অবেলার বকুল পর্ব-১২

0
320

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-বারো
মাহবুবা বিথী

রাহেলার কথাগুলো শুনে বকুল উনার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। যদিও আয়ানের উপর ওর এখনও কোনো ভরসার জায়গা তৈরী হয়নি তারপর মাতৃতুল্য এই মানুষটার সান্নিধ্যে বকুলের ভীষণ ভালো লাগে। জীবনে ওর মায়ের ভালোবাসার অভাব ছিলো। তাই বলে ও যে কষ্টে দিন কাঠিয়েছে তা নয়। বরং মা না থাকায় আরো বেশী করে সবার আদর ভালোবাসা পেয়েছে। শুধু ওর কথা চিন্তা করে ওর বাবা আর বিয়েই করেননি। দাদীও প্রচন্ড আহ্লাদে বড় করেছে। বাবা কোনোকিছু চাওয়ার আগেই সামনে এনে সব হাজির করেছে। তারপরও মায়ের ভালোবাসার প্রতি ওর একধরনের গোপন লোভ ছিলো।
বিয়ের পর শাশুড়ীমায়ের আদর ভালোবাসা পেয়ে ওর মনে হয়েছে,”মায়েরা বুঝি এমনই হয়।” বকুলকে ভাবনার সাগরে ডুবে যেতে দেখে রাহেলা বলে উঠলো,
—-কি অত ভাবছিস রে?
বকুল রাহেলাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-তোমার ছেলে আমায় ভালোবাসলো কি না বাসলো এটা নিয়ে আমার এই মুহুর্তে কোনো ভাবনা নেই। তুমি আমাকে সারাজীবন ভালোবাসবে। এতেই আমি খুশী। জন্ম থেকে মায়ের ভালোবাসা পাইনি। তাই মায়ের আদর ভালেবাসার উপর আমার বড্ড লোভ। জানো মা, আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার যে সব সহপাঠিদের দেখতাম ওরা মায়ের অনেক আদরের সন্তান তাদেরকে আমি সহ্য করতে পারতাম না। তবে আস্তে আস্তে বড় হওয়ার পর এইসব মানসিক বিষয়গুলোকে এড়াতে চেষ্টা করি। আর মনে মনে ভাবতাম যিনি আমার শাশুড়ী মা হবেন তাকে আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবো। আমি তাকে ভালোবাসলে সে আমাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না। আর এখন দেখো আমার ভাগ্য কতো ভালো আমি তোমার মতো একজন শাশুড়ী পেয়েছি। যাকে আমি ভালোবাসার আগেই তার অন্তরের ভালোবাসার উঠোনে আমার জায়গা দিয়েছেন।
রাহেলা আবারও ওর কপালে চুমু দিয়ে বললো,
—-এতো ভারী ভারী কথা শিখলি কবে বলতো?
এমন সময় রায়হান চৌধুরী ঘরে ঢুকে রাহেলাকে বললো,
—-বুড়োটাকে নিচে একা রেখে আদরের বউমার সাথে গল্প ফেঁদে দল ভারী করার কথা বলছো তাই না? সেটি হবে না। তুমি যতই আদর ভালোবাসা দাও না কেন বকুল আমার দলেই থাকবে। তাই না বকুল?
—-বাবা, আমি আপনাদের দু,জনের দলেই থাকবো। কারণ আমার যে আপনাদের দু,জনের ভালোবাসাই দরকার।
রাহেলা বেগম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বারোটা বাজে। বকুলকে বলে,
—-অনেক বেলা হয়েছে রে! আমি নিচে গেলাম। রান্নাগুলো সারতে হবে।
—-মা, আমিও আসি তোমার সাথে।
—-এই অসুস্থ শরীরে একদম বিছানা থেকে উঠবি না। আমি লাঞ্চ তোর ঘরে দিয়ে যাবো।
—-না,মা আমি একা একা খেতে পারবো না। নিচে তোমাদের সাথে খাবো।
—-ঠিক বলেছিস বকুল। আমিও একা একা খেতে পারি না। সে সময় খাবারের স্বাদ ও পাই না। মনে হয় যেন ঘাস চিবুচ্ছি।
—-বাবা আমিও আপনার সাথে সহমত পোষণ করছি।তাড়াতাড়ি আপনি গোসলটা সেরে নিন। অনেক বেলা হয়েছে। ডিসেম্বর মাস পড়েছে। একটু অবেলায় গোসল করলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে
—হুম,
উনারা দু,জন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বকুল বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আসলেই শরীরটা বেশ দুর্বল। মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে আয়ান মেসেজ পাঠিয়েছে।
“এই যে জংলী রানি,টাট্টু ঘোড়ার মতো যেন বিছানা থেকে নেমে লাফালাফি করা না হয়? মাথা ঘুরে পড়ে গেলে আমার মা, বাবা কেউ আপনাকে তুলতে পারবে না। আম্মুর তো কোমরটা ভেঙ্গে যাবে আর আব্বু হার্টে যেহেতু রিং পড়ানো আছে, আপনাকে তুলতে গেলে হার্টের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।”
মেসেজটা দেখা মাত্রই বকুলের মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। প্রথমে মনে হলো কোনো উত্তর দিবে না। পরে মনে হলো উত্তরটা দেওয়া উচিত।
“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি মনে হয় ছোটো খাটো একটা হাতি। একবার কষ্ট করে নিজের শরীরটার দিকে তাকিয়ে নিবেন। আর আপনি মনে হয় ভদ্রভাবে কথা বলতে পারেন না?”
আয়ান বকুলের রাগের পারদ আরো একটু বাড়িয়ে দিতে মেসেজে লিখলো,
“এই শরীরে আবার যেন কোচিং এ যাওয়া না হয়। ওখানে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে একজন সুন্দরী নারীর শরীর স্পর্শ করতে সবাই ছুটে আসবে। তারপর এই সুযোগে কোথায় কোথায় হাত বুলিয়ে আদর দিবে তারতো কোনো ঠিক নাই তাই না? তাই আগাম সাবধানবাণী পাঠিয়ে দিলাম।”
” আপনি ভালো করেই জানেন আমাকে সাবধান বাণী পাঠিয়ে লাভ নেই। আজকে আমার কোচিং এর সিডিউল নেই। আজকে সিডিউল থাকলে আপনার এসব সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে চলে যেতাম। তাই আমিও আগাম বলে দিলাম এসব বাণী টানি আমাকে শোনাতে আসবেন না।”

“তা ঠিকই বলেছো? অযথা উলুবনে মুক্তা ছড়িয়ে লাভ নেই।”
আয়ানের সাথে চ্যাট করে বকুলের রাগের পারদ তুঙ্গে উঠলো। মনে মনে ও ভাবলো যখনি মানুষটার সাথে সন্ধি করার কথা ভাবে তখনই ঐ লোকটা একটা ভজঘট পাকিয়ে ফেলবে।
লাঞ্চ শেষ করে বকুল বিছানায় শুয়ে ভাতঘুম দিলো। ঘর অন্ধকার হয়ে আসছে। দিনের আলো স্তিমিত হতে শুরু করেছে। গোধুলীর আবীর রঙ ছড়িয়ে পড়েছে। আজ হেমন্তিকার শেষদিন। কাল থেকে শীতের বুড়ি পৌষ প্রকৃতিতে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে নেমে আসবে। একটু একটু শীত লাগা শুরু হয়েছে। বকুল বিছানায় গুটিশুটি মেরে তখনও ঘুমিয়ে আছে। আয়ান অফিস ফেরত বাড়ী চলে আসে। বিছানায় ওভাবে বকুলকে শুয়ে থাকতে দেখে কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে দেয়। বকুলের মুখের দিকে হঠাৎ আয়ানের দৃষ্টি নিবন্ধ হয়। মেয়েটার মুখটা ভারী নিস্পাপ।ওর মুখের উপর কিছু মশা তখন ভ্যান ভ্যান করছে। বকুল ঘুমের মাঝে হাত দিয়ে বারবার সরানোর চেষ্টা করছে। কাবার্ড থেকে মশারী বের করে আয়ান টাঙ্গিয়ে দিয়ে বিছানার চারপাশটা ভালো করে মুড়িয়ে দিলো। কোনো মশা যেন ঢুকতে না পারে।
মাগরিবের আযান শেষ হলো। আয়ান পোশাক বদলে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে মাগরিবের নামাজ আদায় করলো। আয়ান বকুলের রুমে উঁকি মেরে দেখলো, তখন ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
দরজা নক করার শব্দে বকুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মশারী ঠাঙ্গানো,গায়ে কম্বল জড়ানো দেখে অবাক হলো। মনে মনে বকুল ভাবলো নিশ্চয় এটা বুইড়া খাঁটাশটার কাজ। সুযোগ পেলে আমাকে খোঁচা মারবে আবার এদিকে আদিখ্যেতা দেখাবে। ও বিছানা থেকে নামার আগেই আয়ান এসে দরজাটা খুলে দিলো। জোহরাকে চা নাস্তা আর সুপের বাটিটা টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে বললো। জোহরা চলে যাওয়ার পর আয়ান বকুলের রুমে উঁকি মেরে বললো,
—-মহারানির ঘুম ভাঙ্গলো?
বকুল আয়ানের দিকে মুখটা মোঁচড় দিয়ে তাকিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। বকুলের আচরণ দেখে আয়ান মুচকি হেসে বললো,
—-তোমার কথার উত্তর দিতে হবে না। শুধু মুখটা হা করে রাখো আমি সুপগুলো ঢেলে দেই।
—আপনার মতো আল্লাহপাক আমাকে দুটো হাত দিয়েছেন। আমি নিজের হাতেই খেতে পারবো। আপনাকে আর আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
—,আল্লাহপাক মাথা দিয়েছেন ঘামানোর জন্য। তাই মাথাটাকে ঘামাতে হয়। দেখো এরকম সুযোগ আর পাবে না। আমি তোমাকে গালে তুলে খাইয়ে দিতে চাইছি। এ সুযোগ মিস করো না। পরে কিন্তু আফসোস করতে হবে।
বকুলও আয়ানের গালে তুলে খাইয়ে দেওয়াটা এনজয় করতে চাইছে। তাই বিছানা থেকে উঠে বসলো। সুপের বাটিটা আয়ান বকুলের মুখের কাছে তুলে ধরলো। তারপর সুপের চামচটা যখনি বকুলের মুখের কাছে নিলো তখনি মোবাইলে একটা ফোন আসলো। আয়ান ও বকুল দু,জনেই মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকালো। জেসিকা নামটা জ্বলজ্বল করে স্ক্রীনে ভাসছে। আয়ান আর বকুল দু,জনের আই কন্ট্রাক্ট হলো। আয়ান বকুলের হাতে চামচটা ধরিয়ে দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। এখনও আয়ানের মোবাইলে জেসিকা নামটা সেভ করা দেখে বকুল খুব অবাক হলো। মনটাও অনেক খারাপ হয়ে গেল। যে মানুষটা ওর জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিয়েছে তার নাম কিভাবে নিজের ফোনে সেভ করে রাখে?বকুলের মাথা কাজ করছে না। যদিও বকুলের সম্পর্ক এখনও আয়ানের সাথে স্বাভাবিক নয় তবুও আয়ানের মোবাইলে জেসিকার নামটা দেখে বুকের বাঁ পাশে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো। সুপটা আর খেতে ইচ্ছে হলো না। পুরো শরীরটা কেন যেন অবশ হয়ে আসছে। বকুল টেবিলের উপর সুপের বাটিটা ঢেকে রাখলো। এরপর বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। একসময় কাঁদতে কাঁদতে বকুল ঘুমিয়ে পড়লো।
প্রায় ঘন্টাখানিকপর আয়ান বকুলের রুমে এসে দেখে,ও ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের জল শুকিয়ে গালের উপর সাদা দাগ পড়েছে। মুখটা খুবই শ্রান্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আয়ানের ভীষণ মায়া হলো। টেবিলে সুপ ঢাকা দেখে বুঝলো বকুল সুপ খায়নি। ও ওভেনে সুপটা গরম করলো। এরপর বকুলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো,
—–শোয়া থেকে উঠে বসো,সুপটা খাইয়ে দিচ্ছি।
যদিও বকুল জেসিকার পরিচয় জানে, তারপরও না জানার ভাণ করে বললো,
—-ফোন কে করেছিলো?
—-তুমি চিনবে না। সুপটা খেয়ে নাও।
—আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে না। আমি একাই খেয়ে নিতে পারবো।(অভিমানের স্বরে)
বকুল যদিও আশা করেছিলো আয়ান ওকে জেসিকার ফোনের ব্যাপারটা বলবে। কিন্তু কৌশলে এড়িয়ে যাওয়াতে বকুলের ভীষণ অভিমান হলো। তারপরও বকুল ভেবেছিলো,জোর করে আয়ান ওকে খাইয়ে দিবে। কিন্তু আয়ান সেটা না করে বকুলের হাতে সুপের বাটিটা দিয়ে দিলো। এরপর নিজের চা,টা ওভেনে গরম করে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। বকুল চামচ দিয়ে সুপটা না খেয়ে দু,চুমুকে শেষ করতে গিয়ে ভীষণ বিষম খেলো। প্রচন্ড কাশি উঠে গেল। নাক মুখ দিয়ে সুপগুলো সব বেরিয়ে পড়লো। বকুলের সেসময় প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হয়ে গোঙ্গানীর মতো শব্দ হলো। আয়ান দৌড়ে এসে বকুলের পিঠ আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বকুল একটু ধাতস্ত হয়ে আয়ানকে বললো,
—-আমার জন্য আপনার এতো ভাবনার দরকার নেই। আপনি এই রুম থেকে চলে যান।
বকুলের এমন আচরণে আয়ান খুব অবাক হলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে