Wednesday, July 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 193



অঙ্গারের নেশা পর্ব-১১+১২

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১১

উত্তাল বাতাসের ধাক্কায় জামা কাপড় তাল মিলিয়ে উড়ছে। চুলগুলো মুখ ঢেকে দিচ্ছে বারংবার, তিন চার সরিয়ে দিয়েছিলো প্রানেশা। এখন আর বলছেনা, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে টানটান হয়ে তাকিয়ে আছে সে। সকাল বাজে আটটা। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ায় চোখের পাতা থেকে নিদ্রা বিদায় নিয়েছে। হাত মুখটা ধুয়ে এক ড্রেসেই জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জানালায় কোনো গ্রিল নেই, তাই হাওয়ার বেগ বেশী। বাহিরে কিছু বিদেশি মানুষের আনাগোনা দেখা যায়। এসব দেখতে দেখতে পেছনে থেকে দুটো হাত জড়িয়ে ধরলো তাকে৷ চমকে পেছনে তাকাতেই দেখলো সুফিয়ান ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। অধরে নিষ্পাপ হাসি, চুলগুলো এলোমেলো। পায়ে একটা ট্রাউজার, গায়ে কিছু পড়েনি। প্রতিদিনই সুফিয়ান জামা খুলে ঘুমায়। কিন্তু প্রানেশা এটায় এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। খালি গায়ে দেখেই প্রানেশা লজ্জায় চোখ ফেরায়। সামনে ফিরতেই সুফিয়ান প্রানেশার কোমরে হাত রেখে আলতো করে টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকালো। প্রানেশা তাকাতেই সুফিয়ান নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রানেশার নাকের ডগায় চুমু খেলো। প্রানেশা ভ্রু বাঁকিয়ে বললো- ‘ নাকে কেউ চুমু খায়!
সুফিয়ান বাদামি রঙয়ের পুরুষালি ঠোঁট চেপে নেশা নেশা কন্ঠে বললো- ‘আমি খাই। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তোমার নাক, ইয়োর নোজ’
প্রানেশা মুখ কুঁচকে বললো -‘ ইহ! নাক! সিরিয়াসলি?’
সুফিয়ানের এমন মুখ কুঁচকানোটা ঠিক পছন্দ হলো না। আমাদের প্রিয় কোনো জিনিসকে যখন কেউ বলে’ছিইই,ওটাতো নোংরা জিনিস! ‘ তখন যেমন ওই মানুষটার কথায় আমরা বিরক্ত হই তেমনই কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো সুফিয়ান। প্রানেশার হালকা নাকটা টেনে দিয়ে বললো- ‘ তোমার এই টার্কিশ নায়িকাদের মতোন নাকটাই তো আমি প্রথম দেখে প্রেমে পড়েছি প্রাণ, এই নাকটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো স্পর্ধা করবে না ‘

প্রানেশার চোখে মুখে খেলে গেলো প্রশ্নের বাহার। তার নাকের প্রেমে পড়েছিলো সুফিয়ান। কিন্তু কবে? সুফিয়ানের কাঁধে এক হাত রেখে মুখ তুলে প্রশ্ন করলো -‘ আপনি প্রথম কবে দেখেছিলেন সুফিয়ান?’

সুফিয়ান উপর দিকে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিলো। এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মনে মনে কিছু আওরালো । ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবলো, তারপর প্রানেশার কোমড় চেপে জানালার উপর বসালো। প্রানেশা ভয় পেয়ে সুফিয়ানের গলা আঁকড়ে ধরলো, ভয়ে মুখ লাল হয়ে গেছে। বেশি ফর্সা হলে যা হয় আর কি! সুফিয়ান কোমর শক্ত করে ধরে বললো-
‘পড়বে না, আমি আছি তো’

প্রানেশা ভয় ভয় চোখে তাকালো৷ সুফিয়ান হেসে বললো -‘বিশ্বাস নেই আমার উপর? ‘

প্রানেশা বড় শ্বাস নিয়ে বললো-‘আছে ‘

সুফিয়ান প্রানেশার হালকা মেজেন্ডা চুলগুলো নিয়ে খেলতে শুরু করলো। প্রানেশা টের পেলো না, যে সুফিয়ান তাকে প্রসঙ্গ ভুলিয়ে দিয়েছে। সুফিয়ান অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো –
‘আমার যেমন তোমার নোজ পছন্দ তেমন তোমার কী পছন্দ আমার?’

প্রানেশা খানিক পর্যবেক্ষণ করলো সুফিয়ানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত। চেহারার দিকে তাকাতেই মনে পড়লো ‘রেয়ান’ নামক অধ্যায়ের। চোখ তুলে সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে একধ্যানে লক্ষ্য করলো, সুফিয়ান আর রেয়ান দুজন আলাদা ব্যাক্তি একদমই আলাদা৷ এই যে সুফিয়ানের ঠোঁটটা, ভ্যানিলা আইসক্রিমের মাঝে চকলেট চিপস মিশে যে রঙ হয় এমন রঙটা রেয়ানের নেই। সুফিয়ানের চোখের মতোন এত গাঢ় কালো বড় মণির ন্যায় লম্বা পাপড়িতে ঘেড়া অক্ষিযুগোলের অধিকারী রেয়ান নয়। কন্ঠ, চলাফেরায় রাজকীয় গাম্ভীর্যে লেপ্টানো ব্যাক্তিত্ব রেয়ানের মাঝে পরিলক্ষিত হয়না।প্রানেশা খেয়াল করলো, এতো মনোযোগ দিয়ে সে রেয়ানকে কখনো লক্ষ্য করেনি।সুফিয়ানের সবকিছুতেই প্রানেশা মুগ্ধ হলো, কিন্ত তুখোড় দৃষ্টি গিয়ে আটকালো সুফিয়ানের গলার এডামস এপেলের খানিক নিচে লাল কালোর সংমিশ্রণে তৈরী মাঝারী তিলে৷ ছেলেদেরও বুঝি এমন আকর্ষনীয় তিল হয়! প্রানেশা বড় ঢোক গিলে নিলো, তার মনে হচ্ছে সে এক ক্ষুদার্ত বাঘ। আর সামনে রাখা তরতাজা মাংসের বড় এক খন্ড। উপলব্ধি করলো সব কিছুর উর্ধে তার ওই তিলটাই সবথেকে ভালো লাগলো। ভীষণ লোভনীয় মনে হলো প্রানেশার, গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে এলো। ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হলো নিগুঢ় হাতে। নাহ,এমন নির্লজ্জের মতোন কাজ সে কখনোই করবেনা। ভেতরের হাসফাস, অস্থিরতা সুফিয়ান ধরে ফেললো। মুচকি হেসে বললো- ‘বললে না যে! ‘

প্রানেশা চোখ মুখ খিচে এক লাফে নিচে নেমে গেলো। বাচ্চাদের মতোন দুই হাতে জামাকাপড় ঝেড়ে বোকা হাসলো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো-

‘আপনি না বলেছিলেন , আমরা নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ড যাবো! ‘

সুফিয়ান হাত ভাজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বললো-
‘হুম, যাবো তো। রেডি হও, এক ঘন্টার মাঝেই বের হবো’

প্রানেশা দ্রুত পায়ে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। ভুলক্রমে হাতের একটা জামা নিচে পড়ে রইলো। সুফিয়ান প্রানেশার অস্থিরতায় হাসলো। জামাটা উঠিয়ে দিতে দিতে বললো-
‘এমন দ্রুত করছো কেনো?’

প্রানেশা হাতে থেকে জামাটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে বিরবির করে বললো-
‘ ছেলেদের জন্যও বোরকার মতোন কিছু থাকার ব্যবস্থা করা উচিত। ছেলেদেরও মাঝে মাঝে মাথা ঘুড়িয়ে দেয়ার রূপ থাকে। যা আমার মতোন দূর্বল হার্টের মেয়েদের জন্য ভয়ংকর, অতি ভয়ংকর, তীব্র ভয়ংকর! ‘

সুফিয়ান বোকার মতোন সেদিকে তাকিয়ে হা করে বললো -‘ আমার রূপ ভয়ংকর! ‘

অস্ট্রেলিয়া-
রংতুলির ছোঁয়ায় সাদা কাগজ যেনো প্রাণ পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠছে। হাতে নীল রঙে রাঙিয়ে আছে। পেইন্টিং স্ট্যান্ডটায় বসানো বড় কাগজটায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের জলে ভেসে আসছে এক কিশোরী মেয়ের শরীর। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে দুই উচ্ছল যুবক।
দুইজনের দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ। নীল টিশার্ট পরিহিত যুবকটির হাতে একটা পেন্সিল। দ্বিতীয়জনের গলায় ঝুলানো বাদামী একটা গিটার। মেয়েটার দেহ এদিকেই ভেসে আসছে। শেষের দিকটায় মাটির রঙ দেয়ার আগেই পুরুষটি পেছনে তাকালো। দরজার বাহির থেকে ভেসে আসছে হালকা চেচামেচির আওয়াজ।
হাতের রঙের প্লেটটা সাইডে রেখে টিস্যু নিয়ে হাতটা মুছে ‘ইউজ মি’ তে ছুড়ে ফেলে দরজা খুলে দিলো।
খুলতেই দেখলো হাঁটুর সমান একটা ড্রেস পড়ে হাই হিলের ফর্সা টলটলে শরীরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে,তার তথাকথিত গার্লফ্রেন্ড। আর আড়ালে পঞ্চম । নীলচোখের পুরুষটি ভ্রু কুচকে বললো-

‘কী হচ্ছে এসব?’

ঘরের মেইড বললো-
‘স্যার, ম্যাম বারবার আপনার রুমে যেতে চাচ্ছিলেন। আপনি তো কাউকে ভেতরে যেতে মানা করেছেন তাই ম্যামকে মানা করছিলাম’

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাউন কাঁধ পর্যন্ত স্ট্রেইট চুলের মেয়েটা এগিয়ে এসে পুরুষটির গায়ের সাথে লেপ্টে গেলো৷ ন্যাকা কান্না করে বললো-
‘ডু ইউ নো? হাও মাচ আই মিস ইউ, ইভ?’

পুরুষটি মেইডের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘গো টু ইওর ওয়ার্ক’

বলেই মেয়েটিকে ঘরে ঢুকিয়ে দিলো, দরজা লাগিয়ে বললো-‘হ্যাজেল! হোয়াট কাইন্ড অফ বিহেভিয়ার ইজ দিস?’

হ্যাজেল নাক টেনে বললো-
‘ইইভ! আই লাভ ইউ ‘

পুরুষটি শুধরে দেওয়ার মতো করে বললো-

‘ কত বার বলেছি! আই এম ইভানান তেহজিব নট ইভ’

হ্যাজেল অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে হওয়ায় আগে বাংলা বুঝতে পারতো না। কিন্তু ইভানানের সংস্পর্শে এসে বাংলা বলতে না পারলেও বুঝতে ঠিকই পারে। ইভানানের কাছে এসে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো-‘হোয়াট এভার! নাও আই ওয়ান্ট ইউ ভেরি ক্লোজ ‘

চলবে…

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব,১২

এক হাতে প্রানেশাকে জড়িয়ে আরেক হাত পকেটে গুঁজে হাঁটছে সুফিয়ান। প্রানেশা বেজায় খুশি। এক্সাইটমেন্টে তার হাত পা কাপছে। অনলাইন, ম্যাগাজিন, টিভি নিউজে বিভিন্ন জায়গায় নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ডের সৌন্দর্যের বিস্তারিত শুনেছে। বিশ্বাসই হচ্ছেনা তার, যে আজ সেও এই জায়গা ঘুরবে, হাত দিয়ে ছুয়ে দেবে। প্রানেশার মনে পড়লো দুই বছর আগে একদিন রেয়ানকে বলেছিলো, বালিতে তাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার। ভেতরের দীর্ঘ শ্বাসকে ভেতরে রেখেই মুখে হাসি টেনে নিলো। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে রেয়ানকে মনমস্তিষ্ক থেকে দূরে রাখতে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় বাঁধাই হলো মুখ অবয়ব। দুই জনের চেহারা এক হওয়ায় কিছুক্ষণ বাদে বাদেই মনে পড়ে যায়। তবে, এখানে এসে প্রানেশা আবিস্কার করছে নতুন সুফিয়ানকে। ভালোবাসা, কেয়ার, আবদার, পজেসিভনেজ সবকিছুতেই নতুন ভাবে প্রেমে পড়ছে প্রানেশা। তবে, ওভার পজেসিভনেসে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হচ্ছে প্রানেশা। এই যেমন হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় প্রানেশা জিন্স শার্ট পড়েছিলো। জিন্স শার্ট যদি ও অনেক বড় আর ঢোলা ছিলো৷ তারপরও সুফিয়ান ভীষণ রেগে বলেছিলো –
‘এসব কী পড়েছো?’

প্রানেশা অবাক হয়ে বললো-
‘কী পড়েছি মানে!সবসময় যা পড়ি। ‘

সুফিয়ান কিছু না বলে একটা প্যাকেট থেকে লম্বা গাউন ও একটা গার্লস ট্রাউজার বের করে দিলো। প্রানেশা না করেনি। চুপচাপ পড়ে নিয়েছিলো৷ এমন নয়,যে প্রানেশা উশৃংখল, আলট্রা মডার্ণ। ছোটবেলা থেকেই যা পড়েছে সেভাবেই ড্রেস কোড ফলো করে। ক্ষমতাবান বাবার মেয়ে হওয়ায় পাওয়ার তো ছিলোই সাথে আবার কাজিনদের সবার ছোট। বংশে দুই মেয়ের বড়জন। তাছাড়া সবাই ভাই । সব ভাই বড় আদরে মানুষ করেছে। তাই, হ্যারেসের মতো ছোটখাটো জিনিসেরও শিকার হওয়ার সুযোগ পায়নি।
কিন্তু তাই বলে সে অবাধ্য নয়। গাউন পড়ে এসে সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে প্রানেশা জিজ্ঞেস করলো –
‘ আমি তো ওগুলো পড়েই যেতে পারতাম, তাহলে এসব কেনো?’

সুফিয়ান জানে প্রানেশার ধর্মীয় আচারের তেমন কোনো জ্ঞান নেই। তাই কোনো প্রকার রাগারাগী না করে মৃদু হেসে বললো –
‘প্রাণ, একটা বইকে তো কভার ছাড়াই বিক্রি করা যায়। কিন্তু তারপরও কভার লাগিয়ে প্যাকিং করে কেনো বিক্রি করে? ‘

‘নরমাল, কারণ কভার লাগানোতে বইয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি তো হয়ই। সঙ্গে ছিড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না, মূলত সেফ থাকে ‘

‘কারেক্ট, তুমি যদি ওগুলো পড়ে যেতে তেমন কিছু হতো না। কিন্তু এই যে, তুমি এগুলো পড়াতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি হলো। নিজেকে ঢেকে হেফাযতে রাখা সুন্নত। এতে তোমার সম্মান, পবিত্রতা বাড়বে। তুমি খারাপ নজর থেকে সুরক্ষিত থাকবে । ‘

প্রানেশা পুরোটা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকালো। সুফিয়ানের মতো করে তাকে কেউ বোঝায়নি। সে যা পড়েছে তাতেই সমর্থন দেয়ায় ভুল আর সঠিকের পার্থক্য বোঝেনি। এভাবেই যদি কেউ বোঝাতো তাহলে ঠিকই বুঝতে পারতো৷ স্বামীদের দায়িত্ব স্ত্রীকে হেফাজতে রাখা। ভূল পথ থেকে সড়িয়ে আনা। স্ত্রীরা ভুল করবেই,কারণ আপন মানুষ ছেড়ে নতুন জায়গায় মানিয়ে নেয়া খুব কষ্টের ব্যাপার। ভুল ত্রুটিগুলো সুধরে নেয়া তাদের দায়িত্ব। এখন যদি সুফিয়ান প্রানেশাকে না বুঝিয়েই সম্পূর্ণটা চাপিয়ে দিতো তাহলে হয়তো প্রানেশা বুঝতো তো পারতোইনা সঙ্গে আঘাত পেতো৷ প্রানেশার মনে সুফিয়ানের জন্য সম্মানের জায়গা তৈরি হলো। তারপর সুফিয়ানের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো। বের হওয়ার পর দেখলো বাহিরে তিনজন গার্ড সহ একজন নতুন ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা এই পজেসিভনেস দেখে বিরক্ত হয়েছিলো। ঘুরতে যাওয়ার সময় যদি এভাবে রোবটের মতোন পেছনে পেছনে ঘুরে তাহলে তো বিরক্ত হবেই। সুফিয়ানের মুখের দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বলেছিলো –
‘শুনুন?’

সুফিয়ান ভাবলো হয়তো প্রানেশার খারাপ লাগছে তাই অস্থির ভাবে বললো –
‘খারাপ লাগছে প্রাণ? ‘

‘উমহু,এই পেছনে আর সামনের বডিগার্ডদের যেতে বলুন না! ‘

সুফিয়ান গম্ভীর মুখভঙ্গিতে বললো-
‘না প্রাণ, সম্ভব নয়। এরা সাথেই থাকবে’

প্রানেশা মুখ লটকে হাঁটতে লাগলো। সুফিয়ান প্রানেশাকে আরও ভালো করে জড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। প্রানেশার পাঁচের মতোন মুখটা দেখে মনে মনে বললো -‘তোমার জন্যই তো এসব প্রাণ, তুমি জানোনা তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে কত হায়নারা ওত পেতে আছে। কষ্ট হলেও এতে অভ্যস্ত হতে হবে তোমায় ‘

গাড়িতে করে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দশটা বাজলো। গিলি গেটওয়ে নামক জায়গা থেকে নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ড যেতে হয়। গিলি গেটওয়েতে এসে প্রানেশা দেখলো সমুদ্রের মাঝে অনেকগুলো স্পিডবোটের মতোন কিছু। কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো -‘ ওটা কী স্পিডবোট? ‘

সুফিয়ান সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো। প্রানেশা জিজ্ঞেস করতেই বললো-
-‘না, ওটা রুকি। নুসা লেম্বগান যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা ট্রান্সপোর্ট আছে। তারমধ্যে রুকি সবচেয়ে ভালো। সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রান্সপোর্ট এটি স্পিডবোর্টের মতোন দেখতে হলেও আকারে আরও বড়। আমরা এটাতেই যাবো। ‘

-‘ ওয়াও! ‘

সুফিয়ান বাঁকা হেসে বললো –

-‘এখন ওয়াও ওয়াও করছো। ওঠার পর ওয়াও ছুটে যাবে ‘

প্রানেশা শুকনো ঢোক গিলে বড় বড় চোখ করে বললো-

-‘মানে! ওইযে সামনে কত মানুষ চড়ছে। তারা তো চুপ করে বসে আছে।আপনি ভয় দেখাচ্ছেন আমায় হুহ! ‘

-‘প্রাণ,তারা এখানে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। বাসে যেমন অভ্যাস হয়ে যায় তেমনই তাদেরও অভ্যাস হয়ে গেছে ‘

প্রানেশা মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। সুফিয়ান ঠোঁট চেপে হাসছে৷ প্রানেশা যে কী পরিমাণ ভীতু! এটা তার থেকে ভালো কে জানে?

রুকিতে উঠে কাচুমাচু মুখ ধুয়ে বসলো প্রানেশা। সিট খামচে ধরে বসে আছে সে। সুফিয়ান সামনে বরাবর বসে আছে, আর প্রানেশার মুখ দেখে মিটমিট করে হাসছে। পেছনের রুকিতে বডিগার্ডরা বসেছে। প্রানেশা
উপর দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলছে-
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দাও। একদম ভালো হয়ে যাবো, কখনো মিথ্যা বলবো না, হুজুরনী হয়ে যাবো, বেশী কথা বলবো না, তছবী হাতে ঘুরবো ‘

সুফিয়ানের পেট ফেটে হাসি আসতে চাইছে। এত বাচ্চামো কেউ করতে পারে! আবার বলছে বেশি কথা বলবে না অথচ ননস্টপ বকবক করছেই। এমনিতে যথেষ্ট বুঝদার। ভয় পেলে সব বুঝাবুঝি শেষ। রুকি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করতেই প্রানেশা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে চিৎকার করে বললো-

‘আল্লাহ গোওওও!আমি নেমে যাবোওও। আমাকে নামিয়ে দাওওও৷ নাতি পুতির মুখ দেখা আমার আর হলোনা বুঝিইই ‘

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা পর্ব-১০

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১০

সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সকাল সাতটায় রওনা হলো সুফিয়ান ও প্রানেশা। ঘুরতে যাওয়ার আগের দিন রাতে কখনোই প্রানেশার ঘুম আসে না। দুইটার দিকে সুফিয়ান বকে ঘুম পাড়িয়েছে৷ সাতটায় সুফিয়ানের সঙ্গে রওনা দিলো প্রানেশা উদ্দেশ্য ‘বালি’

সিঙ্গাপুর ট্রানজিটে চার ঘন্টার ফ্লাইট শেষ করে কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছালো
টানা দশ ঘন্টার ট্রানজিট শেষে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা ওড়ার পর দুজন বালি পৌঁছে গেলো।

প্রানেশার মাঝে তেমন ক্লান্তি নেই বললেই চলে। সবকিছু তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। গায়ে একটা লং টপস আর জিন্স, গলায় স্কার্ফ, চুল পনিটেইল করে বাঁধা। সব মিলিয়ে বয়স কম মনে হচ্ছে। সতেরো, আঠারোর মেয়ে মনে হয় দেখতে। সুফিয়ান হাসলো নিজমনেই। সুফিয়ানের গায়ে কোর্ট প্যান্ট। কিছুটা সামনে একজন লোক দাঁড়ানো হোটেলে নেয়ার জন্য। তাই দুই তিন মিনিট হেঁটে যেতে হবে। প্রানেশা হাঁটতে হাঁটতে বেখেয়ালি ভাবে সুফিয়ানের হাত জরিয়ে ধরে উৎসাহিত হয়ে বললো-
‘ বালি সম্পর্কে কিছু বলুন না! ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –
‘এতক্ষণ যে ধৈর্য ধরে চুপ আছো এতে অবাক আমি’

প্রানেশা সরু চোখে তাকিয়ে বললো-
‘আপনি কী আমায় বাঁচাল বলতে চাইছেন?’

সুফিয়ান হাসি আঁটকে বললো-
‘কী বলো প্রাণ! তুমি আর বাঁচাল! দুটো দুই প্রান্তের বস্তু ‘

প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ান তার সাথে মজা নিচ্ছে। সুফিয়ানের হাত ছেড়ে দূরে গিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। গাল ফুলিয়ে বিরবির করে বললো –
‘বদ লোক! কাল থেকে বারবার জিজ্ঞেস করছি বলে ভাব বেড়েছে, আর জিজ্ঞেসই করবো না ‘

সুফিয়ান হেসে প্রানেশার বাহু এক হাতে জড়িয়ে গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বললো-

‘সরি, শোনো। বালি ইন্দোনেশিয়ার একটি দ্বীপ এলাকা ও প্রদেশ। জাভা শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে ইন্দোনেশিয়ার ৩৩তম প্রদেশ। আর আগেই বলেছিলাম যে, বালিকে পৃথিবীর ‘অন্তিম স্বর্গদ্বান’ বা ‘লাস্ট প্যারাডাইস অন আর্থ’ও বলা হয়। ‘

‘অন্তিম স্বর্গদ্বান কেনো বলা হয়? পৃথিবীতে তো আরও বহু সুন্দর জায়গা আছে! ‘

‘সেখানের মানুষদের দেয়া নাম এটি, জনসংখ্যায় হিন্দুদের বাস বেশী। হিন্দু -৮৩.৫%,মুসলিম -১৩.৪%, খ্রিস্টান -২.৫%, বৌদ্ধ -০.৫% ‘

প্রানেশা আরও প্রশ্ন করতে নিয়েছিলো কিন্তু গাড়ির কাছে এসে পড়ায় আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না।
গাড়ির কাছাকাছি আসার পর পেছনে আরেকটা গাড়ি থেকে দুই তিনজন কালো পোশাকধারী ব্যাক্তি নেমে এলো। প্রানেশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো –

‘এরা কারা?’

সুফিয়ান ট্রলিগুলো তাদের এগিয়ে দিতে দিতে বললো-
‘আমাদের বডিগার্ডস’

‘মানে! আমাদের আবার বডিগার্ড কেনো লাগবে?’

‘এতো কথা না বলে ওঠো’

অবাক ভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই সুফিয়ান প্রানেশাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো ৷ প্রানেশা চুপচাপ বসে গাড়িতে মাথা এলিয়ে দিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলেই প্রানেশা বাহিরের পরিবেশ উপভোগ করতে থাকলো৷ সুফিয়ান প্রানেশার এক হাত মুঠিবদ্ধ করে নিজেও চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পরই হোটেলের সামনে গাড়ি থামলো। এত বড় হোটেল দেখে একই সাথে অবাক আর পুলকিত হয়ে উঠলো প্রানেশা। দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে আসলো। সুফিয়ান সানগ্লাস পড়ে গাড়ির বাহিরে আসতেই প্রানেশা লাফ দিয়ে সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো,উৎকন্ঠার সঙ্গে বললো- ‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ!’

সুফিয়ান মৃদু হেসে প্রানেশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই প্রানেশা ছেড়ে দিলো। প্রানেশার হাত ধরে সামনে এগোতেই হুরমুড়িয়ে একজন ব্যাক্তি এসে দাঁড়িয়ে গেলো।নাক মুখে একরাশ ভয়ের রেখা। সুফিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে লোকটার যে হাঁটু কাপছে তা ভালোই বুঝলো প্রানেশা। সুফিয়ানকে হালকা হাতে ধাক্কা দিয়ে বললো-‘এই লোকের কী হাঁটু কাঁপার রোগ আছে? ‘
সুফিয়ান হেসে বললো –
‘হ্যা প্রাণ, তবে সবসময় না। ব্যাক্তিভেদে এই রোগের দেখা মিলে। ‘

প্রানেশা ভ্রু কুচকে বললো-
‘বড়ই অদ্ভুত রোগ!’

লোকটি ভীষণ ভীতু তা বোঝাই যায়। টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে হাত পেছনে রেখে কাঁপতে কাঁপতে বললো-
‘গুড মর্নিং স্যার, গুড মর্নিং ম্যাম’

সুফিয়ান ঠোঁট চেপে হেসে বললো –
‘ মিস্টার তনিম, আপনার এই ভীরু স্বভাব বদলান। আপনাকে মেরে তো ফেলছি না ‘

তনিম জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মনে মনে বললো-
‘ সেটাও বা অসম্ভব কী!আপনাকে দেখে তো সিংহেরও মুত্রত্যাগ হয়ে যাবে’ কিন্তু মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো –
‘কী যে বলেন স্যার, সব কিছু রেডি আছে। আপনার আর ম্যামের জন্য হোটেলের সবচেয়ে বড় রুমটা বুক করা হয়েছে। আসুন স্যার ‘

সুফিয়ান প্রানেশার হাত এখনো ধরেই আছে। প্রানেশা সবার এহেন কান্ডে বেশ হকচকিয়ে গেছে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মোটাতাজা বডিগার্ডরাও এই ঠান্ডায় ঘেমে ভিজে উঠছে। এরকম হওয়ার কারণ কিছুতেই বের করতে পারলো না সে। কিন্তু সন্দেহ রয়েই গেলো। সুফিয়ান তিন তলার রুমটায় ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। প্রানেশা নরম তুলতুলে বেড দেখে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো। সুফিয়ান গায়ের কোর্ট খুলে পাশে হ্যাংগারে রেখে বললো –
‘প্রাণ, যাও আগে একটা হট বাথ নাও। অনেক বড় জার্নি হয়েছে ‘

প্রানেশার আরামে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। এখন আর উঠতে ইচ্ছে করছেনা। মুখের উপর নরম বালিশ লাগিয়ে ঘুমঘুম গলায় বললো –
‘উমহুম! পরে’

সুফিয়ান গায়ের শার্ট খুলে প্রানেশার হাত ধরে ওঠানোর চেষ্টা করলো। হালকা শক্তি দেয়ায় প্রানেশা দোল খাচ্ছে , হেসে বললো –
‘বৃথা চেষ্টা, আমি ঘুমাবো’

সুফিয়ান বুঝতে পারলো এভাবে কাজ হবেনা। মুখে বালিশ থাকায় প্রানেশা এখনো সুফিয়ানকে খালি গায়ে দেখেনি। সুফিয়ান বালিশ সরিয়ে প্রানেশাকে কাছে টানতেই প্রানেশা চোখ মেললো। উদাম গা দেখেই মুখ কুঁচকে ভেংচি কেটে বললো-
‘নির্লজ্জ কোথাকার! ‘

সুফিয়ানের জ্বালায় শেষমেষ না পেরে উঠে বসলো। সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বকতে বকতে ওয়াশরুমের কাচের গ্লাসটা ঠাস করে বাড়ি দিয়ে লাগিয়ে দিলো। সুফিয়ান প্রানেশার মেকি রাগে হেঁসে ফেললো।

টেবিলের উপর থেকে সবচেয়ে দামী ওয়াইনের বোতল নিয়ে গ্লাসে ঢেলে দুটো আইস ঢেলে ব্যালকনির ফাঁক গলিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে পান করতে থাকলো নীল চোখের সুপুরুষটি। গায়ে তার ছেলেদের লং নাইটি। বোঝা যাচ্ছে, মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে সে। সকালে উঠে দুই গ্লাস কড়া মদ্যপান না করলে তার পুরো দিনটাই পানশে হয়ে ওঠে। ব্যালকনির বাম দিকে নিজের সুবিশাল আভিজাত্যপূর্ণ কক্ষের দিকের বড় একটা ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে পূর্ণ নজরে কিছুক্ষণ তাকালো সে। খোচালো শজারুর কাঁটার ন্যায় লম্বা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে, নারীচিত্রের ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আপনাকে আমি এখনো ভুলিনি স্রোতস্বিনী , আপনি যে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে নিজের বিচরণ চালান! আপনার রূপের স্রোতের ধ্বংসাত্মক তান্ডব আমার দু চোখের পাতা এক হতে দেয়না। খুব শীঘ্রই আমার হবেন আপনি ‘

সোনায় মোড়ানো ফ্রেমের ভেতরের হাত বাড়ানো হাস্যজ্জল নারীটির ওষ্ঠে হাতের আঙুল ছোঁয়লো সে। ফ্রেমের আরও ঘনিষ্ঠে এসে নারীটির গভীর ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো –

আঁধারে শ্রাবণ রাতে সে এসেছিলো বলে,
জোৎস্নারা হেঁসেছিলো ঘরময় জুড়ে।
প্রজাপতি এসেছিলো দলবল নিয়ে ,
আজ সে নেই বলে তারা যাবে চলে।
সেও কী গভীর রাতে মোর নাম জপে?

চলবে…

অঙ্গারের নেশা পর্ব-০৯

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৯

প্রতিদিনের তুলনায় আজ একটু দ্রুতই ফিরে এলো বাড়িতে সুফিয়ান। মিসেস অদিতি ড্রইংরুমে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। সুফিয়ানকে বাসায় তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। মনে মনে ভয় পাচ্ছেন তিনি, সুফিয়ানকে প্রানেশা বলে দেয়নি তো?
সে ভেবেছিলো এসে তাকে সবার প্রথমে ধরবে সুফিয়ান। কিন্তু, সুফিয়ান ভেতরে ঢুকে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক প্রানেশা তাহলে কিছু বলেনি!
সুফিয়ান সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় নিজের রুমে ঢুকতেই দেখলো রুম ফাঁকা। ভ্রু কুচকে খানিক এদিক ওদিক তাকালো। ওয়াশরুমের দরজাও তো খোলা। তাহলে, কী প্রাণ তাকে ছেড়ে চলে গেলো! ভেবে সুফিয়ানের মুখ হিংস্র হয়ে উঠলো। এই মুখ যদি প্রানেশা তাহলে হয়তো তার ভয়ে কলিজা বেরিয়ে যেতো। সুফিয়ানের কপালের রগ টানটান হয়ে উঠলো। রুম থেকে বেরোনোর জন্য উদ্যত হতেই বারান্দার থেকে কিছু পড়ার শব্দ এলো। মাথা ঘুড়িয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখলো প্রানেশা দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজ মনেই ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। প্রানেশা তাকে ছেড়ে যদি যায় তাহলে সেদিনই হবে প্রানেশার শেষ দিন। বারান্দায় নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিরবির করে বললো –
‘ প্রাণ,আমি তোমায় এমন ভাবে নিজের সঙ্গে জড়াবো যে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পথ পেয়েও তুমি যেতে পারবেনা অথবা এই সুফিয়ান তোমায় যেতে দেবে না’

হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে সেদিকে পা বাড়ালো সুফিয়ান। প্রানেশা দোলনার ফাঁক গলিয়ে বাহিরের মৃদুমন্দ হাওয়া উপভোগ করছিলো। গায়ে গোলাপি রঙের সুতি থ্রি পিস। এক পাশে ওরনা জড়ানো। বাতাসে পিঠে বিছিয়ে থাকা চুলগুলো থেমে থেমে উড়ছে। সুফিয়ান এসে দোলনায় বসতেই কারো অস্তিত্ব অনুভব করলো প্রানেশা। কিন্তু কিছু না বলে চুপচাপ মাথাটা সুফিয়ানের বুকের উপর রাখলো। সুফিয়ান একটু নয় বেশ খানিকটা অবাক হলো। প্রানেশা, কারো উপর যতই রাগ থাকুক, ঘৃণা করুক, কথা না বলে কখনোই থাকে না। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে বাচ্চাদের মতোন হাঁপিয়ে ওঠে। ভাঙ্গা রেকর্ডারের ন্যায় বাজতেই থাকে। আজ কোনো কথা বললো না এতে অবাক হওয়ারই কথা। সুফিয়ান বার কয়েক ডাকলো-
‘প্রাণ? ‘

‘প্রাণ, কথা বলবেনা? ‘

প্রানেশা চোখ বন্ধ করে নিরুত্তর বসে রইলো। সুফিয়ানের সঙ্গে কথা বলার পর অনেকটা সময় তার মনটা ফুরফুরে ছিলো। ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘর থেকে কফি করতে গেছিলো। সেসময়ই রেয়ানও এসেছিলো। প্রানেশা কোনো কথা না বলে চলে আসতে নিলেই, রেয়ান তার পা ধরে বসে পড়লো। প্রানেশা হকচকিত হয়ে দুই কদম সরে গেলো।
‘এসব কী রেয়ান! সরো বলছি’

রেয়ান হুহু করে কাঁদলো। পায়ে দুবার ঠোঁট ছুঁইয়ে অনুতপ্ত ভরা ভাঙা কন্ঠে বললো –
‘ক্ষমা করে দাও প্রানেশা, আমি সেসময় খুব রেগে গেছিলাম। তোমায় প্রতিদিন ওর সাথে দেখলে আমার ভেতর জ্বালাপোড়া হয়, কলিজা ছেড়ার মতোন ব্যাথা হয়। তাই, হানিমুনের কথা শুনে খুব রেগে গেছিলাম। ক্ষমা করে দাও। আমার কাছে ফিরে এসো প্লিজ, আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো ‘

প্রানেশা চোখ জ্বলা শুরু হলো। সত্যি সত্যি মনে পড়ে গেলো, সেই রাত জেগে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেমালাপ। প্রথম গান শোনানো, হাজারো পথ পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখা, বিয়ের পর ঘোরাঘুরি করতে যাওয়ার পরিকল্পনা। একের পর এক চোখে ভাসতে লাগলো স্মৃতির পাতা। হঠাৎ করেই মনে পড়লো, সে বিবাহিত। এখন একজনের স্ত্রী। তাকে জড়িয়ে আছে অনেক গুলো সম্পর্ক। ভালোবাসার একজন মানুষ। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দ্রুত পদে নিজের রুমে এসে পড়ে প্রানেশা। নরম হলে তার চলবেনা, আজকের ঘটনা তার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছে৷ নতুন করে সব শুরু করার জন্য কয়েক পা এগিয়েছে প্রানেশা, ফিরে আসার পথ নেই। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে ঘরে এসে দোলনায় বসেছিলো তারপর তিন ঘন্টা হয়ে গেছে সেভাবেই বসে আছে সে৷
সুফিয়ান খেয়াল করলো তার শার্টের পাশটা ভেজা ভেজা লাগছে। চমকে প্রানেশার গাল উঁচু করে দেখতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে, আর জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে দু পাশ বেয়ে৷ ভীষণ বিচলিত হয়ে উঠলো সুফিয়ান৷ এমন ভাবে কান্না তখনই করে যখন খুব কষ্ট পায় প্রানেশা। চঞ্চল বৈশিষ্ট্যের হলেও ভেতরে বেশ চাপা স্বভাবের সে। সবার সামনে নিজের দুঃখ প্রকাশ করেনা কখনো।প্রানেশা গাল মুছে দিয়ে ব্যাথিত গলায় সুফিয়ান বললো –
‘কী হয়েছে প্রাণ? এমন করে কান্না করছো কেনো! কেউ কিছু বলেছে তোমাকে! নাম বলো, শেষ করে দেবো তাকে ‘

প্রানেশা সেভাবেই চোখ বন্ধ করে অশ্রু ঝড়াচ্ছে।সুফিয়ান ব্যস্ত হয়ে প্রানেশাকে আদর করে বললো –
‘কী হয়েছে প্রাণের? আমাকে বলবেনা? ‘

প্রানেশা ছোট বাচ্চার ন্যায় সুফিয়ানের গলা জড়িয়ে কোলে বসলো। সুফিয়ান দুই হাতে জাপটে ছোট পাখির মতো৷ কিছুক্ষনের মধ্যেই কান্না থামিয়ে সোজা হয়ে বসলো প্রানেশা। সুফিয়ানকে অবাক করে আদুরে বিড়াল ছানার মতো মাথা গুঁজে শুয়ে পড়ে সুফিয়ানের কোলের উপর। সুফিয়ান সযত্নে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। প্রানেশা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো –
‘ফ্রেশ হননি?’

সুফিয়ান বুঝতে পারলো প্রানেশা কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। পুরোনো কোনো কথা আর মনে করিয়ে দিতে চাইলো না। তাই সেও স্বাভাবিক ভাবে বললো –
‘না, মাত্রই এলাম। এই শীতে এভাবে বসে আছো কেনো?’

প্রানেশা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো-
‘আর কিছু বললেন না তো!’

‘কিসের ব্যাপারে?বালি?’

‘হু’

‘সব যদি বলেই দেই তাহলে গিয়ে কী লাভ! কালই সব দেখো ‘

প্রানেশা লাফিয়ে উঠলো, বাচ্চাদের মতোন তালি দিয়ে বললো –
‘সত্যিই! কাল কখন যাবো? ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –
‘কাল সকাল সাতটায় রওনা হবো, বালিতে গেলে পাসপোর্টের কোনো ঝামেলা নেই। যত আগে বুকিং দেয়া যায় তত ভালো, যদিও আমি মাত্র তিন দিন আগে দিয়েছি। আমরা সিঙ্গাপুর ট্রেনজিটে যাবো, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বালির কোনো ফ্লাইট নেই তাই ‘

প্রানেশা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো –

‘কাল সকালে গেলে তো অনেক কাজ বাকি! আমি তাহলে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেই ‘

‘হ্যা যাও, আমি ফ্রেশ হয়ে এসে হেল্প করছি ‘

প্রানেশা লাফিয়ে চলে যাচ্ছিলো কী মনে করে যেনো পিছিয়ে এসে বললো-
‘শুনুন ‘

সুফিয়ান সামনে তাকিয়ে দেখতেই প্রানেশা ফট করে গাল চুমু খেয়ে ‘থ্যাংক ইউউ’ বলে এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। সুফিয়ান হা করে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে হেসে উঠলো। অস্ফুটস্বরে বললো –

‘আমার পাগলী’

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা পর্ব-৭+৮ এবং এক্সট্রা পর্ব

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৭

ব্যালকনির দোলনায় বসেই প্রানেশা ঘুমিয়ে পড়লো রাতের বেলা। সুফিয়ান ডাকতে নিয়েও আর ডাকেনি। চাদর মুড়ে দিয়ে প্রানেশাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলো।
কিন্তু নিজে ঘুমায়নি, শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো। ভোরের দিকে ঘুম ভাব ধরা দিলো। তখন প্রানেশাকে কোলে শুইয়ে দিলো নাহলে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। প্রানেশার থুতনিতে একটা খাঁজ আছে। যা চেহারার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সুফিয়ান থুতনিতে আলতো করে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো-
‘ যদি আমার ভালোবাসার এক বিন্দু পরিমাণ তোমার হৃদয়ে আমার জন্য তৈরি হয় তাহলে পৃথিবীর সকল সুখ তোমার চরণে লুটিয়ে দেবো প্রাণ ‘

সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি চোখে মুখে পড়তেই প্রানেশার ঘুম ভাঙলো। চোখমুখ কচলে উঠে সোজা হয়ে বসে লম্বা হাই তুললো। হঠাৎ খেয়াল হলো এটা বিছানা নয় ব্যালকনি। বড় বড় চোখ করে পাশে তাকাতেই দেখলো সুফিয়ান পাশে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বড় দোলনা হওয়ায় তেমন অসুবিধা হয়নি। প্রানেশা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো-
‘আরে! এ তো এখানেই ঘুমিয়ে আছে। আর আমিই বা কখন দোলনায় বসলাম। ‘
চিল্লাতে নিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেললো প্রানেশা। এতক্ষণে ভুলেই গেছিলো যে সে নতুনভাবে সম্পর্কটা তৈরি করবে। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো যতই সে মুখে বলুক কিন্ত নাটক বেশিক্ষণ টেকে না।একজন জীবন থেকে গেলে আরেকজনকে ভালোবাসা যায় কিন্তু একইসাথে মনে দুইজনকে স্থান দেয়া যায়না।সুফিয়ানকে এখনো ভালোবাসতে পারেনি সে,একজন মানুষকে ভালোবাসতে হলে আগে তার ভেতরটা জানতে হয়। মাত্র দুইদিন একঘরে থেকে তো আর ভালোবাসা সম্ভব না। তাই এবার মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলো প্রানেশা। নাটক করে জীবন চলে না। উঠে দাড়িয়ে চাদরটা সুফিয়ানের গায়ে জড়িয়ে দিলো।
হাত মুখ ধুয়ে এসে সুফিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললো –
‘শুনছেন, এই যে উঠুন ‘

সুফিয়ানের ঘুম পাতলা হওয়ায় কিছুক্ষনের মধ্যেই উঠে গেলো৷ প্রানেশাকে দেখে মুচকি হেসে বললো –
‘শুভ সকাল প্রাণ’

প্রানেশা মাথা নাড়লো কিন্তু হাসলো না। সুফিয়ান ব্যাপারটা খেয়াল করলো। কিছু বুঝতে পারলো না, কাল রাতে ভেবেছিলো প্রানেশা বোধ হয় তাকে মেনে নিচ্ছে। কিন্তু প্রানেশার এহেন আচরণে মনে ভয় জমাট বাঁধছে। প্রানেশা বললো-
‘আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ‘

সুফিয়ানের ভেতরটা অজানা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো। তাহলে, প্রাণ কী তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছে! যদি তা-ই হয় তাহলে তার প্রাণকে বেঁধে নিজের সাথে রাখবে। তবুও চলে যেতে দেবে না। প্রানেশা সরতেই সুফিয়ান ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলো। শার্ট প্যান্ট পড়ে রেডি হতেই প্রানেশা বিছানায় বসতে বললো। সুফিয়ানের বুক ধকধক করছে। হসপিটালের সবাই যার ভয়ে থরথর করে কাপে সেও কাউকে হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান ধীর পায়ে বসতেই প্রানেশা হাঁটুগেড়ে নিচে বসে পড়লো। সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘এসব কী করছো!’

