অবেলার বকুল পর্ব-১১

0
322

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-এগারো
মাহবুবা বিথী

আয়ান কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছে শব্দটা আসলে কোথা থেকে আসছে। হঠাৎ ওর মনে হলো পাশের রুম থেকেই তো শব্দটা আসছে? চমকে উঠলো। একথা ভাবতেই ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে বসে আপন মনেই বলতে লাগলো,
“বকুলের আবার কিছু হলো নাতো?”
তারপর চটজলদি বিছানা থেকে নেমে বকুলের রুমে এসে দেখে ও কাঁপছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে বকুলের গা পুড়ে যাচ্ছে। আয়ান ফাস্ট এইড বক্স থেকে থার্মোমিটার বের করে জ্বর মেপে দেখলো তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রী। বকুলের এই অবস্থা দেখে আয়ানের নিজের উপর রাগ হলো। কেন যেন ওর মনে হতে লাগলো মানসিক চাপ থেকেই বকুলের জ্বরটা এসেছে। আর এই মানসিক চাপের কারণ ও নিজে। বকুলের সাথে খারাপ আচরণটা মনে হয় সীমা ছাড়িয়েছে। ও আর দাঁড়িয়ে না থেকে ওয়াশরুমে গিয়ে মগে করে পানি নিয়ে আসলো। তারপর ছোটো রুমাল ভিজিয়ে ওর কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো। বকুলকে কিছুটা অচৈতন্য অবস্থায় দুহাত দিয়ে শোয়া থেকে বসিয়ে একটা নাপা খাইয়ে দিলো। একবার মনে হলো, নিচে গিয়ে মাকে ডেকে আনবে। পরে ভাবলো উনাদের শরীর এমনিতেই ভালো থাকে না। তার উপর রাত দুপুরে দরজা নক করলে উনাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। এছাড়া ওর মনে হলো রাহেলা বেগম নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে ও বকুলকে অনেক বকাবকি করেছে। এখন বকুলের এই অবস্থা দেখলে এটা নিয়ে আবার আর এক কাহিনী শুরু হবে।

ঘন্টাখানিক জলপট্টি দেওয়ার পর ঘাম দিয়ে জ্বরটা সারলো। এতোক্ষণ বকুল খুব ছটফট করছিলো। জ্বরটা কমে যাওয়াতে ও ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বকুলের পোশাক চেঞ্জ করতে হবে। কারণ ঘামে জামাটা ভিজে গিয়েছে। অতঃপর আয়ান নিজেই জামা চেঞ্জ করে ম্যাক্সি পরিয়ে দিলো। ভেজা জামাটা বাথরুমের বাথটাবে রেখে দিলো।
রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে আসছে। পাখির কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বকুলকে এ অবস্থায় রেখে আয়ানের পাশের রুমে যেতে ইচ্ছা হলো না। অগত্যা বকুলের পাশে খাটে হেলান দিয়ে বসে থাকলো। একসময় ওখানেই আয়ান ঘুমিয়ে পড়লো। বাথরুমের চাপ লাগাতে বকুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে টেবিলের উপর মগ আর ভেজা টাওয়েল দেখে ভাবলো,”এটা আবার এখানে কে নিয়ে এসেছে?”
এপাশে তাকিয়ে দেখে আয়ান বসে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর চক্ষুচড়ক গাছ হলো নিজের শরীরের কাপড় চেঞ্জ দেখে। ও পুরো শরীরটা যেন কেমন করে উঠলো। ধাক্কা দিয়ে আয়ানের ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিয়ে বললো,
—-কি মিস্টার আপনি আমার বিছানায় কেন?আর আমার পোশাক কে বদলেছে?
—-এই ঘরে তোমার পোশাক বদলে দেবার জন্য আমি ছাড়াতো কেউ ছিলো না তাই না?
—-ভালো, বিনা খরচে মুভি দেখা হলো।
—-এই শোনো, তোমার এ ধরনের কথা শুনলে না আমার মাথার চাঁদি গরম হয়ে যায়। কোথায় কৃতজ্ঞতা বোধ দেখাবে, সেটা না করে কি সব বলে যাচ্ছো? রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিয়ে সেবা করলাম, ওষুধ খাইয়ে দিলাম,ঘেমে গিয়েছো বলে পোশাক বদলে দিলাম। আর এখন সুস্থ বোধ করাতে মুখ দিয়ে কথার খই ফুটতে শুরু করেছে।
—-অনেক ধন্যবাদ। এবার আপনি আপনার রুমে চলে যান।
আসলে আয়ান ওর পোশাক বদলে দিয়েছে এটা শোনার পর ওর শরীরে যেন বিদ্যুতের শকড লাগলো। পাশাপাশি ওর দিকে তাকাতে বকুলের ভীষণ লজ্জা লাগছে।
আয়ান ওর মনের কথা বুঝতে পেরে প্রশ্নবোধক হাসি দিয়ে বললো,
—আফটার অল আমি তোমার হাসব্যান্ড। সেই অধিকার আমি ধর্মীয়মতে সামাজিকভাবে অর্জন করেছি। এতে এত কুন্ঠিত হওয়ার কিছু নাই। আচ্ছা তুমি আমার উপর এতো রেগে থাকো কেন বলতে পারো? আমি কিন্তু এই বিয়েতেই রাজি ছিলাম না। শুধু আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়েছি। তাই আমার মা আর তোমার বাবা এদের উপর তোমার রাগ করা উচিত।
বকুল আয়ানের কথার কোনো উত্তর দিলো না। মনে মনে বললো,”এই পৃথিবীতে আমার কারো উপরই রাগ করা উচিত নয়। রাগ যদি সত্যি করতে হয় সেটা আমার ভাগ্যের উপর করা উচিত।”
বকুল বিছানা থেকে ওয়াশ যাওয়ার জন্য দাঁড়ানো মাত্রই মাথা ঘুরে পড়ে যেতেই আয়ান ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। লজ্জায় বকুল ওর দুচোখ বন্ধ করে ফেলে। আয়ানের লজ্জাবনত মুখটাকে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। পর মুহুর্তে নিজেকে সামলে নেয়। একটা পুরুষালী সুবাসে বকুলও আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এভাবে আয়ানের বুকে লেপ্টে থাকতে বকুলেরও ভালো লাগছিলো। কিছুটা মুহুর্ত পার হয়ে যাওয়ার পর আয়ান বকুলকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
—-এখন বুঝতে পারছো, কেন রাতজেগে তোমার পাশে বসেছিলাম। তোমাকে আর একা ছাড়বো না। চলো, আমি তোমাকে বাথরুমে বসিয়ে দিয়ে আসি।
—-না,তা আর দরকার হবে না। তাড়াতাড়ি উঠতে যাওয়ায় এই বিপত্তি ঘটেছে। আমি আস্তে ধীরে উঠছি। আপনি আপনার রুমে গিয়ে বিশ্রাম করুন।
—-রাত শেষ হয়ে আসছে। একটু পরে ফজরের আযান দিবে। নামাজ পড়ে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিবো।

আয়ান নামাজ পড়ে নীচে চলে গেল। বকুল ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আয়ানের এই কেয়ারিংটা বকুলের মনের ভিতর ভালোবাসার আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ এমন এক অনুভব যা শুধু অন্তর দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে হয়। ভাষায় আর প্রকাশ করা যায় না। প্রতিটি মেয়ে মনে হয় ওর স্বামীর কাছে প্যাম্পার হতে চায়। বকুলের মন আজ ভীষণ ফুরফুরে। অবশেষে আয়ানের সাথে ও হানিমুন করতে কক্সবাজারে যাচ্ছে। আয়ান ওকে বলেছে, ওর জন্য নাকি কক্সবাজারে বিশাল সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। ওর যেন আর তর সইছে না। মনে হচ্ছে পাখির মতো ডানা লাগিয়ে এখনি কক্সবাজারে উড়ে চলে যেতে। উবারে করে যথাসময়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে ওরা পৌঁছে গেল। বোডিং পাস থেকে শুরু করে সব আনুষ্টানিকতা শেষ করে নভোএয়ার নামক প্লেনটায় ওরা উঠে পড়লো। বকুলের ভীষণ ভয় লাগছে। এই প্রথম ও প্লেনে উঠেছে। আয়ান যত্ন করে ওর সিট বেল্টটা বেঁধে দিলো। এরপর ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বললো,
—-ভয় পেও না, আমি তো আছি তোমার পাশে।
আসলেই বকুলের আজ ভীষণ ভালো লাগছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটা যখন সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চায় পৃথিবীটাকে তখন স্বপ্নের দেশ মনে হয়। নিজেকে মনে হয় এক প্রেমিক রাজার প্রিয়তমা রানী। নানা ভাবনায় প্লেনটা কক্সবাজার এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করলো। কটেজ থেকে আসা গাড়িতে করে বকুল আর আয়ান ওদের রিসোর্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঝাউবনে ঘেরা সৈকত আর পাহাড় বেষ্টিত রিসোর্টটির নাম মারমেইড বিচ রিসোর্ট। কটেজে ঢুকার সময় নামটা বকুলের চোখে পড়লো। বুনো ফুল আর ডাবের পানি সাথে গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে ওদের অভ্যর্থনা জানানো হলো। মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা বকুলের কাছে সিনেমার ডায়লগের মতো মনে হলো,”এতো সুখ ওর কপালে সইবে তো!”
এরপর ওদের রুমে ঢুকে ওর চোখ ছানাবড়া। পুরো বিছানা গোলাপ আর বেলী দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানার মাঝখানে গোলাপ দিয়ে হার্টসেফ বানানো হয়েছে। আয়ান বকুলকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতেই কার ডাকে ওর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সামনে আয়ানকে দেখে লজ্জায় ওর ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে গেল। আয়ান ওর অবস্থা দেখে একটু অবাক হলো। তারপর গম্ভীর হয়ে বললো,
—-সুপটা নিজ হাতে বানিয়ে এনেছি। খেয়ে নাও। আর এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে বুঝলাম নাতো?
বকুল তখনও স্বপ্নের ঘোরে আছে। ভাবছে আসলেই বাস্তবে ওর জীবনে এমন দিন আসবে তো? আয়ানকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-মারমেইড বিচে আপনি কখনও গিয়েছেন?
আয়ান অবাক হয়ে ভাবলো সুপ খেতে গিয়ে মারমেইড বিচের কথা বলছে। মাথাটা আবার আউলা হয়ে যায়নি তো। তাই ও একটু রসিকতা করে বললো,
—-স্বপ্নে কি আমার সাথে সাগরের পানিতে বেশী ডুবেছিলে যে একেবারে জ্বর বাঁধিয়ে বসলে?
—-আপনি কি করে জানলেন?
—-মানেটা কি বকুল? তুমি এরকম আবোল তাবোল বকছো কেন?
আয়ানের ধমক খেয়ে বকুলের ঘোর পুরোপুরি কেটে গেল। সুবোধ বালিকার মতো সুপটা খেয়ে নিলো। এরপর আয়ান ওর হাতে নাপা দিয়ে বললো,
—-তুমি তো মিষ্টি খেতে পছন্দ করো। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে তোমার জন্য মিষ্টি কিনে আনবো।
বকুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। আয়ান রেডী হয়ে বকুলের কাছে বিদায় নিয়ে নীচে নেমে আসলো। ও অফিসে চলে যাবার পর রাহেলা বেগম উপরে চলে আসলো। বকুলের প্রতি আয়ানের এই কেয়ারিং দেখে রাহেলার মনটা আজ ভীষণ আনন্দিতো। ছেলেটাকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে দেখে উনার ভীষণ ভালো লাগছে। বকুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-আমি নিচ থেকে বুঝতে পেরেছিলাম,উপরে কিছু একটা ঘটেছে। ইচ্ছে করেই খোঁজ নিতে আসিনি। দেখতে
চেয়েছিলাম আয়ান কিভাবে ম্যানেজ করে।
বকুলের কপালে চুমু দিয়ে রাহেলা বেগম বললো,
—তুই পারবি মা, আমার আয়ানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। একটু ধৈর্য রাখিস।
বকুল রাহেলার আনন্দ দেখে মনে মনে ভাবছে, ও যে এখনও আয়ানের উপর পরিপূর্ণ ভরসা রাখতে পারছে না।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে