Sunday, July 13, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 355



অবিবাহিত বউ পর্ব-০৪

0

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ৪
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তোহা ক্লাসে গিয়ে রিয়ার সম্মুখীন হলো। রিয়া তার দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। তোহা অরিনকে নিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসেছে। তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলা করছে। ভার্সিটিতে আসার পর নাহিদের দেখা পায়নি সে। দুষ্টু বুদ্ধিরা মাথায় জেঁকে বসেছে।

তোহা অরিনের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
“এখানে না বসে আমার সাথে আয়।

তোহার মুখের দুষ্টু হাসি। চোখ মুখের ভ’ঙ্গি দেখে অরিন সন্দি’হান দৃষ্টিতে তাকাল। ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“কোথায় যাব? তুই কি করতে চাচ্ছিস?

তোহা অরিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিল। মুচকি হেসে বলল,
“কুল বেবি। এতো অ’স্থির হচ্ছো কেন? ধৈর্য’শীল হতে শিখ। কি করবো তা তো দেখতেই পাবে।

অরিন একই ভ’ঙ্গিতে বসে রইল। কিছুটা জেদ নিয়ে বলে উঠল,
“আমার এতো ধৈর্য নেই বাবা। তুই কি করবি না বলা পর্যন্ত আমি এখান থেকে উঠব না। তোর চোখ, মুখ, হাসি অন্য রকম দেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই কোনো কুমত’লব আঁটছিস।

তোহার ঠোঁটের হাসিটা আরেকটু প্রসারিত হলো। অরিনকে হালকা জড়িয়ে ধরে বলল,
“দেখেছিস একেই বলে বন্ধুত্ব। তুই কি সুন্দর আমার মুখ দেখে সব বুঝে গেছিস।

অরিন নিজেকে তোহার থেকে ছাড়িয়ে নিল। তোহার কথায় অমত করে বলল,
“আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোদের তিন দিনের ঝগড়া দেখে আমি ক্লা’ন্ত। এবার এসব বাদ দে।

তোহা অরিনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। কোমরে দুহাত রেখে কড়া গলায় বলল,
“কি বলতে চাচ্ছিস তুই? তুই আমার সাথে যাবি না?

অরিন জে’দ ধরল। তোহার কড়া গলার স্বরকে পাত্তা দিল না। নিজের মতে ঠিক থেকে তোহাকে দৃঢ় গলায় বলল,
“উহু! আমি যাব না। তুই গিয়ে ঝগড়া কর যা। আমাকে এর মধ্যে একদম টানবি না।

তোহা দেখল অরিন নিজের কথায় অটুট রইল। তাই শীতল কন্ঠে বলল,
“তুই সত্যি যাবি না? এভাবে আমাকে একা করে দিবি? তুই না গেলে আমি ও তোর সাথে কথা বলবো না। এখন থেকে তোর সাথে আড়ি।

তোহার এমন বাচ্চামি কথায় অরিন হেসে উঠল। তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস না? আমরা কি এখনো প্রাইমারি স্কুলের স্টুডেন্ট? যে আড়ি করে কথা বলবো না।

তোহা অরিনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেল না। তাই মুখ ভেং’চি দিয়ে অরিনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অরিন সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শেষ পর্যন্ত বলল,
“ঠিক আছে চল। তবে আমি কিছু করবো না। যা করার তুই করবি।

তোহা অরিনের দিকে তাকিয়ে অরিনের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে বেবি, চল।

অরিন তোহার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“ছি’হ! অ’শ্লীল কথাবার্তা।

তোহা মুখ ভেং’চি দিল। বি’দ্রুপ করে বলল,
“বুঝি বুঝি। আমি বলেছি বলে অ’শ্লীল কথাবার্তা। কিন্তু যখন জামাই বলবে তখন হবে রোমান্টিক কথাবার্তা। হুহ।

অরিন তোহার মাথায় গা’ট্টা মেরে বলল,
“তুই চুপ কর তো। খুব বেশি কথা বলছিস।

তোহা অরিনের কথায় হাসল। দুজনই ক্লাস থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াল। দরজার সামনে যাওয়া মাত্র তোহার মনে পড়ল রিয়ার কথা। চোখ বুলিয়ে নিল ক্লাসে। রিয়া একটা মেয়ের সাথে বসে আছে। তোহা অরিনকে আটকে দিল। চোখের ইশারায় রিয়াকে দেখাল।

অরিন ভ্রুঁ কুঁচকে জানতে চাইল ‘কী? তোহা মুচকি হাসল। অরিনকে নিয়ে রিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রিয়া তোহাকে দেখে অবাক হলো। তোহা রিয়ার কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“তোমার নাহিদকে একটু শা’য়েস্তা করে আসি।

রিয়া তোহার কথাটা বুঝতে পারল না। ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“শায়েস্তা করবে মানে? কী করবে তুমি?

তোহা হেঁয়ালি করে হাসল। রিয়ার কথার জবাব দিল না। রিয়া উত্তরের আশায় চেয়ে রইল। তোহা জবাবে বলল,
“সেটা তোমার নাহিদের থেকে জেনে নিও।

তোহা অরিনকে নিয়ে চলে গেল। রিয়া অবাক চোখে চেয়ে রইল তোহার যাওয়ার পথে।

ভার্সিটির মাঠে আসতেই তোহা দেখতে পেল বাইকটিকে। বাইকের আশেপাশে নাহিদের চিহ্ন ও দেখতে পেল না। তোহার চোখ আনন্দে চিকচিক করে উঠল। অরিনের হাত ধরে বাইকটিকে ইশারা করে বলল,
“বাইকটার কাছে চল।

অরিন অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তোহা চোখের ইশারায় আ’স্বস্ত করল। বাইক থেকে প্রায় দশ হাত দূরে থাকতে অরিনের হাত ছেড়ে দিল। অরিন তাকাতেই বলল,
“তুই এখানে দাঁড়া। ওই নাহিদ যদি আসে তাহলে আমাকে ডাক দিস।

অরিন হত’ভম্ব হয়ে মাথা নাড়ালো। তোহা বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। বাইকের কাছাকাছি আসতেই মুখ থেকে সেন্টার ফ্রুট বের করল। বাইকের সিটের মধ্যে লাগিয়ে দিল। অরিন চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল তোহার দিকে। কিছুটা ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“এই তোহা তুই কি করছিস?

তোহা অরিনের দিকে হাসি মুখে তাকাল। তারপর বলল,
“আরে দেখছিস না? এখানে বসলে মজা বুঝবে।

অরিন আর কথা বাড়ালো না। চুপ করে দেখল। আশেপাশে তাকাল নাহিদ আসছে কি-না দেখতে। তখনই দেখল নাহিদ, রনি, ফাহিম এই দিকে আসছে। তিনজনই কথা বলায় ম’গ্ন। অরিন তড়িৎ গতিতে বলল,
“এই তোহা তাড়াতাড়ি আয়। ওরা এসে পড়ছে।

তোহার বুকটা ধক করে উঠল। এক দৌড়ে অরিনের কাছে চলে এলো। বুকটা ধরফর করছে। দুজন দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলো। কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই নাহিদের মুখমুখি হলো। তোহা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে নাহিদ সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তোহা কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। নাহিদ বলল,
“কী ব্যাপার বউ। ভয় পেয়েছো বুঝি?

তোহা নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক রাখল। দৃঢ় গলায় বলল,
“ভয়? কেন? ভয় পাওয়ার মতো কিছু করেছি নাকি যে ভয় পাব? তাছাড়া আমি আপনাকে মোটেই ভয় পাই না।

নাহিদ আরেকটু এগিয়ে এল। তোহার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওহ তাই নাকি?

“জি। এবার আপনি সরে দাঁড়ান তো। ক্লাসের সময় হয়েছে। ক্লাসে যেতে হবে।

নাহিদ সরে দাঁড়ালো। অরিন তোহার হাতটা ধরে এগিয়ে গেল। তার মুখটা একটুখানি হয়ে আছে। ওরা যেতেই রনি বলে উঠল,
“কি অদ্ভু’ত! এতো তাড়াহুড়ো করছে কেন?

নাহিদ হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল,
“কি জানি? বলল তো ক্লাস আছে। তাই হয়তো তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।

ওরা আর কথা বলল না। চুপচাপ এগিয়ে যেতে লাগল। বাইকের কাছে গিয়ে সিটে বসতে গেলেই ফাহিমের চোখ গেল সিটের মধ্যে লাগিয়ে রাখা সেন্টার ফ্রুটের দিকে। নাহিদকে আটকে দিয়ে বলল,
“এই দেখ এখানে কি?

নাহিদের বাইকের দিকে চোখ যেতেই রাগে চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। বাইকের এই বাজে অবস্থা কে করল? নাহিদ ফাহিম রনির দিকে তাকাল। সকলের চোখেই বি’স্ময়। রনি বলে উঠল,
“এই কাজটা কে করল?

নাহিদের মুখের সামনে তোহার থতমত খাওয়া মুখটা ভেসে উঠল। তবে কি ওই মেয়েটাই কাজটা করেছে? নাহিদের মুখে রাগ ফুটে উঠল। কিছুটা সময় পর মুখে হাসি ফুটে উঠল। মুখে বলল,
“বউ তোমার সাহস দেখে আমি মু’গ্ধ। আমার সাথে এই কাজ করলে?

নাহিদের কথা শুনে ফাহিম, রনি তার মুখের তাকাল। ফাহিম বলল,
“কি বলছিস এসব?

নাহিদ হেসে বলল,
“আরে বুঝতে পারছিস না? আমার পেয়ারের বউ এই কাজটা করেছে। তাইতো তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।

রনি বলল,
“তাইতো ভাবছি এই কাজটা কে করতে পারে? তোর বউ ছাড়া কেউ এই কাজ করেনি। বাহ! তোর বউয়ের তো সেই সাহস।

নাহিদ কোনো জবাব দিল না। ক্ষানিক ক্ষন চুপ থেকে বলল,
“তোরা থাক আমি আসছি। বউকে রাঙাতে হবে। রাঙানোর সরঞ্জাম আনতে হবে।

ফাহিম, রনি নাহিদের কথার মানে কিছুই বুঝল না। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল নাহিদের যাওয়ার দিকে।

নাহিদ মিনিট দশেক পর ফিরে এলো। চোখ মুখে উচ্ছাস। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ১০ টা বেজে পঁচিশ মিনিট। তারমানে তোহা এখন ক্লাসে। নাহিদ ছুটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

ছুটি হতেই নাহিদ তোহার ক্লাসের সামনে গেল। তোহা বের হতেই তোহার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে অন্য দিকে নিয়ে গেল। তোহা অবাক কন্ঠে বলল,
“আরে কি করছেন? হাত ছাড়ুন আমার।

নাহিদ হাত ছাড়ল না। তোহাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। তোহা হত’ভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। নাহিদ তার হাতে রঙ নিয়ে তোহার গালে লাগিয়ে দিল। তোহা চমকে গেল। নাহিদ তোহার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“কি ভেবেছিলে বউ? তুমি একাই চালাক। আর আমরা সবাই বোকা?

তোহা তার হাতটা গালে লাগালো। তারপর হাতটা সামনে এনে দেখল লাল রঙ। তোহা ক্রু’দ্ধ স্বরে বলল,
“এটা কি করলেন আপনি?

“কেন? তুমি কি করেছো ভুলে গেলে?

তোহা জবাব দিল না। নাহিদ তোহার হাত ধরে নিয়ে গেল। ক্লাসের সামনে যেতেই অরিনের দেখা পেল তোহা। অরিন অবাক দৃষ্টিতে তোহার দিকে তাকিয়ে আছে। তোহার ডান গালটা লাল রঙে রাঙানো।

নাহিদ ভার্সিটির মাঠে গিয়ে তোহার হাতটা ছেড়ে দিল। সকলে তোহার দিকে তাকিয়ে রইল। রাগে তোহার শরীর কাঁপতে লাগলো। অরিন পাশে এসে দাঁড়াতেই অরিনের সাথে বেরিয়ে গেল ভার্সিটি থেকে।

(রিচেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

#চলবে

অবিবাহিত বউ পর্ব-০৩

0

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ৩
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তোহার গভীর ঘুমটা হালকা হয়ে গেল মেসেজের টুং টাং আওয়াজে। একটার পর একটা মেসেজ এসেই চলেছে‌। তোহা আড়মোড়া ভে’ঙ্গে উঠে বসল। মেজাজটা প্রচ’ন্ড খারা’প। বি’রক্তি নিয়ে মোবাইলটা হাতে নিল। কে এতো মেসেজ দিচ্ছে?

মোবাইল হাতে নিয়ে তোহার ভ্রুঁ কুঁচকে এলো। মেসেঞ্জারে মেসেজ আসছে। কারো আইডি থেকে না। একটা গ্রুপ থেকে। তোহা গ্রুপে গেল। একটা মেয়ে অরিনকে গ্রুপে এড করেছে। অরিন তোহাকে এড করেছে।

গ্রুপে যাওয়া মাত্রই একটা মেসেজে তোহার চোখ আটকে গেল।‌ একটা মেয়ে তোহার আইডি মেনশন দিয়ে বলছে,
“আরে এই মেয়েটাকেই তো ভার্সিটিতে বউ বলে ডেকেছিল। ভাইয়া বুঝি তোমাকে অনেক ভালোবাসে? সকলের সামনে কেমন করে বউ বলে ডেকে উঠল।‌ একটুও দ্বি’ধা করল না।

তোহা অবাক চোখে চেয়ে রইল। কী অ’দ্ভুত! সে-কি ভেবেছিল ভার্সিটির প্রথম দিনে সবাই তাকে এমন বি’শ্রি ভাবে চিনবে? উহু! ভাবেনি। তাও এমন হলো। কতো আ’শ্চর্যময় জীবন আমাদের। নিত্যনতুন কতো জানা অজানা কাহিনি ঘটে যায়।

মেয়েটার মেসেজের রিপ্লাইয়ে আরেকটা মেয়ে বলল,
“কেমন কথা বলছো তুমি? ভালো না বাসলে কি কেউ এভাবে বউ বলে ডাকে? অবশ্যই ভালোবাসে। তাই তো বউ বলে ডাকার সাহস পেল। নাহলে বউ বলে ডাকতে দুবার ভাবতো।

এখন গ্রুপে কথা বলার মূল বিষয় তোহা আর নাহিদের ঘটনা। একেক জন একেক রকমের কথা বলছে। তোহার সর্বা’ঙ্গ রাগে জ্ব’লছে। সবতাই হয়েছে নাহিদের জন্য। শুধুই নাহিদের জন্য? এতে কি তার কোনো হস্ত’ক্ষেপ নেই? হয়তো বা আছে।

তোহা অরিনের মোবাইলে ফোন লাগালো। রিং হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরই অরিন ফোনটা ধরল। ওপাশ থেকে উ’দ্বিগ্ন কন্ঠে শুধাল,
“হ্যাঁ বল। কী হয়েছে?

তোহা কঠিন গলায় বলে উঠল,
“আমাকে গ্রুপে কেন এড দিয়েছিস? দেখছিস কি রকম কথা বলছে। আমার সারা শরীর রাগে জ্ব’লে উঠছে।

অনলাইনে না থাকার কারণে তোহার কথাটা বুঝতে পারল না অরিন। অবাক ক’ন্ঠে বলল,
“কি বলছিস? গ্রুপে এড দিয়েছি তো কি হয়েছে? এটা আমাদের ভার্সিটির গ্রুপ। একটা মেয়ে আমাকে এড দিয়েছে। আমি তোকে এড দিলাম। এতে রেগে যাওয়ার কি হলো?

তোহা আগের ন্যায় বলল,
“তুই দেখছিস না ওরা কি বলছে? নাকি কানা হয়ে গেছিস? যে যার ইচ্ছে মতো কথা বলে যাচ্ছে। নাহিদ আমায় কতো ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই সাহস করে বউ বলে ডাকতে পেরেছে। হেন তেন কতকিছু বলছে। ওরা জানে নাহিদ আমায় ভালোবাসে? না জেনে শুনে এমন গা জ্বা’লানো কথা বললে রেগে যাব না?

অরিন এবার বুঝতে পারল। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“এখানে ওদের দো’ষ কোথায়? তোর আর নাহিদ ভাইয়া সম্পর্ক কেমন তা কি ওরা জানে? জানেনা তো। ওরা যা দেখেছে, শুনেছে তাই বলছে। আর মানুষের স্বভাবই তিলকে তাল বানানো। এখানে ওদের দো’ষ দিয়ে লাভ নেই।

“ওদের দো’ষ দিব না তো কার দো’ষ দিব? ওরা যখন আমাদের সম্পর্কে কিছু জানে না তাহলে নিজের মন মতো একটার পর একটা কথা বলে যাচ্ছে কেন?

একটানে কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস নিল তোহা। পর’ক্ষনেই কিছু একটা মনে পড়ল। অরিনকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই উ’দ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল,
“এই এক মিনিট, এক মিনিট। একটু আগে কি বললি তুই? নাহিদ ভাইয়া? ওই ছেলেটাকে তুই ভাইয়া বলছিস? ছেলেটা তোর মুখ থেকে ভাইয়া ডাক শোনার যোগ্য?

অরিন জানে তোহা রেগে আছে। হয়তো তার কথাটা শুনে আরো রেগে যাবে। তাও মশকরা করে বলল,
“আমার মুখ থেকে ভাইয়া ডাক শোনার যোগ্য না। তাহলে কি তোর বর হিসেবে দুলাভাই ডাকবো?

তোহা অরিনের কথাটা শুনে কয়েক সেকেন্ড কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কয়েক সেকেন্ড নি’শ্চুপ রইল। অরিন? অরিনও তাকে নিয়ে মজা করছে? তোহা যেই চেঁচিয়ে বলল,
“অরিন তুই….

তোহার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই কলটা কেটে গেল। না। অরিন কল কাটেনি। ফোনের ব্যালেন্স শেষ বিধায় নিজে নিজেই কল কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত ফোনও তার সাথে বেই’মানি করছে? তোহা ফোনটা বিছানায় ছুড়ে বলে উঠল,
“ধ্যা’ৎ।
__________

তোহা অরিন ভার্সিটিতে এসেছে। গেইট পেরিয়েই তোহার দৃষ্টি এদিক-সেদিক ঘুরতে লাগলো। তার উদ্দেশ্য নাহিদকে খোঁজা। গতকালকে যেখান থেকে নাহিদ ডাক দিয়েছিল তোহা সেই দিকে তাকাল। হ্যাঁ। গাছের নিচে একটা বাইক আছে। সম্ভবত এটা নাহিদের বাইক। কিন্তু বাইকের আশেপাশে কোথাও নাহিদের দেখা পেল না। অরিন তোহাকে বলল,
“এখানে তো কোথাও দেখছি না। চল একবার কেন্টিনে আছে কি-না দেখে আসি।

তোহা নীরবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। অরিনের পিছু পিছু যেতে লাগল কেন্টিনে। কেন্টিনের কাছাকাছি আসতেই তোহা দেখতে পেল নাহিদকে। শুধু নাহিদই না। নাহিদের পাশে রনি ও ফাহিম আছে। তার চেয়ে বড় কথা কালকের সেই মেয়েটি আছে। তোহা দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে লাগল। কয়েক পা হাঁটার পর লক্ষ্য করল মেয়েটি সেখানে নেই। তোহাকে দেখা মাত্র সেখান থেকে চলে গেল।

তোহা সেই দিকে পাত্তা দিল না। সোজা গিয়ে দাঁড়াল নাহিদের মুখমুখি। তোহার পাশে অরিন দাঁড়াল। তোহাকে দেখা মাত্রই নাহিদ মুখ খুলতে চাইল। কিন্তু তোহা হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“মিস্টার নাহিদ। আপনি কি ভাবেন নিজেকে? পুরো ভার্সিটির সবাই আমাকে আপনার গার্লফ্রেন্ড হিসেবে চিনে? কেন? আমাকে বউ বলে ডাক না দিলে বুঝি আপনার পেটের ভাত হজম হতো না?

তোহার কথা শুনে নাহিদ নির্বি’কার ভ’ঙ্গিতে বসে রইল। টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে পানি খেল। নাহিদের এমন ভাব ভ’ঙ্গি তোহাকে আরেকটু রাগিয়ে দিল। তোহা চাইছে নাহিদ যেন ঝগড়া করে। তাহলে আরো কয়েকটা কথা বলে নিজের রাগটা মেটানো যেত। কিন্তু না। নাহিদ তা করল না। উল্টো মুচকি হেসে বলল,
“মিসেস নাহিদ তো দেখছি সকাল সকাল রেগেমেগে আগুন হয়ে আছে। ব্যাপার কি?

নাহিদের ‘মিসেস নাহিদ’ বলা কথাটায় জ্ব’লে উঠল। রাগে শরীর কাঁপতে লাগলো। তোহা চোখ মুখ শ’ক্ত করে বলল,
“আপনি তো দিন দিন লিমিট ক্র’স করছেন। এতো সাহস কোথায় পান?

তোহার কথায় নাহিদ হু হা করে হেসে উঠল। ফাহিম আর রনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“দেখেছিস বন্ধু? আমার সাহস নিয়ে কথা বলছে।

নাহিদ আরেকবার হেসে তোহাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার সাহসের কী দেখেছো তুমি? উল্টো আমি তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। নাহিদের চোখে চোখ রেখে ঝগড়া করছো। একটু ও ভয় ভর করছো না।

তোহা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। ভ্রুঁ কুঁচকে রেখেই বলল,
“আপনাকে ভয় পাব? কেন? আপনি কি বাঘ না ভাল্লুক যে আপনাকে ভয় পাব? আমাকে খেয়ে তো ফেলবেন না।

নাহিদ খানিকটা এগিয়ে এলো। তোহার দিকে তাকিয়ে নিচু স্ব’রে বলল,
“কে বলতে পারে? বউ তো খেয়ে ও ফেলতে পারি। বিশ্বাস নেই।

নাহিদ কথাটা বলে চোখ টিপল। রনি নাহিদের মাথায় গা’ট্টা মেরে বলল,
“শা’লা দিন দিন লাগামহীন কথা বলছিস। এবার মুখে লাগাম টান।

নাহিদ রনির দিকে তাকাল। ঠোঁট উল্টে বলল,
“কি বলছিস মামা। চোখের সামনে ফুটফুটে সুন্দর একটা বউ থাকতে মুখে লাগাম টানবো? কখনোই না।তোদের ল’জ্জা লাগলে তোরা কানে তুলা গুঁজে বসে থাক। আমার কিন্তু কোনো সমস্যা নেই।

নাহিদের সাথে তাল মিলিয়ে ফাহিম বলে উঠল,
“না বন্ধু। আমার কোনো ল’জ্জা করছে না। তুই বলতে থাক। আমি তোর পাশে আছি। কানে তুলা গুঁজে বসে থাকার কোন প্রশ্নই উঠে না।

অরিন নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“তুই কাদের সাথে কথা বলছিস তোহা? একেক জন বদের হা’ড্ডি। কিসব বলছে। লাজ-ল’জ্জা কিচ্ছু নেই।

রনি সাথে সাথে বলে উঠল,
“মেয়েরা কথায় কথায় ল’জ্জা পায়। আমরা কেন ল’জ্জা পাব? আমরা কি মেয়ে নাকি?

তোহা ওদের তিনজনের দিকে তাকাল। শীতল কন্ঠে বলল,
“আপনারা সবাই একই রকম হলেন কি করে? কি অ’দ্ভুত! সকলে কেমন নির্ল’জ্জের মতো কথা বলছেন। একটু তো ল’জ্জা থাকা উচিত।

তোহা আর সেখানে দাঁড়াল না। ওদের সাথে কথা বলাই ভুল। গটগট পায়ে চলে গেল ক্লাসের উদ্দেশ্যে।

ক্লাসে গিয়ে বসতেই তোহার সামনে কালকের মেয়েটা এলো। চোখ মুখে কালকের মতোই রাগ স্প’ষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তোহা মেয়েটার দিকে তাকাতেই মেয়েটা বলে উঠল,
“তুমি নাহিদের কাছে গিয়েছিলে কেন? কি দরকার নাহিদকে?

তোহা বিদ্রু’প করে বলল,
“কেন? নাহিদের দরকারটা কি তুমি মিটিয়ে দিবে? নাকি তোমার নাহিদের সাথে কথা বলা বারণ?

“অবশ্যই। তুমি কেন নাহিদের সাথে কথা বলবে? যেহেতু নাহিদকে পছন্দ করো না। সেহেতু নাহিদের সাথে কথা বলা দূরের কথা, নাহিদের থেকে একশো হাত দূরে থাকবে।

“তাহলে তুমি একটা কাজ করো। তোমার..

কথাটা বলতে গিয়ে তোহা থেমে গেল। আচমকা বলে উঠল,
“তোমার নাম কি?

মেয়েটা থতমত খেল। পর’ক্ষনেই বলে উঠল,
“রিয়া।

তোহা মুচকি হেসে বলল,
“তুমি বরং নাহিদের গায়ে আঠা দিয়ে একটা কাগজ আটকে দাও। যেখানে লেখা থাকবে ‘রিয়া ছাড়া অন্য কোন মেয়ের নাহিদের সাথে কথা বলা বারণ ‘। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। তোমার নাহিদের সাথে আর কথা বলতাম না।

মেয়েটা কড়া চোখে তাকাল। তোহা সেদিকে পাত্তা দিল না। নিজের মতো অরিনের সাথে কথা বলতে লাগলো।

#চলবে

অবিবাহিত বউ পর্ব-০২

0

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ২
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তোহা চমকে পেছনে তাকাল। তোহার সাথে সাথে অরিন ও পেছনে ফিরল। একটা গাছের নিচে দুটো চেনা মুখ দেখেই বি’রক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে এলো তোহার।

ভার্সিটিতে একটা গাছের নিচে বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নাহিদ। নাহিদের পাশেই ফাহিম দাঁড়িয়ে ছিল। তখনই গেইটের দিকে তাকিয়ে ফাহিমের চোখ আটকে গেল। ফাহিম গেইটের দিকে চোখ রেখেই উ’দ্বিগ্ন কন্ঠে নাহিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“নাহিদ দেখ রেস্টুরেন্টের মেয়ে দুইটা না?

নাহিদ চোখ তুলে তাকাল। মুহূর্তের মধ্যেই মুখে বি’রক্তির ভাঁজ পড়ল। কিন্তু পরক্ষনেই মুখে ফুটে উঠল দুষ্টুমির রেখা। নাহিদ চেঁচিয়ে ডেকে উঠল,
“এই বউ দাঁড়াও।

তোহা পেছন ফিরে তাকাতেই নাহিদ চোখ টিপ মারল। বি’স্ময়ে হত’ভম্ব হয়ে তোহার মুখ হা হয়ে গেল। অরিন চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“তোর বর দেখছি মারা’ত্মক লেভেলের অস’ভ্য। সকলের সামনে চেঁচিয়ে বউ বলছে তার উপর আবার চোখ টিপ মারছে।

অরিনের কথাটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। তোহার থিতিয়ে থাকা রাগটা আরেক ধাপ বেড়ে গেল। একবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সকলে উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। তোহা সেই দিকে পাত্তা না দিয়ে অরিনের মাথায় গা’ট্টা মেরে বলল,
“ওই ব্যা’টাকে আরেক বার আমার বর বললে লাথি মেরে ভার্সিটি থেকে বের করে দেব। বেয়াদব মহিলা।

অরিন মুখ ভেং’চি দিল। তোহার মতো করে তোহার মাথায় গা’ট্টা মেরে বলল,
“যত দোষ নন্দ ঘোষ। তুই যখন অচেনা ছেলেটাকে বর বললি, আবার ছেলেটা যে এখন তোকে বউ বলল তাতে কিছু না। আমি বললেই সব দোষ আমার। হুহ।

অরিনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তোহা কিছু বলার মতো পেল না। চোখ ঘুরিয়ে নাহিদের দিকে তাকাল। নাহিদ আর ফাহিম ইতিমধ্যে ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে। তোহা বুকে দুহাত ভাঁজ করে কড়া গলায় বলল,
“সমস্যা কি আপনার? বউ বউ করে চেঁচাচ্ছেন কেন? আমি আপনার কোন জ’ন্মের বউ?

নাহিদ ফাহিমের কাঁধে হাত রাখল। ভ্রুঁ কুটি করে আফসোসের স্বরে বলল,
“সেকি বউ। এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? কালকেই তো সম্পর্ক হলো। আমরা দুজন বর-বউ। ইশ। আমি তো জানতাম না আমার বউটা এতো মনভোলা। শেষমেষ নিজের বরকেই ভুলে গেল।

তোহা নাহিদের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। চোখ মুখে ফুটে উঠেছে তী’ব্র ক্ষো’ভ। নাহিদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটু বেশি নাটক করে ফেলছেন না মিস্টার? আপনি জানেন আমি ইচ্ছে করে আপনাকে বর বলিনি। তাও আমার পেছনে লাগছেন। কেন?

নাহিদ তার মুখটা এগিয়ে আনলো। তোহার মুখের দিকে ঝুঁকে বলল,
“আমাকে কথাটা মুখে বললেই তো হয়ে যেত। কিন্তু না তুমি তো আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছো। আমি এতো সহজেই ভুলে যাব? বউউউ…!

বউ কথাটা নাহিদ সুর টেনে বলল। তোহা গরম চোখে তাকিয়ে তর্জনী আঙুলটা উঠিয়ে বলল,
“দেখুন মিস্টার আ…..

তোহা কথাটা শেষ করার আগেই নাহিদ আরেকটু এগিয়ে আসল। তোহার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির ছলে বলল,
“কী দেখাবে বউ? তুমি যা দেখাতে চাও দেখাও। আমি মন, প্রান, জান দিয়ে দেখব।

নাহিদের কথা বলার ধরন দেখে ফাহিম, অরিন হেসে ফেলল। ওদের সাথে নাহিদ ও তাল মেলালো। অরিনকে হাসতে দেখে তোহা কড়া দৃষ্টিতে তাকাল। অরিন সাথে সাথে হাসি থামিয়ে দিল। তোহা নাহিদের দিকে তাকাতেই মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো। বি’রক্ততে মুখ থেকে একটা শব্দ বের হলো তোহার,
“অস’ভ্য।

নাহিদ ফাহিমের দিকে তাকাল। অবুঝ শিশুর মতো মুখ ভ’ঙ্গি করে বলল,
“বন্ধু আমায় অস’ভ্য বলছে। আমার বউ আমায় অস’ভ্য বলছে। কোনো অস’ভ্যতা না করতেই অস’ভ্য বলছে।

ফাহিম নাহিদের সাথে তাল মেলালো। ভারী প্রতিবাদী সুরে বলে উঠল,
“এটা ঘোর অন্যা’য় বন্ধু। আমি এটা মেনে নেব না। আমার ইনো’সেন্ট বন্ধুকে অস’ভ্য বলা। অস’ভ্যতা না করতেই যখন তোকে অস’ভ্য বলছে তখন তুই অস’ভ্যতা করিয়ে দেখিয়ে দে বন্ধু।

ফাহিমের কথায় নাহিদ চোখ বড় বড় করে তাকাল। ফাহিমকে একটা থা’প্পড় দিয়ে বলল,
“শা’লা তুই নিজেই একটা অস’ভ্য।

ফাহিম ভ্রুঁ কুটি করে বলল,
“এই জন্যই কারো উপকার করতে নেই। উপকারের বদলে মানুষ থা’প্পড় আর গালি দেয়।

রনি তিনটা কোকের বোতল হাতে নিয়ে এলো। তোহা আর অরিনের মুখ তার চোখে পড়ল না। নাহিদ আর ফাহিমের উদ্দেশ্যে বলল,
“কীরে তোরা এই খানে কি কান্ড করছিস? সকলে এইভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সার্কাস দেখাচ্ছিস নাকি?

রনি কথাগুলো বলতে বলতে নাহিদ আর ফাহিমের হাতে একটা একটা কোকের বোতল দিল। ফাহিম কোকের বোতলটা হাতে নিয়ে রনিকে বলল,
“ভার্সিটিতে দাঁড়িয়ে বউ বউ করে চেঁচালে সকলে তাকিয়ে থাকবে না?

ফাহিমের কথাটা রনির ঠিক বোধগম্য হলো না। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো। ফাহিমকে প্রশ্ন করল,
“বউ? কার বউ? এখানে আবার বউ বউ করে চেঁচালো কে?

ফাহিম কোকের বোতলের ছিপিটা খুলল। চোখ দিয়ে তোহা আর অরিনকে ইশারায় দেখিয়ে কোকের বোতলের কোক মুখে ঢেলে দিল। ফাহিমের ইশারায় রনি ঘাড় ঘুরিয়ে তোহা আর অরিনকে দেখে চমকে উঠল। নাহিদকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
“আরে বাস মামা। রেস্টুরেন্ট থেকে অচেনা বউকে ভার্সিটি পর্যন্ত টেনে এনেছিস। এতো ভালোবাসা কোথায় রাখিস?

“আমি না রে মামা। আমার বউ আমাকে এতো ভালবাসে। তাইতো আমার টানে টানে ভার্সিটি পর্যন্ত চলে এসেছে। আমার বউটা আমায় অনেক ভালোবাসে। তাই না বউ?

অরিন এবার মুখ খুলল। তোহার পক্ষ নিয়ে বলল,
“ভাইয়া আপনারা বেশি বেশি করছেন। তোহা এবার অনেকটা রেগে যাচ্ছে। আপনাদের এবার থামা উচিত। এতোটা মজা করা উচিত নয়।

ফাহিম এবার বলে উঠল,
“সেকি বেয়াইন সাহেবা। সবে তো মজা করা শুরু। এখনই থামিয়ে দিতে বলছেন? এখন থামিয়ে দিলে কীভাবে হবে?

অরিন বুঝে গেল ওদের বলে লাভ হবে না। তাই চুপ করে রইল। তোহা দুচোখ বন্ধ করে শ্বা’স নিল। নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
“দেখুন অনেক হয়েছে। আমি যেমন আপনাকে বর বলে পরিচয় দিয়েছিলাম, আপনিও ভার্সিটিতে প্রথম দিনেই আমাকে সকলের সামনে চেঁচিয়ে বউ বলে ডেকেছেন। হিসাব বরাবর। এবার থেকে আপনি, আমি দুজন দুপথে।

তোহার কথাটা নাহিদ পাত্তাই দিল না। উল্টো বলে উঠল,
“এতো সহজে তো তোমায় ছেড়ে দিব না বউ। এই ভার্সিটিতে যখন এসেই পড়েছ তখন তো আমার জ্বা’লা স’হ্য করতেই হবে।

তোহার রাগটা বেড়ে গেল। প্রচন্ড বি’রক্তি নিয়ে বলে উঠল,
“অ’সহ্য!

তোহার কথা বলার ভ’ঙ্গি দেখে নাহিদ, ফাহিম, রনি হেসে উঠল। তোহা ক্রু’দ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অরিনের হাত ধরে বলল,
“চল।

তোহা অরিন দুজনই ক্লাসের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। ওরা ক্লাসের সামনে আসা মাত্রই একটা মেয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। ফর্সা গোলগাল দেখতে মেয়েটা। চোখে চশমা দেওয়া। হাত দুটো বুকে ভাঁজ করা। চেহারায় রাগী রাগী ভাব। মেয়েটা এভাবে ওদের সামনে দাঁড়ানোর মাহাত্ম্য কেউই বুঝতে পারল না। একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। তোহা ভ্রুঁ নাচিয়ে ইশারায় অরিনকে বলল,
“কী ব্যাপার?

অরিন মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তখনই মেয়েটা ভারী গলায় বলে উঠল,
“তুমি কি নাহিদের গার্লফ্রেন্ড?

মেয়েটার কথা তোহা বুঝতে পারল না। ভ্রুঁ কুঁচকে জিঙ্গেস করল,
“নাহিদ কে?

তোহার কথায় মেয়েটা হু হা করে হেসে উঠল। তোহা অরিন অবাক চোখে চেয়ে রইল। মেয়েটার হাসার কারন তাদের কাছে অ’স্পষ্ট। মেয়েটা এবার বি’দ্রুপ করে বলল,
“ওমা চিনতে পারছো না বুঝি? একটু আগেই তো তোমাকে বউ বউ বলে চেঁচিয়ে ডাকল। নাকি ইতিমধ্যে জেনে গেছো যে আমি নাহিদকে পছন্দ করি। তাই ভয়ে চিনে ও না চেনার ভান করছো।

মেয়েটার কথায় তোহা হেসে উঠল। মেয়েটা চোখ ছোট ছোট করে চাইল। তোহা বলল,
“ওই ফালতু ছেলেটার গার্লফ্রেন্ড হবো আমি? মেয়েদের মতো ঝগড়া করা যার স্বভাব তার গার্লফ্রেন্ড হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।

তোহার কথায় মেয়েটা কিছুটা স্ব’স্তি পেল। কিন্তু নাহিদের ব্যাপারে বলা কথাগুলো তাকে রাগিয়ে দিল। তোহাকে কঠিন গলায় বলল,
“তুমি কিন্তু নাহিদকে অপমান করছো।

“ওপস সরি। আমার তো জানা ছিল না উনাকে কিছু বললে তোমার গায়ে লাগবে। কিন্তু কি করব বল? আমি আবার মুখের উপর সত্যি কথা না বলে থাকতে পারি না। তাই তোমার গায়ে লাগলে ও আমার কিছু করার নেই।

মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে তোহা আর অরিন চলে গেল। মেয়েটা অ’গ্নি দৃষ্টিতে তোহার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। প্রথম আলাপেই যেন শুরু হয়ে গেল শ’ত্রুতা।

তোহা ক্লাসের ভিতরে যাওয়ার পর ও আরো কয়েকজনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সবার একই প্রশ্ন। তোহা নাহিদের গার্লফ্রেন্ড কিনা। ভার্সিটির প্রথম দিনটা যতটা আনন্দদায়ক হবে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি দুর্বি’ষহ ঢেকল তোহার কাছে।

#চলবে

অবিবাহিত বউ পর্ব-০১

0

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ১
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

অচেনা, অজানা ছেলেকে বরের পরিচয় দিয়ে বসে আছে তোহা। তার পাশে বসে ভয়ে নখ কামরাচ্ছে অরিন। চোখ মুখে স্প’ষ্ট ভয়ের ছাপ। তোহা কি করে অচেনা ছেলেটাকে বর বলে দিল? ছেলেটা জানতে পেরে যদি সিন’ক্রিয়েট করে? তখন কি হবে? অরিনের মাথা কাজ করছে না। অন্য দিকে তোহা বেশ আরাম করেই বসে আছে। তার মুখে স্প’ষ্ট বিজয়ের হাসি।

কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই একটা ছেলে তাকে ফলো করছে। কয়েকবার প্রেমের প্রস্তাব ও দিয়েছে। কিন্তু তোহা ডিরে’ক্ট মানা করে দিছে। মানা করার অবশ্য কারণ আছে। ছেলেটা নে’শা করে। এখনও চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। নিশ্চিত কিছু খেয়ে এসেছে।

তোহা রি’জেক্ট করার পরও ছেলেটা তার পিছু ছাড়ছে না। কলেজ লাইফ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে পা রাখবে তোহা। আজ অরিনকে নিয়ে মার্কেটে এসেছে। তোহাকে দেখেই ছেলেটি ওদের পিছু পিছু ঘুরতে লাগলো। তোহা বি’রক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল আজ যে করেই হোক এই বোঝা সে মাথা থেকে নামাবে। যে করেই হোক।

তাই তো ছেলেটাকে নিয়ে সোজা রেস্টুরেন্টে চলে এলো। প্রথমে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলল। কিন্তু যখন দেখল কোনো লাভ হচ্ছে না তখন তাদের পেছনের টেবিলের নীল শার্ট পড়া অচেনা ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল,
“দেখুন নীল শার্ট পড়া ছেলেটা আমার বর। যদিও বিয়েটা এখনও হয়নি তবে খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। আপনি এবার আমার পিছু ছেড়ে দেন।

‘নীল শার্ট পড়া ছেলেটা আমার বর’ কথাটা শুনে নাহিদ নিজের শার্টের দিকে তাকাল। তার শার্টটা ও নীল রঙের। নাহিদ চোখ তুলে সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্টে চোখ ঘুরিয়ে নিল। আ’শ্চর্য! কারো গায়ে তো নীল শার্ট নেই। তবে কি মেয়েটা আমাকে বর বলল?

নাহিদ পেছন ফিরে তাকাল। দুইটা মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে। তাদের মুখমুখি একটা ছেলে। নাহিদ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল‌। একটা মেয়ে ভিতু চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। নাহিদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে চোখ সরিয়ে নিল।

অরিন চোখ সরিয়ে নিলেও নাহিদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পেছনের টেবিলের দিকে। অরিন কয়েক সেকেন্ড পর তাকিয়ে দেখল ছেলেটা একই ভাবে তাকিয়ে রয়েছে। ভয়টা আরেকটু গাঢ় হলো। অরিন তোহার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোহা তোর বর এইদিকে রাক্ষ’সের মতো তাকিয়ে আছে কেন?

অরিনের কথায় তোহা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। অবাক কন্ঠে ফিসফিস করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“কি যা তা বলছিস। আমার বর আসবে কোত্থেকে?

অরিন আগের মতোই ফিসফিস করে বলল,
“আরে একটু আগে যে বললি নীল শার্ট পড়া ছেলেটা তোর বর। সেই ছেলেটা তাকিয়ে আছে। তোর কথাটা কি শুনতে পেল নাকি?

অরিনের কথা শুনে তোহার বুকটা ধক করে উঠল। ছেলেটা কি সব শুনে ফেলল? তোহা পেছনে ফিরে তাকাল। চোখাচোখি হয়ে গেল তোহা আর নাহিদের। তোহা মেকি হেসে দ্রুত চোখে ফিরিয়ে নিল।

অরিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“সত্যি তো। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? আর তাকিয়ে থাকলেই বা কি? আমাদের খেয়ে তো ফেলবে না।

নাহিদের পাশে বসে থাকা তার ফ্রেন্ড রনিও তোহার বলা কথাটা শুনল। রনি নাহিদের দিকে তাকিয়ে দেখল নাহিদ পেছনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিদকে হালকা ধাক্কা দিয়ে রনি বলল,
“কিরে মামা বিয়ে করে বর হয়ে গেছিস। আমাদের ট্রিট দেওয়া তো দূরের কথা জানালিও না।

নাহিদ রনির দিকে তাকিয়ে আফসোসের স্বরে বলল,
“বিয়ে করলাম আমি, বর হলাম আমি অথচ আমিই জানি না। তোদের কি ট্রিট দিবো মামা। তোরা আমাকে ট্রিট দিয়ে আমায় সান্তনা দে।

নাহিদের মুখমুখি বসে থাকা ফাহিম ওদের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। বি’স্ময়ে হত’ভম্ব হয়ে বলল,
“কিসব বলছিস তোরা? কিসের বিয়ে? কিসের ট্রিট?

“এটাই তো। বিষয়টা দেখতে হচ্ছে।

নাহিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পেছনের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে রনি, ফাহিম উৎসুক চোখে চেয়ে রইল।

নাহিদ তোহার সামনে গিয়ে তোহার উদ্দেশ্যে বলল,
“হ্যালো বউ। কেমন আছো?

আক’স্মিক নাহিদকে দেখে তোহা, অরিন দুজনই ভড়কে গেল। একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে দুরুদুরু বুকে উঠে দাঁড়াল। অরিনের মুখে ভিতু ভাবটা স্প’ষ্ট হলেও তোহার মুখভঙ্গি রইল স্বাভাবিক। তোহা কি করবে বুঝতে না পেরে মেকি হাসল। হুট করে মাথায় এলো ‘এটাই মো’ক্ষম সুযোগ ছেলেটাকে পিছু ছাড়নোর’। তোহা নাহিদের দিকে চেয়ে আ’হ্লাদ করে বলল,
“দেখো না তোমার বউকে এই ছেলেটা ডি’স্টার্ব করছে।

তোহাকে চমকে দিতে এসে নাহিদ নিজেই চমকে গেল। মেয়েটা সরাসরি আমায় বর বলছে? অদ্ভুত! নাহিদ কিছু বলার শব্দ খুঁজে পেল না।

অরিন তোহার কথায় চোখ বড়বড় করে তাকাল। তার মুখের ভিতু ভাবটা মিলিয়ে গিয়েছে। চোখে ফুটে উঠেছে কৌতুহল। তোহা ছেলেটার সাথে এভাবে কথা বলছে? ওর কি একটুও ভয় করছে না?

তোহা নাহিদকে চুপ থাকতে দেখে তার মুখমুখি বসে থাকা ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“দেখেছেন আমার বরকে? এবার আপনি বিদায় হোন তো।

ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। তোহা আর নাহিদকে একবার দেখে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। ছেলেটা চলে যেতেই তোহা স্ব’স্তির শ্বাস ফেলল। চেয়ারে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ব’স্তি নিয়ে বলল,
“উফ। বাঁচলাম বাবা।

নাহিদ তোহার দিকে তাকিয়ে ক্রু’দ্ধ স্বরে বলল,
“এই মেয়ে। তুমি আমার কোন জন্মের বউ? আমি তোমায় চিনি না, জানি না অথচ আমাকে তোমার বরের পরিচয় দিয়ে দিলে? এতো সাহস।

নাহিদের কথাটা কানে যেতেই তোহা ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে বলল,
“এক ঝামেলা শেষ হতে না হতেই আরেক ঝামেলা শুরু। অস’হ্য।

তোহা কিছু বলে উঠার আগেই অরিন বলল,
“আসলে ভাইয়া ওই ছেলেটা অনেক দিন ধরে তোহাকে ডি’স্টার্ব করছিল। তোহা ছেলেটাকে বুঝাচ্ছিল কিন্তু ছেলেটা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। তাই তোহা ছেলেটার পিছু ছাড়াতে কিছু না ভেবেই আপনাকে বর বলে দিয়েছে।

নাহিদ অরিনের দিকে তাকাল। ভ্রুঁ কুটি করে কড়া গলায় বলল,
“আমাকে কেন বর বলল? এই দুনিয়াতে কি ছেলের অভাব? নাকি এই রেস্টুরেন্টে ছেলে কম আছে? আমাকে কেন বর বলতে হবে?

নাহিদের কথা শুনে তোহার মাথায় আগুন জ্ব’লে উঠলো। কঠিন গলায় বলল,
“আপনাকে বর বলেছি বলে কি আপনার গায়ে ফো’স্কা পড়েছে? নাকি বর বলাতে আপনি আমার বর হয়ে গেছেন?

তোহার কথা শুনে নাহিদ হেসে উঠল। পরিহাস করে বলল,
“আমি হবো তোমার বর? হাউ ফানি।

তোহা নাহিদের কথা শুনে আরো তেঁতে উঠল। নাহিদকে বি’দ্রুপ করে বলল,
“আপনার কোনো যোগ্যতা আছে আমার বর হওয়ার? আপনার ভাগ্য ভালো আমি আপনাকে বর বলে পরিচয় দিয়েছি।

নাহিদ তোহার কথা শুনে রেগে গেল। কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“নাহিদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছো। এই মেয়ে তোমার কোনো যোগ্যতা আছে আমার বউ হওয়ার?

নাহিদ কথাটা জোরে বলায় রেস্টুরেন্টের সকলে ওদের দিকে তাকাল। অবস্থা বেগতিক দেখে রনি, ফাহিম উঠে দাঁড়াল। ফাহিম নাহিদের কাছে গিয়ে বলল,
“কি করছিস নাহিদ? সকলে তাকিয়ে আছে। আ’স্তে কথা বল।

নাহিদ আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সত্যি সকলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে শান্ত করে বলল,
“আস্তে কীভাবে কথা বলব? এই মেয়েটা বলছে আমার নাকি কোনো যোগ্যতা নেই ওর বর হওয়ার।

রনি নাহিদের দিকে তাকাল। মশকরা করে বলল,
“তোর যোগ্যতা প্রমাণ করতে এখন কি ওর বর হবি নাকি?

তোহা নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“এই ছেলেটা আমার বর হবে। অস’ম্ভব

তোহার কথা বলার ভ’ঙ্গি দেখে নাহিদ বি’দ্রুপ করে বলল,
“আমি যেমন তোমার বর হওয়ার জন্য নাচতেছি।

রনি আর ফাহিম একে অপরেরর মুখের দিকে তাকাল। দুজনই মুচকি হেসে ত’প্ত শ্বা’স ফেলল। ফাহিম নাহিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“তোর বর হওয়া লাগবে না। তোদের বিয়ে হলে দেখা যাবে দুজনই টম এন্ড জেরীর মতো লেগে থাকবি। কেউ কাউকে না চিনেই এভাবে ঝগড়া করছিস। বিয়ে হলে না জানি কি করবি।

নাহিদ ক্রু’দ্ধ দৃষ্টিতে ফাহিমের দিকে তাকাল। ফাহিম নাহিদের ক্রু’দ্ধ দৃষ্টিকে পাত্তা দিল না। উল্টো মুখ ভেং’চি দিল। ফাহিমকে মুখ ভেং’চি দিতে দেখে অরিন মনে মনে বলল,
“কথায় কথায় মেয়েরা মুখ ভেং’চি দেয় বাট এই ছেলেও তো মেয়েদের মতো মুখ ভেং’চি দিচ্ছে। অদ্ভু’ত!

রনি নাহিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“যা হয়েছে, হয়েছে।‌ এখন আর ঝগড়া-ঝাটি না করে এখান থেকে চল‌ তো।

নাহিদ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। রনি কিছুটা জোর করে নাহিদকে নিয়ে গেল। নাহিদ যেতে যেতে তোহার দিকে অ’গ্নি দৃষ্টিতে তাকাল। যেন চোখ দুটো দিয়েই তোহাকে ভ’স্ম করে দিবে।

নাহিদ চলে যেতেই তোহা বলল,
“আল্লাহ এই লোকের সাথে যেন আমার কখনো দেখা না হয়।
_______________________

ভার্সিটিতে আজকে প্রথম দিন। তোহা অরিন দুজনই ভার্সিটিতে এসেছে। দুজনের চোখে মুখেই খুশি খুশি ভাব। ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে ওরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল। ক্ষানিকটা পথ যেতেই তোহার কানে দুটো শ’ব্দ গেল।

তোহা এতটা পাত্তা না দিয়ে আবারো পা বাড়াল। মুহূর্তের মধ্যেই চমকে গেল। কেউ যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই বলে উঠল,
“এই বউ দাঁড়াও।

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

#চলবে

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_অন্তিম[প্রথমাংশ]

“অতিরিক্ত শব্দটাই বিষাক্ত! অতিরিক্ত ভালোবাসা মানুষকে সর্বোচ্চ নিচে নামিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত কোনো কিছু মানেই অধঃপতন।”
নয়নের কথাটা ফাহিমের কানে যেতেই ফাহিম ওর হাতে থাকা ফুলদানিটা দিয়ে, নিজের মাথায় আঘা’ত করতে করতে বলতে লাগল,
“আমার তারাকেই চাই। তারাকেই চাই আমার।”
রিমা বেগমকে ছেলের এই করুণ অবস্থা মেনে নিতে পারছেন না। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বার বার। রুবিনা বেগম তাকে শান্ত করায় ব্যস্ত আছেন। তারা নয়নকে ভয়ার্ত স্বরে বলল,
“কিছু একটা করো, প্লিজ। উনি তো ম’রে যাবে।”
রিমা বেগম দৌড়ে নয়নের কাছে এসে, নয়নের হাত জোড়া আকঁড়ে ধরলেন। আকুতিভরা কণ্ঠে বললেন,
“আমার ছেলেটাকে বাঁচা, বাবা৷ আমার ছেলেটার এই কষ্ট যে আমি সহ্য করতে পারছি না। কিছু একটা কর।”
নয়ন এই মুহুর্তে খুঁজে পাচ্ছে না কি করে ফাহিমকে সামলাবে? তারার দিকে একবার অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করল। তারা ইশারায় ভরসা দিলো খানিকটা। নয়ন রিমা বেগমের হাত দুটো ধরে অভয়বাণীতে শুধালো,
“চিন্তা করো না, মামি।”
বলেই নয়ন ফাহিমের দিকে এগিয়ে গেলো। ফাহিমকে গিয়ে দুইহাতে শক্ত করে ধরল। চিৎকার করে বলতে লাগল,
“কি করছিস তুই? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? যে ভাগ্যে থাকেনা তাকে হাজার চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়না। এই সহজ সত্যি কথাটা মানতে শিখ। তারা এখন আমার বউ। তুই হাজার চেষ্টা করলেও এখন আর তারাকে পাবিনা। তারাকে যদি সত্যিই ভালোবাসিস, তাহলে ওকে ভালো থাকতে দে। তুই এমন করলে তারা ভালো থাকবে না। অপরাধবোধে ধুঁকে ধুঁকে ম’রে যাবে। সেটা কি তুই চাস?”
ফাহিম এতক্ষণের শান্ত হয়ে গেছে। কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনল। যখনি নয়ন প্রশ্ন করল, তখন অসহায় চোখে তাকাল নয়নের দিকে। উত্তর দিলো না। নয়নের মায়া হলো খুব। যতই হোক ভাই বলে কথা। ফাহিমের কপাল দিয়ে গড়িয়ে র’ক্ত পড়ছে। হাতে অজস্র দাগ হয়ে আছে। গালের এক সাইডে কে’টে আছে। ফাহিমকে চুপ করে থাকতে দেখে, নয়ন শান্ত স্বরে আবার প্রশ্ন করল,
“বল, তারা অপরাধবোধে ম’রে যাক সেটা কি চাস তুই?”
ফাহিম দুইদিকে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ ‘না’। নয়ন উত্তর পেয়ে বলল,
“তাহলে এসব বন্ধ কর, ভাই। নিজের জীবনটা নতুন করে শুরু কর। অন্তত মামির দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নে। দেখ, ওই মানুষটা কেমন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তুই ছাড়া তার আর কেউ নেই। প্লিজ ভাই, নিজেকে সামলে নে।”
ফাহিম একবার নিজের মায়ের মুখপানে তাকাল। রিমা বেগম পাগলের মতো আহাজারি করছেন। ফাহিম কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।।পরক্ষণেই ঢলে পড়ে যেতে লাগল। কিন্তু তার পূর্বেই সবাই মিলে ও’কে ধরে ফেলল। নয়ন সবার সাহায্য নিয়ে ফাহিমকে রুমে নিয়ে গেলো। ইমারজেন্সি ডাক্তারকে কল করল। এদিকে রিমা বেগম অস্থির হয়ে কাঁদছেন। নয়ন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিচ্ছে।
“কান্না কইরো না, মামি। সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার দেখছে তো, ফাহিম ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ও’কে একটা ভালো সাইকোলজিস্ট দেখাব৷ দেখবে ও একদম সুস্থ হয়ে যাবে।”
ডাক্তার জানিয়ে গেলো। ফাহিম অতিরিক্ত মানসিক চা’পে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। একটা ভয়ানক ট্রোমাতে আটকে গেছে। যতদ্রুত সম্ভব ভালো সাইকোলজিস্ট দেখাতে।



রাত ১২টা বেজে ১০মিনিট। পুরো বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। যেই বাড়িটা সবসময় হাসি, আড্ডায় মেতে থাকতো, আজ সেই বাড়িটাই শূন্যতায় ভরপুর। সবার উপর দিয়ে অনেক বড় ধকল গেছে। আহসান সাহেব পুরো ঘটনাটায় অনেক ভেঙে পড়েছেন। তনয়া শশুড় বাড়ি ফিরে গেছে। রিমা বেগম ছেলের রুমে অপেক্ষা করছেন ছেলের জ্ঞান কখন ফিরবে, সেই আশায়। তারা আর নয়নের বিয়েটা কি করে হয়েছে সেটাও সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওদের বিয়েটা সামাজিক ভাবে দেওয়া হবে। তারা সারাদিনের ধকল সেরে গোসল করেছে কিছুক্ষণ আগেই। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। ভেজা চুল দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। তারা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু ভাবছিল। জীবন কখন কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে। কেউ বলতে পারবে না। হুট করে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। অতি চেনা, অতি আপন মানুষটার ছোঁয়া পেতেই তারার শরীরের সব অশান্তি, অস্বস্তি কেটে গেলো। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। শরীর ভালোবাসার শিহরণ বয়ে গেলো। শরীর বুঝি এই ছোঁয়ার অপেক্ষায় ছিলো এতক্ষণ। তারা চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইল আগের ন্যায়। নড়াচড়া করল না। খুব করে মানুষটাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা জমেছে মস্তিষ্কে। ইচ্ছাগুলো শিরায় শিরায় ছড়িয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ গতিতে। তারা নয়নের হাত দুটো নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখল। নয়নের হাতের উপর নিজের হাত দিয়ে চেপে রাখল। নয়ন হাতটা সরিয়ে নিলো মুহূর্তেই। তারা তা দেখে খানিকটা অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“সরালে কেন? ভালো লাগছিল এভাবেই।”
নয়ন উত্তর দিলো না। তারার জামার ভেতর দিয়ে হাত ঢুকাল। তারার অনাবৃত পেটে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গে তারা কেঁপে উঠল। এই প্রথম নয়ন তারাকে এত গভীর ভাবে ছুঁয়েছে। এবার নয়ন তারার ঘাড়ে মুখ ডুবাল। সেভাবেই বলল,
“তোর শরীরের ঘ্রাণটা আমাকে মাতাল করে দেয় রে, তারু।”
তারা আবেশে চোখ বন্ধ করে আছে। উত্তর দিলো না কোনো। নয়ন তারার ঘাড়ে গভীর ভাবে চুমু এঁকে দিলো। পেটের উপর থাকা হাতের বাঁধনটা আরো শক্ত হলো। তারাকে এবার নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। রেলিং এর সাথে তারার পিঠ ঠেকলো। নয়ন তারার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল বেশকিছু সময়। বেলকনিতে থাকা লাইটের আবছা আলোয় তারার মুখটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। তারার হালকা গোলাপি রঙের ঠোঁট জোড়া নয়নকে মারাত্নক ভাবে টানছে। তারার দিকে খানিকটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
“তোর ঠোঁট দুটো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে রে, তারু।”
তারা ফট করে চোখ খুলল। চোখ, মুখ কুঁচকে বলে উঠল,
“নির্লজ্জ! তুমি এত নির্লজ্জ হয়ে গেছো?”
নয়ন ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,
“অন্য মেয়েকে বলছি নাকি? আমার বউকে বলেছি। আমার বউ তুই। আমি যা খুশি বলতে পারি। আবার করতেও পারি।”
শেষের কথাটা বলে ঠোঁট চেপে হাসল। তারা সেই হাসির দিকে চেয়ে লজ্জা পেলো বেশ। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। নয়ন হাত তারার অনাবৃত পেট ও কোমড় জুড়ে বিচরণ করছে। ক্ষণে ক্ষণে তারা কেঁপে উঠছে। নয়ন তারার কপালে আলতো করে চুমু খেলো। তারার দুই গালে হাত রেখে নরম স্বরে বলতে লাগল,
“অনেক ঝড়ঝাপটা চলে গেছে আমাদের উপর দিয়ে। উপরওয়ালার অশেষ রহমতে তুই এখন আমার বউ। আমি তোকে হারিয়ে ছন্নছাড়া, দিশেহারা হয়ে যেতাম রে। দ্বিতীয় বার আর কাউকে ভালোবাসতে পারতাম না। আর কাউকে ভালোবাসা, বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। ভালোবাসার উপর আমার এক আকাশসম অভিযোগ জমে গিয়েছিল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তবুও শক্ত ছিলাম। আমার মায়ের তো আমি ছাড়া কেউ নেই।”
নয়নের গলা আটকে আসছে। তারা চেয়ে আছে নয়নের দিকে। নয়ন পুনরায় বলতে লাগল,
“তুই যখন ফাহিমকে ভালোবাসার কথা স্বীকার করলি। তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি ভেতর থেকে মা’রা যাচ্ছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার সময় মনে হচ্ছিলো ফুরিয়ে আসছে। আ…।”
আর কিছু বলার আগেই তারা নয়নের মুখ চে’পে ধরল। আঁতকে উঠে বলল,
“এসব আর বলো না। এতদিন যা হয়েছে সেসব আমাদের অতীত ছিলো৷ অতীত ভেবে কেন ভবিষ্যৎকে নষ্ট করছো? ভেবো না। সব ভুলে যাও। আমি ভুলিয়ে দিবো। আমি আছি তো। তোমাকে আগলে রাখব। কখনো ভেঙে পড়তে দিবো না। কখনো না। তুমি চিন্তা করো না। তোমার তারু যতদিন নিঃশ্বাস নিবে, ততদিন তোমারই থাকবে। নয়নের প্রিয় তারা হয়েই নয়নের আকাশে বিচরণ করব অন্তকাল অব্দি।”
নয়নের ঠোঁটে হাসি ফুটল। তারাকে আলতো করে নিজের বুকের মাঝে আগলে নিলো। তারাও শক্ত করে ধরল নয়নকে। এই বুকের বা পাশেই তারার শান্তি। এই সময়টা এখানেই থেকে যাক। দুটি অশান্ত হৃদয় মিলেমিশে একাকার হয়ে শান্ত হচ্ছে….

#চলবে

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_অন্তিম[শেষাংশ]

ভালোবাসা শব্দটা হয়তো সহজ। কিন্তু কাউকে ভালোবেসে তার সব পরিস্থিতিতে তার পাশে থেকে, ভরসা, সাহস দিয়ে তাকে আগলে রাখা কঠিন। ভালোবাসার মানুষটার হাত শক্ত করে ধরে রাখা কঠিন। সবাই এই কঠিন কাজটা করতে পারেনা। আর যে এই অসাধ্যসাধন করতে পারে সেই প্রেমিক পুরুষ। নয়ন পেরেছে সেই অসাধ্যসাধন করতে। পেরেছে ভালোবাসার মানুষটাকে কঠিন পরিস্থিতিতে আগলে রাখতে। সময় বহমান। নিজের স্রোতে বয়ে চলে। সেদিনের পর কেটে গেছে বেশকিছু দিন, সময়, মুহূর্ত। আধার কাটিয়ে সবার জীবন আলোকিত হয়েছে৷ আজ নয়ন আর তারার বিয়ে। খুব ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো বাড়ি আলোকসজ্জায় ঝিকমিক করছে। সবার মুখে হাসি বিরাজমান। ফাহিম এখন বেশ সুস্থ, শান্ত। নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরে বেশ কয়েকবার ক্ষমা চেয়েছে সবার কাছে। নয়ন আর তারা মিলে ফাহিমকে সুযোগ দিয়েছে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার। যদি কোনো মানুষ ভুল করার পর নিজেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারে, অনুতপ্ত হয়৷ তাহলে তাকে শেষ বার একটা সুযোগ দেওয়া অবশ্যই উচিত। ফাহিমও নিজের জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর সুযোগ পেয়েছে। এটা সে কিছুতেই নষ্ট হতে দিবেনা। তার মায়ের জন্য হলেও তাকে সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বাঁচতে হবে। নিজের জীবনের সাথে সাথে মায়ের জীবনটাকে রঙিন করে সাজিয়ে তুলবে। নয়ন আর তারার বিয়ের আয়োজন ফাহিম একা হাতে করেছে৷ সবদিকে তার সে কী খেয়াল! তারার ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করছে সে৷ বলতে বলতে সেই খুশির লগ্ন চলে এলো। নয়ন বর সেজে অপেক্ষা করছে তার প্রিয় তারার জন্য। নয়নের পাশেই ওর বন্ধুরা মিলে মজা নিচ্ছে। হুট করে চোখ সামনের দিকে যেতেই নয়নের মুখটা হা হয়ে যায়। বউ সেজে এগিয়ে আসছে তারা। পাশেই তনয়া হাসতে হাসতে ইশারায় জিজ্ঞেস করছে,
“কেমন লাগছে?”
নয়ন বুকে হাত দিয়ে সুরে সুরে বলে উঠল,
“জ্ঞান হারাবো, ম’রেই যাবো। বাঁচাতে পারবে না কেউ।”
বলেই পেছনে ঢুলে পড়তেই ওর সব বন্ধুরা মিলে ও’কে ধরে ফেলল। মুহূর্তেই খিলখিল হাসিতে পুরো বাড়ি মেতে উঠল। তারা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ঢং দেখে আর বাঁচি না, বাপু।”
তারাকে কেউ বসতে বলার আগেই তারা নয়নের পাশে বসে পড়ল। নয়নের বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। তা দেখে তনয়া মজা করে বলল,
“তোর কি লজ্জা শরম নেই রে, তারা? এতগুলো মানুষের সামনে হাত ধরে বসে আছিস।”
তারা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তনয়ার দিকে। ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,
“ও মা! লজ্জা থাকবে কেন? আমি কি পরপুরুষ কে ধরেছে? আমি আমার জামাইকে ধরছি৷ শুধু হাত কেন আরো অনেক কিছুই ধরতে পারি। দেখাবো?”
তারার মুখে এমন কথা শুনে নয়নের বন্ধুরা সবাই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে। আর তনয়া বেশ লজ্জা পেলো। আমতা আমতা করে অন্যদিকে পা বাড়ালো। সেদিকে চেয়ে তারা ঠোঁট চে’পে হাসল। নয়ন তব্দা খেয়ে বসে আছে। পাশ থেক্ব কোনোরকম সাড়া শব্দ না পেয়ে তারা নয়নকে ধাক্কা মে’রে বলে উঠল,
“তোমার আবার কী হলো? তব্দা খেয়ে আছো কেন?”
নয়ন অবিশ্বাস্য সুরে বলল,
“তুই কি ইদানীং বেশিই নির্লজ্জ হয়ে গেছিস?”
তারা বিরক্ত হলো বেশ। নয়নের পাঞ্জাবির কলার চে’পে ধরে নয়নের বেশ ঝুকল। দুজনের নাকে নাক ঘষার উপক্রম। দুজনের ঠোঁটের মাঝে অল্প বিস্তর ফাঁকা। নয়ন বেশ ঘাবড়ে গেলো। তারা এবার নয়নের চোখে চোখ রেখে রাগ নিয়ে বলল,
“তোমার জন্য শুধু নির্লজ্জ কেন? সব হতে রাজি। আর একবার যদি আমাকে নির্লজ্জ বলো, তাহলে প্রাকটিকাল দেখিয়ে দিব নির্লজ্জ কাকে বলে? তাও সবার সামনে। বুঝেছো?”
বলেই নয়নকে হালকা ধাক্কা মে’রে ছেড়ে দিলো। নয়নের অবস্থা দেখে ওর বন্ধুরা বেশ মজা নিচ্ছে। সাথে তারাও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সবাই বিয়ের আসরে উপস্থিত হতেই আহসান সাহেব কাজিকে হুকুম করলেন, বিয়ে শুরু করার জন্য। ঠিক তখনি নয়ন সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,
“ এই মুহূর্তে বিয়েটা হবে না। ”
নয়নের মুখে একথা শুনে তারার বুকটা কেঁপে উঠল। বিস্ময়ের চোটে আঁখি জোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বাড়ির সবাই অবাক দৃষ্টিতে নয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহিমও বেশ অবাক। সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপে। হুট করে এমন কথা কানে যেতেই অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো সবাই। জাহানারা বেগম গর্জে উঠে প্রশ্ন করলেন,
“কী বলছিস তুই?”
নয়ন সবার দৃষ্টি পরখ করে হেসে ফেলল। বলল,
“আরে, আরে শান্ত হও! আমার কথাটা শেষ করতে দাও। আমি বলেছি এই মুহূর্তে বিয়েটা হবে না৷ কয়েক মুহূর্ত পরে হবে৷ কারণ আমার সবাইকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার আছে৷”
এবার যেন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তারা তো সহ্য করতে না পেরে ধুম করে কিল বসিয়ে দিলো নয়নের পিঠে। রেগেমেগে বলে উঠল,
“একেবারে সব কথা বলতে পারো না৷ থেমে থেমে কথা বলো কেন, হাম্বার মতো। বলদ পোলাপাইন। অসভ্য একটা।”
তারার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। নয়ন সেই মুহূর্তে তারার কানে ফিসফিস করে বলল,
“এভাবে রেগে যেও না, বউ। রাগলে তোমাকে দারুন লাগে! লাল টমেটো। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করেছে এক্ষুনি। কিন্তু আমি তো এখন খাব না। রাতে খাব।”
তারার নয়নের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই নয়ন আমতা আমতা করে বলল,
“আই মিন, আদর খাব।”
পরমুহূর্তে দুজনেই হেসে উঠল। নয়ন এবার বলে উঠল,
“সবাই এক মিনিট অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
বলেই বাইরে বেড়িয়ে গেলো। মিনিটের মাথায় সাথে মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। নয়নের সাথে সবাই মোস্তফা সাহেবকে দেখে অবাক হলো বেশ খানিকা। আহসান সাহেব রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“ও এখানে কেন?”
মোস্তফা সাহেব নয়নের দিকে একবার অসহায় চোখে তাকালেন। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে ফেললেন। নয়ন আহসান সাহেবের সামনে এসে বলতে শুরু করল,
“দেখো মামু, প্রত্যেকটা আসামীর একটা করে ভালো হওয়ার সুযোগ পাওয়া উচিত। ফাহিমকে তো আমরা সবাই ক্ষমা করে দিয়ে, বুকে জড়িয়ে নিয়েছি। তাহলে ছোট মামুকে কেন, আলাদা করে দিব? তারা দুজনেই কিন্তু সমান অপরাধী। ফাহিম যেমন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে, ঠিক তেমনি ছোট মামুও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তার অপরাধের জন্য যথেষ্ট শাস্তিও পেয়েছে। আর শাস্তি তার প্রাপ্য নয়। তাকে ক্ষমা করে দাও। আমরা সবাই আবার একসাথে বাঁচব। আবার আগের মতো এবাড়িতে হৈ-হুল্লোড় হবে। হাসি, আনন্দে মেতে থাকবে। আমি জানি তুমি নিজেও ভালো নেই। আদরের ভাইকে কারাগারে বন্দি দশায় দেখে তোমার সবথেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে৷ তাই বলছি ক্ষমা করে দাও, মামু৷ বুকে জড়িয়ে নাও তোমার আদরের ভাইকে। আবার আমরা সব ভুলে নতুন করে বাঁচি, চলো?”
নয়নের কথা শেষ হতেই মোস্তফা সাহেব এসে আহসান সাহেবের পায়ে পড়ে গেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ভাইজান, আমারে একটা সুযোগ দাও। আমারে ক্ষমা করে দাও। শেষবারের মতো আমারে একবার বিশ্বাস করো। আমারে মাফ করে দাও, ভাইজান।”
আহসান সাহেবের চোখের কোনে পানি। সত্যিই তো মোস্তফা সাহেবকে তিনি ছোট থেকে কত আদর, স্নেহ দিয়ে ভালোবেসে বড় করেছেন। সেই ভাইকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। উঠিয়ে দাঁড় করালেন। কান্নারত স্বরে বললেন,
“যতই হোক তুই তো আমার রক্তের ভাই। তোর থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকি কিভাবে? আয় ভাই বুকে আয়।”
বলেই তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন ভাইকে। দুই ভাইয়ের মাঝে সব অভিমান, রাগ ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গেলেন। আহসান সাহেব এবার ফাহিমকেও ডাকলেন। ফাহিম এসে উনাদের দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরল। পরিবারের সবার মুখে আজ খুশির বিচরণ। সবার চোখে আনন্দ অশ্রু। কিছুক্ষণ পর ফাহিম উনাদের ছেড়ে গিয়ে নয়নের সামনে দাঁড়াল। নয়নের হাত দুটো ধরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করিস, ভাই। তোকে আর তারাকে অনেক আঘাত দিয়েছি। অপমান করেছি। অনেক অন্যায় করেছি তোদের সাথে। জানি আমার ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। তবুও বলছি পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
নয়ন শুধু হাসিমুখে বলল,
“আমার ছোট ভাই তো তুই। ছোট ভাই যদি কোনো ভুল করে ভাই হিসেবে আমার উচিত সেটা সংশোধন করে দেওয়া। ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়ে বুকে টেনে নেওয়া।”
বলেই ফাহিমকে জড়িয়ে ধরলেন। ফাহিম যেন আজ কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেলো। রিমা বেগমের বুকের থেকে একটা বড় পাথর সরে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সবাই। বাড়িটাকে আবার আগের মতো হাস্যজ্বল দেখে তারার বড্ড আনন্দ লাগছে। সবার চোখে পানি দেখে তারা এবার চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“আমার বিয়েটা কি তোমরা আর দিবে না? আমার তো আর তর সইছে না। আমি বিয়ে করব। তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও আমার।”
তারার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। তনয়ার স্বামী আকাশ হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলল,
“আরে বাহঃ! আমার শালিকার দেখি বিয়ে পাগলী হয়ে গেলো। কী ব্যাপার হ্যাঁ?”
প্রতিউত্তরে তারা লজ্জামাখা হাসি উপহার দিলো। আকাশ পুনরাহ ফিসফিস করে বলল,
“বুঝি, বুঝি সব বুঝি আমি। শালাবাবুকে কাছে পাওয়ার জন্য মন উন্মাদ হয়ে আছে, তাইনা?”
তারা কোমরে হাত দিয়ে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তা দেখে আকাশ হেসে নয়নের উদ্দেশ্যে বলল,
“তাড়াতাড়ি বিয়েতে বসো, শালাবাবু। তোমার বউয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।”
আকাশের কথা শেষ হতেই সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল৷ নয়ন আর তারা আবার পাশাপাশি বসল। কাজি পড়ানো শুরু করল। কবুল বলার সময় তারা একদমে তিনবার কবুল বলে ফেলল। বিয়েটা সম্পূর্ণ হতেই নয়ন তারার কানে কানে বলল,
“তোমাকে কাছে পাওয়ার নেশা জাগছে খুব।”
তারা মুচকি হাসল। ঠোঁট চে’পে হেসে বলল,
“রেডি থাকো, জান। তোমার কাছে পাওয়ার নেশা কাটিয়ে দিব।”
বলেই চোখ টিপ মা’রল। সামনেই বাড়ির সবাই নাচানাচি করছিল৷ এবার তারাও গিয়ে যোগ দিলো সেখানে। ‘মুঝে সাজান ক্যা ঘার যানা হ্যায়’ গানে খুব সুন্দর করে নাচল। অনুষ্ঠানের পর্যায় শেষ হতে হতে রাত হয়ে গেলো। সবাই মিলে তারা আর নয়নের জন্য বাসর সাজিয়ে রেখেছিল। পারিবারিক বন্ধনটা আবার আগের মতো শক্ত সুতোয় বাঁধা পড়ল।



ঘড়ির কাটা টিকটিক শব্দ করে চলছে। তারা বসে অপেক্ষা করছিল নয়নের জন্য৷ সবাই চলে যেতেই কয়েক মিনিটের মাথায় নয়ন ভেতরে ঢুকল। নয়নকে দেখেই তারা খাটের থেকে নেমেই, রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“এই আসার সময় হলো তোমার?”
নয়ন হেসে বলল,
“আমাকে কাছে পাওয়ার নেশা দমিয়ে রাখতে পারছো না, জান?”
তারা হাসল। নয়নের গলায় দুই হাত ঝুলিয়ে বলল,
“একদম না।”
নয়ন হেসেই তারার কোমরে হাত দিলো৷ নিজের সাথে তারাকে মিশিয়ে নিলো। তারার নাকে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
“তাহলে চলো, তোমার নেশা কাটিয়ে দিই।”
তারা উত্তর দিলো না। কোনো এক সুখের আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। নয়ন তারার কপালে চু’মু এঁকে বলল,
“আমাদের জীবনের সব তিক্ততা ভুলে চলো হারিয়ে যাই সুখের অতলে। যাবে আমার সাথে, প্রিয় নয়নতারা?”
তারা চোখ বন্ধ করেই রইল। ঠোঁটে কোনের হাসিটা বিস্তর ছড়িয়ে গেলো। দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নয়নকে। মুহূর্তা শুধুই ভালোবাসার। দুটি হৃদয়ের পূর্ণতার মুহূর্তগুলো সবথেকে দারুন! নয়ন তারাকে এবার কোলে তুলে নিলো। বিছানায় উপর রেখে তারার ঠোঁটে গভীর ভাবে চু’মু খেলো। তারার হাত দুটো নয়নের পাঞ্জাবী শক্ত করে ধরে আছে। নয়ন এক এক করে তারার গহনা গুলো খুলে ফেলল। শাড়ির থেকে সেফটিপিন গুলো খুলে রাখল। তারপর নিজের গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলেই মুখ ডুবালো তারার গলায়। হারিয়ে গেলো দুজন সুখের অতল গভীরে। যেখানে শুধুই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নতুন করে। ভালোবাসার পূর্ণতায় দুটো হৃদয়, মন মিশে একাকার হয়ে গেছে। সব বাধা পেরিয়ে আজ তারা জয়ী। নিজেদের ভালোবাসা দিয়ে সব যুদ্ধ জয় করেছে। সময়টা এখানেই থেমে যাক। ভালোবাসার ছোঁয়ায় দুটি মন উন্মাদ হয়ে আছে আজ। দুনিয়ার কোনো কিছুতেই তাদের মন নেই। তারা আজ সুখের নেশায় ব্যস্ত। তাদের এই সুখ অন্তকাল অব্দি থাকুক এই প্রার্থনা। পরিশেষে ভালোবাসা সুন্দর সঠিক মানুষকে পেলে।

#সমাপ্ত

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৯

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_নবম[প্রথমাংশ]

“যেই মেয়ের সম্মান নষ্ট করলেন। চরিত্রহীন প্রমাণ করলেন। সেই মেয়েকেই ছেলের বউ করতে চাইছেন, ছোট মামা?”
নয়নের কথা শুনে উপস্থির সবাই বিস্ফোরিত স্বরে তাকাল ওর দিকে। তারা বিয়ের আসরে বউ সেজে নিশ্চিন্তে বসে আছে। নয়নের কথা শেষ হতেই ফাহিম বলে উঠল,
“দেখ নয়ন, আজ আমার আর তারার বিয়ে। কোনো রকম সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করিস না।”
নয়ন রহস্যময় হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
“বিয়ে! কার সাথে? তারার সাথে? একজন বিবাহিত মেয়েকে তুই কিভাবে বিয়ে করবি, ফাহিম?”
শেষ কথাটা শুনে ফাহিম বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বিদ্যুৎ চমকানোর ন্যায় সবাই চমকে উঠল। ফাহিম চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“হোয়াট? বিবাহিত মানে?”
তারার কেন যেন খুব হাসি পাচ্ছে ফাহিমের মুখ দেখে। কিন্তু হাসছে না। খুবই শান্ত ভঙ্গিতে গাল দিয়ে বসে আছে। তনয়াও কিছু বলছে না। কারণ তনয়া আগের থেকেই সবটা জানত। সেদিন তারা বাসায় এসে তনয়াকে সব কিছু খুলে বলেছে। ফাহিমের পাশাপাশি রুবিনা বেগম ও প্রশ্ন করলেন,
“তারা বিবাহিত মানে? কিসব বলছিস?”
নয়ন কিছু বলার আগেই আহসান সাহেব বিরক্তি সূচক স্বরে বলে উঠলেন,
“দেখ নয়ন, সেদিন এক বিয়ে বাড়িতে অনেক কিছু হয়েছে। আমার সম্মানহানি হয়েছে। আজকে আর তোরা এমন কিছু করিস না, যেন আমার বাকি সম্মানটুকু ধুলোয় মিশে যায়। আমি আর এইসব সহ্য করতে পারছি না।”
নয়ন আহসান সাহেবের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল। আহসান সাহেবের হাত দুটো ধরে বলে উঠল,
“আমাকে ক্ষমা করো, মামু। সেদিন আমার জন্যই সব হয়েছে। আমার জন্যই এতগুলো মানুষের সামনে তোমাদের সম্মানহানি হয়েছে৷ কিন্তু আজকে তোমার কোনো সম্মান নষ্ট হবে না। তোমার হারানো সম্মান তোমাকে ফিরিয়ে দিতে না পারি। কিন্তু কিছুটা বলেও চেষ্টা তো করতে পারি, বলো?”
আহসান সাহেব প্রশ্নোত্তর চোখে তাকাল৷ নয়ন পুনরায় বলে উঠল,
“আমার উপর একটু ভরসা রাখো, প্লিজ।”
আহসান সাহেবের কোনো ছেলে না থাকায় ছোট থেকেই নয়নকে ছেলের মতো স্নেহ, ভালোবাসা দিয়েছেন৷ তিনি নয়নকে যতটা বিশ্বাস, ভরসা করেন তা আর কাউকে করেন না। তাই নয়নের কথা ফেলতে পারলেন না। বললেন
“যা করার তাড়াতাড়ি কর। আমার এত সব ঝামেলা আর ভালো লাগছে না।”
নয়ন এবার তনয়াকে ইশারা করল কিছু৷ ইশারার সাথে সাথে তনয়া রুমের ভেতর দৌড়ে গেল। মিনিটের মাথায় সাথে করে ল্যাপটপ নিয়ে ফিরে এলো। ল্যাপটপটা এনে একটা চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করল। কয়েক মিনিটের মাথায় তনয়ার মুখে হাসি ফুটল। মাথা উঁচু করে নয়নের দিকে তাকাল৷ বলল,
“অল ডান।”
প্রতিউত্তরে নয়ন হাসল৷ উপস্থিত সবার মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। কেউ বুঝতে পারছে না এখানে কি হচ্ছে? মোস্তফা সাহেব অধৈর্য্যে স্বরে বললেন,
“নয়ন, তোর কাছে কি সময়ের দাম নেই? এখানে প্রত্যেকটা মানুষকে ডেকে এনে কি শুরু করেছিস? বাড়ির মানসম্মান কি তোরা আর রাখবি না?”
নয়ন হেসে উত্তর দিলো,
“মান সম্মানটা যেন থাকে তারেই ব্যবস্থা করছি, ছোট মামা। এক মিনিট অপেক্ষা করো।”
বলেই তনয়ার থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে সামনের একটা টেবিলে রাখল। তারপর সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,
“জানি আপনাদের সবার মনে অনেক প্রশ্ন। কেউ বিরক্ত হচ্ছেন। কেউ-বা মজা নিচ্ছেন। সেদিন যখন আপনাদের সবার সামনে এই বাড়ির মেয়ের সম্মানহানি হয়েছে, তখন কিন্তু আপনারা সবাই মজাই নিয়েছেন। আশেপাশের সবাই কম বেশি এত বছর ধরে তারাকে চিনেন। তারা কেমন মেয়ে কম বেশি জানতেন। অথচ সেদিন কিন্তু কেউ তারার হয়ে প্রতিবাদ করে নি। বরং তারার নামে বদনাম রটিয়েছেন। অবশ্য, আপনাদের দোষ দিব কিভাবে? সেদিন ঘটনাটাই এমন ভাবে ঘটেছে যে, না বিশ্বাস করে উপায় কোথায়?”
বলেই নয়ন একটু থামল। পুনরায় বলতে শুরু করল,
“আমরা সবসময় যা চোখে দেখি, যা কানে শুনি তার মাঝেও ভুল থাকে। সব চোখের দেখা সত্যি হয়না। সব কাজের পেছনে একটা করে উদ্দেশ্য থাকে। যেটা আমাদের চোখের আড়াল হয়ে যায়। আজকে আমি শুধু আড়ালে থাকা একটা সত্য তুলে ধরব আপনাদের সামনে। একটা মেয়ের হারানোর সম্মান ফিরিয়ে আনতে পারব না আমি জানিনা। কিন্তু আপনাদের কাছে অনুরোধ আজকে সত্যিটা জানার পর, দেখার পর কেউ তারাকে নিয়ে বাজে কথা রটাবেন না, প্লিজ। পারলে সত্যিটা কথাটা রটাবেন।”
বলেই ল্যাপটপের স্কীনে গিয়ে ভিডিওটায় টাচ করতেই ভিডিওটা প্লে হয়ে গেলো। ল্যাপটপের সাথে সাউন্ড বক্স সংযুক্ত করা ছিল। তাই ভিডিওটা প্লে হতেই উচ্চ স্বরে ভিডিও কথা গুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মোস্তফা সাহেব রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন। তার পাশেই খাটের উপর ফাহিম বসা। শুরুতেই ফাহিম বলে উঠল,
“বাবা, তুমি তো সত্যিটা জানো। তাহলে তারাকে আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলে কেন?”
ছেলের কথার প্রতিউত্তরে মোস্তফা সাহেব প্রশ্ন করলেন,
“কোন সত্যি জানার কথা বলছিস তুই?”
ফাহিম হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
“তোমার ছেলেকে কি তোমার বোকা মনে হয়?”
মোস্তফা সাহেবও প্রতি উত্তরে হেসেই জবাব দিলেন,
“একদম না। আমার ছেলে একদম তার বাপের মতোই হয়েছে। আমার ছেলে জানে, নিজের ভাগ কি করে আদায় করতে হয়? যদি সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠে তাহলে আঙ্গুল বাকা করতে হয়।”
বলেই তিনি আবার হাসলেন। ফাহিম বিরক্তি সূচক স্বরে বলল,
“বাবা, যা জিজ্ঞেস করছি সেটার উত্তর দাও। বেশি কথা বলতে ভালো লাগেনা আমার।”
মোস্তফা সাহেব এবার উঠে দাঁড়ালেন। ফাহিমের সামনে দাঁড়িয়ে ফাহিমের কাঁধে হাত রাখলেন। বলতে শুরু করলেন,
“ছোটবেলা থেকেই বড় ভাইয়ের যেই জিনিসটা পছন্দ হতো। আমার কেন জানিনা সেই জিনিসটার প্রতি বড্ড হিংসা জন্মাতো। ইনিয়েবিনিয়ে যেভাবেই হোক আমি সেই জিনিসটা আদায় করে নিতাম। কিংবা নষ্ট করে দিতাম। এইযে গোটা বাড়িটা দেখছিস, এটাও বড় ভাইয়ের খুব পছন্দের। ব্যবসাটাও বড় ভাই খুব কষ্টে এত বড় করেছেন। সব কিছু নিজের করে নিতে পারলেও এই দুটো জিনিস নিজের করে নিতে পারলাম না। কতরকম চেষ্টা করলাম, তাও পারলাম না। হিংসা আর রাগের বশীভূত হয়ে যখন বড় ভাইকে মে’রে ফেলার চিন্তা মাথায় ঢুকল, তখনি জানতে পারলাম তুই তারাকে পছন্দ করিস। মাথায় নতুন বুদ্ধির উদয় হলো। তারাকে রপ্ত করে এইসব কিছু হাতানো খুব সহজ হয়ে যাবে। তাই ওইসব চিন্তা ভাবনা দূরে ঠেলে দিয়ে বড় ভাইকে তারার বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হলো না। আমি দমে যাইনি। তারাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি, ধমকি দিয়েও রাজি করাতে পারিনি। ওই মেয়ে বড্ড চালাক। কিছুতেই আমার ফাঁদে পা দিল না। তবুও হার মানলাম না। ধৈর্য ধরলাম। কারন তুই তো আমার ছেলে তাই আমি খুব ভালো করেই জানি, তুই তোর জিনিসটা ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক আদায় করবি। আর করলিও সেটা। এমন একটা চাল দিয়েছিস, যেই চালে সবাইকে বাজিমাত করে দিয়েছিস।”
ফাহিম সব কথায় কান না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,
“তুমি নাকি তারাকে ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছো? তুমি ভিডিও ব্যাপারে কি করে জানলে? আমি তো তোমাকে বলিনি। তাহলে?”
মোস্তফা সাহেবের মুখে আগের ন্যায় হাসি বজায় থাকল। বললেন,
“তুমি আমাকে ভিডিওর কথা বলোনি, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি তো আমাকে সেদিন রাতের প্লানের ব্যাপারে বলেছিলে।”
ফাহিম ভাবুক স্বরে বলল,
“বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তো সেদিন আমার সাথে হাত মেলাতে রাজি হও নি। তোমাকে তো আমি ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে রাজি করিয়েছিলাম।”
ফাহিমের কথা শুনে মোস্তফা সাহেব উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন,
“যতই হোক তুমি আমার ছেলে। আমি যদি তোমার প্রস্তাবে একেবারেই রাজি হয়ে যেতাম, তাহলে ব্যাপারটা ভালো দেখাতো না৷ ছেলের কাছে নিজের রেপুটেশন ধরে রাখার জন্য একটু নাটক করেছিলাম। এই যা।”
বলে আবার হাসতে শুরু করলেন। ফাহিম হাফ ছাড়ল। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠল,
“মাই গুডনেস। তুমি তাহলে সেদিন তারার সাথে আমার ছবি তোলার সময় আমার ফোন থেজে ভিডিওটা দেখেছিলে?”
মোস্তবা সাহেব হাসতে হাসতে ফাহিমের কাঁধে কয়েকবার চাপড় মা’রতে মা’রতে বললেন,
“সাব্বাশ বেটা! এইজন্যই তো বলি, তুমি আমার ছেলে। এক চান্সেই কি সুন্দর বুঝে গেলে। তুমি তো তারাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো৷ তুমি যে কোনোদিনেই তারার ভিডিওটা ভাইরাল করবে না আমি জানি। শুধুমাত্র তারাকে ভয় দেখানোর জন্য ভিডিওটা করেছো এটাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তাই সেদিন ভিডিওটা দেখার সাথে সাথে আমি আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে রেখেছিলাম। তারা সেদিন এতকিছুর পরেও সবটা নিজের মুখে স্বীকার করতে চাইছিলো না৷ তাই আমিই সবার আড়ালে ওকে বাধ্য করেছিলাম সবকিছু স্বীকার করতে। ভিডিওটা নিয়ে তখনি হুমকি দিয়েছিলাম। বুঝেছো?”
ফাহিম সব শুনে বলে উঠল,
“তুমি কাজটা একদম ঠিক করো নি, বাবা। ভিডিওটা এক্ষুনি ডিলিট করো আমার সামনে। আমি চাইনা তারার কোনো ক্ষতি হোক। তারার যতটুকু সম্মান আমি নষ্ট করেছি, ততটুকু ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিব। খবরদার তারার কোনোরকম ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। তাহলে আমি ভুলে যাব, তুমি আমার বাবা।”
ভিডিওটা শেষ হতেই বিয়ে বাড়ি জুড়ে সুনশান নিরবতা বয়ে গেলো। আহসান সাহেব দাঁড়ানো থেকে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারার চোখের কোনে পানি। আহসান সাহেব বসে পড়তেই তারা দৌড়ে এলো। হাটু ভেঙে বাবার সামনে বসে ছলছল চোখে বলে উঠল,
“আমি খারাপ, চরিত্রহীন, নোংরা মেয়ে না, বাবা।”

#চলবে

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_নবম[শেষাংশ]
বিয়ে বাড়িতে আনন্দের বদলে ছেয়ে আছে নিস্তব্ধতা। বউ সেজে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। পাশেই তনয়া তারাকে শক্ত করে ধরে দাঁড়ানো। তনয়ার বিয়ে হয়েছে আজ দুদিন হলো। এই দুদিনের ব্যবধানে আজ তারা আর ফাহিমের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে৷ বাড়ির সবাই যে যার মতো স্থির হয়ে দাঁড়ানো। কেউ কোনো রকম কথা বলছে না৷ মোস্তফা সাহেবের চোখেমুখে ভয়। আহসান সাহেব মোস্তফা সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়াতেই মোস্তফা সাহেব আমতা আমতা করে বলে উঠলেন,
“এসব কিছু মিথ্যা, ভাই। আ…।”
আর কিছু বলার আগেই আহসান সাহেব জোরে থাপ্পড় মে’রে বসলেন তার গালে। বলতে লাগলেন,
“তোকে আমার ভাই বলতেও লজ্জা লাগছে। আমার রক্তের ভাই হয়েও তুই আমার পেছনেই ছু’ড়ি মা’রলি? কী করে পারলি তুই এইসব করতে? আচ্ছা ধরে নিলাম, তোর আমার সাথে শত্রুতা। কিন্তু আমার মেয়েটার কী দোষ ছিল রে? কেন আমার জন্য আমার মেয়েটাকে বলি দিলি? আমার এইটুকু মেয়েটাকে সবার সামনে কেন লাঞ্চিত করলি? আমার সব বিশ্বাস, ভরসা এভাবে কেন ভেঙে দিলি? আরে তুই আমার ভাই। আমার থেকে হাসি মুখে আবদার করলে আমি তোকে আমার জানটাও দিয়ে দিতাম। তুই যদি এসব না করে, আমাকে মে’রে ফেলতি তবুও আমার এতটা কষ্ট লাগতো না।”
আহসান সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না। ভাইয়ের করা বিশ্বাসঘাতকা তাকে কষ্টে অসাড় করে দিচ্ছে। রুবিনা বেগম স্বামীর পাশে এসে আকঁড়ে ধরলেন তাকে। মোস্তফা সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কী করে এতটা নিচে নামতে পারলে তুমি? আমার মেয়ের সাথে যা যা হলো এসব যদি তোমার মেয়ের সাথে হতো, কী করতে তুমি? একটাবার ভেবে দেখেছো? আমার তো তোমার প্রতি ঘৃণা না করুণা হচ্ছে। যে তুমি আসলে মানুষ হয়েও অমানুষ হিসেবে পরিচিতি পেলে। ছিহ!”
তিনি আহসান সাহেবকে ধরে নিয়ে চেয়ারে বসালেন। মোস্তফা সাহেব উপায়ন্তর না পেয়ে আহসান সাহেবের সামনে গিয়ে হাত জোড় করে বলতে লাগলেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও, ভাইজান। আমি ভুল করে ফেলেছি। শেষ বারের মতো আমাকে ক্ষমা করে। আমি তোমার পায়ে পড়ছি।”
বলেই তিনি আহসান সাহেবের পা জড়িয়ে ধরল। আহসান সাহেব চিৎকার করে নয়নের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“নয়ন, ও’কে আমার চোখের সামনের থেকে নিয়ে যা। ওর জন্য যথাযথ শাস্তি হয় তার ব্যবস্থা তুই করবি। এত বছর ধরে করে আসা সব অন্যায়ের শাস্তি পাবে ও। এক্ষুনি নিয়ে যা ও’কে।”
নয়ন পেশায় একজন পুলিশ অফিসার৷ তাই আগের থেকেই নিজের ফোর্স তৈরি করে রেখেছিল। আহসান সাহেব বলার সাথেই সাথেই নয়নের ইশারায় একজন এসে মোস্তফা সাহেবের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়ালো। মোস্তফা সাহেবের কোনো আকুতি-মিনতি কেউ শুনল না। ফাহিম কিছু বলছে না। ওর মুখে ভয় বা অনুতাপের কোনো চিহ্ন নেই। ওর বাবাকে যে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকেও ওর খেয়াল নেই। রিমা বেগম এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন। স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছেন দেখেও চুপ করে আছেন। তার বলার কিছুই নেই। আজ থেকে তার পরিচয় একজন অপরাধীর বউ। নানারকম ভাবনায় বুকের ভেতরটা যন্ত্রণা করছে।মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি, মোস্তফা সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কান্নারত স্বরে বলে উঠলেন,
“এর থেকেও বড় কোনো শাস্তি হওয়া উচিত ছিলো তোমার। তোমরা বাপ, ছেলে এত নিচে নেমে গেলে! আমাকে তো সারাদিন কথা শুনাতে আমি নাকি তারাকে সহ্য করতে পারি না। তারাকে তো আমি শুধু সহ্য করতে পারিনা ও মুখে মুখে কথা বলে তাই। তারা তো আমার আপন কেউ না। আমার রক্তের কেউ না। আমি তারাকে সহ্য করতে পারি না বলে, ওর খারাপ চাইনি কখনো। কোনোদিন চাইনি। কিন্তু তুমি তো বলতা তারা নাকি তোমার মেয়ে? তাহলে যাকে মেয়ে ভাবো তার সাথে এতটা নিচু কাজ কিভাবে করতে পারলা?”
মোস্তফা সাহেবের চোখ টলমল করছে। অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে বলে উঠলেন,
“আমাকে ক্ষমা করো পারলে।”
যাওয়ার সময় তারার সামনে পড়তেই, হাত জোড় করে অনুতাপের স্বরে বললেন,
“এই অধম অপরাধীকে পারলে ক্ষমা করে দিস, মা।”
তারা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না৷ চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইল। মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে যেতেই রিমা বেগম গিয়ে দাঁড়ালেন ফাহিমের সামনে। বললেন,
“তোকে আমার ছেলে ভাবতেও লজ্জা করছে৷ এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে? অবশ্য, তোকেই বা কি দোষ দিব? যার বাবা এতটা নোংরা মানসিকতার সে ভালো হবে কী করে?”
ফাহিম এতক্ষণের সবকিছুতে বেশ বিরক্ত। ও অপেক্ষা করছে কখন ওর আর তারার বিয়েটা শুরু হবে। চোখে মুখে বিরক্তিকর ভাব এনে বলে উঠল,
“উফফ! মা! তোমার এইসব আজাইরা ক্যাচাল বাদ দাও। আর এখানে কি নাটক হচ্ছে? বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজনদের সামনে কি নাটক শুরু করছো তোমরা? এতক্ষণ অনেক নাটক হয়েছে। এবার নাটকের হ্যাপি এন্ডিং হবে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন সবাই এসব বাদ দাও। তারা আর আমার বিয়ে আজকেই হবে। কেউ আটকাতে পারবে না।”
ছেলের কথা শুনে রিমা বেগম প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। রাগে শরীর শিরশির করে উঠল তার। চ্যাঁচিয়ে বললেন,
“তুই এত বড় অন্যায় করে এখনো মাথা উঁচু করে কথা বলছিস?”
“মাথা নিচু করার মতো কোনো কাজ আমি করিনি তো, মা।”
ফাহিমের কথা শেষ হতে না হতেই রিমা বেগম ফাহিমের গালে কষিয়ে থা’প্পড় বসিয়ে দিলেন। বললেন,
“একটা মেয়ের সম্মানে হাত দিয়েছিস তুই। মেয়েটাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করেছিস৷ সবার সামনে এই বাড়ির সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস। এতকিছুর পরেও বলছিস তুই কিছু করিসনি। কোন ধাতু দিয়ে তৈরি তুই?”
ফাহিমের মধ্যে কোনোরকম হেলদোল দেখা গেলো না৷ সে সোজাসাপটা উত্তর দিলো,
“আমি তারাকে ভালোবাসি। যা করেছি সব ভালোবেসে করেছি। যা করেছি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার জন্য করেছি। ব্যস!”
রিমা বেগম ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। এ ছেলেকে বুঝানোর সাধ্য তার নেই। এবার মুখ খুলল তারা। ফাহিমের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“ভালোবাসেন আমাকে, তাইনা?”
ফাহিম অকপটে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, ভালোবাসি।”
উত্তর শুনে তারা হাসল। পরক্ষণেই ফাহিমের গালে থা’প্পড় বসিয়ে দিলো। উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“ভালোবাসেন! লাইক সিরিয়াসলি! যাকে ভালোবাসেন তার সম্মান নষ্ট করতে না, বাঁচাতে শিখতে হয় আগে। আপনার মতো নোংরা, সাইকো মানুষ শুধু নিজের স্বার্থ বুঝে। অন্য কিছু না। আপনি আমার সাথে সাথে আমার পরিবার, আমার বাবার সম্মান ও নষ্ট করেছেন। আপনাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। কোনো দিন না। মৃত্যুর আগে অব্দি আপনার দেওয়া প্রত্যেকটা কষ্ট আমি মনে রাখব। আপনার দেওয়া আঘাতটা আমার রুহ অব্দি কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাই আমি ক্ষমা করলেও আমার রুহ আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। কোনোদিন না।”
কথাগুলো বলতে বলতে তারা ডুকরে কান্না করে উঠল। হাটু ভেঙে নিচে বসে পড়ার আগেই এক জোড়া শক্ত হাত ধরে ফেলল। যত্ন সহকারে বুকে টেনে নিলো। মাথায় হাত রাখল। তারা যেন এই আশ্রয়টাই খুঁজছিল। আপন নীড় পেয়ে স্বস্তি পেলো। নয়নের বুকে তারাকে মাথা রাখতে দেখে ফাহিমের আঁখি জোড়া আগুনের ন্যায় ধারণ করল। ফাহিম হেঁচকা টানে তারাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু তার পূর্বেই নয়ন ফাহিমের হাত ধরে ফেলল। শান্ত স্বরে বলল,
“আমার বউকে টাচ করার দুঃসাহস করিস না। ফলাফল খুব খারাপ হবে।”
বলেই ফাহিমকে ধাক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিলো। ফাহিম রক্তচক্ষু নিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলল,
“তারা আমার। শুধু আর শুধুমাত্র আমার৷ আমার তারাকে এক্ষুনি ছেড়ে দে, নয়তো এখানে তুলকালাম হয়ে যাবে।”
নয়ন সাথে সাথে জবাব দিলো,
“অনেক সিনক্রিয়েট করেছিস। সবার সামনে আর সিনক্রিয়েট করিস না৷”
তারপর তারাকে শান্ত করে দাঁড় করাল। সবার উদ্দেশ্য বলতে লাগল,
“আপনাদের সবার সিনেমা দেখার টাইম এখানেই শেষ। আমাদের পারিবারিক ব্যাপার আপনাদের সামনে নিয়ে আসার কোনোরকম উদ্দেশ্য আমার ছিল না। শুধু এনেছি একটা মেয়ের সম্মানে যেই কালি লেগেছে সেই কালির দাগটা যেন একটু হলেও হালকা হয় তাই৷ আশা করি, ভিডিওটা দেখে আপনারা সত্যি, মিথ্যার প্রার্থক্য বুঝতে পেরেছেন। না বুঝলেও সমস্যা নেই। আপনাদের বুঝা না বুঝায় আমার বা আমার পরিবারের কিছু আসে যায় না৷ আর একটা কথা, ‘তারা আমার বউ’। এখন আমাদের কবে, কোথায় বিয়ে হলো? কি করে হলো? এসব আপনাদের জানাতে ইচ্ছুক নই আমরা। যেটুকু জানার দরকার জানিয়েছি। বাকিটুকু আমাদের পারিবারিক ব্যাপার। এবার আপনারা আসতে পারেন। আস’সালামু আ’লাইকুম।”
বলেই নয়ন জাহানারা বেগমকে ইশারা করলেন সবাইকে বিদায় করার জন্য। অতিথীরা সবাই চলে যেতেই ফাহিম খাবলে ধরল নয়নের কলার। চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“তুই আমার তারাকে নিজের বউ বলে দাবি করিস কোন সাহসে?”
নয়ন হালকা হাসল। ফাহিমের থেকে নিজের শার্টের কলার ছাড়িয়ে নিলো। সজোরে থাপ্পড় বসালো ফাহিমের গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমার সাথে লাগতে আসিস না। ফলাফল খুব খারাপ হবে। ভুলে যাস না আমি কে? তোর বাবা তার পাপের শাস্তি পেলেও তুই কিন্তু তার থেকেও বড় অপরাধী। তোর শাস্তি কিন্তু এখনো বাকি। আমার বউয়ের সাথে নোংরামি করার অপরাধে আমি চাইলে তোকেও এক্ষুনি সারাজীবনের জন্য জেলে ঢুকাতে পারি। সারাজীবন জেলে বসে ম’রতে হবে। কিন্ত এটা আমি করব না। ছোটমামির বুক খালি করার মতো এতটা নিচ কাজ আমি কখনোই করব না। ছোট মামার নিজেকে শুধরে নিলে তাকেও সুন্দর ভাবে বাঁচার জন্য শেষ সুযোগ দেওয়া হবে৷ আর তোকে কেন এখনো আমি কোনো শাস্তি না দিয়ে এখানে রেখেছি ভাবছিস তো?”
কথাটা শেষ করেই নয়ন হাসল। ফাহিমের দিকে সামান্য ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল,
“তোর শাস্তিটা কোনো শারীরিক শাস্তি হবে না। তোর হবে মানসিক শাস্তি। ভালোবাসিস তো তারাকে তাইনা? সেই ভালোবাসার মানুষটাকে যখন আমার বুকে সুখে থাকতে দেখবি, তখন বুঝবি যে ভালোবাসা আসলে কী? আর আমার মতে মানসিক শাস্তির চাইতে বড় শাস্তি কিছু নেই।”
ফাহিম প্রতিউত্তরে বলল,
“আমার তারাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারব না। কিছুতেই না।”
বলেই পাগলের ন্যায় আচরণ করতে লাগল। তারার হাতটা শক্ত করে ধরল। বলতে লাগল,
“এই তারা! এই! তুই তো আমাকে ভালোবাসিস বল? সেদিন তো নিজের মুখেই স্বীকার করলি। আমাকে বিয়ে করার জন্য রাজিও হয়েছিস। তোর কথায় আমি সেদিন বাবার সাথে এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। তোর জন্য আমি বাবাকে বিপদে ফেলেছি। এখন তুই আমাকে ঠকাতে পারিস না, তারা। কিছুতেই পারিস না।”
ফাহিমের কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শুনাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও নিজের মধ্যে নেই। ফাহিমের চোখের কোনে স্পষ্ট অশ্রুর ছাপ। তারার কেমন মায়া হচ্ছে এই মানুষটার জন্য। এই মানুষটার অতিরিক্ত ভালোবাসাই মানুষটার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, সেদিন তারাই ফাহিমকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে, ভুলিয়ে ভালিয়ে মোস্তফা সাহেবের রুমে পাঠিয়েছিল। মোস্তফা সাহেবের মুখ থেকে সত্যিটা বের করার জন্য ফাহিমকে রাজি করিয়েছিল। ফাহিম যখন তারার কথামতো সবটা করছিল, তখনি তারা রুমের বাহিরের থেকে ভিডিওটা করে রেখেছিল। তারা সবটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফাহিমের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, খুব শান্ত স্বরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করবেন, ফাহিম ভাই। আপনাকে ঠকানোর কোনোরকম ইচ্ছে আমার ছিলো না। কিন্তু আপনি আমার সাথে যেই অন্যায় করেছেন, তারপর এই কাজটা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না। আমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি আমি আপনাকে দিব না। সবটা উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিলাম। তিনি যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন।”
ফাহিম যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা ওর সাথে তাহলে এই কয়েকদিন অভিনয় করেছে। কিছুতেই মানতে পারছে না। পাগলের মতো পুনরায় বলে উঠল,
“না, তারা! তুই আমাকে ঠকাতে পারিস না। আমি তোকে অন্য কারোর সাথে মানতে পারব না। কিছুতেই মানতে পারব না। আমি তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসি, তারা৷ অনেক বেশি ভালোবাসি।”
তারা শান্ত স্বরে বলল,
“এখন আর আমাকে ভালোবেসে কোনো লাভ নেই। আমি এখন অন্যের স্ত্রী। বয়সে আমার স্বামী আপনার বড়। সেই হিসেবে আপনার বউ ভাইয়ের বউ আমি।”
ফাহিম মানতে পারল না। আচমকা-ই অদ্ভুত ভাবে চিৎকার করা শুরু করল।
“কিছুতেই না। আমার তারা অন্য কারোর হতে পারে না। কিছুতেই পারে না। ”
বলতে বলতে কেমন একটা উন্মাদের মতো আচরণ করছে। চারদিকে যা পাচ্ছে তাই ফ্লোরে ছুড়ে মারছে। তারা ভয়ে নয়নের বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছে। নয়ন তারাকে অভয় বানীতে শুধাল,
“ভয় পাস না। আমি আছি তো।”
নয়ন আর ফাহিমের বন্ধু যারা সেখানে উপস্থিত ছিল সবাই মিলে ফাহিমকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিছু পারছে না। হুট করে সামনে থাকা একটা ফুলদানি দিয়ে নিজেই নিজের মাথায় আঘাত করা শুরু করল। নিজেকে রক্তা’ক্ত করা শুরু করল…

#চলবে

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৮

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_অষ্টম

“তোর গালে আবার কে কামড় দিলো, তারা?”
প্রশ্নটা শুনেই তারা থমকে গেলো। পেছন ফিরে দেখল রিমা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তারা ঢোক গিলল। মনে মনে বলে উঠল,
“যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।”
তারাকে চুপ থাকতে দেখে রিমা বেগম এগিয়ে আসলেন। সন্দিহান স্বরে বললেন,
“নিজের ঘর থেকে চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মে’রে বের হচ্ছিস। আবার গালে কামড়ের দাগ৷ ব্যাপার কি, তারা?”
তারা মেকি হাসল৷ আমতা আমতা করে বলল,
“কই? চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মা’রতে যাবো কেন, চাচি? আমি তো দেখছিলাম সবাই কোথায়?”
বলেই আবার হাসল। রিমা বেগম এখনো সন্দিহান দৃষ্টিতেই তারার দিকে তাকিয়ে আছেন। পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“গালে এটা কিসের দাগ? কামড়ের? কিন্তু কে কামড় দিলো তোকে?”
তারার মন চাইলো মুখের উপর কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। আরে বাবা এমন নির্লজ্জের মতো কেউ কাউকে এভাবে প্রশ্ন করে? আজব ব্যাপার! কিন্তু এখন রাগলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলাতে হবে। তারা একটু লজ্জা লজ্জা হাসি দিয়ে বলে উঠল,
“চাচি, এভাবে প্রশ্ন করবেন না। আমার লজ্জা লাগছে।”
রিমা বেগম ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকালেন। বললেন,
“এভাবে গালে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালে যে কেউ প্রশ্ন করবে। আর এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? বাড়িতে ছোট বাচ্চা কাচ্চা আছে তারা কামড় দিতেই পারে। সেইজন্যই জিজ্ঞেস করেছি, কোন বাচ্চা কামড় দিয়েছে।”
তারা মুখ চেপে হাসল। রিমা বেগমকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তারার এহেন কান্ডে সে বেশ খানিকটা অবাক হলো বটে৷ তারা তো তাকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনা। তাহলে হঠাৎ এত ভাব কিসের জন্য? তারা এবার রিমা বেগমের কানে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“ডিয়ার হবু শাশুড়ী মা, আপনার ঘরে বড় একটা বাচ্চা থাকতে, কোনো ছোট বাচ্চার সাহস হবে না আমাকে কামড় দেওয়ার। তাই বলছিলাম কি, এভাবে ছেলের বউকে যখন তখন প্রশ্ন করে লজ্জায় ফেলে দিবেন না।”
বলেই তারা সেখানে আর দাঁড়াল না। হনহন করে ছুটল অন্য দিকে। আর রিমা বেগম তব্ধা খেয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। কি বলে গেলো মেয়েটা? তার মানে তারার গালে কামড় ফা…? ভেবেই নিজে নিজেই কপাল চাপড়ে বলে উঠলেন,
“ছিঃ! ছিঃ! আমার ছেলেটাও দেখছি আজকাল বড্ড নির্লজ্জ হয়ে গেছে। ছিহ! এই ছেলেকে আমি এই শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি? হায়, আল্লাহ!”
ফাহিমের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে তিনি ছুটলেন রান্না ঘরের দিকে। রিমা বেগম চলে যেতেই তারা শব্দ করে হেসে উঠল। রিমার বেগমের মুখটা দেখার মতো ছিলো। তারার থেকে নিশ্চয়ই এমন উত্তর আশা করেন নি, ভেবেই তারার আরো জোরে হাসি পাচ্ছে। হাসতে হাসতে পেটের খিল ধরে যাচ্ছে তবুও হেসে যাচ্ছে।
“এভাবে একা একা গা’ধার মতো হাসছিস কেন?”
হুট করে চেনা কণ্ঠ স্বর শুনে চমকে গেলে তারা। দেখল নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। নয়নকে দেখেই তারার হাসি থেমে গেলো। মুহূর্তেই হাস্যজ্বল মুখে রাগের আভাস ফুটে উঠল। নয়নের সামনে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়াল। নয়নের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“তুমি কি আমাকে গা’ধা বললে?”
“গা’ধাকে তো গা’ধাই বলতে হয়।”
তারা নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“ছিহ! তুমি আমার জেন্ডার চেঞ্জ করে ফেললে?”
নয়ন প্রশ্নোত্তর চোখে তাকাল। বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল,
“মানে?”
তারা দাঁতে দাঁত চে’পে উত্তর দিলো,
“ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন গা’ধার ফিমেল ভার্সল হচ্ছে, ‘গা’ধি’। সো, আমাকে গা’ধা নয় গা’ধি বলতে পারো।”
নয়ন বিস্মিত চোখে তাকাল। বলল,
“তার মানে স্বীকার করলি তুই গা’ধি?”
তারা খুবই অসহায় মুখ করে বলে উঠল,
“স্বীকার না করে আমার কি আর উপায় আছে বলো? আমার স্বামী এই প্রথম আমাকে ভালোবেসে এত সুন্দর একটা নাম দিয়েছে। স্ত্রী হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না? স্বামীর ভালোবাসাকে সম্মান জানানোর জন্য হলেও স্বীকার তো করতেই হবে, বলো?”
বলেই ফিক করে হেসে দিলো। নয়ন তারার কান ধরে বলে উঠল,
“তবে রে, পাকামো হচ্ছে খুব। একবার পাই তখন দেখিস কি করি?”
তারা একটু এগিয়ে গেলো। নয়নের দিকে সামান্য ঝুঁকে বলল,
“জানি তো আদর করবে। এইযে নাও, সামনেই আছি আদর করে দাও।”
হুট করে তারা এত কাছে আসায় নয়ন ভড়কে গিয়েছিল। তারার মুখে এমন কথা চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। তারা নয়নের এমন ফেস দেখে হিহি করে হেসে উঠল। নয়নের দুই কাঁধে হাত রাখল। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল,
“ভয় পাচ্ছো, জান?”
নয়ন চারদিকে নজর বুলালো। কি করছে মেয়েটা? এখানে কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে৷ নয়ন ভয়ার্ত স্বরে বলল,
“কি করছিস? সরে যা। কেউ দেখে ফেললে খারাপ হবে ব্যাপারটা।”
তারা সরল না। বরং আরো ঘনিষ্ট হলো নয়নের সাথে। বলে উঠল,
“দেখুক। তাতে আমার কি? আমি আমার জামাইয়ের সাথে রোমান্স করছি। অন্য কারোর সাথে না। বুঝলে?”
নয়ন মুচকি হাসল। তারার নাক টেনে বলল,
“বুঝেছি, ম্যাডাম। কিন্তু এখন সরুন। ওইদিকে অনেক কাজ আছে।”
“আগে আমাকে আদর করো। আমাকে আদর করার চাইতে বড় কাজ আর কিছু নেই, বুঝছো?”
নয়ন হেসে দিলো। তারার কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে আরো মিশিয়ে নিলো। তারার নাকে নাক ঘষে বলে উঠল,
“আর মাত্র একদিন। তারপর তোমাকে এমন আদর করব যে, তুমি সামলাতে পারবে না।”
“নির্লজ্জ লোক কোথাকার!”
“আমার বউকে বলেছি, তোর জ্বলছে কেন?”
তারা প্রতিউত্তরে হাসল। হুট করে চোখ গেলো নয়নের গলায় থাকা কালো তিলটার দিকে। নয়নের ফর্সা গলায় তিলটা ফুটে উঠেছে। তারার খুব ইচ্ছে হলো সেখানটায় ঠোঁট ছোঁয়াতে। কিছুক্ষণ চেষ্টা করল নিজের ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখতে। কিন্তু পারছে না। চোখ বার বার সেদিকে চলে যাচ্ছে। এর মাঝে নয়ন হুট করে তারার কপালে চুমু খেয়ে বসল। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো তারা। কানে ভেসে আসল,
“তুমি আমার প্রিয় তারা।”
তারা চোখ খুলল। নয়নের দুই গালে হাত রেখে নয়নের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। বলে উঠল,
“প্রিয় নয়নের প্রিয় তারা।”
নয়নও তাল মিলিয়ে বলল,
“প্রিয় নয়নতারা।”
এরপর দুজনেই একসাথে হেসে উঠল। তারা হাসতে হাসতেই বলল,
“ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি!”
বলেই নয়নকে জড়িয়ে ধরল। নয়নও আকঁড়ে ধরল প্রিয়তমাকে। পরক্ষণেই তারাকে সরিয়ে দিতে দতে বলল,
“এবার ছাড়েন, ম্যাডাম। অনেক প্রেম ভালোবাসা হয়েছে।”
তারা ছাড়ল না। আরো শক্ত করে ধরল। নয়ন এবার একটু কড়া স্বরেই বলল,
“ছাড়তে বললাম তো? ছেড়ে দে৷ কেউ দেখলে বাজে কথা রটাবে আবার৷ আমি চাইনা আর কেউ তোর নামে বাজে কথা বলুক।”
তারা ছাড়ল। কিন্তু দূরে গেলো না। নয়নের গা ঘেষে থেকে, নয়নের গালে হাত রেখে বলল,
“যে যা খুশি বলুক। আমার তাতে কিছু আসে যায় না। আমার পাশে আমার নয়ন আছে। আমার স্বামী আছে। তার বুকে আমার ঠাঁয় আছে। এতকিছু থাকতে লোকের কথার কান দিতে যাবো কেন?”
নয়ন হাসল। মেয়েটা বড্ড বকবক করে। বলল,
“এবার থামেন, ম্যাডান। তনয়া ডাকছে সেদিকে যান।”
“ভালোবাসি বলেন।”
নয়ন হেসে বলল,
“ভালোবাসি।”
তারাও প্রতিউত্তরে বলল,
“ভালোবাসি।”
“হয়েছে, এবার যান।”
“যাচ্ছি তবে আমার একটা কাজ আছে।”
“কি কাজ?”
নয়নের প্রশ্নের উত্তরে তারা, “দেখাচ্ছি।” বলে দেরি না করে সাথে সাথে নয়নের গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। গভীর ভাবে চুমু এঁকে দিলো সেখানেটায়। ছেড়ে দেওয়ার সময় জোরালো ভাবে কামড় দিয়ে বসল। ব্যাথায় একটু নড়েচড়ে উঠল নয়ন। কামড় দিয়েই তারা আর আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। আর নয়ন ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইল। হুট করে কি হয়ে গেলে? সব বেচারার মাথার উপর দিয়ে গেলো। আনমনে নিজে নিজেই বলে উঠল,
“ডেঞ্জারাস গার্ল!”

#চলবে

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৭

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সপ্তম

“দুদিন আগে নষ্টামি করতে গিয়ে সম্মানহানি করল। আর এখনেই দেখো মেয়ের মুখের থেকে হাসি যেন সরছেই না। নষ্ট মেয়ে একটা!”
“এসব চরিত্রহীন মেয়েকে বাসায় রাখাই উচিত না। এদের দেখে আমাদের মেয়েগুলো খারাপ হবে।”
তারার কানে কথাগুলো যেতেই তারা একবার মহিলাটার দিকে তাকাল। দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে তারার নামে নিন্দা, মন্দ করে যাচ্ছে। দুজনেই তারার প্রতিবেশী। আজ তনয়ার বিয়ে। সকালে সবাই তারাকে গায়ে হলুদ দিয়ে, গোসল করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেখানেই তারা সবার সাথে হাসি আড্ডায় মত্ত ছিল। সেদিনের পর মাঝে ৩/৪দিন কেটে গেছে। এই ৩/৪দিনে আহসান সাহেব বাদে বাড়ির বাকিরা স্বাভাবিক হয়েছে। সবাই তারার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। তারাও আগের মতো একদম স্বাভাবিক। যেন আগের মতোই রয়েছে সব। কিছু হয় নি। সেদিনের সবকিছু যেন দুঃস্বপ্ন। পাশের একজন মহিলা পুনরায় বলে উঠলেন,
“ফাহিমের মা-বাপ ভালো বলেই আজ এই মেয়েকে মেনে নিয়েছেন। অন্য কেউ হলে কোনোদিন মানত না। অস’ভ্য মেয়ে একটা। এতদিন কত ভালো ভেবে এসেছিলাম। কিন্তু তলে তলে যে এই মেয়ে এত দূর কে জানত?”
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”
হুট করে তারার কণ্ঠস্বর মহিলা দুজন চমকে উঠলেন। আমতা আমতা করে দুজনেই সালামের উত্তর দিলো। তারা তাদের কাছে এসে দাঁড়াল। মুখ জুড়ে চওড়া হাসি। চোখ, মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই, এই মেয়ে কি কান্ড ঘটিয়েছিল। তারা হাস্যজ্বল স্বরে বলে উঠল,
“রাহেলা আন্টি, পপি আপু যেন কোথায়?”
তারার কথা শুনে রাহেলা বেগমের মুখ চুপসে গেলো। তার বুঝতে দেরি হলো না যে, তারা কেন এই প্রশ্ন করেছে। রাহেলাকে চুপ করে থাকতে দেখে তারা অপর পাশে ফিরে নাজমা বেগমকে প্রশ্ন করল,
“নাজমা আন্টি, অমিত ভাই এই কাজটা করল কিভাবে? নিজের ঘরে বউ, সন্তান রেখে অন্য একটা সুগার মাম্মিকে বিয়ে করল। ইশ! কি লজ্জার বিষয়! তা আন্টি আপনার বয়সী কাউকে আপনি পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিয়েছেন তো? সুগার মাম্মির তো আবার গুলশানে বাড়ি আছে শুনলাম। সেই লোভে হলেও আপনি মেনে নিবেন। যতই হোক, আপনি তো আবার লোভ সামলাতে পারেন না। ”
তারার কথা শুনে নাজমা বেগম রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকাল। গর্জে বলে উঠলেন,
“তারা, মুখ সামলে কথা বল।”
তারা হাসল। দাত কেলিয়ে বলল,
“আপনারা তো জানেন, আমি সব সামলাতে পারলেও মুখটা ঠিক সামলাতে পারিনা। কি যেন বলছিলেন, রাহেলা আন্টি? ‘আমাকে দেখে আপনার ছেলেমেয়ে খারাপ হবে’, তাইতো? তা পপি আপুকে কি আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম, বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য? শুনলাম, পপি আপু নাকি প্রেগন্যান্ট?”
রাহেলা বেগম আমতা আমতা করে বললেন,
“হ্যাঁ। ”
তারা আগের থেকে দ্বিগুণ খুশি নিয়ে লাফিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ। খুবই ভালো খবর। তা আন্টি পপি কি শশুড় বাড়ি?”
রাহেলা বেগম কি বলবে ভাবছে। তার উপর তারা আবার বলে উঠল,
“ওহো, স্যরি! পপি আপুর স্বামী তো আবার তাকে পরকিয়ার অপবাদ দিয়ে আপনাদের বাড়ি ফেলে রেখে গেছে। আচ্ছা আন্টি, বাচ্চাটা আসলে কার?”
নাজমা বেগম কাজের বাহানায় চলে গেলেন। রাহেলা ও তার পিছু পিছু ছুটল। তারা চলে যেতেই তারা শব্দ করে হেসে উঠল। পেছন ফিরতেই দেখল নয়ন তার খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। তনয়া তারার পাশে এসে দাঁড়াল। তারার গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
“একেবারে উচিত শিক্ষা হয়েছে। এদের মতো কিছু পাবলিকের কাজেই হলো অন্যের বাড়ি নিয়ে কানাঘুষা করা। নিজের ঘরের খবর নেই, আসছিল অন্যের মেয়েকে নিয়ে নিন্দা রটাতে। এদের মুখে আসলে এমন করেই ঝাটা মে’রে বিদায় করতে হয়।”
তারা মুচকি হাসল। তনয়াকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমিই তো শিখিয়েছো কোন পরিস্থিতিতে কি করে প্রতিবাদ করতে হয়।”
তনয়া হাসল৷ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল,
“নিজের সম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হয়। কিন্তু তুই পারিস না। ভুল করেছিস। মানুষের মিথ্যে হুমকিতে ভয় পেয়ে নিজের সম্মানে কালি লাগিয়েছিস। এটার মাশুল তোকে দিতেই হবে। কিন্তু তাই বলে মুখ বুঝে সব অন্যায় মেনে নিবি না। প্রতিবাদ করবি। সবসময় চুপ থাকলে হয়না। বুঝলি?”
“তুমি বুঝেছো আর আমি বুঝব না তা কি হয়?”
তনয়া হেসে তারার নাক টেনে বলল,
“হয়েছে, এবার আসুন। ওইদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বলেই গোসলের জায়গায় চলে গেল। তারা সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একজন ওর হাত টেনে ধরল। তারা পেছন ফিরে দেখল ফাহিম দাঁড়িয়ে আছে। ফাহিমকে দেখেই তারা এক গাল হেসে হেচকা টানে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। শান্ত স্বরে বলল,
“যেখানে সেখানে হাত ধরে টানাটানি করেন কেন, ফাহিম ভাই?”
ফাহিম প্রতিউত্তরে বলল,
“এখন তো তুই আমার বউ। তাহলে সমস্যা কোথায়?”
তারা আগের ন্যায় ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,
“উহু! বউ হয় নি এখনো। যখন বউ হবো। তখন দেখা যাবে।”
ফাহিম সন্দিহান স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“তুই আসলেই এই বিয়েতে রাজি? ”
“অবশ্যই। কেন কোনো সন্দেহ আছে নাকি?”
“না মানে..?”
“এত মানে মানে করবেন না, ফাহিম ভাই। এত ভাবতেও যাবেন না। দেখা যাবে এইসব ভাবতে গিয়ে আপনার মাথাটাই ঘুরে গেছে। তখন আমার কি হবে বলুন তো?”
শেষের কথাটা তারা বেশ ইনোসেন্ট ফেস করে বলে উঠল। তা দেখে ফাহিমের ঠোঁট জুড়ে সে কি হাসি! বলল,
“তুই থাকলে আমার কিছু হবেনা। আমি একদম ঠিকঠাক থাকব, জান। কিন্তু তুই না থাকলে আমি মরেই যাব রে, তারা।”
ফাহিম কথা শেষ করতে না করতেই তারা ফাহিমের মুখ চেপে ধরল। আঁতকে উঠে বলল,
“ফাহিম! এসব বলবে না একদম। তুমি এসব বললে আমার কষ্ট হয়।”
ফাহিম নিজের কানকে বিশ্বাস করতেই পারছে না। কি শুনছে এসব? তারা ‘তুমি’ বলে সম্মোধন করছে! আশ্চর্য!
“কি বললি?”
“হ্যাঁ! বিশ্বাস করো আমার অনেক কষ্ট হয়। তোমাকে তো অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমার ভালোবাসা এতদিন পায়ে ঠেলে দূরে ফেলে দিয়েছি। নয়ন ভাইকে ভালোবেসেছিলাম। আর সে কি করল? আমাকে অবিশ্বাস করল। তোমাকে জড়িয়ে নোংরা কথা বলল। তার জন্যই আজকে আমাকে সবাই নোংরা মেয়ে বলে। এতকিছুর পরেও আমি তার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই এখন সব ভুলে শুধু তোমাকে নিয়ে থাকতে চাই, ফাহিম। আমাকে ভালোবেসে রাখবে তো নিজের কাছে। আমার একটু সুখের প্রয়োজন। দিবে তো?”
ফাহিম যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে আছে। খুশিতে চোখের পলক পড়ছে না। মন চাচ্ছে তারাকে কোলে তুলে নাচতে। কিন্তু তারা যদি রেগেমেগে আবার বেঁকে বসে তাই নিজের ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখল। তারার গালে হাত রাখল। তারা অবশ্য একটু নড়ে উঠছে। কিন্তু কিছু বলল না। ফাহিম বলল,
“দিবো। তোকে আমি সব দিবো। তুই শুধু আমার থাকিস। আমি তোকে সব দিয়ে দিব। তোর জন্য আমার জানটাও হাজির রে, জান। অনেক বেশি ভালোবাসি তো।”
তারা প্রতিউত্তরে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে উঠল,
“আচ্ছা, আমাকে ওইদিকে ডাকছে। আমি এখন যাই।”
ফাহিম মাথা নাড়াতেই তারা সেদিকে ছুটল। আর ফাহিম খুশিতে নিজে নিজেই নাচতে শুরু করল। তারা পেছন ফিরে ফাহিমের এহেন কান্ড দেখে বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“শালা! পা’ঠা! তোর নাচানাচি কি করে বন্ধ করতে হয় তা আমি বেশ ভালো করে জানি।”
বলেই নিজের গাল ঘষতে লাগল। নিজের রুমের দিকে ছুটল। রুমে গিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে মুখ সাবান দিয়ে কয়েকবার ধুয়ে নিলো। নিজের ওড়নায় মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই চোখ চড়ক গাছে। অবাক স্বরে বলল,
“আপনি? এখানে?”
নয়ন এতক্ষণ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারার কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আমি। কেন ফাহিমকে আশা করেছিলি বুঝি?”
তারা চুপসানো মুখে উত্তর দিলো,
“ছিহ! না। ওই গা’ধারে কেন আশা করব? হালায় এক নাম্বার লুচ্চা। যখন তখন গায়ে হাত দেওয়া শুরু করে। বিরক্তিকর!”
নয়ন তারার মুখের রিয়েকশন দেখে ঠোঁটে চেপে হাসল। কিন্তু তারাকে বুঝতে দিলো না। তারার হাত ধরে টেনে এনে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারার দুই পাশে হাত রেখে, তারার মুখের উপর ঝুঁকতেই, তারা চোখ বন্ধ করে নিলো। বুকের ভেতর হৃদ যন্ত্রটা লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। তারা জিভ দিয়ে কয়েকবার ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। নয়ন মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে তারার দিকে চেয়ে আছে। হুট করে তারার গালে জোরে কামড় পড়তেই তারা ব্যাথায় চিৎকার করে উঠল। সাথে সাথে নয়ন তারার ঠোঁট জোড়া নিজের করে নিলো। অনুভূতির স্রোতে ভেসে গেলো দুজন। তারা নিজের অজান্তেই নয়নের শার্ট খামচে ধরেছে। নয়নের সাথে নিজেও তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নয়ন তারাকে ছেড়ে দিয়ে, তারার কানে কানে বলে উঠল,
“গালের কামড়টার কথা মনে রাখিস। আর একবার যদি ফাহিম তোকে ছুঁয়েছে, তাহলে পরের বার এমন জায়গায় কামড় দিব যে, কাউকে দেখাতে পারবি না।”
বলেই তারাকে সাইড করে দরজা খুলে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো। তারা আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাল ঘষছে। দৌড়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই দেখল, গালে কয়েক দাঁতের ছাপ স্পষ্ট। সেই সাথে লাল হয়ে আছে। দেখেই তারা চিন্তায় পড়ে গেলো। এই মুখ নিয়ে এখন বাইরে বের হবে কি করে? মনে মনে নয়নের গুষ্টি উদ্ধার করে বলে উঠল,
“আইছে এখন ঢং করতে। নিজেই বিয়েতে রাজি হতে বলল, নিজেই ফাহিমের সাথে ঢং করতে বলল। আর এখন সব দোষ আমার হয়ে গেলো।”
বলেই খাটের উপর ধপ করে বসে পড়ল। গাল হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগল, কি করে রুমের বাইরে যাবে?

#চলবে

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৬

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ষষ্ঠ

“ফাহিম কি তোর সাথে ফিজিক্যালি ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছে, তারা?”
তারা চমকে তাকাল। অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
“ঘনিষ্ঠ কিছু হয়নি। কিন্তু সে আমাকে ব্যাড টার্চ করেছে।”
কথাটা শুনেই নয়নের হাত দুটো তারার গাল থেকে সরে আসল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নয়ন দাঁড়িয়ে পড়ল। তারার থেকে পিছিয়ে গেল। তা দেখে তারার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। নয়নকে সরে আসতে দেখে তারা শব্দ করে কান্না করে উঠল। উঠে এসে নয়নের হাত দুটো আকঁড়ে ধরে বলতে লাগল,
“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যাবে না। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। হ্যাঁ, মানছি আমি ভুল করেছি৷ আমার তোমাকে আগেই সব কিছু জানানো উচিত ছিল। আমি তা করিনি এটা আমার ভুল। সব কিছু আমার ভুলে হয়েছে। আমার ভুলের জন্যই এতগুলো মানুষ সাফার করছে। আমি সব মেনে নিচ্ছি কিন্তু তুমি আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো, প্লিজ। আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ।”
তারা একনাগাড়ে কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো বলে উঠল। নয়নের দৃষ্টি অন্য দিকে। চেহারার কাঠিন্যে ছাপ স্পষ্ট। তারার কথা শেষ হতেই নয়ন হাত ছাড়িয়ে নিল। তারা অবাক চোখে তাকাল নয়নের দিকে। তাহলে কি ফাহিম তারাকে ব্যাড টার্চ করেছে বলে, নয়ন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? তারার গলায় কান্নাগুলো ঝট পাঁকিয়ে আসল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কণ্ঠ স্বর থেকে একটাও শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল তারা। অবাক পানে চেয়ে শুধু নয়নের দিকে। অবাক স্বরে বলে উঠল,
“তুমি আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে কেন নিচ্ছো, নয়ন ভাই?”
নয়ন চুপ রইল। কোনো উত্তর দিলো না। তারা এবার নয়নের দিকে তাকিয়ে হাসল। কেন হাসল জানেনা। এ হাসি খুশির নয়। আবার দুঃখের ও না। এটা তাচ্ছিল্যের হাসি। তারার নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। ফাহিমের হাতের ছোঁয়া মনে পড়তেই, শরীর শিউরে উঠল। নয়নের মুখটা হাত দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আমার দিকে তাকাতে ঘৃণা হচ্ছে, নয়ন ভাই?”
নয়ন অবাক চাহনী নিক্ষেপ করল তারার দিকে। ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“মানে?”
তারা আগের ন্যায় হাসল। বলল,
“অবশ্য, ঘৃৃণা হবারেই কথা। আমার মতো একটা মেয়েকে শুধু ঘৃণা করা যায়। ভালোবাসা যায়না। আমি ভালোবাসা ডির্জাভ করিনা তাইনা, নয়ন ভাই?”
নয়ন বুঝতে পারল, তারা কষ্টের থেকে কথাগুলো বলছে। তাই তারাকে শান্ত করতে তারার গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,
“এসব কী বলছিস তুই? একদম এসব ফালতু চিন্তা ভাবনা মাথায় আনবি না।”
তারা নয়নের চোখে চোখ রাখল। পরক্ষণেই নয়নের হাত দুটো ছিটকে বলে উঠল,
“একদম ছুঁবে না আমাকে। একদম না৷ আমি খারাপ। আমার শরীরে পরপুরুষের বিশ্রি ছোঁয়া লেগে আছে। একটা ছেলের সাথে একই রুমে, একই বিছানায় ছিলাম। অপবিত্র আমি। কলঙ্কিত হয়ে গেছি। আমাকে তুমি ছুঁবে না। আমার মতো চরিত্রহীন, নির্লজ্জ মেয়েকে ছুঁয়ে তোমার হাত নষ্ট করো না, নয়ন ভাই। আমা…।”
তারার সম্পূর্ণ কথা শেষ না হতেই নয়ন তারার গালে থা’প্পড় বসিয়ে দিল। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে থা’প্পড় মে’রেছে। ব্যাথায় ডান পাশটা চিনচিন করে উঠল। মাথার মধ্যে ঘুরছে৷ নয়ন থা’প্পড় মে’রেই তারাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। তারার মাথাটা নিজের বুকে চে’পে ধরে বলে উঠল,
“আর একবাদ যদি নিজেকে নিয়ে বাজে কথা বলেছিস, তাহলে আমার থেকে বেশি খারাপ কেউ হবে না।”
তারা থামবার পাত্রী না৷ নয়নকে দুই হাতে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল,
“আমাকে ছাড়ো। আমাকে ছুঁবে না তুমি। ছেড়ে দাও আমাকে। আমি এত কলঙ্ক নিয়ে কী করে বাঁঁচব? আমাকে সবাই চরিত্রহীন মেয়ে বলেই জানে। আমার জন্য আমার বাবা এখন বাইরে মুখ দেখাতে পারবে না। সবাই বাবাকে দেখলেই বলবে৷ ‘আহসান সাহেবের’ ছোট মেয়ে চরিত্রহীন। এত অপমান, লাঞ্চনা, কলঙ্ক নিয়ে আমি সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারব না, নয়ন ভাই। আমি ম’রে যাব। যতবার ফাহিম ভাইয়ের বিশ্রি ছোঁয়ার কথা মনে পড়ে ততবার আমি ঘৃণা, লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। এত এত যন্ত্রণা নিয়ে আমি বাঁচব কিভাবে?”
কাঁদতে কাঁদতে তারার হেচকি উঠে গেছে। নয়নের চোখের কোনেও পানি। তারাকে শান্ত করতে নয়ন আরো শক্ত করে তারাকে আকঁড়ে ধরল। এবার তারা নয়নের শার্ট দুই হাতে খামচে ধরে শব্দ করে কান্না করতে লাগল। নয়ন তারার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“অন্য একজন তোকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে বলে, তুই বাজে হয়ে গেছিস। অপবিত্র হয়ে গেছিস। কে বলল তোকে?”
তারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে উঠল,
“আজকে থেকে সবাই তাই বলবে।”
নয়ন দুই হাতে তারার চোখের পানিটুকু মুছে দিল। তারার গালে আলতো করে হাত রাখল। বলল,
“আমার দিকে তাকা।”
তারা আঁখি তুলে তাকাল। নয়ন অশ্রুসিক্ত সেই আঁখি পানে চেয়ে বলে উঠল,
“তোকে অন্য কেউ ছুঁয়েছে তো কী হয়েছে? অন্য একজনের স্পর্শে তুই বাজে হয়ে যাবি? কখনোই না। আমার তারু আমার স্পর্শ ছাড়া সর্বদাই কুমারী।”
বলেই নয়ন তারার কপালে চুমু খেলো। তারা খুশিতে ডুঁকরে কেঁদে উঠে নয়নকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙে নয়ন বলে উঠল,
“চল আমার সাথে।”
বলেই নয়ন তারার হাত ধরে হাঁটা শুরু করল। মাঝ পথে থেমে গিয়ে প্রশ্ন করল,
“জিজ্ঞেস করলি না, ‘কোথায় যাচ্ছি’?”
তারা হাসল। বলল,
“আপনার উপর আমার ভরসা আছে।”
নয়ন প্রতিউত্তরে হাসল। ড্রয়িংরুমে গিয়ে জাহানারা বেগমকে দেখতে পেয়ে সোজা বলে উঠল,
“আম্মু, আমি তারাকে বিয়ে করব। আজ, এখন, এই সময়ে।”
নয়নের কথা শুনে জাহানারা বেগম আর তারা দুজনেই যেন আকাশ থেকে পড়ল। জাহানারা বেগম পাউরুটিতে জেলি মাখছিলেন, নয়নের কথা শুনে হাত থেমে গেলো। বিস্মিত স্বরে বললেন,
“কী বললি?”
“আমি তারাকে বিয়ে করব।”
জাহানারা বেগমের হুঁশ আসল। জোরে বলে উঠলেন,
“কী বলছিস তুই? বিয়ে করবি মানে? বিয়ে কি ছেলে খেলা নাকি?”
নয়ন পাত্তা দিল না সেসব কথায়। নিজের মতো করে বলে উঠল,
“তুমি তারাকে ভালোবাসো, আম্মু?”
“এটা কেমন প্রশ্ন? তারা আমার মেয়ের মতো। ওকে ভালোবাসব না তো কাকে ভালোবাসব?”
“তাহলে তারার ক্ষতি হোক তা কি তুই চাও?”
জাহানারা বেগম থেমে গেলেন। উত্তর দিলেন না। নয়ন পুনরায় প্রশ্ন করল,
“ফাহিমের সাথে বিয়ে করে মেয়েটার জীবন নষ্ট হোক তা কি তুমি চাও?”
এবারো তিনি চুপ রইলেন। নয়ন মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“তোমার ছেলে তোমার মাথা নিচু করবে না, আম্মু। একটু ভরসা করো আমাকে। আমি তোমার সম্মান নষ্ট হতে দিব না। তুমি যদি আমার পাশে না থাকো, তাহলে আমি এক পাও এগিয়ে যেতে পারব না, আম্মু। থাকবে না আমার পাশে?”
জাহানারা বেগম ছেলের কথায় ভরসা খুঁজে পেলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“থাকব। তুই ছাড়া আমার ভরসা করার কেউ নেই আর।”
“তাহলে আমি যা করব ভেবে নাও সবার ভালোর জন্যই করব।“



তারা দরজায় কলিং বেল বাজাতেই, তনয়া এসে দরজা খুলে দিল। তারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, চিন্তিত স্বরে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলি তুই? সবাই কত চিন্তা করছিল জানিস?”
তারা হাসল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“এবাড়িতে তুমি ছাড়া আমাকে নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই এখন।”
বলেই তনয়াকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে আসল।।তনয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজা আটকে দিতে দিতে বলল,
“তাহলে আমাকেই বলে যাওয়া উচিত ছিল তোর। না বলে বাড়ির বাইরে পা রাখবি না। আশেপাশের মানুষ দেখলে কথা শুনাতে একবারও ভাববে না।”
তারা আগের ন্যায় হেসেই জবাব দিল,
“দোষ করলে কথা শুনাবে এটাই স্বাভাবিক। এতকিছু গায়ে মাখানোর সময় নেই আমার।”
তনয়া আর কথা বাড়াল না। জিজ্ঞেস করল,
“এতক্ষণ কোথায় ছিলি তুই?”
তারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে রিমা বেগম বলে উঠলেন,
“কোথায় আর যাবে খোঁজ নিয়ে দেখ আবার কোন ছেলের সাথে গিয়ে লেপ্টে ছিল।”
রিমা বেগমের কথা শুনে তনয়া গর্জে উঠে বলল,
“চাচি, এত বয়স হয়ে গেলো আর এখনো ভদ্র ভাষায় কথা বলা শিখলেন না?”
রিমা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“তনু, তোর বোনের মতো দেখছি তোরও উন্নতি হয়েছে। বড়দের কি করে সম্মান করতে হয় জানিস না? দুদিন পর শশুড় বাড়ি যাবি, তাদের সাথেও এভাবে আচরণ করবি নাকি?”
তনয়া গা ছাড়া ভাবে উত্তর দিল,
“আমার শশুড় বাড়ির মানুষ আপনার মতো না, চাচি। তারা যথেষ্ট রুচিশীল, ভদ্র এবং শিক্ষিত।”
রিমা বেগম কিছু বলে উঠার পূর্বেই তনয়া তারার হাত ধরে হনহন করে রুমের দিকে চলে গেল। আর রিমা বেগম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলেন।



পরের দিন সকালে ভোরে ঘুম থেকে উঠতেই তারার ডাক পড়ল। নিচে নেমে আসতেই দেখল ড্রয়িং রুমে বাড়ির সবাই উপস্থিত। নয়ন আর জাহানারা বেগম ও আছেন। তারা নেমে আসতেই আহসান সাহেবের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তা দেখে তারা কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিল। কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন করল,
“আমাকে এখানে কেন ডাকা হয়েছে, চাচ্চু?”
মোস্তফা সাহেব বলে উঠলেন,
“একটু অপেক্ষা করো। যা বলার ভাইজান বলবেন।”
আহসান সাহেব প্রতি উত্তরে বলে উঠলেন,
“এই মেয়ের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। তোদের যা কথা বলার আছে বলে নে। আমাকে এসবের মধ্যে ডাকবি না। আমি এই মেয়ের মুখ দেখতেও চাইনা।”
বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন। তারার চোখে কোনে পানি জমতে শুরু করেছে। মোস্তফা সাহেব বললেন,
“যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। এখন, সম্মান রক্ষার্থে ফাহিম আর তারার বিয়ে ঠিক করেছি আমরা সবাই মিলে। তাতে তোমাদের কারোর আপত্তি আছে?”
বাড়ির সবাই মোস্তফা সাহেবের সিদ্ধান্ত মেনে নিল। এবার তিনি তারাকে প্রশ্ন করলেন,
“তোমার কোনো আপত্তি আছে, তারা মা?”
তারা সাথে সাথে উত্তর দিল,
“যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করতে আবার কিসের আপত্তি, চাচ্চু?”
তারার উত্তর শুনে মোস্তফা সাহেব আর ফাহিম দুজনেই অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলেন। ফাহিম যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ও কি ভুল শুনল? শিওর হওয়ার জন্য প্রশ্ন করল,
“তোর সত্যিই কোনো আপত্তি নেই, তারা?”
তারা হাসল। ঠোঁট জুড়ে হাসি। বলল,
“একদম না। ”
ফাহিমের বিশ্বাস হলো না। যে মেয়ে কাল অব্দি ফাহিমকে সহ্য করতে পারছে না সে হঠাৎ এক রাতে কি করে বদলে গেল?

#চলবে

প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৫

0

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পঞ্চম

“আমার ড্রেস চেঞ্জ করার আপত্তিকর ভিডিওটা যদি ফাহিম ভাই ভাইরাল করে দেয় তাহলে আমার কী হবে, নয়ন ভাই? এখন তো আমি শুধু আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর ও পরিবারের কাছে খারাপ। চরিত্রহীন মেয়ে। কিন্তু তখন তো পুরো দুনিয়ার কাছে ভাইরাল গার্ল হয়ে যেতাম। আমি সেদিন ভয় পেয়েও নিজের নামে কলঙ্ক রটাতে চাইনি বিশ্বাস করো, ফুপ্পি। কিন্তু চাচ্চু বাধ্য করেছে। চাচ্চুও ভিডিও সম্পর্কে জানত। কাল সবার আড়ালে বলেছিল, ‘আমি যদি স্বীকার না করি তাহলে সে নিজে ভিডিওটা ভাইরাল করে দিবে’ বিশ্বাস করো আমি ওই পরিস্থিতিতে সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। তাই তখন যা মুখে আসছে বলে দিয়েছি। বিশ্বাস করো, আমার কাছে অন্য কোনো রাস্তা ছিল না। আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি। তোমরা একটু বিশ্বাস করো। আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো, প্লিজ। প্লিজ নয়ন ভাই, একটু বিশ্বাস করো আমাকে। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।”
কথা গুলো বলতে বলতে তারা মেঝেতে বসে পড়ল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করল। জাহানারা বেগম নিজের কানে শোনা কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজের ভাইয়ের এত জঘন্য রুপটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। জাহানারা বেগম ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলেন,
“ছোট ভাইজান, এতটা নিচে নামতে কী করে পারল? যাকে সবার সামনে নিজের মেয়ে বলে বেড়ায় তারেই সর্বনাশ করতে এত বড় একটা নোংরা কাজ করল? ছিহ! ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে। তুই ওই নোংরা মানুষগুলোকে ভয় পাচ্ছিস, তারা? তুই ওই নোংরা মানুষ গুলোর হুমকিতে এত বড় একটা অন্যায় চুপচাপ মেনে নিয়েছিস? ওই মানুষগুলোর জন্য কষ্ট পাচ্ছিস? চোখের জল ফেলছিস? একদম না। একদম কাঁদবিনা। একদম চোখের জল গুলো নষ্ট করবিনা। উঠ, এক্ষুনি।”
বলেই তিনি তারাকে দাঁড় করাল। দুই হাতে চোখের পানিগুলো মুছে দিতে দিতে বলল,
“একদম কাঁদবি না, মা। তোর ফুপ্পি আছে তো। তোর পাশে সবসময় থাকবে।”
তারা এবার জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে লাগল শব্দ করেই৷ নয়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। দৃষ্টিতে মেঝেতে সীমাবদ্ধ। কোনো শব্দ করছে না। কথা বলছে না। জাহানারা বেগম তারাকে নিয়ে ভেতরে গেল। সোফায় বসিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“পানিটা খেয়ে নাও। শান্ত হও একটু, মা। আর কান্না করে না।”
তারা শুনল। পানিটুকু ঢকঢক করে গিলে ফেলল। কোনোরকমে শান্ত করল নিজেকে। নয়ন ভেতরে এসে তারাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার রুমে আয় তো একটু। কথা আছে তোর সাথে।”
তারা জাহানারা বেগমের দিকে তাকাল। জাহানারা বেগম তারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমরা আছি তো। তুই চিন্তা করিস না। নয়ন, ডাকছে যা। আমি নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসছি। খেয়েছিলি কিছু?”
তারা মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘না’। জাহানারা বেগমের আদেশ পেয়ে তারা নয়নের রুমের দিকে যেতে লাগল। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। হার্ট বিট বড্ড ফাস্ট চলছে। নয়নের দরজার সামনে এসে রুমের ভেতর উঁকি দিতেই দেখল নয়ন বিছানায় বসে আছে। মুখটা দুই হাতে চেপে মাথা নিচু করে আছে।
“ওখানে দাঁড়িয়ে চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দেওয়ার জন্য তোকে ডাকা হয়নি।”
কথাটা তারার কানে যেতেই তারা ধড়ফড়িয়ে উঠল। মাথা নিচু করে ওড়নাটা হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে রুমে ঢুকল। নয়ন বলল,
“তোর তুই আজকাল ড্রেস রাস্তাঘাটে চেঞ্জ করস?”
”এটা কেমন কথা, নয়ন ভাই?”
“তাহলে তোর ড্রেস চেঞ্জ করাটা মানুষ ভিডিও করে কীভাবে?”
তারা দীর্ঘশ্বাস নিলো। শান্ত স্বরে বলল,
“আমার রুমে হিডেন ক্যামেরা লাগানো ছিল।”
এবার নয়ন মাথা তুলে তাকাল। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। তারা সে চোখে তাকিয়ে ভয় পেলো। নয়ন দাঁতে দাঁত চে’পে বলল,
“থা’প্পড় মে’রে তোর দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে, বে”দ্দপ।”
তারা সাথে সাথে গালে হাত দিয়ে বসে রইল। নয়নকে এত শান্ত স্বরে কথা বলতে দেখে অবাক হলো। নয়ন উঠে দাঁড়াল। কঠিন স্বরেই বলতে শুরু করল,
“কেমন মেয়ে তুই? তোর রুমে একজন ক্যামেরা লাগিয়ে তোর ভিডিও ধারণ করল আর তুই কিছু টের পেলি না? তোকে এক্সর্টা রুম কেন দেওয়া হয়েছে? তুই বড় হয়েছিস, আলাদা প্রাইভেসি আছে এই জন্যই তো?”
তারা চুপ করে আছে। কোনো উত্তর দিলো না। তারাকে চুপ করে থাকতে দেখে নয়নের রাগ বেড়ে গেলো। ধমক দিয়ে বলে উঠল,
“কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি?”
কথাটা খুব জোরে বলেছে নয়ন। তারা ভয় পেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল,
“কী বলব?”
নয়নের ইচ্ছে করছে তারার গালে কয়েকটা থা’প্পড় মা’রতে। নিজের রাগটা দুইভাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। জোরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিজে নিজেই বলে উঠল,
“শান্ত! শান্ত! শান্ত!”
তারপর একটা চেয়ার টেনে তারার মুখোমুখি হয়ে বসল। তারাকে উদ্দেশ্য করে শান্ত স্বরে বলল,
“যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার উত্তর দিবি চুপচাপ। বুঝতে পেরেছিস?”
তারা মাথা নাড়াল। নয়ন শান্ত কন্ঠেই প্রশ্ন করতে লাগল,
“তুই কী এখনো ছোট নাকি এডাল্ট?”
“আমি যথেষ্ট এডাল্ট।”
”বেশ! তোকে আলাদা রুম কেন দেওয়া হয়েছে?”
“আমার প্রাইভেসি মেইনটেইন করার জন্য।”
“বেশ! তাহলে তোর প্রাইভেসি মেইনটেইন করার জন্য কি রুমের দরজা সবসময় আনলক করে রাখা উচিত?”
“না। সবসময় তো আমি…।”
“আমি যা প্রশ্ন করব শুধু ওইটুকুর উত্তর দিবি।”
তারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। নয়ন প্রশ্ন করল,
“তুই কি সবসময় দরজা লক করে রাখিস?”
“না।”
“কেন?”
তারা চুপ করে রইল। উত্তর দিলো না। নয়ন রাগে সামনে থাকা ট্রি-টেবিলে হাত দিয়ে জোরে আঘাত করল। চ্যাঁচিয়ে বলল,
“এন্সার মি।”
তারা ভয়ার্ত স্বরে আমতা আমতা করে বলল,
“আমি বুঝতে পারিনি, নয়ন ভাই।”
নয়ন এবার রাগে দাঁড়িয়ে পড়ল। ট্রি-টেবিলটায় লা’থি মে’রে চিৎকার করে বলে উঠল,
“বুঝতে পারিনি, মাই ফুট। কী বুঝতে পারিসনি তুই? তোরেই কাজিন তোকে পছন্দ করে, ভালোবাসে এটা তুই জানতি না? এটা বুঝিস নি? সে কেমন এটা তো এটলিস্ট জানতি? সে তোর ক্ষতি করতে পারে এটাও তোর অজানা নয়। তাহলে নিজেকে সেফ রাখতে পারিস নি কেন? হুয়াই?”
তারা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। নয়ন একটু থেমে আবার বলতে লাগল,
“একটা ছেলে তোর রুমে গিয়ে ক্যামেরা সেট করে চলে আসল এটা তুই বুঝতে পারলি না। জানলি না। বেশ! মেনে নিলাম। একটা ছেলে তোর রুমে গিয়ে তোরেই বিছানায় সুয়ে পড়ল, তাও আবার তোকে জড়িয়ে ধরে। এটা কি মেনে নেওয়া সম্ভব?”
তারা চুপ করে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।।অপরাধ বোধে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো! আজকে যা হচ্ছে সব তারার বোকামির ফল। তারা যদি আগেই নয়নকে সব বলে দিতো তাহলে এত কিছু হতো না। কিন্তু ফাহিম যে নয়নকে নিয়েও হুমক দিয়েছিল, এই ভয়টাই তারা সবথেকে বেশি পেয়েছিল। নয়নকে হাজারবার বলতে গিয়েও বলা হয়ে উঠেনি। ফাহিম নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য সব করতে পারে। কয়েকদিন আগে তারাকে বিশ্বাস করানোর জন্য নয়নের একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট অব্দি করিয়েছিল। তাইতো তারা চুপ করে সব মেনে নিয়েছে। এই কথাটা যদি নয়ন জানে তাহলে শিওর তারাকে থা’প্পড় মা’রবে আরো কয়েকটা। তারা জানে নয়ন এসব কিছুকে পরোয়া করেনা। কখনো করবেও না। তারার জীবন টাতো এমন হওয়ার কথা ছিলো। আজকে সবার সাথে আনন্দে মেতে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু জীবনটা একদিনেই কেমন পালটে গেলো। সব এলোমেলো হয়ে গেলো। স্বপ্ন ভেঙে গেলো। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্ট যে তীব্র! তারা শব্দ করে কান্না করে উঠল। নয়ন কিছুটা ভড়কে গেলো। তারার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন, বলদ? ভয় পাচ্ছিস?”
তারা মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’। নয়ন এবার হাসল। তারার দুই গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,
“তোর নয়ন ভাই আছে না? একদম ভয় পাস না। কিছু হবে না বাবু। কান্না করিস না, সোনা। সব ঠিক করে দিব। সব কিছু আগের মতো করে দিব। তোর গায়ে যে কলঙ্ক লেগেছে তা আমি ভালোবাসা দিয়ে মুছে দিব। কান্না বন্ধ কর, তারু।”
এবার তারার আরো জোরে কান্না করে উঠল। কতদিন পর নয়নের মুখে ‘তারু’ ডাকটা শুনছে। গত কয়েকদিন ধরে ফাহিমের সাথে তারার বেশি মেলামেশার জন্য নয়ন অভিমানে তারার সাথে প্রায় কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। তারার ইচ্ছে করছে নয়নকে জড়িয়ে ধরে ‘ভালোবাসি’ বলতে। কিন্তু নয়ন যদি রেগে যায় এই ভয়ে চুপ করে রইল।।ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখল। নয়ন তারার মাথায় হাত রাখল। আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“কান্না অফ করতে বলেছি, তারু। প্লিজ কান্না করিস না। তোর কান্না যে আমার সহ্য হয়না।”
নয়নের কন্ঠে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেলো। তারা অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল নয়নের দিকে। নয়ন জিজ্ঞেস করল,
“কেন কাঁদছিস? সব ঠিক করে দিব, প্রমিস। কাঁদিস না, সোনা।”
তারা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ফাহিম ভাই আমার সাথে..।”
বলে আবার কান্না করে দিলো। নয়নের বুকটা ধক করে উঠল। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসল। যাকে ছোট থেকে এত যত্ন করে বড় করল। যত্ন করে নিজের বুকে রাখল। সেই তারাকে অন্য কেউ ছুঁয়েছে। তবে কী ফাহিম তারার সাথে আরো খারাপ কিছু করেছে…?

#চলবে