Thursday, July 31, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 192



অঙ্গারের নেশা পর্ব-২৪+২৫

0

‘অঙ্গারের নেশা ‘
পর্ব-২৪

‘রেয়ান, তুমি বলেছিলে তোমার বড় ভাই আছে। মা বাবার ছবি দেখালেও ভাইয়ের ছবি তো দেখালে না! ‘

তখন সম্পর্কের বয়স চার বছর। এর মধ্যে প্রানেশার মনে নানারকম সন্দেহের উৎপাত হয়েছে। প্রানেশার শুধু মনে হতো রেয়ান কিছু লুকাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেই রেয়ান নানা অযুহাত দিয়ে দিতো৷ আর পাঁচ দশটা স্বাভাবিক কাপলদের মতো প্রানেশা হতে পারে না। কেনো তার জানা নেই। আজ গাড়িতে বসে রেয়ানকে জিজ্ঞেস করে ফেললো সে৷ রেয়ান ড্রাইভিং করছিলো। প্রানেশার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো। আমতা
আমতা করে বললো –
‘ বলেছিলাম না, আমার ভাই এখানে থাকে না। হি ইজ আউট অফ কান্ট্রি ‘

‘কিন্তু, তাই বলে তার কোনো ছবিই নেই! ‘

রেয়ান রাগী মুখে বললো-

‘ তুমি কী সন্দেহ করো প্রানেশা! ‘

প্রানেশার উৎসুক মুখ মিইয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে উইন্ডোর দিকে তাকিয়ে রইলো। চাইলেও হিসাব যে মিলে না। রেয়ান মুখ অন্য দিকে করে মুখ হাসলো, যাক প্রানেশার প্রশ্নের জাল থেকে এবার বাঁচা যাবে। প্রানেশার মলিন মুখ দেখে প্রানেশার হাত এক হাত রাখলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো –
‘সরি, আমি রেগে গেছিলাম। তুমি বারবার এত প্রশ্ন করবে না ‘

প্রানেশা চমকে হাত সরিয়ে ফেললো৷ রেয়ানের ছোঁয়ায় প্রানেশা এখনো কম্ফোর্ট হতে পারেনি। রেয়ান আর কিছু বললো না।
রেয়ান চেহারা বদলানোর পর থেকে আগের ভার্সিটিতে পড়ে না। ওখানে থাকলে যে তাকে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই, অন্য ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। সবাই শুধু এতটুকু জানে যে সুফিয়ান বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে আর রেয়ান অন্য ভার্সিটিতে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। যেদিন মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেব এই ব্যাপারটা জানতে পারেন সেদিন তাকে খুব মেরেছে। প্রানেশাকে নিয়ে সংগঠিত ঘটনা জানেনা বলেই রহস্য ভেদ করতে পারেনি। কিন্তু রেয়ানের ভেতরের রাগ আরও বেড়েছে। চেহারার জন্য নতুন ভার্সিটিতে বেশ ভালো নাম হয়ে গেছে তার। মনে মনে সে এটা ভেবেই খুশি হয় যে তাকে কেউ আর অবজ্ঞা করতে পারে না। ব্যস এটুকুই তো চেয়েছে সে ৷

———
পাঁচ বছর পর,

ডান্স ক্লাবের ড্রিংক জোনে একটার পর একটা গ্লাস খালি করছে সুফিয়ান। আট পেগ শেষ করার পর পাশের সোফায় গিয়ে বসলো। ইভানান সামনে একটা শর্ট ড্রেস পড়া মেয়ের সঙ্গে ডান্স করছে। হাতে মদের একটা ডিজাইনিং গ্লাস। সুফিয়ানকে বসতে দেখে এগিয়ে এসে পাশে লাফিয়ে বসলো। পুরো সোফা দুলে উঠতেই সুফিয়ান একবার আড়চোখে তাকালো। ইভানান ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে বললো –
‘সুফি, প্রতিদিন কম মেয়েকে তো পাঠাচ্ছি না তোর কাছে। তবুও এমন দেবদাস! ‘

সুফিয়ান দুই হাতের তালু দিয়ে মুখমন্ডল ঘষলো। হাতের কব্জি উল্টিয়ে দেখলো রাত ১১.৩০। উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির চাবি বের করলো। তারপর হাঁটা ধরলো। ইভানান হাতের গ্লাসটা দ্রুত ভঙ্গিতে রেখে পেছনে পেছনে এলো। গাড়ির দরজা খুলে নির্লিপ্ততা নিয়ে বসলো সুফিয়ান, তার পাশের সিটে ইভানান বসলো। ইভানান চিন্তিত হওয়ার মতো করে বললো –

‘তুই আজ বেশি খেয়েছিস। আমি ড্রাইভ করি, তুই ওঠ’

সুফিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো-

‘আই এম কমপ্লিটলি ফাইন। ইউ ডোন্ট নিড টু ওয়ারি ‘

‘ইফ আই ডোন্ট থিঙ্ক, হু ইলস উইল? ‘

সুফিয়ান শক্ত কন্ঠে বললো-

‘ আই ডোন্ট নিড এনিওয়ান’

সুফিয়ানের দৃষ্টি আবদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার অন্ধকার জনমানবহীন রাস্তায়। কিন্তু মন একবিন্দুও এখানে নেই। পাঁচ পাঁচটে বছর হয়ে গেছে, অথচ এখনও সুফিয়ান ভুলতে পারেনি তার প্রাণের কথা। কী করে ভুলবে! নিজের সবটা দিয়ে যে ভালোবেসেছিলো।
অতিরিক্ত ভালোবাসায় একবার ডুবলে বাঁচার উপায় নেই। হয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে হবে, না হয় কেউ টেনে তুলবে এই আশায় হাত পা ছুড়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।আদৌ যে কেউ বাঁচাবে, এই নিশ্চয়তা নেই।
কিন্তু ওই যে ভালোবাসা!
তাহার চেয়ে সু্ন্দর আর একইসাথে কুৎসিত অনুভূতি পৃথিবীতে একটিও নেই!

ইভানান মাথা হেলে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। গাছগুলো যেনো পেছনে চলে যাচ্ছে একের পর এক। মনে মনে সে নিজের ব্যাথিত অতীত মনে করছে।

তখন সে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে ৷ প্লে থেকে এই পর্যন্ত সুফিয়ানের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে জান দিয়ে ভালোবেসে বন্ধুত্বের সকল দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময়ই সুফিয়ানকে নিজের ভাই মেনেছে।
নিজের সকল কিছু ভাগ করে নিতো সুফিয়ানের সঙ্গে।
কিন্তু সুফিয়ান কি করলো তার সাথে! তার আদরের ছোট বোনটাকে শেষ করে দিলো। মেরে ফেললো!

মনে হয় এই তো সেইদিন ছোট বোনের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করলো, কেক নিয়ে মুখে লাগিয়ে দিলো, বোনের বিনুনি ধরে টেনে দৌড়ে ভেগে গেলো। এখন সব স্মৃতি! অথচ এখনও জীবন্ত। হাতড়াতে শুরু করলে গোলকধাঁধার মতো সব চোখে মুখে বাড়ি খায়।
ছোট বোন ইনায়া, মা, বাবা। কত সুন্দর একটা পরিবার ছিলো তার৷ খুব বেশি একটা গ্যাপ ছিলো না ইনায়া আর ইভানানের মাঝে। তাই সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ। ইনায়া তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ইভানান বোনের রুমে ঢুকতেই দেখলো জানালার পাশে বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইভানান মাথায় হাত দিয়ে হালকা করে বাড়ি দিলো। ইনায়া একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভানান দেখলো ইনায়ার মুখটা লাল হয়ে আছে, চোখের কোণে জল। ইভানান জিজ্ঞেস করলো ‘ কী হয়েছে? ‘

ইনায়া ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করলো। ইভানান অবাক হয়ে গেলো। ইনায়া কখনো এভাবে তো কাঁদেনা! আজ কী হলো তাহলে?
মাথায় হাত রেখে অস্থির ভাবে বললো –
‘ ইনু, কী হয়েছে তোর? কেউ কিছু বলেছে তোকে!একবার নাম বল, কেটে রেখে দেবো ‘

ইনায়া ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো-
‘ সুফিয়ান ভাই আমাকে বোঝে না কেনো ইভ ভাইয়া? ‘

ইভানান বুঝতে পারলো না। তাই অবাক হয়ে বললো-
‘সুফি! ‘

‘হ্যা সুফিয়ান ভাই। আমি তাকে ভালোবাসি ইভ ভাইয়া’

ইভানান অবাক হয়ে তাকালো ৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত স্বরে বললো-

‘ কবে থেকে? ‘

ইনায়া নিজেকে সামলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। লজ্জিত হওয়ার মতো করে বললো –

‘ ক্লাস নাইন থেকেই ভালো লাগতো। বিশ্বাস করো ইভ ভাই, আমি সুফিয়ান ভাইকে সত্যিই খুব ভালোবাসি। ‘

একটু থেমে ইভানানকে অনুরোধ স্বরে বললো –
‘ ভাইয়া, সুফিয়ানকে ভাইকে আমি অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে কিছুতেই বোঝে না। তুমি একটু বোঝাও না তাকে’

ইভানান মৃদু হেসে বললো –
‘মনের কথা জানিয়েছিস ওকে?’

ইনায়া চকিত নজরে তাকিয়ে বললো –
‘সুফিয়ান ভাই কী আমাকে গ্রহণ করবে? ‘

ইভানান মজা করে বললো-
‘মনে মনে যাকে নিয়ে সংসার সাজিয়ে ফেললি, আর তাকেই বললি না! পাগলী ‘

ইনায়া ভয়ার্ত চেহারায় বললো-
‘ সুফিয়ান ভাই যদি না মানে, আমি মরে যাবো ভাইয়া’

ইভানান রাগী মুখে বললো-
‘ এক থাপ্পড় মারবো না! বেশী বুঝিস। অত বেশি ভয় না পেয়ে বলে দে ‘

‘আচ্ছা, তাহলে কালই বলি’

ইভানান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বাহিরে চলে গেলো। তার কোনো আপত্তি নেই, থাকবে কী করে! সুফিয়ানের শিরা উপশিরা চিনে সে। মেয়েলি দোষ নেই, চরিত্র ভালো, সৎ। ব্যস এটুকুই যথেষ্ট। তার বিশ্বাস তার বোন সুফিয়ানের সঙ্গে ভালো থাকবে।

পরের দিনই শাড়ি পড়ে, পিঠ পর্যন্ত চুল খুলে রেখে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে সুফিয়ানকে মনের কথা জানায় ইনায়া। সুফিয়ান প্রথমে অবাক হয়েছিলো। কারণ, ইনায়াকে সে নিজের বোন ব্যতিত কিছু ভাবেনি কখনো। তাই , ভালো করে বুঝিয়ে বলে দিলো৷ কিন্তু ইনায়া কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে বললো-
‘ সুফি ভাই, আমার মতো করে কেউ আপনাকে ভালোবাসবে না। একটা সুযোগ দিন আমাকে। ‘

সুফিয়ান ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। রাগী স্বরে বললো –

‘ ইউ হ্যাভ লস্ট ইওর মাইন্ড ইনায়া। ইউ নিড ট্রিটমেন্ট’

‘ তো দিন না, ট্রিটমেন্ট দিন আমাকে। আপনিই একমাত্র ঔষধ আমার ‘

‘জাস্ট স্টপ ইট। চলে যাও ইনায়া, আমাকে রাগীও না’

ইনায়া নিচে বসে পড়লো, সুফিয়ানকে আরও অবাক করে দিয়ে সুফিয়ানের পা ধরে আকুতিভরা টলটলে স্বরে বললো –

‘ সুফি ভাই, কৈশোরের প্রথম প্রেম আপনি। কী করে ভুলি আমি? ‘

সুফিয়ান টেনে উঠিয়ে ইনায়ার গালে পরপর দুটি থাপ্পড় মেরে দিলো। রাগে হতবুদ্ধ হয়ে গেছে সে। কী করে এত বেহায়া হয় ইনায়া ভাবতেই রাগের পারদ বাড়তে থাকলো। কিন্তু সে তখনও জানতোই না, ভালোবাসা মানুষকে দিয়ে সব করাতে পারে।
ইনায়া হৃদয়ভগ্ন হয়ে দৃষ্টি স্থির করে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে জায়গা ত্যাগ করলো। এতক্ষণ তারা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইভানান কল করে আসতে বললো তাই এসেছিলো। কিন্তু ইনায়া যে এমন করবে সে জানতো না। চুপচাপ নিচে নেমে গেলো। আর ছাদে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ইনায়া। অস্ফুটস্বরে বললো –
‘ আমার মতো আপনিও একদিন ভালোবাসার শিখায় পুড়বেন সুফি ভাই ‘

দীর্ঘক্ষণ পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোলাপ গুলো যত্নশীল হাতে উঠিয়ে নিলো। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো৷ একটা কাগজে লিখলো –

‘ইভ ভাইয়া, তোমার এই বোনটাকে ক্ষমা করে দিও।
ঐ নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন মানুষটাকে ছাড়া জীবনটা কী যে বিষন্নময়! তাকে বিহীন এক একটা রাত কী যে দুর্বিষহ! আফসোস, জমা কথাগুলো কিছুই তাকে বলা হলো না। তার আগেই আমি পাড়ি জমাবো, না ফেরার দেশে ‘

পরের দিন সকালে যখন ইনায়া দরজা খুলছিলো না তখন অজানা আশঙ্কায় শরীর কেঁপে উঠলো ইভানানের। দরজা ভেঙে ভেতর যেতেই দেখলো ইনায়ার লাশটা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। বোনের লাশ জড়িয়ে পাগলের মতোন চিৎকার করে কেঁদেছিলো। বিশ্বাসই হয়নি তখনও যে বোনটা বেঁচে নেই। সুখ শান্তি সব যেনো চলে গিয়েছিলো পরিবারের। সুফিয়ানকে যখন বললো ইনায়ার কথা তখন সুফিয়ানেরও অপরাধবোধ হয়েছিলো কিন্তু সেই কষ্টটা ইভানানের সামনে খুলে প্রকাশ করতে পারেনি। ইভানান সুফিয়ানের নির্লিপ্ততা সহ্য করতে পারছিলোনা। যার জন্য নিজের জীবন শেষ করলো তার বোন, সে এতটা স্বাভাবিক এটা ভাবতেই সুফিয়ানের প্রতি ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছিলো তার। তারপর শুরু হলো তার প্রতিশোধ নেয়ার নেশা। সুফিয়ানকে তিলে তিলে শেষ করার জন্যই এসবকিছু৷

গাড়ির হর্ণ বাজতেই ধ্যান ভাঙলো ইভানানের। সুফিয়ান গাড়ি পার্ক করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। ইভানানকে নামতে বলেছে৷ ইভানান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নেমে পড়লো। সুফিয়ান এপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকে গেছে। ইভানান খেয়াল করলো বহুদিন পর চোখের কোণা ভিজে উঠেছে তার। রাতের তারায় ঢাকা ঝলমলে আকাশ দেখতে দেখতে অভিমানী সুরে বললো –

ভালো আছো তো না ফেরার দেশে?
মনে করো তো সেখানে আমাকে?
নাকি লেলিহান দাবানলে এখনো পুড়ো?

পৃথিবীর বুক ছেড়ে গেলে অজানায়,
ভালোবাসার কী এতোই শক্তি,
যে করে দিলো নিঃস্ব তোমায়!

চলবে….

“অঙ্গারের নেশা”
পর্ব-২৫

অন্যান্য দিনের চেয়ে সেই সকালটা ছিলো অন্যরকম।
আকাশ তখন হলদে রঙে সেজেগুজে হাজির হয়েছে। নারীর দেহে অলংকারের ন্যায় আকাশেরও হলদে রঙ বেশ শোভা ছড়াচ্ছে। না আছে রোদ আর না আছে কোনো মেঘলা ভাব। চমৎকার একটা পরিবেশ। এরকম একটা সময়ে ভালোবাসার মানুষের হাতটা যদি নিজের মুঠোয় থাকে তাহলে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে বেশি কিছু লাগে না।
হসপিটালের ৩০৯ নাম্বার কেবিনে আড়াআড়ি ভাবে লম্বা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুফিয়ান। জানালার বাহিরের সৌন্দর্যে মোড়ানো এক টুকরো অপার্থিব দৃশ্য উপভোগ করছিলো। একাকিত্বের এই মূহুর্তগুলোতে প্রানেশার স্মৃতিগুলো খুব কঠোর ভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে অতৃপ্ত শ্বাস।
পাশের ঝুলানো ক্যালেন্ডারে লাল কালির দাগ জ্বলজ্বল করছে৷ সুফিয়ানের মনে পড়লো, আজ নিজের মাতৃভূমি থেকে দূরে চলে এসেছে ৫ বছর ৩ মাস। এর আগে চারটা ক্যালেন্ডারেও সে এভাবেই লাল কালির একটা দাগ কেটে দিতো৷ কোনো লাভ নেই, কিন্তু কোথায় কিছু একটা ভালো লাগে তার৷ গায়ে সাদা রঙের একটা শার্ট ইন করা। পাশের ডেস্কে সার্জিক্যাল স্যুট, গ্লাভস, মাস্ক পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আজ তার পাঁচ নাম্বার অপারেশন ছিলো।
নতুন ডাক্তার হওয়ায় খুব বেশি অপারেশন করে না সে৷ সার্জারির জন্য বেশি প্রেশার পড়লে তবেই করে।
এখন, মেডিসিনের উপর ২ বছরের একটা কোর্স করবে ঠিক করলো। নাহলে, শুধু সার্জারী করে আত্মতুষ্টি পাওয়া যায় না বলে মনে করে সুফিয়ান। ঠিক করলো, মেডিসিন কোর্স শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সে বাংলাদেশেই ফিরবে না। এতগুলো দিনে একবারো বাংলাদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। ইচ্ছে যে হয়নি তা না, বরং মাকে, রেয়ুকে খুব মনে পড়েছে কিন্তু বললেই যে বাংলাদেশে চলে যেতে মন চাইবে।
জাস্টিন বেইবারের ‘বেবি ‘ গানের রিংটোন বেজে উঠতেই হাল্কা চমকপ্রদ হলো সুফিয়ান। ডেস্কের কাছে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো। ‘ইভ’ নামটা উঠে আছে৷ সুফিয়ানের চোখে তার জীবনের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। যে তার বিপদে আপদে মনে রাখে, ঠিক এমনটাই তো মনে করে সুফিয়ান!
কল রিসিভ করে কানে তুলতেই শোনা গেলো সুর টেনে ইভানান বলছে-
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ‘

সুফিয়ান অবাক হয়ে গেলেও পরে মনে করলো আজ তার জন্মদিন। এত ব্যস্ততায় সে ভুলে বসেছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-
‘তুইও না! বুড়ো হয়ে বাচ্চাদের মতো বার্থডে উইশ করিস ‘

ইভানান হাসতে হাসতে বললো-
‘আমি কী আর তো মতো বুড়ো নাকি! আই এম ফিট এন্ড ফাইন। ত্রিশ পেরোলেই না তার আগেই তুই বুড়োর মতো গম্ভীর হয়ে থাকিস বুড়োদের মতো আচরণ করিস’

‘মনের রঙ ঘুচে গেলে তখন আর নিজেকে জুয়ান মনে হয় না, শরীর তরতাজা থাকলেও মনটা মরা মাছের মতোন ‘

‘হয়েছে, এবার তোর জ্ঞান শুরু করে দিস না। ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –

‘আচ্ছা তা না হয়, না দিলাম। তোর খবর কী বল, দুই বছর ধরে আলাদা থাকছিস’

‘এখানে থেকে আমি একটু শান্তি অনুভব করি। প্রকৃতির রূপে ডুবে থাকি, আমি তো চাকরি- বাকরি
করবো না। তাই, আঁকাআকি করে এক্সিবিশন গুলোতে যা পাই তা দিয়েই চলি ‘

‘হাহাঃ আমি দুইটা সার্জারী করেও যা পাইনা তার ডাবল তুই একটা এক্সিবিশনেই পেয়ে যাস। ‘

প্রতুত্তরে হাসলো ইভানান। সত্যি বলতে প্রচুর টাকার মালিক ইভানান। প্রকাশ না করলেও তা সুফিয়ান ভালোই জানে। বেশ ভালো একটা হোটেলে থাকছে এখন সে, প্রতি ছয় মাস পরপর নানান হোটেল বুক করে ঘুরাফেরা করে। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –

‘ওহ শোন, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ‘

‘সারপ্রাইজ! ‘

‘হ্যা, তোর জীবনের সেরা উপহার হবে এটা সুফি’

সুফিয়ান হেঁসে বললো –
‘ঠিক আছে, টাইম ইজ স্টার্ট নাও ‘

কল কেটে দিতেই সুফিয়ান নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ৷ দুই মিনিট পর ডোরে কেউ নক করায় ভ্রু কুচকে সুফিয়ান বললো-
‘ কাম ইন ‘

বিদেশি কালোমতো একটা ছেলে ভেতরে এসে গুড মর্নিং বললো৷ এখন বাজে সাড়ে এগারোটা, তাই গুড মর্নিং শুনে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুফিয়ান তাকালো। ছেলেটার হাঁটু কাপছে। সুফিয়ান গম্ভীর স্বরে বললো-

‘সে ইট কুইকলি ‘

ছেলেটা কেঁপে কেঁপেই বললো-

‘এ ম্যান হ্যাজ কাম টু সি ইউ, স্যার’
(আপনার সঙ্গে একজন লোক দেখা করতে এসেছে স্যার)

সুফিয়ান হাতের বইটা সাইডে রেখে বললো –
‘নেম? ‘

‘তনিম ‘

সুফিয়ান চকিতে তাকালো। তনিম! এখানে তার সাথে দেখা করতে কেনো এসেছে! তনিমকে তো সে প্রানেশার খোঁজ নিতে পাঁচ বছর আগে পাঠিয়েছিলো।
মাথা তুলে বললো-

‘সেন্ড হিম ‘

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড পরই ভেতরে স্যুট প্যান্ট পড়া ভদ্রলোক আসলো৷ সুফিয়ান বেশ খানিকটা অবাক হলো৷ তনিম যে এতটা বদলাবে ভাবেনি। উঠে দাঁড়াতেই তনিম তার স্বভাবমতোন সুফিয়ানের কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ান পিঠ চাপড়ে বললো-
‘কী ব্যাপার তনিম? কেমন আছো?’

তনিমকে অনেক উত্তেজিত দেখালো৷ যেনো কিছু বলার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছে সে৷ সুফিয়ানের প্রশ্নে বললো –

‘জি আলহামদুলিল্লাহ ভাই, ভালো আছি ‘

কিছুটা থেমে আবার বললো-
‘ভাই, আপনাকে কিছু কথা বলা অনেক জরুরি। ‘

‘ঠিক আছে, বসো আগে ‘

তনিম সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। হাতের তালু কচলে আমতাআমতা করতে করতে বললো –

‘ভাই, একটা ভুল হয়ে গেছে ‘

সুফিয়ান ভ্রু বাকিয়ে বললো-
‘কী ভুল তনিম?

তনিম আচমকা ঠোঁট চেপে কেঁদে ফেললো৷ সুফিয়ান থতমত খেয়ে বললো-
‘আরে! কাঁদছো কেনো? কী হয়েছে বলবে তো?’

‘অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে ভাই। পাপ করেছি আমি, আজ শাস্তি ভোগ করছি, পাঁচ বছর আগের করা ভুলের মাশুল গুনছি আমি ‘

এতটুকু বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো তনিম। সুফিয়ান তনিমের কাঁধে হাত রেখে বললো –

‘কী করেছো খুলে বলো ‘

তনিম দুই হাতে চোখ মুছে নিলো৷ লম্বা শ্বাসে বললো-

‘আপনি তো জানেনই ভাই, আমি গরীব ঘরের ছেলে। এলাকায় বড় ভাই টাইয়ের সাথে ঘুরতাম তাই মানুষ চিনতো৷ বাবা যখন মারা গেলো, তার কয়েক দিন পরই আবার মায়ের একটা কিডনি নষ্ট হলো৷ আমি আকূলপাথারে পড়লাম৷ তখন আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি সাহায্যের জন্য সবার আগে আপনার কাছে গেলাম, কিন্তু আপনি তো হসপিটালের বেডে তখন৷ তবুও, আপনাকে দেখার জন্য একবার হসপিটালের ভিতর ঢুকলাম। দেখে চলে আসছিলাম, ঠিক তখন পেছন থেকে আমাকে কেউ ডাকলো। ফিরে দেখি ইভানান ভাই। আমি তাকে দেখে সালাম দিলাম, সে আগে থেকেই বোধ হয় আমার মায়ের ব্যাপারটা জানতো৷ সে নিজে থেকেই আমাকে দশ লাখ টাকা দিলো৷ আমি মানা করলে জোর করে টাকা দিলো৷ আমি ভেবেই নিলাম, আপনার বন্ধুও আপনার মতোন বড় মনের মানুষ। আমার মায়ের অপারেশনের পর, আমি যখন বাড়ি ফিরলাম। সে বললো আমাকে তার হয়ে একটা কাজ করতে হবে। তা নাহলে, পাঁচ দিনের মাঝেই টাকা ফেরত দিতে হবে। আমার ঘাম ছুটে গেলো৷ পাঁচ দিনের মাঝে টাকা দেয়া কোনো ভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব না তা ইভানান ভাইও জানে।
আমি বুঝলাম, বড় কোনো কাজ করাতেই সে আমাকে ব্যবহার করতে চায়। কোনো উপায় না পেয়ে আমি সায় দিলাম। সে বললো ফোনে কাজ বুঝিয়ে দিবে। তার কয়েক দিন পরই আমাকে সকালে ফোন দিয়ে বললো আমি যেনো বলি প্রানেশা ভাবির আরেক জায়গায় সম্পর্ক আছে, আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। আমি তার হাত পায়ে ধরে অনুরোধ করে বলেছি এসব করতে পারবো না। কিন্তু, টাকার হুমকি দেয়ায় কাজটা করতে বাধ্য হলাম৷ যখন আপনাকে বললাম ভাবীর অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে তখন সে বললো, মায়ামতী ঝিলের কথাটা বলতে ৷ বলার পরে যে আপনি এভাবে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসবেন আমি ভাবিনি ‘
কিছুটা থেমে তনিম আবারও রেয়ানের চেহারা সহ সবকিছু খুলে বললো৷

সুফিয়ান স্থির হয়ে সবকিছু শুনছে৷ এখনও বিশ্বাস করে ওঠতে পারছে না। যাকে এতোটা বিশ্বাস করলো সে কিভাবে এমন করবে! সুফিয়ান থমকে যাওয়া চোখে বললো-
‘ইভানান! ‘

তনিম সুফিয়ানের মুখপানে চেয়ে বুঝতে পারলো ধোঁকায় সুফিয়ান কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।
তনিমের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো-
‘তুমি এখন যাও তনিম ‘

তনিম নিঃশব্দে হেঁটে বাহিরে চলে গেলো৷ সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে দুই মিনিট ধাতস্থ হলো, চোখ খুলতেই বাম চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে টুপ করে নিচে পড়লো। এই তাহলে মূল্য দিলো ইভানান তার বন্ধুত্বের। বাহ! চমৎকার। তনিম সবকিছু বললেও ইভানান কেনো এসব করেছে তা বলেনি৷ সুফিয়ানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে । উঠে দাড়িয়ে রওনা হলো ইভানানের হোটেলের উদ্দেশ্যে।
ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে আধা ঘণ্টায় রাস্তা পাড় করে ফেললো৷ রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইভানান যদি সত্যিই এসব করে তাহলে জান নিয়ে ছাড়বে ওর।
উপরে উঠতেই বিশাল রুমের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো৷ হাসতে হাসতে কেউ একজন বললো-

‘সারপ্রাইজ কেমন লাগলো বন্ধু? ‘

সুফিয়ান রেগে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ইভানান হাত
ভাজ করে খাটের উপর বসে আছে। সুফিয়ান ঠাস করে গালের উপর চড় বসিয়ে দিলো। ইভানানের ঠোঁটের হাসি মুছেনি৷ সে তার হাসি আরও বিস্তৃত করলো। সুফিয়ান মারতে মারতে হাঁপিয়ে উঠলো৷ দূরে সরে এসে বললো-

‘তোর এখনো লজ্জা করছে না? ‘

ইভানান হেসে বললো –
‘নাহ, কারণ এসব তো আমিই সাজিয়েছি। আমি না চাইলে তনিম এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতো না৷ আজ মা মরেছে বলে জানপ্রাণ নিয়ে ছুটে এলো ‘

‘এসব কেনো করলি তুই?’

‘এখনও বুঝিসনি? ‘

সুফিয়ান চিৎকার করার স্বরে বললো –
‘না বুঝিনি, এসব কেনো করলি?’

ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –
‘কারণ আমি চাই, তুইও বুঝিস যে আপন মানুষ থেকে দূরে থাকা ঠিক কতটা কঠিন সঙ্গে যখন নিজের বন্ধুর কারণেই হয় ‘

সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘ কেনো? ‘

‘কেনোনা তুই পাঁচ বছর আগে আমার সঙ্গেও এটাই করেছিলি, আমার ইনু শুধু মাত্র তোর কারণে মারা গেছে। তুই যদি আমার বোনকে কষ্ট না দিতি আত্মহত্যা কখনো করতো না ‘

‘ইনায়াকে আমি আত্মহত্যা করতে বলিনি ইভ!’

‘বলিসনি কিন্তু বাধ্য করেছিস, আমার সহজসরল বোনটাকে শেষ করেছিস। আর তাই তোর কাছে থেকে বদলাস্বরূপ আমি তোর ভালোবাসাকে সরিয়ে দিলাম তোর কাছে থেকে দূরে ‘

সুফিয়ান বুঝতে পারলো একে বলে কিছু লাভ নেই।
ইভানান যে বোনের শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই ইভানানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো-
‘যাই করিস, এবার প্রানেশাকে আমি আমার কাছে আনবোই ‘

সুফিয়ান বের হওয়ার পর ইভানান উচ্চস্বরে বললো –
‘কী করে হয় আমি দেখবো সুফি ‘

সুফিয়ান সেদিকে কান না দিয়ে চলে গেলো। দুইদিন পরই বাংলাদেশে চলে গেলো৷ মা আর বাবাকে ইভানান, রেয়ানের কাজের কথা বললো। মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেব অবাক হয়ে গেলেন৷ কারণ, রেয়ান চেহারা পাল্টে যে এই ভয়ংকর খেলায় মেতেছে। সুফিয়ান মিসেস অদিতিকে বললো প্রানেশার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে ৷ আর বিয়েতে যেনো সমস্যা না হয় তাই রেয়ানকে সিঙ্গাপুর পাঠালেন রাহাত সাহেব। তার আট দিন পরে হুলুস্থুল করে প্রানেশাকে বিয়ে করে নিলো।

বর্তমান –
সুফিয়ান ফুঁপানোর শব্দে পাশে ঘুরলো৷ প্রানেশা ঠোঁট চেপে কাঁদছে। সুফিয়ান অস্থির ভাব উঠলো। প্রানেশাকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। প্রানেশা সুফিয়ানের গলা জড়িয়ে কাঁধের একটু নিচে মাথা রেখে আদুরীর মতো বললো-

‘ভালোবাসি অঙ্গার’

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা পর্ব-২৩

0

‘অঙ্গারের নেশা ‘
পর্ব-২৩

বাহিরে বোধহয় হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। সুফিয়ান বুকে গুটিয়ে থাকা যুবতীর দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো৷ ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে গেছে প্রাণেশা, গাঁয়ের সঙ্গে নিবিড় হয়ে লেপ্টে আছে। উপরে একটা কম্ফর্টার দেয়া আছে গায়ে, কিন্তু তারপরও প্রাণেশার ঠান্ডা কমছে না। সুফিয়ান হাত বাড়িয়ে মোমের মতো সাদা নাকটা ছুয়ে দিতেই প্রানেশা হালকা কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে স্নিগ্ধ হাসলো। সুফিয়ান প্রানেশার হাতটা আলতো হাতে ধরে দীর্ঘক্ষণ অধরে লাগিয়ে রাখলো৷ প্রানেশা সরালো না , তার দৃষ্টিও নিবদ্ধ সুদর্শন যুবকের খাড়া কাটা চোয়ালের উপর, ছেলেদের চোখ ছোট থাকে কিন্তু সুফিয়ানের বড় চোখ তার ভেতরে গভীর ডার্ক চকলেট বলের মতোন চকচকে মণি। প্রাণেশার হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো গভীর চোখদ্বয়ে গভীর ছুঁয়ে দিতে, ঘোরের মাঝেই মুখটা উঁচু করে চোখের পাতায় চুমু খেয়ে কাঁধে মুখ গুজে রইলো৷ সুফিয়ানের নিশ্বাস ঘন হয়ে গেলো, প্রাণেশার মাথায় হাত রেখে বললো-
‘একটু আগে তো শুনবো শুনবো বলে জেদ করছিলে, এখন শুনবে না?’

‘হু, শুনবো বলুন ‘

‘এমন করে থাকলে বলবো কীভাবে?’

প্রানেশা দুষ্টু হেঁসে বললো –
‘কিছু জানিনা, এভাবেই বলুন ‘

সুফিয়ান বুঝতে পারলো এসব তাকে জ্বালানোর উসিলা মাত্র। সুফিয়ান প্রানেশাকে টেনে বালিশে শুয়ে দিলো। প্রাণেশা ভাবলো সুফিয়ান রেগে গেছে, এখন খুব বকবে। তাই সরি বলতে প্রস্তুতি নিতেই তাকে অবাক হয়ে দিয়ে প্রাণেশার আগের ভঙ্গিতে নিজেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশার থমকে যাওয়া মুখ দেখে মৃদু হেসে বললো –
‘এবার ঠিক আছে ‘

প্রানেশাও প্রতুত্তরে হেঁসে ফেললো। সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে সেই অন্ধকারে ঢেকে থাকা দিনটার কথা মনে করলো। কী কুৎসিত একটা দিন ছিলো সেটা! ভাবতেই সুফিয়ানের গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে।

সেদিন যখন সুফিয়ানের দীর্ঘ আট দিন পর জ্ঞান ফিরলো সেদিন সে সবার প্রথমে সৃষ্টিকর্তাকে বিরাট ধন্যবাদ জানালো। এত বড় এক্সিডেন্টের পর সে যে বেঁচে আছে ভাবতেই শুকরিয়া আদায় করলো। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো তার প্রানেশার সঙ্গে তো তার দেখা করার কথা ছিলো! লাফিয়ে উঠে বসলো সে। হাতের ক্যানালোতে টান লাগতেই কয়েক ফোটা রক্ত গড়িয়ে পড়লো। অতকিছু খেয়াল না করে জোরে চেচিয়ে মাকে ডেকে উঠলো, কিন্তু একি!তার গলা দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছে না। অতিরিক্ত মাত্রায় স্ট্রেসের কারণের গলা দিয়েও রক্ত পড়তে শুরু করলো। বাহির থেকে আওয়াজ পেয়ে নার্স ভেতরে ঢুকে পড়লো, মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেবও আসলেন৷ সুফিয়ানের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গলা আওয়াজ বের করতে না পেরে গলায় চেপে ধরে আছে। ডক্টর এসে সুফিয়ানকে তার গলায় ইনজুরির কথা জানালেন। সুফিয়ান ইশারায় জিজ্ঞেস করতেই ডক্টর বললেন-
‘এই এক দেড় মাস লাগবে! কিন্তু গলায় প্রেশারাইজ করলে রিকোভার করতে টাইম লাগবে। মেডিসিন নিয়মিত নিলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন, ডোন্ট নিড টু ওয়ারি ‘

সুফিয়ান ততক্ষণে শান্ত, নিশ্চুপ। মিসেস অদিতি থাকতে চাইলেও সুফিয়ানের ভয়ে আর থাকতে পারেনি। সুফিয়ান বলেছে সে কিছুটা সময় একা থাকতে চায়।
কয়েক দিন পরই রিলিজ হয়ে বাড়ি ফিরলো সুফিয়ান৷
সবার আগে প্রাণেশার সঙ্গে দেখা করার জন্য মন ছুটে গেলো। প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো প্রাণেশা নিজেই ফোন দিবে, কিন্তু মোবাইল অন করতেই দেখলো প্রানেশার কল তো দূরের কথা, তার নাম্বারই পড়ে আছে ব্লক লিস্টে। প্রতিবার সুইচ অফ বলছে৷ সুফিয়ানের হার্টটা তখন মিনিটে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেগে ছুটতে লাগলো। আরেকটা নাম্বারে কল দিতেই সেটা বিজি শোনালো। সুফিয়ানের বুকে তখন তীব্র ব্যাথায় ভরে উঠেছে, একজনকে দিয়ে খোঁজ লাগাতেই শুনলো প্রানেশা অন্য কারো সাথে রিলেশনে আছে এটা খবর পেয়েছে। সুফিয়ান মাথা ঘুড়িয়ে নিচে বসে পড়লো। এসব তার কিছুতেই বিশ্বাস হলো না। সে নিজেই ক্ষত গলা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। অদিতি আর রাহাত সাহেব ঘরে ছিলো বলে জানতে পারেনি৷

কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে গেলো, প্রানেশা নাকি মায়ামতী
ঝিলে একটা ছেলের হাত ধরে বসে আছে। সুফিয়ান তখনও বিশ্বাস করেনি। কিন্তু নিজে যখন দেখলো ঠিকই প্রানেশা একটা ছেলের হাত ধরে কথা বলছে স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। রেয়ানই ছিলো সেটা, কিন্তু সাইড থেকে চেহারা খেয়াল করেনি সুফিয়ান।

বেড়িয়ে গেলো তখন সে, আর সহ্য করতে পারছিলো না অন্য কারো সাথে। কী অসহ্য তেঁতো যন্ত্রণা!

সেদিন রাতেই সুফিয়ান টিকিট বুক করে, সকালে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলো সে। সাথে ছিলো তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ইভানান। যে ইমোশনাল ব্লেইকমেইল করে রওনা হলো। সুফিয়ান কষ্টে জর্জরিত মনে আর কিছু ভাবতে পারেনি৷ বন্ধু সাথে থাকলে কষ্ট কমবে ভেবেই সে সাথে নিলো৷ কিন্তু তখনও সে জানতোনা, ইভানান কী ভয়ংকর খেলায় মেতেছে! সুফিয়ানের কানে যেনো কোনোভাবেই রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্কের কথা না জেনে সব ব্যবস্থা করে ফেললো। আর সুফিয়ানকে অনবরত ব্রেইন ওয়াশ করতে থাকতে থাকলো। প্রাণেশা যে তার সাথে বেইমানি করেছে তা একপ্রকার জোর করে বিশ্বাস করালো। সুফিয়ান মেতে থাকলো পার্ট ক্লাব, মেয়ে নিয়ে। ইভানানের গভীর ফাঁদে পুরোপুরি পা দিয়ে ফেললো৷ শুধু মিসেস অদিতির রিকুয়েষ্টে, নতুন করে একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো৷ ব্রিলিয়ান্ট হওয়ায় অল্প দিনের মাঝেই পাকাপোক্ত ভাবে সকল কিছু আয়ত্ত্বে করে নিলো। আর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করলো এক মিথ্যা বন্ধুকে। ইভানানের কথাই তার কাছে একসময় সত্যি মনে হলো। কিন্তু সুফিয়ানের বোধ হয় মনেই ছিলো না

‘ Evil was once an angel ‘

চলবে…

অঙ্গারের নেশা পর্ব-২১+২২

0

অঙ্গারের নেশা
পর্ব ২১

সুফিয়ানের পরিবারকে জানালো, আল্লাহর রহমতে সুফিয়ান বেঁচে থাকলেও গলায় জখম হওয়ায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই, সুফিয়ানের গলা রিকোভার করতে কয়েক মাস সময় লাগবে। রিকোভার হওয়ার পর কথা বলতে পারলেও গলায় চাপ পড়ে এমন কিছু করা যাবে না। সুফিয়ান তখনও হসপিটালের বেডে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মাথায় বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে, তাই তার জ্ঞান ফিরতে চার পাঁচ দিয়ে দিন সময় লাগবে। জ্ঞান ফেরার পর এক মাস বেড রেস্টে থাকতে হবে। রাহাত সাহেব আর মিসেস অদিতি ছেলে বেঁচে আছে এটাতেই খুশি হয়ে গেলো। যতদিন লাগে ততদিন রেস্ট করুক৷ কিন্তু দুইদিন যাওয়ার পরই কনসার্টের জন্য মিটিং করে দিন নির্ধারিত হলো। সুফিয়ান চুক্তিবদ্ধ ছিলো প্রডিউসারের সঙ্গে। এখন যদি সুফিয়ান কনসার্টে না যায় তাহলে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে, তারচেয়ে বড় কথা সুফিয়ানের নাম অপ্রকাশিত থাকলেও একটা ছবি নেটে ভিডিও সহ আপলোডও হয়েছে। মূলত সুফিয়ানের গানে মুগ্ধ হয়েই কনসার্টের আয়োজন। প্রডিউসার মিস্টার দামান অকূলপাথারে পড়ে সুফিয়ানের বাড়িতে এসে হাজির হলেন। মিস্টার রাহাত আর মিসেস অদিতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন -‘আপনি এখানে কী করছেন?’

দামান সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন –
‘কেনো! আপনারা জানেন না? সুফিয়ানের সঙ্গে আমার কন্ট্রাক্ট সাইন হয়েছে কাল কনসার্টের জন্য। ‘

রাহাত আর অদিতি দুজনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো হতাশার শ্বাস। রাহাত সাহেব এই বাড়িতে আসার পর থেকেই সুফিয়ান নিজেদের কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের জানায়না। যত বড় কিছুই হোক নিজের ভেতর চেপে রাখে। অদিতি ব্যাপারটা আড়াল করে বললো –
‘ওহহ, হ্যা বলেছিলো তো। কিন্তু সুফিয়ানের এক্সিডেন্টের চিন্তায় ভুলে গেছিলাম আমি। ‘

‘আচ্ছা, কিন্তু এখন যে আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। সুফিয়ান তো শুনেছি খুব অসুস্থ। তাহলে, কাল কনসার্টের কী হবে!’

পেছনে থেকে একজন বলে উঠলো –
‘আমি হয়তোবা আপনার সাহায্য করতে পারি ‘

সবাই অবাক চোখে পেছনে তাকিয়ে দেখলো রেয়ান দাঁড়িয়ে আছে৷ দামান সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন-

‘আপনি! কীভাবে? ‘

রেয়ান ধীরে সুস্থে এগিয়ে এলো৷ সোফার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হালকা ব্যাথিত গলায় বললো –

‘ সুফি ভাই তো খুব অসুস্থ। মনে হয় না কনসার্টে অংশ নিতে পারবে। তাছাড়া এই মাসেই নাকি পরপর দুটো অনুষ্ঠানে গাওয়ার কথা। কিন্তু সুফি ভাইয়ের গলায় রক্তক্ষরণ হওয়ায় আর কখনো গাইতে পারবে না ‘

‘সে কী! একেবারে গলা নষ্ট হয়ে গেছে! কথা বলতে পারবে তো?’

‘কথা বলতে পারবে। কিন্তু আর কখনো গান করতে পারবে না অর্থাৎ সুর আসবে না ‘

দামান সাহেব অবাক হয়ে বললো-
‘তাহলে এক্ষেত্রে আপনি কীভাবে হেল্প করবেন?’

রেয়ান নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসলো৷ কপালে ডান হাতটা ঘষে বললো-
‘ হ্যা, আমি জানি সুফি ভাইয়ের মতো গান করতে পারিনা। কিন্তু, সুফি ভাইকে দেখে আমি মোটামুটি গান শিখে নিয়েছিলাম। প্রেকটিস করিনি, আগ্রহ ছিলো না। এখন যেহেতু ভাই অসুস্থ তাহলে সেক্ষেত্রে আমি পার্টিসিপেট করতে পারি। ‘

দামান সাহেব হালকা তাচ্ছিল্য করে বললো –

‘ গান পারলেই হবে না, তার সাথে চেহারাও থাকতে হবে। আপনার চেহারা দেখেই তো মানুষ চলে যাবে ‘

রেয়ানের ভেতরের রাগ আবারও উপচে উঠলো। এতক্ষণ সে ভাবছিলো আলাদা মাস্ক বানিয়ে সেটা দিয়েই শো করবে কিন্তু সেই একই খোঁটা! চেহারা! রেয়ানের ক্রুদ্ধ মন খলবলিয়ে বললো-‘ চেহারা নিয়েই এতো সমস্যা তো! এই চেহারাই আমি সারাজীবনের জন্য পাল্টে ফেলবো। সুফি ভাই সত্যিই আমাকে সবসময় নিচে নামিয়ে রেখেছে। এবার সুফি ভাই বুঝবে অধিকার না পাওয়ার ব্যাথা , সরি ভাই কিন্তু এটা আমায় করতেই হবে। নিজের জন্য একবার স্বার্থপর হয়ে দেখতে চাই আমি ‘

মনকে শান্ত করে মাথা উঠিয়ে বললো-

‘সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। তিনদিন পর যথাসময়ে কনসার্টে আমি এসে পড়বো৷ আর চেহারাটাও কোনো প্রভাব ফেলবেনা এতে ‘

‘কিন্তু এটা কীভাবে..? ‘

‘আহা, আপনি এতো চিন্তা করছেন কেনো! আপনি যান ‘
মিস্টার দামান একরাশ চিন্তা বোঝাই করে বেরিয়ে গেলেন। কীভাবে কী হবে, ভেবেই তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷

তিনদিন পর, কনসার্ট শুরু হতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। কিন্তু এখনো রেয়ান এসে পৌঁছাতে পারেনি। দামান সাহেব ভাবছেন ঘোষণা করবেন যে সুফিয়ান আসতে পারবেনা। মাইক হাতে নিয়ে স্টেজে উঠতে গেলেই পেছনে কেউ তাকে ডাকলো৷ বিরক্ত হয়ে তাকাতেই হাত থেকে মাইক পড়ে গেলো। এ কীভাবে সম্ভব! স্বয়ং সুফিয়ান! কিন্তু সে তো..

লোকটি সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেললো৷ হালকা হেসে বললো –

‘কী দামান সাহেব? অবাক হলেন?’

দামান সাহেব বাকহারা হয়ে তাকিয়ে আছেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ব্যাক্তিটি তুড়ি বাজিয়ে বললো-
‘আরে এতো অবাক হচ্ছেন কেনো?

‘অবাক হবো না?সুফিয়ানের মতোন কী করে! ‘

‘আপনি বোধ হয় জানেন না, এটা আর সেই আদি কাল নেই। ‘

‘প্লাস্টিক সার্জারি! ‘

‘ইয়েস। শো করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে মনে হয় ‘

চেহারায় অমিল হলেও কন্ঠ সুফিয়ানের সঙ্গে কিছুটা মিলে যায় রেয়ানের। এটার সুযোগ নিয়েই কাজটা করলো রেয়ান। দুই ঘন্টা পর শো শেষ করে বের হতেই দেখলো বাহিরে গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইভানান। রেয়ান হাসলো। হাসিতে বিজয়ের উচ্ছ্বাস। ইভানানকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো সে। ইভানান কাঁধ চাপড়ে গর্বিত গলায় বললো –
‘ এই হলো সাহসী ছেলে! পুরাই বাজিমাত করে দিলি’

রেয়ানও অহংকারে লেপটে থাকা হাসি হাসলো। তার ধারণা হলো, এবার তার চেহারা আছে। কেউ আর তাকে ঠেকাতে পারবে না। অথচ এটা বুঝতে পারলো না যে সে নিজেকেই হারিয়ে ফেললো। ইভানান পকেট থেকে একটা ছবি বের করে রেয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-‘ কাল রাতে যেসব ইনফরমেশন দিয়েছিলাম সেসব মুখস্থ করেছিস তো?’

রেয়ান ছবিটি দেখতে দেখতে বললো –
‘হুম ‘

‘তাহলে এখন যা, ঠিকানা মেসেজ করে দিয়েছি তোর ফোনে। সব ঠিকঠাক ভাবে করিস ‘

‘ঠিক আছে, কিন্তু ইভ ভাই একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। ‘

‘কী?’

‘এই মেয়ের সঙ্গে নাটক করলে তোমার কী লাভ?তুমি বলেছিলে দ্রুত সার্জারি করানোতে আমাকে সাহায্য করবে তার বদলে আমাকে এই মেয়ের সঙ্গে প্রেমের নাটক চালাতে হবে ‘

‘উফ, বেশী কথা বলিস না। তুই যা আর যা বলেছি সেসব কর ‘
রেয়ান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো সেই ঠিকানায়।
যেতেই ইভানান ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো৷ আড়মোড়া ভেঙে গাড়ির উপর লাফ দিয়ে বসে উপর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো-
‘এবার তুই বুঝবি সুফিয়ান, আপন মানুষ ধোঁকা দিলে ঠিক কতটা কষ্ট হয় ‘

বটতলার নিচে একটা সিটে বসে অনবরত হাত কচলাচ্ছে প্রানেশা। কী ভীষণ আনন্দের অনুভূতি ! সাথে কিছুটা লজ্জাও লাগছে। মনে মনে নানা কল্পনা জল্পনা করছে৷ কেমন দেখতে মানুষটা! আনমনেই হেসে উঠলো প্রানেশা। ক্ষন বাদেই একটা গাড়ি এসে থামলো। প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে গেলো। গেট খুলে বেরিয়ে আসলো ফর্সা ত্বকের এক মানবী। শব্দ করে হেঁটে এসে প্রানেশার সামনে হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে বললো

‘ কেমন আছো প্রানেশা? বেশি অপেক্ষা করাইনিতো?
আমি রেয়ান তেহজিব। যার সাথে তুমি এতদিন কথা বলেছো ‘

চলবে….

অঙ্গারের নেশা
পর্ব-২২

গৌধুলি পেরিয়ে সন্ধ্যার ঘ্রাণ ঘনিয়ে আসছে। দিক দিগন্তের নানান মানুষ হালকা আনাগোনা শুরু করেছে, তাদের বেশীর ভাগই সদ্য বিবাহিত। তাই প্রেমও মাখোমাখো। কেউ একে অপরকে জড়িয়ে সূর্য ডোবার সোনালী আভায় ছড়িয়ে থাকা আকাশের দিকে মনোনিবেশ করে আছে তো কেউ আবার ভেজা বালির উপর হাতে হাত রেখে হেঁটে বেরাচ্ছে। সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রানেশা। দৃষ্টি তার শান্ত নিথর। তার তিন হাত দূরে এক হাঁটু উঁচু করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সুফিয়ান। প্রানেশা একবার পেছন ফিরে চাইলো, এখনো সে পুরোটাই ভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা যে পাঁচ পাঁচটে বছর সে ধোঁকায় পড়ে ছিলো। রেয়ানের সঙ্গে মনের মিল কখনোই ছিলো না, সম্পর্কটা টিকে ছিলো রেয়ানের ধূর্ততা আর প্রানেশার মনে দাগ কেটে যাওয়া প্রথম ছয় মাসের ফোনালাপ। প্রানেশা ধীরস্থ পায়ে হেঁটে সুফিয়ানের সামনে দাঁড়ালো। সুফিয়ান মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো। প্রানেশার থমথমে মুখটা দেখে নিজের দুই হাত দিয়ে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নিলো। প্রানেশা চেয়ে আছে অনুভূতিহীন ভঙ্গিতে। চোখের পাপড়ি ভেজা ভেজা। অতিরিক্ত ফর্সা ত্বকটা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে আছে৷ প্রানেশার সাদা গালটায় ডান হাতে ছুঁইয়ে বললো-

‘প্রাণ! ‘

‘হু?’

‘ সেই অঙ্গারের কথা কখনো মনে পড়েনি? ‘

প্রানেশার গাল বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। সুফিয়ান হাত পেতে জলটুকু ধরে নিজের টিশার্টের ডান পকেটে এমন ভঙ্গিতে গুঁজে রাখলো যেনো ওটা মহামূল্যবান কোনো বস্তু। প্রানেশার গলা রোধ হয়ে আছে,অদৃশ্য কিছু একটা যেনো গলা শক্ত হাতে চেপে রেখেছে। কোনো রকম মাথা নাড়িয়ে বললো-

‘পড়েছে, খুব পড়েছে ‘

সুফিয়ান যেনো তাচ্ছিল্য হাসলো। প্রানেশাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলো। সমুদ্রের ঠান্ডা পানির স্রোত হাঁটুতে ধাক্কা লাগাচ্ছে। প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ানের চাপা কষ্ট। ঠিকই তো, এতগুলো দিন সুফিয়ান একাই তাকে ভালোবেসে গিয়েছে আর তাকে কী দিতে পেরেছে প্রাণেশা! নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো সে। দুই হাতে চোখ মুছে সুফিয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো-

‘ রেয়ানকে আমার সন্দেহ হতো মাঝে মাঝে। প্রথম যেদিন আমার সঙ্গে দেখা হলো সেদিন আমার একটু সন্দেহ লেগেছিলো কারণ অঙ্গার তো আমাকে বলেছিলো সে এসে প্রথম আমার দিকে একমুঠোভর্তি তাজা বেলীফুল এগিয়ে দেবে। কিন্তু রেয়ান এসে আমার সঙ্গে ফরমাল আলাপ করেছিলো, তার চারদিন পর আমার মোবাইল থেকে নিজেই অজানার নাম্বার সহ ডিটেইলস ডিলিট করে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলে বলে এই নাম্বারটা এখন আর সে ইউজ করে না, এক মামাতো ভাই এই সিম নিয়ে নিয়েছে। আর তাই আমিও বিশ্বাস করে নেই আমার অজানাকে ভেবে। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অঙ্গার মানে কী? সে সাধারণ ভাবে উত্তর দিয়েছিলো ‘কয়লা ‘। সেই কথার মাঝে আমি মিষ্টতা খুঁজে পাইনি। সম্পর্ক ভাংতে চেয়েও পারছিলাম না, কীভাবে পারবো! আমার সেই কৈশোরের স্মৃতিতে যে সিলমোহর মেরে বসে আছে সেই ছয় মাসের প্রমালাপ’

কথাগুলো বলে কেঁদে উঠলো প্রানেশা। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। ভালোবাসার বিনিময়ে সে যে কিছুই দিতে পারলো না। সুফিয়ান ব্যাথিত হয়ে তাকিয়ে আছে। সে যে তার প্রাণেশ্বরীর কান্না সহ্য করতে পারে না, তার বুকে যে খুব ব্যাথা করে এই কান্নায়। প্রাণেশার কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সুফিয়ান, আদুরে কন্ঠে বললো –
‘ প্রাণ, আর কেঁদোনা। বুকে যে খুব ব্যাথা করে! ‘

প্রানেশা কাঁদতে কাঁদতে হেঁসে ফেললো৷ সুফিয়ান গাঢ় চুমু খেলো প্রাণেশার কপালে।লম্বা চুলগুলো হাতের পিঠে পেচিয়ে খেলতে খেলতে বললো-

‘চলো রুমে চলো৷ দেখেছো পুরনো কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে! ‘

প্রানেশা বুকে মাথা গুজে থেকে বললো-
‘পাঁচ বছরে আপনি একবারও আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি?’

সুফিয়ান খপ করে প্রানেশাকে ছাড়িয়ে আলগোছে কোলে উঠিয়ে নিলো। প্রানেশা হকচকিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললো-
‘আরে করছেন কী! ছি ছি! সবাই কী মনে করবে! ‘

সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো-
‘কে কী মনে করলো এই নিয়ে বসে আছি নাকি আমি! ওই দেখো ওরা আমাদেরও ছাড়িয়ে গেছে তো কেউ কিছু বলেছে নাকি? ‘

প্রানেশা সুফিয়ানের ইশারা বরাবর তাকাতেই লজ্জায় লাল নীল হয়ে উঠলো। দুটো ছেলে মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে কিস করছে৷ প্রানেশা চোখ খিঁচে বন্ধ করে সুফিয়ানের বুকে কিল বসিয়ে দিলো। সুফিয়ান মেকি আর্তনাদ করে বললো –
‘উফ ব্যাথা পেয়েছি! ‘

প্রানেশা জানে এই হৃষ্টপুষ্ট দেহে নরম হাতের একটা কিল চামড়াও ভেদ করবে না। সুফিয়ান ভেতরে যেতে যেতে বললো-
‘এখানে থাকলে তুমি প্রশ্ন করতেই থাকবে। তাই এখন আমরা রুমে যাবো তারপর ফ্রেশ হবো, খাবো তারপরে তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবো ‘

প্রানেশা অবাক হয়ে আছে ৷ নিজেকে খুব খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে তার। সে তো এতো সুখ পাবে কল্পনায়ও করেনি। যতকিছুই হোক সৃষ্টিকর্তা সেই আকাঙ্খিত পুরুষকে তার ভাগ্যে লিখে দিলো।

রুমে যেয়ে প্রাণেশা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো সুফিয়ান খাবার রেডি করছে। প্রানেশা টাওয়াল পাশে রেখে খাটে বসতেই সুফিয়ান তার চিরচেনা মনোমুগ্ধকর হাসি উপহার দিয়ে বললো-

‘প্রাণ,তুমি খেতে শুরু করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ‘

বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে। আর প্রানেশা! সে তো সেভাবেই থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম বার বোধ হয় তার হার্টবিট দ্বিগুণ বেগে চলতে শুরু করলো। সুফিয়ান তো তার সামনে এর আগেও বহুবার হেঁসেছে। কিন্তু কখনোই হার্টের গতি বেড়ে যায়নি! আনমনেই কপাল চুলকে প্রানেশা বললো-
‘তবে, আমি প্রেমে পড়ে গেলাম! ‘

সুফিয়ান বের হয়ে এসে প্রানেশাকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে ভাজ ফেলে চোখ ছোট ছোট করে বললো-
‘কী হয়েছে প্রাণ? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ‘

প্রানেশা অপ্রস্তুত হেঁসে ‘না’ বোধক মাথা নাড়লো। সুফিয়ান প্রানেশার সঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে বিছানা ঝেড়ে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লো। প্রাণেশা হাতে পায়ে লোশন লাগিয়ে শুতেই শরীরে কম্পন শুরু হলো। বাম পাশে শুয়ে আছে সুফিয়ান। নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বটে, কিন্তু তবুও প্রানেশার কাছে সবকিছু কেমন যেনো নতুন মনে হচ্ছে। এ বুঝি প্রেমে পড়ার সংকেত! সুফিয়ানের আরেকটু কাছে এসে প্রানেশা বাচ্চাদের মতো মিনমিন করে বললো-

‘আমি আরেকটু কাছে এসে শুই? ‘

সুফিয়ান মিটমিট করে হেসে বললো –

‘শোও ‘

দুই মিনিট যেতেই আবারও প্রানেশা বললো-

‘আমি একটু বুকে মাথা রাখি? ‘

‘রাখো ‘

সুফিয়ানের মুখে প্রাপ্তির খুশি। মনে আনন্দের ঢেউ। এর থেকে কত কাছে এসেছে! তারপরও মনে হচ্ছিলো কোথাও কী যেনো ফাঁকাফাঁকা। বুকে এলিয়ে থাকা মাথাটার দিকে তাকিয়ে সুফিয়ান নিজস্ব ভঙ্গিতে বললোঃ

এ ব্যাথা লাল নীল,
থাকুক না চিরদিন!
কথারা শব্দহীন,
যেনো তা তুমিহীন!
বসন্তের ঘ্রাণ নেই,
যেখানে তুমি নেই।
প্রেমেরা রঙহীন!
আমি আজ দিশাহীন।

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা পর্ব-২০

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~২০

লাইব্রেরির একটা কোণায় বই হাতে বসেছিলো রেয়ান। মন দিয়ে প্রতিটা লাইনে ডুবে আছে। টেবিলের সামনে দুই জোড়া জুতোআলা পা দাঁড়াতেই উপরে মাথা তুললো রেয়ান। দেখা গেলো নীল চোখের পুরুষকে, অর্থাৎ ইভানান। চোখে প্রতিদিনের মতোন চশমা নেই। গায়ে একটা জার্সি দেখা যাচ্ছে লাল রঙের। রেয়ান নিষ্পাপ হাসলো। ইভানানও হালকা হেসে পাশের প্লাস্টিকের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে রেয়ান বললো-

‘কিছু বলবে ইভ ভাই?’

ইভানান গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো। রেয়ান ইশারায় বললো-‘তো বলো ‘

ইভানান হাত ভাজ করে শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে বসে রইলো তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো –
‘তোর মনে হয় না? তুই নিজের অধিকার এখনো বুঝে উঠতে পারিসনি! ‘

রেয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘কীসের অধিকারের কথা বলছো?’

‘আরে বোকা ছেলে! নিজের ব্যাক্তিগত অধিকারটাই তো পেলিনা তুই’

‘ব্যাক্তিগত অধিকার! ‘

‘হ্যা, এই যেমন দেখ ঘরেও তোর কোনো মর্যাদা নেই আবার বাহিরেও কোনো মূল্য নেই। সব জায়গায় তো সুফিয়ানেরই জয়গান চলে ‘

রেয়ান প্রতিবাদ স্বরে বললো-
‘এসব কী বলছো! সুফিয়ান ভাইয়ের তো কোনো দোষ নেই এতে’

‘আহা! উল্টো বুঝিস কেনো?আমি কী বলেছি নাকি, যে সুফিয়ানের কোনো দোষ আছে! সুফিয়ান তো প্রাণের বন্ধু, ভাই। কিন্তু তুইও তো আমার ভাই হোস। তোকেও আমি ভালোবাসি। তাই চাই তুইও ভালো থাক।’

‘আমি তো ভালো আছি ইভ ভাই ‘

‘সত্যিই ভালো আছিস? একটু ভেবে দেখ তো? ‘

রেয়ান স্মৃতির পাতা হালকা উল্টোতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সবার করা অপমান, তাচ্ছিল্য৷ তারপরও মুখে হেসে বললো –
‘এমন কিছুই নেই ইভ ভাই। ভালোই তো আছি আমি সুফিয়ান ভাই কত ভালোবাসে আমাকে, আমি খেতে পারছি, মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে। এইবা কয়জন পায় বলো?’

ইভানান বিরক্তিস্বরে বললো-

‘তোর এই বোকামির কারণেই তুই পিছিয়ে আছিস। দেখবি একদিন তুই কিছুই পাবিনা। ‘

‘মানে? ‘

‘ যেমন, তোর বাবার কথাই দেখ। তোর সাথে ঠিক মতো কথা বলে? সুফিয়ানের কটুবাক্য শুনেও চেষ্টা করে ওর সাথে কথা বলার। তোর মা? কখনো তোর আলাদাভাবে ভালো লাগা মন্দ লাগার খোঁজ নেয়? নেবে কী করে সুফিয়ান আছে না? আরে ভাই, ইউনিভার্সিটিতে যখন হরেক রকম প্রতিযোগিতা, রেস, অনুষ্ঠানে সবার প্রথমে কার ডাক পড়ে? ‘

রেয়ান সম্মহিতের মতোন বললো-
‘সুফি ভাই? ‘

‘এক্সাক্টলি! সুফিয়ানের রূপ, গুণের একটাও তোর মাঝে নেই বলেইতো তুই এখনো পিছিয়ে আছিস ‘

‘তাহলে এখন কী আমার সুফিয়ান ভাইয়ের গুণগুলো আমার মাঝে আনা উচিত? ‘

‘শুধু গুণই নয় রূপও খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেখ, সুফিয়ানের জন্য কত মেয়ে পাগল। অথচ এই পর্যন্ত একটা মেয়েও তোর দিকে ভালো মতো তাকায়নি ‘

রেয়ান মন খারাপের সুরে বললো –

‘গুণগুলো নাহয় আমি আমার আয়ত্তে আনতে পারবো কিন্তু রূপ তো আল্লাহর দান। সুফি ভাই মায়ের মতোন হয়েছে। আমি তো বাবার মতোন ‘

‘হুম, তা ঠিক যদিও। কিন্তু এখন তো আর আগের যুগ নেই, চাইলেই কত কিছু করে চেহারা পাল্টানো যায়! নায়ক নায়িকারাও করে অনেক সময়। তবে তোর করার কোনো দরকার নেই। তুই যেভাবে আছিস, সেভাবেই থাক। কী দরকার এসবের! ‘

বলেই চেয়ার টেনে আগের জায়গায় রেখে শিশ বাজাতে বাজাতে বাহিরে চলে গেলো। পেছনে থম মেরে বসে রইলো রেয়ান, মাথায় বারবার ইভানানের কথাগুলো ক্রমাগত গর্জন করে উঠছে৷ নিজমনেই বিরবির করে বললো -‘ প্লাস্টিক সার্জারি করলেই কী আমি বদলে যাবো! ‘ আবার আরেকমনে বললো-
‘ নাহ, কী উল্টো পাল্টা ভাবছি! জমজ হলে আলাদা কথা ছিলো। আমি সুফি ভাইয়ের ছোট। তাছাড়া সুফি ভাইয়ের মতো হওয়ার কী দরকার ‘
বলেই নিজের হাতে আবার বইটা নিয়ে নিলো কিন্তু মনোযোগ দিতে পারলো না। কোনো খাবারের একটা পাশে যদি পোকা পড়ে তাহলে আমাদের পুরো খাবারটার উপর অরুচি ধরে যায় তেমন মস্তিষ্কে নেগেটিভিটি টাই সবচেয়ে বেশী ছড়িয়ে পড়ে।

একসপ্তাহ পরের কথা, রাহাত সাহেবের অনুরোধে আজ ডাইনিং টেবিলে বসেছে ৷ সাধারণত রেয়ান নিজের রুমে খায়, সুফিয়ান কখনো বাহিরে থেকে খেয়ে আসে তো কখনো না খেয়েই কাটিয়ে দেয়, বাকি থাকেন রাহাত সাহেব আর মিসেস অদিতি তারা একসঙ্গে বসে খান। কিন্তু, সবাইকে অনুরোধ করে বলেছেন, আজ যেনো সবাই একসঙ্গে বসে। কারণ তিনি একটি জরুরি কথা বলবেন। সুফিয়ান আসতে না চাইলেও মায়ের হাতজোর করায় না এসে পারলো না। রেয়ান একবার বলার পরই এসে পড়লো৷ সুফিয়ান মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বসে একটা স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পরই রাহাত সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন –

‘আমি তোমাদের সবাইকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ডেকেছি ‘

সুফিয়ান অনাগ্রহ নিয়ে বললো-
‘তো বলুন দ্রুত। সেই কখন থেকে বসিয়ে রেখেছেন ‘

রাহাত সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন-
‘হুম বলছি। কথা হচ্ছে, তুমি বড় হয়েছো। আমার বয়স বেড়েছে। তাই আমি চাই তুমি ব্যবসার হাল ধরো। ব্যবসা তো তোমারই ‘

রেয়ানের কপালে হালকা ভাজ পড়লো। তার কারণ হলো ব্যবসা সুফিয়ানের বলায়। সুফিয়ান বললো –
‘ আমার থেকে এইসবের এক্সপেকটেশন না রাখাই রীতিমত বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি আপনার ব্যবসাশ একরত্তিও হাত দেবো না। তাই নেক্সটে এসব বলে আমার টাইম ওয়েস্ট করবেন না ‘

রাহাত সাহেব আহত দৃষ্টি দিয়ে বললেন –

‘তুমি আমার বড় ছেলে। যদি এসবের দায়িত্ব তুমি না নাও তো কী করে হবে?’

রেয়ানের মনে সৃষ্টি হলো একরাশ অভিমান। আর তা মস্তিষ্কে গিয়ে তৈরি হলো গভীর ক্রোধানল। মনে বারবার একটাই প্রশ্ন আসছে’ সে নাহয়, দেখতে একটু খারাপই, কিন্তু পড়াশোনা যোগ্যতায় তো কম নয়। তাহলে সব জায়গায় কেনো তাকে হেট করে নিচু দেখানো হয়! সুফি ভাইকেই কেনো চোখে পড়ে? সেও তো তার ছেলে তাহলে ব্যবসা কেনো সুফিয়ানের একারই হবে! ‘

কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না রেয়ানের ক্রুদ্ধ মন৷ হিংসা মানুষকে ঠিক কতটা খারাপ বানাতে পারে তা রেয়ান জানতো না। খাবার পুরোটা না খেয়েই হনহন নিজের রুমে চলে গেলো। সুফিয়ান সহ সবাই কথায় ব্যাস্ত ছিলো তাই সেদিকে খেয়াল করেনি কেউই। রেয়ানের মস্তিষ্কে শুধু চিন্তা এলো, যে সুফিয়ানকেই সবাই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে আর তাকে মনে করে অযোগ্য তাই তো তাকে ব্যবসার কিছু বলা হলো না। কিন্তু সে এটা একবারও চিন্তা করেনি, যে সুফিয়ানের সঙ্গে তফাৎ কম হলেও সত্য এটাই যে সুফিয়ান বড়। তা-ই রাহাত সাহেব সুফিয়ানকে বলেছে। তার উদ্দেশ্য যে রেয়ানকে ব্যবসা না দেয়ার ছিলো না তা রেয়ানের বোকা মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারেনি।

সব কথা শেষে সুফিয়ান নিজেই বলে দিয়েছিলো যে সে কোনো দায়িত্ব নিতে পারবে না। তাই রেয়ানকে এসব বুঝিয়ে দেয়া হোক। রাহাত সাহেবও ভাবলেন জোর করে তো আর কিছু হয়না তাই দায়িত্বটা রেয়ানকেই দেয়া হবে। সুফিয়ান নির্লিপ্ত ভাবে নিজের রুমে চলে গেলো। তার একমাত্র মনোনিবেশ শুধুমাত্র গান। কয়েকদিন আগেই একজন প্রডিউসারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তার কয়েকটি গান জমা দিয়েছিলো সে। প্রডিউসার জানিয়েছে একটা কনসার্টে তাকে গান গাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। তারপরই তার প্রাণের সঙ্গে দেখা করবে। অর্থাৎ একদিকে কনসার্ট শেষ হবে তারপরই যাবে প্রাণের সঙ্গে দেখা করতে। ফোন করে জানাতেই প্রানেশাও হ্যা বললো। সেও খুব করে চায় মনের মানুষটাকে একবার দেখতে। যেখানে দুইজন মানব মানবী নিজেদের প্রেম নিবেদনের উচ্ছলতায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো। মত্ত ছিলো নিজেদের প্রথম দেখা, প্রথম হাতে হাত রাখা, একসঙ্গে প্রথমবারের মতোন চোখে চোখ রাখা নিয়ে। কিন্তু তারা কী জানতো? যে তাদের আলাদা করতে প্রকৃতি নতুন খেলায় মেতেছে?

চারদিন পরই রাস্তায় ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে বড় একটা এক্সিডেন্ট হলো। সেই গাড়িতেই ছিলো সুফিয়ান। গাড়ি ট্রাকের সঙ্গে এক্সিডেন্ট হয়ে সুফিয়ানের মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে গেলো।

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা পর্ব-১৯

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৯

‘এমন হাসছিস কেনো তুই? ‘

প্রানেশার মা মিসেস আরা খাবার বাড়তে বাড়তে প্রশ্ন করলো প্রানেশাকে ৷ প্রানেশা তখন মগ্ন তার মনের মানুষের চিন্তায়। আজ ছয়মাস যাবৎ সেই অজানা লোকটার সাথে কথা বলছে সে৷ কিছুক্ষণ আগেই ফোন দিয়ে পাগলামো কথাবার্তা বলে প্রানেশাকে হাসালো৷ প্রাণেশার এখন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে যেনো। এই বয়সটাই হলো ফ্যান্টাসির৷ যা দেখে সবই রঙিন। একটু কিছুতেই অনেক বড় স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলে এরা৷ প্রানেশাও ব্যাতিক্রম নয়। ঐ মুগ্ধ করা কন্ঠ শুনলে প্রানেশার মন ফুরফুরে হয়ে আসে৷ খাওয়ার টেবিলে বসে ভাত নাড়তে নাড়তে ফিক করে হেসে উঠতেই মিসেস আরা ভ্রু কুচকে বললেন কথাটি। প্রানেশা স্বাভাবিক মুখ করে বললো ‘কিছু না মম’

‘ গভীর প্রেম মনে হচ্ছে! ‘

ইভানানের কথায় কিঞ্চিৎ হাঁসলো সুফিয়ান। লাইব্রেরিতে বসে কিছু নোটস তৈরি করছিলো৷ সামনে পরীক্ষা, তাই কিছু সময় হলেও পড়তে হবে। কিন্তু মনটা প্রানেশার কাছেই পড়ে আছে। মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলো তাই ইভানান টিটকারি স্বরে কথাটা বললো। সুফিয়ান সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বললো- ‘প্রেম নয় নেশা! গভীর নেশায় পড়ে গেছি। এবার পরীক্ষাটা হোক তারপর আমার গানকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবো। আমার প্রাণকেও আমার কাছে নিয়ে আসবো ‘

কথাগুলো বলার সময় চোখ মুখে উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠলো সুফিয়ানের। ইভানান সেই আভায় নিজের নীল চোখদ্বয় নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো। সেই দৃষ্টি সুফিয়ান বুঝতে পারলো না। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো – ‘ ছোট চাচার তো ব্যবসা আছে, এত নামীদামী ব্যবসা থাকতে তুই কিনা গানকে পেশা হিসেবে নিবি!’

সুফিয়ানের হাস্যজ্জল মুখ শক্ত হয়ে এলো৷ খসখসে গলায় বললো -‘ ঐ লোকের ব্যবসায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার। তার ব্যবসা নিয়ে সে যা ইচ্ছে করুক। আমার রেয়ু ভালো পড়াশোনা করছে , তাই ও নিজে কাজ করে খাবে আর আমিও আমার ক্যারিয়ার নিজ হাতে গড়বো। তার নাম আমার সামনে নিবি না! আই জাস্ট হেট হিম’

‘সে তো বাবা হয় সুফি,একটা ভুল নাহয়.. ‘

সুফিয়ান উঠে দাড়িয়ে চেয়ারে লাথি মেরে রাগে ফুঁসতে
লাগলো৷ মুখ লাল হয়ে গেছে। হিংস্র রুপে বললো-

‘নাহ, কোনো যোগ্যতা নেই ঐ লোকের আমার বাবা হওয়ার। আমার সহজ সরল মাকে ঠকিয়েছে সে।সুখেই তো ছিলাম আমরা! টাকা নাহয় একটু কমই ছিলো। তাতে কী? সুখের কমতি তো ছিলো না ৷ কত সুখী ছিলাম আমরা। ছোট দুই রুমের একটা ঘর ছিলো, একটা টিভি ছিলো। আমি বাবার কোলে বসতাম আর রেয়ু মায়ের কোলে৷ বাবা মার প্লেটে খাবার না খেলে পেটই ভরতো না। মা সবসময় হাসিখুশি থাকতো। বাবা মায়ের খুনসুটি ঝগড়া, ভালোবাসা দেখতাম। সব তো ঠিকই ছিলো। কিন্তু , কেনো ঐ লোকটা আমার মাকে ঠকিয়ে বসের মেয়েকে বিয়ে করলো তাও কিনা টাকা পয়সার জন্য!
যেদিন লোকটা ঐ মহিলাকে বিয়ে করে অন্য বাড়ি চলে গেলো সেদিন মা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিলো, রেয়ুর পাঁচ আর আমার সাত বছর। লোকটা একবারও ভাবেনি আমার সহজ সরল মায়ের কী হবে! প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে দিতো। মা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব অন্যায় মুখ বুজে সয়ে গেলো। রেয়ু চুপচাপ হয়ে গেলো, শান্ত, স্থির। আর আমি সারাদিন বাহিরে থাকা শুরু করলাম। ঘরে গেলেই মায়ের বিষন্ন মুখটা দেখে ভেতরটা খানখান হয়ে যেতো। চার বছর আগে যেই দ্বিতীয় বউ মারা গেলো, আবার ইনিয়ে বিনিয়ে আমার মায়ের কাছে মাফ চেয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে এলো। টাকা পয়সা তো তখন সব ঐ লোকটারই। কারণ, দ্বিতীয় ঘরে কোনো সন্তান হয়নি, মহিলাটি সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম হওয়ার জন্যই এত বড়লোকের মেয়ে হয়েও সাধারণ কর্মচারীকে বিয়ে করলো৷ মায়ের থেকে দূরে যেতে পারিনা বলেই তো এখনও ঐ বাড়ি পড়ে আছি। নাহলে, লোকটার মুখ দেখতেও আমার জাস্ট ঘেন্না হয়! ‘

বলতে বলতে সুফিয়ানের চোখে পানি এসে গেলো প্রায়। লম্বা শ্বাস ফেলে ব্যাগটা কাঁধে তুলে শান্ত ভেজা গলায় বললো -‘ ছন্নছাড়া পরিবারে সন্তানরা ঠিক কতটা কষ্টে বড় হয়, তা বলে প্রকাশ করা যায় নারে, আজ আসি ‘

বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো মিস্টার রাহাত টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন। সুফিয়ান বিরক্তিতে চোখ সরিয়ে এগোতেই মিস্টার রাহাত নরম কন্ঠে বললো-
‘সুফিয়ান বাবা, এসো খাবার খেয়ে নাও’

সুফিয়ান উত্তর না দিয়ে ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে পান করে চুলে হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। মিস্টার রাহাত আবারও বললেন –
‘কী হলো এসো! কিছু তো খাওনি নিশ্চয়ই ‘

সুফিয়ান তাচ্ছিল্য হেঁসে বললো –

‘এত ভাবতে হবে না আপনাকে, পুট ওয়েল অন ইয়োর হুইল’

মিস্টার রাহাত আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক তপ্ত নিঃশ্বাস। মিসেস অদিতি পাশেই বসে ছিলেন এতক্ষণ। এসব নতুন নয়। প্রতি দিনই মিস্টার রাহাত নিজ থেকে কথা বলার চেষ্টা করেন কিন্তু সুফিয়ান খুব বেশি হলে হ্যা, না মতো কথা বলে চলে যায়। মিসেস অদিতি এ নিয়ে উচ্চ্যবাচ্য করেন না। কারণ, সুফিয়ান আগেই বলে দিয়েছে যদি কোনো রকম মানিয়ে নেয়ার কথা বলা হয় সে বাড়ি ছাড়তে এক মিনিটও ভাববে না। মিসেস অদিতি খাবার খাওয়ার পর চুপচাপ বিনাবাক্যে চলে গেলেন। রাহাত সাহেব অসহায়ের মতো বসে রইলেন, এখন তার ভুল সে বুঝতে পেরেছেন। বুঝেছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক বছর পরই। দুই সন্তান, প্রথম ভালোবাসার বউকে ছাড়া যে থাকা সম্ভব না তা ঠিকই বুঝেছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় বউ কাগজ পত্রে সই করিয়ে নিয়েছিলো। দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে যদি কোনো প্রকার সন্তানদের সঙ্গে দেখা করে তাহলে জেলে যেতে হবে। তখন কিছুই করার ছিলো না৷ অদিতি যতই বলুক ক্ষমা করে দিয়েছে, কিন্তু সে জানে অদিতি সেই আঘাত এখনো ভোলেনি। তা-ই তো এখন তার সাথে প্রয়োজনীয় কিছু ছাড়া কথা বলেনা। এ যেনো বিনা আঘাতে রক্তাক্ত করা৷ অপরাধবোধ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি। এর চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া পৃথিবীর বুকে সম্ভব নয়।

বেলকনিতে বেছানো মেট্রেসের উপর নিথর হয়ে শুয়ে আছে সুফিয়ান। চোখ মুখ শুকনো। প্রায় রাতেই এভাবে বসে থাকে সে। একাকীত্ব কুড়ে কুড়ে খায় তখন। এ যেনো নিত্যদিনের সঙ্গী সুফিয়ানের। সেও চায় স্বাভাবিক একটা জীবন। যেখানে এই বিষন্নতা আর দীর্ঘশ্বাসের কোনো স্থান থাকবে না। কিন্তু সবার কপালে যে এই সুখ লেখা থাকে না। রাতের নিস্তব্ধতায় মোড়া শহরের দিকে এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আছে। মুখে শব্দ নেই। চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে স্মার্টফোনের ঝকঝকে স্কিৃনে ‘নেশা ‘ ইজ কলিং লেখা দেখা যাচ্ছে। ঠোঁট আপনাআপনি প্রসারিত হয়ে হাসির ভঙ্গিমা হয়ে এলো৷ এই একটা মানুষের কন্ঠে ভেতরের সকল বিষন্নতা দূর হয়ে যায় তার৷ দ্রুত রিসিভ করে কানে দিতেই ভেসে এলো অভিমানী সুর -‘আমায় আপনি ভুলে গেছেন তাইনা? ‘

সুফিয়ান হেঁসে উঠে দাড়িয়ে দোলনায় বসে পড়লো। দোল খেতে খেতে বললো-
‘ আমি ভুলে গেলে কী তোমার কিছু এসে যাবে প্রানেশা? আমি কী খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ?’

প্রানেশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো৷ সারাদিন শুধু মোবাইল হাতে নিয়ে ফোনের অপেক্ষা করেছে সে। কিন্তু নিষ্ঠুর মানুষটা কী তা বোঝে! একটুও বোঝে না। এই যে প্রানেশা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে নিজে থেকে প্রথম বার কল করলো অথচ তাকে কী লজ্জাটাই না দিচ্ছে। প্রানেশা হালকা লজ্জা আর রাগ মেশানো কন্ঠে বললো- ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ফোন রেখে দিচ্ছি। খুব ডিস্টার্ব করে ফেলেছি আপনাকে ‘

রাগে গলার স্বর ডেবে গেছে প্রানেশার। সুফিয়ান বুঝলো এই রাগ সহজে ভাঙার নয়, সারাদিন যে প্রানেশা তার অপেক্ষা করেছে ভাবতেই ভালো লাগায় শরীর জুড়িয়ে গেলো। আদুরে কন্ঠে বললো-

‘খুব ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন হবে না রাণী’

প্রানেশা নাক টেনে টেনে বললো-
‘আর যদি হয়?’

‘তাহলে, এই আমিটাকে আপনাতে সপে দেবো। পুড়িয়ে অঙ্গার বানিয়ে নিয়েন ‘

প্রানেশা লজ্জামিশ্রিত হেঁসে বললো –

‘ তা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু একটা জিনিস যে আপনি এখনো বললেন না!’

‘কী বলিনি? ‘

‘আপনার নাম! ছয় মাস হয়েছে অথচ আপনার নামটাই বললেন না ‘

‘ আমি ঠিক করে রেখেছি যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন আপনাকে আমার নাম বলবো। তার আগ পর্যন্ত আপনি নাহয় আমায় ‘অঙ্গার ‘ বলেই ডাকুন ‘

‘অঙ্গার! অদ্ভুত তো! ‘

‘ অদ্ভুত হলেও এটাই ডাকবেন। যেদিন আমাদের দেখা হবে এর অর্থ আপনাকে ব্যাখ্যা করবো, এই শব্দে যে কতটা মায়া লেগে আছে তা দেখাবো৷ ‘

‘আচ্ছা ‘

সুফিয়ান মৃদু হেঁসে বললো –

‘ রাণী শাস্তি মওকুফ করেছেন তো? নাকি আরও বাকি!’

প্রানেশা চাপা হেঁসে বললো –

‘নাহ, আরও বাকি। অঙ্গার সাহেব যদি নিজের অতীব সুন্দর কন্ঠে একখানা কবিতা শোনায় তাহলে রাণী ভেবে দেখবেন ‘

সুফিয়ান দোলনায় হেলান দিয়ে হাসিমুখে বললো-

একটা হলুদ বিকেল হবো
একপশলা হাসি হবো
তোর বাঁকা ঠোঁটে রাখবি আমায়?
তোর জেগে থাকা রাত্রি হবো
পূর্ণিমার ঐ চাঁদ হবো
জানালাতে দেখবি আমায়?
তোর পায়ের আলতা হবো
একটা লাল টিপ হবো
তোর কপালে রাখবি আমায়?
তোর খোঁপার ফুল হবো
রেশমি কাচের চুড়ি হবো
তোর হাতে পড়বি আমায়।
তোর লেখা চিঠি হবো
একটা প্রেমের গল্প হবো
লিখবি আমায়?

– কাব্য আহমেদ

চলবে…

অঙ্গারের নেশা পর্ব-১৮

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৮

‘কোকিলপুর ‘ গ্রামের থেকে সুফিয়ান ফিরেছে আজ এক মাস। এই এক মাসে সুফিয়ান প্রতিটি নিঃশ্বাস নেয়ার সময় প্রানেশাকে মনে করেছে। গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছে ওই অচেনা মেয়েটাকে ছাড়া শান্তিমতোন নিঃশ্বাস নেয়া সম্ভব না। মেয়েটার ওই ভেজা ঠান্ডা পবিত্র মুখটা প্রতি রাতেই সুফিয়ান স্বপ্ন দেখে। তখন শরীরে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায়। স্বপ্ন সাজায় নতুন জীবনের। সেখানে ছোট্ট একটা ঘর থাকবে, বৃষ্টির দিনে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি আওয়াজ শোনা যাবে, পাশে একটা পুকুর থাকবে। সব মিলিয়ে ছিমছাম সংসার কিন্তু সুখ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হবে। কী সুন্দরই না হবে সেই মুহূর্তগুলো!

সুফিয়ান বসে আছে নিজের বারান্দার দোলনায়। হাতে কফির কাপ। সময় এখন বিকাল পাঁচটা। এই সময়টা একা একাই কাটায়, বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ায়। নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিলো, তনিম কল করেছে। এলাকার ছোট ভাই, একে কয়েকদিন আগে প্রানেশার খোঁজ নিতে পাঠিয়ে ছিলো ৷ হয়তো কোনো খোঁজ পেয়েছে ভাবতেই এক চিলতে হাসি নিয়ে ফোন রিসিভ করলো-

‘বল তনিম কী খবর পেলি?’

‘ভাইই!’

এমন কাঁদো কাঁদো স্বরে সুফিয়ান অবাক হলো। পরমুহূর্তেই বললো –

‘ কী হয়েছে? ‘

‘ভাই, এ আপনি আমাকে কার কাছে পাঠালেন! এ তো মেয়ে না ভাই! ‘

‘হোয়াট ননসেন্স! ‘

‘না না মানে! এ হলো বোম্বাই মরিচ । ‘

‘কী করেছে তোমায়?’

তনিম কাতর গলায় বললো –

‘ ভাই! ভাবী, কলেজ থেকে ফিরছিলো। আমি কলেজের ফলো করে বাসার এড্রেস বের করতে পিছু নিলাম। ভাবী মনে হয় সন্দেহ করলো, দুই একবার পিছনে ফিরছিলো। আমি অনেক লুকিয়ে চুপিসারে যাচ্ছিলাম কিন্তু..! ‘

‘ কিন্তু কী?’

‘মাঝপথে ভাবী রাস্তায় দৌড়ে এসে আমাকে ধরে মেয়েধরা! মেয়েধরা! বলে জনগণের কাছে উদুম কেলানি খাইয়েছেন ‘

সুফিয়ান মনোভাব সহকারে সব কথা শুনছিলো। শেষের কথা শুনে সুফিয়ান হেসে ফেললো৷ তনিম তখনও হা হুতাশ করছে। হাসিটা চেপে বললো-

‘তোমাকে কে বলেছিলো একা যেতে,ডাফার! ‘

হাসতে হাসতে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো সুফিয়ানের। কয়েক দিন আগেই সেভ করেছে সুফিয়ান। কল দিতেই জ্বলজ্বল করে উঠলো ‘নেশা ‘। চতুর্থবারের সময় কলটা রিসিভ হলো।
অপর পাশ থেকে প্রানেশা বললো-

‘কে বলছেন?’

সুফিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বললো-

‘ সুমি বলছেন?’

প্রানেশা শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিলো। গায়ে একটা লেডিস শার্ট আর প্লাজু। ভ্রু কুচকে বললো-

‘ জি না, আপনি বোধ হয় রং নাম্বারে কল দিয়েছেন! আমি সুমি নই ‘

‘কিন্তু আমাকে তো বলা হয়েছে এটাই সুমির নাম্বার!’

‘ওহহো! বললাম তো আমি সুমি নই৷ আমি প্রাণেশা ‘

‘ওহ আচ্ছা , তাহলে ওই গুন্ডি মেয়েটার নাম প্রাণেশা! ‘

প্রানেশার পিলে চমকালো। গুন্ডি মেয়ে মানে! লোকটা কী বোঝাতে চাইছে! ওহ, আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় একটা লোককে ইচ্ছেমতো মার নিজেও দিয়েছে, সঙ্গে জণগণ দিয়েও খাইয়েছে। যদিও প্রানেশা এখনো সিউর না যে লোকটা আসলে কে ছিলো! সন্দেহবশত কাজটা করে কী তবে ফেঁসে যেতে হবে! কলেজ থেকে
ফেরার সময় মাথা এমনিতেই গরম ছিলো। তারপর নিজের সব রাগ মিটিয়েছে লোকটার উপর৷ তারপর বাসায় এসে নিজেই আফসোস করলো৷ কিন্তু এখন আফসোস করে কী হবে!

‘শুনছেন মিস?’

প্রাণেশা তোতলানো গলায় বললো –

‘জি জি, শুনছি। ‘

‘তো আপনি কী জানেন আপনি কার গায়ে হাত তুলেছেন? ‘

প্রানেশার কেঁদে ফেলার মতোন অবস্থা হলো৷

‘ক.. কার উপর? ‘

‘এলাকার নেতার ছেলের উপর ‘

প্রানেশা মনে মনে ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। নাটক সিনেমায় দেখেছে সে নেতারা মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যায়! অনেক সময় মেরে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলে রাখে৷ প্রানেশার চোখ লাল হয়ে গেছে, টুপটুপ করে জল পড়ছে৷

‘এখন কী তাহলে সে আমায় মেরে ফেলবে?’

সুফিয়ান মনে মনে ভীষণ হাসছে৷ এভাবে কে বিশ্বাস করে! তারপরও গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললো –

‘ হতে পারে! ‘

প্রানেশা আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান প্রথম কথোপকথনেই বুঝতে পারলো প্রানেশা মেয়েটা সহজ সরল বোকাসোকা, ভীতু ৷ কিন্তু এভাবে কাঁদছে দেখে সুফিয়ানের নিজেরই কষ্ট লাগলো। হড়বড় করে বললো –

‘আরে মেয়ে কাঁদছো কেনো! তোমাকে বাঁচাতেই তো আমি কল করলাম’

‘আপনি সত্যিই বাঁচাবেন আমায়?’

‘হ্যা বোকা মেয়ে ‘

‘কীভাবে? ‘

‘শোনো,তুমি যাকে মার দিয়েছো সে আমার পরমবন্ধু আমি হলাম তার বেস্ট ফ্রেন্ড। যদি তুমি আমার কথামতো চলো তাহলে আমি তোমার সাহায্য করতে পারি’

প্রানেশার আশার প্রদীপ খুঁজে পেলো। খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে বললো-

‘সত্যিই!’

‘হ্যা একদম সত্যি ‘

‘আমাকে কী করতে হবে? ‘

‘আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে। যা বলবো সেটা মানতে হবে, বন্ধু হতে হবে’

‘তাহলেই আমাকে আপনার বন্ধু আর কিছু বলবে না! ‘

‘একদম না, আমি না বললে কখনোই করবেনা ‘

প্রাণেশা খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো৷ সতেরো বছরের আদরের দুলালি এতটুকু বুঝতে পারলো না যে তাকে বোকা বানানো হচ্ছে। খুশি খুশি সবটা মেনে ফোন রেখে দিলো সে৷ সুফিয়ান ফোনের দিক তাকিয়ে বললো –

‘ আমার বোকা প্রাণেশ্বরী! ‘

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা পর্ব-১৭

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৭

সেসময়টা ছিলো খুব প্রাণবন্ত, জীবন্ত । আমরা সবাই মিলে ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। ফায়েজ বললো সিঙ্গাপুরের কথা, জয় বললো লন্ডন, কিন্তু আমি আর ইভানান ঠিক করলাম দেশের ভেতরে কোথাও ঘুরার। ফায়েজ বললো ওর নানা বাড়িটা খুব সুন্দর। সেখানে পুরনো জমিদার বাড়ি, একটা লেক, একটা পার্ক আর জিন বাড়ি নামের একটা প্রাসাদের মতো বড় একটা বাড়ি আছে। ‘কোকিলপাড়া ‘ যাওয়ার জন্য সবার ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। রেয়ানকে সবসময়ের মতোই আমার সঙ্গে যেতে বললে রেয়ান স্বাভাবিক ভাবে বললো –
‘তোমরা যাও সামনে আমার পরীক্ষা ‘

কিছুতেই রাজী হলো না রেয়ান। আমরা সবাই ব্যাগ প্যাক করে রওনা হলাম ‘কোকিলপাড়া ‘। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফুলের সারি। এরকম গ্রাম আমি শুধু মাত্র কল্পনাতেই দেখেছি, কিন্তু বাস্তবে প্রথম। আমি তখনও জানতাম না, এই সুন্দর গ্রামে এসে আমি দেখা পাবো আমার প্রাণভোমরার।

ওখানে বেশ যত্ন করেই রাখা হলো আমাদের। যেদিন আমরা ফিরে আসবো সেই দিন জয় বললো-

‘শুনেছি এখানে নাকি একটা বড় নদী আছে, চল ঘুরে আসি’

আমি বললাম -‘না দেরি হয়ে যাবে, দরকার নেই ‘

ইভানান শেষমেষ আমাকে রাজী করিয়ে নিয়ে গেলো। আমরা সবাই সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। বৃষ্টি নামলো সেদিন আমরা ঠিক করলাম আজ যাবো না। এত সুন্দর পরিবেশ ফেলে আমারও যেতে মন সায় দিলো না। চিত্রকররা বৃষ্টি দেখলে নাকি নিজেকে কখনো আটকে রাখতে পারে না। এটা ইভানানের মতামত । ও পাশের একটা টিনের ঘরে নদীর পাড়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কবিতা টাইপের কিছু একটা লিখছিলো কলম নিয়ে। আর আমি বৃষ্টির মধ্যে সবার অনুরোধে গলা উঠিয়ে গান ধরলাম গিটার নিয়ে। আমি ছিলাম আমার গানে আর ইভানান ছিলো তার কলম নিয়ে লেখার কার্যে।

জয় হঠাৎ করেই চিৎকার করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিলো। সুফিয়ানের ধ্যান ভাংলো। চোখ সরিয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখলো একটা মেয়ে ভেসে উঠেছে কিনারায়। কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল সুফিয়ান৷ হাঁকডাকে ইভানানও কলম হাতে নিয়েই দৌড়ে এলো। সুফিয়ান কাঁধের গিটার রেখে কোনো কিছু না ভেবেই পাড়ে নেমে গেলো। সুফিয়ান হাত গুটিয়ে চার ধাপ সিঁড়ি নেমে পাঁজাকোলে উঠিয়ে নিলো৷ সুফিয়ান তখনও কিছু ভালো করে খেয়াল করেনি। উঠিয়ে কোলের উপর নিয়েই সিঁড়ির উপর বসে পড়লো৷ চুলে মুখ ঢেকে আছে ৷ কোমড় পর্যন্ত চুল গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে মুখ দৃশ্যমান হতেই সুফিয়ান থমকে গিয়েছিলো৷ নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো। পেটে কেমন মোচড় দেয়ার ন্যায় ব্যাথা করে উঠলো৷ ভেজা ঠান্ডা মুখটা দেখে সুফিয়ানের ভেতরটা এক পশলা বৃষ্টির মতোন এসে ভিজিয়ে দিলো৷ অজান্তেই গাল ছুঁয়ে বললো -‘ এলোকেশী ভোমর’

সবার আড়ালে একইসঙ্গে চোখ পড়েছিলো আরও একজনের। সে ইভানান৷ তার নজর পড়লো সেই মেয়েটির গলার নিচের বিউটি বোনে, ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে যাওয়া লাল টকটকে ঠোঁট, আর মসৃণ ফর্সা পা টায়। এই পর্যন্ত সব মেয়েকে সে শুধু একদিনের জন্যই ব্যবহার করেছে। আজ প্রথম মনে হলো এই মেয়েটাকে তার একদিনের জন্য নয় সারাজীবনের সঙ্গীনী বানাতে হবে৷ দুইজনই পুরুষ, একজন চিন্তা করলো পবিত্রতা নিয়ে, আর আরেকজন সুন্দর যৌবনা শরীরে মগ্ন হয়ে ৷ একটি অজানা মেয়ে দুইজনের বুকের ভিতরে জায়গা করে নিলো। একজনের ‘প্রাণভোমরা’ হয়ে তো আরেকজনের ‘স্রোতস্বিনী’ হয়ে৷

জয় তার স্বাভাবিক স্বভাবমতোন বললো-
‘মইরা গেলো নাকি!’

সুফিয়ান সাথে সাথে হুংকার দিয়ে বললো-

‘জাস্ট শাট আপ! সবসময় এক্সট্রা ওর্ডিনারি ভাবতে কে বলে তোকে? ‘

ইভানানও রক্তশক্ষু নিয়ে তাকালো। জয় বুঝতে পারলো কথাটা বলা এই মুহূর্তে ঠিক হয়নি৷ সুফিয়ান নিজের গেঞ্জির উপরের টিশার্ট টা খুলে মেয়েটার বাহুতে জড়িয়ে দিলো৷ শ্বাস পরখ করতেই বুঝতে পারলো শুধু অজ্ঞান হয়েছে৷ গলার কাছে পড়ে থাকা ব্যাগে একটা আইডি কার্ডে দেখলো কলেজের একটা কার্ড ৷ নাম -প্রানেশা ইয়াসরার, বয়স-১৭, ঠিকানা সহ বোঝাই যাচ্ছে বয়স কম,হবে সতেরো আঠারো৷ ফায়েজ বললো-
‘ যাক বাবা এবার অন্তত সমস্যা হবে না। চল পাশের হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেই, প্যারেন্টস নাম্বার তো আছেই কার্ডে ‘

সুফিয়ান যত্নশীল হাতে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে৷ কাঁদা মাটি হয়ে গেছে রাস্তায়৷ সুফিয়ান সবাইকে উঠতে বলে নিজেও উঠে পরলো। সুফিয়ানের পাশেই উঠে বসলো ইভানান। জয়, ফায়েজ আর ইকরাম সামনের সিটে৷ সুফিয়ান নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে। মনে মনে আওরালো-‘ আল্লাহ খুব যত্ন করে বানিয়েছে তোমায়’

কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে এসে পড়লো৷ তেমন কিছু হয়নি বলে ডাক্তাররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কেবিনে শিফট করে দিলো। দুর্বল শরীরে প্রানেশার জ্ঞান ফিরলো না৷ সুফিয়ান কেবিনে সারা রাত বসে রইলো। ইভানান রইলো ঠিকই তবে এমনভাবে যে কেউ বুঝতেই পারলো না। সুফিয়ান যেমন খোলামেলা স্বভাবের তেমনই ইভানান সব কাজে একটা গোপনীয়তা বজায় রাখতে পছন্দ করে।ভোরের দিকে যখন সবাই চলে যাওয়ার তাগিদ দিলো সুফিয়ান না করে দিলো কিন্তু মিসেস অদিতির শরীর খারাপ শুনেই মন খারাপ হয়ে গেলো৷ নিজের মাকে খুব ভালোবাসে সুফিয়ান৷ যেতে ইচ্ছে না করলেও মায়ের টানে যেতেই হবে ভেবে, কার্ডের নাম্বারটা সেভ করে নিলো। বেডে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে থাকা প্রানেশার হাতটা মুঠোয় নিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে মায়া কন্ঠে বললো –

‘আমার প্রাণেশ্বরী! এই একদিনে যে গভীর মায়ায় আমায় জড়ালে এই মায়া কাটাতে আমার আরও সহস্র শতাব্দীর প্রয়োজন। তুমি কী কখনো অঙ্গার দেখেছো!
অঙ্গার মানে বোঝো? সিগারেট যেমন ধোঁয়া দিয়ে বুকের ভেতরটা জ্বালিয়ে দিতে দিতে অঙ্গারের মতো কালো করে দেয় কিন্তু তারপরও মানুষ সেই নেশায় মত্ত হয়ে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়ে । ঠিক তেমনই আমিও জড়িয়ে পড়েছি তোমার নেশায়। আমি অঙ্গার আর তুমি এই ‘অঙ্গারের নেশা’

সুফিয়ান বের হতেই পাশে থাকা ইভানান সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো –

‘শুরুটা নাহয় তুই-ই করলি, শেষটুকু বরং নিয়তি বোঝাপড়া করুক। প্রানেশা আমাদের নেশা তা ঠিক কিন্তু তার অঙ্গার কে হবে তা রহস্য থাকুক ‘

চলবে

অঙ্গারের নেশা পর্ব-১৬

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৬

‘প্রাণ, যদি শোনো। আমি একজন খুনী, তাহলে তুমি কী আমায় ঘৃণা করবে!’

কথাটা ভীষণভাবে আকুতিভরা টলটলে শোনালো প্রানেশার কানে৷ প্রানেশা সুফিয়ানের ঠিক বাম পাশে হাঁটুতে মাথা দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে ছিলো। খুনের কথা শুনে প্রানেশার হয়তো এই মূহুর্তে আতংকিত হয়ে চেচামেচি করে ওঠার কথা অথচ সুফিয়ানের মায়া চোখের উপর তেমন কিছু বলতে পারলো না। শরীরের অর্ধাংশ বোধ হয় কেঁপে উঠলো। মাথা নাড়িয়ে বললো-

‘নাহ’

সুফিয়ান দুর্বধ্যে হাসলো। প্রানেশার ভেতরের হাসফাস টের পেলো। নির্লিপ্ততা নিয়ে মাথার নিচে দুই হাত ভাজ করে বালির উপর শুয়ে পড়লো৷ প্রানেশার তখন মনে হলো ” এটি সবচেয়ে সুন্দর চিত্র। রংতুলি হাতে থাকলে নিশ্চিত কাঁচা হাতেই একটা পেইন্ট করে ফেলা যেতো৷ এই যে সারা রাত ধরে ঘটা করে প্রবল বৃষ্টি হলো এখন এই ঠান্ডা বাতাসের মাঝে সূর্যর হালকা আলো, কেমন একটা মোমবাতির সোনালী আভার মতোন চিকচিক করছে৷ চিকচিকে সোনালী আভাটা নিজের রং দিয়ে সুফিয়ানকে সাজিয়ে দিতে চাচ্ছে। যদি এমন একটা থমথমে পরিবেশ না হতো, তবে এই মূহুর্তে আমি রোম্যান্টিক বনে যেতাম ” পরমুহূর্তেই ভাবলো ”ধুরর,যতসব উদ্ভট চিন্তা ”

সুফিয়ান সোনালী আকাশটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো আজ সব সত্যি উন্মুক্ত করে দেবে। তারপর যা হওয়ার হোক৷ প্রানেশা যেমন রিয়েক্টই করুক, কিন্তু ছেড়ে চলে যেতে দেবেনা। প্রানেশার দিকে তাকিয়ে বললো-

‘প্রাণ, রেয়ান তোমাকে কখনো ভালোবাসেনি ‘

প্রানেশা বিস্মিত ভঙ্গিতে বললো –

‘কী বলছেন এসব!’

‘আমি মিথ্যা বলিনা প্রাণ, আর একটা কথা কী জানো!তুমিও রেয়ানকে ভালোবাসোনি ‘

প্রানেশা এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। চমকে উঠলো। অস্বীকার করে বললো –

‘আপনি কী করে জানবেন! আমি সত্যিই ভালোবাসতাম ‘

‘হাঃ হাঃ, তুমি খুব বোকা প্রাণ! এখন শোনো তুমি যা এতোদিন জানতে বা দেখতে সেসব কিছু তোমায় দেখানো হয়েছে। এক কথায় তোমার সাথে মাইন্ড কনট্রোল করা হয়েছে ‘

‘মানে! ‘

‘মানে হলো, তোমার জীবনের প্রথম পুরুষ আমিই ছিলাম আর শেষ পুরুষও আমিই থাকবো ‘

প্রানেশা কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। সুফিয়ানের কাছে হামাগুড়ির মতোন দুই হাত এগিয়ে এলো৷ সুফিয়ান আড়চোখে একবার দেখে নিলো প্রানেশাকে। সুফিয়ান নিজের একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দিলো। প্রানেশা সেই বাহুতে নির্দ্বিধায় মাথা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথার উপরে রংবেরঙের দুই একটা বিদেশি পাখি উড়ে বেরাচ্ছে। সূর্যর মতিগতি বোঝা বড় দায়। এই আলো ছড়িয়ে রাজার মতো আকাশকে দখল করছে তো আরেকবার মেঘের ভেলায় মুখ লুকোচ্ছে। সুফিয়ান প্রানেশার গায়ের উপরের ওরনা দিয়ে হাতে পেচিয়ে অযথাই নাড়াচাড়া করতে থাকলো। প্রানেশার উৎসুক দৃষ্টির দিকে তাক করে মনে করলো সেই সময়ের কথা-

‘এবারের প্রথম বিজয়ীর স্থান দখল করেছে ‘সুফিয়ান তেহজিব’ ‘

হাস্যজ্জল মুখভঙ্গিতে স্টুডেন্টদের মাঝে থেকে গিটার কাঁধে স্টেজে উঠে এলো সুফিয়ান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা প্রতিবারের মতো এবারও প্রথম স্থান দখল করে নিলো সে। ট্রফি হাতে নেমে আসতেই বন্ধুরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বন্ধুদের চোখের মণি সুফিয়ান। বাহ্যিক ব্যবহার, কথাবার্তায় মুখভর্তি হাসি, সকলকে সম্মান এসব গুণ সবার চোখে তাকে উঁচু করেছে বহু গুনে৷ বন্ধুদের মাঝে দুইজনকে অনবরত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সুফিয়ান। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফায়েজ সুফিয়ানের চিন্তিত মুখভঙ্গি দেখে বললো-

‘কী মামা! প্রত্যেক বারের মতো এইবারও ছক্কা হাঁকাইলা। এখন কারে খুঁজো? ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –

‘ ইভানান আর রেয়ান ‘

ফায়েজ ভ্রু কুচকে বললো-

‘ইভানান মনে হয় কিছুক্ষণের মাঝেই আইবো। এবারে ওর পেইন্টিংএ সবার নজর পড়সে। ‘ স্টেজের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘আরে ঐ যে দেখ! ‘

সুফিয়ান তাকাতেই দেখলো গ্রিন ফুল হাতা শার্টের হাতা গুটিয়ে ক্লাসিকাল ড্রেসআপে নেমে আসছে তার চাচাতো ভাই ইভানান৷ ছোট বেলা থেকেই দুজনের গভীর বন্ধুত্ব। একজন আরেকজনের প্রাণ। দুইজনের মধ্যে যদি কম্পিটিশন করা হয়, তাহলে বিচারক হিমশিম খেয়ে যাবে। সুফিয়ানের যেমন খাঁড়া নাক, গভীর কালো ঘোর লাগানো চোখ, পেটানো জিম করা বডি, গলায় মধুর সুর। ঠিক তেমনই ইভানানও কোনো অংশে কম নয়,তার আছে নীল সাগরের মতোন দুটি নয়ন, খাড়া কাটা কাটা চুল, ঠোঁটের উপরের খাঁজে একটা তিল সঙ্গে জাদুকরী হাতের আর্ট ৷ কারো সাথে যেন কারো তুলনা করা মুশকিল। শুধু একটা দিকই ইভানানের খারাপ, তা হলো চরিত্রদোষ। সুফিয়ান যেমন কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে ঠিক মতো দেখেনা, সেখানে ইভানান দশ পনেরো বার রুম ডেট করেছে । সুফিয়ানের দিকে এগিয়ে এসে ইভানান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-

‘ভাই! কেমন আছিস ‘

‘এমন ভাবে বলছিস যেনো কয় যুগ পর দেখা হলো!দুইদিন আগেই তো বড় মার সঙ্গে দেখা করে এলাম’

‘তা ঠিক আছে, কিন্ত তোকে দুইদিন না দেখলে সব পানশে পানশে লাগেরে বেটা!’

সুফিয়ান প্রতুত্তরে হাসলো। ফায়েজ সুফিয়ান আর রেয়ানের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। গালে হাত দিয়ে দুইজনের দিকে সন্দেহ নজরে তাকিয়ে বললো-

‘কী ব্যাপার বলতো! তোরা দুইদিন আলাদা থাকতে পারোস না। এই! তোদের দুইজনের আবার সমস্যা টমস্যা নেই তো!’

সুফিয়ান আর ইভানান ইচ্ছেমতোন কিল ঘুষি মারলো ফায়েজের পিঠে৷ তারপর তিনজন একসাথে হেসে উঠলো৷ তাদের ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক বড় হলেও তিনজন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কারণ বন্ধুত্বের শুরুটা স্কুল জীবনের। তিনজন যখন হাসি ঠাট্টায় মত্ত তখন হঠাৎ করে একটা ছেলে এসে সামনে দাঁড়ালো। হাতে এইচ. জি ওয়েলসের ‘ইনভিসিবল ম্যান’ বইটি৷ ঢোলা একটা প্যান্ট, চিকন কোমড়ের থেকে খুলবে খুলবে ভাব। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভোঁতা নাক, গোলগাল মুখের সামনে থেকে বই সরাতেই সুফিয়ান আর ইভানানের দিকে তাকিয়ে বোকা হেঁসে বললো –

‘ কংগ্রাচুলেশনস, সুফি ভাই, ইভ ভাই ‘

সুফিয়ান হেসে ছেলেটার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো৷ ভাইটা তার বড্ড সহজ সরল। প্যাচগোছ বোঝে না। কেউ তার উপর জোড়দাঁড়ি করলেও বুঝি রাগ করবেনা। চুপচাপ মেনে নেবে৷ সারাদিন বই হাতে ঘুরে বেড়ায়। বইটা হাত থেকে নিয়ে ইভানান বললো-

‘হুহ! তুই কীরে রেয়ান! এই সারাদিন শুধু বই হাতে ঘুরে বেড়াস। এমন করলে চলবে, একটু কথাবার্তাও বল’

রেয়ান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসলো৷ সুফিয়ান আর ইভানানের সম্পূর্ণ বিপরীতে রেয়ান। চেহারা একবারে খারাপ না হলেও সুন্দর বলা যাবেনা। ছোট বেলা থেকেই সহজ সরল বোকাসোকা। যে যা বোঝায় তা-ই বোঝে। কিন্তু খুব বেশি একটা কথা বলে না। একা একা থাকে, বই পড়ে ৷ স্মার্টনেসের ধারের কাছেও নেই। পিছনে থেকে জয় এলো আড্ডায় সামিল হতে। জয় খুবই ঠোঁট কাটা স্বভাবের। কোন পরিস্থিতিতে কী কথা বলতে হয় তা বোঝে না, ত্যাড়ামি করে। কারো পিঠপিছে কিছু বলেনা, একদম স্রেইট ফরওয়ার্ড। রেয়ানের হাতে সবসময়কার মতোন বই দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো, গায়ের ঢোলা টিশার্ট একবার ফাজলামো করে টেনে দিয়ে রেয়ানের কাঁধে হাত রেখে তীর্যক ব্যাঙ্গ করে বললো –

‘রেয়ান, কিছু মনে করিস না। বড় ভাই হিসেবে বলি শোন। এই যে এমনিতেই মুখের গড়ন বেশি ভালো না। তার উপর আবার এমন মেয়েদের মতোন এই চশমা ঢোলা জামা কাপড় পড়িস। এমন হলে তো বউ পাবি না! আমরা সবাই বিয়ে করবো কিন্তু তোকে বিয়ে দেয়া লাগবে!’ বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। প্রথমের কথা গুলোতে তেমন কিছু না বললেও পরের কথাটা ঠিক বুঝতে পারলো না রেয়ান। বোকার মতো করে জিজ্ঞেস করলো ‘ আমাকে বিয়ে দিতে হবে মানে!’

জয় আবারও হাসলো। রেয়ানের মাথায় চাটি মেরে বললো- ‘গাধারে! এর মানে হচ্ছে আমরা বিয়ে করে বউ ঘরে আনবো। আর তোকে ঘরজামাই করে বউয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে ‘

সবাই হাসত হাসতে গড়াগড়ি খেলেও সুফিয়ান কড়া কন্ঠে বললো –

‘জয়! আমি বলেছি না, এভাবে রেয়ুর সাথে কথা বলবি না। সবার নিজের একটা আলাদা ব্যাক্তিত্ব থাকে। রেয়ু যদি এভাবে কম্ফোর্ট ফিল করে তাহলে আমাদের এতো সমস্যা কোথায়! ‘

সুফিয়ান থাকতে চাইলেও সবাই টেনে নিয়ে গেলো ক্যান্টিনে। রেয়ান সবসময়ই এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে অভ্যস্ত । কিন্তু আজকের অপমানে ভেতরটা তেঁতো হয়ে উঠলো। সবকিছু চুপ করে সয়ে নিয়ে লাইব্রেরিতে যেতে নিলে দুইজনের ফিসফিস কানে এলো –
‘দেখসোস, কেমনে বোকা পাইয়া মদন বানায় রাখে ওরে! ‘
অপরপক্ষ থেকে একটা মেয়েলি ধ্বনি বললো-

‘ তা আর বলতে! আহারে বেচারা। সুফিয়ান আর ইভানান দুইজন তরতর বেগে উপরে উঠছে আর ওকে বোকা পেয়ে অবিচার করে যাচ্ছে ‘

রেয়ান কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলো। ভেতরের এতদিনকার আত্মবিশ্বাস নড়েচড়ে গেলো। চোখে বোধ হয় পানি জমছে৷ নাহ, সবাই ঠিকই বলে তার স্বভাবে মেয়েলিপনা আছে৷ তা-ই বোধহয় কেউ তাকে দুই পয়সার মূল্য দেয়না৷
_____________

‘জানো প্রাণ, আমরা সবাই মুভি দেখার সময় শুধু একজন ভিলেনকে দোষারোপ করি। তাকে গালমন্দ করি কিন্তু একবারও চিন্তা করিনা, সেই মানুষটার ভিলেন হওয়ার পেছনে থাকতে পারে এক বিস্তৃত ঘটনা। থাকতে পারে এক কষ্টদায়ক অতীত। শুধু প্রেম জীবনে প্রত্যাখ্যান পেয়েই যে কেউ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে তা কিন্তু নয়, আশেপাশের মানুষের কটু মন্তব্যই যথেষ্ট একজনকে ডিপ্রেশনে ঠেলে দিতে। মানুষ যদি তার মুখের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতো তাহলে, কারো নিজের জীবনের প্রতি এতো অনীহা জাগতো না! ‘

চলবে……

অঙ্গারের নেশা পর্ব-১৫

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৫

আপন মানুষের হঠাৎ বদলে যাওয়া আমরা কখনোই মেনে নিতে পারিনা। আমরা ভরকাই, চমকে যাই, হতবাক হই। আর তা যদি নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ ‘স্বামী ‘ নামক মানুষটি৷ তাহলে, আঘাতের পরিমাণ হয় আরও দগদগে। ভেতরে ভেতরে আঘাতের চিহ্ন বাড়তে থাকে। এক সময় গিয়ে সম্পর্কটাই হয়ে যায় ঠুনকো। সম্পর্কের পিলার গুলো যেনো ধ্বসে পড়ে।
তিন ঘন্টা আগের ঘটনায় মানসিক ভাবে থমকে গিয়েছিলো প্রানেশা। হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো সুফিয়ানের ভয়াবহ রূপে। সবেমাত্র ভালোবাসতে শুরু করেছিলো সে। কিন্তু সুফিয়ানের ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান ঘর থেকে তখনই বেরিয়ে গেলো। তিন ঘন্টায় একবারও আসেনি। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কিছুসময় পরই জ্ঞান ফিরে প্রানেশার। থরথর করে কেঁপে উঠলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ঘরের দরজা বন্ধ। মনে মনে ভাবলো পালিয়ে যাওয়ার কথা।
দ্রুত উঠে দরজা খুলতে নিতেই দেখলো ঘরে দরজা বাহির থেকে লাগানো। দুই একবার হাত দিয়ে বাড়ি দিলো। কেউ নেই বোঝাই যাচ্ছে। তাছাড়া এই সময়টায় সবাই সাগরের পাড়ে থাকে। বুঝে গেলো সুফিয়ান তার যাওয়ার পথ বন্ধ করেই গেছে। ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে প্রানেশা ভয়ানক এক সিদ্ধান্ত নিলো। চোখ মুছে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিলো। এখানে থেকে লাফিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। নিচের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘ এখানে থেকে লাফ দিলে বালুর উপর পড়বো, খুব বেশি একটা ব্যাথা পাবো বলে মনে হয় না ‘

মনে মনে সাহস নিয়ে চোখ বন্ধ করে জানালার উপর দাঁড়িয়ে এক পা বাহিরে দিতেই পেছনে থেকে সুফিয়ান টেনে নিচে নামিয়ে ফেললো। প্রানেশা চমকে উঠলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আগের মানুষটাই কিন্তু চোখ মুখের ভাষা আলাদা।কয়েক ঘন্টা আগেই মুখে হিংস্রতা নিংড়ে পড়ছিলো। অথচ, এখন মুখটা ভীষণ অসহায়ের মতো। চোখে টলমল করছে ৷ সুফিয়ান বুক ওঠানামা করছে। দেখে মনে হয়, খুব ভয় পেয়ে আছে ৷ প্রানেশার হাত মুখ ভালো করে চেক করে প্রানেশাকে বিছানায় বসালো।প্রানেশা মনে মনে ভয় পাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই পাগলের মতোন ব্যবহার করছিলো অথচ এখন কেমন শিশুর মতো আচরণ। সুফিয়ান হাঁটু গেড়ে বসে প্রানেশার কোলের উপর মাথা রাখলো। হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অজস্র চুমু খেলো। প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ান ফুঁপাচ্ছে। প্রানেশার না চাইতেও মায়া হলো৷ হাতে কবজিতে ভেজা অনুভব হতেই এক হাত সরিয়ে সুফিয়ানের মাথায় রাখলো। সুফিয়ান প্রানেশার কোল আরও শক্ত হাত ধরে বললো-
‘এমন আর কক্ষনও করবেনা প্রাণ! আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার সব হারিয়েছি।কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে আমি মারা যাবো প্রাণ। চলে যাওয়ার আগে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিও।তোমাকে হারিয়ে বাঁচা সম্ভব নয় ‘

প্রানেশা এবার বুঝতে পারলো। জানালার উপর দাঁড়িয়ে থাকায় সুফিয়ান ভেবেছে সে আত্মহত্যা করতে চাইছিলো৷ কিন্তু, মুখে কিছু বললো না। কারণ এটাই সুযোগ সত্যি জানার। মুখে গম্ভীরতা নিয়ে বললো-
‘ কিন্তু আপনার মতো একজন মানুষের সাথে একসাথে সংসার করা সম্ভব না। ‘

সুফিয়ান বোধ হয় কয়েক বছর পর কাঁদল। সেই সময়ের কান্নার কারণও ছিলো তার প্রাণ আজও তাই।
প্রানেশার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-

‘ক্ষমা করে দাও প্রাণেশা। আমি ভীষণ রেগে গেছিলাম। আমি ভয়ে ছিলাম, যদি সত্যি শুনে তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাও!’

প্রানেশা সন্দেহ গলায় বললো –

‘এমন কী করেছেন আপনি? যা শুনলে আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো!’

সুফিয়ান নিষ্প্রাণ হয়ে বসে রইলো। দৃষ্টি নিচের দিকে। অপরাধীর মতোন মুখ থমথমে। প্রানেশা চুপ করে থেকে বললো-

‘ আপনি যদি আমায় আর ধোঁয়াশায় রাখেন আমি ছেড়ে চলে যাবো, আজই সব সত্যি বলবেন আপনি। আপনাকে আমার কসম’

সুফিয়ান চমকে উঠলো। হাত সরিয়ে বললো-

‘কসম করা গুণাহ প্রাণ! এসব আর বলবেনা ‘

‘ঠিক আছে। কিন্তু আপনি আজই সব সত্যি বলবেন ‘

সুফিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বললো-
‘বলবো প্রাণ, সব বলবো। তুমি নিজের কোনো ক্ষতি করবে না। ‘

‘হুম’

সুফিয়ান আসার সময় খাবার নিয়ে এসেছিলো। হাতের পাস্তার প্লেটটা নিয়ে এক চামচ নিয়ে প্রানেশার মুখের সামনে নিয়ে বললো-

‘ আগে খাবারটা খাও, বিকেল হয়ে এলো । সকালেও কিছু খাওনি ‘

প্রানেশা বললো-
‘কিন্তু, সত্যিটা!’

‘বলবো,আগে খাও। তারপর ‘

‘আচ্ছা ‘

অর্ধেকটা খেতেই প্রানেশার মনে পড়লো সুফিয়ানও সকাল থেকে কিছু খায়নি। সুফিয়ান চামচ আবার মুখের সামনে ধরলে প্রানেশা বললো-

‘ আপনি খেয়েছেন?’

সুফিয়ান মলিন হেসে বললো –

‘আমি পরে খেয়ে নেবো ‘

প্রানেশা জেদি গলায় বললো –

‘না না, পেট ভরে গেছে। এটুকু আপনি খান ‘

সুফিয়ান হাত নিচে নামাতেই প্রানেশা খেয়াল করলো বাম হাতে সাদা ব্যান্ডেজ করা। হালকা ছোপ ছোপ রক্ত। প্রানেশা বললো-

‘এটা কী করে হলো?’

সুফিয়ান নিজের মুখে অল্প পাস্তা পুড়েছিলো। হাতের কথা শুনে চিবোতে চিবোতে বললো-

‘ যে হাত তোমায় আঘাত করে সে হাতকে আমি কী করে অক্ষত থাকতে দেই প্রাণ! ‘

প্রানেশা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো-

‘আপনি নিজেকে ইচ্ছে করে আঘাত করেছেন! ‘

সুফিয়ান হেসে উঠে চলে গেলো। প্লেট রেখে বললো-

‘চলো প্রাণ, আজ তোমার মনের সকল কৌতুহল, প্রশ্ন মেটাবো ‘

প্রানেশার হাত ধরে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে গেলো। প্রানেশা সমুদ্র থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান গম্ভীর স্বরে বললো –

‘প্রাণ, তোমার ওয়াটার ফোবিয়া কী জন্মের পর থেকেই?’

‘নাহ,আমার জীবনের এক দূর্ঘটনায় এই ফোবিয়ার সৃষ্টি হয়’

সুফিয়ান প্রানেশার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘ সেটা শুধু তোমার জীবনের দূর্ঘটনা ছিলো না প্রাণ। আমার জীবনেরও একটা ঘটনা, সেটা না হলে হয়তো আমি তোমায় পেতাম না ‘

প্রানেশা হা করে থেকে বললো-
‘মানে! ‘

‘দূর্ঘটনাটা ঠিক কীভাবে, কোথায় হয়েছিলো মনে আছে তোমার? ‘

প্রানেশা বলতে শুরু করলো আজ থেকে চার বছর আগের ঘটনা-

‘ তখন আমার পরীক্ষার পর ছুটি চলছিলো। বয়স সবে মাত্র ১৭ বছর হয়েছে। সব বান্ধবীরা ঠিক করলাম পিকনিকে যাবো।সেখানে তিন দিনের দিন, নৌকা ভ্রমণে, হঠাৎ নৌকা থেকে আমি পড়ে যাই। সাঁতার না জানায় আরও ভয় পেয়ে যাই। তারপর কে বা কারা আমায় উদ্ধার করেছে আমি জানিনা, হুঁশ ফিরতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে পাই ‘
কিছুটা থেমে বললো-‘ব্যস, এখানেই শেষ ‘

সুফিয়ান পাড়ের কিনারায় বসে আছে। উত্তাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘শেষ নয় প্রাণ। সেটা শুরু ছিলো, এক রক্তাক্ত ইতিহাসের শুরু, গল্পের শুরু। এক ভয়ংকর প্রেমের শুরু। ‘

তারপর প্রানেশার দিকে পেছনে তাকিয়ে বললো-

নীল সমুদ্রের কোলে করে এলে তুমি ভেসে,
মুখখানা ঢেকে ছিলো তোমার এলোকেশে।
ভালোবাসার গহীন কোণে হারিয়ে আমি আজ,
খুঁজে ফিরি বনে বনে তোমার নামের সাঁঝ।
আকাশেতে তারার মেলা, অঢেল আলোর ঘর
আজও ওঠে বুকের মাঝে তুমি নামক ঝড়।

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা পর্ব-১৩+১৪

0

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৩

প্রানেশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সুফিয়ান। এই পনেরো মিনিট যাবৎ অনবরত হিচকি তুলে কান্না করেছে প্রানেশা। এখন মনে মনে নিজেকেই বকছে সুফিয়ান। প্রানেশার ওয়াটার ফোবিয়া আছে৷ এই কথাটা সুফিয়ানের মনে ছিলো না। নিজের প্রতি এত রাগ কখনো লাগেনি যতটা আজ লাগছে। প্রানেশার ভয় আপাতত কাটাতে হবে ভেবেই প্রানেশাকে উঠিয়ে বসালো। প্রানেশার মুখ লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে হালকা ছোঁয়ালেই টুপটুপ করে রক্ত বের হবে। সুফিয়ান নিজের হাত দিয়ে যত্ন করে মুখ চোখ মুছিয়ে দিলো৷ প্রানেশাকে পানি খাইয়ে দিয়ে জড়িয়ে রাখলো বাহুডোরে৷ প্রানেশা ঠোঁট উল্টে বললো-‘আপনি আমায় ভয় দেখাচ্ছিলেন? ‘

সুফিয়ান প্রানেশার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বললো-
‘না প্রানেশ্বরি, রুকি সত্যিই দ্রুত চলে৷ এখন আমি বলায় ধীরে চালাচ্ছে। ‘

প্রানেশা চুপ করে বুকের সাথে লেপ্টে আছে৷ সুফিয়ান বললো-
‘প্রানেশ্বরি, এভাবে চললে তো দ্রুত পৌঁছাতে পারবো না। ‘

প্রানেশা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো৷ সুফিয়ান মৃদু হেসে বললো –
‘ভয় পাচ্ছো কেন? এক কাজ করো তুমি শক্ত করে আমায় ধরে রাখো তো। আর যা ইচ্ছে প্রশ্ন করো ‘

প্রানেশা প্রশ্ন করতে পছন্দ করে। তাই সুফিয়ান ভয় ভুলাতে এই কথা বললো। সুফিয়ান হাত দিয়ে ইশারা করতেই রুকি আবারও দ্রুত চলতে শুরু করলো। নরমাল যে কেউই রুকিতে ভীষণ উপভোগ করবে। নীল সমুদ্রের জলের স্নিগ্ধ ফোঁটাগুলোকে মুক্তর দানা মনে হবে। কিন্তু এসবের কিছুই দেখতে পারলো না প্রানেশা। তার যে সাধারণ কোনো ফোবিয়া নয়। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো ‘যদি সেই ঘটনাটা আমার সঙ্গে না ঘটতো, তাহলে আমি হয়তো আজ সবকিছু উপভোগ করতে পারতাম’ এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরও শক্ত করে ধরে রাখলো সুফিয়ানকে৷

সুফিয়ানকে হঠাৎই একটা উদ্ভট প্রশ্ন করতে মন চাইলো প্রানেশার। চট করে বললো –

-‘ আপনি আগে কারো প্রেমে পড়েছিলেন?’

সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো-
-‘হঠাৎ এই প্রশ্ন? ‘

-‘আপনি কিন্তু বলেছেন সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন! ‘

-‘হুম, তবে শোনো আমি এক এলোকেশীর প্রেমে পড়েছিলাম কয়েক বছর আগে ‘

প্রানেশার মুখ কালো হয়ে গেলো। ভালো না বাসলেও সুফিয়ান তার স্বামী। মেয়েরা সব ভাগ করতে পারলেও স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে চায়না। এ যেনো একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষ। প্রানেশার মনে কিছু একটা চিনচিন করে উঠলো৷ ভাবতেই কষ্ট হলো, তার আগে এই বুকে অন্য কারো স্থান ছিলো। ভালোবাসাটা অন্য কারো নামে ছিলো। ধুপ করে মনে এলো, রেয়ানকে যখন প্রানেশা জড়িয়ে ধরেছিলো তখনও কী সুফিয়ানের এমন কষ্ট হয়েছিলো৷ নাহ, হয়তো আরও বেশী হয়েছে। ভাবতেই বুক ভারি হয়ে এলো। নাহ আজ থেকেই সবকিছু নতুন করে শুরু করবে। বালিতে আসার মূল কারণ তো এটাই ছিলো।এক ঘন্টার মাঝেই পৌঁছে গেলো দুজন। পৌঁছাতেই প্রানেশাকে ধরে নামালো সুফিয়ান। প্রানেশাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটা শুরু করলো।

দ্বীপটা খুবই নিরিবিলি, শান্ত। মানুষ জন কম হওয়ায় হেঁটে শান্তি পাওয়া যায়। এমন পরিবেশে সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দিলেও প্রানেশার কোনো আপত্তি থাকবে না। এখানে অনেকগুলো সুন্দর রিসোর্ট ও ভিলা আছে। ‘হারতা লেম্বগান ‘ নামক ভিলায় উঠলো সুফিয়ান ও প্রানেশা। সুফিয়ান প্রানেশাকে রুমে পাঠিয়ে বললো এক ঘন্টা পরই আসবে। সুফিয়ান মূলত সিকিউরিটি গার্ডদের আরও কড়া ভাবে নজর রাখতে বলার জন্য গেলো৷ প্রানেশা রুমে ঢুকতেই দেখলো রুমটা থেকে কাছেই সমুদ্র দেখা যায়। কিছুক্ষণ ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করে গুনগুন করে ওয়াশরুমে গেলো শাওয়ার নিতে।

ক্লান্ত হয়ে টাইয়ের নাট ঢিলে করতে করতে রুমের দরজা খুলতেই হা করে তাকালো৷ একি!রুমে একফোঁটা আলোও নেই৷ প্রানেশা এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে কী করছে! হাত দিয়ে খুঁজে খুঁজে দেয়ালের সুইচবোর্ডে সুইচ চেপে লাইট জ্বালালো৷ সাথে সাথেই অবাক হয়ে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো৷ এসব কী! বিছানায় লাভ শেইপ করে গোলাপের পাপড়ি৷ আশেপাশে কয়েকটা ক্যান্ডেল লাইট।সুফিয়ান ঘরের লাইট বন্ধ করতেই ঘরে হালকা মোমের আলো নিজের শোভা ছড়ালো৷ এসব তবে, তার প্রাণ করেছে! ভাবতেই মনে খুশির জোয়ার বইলো । এতদিনের অতি প্রত্যাশিত মেয়েটিই তাকে আজ এতো বড় সারপ্রাইজ দিলো, ভেবে মুখে হাসি ফুটলো৷

কিছুদূর এগিয়ে দেখলো প্রানেশাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে৷ এখানে আরও বড় শক খেলো যখন দেখলো, প্রানেশা নাইটি পড়েছে। তাও হাটুর একটু নিচ পর্যন্ত, পিঠের অর্ধেকের বেশি দেখা যাচ্ছে। হায় আল্লাহ! এ তো তাকে পাকাপোক্ত ভাবে মারার প্ল্যান। ঘাম ছুটে গেলো সুফিয়ানের। শুকনো ঢোক গিলে প্রানেশার কাঁধে পেছনে থেকে হাত রাখতেই প্রানেশা সামনে ফিরলো৷ মাতালের মতন হাসতেই সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো- ‘আর ইউ ড্রাংক প্রাণ?’

প্রানেশা বাচ্চাদের মতোন মাথা নাড়িয়ে বললো-
-‘হুম,বেশী না একটুউউ’

সুফিয়ান বড় বড় চোখ করে বললো-
-‘ ড্রিংকস কোথায় পেলে তুমি? ‘

প্রানেশা খাটের নিচে থেকে একটা ওয়াইনের বোতল বের করে গর্বের হাসি দিলো, এ যেন খুবই গর্বের একটি কাজ। হাসতে হাসতে বললো-
-‘ কিছুক্ষণ আগেই একজন ওয়েট্রেস এটা দিয়ে গেলো৷ ‘ তারপর বাচ্চাদের মতো করে ঠোঁট উল্টো করে বললো-‘বিশ্বাস করুন, আমি চাইনি এটা খেতে। কিন্তু এইযে বোতলটা বারবার খালি বলছিলো ‘একটু খেয়ে দেখো, ভীষণ টেস্ট ‘ আমি কী করবো! একটু খেয়ে নিলাম ‘

সুফিয়ানের মাথায় হাত! এ কী সর্বনাশ! এমনিতেই কথার চোটে কান ঝালাপালা করে দেয়। এসব খেয়ে সারা রাত আর ঘুমাতে দেবে না। চিন্তিত ভঙ্গিতে এসব ভাবতেই হঠাৎ দেখলো, প্রানেশা তার পায়ে পা রেখে গলা জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা হয়তো খুব বেশি একটা মাতাল হয়নি। জ্ঞান আছে এখনো ভালোই। হালকা নেশা নেশা কন্ঠে বললো-
‘আপনি এতো সুন্দর কেনো?’

সুফিয়ান হা করে তাকিয়ে আছে। তাকে আরও অবাক করে প্রানেশা সুফিয়ানের এডামস এপেলের নিচের সেই তিলটায় গাঢ় ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো৷ সুফিয়ানের পুরো শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো৷ ভেতরে ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে টের পেতেই সুফিয়ান বললো-

‘এমন করেনা লক্ষ্মীটি!তুমি এখন হুঁশে নেই। পরে পস্তাবে, চলো ঘুমাবো’

প্রানেশা কথায় তেমন গুরুত্ব দিলো বলে মনে হয় না। সে সুফিয়ানের আর মাঝের হালকা দুরত্বটুকুও ঘুচিয়ে আরও কাছে এলো।ছোট বাচ্চার ন্যায় আবদার করলো-
‘ আমি আপনার ঠোঁটটা খাই?’

সুফিয়ান কড়া কন্ঠে বললো –
‘চুপ! চলো ঘুমাবে। ঠোঁট কোনো খাওয়ার জিনিস নয় ‘

প্রানেশা জেদ করার ভঙ্গিতে বললো –
‘নাহ, আমি খাবো৷বেশী না একবার, সত্যি বলছি

সুফিয়ান নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। শেষ বারের মতো বললো-

‘এমন বলতে নেই প্রাণ, ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে ‘

প্রানেশা গলা জড়িয়ে গা এলিয়ে দিতেই সুফিয়ান পাঁজা কোলে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে উন্মাদের মতো গলায় চুমু খেতে লাগলো। প্রানেশা হালকা হলেও হুঁশে
আছে। ছোঁয়ায় লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান পেছনে ফিতা খুলতে নিলেই প্রানেশা লজ্জায় মাথা নেড়ে না বললো৷ সুফিয়ান অধর কোণে হেঁসে বললো –

‘আমি তো বলেছিলাম প্রাণেশ্বরী, এখন না করলেও আমি যে শুনবোনা ‘

সারা রাতের ভালোবাসায় প্রানেশার সত্যিই মনে হলো তার ভুল হলো, বিশাল ভুল, সর্বনাশা ভুল।

চলবে……

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৪

মেঘ জমতে জমতে ঘন এক আস্তরণ ফেলেছে আকাশের বুকে ৷ হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নিকষ কালো আধার জাপটে ধরেছে আলোকে ৷ যেনো কোনোভাবেই আলোকে পৃথিবীর বুকে যেতে দেবেনা। আলো প্রাণপণে চেষ্টা করছে বিধায় এখন অব্দি হালকা আলোর রেশ দেখা যাচ্ছে। বাতাসের ধাক্কায় রুমের পর্দা ভেদ করে রুমটাকে শীতল করে দিয়েছে।

সুফিয়ান চোখ খুলে কোনোমতে জানালাটা বন্ধ করে দিলো ৷ ঘরে বাতি নিভানো থাকায় ঝাপসা লাগছে সবকিছু । ঘুমের ঘোর একটু হালকা হতেই খেয়াল হলো প্রানেশার কথা। হাত দিয়ে পাশ হাতরাতেই দেখলো পাশের জায়গাটা খালি পড়ে আছে । ভ্রু কুচকে এলো৷ গায়ের চাদরটা ভালো করে টেনে উঠে চোখ কচলিয়ে আশেপাশে তাকালো। চোখ পড়লো সদ্য স্নান করে বের হওয়া প্রানেশার দিকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছচ্ছে। গায়ে সুতির হলুদ শাড়ি। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িতে রুপবতী লাগছে খুব। এতদিন বিয়ে হলেও বউ বউ ভাবটা আজ এসেছে। সুফিয়ান নিজ মনে হাসলো৷ পাশে থেকে টাওয়ালটা গায়ে পেচিয়ে প্রানেশার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রানেশা আগেই সুফিয়ানকে উঠতে দেখেছে৷ কিন্তু কাল রাতে করা নিজের কান্ডে লজ্জায় আর কথা বলার সাহস করেনি৷ চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে চুল মুছে নিচ্ছিলো৷ সুফিয়ান লজ্জাটা বুঝে নিলো। চুলের পানিতে ভিজে থাকা পেটটায় হাত ছোঁয়ালেই প্রানেশা ছিটকে সড়ে গেলো। সুফিয়ান এখনো একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশাকে সরতে দেখে প্রানেশার হাত ধরে কাছে নিয়ে এলো। হালকা রাগ কন্ঠে বললো-
‘ আমি কাছে এলে কখনো সরবেনা প্রাণ ‘

প্রানেশা চোখ তুলে তাকালো। সুফিয়ান হেসে বললো –
‘আরে! তুমি কী সিনেমার নায়িকা নাকি হ্যা! অত লজ্জা পেতে হবেনা ‘

প্রানেশা চোখ নামিয়ে ফেললো৷ সুফিয়ান প্রানেশাকে ঘুরিয়ে পেছনে থেকে জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখলো৷ অদ্ভুত ভঙ্গিতে বললো –
‘শুরুটা যদিও সিনেম্যাটিক ছিলো, কিন্তু শেষটা বাস্তব দিয়ে হবে। ইউ হ্যাভ টু রেডি ফর এভরিথিং ‘

প্রানেশা কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে বললো –
‘মানে?সিনেমা! বাস্তব, এসব কী বলছেন? ‘

সুফিয়ান মৃদু হেসে বললো –
‘কিছু না প্রানেশ্বরী, যে যাই বলুক তুমি শুধু আমায় ভরসা করবে। বাকি সবকিছুর সঙ্গে আমি লড়াইয়ের করবো ‘ কিছুটা থেমে বললো-

‘ আমি শাওয়ার নিয়ে আসি তুমি কল দিয়ে খাবার অর্ডার করে নাও যা ইচ্ছে ‘

প্রানেশা তাকিয়ে রইলো সেদিকে। সুফিয়ানকে সে মেনে নিয়েছে এখন তো ভালোবেসেও ফেলেছে কিন্তু তাই বলে রহস্য উন্মোচনের ইচ্ছেটা এখনও বহাল৷ মনে মনে বারবার নানান চিন্তা ভাবনা আসে। সত্যি মিথ্যার এক গভীর জালে আটকে গেছে তা বুঝতে পারছে প্রানেশা। এতটাও বোকা নয় সে। কাউন্টারে কল দিয়ে খাবার অর্ডার দিলো৷ চুপ করে কিছু ভাবছিলো সে এমন সময় মোবাইলে একটা কল এলো৷ প্রানেশার কপালে ভাজ পড়লো। মনে মনে বললো ‘ এয়ারপোর্ট থেকে তো সিম চেঞ্জ করে দিয়েছে,এই নাম্বার তো কারো কাছে নেই। তাহলে কে কল করলো!’
কিছুটা সময় নিয়ে রিসিভ করেতেই কানে ভেসে এলো
আদুরে লাইন –
‘ কেমন আছেন স্রোতস্বিনী? ‘

‘কে বলছেন? ‘

‘আপনার কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী ‘

‘ মানে! ‘

‘শুভাকাঙ্ক্ষী মানে বোঝেননি! আপনার ভালো চাই আমি ‘

‘ আমি ভালোই আছি। আপনাকে আমার ভালো চাইতে হবে না। ‘

‘আপনি কতটুকু ভালো আছেন আমি জানি। আপনি যাতে আগামীতেও ভালো থাকেন সেটাই চাই আমি। কিন্তু যার সাথে থাকছেন সে কতটুকু আপনাকে ভালো রাখবে তা সম্পর্কে আপনার কিছুটা জানা প্রয়োজন ‘

প্রানেশা অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। পরিচয় না দিয়ে কীসব কথা বলে যাচ্ছে। প্রানেশা রেগে বললো –
‘সমস্যা কী আপনার?কী বলতে চান সরাসরি বলুন ‘

‘শুধু এতটুকুই বলবো আপনি যার সাথে সংসার করছেন তিনি কতটা বর্বর, নিষ্ঠুর! ‘

‘মানে!’

‘হাঃ হাঃ, এখনো বুঝতে পারেননি। অবশ্য বুঝবেনই কীভাবে? ভালো মানুষির মুখোশ যে লাগিয়ে রেখেছে, ঐ সুফিয়ান একজন হ…..

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই কে যেনো ফোনটা কেড়ে নিলো৷ সামনে তাকাতেই দেখলো সুফিয়ান রক্ত চোখে তাকিয়ে আছে । প্রানেশা প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো। সুফিয়ান ফোনটা সজোরে আছড়ে ফেলে পা দিয়ে পিষে গুড়ো গুড়ো করে দিলো। প্রানেশার গাল শক্তি দিয়ে চেপে ধরলো। খশখশে গলায় চিৎকার করে বললো-
‘ কোন সাহসে পরপুরুষের সাথে কথা বলছিলি!’

প্রানেশা ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বের বের করতে পারছিলো না। সুফিয়ান ঘাড় বাকিয়ে সেই প্রথম দিনের ন্যায় হেসে বললো –
‘তুমি কী জানো প্রাণ? এর শাস্তি কতটা ভয়ংকর হতে পারে! ‘

প্রানেশা চোখভরা বিস্ময় নিয়ে বললো-

‘ কে আপনি? আপনার আসল পরিচয় কী? ‘

সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গেই প্রানেশার গালে চড় বসিয়ে দিলো। প্রানেশা হতভম্ব হয়ে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো। তার মস্তিষ্ক বোধ হয় সুফিয়ানের আসল রূপটা মেনে নিতে পারলোনা।

চলবে…