অবেলার বকুল পর্ব-০৭

0
301

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

—এই মেয়ে তুমি এতো নির্লজ্জ্ব কেন? বেহায়ার মতো এখন জেন্ডারের ভুল ধরছো?
বকুল ন্যাকা সুরে একটু জোরে কেঁদে কেঁদে বললো,
—-ব্যথা দিলেন আবার ধমকাচ্ছেন কেন?
বকুলের মুখে “ব্যথা দিলেন” শব্দটা শোনা মাত্রই আয়ান দৌড়ে এসে ওর মুখটা চেপে ধরে বললো,
—-একদম চুপ। এমনি এমনি তোমাকে নির্লজ্জ্ব বেহায়া বলিনি। বেহায়া না হলে বাসর রাতে এভাবে জোরে জোরে কেউ কাঁদে না। তোর বিছানায় তুই শুয়ে থাক। আমি তো আর সেই কপাল নিয়ে পৃথিবীতে আসিনি। বাসর রাতে সুখ নিদ্রা দিবো।
—-ওহ্ লাগছে তো! আমাকে তুই তোকারি করছেন কেন?
আয়ান মুখটা ছেড়ে দিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। বকুল আপাত যুদ্ধে জিতে ফেরার আনন্দে লাইট অফ করে দিয়ে বললো,
—-আমি লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে পারি না।
এই জংলিটার সাথে আয়ানের এই মুহুর্তে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। কথায় কথা বাড়ে।
আজ কৃষ্ণপক্ষ চলছে। চাঁদটা একটু দেরী করে উঠেছে। আয়ান ভাবছে ওর জীবনেও মনে হয় কৃষ্ণপক্ষের প্রভাব চলছে। না,হলে এতো উজাড় করে ভালোবাসার পরেও জেসিকার কাছে ওর ভালোবাসাটা ঠকে গেল। এই মুহুর্তে জেসিকার সাথে কাটানো বাসর রাতের স্মৃতিগুলো আয়ানের মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। বিয়ের আগের জেসিকা আর বিয়ের পরের জেসিকার মাঝে বিস্তর ফারাক। আয়ান বিয়ের আগে জেসিকাকে বলেছিলো,” বাসর রাতে ওরা সারারাত জোৎস্নায় ভিজবে। আর গল্প করবে। সেদিন ওদের ভালোবাসার সফলতার স্বাক্ষী হবে আকাশের চাঁদ তারা এমনকি আল্লাহপাকের পুরো সৃষ্টিকুল। জেসিকাও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলেছিলো,”দারুন আইডিয়া।” অথচ এই মানুষটাই বিয়েরদিন রাতারাতি বদলে গেল। ওর কাছে সেদিন আয়ানকে পাওয়ার থেকে কতো ভরি গয়না আর কতোদামী শাড়ি পেয়েছে সেটার মুল্যটাই বেশীছিলো।
আয়ান সেদিন ওকে রাতে জোৎস্না দেখার জন্য ছাদে যাওয়ার কথা বলতেই ও বলেছিলো,
—রাত দুপুরে কি পাগলামী শুরু করেছো? সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে। আমি এখন ঘুমোবো।
এভাবে খেঁকিয়ে কথাগুলো বলাতে আয়ানের আত্মসম্মানে লেগেছিলো। ও আর জোর করেনি। মনের গহীন অন্ধকারে ইচ্ছেটা সারাজীবনের তরে পুষে রাখলো। ও জানে, এই পৃথিবীতে সবার চাওয়া পাওয়াগুলো আলোর মুখ দেখতে পায় না। ও না হয় সেই না পাওয়া দলের অন্তভুক্ত হয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে।
আয়ানের চোখের কোনটা বিষাদের জলে আদ্র হয়ে উঠলো। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো।

সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা যেন বকুলও ছুঁয়ে গেল। আয়ানকে এরকম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়ে বকুলের নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। ও ভাবছে মানুষটার সাথে এতোটা না করলেও পারতো। ওর মতো হয়তো আয়ানেরও বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না। হয়তো উনার দগদগে ঘা টা এখনও পরিপূর্ণ শুকায়নি। আরো একটু সময়ের দরকার ছিলো। আন্টির জোরাজুরিতে হয়তো এখানে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। যেভাবে ওকে ওর মৃত মায়ের ইচ্ছা আর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হতে হয়েছে। নিয়তির উপর আসলেই কারো যেন হাত থাকে না। আয়ানের জন্য বকুলের কেমন যেন মায়া হতে লাগলো। অন্ধকারের মধ্যে ছ,ফিটের মতো বলিষ্ট মানুষটার দিকে তাকিয়ে বকুল ভাবছে, এই মানুষটার সাথে ও আজ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। একথা ভাবতেই কেমন যেন ওর শরীরে শিরশিরে অনুভূতীর সৃষ্টি হলো। মায়াটা যেন ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো। বেচারা এতোটা পথ জার্ণি করে এসেছে। তারপর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। ও বেচারাতো কারো উপর রাগ ঝাড়তে পারছে না। ও তো আয়ানের উপর আসার পর থেকে রাগ ঝেড়ে যাচ্ছে। নাহ্ বাড়াবাড়িটা একটু মনে হয় বেশী হয়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে আস্তে আস্তে আয়ানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়ানও অনুভব করছে করছে ওর ঘাড়ের কাছে কেউ একজন নিশ্বাস ফেলছে। এ যে বকুল ছাড়া কেউ নয় তা ও অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে ঠিক বুঝতে পারছে। এ ঘরে তো ও আর বকুল ছাড়া কেউ নেই। তাই বেশ গুরু গম্ভীর গলায় বললো,
—-জুতো মেরে এখন আবার গরু দান করতে এসো না। তোমার পাশে আমার আর শোয়ার ইচ্ছে নেই। তুমি যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো।
—সরি, প্লিজ ঘুম ঘুম চোখে মাথাটা গরম ছিলো। কি বলতে কি বলেছি। প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমার এখন আর ঘুম আসবে না। আপনি এতোটা পথ জার্ণি করে এসেছেন আপনার সাথে আমার এরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি।

আয়ান এতোক্ষণ বকুলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি। এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ লম্বা। আয়ান তো প্রায় ছ,ফিটের মতো লম্বা কিন্তু ওর মনে হলো বকুলও ৫–৬ইঞ্চি হবে। গলার ভয়েসটাও মিষ্টি আছে। ওর কথার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিলো আয়ান অগ্রাহ্য করতে পারেনি। আয়ান এসে বিছানায় বসলো। তবে ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলো না।মনে মনে ভাবছে জংলিটা এখন কি ফায়দা লুটবে কে জানে? বকুল খাটের কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে বললো,
—-এতোক্ষণ তো খুনসুঁটি করলাম। এখন গল্প করে আপনার মন ভালো করে দিবো। জানেন, আমার ইচ্ছে ছিলো আমার বিয়েটা যেন চাঁদনি রাতে হয়। আমি আর আমার বর চাঁদনি রাতে তিস্তার পাড় ধরে হেঁটে বেড়াবো। তারপর একটা নৌকা করে তিস্তা নদীতে আমরা দুজন ঘুরে বেড়াবো। জানেন তিস্তার জল খুব টলমলে। এতো স্বচ্ছ আপনি নদীর তলটা স্পষ্ট দেখতে পারবেন। কারন নদীতে বৈশাখ মাসে পানি খুব কম থাকে। তবে ভীষণ স্রোত আছে। নদীটা বেশ পাথুরে। নদীর জলে তলার পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়।ঐ পাথরে নদীর জল ধাক্কা খেয়ে কলকল শব্দ হয়। সে শব্দটা ভীষণ মায়াবী। আমাকে খুব টানে। তাই আমি চেয়েছিলাম নদীটা আমার বাসরের অংশ হয়ে থাকুক।সেই কারনেই চেয়েছিলাম নদীর জলে নৌকায় ঘুরে বেড়াবো আর জলের পরে আমাদের দু,জনের ছায়া দেখবো। চাঁদের ছায়া আর আমাদের দু,জনের ছায়া সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। অথচ দেখেন আমার বিয়েটা হলো কৃষ্ণপক্ষে। মাথাটা কেন গরম হবে না বলুন?আপনি খুব অবাক হচ্ছেন আর ভাবছেন আমার মাথায় কিঞ্চিৎ গন্ডগোল আছে।

একথা বলে বকুল মিটমিটি হাসতে লাগলো। হাসলে বকুলকে আরো সুন্দর লাগে। আয়ান অবাক হয়ে গ্রাম্য এক অষ্টাদশী কন্যার হাসি দেখে ভাবতে লাগলো, “মানুষের হাসি এতো নিস্পাপ কি করে হয়? আর ঐ হাসিতে মেয়েটার পুরো অবয়বে অপরুপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সৌন্দর্য যেন আয়ানের চোখ দুটোকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করলো।” রুমটা আবারো কিছুক্ষণ মৌনতার চাদর ঢেকে থাকলো। বকুল মৌনতার চাদর সরিয়ে আবারও কথা বলা শুরু করলো।
—-জানেন, তিস্তা আর আমি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তিস্তার বালুচরের বালু গায়ে মেখে আমার ছোটোবেলাটা কেটেছে। আমি বালুতে তিতির পাখির বাসা খুঁজতাম। বর্ষাকালে যখন কাশফুল ফুটে থাকতো দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। আর গল্প করবো না। আপনার মনে হয় বিরক্ত লাগছে। রাতও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আপনি শুয়ে পড়ুন।

আয়ানের আসলে বকুলের কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছে। মেয়েটার মাঝে সারল্য আছে। আর একটা বিষয় ওর ভাবতে ভালো লাগছে। ওর চাওয়ার সাথে বকুলের চাওয়াটা কিভাবে যেন মিলে গেল। আজকের রাতটা যদি পূর্ণিমা হতো ও হয়তো বকুলের ইচ্ছাটা পূরণ করতো। সত্যি সত্যি বকুলের হাত ধরে তিস্তার বালুচরে হেঁটে বেড়াতো আর জোস্নার আলোতে দুজনে ভিজতো। বিছানার দুপাশে বসা মানুষ দুটোর মাঝে আবারও অদ্ভুত নিরবতা ছেয়ে গেল। আয়ানের ইচ্ছা হলো বকুলকে বলতে,
“তুমি হাঁটবে আমার সাথে তিস্তার বালুচরে।” পর মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিলো। কেন যেন বকুলের কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে মন চাইলো না।
পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বকুল আবারো আয়ানকে বললো,
—-,আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন।
এ কথা বলে বকুল বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রাত্রীর অন্ধকার পার হয়ে সুপারী গাছগুলোর মাথাটা আলো আঁধারীর মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চারিদিকে নিস্তদ্ধতা ছেয়ে আছে। এই নিস্তদ্ধতাটুকু বকুলের ভীষণ ভালো লাগে। দূরে তিস্তা নদীটা দেখা যাচ্ছে। ও যেন এখান থেকে তিস্তার ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পারছে। ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। বকুল মাথায় কাপড় তুলে দিলো। আয়ানের আর ঘুমাতে ইচ্ছা হলো না। বকুল ওজু করতে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওজু করে এসে নামাজে বসলো। আয়ানও বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষ করে বকুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচঁড়াতে লাগলো। আয়ান নামাজ শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। বকুলের চুলের উপর ওর চোখ পড়লো। পুরো পিঠ ভর্তি বকুলের লম্বা চুল দেখে আয়ানের চোখে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়লো। চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা হলো। বকুল আয়নাতে দেখছে আয়ান ওর চুলের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। বকুলের সাথে আই কন্ট্রাক হওয়াতে আয়ানের একটু লজ্জা বোধ হলো। তাই বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দিতে বকুলকে আয়ান জিজ্ঞাসা করলো,
—-জীবন নিয়ে তোমার পরিকল্পনা কি?
বকুলের মনে হলো ওর ইচ্ছাটা আয়ানকে জানানো উচিত। তাই ও বললো,
—-আমি অনেকদূর পড়াশোনা করতে চাই। অনেকদিনের স্বপ্ন আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়বো।
—স্বপ্ন দেখলে তো হবে না। যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
—-আমার পড়তে ভালো লাগে। আমি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসি।

দরজা নক করার শব্দে দু,জনের কথায় ছন্দপতন ঘটলো। বকুল দরজা খুলে দেখলো, রিক্তা চা আর পোয়া পিঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার কাছ থেকে বকুল সরে দাঁড়াতে রিক্তা ভিতরে ঢুকে বললো,
—-রাতে তোমাদের ঘুম ঠিকমতো হয়েছে। অনেকের আবার বিছানা চেঞ্জ হলে ঘুম আসে না। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
রিক্তার কথা শুনে দু,জনের আই কন্ট্রাক হলো। রাতের ঘটনাগুলো রিক্তাকে বলে দিতে আয়ানের ইচ্ছা হলো। কিন্তু বকুলের চোখে আয়ান যেন রাত্রীর ঘটনাগুলো না বলার জন্য একরাশ অনুনয় দেখতে পেলো। রিক্তা ওদের দু,জনের চোখে চোখে কথা বলা দেখে অবাক হলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে