ইয়াতিম শিকদার আর তার বড় ছেলে তারেক শিকদার একসাথে বাড়িতে ঢুকল। তারেক শিকদার বড় ফুফু কে দেখতে পেয়েই কুদুমবসী করলেন। সাথে সাথে তার বউ সায়মা ও। নিয়াজ ফিটফাট সেজে পিছনে এসে দাঁড়াল। বড়ফুফু চোখ রাঙিয়ে প্রশ্ন করলেন, ”ভালোই তো সেজেগুজে এসেছিস। শরম লজ্জা কি নাই তোর।
বে/হায়া হাবলার মতো চলে এলি?” ইয়াতিম শিকদার জবাব দিতে চাইলেন তবু দিলেন না। দাঁত কেলিয়ে হাসলেন। নিয়াজের ভাবভঙ্গি ও তেমন। বড় ফুফুর কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলো। ছোট ফুফু এসে বড় ফুফুর কানে কানে বলতে লাগলেন, “আস্তে বলেন আপা। সবার সামনে এসব কি বলেন? আর যতই হোক, ও তো আমাগো নিজের বংশের!”
বড় ফুফু হুং/কার দিয়ে উঠ’লেন। বললেন, ”কি আমাদের বংশের! আমাদের বংশের এমন
জানো/য়ারের মতো কে করেছিলো বল তো? দেখছিস কখনো কেউ আমাদের বাবার দিকে আঙ্গুল তুলতে। আর আজকের দিনটা দেখ একবার!” ছোট ফুফু কথা বাড়ালেন না। তার শশুড়র অনেক লোকজন এখানে। তিনি কিছু বললে বড় ফুফু শান্ত হওয়া তো দূর আর
গ/র্জে উঠবেন। তাই কিছু নাই বলা ভালো। ইয়াতিম শিকদার এবারও হাসলেন। ভাবছেন, “হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে”। কথা শুনে হজম করা ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। নিয়াজের ঘাড় চেপে ধমকের সুরে বললেন, “ দাঁড়াইয়া আছোস কেন ব্যাটা? যা! কুদুমবসী কর ফুফুরে। আদব কায়দা সব ভুইলা গেছোস?”
বড় ফুফু আবারো বললেন, “শুধু আদব কায়দা। এর সাথে সবকিছুই ভুলছে। হারাম/জাদা!” বড় ফুফুর আচরণ অত্যন্ত কঠোর। কথায় কথায় গালা/গালি করা তার চাই। শুধু তাই নয়, তার সাথে উচিত কথাও বলবেন। গোলমালের শব্দ শুনেই আরিফ হাসান ছুটে এলেন। তার পিছনে পিছনে ফরহাত, রুদমিলা,শ্রেয়মী সবাই এলো। ফরহাত শ্রেয়মীর কানে ফিসফিস করে বলল, “এই ঠোঁট আর্ট করা লিপস্টিক ছাড়া মহিলা হঠাৎ এমন চেত/ছে ক্যান?”
শ্রেয়মীর ভাইয়ার কানে কানে বলল,”আরে নিয়াজ এসেছে। তাই এমন চেতছে।”
“ভালো কাজ। শুধু বকাবকিতে কি লাভ? ঘাড় ধরে বের করে দিলেই তো হয়!” কথাটা আরিফ হাসানের কানে গেল। তিনি চোখ ঘুরিয়ে ফিরলেন। ফরহাত অন্যদিকে মুখ সরিয়ে বাঁশি বাজাতে লাগল। আরিফ হাসান বড় ফুফু কে শান্ত করিয়ে মেহমানদের ভেতরে বসালেন। যতই হোক এখন তাদের বিয়ানের সম্পর্ক। তারা কুটুম। ভুলে গেলে চলবে না, অর্নিলা তাদের বংশের। কোন দিন যাতে আ/ঙ্গুল তুলে কিছু একটা বলতে না পারে সেসব প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন আরিফ হাসান। শাহিনুর বেগম নিজে ছুটে এসে মেহমানদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। ইয়াতিম শিকদার দাঁড়িয়ে গেলেন আরিফ হাসানের সাথে। তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে হেসে বলতে লাগলেন, ”কি বিয়াইন সাব! এখন আমাদের সম্পর্ক তো এটাই তাই না!”
”যা বলে আপনার শান্তি।”
“কিন্তু বিয়াইন সাব, আপনি কিন্তু ভালো খেলোয়াড়। যখন বিয়ার প্রস্তাব আমি দিলাম তখন কইলেন মাইয়ার বয়স কম, ছোট মানুষ! আর এখন মাইয়া কি ডাঙ্গ/র হইয়া গেলো। একদম বিয়ার লাক!”
”ছিঃ ছিঃ ভাই! এমন বলবেন না। মেয়ে আমার বড় হই নাই,ছোটই আছে। কিন্তু ওর তো একটা মত আছে।নিয়াজ ওর সাথে যা করছে এরপর সেই বিয়েতে তার কোন মত ছিল না। তবে সারফারাজ এর সাথে বিয়েতে তার অমত নেই। আপনি চাইলে জিজ্ঞেস..
কথা শেষ করতে দেয়নি ইয়াতিম শিকদার। অট্টহাসি হেসে বললেন,“ঠিক কইছেন। কিছু বছর পর আপনার পোলা হইবো বড় ডাক্তার। আর আমার পোলা ভাই
জা/ত অশিক্ষিত। থাক থাক,অসুবিধা নাই। মানুষের থাকে দুই হাত ডান হাত আর বাম হাত। এর সাথে থাকে অজুহাত!”
বলেই হাসতে হাসতে ভেতরে চলে গেলেন। আরিফ হাসান অস্বস্তিতে ভুগতে লাগলেন। জলদি জলদি এই বিয়ে মিটে গেলে বেঁচে যায়। নাহলে এই লোক একটা হুল/স্থুল কাণ্ড করে ছাড়বে।
.
কাজী এসে বসে আছে। ডয়িং রুম ভর্তি মানুষ। বিয়ে বাড়িতে গ্যা/ঞ্জাম বেশি। দশজনের দশ মত। সারফারাজ তার লাল খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি পরে সোফার এক কোনে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। ফরহাত এসে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ”কি ব্রাদার! অনেক টেনস লাগছে মনে হচ্ছে। ব্যাপার না! চিল! আজ তো তোমার বাসর রাত ও না।“
সারফারাজ চাপা স্বরে জবাব দিল, “টেনশন হচ্ছে না। রাগ হচ্ছে। রাগ কমানোর চেষ্টা করছি তো নার্ভ কাজ করছে না। না/র্ভাস হয়ে যাচ্ছি।”
“না না, অর্নিলার এতোকিছু মনে থাকে না।আর এভাবেও এখন ও বিয়েতে মশগুল এসব দিকে নজর দিবে না। আর আংকেল যখন আনছে নিশ্চিত কোন চিন্তা ভাবনা আছে।”
সারফারাজ মাথা দুলাল। ফরহাত যতই বলুক ব্যাপার না তবুও তার টেনশন হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনি ওকে দেখে শান্ত থাকতে পারবে না। এখন বাচ্চামি যতই থাকুক তার মধ্যে। অর্নিলা কে সাজিয়ে নিয়ে আসা হলো। নিজের মায়ের শাড়িতে অর্নিলা কে প্রথমবার দেখে খানিকটা হকচকিয়ে গেল সারফারাজ। মনে হলো,অনি কে সে প্রথমবার দেখছে। এর আগে কখনো এমনভাবে দেখে নি। মায়ের লাল রঙের বেনারসীতে অনি কে বেশ মানিয়েছে। কিন্তু বেচারি শাড়ি সামলাতে পারছে না। শাহিনুর বেগম নিজে এসে তাকে বসিয়ে দিলেন সারফারাজের পাশে। সারফারাজ খানিকটা দূরত্ব রেখে বসলো। আরাফাত ছুটে এসে দাঁড়াল সোফার পিছনে। সে আর অনি দুজনেই সমবয়সী। তাকে পিছন থেকে খোঁচা মেরে বলল, “বুড়ি , তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে হি হি!” শ্রেয়মী আর রুদমিলা এসে দাঁড়াল তার পাশে। এরা দু’জনেই এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। সামনে এইচএসসি দিবে। আরাফাতের কথার জবাবে অর্নিলা কিছু বলতে চাইল ওমনি শ্রেয়মী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “চুপ চুপ! নতুন বউ কথা বলে না!” বড় ফুফু এসে দাঁড়ালেন তার পাশে।
অর্নিলা কে দেখে নিয়াজের ভাবি সায়মা শিকদার, হাসতে হাসতে বলে ফেললেন, ”আরে, অর্নিলার তো এখনো আঠারো বছর হয়নি। তা রিটেয়ার বিচারপতি সেই কথা ভুলে গেছেন নাকি? বাল্য/বিবাহ হচ্ছে দেখি?”
আরিফ হাসান সবেমাত্র এক মেহমান কে সোফায় বসিয়ে বললেন, ”সবদিকেই আমার নজর থাকে বউমা। ওদের রেজিস্টার হচ্ছে না। শুধু কাবিনামা!”
ইয়াতিম শিকদার খোঁচা মেরে বললেন, ”তাই তো বউ মা! তোমার এতো চিন্তা ভাবনা কিসের। তুমি কি তার থেকে আইন বেশি জানো নাকি? দেখছো না, ওসি সাহেব নিজে বিয়েতে উপস্থিত! মনে হচ্ছে তিনি সাক্ষী দিবেন!” বলেই তার বিশ্রী দাঁত বের করে বিখ্যাত হাসি দিলেন। এই হাসি দেন মানুষ কে ছোট করার পর। আগত নতুন মেহমান ছিলেন ওসি সাহেব! তিনি হাসলেন। বলে উঠ’লেন, “সে যা বলেছেন। যেখান আমি স্বয়ং উপস্থিত সেখানে আইনি ঝা/মেলা মুক্ত থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক!” কথাটা ইয়াতিম শিকদার হজম করতে পারলেন না। ওসি সাহেব যে তার কথার পিঠে জবাব দিয়ে দিবেন এটা তার ধারণায় ছিলো না। আরিফ হাসান মুচকি হাসলেন।
বিয়েতে ঝামেলা থাকবে না, এমনটা হতেই পারে না। কাবিন নিয়েও একটা ঝামেলা দেখা গেল। ইয়াতিম শিকদার অর্নিলার বর্তমান অভিভাবক। ১০ লক্ষ টাকা ছাড়া তিনি কাবিন করবেন না, বস্তুত আরিফ হাসান চাইছিলেন ৫ লক্ষ টাকা কাবিন করতে। তাও তিনি ইয়াতিম শিকদারের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। ঝামেলা তার পছন্দ না। এর মধ্যে টাকা ওসুলের কথাও চলে এলো। আরিফ হাসান বললেন, “সেই নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আল্লাহর রহমতে আমার কম নেই।“
সারফারাজ তটস্থ হয়ে গেল। আচমকা সে বলে উঠল, ”তা কি করে হয়? আমার কাবিনের টাকা তুমি কেন দিবে? আমি দিবো। সেটা আমার হক। সব দিতে পারব না তবু যত পারি ততোটুকুই দিবো।” বড় ফুফু খুশি হলেন। বলে উঠলেন, “আলহামদুলিল্লাহ! মন খুশি করে দিলে বাবা!”
অর্নিলা চুপচাপ বসে টাকার হিসেব দেখছিলো। সে বুঝতে পারছিলো এতো টাকা কে কাকে দিবে? তাকে! ফস করে বড় ফুফু কে জিজ্ঞেস করল, “টাকা কাকে দিবে বড় ফুফু?”
“কেন? তোকে দিবে। এখন সব না অল্প কিছু দিবে।এটা তোর হক বুঝলি মেয়ে। বিয়ের সময় কাবিনের এই টাকা তুই পাবি।”
অর্নিলা মাথা দুলালো। ফস করে বলে উঠলো, “তাহলে বাকি টাকা কখন দিবে? ডির্ভোসের পর?” উপস্থিত সকলে হত’ভম্ব! কেউ কেউ উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সারফারাজ শেহদাতের বিষম লেগে গেলো। এই মেয়ে তো জোড়া হবার আগেই আলাদা হবার চিন্তা ভাবনায় আছে।বড় ফুফু জিহ্ব কামড়ে বলল, ”এসব কি কথা? তওবা পর মাইয়া!”
অর্নিলা উঁচু গলায় বলতে লাগল,“তওবা তওবা!“ উপস্থিত সকলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবার অবস্থা। ফরহাত হেসে হেসে সারফারাজের মুখ দেখছে। সে রাগী চোখে দেখছে অর্নিলা কে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে কসিয়ে একটা দিতে। কাজী সাহেব বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন!
সারফারাজ একটু বাদে বাদে অর্নিলা কে দেখছে। তার মন খচখচ করছে কোন কারণে। সে বার বার সামনে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলছে। সারফারাজ সামনে ফিরল। অ/ভদ্র হাসি হেসে নিয়াজ এদিকেই তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটার শিক্ষা এখনো হয়নি। সারফারাজ এবার একটু গা ঘেঁষেই বসল অর্নিলার। অর্নিলা কপাল কুঁচকে ফেলল। ফারাজ ভাইয়ের দিকে মুখ করে ফিসফিস করে বলল, “আর কতো এদিক বসবেন? আমার কোলে বসে পড়বেন নাকি ফারাজ ভাই!”
“চুপ গাধি! কবুল বল! সময় চলে যাচ্ছে।”
অর্নিলা জোরে জোরে বলল, “কবুল কবুল!” কাজী সাহেব শুকনো মুখে অর্নিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মা এখন না তো। আমি কথা শেষ করে নিই। তোমার তো দেখছি তর সইছে না!”
অর্নিলা বোকার মত সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সবাই হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। এমনকি ফারাজ ভাই ও মুখ টিপে হাসছে। লজ্জায় সে মাথা নিচু করে ফেলল। এবার আর কারো কথা কানে যাচ্ছে না তার। ফারাজ ভাই তার সাথে এমন করল। হুঁ সবাই হাসছে তাকে দেখে। আর কথা বলবে না সে ভাইয়ের সাথে। কাজী সাহেব এবার ধীর স্বরে বললেন, “মা, এবার কবুল বলো!”
.
খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বাড়ির ছাদে। বিশাল বড় এই বাড়ির ছাদ ও বিশাল। আয়োজনে কোন ত্রুটি নেই। ছোট ফুফু এসে বড় ফুফুর কানে কানে বলছে, “আপা,রান্না নাকি খুব ভালো হয়েছে। আমার শাশুড়ি বলছিলো গরুর গোশত নাকি ভালো রান্না করেছে। কিন্তু মাছ নাকি ভালো না। রুই মাছে কেমন গন্ধ গন্ধ নাকি পাচ্ছিল। রিয়াদের বাপ বলল, মুরগির রোস্ট ভালো ছিল কিন্তু পোলাও গরম আছিলো না। এটা কোন কথা বলো তো? আমরা কুটুম না! আমাদের এমন আথিতীয়তা করলে হয়?”
বড় ফুফুর ইচ্ছে করল একটা ধমক দিয়ে বলতে,
“গাধী/রে গা/ধী! রান্না ভালোই আছে, তোর মুখ নষ্ট। তাই এসে এখানে এমন কথা বলছিস!” কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন। তার বোনের স্বভাব ভালো না। খুব ছোট কারণেই কেঁদে ফেদে একাকার। দেখ যাবে বিয়ে বাড়ি পরে ম/রা বাড়ি হয়ে উঠবে। শান্ত স্বরে বললেন, “থাক,তুই একদিন ওদের দাওয়াত করে খাইয়ে দিস। তখন বুঝে যাবে, আথিতীয়তা কাকে বলে?”
ছোট ফুফুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার চোখ চকচক করছিলো। আগ্রহ নিয়ে বলল, ”ঠিক বলেছো আপা। কিন্তু আপা, খাবার কিন্তু আমার কাছে ভালোই লাগছে। ওই বোরহানী টা আছে না, ওইটা খেতে একদম দারুণ!”
সবার খাবার দাবার উপরে ব্যবস্থা করা হলেও অর্নিলা আর তার ভাইবোনদের ঘরেই খাবার দেওয়া হলো। ছাদের চারদিকে রেলিং দেওয়া নেই। সেখানে বাচ্চাদের যাওয়া নিষেধ। সদ্য বিয়ে হওয়া অর্নিলার ক্ষেত্রেও তাই। সবচেয়ে উড়নচণ্ডী সে একাই।
এদিকে সারফারাজ দাঁড়িয়ে ফরহাতের সাথে কথা বলছে। হঠাৎ করেই কান্নার আওয়াজ। এর মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ। দুজন ফিরে পিছনে তাকিয়ে দেখল অর্নিলা ছুটছে। ছুটতে ছুটতে তার শাড়ি খুলে যাচ্ছে ওদিকে তার নজর নেই। আরাফাত তার রোস্ট নিয়ে ভেগেছে। রোস্ট উদ্ধারের অভিযানে সে ব্যস্ত। শ্রেয়মী এসে তাকে জাপটে ধরতেই রোস্টের জন্য সে মরা কান্না কাঁদছে। সারফারাজ কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “অন্য বউরা টেনশনে খাওয়ার কথা ভুলে যায় এদিকে আমার বউ মুরগির রোস্ট নিয়ে ঝগড়া করছে। বাহ্, কি ভাগ্য আমার!”
অর্নিলা কাঁদতে কাঁদতে আরিফ হাসানের সামনে এসে থামল। তাকে দেখতে পেয়েই অস্ফুট স্বরে বলল, “মামা, ভাইয়া আমাকে ছুঁয়েছে!”
আরিফ হাসান থমকে দাঁড়ালেন। কি বলল অর্নিলা? ছুঁয়েছে মানে? কেমন ছোঁয়া? অর্নিলার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বেশ বুঝতে পারলেন কোন ধরণের ছোঁয়ার কথা বলছে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে উঠল। তার চোখ, মুখ লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ। থেমে থেমে কাঁদতে সে? অর্নিলা আবারো বলল, “মামা জানো, আমি খুব বারণ করলাম। কিন্তু ভাইয়া শুনলো না। আমার জামা ধরে টানাটানি করছিলো!” বলেই চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। অর্নিলা কখনো নিঃশব্দে কাঁদতে পারে না। সবসময় চিৎকার করে কাঁদবে। আরিফ হাসান হত’ভম্ব। আচমকা বজ্র’পাত যেন তার মাথার উপর পড়ল। মনে হচ্ছে তার বুকের ভেতর থেকে কেউ ক’লিজা ছিঁ’ড়ে টেনে বের করে ফেলছে। তিনি অর্নিলা কে জড়িয়ে ধরলেন। ভ/য়ে মেয়েটা কাঁপছে। কে ছুঁয়েছে? ভাই? কোন ভাই? কার এতো সাহস হলো? ইঙ্গিত কোনদিকে যাচ্ছে সে বেশ বুঝতে পারছে? সারফারাজ বাড়িতে নেই, সে থাকলেও এমন কাজ কখনো করবে না। তাহলে কে? আরাফাত! অসম্ভব। এমন শিক্ষা তার ছেলেকে সে দেয় নি। তবুও কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে? আরাফাত?” অর্নিলা কান্না থামালো। মাথা দুলিয়ে না করল।
আরিফ হাসানের উধাল/পাতাল মন তবুও শান্ত হয়নি। তিনি হাঁটু গেড়ে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা, কান্না করে না। তুমি আমায় বলো, এমন বাজে কাজ কে করেছে তোমার সাথে? আমি তাকে শা/স্তি দিবো। বলো মা? কে করেছে?”
অর্নিলা কান্না থামালো। সে হাপাচ্ছে। এখন আর ভয় লাগছে না। মামার কাছে থাকলে তার কখনো ভয় লাগে না। দুই হাতে চোখের পানি মুছল। একটু শান্ত হয়ে বলল, ”নিয়াজ ভাইয়া!” আরিফ হাসান চমকে উঠলেন। নিয়াজ! ওই বখাটে ছেলেটা। এদিকে অর্নিলার কান্নার শব্দে শাহিনুর বেগম আর আরাফাত শেহদাত ছুটে এলো। আরিফ হাসান অর্নিলা কে শাহিনুর বেগমের হাতে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। কি ভ’য়ং’কর ঘটনা! কি সাংঘা/তিক! কি কু/ৎসিত। নিয়াজ শিকদার! অর্নিলার চাচাত ভাই। এক নাম্বারের বখাটে ছেলে। দিনরাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে, নেশা/পানি করবে আর এভাবে মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করবে। না, এ কখনো হয় না। এর একটা সমাধা করাই উচিত।
কিছুদিন আগেই অর্নিলার বাবা মা/রা গেছেন। আজ তার চল্লিশ দিন পার হয়েছে। এ কারণে অর্নিলার চাচা বিশাল এক মিলাদের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আরিফ হাসানের পুরো পরিবারের সাথে অর্নিলাও উপস্থিত। অর্নিলা তার নিজের রক্তের নয়। আদরের একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়ে। মা, বাবা মরা এই মেয়েটার জন্য তার খুব মায়া হয়। তাই তাকে আগলে রাখতে চান। কিন্তু অর্নিলার আপন চাচা ও তাকে নিজের কাছে রাখতে চান। তার আরও দুই ফুফু আছে, একজন সবার বড় আরেকজন সবার ছোট। তারা এখন অবধি কিছু বলে নি। অর্নিলা থাকতে চায় তার মামার সাথে। গোলমাল এদিকেই বেঁধেছে। আজ সবাই যখন চাচা ইয়াতিম শিকদারের বাড়িতে মিলাদে ব্যস্ত ছিলো তখনই ওই শয়/তান নিয়াজ অর্নিলার সাথে এমন ঘৃ/ণ্য আচরণ করার সুযোগ পেয়েছে এমনটাই আরিফ হাসানের ধারণা। কিন্তু এভাবে ছাড় দেওয়া যায় না, এর একটা বিহিত না করলেই নয়।
পুরো নাম অর্নিলা অথৈ! মা বাবার একমাত্র সন্তান সে। মা মা/রা গেছে প্রায় ৭ বছর হতে চলল। বাবা মা/রা গেছে এই তো মাস পেরিয়ে গেল। বাবা শামসের শিকদার মারা যাবার আগে মেয়ের কোন কমতি রাখেন নি। বলতে গেলে ভালোই সম্পত্তি আছে তার। নিজের দুটো বাড়ি আছে, যেগুলো ভাড়ায় চলে। ঢাকায় নিজের তিনটে ফ্লাট। ভালো ব্যবসা ছিল। মারা যাবার পর সেসব এখন চাচার হাতে। সেখানেই থাক, ওসব নিয়ে অর্নিলার কোন মাথাব্যাথা নেই। ওসব ছাড়া যা আছে তা ঢের কম নয়। জমিজমা আছে নিশ্চয়। এছাড়া মামা আছে, বড় ফুপু আছে যিনি বিদেশে থাকেন। ছোট ফুফু থাকেন একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে। চাচার অবস্থাও কম ভালো নয়। তবুও, যার থাকে বেশি তার চাইও বেশি। তাই তো, অর্নিলার ভাগের ওতোটুকুর উপর নজরও তার। ইচ্ছে আছে তার ছোট ছেলের সাথে বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই অর্নিলার ভাগের সম্পত্তি তার সন্তান পাবে। কিন্তু মাঝখানে বাঁধ সাধছে ওই আরিফ হাসান।
.
ফরহাত সবকিছু বলে একটা সিগারেট ধরাল। সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখে বলল,”সিগারেট খাওয়া ভালো না। এর জন্য শরীরে..
”এই থাম তো। আমি তোর কাছে ডাক্তারি শিখতে আসি নি। যা বলছি তা শোন।”
“সবই শুনলাম। কিন্তু আমার সাথে অর্নিলার বিয়ের কাহিনী টা বুঝলাম না। গোয়ালে গরু কি আমি একটাই ছিলাম!”
“গোয়ালের গুরু তুমি হতে যাবে কেন? তুমি হচ্ছো সাত রাজার ধন। নিয়াজ যা করেছে এসব জানাজানি হয়েছে। অর্নিলার বড় ফুফু আছে না? ওই যে বিদেশী মেমসাহেব। তিন ইঞ্চি উঁচু জুতা পড়ে সাজগোজ করে যে ঘোরাঘুরি করে সে, ঠোঁটে লিপস্টিক দিবে না কিন্তু ঠোঁটের চারদিক আর্ট করে রাখবে!”
“অদ্ভুত! আমি এসব জেনে কি করব? ওই মহিলা ঠোঁট লিপস্টিক করে না আর্ট করে তা আমার জেনে কি কাজ? আর তাছাড়া তুই আর কিছু না দেখে মহিলার ঠোঁটের লিপস্টিকের রঙ দেখতে গেলি। এতো
ক্যারেক্টার/লেস তুই!”
”আরে বাবা, আমি তো তোকে তার বর্ণনা দিচ্ছি। আর তাছাড়া তার ঠোঁটের লিপস্টিক নিয়ে আমার কোন কাজ নেই। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে দেবার লোক আমার আছে। তার রাঙা ঠোঁট ন/ষ্ট করার অধিকার ও আছে।” বলেই সিগারেটের ধোঁয়া শূন্যে ছাড়ল। সারফারাজ বলে উঠল, “সেই মেয়ে তোর এই সিগারেট খাওয়া ঠোঁটে চুমু খেতে চাইবে?”
“পাগল হয়ে আছে!” বলেই অট্টহাসি হাসল। ”আচ্ছা যাক, এসব আলোচনা পরে করা যাবে। শোন তবে, সব জানাজানির পর ইয়াতিম শিকদার তো বেজায় রাগ। শুনলাম সবার সামনেই নাকি নিয়াজ কে চ/ড় মেরেছে।লাথি মে/রে বাড়ি ছাড়া করেছে!”
“যাক, যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম ততোটাই খারাপ নয় দেখছি!”
“তার চেয়েও দশগুণ। সবার সামনে মেরে ঘর থেকে বের করার পর রাতে এসে তোমার বাবা কে বলছে তার ছেলের সাথে অর্নিলার বিয়ে পড়িয়ে দিতে। এখন সবাই জানে, আরিফ হাসান নিজের জী/বন দিয়ে দিবে, তবু অর্নিলার সাথে ওই বখাটে নিয়াজের বিয়ে দিয়ে তার জীবন ন/ষ্ট করবে না।”
“ওহ, তাই এর জন্য এবার আমাকেই বর সাজিয়ে বিয়েতে বসতে হবে তাই তো!”
ফরহাত দাঁত কেলিয়ে হাসল। সিগারেট নিভিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে বলল, “তা বটে। কিন্তু জানিস, প্রথমে বর সাজানোর জন্য কাকে বলির বক/রা বানিয়েছিলো?”
“কাকে?”
“আমাকে! আর কাকে? ভাই আমি তো বলেই দিয়েছি। চাচা দেখো, আমার নায়িকা রেডি, বাসর ও রেডি। তাই অন্য রমনীর গলায় ফুলের মালা দিতে আমি পারব না। রক্ষা করো!”
”তুই এভাবে বাবা কে বলেছিস!”
“সেম টু সেম। সেজন্যই তো তোর সাথে বিয়ে ফাইনাল। যদিও এসব ওই বিদেশী মেমসাহেব এর কারবার। তারই বুদ্ধি!”
সারফারাজ মাথা দুলিয়ে বলল, “ওহ আচ্ছা!” অতঃপর খানিকক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগল। ফরহাত তার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “আসছি আমি! বিয়ে বাড়িতে অনেক কাজ আছে?”
“আচ্ছা যা, কিন্তু ফরহাত?
”হ্যাঁ!
“তোর মনে হয় না? অর্নিলার কোন সমস্যা আছে। মানে এই বয়সে পুরোপুরি ম্যাচুরিটি না এলেও খানিকটা থাকা দরকার। কিন্তু এরকম কিছুই ওর মধ্যে নেই।”
“সবার ম্যাচুরিটি একসাথে আসে না। কারো কারো আসতে সময় লাগে। দেখবি, বিয়ের পর হয়তো ম্যাচুরিটি চলে এসেছে। তাই না! এসব নিয়ে তোর মাঝে দ্বিধা থাকার কথা নয়। তুই তো ভালোই জানিস।”
সারফারাজ নিচু স্বরে বলল, “হ্যাঁ, তা বটে। তবুও মেয়েটাকে আমার বাচ্চা বাচ্চা লাগে।”
“তা তো লাগবেই। তোর চেয়ে সাত বছরের ছোট। আর যা উড়নচণ্ডী!”
“সাত বছর!“
“হ্যাঁ, আচ্ছা তোর ইন্টার্নশিপ কবে?”
“সে তো খুব দেরী। এখনো প্রায় ২ বছর বাকি। আর ইন্টার্নশিপ এর কথা বলছিস আগে পাশ করে বের হতে দে!
“তুই আবার কবে থেকে পাশ ফেল এর চিন্তা করিস? ভুলে যাস না আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে তুই বেস্ট। আমি লিখি দিতে পারি তুই একদিন খুব বড় ডাক্তার হবি। যাক তৈরি হয়ে নিস।”
সারফারাজ বেলকনি থেকে ঘরের দিকে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে বলল, “হ্যাঁ, ব্যাগ গোছাতে হবে।”
“ব্যাগ গোছাবি মানে? তুই কি আজই চলে যাবি?”
”হ্যাঁ, রাতের ট্রেনে ঢাকা ফিরব। অনেকদিন পড়া ছাঁটাই হয়েছে আর না!”
“আজই তোর বিয়ে আর আজই তুই চলে যাবি?”
“ওটা বিয়ে না কাবিন! আর মা বাবা আমায় বিয়ে করাতে চাইছে যাতে অনি কে তাদের কাছে রাখতে পারে।অনি আমাকে চায় না কিংবা আমি অনিকে। ওই অবুঝ মেয়েকে নিয়ে এখন সংসারের চিন্তা করা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। গিয়ে দেখ, বিয়ের কথা শুনে সে নাচছে কারণ কেউ তাকে বলেছে বিয়ের পর সে এই বাড়িতে পার্মানেন্ট থাকতে পারবে। এছাড়া আর কি চাই তার!”
ফরহাত কিঞ্চিত পরিমাণ হাসল। তার হাসির কারণে গালে দুটো টোল পড়ল।বাহ চমৎকার হাসি তার। বলে উঠল, “আর কেউ না। আমার জোড়া বোন আছে কি করতে!” সারফারাজ তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। মনের ভার এখন অনেকটাই কমেছে তার। এতোক্ষণ কি কারণে তার মনে এতো ভার ছিল সে জানতো না। এখন বোধহয় বুঝতে পারছে। একটা অবুঝ মেয়েকে বিয়ে করার মতো বোকা সিদ্ধান্ত। সবাই অনি কে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। অথচ কেউ তার কথা ভাবছে না।কি অদ্ভুত! তার অস্তিত্ব সকলে বিলীন করে দিল এক নিমিষেই।
.
ষাটোর্ধ্ব মহিলা। আরিফ হাসানের চেয়ে বড় না। তবুও তিনি অনেক মান্য করেন তাকে। সে আজ থেকে না অনেক বছর আগে থেকেই। বড় ফুফু বললেন, “না ঘরে বসব না। বিয়ে শুরু হয়ে যাবে। এই তো কাজী আনতে সিধু কে পাঠিয়েছি। বলছি বিয়ের পড়ানোর পরই তো খাওয়া-দাওয়া হবে তাই না!”
“হ্যাঁ, আপা। সেই ব্যবস্থা। আপনি রান্না বান্না দেখে এসেছেন। শিকদার সাহেব পরিবার নিয়ে আসবেন। এছাড়া তো আপনার ছোট বোন, তার পরিবার ও আসবে। একটু দেখে নিতেন যদি।”
“এসবের দরকার না। শাহিনুরের চেয়ে খাবার দাবারের ব্যবস্থা ভালো কেউ সামলাতে পারবে না। কিন্তু আরিফ, একটা ব্যাপার নিয়ে আমি তোমার সাথে নারাজ। তুমি ওই ই/তর ইয়াতিম আর ইত/রের ছেলে ইত/র নিয়াজ কে বিয়েতে আসতে বললে কেন? কি দরকার ছিল নিকুঞ্জ নিবাসে এসে বাড়ি নোংরা করার।”
আরিফ হাসান হাসলেন। বিনয় ভঙ্গিতে বললেন, “আপা! নোং/রা মানুষের মন কলু/ষিত করে শরীর নয়। কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকুন, তাদের পায়ের ধুলো এই বাড়িকে অপবিত্র করতে পারবে না। আমার এই বাড়ি আগে যেমন পবিত্র ছিল এখনো তাই থাকবে।”
“হুম, সারফারাজ রাজী বিয়েতে।”
“হ্যাঁ রাজি। তবে বিয়ে পড়ানোর পরই সে ঢাকায় রওনা দিবে। তাকে যেতেই হবে।”
“সে জানি আরিফ। তোমার দুটো ছেলেই বড় ভালো। আমার ছোট দুই ভাইয়ের মতো কুলা/ঙ্গার না। তারা যেমন তাদের ছেলেগুলো ও তেমন। শুধু একটি মাত্র রত্ন অর্নিলা। সে সোনায় বাঁধানো। তাকে কোন সেকরার হাতে আমি দিবো না। যোগ্য হাতেই দিবো।”
দুই ছেলের প্রশংসা শুনে গর্ববোধ করলেন আরিফ হাসান। তার চোখে মুখে এক ধরণের উচ্ছাস দেখা গেল। এর মধেই গাড়ির শব্দ। “নিকুঞ্জ নিবাসে” সদর দরজায় শিকদারদের গাড়ি হাজির। নির্বিঘ্নে বিয়েটা দিতে পারলেই হয়। বড় ফুফু কর্কশ গলায় আবারো বলে উঠলেন, ”এসেছে কুলা/ঙ্গারের দল!” অতঃপর তার উঁচু উঁচু জুতোর ঠকঠক আওয়াজে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “শোন আরিফ! তুমি আজ যা করছো এ জন্যে আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব!”
“আমি আপনার জন্য কিছু করছি না আপা। যা করছি আমার ছোট বোনের জন্য। তার একমাত্র স্মৃতি আমার মা অর্নিলা। তাকে দেখা রাখাই আমার দায়িত্ব!” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন বড় ফুফু।আবারো ঠকঠক শব্দ। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন!
#চলবে….
“কি বললে বাবা? আমায় এখন একটা বাচ্চা কে বিয়ে করতে হবে? তাও সবে মাত্র এসএসসি পরিক্ষা দেওয়া বাচ্চা! আর ইউ সিরিয়াস? তোমার কথা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না!”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল সারফারাজ। তীব্র চোখের পলক ভেবে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করছে। এমন খামখেয়ালি চিন্তা বাবা কখনো নিতে পারেন না। সে শিক্ষিত, শুধু তাই না দেশের একজন রিটেয়ার বিচারপতি ও। তার চিন্তাভাবনা, বিচক্ষণতা বরাবরই সারফারাজ কে মুগ্ধ করত। কিন্তু আজ সে কোনভাবেই মুগ্ধ হতে পারছে না।
রিয়েটার বিচারপতি আরিফ হাসান আজকের খবরের কাগজ মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারছেন না। পারবে না এটাই স্বাভাবিক। “নিকুঞ্জ নিবাসে” আজ প্রচুর শোরগোল। তাদের পৈত্রিক বাড়ি এটা। ঘরভর্তি মেহমান। ঈদ উপলক্ষে মেহমানে পুরো বাড়িতে গুনগুন রব। অথচ ঈদ পেরিয়ে গেছে আজ ৭ দিন। তার বড় ছেলে সারফারাজ শেহদাত! বর্তমানে ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করছে। ছোট ছেলে আরাফাত শেহদাত। এবার এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছে। এই তো, দু মাস বাদে তারও রেজাল্ট বেরিয়ে যাবে। সেসব নিয়ে তার চিন্তা নেই। তার মতোই দুই ছেলেও ভালোই মেধাবী। পড়াশোনা নিয়ে কখনো বকতে হয়নি। বড় ছেলে সারফারাজ এসেছিলো বাবার অনুমতি নিতে। সন্ধ্যার ট্রেনে সে ঢাকা ফিরবে। অথচ তার বিয়ের কথা শুনে খানিকটা বিস্মিত আর বিভ্রান্ত। সবচেয়ে বিভ্রান্ত এটা শুনে তার বিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে হতে যাচ্ছে। তার বাবা কয়েকমাস আগেই গত হয়েছেন। এই মূহূর্তে এমন একটা সিদ্ধান্ত তাকে কি পর্যায়ে ভাবাবে এটা সে বুঝতে পারছে না। সারফারাজ দ্বিতীয় বারের মতো আবার বলতে আরম্ভ করল,
“বাবা! তুমি যা বলছো ভেবে বলছো কি? তুমি একজন রিয়েটার বিচারপতি। নিশ্চিত জানো, ১৮ বছরের নিচে কোন বাচ্চা কে বিয়ে দেওয়া আই/নত অ/পরাধ। এর পরেও তুমি আমায় বিয়ের জন্য বলছো?”
আরিফ হাসান মনোযোগ দিয়েই কথাগুলো শুনছেন। এর ফাঁকে একবার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। চোখের চশমা খুলে পাশের টেবিলে রাখলেন। দৃষ্টি রাখলেন ছেলের উপর। বিয়ের কথা শুনে ছেলে যতোটা বিস্মিত হবে ভেবেছিলেন ততোটাই বিস্মিত হয়নি। হয়তো কথাটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। অতঃপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একজন নারী। পরনে তার হালকা বাদামী রঙের শাড়ি, চোখে সোনালি রঙের চশমা, হাতে চায়ের কাপ। ঘরে আজ প্রচুর কাজ, এতো কাজের চাপে তিনি যেন অস্থির হয়ে উঠেছেন। তার ছাপ চোখে মুখে ফুটে উঠছে। সারাফারাজ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল গম্ভীর দৃষ্টিতে। মা শাহিনুর বেগম চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন স্বামীর কাছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “দোকানপাট এখনো ভালো করে খুলেনি। সকাল থেকে ঘুরেও মনমতো একটা শাড়ি পাইনি। ভাবছি আমার বিয়ের শাড়িটাই ওকে পরিয়ে দিই। তুমি কি বলো?”
সারাফারাজ ভেতরে ভেতরে রে/গে যাচ্ছে। তার মা বাবা ভেবেই নিচ্ছে এই বিয়েটা সে করছে। নাহলে এই শাড়ির কথা এখানে তুলবার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু যতই রেগে যাক না কেন? মা বাবার মুখের উপর কথা সে বলতে পারে না। তবু শান্ত গলায় শুধালো,
“কাকে বিয়ের শাড়ি পরাবে মা?”
”কেন? অনি কে? ও ভালো কথা! আমি তোর জন্য একটা পাঞ্জাবি আনিয়ে রেখেছি। ঘরে বিছানার উপর রাখা আছে। পরে দেখিস, ঠিক আছে কি না?”
“বিয়ে কখন পড়ানো হবে?”
“এই তো আছরের পরে! কাজী কে বলা আছে।”
সারাফারাজ চোয়াল শক্ত করল। আশ্চর্য! তার আজ বিয়ে অথচ সে কিছুই জানে না। এমনকি কাজী থেকে শুরু করে শাড়ি পাঞ্জাবি সব তৈরি শুধু বর কে জানানো হয়নি তারই আজ বিয়ে। চমৎকার! ইচ্ছে করল কথাটা জোরে বলতে কিন্তু পারল না। তার মন বলছে, এই ঘর ছেড়ে বের হবার পরপরই দেখবে, বাড়ির সব মেহমান তাকে এসে ঘিরে ধরছে। সবাই জানে তার বিয়ের একমাত্র সে ছাড়া। রে/গে ঘর ছেড়ে বের হবার জন্য উদ্বেগ হলো। আরিফ হাসান তাকে থামিয়ে দিয়ে শাহিনুর বেগম কে বলল, “রান্নাবান্না কেমন হচ্ছে?”
“ভালোই এগুচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে মুরগির রোস্ট কম পড়ে যাবে।”
“সিধু কে ডেকে আনিয়ে নাও। খেয়াল রেখো, খাবার দাবার নিয়ে কেউ যেন কিছু বলতে না পারে!”
”আচ্ছা!”
বলেই শাহিনুর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সারাফারাজ শেহদাত ঠোঁট কামড়ে ধরল। বিয়ে নিয়ে বাড়িতে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। অথচ এসব কিছু থেকে সে অনাগত। আরিফ হাসান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “বসো। ঠান্ডা মাথায় কথা বলি।”
”আর কি বলবে বাবা? বিয়ের সবকিছু্ই তো দেখছি তৈরি। শুধু আমিই কিছু জানি না।”
“জানাবার সময় হয়নি। বিয়ে ঠিক হয়েছে গত রাত ১ টার দিকে। ভোর থেকেই সব তোড়জোর শুরু। আর তুমি ঘুম থেকে উঠেছ সকাল ১১ টার দিকে। ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেড়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো। আর এখন বাজে দুপুর ১ টা!”
বিস্তৃত এক বর্ণনা দিয়ে সারাফারাজ এর মুখ বন্ধ করে দিল বাবা আরিফ হাসান। আশ্চর্য কিছু না। তার কথায় এক ধা/রালো অ/স্ত্র লুকিয়ে আছে। সে কথার জোরে কেউ কিছু বলতে পারে না। তবু সারাফারাজ বলল, ”কিন্তু আমায় জিজ্ঞেস করতে পারতে একবার।”
“করার মতো কিছু ছিল না ফারাজ। তোমার পছন্দের কেউ নেই এটা তুমি আমায় দুদিন আগেই বলেছো। দুদিনের মধ্যে পছন্দ হয়ে যাবে এমন কোন মেয়েও আশেপাশে নেই। তাই আমার ধারণা এই বিয়ে হচ্ছে আর তুমি এই বিয়ে করবে। ঠিক তো!”
“তুমি বললে বি/ষ ও খেয়ে ফেলব। তুমি জানো, আমি তোমার কথার অবাধ্য হই না।”
তিক্ত স্বরে কথাগুলো বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো সারফারাজ। রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁ/পছে। তার দিকে তা কিয়ে চাপা হাসল চাচাত জমজ দুই বোন রুদমিলা আর শ্রেয়মী। তারা দু’জন বড্ড সুন্দরী আর দেখতে প্রায় একইরকম। নিজেদের সবসময় একরকম তারা আবার সেম পোশাক ও পরে। বড় আশ্চর্য! শুধু সে না, তাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে এমন দু একজন আশ্চর্য মানুষ থাকবেই। সারফারাজ কপাল কুঁচকালো। দুজনের হাসি মূহূর্তেই থেমে গেল। তাদের এই ভাইকে তারা প্রচন্ড ভয় পায়। সারফারাজ কঠিন গলায় বলে উঠল,
“হাসছিস কেন দাঁত কেলিয়ে। আর কোন কাজ নেই তোদের।”
শ্রেয়মী বলল, “না ভাই।” রুদমিলা মুখ ফসকে বলে ফেলল, “আছে না, অনেক কাজ! তোমার আর অর্নিলার বিয়ের অনেক কাজ বাকি। একটু পরই অর্নিলা কে মেহেদী পড়ানো হবে!” আরো কিছু বলার ছিল। শ্রেয়মী গুঁতো দিয়ে তাকে চুপ করে দিল। ভাই কে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না তিনি খুশি হচ্ছেন। কেমন গম্ভীর করে রেখেছে মুখটা। দু বোন একসাথে পগাড় পার। ভাই হুটহাট ধমক দিয়ে বসেন, তাদের ধমক খেতে ইচ্ছে না। সারফারাজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ডাক্তার হতে হলে ধৈয্য ধরে রাখা বহুত বড় কাজ। সে খুব ছোট কারণেই রেগে যায়, এভাবে রেগে যাওয়া যাবে না। সামলাতে হবে। ঘরের দিকে পা রাখল। বাড়ি ভর্তি মেহমান। তার চাচা, চাচি, চাচাত তিন ভাই বোন। এছাড়া মায়ের তরফ থেকে এসেছে মামা মামী, তাদের বাচ্চার বাচ্চারা। যদিও মামা তাদের আপন নন। মায়ের দিক থেকে কোন ভাইবোন নেই। উনি তার দূরসম্পর্কের মামা। এই মামা বাচ্চার বাচ্চারা ছোটাছোটি করে এসে থামল সারফারাজের সামনে। তাকে ঘিরে দুজনে ছুটতে লাগল। তার সাথে চিৎকার ও করছে। বি/রক্ত লাগছে, ভীষণ বিরক্ত। এক ধম/ক দিয়ে বলল, ”এই চুপ!” দুজনেই চুপসে গেল। হতবাক হয়ে চেয়ে রইল সারফারাজের দিকে। সে হম্ভিতম্ভি করে তার ঘরের দিকে রওনা হলো। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সামনে ফিরতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বিস্মিত স্বরে বলল, “অর্নিলা?”
অর্নিলা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে দরজা বন্ধের শব্দে বেচারি ভয় পেয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ফারাজ ভাইয়ের গলার স্বর। দিনটাই বুঝি এবার যাবে। ফিরে তাকাল সামনের দিকে। তার গালভর্তি হাসি।
বি/রক্তির শেষ রইলো না। এই মেয়ে শুধু শুধুই হাসে। একে ধমক দিলেও হাসে, বকা দিলেও হাসে। পারে শুধু ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে। বোধহয় কান্না আর হাসি ছাড়া ও কিছুই শিখে নি।
”তুমি এখানে?”
“মামনি বলল পাঞ্জাবি দিয়ে যেতে তাই এসেছি ফারাজ। বলেছে আজ আছরের সময় এটা পরে যেতে। আমার আর আপনার আজ বিয়ে!” বলেই দাঁত বের করে হাসি দিল। এই হাসি লজ্জার হাসি না, মজার হাসি। এ বাড়ির সব মেয়েরাই শুধু হাসে। আশ্চর্য, এদের কি ভূ/তে ধরেছে! সারফারাজ কঠিন গলায় বলল, ”আমার ঘর থেকে বের হ, এখুনি!” অর্নিলা জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল। ফারাজ ভাই তুমি থেকে তুই তে চলে গেছে এর মানেই তার রাগ অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেছে। এসময় তার সামনে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু সে বুঝল না, বিয়ের কথা শুনে ফারাজ ভাই ওমন রেগে গেলো কেন? ভালোই তো হচ্ছে তার বিয়ে হচ্ছে তাও ফারাজ ভাইয়ের সাথে। ইশ কতো মজা, মামনির সাথে এখন সে সারাক্ষণ থাকতে পারবে। এই বাড়িতে ঘুমাতে পারবে। কতো মজা! নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ এক বিকট আওয়াজে থেমে গেল। ফিরে চাইল ফারাজ ভাইয়ের ঘরের দিকে। ভাই বেশি রেগে গেলে চিৎকার করে। ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। এবারও তাই ঘটল। তাতে অর্নিলার কি? সে মুখ টিপে হাসল।
দুই হাত কোমরে রেখে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সারফারাজ। এই পাজি মেয়ের সাথে তার বিয়ে! অসম্ভব। এই মেয়েটিকে একটুও পছন্দ না তার। তার ফুফাতো বোন বলতে শুধু এই। তার ফুফা কেও পছন্দ না আর তার মেয়েকেও না। ফুফু কে দেখেছিলো সেই ছোটবেলায়। তখন তার বয়স খুব বেলি না, এই ১২ কি ১৩ হবে? এই মেয়ে, অনি তখন আসত আর তার সমস্ত খেলনা ভেঙে ফেলত। খুব বিরক্তিকর। যখন তখন তার জিনিসপত্র ভেঙে ফেলে। তার ঘরে এসেছে মানে কিছু একটা ভাঙবে। ছোট বেলায় তার পছন্দের জিনিস ভাঙত। একটু বড় হতেই তার বই খাতা ছিঁড়ে ফেলতো। একবার তো তার প্যার্ক্টিকাল খাতায় তরকারির ঝোল ফেলে দিয়েছিল। কি অদ্ভুত! তার সবকাজে গণ্ডগোল বাঁধায়। এখন বিয়ের পর কি করবে? তার জিনিসপত্র নিয়ে ডাক্তার ডাক্তার খেলবে? অবশ্যই তাই করবে। এ ছাড়া আর কি পারে। দরজায় আবারো কড়া নাড়ার শব্দ। রেগে ফট করে দরজা খুলে বলল, “কে?” অতঃপর সে সহজ হলো। শান্ত কণ্ঠে বলল, “ওহ, তুই!”
রাইমা হতম্ভব হয়ে একবার বাবা, একবার মায়ের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — কি বললে?
—- আজকে সন্ধ্যায় তোকে দেখতে আসবে?
— কেন, কি হয়েছে আমার? ক্যান্সার ট্যান্সার নাকি? লাস্ট স্টেজ! সময় কম?
সাবিহা এসে মেয়ের মাথায় থাপ্পড় মারলো। মেরে বললো, এই ঢংয়ের জন্যই তাড়াতাড়ি বিদায় করবো।
রাইমা মুখ ফোলালো! ফুলিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, — একটা মাএ মেয়ে। এই পিঁপড়ার দানার খাবার খাই। অনন্ত অনার্সটা তো কমপ্লিট করতে দেবে। তা না! এখনই তাড়াচ্ছো? এতো বোঝা আমি?
রাইমার বাবা মুখ খোলার সময়ই পেলো না। তার আগেই সাবিহা তেজের সাথে বললো, — তো কি করবো? সায়মার মতো নাক কাটার জন্য বসে বসে ওম দেবো। যতো পড়ার ইচ্ছা, বিয়ের পরে পড়বে। এমনিতেও আইনস্টাইনের নাতি না তুমি।
—- সায়মার জন্য এখন গুষ্টির সব মেয়ে শাস্তি পাবে। রুনুর জন্যও নাকি খালামণি ছেলে দেখছে।
—- তো কি করবে? সবগুলো তো তলায় তলায় রসুনের বোটা। কোন কোন আকাম করে রেখেছো কে জানে।
রাইমা ঢোক গিললো! গিলো আস্তে করে কেঁটে পড়লো। আকামের কথা উঠার দরকার নেই। তার চেয়ে ভালো ভালোয় ভালোয় বিয়ে করে ফেলা যাক। এ আর এমন কি? এমনিতেও প্রেম ট্রেম তাকে দিয়ে হচ্ছে না। বিয়ে করে অনন্ত এই ডাকাতের বংশ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যা’ই করতে যাও দা, বটি নিয়ে দৌড়ে আসে। হুহ্!
সন্ধ্যায় রাইমা সুন্দর করে শাড়ি পড়লো। সবুজ আর কালো মিশেলের শাড়ি। এই শাড়িটা তার বাবা দিয়েছিলো।তার জন্মদিনে। অবশ্য বলতে গেলে দেয় নি। সে’ই নিয়েছে। তার জন্মদিনে রাত বারোটায় সোজা গিয়ে বাবাকে ঘুম থেকে টেনে বলেছে, — হুমায়ূন আহমেদ কি বলেছে জানো?
তার বাবা হতম্ভব! ঘুমও কাটেনি! হতম্ভব ভাবেই বললো, — হুমায়ূন আহমেদ কে?
রাইমা আকাশ থেকে পড়ার মতো করে বলেছে, — তুমি এ কথা বলতে পারলে বাবা? আমাদের হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের গর্ব, আমাদের স্বর্ণ, আমাদের….
—- হয়েছে থাম! কাহিনী কি সেটা বল।
—- সে বলেছে মেয়েরা প্রথম শাড়ি পায় তাদের বাবার কাছ থেকে। আর সেটা মেয়েদের কাছে হয় হিরের মতো দামি। তো আমার
হিরে কই?
—- এই কথা আবার কবে বললো? তাছাড়া তোর সব কাপড়, চোপড় আমি ছাড়া দেয়’ই বা কে?
—- সেটা তো তোমার জেনে লাভ নেই বাবা। তাছাড়া কাপড়, চোপড় আর হিরে মার্কা শাড়ি কি এক হলো? এটা হবে স্পেশাল। আমি তোমার নাতি পুতিদের কি বলবো। কোন শাড়ি নিয়ে চোখের দুফোটা পানি ফেলবো?
বাবা হাল ছেড়েছে! বলেছে ” মাফ কর! দিয়ে দেবো তোর স্পেশাল শাড়ি। এবং দিয়েছেও। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এই শাড়ি সে মাথার কাছে পেয়েছে। ইশ! দেখতে হবে না কার বাবা। শাড়িটাও এনেছে হিরের মতোই। তার ফর্সা, চিকন, শরীরে একেবারে ঝলঝল করছে।
এই ঝলমল করা শরীর, মন, মুখ নিয়েই সে মেহমানের সামনে গেলো। গিয়েই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলো। ফাইয়ায ভাই বসে আছে। অবশ্য গুষ্টির অনেকেই আজ তাদের বাসায়। তবুও সে ভাবেনি ফাইয়ায ভাই থাকবে। এরকম একটা বিষয়ে এর কি কাজ। তাদের বিশাল গুষ্টিতে কতো কাজিন কেই তো দেখতে আসছে যাচ্ছে। কই, সেখানেতো এর খবর থাকে না। রাইমার টায় আসতে হবে কেন? চাচাতো চাচার চাচাতো ভাই চায়ের দোকানে গিয়েই চা খা না। আমার খুশিতে কেন বেগরা বাজাচ্ছেন?
সে মনের দুঃখ মনে রেখে ভোঁতা মুখে বসলো। শুধু বসলো তা না। তার ভেতরে বাহিরে সব কাঁপাকাঁপিও শুরু হয়ে গেলো। একে দেখলেই সে সহজ হতে পারে না। কেন, কেন, কেন? সে মনে মনে দোয়া করতে লাগলো। আল্লাহ ফাইয়ায ভাই যেন চলে যায়। তার ফোন বেজে উঠুক, তার ব্যবসায় আগুন লাগুক, তার বন্ধু – বান্ধুব কেওর হাত পা ভাঙুক। আল্লাহ রহম করো, এই শেষ বার করো। সব ঠিক থাকলে এই গুষ্টি থেকে বিদায়। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।
তার দোয়া কবুল হওয়ার কেন লক্ষণ দেখা গেলো না। বরং ফাইয়ায় আরো আরাম করে বসলো। আর তার এই আরামে রাইমার বারোটা বেজে গেলো। মেহমানরা যা বললো কোন কিছুরই ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলো না। এমনকি তার নিজের ভার্সিটির নামও। শুধু যে বলাবলিতে গন্ডগল করলো তা না। চা দিতে গিয়ে ছেলের মায়ের উপরে ফেললো। সেই চা মুছতে গিয়ে তড়িঘড়িতে টিস্যু নিতে গিয়ে শাড়িতে পা পেচিয়ে উষ্টা খেলো। খেয়ে দেয়ে নিজেকে সামলাতে গিয়ে ফুলদানিও ভাঙলো।
ভাঙা ফুলদানি তোলার আর তার সাহস হলো না। সে চোখ মুখ খিঁচে শক্ত হয়ে বসে রইলো। তার মাথা ঘুরছে। কেন? তার সাথেই কেন। মনে মনে তার হায় হুতাসের রেল গাড়ি শুরু হয়ে গেলো। তা না হলে, সে ঠিক দেখতো তার চাচাতো চাচার চাচাতো ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে হাসি, চোখে মুখে মুগ্ধতার ছড়াছড়ি।
রাইমা রুমে এসে হাঁফ ছাড়লো। মাথায় থেকে ঘোমটা ফেলে পা ছড়িয়ে বসলো। নিচু হয়ে বসে থাকতে থাকতে তার ঘাড়ের বারোটা বেজে গেছে। ধুর! এই এ্যারেঞ্জ ম্যানেজ কে করে? ইশ! তার একটা বয়ফ্রেন্ড থাকলে সে ঠিক ভেগে যেতো। সায়মার বাচ্চা সায়মা! নিজে তো গেছো পেয়ারের মানুষের সাথে আর আমাদের ফাঁসিয়ে গেছো কুদ্দুরআলিদের কাছে। তোর জীবনেও সুখ হবে না দেখিস।
তখনি সাবিহা আসলো! মেয়ের উদ্যেশ্য বললো,
— কাপড় খুলিশনি এখনো?
—- কেন! আমি পড়ে আছি তোমার সমস্যা কি?
—- আমার আবার কি হবে? ফাইয়াযের নাকি কি একটু কাজ আছে। তোকেও নাকি লাগবে ।
রাইমা লাফ দিয়ে উঠলো! তোতলিয়ে বললো,
— আমার সাথে তার কি কাজ?
—- কি জানি? শুধু বললো দু- মিনিট নাকি লাগবে। একটু নিচে যেতে বললো।
—- আমি পারবো না মা! যাও তো।
—- নিজেদের কাজে তো তাকে ইচ্ছে মতো খাটাও।আর তার কাজের বেলা যাও তো।
রাইমা কাতর গলায় বললো, — মা! কিছুক্ষণ আগে ছেলে পক্ষ এসে তোমার মেয়েকে দেখে গেছে। নাইটি নাইন পার্সেন পছন্দ। এখন বাসায় গিয়ে শুধু একটু বুঝবে। আর এমন সময় এই রাতের বেলায় একটা ছেলের সাথে যাওয়া ভালো দেখায়। বলো, ভালো দেখায়?
—- থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো রে রাইমা। ছেলে কি হ্যাঁ! বড় ভাই তোর। আর ওই নাইনটি নাইন পার্সেনও না হান্ড্রেড পার্সেন্ট হতো যতি একটা কাজও ঠিকঠাক করতি। এখন যা! ফাইয়ায দাঁড়িয়ে আছে। আর তাড়াতাড়ি আসবি। মেহমানদের মিষ্টি সবার বাসায় দিতে হবে।
রাইমা অবাক হয়ে বললো, — আমার বিয়ের মিষ্টি আমাকেই বিলাতে হবে নাকি?
—- যাবি তুই।
রাইমা ভোঁতা মুখে বেড়িয়ে আসলো। মরেও শান্তি নেই তার। এবার অবশ্য ঘোমটা টানলো না। আঁচল পেছন থেকে পেঁচিয়ে সামনে আনলো। শক্ত করে ধরলো। খুলে গেলে আবার আরেক ঝামেলা।
সে ধরেই ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসলো। তার আবার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। সে তো এটাই বুঝতে পারছে না তার সাথে ফাইয়ায ভাইয়ের কি কাজ?
সে বাইরে এসে অবাক হলো! ফাইয়ায ভাই সাদা রঙের শার্ট পরে সাদা রঙের একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও না তার গায়ে অন্য টির্শাট ছিলো।
সে ঢোক গিললো! সাদা তার প্রিয় রং। ফোনে একবার বলেছিলো। আর গাড়ি আসলো কোথা থেকে? তাও আবার সাদা। ফাইয়ায ভাইরা কি গাড়ি কিনেছে নাকি? কিনলে কিনতেও পারে। টাকা পয়সা তো কম কামাচ্ছে না। তাই বলে একই এলাকায়, দু- বাড়ি পরে বাড়ি। সেখান থেকে এখানে গাড়িতে আসতে হবে?
কি জানি ভাই, সে আর ভাবলো না! যা খুশি করুক, তার কি? নিজের জ্বলায় বাঁচে না। পরের চিন্তায় ঘুম হারাম করে লাভ আছে। এমনি তার হলুয়া টাইট হওয়ার অবস্থা। ধুর! বিয়েটাও মনে হয় সে শান্তিতে করতে পারবে না।
সে বহুত কষ্টে টেনে টুনে ফাইয়াযের সামনে দাঁড়ালো। ঢোক গিলে আস্তে করে বললো, — ডেকেছেন ভাইয়া?
ফাইয়ায সোজা হয়ে দাঁড়ালো! তার নিজেরও একটু অস্বস্তি হচ্ছে। হওয়ারই কথা! সে কাজ ছাড়া নিজের গুষ্টির কোন মেয়ের সাথে কোন কথা বলেছে কিনা মনে পড়ে না। অবশ্য বলতে গেলে এটাও এক ধরণের কাজ। তবে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কাজ।
সায়মার কাছ থেকে সব শুনেছে সে! সেই দিন যখন ফোন ধরলো! তখনি সে ধরে ফেলেছিলো। তবে শিউর হওয়ার প্রয়োজন ছিলো। কেননা! গত এক বছর সে এই কন্ঠটা খুঁজেছে। যে কোন নাম্বার থেকে ফোন আসলেই সে তড়িঘড়ি করে ফোন ধরেছে। কন্ঠটার হাসি, কথার শব্দ ছন্দের মতো কানে বেজেছে। কতো রাত যে চিন্তায় নির্ঘুম কেটেছে। একবার মনে হয়েছে, কেও দুষ্টুমি করেছে, আবার মনে হয়েছে কোন বিপদ হয়নি তো। এভাবে হঠাৎ করে হাড়িয়ে যাওয়ার মানে কি? সে যদি কথা বলতে না চাইতো, সে নিশ্চয়ই জোর করে ফোন দিতো না। যতোদিন ফোনে কথা বলেছে ততোদিন কোন সমস্যা ছিলো না। হয়তো হতোও না। যদি হঠাৎ হাড়িয়ে না যেতো।
এই মেয়ে কি জানে হঠাৎ হাড়িয়ে যেয়ে কি করেছে? তার চিন্তা, চেতনা, ধ্যান, জ্ঞান সব কিছুতে জেকে বসেছে। আর যখন জানলো কে! তার দুনিয়া আরো এলোমেলো হলো। এই এলোমেলো হওয়া থেকে নিজেকে সরানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো। পারলো কই! যখনি শুনলো তাকে দেখতে আসবে। পাগলের মতো ছুটে আসলো। এই মেয়ে কি বুঝতে পারছে কি করেছে সে? পুরো গুষ্টি দা, বটি তো ভালোই বোমা মেরে গুষ্টি থেকেই বের করেই দেয় কিনা কে জানে?
রাইমার কান্না পেয়ে গেলো ! তার মন বলছে গরমিল রে ভাই গরমিল। তা না হলে তার সাথে কি কাজ। হতে পারে ভাই। একই এলাকায় বড় হয়েছি। কই এতোদিনতো কোন দরকার পরেনি। তাও আবার দুধ সাদা হয়ে।
সে কেঁদেই দিলো। ছোট মোট জান তার আর কতো সইবে। এক বছর ধরে হাতিপাতি করে মরছে। আর কতো? সে কেঁদে বললো, — স্যরি ভাইয়া! সত্যিই স্যরি। আমি একদম জানতাম না ওটা আপনার নাম্বার। সব সায়মাদের দোষ। প্লিজ! কাওকে বলবেন না। যা শাস্তি দেওয়ার দেন। নিজেই দেন। এখনি দেন। বড়দের এর মধ্যে টানাটানি করার দরকার কি? আর পাক্কা প্রমিজ করছি! জীবনে আর এমন কোন কাজ করবো না।
ফাইয়ায হাসলো! তার হাসি অবশ্য রাইমা দেখলো না। সে হেসে মুগ্ধভরা চোখে তাকিয়ে রইলো! সোডিয়াম আলোর নিচে সবুজ শাড়ি পড়া এক রমনী। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার মনে হলো তার জীবনে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য সে আর দেখেনি।
সে বুকে অনেক সাহস নিয়ে দু- কদম এগুলো। সে জানে, এই এগুনের মূল্য তাকে অনেক কষ্টে শোধ করতে হবে। তবে যে মায়ায় সে পড়েছে। এই মায়া ছাড়লে মনে হয় না, বাকি জীবন আর ভালো থাকতে পারবে।
সে এগিয়ে শান্ত ভাবে বললো — তোকে দশ মিনিট সময় দেওয়া হলো। এই দশ মিনিট শুধু আমার কথা ভাববি। ভেবে যদি কিছু পাস তাহলে গাড়িতে আসবি, না হলে সোজা ঘরে চলে যাবি। আর এই ভাবার মধ্যে এই কথা টাও মাথায় রাখিস। একবার যদি গাড়িতে আসিস। আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানেই যেতে হবে। ফেরার কোন চান্স নেই।
বলেই ফাইয়ায গাড়িতে গিয়ে বসলো। বসে চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা রাখলো। মনে মনে বললো,— চলে আয় রাইমা! ভালো মনের ভালো মানুষদের প্রেমে ফেলতে নেই । তারা একবারই প্রেমে পড়ে। আর সেটা হয় ভয়ংকর। আর এই ভয়ংকর প্রেমের আগুনে আমি শেষ হয়ে যাবো।
রাইমা হা হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো। হতম্বভে সে কান্না টান্না সব ভুলে গেছে। ফাইয়ায ভাই বলতে চাইছে কি? এদিকে মোবাইল টাও আনেনি। আনলে দুটো কাজ হতো! গ্রুপে সবার সাথে পরামর্শ টা করা যেতে। আর সময় টাও দেখা যেতো! ধুর! দশ মিনিট কি হয়ে গেলো নাকি? সে আর ভাবলো না, তড়িঘড়ি করে গাড়িতে গিয়ে বসলো।
ফাইয়ায দীর্ঘশ্বাস ফেললো! চোখ না খুলেই বললো, — গাধী।
রাইমার আবার কান্না পেলো! ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না থামালো! থামিয়ে কোন রকম বললো, — আরো দশ মিনিট দেন। এবার সত্যিই ভাববো।
ফাইয়ায চোখ খুললো! সোজা হয়ে বসে বললো, — জীবনে ভেবে কিছু করেছিস?
রাইসা সাথে সাথেই উপর নিচ মাথা নাড়ালো! নাড়িয়ে বললো, —- হ্যাঁ করেছিতো! ঐ যে আপনাকে হাজার টাকা ফ্লাক্সিলোড করলাম।
ফাইয়ায হেসে ফেললো! হেসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললো, — গুড! ভেরি গুড! গাড়িতে যখন এসেই পড়েছিস, তোর আর কোন ভাবাভাবির দরকার’ই নেই। আজ থেকে সেই ডিপার্টমেন্ট আমার। তোর কাজ হলো ফোনে যেমন সব কথায় খিলখিল করে হাসতি, আজকে থেকে আমার বুকে মাথা রেখে হাসবি।
রাইমা দরজা খুলতেই ঝটকা খেলো। এতোটাই যে ঝটকায় তার হাতে রাখা বই আর জগ নিচে পড়ে গেলো। ভাগ্যিস প্লাস্টিকের! তা না হলে খবর ছিলো। সে তড়িঘড়ি করে উঠাতে গেলো। সেখানেও বিপত্তি ঘটে গেলো। তড়িঘড়িতে নিচু হওয়াতে তার গলা থেকে ওড়না পড়ে গেলো।
সে হতোম্ভব! সে বই ধরবে, জগ উঠাবে, না ওড়না ধরবে, না নিচু হওয়াতে যে অপ্রিতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা সামাল দেবে।
সে আর ভাবলো না। সব জাহান্নামে যাক। সে সব রেখেই দিলো ভৌঁ দৌড়। ইশ! কি লজ্জা! কি লজ্জা! তার সাথেই কেন এমন হয়?
সে তো ভাই আপনমনে পড়ছিলো। চুলায় রান্না! কলিংবেলের শব্দে মা ভেবেছিলো দুধওয়ালা। এই সময় ভর দুপুরে তাদের বাসায় একমাএ সে’ই তো আসে। তাই মা চেঁচিয়ে বললো দুধ রাখতে। সেও আর ডানে বামে তাকায়নি। টেবিল থেকে জগ নিয়ে ডাইরেক্ট দরজা খুলে ফেলেসে। ইশ কেন যে না দেখে খুলেছে।
ফাইয়ায ঢোক গিললো! সে নিজেও হতোম্ভব। সে নিচু হয়ে বই, জগ, ওড়না তুললো। ওড়না তুলতে গিয়ে তার হাত কাঁপতে লাগলো। সে মনে মনে নিজেকে নিজেই শাসালো। বোন লাগে তোর, বোন! ছোট মানুষ! হঠাৎ দেখে আঁতকে গেছে।
অবশ্য কেন যে এতো আঁতকে উঠে ফাইয়ায নিজেও জানে না। এই মেয়ে বলতে গেলে তার সামনেই আসে না। ভুল ক্রমে পড়ে গেলেও এইরকম আচরণ । সমস্যা টা কোথায় ?
সে নিজে খুবই শান্তশিষ্ট, ভদ্র টাইপ ছেলে। উঁচু গলায় কখনও কেওর সাথে কথা বলেছে বলে মনে পড়ে না। কাজিন মহলে সে মাই ডিয়ার টাইপ। যে কোন প্রয়োজনে, যে কোন সমস্যায় সবাই আগে তাকেই জানাবে। তবে এই মেয়ে ভিন্ন! এমন না ছোট বেলা থেকে। আগে তো ভালোই ছিলো। দেখা সাক্ষাৎ, কথা কম হলেও অনন্ত স্বাভাবিক আচরণ করতো। কিন্তু গত এক বছর এমন আচরণ করছে কেন কে জানে?
সে আর ভাবলো না! বই ওড়না সোফায় রাখলো। কাজিন টাজিন নিয়ে যতো কম ভাবা যায় ততো ভালো। সে ভেতরে এসে চাচাকে ডাকলো, কাজ আছে তার । এসব হাবি জাবি জিনিস নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্টের মানে হয় না।
তার মানে না হলেও রাইমা নিজের রুমে এসে কেঁদে ফেললো! আয়নার সামনে এসে বেশ কয়েক বার উঁচুনিচু হলো। কতোটুকু চিচিংফাঁক হয়েছে কে জানে। আল্লাহ! মাটি ভাগ করো আমি ঢুকে যাই। এই লজ্জা সে কোথায় রাখবে। এমনিতেই সে এক অকাজ করে রেখেছে। তার মধ্যে আবার এই সব। ধুর! বলেই সে মোবাইল নিলো। গ্রুপে ঢুকেই উরাধুরা গালিগাজ টাইপ করতে লাগলো। এই শয়তান, এই শয়তানগুলোর জন্যই তো সে ফেসেছে। এখন না আছে শান্তি, না আছে স্বস্তি।
ফাইয়ায ভাই তার চাচাতো চাচার ছেলে। একই এলাকায় ছোট থেকে বেড়ে ওঠা। এই তো তাদের বাড়ির দু- বাড়ি পরেই বাড়ি। খুবই ভদ্র, নম্র টাইপ ছেলে। গুষ্টির যে কোন বিপদে আপদে সবার আগে সে’ই ঝাঁপিয়ে পড়ে । এই ভালো মনের ভালো মানুষটা কে সে খুবই সম্মান করে। কিন্তু গিট্টু লাগিয়ে ফেলেছে তার সমবয়সী কাজিনরা। তাদের সবার একটা স্পেশাল, সিক্রেট গ্রুপ আছে। সেখানে তারা নানা রকম দুষ্টুমিসহ গেম টেম খেলে। সেই দিনও খেলেছিলো।
সেই দিন ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে কুফা মার্কা দিন। যাই করেছে হেরেছে। আর এই গ্রুপের রুলস হলো। যে হারবে সবাই মিলে তার জন্য একটা শাস্তি ঠিক করবে। আর তার শাস্তি হয়েছিলো একটা নাম্বার! এই নাম্বারের মালিক ছেলে হোক মেয়ে প্রেমে ফেলতে হবে। আর না হলে সাবাইকে স্পেশাল ট্রিট।
প্রথমে সে রাজি হয়নি। কে না কে। কিন্তু রাজি না হয়েও উপায় কি। এতো গুলো ভেরার পালকে খাওয়াতে গেলে সে ফকির হয়ে যাবে। তাই আল্লাহ, আল্লাহ করে এই পথেই নেমে পড়লো। কে জানবে? কাম খতম, নাম্বার হজম।
ফাইয়ায ভাই ব্যবসায়ী মানুষ। তার দু- তিনটা নাম্বার আছে। শয়তান গুলো যে তার মধ্যে থেকে অচেনাটা ই তাকে দিয়েছে, সে কল্পনায়ও ভাবেনি। ফাইয়ায ভাই জেন্টলম্যান টাইপ ছেলে। কোন বদ দোষ টোষ নেই। তার জন্য টুকটাক মেয়ে দেখা টেখা হচ্ছে, আমরাও দাঁত টাঁত মেজে রোস্ট খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ব্যাস পছন্দ হলেই বিয়ে। তাই এরকম কিছুতে সে কি গলবে? এখানে আমার হার নিশ্চিত আর তাদের ট্রিটও। তাই তারা নিশ্চিন্তেই নাম্বারটা দিয়েছিলো।
কিন্তু সেও তো রাইমা! কাজের ক্ষেএে তার ব্রেইন কাজ না করলেও অকাজের ক্ষেএে দৌড়ে চলে। তাই এটা ফাইয়ায ভাইয়ের নাম্বার না জানলেও। এটা ঠিক জানতো সোজা কেওর নাম্বার এরা দেবে না। তাই ডাইরেক্ট ফোন না দিয়ে সে গেলো একটু ভিন্ন রাস্তায়। হাজার টাকা ফ্ল্যাক্সিলোড করে ফেললো। তারপরে চুপ! এখন আল্লাহ ভরসা! ট্রিটের টাকা বাঁচাতে এখন না তার হাজার টাকাই জলে যায়। সে আল্লাহ, আল্লাহ করতে লাগলো। মনে মনে বললো, — আল্লাহ আমও বাঁচাও ছালাও বাঁচাও।
তারপরেই তো কাঙ্খিত ফোনটা আসলো । নারী জাল বিছাবে সেই জালে পুরুষ ফাঁসবে না তা কি করে হয়। কতো বড় বড় যোগী তপস্বীর তপস্যা ভঙ্গ করে ফেলে এই নারী। এ আর কোন ছাতার মাথা। হুহ্!
রাইমা রিসিভ করে লজ্জিত মাখা কন্ঠে বললো, — ইটস ওকে! আমারই ভুল। আমার ভুলের জন্যই হয়েছে, আপনার কষ্ট করে ফেরত দিতে হবে না।
ফাইয়ায ভাই তো ফাইয়ায ভাই। আমাদের গোষ্ঠীর মানবতার ফেরিওয়ালা। অন্যের ভুলের টাকা সে হজম করবে এটা হয়? সে ব্যস্ত হয়ে গেলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
তার এই ব্যবস্তারই রাইমা সুযোগ নিলো। প্রথমে টুকটাক কথা। হাই, হ্যালো টাইপ! ব্যাস সেখান থেকেই শুরু। আস্তে আস্তে দিনে, তারপরে রাতে। সময় অসময় অসংখ্য মেসেজ আদান প্রদান হতে লাগলো।
না প্রেম না! রাইমা বোকা হতে পারে তবে এটা ঠিক জানে সেঁধে কোন ইঙ্গিত দেওয়া যাবে না। সে তো শুধু টুকটাক কথায় এইটুকুই বুঝিয়েছে, আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি।
ফাইয়ায ভাইও সেটাই বুঝেছে। তাই সেও কথা বলেছে নির্দ্বিধায়। দু- জনের মধ্যে যখন ভালো একটা আন্ডাস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়ে গেলো, তখনি তো লাগলো আসল গেঞ্জাম।
তাদের এক কাজিনের বিয়ে। গায়ে হলুদের ড্রেস কোর্ড নীল। বিয়ের আনন্দের মাঝেই মেসেজে টুকটাক কথা হচ্ছিলো। সেই কথার মাঝেই জানতে পারলো, সেও বিয়েতে। রাইমা মাথা ঘামায়নি। শীতের সিজন মানেই তো বিয়ের সিজন। মিলে যাওয়া ব্যাপার না। মাথা তো ঘামালো তখন যখন জানতে পারলো তাদের ড্রেস কোর্ড ও নীল। তার কলিজা খাবলে উঠলো। দুটো জিনিস মিলে যাওয়া আর যাই হোক, কাকতালীয় হতে পারে না।
তাকে কার নাম্বার দিয়েছে এরা। সে সাথে সাথেই টাইপ করলো, ” আপনার যে কাজিনের বিয়ে সে ছেলে না মেয়ে?
উত্তর এলো মেয়ে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে আবার মেসেজ টাইপ করলো ” নামটা জানতে পারি?
ব্যাস কাম খতম! ওপাশ থেকে যে নাম আসলো, রাইমা দেখে সাথে সাথেই তার হাত মাথায় চলে গেলো। সর্বনাশ! সে সাথে সাথে মোবাইল অফ করে সিম খুলে ফেললো। খুলে দৌড়! সব কয়টাকে ধরে এক সাইডে আনলো। এক প্রকার গলায় চেপে ধরতেই তারা সাথে সাথেই স্বীকার করলো।
রাইমা নতুন শাড়ি নিয়েই মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো। আল্লাহ! এখন কি হবে। যদি কোন ভাবে জানে! ফাইয়ায ভাই তো ভালোই, তার নিজের বাবা, মাই তাকে ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলবে। তাদের গুষ্টিতে কাজিন টাজিনের মধ্যে বিয়ে তো দূরের কথা। প্রেম, ট্রেমও কেও করেনি। এটা সবার অপছন্দ। তাদের এক কথা, ভাই বোন মানে ভাই বোন। এখানে খালাতে, মামাতে, চাচাতো বলে কোন কথা নেই।
সবাই তাকে মিলে সান্তনা দিলো! এমন কিছুই হয়নি। কথাই তো বলেছিস। আর তাছাড়া কে বলবে। মুখ খুললে কি তারাও ফাসবে না। তাই চিল! কতো আকাম করে মাটি চাপা হয়ে গেছে। এ আর কি। চিল ভাই চিল। তুই এই পর্যন্ত গিয়েছিস তাতেই আমাদের জন্য অনেক। তুই জিতেছিস! আমরা সবাই মিলে এখন তোকে ট্রিট দেবো।
রাইমা খুশিতে বাকবাকুম ! তাইতো জানছে কে? সে ট্রিট হজম করলো ভালো ভাবেই। কিন্তু ফাইয়ায ভাইকে করতে পাড়লো কই। ও যে বলে না, চোরের মন পুলিশ, পুলিশ। তারও সেই অবস্থা। ফাইয়ায ভাইকে দেখলেই তার কলিজা কাঁপতে থাকে, গলা শুকিয়ে যায়। মনে হয় এই বুঝি ধরে ফেললো।
যদি ধরে ফেলে? এই কথা কল্পনা করলে, কল্পনার মাঝেই তার রুহু কেঁপে উঠে। কিভাবে ফেস করবে সে? এমন না আগে গলায় গলায় ভাব ছিলো। তবুও যতো সম্ভব এড়িয়ে ই চলতে লাগলো । কিন্তু কপাল খরাপ হলে যা হয় আর কি? কিভাবে কিভাবে যেন দেখা হয়েই যায়। যেমন আজ হলো। এই দুঃখে রাইমা কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেললো। নাকের পানি চোখের পানি দিয়ে খাট বালিশ টইটুম্বুর করলো। ফাইয়ায ভাইয়ের কন্ঠ ড্রয়িং রুম থেকে যতোবার তার কানে আসলো, ততোবার দেওয়ালে মাথা ঠুকলো। কেন, কেন তার সাথেই কেন?
তারপর অবশেষে হাত পা ছড়িয়ে লম্বা ঘুম দিলো। তার এই ছোট্ট জানে আবার বেশি লোড নিতে পারে না। তার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার পরে, ফোনের শব্দে। ফোন দিয়েছে সায়মা। সেও তাদের কাজিন। আর তার গল্পের মেইন কালপ্রিন্ট হলো এ। ভাইয়ার ব্যক্তিগত নাম্বার টা তো এ’ই দিয়েছিলো।
সে ফোন ধরলো না। মর তুই! কিন্তু ফোনের উপর ফোন দেখে থাকতেও পারলো না। শেষ মেষ ধরলো! ধরতেই সায়মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, বড় একটা আকাম করে ফেলেছি বোইন। প্লিজ হেল্প মি?
রাইমা বিরক্তমুখে উঠে বসলো। এ আবার নতুন করে করেছে কি ? সে বিরক্ত মুখেই বললো, —- কি হয়েছে?
—- আমি বিয়ে করে ফেলেছি রে ।
রাইমা প্রথম খেয়াল করেনি। এই মেয়ে সব সময় কোন না কোন আকাম করতেই থাকে। তাই স্বভাব মতো বললো, — ও! সাথে সাথেই সে ঝটকা খেলো। খেয়ে বললো, — কি করেছিস?
রাইমা হা হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। তারপর গ্রুপে ঢুকো সবাই কে জানালো। জানিয়ে কোন রকম রেডি হলো। এবার অবশ্য ভুল করলো না। দুই সাইডের ওড়নার ইচ্ছে মতো পিন মারলো। তার মাংস খুলে যাবে। তবুও না খুলবে পিন, না পড়বে ওড়না।
ইচ্ছেমতো পিনটিন মেরে সে বেড়িয়ে এলো। এখন একমাএ ভরসা ফাইয়ায ভাই। লাজ লজ্জা সব এখন জাহান্নামে। তাকে কি আর আজ নতুন দেখেছে। হাফ প্যান্ট, ফুল প্যান্ট সব কিছুতেই দেখা শেষ। না হয় আরেকটু বেশি দেখেছে। এই আর কি?
সে ফাইয়ায ভাইদের বাসায় এসে শুনলো সে বাসায় নেই। না থাকারই কথা। এই ভর সন্ধ্যায় কোন ছেলেই বাসায় থাকে। সে এখন কি করবে? ফোন তো সে মরে গেলেও দিবে না। যদি কন্ঠ শুনে চেনে ফেলে। সে টেনশনে হাবুডুবু খেতে লাগলো। খেতে খেতেই মাথায় বুদ্ধি এলো। মেসেজ করি! হারামি তো বিয়ে করেই ফেলেছে। কি দরকার এখন এতো তড়িঘড়ি করার।
সে মেসেজে বিস্তারিত লিখলো! লিখে পাঠিয়ে দিলো। এখন নিজে থেকেই সায়মার সাথে যোগাযোগ করে নিবে।
সে নিশ্চিন্তেতে বাসার দিকে রওনা দিলো। কিছুদূর যেতেই ফাইয়ায ভাইয়ের ফোন আসলো। তার কলিজা কেঁপে উঠলো। এখন কি করবে? আল্লাহ! কি করবে? কি করবে, করতে, করতে ফোন কেঁটে গেলো।
—- কোথায় তুই?
রাইমা ঢোক গিললো! গিলে আস্তে করে বললো, — বাসার সামনে। বলেই চোখ বন্ধ করে ফেললো।
ওপাশে নিশ্চুপ! রাইমা মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলো! এই দোয়ায় ইউনুস নবি মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আর আল্লাহ তাকে এই সামান্য বিপদ থেকে রক্ষা করবে না?
রাইমার দোয়া কবুল হলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে কিছুক্ষণ পরে ফাইয়ায শান্ত ভাবে শুধু বললো, — সায়মা দের বাসায় যা। সুন্দর করে বুঝিয়ে বল। এদিকটা আমি দেখছি।
রাইমা হাঁফ ছাড়লো! যাক বাবা বেঁচেছে। মনে মনে ঠিক করলো! আজকের দুপুরের ঘটনা না ভোলা পর্যন্ত আর এর সামনে যাবে না। উঁহু! একদম না।
তার একদম না, একদমই কাজ করলো না। পরের দিনই দেখা হলো। সায়মাদের বাসায়! সায়মার শুশুর বাড়ি, বাবা বাড়ি দু- পক্ষের মিটিংয়ে। আর এই মিটিংয়ের মধ্য মণি ফাইয়ায ভাই। তার কথা, তার সুন্দর ভাবে বোঝানো, সব কিছু সুন্দর ভাবে সামাল দেওয়া। সব সব রাইমার ভেতরের অপরাধবোধ আরো বাড়িয়ে দিলো। ইশ! কিভাবে করলো সে? আর কেও না জানুক, সে তো জানে শেষের দিনের কথা গুলোর গভীরতা কতোটুকু ছিলো। নিশ্চয়ই তাকে হাজার বার ফোন দিয়েছে। এছাড়া তো খোঁজার আর উপায় নেই। নামটাও বলেছিলো মিথ্যা। আহারে বেচারা! কতো রাতের ঘুম হারাম হয়েছে কে জানে?
তার দুঃখের কথা চিন্তা করে রাইমা নিজেই দুঃখে চোখ, মুখ ফুঁলিয়ে বসে রইলো। মনে মনে আল্লাহ কে বললো, ” এই ভালো মনের ভালো মানুষটার সাথে এই নোংরা গেইমটা না খেললে হতো না? শয়তান যখন ওই শয়তান গুলোকে কুরকুরি দিচ্ছিলো। তখন তুমি কি করেছো। দু- একটা ঠাটা কি এদের মাথায় ফেলতে পারলে না? এতো এতো ঠাটা রিজার্ভে রেখে হবেটা কি? যদি এরম শয়তানদের মাথায় দু- একটা নাই ফেলতে পারো। হুহ্!
রাইমার হায়, হুতাস মনে মনে চলতেই থাকলো। সে যদি একটু থেমে আশেপাশে নজর দিতো। তাহলে সে ঠিকিই দেখতো পারতো, এই কিছু সময়ের মাঝে তার ভালো মনের ভালো ফাইয়ায ভাই তার দিকে কতোবার তাঁকিয়েছে।
গমগমিয়ে বৃষ্টির আওয়াজ রোজকার মতো আজ আর স্নিগ্ধ মোহময় হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে না। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো শোনাচ্ছে কোনো এক কিশোরীর আর্তনাদের ন্যায়। এমনটাই অনুভূত হচ্ছে কাঁচের তৈরি আবদ্ধ কক্ষে।
মাথায় ভারী জিনিস রাখা এমন লাগছে প্রানেশার।
ঘ্রাণ শক্তি লোপ পেয়েছে। নাকি, এখানে ঘ্রাণের কোনো উৎসই অবশিষ্ট নেই! বুঝতে পারছে না প্রানেশার অবচেতন মন৷
চেতনা ফিরেনি এখনো তার। ঘুমঘুম দেহে নরম শরীরটা উঠিয়ে বসালো প্রানেশা। চোখ কচলে নিলো।
চারপাশে হালকা ঝাড়বাতির আলো ৷ চোখ মেলতেই চারপাশের পরিবেশ অচেনা মনে হলো। পুরো রুমের নকশাই আলাদা৷ রুম বললে বোধ হয় ভুল হবে৷ এত বড় রুম হয়! কেমন গা ছমছমে।
ঘুমের ঘোর কাটতেই মনে পড়লো সে তো পরীক্ষার হলের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইভানান হঠাৎ তার মুখে রুমাল চেপে ধরলো। তারপরই সব অন্ধকার। অর্থাৎ,তাকে ইভানান কিডনেপ করে ফেলেছে।
সুফিয়ান নিশ্চয়ই খুঁজছে তাকে! সুফিয়ান কী জানে ইভানানের এই জঘন্য অপরাধের কথা? মনে একের পর প্রশ্ন দলা পাকিয়ে বেরিয়ে এলো। বিছানা থেকে নামতে নিতেই চমকে উঠলো। একি! তার পা অবশ হয়ে আছে। পা পাথরের মতোন লাগছে। অদ্ভুত! কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। এটা কী করে হলো!
খট করে দরজা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়লো। হালকা আওয়াজে দরজাও আঁটকে নিলো। প্রানেশা চোখ তুলে চাইতেই সামনের দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠলো ইভানানের চেহারা। আবছা আলোয় কী ভয়ংকর দেখাচ্ছে নীল চোখদ্বয়! প্রানেশা পেটের কাছটা খামচে ধরে রেখেছে। চিনচিনে ব্যথা উঠছে। ছয় মাসের পর থেকেই এমন ব্যথা করে। আজ পরিমাণ বেশী। শরীর নাড়াতে না পেরে ব্যথাটা বেড়ে যাচ্ছে। ইভানান বেডের মাঝ বরাবর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রানেশার হাত মৃদু কাঁপছে। ইভানান যদি খারাপ কিছু তার সাথে করার চেষ্টা করে, এই রকম শরীর নিয়ে প্রানেশা হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারবেনা। এ ভেবেই অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। ইভানান অদ্ভুত স্বরে বললো –
ইভানান হাসলো ৷ ভয়ংকর হাসি। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়ার ন্যায় হাসি। প্রানেশার কাছে এসে কিছুটা ঝুঁকে গালের উপরে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিলো। হাসিমুখেই প্রানেশার নরম কোলে মাথা রেখে হাত ভাজ করে শুয়ে পড়লো। প্রানেশার গা অস্বস্তিতে গুলিয়ে আসতে শুরু হলো৷ দুই হাতে ধাক্কা দিয়ে মাথাটা নিচে নামিয়ে দিলো। ইভানানের ঘুমন্ত রাগ ডগমগিয়ে উঠলো। তেড়ে এসে প্রানেশার গাল চেপে ধরলো। সাপের মতো ফেনা তুলার ভঙ্গিতে বললো-
‘একদম চুপ! আমাকে রাগান্বিত করবেন না স্রোতস্বিনী
এর ফল ভালো হবে না ‘
‘স্রোতস্বিনী, আপনি জানেন আমরা এখন কোথায় আছি? ‘
থেমে নিজে নিজেই বললো –
‘নীলগিরি ‘
উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পদে হেঁটে লম্বা কাঁচে ঘেরা জানালাটা খুলে দিলো। বৃষ্টির বেগ হালকা হয়ে এসেছে। সামনেই ছোট নদীর স্বচ্ছ পানির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটা ইভানানের অদ্ভুত সুন্দর মনে হচ্ছে। হবেই না বা কেনো! তার স্রোতস্বিনী যে তার কাছে। কত সাধনাই না করেছে সে এই দিনের অপেক্ষায়। প্রানেশার দিকে এগিয়ে আসলো। প্রানেশা ভয়ে কাতর হয়ে গুটিয়ে বসে আছে। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –
থেমে আবার বললো- ‘কিন্তু, এরপরও কেনো এসব করছি জানেন? ‘
প্রানেশার কোমল গালে দুই হাত রেখে বললো –
‘শুধু মাত্র আপনার জন্য স্রোতস্বিনী!কারণটা আপনি’
প্রানেশা অবাক চোখে বললো-
‘আমি! ‘
‘হ্যা, সেই প্রথম দিন আপনাকে যখন দেখলাম জানিনা কী হয়েছিলো আমার। দুনিয়াটাই উলোট পালোট করে দিয়েছিলো। রাতের নিদ্রাহীন প্রহরের সৃষ্টি করেছিলেন। ইনায়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি অন্য ভাবে নিতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম রেয়ান আর ছোট চাচিকে চিরদিনের জন্য ওর থেকে কোনোভাবে দূরে সরিয়ে দিবো। রেয়ানটা তো বোকা ৷ ওকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসবো। কিন্তু, সুফিয়ান আরও একবার আমার আপনজন কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। আমার স্রোতস্বিনীকে নিজের করার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছিলো। অসহ্য লাগতে শুরু করলো আমার। দিনরাত নিজের ভালোবাসার মানুষের কথা অন্য কারো মুখে শুনতে শুনতে হৃদয়ে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন সুফিয়ানের মুখে শুনলাম আপনিও ওকে ভালোবাসেন। সহ্য করতে পারিনি আর। মনে মনে ভেবে নিলাম, আপনাকেও বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ওকে একেবারে নিঃশেষ করে দেবো। রেয়ানকে ধীরে ধীরে বোঝালাম সুফিয়ান ওর ভালো চায় না। রেয়ান প্রথমে বিশ্বাস না করলেও আমি বারবার এক কথা স্মরণ করানোতে বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করলো। সবই মস্তিষ্কের খেলা। ততদিনে রেয়ান আমার বশে। ফুলপ্রুভ প্ল্যান সাজিয়ে নিলাম। যেদিন সুফিয়ানের কনসার্ট। সেদিন কনসার্টের চেয়ে বেশি আপনার সাথে দেখা করার জন্য উৎফুল্ল ছিলো৷ আমিই ওর এক্সিডেন্ট করিয়ে দিলাম।
আরেকটু সহজ হলো আমার জন্য, ওর গলায় সমস্যা
হয়ে গেলো। আমার উদ্দেশ্য ছিলো ওকে আপনার কাছে পৌঁছাতে আটকানো। যেভাবেই হোক ৷ কিন্তু গলায় আঘাত পাওয়াটা সম্পূর্ণ প্ল্যানের বাহিরে। রেয়ান যে গাইতে পারে এটা আমার প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ালো৷ আমি ওকেই গানের দুনিয়ায় মগ্ন করে তুললাম। ক্যারিয়ার থেকে ওর নিজের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।
ততদিনে ওকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। আমি গেলে আপনি হয়তো আমাকে মেনে নিতেন না। কারণ কোনোকিছুই আমার সঙ্গে মিলতো না। কিন্ত, আপন ভাই হওয়ায় রেয়ানের সঙ্গে মিলে যায়। রেয়ান আমার কথায় উঠবে আর বসবে বলেই আমি ওকে আপনার কাছে পাঠালাম। রিলেশনে আপনার সাথে থাকলেও আমরা কথামতো চলতো৷ সুফিয়ানকে ইমোশনাল করে ওর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমালাম। লোকজন লাগিয়ে রাখলাম টাকা দিয়ে যাতে সুফিয়ান বাংলাদেশের কোনো খবর না পায়।
আমার উদ্দেশ্য ছিলো ওকে একটা ধাক্কা খাওয়ানো। যেদিন ওর জন্মদিন সেদিনই তনিমকে মুক্ত করে দিলাম। বোকাটা বোঝেইনি, যে সবই আমার প্ল্যান।
সুফিয়ান কীভাবে যেনো সব ঠিকঠাক করে আপনাকে বিয়ে করে নিলো৷ সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো বটে। ‘
প্রানেশা বিস্ময়ে বিভোর হয়ে গেছে। একজন মানুষ কতটা নিচুস্তরের হতে পারে! ঘৃণায় মুখ কুঁচকে রইলো।
ইভানান অস্থির কন্ঠে বললো-
‘আমার কিচ্ছু চাইনা স্রোতস্বিনী। আপনি আমার হয়ে যান৷ খুব ভালোবাসবো আপনাকে। আর কারো ক্ষতি করবো না ‘
প্রানেশা ধাক্কা দিয়ে গালে রাখা হাতটা সরিয়ে দিলো।
চিৎকার করে বললো –
‘পাগল আপনি। একে ভালোবাসা বলেনা। পাগলামো বলে। যে নিজের আপন বন্ধুর সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করে সে আমাকে কী করে ভালোবাসে! ‘
ইভানান হিংস্র রুপে বললো-
‘হ্যা, পাগল হয়ে গেছি আমি! এই পাগলেরই হতে হবে আপনার। ‘
পরমুহূর্তেই আদুরে কন্ঠে বললো –
‘আপনার সন্তানকেও আমি নিজের সন্তানের চোখে দেখবো। কোনো অবহেলা হবে না। তারপরও বিয়ে করুন, আপনি আমায় ভালোবাসুন ‘
প্রানেশা কোনো কথা না শুনে নামার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু পা দুটো নাড়াচাড়া করা যাচ্ছেই না। কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। ইভানান হেঁসে বললো –
‘আপনাকে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। আগামী এক ঘন্টায় আপনার পায়ের অবশ ভাব সরবেনা। বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই ‘
প্রানেশা চিল্লাতে চিল্লাতে বললো-
‘কেনো করলেন এমন? ‘
‘এমন না করলে যে আপনি বারবার চলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন! আপনাকে বেঁধে রাখতে হবে। কষ্ট হবে আপনার, আর তা আমি কী করে সহ্য করবো বলুন তো!’
প্রানেশা বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো সে। এখন যে পা নাড়াতে না পেরে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই ছয় মাস হওয়ার পর থেকে এক জায়গায় বেশি সময় বসলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর এখন তো ইয়াত্তাই নেই। সেই কখন থেকে পা অবশ। নাহ, এই পাগলকে অন্য কায়দায় বোঝাতে হবে। প্রানেশা বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে বললো-
‘দেখুন, আপনি যা করছেন তা সবার জন্যই ক্ষতিকর। আমি বিবাহিত, কয়েক দিন পর এক বাচ্চার মা হবো৷ আমাকে বিয়ে করে কী লাভ! আমি সুফিয়ানকে ভালোবাসি। ‘
ইভানানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। তেড়েমেড়ে এসে প্রানেশার গলা চেপে ধরলো। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো প্রানেশার। মুহূর্তেই চোখ উল্টে আসতে শুরু করলো৷
আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে মৃত্যু অতি সন্নিকট হবে। ইভানান রাগের মাথায় প্রানেশাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো ফ্লোরে । প্রাণ সঞ্জিবনী ফুরিয়ে আসলো বোধ হয়। তলপেটের দিকটা ছিড়ে যাওয়ার মতো ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।
হঠাৎ সম্বিত ফিরলো ইভানানের। নিচে নেমে উঠাতে যাবে এমন সময় কে যেনো লাথি মেরে দরজা খুলে ফেললো৷ চমকে তাকালো সেদিকে৷ সুফিয়ানের মতো মনে হলেও ধরে ফেললো এটা রেয়ান।
অনেকক্ষণ ধরেই বাহিরে দাঁড়ানো ছিলো সে৷ ইভানানের প্রতিটি কথাই শুনেছে সে৷ মস্তিষ্ক রাগে টগবগ করছে। বিশ্বাসই করতে পারছেনা যে, ভালো মানুষীর মুখোশ পড়ে কত বিচ্ছিরি এক খেলা খেলছিলো। অস্ট্রেলিয়ায় ইভানানের বাড়িতেই ছিলো। ইভানান এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে ফিরেছে। রেয়ানের অফিসের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেও ফিরে এলো৷ ইভানানের বান্দরবনে আসার কথা বাড়ির কেয়ার টেকারের থেকে শুনলো। নীলগিরিতে কী করছে ভেবে পেলো না সে। কারণ পেইন্টিং এর কাজ এখন সিলেট ছিলো৷ ইভানান হয়তো জানতো না টেক কেয়ার ওর নীলগিরিতে থাকার কথা বলে দেবে। রেয়ান যে সব সত্যি জেনে গেছে এটা বুঝতে পারলো।
রেয়ান দ্রুত পদে এগিয়ে আসলো৷ ইভানানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। তুমি এমন জঘন্য মানুষ,ছি! ‘
থেমে উত্তেজিত কন্ঠে বললো-
‘আমি সুফি ভাইকে সব বলবো। এখনই ডেকে আনছি’
প্রানেশার আর্তনাদের পরিমাণ বাড়ছে। প্রানেশার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো তার। অজান্তেই সবার অপরাধী হয়ে গেছে সে। নিজেকেই একবার ধিক্কার দিয়ে উঠলো মনে মনে রেয়ান ।
পরমুহূর্তেই দৌড়ে বেড়িয়ে সুফিয়ানকে খবর দিতে নিলেই পেছন থেকে ইভানান পাশের ফুলদানি দিয়ে মাথায় আঘাত করলো৷ দুনিয়া ঘুরে উঠলো রেয়ানের।
ঘাড় বেয়ে নামতে লাগলো লহুর সরু লাইন। ফ্লোরে পড়ে থেকে রেয়ানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রানেশা। কিছুই যেনো করার নেই৷ সুফিয়ান না আসা পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব হবে না। রেয়ান লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে,হালকা জ্ঞান আছে । ইভানান পাগলের মতোন হাসতে হাসতে প্রানেশার দিকে ঝুঁকে বললো-
‘এত দিনের স্বপ্ন কী করে ধুলোয় মিশে যেতে দেই বলুন স্রোতস্বিনী! আপনি যে আমার বহু আকাঙ্খিত নারী। কত কিছু করেছি আমি আপনার জন্য। আপনি বাঁচলে শুধু আপনার নীল পুরুষের জন্য বাঁচবেন। যে আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেবো আমি। ‘
প্রানেশার ব্যাথার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মুখ নীলচে রঙ ধারণ করছে। সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ইভানান বললো-
‘আপনার কষ্ট হচ্ছে স্রোতস্বিনী?আরেকটু কষ্ট সহ্য করুন আমি ডাক্তার ডাকছি৷ ‘
প্রানেশাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো। এক ঘন্টার মতো হয়ে এসেছে প্রায়। প্রানেশা পা দাপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। ইভানান মোবাইল নিয়ে কল করে পেছনে ফিরতেই কিছু পড়ার আওয়াজ আসলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুফিয়ান ভেতরে ঢুকে পড়লো। ইভানান চমকে উঠলো। এত কড়া নিরাপত্তা ভেঙে কী করে প্রবেশ করলো বুঝতে পারছে না সে ৷ সুফিয়ানের শরীর ঘামে ভিজে একাকার। সেই সকাল থেকে প্রানেশাকে না পেয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে । কোথায় যেতে পারে ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিলো না। ফোনটাও রাস্তায় একটা দোকানের সামনে পেলো৷ অনেক খোঁজ খবরের পর নীলগিরিতে আসার খবর পেলো শেষমেষ।
প্রানেশাকে চিৎকার করে কাঁদতে আর রেয়ানকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সমস্ত রাগ দাউদাউ করে জ্বলজ্বল করে উঠলো৷ বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখে এতদিনের সকল অপরাধ ক্ষমা করেছিলো। অথচ, ইভানান এখনো শুধরায়নি। এবার আর কোনো ক্ষমা নেই। সোজা ইভানানের গালে চড় বসিয়ে দিলো। কলার টেনে দুটো ঘুষি মেরে বললো-
‘তোকে এবার আর ক্ষমা করবো না৷ তুই না মরা পর্যন্ত শান্তি হবেনা আমার৷ সব সীমা লঙ্ঘন করে ফেললি ‘
আকাশের রঙ আজ পরিষ্কার। গাছে গাছে নতুন ফুল ফুটেছে ৷ ফুটবেই তো আজ যে বসন্ত! বসন্তকাল জুড়েই তো নানা রঙের ফুল ফলালির ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা। রাস্তায় লাল ফুল বিছিয়ে পড়ে আছে। প্রকৃতি নতুন রঙে সেজেগুজে নবাবী ভঙ্গিতে হাসলো যেনো। আহা! এই সুন্দর রূপে ডুবিয়েই ছাড়বে সবাইকে।
লাল রঙে সুসজ্জিত রূপের গাছটি দেখে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে আছে একটি ছোট মেয়ে। বয়স চার বছর। তার গায়েও যে লাল রঙের ফ্রক৷ মনে মনে সে কিছু একটা ভাবলো। ঠোঁট উল্টে গাছটিকে কিছু একটা শুধালো। নির্বোধ গাছটি কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কয়েক কদম দূরে একটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা৷ মেয়েটি দৌড়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ানো মানুষটির কাছে গিয়ে নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে আঁকড়োমুঠোয় হাঁটু জড়িয়ে ধরলো। ব্যাক্তিটি তার হাঁটুতে স্পর্শ পেয়ে নিচের দিকে তাকালো ৷ মৃদু হেসে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো ৷ নরম গাল দুটো হালকা টানতেই মেয়েটি ফুলে ফেঁপে থাকা গাল আরেকটু ফুলিয়ে আদো আদো কন্ঠে বললো-
‘বাব্বা! ‘
ব্যাক্তিটি মেয়েটির মতোন গাল ফুলিয়ে একই ভঙ্গিতে বললো –
‘কী হয়েছে বাব্বা? ‘
মেয়েটি সামনের গাছ করে বললো –
‘বাব্বা! ওতা কী গাচ?’
ব্যাক্তিটি আঙুল বরাবর তাকালো। লাল ও কমলা রঙের ফুলে ফেঁপে থাকা গাছটি দেখে বললো-
‘ওটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ‘
ছোট মেয়েটা আপনমনে উচ্চারণ করার চেষ্টা করলো –
‘ওওও আত্তা, কিত্নচূলা গাচ’
ব্যাক্তিটি হো হো করে হাসলো৷ মেয়ের মন রক্ষার্থে বললো-
‘হ্যা, সায়েশা মা ঠিক বলেছো ‘
মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে হাসলো। কিছুটা সময় থেমে বললো-
‘বাব্বা, আমলা পাপাল কাচে কখন যাবো? ‘
‘এই তো সায়েশা, আমার কলে কথা বলা শেষ। চলো এখনই যাবো এয়ারপোর্টে । ‘
‘আত্তা চলো ‘
ব্যাক্তিটি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে দিলো। নিজেও ড্রাইভিং সিট বসে পড়লো। আধা ঘণ্টা পর এয়ারপোর্টের সামনে গাড়ি থামলো। নেমে আসলো ব্যাক্তিটি। পড়নে কোর্ট, চোখে কালো ফ্রেমের বেশ স্টাইলিং একটা চশমা। সায়েশা টুকুর টুকুর করে নামলো। দূর থেকে দেখলে বিদেশি কোনো পুতুল মনে হবে। ব্যাক্তিটি মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ বাদেই আরেকজন ব্যাক্তি তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো। চিৎকার করে বললো –
‘আমি এসে গেছি সুফি! ‘
সুফিয়ান চকিতে সেদিকে তাকাতেই মুখে ছড়িয়ে পড়লো মুক্তোর মতো হাসি৷ বহু দিন পর বহু আকাঙ্খিত মানুষ। হ্যা, এটা সুফিয়ান। কেটে গেছে আজ চার বছর। কেটেছে সময়। পুরনো মানুষ অথচ নতুন রূপ। বহু মানুষ কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। আবার নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে। আজ সে একজন বাবা। সুফিয়ান হেসে সেদিকে দ্রুত পদে এগিয়ে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির সাথে কোলাকুলি করলো। সুফিয়ান আবেগি গলায় বললো –
‘ভালো আছিস ইভ? ‘
ইভানান মুখ নিচু করে হাসলো৷ সুফিয়ানের পাশে দাঁড়ানো ছোট পুতুলের মতো মেয়েটাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে সারামুখে চুমু খেলো। সায়েশাও গলা জড়িয়ে ইভানানের কাঁধে মুখ গুজলো। আদো আদো কন্ঠে অস্পষ্টতা নিয়ে বললো-
‘সাইরান, তার ছোট বাবাকে পেয়েছে না! আজ আর সে কোথাও নড়বে না। তার ছোট বাবার আজ ছুটি। ‘
‘ওহহ’
ইভানান মলিন মুখে জিজ্ঞেস করলো –
‘সুফি, সে আমায় ক্ষমা করেছে তো? ‘
সুফিয়ান গম্ভীর গলায় বললো –
‘নিজেই জিজ্ঞেস করে নিস।’
ব্যস, এরপর সায়েশা আর ইভানানের কথা গাড়ির আনাচে কানাচে ভরে উঠলো ৷ সুফিয়ান গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো ৷ পথ অতিক্রম করতে এক ঘন্টা সময় লাগলো৷ বাড়িতে পৌঁছাতেই ইভানান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ পা থমকে গেলো। সুফিয়ান হেসে বললো ‘এত সংকোচ কিসের বলতো! ‘
ইভানান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। মিসেস অদিতি এসে দাঁড়াতেই ইভানান সালাম করলো৷ মিসেস অদিতি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন –
‘বেঁচে থাক বাবা। ভালো আছিস তো? ‘
ইভানান হেসে বললো –
‘ তোমাদের দেখে অনেক ভালো আছি। ‘
মিসেস অদিতি মৃদু হেসে সবাইকে ভেতরে নিয়ে আসলেন। রাহাত সাহেবও বেরিয়ে আসলেন। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সোফায় বসলেন। সবাই নানান রকম কথায় মেতে উঠলো৷ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো এক সুশ্রী রূপের রমনী। হাতে পায়েস আর সন্দেশের ট্রে। পাক্কা গৃহিণী যেনো। সুফিয়ান সহ সবাই সেদিকে তাকালো। রমনীটি ট্রে টি-টেবিলে রেখে ইভানানকে বললো-
‘ সময় হলো তাহলে আপনার আসার! ‘
ইভানান অপরাধীর মতো মুখ কাচুমাচু করে হাসলো। নত মুখেই বললো-
‘কী করবো বলো! ওখানের কম্পানিতে আমি না থাকলেই কর্মচারীরা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে। ‘
রমনী আলতো হেসে সবাইকে পায়েসের বাটি তুলে দিলো। সুফিয়ান সেই রমনীকে মুগ্ধ চোখে দেখলো। এই কী সেই অবুঝ বউটা! যে অল্প কিছুতেই কেঁদে ভাসাতো। একটু ব্যাথাতেই কাতর হয়ে পড়তো। বিশ্বাসই হয়না এটা সেই প্রানেশা। তার প্রাণ। চার বছর আগের স্মৃতি হাতরালো সুফিয়ান। সেই দিনটি যেদিন প্রানেশাকে আরেকটু হলেই হারিয়ে ফেলতো সে।
বুক ধকধক করে ওঠে সেসব কিছু মনে করলে।
চার বছর আগে –
ইভানান প্রানেশার দিকে শুট করতেই সেটা লেগে যায় রেয়ানের বাহুতে। মূলত রেয়ান ইচ্ছে করেই প্রানেশাকে সরিয়ে দিয়েছে ৷ রেয়ানের চোখ মুখ ব্যাথায় লাল হয়ে উঠলো। সুফিয়ান দৌড়ে রেয়ানকে ধরলো। প্রানেশা ভয় পেয়ে চিৎকারে করে উঠলো। রেয়ানের রক্তাক্ত বাহুর দিকে তাকিয়ে নিচে বসে পড়লো। লেবার পেইন উঠেছে কিছু ক্ষণ আগে থেকেই। সারা শরীর ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে আছে। রেয়ান ব্যাথাকে পাত্তা না দিয়ে সুফিয়ানকে বললো-
‘সুফি ভাই, প্রানেশাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমার জন্য কম ক্ষতি হয়নি। এবার ভালো কিছু হোক। ‘
সুফিয়ান নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে রেয়ানের হাতে বেঁধে দিলো,প্রানেশার নিভু নিভু শরীরটা কোলে তুলে নিয়ে, বললো-
‘তুইও চল। তোরও ব্যান্ডেজ করা লাগবে। ‘
বাহিরের দিকে পা বাড়াতে নিয়েও ইভানানের দিকে ফিরলো। ইভানান কোনো কারণে মাথা চেপে ধরে আছে। মাথার রগ ফোলা ফোলা। সুফিয়ান অতকিছু খেয়াল না করে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো –
‘এবার তো তুই খুশি তাই না! এখন নিশ্চয়ই তোর খুব ভালো লাগছে। তোর বোনের মৃত্যুর পেছনে আমার কোনো হাত ছিলো না। কিন্তু আমার প্রাণের কিছু হলে দায়ী থাকবি তুই। তুই একটা খুনি হয়ে বাঁচবি সারাজীবন। কথায় কথায় বলিস, প্রাণকে ভালোবাসিস। অথচ, নিজের হাতেই শেষ করে দিলি। ‘
বলেই সুফিয়ান রেয়ান আর প্রানেশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো৷ কেউ দেখলো না সেদিকে ইভানান মাথা চেপে নিচে বসে পড়লো। হাঁপাতে হাঁপাতে শ্বাস কষ্ট উঠে গেলো৷ পাশের মানিব্যাগ থেকে ঔষধ বের করে কোনমতে গিলে বিরবির করতে করতে নিজেও হাসপাতালের দিকে পা চালালো৷
সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে। হাত পা অনবরত কাপছে। বুকের অস্থিরতা ক্রমশই বেড়ে উঠছে। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। প্রানেশার যদি কিছু হয় তাহলে এই জীবন আর রাখবে না সে। প্রাণ চলে গেলে দেহ পঁচতে বেশি সময় নেয় না। নিচ তলা থেকে দুর্বল পায়ে রেয়ান আসলো৷ সুফিয়ান দাঁড়াতে না পেরে সামনের একটা সিটে বসে পড়েছিলো। রেয়ান আচমকা সুফিয়ানের পা জড়িয়ে নিচে বসে পড়লো। হুহু করে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান তাকাতেই বললো-
‘আমাকে মেরে ফেলো সুফি ভাই। আমাকে মেরে ফেলো। আমি সত্যিই অধম। সত্যিই খুব খুব বোকা।
তুমি তো তুমিই। তোমার ভেতরের আত্মা আলোয় পরিপূর্ণ। আর আমার অন্ধকারে। সেই অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে না পেরে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম আর সেখানে থেকে যখন ইভ ভাই একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। আমার খুব আপন মনে হলো। বাবা বাড়িতে আসার পর মা সারাদিন চুপচাপ। তুমি তোমার লাইফে ব্যস্ত। আর আমিও ইন্ট্রোভার্ট। কাউকে নিজের মনের কথা জানাতেও পারিনি। নিজেকে তুলে ধরতে পারিনি। ইভ ভাই, আমাকে নিজের কাছে পুরো অন্যরকম করে তুলে ধরলো৷ আমি স্বার্থপর হয়ে উঠলাম। একবার যদি ভাবতাম, তুমি কখনো আমার খারাপ চাবেনা। তাহলে, এইসব হতো না। ‘
সুফিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে রেয়ানকে তুলে নিলো সামনে। রেয়ান ভাবলো হয়তো সুফিয়ান মারবে তাকে। কিন্তু তাকে স্তব্ধ করে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ানও বোধ হয় কাঁদলো৷ গাল বেয়ে দুজনেরই অশ্রু ঝরলো৷ সুফিয়ান রেয়ানকে চাপকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো৷ চোখ মুছে বললো-
‘তোর একার দোষ ছিলো না রে। দোষটা আমাদের সবার। আমি নিজেকে নিয়ে এতো ডুবে ছিলাম যে আমার ছোট ভাইটাকে সময়ই দেইনি। তোকে একা ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ ভেবেছি তুই এভাবেই কম্ফোর্ট ফিল করিস। ‘
থেমে দীর্ঘ শ্বাসে বললো-
‘এসব বাদ। এবার কোনো কথা বলতে হলে সবার আগে আমার কাছে আসবি। ছোটরা তো ভুল করবেই শোধরানোর দায়িত্ব বড়দের। ‘
ইভানান বিমোহিত চোখে তাকিয়ে বললো-
‘সত্যিই সুফি ভাই, তোমার সাথে কাউকে মেলানো সম্ভব না। আমরা সবাই নিজেদের স্বার্থ খুঁজে বেরাই। আর তুমি সবার স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দাও। ‘
‘প্লিজ সুফি ভাই, আমি সেই পুরনো ক্ষত আবার আগের করতে পারবো না। কিন্তু, মলম তো দিতে পারি। রক্ত দিয়ে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। বাঁধা দিওনা ‘
সুফিয়ান চিন্তিত স্বরে বললো –
‘চেক আপ করে যদি দুর্বল আসে তাহলে আমি তোকে দিতে দিবো না ‘
রেয়ান সম্মতি দিয়ে নার্সের সঙ্গে রক্তের জন্য চেক- আপের জন্য। ডাক্তার বলেছিলো রেয়ানের শরীর অত্যন্ত দুর্বল কিন্তু রেয়ান ডাক্তারের হাত পায়ে ধরে সুফিয়ানকে এই কথা বলতে মানা করে জোর করে রক্ত দিলো। রক্ত দিয়ে বেরিয়ে এসে সুফিয়ানের পাশে বসলো। দুই ভাই পুরনো স্মৃতি চারণ করছিলো। এরই মাঝে ইভানান তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। সুফিয়ান ক্ষিপ্ত হয়ে ইভানানের গালে পরপর তিনটে চড় বসিয়ে দিলো। ইভানান নিচের তাকিয়ে কী যেনো অনবরত বলে যাচ্ছে। সে যেনো বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ইভানানকে চতুর্থ থাপ্পড়টি মারতে নিলেই একজন লোক সুফিয়ানকে বাঁধা দিলো। সুফিয়ানকে সরিয়ে দিলো। সুফিয়ান রেগেমেগে বললো-
‘কে আপনি! ‘
লোকটি অর্ধবয়স্ক। চুল হালকা পাক ধরানো। ইভানানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘একজন প্যাশেন্টের সঙ্গে হাসপাতালে আপনি মারামারি করছেন কেনো?’
সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘প্যাশেন্ট! ও প্যাশেন্ট নয় অপরাধী ও ‘
লোকটি কিছু বোঝার মতো করে বললো –
‘বুঝতে পেরেছি, আপনারা আমার সঙ্গে কেবিনে আসুন। আমি একজন কাউন্সিলর । ‘
সুফিয়ান আর রেয়ান কিছু বুঝতে পারলো না। লোকটার পেছনে কেবিনে গেলো। লোকটি পাশের আলমারি থেকে কিছু কাগজ ঘেটে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো। সুফিয়ানের দিকে পেপার বাড়িয়ে দিয়ে বললো-
‘পেপারটা পড়ুন ‘
সুফিয়ান দ্রুত পেপারটা নিলো। তেমন কিছু না বুঝলেও প্যাশেন্টের জায়গায় যে ইভানানের নামটি দেখলো। সুফিয়ান কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটি থামিয়ে বললো –
‘ হ্যা , সে একজন মানসিক রোগী। তার মানসিক অসুস্থতা রয়েছে। অনেক আগে, একদিন আমার শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। তার মানসিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। শুনেছিলাম, তার বোন মারা যাওয়ার পর থেকে সে রাতের বেলা ঘুমাতে পারে না। সব জায়গায় তার বোনকে দেখতে পায়। এটা এক ধরনের ডিসওর্ডার। প্রথম একমাস সে আমার কাছে চিকিৎসা করায়। কিন্তু সুস্থ হতে পারেননি। এটা ঠিক হতে অনেক সময় লাগে। বেশিরভাগ প্যাশেন্টরা একসময় সাইকো হয়ে ওঠে। তার আচরণে অন্য আট দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হলেও সে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। ‘
সুফিয়ান আর রেয়ান বড় একটা ধাক্কা খেলো। কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছেনা। সুফিয়ান হঠাৎ মনে করার মতো করে বললো –
‘এইজন্যই, অস্ট্রেলিয়ায় ওর সাথে থাকার সময় ও রাতের বেলা কী যেনো বিরবির করতো। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতো না! ‘
‘হ্যা, এই ধরনের রোগীরা নিজেকে সবার আড়ালে রাখে। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায়, মাঝে মাঝে কী করে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনা। এরা ঠিক না হলে আশেপাশের মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ‘
সুফিয়ান মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এ কেমন নিয়তি! কাউকেই যেনো দোষ দেয়া যায় না। সুফিয়ান কাউন্সিলরকে জিজ্ঞেস করলো –
‘এই রোগ ঠিক হতে কতদিন লাগবে?’
‘যদি নিয়মিত চিকিৎসা করানো হয়, আর প্রপার কেয়ার করা হয়। তাহলে, এক বছরের মধ্যে মোটামুটি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মূল চিকিৎসা চালিয়ে যেতে দুই তিন বছরের মতো লাগবে। ‘
সুফিয়ান তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। রেয়ান পিছুপিছু আসলো। দুজন অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসতেই চেঁচামেচি শুনতে পেলো।
সুফিয়ান আর রেয়ান এগুতেই দেখলো নার্স ইভানানকে বকাঝকা করছে৷ ইভানানের হাতে ছোট সদ্য জন্মানো বাচ্চা মেয়েটা । ইভানান চেয়ারের পাশে হেলে বসে আছে। বাচ্চাটার হাত ধরে কিছু একটা বলছে অস্পষ্টতা নিয়ে। সুফিয়ান নার্সকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললো-
‘দেখুন তো,বাচ্চাকে নিয়ে জোড় করে বসে আছে। ‘
সুফিয়ান সেদিকে একবার তাকালো। ইভানান যে কোনো ক্ষতি করবেনা, তা জানে সুফিয়ান। নার্সের কোলে আরেকটা বাচ্চা দেখতেই বললো –
‘এই বাচ্চাটা! ‘
নার্স এগিয়ে তোয়ালে পেচানো বাচ্চাটা সুফিয়ানের হাতে দিয়ে বললো –
সুফিয়ান খুশিতে কেঁদে ফেললো৷ ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে সারা মুখে হাত দিয়ে আদর করলো। আবার কী মনে করে যেনো রেয়ানের হাতে বাচ্চাটা দিয়ে নার্সকে বললো –
‘আমার ওয়াইফ? ‘
নার্স মুচকি হেসে বললো –
‘তিনি সুস্থ আছেন। ভেতরেই শুয়ে আছেন। ‘
সুফিয়ান হেসে ভেতরে ঢুকে পড়লো। প্রানেশাকে নিয়ে এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরলো। প্রানেশাকে ইভানানের রোগের কথা জানাতেই সেও বললো বাড়িতে রেখেই ইভানানকে চিকিৎসা করাতে। কারণ, ইভানান বাচ্চা মেয়েটাকে নিজের কোল ছাড়া করতে চায়না৷ কিছুটা ঠিক হতেই সে নিজে থেকে নিজের চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে চলে যায়। বাংলাদেশে থাকলে রোগ ঠিক হতে বেশি সময় লাগবে। নিজের মেয়ের মতোন ভালোবাসে সে বাচ্চাটাকে। নিজেই নাম রাখলো সায়েশা। সুফিয়ান আর প্রানেশাও ক্ষমা করে দিলো ইভানানকে। কারণ, একজন মানসিক রোগীর বোধ শক্তি কতটুকু তারা জানে। ক্ষমা করেনি শুধু রেয়ান। সে শুধু বলে -‘সে এতো মহান হতে পারবেনা। ইভানানের শাস্তি পাওয়া উচিত। ‘
কেউ তাকে কিছু বলেনি এই নিয়ে। বাচ্চা ছেলের নাম রাখা হয় সাইরান। সায়েশা সাইরানকে নিয়েই তাদের সুখী পরিবার।”
কারও ধাক্কায় অতীত থেকে বেরিয়ে আসলো সুফিয়ান। চারপাশে তাকাতেই দেখলো সব স্বাভাবিক।
হ্যা, আজ এই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিতে সবাইকেই অনেক বাঁধা পেরোতে হয়েছে। ধাক্কাটা সাইরান দিয়েছে। হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো-
‘বাবা! ছোট বাবা সেই কখন থেকে ফোনে কথা বলছে’
সুফিয়ান মৃদু হেসে সাইরানকে কোলে উঠিয়ে বসালো।
‘বলবেই তো বাবা, তুমি মন খারাপ করোনা। সব সময় তো তোমার সাথেই থাকে৷ এখন ছোট মাকে একটু সময় দেক ‘
‘ছোট মা কে বাবা? ‘
‘যার সাথে কয়েক দিন আগে তোমার ছোট বাবার বিয়ে ঠিক হলো। ‘
‘ওও, তালহা আন্তি! ‘
‘হ্যা, তালহা আন্টি ‘
সাইরান নিজের বয়স অনুযায়ী অনেক ম্যাচুয়ার্ড। সায়েশা যেমন তার ঠিক বিপরীত। জমজ ভাই-বোন হলেও চেহারা ছাড়া কোনো কিছুতেই মিল নেই। রেয়ানও আসলো। সবাই আড্ডায় মশগুলো। সুফিয়ান সুযোগ পেয়েই উঠে পড়লো। সবাই ব্যস্ত , তাই তার দিকে কোনো মনোযোগ নেই। প্রানেশা বাচ্চাদের খাবারের জিনিসপত্র ঠিক করছিলো। সুফিয়ান সেদিকে পানি খাওয়ার বাহানাতে প্রানেশার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো –
‘প্রাণ, উপরে এসো তো। ‘
প্রানেশা একবার তাকিয়ে নিজের কাজ করতে করতে বললো –
‘বুড়ো বয়সেও রঙঢঙের শেষ নেই। দুই বাচ্চার বাবা হয়েছেন আপনি! ‘
সুফিয়ান অভিমানী সুরে বললো –
‘সবার দিকেই খেয়াল থাকে তোমার। আমাকেই চোখে পড়ে না। আসতে হবে না তোমাকে হুহ! ‘
বলেই আওয়াজ করে গ্লাসটা রেখে হুড়মুড় করে উপরে উঠে গেলো৷ প্রানেশা মুচকি হেসে সেদিকে পা বাড়ালো। সে জানে লোকটা ঠিক তার জন্য অপেক্ষা করছে। উপরে চলে যেতেই, দুটো তৃষ্ণার্থ চোখ ভিজে উঠলো। ইভানানের বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো ভারী শ্বাস। একাকীত্ব যে কত ভয়ংকর! সজ্ঞানে পাপ না করলেও শাস্তি তো সে ঠিকই পাচ্ছে। সে যে এখনো ভালোবাসে তার স্রোতস্বিনীকে। বাকীটা জীবন সে তার স্রোতস্বিনীকেই ভালোবেসে যাবে। এভাবেই পুড়তে পুড়তে অঙ্গারে পরিণত হবে। কিন্তু নেশা কখনো তার হবে না।
সুফিয়ান দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলো। বসন্তের ঐশ্বরিক মাতাল হাওয়ায় মনের ভেতর বইছে শীতল শিহরণ। চোখ বন্ধ অবস্থাই বুঝতে পারলো তার প্রাণের আগমণ ঘটেছে। বুঝবে নাই বা কেনো! তার অর্ধাঙ্গিনীর শরীরের স্নিগ্ধ ঘ্রাণে সে ডুবেছে বহুবার। চেনা পরিচিত হয়ে উঠেছে কোমল ঘ্রাণের সঙ্গে। চোখ বুজেই প্রানেশাকে টেনে নিলো কাছে। দোলনা নড়ে উঠলো প্রানেশা সুফিয়ানের বুকে মাথা রেখে বললো –
‘ভালোবাসি খুব! ‘
সুফিয়ান হাসলো কিন্তু কিছু বললো না। প্রানেশার রাগ হলো। মানুষটা কখনোই বলে না,আমিও তোমাকে ভালোবাসি। তার বুঝি মানে লাগে না! প্রানেশা অভিমানী সুরে বললো –
‘ঠিকই তো আছে, আমি কে হই আপনার! ‘
সুফিয়ান প্রানেশার দিকে মাতাল চাহনি নিক্ষেপ করে মাদকীয় গলায় বললো –
প্রথম ভালোলাগা তুমি,
প্রথম ভালোবাসা তুমি,
শ্রাবণের প্রথম বৃষ্টি তুমি,
হারানো প্রেম তুমি, ফিরে পাওয়া সেই তুমি।
আমার গল্পের প্রথমাংশ তুমি,
শেষাংশের অধিকারিণী তুমি,
ভালোবাসায় পরাজিত সেনা আমি,
আর এই অঙ্গারের নেশা তুমি।
সুফিয়ানের কথায় প্রতুত্তর করতে পারলো না প্রানেশা।
এতক্ষণের সকল ক্ষোভ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সুফিয়ান যেনো তার দোষ গুলো তার চোখের সামনে তুলে ধরলো ৷ ঠিকই তো বলেছে সুফিয়ান!
না জেনেই হোক রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলো সে। প্রানেশা যেমন সত্যি জানতো না তেমন
সুফিয়ানও ধোঁয়াশায় ছিলো। সে হিসেবে দুজনেই বরাবর অপরাধী৷
সুফিয়ান যখন বুঝতে পারলো প্রানেশার মন শান্ত হয়ে এসেছে, তখন নিজের দিকে ফেরালো। প্রানেশার চোখ বেয়ে অশ্রুর সাড়ি। সুফিয়ান মৃদু কন্ঠে বললো-
‘সরি প্রাণ, আমি পুরনো কথা বলতে চাইনি। আই এম সো সরি ‘
প্রানেশা আচমকা সুফিয়ানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান তাল সামলাতে না পেরে খাটে বসে পড়লো। প্রানেশা কেঁদেকেটে নিজের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সুফিয়ান অস্থির ভাবে বললো –
‘আহা! আর কাঁদে না প্রানেশ্বরী। অসুস্থ তো তুমি ‘
প্রানেশা হেঁচকি তুলে ফেলেছে । হেঁচকিতে আটকে আটকে বললো –
‘সব আমার দোষ। আমার ওমন করা উচিত হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনাকে হঠাৎ ওই অবস্থায় দেখে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছিলো৷ পৃথিবীটা অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিলো। খুব ভালোবাসি আপনাকে।’
সরল স্বীকারোক্তিতে সুফিয়ানের মন ভালো লাগায় ভরে গেলো। সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি তো হবেই। কিন্তু তা নিজেদেরই মিটিয়ে নিতে হবে। একজনের অভিমান হলে আরেকজনের মাথা নত করতে হবে। ইগো বজায় রাখতে গিয়ে অনেক সময় সম্পর্কে ফাটল ধরে। অথচ,সম্পর্কের একটুখানি যত্ন নিলে তা নতুনত্ব বরণ করে নেয়। এখন প্রানেশা যদি অবুঝের মতো নিজের রাগ বজায় রেখে চলে যেতো তাহলে এত দিনের সুন্দর ভালোবাসাময় সম্পর্কটা ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়তো।
সুফিয়ান প্রানেশার কান্নামাখা মুখ আর সহ্য করতে পারলো না। তাই বললো-
‘ প্রাণ, মেয়েগুলোর কারো সঙ্গেই আমার শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি ‘
‘ইভানান আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতো যে মেয়ের নেশা মেয়ে দিয়ে কাটবে। প্রথমে আমি রেগে গেছিলাম। কিন্তু বন্ধুর উপর বিশ্বাস করে পরবর্তীতে রাজি হই। মেডিকেলে পড়াশোনা করে, ক্লাবে ড্রিংকস করার পরও যখন তোমাকে না পাওয়ার বিরহে কাতর হয়ে উঠতাম তখন ইভানান সুযোগের সৎ ব্যবহার করে আমার রুমে ক্লাবের একটা ড্যান্সারকে পাঠায়। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের অধিকারী। আমার মনে হয়েছিলো আমি হয়তো তোমার জ্বালানো আগুন নিভাতে সক্ষম হবো ৷ অথচ কাছে আসার পর আগুন যেনো আরও বেশি পুড়াতে শুরু করলো আমাকে। মেয়েটার পর আরও অনেক সুন্দর মেয়েকে আমার রুমে পাঠাতো ইভানান। কিন্তু কোনোভাবেই আমি ওদের খুব কাছে যেতে পারিনি। তোমার ভালোবাসা আমায় যেতে দেয়নি প্রাণ। ‘
প্রানেশার চোখ মুছে সুফিয়ান বললো-
‘বসো, সকালে বমি করে সব ফেলে দিয়েছো। খাবার খেয়ে আবার কেঁদো ‘
বলেই রসাত্মক হেঁসে খাবার আনতে চলে গেলো। প্রানেশা বিস্ময় নজরে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটা কতটা ত্যাগ করেছে তার জন্য। আর সে কিনা টেরও পায়নি। এত আঘাতের পরও তাকে ভালোবেসে যাচ্ছে! সুফিয়ান যে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তা ঢের ভালো করে জানে প্রানেশা। অথচ , সে যে ক্ষুদার্ত তা বলার আগেই জেনে গেছে সুফিয়ান। এত ভালোবাসা সবার কপালে জোটে না।
__________________
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রানেশা। আজ তার থার্ড সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা ছিলো।
সুফিয়ানের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিলো। ডক্টর বলেছে আর ১৫ দিন পরই ডেলিভারি ডেট। সবগুলো পরীক্ষার দিনই সুফিয়ান ঘন্টার পর ঘন্টা সব কামধাম ফেলে গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতো। অনেক সময় দেখা গেছে পারমিশন নিয়ে হুটহাট হলের ভিতর ঢুকে পরীক্ষার মাঝে প্রানেশাকে খাইয়ে দিয়ে আসতো। প্রানেশা এত মানুষের ভিতর লজ্জা পেয়ে সুফিয়ানকে আসতে মানা করতো। কিন্তু সুফিয়ান তো সুফিয়ানই! সে প্রানেশাকে কোনোরকম তোয়াক্কা না করে খাবার দাবার নিয়ে হাজির হতো৷
আজও সুফিয়ান সকালে দিয়ে গেছে। শেষ পরীক্ষায়ও সুফিয়ান চেয়েছিলো বাহিরে অপেক্ষা করতে। কিন্তু ইমার্জেন্সি থাকায় প্রানেশা নিজেই জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো৷ গত এক মাস যাবৎ সুফিয়ান প্রানেশাকে দেখাশোনার জন্য হসপিটালের কাজ থেকে বিরতিতে ছিলো।
সুফিয়ান কল করে বলেছে দশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে। গার্ড পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু প্রানেশা বলেছে
তার প্রয়োজন নেই। গ্রীষ্মের ভস্ম করা গরম। উঁচু পেট ঢাকতে প্রানেশার গায়ে বড় শাল জড়ানো। গরমের সময়ে শালটা পড়ে আত্মা বের হওয়ার উপক্রম।
নাহ! আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মাথা ঘুরে আসছে। প্রানেশা পাশের চায়ের দোকানের ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালো৷ ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলো পানি খেয়ে মোবাইলটা বের করে সুফিয়ানকে আরেকবার কল করলো৷ হয়তো ব্যস্ত, তাই রিসিভ করছে না৷
আরেকটু অপেক্ষা করতে পাশের বেঞ্চে বসে পড়লো।
বিকেলে বৃষ্টি হবে হয়তো। এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখ ঢেকে বসে রইলো। গাড়ি থামার আওয়াজে মুখ তুললো। প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো সুফিয়ান৷ কিন্তু নাহ, গাড়ি তো এটা নয়। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ব্লু কোর্ট পরিহিত সুদর্শন যুবক। নীল চোখের স্বচ্ছ পানির ন্যায় চোখের পুরুষ। সামনের আরেকটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ছয়জন মুখোশ পড়া লোক ৷
সুদর্শন যুবকটি প্রানেশার বরাবর এসে দাঁড়ালো। প্রানেশা প্রথমে চিনতে না পারলেও পরবর্তীতে সুফিয়ানের বলা বর্ণনায় মিলে যাওয়ায় বুঝতে পারলো এটা ইভানান। শজারুর কাঁটার ন্যায় চুলগুলো পেছনের দিকে এলিয়ে রাখা৷ চলাচলের ভঙ্গি সুফিয়ানের সঙ্গে কিছুটা মিলে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে৷ প্রানেশা উঠে দাঁড়িয়ে ভীত মনে বললো-
‘কী চাই আপনার? এখানে কেনো এসেছেন? ‘
ইভানান ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটিয়ে প্রানেশার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো-
‘স্রোতস্বিনীর স্থান শুধু তার নীল পুরুষের বুকে ৷ নীল পুরুষ বেঁচে থাকতে স্রোতস্বিনী অন্য কারো বুকে বাসা কী করে বাঁধে! ‘
বেঁচে থাকতে হলে সুখ দুঃখ দুটিরই স্বাদ সমানভাবে আস্বাদন করতে হবে। সব মিলিয়েই জীবন। সারাজীবন সুখ অথবা দুঃখ একাধারে পাওয়া সম্ভব না। প্রকৃতির এই বানানো নিয়মে জগৎ সংসার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তা-ই তো বলা হয় – ‘ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন ‘
পঞ্চম বারেও যখন প্রানেশা কল রিসিভ করলো না, তখন ঘাবরে গেলো সুফিয়ান। শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চিনচিনে ব্যথা। কিছুক্ষণ আগেই অপারেশন করে ফিরলো। এক কথায় প্রচুর প্রেশারে ছিলো। এমনিতেই প্রানেশার প্রেগ্ন্যাসির খবর শোনার পর থেকে সারাক্ষণ মন ছটফট করতে থাকে। হসপিটালের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার চেষ্টায় থাকে ৷ কীভাবে প্রানেশাকে একটু বেশি সময় দেয়া যায়, কী করে ওকে হাসিখুশি রাখা যায়, কোন খাবার বাচ্চার জন্য ভালো এসব কিছু নিয়ে সবসময়ই চিন্তায় থাকে সে। তা-ই তো কিছুক্ষণ পর পরই কল করে খবর নেয়। প্রানেশা কমসেকম দ্বিতীয় বারের মধ্যেই রিসিভ করে ফেলে। কিন্তু এত লেট কখনো হয়না। হাত পা ঘামতে শুরু করলো সুফিয়ানের। নিজের পরনে এখনো অপারেশনের স্যুট। অর্থাৎ, চেঞ্জ করার সময়টুকুও সে পায়নি। স্যুটটা খুলেই দ্রুত হাতে মিসেস অদিতিকে কল করলো। মিসেস অদিতি তখন প্রানেশার জন্য তেল গরম করছিলেন, অনেক দিন ধরে ঘাড়ে ব্যাথা মেয়েটার। নিজের রুমে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। ঘুম ভেঙে গেলো বিধায় তেল গরম করে প্রানেশার রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলেন। চুলোর পাশেই সেলফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করে কানে দিতেই ভেসে এলো সুফিয়ানের অস্থির কন্ঠ –
মিসেস অদিতিও ভীত মনে উপরের দিকে অগ্রসর হলেন। দরজা চাপানো ছিলো৷ ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো৷ প্রানেশাকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন। অপর পাশে সুফিয়ানের বুক ধকধক করছে। মিসেস অদিতির হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো। তিনি গলা ফাটানো শব্দ করে বললেন –
‘আল্লাহ গো! সব শেষ হয়ে গেলো সুফি, সব শেষ হয়ে গেলো! ‘
সুফিয়ান মাথা ঘুরিয়ে চেয়ারের সাথে ধাক্কা খেলো। গায়ের শার্টটা ঘামে ভিজে চুব চুব করছে৷ নিজেকে সামলে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো। গাড়ি চালানোর ক্ষমতা নেই তার। তাই ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে পাশে বসলো সে৷ আধা ঘণ্টায় পৌঁছে গেলো বাড়ি। এক দৌড়ে নিজের রুমে পৌঁছালো৷ একজন ডাক্তার ভেতরে বসে আছে। মিসেস অদিতিই কল করে ডেকে এনেছেন। বিছানায় শুয়ে আছে নিথর প্রানেশা। সুফিয়ান দ্রুত পদে হেঁটে প্রানেশার পাশে বসলো৷ মুখ পাণ্ডুর, মাথায় আর ডান হাতের কবজিতে ব্যান্ডেজ করা। ডাক্তার চেকআপ শেষ করে সুফিয়ানের দিকে ফিরলেন। সুফিয়ান উদ্বিগ্ন হয়ে বললো-
‘ডক্টর, প্রাণ আর বেবি ঠিক আছে তো?কোনো ক্ষতি হয়নি তো? এভরিথিং ইজ ফাইন না? ‘
ডক্টর প্রিয়া, সুফিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-
‘দেখুন, আরেকটু দেরি হলে হয়তো ক্ষতি হয়ে যেতো পারতো৷ প্রথমত পেটে তেমন কোনো আঘাত পায়নি আর দ্বিতীয়ত মাথায় খুব বেশি ব্লিডিং হয়নি। তাই তেমন কিছু হয়নি বললেই চলে ‘
কিছুটা থেমে তারপর আবার বললেন –
‘কিন্তু, এরপরে একটু বেশি করে খেয়াল রাখবেন। এই যাত্রায় বেঁচে গেছেন৷ পরে আবার কিছু হলে কিন্তু বড় কোনো ক্ষতি হতে পারে ‘
সুফিয়ান প্রথমের কথায় স্বস্তি পেলেও শেষের কথা গুলোতে আবার চিন্তায় পড়ে গেলো। ডক্টর আরও কিছু এডভাইস দিয়ে ঔষধ প্রেসক্রাইব করে চলে গেলেন৷ সুফিয়ান দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রানেশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ মনে মনে নিজেকেই দোষ দিলো,বাসায় থাকলে হয়তো প্রানেশার এত কষ্ট করার প্রয়োজন হতো না। কিছুক্ষণ যেতেই প্রানেশার জ্ঞান ফিরে এলো। হাত পা হালকা নেড়ে উঠে বসলো আস্তে ধীরে। মাথা ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো –
‘খারাপ লাগছে প্রাণ? পানি খাবে? খুব বেশি লেগেছে মাথায়?’
প্রানেশা সুফিয়ানের হাতটা সরিয়ে দিলো। জোর করে নিজের শরীরে ভর দিয়ে উঠে পড়লো। হাতে চাপ লাগতেই আর্তনাদ মূলক গোঙানির শব্দ করে উঠলো৷
সুফিয়ান ধমকের গলায় বললো –
‘প্রাণ! বারবার বলার পরও কথা শুনছো না কেনো? ‘
প্রানেশা নিজের হাতের ব্যাথাকে বেশি একটা পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ কিছু মুহূর্তের জন্য সে নিজেও ঘাবড়ে গেছিলো। কিন্তু এখন শরীরের থেকে মনের ব্যাথাটাই বেশি কষ্ট দিচ্ছে। প্রানেশার প্রথমে মনে হয়েছিলো, ছবিগুলো হয়তো ইডিট না হয় রেয়ানের। কিন্তু শারীরিক গঠন আর গলার কন্ঠমনিতে বোঝাই যাচ্ছে ওটা সুফিয়ান। তারপরও সুফিয়ানের মুখে সত্যিটা শুনতে চায়। সুফিয়ান একবার যদি বলে যে ছবিগুলো তার নয় তাহলে বিনাবাক্যেই বিশ্বাস করে নেবে সে। এই সিদ্ধান্তে মনোনিবেশ করেই অস্থিরচিত্তে মোবাইল খুঁজে বের করলো৷ পাশেই ফ্লোরে পড়ে ছিলো। মোবাইল উঠিয়ে দ্রুত পদে সুফিয়ান পায়ের কাছে বসলো। সুফিয়ান প্রানেশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কী করতে চাইছে প্রানেশা সেটা এখনও বোধগম্য হয়ে ওঠেনি।
প্রানেশা মোবাইল ঘেঁটে ছবিগুলো বের করলো। আবারও চোখ টলমল করে উঠলো। কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না সে। সুফিয়ানের সঙ্গে অন্য কাউকে এই অবস্থায় দেখে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। সুফিয়ানের হাত মুঠোয় নিয়ে প্রানেশা শান্ত কন্ঠে বললো-
‘আজ আমি যা জিজ্ঞেস করবো তা সত্যি সত্যি উত্তর দেবেন ‘
সুফিয়ানের কপালে ভাজ পড়লো। ভ্রু কুচকে বললো-
‘কী জানতে চাও প্রাণ?’
প্রানেশা হাতের মোবাইলটা কাঁপা হাতে সুফিয়ানের মুখের সামনে ধরলো৷ সুফিয়ান অবহেলা দৃষ্টি দিয়ে মোবাইলে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলো কিন্তু চোখ আর ফেরানো হলো না৷ বিস্ফোরিত নয়নে নিবদ্ধ হয়ে গেলো স্ক্রিনে থাকা ছবিতে। হ্যা এটা তখনকার ছবি যখন সে অস্ট্রেলিয়ায় নেশায় বুদ ছিলো৷ ইভানান রোজ তার রুমে ক্লাবের মেয়ে পাঠাতো৷ শারীরিক সম্পর্ক না হলেও ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত তৈরি হয়েছিলো৷ তখনও সুফিয়ান বোঝেনি ইভানানের মেয়ে পাঠানোর পেছনের কারণ। ইভানান তাহলে এই কারণে ওইসব করেছিলো! সুফিয়ানের সঙ্গে সঙ্গে পিলে চমকে উঠলো। মনের মধ্যে অপরাধ বোধও জন্মালো। এখন সে প্রানেশাকে কী করে বোঝাবে যে, বহুবার বহু নারীর সংস্পর্শে যেয়েও ফিরে এসেছে প্রানেশার টানে। যতবার চেষ্টা করেছে প্রানেশাকে ভুলে নতুন কারো সাথে মগ্ন হতে কিন্তু ততবারই প্রানেশার মুখ ভেসে উঠতো। কিন্তু প্রানেশাকে এখন কী বোঝানো সম্ভব! কারণ, বিছানায় অনেকটাই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে।
প্রানেশা থমকানো স্বরে বললো –
‘ শুধু একবার বলুন, এটা আপনি নন। আমার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই। ‘
সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো৷ মিথ্যা বলতে চায় না। কিন্তু প্রানেশা কী সত্যিটা অসুস্থ শরীরে মেনে নিতে পারবে! এটা ভেবেই সুফিয়ান সাহস পাচ্ছে না। তারপরও একরাজ্য অস্বস্তি আর ভয়কে ঠেলে দিয়ে প্রানেশার মুখোমুখি হয়ে এক নিশ্বাসে বললো-
‘ওটা আমিই প্রাণ।’
প্রানেশার হাত থেকে ঠাস করে মোবাইলটা নিচে পড়ে গেলো। শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামা বেড়ে গেলো৷ সব কিছু এমন অন্ধকার লাগছে কেনো? কোথাও কী আলোর ঘাটতি পড়লো! ওহ না,সব ঠিকই আছে। বোধ হয় তার দুনিয়াটাতেই শুধু আলোরা নেতিয়ে পড়েছে। সুফিয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
‘প্রাণ, হ্যা ওটা আমি কিন্তু তুমি যা ভাবছো ব্যাপারটা তেমন নয় বিশ্বাস করো। আমার সঙ্গে তেমন.. ‘
পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রানেশা খাটের সঙ্গে হেলে বসলো৷ তাচ্ছিল্য হেসে বললো –
‘আর বলতে হবে না। শিশু নই আমি। সবটা পানির মতোন পরিষ্কার হয়ে গেছে। ‘
তীক্ষ্ণ আক্রোশের দৃষ্টি দিয়ে প্রানেশা জোরে চেচিয়ে বললো -‘আপনার মুখও দেখতে চাই না আমি৷ এই মুহুর্তে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো ‘
বলেই উঠে বাহিরে যেতে উদ্যত হলো সে। সুফিয়ান পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো৷ প্রানেশা ছুড়াছুড়ি করে একসময় ক্লান্ত হয়ে ভর ছেড়ে দিলো। সুফিয়ান প্রানেশার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে আহতস্বরে বললো-
‘ এইটুকু সহ্য করতে পারছো না প্রাণ! তাহলে আমি পাঁচ পাঁচটে বছর তোমাকে আমার আপন ভাইয়ের সঙ্গে কী করে সহ্য করেছি? তুমি কেঁদে চিৎকার করে সবটা বলতে পারছো৷ আমি যে রাতের পর রাত তরপেছি। তোমাদের কাছাকাছি ছবি, হাতে হাত ধরে চলার সাক্ষী হয়ে থেকেছি! এই পর্যন্ত সবটা চুপচাপ বুকের ভিতর চেপে পুড়েছি। পুড়তে পুড়তে আজ আমি অঙ্গার হয়েছি প্রাণ। কিন্তু তুমি অঙ্গারের নেশা হতে পেরেছো তো?’
আজ আনন্দরা দলবদ্ধ হয়ে যেনো ধরা দিয়েছে। কী সুন্দর অনুভূতি! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর ঘটনা বুঝি এটিই?
নাহলে সুফিয়ানের চোখের কোণে জল জমবে কেনো?
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহের ভিতর ভর করলো সজীবতা।
ক্লান্ত হয়ে ফিরে যে এত বড় সুসংবাদ পাবে ভাবতেই পারেনি সে৷ হাতে এখনো চিরকুট মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট কাঁপছে, চোখের জল গড়িয়ে পড়বে খানিক বাদে। সুফিয়ান কাঁপন ধরানো পায়ে এগিয়ে গেলো বারান্দায়। প্রানেশার গায়ে কমলা রঙের সুতি শাড়ি। রেলিংএ হেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে কী যেনো দেখছে। সুফিয়ান নিঃশব্দে প্রানেশাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সুফিয়ান কাঁধে থুঁতনি রেখে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো –
‘এটা কী সত্যি? ‘
প্রানেশা নির্লিপ্ত ভাবে বললো –
‘হু’
সুফিয়ান প্রানেশাকে নিজের দিকে ফেরালো। প্রানেশার উদাস হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘কিছু নিয়ে মন খারাপ প্রাণ? ‘
প্রানেশা হুট করে রেগে উঠলো। চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো –
‘ডাক্তার হতে কে বলেছিলো আপনাকে?’
সুফিয়ান বিস্মিত ভঙ্গিতে বললো-
‘এ্যা!’
‘এ্যা কী? কয়টায় আসার কথা ছিলো আজ? ‘
সুফিয়ান এবার অভিমানের কারণ বুঝলো। শুক্রবার থাকা সত্বেও হসপিটালের কাজে ব্যস্ত ছিলো আজ। প্রানেশা সকালে বলেছিলো একটু তাড়াতাড়ি আসতে। সুফিয়ান বলেছিলো ‘চেষ্টা করবো’। কারণ দ্রুত আসবো, এটা ডাক্তারী পেশায় যুক্ত হওয়ার পর আর বলা যায় না। দ্রুত আসার চেষ্টা করলেও পারেনি সুফিয়ান, কারণ প্যাশেন্ট বেশি ছিলো। সুফিয়ান অসহায় মুখ করে বললো –
‘সরি প্রাণ ‘
প্রানেশার অভিমানের কারণ আছে বটে। সে যে সন্ধ্যা থেকে সুফিয়ানের অপেক্ষা করছিলো৷ শাড়ি পড়ে এই গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলো। সুফিয়ানের উপর খুব অভিমান হলো তার। এই স্পেশাল একটা দিনেও কী কেউ দেরি করে!
সুফিয়ান ধাতস্থ হয়ে প্রানেশার কোলে মাথা রাখলো৷ উদরের আঁচল সরিয়ে মুখ গুঁজে রাখলো। প্রানেশা আলতো হাতে সুফিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো৷ সুফিয়ান মাথা হালকা উঁচু করে বললো –
‘আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না প্রাণ! ‘
পরক্ষণেই প্রানেশার হাত নিজের হৃদপিণ্ডের জায়গাটায় রেখে বললো –
‘আজকে তুমি যা চাও তাই পাবে, বলো প্রাণ কী দিতে পারি আমি ‘
প্রানেশা খানিক নড়েচড়ে বসলো। যেনো খুব বড় কিছু চাইবে সে। সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘সত্যি? যা চাইবো তাই দেবেন!’
‘একদমই তাই’
প্রানেশা সুফিয়ানের হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললো-
‘তবে, এই পারিবারিক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নিন ‘
সুফিয়ানকে শান্ত দেখে আরেকটু সাহস জমিয়ে বললো-
‘ আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না, আপনার সন্তানও আপনার আর রেয়ানের মতোন একা একা বড় হোক। আপনার মা বাবা দুজনেই বেঁচে ছিলেন কিন্তু দ্বন্দ্ব, ধোঁকা এইসব কিছু সবার জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে। আপনি ঠিক থাকতে পারলেও, রেয়ান পারেনি। ইভানানের প্রতিশোধের স্পৃহায় রেয়ানের একাকিত্বকেই ব্যবহার করেছে হাতিয়ার হিসেবে। ‘
কিছুটা থেমে বললো-
‘নিজেকেও তো কম কষ্ট দিচ্ছেন না! বাবার চোখেও আমি অনুতপ্ততা দেখেছি। আগে সে হয়তো একটা ভুল করেছে, টাকার লোভে আপনাদের ঠকিয়েছে। কিন্তু কম শাস্তি তো পায়নি৷ ওই সংসারে সন্তান ছিলো না, আপনাদের কাছে আসতে চেয়েও পারেনি। সেও কিন্তু তার ভাগের শাস্তি পেয়েই গেছেন। এখন যেহেতু সে অনুতপ্ত, আপনার উচিত এক কদম বাড়ানো। বাকিটা তার উপর ছেড়ে দিন ‘
সুফিয়ান মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ কথা শুনে বললো-
‘আমি চেষ্টা করবো, প্রাণ’
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে। প্রানেশাও লম্বা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। এবার কিছুটা হলেও চিন্তামুক্ত। সুফিয়ান যেহেতু বলেছে চেষ্টা করবে তাহলে কিছুটা হলেও করবে৷ ওয়াশরুমে চলে যাওয়ার কারণও প্রানেশা জানে। জীবনের কিছু মুহূর্তে সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র আমাদের নিতে হয়। তখন একাকী থাকাটা খুব প্রয়োজন।
গ্রীষ্মের টগবগে গরমকাল৷ আম,কাঁঠালের পদার্পণ ঘটেছে এরইমধ্যে। ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজাচ্ছিলেন মিসেস অদিতি। রাহাত সাহেব চেয়ার টেনে বসলেন। পায়েশ নানা রকম পিঠে দিয়ে ভরপুর টেবিল ৷ গ্রীষ্মের গরমে পিঠের আয়োজন অনেকটাই বেমানান। কিন্তু, প্রানেশার নাকি এসবই খাওয়ার স্বাদ জেগেছে। প্রেগ্ন্যাসিতে মেয়েরা টক ঝাল নাকি বেশি খায়। কিন্তু প্রানেশার শুরু থেকেই মিষ্টির প্রতি দারুণ আকর্ষণ। নিজের মা যখন আচার, টক ঝাল খাবার পাঠাতে চেয়েছিলো তখনও সে মিষ্টি পাঠাতে বলেছে। কয়েক দিন বাপের বাড়ি থেকেও এলো সে৷ সুফিয়ানও বউয়ের পিছনে পিছনে সেখানে থেকেছে। কী আর করবে, একরাত নিজের বাড়িতে কাটিয়ে নিজের বেহাল দশা করে ফেলেছিলো সে৷ প্রানেশার থেকে দূরে থাকা তার পক্ষে অন্তত সম্ভব বলে মনে হয়না।
প্রানেশার আট মাস চলছে৷ আগের পাতলা ফড়িংয়ের মতো শরীরটা হালকা মুটিয়েছে৷ পেট অনেকটাই উঁচু হয়েছে। সুফিয়ানের কড়া নিরাপত্তা, মিসেস অদিতির আদর, রাহাত সাহেবের স্নেহে ভালোই দিন কাটছে প্রানেশার।
সুফিয়ান তখন হসপিটালের একটা অপারেশনে ব্যস্ত ছিলো৷ প্রানেশা সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে মুখ মুচ্ছিলো৷ মোবাইলের টুংটাং আওয়াজে মুচকি হেসে উঠলো প্রানেশা। সুফিয়ান দশ মিনিট পরপরই কল করতে থাকে। হয়তো এখন মেসেজ পাঠিয়েছে ভেবেই মোবাইলটা হাতে নিলো। মেসেজ অপশন অন করতেই মাথা ঘুরে গেলো। প্রানেশার চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে টুপ করে পড়লো পায়ের আঙুলে। সুফিয়ানের সঙ্গে চার পাঁচটা মেয়ের বিছানায় ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি। প্রানেশার দুর্বল শরীর আর নিতে না পেরে ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে রইলো৷ দূর্ঘটনার হাত থেকে আর রেহাই পাওয়া গেলো না অবশেষে। প্রানেশার মাথাটা ড্রেসিং টেবিলের উপর বাড়ি খেয়ে রক্তের ফোঁটায় রঞ্জিত হয়ে গেলো ফ্লোর।
রিসোর্টের বিশাল রুমটায় মৃদুমন্দ হওয়ার আনাগোণা।
বাতাসের এলোমেলো ধাক্কা হালকা পাতলা জিনিসগুলোকে দোলাচ্ছে। বিছানায় ছড়ানো ছিটানো কাপড় বিছিয়ে রাখা। কাবার্ড থেকে জামা কাপড় নিয়ে বিছানায় রাখছে প্রানেশা, সব জামা কাপড় রেখে উপর থেকে লাগেজটা নামিয়ে নিলো। তারপর বিছানা থেকে একটা কাপড় উঠিয়ে ভাজ করে রাখতেই হাঁপিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। অসহায় মুখ করে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো-
‘হায় আমার পোড়া কপাল! খেটে খেটে মরি অথচ আমার সোয়ামী ফিরে চাহিয়াও দেখেন না। ‘
পরমুহূর্তেই বুক চাপড়ে বললো-
‘তোর বেঁচে কী লাভ, তুই মরে যা প্রানেশা। মরে যা তুই, কেউ তোকে ভালোবাসে না! ‘
সোফায় বসে ল্যাপটপে হাত চালাতে চালাতে প্রানেশার কর্মকাণ্ড দেখছিলো সুফিয়ান৷ প্রানেশার মেজাজ খারাপ বোঝাই যাচ্ছে। হবে নাই বা কেনো?রাতের বেলা সুফিয়ান বলেছিলো কাছেই আজকে তারা আরেকটা বিচে ঘুরবে৷ সকাল বেলা প্রানেশা টিপটাপ হয়ে রেডি হয়ে যেই এক্সাইটেড হয়ে বেরোনোর প্রস্তুতি নিলো সুফিয়ানের সঙ্গে। তখনই সুফিয়ানের কল আসলো, বাংলাদেশে তার একটা সার্জারী পড়েছে। আজকে রাতের মাঝেই সেখানে উপস্থিত হতে হবে। ছুটি নিয়েছে ১০ দিনের, অথচ সাত দিন হওয়ার আগেই চলে যেতে হচ্ছে। খুব বেশি ঘোরাও হয়নি৷ প্রানেশাকে সুফিয়ান যখন কথাটা বললো প্রানেশা চুপচাপ বসেছিলো তারপর উঠে কোমড়ে নিজের ওরনাটা বেঁধে নিয়ে জিনিস পত্র গোছানো শুরু করলো। গোছাচ্ছে কম, মিনমিন করে সুফিয়ানকে গালমন্দ করছে বেশি। সুফিয়ান, একবার উঠে হেল্প করতে যেতেই প্রানেশা কটমট করে তাকালো। তাই ল্যাপটপ নিয়ে সেই প্যাশেন্টের মেডিকেল হিস্ট্রি গুলোতে চোখ বুলাচ্ছে। প্রানেশা সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে গাল ফুলিয়ে বিরবির করতে করতে গোসল করে আসলো। গায়ে ম্যাজেন্ডা রংয়ের লং টপস সাথে টাউজার।
সুফিয়ান রেডি হয়ে এসে খাবার অর্ডার করলো৷ প্রানেশা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান দুই বার ডাক দেয়ার পরও যখন আসলো না তখন সুফিয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে গেলো সেখানে। প্রানেশাকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে আসলো৷ প্রানেশা হাত পা ছুঁড়ে মুচড়াতে শুরু করলো। সুফিয়ান বিছানায় বসে প্রানেশাকে নিজের সঙ্গে চেপে রেখে বললো-
‘এমন কেনো করছোরে বাবা! আমরা আবার আসবো তো ‘
প্রানেশা শক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। সুফিয়ান মৃদু হেসে প্রানেশার ঘাড়ের ওপর চুমু খেয়ে বললো-
‘রাগ করোনা বউ, বাংলাদেশেও অনেক সুন্দর জায়গা আছে আমরা সেখানেও ঘুরবো। আজ না গেলে একজন মানুষের জীবন সংকটে পড়বে। ডক্টরের বউ হয়ে এত অবুঝ হলে চলে?’
প্রানেশা কিছুটা শিথিল হলো। ঠোঁট চেপে কিছু ভেবে সুফিয়ানের দিকে পিটপিট করে চেয়ে বললো-
‘সত্যি, নিয়ে যাবেন ঘুরতে নাকি আবার ডক্টর হওয়ার বাহানা দেবেন? ‘
সুফিয়ান হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে প্রানেশার মুখের সামনে ব্রেডের টুকরোটা ধরলো। প্রানেশা লক্ষ্মী মেয়ের মতো মুখে পুড়ে নিলো। সুফিয়ান নিজেও একসাথে খেয়ে উঠলো৷ প্রানেশা সবকিছু গোছানো শেষ করে ফেলেছে আগেই৷ তাছাড়া জামা কাপড় ছাড়া খুব বেশি জিনিস তারা আনেনি। টুকটাক যা ছিলো গুছিয়ে নিয়েছে৷
এক ঘন্টার মাঝেই গাড়ি সব এসে হাজির। এখানে থেকে এয়ারপোর্টে যেতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগবে।
বাহিরে বের হতেই আগের চারজন বডিগার্ড এসে হাজির হলো। এবার প্রানেশা সব ব্যাপারে জানে, তাই দ্বিরুক্তি না করে গাড়িতে উঠলো। সুফিয়ান উঠতে নিলে পেছনে একজন ‘স্যার’ বলে চিৎকার করলো।
প্রানেশা আর সুফিয়ান দুজনেই পেছনে তাকালো। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো -‘ এই লোকটাকেই তো প্রথমে হোটেলে দেখেছিলাম! ‘
সুফিয়ান গা দুলিয়ে হালকা হেসে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার সঙ্গে কোলাকুলি করলো। প্রানেশা অনেকটাই অবাক হলো কারণ যখন বালিতে আসলো তখনও সুফিয়ান দুরত্বে থেকে কথা বলছিলো। অথচ, আজ কথা বলার ভঙ্গিমা খুবই আত্মিক। যেনো দুজন কত আপন। সুফিয়ান গাড়িতে বসতেই প্রানেশা বললো-
‘কী হলো ব্যাপারটা!’
সুফিয়ান চোখের বাদামী রঙের রোদচশমাটা কোটের পকেটে গুঁজে গাল বাকিয়ে হাসলো। প্রানেশার দিকে তাকিয়ে বললো –
‘ব্যাপারটা স্বাভাবিক ‘
একটু থেমে বললো-
‘ওটা তনিম ছিলো প্রাণ ‘
প্রানেশা স্থির হয়ে বসে রইলো। মনে মনে কিছুটা এরকমই কল্পনা করেছিলো। আচমকা চোখ বড় বড় করে বললো –
‘কিন্তু তনিম ভাইয়া, বালিতে কী করে? ‘
সুফিয়ান প্রানেশার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘তনিম যেদিন আমাকে সেসব বললো সেদিনই সকালে ওর মা মারা গেলো। বোনকে ইভানানের যে টাকায় বিয়ে দিয়েছিলো, সেই সুখ শান্তি ওর বোন পায়নি। তালাকও হয়ে গেছিলো। আর যেখানে চাকরি করতো সেখানে থেকেও বের করে দিয়েছিলো। আমি তা পরে জানতে পারি। তনিম লজ্জায় গ্রামের বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি পরের দিনই ওকে খুঁজে বের করে আনি৷ এইখানে আমার এক বন্ধু থাকে, স্মিথ। আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম সেটার মালিকের ছেলে। তাই, ওকে বলে এখানে ওকে শিফট করিয়ে দিয়েছি ম্যানেজার পদে ।’
প্রানেশার প্রথমবার ইচ্ছে করলো এখনই সামনে বসে থাকা মানুষটার বুকে ঝাপিয়ে পড়তে। শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো-
‘তনিম ভাইয়া আমাকে আপনার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো তাহলে আপনার তো তার দুর্দশায় খুশি হওয়া উচিত ছিলো, সাহায্যে কেনো করলেন?’
সুফিয়ান প্রানেশার নরম হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বুকে নিয়ে বললো-
‘প্রাণ, তুমি জীবনে আসার আগ পর্যন্ত আমি ভীষণ পাষাণ ছিলাম। এক ধরনের ঘাড়ত্যাড়াও বলতে পারো৷ যা আমার তা আমি ছিনিয়ে হলেও নিজের কাছে রাখবো কিছুটা এমন। কিন্তু তুমি আমার জীবনে আসার পর এই পাষাণ, শক্ত হৃদয়ের আমিটা কীভাবে যেনো পাল্টে গেলো৷ তুমি আসার পর আমি জানতে পারলাম বিধাতা যদি আমার ভাগ্যে কিছু লিখে রাখেন তাহলে আমি তা অবশ্যই পাবো৷ শত বাঁধা অতিক্রম করে হলেও সেটা আমারই হবে।
মনে আছে?যেদিন তোমাকে বিয়ে করে আমার ঘরে আনলাম সে কয়েক দিনও আমি তোমার সঙ্গে সাইকোর মতো ব্যবহার করেছি! কেনো জানো? ভয় থেকে, আমার মনে ভয় ছিলো যদি সেই কালো অন্ধকার তোমাকে আবারও তোমায় হারিয়ে ফেলি৷ সত্যি সত্যি দম বন্ধ মারা যাবো আমি।
পাঁচটা বছর তোমাকে না দেখে তোমার কন্ঠ না শুনে আমার আত্মা মরুভূমির মতো শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছিলো৷ কয়েক দিন যেতেই আমি বুঝতে পারলাম,আল্লাহ আমার ভাগ্যেই রেখেছিলো তোমাকে।
শুরু থেকে তো তুমি আমারই ছিলে। কিন্তু আমার ভুলেই আমি তোমাকে হারিয়েছিলাম। যদি আমি সরাসরি তোমার সামনে দাঁড়াতাম তাহলে ওসব কিছু হতোই না৷ দোষটা তাহলে একজনকে কীভাবে দেই প্রাণ বলতো! ‘
প্রানেশা এবার সত্যি সত্যি সুফিয়ানকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো৷ সুফিয়ান চমকে গিয়ে পরমুহূর্তেই নিজের দুই হাতে আকড়ে ধরলো৷ প্রানেশার চোখ বেয়ে গড়াচ্ছে নোনাজল। এতো সুখ অনুভব হচ্ছে, যা আগে কখনো হয়নি তার। একজন পার্ফেক্ট জীবনসঙ্গী পেলে বুঝি এমনই অনুভূত হয়! নিশ্চয়ই সব মেয়েরা এমন একজন মানুষই নিজের জীবনে চায়। যে তাকে সম্মান করবে, ভালোবাসবে, আবার একই সাথে মনের আঁটকে পড়ে থাকা কথাও জেনে যাবে। আর এমন মানুষটা যদি উপরওয়ালা নিজের হাতে তাকে দান করেন তাহলে খুশিটা কী ভাষায় যায়!
সুফিয়ান প্রানেশার গালে হাত রেখে নরম গলায় বললো -‘আর কাঁদেনা বউ, তারপর মা বলবে তার বউমাকে আমি হানিমুন থেকে মেরে এনেছি ‘
প্রানেশা কান্নামিশ্রিত গলায় ফিক করে হাসলো। সুফিয়ানের প্রশস্ত বুকেই নিজের মাথাটা এলিয়ে বসে রইলো। সুফিয়ান মাথায় বিলি কাটতেই আরামে ঘুমিয়ে পড়লো প্রানেশা। যখন ঘুম ভাঙলো তখন গাড়ি থামানো। প্রানেশা চোখ কচলে হাই তুলে নিয়ে বললো-
‘আমরা কী এয়ারপোর্টে এসে পড়েছি?’
সুফিয়ান স্মিত হেসে বললো –
‘আরও আধা ঘণ্টা আগে’
প্রানেশা চমকে উঠলো। আশপাশের জায়গা দেখে সুফিয়ানের বাম হাতটা উপরে উঠালো। ইয়া আল্লাহ! সত্যিই আরও আধা ঘণ্টা আগেই পৌঁছে যাওয়ার কথা। সুফিয়ান নিজে বের হয়ে প্রানেশার পাশের দরজাটা খুলে দিলো। প্রানেশা ঘুমঘুম দেহে বেরিয়ে এলো। ঘুমের ঘোর এখনও অল্প রয়ে গেছে। সুফিয়ান গার্ডদের হাতে ব্যাগগুলো তুলে দিয়ে প্রানেশাকে নিজের সাথে জড়িয়ে হাঁটা ধরলো। প্রানেশার অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় জিজ্ঞেস করলো –
‘আধা ঘন্টা আগেই যখন গাড়ি থেমেছে তাহলে আমাকে ডাকলেন না কেনো?’
সুফিয়ান ব্যস্ত তখন প্রানেশার চুল ঠিকঠাক করে দিতে। মনোযোগ সরিয়ে বললো-
‘কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলে মাথা ব্যাথা করতো, আর আধা ঘণ্টা লেট তেমন কোনো ব্যাপার না ‘
প্রানেশা প্রসন্ন হাসলো। সে হাসি সুফিয়ানের প্রেমিক বুকে ঝড় তুললো। প্রানেশাকে আরেকটু কাছে এনে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো সে। প্লেনে উঠে সুফিয়ানের কাঁধে মাথা রেখেই পুরো জার্নি হলো প্রানেশার।
এত ঘন্টার জার্নিতে ক্লান্ত হলো প্রানেশা। সুফিয়ান যত্ন করে বাড়িতে ঢোকালো নিজের সঙ্গে। মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেব এতক্ষণ ওদের অপেক্ষাতেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলো। সুফিয়ান আর প্রানেশা ভেতর ঢুকতেই মিসেস অদিতি দুজনকে জড়ানো কুশলাদি বিনিময় করলেন। রাহাত সাহেব আগের জায়গায়ই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রানেশা যেহেতু এবার সবকিছু জানে তাই তার কেমন যেনো সবাইকে খুব আপন মনে হচ্ছে। মিসেস অদিতি আগেও তাকে খুব আদর করতো কিন্তু প্রানেশা সহজ হতে পারেনি, কারণ তখন সকল রহস্য থেকে সে অজ্ঞ ছিলো। এবার সে সবই জানে। রাহাত সাহেবকে দেখে মনে মায়া হলো প্রানেশার। মিসেস অদিতিকে সালাম করে কথাবার্তা বলে রাহাত সাহেবকে সালাম করে কেমন আছে জিজ্ঞেস করতেই রাহাত সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠলো। কত বছর পর কেউ জিজ্ঞেস করলো সে কেমন আছে! উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠলো চোখ মুখে। যৌবন বয়সের করা ভুলের মাশুল আর কতদিন দিতে হবে সে জানেন না। হাসিমুখে প্রানেশার মাথায় হাত রেখে কিছু বলার আগেই সুফিয়ান শক্ত গলায় বললো
-‘প্রানেশা, চলো হাত মুখ ধোও। দিনকাল ভালো না, হাতে পায়ে জীবাণু থাকতে পারে। ‘
প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ান এখনও অভিমান করে আছে তার বাবার উপর। এত বছরের অভিমত একদিনে তো আর ভাংবেনা। সময় দিতে হবে। প্রানেশা মনে মনে ঠিক করে যে করে এই পরিবারের মানুষগুলোকে এক করবে সে। কতটুকু সম্ভব সে জানেনা। কিন্তু চেষ্টা তো করে দেখা যায়।
রুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। সুফিয়ান শাওয়ার নিয়েই হসপিটালের কাজের জন্য বেরিয়ে গেছে। রেয়ান নাকি অস্ট্রেলিয়ায় গেছে। শুনে অবাক হয়নি সে। ইভানানের হাতের পুতুল হয়েছে তা জানে প্রানেশা। এভাবেই আরও এক মাস কেটে গেছে। সুফিয়ানের ভালোবাসায় প্রানেশা ধীরে ধীরে সিক্ত হয়ে উঠছে । ভালোবাসার গভীর নেশায় সেও তলিয়েছে স্বামীর সংসারে। সব কিছু কী সুন্দর করে এক হাতে সামলায় ভাবতেই অবাক হয় প্রানেশা। সুফিয়ান মেডিসিন কোর্সের উপর পড়াশোনা করছে, হসপিটালের কাজ তো আছেই সঙ্গে প্রানেশাকে নিজেই গাইড করে পড়াশোনা করায়। প্রানেশার মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে -‘এই, আপনি কী মানুষ নাকি রোবট? ‘
রাত বাজে আটটা পয়ত্রিশ। বাহিরে জমকালো বৃষ্টির আয়োজন। ঝুমঝুম বৃষ্টিতে ঠান্ডা পরিবেশ। সুফিয়ান গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে প্রবেশ করলো। মিসেস অদিতির মুখ হাসিহাসি৷ মনে হচ্ছে কী নিয়ে যেনো ভীষণ আনন্দিত। সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলো কিন্তু মিসেস অদিতি মাথা নাড়িয়ে ‘কিছু না ‘ বললেন।
সুফিয়ান সন্দেহ চোখে নিজের রুমে প্রবেশ করলো। রুমের ভিতরে ঢুকতেই আরেক দফা চমকালো। দরজার শুরুতেই ফুলের পাপড়ি বেছানো। দুই কদম দূরে ছোট একটা গিফট বক্স। সুফিয়ান ভ্রু বাকিয়ে বক্সটা হাতে উঠালো৷ আজ তো কোনো স্পেশাল ডে না তাহলে প্রানেশা এসবের আয়োজন কেনো করলো?
বক্স খুলতেই বের হলো ছোট একজোড়া জুতো, আর একটা সোয়েটার। সুফিয়ান চমকে উঠলো। বক্সের ভেতরে থেকে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা চিরকুট।