চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২৩+২৪

0
312

#চিত্রলেখার_কাব্য
ত্রয়োবিংশ_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা বেশ অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে নওশাদকে কল করলো। নওশাদ তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো না। একটু বাদে নওশাদ নিজেই কল ব্যাক করলো অপর্ণাকে।

-অপর্ণা?

-জ্বী। তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে। তুমি আমার অফিসে এসে দেখা করতে পারবে?

-আজকেই?

-তোমার সুবিধামতো সময়ে আসলেই হবে। আজকে তো তোমার দেবর জেল থেকে ফিরেছে, আজ থাক। তুমি দিন দুয়েকের মাঝে দেখা করো।

-আচ্ছা কিন্তু কী বিষয়ে কথা বলতে চান?

-অবশ্যই তোমার লাভের বিষয়ে। এখন রাখো, আমি একটু ব্যস্ত আছি।

-আচ্ছা।

অপর্ণা ফোন রেখে গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলো। এর মধ্যেই অর্ণব এসে বসলো পাশে।

-রূপসা আর রাদিফকে নিয়ে আসবো কবে? এখন তো বাড়িতে সব ঠিক আছে।

-কী ঠিক আছে? আশেপাশের মানুষ এখনো কেমন করে তাকাবে! আমার বাচ্চারা ভয় পাবে।

-আমার কথার বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা সবসময় করবে না অপর্ণা। যেটা বলেছি ঐটা করবে।

-তুমি আমাকে ধমকানোর সাহস কী করে পেলে? আমি আজকেই চলে যাবো বাড়ি ছেড়ে।

-দ্বিতীয়বার এই কথা বললে আমি নিজেই সসম্মানে তালাক দিয়ে রেখে আসবো। তোমার রাগটা লেখার উপর ঝেরেছি বলে ভেবো না তোমাকে কিছু বলবো না। তোমাকে যখন আনতে পেরেছি ঠিক সেভাবেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসবো।

অপর্ণা চুপ হয়ে গেল। অর্ণবের অগ্নিচক্ষু তাকে এক মুহূর্তে নীরব করে দিল। বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না সে। অর্ণব তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অপর্ণার বাঁকা কথাগুলো অর্ণব আর কোনোভাবেই নিতে পারছে না। সহ্যসীমা তার অবশিষ্ট নেই আর। অপর্ণাও বুঝতে পেরেছে অর্ণব মারাত্মক রেগে আছে তবুও তার জেদ কমলো না। সে ভাবলো এ রাগের কারণ চিত্রলেখা! রাগটা আবারো চিত্রলেখার উপর গিয়েই পড়লো।

____________

চিত্রলেখাকে রান্নাঘরে দেখে ভ্রু কুঁচকালো সাথী। মেয়েটার উপর কাজ চাপিয়ে অপর্ণা আবারো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে নির্ঘাত!

-তুই কেন কাজ করছিস এখন? উনি কাজ চাপিয়ে পালিয়েছে?

-বাদ দাও তো ভাবী।

-আর কত বাদ দিবি তুই? তোর মধ্যে একটুও রাগ জেদ জাগে না?

-আল্লাহর উপর ছেড়ে দিছি ভাবী, বিচারের মালিক তো তিনিই। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।

-ধৈর্য রাখা ভালো তবে অন্যায় মুখ বুঁজে মেনে নেওয়া নয়। দিনরাত ও তোকে অপমান করে, তোর কি একটুও প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করেনা?

-করেছিলাম তো ভাবী, দেখলে তো ভাইয়া কেমন ব্যবহার করলো। এখন প্রতিবাদ কথায় করবো না, কাজেই প্রতিবাদ করবো।

-মানে?

-বুঝতে পারবে ভাবী, ধৈর্য রাখো।

চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি লক্ষ করলো সাথী কিন্তু বুঝে উঠতে পারলো না সে কী করতে চাইছে। চিত্রলেখা রান্না শেষ করলো। পেঁয়াজু ভেজেছে সে। অপর্ণার ঘরে পেঁয়াজুর বাটি রাখতে গেল সে। অপর্ণা তখনো রেগে ছিল। চিত্রলেখাকে দেখে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো তবে অকস্মাৎ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চিত্রলেখা বাটি রেখে চলে গেল। অপর্ণা কেবল রক্তচক্ষু মেলে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। চিত্রলেখাকে এত সহজে সে ছাড়বে না তা স্পষ্ট বয়ান হলো তার চাহনি দ্বারা।

_______________

চিত্রলেখা ঘরে এসে বইখাতা গোছাতে শুরু করলো। হোস্টেলে যাওয়ার সময় সন্নিকটে তার। এতদিন অনিকের আসার অপেক্ষায় ছিল। এখন সব যখন ঠিকই হয়েছে, তখন আবার হোস্টেলে ফিরতে পারে সে। ওখানে চাইলেও অপর্ণা তাকে বিরক্ত করতে পারবে না। চিত্রলেখাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে অনিক ঢুকলো তার রুমে। অনিককে দেখে খানিকটা বিস্মিত হলো সে। অনিক সচরাচর যেচে তার সাথে কথা বলতে আসে না অথচ আজ এসেছে! কৃতজ্ঞতাবোধ নাকি দায়িত্ববোধের জন্ম?

-কোথায় যাচ্ছিস তুই?

-হোস্টেলে ভাইয়া। অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে, এখন হোস্টেলে থেকে দিনরাত পড়েই কভার করতে হবে।

-বাসায় কী অসুবিধা?

-সবসময় বাচ্চারা থাকে, ওদের রেখে আমার পড়তে বসতে মন চায় না।

-হোস্টেলের রুমমেট কী রকম? সমস্যা করে? তোর সাথে ভালো ব্যবহার করে?

-কোনো সমস্যা হয়না ভাইয়া।

-আচ্ছা আমিই রেখে আসবো কাল তোকে।

চিত্রলেখা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অনিক আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল। চিত্রলেখা মুচকি হাসলো। সময়ের পরিক্রমায় চরিত্রগুলোর বিপরীত রূপ তার সামনে আসছে, কেবল সবসময় সাথী ভাবীকেই পাশে পেয়েছে সে। মানুষটাকে চিত্রলেখা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে শুধুমাত্র তার ব্যবহার এবং ভালোবাসার জন্য। অপর্ণার অত্যাচারের মাঝে খানিকক্ষণের প্রশান্তি হয়ে আছে সাথীর আদর-স্নেহ। এসব না থাকলে হয়তো সে অনেক আগেই মরে যেত অনাদরে।

_________________

রাতের জার্নি সচরাচর সহ্য না হলেও সিয়ামের কিছু করার নেই। চাচার শরীর খারাপ, এমতাবস্থায় নিজের কমফোর্ট নিয়ে ভাবার অবকাশ তার নেই। আর বোধহয় দেড় ঘণ্টার মতো লাগবে পৌঁছাতে। সিয়াম আগামীকাল যাবে ভেবেছিল কিন্তু আজ আচমকা চাচার শরীর বেশি খারাপ হওয়াতে লাস্ট বাসটার টিকিট সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে সেটাতেই চড়ে বসেছে সে।

ঘণ্টা দেড়েক পর বাস থেকে নেমে সোজা হাসপাতালের উদ্দেশ্যেই রওনা দিল সে। তার চাচাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সন্ধ্যা নাগাদ। হার্ট এটাকের আশঙ্কা সন্দেহে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিয়ামের সেখানে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না। হাসপাতালের কেবিনের একপাশের চেয়ারে সুবহা বসে কাঁদছে, অন্যপাশে তার চাচী বিলাপ করছে। সিয়াম কার কাছে কী সান্তনা দিবে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। সিয়ামকে দেখামাত্র সুবহার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। সিয়ামের বুকের কাছাকাছি আশ্রয় নিয়ে সে আর্তনাদ করতে লাগলো।

-ভাইয়া, আমার বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো? আমার বাবা কেন এমন করছে? ভাইয়া বাবার কিছু হবে না তো?

-তুই একদম চিন্তা করিস না। বোস এখানে চুপচাপ, কিচ্ছু হবেনা চাচ্চুর।

সুবহাকে বসিয়ে সিয়াম তার চাচীর পাশে বসলো। তিনিও চিৎকার করে আর্তনাদ করে উঠলেন। সিয়াম তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।

-চাচী, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। চাচ্চুর কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।

-বাবা, ভালো মানুষ খাইতে বসছিল। কিসের না কিসের কল আসলো, কথা বলার পর থেকেই মানুষটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো! আল্লাহ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা কেন নিতেছে রে বাবা! লোকটারে কেন এত কষ্ট দিচ্ছে?

-শান্ত হোন চাচী, সব ঠিক হয়ে যাবে।

সিয়ামের মনেও ভয় খেলা করছে। এই চাচ্চুই তাকে দীর্ঘতম ধরে লালন পালন করেছেন। বলতে গেলে বাবার মতো ছায়া হয়ে ছিলেন সবসময়। সিয়ামের আদর্শ, নৈতিকতা সবই তার এ চাচ্চুর গড়ে দেওয়া। আজ সেই মানুষটাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে সিয়ামের ভেতরটাও দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। ডাক্তাররা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছেন তবুও সিয়ামের মনের ভয় একটুও কমছে না।

ঘণ্টাখানেক পর তার চাচা শাহজাহান আলীর জ্ঞান ফিরলো। ডাক্তাররা যেকোনো একজনকে দেখা করার অনুমতি দিলেন। সিয়ামের চাচী ভেতরে যেতে চাইলো কিন্তু ডাক্তার বললেন তিনি বেশ কয়েকবার ‘সিয়াম’ নাম ধরে ডাকছিলেন। শেষমেশ সিয়ামই গেল তার চাচ্চুর সাথে দেখা করতে।

শাহজাহান আলীর শক্ত সামর্থ শরীরটা মুহুর্তেই রোগা হয়ে গেছে যেন। যমে মানুষে টানাটানির পর যে কঙ্কালসার অবশিষ্ট রয়েছে তা চোখে দেখেও সিয়ামের বুক চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। বেডের পাশে থাকা ছোট টুল সিস্টেম জায়গাটাতে বসলো সে। চোখ পিটপিট করে শাহজাহান আলী সিয়ামের উপস্থিতি দেখলেন।

-সিয়াম এসেছো তুমি?

-জ্বী চাচ্চু, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। ডাক্তার বলেছেন আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন।

-আ..আমার তো..তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ক..কিছু কথা আছে সিয়াম। আমি যদি তোমার লালন পালনে কোনো অবহেলা না করে থাকি, আমি আশা করি তুমি আমার কথা রাখবে।

-কী কথা চাচ্চু?

-তোমার আগামী সপ্তাহের আগেই সুবহাকে বিয়ে করতে হবে।

সিয়ামের মনে হলো তার পায়ের নিচের জমিন যেন কেঁপে উঠলো। এ কেমন অদ্ভুত শর্তের মুখোমুখি তাকে করা হলো? সুবহাকে সে সর্বদা বোনের নজরে দেখে এসেছে। চিত্রলেখার জন্য তার অনুভূতিও মিথ্যে নয়। তবে কী করে অন্য একজনকে সে বিয়ে করে ফেলতে পারে?

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
চতুর্বিংশ_পর্ব
~মিহি

সিয়াম একমনে বসে আছে। কিছু বলার কিংবা কাউকে কিছু জানানোর ক্ষমতা তার নেই, বিশেষ করে সুবহাকে। শাহজাহান আলীকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। আপাতত তার সাথে সকাল অবধি কাউকে দেখা করতে দেওয়া হবে না। সিয়ামের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আচমকা তার চাচা এমন সিদ্ধান্ত কেন নিতে চাইছেন বুঝে উঠতে পারলো না সে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিয়াম বুঝতে পারলো তার উচিত তার চাচী এবং সুবহাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসা। এভাবে সারারাত এখানে বসিয়ে রাখা উচিত না তাদের।

-চাচী, রাত তো অনেক হচ্ছে। আমি আছি এখানে, সুবহা আর আপনাকে পৌঁছি দিয়ে আসি?

-না সিয়াম। আমি এখান থেকে সরবো না। আমি আছি, তুমি সুবহাকে দয়া করে রেখে এসো।

-কিন্তু চাচী।

-ওর জেগে থাকার অভ্যেস নেই, মাইগ্রেন বাড়বে। ওকে রেখে আসো তুমি।

সিয়াম না করতে পারলো না কিন্তু সুবহার আশেপাশে থাকতেও তার ইচ্ছে করছে না। অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে পড়েছে সে। চাচীকে নিষেধও করতে পারলো না সে। সুবহা হ্যাঁ না কিছু বললো না। সে মূর্তির ন্যায় হয়ে আছে। কান্নাও করছে না। সুবহার এ নীরবতা ভয়ঙ্কর লাগছে সিয়ামের কাছে।

সুবহা বাড়িতে ঢোকামাত্র যথারীতি নিজের ঘরে ঢুকলো চুপচাপ। সিয়াম ভাবলো সে হয়তো ঘুমোনোর জন্য গেছে। চাচীকে কল দিল সে।

-চাচী, আমি সুবহাকে পৌঁছে দিয়েছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি অল্প সময়ের মধ্যেই আসছি।

-সুবহা একা ভয় করতে পারে, তুমি ওখানেই থাকো সিয়াম। ভোরে চলে এসো বাবা। আমার সমস্যা হবে না।

সিয়াম আবারো অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। পৃথিবীর সব সূত্র কি আজ তার বিপক্ষে? যাই হোক, সে আপাতত এসব ভাববেই না। পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিংয়ে আসতেই সিয়াম দেখলো সুবহার ঘরের আলো এখনো জ্বালানো। তার মানে কি সে এখনো ঘুমায়নি? সিয়াম সুবহার ঘরের দিকে এগোল। ঘরের দরজায় আসতেই অবাক হলো সিয়াম। সুবহা একদম পাথরের ন্যায় মেঝেতে বসে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে আছে। চোখ নির্জীব, ঠোঁট খানিকটা কাঁপছে। সিয়ামের ভয় বাড়লো। মেয়েটা কি বড়সড় শকের মধ্যে আছে এখনো। সিয়াম সুবহার পাশে বসে সুবহার কাঁধে হাত রাখলো।

-চাচ্চুর কিছু হবেনা, সুবহা। চিন্তা করিস না তুই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

-বাবা ঠিক হবে? আবার আগের মতো?

-হুম, একদম ঠিক হয়ে যাবে চাচ্চু।

-আমার জন্য সব হয়েছে। সব আমার দোষ ভাইয়া, সব আমার দোষ।

চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সুবহা। সিয়াম আলতো করে সুবহার মাথায় হাত রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। সুবহা কোনোক্রমেই থামতে চাইলো না। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠতে শুরু করলো তার। সিয়াম আলতো করে সুবহাকে ধরে বিছানায় বসালো।

-সুবহা, শান্ত হ। তুই না চাচ্চুর স্ট্রং মেয়ে? তুই এতটা ভেঙে পড়ছিস? নিজেকে স্বাভাবিক কর। তোকে শক্ত থাকতে হবে। এখন চুপচাপ ঘুমা, সকালে উঠে দেখতে যেতে হবে না?

-হু।

সুবহার কান্নার গতি কমলো। বিছানায় হেলান দিল সে। সুবহার গায়ে কাঁথা দিয়ে আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিল সিয়াম। সুবহা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করলো। লাইট অফ করে নিজের ঘরের দিকে এগোলো সে। আচমকা সিয়ামের মাথায় একটা কথা খেলতে লাগলো, সুবহা কেন বললো সব দোষ ওর? কিছু কি হয়েছে? প্রশ্নটা মাথায় আসলেও সিয়াম ভাবলো সুবহা শোকে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাই নিজেকে দোষ দিচ্ছে। এটা মনুষ্য স্বভাব। কাছের মানুষজনের বিপদ হলে মানুষ নিজের ছোট ছোট কাজগুলোর দোষ দিতে থাকে সেই বিপদের কারণ হিসেবে। সুবহাও তার ব্যতিক্রম নয়। সিয়ামের ঘুম হলো না। চাচার বলা কথায় সে চিন্তিত। এত বছরে এমন কোনো বিষয় ঘটেনি যার জন্য তার চাচা তাকে এমন শর্ত দিতে পারে! নির্ঘুম, চিন্তিত রাত কাটলো সিয়ামের ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।

___________________

অনিক চিত্রলেখাকে বেশ সকালেই হোস্টেলে রেখে গেছে। অনিক বাড়তি কথা না বললেও চিত্রলেখার প্রতি অনিকের সামান্য হলেও স্নেহ অনুভব করতে পেরেছে চিত্রলেখা। নিজের ভাগ্যের উপর করুণা হচ্ছে তার। এক ভাই ভালোবাসে তো আরেক ভাই মুখ ফিরিয়ে নেয় অথচ সে তো চাইতো দুই ভাইয়ের নয়নের মণি হয়ে থাকতে। এ আশা বোধহয় তার কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কলেজের ক্লাস বারোটায়। চিত্রলেখা বেশ তাড়াহুড়ো করেই ক্লাসে গেল। আশেপাশে সুবহাকে খুঁজলো, না আসেনি মেয়েটা। সুবহাকে ছাড়া ক্লাসে চিত্রলেখার নিজেকে এতিম মনে হয়। একটাই বন্ধু তার, সেও আসেনি। আগের ক্লাসগুলোও মিস করেছে চিত্রলেখা। কেইস চলার কয়েকদিন সে কলেজে আসেনি, সুবহাকে জানানোও হয়নি এসব ঘটনা। এখন জানালেও রাগ করবে। চিত্রলেখা ঠিক করলো কলেজের পর সুবহার বাড়িতে গিয়ে দেখা করবে আর নোটগুলোও নিয়ে আসবে। দুইটার পর আর ক্লাস হলো না। কলেজ থেকে বেরিয়েই সুবহাকে কল করলো সে।

-সুবহা কই তুই? বাসায় আছিস? আমি আসবো একটু তোর ওখানে।

-লেখা…

-তোর কণ্ঠ এরকম কেন? কী হয়েছে তোর?

-লেখা বাবা..হা..হাসপাতালে।

-আঙ্কেলের কী হয়েছে? তুই কোন হাসপাতালে? আমি আসছি দাঁড়া।

-সেন্ট্রাল হাসপাতাল।

-আচ্ছা তুই নিজেকে সামলা, আমি এসে সব শুনবো।

চিত্রলেখা কল রেখে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হলো। সুবহা এমন সমস্যায় আছে কল্পনাও করেনি সে। না জানি আঙ্কেলের কী হয়েছে! অবশ্যই সিরিয়াস কিছু বোধহয়। চিত্রলেখার মনটাও বিমর্ষ হয়ে উঠলো। সুবহার বাবা তাকে নিজ মেয়ের মতোই দেখতেন। তার অসুস্থতা চিত্রলেখাকেও পীড়িত করছে।

হাসপাতালে আসতে মিনিট পনেরো লাগলো। চিত্রলেখা হাসপাতালে ঢুকে রিসেপশনে থাকা মহিলার থাকা কেবিন নম্বরের খোঁজ নিল। হার্টের ওয়ার্ডে! খানিকটা ভয় পেল চিত্রলেখা। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগোলো।

চিত্রলেখাকে দেখেই সুবহা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কান্নাগুলো আবারো বাঁধ মানলো না তার। চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারলো না কী ফলে সুবহাকে শান্ত করবে। বাবার ভালোবাসা সে পায়নি তবুও লোকটার মৃত্যুতে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল সেখানে মেয়েটার সবচেয়ে কাছের মানুষ তার বাবা আর সেই বাবাই এখন এ অবস্থায় আছে! চিত্রলেখা সুবহাকে ছাড়ালো না, কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকুক তাতে যদি যন্ত্রণা কিছুটা কমে।

দুপুরের দিকে সুবহার মাকে এলাও করা হলো। শাহজাহান আলীর জ্ঞান আছে তখন, তিনিই দেখা করতে চেয়েছেন। চোখের পানি মুছে সুবহার মা রেহানা সুলতানা কেবিনে ঢুকলো। নিজের স্বামীর শরীরের দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে উঠে তার। অসুস্থতা যেন তাকে কাবু করে ফেলেছে। শাহজাহান আলী বেশ কষ্টেই একটু কথা বলার চেষ্টা করলেন।

-রেহানা, তো..তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে। তুমি একটু শোনো আমার কথা।

-বলো আমি শুনছি।

-তোমার দুর্জয়ের কথা মনে আ..আছে?

-এমপির ভাইপো? যার উপর তুমি তোমার এক ছাত্রকে খুন করার সাক্ষী দিয়েছিলে?

-হ্যাঁ, সে আগামী মাসে ছাড়া পাচ্ছে। ওর লোক আমাকে কল করেছিল, এতদিন নাকি দুর্জয়ের জেল থেকে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সুবহার উপর নজর ওদের।

-সুবহা? ওরা সুবহার ক্ষতি করতে চায়?

-ওরা সুবহাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো চেষ্টা বাকি রাখবে না। আমি চাই সুবহাকে সিয়াম বিয়ে করে রাজশাহী নিয়ে যাক। দুর্জয়ের নাগালের বাইরে নিয়ে যাক।

-সিয়াম কি রাজি হবে?

-সিয়ামকে বোঝাও রেহানা, ও যেন আমার মেয়ের ক্ষতি হতে না দেয়। সুবহার অন্য কোথাও বিয়ে হলে আমার দুশ্চিন্তা থাকবেই তবে সিয়ামের কাছে সে নিরাপদ। ও…ওকে..বো…বোঝাও …

-তুমি শান্ত হও, শান্ত হও তুমি।

শাহজাহান আলীর হৃদস্পন্দন দ্রুত চলতে লাগলো। রেহানা বেগম চেঁচিয়ে ডাক্তার-নার্সকে ডাকলেন। পরিস্থিতি ক্রমাগত হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। রেহানা সুলতানা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সুবহা আবারো পাথরের ন্যায় হয়ে পড়লো। সিয়াম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখার দিকে তাকানোর সাহস সে পাচ্ছে না আর না পারছে সুবহার আশেপাশেও থাকতে। এ কেমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে বাঁধা পড়েছে সে?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে