Monday, July 14, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 360



অবেলার বকুল পর্ব-১৪

0

#ধারাবাহিক
#অবেলার বকুল
পর্ব-চৌদ্দ
মাহবুবা বিথী

—দরজাটা বন্ধ করে নিলেই পারতে?
—-না,মানে। তুই এই মুহুর্তে এখানে কেন? তোর কোনো কান্ডজ্ঞান নাই? বিবাহিত মানুষের ঘরে ঢুকতে হলে নক করে ঢুকতে হয় এই কমনসেন্সটুকু অন্তত তোর থাকা উচিত ছিলো।
—তোমাকে দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছো। কে জানতো, তুমি জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে এই কাহিনী রচনা করবে? বৌয়ের মন গলাতে অজ্ঞান হয়ে যাবার ভান করেছিলে নাকি সত্যি জ্ঞান হারিয়েছিলে আমার এখন সন্দেহ হয়?
কথাগুলো বলে সায়ান মিটমিট করে হাসতে লাগলো।
—-তুই তো আচ্ছা বেয়াদব হয়েছিস?
—-না,সায়ান তোমার ভাই সত্যিই অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলো।
—-বুঝতে পারছি,আমে দুধে তোমরা এখন মিশে গিয়েছো। তবে ভাইয়া তুমি আমাকে বেয়াদব বলো বা আরো কিছু গালিগালাজ করো তাতে কোনো সমস্যা নেই, অসুস্থ অবস্থায় এতো তেল তোমার কোথা থেকে আসে বুঝে পাই না।
—আমাকে আর বলতে হবে না। তোমার বেলায় দেখবো, তুমি কি করো?
—মনে হয় না,তোমার মতো এতো তেল আমার থাকবে। যাইহোক এই ওষুধগুলো টেবিলে রাখলাম। সময়মতো খেয়ে নিও। আমার আবার কোচিং এ যেতে হবে।
সায়ান চলে যাবার পর আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-সায়ানটা পাজী আছে। ঘরে ঢুকে কাশি দিলো। আসলে ওর চুলকানি আছে তাই বিনা পয়সায় নাটক দেখতে এই কাহিনী রচনা করেছে।
আয়ান হঠাৎ খেয়াল করলো,বকুল ওর দিকে তাকাতে পারছে না। বকুলের লজ্জা মাখানো রক্তিম মুখটা দেখতে আয়ানের ভীষণ ভালো লাগছে। আয়ান বকুলের হাতটা ধরে নিজের কাছে টেনে এনে কানের লতিতে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—-আজ এপর্যন্ত থাক। বাকীটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকলো।
আয়ানের মুখে একথা শুনে বকুল লজ্জাবতী লতার মতো লাজে কুঁকড়ে গেল। ওর লাজ রাঙ্গা মুখটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে আয়ান বললো,
—-আর লজ্জা পেতে হবে না। আমার খিদে পেয়েছে। নীচে গিয়ে আম্মুর কাছ থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসো।
বকুল আয়ানের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
রাহেলা বেগম কিচেনে আয়ানের জন্য সুপ আর আপেলের জুস রেডী করছেন। বকুলকে দেখে বললেন,
—-তুই যখন এসে পড়েছিস খাবারটা নিয়ে উপরে চলে যা।
—-উনার নাকি খুব খিদে পেয়েছে। এখুনি নিয়ে যাচ্ছি।

ওদিকে আয়ানের মনে হচ্ছে বুকের উপর অনেক দিনের চেপে থাকা ব্যথার বোঝাটা যেন আজ নেমে গেল। বকুলকে ওর প্রথম থেকেই ভালো লেগেছে। যদিও ওর মাঝে অল্প বয়সী চপলতাটুকু ভালোই আছে। বকুলের বয়সটা কম হওয়াতে প্রথমে আয়ানের ওর সাথে অ্যাডজাস্ট করতে একটু সমস্যা হচ্ছিলো। আসলে একদম অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে ঘনিষ্ট আচরণ করতে একটু সংকোচ লাগে। যতই স্বামী স্ত্রীর বন্ধনে বাঁধা হোক না কেন? অথচ আগের যুগে সম্পূর্ন অপরিচিত দুটো মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো। সাথে সাথে দাম্পত্য জীবনও শুরু হয়ে যেতো। যাক সবাই তো একরকম নয়।
আয়ানের মনের পর্দায় আবারও জেসিকার মুখটা ভেসে উঠলো। ছয় বছরের প্রেম আর দু,বছরের সংসার জীবনও পারেনি জেসিকাকে আটকে রাখতে সেখানে একদম অপরিচিত বকুল ওকে আর কতটুকু ভালোবাসবে? কিন্তু আয়ান বকুলের চোখে ওর প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টি দেখেছে। আয়ানেরও ইচ্ছে হয় বকুলকে ভালোবাসতে। তাই আজ দু,জনের মাঝে দুরত্বের প্রাচীরটা আয়ান নিজ হাতে ভেঙ্গে দিলো। নিজেকে খুব হালকা লাগছে। বকুল নামক এক মাদকতায় আয়ানের চারপাশটা ভরে আছে। এ যেন বকুল ফুলের ঘ্রাণ।
আয়ান বারান্দায় গিয়ে রকিং চেয়ারটায় বসে হালকা দোল খেতে লাগলো। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। বারান্দায় টবে লাগানো শিউলি গাছটা থেকে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। বকুল রুমে এসে টেবিলের উপর খাবারটা রেখে আয়ানকে খুঁজতে লাগলো। বারান্দায় উঁকি মেরে দেখে আয়ান বসে আছে। বকুল কাছে এসে বললো,
—-আবারও বারান্দায় এসে বসেছেন?
আয়ান মুচকি হেসে বললো,
—বারান্দায় বসলে সমস্যা কি?
—-সকালে জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে যাবার পরও আপনার শিক্ষা হয়নি?
—-সায়ান কি বললো শোনোনি? আমি নাকি বউয়ের আদর খাওয়ার জন্য অজ্ঞান হবার ভান ধরেছি?
—আমি কি করে জানবো? আপনার মনের ভিতর কি চলছে? এখন খেতে আসেন।
বকুল রুমে এসে সুপের বাটিটি হাতে দিয়ে বললো,
—-চট জলদি খেয়ে নিন,ওষুধ খেতে হবে।
—আমার হাতে ব্যথা,
—এই চেয়ারটায় বসুন,আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
আয়ান চেয়ারটায় বসার পর বকুল চামচ দিয়ে ওর মুখে সুপ তুলে দিতে লাগলো। আয়ান এক দৃষ্টিতে বকুলের লজ্জারাঙ্গা মুখটির পানে তাকিয়ে থাকলো আর একটু একটু করে খেতে লাগলো। একটু আগে বকুলের জীবনে যা ঘটলো তাতেই ও লজ্জায় নুয়ে পড়েছে তারউপর আয়ানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বকুল মাথা নিচু করে বললো,
—-আপনি এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি খাওয়াতে পারবো না। আপনার খাবার আপনি খেয়ে নিবেন।
—-আমিও খাবো না।
—-মা কিন্তু মন খারাপ করবে? আপনার শরীর দুর্বল দেখে মা কষ্ট করে সাত সকালে খাবারগুলো রেডী করেছে।
— মায়ের মন খারাপ করবে সেটা আমি জানি কিন্তু আর কারো মন খারাপ হবে কিনা সেটা জানতে বড্ড ইচ্ছে হয়।
—-সেটা আপনি বুঝে নিন। এখন বড় বড় হা করে খুব দ্রুত সুপটা খেয়ে নিন।
—খাওয়া শেষ হলেই তো তুমি নিচে চলে যাবে। তোমাকে আটকে রাখার এটা একটা আমার বাহানা সেটা কি বুঝো না?
—-এখন বুঝেও লাভ হবে না। আমাকে নিচে যেতে হবে। আর আপনারও রাতে ঘুম হয়নি। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আয়ানের খাওয়া শেষ হলে বকুল এঁটো বাসনগুলো ট্রের মধ্যে গুছিয়ে নিতে লাগলো। হঠাৎ বকুল পিছন দিক থেকে এক বলিষ্ট হাতের জড়িয়ে ধরার স্পর্শ অনুভব করলো। এযে আয়ান ছাড়া কেউ নয় তা বকুল স্পষ্ট বুঝতে পারছে। এই মুহুর্তে এই ঘরে ও আর আয়ান ছাড়া কেউ নাই। আয়ান বকুলের ঘাড়ে মুখটা ঘষে আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
—-তুমি আমাকে ছেড়ে কোনোদিন চলে যাবে নাতো?তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে আমি আর বাঁচতে পারবো না।
বকুল আয়ানের বাঁধন থেকে নিজেকে আলগা করে নিয়ে বলে,
— প্রথমত এই পৃথিবীতে কারো জন্য কেউ বাঁচতে পারবে না। কথাটা ঠিক নয়। আল্লাহপাক যার হায়াত যতদিন রেখেছে তাকে ততদিনই বাঁচতে হবে। সময়ের সাথে মানুষ নিজেকে ঠিক সামলে নেয়।
—তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তরটা কৌশলে এড়িয়ে গেলে।
—-এখানে এড়িয়ে যাওয়ার কিছু নেই। কিছু কিছু ভাষা বুঝে নিতে হয়। এখন এতো বকবক না করে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আয়ানের মোবাইলটা টুং করে শব্দ হলো। মনে হলো কেউ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। মোবাইলের দিকে তাকানো মাত্রই আয়ানের মুখের মানচিত্র বদলে গেল। ভুরুটা কুঁচকে বকুলকে বললো,
—-আমি সময়মতো ওষুধ খেয়ে নিবো। তুমি নিচে চলে যাও।
হঠাৎ আয়ানের মুড চেইঞ্জ দেখে বকুলের কেন যেন মনে হলো জেসিকা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। একটু আগের আয়ান আর এই আয়ানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। বকুল এঁটো বাটিগুলো নিয়ে নীচে চলে গেল। এরপর ও দীর্ঘসময় উপরে যায়নি। আয়ানের উপর খুব অভিমান হয়েছিলো।দুপুরের খাবার রাহেলা বেগম নিয়ে গিয়েছিলো। আয়ানকে খাইয়ে দিয়ে নিচে চলে এসেছে। খাবার টেবিলে বকুল সায়ানের কাছে শুনেছিলো,ঢাকা ভার্সিটিতে সার্কুলার হয়েছে। দ্রুত পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। এখন পড়াশোনা ছাড়া আর কোনোদিকে মাথা ঘামানোর মতো সময় বকুলের হাতে নেই। রাতে আয়ানের রুমে ডিনার পৌঁছে দিয়ে পড়ার ছুঁতোয় আয়ানের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আয়ানও ভাবে, পরীক্ষা সামনে তাই হয়তো বকুল চলে গেছে।
আসল কথা হলো আয়ানের উপর বকুলের অভিমান হয়েছে। যাইহোক পরীক্ষা সামনে তাই বকুল পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো বিষয় নিজের ভাবনায় আনতে চায় না।
আয়ান সুস্থ হয়ে অফিস শুরু করলো। বকুলেরও পড়াশেনার চাপ দিনদিন বাড়তে লাগলো। এদিকে রাতে পড়তে বসে বকুল বুঝতে পারে আয়ান কার সাথে যেন কথা বলে। কেন যেন বকুলের মনে হয় আয়ান জেসিকার সাথে কথা বলে। সন্দেহ দূর করতে একদিন রাতে বকুল চুপি চুপি আয়ানের ঘরে ঢুকে মোবাইলটা চেক করে। এবং ওর সন্দেহটা সঠিক হয়। আয়ান জেসিকার সাথে রাতে চ্যাট করে। তবে ম্যাসেজগুলো সব ডিলিট করা। বকুল প্রচন্ড কষ্ট পায়। মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে বকুল পড়াশোনার ভিতর নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। এদিকে আয়ান বকুলকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার জন্য পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-১৩

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-তেরো
মাহবুবা বিথী

অভিমানে বকুলের দু,চোখ বেয়ে বরষার বারিষধারা গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। আর মনে মনে আয়ানকে বললো,”আপনি তো আমাকে ভালোবাসতে পারলেন না। অথচ আমি যে ভালােবাসার চোরা স্রোতে ভেসে গেলাম। এখন এখান থেকে আমার পরিত্রাণের উপায় কি? অথচ আপনি আজও জেসিকাকে ভুলতে পারেননি। তাহলে শুধুমাত্র নিজের মায়ের কথায় আমাকে বিয়ে করা আপনার উচিত হয়নি।”
বকুল নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করলো। আসলে যার কপালে মায়ের ভালোবাসা জোটে না সে পৃথিবীর কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্য হয়ে উঠে না। বকুল রাতে ডিনার না করেই শুয়ে পড়লো। ওদিকে আয়ান ও ডিনার করলো না। বকুলকে ভালোবাসতে ওর খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু দুরুত্বের দেয়ালটুকু তো ও নিজ হাতে তুলে দিয়েছে। সেটা ভেঙ্গে দিয়ে এই মুহুর্তে বকুলের কাছাকাছি আসতে ওর আত্মসম্মানে বাঁধছে। এদিকে এতোদিনপর জেসিকার ফোন ওকে অস্বস্তিতে ফেলছে। আয়ান নিজেও অবাক হয়েছে যে ও এখন ওর মোবাইলে জেসিকার নাম্বার সেভ করে রেখেছে। বকুল তো মনে হয় জেসিকার ব্যাপারটা জানে। কে,জানে এবার হয়তো দুরত্বটা আর একটু বাড়বে।আয়ান নিজ থেকেই এখন দুরত্বের দেয়ালটা ভাঙ্গতে চাইছে। কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। এসব নানা ভাবনায় বারান্দায় রকিংচেয়ারটায় বসে থেকে রাতটা পার করে দিলো। বকুল রুমে থেকেই বুঝতে পারছে আয়ান সারারাত বারান্দায় বসে ছিলো। ও রুমে নিকোটিনের গন্ধ অনুভব করছে। কারণ দুটোরুমের সাথেই বারান্দার সংযোগ আছে। আর আজই তাপমাত্রা ফল করলো। যদিও এতোদিন শীত অনুভূত হয়নি কিন্তু আজ যেন ভালোই শীত পড়েছে। ঠান্ডায় এভাবে খোলা বারান্দায় বসে থাকলে জ্বর হতে পারে। এই কারনে আয়ানকে রুমের ভিতরে চলে আসার জন্য বকুলের বলবার ইচ্ছে হল। পরক্ষণে অভিমানের আগুনে পুড়ে যাওয়া মনটা নিজেকে প্রবোদ দিলো। যার অন্তরে ওর জায়গা হয়নি তার জন্য এতো ভেবে লাভ কি? ভোরের দিকে বকুলের চোখ দুটো লেগে আসছে।
রাহেলা বেগম ডিনার করার জন্য আয়ান আর বকুলকে ডেকেছিলো। দুটোর কেউ খেতে না আসাতে উনারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। উনি নিজেও কিছু মুখে তুলতে পারলেন। কে,জানে,উনার এই সিদ্ধান্তের কারনে না জানি দুটোজীবন নষ্ট হয়। এই ভাবনায় রাতে উনার দু,চোখে ঘুম এলো না। কেন যেন উনার মনটা কু গাইছে। তাই ফজরের নামাজ পড়ে উপরে চলে আসলেন। দরজা নক করার সাথে সাথে আয়ান এসে দরজা খুলে দিয়ে টলতে টলতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। উনি দু,রুমে দু,জনের বিছানা দেখে বললো,
—-কিরে, তুই এ রুমে কেন?
—-ঐ রুমেই ছিলাম। শরীরটা খারাপ লাগছে। ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ করছিলাম। ভাবলাম ওর ঘুম যদি ভেঙ্গে যায় তাই এই রুমে চলে আসছি।
আয়ান যতই অভিনয় করে বলুক না কেন রাহেলা বেগমের অভিজ্ঞ চোখ অনেক কিছুই বুঝে ফেললো। আয়ানকে ওভাবে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এখনকার জ্বরগুলো ছোঁয়াচে। দু,দিন আগে বকুলের জ্বর হলো এখন আবার আয়ানের জ্বর আসছে।
—এতো জ্বর শরীরে আমাকে ডাকলেই পারতি। আমি তো রাতে প্রায় জেগেই থাকি। ফাস্ট এইড বক্সটা কোথায়? জ্বরটা মেপে দেখতে হবে।
—-দেখো, টেবিলের উপর রাখা আছে।
একথা বলেই আয়ান জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। রাহেলা বেগম তাড়াতাড়ি ফাস্ট এইড বক্স খুলে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দেখলেন। ১০৪ড্রিগ্রী। ফোন দিয়ে সায়ানকে ডাক্তার ডেকে আনতে বললেন। রাহেলা বেগম ছেলের এই অবস্থা দেখে হাউমাঁউ করে কাঁদতে লাগলেন। উনার কান্নার শব্দে বকুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। বকুল এরুমে চলে এসে রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-মা,কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন?
—দেখনা,আমার ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। জ্বরে ওর শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
বকুল ওয়াশরুমে গিয়ে এক বালতি পানি নিয়ে আসলো। এরপর ওকে আড়াআড়ি শুয়ে দিয়ে মাথার নিচ থেকে বালিশটা সরিয়ে প্লাস্টিকের ক্লথ বিছিয়ে দিলো। তারপর একটানা একঘন্টা ওর মাথায় পানি ঢাললো। জ্ঞানটাও ফিরে আসলো। চোখ মেলে তাকাতে রাহেলা বেগম ছেলের মুখের উপর ঝুঁকে বললেন,
—-এখন কেমন আছিস বাবা?
—-ভালো, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি একটু ঘুমাবো।
একথা বলে ও আবার চোখটা বন্ধ করলো। সায়ান ততক্ষণে ডাক্তার নিয়ে এসেছে। ডাক্তারকে দেখে রাহেলা বেগম বললেন,
—-দেখুন না ডাক্তার সাহেব,আমার ছেলের কি হলো? রাতেই তো আমার ছেলে পুরো সুস্থ ছিলো।
—-এতো অস্থির হবেন না। আমাকে আগে রোগী দেখতে দিন।
মাকে এভাবে অস্থির হতে দেখে সায়ান বললো,
—আম্মু তুমি এভাবে প্যানিক করো না,জ্বর বেশী আসাতে মনে হয় ভাইয়া জ্ঞান হারিয়েছিলো।
জ্ঞান ফিরে আসাতে বকুল শুকনো টাওয়েল দিয়ে ভালো করে মাথা মুছে দিলো। এরপর গামছা ভিজিয়ে দু,হাত পিঠ,বুক পায়ের তলা সব মুছে দিলো। থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখলো জ্বর১০২ড্রিগ্রী। ডাক্তার আয়ানকে দেখে বললো,
—-ঠিক সময়ে ওর মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। না,হলে অনেক বড় ক্ষতি হতে পারতো।
কিছু টেস্ট আর ওষুধ দিয়ে ডাক্তার চলে গেল। সায়ান ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে ওষুধ আনতে ফার্মেসীতে চলে গেল। রাহেলা বেগম বকুলের নার্সিং এ খুশী হয়ে ওকে বললেন,
—আল্লাহপাক তোকে স্বামী সুখে অনেক সুখী করুন। ভাগ্যিস তোর মাথাটা ঠিকভাবে কাজ করছিলো। আমার তো তখন মাথা কাজ করছিলো না। তুই ওর কাছে একটু বস। আমি সুপ বানিয়ে নিয়ে আসি।
রাহেলা বেগমের কথা শুনে বকুল মনে মনে বললো,ও এই কপাল নিয়ে পৃথিবীতে আসেনি যে স্বামীর সংসারে সোহাগিনী হয়ে রাজ করে বেড়াবে।
বকুলকে বসিয়ে রেখে রাহেলা বেগম নিচে চলে গেলেন। আয়ান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। বকুল এক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর আয়ানের মাথার চুলে বিলি কেটে দিলো। একসময় বকুল আয়ানের কাছ থেকে উঠে যেতে চাইলে পিছন দিক থেকে ওড়নায় টান পড়ে। তাকিয়ে দেখে আয়ান বিছানা থেকে উঠে বসে ওড়নাটা টেনে ধরেছে। বকুল এপাশ থেকে ওড়নাটা টেনে ধরে কিছু বলার আগেই আয়ান হ্যাঁচকা টান মেরে বকুলকে নিজের বুকের দিকে টেনে নিলো। বকুল টাল সামলাতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
—জ্বর শরীরে কি শুরু করেছেন?
—-কিছুই তো শুরু করিনি
—-ছাড়ুন আমাকে, সারারাত বারান্দায় বসে জ্বর বাঁধাতে কে বলেছে?
—-জ্বর না বাঁধালে জানাই হতো না তোমার ভালোবাসার গভীরতা। জংলী রানি, ছাড়ার জন্য তো ধরিনি। তুমি আমার কলেমা পড়া বউ। সুতরাং এই ধরাতে কোনো অন্যায় নেই।
—কে বলেছে আমি আপনাকে ভালোবাসি? আমি আপনার কলেমা পড়া বউ এতোদিন এটা আপনার মনে ছিলো না?
—ভালো না বাসলে এভাবে মাথায় পানি ঢাললে কেন?আমি মরে যেতাম। এতে তোমার কি এমন ক্ষতি হতো।বরং আপদ বিদেয় হতো।
বকুল আয়ানের মুখটা চেপে ধরে বললো,
—আর এভাবে মৃত্যু কথা বলবেন না। আমাকে কষ্ট দিলে মনে হয় আপনার খুব সুখ লাগে তাই না? তাহলে আমার জ্বরের সময় আপনাকে কে বলেছিলো সেবা করতে?
—-কে,কাকে কষ্ট দেয়? তুমি তো কাছে আসার সুযোগই দাও না?
—-হুম, সব দোষ তো এখন আমার। আপনি তো আমাকে কাছে টানেননি।
—যদি সত্যিকথা বলি তোমাকে প্রথমদিন থেকে ভালোবেসে ফেলেছি। তবে কি জানোতো,ঘর পোড়া গরু সিঁদূরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। কাছে টানতে তো ইচ্ছে হতো। পরক্ষণে ভাবতাম, ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয়। এর থেকে দূরে থাকাই ভালো। কিন্তু আজ আর নিজেকে তোমা থেকে দূরে রাখতে পারলাম না।
বকুলের চোখ দিয়ে এতোদিনের সঞ্চিত ব্যথার মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়তে শুরু করলো। আয়ান টিসু দিয়ে ওর চোখটা মুছে দিয়ে বললো,
—আজ আমার আদরের স্রোতে তোমার সব অভিমানের জল ভেসে যাবে।
তারপর আয়ান বকুলের মুখের পানে নিজের ভালোবাসার দৃষ্টি মেলে ধরলো। লজ্জ্বায় আর কিছুটা ভয়ে বকুল চোখ দুটি বন্ধ করে ফেললো। বকুলের মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে কপালে ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দিলো। একে একে বকুলের চোখ, চিবুকে আয়ান ওর ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দিলো। বকুল আজ আর কোনো বাঁধা দিলো না। সবশেষে আয়ান বকুলের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিয়ে খুব শক্ত করে আলিঙ্গন করলো। এতোদিন ধরে জমে থাকা দ্বিধা আর অভিমানের মেঘ কেটে গিয়ে ওদের হৃদয়াকাশে ভালোবাসার সূর্যটা উঁকি দিলো। দুটোমানব মানবী প্রণয়ের টানে নিজেদের জড়িয়েছিলো। হঠাৎ কাশির শব্দে ওরা সম্বিত ফিরে পেলো।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-১২

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-বারো
মাহবুবা বিথী

রাহেলার কথাগুলো শুনে বকুল উনার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। যদিও আয়ানের উপর ওর এখনও কোনো ভরসার জায়গা তৈরী হয়নি তারপর মাতৃতুল্য এই মানুষটার সান্নিধ্যে বকুলের ভীষণ ভালো লাগে। জীবনে ওর মায়ের ভালোবাসার অভাব ছিলো। তাই বলে ও যে কষ্টে দিন কাঠিয়েছে তা নয়। বরং মা না থাকায় আরো বেশী করে সবার আদর ভালোবাসা পেয়েছে। শুধু ওর কথা চিন্তা করে ওর বাবা আর বিয়েই করেননি। দাদীও প্রচন্ড আহ্লাদে বড় করেছে। বাবা কোনোকিছু চাওয়ার আগেই সামনে এনে সব হাজির করেছে। তারপরও মায়ের ভালোবাসার প্রতি ওর একধরনের গোপন লোভ ছিলো।
বিয়ের পর শাশুড়ীমায়ের আদর ভালোবাসা পেয়ে ওর মনে হয়েছে,”মায়েরা বুঝি এমনই হয়।” বকুলকে ভাবনার সাগরে ডুবে যেতে দেখে রাহেলা বলে উঠলো,
—-কি অত ভাবছিস রে?
বকুল রাহেলাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-তোমার ছেলে আমায় ভালোবাসলো কি না বাসলো এটা নিয়ে আমার এই মুহুর্তে কোনো ভাবনা নেই। তুমি আমাকে সারাজীবন ভালোবাসবে। এতেই আমি খুশী। জন্ম থেকে মায়ের ভালোবাসা পাইনি। তাই মায়ের আদর ভালেবাসার উপর আমার বড্ড লোভ। জানো মা, আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার যে সব সহপাঠিদের দেখতাম ওরা মায়ের অনেক আদরের সন্তান তাদেরকে আমি সহ্য করতে পারতাম না। তবে আস্তে আস্তে বড় হওয়ার পর এইসব মানসিক বিষয়গুলোকে এড়াতে চেষ্টা করি। আর মনে মনে ভাবতাম যিনি আমার শাশুড়ী মা হবেন তাকে আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবো। আমি তাকে ভালোবাসলে সে আমাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না। আর এখন দেখো আমার ভাগ্য কতো ভালো আমি তোমার মতো একজন শাশুড়ী পেয়েছি। যাকে আমি ভালোবাসার আগেই তার অন্তরের ভালোবাসার উঠোনে আমার জায়গা দিয়েছেন।
রাহেলা আবারও ওর কপালে চুমু দিয়ে বললো,
—-এতো ভারী ভারী কথা শিখলি কবে বলতো?
এমন সময় রায়হান চৌধুরী ঘরে ঢুকে রাহেলাকে বললো,
—-বুড়োটাকে নিচে একা রেখে আদরের বউমার সাথে গল্প ফেঁদে দল ভারী করার কথা বলছো তাই না? সেটি হবে না। তুমি যতই আদর ভালোবাসা দাও না কেন বকুল আমার দলেই থাকবে। তাই না বকুল?
—-বাবা, আমি আপনাদের দু,জনের দলেই থাকবো। কারণ আমার যে আপনাদের দু,জনের ভালোবাসাই দরকার।
রাহেলা বেগম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বারোটা বাজে। বকুলকে বলে,
—-অনেক বেলা হয়েছে রে! আমি নিচে গেলাম। রান্নাগুলো সারতে হবে।
—-মা, আমিও আসি তোমার সাথে।
—-এই অসুস্থ শরীরে একদম বিছানা থেকে উঠবি না। আমি লাঞ্চ তোর ঘরে দিয়ে যাবো।
—-না,মা আমি একা একা খেতে পারবো না। নিচে তোমাদের সাথে খাবো।
—-ঠিক বলেছিস বকুল। আমিও একা একা খেতে পারি না। সে সময় খাবারের স্বাদ ও পাই না। মনে হয় যেন ঘাস চিবুচ্ছি।
—-বাবা আমিও আপনার সাথে সহমত পোষণ করছি।তাড়াতাড়ি আপনি গোসলটা সেরে নিন। অনেক বেলা হয়েছে। ডিসেম্বর মাস পড়েছে। একটু অবেলায় গোসল করলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে
—হুম,
উনারা দু,জন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বকুল বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আসলেই শরীরটা বেশ দুর্বল। মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে আয়ান মেসেজ পাঠিয়েছে।
“এই যে জংলী রানি,টাট্টু ঘোড়ার মতো যেন বিছানা থেকে নেমে লাফালাফি করা না হয়? মাথা ঘুরে পড়ে গেলে আমার মা, বাবা কেউ আপনাকে তুলতে পারবে না। আম্মুর তো কোমরটা ভেঙ্গে যাবে আর আব্বু হার্টে যেহেতু রিং পড়ানো আছে, আপনাকে তুলতে গেলে হার্টের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।”
মেসেজটা দেখা মাত্রই বকুলের মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। প্রথমে মনে হলো কোনো উত্তর দিবে না। পরে মনে হলো উত্তরটা দেওয়া উচিত।
“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি মনে হয় ছোটো খাটো একটা হাতি। একবার কষ্ট করে নিজের শরীরটার দিকে তাকিয়ে নিবেন। আর আপনি মনে হয় ভদ্রভাবে কথা বলতে পারেন না?”
আয়ান বকুলের রাগের পারদ আরো একটু বাড়িয়ে দিতে মেসেজে লিখলো,
“এই শরীরে আবার যেন কোচিং এ যাওয়া না হয়। ওখানে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে একজন সুন্দরী নারীর শরীর স্পর্শ করতে সবাই ছুটে আসবে। তারপর এই সুযোগে কোথায় কোথায় হাত বুলিয়ে আদর দিবে তারতো কোনো ঠিক নাই তাই না? তাই আগাম সাবধানবাণী পাঠিয়ে দিলাম।”
” আপনি ভালো করেই জানেন আমাকে সাবধান বাণী পাঠিয়ে লাভ নেই। আজকে আমার কোচিং এর সিডিউল নেই। আজকে সিডিউল থাকলে আপনার এসব সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে চলে যেতাম। তাই আমিও আগাম বলে দিলাম এসব বাণী টানি আমাকে শোনাতে আসবেন না।”

“তা ঠিকই বলেছো? অযথা উলুবনে মুক্তা ছড়িয়ে লাভ নেই।”
আয়ানের সাথে চ্যাট করে বকুলের রাগের পারদ তুঙ্গে উঠলো। মনে মনে ও ভাবলো যখনি মানুষটার সাথে সন্ধি করার কথা ভাবে তখনই ঐ লোকটা একটা ভজঘট পাকিয়ে ফেলবে।
লাঞ্চ শেষ করে বকুল বিছানায় শুয়ে ভাতঘুম দিলো। ঘর অন্ধকার হয়ে আসছে। দিনের আলো স্তিমিত হতে শুরু করেছে। গোধুলীর আবীর রঙ ছড়িয়ে পড়েছে। আজ হেমন্তিকার শেষদিন। কাল থেকে শীতের বুড়ি পৌষ প্রকৃতিতে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে নেমে আসবে। একটু একটু শীত লাগা শুরু হয়েছে। বকুল বিছানায় গুটিশুটি মেরে তখনও ঘুমিয়ে আছে। আয়ান অফিস ফেরত বাড়ী চলে আসে। বিছানায় ওভাবে বকুলকে শুয়ে থাকতে দেখে কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে দেয়। বকুলের মুখের দিকে হঠাৎ আয়ানের দৃষ্টি নিবন্ধ হয়। মেয়েটার মুখটা ভারী নিস্পাপ।ওর মুখের উপর কিছু মশা তখন ভ্যান ভ্যান করছে। বকুল ঘুমের মাঝে হাত দিয়ে বারবার সরানোর চেষ্টা করছে। কাবার্ড থেকে মশারী বের করে আয়ান টাঙ্গিয়ে দিয়ে বিছানার চারপাশটা ভালো করে মুড়িয়ে দিলো। কোনো মশা যেন ঢুকতে না পারে।
মাগরিবের আযান শেষ হলো। আয়ান পোশাক বদলে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে মাগরিবের নামাজ আদায় করলো। আয়ান বকুলের রুমে উঁকি মেরে দেখলো, তখন ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
দরজা নক করার শব্দে বকুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মশারী ঠাঙ্গানো,গায়ে কম্বল জড়ানো দেখে অবাক হলো। মনে মনে বকুল ভাবলো নিশ্চয় এটা বুইড়া খাঁটাশটার কাজ। সুযোগ পেলে আমাকে খোঁচা মারবে আবার এদিকে আদিখ্যেতা দেখাবে। ও বিছানা থেকে নামার আগেই আয়ান এসে দরজাটা খুলে দিলো। জোহরাকে চা নাস্তা আর সুপের বাটিটা টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে বললো। জোহরা চলে যাওয়ার পর আয়ান বকুলের রুমে উঁকি মেরে বললো,
—-মহারানির ঘুম ভাঙ্গলো?
বকুল আয়ানের দিকে মুখটা মোঁচড় দিয়ে তাকিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। বকুলের আচরণ দেখে আয়ান মুচকি হেসে বললো,
—-তোমার কথার উত্তর দিতে হবে না। শুধু মুখটা হা করে রাখো আমি সুপগুলো ঢেলে দেই।
—আপনার মতো আল্লাহপাক আমাকে দুটো হাত দিয়েছেন। আমি নিজের হাতেই খেতে পারবো। আপনাকে আর আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
—,আল্লাহপাক মাথা দিয়েছেন ঘামানোর জন্য। তাই মাথাটাকে ঘামাতে হয়। দেখো এরকম সুযোগ আর পাবে না। আমি তোমাকে গালে তুলে খাইয়ে দিতে চাইছি। এ সুযোগ মিস করো না। পরে কিন্তু আফসোস করতে হবে।
বকুলও আয়ানের গালে তুলে খাইয়ে দেওয়াটা এনজয় করতে চাইছে। তাই বিছানা থেকে উঠে বসলো। সুপের বাটিটা আয়ান বকুলের মুখের কাছে তুলে ধরলো। তারপর সুপের চামচটা যখনি বকুলের মুখের কাছে নিলো তখনি মোবাইলে একটা ফোন আসলো। আয়ান ও বকুল দু,জনেই মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকালো। জেসিকা নামটা জ্বলজ্বল করে স্ক্রীনে ভাসছে। আয়ান আর বকুল দু,জনের আই কন্ট্রাক্ট হলো। আয়ান বকুলের হাতে চামচটা ধরিয়ে দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। এখনও আয়ানের মোবাইলে জেসিকা নামটা সেভ করা দেখে বকুল খুব অবাক হলো। মনটাও অনেক খারাপ হয়ে গেল। যে মানুষটা ওর জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিয়েছে তার নাম কিভাবে নিজের ফোনে সেভ করে রাখে?বকুলের মাথা কাজ করছে না। যদিও বকুলের সম্পর্ক এখনও আয়ানের সাথে স্বাভাবিক নয় তবুও আয়ানের মোবাইলে জেসিকার নামটা দেখে বুকের বাঁ পাশে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো। সুপটা আর খেতে ইচ্ছে হলো না। পুরো শরীরটা কেন যেন অবশ হয়ে আসছে। বকুল টেবিলের উপর সুপের বাটিটা ঢেকে রাখলো। এরপর বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। একসময় কাঁদতে কাঁদতে বকুল ঘুমিয়ে পড়লো।
প্রায় ঘন্টাখানিকপর আয়ান বকুলের রুমে এসে দেখে,ও ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের জল শুকিয়ে গালের উপর সাদা দাগ পড়েছে। মুখটা খুবই শ্রান্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আয়ানের ভীষণ মায়া হলো। টেবিলে সুপ ঢাকা দেখে বুঝলো বকুল সুপ খায়নি। ও ওভেনে সুপটা গরম করলো। এরপর বকুলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো,
—–শোয়া থেকে উঠে বসো,সুপটা খাইয়ে দিচ্ছি।
যদিও বকুল জেসিকার পরিচয় জানে, তারপরও না জানার ভাণ করে বললো,
—-ফোন কে করেছিলো?
—-তুমি চিনবে না। সুপটা খেয়ে নাও।
—আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে না। আমি একাই খেয়ে নিতে পারবো।(অভিমানের স্বরে)
বকুল যদিও আশা করেছিলো আয়ান ওকে জেসিকার ফোনের ব্যাপারটা বলবে। কিন্তু কৌশলে এড়িয়ে যাওয়াতে বকুলের ভীষণ অভিমান হলো। তারপরও বকুল ভেবেছিলো,জোর করে আয়ান ওকে খাইয়ে দিবে। কিন্তু আয়ান সেটা না করে বকুলের হাতে সুপের বাটিটা দিয়ে দিলো। এরপর নিজের চা,টা ওভেনে গরম করে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। বকুল চামচ দিয়ে সুপটা না খেয়ে দু,চুমুকে শেষ করতে গিয়ে ভীষণ বিষম খেলো। প্রচন্ড কাশি উঠে গেল। নাক মুখ দিয়ে সুপগুলো সব বেরিয়ে পড়লো। বকুলের সেসময় প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হয়ে গোঙ্গানীর মতো শব্দ হলো। আয়ান দৌড়ে এসে বকুলের পিঠ আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বকুল একটু ধাতস্ত হয়ে আয়ানকে বললো,
—-আমার জন্য আপনার এতো ভাবনার দরকার নেই। আপনি এই রুম থেকে চলে যান।
বকুলের এমন আচরণে আয়ান খুব অবাক হলো।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-১১

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-এগারো
মাহবুবা বিথী

আয়ান কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছে শব্দটা আসলে কোথা থেকে আসছে। হঠাৎ ওর মনে হলো পাশের রুম থেকেই তো শব্দটা আসছে? চমকে উঠলো। একথা ভাবতেই ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে বসে আপন মনেই বলতে লাগলো,
“বকুলের আবার কিছু হলো নাতো?”
তারপর চটজলদি বিছানা থেকে নেমে বকুলের রুমে এসে দেখে ও কাঁপছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে বকুলের গা পুড়ে যাচ্ছে। আয়ান ফাস্ট এইড বক্স থেকে থার্মোমিটার বের করে জ্বর মেপে দেখলো তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রী। বকুলের এই অবস্থা দেখে আয়ানের নিজের উপর রাগ হলো। কেন যেন ওর মনে হতে লাগলো মানসিক চাপ থেকেই বকুলের জ্বরটা এসেছে। আর এই মানসিক চাপের কারণ ও নিজে। বকুলের সাথে খারাপ আচরণটা মনে হয় সীমা ছাড়িয়েছে। ও আর দাঁড়িয়ে না থেকে ওয়াশরুমে গিয়ে মগে করে পানি নিয়ে আসলো। তারপর ছোটো রুমাল ভিজিয়ে ওর কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো। বকুলকে কিছুটা অচৈতন্য অবস্থায় দুহাত দিয়ে শোয়া থেকে বসিয়ে একটা নাপা খাইয়ে দিলো। একবার মনে হলো, নিচে গিয়ে মাকে ডেকে আনবে। পরে ভাবলো উনাদের শরীর এমনিতেই ভালো থাকে না। তার উপর রাত দুপুরে দরজা নক করলে উনাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। এছাড়া ওর মনে হলো রাহেলা বেগম নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে ও বকুলকে অনেক বকাবকি করেছে। এখন বকুলের এই অবস্থা দেখলে এটা নিয়ে আবার আর এক কাহিনী শুরু হবে।

ঘন্টাখানিক জলপট্টি দেওয়ার পর ঘাম দিয়ে জ্বরটা সারলো। এতোক্ষণ বকুল খুব ছটফট করছিলো। জ্বরটা কমে যাওয়াতে ও ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বকুলের পোশাক চেঞ্জ করতে হবে। কারণ ঘামে জামাটা ভিজে গিয়েছে। অতঃপর আয়ান নিজেই জামা চেঞ্জ করে ম্যাক্সি পরিয়ে দিলো। ভেজা জামাটা বাথরুমের বাথটাবে রেখে দিলো।
রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে আসছে। পাখির কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বকুলকে এ অবস্থায় রেখে আয়ানের পাশের রুমে যেতে ইচ্ছা হলো না। অগত্যা বকুলের পাশে খাটে হেলান দিয়ে বসে থাকলো। একসময় ওখানেই আয়ান ঘুমিয়ে পড়লো। বাথরুমের চাপ লাগাতে বকুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে টেবিলের উপর মগ আর ভেজা টাওয়েল দেখে ভাবলো,”এটা আবার এখানে কে নিয়ে এসেছে?”
এপাশে তাকিয়ে দেখে আয়ান বসে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর চক্ষুচড়ক গাছ হলো নিজের শরীরের কাপড় চেঞ্জ দেখে। ও পুরো শরীরটা যেন কেমন করে উঠলো। ধাক্কা দিয়ে আয়ানের ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিয়ে বললো,
—-কি মিস্টার আপনি আমার বিছানায় কেন?আর আমার পোশাক কে বদলেছে?
—-এই ঘরে তোমার পোশাক বদলে দেবার জন্য আমি ছাড়াতো কেউ ছিলো না তাই না?
—-ভালো, বিনা খরচে মুভি দেখা হলো।
—-এই শোনো, তোমার এ ধরনের কথা শুনলে না আমার মাথার চাঁদি গরম হয়ে যায়। কোথায় কৃতজ্ঞতা বোধ দেখাবে, সেটা না করে কি সব বলে যাচ্ছো? রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিয়ে সেবা করলাম, ওষুধ খাইয়ে দিলাম,ঘেমে গিয়েছো বলে পোশাক বদলে দিলাম। আর এখন সুস্থ বোধ করাতে মুখ দিয়ে কথার খই ফুটতে শুরু করেছে।
—-অনেক ধন্যবাদ। এবার আপনি আপনার রুমে চলে যান।
আসলে আয়ান ওর পোশাক বদলে দিয়েছে এটা শোনার পর ওর শরীরে যেন বিদ্যুতের শকড লাগলো। পাশাপাশি ওর দিকে তাকাতে বকুলের ভীষণ লজ্জা লাগছে।
আয়ান ওর মনের কথা বুঝতে পেরে প্রশ্নবোধক হাসি দিয়ে বললো,
—আফটার অল আমি তোমার হাসব্যান্ড। সেই অধিকার আমি ধর্মীয়মতে সামাজিকভাবে অর্জন করেছি। এতে এত কুন্ঠিত হওয়ার কিছু নাই। আচ্ছা তুমি আমার উপর এতো রেগে থাকো কেন বলতে পারো? আমি কিন্তু এই বিয়েতেই রাজি ছিলাম না। শুধু আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়েছি। তাই আমার মা আর তোমার বাবা এদের উপর তোমার রাগ করা উচিত।
বকুল আয়ানের কথার কোনো উত্তর দিলো না। মনে মনে বললো,”এই পৃথিবীতে আমার কারো উপরই রাগ করা উচিত নয়। রাগ যদি সত্যি করতে হয় সেটা আমার ভাগ্যের উপর করা উচিত।”
বকুল বিছানা থেকে ওয়াশ যাওয়ার জন্য দাঁড়ানো মাত্রই মাথা ঘুরে পড়ে যেতেই আয়ান ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। লজ্জায় বকুল ওর দুচোখ বন্ধ করে ফেলে। আয়ানের লজ্জাবনত মুখটাকে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। পর মুহুর্তে নিজেকে সামলে নেয়। একটা পুরুষালী সুবাসে বকুলও আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এভাবে আয়ানের বুকে লেপ্টে থাকতে বকুলেরও ভালো লাগছিলো। কিছুটা মুহুর্ত পার হয়ে যাওয়ার পর আয়ান বকুলকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
—-এখন বুঝতে পারছো, কেন রাতজেগে তোমার পাশে বসেছিলাম। তোমাকে আর একা ছাড়বো না। চলো, আমি তোমাকে বাথরুমে বসিয়ে দিয়ে আসি।
—-না,তা আর দরকার হবে না। তাড়াতাড়ি উঠতে যাওয়ায় এই বিপত্তি ঘটেছে। আমি আস্তে ধীরে উঠছি। আপনি আপনার রুমে গিয়ে বিশ্রাম করুন।
—-রাত শেষ হয়ে আসছে। একটু পরে ফজরের আযান দিবে। নামাজ পড়ে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিবো।

আয়ান নামাজ পড়ে নীচে চলে গেল। বকুল ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আয়ানের এই কেয়ারিংটা বকুলের মনের ভিতর ভালোবাসার আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ এমন এক অনুভব যা শুধু অন্তর দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে হয়। ভাষায় আর প্রকাশ করা যায় না। প্রতিটি মেয়ে মনে হয় ওর স্বামীর কাছে প্যাম্পার হতে চায়। বকুলের মন আজ ভীষণ ফুরফুরে। অবশেষে আয়ানের সাথে ও হানিমুন করতে কক্সবাজারে যাচ্ছে। আয়ান ওকে বলেছে, ওর জন্য নাকি কক্সবাজারে বিশাল সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। ওর যেন আর তর সইছে না। মনে হচ্ছে পাখির মতো ডানা লাগিয়ে এখনি কক্সবাজারে উড়ে চলে যেতে। উবারে করে যথাসময়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে ওরা পৌঁছে গেল। বোডিং পাস থেকে শুরু করে সব আনুষ্টানিকতা শেষ করে নভোএয়ার নামক প্লেনটায় ওরা উঠে পড়লো। বকুলের ভীষণ ভয় লাগছে। এই প্রথম ও প্লেনে উঠেছে। আয়ান যত্ন করে ওর সিট বেল্টটা বেঁধে দিলো। এরপর ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বললো,
—-ভয় পেও না, আমি তো আছি তোমার পাশে।
আসলেই বকুলের আজ ভীষণ ভালো লাগছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটা যখন সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চায় পৃথিবীটাকে তখন স্বপ্নের দেশ মনে হয়। নিজেকে মনে হয় এক প্রেমিক রাজার প্রিয়তমা রানী। নানা ভাবনায় প্লেনটা কক্সবাজার এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করলো। কটেজ থেকে আসা গাড়িতে করে বকুল আর আয়ান ওদের রিসোর্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঝাউবনে ঘেরা সৈকত আর পাহাড় বেষ্টিত রিসোর্টটির নাম মারমেইড বিচ রিসোর্ট। কটেজে ঢুকার সময় নামটা বকুলের চোখে পড়লো। বুনো ফুল আর ডাবের পানি সাথে গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে ওদের অভ্যর্থনা জানানো হলো। মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা বকুলের কাছে সিনেমার ডায়লগের মতো মনে হলো,”এতো সুখ ওর কপালে সইবে তো!”
এরপর ওদের রুমে ঢুকে ওর চোখ ছানাবড়া। পুরো বিছানা গোলাপ আর বেলী দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানার মাঝখানে গোলাপ দিয়ে হার্টসেফ বানানো হয়েছে। আয়ান বকুলকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতেই কার ডাকে ওর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সামনে আয়ানকে দেখে লজ্জায় ওর ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে গেল। আয়ান ওর অবস্থা দেখে একটু অবাক হলো। তারপর গম্ভীর হয়ে বললো,
—-সুপটা নিজ হাতে বানিয়ে এনেছি। খেয়ে নাও। আর এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে বুঝলাম নাতো?
বকুল তখনও স্বপ্নের ঘোরে আছে। ভাবছে আসলেই বাস্তবে ওর জীবনে এমন দিন আসবে তো? আয়ানকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-মারমেইড বিচে আপনি কখনও গিয়েছেন?
আয়ান অবাক হয়ে ভাবলো সুপ খেতে গিয়ে মারমেইড বিচের কথা বলছে। মাথাটা আবার আউলা হয়ে যায়নি তো। তাই ও একটু রসিকতা করে বললো,
—-স্বপ্নে কি আমার সাথে সাগরের পানিতে বেশী ডুবেছিলে যে একেবারে জ্বর বাঁধিয়ে বসলে?
—-আপনি কি করে জানলেন?
—-মানেটা কি বকুল? তুমি এরকম আবোল তাবোল বকছো কেন?
আয়ানের ধমক খেয়ে বকুলের ঘোর পুরোপুরি কেটে গেল। সুবোধ বালিকার মতো সুপটা খেয়ে নিলো। এরপর আয়ান ওর হাতে নাপা দিয়ে বললো,
—-তুমি তো মিষ্টি খেতে পছন্দ করো। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে তোমার জন্য মিষ্টি কিনে আনবো।
বকুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। আয়ান রেডী হয়ে বকুলের কাছে বিদায় নিয়ে নীচে নেমে আসলো। ও অফিসে চলে যাবার পর রাহেলা বেগম উপরে চলে আসলো। বকুলের প্রতি আয়ানের এই কেয়ারিং দেখে রাহেলার মনটা আজ ভীষণ আনন্দিতো। ছেলেটাকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে দেখে উনার ভীষণ ভালো লাগছে। বকুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-আমি নিচ থেকে বুঝতে পেরেছিলাম,উপরে কিছু একটা ঘটেছে। ইচ্ছে করেই খোঁজ নিতে আসিনি। দেখতে
চেয়েছিলাম আয়ান কিভাবে ম্যানেজ করে।
বকুলের কপালে চুমু দিয়ে রাহেলা বেগম বললো,
—তুই পারবি মা, আমার আয়ানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। একটু ধৈর্য রাখিস।
বকুল রাহেলার আনন্দ দেখে মনে মনে ভাবছে, ও যে এখনও আয়ানের উপর পরিপূর্ণ ভরসা রাখতে পারছে না।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-১০

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী

বকুলকে গাড়িতে উঠিয়ে গাড়ির দরজাটা খুব জোরে লাগিয়ে দিলো। সেই শব্দে বকুলের সহপাঠি ছেলেটার শ্রবনইন্দ্রিয় চমকে উঠলো।
বকুল ভাবছে,ওতো তেমন কিছুই করেনি। শুধু একটু হেসে হেসে কথা বলেছে। এতে ওর কি অন্যায় হলো বকুল বুঝতে পারলো না। কিংবা ওর বর আয়ানের কোথায় লাগলো সেটা ও আন্দাজ করতে পারছে না। অথচ এই আয়ান ওকে বাসর রাতে বলেছিলো,” তুমি আমার কাছে কোনোদিন স্বামীর ভালোবাসা আশা করো না।”বকুল আয়ানের আচরণে তব্দা খেয়ে গেল।

আয়ান গাড়িতে বসে সিট বেল্টটা বেঁধে নিলো। গাড়ি চালাতে শুরু করলো। বকুল জানালা দিয়ে বাইরের তাকিয়ে দেখে মুক্ত আকাশে নাম না জানা পাখিগুলো ডানা মেলে উড়ছে। ও দেখে মনে মনে ভাবলো, ওর ইচ্ছা ছিলো ঐভাবে বলাকাদের মতন স্বাধীনভাবে উড়তে। অথচ এই মানুষটার কারনে ওকে খাঁচায় বন্দী হতে হলো। ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর খুব বেশীদূর নয়। আয়ান বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল।
তারপর গাড়ি থেকে নেমে এতো জোরে গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিলো যে রাহেলা বাসার ভিতর থেকে সেই শব্দ শুনে অবাক হলো। এরপর গাড়ি দরজা খুলে বকুলের হাত ধরে টেনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। রাহেলা জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখে চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগলো, “ঐ দুটির মাঝে কি ঘটলো কে জানে?”
আয়ান খুব শক্তভাবে বকুলের হাত ধরেছিলো। এতে কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে হাত কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এরপর বকুলকে খাটে বসিয়ে দিয়ে আয়ান চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,
—দু,মাস হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে, কোনোদিন তো দেখলাম না আমার সাথে বত্রিশ পাটি বের করে কথা বলতে? এমন ভাবে থাকো যেন একটা রোবট। আমার ধারণা ছিলো তুমি মনে হয় হাসতে জানো না।
আয়ানের কথাগুলো শুনে বকুল যেন আকাশ থেকে পড়লো। কারন আয়ান নিজের হাতেই তো ভালোবাসার আদান প্রদানের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আজ কেন এই দরজাটা ও খুলতে চাইছে। বকুল ভাবছে, তবে কি ও আয়ানের মোহ নাকি অভ্যাস অথবা অধিকারবোধ।
—-কি ব্যাপার এখন তো দেখছি বোবা হয়ে গিয়েছো?
—-আমি কার সাথে হাসবো কার সাথে কাঁদবো এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি কেন এর মাঝে নাক গলাতে চাইছেন?
—-ঐ তো একটা জিনিস ই ভালো করে জীবনে আয়ত্ব করেছো। আর তা হচ্ছে লম্বা চওড়া কথার ফুলঝুড়ি। বিবাহিত নারী হয়ে পরপুরুষের সাথে ঢলাঢলি করতে তো ভালোই লাগে। কেউ চরিত্রের দোষ ধরতে পারবে না। নিজের এই অপকর্মের সুবিধার জন্য স্বামী নামক সাইনবোর্ডটি তো ঝোলানো আছে তাই না?
এ কথাগুলো বলে আয়ান রুম থেকে বের হয়ে পাশের রুমে চলে গেল।
গোধুলী নেমে এসেছে। হেমন্তিকার দিনের আলো নিভে গিয়ে রাত্রির অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। স্বামীর কাছে অপমানিত বকুলের দুচোখ দিয়ে বাদলের ধারা বইছে। বকুল বিছানায় ওর শরীরটা এলিয়ে দিলো। হাতটা কেটে যাওয়াতে বেশ ব্যথা করছে। ইচ্ছে হচ্ছে না ফাস্ট এইড বক্স থেকে মেডিসিন নিয়ে লাগাতে? বকুল শুয়ে শুয়ে ভাবছে বিয়ে হয়েছে দু,মাস আয়ান কি ওকে পরিপূর্ণ স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে? আয়ানের এই আচরণটা বকুলকে কতটা ব্যথিত করে তার খোঁজ কি কখনও ও নিয়েছে। অথচ আজ নিজের অধিকারবোধ ফলাতে এসেছে।
আয়ানের নিজের রুমে এসে খুব খারাপ লাগছে। এতো কঠিন কথাগুলো বলে বকুলকে ও আঘাত করতে চায়নি। কিন্তু ওকে ওভাবে ঐ ছেলেটার সাথে কথা বলতে দেখে ওর প্রচন্ড রাগ হলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে কথার তিক্তবাণে বকুলকে আঘাত করে গেল। অথচ মেয়েটা স্ত্রী হিসাবে আয়ানের প্রতি সব দায়িত্ব নিরবে পালন করে যায়। আয়ানের কাপড় লন্ড্রী করে আনা থেকে শুরু করে অফিসের টিফিন সব নিজ দায়িত্বে করে। ওতো পারে না ওর বাবা মাকে সঙ্গ দিতে। সায়ান ওর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বকুল ওর বাবা মাকেও company দেয়। বিশেষকরে ওর বাবা খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকে। অথচ মেয়েটাকে ও নোংরা কথাগুলো বলে আহত করলো। আয়ান এখন অপরাধবোধে ভুগছে। আর বকুলের প্রতি ওর আজকের আচরণ দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল। তাইতো বকুল তো ঠিক কথাই বলেছে। ও কার সাথে হাসবে কার সাথে কাঁদবে একান্তই ওর ব্যাপার। তবে কি ও বকুলকে আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলছে। নাকি কলেমা পড়ে কবুল বলাতে ওর উপর অধিকারবোধ ফলাতে ইচ্ছে হয়েছে। অথচ ওতো নিজেই ওর আর বকুলে মাঝে সযতনে দুরুত্বের দেয়াল তুলে দিয়েছে। আজ কেন সেই প্রাচীর এই মনটা ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে? বড় রহস্যময় মানুষের মন।
পাশাপাশিরুমে দু,জন নরনারী বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ। এদের মাঝে একজন আস্তে আস্তে প্রেম যমুনায় ডুবতে শুরু করেছে আর একজন অভিমানের দেওয়ালটা আরো শক্ত করে গেঁথে তুলতে চাইছে। ওরা জানে না ওদের ভাগ্যে কি লেখা আছে। আর এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি বা কি?
মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হয়েছে। আয়ান ওজু করতে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় বিছানায় শুয়ে থাকা বকুলের দিকে দৃষ্টি চলে গেল। আসলে দুটো রুমের মাঝে একটা ওয়াশরুম। ওয়াশরুমে যেতে হলে আয়ানকে এ রুমে আসতে হয়। হঠাৎ চোখ পড়লো বকুলের হাতের উপর। তখনও রক্তে জায়গাটা ভেজা আছে। বকুল কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আয়ান ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসে বকুলের হাতটা ভালো করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলো। বকুলের মুখের দিকে চোখ পড়তেই ও দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না। গোলাপী ঠোঁট জোড়া ওকে যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে চাইলো। হঠাৎ বকুল পাশ ফিরতে আয়ান ওখান থেকে সরে আসে। ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে মাগরিবের নামাজটা আদায় করে নেয়।

এদিকে সন্ধের চা খেতে বকুল নীচে নামেনি দেখে রাহেলা বেগম নিজেই উপরে এসে বকুলকে ডেকে বললেন,
—-উঠে পড় বকুল। নীচে আয়। আমি টেবিলে ডিনার দিয়ে দিচ্ছি।
একথাগুলে বলে রাহেলা নীচে চলে গেল। বকুল ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো। নিজের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে একটু অবাক হলো। মনে মনে আয়ানকে বললো,”জুতো মেরে গরু দান করতে কে বলেছে আপনাকে?”

বকুল নিচে নেমে সবার সাথে ডিনার করতে বসলো। ওর হাতে ব্যান্ডেজ দেখে রাহেলা আঁতকে উঠে বললেন,
—-এ বিপদ আবার কখন ঘটলো?
আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে আছে। বকুল ওর দিকে না তাকিয়ে বুঝতে পারছে আয়ান এ বিষয়টা নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বকুল বললো,
—-তেমন কিছু না। চুড়িটা খুলতে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছি। ভাঙ্গা চুড়িটা দিয়েই জায়গাটা একটু কেটেছে। ফাস্ট এইড দিয়েছি সেরে যাবে।
আয়ান কিচেনে গিয়ে চামচ নিয়ে এসে বকুলের হাতে দিলো। রায়হান খেতে খেতে বললো,
—-এরকম হলে সাবান নয়ত তেল মাখিয়ে নিও। তা
হলে খুলতে সুবিধা হবে।
কেন যেন আয়ানের নোংরা কথাগুলো ওর কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অভিমানের বর্ষণগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে আছে। যে কোন মুহুর্তে বাদলের ধারা হয়ে দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে পারে। তাই কোনো রকমে দুটো ভাত মুখে পুরে খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। রাহেলা বকুলের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। তাই আর জোর করেনি। তবে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো। বকুল ভালোমতো না খাওয়াতে আয়ানও তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে উঠে পড়লো।

পাশাপাশি রুমে দুটোমানুষ বিনিদ্র রাত্রি যাপন করছে। বড়ই অদ্ভুত এই পৃথিবী। তার থেকে অদ্ভুত মানুষের মন পাখি। কখন যে কার আকাশে সে উড়ে নিজেই জানে না। এই অদ্ভুত মন পাখিটা মাঝে মাঝে ইগো দ্বারা শাসিত হয়। তখনই ঘটে যতো বিপত্তি। বাসর রাতে আয়ানের বলা কথাগুলো যেমন বকুলের ইগোতে লেগেছে তেমনি আয়ান নিজের ইগোর বেড়াজালে আটকে ছটফট করছে। পারছে না ইগোর দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে বকুলকে নিজের বুকের পশমে জড়িয়ে নিতে। আয়ানের চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। হঠাৎ রাত গভীরে গোঙ্গানীর শব্দে আয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেল।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-০৯

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী

—-কিরে দাদাভাই, তোদের দিন দুপুরে এভাবে রোমাঞ্চ করা ঠিক হচ্ছে না। লোকে দেখলে মন্দ বলতে পারে? আফটার অল এটাতো ঢাকা শহর নয়। সেটা তোদের মনে রাখা উচিত।
—-না বুঝে শুনে কি সব বাজে কথা বলছিস?
—-একটু দুষ্টুমি করছিলাম। তোদের দুজনকে মানিয়েছে বেশ।
আয়ান সায়ানের কথা শুনে মনে মনে বললো,”আর মানামানি, জানি না এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি কি? আয়ান বাহ্যিক ভাবে স্বাভাবিক থেকে সায়ানকে বললো,
—–ওর চোখে ধুলো পড়েছিলো তাই ক্লিন করে দিচ্ছিলাম। এখন আসল কথা বল গাড়িটা ধুয়েছিস?
—-হুম,আম্মু তোদের ডাকছে।
—-তুই বকুলকে সাথে নিয়ে যা,আমি আসছি।
ওরা চলে যাবার পর আয়ান নদীর শীতল হাওয়া গায়ে মেখে ভাবছে,”সংসার নামক এই জটিল প্রাঙ্গনে কেউ জানে না কখন কি ঘটবে?যেমন সময়ের হাত ধরে জেসিকা ক্রমে চলে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে। তবুও হঠাৎ আলোর বিদ্যুৎ ঝলকানির মতো মাঝে মাঝে ওর কথা মনে পড়ে যায়। একসময় প্রবল আবেগে জেসিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আয়ান বলেছিলো ওর মতো একজনকেই ওর জীবনে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই সুন্দর সময়গুলোকে দুপায়ে মাড়িয়ে জেসিকা চলে গেছে আজ বহু দূরে। আয়ান কিছুদিন আগে শুনেছে জেসিকা বিয়ে করে স্বামীর সাথে অস্টেলিয়া পাড়ি জমিয়েছে। তাই ও আর দেরী করেনি। মায়ের কথা মতো বকুলকে বিয়ে করেছে। বকুলকি পারবে ওর দুষ্ট অতীতকে ভুলিয়ে দিতে? তা একমাত্র সময় বলতে পারবে।

গেস্টরা খাওয়া শেষ করে চলে যাবার পর রাহেলারা সবাই খেতে বসলো। বিকাল পাঁচটায় রাহেলাদের ফ্লাইট। তাড়াতাড়ি লাঞ্চ শেষ করে রাহেলা, রায়হান আর সায়ান বকুলের বাবা, দাদী থেকে শুরু করে আয়ানের মামা মামী রিক্তা সবার কাছে বিদায় নিয়ে সৈয়দপুরের দিকে রওয়ানা হলো। সেখান থেকে এয়ারে করে ঢাকার পথে রওয়ানা দিবে। আয়ান আর বকুলও সবার কাছে বিদায় নিতে লাগলো। ওদেরও যাওয়ার সময় ঘণিয়ে আসলো। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় হামিদুর আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না। বকুলকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলো। ওর দাদী আসমা খাতুনও গলা ছেড়ে কাঁদতে বসলো। এসব দেখে বকুল বললো,
—-তোমরা যদি এভাবে কাঁদো তাহলে আমি শ্বশুর বাড়ি যাবো না।
বকুলের কথা শুনে উনারা কান্নাকাটি বন্ধ করলেন। বকুল বিদায়ের পালা শেষ করে আয়ানের সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। তখন বিকেল পাঁচটা বাজে। আর তো দেরী করা যাবে না। আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। ওর ধারণা ছিলো বকুল অনেক কান্নাকাটি করবে। কিন্তু সেসবের কিছুই হলো না। মনে মনে বললো,”বাব্বাহ্ ভারী শক্ত মেয়ে।”

গাড়ি চলতে শুরু করলো। ড্রাইভিং সীটে আয়ান আর পাশের সীটে বকুল বসেছে। গাড়ির গতির তালে তালে বকুলের কান্নার বেগ উথলে উঠতে লাগলো। আয়ান আড় চোখে খেয়াল করে ভাবছে,”এ আবার কি শুরু করলো কে জানে?”
—কি ব্যাপার এতোক্ষণ তো ভালোই ছিলে! কান্নাকাটি তো বিদায় নেওয়ার সময় করলে না তাই ভাবলাম উপরে উপরে যতই বিয়ে না করার ভাব দেখাও না কেন শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য মনে হয় পা বাড়িয়ে আছো।
—-শুনুন সব কিছু নিয়ে ফান করা ভালো লাগে না।
—-না,আমি তো ফান করি নাই। কথাটা সিরিয়াসলি বলেছি।
এ কথা শুনে বকুল কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—-এটা একটা মেয়ের কাছে কতো বড় কষ্ট আপনি কি করে বুঝবেন? নিজের চেনা পৃথিবীটা ছেড়ে যখন চলে যেতে হয় এই মুহুর্তটা যে কতটা বেদনার তা আপনার কাছে ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
—বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদলে না কেন?
—-এমনিতেই আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না। এটা আব্বু জানে। তার উপর যদি বেশী কান্নাকাটি করি তাহলে উনাদের মন ভেঙ্গে যাবে। তাই বহু কষ্টে কান্নাটা আটকে রেখেছিলাম।
—-এই টুকুন বয়সে অভিনয় করা শিখে গিয়েছো।
—–এই যে আমাকে এতো জ্বালাচ্ছেন কেন?
একথা বলে কান্নার বেগ বাড়াতেই বকুল বিষম খেয়ে হড়হড় করে গাড়িতে বমি করে দিলো। আয়ান অবাক হয়ে বললো,
—-এটা কি হলো?
—-,সেই তখন থেকে আমাকে জ্বালাতন করছেন এখন বুঝুন ঠেলা।
—-তাই বলে তুমি ইচ্ছা করে বমি করবে?
—-আমি ইচ্ছা করে করিনি। আমার এভাবে এসি গাড়ি চড়ার অভ্যাস নেই। তাই হয়তো বমি হয়ে গেছে।
রাস্তার পাশে একটা পেট্রোল পাম্পের কাছে আয়ান গাড়িটা থামিয়ে দরজা খুলে একটু রেগে বকুলকে বললো,
—গাড়ি থেকে নামেন মহারানি।
—-আমাকে বকছেন কেন?আমার বমি আমি পরিস্কার করছি।
—-তার দরকার নেই। আপাতত নেমে আমায় উদ্ধার করেন।
বকুল গাড়ি থেকে নেমে একপাশে দাঁড়িয়ে টিসু দিয়ে নিজের চোখ মুখ মুছতে লাগলো।
এরপর আয়ান গাড়ি পরিস্কার করতে গিয়ে বকুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—যে ভাবে মিষ্টিগুলো জেদ করে উদরে পুড়েছো তাতে এটা ঘটারই কথা ছিলো। সব মিষ্টিগুলো বের হয়েছে।

টিসু দিয়ে আয়ান বমিগুলো পরিস্কার করে ফেললো। এরপর ভিজা কাপড় দিয়ে পুরো জায়গাটা কয়েকবার মুছলো। দূর থেকে আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা তখনও কাঁদছে। ওর কেন যেন বকুলের জন্য মায়া হতে লাগলো।
এদিকে আয়ানকে পরিস্কার করতে দেখে বকুলের খুব অস্বস্তি হতে লাগলো। নিজের মাঝে গিলটি ফিল হচ্ছে। তাই আয়ানের কাছে এসে বললো,
—সরি,
আয়ান পানির বোতলটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—হাত মুখ ধুয়ে ফেলো। ফ্রেস লাগবে।
এরপর গাড়িতে উঠে বকুল সিটে হেলান দিয়ে বসলো। আয়ান গাড়ির জানালাগুলো খুলে রাখলো। সীটে বসে সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বকুল মৃদুমন্দ বাতাসে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। আয়ান ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। খুব নিস্পাপ মুখশ্রী। পুরো মুখে কোথাও কোনো কৃত্রিমতার ছাপ নেই। ভুড়ু প্লাক করা নেই। চুল কালার করা নেই। অথচ মেয়েটাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। আয়ানের মনে হলো আল্লাহপাক খুব নিপুনভাবে মেয়েটাকে গড়েছেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর কাছে একটা রেস্টুরেন্টে এসে আয়ান বকুলকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে বললো,
—-চলো কিছু খাবে। তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
—-আপনি খেয়ে আসুন। আমি খেলে আবার বমি হবে।
বকুল খেলো না বলে আয়ানও কিছু খেতে পারলো না। বাড়িতে পৌছাতে ওদের রাত বারোটা বেজে গেল।

রাহেলার ঘরে আজ খুশীর ঢেউ উথলে উঠেছে। এই খুশীটুকুর জন্য গত দু,বছর ধরে উদগ্রীব হয়ে ছিলো। গাড়ির হর্ণের শব্দ শোনা মাত্রই রাহেলা দোতলা থেকে নেমে এসে ছেলে আর বৌমাকে মিষ্টি মুখ করিয়ে ঘরে তুললো। উনি আগেই খবর পেয়েছিলেন বকুল বমি করেছে। তাই ওকে নিয়ে সোজা তিনতলায় উঠে গেলেন। গিজার আগেই ছেড়ে রেখেছিলেন। বকুলকে ফ্রেস হওয়ার জন্য গরম পানি দিয়ে গোসল করতে বললেন। বকুল সুটকেস খুলে একটা নীল রঙের সুতি শাড়ি পেটিকোর্ট ব্লাউজ অম্তর্বাস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। আয়ান অপর আর একটি ওয়াশরুম থেকে গোসল করে স্লিপিং সুট পরে বের হয়ে আসলো। বকুলও সবে ওয়াশরুম থেকে শাড়ি পড়ে বের হয়েছে। পিঠ ভর্তি ছড়ানো চুলের গোড়া দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আয়ান অবাক হয়ে ছিপছিপে গড়নের সেই সরল মুখের কান্তির দিকে তাকিয়ে ভাবলো,”মেয়েটা আসলেই শিউলফুলের মতো সুন্দর।” হঠাৎ বকুলের চোখে চোখ পড়াতে আয়ান বলে উঠলো,
—-শরীর এখন কেমন লাগছে?
—-ভালো
রাহেলা ততক্ষণে এঘরে গরম গরম ভাত তরকারি পৌঁছে দিয়ে বললো,
—–জার্ণি করে আসছিস। তাড়াতাড়ি ডিনার করে তোরা শুয়ে পড়।
খাওয়া শেষ করে আয়ান নিজের বেডরুমটা বকুলের জন্য ছেড়ে দিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। বকুল ক্লান্ত থাকার কারনে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখ জুরে রাজ্যের ঘুম নেমে আসলো। ওদিকে বিছানা চেঞ্জ হওয়াতে আয়ানের চোখের ঘুম ইনসমিয়ার দেশে হারিয়ে গেল। পুরোনো অনেক স্মৃতি মনের আঙ্গিনায় ভেসে উঠলো। ও ভাবছে ওর মাঝে কিসের অভাব ছিলো যে জেসিকা এমন আচরণ করলো? এতো ভালোবাসার পরেও যাকে আটকাতে পারেনি সেখানে নতুন করে আবারও কাউকে ভালোবাসায় জড়াতে বড্ডো ভয় হয়।
ভোরের দিকে আয়ানের চোখটা লেগে আসছিলো। কিন্তু ওয়াশরুমে পানি পড়ার শব্দে ঘুমটা আবারও ভেঙ্গে যায়। বকুলের উপর প্রচন্ড বিরক্ত অনুভব হলো। রেগে বিছানা থেকে উঠে পাশের রুমে গিয়ে যখনি বকুলকে ধমকাতে যাবে অমনি ওর প্রতি ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল। মেয়েটা অজু করে তখন নামাজে দাঁড়িয়েছে। আয়ানও ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে এসে ফজরের নামাজ আদায় করলো। বকুল নামাজ শেষ করে নীচে এসে শাশুড়ী রাহেলার সাথে কিচেনের কাজে সাহায্য করতে লাগলো। ওকে এতো সকালে কিচেনে আসতে দেখে রাহেলা বললো,
—-তোকে এখানে এতো সকালে কে আসতে বলেছে?
—-উনি তো অফিসে যাবেন তাই ভাবলাম তোমায় কাজে একটু সাহায্য করি।
—-তোকে এসব করতে হবে না। একটু পরেই জোহরা চলে আসবে। তুই বরং আমার ছেলেটাকে একটু মানিয়ে নিস। ওর জীবনের উপর দিয়ে বেশ ট্রমা গিয়েছে। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে একটু সময় লাগবে। ধৈর্য হারাস না। ওকে একটু সময় দে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

রাহেলার এসব কথায় বকুল যেন চাপ অনুভব করতে লাগলো। ও তো জানে না আয়ানের সাথে ওর জীবনের সমীকরণ একই রেখায় মিলবে কিনা। যদি না মিলে তবে এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি কি?
প্রসঙ্গ পাল্টাতে বকুল রাহেলাকে বললো,
—-মা, এখান থেকে উদ্ভাসের কোচিং সেন্টারটা কতদূর?
—-একটু দূর আছে। বাসে যাওয়া যায় আবার রিকশা করেও যেতে পারবি। তুই একা যেতে পারবি তো?
—-তা পারবো, আমার অভ্যাস আছে।
রাহেলা কথা বলতে বলতে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিলো। চা আর বিস্কুট রেডী করে আয়ানের জন্য বকুলের হাতে দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দিলো। এরমাঝে রায়হান চৌধুরী টেবিলে এসে বসলো। সায়ানও চলে আসলো। ওর আবার সকালে কোচিং আছে। টেবিলে সবাই মিলে চা খাওয়ার সময় জোহরা ডোরবেল বাজালো। রাহেলা টেবিল থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে ওকে বললো,
—-আগে সবজিগুলো কেটে দে। তারপর পরোটা বানানোর জন্য ময়দা ময়ান দিয়ে রাখ।

বকুল চা নিয়ে রুমে এসে আয়ানকে দেখে অবাক হলো। মানুষটা দেখতে ভারী সুন্দর। আয়ান তখন খালি গায়ে জিমের যন্ত্রপাতি দিয়ে ব্যায়াম করছে। বেশ সুপুরুষ বলিষ্ট মেদহীন ঝরঝরে ফিগার আয়ানের। বকুলের পায়ের শব্দে আয়ান পিছন ফিরে তাকিয়ে বললো,
—-চা,টা টেবিলে ঢেকে রাখো। আমি ফ্রেস হয়ে খেয়ে নিবো।
—ঠান্ডা হয়ে যাবে তো
—-সমস্যা নাই। আমার ঠান্ডা চা খাওয়ার অভ্যাস আছে। তুমি খেয়েছো?
—আমি নিচে গিয়ে খাবো।
বকুল চা দিয়ে নিচে নেমে এসে রাহেলার সাথে টেবিলে বসলো। রাহেলা ফ্লাক্স থেকে বকুলকে চা ঢেলে দিয়ে বললো,
—-ভাবছি তোকে আজকে কোচিং এ ভর্তি করে দিবো।
—-মামনি, আমার সময় বেশী নাই। সামনেই ভর্তি পরীক্ষাগুলো শুরু হবে।
—হুম,এজন্যই আর দেরী করবো না।

সেদিনই বিকালবেলা রাহেলা বকুলকে কোচিং এ ভর্তি করে দিলো। বকুল খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগলো। প্রতিদিন বকুল বাসে করে কিংবা রিকশা করে কোচিং এ আসা যাওয়া করে। এরমাঝে একদিন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। রাহেলা ফোন করে আয়ানকে বলে, অফিস থেকে ফেরার সময় যেন বকুলকে নিয়ে আসে।আয়ান কোচিং এর সামনে গিয়ে দেখে বকুল একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। এটা দেখার পর আয়ানের প্রচন্ড রাগ হয়। বকুলকে হ্যাঁচকা মেরে টান দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় বকুল অবাক হয় এবং নিজের ক্লাস মেটের সামনে এহেন আচরণে খুব অপমানিতবোধ করে।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-০৮

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী

রিক্তা ওদের দু,জনকে ইশারায় কথা বলতে দেখে খুব খুশী হলো। ওর ফুফুকে একটা পজেটিভ নিউজ দিতে পারবে এটা ভেবে মনে মনে রিক্তার ভীষণ ভালো লাগলো। চা নিয়ে আসার সময় রাহেলা রিক্তাকে বলেছিলো,
” রিক্তা একটু খেয়াল করে দেখে আসিস ওদের মাঝে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা? ছেলেটাকে আমি একরকম জোর করেই বিয়ে দিলাম। বকুলকে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা কে জানে। আর বকুলও কি আয়ানের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে?”
রিক্তা চা নাস্তা পৌঁছে দিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে আসলো। আয়ানের জন্য রিক্তার ভীষণ মায়া হয়। ওর লাইফে এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়াতে বেচারা একটা মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলো। আয়ানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে রাহেলাও ওর সাথে স্ট্রাগল করে গেছে। এই ঘটনাগুলো রিক্তা জানে। যদিও রিক্তার মা আয়ানের সাথে ওর বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু রিক্তা চায়নি। রিক্তা ছোটোবেলা থেকে আয়ানকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখে আসছে। ওর তো কোনো ভাইবোন নেই। রিক্তা ওর বাবা মায়ের একমাত্র সম্তান। বড় ভাইয়ের স্থানটা ও আয়ানকে দিয়েছে। তাই আয়ানের এই কষ্টটা রিক্তাকেও অনেক আহত করে। ও মন থেকে চায় আয়ান আর বকুল যেন অনেক সুখী হয়। এজন্য ওদের দু,জনকে এভাবে ইশারায় কথা বলতে দেখে ওর মনটাও আবেগে আপ্লুত। তাই আর দেরী না করে ফুফু রাহেলার কাছে চলে গেল। রাহেলা তখন সবাইকে নিয়ে নাস্তার টেবিলে বসেছে। রিক্তাকে দেখা মাত্রই রাহেলার চোখ দুটো উৎসুক হয়ে উঠলো। রায়হানও কিছু শোনার অপেক্ষায় রিক্তার মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। রিক্তা বেশ উৎফুল্ল হয়ে রাহেলাকে বললো,
—-আয়ান ভাইকে নিয়ে আর চিন্তা করো না। দেখো খুব শীঘ্রই আয়ান ভাইয়ের জীবন থেকে বিষাদের মেঘ কেটে যাবে।
রিক্তার কথার সাথে তাল দিয়ে সাইফুল বললো,
—-আমাদের বকুলের ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। তুই ওদেরকে নিয়ে আর ভাবিস না। রাহেলা তাড়াতাড়ি নাস্তা করে ফেল। পিঠাগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
—-ভাইয়া বাবুর্চির রান্না কতদূর?রিক্তা তুইও খেতে বস।
—-তোমরা খেয়ে নাও। আমি আম্মুর সাথে খেয়ে নিবো।
—–রান্না প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ভোর থেকে রান্না শুরু করেছে। রাতেই গরু আর খাসীর মাংস কিনে রেখেছিলাম। মুরগী আর পোলাওয়ের চাল মশলাপাতি সকালে কিনে এনেছি।
রায়হান খেতে খেতে সাইফুলকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ডেজার্টের আইটেম রাখেননি ভাইয়া?
—-পায়েস রাঁধতে বলেছি।
সায়ানের দিকে তাকিয়ে সাইফুল বললো,
—-ছোটো ভাগনে মফস্বল শহরের বিয়ে কেমন লাগছে?
—-মন্দ না।
সাইফুল তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বললো,
—-আমি বাবুর্চির কাছে যাই। তাগাদা না দিলে দেরী করে ফেলবে। গ্রামের দু,একজনকে দাওয়াত দিয়েছি। ডেকোরেটর থেকে লোক চলে আসবে। উঠোনে খাওয়ার ব্যবস্থা করবো। আমিনুল রংপুর থেকে রওয়ানা দিয়েছে।
জরিনা কিচেন থেকে চা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে বললো,
—আয়ানের বিয়ে উপলক্ষ্যে অনেকদিন পর বাড়িটা জমজমাট হলো।
চা খাওয়া শেষ করে সাইফুল বাবুর্চির কাছে চলে গেল।ওদিকে আয়ান আর বকুল নিজেদের রুমে নাস্তা করে নিলো। আয়ান খাওয়া শেষ করে বকুলকে বললো,
—আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।
—-বলুন,আমি শুনছি।
—-আমার ডিভোর্সের ব্যাপারটা তোমার নিশ্চয় জানা আছে।
—-হুম,
—-আমার সেই ক্ষতটা এখনও পরিপূর্ণ সেরে উঠেনি। তাই আর কাউকে এতো তাড়াতাড়ি নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিতে চাইনি। আব্বু অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে বাধ্য হলাম। আসলে জোর করে কি ভালোবাসা হয়?
—-জানি জোর করে ভালোবাসা হয় না। তবে যে চলে যায় তার জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। সে যদি সত্যি ভালোবাসতো তাহলে আপনাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে যেতে পারতো না। যে সম্পর্কগুলো নড়বড়ে ভিতের উপর তৈরী হয় সেগুলো যতো তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যায় ততই ভালো। সারাজীবন কষ্ট পাওয়ার চেয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসাটা আমার কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়।

আয়ান এই পুঁচকে মেয়েটার মুখে ভারী ভারী কথাগুলো শুনে অবাক হলো। মনে মনে ভাবছে জন্মের পর মাকে হারিয়ে মেয়েটা একা একা বড় হয়েছে। যদিও ওর বাবা ওর দাদী সাথে ছিলো কিন্তু মায়ের জায়গাটা তো শুন্যই ছিলো।সেই শুন্য স্থানটার কারনে ওর ম্যাচিউরিটি এতো বেশী। যাই হোক আয়ান ভাবছে ওকে একটা কথা জানানো দরকার। গলাটা একটু কেশে পরিস্কার করে নিয়ে বললো
—-বকুল, আমি তোমাকে এখন যে কথাটা বলবো তুমি শুনে হয়তো কষ্ট পাবে। তারপরও আমার তোমাকে কথাটা জানানো উচিত। আমি তোমার লোকদেখানো স্বামী হিসাবে তোমার প্রতি আমার সব দায়িত্ব পালন করে যাবো। তুমি ও আমার প্রিয়তম স্ত্রীর ভুমিকায় অভিনয় করে যাবে। তুমি যতদূর লেখাপড়া করতে চাও আমি তোমাকে সাপোর্ট দিবো। তবে স্বামীর ভালোবাসাটুকু তোমায় কোনোদিন দিতে পারবো কিনা জানি না।
বকুল ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে বিছানায় বসে আয়ানের কথাগুলো চুপচাপ শুনছিলো। আয়ান ওর নিরবতার প্রাচীরটা ভেঙ্গে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তুমি কিছু বললে না?
—-আসলে আমি বিশ্বাস করি যেটা আমার সেটা আমার কাছ থেকে কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না। পরমকরুনাময় আল্লাহপাক আমাকে আজ অথবা কাল ঠিক দিয়ে দিবেন। কিন্তু যেটা আমার নয় তার জন্য হাজারবার মাথা ঠুকলেও সেটা কখনও আমার হবে না। তাই আপনার এই কথাগুলো শুনে আমার বলার কিছু নাই।

আয়ান মনে মনে বকুলের উপর খুশী হলো। ওর কাছে বকুল তেমন কিছু আশা করে না সেটা ভেবে নিজেকে বেশ ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। বকুলের আয়ানের দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওর মুখ থেকে এ কথাগুলো শোনার পর একটা রিল্যাক্স ভাব আয়ানের বডিল্যাঙ্গুয়েজে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ বকুলের বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ও ভাবছে কি ভাগ্য নিয়ে ও পৃথিবীতে আসছে! জন্মের পর থেকে মায়ের ভালোবাসা পায়নি আবার বিয়ের পর স্বামী নামক মানুষটি ওকে বলছে,ও যেন কখনও স্বামীর ভালোবাসার প্রত্যাশা না করে? নিজের এই দুর্বলতা আয়ানের সামনে প্রকাশ করলো না। তবে মনে মনে আয়ানকে বললো, “মিস্টার জীবনটাকে আপনি সিনেমা কিংবা নাটক পাননি। আপনি আমাকে ন্যাঁকা ন্যাঁকা করে সিনেমার ডায়লগ বলবেন আমিও নায়িকা শাবানার মতো নাকের জল চোখের জল এক করে আপনার ভালোবাসা পাবার প্রত্যাশা করে যাবো। সেই মানুষ আমি নই। হয়তো একদিন এমন মুহুর্ত আসবে আমাকে ভালোবাসা দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করবেন”।
এই মুহুর্তে বকুল বাহ্যিকদিক থেকে কঠিনভাব বজায় রেখে বললো,
—-আমাদের মনে হয় এখন রুম থেকে বের হওয়া উচিত।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আয়ান বললো,
—-তা ঠিক,সকাল দশটা বাজতে চলেছে।
ওরা দু,জনে বেশ হাসি হাসি মুখ করে ঘর থেকে উঠোনে বেরিয়ে আসলো। ওদেরকে এভাবে দেখে রাহেলার চোখটা ভিজে গেল। রিক্তা মুচকি হেসে বকুলকে বললো,
—-ভাবী ভাইয়াকে নিয়ে নদীর পাড়টা ঘুরে এসো। তোমার তো আবার তিস্তার সাথে জন্ম জন্মান্তরের প্রেম। আজ তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছো। তোমার প্রেমিকের কাছে বিদায় নিয়ে এসো।
—-কিযে বলোনা রিক্তাপু,তোমার মুখে কোনো লাগসম নেই। কখন যে কি বলে ফেলো তার কোনো ঠিক নাই।
রাহেলা বুঝতে পারলো বকুল রিক্তার কথায় খুব লজ্জা পেয়েছে। তাই সংকোচটাকে আড়াল করতে বকুলকে বললো,
—-এতে লজ্জা পাবার কিছুই নাই। তিস্তাকে আমিও খুব ভালোবাসি। বলতে পারিস ও আমার জীবনের প্রথম প্রেম। আয়ানকে নিয়ে তিস্তার পাড়টা ঘুরে আয়।

আয়ান বকুলের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সময় সায়ানকে ডেকে বললো,
—-,গাড়িটা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রাখিস। আজকে আবার গাড়ি নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে।
—-আমি একা একা গাড়ি ধুইতে পারবো না। তোমাকে সাহায্য করতে হবে।
আয়ান কিছু বলার আগেই রিক্তা বললো,
—আমি তোমাকে সাহায্য করবো। উনারা ঘুরতে চলে যাক।
আয়ান আর বকুল হেঁটে হেঁটে তিস্তার পাড়ের দিকে চলে আসলো। বালুর উপর দিয়ে দু,জন হাঁটছে। চওড়া বিশাল নদী। স্রোতগুলো পাথরে ধাক্কা খেয়ে কলকল শব্দ করে বয়ে চলছে। পাশাপাশি দুটো মানুষ মৌনতার চাদরে পরিবেশটা যেন ঢেকে রেখেছে । হঠাৎ জোরে বাতাস বয়ে যাওয়ার কারনে ধুলো উড়তে শুরু করলো। আয়ানের চোখে সানগ্লাস থাকার কারনে ওর কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু বকুলের চোখে বালু ঢুকে যাওয়াতে ও কিছুই দেখতে পারছিলো। যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো। ওর কষ্ট দেখে আয়ান কাছে এসে বললো,
—-টিসু দিয়ে আমি তোমার চোখটা পরিস্কার করে দিচ্ছি।
এ কথা বলে আয়ান একদম বকুলের কাছে চলে এলো। একটা পুরুষালী সুবাস বকুলকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেললো। আয়ান ওর আঙ্গুল দিয়ে বকুলের চোখ স্পর্শ করাতে ওর শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আয়ান ওর চোখটা একটু ফাঁক করে টিসু দিয়ে ময়লা ক্লিন করে দিলো আর ফুঁ দিতে লাগলো। আয়ানের মুখ দিয়ে বের হওয়া গরম বাতাসে বকুলের পুরো শরীরে শিহরণ খেলে গেল। বকুল যেন ওর বুকের ভিতরে লাগামছাড়া হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পারছে। আয়ান যেন এই মুহুর্তে পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর চোখ দুটোর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইছে।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-০৭

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

—এই মেয়ে তুমি এতো নির্লজ্জ্ব কেন? বেহায়ার মতো এখন জেন্ডারের ভুল ধরছো?
বকুল ন্যাকা সুরে একটু জোরে কেঁদে কেঁদে বললো,
—-ব্যথা দিলেন আবার ধমকাচ্ছেন কেন?
বকুলের মুখে “ব্যথা দিলেন” শব্দটা শোনা মাত্রই আয়ান দৌড়ে এসে ওর মুখটা চেপে ধরে বললো,
—-একদম চুপ। এমনি এমনি তোমাকে নির্লজ্জ্ব বেহায়া বলিনি। বেহায়া না হলে বাসর রাতে এভাবে জোরে জোরে কেউ কাঁদে না। তোর বিছানায় তুই শুয়ে থাক। আমি তো আর সেই কপাল নিয়ে পৃথিবীতে আসিনি। বাসর রাতে সুখ নিদ্রা দিবো।
—-ওহ্ লাগছে তো! আমাকে তুই তোকারি করছেন কেন?
আয়ান মুখটা ছেড়ে দিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। বকুল আপাত যুদ্ধে জিতে ফেরার আনন্দে লাইট অফ করে দিয়ে বললো,
—-আমি লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে পারি না।
এই জংলিটার সাথে আয়ানের এই মুহুর্তে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। কথায় কথা বাড়ে।
আজ কৃষ্ণপক্ষ চলছে। চাঁদটা একটু দেরী করে উঠেছে। আয়ান ভাবছে ওর জীবনেও মনে হয় কৃষ্ণপক্ষের প্রভাব চলছে। না,হলে এতো উজাড় করে ভালোবাসার পরেও জেসিকার কাছে ওর ভালোবাসাটা ঠকে গেল। এই মুহুর্তে জেসিকার সাথে কাটানো বাসর রাতের স্মৃতিগুলো আয়ানের মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। বিয়ের আগের জেসিকা আর বিয়ের পরের জেসিকার মাঝে বিস্তর ফারাক। আয়ান বিয়ের আগে জেসিকাকে বলেছিলো,” বাসর রাতে ওরা সারারাত জোৎস্নায় ভিজবে। আর গল্প করবে। সেদিন ওদের ভালোবাসার সফলতার স্বাক্ষী হবে আকাশের চাঁদ তারা এমনকি আল্লাহপাকের পুরো সৃষ্টিকুল। জেসিকাও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলেছিলো,”দারুন আইডিয়া।” অথচ এই মানুষটাই বিয়েরদিন রাতারাতি বদলে গেল। ওর কাছে সেদিন আয়ানকে পাওয়ার থেকে কতো ভরি গয়না আর কতোদামী শাড়ি পেয়েছে সেটার মুল্যটাই বেশীছিলো।
আয়ান সেদিন ওকে রাতে জোৎস্না দেখার জন্য ছাদে যাওয়ার কথা বলতেই ও বলেছিলো,
—রাত দুপুরে কি পাগলামী শুরু করেছো? সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে। আমি এখন ঘুমোবো।
এভাবে খেঁকিয়ে কথাগুলো বলাতে আয়ানের আত্মসম্মানে লেগেছিলো। ও আর জোর করেনি। মনের গহীন অন্ধকারে ইচ্ছেটা সারাজীবনের তরে পুষে রাখলো। ও জানে, এই পৃথিবীতে সবার চাওয়া পাওয়াগুলো আলোর মুখ দেখতে পায় না। ও না হয় সেই না পাওয়া দলের অন্তভুক্ত হয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে।
আয়ানের চোখের কোনটা বিষাদের জলে আদ্র হয়ে উঠলো। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো।

সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা যেন বকুলও ছুঁয়ে গেল। আয়ানকে এরকম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়ে বকুলের নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। ও ভাবছে মানুষটার সাথে এতোটা না করলেও পারতো। ওর মতো হয়তো আয়ানেরও বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না। হয়তো উনার দগদগে ঘা টা এখনও পরিপূর্ণ শুকায়নি। আরো একটু সময়ের দরকার ছিলো। আন্টির জোরাজুরিতে হয়তো এখানে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। যেভাবে ওকে ওর মৃত মায়ের ইচ্ছা আর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হতে হয়েছে। নিয়তির উপর আসলেই কারো যেন হাত থাকে না। আয়ানের জন্য বকুলের কেমন যেন মায়া হতে লাগলো। অন্ধকারের মধ্যে ছ,ফিটের মতো বলিষ্ট মানুষটার দিকে তাকিয়ে বকুল ভাবছে, এই মানুষটার সাথে ও আজ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। একথা ভাবতেই কেমন যেন ওর শরীরে শিরশিরে অনুভূতীর সৃষ্টি হলো। মায়াটা যেন ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো। বেচারা এতোটা পথ জার্ণি করে এসেছে। তারপর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। ও বেচারাতো কারো উপর রাগ ঝাড়তে পারছে না। ও তো আয়ানের উপর আসার পর থেকে রাগ ঝেড়ে যাচ্ছে। নাহ্ বাড়াবাড়িটা একটু মনে হয় বেশী হয়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে আস্তে আস্তে আয়ানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়ানও অনুভব করছে করছে ওর ঘাড়ের কাছে কেউ একজন নিশ্বাস ফেলছে। এ যে বকুল ছাড়া কেউ নয় তা ও অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে ঠিক বুঝতে পারছে। এ ঘরে তো ও আর বকুল ছাড়া কেউ নেই। তাই বেশ গুরু গম্ভীর গলায় বললো,
—-জুতো মেরে এখন আবার গরু দান করতে এসো না। তোমার পাশে আমার আর শোয়ার ইচ্ছে নেই। তুমি যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো।
—সরি, প্লিজ ঘুম ঘুম চোখে মাথাটা গরম ছিলো। কি বলতে কি বলেছি। প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমার এখন আর ঘুম আসবে না। আপনি এতোটা পথ জার্ণি করে এসেছেন আপনার সাথে আমার এরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি।

আয়ান এতোক্ষণ বকুলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি। এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ লম্বা। আয়ান তো প্রায় ছ,ফিটের মতো লম্বা কিন্তু ওর মনে হলো বকুলও ৫–৬ইঞ্চি হবে। গলার ভয়েসটাও মিষ্টি আছে। ওর কথার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিলো আয়ান অগ্রাহ্য করতে পারেনি। আয়ান এসে বিছানায় বসলো। তবে ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলো না।মনে মনে ভাবছে জংলিটা এখন কি ফায়দা লুটবে কে জানে? বকুল খাটের কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে বললো,
—-এতোক্ষণ তো খুনসুঁটি করলাম। এখন গল্প করে আপনার মন ভালো করে দিবো। জানেন, আমার ইচ্ছে ছিলো আমার বিয়েটা যেন চাঁদনি রাতে হয়। আমি আর আমার বর চাঁদনি রাতে তিস্তার পাড় ধরে হেঁটে বেড়াবো। তারপর একটা নৌকা করে তিস্তা নদীতে আমরা দুজন ঘুরে বেড়াবো। জানেন তিস্তার জল খুব টলমলে। এতো স্বচ্ছ আপনি নদীর তলটা স্পষ্ট দেখতে পারবেন। কারন নদীতে বৈশাখ মাসে পানি খুব কম থাকে। তবে ভীষণ স্রোত আছে। নদীটা বেশ পাথুরে। নদীর জলে তলার পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়।ঐ পাথরে নদীর জল ধাক্কা খেয়ে কলকল শব্দ হয়। সে শব্দটা ভীষণ মায়াবী। আমাকে খুব টানে। তাই আমি চেয়েছিলাম নদীটা আমার বাসরের অংশ হয়ে থাকুক।সেই কারনেই চেয়েছিলাম নদীর জলে নৌকায় ঘুরে বেড়াবো আর জলের পরে আমাদের দু,জনের ছায়া দেখবো। চাঁদের ছায়া আর আমাদের দু,জনের ছায়া সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। অথচ দেখেন আমার বিয়েটা হলো কৃষ্ণপক্ষে। মাথাটা কেন গরম হবে না বলুন?আপনি খুব অবাক হচ্ছেন আর ভাবছেন আমার মাথায় কিঞ্চিৎ গন্ডগোল আছে।

একথা বলে বকুল মিটমিটি হাসতে লাগলো। হাসলে বকুলকে আরো সুন্দর লাগে। আয়ান অবাক হয়ে গ্রাম্য এক অষ্টাদশী কন্যার হাসি দেখে ভাবতে লাগলো, “মানুষের হাসি এতো নিস্পাপ কি করে হয়? আর ঐ হাসিতে মেয়েটার পুরো অবয়বে অপরুপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সৌন্দর্য যেন আয়ানের চোখ দুটোকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করলো।” রুমটা আবারো কিছুক্ষণ মৌনতার চাদর ঢেকে থাকলো। বকুল মৌনতার চাদর সরিয়ে আবারও কথা বলা শুরু করলো।
—-জানেন, তিস্তা আর আমি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তিস্তার বালুচরের বালু গায়ে মেখে আমার ছোটোবেলাটা কেটেছে। আমি বালুতে তিতির পাখির বাসা খুঁজতাম। বর্ষাকালে যখন কাশফুল ফুটে থাকতো দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। আর গল্প করবো না। আপনার মনে হয় বিরক্ত লাগছে। রাতও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আপনি শুয়ে পড়ুন।

আয়ানের আসলে বকুলের কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছে। মেয়েটার মাঝে সারল্য আছে। আর একটা বিষয় ওর ভাবতে ভালো লাগছে। ওর চাওয়ার সাথে বকুলের চাওয়াটা কিভাবে যেন মিলে গেল। আজকের রাতটা যদি পূর্ণিমা হতো ও হয়তো বকুলের ইচ্ছাটা পূরণ করতো। সত্যি সত্যি বকুলের হাত ধরে তিস্তার বালুচরে হেঁটে বেড়াতো আর জোস্নার আলোতে দুজনে ভিজতো। বিছানার দুপাশে বসা মানুষ দুটোর মাঝে আবারও অদ্ভুত নিরবতা ছেয়ে গেল। আয়ানের ইচ্ছা হলো বকুলকে বলতে,
“তুমি হাঁটবে আমার সাথে তিস্তার বালুচরে।” পর মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিলো। কেন যেন বকুলের কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে মন চাইলো না।
পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বকুল আবারো আয়ানকে বললো,
—-,আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন।
এ কথা বলে বকুল বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রাত্রীর অন্ধকার পার হয়ে সুপারী গাছগুলোর মাথাটা আলো আঁধারীর মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চারিদিকে নিস্তদ্ধতা ছেয়ে আছে। এই নিস্তদ্ধতাটুকু বকুলের ভীষণ ভালো লাগে। দূরে তিস্তা নদীটা দেখা যাচ্ছে। ও যেন এখান থেকে তিস্তার ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পারছে। ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। বকুল মাথায় কাপড় তুলে দিলো। আয়ানের আর ঘুমাতে ইচ্ছা হলো না। বকুল ওজু করতে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওজু করে এসে নামাজে বসলো। আয়ানও বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষ করে বকুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচঁড়াতে লাগলো। আয়ান নামাজ শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। বকুলের চুলের উপর ওর চোখ পড়লো। পুরো পিঠ ভর্তি বকুলের লম্বা চুল দেখে আয়ানের চোখে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়লো। চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা হলো। বকুল আয়নাতে দেখছে আয়ান ওর চুলের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। বকুলের সাথে আই কন্ট্রাক হওয়াতে আয়ানের একটু লজ্জা বোধ হলো। তাই বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দিতে বকুলকে আয়ান জিজ্ঞাসা করলো,
—-জীবন নিয়ে তোমার পরিকল্পনা কি?
বকুলের মনে হলো ওর ইচ্ছাটা আয়ানকে জানানো উচিত। তাই ও বললো,
—-আমি অনেকদূর পড়াশোনা করতে চাই। অনেকদিনের স্বপ্ন আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়বো।
—স্বপ্ন দেখলে তো হবে না। যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
—-আমার পড়তে ভালো লাগে। আমি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসি।

দরজা নক করার শব্দে দু,জনের কথায় ছন্দপতন ঘটলো। বকুল দরজা খুলে দেখলো, রিক্তা চা আর পোয়া পিঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার কাছ থেকে বকুল সরে দাঁড়াতে রিক্তা ভিতরে ঢুকে বললো,
—-রাতে তোমাদের ঘুম ঠিকমতো হয়েছে। অনেকের আবার বিছানা চেঞ্জ হলে ঘুম আসে না। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
রিক্তার কথা শুনে দু,জনের আই কন্ট্রাক হলো। রাতের ঘটনাগুলো রিক্তাকে বলে দিতে আয়ানের ইচ্ছা হলো। কিন্তু বকুলের চোখে আয়ান যেন রাত্রীর ঘটনাগুলো না বলার জন্য একরাশ অনুনয় দেখতে পেলো। রিক্তা ওদের দু,জনের চোখে চোখে কথা বলা দেখে অবাক হলো।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-০৬

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

“কথাটা ভুল বললেন। কারণ আপনি বরং এতো মিষ্টি জীবনে দেখেননি। আর খাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আমি দেখেছি। পহেলা বৈশাখে ময়ড়া ডেকে নিয়ে এসে হালখাতার জন্য বাসায় আমাদের মিষ্টি বানানো হয়। বন্দরে আমাদের একটা ফার্মেসী আছে। স্কুলে মাস্টারীর পাশাপাশি আব্বু ফার্মেসীটা চালায়। আমি মিষ্টির বাক্স দেখে বড় হইনি। পাতিল দেখে বড় হয়েছি। অবশ্য আমার খাওয়া দেখে আপনার আগেই বুঝা উচিত ছিলো”।
—–আদরে আদরে মানুষ যে বাঁদর হয় তোমাকে দেখে বিশ্বাস হলো।
ওদের ফিসফাস কথা শুনে আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আয়ানের কানের কাছে সায়ান মুখ নিয়ে বললো,
—–দাদাভাই, তোরা কি এখানেই ঝগড়া শুরু করে দিলি? সবাই তো দেখছে।
আয়ান চারপাশটা ভালো করে দেখে নিজেকে সামলে নিলো। মনে মনে ভাবলো ঢাকায় চলো এরপর চান্দু তুমি বুঝবে কত ধানে কত চাল।

বকুলের দিকে তাকিয়ে রাহেলা বেগমের ভীষণ ভালো লাগলো। আজ মরিয়ম বেঁচে থাকলে ভীষণ খুশী হতো। ছোটো বেলায় ও আর মরিয়ম পুতুলের বিয়ে দিতো। আজ আয়ান আর বকুলকে দেখে ছোটো বেলার পুতুল বিয়ের নস্টালজিয়ায় হারিয়ে গেল। বিয়ের কাজ শেষ করে সাইফুল তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে গেল। যাওয়ার সময় বাসর খাট সাজানোর জন্য কিছু তাজা ফুল কিনে বাড়ি চলে গেল। বাবুর্চি ঠিক করতে হবে। কিছু বাজারও আজকে করে রাখতে হবে। জরিনা বকুলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আফসোস করতে লাগলো। আয়ানের বউয়ের স্থানটা আজ ওর মেয়ে রিক্তারও হতে পারতো। বকুলের উপর ওর হিংসার দৃষ্টি পড়লো। এই সুযোগে রাহেলার কানে বকুলের নামে বিষ ঢেলে বললো,
—–আপা,ওকে দেখে যদি মনে হয় ও সহজ সরল তাহলে ভুল করবেন। গ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে হবে ও হচ্ছে ধানী লঙ্কা।

রাহেলা জরিনার মনোভাব বুঝতে পেরে বললো,
—-এই যুগে এমন না হইলে চলে না ভাবি। তাহলে যে পদে পদে ঠোক্কর খেতে হবে।
রাহেলার পজেটিভ মনোভাবে জরিনা সুবিধা করতে পারলো না। তাই ওখান থেকে উঠে এসে আদিখ্যেতা দেখিয়ে আসমা বেগমকে বললো,
——রাত হয়ে যাচ্ছে চাচী। আকাশটা থম মেরে আছে। বৃষ্টি হতে পারে। মেঘটা যেন ঘণিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি খাবার দিয়ে দাও। আমাদের তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। আপা দুলাভাইয়ের একটু রেস্ট নেওয়া দরকার।
আসমা আর হামিদুর মিলে বর কনে থেকে শুরু করে রাহেলার পুরো পরিবারকে খুব যত্ন করে খাইয়ে দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বর আর বউকে বসিয়ে রুসমত পালন করা হলো। আসমা আয়নার দিকে তাকিয়ে আয়ানকে জিজ্ঞাসা করলো
——আয়নাতে তুমি কাকে দেখছো ভাই?
আয়ান মনে মনে বকুলের উপর রেগে ছিলো। তাই এই মুহুর্তটা কাজে লাগাতে একটুও দেরী করলো না। আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–শ্যাওড়া গাছের পেত্নি দেখছি।
আয়ানের কথা শুনে রাহেলা বিব্রতবোধ করলো। রায়হান আয়ানের এই আচরণটাকে হালকা করার জন্য বললো,
—–আন্টি আমার আয়ানের মধ্যে রসবোধ একটু বেশী আছে।
আয়ান কটমট করে বাপেরদিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,”এখানে রসবোধের কি আছে ওর তো মাথায় ঢুকছে না। যাইহোক যাকে খোঁচা দেওয়ার জন্য বলেছে সে বুঝতে পারলেই হলো”।
এবার বকুলের দিকে তাকিয়ে আসমা বেগম বললেন,
—–তুমি কি দেখছো দিদিভাই?
——বট গাছের ভুত
রাহেলা বেগম বকুলের কথা শুনে মনে মনে বললেন,”যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল”। ওদের দু,জনের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে ফেললো। তবে আয়ানের মেজাজ প্রচন্ড রকম খারাপ হলো। এই পুৃঁচকে মেয়েটার কাছে ওকে বার বার হেনস্থা হতে হচ্ছে।
সমস্ত আনুষ্টানিকতা শেষ করে বিদায়ের সময় ঘণিয়ে আসলো। হামিদুর রাহেলা আর রায়হানকে বললো,
—–মা,হারা মেয়ে আমার। জন্মের পর কোনোদিন মায়ের আদর পায়নি। আমি বাবা হয়ে চেষ্টা করেছি মা আর বাবার আদরে ওকে ভরিয়ে রাখতে। আর ওর দাদীর বুকে ও বড় হয়েছে। আমার মা ওকে প্রচন্ড ভালোবাসে। সেই কারনে একটু ফটফট করে বেশী কথা বলে। তোমরা ওকে একটু মানিয়ে নিও। তবে আমার বকুল মায়ের মনটা ভীষণ সাদা।
রাহেলা হামিদুরকে সান্তনা দিয়ে বললো,
—–ও নিয়ে তুমি ভেবো না। যারা স্পষ্ট কথা বলে তাদের মন পরিস্কার থাকে। বকুল ওর মায়ের মতোই হয়েছে। মরিয়মও এমনই ছিলো।
—–ভাই আমার তো মেয়ে নেই। আল্লাহপাক আমাকে দুটো ছেলে দিয়েছেন। বকুল আমাদের কাছে মেয়ের আদরে থাকবে।
সাইফুল রায়হানের কথায় আশ্বস্ত হলেন। বকুলকে জড়িয়ে ধরে হামিদুর বললো,
—–কখনও শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে বেয়াদবী করবি না। আয়ানকে সম্মান করে কথা বলবি। সায়ানকে ছোটো ভাইয়ের আদরে রাখবি।
রাহেলা হামিদুরের কথা শুনে বললো,
—-ও ছোটো মানুষ ভাই। ওকে আপনি এতো ভারী ভারী কথা কেন বলছেন? বরং আমাদের উচিত ওর দিকে সম্পূর্ণ খেয়াল রাখা। ওতো সবাইকে ছেড়ে নিজের আপন আলয় ছেড়ে যাচ্ছে। ওকে নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। বরং আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করেন ওরা দু,জনে যেন অনেক সুখী হতে পারে।
আয়ান রাহেলার কথা শুনে মনে মনে ভাবছে,আম্মুর আদিখ্যেতা দেখলে মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়।
এরপর বকুল ওর দাদীকে জড়িয়ে ধরে। দাদীর দুচোখ দিয়ে অঝোরে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। দাদীর কান্না দেখে ও বললো,
—–তুমি যদি এভাবে কাঁদো তাহলে আমি শ্বশুরবাড়ি যাবো না।
একথা শুনে দাদী আসমা খাতুন বললো,
—–ঠিক আছে আর কাঁদবো না। সবার সাথে মানিয়ে চলবি।
এদিকে আকাশের মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়াতে রায়হান সবাইকে তাগিদ দিলো। বকুল সায়ান আর আয়ান গাড়িতে উঠে বসলো। আর একটা ভাড়া করা গাড়িতে রায়হান রাহেলা আর জরিনা উঠে বসলো।
দশ মিনিটের মধ্যে ওরা বাড়ি পৌঁছে গেল। রিক্তা এসে সবাইকে সালাম দিয়ে বকুলকে গাড়ি থেকে নামালো। জরিনা রিক্তাকে বললো,
—–বাসর খাট সাজিয়েছিস?
—–আমার রুমে ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। তাই আমার খাটটা সাজিয়েছি।
রিক্তা রাহেলা আর রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–ফুফা ফুফু তোমরা আয়ান ভাইকে নিয়ে আসো।
বকুলের ঈদ উৎসবে এ বাড়িতে আসা হয়েছে। তাই এ বাড়ির অন্দরমহল ওর ভালোই পরিচিত। বাসর খাটে বসিয়ে রিক্তা বকুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–তোকে আর আমি নাম ধরে ডাকবো না। ভাবী বলে ডাকবো। এতে আমার ভাবী বলার স্বাধ মিটবে।
—–নাম ধরে ডাকলেও কোনো সমস্যা নেই।
—–রাজপুত্তুরের মতো স্বামী পেয়েছিস। অবশ্য তুইও দেখতে রাজকন্যার মতো। দেখে মনে হয় এ যেন রাজযোটক।
—–কি জানি আপু। উনি আসার পর থেকে আমার সাথে লাগালাগি হয়েই আছে। এতে অবশ্য আমারও দোষ আছে। উনাকে দেখলেই আমার রাগ চড়তে থাকে। এখানে বিয়ে করতে আসার কি দরকার ছিলো? তাহলে তো এতো তাড়াতাড়ি আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হতো না। ঢাকায় কি মেয়ের আকাল ছিলো।
—–শোন, বিয়ের ফুল ফুটলে বিয়ে হয়ে যায়।আমি তোর বড়। অথচ তোর আগে বিয়ে হলো। তার মানে, আমার আগে তোর বিয়ের ফুল ফুটেছে। তুই তো ভাইয়ার লাইফের ঘটনা জানিস?
—–জানি, বউ চলে গেছে বলে কি দেবদাস হতে হবে? বরং ঐ মেয়ের পোষায়নি চলে গিয়ে ভালোই হয়েছে। সারাজীবন উনাকে জ্বালিয়ে মারতো।
রিক্তা ফিক করে হেসে বললো,
—–তাহলে ভাইয়াকে দেখে রাগ করছিস কেন? ঐ বউটা চলে গেছে বলেই না তুই আমার ভাইয়ের মতো রাজপুত্তুর পেয়েছিস।
—–,হু তোমার ভাইয়ের বউ হতে না আমার বয়েই গেছে। যে পরিমান গোঁয়ার গোবিন্দ না জানি আমার জীবনটাকে ত্যানা ত্যানা করে দেয়।
দরজা নক করার শব্দে ওদের দু,জনের আলাপের ছন্দপতন ঘটলো। রিক্তা এসে দরজা খুলে দেখে আয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ও আয়ানকে ভিতরে ঢুকতে না দিয়ে বললো,
—–টাকা না দিলে তোমাকে এঘরে ঢুকতে দিবে না।
—–ঠিক আছে, ঢুকবে না। আমি অন্য যেন কোনো একটা ঘরে শুয়ে পড়বো।
মনে মনে আয়ান বললো,”ঢুকতে না হলে বেঁচে যাই। ঐ জংলীর সাথে থাকতে আমার ঠেকা পড়ে নাই”।
আয়ানের কথা শোনা মাত্রই রাহেলা নিজের ব্যাগ থেকে পাঁচহাজার টাকা রিক্তার হাতে দিয়ে বললো,
—–আয়ান আমার কাছে আগেই দিয়ে রেখেছিলো।
আয়ান কটমট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
—–মিথ্যা কথা ভালোই বলতে পারো।
টাকা পেয়ে রিক্তা আয়ানকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে বললো,
—–তোমার বউ এখন তোমার কাছে বুঝিয়ে দিলাম।
রিক্তা আর রাহেলা চলে যাবার পর সায়ান এসে সুটকেসটা দিয়ে চলে গেল। আয়ান সুটকেস খুলে নিজের স্লিপিং সুট বের করে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকলো। আয়ান বের হয়ে আসলে বকুলও ওর থ্রীপিচ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। এই সুযোগে আয়ান অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঁথাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। এ রুমে শোয়ার জন্য শুধু এই খাটটাই আছে। আর একটা কাঠের চেয়ার আর টেবিল আছে। আয়ান ভাবছে ঐ মেয়ের ঠিক নাই নিজে খাটে শুয়ে ওকে হয়তো মাটিতে শুইতে বলবে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নামছে। একটু শীত শীত লাগছে। আয়ান আবার কারো সাথে কাঁথা কম্বল শেয়ার করতে পারে না। তাই পুরো কাঁথাটাই নিজের আয়ত্বে রাখলো। বকুল ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এসে আয়ানকে বললো,
—–নামাজ পড়ে নিন।
—–তোমার নামাজ তুমি পড়ে নাও। আমাকে অর্ডার করতে হবে না। সময় হলে আমার নামাজ আমি ঠিক পড়ে নিবো। বকুল আয়ানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“চান্দু বিছানা আর কাঁথা দখল করে শোয়ার মজা রাত্রে তুমি টের পাবে। তখন বিছানায় না শুয়ে ছেড়ে দে কেঁদে বাঁচি অবস্থা হবে”।
সারাদিনের ধকলে শোয়ার সাথে সাথে আয়ান ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। বকুল নামাজ শেষ করে লাইট অফ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ মাঝরাতে ধপাশ করে আয়ান বিছানা থেকে ফ্লোরে পড়ে গেল। লাইট জ্বালিয়ে দেখলো ওর জায়গায় বকুলের দু,পা ছড়িয়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না কি ঘটেছে? বকুল দুই ঠ্যাং একসাথে করে আয়ানকে লাথি মেরেছে। আয়ান মেজাজ কন্ট্রোল করতে না পেরে বকুলকে এক ঝটকায় শোয়া থেকে টেনে তুলে বললো,
—-তোমাকে তো এমনি এমনি জংলি বলি না। আদরে যে পুরো একটা বাঁদর হয়েছো বুঝতে পারছো?
জিম করা হাতে হ্যাঁচকা মেরে টেনে উঠাতে বকুল ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে কাঁদতে লাগলো। আর বললো,
—–এমনিতে আমাকে ব্যথা দিলেন আবার জেন্ডারে ভুল করলেন। বাঁদর না বাঁদরী হবে।

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-০৫

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
#পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

এদিকে দুপুরের খাওয়া শেষ করে সবাই ড্রইং রুমে বিয়ের আলাপচারিতায় বসলো। আয়ানের সামনে বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছেন না। তাই কৌশলে রাহেলা বেগম বকুলের বাবাকে বললেন,
——হামিদুর ভাই আয়ান আর বকুলের একটু নিজেদের মধ্যে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হয়। ওদের দু,জনের নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলার থাকতে পারে।
রাহেলা বেগমের কথা শুনে হামিদুর মা আসমা বেগমের মুখের দিকে তাকালেন। আয়ান রাহেলা বেগমের এ কথা শুনে মনে মনে খুশী হলো। কারন ও যে বিয়েটা নিজের ইচ্ছে করতে আসেনি এটা বকুলকে জানানো দরকার। স্ত্রীর সব দায়িত্ব ও পালন করবে শুধু স্বামীর ভালোবাসা দিতে পারবে না।আসমা খাতুন আয়ানকে সাথে নিয়ে বকুলের রুমে পৌঁছে দিয়ে বললো,
——তোরা দুজনে কথা বল। আমার একটু ব্যস্ততা আছে।
আসমা বেগম আয়ানকে বকুলের রুমে পৌঁছে দিয়ে ড্রইংরুমে এসে বিয়ের আলোচনাতে অংশ নিলো।
আয়ান বকুলের রুমে এসে অবাক হয়ে গেল। খুব সুন্দর পরিপাটি করে ঘরটা গুছিয়ে রাখা হয়েছে। খাটে বুটিকের একটা চাদর বিছানো আছে। চাদরের সাথে ম্যাচ করে জানালার পর্দা লাগানো হয়েছে। পড়ার টেবিলের বইগুলো খুব সুন্দর করে গোছানো আছে। রুমে একটা রকিং চেয়ার আর একটা নরমাল চেয়ার আছে। একটা ওয়াড্রোব আছে। ওয়াড্রোবের উপর তাজা ফুলের তোড়া ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা আছে। মানিপ্লান্ট গাছের ঝাড় আর একটা ফুলদানিতে পানি দিয়ে রাখা আছে। রুমটাতে ফুলের হালকা মিষ্টি সুবাস ভেসে বেরাচ্ছে। বকুল খাটের এক কোনায় বসে আছে। আয়ানও খাটের এক কোনায় বসে পড়লো। রুমের ভিতরে শুনশান নিরবতা। আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, “এখন দেখে মনে হচ্ছে ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু তখন যা তেজ দেখালো এই চেহারার সাথে তো সেই চেহারা মেলানো যাচ্ছে না। তবে সাধারণ পোশাকে মেয়েটাকে ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছে”। যাই হোক নিরবতা ভঙ্গ করে আয়ান বললো,
—–আম্মু চেয়েছে বলে আমি আসলে তোমাকে বিয়ে করতে আসছি। স্ত্রী হিসাবে আমি তোমার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করে যাবো তবে এর_____র
আয়ানের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই বকুল স্বমূর্তি ধারণ করে বললো,
—–এই যে মিস্টার এসব ফালতু কথা আমার সাথে বলবেন না। দামড়া বেটা হয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন ফিডারে দুধ খান। আজ বলবেন মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করতে আসছেন কাল বলবেন মায়ের ইচ্ছায় বাচ্চা পয়দা করতে আসছেন এসব ফাউল কথা আমার সাথে বলবেন না। যা বলবেন ঝেড়ে কাশবেন। আর মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করতে আসলে বিয়ে বন্ধ করেন। আপনাকে বরের মাল্য দেওয়ার আমার এতো দায় পড়েনি।
——এই মেয়ে ক বললে তুমি কলা বুঝো কেন? একটু বেশী বুঝার চেষ্টা করো। নির্লজ্জ্বের মতো বাচ্চা পয়দা করার কথা বলতে তোমার মুখে আটকালো না। নাকি আমার মতো স্টাবলিস ছেলে দেখে ঘাড়ে সওয়ার হওয়ার লোভ সামলাতে পারলে না। এতোক্ষণ জানতাম জংলী রানী। আর এখন দেখছি মুখরা রমনী।
—–এখনও সময় আছে আপনার আম্মাকে বিয়ের আয়োজন করতে নিষেধ করুন। আর আপনি বলতে না পারলে আমি গিয়ে আন্টিকে বলে আসি। আর শুনুনু ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাই না। এসব আমার সাথে চলবে না। যা বলবেন স্পষ্ট ভাষায় বলবেন।
—–তোমাকে আর পাকনামো করতে হবে না। আমারই দুর্ভাগ্য!
আয়ান মনে মনে একটু ঘাবড়ে গেল। সত্যিই যদি ড্রইং রুমে গিয়ে বলে দেয় বিয়ে বন্ধ করতে ওর বাবা মা চরম অপমানিত বোধ করবেন। এই মেয়েকে দেখে যা মনে হলো এর দ্বারা সবই সম্ভব। তবে আয়ান একটু বিরক্ত বোধ করলো।
এই চন্ডালিনীর সাথে ওকে সারাজীবন থাকতে হবে। কি কপাল নিয়ে ও জন্মেছে! ড্রইংরুমে এসে এক কোনায় সোফায় বসে পড়লো। ওদিকে বকুলও ভাবলো আয়ান নিশ্চয় বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে। আর যাই হোক বেচারা ওর মতো ঝগড়াটে মেয়েকে বউ করে নিবে না। রায়হান চৌধুরী আয়ানের মুখটা কালো দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
—–আয়ান তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তুমি ঠিক আছো তো?
—–হুম,
রাহেলা বেগম আয়ানের মুখের মানচিত্র দেখে মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেন। কখন আবার ছেলে বিয়েতে অমত করে বসে? মান সম্মান দুটোই তখন ডুববে। ঐ সুযোগে না জানি সাইফুল নিজের মেয়েকে রাহেলার কাছে গছিয়ে দেয়। রাহেলা নিজের ভাইয়ের মেয়েকে বউ করে নেওয়ার ইচ্ছে মোটেই নেই। এক তো আত্মীয়ের সাথে আত্মীয়তা করতে রাহেলার ভালো লাগে না। আর দ্বিতীয়ত জরিনার মেয়ে বলে কথা। মা যেমন হয় মেয়ে তো তেমনি হবে। জরিনা খুব স্বার্থপর। রাহেলা ওদের দুভাইয়ের একমাত্র বোন। বিয়ের আগে বড়ভাই সাইফুল ওকে চোখে হারাতো। আর ভাইটার বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে পুরো পাল্টে গেল। যদিও রাহেলা খুব বেশী আশা করে না তবুও তো নিজের বাপের বাড়ি আস্তে ইচ্ছে হয়। কিন্তু জরিনার আচরণে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। মা বাবা মারা যাওয়ার পর যখন বাপের বাড়ি বেড়াতে আসতো সাইফুল বাজার করে দিয়ে হয়তো স্কুলে চলে গেল। জরিনা রান্না করতো। কিন্তু মুরগীর রান বুকের মাংসগুলো বক্সে তুলে রেখে দিতো। মাছের বড় বড় পেটিগুলোও লুকিয়ে রাখতো। দুপুরে স্বামী সন্তান নিয়ে খেতে বসে রাহেলা লজ্জ্বায় পড়তো। কারণ হাড্ডি ছাড়া তরকারীর বাটিতে কিছুই নেই। মাছের ছোটো ছোটো পিচ অল্প করে সব্জি জরিনা টেবিলে বেড়ে দিতো। নিজের মান সম্মান রক্ষার্থে বাপের বাড়িমুখো ও খুব একটা হয় না। আর ওদিকে ছোটো ভাই আমিনুল নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করে বাবা মায়ের অবর্তমানে শ্বশুর বাড়িটাকে আপন করে নিয়েছে। আজ যে রাহেলা জলঢাকা এসেছে এটা আমিনুল জানে। তবুও দেখা করতে আসার প্রয়োজন বোধ করলো না। আয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললো,
—–আজ রাতেই তোমার বিয়ে।
আয়ান জানে, এখানে অমত করলে ওর মা,বাবা অসম্মানিতো হবে। তার উপর বাবার শরীর স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো না। তাই অমত করার সুযোগটা হাতে রেখে বললো,
—–এতো অস্থির হচ্ছো কেন? বিয়ে তো পরও করা যাবে।
সাইফুল ভাগনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
—–রাহেলা আয়ান যখন একটু সময় হাতে নিতে চাইছে তখন ওকে একটু সময় হাতে দেওয়া উচিত।
——না,ভাইজান আমার পক্ষে ওর বাবাকে নিয়ে বার বার এতোটা পথ আসা সম্ভব না। আয়ানের অফিসও এতো ছুটি দিবে না। এছাড়া শুভ কাজ ফেলে রাখতে নেই। এখানে বিয়ের কাজ মিটে গেলে বাড়ি গিয়ে রিক্তাকে দিয়ে ওদের বাসর খাট সাজানোর ব্যবস্থা করো। আর কালকের জন্য বাজার করো। হামিদুর ভাইয়েরা কাল গিয়ে মেয়ে জামাই নিয়ে আসবে। আমিও কাল সন্ধার ফ্লাইটে ঢাকা চলে যাবো। আয়ান আর বকুল গাড়িতে করে ঢাকায় ফিরবে।
রায়হানও রাহেলার কথার সাথে সহমত প্রকাশ করলো। রাহেলার কথাগুলো শুনে আয়ান আর একবার চান্স নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—–মা,বিয়ের শপিং তো কিছুই করা হয়নি?
—–সেসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমি সব গুছিয়ে এনেছি।
এ কথা বলে রাহেলা সায়ানকে বললো,
—–সুটকেসটা ভিতরে দিয়ে আয়। ০০১ পাসওয়ার্ড দিয়ে সুটকেসটা খুলতে বলিস।
রাহেলার গুছিয়ে আনা দেখে আয়ানের পুরোনো কথা মনে পড়লো। জেসিকার সাথে যখন ওর বিয়ে হয় পুরোটাই আয়ানকে গুছাতে হয়েছে। ও খেয়াল করেছে ওর মা প্রথম থেকে জেসিকাকে পছন্দ করেনি। হয়তো মায়ের অভিজ্ঞ চোখে জেসিকার ত্রুটিগুলো ধরা পড়ে ছিলো। সায়ান ভিতরে সুটকেসটা দিয়ে আসার সাথে সাথে হামিদুর লুবনান থেকে আয়ানের জন্য কেনা শেরওয়ানি কাট পাঞ্জাবীটা আয়ানের হাতে দিয়ে বললো,
—–তোমার আম্মুর কাছে মাপ নিয়ে কিনেছি। দেখতো বাবা তোমার পছন্দ হবে কিনা?
আয়ানও পাঞ্জাবীর দিকে তাকিয়ে মুখে মেকি হাসির প্রলেপ টেনে বললো,
—-না,খুব সুন্দর হয়েছে।
—–ফিটিংটা ঠিক হবে তো?
—–আম্মু যখন মাপ দিয়েছে ঠিকই হবে। আমার পাঞ্জাবী শার্ট ম্যাক্সিমাম আম্মুই কিনে থাকে।
এরপর ঘরের ভিতরে গিয়ে জুতো জোড়া সায়ানের হাতে পাঠিয়ে দিলো।
বিয়ের সুটকেস পাঠিয়ে দেওয়াতে বকুলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতো তর্ক বিতর্ক করলো তবুও বিয়েটা রোধ করা গেল না।
যথারীতি মাগরিবের আযানের পর বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। কাজী এসে বিয়ে কাজ সমাধা করলেন।আয়ান গোল্ডেন কালারের পাঞ্জাবী পরে বরের আসনে বসেছিলো। বকুলকে মেরুন লাল রঙের বেনারশী শাড়ি গায়ে জড়িয়ে হালকা সাজে বধুবেশে আয়ানের পাশে বসানো হলো। রাহেলা ব্যাগ থেকে দুটো গোলাপ বালা বকুলের হাতে পরিয়ে দিয়ে বললো,
—–এ বালা জোড়া আমার শাশুড়ী মায়ের দেয়া। আজ থেকে এর মালিক তুমি। খুব যত্ন করে রেখো। গলায় আর কানে হালকা গয়না পরিয়ে দিলো।
আয়ান একপলক বকুলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ওর পুরো পবিত্র মুখচ্ছবিটার দিক থেকে আয়ান যেন চোখ ফেরাতে পারছে না। চুম্বকের মতো ওর চোখ দুটো ঐ মুখটাতে আঁটকে আছে। সায়ান এক ফাঁকে আয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, “এভাবে তাকিয়ে থাকিস না। দেখতে খুব অড লাগছে”। সায়ানের কথায় আয়ান চোখ নামিয়ে ফেললো। এরপর বকুলের বাবা আয়ানের আঙ্গুলে একটা সোনার আংটি আর হাতে ঘড়ি পরিয়ে দিলো। ঢাকা থেকে আনা মিষ্টিগুলো বর বউয়ের সামনে দেওয়া হলো। আয়ান অবাক হয়ে দেখলো এখানে সবাই বকুলের মুখে আস্তো মিষ্টি তুলে দিচ্ছে। ও মিষ্টিগুলো কোঁত কোঁত করে গিলে খাচ্ছে। ওর আসলে মিষ্টি খুব পছন্দের খাবার। আয়ানও ভাবছে ও পিছিয়ে থাকবে কেন? ও আস্তো মিষ্টি খাওয়া শুরু করলো। যদিও মিষ্টি খেতে ওর ভালো লাগে না। কিন্তু বকুলের খাওয়া দেখে মনে হলো এই বাজিতে ও বকুলের সাথে পেরে উঠবে না। তাই ওকে থামিয়ে দিতে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
—–বাপের জনমে এতো মিষ্টি মনে হয় দেখা হয়নি। তাই লোভ সামলাতে না পেরে হাভাতের মতো খাচ্ছো?..

চলবে