দহন ফুল পর্ব-০৮

0
100

#দহন_ফুল– ৮

আম্মা কাজটা খুবই অন্যায় হচ্ছে, একদম ঠিক করছেন না।
— তোমার কাছ থেকে আমার ন্যায় অন্যায় শিখতে হবে?
— আমি তা বলিনি, তবে ভুল মানুষেরই হয় শিখলে দোষ কি?
— তোমার সাহস তো কম নয়? আমাকে আসছো জ্ঞান দিতে?
— জ্ঞান দিতে আসি নাই আম্মা, অন্যায় দেখে চুপ থাকাও অন্যায় করার সামিল।
— একদম চুপ থাকো, বার বেড়ো না, তোমাকে আমি চিনতে ভুল করেছি? মনে করেছিলাম ভালো মেয়ে, এখন দেখি সাপের বাচ্চা ধরে নিয়ে আসছি। তুমি ভাবছো আমি কিছু বুঝি না? সব কলকাঠি তুমি নেড়েছো, এই ঘরে এতো সাহস কারো ছিলো না আমার মুখের উপর কথা বলে? কিন্তু এখন সবার মুখে বুলি ফুটছে আর তুমি এসবের গোড়াতে আছো। অপেক্ষা করো তোমারও হবে।
— সে সাহস দেখাবেন না আম্মা, মনে রাখবেন, আমি মাসুমা নই।
— সে দেখা যাবে, এখন এখান থেকে যাও।

রাগে জেদে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে টানা দুইগ্লাস পানি খেলাম।
ভাবী চুপচাপ রান্না করছে, কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো
— কি হয়েছে প্রভা?
— শাশুড়ীকে বোঝাতে গেলাম উল্টো কথা শুনিয়ে দিলো?
— অযথা চেষ্টা করতে যেও না, উনি যা বলেন তা করে ছাড়েন।
— ভাবী তাই বলে…. দ্বিতীয় বিয়ে!
— আমার কপালে থাকলে কি করে ঠ্যাকাবো?
— আমি হতে দেবো না?
— অযথা ঝামেলায় জড়িয়ো না।
— তুমি কি দিয়ে তৈরি ভাবী আমি বুঝিনা!
— অত বুঝে কাজ নেই।
— ভাবী তোমার বাবা মা মারা গেছে জানি, কিন্তু আত্মীয় স্বজন তো আছে তাদের সব জানাচ্ছো না কেনো?
— আম্মু আব্বু মারা যাবার সাথে সাথে পৈত্রিক সম্পত্তি সব যারা দখলে নিলো আমার কথা একবারও ভাবলো না, তারা কি আমার পাশে এসে দাঁড়াবে?
— তোমার মামা তার ছেলেরা তারা তো আছে, তারা তো ফেলে দেবে না।
— মামা আমাকে বুকে তুলে নিয়ে মানুষ করেছেন। এখন তিনি খুব অসুস্থ আর তার ছেলেরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মামা এসব শুনলে সইতে পারবেনা, আমি মামাকে কষ্ট দিতে চাই না।
— সো স্যাড.. তোমার জন্য কিছু করতে পারছি না, ভীষণ রাগ লাগছে।
— থাক বাদ দাও।
— হ্যা দিলাম এছাড়া আর কি করবো? আচ্ছা ভাবি শাশুড়ী না বললো, রুম বন্ধ করে রাখবে? কিন্তু সবই তো খোলা, খালি তেলানি খুঁজছে বুঝছো? সবার সাথে ভাত খাচ্ছে না কিন্তু দেখে তো তরতাজাই লাগছে।

মনির মা মশলা বাটা থামিয়ে বললো,
— হেরে লইয়া অতো ভাইবেন না আফনেরা, হের ঘরে বয়ামে বয়ামে যত খানাদানা আছে, পুরা একসপ্তাহ ভাত না খাইলেও হে মরবো না। বড় বোতল ভরা পানি আমি দেইখা আইছি ঘর মুছার সময়।
আমি হাসলাম, কিন্তু ভাবী হাসলো না শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

প্রথম দিন ভাবী কান্নাকাটি করেছে আম্মার হাতে পায়ে ধরেছে, খাওয়াদাওয়া করার জন্য অনুরোধ করেছে কিন্তু শাশুড়ী মার মন টলেনি। তার এক কথা হয় সাবির রাজী হবে নয়তো সে না খেয়ে দরকার হলে মরে যাবে।
শ্বশুর বাবা জানতে পেরে ভাবীকে বকা দিয়েছে, আর সবাইকে নিষেধ করেছে ডাকাডাকি করার জন্য। বলেছে
— খবরদার কেউ ওকে ডাকাডাকি করবে না, দেখা যাক কয়দিন না খেয়ে থাকতে পারে। ওর কই মাছের প্রাণ সহজে যাবে না, একদম হাড় বজ্জাত।
আমি শুনে মুচকি মুচকি হাসি।

শাশুড়ী মা কারো সাথে খেতে বসে না ঠিকই তবে ফ্রিজ থেকে রাতে খাবার উধাও হয়, এদিকে শাশুড়ী একদম অনঢ় মরে গেলেও খাবার খাবে না যতদিন ওনার কথা মানা হয়। তাই কি আর করা ফ্রিজই রাতে চুপিচুপি খাবার খেয়ে ফেলে মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় কি?

মনে অনেক কষ্ট চেপেও ভাবী ভাইয়াকে মানাতে চেষ্টা করে,
— সাবির তুমি মায়ের কথা মেনে নাও।
চোখ বুঁজে কপালের উপর হাত রেখে শুয়েছিলো সাবির ভাইয়া। ভাবীর কথায় কপাল থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসলো ভাইয়া।
— এসব কি বলছো নিনু? এটা অসম্ভব? এটা হতে পারে না কিছুতেই।
— আমি সংসারে শান্তি চাই, এই যে মা অনশন করে আছেন, এটা কি ভালো দেখায়?
— কিছু হবে না মায়ের, কদিন আর না খেয়ে থাকবে? তার এই অন্যায় আবদার আমি কিছুতেই মেনে নেবো না নিনু।
— আমি যে আর অশান্তির ভার নিতে পারছি না। সত্যিই তো পাঁচ বছরেও আমি কোনো সন্তানের সুখ দিতে পারিনি। তাহলে উনার আবদার অন্যায় হলো কি করে?
— প্লিজ নিনু… তোমার আমার কারো কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহ চাহেত আমরা বাবা মা একদিন হবই। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।
— কিন্তু মায়ের শখ তার কি হবে?.
— নিনু তোমার মনে আছে? আমি যখন মাস্টার্স শেষ বর্ষে তুমি তখন সবে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। হঠাৎ দেখায় তোমাকে ভালো লেগে গেলো। তারপর কি থেকে কি হলো দুজনার প্রেম হয়ে গেলো। আমি নতুন ব্যবসা শুরু করলাম তুমি পড়ালেখা চালিয়ে গেলে আমাদের চারবছর প্রেম শেষে পরিণয়ের দিকে এগোলাম । এতিম, মা বাবা নেই মামার বাড়িতে মানুষ, এ সমস্ত নানা অজুহাত দেখিয়ে মায়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বাবা তোমাকে দেখতে গেলো, তোমাকে দেখে তার ভীষণ পছন্দ হলো।
বাড়ি এসে আমাকে বললো,
— এই পুতুল চেহারার মেয়েটাকে কোথায় পেলি রে সাবু?
মা ফোঁড়ন কাটলো,
— পুতুল নাচ নাচাবে দেখে নিও।
— নাচালে নাচবো তুমিও নেচো।
— আমার অতো ঠ্যাকা পড়ে নাই।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শেষমেষ মা ও রাজী হয়ে গেলো।
দিনক্ষণ ঠিক করে স্বল্প আড়ম্বরে আমাদের বিয়ে হলো।
বিদায় বেলায় তোমার মামা আমার হাতে তোমাকে তুলে দেবার সময় বলেছিলো,
— আমার মৃত বোনের আমানত যত্নে রেখো।
আমিও কথা দিয়েছিলাম তোমাকে যত্নে রাখবো কোনো আঁচ আসতে দেবো না। আমি কথা রাখতে পারিনি, এই পরিবারে এসে নিজের মাস্টার্স করার স্বপ্ন বিসর্জন দিলে। পুরো ঘরের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলে, তারপর মা তোমাকে সারাদিন কথা শোনাতে পিছপা হতো না, দিনরাত তোমাকে এতো অপমান, গঞ্জনা সহ্য করতে দেখেও মা কষ্ট পাবে ভেবে মায়ের মুখের উপর কিছু বলতে পারিনি। অথচ দিনদিন তুমি কষ্ট পেয়ে গেছো, সেটার জন্যও প্রতিকার করিনি। আমি একজন অযোগ্য স্বামী, কিন্তু আজ এই অন্যায় আমি কিছুতেই করতে পারবো না।

অঝোর ধারায় কাঁদছে ভাবী,
— তুমি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসো তাই সমস্ত কষ্টগুলো আমি সয়ে নিয়েছি। দিনশেষে তোমার বুকেই আমার সমস্ত কষ্টের অবসান হতো। মা আমাকে মন থেকে মানতে পারেনি সেটা আমার দুর্ভাগ্য। আজ পাঁচবছরেও উনার মনের কোনে জায়গা তৈরি করতে পারিনি ভেবে সত্যিই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।
— এমন অলুক্ষুনে কথা বলো না নিনু, আমি তোমাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাবো। আমি বাসা খুঁজতেছি, এখানে আর থাকা সম্ভব নয়।
সামির আর ওর বউ বললো তোমার সম্পদপ্রাপ্তির খবর মাকে জানাতে, তখন হয়তো বিয়ে ক্যান্সেল করতে পারে। বিশ্বাস করো নিনু? লোভ থেকে মেনে নেয়া আর মন থেকে মেনে নেয়া এক নয়, আমি তোমাকে আর ছোট হতে দেবো না। একটা কথা ফুল এন্ড ফাইনাল আমি দ্বিতীয় বিয়ে করবো না কিছুতেই না।

ভাবি ঢুকরে কেঁদে ফেললো, ভাইয়া কাছে এসে বুকে জড়িয়ে নিলেন, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাইরে থেকে এই দৃশ্যটুকু দেখে আমার চোখ ভিজে গেলো।

সারাঘরে শশ্মানের নীরবতা, কারো মুখে হাসি নেই কেউ যেনো ব্লডিং পেপার দিয়ে সব হাসি শুষে নিয়েছে। আমার সময় কাটে না, মুভি দেখতে ও বিরক্ত লাগে। মাকে বলেছি একটু আসার জন্য, কিছুক্ষণ কথা বললে ভালো লাগবে, এতো স্ট্রেস আর নিতে পারছি না।

সন্ধ্যার একটু আগে মা এসে হাজির,মাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলাম, কি হলো জানিনা কেঁদেও ফেললাম। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— কি হয়েছে সোনা কাঁদছিস ক্যানো?
চোখ মুছে বললাম,
— কিছু না মা… আমার এখানে ভাল্লাগেনা, ভাবী সারাক্ষণ কাঁদে… আর শাশুড়ী মা কুট..
মা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে ধরলেন কথা শেষ করতে আর দিলেন।
ড্রাইভার এসে কতগুলো ব্যাগ রেখে গেলো টেবিলে। মা ওদিকে তাকিয়ে বললেন,
— তোর পছন্দের কিছু ফ্রুটস, কুকিজ আর সুইটস এনেছি। সবাইকে নিয়ে খাস কেমন?

মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে, ভাবী রুম থেকে বেরিয়ে এসে কুশল বিনিময় করলেন। মা মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন।
— মাসুমা!! একি চেহারা হয়েছে তোমার?
চোখ মুখ ঢেবে গেছে?
ভাবীর চোখ ছলছল করে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— আন্টি আপনি বসুন? আমি একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা করছি।
— না না ঝামেলা করো না, এখানে কিছু খাবার আছে তা থেকে খানিকটা সাজিয়ে নিয়ে এসো।
মাসুমা ভাবী সম্মতি জানিয়ে প্যাকেটগুলো নিয়ে রান্না ঘরে গেলো আমিও পিছে পিছে গেলাম।

মা শাশুড়ীর রুমে ঢুকে দেখেন তিনি শুয়ে আছেন, পায়ের শব্দ পেয়ে উঠে বসলেন।
— আপা কেমন আছেন?
মায়ের কথার পিঠে দায়সারা অথচ খোঁচা মারা উত্তর দিলেন,
— আছি একরকম, আমার আর থাকা না থাকা, সন্তান যখন অবাধ্য হয়ে যায় তখন আর কি? কোন রকমে বেঁচে থাকা।
— এভাবে বলছেন কেনো আপা? সন্তানদের ইচ্ছের ও তো মূল্য দেয়া লাগে, তাই না?
— আমিতো সন্তানের ভালোই চাই? কিন্তু আমাকেই তো শত্রু ভাবে।
— মাসুমার জায়গায় যদি আপনার নিজের মেয়ে থাকতো?
— থাকলে সে দেখা যেতো? নেই যেহেতু সে কথা বলে লাভ কি?
— ছেলের বউগুলোকে মেয়ে ভাবা যায় না আপা?
— এক গাছের ছাল-বাকল অন্য গাছে লাগে না।
— আপনাকে বোঝাতে পারবো বলে মনে হয় না, তবে মনে রাখবেন, আল্লাহ ও তার বান্দাকে সাধ্যাতীত কষ্ট দেয় না। একটু ভেবে দেখবেন।
— আচ্ছা দেখবো নে, আর আপা আরেকটা কথা, আমার সাংসারিক ব্যাপারে বাহিরের কেউ নাক গলাক আমার পছন্দ নয়। আর আপনার মেয়ে অনেক বেয়াদবি করে সে নালিশ এখনো কিন্তু আমি করিনি অতএব…
— মনে রাখবো আপা, মেয়ে যদি বেয়াদবি করে তাকে অবশ্যই শাসন করবো। তবে যতদুর জানি আমার মেয়ে অন্যায় দেখলে চুপ থাকতে পারে না।

মাকে অপমানিত মুখ নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ভীষণ কষ্টে চোখে পানি চলে আসলো। মা আমাকে বললো,
— আমার সাথে চল প্রভা? কিছুদিন থেকে আসবি?
— না মা ভাবী একটা ট্রমার মধ্যে আছে, তাকে এভাবে ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না।
— ঠিক আছে, থাকো মা তবে আমার মনে হচ্ছে তোমার শীঘ্রই শাশুড়ীর পতন ঘনিয়ে আসছে। আর শোনো উনার মুখে মুখে আর কথা বলো না, কেমন।

মার চলে যাওয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম কষ্টটা দলা পাকিয়ে ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়ে এলো।

চলবে

#শামীমা_সুমি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে