি। বাচ্চারা খেয়ে ঘুমিয়েছে।

-আমি খাবোনা। তুই খেয়ে নিস।

অর্ণবের রক্তিম চোখ অনেককিছু জানিয়ে দিল চিত্রলেখাকে। চিত্রলেখার চোখের কোণেও জলেরা ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকলো। রূপসা ও রাদিফের ঘরের দিকে এগোলো সে। ঘর অন্ধকার। চিত্রলেখা গুটি গুটি পায়ে বাচ্চাদের বিছানার কাছে এসে বসলো। নোনা জল অবিরত চোখ বেয়ে গড়াচ্ছে তার। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। রূপসা কী যেন বিড়বিড় করছে। চিত্রলেখা চোখের জল মুছে রূপসার মুখের কাছে খানিকটা এগোলো। রূপসা অস্পষ্টভাবে কিছু বলছে। চিত্রলেখা কিছু বুঝতে না পারলেও মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো।

“মা..আমি আর দুষ্টুমি করবো না মা…আ..আমার কাছে..ফিরে আ..আসো মা। ভাইয়া তোমাকে ছাড়া কান্না করেছে মা..মা তুমি আসবেনা? বাবার উপর রাগ করেছো? আমাদের কী দোষ মা? আমরা ভালো হয়ে থাকবো মা…আমাদের কাছে ফিরে আসো মা। দেখো আমি গুড গার্ল হয়ে গেছি মা…”

রূপসার কথার ভারটুকু কতখানি তা চিত্রলেখার বুঝতে বাকি নেই। অপর্ণার মৃত্যুর খবর এই বাচ্চাগুলোকে কিভাবে জানাবে সে? মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে কী-ই বা জবাব দিবে সে? অদ্ভুত এক দোটানায় সৃষ্টিকর্তা তাকে ফেলেছে। প্রাপ্তির খাতা পূরণের আগেই অপ্রাপ্তির খাতা ভরে উঠছে। এ বিপরীতকরণের শেষ কোথায়?

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪৯

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনপঞ্চাশতম_পর্ব
~মিহি

লম্বা সফর শেষে চিত্রলেখার মাথা ঝিমঝিম করছে। ঠিক করলো সোজা বাসায় ফিরে অর্ণবের সাথে কথা বলবে কিন্তু রঙ্গন তাকে একা ছাড়তে চাইছে না। চিত্রলেখার রঙ্গনকে বাড়িতে নিয়ে যেতে খানিকটা ভয় কাজ করছিল মনে। নিজের ভাইকে তো সে চেনে, আচমকা রঙ্গনের উপস্থিতি বোধহয় তার জন্য হজমযোগ্য হবে না। অর্ণবের রাগ কিঞ্চিত এখনো সঞ্চিত রঙ্গনের প্রতি। অনেকক্ষণ বুঝিয়ে রঙ্গনকে বোঝাতে সক্ষম হলো চিত্রলেখা। রঙ্গন চিত্রলেখাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

চিত্রলেখা বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে মুখোমুখি হলো সায়রা খালার। আচমকা চিত্রলেখার উপস্থিতি যেন তাকে মারাত্মক ঘাবড়ে দিয়েছে। চোর ধরা পড়লে যেমন একটা হাবভাব হয় মুখের, তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন সায়রা খালা। চিত্রলেখা এ প্রতিক্রিয়ার মানে বুঝতে পারলো না। এমন অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া তো সে প্রত্যাশা করেনি।

-খালা এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? যেন ভূত দেখেছেন! ভাইয়া কোথায় বলুন তো। আমার ফোন-টোন ধরছে না কেন? ভাইয়া এসেছে তো এতক্ষণে? কোথায় সে?

-অ..অর্ণব? সে…সে তো হা..হাস..

-খালা, কী বলতে চাচ্ছেন একটু তাড়াতাড়ি বলেন। এভাবে তোতলাচ্ছেন কেন? ভাইয়া কোথায়? এতক্ষণ তো দোকান থেকে চলে আসার কথা।

-তুমি আসবে তা বলোনি কেন? জানায়ে আসবা না?

-জানানোর উপায় কই? ভাইয়ার ফোন কতসময় ধরে বন্ধ সে হিসাব আছে? ভাইয়া কোথায় বলেন তো আগে। ভাইয়ার বিচার করি আগে।

-সে বাড়িতে নেই, লেখা। ও হাসপাতালে গেছে।

-হাসপাতালে কেন? কেউ অসুস্থ?

-অ..অপর্ণা অসুস্থ। সেই থেকে অর্ণব বাড়িতে কমই আসে, বাচ্চা দুটার কাছেই থাকে।

-ভাবীর কী হয়েছে?

-ও..ওনারে কয়েকটা লোক মিলে ধর্ষণ করছিল। শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ, বাঁচবে কিনা বলা যাইতেছে না। বাচ্চা দুইটা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। আমি গেছিলাম গতকাল দেখতে।

-এই কথাটা আমাকে আগে কেন বলেননি খালা? কোন হাসপাতালে আছে ভাবী?

-অপেক্ষা করো একটু, অর্ণব এখন আসবে হয়তো বাচ্চাদের রাতে রেখে যেতে। রাতে বাচ্চারা এখানে থাকে, সকালে আবার মায়ের কাছে যাওয়ার জেদ ধরলে অর্ণব নিয়ে যায়।

চিত্রলেখা চৌকাঠেই বসে পড়লো। পৃথিবী যেন থমকে গেছে তার। সবকিছু এলোমেলো লাগছে এখন। এতকিছু হয়ে গেছে এত অল্প সময়ে অথচ তাকে কেউ জানায়নি অবধি! নিজেকে এ মুহূর্তে প্রচণ্ড অপরাধী মনে হচ্ছে চিত্রলেখার। তার জন্যই এ সবকিছু হয়েছে। নওশাদ লোকটাকে নিজ হাতে খুন না করা অবধি চিত্রলেখার যেন স্বস্তি হবে না। একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে নওশাদকে না দেখলে ডানতেও পারতো না চিত্রলেখা। সায়রা খালা চিত্রলেখাকে ধরে ওঠানোর চেষ্টা করলেন। চিত্রলেখার হাত পা অসাড় হয়ে আসছে, দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও যেন সে পাচ্ছে না। চোখের সামনে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে সে।

ঘণ্টাখানেক পেরিয়েছে। অর্ণব বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে চিত্রলেখার বিছানার পাশে এসে বসলো। এখনো জ্ঞান ফেরেনি মেয়েটার। বড়সড় একটা ধাক্কাই খেয়েছে বলা যায়। নিজের ভাবীর এ পরিণতি সেও কখনো কল্পনাতে আনেনি। স্বভাবতই ভয়ের মাত্রাটা বেশি হবে। খানিক বাদেই চিত্রলেখা চোখ মেললো। চোখ মেলে অর্ণবকে সামনে দেখে চিত্রলেখার মনের ভয় যেন আরো বেড়ে গেল। নিজের ভাইয়ের চোখে চোখ মিলানোর সাহসটুকুও কি সে পাবে এখন?

-তুই আসবি বলিসনি কেন লেখা?

-তোমায় ফোনে পাচ্ছিলাম না, রেজাল্টের কথাও জানাতে পারছিলাম না। তাই ভেবেছিলাম সামনাসামনি এসেই সবটা বলবো কিন্তু বুঝতে পারিনি এসে এসব দেখবো।

-লেখা, এসব একরকম এক্সিডেন্ট। তুই রিল্যাক্স হ।

-আমার জন্য এসব হয়েছে ভাইয়া! ঐ নওশাদ লোকটাকে আমার মেরে এখান থেকে যাওয়া উচিত ছিল।

-নওশাদ ওর ভুলের শাস্তি পাচ্ছে সে। ওকে পুলিশ এরেস্ট করেছে। ওর প্রাপ্য শাস্তি ও পাবেই।

-ভাইয়া, আমি ভাবীর সাথে একটু দেখা করতে চাই।

-কাল সকালে নিয়ে যাবো। এখন ঘুমা তুই।

চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অর্ণব। নিজের বোনকে অপর্ণার বাড়ির লোকদের সামনে উপস্থাপন করতে সামান্য ভীতবোধ করছে সে। ঐ বাড়ির সব লোকই যে চিত্রলেখার পরিস্থিতি বুঝবে তা আশাও করা যায় না। অর্ণব দ্বিধার মধ্যে পড়লো।

___________________________

রঙ্গন বাড়িতে ফেরার পর থেকে চিত্রলেখার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। একবার ভাবলো মেয়েটা বোধহয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, পরক্ষণেই নানা দুশ্চিন্তা ভর করেছে তার মাথায়। কিছুতেই মন শান্ত হচ্ছে না তার। অহমের ঘরে গিয়ে একটু আগে দেখে এসেছে অহম পড়ছে। ওর সমস্যা হবে ভেবে আর থাকেনি সেখানে। ঘরে আসার পর থেকে দুশ্চিন্তাগুলো আরো জেঁকে ধরছে তাকে। না পারছে সেগুলি ছুঁড়ে ফেলতে আর না পারছে মেনে নিতে। ভাবনার মাঝেই আশফিনা আহমেদ এলেন রঙ্গনের ঘরে। মাকে দেখে রঙ্গন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।

-ফেরার পর থেকে একবারও আমার ঘরে আসোনি কেন রঙ্গন?

-গিয়েছিলাম, তুমি কাজ করছিলে তাই চলে এসেছি।

-ডাকা যেত না? তা বাদ দাও, মন খারাপ কেন তোমার?

-কিছু না মা, এমনি। এদিকের খবর কী?

-খবর একটা দিতে পারি। ভালো খবরই বলা চলে। বলবো?

-অবশ্যই।

-নওশাদের জেল হয়েছে। এখনো যোগাযোগ মাধ্যমে খবর আসেনি, অতি শীঘ্রই ভাইরাল হবে।

-মজা করছো মা? ঐ লোকটার ক্ষমতা আমরা জানি। তোমার ভাই তো কৈ মাছের প্রাণ। আমার এত মার খেয়েও বেঁচেছে আর তো জেলে একদিন।

-না এবারের প্রমাণ শক্তপোক্ত। নিজের মুখে দোষ স্বীকার করেছে।

-কার কাছে স্বীকার করলো?

-আমার কাছে?

-তুমি ধরিয়ে দিয়েছো ওকে?

-হুম।

আশফিনা আহমেদ হাসলেন। রঙ্গনের মুখে বিস্ময়। মায়ের এ রহস্যময় রূপের সাথে সে খুব একটা অবগত নয়। সে সবসময় তার মাকে দেখেছে কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে। আজ যেন সে ব্যক্তিত্ব রহস্যের চাদরে আবৃত।

-রঙ্গন!

-জ্বী মা।

-বিয়ে কবে করবে তুমি? তোমার প্রেয়সী তো ডাক্তার হবে। তার কি সময় হবে বিয়ে করার? নাকি আগে থেকেই এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখবো? কী বলো রঙ্গন? কবে আমাদের ডাক্তার বউকে নিয়ে আসতে চলেছো এ গৃহে?

এ পর্যায়ে রঙ্গন কয়েকবার হৃদস্পন্দন মিস করলো। আজ আশফিনা আহমেদ তাকে প্রতি পদে পদেই অবাক করছে। অবশ্য মায়ের কথায় রঙ্গনের চোখে যে ঝলকানি দেখা গেল, তাতে রঙ্গন নিজের অনুভূতি আড়াল করতে পারলো না। তার চোখের চাহনি বলে দিচ্ছে সে চিত্রলেখাকে একান্ত নিজের করে পেতে কতখানি উৎসুক।

________________________________

অপর্ণা নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ছটফট করছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে গলা দিয়ে আওয়াজটুকুও ঠিকঠাক বের করতে পারছে না। নার্স তার অবস্থা দেখে অনেকাংশ ভীত হলো। চটজলদি ডাক্তার ডেকে পাঠালো সে। রাতের প্রায় আড়াইটা। দায়িত্বে থাকা একজন ডাক্তার ছুটে এলেন। অপর্ণাকে চেক করতে লাগলেন। পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারলেন তিনি। পরিবারের লোকদের কিভাবে বিষয়টা জানাবেন ভাবতে শুরু করলেন তিনি। ভাবার সময়টুকু অপর্ণা আর দিল না। জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা এবং বেঁচে থাকার তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে রাত দুইটা চৌত্রিশ মিনিটে পৃথিবীর মায়াত্যাগ করলো সে। ঘুমিয়ে থাকা তার সন্তানগুলো জানলো না তাদের মা এ পৃথিবীতে আর নেই। ডাক্তার অপর্ণার মৃত্যু সংবাদটা বাইরে থাকা অপর্ণার বাবা এবং মাকে জানালেন। বয়স্ক মানুষ দুজন নিজেরাই ভেঙে পড়লেন। কী করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। মেয়েকে হঠাৎ হারিয়ে তারা যে ধাক্কাটা খেয়েছেন তা সামলে উঠে কাউকে জানানোর বিবেক তাদের কাজ করছে না। অপর্ণার মা বহু কষ্টে অর্ণবের নম্বর ডায়াল করলেন। অর্ণব ফোন বিছানার পাশেই চার্জে দিয়ে ঘুমিয়েছিল। ফোনের ভাইব্রেশনে তৎক্ষণাৎ ঘুম ভাঙলো তার। অপর্ণার মায়ের নম্বর দেখে তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো সে। অপর পাশ থেকে ভাঙা ভাঙা গলায় কেবল একটি বাক্য ভেসে এলো,” আমার মেয়েটা আর নেই…”।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪৭+৪৮

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
সাতচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

তৌহিদ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আশফিনা আহমেদের এই অকস্মাৎ পরিবর্তন তার সমস্ত বিশ্বাসকে কাঁচের ন্যায় ভেঙে ফেলেছে। নওশাদের ঠোঁটের কোণে ভেসে থাকা কুৎসিত হাসিটা তার চোখে লাগছে। নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। আশফিনা আহমেদ প্রমাণগুলো নওশাদকে দিবেন এটা সে ভুলেও ভাবেনি।

-তোমায় বারবার আমি বাঁচাতে আসবো না নওশাদ! ভাই হয়েছো বলেই সবসময় পার পেয়ে যাবে তা ভেবো না। নির্ঘাত চিত্রলেখাকে আমিও পছন্দ করিনা বলে এবার বাঁচালাম। তুমি এসব কেন করেছো ওর সাথে?

-আপা, দোষ ঐ মেয়েটার। চুপচাপ বিয়ের জন্য রাজি হলেই পারতো! তাহলে পরীক্ষাও শান্তিতে দিতে দিতাম আর ওর ভাবীকে আমি শুধু ভয় দেখানোর জন্য লোক পাঠিয়েছি। ওরা ঐ মহিলাকে রেপ করবে তা কি আমি জানতাম? তাছাড়াও ঐটার টাকার লোভ বেশি, এটুকু শাস্তি পাওয়া দরকার ছিল।

-নওশাদ, জীবনে যত পাপ করেছো! এখন একটু ভালো হও।

-কিসের ভালো? এখন ক্ষমতাই নাই দেখে কি প্রভাবও কমছে? আরো দশটা মেয়েকে তুলে আনবো কেউ কিছু করতে পারবে না। তোমার সামনে ভালো সাজছি অনেক, এখন তো জানোই সব। এখন তুমি আমাকে আটকাতে চাইলেও পারবেনা।

-তুমি একটা এলাকার দায়িত্বরত চেয়ারম্যান ছিলে নওশাদ!

-তখনো এসব করছি, এখনো করবো। বাদ দাও আপা, চিত্রলেখার ক্ষতি হলে তো তোমারই লাভ। নিজের লাভ দেখো আর এই তৌহিদরে মেরে রেখেই যাই, শালা কাউকে বলে দিলে বিপদ!

-ওর ব্যবস্থা আমি করছি, যাও এখান থেকে। আর এসব প্রমাণ পুড়িয়ে ফেলো আগে।

নওশাদ মাথা নেড়ে চলে যায়। আশফিনা আহমেদ আসলেই তার আদর্শ বোন। ভাইকে তো এভাবেই আগলে রাখতে হয়! নওশাদ ক্রুর হাসি হাসে। পরের আঘাতটা সে এই আদরের বোনের আদরের সন্তানকেই করবে ভেবে তার পিশাচ মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে।

তৌহিদের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। তার সমস্ত চেষ্টা আশফিনা আহমেদ এক নিমেষে ধ্বংস করে ফেলল। মনে মনে যত জানা গালি ছিল সব মহিলাটার উপর প্রয়োগ করলো সে। তৌহিদের হাত বাঁধা থাকায় কিছু করতেও পারছে না সে। নওশাদকে ডাকার আগেই তিনি সুকৌশলে তৌহিদের হাত বেঁধে ফেলেন। হাতে খানিকটা ব্যথাও করছে এখন তবুও কিছু করার নেই তৌহিদের।

-পানি খাবে তৌহিদ?

-বিষ অফার করতেন এর চেয়ে! আপনার ছেলে যে মেয়েটাকে ভালোবাসে তার লাইফ নিয়ে এভাবে খেলছেন? মেয়েটার অবস্থা জানেন? ঐ মেয়েটা জন্মের পর থেকে বাবার ভালোবাসা পায়নি, মাকে অত্যাচারিত হতে দেখেছে। যখন বড় ভাই পাশে ছিল তখন ছোট ভাইয়ের অবহেলা সহ্য করেছে। দিনশেষে তার চরিত্রে অবধি দাগ লাগানো হয়েছে। এত যুদ্ধের পর মেয়েটা যখন স্বপ্ন পূরণে মন দিল, আপনার ঐ পিশাচ ভাই তার পরীক্ষার হলে তাকে বেরং বিরক্ত করলো, হ্যারাস করলো! আপনার মনে নূন্যতম বিবেক কাজ করেনা? আরে আপনিও তো মেয়ে!

-আগে মাথা ঠাণ্ডা করো। আমার বিবেক কাজ করে বলেই আমি সঠিক কাজটা করেছি। তোমার মতো আবেগ দিয়ে কোর্ট চলেনা। তুমি যা প্রমাণ এনেছো তা ভুল বানাতে নওশাদের দশ সেকেন্ড লাগতো না!

-সেজন্য প্রমাণ ওর হাতেই তুলে দিলেন! সাবাশ!

আশফিনা আহমেদ বিরক্ত হলেন। এত বেশি কথা বলার স্বভাব ছেলেটার! এমন করলে জীবনেও ভালো কিছু করতে পারবে না। আশফিনা আহমেদ কথা বাড়ালেন না। ঘর থেকে নিজের ল্যাপটপটা নিয়ে এসে তৌহিদের দিকে ঘোরালেন। তৌহিদ খেয়াল করলো একটু আগে নওশাদের বলা প্রতিটি কথা এখানে রেকর্ড হয়েছে। ভ্রু কুঁচকালো সে। আসলে ঘটনাটা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। আশফিনা আহমেদ আসলে কী করতে চাচ্ছেন তা ভেবেই মাথা ঘুরাচ্ছে তার।

_________________________

-রঙ্গন, ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ হয়নি। আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। এখানে মন টিকছে না আমার। আমি আপাতত বাড়িতে ফিরতে চাই।

-আমি টিকিট কেটে রাখবোনি সকালের। আমি নিয়ে যাবো, এখন একটু শান্ত হও তুমি।

চিত্রলেখা মলিন হেসে রঙ্গনের দিকে তাকায়। সামনে ব্যস্ত রাস্তা। সবকিছু যেন মুহূর্তে থমকে গেল। চিত্রলেখার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান রঙ্গনকে ঘিরে আবদ্ধ হলো।

-টিএসসি এলাকাটা সুন্দর বুঝছো? ঠিক তোমার মুখের হাসির মতো আর এই ঢাকা শহরের খাবার দাবার তোমার মলিন মুখের মতো।

চিত্রলেখা এবার হেসে ফেলল। কথাটা ভুল বলেনি রঙ্গন। দিন কয়েকেই ঢাকার খাবার দাবারের উপর থেকে মন উঠে গেছে তার। হয়তো অভ্যেস নেই বলে ভালো লাগছে না।

-কথা ঠিক বলেছেন। ঢাকার খাবার দাবার আমার মলিন মুখের মতোই!

-অনিক ভাইয়া তোমায় বাইরে আসতে দিল কিভাবে আজ? ভাবতে পারিনি তুমি আসতে পারবে।

-ভাবী জানে। ভাবীই ভাইয়াকে ম্যানেজ করেছে।

-আপা আর ভাইয়ার প্রেমটা ভালোই। আমাদের সংসার হলে আমিও এমন তোমার সব কথা শুনবো।

-তো বিয়ে কবে করতেছেন?

-অতীব শীঘ্রই ডাক্তার সাহেবা। আচ্ছা বাস তো সম্ভবত সকাল নয়টার আছে। তোমায় রাতের বাসে তো নিয়ে যাওয়া রিস্কি, কোনো হেলথ ইস্যু আছে তোমার?

-ট্রেনে যাওয়া যায় না?

-তোমার যদি পক্ষীরাজ ঘোড়াতেও যেতে মন চায় আমি ম্যানেজ করবো তবুও হাসিখুশি থাকো। তোমার মন খারাপ দেখলে আমার মনে অমাবস্যার আঁধার ছেয়ে যায়।

-থাক হইছে! এত সাহিত্যমাখা কথা বলতে হবে না। আপনার সাথে ভাইয়া আমাকে যেতে দিবে বলে তো মনে হয়না। আমি ভাবীর সাথে যেতে পারবো।

-আজব তো! আমি কী দোষ করছি? এই চলো তো বিয়ে করবো। বিয়ে করে বউ নিয়ে নিজের বাড়ি যাবো। শালাদের এত অত্যাচার এত ভালো লাগে না!

-এই কী বললেন আপনি?

-না মানে তোমার ভাই! তারা তো আমার শালা, তাই না?

-আপনি অফিস বাদ দিয়ে আমার সাথে বসে আছেন। কাজ নাই অফিসে?

-একদিন আমার রঙ্গনাকে সময় দিতে ছুটি নেওয়াই যায়! এসো হেঁটে কথা বলি।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঢাকার রাস্তায় হাঁটার একটা বিশেষত্ব আছে। এস্থেটিক একটা ভাব কাজ করে মনে। ফুলপট্টির কাছে আসতেই চিত্রলেখার চোখ ধাঁধিয়ে আসলো। ফুলপট্টি জায়গাটা বরাবরই এত সুন্দর কেন? রঙ্গন বোধহয় উপলব্ধি করলো বিষয়টা।

চিত্রলেখা বিস্মিত নয়নে কেবল পর্যবেক্ষণ করছিল চারপাশ। রঙ্গন কখন তার হাত ছেড়ে দিয়েছে খেয়াল করেনি সে। আচমকাই তিন রঙের তিনটি জবা তার মুখের সামনে বাড়িয়ে দিল রঙ্গন। ঠোঁটের কোণে মনোমুগ্ধকর হাসি। গানের সুরে বলে বসলো,

“গোলাপ ফুলের জায়গায় আমি দিলাম তোমায় জবা,
বলো তুমি এইবারে কি আমার প্রেমিকা হবা?”

চিত্রলেখা হাত বাড়িয়ে ফুল তিনটা নিয়ে মাথা নিচু করলো। লজ্জার লাল আভা তার গালে শোভা পাচ্ছে। রঙ্গনের বেশ লাগছে এই লজ্জাটুকু উপভোগ করতে। চিত্রলেখার মুখের হাসি তাকে প্রশান্তি দিচ্ছে। এই মেয়েটাকে সে জীবনের এমন একটা পরিস্থিতিতে পেয়েছিল যখন সে নিতান্তই মানসিক ভেঙে পড়েছিল। বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ এবং জীবনের অন্যতম একটা লুকানো সত্য জেনে সেই সত্য আড়াল করার প্রচেষ্টা প্রচণ্ডভাবে কুঁড়ে খাচ্ছিল তাকে। কারো সামনে স্বীকারও করতে পারেনি মনের অবস্থা। চিত্রলেখার আগমনটাই যেন তার জীবনে বিশেষ কিছু ছিল। মেয়েটা কখনো তাকে মোটিভেশনাল বাক্য শোনায়নি অথচ তার উপস্থিতিই যেন একেকটা মোটিভেশন। চিত্রলেখা আশেপাশে থাকলে সে সবসময় নিজেকে ভালো অনুভব করতো। এ ভালো থাকার অনুভূতিটাই তাকে চিত্রলেখাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল।

-কী ভাবছেন এত?

-শুনেছি প্রেমের মরা জলে ডোবে না। আমি তো সাঁতার জানি না। আমি তো তোমার প্রেমে মরেছি। আমার জলে ডোবার চান্স আছে?

-হে ধরণী দ্বিধা হও! এই লোকটা ফিজিক্সে পড়ে এত ফ্লার্টিং লাইন কোথায় শিখছে?

-পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়েছি বলে প্রেমিক হওয়া যাবে না কি? তোমার মতো আঁতেল ছিলাম না বলেই প্রেমটা করতে পারতেছি!

চিত্রলেখা চোখ গরম করে তাকালো রঙ্গনের দিকে। রঙ্গনের ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হলো। চিত্রলেখার রাগী চোখখানার মায়ায় সে একেবারে ধ্বংস হতে প্রস্তুত!

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
আটচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

-সাথী তোমার মাথা ঠিক আছে? রঙ্গনের সাথে লেখাকে কেন পাঠাতে হবে? তাও আবার একরাত আগে এসব বলতেছো আমাকে! দেখো, আমি জানি রঙ্গন যথেষ্ট ভালো কিন্তু …

-তোমার কাল সকালে মিটিং। তুমি পারবে যেতে? আমি গেলে তোমার রান্না কে করবে? আরেকটা বিয়ে করে তারে দিয়ে করাও!

-আজব তো, এতো রাগ করার কী আছে? পাঠাও তোমার ভাইয়ের সাথে। একেবারে বিয়ে করায়েই পাঠায়ে দাও। নিজে প্রেম করছে, এখন চৌদ্দ গোষ্ঠীরে লাভ ম্যারেজ না করায়া শখ মিটতেছে না।

-অনিক!

-আচ্ছা রাগ কোরো না। রঙ্গনকে সকালে আসতে বলবা, আমি ওরে ইনস্ট্রাকশন দিব।

-তুমি প্রেম করার সময় এত জ্ঞান মাথায় ছিল?

অনিক চুপ হয়ে গেল। প্রেমের বিয়ে বস্তুটা আসলে এক প্রকার ফ্যাসাদ ছাড়া কিছুই না। প্রেমিকা বউ হলে তাকে কিছু বলাই যায় না। কিছু বলতে গেলেই ছ্যাঁত করে ওঠে। রঙ্গন ছেলে ভালো হলেও অনিকের মনে একটু ভয় কাজ করছে। চাইলেই তো বোনকে এত লম্বা সফরে কারো হাতে ছাড়া যায় না। সে ঠিক করলো অর্ণবের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিবে কিন্তু সাথীকে সে কথা আর জানালো না।

সাথী চলে যাওয়ার পর অনিক বেশ কয়েকবার অর্ণবের নম্বরে কল করলো। নম্বর এখনো বন্ধ বলছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে অর্ণবের নম্বর কখনো বন্ধ থাকে না। অনিকও এবার চিন্তায় পড়লো। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে তাদের মোটেও সখ্যতা নেই। এ মুহূর্তে কাকে কল করবে বুঝে উঠতে পারলো না অনিক। এর চেয়ে রঙ্গনকে বিশ্বাস করাটাই অধিক শ্রেয় মনে হলো তার নিকট।

_______________

সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেন। এখন বাজে সাতটা তিপ্পান্ন। ট্রেন এখনো আসেনি। রঙ্গন স্টেশনের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। অপর পাশেই অনিক চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে। রঙ্গন কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনিক বাসায় ডেকে তাকে শাসিয়েছে কথাবার্তা কম বলতে। রঙ্গন মনে মনে যে কত গালাগাল করেছে তার এই শালাকে, পরমুহূর্তে আমার দুলাভাই ভেবে মাফও করে দিছে। তবে অনিকের এই হিটলারপনা দেখে রঙ্গনের মাথায় কেবল একটা বাক্যই ঘুরে বেড়াচ্ছে,”আমিও যদি এমন করতাম, এই শালা আমার বোনের সাথে প্রেম করতে পারতো?” কথাটা মনে মনেই সীমিত রাখলো সে। সামনাসামনি বলার সাহস তার নাই। ট্রেন আসলো কাঁটায় কাঁটায় সাতটা আটান্ন। বাংলাদেশের ট্রেন সিস্টেমটা অদ্ভুত। ভুলক্রমেও কোনদিন পাঁচ মিনিট আগে আসবে না। যদি কখনো দেখেন আটটার ট্রেন সাতটায় এসেছে তাহলে ধরে নিবেন এটা আগেরদিনের ট্রেন, এখন এসেছে মাত্র। ট্রেন আসাতে রঙ্গনের মুখে খুশির ঝলক দেখা দিলেও সে তা আড়াল করার চেষ্টা করলো। অনিক দেখতে পেলে নির্ঘাত আবার বলবে দুইজন দুই প্রান্তে বসো।

রঙ্গন ও চিত্রলেখাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে আসার সময় অনিক কেবলমাত্র রঙ্গনের কানে কানে ‘অল দ্য বেস্ট’ বলে চলে গেল। রঙ্গন বিব্রত হলো। অনিকের মুখে এমন কথা কেন যেন বেমানান। চিত্রলেখা বসেছে জানালার পাশে আর রঙ্গন তার পাশে। মেডিকেলের রেজাল্ট দেওয়ায় ভালোই ভীড় ট্রেনে। রঙ্গন অবশ্য আশেপাশে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না। চিত্রলেখার নজর জানালার বাইরে আর রঙ্গনের নজর চিত্রলেখাতেই সীমাবদ্ধ।

___________________________________

-ভোররাতে একজন রেসপেক্টেড পার্সনকে এভাবে তুলে আনার সাহস হয় কী করে আপনার? আপনি নতুন এলাকায়? আমার পরিচয় জানেন না নাকি?

-দেখুন স্যার, আপনি কো-অপারেট করুন। আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। আপনাকে আমরা শখের বসে অ্যারেস্ট করিনি।

নওশাদের মনে এবার ভয় কাজ করে। প্রমাণগুলো তো সে পুড়িয়ে ফেলেছে তবে কমপ্লেইন কে করলো? আর পুলিশই বা কোনো প্রমাণ ছাড়া কেন তাকে এখানে ধরে আনবে? এটা কি বিরোধী দলের ঐ শামসুর কাজ হতে পারে? নওশাদ বোঝার চেষ্টা করলো কে এমন করতে পারে তার সাথে। দীর্ঘসময় চিন্তা করতে হলো না। একটু পরেই আশফিনা আহমেদ এলো নওশাদের সাথে দেখা করতে। বোনকে পেয়ে নওশাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এবার সে নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে। আশফিনা আহমেদ নওশাদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন।

-সব পাপের বিচার একদিন হয়, এটা মানো নওশাদ?

-আপা, এখন এসব কথা বলার সময় না। আমার বেইল করানোর ব্যবস্থা করো।

-ব্যবস্থা তো করবো তবে তোমায় যতটা বেশি শাস্তি দেওয়া যায় সেটার। তোমার মতো নরপশু আমার ভাই ভাবতেও আমার ঘৃণা লাগে! কতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছো। অপর্ণা নাহয় দোষ করেছিল সামান্য কিন্তু বাকিরা? ওদের কী দোষ? আর অপর্ণা ভুল করে থাকলেও তাকে এমন নিকৃষ্ট শাস্তি দেওয়ার তুমি কে? একটা মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করা কিছুই না তাইনা? আরে অপর্ণা হয়তো লোভ করেছিল কিন্তু তার জন্য ও এখন যে ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা কতটুকু যন্ত্রণার জানো? একটা মেয়ে রেইপ হলে তার মধ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছে অবশিষ্ট থাকে? অপর্ণার বডি রেসপন্স করছে না! চিত্রলেখার জীবনটাও তুমি বরবাদ করতে উঠেপড়ে লেগেছো। আমি সব দেখেও চুপ থাকবো ভেবেছিলে?

-ভুল করছো আপা। আমাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবেনা। কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে?

-তোমার নিজস্ব স্বীকারোক্তি। জেলে পচার জন্য তৈরি থেকো নওশাদ!

আশফিনা আহমেদ আর কথা বাড়ালেন না। গা গুলাচ্ছে তার। এই লোকটার উপস্থিতিও তার জন্য ঘৃণিত! অপর্ণার অবস্থা দেখলেও করুণা হয় আশফিনা আহমেদের। মেয়েটার বাচ্চা দুইটার অসহায়ত্ব প্রতিমুহূর্তে তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। নিজের এই ভাইটাকে প্রথমবারেই শাস্তি দিলে হয়তো এত কিছু হতোই না। অন্তত বাচ্চা দুটোর জীবন এতটা নির্মম হতো না! অর্ণব এবং তৌহিদকে ঘটনাগুলো জানানো দরকার। আশফিনা আহমেদের চোখের কোণে জল চিকচক করছে। বাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে জলটুকু মুছে তিনি পুলিশ স্টেশনের বাইরে পা রাখলেন। এখন থেকেই চিত্রলেখা এবং রঙ্গনের জীবনটা বাধামুক্ত করলেন তিনি। এখন কেবল দুজনের চারহাত এক করার পালা।

______________________

চিত্রলেখা বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেয়াল করছে তাদের মুখোমুখি বসে থাকা মেয়েটা আড়চোখে রঙ্গনের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে নাইন-টেনের বাচ্চা মনে হচ্ছে। রঙ্গনকে এভাবে আড়চোখে দেখাটা তার মোটেও ভালো লাগছে না। সে ফিসফিস করে ডাকলো রঙ্গনকে।

-এই সামনের মেয়েটা তোমায় এভাবে দেখছে কেন? চেনে তোমাকে?

-আরে নাহ! আমি কখনো দেখিইনি একে, এ আমায় কিভাবে চিনবে?

-তো তাকায়ে আছে কেন?

-সুন্দর ছেলে দেখলে তো মেয়েরা তাকাবেই। তুমি তো পাত্তা দিচ্ছো না, তাই বলে কি সবাই গাধা?

-তুমি আমাকে গাধা বললা?

-পাশে এত সুন্দর ছেলে রেখে কেউ যদি বাইরে তাকায়ে থাকে তাকে গাধা বলাটা কি আমার অন্যায়?

চিত্রলেখা খানিকটা রাগত স্বরে বলে উঠতেই রঙ্গন হালকা কেশে উঠলো। সামনে বসে থাকা মেয়েটা যেন এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পানির বোতলটা তৎক্ষণাৎ রঙ্গনের দিকে বাড়িয়ে দিল।

-ভাইয়া পানিটা খেয়ে নিন। সমস্যা হচ্ছে কি?

-না আপু ধন্যবাদ।

-আরে পানিটা খান। অসুবিধা নেই।

চিত্রলেখার এবার আরো মেজাজ খারাপ হলো। পানির বোলতটা নিয়ে ছিপি খুলে সমস্ত পানি সে মেয়েটার মাথায় ঢালতে উদ্যত হলে রঙ্গন কোনমতে বসালো তাকে। চিত্রলেখা তখনো অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মেয়েটার দিকে।

-সমস্যা কী মেয়ে তোমার? আরেকজনের বরের দিকে তাকাও কেন?

-ওহ! ভাইয়া আপনি ম্যারিড?

-কেন আমি বলতেছি বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাইয়াকে জিগানো লাগবে কেন? অসভ্য মেয়ে, সেই থেকে তাকায়ে আছো! লজ্জা নাই? এই তোমার গার্ডিয়ানের নম্বর দাও! তাদেরও জানা উচিত তাদেদ মেয়ে এসব করে বেড়ায়।

চিত্রলেখার কথা শুনে মেয়েটা তৎক্ষণাৎ তার ব্যাগপত্র নিয়ে অন্য সীটের উদ্দেশ্যে কেটে পড়লো। চিত্রলেখার সাপের মতো ফুলে ফেঁপে উঠা দেখে রঙ্গনের মজা লাগছে। এতক্ষণ মেয়েটা তার দিকে তাকাচ্ছিলই না অথচ অন্য কেউ তাকানোতে যে অনর্থ বাধালো, তাতে রঙ্গন নিশ্চিত এ মেয়ে থাকতে তার জীবনে ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি হবে না।

-রঙ্গন স্যরি, বেশি রিএক্ট করে ফেলছি। নিব্বি টাইপ ব্যবহার করে ফেললাম?

-ধূর পাগলী! আমি তো চাই তুমি এমন অধিকার দেখাও। অন্য কেউ আমাকে চেক আউট করবে আর তুমি চুপচাপ থাকবে তাহলে কিছু হলো? ভালোবাসো বলেই তো অধিকার দেখাবে!

চিত্রলেখা উত্তর দিলো না। ট্রেনের জানালা বেয়ে তীব্র বাতাস আসছে। চিত্রলেখার কপালের কাছে চুলগুলো বড্ড বিরক্ত করছে। এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে রঙ্গনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঁজলো সে। সফরটা সাত ঘণ্টার না হয়ে সাতশো বছরেরও তো হতে পারতো।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪৫+৪৬

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঁয়তাল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

“চিত্রলেখাকে এখন এসব জানিয়ো না অর্ণব। মেয়েটার কাল পরীক্ষা। এসব নিয়ে ভাবলে ওর পরীক্ষা খারাপ হবে।” আশফিনা আহমেদের কথায় মুখ তুলে তাকালো অর্ণব। পরিস্থিতি এতটা দ্রুত এমন বদল দেখাবে কল্পনাও করেনি সে। অপর্ণাকে বোধহয় খানিকটা ঘৃণা করতে শুরু করেছিল সে কিন্তু এমন পরিণতি কখনো চায়নি। অপর্ণাকে তুলে নিয়ে যেতে নওশাদ লোক পাঠিয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন অপর্ণার এক আত্মীয়ের বিয়েতে সবাই গিয়েছিল। অপর্ণা বাসায় একা ছিল, সাথে এক কাজের মহিলা। নওশাদের ভাড়া করা লোকগুলো এসেছিল অপর্ণাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিন্তু অপর্ণাকে দেখে তাদের মনে যে কুমতলব ভর করে তার পরিণাম হয়ে উঠে ভয়াবহ। অতর্কিত আক্রমণ চলে অপর্ণার উপর। কাজের মেয়েটাকে বেঁধে রেখে অত্যাচার করা হয়েছে দিন দুপুরে! অত্যাচারের এক পর্যায়ে অপর্ণার নিঃশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসলে ছেলেগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তাদেরকে পালাতে দেখে নিকটস্থ প্রতিবেশী। তিনি চটজলদি অপর্ণাদের বাড়িতে ঢুকে দেখেন এই অবস্থা। এম্বুলেন্সে কল করে অপর্ণাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন অল্প সময়ের মধ্যেই। পাশাপাশি অপর্ণার বাড়ির লোক এবং অর্ণবকেও তিনিই খবর দেন। অর্ণব বুঝতেই পারছে এসবে নওশাদ ছাড়া কারো হাত নেই। আশফিনা আহমেদ কিভাবে এসব খবর পেলেন এখনো জানে না সে তবে অপর্ণার জন্য করুণা হচ্ছে তার। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে আছে। বাচ্চা দুটো অর্ণবের পাশে ঝিম ধরে বসে আছে। তারা বুঝতে পারছে না তাদের মায়ের কী হয়েছে। কাজের মেয়েটার শরীরেও বেশ কিছু ক্ষত। অপর্ণার জ্ঞান না ফিরলে বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। অর্ণব ভেবেছিল অপর্ণার মা এসব নিয়ে একটা কাণ্ড নিশ্চিত বাধাবেন কিন্তু তা হলো না। ভদ্রমহিলা চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সবকিছুর জন্য যেন নিজেকেই আংশিক দায়ী করছেন এখন তিনি। কোনো একসময় চিত্রলেখার সাথেও এমন করার মতলব তিনিই বাতলে দিয়েছিলেন। আজ সে যন্ত্রণা হারে হারে টের পাচ্ছেন। নিজের কলিজার টুকরো সন্তানের উপর আঁচ আসলে মা সহ্য করতে পারে কখনো? সেখানে চিত্রলেখা মা হারা প্রাণ ছিল, তার মাথা রাখার জন্য তো মায়ের আঁচলটুকুও ছিল না। আজ বড্ড অসহায় লাগছে তার নিজেকে। মেয়ের এ অবস্থার কিয়দংশ দায়ভার নিজ কাঁধে নিয়ে প্রাণত্যাগ করার তীব্র বাসনা যেন জেঁকে বসেছে তাকে।

আশফিনা আহমেদ হাসপাতালে এসেছেন তাও এক ঘণ্টা হতে চললো। তিনি মূলত অর্ণবের সাথে কথা বলার জন্যই এসেছিলেন কিন্তু কথা শেষ হয়নি এখনো। কথা হওয়ার সুযোগও নেই। এমন একটা পরিস্থিতি এখানে, তিনি হুট করে বলতেও পারছেন না এসবের জন্য তিনি তার ভাইকে শাস্তি দিতে চান। অনেকটা গরু মেরে জুতো দানের মতো শোনাবে বিষয়টা তবে আশফিনা আহমেদ এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নওশাদের এ ভুলের ক্ষমা তিনি করবেন না। ক্ষমতা কেবল নওশাদের একার নেই, তারও রয়েছে। নওশাদের চেয়ে বরং কয়েকগুণ বেশি ক্ষমতা এখন তার হাতে। অর্ণবকে এককোণে দাঁড়াতে দেখে আবারো কথা বলার চেষ্টা করলেন আশফিনা আহমেদ।

-অর্ণব?

-দুঃখিত আন্টি, আমি আপনাকে এড়িয়ে যেতে চাইছি না কিন্তু পরিস্থিতিটাই এমন যে ঠিকমতো কথা বলার অবস্থা নেই।

-সমস্যা নেই। আমার শুধু একটা কথাই বলার ছিল। নওশাদের উপর তুমি যাকে নজর রাখতে বলেছো, তার সংগ্রহ করা প্রমাণসহ তাকে আমার সাথে দেখা করতে পাঠিয়ো। আমি চাই নওশাদ তার ভুলের শাস্তি পাক।

-আচ্ছা আন্টি, আমি তৌহিদকে জানাবো।

-এদিকে সামলে নিও। আমি আসছি।

-জ্বী আচ্ছা।

আশফিনা আহমেদ বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না আর। অর্ণব এখনো অপর্ণার কেবিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোথাও একটু হলেও মায়া যেন রয়েই গেছে। অপর্ণার এই অবস্থাটা অর্ণবের মনকে ঠিকই পোড়াচ্ছে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে অর্ণব বোধহয় কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। পরোক্ষভাবে সেও কিছুটা দায়ী এসবের জন্য।

_________________________________

-ভাবী আমার প্রচণ্ড ভয় করছে। মনে হচ্ছে কাল কিছুই পূরণ করতে পারবো না আমি।

-লেখা! ঘুমা তুই এখন। আজকে রাত জাগিস না অন্তত। এতদিন যা পড়েছিস তা যথেষ্ট। আজকে শান্তিতে একটু ঘুমা তাহলেই কাল ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা দিতে পারবি।

-আচ্ছা তুমি যাও। আমি ঘুমাচ্ছি।

-আমার সামনেও রঙ্গনকে কল করতেই পারিস!

কথাটা বলে মুখ টিপে হাসলো সাথী। চিত্রলেখার লজ্জারাঙা মুখটা প্রত্যক্ষ না করেই কক্ষ ত্যাগ করলো সে। সাথীর কথাতে চিত্রলেখার যেন আরো মন চাইলো রঙ্গনকে একটু কল করতে। পরক্ষণেই মনে হলো কথা বলার পর যদি আরো অস্থির হয়ে পড়ে সে? তখন তো আরো ঝামেলা বাঁধবে! এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে বেশিক্ষণ থাকতে হলো না চিত্রলেখার। রঙ্গন নিজেই কল করলো। তড়িৎ গতিতে রিসিভ করলো চিত্রলেখা।

-আসসালামু আলাইকুম। ঠিক আছেন ম্যাডাম? নাকি চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন?

-ঠিক আছি।

-তুমি জীবনেও ঠিক নাই! এত ওভারথিংক করলে হয় সোনা? তুমি যা প্রিপারেশন নিয়েছো, সেটা শুধু কাল এপ্লাই করবে। এখনো জেগে আছো কেন? এখনি ঘুমাবা!

-আমার ঘুম আসতেছে না। প্রচণ্ড চিন্তা হচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু পারবো না।

-চিত্রলেখা, আমরা হারানোর ভয় তখন পাই যখন আমাদের চাওয়াটা অনেক বেশি হয় আর এ চাওয়াটা খাঁটিও হয়। খাঁটি চাওয়ার ফলাফল আল্লাহ ঠিকই দিবেন। তুমি কেবল নিজের উপর ভরসা রাখো। আমি জানি তুমি ভালোমতোই পরীক্ষা দিবে।

-আমার যদি মেডিকেলে না হয়?

-জীবন শেষ হয়ে যাবে তাতে? মেডিকেল কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সীট শুধু সমাজের সামনে তোমায় একটা যোগ্যতার আসন দেয়। দিনশেষে ঠিকই ডাক্তাররা বেতন না পেয়ে আন্দোলনে নামে। তখন সমাজের মানুষ কোথায় থাকে? জীবনে একটা কিছু এচিভ করতে পারাটা সফলতা বটে তবে তার উপর জীবন মরণ নির্ভর করানো নিছক বোকামি। তোমাকে আমিই বলেছিলাম বড় স্বপ্ন দেখতে কিন্তু এতটাও বড় স্বপ্ন না যেটা ভাঙলে তুমি আর দাঁড়াতেই পারবে না!

-এত কথা কোথায় পান আপনি?

-পরিস্থিতি বা অন্য কোনভাবে হয়তো শিখে গেছি। রঙ্গন শুধু তোমার সামনেই বড্ড বেশি চঞ্চল, অন্যদের কাছে সে বড্ড ম্যাচিউর। বুঝেছো রঙ্গনা?

-বুঝেছি।

-ঘুমাও এখন। সবরকম দুশ্চিন্তা বাইরে ছুঁড়ে পেলে নিদ্রার জগতে পাড়ি জমাও।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখা ফোন রাখলো। কালকের দিনটা বিশেষ। সকালে তাড়াতাড়ি উঠবে সে। একবার অর্ণব ভাইয়ের সাথে কথা বলা উচিত। এখানে আসার পর থেকে হাতেগোনা কয়েকবার কথা হয়েছে। কাল একটা বিশেষ দিন। বড় ভাইয়ের দোয়া নেওয়াই উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। অর্ণবের নম্বর ডায়াল করলো চিত্রলেখা। প্রথমবারে রিসিভ করলো না অর্ণব। কিছুক্ষণ পর নিজেই কল ব্যাক করলো সে।

-ভাইয়া, কল ধরলে না যে? ব্যস্ত ছিলে?

-একটু। তুই ঘুমাসনি? কাল না পরীক্ষা তোর?

-তোমার মনে আছে? একবার তো কলও করোনি আমায়! আমি ভাবলাম ভুলেই গেছো।

-তোকে বিরক্ত করতে চাইনি পিচ্চি।

অর্ণব কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়ার্ড বয় পাশে থেকে কিছু একটা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। অর্ণব কোনোরকম পাশ কাটিয়ে এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালো। চিত্রলেখা জানতে পারলে বিষয়টা আরো জটিল হবে। তাই অর্ণব যতটা পারছে সবকিছু আড়াল করার চেষ্টা করছে।

-ভাইয়া কোথায় তুমি? কে যেন কিছু একটা বলে উঠলো, ওষুধ না কী যেন একটা। হাসপাতালে তুমি?

-আরে নাহ পিচ্চি। একটূ জ্বর এসেছে তাই ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে এসেছি। তুই অযথা চিন্তা করা বাদ দিয়ে ঘুমা তো।

-আচ্ছা ভাইয়া দোয়া রেখো আমার জন্য।

-ফি-আমানিল্লাহ।

চিত্রলেখা কল কেটে দিলেও তার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। অর্ণব ফার্মেসিতে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। চিত্রলেখার কেন যেন মনে হচ্ছে অর্ণব তার থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে কিন্তু কী লুকোচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না সে। বিছানায় হেলান দিয়ে ভাফতে শুরু করলো সে। ঘুমের আগমন ঘটতে বেশি সময় লাগলো না। কাল এক নতুন যুদ্ধ চিত্রলেখার জীবনের, হতেই পারে এটাই শেষ যুদ্ধ হবে।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
ছেচল্লিশ_পর্ব
~মিহি

“স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ! লেখা তুই খুশি না?” সাথীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা চিত্রলেখা। সে অনেক বেশি খুশি কিন্তু কোথাও একটা সংকোচ-দ্বিধা তাকে আটকে ফেলেছে ভেতরে ভেতরে। ঢাকা মেডিকেলের জন্য চিত্রলেখার গভীরতম স্বপ্ন হয়তো ছিল না কিন্তু রঙ্গনের ইচ্ছে ছিল। রঙ্গন কি মন খারাপ করবে? চিত্রলেখা চাইলেও খুশি হতে পারে না। সাথী ইতোমধ্যে অনিককে মিষ্টি আনতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিকে চিত্রলেখার মুখে হাসির রেশমাত্র নেই। রঙ্গনকে কল করার সাহসটুকুও যেন পাচ্ছে না সে। চিত্রলেখার উদাসীনতা অনুভব করতে পারলো সাথী।

-লেখা? কী হয়েছে তোর? এত ভালো রেজাল্টের পরও তোর মন খারাপ কেন?

-জানিনা ভাবী। মনে হচ্ছে কিছু একটা কমতি রয়ে গেছে।

-রঙ্গনের সাথে কথা বলেছিস?

-না ভাবী। ও চেয়েছিল আমি যেন ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাই। ওর ইচ্ছেটা অপূর্ণ থেকে গেল ভাবী।

-পাগল মেয়ে, আগে কথা বলে তো দেখো।

সাথী মুচকি হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এই দুইজনের প্রেম তাকে নিজের অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনিকের সাথে প্রেমের স্মৃতিগুলি এখনো অম্লান তবুও সংসারের চাপে কোথাও একটা হারিয়ে গেছে সেই পুরনো টান। প্রেমিকের ভালোবাসার সংজ্ঞা আর স্বামীর ভালোবাসার সংজ্ঞা বরাবরই আলাদা। প্রেমিকের বেলায় শুধু প্রেমটাই থাকে, স্বামীর বেলায় থাকে দায়িত্ব। সমুদ্রের নীরব ঢেউ যেমন আচমকা তীরে আছড়ে পরে, তেমন করে সাথীর মনের রদবদলটা ক্ষণিকের মাঝেই ঘটে। অনিকের সেই প্রেমিক রূপটা আজ বড্ড অনুভব করছে সে।

রঙ্গন দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। চিত্রলেখা এখনো কল করলো না কেন এই ভেবে সে অস্থির। রেজাল্ট কী এমন এসেছে! রঙ্গনের চিন্তা কোনভাবেই কমছে না। সামনে থেকে কল করারও সাহস পাচ্ছে না। ইদানিং চিত্রলেখাকে নিয়ে বড্ড ভয় পায় রঙ্গন। মেয়েটার মনের অবস্থা শতভাগ বোঝার চেষ্টা করে সে। রঙ্গনের বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হলো না। চিত্রলেখার কল আসলো। রঙ্গন যেন এই মুহুর্তের অপেক্ষাতেই ছিল। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো সে।

-হ্যালো!

-কী হয়েছে? তোমার কণ্ঠ এরকম কেন? ঠিক আছো তুমি?

-ঢাকা মেডিকেলে আসেনি, স্যার সলিমুল্লাহ’তে এসেছে।

-আলহামদুলিল্লাহ। এত খুশির খবর কেউ এভাবে বলে? এই মেয়ে তুমি পাগল? আমি..আমি কী করবো বুঝতেছি না। এই তুমি বাইরে অনেক করো, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।

-কিন্তু আমার তো ঢাকা মেডিকেলে হয়নি রঙ্গন!

-ঢাকা মেডিকেলের এপ্রোনের রঙ আলাদা? তুমি চেষ্টা করেছো রঙ্গনা, শত চেষ্টার পরও অনেকেই হেরে যায়। তুমি তো তবুও নিজের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পেয়েছো। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। আমি তোমার বাসার সামনে গিয়ে কল করছি।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখার মন খারাপ ভাব খানিকটা কমে আসলো। সে ভেবেছিল রঙ্গন বোধহয় মন খারাপ করবে কিন্তু ছেলেটা যেভাবে বোঝালো তাতে চিত্রলেখার মন খারাপ টেকার কথাই ছিল না। চিত্রলেখা চটজলদি অর্ণবের নম্বরে কল করলো। রঙ্গনকে কল করার আগেও দুইবাদ সে অর্ণবের নম্বর ডায়াল করেছে। নম্বর বন্ধ বলছে। বাড়িতে ফোন বলতে ঐ এক অর্ণবেরটাই। চিত্রলেখা নিজের ভাইকে খুশির খবর জানাতে উৎসুক অথচ সে কলই রিসিভ করছে না! খানিকটা রাগ হয় তার। তার বড় ভাই তার রেজাল্টের কথা যেন ভুলেই গেছে! চিত্রলেখা ঠিক করলো সেও আর কল করবে না, ভাইয়ের উপর সেও রাগ করবে এবার! কথাটা ভেবে ফোন সাইলেন্ট করে বিছানার পাশে রেখে দিল সে। এখনো সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে তার। সত্যিই কি সাদা এপ্রোনের যোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে সে? পরীক্ষার একটা ঘণ্টা চিত্রলেখার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সর্বপ্রথম ইংরেজী আর জিকে অংশটুকু শেষ করেছিল সে। এদিকে বাঁচানো সময়টুকু ফিজিক্সে কাজে লাগিয়েছে বলেই কোনরকম তাড়াহুড়ো হয়নি। শিওর না হয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর সে করেনি তবুও পরীক্ষার হল ছেড়ে বেরোতেই কতরকম আজগুবি চিন্তা যে দানা বাঁধে মাথায়! একবার মনে হয় খাতায় রোল ঠিকমতো পূরণ করিনি, আবার কখনো মনে হয় প্রশ্নের সিরিয়াল অনুযায়ীই উত্তর করেছি তো? এ ভয়টা চিত্রলেখা রেজাল্টের আগ অবধি আটষট্টি ঘণ্টা দিব্যি উপলব্ধি করেছে। খেতে, বসতে, উঠতে সব জায়গায় সে কেবল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে গেছে যেন সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। আল্লাহও তার দোয়া কবুল করেছেন। মেয়েটার অসংখ্য স্বপ্নভঙ্গের পর অবশেষে স্বপ্ন পূরণের দরজাগুলো খুলতে শুরু করেছে।

___________________________________

অপর্ণার অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ। একে তো শারীরিক অসুস্থতা, পাশপাশি মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছে সে। ডাক্তারদের মতে মেয়েটার বাঁচার কোনো ইচ্ছে অবশিষ্ট নেই যার কারণে সে কোনভাবেই নিজেকে সুস্থ হতে দিতে চাচ্ছে না। অর্ণব কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। একদিকে তার দুই বাচ্চা, তাদের তো কোনো দোষ নেই! অপর্ণার দিকে তাকিয়ে আজ কেবলই করুণা হচ্ছে অর্ণবের। পাপের শাস্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা স্বীয় চোখে প্রত্যক্ষ করলো সে। অপর্ণা যদি সময় থাকতে একবার বুঝতো! রূপসা কান্না করতে করতে অর্ণবের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ণব উঠতেও পারছে না। ফোনটা পকেটে আছে, সেটা বের করারও সুযোগ হচ্ছে না। কিছু সময় বাদে অপর্ণার মা এসে বাচ্চা দুটোকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। রূপসা রাদিফকে কোনভাবেই বাড়িমুখো করা যাচ্ছে না। তাই অর্ণবও হাসপাতালেই রয়ে গেছে। তার বাচ্চাদের এখন তাকে প্রয়োজন। প্রয়োজন অপর্ণারও ছিল তাকে তবে এখন অনুভূতিগুলো কেবল রূপসা রাদিফের মা হিসেবে আসবে, স্ত্রী হিসেবে যে মায়া তা আর কখনো জন্মাবে না রঙ্গনের মনে।

________

তৌহিদ খানিকটা ভীত সন্ত্রস্ত অনুভব করছে। প্রথমত আশফিনা আহমেদের বাড়ির আয়তনটাই তাকে অবাক করেছে। দ্বিতীয়ত নওশাদের সাথে আশফিনা আহমেদের সম্পর্কে তাকে একদম সাত তলা থেকে যেন নিচে ফেলেছে। তৌহিদের এখন নিজেরই জানের মায়া হচ্ছে। আশফিনা আহমেদ আবার ভাইকে বাঁচাতে তাকে মেরে টেরে ফেলবে না তো? সোফায় বসে জিকির করতঃ লাগলো তৌহিদ।

আশফিনা আহমেদ সময়ের পাকা হলেও গুণে গুণে সাড়ে চার মিনিট লেইট করলেন তিনি। তৌহিদের মুখোমুখি বসতেই অনুভব করলেন ছেলেটা ভীত হয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলার চেষ্টা করলেন আশফিনা আহমেদ।

-তুমি তৌহিদ?

-জ্বী ম্যাম।

-তো উকিলগিরি ছেড়ে গোয়েন্দাগিরিতে কেন?

-প্যাশন ম্যাম!

-আচ্ছা ভালো। নওশাদের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ তোমার কাছে আছে?

-প্রমাণ বেশ অনেকগুলোই আছে। কিছু প্রমাণ শুরুর সময়ের যেগুলো শক্তপোক্ত না তবে এখন যেগুলো প্রমাণ পেয়েছি তাতে কাজ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। কমসে কম বছর দশেকের শাস্তি তো কনফার্ম।

-প্রমাণটা কী? কথা না ঘুরিয়ে সরাসরি প্রমাণগুলোর কথা বলো।

তৌহিদ এবার সিরিয়াস হলো। স্পাইডারম্যান কালারের ব্যাগটা থেকে বেশ কিছু পেন ড্রাইভ এবং ফাইল বের করলো সে। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বল রেখা। আশফিনা আহমেদ স্পষ্ট লক্ষ করলেন এ ছেলের সবকিছু নিয়েই আত্মবিশ্বাস অধিক। চোখের চাহনিই বলে দিচ্ছে বিষয়টা।

তৌহিদ একে একে বোঝালো কোন ফাইল, কোন পেন ড্রাইভে কী আছৈ। কয়েকটাতে নওশাদের রাজনৈতিক কারচুপির প্রমাণ আছে তো কিছু পেন ড্রাইভে তার নোংরা চরিত্রের। নিষিদ্ধ পল্লী থেকে শুরু করে গ্রামের সহজ সরল মেয়েরাও তার অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। এসব প্রমাণ তৌহিদের জোগাড় করতে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা কেবল সে-ই জানে। বিশেষ করে কোনো মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া অত্যাচার সম্পর্কে জানতে চাইতেও তৌহিদের লজ্জায় মাথা নিচু হয়েছে। তবে নওশাদ সম্পর্কে যত জেনেছে তত আগ্রহ বেড়েছে তৌহিদের। একটা লোক এত কুকর্ম করেও কী ক্লিন ইমেজ নিয়ে চলে! ভাবতেও অবাক লাগে তার।

“এখন বাড়িতে কাজের লোকরা ঘুমিয়ে, কোনো জাগ্রত মানব নেই ভেতরে। তোমায় যদি খুন করে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দিয়ে আসি এ প্রমাণগুলোর কী হবে ভেবে দেখেছো?” তৌহিদ যেন অনুভব করলো আশফিনা আহমেদের কণ্ঠস্বরের এক আকস্মিক পরিবর্তন!

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪৩+৪৪

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
তেতাল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

রঙ্গন মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছে। একটু পরপর তার হাতে মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে। বরাবরই সে শান্ত স্বভাবের ছেলে কিন্তু একবার রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তা দমানো দায় তার পক্ষে। রঙ্গনের মুখোমুখি বসে আছে আহাদ লোকটা। পাশেই কোচিংয়ের অথোরিটির সবাই। রঙ্গনের কথায় বেশ কিছু মেয়ে দাঁড়িয়ে আহাদের নামে কমপ্লেইন করেছে। কোচিং কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই আহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তবে রঙ্গন যেন বিষয়টা নিয়ে আর ঝামেলা না করে তাই তাকেও বোঝানো হয়েছে। রঙ্গন এসব নিয়ে আর মাথা ঘামালো না। আহাদের উপর তার রাগ তখনো কমেনি। মানুষ কতটা নোংরা হলে নিজের ছাত্রীকে হ্যারাস করার চেষ্টা করে! নিজেকে কোনোরকম শান্ত করে কোচিং ছেড়ে বেরোলো সে। সর্বপ্রথম সাথীর নম্বরে কল করলো সে।

-আপা, লেখার কী অবস্থা? শান্ত হয়েছে?

-হুম। কথা বলছে না সেভাবে তবে পড়ছে এখন।

-ওর কোচিংয়ের ঐ স্যারকে আমি মেরেছি আজ। আরো কয়েকটা মেয়েকে বিরক্ত করতো লোকটা। কোচিং ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। লেখাকে এসব জানানোর দরকার নেই আপা। কোচিং থেকে যদি কোনোরকম কল যায় ও যেন রিসিভ না করে। এখানে যা যা হয়েছে সব যেন ওর আড়ালে থাকে। ও ওর মতো করেই পড়ুক।

-রঙ্গন তুমি মারামারি করেছো? ফুপু জানলে …

-আমিই জানাবো মাকে, তুমি চিন্তা করো না আপা। আমার চিত্রলেখার খেয়াল রেখো। ওর কিছু হলে আমি সত্যিই বাঁচতে পারবো না আপা।

-আমি বুঝি রঙ্গন। তুমি চিন্তা কোরো না।

রঙ্গন কল কাটলো। এখন সন্ধ্যে। হাঁটতে হাঁটতে কখন ব্রিজের কাছাকাছি চলে এসেছে খেয়াল করেনি রঙ্গন। ব্রিজের সাথে হেলান দিল সে। চিত্রলেখার প্রতি নিজের অনুভূতির প্রখরতা দিব্যি অনুভব করতে পারছে সে। কিছুক্ষণ সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের মায়ের নম্বরে কল করলো সে। আশফিনা আহমেদ যেন ফোনের কাছেই ছিলেন। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলেন তিনি।

-রঙ্গন, ভালো আছো তুমি?

-তুমি কি ফোনের কাছেই ছিলে মা? নাকি জানতে আমার কল আসবে?

-তোমায় কল করবো ভাবছিলাম। ভালো আছো তো তুমি? সকাল থেকে মন কু’ডাক ডাকছিল। তাই ভাবছিলাম এখন বোধহয় অফিস টাইম শেষ, তাই কল করি।

-মা তোমার মনে আছে ছোটবেলায় একবার মারামারি করেছিলাম বলে তুমি সাতদিন আমার সাথে কথা বলোনি?

-হুম মনে আছে।

-কেন মারামারি করেছিলাম মনে আছে?

-হুম। শপিং মলে একটা লোক আমায় ধাক্কা দিয়ে আমাকেই দোষারোপ করছিল বলে।

-আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি বলেই ঐ অল্প বয়সেও নিজের তিনগুণ বয়সী লোকটার গায়ে হাত তুলতেও সংকোচবোধ করিনি। এটা আমার ভালোবাসা ছিল মা। এরপর তোমায় আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম পরিস্থিতি যেমনই হোক আমি মারামারিতে জড়াবো না। আমি সেই প্রতিজ্ঞা দুইবার ভেঙেছি মা। দুইবারই চিত্রলেখার জন্য? মেয়েটাকে কি তবে আমি ভুলতে পারবো মা? তোমায় আমি যতটা ভালোবাসি ততটাই আমি সেই মেয়েটাকেও ভালোবেসে ফেলেছি। আমার দোষ কোথায় মা? মেয়েটা তো নিজের স্বপ্নের জন্য লড়ছে পুরো পৃথিবীর সাথে! আমি যদি ওর পাশে না থাকি ও হয়তো তবুও একা লড়ে যাবে কিন্তু আমি তো তা চাইনি মা। আমি তো সবসময় ওর পাশে থাকতে চেয়েছি।

-রঙ্গন মাথা ঠাণ্ডা করো। চিত্রলেখার পাশে তুমি সবসময় থাকবে। আমি নিজেই তোমাদের বিয়ে দিব। তুমি শান্ত হও।

-তোমার ভাই আমার লেখার দিকে হাত বাড়িয়েছিল মা। ঐ লোকটাকেও আমি মেরেছি। ও ভবিষ্যতেও আমার লেখার ক্ষতি করতে চাইবে। আমি যদি তাকে মেরে ফেলি তুমি আমায় ভুল বুঝবে মা?

আশফিনা আহমেদ চুপ হয়ে গেলেন। রঙ্গনের মাথায় কী পরিমাণ রাগ চড়ে বসেছে তা যেন স্পষ্ট টের পেলেন তিনি। নিজের ছেলের অবস্থাটা অল্প হলেও আঁচ করতে পেরেছেন তিনি। এখন রঙ্গনকে কিছু বলাই উচিত হবে না তার।

-কিছু বলছো না কেন মা?

-রঙ্গন, চিত্রলেখার তোমাকে প্রয়োজন। তুমি ওর প্রতি নজর রাখো। নওশাদ অন্যায় করেছে, তার শাস্তি আমিই তাকে পাওয়াবো। তুমি এসব বিষয়ে জড়িয়ো না। তুমি লেখার পাশে থাকো।

রঙ্গনের মাথা বোধহয় খানিকটা ঠাণ্ডা হলো। এ প্রসঙ্গ থেকে সরে বাড়ির খোঁজখবর নিলো সে। আরো নানান কথা বলে মিনিট পনেরো পরে কল রাখলো। রঙ্গন কল কেটে দিতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আশফিনা আহমেদ। নওশাদের মুখোমুখি তিনি রঙ্গনকে হতে দিতে পারেন না। রঙ্গন নওশাদের বড়সড় ক্ষতি করতেই পারে তবে নওশাদ রঙ্গনের যে ক্ষতিটা করবে তা হলো রঙ্গনের জন্মপরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা। এই একটা সত্য আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে আশফিনা আহমেদ ক্লান্ত। তবুও এ বিষয়টা তিনি রঙ্গনের সামনে আসতে দিতে চান না। তার জন্য যা করতে হয় তিনি করবেন।

_______________________

-বারান্দায় আসো।

-আপনি এই রাতে এখানে কেন?

-চুপচাপ বারান্দায় এসো। তোমায় দেখবো একবার।

রঙ্গনের আকুতিটা যেন চিত্রলেখার অন্তর ফালা ফালা করে চলে গেল। কেন সে এই ছেলেটাকে এত কষ্ট দিচ্ছে? চিত্রলেখার মন মাঝেমধ্যেই বলে যদি রঙ্গনের সাথে তার আরো দেরিতে দেখা হতো! তবেই বোধহয় ভালো হতো। এত অপেক্ষা তার নিজেরও ভালো লাগছে না। গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। নিচে তাকাতেই দেখতে পেল রঙ্গন তার বারান্দার দিকেই তাকিয়ে আছে। পড়নে ফরমাল শার্ট প্যান্ট কিন্তু শার্টের এক হাতা গোটানো আবার অপরটা ছেড়ে দেওয়া। ইন করা শার্টের একাংশ বেরিয়ে আছে। এমন ছন্নছাড়া রঙ্গনকে কখনো দেখেছিল কিনা মনে করতে পারছে না চিত্রলেখা।

-আপনার কী হয়েছে রঙ্গন? একে তো এই শীতের মধ্যে সোয়েটার ছাড়া এসেছেন, তার উপর এমন অবস্থা কেন? কিছু হয়েছে?

-আমায় একটা প্রমিজ করো।

-কী?

-ছোটখাটো যে রকম সমস্যাই হোক না কেন, তুমি আমাকে জানাবে।

-আচ্ছা জানাবো।

-তোমার কোচিংয়ের স্যারকে আমি আজ মেরেছি। আপাকে নিষেধ করেছিলাম কথাটা তোমাকে জানাতে কিন্তু আমি নিজেই জানালাম কারণ তুমি যেন নিজেকে একা না ভাবো। তোমার উপর একটুও আঁচ আসলে তার পরিণতি আমি ভালো রাখবো না রঙ্গনা! তবে এটা ভেবো না আমি সবসময় আসবো। আমি থাকবো তোমায় যুদ্ধ শেখাতে, তোমার লড়াইটা আমি লড়বো না। এবার যা করেছি রাগের মাথায় তবে পরবর্তীতে যদি এমন পরিস্থিতি আসে, চুপচাপ চলে না এসে মেরে রেখে আসবে। বুঝেছো?

-হুম। এখন আপনি উপরে আসেন। আমি ভাবীর হাত দিয়ে চাদর পাঠাচ্ছি।

-তুমি নিজের দিকে তাকাও তো! তোমার শীতের কাপড় কোথায়? সোয়েটার সব বেঁচে দিছো? যাও নিজে আগে সোয়েটার পড়ো! আর চাদর দিতে চাইলে নিজে আসবা। আমি অপেক্ষা করছি।

চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সারাদিনের উদাসীনতা যেন এক মুহূর্তে মলিন হয়ে গেল। একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিজের চাদরটা হাতে নিল সে। খুব সাবধানে ড্রয়িং রুমে খেয়াল করলো। অনিক এখনো আসেনি আর সাথী রান্নাঘরে ব্যস্ত। গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো চিত্রলেখা। বাড়ির পেছনের অংশটা গাছগাছালিতে ভরা, অনেকটা বাগানের মতো জায়গা। রঙ্গন সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখা সতর্ক পায়ে রঙ্গনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। রঙ্গনের চোখে এখনো রাগের ঝাঁঝ যেন বহাল! তবে চিত্রলেখাকে ক্ষণিক সময় দেখার পর তার চাহনি স্বাভাবিক হয়ে এলো। আগের চঞ্চল রঙ্গন যেন ফিরলো।

-চাদর নেন। বাচ্চা এখনো আপনি? এভাবে এসেছেন! ঠাণ্ডা লাগলে?

-ঠাণ্ডা লাগলে তুমি সেবা করতে! এই বাহানায় তোমায় পাশে পাওয়া যেতো।

-বাচ্চামি রেখে বাসায় যান।

-সারাদিন এত মন খারাপ ছিল, আমায় একবার কল দেওয়া যেত না? তোমার মাথায় একটা বিষয় ঢুকে গেছে যে প্রেম করলে কোনদিন ভালো করা যায় না! লেখা আমরা বাচ্চা না, তোমার ভাই ভাবী যেমন তোমার স্বপ্নপূরণে পাশে আছে আমিও তেমন। আমার সাথে দিনরাত তোমায় কথা বলতে হবে না। একটু মন খারাপ হলে আমায় তুমি কল করতেই পারো। আমি তোমার বন্ধু এটা ভুলে যেও না। তাছাড়া প্রাইভেটে পড়ি বলে এতটাও খারাপ স্টুডেন্ট না যে সমস্যা সমাধান করে নেওয়ার বাহানায় একটু কলও করা যাবে না!

-আচ্ছা? ঠিক আছে এরপর সব সমস্যা আপনার থেকেই সলভ করে নিব।

-আমরা বিশেষ মানুষের জন্য সবসময় নিয়ম ভাঙি রঙ্গনা। তুমিও নিয়ম ভাঙার দলে নিজেকে ক্ষণিকের জন্য রাখতে পারো।

-অনেক হয়েছে। ঠাণ্ডা লাগবে, বাসায় যান এখনি।

-চলে যাবো? বিদায় করার এত তাড়া? আচ্ছা বুঝলাম। যাচ্ছি।

রঙ্গনের মেকি অভিমান বুঝে খানিকটা হাসলো চিত্রলেখা। তবে বিদায় শব্দটা যেন তাকে উদাসীই করে তুললো। চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো তার। চিত্রলেখা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রঙ্গন পিছু ফিরে চিত্রলেখার চোখে হাত রেখে কপালে আলতো করে একটা চুমু খেল।
“আমার স্পর্শ তোমার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটানোর দুঃসাহস না করুক তবে তোমার মনে উদাসীনতার আগমনের পথে দেয়াল হয়ে থাকুক।” কথাটুকু বলে কয়েক ন্যানোসেকেন্ডের মাঝেই যেন রঙ্গন চলে গেল। চিত্রলেখা বুঝতেও পারলো না কী থেকে কী হলো। সে বিস্মিত হয়ে তখনো সেখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রঙ্গনের প্রস্থানের পানে চেয়ে রইলো।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
চুয়াল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

আজ রঙ্গনের জন্মদিন। সপ্তাহ তিনেক হলো রঙ্গনের চিত্রলেখার সাথে কথা হয় না। রঙ্গন প্রতিমুহূর্তেই মনে করে চিত্রলেখার কথা কিন্তু আজকের দিনে মনটা যেন একটু বেশিই খারাপ হয়ে আছে। চিত্রলেখার জন্মদিনের জন্য অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল কিন্তু চিত্রলেখা আচমকা সাথীকে নিষেধ করলো তার জন্মদিনে কোনোরকম অনুষ্ঠান না করতে। এতে অবশ্য সাথী বিশেষ অবাক হয়নি। জন্মদিন শব্দটাই চিত্রলেখার পছন্দ না তবুও সে চেয়েছিল একটু কিছু করতে কিন্তু চিত্রলেখার নিষেধাজ্ঞার পর আর সাহস পায়নি। জন্মদিন নিয়ে মেয়েটার স্মৃতি মোটেও সুখকর নয়। চিত্রলেখার পাঁচ কি ছয় বছর বয়সের সময় জন্মদিনে মেয়েটা তার বাবার হাতে বেধড়ক মার খেয়েছিল। এরপর থেকেই এ দিনটা তার জন্য অভিশপ্ত। ঘটনাটা সাথী রঙ্গনকে বুঝিয়ে বলেছিল তবুও রঙ্গন মানতে পারেনি। একটা ঘটনাকে এভাবে বয়ে বেড়াবে এটার কোনো মানে নেই। তবে সাথীও রঙ্গনকে নিষেধ করে। চিত্রলেখার জন্মদিন পালন করতে না পারার খারাপ লাগাটা যেন আজ কয়েকগুণ বিষিয়ে তুলছে রঙ্গনের মনটাকে। চাইলেও আজ কোনোকিছুতে মন বসছে না তার। অফিস থেকে ছুটি নিতে চেয়েছিল তবে ফ্রি থাকলে মন আরো খারাপ হবে। অফিসে এসে মন ভালো হওয়া তো দূর উল্টো আরো খারাপ হয়ে আসলো। একেকজন এসে উইশ করছে, রঙ্গনের মনের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। জন্মদিন শব্দটার উপর যেন এখন তারও রাগ উঠে গেছে। কাজের উপরও ঠিকঠাক মনোযোগ আসছে না। অফিস টাইম শেষ ছয়টায়। পাঁচটার পর রঙ্গনের মন কোনভাবেই টিকলো না। মন অদ্ভুত রকমভাবে আনচান করছে। রঙ্গনের ফোনটা অনেকটা আচমকাই বেজে উঠলো। চিত্রলেখার নম্বর ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। রঙ্গন চোখ কচলালো। সত্যিই চিত্রলেখা কল করেছে! তড়িঘড়ি করে চল রিসিভ করলো সে।

-লেখা, কিছু হয়েছে? তুমি এই অসময়ে কল? ঠিক আছে সব?

-শশশশ! এত বেশি বোঝেন কেন? আমি কি এমনি কল করতে পারি না? অফিস টাইম শেষ কখন?

-ছয়টা!

-এখন বেরোতে পারবেন একটু?

-কোথায় আসতে হবে?

-আপনার অফিসের নিচে আমি অপেক্ষা করছি!

-তুমি এখানে এসেছো? কখন? কিভাবে?

-এতগুলো প্রশ্ন একসাথে? নিচে আসেন বলতেছি।

রঙ্গন কাজগুলো গুছিয়ে রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে নামলো। চিত্রলেখা পার্কিং সাইটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গনের দৃষ্টি তার উপর পড়তে কয়েক ন্যানোসেকেন্ড লাগলো মাত্র। চিত্রলেখাকে দেখে রঙ্গনের হৃদস্পন্দন যথানিয়মে কম্পন তুললো। মেয়েটাকে যখনই দেখে সে, তার হৃদস্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি যেন অনিবার্য। রঙ্গন জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

-এখন বলো এখানে তুমি হঠাৎ?

-এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম তাই ভাবলাম দেখা করি একটু। তোমার বাসাটা কোথায়? দেখাও তো।

-তুমি বাসায় যাবে? পরে নিয়ে যাবো কখনো, এখন তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি চলো।

-বাসায় নিয়ে যাবেনা সরাসরি বললেও চলতো।

-কেন নিয়ে যেতে চাচ্ছিনা তা বুঝতেছো না? অন্য কোথাও নিয়ে যাই?

-হুম চলো। তোমার চেনা জায়গায় অনেক ঘুরেছি, এখন আমার পছন্দের একটা জায়গায় চলো।

-কোথায়?

-আসো।

চিত্রলেখার পিছু পিছু চলতে শুরু করলো রঙ্গন। চিত্রলেখা রিকশা ধরলো। রঙ্গন আদেশমতো চিত্রলেখার পাশাপাশি বসলো। চিত্রলেখার পড়নে সাদা নীলের সংমিশ্রণে একটি গোল জামা। রঙ্গনের মনে হচ্ছে আজ পৃথিবীর সমস্ত শুভ্রতা এসে চিত্রলেখাকে ছুঁয়েছে। রঙ্গন এ শুভ্রতায় কোনো কলঙ্কের দাগ লাগাতে পারে না। রিকশা বেশ ধীরগতিতে চলছে। রঙ্গনের অবশ্য বেশ ভালো লাগছে। চিত্রলেখার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে সে। মেয়েটার চুল হালকা বাতাসে উড়ছে। বারংবার লেখা কানের পিছে তা গুঁজে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। রঙ্গন দৃশ্যটা উপভোগ করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকার বাহানায় কখন যে রিকশা থেমেছে সেদিকেও ধ্যান নেই তার। চিত্রলেখা নামাতে রঙ্গনের ঘোর কাটলো। নিজের খামখেয়ালিপনার জন্য নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো।

-কী জনাব? ধ্যানজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন? আসুন নৌকায় উঠবো।

-নৌকা? এখন? সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তো। নৌকা কোথায় পাবে?

-আসবেন চুপচাপ?

রঙ্গন কথা না বাড়িয়ে পিছু পিছু গেল। চিত্রলেখার এক নাবিকের সাথে কী যেন কথা বললো। অতঃপর রঙ্গনকে ডেকে নিল সে। রঙ্গন খানিকটা বিস্মিত হয়ে নৌকার দিকে এগোলো। চিত্রলেখার হাবভাব আজ বড্ড অন্যরকম লাগছে রঙ্গনের। নৌকায় একপাশ হয়ে বসলো দুজন। রঙ্গন খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলেও চিত্রলেখা রঙ্গনের এক হাত নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিলো।

-দেখেছেন রঙ্গন তারারা আমাদের জন্য মিটিমিটি করছে?

-চাঁদ ছেড়ে তারার দিকে তাকানোর বোকামি কিভাবে করি বলো তো রঙ্গনা! যেখানে চাঁদ আভায় স্পর্শ করে আছে, আমি কি এমন যে চাঁদকে উপেক্ষা করে তারার দিকে দৃষ্টিপাত করবো?

-কাব্যচর্চা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

-মোটেও না! আজ হঠাৎ একসাথে তারাবিলাস করতে ইচ্ছে হলো যে? বই বেচারা প্রত্যাখ্যান করেছে আমার প্রেয়সীকে?

-উহু। শুভ জন্মদিন রঙ্গন। এই তারাগুলোর চেয়েও আপনার জীবন উজ্জ্বল হোক।

-তুমি তো জন্মদিন পছন্দ করো না!

-আমার বেলায় সেটা। আপনার বেলায় না! তাছাড়া আজ বইগুলো আসলেই আমাকে তিরস্কার করেছে। আমার কেবলমাত্র সাদা এপ্রোন দরকার। ঢাকা মেডিকেলে টপ করতে চাইনা আমি। পাগলের মতো সেদিকে আর ছুটতেও চাইনা। আমার রঙ্গনকে চাই, আমার পাশে সবসময় আমার রঙ্গনকে চাই।

-স্বপ্ন সবসময় বড়ই দেখতে হয় রঙ্গনা। স্বপ্ন না দেখলে তা পূরণ হবে কী করে? তুমি না চাইলেও আমি চাই তুমি মেডিকেলে টপ করো! এতে তোমার উপর আনীত সব মিথ্যে অভিযোগ মুছে যাবে। আমি সবসময় আছিই, স্বপ্নের পেছনে ছোটো তুমি।

-সিরিয়াস আলাপ থাকুক এখন?

-যথা আজ্ঞা রানীসাহেবা। বলেন কী হুকুম।

-জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে একটা গান শোনাতে হবে এখনি।

-উমম..যা আদেশ করবেন শিরোধার্য!

রঙ্গন একবার আকাশের দিকে তাকালো। অতঃপর চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করলো,

“এই মায়াবী চাঁদের রাতে, রেখে হাত তোমার হাতে
মনের এক গোপন কথা তোমায় বলতে চাই…”

চিত্রলেখা আনমনেই রঙ্গনের কাঁধে হেলান দিল। মুহূর্তগুলো থেমে যাক! এভাবেই রঙ্গনের পাশে বসে আজীবন অতিবাহিত করুক সে। চিত্রলেখার ভাবনায় কেবল এটাই ঘুরপাক খেতে থাকে। রঙ্গন বোধহয় বুঝতে পারলো চিত্রলেখার মনের অবস্থাটা কিন্তু চাইলেই সবসময় সব সম্ভব হয় না। এই মুহূর্তটুকুও শেষ হওয়ার ছিল।

-তোমায় রেখে আসি চলো।

-আমি যেতে পারবো।

-তুমি যেতে পারলেও আমি যেতে দিব না। তোমার সাথে আরো কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত করার সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইনা।

-আপনি আন্টিকে কল করেছেন আজ?

-উহুম। মা-ই কল করবে তবে সবার শেষে। মা বলে প্রথমে জন্মদিনে উইশ করার চেয়ে শেষে উইশ করাটা বেশি মনে থাকে। এতে মায়া বেশি থাকে।

চিত্রলেখা মুচকি হাসলো। রঙ্গন ছেলেটা বড্ড ভাগ্যবান। আশফিনা আহমেদের মতো একজন মা সে পেয়েছে। চিত্রলেখার মাঝে মাঝে বড্ড আফসোস হয়। আশফিনা আহমেদ হয়তো কখনোই তাকে মেনে নিবেন না। তখন রঙ্গনের সাথে তার সম্পর্কে যদি ভাটা পড়ে? চিত্রলেখা তা কোনোক্রমেই চায় না। রঙ্গন না জানুক, চিত্রলেখা তো ডানে আশফিনা আহমেদ রঙ্গনকে ঠিক কতটা ভালোবেসে আগলে রেখেছেন। এ ভালোবাসার কাছে চিত্রলেখার ভালোবাসার মূল্য কতটুকূ? যদিও ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় না তবুও চিত্রলেখা আন্দাজ করতে পারে আশফিনা আহমেদের ভালোবাসা এক সুবিশাল সমুদ্রের ন্যায়। রঙ্গন সে সমুদ্রে আজীবন ভেসে বেড়াতে পারবে আর চিত্রলেখার ভালোবাসা বোধহয় ছোট্ট একটা নদী। এ নদীর স্রোতে ভেসে কতদূরই বা যেতে পারবে রঙ্গন? অবান্তর সব প্রশ্নে চিত্রলেখার মস্তিষ্কে জ্যাম বাঁধে। চিত্রলেখার আনমনা রূপটা রঙ্গনেরও নজর এড়ায় না। রঙ্গনের ইচ্ছে করে আলতো করে চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে স্পর্শ করে মেয়েটাকে ভড়কে দিতে।

চলবে …