প্রানেশা আঙুল মুখে দিয়ে চুপ থাকতে বললো। লম্বা একটা শ্বাস টেনে সুফিয়ানের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। সুফিয়ান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। প্রানেশা সুফিয়ানের চোখে চোখ রেখে বলা শুরু করলো –
“আমি জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন। কতটা বাসেন আমি তা জানিনা, আপনার ঐ দু চোখে নিজের জন্য অজস্র ভালোবাসা দেখেছি আমি৷ আমিও ঠিক করেছিলাম সব মেনে নিয়ে আপনার সাথে নতুন করে সব শুরু করবো৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন, মনের উপর জোর দিয়ে আমি তা পারছিনা৷ আপনার কাছে গেলে আমি তেমন কোনো অনুভূতি পাইনা। কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম আমাকে আপনার কাছে আসতে দেয়না। একই চেহারা হওয়ায় আমি যতবার আপনাকে দেখি ততবারই রেয়ানের কথা মনে পড়ে। হয়তো, শারীরিক ভাবে আমাদের মাঝে একসময় সম্পর্ক হবে কিন্তু একসময় যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাবো, হাত মুখ কুঁচকে যাবে তখন আমাদের বিরক্তি এসে যাবে।
আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি তখন তার পরে কী হবে তা চিন্তা করিনা। তাকে ভালোবাসতেই থাকি, আর মুখে বলি ‘ আমি একতরফা ভাবেই ভালোবেসে যাবো’ কিন্তু এক না একসময় মনে হবে ‘আমারও একটু ভালোবাসার প্রয়োজন’ । মনে হবেই, কারণ এটাই নিয়ম। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”

সুফিয়ান চোখ এদিক ওদিক করলো। চোখ থেকে এই বুঝি জল গড়াবে। এ হতে দেয়া যাবে না। হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে বুকে৷ প্রানেশা মৃদু হেসে সুফিয়ানের গাল ধরে নিজের দিকে ফেরালো।সুফিয়ানের ঠোঁট কাঁপছে। চোখ লাল হয়ে আসছে। কোনো রকম সামলে বললো-
‘কী.. সিদ্ধান্ত?’

প্রানেশা মলিন মুখ করে বললো –
‘ আগে কথা দিন আমায়, যা বলবো তাই হবে’

সুফিয়ানের ভেতরটা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুখ পাশে ফিরিয়ে হাত দিয়ে চোখ কচলে বহু কষ্টে করে বললো –
‘ হু ‘
প্রানেশা বললো-
‘আপনি চোখ বন্ধ করুন নাহলে সহ্য করতে পারবেননা’

এবার যেনো সুফিয়ানের আত্মা বের হয়ে যাবে। এমন কী কথা! যা সে সহ্য করতে পারবে না৷ তবুও, জানার জন্য বিনাবাক্যে চোখ বন্ধ করলো। মনে মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। শুধু একটাই দোয়া ‘আমার থেকে আমার প্রাণকে ছিনিয়ে নিওনা ক্ষোদা’। এমন সময় প্রানেশা কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে বললো-
‘ আমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবেন?’

শোনা মাত্রই তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে ফেললো৷ হা করে তাকিয়ে দেখলো প্রানেশা হাসতে হাসতে ফ্লোরে শুয়ে পড়েছে। পেটে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালো। টিস্যু দিয়ে নিজের কপাল মুছে ঘন ঘন শ্বাস নিলো৷ প্রানেশার দিকে তাকিয়ে জোড়ে জোড়ে বললো-
‘আর ইউ ম্যাড! দিস ইজ টোটালি রাবিস।স্টপ প্রাণ ‘

প্রানেশা হাসি থামিয়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো। সুফিয়ানের
কাছে এসে হাত ধরে বললো-
‘সরি, কিন্তু আমি সত্যিই চাই এটা৷ একজন মানুষকে জানতে হলে তার সাথে সময় কাটাতে হয়। একঘরে সারাজীবন থেকেও দুজন অজানা থেকে যায়। তাই, আমি চাই দূরে কোথায় যেতে। যেখানে, সমাজ, রেয়ান সবকিছু একটু ভুলতে পারি।আমি এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যদি আমি দুই মাসের মাঝে আপনার জন্য কিছু অনুভব করি তাহলে আমি এখানেই থাকবো কিন্তু যদি মনে হয় ভালোবাসা সম্ভব না তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাবো। আমি চাই নিজেকে, আপনাকে আর আমাদের এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে। সাহায্য করবেন না আপনার প্রাণকে?’

সুফিয়ান মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে কপালে চুমু খেলো। প্রানেশার বাহু ধরে বললো-
‘ করবো প্রাণ, অবশ্যই করবো। বেশি না তুমি শুধু আমার ভালোবাসার এক বিন্দু দিও তা নিয়ে সারাজীবন কাটাবো আমি। ‘

চলবে…

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৮

প্রানেশা আজ সকাল বেলা উঠেছে। ছয়টায় উঠে সবার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করে টেবিলে পরিবেশন করছে। মিসেস অদিতি, মিস্টার রাহাত নিচে নেমে এসব দেখতেই অবাক হলেন। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে বললেন-
‘আরে! এসব কী করছো তুমি? এত কষ্টের কেনো করতে গেলে? ‘

প্রানেশা মুচকি হেসে হাতের পায়েসের বাটিটা টেবিলের উপর রাখলো। মিসেস অদিতির কাছে এসে গাল ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বললো –
‘ কেনো মা, আমার রান্না কী এতোই খারাপ যে মুখেই তোলাই যাবে না! ‘

‘আরে না না, তা কেনো হবে! শোনো মেয়ের কথা। ‘

‘তাহলে, আমায় একদিনও করতে দেননা কেনো! আমার মা তো বলতো আমাকে নাকি শ্বাশুড়ি রান্না না করলে ভীষণ রাগ করবে! অথচ আমাকে কেউ রান্নাঘরেই ঢুকতে দেয়না ‘

মিসেস অদিতি প্রানেশার বাচ্চামো কথায় হেসে ফেললেন। মাথায় হাত বুলিয়ে থুতনি ধরে বললেন –

‘আমিও তোমার আরেকটা মা। রান্নাবান্নার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে । সুফিয়ান জানলে রেগে যাবে তাছাড়া, এই আর কটা দিন তারপর আমি নাতি পুতির সাথে খেলবো আর তুমি রান্নাঘর সামলাবে ‘

প্রানেশা খানিক লজ্জা পেলো। চেয়ার টেনে মিসেস অদিতিকে বসতে বললো। মিস্টার রাহাতও বসলেন। আজ রেয়ান নেই, সে একটা কনসার্টে গেছে। পেশায় নামকরা গায়ক সে।খুব বড় কোনো সমস্যা হলে তবেই মিস্টার রাহাতের ব্যবসায় সাহায্য করে। আজ বাসায় থাকবে না শুনেই প্রানেশার স্বস্তি। নাহলে, রেয়ানকে দেখলে প্রানেশার সব মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। যেখানে তার জীবনটাই মানিয়ে নেওয়ার।

খাবার বাড়তে বাড়তে উপর থেকে সুফিয়ান আসলো। এসে টেবিলে বসতেই প্রানেশা প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো। সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো-
‘এসব তুমি করেছো?’

প্রানেশা ঘাবড়ে গেলো। ঘরের ভেতরে সে সুফিয়ানকে একটুও ভয় পায় না। সেখানে তো সুফিয়ান হাসে, তার সাথে দু চারটে কথা বলে, রাগ করলে মজার কথাও বলে। কিন্তু রুম থেকে বের হলে সুফিয়ানকে অন্য রকম লাগে প্রানেশার। কেমন যেন গম্ভীর রাগী একটা মুখ। আরেকটা জিনিসও অদ্ভুত লাগে প্রানেশার তা হলো, পরিবারের কারো সাথে তেমন আলাদা কোনো কথা বলে না সুফিয়ান। একমাত্র মা ব্যতিত । তাও যে বেশি তা না, এই যেমন -হ্যা, হু, না, ঠিক আছে।মাঝে মাঝে প্রানেশার মনে হয়, সুফিয়ানের আলাদা একটা রুপ আছে । যা প্রানেশাকে সুফিয়ান দেখায় না। তাই রুমের বাহিরে সবার মতোই ভয় পায় সুফিয়ানকে। ভয়ে ভয়ে বললো-
‘আ..আমিই করেছি ‘

সুফিয়ান কিছু বললো না। প্রানেশা ভাবলো, হয়তো খাওয়া শেষে বকবে। কিন্তু খাওয়া শেষ করে হাত মুছে বললো-
‘খাবারটা সুস্বাদু ছিলো ‘

প্রানেশা চমকে উঠলো। মিসেস অদিতি প্রানেশার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন-
‘ সত্যিই, আজ খাবারটা ভালো হয়েছে৷ তোমার রান্নার হাত ভালো বলতে হবে ‘

খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সুফিয়ান বললো-
‘আমার একটা জরুরি কথা আছে’

সবাই সুফিয়ানের দিকে তাকালো। সুফিয়ান হাতঘড়ি পড়তে পড়তে বললো-
‘ আমি আর প্রানেশা কয়েকদিনের জন্য বালি যাচ্ছি ‘

মিসেস অদিতি বললেন –
‘ভালো তো যাও, নতুন বিয়ে হয়েছে। দুজন দুজনকে যত জানবে ততো ভালো’

মিস্টার রাহাত বললেন –
‘ টিকেট বুক করেছো তো? ‘

সুফিয়ান তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। উঠে দাড়িয়ে ‘আসছি ‘ বলে চলে গেলো। প্রানেশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নিজের বাবাকে কেউ এভাবে উপেক্ষা করে তা প্রথম দেখলো সে। এমন করার কারণ কী বুঝতে পারলো না। সুফিয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মিস্টার রাহাত স্বাভাবিক, এটা মনে হয় নতুন না, শুধু এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তিনি উঠে পড়লেন। তিনি চলে যেতেই প্রানেশা এঁটো থালাগুলো জড়ো করে নিয়ে বললো-
‘মা, আমি আসার পর থেকে একবারও স্বাভাবিক ভাবে বাবার সাথে কথা বলতে দেখিনি। আপনার ছেলে কী সবসময়ই এমন করেন? ‘

মিসেস অদিতিও প্লেট গুছিয়ে দিতে দিতে বললো –
‘নারে মা!সবই আমাদের কর্মের ফল’

প্রানেশা খানিক অবাক গলায় বললো –
‘মানে?’

‘রান্না ঘরে অনেক কাজ বাকি আছে আবার দুপুরের রান্নাও বাকি, তুমি ঘরে যাও প্যাকিং করো ‘

প্রানেশা বুঝতে পারলো মিসেস অদিতি কথা এড়িয়ে গেলেন। প্রানেশা কথা বাড়ালো না।সব কিছু গুছিয়ে রেখে নিজের ঘরে গেলো৷ বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলো, রান্না ঘরে থেকে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বিছানা ঝেড়ে বালিশ গুছিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠান্ডা বাতাসে বেশ ভালো লাগছে। চোখ বন্ধ করে বাতাস উপভোগ করতেই দুটো হাত পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা চোখ খুলে ফেললো, মনে মনে ভাবলো ‘সে তো এক ঘন্টা আগেই হাসপাতালে চলে গেলো তাহলে এখানে কেনো!’
পেছনে ফিরে প্রথমে চেহারা দেখে ভাবলো সুফিয়ান কিন্তু গেজ দাঁতের হাসি দেখেই বুঝতে পারলো এটা রেয়ান। হোক প্রথম ভালোবাসা কিন্তু বিয়ের পর অন্য কারো সাথে সম্পর্ক রাখার মতো মেয়ে তো সে নয়। প্রানেশা ধাক্কা দিয়ে দুই হাত সরিয়ে দিলো রেয়ানকে। রেগে বললো –
‘রেয়ান! এসব কী ধরনের অসভ্যতা? ‘

রেয়ান অবাক গলায় বললো –
‘অসভ্যতা! আমি এখন অসভ্য! বাহ, ভালোই তো। ঐ সাইকোটা তোমায় বশ করে ফেলেছে তাহলে’

‘ দেখো রেয়ান, আমি জানি। তুমি আমায় ভালোবাসো। তোমার জন্য এটা কষ্টকর, কিন্তু আমার সঙ্গে তোমার বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সম্পর্কে তুমি আবার দেবর। এছাড়া আমি আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা ‘

রেয়ান প্রানেশার বাহু চেপে ধরলো। খসখসে গলায় বললো –
‘কখনোই না, তোমাকে ওই সাইকোর সাথে দেখতে চাইনা আমি। ভেবেছিলাম তোমাকে আদর করে নিজের কাছে রাখবো।কিন্তু তুমি এমন মেয়ে নও, এবার তোমাকে কী করে নিজের করতে হয় তা দেখাবো ওয়েট ‘

প্রানেশার কলিজা কাপছে। রেয়ান ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। বের হওয়ার কোনো উপায় পাচ্ছে না সে৷ ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো প্রানেশা, রেয়ান এক পা দুই পা করে প্রানেশার কাছে গিয়ে জোরাজুরি শুরু করলো । প্রানেশা কেঁদে কেঁদে বলছে-
‘দোহাই লাগে রেয়ান, ছাড়ো আমাকে’

চলবে…

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
#সারপ্রাইজ পার্ট

‘ খুব শখ না! হানিমুনে যাবে তুমি। আর আমি এখানে বিরহে মরবো, তা তো হবেনা জান। হানিমুনটা না হয় ঘরে আমার সাথেই করলে ‘

প্রানেশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে৷ কাকে দেখছে সে! যে মানুষটাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে যার কাছে নিজেকে নিরাপদ ভেবেছে এমনকি নিজের স্বামীকে পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি! এখন বুঝতে পারলো প্রানেশা,আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সুফিয়ান তার স্বামী হয়ে, এক ঘরে এতগুলো দিন থেকেও তার সম্মানে আঘাত করা তো দূর বরং ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিয়েছে। অথচ, প্রথম যাকে বিশ্বাস করলো সেই ধোঁকা দিয়ে দিলো। প্রানেশা কাঁদতে কাঁদতে বললো –
‘এমন কুৎসিত বিকৃত মনের অধিকারী একজনকে আমি ভালোবেসেছিলাম ভাবতেই নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। ‘

রেয়ান কথায় কোনো রকম পাত্তা দিলো না। শাড়ির আচল ধরে টানতেই দরজায় নক হলো৷ কেউ অনেক জোরে জোরে ডাকছে৷ প্রানেশা নিজের প্রাণ ফিরে পেলো। শাড়ি খামচে ধরে সেখানেই বসে পড়লো৷ রেয়ান বিরক্ত হয়ে গেট খুলতেই মিসেস অদিতি ঠাস করে রেয়ানের গালে পরপর দুটি চড় বসিয়ে দিলেন। রেয়ান তব্দা খেয়ে বললো-
‘মা!’

মিসেস অদিতি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন রেয়ানকে। দ্রুত পায়ে বারান্দায় যেতেই দেখলেন বিধ্বস্ত হয়ে নিচে বসে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে প্রানেশা। এই একুশ বছরের জীবনে কখনোই এসবের স্বীকার হয়নি সে। ফুলের টোকা অব্দি কখনো লেগেছে কিনা সন্দেহ। ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে উঠিয়ে আদর করে কাপড় ঠিক করে দিয়ে বললেন –
‘ভয় পেয়ো না মা! আমি আছি তো ‘

প্রানেশা কেঁদেই যাচ্ছে। তিনি রেয়ানকে বললেন –
‘ তোকে জন্ম দিয়ে পাপ করেছি আমি। আল্লাহ কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন আমাদের! না পারছি সহ্য করতে আর না পারছি কিছু করতে। আল্লাহ তোর বিচার করবে, এখুনি বের হ এখান থেকে ‘

রেয়ান নির্লিপ্ত ভাবে বেরিয়ে গেলো। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে পানি পান করিয়ে শুইয়ে দিলেন। প্রানেশা তার হাত ধরে ছিলো কিন্তু তার একটা কথায় হাত ছেড়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো –
‘এসব কথা সুফিয়ানকে বলোনা প্রানেশা ‘

প্রানেশা হতভম্ব হয়ে বললো-
‘ কী বলছেন মা! এত বড় কথাটা তাকে বলবো না! ‘

‘ দেখো প্রানেশা, এসব বললে ঘরে অশান্তি হবে। তুমি জানোনা, রোজ রোজ এসব নিয়ে ঝামেলা পছন্দ করিনা আমি ‘

‘কিন্তু.. ‘

‘কিন্তু কিছুই না, কথা দাও প্রানেশা এসব কথা সুফিয়ানের কানে যাবে না। যদি যায় তাহলে কী হতে পারে এর কোনো ধারণাই নেই তোমার। ‘

প্রানেশা আর কিছু বলতে পারলো না। এমনিতেও সে মানসিক ভাবে ভেঙে গেছে। বিশ্বাসঘাতকতা যে কতটা আঘাত দেয় মনে তা প্রানেশা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলতেই মিসেস অদিতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। কিছুক্ষন বাদেই প্রানেশা উঠে বসলো। মাথা ব্যাথা করছে, তাই কাপড় চোপড় নিয়ে গোসল করে আসলো। দুপুর দুইটা বাজে। নিজের মা বাবাকে একবার কল দিয়ে কথা বলে নিলো। কিন্তু কিছুতেই মনটা ভালো হচ্ছে না। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে, প্রানেশার মন হঠাৎ প্রশ্ন করলো ‘এই অস্থিরতা কী সুফিয়ান কাছে নেই বলে!’ একবার কল করে দেখবো? আরেক মনে ভাবলো ‘কী মনে করবে সে!’ আবার নিজেই বললো-
‘যা মনে করার করুক ‘ মোবাইল হাতে নিয়ে সুফিয়ানের নাম্বারে কল করলো৷ কয়েক দিন আগেই সুফিয়ান তার মোবাইলে নাম্বার সেভ করে দিয়েছে। এতে লাভই হয়েছে ভেবে প্রানেশা হাসলো। কিন্তু হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না, সুফিয়ান রিসিভ করে গম্ভীর গলায় বললো –
‘হ্যালো, ডা.সুফিয়ান তেহজিব স্পিকিং। হাও ক্যান আই হেল্প ইউ? ‘

প্রানেশা মিনমিন করে বললো –
‘আমি প্রানেশা ‘

সুফিয়ান হাতের মোবাইলটা আরেকবার চেক করলো। এতক্ষণ রোগী দেখে মাত্র ফ্রী হলো সে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা এলো। ক্লান্ত হয়ে আর তেমন কিছু খেয়াল করেনি সে। নাম্বার সেভ না থাকায় বুঝতে পারেনি। সাথেই কন্ঠভঙ্গি বদলে ফেললো সুফিয়ান। আদুরে গলায় বললো –
‘প্রাণ!শরীর ঠিক আছে তো! ‘

প্রানেশা কৈফিয়ত দেয়ার স্বরে বললো-
‘শরীর ঠিক আছে ‘

‘তাহলে?কেনো ফোন করলে?’

প্রানেশা নার্ভাস হয়ে পড়লো। এখন কী বলবে! ফোন দিয়ে এখন বিপদে পড়ে গেলো। কী বলবে বুঝতে না পেরে রাগ দেখিয়ে বললো-
‘ কেনো? ফোন দিলে কোনো কারণ থাকতে হবে!সমস্যা হলে রেখে দিচ্ছি, আর বিরক্ত করবোনা ‘

সুফিয়ান হো হো করে হেসে বললো –
‘ওহহো প্রাণ, তুমি এতো বোকা কেনো বলোতো! তোমার স্বামীকে তুমি যখন ইচ্ছে কল করতেই পারো। আমি মজা করছিলাম ‘

প্রানেশা কিছু না বলে চুপ করে রইলো৷ সুফিয়ান বুঝতে পারলো কোনো কারণে প্রানেশার মন খারাপ। তাই বললো –
‘প্রাণ, জানো এবার আমরা কোথায় যাবো?’

প্রানেশা উৎসাহিত হয়ে বললো-
‘ কোথায়? ‘

‘ইন্দোনেশিয়ার বালিতে’

‘ আমি শুনেছি সেটা নাকি খুব সুন্দর জায়গা! ‘

‘শুধু সুন্দর না প্রাণ, বালিকে বলা হয় ‘অন্তিম স্বর্গদ্বান’
বা ‘লাস্ট প্যারাডাইস’ এখানের সৌন্দর্য চোখ ঝলসানোর মতোন’

‘ওখানে কোথায় কোথায় ঘুরবো আমরা?’

‘ বিভিন্ন দ্বীপ ঘুরবো, নুসা দুয়া বীচ, নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ড, আরও আছে। সব ঘুরে দেখাবো তোমায় ‘

প্রানেশা উত্তেজিত হয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে নানান কল্পনা করছে । খুশিতে গদগদ হয়ে বললো-

‘ঠিক আছে, আপনি বাসায় আসুন। আমি আরও শুনবো ‘

সুফিয়ান হাসতে হাসতে বললো-
‘ আপকে লিয়ে জান কুরবান। সন্ধ্যার আগেই ফিরবো, আর শোনো ড্রয়ারে চকলেট আছে খেও ‘

প্রানেশা হ্যা বলে ফোন রাখলো। খেয়াল করলো তার মনটা এখন খুব ভালো হয়ে গেছে । মুচকি হেসে নিজমনেই বললো –

‘লোকটা আমায় এত বোঝে কেনো!’

চলবে..

অঙ্গারের নেশা পর্ব-৫+৬

0

‘অঙ্গারের নেশা’
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৫

[বিঃদ্রঃ এটি আমার লেখা এই পর্যন্ত সকল গল্প থেকে ভিন্ন ও রোম্যান্টিক হবে সাথে কিছুটা থ্রিলারও।তাই সবাইকে অনুরোধ যারা রোম্যান্টিক গল্প সহ্য করতে পারেন না তারা এটা পড়বেন না]

সদর দরজার দিকে সবার দৃষ্টি গেলো। ট্রলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে রেয়ান। প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে রেয়ানের কাছাকাছি যেতে নিলে সুফিয়ান হাত ধরে ফেললো৷ প্রানেশা দেখলো সুফিয়ানের মাঝে কোনো প্রকার অবাকের ছাপ নেই৷ এ যেন স্বাভাবিক একটা বিষয়৷ সুফিয়ান আগের মতোই চুপচাপ বসে কাটা চামচ দিয়ে চাওমিন খাচ্ছে। কিছুটা পানি পান করে চুপচাপ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো৷ কিন্তু প্রানেশার হাতটা ছাড়লো না৷ রেয়ান রাগী মুখে এগিয়ে এলো। জোরে চেচিয়ে বললো -‘এসবের মানে কী?’
তারপর বাবা মার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বললো-‘ তোমরা আমার সাথে এমন কী করে করতে পারলে! তোমাদের বড় ছেলে তো সবসময়ই তোমাদের অতি প্রিয় তাই বলে ছোট ছেলের কোনো মূল্যই নেই!’
মিস্টার রাহাত কিছু বলার আগেই সুফিয়ান ঠান্ডা গলায় বললো -‘সবাই খেতে বসো ‘
এক কথায়ই সবাই চুপচাপ বসে পড়লো৷ এতক্ষণ যেন কিছুই হয়নি৷ প্রানেশা সবার এহেন কান্ডে হতভম্ব হয়ে রইলো৷ এ কেমন রহস্য পরিবার! সুফিয়ানের এক কথাই মনে হয় শেষ কথা৷ সুফিয়ান চুপচাপ বসে কিছু ফাইল দেখছে ৷ প্রানেশা সবার এই নির্লিপ্ততা সহ্য করতে পারছেনা, নিজের একটা প্রশ্নের জবাবও সে পায়নি। সুফিয়ানের ধরে থাকা হাতটা ছাড়িয়ে দৌড়ে রেয়ানের সামনে দাঁড়ালো প্রানেশা। রেয়ানের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এলোমেলো। প্রানেশা রেয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। বহুযুগ পর যেন আপনজনকে খুঁজে পেলো সে৷ রেয়ান প্রানেশার মাথায় হাত রেখে বললো –
‘বিয়ে কেনো করলে প্রানেশা? আমার ভালোবাসা এত ঠুনকো ছিলো তোমার কাছে? ‘

প্রানেশা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে না বললো৷ হিচকি ওঠা গলায় বললো –
‘বিশ্বাস করো রেয়ান, আমি কাল তোমাকে ফোন করার আগ পর্যন্ত কিছুই জানতাম না । জানলে কখনো বিয়ে করতাম না ‘

রেয়ান প্রানেশার হাত ধরে বললো-
‘চিন্তা করো না, দ্রুত তোমার তালাক করিয়ে আমরা বিয়ে করে নেবো’
প্রানেশা হা করে কিছু বলতে নিলেই সুফিয়ান এসে একটানে রেয়ানের কাছে থেকে ছিনিয়ে নিলো প্রানেশাকে। তারপর হাত ভাজ করে রেয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো –
‘সে আশা ভুলে যা রেয়ান৷ এই আশা কখনো পূরণ হওয়ার নয় ‘ তারপর রেয়ানের কানের কাছে হালকা আওয়াজে বললো-‘ কী জানিস তো, অগাস্টিন বলেছেন- দুর্বলেরা ভাগ্যে বিশ্বাসী হয়, আর সবলেরা তা ছিনিয়ে নেয়’

বলে সুফিয়ান দূরে সরে আসলো। রেয়ানের মুখ লাল হয়ে আছে৷ দুজনের চোখে যেন এক নিশ্চুপ যুদ্ধ চলছে৷ একজনের চোখে জিতে যাওয়ার জ্যেতি আর আরেকজনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ। রেয়ান ফসফস করতে করতে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। প্রানেশা সেই দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। নিজেকে বেইমান মনে হচ্ছে তার। ভালোবাসার মানুষটাকে ধোঁকা দিয়ে কী করে সুখী হবে সে! যদিও সে সেচ্ছায় কিছুই করেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান এতক্ষণ হাসলেও এখন চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে প্রানেশার দিকে। সাহস কী করে হয়, পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরে স্বামীর সামনে! প্রানেশার হাত ধরে নিজের রুমের দিকে নিতে ধরলেই রাহাত সাহেব বললেন -‘ আহা, মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। ওর কী দোষ! ‘

সুফিয়ান চোখ লাল করে রাহাত সাহেবের দিকে তাকালো। ঘাড় বাকিয়ে বললো- ‘আমার এবং আমার স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যাক্তিকে কথা বলার অনুমতি দেইনি আমি। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি একা নিতে শিখেছি বহু আগেই ‘

রাহাত সাহেব মুখ নিচু করে রাখলেন৷ সুফিয়ান প্রানেশাকে ধরে উপরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো৷ দরজা খুলে প্রানেশাকে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললো। সুফিয়ান দরজা লক করতেই প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে গেলো। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। লোকটা যে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় তা একদিনেই বুঝতে পেরেছে প্রানেশা। সুফিয়ানের মুখটা অস্বাভাবিক লাগছে প্রানেশার কাছে, কেমন যেন উন্মাদের মতোন৷ ঘাড়ের নীল রগটা ফুলে আছে৷ চোখের পলকও যেন আটকে আছে। প্রানেশার কপালে কপাল ঠেকিয়ে পেছনে হাত বাকিয়ে ধরলো সুফিয়ান৷ প্রানেশার মুখ চোখ কুচকে এলো ব্যাথায়৷ সুফিয়ান জোরে হাসা শুরু করলো, এমন পরিস্থিতিতে কেউ এভাবে হাসতে পারে তা প্রথম দেখলো প্রানেশা , ভয়ে গা গুলিয়ে আসছে তার । ভেতরের সব যেন এখনই বেরিয়ে আসবে। সুফিয়ান প্রানেশার কপাল ছুয়ে হেসে বললো –

-‘এত ভয় পাও তাহলে ওই কাজ কেন করলে প্রাণ?’

প্রানেশা থরথর করে কাপছে। সুফিয়ান আরও জোরে চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-

-‘ কেনো করলে বলো? সাহস কী করে হলো অন্য কারো ছোঁয়া শরীরে মাখার!’ বলে সুফিয়ান ঘন ঘন শ্বাস নেয়৷ তারপর মুখটা এমন করলো যখন কোনো বাচ্চার মাথায় চমৎকার বুদ্ধির আবির্ভাব ঘটে। এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বোকা হেসে বললো –
-‘পেয়েছি! চলো আমার সাথে ‘

প্রানেশার মাথা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ এতক্ষণে সে বুঝে গেছে, সুফিয়ান স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ নয়। সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন ভালো না তার। নাহলে এমন ব্যবহার নরমাল কেউ করেনা। সুফিয়ান বাথরুমের ভেতরে তাকে ঢুকাতেই প্রানেশার ভেতরটা ধক করে উঠলো, তাহলে কী এবার বাথটাবে চুবিয়ে মারবে! মানুষ সব কিছু হারাতে পারলেও প্রাণ হারাতে চায় না। প্রানেশা ভয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘প্লিজ, ছেড়ে দিন আমায়। আর কক্ষনো এমন হবেনা। মারবেন না আমাকে ‘

সুফিয়ান কোনো উত্তর দিলো না। প্রানেশাকে রেখে রুম থেকে একটা সোবা নিয়ে এলো। যা দিয়ে থালা বাসন মাজা হয়। ভীষণ রুক্ষ, মাঝে মাঝে বেশি ঘষা লাগলে হাত ছুলে যায়। প্রানেশাকে বাথটাবে বসিয়ে হাতের চুড়ি খুলে একনাগাড়ে ঘষতে থাকলো। হাত থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত অনবরত ঘষে গেলো। প্রানেশার মুখ যখন ব্যাথায় লাল হয়ে গেলো তখন সুফিয়ান থামলো৷ মুখের অভিব্যাক্তি এখনও স্বাভাবিক নয় তার, প্রানেশা প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে তখন সুফিয়ান প্রানেশার মুখটা আজলায় নিয়ে নরম গলায় বললো -‘ আমার জিনিসে আর কখনো অন্য কারো ছোঁয়া লাগাবে না প্রাণ। দেখলে তো কত কষ্ট হয় ছোঁয়া মুছতে! আমি একবার হারিয়েছি আর হারাতে দেবোনা। ‘
প্রানেশা সুফিয়ানের পাগলামিতে তাচ্ছিল্য করে হাসলো৷ ভেঙে যাওয়া গলায় ধীরে ধীরে বললো-
‘আপনি একটা পাগল। মানুষ খুন করতেও আপনার হাত কাঁপবে না ‘
সুফিয়ান প্রানেশার চুলের মুঠি ধরে কানের কাছে বললো-‘ খবরদার প্রাণ! আজ বলেছো ক্ষমা করলাম , দ্বিতীয়বার আমায় পাগল বললে ক্ষমা পাবেনা। আর খুন করতে পারি আমি কিন্তু তোমায় শেষ করা আমার সাধ্যের বাইরে। নিজের প্রাণকে শরীরের থেকে আলাদা করা কী এতই সহজ! ‘
প্রানেশা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সুফিয়ান কোলে করে উঠিয়ে বেডে নিয়ে শুইয়ে দিলো৷এসির সাথে এডজাস্ট ফ্যান অন করে, টাওয়াল দিয়ে প্রানেশার হাত পা মুছে নিলো। ব্যাথা কমার একটা ক্রিম নিয়ে হাতে আর গলায় লাগিয়ে দিলো। তারপর বেডে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে হসপিটালে কল করলো –
‘ আসাদ, তুমি আজকের প্যাশেন্টগুলোকে অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি আজ আসবো না৷ প্যাশেন্টদের কিছু ফাইল আছে এসে নিয়ে যেও, দেখে রেখেছি ‘
বলে ফোনটা সুইচ অফ করে দিলো৷ সে পেশায় একজন সিনিয়র হার্ট সার্জেন। বর্তমানে সে নিজের একটা হাসপাতাল বানানোর একটা প্ল্যান করছে। সেটার কাজ কমপ্লিট হলে সেখানে জয়েন করবে সে।
প্রানেশার মুখের দিকে তাকিয়ে সুফিয়ান দেখলো মুখ লাল হয়ে গেছে।একটা চিনির পুতুল প্রানেশা, ছোট খাটো ব্যাথায়ও তার নাজেহাল অবস্থা হয়। সুফিয়ান যে ঔষধ দিয়েছে তাতে রাতের আগেই ব্যাথা কমে যাবে। কিন্তু এখন সুফিয়ানের নিজেরই চিন্তা হচ্ছে, নিজের ডাক্তারিতেও ভরসা করতে পারছেনা। তাই, হসপিটালে মানা করে দিলো। কিছুর যদি প্রয়োজন হয়! প্রানেশাকে জড়িয়ে ধরে সেও পাশে শুয়ে পরলো। প্রানেশার হাতটা মুখের সামনে নিয়ে বিরবির করে বললো-
” প্রাণ, এই পৃথিবীতে প্রেমিক অনেকেই হয় । কিন্তু পাগল প্রেমিক সবাই হতে পারে না। পাগল প্রেমিক হওয়া সহজ নয়, কারণ পাগলদের ভালোবাসার সীমা বোঝে না ”

চলবে…

অঙ্গারের নেশা
পর্ব~৬
নাঈমা হোসেন রোদসী

ঘুমের ইনজেকশনের কারণে সারা রাত ঘুমিয়ে ছিলো প্রানেশা। সকাল আটটায় ঘুম ভেঙে গেলো। শরীর বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে। আড়মোড়া ভেঙে বসতেই
রাতের কথা মনে পড়লো তার। চোখজোড়া দিয়ে সুফিয়ানকে খুজতেই দেখলো প্রানেশার কোমড় জড়িয়ে শুয়ে আছে। প্রানেশা ঘুম থেকে উঠে তেমন কিছু মনে থাকে না, সুফিয়ানকে দেখে প্রানেশার ভেতরটা উথলে উঠলো। সুফিয়ানের ঠোঁট লাল নয় বাদামী বর্ণের। প্রানেশার মনে প্রশ্ন জাগলো ‘লোকটা কী সিগারেট খায়?’
খেতেও পারে যে বদ! হঠাৎ করে রাতের কথা মনে পড়ে গেলো তার। কি নিষ্ঠুরের মতোন আচরণ করে ছিলো তার সাথে! হাত গুলো চোখের সামনে নিতেই প্রানেশা হা করে তাকিয়ে রইলো। তার ধারণা মতে হাতে অসম্ভব ব্যাথা হওয়ার বা চামড়া ঝলসে যাওয়ার
কথা। শুধু মাঝে হালকা লালচে ভাব ছাড়া কিছুই নেই।
লোকটা কী জাদু করলো নাকি! প্রানেশা গালে হালকা চাপড় মেরে সুফিয়ানকে উঠানোর চেষ্টা করলো। ঘুম ভাঙছেনা দেখে প্রানেশার মন চাইলো গলা টিপে দিতে। প্রানেশা তো আর জানেনা তার সেবা যত্ন করে সুফিয়ান তিনটার দিকে ঘুমিয়েছে৷ প্রানেশার রাতে তীব্র জ্বর এসেছিলো, সেটাও সুফিয়ানের সেবায় সেরেছে। সত্যি সত্যি গলা টেপার জন্য গলায় হাত রাখতেই সুফিয়ান মাথা এপাশ ওপাশ করলো। কিছু খাওয়ার মতো মুখ নেড়ে গাল ফুলিয়ে প্রানেশার পেটে মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো৷ প্রানেশার কেন জানি খুব মায়া লাগলো। গভীর টান অনুভব হলো। কীসের জন্য এই টান বুঝতে পারলো না। এই মানুষটাকে সে কষ্ট দিতে পারবেনা তা ভালোই বুঝতে পারলো। সুফিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রানেশা মনে মনে ভাবলো
‘ চেহারা এক হলেও সুফিয়ান সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাব ভঙ্গি থেকে শুরু করে সবকিছু। ‘
প্রানেশা কাল খেয়াল করেছে রেয়ানের সঙ্গে দাঁড়ালে সুফিয়ানকে বেশ খানিকটা লম্বা মনে হয়। অর্থাৎ, সুফিয়ানের হাইট ছয় ফুট না হলেও এর কাছে। তাছাড়া হাঁটাচলায় রাজকীয় একটা ভাব আছে। শরীরটা আরেকটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায় শারীরিক গঠনে সুফিয়ান বেশ স্বাস্থ্যবান। জিম করায় হাতের মাসেল গুলো ফুলে থাকে সবসময়। কিন্তু, একটা প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই বুঝতে পারেনা প্রানেশা, রেয়ান যদি সুফিয়ানের ছোটই হয় তাহলে দুজনের চেহারা কী করে এক রকম হয়। ভাইয়ের সাথে চেহারার মিল থাকতেই পারে তাই বলে হুবুহু কপি! এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে প্রানেশা খেয়াল করেনি যে সুফিয়ান ঘুম থেকে উঠে গেছে। সুফিয়ান দুষ্টু স্বরে বললো –
‘কী ব্যাপার প্রাণ? জেগে থাকলে ফিরেও তাকাও না আর ঘুমিয়ে থাকলে চোখ দিয়ে সব গিলে খাও!’

প্রানেশা চোর ধরা পড়ার মতো মুখ করে আমতা আমতা করে বললো –
‘কী..কীসব উল্টো পাল্টা কথা! আমি আপনাকে দেখতে যাবো কোন দুঃখে? ‘

বলে কোনোরকমে পালিয়ে যাওয়ার জন্য খাটের থেকে নামতেই সুফিয়ান পেছনে থেকে জড়িয়ে রাখলো। চুল সরিয়ে ঘাড়ে নাক ঘষে বললো-
‘ দুঃখে কেনো প্রাণ! সুখে দেখবে। এত সুন্দর বর পেয়ে তো তোমার উচিত সুখে সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকা। আদরও করতে পারো আমি মাইন্ড করবো না ‘

প্রানেশার ভেতরে সব যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। শরীর অসাড় হয়ে আসলো৷ সব ভর সুফিয়ানের উপর ছেড়ে দিলো। রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও সুফিয়ানই তাকে প্রথম এভাবে ছুঁয়ে দিলো। এর আগে কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার, কিন্তু একুশ বছরের যুবতী সে। তার অনুভূতিও খুব প্রখর। সুফিয়ান প্রানেশার অবস্থা বুঝতে পেরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কোমড় চেপে কানের নিচে চুমু খেতেই প্রানেশা দিকবিদিকশুন্য হয়ে সুফিয়ানকে আঁকড়ে ধরলো। এখন তার মস্তিষ্কে শুধু সুফিয়ানের নাম চলছে।পৃথিবীর সকল কিছু থেকে সে যেনো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো কয়েক মূহুর্তের জন্য। সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরে লম্বা শ্বাস ফেলতে থাকলো সে। এমন সময় দরজায় কে যেনো কড়া নাড়লো। সুফিয়ান প্রানেশার মাথায় আলতো চুমু খেয়ে বললো-
‘যাও, হাত মুখ ধুয়ে এসো ‘

প্রানেশার মস্তিষ্ক সচল হলো৷ এতক্ষণের সব কিছু একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অপরাধ বোধও নিজের দাপট বাড়িয়ে দিল। সুফিয়ানের থেকে নিজেকে এক ঝটকায় দূরে সরে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। সুফিয়ান উঠে দরজা খুলতেই দেখলো মিসেস অদিতি দাঁড়িয়ে আছে। নিজের মাকে দেখে বললো-
‘কী হয়েছে মা?’

মিসেস অদিতি সুফিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন –
‘ তোমার না হাসপাতালে যেতে হবে , এসে খেয়ে নাও। আর প্রানেশা উঠেছে?’

‘হ্যা, ফ্রেশ হচ্ছে ‘

‘ঠিক আছে, ওকে নিয়ে খেতে এসো ‘

‘মা শুনো’

‘কী হয়েছে?’

সুফিয়ান শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো –

‘ফুপি কী নিচে বসে আছে? সে থাকলে খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দাও, আমি চাইনা প্রাণ বিনা দোষে কারো কটু কথা শুনুক’

মিসেস অদিতি মুচকি হেসে বললেন-

‘না, সে তো কাল সন্ধ্যায়ই নিজের বাসায় চলে গেছে।তুমি চিন্তা করোনা, এখন শুধু তোমার মামাতো বোন লিজা আছে মেহমানদের মাঝে। ‘

‘লিজা তো আরও বড় সমস্যা মা’

‘ আমি বলে দিয়েছি যেন সে কোন প্রকার অযৌক্তিক আচরণ না করে। লিজা আর ওমন করবেনা বলেছে ‘

‘না করলেই ভালো । আমার প্রাণের সামনে যদি কোনো প্রকার ছেঁচড়ামো করে তাহলে জান হাতে আর ফিরবেনা তোমার ভাগ্নী ‘

‘আহা! তুমি এসো তো’

বলে মিসেস অদিতি সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। প্রানেশা বের হতেই সুফিয়ান ভেতরে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে গায়ে হোয়াইট শার্ট প্যান্ট চাপিয়ে নিলো৷ প্রানেশার চুল আঁচড়ানো হলে সুফিয়ান প্রানেশার মাথায় আলতো চুমু খেয়ে হাত ধরে নিচে নামলো। প্রানেশা প্রথমে ছাড়িয়ে নিলেও সুফিয়ানের চোখ রাঙিয়ে দেওয়ায় আর সাহস পায়নি। নিচে গিয়ে টেবিলে বসতে নিতেই প্রানেশার চোখ গেলো রেয়ানের দিকে। এতক্ষণ ধরে রেয়ান ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দুজনকে একসাথে দেখে রেয়ান চোখ মুখ লাল করে তাকিয়ে আছে। মনে মনে সুফিয়ানের থেকে প্রতিশোধ নেয়ার পণ করছে। এর মাসুল সে নিয়েই ছাড়বে।
প্রানেশা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো রেয়ানের দিকে। এতক্ষণ ধরে তার মনেই ছিলো না যে রেয়ানও এখানে থাকবে৷ দম বন্ধকর হাসফাসে মারা যাচ্ছে সে। বার বার মনে হচ্ছে সে ধোঁকা দিচ্ছে তার প্রথম প্রেমকে। সুফিয়ান ব্রেডে হালকা বাটার লাগাতে লাগাতে বললো -‘প্রাণ,বসে খেয়ে নাও’

প্রানেশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে বসলো। দ্বিধায় আছে সে। বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে প্রানেশা সিরিয়াস। বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়, যে চাইলে ভেঙে আরেকটা করে নিলাম। আবার, জীবনের প্রথম অনুভতি যার জন্য তাকেই বা কী করে ছেড়ে মুখ ফেরাবে সে! এসব ভাবলে প্রানেশার মাথা ঘোরে। ব্রেড মুখে নিয়েও গিলতে না পেরে পানি খেয়ে নিলো। মুখে দিতেও ইচ্ছে করছে না। প্লেটটা সরিয়ে উঠতে নিলে সুফিয়ান বললো-
‘খাবার নষ্ট করতে নেই, খেয়ে তারপর ওঠো’

প্রানেশা বিরক্তিকর কন্ঠে বললো –

‘ বমি পাচ্ছে আমার, আমি খেতে পারছি না ‘

পাশের থেকে লিজা হেঁসে হেঁসে বললো –

‘এ বাবা! বিয়ের দুইদিন হলো না তার মাঝেই বমি পাচ্ছে। অবশ্য, অস্বাভাবিক তো নয়। রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক তো ছিলো তোমার। এই সুফি, কেন বিয়ে করলে এমন কাউকে বলোতো! ‘

প্রানেশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ ভীষণ বিরক্ত হলো প্রনেশা। সে হিন্দি সিরিয়ালের নাইকার মতোন ছিচকাদুনে, ইমোশনাল নয়। যথেষ্ট পজিটিভ মাইন্ডের। সামনে বসা লিজার মুখে এসব বেশি বিরক্ত হলো সে৷ কারণ এই রকম কথা যদি লিজাকে বলা হতো তাহলে হয়তো বিশ্বাস করা যেতো, লিজার গায়ে হাতাকাটা টপ, পায়ে এঙ্কার হিল জুতা, গোরালির থেকে উঁচুতে একটা স্কার্ট। প্রানেশাকে তাচ্ছিল্য করে লিজা মনে মনে পৈশাচিক সুখ অনুভব করছিলো কিন্তু তাতে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে প্রানেশা আবারও চেয়ার টেনে বসলো। ব্রেড হাতে নিয়ে বললো-

‘ লিজা আই থিঙ্ক, তোমার কমন সেন্সের অভাব আছে। ইউ নিড প্রপার ট্রিটমেন্ট । বমি হলেই যে একজন মানুষ প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবে এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বমি সাধারণত দুর্বলতা, সিকনেস,জ্বর আরও অনেক কিছু হতে পারে। তুমি করে বললাম বলে কিছু মনে করো না, একচুয়েলি বড় হলেও সম্পর্কে তুমি আমার ছোট তাছাড়া হাতে পায়ে বড় হলেই তো আর বড় হওয়া যায় না । একটা সুস্থ মস্তিষ্কেরও প্রয়োজন ‘

পুরো কথাটা বলে প্রানেশা ব্রেড চিবোতে থাকলো। সুফিয়ান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রানেশার দিকে। দারুণ জবাব দিলো লিজাকে। লিজাকে তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো –
‘তো লিজা, কী যেন জিজ্ঞেস করছিলি! আমি কেন প্রানেশার মতোন মেয়েকে বিয়ে করলাম। এতক্ষণে নিশ্চিয়ই জবাব পেয়ে গেছিস’

লিজা অপমানে ফুঁসে উঠলো৷ খাবারের প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে বিরবির করতে করতে উপর চলে গেলো। ছোট বেলা থেকে সুফিয়ানের জন্য পাগল হয়ে আছে লিজা, কিন্তু অপমান ছাড়া আর কিছুই পায়নি।

সুফিয়ান খাওয়া শেষ করে এপ্রোন পড়ে নিয়ে প্রানেশাকে সাবধানে থাকতে বলে চলে গেলো।
এভাবেই নিজের ঘরে বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছে প্রানেশা, তাই রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো মিসেস অদিতি রান্না করছেন। বেশ সুন্দর দেখতে, এত বড় ছেলে আছে বোঝাই যায় না। সুফিয়ানের মুখের গড়ন তার মায়ের মতোন হয়েছে। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে দেখতেই মুচকি হেসে বললেন-
‘এসো, তোমার সাথে তো কথাই হলো না ‘

প্রানেশাও হালকা হেসে ভেতরে এসে তার পাশে দাঁড়ালো। কী কাজ করবে বুঝতে পারছেনা। রান্না পারে সে কিন্তু অন্য কারো রান্নাঘরের তেমন কিছুই জানেনা তাই মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো –
‘মা, আমি কি কাজ করবো? ‘

মিসেস অদিতি হাসতে হাসতে বললেন-

‘তোমাকে কাজ করতে হবে না মা, তুমি পাশে দাঁড়াও অথবা গরম লাগলে নিজের রুমে চলে যাও’

প্রানেশা এত সুন্দর নির্লিপ্ত কথায় খুশি হলো। এখানে আসার পর নিজের মা বাবাকেও মিস করছিলো। এখন মনে হলো এটা বুঝি আরেকটা মা। সংকোচ নিয়ে প্রানেশা বললো-

‘মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ‘

‘পাগলি মেয়ে! মাও বলছে আবার জিজ্ঞেস করতেও ভয় পায়! বিনা সংকোচে যা ইচ্ছে বলো’

প্রানেশা উৎসাহ নিয়ে বললো-

‘ মা, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সুফিয়ান কেনো আমাকে বিয়ে করলো এটা জানা সত্ত্বেও যে তার ছোট ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আছে? তাছাড়া, সুফিয়ান আর রেয়ানের চেহারায় এতো মিল কী করে!’

মিসেস অদিতির মুখ মলিন হয়ে গেলো। প্রানেশার হাত ধরে বললো-

‘ শোনো প্রানেশা, আমি জানি তুমি রেয়ানকে ভালোবাসতে। তারপরও সুফিয়ান তোমায় বিয়ে করেছে এ নিয়ে তুমি খুব চিন্তায় আছো, কিন্তু একটা কথা বলি সুফিয়ান যেমন খুব কঠোর তেমনি মনের দিকে ভীষণ নরম। ছেলেটা আগে এমন ছিলো না, নিজের অতি প্রিয় এক জিনিস হারিয়ে এমন হয়ে গেছে। তাকে একটু ভালোবেসে দেখো সে তোমায় মাথায় করে রাখবে, জানি এটা তোমার পক্ষে কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। জানো তো মেয়েদের সম্মান তাদের কাছে সবার আগে, সমাজকে আমরা যতই পরোয়া না করি কিন্তু দিন শেষে এখানেই থাকতে হয় আমাদের। তাই, আলাদা হওয়ার চিন্তা না করে তাকে আপন করার চেষ্টা করো। দেখবে সে নিজেই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে’

কথাগুলো বলে তিনি প্রানেশাকে আদর করে মাথায় চুমু দিয়ে ঘরে যেতে বললেন। প্রানেশা মাথা নাড়িয়ে ঘরে গেলো। এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেলো। প্রতিটি মুহূর্ত মিসেস অদিতির কথা ভেবে গিয়েছে সে। সুফিয়ানের এতো ভালোবাসা আর কেয়ার তাকে বাধ্য করে ভাবতে। তার বুকে মাথা রেখে ঘুমানো। সকালে উঠে সুফিয়ানের দুষ্ট কথা, হাসপাতাল থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরেও তার খেয়াল রাখা সবকিছু তাকে ভাবায়। এতদিনে সে বুঝতে পেরেছে সুফিয়ান তাকে অতিরিক্ত মাত্রায় ভালোবাসে। মনে মনে সে ভাবে-
‘মানুষটাকে কী একটা সুযোগ দিয়ে দেখবো!’

কলিং বেল বাজতেই ভাবনায় ছেদ ঘটে। প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ান এসেছে। আজ নিজে থেকেই একটা লাল শাড়ি পড়ে নিলো প্রানেশা। সুফিয়ান ঘরের দরজায় নক করতেই গেট খুলে একগাল হেঁসে ভেতরে আসতে বললো। সুফিয়ান শক হয়ে গেলো, এত পরিবর্তন কী করে হলো। প্রানেশা তো তার সাথে কথা বলতেও দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না। তাহলে আজ লাল শাড়ি পড়ে তার অপেক্ষা করছে কী করে!
প্রানেশা নিজেই সুফিয়ানের এপ্রোন খুলে দিয়ে পানি এগিয়ে দিলো। সুফিয়ান বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রানেশার হাত থেকে পানি নিয়ে খেয়ে ফ্রেশ হতে গেলো৷ প্রানেশা ঠোঁট চেপে হাসলো। এবার থেকে সে চেষ্টা করবে এই মানুষটাকে মেনে নিতে। সময় লাগলেও এরকম ভালোবাসা সে পায়ে ঠেলার মতো বোকা নয়। সুফিয়ান বের হয়ে দেখলো প্রানেশা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। চুল গুলো মুছে টাওয়াল পাশে ছড়িয়ে দিয়ে ব্যালকনির দিকে গেলো। পাশে দাঁড়াতেই প্রানেশা তাকে আরও অবাক করে দিয়ে হালকা করে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ান অবাক হওয়ার পালা চুকিয়ে হেসে নিজেও জড়িয়ে ধরলো। গাল হাত রেখে পরিবেশটা আরও সৌন্দর্যে মুড়িয়ে দিতে মোহনীয় কন্ঠে বললো –

দেখো, নিয়ন বাতির ঝাপসা আলোয়
সব যেনো আলোকিত,
বুকের পাশে চুপটি করে
শুনছো তুমি কী এতো?
দেখো, ভালোবাসার চাদর মুড়ে
মাখছো গায়ে উষ্ণ ছোঁয়া,
অনুভূতির সংবিধানে
বুঝতে পারো মনের কথা?
গেলে সেদিন দৌড়ে কোথায়?
ভরিয়ে দিয়ে রঙিন ব্যাথায়!
লুকোচুরির অন্ত হলে,
এসে পড়ো মনের কোঠায়। (স্বরচিত)

চলবে….

অঙ্গারের নেশা পর্ব-৩+৪

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৩

হালকা হালকা আলোর মাঝে চুপ হয়ে বসে আছে প্রানেশা। মনের অসংখ্য প্রশ্নগুলোকে দমিয়ে অপেক্ষা করছে রেয়ানের মতো দেখতে বহুরূপীর। এক ঘন্টা হলো প্রানেশাকে রুমে এনে বসানো হয়েছে। পরিবেশ ঠান্ডা হলেও ভারি শাড়ি পড়ে শ্বাস ছাড়তেও নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে প্রানেশার। খট করে আওয়াজ হতেই প্রানেশা দরজার দিকে তাকালো। হ্যা, বহুরূপী লোকটি এসেছে। এবার প্রানেশা কোমর বেঁধে নেমেছে, কিছুতেই সত্য না জেনে থাকবেনা।
সামনে তাকিয়ে দেখলো খাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাক্তিটি। হালকা আলোয় কেমন যেন অপার্থিব দৃশ্য মনে হচ্ছে লোকটিকে দেখে৷ এই জায়গায় রেয়ান থাকলে আজ প্রানেশা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো৷ একই চেহারা হলেও তা হতে পারছেনা সে৷ উঠে দাড়িয়ে লোকটির সামনে দাঁড়াতে নিয়েও পারলোনা প্রানেশা। তার আগেই লোকটা প্রানেশার বাহু চেপে বসিয়ে পাশে বসে পড়লো। প্রানেশা রেগে বললো –
‘সমস্যা কী আপনার? বারবার কেনো এমন করছেন? ‘

ব্যাক্তিটি অধর কোণে বাকা হাসি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বললো-‘কোনো সমস্যা নেই প্রাণ। সব সমস্যার সমাধান হয়েছে আজ। সব হিসেব পূর্ণ হলো ‘

প্রানেশা বাকা উত্তরের তেমন কোনো অর্থ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলো৷ হাত ছাড়াতে ধস্তাধস্তি শুরু করলো। ব্যাক্তিটি একসময় জোরে ধমক দিলো।
‘হয়েছে কী!এমন করছো কেনো? আর একবার ছাড়ানোর চেষ্টা করলে পরিণতি কিন্তু ভাবতেও পারবেনা ‘

প্রানেশা কড়া ধমকে চুপ হলেও চোখে পানি এসে পড়লো৷ ছোট বেলা থেকেই ভীষণ আদরের সে। বাবা মা এমনকি পুরো নানা দাদার পরিবারে সকলের চোখের মণি। একবেলা তাকে খাওয়ানোর জন্য তিন জন মানুষ লেগে থাকে। এত জোরে তাকে কখনোই কেউ বকেনি। তাই খুব অভিমান হলো প্রানেশার। তার কথা হলো এভাবে কেনো বকবে! হাত ছাড়াতে এবার আরও জোর দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু হলো প্রানেশা। ব্যাক্তিটি ভরকালো না। বুঝতে পারলো তার প্রাণের অভিমান হলো। জোর করে টেনে কোলে বসিয়ে চোখ মুখ মুছে দিলো। সারাদিনের দুশ্চিন্তা আর ধকলে মুখটা ভীষণ শুকনো লাগছে। ব্যাক্তিটি উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো । প্রানেশা হা করে তাকিয়ে আবার মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। ব্যাক্তিটি ঘরে আসতেই প্রানেশা দেখলো হাতে একটা প্লেট, তারমধ্যে ভাত আর মুরগীর ভাজা মাংস সাথে ডাল ৷ প্রানেশা মনে মনে ভাবলো ‘এই লোক কীভাবে জানলো আমার ভাতের সঙ্গে ডাল আর মুরগীর মাংস দিয়ে খেতে ভালোবাসি! ‘
লোকটা হাত ধুয়ে এসে প্লেট থেকে এক লোকমা ভাত মাখিয়ে প্রানেশার মুখের সামনে ধরলো। প্রানেশার ক্ষুধা লাগলেও অভিমানী স্বরে বললো –
‘আমি খাবো না, আগে বলুন কে আপনি?’
ব্যক্তিটি শক্ত গলায় বললো –
‘আগে চুপচাপ খাও তারপর বলবো’

প্রানেশা সত্যি জানার জন্য ব্যকুল হয়ে দ্রুত ভাতের লোকমাটা মুখে নিলো৷ অর্ধেক খাওয়ার পর প্রানেশা বাচ্চাদের মতোন দুইহাত দিয়ে না দেখালো, বোঝানোর চেষ্টা করলো-‘আমার পেট ভরে গেছে’
ব্যক্তিটি বুঝতে পেরে প্লেট সহ উঠে দাড়িয়ে যেতে যেতে আদেশের সুরে বললো -‘বেড বক্স থেকে পানিটা খাও ‘
প্রানেশার কেনো জানি মনে হলো লোকটা ভীষণ কেয়ারিং। যেমনটা সে রেয়ান আর তার প্রেমের প্রথম দিকে চাইতো ঠিক তেমন। রেয়ান খেয়াল তার খেয়াল রাখলেও মাঝে মাঝে কেমন একটা উদাসীন ভাব অথচ সম্পর্কের শুরুর দিকটা ছিলো স্বপ্নের মতোন। ভাবতে ভাবতে পানিটা খেয়ে চুপ করে বসলো। আবার ভাবলো লোকটা আসতে আসতে কাপড়টা চেঞ্জ করে ফেলি। ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে বদলিয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলো৷ টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতেই ব্যাক্তিটি ভেতরে ঢুকলো৷ প্রানেশা টাওয়াল রেখে এগিয়ে গেলো লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে হাত ভাজ করে বললো -‘ এবার বলুন ‘
লোকটি ড্রেসিং টেবিলের দিকে ফিরে পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে বললো-‘কী বলবো? ‘

প্রানেশার এমন ইয়ার্কি পছন্দ হলো না। পাঞ্জাবি খুলে ফেলতে দেখে চোখ মুখ ঢেকে চিৎকার করে বললো-
‘লজ্জা শরম নেই! অপরিচিত মানুষের সামনে জামা কাপড় খুলে ফেলেন ‘

ব্যাক্তির এমন অযাচিত কথা অপছন্দ হলো৷ উদাম গায়ে এগিয়ে এসে প্রানেশার পিঠে একহাত রেখে গালে চুমু খেয়ে বললো-
‘ প্রথম কথা আমি জামা কাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে যায়নি টাউজার আছে। দ্বিতীয়ত, তোমার স্বামী অপরিচিত কারো সামনে জামা খোলে না মিসেস সুফিয়ান তেহজিব ‘

প্রানেশার চোখ সুফিয়ানের উদাম গা দেখে পুড়ে যেতে চাইলো৷ এত ফর্সা ত্বকের সাথে ব্যায়াম পুষ্ট দেহ চোখে লাগছে। প্রানেশার চোখ মুখ খিচে বললো –
‘দূরে যান বলছি । আপনি দেখছি উচ্চ লেভেলের বেহায়া! ‘
সুফিয়ান হেসে সরে গেলো৷ গায়ে কফি কালারের শার্ট চাপিয়ে গম্ভির গলায় বললো-
‘শোনো প্রাণ, আজ থেকে তোমার একটাই পরিচয়। তুমি সুফিয়ান তেহজিবের স্ত্রী। তোমার অতীতে কে ছিলো কে ছিলো না আমি এতকিছুর ধার ধারি না। আর হ্যা, তোমার রেয়ান সম্পর্কে আমার ছোট ভাই। দুই বছরের বড় আমি তার। তাই এখন থেকে তাকে শুধু একটা নজরেই দেখতে পারো, দেবর ‘

প্রানেশা খাটের উপর ধপ করে বসলো৷ চোখ লাল হয়ে আসছে, কী অসহ্য যন্ত্রণা! যে মানুষটা জীবনের প্রথম প্রেম হিসেবে এলো তাকে কী করে প্রানেশা স্বামীর ছোট ভাই মানবে? চিৎকার করে বললো-
‘আপনার লজ্জা করলো না ছোট ভাইয়ের ভালোবাসায় কুনজর দিতে? ‘

সুফিয়ান প্রানেশার গাল চেপে ধরলো । রাগে কাঁপতে
কাঁপতে অদ্ভুত ভাবে সাইকোর মতো হেসে বললো –

‘নাহ, করলো না। ভালোবাসা তুই আমার, বলেছি না? প্রাণ শুধু আমার! তোর নেশায় পুরে অঙ্গার হয়েছি আমি, তোকেও হতে হবে এই অঙ্গারের নেশা ‘

চলবে…

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৪

প্রানেশার গাল ছেড়ে সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালো৷ প্রানেশা পাথরের মতোন শক্ত হয়ে বসে আছে। সুফিয়ান এক গ্লাস পানি পান করে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে বিছানায় শুয়ে প্রানেশাকে টেনে নিজের বুকের উপর শোয়ালো। প্রানেশা ঘোর থেকে বেরিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো –
‘ ছাড়ুন আমায়, এমন একজন নিকৃষ্ট মানুষের সাথে আমি সংসার করবো না। ডিভোর্স দেবো আমি ‘

এতক্ষণ নিজের রাগের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও সুফিয়ান ডিভোর্সের কথা শুনে রাগ সীমানা প্রাচীর ভেদ করে ফেললো৷ প্রানেশাকে উল্টো করে বালিশে ফেলে বিছানায় হাত চেপে ধরলো। প্রানেশা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে সুফিয়ানকে দেখছে। তার মতে সুফিয়ান একজন নোংরা মনমানসিকতার মানুষ,নিজের ছোট ভাইয়ের ভালোবাসা নিশ্চিয়ই ভালো কেউ ছিনিয়ে নেয়না। সুফিয়ানের ফর্সা ধবধবে মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে৷ প্রানেশার মুখের কাছে মুখ নিয়ে রাগে চিৎকার করে বললো-
‘এই আশা ভুলে যা, এই নিকৃষ্ট মানুষের সাথেই সারাজীবন কাটাতে হবে তোকে৷ কোর্টে গিয়ে ডিভোর্স পেপার রেডি করবি! কীভাবে? কোর্টে তোর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেবো। একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ তুই আগেও আমার ছিলি আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমারই থাকবি। ‘
তারপর শ্বাস ফেলে হুট করে সুফিয়ান মুখে দুষ্টু হাসি দিয়ে প্রানেশার গলার কাছে নাক ঘষে হালকা কন্ঠে বললো-
‘প্রাণ, আমি চাইলে এখনি বাসর সেড়ে ফেলতে পারি’

প্রানেশা হা করে তাকিয়ে থেকে ভাবলো ‘ লোকটা তো দেখছি ভীষণ লুচু’
একধাক্কা দিয়ে সুফিয়ানকে সরিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো প্রানেশা। সুফিয়ান বাঁকা হেসে উল্টো হয়ে বুকে ভর দিয়ে শুয়ে পড়লো। সুফিয়ানের ঘুম এসে পড়লেও প্রানেশা এপাশ ওপাশ করতে থাকলো। নতুন জায়গায় আসলে প্রানেশার ঘুম আসেনা। এবার বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। ঘুম না আসায় মেজাজও বিগড়ে যাচ্ছে। প্রানেশাকে উঠতে দেখে সুফিয়ান গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো -‘কী হয়েছে? ঘুমাচ্ছো না কেনো?’

প্রানেশার মনে পড়লো রেয়ানের সঙ্গে প্রেমের শুরুটা হয় ফোনে৷ একটা রং নাম্বারে কল চলে গেছিলো। তারপর প্রানেশা সরি বলতে নিলে থমকে গিয়েছিল এক মোহময় পুরুষ কন্ঠে। রেয়ানকে তখনও দেখেনি প্রানেশা, সম্পর্কের তখন দুই মাস। কত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলো প্রানেশা আর রেয়ান! রেয়ান বলেছিলো-
‘ আমাদের বিয়ের পর তোমার ঘুম না আসলে আমি তোমার বুকে মাথা রেখে তোমায় ঘুম পাড়াবো’
প্রানেশা খিলখিল করে হেসে বলেছিলো –
‘এভাবে কী ঘুম আসবে! দেখা যাবে আপনি ঘুমিয়ে পানি হয়ে যাবেন আর আমি ওভাবেই জেগে থাকবো।’
রেয়ান জোর দিয়ে বলেছিলো -‘ঘুম আসতে বাধ্য ‘

সুফিয়ানের ডাকে কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসলো প্রানেশা। চোখের কোণায় জমা জলটুকু মুছে নিলো। আবার বালিশে মাথা এলিয়ে দিলো। সুফিয়ান হুট করে এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলো। প্রানেশার বুকে মাথা রেখে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে চোখ বুজলো। প্রানেশা হকচকিয়ে বললো-
‘আরে আরে! হচ্ছেটা কী! উঠুন বলছি। আমার বুকে মাথা রাখার অধিকার দেইনি আপনাকে’

সুফিয়ান বললো-
‘ বুকে মাথা রাখার জন্য বিয়েই যথেষ্ট, আমার আর এক্সট্রা কোনো সুপারিশের প্রয়োজন নেই প্রাণ’

প্রানেশা তারপরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করলো কিন্তু আর পারলো না, শক্তিতে হেরে ক্লান্ত হয়ে চোখে ঘুম নেমে আসলো৷ প্রানেশা ঘুমিয়ে পড়তেই সুফিয়ান প্রানেশার কপালে আর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে চাদরটা ভালো লেগেছে টেনে দিলো৷ তারপর বুকে আবারও মুখ গুজে বিরবির করে বললো -‘ তুমি শুধু আমার প্রাণ,আর কারো অস্তিত্ব থাকবে না তোমার মাঝে ‘

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রানেশা দেখলো নয়টা বাজে। সাধারণত সাতটার মাঝেই প্রানেশা জেগে পড়ে। রাতে দেরীতে ঘুম হওয়ায় লেট হয়ে গেছে । মনে মনে প্রানেশা লজ্জা পেলো, স্বামীকে না মানলেও এটা সত্য যে বিয়ে হয়েছে। এখন সে বিবাহিত, এতক্ষণ পর্যন্ত ঘুমানো মানায় না। ভেতরে ভেতরে ভয় লাগছে, শ্বশুরবাড়ির মানুষ জন না জানি কেমন হয়! ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরোলো সুফিয়ান। সুফিয়ান প্রানেশার দিকে এসে কপালে চুমু খেয়ে বললো- ‘শুভ সকাল প্রাণ, যাও শাওয়ার নিয়ে এসো ‘
সুফিয়ানের কথায় প্রানেশার কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগে৷ সুফিয়ান শুধু একটা ব্লু টাউজার পড়ে আছে। পায়ের দিক তাকিয়ে প্রানেশা হা করে তাকিয়ে রইলো। ছেলে মানুষের পা এত ফর্সা হয়! প্রানেশা ঘোরে অজান্তেই ছুঁয়ে বললো ‘এত সুন্দর কেনো!’
সুফিয়ান প্রানেশার মুখভঙ্গি দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।
কানের কাছে দুষ্টু স্বরে বললো -‘পছন্দ হয়েছে? ‘

প্রানেশার ধ্যান ভেঙে গেলো। সামনে তাকিয়ে সুফিয়ানের মুখে দুষ্ট হাসি দেখতেই মনে পড়লো সে কী করেছে! লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেছে প্রানেশার। প্রানেশা দ্রুত খোপা করে উঠে পড়লো। সুফিয়ান হেসে উঠে আলমারি থেকে শার্ট প্যান্ট পড়ে নিলো। প্রানেশা রেডি হয়ে বেড়োতেই সুফিয়ান বললো নিচে যেয়ে সবার সাথে খাবার খেতে। অন্য কোনো কারণ হলে প্রানেশা না করে দিতো কিন্তু বড়দের অসম্মান করতে চায়না সে। তাই সুফিয়ানের পিছু পিছু নেমে এলো। লাল শাড়িতে পুতুলের মতো সুন্দর লাগছে প্রানেশাকে। ডাইনিং টেবিলে বসতেই খেয়াল করলো এতক্ষণ সবাই গল্প করলেও সুফিয়ানকে দেখে সবাই নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছে। কারণটা বুঝতে পারলো না প্রানেশা। সুফিয়ানের বাবা মা খুব ফ্রি মাইন্ডের, প্রানেশাকে খুব আদর করছে। কিন্তু সুফিয়ানের ফুপু এত আদর সহ্য করতে পারছেনা, মুখ ফসকে বললো-‘ নতুন বউ এত দেরি করে ঘুমালে চলে! তোমার উচিত ছিলো সকালে উঠে সবার আগে নাস্তা বানিয়ে সবাইকে খাইয়ে তারপর বসা ‘

প্রানেশা মনে মনে কষ্ট পেলেও মুখে কিছু বললো না। কিন্তু সুফিয়ান খাবার প্লেটটা চামচ দিয়ে খটখট আওয়াজ করে বললো-‘ ফুপুমনি তুমি দেখছি আজকাল খুব সাংসারিক হয়ে গেছো!এত উন্নতি কবে হলো? তুমি তো বিয়ের দুইদিন পরই শ্বশুর শ্বাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছো ‘
মিসেস কাবিরার মুখটা ফাটা বেলুনের মতোন চুপসে গেলো৷ অন্য কেউ সুফিয়ানের জায়গায় হলে তিনি ছেড়ে দিতেন না কিন্তু সুফিয়ানের সামনে আর বলার সাহস পেলেন না। কলিংবেলের আওয়াজে সবার নজর গিয়ে পড়লো সদর দরজায়। কাজের লোক গিয়ে দরজা খুলে দিলো। ব্যাক্তিটি ভেতরে ঢুকতেই প্রানেশার চোখ ছলছল করে উঠলো৷ অস্ফুটস্বরে বললো -‘রেয়ান!’

চলবে…

অঙ্গারের নেশা পর্ব-১+২

0

“অঙ্গারের নেশা”
” নাঈমা হোসেন রোদসী ”
-সূচনা পর্ব

ভয়ে কাঁপতে থাকা প্রানেশা পাত্রের দিকে তাকিয়ে লজ্জা ভুলে হা করে তাকিয়ে থাকলো৷ সকাল থেকে তার মায়ের বকাবকির কারণে পাত্রপক্ষের সামনে বসেছিলো সে। নার্ভাসনেসের জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ফ্লোরে ঘষছিলো৷ পাত্রের দিকে ভূলেও তাকায়নি৷ হঠাৎ নাম জিজ্ঞেস করায় প্রানেশার মনে হলো অতি পরিচিত কেউ। মুখের দিকে তাকাতেই, মুখ আপনা আপনি হা হয়ে গেলো৷
এটাতো তারই বয়ফ্রেন্ড রেয়ান!

পাঁচ বছরের সম্পর্ক প্রানেশার রেয়ানের সঙ্গে, রেয়ানের প্রপোজের থেকে প্রেমের শুরু। এখন প্রানেশা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে রেয়ানকে৷ কয়েক দিন আগেও প্রানেশা যখন রেয়ানকে বিয়ের জন্য বললো, রেয়ান বলেছিলো ‘ কয়েক দিন যাক, তারপর বিয়ের ব্যাপারে ভাববো’ অথচ পরিবার নিয়ে বিয়ের কথা বলতে এলো! প্রানেশা অবাক হলেও ভিষণ খুশি হলো৷ ইশ,ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর মতো সুসংবাদ আর কী হতে পারে!

প্রানেশা ঠিক করলো, রেয়ানকে এবার ধরবে। পেয়েছেটা কী! সকাল থেকে ফোনের পর ফোন দিয়েছে সে একবারও রিসিভ করেনি। কিছুক্ষণ পর,রেয়ানের বাবা নিজেই বললো দুজনকে একটু আলাদা করে কথা বলতে। প্রানেশা সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করলোনা, রাজি হলো। প্রানেশা রেয়ানকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। যেহেতু, প্রানেশা আগে থেকেই রেয়ানকে চেনে তাই লজ্জা না পেয়ে রুমের সিটকানি লাগিয়ে দিলো। রেয়ান পাশেই ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রানেশা কয়েক কদম এগিয়ে খপ করে রেয়ানের কলার টেনে রাগী মুখে তাকালো৷

-‘সমস্যা কী? ফোন ধরনি কেনো? জানো আমি কত ভয় পেয়েছিলাম৷ তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে কী হতো?জবাব দাও রেয়ান তেহজিব ‘

রেয়ান কোনো উত্তর দিলো না। ব্যায়ামপুষ্ট লম্বা দেহের উপর আক্রমণাত্মক দৃষ্টি দিয়ে তাকানো প্রানেশাকে হালকা হাতে ছাড়িয়ে নিলো। আয়েশি ভঙ্গিতে পাশের সোফায় বসে এসির রিমোট দিয়ে পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো৷ পায়ের উপর পা তুলে হাত ঘড়ির টাইমটা দেখে নিলো৷ প্রানেশা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। রেয়ান এমন কেনো ব্যবহার করছে, সে বুঝতে পারছেনা। হঠাৎ করে প্রানেশার মনে হলো, রেয়ানকে আজ
মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে৷ সাধারণত রেয়ান সুন্দর, পাঁচ ফুট দশের লম্বা দেহের ফর্সা ত্বকের অধিকারী। কিন্তু, এখন সামান্য কিছু পার্থক্য লাগছে। যেমন,বেশী ফর্সা দেখাচ্ছে, চুলগুলো একটু বড়, দেহটাও যেন আরও বেশি আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে। এমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি হওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না৷ বেশির ভাগ সময় রেয়ান তার রাগ ভাঙায়। যখনই প্রানেশা রাগে তখন রেয়ান কান ধরে, আদুরে কথা বলে। কিন্তু এখন এমন করছে কেনো?

রেয়ান প্রানেশার হাত হেঁচকা টান দিয়ে কোলে উঠিয়ে নিলো৷ প্রানেশা হকচকিয়ে তাকিয়ে আছে৷ তাকে আরও বিভ্রান্ত করতে রেয়ান প্রানেশার ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। প্রানেশা থরথরিয়ে কাঁপা শুরু করলো। তিন বছরে প্রানেশা কখনোই রেয়ানকে এত কাছে আসতে দেয়নি। আজকে রেয়ানের ছোঁয়াও বোধ হয় বদলে গেছে। আগে হাত ধরলেও তেমন কোনো অনুভূতি হতো না, অথচ কেমন অস্থিরতায় ভেসে যাচ্ছে সে। এত প্রখর ছোঁয়ায় চুপসে গেলো প্রানেশা। রেয়ান কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো –

‘এত রাগ ভালো না প্রাণ। শরীরের ক্ষতি হয়। ‘

‘ প্রাণ? কখনো তো এই নামে ডাকোনি। তাহলে আজ কেনো?’

রেয়ান অধর ছড়িয়ে হাসলো। প্রানেশার চুলগুলো পিছনে সরিয়ে হিম শীতল কণ্ঠে বললো –

‘ আগে তো শুধু প্রেমিকা ছিলে, কয়েক দিন পর বউ হয়ে যাবে। বউ তো নেশার জিনিস প্রাণ,তাই এখন থেকে তোমার এই নামই বরাদ্দ হবে ‘

প্রানেশা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রেয়ান তার ছোয়াঁয় তাকে আবার ডোবালো। প্রানেশা কাঁপতে থাকা গলায় বললো –

‘আজ কী আমায় মেরে দেয়ার মনোভাব স্থির করলে?’

রেয়ান হাসলো। দূরে সরে এসে প্রানেশার গলায় দুই আঙুল আলতো ছুঁয়ে বললো ধীর গতিতে বললো –

‘ এমন হাজারওবার মরতে তৈরি হও প্রাণ ‘

প্রানেশা কথাটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিলো৷ দুইজন বের হয়ে সম্মতি দিতেই বিয়ের কথা আগালো৷ ধুমধামে রেয়ান প্রানেশার বিয়ের আয়োজন শুরু হলো।

নিজের রুমে বসে প্রানেশা বধূ বেশে চুপটি করে বসে আছে৷ কিছুক্ষণ পরই বর আসবে। রেয়ান আর কিছুক্ষণ পরই তার নামে লেখা হয়ে যাবে৷ কী মনে করে প্রানেশা মোবাইল হাতে নিলো৷ মনে মনে ভাবলো একবার কল করে দেখা যাক রেয়ান কোথায়! কল দিতেই তিন বারের সময় রিসিভ হলো। সাথে সাথেই রেয়ান অতি আদুরে কন্ঠে বললো –

‘সরি জান এই দশদিন কল করতে পারিনি। বাবা আমাকে আর্জেন্ট কিছু কাজে সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছিলো। এত ঝামেলা যে তোমায় কল করার সময় পাইনি। ‘

প্রানেশা থম মেরে বসে পড়লো। বুকের ভিতরটা হঠাৎ অস্থিরতায় ভরে উঠছে। ভাঙা কন্ঠে বললো –

‘মানে! আজ তোমার আর আমার বিয়ে। কয়েকদিন আগেও তো তুমি বললে আমায় লাল বেনারসিতে দেখতে চাও’

রেয়ান বিরক্তি ভঙ্গিতে অবাক হয়ে বললো-

‘এসব কী উল্টো পাল্টা বলছো প্রানেশা? দশ দিন আগেই আমি সিঙ্গাপুর চলে এসেছি, বিয়ে কীভাবে করবো?’

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব-২

প্রানেশা ধপ করে নিচে বসে পড়লো৷ কী করে সম্ভব এটা? যদি রেয়ান সিঙ্গাপুরেই থাকে তাহলে দুইদিন আগেও এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো সে কে? প্রশ্নে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নাহ,আর চুপ করে থাকা যাবে না। নাহলে ভালোবাসা চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলবে প্রানেশা। দ্রুত উঠে দাড়িয়ে কপালের উপর জমা ঘাম মুছলো সে৷ দরজা খুলতে হাত বাড়াতেই, কেউ একজন দরজা টান দিয়ে খুলে ফেললো৷ হকচকিয়ে সামনে তাকালো প্রানেশা, রেয়ান দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো ‘নাহ, এ রেয়ান হতে পারে না। ‘ রেয়ান অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপছে। সাহস করে চিৎকার করে বললো-
‘কে আপনি? আপনি আমার রেয়ান হতে পারেন না ‘

রেয়ানের মাঝে কোনো আলাদা প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। সে যেনো আগে থেকেই এই ব্যাপারে অবগত। চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রানেশার কোমর ধরে টেনে নিলো৷ প্রানেশা এত শক্তির সাথে না পেরে হাঁপিয়ে উঠলো৷ ব্যাক্তিটি প্রানেশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো –
‘বলেছিনা প্রাণ? এত রাগ দেখাবে না। আর আমার সাথে তো নয়ই। এখনো চেনোনি আমায়। ‘

কিছুটা থেমে অস্বাভাবিক ভাবে ঘাড় বাকিয়ে বললো-
‘শোনো প্রাণ, আমাকে রাগিও না। এর ফল ভালো হবে না। শুনেছিলাম তোমার বাবার হার্টের অসুখ আছে। এর আগেও দুইবার এট্যাক হয়েছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙলে নিশ্চয়ই সহ্য করতে পারবে না? এবার কিন্তু এট্যাক হলে মারা যাওয়ার সম্ভবনা ১০০ পার্সেন্ট’

প্রানেশা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। এ কেমন পরীক্ষায় পরলো সে? ঠিকই, এবার যদি বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙে তাহলে আর সে সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু বিয়ে করলে, রেয়ান কী করে সহ্য করবে! তার প্রথম ভালোবাসা রেয়ান। তাকে ভূলে এই বহুরূপীর সঙ্গে কী করে সংসার করবে ভেবে পাগল লাগছে নিজেকে প্রানেশার। জোর করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জোরে বলে উঠলো –
‘কখনোই না। আপনাকে বিয়ে করবো না আমি। আমার ভালোবাসা রেয়ান। ‘

ব্যাক্তিটি ভীষণ রেগে গেলো। নিজের গায়ের সব শক্তি লাগিয়ে প্রানেশার গলা চেপে ধরলো । ফুঁসতে ফুঁসতে বললো-
‘খবরদার, তোমার মুখে অন্য কারো নাম আমি সহ্য করবো না প্রাণ। তোমার চোখে মুখে, অন্তরে, তোমার দেহের সর্বাঙ্গে শুধু এই আমার বিচরণ চলবে। তুমি আমার প্রাণ, যে আমার প্রাণকে আমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে তাকে কেটে টুকরো করতে আমি দুবার ভাববো না।’

প্রানেশা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে । কেমন হিংস্র পশুর মতোন ব্যবহার। এই মানুষটাকে বিয়ে করলে বাঁচার সম্ভবনা আছে কী? মনে সংশয় জাগে প্রানেশার। চোখের পানি পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে৷ ব্যাক্তিটি লম্বা শ্বাস ফেলে প্রানেশাকে ছেড়ে দিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
‘বিয়ে ভাঙার কোনো চেষ্টা করবে না প্রাণ। চুপচাপ নিজে যাবে কবুল বলবে। যদি কোনো গন্ডগোল করার চেষ্টা করো তো তোমার রেয়ানকে সিঙ্গাপুরের মাটিতেই পুতেঁ রাখবো’
প্রানেশা শব্দ করা ভুলে গেছে। সে বুঝে গেছে সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি সামান্য কেউ নয়। কতটা শক্তিশালী হলে, ফোনে রেয়ানের সাথে কথা বলে যে সত্যিটা প্রানেশা জেনে গেছে তা নিমিষেই ধরে ফেললো। অর্থ ও শক্তি দুটোই প্রচুর পরিমাণে আছে এর। কোনোভাবেই এখন পালানো সম্ভব না। প্রানেশাকে চুপ থাকতে দেখে লোকটি ঠোঁট এলিয়ে হাসলো । সে বুঝে গেছে প্রানেশা আর পালানোর চেষ্টা করবেনা। প্রানেশার কাছে দুই পা এগিয়ে গেলো সে। হাত দিয়ে গাল মুছে দিয়ে মাথার ঘোমটা টেনে আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। মুখ বাড়িয়ে প্রানেশার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে সরে গেলো। ধীর পায়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। প্রানেশা চুপ করে চেয়ারে পুতুলের ন্যয় শক্ত হয়ে বসে থাকলো৷ ব্যাক্তিটির সত্যিটা জানতে হলেও বিয়ে করতে হবে। মনে মনে স্থির করে এখন পালানোর পথ না পেলেও বিয়ের পর তো পাবে। এক না একদিন তো রহস্য বের করবেই সেদিনই এই হিংস্র বহুরূপীকে ডিভোর্স দেবে। এতে যা হওয়ার হোক৷ কিছুক্ষণ পরই কাজিনরা এসে তাকে নিচে নিয়ে গেলো৷ পুতুলের মতোই কবুল বলে বিয়ে সম্পন্ন করলো৷
বিদায়ের সময়ও প্রানেশা কাঁদলো না। অনুভূতিহীন ভাবে বসে থাকলো৷ গাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা এলিয়ে বসে নিজের ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হাসলো।
মনের তীব্র হাহাকার যেনো বেড়েই যাচ্ছে। কী হবে আগামীর ভবিষ্যৎ! রেয়ানকে সে কী জবাব দেবে? আর এই বহুরূপীকেই বা কী করে স্বামীর স্হান দেবে সে!
শ্বশুর বাড়ির সামনে গেট খুলতেই প্রানেশা বাহিরে বের হলো৷ বাড়ি দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। কালো রঙের এমন বিশাল বাড়ি প্রথম বার দেখলো সে৷ প্রানেশার বাবারও যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে৷ বাড়িও যথেষ্ট সুন্দর। কিন্তু এতবড় নয়, কালো রঙ দিয়ে এমন কেন করলে বাড়িটাকে প্রানেশা বুঝে উঠতে পারলো না। লম্বা শ্বাস ছেড়ে সবার সাথে ভেতরে প্রবেশ করলো।

রাহাত তেহজিব নিজের রুমে বসে চিন্তায় পায়চারি করছেন৷ মিসেস অদিতি তেহজিব ভেতরে প্রবেশ করে বললেন-‘কী হয়েছে?আপনি এভাবে পায়চারি করছেন কেনো?’

তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন-
‘তুমি বুঝতে পারছো না? কেনো আমি এত চিন্তা করছি! এমন করে মেয়েটাকে ধোঁয়াশায় রাখা উচিত হচ্ছে? ‘

মিসেস অদিতি ভাবলেশহীন ভাবে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালেন৷ তিনি ভীষণ ক্লান্ত। ছেলের বিয়েতে খাটুনি কম হয়নি৷ এখন লম্বা একটা ঘুমের প্রয়োজন তার। হাতের চুড়ি গুলো খুলতে খুলতে হাই তুলে বললেন-
‘এত চিন্তা করো না। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যেতো’

মিস্টার রাহাত অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন –
‘আর এখন? মেয়েটার জীবন এখন নষ্ট হয়নি? তোমার বড় ছেলে কেমন মানুষ তুমি জানো না! মেয়েটাকে বাঁচতে দেবে! ‘

চলবে…

দহন ফুল পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

#দহন_ফুল– ১০ (শেষ পর্ব)

প্রভা তোমার হলুদের শাড়ি আছে তো নাকি লিস্টে নাম তুলে নিবো?
ডাইনিংয়ে বসে বিয়ের কেনাকাটার লিস্ট বানাচ্ছেন শাশুড়ী আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন।
— না মা আমার লাগবে না, তাছাড়া ওই তারিখে মানে বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত আমি এবাড়িতে থাকবো না।
— কি বলছো এসব?
— জ্বি আম্মা, আমার আম্মুর সাথে জরুরি কাজ আছে।
— কাজ অন্যদিন করলে হয়না?
— না আম্মা ওইদিনই করতে হবে।
— সবই বুঝেছি বাড়িতে থাকতে চাও না, তোমরা সবাই আমার সাথে এমন করছো যেনো আমি গুরুতর কোনো অপরাধ করছি। বলো আমি কি অপরাধ করছি?
— সেটা আপনার বিবেককে প্রশ্ন করুন।
— হ্যা কত কিছু যে বলবা তোমরা আল্লাহ জানে।
— আম্মা আপনার সাথে তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মনির মা ফ্রিজে জমানো রান্না করা খাবারের বক্স ফ্রিজ থেকে নামিয়ে গরম করছে। চুলার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলাম,
— মনির মা ফ্রিজ থেকে রান্না করা তরকারি নামিয়েছো কেনো? আজ নতুন কিছু রান্না হবে না?
— বড় ভাবীর শরীর খারাপ, তাই আইজ এই দিয়াই চলতে অইবো।
— কি হয়েছে তার?
— জানিনা, মাথা ঘুরায়ে পইড়া গেছে, বমিও করছে, আমি ধইরা নিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া আসছি।
— আম্মা কিছু বলে নাই?
— না হে কইলো, শরীর খারাপ অইলে শুইয়া থাহুক রান্দনের দরকার নাই।
— আচ্ছা আচ্ছা আমি দেখছি তুমি কাজ করো।

মনেমনে অনুশোচনা হলো, এমনিতেই বেচারি একটা ট্রমাতে আছে, কতটা নিরুপায় হলে এমন সিদ্ধান্তে রাজী হয়, যার উপর বর্তায় সে জানে। আর আমি কিনা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি? টিপ্পনী করেছি, আঘাত করে কথা বলেছি। একদম ঠিক করিনি কাজটা? ইশ কি যে হয় আমার!
ক্ষমা চেয়ে নেবো ভাবীর কাছে।

দরজা খোলাই ছিলো, গিয়ে দেখি ভাবী চোখ বুঁজে আছেন, কিন্তু চোখের কোলজুড়ে পানি জমে আছে। বুঝাই যাচ্ছে কেঁদেছেন কিছুক্ষণ আগে, আমি ভাবীর হাতটা মুঠোতে নিলাম। ভাবী চোখ মেলে বললেন,
— ওহ প্রভা… তুমি?
— হ্যা আমি….. ভাবী আমাকে ক্ষমা করে দাও, তোমার উপর রাগ থেকে খারাপ ব্যবহার করেছি, এটা ঠিক করিনি। তুমি আমার উপর রাগ করো না।
— না প্রভা আমি তোমার উপর রাগ করিনি, সবই আমার ভাগ্য না হয় পাঁচ বছরেও শাশুড়ীর মনে জায়গা পাইনি কেনো? সাবির আমার সাথে সেদিনের পর থেকে আর কথা বলে না।

বলেই ভাবী ডুকরে কেঁদে উঠলেন, কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ উঠে ওয়াশরুমে গেলেন বেসিনে প্রচুর বমি করলেন। রুমে ঢুকে বিছানায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলেন।

আমি কি করবো বুঝতে না পেরে ভাবীর মোবাইল থেকে সাবির ভাইয়াকে ফোন করলাম। ভাইয়া ফোন কেটে দিলেন, কয়েকটা কল দিলাম সব কয়টাই কেটে দিলেন। আমি দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে চার্জ থেকে ফোন খুঁলে কল দিলাম। এবার একটা কলেই উনি রিসিভ করলেন।
— হ্যালো
— ভাইয়া.. ভাবী খুবই অসুস্থ, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।
— তো আমি কি করবো?
— এখন রাগ দেখানোর সময় নয় আপনি বাড়ি আসুন। আমি গাইনি ডাক্তারের সাথে কথা বলছি। তাড়াতাড়ি আসুন।

যতই রাগ দেখাক ভাইয়া ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাড়ি এলেন, শাশুড়ী তো দেখে মহা খুশি, বললেন,
— সাবির এসেছিস বাবা, জানতাম তুই আমার কথা ফেলবি না। বিকেলেই কেনাকাটার জন্য বেরিয়ে পড়বো।
— তোমার এসব আজাইরা কাজ তুমি সামলাও, আমাকে এসবে টেনো না।
বলেই গটগট করে রুমে চলে গেলো।
— কি বেয়াদব হয়েছে ছেলেটা! দাঁড়া সব ঠিক করবো সময় মতো।

ভাইয়া রুমে ঢুকে দেখে আমি ভাবীর মাথায় হাত বুলাচ্ছি, আমি ভাইয়াকে দেখে উঠে বললাম,
— আমি একগ্লাস লেবুর শরবত খাইয়েছি, আর আমার মামাতো বোন গাইনোকোলোজিস্ট ডাঃ আশাফাকী খানম তার সাথে কথা বলেছি, সে ৪টার দিকে চেম্বারে আসবে। সরাসরি ওখানে চলে যাবেন এইতো সাত মসজিদ রোডে।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— আমি আপনাদের খাবার এখানে নিয়ে আসছি। এখানেই খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে চলে যাবেন।

বেরিয়ে আসার সময় আড়চোখে দেখলাম ভাইয়া ভাবীর কপালে নিজের মাথাটা আলতো চেপে রেখে কাঁদছেন।
আমার চোখেও ভিজে গেলো।

ট্রেতে করে খাবার নিয়ে যাবার সময় শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলেন,
— এগুলো কার খাবার নিয়ে যাচ্ছো?
— ভাইয়া ভাবী রুমে খাবার খাবেন, ভাবী খুব অসুস্থ।
— ওহ আচ্ছা,…. তা করে নিক যত ঢং কদিন পরে তো আর এসব কপালে জুটবে না।
— বালাইষাট মা আল্লাহ যেনো এমন দিন না দেখান।
শাশুড়ী চোখ দিয়ে আমায় ভস্ম করে দিতে চাইলেন। আমি চুপচাপ সরে গেলাম।

সন্ধ্যার দিকে ভাইয়া ভাবীকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার দোকানে চলে গেলেন ক্লোজ করে আসার জন্য। ভাবীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি খবর ভাবি? ডাক্তার কি বললো?
— স্পষ্ট কিছু বুঝছে না, প্রেশার লো, এসিডিটি আছে শুধু বমি বন্ধের ওষুধ দিলো আর কিছু টেস্ট করালো, আগামীকাল রিপোর্ট দেবে। তাইতো দেরি হলো আসতে, নয়তো আরো আগেই ফিরতাম।
— ইশশ! যদি কোনো সুখবর হতো…
— সে ভাগ্য কি আর আমার আছে ?
— ভাবী নিরাশ হইও না, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।

দুপুরে নতুন কিছু রান্না হয়নি তাই রাতে আলুভর্তা, ডালভর্তা, বেগুনভাজা আর ডিমভাজি দিয়েই সবাই খাওয়াদাওয়া সারলো। রাতে ব্রেড জেলি এসব আনিয়ে রাখলাম সকালের নাস্তার জন্য।

শাশুড়ীর সারাদিন কাটে ফোন করা নিয়ে ব্যস্ত থেকে গ্রাম থেকে ভাগ্নেকে আনছেন বিয়ের কেনাকাটায় সঙ্গী পাচ্ছেন না বলে। সারাদিন ভাই ভাতিজি ও তার চৌদ্দগুষ্টির সাথে উচ্চস্বরে কথা বলে বলে কানের বারোটা বাজাচ্ছেন। একেকটা হাসি দিচ্ছেন যেনো বিল্ডিং কেঁপে উঠে। এমনিতেই উনার গলা বড় এখন তার পুরোটা ছেড়ে হাকাচ্ছেন। শ্বশুর থাকলে তো একটু দমে থাকেন এখন তো পুরাই ফাঁকা মাঠ। শ্বশুর বাবা কেনো যে এখনো আসছে না?

ভাবীর শরীর অসুস্থ তাই তাকে কোনো কাজ করতে দিলাম না, মনির মাকে নিয়ে সব কাজ সারলাম। ক্লান্ত শরীরে গোসল সেরে নামাজ শেষ করতেই সামির চলে আসলো অসময়ে। শরীর খারাপ লাগছে তাই হাফ বেলার ছুটি নিয়ে চলে এসেছে।
আজ একটু কাজ বেশি করেছি শরীর ক্লান্ত তাই দুপুরবেলায় শুতে না শুতেই ঘুম চলে আসলো।

শেষ বিকেলে হঠাৎ কান্নাকাটির আওয়াজে ঘুম ছুটে গেলো? বুক ধরাস করে উঠলো, ভাবীর কিছু হলো না তো!! তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালাম সোয়া পাঁচটা বাজে।
আমি আর সামির দৌড়ে রুম থেকে বের হলাম, কান্নাটা ড্রয়িংরুম থেকে আসছে। গিয়ে দেখি শ্বশুর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন আর শাশুড়ী মা মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদছেন,
— ও সাবিরের বাপ তুমি এইডা কি করলা…? আমারে এতবড় শাস্তি দিলা…? আমারে তুমি মাইরা ফেললা না কেনো?

আরেকটু ভালো করে তাকাতেই দেখলাম, সোনালি পাড় নেবীব্লু আঁচলের নীল কাতান শাড়ি পড়নে এক টুকটুকে ফর্সা, ছিমছাম গড়নের সুন্দরী মধ্য বয়সী মহিলা বসে আছেন সোফাতে। আশ্চর্য হলাম উনি কে?
সামির আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
— উনি বেলী ফুফু, শুনেছিলাম এর সাথে বাবার…. তবে খুব ভালো মানুষ, আমাদের ভীষণ আদর করতেন।
আমি টাশকি খেয়ে তাকিয়ে রইলাম।

সামির বললো,
— বেলী ফুফু ভালো আছেন?
শ্বশুর বললেন,
— ফুফু কি রে গাধা, ছোট মা বল।
সামির মাথা নুইয়ে রাখলো।

শ্বশুর বাবা ডাকলেন,
— প্রভা.. এটা তোমার ছোট শাশুড়ী, কাছে এসে তাকে সালাম করো।
বড়ভাবীও কখন যেনো আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন টের পাইনি।
আমি এগিয়ে গিয়ে সালাম করলাম, বড়ভাবীও এগিয়ে গেলেন।

শ্বশুর বাবা বললেন, শোনো মা লক্ষ্মীরা উনি তোমাদের ছোট শাশুড়ী, তাকে কোনো অসম্মান করবা না। আর যাও আমাদের জন্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করো, খালি মুখে নতুন মানুষরে আর কতক্ষণ রাখবা?

শাশুড়ী অনবরত বিলাপ করেই চলেছেন। এক পর্যায়ে পা চেপে ধরলেন,
— সাবিরের বাপ তুমি ওরে ফিরাইয়া দিয়া আসো, তারপর যা বলবা আমি সব মাইন্না নিমু তবুও তুমি আমারে আর কষ্ট দিও না।
— মঘের মুল্লুক পাইছো ফিরাইয়া দিয়া আসো কইলেই হইলো নাকি?
আর এতো কান্নাকাটির কি আছে আমি বুঝলাম না? তুমিই না বলছো পুরুষ মানুষ দুই বিয়া করলে কিছু হয় না, দুই বউ মিল্লা-মিশ্যা থাকলেই শান্তি। তাইলে এখন কান্দো ক্যান?
— আমি তো সাবিরের কথা কইছিলাম, আমি তো তোমার কথা কই নাই গো সাবিরের বাপ….
— ক্যান আমারে তোমার পুরুষ মনে হয় না? বেলীর জন্য আমার অন্তর পুড়তো, জ্বালামুখ ফুটতো কিন্তু সাহস পাইতাম না। আর তুমি সেই জ্বালামুখে বাতাস দিছো। দুই বিয়াতে সমস্যা নাই তুমিই বলছো, এখন এসব কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নাই।

নতুন শাশুড়ীকে শরবত দিয়ে সাহস করে শ্বশুরকে প্রশ্ন করলাম,
— বাবা সত্যিই কি আপনি বিয়ে করেছেন? নাকি মিথ্যামিথ্যি আম্মাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
শ্বশুর রাগী সুরে বললেন,
— তোমার কি মনে হয় আমি মস্করা করতেছি? আমি সত্যি সত্যি বিয়ে করছি।
এই বেলীর সাথেই আমার ছোটবেলায় ভাব ভালোবাসা ছিলো, বাবা মার কাছে সাহস করে বলতে পারি নাই, কারণ আমিও ছোট বেলীও ছোট। আমি শহরে পড়তে আসলাম এই ফাঁকে বেলীর বাল্যবিবাহ হয়ে গেলো। জানতে পেরে খুব কাঁদছিলাম প্রথম ভালোবাসা বলে কথা। তারপর তোমার শাশুড়ীকে বাবা মা আমার ঘাড়ে চাপায়ে দিলো, ভাবলাম বেলী না পাই পারুল তো পাইলাম, কিন্তু নামেই ফুল চারিদিকে সুবাসের বদলে দুর্গন্ধ ছড়াইলো।
বছর পনেরো আগে বেলীর স্বামী মারা গেলো অসুস্থ হইয়া, ছোট একটা মেয়ে নিয়া জীবন কাটাইয়া দিলো। আমার খুব ইচ্ছে করতো ওর জন্য কিছু করতে, ওর খোঁজ খবর রাখতাম, কয়েকমাস আগে ওর মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করলাম সুপাত্র দেখে।
তোমার শাশুড়ী যখন দুইবিয়াতে সমস্যা নাই কইলো, আমি গিয়া বেলীর মেয়ে জামাইরে রাজী করাইলাম। তাদের সম্মতিতেই দুই হাত এক হইলো।

আমাদের সবার কথার মাঝে সাবির ভাই দুই হাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
শ্বশুর বাবা বললেন,
— সাব্বাস ব্যাটা! বাপের বিয়ের কথা শুনে ছেলে মিষ্টি নিয়ে হাজির।
সাবির ভাইয়া ঘটনার কিছুই না বুঝে বললো,
— মানে কি?
শাশুড়ী মা চিৎকার করতে করতে সাবির ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
— ওরে…. সাবিররে… তোর বাপের বুড়াকালে ভীমরতি ধরছে রে…. তোর বাপ বেলীরে বিয়া কইরা নিয়া আসছে রে…..

সাবির ভাইয়া শাশুড়ী মায়ের হাত ছাড়িয়ে এসে শ্বশুর বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো,
— বাবা এসবের মানে কি?
— উহু… যে পুরুষ নিজের নির্যাতিতা স্ত্রী পাশে দাঁড়াতে পারে না, তার বাবার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া মানায় না।
— তাই বলে এই বয়সে?
— তোমার মা ই তো বলেছে পুরুষ মানুষ দুই বিয়া করলে কিছু হয় না, মিল্লা-মিশ্যা থাকলেই শান্তি।
এখন যদি তোমার মা মিল্লা-মিশ্যা থাকতে পারে থাকবে, নয়তো অন্য ব্যবস্থা করুক। কি বেলী বেগম মিল্লা-মিশ্যা থাকবা তো?

এতক্ষণ পর মহিলার কণ্ঠ শুনলাম,
— জি আমার মিল্লা-মিশ্যা থাকতে আপত্তি নাই, আপার কথা আমি জানিনা।
— শুনছো পারুল বেগম? এইবার ভাইবা দেখো কি করবা? তা বাবা সাবির এত মিষ্টি নিয়া বাসায় আসার কারণ?

সাবির ভাইয়া মাথা নুইয়ে মুচকি হাসলো, রিপোর্টটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো,
আমি রিপোর্ট পড়ে বললাম,
— বাবা দারুণ সুখবর, আপনার ঘরে ছোটছোট পায়ে হাঁটার জন্য মেহমান আসছে।
— আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ!! বেলী তোমার কদম আমার সংসারে সৌভাগ্য নিয়ে আসছে। প্রভা সবাইকে মিষ্টিমুখ করাও। পারুলরে দুইটা মিষ্টি বেশি দিও, অনেক কষ্ট করছে সে।

আমি মনির মাকে দিয়ে সবাইকে মিষ্টি দেওয়ালাম, ভাবীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম, ভাবী লজ্জায় লাল হয়ে আছে।
সাবির ভাইয়া শ্বশুর বাবার সামনে এসে আমতাআমতা করে বললো,
— বাবা….. আমি একটা বাসা দেখেছি,….. নিনুকে নিয়ে ওখানে চলে যাবো, স্ত্রী সন্তানদের এখানে রাখার ভরসা পাচ্ছি না।
— খবরদার যদি এই বাড়ির বাইরে পা রাখিস, একদম ঠ্যাং ভেঙে দেবো। আমার নাতিনাতনি সারাঘরে দৌড়াবে আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো।

নতুন শাশুড়ী উঠে এসে সাবিরের হাত ধরলেন,
— বাবা আমি সেবা করবো বড় বউমার, সংসারের সব দায়িত্ব আমি নিলাম তাকে কোনো কাজ করতে দেবো না। আমার দুই বউমা এবার আরাম করবে। কথা দিলাম কোনো অযত্ন হবে না তাদের। তুমি বউমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।

শাশুড়ী মা কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় বসে আছেন, না পারছেন কাঁদতে না পারছেন হাসতে।
শ্বশুর বললেন বুঝলে বউমা,
— আমি এখন দুই ফুলের এক মালি, আমার সুখের কোনো অভাব নাই।
শ্বশরের রসিকতায় হেসে উঠলাম।

আর এদিকে আমার শরীরটাও ইদানীং ভালো যাচ্ছে না, মাথা ঘুরায়, বমি লাগে ভাবছি গাইনি ডাক্তার একবার দেখিয়েই ফেলি কি বলেন আপনারা।

সমাপ্ত

#শামীমা_সুমি

দহন ফুল পর্ব-০৯

0

#দহন_ফুল — ৯

অনশনের ছয় দিনের মাথায় শাশুড়ীর মনে হলো, কেউ তো আর তার রুমে উঁকি দিচ্ছে না তাই নিজে থেকে বের হওয়া উচিত । আমরা সবাই সকাল বেলা নাস্তা খেতে বসেছি। শাশুড়ীকে দেখলাম জুলজুল করে হেঁটে ডাইনিং এর দিকে আসলো। সবাই আড়চোখে দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম সুমতি হলো বোধহয়।

আশার গুড়ে পানি ঢেলে দিয়ে হঠাৎ করে উনি ঢলে পড়ে গেলেন। মাসুমা ভাবী আমি খাবার ফেলে দৌড়ে গিয়ে উঠাতে চেষ্টা করলাম। সাবির ভাইয়া, সামির চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, শ্বশুর দিব্যি আয়েশ করে নাস্তা খাচ্ছে, খাওয়া ফেলে উঠার নাম গন্ধ নেই উল্টো আরো বলছে,
— পড়ছে রে পড়ছে, কাতলামাছ কাঁদায় পড়ছে,
ওরে এতো তোয়াজ না কইরা পানিতে চুবাও ভুত ছুঁটে যাবে।
শাশুড়ীর চোখ পিটপিট করছে, আর হাত পা মাটিতে আছড়াচ্ছে।
আমার ভীষণ হাসি পেলো, অতি কষ্টে হাসি চাপলাম।
শাশুড়ীকে উঠাতে পারছি না দুই বউ, সামিরকে এগিয়ে আসতে বললাম, সে এগিয়ে এসে শাশুড়ীর মুখ খুলে জিহবা পরীক্ষা করে বললো — হাইপো হয়ে গেছে একগ্লাস কড়া মিষ্টি করে শরবত বানিয়ে নিয়ে এসো। সামির রুমে গিয়ে ইনসুলিন নিয়ে আসলো।
চুরিচামারি করে যদিও খাচ্ছিলো কিন্তু সবটা চাহিদা কি পূরণ সম্ভব? হয়তো ওষুধ খেতে ভুল করেছে তাই এই হাইপো।
সবাই ধরাধরি করে তুলে সোফায় শোয়ানো হলো। আমি শরবত নিয়ে আসলাম, কিন্তু উনি গো ধরে বসে আছেন, ভেবেছেন অবস্থা আবার উনার অনুকূলে, তাই আবার বলে দিলেন সাবির ভাইয়া বিয়েতে রাজী না হলে কিছুই খাবেন না ইনসুলিনও নেবেন না।

শ্বশুর নাস্তা সেরে উঠে তামাশা দেখছেন দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বললেন,
— দেখো দেখো দম চলে যাচ্ছে তবুও কৃষ্ণের লীলা থামার খবর নাই, বজ্জাত মহিলা।
মাসুমা ভাবী হঠাৎ এক কান্ড করে বসলেন, সাবির ভাইয়ার পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন,
— তুমি রাজী হয়ে যাও নয়তো মায়ের কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
সাবির ভাইয়ার ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব অবস্থা কাটাতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। পা ঝাড়া দিয়ে সরে গেলেন,
— তোমার যা খুশি করো গর্দভ.. কোথাকার।
বলে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বাসার বাইরে বের হয়ে গেলেন।
শ্বশুর বাবাও রেগেমেগে,
–তোমাদের এসব তামাশা আর সহ্য হচ্ছে না।
বলে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে চলে গেলেন।

ভাবী শাশুড়ীর কাছে এসে,
— আম্মা আপনি যা বলবেন তাই হবে।
বলে শাশুড়ীকে আস্বস্ত করে শরবত খাইয়ে দিলেন। সামির চুপচাপ ইনসুলিন পুশ করে নিজের রুমে চলে গেলো।
আমার ভাবীর বোকামি দেখে মেজাজ খারাপ হলো, সামিরের পিছে রুমে চলে গেলাম।
বাবা ছাড়া কারো আর পরিপূর্ণ নাস্তা খাওয়া হলো না।
রুমে গিয়ে টিভি অন করে শুয়ে রইলাম।

সাড়ে দশটার দিকে বের হয়ে দেখি ডাইনিং টেবিলে বসে শাশুড়ী বসে কি যেনো খাচ্ছেন, না দেখার ভান করে রান্নাঘরে চলে গেলাম।
বড় ভাবী যত্ন করে কিছু একটা রান্না করছে, উঁকি দিয়ে দেখি চিকেন স্যুপ, ভ্রুকুটি করলাম। ভাবীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
— একটু পোকামারার ওষুধ সাথে দিলে আরো মজা হবে।
মনির মা পেঁয়াজ কাটা ফেলে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হচ্ছে,
— ছুডু ভাবী যে কি কথা কয় হাসতে হাসতে মরি… সকালেও খালুজ্বি খালাম্মারে কইলো কাতলা মাছ.. হা হা হা হা।
ভাবী মুচকি হাসলো,
— প্রভা বড়দের এসব বলতে হয় না।
— আহারে আমার মাদার তেরেসা, মানবতার মুর্তি, বিনয়ের অবতার বাংলা সিনেমার শাবানা রে… বললে রাগ হইও না ভাবী, তোমার সাথে যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে , এমনটাই হওয়া উচিত।
যাও বেশি করে খাওয়াও সাপকে দুধকলা।
বলেই ফিল্টার থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে চা বসালাম।
ভাবী আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

ভাবী স্যুপের বাটিতে নিয়ে বের হয়ে গেলো, চা নিয়ে ফেরার সময় দেখলাম,
শাশুড়ী মা ভাবীকে আপেলের টুকরো মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন, ভাবীও হাসিমুখে খাচ্ছে দেখে আমার গা জ্বালা ধরলো।
— কি আদিখ্যেতা!
আমাকে দেখে শাশুড়ী ডাকলেন,
— প্রভা… মা.. এখানে এসো, আপেল খাও।
উহু গলায় মধু ঝরছে মনেমনে বললাম, মুখে বললাম,
— না মা আমি আপেল খাই না, আমার এলার্জি হয়।
— আপেল খেলে এলার্জি হয়? কখনো শুনিনি তো?
— আমার হয়।
বলেই নিজের রুমে ঢুকে গেলাম।

সারাবিকেল ঘর থেকে বেরুলাম না, সন্ধ্যায় বের হয়ে সামিরের জন্য একটু নুডলস করে নিয়ে এসে রুম বন্দী হলাম। অসহ্য লাগছে বাড়ির পরিবেশ, শাশুড়ী মা গলায় মধু ঢেলে সারাদিন এটা সেটার অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে আর ভাবী আদেশ শিরোধার্য ভঙ্গিতে পালন করে যাচ্ছে।
মনির মা বলে,
— এই মাতারী ছয়দিনের সব খানা উশুল করতাছে, বড়ভাবী কিছু কয় না দেইখা আরো বেশি বেশি করতাছে।

মাগরিবের কিছু আগে শ্বশুর বাবা একটা কাপড় ভর্তি ব্যাগ নিয়ে এসে দরজা নক করলো,
— প্রভা… মা মাসুমার দিকে খেয়াল রেখো, আমি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি, জমি সংক্রান্ত একটা ঝামেলা হয়েছে ওটা মিটমাট করে আসবো।
— বাবা ফিরবেন কবে?
— দুই তিনদিন লাগবে সারতে তারপর ফিরে আসবো। তুমি মাসুমার সাথে রাগ করে থেকো না ও পরিস্থিতির স্বীকার। আমি গ্রাম থেকে ফিরে সব সমাধান করবো।
— আচ্ছা বাবা সাবধানে যাবেন।

রাতে খাবারের সময় রান্নাঘরে গিয়ে ভাবীর সাথে হাতে সব কাজ এগিয়ে দিলাম,কিন্তু ভাবীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। তবে খেয়াল করলাম চোখ ফোলা ও লাল। রাগ লাগে তার উপর নিজের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে জানে না কেনো?
মানুষ গায়ের জোরে, বুদ্ধির জোরে, টাকার জোরে আর না হলে গলার জোরে তো টিকে থাকতেই হয়।
ভাবী কেনো বোঝে না, বিনয় এখন দুর্বলতার প্রকাশ, যতই নুয়ে থাকবে সুবিধাবাদী মানুষগুলো পিঠটাকে পা রাখার জায়গা ভেবে নেবে।

রাতে খাবার টেবিলে শাশুড়ী কথা তুললেন,
— সাবির… তাহলে তোমার মামাকে কাল আসতে বলি?
সাবির ভাইয়া কোনো প্রতিউত্তর করলো না, শাশুড়ী প্রশ্ন করে তাকিয়েই আছেন। সামির বললো,
— কেনো?
— কেনো আবার? বিয়ের কথা পাকা করতে?
— ও
— আমি চাচ্ছি ৭/৮ দিনের ভেতর কাজটা সারতে।
— এত তাড়াহুড়ো কিসের?
— শুভ কাজে দেরি করতে নেই, তাছাড়া তোর বাবা তো আর সম্মত নয় তাই যা করার আমাকেই করতে হবে। সামির বাবা তুই আমার সাথে বিয়ের কেনাকাটায় একটু সাহায্য করিস?
— না না আমি এসব পারবো না, অফিসে প্রচুর কাজের চাপ এ মাসে একদিনও আমি নষ্ট করতে পারবো না, অনলাইন অফলাইন সবভাবে কাজ করতে হবে।
— ওহ, সাবির বাবা তুই কাল ছুটি নে বাড়িতে থাকিস, তোর মামা আসবে তোকে না পেলে কি ভাববে? বিষয়টা খারাপ দেখায়।
সাবির ভাইয়া বিরক্তমুখে ভাতের প্লেট ঠেলে দিয়ে উঠে চলে যান।
সামির মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মা… যেখানে ভাইয়া রাজী নয়, বাসার কেউ রাজী নয় তোমার এসব পাগলামি না করলে চলছে না?
— নাহ… আমি যা বলেছি তাই হবে, এখন এইটা আমার জেদে পরিণত হয়ে গেছে।
— মা সব জেদ কিন্তু কল্যাণ বয়ে আনে না ক্ষতিও করে।
— চুপ করো? জ্ঞান দিতে এসো না?
সামির আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ পাতের খাবার শেষ করে উঠে পড়লো।

পরদিন বেলা বারোটা নাগাদ মামা শ্বশুর মজিদ হাওলাদার এসে হাজির, দেশি মুরগী, পুকুরের মাছ, দেশি কলা, কলার মোচা, বোতল ভর্তি দুধ, জমিনের কাঁচা তরিতরকারি দিয়ে রান্নাঘর ভরে ফেললেন। শাশুড়ীর খুশি আর ধরে না, যেনো মণিমাণিক্য নিয়ে এসেছে।
বারবার বলতে লাগলেন, ছেলের শ্বশুর বাড়ি এমন হওয়া লাগে।
মামা শ্বশুর একটু পরপর ডাকাডাকি করেন,
— কই গো মা লক্ষ্মীরা, এদিকে আসো। তুমরা সবাই কেমুন আছো?
আমি কাছে গিয়ে বললাম,
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো মামা।
— আলহামদুলিল্লাহ, আমার মাইয়া কিন্তু অনেক ভালো, দেখবা তোমাগ লগে একদম মিল্লা-মিশ্যা চলবো।

বিড়বিড় করে বললাম, জ্বি জ্বি আগে আসুক হাড় মাংস যদি আলাদা না করে ফেলেছি তো আমার নাম পালটে রাখবো।
মামা শ্বশুর বললেন,
— কিছু বললা মা?
— জ্বি বললাম যে তাহলে তো খুবই ভালো, মিলেমিশে থাকারই তো দরকার।

রান্নাঘরে ভাবী সব গোছাচ্ছে, আমাকে দেখে বললো,
— প্রভা মাছটা একটু উল্টে দাও আর মাংসটা একটু নেড়েচেড়ে দাও।
আমার রাগ লাগছে গুদাম পুড়ে যাচ্ছে সে আলুপোড়া খায়, যত্তসব! রেগে বললাম,
— আমি পারবো না, তুমিই খাতির করো গিয়ে তোমার সতিনের বাপকে, আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি আমার রুমে গেলাম।

আমি একবোতল পানি নিয়ে রুমে চলে গেলাম।
ভাবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই গিয়ে নাড়তে লাগলো।
আমার সারা শরীর রাগে ফুঁসছে, একজন বেহায়ার মতো জবরদস্তি জুলুম করেই যাচ্ছে, অন্যজন টু শব্দ না করে সব সয়ে নিচ্ছে। জাস্ট বিরক্তিকর!

সাবির ভাইয়া সামির, শ্বশুর বাবা কেউ নেই, শাশুড়ী একা একাই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে নিলো। আজ তো রবিবার সামনের শুক্রবার বিয়ে । বিয়ে এই বাড়িতে হবে, বেশি লোকজন বলাবলি হবে না, মামা শ্বশুর ও তার পরিবার মেয়ে নিয়ে বুধবার এখানে চলে আসবে। বৃহস্পতিবার ছেলে মেয়ের একসাথে গায়ে হলুদ হবে আর শুক্রবার বাদ জুম্মা বিয়ের শুভ কাজ সম্পন্ন হবে।

দুপুরে খাবার খেতে বেরিয়ে এই নাটকের অংশ হলাম। মামা শ্বশুর যাবার বেলায় ভাবীকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বারবার আশ্বস্ত করে গেলেন, তার মেয়ে কখনোই ভাবীর অবাধ্য হবে না, ভাবীর সাথে মিলেমিশে চলবে তাকে সম্মান করবে।

ভাবী মন খারাপ করে রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে বললাম,
— জানো ভাবী তোমার উপর প্রচন্ড রাগ হয় আমার? এখনো যদি চুপ করে থাকো তবে বিয়ে হয়ে গেলে ঠ্যাকাবে কি করে?
— প্রভা আমার মন বলছে এই বিয়ে হবে না, তাছাড়া সাবির আমাকে বলেছে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না।

মনেমনে ভাবলাম, কি জানি! বিশ্বাস প্রবল হলে স্রষ্টা সাহায্য করতেও পারেন। অথৈ সাগরে পড়লে মানুষ শেষ খড়কুটো আঁকড়ে হলেও বাঁচতে চায়, হয়তো বিশ্বাসটুকুই ভাবী শেষ সম্বল।
দেখা যাক কে জেতে।

চলবে

#শামীমা_সুমি

দহন ফুল পর্ব-০৮

0

#দহন_ফুল– ৮

আম্মা কাজটা খুবই অন্যায় হচ্ছে, একদম ঠিক করছেন না।
— তোমার কাছ থেকে আমার ন্যায় অন্যায় শিখতে হবে?
— আমি তা বলিনি, তবে ভুল মানুষেরই হয় শিখলে দোষ কি?
— তোমার সাহস তো কম নয়? আমাকে আসছো জ্ঞান দিতে?
— জ্ঞান দিতে আসি নাই আম্মা, অন্যায় দেখে চুপ থাকাও অন্যায় করার সামিল।
— একদম চুপ থাকো, বার বেড়ো না, তোমাকে আমি চিনতে ভুল করেছি? মনে করেছিলাম ভালো মেয়ে, এখন দেখি সাপের বাচ্চা ধরে নিয়ে আসছি। তুমি ভাবছো আমি কিছু বুঝি না? সব কলকাঠি তুমি নেড়েছো, এই ঘরে এতো সাহস কারো ছিলো না আমার মুখের উপর কথা বলে? কিন্তু এখন সবার মুখে বুলি ফুটছে আর তুমি এসবের গোড়াতে আছো। অপেক্ষা করো তোমারও হবে।
— সে সাহস দেখাবেন না আম্মা, মনে রাখবেন, আমি মাসুমা নই।
— সে দেখা যাবে, এখন এখান থেকে যাও।

রাগে জেদে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে টানা দুইগ্লাস পানি খেলাম।
ভাবী চুপচাপ রান্না করছে, কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো
— কি হয়েছে প্রভা?
— শাশুড়ীকে বোঝাতে গেলাম উল্টো কথা শুনিয়ে দিলো?
— অযথা চেষ্টা করতে যেও না, উনি যা বলেন তা করে ছাড়েন।
— ভাবী তাই বলে…. দ্বিতীয় বিয়ে!
— আমার কপালে থাকলে কি করে ঠ্যাকাবো?
— আমি হতে দেবো না?
— অযথা ঝামেলায় জড়িয়ো না।
— তুমি কি দিয়ে তৈরি ভাবী আমি বুঝিনা!
— অত বুঝে কাজ নেই।
— ভাবী তোমার বাবা মা মারা গেছে জানি, কিন্তু আত্মীয় স্বজন তো আছে তাদের সব জানাচ্ছো না কেনো?
— আম্মু আব্বু মারা যাবার সাথে সাথে পৈত্রিক সম্পত্তি সব যারা দখলে নিলো আমার কথা একবারও ভাবলো না, তারা কি আমার পাশে এসে দাঁড়াবে?
— তোমার মামা তার ছেলেরা তারা তো আছে, তারা তো ফেলে দেবে না।
— মামা আমাকে বুকে তুলে নিয়ে মানুষ করেছেন। এখন তিনি খুব অসুস্থ আর তার ছেলেরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মামা এসব শুনলে সইতে পারবেনা, আমি মামাকে কষ্ট দিতে চাই না।
— সো স্যাড.. তোমার জন্য কিছু করতে পারছি না, ভীষণ রাগ লাগছে।
— থাক বাদ দাও।
— হ্যা দিলাম এছাড়া আর কি করবো? আচ্ছা ভাবি শাশুড়ী না বললো, রুম বন্ধ করে রাখবে? কিন্তু সবই তো খোলা, খালি তেলানি খুঁজছে বুঝছো? সবার সাথে ভাত খাচ্ছে না কিন্তু দেখে তো তরতাজাই লাগছে।

মনির মা মশলা বাটা থামিয়ে বললো,
— হেরে লইয়া অতো ভাইবেন না আফনেরা, হের ঘরে বয়ামে বয়ামে যত খানাদানা আছে, পুরা একসপ্তাহ ভাত না খাইলেও হে মরবো না। বড় বোতল ভরা পানি আমি দেইখা আইছি ঘর মুছার সময়।
আমি হাসলাম, কিন্তু ভাবী হাসলো না শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

প্রথম দিন ভাবী কান্নাকাটি করেছে আম্মার হাতে পায়ে ধরেছে, খাওয়াদাওয়া করার জন্য অনুরোধ করেছে কিন্তু শাশুড়ী মার মন টলেনি। তার এক কথা হয় সাবির রাজী হবে নয়তো সে না খেয়ে দরকার হলে মরে যাবে।
শ্বশুর বাবা জানতে পেরে ভাবীকে বকা দিয়েছে, আর সবাইকে নিষেধ করেছে ডাকাডাকি করার জন্য। বলেছে
— খবরদার কেউ ওকে ডাকাডাকি করবে না, দেখা যাক কয়দিন না খেয়ে থাকতে পারে। ওর কই মাছের প্রাণ সহজে যাবে না, একদম হাড় বজ্জাত।
আমি শুনে মুচকি মুচকি হাসি।

শাশুড়ী মা কারো সাথে খেতে বসে না ঠিকই তবে ফ্রিজ থেকে রাতে খাবার উধাও হয়, এদিকে শাশুড়ী একদম অনঢ় মরে গেলেও খাবার খাবে না যতদিন ওনার কথা মানা হয়। তাই কি আর করা ফ্রিজই রাতে চুপিচুপি খাবার খেয়ে ফেলে মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় কি?

মনে অনেক কষ্ট চেপেও ভাবী ভাইয়াকে মানাতে চেষ্টা করে,
— সাবির তুমি মায়ের কথা মেনে নাও।
চোখ বুঁজে কপালের উপর হাত রেখে শুয়েছিলো সাবির ভাইয়া। ভাবীর কথায় কপাল থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসলো ভাইয়া।
— এসব কি বলছো নিনু? এটা অসম্ভব? এটা হতে পারে না কিছুতেই।
— আমি সংসারে শান্তি চাই, এই যে মা অনশন করে আছেন, এটা কি ভালো দেখায়?
— কিছু হবে না মায়ের, কদিন আর না খেয়ে থাকবে? তার এই অন্যায় আবদার আমি কিছুতেই মেনে নেবো না নিনু।
— আমি যে আর অশান্তির ভার নিতে পারছি না। সত্যিই তো পাঁচ বছরেও আমি কোনো সন্তানের সুখ দিতে পারিনি। তাহলে উনার আবদার অন্যায় হলো কি করে?
— প্লিজ নিনু… তোমার আমার কারো কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহ চাহেত আমরা বাবা মা একদিন হবই। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।
— কিন্তু মায়ের শখ তার কি হবে?.
— নিনু তোমার মনে আছে? আমি যখন মাস্টার্স শেষ বর্ষে তুমি তখন সবে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। হঠাৎ দেখায় তোমাকে ভালো লেগে গেলো। তারপর কি থেকে কি হলো দুজনার প্রেম হয়ে গেলো। আমি নতুন ব্যবসা শুরু করলাম তুমি পড়ালেখা চালিয়ে গেলে আমাদের চারবছর প্রেম শেষে পরিণয়ের দিকে এগোলাম । এতিম, মা বাবা নেই মামার বাড়িতে মানুষ, এ সমস্ত নানা অজুহাত দেখিয়ে মায়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বাবা তোমাকে দেখতে গেলো, তোমাকে দেখে তার ভীষণ পছন্দ হলো।
বাড়ি এসে আমাকে বললো,
— এই পুতুল চেহারার মেয়েটাকে কোথায় পেলি রে সাবু?
মা ফোঁড়ন কাটলো,
— পুতুল নাচ নাচাবে দেখে নিও।
— নাচালে নাচবো তুমিও নেচো।
— আমার অতো ঠ্যাকা পড়ে নাই।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শেষমেষ মা ও রাজী হয়ে গেলো।
দিনক্ষণ ঠিক করে স্বল্প আড়ম্বরে আমাদের বিয়ে হলো।
বিদায় বেলায় তোমার মামা আমার হাতে তোমাকে তুলে দেবার সময় বলেছিলো,
— আমার মৃত বোনের আমানত যত্নে রেখো।
আমিও কথা দিয়েছিলাম তোমাকে যত্নে রাখবো কোনো আঁচ আসতে দেবো না। আমি কথা রাখতে পারিনি, এই পরিবারে এসে নিজের মাস্টার্স করার স্বপ্ন বিসর্জন দিলে। পুরো ঘরের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলে, তারপর মা তোমাকে সারাদিন কথা শোনাতে পিছপা হতো না, দিনরাত তোমাকে এতো অপমান, গঞ্জনা সহ্য করতে দেখেও মা কষ্ট পাবে ভেবে মায়ের মুখের উপর কিছু বলতে পারিনি। অথচ দিনদিন তুমি কষ্ট পেয়ে গেছো, সেটার জন্যও প্রতিকার করিনি। আমি একজন অযোগ্য স্বামী, কিন্তু আজ এই অন্যায় আমি কিছুতেই করতে পারবো না।

অঝোর ধারায় কাঁদছে ভাবী,
— তুমি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসো তাই সমস্ত কষ্টগুলো আমি সয়ে নিয়েছি। দিনশেষে তোমার বুকেই আমার সমস্ত কষ্টের অবসান হতো। মা আমাকে মন থেকে মানতে পারেনি সেটা আমার দুর্ভাগ্য। আজ পাঁচবছরেও উনার মনের কোনে জায়গা তৈরি করতে পারিনি ভেবে সত্যিই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।
— এমন অলুক্ষুনে কথা বলো না নিনু, আমি তোমাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাবো। আমি বাসা খুঁজতেছি, এখানে আর থাকা সম্ভব নয়।
সামির আর ওর বউ বললো তোমার সম্পদপ্রাপ্তির খবর মাকে জানাতে, তখন হয়তো বিয়ে ক্যান্সেল করতে পারে। বিশ্বাস করো নিনু? লোভ থেকে মেনে নেয়া আর মন থেকে মেনে নেয়া এক নয়, আমি তোমাকে আর ছোট হতে দেবো না। একটা কথা ফুল এন্ড ফাইনাল আমি দ্বিতীয় বিয়ে করবো না কিছুতেই না।

ভাবি ঢুকরে কেঁদে ফেললো, ভাইয়া কাছে এসে বুকে জড়িয়ে নিলেন, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাইরে থেকে এই দৃশ্যটুকু দেখে আমার চোখ ভিজে গেলো।

সারাঘরে শশ্মানের নীরবতা, কারো মুখে হাসি নেই কেউ যেনো ব্লডিং পেপার দিয়ে সব হাসি শুষে নিয়েছে। আমার সময় কাটে না, মুভি দেখতে ও বিরক্ত লাগে। মাকে বলেছি একটু আসার জন্য, কিছুক্ষণ কথা বললে ভালো লাগবে, এতো স্ট্রেস আর নিতে পারছি না।

সন্ধ্যার একটু আগে মা এসে হাজির,মাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলাম, কি হলো জানিনা কেঁদেও ফেললাম। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— কি হয়েছে সোনা কাঁদছিস ক্যানো?
চোখ মুছে বললাম,
— কিছু না মা… আমার এখানে ভাল্লাগেনা, ভাবী সারাক্ষণ কাঁদে… আর শাশুড়ী মা কুট..
মা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে ধরলেন কথা শেষ করতে আর দিলেন।
ড্রাইভার এসে কতগুলো ব্যাগ রেখে গেলো টেবিলে। মা ওদিকে তাকিয়ে বললেন,
— তোর পছন্দের কিছু ফ্রুটস, কুকিজ আর সুইটস এনেছি। সবাইকে নিয়ে খাস কেমন?

মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে, ভাবী রুম থেকে বেরিয়ে এসে কুশল বিনিময় করলেন। মা মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন।
— মাসুমা!! একি চেহারা হয়েছে তোমার?
চোখ মুখ ঢেবে গেছে?
ভাবীর চোখ ছলছল করে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— আন্টি আপনি বসুন? আমি একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা করছি।
— না না ঝামেলা করো না, এখানে কিছু খাবার আছে তা থেকে খানিকটা সাজিয়ে নিয়ে এসো।
মাসুমা ভাবী সম্মতি জানিয়ে প্যাকেটগুলো নিয়ে রান্না ঘরে গেলো আমিও পিছে পিছে গেলাম।

মা শাশুড়ীর রুমে ঢুকে দেখেন তিনি শুয়ে আছেন, পায়ের শব্দ পেয়ে উঠে বসলেন।
— আপা কেমন আছেন?
মায়ের কথার পিঠে দায়সারা অথচ খোঁচা মারা উত্তর দিলেন,
— আছি একরকম, আমার আর থাকা না থাকা, সন্তান যখন অবাধ্য হয়ে যায় তখন আর কি? কোন রকমে বেঁচে থাকা।
— এভাবে বলছেন কেনো আপা? সন্তানদের ইচ্ছের ও তো মূল্য দেয়া লাগে, তাই না?
— আমিতো সন্তানের ভালোই চাই? কিন্তু আমাকেই তো শত্রু ভাবে।
— মাসুমার জায়গায় যদি আপনার নিজের মেয়ে থাকতো?
— থাকলে সে দেখা যেতো? নেই যেহেতু সে কথা বলে লাভ কি?
— ছেলের বউগুলোকে মেয়ে ভাবা যায় না আপা?
— এক গাছের ছাল-বাকল অন্য গাছে লাগে না।
— আপনাকে বোঝাতে পারবো বলে মনে হয় না, তবে মনে রাখবেন, আল্লাহ ও তার বান্দাকে সাধ্যাতীত কষ্ট দেয় না। একটু ভেবে দেখবেন।
— আচ্ছা দেখবো নে, আর আপা আরেকটা কথা, আমার সাংসারিক ব্যাপারে বাহিরের কেউ নাক গলাক আমার পছন্দ নয়। আর আপনার মেয়ে অনেক বেয়াদবি করে সে নালিশ এখনো কিন্তু আমি করিনি অতএব…
— মনে রাখবো আপা, মেয়ে যদি বেয়াদবি করে তাকে অবশ্যই শাসন করবো। তবে যতদুর জানি আমার মেয়ে অন্যায় দেখলে চুপ থাকতে পারে না।

মাকে অপমানিত মুখ নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ভীষণ কষ্টে চোখে পানি চলে আসলো। মা আমাকে বললো,
— আমার সাথে চল প্রভা? কিছুদিন থেকে আসবি?
— না মা ভাবী একটা ট্রমার মধ্যে আছে, তাকে এভাবে ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না।
— ঠিক আছে, থাকো মা তবে আমার মনে হচ্ছে তোমার শীঘ্রই শাশুড়ীর পতন ঘনিয়ে আসছে। আর শোনো উনার মুখে মুখে আর কথা বলো না, কেমন।

মার চলে যাওয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম কষ্টটা দলা পাকিয়ে ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়ে এলো।

চলবে

#শামীমা_সুমি