Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 195



ভুল সত্য পর্ব-১৭

0

ভুল সত্য

১৭

আমি কি করবো সব ঠিক করে ফেলেছি। মুকুলের সঙ্গে আর থাকবো না। বাবা-মায়ের সঙ্গেও না। বিয়ের আগেই বাবা-মা আমার কথা শোনেনি আর এখন আলাদা হতে চাইলে এসব নিয়ে নানান কথা হবে। সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে বসা হবে, লোকজনের সামনে জবাবদিহিতা করতে হবে দুজনকেই। কথায় কথা বাড়বে। আমার এসব ভালো লাগে না। আমার খুব ইচ্ছা করছে কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপ করে কোথাও চলে যেতে। অনেকটা যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না। মুকুল ফিরে আসবে ওর মুখোমুখি হতে হবে।

আগামীকাল রাতে ওর ফ্লাইট। খুব সম্ভব রাত দশটার ফ্লাইট। সকালের আগেই বাড়িতে পৌঁছে যাবার কথা। নিশ্চয়ই পরশুদিন সকালবেলা এখানে এসে হাজির হবে। যত কিছুই হোক বউকে ম্যানেজ তো করতে হবে। যাক, তবু ভালো দুটো দিন শান্তিতে থাকা যাবে। আমি মাথাব্যথার ট্যাবলেট আনতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মা বিশাল রান্নার আয়োজন করেছে। বুটের ডাল আর গরুর মাংস সিদ্ধ করা হয়ে গেছে। ফুড প্রসেসর এ বাটার আয়োজন চলছে। নিশ্চয়ই শামি কাবাব হবে। অন্যদিকে চিকেনের লেগ পিস ম্যারিনেট করা হচ্ছে রোস্টের জন্য। ডজন খানেক ডিম সেদ্ধ করা হয়েছে। আমার মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার খোসা ছাড়াচ্ছে। অন্য সময় হলে এসব আয়োজন দেখে আমার ভালো লাগতো। বলতে দ্বিধা নিয়ে হয়তো নিজেও হাত লাগাতাম। আজ অসহ্য লাগছে।

আমি মাকে পাশ কাটিয়ে মাইক্রোওয়েভে চা যাওয়ার জন্য পানি চাপালাম। মা একবার আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
বুঝলি তুলি, একটু কাজ এগিয়ে রাখি।
কাজ এগিয়ে রাখা মানে তো তিন দিন আগে রান্না করা না, মা
না, তিন দিন কেন হতে যাবে?
মা হঠাৎ করে কেমন যেন চুপ করে গেল তারপর আমতা আমতা করে বলল কালকে তো আমার স্কুল। বুঝিস না
আমি আর কিছু বললাম না। শুধু শুধু মায়ের সাথে ঝামেলা করে লাভ নেই। টুকটুকি কে নিয়ে বারান্দার দোলনাতে বসে দোল খেতে লাগলাম। আচ্ছা, আমি চলে গেলে টুকটুকির কি হবে? হোস্টেলে নিশ্চয়ই আমি ওকে সঙ্গে রাখতে পারব না। এই মুহূর্তে বাড়ি ভাড়া করে থাকা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। এভাবে হুট করে, এত শর্ট নোটিশে ঢাকা শহরে একটা একা মেয়েকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেবে না। টুকটুকির কি হবে তাহলে? বাবা বিড়াল দুচোখে দেখতে পারে । তিথিদের ওখানে অবশ্য রাখা যায় কিন্তু কেন জানিনা আমার ওদের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। রেহানা আন্টি আর তিথি এরা নিশ্চয়ই শাওনের ব্যাপারটা জানত। না জানার তো কোনো কারণ নেই, তারপরও ওরা কি করে আমার সঙ্গে এই বিয়েটা হতে দিল। একবার চলে গেলে আমি কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখব না।

ও বাড়ি থেকে আসার সময় আমি আমার সমস্ত গয়না নিয়ে এসেছি। বিয়েতে দুপক্ষ মিলিয়ে প্রায় ৩০ ভরির মতন গয়না দিয়েছিলা আমাকে । ওদের দেয়া গয়না গুলো আমি সঙ্গে নেব না। সেগুলো বাদ দিলেও যা থাকে তার বর্তমান বাজার দর অনেক; এছাড়া আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট্টেও ভালই টাকা আছে। কাল চেক করেছি। কলেজে ভর্তি হবার সময়ে ব্যাংক একাউন্ট করেছিলাম। প্রতি মাসে পকেট মানি পেতাম এছাড়াও বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনেরা পালা পর্বনে আমার হাতে টাকা দিত। আমার তিন মামা, দুই চাচা প্রায়ই টাকা দিত। বিদেশে থাকা আমার দুই ফুপু মাঝে মাঝে ডলার পাঠায়, সেসব আমি আমার একাউন্টে তুলে রাখতাম। কাল চেক করে দেখেছি প্রায় ৭৫ হাজার টাকা আছে। আপাতত ওতেই আমার চলে যাবে। পাশ করে না হয় একটা চাকরি নিয়ে নেব।
আগে হলে এসব আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হতো কিন্তু এখন কেন যেন মন খারাপ লাগছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা আমি আর মুকুল ছাদে বসে চা খাই, ছুটির দিনে রিক্সা করে ঘুরতে যাই। ও আমার একটা হাত ধরে রাখে সবসময়। অস্ট্রেলিয়ায় গেলে কি কি করব তার কত পরিকল্পনা যে করি। এখন মনে হয় সেগুলো সব আসলেই স্বপ্ন ছিল। ও মিথ্যেই আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। হয়তো শেষ মুহূর্তে আমাকে না নিয়েই চলে যেত।

আমি রাতের খাবারও খেলাম না, আবারও একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা আবারো একই কাহিনী, মনে হচ্ছে কেউ দরজা ভেঙে ফেলছে। আমি দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুকুল আমাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। কি হয়েছে বলোতো?
আমি কোনমতে বললাম
আপনার না কাল আসার কথা
হ্যাঁ কথা ছিল কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না, তাই একদিন আগেই চলে এসেছি কেন তুমি খুশি হওনি?
আমি জবাব দিলাম না। জামা কাপড় নিয়ে চলে গেলাম। ইচ্ছে করেই দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করলাম। বেরিয়ে দেখি মা আর মুকুল বসে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে। আমি কাছে এসে বললাম
তুমি আজ স্কুলে যাওনি মা?
নারে, আজ ছুটি নিয়েছি
বুঝলাম মা এসব আগে থেকেই জানতো। শুধু আমার কাছেই লুকিয়েছে।

দুপুরের খাবার পর মুকুল বলল
তুলি চল বাড়ি যাবে
প্রথমে ভেবেছিলাম যাব না, পরে মনে হয়েছে চলে যাওয়াটাই ভালো। ওই বাড়ি থেকে বরং হোস্টেলে ওঠাটা সহজ হবে। এখানে মা নানান ঝামেলা করবে। আমি সব গুছিয়ে ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরে গেলাম।

বাড়ি ফিরতেই আমার শাশুড়ি তার অভিযোগের ঝুলি নিয়ে বসে গেল। এই কদিন তার খোঁজ নিইনি, বাপের বাড়ি গেলে আর কিছু মনে থাকে না, আমার মা পোলাও কোরমা খাইয়ে তার ছেলেকে কব্জা করার চেষ্টা করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। চাইলে কথাগুলোর জবাব দিতে পারতাম কিন্তু ইচ্ছা করলো না। মুকুলকে দেখলাম বিরক্ত হয়ে উপরে চলে গেল। আমি আরো কিছুক্ষণ তার ভ্যজর ভ্যজর শুনলাম নিঃশব্দে। এক পর্যায়ে উনি বিরক্ত হয়ে বললেন
কি কইতাছি কিছু হু্নছো? নাকি কানের মাথা খাইয়া বইয়া আছো?
আমি কান থেকে হেডফোন খুলে বললাম
জ্বী না কানের মাথা খাইনি। আপনাকে কি চা দেব?
দেও
মিল্ক টি না গ্রিন টি?
গ্রিন টি, মাচা
আমার বিষম খাবার যোগাড়। এই ভদ্রমহিলা বিউটি কনটেস্টে অংশ নেবার তাল করছে নাকি। যাইহোক, তাকে মাচা গ্রিন টি দিয়ে ঘরে ফিরে দেখি মুকুল ঘুমিয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা কেবল সাড়ে সাতটা বাজে, এত সকাল সকাল তো কখনো ঘুমায় না। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম কেমন এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। কপালে হাত রেখে বুঝলাম জ্বর বাধিয়েছে। যা বাবা! সব তো ওলটপালট হয়ে গেল; তার মানে কালকে অফিসে যাবে না। আমি ভেবেছিলাম কাল কলেজে যাবার নাম করে বাড়ি থেকে চলে যাব।

আমি ওর মাথার কাছে বসে বললাম
ওষুধ খাবেন?
মুকুল আমার একটা হাত ধরে বলল
আমার কি জ্বর এসেছে তুলি?

তাই তো মনে হচ্ছে , হঠাৎ করে জ্বর বাধালেন কি করে?
সেদিন পানিতে নামাটা উচিত হয়নি।
আচ্ছা উঠে ওষুধ খেয়ে নিন।
মুকুল বাধ্য ছেলের মতন উঠে ওষুধ খেয়ে নিল। তারপর বলল
আমার কাছে একটু বসবে তুলি
ভেবেছিলাম ও ঘুমিয়ে পড়লে ছাদে চলে যাব সেটা আর হলো না; অন্তত আমার কৃতজ্ঞতাবোধ সেটা করতে দিল না। আমার অসুস্থতার সময় ও অনেক করেছে। আমি ওর মাথার কাছে বসে বললাম
ঘুমিয়ে পড়ুন। ঘুমালে ভালো লাগবে

মুকুল আমার একটা হাত ধরে রেখেছে কিছুতেই যেতে পারছি না। ওর ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। খুব সম্ভব ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ওর কপালে হাত রেখে দেখলাম জ্বর নামেনি। ও কেমন গোঙ্গানির মতন একটা শব্দ করছে। আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম
কষ্ট হচ্ছে?
ও অস্ফুটে কি যেন বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম
কি হয়েছে?
আমাদের নতুন বাড়িতে তুমি গাছ লাগাবে তুলি?
আমি কেমন হোঁচট খেলাম। হঠাৎ করে এই কথা কেন? বোধহয় জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। আমি বললাম
হ্যাঁ লাগাবো
একটা কামিনী গাছ লাগিয়ো কেমন?
কামিনী গাছ কেন?
মায়ের খুব প্রিয় ছিল

আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম আচ্ছা
টুকটুকিকে নিয়ে যাবে না?
নিয়ে যাবে। আপনি আর কাউকে নিতে চান?
আর কাকে?
শাওনকে নিবেন না
মুকুল জবাব দিল না। বদমাইশের হাড্ডি একটা। সময়মতো ঠিক ঘুমিয়ে পড়েছে।

চলবে………

ভুল সত্য পর্ব-১৬

0

ভুল সত্য

১৬
প্রচন্ড জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। ধর মর করে উঠে বসে প্রথমটায় কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। দরজা ধাক্কানো সমানে চলছেই। আমি বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুলে দেখি, মা আমার চাইতেও বেশি বিরক্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। আমি দাতে দাত পিষে বললাম
কি হয়েছে?
মুকুল ফোন দিচ্ছে, ধরছিস না কেন?
মুকুল সকাল থেকেই ফোন দিচ্ছি। এমনটা যে হবে আমি ধারণা করেছিলাম। কাল সারাদিন ওর মিটিং ছিল শুধু রাতে একবার ফোন করে একটু কথা বলেছে। আজ সকালে কি একটা অনুষ্ঠান তারপরেই সারাদিন ওরা ফ্রি। আর কাল সারাদিন ওদের কোন কাজ নেই শুধু বেড়ানো।আগামিকাল রাতের ফ্লাইটে ওর রওয়ানা দেয়ার কথা।

আমি ইচ্ছা করেই ফোন ধরিনি। বলা ভালো ওর ফোন যেন ধরতে না হয় সেজন্যই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। মাও বাসায় ছিল না। ভেবেছিলাম সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ঘুমাবো। মা এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলো কেন বুঝতে পারছি না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে তিনটা বাজে। অবেলায় ঘুমিয়েছি তার উপর আবার ঘুমের ওষুধও খাওয়া হয় না সচরাচর। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম একুশটা মিস কল।

এখানে আসার পর আমি অনেক ভেবেছি। হতে পারে আমার কোন ভুল হচ্ছে। এমন হুট করে কারো ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া ঠিক হবে কি। ভাবলাম আরেকবার যাচাই করে দেখব। প্রয়োজনে ওর সঙ্গে সরাসরি কথা বলবো; দেখি কি বলে আর ও কি কি মিথ্যা সাজিয়ে রেখেছে।ও যাবার আগের দিন ইচ্ছা করেই ওর মোবাইলে ফোন না করে অফিসের নাম্বারে ফোন দিলাম। ওর এক্সটেনশন আমি জানি। এর আগেও দুই একবার কথা হয়েছে। প্রথমবার ফোন বেজে বেজে কেটে গেল দ্বিতীয়বার ফোন ধরল অন্য কেউ। আমি পরিচয় দিয়ে মুকুলকে চাইলে বলল
ও তো লাঞ্চ করতে অফিসের বাইরে গেছে
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম
কেন ক্যান্টিনে লাঞ্চ করছে না?
না ও আর শাওন তো প্রায়ই বাইরে গিয়ে লাঞ্চ করে
রাগে আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো। আমার সঙ্গে ঢং করে বলে যে আমার রান্না এত ভালো অথচ অফিসে খাবার দিতে চাইলে নিতে চায় না। এই তাহলে রহস্য। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রত্যেকদিন গিয়ে লাঞ্চ করবে। আর কথা বলার কোন দরকার নেই।
এরপর করি আমি মোটামুটি সব গুছিয়ে ফেলেছি। এই ছেলের সঙ্গে আর নয়। ওর মায়ের এত সার্কাস সহ্য করছিলাম শুধু এই ভেবে যে ছেলেটা অনেস্ট। আমারই বোঝার ভুল। এই জীবনে আরো একবার মানুষ চিনতে ভুল করলাম। তবে এটাই শেষ।শুরু থেকে কত চেয়েছিলাম যে ওকে বিশ্বাস করব না। কি করে যে কি হয়ে গেল। কবে কোন অবসরে যে ও আমার এত কাছে এসে গেল নিজেই টের পাইনি।

আবারো ফোন বাজছে। এবার আর না ধরে উপায় নেই। আমি ফোন ধরে বললাম
হ্যালো
কি হয়েছে তুলি, ফোন ধরছিলে না কেন?
ঘুমিয়ে ছিলাম
অবেলায় ঘুমাচ্ছিলে কেন? শরীর খারাপ?
না
মুকুল একটু চিন্তিত কন্ঠে বলল
তোমার কি হয়েছে? মন খারাপ?
আমি ঠিক করেছিলাম ওর সঙ্গে আর অভিনয় করব না কিন্তু কিছু করার নেই। আমি আবার আমার আগের রূপে ফিরে গেলাম স্মিত হেসে বললাম
কিছু হয়নি এমনি ঘুম থেকে উঠলাম তো। আপনার কি খবর?
তোমাকে খুব মিস করছি
হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে কেমন একটা ধাক্কা লাগলো। আমি জানি কথাটা সম্পূর্ণ বানানো। আমাকে ম্যানেজ করার জন্য নিশ্চয়ই বলছে হয়তো শাওন সামনে দাঁড়িয়ে আছে; এতক্ষণ দুজন জলকেলি করছিল। ভাবতেই মাথার মধ্যে চিনচিনে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করলাম তবু নিজেকে শান্ত করে বললাম
কেন?
এখানে একটা পুল আছে ছাদের উপর; খুব সুন্দর। এরা সবাই মিলে জোর করে আমাকে ওটাতে নামালো। এখন আমার ভয় করছে। তোমার কথা মনে পড়ছে। তুমি সেদিনের মত আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে আর ভয় করত না।

আমার হঠাৎ করেই কেমন যেন কান্না পেল। আমি ফোনটা কেটে দিয়ে মেসেজ পাঠালাম নেটওয়ার্কে সমস্যা পরে কথা বলব, তারপর ফোনটা সুইচ অফ করে দিলাম।
মাথার ভিতর প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমার মাইগ্রেনের সমস্যা কান্নাকাটি করলে মাথা ব্যাথার তীব্রতা ভয়ংকর রকমের বেড়ে যায়। গত কদিনে যত কাঁদলাম মনে হয় গত ১০ বছরেও এত কাদিনি।আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম। মুকুলের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা জন্মানোর কথা কিন্তু কেন যেন সেটা হচ্ছে না ও আমার সঙ্গে যেটা করেছে তাতে আমার ওর প্রতি খুব প্রতিশোধপরায়ন হওয়া উচিত ছিল কিন্তু কেন যেন পারছি না। এই একই জিনিস আমার সঙ্গে আগেও হয়েছে। খুব সম্ভবত আমার মধ্যে প্রতিশোধ পরায়ণতা নেই; যদি থাকত তাহলে আমার বাবা এতদিনে বেঁচে থাকতেন না।

ছোটবেলা থেকেই আমি বাবার ভীষণ ন্যাওটা ছিলাম।বাবার ব্যবহারে প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলাম আশরাফ চাচার ঘটনাটাতে। এরপর থেকে বাবার প্রতি আমার কেন যেন ধারণাটাই বদলে গেল। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম ওই ঘটনার পর বাবা সব সময় আমাদেরকে চোখে চোখে রাখতেন। কখনোই আমাকে একা ফেলে বাইরে চলে যেতেন না; এমনকি এক ঘরে থাকলেও পাশে বসে থাকতেন। ব্যাপারটা আমি বুঝলাম, চাচা ও যে বুঝতেন না তা নয়। ধীরে ধীরে বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হলেও কোথায় যেন একটা সুর কেটে গিয়েছিল। তবে এই সুর কেটে যাওয়া যে একসময় সুর ছিন্ন হয়ে যাওয়া হবে সেটা সে সময় ভাবিনি।

ছোটবেলায় বাবার প্রতিটা কথাই আমার কাছে ঠিক মনে হতো। বাবা যখন মাকে বকতেন, মায়ের প্রতিটা কাজে ভুল ধরতেন তখন মনে হতো, সত্যিই তো কাজগুলো তো ওভাবেই হওয়া উচিত ছিল। মাটাই কিছু করতে পারেনা। মা কিছু বলত না, মুখ বুজে সব মেনে নিত। আমি যত বড় হতে লাগলাম ধীরে ধীরে মনে হতে লাগলো আমার মা একটা বোকা, কিচ্ছু পারে না। তবু মায়ের মনটা এত ভালো এত নরম যে মাকে ভালো না বেসে পারতাম না। তবে একটা সময় বুঝেছিলাম মা আসলে বোকা নয়, ভীতু, ভীষণ রকম ভীতু। আমার মা সারাক্ষণ ভয়ে থাকত। সমাজের ভয় সন্তান হারাবার ভয় মাকে এমন কাবু করে রেখেছিল যে মার জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হত।

বাবার সত্যটা জানতে পেরেছিলাম অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে। বলতে দ্বিধা নেই কলেজ পাশ করার পর যখন অনার্সে ঢুকলাম হঠাৎ করেই আশেপাশের সবার দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারতাম যে আমাকে অসাম্ভব রকমের সুন্দর দেখায়। সেই সময় আবার খেয়াল করলাম আশরাফ চাচার আমাদের বাড়িতে আনাগোনা বেড়ে গেছে। ততদিনই আমার বুদ্ধি বেড়েছে সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতাও। আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি আমি খুব ভালোই বুঝতাম তাই কলেজ শেষ করার পর আর বাড়ি না ফিরে তিথিদের বাসায় চলে যেতাম।

সেদিন তিথিদের বাসায় একটা অনুষ্ঠান ছিল। অনেক লোকজন দাওয়াতে এসেছিল, তিথি কলেজে আসেনি। আমারও আর ওদের বাসায় যেতে ইচ্ছা করলো না। তিনটা নাগাদ কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি ঢাকা মেডিকেলে চলে গেলাম। বাবার চেম্বারের বাইরে কালাম ভাই বসে থাকে একটা টুলের উপরে। আমাকে দেখে সেদিন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। আমি কাধ থেকে ব্যাগ নামাতে নামাতে বললাম
কালাম ভাই, খাবার কিছু নিয়ে আসেন তো, ভীষণ খিদে পেয়েছে
কালাম ভাই কেমন কাচুমাচু হয়ে বলল
আপনি আজকে এত তাড়াতাড়ি চইলা আইলেন যে
আমার ক্লাস শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি যান না , খিদা পেয়েছে তো। বাবা কি সার্জারিতে?
স্যার রুমেই আছে আপনি বরং ক্যান্টিন থেকা কিছু খায়া আসেন
আমি একটু অবাক হলাম। বাবা সাধারণত আমাকে হাসপাতালের ক্যান্টিনের
খাবার খেতে দেয় না। কালাম ভাইকে পাঠিয়ে চানখার পুল থেকে কিংবা নিরব হোটেল থেকে খাবার আনায়, মাঝে মাঝে নাজিমুদ্দিন রোড থেকে বিরিয়ানিও নিয়ে আসে। আজ হঠাৎ কি হল? আমার কেমন যেন একটু সন্দেহ হলো। আমি বললাম
আমি ক্যান্টিনের খাবার খাব না
বাবার চেম্বারের দিকে এগিয়ে যেতে নিলে কালাম ভাই আমাকে আটকাল। বলল
তুলি আম্মা এখন যাইয়েন না
আমি কথা শুনলাম না দরজার সামনে দিয়ে দাঁড়ালাম।। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কিন্তু বাইরে থেকেও কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আমার সারা শরীর জমে পাথর হয়ে গেল। যে কণ্ঠস্বরটা ভেতরে কথা বলে যাচ্ছে সে লোকটা কি সত্যিই আমার বাবা? আমারই বাবা?

চলবে,….

ভুল সত্য পর্ব-১৫

0

ভুল সত্য

১৫

আমি সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। মুকুল বোধ হয় ক্লান্ত ছিল, বিছানায় পড়তেই ঘুমিয়ে গেল। ফোনটা বালিশের পাশেই রাখা। আমি চাইলেই নিয়ে দেখতে পারি। সিকোয়েন্স এমন কিছু কঠিন হবার কথা নয়। ও তো এমন কোন জটিল মানুষ নয়। অবশ্য বলা যায় না; আর যেটা ঘটছে মনে হচ্ছে মুকুল অসম্ভব ভালো অভিনেতা; হয়তো আসলে ওর ভেতরটা অনেক জটিল। কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। আমি আনমনে একবার ওর কপালটা ছুঁয়ে দিলাম। কি গভীর ঘুমিয়ে আচ্ছন্ন। কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে ওকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

ব্যাপারটা অন্যায় জেনেও আমি ওর ফোনটা তুলে নিলাম। এক দুইবার চেষ্টা করতেই ফোনটা আনলক হয়ে গেল। এবং তার পরপরই আমি বুঝলাম যে ওকে বুঝতে আমি কতটা ভুল করেছি। ফোনের সিকোয়েন্স ‘এস’। এস দিয়ে তো শাওন হয়। এই অবস্থা! আর আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। চকিতে আমি একবার ওর দিকে তাকালাম। নাহ! গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি চ্যাট লিস্টে মনোযোগ দিলাম। বেশ বড় চ্যাট লিস্ট। বোঝা যায় দীর্ঘ দিনের আলাপ। কথাবার্তার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর কলিগ। কি আশ্চর্য! কলিগের সাথে এত সম্পর্ক তাহলে আমাকে বিয়ে করার কি দরকার ছিল। কিছুদূর পড়েই অবশ্য বুঝতে পারলাম বিষয়টা কি। কথাবার্তার ধরন মোটামুটি এইরকম

প্যকিং করেছ? সুইমিং কস্টিউম নিও কিন্তু।। ওখানে একটা ইনফিনিটি পুল আছে। উই উইল হ্যভ লট অফ ফান টুগেদার
এইটুকু আমি কাল রাতেই দেখেছি , যখন মুকুল ওয়াশ রুমে ছিল। পরেরটুকু দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। আমি স্ক্রল করে দেখতে লাগলাম মুকুল লিখেছে
আরে কিসের প্যাকিং। যাইতে ইচ্ছা করছে না
কেন? বউকে মিস করবা নাকি?
সে আর বলতে
সমস্যা নাই। পুষিয়ে দেব।
ও মনে হয় মন খারাপ করবে
আরে ধুর! ৩ দিনের তো ব্যাপার
হ্যাঁ সেটা ঠিক। আমি অবশ্য ম্যানেজ করে নিয়েছি ওকে।
কি? মালয়েশিয়া ট্রিপ দিয়ে? তবু ভালো তোমার জন ম্যনেজ হয়।
এত সোজা? মেলা সময় লাগসে। তবে ম্যনেজ হইসে
তাহলে আর সমস্যা কি? লেটস এনজয়।

এইটুকু পড়ে আমি ফোন বন্ধ করে দিলাম। আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমার ধারণা ছিল আমি খুব শক্ত ধরনের মেয়ে। আজ বুঝলাম ধারণাটা কতটা ভুল। গালে কি যেন সুরসুরি দিচ্ছে। হাত দিয়ে বুঝলাম আমার গাল ভেজা। কাঁদছি নাকি আমি? কি অদ্ভুত! আমি কাঁদতেও জানি?

নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। এমনটাই তো হবার কথা ছিল, তাহলে এমন লাগছে কেন এখন? দুই হাতে মাথা চেপে ধরে অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে রইলাম। ঘুমাতে গেলাম শেষ রাতের দিকে। যথারীতি সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। ঘুম ভেঙ্গে দেখি মুকুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছে। আমাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলল
গুড মর্নিং
এত দেরি হয়ে গেছে আমাকে ডাকেন নি কেন
তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই আর ডাকিনি

আমি বেশি কথা বাড়ালাম না শুধু ও যাওয়ার আগে বললাম যে আমি আজই মার ওখানে চলে যাব। ও একটু অবাক হলো তবে মানা করল না। বলল গাড়ি নিয়ে যেতে। এমনিতেও কনফারেন্স এর আগে খুব ব্যস্ত থাকবে আমি শুধু শুধু বোর হব ওখানে থাকাটাই ভালো। নানান যুক্তি দিল আমার যাওয়ার ব্যাপারে। আমি সবই বুঝলাম, কেন আমাকে বিদায় করতে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, ও ওর মত ইনজয় করুক।

মুকুল যাবার পর আমি ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। ওর দেয়া কোন জিনিসই আমি নিলাম না শুধু টু্কটুকিকে সঙ্গে নিলাম। ইচ্ছে করেই বেশি জিনিসপত্র নিলাম না। বড় ব্যাগ দেখে বাবা-মা আবার নানান প্রশ্ন শুরু করে দেবে। কোন কিছু ছেড়ে যাওয়ার সময় শুধু শুধুই মানুষ জিনিসপত্র নিয়ে মাতামাতি করে। জিনিসপত্র দিয়ে কি হবে? এসব তো চাইলে আবারো কেনা যাবে। মানুষই যেখানে নিজের থাকলো না।

আমি ব্যাগ হাতে আমার ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে একবার দাঁড়ালাম। শেষবারের মতন। এই আয়নাটার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রতিদিন কাজে যাবার আগে মুকুল অনেক সময় নিয়ে তৈরি হয়।। যত্ন করে চুল ঠিক করে, পারফিউম মাখে, একটার পর একটা টাই পাল্টায়; শেষমেষ আমাকে বলে
দেখতো কোনটা পরব।
আমি ওর কান্ড দেখে হাসি। সব টালবাহানা। আমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকি তাই কাছে টানার ফন্দি। আমি টাই নিয়ে কাছে এলে বলে

বউ, আজকে একটা জিনিস খেতে খুব ইচ্ছা করছে
আপনি আমাকে এমন গ্রামের লোকের মতন বউ বলছেন কেন?
বউকে বউ বলবো না? তাছাড়া তুমিও তো গ্রামের বউদের মতন আমাকে আপনি বল
আমি কিছু বলি না। হাসতে হাসতে জানতে চাই কি খেতে ইচ্ছা করছে
চিতই পিঠা
চিতই পিঠার সঙ্গে কি?
তুমি যা দেবে তাই খেতে ভালো লাগবে
ও আচ্ছা, তাই? তাহলে করলার চাটনি করব
মুকুল আঁতকে উঠে বলে
সেটা কি জিনিস?
করলা আর চিরতা একসঙ্গে বেটে বানাতে হয়। দারুন খেতে
তুমি বিষ দিলে তাও খাব বউ

আমি হাসতে হাসতে ওর উপর ঢলে পড়ি।
সেই সময় বুঝতে পারিনি এইসব কথা ছিল আসলে আমাকে ম্যানেজ করার জন্য। শেষ অবধি ওর মুখোশটাও খুলল। এটাতো হবারই ছিল তবু কেন যে এত কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি না। সেই প্রথম দিন থেকেই তো আমি এটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম।

দুপুরের আগেই আমি আমার শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা দিলাম। উনার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝলাম না রাগ হয়েছে না খুশি হয়েছে।
শাশুড়ির ঘর থেকে বেরোতেই দেখলাম নাজু আপা তার বিশাল শরীর নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমাকে দেখে বলল
ভাবি আপনি বলে বাড়িত যাইতাছেন?
হু
আয়হায়! তাইলে আমার কি হইব?
কেন?
ভাবসিলাম আপ্নের কাছে ইংরেজি শিখুম
কি শিখবেন?
ইংরেজি। খালাম্মার লগে নেটফিলিক্স এ মুবি দেহি। কিছুই বুজি না
এই ফ্যমিলির সবাই এক একটা পিস। কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
আমার কাছে শেখার কি আছে? কত অনলাইন কোর্স আছে। একটাতে ভর্তি হয়ে যান
হইসি তো
তাহলে তো হলই। শিখতে থাকেন
কেমনে শিখমু ওই বেটার কথা তো কিছুই বুঝিনা
কোন ব্যাটা?
অনলাইন ইংরেজি কেলাসে ভর্তি হইসি। ৩০০ ট্যকা দিয়া। ব্যটার কথা কিছুই বুজি না।
আমি একটু কৌতুহলি হয়ে বললাম
কেন কি বলে সে?
প্রথম দিন কইলো মাতৃভাষা হইলো মায়ের মতন পাঁচ বছর এর দরকার লাগে আর ইংরেজি হইল বউ এর মতন মরন পর্যন্ত কামে লাগে। এমুন কি মরনের সময় ও লাগে।
মরনের সময় ইংরেজি দিয়ে কি হবে? আজরাইল কি এসে জিজ্ঞেস করবে

এক্সকিউজ মি, উড ইউ মাইন্ড ইফ আই কিল ইউ নাও ওর ইউ নিড ফিউ মোর মিনিটস

নাজু আপা তার জলহস্তীর মত শরীর দাপিয়ে বলল
হায় আল্লাহ! ভাবী আপনে এত সুন্দর ইংরেজি কন। আগে জানলে তো আপনের থেকাই শিখতাম। হুদাই ৩০০ টাকা লস দিলাম।

রাগে আমার ইচ্ছা হল এই মহিলাকে ধাক্কা মেরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দেই। বহু কষ্টে এই অতিকায় হস্তিনীকে পাশ কাটিয়ে বাড়ীর পথ ধরলাম।

মা আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হল। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে নানান পদের রান্না শুরু করে দিল। আমি একটু একা থাকতে চেয়েছিলাম সেটা আর হল না।

পরদিন জোর করেই মা কে স্কুলে পাঠালাম। দুদিন মোটামটি ঘর বন্ধ করে পড়ে রইলাম। মুকুল দিনে ফোন দিলে ধরিনি। রাতে ফোন দিয়ে দুটো কথা বলেই ও ঘুমিয়ে পড়েছে। এত ঘুমকাতুরে ছেলেটা। বলে কিনা সব কথা নাকি মালয়েশিয়া গিয়ে বলবে। অনেক নাকি সারপ্রাইজ আছে। বেকুব একটা। আমি ওর সঙ্গে মালয়েশিয়া গেলে তো। কোথাও যাবো না। সব ঠিক করে ফেলেছি কি করব।

আমাকে ঠকানোর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। কঠিন শাস্তি।

চলবে………

ভুল সত্য পর্ব-১৪

0

ভুল সত্য
১৪

দরজা খুলে আমি যতটা না অবাক হলাম খুশি হলাম তার চাইতে অনেক বেশি। রেহানা আন্টি কতদিন পর বাসায় এসেছে। আমি উকি দিয়ে তিথিকে খুঁজতে লাগলাম। আন্টি হাসতে হাসতে বললেন

ও আসছে একটু পরেই
আমি হরবর করে অনেক কথা বলতে লাগলাম। তারপর আন্টিকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলাম। উনি আশেপাশে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন

তোর শাশুড়ি কোথায়?
ঘরে। একেবারে নামাজ গোসল শেষ করে খেতে আসবেন। তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে তো?
খাব। তিথি আসুক তারপর একসঙ্গে খাবো। রান্না কি তুই করলি নাকি?
হ্যাঁ আজকে আমার ক্লাস ছিল না। আমি রান্না করেছি
রেহানা আন্টি ভুরু কুচকে বললেন
প্রতিদিন তোকে রান্না করতে হয় নাকি?
কাজের একটা মহিলা আসে। আমার ক্লাস থাকলে ওই করে।
কে? নাজু?
হ্যাঁ তুমি দেখি সবকিছুই জানো
আরে, নাজুকে তো আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তবে যে তাদের দুজনের মধ্যে খুব আঁতাত চলছে এখন। তার কি?
উনি মনে হয় আমার মন পড়ে ফেললেন। বললেন
আমি বলেছি বেশি ঝগড়া ঝামেলা না করে একটু বন্ধুত্ব করে নিতে।
বন্ধুত্ব? মানে এখন ওদের দুজনের মধ্যে যেটা চলছে তুমি সেটাও জানো?
জানব না কেন? ওই যে তোর শাশুড়ির বস্তা ভরে ওকে খাবার দিয়ে দিচ্ছে ওইটা তো?
আমি আবারো অবাক।
তোর শাশুড়ি নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী মনে করে। সে বুদ্ধিমতী এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে বাকিদের বোকা ভাবে এটা ঠিক না
একটা ব্যাপার অবশ্য আমিও লক্ষ্য করেছি; আমার শাশুড়ি অন্যদের সঙ্গে যতই ঝামেলা করুক না কেন রেহানা আন্টিকে কেমন একটু সমীহ করে। আন্টির ব্যাপারটাও অদ্ভুত ওনাকে ভাবি না ডেকে কেমন কোন সম্বোধন এড়িয়ে যায়। এমনকি আপনি তুমিও বলে না। কথাবার্তা হয় ভাববাচ্যে। ওনার আচরণটা আবার সম্পূর্ণই বিপরীত। উনি রেহানা আপা আর আপনি আপনি বলে নিজেকে ছোট প্রমাণ করার একটা চেষ্টা সবসময় চালিয়ে যান। আন্টি অবশ্য এতে বিরক্ত না হয়ে বরং খুশি হন।
তুই গোসল করেছিস?
করেছি সকালে একবার এখন আবার করব। কথাটা বলেই মনে মনে জিভ কাটলাম। এত ডিটেলে না বললেও চলবে।
চল তো, তোর ঘরে গিয়ে দেখি ঘর কেমন সাজিয়েছিস।
আমি আন্টিকে নিয়ে উপরে যাওয়ার সময় দেখলাম আমার শাশুড়ির ঘরের দরজা বন্ধ। আন্টির কাছ থেকেই জানতে পারলাম তিথি একজনের সঙ্গে দেখা করতে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে গেছে। আমাদের বাড়ির কাছেই ধানমন্ডি সাতাইশে। ছেলেপক্ষ ওদের বাড়িতে এসে আনুষ্ঠানিক দেখাদেখি করে গেছে।। আজ ছেলের সঙ্গে আলাদা কথা বলবে তাই একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে। আমাকে বলেছিল আগে। ইস! একদম ভুলে গেছি। কি যে হয়েছে আমার, নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে আছি। তাকিয়ে দেখলাম আন্টি কেমন জহুরীর মত চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর বলল
মুকুলের সঙ্গে তোর সব ঠিকঠাক চলছে?
আমি একটু লজ্জা পেয়ে বললাম, হু
উনি আর কথা বাড়ালেন না। বললেন
যা তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়। তিথি চলে আসবে, টেক্সট করেছে।
আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। অন্তত মায়ের মতন করেনি। গত মাসে মায়ের ওখানে গিয়েছিলাম এক শুক্রবারে। সেদিন মুকুল আমাকে নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়েছিল। আমরা বাইরে সকালের নাস্তা করে একটু রিক্সা করে ঘুরলাম। ফুলার রোড শহীদ মিনার ওই দিকটাতে। তারপর মুকুল বলল
তুলি তোমাকে একটু তোমাদের বাসায় নামিয়ে দেই? অনেক দিন তো যাও না
আমি বুঝলাম নিশ্চয়ই তার অন্য কোথাও যাবার আছে। তার তো আবার বন্ধুর অভাব নেই। আমি বললাম
আজ কোন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন? নার্সারিতে যাদের সঙ্গে পড়েছেন?
ও একটু লজ্জা পেয়ে বলল
না মানে অনেকদিন ধরে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না তো; তাই ওরা খুব করে ধরেছে। বেশি সময় লাগবে না আমি লাঞ্চের পর তোমাকে ওখান থেকে পিক করে নেব, তারপর সারা বিকেল ঘুরবো। কেমন?
ওর কৈফিয়ৎ দেয়া দেখে আমি হেসে ফেললাম। বেচারার জন্য একটু খারাপই লাগলো। আমার জন্য ওর স্বাধীন জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল অথচ আমার সঙ্গেও সুবিধা করতে পারছে না।

অসময়ে আমাকে দেখে মা ভীষণ খুশি হয়ে গিয়েছিল। কি খেতে দেবে, কি রান্না করবে এই নিয়ে কতক্ষণ ছুটাছুটি করলে। আমি বিরক্ত হয়ে একসময় বললাম
কি শুরু করলে
ঠিক আছে চুপচাপ বসতো একটু কথা বলি
কি কথা?
দেখি এদিকে তাকা।, তুই কি মোটা হয়েছিস? চোখের নিচে কালি পড়েছে
কি সব অদ্ভুত কথা বলছো।
মুকুল কি তোকে খুব বিরক্ত করে?
না তো। বিরক্ত করবে কেন?
এরপর আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল
খবরদার পিল খাবি না।
আমি এতক্ষণে মায়ের কথা সারমর্ম বুঝতে পারলাম। লজ্জায় আমার সারা শরীর লাল হয়ে গেল। কোনমতে বললাম
এসব কি বলছো মা?
কি আবার বলছি? বিয়ের পর এত লজ্জা পেতে হয় না। বিয়ে হয়ে গেলে মায়েরা বন্ধুর মতন হয়ে যায়, তাদের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করা যায়। তুই আমাকে সব বল।
আরে আজীব তো। কি বলবো?
সব খুলে বল। দেখ পুরুষ মানুষ ঘরেরটা না পেলে কিন্তু তখন বাইরেরটা খুঁজবে। মা হঠাৎ করেই পুন পুন করে কান্না শুরু করল, তারপর বলল
আমি চাই না তোর জীবনটা আমার মতন হোক।

মায়ের উপর রাগ হলেও সেদিন আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। কতবার যে মাকে বলেছি এসব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যেতে। কিন্তু ওই। লোকে কি বলবে, তার কলিগদের কাছে কি করে মুখ দেখাবে। এসব বলেই আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
বিয়ের আগেও আমি মাকে এই কথাটা বলেছিলাম যে আমার জীবনটাও তো তার মতোই হতে পারে। কিন্তু মা মানেনি। রেহানা আন্টির উপর তার অগাধ বিশ্বাস। উনি যখন বলেছেন ছেলে ভালো তার মানে অবশ্যই ভালো। রেহানা আন্টিকে অবশ্য আমিও ভীষণ বিশ্বাস করি। আমার ভীষণ কঠিন একটা সময় উনি আমার পাশে ছিলেন।

এখনো মনে আছে আশরাফ চাচার ঘটনাটার পর আমি ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারছিলাম না। শুধু তিথিকে বলেছিলাম।প্রমিস করিয়েছিলাম যেন কাউকে না বলে। তিথি অবশ্য সে প্রমিস রাখেনি। ওর সাথে এজন্য আমার ঝগড়া ও হয়েছিল অনেক। তবে এখন বুঝতে পারি ভাগ্যিস ও প্রমিসটা রাখেনি। । ও যেদিন আমাকে বলেছিল ও মাকে সব বলে দিয়েছে আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম কোনদিন আর ওর সঙ্গে কথা বলবো না। সবাই আমার বিশ্বাস ভেঙেছে । এই পৃথিবীতে সবাই।

এর কদিন পর এক দুপুর বেলা রেহানা আন্টি বাড়িতে এসেছিলেন। সে সময় একা বাসায় থাকতে আমার ভীষণ ভয় করত কিন্তু উপায় ছিল না। মার ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার স্কুলেও যেতে ইচ্ছা করত না। আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। কেউ এলে দরজা খুলতাম না। আন্টিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম খুব। কথা বলতে না চাইলেও উনি কি করে যেন আমার ভেতর থেকে কথাগুলো টেনে বের করে নিয়ে আসলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো ওনার সঙ্গে কথা বলে খুব হালকা মনে হয়েছিল নিজেকে। একমাত্র উনিই মনে হয় আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলেন আমাকে বলেছিলেন
তুই যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস। মেয়েদের নিজের সেফটি নিজেকেই দেখতে হয়। কোন রাজপুত্র এসে উদ্ধার করবে কিংবা তোর হয়ে অন্য কেউ কিছু করবে এই আশায় থাকবি না। সবসময় চোখ কান খোলা রাখবি। বুঝেছিস? আর এখন থেকে স্কুলের পর আর বাড়িতে একা থাকার দরকার নেই। তিথির সঙ্গে আমাদের ওখানে চলে আসিস। ঢাকা মেডিকেল তো আমাদের বাসার কাছেই ফেরার সময় তোর বাবা তোকে নিয়ে যাবে।

সেই রেহানা আন্টি আমার ব্যাপারে সবকিছু জানা সত্ত্বেও যখন আমার বিয়ের কথা তুললেন আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। রাগ হয়েছিল খুব তার উপর। কিন্তু উনি অনেক বুঝিয়েছিলেন। আমাকে ডেকে নিয়ে আলাদাভাবে অনেক কথা বলেছিলেন
বিয়ে তো একদিন তোকে করতেই হবে, আজেবাজে কোন ছেলের হাতে পড়ার থেকে মুকুলকে বিয়ে কর। ও খুব ভালো ছেলে। আমি ওকে ভালো করে চিনি।
আমার বিশ্বাস হয়নি। আমি বলেছিলাম
সবাই এমন বাইরে থেকে ভালোই হয়। তুমি কি আর তার ভেতরের রূপটা জানো? ও তোমার ভাইয়ের ছেলে তাই হয়তো তোমার তাকে ভালো মনে হচ্ছে। পৃথিবীর সব ছেলেরাই এমন। সবাই তো কারো না কারো ভাই, বাবা, বোনের ছেলে।
আন্টি হেসে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, একদিন বুঝবি।

মুকুল ফিরল অনেক রাতে। আজকাল প্রায়ই রাত করে ফেরে। অফিসে নাকি কাজের অনেক চাপ। সামনের সপ্তাহে ওর কনফারেন্স। কনফারেন্সের জন্য চিটাগাং যাচ্ছে তিনদিনের জন্য। আমাকে বলেছিল মায়ের ওখানে গিয়ে থাকতে আমার ইচ্ছা করেনি। আমি বলেছি এখানেই থাকবো। তাছাড়া কনফারেন্সের পর ও দশ দিনের ছুটি নিয়েছে। আমরা মালয়েশিয়া যাচ্ছি। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি তাই একবারে ছুটি জমিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি আগে কখনো মালয়েশিয়া যাইনি।

দুপুরে তিথিদের সঙ্গে অনেক খাওয়া-দাওয়া করেছি বলে আমি আর রাতে কিছু খাইনি।। মুকুল ও বলল দেরি হয়েছে বলে অফিস থেকে খাবার দিয়েছে। ওর খিদে নেই। ঘরে ঢুকে একবারে গোসল করতে চলে গেল। । আমি সব গুছিয়ে ঘরে এসে দেখলাম ওর ফোন বাজছে। দেখার আগেই বন্ধ হয়ে গেল। মুকুল নতুন ফোন কিনেছে। একদিন আমি দেখছিলাম তখন লক্ষ্য করলাম ফোন লক করা। আমার একটু রাগ হয়েছিল। ফোন লক করে রাখার কি মানে? আমি কি ওর ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করব। আমি এই কথা ওকে বলেছিলাম ও। তখন বলেছিল
তোমার জন্য করিনি। তুমি চাইলে তোমাকে কম্বিনেশন বলে দেব। আমার কলিগরা গ্যালারি থেকে ছবি দেখে। আমার ভালো লাগে না সেটা।
এটা অবশ্য ঠিকই বলেছে। মুকুল আমার অনেক ছবি তুলে দেয়। সেসব ছবি অন্য কেউ দেখছে ভাবতে আমার ও ভালো লাগে না।
ফোনটা আবারো বাজছে। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম শাওন নাম উঠে আছে। এই শাওন টা আবার কে? ভাবতে ভাবতেই ফোনের স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে উঠলো। মেসেজটার দিকে তাকিয়ে আমার সারা শরীর জমে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এমনটাই যদি হবে তাহলে কেন আরো আগে হলো না। এভাবে আমার বিশ্বাস ভাঙার কি অর্থ ?

চলবে………

ভুল সত্য পর্ব-১৩

0

ভুল সত্য
১৩

মুকুল আজকাল কেমন সিনেমার নায়কদের মতন আচরণ করছে। হুটহাট জড়িয়ে ধরছে। আলটপকা চুমু খাচ্ছে। কাজে বেরুনোর আগে তো যা করছে সেটা বলার মতো না। ওর এইসব আচরনে আমার বিরক্ত হওয়া উচিত, রাগ হবার কথা কিন্তু অদ্ভুত ব্যপার হল আমার রাগ হচ্ছে না বরং ভালো লাগছে। আশ্চর্যের কথা হল ও এমন না করলেই অস্বাভাবিক লাগছে। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। এতে একধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়, যেটা পূরণ না হলে হতাশা জন্মায়।

আমি এসব থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে চাই। নিজেকে প্রতিদিন বোঝাচ্ছি এসব আর কিছু নয়, অভ্যাস মাত্র; কিংবা বলা যায় এক ধরনের চাহিদা। মুকুল যখন আমাকে বাইরে খেতে নিয়ে যায়, আমি কি খাচ্ছি না? খাবারটা যেমন একটা চাহিদা সেই রকম শরীরেরও নিজস্ব কিছু চাহিদা আছে। এর বেশি তো কিছু নয়। এর বেশি কিছু হলেও আমি সেটা ভাবতে চাই না। চাইনা মনের মধ্যে কোন দুর্বলতাকে স্থান দিতে। চাইনা আবার নতুন করে কারো প্রতি বিশ্বাস তৈরি করতে। সত্যি কথা বলতে আরেকবার ঠকতে চাই না।

অনেক রাত হয়েছে। আজ খুব শখ করে পুরনো কতগুলো সুতি শাড়ি হাতে ধুয়ে দিয়েছিলাম। আমি আর তিথি এই শাড়িগুলো বঙ্গবাজার থেকে কিনেছিলাম। বঙ্গবাজার মার্কেটটা তিথিদের বাড়ির একেবারেই কাছে।। ক্লাসের শেষে আমরা দুজন প্রায়ই ওদের বাসায় চলে যেতাম। পথেই মার্কেটে ঢু মারতাম। এত কম দামে এত সুন্দর সুন্দর শাড়ি; মোটামুটি আমাদের পকেটে মানির টাকা দিয়েই হয়ে যেত। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে পহেলা ফাল্গু্‌ন একুশে ফেব্রুয়ারি সব উপলক্ষেই শাড়ি কিনতাম। বিয়ের পর এখানে আসার সময় এগুলো নিয়ে আসতে পারিনি। মা কাল বস্তা ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার একটু সুচিবাই এর মত আছে। সব শাড়ি গুলো আজ ধুয়ে দিয়েছি। ছাদে মেলতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম ওদের ছাদটা বেশ সুন্দর। আমি বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য যাই। শাড়ি গুলো বিকেলে ছাদ থেকে নিয়ে এসেছি। গুছিয়ে রাখা হয়নি। আলমারিতে
শাড়ি গুলো রাখতে গিয়ে মনে পড়ল বিয়ের পর মুকুল আমাকে কয়েকটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল। সে সময় খুলে ও দেখিনি। আজ বের করে নিয়ে বসলাম। দুটো গোলাপি আর একটা সবুজ রঙের। গোলাপি রং আমার দু চক্ষের বিষ। ছোট বেলায় মা আমকে সারাক্ষণ গোলাপি জামা পরিয়ে রাখত।

আমি সবুজ শাড়িটা খুলে দেখলাম। ঘন সবুজ রঙ্গে কালো পাড়। নরম বাটিকের সুতি শাড়ি। আমি খুব যত্ন করে পরলাম। ঘন করে কাজল দিলাম চোখে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে কয়েকবার নিজেকে বললাম
ওকে খুশি করার জন্য পরিনি। পড়তে ইচ্ছা হয়েছে তাই পরেছি।
মনে হচ্ছে কিছু একটার অভাব। ছোট করে একটা কালো টিপ দিলাম। হ্য, এবার ঠিক আছে। সব শেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। সাড়ে নয়টা বাজে। ও তো সাতটার মধ্যেই চলে আসে। দেরী হলে ফোন করে। আজ কি হল?

আমি নিচে নেমে গেলাম। পুরো বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। আমার শাশুড়ি নতুন ডায়েট শুরু করেছে। আটটার সময় গ্রিন জুস আর ডিম খায়। রাতে খাবারের সময় আমাদের সঙ্গে দুধ আর ওটস নিয়ে বসে। আজ আটটার সময়ই খেয়ে শুতে চলে গেল আমাকে বলে। আমি কয়েকবার ফোন দিলাম, মুকুল ফোন ধরল না। আমার কেমন কান্না পাচ্ছে। বাইরে শো শো শব্দে ঝোড়ো বাতাস দিচ্ছে। এত দেরী হচ্ছে কেন? কোন বিপদ হয়নি তো?

মুকুল ফিরল সাড়ে দশটার দিকে। আমাকে দেখে ভুরু নাচিয়ে বলল
কি? রাত বিরাতে এত সাজগোজ করেছ কি আমার জন্য?
রাগে আমর ইচ্ছা করছিল ওর উপর ঝাপিয়ে পড়তে। আমি ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম
ফোন ধরছিলেন না কেন?
ফোন ভেঙে গেছে
আমি ভুরু কুচকে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকালাম
সত্যি। এই দেখো
তাকিয়ে দেখলাম ফোন আসলেই ভাঙ্গা
ভাঙল কেমন করে?
মুকুল টাই খুলতে খুলতে চেয়ারে বসে বলল
সে অনেক কথা। পরে বলব। আগে এদিকে এস তো। তোমাকে একটু দেখি
আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। একে তো দেরী করে এসেছে আবার বলছে ও না কিছু ঠিকমত উল্টো ঢং দেখাচ্ছে।
আমাকে দেখার কি আছে?
বাহ! নিজের বউকে দেখব নাতো কি পাশের বাসার মেয়েকে দেখব
আমার ভেতরটা হঠাত জ্বলে উঠল। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম
অন্য কোন মেয়ের দিকে যদি তাকান তাহলে কাটা চামচ দিয়ে চোখ তুলে নেব।
মুকুল কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হো হো করে হাসতে শুরু করল। আমার হঠাতই কেমন লজ্জা করতে লাগল। আচ্ছা ও কি ভাবল। অন্য মেয়ের কথা শুনে আমি জেলাস। ব্যপারটা তো তা নয়। একজন বিবাহিত পুরুষ অন্য মেয়ের দিকে চোখ দিচ্ছে বিষয়টাই তো অশ্লীল। কিন্তু এখন ওকে এটা কে বোঝাবে। ধুর! কি বলতে যে কি বলে ফেলি।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম
খাবার গরম করছি
ও আমার একটা হাত ধরে বলল
আচ্ছা শোনো। একটু পরে খাই। চল ছাদে যাই
আমি অবাক হয়ে বললাম
কেন? এখন তো বৃষ্টি পরছে।
এজন্যই তো
চল বৃষ্টিতে ভিজি
বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।
একদিন ভিজলে কিছু হবে না
না।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি রেইন কোট পরে নিচ্ছি
সেটা খুবই হাস্যকর হবে
কিচ্ছু হবে না। চলো তো
না এখন না
মুকুল আমার কথা শুনল না। জোর করে ছাদে নিয়ে গেল।আজকের বৃষ্টিটা একেবারেই অন্যরকম। কতদিন পর বৃষ্টিতে ভিজলাম। আমি ইচ্ছা করেই ওকে আমার সঙ্গে ভিজতে দিলাম না। চিলেকোঠার ঘরের সামনের সেডটার নিচে দাড়িয়ে থাকতে বললাম। অনেক অনেকদিন পর এমন নিশ্চিন্তে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজলাম। চোখ বুজে আকাশের দিকে মুখ করে অনেকক্ষণ ভিজলাম। হঠাৎই গালে কারো হাতের স্পর্শ টের পেলাম। আমার ভয় করলো না। যেন এ স্পর্শ আমার অনেক দিনের চেনা। চোখ মেলে দেখলাম ও কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

উত্তপ্ত দীর্ঘ চুমু। অনেকটা সময় পর মুকুল খুব আস্তে আস্তে বলল, চলো ভেতরে যাই, আর ভিজতে হবে না। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো আমাকে নিচে নিয়ে যাবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আমাকে চিলেকোঠার ঘরটাতে নিয়ে গেল। পুরনো দিনের রঙ চটা একটা বেতের সোফা রাখা ওখানে। আমি ওটাতেই বসলাম। ও আমার হাতে চায়ের মগ দিয়ে পাশে বসতে বসতে বলল
তোমাকে এরকমই বৃষ্টির দিনে প্রথম দেখেছিলাম
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম
হ্য, মনে আছে
ও খুব অবাক হয়ে বলল
তোমার সত্যিই মনে আছে?
থাকবে না কেন? এইতো সেদিনের কথা

মুকুল হাসছে। কেন হাসছে বুঝতে না পেরে আমি বললাম
হাসছেন কেন?
ও হাসি থামিয়ে বলল
তোমাকে আমি প্রথম তিথিদের ছাদে দেখিনি। দেখেছিলাম আরো প্রায় বছরখানেক আগে। তুমি শহীদ মিনারের সামনে একটা ছোট কুকুর ছানা কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছিলে।
আমার শরীর কেমন শিরশির করে উঠলো। সেদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি ঢাকা মেডিকেলে বাবার কাছে গিয়েছিলাম। মেডিকেলের গেটেই ছোট কুকুরছানাটাকে দেখে এত কষ্ট হলো যে তুলে নিলাম। বাবাকে এত করে অনুরোধ করার পরও বাবা রাজি হলো না ওকে আমাদের সঙ্গে রাখতে। আমি তখন ওকে নিয়ে কি করি? বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে, ভাবলাম ওকে তিথিদের বাসায় দিয়ে আসি। ওদের বাসায় তো আরো কিছু কুকুর আছে। বেরিয়ে কোন রিক্সা ও পাচ্ছিলাম না। শহীদ মিনার পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম। এত কান্না পাচ্ছিল। কেন ওকে আমাদের সঙ্গে রাখতে পারব না? হঠাৎ করেই কোত্থেকে একটা ছেলে এসে আমাকে বলল
কি হয়েছে খুকি? কোন সমস্যা? তোমার কোন সাহায্য লাগবে?
আমার এত রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল ছেলেটা গায়ে পড়ে কথা বলতে এসেছে। নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে। খুব খারাপ ব্যবহার করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সায় উঠে গিয়েছিলাম। কি অদ্ভুত! ওটা মুকুল ছিল? আমি কোনমতে বললাম

ওটা আপনি ছিলেন?
হ্যাঁ এরপর আমি কতবার যে ওখানে তোমাকে খুঁজেছি। অথচ তুমি আমার এত কাছেই ছিলে। সেদিন তিথিদের ছাদে তোমাকে দেখে এত অবাক হয়েছিলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
মুকুল আরো কি সব বলছে। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে; তার মানে ও সেদিন আমার বৃষ্টি ভেজা শরীর দেখে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি। আমি শুধু শুধু এতদিন ওকে ভুল বুঝেছি। আমার ভেতরে কিছু একটা হল। সেদিনের মতো আমি আবারো ওকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরলাম। বোধহয় একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিলাম। ও আমাকে দুই হাতে তুলে নিয়ে নিচে আমাদের ঘরে নিয়ে গেল।
উত্তাল রাত্রির শেষ প্রহরে মুকুল আমাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বিষন্ন কন্ঠে বলল
আমার সাথে যাবে তুলি?
যাব
কোথায় যাবে জানতে চাইলে না?
যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাব
সত্যি?
হু
আমি অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশনের জন্য এপ্লাই করেছি। অনেকটা প্রসেস এগিয়ে গেছে। হয়ে গেলে আমরা দুজন চলে যাব। কেমন?
শুধু আমরা দুজন যাব?
হ্যাঁ, শুধু তুমি আর আমি। যাবে তো?
যাব
একটা বড় উঠানসহ বাড়ি নেব। সেখানে তুমি যত ইচ্ছা হাস, মুরগি, বিড়াল, কুকুর হরিণ রাখতে পারবে।
হরিণ ও রাখতে পারব?
পারবে না কেন? নাকি তুমি ক্যাঙ্গারু রাখতে চাও?
আমি হেসে ফেললাম। পুরোটা আমার কাছে কেমন স্বপ্নের মতন লাগছে। হঠাত কেমন ভয় করতে লাগল। স্বপ্ন তো হয়ই ভেঙে যাবার জন্য।

চলবে………

ভুল সত্য পর্ব-১২

0

ভুল সত্য

১২

প্রচন্ড মাথা ধরেছে। যদিও এটা নতুন কিছু না। তবু প্রতিবারই মনে হয় নিতে পারছি না। মাথার দুপাশ যেন কেউ ব্লেড দিয়ে চিড়ে দিচ্ছে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছি তবু কমছে না। একটু আগে মুকুল মাথা ব্যথার ওষুধ দিয়েছে। খেতে ইচ্ছা করছিল না, তবু জোর করে খাওয়াল।

সকাল থেকে সবকিছু ঠিকই চলছিল। খাবার টেবিলে এতসব রান্নাবান্না দেখে মুকুল একটু বিরক্ত হলেও পোলাও আর ভুনা মাংস দেখে বেশ খুশি হয়েছিল। বিপত্তিটা বাঁধল খাওয়ার পর যখন আমার শাশুড়ি সারাদিনের রান্না বান্না করা সব খাবার বক্সে ভরে নাজু আপাকে দিয়ে দিল। নাজু আপা মহা খুশি। হবারই কথা। ব্যগ গুছাতে গুছাতে উনি বলতে লাগলেন
বুচ্ছস নাজু, বাসি খাওন আমি খাইতে পারি না। একদিনের খাওন আরেকদিন মাইনসে খায়? একদিনের খাওন পরের দিন খাইব কুত্তা বিলাই। আগে তো বেলায় বেলায় রান্দা হইতো। আমরা তো কোনদিন সকালের তরকারি দিয়া রাইতে ভাত খাই নাই।

খুবই স্পষ্ট ইঙ্গিত। বোঝাই যাচ্ছে পরের দিন আবার আমাকে বিস্তর রান্নাবান্না করতে হবে। আমি কিছু বললাম না পাশে তাকিয়ে দেখলাম মুকুলের খাওয়া থেমে গেছে। ও নাজু আপাকে উদ্দেশ্য করে বলল
কালকে কি রান্না করবে মার কাছ থেকে জেনে নিন। কাল তুলি থাকবেনা। ওর ক্লাস আছে।।
আমার শাশুড়ি ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল
অসুবিধা নাই কলেজ থেকে আইসা রানবো
সেটা সম্ভব না। ক্লাসের পর ও আমার অফিসে আসবে আমরা একটু শপিং করতে যাব।
উনার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। মুকুল খাওয়া শেষ করতে করতে বলল
তুলি, এত সব ঝামেলার আইটেম প্রতিদিন করবে না। ক্লাস থেকে ফিরে একটা দুটো আইটেম করতে পারো। দিনেরটা নাজু আপা আর মা মিলে সামনে নেবে।

আমি আর কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। তবে তাকিয়ে দেখলাম আমার শাশুড়ি আর নাজু আপার মধ্যে এক ধরনের দৃষ্টি বিনিময় হল। বিষয়টা বেশ অর্থপূর্ণ তবু আমি এড়িয়ে গেলাম। এই মহিলা যদি ভেবে থাকেন রান্নাবান্না দিয়ে আমাকে নাজেহাল করবেন তাহলে ব্যাপারটা হাস্যকর। তবে মুকুল এসব মেয়েলি ব্যাপারের মধ্যে কেন ঢুকছে বুঝতে পারছি না। হয়তো ওর মায়ের চরিত্র খুব ভালো করে জানে বলেই, নাকি অন্য কোন ব্যাপার আছে?

এতসব রান্নাবান্না করেছি বলেই কিনা জানিনা বিকেল থেকেই প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হল। মুকুলের খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে নিয়ে বাইরে বের হবে। একটা মাত্র ছুটির দিন ওর আমি সেটা নষ্ট করতে চাইনি। তাই একপ্রকার জোর করেই ওকে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। একটু ভালো সময় কাটিয়ে আসুক। যাওয়ার আগে ও অনেকবার করে বলে গেল কোন দরকার হলে ফোন করতে। আমি সায় দিয়ে দ্রুতই ওকে বিদায় করলাম। আমি চাইনা ও আমার আশেপাশে বেশি সময় ধরে থাকুক। কি জানি কেন, ওর প্রতি আমার মনে একপ্রকার গভীর মায়ার সৃষ্টি হয়েছে। শুধুমাত্র আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে বলে নয়। ওর জীবনের একটা গভীর সত্য আমি জেনে ফেলেছি বলে। প্রথম দিকে শুধু সন্দেহ ছিল কিন্তু কাল নিশ্চিত হয়েছি। এরপর থেকে আমার খুব ইচ্ছা করছে ঠিক যেরকমভাবে ও আমাকে আগলে রাখে আমিও ওকে সেই ভাবে আগলে রাখি।

আমি মনের মধ্যে কোন দুর্বলত কে পশ্রয়দিতে চাইনা। ছেলেদের ভালো মানুষের মুখোশ দেখার অভ্যাস আছে আমার। এই মুখোশ খসে পড়তে বেশি দিন লাগে না। কলেজ ভর্তি কোচিং করার সময় সায়মা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। মেয়েটা ভাল ছাত্রী হলেও একটু বোকা আর সহজ সরল। কোচিং এর পর আমরা মাঝে মাঝে সেন্টারে বসেই একটু এক্সট্রা পড়াশোনা করতাম। ওর সব কথাই আমাকে বলতো। আমাদের ক্লাস নিতেন যে তমাল ভাই উনি আমাদের সিনিয়র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। সায়মা পড়াশোনার চাইতে তমাল ভাইয়ের গল্পই বেশি করত। সপ্তাহ খানেক এর মধ্যেই জানতে পারলাম ওদের প্রেমটা হয়েই গেছে। আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। সায়মা যেমন সহজ-সরল, তমাল ভাই সেই রকমই দুর্দান্ত স্মার্ট। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম সবার সামনে তারা দুজন দুজনকে না চেনার ভান করছে। সায়মাকে জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল তমাল ভাই চান না ব্যাপারটা সবার সামনে আসুক। বিষয়টা আমার ভালো লাগেনি। ভেবেছিলাম হয়তো এখানে ছাত্রী শিক্ষক বলে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম দু একদিন পর। একদিন সায়মা আসেনি আমি একাই একটা ফাঁকা রুমে বসে অংক করছিলাম। হঠাৎ করেই তমাল ভাই এসে আমার পাশের বেঞ্চে বসলেন। আমি ভাবলাম হয়তো সায়মার জন্য কোন মেসেজ দেবেন। প্রথমে কিছু সময় এদিক ওদিককার গল্প করার পর হঠাৎ করেই বললেন তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে তুলি। আমি জবাব দিলাম না। উনি আরেকটু এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি চমকে উঠে বললাম
ভাইয়া, আপনি না সায়মাকে
উনি হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মতন ভঙ্গি করে বললেন
আরে ধুর! ওর মতো একটা মেয়েকে আমি পছন্দ করব? কি করে সম্ভব ? ওই পাগল হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। আমার বরাবরই তোমাকেই ভালো লাগে।

আমি হতভঙ্গ হয়ে গেলাম তাহলে এতদিন ধরে তাদের মধ্যে কি চলছিল? টাইম পাস? একটা কথা ও না বলে সেদিন উঠে চলে গিয়েছিলাম। এরপর আর কোচিংয়ে যাইনি। পরে অন্যদের কাছে যেদিন শুনেছি যে সায়মা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, আমার খুব তোমার ভাইকে বলতে ইচ্ছা করেছিল যে আপনার মত একটা থার্ড ক্লাস ছেলে সায়মার মত মেয়েকে ডিজার্ভ করে না।

এই জীবনে বিভিন্ন রূপেই আমি পুরুষদের মুখোশ উন্মোচিত হতে দেখেছি। তবে শেষেরটা সবচাইতে ভয়ংকর ছিল কিংবা কে জানে এর পরেরটা হয়তো আরো ভয়াবহ হবে। যখন মুকুলের আসল চেহারাটা দেখতে পাব। বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণা আমি আর আমি নিতে চাইনা। এজন্য এই জীবনে আর কাউকে বিশ্বাস করব না বলে ঠিক করেছি।

কোথায় যেন একটানা একটা শব্দ হচ্ছে। ভুমিকম্প হচ্ছে নাকি বালিশটা ও মনে হয় কাঁপছে। এসব কি সত্যিই হচ্ছে নাকি আমার মাথার ভিতরে। অনেকটা সময় লাগলো বুঝতে যে বালিশের নিচে আমার মোবাইল্টা ভাইব্রেট করছে। এ সময় কে ফোন করল? মা নাকি? মা প্রতিদিনই একবার করে ফোন করে। কেমন আছি, কি খেয়েছি এসব অর্থহীন প্রশ্ন করে। আমার জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। এতই যদি আমার জন্য চিন্তা তাহলে বিয়ের আগে আমার কথ একটু শুনলে কি হত? ফোনটা টেনে নিয়ে দেখলাম মা ফোন করেনি, মুকুল করেছিল লাইন কেটে গেছে। বাইরে গেছে এক ঘন্টাও হয়নি এর মধ্যে কি হয়ে গেল। আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তাই আর ফোন করলাম না। অবশ্য তার দরকার পড়ল না। ও নিজেই আবার ফোন করল। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম
কি হয়েছে?
মাথা ব্যথা কমেনি?
কমে যাবে
তার মানে এখনো কমেনি। এই অষুধে কাজ হচ্ছে না। দাড়াও আমি আসছি
না আসার দরকার নেই। এখন আর……
আমার কথা না শুনে ও ফোন রেখে দিল। ধ্যত! বললেই হত ব্যথা কমে গেছে। এখন আবার চলে আসবে। আমি চাইনা ও আমার আশেপাশে থাকুক।

মুকুল ফিরে এল দশ মিনিটের মাথায়। নিশ্চই বেশিদুর যায়নি। মেইন রোডেই কোথাও বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিল। ফিরে এসেই অত্যাচার শুরু করল। অন্য ওষুধ নিয়ে এসেছে, সেটা খেতে হল। শুধু তাই নয়। ঘর অন্ধকার করে মাথা মাসাজ করা শুরু করল। প্রথম দিকে বিরক্ত হলেও একটু পরেই আমার মনে হল মুকুল ক্যরিয়ার নির্বাচনে ভুল করেছে। ওর উচিত ছিল মাসাজ থেরাপিস্ট হওয়া। এত আরাম আমি জীবনে পাইনি। আমি অস্ফুটে বললাম
আহ! কি আরাম
ও বুঝতে না পেরে বলল
কি হয়েছে তুলি? কষ্ট হচ্ছে?
আমি চোখ মেলে তাকালাম। ওর দুচোখে কি গভীর উদ্বেগ, কি অসীম মায়া। আমার ভেতরে কি একটা হল। আমি দুই হাতে ওর মুখটা তুলে ধরে গভীর চুমু দিলাম। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। ইচ্ছা হল নিজের দুই গালে জুতার বাড়ি মারি। এখন কি করি? এটা তো আর ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। তাকিয়ে দেখলাম ও হতভম্ব মুখ করে তাকিয়ে আছে। কোনমতে বলল
আমি কিন্তু তোমাকে নেশার কোন ওসুধ দেইনি
ওর বলার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম। এরপর যেটা হল তার জন্য আমার কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।

চলবে………

ভুল সত্য পর্ব-১১

0

ভুল সত্য

১১

সারা জীবনে আমি এত লজ্জা কোনদিন পাইনি, ঘুম ভেঙে যে পরিমান লজ্জা পেলাম। চোখ মেলে দেখলাম আমি মুকুলকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছি। সাধারণত ভয় পেলে আমার টেডি বেয়ারটাকে এইভাবে ধরি। ও বেচারা তো আর কিছু বলতে পারেনা। কিন্তু মুকুল যে এখনো দম বন্ধ হয়ে মরে যায়নি সেই ঢেড়। উঠতে গিয়ে টের পেলাম ও নিজেও আমাকে একইভাবেই জড়িয়ে ধরে আছে। হাত ছাড়িয়ে উঠতে যেতেই মুকুল , ধরমর করে উঠে বসে বললো
তুমি ঠিক আছো তুলি?
আমি কোনমতে বললাম
আমি কি আপনাকে অনেক বিরক্ত করছি?
না একেবারে না। এ

    কটু ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে
    কি হয়েছিল আমার? আমি এখানে কি করে এলাম?
    তুমি ছাদ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। এখন কেমন লাগছে?

    আমি জবাব না দিয়ে ঘাড় কাত করলাম। ভীষণ অসস্তি হচ্ছে। ও নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন করবে। এর আগেও আমি ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরন করেছি বেশ কয়েকবার, আবার কাল রাতেও ওর কথা শুনে ছাদের মধ্যে কিসব করলাম; এমনকি ওকে চিনতে ও পারলাম না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যপার হল। মুকুল কিছুই জানতে চাইল না। শুধু বলল
    ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে কিছু খেয়ে নিতে। রাতেও খাওয়া হয়নি। আমি বাধ্য মেয়ের মতো ওর কথামতো নিচে গেলাম। তবে সেখানে যে আমার জন্য এত বড় চমক অপেক্ষা করছিল সেটা ভাবতেও পারিনি।

    ড্রইং রুমের সোফায় আমার শাশুড়িকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তার পায়ের কাছে কেউ একজন বসে ঝামা দিয়ে পা ঘষে দিচ্ছে। সামনে গামলা ভর্তি পানি ও দেখা যাচ্ছে। বোধহয় সকাল সকাল পেডিকিউর চলছে। এই দৃশ্য দেখে তেমন অবাক হলাম না কিন্তু পায়ের কাছে বসে থাকা মানুষটিকে দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। সে আর কেউ নয় আমাদের অতি প্রিয় নাজু আপা, যাকে গতকাল এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছিল। আমাকে দেখে উনি বললেন
    – এইত তর ভাবী আইসা গেছে। কি কি কইরা কাখসস বুঝায়া ক
    – হ ভাবী, আলু ভাজি কইরা রাখসি, হালুয়া ও করসি। আটা মাকসি। আপ্নে রুটি বানায়া দিয়েন। আমার রুটি তো খালাম্মার পসন্দ হয় না।
    তর ওই ল্যপের মত রুটি খাওন যায় নাকি? দে ভালো কইরা ঘষা দে পায়ে
    উনার কন্ঠে স্নেহের ছোঁয়া। বুঝলাম এদের মধ্যে পাঁচমিশালি খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের আভাষ। আমি রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে উনি ডেকে দুপুরের রান্নার মেনু দিলেন। সেই মেনুর বহর শুনে আমার মত রান্না প্রিয় মানুষ ও আঁতকে উঠল

    ১ লতি দিয়ে শুঁটকি
    ২ খাসির মাথা
    ৩ মুরগির গিলা কলিজা দিয়ে লটপটি
    ৪ মুগডাল দিয়ে রুই মাছের মাথার মুড়িঘন্ট
    ৫ বাসমতী চালের ভাত
    ৬ কচুর মুখি দিয়ে আলু বেগুনের ঝোল

    মেনু শুনে মাজাজ খারাপ হল। এত সব রান্না করতে হবে বলে নয়। যে সব আইটেম বলা হয়েছে এর একটাও মুকুল খায় না। এই মহিলা আমাকে যন্ত্রনা দিতে যতটা উৎসাহী এর দশ ভাগের এক ভাগ ও যদি ছেলের স্বাস্থ্য নিয়ে হত তাহলে ছেলের এই হাল হত না। যাক তার মায়েরই যদি কোন চিন্তা না থাকে তো আমার কি? আমি রুটি সেকে টেবিলে দিলাম। উনি বললেন
    বেগুন একটু বাচলে ভর্তা বানায়ো তো
    আমার আবারো মেজেজ খারাপ হল। বেগুনে মুকুলের অ্যালার্জি। এসব কি উনি ইচ্ছা করে করছেন? আমি নাজুকে বললাম
    নাজু আপা গরুর মাংস বের করেন তো আর পোলায়ের চাল ধুয়ে রাখেন।
    তারা দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।

    নামার আগে মুকুল বলেছিল
    ভেবেছিলাম আজ সারাদিন ঘুরব। কিন্তু কাল যে অবস্থা হল বিকেলের আগে বেরোনো সম্ভব না
    আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম
    না না আমি আজকে সারাদিন রান্না করব। ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার সব বাসায় করব।
    শোন তুলি
    জি
    বেশি স্ট্রেস নেয়ার দরকার নেই। কিছু লাগলে আমাকে বলো
    ওর বলার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম। মনে হচ্ছে যেন আমার খুব কঠিন কোন অসুখ করেছিল কেবলই সেরে উঠেছি। অথচ এগুলো আমার সঙ্গে প্রায়ই হয়। বিশেষ করে সেই দিনের পর থেকে। সেদিনের সেই অন্ধকারে ভয়াবহ আতঙ্ক, এর পরে ও আমার জীবনে বারবার ফিরে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম মা ভিষণ রেগে যাবে। হয়ত বাবার সাথে ঝাগড়া করবে। কারন বাড়িতে আশরাফ চাচার এই অবাধ বিচরন মা কখনোই স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। প্রায়ই খুব বিরক্ত হত। কিন্তু দেখা গেল মা কেমন যেন মুষড়ে পরল বরং বাবাই খুব হম্বিতম্বি শুরু করল। বারবার বলতে লাগল
    দুধকলা দিয়ে মানুষ সাপ পোষে আর আমি পুষেছি শেয়াল। যে থালিতে খায় সেখানেই হাগে। হারা/মজাদার হাগা আমি বের করছি। এমন ওষুধ দেব যে হাগা মাথায় উঠে যাবে।
    যখন এত হম্বিতম্বি করছিল তখনি আমার সন্দেহ হয়েছিল, কিছু একটা ঝামেলা আছে। মাকে বলেছিলাম সে কথা, মা তখন গুরুত্ব দেয়নি বলেছিল
    না, এবার তোর বাবা সত্যি রেগে গেছে। ওই বদমাইশটা আর বাড়িতে আসবে না। আমার তবু কেন যেন ভরসা হলো না। মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল হয় কথাটা বোধ হয় আসলেই সত্যি। এর ঠিক দুই দিনের মাথায় বাবা আশরাফ চাচাকে নিয়ে আবার বাড়ি এলেন। বাবার মুখ কাচুমুচু, আশরাফ চাচার কাঁদো কাঁদো। বাবা হাত কচলাতে কচলাতে বললেন
    একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে এই জন্য এত দিনের সম্পর্ক নষ্ট করা কি ঠিক?
    আমি হতভম্ব মুখ করে তাকিয়ে রইলাম, কোন জবাব দিতে পারলাম না। এবার বাবা বেশ কড়া গলায় বললেন
    উনি তো তোর বাবার মতোই বরং তুই যেটা করেছিস সেটাই অন্যয়। তোর উচিত আশরাফের কাছে ক্ষমা চাওয়া
    আশরাফ চাচা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে ছিলেন, এই কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে বললেন
    না না কায়সার ও কথা বলিস না। ও ছোট মানুষ, বুঝতে পারেনি। আমাকে মাফ করে দাও প্রিন্সেস, প্লিজ।
    বলতে বলতে আসরাফ চাচা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আমি আর নিতে পারছিলাম না। এক ছুটে নিজের ঘরে দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেখান থেকেই শুনলাম আশরাফ চাচা বাবাকে বলছে
    তোর মেয়ে যেন আর বেশি বাড়াবাড়ি না করে। তা না হলে তোর জন্য ভালো হবে না। মনে রাখিস তোর ব্যাপারে আমি ও অনেক কিছুই জানি।

    এই কথা শুনে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু সেটা হয়নি। ওই মুহূর্তে শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল আল্লাহ আমাকে একটু কম বুদ্ধি দিলেও চলত, তাহলে জীবনটা এর চেয়ে একটু সহজ হতো। এর পরের অংশটা আমার জন্য সহজ হল না। আমি চোখ মুছে আবার ড্রয়িং রুমে ফিরে গেলাম

    চাচা আমাকে দেখে কান্নার মত একটা ভঙ্গি করলেন। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম
    চাচা আমাকে মাফ করে দিন। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আপনি আমার সঙ্গে যা করেছেন নিশ্চয়ই মৌরিন আপুর সঙ্গেও তাই করেন। আমারই বোঝার ভুল হয়েছে। আই এম সরি।
    আমি তাকে দেখলাম, তার চোখের মনি মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠেছে প্রচন্ড ক্রোধে। উনি এক মুহূর্ত সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলবেন
    প্রিন্সেস তুমি আর মৌরিন আমার কাছে একই
    তা তো নিশ্চয়ই। বাবা আমি আর মৌরিন আপু যেন তোমার কাছেও এখন থেকে একই হই।
    মৌরিন আশরাফ চাচার মেয়ে। বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় হবে। তাকিয়ে দেখলাম রাগে চাচার ফর্সা গাল লাল হয়ে গেছে। উনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন
    প্রিন্সেস দেখি বড় হয়ে গেছে।

    আমি আর কথা বাড়ালাম না, নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। সেদিন থেকেই আমার অভিনয় জীবনের শুরু। সেদিন আমরা তিনজনই জানতাম আসল সত্যটা কি অথচ তিনজনই অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। এরপর দশ বছর চলে গেছে। জীবনের প্রতিটি দিনই আমার অভিনয় করে কেটেছে। এখন তো এমন অবস্থা হয়েছে যে কোনটা অভিনয় কোনটা সত্যি নিজেই বুঝতে পারি না। এই যেমন কদিন ধরে মুকুলের সঙ্গে বেশ প্রেম প্রেম অভিনয় করছি। এটা তো অভিনয়ই তাই না? আমি নিশ্চই সত্যি সত্যি ওর প্রেমে পড়িনি? আপনাদের কি মনে হয়?

    চলবে………

ভুল সত্য পর্ব-১০

0

ভুল সত্য

১০

বাড়ীর পরিবেশ বেশ থমথমে। রাত এগারোটা বেজে গেছে এখনো কারো খাওয়া হয়নি। আমার শাশুড়ি সাধারণত সারে নয়টার দিকে আমাকে ডাকেন। আমি খাবার গরম করে দিলে দশটা নাগাদ আমরা তিনজন খেতে বসি। দুপুরে মুকুল থাকে না বলে রাতের খাবারটা সবাই একসঙ্গে খাই। এটাই নিয়ম। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হল। আমি কয়েকবার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম তার ঘরের দরজা বন্ধ। দশটা নাগাদ একবার শেষ চেষ্টা করলাম। ভয়ে ভয়ে তার ঘরের দরজা ধাক্কা দিলাম। ভেতর থেকে বাজখাই কন্ঠ ভেসে এল
কে?
আমি মিনমিন করে বললাম
আমি
জ্বালাইতাস কেন? বিদাই হও।
খাবেন না?
ওই গুয়ের খাওন খাইতে চাই না। তোমরা খাও।
বুঝলাম নাজু আপার খাওয়ার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। তবু আমি শেষ চেষ্টা করতে বললাম
আমি রান্না করে দিচ্ছি, খেয়ে নিন।
রাইত বিরাইতে রং দেহায়ো না। কাইককা থেকা রাইন্দো, খামু নে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হঠাত করে আমার রান্না অমৃত সুধা হয়ে গেল কি করে বুঝলাম না। যাই হোক এই সরাবান তহুরাই কাল থেকে তাকে খাওয়াবো এই প্রতিজ্ঞা করে ঘরে ফিরে এলাম।

ঘরে ফিরে এসে ঘুমানোর আয়োজন করতে লাগলাম। মুকুল প্রতিদিন রাতের খাবারের পর ছদে গিয়ে সিগারেট খায়। আজ সন্ধ্যা থকেই ছাদে গিয়ে বসে আছে। ভালোই হয়েছে। ও আসার আগে ঘুমিয়ে পরতে পারলেই রক্ষা। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করলাম ঘুম এল না। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বোধহয় বৃষ্টি নামবে। বাতাসে ঠান্ডা ভাব। একটু ঝরের আভাস ও পেলাম। জানালার কপাট শব্দ করে আছড়ে পড়ছে। আমি উঠে জানালা বন্ধ করে ঘড়ি দেখলাম। সোয়া এগারোটা। মুকুলের এখনো নামার কোন লক্ষণ নেই। আবার ঝর জলে ঠাণ্ডা জর বাধানোর ধান্দা। ভালো লাগে না আর। কি দরকার এই সব করার। রাত হয়েছে নেমে এলেই হয়। মা ছেলে দুইজন মিলেই জালিয়ে মারল।

আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম। মুকুলকে দেখা যাচ্ছে রেলিঙ ধরে ঝুকে দাড়িয়ে আছে। হাতে জলন্ত সিগারেট। আমাকে দেখে ও কেমন চমকে উঠল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
তুমি এখানে?
আজ রাতে কি এখানেই থাকবেন?
আমার কথা শুনে ও হেসে ফেলল। বলল
থাকতে পারলে তো ভালোই হত
থাকতে চাইলে বলেন, বিছানা করে দেই
মুকুল কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। নিজেকে সংযত করে নিল। তারপর বলল
তুমি রাতে খেয়েছ?
না। আপনাকে খাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই এলাম
আমার আর খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে শুয়ে পর
চা খাবেন?
মুকুল একটু অবাক হয়ে বলল
চা?
হ্য। নাম শোনেননি আগে?
তুমি খাবে?
খাওয়া যায়
এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে ও চিলেকোঠার ঘরের দরজা খুলল। আমি উকি দিয়ে দেখলাম। ঘরের ভেতর পুরানো সাইকেল থেকে শুরু করে আলমারি বইয়ের তাক সবই আছে। অনেকগুলো ঝুড়ি ভর্তি খেলনা। বোধহয় এখানে ওর ছোটবেলার জিনিসপত্র রাখা। কোনার দিকের একটা ছোট টেবিলে একটা ইলেকট্রিক কেটলি আর চায়ের সরঞ্জাম। মুকুল দুই মগ চা বানিয়ে একটা আমার হাতে দিল। আমারা আবার ফিরে এসে রেলিং ঘেঁষে দারালাম।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমি চমকে গেলাম। এত ভালো চা অনেকদিন খাইনি।
মুকুল হালকা গলায় বলল
চা ঠিক আছে?
হু, খুব ভালো হয়েছে। আপনাকে কয়েকটা কথা বলব
বলো
আমার জন্য এত ঝামেলা নেয়ার দরকার নেই
কি ঝামেলা?
আমার মাস্টার্স করা নিয়ে বাড়িতে অহেতুক ঝামেলা হচ্ছে। এত ঝামেলা করে আমি পড়াশোনা করতে চাই না
মুকুল এতক্ষণ বেশ মন দিয়ে আমার কথা শুনছিল এবার স্কুলের মাস্টারদের মতন বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল
বিষয়টা মাস্টার্সের না। পুরো সেট আপটা ঠিক হওয়া দরকার। এখন তুমি ক্লাসে যাচ্ছ এটা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে এরপর পাশ করে চাকরি করবে তখন আবার একই পরিস্থিতি হবে। এর চেয়ে বরং এখনই সব………
চাকরি? আমি চাকরি করব?
কেন? তুমি চাকরি করতে চাও না?
মুকুল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কি জবাব দেব বুঝতে পারছি না। এসব নিয়ে অনেক বছর কারো সঙ্গে কথা হয় না। কথা বলতে ইচ্ছা ও করে না। মনবিজ্ঞান নিয়ে পড়াটা আমার শখ ছিল। ক্যরিয়ারের কথা চিন্তা করলে হয়ত অন্য কোন বিষয় নিয়ে পড়তাম। বরাবরই আমার অন্য কিছু করার ইচ্ছা কিন্তু এই নিয়ে কখনো কারো সঙ্গে আলাপ হয়নি। শুধু একবার একজনের সঙ্গেই কথা হয়েছিল।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মুকুল আবারো বলল
তুমি কি চাকরি না করে অন্য কিছু করতে চাও?
জি
সেটা কি? কোন রকম বিজনেস?
অনেকটা সেই রকমই
ও কৌতূহল নিয়ে বলল
কি রকম?
আমার হঠাত করেই আজ কেন যেন ওকে সবটা বলতে ইচ্ছা হল
আমার আসলে খুব শখ একটা রুফটপ রেস্টুরেন্ট করার। ঠিক রেস্টুরেন্ট না, কফিশপ বা চা বার বলতে পারেন।
মুকুল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
ইন্টারেস্টিং! কি রকম বলতো
ছাদের উপর একপাশে ছাউনি দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা থাকবে। চা, সিঙ্গারা, লুচি আলুর দম, পিয়াজু, ছোলা ঝালমুড়ি এই সব দেশীয় খাবার পাওয়া যাবে। মাটির পাত্রে সব খাবার দেয়া হবে।
বাহ! এটা তো খুবই ভালো আইডিয়া।
আমার কেমন একটু লজ্জা করতে লাগল। মুকুল আমার সব ছেলেমানুষি ইচ্ছে গুলোকে অনেক গুরুত্ব সহকারে নেয়। ও আবারো বলল
তুমি আগে পড়াশোনা শেষ কর তারপর আমারা এটা নিয়ে কাজ শুরু করব।
কি কাজ?
লোনের ব্যবস্থা করতে হবে, লোকেশন দেখতে হবে। আমি তোমার জন্য চমৎকার একটা বিজনেস প্ল্যন করে দেব কেমন?

মুকুল আরো কিসব যেন বলছে। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। বহুবছর আগে ঠিক এই কথাগুলোই কেউ আমাকে বলেছিল। সেই ভয়াবহ স্মৃতি হঠাত করেই বহুবছর পর ফিরে এসেছে।

তখন আমি সবে ক্লাস এইটে উঠেছি। স্কুলে ক্লাস সেইভাবে শুরু হয়নি বলে হাতে অফুরন্ত সময়। বাবা কদিন আগে আমাকে একটা ছোট ইলেকট্রিক অভেন কিনে দিয়েছে। আমি প্রতিদিনই কেক পিজা ব্রাউনি সহ নানান মজার মজার খাবার বানাচ্ছি। চুলা না জালিয়ে মাইক্রো ওয়েভে চা বানাচ্ছি। আমার রান্নার সবচেয়ে বড় ভক্ত আশরাফ চাচা প্রতিদিনই বাড়িতে আসতেন। সময় অসময়ে তার চলে আসাটা নতুন কিছু না। উনি বাবার কলেজের বন্ধু। একই মেডিকেল থেকে দুজনে পাশ করেছেন। বাবা ঢাকা মেডিকেলে কাজ করেন আর উনি মিডফোরড হাসপাতালে। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যা বেলা চাচা চলে আসতেন। সেদিন সকাল সকালই চলে এসেছিলেন। মা ততখনে স্কুলে বেরিয়ে গেছে। বাবাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চাচাকে বলাতে উনি বললেন চা খেয়ে বের হবেন। বাবাও বেরিয়ে গেল। আমি তাকে পিরিচে করে ব্রাউনি দিলাম। উনি মুখে দিয়ে আয়েশে চোখ বুজে বললেন
দারুণ! চা দেবে না প্রিন্সেস?
আমি মাইক্রো ওয়েভে চা বসিয়ে ফিরে এসে দেখলাম উনি মজা করে ব্রাউনি খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বড় সোফাটার একপাশে সরে গিয়ে আমাকে বসার জায়গা করে দিলেন। আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বসলাম। চাচা হঠাত করেই আমার গাঁ ঘেঁষে বসে এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরলেন। আমার সমস্ত শরীর কাঠ হয়ে গেল। আমি আমার পাজরে তার আঙ্গুলের নড়াচড়া টের পাচ্ছিলাম। হঠাত করেই ভীষণ কান্না পেল। ঠিক যে মুহূর্তে টের পেলাম তার হাত উপরের দিকে উঠছে আমি কান্নাটা গিলে ফেলে ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম তারপর মধুর হাসি দিয়ে বললাম
চা টা নিয়ে আসি?
উনি চোখ টিপে ইশারায় বোঝালেন ঠিক আছে।
আমি দ্রুতই চা নিয়ে ফিরে এলাম। আশরাফ চাচা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি মগটা উনির হাতে না দিয়ে ফুটন্ত চা টা উনার প্যন্টের উপর যায়গা মত ঢেলে দিলাম। উনি বাবা গো মাগো বলে চিৎকার করে উঠলেন। আমি এই সুযোগে মগটাও সেখানে ফেলে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ভেতর থেকে শুনছি উনি সমানে চিৎকার করে যাচ্ছেন। অকথ্য ভাষায় আমাকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছেন। বাথরুমের লাইটের সুইচ বাইরের দিকে। তাড়াহুড়ায় লাইট জালাতে ভুলে গেছি। বাইরে তখনো উনি একইভেবে গর্জন করে যাচ্ছেন। ভয়ে আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বোধহয় উনি দরজা ভেঙে ভেতরে এসে আমার উপর ঝাপিয়ে পরবেন।

আমি অজ্ঞান হলাম না। স্পষ্ট চেতনা নিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে ভেতরে বসে রইলাম। বাইরের শব্দ বন্ধ হয়ে যাবার পরেও দরজা খোলার সাহস পেলাম না। এরও প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা পর বাবা মা এসে আমাকে ভেতর থেকে বের করল। আমি দৌড়ে গিয়ে মায়ের বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এতক্ষণে মনে হল আমি বোধহয় জ্ঞান হারাচ্ছি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো
আমি মুখ তুলে মায়ের চেহারাটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। মাকে এত অচেনা লাগছে কেন? এতো মা নয়, অন্য কেউ। তবে যেই হোক তার চোখেও মায়ের মতই গভীর মায়া। সে দুই হাতে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। আমি তাকে চিনতে পারার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

চলবে………

ভুল সত্য পর্ব-০৯

0

ভুল সত্য

তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুলি?

আমি কি জবাব দেব বুঝতে পারলাম না। প্রশ্নটাই বুঝলাম না। আমি ছেড়ে চলে যাব মানে কি? এখন চলে গেলে তো ও এই হাটু পানিতেই ডুবে যাবে। তাছাড়া আমি ওকে ডুবতে দিলে তো? সুইমিং এ এতগুলো মেডেল কি আমি এমনি এমনি পেয়েছি? নাকি ও ভাবছে আমি ওকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব? সেটাই বা কেন ভাববে? আর আমি যাবটা কোথায়? বাবা মায়ের কাছে তো আমি মরে গেলেও ফিরে যাব না। যারা বিয়ে হবার আগেই আমাকে বোঝেনি তারা এখন কি বুঝবে।
মুকুল অনেক ক্ষণ জবাবের জন্য অপেক্ষা করে একসময় আমাকে ছেড়ে আস্তে আস্তে হেটে ঘাটের দিকে চলে গেল। আমি ওর যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন কুজো হয়ে আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত ওর ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। মন খারাপ হলে ও এমন কুজো হয়ে হাটে। এই কদিনে আমি এটা লক্ষ্য করেছি।

ও চলে যাবার পর আমারো আর পানিতে থাকতে ইচ্ছা হল না। উঠানে এসে দেখলাম মরিয়ম বিবি সর্ষে ইলিশ বসিয়েছে। এই আইটেমটা সামনাসামনি দেখার আমার খুব শখ ছিল। আমি কয়েকবার ট্রাই করেছি। সবই ঠিক থাকে কিন্তু কেন যেন একটু তেতো হয়ে যায়। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের মাটির ঘরের দরজা বন্ধ। মুকুল নিশ্চয়ই চেঞ্জ করছে। ওর সাধারণত এসব কাজে অনেক সময় লাগে। সকালে অফিস যাবার আগে ও দেখি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে তারপর যত্ন করে তৈরি হয়। এমনিতেই ওর ঠান্ডার ধাত, তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিলেই ভালো। আমার আবার এসব ঠান্ডা জলে কিছু যায় আসে না। আমি দিন রাত বৃষ্টিতে ভিজেও দিব্যি সুস্থ থাকতে পারি।

আমি চুলার ধারে বসে পড়লাম। মরিয়ম দিবি আমাকে একটা কাঠের পিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল
চা খাইবা?
খাব। একটু আদা দিয়ে রং চা দিতে পারবেন? উনার আসলে একটু ঠান্ডার ধাত তো
বলতে বলতে আমি কি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম? তা কেন? মরিয়ম বিবির সঙ্গে তো আমার অভিনয় করার দরকার নেই। ধুর! সারাক্ষণ অভিনয় করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন কোনটা অভিনয় কোনটা সত্যি নিজেই বুঝতে পারি না।

ব্যবস্থা মনে হয় করাই ছিল। মরিয়ম বিবি চটপট চা দিয়ে দিল। স্বচ্ছ কাঁচের কাপে সোনালী লিকারটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে। মাঝে কিছু আদা আর এক টুকরো লেবু ভাসছে। আমি কাপ দুটো তুলে নিয়ে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম। কি আশ্চর্য! দরজা খোলাই। ভেতরে ঢুকে দেখলাম মুকুল দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানায় বসে আছে। আমাকে দেখে চোখ তুলে তাকাল। ওর চোখ কেমন লাল হয়ে আছে। এই রে, ঠান্ডা বাধিয়ে ফেলেছে। সব আমার দোষ। কেন যে পানির মধ্যে নিয়ে গেলাম। আমি ওর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বললাম
তাড়াতাড়ি চা টা খান। গলা ব্যথা করছে?
ও আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল
তুমি চেঞ্জ করে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে।
আমার শাড়ি শুকিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চা টা খান তো। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
মুকুল চায়ের কাপে চুমুক দিল। দেখে মনে হচ্ছে বেশ আরাম পাচ্ছে। আমি আমার হ্যন্ডব্যগ থেকে পানির বোতল সেই সঙ্গে ঠান্ডা আর মাথাব্যথার ওষুধ বের করে দিয়ে বললাম
জলদি খেয়ে ফেলুন। আপনাকে পানিতে নামিয়েছি জানতে পারলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না
মুকুল কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল, যেন আমি খুব অবান্তর কিছু বলে ফেলেছি। কেন যেন হঠাত আমার ওর জন্য খুব মায়া হল। ওর মায়ের সঙ্গে কেমন একটা দূরত্ব, আমার সঙ্গে ও সুবিধা করতে পারছে না। পৃথিবীতে কত আজেবাজে ছেলেরা মায়ের আদর পায় আবার একান্ত বাধ্যগত বউ ও পায়। বেচারা ওর ভাগ্য দুদিক দিয়েই খারাপ। কিন্তু তাতে আমার কি? হঠাত করে আমার ওর প্রতি এত আলগা দরদ উথলে উঠল কেন? আমি শক্ত হাতে নিজের মনের লাগাম টেনে ধরলাম। আর যাই করি ওকে বিশ্বাস করর মতো ভুল আমি করব না। তবে একথা সত্যি যে মুকুলার প্রতি আমার এক ধরনের মায়া জন্মেছে। সেটা আহামরি কিছু না। মায়া তো আমার টুক্টুকির জন্য ও আছে। ওকে তো মাত্র আজই পেলাম। সেখানে মুকুল তো আমার সঙ্গে গত দশ দিন ধরে আছে। আর আমার অনেক উপকার ও করেছে। ও সাহায্য না করলে আমার মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া হত না। আমার ভর্তি র কথা শুনে শাশুড়ি অনেক তুলকালাম করেছে। মুকুলের সঙ্গে সুবিধা করতে না পেরে একদিন আমাকে ডেকে বললেন
শুনো ওইসব পড়ালেখার ধান্দা মাথা থেকা বইর কইরা ফালাও
কিভাবে মাথা থেকে বের করব? নাকের ফুটা দিয়ে না কানের ফুটা দিয়ে?
ওই বেয়াদ্দব মাইয়া। শাশুড়ির লগে কেম্নে কথা কইতে হয় বাপ মায় শিখায় নাই।
না তো
খাড়াও তোমার বাপ মায়েরে খবর দিয়া আনাইতাসি। ভাইবো না এই বার জামাইয়ের গলা ধইরা কইলে লাভ হইব। বউ বাড়িতে থাকবো, রানবো, বাড়বো। জজ বালেস্টর বউ দিয়া কি করুম?
উনি বোধহয় ভেবেছিলেন এই কথা শুনে আমি তার পায়ে উপুড় হয়ে পড়ব। সিরিয়ালের নায়িকাদের মত বলল
না না মা, অমন করবেন না । ওতে যে তারা অনেক কষ্ট পাবে।
আমি তার ধার দিয়েও গেলাম না। নির্বিকার ভাবে বললাম
খবর দেন।
ভালোই হবে। তারাও এসে দেখুক কেমন ঘরে বিয়ে দিয়েছে। তখন যে ছেলেকে দেখে রসগোল্লা মাকে পান্তোয়া ভেবেছিল এখন এসে দেখে বুঝুক তারা আসলে কি।
আমার নির্বিকার ভাব দেখে উনি একটু থমকে গেলেও দমে গেলেন না। রাতের বেলা খাবার টেবিলে এই নিয়ে কথা উঠল। বাবা মা কে খবর দিয়ে আনানোর কথা শুনে মুকুল রেগেমেগে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। উনি কয়েকবার পেছন থেকে ডাকলেন কিন্তু লাভ হল না। অগত্যা তিনি ও উঠে পিছু নিলেন। আবার রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল। যথারীতি বাইরে থেকে কিছুই শোনা গেল না। কিন্তু এর পর আমার শাশুড়ি আর এই নিয়ে একটা কথা ও বললেন না।

বাবা মা কে আনানো হল না বলে আমার বরং একটু আফসোসই লাগতে লাগল। প্রথমদিন মুকুল আমাকে সঙ্গে করে কলেজে নিয়ে গেল আবার দুপুরে সঙ্গে করে নিয়েও এল।
বাড়ীতে এসে দেখি এলাহি কারবার চলছে। নাজু আপা তার স্থূলকায় শরীর নিয়ে নিচের হলঘরে রীতিমতো দাপাদাপি করছে। আমাদের দেখে শরীর নাচিয়ে বলল
ভাইজান আমি আর কাম করুম না।
মুকুল থম্থমে গলায় বলল
কেন, কি হয়েছে?
খালাম্মায় আমারে অপমান করসে। আমারা গরীব বইলা কি আমোগো আত্ম সন্মান নাই?
আমি তার ভাষা জ্ঞান দেখে চমৎকৃত হলাম। তার মধ্যে এত সুপ্ত প্রতিভা আছে জানা ছিল না। যদিও তার আর একটু বহিঃপ্রকাশ দেখার সুযোগ পেলাম না। আমার শাশুড়ি গর্জে উঠে বললেন
ওই মাথারি কি অপমান করসি তরে? তুই যা তরে তো তাই কইসি।
নাজু আপা হঠাত পল্টি খেয়ে উনাকে বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে পড়ল।
ভাবী আপনের কিন্তু কপাল পুড়সে। এমুন শাশুড়ি পাইসেন। আপ্নের কপাল নিরুপামার থেকা ও খারাপ।
ওই বেটি নিরুপামার কেডা?
কেন, আপনি ইস্টার পেলাস দেহেন না?
আমার শাশুড়ি স্টার প্লাস দেখেন না, তিনি পাকিস্তানি সিরিয়ালের ভক্ত। নিরুপামা না বলে যদি তেরে বিন কিংবা মুরাত মান্নাত বলত তাহলে বোধহয় ভালো হত। যদিও দ্বিতীয়টা উনার সঙ্গে ভালো যেত। ইস্টার পেলাস না দেখলেও উনি অবশ্য দমে গেলেন না। ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে বললেন
ওই মুকুল, এই বেটির চুলের মুঠিটা ধইরা এরে বাড়ি থেকা বাইর কর। আজকা ইস্টার পেলাস আমি তর………

আমি পরম আনন্দে স্টার প্লাস এবং স্কাই টিভি বাদ দিয়ে আমার সামনে অভিনীত বঙ্গ সিনেমার ব্যপক মজা নিতে লাগলাম।

চলবে……

ভুল সত্য পর্ব-০৮

0

ভুল সত্য

দুপুরে কি খাবে তুলি?

টুকটুকি আমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছিল। আমি ওর শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম
যা খাওয়াবেন তাই খাব
মুকুল ড্রাইভ করতে করতেই চকিতে একবার আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল
ওর নাম কি রাখবে?
টুকটুকি
বাহ! খুব সুন্দর নাম। আর ও কোথায় থাকবে? জানো তো মা বিড়াল একেবারেই পছন্দ করে না
আমার ভেতরটা হঠাত করেই কেমন নিভে গেল। এত বছর পর মনে হয়েছিল আমি আবার আমার শৈশবে ফিরে গেছি এখন সবাই আবার ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে? আমার অবস্থা দেখে মুকুল হেসে ফেলল।
– রিল্যাক্স। ও আমদের বারান্দায় থাকবে। শুধু খেয়াল রেখ যেন মায়ের ঘরে না যায়।
– কিচ্ছু চিন্তা করবেন না আমি ওর জন্য একটা হাউজ কিনে নেব। অনলাইনে অর্ডার দিয়ে দেব আজই। ও একটু ও বিরক্ত করবে না কাউকে। প্রমিজ।
– আর ওকে কি খেতে দেবে? ক্যট ফুড ও অর্ডার দিয়ে দিও
– না না। দোকানের এসব খাবার হেলদি না, আমি ওকে বাসার খাবার খাওয়াব
– ওর জন্য কি আলাদা রান্না হবে? তাহলে নাজনীন কে বলে দিও
আমি বুঝতে পারছি না মুকুল কি ইচ্ছে করেই এমন বোকা বোকা কথা বলছে? নাকি আমার সঙ্গে মজা নিচ্ছে? আমি বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বিড়াল নিয়ে আরো অনেকক্ষণ টুকটাক কথা হল। কথা বলতে বলেন কখন যে আমরা শহরতলী ছেড়ে গ্রামের কাচা রাস্তায় উঠেছি টেরই পাইনি। মুকুল কাচা রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে আমাকে নামতে বলল।

আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা কাচা মাটির ঘর ওপরে খড় দেয়া। এমন ঘর আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। আমার ছোট বেলায় আমি নানা বাড়িতে গেলে দেখেছি। নানাবাড়ি শহর ছেড়ে একটু ভিতরে। বাড়ির চারদিকে আম বাগানে, দক্ষিণ কোনে পুকুর ঘাট। তবে সবকিছুতে আধুনিকতার ছোয়া। আমার বরং বেশি ভালো লাগত নানা ভাইয়ের বাসায়। আগেও বলেছি নানা ভাই আমার মায়ের খালা। তার বিয়ে হয়েছিল গ্রামেই। শশুড় বাড়ি আর একটু ভেতরের দিকে। ছোটবেলায় নানাবাড়িতে এলে আমরা ওখানে ও যেতাম। ছোট্ট মাটির ঘর। উঠোন পেরুলে পুকুর ঘাট। নানা বাড়ি এলে আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম কখন ওখানে যাব। নানা ভাইয়ের একটাই মেয়ে সালেহা খালা ও আমাকে খুব ভালোবাসত। সালেহা খালার বিয়ে হয়ে যাবার এক বছরের মাথায় নানাভাই এর স্বামী মারা যায়। একা একা উনি এই অজ পাড়া গায়ে পরে থাকবেন তাই মা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। প্রতি বছর গরমের ছুটিতে আমরা এখানে আসতাম। সালহা খালা ও সেসময় শশুর বাড়ি থেকে বেড়াতে আসত। ভারি মজা হত তখন। আমরা চড়ুইভাতি করতাম, সারা পুকুর দাপিয়ে সাতার কাটতাম।

আমার সাতারের হাতেখড়ি সালেহা খালার হাত ধরে। পরে অবশ্য বাবা আমাকে মহিলা কমপ্লেক্স থেকে সাতার শিখিয়েছে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান বলে তাদের যত অপূর্ন ইচ্ছা সব আমাকে দিয়ে পুরন করতে চেয়েছিলেন। তাই ছোট বেলায় আমি নাচ, গান, ছবি আকা, সাতার সবই শিখেছি। যদিও তারা কেউ কখনো জানতে চায়নি আমার কোনটা ভালো লাগে। একবার অবশ্য বলতে গিয়ে এমন ধাতানি খেয়েছি যে পরবর্তীতে আর সাহস হয়নি। মা চোখ পাকিয়ে বলেছিল
রান্নাবান্না তো শশুর বাইতে গেলে সারা জীবনই করবি। এটা আবার শখ করে শেখার কি আছে।
বাবা বলেছিলেন
তুমি সুযোগ পেয়েছ তো তাই মর্ম বুঝতে পারছ না। তুমি যতটা পাচ্ছ তার জন্য কত ছেলেমেয়ে হাহাকার করে মরে।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন মুলা তাদের কাছে নেই। তাই নিজেই ইউটিউব দেখে বেকিং শিখতাম। নানাভাই মারা যাবার পর ইউটিউব আমার সবচেয়ে বড় সঙ্গি হয়ে উঠেছিল। দেশি কন্টিনেন্টাল চাইনিজ সবই শিখেছিলাম ইউটিউব দেখে। বাবা আমাকে কুকিং ক্লাসে ভরতি না করলেও যখন যা লাগবে এনে দিত। আমার বানানো ব্রাউনি পিজা মুজ কেক খেয়ে প্রয়াংশাও করত খুব। মা অবশ্য বিরক্ত হত। সবচেয়ে বেশি খুশি হত আশরাফ চাচা। আমার রান্নার সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিলেন তিনি। এত প্রশংসা করতেন যে আমি মঝে মাঝে লজ্জাই পেয়ে যেতাম। আমার প্রথম বানানো মুজ কেক খেয়ে বললেন
যে হাতে এই কেক বানানো হয়েছে সেই হাতটাই তো চেটেপুটে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। প্রিন্সেস আরেক পিস পেতে পারি কি?
আমি প্লেটে তুলে দিতে গেলে বললেন
উঁহু খাইয়ে দাও।
এবং খাওয়ানোর সময় সত্যি সত্যিই আমার আংগুল চেটে খেতে লাগলেন। তখন আমার বয়সে এগারো। সেসময় তার অভিপ্রায় বুঝতে পারিনি। বুঝেছিলাম আরো এক বছর পরে।

তুলি ভেতর এস
আমি চমকে তাকালাম। ভাবনায় জাল ছিড়ে বেরিয়ে এলাম। মুকুল আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। আজ কেন জানি ওর হাত ধরাটা খারাপ লাগল না। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম উঠানে বিশাল রান্নার আয়োজন। লাকড়ির চুলার সামনে যিনি বসে আছেন তার বয়স পঞ্চাশের উপর হলেও মুখে কেমনে একটা শিশু সুলভ লাবন্য। কোন এক অদ্ভুত কারনে তার মুখটা ভিষণ চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি।

আমরা কাছে গেলে মুকুল পরিচয় করিয়ে দিল। এবার আমি তাকে চিনতে পারলাম। ওর নাম মরিয়ম বিবি। উনি একজন বিশিষ্ট ইউটিউবার। তার চ্যনেলের ফলোয়ার লক্ষধিক। ভিডিওগুলো বেশ সুন্দর গ্রাম্য পরিবেশে, মাটির হাড়িতে লাকড়ির চুলায় রান্না হয়। কখনো দেশি রান্না করতে হলে আমি তার ভিডিওই দেখি। কিছু দিন আগে তার চ্যানেলে দেখেছিলাম যে প্রতি শুক্রবার এই যায়গাটা ভাড়া নেয়া যায়। মুকুল আমাকে এখানে নিয়ে আসবে ভাবিনি।

মরিয়ম বিবিকে আমার খুব ভালো লাগল। ভিষন আন্তরিক। যদিও আমার উঠানে বসে তার রান্না দেখতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু মুকুল বলল আগে যায়গাটা ঘুরে দেখতে। আমাদের জন্য একটা মাটির ঘরের ব্যবস্থা আছে। আমরা আমাদের ব্যগ পত্র আর টুকটুকিকে সেখানে রেখে চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। যায়গাটা খুব বেশী বড় নয় তবে সব গোছানো আর খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। মাটির ঘরের কোন ঘেষে সিমের গাছ লতিয়ে উঠেছে। বেগুনি ফুল ফুটে আছে। দুই একটা কচি সিম ও উকি দিচ্ছে। বাড়ির পেছনে দুটো কলা গাছ। একটা পেয়ারা আর কোনার দিকে একটা কামরাঙা গাছ ও দেখলাম। তবে আমার সব চাইতে ভালো লাগল পুকুর ঘাট। বাধাই করা ঘাট। একেবারে নির্জন। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুকুল বলল
পানিতে নামবে?
এক্সট্রা ড্রেস আনলে নামতাম
আমি এনেছি তুমি চাইলে নামতে পারো
এবার আমি বুঝলাম মুকুলের এত বড় ব্যগের রহস্য। আমি আর সময় নষ্ট না করে তরতর করে সিড়ি বেয়ে নেমে পানিতে ঝাপিয়ে পরলাম। প্রথমে পানি ঠান্ডা মনে হলেও পুকুরের মাঝ বরাবর আসতে আসতে টের পেলাম নিচের দিকের পানি বেশ উষ্ণ। পুকুরের ঠিক মাঝখানে এসে আমি মাথা তুললাম। পানি একেবারেই অগভীর। আমার গলা পর্যন্ত হবে। আমি স্যামনে তাকিয়ে দেখলাম মুকুল সিঁড়ির শেষ ধাপে দড়িয়ে অপলক চেয়ে আছে। আমি ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বললাম
আপনি ও নামেন
ও কিছু একটা বলল, এতদুর থেকে শোনা গেল না। আমি সাঁতরে আবার ঘাটে ফিরে গেলাম তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম
আসেন, আপনিও নামেন

মুকুল কেমন বিষন্ন চোখে তাকিয়ে রইল। আমার প্রথম একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার পরনের শাড়ি ভেজা, শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। তাকিয়ে দেখলাম মুকুল আমাকে দেখছে না করুণ চোখে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সিড়ির ধাপে উঠে বললাম
কি হয়েছে?
কিছু না, তুমি সাঁতার কাটো
আপনি আসছেন না কেন?
আমি পানিতে নামতে ভয় পাই। ছোটবেলায় একবার ডুবে গিয়েছিলাম তারপর আর কখনো নামিনি
আমি এগিয়ে এসে বললাম
কিছু হবে না, এইটুকু পানিতে আপনি ডুববেন না। আসেন তো
মুকুল আমার সঙ্গে পানিতে নেমে এলো। আমি ওর হাত ধরে মাঝ বরাবর নিয়ে এসে থামলাম। এখানে ওর বুক অবধি পানি।। আমি ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে চারদিকে সাঁতার কাটতে লাগলাম। হঠাৎই মনে হল ও টাল সামলাতে পারছে না। ভারসাম্য হারিয়ে পড়েই যেত আমি দ্রুত এসে ওকে ধরে ফেললাম। ওর মুখের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। পানিতে একবার যার ভয় জন্মায় সেটা থেকে বেরিয়ে আসা এত সহজ নয়। আমি ওর বুকের মধ্যে মাথা রেখে টের পেলাম হৃদস্পন্দন অনেক দ্রুত। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম
ভয় নেই, সব ঠিক আছে। আমি আছি তো
মুকুল যে কাজটা কখনই করেনা আজ সেটাই করল; দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করল আমি তার কি জবাব দেবো বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

চলবে……….