অঙ্গারের নেশা পর্ব-৭+৮ এবং এক্সট্রা পর্ব

0
109

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৭

ব্যালকনির দোলনায় বসেই প্রানেশা ঘুমিয়ে পড়লো রাতের বেলা। সুফিয়ান ডাকতে নিয়েও আর ডাকেনি। চাদর মুড়ে দিয়ে প্রানেশাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলো।
কিন্তু নিজে ঘুমায়নি, শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো। ভোরের দিকে ঘুম ভাব ধরা দিলো। তখন প্রানেশাকে কোলে শুইয়ে দিলো নাহলে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। প্রানেশার থুতনিতে একটা খাঁজ আছে। যা চেহারার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সুফিয়ান থুতনিতে আলতো করে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো-
‘ যদি আমার ভালোবাসার এক বিন্দু পরিমাণ তোমার হৃদয়ে আমার জন্য তৈরি হয় তাহলে পৃথিবীর সকল সুখ তোমার চরণে লুটিয়ে দেবো প্রাণ ‘

সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি চোখে মুখে পড়তেই প্রানেশার ঘুম ভাঙলো। চোখমুখ কচলে উঠে সোজা হয়ে বসে লম্বা হাই তুললো। হঠাৎ খেয়াল হলো এটা বিছানা নয় ব্যালকনি। বড় বড় চোখ করে পাশে তাকাতেই দেখলো সুফিয়ান পাশে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বড় দোলনা হওয়ায় তেমন অসুবিধা হয়নি। প্রানেশা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো-
‘আরে! এ তো এখানেই ঘুমিয়ে আছে। আর আমিই বা কখন দোলনায় বসলাম। ‘
চিল্লাতে নিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেললো প্রানেশা। এতক্ষণে ভুলেই গেছিলো যে সে নতুনভাবে সম্পর্কটা তৈরি করবে। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো যতই সে মুখে বলুক কিন্ত নাটক বেশিক্ষণ টেকে না।একজন জীবন থেকে গেলে আরেকজনকে ভালোবাসা যায় কিন্তু একইসাথে মনে দুইজনকে স্থান দেয়া যায়না।সুফিয়ানকে এখনো ভালোবাসতে পারেনি সে,একজন মানুষকে ভালোবাসতে হলে আগে তার ভেতরটা জানতে হয়। মাত্র দুইদিন একঘরে থেকে তো আর ভালোবাসা সম্ভব না। তাই এবার মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলো প্রানেশা। নাটক করে জীবন চলে না। উঠে দাড়িয়ে চাদরটা সুফিয়ানের গায়ে জড়িয়ে দিলো।
হাত মুখ ধুয়ে এসে সুফিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললো –
‘শুনছেন, এই যে উঠুন ‘

সুফিয়ানের ঘুম পাতলা হওয়ায় কিছুক্ষনের মধ্যেই উঠে গেলো৷ প্রানেশাকে দেখে মুচকি হেসে বললো –
‘শুভ সকাল প্রাণ’

প্রানেশা মাথা নাড়লো কিন্তু হাসলো না। সুফিয়ান ব্যাপারটা খেয়াল করলো। কিছু বুঝতে পারলো না, কাল রাতে ভেবেছিলো প্রানেশা বোধ হয় তাকে মেনে নিচ্ছে। কিন্তু প্রানেশার এহেন আচরণে মনে ভয় জমাট বাঁধছে। প্রানেশা বললো-
‘আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ‘

সুফিয়ানের ভেতরটা অজানা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো। তাহলে, প্রাণ কী তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছে! যদি তা-ই হয় তাহলে তার প্রাণকে বেঁধে নিজের সাথে রাখবে। তবুও চলে যেতে দেবে না। প্রানেশা সরতেই সুফিয়ান ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলো। শার্ট প্যান্ট পড়ে রেডি হতেই প্রানেশা বিছানায় বসতে বললো। সুফিয়ানের বুক ধকধক করছে। হসপিটালের সবাই যার ভয়ে থরথর করে কাপে সেও কাউকে হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান ধীর পায়ে বসতেই প্রানেশা হাঁটুগেড়ে নিচে বসে পড়লো। সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘এসব কী করছো!’

প্রানেশা আঙুল মুখে দিয়ে চুপ থাকতে বললো। লম্বা একটা শ্বাস টেনে সুফিয়ানের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। সুফিয়ান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। প্রানেশা সুফিয়ানের চোখে চোখ রেখে বলা শুরু করলো –
“আমি জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন। কতটা বাসেন আমি তা জানিনা, আপনার ঐ দু চোখে নিজের জন্য অজস্র ভালোবাসা দেখেছি আমি৷ আমিও ঠিক করেছিলাম সব মেনে নিয়ে আপনার সাথে নতুন করে সব শুরু করবো৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন, মনের উপর জোর দিয়ে আমি তা পারছিনা৷ আপনার কাছে গেলে আমি তেমন কোনো অনুভূতি পাইনা। কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম আমাকে আপনার কাছে আসতে দেয়না। একই চেহারা হওয়ায় আমি যতবার আপনাকে দেখি ততবারই রেয়ানের কথা মনে পড়ে। হয়তো, শারীরিক ভাবে আমাদের মাঝে একসময় সম্পর্ক হবে কিন্তু একসময় যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাবো, হাত মুখ কুঁচকে যাবে তখন আমাদের বিরক্তি এসে যাবে।
আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি তখন তার পরে কী হবে তা চিন্তা করিনা। তাকে ভালোবাসতেই থাকি, আর মুখে বলি ‘ আমি একতরফা ভাবেই ভালোবেসে যাবো’ কিন্তু এক না একসময় মনে হবে ‘আমারও একটু ভালোবাসার প্রয়োজন’ । মনে হবেই, কারণ এটাই নিয়ম। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”

সুফিয়ান চোখ এদিক ওদিক করলো। চোখ থেকে এই বুঝি জল গড়াবে। এ হতে দেয়া যাবে না। হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে বুকে৷ প্রানেশা মৃদু হেসে সুফিয়ানের গাল ধরে নিজের দিকে ফেরালো।সুফিয়ানের ঠোঁট কাঁপছে। চোখ লাল হয়ে আসছে। কোনো রকম সামলে বললো-
‘কী.. সিদ্ধান্ত?’

প্রানেশা মলিন মুখ করে বললো –
‘ আগে কথা দিন আমায়, যা বলবো তাই হবে’

সুফিয়ানের ভেতরটা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুখ পাশে ফিরিয়ে হাত দিয়ে চোখ কচলে বহু কষ্টে করে বললো –
‘ হু ‘
প্রানেশা বললো-
‘আপনি চোখ বন্ধ করুন নাহলে সহ্য করতে পারবেননা’

এবার যেনো সুফিয়ানের আত্মা বের হয়ে যাবে। এমন কী কথা! যা সে সহ্য করতে পারবে না৷ তবুও, জানার জন্য বিনাবাক্যে চোখ বন্ধ করলো। মনে মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। শুধু একটাই দোয়া ‘আমার থেকে আমার প্রাণকে ছিনিয়ে নিওনা ক্ষোদা’। এমন সময় প্রানেশা কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে বললো-
‘ আমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবেন?’

শোনা মাত্রই তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে ফেললো৷ হা করে তাকিয়ে দেখলো প্রানেশা হাসতে হাসতে ফ্লোরে শুয়ে পড়েছে। পেটে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালো। টিস্যু দিয়ে নিজের কপাল মুছে ঘন ঘন শ্বাস নিলো৷ প্রানেশার দিকে তাকিয়ে জোড়ে জোড়ে বললো-
‘আর ইউ ম্যাড! দিস ইজ টোটালি রাবিস।স্টপ প্রাণ ‘

প্রানেশা হাসি থামিয়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো। সুফিয়ানের
কাছে এসে হাত ধরে বললো-
‘সরি, কিন্তু আমি সত্যিই চাই এটা৷ একজন মানুষকে জানতে হলে তার সাথে সময় কাটাতে হয়। একঘরে সারাজীবন থেকেও দুজন অজানা থেকে যায়। তাই, আমি চাই দূরে কোথায় যেতে। যেখানে, সমাজ, রেয়ান সবকিছু একটু ভুলতে পারি।আমি এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যদি আমি দুই মাসের মাঝে আপনার জন্য কিছু অনুভব করি তাহলে আমি এখানেই থাকবো কিন্তু যদি মনে হয় ভালোবাসা সম্ভব না তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাবো। আমি চাই নিজেকে, আপনাকে আর আমাদের এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে। সাহায্য করবেন না আপনার প্রাণকে?’

সুফিয়ান মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে কপালে চুমু খেলো। প্রানেশার বাহু ধরে বললো-
‘ করবো প্রাণ, অবশ্যই করবো। বেশি না তুমি শুধু আমার ভালোবাসার এক বিন্দু দিও তা নিয়ে সারাজীবন কাটাবো আমি। ‘

চলবে…

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৮

প্রানেশা আজ সকাল বেলা উঠেছে। ছয়টায় উঠে সবার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করে টেবিলে পরিবেশন করছে। মিসেস অদিতি, মিস্টার রাহাত নিচে নেমে এসব দেখতেই অবাক হলেন। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে বললেন-
‘আরে! এসব কী করছো তুমি? এত কষ্টের কেনো করতে গেলে? ‘

প্রানেশা মুচকি হেসে হাতের পায়েসের বাটিটা টেবিলের উপর রাখলো। মিসেস অদিতির কাছে এসে গাল ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বললো –
‘ কেনো মা, আমার রান্না কী এতোই খারাপ যে মুখেই তোলাই যাবে না! ‘

‘আরে না না, তা কেনো হবে! শোনো মেয়ের কথা। ‘

‘তাহলে, আমায় একদিনও করতে দেননা কেনো! আমার মা তো বলতো আমাকে নাকি শ্বাশুড়ি রান্না না করলে ভীষণ রাগ করবে! অথচ আমাকে কেউ রান্নাঘরেই ঢুকতে দেয়না ‘

মিসেস অদিতি প্রানেশার বাচ্চামো কথায় হেসে ফেললেন। মাথায় হাত বুলিয়ে থুতনি ধরে বললেন –

‘আমিও তোমার আরেকটা মা। রান্নাবান্নার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে । সুফিয়ান জানলে রেগে যাবে তাছাড়া, এই আর কটা দিন তারপর আমি নাতি পুতির সাথে খেলবো আর তুমি রান্নাঘর সামলাবে ‘

প্রানেশা খানিক লজ্জা পেলো। চেয়ার টেনে মিসেস অদিতিকে বসতে বললো। মিস্টার রাহাতও বসলেন। আজ রেয়ান নেই, সে একটা কনসার্টে গেছে। পেশায় নামকরা গায়ক সে।খুব বড় কোনো সমস্যা হলে তবেই মিস্টার রাহাতের ব্যবসায় সাহায্য করে। আজ বাসায় থাকবে না শুনেই প্রানেশার স্বস্তি। নাহলে, রেয়ানকে দেখলে প্রানেশার সব মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। যেখানে তার জীবনটাই মানিয়ে নেওয়ার।

খাবার বাড়তে বাড়তে উপর থেকে সুফিয়ান আসলো। এসে টেবিলে বসতেই প্রানেশা প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো। সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো-
‘এসব তুমি করেছো?’

প্রানেশা ঘাবড়ে গেলো। ঘরের ভেতরে সে সুফিয়ানকে একটুও ভয় পায় না। সেখানে তো সুফিয়ান হাসে, তার সাথে দু চারটে কথা বলে, রাগ করলে মজার কথাও বলে। কিন্তু রুম থেকে বের হলে সুফিয়ানকে অন্য রকম লাগে প্রানেশার। কেমন যেন গম্ভীর রাগী একটা মুখ। আরেকটা জিনিসও অদ্ভুত লাগে প্রানেশার তা হলো, পরিবারের কারো সাথে তেমন আলাদা কোনো কথা বলে না সুফিয়ান। একমাত্র মা ব্যতিত । তাও যে বেশি তা না, এই যেমন -হ্যা, হু, না, ঠিক আছে।মাঝে মাঝে প্রানেশার মনে হয়, সুফিয়ানের আলাদা একটা রুপ আছে । যা প্রানেশাকে সুফিয়ান দেখায় না। তাই রুমের বাহিরে সবার মতোই ভয় পায় সুফিয়ানকে। ভয়ে ভয়ে বললো-
‘আ..আমিই করেছি ‘

সুফিয়ান কিছু বললো না। প্রানেশা ভাবলো, হয়তো খাওয়া শেষে বকবে। কিন্তু খাওয়া শেষ করে হাত মুছে বললো-
‘খাবারটা সুস্বাদু ছিলো ‘

প্রানেশা চমকে উঠলো। মিসেস অদিতি প্রানেশার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন-
‘ সত্যিই, আজ খাবারটা ভালো হয়েছে৷ তোমার রান্নার হাত ভালো বলতে হবে ‘

খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সুফিয়ান বললো-
‘আমার একটা জরুরি কথা আছে’

সবাই সুফিয়ানের দিকে তাকালো। সুফিয়ান হাতঘড়ি পড়তে পড়তে বললো-
‘ আমি আর প্রানেশা কয়েকদিনের জন্য বালি যাচ্ছি ‘

মিসেস অদিতি বললেন –
‘ভালো তো যাও, নতুন বিয়ে হয়েছে। দুজন দুজনকে যত জানবে ততো ভালো’

মিস্টার রাহাত বললেন –
‘ টিকেট বুক করেছো তো? ‘

সুফিয়ান তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। উঠে দাড়িয়ে ‘আসছি ‘ বলে চলে গেলো। প্রানেশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নিজের বাবাকে কেউ এভাবে উপেক্ষা করে তা প্রথম দেখলো সে। এমন করার কারণ কী বুঝতে পারলো না। সুফিয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মিস্টার রাহাত স্বাভাবিক, এটা মনে হয় নতুন না, শুধু এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তিনি উঠে পড়লেন। তিনি চলে যেতেই প্রানেশা এঁটো থালাগুলো জড়ো করে নিয়ে বললো-
‘মা, আমি আসার পর থেকে একবারও স্বাভাবিক ভাবে বাবার সাথে কথা বলতে দেখিনি। আপনার ছেলে কী সবসময়ই এমন করেন? ‘

মিসেস অদিতিও প্লেট গুছিয়ে দিতে দিতে বললো –
‘নারে মা!সবই আমাদের কর্মের ফল’

প্রানেশা খানিক অবাক গলায় বললো –
‘মানে?’

‘রান্না ঘরে অনেক কাজ বাকি আছে আবার দুপুরের রান্নাও বাকি, তুমি ঘরে যাও প্যাকিং করো ‘

প্রানেশা বুঝতে পারলো মিসেস অদিতি কথা এড়িয়ে গেলেন। প্রানেশা কথা বাড়ালো না।সব কিছু গুছিয়ে রেখে নিজের ঘরে গেলো৷ বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলো, রান্না ঘরে থেকে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বিছানা ঝেড়ে বালিশ গুছিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠান্ডা বাতাসে বেশ ভালো লাগছে। চোখ বন্ধ করে বাতাস উপভোগ করতেই দুটো হাত পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা চোখ খুলে ফেললো, মনে মনে ভাবলো ‘সে তো এক ঘন্টা আগেই হাসপাতালে চলে গেলো তাহলে এখানে কেনো!’
পেছনে ফিরে প্রথমে চেহারা দেখে ভাবলো সুফিয়ান কিন্তু গেজ দাঁতের হাসি দেখেই বুঝতে পারলো এটা রেয়ান। হোক প্রথম ভালোবাসা কিন্তু বিয়ের পর অন্য কারো সাথে সম্পর্ক রাখার মতো মেয়ে তো সে নয়। প্রানেশা ধাক্কা দিয়ে দুই হাত সরিয়ে দিলো রেয়ানকে। রেগে বললো –
‘রেয়ান! এসব কী ধরনের অসভ্যতা? ‘

রেয়ান অবাক গলায় বললো –
‘অসভ্যতা! আমি এখন অসভ্য! বাহ, ভালোই তো। ঐ সাইকোটা তোমায় বশ করে ফেলেছে তাহলে’

‘ দেখো রেয়ান, আমি জানি। তুমি আমায় ভালোবাসো। তোমার জন্য এটা কষ্টকর, কিন্তু আমার সঙ্গে তোমার বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সম্পর্কে তুমি আবার দেবর। এছাড়া আমি আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা ‘

রেয়ান প্রানেশার বাহু চেপে ধরলো। খসখসে গলায় বললো –
‘কখনোই না, তোমাকে ওই সাইকোর সাথে দেখতে চাইনা আমি। ভেবেছিলাম তোমাকে আদর করে নিজের কাছে রাখবো।কিন্তু তুমি এমন মেয়ে নও, এবার তোমাকে কী করে নিজের করতে হয় তা দেখাবো ওয়েট ‘

প্রানেশার কলিজা কাপছে। রেয়ান ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। বের হওয়ার কোনো উপায় পাচ্ছে না সে৷ ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো প্রানেশা, রেয়ান এক পা দুই পা করে প্রানেশার কাছে গিয়ে জোরাজুরি শুরু করলো । প্রানেশা কেঁদে কেঁদে বলছে-
‘দোহাই লাগে রেয়ান, ছাড়ো আমাকে’

চলবে…

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
#সারপ্রাইজ পার্ট

‘ খুব শখ না! হানিমুনে যাবে তুমি। আর আমি এখানে বিরহে মরবো, তা তো হবেনা জান। হানিমুনটা না হয় ঘরে আমার সাথেই করলে ‘

প্রানেশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে৷ কাকে দেখছে সে! যে মানুষটাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে যার কাছে নিজেকে নিরাপদ ভেবেছে এমনকি নিজের স্বামীকে পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি! এখন বুঝতে পারলো প্রানেশা,আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সুফিয়ান তার স্বামী হয়ে, এক ঘরে এতগুলো দিন থেকেও তার সম্মানে আঘাত করা তো দূর বরং ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিয়েছে। অথচ, প্রথম যাকে বিশ্বাস করলো সেই ধোঁকা দিয়ে দিলো। প্রানেশা কাঁদতে কাঁদতে বললো –
‘এমন কুৎসিত বিকৃত মনের অধিকারী একজনকে আমি ভালোবেসেছিলাম ভাবতেই নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। ‘

রেয়ান কথায় কোনো রকম পাত্তা দিলো না। শাড়ির আচল ধরে টানতেই দরজায় নক হলো৷ কেউ অনেক জোরে জোরে ডাকছে৷ প্রানেশা নিজের প্রাণ ফিরে পেলো। শাড়ি খামচে ধরে সেখানেই বসে পড়লো৷ রেয়ান বিরক্ত হয়ে গেট খুলতেই মিসেস অদিতি ঠাস করে রেয়ানের গালে পরপর দুটি চড় বসিয়ে দিলেন। রেয়ান তব্দা খেয়ে বললো-
‘মা!’

মিসেস অদিতি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন রেয়ানকে। দ্রুত পায়ে বারান্দায় যেতেই দেখলেন বিধ্বস্ত হয়ে নিচে বসে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে প্রানেশা। এই একুশ বছরের জীবনে কখনোই এসবের স্বীকার হয়নি সে। ফুলের টোকা অব্দি কখনো লেগেছে কিনা সন্দেহ। ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে উঠিয়ে আদর করে কাপড় ঠিক করে দিয়ে বললেন –
‘ভয় পেয়ো না মা! আমি আছি তো ‘

প্রানেশা কেঁদেই যাচ্ছে। তিনি রেয়ানকে বললেন –
‘ তোকে জন্ম দিয়ে পাপ করেছি আমি। আল্লাহ কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন আমাদের! না পারছি সহ্য করতে আর না পারছি কিছু করতে। আল্লাহ তোর বিচার করবে, এখুনি বের হ এখান থেকে ‘

রেয়ান নির্লিপ্ত ভাবে বেরিয়ে গেলো। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে পানি পান করিয়ে শুইয়ে দিলেন। প্রানেশা তার হাত ধরে ছিলো কিন্তু তার একটা কথায় হাত ছেড়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো –
‘এসব কথা সুফিয়ানকে বলোনা প্রানেশা ‘

প্রানেশা হতভম্ব হয়ে বললো-
‘ কী বলছেন মা! এত বড় কথাটা তাকে বলবো না! ‘

‘ দেখো প্রানেশা, এসব বললে ঘরে অশান্তি হবে। তুমি জানোনা, রোজ রোজ এসব নিয়ে ঝামেলা পছন্দ করিনা আমি ‘

‘কিন্তু.. ‘

‘কিন্তু কিছুই না, কথা দাও প্রানেশা এসব কথা সুফিয়ানের কানে যাবে না। যদি যায় তাহলে কী হতে পারে এর কোনো ধারণাই নেই তোমার। ‘

প্রানেশা আর কিছু বলতে পারলো না। এমনিতেও সে মানসিক ভাবে ভেঙে গেছে। বিশ্বাসঘাতকতা যে কতটা আঘাত দেয় মনে তা প্রানেশা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলতেই মিসেস অদিতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। কিছুক্ষন বাদেই প্রানেশা উঠে বসলো। মাথা ব্যাথা করছে, তাই কাপড় চোপড় নিয়ে গোসল করে আসলো। দুপুর দুইটা বাজে। নিজের মা বাবাকে একবার কল দিয়ে কথা বলে নিলো। কিন্তু কিছুতেই মনটা ভালো হচ্ছে না। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে, প্রানেশার মন হঠাৎ প্রশ্ন করলো ‘এই অস্থিরতা কী সুফিয়ান কাছে নেই বলে!’ একবার কল করে দেখবো? আরেক মনে ভাবলো ‘কী মনে করবে সে!’ আবার নিজেই বললো-
‘যা মনে করার করুক ‘ মোবাইল হাতে নিয়ে সুফিয়ানের নাম্বারে কল করলো৷ কয়েক দিন আগেই সুফিয়ান তার মোবাইলে নাম্বার সেভ করে দিয়েছে। এতে লাভই হয়েছে ভেবে প্রানেশা হাসলো। কিন্তু হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না, সুফিয়ান রিসিভ করে গম্ভীর গলায় বললো –
‘হ্যালো, ডা.সুফিয়ান তেহজিব স্পিকিং। হাও ক্যান আই হেল্প ইউ? ‘

প্রানেশা মিনমিন করে বললো –
‘আমি প্রানেশা ‘

সুফিয়ান হাতের মোবাইলটা আরেকবার চেক করলো। এতক্ষণ রোগী দেখে মাত্র ফ্রী হলো সে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা এলো। ক্লান্ত হয়ে আর তেমন কিছু খেয়াল করেনি সে। নাম্বার সেভ না থাকায় বুঝতে পারেনি। সাথেই কন্ঠভঙ্গি বদলে ফেললো সুফিয়ান। আদুরে গলায় বললো –
‘প্রাণ!শরীর ঠিক আছে তো! ‘

প্রানেশা কৈফিয়ত দেয়ার স্বরে বললো-
‘শরীর ঠিক আছে ‘

‘তাহলে?কেনো ফোন করলে?’

প্রানেশা নার্ভাস হয়ে পড়লো। এখন কী বলবে! ফোন দিয়ে এখন বিপদে পড়ে গেলো। কী বলবে বুঝতে না পেরে রাগ দেখিয়ে বললো-
‘ কেনো? ফোন দিলে কোনো কারণ থাকতে হবে!সমস্যা হলে রেখে দিচ্ছি, আর বিরক্ত করবোনা ‘

সুফিয়ান হো হো করে হেসে বললো –
‘ওহহো প্রাণ, তুমি এতো বোকা কেনো বলোতো! তোমার স্বামীকে তুমি যখন ইচ্ছে কল করতেই পারো। আমি মজা করছিলাম ‘

প্রানেশা কিছু না বলে চুপ করে রইলো৷ সুফিয়ান বুঝতে পারলো কোনো কারণে প্রানেশার মন খারাপ। তাই বললো –
‘প্রাণ, জানো এবার আমরা কোথায় যাবো?’

প্রানেশা উৎসাহিত হয়ে বললো-
‘ কোথায়? ‘

‘ইন্দোনেশিয়ার বালিতে’

‘ আমি শুনেছি সেটা নাকি খুব সুন্দর জায়গা! ‘

‘শুধু সুন্দর না প্রাণ, বালিকে বলা হয় ‘অন্তিম স্বর্গদ্বান’
বা ‘লাস্ট প্যারাডাইস’ এখানের সৌন্দর্য চোখ ঝলসানোর মতোন’

‘ওখানে কোথায় কোথায় ঘুরবো আমরা?’

‘ বিভিন্ন দ্বীপ ঘুরবো, নুসা দুয়া বীচ, নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ড, আরও আছে। সব ঘুরে দেখাবো তোমায় ‘

প্রানেশা উত্তেজিত হয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে নানান কল্পনা করছে । খুশিতে গদগদ হয়ে বললো-

‘ঠিক আছে, আপনি বাসায় আসুন। আমি আরও শুনবো ‘

সুফিয়ান হাসতে হাসতে বললো-
‘ আপকে লিয়ে জান কুরবান। সন্ধ্যার আগেই ফিরবো, আর শোনো ড্রয়ারে চকলেট আছে খেও ‘

প্রানেশা হ্যা বলে ফোন রাখলো। খেয়াল করলো তার মনটা এখন খুব ভালো হয়ে গেছে । মুচকি হেসে নিজমনেই বললো –

‘লোকটা আমায় এত বোঝে কেনো!’

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে