Monday, July 14, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 361



অবেলার বকুল পর্ব-০৪

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

—–জ্বী_মানে
গাড়ি থেকে নেমে রাহেলা বকুলকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—–আমি তোমার রাহেলা খালা।
—–আসসালামু আলাইকুম। আজতো আপনাদের আমাদের বাসায় আসবার কথা।
—–হুম,তুমি এসময় কোথা থেকে ফিরছো?
——আমার টিচারের বাসায় পড়তে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই ফিরছি।
ততক্ষণে গাড়ি থেকে আয়ান সায়ান ও রায়হান নেমে এসেছে। আয়ান আর সায়ান একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে রাহেলা আর বকুলের কথা শুনছিলো। আয়ান ফিসফিস করে সায়ানকে বলছিলো,
—–মা কি শেষ পর্যন্ত এই জংলিটাকে ছেলের বউ হিসাবে পছন্দ করলো?
——তুমি কিন্তু আজকে ধরা খেয়েছো।
——আমার গাড়িটাকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছিলো। তাও আবার সাইকেল দিয়ে। তুই ওর সাহসটা দেখেছিস?
——যাই বলো দাদাভাই সাইকেলটা কিন্তু পঙ্খিরাজের মতো চালাচ্ছিলো। আমার কিন্তু বেশ লাগছিলো।
—–আর আমার রাগের পারদ ক্রমে বাড়ছিলো।
——তাতো বুঝতে পারছি। সেই কারনে তুমি ইচ্ছা করেই ধাক্কাটা মেরে দিলে। কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করোনি।
—–যা করেছি বেশ করেছি।
ওদিকে বকুলের সাথে রাহেলা আর রায়হানের পরিচয় পর্ব চলছিলো। রাহেলা বকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—–কেমন আছো মা?
——ভালো।
এরপর রায়হান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বকুল বললো,
——আঙ্কেল, আসসালামু আলাইকুম। আপনার শরীর ভালো?
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম,
আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহপাকের রহমতে বেশ ভালো আছি।
—–দুপুরে খাবারের সময়তো পেরিয়ে যাচ্ছে। আপনারা তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলুন। লোকেশনটা কি দেখিয়ে নিয়ে যাবো?
আয়ান একটু বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বললো,
(আপনার কারনেই তো দেরী হলো)
—–আমায় কিছু বলছেন?
——না, আপনাকে আর এতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। ঢাকা থেকে এতোটা পথ আমি তো একাই চালিয়ে নিয়ে আসছি।
—–ঢাকা থেকে আসুন আর আমেরিকা থেকে আসুন সেটা তো আমার হেডেক না। আপনি যখন আমার এলাকাতে এসেছেন এটুকু কেয়ার করা আমার ভদ্রতার মধ্যে পড়ে।
রায়হান চৌধুরী এটুকু একটা মেয়ের কাছে আয়ানের নাকানিচুবানি খেতে দেখে মনে মনে পুলকিত হচ্ছেন আর ভাবছেন এরকম একটা মেয়ে পরিবারে থাকা খুব দরকার। যে ভালোকে ভালো মন্দকে মন্দ অকপটে বলতে পারে। এমনসময় রাহেলা আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলছে,
—–কিরে তুই ওকে তখন থেকে আপনি আপনি করছিস কেন? ও তোর থেকে আট বছরের ছোটো।
——মানে কি? আমি কি ওকে নিয়ে পুতুল খেলবো নাকি।
রাহেলা আয়ানের কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে বকুলকে বললো,
—–মা,তুমি বাড়িতে যাও। যদিও অনেক পরিবর্তন হয়েছে তবুও আমি চিনে নিতে পারবো। আমিও তো এখানেই বড় হয়েছি।
বকুল চলে যাওয়ার পর রাহেলা আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–কিরে তোর কি ভদ্রতা জ্ঞান বলতে কিছুই নাই। বকুলের সামনে কি সব আবোল তাবোল বলছিস?
—–আবোল তাবোল বলিনি। ঠিক কথাই বলেছি। ঐ বাচাল মেয়েটার সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে এটা ভাবতেই মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
——এসব ভিত্তিহীন কথা না বলে গাড়িটা তাড়াতাড়ি চালানোর ব্যবস্থা কর।
আর মনে মনে রাহেলা বেগম বলছেন, তোমার মেরুদন্ড সোজা রাখার ব্যবস্থা করছি। এবার আর কোনো সাইকোথেরাপি দিবো না। এবার তোমাকে দেওয়া হবে বকুল থেরাপি। দেবদাস হয়ে থাকা এবার বার করছি। রাহেলা বেগমের মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখলো বড় ভাই সাইফুল ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করে রাহেলা বললো,
——হ্যালো, ভাইয়া এইতো চলে এসেছি।
—— আর কতদূর?
—–আর দু,মিনিট লাগবে। ফোন রাখছি।
এমন সময় বকুলও সাইকেলের ঘন্টা বাজিয়ে উঠোনে প্রবেশ করে বললো,
——মামা,উনারা এসে পড়েছেন।
হামিদূর রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে বললো,
—–তোর সাথে দেখা হয়েছে?
—–হুম,
বকুলের দাদী বের হয়ে এসে বললো,
—-তোর মুখটা বাংলার পাঁচ করে রেখেছিস কেন?
সাইকেলটা উঠোনের এক কোনায় রেখে বকুল নিজের রুমে আসলো। দাদী আসমা খাতুনও ওর পিছু পিছু এসে জিজ্ঞাসা করলো,
—–কিরে, তোর মন খারাপ?
——দাদী বিয়েটা কি করতেই হবে?
——কেন কি হয়েছে?
—–আমার অনেক পড়ালেখা করার ইচ্ছে। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হবো ছোটোবেলা থেকেই এই স্বপ্নটা দেখে আসছি।
—–তোর বাবা কথা বলেছে। ওরা বলেছে,তোকে পড়াশোনা করাবে।
—–আর ঐটাতো একটা বুইড়া খাঁটাশ।
——কেন ও আবার কি করলো?
——আমি আপন মনে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ পিছনদিক থেকে ধাক্কা দিলো।
—–ইচ্ছা করে হয়তো দেয়নি। এক্সিডেন্টলি ধাক্কা লেগেছে।
—–ইচ্ছা করে দিক বা এক্সিডেন্টলি ঘটুক এমন ছ্যাঁচা দিয়েছি বুঝবে আমি কি জিনিস?
এমন সময় গাড়ির হর্ণের শব্দে আসমা বেগম বকুলকে রেডী হতে বলে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। আয়ানের মামা সাইফুল মামী জরিনা আর হামিদুর গাড়ির কাছে এগিয়ে আসলো। বকুলের দাদী আয়ানের মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—–পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো মা?
—–না,খালাম্মা। আল্লাহপাকের রহমতে সহিসালামতে আসতে পেরেছি। মাশাআল্লাহ আমার আয়ানও খুব সুন্দর গাড়ি চালায়।
রাহেলা সায়ানকে গাড়ির বনেট থেকে মিষ্টির প্যাকেট একটা সুটকেস বের করে আনতে বললো। ও মত দিতে না দিতেই সব প্রস্তুতি নিয়ে ওর মা এখানে এসেছে দেখে আয়ান মনে মনে ওর মায়ের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলো। হামিদুর সবাইকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসালো। হামিদুর গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারী করে। বাকি সময়টা ক্ষেত খামার দেখাশোনা করে। আসমা বেগম কিচেনে চলে আসলেন। উনার সাথে আয়ানের মামীও চলে আসলো। জরিনা লেবুর সরবত বানিয়ে ফেললো। আসমা বেগম বকুলের হাতে সরবত দেওয়ার জন্য ওকে ডাকতে গিয়ে দেখেন ও একটা সুতির থ্রীপচ পড়ে বসে আছে। এটা দেখে আসমা বেগম রাগ দেখিয়ে বললেন,
—–এতো ভালো ভালো জামা কাপড় থাকতে এই থ্রীপিচটা পড়েছিস কেন?
—–আমার সুতির থ্রীপিচ পড়তে ভালো লাগে।
বকুলের মুখ গম্ভীর দেখে জরিনা আসমা বেগমকে বললেন,
——ও লেখা পড়ায় ভালো। আরো পড়াশোনা করুক। পরে দেখেশুনে একটা ফ্রেস ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিতে পারতেন। আয়ান যদিও ভালো চাকরি করে, ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে তারপরও তো ও দোঁজবর।
আসলে জরিনা ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছে। ও চেয়েছিলো ওর মেয়ে রিক্তার সাথে যেন আয়ানের বিয়ে হয়। রিক্তা জলঢাকা সরকারী কলেজে ডিগ্রী পড়ে। বকুলের দাদী জরিনার এ কথায় একটু বিরক্ত বোধ করলেন। বকুলের হাতে সরবতের গ্লাস দিয়ে ড্রইংরুমে পাঠিয়ে দিয়ে জরিনাকে বললেন,
—–রাহেলার যে রাজপুত্তুরের মতো ছেলে ঐটুকু ত্রুটি আছে বলেই না বকুলকে বউ করে নিতে রাজি হয়েছে।
—–খালা তোমার বকুল দেখতে বকুল ফুলের মতো সুন্দর। তুমি আয়ানের থেকে ভালো ছেলে দিয়ে ওর বিয়ে দিতে পারতে।
—–আয়ানকে স্বামী হিসাবে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। মায়ের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে এই মফস্বল শহর থেকে বউ আনতে রাজি হয়েছে। যে ছেলে নিজের মাকে সম্মান করে সে দিনশেষে বউকেও সম্মান করে। আর আমার বকুল সুন্দর আমি জানি। ওর ইচ্ছা ঢাকাতে পড়াশোনা করবে। গার্ডিয়ান ছাড়া ঢাকাতে পাঠাতে ভয় হয়। ওর বাবাও তো ঢাকায় গিয়ে থাকতে পারবে না। তবে এখানে বিয়ে হলে বকুলের সবকুল রক্ষা হবে।
বকুলের দাদীর কথাগুলো শুনতে জরিনার ভালো লাগলো না। আসমা বেগম জরিনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেবিলে খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন।
ওদিকে আয়ান বকুলকে দেখে খুব অবাক হলো। অতি সাধারণ একটা পোশাকে একটা মেয়েকে এতো স্নিগ্ধ লাগে ওর ধারণা ছিলো না। ওর বকুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছিলো। হঠাৎ মনে হলো এরকম একটা মেয়ের দিকে সারাজীবন তাকিয়ে থাকা যায়। একবার বকুলের চোখে চোখ পড়াতে কটমট করে বকুল ওর দিকে তাকালো। আর বিড় বিড় করে বুইড়া খাঁটাশ বলে গাল দিলো। আয়ান ওর ঠোঁটটাকে নড়তে দিকে মনে মনে ভাবতে লাগলো,এই জংলীটা কি ওকে গাল দিলো?
চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-০৩

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

“আম্মু তোমার কথা শেষ হয়েছে”?
” না এখনও শেষ হয়নি? যে মেয়েকে আমি তোমার বউ করে এ বাড়িতে নিয়ে আসবো তাকে তোমার পরিপূর্ণ স্ত্রীর মর্যাদা দিতে হবে। ওর এতোটুকু অসম্মান আমি মেনে নিবো না”।
“ঠিক আছে। স্ত্রীর প্রতি আমার যে দায় দায়িত্ব সেখানে আমার কোনো গাফিলতি থাকবে না। এর বেশীকিছু দিতে পারবো না। তুমি এখন ঘুমাতে যাও। রাত অনেক হয়েছে”।
—–তুমি খাবে না?
—–না আমি খেয়ে আসছি।
—–তবে বিয়ের পর তোমার এই অভ্যাস বদলাতে হবে।
—–মা, তুমি তো আমার বিষয়টা জানো। তাহলে সব বিষয়ে এতো জোর করছো কেন?
—–কারণ তুমি যেভাবে চলছো এটা দেখার জন্য আমি তোমাকে মানুষ করিনি? আমি জানি তুমি একজনের কাছে তোমার ভালোবাসাকে পরাজিত হতে দেখেছো তাই বলে জীবন তো এখানেই থেমে যেতে পারে না। তুমি ও সায়ান তোমরা যেন সুখে থাকো সেজন্য আমি ঢাকায় থেকে তোমাদের ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছি। যার জন্য আমি ও তোমাদের বাবা দুজনেই আমাদের গোল্ডেন পিরিয়ডটাকে সেক্রিফাইস করেছি। সুতরাং তুমি নিজেকে ভেঙ্গেচুরে আবার নতুন করে সব শুরু করবে। আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে মানুষ চেষ্টা করলে জীবনে সফলতা আসবে। ইনশাআল্লাহ, তুমিও সুখী হবে। তাহলে ঐ কথাই থাকলো, সামনের শুক্রবারে আমরা সবাই মিলে জলঢাকা যাবো।
——তুমি কি আমার জন্য বউ আনতে জলঢাকা যাবে?
—–কেন সমস্যা কি?
—–আজিব তো! ঢাকা শহরে কি মেয়ের আকাল পড়েছে?
—–ঢাকা শহরে মেয়ের আকাল পড়েনি। তবে আমার ছেলের বউয়ের আকাল পড়েছে। যা এখন ঘুমুতে যা।
একথা বলে রাহেলা বেগম আয়ানকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিলেন। আর মনে মনে ভাবলেন কাল হামিদুর ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। বেশী দেরী করা যাবে না। নিজের সই মরিয়মের মেয়েকে ছেলের বউ হিসাবে রাহেলা মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন। যদিও আয়ানের থেকে মেয়েটা ন,বছরের ছোটো হবে তাতে কি? আয়ান যেবার এসএসসি পরীক্ষা দেয় সেবার পরীক্ষার পর জলঢাকায় রাহেলা বেগম নিজের বাপের বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলেন। এরপর আর যাওয়া হয়নি। আসলে মা,বাবা কেউ বেঁচে না থাকাতে ভাইয়েরাও তেমন খোঁজ খবর করে না। দু,ভাই দুজনের মতো আলাদা থাকে। রাহেলা বেগমেরও আর বাপের বাড়ি তেমন একটা যাওয়া হয় না। বড়ভাইটা জলঢাকাতেই থাকে আর ছোটো ভাইটা রংপুর শহরে থাকে। যাইহোক এই সুবাদে বাপের বাড়ির মুখটা রাহেলা বেগম আবার দেখতে পাবেন এই খুশীতে উনি পুলকিত। মেয়েটার জন্মের পরপর মরিয়ম মারা যায়। এমনিতেই বিয়ের আট বছর পর অনেক চিকিৎসা করে মেয়েটার জন্ম হয়েছিলো। মরিয়ম মারা যাওয়াতে হামিদুরের সমস্ত অভিমান জমা হয় ঐ বাচ্চা মেয়েটার উপর। দু,বছর মেয়েটাকে কোলে নেয়নি। মেয়েটার নাম রাখা হয়েছিলো বকুল। মরিয়মের বকুল ফুল খুব পছন্দের ছিলো।
এরপর থেকে দাদীর কাছে বকুল বড় হতে থাকে। সেবার রাহেলার বকুলকে দেখে মনে হয়েছিলো এ যেন সেই ছোটোবেলার মরিয়ম। দু,বছর বয়সে বকুলের চেহারায় মরিয়মের আদল দেখে হামিদুরের সব অভিমানের বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছিলো। সেই থেকে মেয়ে আর মাকে ঘিরেই হামিদুরের সংসার আবর্তিত। উনি আর বিয়ে করেননি। যদিও হামিদুরের মা ছেলেকে বিয়ে দিয়ে আবার সংসারী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে রাজী হয়নি।

নিজের রুমে এসে আয়ান ধপাশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সাথে সাথে কিছু পুরনো স্মৃতি আয়ানকে ঘিরে ধরলো। আয়ানের চোখের কোনটা আদ্র হয়ে গেল। এক সময় ভেজা দুচোখের পাপড়িতে ঘুমের রাজ্য এসে ভর করলো।

খুব সকালে আয়ানের ঘুম ভাঙ্গলো। আয়ান বাসাতেই জিমের ব্যবস্থা করেছে। ব্যায়াম সেরে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে ফেললো। অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নিচে নামতে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর চোখ পড়লো। ওকে দেখে রায়হান সাহেব লুচির নিচে বিফের পিচগুলো লুকিয়ে ফেললেন। সেটা আয়ানের চোখ এড়ালো না। সায়ানও বাবার সাথে বসে ব্রেকফাস্ট করছিলো। ওর সকালে উদ্ভাসের কোচিং এ যেতে হবে। ও এবছর গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে এইচএসসি কমপ্লিট করেছে। আয়ান এসে ওর বাবার প্লেটের লুচি সরিয়ে টপাটপ দু,টুকরো মাংস মুখে পুড়ে সায়ানকে বললো,
—–তোর সামনে আব্বু মাংসের পিচগুলো তুলে নিলো তুই আব্বুকে কিছু বললি না কেন?
—–বললে তো আব্বু শোনে না। তাছাড়া উনি তো ছোটো বাচ্চা নন যে নিজের ভালো বুঝবেন না?
——আয়ান, তুই এটা কি করলি?
—–কি করেছি?
—–মাংসগুলো খেয়ে ফেললি। আমি লুচি কি দিয়ে খাবো?
——তোমার তো এতো প্রোটিন একসাথে খাওয়া ঠিক হবে না।
——হুম, এখন বল রোজা রাখতে। যাতে খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
——খাওয়া বন্ধ হবে কেন? সব্জি দিয়ে খাবে। তোমার বাইপাসের কথা ভুলে গেছ? আর আম্মুও বটে! সুযোগ পেলেই আমার উপর ছড়ি ঘোরাবে এদিকে তোমাকে কন্ট্রোল করতে পারে না।
আয়ানকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে দেখে রায়হান সাহেব মনে মনে ভীষণ খুশী হলেন। রাহেলা বেগম কিচেন থেকে গরম গরম লুচি আর গরুর মাংস এনে আয়ানকে খেতে দিলেন। আয়ান প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিলো। ও গোগ্রাসে মুহুর্তে লুচি আর মাংস সাবাড় করে ফেললো। তারপর চা খেয়ে অফিসের দিকে রওয়ানা হলো। সায়ানও ব্রেকফাস্ট সেরে কোচিং এর পথে পা বাড়ালো। রাহেলা বেগমও নিজের নাস্তা নিয়ে টেবিলে বসে পড়লেন। রায়হান চৌধুরী খাওয়া শেষ করে রাহেলা বেগমকে বললেন,
—–অনেকদিন পর ছেলেটাকে স্বাভাবিক হতে দেখলাম। খুব ভালো লাগলো। তুমি ওর সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছো?
—–হুম বলেছি। জলঢাকা যাচ্ছি শুনে একটু অবাক হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে।
——কবে যাবে ঠিক করেছো?
——সামনের শুক্রবার।
——আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহপাকের রহমতে ভালোভাবে যেন সব শেষ হয়। তুমি আয়ানের বিয়ে এবং ডিভোর্সের কথা হামিদুর ভাইকে বলেছো তো?
——হুম বলেছি। হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে কেন?
——দেখো ছেলে কিংবা মেয়ে বলে কথা নয়। এখনও এ সমাজে ভিভোর্সের তকমা লেগে গেলে সেটাকে ত্রুটি হিসাবে ধরা হয়। ওদের মেয়েটা ফ্রেস। জেনে বুঝে আমাদের ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে তো? বিয়ের আগেই এই বিষয়গুলো পরিস্কার হওয়া দরকার। যাতে পরবর্তীতে জটিলতার সৃষ্টি না হয়।
—–ফোন করে সবই বলেছি। শুধু আয়ানের একবছর ডিপ্রেশনে থাকার কথা বলিনি। এছাড়া আমি হামিদুর ভাইকে সবটা জানিয়ে আয়ানের জন্য মেয়ে দেখতে বলেছিলাম। হামিদুর ভাই নিজ থেকে বকুলের সাথে আয়ানের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাশি আর একটা কথাও বলেছে।
——কি বলেছে?
——বলেছে, মাতৃহীনা বকুলকে আমি যেন মায়ের ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নেই। এটুকু পেলেই উনি খুশী। উনার বিশ্বাস বকুলের অনাদর আর অবহেলা আমি কোনোদিন করবো না। সেই ভরসায় উনি আমার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।
শুক্রবারে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠার আগেই রাহেলা বেগম সবাইকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে জলঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো। রাহেলা ড্রাইভারকে সাথে নেয়নি। যেহেতু আয়ানের বিয়ের ব্যাপারে যাচ্ছে তাই কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করতে হচ্ছে। ঘরের একান্ত গোপন কথাগুলো বাইরে প্রকাশ করা হচ্ছে ড্রাইভার আর কাজের অ্যাসিসটেন্ট এর কাজ। সেই সচেতেনতা থেকে রাহেলার ড্রাইভারকে সাথে নিতে ইচ্ছা হয়নি।
ড্রাইভিং সিটে আয়ান বসেছে। খুব সকালে রওয়ানা দেওয়াতে জ্যাম শুরুর আগেই ওরা ঢাকা ছাড়তে পেরেছে। রায়হান সাহেব হুমায়ুন আহমেদ এর মিসির আলি বইটা সঙ্গে করে এনেছে। একবই যে কতোবার পড়তে পারে এটা দেখে রাহেলা অবাক হয়। সায়ান গান শুনছে। আর মোবাইলে গেম খেলছে। দশটার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে গেল। তারপর ঐ পারে ফুড ভিলেজ নামে একটা ফুড কোটে ঢুকে সকালের নাস্তার পাট চুকালো। চা কফি খেয়ে আয়ানও জড়তা কিছুটা কাটালো। অনেকদিন পর ঢাকার একঘেঁমেয়ি জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়ে সবারই ভীষণ ভালো লাগছে। গাড়ি আবারও চলতে শুরু করলো। আয়ান ভালোই গাড়ি চালাচ্ছে। ড্রাইভিং এর উপর ফ্যাসিনেশন থাকায় গাড়ি চালানোটা ভালোই রপ্ত করেছে। রাহেলা বেগম আর রায়হান সাহেব গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃষ্টিনন্দন সোনালী ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন অক্টোবর মাস। হেমন্তকাল। নবান্নের মরশুম। রাহেলা যেন মুহুর্তে তার ছোটোবেলার স্মৃতির মাঝে হারিয়ে গেল। তখনও চালের আটা তৈরী করার মেশিনের প্রচলন ছিলো না। তাই উত্তরবঙ্গে সেসময় ছাম আর গাইন(অন্যান্য অঞ্চলে কাহালছিয়া বলা হতো) দিয়ে চালের গুড়ি তৈরী করা হতো। সবার বাসায় ছাম গাইনের ধুপধাপ শব্দ। পিঠা আর পায়েসের মৌ মৌ সুবাসে চারিদিকে যেন উৎসবমুখর পরিবেশ। মরিয়ম রাহেলাদের বাসায় বেড়াতে আসতো। আবার রাহেলা ওদের বাসায় বেড়াতে যেতো। কতো না মধুর ছিলো সেসব দিন। সকালের শিশির ভেজা ঘাসের উপর হাঁটতে খুব ভালো লাগতো। শিউলি ফুল ফুটে গাছের নীচে ঝরে পড়তো। সেই ফুল কুড়িয়ে রাহেলা মালা গাঁথতো।

গাড়ি জলঢাকায় পৌঁছাতে তিনটা বেজে গেল। হামিদুর এর মধ্যে কয়েকবার রাহেলা আর রায়হানের সাথে কথা বলে নিয়েছে। এরপর বালাগ্রামের পথে গাড়ি চলতে শুরু করলো। ম্যাপ দেখে আয়ান এতোটা পথ গাড়ি সুন্দরভাবে চালিয়ে আসলো। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষাতে রাহেলার ভাবনার জগতে ছন্দপতন ঘটলো। হেজাব পড়া একটা মেয়ে সাইকেল হাতে গাড়ির জানালার কাঁচ নক করছে। আয়ান কাঁচ নামিয়ে সরি বলাতে মেয়েটা তেতে উঠে বললো,
——ফেলে দিয়ে এখন সরি বলা হচ্ছে। এই যে মিস্টার গাড়ি যখন চালাতে পারেন না তখন চালাতে যান কেন? আর একটু হলেই আমার জানটা আপনার গাড়ির চাকার তলায় পিষ্ট হতো।
—–পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া করছেন কেন? সরি বললাম তো। জংলী কোথাকার।
—–অন্যায় করছেন আবার জংলী বলে গাল দিচ্ছেন। এ যেন চোরের মায়ের বড় গলা।
ওদের চিৎকার চেঁচামেচিতে রাহেলা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
——তুমি মরিয়মের মেয়ে বকুল না?

চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-০২

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

এর মাঝে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। রাহেলা বেগম খেয়াল করলেন, জেসিকাকে আনার ব্যাপারে আয়ানের কোনো তাগিদ নেই। এটা নিয়ে উনি দুঃশ্চিন্তায় আছেন। সেদিন সকালে আয়ান অফিসে রওয়ানা দেওয়ার পর রাহেলা বেগম নাস্তার টেবিলে রায়হান চৌধুরীকে বললেন,
—–আমার কাছে বিষয়টা ভালো লাগছে না। জেসিকাকে আনার ব্যাপারে আয়ানের নিস্ক্রিয়তা আমাকে ভাবিয়ে তুলছে? কি করা যায় বলতো?
——এতো ভাবছো কেন? ভুলে যেও না ওরা ভালোবেসে বিয়ে করেছে। সুতরাং ওদের ভিতরে টানটা ঠিকই রয়েছে। হয়তো বিরহটাকে আর একটু অনুভব করে আয়ান ঠিক জেসিকাকে নিয়ে আসবে।
—–ভালোবেসে বিয়ে করেছে বলেই তো ভয়টা বেশী। বিয়ের আগেই যদি সব ভালোবাসার আদান প্রদান হয়ে থাকে তাহলে বিয়ের পরে তো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এখনকার ছেলে মেয়েরা যেমন ভালোবেসে বিয়ে করে তেমন ঘর ভাঙ্গতেও সময় নেয় না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে?
—–বেশী ভাবনা হলে বেয়াইনকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর করার ছলে জেসিকার আসার ব্যাপারে কথা বলতে পারো?
——পরামর্শটা ভালোই দিয়েছো। আজকালের মধ্যে ফোন দিবো।

আসরের নামাজ পড়ে রাহেলা বেগম জেসিকার মায়ের কাছে ফোন দেন।
—–হ্যালো বেয়াইন কেমন আছেন?
একটু গম্ভীর হয়ে জেসিকার মা বললো,
—–ভালোই আছি।
——জেসিকা কেমন আছে? ও আসবে কবে?
——ও ভালো আছে। সময় হলে যাবে।
——আমি কি গাড়ি পাঠাবো?
—–আপনার গাড়ি পাঠানো দরকার নেই। আয়ানকে বলবেন আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে হলে গাড়ি কিনে পাঠাতে হবে।
—–এ আপনি কি বলছেন? ওর তো নতুন চাকরি। ক,দিন আগে এতো গয়নাগাটি দিয়ে বিয়ে করলো। এরমধ্যে গাড়ি কেনার পয়সা কোথায় পাবে?
——সেটা তো জেসিকার বুঝার কথা নয়। স্বামী হিসাবে বউয়ের সবদিকে খেয়াল রাখা আয়ানের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। গাড়ির কারনে যার তার কাছে আমার মেয়ে কথা শুনতে পারবে না। আর গয়নাগাটির কথা বলছেন, অথচ আপনারা তো উসুল হিসাবে দশ লক্ষ টাকা কাবিনের মধ্যে পাঁচলক্ষ টাকা দেখিয়ে দিয়েছেন। তাহলে এটা এতো ঘটা করে বলার কি আছে? আমি একটু ব্যস্ত আছি। এখন রাখি।
ঠাস করে জেসিকার মা ফোনটা রেখে দিলো। রাহেলা বেগম ভীষণ অবাক হলেন। ভীষণ টেনশনে পড়লেন। জেসিকার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলেছেন এটা সবার কাছে গোপন রাখলেন। রায়হান চৌধুরীর হার্টে রিং পরানো আছে। সে কারনে বেশ ভালোভাবেই গোপনীয়তা রক্ষা করলেন। রাহেলা বেগম উনাকে এসবের মধ্যে জড়াতে চাইলেন না।তাই রাতে খাবার টেবিলে আয়ানকে বললেন,
—–জেসিকা আর কতোদিন বাপের বাড়ি থাকবে। ওকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর?
——মা ও যখন নিজ থেকে বাপের বাড়ি চলে গেছে আসতে হলে ওকে নিজ থেকেই আসতে হবে। আমার অতো দায় পড়েনি ওকে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসবো।
রায়হান চৌধুরী একটু চিন্তিত হয়ে বললেন,
—–এটা কেমন কথা হলো আয়ান? দু,জনকে জেদ করলে তো সংসার চলবেনা। একজন একটু ছাড় দিতে হবে।
——বাবা আমার পক্ষে আর ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।
রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে রায়হান চৌধুরী বললেন,
——তুমি ফোন করেছিলে?
——না,সময় পাইনি।
——আম্মু তুমি ফোন দিবে না। আর আব্বু তোমার শরীর ভালো থাকে না। তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নিজের শরীর খারাপ করো না।

এর মধ্য একমাস পার হয়ে গেল। তখন ছিলো জুন মাস। আয়ানের অফিসে অডিট চলছিলো। এর মাঝে জেসিকা আয়ানকে ফোন দিয়ে বলে,
——তুমি আমাকে নিতে আসছো না কেন?
——তোমাকে কেউ ও বাড়িতে চলে যেতে বলেনি। তুমি নিজে থেকেই যখন গিয়েছো তখন নিজ থেকেই তোমাকে আসতে হবে। অফিসে অডিট চলছে। ব্যস্ত আছি। ফোন রাখো।
আয়ান ফোনটা রেখে দেওয়ার পর জেসিকার খুব আত্মসম্মানে লাগে। ওর ধারণা আয়ান ইচ্ছে করেই ওকে এভয়েড করার জন্য ফোন রেখে দিয়েছে। তাই ওকে শায়েস্তা করার জন্য অফিসের কাছে চলে আসে। তারপর ওকে ফোন দিয়ে বলে,
—–আয়ান আমি তোমার অফিসের নীচে আছি। তুমি এই মুহুর্তে না আসলে আমি আমার হাতের রগ কেটে ফেলবো।
আয়ানের তখন মিটিং চলছিলো। ও আস্তে করে ফোনে বলে তোমার যা ইচ্ছা হয় তাই করো। আমি এখন অফিসের মিটিং ফেলে নীচে নামতে পারবো না।
আয়ান ফোনটা রেখে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর নীচের দারোয়ান দৌড়ে এসে মিটিং এ সবার সামনে আয়ানকে বলে,
—–স্যার আপনি যা করতে বলেছেন ম্যাডাম তাই করেছে।
মিটিং এ উপস্থিত আয়ানের বস আফজাল খান দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে,
——আয়ান কি করতে বলেছে?
——ম্যাডামের হাতের রগ কেটে ফেলতে বলেছে?
আফজাল খান আয়ানের উপর রেগে গিয়ে বললেন,
——ছিঃ আয়ান চৌধুরী, আমি আপনাকে ভদ্রলোক বলেই জানতাম। অথচ ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে আপনি হোম ভায়োল্যান্সে লিপ্ত আছেন? খুবই দুঃখ জনক! আপনার মিটিং এ থাকতে হবে না। স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
আয়ান নিচে এসে জেসিকাকে অফিসের পাশে একটা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানে জেসিকার হাতে স্ট্রীচ দেওয়া হয়। এরপর আয়ান জেসিকার বাবাকে ফোন দিয়ে ডেকে মেয়েকে তার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসে।
এরপর আয়ান আর জেসিকার সাথে সংসার করতে চায় না। ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়। কাবিনের পাঁচ লক্ষ টাকা আয়ান জেসিকাকে বুঝিয়ে দেয়। এরপর ট্রাক নিয়ে এসে জেসিকার বাবা আয়ানদের বাসা থেকে সব ফার্ণিচার নিয়ে যায়। অতঃপর আয়ানের এতো ভালো চাকরিটাও চলে যায়। কারণ জেসিকা অফিসে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে আয়ান ওকে নির্যাতন করতো। একসাথে এতোগুলো আঘাত হজম করতে না পেরে আয়ান ডিপ্রেশনে চলে যায়। এদিকে রায়হান সাহেবের শরীরও খারাপ হতে থাকে। সায়ান তখন ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। অসুস্থ শরীরে ছেলের ভিভোর্সর ধাক্কা সামলাতে না পেরে হার্টের অবস্থা অনেক বেশী খারাপ হয়ে যায়। যার ফলে উনাকে বাইপাস করতে হয়। সেসময় সায়ান মা বাবাকে অনেক সহযোগিতা করে। এদিকে আয়ানের মানসিক অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে থাকে। অতঃপর রাহেলা বেগম ছেলেকে স্বাভাবিক করতে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানোর ব্যবস্থা করলেন। প্রথমদিকে আয়ান যেতে চাইতো না। পরে কল করে বাসায় ডেকে আনার ব্যবস্থা করলেন। এতে ভিজিটও অনেক টাকা গুনতে হলো। তবে উনার কাছে এই মুহুর্তে ছেলের সুস্থতা সবার আগে। তাই টাকা পয়সার বিষয়টা আমলে নিলেন না। একবছর চেষ্টার পর আয়ান অনেকটা সুস্থ হয়। এরপর বিভিন্ন চাকরিতে ইন্টারভিউ দিতে থাকে। অবশেষে ইউনিলিভারে চাকরি হয়। চাকরি পাওয়ার পর থেকে ও একটু রাত করে বাড়ি ফেরা শুরু করে। এখানে চাকরি করছে দশ মাস। প্রথমে অফিস ফেরত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতো। তবে বেশ কিছুদিন হয় অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। আর রাহেলা বেগমেরও ছেলের জন্য জেগে থাকে আর আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করে ছেলের যেন সুমতি হয়।
নিচে গেট খোলার শব্দে রাহেলা বেগম ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসলেন। বাইকের শব্দে বুঝতে পারলেন সেজান এসেছে। ড্রইংরুমের সবগুলো আলো নেভানো আছে। শুধু একটা মৃদু আলো টিম টিম করে জ্বলছে। দরজাটা ভেজানো ছিলো। আজ আয়ান একটু বেশীই দেরী করে ফেলেছে। জেসিকার সাথে ডিভোর্সের পর আয়ান বাবা মায়ের সাথেই থাকে। তিনতলাটা তালাবদ্ধ করে রাখা আছে। ও পা টিপে টিপে ভেজানো দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে যখনি উপরে উঠতে যাবে অমনি বেশ রাশভারী গলায় রাহেলা বেগম বলে উঠলেন,
——-এভাবে চোর ছ্যাচ্চোড়ের মতো ঘরে ঢুকছিস কেন। জানিসই যদি এতো রাত করে ঘরে ফেরা অন্যায় তাহলে এ কাজ কেন করিস?
——-তুমি এখনও ঘুমাওনি? তোমাকে না বলেছি আমার জন্য না জেগে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে। আমার ফেরার সময় ঠিকই ফিরে আসবো।
——তুই তো বলেই খালাস। কিন্তু আমি তো মা। তোদের জন্ম দিয়েছি। তোর বাবার বদলির চাকরি ছিলো। বলতে পারিস এক হাতেই তোদের বড় করেছি। আমারও তো ইচ্ছে হয় তোদের সুখী সুন্দর জীবন দেখতে। এভাবে আর কতদিন চলবে আয়ান? তোমার বাবার বাইপাস হয়েছে। তার শরীর ও ভালো থাকে না। আমারও বয়স হয়েছে। এবার তো জীবনটাকে নিয়ে তোর নতুন করে ভাবা উচিত।
——জীবনটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে গেলে কি করতে হবে বলো?
——বিয়ে কর।
——আমার পক্ষে এখন পাত্রী খোঁজা সম্ভব না।
——তোকে কিছুই করতে হবে না। এবার আমার উপর পুরোটা ছেড়ে দে।
——ঠিক আছে।
যদিও আয়ান মত দিলো কিন্তু রাহেলা বেগম মা হয়ে ছেলের বুক ভরা দীর্ঘশ্বাসের চাপা কষ্টটা ঠিকই অনুভব করতে পারলো।
চলবে

অবেলার বকুল পর্ব-০১

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ জানান দিলো কাঁটা বারোটা ছুয়েছে। রাহেলা বেগম এশার নামাজ পড়ে ছেলে আয়ান ফেরার অপেক্ষায় ড্রইংরুমে বসে আছেন। বছর খানিক ধরে উনাকে এই রুটিন মেনে চলতে হয়। যদিও এটা হওয়ার কথা ছিলো না। রাহেলা বেগমের খুব সুখের সংসার ছিলো। স্বামী সরকারী অফিসার ছিলেন। বদলীর চাকরি। সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াতে হতো। রাহেলা বেগম দুই ছেলে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডে দু,কাঠার একটা সরকারী প্লট পেয়েছিলেন। ওখানে ব্যাংক লোনের সহযোগীতায় পাঁচতলা বাড়ির ফাউন্ডেশন দিয়েছিলেন। আপাতত তিনতলা করেছেন। নিজেরা ডুপ্লেক্স নিয়ে থাকেন আর একটা ফ্লোর ভাড়া দিয়েছিলেন। আয়ান তখন সবে সেন্ট জোসেফ স্কুলে ক্লাস থ্রীতে চান্স পেয়েছে। আর সায়ানের তখন একবছর বয়স। দু,ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান ন,বছর। মাশাআল্লাহ রাহেলা বেগমের ছেলেদুটো যেমন মেধাবী তেমনি মায়ের কথাশুনে চলতো। প্রতি বৃহস্পতিবার স্বামী রায়হান চৌধুরী ঢাকায় চলে আসতেন। স্ত্রী সন্তানদের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করে নিজের কর্মস্থলে ফিরে যেতেন। আয়ান স্কুল, কলেজ পার হয়ে ঢাকাভার্সিটিতে আইবিএ তে ভর্তি হয়। এদিকে সায়ানও সেন্টজোসেফ স্কুলে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়। আয়ানের সাথে ভার্সিটিতে জেসিকার পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে দু,জনের মধ্যে মন দেয়া নেয়া শুরু হয়। এরমাঝে আয়ান মা রাহেলা বেগমের সাথে জেসিকার আলাপ করিয়ে দেয়।প্রথম দর্শনে জেসিকাকে রাহেলা বেগমের খুব একটা ভালো লাগেনি। মাঝে মাঝে আয়ান ঐ মেয়ের সাথে ঘুরতে যেতো। আয়ান মুখে কিছু না বললেও ওর মা ঠিক বুঝতে পারতো। যেদিন ঘুরতে যেতো আয়ান সেদিন গাড়ি নিতে চাইতো না। পরে একদিন রাহেলা বেগমই ছেলেকে বলেন,”আয়ান তুমি জেসিকাকে নিয়ে প্রায় ঘুরতে যাও বিষয়টা আমার পছন্দ নয়।তোমরা ইয়ং দু,জন ছেলে মেয়ে একসাথে টাইম স্পেন্ড করো আমার অস্বস্তি হয়”। আয়ানও রাহেলা বেগমকে বলে,” আম্মু ওকে আমি ভালোবাসি। বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো। সুতরাং একসাথে সময় কাটালে আমরা দু,জন দুজনকে ভালোমতো বুঝতে পারবো”।রাহেলা বেগমও ছাড়বার পাত্রী নন। উনিও বলেন,”আমি আর তোমার বাবা যে টাইম স্পেন্ড না করে বিয়ে করেছি তো আমাদের দু,জনকে বুঝতে তো কোনো সমস্যা হয়নি”। আয়ান মায়ের সাথে একমত হয় না। এদিকে রাহেলা বেগমও ছেলেকে নিয়ে টেনশনে থাকেন। কখন কি অঘটন ঘটে যায়। অগত্যা ছেলেকে বলেন,”আমার নিষেধ সত্বেও তুমি জেসিকাকে নিয়ে ঘুরতে যাও বুঝতে পারি। কিন্তু এরপর আমাকে জানিয়ে যেও। আমি তোমাকে বাধা দিবো না। কিন্তু কোনো বিপদ আপদ হলে অন্তত আমি তোমার অবস্থান বুঝতে পারবো”। সময়ের উল্টোস্রোতে উনি হার মানলেন। নিজের ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সারাদিন দুটো ইয়ং ছেলেমেয়ে একসাথে সময় কাটায় একজন মা হিসেবে রাহেলা বেগমের বিষয়টা ভালো লাগে না। যাই হোক ছেলে কষ্ট পাবে বলে এবিষয়টা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করেননি। তবে পাশ করার সাথে সাথে বিয়ে দিবেন এই বিষয়টি মনস্থির করলেন। আয়ান জেসিকার উপর খুব দুর্বল ছিলো। মা হয়ে উনি এটা ভালোই বুঝতে পারতেন। তাই জেসিকার বিষয়ে কোনো নেগিটিভ কথা ছেলেকে কখনও বলেননি। এখানে কোনো সেশনজট না থাকার কারনে চারবছরে আয়ান আর জেসিকার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যায়। ততদিনে রায়হান সাহেবও বদলি হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসাবে শিক্ষা অধিদপ্তরে পোস্টিং হয়। পাশ করার সাথে সাথে আয়ানের ও বৃটিশ টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি হয়। চাকরিটা খুব লুক্রেটিভ দেখে বিদেশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে এখানেই জয়েন করে। অপরদিকে জেসিকা তখন ওকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। এবং কিছু শর্ত আয়ানের উপর চাপিয়ে দেয়। ওকে দশ ভরি গোল্ড দিতে হবে। বেশ প্রমিন্যান্ট একটা কনভেনশন হলে বিয়ের আয়োজন করতে হবে। আয়ান রাহেলা বেগমকে এসব কথা জানালে উনি দশ ভরি গয়না দিতে অস্বীকৃতি জানান। আসলে সোনার এখন যা দাম দশভরি গোল্ড কেনা সহজ কথা নয়। এসব নিয়ে মায়ের সাথে আয়ানের নিত্য অশান্তি হতে থাকে। বাধ্য হয়ে রাহেলা বেগম ছেলেকে বলে,
“তোমাকে সংসারে কোনো কন্ট্রিবিউট করতে হবে না। তোমার বেতনের টাকা দিয়ে বউয়ের গয়না বানাও”।
এতে রাহেলা বেগমের সংসারে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। তবে রায়হান সাহেব খুব মনক্ষুণ্ন হন। তার কথা হচ্ছে,
” ঐ মেয়েকে তো বুঝতে হবে আয়ানের সামর্থ কতটুকু। একজন স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর সামর্থ বোঝা আর স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর ভরণপোষণ ঠিকভাবে পালন করা”।
রাহেলা বেগম এসব টানা পোড়েনে ছেলেকে একদিন বলেন,
“তুই এতো সুন্দর চাকরি করছিস, জেসিকাও তো ঐ একই ডিপার্টমেন্ট থেকে পাশ করেছে। ওকে চাকরি করতে বল। হাতে পয়সা থাকলে জেসিকারও মন মেজাজ ভালো থাকবে”।
আয়ান মাকে জানায়,” ও চাকরি করবে না। অনলাইন বিজনেস করবে”।
আসলে জেসিকা তো আইবিএ তে পড়াশোনা করলেও আয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে পুরোটাই কমপ্লিট করেছে। অথচ চাকরি ক্ষেত্রে নিজের কোয়ালিটি শো করতে হবে। কিন্তু জেসিকার নিজের উপর সেই কনফিডেন্ট নাই। তাই অনলাইন বিজনেসে নামতে চাইছে। আয়ান জেসিকার দুর্বলতা বুঝতে পারছে তাই চাকরি করার জন্য জেসিকাকে চাপ দিতে চাইছে না। এমনকি জেসিকাকে এই অপশনও দিয়েছে ওর মন না চাইলে ওকে কিছুই করতে হবে না। শুধু সংসারটা ঠিকমতো সামলে রাখতে পারলেই আয়ান খুশী।
বছর দুয়েক সময় হাতে নিয়ে দশ ভরি গোল্ড দিয়ে গয়না বানালো আয়ান। সে সময় আয়ানের বাবা রায়হান চৌধুরীও এলপিআর এ গেলেন। কিছু টাকাও হাতে পেলেন। সব মিলিয়ে আয়ান আর জেসিকার বিয়েটা ভালো ভাবেই হলো। জেসিকার বাবার বাড়ি থেকে কিছু ফার্নিচার দেওয়া হলো। সেটা রাখতে গিয়ে রায়হান চৌধুরী উনার তিন তলার ভাড়াটিয়াকে উঠিয়ে দিলেন। ঐ ফ্লাট খুব সুন্দর করে ফার্নিচারগুলো দিয়ে সাজানো হলো। তবে আলাদা ফ্লাটে উঠলেও আয়ানের বাবা রায়হান চৌধুরী ওদেরকে ডেকে বললেন,
“তোমরা আলাদা থাকলেও একসাথে খাওয়া দাওয়া চলবে”।
কথাটা জেসিকার ভালো লাগেনি। ও নিজে কিছু বলেনি। ওর মাকে এই বিষয়টা জানিয়েছে। ওর মা রাহেলা বেগমকে ফোনে বলেছে,
” বেয়াইন ওরা যেহেতু আলাদা আছে তো খাওয়া দাওয়াও আলাদা করুক। বিয়ে যখন হয়েছে তখন নিজেদের সংসার যত তাড়াতাড়ি বুঝে নিবে আপনার আমার জন্য ততই মঙ্গল”। একথা শুনে রাহেলা বেগমের মনে আঘাত লাগলেও বাহ্যিকদিক থেকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেন। জেসিকার মায়ের কথা শুনে রাহেলা বেগম একটু অবাক হলেন। মেয়েকে উনি একটু বোঝাতে পারতেন সেটা না করে বরং মেয়ের অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দিলেন। তুলনামুলক জেসিকার বাবাকে রাহেলা বেগমের ভালো লেগেছে। ভদ্রলোক নিপাট ভালোমানুষ। সংসারে মনে হয় জেসিকার মায়ের প্রভাব বেশী। বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে ভদ্রলোকের দুটো দোকান আছে। ব্যবসা নিয়েই হয়তো বেশী ব্যস্ত থাকেন। জেসিকার বড় বোন আছে। ওর হাসবেন্ড ও ব্যবসা করে। একটা চার বছরের ছেলে আছে। তবে ওর বড় বোন মায়ের সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখে না। কারণ জেসিকার মা মেয়েদের সংসারে খুব মাথা ঘামায়। আয়ানের বিয়ের পরে রাহেলা বেগম জেসিকাদের এক আত্মীয়ের কাছে এই খবর জানতে পারেন।
তবে জেসিকার মায়ের এই আব্দার আয়ানের কাছে ভালো লাগেনি। যদিও আয়ান জানতো এতে জেসিকার ইন্ধন আছে। তবুও সংসারের শান্তির জন্য পুরো বিষয়টা হজম করে নিলো। কিন্তু ও নিজের মতো করে চলতে লাগলো। এরপর থেকে সকালে নিচে নেমে মায়ের সাথে ব্রেকফাস্ট করে অফিসে যাওয়া শুরু করলো। সন্ধায় বাসায় ফিরে বাবা মায়ের সাথে চায়ের পর্ব শেষ করে ঘরে ফিরে শুধু ডিনার করতো। যদিও এ বিষয়গুলো নিয়ে ওদের মাঝে নিত্য অশান্তি শুরু হয়। তারপরও রাহেলা বেগম ছেলেকে বুঝিয়ে বলে,”জেসিকা যখন মানতে চায় না তাহলে তুই নিচে বেশী আসিস না”।
আয়ানও বলে,”না, মা আমি ওর এই অন্যায় আবদার মানতে পারবো না। ও যা বলেছে আমি তো তাই করেছি। আমার কষ্ট হলেও ওর চাওয়া অনুসারে বিয়ের আয়োজন করেছি। ওকে নিয়ে থাইল্যান্ডে হানিমুনে গিয়েছি। বাংলাদেশের কোথাও হানিমুন করতে আমি বলেছিলাম। ও আমার কোনো কথা শোনেনি। ওর নাকি বান্ধবী আত্মীয়স্বজনদের কাছে স্ট্যাটাস থাকবে না। অথচ আমার যে কষ্ট হলো সে বিষয়টা ওর চোখে পড়লো না”।
এরমাঝে বিয়ের দুবছর সময় পার হয়ে গেল। একদিন জেসিকা রাহেলা বেগমকে না জানিয়ে ড্রাইভার মতিকে নিয়ে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিতে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। সেদিন রায়হান সাহেবের হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হয়। সায়ান তখন এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বাসায় বসে পড়াশোনা করছিলো। রাহেলা বেগম ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে জানতে চায় ও কোথায়? ড্রাইভার বলে বউমনিকে নিয়ে ধানমন্ডী শেফস টেবিলে আসছে। উনি ও জানতে চান ওখানে কি দরকার? ড্রাইভার জানায়,”বউমনির বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে আসছে”। এদিকে গাড়ি এসে রায়হান সাহেবকে হাসপাতালে নিতে দেরী হয়ে যাবে। তাই সায়ানকে দিয়ে উবার ডেকে রায়হান সাহেবকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দি হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু মনে মনে জেসিকার উপর উনি প্রচন্ড বিরক্ত হন। এক সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে রায়হান সাহেবকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। উনার দুটো ব্লক ছিলো। রিং পড়ানো হয়েছে। বাসায় এসে এই বিষয়টি নিয়ে আয়ানের সামনে জেসিকাকে রাহেলা বেগম বলেন,
——আমার ছেলেরাও গাড়ি নিয়ে বের হতে চাইলে আমার অনুমতি নিতো। অথচ তুমি আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলে না? তোমার শ্বশুরকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে না নিতে পারলে হয়তো বড় কোনো ক্ষতি হতে পারতো? ভাগ্যিশ আল্লাহপাকের রহমত ছিলো। সায়ান বাসায় থাকাতে ট্যাক্সি ডেকে হাসপাতালে সময়মতো নিতে পেরেছি।
——আয়ানকে বলে গিয়েছি।
——এই সংসারটা আমার। সর্বোপরি গাড়িটা তোমার শ্বশুর কিনেছে। সেদিকে খেয়াল রেখে হলেও তোমার আমার অনুমতি নেওয়া দরকার ছিলো। ঠিক আছে এরপর গাড়ি নিয়ে বের হতে চাইলে তুমি আমার অনুমতি নিয়ে বের হবে।
বিষয়টা জেসিকা স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। সেদিন সন্ধা বেলায় ও বাবার বাড়ি চলে যায়।

চলবে

প্রেম রাঙানো ক্যানভাস পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেম_রাঙানো_ক্যানভাস💜
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#অন্তিম_পর্ব

ছাদে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। মনটা বড্ড খারাপ। তারও বিয়ে! হ্যাঁ তার বিয়ে। তাও ধূসর নামক লোকটির সাথে। যার সাথে দুমিনিট থাকলেই তার ঝগড়া বাদে। সে কিভাবে সারাটা জীবন থাকবে লোকটির সাথে। এটাই সে ভেবে পায় না। তবে তার আব্বু আম্মু যা ঠিক করেছে তাতেই সে খুশি। মত দিয়েছে বিয়েতে সে। ধূসরকে তার ততোটাও খারাপ লাগে না। লোকটা খারাপ নয়। ভালোই। ধূসর ছাদে উঠে দেখে অরিন দাঁড়িয়ে নিজের ভাবনায় বিভোর। অরিন কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে পাশ ফিরে চাইলো ধূসরকে দেখলো তবে কোনো প্রতিক্রিয়া করলো নাহ।

“তোমার আমাকে বিয়ে করতে কোনো সমস্যা নেই তো প্রিটি গার্ল”

অষ্টাদশী চোখ তুলে তাকালো। সুদর্শন পুরুষটির সাথে চোখাচোখি হলো। অষ্টাদশী দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। পুরুষটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
সে তেজী কন্ঠে বলল,,,

“প্রিটি গার্ল কি হ্যাঁ?নাম আছে আমার একটা সেইটা বলে ডাকুন। আর বিয়ে! আব্বু রাজি বিধায় আমি রাজি হয়েছি না হলে আপনার মতো বিদেশী বাদুড়কে আমি বিয়ে করতাম নাহ”

মেয়েটি উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো। যার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসলো ধূসর । রমনীকে রাগলে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। তার জন্যই ধূসর বারবার তাকে এটা ওটা বলে রাগিয়ে দেয়।

“বোম্বায় মরিচ তোমাকে রাগলে আসলেই অনেক প্রিটি লাগে।”

অরিন সোজা নিচে নামলো। অনামিকা ইসলাম তাকে দেখে কাছে ডাকলেন। অরিন ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলো। অনামিকা ইসলাম ইশারায় পাশে বসতে বললো। অরিন পাশে বসতেই অনামিকা ইসলাম বললেন,,,
“অরিন মা তুই তো শুনেছিস সব। তোর কি বিয়েতে মত আছে?”

“ফুপি তোমরা যা করবে তা আমার ভালোর জন্যই করবে। যেখানে সবাই রাজি সেখানে না বলার কোনো প্রশ্নই উঠছে না”

“আলহামদুলিল্লাহ। ছোটখাটো আয়োজন করে শুক্রবারেই তোদের বিয়েটা হয়ে যাক তাহলে। এ কদিন দুজন দু’জনকে চিনেও নে কিছুটা”

অরিন সম্মতি জানায়। অরিন নিজের রুমে চলে আসে। ফোন বাজছে অরিনের। রাহিয়া কল করেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রাহিয়া বলে উঠলো,,,
“কি রে নতুন বউ দেখলি তো সেই ধূসর ভাইয়ের সঙ্গেই তোর বিয়ে হচ্ছে। আমি যখন বলেছিলাম তখন তো কত কথা বললি”

“ভাগ্যে ছিলো সে আমার তাই তাকে পাচ্ছি। আমি ভাগ্যে খুব করে বিশ্বাসী। আল্লাহ তায়ালা আমায় তার জন্য তৈরি করেছেন তাই আমি তার হচ্ছি বুঝেছিস?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ খুব বুঝেছি। তা তুমি এতো বুঝদার কবে থেকে হলে ধূসর ভাইয়ার বোম্বায় মরিচ?”

“রাহিয়া এখন তুই শুরু করিস না দয়া করে। এমনিতেও মনটা খারাপ। নিজ বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। নতুন জায়গায় কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিবো কে জানে!”

“আচ্ছা কল কাট জাহিন ভাইয়া গ্রুপ কল করেছে সেইটা রিসিভ কর”

অরিন সম্মতি জানিয়ে কল কেটে গ্রুপ কলে যোগ দেয়। সবাই এটা ওটা বলে অরিনকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। না পেরে সে কল কেটে দেয়। অরিন ধপাশ করে শুয়ে পরে। অন্যদিকে সবাই অরিনকে নিয়ে বেশ হাসাহাসি করলো। মেয়েটাকে জ্বালাতে তাদের ভালোই লাগছিলো। অরিনের মাথায় হাজার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে কি আদেও পারবে ধূসরের সাথে মানিয়ে নিতে। সে বড় হয়েছে দেশে গ্রামের মাটিতে আর ধূসর সে তো বিদেশে বড় হয়েছে। আচ্ছা আদেও ধূসর কি রাজি বিয়েতে?

গোধূলি রাঙা বিকাল। অরিন আর ধূসর বের হয়েছে ঘুরতে। মূলত তাদের জোড় করে পাঠানো হয়েছে এক কথায়! দু’জন ভ্যানে চড়ে মেলায় আসলো প্রথমে। মেলাটা ঘুরলো দু’জন তবে একটা আশ্চর্যের কথা হচ্ছে আজকে তাদের ঝগড়া হয়নি। এখানে আসার আগেও হয়নি, এখনও হচ্ছে নাহ। হুট করে ধূসর তার হাত ধরে টান দেয়। অরিন হকচকিয়ে যায়। ধূসর তাকে নিয়ে একটা চুড়ির দোকানে এসেছে। ধূসর এক সেট নীল রঙা চুড়ি হাতে নিয়ে দেখলো প্রথমে অতঃপর অরিনের বাম হাতটিতে চুড়ি গুলো পরিয়ে দিলো। অরিন অবাক চোখে দেখছে ধূসরকে। ধূসরকে আগে সে এমন রূপে কখনো দেখেনি।

“কি দেখছো তুমি এইভাবে বোম্বায় মরিচ?”

“আপনাকে আজকে আপনাকে একটু অন্যরকম লাগছে! কি হয়েছে কি আপনার?”

“ও তুমি বুঝবে না। ঝগড়া বাদ দিয়ে প্রেমে পরো আগে তারপর বুঝবে। তবে আমার প্রেমেই পরো কিন্তু বোম্বায় মরিচ!”

“প্রেমে তাও আপনার স্বপ্ন দেখুন”

“পরবে তো তুমি অবশ্যই। ভীষণ ভালোবাসবে আমায় দেখে নিও”

অরিন কথা বাড়ালো না। ধূসরের বলা কথাটা সত্য। বিয়ে যখন হবে তখন অবশ্যই সে ভালোবাসবে ধূসরকে। তবে ধূসর কি তাকে পছন্দ করে। ততক্ষণে ধূসর চুড়ির দাম পরিশোধ করে তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চলতে শুরু করেছে। অরিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ধূসরকে। এই ধূসর তার বড্ড অচেনা। ধূসর মৃদু হেসে শুধায়,,

“এভাবে তাকিয়ে থেকো না বোম্বায় মরিচ প্রেমে পরে যাবে তো”

অরিন দ্রুত চোখ সরালো। দু’জন হাঁটছে পাশাপাশি তবে কারো সাথে কেউ কথা বলছে না। অরিন নিরবতা ভেঙে বলল,,
“আপনি কি আমায় পছন্দ করেন বিদেশী বাদুড়?”

ধূসর তাকালো অরিনের দিকে। অরিন চোখ সরিয়ে নিলো। ধূসর অরিনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে শুধালো,,“আমি ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলতে জানি নাহ। এতো টুকু জানি তোমায় ভালো লাগে। তোমার রাগান্বিত চেহারা দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। জীবনে কম মেয়ে দেখিনি আমি তবে তুমি আলাদা ভীষণ আলাদা। এর জন্যই হয়তো তোমার প্রতি অনুভূতি জন্মেছে আমার”

অরিন নিরবে শুনে গেলো। ধূসর তাকে পছন্দ করে! কিন্তু কিভাবে। সে তো কখনো ধূসরের সাথে ঠিকমতো কথাই বলেনি। সেই ধূসর তাকে ভালোবাসে। এটাও সম্ভব। সে আচমকা প্রশ্ন করেই বসলো,,,
“কিন্তু কিভাবে সম্ভব আপনার সাথে তো আমি ভালো মতো কথাও বলেনি শুধু ঝগড়াই করেছি”

“সম্ভব বোম্বায় মরিচ। বলতে গেলে তোমার ঝগড়ার প্রেমেই পরেছি আমি। এগুলো তোমার ছোট মাথায় ঢুকবে নাহ বাদ দাও”

দু বছর পার হয়েছে। সময় কিভাবে যায় বলা যায় না। অরিন, ধূসর, রাহিয়া, জাহিন, রাফা, মিহান সবাই ট্রেনে করে যাচ্ছে তাদের গ্রামে। সবাই হাসি ঠাট্টা করছে। জাহিন রাহিয়ার বিয়ে হয়েছে ছ’মাস হলো। সবাই সুখে আছে। হ্যাঁ ধূসর অরিন ও সুখে আছে। তাদের গন্তব্যে এসে ট্রেন থামলো। সবাই ধীরে ধীরে ট্রেন থেকে নামলো। কুয়াশা ঢাকা চারপাশ। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়। ধূসর একটা চাদর অরিনকে পরিয়ে দিয়ে বলে,,

“কি করো বলো তো! এই ঠান্ডায় কিছু না জড়িয়ে কেনো নেমেছো?”

“এই যে বিদেশী বাদুড় আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন আমি এই গ্রামের মেয়ে। আমার এসবে অভ্যাস আছে। আপনি বরং আরো একটা সোয়েটার পরে নিন। আপনি যা শীতকাতুরে লোক”

ধূসর অরিনের কানে কানে বলে,,,“তোমায় জড়িয়ে ধরলে আর সোয়েটার লাগবে না বোম্বায় মরিচ।”

অরিন ধূসরের বুকে থাপ্পড় মেরে বলল,,
“আপনি জীবনেও ভালো হবেন না? এখনো বোম্বায় মরিচ বলে ডাকতে হবে?”

“তুমি আমার সব বোম্বায় মরিচ। তোমাকে আমি সব নামে ডাকবো। তার অধিকার কিন্তু দুবছর আগেই পেয়ে গিয়েছি আমি”

মিহান এগিয়ে এসে বলে,,,“কি গো শালা শালি তোমরা এতো ফিসফিস করছো কেনো? আমাদের ও বলো আমরাও শুনি”

ধূসর হেসে বলে,,,“তেমন কিছু না ভাইয়া। চলো চা খাই সবাই”

সবাই চা খেলো। এরপর সেই আগের মতো ভ্যান ঠিক করা হলো। তিন জোড়া দম্পতি তিনটা ভ্যানে উঠলো। অরিনকে একহাতে জড়িয়ে ধরলো ধূসর। অরিন শান্তিতে কাঁধে মাথা রাখলো। এই মানুষটাকে দু’বছর আগেও সে পছন্দ করতো নাহ আর এখন অনেক বেশিই ভালোবাসে। প্রথম প্রথম ধূসর তাকে অনেক বেশিই জ্বালাতো, এখন যে জ্বালায় না তা নয়। তবে এখন অরিন বুঝে ধূসর তাকে ভালোবেসেই জ্বালায়। ধীরে ধীরে সেও ভালোবেসে ফেললো ধূসর নামক পুরুষটিকে।

অরিন বসে আছে নিজের চিলেকোঠা রুমটায়। এখনও সেই আগের মতো রয়েছে সব। তার আম্মু সব পরিষ্কার করে রাখে। তার আঁকা ছবিগুলো ঠিক আগের মতোই আছে। আপন মনে কিছু একটা আঁকলো সে। আঁকা শেষ হতে না হতেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। অরিন বুঝলো কে এসেছে। সে দরজাটা খুলে দিলো। ধূসর অরিনকে দেখে মৃদু হেসে বলে,,,

“ম্যাম আমি কি এখন এই রুমে আসতে পারি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন কেনো আসবেন না? আপনি তো এখন এই রুমের মালিকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন আর এই রুমটা কি তাহলে। এটাতে আসার অধিকার তো আপনারও আছে তাই নয়কি?”

ধূসর ভেতরে প্রবেশ করে বলে,,,
“হ্যাঁ ম্যাম আপনি ঠিক বলেছেন এই রুমটাও আমার এবং মালকিনও। তাকে তো দু’বছর আগেই পেয়ে গিয়েছি।”

অরিন ধূসরকে তার মাত্র আঁকা ছবিটার সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,,,“মনে আছে এই দিনটার কথা?”

“মনে কেনো থাকবে না। এইটা সেই মুহুর্ত যখন আমি তোমায় চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছিলাম আর তুমি অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে”

“হ্যাঁ আপনার মনে আছে?”

“মনে থাকবে না কেনো। এই দিনেই তো আমি তোমাকে বলেছিলাম আমি তোমায় পছন্দ করি”

“হুম। শুনুন বিদেশী বাদুড় আপনি আমার রঙহীন জীবনের রঙ। আমার ক্যানভাসটাকে প্রেম রঙে রাঙিয়েছেন, আমায় ভালোবেসেছেন, আগলে রেখেছেন তার জন্য ধন্যবাদ। প্রেম রাঙানো ক্যানভাসটাতে শুধু আপনি আর আমি”

“ভালোবাসি বোম্বায় মরিচ”

অরিন মুচকি হেসে বলল,,,“আমিও ভালোবাসি আমার ছাইকে”

#সমাপ্ত

প্রেম রাঙানো ক্যানভাস পর্ব-০৯

0

#প্রেম_রাঙানো_ক্যানভাস💜
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৯

সন্ধ্যা নেমেছে পৃথিবীর জুড়ে। একতলার ছাদ জুড়ে রঙ বেরঙের বাতি জ্বালানো। কি সুন্দর সাজানো। বিয়ে বাড়িতে তো সাজানোই থাকবে। হলুদ সন্ধ্যা আজ। রাফা তৈরি হচ্ছে। ধূসর এক সাইডে বসে ফোন দেখছে। তার কোনো কাজ নেই। কেউ একটা কাজও করতে দিচ্ছে না তাকে। অরিনও ভীষণ ব্যস্ত। রাফাকে সাজাচ্ছে রাহিয়া। জাহিন নিজের কাজে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মাঝে বউয়ের এন্ট্রি হয়। কাজিনরা সবাই এক সাথে নেচেছে তারপর সবার শেষে রাফা। রাফাকে নিয়ে স্টেজে বসিয়ে দেওয়া হয়। রাফার পরনে হলুদ রঙা লেহেঙ্গা। হলুদ গাজরা দিয়ে তাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। জাহিন দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে রাহিয়াকে। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।

“কি জাহিন ভাইয়া তুমি তো দেখছি তলে তলে টেম্পো চালিয়ে অনেক দূর চলে এসেছো”

জাহিন হকচকিয়ে উঠে। অরিন ফিক করে হেসে দেয়। অরিনকে দেখে জাহিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। জাহিন অরিনের মাথায় হালকা করে টোকা দিয়ে বলে,,,“তুমি তো আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে অরিন। আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক করতাম আমি”

অরিন দাঁত কেলিয়ে বলল,,,“ভাই তুমি হার্ট অ্যাটাক করলেও তোমার ঔষধ দিয়ে আমরা তোমাকে ঠিক করে দিতাম। ওই যে সামনে তোমার হলুদ ঔষধ।”

“আস্তে বলো অরিন। কেউ শুনলে কি হবে”

অরিন হাসতে হাসতে বলে,, “ভাই কেউ শুনবে না তুমি চিন্তা করো নাহ। কিন্তু তলে তলে টেম্পো চালিয়েছো আর আমরা কেউ ধরতেও পারলাম নাহ।”

“অরিন তোমাকে আমি পরে সব বলবো বইন এখন চুপ যাও। এটা যদি খালামনির কানে যায় তাহলে তিনি আরেক তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলবেন”

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আর বলছি না। তুমি এখন এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে কাজে যাও”

ধূসর বসে অরিন আর জাহিনের ফুসুরফাসুর করা দেখছে। তার বড্ড ইচ্ছে করছে এভাবে ভাই বোনদের সাথে কথা বলার। তবে তার সাথে কেউ এতো ক্লোজ না। চাইলেও কেউ এভাবে কথা বলবে না। অরিনরা সবাই নিজেদের নাচের জন্য তৈরি হতে থাকলো। ধূসর পর্যবেক্ষণ করছে সব কিছু। সবাই নাচলো। এরপর ছেলের বাড়ির থেকে লোকজন এসেও বউকে হলুদ লাগিয়ে যায়। অনামিকা ইসলাম ধূসরকেও সবার সাথে এনজয় করতে বলে।

রাত বারোটা। মুরব্বিরা সবাই চলে গিয়েছে ঘুমাতে। রাফা, রাহিয়া অরিনও সাজগোছ উঠিয়ে, জামা চেঞ্জ করতে এসেছে। অরিন রাহিয়া, রাফাকে বলে,,,
“চল ছাদে গিয়ে আড্ডা দেই”

“হ্যাঁ চল”

“কিন্তু জাহিন ভাইয়া আর ধূসর ভাইয়াকে কে ডাকবে?”

অরিন বলে,,,“রাহিয়া যা ডেকে নিয়ে আয়”

“আমি আর রাফা উপরে যাচ্ছি তুই ডেকে নিয়ে আয়”

অগত্যা অরিনেরই যেতে হয় দু’জনকে ডাকতে। জাহিন আর ধূসরের রুমের সামনে এসে দরজায় টোকা দেয় অরিন তবে খোলে না কেউ। হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে যায় দরজা। সে ভেতরে প্রবেশ করে। তবে কাউকেই দেখতে পায় না। তখনই ধূসর ওয়াশরুম থেকে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়। অরিন অপ্রস্তুত হয়ে পরে। প্রথম দিনের ঘটনা মনে পরে যায়। কি করেছিলো সে। ইশ কি লজ্জা জনক পরিস্থিতি ছিলো সেইটা। আজ লজ্জা লাগছে না। অস্বস্তি কাটিয়ে সে বলল,,,

“আপনি কি ছাদে আসবেন আমরা আড্ডা দিবো। আর জাহিন ভাইয়া কেথায়?”

ধূসর তোয়ালে রাখতে রাখতে বলল,,,“হ্যাঁ যাবো না কেনো। অবশ্যই যাবো। জাহিন তো এখনো রুমে আসেনি। আছে হয়তো আসে পাশে চলো”

দু’জন উপরে আসে। উপরে আসতেই জাহিনকেও নজরে পরে। আগে থেকেই ছিলো জাহিন। অরিন একটু অবাক হয়। তবুও কিছু বলে নাহ। ধূসর এবং অরিন এসে বসে পরে ওদের সাথে। রাহিয়া মনে মনে হাসে। সে আগেই জানতো জাহিন নেই রুমে। তবে জাহিন নেই জানলে সে কখনোই ডাকতে যেতে নাহ। জাহিন যে আগেই ছাদে ছিলো তা খুব ভালো করেই জানতো রাহিয়া। সে চাই ধূসরের সাথে যেনো অরিনের লাইন ঘাট হয়ে যায়। যদিও সে একটু একটু জানে যে দুজন এক জায়গায় থাকলেই ঝগড়া লাগে। তবুও ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সবাই এটা ওটা নিয়ে গল্প করছে। রাহিয়া ধূসরকে উদ্দেশ্য করে বলে,,

“ধূসর ভাইয়া চুপ করে আছো কেনো? কিছু বলো। কানাডায় থাকতে কি কি করেছো বলো তো?”

ধূসর হেসে বলা শুরু করলো। সবাই শুনছে তার কথা। অরিন কিছুক্ষণের মাঝেই বোরিং ফিল করলো। কারণ ধূসর ভার্সিটি লাইফে কি করেছে কোথায় কোথায় ঘুরেছে এগুলোই বলছে। যা শুনতে মোটেও তার ইচ্ছে করছে নাহ। ঘুম আসছে তার। রাহিয়া খেয়াল করলো বিষয়টা। সে ধূসরকে থামিয়ে দিয়ে বলল,,,

“আচ্ছা ভাইয়া আজকে থাক। অন্য আরেকদিন শুনবো। এখন বরং আমরা সবাই কিছু খেলি”

জাহিন বলে “হ্যাঁ চলো গানের কলি খেলি”

সবাই সম্মতি দেয়। জাহিন শুরু করে। জাহিনের পরে একেক করে সবাই গান গায়। অরিনের গলা তেমন একটা ভালো নাহ তবে খারাপ ও নাহ। ধূসরের পালা এবার যদিও সবাই ভেবেছে ধূসর পারে না পারলেও ইংরেজি গানগুলোই পারে। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ধূসর গেয়ে ওঠে,,,

যদি বারে বারে একি সুরে,
প্রেম তোমায় কাঁদায় তবে
প্রেমিকা কোথায় আর প্রেমই বা কোথায়!

সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। সামান্য তিনটা লাইন গেয়েছে তবে ধূসরের কন্ঠ এতো সুন্দর বলার বাইরে। তারা কেউই ভাবেনি ধূসরের কন্ঠ এতো সুন্দর হবে। জাহিন বলে উঠে,,

“ব্রো তুমি এতো ভালো বাংলা গান পারো কিভাবে?”

“আমি তো বাংলা গান শুনি। আমার বাংলা গান প্রচন্ড ভালো লাগে”

সবাই আরও কিছুক্ষণ প্রশংসা করলো ধূসরের গানের গলার। তবে অরিন কিছুই বলেনি। ধূসর আশা ও করে না অরিনের থেকে কিছু। সবাই একটা পর্যন্ত গল্প, আড্ডা দিয়ে নিজেদের রুমে চলে আসে। রাহিয়া রুমে এসে বলে,,,

“ ধূসর ভাইয়ার গলা কিন্তু বেশ ভালো। কি সুন্দর করে গান গাইলো। আমার দারুন লেগেছে তার কন্ঠ”

রাফাও রাহিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলল,,,“হ্যাঁ আসলেই অনেক সুন্দর। আমার ও খুব ভালো লেগেছে।”

অরিন বিরক্ত হয়ে বলে,,,“থামবি তোরা। কি এমন গলা যা নিয়ে এতো মাতামাতি করছিস আমাকে বোঝা একটু। উনার কন্ঠ ততোটাও সুন্দর নয়”

রাফা ভ্রু কুঁচকে বলে,,,„“কি বলিস তুই। মাথা খারাপ তোর। ভাইয়ার গলা দারুন।”

অরিন উত্তর না দিয়ে শুয়ে পরলো। রাফা রাহিয়া কিছুক্ষণ অরিনের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেরাও শুয়ে পরবে। এই মেয়ে কখনোই কারো কথা শুনে না। আর ধূসরকে তো পছন্দই করে নাহ। আবার তার সম্পর্কে কিভাবে ভালো কথা বলবে বা প্রশংসা করবে।

সকাল সকাল বাড়িটা কোলাহল পূর্ন। সবাই ব্যস্ত যার যার কাজে। সকাল থেকে রাফার মনটা বড্ড খারাপ। আজকে থেকে সে অন্যকারো হয়ে যাবে। চেনা পরিচিত সব ছেড়ে নতুন জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। তার বর কেমন হবে এটা নিয়েও চিন্তিত সে। রাহিয়া সকাল থেকে এ নিয়ে তাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে। তবুও কোনো কথা কানে নিচ্ছে না সে। তখনই তার হবু বর মিহান ফোন করে। রাহিয়া দেখে বলে,,,

“ভাইয়া ফোন করেছে রিসিভ করে কথা বল”

রাফা নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন রিসিভ করে বলল,,,
“হ্যাঁ বলুন?”

“কি করছো? মন খারাপ তোমার?”

“হ্যাঁ একটু”

“মন খারাপ করো না। আমি তোমার পাশে আছি তো”

রাফা বউ সেজে বসে আছে। কিছুক্ষনের মাঝেই বর চলে আসবে। সকালে রাফা মিহানের সাথে কথা বলার পর মন খারাপ একটু কমেছে। সবাই রেডি হয়ে নিয়েছে। গেট ধরার জন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েপক্ষ ঝগড়া করে তাদের হক আদায় করে নিয়েছে। অতঃপর তাদের বিবাহ সম্পূর্ণ হয় ভালোভাবে।

#চলবে~

প্রেম রাঙানো ক্যানভাস পর্ব-০৮

0

#প্রেম_রাঙানো_ক্যানভাস💜
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৮

অরিনের মেঝো ফুপি এবং ছোট ফুপি চলে গিয়েছেন সকাল সকাল। অনামিকা ইসলাম এখনো আছেন। বাড়িটা আবারও ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। তার ভীষণ খারাপ লাগছে। সে ছাদে এসে সেই রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো। এই রুমটাই তাকে শান্তি দেয়। এখানে থাকলে বাইরের দুনিয়ার কিছুই মাথায় আসে না। তার শান্তির জায়গা এটা।সে বসে একটা উপন্যাসের বই বের করে পড়া শুরু করলো।

কিছুক্ষণ বাদে রুমে কারো উপস্থিতি টের পেলো অরিন। বইটি রেখে পাশে তাকাতে দেখলো ধূসরকে সে নিজেও একটা উপন্যাসের বই পড়ছে। অরিন বেশ রেগে গেলো। সে মানা করার পরও ছেলেটা এসেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো ধূসরের দিকে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,,,

“কি সমস্যা আপনার? আপনাকে কে না মানা করেছিলাম আমি এখানে আসতে। বজ্জাত লোক, নির্লজ্জ লোক। আমার রুমে কেনো এসেছেন আপনি?”

“সাট আপ বেয়াদব। তুমি কি ভদ্রতা শেখোনি? বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না?”

“ঠিক আছে আমি না হয় বড়দের সাথে ঠিক মতো কথা বলতে জানি না। কিন্তু আপনি! আপনি নিজেই কারো নিষেধ মানেন না। তার বেলায়”

“তুমি তো বলেছো তোমার অনুপস্থিততে যেনো না আসি। তুমি থাকলে তো আর আসতে মানা করোনি। তাই আমি এসেছি”

“আপনি, আপনি একটা যত্তসব। এমনিতেও মনটা ভালো ছিলো না। এখন আপনি এসে আমার মুডটা আরো নষ্ট করে দিলেন ছাই কোথাকার”

ধূসর হেসে বলে,,“বোম্বায় মরিচ কোথাকার”

ধূসর রুম থেকে বের হয়ে যায়। অরিন ঠিক করে এই বেয়াদব যতদিন না যায় সে আর এই রুম খুলবে না। সে কিছু আঁকার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। রুমটাতে বড় তালা মেরে চলে আসে নিজের রুমে। বেয়াদব ছেলেটার জন্য কোথাও গিয়েও লাভ নেই। ফোনটা খুঁজে ফোন করলো রাহিয়াকে। দুইবার কল করার পর রাহিয়া অপাশ থেকে রিসিভ করে।

“হ্যাঁ বল অরিন”

“কোথায় তোরা এখন?”

“এইতো ট্রেন স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে। বাড়ি যেতে হয়তো এক ঘন্টা লাগতে পারে।”

“আচ্ছা সাবধানে যাস। পৌঁছে ফোন করিস রাখছি”

কল কেটে দিলো অরিন। এডমিশনের জন্য এখনো কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। তবে খুব তাড়াতাড়ি নিতে হবে। ঢাকা ভার্সিটি বা জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটিতে চান্স পেলেই হচ্ছে। অরিন নিচে নামে। নিচে নামতেই দেখে সবাই গল্প করছে। সে সবার সাথে টুকটাক কথা বলে চলে যায় রান্না ঘরে নিজের মায়ের কাছে।

সব কাজিনরা মিলে শপিং এ এসেছে। রাফার বিয়ের মাত্র ৫ দিন বাকি। সবার অবস্থান এখন রাফাদের বাসায়। সবাই দুটো অটো করে চলে এসেছে মার্কেটে। বউয়ের শপিং করা শেষ। এখন বাকি শুধু রাহিয়া, জাহিন,জায়রা, অরিনের। সবাই মিলে শপিং শেষ করলো। রাহিয়া, জায়রা আর অরিন হলুদের জন্য একই রকমের লেহেঙ্গা নিয়েছে। সকালে হলুদ ছোঁয়ানোর জন্য শাড়িও কিনেছে। বিয়ের জন্য সাদা রঙের একটা লেহেঙ্গা কিনেছে অরিন। রাহিয়া কিনেছে কালো রঙের লেহেঙ্গা আর জায়রা নিয়েছে নীল রঙের। তিনটাই বেশ সুন্দর। জাহিন ও পাঞ্জাবি নিলো। ধূসরকেও জাহিন জোড় করিয়ে পাঞ্জাবি কিনিয়েছে।

সবাই কেনাকাটা শেষে রেস্টুরেন্টে আসলো। কেনাকাটা করতে করতে দুপুর হয়ে গিয়েছে। সবার ক্ষুধা ও লেগেছে। রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে সবাই আবারও অটো করে রাফাদের বাড়িতে চলে আসলো। রাফাদের বাড়িটা একতলা বিল্ডিং। চারটা রুম, একটা ড্রয়িংরুম সব আছে। রান্নাঘর বড় করে বাইরে দেওয়া। বেশ সুন্দর। অরিনের অনেক পছন্দ। রাহিয়াদের বাড়িটা না গ্রামে আবার না শহরে। বেশ ভালো একটা জায়গায়। শহর থেকে একটু ভেতরের দিকে।

সবাই এখন জামা কাপড় খুলে রাফাকে দেখাচ্ছে। বেচারি যেতে পারেনি। রাফা সবার জামা কাপড় দেখে বেশ খুশি হলো। ধূসর ও দেখালো তার তা। সে আসলে এসব কখনো দেখেনি। তবে এগুলো দেখতে তার বেশ ভালো লাগছে। দুপুরের সময় সবাই খেয়ে যার যার রুমে চলে গিয়েছে। জাহিন রাহিয়া এক সাইডে ডেকে এনে বলে,,,

“রাহিয়া একটু ছাদে আসবে তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো”

“আচ্ছা জাহিন ভাইয়া তুমি উপরে যাও আমি আসছি”

জাহিন রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ধূসরও বের হয়ে গিয়েছে। এখন রাফার রুমে অবস্থান তিন জনের, রাহিয়া, অরিন আর রাফার। রাফা রাহিয়াকে চেপে ধরে বলল,,,
“জাহিন ভাই কি বললো রে তোকে?”

অরিন না বুঝে তাকিয়ে আছে। সে আসলে খেয়ালই করেনি জাহিন রাহিয়াকে কিছু বলেছে। রাহিয়া বলল,,,
“ছাদে যেতে বলেছে কিছু কথা বলবে”

অরিন বোকার মতো প্রশ্ন করলো,,“ছাদে গিয়ে কথা বলতে হবে কেনো এখানে বললেই তো হতো”

রাফা বুরক্ত হয়ে বলল,,
“ওরে গাধা জাহিন ভাই রাহিয়াকে পছন্দ করে আর রাহিয়াও”

অরিন লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালো। সে অবাক হয়ে রাফা এবং রাহিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তো জানতোই না এসব কিছু।
“এতো কিছু হয়ে গেলো আর তোরা দু’জন আমায় কিছুই জানাসনি। আমি জাহিন ভাইয়াকে পেয়ে নেই।”

“আচ্ছা শোন জাহিন ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার কাছে গেলাম”

“হ্যাঁ যাও যাও মানা কে করেছে।”

রাফার কথায় রাহিয়া বেশ লজ্জা পেলো। অরিন হাসছে। অরিন রাফার পাশে বসে বলল,,,“এসব কবে থেকে চলছে বল তো?”

“জাহিন ভাইয়ারটা তো জানি নাহ তবে রাহিয়া গত এক বছর যাবত জাহিন ভাইয়াকে পছন্দ করে। আজ মনে হয় জাহিন ভাইয়া তার মনের কথা বলতেই ডেকেছে রাহিয়াকে”

“বাহ কাজিন কাজিন কাপল। বেশ হবে তো”

রাফা ফাজলামি করে বলে,,,“হ্যাঁ আর তোর সাথে ধূসর ভাইয়ার ও কিন্তু বেশ যাবে”

অরিন মৃদু স্বরে চিৎকার করে বলল,,
“অসম্ভব চুপ কর। ওই বিদেশী বাদুড়কে আমি কখনোই বিয়ে করবো না। আস্ত খাটাশ। আমার সাথে শুধু ঝগড়া করে।”

“কিন্তু তোদের জুটিটা কিন্তু জোস হইতো”

“তুই চুপ করবি নাকি মারা খাবি তাই বল”

“জাহিন ভাইয়া!”

জাহিন পেছনে ঘুরলো। তার সামনে রাহিয়া দাঁড়িয়ে আছে। রাহিয়া জাহিনের থেকে দুই হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। জাহিন গলা ঝেড়ে মৃদু স্বরে বলল,,,

“তোমার সাথে আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে রাহিয়া।”

“হ্যাঁ জাহিন ভাইয়া বলো।”

জাহিন সাহস নিয়ে কাঙ্ক্ষিত কথাটি বলেই ফেললো,,,
“আমি কি তোমাকে বোনের থেকে বেশি কিছু ভেবে ভালোবাসলে তুমি কি খুব রাগ করবে রাহিয়া?”

রাহিয়া বিষ্মিত কন্ঠে বলে,,,“মানে?”

“মানে আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি প্রেম করতে তোমায় বলবো না তবে অন্যকারো সাথে তোমায় সহ্য ও করতে পারবো না। তুমি দয়া করে আমি ছাড়া অন্য হইও না।”

“এটা কি ছিলো জাহিন ভাইয়া”

“আমি তোমায় ভালোবাসি এটাই জানালাম। আমি জানি নাহ তোমার মনের কথা। আমি এখন তোমায় বিয়ে করতে পারবো না কারণ আমার কোনো চাকরি নেই স্টুডেন্ট আমি। তবে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে তোমায় হবে না দুবছর সময় দাও আমায় আমি তোমাকে ঠিক নিজের করে নিবো”

“তোমার এই কথাটা বলতে এতো সময় লাগলো জাহিন ভাইয়া। আমি কতগুলো দিন অপেক্ষা করেছি তোমার মুখে ভালোবাসি কথাটা শোনার জন্য। শেষ অব্দি বলেই ফেললে। আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি জাহিন ভাইয়া। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো হোক তা দু’বছর বা আরো বেশি।”

জাহিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো রাহিয়ার মুখখানে। সে এটা আশাই করেনি। তার ভালোবাসার মানুষটা তাকে ভালোবাসে এটা কম কিছু নয় তার জন্য। অতিরিক্ত খুশিতে যেনো সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এটা কল্পনাতীত ছিলো তার কাছে। রাহিয়া মুচকি হেসে বলে,,,

“জাহিন ভাইয়া কোথায় তুমি?”

“না না কোথাও না। আমি কল্পনাও করতে পারি নি বিষয়টা”

রাহিয়া শব্দহীন হেসে বলে,,
“কিছু কিছু জিনিস আমরা কল্পনাও করি নাহ তবে তা পেয়ে যাই”

জাহিন সম্মতি জানায়। রাহিয়া আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ দেখলো কি না! না কেউ দেখেনি। সে জাহিনকে বলে নিচে নেমে যায়। জাহিন এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। একটু আগে যা ঘটলো তা সত্য কি না। তবে সত্য সবই সত্য। খুশিতে তার সব কিছু এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

“কি রে দু’জন কি এতো কথা বললি এতো সময় ধরে বলতো?”

অরিনের কথায় রাহিয়া লজ্জা পেলো তবে মুখভঙ্গিতে তা প্রকাশ করলো না সে। রাগি কন্ঠে বললো,, “কি পেয়েছিস তোরা দু’জন আমায়। ভাইয়া আমায় এমনিতেই ডেকেছে”

“ওসব বাদ দিয়ে মানে মানে সত্যি কথা বলে ফেলো সোনা। তোমার মিথ্যা আমি বা অরিন কেউই শুনতে চাইছি না। সত্যি বল তাড়াতাড়ি”

রাহিয়া জানে সে এদের সাথে পারবে না। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে বলে,,,“ভাইয়া তার ভালোবাসার কথা জানিয়েছে”

রাহিয়া সব খুলে বলল দু’জনকে। দু’জন বেশ খুশি হয়েছে। যাক অবশেষে তাদের জাহিন ভাইয়া তার মনের কথাটা বলেই দিলো। জাহিনের চিন্তা ভাবনা তাদের তিনজনকেই মুগ্ধ করেছে। এই যুগে কেই বা বিয়ে করতে চায়। এখন তো সবাই প্রেমই করে। তবে জাহিনের মনোভাব বেশ ভালো লাগলো। ছেলেটা সোজা বিয়ে করতে চায়। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে!

#চলবে~

প্রেম রাঙানো ক্যানভাস পর্ব-০৭

0

#প্রেম_রাঙানো_ক্যানভাস💜
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৭

সব কাজিনরা মিলে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছে। ধূসর অসুস্থ ছিলো বিধায় অরুনি শেখ কাউকে বের হতে দেননি। সাথে বৃষ্টি তো টানা লেগেছিলো এই তিনদিন। আজ রোদ উঠেছে। বেশ কড়া রোদ। অরিন রাফা রাহিয়া হাসাহাসি করছে কিছু নিয়ে। জাহিন রাহিয়ার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে এই হাসিতেই তো কতবার পাগল হয়েছে। ধূসর ফোনে ছবি তুলছে আশেপাশের। অরিন তাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে চলে যায়। জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর। আকাশে রোদ তো আছেই বেশ। সবাই পাড়ে ঘাসের উপর বসে পরলো। ধূসর নিজেও বসলো।

“রাফুর বিয়ের আর পনেরো দিন আছে। শপিং করতে হবে তো। আমি অনেক বেশি এক্সাইটেড। কত দিন যে বিয়ে খাই না।”

অরিনের কথা ধূসর রাফা বাদে সবাই হেসে দিলো। রাফার মনটা খারাপ। সে জাহিনকে কিছুটা পছন্দ করতো। তবে সমস্যা নেই কারণ সে জানে জাহিন তার বোনকে পছন্দ করে। সে নিজেকে সামলে নিয়েছে তখন থেকে। মন খারাপ নিজের পরিবারকে ছেড়ে যেতে হবে এই নিয়ে। অরিন সবাইকে নিয়ে নৌকায় উঠার সিদ্ধান্ত নিলো। সবাই মিলে একটা নৌকা ঠিক করলো। সবাইকে নৌকায় উঠলেও ধূসর এখনো আসেনি। অরিন এগিয়ে এসে বলে,,,

“এই যে মিস্টার ছাই আপনি কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকার পরিকল্পনা করেছেন নাকি? চলুন সবাই নৌকায় উঠে পরেছে”

ধূসর পিছনে ফিরে অরিনকে দেখে বলল,,,“হ্যাঁ চলো বোম্বায় মরিচ”

অরিন ধূসরের কথা শুনে ভেংচি কেটে ধূসরের পিছু পিছু যেতে থাকে। নৌকায় উঠে সবাই বেশ উপভোগ করছে। তবে ধূসরের একটু ভয় ভয় করছে। নদীতে ঢেউ অনেক। মৃদু বাতাস ও বইছে। সবাই মিলে ঘুরে বাড়িতে চলে আসলো। বাড়িতে সবাই মিলে বসে রাফার বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছে। তবে ওরা সেখানে যোগ না দিয়ে ছাদে চলে আসলো। পিকনিক করবে তারা। খিচুরি রান্না করবে সবাই মিলে। ধূসরও বেশ এক্সাইটেড। মেয়েরা মিলে সব জোগাড় করছে। রান্না করবে অরিন রাহিয়া আর রাফা মিলে।

জাহিন আর ধূসর ও তাদের সাহায্য করবে। অরিন ধূসর জাহিনকে কাজ দিয়েছে কাঠ নিয়ে আসার জন্য। মাটির চুলায় রান্না করবে। ধূসর আর জাহিন মিলে বাড়ির পেছন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে আসছে। কিছু কাঠ আনা হয়েছে এখনো অনেক বাকি। ধূসরের মুখ লাল হয়ে গিয়েছি এতোটুকুতে। কাশছেও। অরিন তা দেখে বলে,,,

“আপনি কি আমাদের মার খাওয়াতে চাইছেন? আপনার যে ধুলো বালিতে এলার্জি আছে বললে কি আমরা আপনায় কাজ করতে দিতাম? এগুলো জানলে আম্মু আমায় কতো বকতো জানেন?”

ধূসর কাশতে কাশতে বলে,,,“আরে তেমন সমস্যা হয় না বোম্বায় মরিচ। আমি করতে পারবো”

অরিন ধূসরের হাত থেকে কাঠ নিয়ে বলে,,,“দরকার নেই। জাহিন ভাইয়া একাই পারবে। আপনি বরং এখানে বসে রান্না করা দেখুন বাচ্চাদের সাথে”

ধূসর ভ্রু কুঁচকে বলে,,,
“আমি বাচ্চা? যে ওদের সাথে বসে রান্না করা দেখবো”

অরিন ধূসরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলে,,,“ হা পা লম্বায় তো বিশাল, জিরাফের থেকে লম্বা তবে ব্যবহার বাচ্চাদের থেকেও খারাপ”

অরিন কথাগুলো বলে নিজের কাজে চলে গেলো। ধূসর বিরক্ত হলো। এই পুচকে মেয়ে তাকে বাচ্চা বলছে। হ্যাঁ হয়তো সে একটু লম্বা বেশি তো? কি হয়েছে কি। এই মেয়ে সব সময় তার সাথে লাগবে। ধূসর বেশ কিছুক্ষণ বসে ওদের কাজ দেখলো। তবে আর পারছে না। সে উঠে সিঁড়ি ঘরের কাছে আসতেই চিলেকোঠার রুমটা চোখে পরলো। সে সেদিকে এগিয়ে গেলো। নাহ আজ দরজায় তালা মারা না।
সে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রবেশ করতেই মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলো তার চোখ মুখ। বেশ সাজানো গোছানো একটা রুম। এক পাশে বই রাখার বড় টাক। যেখানে হরেক রকম বই দিয়ে সাজানো। সাথে ছোট ছোট লাইট, মানি প্লান্টের গাছ দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো। আর একপাশে একটা সোফা আর টেবিল। তার পাশে ছবি আকার যাবতীয় সব জিনিস পত্র রাখা। এক পাশের দেওয়ালে অনেক গুলো ছবি টানানো।

ধূসরের এক নিমেষেই মন ভালো হয়ে গেলো। এতো সুন্দর রুম সে আগে দেখেনি। সে নিঃসন্দেহে বলে দিবে অরিনের পছন্দ আছে। তখনই অরিন রুমে প্রবেশ করে। ধূসরকে দেখে ক্ষানিক অবাক হয়। তবে সে শক্ত কন্ঠে শুধায়,,

“আপনি? আপনি এখানে কি করছেন”

“রুমটা কি তোমার বোম্বায় মরিচ। এতো সুন্দর রুম আমি আগে দেখেনি। আচ্ছা জ্বানালাটা কি খোলা যায় না? আমি যতদিন আছি তুমি কি আমায় এই রুমে আসার অনুমতি দিবে?”

অরিন মৃদু কন্ঠে শুধায়,,,“দেখুন ধূসর সাহেব এটা আমার সব থেকে পছন্দের জায়গা। আমি এটা মোটেও পছন্দ করি না আমার পছন্দের জিনিসে কেউ হাত বাড়াক। এখানে কিন্তু আমার আম্মুও আসে না। এটা শুধু মাত্র আমার। এখানে আসার অনুমতি আমি দিতে পারবো না। আপনি দয়া করে বের হয়ে যান।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আমাকে কি ভাইয়া বলে ডাকা যায় না?ধূসর সাহেব কি। ফুপাতো ভাই হই আমি তোমার”

“আসলে অভ্যাস নেই তাই ধূসর সাহেব হয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে ভাইয়া বলার চেষ্টা করবো তবে আপনি! আপনি আমার নাম ধরে ডাকবেন তাহলে আমি আর ছাই বা অন্য কিছু বলবো না। আপনার কি আমার নামটা পছন্দ না?”

“তা তো সম্ভব নয়। আমার অরিন নামটা ঠিক পছন্দ নয় তা নয় তবে বোম্বায় মরিচ নামটা আমার বেশি পছন্দের, আর সাথে একটু আধটু তুমিও বোম্বায় মরিচ”

কথাটা বলেই বের হয় যায় ধূসর রুম থেকে। অরিন বিষ্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলে গেলো ধূসর মাত্র। অরিন বেশ কিছুক্ষণ সেভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। রুমে তালা লাগিয়ে আবারও সবার কাছে চলে আসে। রাহিয়া তাকে দেখে তাড়া দেখিয়ে বলে,,

“কোথায় ছিলি এতো সময় তুই? তাড়াতাড়ি আয় রান্নার সব জিনিস আনা শেষ”

অরিন এগিয়ে এসে রান্নায় হাত লাগায়। তিনজন মিলে রান্না করছে। এর ফাঁকে অবশ্য তার চোখ জোড়া ধূসরকে খুঁজেছে। তবে ছাদের কোথাও তার দেখা মেলেনি। তবে সে সব মাথা থেকে ঝেড়ে রান্নায় মনোযোগ দিলো। অতঃপর কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারলো ধূসর তাকে অস্বস্তি, ভয় পাওয়ানোর জন্য এমন করেছে। মনে মনে বেশ কয়েকটা গালি দিলো সে ধূসরকে। রান্না শেষ হয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। সন্ধ্যাও পেরিয়েছে সেই কখন। রাহিয়া হায়াতকে দিয়ে সবাইকে ডাকতে পাঠালো। সবাই এসে ছাদে গোল হয়ে বসে পরে। তিনজন মিলে খাবার বেড়ে দিতে থাকে সবাইকে। অরিন ইচ্ছে করে ধূসরকে অনেক দেয়। যাতে খেয়ে না উঠতে।

তবে ধূসর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নিজের মতো খেতে লাগলো। ওরা তিনজনও খেতে বসে পরলো। নাহ বেশ ভালোই হয়েছে রান্না। ধূসরের কাছেও বেশ লেগেছে। জাহিন বলে উঠে,,,

“বাহ বেশ সুন্দর তো তোমাদের রান্নার হাত। দারুন হয়েছে রান্না”

রাহিয়া লাফিয়ে উঠে বলে,,,“তুমি সত্যি বলছো জাহিন ভাইয়া?”

“হ্যাঁ সত্যি বলছি রাহিয়া দারুন হয়েছে।”

সবাই নিজের মতো খেয়ে উঠে গেলো। সবাই প্রশংসা করলেও ধূসর কিছুই বলেনি। এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না তিনজনের। নিচে নামতেই জানতে পারলো অরিন মেঝো ফুপি আর ছোট ফুপি আগামীকালই বাড়ি চলে যাবেন। বড় ফুপি বিয়ের কয়েকদিন আগে যাবেন। এতো বছর পর এসেছেন কিছুদিন না থাকলে তো হয় না। অরিনের মন খারাপ হলো এটা ভেবে যে রাফা আর রাহিয়া জাহিন চলে যাবে। পরে সব জানতে পারলো অরিন। বিয়ের সব জিনিস কেনা বাকি আরো অনেক কিছু তার জন্য সবাই চলে যাবে। সবাই অরিনের রুমে আসে লুডু খেলার জন্য। তবে অরিনের মন খারাপ দেখে রাহিয়া বলে,,

“কি রে অরিন মন খারাপ কেনো তোর?”

“তোরা আসলিই তো তিন চারদিন হলো আবার চলে যাবি। ধূর ভাবলাম এবার অনেক ঘুরবো তবে হলো কোথায় আর”

“আরে মন খারাপ করিস না আমরা তো আবারও আসবো”

#চলবে

প্রেম রাঙানো ক্যানভাস পর্ব-০৬

0

#প্রেম_রাঙানো_ক্যানভাস💜
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৬

কত সময় তারা দু’জন ওভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছে। তা কারোরই খেয়াল নেই। বৃষ্টির তেজ কমেছে। অরিনের শীত শীত অনুভব হচ্ছে। তার হঠাৎ খেয়াল আসলো ধূসরের কথা। পাশে তাকাতেই দেখলো ধূসর দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুত ধূসরের কিছুটা কাছে এসে বলল,,,

“এই যে বিদেশী বাদুড় ঠিক আছেন আপনি?”

ধূসর কথা বললো না। অরিন ভয় পেয়ে গেলো। আবারও জিজ্ঞেস করলো,,, “আপনি ঠিক আছেন ধূসর সাহেব”

হঠাৎই ধূসর হেসে উঠলো। অরিন বুঝলো ধূসর মজা করছিলো। অরিনের প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো। সে নেমে গেলো ছাদ থেকে। ধূসর মৃদু হেসে নিজেও সে দিকে পা বাড়ায়। যাক একবার তো বিদেশী বাদুড় বলেনি। এটাই অনেক। মাথা ভার ভার লাগছে তার। এতো সময় ধরে আগে কখনো বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। রুমে এসে টিশার্ট ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো গোসল করতে। অরিন নিজের রুমে এসে দেখে সবাই এখনো মরার মতো ঘুমাচ্ছে। অরিন বিরক্ত হলো। জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ভ্যাগিস তাকে মা দেখেনি না হলে বকা খেতে হতো। চেঞ্জ করে বাইরে এসে দেখে তিনটা এখনো ঘুম। অরিন এগিয়ে এসে সব ক’টাকে তুলল।

রাহিয়া বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,,,
“কি হলো অরিন এখন ডাকছিস কেনো? মাত্রই তো ঘুমালাম”

“মাত্র ঘুমিয়েছিস? এখন তিনটা বাজে। সবাই হতো যার যার মতো খেয়েও নিয়েছে। তোরা খাবি না?”

“কেনো তুই খাসনি? এতো সময় তুই কি করছিলি?”

“ঘুমাচ্ছিলি তো গরুর মতো। কখন কি হয় সেই খবর কি আর তোরা জানবি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল তাই ভিজছিলাম।”

“আচ্ছা আমরা ফ্রেশ হয়ে আসছি তুই ততক্ষণ অপেক্ষা কর। আমরা এক সাথেই খাবো ঠিক আছে?”

অরিন সম্মতি দেয়। সবাই ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়। নিচে নামতেই জাহিনকে দেখলো। তারা সবাই কথা বলতে বলতে খাবার টেবিলে এসে বসলো। অরুনি শেখ অরিনদের দেখে বলে উঠেন,,,
“তবে আপনাদের এতো সময় পর আসার সময় হলো। এতো দেরি করলি কেনো? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি”

“মামি তুমি যাও আমরা নিজেরা নিয়ে খেতে পারবো”

সবাই জাহিনের কথায় সম্মতি দেয়। অরুনি শেখ বলেন,,“আচ্ছা আমি ধূসরকে ডেকে দিয়ে যাচ্ছি। ও তো খায়নি। দুপুরে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম হায়াতকে ও বলল নেই। ব্যস্ততায় আর খোঁজ নেওয়া হয়নি। অরিন তুই একটু দেখে শুনে ওকে খাওয়াস”

অরিন মনে মনে বলল,,,“এহ আমার তো কোনো কাম কাজ নেই ছাইয়ের দেখাশোনা ছাড়া।”

তবে মুখে সেগুলো প্রকাশ না করে বলল,,, “আচ্ছা ঠিক আছে আম্মু”

অরুনি শেখ ধূসরের রুমে চলে আসে। দরজা টোকা দিয়ে বলেন,,“ ধূসর আছো তুমি?”

ধূসর দরজা খুলে বলে,,,“জি মামি কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ দুপুরের খাবার তো এখনো খাওনি। চলো খেয়ে নিবে। তোমার বাকি সব ভাই বোনেরা খেতে বসেছে। তুমিও তাদের সাথে খেয়ে নাও। আর কিছু লাগলে অরিনকে বলো”

ধূসর মাথা নাড়াতেই তিনি নিজের রুমে চলে যান। ধূসরের শরীরটা ভালো না। বৃষ্টিতে ভেজার ফলে এরকম হয়েছে। শরীর হালকা গরম। তবে সে এগুলো মাকে বলে টেনশনে ফেলাতে চাইছে না। তাই চুপ থাকাই ভালো মনে করলো। ধীরে ধীরে নিচে নামলো। দেখলো সবাই বসে খাচ্ছে। সে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলো। জায়রার আবার ভীষণ পছন্দ ধূসরকে। সে ধূসরকে দেখে খুশি হয়ে বলল,,,

“ভাইয়া এতো সময় কোথায় ছিলে তুমি?”

ধূসর ধীর কন্ঠে শুধালো,,,“এইতো শুয়ে ছিলাম।”

অরিন ধূসরের গলা শুনে বুঝে ফেললো ধূসরের শরীর খারাপ। বৃষ্টিতে ভেজার কারণেই হয়েছে। তার অনুশোচনা হলো। সে বলেছিলো বিধায় হয়তো ধূসর ভিজেছিলো। অরিন নিজে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করলো। অতঃপর ধূসরকে এগিয়ে দিলো সব। ধূসর অবাক হলেও কিছু বলল না। কারণ তার এখন কথা বলতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। ধূসর বেশি খেতেও পারলো না। বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। দ্রুত উঠে রুমে চলে আসলো। অরিন বুঝলো সব কিছু। তবে এটা ভেবে ভীষণ অবাক হলো যে সে কাউকে কেনো কিছু বললো না। সবাই নিজের রুমে চলে গিয়েছে। অরিন বুঝলো এখন যদি ধূসর ঔষধ না খায় তাহলে জ্বর আরো বাড়তে পারে।

তাই সে সব অস্বস্তি এক পাশে রেখে ওষুধ নিয়ে রুমে গেলো ধূসরের। ভেতরে প্রবেশ করতেও কেমন লাগছে। তবুও দরজায় আঘাত করে বলল,,,
“আসতে পারি?”

ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো না। অরিন বেশ ভয় পেলো। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো। রুমে ঢুকতেই তার খারাপ লাগলো ভীষণ। ধূসর বিছানায় কাঁথা গায়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। জ্বরে কাঁপছে হয়তো। সে দ্রুত কাছে আসলো। এসে ধূসরকে ডাক দিলো তবে উত্তর আসলো না। এবার অরিন অনেক বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছে। এসে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে তার আম্মু আব্বুর রুমে এসে নক করে। অরুনি শেখ মাত্রই শুয়েছিলেন। দ্রুত উঠে পরলেন তিনি। মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,,,

“কিছু লাগবে তোর?”

“আম্মু ধূসর সাহেবের জ্বর এসেছে। তাড়াতাড়ি চলো”

অরুনি শেখ চমকে উঠলেন। দ্রুত মেয়ের সাথে চলে আসলেন ধূসরের রুমে। ছেলেটা এখনো কাঁপছে। তিনি অরিনকে কম্বল এনে দিতে বলেন আর অনামিকা ইসলামকে ডেকে দিতে বলেন। অরিন প্রথমে কম্বল এনে দেয়। তারপর অনামিকা ইসলামকে ডাকে। অনামিকা ইসলাম এসে ছেলের অবস্থা দেখে আটকে উঠেন। আসাদ আহসানও ছেলের খবর পেয়ে তার রুমে চলে এসেছে। একে একে বাড়ির সবাই চলে আসলো। ধূসর এখনো জ্বরে কাঁপছে ভীষণ। অনামিকা ইসলাম সুপ রান্না করে এনে সেটা খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন ছেলেকে। তবে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না হঠাৎ করে সুস্থ ছেলেটার জ্বর কিভাবে আসলো।

সৃজনী শেখ বলেন,,,“হঠাৎ করে সুস্থ স্বাভাবিক ছেলেটার জ্বর আসলো কি করে। ও কি বৃষ্টিতে ভিজেছে”

অরিন মাথা নিচু করে অপরাধী কন্ঠে বলে,,,“হ্যাঁ মেঝো ফুপি উনি আমার সাথেই বৃষ্টিতে ভিজেছে”

সবাই এবার বুঝলো আসল বিষয়টা। তবে কেউ অরিনকে কিছু বলল না। কি বলবে ওর তো কোনো দোষ নেই। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ তাই হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে। অনামিকা ইসলাম সবাইকে চলে যেতে বলেন। সবাই ধীরে ধীরে রুম ত্যাগ করে। তিনি ছেলের পাশে বসে আছেন। তার বড্ড আদরের ছেলে। অনেক সাধনার ফল।

দেখতে দেখতে তিনদিন পার হয়েছে। ধূসর এখন সুস্থ বলা চলে। অনামিকা ইসলাম এই তিনদিন ধূসরকে রুমের থেকে বের হতে দেয়নি। ধূসর অবশ্য বৃষ্টিতে ভেজার জন্য বকাও খেয়েছে মায়ের কাছে। এখন পরিবারের সকলে মিলে বসে আছে বসার রুমে। ধূসরও আছে। আজ আর অনামিকা ইসলাম কিছু বলেননি। অরিনের সাথে এই তিন দিন একবারের জন্যও দেখা হয়নি ধূসরের। সে বেশ মিস করেছে অরিনকে। অরিনের ছোটফুপি ইফাতারা খানম আমতা আমতা করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“তোমাদের সবাইকে আমার কিছু বলার আছে”

সবাই সম্মতি দিতেই তিনি বললেন,,,“রাফার বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনে মাসেই বিয়ে। তোমাদের সবাইকে জানাতেই এসেছি আমরা খবরটা”

আজাদ শিকদার খুশি হয়ে বলেন,,,“বাহ এতো বেশ খুশির খবর তা ছেলে কি করে?”

“আব্বু ছেলে একজন আর্মি অফিসার। পরিবারও বেশ ভালো। তাই বিয়ের তারিখ ঠিক করেছি। ছেলেদের বাড়িও বেশি দূর না আমাদের বাড়ি থেকে।”

“যাক ভালো তো তাহলে”

কাজিনরা সব রাফাকে নিয়ে অরিনের রুমে চলে। অরিনের রুমে আসতেই ওকে চেপে ধরে সব কটা। রাফা না পেরে বলে,,,
“ভাই থাম তোরা। আমার বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল তাই বলিনি। এখন তো জানলি ”

জাহিনের খারাপ লাগছে কেনো যেনো রাফার বিয়ের কথা শুনে। তাহলে কি এর পর নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে তার হারাতে হবে। সে সহ্য করতে পারবে না রাহিয়ার পাশে অন্য কাউকে। সে মাথা থেকে উল্টাপাল্টা চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চাইলো। তবে সম্ভব হচ্ছে না। রাহিয়া অন্য কারো হবে ভাবতেই কাটা দিচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটাকে অন্তত সে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু সে তো জানেও না রাহিয়ার মনে তার জন্য অনুভূতি আছে কি না। তবে এখন সে জানার চেষ্টা করবে।

#চলবে~

প্রেম রাঙানো ক্যানভাস পর্ব-০৫

0

#প্রেম_রাঙানো_ক্যানভাস💜
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৫

স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ধূসর এবং অরিন। ট্রেন এসে পৌঁছিয়েছে। তবে এখনো তাদের খুঁজে পায়নি। ধূসরের প্রতি বেশ বিরক্ত অরিন। অরিনের নিজের প্রতিই রাগ লাগছে। নিজের ফোনটাও আনেনি। ফোন দিয়ে যে শুনবে তারও উপায় নেই। আর সে ধূসরের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। তখনই একটা মেয়ে এসে অরিনকে জড়িয়ে ধরলো। অরিন প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও বুঝতে পারলো কে হতে পারে। মেয়েটি তাকে ছেড়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে শুধালো,,,

“কেমন আছিস অরিন। কত দিন পরে দেখা হলো। আরে ধূসর ভাইয়াও যে এসেছো। তুমি কেমন আছো?”

অরিন মুচকি হেসে বলে,,
“এই তো ভালো আছি রাহিয়া।”

“চুপ কর ফাজিল মেয়ে। তুই তো খোঁজ খবর ও নিস না আমাদের। আমি কল বা মেসেজ করলে তারপর রিপ্লাই দিস। তোর সাথে কথা বলাও ঠিক না”

ধূসর বেশ বিরক্ত। এমনিতেও অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে আছে তার উপর এদের এসব কথাবার্তা। কিছুই সে সহ্য করতে পারছে না। তখনই জাহিন এগিয়ে আসলো। জাহিন অরিনের মেঝো ফুপি সৃজনী রহমানের ছেলে। ধূসরের থেকে কিছুদিনের ছোট। তার এখনো মাস্টার্স শেষ হয়নি। সে ধূসরকে বলে,,
“ভালো আছো ব্রো?”

ধূসর মৃদু স্বরে শুধালো,,“হ্যাঁ দেখতেই তো পাচ্ছো”

জাহিন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এই ছেলেটা তার বড় ভাই হলেও এখনো ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলেনি তাদের সাথে। সে আর কথা বাড়ালো না। অরিন ধূসরের আব্বু আসাদ আহসান, মেঝো ফুপা,ছোট ফুপাকে সালাম দিয়ে কথা বলল। তিনটা ভ্যান ঠিক করে অরিনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো সবাই। অরিনসহ চারজন মেয়ে ছিলো তারা এক ভ্যানে বসেছে। বাকি রা বাকি দুটো ভ্যানে বসেছে। ধূসর নিজের বাবার সাথে ভালো মন্দ টুকটাক কথা বললো। বাবা ছেলে এক ভ্যানে বসেছে। আর এক ভ্যানে জাহিন আর অরিনের বাকি দুই ফুপা।

অরিনের বড় ফুপি অর্থাৎ অনামিকা ইসলামের একটা মাত্র ছেলে ধূসর। মেঝো ফুপির তিন ছেলে মেয়ে জাহিন, জায়রা, আর হায়াতের বয়সী একটা মেয়ে যার নাম ইলা। ছোট ফুপির চার ছেলে মেয়ে। রাহিয়া, রাফা, তাতান, টুসি। রাহিয়া,রাফা অরিন সমবয়সী। রাহিয়া রাফা জমজ।তাতান তো অনেক ছোট। টুসি হায়াতের থেকে এক বছরের ছোট। জায়রা আবার অরিনদের থেকে দু বছরের ছোট। এই তো এদের নিয়েই অরিনের কাজিন মহল। অরিনের বাবা তিনবোনের একমাত্র ভাই। বড় দুই বোনের পরে সে তারপর ছোটজন। অরিনদের পরিবার বেশ বড়ই।

বাকি সবাই বছর শেষে বেড়াতে আসলেও অরিনের বড় ফুপিরা আসতেন না। তারা চৌদ্দ বছর ধরে কানাডায় থাকেন। এ বছর ধূসরের গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে তাই অনামিকা ইসলাম ঠিক করেছেন একেবারের জন্য বাংলাদেশে চলে আসবেন। তাই সপরিবারে এখানে। ধূসরেরও নিজ মাতৃভূমির প্রতি টান ছিলো, অনেক তো হলো অন্যের দেশে পরে থাকা এবার না হয় নিজ দেশেই থেকে গেলো।

বাড়ি আসতেই হৈ চৈ লেগে গেলো। বাড়ির তিন জামাই এতো বছর পর এক সাথে বাড়িতে এসেছে। আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখছেন না আজাদ শিকদার, ইমরুল শিকদার। অরুনি শেখ ও রান্নাঘরের কাজ সামলাচ্ছেন। সাথে অনামিকা ইসলাম এবং অরিনের ছোট ফুপি ইফাতারা খানম ও তাকে সাহায্য করছেন। সৃজনী রহমান ছেলে মেয়ে আসাতে তাদের নিয়ে ব্যস্ত।
আজাদ শিকদার সহ বাকিরা বসার রুমে বসে আছেন।

“আব্বু আম্মু কোথায়? তাকে যে দেখছি না?”

“তোমার শ্বাশুড়ি আম্মু অসুস্থ আসাদ। সে নিজের রুমেই থাকে সব সময়”

“তাহলে আব্বু যাই আমি তাকে দেখে আসি?”

“হ্যাঁ যাও। সেও তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে”

তিন জামাই শ্বাশুড়িকে দেখতে গেলো। অপর দিকে কাজিনরা সব আড্ডায় বসেছে অরিনের রুমে। শুধু মাত্র একজন নেই আর সেই একজন হলো ধূসর। রাহিয়া, রাফা, অরিন, জায়রা জাহিন পাঁচ জন মিলে আড্ডা দিতে বসেছে। জাহিনের সাথে সবাই অনেক ফ্রি। জাহিনও সবাইকে বোনের চোখেই দেখে শুধু এজন ছাড়া। গত দু বছর যাবত একটু একটু করে তার প্রতি অনুভূতি নিজের হৃদয় কোঠায় সাজিয়েছে জাহিন। তবে এখনো সাহস হয়নি তাকে মনের কথা জানানো। প্রেম সে করতে চায় না। করলে বিয়ে করবে। তবে এখন সে পড়াশোনা করছে, তাই চাইলেও সম্ভব নয়।

“কি হলো জাহিন ভাইয়া কোথায় হারালে?”

অরিনের কথায় জাহিন জোর পূর্বক হেসে বলল,,,“কোথায় আর হারাবো। আছি তো তোমাদের মাঝে।”

অরিন সন্দিহান কন্ঠে বলল,,“ভাই তুমি কি প্রেমে পরেছো? তাই তো মনে হচ্ছে! প্রেমে পরলেই কিন্তু মানুষ কল্পনায় ডুবে থাকে”

কথাটা বলতেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে রাহিয়া,রাফা, অরিন, জায়রা। জাহিন লজ্জা পায় কিছুটা। ইশশ এই মেয়েটা তাকে সব সময় লজ্জায় ফেলে দেয়। সে ধমক দিয়ে বলে,,,,
“হাসি থামা ফাজিলের দল। বড় ভাইয়ের সাথে মজা করতে ভালো লাগছে না। অরিন মামিকে বলে কিন্তু তোমাকে বকা খাওয়াবো”

“জাহিন ভাইয়া আমিও কিন্তু মেঝো ফুপিকে বলে তোমাকেও বকা খাওয়াতে পারবো। তাই ভেবে চিন্তে কাজ করো। তুমি একা আর আমার দলে এই যে আমার বোনগুলো”

জাহিন অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সবার দিকে। অরিনের সাথে সে কোনো কালেই পেরে উঠে না। পাশ থেকে রাহিয়া বলে,,,
“আচ্ছা বাদ দাও এসব। আজকে রাতে কিন্তু সেই একটা আড্ডা দিবো। ছাদে বসে সবাই গল্প করবো। মজা হবে, অনেক দিন ওইভাবে আড্ডা দেওয়া হয় না”

অরিনও সম্মতি দিয়ে বলে,,,“হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। কি রে রাফা আজ তুই চুপচাপ যে? কিছু হয়েছে?”

রাফা ক্লান্ত কন্ঠে শুধালো,,
“আমি ভাই অনেক ক্লান্ত। অনেকটা সময় জার্নি করেছি। তোদের মতো আমার এতো এনার্জি নেই ভাই। তাই তো চুপচাপ তোদের কথা শুনছি।”

জাহিন রাফার কথা শুনে বলল,,আচ্ছা এখন তোমরা বিশ্রাম করো। আমিও যাই। আসলেই অনেক ক্লান্ত লাগছে আমার”

জাহিন বের হয়ে যায়। অরিন উঠে দরজা আটকে দেয়। ততক্ষণে সবগুলো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পরেছে। অরিন বিরক্ত হয়ে বলল,,
“ভাই তোদের তো আম্মু রুম দিয়েছে থাকতে তাই না? তোরা আমার রুমে এমন হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলি কেনো?”

রাহিয়া বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,,,“চুপ থাক তুই। এইটা এখন আমাদের রুম। মোটেও জ্বালাবি না। ভাগ এখান থেকে ”

অরিন কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এদের সাথে কথায় পারবে না। বাইরের আবহাওয়া এখনও খারাপ। যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে। সে ছাদে আসলো। মৃদু হাওয়া বইছে, আকাশে ঘন কালো মেঘ। এমন পরিবেশ ভীষণ পছন্দ অরিনের। স এককাপ চা করে নিলো যদিও পাশ থেকে মা তাকে বকেছে তবুও কিছু যায় আসে না তার। এখন একটু ছবি আঁকবে। সুযোগ যখন পেয়েছে এমন দৃশ্যের একখানা ছবি না হয় একেই ফেললো সে। ক্যানভাস, রংতুলি নিয়ে বাইরে চলে আসলো। আঁকা শুরু করলো সে।

“বাহ বোম্বায় মরিচ তুমি তো বেশ সুন্দর ছবি আঁকো।”

“আমি জানি। আপনাকে বলতে হবে নাহ”

ধূসর বেশ বিরক্ত হলো। দেশে আসার পর বৃষ্টি দেখেনি সে। তাই তো এরূপ আবহাওয়া দেখে সেও ছাদে চলে আসলো। আসতেই দেখতে পেলো অরিন ছবি আঁকছে। ছবি আঁকা এতোটাই সুন্দর হয়েছে যে সে মুখ ফসকে কথাটা বলেই ফেলেছে। তবে সে ভুলেই গিয়েছিলো এই মেয়ে কেমন। সে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলে,,

“তুমি কি ভালো ভাবে কথা বলতে পারো না? আমি স্বাভাবিক ভাবে তোমার ছবি আঁকার প্রশংসা করেছি আর তুমি ত্যাড়া জবাব দিচ্ছো?”

“আমি এমনই সোজাসুজি উত্তর দেওয়া আমার পছন্দ নয়।”

ধূসর বিরক্ত হয়ে কথা না বাড়িয়ে ছাদের উপর পাশে এসে বসে। পরিবেশটা উপভোগ করছে। হুট করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া শুরু করলো। অরিন নিজের জিনিসপত্র সেই চিলেকোঠার রুমটাতে রেখে আবারও বাইরে আসলো। ইতিমধ্যে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ঝড়ো হাওয়া বইছে। অরিন নিজেকে সামলাতে পারলো না। নেমে পরলো বৃষ্টিতে। ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে বৃষ্টি। ধূসর ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে দেখছে অরিনকে। তার একটু অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে। যা আগে কখনো হয়নি। ধূসরের বেশ ভালোই লাগছে অরিনকে দেখতে। হুট করে কি হলো তার। অরিন ধূসরকে দেখে চিল্লিয়ে বলে,,,

“এই যে বিদেশী বাদুড় চাইলেও আপনিও আমার সাথে ভিজতে পারেন। আমি এখন ঝগড়া করার মুডে নেই। মনে হয় না তো কখনো বৃষ্টিতে ভিজেছেন”

ধূসর নিজেও ভাবলো বৃষ্টিতে ভিজবে। এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে আসলো। সাথে সাথে ভিজে গেলো সে। বেশ ভালো লাগছে বৃষ্টি তার। বৃষ্টি তার খুব প্রিয় ছিলো ছোট বেলায়। ধূসর ভীষণ উপভোগ করছে।

#চলবে~