অবেলার বকুল পর্ব-০১

0
465

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ জানান দিলো কাঁটা বারোটা ছুয়েছে। রাহেলা বেগম এশার নামাজ পড়ে ছেলে আয়ান ফেরার অপেক্ষায় ড্রইংরুমে বসে আছেন। বছর খানিক ধরে উনাকে এই রুটিন মেনে চলতে হয়। যদিও এটা হওয়ার কথা ছিলো না। রাহেলা বেগমের খুব সুখের সংসার ছিলো। স্বামী সরকারী অফিসার ছিলেন। বদলীর চাকরি। সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াতে হতো। রাহেলা বেগম দুই ছেলে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডে দু,কাঠার একটা সরকারী প্লট পেয়েছিলেন। ওখানে ব্যাংক লোনের সহযোগীতায় পাঁচতলা বাড়ির ফাউন্ডেশন দিয়েছিলেন। আপাতত তিনতলা করেছেন। নিজেরা ডুপ্লেক্স নিয়ে থাকেন আর একটা ফ্লোর ভাড়া দিয়েছিলেন। আয়ান তখন সবে সেন্ট জোসেফ স্কুলে ক্লাস থ্রীতে চান্স পেয়েছে। আর সায়ানের তখন একবছর বয়স। দু,ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান ন,বছর। মাশাআল্লাহ রাহেলা বেগমের ছেলেদুটো যেমন মেধাবী তেমনি মায়ের কথাশুনে চলতো। প্রতি বৃহস্পতিবার স্বামী রায়হান চৌধুরী ঢাকায় চলে আসতেন। স্ত্রী সন্তানদের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করে নিজের কর্মস্থলে ফিরে যেতেন। আয়ান স্কুল, কলেজ পার হয়ে ঢাকাভার্সিটিতে আইবিএ তে ভর্তি হয়। এদিকে সায়ানও সেন্টজোসেফ স্কুলে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়। আয়ানের সাথে ভার্সিটিতে জেসিকার পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে দু,জনের মধ্যে মন দেয়া নেয়া শুরু হয়। এরমাঝে আয়ান মা রাহেলা বেগমের সাথে জেসিকার আলাপ করিয়ে দেয়।প্রথম দর্শনে জেসিকাকে রাহেলা বেগমের খুব একটা ভালো লাগেনি। মাঝে মাঝে আয়ান ঐ মেয়ের সাথে ঘুরতে যেতো। আয়ান মুখে কিছু না বললেও ওর মা ঠিক বুঝতে পারতো। যেদিন ঘুরতে যেতো আয়ান সেদিন গাড়ি নিতে চাইতো না। পরে একদিন রাহেলা বেগমই ছেলেকে বলেন,”আয়ান তুমি জেসিকাকে নিয়ে প্রায় ঘুরতে যাও বিষয়টা আমার পছন্দ নয়।তোমরা ইয়ং দু,জন ছেলে মেয়ে একসাথে টাইম স্পেন্ড করো আমার অস্বস্তি হয়”। আয়ানও রাহেলা বেগমকে বলে,” আম্মু ওকে আমি ভালোবাসি। বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো। সুতরাং একসাথে সময় কাটালে আমরা দু,জন দুজনকে ভালোমতো বুঝতে পারবো”।রাহেলা বেগমও ছাড়বার পাত্রী নন। উনিও বলেন,”আমি আর তোমার বাবা যে টাইম স্পেন্ড না করে বিয়ে করেছি তো আমাদের দু,জনকে বুঝতে তো কোনো সমস্যা হয়নি”। আয়ান মায়ের সাথে একমত হয় না। এদিকে রাহেলা বেগমও ছেলেকে নিয়ে টেনশনে থাকেন। কখন কি অঘটন ঘটে যায়। অগত্যা ছেলেকে বলেন,”আমার নিষেধ সত্বেও তুমি জেসিকাকে নিয়ে ঘুরতে যাও বুঝতে পারি। কিন্তু এরপর আমাকে জানিয়ে যেও। আমি তোমাকে বাধা দিবো না। কিন্তু কোনো বিপদ আপদ হলে অন্তত আমি তোমার অবস্থান বুঝতে পারবো”। সময়ের উল্টোস্রোতে উনি হার মানলেন। নিজের ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সারাদিন দুটো ইয়ং ছেলেমেয়ে একসাথে সময় কাটায় একজন মা হিসেবে রাহেলা বেগমের বিষয়টা ভালো লাগে না। যাই হোক ছেলে কষ্ট পাবে বলে এবিষয়টা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করেননি। তবে পাশ করার সাথে সাথে বিয়ে দিবেন এই বিষয়টি মনস্থির করলেন। আয়ান জেসিকার উপর খুব দুর্বল ছিলো। মা হয়ে উনি এটা ভালোই বুঝতে পারতেন। তাই জেসিকার বিষয়ে কোনো নেগিটিভ কথা ছেলেকে কখনও বলেননি। এখানে কোনো সেশনজট না থাকার কারনে চারবছরে আয়ান আর জেসিকার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যায়। ততদিনে রায়হান সাহেবও বদলি হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসাবে শিক্ষা অধিদপ্তরে পোস্টিং হয়। পাশ করার সাথে সাথে আয়ানের ও বৃটিশ টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি হয়। চাকরিটা খুব লুক্রেটিভ দেখে বিদেশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে এখানেই জয়েন করে। অপরদিকে জেসিকা তখন ওকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। এবং কিছু শর্ত আয়ানের উপর চাপিয়ে দেয়। ওকে দশ ভরি গোল্ড দিতে হবে। বেশ প্রমিন্যান্ট একটা কনভেনশন হলে বিয়ের আয়োজন করতে হবে। আয়ান রাহেলা বেগমকে এসব কথা জানালে উনি দশ ভরি গয়না দিতে অস্বীকৃতি জানান। আসলে সোনার এখন যা দাম দশভরি গোল্ড কেনা সহজ কথা নয়। এসব নিয়ে মায়ের সাথে আয়ানের নিত্য অশান্তি হতে থাকে। বাধ্য হয়ে রাহেলা বেগম ছেলেকে বলে,
“তোমাকে সংসারে কোনো কন্ট্রিবিউট করতে হবে না। তোমার বেতনের টাকা দিয়ে বউয়ের গয়না বানাও”।
এতে রাহেলা বেগমের সংসারে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। তবে রায়হান সাহেব খুব মনক্ষুণ্ন হন। তার কথা হচ্ছে,
” ঐ মেয়েকে তো বুঝতে হবে আয়ানের সামর্থ কতটুকু। একজন স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর সামর্থ বোঝা আর স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর ভরণপোষণ ঠিকভাবে পালন করা”।
রাহেলা বেগম এসব টানা পোড়েনে ছেলেকে একদিন বলেন,
“তুই এতো সুন্দর চাকরি করছিস, জেসিকাও তো ঐ একই ডিপার্টমেন্ট থেকে পাশ করেছে। ওকে চাকরি করতে বল। হাতে পয়সা থাকলে জেসিকারও মন মেজাজ ভালো থাকবে”।
আয়ান মাকে জানায়,” ও চাকরি করবে না। অনলাইন বিজনেস করবে”।
আসলে জেসিকা তো আইবিএ তে পড়াশোনা করলেও আয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে পুরোটাই কমপ্লিট করেছে। অথচ চাকরি ক্ষেত্রে নিজের কোয়ালিটি শো করতে হবে। কিন্তু জেসিকার নিজের উপর সেই কনফিডেন্ট নাই। তাই অনলাইন বিজনেসে নামতে চাইছে। আয়ান জেসিকার দুর্বলতা বুঝতে পারছে তাই চাকরি করার জন্য জেসিকাকে চাপ দিতে চাইছে না। এমনকি জেসিকাকে এই অপশনও দিয়েছে ওর মন না চাইলে ওকে কিছুই করতে হবে না। শুধু সংসারটা ঠিকমতো সামলে রাখতে পারলেই আয়ান খুশী।
বছর দুয়েক সময় হাতে নিয়ে দশ ভরি গোল্ড দিয়ে গয়না বানালো আয়ান। সে সময় আয়ানের বাবা রায়হান চৌধুরীও এলপিআর এ গেলেন। কিছু টাকাও হাতে পেলেন। সব মিলিয়ে আয়ান আর জেসিকার বিয়েটা ভালো ভাবেই হলো। জেসিকার বাবার বাড়ি থেকে কিছু ফার্নিচার দেওয়া হলো। সেটা রাখতে গিয়ে রায়হান চৌধুরী উনার তিন তলার ভাড়াটিয়াকে উঠিয়ে দিলেন। ঐ ফ্লাট খুব সুন্দর করে ফার্নিচারগুলো দিয়ে সাজানো হলো। তবে আলাদা ফ্লাটে উঠলেও আয়ানের বাবা রায়হান চৌধুরী ওদেরকে ডেকে বললেন,
“তোমরা আলাদা থাকলেও একসাথে খাওয়া দাওয়া চলবে”।
কথাটা জেসিকার ভালো লাগেনি। ও নিজে কিছু বলেনি। ওর মাকে এই বিষয়টা জানিয়েছে। ওর মা রাহেলা বেগমকে ফোনে বলেছে,
” বেয়াইন ওরা যেহেতু আলাদা আছে তো খাওয়া দাওয়াও আলাদা করুক। বিয়ে যখন হয়েছে তখন নিজেদের সংসার যত তাড়াতাড়ি বুঝে নিবে আপনার আমার জন্য ততই মঙ্গল”। একথা শুনে রাহেলা বেগমের মনে আঘাত লাগলেও বাহ্যিকদিক থেকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেন। জেসিকার মায়ের কথা শুনে রাহেলা বেগম একটু অবাক হলেন। মেয়েকে উনি একটু বোঝাতে পারতেন সেটা না করে বরং মেয়ের অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দিলেন। তুলনামুলক জেসিকার বাবাকে রাহেলা বেগমের ভালো লেগেছে। ভদ্রলোক নিপাট ভালোমানুষ। সংসারে মনে হয় জেসিকার মায়ের প্রভাব বেশী। বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে ভদ্রলোকের দুটো দোকান আছে। ব্যবসা নিয়েই হয়তো বেশী ব্যস্ত থাকেন। জেসিকার বড় বোন আছে। ওর হাসবেন্ড ও ব্যবসা করে। একটা চার বছরের ছেলে আছে। তবে ওর বড় বোন মায়ের সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখে না। কারণ জেসিকার মা মেয়েদের সংসারে খুব মাথা ঘামায়। আয়ানের বিয়ের পরে রাহেলা বেগম জেসিকাদের এক আত্মীয়ের কাছে এই খবর জানতে পারেন।
তবে জেসিকার মায়ের এই আব্দার আয়ানের কাছে ভালো লাগেনি। যদিও আয়ান জানতো এতে জেসিকার ইন্ধন আছে। তবুও সংসারের শান্তির জন্য পুরো বিষয়টা হজম করে নিলো। কিন্তু ও নিজের মতো করে চলতে লাগলো। এরপর থেকে সকালে নিচে নেমে মায়ের সাথে ব্রেকফাস্ট করে অফিসে যাওয়া শুরু করলো। সন্ধায় বাসায় ফিরে বাবা মায়ের সাথে চায়ের পর্ব শেষ করে ঘরে ফিরে শুধু ডিনার করতো। যদিও এ বিষয়গুলো নিয়ে ওদের মাঝে নিত্য অশান্তি শুরু হয়। তারপরও রাহেলা বেগম ছেলেকে বুঝিয়ে বলে,”জেসিকা যখন মানতে চায় না তাহলে তুই নিচে বেশী আসিস না”।
আয়ানও বলে,”না, মা আমি ওর এই অন্যায় আবদার মানতে পারবো না। ও যা বলেছে আমি তো তাই করেছি। আমার কষ্ট হলেও ওর চাওয়া অনুসারে বিয়ের আয়োজন করেছি। ওকে নিয়ে থাইল্যান্ডে হানিমুনে গিয়েছি। বাংলাদেশের কোথাও হানিমুন করতে আমি বলেছিলাম। ও আমার কোনো কথা শোনেনি। ওর নাকি বান্ধবী আত্মীয়স্বজনদের কাছে স্ট্যাটাস থাকবে না। অথচ আমার যে কষ্ট হলো সে বিষয়টা ওর চোখে পড়লো না”।
এরমাঝে বিয়ের দুবছর সময় পার হয়ে গেল। একদিন জেসিকা রাহেলা বেগমকে না জানিয়ে ড্রাইভার মতিকে নিয়ে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিতে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। সেদিন রায়হান সাহেবের হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হয়। সায়ান তখন এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বাসায় বসে পড়াশোনা করছিলো। রাহেলা বেগম ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে জানতে চায় ও কোথায়? ড্রাইভার বলে বউমনিকে নিয়ে ধানমন্ডী শেফস টেবিলে আসছে। উনি ও জানতে চান ওখানে কি দরকার? ড্রাইভার জানায়,”বউমনির বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে আসছে”। এদিকে গাড়ি এসে রায়হান সাহেবকে হাসপাতালে নিতে দেরী হয়ে যাবে। তাই সায়ানকে দিয়ে উবার ডেকে রায়হান সাহেবকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দি হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু মনে মনে জেসিকার উপর উনি প্রচন্ড বিরক্ত হন। এক সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে রায়হান সাহেবকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। উনার দুটো ব্লক ছিলো। রিং পড়ানো হয়েছে। বাসায় এসে এই বিষয়টি নিয়ে আয়ানের সামনে জেসিকাকে রাহেলা বেগম বলেন,
——আমার ছেলেরাও গাড়ি নিয়ে বের হতে চাইলে আমার অনুমতি নিতো। অথচ তুমি আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলে না? তোমার শ্বশুরকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে না নিতে পারলে হয়তো বড় কোনো ক্ষতি হতে পারতো? ভাগ্যিশ আল্লাহপাকের রহমত ছিলো। সায়ান বাসায় থাকাতে ট্যাক্সি ডেকে হাসপাতালে সময়মতো নিতে পেরেছি।
——আয়ানকে বলে গিয়েছি।
——এই সংসারটা আমার। সর্বোপরি গাড়িটা তোমার শ্বশুর কিনেছে। সেদিকে খেয়াল রেখে হলেও তোমার আমার অনুমতি নেওয়া দরকার ছিলো। ঠিক আছে এরপর গাড়ি নিয়ে বের হতে চাইলে তুমি আমার অনুমতি নিয়ে বের হবে।
বিষয়টা জেসিকা স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। সেদিন সন্ধা বেলায় ও বাবার বাড়ি চলে যায়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে