Tuesday, July 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 194



দহন ফুল পর্ব-৭

0

#দহন_ফুল ৭

শাশুড়ীর অসম্ভব রকমের চুপচাপ থাকা আমার মোটেও ভালো ঠ্যাকছে না, মনে হচ্ছে প্রচন্ড ঝড়ের পূর্বাবস্থা। যে মানুষ সারাক্ষণ কুটচাল নিয়ে থাকে সে যখন চুপচাপ থাকে তখন বুঝতে হবে বড় কোনো জট পাকাচ্ছে ভেতরে ভেতরে।
আজ এক দেড়মাস যাবত বাসায় কোনো ক্যাঁচাল হচ্ছে না, আমার খালি হিন্দী সিনেমার ডায়লগ মনে পড়ে, ইধার ইতনি সান্নাটা কিউ হ্যায় ভাই। নিজেই হাসি আবার নিজেকে শাসন করি, মানুষ তো বদলাতেই পারে।

কতটা বদলেছে টের পাওয়া গেলো মাসখানেক পর। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এক ছুটির দিনে বাপি মা এসে হাজির।
আমিতো পুরাই সারপ্রাইজড! ঘরে খাসির মাংশ ভুনা করা ছিলো ভাবী তাড়াতাড়ি ইলিশ মাছ, মুরগী ফ্রিজ থেকে নামিয়ে রান্না করলো। টেবিল ভর্তি করা হলো যৎসামান্য যা আছে তা দিয়ে, আমার কেনো জানি ভেতরে ভেতরে ভয় লাগছিলো, কেউ আবার নালিশ টালিশ করলো না তো? ইদানীং একটু বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছি যার খেসারত দিতে হতে পারে।
দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই বৈকালিক আড্ডায় বসলো। বাপি সামিরকে ডেকে নিয়ে কাছে বসালেন তারপর হাতে একটা চাবির রিং তুলে দিলেন। সামির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বাবা বললেন,
— প্রভার কাছে শুনেছি তোমার একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্র্যান্ডের গাড়ির খুব শখ, এটা আমার তরফ থেকে তোমাকে উপহার।
— না না বাবা, এটা আমি নিতে পারবো না, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন।
— কেনো বাবা, আমার যা আছে সবই তো দিবা আর প্রভার তারমানে তোমাদেরও। নিতে আপত্তি কিসের?
— না বাবা এ হয় না, ওদের সম্পত্তি ওরা যা করার করবে তাতে আমার বা আমাদের নাক গলানো ঠিক হবে না।

শাশুড়ী মা সবার সাথে এই আড্ডায় বসে থেকে সব শুনছেন, একসময় বললেন,
— উনি ভালোবেসে দিচ্ছে নিয়ে নে বাবা।
— মা তুমি এই বিষয়ে কথা বলো না প্লিজ।
শাশুড়ীর মুখ গভীর কালো হয়ে গেলো, আর চোখ ঠিকরে যেনো আগুন বেরুবে। কখনো উনার মুখের উপর কেউ কথা বলেনি, আজ ছেলের সাহস দেখে মাথায় আগুন জ্বললো বোধহয়।
উনি উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

বাপি আবার বললেন,
— সামির তুমি কি বাবা আমার উপর কোনো কারণে রাগ হয়েছো। প্রভা কিছু বলেছে?
— না না বাবা, আসলে আমি চাচ্ছি নিজের যোগ্যতায় এসব জিনিস অর্জন করতে, এ যাবত যা দিয়েছেন তা অনেক।
বাকী সব নিজ যোগ্যতায় অর্জন করতে চাই নিজের আত্মতুষ্টির জন্য।

বাপি উঠে সামিরকে বুকে জড়িয়ে নিলেন,
— বাবা আজ আমি ভীষণ খুশি হলাম, আমার মেয়েটা সঠিক মানুষের হাতেই দিয়েছি।

মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন। আমার আনন্দে চোখে পানি চলে আসলো, সামিরের প্রতি মন ভালো লাগায় ভরে গেলো।

রাতে খেতে বসে শ্বশুর বাবা সামিরকে বললেন,
— আই এম প্রাউড অফ মাই সান। এমনটাই হওয়া উচিত।
সামির খুশিমনে বললো,
— ধন্যবাদ বাবা, দোয়া করো কথা যেনো রাখতে পারি।
— ইনশাআল্লাহ পারবি বাবা।
শাশুড়ী ফোঁড়ন কাটলেন,
— তা বটে, গর্ববোধ করো যত খুশি, এদিকে মাকে যত খুশি অপমান করুক।
সামির বললো,
— মা আমি তোমাকে মোটেও অপমান করিনি, শুধু ব্যাপারটাতে জড়িত হতে মানা করেছি।
— হ্যা দিনদিন সাহস ও বাড়ছে মায়ের মুখের উপরও কথা বলো।

শ্বশুর বাবা বললেন,
— পারুল তোমার ছেলের সেলফ রেসপেক্ট দেখে খুশি হবার বদলে উল্টাপাল্টা কথা বলছো? তুমি আর বদলালে না?

শাশুড়ীর দিকে মাংসের বাটিটা এগিয়ে দিলাম, বেশ খানিকটা তরকারি ও ভাত নিলেন। আয়েশ করে মেখে মুখে লোকমা তুললেন। তারপর বললেন,
— বাদ দাও, আমিতো চিরকালই খারাপ, এখন যে জরুরী কথাটা বলতে যাচ্ছি তা মনোযোগ দিয়ে শোনো সবাই।
— হুমম বলো শুনছি (শ্বশুর বাবা বললেন)
— মজিদের মেয়ে সাবিহার কথা তো মনে আছে তোমাদের।
— হ্যা আছে, সাবিহার কি হয়েছে?
— ওর মাস ছয়েক আগে তালাক হয়ে গেছে, শাশুড়ীটা বড্ড পাজী ছিলো, এতো ভালো একটা মেয়ে খুব জ্বালাতন করতো মেয়েটাকে, শেষ পর্যন্ত সংসারটা আর টেকেনি।
— হুমম, তোমার মতো ভালো বুঝেছি।
— কিছু বললে নাকি?
— না তেমন কিছু না তুমি বলো?
— আমি চিন্তা করেছি?
— কি চিন্তা করেছো?
— চিন্তা করেছি সাবিরের সাথে তার বিয়ে দেবো?
ঘরে হঠাৎ করে যেনো বাজ পড়লো, উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো, কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভাবী আমাকে দু’হাতে খামছে ধরলো। আমি ভাবীর দিকে তাকিয়ে আছি।
— হোয়াট? তোমার মাথা ঠিক আছে? সাবির বিবাহিত একথা কি ভুলে গেছো?
— আমার মাথা ঠিকই আছে.. বিবাহিত একথা ভুলবো কেনো? পাঁচ বছর হতে চললো এখনো সন্তান সন্ততি হয়নি আর হবার আশাও নেই। ও বউ বাঁজা ওর বাচ্চা কাচ্চা হবে না।

সাবির ভাইয়া ক্ষেপে গেলেন,
— মা এমন কথা তুমি বলতে পারলে? আমার জীবন থাকতে আমি এই কাজ করতে পারবো না।
— সাবির!! তুমি আমার মুখের উপর কথা বলছো?
— হ্যা বলছি, তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো?
— কি সীমা ছাড়াচ্ছি? আমি তো বউ ছেড়ে দেবার কথা বলিনি? দুই বিয়ে কি মানুষ করে না?
— আমি এই কাজ কখনোই করবো না।
বলে খাবার ফেলে রেগেমেগে নিজের রুমে চলে গেলেন।

শাশুড়ী নির্বিকার চিত্তে খেতে লাগলেন, শ্বশুর তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন,
— তুমি কি মানুষ? কদিন ঘরে শান্তি বিরাজ করছিলো দেখে ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় বদলে গেছো? কিন্তু কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।
— যত যা খুশি বলো আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না, সাবিহাকে আমি সাবিরের বউ করে ঘরে আনবোই। নাতিপুতির মুখ তো আমারও দেখতে ইচ্ছে করে নাকি?
— অসভ্য মহিলা…. বাপ হয়ে আমাকে বলতে হচ্ছে, মাঝরাতে যখন তোর হাত পায়ে কড়কড়ি মড়মড়ি ব্যথা উঠে বউকে তুলে এনে হাত পা টেপাস। ছেলেকে বউকে সময় কাটাতে না দিলে বাচ্চা কি আকাশ থেকে পড়বে? জন্তু কোথাকার! আমারই ভুল হয়েছে ওইসময় তোকে পিটিয়ে তখন তোর হাত পা লুলা করে দেওয়া উচিত ছিলো। যাতে সারাজীবন বিছানায় পড়ে থাকিস? আর যেনো এমন অলুক্ষুণে কথা এই ঘরে না শুনি, আর যদি শুনি খুব খারাপ হবে বলে রাখলাম।

বলেই ভাতের প্লেট মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, রুমে চলে গেলেন। শাশুড়ী কিছুই হয়নি ভাবে খেতে লাগলেন।
আর ভাবী এদিকে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন।
আমাদের কারো আর রাতে খাওয়া হলো না।
হাসিখুশি আনন্দময় পরিবেশটা গোরস্থানের নীরবতায় পরিণত হলো।

পরদিন খাবার টেবিলে সবাই বসেছে মরা বাড়ির মতো শোকের পরিবেশ, ভাই ভাবী সারারাত ঘুমায়নি তাদের চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভাবীর চোখ দুটো ফুলে টকটকে লাল হয়ে আছে। চুপচাপ সবাই খাবার খাচ্ছে, হঠাৎ শাশুড়ী বললেন?
— কি সিদ্ধান্ত নিলে সাবির?
— কোন বিষয়ে?
— সাবিহাকে বিয়ের ব্যাপারে?
— এই কাজ আমি জীবনেও করবো না।
— তবে শুনে রাখো, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি এটা আমি করেই ছাড়বো।

শ্বশুর বললেন,
— খারাপ মহিলা.. তুই আর ভালো হবি না।
এবার শাশুড়ী রেগে গেলেন,
— কাল থেকে যা খুশি তাই বলছো? আমি অন্যায় কি বলেছি?
— ছেলের সংসারে আগুন লাগাচ্ছিস? আর অন্যায়ের বাকী আছে কি?
— কি আগুন লাগাচ্ছি, আমি কি বউকে ছেড়ে দিতে বলেছি? দুই বিয়ে কি কেউ করে না? তাছাড়া পুরুষ মানুষ দুই বিয়ে করলে কিছু হয় না। দুই বউ একসাথে মিলেমিশে থাকলেই হয়। মেনে নিলেই তো শান্তি।
— যা বলছিস ভেবে বলছিস তো?
— হ্যা ভেবেই বলছি।
সাবির খাবার ফেলে উঠে পড়ে, শাশুড়ী জোর গলায় চিৎকার করে বলেন,
— আমার কথা যদি মেনে নেয়া না হয় তবে আমি আজ থেকে এখন থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করলাম। নিজেকে রুম বন্দি করলাম, যতক্ষণ আমার দাবী মানা না হয় ততক্ষণ আমি খাবোও না, রুম থেকে দরকার হলে আমার লাশ বের হবে।
— তাহলে তুই মর!
সাবির ভাইয়া সামির, শ্বশুর উঠে চলে গেলেন।
হঠাৎ ঠাশ করে কিছু পড়ার শব্দে সবাই দৌড়ে রান্নাঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি মাসুমা ভাবী মাথাঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
শাশুড়ী ফোঁড়ন কাটলেন
— ঢং শুরু হয়েছে বিয়ে আটকানোর জন্য, কোনো কাজ হবে না।
শ্বশুর বললেন,
— জানোয়ার কোথাকার!

চলবে।

#শামীমা_সুমি

দহন ফুল পর্ব-০৬

0

#দহন_ফুল– ৬

আমি বলছি কি?
ওদের দুজনকে কোথাও ঘুরতে পাঠালে কেমন হয় মা প্রভা?

কথাটা প্রথম শ্বশুর বাবাই ওঠালেন , আমিও ভাবলাম, এই কথাটা আমার মাথায় এলো না কেনো?
বললাম
— বেশ হয় বাবা, কিন্তু মা…
— আরে এই শনি বাড়ি নেই বলেই তো বলছি রে মা…. বিগত চার বছরে শুধু গাধার খাটনি খাটিয়েছে,দুজনকে একসাথে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি কখনো।
— কোথাও যায়নি দুজনে?
— গিয়েছিলো বিয়ের প্রথম দিকে একদিন দুরের এক রিসোর্টে একদিন একরাত্রি ছিলো, সে নিয়ে তো চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো।
— তাহলে তো এবারও এমন করার সম্ভাবনা আছে বাবা?
— আরে সেটা দেখা যাবে, একটা কিছু করে ম্যানেজ করে নেবো দুজনে, কি পারবে না?
— জ্বি বাবা বুদ্ধি একটা বের করতেই হবে। চলেন কালই দুজনকে ৬/৭ দিনের জন্য পাঠিয়ে দেই।
— হুমম সেটাই ঠিক হবে সময় তো বেশিদিন হাতে নেই, বড়জোর দশ দিন তারপর শনি এসে ভর করবে এই বাড়িতে।

বাবার কথায় আমি হেসে ফেললাম,
— বাবা মা কি সারাজীবনই এমন ছিলো?
— হুম তা বলতে পারো? আমার মা বোনকে দেখলে বাড়তো এখন বড় বউমাকে পেয়ে বেড়েছে, মানে কথায় আছে না নাপিত দেখলে নখ বড় হওয়া আর কি?
— আপনি কিছু বলেনি না কখনো?
— এই মেয়ে তোমার কি মনে হয় আমি বউ ভেড়ুয়া ( কপট রাগ দেখিয়ে)
— না না বাবা সেভাবে বলতে চাইনি।
— আসলে রে মা সংসারে অশান্তির ভয়ে চুপ থেকে ওর সাহস বাড়িয়ে ফেলেছি। তবে এবার তুমি সাথে আছো, দুজন মিলে জব্দ করবো, পারবো না?
বলেই হা হা হা হা করে শ্বশুর বাবা হেসে ফেললেন।
আমি শ্বশুরের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছি ভেবে হাসিতে যোগ দিলাম।

পরদিন সন্ধ্যার আড্ডায় এই প্রস্তাব রাখতেই সাবির ভাই ও ভাবী সাথে সাথে নাকচ করে দিলো।
— না না বাবা কি বলছো? এটা সম্ভব নয়, মা বাড়িতে নেই। তাছাড়া শুনতে পেলে ঝামেলা হবে ভীষণ।
— আরে নেই বলেই তো যাবি, থাকলে কি আর আমি এই প্রস্তাব রাখতাম।
— না বাবা এটা সম্ভব নয়, তোমার আগের ঘটনা মনে নেই, কি অবস্থা হয়েছিলো। আমি সংসারে অশান্তি চাচ্ছি না।
মাসুমা ভাবী বাবার কাছে এসে বসলো,
— বাবা আপনি আমাদের জন্য চিন্তা করেছেন, তাতেই আমরা খুশি। আপনি আমাদের জন্য সব সময় দোয়া করবেন, আর কিছু চাই না।
— অমত করিস না মা, আমি সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেছি, প্লেনের টিকেট, হোটেল রুম বুকিং, শীপের টিকিট সবকিছু।
— বাবা এটা ঠিক হলো না।

আমি ভাবীর কাছে গিয়ে বসলাম,
— ভাবী কোনো চিন্তা নেই বাবা আর আমি সামলে নেবো।
— না না প্রভা তুমি জানো না কত্তবড় ঝামেলা হবে?
— সে যদি হয় আমি সামলাবো, তাছাড়া উনি আসার আগেই তো আপনারা চলে আসবেন, উনাকে কেউ৷ বলবে না।

অনেক অনুনয় বিনুনয় অভয় দেবার পর ওরা রাজী হলো। পরদিন সকাল ১০টায় ফ্লাইট। রাতে আমি নিজে ভাবীকে নতুন কিছু কুর্তি, ফতুয়া নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্যাকিং করে দিলাম। ভাবীর ডিএকটিভ আইডিটা একটিভ করে হোয়াটসঅ্যাপ অন করে দিয়ে যত ছবি তুলবে আমাকে পাঠাতে বলে দিলাম।
ভাবী মুখে যেতে অপারগতা জানালেও চেহারায় খুশির ছাপ স্পষ্ট ছিলো।

পরদিন সকালে নাস্তা শেষে হাসি খুশি দুজনে বের হলো। সামিরকে অফিসে পাঠিয়ে দিলাম, তারপর শ্বশুর আর বউমা মিলে বসলাম যদি ধরা পড়ে যাই তবে কিভাবে সমাধান করবো তার ফন্দি আটতে। প্রথমে কথা ঠিক হলো, ঘরের কেউ ভুলক্রমে ও তাদের এই আনন্দভ্রমণের কথা মুখে আনবে না। দ্বিতীয়ত যদি ফাঁস হয়েই যায়, সামিরের অফিসের ট্যুর বা এ জাতীয় কিছু একটা বলে দেবো।
তবে সবচেয়ে দুঃখ লাগলো এই ভেবে যে দুজন মানুষ একান্তে নিজের মতো করে সময় কাটাবে, তাতেও অন্যের অনুমতি প্রাধান্য পাচ্ছে, কি অমানবিক।

সারাবাসা খালি খালি লাগছিলো তাই সামিরকে বগলদাবা করে চলে গেলাম দিয়াবাড়ির দিকে, ইচ্ছেমতো ঘুরলাম ফিরলাম। শ্বশুর বাবা রয়ে গেলো বাড়ি পাহারা দেবার জন্য।
ফিরে এসে দেখি বাবারও মন খারাপ তাই উনার সাথে ৬০ এর দশকের পুরনো বাংলা ছবি দেখতে বসে গেলাম। একটা বোলে চানাচুর মুড়ি পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও সরিষা তেল মাখা নিয়ে বসলাম।
বাবার সাথে এতোটা ক্লোজ হতে পারবো আমার ভাবনারও অতীত ছিলো , মজার বিষয় হলো অন্তরঙ্গ কোন সিন আসলে বাবা উঠে এদিকসেদিক হাঁটেন, আবার একটু পর ফিরে আসেন। আমি আর সামির মুখ টিপে হাসতে থাকি।

এদিকে আমি সারাক্ষণ ভয়ে আছি মনির মাকে নিয়ে, উপহার উপটোকণ দিলাম ঘুষ হিসাবে যাতে কোনোভাবেই শাশুড়ী মায়ের কাছে বলে না দেয়। সারাক্ষণ যেহেতু ওকে কাছাকাছি নিয়ে রাখে, যাতে না বলে তাই প্রতিদিন তালিম দিচ্ছি। সেও কিরা কসম খাচ্ছে তিনবেলায় সে নাকি মুখ খুলবে না।

ওদিকে ভাবী বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করছেন আর সমস্ত ছবি আমার কাছে জমা রাখছেন। আমি হলাম গোপন ব্যাংক, যেখানকার তহবিলে সব জমা হচ্ছে । প্রত্যেকটা ছবি এতো সুন্দর বলার মতো নয়। ভাবীর অপরুপ সৌন্দর্যের কারণে আমার এমনিতেই ঈর্ষা হয়, আজ আরো বেশি বেশি হচ্ছে। কুর্তি গাউন ফতুয়ায় ভাবীর অন্যরকম রূপের খোলতাই হচ্ছে।
কক্সবাজার, ইনানী, হিমছড়ি ও সেন্টমার্টিন সব জায়গায় ঘুরেফিরে ঠিক ৭দিনের মাথায় দুজনে ফিরে এলেন। উপহার সামগ্রী আনতে নিষেধ করে দিয়েছিলাম কারণ ওখানে সব কিছু প্রচুর দাম তাই আনেনি। কিছু শুটকি আর বার্মিজ আচার নিয়ে এসেছে, শুটকি রেখেছি ধীরেধীরে খাবার জন্য, কিছু শুটকি মনির মাকেও দিলাম, আর আচারের একটা খোসাও কোথা রাখিনি, সন্দেহ হবার মতো কোনো চিহ্ন নেই ভাই ভাবীর কক্সবাজার যাবার।

ভাই ভাবী ফেরার ঠিক দুদিন পর শাশুড়ী মা ফিরলেন বাবার বাড়ি থেকে ভাতিজার বিয়ে খেয়ে। এসেই সারা বাড়ি একবার টহল দিলেন, কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন না। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে স্বস্তি পেলেন।
রাতে খাবার দাবার শেষে সবাইকে নিয়ে বসলেন, কি কি উপহার পেয়েছেন তা দেখানোর উদ্দেশ্যে। উনি প্রচুর উপহার পেয়েছেন, আর মামা শ্বশুর নাকি দুই ভাগ্নে বউকে ও শাড়ি দিয়েছে, আমার হাতে তুলে দিলেন মোটা পাড়ের টকটকে গোলাপি কাতান শাড়ি। বড় ভাবীকেও হলুদ রঙের একটা একটা কাতান শাড়ি দিলেন।

কিন্তু পরদিন থেকে বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে বারবার স্মরণ করাচ্ছেন, যে বুড়াকালেও তার কতো কদর আছে বাবার বাড়িতে। কারো কারো তো কেউ পোছেও না, দুই পয়সার দামও নাই।
দুইদিন আগে যে গাছটি সতেজ ও তরতাজা ছিলো আজ হঠাৎ করে ঝিমিয়ে যেতে লাগলো। কথার বাণ সবচেয়ে কড়া আঘাত প্রাণ যায় না আবার বেঁচেও থাকতে দিতে চায় না। ভাবী আবার সেই আগের মানুষে পরিণত হতে লাগলেন। যেভাবে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন এখন যেনো প্রতি দমে থমকে যান, যেনো কেউ টুঁটি চেপে ধরে আছে। আমার ভীষণ কষ্ট হতে লাগতে লাগলো কিন্তু আমার কিইবা করার আছে। একজন মানুষ নিজ থেকে উপলব্ধি করতে না পারলে তার ভুলগুলো অন্য মানুষ কতক্ষণ আঙ্গুল তুলে দেখাবে।

ওদিকে আরেক বিপত্তি বাঁধলো, কুকুরের পেটে নাকি ঘি হজম হয় না, মনির মার পেটেও শুটকি হজম হলো না, এত এত উপহার কিরা কসম গোল্লায় গেলো। শাশুড়ী মা অসময়ে চায়ের জন্য রান্নাঘরে এলেন, দুপুরে খাবার জন্য শুটকিভুনা করা হচ্ছিলো , মনির মা মুখ ফসকে বলে ফেলে ,
—বড় ভাবী ভালো শুটকি চেনে, উনার কক্সবাজার থেকে আনার শুটকিগুলো খুব স্বাদ।
আর যায় কই, শাশুড়ী তাকে চেপে ধরলেন, সে বারবার না না বলতে লাগলো, এটাও বললো, ভুল করে ভুল কথা বলে ফেলেছে বাজার থেকে বলতে গিয়ে কক্সবাজার বলেছে। কিন্তু তিনি মানতে নারাজ, মনির মাকে বললেন,
— আল্লার কিরা, তর মায়ের মাথা খাস সত্য বল।
সেই জেরা আর সইতে না পেরে মনির মা বলে দিলো,
— হ খালাম্মা , বড় ভাবী কক্সসোবাজার গেছিলো, হে যাইতে চায় নাই, ছোট ভাবী আর খালু জোর করে পাঠাইছে।

শাশুড়ী মা তেলে বেগুণে জ্বলে বড় ভাবীকে ধরলেন,
— ফকিন্নীর বেটি… আমি বাড়িতে নাই আর পাখনা গজাইয়া গেছে? কতবড় সাহস আমার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে পা দেওয়ার কথা না, আবার কক্সবাজার যায়।
বড় ভাবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
— আমি ইচ্ছে করে যাইনি আম্মা, সবাই জোর করে পাঠাইছে।
— কোন সবাই?

আমি পরিস্থিতি দেখে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম,
— জোর গলায় বললাম, আমি পাঠিয়েছি, আর কেনো পাঠিয়েছি তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন তারপর, যা শাস্তি দেবার দেবেন?
— হ্যা বলো দেখি কি কারণ, যে কারণে তোমাদের কলিজা দশহাত লম্বা হয়ে গেছে।
— আপনার ছেলের অফিস থেকে বেশ কয়েকজন এমপ্লয়িকে সারাবছরের কাজে খুশি হয়ে পাঁচদিনের একটা ফ্যামিলী ট্যুরে যাবার একটা সুযোগ দিয়েছে। অর্ধেক খরচ অফিস দিচ্ছে আর বাকী অর্ধেক এমপ্লয়িরা কিন্তু হঠাৎ আমার মেয়েলি সমস্যা শুরু হয় সাথে পেটব্যথা আর আপনার ছেলের পেটে সমস্যা। কিন্তু আমরা না গেলেও টাকা কেটে নেবে তাই বাবা বললো ভাই ভাবীকে পাঠিয়ে দিতে। আপনিই বলেন এতোগুলো টাকা কি অযথা নষ্ট করবো।
— হুমম বুঝলাম, তবে সত্য মিথ্যে তোমরা জানো। কিন্তু এসব আমাকে বলোনি কেনো?
— আমরা জানি আপনি পরিবারের সবাইকে কত্ত ভালোবাসেন, আপনি আনন্দ করতে গেছেন, এসব বলে আপনাকে অযথা চিন্তায় ফেলতে চাইনি।

শাশুড়ী চুপচাপ সরে গেলেন, আর কিছু বললেন না, এমনকি পরেও এসব নিয়ে আর কোনো কথা বললেন না।

আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে শাশুড়ী এসব বিশ্বাস করেননি, তাই ভেতরে ভেতরে ঝড় ফুসছিলো কিন্তু ঝড় একা আসেনি সাথে সুনামিও নিয়ে এসেছে।
যা বুঝা গেলো মাসখানেক পর।

চলবে

#শামীমা_সুমি

দহন ফুল পর্ব-০৫

0

#দহন_ফুল -৫

আরে ভাবী তুমি উঠে এলে কেনো?
ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি ভাবী রান্নাঘরে গরুর মগজ ভুনছে অন্যচুলায় আলু ভাজা হচ্ছে।
— শুয়ে বসে থেকে বোরিং লাগছে তাই চলে এলাম।
মনির মা রুটি বেলে দিতেই আমি সেকে নিয়ে ডিম ভেজে কোয়ার্টার প্লেটগুলো নিয়ে গিয়ে টেবিল সাজালাম।

সাত দিন রেস্ট নেবার কথা থাকলেও পাঁচদিন পরে রান্নাঘরে এসে জুটলেন মাসুমা ভাবী। আমি যদিও বাঁধা দিলাম অন্যদিকে স্বস্তিও পেলাম, ভোজনরসিক মানুষগুলো কষ্ট আর মেনে নেয়া যাচ্ছিলো না। একদিন লবন কম তো আরেকদিন মুখে দেয়া যায় না, ঝাল খেয়ে নাজেহাল, হলুদের গন্ধ সব মিলিয়ে হযবরল অবস্থা।

আজ ধর্মীয় দিবসের কারণে অফিস বন্ধ সামির বাসায় ছিলো, ভাইয়াও লাঞ্চ টাইমে বাসায় চলে এলো, দুপুরে জম্পেশ রান্না আর খানাপিনা হলো। আজ বহুদিন পর সবাই চেটেপুটে খাবার খেলো। আমি ভাবীর আশেপাশেই থাকলাম সব পারফেক্টভাবে শেখার জন্য। ভাবীর শরীরের দুর্বলতা কাটেনি তাই তার যত্নের প্রয়োজনে কাজের চাপ যেনো না পড়ে তার সর্বাত্মক চেষ্টা ছিলো আমার।

ভাই, ভাবী ১০০টাকা দে,
— ১০০ টাকাই দেয়া লাগবে?
সামিরের কথায় আমি হাসলাম
— হ তোরা না দিলে আমরা খামু কি?
পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে বৃহন্নলাকে দিলো।
চীনাবাদামের খোসা ছাড়িয়ে মুখে দিলাম, সামিরের হাত থেকে আবার বাদাম নিলাম। আমরা রবীন্দ্র সরোবরের অর্ধচন্দ্রাকার মঞ্চের বেদিতে বসে আছি।

দুপুরে হালকা ভাত ঘুম শেষে সামির তার বাহুডোর আলগা করে বললো,
— প্রভা চলো কোথাও ঘুরে আসি।
আমি চোখ পিটপিট করে আশ্চর্য হয়ে তাকালাম,
— তুমি বলছো?
— হ্যা, অনেক দিন হয়ে যাচ্ছে একসাথে ঘুরতে বের হই না, অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি।
— হুমম মনে আছে তাহলে রোবট সামির! ওকে চলো।
আমি একটা আকাশী জমিনে হলুদ কাঠগোলাপ হ্যান্ড পেইন্ট শাড়ি পড়লাম, সামির পড়লো একটা আকাশী পাঞ্জাবি।
বাসা থেকে বের হয়ে দুজনের হাঁটা ধরলাম, লেকের পকেট গেইটের কাছে আসতেই, একটা বাচ্চা মেয়ে বেলীফুলের মালা নিয়ে আসলো,
— আপা মালা নেন না, আপনারে সুন্দর লাগবো।
— আচ্ছা… তাই নাকি? কি নাম তোর?
— ময়না,
— মা কই তোর, বাবা কি করে?
— ওইযে মা… মালা বানায় আর আমি বেঁচি, বাপ বাস এক্সিডেন্ট কইরা মইরা গেছে।
দেখলাম গেইটের ভেতরের মাঠে ঘাসে বসে একজন নারী মালা বানাচ্ছে,
লাল চুল আর ধুসর চোখের দুইঝুটি বাঁধা টুকটুকে মেয়েটি খুব সুন্দর, অথচ যদি ধনীর সন্তান হতো, ফুলের বিছানায় থাকতো।
সামির মালা কিনে আমাকে পরিয়ে দিলো। আমি ওর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলাম
সামিরের এই খোলতাই রূপ আমার ভালোই লাগছে।

একটা কথা শোনো সামির..
— হুমম বলো
— নামাজ পড়লে, সেজদায় গেলে মানুষের মন নরম হয় শুনেছি, এখন বাস্তব প্রমান পাচ্ছি।
সামির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, যেমন?
— আমার খুব অনুশোচনা হয়, জানো তো? আমি ভাবীকে আন্ডার এস্টিমেট করতাম, শুধু মাত্র একটু কাজ করা থেকে বাঁচতে। আর আমার শাশুড়ি মা তাতে ঘি ঢালতো।
— আর এখন?
— এখন মনে হয় কাজগুলো ঠিক হয়নি? এখানে তোমার ভুমিকা কম ছিলো না।
— আমিইই…আমি আবার কি করলাম?
— তুমি তো কখনো আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দাওনি।
— দেখো তুমি যে পরিবার থেকে পরিবেশ থেকে এসেছো, তোমাকে কিছু বললে যদি রেগে যাও তাই আর কি…।
— একটা কথা সত্যি করে বলো তো? তুমি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসো? নাকি আমার স্ট্যাটাস দেখে আমাকে বিয়ে করেছো?

সামির থতমত খেয়ে গেলো, একদম চুপ হয়ে রইলো অনেকক্ষণ। আমি আবার বললাম,
— কি হলো উত্তর দাও…
— ইয়ে মানে…
— সত্যটা বলো, আমার সত্য জানার দরকার? আমি আমার মায়ের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ?
— আসলে তোমাকে আমি প্রথম যখন দেখি তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। জানো তো আমি প্র‍্যাকটিকাল মানুষ রোমান্টিকতা বুঝতাম কম। যখন দেখলাম দামী গাড়ী বাড়ির মালিক,বর্ণাঢ্য বাবার সন্তান, ফ্যামিলি স্ট্যাটাস সব মিলিয়ে টু মাচ বেটার। আর তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব দিতে উনি রাজী হয়ে গেলেন, আর না চাইতেই বিয়েতে অনেক কিছু দিলেন। আরো দেবেন ভবিষ্যতে।

আমার ভেতরে শূল বিদ্ধ হলো, চোখের কোল ভিজে উঠলো। মায়ের কথাই তো পুরোপুরি সত্য, আমার একার একক মূল্যায়ন হয়নি। ফ্যামিলি স্ট্যাটাস, বাবার সামাজিক অবস্থান প্রতিপত্তি, সুন্দরী শিক্ষিতা সব মিলিয়ে আমি। এসব বাদ দিলে আমিতো কিছু নয় এ বিগ জিরো। আর ভাবী! শুধু ভাবীকে ভালোবেসে সমাজ ব্যবস্থাকে তুড়ি মেরেছে ভাইয়া। সংসারে শাশুড়ীর কাছে অবহেলিত হয়েও ভাইয়ার মাথার তাজ হয়ে আছে সে।

আমার চোখে পানি দেখে, সামির আমার হাত দুটো মুঠোতে নিলো,
— প্রভা… কিন্তু এখন আমি তোমাকে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, তুমি চাইলে আমি সব ত্যাগ করতে পারবো। তুমি যখন বললে ভাইয়ার মতো ভালোবাসতে হবে। আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম, একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম৷ ভাবতাম ভাইয়ার মতো ভালোবাসা! মানে কি? কিন্তু দিনেদিনে উপলব্ধি করেছি… সমক্যকে পেতে হলে সমস্তকে বিসর্জন দিতে হবে। আমি তেমন হয়ে উঠতে চাই, প্লিজ প্রভা আমাকে সাহায্য করো তোমার মনের মতো হয়ে উঠতে। পারবে না?
আমি চোখ মুছে ওর কাঁধে মাথা রাখলাম,
— পারবো সামির.. পারতে আমাকে হবেই।

রাতে খাবার টেবিলটা সংসদের মতো, যত রকম আর্জি দাবী দাওয়া উত্থাপন হয়। রাতে সবাই অল্পস্বল্প খারাপ খায় তবে আজ টেবিলে নতুন তরকারি রান্না করা হয়েছে । শাশুড়ী মায়ের দুর সম্পর্কের ভাগ্নে এসেছে তাকে নিয়ে যেতে, উপলক্ষ মামা শ্বশুরের ছেলের বিয়ে।
খাবার টেবিলেই শাশুড়ী আর্জিটা রাখলেন,
— দেখো সাবিরের বাপ, তোমার কথা তো কখনো অমান্য করিনি। আমি মজিদের ছেলের বিয়েতে যেতে চাই, তুমি কি বলো?
(আমি ভাবী একে অন্যের দিয়ে চেয়ে মুখটিপে হাসছি)
শ্বশুর গলাখাকারী দিয়ে বেশকিছু সময় পরে বললেন।
— সে কথা আর বলতে, তোমার মতো বাধ্যগত স্ত্রী কজনার আছে, আমার সাত জনমের ভাগ্য তোমার মতো স্ত্রী পেয়েছি। তা যেতে যখন চাচ্ছো যাও।
— টিপ্পনী কাটছো নাকি?
— না না, সে সাহস কি আমার আছে? ঘাড়ে আমার মাথা একটাই, তা কতদিন থাকবে?

রান চিবুতে চিবুতে ভাগ্নে সফিক বললো,
— খালাকে ১০/১২দিন রেখে দেবো। খালু আপনারা কবে আসবেন?
— আমরা আর যাবো না, তোমার খালা যাচ্ছে মানে আমাদের সবার যাওয়া হচ্ছে। কখন যাবে তোমরা?
— আগামীকাল সকালেই যাবো টিকেট কেটে নিয়ে এসেছি। চিন্তা করবেন না আমি নিজেই এসে খালাকে দিয়ে যাবো।
— না না চিন্তা কিসের? বাবার বাড়ি যাচ্ছে সেখানে তো ভালোই থাকবে। ফি আমানিল্লাহ, ভালোয় ভালোয় যাও।

পরদিন খুব সকালে অল্পস্বল্প নাস্তা খেয়ে শাশুড়ী মা যাত্রা করলেন ভাইয়ের বাড়ি।
একটা জিনিস খেয়াল করলাম, শাশুড়ী মা বাড়ি থেকে বের হতে না হতেই ভাবী উচ্ছল হরিণীর মতো হয়ে গেলেন। কথায় কথায় হাসছেন, সব কাজ কর্ম যেনো উড়ে উড়ে করছেন। শ্বশুর বাবাকে দেখলাম মজার মজার ঠাট্টা করছেন আমাদের সাথে, আর ভাবী হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। আমি ভাবীর এই রূপ আজ দেখলাম, এমন করে হাসতে আমি এই দুইবছরে দেখিনি।
আমি খুব ভালো লাগছিলো আবার অস্বস্তিও হচ্ছিলো, তাহলে কি শাশুড়ী মায়ের চোখ রাঙানীর ভয়ে ভাবী এমন মুষড়ে থাকেন। একজন মানুষের ভালো থাকা মন্দ থাকা যখন অন্য মানুষের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করে তখন সত্যিই জীবন দুর্বিষহ লাগে।

বিকেলে কুচো সালাদ মাখিয়ে চানাচুর মুড়ি মাখা একসাথে একই বোলে করে সবাই হাতাহাতি করে খেতে দারুণ লাগলো। অথচ অন্য সময় কত দামী নাস্তা খাই কিন্তু এতো পরিতৃপ্তি পাই না।

রাতে সবার খাওয়া শেষে আমি আর ভাবী ছাদে পাটি বিছালাম গল্প করবো বলে। ঝিরিঝিরি বাতাস আর আকাশে থালার মতো চাঁদ মায়াবী জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীতে। ভাবী আজ নিজেকে মেলে ধরেছে তার ছেলে বেলার কথা বলছে, আরো ককক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাবার খুব শখ তার, আর কি কি অপুর্ণ ইচ্ছে আছে নিজ থেকে অনর্গল বলে যাচ্ছে আর আমি শুনছি মনোযোগী শ্রোতা হয়ে।
পেছনে সাড়া পেলাম কেউ আসার, চেয়ে দেখি সাবির ভাই, আমার লজ্জা লাগাতে উঠে যেতে চাইলাম। ভাই ভাবী বাঁধা দিলেন। হঠাৎ ভাবী গুণগুণ করে গেয়ে উঠলেন, চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে…। আমি মুগ্ধ হয়ে খেয়াল করলাম চমৎকার গানের গলা ভাবীর।
সাবির ভাই কিছুক্ষণ ইতস্তত করে আমাকে বললেন।
— সামির গাধাটা কি করছে একা একা।
আমি হেসে বললাম,
— ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে?
— কাজ পরে হবে ডাকো ওকে। এমন সময় ও পরিবেশ সব সময় পাওয়া যায় না।

ভাইয়ার কথামতো সামির কল করে ছাদে ডাকলাম। কল কাটতেই সাবির ভাইয়া বললেন,
— প্রভা… তুমি যদি কিছু মনে না করো তবে কিছু কথা বলতে চাই।
আমি বললাম,
— না না ভাইয়া, কিছু মনে করবো কেনো?আপনি বলুন?
— প্রথমে তোমাকে ধন্যবাদ, ওইদিন যদি তুমি নিনুকে খেয়াল না করতে সেবা না করতে যেকোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। ও ঘরে মরে পড়ে থাকলেও মায়ের কিছু আসতো যেতো না।
— ধন্যবাদ দিতে হবে না ভাইয়া, আমার কিছু হলে তো ভাবীও এমনটা করতো।
— হ্যা তা ঠিক তবে একটা অনুরোধ, নিনুকে খেয়াল রেখো, আমি তো ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি আমি ছাড়া ওর এই দুনিয়ায় কেউ নেই। ওকে আমি খুব ভালোবাসি, ওর ভালো থাকার চিন্তায় থাকি, যদি কোনো ভাবে নিনু একটু ভালো থাকে আমি স্বর্গীয় সুখ পাই। ওর পাশে থেকো প্লিজ।
— জ্বি ভাইয়া রাখবো।

সামির নিচ থেকে এসে আমাদের পাশে বসলো, ভাইয়া আবার বলা শুরু করলেন।
— নিনুকে মা কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, ফকিন্নির বাচ্চা, ছোটলোক আরও কিসব বলে। আমি সবই শুনি বুঝি কিন্তু কিছু বলতে পারি না।
— ভাইয়া আমার মনে হয় আপনার প্রতিবাদ করা উচিত।
— না আমি মায়ের সাথে বেয়াদবি করতে পারবো না। নিনু আর কিছুদিন কষ্ট করুক সব সহ্য করুক, তারপর আমি নিনুকে আর এখানে রাখবো না।
— মানে এই কি বলছো তুমি? এখানে রাখবে না মানে কোথায় রাখবে? (ভাবী আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো)
–সেটা সময় হলেই দেখবে। আচ্ছা যা বলছিলাম প্রভা শোনো, নিনু যখন একা একা সংসার সামলাতো আমার খুব কষ্ট হতো। রাত ১টা ২টার আগে বিছানায় যেতে পারতো না, আবার ভোরে উঠে যেতে হতো। আমি কিছুই করতে পারতাম না, তখন তোমার প্রতি আমার রাগ হতো, মেয়েটা কি একটু সাহায্য করতে পারে না। ও যদি সাহায্য করতো তবে তো আমার নিনুর কষ্ট কম হতো।

আমার খুব লজ্জা লাগতে লাগলো, ভাবীকে দেখলাম কাঁদছে। আমি বললাম,
— আমাকে মাফ করে দেবেন ভাইয়া,আসলে আমি কখনো কাজকর্ম করে অভ্যস্ত ছিলাম না। তার মধ্যে যদি কেউ অনুপ্রাণিত করতো তা হলে হয়তো ভাবীর সমব্যথী হতাম, সামিরও না আমার শাশুড়ী মা তো উল্টো বাঁধা দিতেন।
— না না ক্ষমা চেয়ো না প্লিজ। তুমি আমার ছোট বোনের মতো। আসলে কি জানো নিনু কোনো অশিক্ষিত বা হাভাতে ঘরের মেয়ে নয়, ওর বাবা একজন প্রকৌশলী ছিলেন রোডস এন্ড হাইওয়েতে, এক দুর্ঘটনায় বাবা ও অন্তসত্ত্বা মা মারা যায়। সুযোগ বুঝে যত সহায় সম্পত্তি আত্মীয় স্বজনেরা দখলে নেয়। শুধু অফিশিয়াল টাকা পয়সাগুলো নিতে পারেনি কারণ নিনু আর ওর মা সব জায়গায় নমিনী। ওর মামা ওকে বুকে তুলে নিলেন মানুষ করলেন , এই টাকায় নিনুর যাবতীয় খরচ ও পড়ালেখা সব হতো, আর এখনো ওখান এককালীন কিছু টাকা আছে যার লাভাংশ তিনমাস অন্তর আমি ওকে তুলে এনে দেই।
— চাচা ফুফু এরা কেউ খবর নিতো না।
— নিতো মাঝেমধ্যে, অফিসের টাকাগুলো কিভাবে খরচ হচ্ছে জানতে আসতো। তবে মাস ছয়েক আগে একটা মিরাকল হলো?
— কি?
— নিনুর মামা মৃত্যুশয্যায় আমাকে ডাকলেন, তার উদ্দেশ্য সৎ ছিলো কিনা নাকি পরকালের ভয় জানিনা। আমাকে ডেকে নিয়ে একটা দলিল হাতে দিয়ে বললেন,
— বাবা এটা মাসুমার আমানত, এর দায়িত্ব এখন তুমি নাও।
— এটা কিসের মামা আমি বুঝলাম না?
— এটা মাসুমার বাবা মৃত্যুর একবছর আগে আমার বোনের ও মাসুমার নামে কিনেছিলো। আমার বোন আমার কাছে দলিলটা রাখতে দিয়েছিলো। এখন এটা তুমি কি করবে করো। আমি মরে গেলে হয়তো আমার ছেলেরা লোভী হয়ে উঠতে পারে।

মামার কথায় আমি দলিল খুলে সব পড়ে দেখলাম সাভারের কাছে এক বিশাল কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির কাছে প্রায় ৪০ শতাংশ জমি তখন জমিগুলো খুব সস্তা ছিলো । পাশ দিয়ে অনেক বড় রাস্তা গিয়েছে, আশেপাশের মিল ফ্যাক্টরি হয়েছে তাই ওখানকার জমি এখন প্রচুর দাম, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না সবকিছু।
একেক কাঠা জায়গার দাম কম করে হলেও ৭০/৮০লাখ করে হবে। বেশ অনেকদিন যাবত দেখছো আমি অনেক রাত করে বাড়ি ফিরি। সেটা এই জমির সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করার জন্য দৌড়াদৌড়িতে যাচ্ছে।

আমিতো আশ্চর্য হয়েছিই ভাবীর তো আকাশ থেকে পড়ার পালা।
— কি বলো সাবির?
— হ্যা নিনু.. ভেবেছি সব কমপ্লিট করে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো। কিন্তু আজ কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেললাম। কিন্তু তোমাদের সবার কাছে অনুরোধ, মা যেনো ঘুনাক্ষরেও না জানো।

সামির ত্রস্ত্র হয়ে বললো,
— কেনো ভাইয়া? তাহলে তো অন্তত ভাবীকে আর জ্বালাতন করবে না।
সাবির ভাইয়া সামিরের কাঁধে হাত রাখলেন।
— না রে ভাই, মন থেকে ভালোবাসতে না পারলে, সম্পদ দেখে যে ভালোবাসে সে ভালোবাসা আমি চাই না। আমি চাই মা মন থেকে নিনুকে ভালোবাসুক।

সাবির ভাইয়ার আবেগ অনুভূতির ডালপালার বিস্তার আজ দেখলাম, আরো দেখলাম তাদের ভালোবাসার বিস্তৃতি। একের ভাবনায় অন্যের বিহবলতা।৷ সারারাত একটা কথাই ভাবলাম, প্রকৃত ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়।

#শামীমা_সুমি

দহন ফুল পর্ব-০৪

0

#দহন_ফুল– ৪

এলার্ম বাজার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেলো, ঘড়িতে ৫টা ১০বাজে গতরাতে গুগল থেকে সব নামাজের নিয়ম কানুন জেনে নিয়েছি। অনেক আগে পড়েছি দাদীর সাথে মায়ের সাথে অনেক ছোটখাটো ব্যাপার ভুলে গেছি। তবে অনেকদিন পর নামাজ পড়ছি কেমন যেনো জড়তা আর নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। অজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ শুরু করলাম।

গতরাতে আম্মু ফোন করে খুব খুশি প্রকাশ করলো, — আমি খুব খুশি হয়েছি প্রভা তোমার পরিবর্তন দেখে। এইযে নিজেকে নিজেকে বদলে নিয়েছো এটা শুধু তোমার জন্য নয়, তোমার ভবিষ্যত সন্তানদের জন্যও ভালো। কি হবে একটু গা বাঁচিয়ে থেকে তাতে তোমারই ক্ষতি, কাজ করলে শরীর পঁচে যায় না, বরং ভালো থাকে। আর কার সাথে কিভাবে কথা বলা উচিত কি উচিত নয়, আরো কত কত যে কথা বললো ।
আম্মুর খুশি দেখে নিজেরও ভালো লাগছে।

শুদ্ধ অশুদ্ধের শংকা নিয়ে নামাজ শেষ করে দেখি, সামির বসে অদ্ভুতভাবে দেখছে আমাকে।
— কি ব্যাপার হঠাৎ এতো পরহেজগার হয়ে গেলে?
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে , বললাম
— কি বলতে চাও?
— না মানে, হঠাৎ এতো পরিবর্তন, কাজ করছো, নামাজ পড়ছো।
— হ্যা মানুষ নিজেকে বদলাতে পারে না?
— হ্যা তাতো পারেই, তবে ভালো লাগছে।
বিছানা থেকে নেমে গাঁ ঘেষতে চাইলো, বললাম খবরদার শর্ত ভুলে যেও না।
— কোন শর্ত?
— যেটা দুদিন আগে বলেছি।
— উফফ কি যন্ত্রণা!
হঠাৎ দুহাতে কলার টেনে ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললাম — তুমিও নামাজ পড়ে নাও, পারো তো নাকি?
— পারবো না কেনো? আমি মাঝেমধ্যে নামাজ পড়ি।
— ঠিক আছে, তবে আমি নামাজ পড়ছি একথা সবার কাছে ঢোল পিটাতে হবে না। জানলে তোমার খবর আছে?
— জানলে কি হয়েছে?
— ভালো ভাবে শিখে নেই, তারপর সবাই জানবে।
— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। শোনো শর্তটা সিথিল করা যায় না?
— নাহ… যায় না।
— ডিজগাস্টিং….
বিরস মুখে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

রুম থেকে বের হয়ে দেখি শাশুড়ী মগভর্তি ইসবগুলের শরবত খাচ্ছেন। আমাকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন,
— প্রভা এত সকালে উঠলে যে?
— রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছি, তাই ঘুম ভেঙে গেলো মা। ভাবলাম রান্নাঘরে যাই দেখি কি হচ্ছে আজকের আয়োজন।
— ওদিকে যাওয়া লাগবে না, আমার কাছে এসে বসো। ওদিকটা ওই হাভাতের মেয়ে আর মনির মা সামলে নেবে। এমনিতেও আজকাল ওর পিছু রান্নাঘরে ঘুরাঘুরি করছো।

অন্য সময় এসব কথা শুনতে ভালো লাগতো, কিন্তু আজ ভালো লাগছে না, একটা মানুষের জন্য অন্য মানুষের মনে এতো বিষ কি করে পুষে রাখে। আমার কথাগুলো বিরক্ত লাগলো তবুও একে তো চটানো যাবে না, গতকাল মা একটা কথা বলেছিলো, যে বাঘকে ঠান্ডা রাখতে জানলে বাঘের লেজ দিয়ে কানও চুলকানো যায়। আমিও পাশে গিয়ে বসলাম তেলতেলে হয়ে বললাম।
— আপনি কি ভেবেছেন মা? আমি ভাবীর সাহায্য হবে ভেবে এসব করি? মোটেও না ভাবীর সাহায্য হোক বা না হোক আমার তাতে কি? আমি আসলে শেখার জন্য করি, আপনার সন্তানরা যেমন আপনার রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ আমার সন্তানরাও যেনো আমাকে নিয়ে এমন করে তার জন্য শিখি।
কতটুকু আটাতে কতটুকু পানি, কিভাবে মথতে হয়, কিভাবে রুটি গোলও হবে আবার বেলনের নীচে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরবে, আরও নানা পদের রান্না কোনটা কিভাবে করতে হয় সব কিছু শিখতে চাই।
— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে শিখো তবে, ফকিন্নীর বেটিকে বেশি মাথায় তুলো না। ছোটলোক তো মানসম্মান বোঝে কম।
মনে মনে বললাম.. তুমি যে কত বড় মনের তা তো তোমার আচরণেই বুঝা যাচ্ছে।
মুখে বললাম — জ্বি আম্মা স্মরণ রাখবো।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম মনির মা পেঁয়াজ, আলু কুচি করছে আর ভাবী সেদ্ধ আটা মথে নিচ্ছে, আমাকে দেখে স্মিত হাসলেন আমিও হাসলাম,
— ভাবী আজ মেন্যুতে কি হচ্ছে সকালের আয়োজন?
— ওইতো রুটি, সুজির হালুয়া, আলুর ঝুড়ি ভাজা আর মাংসের শুটকি ভুনা।
— মাংসের শুটকি! সে আবার কি জিনিস?
— সেটা খুব কঠিন নয়, চট্টগ্রামের মাংসের কোয়াবের মতোই রেসিপিটা শুধু লবন দিয়ে অল্প তেলে ভেজে ফ্রিজের নরমালে সংরক্ষণ করা হয়, আর গ্রাম দেশে লবন দিয়ে সিদ্ধ করে চিকন তারে ঝুলিয়ে রোদে শুকিয়ে রাখে। তারপর যেদিন খেতে ইচ্ছে হবে ফুটন্ত গরম পানিতে ২/৩ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে শিলপাটায় ছেঁচে নিয়ে পেঁয়াজ কুচি আর যত রকম মাংসের মশলা আছে তা দিয়ে ভুনতে হয়। রুটি পরোটা গরম ভাত যেভাবে ইচ্ছে খাওয়া যায়।
— বাহ! বেশ তো! আজ একটা নতুন রেসিপি ট্রাই করা হবে।
— আচ্ছা ট্রাই করো।

ভাবী রুটি বানাচ্ছে আমি দাঁড়িয়ে না থেকে ভাবীর ডিরেকশন নিয়ে রুটি সেকে হটপটে রাখছি।
সব খাবার টেবিলে নিয়ে রাখলাম, সবাই এসে খুশিমনে নাস্তা খাচ্ছে রেসিপি আমার জন্য নতুন হলেও দেখলাম এই টেবিলে এটা পুরাতন খাবার। বেশ প্রশংসা হচ্ছিলো মাংসের শুটকি ভুনার, শাশুড়ী নাক সিঁটকে পছন্দ করি না বলে বলে সবার চেয়ে বেশিই খেলেন।
জগতে কিছু মানুষ সত্যিই অদ্ভুত থাকে, এদের কোনোভাবেই খুশি করা যায় না।

নাস্তা শেষে সবাই যার যার কর্মস্থলে যাচ্ছে, আমি ভাবীর সাথে রান্নাঘর গোছাচ্ছি, সামির জোরেজোরে নাম ধরে ডাকছে, ভাবী ঠেলে রুমে পাঠালেন।
— কি ব্যাপার ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছ কেনো?
— দেখতো টাই বাঁধাটা ঠিক হচ্ছে কিনা?
— এটা দেখানোর জন্য এভাবে ডাকছো?
— আরে না না, ওইযে বললে ভাইয়ার মতো ভালোবাসতে পারলে কাছে আসতে দেবে। কিভাবে ভাইয়া ভালোবাসে আমি তো জানিনা…. একটু বলে দেবে? আর ভাল্লাগছে না আমার।

আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
— উহু তা হবে না… চোখ কান খোলা রাখো তাহলেই তো দেখতে পাবে।
এবার একটু রেগে গেলো,
— আমি তোমাকে কত্ত সময় দেই, ভাবী তো ভোর থেকে সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ভাইয়া সকালে বেরিয়ে ফেরে অনেক রাতে, ভাবীকে কোথাও ঘুরতেও নিয়ে যায় না। বুঝিনা ভাইয়া অন্যরকম ভাবে ভাবে ভালোবাসে কখন?
বিরক্ত মুখ নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো। আমি হেসে কুটিকুটি হচ্ছি.. বেচারা ভালো বিড়ম্বনায় পড়েছে, খুব জব্দ হচ্ছে।
মানুষ অভ্যাসের দাস আর নিজেকে দুদিনের ভেতর সে অভ্যাস থেকে বের করে আনা কষ্টের। টিভি অন করে একটা মুভি দেখতে দেখতে কখন যেনো ঘুমিয়ে গেছি জানিনা। ঘুম ভেঙে দেখি বারোটা বেজে গেছে। দ্রুত বের হয়ে গিয়ে দেখি ভাবী ঘেমে নেয়ে একার হাতে সব সামলাচ্ছেন, কাটাকুটি আর রান্নাবান্না করছে। তার চোখগুলো অস্বাভাবিক লাল হতে পারে মশলার ঝাঁঝ হতে পারে কেঁদেছেন বা অসুস্থতা হালকা কাশছেন নাক টানছেন একটু একটু আর মনির মা আশেপাশে কোথাও নেই। নিজের কাছে অনুশোচনা হচ্ছে, বললাম
— ভাবী আমায় ডাকেননি কেনো? আর মনির মা কই?
— মনির মাকে মা ডেকে নিয়ে গেছে ঘন্টা দুয়েক হবে।
মাছ, মাংস ধুলে হাতে গন্ধ লাগে তাই এসব কখনো করিনি তবুও যতটা সম্ভব ধুয়ে আর এটা সেটা এগিয়ে দিলাম। মনির মার খোঁজে বের হলাম, গিয়ে দেখি শাশুড়ী মনির মাকে নিয়ে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখছেন, মনির মা উনার হাত পা টিপে দিচ্ছে।

আমার শরীরের রক্ত সব রাগে মাথায় উঠে যাচ্ছি, কি থেকে কি বলে ফেলবো, হঠাৎ মায়ের বাঘের লেজের কথা মনে পড়ে গেলো। গলা যথেষ্ট নরম করে বললাম,
— মনির মা তুমি আম্মার এতবড় ক্ষতি কেনো করছো?
মনির মা থতমত খেয়ে বললো,
— আমি আবার কি করলাম ছোটভাবী?
— তুমি তো এভাবে হাত পা টিপে আম্মার হাড় ক্ষয় করে ফেলছো? বেশি হাত পা টেপালে মারাত্মকভাবে হাড় ক্ষয় হয়ে যায়! আম্মার কি এমন বয়স হয়েছে?
শাশুড়ী মনির মার হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
— কি বলছো বউ মা, একথা কোথায় পেলে?
— আম্মা আমি পেয়েছি, বিশ্বাস না হলে গুগুলে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন।
শাশুড়ী চিন্তিত মুখে বসে রইলেন। মনির মাকে বললেন তুই রান্নাঘরের কাজে যা।

আমি ওখান থেকে সরে আসতে আসতে মনেমনে বললাম আসলে এই ব্যাপারে আমি কিছু পাইনি হুদাই গুল মেরে আসলাম, উনি কি আর গুগল সার্চ দিয়ে খুঁজতে যাবেন।

দুপুরের ভাত ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার দিকে তাড়াতাড়ি উঠে নামাজ সারলাম। প্রবল পানি তৃষ্ণা পেলো কিন্তু বোতল খালি তাই বোতল হাতে ডাইনিংয়ে এসে দেখি শাশুড়ী বিড়বিড় করে বকাবকি করছেন? আমি সামনে আসতেই বললেন,– বুড়া মানুষ অকাজের এককাজ করো আমাদের মেরে ফেলো?
আগামাথা কিছু খুঁজে পাচ্ছি না, তাই জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে আম্মা খুলে বলেন?
— কি আর হবে সবই আমার কপাল, আমার কথা কি কোনো দাম আছে? বড় বউকে বলেছিলাম বিকেলে ফুল কপির বড়া বানাতে। সন্ধ্যা হতে চললো কিন্তু সেটা না করে নবাবের বেটি ঘুমিয়ে আছে।
— ঘুমিয়ে আছে? আচ্ছা আমি দেখছি?

ভাবীর রুমে সচরাচর যাওয়া হয় না আমার।আজ রুমে ঢুকতেই দেখলাম, সত্যিই ভাবী বেঘোরে শুয়ে আছে, যেটা ভাবী পারতপক্ষে করে না। কয়েকবার ডাকলাম কিন্তু সারা নেই, কাছে গিয়ে গায়ে হাত রাখতেই মনে হলো গরম তাওয়ায় হাত রাখলাম। আমি তড়াক করে সোজা হয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি ভাবীর ফোন থেকে ভাইয়াকে কল দিয়ে বিস্তারিত বললাম, ভাইয়া আমি এক্ষুনি ডাক্তার নিয়ে আসছি বলে ফোন রাখলেন।

মাকে দেখেছি অতিরিক্ত জ্বরের সময় মাথায় পানি ঢালতে তাৎক্ষণিক ভাবে তাই করার প্রস্তুতি নিলাম।
দৌড়ে রান্না ঘরে গেলাম, ময়লা ফেলার বড় পলিথিন কেটে বড় করে নিয়ে যাচ্ছি, শাশুড়ী প্রশ্ন করলেন
— পলিথিন নিয়ে কই যাও
— ভাবীর খুব জ্বর মা সেন্সলেস হয়ে গেছে।
— কিচ্ছু হয়নি, সব ঢং কাজ থেকে বাঁচার বাহানা।
প্রচন্ড রাগ উঠে গেলো, তবু্ও নিজেকে কন্ট্রোল করলাম, বললাম।
— মরেটরে গেলে কেলেংকারী হবে মা।
শাশুড়ীর মুখ পাংশুটে হয়ে গেলো, বললেন
— দাঁড়িয়ে আছো কেনো যাও সেবা করো গিয়ে।

ভাবী হুশ নেই কোনো রকমে টেনে এনে, মাথার নিচে পলিথিন দিয়ে অনবরত পানি ঢালতে লাগলাম, কী মনে করে কে জানে? শাশুড়ী রুমে এলেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন। অনবরত পানি ঢালতে ঢালতে একসময় দেখলাম ভাবীর ঠোঁটদুটো নড়ছে।
ভাইয়া ডাক্তার নিয়ে বাসায় এলেন, ভাবীর মাথা মুছে দিয়ে বালিশে তুলে দিলাম। ডাক্তার চেক আপ করলেন,
— কখন থেকে জ্বর কেউ জানেন?
আমি বললাম
–সেটা তো জানিনা, তবে সকাল থেকেই দেখছি চেহারায় অসুস্থতার ছাপ। কাউকে তো কিছু বলেনি।
— ওকে ভয় পাবেন না, প্রচন্ড জ্বর থেকে শকে চলে গিয়েছিলেন, মাথায় পানি দেওয়াটা বুদ্ধির কাজ হয়েছে। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, একসপ্তাহ পড়ে জ্বর ভালো না হলে এই টেস্টগুলো করাবেন, আপাতত এই ওষুধগুলো চলবে আর সাথে প্রচুর তরল খাবার আর হ্যা একসপ্তাহ ফুল রেস্টে থাকুক।

আমি ভাইয়াকে বললাম আপনি ওষুধ পথ্য সব নিয়ে আসুন আমি ভাবীর কাছে আছি। ভাইয়া বিভিন্নরকম ফল আর ওষুধ নিয়ে ফিরে এলে ভাবীকে একটু জুস খাইয়ে ওষুধ খাওয়ায়ে দিলাম।

রাতের খাবারে বেশি ঝামেলা করলাম না, দুপুরের যা তরকারী ছিলো ওসব গরম করে, কষ্ট করে কোনরকমে ভাত রান্না করে সবাইকে খেতে দিলাম। খেতে বসে শ্বশুর বললেন —
— বড় বউমা কিছুদিন রেস্টে থাকুক, সবাই তার যত্ন নিও।
শাশুড়ী খাচ্ছিলেন বললেন,
— অসুখের বাহানায় বিছানায় পড়ে থাকলে সংসার চলবে কি করে?
সাবির ভাইয়ার মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেলো, শ্বশুর খেয়াল করলেন এবং বললেন,
— তোমার তো মানবতা নেই সেটাই জানা আছে, তা তুমি কি করবে? সারাদিন তো শুয়ে বসে কুটনামি করে দিন যায়।
— কি আমি কুটনামি করি? আমি তো মানুষ খারাপই, আমি পারবো না রান্নাঘরে যেতে।
আমি বললাম,
— বাবা চিন্তা করবেন না, আমি তেমন রান্নাবান্না পারি না কিন্তু আমি চালিয়ে নিতে পারবো, সকালে কয়দিন আমরা সবাই ব্রেড জ্যাম জেলি, ডিম, টোস্ট এসব দিয়ে চালিয়ে নেবো আর দুপুর রাতে ভাবীকে জিজ্ঞাসা করে করে রেঁধে ফেলবো মনির মা তো সাথে আছেই । লবন ঝাল কমবেশিটা আপনারা মাফ করে দেবেন।
শ্বশুর হেসে বললেন,
— বউ মা তুমি লবন দিয়ে সেদ্ধ করে দিলেও খেয়ে নেবো। আমাদের মজার খাবার খাওয়াতে গিয়ে বড় বউমার তো মরে গেলে আর চলবে না।
বড় ভাইয়ার মুখটা দেখলাম প্রসন্ন হলো।

রাতে ইউটিউব দেখে দেখে চিকেন প্রণ স্যুপ রান্না করে বাটিতে করে, ভাবীর রুমে নিয়ে গেলাম, ভাইয়া ভাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ভাবী চোখ বুজে শুয়ে আছে। আমার সাড়া পেয়ে ভাইয়া সচকিত হলো, আমার হাতে স্যুপের বাটি দেখে বললো আমার কাছে দাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
ভাইয়ার হাতে বাটি দিয়ে দরজাটা একটু ফাঁকা রেখে নিজের রুমে আসলাম, সামির ল্যাপটপে কি যেনো করছে। হাঁদারামকে বললাম, তুমি না বলেছো ভাইয়া কি করে ভালোবাসে দেখবে? যাও কোনো রকম শব্দ না করে চুপচাপ ভাইয়া ভাবীর রুমে উঁকি দেবে খবরদার! ভাইয়া যেনো টের না না পায়।

কতক্ষণ পর সামির ফিরে এলো,
আমি প্রশ্ন করলাম,
— কি দেখলে?
— ওইতো ভাইয়া ভাবীকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে।
আমি অভিমান দেখিয়ে বললাম,
— গরু তো ঘাস ছাড়া আর কি চোখে পড়বে?
রাগ করে উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে লাগলাম। পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজলো। ফিসফিস করে বললো,
— যত্ন করে স্যুপ খাওয়াচ্ছে, আর খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়াচ্ছে, কপালে চুমু খাচ্ছে।
— আর….
— আর গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকছে, দুচোখের তারায় অবাধ প্রেম।
আমি ঘাড় ফিরিয়ে বললাম,
— তুমি এভাবে পারো ভালোবাসতে? ভালোবাসা শুধু শরীরের সাথে শরীর মেশা নয়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেয়া। যেখানে অর্থের কমতি হলেও ভালোবাসার কমতি হবে না। পারবে এমন ভালোবাসাতে?
— খুব পারবো, নয়তো তুমি শিখিয়ে দেবে।

আমি মাথায় আলতো করে একটা গাট্টা মারলাম। ঘাড়ে নিঃশ্বাস আরো ভারী হলো।

চলবে

#শামীমা_সুমি

দহন ফুল পর্ব-০৩

0

#দহন_ফুল– ৩

শরীরের ঘাম আর শ্রম দিয়ে যে কাজ করবা তার মূল্য তোমাদের কাছে অনেক বেশি মনে হবে, কিছু বুঝলা ?

কি সাবির মিয়া কিছু বলো না কেনো?
— জ্বি আব্বা।
সামির মিয়া তোমার কোনো কথা নাই বলার মতো?
— জ্বি বুঝেছি।
বাবা একটু পায়েশ দেবো?
মাসুমা ভাবী পায়েশের বাটি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসলেন।
— না না বউ মা এখন আর খাবো না, পেট ভরে গেছে, রান্না সবগুলো চমৎকার হয়েছে, বিশেষ করে কলাপাতায় ইলিশ ভাপা।
কই চলো দুইভাই আমার সাথে ড্রয়িংরুমে, তোমাদের সাথে আমার জরুরি কথা আছে। মেয়েরা সবাই খেয়ে নাও, খবরদার আগে পড়ে না একসাথে বসবা সবাই।শাশুড়ীর মনোমত হলো না কথাটা পিনপিন করে কি সব বললো। সবাই খেতে বসার আগে আমি দৌড়ে গিয়ে মিষ্টি মশলার বাটিটা শ্বশুর বাবার সামনে রেখে আসলাম, — বাবা মশলা।
শ্বশুর বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমার কি যে ভালো লাগলো, শ্বশুরের মন জয়ের চেষ্টায় আছি আজকাল।

টেবিলে গিয়ে খেতে বসলাম প্লেটে ভাত নিয়ে ভাপা ইলিশ একপিস নিলাম, ভাতে মেখে মুখে দিলাম চোখ বুজে এলো উমমম.. সত্যিই তো চরম স্বাদ! ভাবী ধন্যবাদ আপনাকে এতো মজার রান্না করার জন্য, আমাকেও কিন্তু শেখাবেন এটা কিভাবে রাঁধে।
শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, — বুঝি না বাপু কি এমন স্বাদ হয়েছে যে সবাই আদিখ্যেতা শুরু করেছে।
বিরক্ত লাগলেও কথাটা ইগনোর করলাম ভাবীও আমি ও।
যা ই খাচ্ছি না কেনো আমার সমস্ত মনোযোগ বাবা ছেলেরা কি বলছে তা শোনার জন্য। আমি নাকে মুখে গিলে দৌড়ে গিয়ে দরজায় দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে শ্বশুর বাবা বললেন এসো মা, আর সবাইকেও ডাকো খাওয়া শেষে সবাই এখানে আসুক। সবারইকে সাথে নিয়ে সাক্ষী রেখেই কথাটা বলবো।

আমি গিয়ে প্লেট বাটি গোছাচ্ছি আর দুজনকে বাবার কথাটাও বললাম, ভাবী দেখলাম বড় বড় লোকমায় খাবার শেষ করলো। শাশুড়ী চুপচাপ উনার তাড়া নেই। আমরা উনার প্লেট বাটি রেখে বাকী সব গুছিয়ে ফেললাম । ড্রয়িংরুমে গেলাম, আমাদের দেখে বাবা বললেন — তোমার শাশুড়ী এলো না?
— উনি খাচ্ছেন বাবা।
— এর তো সারাজীবনই এমন, আপন মর্জির মালিক।

আইচ্ছা এইবার শোনো সবাই,
সামির তুমি যে বিরক্ত হইতেছে সেটা আমি জানি, হইলেও কিছু করার নাই, তোমার গতিবিধি আমার কাছে ভালো ঠ্যাকতেছে না, তোমার কথাগুলো শোনা বেশি জরুরি।
সারাজীবন শুনে আসছো এক পুরুষে করে ধন, সাত পুরুষে খায়
এখন এসব কথার ভাত নাই, নিজের ঘাম ও শ্রমের মূল্য দিয়ে সব করতে হয়।
আমি হাফিজ আজমান কৃষকের ছেলে, আমার দাদা আরো বড় কৃষক শহুরে ভাষায় চাষাই বলতে পারো। তাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিলো, রাস্তার মাথায় দাঁড়ালে যতদুর চোখ যায় সব জমি আমার হবে। পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু। তারা খেয়ে না খেয়ে জমি জিরাত করতো এটাই তাদের মনের শান্তি ছিলো। আমার দাদা ইংরেজদের দেখাদেখি দুই চার পাতা লেখাপড়া করেছেন। তার ছেলে মানে আমার বাবাকেও এন্ট্রান্স পাস দেওয়াইলেন চাকুরী বাকুরী করান নাই ক্ষেত খামার নিয়াই পইড়া রইলেন সারাজীবন। কিন্তু আমার বাবার শখ জাগলো তার ছেলেকে কোট টাই পড়া ভদ্রলোক বানাবেন। তাই বিদ্যা শিক্ষা দিলেন পর্যাপ্ত, দেশে যুদ্ধ শুরু হইলো, বয়স আমার ১৭/১৮ বছর, না আমি যুদ্ধে যাই নাই, কেনো যে যাই নাই নিজেও জানিনা। আমার মতো যারা যায় নাই তারাও জানে না, তাই বলে মনে দেশ প্রেম নাই তা কিন্তু না। জীবনে একটা বোধহয় ভালো কাজ করছিলাম, যুদ্ধের সময় একজন রাজাকাররে ধরাইয়া দিছিলাম চুপেচুপে, তাই যুদ্ধে না যাবার দুঃখ আমার ঘুচে গেছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তারপর বাকী পড়ালেখা মানে ডিগ্রি পাস করলাম, ঢাকা শহরে আইসা চাকরি নিলাম সাবরেজিস্টার অফিসে সত্তুর দশকের মাঝামাঝি । বলা নাই কওয়া নাই হুট কইরা অনুমতি ছাড়া বাবা মা গ্রামে তলব কইরা নিয়া বিয়া করাইয়া দিলেন। সে গল্প অন্যদিন হবে এখন আসল কথায় আসি।
তোমার মাকে নিয়া আইসা উঠলাম নুরজাহান রোডের একটা দেড়কামরার বাসায়। নতুন সংসার আনাড়ি সব কিছু চলছে কোনো রকম।
এর মাঝেই খবর পাইলাম রইছ শেখ নামের এক ধনী ব্যক্তি তার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি বিক্রি করে ইউরোপ চলে যাচ্ছে তার খুব সুন্দর একটা বাড়ি আছে।সেটা সে একপ্রকার পানির দরেই বেঁচে দিচ্ছে। কৌতুহলী হয়েও দেখতে আসলাম বাড়িটা, দেখে আমার আর চোখ সরে না। রইছ শেখের হাত ধরে ফেললাম, এই বাড়ি যেনো সে আর কাউকে না বেচে আমি যেভাবেই হোক আমি কিনবো। সে আমারে সময় দিলো ২০দিনের, তার জন্য পানির দর হলেও আমার জন্য বিরাট কিছু। দৌড়ে গেলাম আব্বার কাছে, আব্বা প্রথমে খুব রাগ করলেন, আমিও জিদ ধরে বসলাম। আপনাদের পছন্দে বিয়ে করাইছেন কিচ্ছু কই নাই এখন নিজের পছন্দে এই বাড়ি আমার চাই, ভবিষ্যতে আমারে আর কোনো সম্পত্তির ভাগ দিয়েন না যান। আব্বা অনেকক্ষণ পায়চারি করলেন মাথা চুলকালেন এরপর বললেন
– আইচ্ছা যাও একটা বিহিত করতেছি।

তবুও মনে শংকা নিয়ে ফেরত আসলাম, এক সপ্তাহ পরে আব্বা আসলেন বাড়ির যা দাম তার অর্ধেকের বেশি টাকা নিয়া। এই বাড়ি কিনতে গিয়া হারাইলাম খুব প্রিয় একটা জিনিস, এতো তাড়াতাড়ি টাকা পাওয়া সম্ভব না, জমির খরিদ্দার নাই কিন্তু মাছভর্তি পুকুর, ভরা দীঘি বেইচা দিলেন আরও কিছু বাড়তি টাকার আসায় আমার অতিপ্রিয় রেডিওটা হারাইলাম।

শ্বশুর থামতেই আমরা সবাই মোটামুটি একসাথে বলে উঠলাম — রেডিও!!
শ্বশুর বললেন — হ্যা রেডিও, যে সে রেডিও নয় মরফি ব্র‍্যান্ডের রেডিও।
তোমরা কি বুঝবা রেডিওর কদর। কোনো কোনোটা তো ছোটখাটো সুটকেসের সাইজ হতো। তখনকার সময়ে গ্রাম বাংলার পালা গান, জারী গান, কুস্তি খেলা আর আধুনিক বিনোদন যন্ত্র ছিলো এই রেডিও।

যখন টিভি ছিলো ধনী ব্যক্তিদের বিলাসিতা তখন সময় কাটানোর জন্য কম বেশি মধ্যবিত্তদের অনেকে সাধ্যের মতো মূল্যের এবং অ্যাক্সেসযোগ্য মারফি রেডিওর মালিক হওয়া ছিলো রীতিমতো গর্বের বিষয়।
তখন যৌতুক হিসেবে রেডিও দেয়া হতো , গ্রামে যার ঘরে রেডিও আছে তারে অনেক সম্মানের চোখে দেখা হইতো।
পুরো গ্রাম জুড়ে দুই একজন সৌখিন মানুষের ঘরে রেডিও থাকতো আর সে সবার কাছে ভি আই পি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ চরমপত্র শুনতো এই রেডিওতে, যজ্ঞের ধনের মতো যত্নে রাখতো মানুষ। বিশ্বাস না হইলে পুরানো দিনের বাংলা ছবিগুলো দেখে নিও।

আর টিভি কয়েক গ্রাম খুঁজলে একজনের পাওয়া যেতো, কারণ সামর্থ্যও ছিলো না আবার টিভি দেখা হারাম এই ফতোয়া জারী ছিলো । যেদিন বাংলা সিনেমা থাকতো সেদিন প্রজেক্টরের মতো করে টিভিটা উঠানে টেবিল পেতে তার উপর রাখা হতো, এই দৃশ্য নব্বই দশকে প্রথমার্ধেও ছিলো। তারপর চায়না কোম্পানি আইসা টেলিভিশন সস্তায় বাজারে ছাড়া শুরু করলো, বাংলাদেশেও বানানো শুরু হইলো মানুষের হাতের নাগালেও আসলো।

আসল কথায় আসি এইবার, পুকুর বেচা দীঘি বেচা, রেডিও বেচা টাকা দিয়ে, বিভিন্ন জনের কাছে ধারকর্জ কইরা এই বাড়ি আমি কিনলাম। সৌখিন মানুষ চুনকাম করে রাখতো সব সময় তাই নতুন করে রঙটঙ করা আর লাগে নাই, নইলে আরেক দফা খরচ হইতো।
এই ধারের টাকা শোধ দিতে গিয়া আমরা ঠিকমতো মাছ গোস্তো খাওয়া ছাড়লাম কয়েকবছর টানা কষ্ট কইরা ঋণ শোধ দিলাম।
যদিও গুলশান, ধানমন্ডির আশপাশ বলতে গেলে পুরোপুরি শহর হয়ে উঠে নাই, গ্রামই ছিলো কিন্তু এই লেকপাড়ের আশেপাশে জায়গা জমি তখনও দাম ছিলো আর এখন তো আগুন দাম।

এই যে সামির বাবা, আমার এতো সাধনার এতো কষ্টের বাড়ি তুমি কোন আক্কেলে ডেভলপারদেরকে দিয়া দেবার পায়তারা করতেছো?
তোমার মনে এই দূরাভিসন্ধি কে ঢুকাইলো?
— বাবা আসলে মানে ওই হইছে কি?
— মানে মানে বাদ দেও.. আর স্বপ্নেও এই চিন্তা যেনো না আসে মাথায়।
— বাড়িটা তো পুরাতন হয়ে গেছে, তাছাড়া আশেপাশে সব উঁচু উঁচু বিল্ডিং, তার মাঝখানে বাড়িটা…..
— বাড়িটা বেমানান তাইতো?
— জ্বি
— এই বাড়িটাতে যখন উঠি, তখন আশেপাশে এরচেয়ে সুন্দর বাড়ি একটাও ছিলো না, আমরা কষ্ট করে খেয়ে পড়ে থেকেছি কিন্তু, মনে শান্তি আসতো বাড়িটার দিকে তাকালে। এই বাড়িটাতে আমাদের তোমাদের ভাইয়ের শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
— বাবা আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না।
— তোমার সাহস দেখে তাজ্জব হচ্ছি। তোমার যদি ফ্ল্যাট বাসার শখ হয়ে থাকে, তাহলে নিজের যোগ্যতায় করো। তোমার বেতনের একটাকাও তুমি ঘরে খরচ করো না, সব আমার আর সাবিরের টাকায় চলে। যাও ওগুলো কাজে লাগাও। আর কোনোদিন বাড়ি নিয়ে কথা বলবা না। আমি বেঁচে থাকতে এই বাড়িতে কেউ হাত দিবে না বলে রাখলাম।
আহা — ছেলেটা কি বলতে চায় শুনবা তো একবার? বললেন শাশুড়ী মা।
রেগে গেলেন শ্বশুর,
— তুমি চুপ থাকো, পারুল, এই বাড়ির জন্য তুমি কোনো কষ্ট করো নাই, আমার আব্বা জমিজিরাত বেইচা এই বাড়িতে টাকা দিছি, সেই বাড়িতে আমার মা বাবা বোন আসলে তুমি বিছানা নিতা, অসুস্থ হইয়া পড়তা, হাড় কড়াকড়ি মরমরি ব্যারাম হইতো। তুমি তাদের সেবা করবা কি তারাই তোমার সেবা ঘরের রান্নাবান্না সব করতো। তোমার ছেলেদের লালনপালন তো আছেই।
— হ আমি কোনো কষ্ট করি নাই।
— করছো তো কষ্ট কইরা খাইছো, আর ঘুরছো। ছেলেদেরকে পালছে আমার বিধবা বইন।
— তুমি পোলার বউদের সামনে আমাকে অপমান করছো, ওরা কিন্তু লাই পেয়ে মাথায় উঠবে।
— আমার ঘাড়ে একটাই মাথা ওইটাতে তুমি উঠে বসে আছো, আর জায়গা নেই। এখন আমার সামনে থেকে তোমরা দুই মা ছেলে যাও তো, আর সহ্য হচ্ছে না।
সবাই চুপ হয়ে গেলো, শুনশান নীরবতা নেমে এলো।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে শোবার আগে মাথা আঁচড়ে নিলাম, নাইট ক্রিম মেখে, গুণে গুণে ২০ বার পায়চারি করলাম, ২০বার উঠ বস করলাম। ২০বার হাত গুলোকে আগে পিছে ঘুরালাম। সামির আমার দিকে চেয়ে থেকে বললো,
— কি হলো এমন অদ্ভুত আচরণ করছো কেনো?
— শরীরটাকে ক্লান্ত করছি যেনো তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসে।
— কে শিখিয়েছে এসব ফর্মুলা?
— আম্মু
— বেশ ভালো।
— হুমম।
— দেখলে তো আব্বা কি রকম করলো?
— কি করলো?
— এইযে বাড়ি নিয়ে তামাশা।

আমি গিয়ে বিছানায় সামিরের পাশে বসলাম,
— এখানে তামাশার কি হলো? উনি কষ্ট করে বাড়ি করেছেন, উনার বাড়ি উনি যা খুশি করবেন।
— প্রভা আংকেল না তোমাকে ফ্ল্যাট দেবেন বলেছিলেন? তাকে বলো না বুকিং দিতে?
— নাহ আমার লাগবে না।
— কি বলো? আমার কত্তদিনের শখ তোমার ফ্ল্যাট হবে, ওটা তুমি মনের মতো করে সাজাবে?
— আমার ফ্ল্যাট হলে তোমার শখ হবে কেনো?
— তুমি আমি কি আলাদা? তোমার যা তাতো আমারই আর আমার যা তা তোমার।
— সব যদি আমার বাবাই করে তুমি জীবনে কি করবে? বাই দ্যা ওয়ে তোমার বেতনের টাকা সংসারে না দিলে ওটা তুমি কি করো?
— ওওও ওটা একটা বিজনেসে ইনভেস্ট করার চেষ্টা করছি।
— আচ্ছা আচ্ছা তা কিসের বিজনেস?
— একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি করবো বন্ধুরা মিলে।
— দেখো আবার টাকা পয়সা নিয়ে ভেগে না যায়।
— না না তা হবে না। ওরা খুব ভালো মানুষ।

সামির আসলে মানুষ খারাপ নয় লোভী ও নয়, নিজের বুদ্ধি খাটায় কম আর অন্যের বুদ্ধি শোনে বেশি এই যেমন ইতিমধ্যে হয়তো কোনো ডেভলপার বুদ্ধি দিয়েছে বাড়ি ভেঙে এপার্টমেন্ট করার তাই শুনে এসে বাবার সাথে অযথা ঝামেলা করেছে। বাবার আবেগ অনুভূতির তোয়াক্কা করছে না। এখন বেতনের সব টাকা কি করছে ভালো করে খোঁজ নিতে হবে। শ্বশুর বাবা শুনলে রেখে যাবেন তাই বাপিকেই বলবো খোঁজ নিতে।
ঘাড়ে হাত পড়তেই ভাবনার ঘোর কাটলো। দেখি সামির আদুরে বিড়ালের মতো আমার ঘাড়ে নাক মুখ ঘষছে। হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কপট রাগ দেখালাম,
— এই কি হচ্ছে এসব?
— কিছু না, একটু কাছে এসো না।
— না তুমি ভালোবাসতে জানো না।
— তাহলে কে জানে?
— তুমি সাবির ভাইয়ার মতো করে ভালোবাসতে পারো না।
— ভাইয়া কিভাবে ভালো বাসে আমি কি করে জানবো।
— সে আমি জানিনা, সে রকম করে ভালোবাসতে পারলে আমার কাছে এসো, না হলে তোমার সাথে কোনো কথা নেই।
বলেই আমি লাইট অফ করে চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম, হাবাটা বসেই আছে, ঠিকইতো একজনের মতো করে অন্যজন কিভাবে তার অনুভূতি প্রকাশ করবে? প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র, তার প্রকাশভঙ্গীও আলাদা। আমার মনেমনে খুব হাসি পাচ্ছে, কিন্তু আমি কপট অভিমান দেখাচ্ছি। আজ জব্দ করতে বেশ মজা লাগছে। চুপচাপ অন্ধকারে বসে আছে আমার পায়ের কাছে, আর আস্তে আস্তে ডাকছে… প্রভা শোনো না….
আমি চুপ করে মজা নিচ্ছি এতো বোকা কেনো? নিজের বুদ্ধি খাটায়ই না, হাঁদারাম…..

দহন ফুল পর্ব-০২

0

#দহন_ফুল– ২

মা তুমি কথাগুলো ওভাবে না বললেও পারতে?
— কোন কথাগুলো?
হাতের নাগেটস আর পাস্তার বাটি গুলো টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন প্রভার মা লুবনা।
— ওই যে সেদিন আমার শ্বশুর বাড়িতে রান্নাঘরে বললে।
— তোমার কষ্ট লেগেছে?
— হ্যা ভীষণ ভীষণ রকম।
— এবার বুঝে দেখো, মাসুমার কেমন লাগে?
— কিন্তু আমি তো কিছুই করিনা ভাবীর সাথে?
— সেটাই তো সমস্যা তুমি কিছু করো না, তোমার করা উচিত।
— কি করবো আমি? শাশুড়ী মা সারাদিন বকাবকি করে ভাবীকে, হাভাতে, ছোটলোক, ফকিন্নি এসব বলে আমি কি করে থামাবো?
— করতে জানলে অনেককিছু করা যায়?
— মানে? বুঝতে পারছি না মা খুঁলে বলো?
— আচ্ছা বাদ দাও, আজ মা মেয়েতে গল্প করবো। তোমার পছন্দের ঝাল ঝাল চিজি হোয়াইট সস পাস্তা খাও আর ওখানে কিভাবে সময় কাটাও বলো আমি শুনি।

— ওখানে…. ওখানে সকালে উঠে নাস্তা খাই, তারপর মুভি দেখি শুয়ে থাকি। কখনো বই পড়ি কখনো একটু ঘুমাই অথবা কাজের মেয়েটাকে দিয়ে দু’দিন পর পর ফার্নিচারগুলো মুছাই। কোনো কোনো দিন উপটান মাখাই বা চোখে শসা স্লাইস দিয়ে কতক্ষণ পর কুসুম কুসুম পানিতে গোসল করি। বেশ ফ্রেশ লাগে জানো মা তুমিও করে দেখতে পারো।
— আচ্ছা অবসর পেলে করবো।
— তারপর কি করো?
— তারপর দুপুরের খাবার খাই, গান শুনি বা ঘুমাই নয়তো ঘুরতে বের হই লেক পাড়ে হেটে আসি।
— এরপরে…
— এরপরে নাস্তা খাই, সামির আসে বাসায় ওর সাথে গল্প গুজব করি, ডিনারের পর সামির কাজ করে আমি মুভি দেখি।
— এতো ঘুমাও এতো মুভি দেখো?
— কি করবো সময়ই কাটে না।
— রাতে ঘুমাও কখন?
— মুভি শেষ করতে করতে তিনটা চারটা বেজে যায়। কিন্তু সামিরের জন্য সকালে আবার উঠা লাগে ঘুম চোখে লেগে থাকে।(বিরক্তির সুরে)
— তাইতো সময় না কাটলে কি করবে?
— হুমম
— জানো খুব আফসোস হয় আমার…

মা বিষন্ন মুখে কথাগুলো বললেন।
— কেনো মা?
— কারণ তোমাকে শিক্ষিত করতে পেরেছি কিন্তু মানুষ বানাতে পারিনি। মা হিসেবে আমি ভীষণ ব্যর্থ ।
— মায়ায়া… আবার শুরু করলে? আমি কিন্তু এখন চলে যাবো।
— নাহ তুমি যাবে না (রুক্ষস্বরে বললেন) আমার সন্তান অমানুষের মতো বিবেকবর্জিত আচরণ করবে আমি তা কিছুতেই মেনে নেবো না।

মায়ের এই উগ্রমূর্তি দেখে আমি মিনমিন করে বললাম— মা..
— চুপচাপ বসে আমি যা বলবো, তুমি তাই শুনবে?
আমি ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ালাম যেমন করে রিপোর্ট কার্ডে গড়বড় করলে নাড়াতাম।
— তোমার যখন সময় কাটে না, মাসুমা তখন কি করছে খবর নিয়েছো?
— জানিতো ভাবী খুব সকালে উঠে নাস্তা বানায়, রুটি, আলুভাজি অথবা সুজির হালুয়া, ডিম ভাজি ডিমপোচ, চা এসব বানায়।
— আর তুমি রেডিমেড খেতে যাও
— আমি কি এসব পারি নাকি?
— কেনো পারো না? হাত পা নেই তোমার?
মেয়েটা সেই ভোরে উঠে সবার জন্য নাস্তা বানায়, দুপুরে কাটাকুটি রান্নাবান্না, বিকেলের নাস্তা, রাতের খাবার সব কাজ সেরে ঘুমাতে যায়।
তোমার শ্বশুর বাড়ি যতবার গিয়েছি দেখেছি, সে সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকে কারো সাথে বসে দুদন্ড কথা বলার সুযোগ নেই তার।

বিষয়টাকে হালকা করার জন্য মাকে প্রশ্ন — তুমিতো আমার মা উকালতি ভাবীর জন্য করছো যে?
— করছি কারণ এই অবস্থাটার মধ্য দিয়ে আমি গিয়েছি, আমি জানি একা একা সব কাজ সামলানো তার পরও কটুকথা শুনতে কতটা কষ্ট লাগে।
— তুমিও মানে?
— হ্যা আমিও.. আমার অপরাধ কি ছিলো জানো? সবার অমতে তোমার বাবার মতো বেকার ছেলেকে বিয়ে করা। বরের ইনকাম নেই বউকে দাসীবৃত্তি করতে হবেই, এটা আর নতুন কি? অবশেষে তোমার বাবা ছোটখাটো একটা চাকুরী জোটালেন, যা বেতন পেতেন তাতে তার যাতায়াত খরচ রেখে সংসারে খুব সামাণ্যই দিতে পারতেন। আমি গ্রাজুয়েশন করা মেয়ে কিন্তু কিছু না করে সবার মন জোগাতে দিনরাত এক করে সেবা করে যাচ্ছি। কিন্তু ফলাফল শূন্য, তোমার দিপা আপু জন্মের পরও কেউ বদলালো না। খেয়াল করে দেখলাম আমি নত হওয়াটাকে তারা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করে। ধীরেধীরে আমার পিঠটাকে তারা তাদের পা রাখার জায়গা বানিয়ে নিচ্ছে। এবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম, আর নয় এবার এদের থামাতেই হবে।

বিস্ময়ে হতবাক আমি বললাম
— মা কখনো তো বলোনি।
— তোমার বারার পরিবার লোকদেরকে তোমাদের চোখে ছোট করতে চাইনি কখনো।
— তারপর কি হলো?
— প্রতিবাদ করলাম, আমার একার পক্ষে সকলের ফরমায়েশ খাটা সম্ভব নয়। লেগে গেলো আগুন, অন্যায় কর‍তে করতে অন্যায়কারীদের কাছে এটাই নিয়মে পরিনত হয়। প্রচন্ড গালাগালি করে যা নয় তা বলে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তোমার বাবার হাত ধরে ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে পথে নামলাম। এক বান্ধবীর সহায়তায় খিলগাঁওয়ের দিকে, সাবলেটে এক কামরার একটা বাসায় উঠলাম। তোমার বাবা বাসে করে আসা যাওয়া করতো আর আমি একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকুরী নিলাম, বাচ্চাকে আয়ার কাছে এর ওর কোলে রেখে চাকুরী করতাম। বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করতে পারবো না তাই বাসায় আশেপাশের গরীবদের বাচ্চা অল্প টাকায় পড়াতে শুরু করলাম। সিভি জমা দিতে লাগলাম বেসরকারি স্কুলগুলোতে, ওদিকে আমার এক মামার সহায়তায় তোমার বাবার ইনকাম ট্যাক্স অফিসে চাকুরীর সুযোগ এলো। উনি দরখাস্ত করতে বললেন, তুখোড় মেধাবী তোমার বাবা রিটেন ও ভাইবা’ দুটোতেই টিকলো আমার মামা সুপারিশ বা টাকার ব্যাপার কিভাবে কি করলেন জানিনা চাকুরীটা হলো। আল্লাহ নিরাশ করেন না তাই আমাদের সুদিন এলো, আমরা মোহাম্মদপুর ভালো বাসা নিয়ে অভিজাত এলাকায় আসলাম। এদিকে আমারও ডাক আসলো বেসরকারি গার্লস স্কুল থেকে, তোমার বাবা চায়নি আমি চাকুরী করি, কিন্তু আমি নিজেকে চেনার আত্মনির্ভরশীল হবার সুযোগ আর হাতছাড়া করিনি। তুমি জন্ম হলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে তাই এত্তকিছুর কোনো কিছুই তোমাকে ছোঁয়নি।

— তাহলে কাকা ফুফুরা সবাই যে আসে আমাদের বাসায়?
— এরা সুদিনের মৌমাছি, তোমার জন্মের পর তোমার দাদী পার্মানেন্ট থাকতে এলেন, ওখাকার চরম আদর যত্ন উনার সয়নি, ফিরলেন আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন নিজের কৃতকর্মের জন্য। আমিও ফিরিয়ে দেইনি, দাম্ভিক মানুষের নতমুখ সমস্ত যন্ত্রণার শীতল পরশ হয়ে আসে। তোমাকে দেখাশোনা করেন, কাজের লোকেদের পরিচালনা করেন আমিও ছেড়ে দিলাম থাকুক যেভাবে শান্তি পায়। তারপর থেকে পরিবারের সব একে একে এসে জুটছে। আমি ওদের সাথে গম্ভীর হয়ে কথা বলি বলে তোমাদের মনে প্রশ্ন ছিলো, এই হলো তার উত্তর।
— মা এতোটা সয়েছো তুমি?
— যন্ত্রণা কাতর মানুষ একটু ভালো ব্যবহারকে স্বর্গীয় সুখ ভাবে। কখনো কারো জন্য যদি কিছু করতে না ই পারো তবে তার কষ্টের কারণ হইও না।

— মা তোমার অনেক গোপন ব্যথা আজ জানলাম, তোমার গাম্ভীর্যের পেছনে কোমল মনের খবরও জানলাম।

— আচ্ছা তোমার শাশুড়ী মাসুমাকে পছন্দ করে না কেনো?
— আমি ঠিক জানি না মা, তবে পরিবারের অমতে গিয়ে ভাইয়া বিয়ে করেছে, ভাবীর মা বাবা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, মামা মামীর কাছে থেকে বড় হয়েছেন। বিয়ের সময় কিছু আনতে পারেনি। শাশুড়ীর শখ পূরণ হয়নি ঠকেছেন এসব সারাদিনই বলতে থাকেন।
— আর তোমাকে আদর করে কেনো?
— আমি শিক্ষিতা, সুন্দরী মিষ্টি মেয়ে বিয়েতে অনেককিছু পেয়েছে, ঈদেও ভালো উপহার পায়, আমার বাবার বাড়িতে আদর আপ্যায়ন পায় এসবই তো বলেন। তাছাড়া সামির খুব ভালো বেতনে চাকুরী করে।
— শ্বশরবাড়িতে তোমার অবস্থান বুঝেছো?
— মানে?
— তোমার কোনো কদর নেই, তোমাকে তারা ভালোবাসে তোমার বাবার অর্থবিত্তের কারণে। সব স্বার্থের জন্য এমনকি সামিরও তোমাকে নয় তোমার বাবার অর্থবিত্তকে ভালোবাসে। প্রকৃতপক্ষে মাসুমা ভাগ্যবতী মেয়ে, যতকটু কথাই শুনুক সবার আত্মার দোয়া সে পাচ্ছে। আর সাবির তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, সে ভালোবাসার জোরে মাসুমা সব কষ্ট সয়ে নিচ্ছে।
— সেটা জানিনা…তবে সামির আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে মা, আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছি।
— আচ্ছা….. ঠিক আছে পরীক্ষা নিও.. কিভাবে নেবে তুমি ভেবে নাও।

বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে ঢুকে দেখি ভাবী রাতের খাবার তৈরি করছে।
পেছন থেকে ডাকলাম — ভাবী কি করছো?
মাসুমা ভাবী তাজ্জব হয়ে তাকালো, হবারই কথা কখনো এভাবে জিজ্ঞেসও করিনি বা দুই বছরে কখনো দাঁড়িয়ে কথা বলেছি কবে আমারই মনে নেই।
— ওইতো রাতের খাবার তৈরি করছি, তোমার কিছু লাগবে?
— না না কিছু লাগবে না, আমি কি সাহায্য করতে পারি?
এবার ভাবীর আকাশ থেকে পড়ার পালা..
আমার মুখে এমন কথা কখনো শোনেনি,
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, — না সাহায্য লাগবে না, তুমি গিয়ে বসো আমি সব করছি।
তবুও মাসুমা ভাবীর আশেপাশেই রইলাম।

হাতে হাতে খাবারের বাটি সব টেবিলে রাখলাম, ভাবীর চোখে প্রশান্তির ঝিলিক দেখলাম। শাশুড়ী এসে আমাকে টেবিল সাজাতে দেখে প্রশ্ন করলেন
— প্রভা তুমি এসব করছো কেনো? এসো আমার সাথে বসো , তুমিতো এসব কাজে অভ্যস্ত না সোনা মা ।
অন্যসময় ভালো লাগলেও আজ কেনো যেনো শাশুড়ী মায়ের আমার প্রতি আহ্লাদ ভালো লাগলো না।
বললাম — না মা আমার করতে ভালো লাগছে।

সবাই খেতে বসলো, আমি ভাবীকে বললাম
— ভাবী আপনিও আসুন।
শাশুড়ী মা বললেন ওকে ডাকছো কেনো? ও পরে খাবে।
মাসুমা ভাবী বললেন — হ্যা আমি পরে খাবো, তোমার ভাই আসুক।

আমরা সবাই খেয়ে নিলাম, ভাবী দাঁড়িয়ে থেকে কার কি লাগবে দেখতে লাগলো। সবার খাওয়া শেষে ভাবী সব গোছাতে লাগলো, সাথে আমিও হাত লাগালাম। শাশুড়ী মা বললেন — প্রভা তোমার এসব করা লাগবে না, তুমি রুমে যাও সামিরের কিছু লাগবে কিনা সেটা দেখো।
মায়ের সম্মতি পেয়ে, সামির বললো — হ্যা হ্যা এসো একটু কাজ আছে।
আমি পানির বোতল হাতে দিয়ে বললাম — তুমি রুমে যাও, আমি আসছি। সামির থ হয়ে থেকে রুমে চলে গেলো।

প্লেট বাটি সিংকে রাখতে রাখতেই কলিং বেল বাজলো, ভাবী দরজা খুলে দিতে ভাই বাজারের থলে হাতে ধরিয়ে দিলো।
ভাবী ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরের দিকে আসছে ভাই পেছনে পেছনে আসছে আর বলছে— নীনু জানো এই ইলিশ মাছগুলো বেশ পছন্দ হয়ে গেলো আর তুমিও পছন্দ করো তাই নিয়ে এলাম।
ভেতরে ঢুকে আমাকে দেখে থমকে গেলো। ভাবী কৌতুকপূর্ণ হাসি দিতেই ভাই লজ্জা পেয়ে চলে গেলো রুমের দিকে।
এই প্রথম আমি ভাইকে সরাসরি খেয়াল করে দেখলাম, ভাই বেশ লম্বা সুদর্শন ও সুঠাম, কাটা কাটা চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট সে তুলনায় সামির সাদামাটা চলনসই পুরুষ। ধৈৎ নিজের ভাসুরকে বিশ্লেষণ করছি মনে পড়তেই লজ্জা লাগলো। নিজের রুমে ফিরে গিয়ে দেখি সামির ল্যাপটপে কিছু একটা করছে। আমি তার পাশে গিয়ে আধা শোয়া বসলাম। আমাকে দেখে প্রশ্ন করলো– কি ব্যাপার আজ যে বড্ড কাজ দেখাচ্ছিলে?
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, রেগে গেলাম — কাজ দেখাচ্ছিলাম মানে?
— রাগ করছো কেনো? কখনো কিছু করতে দেখিনি তো তাই বললাম।
— কখনো করিনি বলে কোনোদিনই করবো না এর কোনো মানে নেই।
— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।
— ভাবীকে ভাই নীনু বলে ডাকে?
— হুমম, ডাকে ওসব ঢং ছাড়া কিছু না, আমার ভাল্লাগেনা।
বলেই সে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
আমি নেটফ্লিক্সে মুভি অন করলাম, কতক্ষণ দেখলামও কিন্ত মন বসছে না। মায়ের সব কথা রিফ্লেকশন হচ্ছে, মনে ভাবনার ঝড় উঠেছে, কিছুই ভাল্লাগছেনা। উঠে পায়চারি কর‍তে লাগলাম। আড়ি পাতা স্বভাবে নেই আমার কিন্তু আজ খুব করে মন চাচ্ছে ভাই ভাবীর জগতে আড়ি পাতি। চুপচাপ বেড়াল পায়ে ডাইনিং এর দিকে গেলাম আড়ালে দাঁড়িয়ে যা দেখলাম তাতে হিংসুক ছাড়া যে কেউ মুগ্ধ হবে। ভাই ভাবীকে লোকমা তুলে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, ভাবী কি মিষ্টি করে হাসছে। ভাই দুষ্টু চোখে ভাবীকে দেখছে, অন্যহাতে ভাবীর কপাল থেকে অবাধ্য চুল সরিয়ে দিচ্ছে। দুজনার চোখে দুজনের জন্য বাঁধভাঙা প্রেম। সামির আর আমার প্রেমের বিয়ে কিন্তু সামিরের চোখে এমন প্রেম আজো দেখলাম না কখনো এমন করে কাছে বসিয়ে যত্ন করতে দেখলাম না। সামিরের সবকিছু প্রয়োজনে কেমন যেনো গৃহস্থালি প্রেম। শরীরে খেলায় শরীর কাছে আসে, ঝড় উঠে উত্তাল, ভেস্তে যায় লাজ লজ্জার দেয়াল সমর্পণের আলিঙ্গনে কিন্তু ঝড় থেমে গেলে আর চেনে না সামির। অথচ এমন একটা প্রেমপূর্ণ দৃষ্টির জন্য হাজার কষ্ট, এমন এক চিলতে ভালোবাসার জন্য অগ্নিকাঁকরও মাড়িয়ে যাওয়া যায়। ভাবীর সারাদিনে করা সব কষ্টের, কটু কথা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, যন্ত্রণার অবসান এই সময়টুকুতে এসে।
সত্যিই ভাবীর কাছে আজ নিজেকে বড্ড কাঙাল নিঃস্ব রিক্ত মনে হচ্ছে। আমি সব পেয়েও শূন্য ভাবী কিছু না পেয়েও কানায় কানায় পূর্ণ।

চলবে….

দহন ফুল পর্ব-০১

0

#দহন_ফুল — ১

কই গো নবাবের বেটি ভাত তরকারি দিবানি? নাকি দুপুরের ভাত সন্ধ্যায় খাওয়াবা?
— এই তো নিয়ে আসছি মা ৫মিনিট। বলে ভাবী জানালার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন৷ ওখানে একটা কাক গম্ভীর ভাবে বসে আছে৷ ভাবী কি নিজের সাথে ওই কাকের তুলনা করলেন? স্বাধীন পাখি, পরাধীন নারী?
— হ উদ্ধার করো, সারাদিনে একটু রান্নাবান্না করো, সেটাও ঠিক টাইমে হয় না।

চোখের কোলটা মুছে রান্নাঘর থেকে ভাতের বাটি, তরকারির বাটি সব এনে এনে টেবিলে রাখছে ভাবী। ফেসবুক স্ক্রল করা থামিয়ে সেদিকে তাকালাম। বাটিগুলো সব রেখে আঁচলে ক্লান্ত শ্রান্ত চোখমুখের ঘাম মুছলেন ভাবী। শাশুড়ী বললেন
– যাও এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো কাপড়গুলো ধুয়ে ছাদে মেলে দাও রোদ পড়ে গেলে আর শুকাবে না ভালো করে।
ভাবী আমার দিকে ভেজা ও নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
— যাচ্ছি মা (বলে চলে গেলেন)
ভ্রুকুটি করলাম মনেমনে .. কাজ আর যেনো কেউ করে না ঢং, প্রতিদিন প্রচন্ড খিদে নিয়ে খাবার খেতে হয়।

প্রভা খাবার নিচ্ছ না কেনো?
শাশুড়ীর কথায় সম্বিৎ ফিরলো, প্লেটে ভাত আর সবজি নিয়ে মাখিয়ে খেতে লাগলাম। খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে শ্বশুর বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলেন।
ভাবী এক বালতি ধোয়া কাপড় নিয়ে ছাদের দিকে যাচ্ছেন, শ্বশুরের চোখে পড়তেই — একি বউ মা! এতগুলো কাপড় তুমি ধুয়েছো? মনির মা কি করেছে?
— মনির মা ধুইলে কাপড় পরিস্কার হয় না। (শাশুড়ী বললেন)
— তা ও এখন গোসল করবে কখন, নামাজ পড়বে কখন খাবে কখন?
— হয়ে যাবে বাবা আপনি চিন্তা করবেন না, বলে ভাবী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।

শাশুড়ী মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
— হয়ে যাবে তুমি হাত ধুয়ে খেতে বসো, তোমার অতো দরদ দেখাতে হবে না।
শ্বশুর হাত ধুয়ে এসে প্লেটে ভাত নিলেন,
তরকারি মাখিয়ে লোকমা মুখে তুলে বললেন.
— একটু বিবেক খাটাও সাবিরের মা, এতটা জুলুম ভালো নয়।
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন শাশুড়ী,
— জুলুম! কিসের জুলুম? ঘরের কাজ ছেলের বউদের করতে হয় এটাই তো স্বাভাবিক, এখানে জুলুমের কি হলো?
— ঘরের বউ তো তোমার আরো আছে, তাদের বেলায়ও কি তোমার একই মনোভাব ?

স্পষ্ট আমাকে ইঙ্গিত করেছেন, আমার গলা দিয়ে আর ভাত নামলো না। চুপ করে বসে থেকে, ভাতের প্লেট নিয়ে সিংকের দিকে গেলাম। শাশুড়ী রে রে করে উঠলেন, প্রভা খাওয়া বন্ধ করলে কেনো? হাত ধুয়ে ফেললে কেনো, মাংসটা তো চেখে দেখলে না?
— না মা আর খাবো না, পেট ভরে গেছে আমার।
প্লেট সিংকে রেখে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে শুনলাম, শাশুড়ী শ্বশুরকে বকছেন।
— দিলে তো মেয়েটার মন খারাপ করে? কত্ত বড় ঘরের মেয়ে, জীবনে কখনো একগ্লাস পানি ঢেলে খায়নি। আহারে খিদের কষ্ট পাবে মেয়েটা।
— দুচোখে বিচার বন্ধ করো সাবিরের মা, পর্দা সারাও চোখের, বিবেক খাটাও।

কষ্টে আমার চোখে পানি চলে আসলো, শ্বশুর বাবা আমাকে একদম পছন্দ করেন না। ঘরে এসে খুব কাঁদলাম, আমি কি কখনো ঘরের কাজ করে বড় হয়েছি, ঘরভরা চাকর বাকর ছিলো, শ্বশুর বাবা পারলেন আমাকে কাজের খোটা দিতে? কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেললাম,আসুক আজ সামির একটা বিহিত করতে হবে? কতক্ষণ রাগে গজগজ করলাম তারপর উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিলাম। পেটে খিদে লেগেছে তাই ড্রাইফ্রুটস এর কৌটাটা নিয়ে বসলাম, টিভিটা অন করে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখছি আর নাট খাচ্ছি।
মোবাইলে রিং হতেই ফোন তুলে দেখি মা কল করেছে,
হ্যালো বলেই কেঁদে ফেললাম,
মা ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কি হয়েছে কাঁদছো কেনো?
আমি আজকের ঘটনা সব খুঁলে বললাম। সব শুনে মা নিরসভাবে উত্তর দিলো — ও আচ্ছা, এবার অন্য কথা বলো।
— তাজ্জব ব্যাপার মা!
— কোনটা তাজ্জব?
– এইযে সব শুনেও বিষয়টা তোমার কাছে কিছুই মনে হলো না।
— হ্যা… গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলে কিছু মনে হবে কেনো?
— এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না?
— না, উনি তো সত্যিই বলেছেন। তুমি তো কুটোটিও নাড়ো না।
— মা আয়ায়া… তোমার চেয়ে আমার শাশুড়ীই ভালো, সাথে সাথে প্রতিবাদ করেছেন।
— তাহলে তো হয়েই গেলো, বিচার তো পেয়েই গেছো।
— সবার মা কি আর তুমি কি?
— হুমম আমিতো সারাজীবনই খারাপ মা।
— বাপি হলেও কিছু বলতো, তুমি কেমন যেনো?
— বাপির আদরেই বাদর হয়েছো, শোনো বাপিকে আবার এসব বলতে যেও না। শ্বশুরবাড়িতে কতকিছুই হয় সব কথা, সবাইকে জানাতে হয় না। নিজে ছোট হতে হয়, এখন বুঝবে না, তবে আর কয়েকবছর যাক বুঝতে পারবে।
— যাও আর কথাই বলবো না।
— আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থেকো।

মা ফোন কেটে দিতেই মনটা বিরক্ততে ছেয়ে গেলো? সবার মা কেমন আর আমার মা কেমন? অন্যকেউ হলে এর একটা বিহিত করতো, আমার মা একদম অন্যরকম। বাবা ইনকাম ট্যাক্স এর বড় অফিসার টাকার অভাব কখনো দেখিনি, ঘরের কুটোটিও নাড়ানো লাগেনি, বড় আপু তবুও মায়ের সাথে সাথে এটাসেটা কর‍তো। আমি ছিলাম বিন্দাস। বাপি দু’হাতে খরচ করলেও মাকে দেখতাম বস্তাপচা নীতিকথা নিয়ে পরে থাকতে। বাবার এত নিষেধ সত্ত্বেও স্কুলের চাকরি ছাড়েননি, বাবা জোর করেননি কখনো, বাবাকে দেখতাম যেনো মাকে একটু ভয় পায়। বড় আপু বিয়ের হয়ে গেলে অষ্ট্রেলিয়া চলে যাবার পর মা নিঃসঙ্গ হয়ে যান, আমার সাথে মায়ের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, তবে বাপির সাথে আমি বন্ধুর মতো।

সামিরের সাথে রিলেশন হবার পর বাপির কাছেই বলেছি, বাপিও খোঁজ খবর নিয়েছে, সামির লন্ডন থেকে পড়াশোনা কমপ্লিট করার পর দেশে এসে একটা ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানীতে বেশ বড় পদে জয়েন করেছে।
মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি হলেও ছেলে যোগ্য তাই আর দ্বিমত করেনি।
দুই পরিবারের সম্মতিতে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে আমাদের বিয়েটা হয়। আজ দুইবছর হতে চললো, একা বাসা নিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়নি কখনো। এইতো বেশ আছি সংসারের কোনো কাজকর্ম করা লাগে না, তবে বিয়ের আগে মা জোর জবরদস্তি করে কিছু রান্নাবান্না শিখিয়েছেন, একেবারে কিছুই পারি না তা নয় তবে গা বাঁচিয়ে চলা যায় তাই একা বাসায় যাবো না যতদিন পারা যায়।

ধানমন্ডির অভিজাত এলাকায় এই বাংলো টাইপ বাড়িটা সামিরদের নিজেদের, লেকপাড়ের খুব কাছেই তাই কিছুক্ষণ হাঁটলেই লেকে যাওয়া যায়।
পঁচিশশো স্কয়ার ফিটের এই বাসাটায় পাশাপাশি দুটি রুম আমি নিয়েছি, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে ডিজাইন করিয়ে পুরো রুম সাজিয়েছি। দামী ঝাঁড়বাতি, এক্সক্লুসিভ সব পর্দা, দামী আসবাবপত্র, দেয়াল জুড়ে বিশাল টিভি কি নেই এই ঘরে? পুরো রুম জুড়ে একটা স্বপ্নময় আবহ। শাশুড়ীকে এনে বসিয়ে রাখি, উনি মুগ্ধ চোখে দেখেন, ফ্রিজ খুঁলে বিদেশি ফল, চকলেট খাওয়াই, ড্রাইফ্রুটস খাওয়াই, দামী কফি, মিল্কশেক উনার খুশি আর ধরে না। সারাক্ষণ আমাকে চোখে হারান।
আর বড় ভাবী মানে মাসুমা ভাবীর রুমের দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হয় না, পুরনো খাট,তোষক, আলমারী, সোফা পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে থাকে। আমি পারতপক্ষে ও ঘরে যাই না, শাশুড়ী মা ও যান না।

দরজা খুলে শাশুড়ী মা ঘরে ঢুকলেন, আমি আধাশোয়া থেকে উঠে ঠিকঠাক বসলাম, মা এসে মাথায় হাত রাখলেন, আহ্লাদে আমার চোখে পানি চলে আসলো।
— এসো মা, একসাথে বসে নাস্তা খাই, তোমার শ্বশুরের কথায় কিছু মনে করো না। সব ওই হাভাতে ঘরের মেয়ের চাতুরী, তোমার শ্বশুর আসার সময় হয়েছে অমনি কাপড়ের বালতি নিয়ে হাজির। সব লোক দেখানো কাজ করে, আমার সংসারে কি এমন কাজ, ওই একটু রান্নাবান্নাই তো? কি দেখে যে আমার গাধা বড় ছেলেটা বিয়ে করে নিয়ে আসলো? মা বাপ নেই মামার ঘরে মানুষ, ভালো শিক্ষাদিক্ষা আর পাবে কই? বাপের বাড়ি থেকে ফুটো কড়িও আনতে পারেনি, তবুও কত্ত দেমাগ? চলো গিয়ে নাস্তা করি, গরম গরম চিকেন সমুচা আর মালাই চা করতে বলে এসেছি।

বড় ভাবীর রুমের সামনে দিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে যাবার সময় চোখে পড়লো ভাবী নামাজ পড়ছে।
শাশুড়ী মা দেখে বললে – সব লোক দেখানো বুঝলে।

আমরা গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলাম, শাশুড়ী তার জীবনের গল্পজুড়ে দিলেন, কত কি করতে পারতেন, কোন খাবার খেয়ে কে কবে প্রশংসা করেছে এসব। এর মধ্যেই আবার রান্নাঘরের উদেশ্যে হাক দেন কই হলো তোমার?

ঘেমে-নেয়ে বড় ভাবী এক প্লেট চিকেন সমুচা আর ব্রোকলির পাকড়া এনে রাখলেন টেবিলে, শাশুড়ী মা প্রশ্ন করলেন — চা কই?
— আপনারা খেতে থাকুন, আনছি।
— তাড়াতাড়ি এনো, মাগরিবের আজান যেনো না দেয় আবার।

ভাবীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুবই ক্লান্ত, আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম, — ও বাবা চুলায় যেতে পারবো না।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে খুব যত্ন করে সাজছি আমি, দিবা আপু অষ্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরেছে, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এই বাসায় আসছে। পার্পল জামদানীর সাথে পার্লের গহনাটা সেটিং মিলিয়ে পরে নিলাম, মেকওভারটা ম্যাচিং করেই নিয়েছি শুধু একটু ফিনিশিং টাচটা দিয়ে নিচ্ছি। পাক্কা দু’ঘন্টা লাগলো, যাক এবার ইউনিক লাগছে।

মায়ের কল এলো ওরা গেটের কাছে এসে গেছে। আমি দ্রুত আয়নায় আরেক ঝলক দেখে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম, ড্রাইভার ফল মিষ্টি এসব এনে টেবিলে রাখছে।আমি এগিয়ে গিয়ে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম, আলিঙ্গন শেষে আপু আমার দিকে তাকিয়ে বললো — ইউ লুকিং সো গর্জিয়াছ।
– ধন্যবাদ আপু, তোকেও দারুণ লাগছে। আমিও বললাম।
সবাই গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতেই ভাবী ফ্রেশ জুস নিয়ে আসলো সবার জন্য। — কেমন আছেন আপনারা সবাই?
আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, ত্যানা ত্যানা একটা কাপড় পরণে ঘাম তেল মশলায় বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। বললাম — হ্যা সবাই ভালো আছে ভাবী, সব এখানে রেখে তুমি যাও। ভাবীর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ম্লান হয়ে গেলো। মায়ের চোখ কঠিন হলো, আমার দিকে তাকালেন। ভাবীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন
— ভালো আছি মা, তুমি কেমন আছো, সকাল থেকে বুঝি আয়োজনে ব্যস্ত আছো।
— আলহামদুলিল্লাহ খালাম্মা, ওইতো আর কী । আচ্ছা আমি রান্নাঘরে গেলাম, কিছু কাজ বাকী আছে।
— আচ্ছা, যাও
এসব দেখে আমার শাশুড়ীর চোয়াল শক্ত হলো,কিন্তু মুখে মেকি হাসি ধরে রাখলেন।

সবাই জুস নাস্তা খেয়ে গল্প গুজবে সময় পার করছে। দুপুরের খাবার সময় ঘনিয়ে আসছে, মাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি ছুরি দিতে সালাদ কাটছেন।
আমি দ্রুত গিয়ে হাত থেকে কেড়ে নিলাম,
— মা, ভাবী থাকতে তুমি এসব কাটছো কেনো?
— মাসুমাকে গোসল করতে পাঠিয়েছি। বেচারি ঘেমে নেয়ে একসার।
— সালাদটা কেটে গেলে কি হতো?
মা হাত থেকে ছুরি টেনে নিয়ে কাটতে লাগলেন। আমি আবার কেড়ে নিয়ে বললাম আমি করছি তুমি সরো।
— না না তা কেনো হবে, তুমি পটের বিবি সেজে বসে থাকো, শরীর বাঁচাও কবরে গেলে পোঁকায় খেতে সহজ হবে।
— মা আয়ায়ায়া
— কি মা? একটা মানুষ সকাল থেকে খেটে মরছে, আর তুমি ছিঃ….
পেছনে ফিরে দেখি মাসুমা ভাবী অশ্রুসিক্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চোখ মেলাতে লজ্জা পাচ্ছিলাম।

টেবিল ভর্তি এতো এতো খাবার কিন্তু কোনটাই আমার গলা দিয়ে নামছে না, কষ্টের একটা দলা গলায় আটকে আছে।

চলবে….

#শামীমা_সুমি

ভুল সত্য পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0

ভুল সত্য
শেষ পর্ব

এসবের মানে কি রেহানা আন্টি?

আন্টির ঠোটে মিটি মিটি হাসি, অন্যদিকে মায়ের সমস্ত মনযোগ চায়ের কাপে, যেন চায়ের ভেতরে কেউ স্বর্ণালঙ্কার লুকিয়ে রেখেছে। আমি আমার শরীরে আগুনের উত্তাপ টের পাচ্ছি।
আন্টি হালকা গলায় বললেন
তুই ফোন বন্ধ করে রেখেছিস, কোন খোজ নেই এদিকে এত বড় সুসংবাদ। তোকে ছাড়া চলে? তাই মেসেজ পাঠাতে হল। বুদ্ধিটা অবশ্য তোর মায়ের। আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম সেখানে কোন অপরাধ বোধের চিহ্ন মাত্র নেই। আমার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। পাশে রাখা খাতায় কি সব লিখতে লিখতে বলছে
আপা কেটারিং এ খবর দিতে হবে তো। এত দেরী করলে চলবে?
আরে কেটারিং লাগবে না। আমরা বাড়িতেই রান্না করব
কি বলেন? দেড়শ লোকের রান্না
আমি তেতে উঠে বললাম
কি হচ্ছে এখানে এসব। কিসের রান্না?
পানচিনি
আ। কি চিনি?
আরে কথাপাকা
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি যেতেও পারলাম না এর মধ্যেই কথাপাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। আমি অস্থির কন্ঠে বললাম
কার কথাপাকা? মুকুলের?
রেহানা আন্টি এবং মা দুজনেই আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলেন। কোন জবাব দিলেন না।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম
তোমরা কিছু বলছ না কেন?
আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বললেন
এই, মুকুলের কয়বার কথা পাকা হবে রে?
এবার মা আমার দিকে মুখ তুলে চাইল তারপর বিরক্ত কণ্ঠে বললো
হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? খেতে বস। দুপুরে খেয়েছিস ?
তিথি এগিয়ে এসে বলল
নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি তাড়াতাড়ি বসে পড়তো
আমি ওদের দুজনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রেহানা আন্টিকে বললাম
আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে
আন্টি খাবার টেবিল গোছাতে গোছাতে বললেন
হ্য বল না
এখানে না। আমি একটু আলাদা কথা বলতে চাই
আন্টি এবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তার মুখ কেমন থমথমে দেখাচ্ছে। আমি বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তারাও চুপচাপ যেন জানতই এমনই কিছু একটা হবে। আন্টি হাতের ইশারায় আমাকে পাশের ঘরটা দেখিয়ে দিলেন তারপর নিজেও ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

আমার অস্থির লাগছে, ভীষণ অস্থির লাগছে, কোথা থেকে কথা শুরু করব বুঝতে পারছি না। মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন। আমার জীবনে এই মানুষটির গুরুত্ব অপরিসীম। উনি না থাকলে হয়তো আমি একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতাম না। যার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু পাই কি জানি কেন কৃতজ্ঞতার বদলে তার কাছ থেকে প্রত্যাশা বেড়ে যায় হাজার গুণ। শুধু প্রত্যাশা নয় তাদের প্রতি এক ধরনের অধিকারবোধ ও জন্ম নেয়। তাদের সামান্যতম ভুল ও আমরা ক্ষমা করতে পারিনা। ঠিক এমনটাই হয়েছে আমার আন্টির ক্ষেত্রে। আমার গলা কাঁপছে। কেন যেন হঠাত করে আর আগের মতন গলায় জোর পাচ্ছি না। নিভে যাওয়া কন্ঠে আমি বললাম
তুমি আমার সঙ্গে এমন কেন করলে আন্টি? তুমি তো সব জানতে
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম উনার ঠোটে সেই চিরচেনা হাসিটা লেগেই আছে
কি জানতাম?
শাওনের কথা, ওদের সম্পর্কের কথা
জানব না কেন?
তবু তুমি আমাকে এই বিয়েটা করতে বলেছিলে? কেন?
উনি নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন
হু
তোমার মনে আছে সে সময়ে আমি কাউকে বোঝাতে না পেরে তোমার কাছে এসেছিলাম। তুমি আমাকে বলেছিলে এই বিয়েটা করতে। আশ্বস্ত করেছিলে যে আমি ঠকবো না। বরং সমগ্র পুরুষ জাতির প্রতি আমার যে ধারণা সেটা বদলে যাবে
সেটা বদলায়নি?
আমি কোথা থেকে আবার সেই পুরনো গলার জোর ফিরে পেলাম। গলা উচিয়ে বললাম
না বদলায়নি বরং আমার ধারণা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। আমি জানতাম এমনটাই হবে। এই পৃথিবীতে সবাই এক। সব পুরুষই ভন্ড, লম্পট, চরিত্রহীন
মুকুল যে এমন সেটা কি করে প্রমাণ হলো?
তুমি সবকিছু জেনে শুনে আবার আমাকে প্রশ্ন করছো?
হ্যাঁ করছি। তুই কেমন করে , এত নিশ্চিত হচ্ছিস সেটাই জানতে চাইছি। তুই দেখেছিস ওদের একসঙ্গে?
না
মুকুলকে জিজ্ঞেস করেছিস কিছু?
না
তাহলে? শাওনের সঙ্গে কথা বলেছিস?
না সেটাও বলিনি।
তাহলে কি করে এত নিশ্চিত হলি? ওই হিন্দি সিরিয়ালের মত ভিডিও টিডিও দেখেছিস কিছু?
রাগে আমার সমস্ত শরীর জ্বলছে। আমি কোন মতে বললাম
সেসব দেখার কোন প্রয়োজন নেই। আমি ঘাস খাই না। আমি ওর ফোনে ওদের কনভারসেশন পড়েছি। সেই সব ভাষা আমি মুখেও আনতে পারবনা
ওতেই বুঝে গেলি?
আরো শুনতে চাও? ওর ফোনের পাসওয়ার্ড সিকোয়েন্স এস। এস দিয়ে কি হয় বলো ? আমাদের কারো নাম এস দিয়ে?
এস দিয়ে শাহনাজ।
কে?
ওর মায়ের নাম শাহনাজ। বাড়ীতে যাকে দেখিস সে যে ওর আসল মা না সেটা নিশ্চই বুঝতে পেরেছিস? এত বোকা তো তোকে আমার মনে হয়নি।

আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। আলমারির ড্রয়ারে ওর বাবা মায়ের ছবি আমি দেখেছি। কিন্তু ওর মায়ের নাম কি আমি জানিনা। কি অদ্ভুত এই বিষয়টা একবারও আমার মাথায় আসেনি। বেশ কয়েকবার ভেবেছি ওকে ওর মার কথা জিজ্ঞেস করবো তারপর মনে হয়েছে থাক; যখন নিজে থেকে বলবে তখনই না হয় শুনবো। কিন্তু সে যাই হোক, তাতে তো আর শাওনের ব্যাপারটা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে না। তাকিয়ে দেখলাম আন্টি আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম
ঠিক আছে সেটা না হয় বুঝলাম। তাই বলে তো আর শাওনের ব্যাপারটা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে না।
না তা কেন হবে
এই যে দেখেছো। তুমি ওর ব্যাপারে আগে থেকে জানতে। জানতে না?
জানব না কেন?
তারপরও তুমি আমাকে এই বিয়েটা করতে দিলে?
শোন তুলি, তোকে কয়েকটা কথা বলি। মুকুল যখন তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিল আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কেন তোকে পছন্দ করল। এর আগেও অনেক ছেলেই আমার কাছে তোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। আমি কখনো তাদেরকে তোদের বাড়ি পর্যন্ত যেতে দেইনি; কেন জানিস, কারণ তারা সবাই তোকে পছন্দ করেছে তোর সৌন্দর্য দেখে। মুকুল সেই রকম নয়। যখন আমার কাছে বলেছিল তোকে বিয়ে করতে চায় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম
কেন? মেয়েটা সুন্দর তাই? ও কি বলেছিল জানিস?
আমি তাকিয়ে আছি, আন্টি বলেই যাচ্ছেন আমি নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছি
ও বলেছিল
না ফুপি। সুন্দর মেয়ে আমি অনেক দেখেছি কিন্তু ওকে দেখে আমার কেন যেন মনে হয়েছে ওর মধ্যে অনেক মায়া। ওর মনটা ভালোবাসায় ভরা। আর একটা কথা ও মনে হয়েছে। কোথাও না কোথাও ওর মধ্যে একটা কষ্ট আছে অনেকটাই আমারই মতন।
তা এসব কথা আমাকে বলল না কেন?
বলতে চেয়েছিল আমি নিষেধ করেছি। বললেও তুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতি না। তোর ঠিকই মনে হত ওর অন্য কোন মতলব আছে।
আমি চুপ করে রইলাম। কথা মিথ্যা নয়। বিয়ে করতে চেয়েছে তাতেই আমি ওকে কত খারাপ ভেবেছি। আর ভালো লাগার কথা বললে তো……
কি ভুল বললাম?
উনার কোথায় আমার ধ্যন ভাঙলো। আমার রাগ তখনও কমেনি আমি আবারো বললাম
এতে কিছু প্রমাণ হয় না।
হু , আমি কিন্তু প্রথমে এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না
আমি চমকে উঠলাম। রাজি ছিল না তবুও আমাকে এত জোর করেছে? এত বুঝিয়েছে?
তো রাজী হলে কেন?
কারন মুকুল তোকে সত্যিই ভালোবাসে।
হাহ! এটাও এখন আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
তুই বিশ্বাস কর বা না কর, এটাই সত্যি। আমি প্রথমে ভয় পাচ্ছিলাম যে তুই হয়ত তোর অতীত ভুলে ওর সঙ্গে সহজ হতে পারবি না। কিন্তু ও আমাকে আশ্বস্ত করেছিল, বলেছিল যতটা ইনসিকিওরিটি নিয়ে ওর দিন কেটেছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে আমি ওকে আগলে রাখব।
আমার কেন জানিনা কান্না পাচ্ছে, ভীষণ ভীষণ রকম কান্না পাচ্ছে; তবু আমি গলায় জোর এনে বললাম
এই তার নমুনা। ও কি করে এটা করতে পারল?
আর কি করেছে ও ?
আর কি? এত টুকু কি যথেষ্ট না? তবু বলি আরো আছে। কক্সবাজারে গিয়ে পুলে নেমে জলকেলি করার প্ল্যন করেছে দুজন। প্রতিদিন দুজন একসাথে লাঞ্চ করতে যায় দুপুরে। আমি নিজে ফোন করে খোজ নিয়েছি। আর কি চাও?
আমি তাকিয়ে দেখি আন্টি মুখে আচল চেপে হাসছেন। আমার রাগটা আবার ফিরে এল। আমি কট্মট করে বললাম
তুমি হাসছ?
তো কি কাঁদব? তুই ওকে জিজ্ঞেস করতে পারতি। চার্জ করতি ওকে? ঝগড়া করতি। এই রকম পালিয়ে গেলি কেন?
পালিয়ে যাইনি। ওকে সুযোগ করে দিয়ে গেছি।
কিসের সুযোগ?
থাকুক নিজের শাওনকে নিয়ে?
তুই শাওন কে দেখেছিস?
না। তুমি নিশ্চই দেখেছ
দেখব না কেন? এই বাড়িতে কত এসেছে।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
এখানে এসেছে?
হ্য। গতমাসেও তো এসেছিল বউ বাচ্চা নিয়ে। বউটা ভারি মিস্টি কিন্তু বাচ্চাটা সেই রকম দুষ্ট।
বউ বাচ্চা মানে?
মানে আবার কি? শাওন বিবাহিত। ওর তিন বছরের মেয়ে আছে। আমি তো ওর বিয়েতেও গেছি। ওর বউ আমার বান্ধবির মেয়ে।
আমি হঠাত করে বলার মতো কিছু খুজে পেলাম না
আন্টি এগিয়ে এসে আমার কাধে হাত রাখলেন। নরম গলায় বললেন
তোর সঙ্গে এমন কেন হচ্ছে জানিস? কারন তুই মনে করিস পৃথিবীর সব ছেলেই চরিত্রহীন। শোন, কিছু পুরুষ চরিত্রহীন এটা সত্য এবং তোর আশেপাশে হয়ত এদের সংখ্যাই বেশি কিন্তু সব পুরুষ চরিত্রহীন এটা ভুল। তুই একটা ভুল সত্যকে আঁকড়ে ধরে সংসার শুরু করেছিস। মুকুলকে তুই ভালোবাসিস কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিস না। তোর ধারনা সব পুরুষেরা লম্পট আর মেয়েরা সাধু? এটা ও ঠিক না। খারাপ মেয়ের সংখ্যা ও কম নেই এই পৃথিবীতে। এই যে তোর শাশুড়ি, সে কি ছিল জানিস? মুকুলের আয়া। ওর যখন চার বছর বয়স তখন ওদের গাড়ির এক্সিরেন্ট হয়। ভাইজান আর মুকুলের তেমন কিছু না হলেও ভাবির আঘাত বেশ গুরুতর ছিল। সে সময়ই তাকে রাখা হয়। এক্সিরেন্টের পর ভাবি প্রায় ছয় মাস বিছানায় ছিলেন। ভাবি মারা যাবার দুমাস পর ভাইজান ঘোষণা দিলেন বিয়ে করছেন। মুকুলের দোহাই দিয়ে ওকে বিয়ে করলেন। ভাইজানের উপরে আমরা কেউ কখনো কথা বলিনি। কেন উনি এই সিধান্ত নিয়েছিলেন আমারা কেউই বুঝতে পারিনি সেসময়। পরে অবশ্য জেনেছি। সে যত খারাপই হোক ছোটবেলেয় মুকুলকে আগলে রেখেছে। ওর লোভ ছিল বিষয় সম্পত্তির। ভাইজান মারা যাওয়ার আগে বাড়িঘর, বিষয় সম্পত্তি সব নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিল। ভেবেছিল টাকা দিয়ে ছেলেকে আটকে রাখবে কিন্তু মুকুল আর সবার মতো না রে। ওর এসবে কোন আগ্রহ নেই। ছেলেটা শুধু মায়ার কাঙ্গাল। আমাকে বলে তোকে দেখলে নাকি ওর মায়ের কথা মনে পড়ে। ভাবির ও বিড়াল কুকুরের খুব শখ ছিল। তুই ওর সঙ্গে একবার কথা বলতে পারতি। শুধু শুধু ছেলেটা কে টেনশনে রাখলি। তোকে খুজে না পেয়ে কত অস্থির হয়ে গেছিল জানিস?

আমি কোনমতে বললাম
ও এখন কোথায় ?
ছাদে আছে। যা দেখা করে নে।
বাইরে তো বৃষ্টি পরছে। ছাদে কি করছে?
জানিনা। যা গিয়ে দেখ।

আন্টি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। লজ্জায় আমার সারা শরীর কুকড়ে আছে। আমি এখন কিছুতেই ওর মুখোমুখি হতে পারব না। আমি আস্তে আস্তে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। অঝোর ধারা নেমেছে আমার চোখেও। দরজা খোলার শব্দ পাচ্ছি। আন্টি নিশ্চই আবার ফিরে এসেছেন। কেউ একজন আমার কাধে হাত রাখল। আমি পাথরের মত জমে গেলাম। পেছন ফিরে তাকাবার সাহস আমার নেই। মুকুল দুই হাতে আমার কাধ ধরে ওর দিকে ফেরাল তারপর চিবুকটা তুলে ধরে বলল
একি অবস্থা হয়েছে কাঁদতে কাঁদতে?
আমি ওর বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানিনা। একসময় মনে হল মুকুল হাসছে। আমি মুখ তুলে দেখলাম ও সত্যি সত্যই হাসছে। মুহূর্তেই আমর রাগটা আবার ফিরে এল। আমাকে এত যন্ত্রনা দিয়ে এখন হাসছে। আমি কট্মট করে বললাম
হাসছ কেন তুমি?
হাসব না তো কি করব? তুমি শেষমেশ শাওনকে নিয়ে সন্দেহ করলে? আর কাউকে পেলে না। তবে একটা ব্যপার ভালো লেগেছে।
কি?
তুমি আমার ব্যপারে এতটা পসেসিভ এটা আমি জানতাম না। যাক চল।
কোথায়?
শাওন এসেছে। চল দেখা করে আসি।
না। আমি বাড়ি যাব।
আচ্ছা চল তাহলে বাড়ি যাই। রিক্সা করে ভিজতে ভিজতে যাব।
মুকুল এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল। আমি ওর হাতে হাত জড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। এত দিন এই হাত ধরেছি কেবলই ভালোলাগায় আজ ধরলাম পরম নির্ভরতায়।

সমাপ্ত

ভুল সত্য পর্ব-১৯

0

ভুল সত্য
১৯

ভেবেছিলাম হোস্টেলে উঠেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে লম্বা ঘুম দেব কিন্তু ঘরে ঢুকেই মাথা আউলা হয়ে গেল। আমাকে বলা হয়েছিল সিঙ্গেল রুম সঙ্গে একটা এটাচ বাথরুম। কিন্তু ভেতরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না। ছোট্ট একটা ঘুপচি টাইপের ঘর। কায়দা করে তিনটা বেড ফেলা হয়েছে। বিছানার পাশে নিয়ম মত একটা টেবিল ঠিকই আছে কিন্তু এই সাইজের টেবিল কোথা থেকে আমদানি করেছে সেটা একটা বিস্ময়। আমাদের টি টেবিলের সাইজ এর থেকে বড়। কোন বইয়ের তাক নেই। জামা কাপড় কোথায় থাকবে বুঝতে পারছি না।
আমাকে যে মেয়েটা ঘর দেখিয়ে দিল সে এখানে রান্নাবান্নার কাজ করে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম হোস্টেল ম্যানেজার বা সুপার যাই হোক তার সঙ্গে কি করে দেখা করা সম্ভব। সে জানালো তিনি ঘন্টাখানেক পর আসবেন। এখানে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন। উপায়ান্তর না দেখে আমি ঘরের ভেতর পা বাড়ালাম। ।

ভেতরের অবস্থা আরো ভয়াবহ। পুরো ঘর জুড়ে সিগারেটের গন্ধ। কারণ অন্বেষণ করতে গিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কোনার দিকের খাটে একটা মেয়ে বসে আছে।
শ্যামলা মতন কোঁকড়ানো চুল, বড় বড় চোখ। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। রাতের বেলা হলে ভয় পেয়ে যেতাম নির্ঘাত। মেয়েটা আমার দিকে না তাকিয়েই নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল
শীতের পাখি নাকি?
কণ্ঠস্বর বেশ মিষ্টি তাই রাগ করতে পারলাম না। খাটের উপর ব্যাগ রেখে বললাম
কি বললে?
বাবা মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছ?
শীতের পাখিরা কি বাবা মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে এখানে আসে?
মেয়েটা একটু অদ্ভুত ভঙ্গিতে আসলো। তারপর বলল
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না, রেগুলার মাল
রেগুলার মালরা কি করে?
মেয়েটা আবারো অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর বলল
তোমার মত মেয়েরা বাবা মা কিংবা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বিলাসিতা করে এখানে ওঠে তারপর দু-তিন বাদে তারা এসে মান ভাঙ্গিয়ে নিয়ে যায়। এই আর কি। কমন কেস।
কথাবার্ত এই পর্যায়ে হোস্টেল সুপারকে হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে দেখা গেল। আমার মেজাজ এমনিতেই খারাপ হয়ে ছিল। আমি তেতে উঠে বললাম
এই রুমটাই কি আমার? আপনি তো বলেছিলেন সিঙ্গেল রুম
উনি ওনার স্থূলকায় শরীর নাচিয়ে ভেতরে ঢুকে বললেন
হ্যাঁ হ্যাঁ সিঙ্গেল রুমই তো
তাহলে এখানে যে বসে আছেন তিনি কি? একটা শোপিস?
ও এখনো যায়নি?
আর অন্য বেডটা কি আমার জামা কাপড় রাখার জন্য?
আরে আপা এত রাগ করেন কেন?
ওই বেডে যে ছিল তার বিয়ে হয়ে গেছে। বেড সরায়া ফেলা হবে।
আর ইনি?
এর তো তিন মাসের ভাড়া পাওনা। পরশুদিনের মধ্যে ভাড়া দিতে না পারলে ইনিও গন
মেয়েটা বসা অবস্থা থেকে হাতের মধ্যে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল তারপর আয়েশ করে ধোয়া ছেড়ে বলল
চেষ্টা করে দেখেন। আমি বের হয়ে গেলে আপনার হোস্টেলে না সার্কিট হয়ে যায়
মহিলা এবার একটু নরম হয়ে বললেন।
আচ্ছা ঠিক আছে সে দেখা যাবে। তারপর আমার কাছে এসে গলা নামিয়ে বললেন
আপা, মেয়ে ভালো। একা একা থাকবেন ভয় লাগবে না? থাকুক কয়দিন। সামনের মাসে এরে পাশের রুমে পাঠায়া দিব। তখন পুরা ঘর আপনার।
আপনি ভাঙ্গা মাসে উঠছেন তো
কিন্তু টাকা তো পুরো মাসেরই নিয়েছেন
আচ্ছা ছাড়েন এসব। দুপুরে কি খাবেন বলেন?
ভদ্রমহিলা এমন ভাব করছেন যেন এটা একটা রেস্টুরেন্ট; যা চাইবো তাই এনে হাজির করবে। আমি ইচ্ছে করেই বললাম
সরপুঁটি মাছ ভাজা, ঘন মুগের ডাল আর সাদা ভাত
মহিলা বিগলিত হয়ে বললেন
আপা যে কি বলেন। আজকের মেনু খুচুরি, আলু ভর্তা আর ডিম ভুনা। সাপ্তাহিক মেনু ডাইনিং এ টানানো আছে। চা কফি খেতে চাইলে নিজ খরচে। মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে সেখান থেকেও আনাতে পারেন।

চা এর কথা শুনে চা খেতে মন চাইছে। মোড়ের দোকানে গিয়ে খেয়ে আসা যায় বেরোতে ইচ্ছা করছে না। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা যায় সেটাও ইচ্ছা করছে না। আমি ব্যাগ খুলে একটা চাদর বের করে বিছানাটা গুছিয়ে ফেললাম।আসার আগে শুধু আমার ব্যগপ্যক টা সাথে এনেছি।দুই জোড়া জামা, একটা বিছানার চাদর তোয়ালে , ল্যাপটপ মোবাইল ছাড়া আর কিছু ই আনতে পারিনি। ভেবেছিলাম সব কিনে নেব। একটা তালা অব্ধি কেনা হয়নি। ভাগ্যিস গয়নাগুলো মার ওখানে রেখে এসেছিলাম।

এভাবে বাড়ির বাইরে কখনো একা থাকিনি। হাত পা ছড়িয়ে কাদতে ইচ্ছে করছে।
কান্নাকাটি করে কোন লাভ হবে না। বাড়ি ফিরে যাও
আমি চমকে উঠলাম। এই মেয়ের দেখি মাথায় পেছনে ও চোখ আছে। আমি কিছু বললাম না। কিন্তু ও কথা থামাল না বলেই যেতে লাগলো।

চার ঘন্টা ও এখানে টিকতে পারবে না। পাশের বেডের মদিনা যখন আসবে তখন টের পাবে।
আমি আতকে উঠে বললাম
কেন? সে না চলে গেছে?
আরে ধুর! ওই মুটকির কথা বিশ্বাস করেছ নাকি। মদিনা আসে গভীর রাতে ভোরের আগে বেরিয়ে যায়। সুটকেস টুটক্যেস তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ভালো করে তালা মেরে রেখ। ওর হাত টানের অভ্যাস আছে। আমার ন্যপকিনটা পর্যন্ত ছাড়ে না।
এই মেয়ের বকবকানি শুনে মাথা ধরে যাচ্ছে। তোর এত কি? তবে যতই ভাবলেশহীন ভাব ধরে থাকি না কেন এবার আমার সত্যিসত্যিই চিন্তা হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার। মুকুল নিশ্চয়ই এতক্ষনে বাড়ি চলে এসেছে। আমি আসার আগে কাউকে বলে আসিনি। ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা চিরকুট রেখে এসেছি। বিস্তারিত কিছু লিখিনি, শুধু লিখেছি “আমি চলে যাচ্ছি। আপনি আপনার শাওনকে নিয়ে সুখে থাকুন”। ও নিশ্চয়ই এতক্ষণে মাকে জানিয়ে দিয়েছে। মা নির্ঘাত তুলকালাম করে ফেলেছে এতক্ষণে।
কেসটা কি? বাবা মায়ের সাথে অভিমান নাকি স্বামীর পরকীয়া।
এবারে আমার মেজাজটা সত্যি সত্যি খারাপ হলো। আমি বিরক্ত কন্ঠে বললাম
তোমাকে কি হোস্টেল খালি করার কাজে নিয়োগ দেয়া হয়েছে? যে আসবে তাকে ভয় দেখিয়ে বিদায় করে দিতে হবে?
মেয়েটা এবার হেসে ফেলল এবং আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর শ্যামলা মুখশ্রী সঙ্গে হাসিটা বেশ মানিয়ে গেছে। ও আমার দিকে সিগারেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
একাটা টান মেরে দেখো। মাথার ভেতর যে ধোঁয়াশা জমে আছে একটানে সব খালি হয়ে যাবে।। কান্না থেমে যাবে নির্ঘাত।
আমি এর আগে সিগারেট খেয়েছি দুই একবার। তবে বিশেষ সুবিধা করতে পারিনি। তবু হাতে তুলে নিলাম। এই ব্যাপারটা আশ্চর্যের। মানুষ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পাশের জনকে এগিয়ে দিতে পারে না কিন্তু সিগারেট অবলীলায় অন্য জনকে অফার করা যায় এবং সেও তা নির্দ্বিধায় ঠোটে ছুঁয়ে ফেলে। আমি লম্বা একটা টান দিলাম। মাথার ভেতরের ধোঁয়াশা তো কাটলোই না বরং ফুসফুসের মধ্যে জ্যাম বেধে গেল। আমি কাশতে কাশতে সিগারেট ওর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম
এই জিনিস খাও কি করে? সিগারেট নাকি গাজা?
গাজা না। সিগারেটই, তবে সস্তা ব্র্যান্ড।
মেয়েটা এবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
আমি নিবেদিতা। চারুকলা থার্ড ইয়ার।
আমি নিজের পরিচয় দিলাম। চারুকলার সঙ্গে জিন্স এবং সিগারেটের বোধহয় গভীর সম্পর্ক আছে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই দুটোই তাদের ব্যবহার করতে দেখা যায়। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই জায়গায় বেশি দিন থাকা যাবে না। ঘর ভর্তি সিগারেটের ধোঁয়া। এক রুমমেট বাচাল অন্যজন চুরিতে সিদ্ধহস্ত। বাথরুম রান্নাঘর তো এখনো দেখাই হয়নি। সেখানে কি অপেক্ষা করছে কে জানে।

চারিদিকে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। ঘরের পরিবেশ কেমন ভৌতিক। আমি এতক্ষণ পর আমার মোবাইলটা অন করলাম। যা ভেবেছিলাম তার থেকেও খারাপ অবস্থা। ১৯৬ টা মিসকল। ৮৫ টা মেসেজ। শেষ মেসেজটা করেছেন রেহানা আন্টি। সেটা পড়ে আমার আক্কেল গুরুম হয়ে গেল। আমি আমার ব্যগপ্যকটা কাধে নিয়ে ভো দৌড় দিলাম। পেছনে বলতে শুনলাম
চার ঘন্টা বলেছিলাম ২ ঘন্টা ৩৩ মিনিটের মাথায়ই কেল্লা ফতে।
আমি সেই মন্তব্য উপেক্ষা করে সামনে যে খালি রিকশা পেলাম তাতেই লাফিয়ে উঠে পড়লাম।
রেহানা আন্টি লিখেছেন আমার খবর শুনে মা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছিল। এখন তিথিদের বাসায় আছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক।

আমি দৌড়াতে দৌড়াতে তিথিদের বিল্ডিং এর সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। ওদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই। ভেতর থেকে বেশ গল্প গুজবের শব্দ ভেসে আসছে। আসারই কথা ভেতরে যখন আশঙ্কাজনক রুগী। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মা টেবিলে বসে চা খাচ্ছে। টেবিল ভর্তি নানান পদের মিষ্টি। রেহানা আন্টি বিস্কুট আর ডালপুরি এগিয়ে দিতে দিতে বলছেন
আপা তো কিছুই খাচ্ছেন না। আরেকটু নিন। আজ এত খুশির একটা দিন।
তিথি রান্নাঘর থেকে লজ্জা লজ্জা মুখ করে বেরিয়ে এসে বলল
আরে তুই এসে গেছিস? আয় বস। চা নে।

বিরাট ভুল হয়ে গেছে। উপরে ওঠার আগেই নিচের ডাস্টবিন থেকে এক বালতি ময়লা নিয়ে ওঠা উচিত ছিল।। সেটা টেবিলের উপর ঢেলে দিতে পারলে আমার মনে শান্তি আসতো।

চলবে………

ভুল সত্য পর্ব-১৮

0

ভুল সত্য
১৮

কিরে, তুই আজকে কলেজে এলি যে?
তিথির কথা শুনে আমি বিরক্ত হয়ে তাকালাম
কেন? কলেজে আসব না কেন?
শুনলাম ভাইয়ের জ্বর, তা বরকে ফেলে চলে এলি?
জ্বর তো কি হয়েছে? তাকে দেখার লোকের কি অভাব?
খুব সেবা যত্ন করছিস শুনলাম
আমার আপাদমস্তক জ্বলে গেল। এরা দেখি সব খবরই রাখে, তা এত খবরই যখন রাখে তখন শাওনের খবরটা রাখতে পারল না? এক মিনিট! নিশ্চয়ই এরা শাওনের ব্যাপারে সব জানে। আমি একটু রাগত স্বরেই বললাম
সব খবরই রাখিস দেখছি।
রাখবো না কেন? আমার প্রিয় বান্ধবী আর আমার একমাত্র ভাই
তাহলে তো শাওনের খবরও জানিস নিশ্চয়ই
তিথি একটু অবাক হয়ে বলল।
কেন, তার আবার কি হলো?
যা ভেবেছিলাম তাই। তার মানে এরা সবাই শাওনকে চেনে।
তুই শাওন কে চিনিস?
ওমা, চিনবো না কেন?
কতটুকু চিনিস?
মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়িতে এসেছে। আমার চেয়ে মায়ের সঙ্গে ভাব বেশি ।
এই কথা শুনে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল । যাও ভেবেছিলাম তিথির সঙ্গে পুরো বিষয়টা শেয়ার করব সবকিছু নিয়ে একটা আলোচনা করব তারপর হোস্টেলে ওঠার ডিসিশন নেব। কিন্তু না, এখন ঠিক করে ফেলেছি, আর কোন অবস্থাতেই কারো সঙ্গে কোনো কথা বলবো না।

আমি ক্লাস আছে এই ছুতো করে ওর সামনে থেকে চলে গেলাম। ক্লাস আসলেই ছিল কিন্তু মন বসলো না। আমি পরের ক্লাসটা না করে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কাল দুটো হোস্টেলের সাথে কথা বলেছি। কথা বলে তো ভালোই মনে হয়েছে। লোকেশন ভালো। একটা আজিমপুরে অন্যটা রায়ের বাজারে। আজিমপুর হলেই আমার জন্য ভালো। কলেজ থেকে কাছাকাছি হবে তাছাড়া আমি রায়ের বাজারে থাকতেও চাই না। মুকুলদের বাসা শংকর, কাছাকাছি এলাকায় থাকলে দেখা যাবে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যাবে।

আমি রিক্সা নিয়ে হোস্টেল দুটো থেকে ঘুরে এলাম। দুটোর একটাও পছন্দ হলো না। আজিমপুরেরটাতে শেয়ারের রুম, শেয়ারের বাথরুম। জঘন্য অবস্থা। আর রায়ের বাজারেরটা এমন চিপা গলির ভেতর যে রাত বিরাতে ওখানে যেতে গেলে ভয়ই আমি মরে যাব। লাভের লাভ কিছু তো হলোই না উল্টো ড্রেনের মধ্যে পা পিছলে পা কেটে ফেললাম খানিকটা। কাটা পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসায় ফিরে আমি হতবাক। আমার শাশুড়ি নাজুকে নিয়ে বাজার করতে চলে গেছে। অসুস্থ ছেলেকে একা ফেলে এই মহিলা বাজার করতে চলে গেল? আমি আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা পর্যন্ত করতে পারল না। কি জানি কি খেয়ে আছে সকাল থেকে। আমি দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। ঠিক যতটা উদ্বেগ আর অস্থিরতা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম ততটাই রাগ আর হতাশা আমাকে ঘিরে ধরল। মুকুল পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছি আর উচ্চস্বরে হাসছে। আমি একটু থেমে ওর কথা শুনতে লাগলাম ও হাসতে হাসতে বলছে

তুমি যে কি বলো না তোমার কথা শুনে আমার কান গরম হয়ে যাচ্ছে।

ওই পাশের কথা শোনা যাচ্ছে না তবে মুকুলের হাসি আবারো শুনতে পেলাম।
রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। আমি ঘরের ভেতর ঢুকে ব্যাগ একপাশে রাখলাম শব্দ করে। মুকুল আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তারপর ইশারায় জানতে চাইলো এত তাড়াতাড়ি কেমন করে এলাম। আমি দাঁতে দাঁত পি্ষে মনে মনে বললাম এসে মনে হয় বিপদে ফেলে দিয়েছি? মুকুল আবারো ফোনে মনোযোগী হয়ে বলল
আচ্ছা ঠিক আছে রাখছি এখন
আবার ওই দিককার কথা শোনা গেল না। মুকুল বোধহয় আমাকে শোনানোর জন্যই বলল
হ্যাঁ বউ চলে এসেছে এখন আর তোমাকে দরকার নেই।
কত বড় বেয়াদব। আমার সামনে এসব কথা বলা শুরু করেছে। সামান্যতম চক্ষু লজ্জা পর্যন্ত নেই। মুকুল হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডাকল আমি কাছে এসে বললাম কার সঙ্গে কথা বলছিলেন ?
আমার কলিগ
কোন কলিগ?
তুমি চিনবে না
শয়তান একটা। না চেনালে চিনব কি করে? আমি ইচ্ছে করেই বললাম
আমাদের বিয়েতে এসেছিল?
কে শাওন? না ও আসতে পারেনি। কি যেন একটা ঝামেলা ছিল ওর। বাদ দাও ওর কথা। তুমি এত তাড়াতাড়ি এলে কি করে?
কেন তাড়াতাড়ি এসে কি আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম?
তোমার পরীক্ষা বলেছিলে, তাই জানতে চাইছি
আরে তাই তো! আমার তো পরীক্ষা ছিল লাস্ট পিরিয়ডের একদম ভুলে গেছি। কি যে সব হচ্ছে আমার সঙ্গে। কেন যেন রাগ অভিমান বাদ দিয়ে ভীষণ মন খারাপ লাগছে। আমি ওর পাশে বসে বললাম
শাওনকে কি আপনি অনেক দিন ধরে চেনেন ?
হ্যাঁ প্রায় তিন বছর
ও কি শুধুই আপনার কলিগ?
আমরা ভালো বন্ধু ও। তুমি হঠাৎ ওকে নিয়ে পড়লে কেন?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম এমনি। দুপুরে খেয়েছেন কিছু?
না এখনো খাইনি। বাসায় কি কেউ নেই?
না সবাই বাজার করতে গেছে। টেবিলে নোট রেখে গেছে। আপনার খাবার কি এখানে নিয়ে আসবো?
না তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো তারপর একসঙ্গে খাই
খাওয়া টেবিলেও আমি বিশেষ কথা বলতে পারলাম না। আমার কেন যেন অসম্ভব মন খারাপ লাগছে। চেষ্টা করেও একটু স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছি না । যে আমি সারা জীবন অভিনয় করে এসেছি, নিজের বাবা-মা অতি পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে অভিনয় করেছি সারাক্ষণ; সেই আমি এখন কিছুতেই নিজেকে লুকাতে পারছি না। মুকুল বোধ হয় সেটা লক্ষ্য করেই বলল
কি হয়েছে তুলি? মন খারাপ? পরীক্ষা খারাপ হয়েছে? আমার জন্য পড়তে পারেনি তাই না?
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম
না না আজকে পরীক্ষা হয়নি।
তাহলে কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে বললাম কালকে আপনি অফিসে যাবেন?
হ্যাঁ যাবো। সামনে ছুটি নিচ্ছি তো তাই এখন মিস করা যাবে না।
সামনে কিসের ছুটি ?
ও খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমার হঠাৎই মনে পড়ল, আরে তাইতো, আমাদের তো মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা সামনের সপ্তাহে। মনটা আগের চাইতেও বেশি খারাপ হয়ে গেল।

আমি পুরো বিকেলটা ছাদেই থাকলাম। মুকুল সারা দুপুর বিকেল ঘুমিয়ে কাটাল। সন্ধ্যার দিকে উঠে ওষুধ খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সত্যিই অনেক ধকল গেছে ওর উপর। কনফারেন্স এর আগেও দিনরাত পরিশ্রম করেছে, তারপর জার্নির ধকল। আমি অনেক রাত করে ছাদ থেকে নামলাম। ঠিক করে রেখেছিলাম একটুও কাঁদবো না কিন্তু কেন যেন ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখে ভীষণ কান্না পেল।

ঘরে ঢুকে দেখি ওর ফোন বাজছে। ও একেবারে ঘুমে কাদা হয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে ফোন ধরার আগেই রিং বন্ধ হয়ে গেল। তারপর টুং করে একটা মেসেজ এল। সেই মেসেজের ভাষা দেখে আমার ইচ্ছা হল বার্তা প্রেরণকারী আর গ্রহীতাকে যদি একসাথে দাঁড় করিয়ে ঝাড়ু দিয়ে পিটাতে পারতাম তাহলে আমার মনে শান্তি আসতো। মেসেজ লিখেছে
হ্যভ আ সুইট নাইট বাবু। তার সাথে বেলুনের মতো উড়ে যাওয়া কতগুলো হার্ট সাইন।

চলবে………