অবেলার বকুল পর্ব-০৬

0
319

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

“কথাটা ভুল বললেন। কারণ আপনি বরং এতো মিষ্টি জীবনে দেখেননি। আর খাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আমি দেখেছি। পহেলা বৈশাখে ময়ড়া ডেকে নিয়ে এসে হালখাতার জন্য বাসায় আমাদের মিষ্টি বানানো হয়। বন্দরে আমাদের একটা ফার্মেসী আছে। স্কুলে মাস্টারীর পাশাপাশি আব্বু ফার্মেসীটা চালায়। আমি মিষ্টির বাক্স দেখে বড় হইনি। পাতিল দেখে বড় হয়েছি। অবশ্য আমার খাওয়া দেখে আপনার আগেই বুঝা উচিত ছিলো”।
—–আদরে আদরে মানুষ যে বাঁদর হয় তোমাকে দেখে বিশ্বাস হলো।
ওদের ফিসফাস কথা শুনে আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আয়ানের কানের কাছে সায়ান মুখ নিয়ে বললো,
—–দাদাভাই, তোরা কি এখানেই ঝগড়া শুরু করে দিলি? সবাই তো দেখছে।
আয়ান চারপাশটা ভালো করে দেখে নিজেকে সামলে নিলো। মনে মনে ভাবলো ঢাকায় চলো এরপর চান্দু তুমি বুঝবে কত ধানে কত চাল।

বকুলের দিকে তাকিয়ে রাহেলা বেগমের ভীষণ ভালো লাগলো। আজ মরিয়ম বেঁচে থাকলে ভীষণ খুশী হতো। ছোটো বেলায় ও আর মরিয়ম পুতুলের বিয়ে দিতো। আজ আয়ান আর বকুলকে দেখে ছোটো বেলার পুতুল বিয়ের নস্টালজিয়ায় হারিয়ে গেল। বিয়ের কাজ শেষ করে সাইফুল তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে গেল। যাওয়ার সময় বাসর খাট সাজানোর জন্য কিছু তাজা ফুল কিনে বাড়ি চলে গেল। বাবুর্চি ঠিক করতে হবে। কিছু বাজারও আজকে করে রাখতে হবে। জরিনা বকুলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আফসোস করতে লাগলো। আয়ানের বউয়ের স্থানটা আজ ওর মেয়ে রিক্তারও হতে পারতো। বকুলের উপর ওর হিংসার দৃষ্টি পড়লো। এই সুযোগে রাহেলার কানে বকুলের নামে বিষ ঢেলে বললো,
—–আপা,ওকে দেখে যদি মনে হয় ও সহজ সরল তাহলে ভুল করবেন। গ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে হবে ও হচ্ছে ধানী লঙ্কা।

রাহেলা জরিনার মনোভাব বুঝতে পেরে বললো,
—-এই যুগে এমন না হইলে চলে না ভাবি। তাহলে যে পদে পদে ঠোক্কর খেতে হবে।
রাহেলার পজেটিভ মনোভাবে জরিনা সুবিধা করতে পারলো না। তাই ওখান থেকে উঠে এসে আদিখ্যেতা দেখিয়ে আসমা বেগমকে বললো,
——রাত হয়ে যাচ্ছে চাচী। আকাশটা থম মেরে আছে। বৃষ্টি হতে পারে। মেঘটা যেন ঘণিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি খাবার দিয়ে দাও। আমাদের তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। আপা দুলাভাইয়ের একটু রেস্ট নেওয়া দরকার।
আসমা আর হামিদুর মিলে বর কনে থেকে শুরু করে রাহেলার পুরো পরিবারকে খুব যত্ন করে খাইয়ে দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বর আর বউকে বসিয়ে রুসমত পালন করা হলো। আসমা আয়নার দিকে তাকিয়ে আয়ানকে জিজ্ঞাসা করলো
——আয়নাতে তুমি কাকে দেখছো ভাই?
আয়ান মনে মনে বকুলের উপর রেগে ছিলো। তাই এই মুহুর্তটা কাজে লাগাতে একটুও দেরী করলো না। আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–শ্যাওড়া গাছের পেত্নি দেখছি।
আয়ানের কথা শুনে রাহেলা বিব্রতবোধ করলো। রায়হান আয়ানের এই আচরণটাকে হালকা করার জন্য বললো,
—–আন্টি আমার আয়ানের মধ্যে রসবোধ একটু বেশী আছে।
আয়ান কটমট করে বাপেরদিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,”এখানে রসবোধের কি আছে ওর তো মাথায় ঢুকছে না। যাইহোক যাকে খোঁচা দেওয়ার জন্য বলেছে সে বুঝতে পারলেই হলো”।
এবার বকুলের দিকে তাকিয়ে আসমা বেগম বললেন,
—–তুমি কি দেখছো দিদিভাই?
——বট গাছের ভুত
রাহেলা বেগম বকুলের কথা শুনে মনে মনে বললেন,”যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল”। ওদের দু,জনের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে ফেললো। তবে আয়ানের মেজাজ প্রচন্ড রকম খারাপ হলো। এই পুৃঁচকে মেয়েটার কাছে ওকে বার বার হেনস্থা হতে হচ্ছে।
সমস্ত আনুষ্টানিকতা শেষ করে বিদায়ের সময় ঘণিয়ে আসলো। হামিদুর রাহেলা আর রায়হানকে বললো,
—–মা,হারা মেয়ে আমার। জন্মের পর কোনোদিন মায়ের আদর পায়নি। আমি বাবা হয়ে চেষ্টা করেছি মা আর বাবার আদরে ওকে ভরিয়ে রাখতে। আর ওর দাদীর বুকে ও বড় হয়েছে। আমার মা ওকে প্রচন্ড ভালোবাসে। সেই কারনে একটু ফটফট করে বেশী কথা বলে। তোমরা ওকে একটু মানিয়ে নিও। তবে আমার বকুল মায়ের মনটা ভীষণ সাদা।
রাহেলা হামিদুরকে সান্তনা দিয়ে বললো,
—–ও নিয়ে তুমি ভেবো না। যারা স্পষ্ট কথা বলে তাদের মন পরিস্কার থাকে। বকুল ওর মায়ের মতোই হয়েছে। মরিয়মও এমনই ছিলো।
—–ভাই আমার তো মেয়ে নেই। আল্লাহপাক আমাকে দুটো ছেলে দিয়েছেন। বকুল আমাদের কাছে মেয়ের আদরে থাকবে।
সাইফুল রায়হানের কথায় আশ্বস্ত হলেন। বকুলকে জড়িয়ে ধরে হামিদুর বললো,
—–কখনও শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে বেয়াদবী করবি না। আয়ানকে সম্মান করে কথা বলবি। সায়ানকে ছোটো ভাইয়ের আদরে রাখবি।
রাহেলা হামিদুরের কথা শুনে বললো,
—-ও ছোটো মানুষ ভাই। ওকে আপনি এতো ভারী ভারী কথা কেন বলছেন? বরং আমাদের উচিত ওর দিকে সম্পূর্ণ খেয়াল রাখা। ওতো সবাইকে ছেড়ে নিজের আপন আলয় ছেড়ে যাচ্ছে। ওকে নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। বরং আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করেন ওরা দু,জনে যেন অনেক সুখী হতে পারে।
আয়ান রাহেলার কথা শুনে মনে মনে ভাবছে,আম্মুর আদিখ্যেতা দেখলে মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়।
এরপর বকুল ওর দাদীকে জড়িয়ে ধরে। দাদীর দুচোখ দিয়ে অঝোরে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। দাদীর কান্না দেখে ও বললো,
—–তুমি যদি এভাবে কাঁদো তাহলে আমি শ্বশুরবাড়ি যাবো না।
একথা শুনে দাদী আসমা খাতুন বললো,
—–ঠিক আছে আর কাঁদবো না। সবার সাথে মানিয়ে চলবি।
এদিকে আকাশের মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়াতে রায়হান সবাইকে তাগিদ দিলো। বকুল সায়ান আর আয়ান গাড়িতে উঠে বসলো। আর একটা ভাড়া করা গাড়িতে রায়হান রাহেলা আর জরিনা উঠে বসলো।
দশ মিনিটের মধ্যে ওরা বাড়ি পৌঁছে গেল। রিক্তা এসে সবাইকে সালাম দিয়ে বকুলকে গাড়ি থেকে নামালো। জরিনা রিক্তাকে বললো,
—–বাসর খাট সাজিয়েছিস?
—–আমার রুমে ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। তাই আমার খাটটা সাজিয়েছি।
রিক্তা রাহেলা আর রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–ফুফা ফুফু তোমরা আয়ান ভাইকে নিয়ে আসো।
বকুলের ঈদ উৎসবে এ বাড়িতে আসা হয়েছে। তাই এ বাড়ির অন্দরমহল ওর ভালোই পরিচিত। বাসর খাটে বসিয়ে রিক্তা বকুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–তোকে আর আমি নাম ধরে ডাকবো না। ভাবী বলে ডাকবো। এতে আমার ভাবী বলার স্বাধ মিটবে।
—–নাম ধরে ডাকলেও কোনো সমস্যা নেই।
—–রাজপুত্তুরের মতো স্বামী পেয়েছিস। অবশ্য তুইও দেখতে রাজকন্যার মতো। দেখে মনে হয় এ যেন রাজযোটক।
—–কি জানি আপু। উনি আসার পর থেকে আমার সাথে লাগালাগি হয়েই আছে। এতে অবশ্য আমারও দোষ আছে। উনাকে দেখলেই আমার রাগ চড়তে থাকে। এখানে বিয়ে করতে আসার কি দরকার ছিলো? তাহলে তো এতো তাড়াতাড়ি আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হতো না। ঢাকায় কি মেয়ের আকাল ছিলো।
—–শোন, বিয়ের ফুল ফুটলে বিয়ে হয়ে যায়।আমি তোর বড়। অথচ তোর আগে বিয়ে হলো। তার মানে, আমার আগে তোর বিয়ের ফুল ফুটেছে। তুই তো ভাইয়ার লাইফের ঘটনা জানিস?
—–জানি, বউ চলে গেছে বলে কি দেবদাস হতে হবে? বরং ঐ মেয়ের পোষায়নি চলে গিয়ে ভালোই হয়েছে। সারাজীবন উনাকে জ্বালিয়ে মারতো।
রিক্তা ফিক করে হেসে বললো,
—–তাহলে ভাইয়াকে দেখে রাগ করছিস কেন? ঐ বউটা চলে গেছে বলেই না তুই আমার ভাইয়ের মতো রাজপুত্তুর পেয়েছিস।
—–,হু তোমার ভাইয়ের বউ হতে না আমার বয়েই গেছে। যে পরিমান গোঁয়ার গোবিন্দ না জানি আমার জীবনটাকে ত্যানা ত্যানা করে দেয়।
দরজা নক করার শব্দে ওদের দু,জনের আলাপের ছন্দপতন ঘটলো। রিক্তা এসে দরজা খুলে দেখে আয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ও আয়ানকে ভিতরে ঢুকতে না দিয়ে বললো,
—–টাকা না দিলে তোমাকে এঘরে ঢুকতে দিবে না।
—–ঠিক আছে, ঢুকবে না। আমি অন্য যেন কোনো একটা ঘরে শুয়ে পড়বো।
মনে মনে আয়ান বললো,”ঢুকতে না হলে বেঁচে যাই। ঐ জংলীর সাথে থাকতে আমার ঠেকা পড়ে নাই”।
আয়ানের কথা শোনা মাত্রই রাহেলা নিজের ব্যাগ থেকে পাঁচহাজার টাকা রিক্তার হাতে দিয়ে বললো,
—–আয়ান আমার কাছে আগেই দিয়ে রেখেছিলো।
আয়ান কটমট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
—–মিথ্যা কথা ভালোই বলতে পারো।
টাকা পেয়ে রিক্তা আয়ানকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে বললো,
—–তোমার বউ এখন তোমার কাছে বুঝিয়ে দিলাম।
রিক্তা আর রাহেলা চলে যাবার পর সায়ান এসে সুটকেসটা দিয়ে চলে গেল। আয়ান সুটকেস খুলে নিজের স্লিপিং সুট বের করে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকলো। আয়ান বের হয়ে আসলে বকুলও ওর থ্রীপিচ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। এই সুযোগে আয়ান অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঁথাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। এ রুমে শোয়ার জন্য শুধু এই খাটটাই আছে। আর একটা কাঠের চেয়ার আর টেবিল আছে। আয়ান ভাবছে ঐ মেয়ের ঠিক নাই নিজে খাটে শুয়ে ওকে হয়তো মাটিতে শুইতে বলবে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নামছে। একটু শীত শীত লাগছে। আয়ান আবার কারো সাথে কাঁথা কম্বল শেয়ার করতে পারে না। তাই পুরো কাঁথাটাই নিজের আয়ত্বে রাখলো। বকুল ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এসে আয়ানকে বললো,
—–নামাজ পড়ে নিন।
—–তোমার নামাজ তুমি পড়ে নাও। আমাকে অর্ডার করতে হবে না। সময় হলে আমার নামাজ আমি ঠিক পড়ে নিবো। বকুল আয়ানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“চান্দু বিছানা আর কাঁথা দখল করে শোয়ার মজা রাত্রে তুমি টের পাবে। তখন বিছানায় না শুয়ে ছেড়ে দে কেঁদে বাঁচি অবস্থা হবে”।
সারাদিনের ধকলে শোয়ার সাথে সাথে আয়ান ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। বকুল নামাজ শেষ করে লাইট অফ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ মাঝরাতে ধপাশ করে আয়ান বিছানা থেকে ফ্লোরে পড়ে গেল। লাইট জ্বালিয়ে দেখলো ওর জায়গায় বকুলের দু,পা ছড়িয়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না কি ঘটেছে? বকুল দুই ঠ্যাং একসাথে করে আয়ানকে লাথি মেরেছে। আয়ান মেজাজ কন্ট্রোল করতে না পেরে বকুলকে এক ঝটকায় শোয়া থেকে টেনে তুলে বললো,
—-তোমাকে তো এমনি এমনি জংলি বলি না। আদরে যে পুরো একটা বাঁদর হয়েছো বুঝতে পারছো?
জিম করা হাতে হ্যাঁচকা মেরে টেনে উঠাতে বকুল ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে কাঁদতে লাগলো। আর বললো,
—–এমনিতে আমাকে ব্যথা দিলেন আবার জেন্ডারে ভুল করলেন। বাঁদর না বাঁদরী হবে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে