Friday, August 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 190



চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-১২

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১২

রাত তখন অনেক গভীর। এই ছোট বিছানার উপর কোনভাবে গুটি শুটি মে’রে শুয়ে আছে অর্নিলা। সারফারাজ দরজার সামনে থেকে অনি কে দেখছে। খোলা জানালা থেকে বাতাস আসছে তীব্রতরে। অনি কাঁপছে। ওর বোধহয় শীত লাগছে। সারফারাজ এগিয়ে গিয়ে জানালা বন্ধ করল। এবার সাদা রঙের একটা লাইট জ্বলছে মাথার উপর। ঘরটা বোধহয় কাঁপছে। ঝাকুনি খাচ্ছে সারফারাজ,‌ তার পুরো শরীর নড়ছে অথচ নড়ছে না তার দৃষ্টি। চোখ অন্যদিকে ফিরছে না। একদৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে অনির দিকে। এই মেয়েটার আর্কষন প্রবল অনেক। ফারাজ সেটা এড়িয়ে চলতে পারে না। সে আরো এগিয়ে গেলো। অনেক কাছে সে অর্নিলার অনেক কাছে। মাথা উপর করে অনিকে দেখছে। চুল গুলো সুন্দর করে বেনুনী করা। ছোট ছোট চুল গুলো কপালে জড়ো হয়ে আছে। সারফারাজ হাত দিলাম সেগুলো সরিয়ে দিল। তার হৃৎস্পন্দন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে, সে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। ভালোবেসে ফেলছে অনি কে। কিন্তু এই ভালোবাসা থাকবে তো চিরকাল। চিরকাল রইবে তো এই ভালোবাসার মুগ্ধতা।

আচমকা চুমু খেলো অনির কপালে। তার হৃৎস্পন্দন এবার বোধহয় একটু শান্ত হলো। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। এতোক্ষণ ধরে যেমনটা অনুভব করছিলো এখন আর তেমন লাগছে না। মনের উপর থেকে কোন এক ভার যেন সরে যাচ্ছে। তার মন , হৃদয়, আত্মা তাকে বলছে ভালোবাসতে। এই ভালোবাসায় তারা তৃপ্ত!

অনি চোখ মেলে তাকাল। ঘুমটা যেন হঠাৎ ই ভেঙে গেল। কিন্তু ঘুমের মাঝে সে একটা স্বপ্ন দেখেছিলো। কপালে হাত রাখল। ফারাজ ভাই তার কপালে চুমু খেয়েছে। লজ্জায় বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে ধরল। অসম্ভব এটা কখনো হতে পারে? ভাই তো তার হাতটা আজ অবধি ঠিক করে ধরল না। আলতো করে তার হাত স্পর্শ না করে কপাল কেন করবে। এটা কি কখনো হয়?

চারপাশ চোখ বুলিয়ে দেখল ফারাজ ভাই নেই। কোথায় গেলো ভাই? জানালা টা বন্ধ। ঘুমানোর আগে বেশ মনে ছিল জানালাটা খোলা। বন্ধ করল কে? তাহলে কি ফারাজ ভাই এসেছিল। বিছানা ছেড়ে নামল সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ঝনঝন ট্রেনের শব্দ। ধরে ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে অনি। হঠাৎ সে থেমে গেল। তার চোখ আটকে গেল ফারাজ ভাই কে দেখে। ফারাজ ভাই দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। অনি অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। ফারাজ ভাইয়ের চুল গুলো এলোমেলো হয়ে দোল খাচ্ছে। একহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাত সিগারেটের ধোঁয়া শূন্যে মিলিয়ে দিচ্ছে। দৃষ্টি কোমল হলো। ভাই কে সিগারেট খেতে দেখে অতো অবাক লাগল না। কিন্তু অনির মনে হলো সে ভাইয়ার প্রেমে পড়ে গেল। আশ্চর্য! এটা কোন সময় হলো প্রেমে পড়ার মতো।

এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়াল। ফারাজ তখনো অনির সম্পর্কে অবগত না। তার বিস্ময় দৃষ্টি ফারাজ ভাইকে ঘিরে। দ্রুতবেগে তার হৃদয়ের হৃৎস্পন্দন চলছে। বুকে হাত রাখল অনি। ফারাজের খেয়াল হলো। শুধালো, “অনি? তুমি এখানে? কি করছো?”

“আপনাকে দেখছি ফারাজ ভাই!”

ছোট ছোট চোখ করে চেয়ে রইল ফারাজ। এই মেয়েটা এতো স্পষ্টভাষী! দেখে তো মনে হচ্ছে না মিথ্যে বলছে।‌ অর্ধেক খাওয়া সিগারেট ফেলে দিতে চাইল সে। বাঁধ সাধল অনি। তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, ”ফেলবেন না ফারাজ ভাই?”

”কেন?”

”আপনি দাঁড়িয়ে সিগারেট খান, আমি আপনাকে একটু দেখি।”

কথাগুলো বারি খাচ্ছে। ফারাজ প্রথমে বুঝতে পারল না। একটু পর বলে উঠল, “তুমি কি পাগল হয়ে গেছো অনি?”

“হ্যাঁ, ফারাজ ভাই পাগল হয়ে গেছি। আপনার প্রেমে পড়ে আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি।”

ফারাজ চমকে উঠল। হাতের সিগারেট ফেলে দিল সে। অনির হাস্যউজ্জ্বল মুখটা নিমিয়ে গেল। সে বলে উঠল, ”জানেন আপনাকে কতোটা সুর্দশন লাগছিলো দূর থেকে। আমি দেখেই তো প্রেমে পড়ে গেলাম।”

সারফারাজ জবাব দিল না। তার হাত ধরে ফের নিয়ে এলো ঘরের মধ্যে। হাতটা ছাড়তে যাবে অমনি অনি বলে উঠল, “হাত ছাড়বেন না ফারাজ ভাই, আরেকটু ধরে রাখুন।”

সারফারাজ কথা শুনল না। ধপ করে হাতটা ছেড়ে দিল। ঠোঁট উল্টে ফেলল অনি। ফারাজ তার কপালে টোকা দিয়ে বলল, “আমার প্রেমে পড়ার জন্য আমায় মৃ/ত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছ। বাহ অনি!”

“মানে ফারাজ ভাই?”

“সিগারেট খেলে মর/ণ নিশ্চিত। তবুও ভালো ভাবে কেউ মর/তে পারে না। অথচ তুমি চাইছো আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার সামনে সিগারেট খাই। কি আবদার!”

অনি চোখ নামিয়ে ফেলল। মিনমিন স্বরে বলল, “আমি‌‌ ওভাবে বলি নি ফারাজ ভাই। আপনি দূর থেকে দেখতে পুরো মুভির হিরোর মতো লাগছে।”

”আর নিজেকে কি ভাবছিলে? হিরোয়িন!”

“দোষ কি ভাবলে ফারাজ ভাই। সব মুভিতেই তো হিরোর হিরোয়িন থাকে তার স্ত্রী! আমিও তো আপনার স্ত্রী!”

”এসব কথা তোমাকে কেউ শিখিয়েছে?”

“সে শিখাবে। আমি নিজেই জানি। আপনি দেখেন না ফারাজ ভাই, আমি বড় হয়ে গেছি। আগে টপস পরতাম এখন শাড়ি পরি, এখন আমি রান্নাও করতে পারি, ঘর গোছাতে পারি আর কিছুদিন পর ভার্সিটিতেও ভর্তি হবো। তখন আমি আরো বড় হয়ে যাবো।”

“এতো বড় হয়ে কি হবে অনি?”

“আপনাকে ভালোবাসতে পারব!”

আকস্মিক কথায় ফারাজ চমকে উঠল। কিয়ৎকাল চেয়ে থাকার পর তার বিস্ময় ভাব কাটল। ট্রেনটা তখনি যেন থেমে যেতে লাগল। হয়তো কোন স্টেশনে এসেছে। সবকিছু কেঁপে উঠল। তাল সামলাতে না পারে অনি এসে ঠেকল সারফারাজের কাছে। তার দৃষ্টি পড়ে আছে ফারাজ ভাইয়ের খোলা শার্টের বুকের উপর। আজকের এই একরাতে তারা অনেক কাছাকাছি এসেছে যা গত কয়েকবছরেও যায় নি। ফারাজ ভাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসার অনুভূতি সেদিন প্রথম এসেছিল যেদিন দেখেছিল তার জন্য ফারাজ ভাই প্রতিবাদ করছে। সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলো, আবার আনন্দ ও হচ্ছিল। তার ফারাজ ভাই তার জন্য লড়ছে। সেদিন প্রথমবারের মতো তার হাত শক্ত করে ধরেছিল ফারাজ ভাই। সেই ছোঁয়া সে আজ অবধি ভুলতে পারেনি। ওমন ভাবে কেউ তাকে কখনো ধরে রাখেনি। ফারাজ ভাই আর শতবার ও তার হাত ছুঁয়ে নিলে ওমন অনুভূতি আর কখনো আসবে না। কখনো না, প্রথম অনুভূতির প্রথম ছোঁয়া সব অন্যরকম। কখনো তা এক হয় না।

ফারাজ মুখ নিচু করে তাকাল। অনি চোখ মেলে তাকাল তার দিকে। অনি তার হাত শক্ত করে ধরে নিল। ফারাজ ভ্রু কুঁচকে নিল। আচমকা তার ওষ্ঠাদ্বোরে আবদ্ধ করে নিল অনি। ফারাজ চমকে উঠল। বিস্ময়ে হতবাক সে। কোন শব্দ করল, কোন কথা বলল না। দু সেকেন্ডের মাঝে কি হলো ভাবতে সময় লাগল। অনির অশ্রুসিক্ত নয়নের দৃষ্টিজোড়া তখনো বহমান।‌ সে দূরেও যাচ্ছে না, কাছেও আসছে না। কেমন এক মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছে। ফারাজ মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনি হাত ছাড়েনি তখনো, হন হন করে ফারাজ চলে গেল। হাতের বন্ধন আলাদা হয়ে গেল। অনি কেঁদে উঠল। ফারাজ ভাই আবারো তাকে ফেলে চলে গেছে। সেদিনকার মতো। রাতে ঘুম থেকে উঠে পাগলের মতো খুজেছিলো ফারাজ ভাইকে। কিন্তু পায়নি, আজও কি পাবে না! ফারাজ ভাই কি আজ আবারো চলে যাবে তাকে ফেলে…
.
খানিকক্ষণ বাদে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। অনি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। অশ্রুকণা শুকিয়ে গেছে। ফারাজ ভাই এখনো এলো না। চলে যায় নি তো আবার। ফারাজ ভাইয়ের যা রাগ হয়তো কোন স্টেশনে নেমে চলেও গেলো। কিন্তু তাকে এখানে একা ফেলে ফারাজ ভাই চলে যেতে পারে না। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেলো।‌ কেঁপে উঠলো সে। ফিরে তাকিয়ে দেখল সারফারাজ!

উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কি বলবে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ফারাজ পানির বোতল এগিয়ে দিল তার হাতে। আবারো বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। তার সাথে যেন লুকোচুরি খেলছে ফারাজ ভাই।

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-১১

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১১

অর্নিলা কে সাথে নিয়ে সারফারাজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। বের হবার পথে শাহিনুর বেগমের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি অস্থির। আরিফ হাসান শক্ত মানুষ। তিনি একদৃষ্টিতে সারফারাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ”ওর খেয়াল রাখবে,‌ঠিক যেভাবে আমি রেখেছিলাম। ও আমার মেয়ে! নিজের বউ মনে করে না, আমার মেয়ে মনে করে ওর খেয়াল রাখবে সারফারাজ।”

সারফারাজ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল। ফরহাত দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সব শয়তানি বুদ্ধি ওর। শ্রেয়মী আর রুদমিলা তারাও এসে হাজির। আরাফাত দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে হাসছে। হেসে হেসে বলছে, “যা তোরা। আমিও আসছি। বেশিদিন তো আর বাকি নেই।”

অর্নিলার অশ্রুসিক্ত আঁখি দুটি নামিয়ে রাখল। ব্যাগপত্র সব গাড়িতে তুলছে সিধু। ট্রেন অবধি তাদের এগিয়ে দিয়ে আসবে। সারফারাজ গাড়ির দরজা খুলল। অর্নিলা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফাত এগিয়ে আসতেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, “আমি যাবো না!”

আরাফাত তার হাত আগলে ধরল। ফিসফিসিয়ে বলল, “কেন যাবি না রে বুড়ি। গেলে তো ভালোই হবে। তোর ভালোবাসার মানুষ কে তুই একা পাবি, আলাদা করে পাবি। ভালোবাসতে পারবি। এটাই তো সময়, নিজের ভালোবাসা এবার তাকে বুঝিয়ে দে। আর কতোকাল একপাক্ষিক ভালোবেসে যাবি।”

দৃষ্টি মেলে চাইল অর্নিলা। চোখের পাতা কাঁপছে। কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আরাফাত হাসছে! এই ছেলেটা সম্পর্কে তার দেওর হয়, সে হয় তার ভাবী। বলে ভাবী নাকি দেওর কে আগলে রাখে অথচ তার দেওর তাকে আগলে রাখছে। আরাফাত তার দেওর না, নিজের আপন ভাই, সবচেয়ে কাছের বন্ধু। অর্নিলার মনের সব কথা তার নখদর্পণে। আরাফাত ধমকের সুরে বলল, ”দেখি , চল উঠতো গাড়িতে।”

পেছন থেকে ছোট ফুফু বলে উঠলেন, ”একি? দেওর ভাবী কে ধ/মক দিচ্ছে। অর্নিলা তো সম্পর্কে বড় হয় তোমার আরাফাত!”

শাহিনুর বেগম বলে উঠলেন, “ওসব সম্পর্ক ওদের মাঝে নেই ভাবী। দুজন ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে। এসব সম্পর্কের টানাপোড়েন ওদের মাঝে আনবেন না।”

“তা বললে কি করে হবে? সম্পর্কে বড় মানে বড় ওখানে…

থামিয়ে দিল বড় ফুফু। তিনি গম্ভীর মুখে চেয়ে আছে সারফারাজের দিকে। সে এসেছে শুনে তাড়াহুড়ো করে বিদেশ থেকে এসেছে আজ তিনদিন। এর মধেই সারফারাজ চলে যাচ্ছে। কথা হলো না ঠিক করে। আরিফ হাসান এগিয়ে গেলেন। অর্নিলা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল। আরাফাত তাকে ধরে নিয়ে গাড়িতে বসাল। ফরহাত এগিয়ে এসে বলল, ”আমি যাচ্ছি ওদের ছেড়ে দিয়ে আসতে। আরাফাত তুই যাবি?”

দুই কদম পিছিয়ে গেল আরাফাত। মাথা দুলিয়ে জবাব দিল না। আরিফ হাসান পেছন ঘুরলেন। তিনি আর পারবে না। হয়তো আরো এগিয়ে দিয়ে আসতে গিয়ে অর্নিলা কে বাসায় ফেরত নিয়ে আসবেন তিনি। “নিকুঞ্জ নিবাস” এর দিকে ফিরে চাইলেন। এই বাড়িটা এখন নিশ্চুপ হয়ে গেল। এখন আর কেউ বাড়ির ছাদে ছোটাছুটি করবে না। আর কেউ তাকে ঔষধের কথা মনে করিয়ে দিবে না। রাত জেগে থাকত বলে বকা দেওয়ার মতো কেউ রইল না। তিনি বোধহয় একা হয়ে গেলেন। শাহিনুর বেগম এগিয়ে গিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কান্না থামছে না তার। আরাফাত তাকে ধরে রাখলেন। সবাইকে কাঁদিয়ে দিয়ে অর্নিলা আর সারফারাজ চলে যাচ্ছে। কে জানে? হয়তো এখান থেকে নতুন শুরু তাদের!
.
ফরহাত দুজনকে ট্রেন অবধি পৌঁছে দিল। অর্নিলা মন খারাপ করে কেবিনের মধ্যে বসে আছে। ফারাজ বাইরে দাঁড়িয়ে ফরহাতের সাথে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। ফরহাত মুচকি মুচকি হেসে ফারাজের ঘাড়ে হাত রাখল। বলে উঠল, ”বুঝলি! এরপর টানা দুই তিন বছর পর হাজির হবি। জোড়ায় আসবি না খবরদার। সাথে আরো একজনকে নিয়ে আসবি।

”তোর আজেবাজে কথা রাখ তো ফরহাত।”

“আজেবাজে কথা! সত্যি, তোর মনে হয় তুই সবার মতো আমাকেও বোকা বানাতে পারবি। শোন ফারাজ। আর কেউ পারুক আর না পারুক এই ফরহাত কিন্তু ফারাজের মনের কথা ভালো বুঝতে পারে। আমি জানি তোর মনে কি চলছে। আরে আমরা রক্তে মিশে আছি।”

ফারাজ চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। ফরহাত বলে উঠল, “কিন্তু সাবধান বাদ্রার। বাচ্চা মানুষ তো!”

“বাচ্চা মানুষ! কে বাচ্চা? অনি! ও অনেক বড় হয়ে গেছে এখন তুই হয়তো দেখে বুঝতে পারছিস না নয়তোবা না বোঝার ভান করছিস।

“এজন্যই বোধহয় ফারাজ ভাইয়ের তর সইছে না।

“কি সব কথা বলছিস ফরহাত। আমি এখনো অনি কে পুরোপুরি বিশ্বাস করি না।‌আফটার অল ও শামসের শিকদারের মেয়ে। ওদের বংশের কাউকে বিশ্বাস করতেই আমায় ভয় করে।

ফরহাত হালকা কাশল। খানিকটা সিরিয়াস মুড নিয়ে বলে উঠল, “তুই লিখে রাখ। আমি বলে দিচ্ছি, অনি একদম তেমন নয়। তুই এখনো ওকে চিনতে পারিস না। যেদিন পারবি, সেদিন খুশিতে পাগল হয়ে যাবি। তোর চাইতে কেউ আর বেশি ভালোবাসতে পারবে না ওকে।”

ফারাজ কথা বাড়াল না। ওর সত্যিই ভীষণ ভয় করে। একবার ঠকেছে বার বার ঠ/কতে মন চায় না। তাও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছে এতোদিন দমিয়ে রেখেছিল এখন রাখবে কি করে? অনি তো এখন তার সাথেই থাকবে, তারা দুটি মানব এখন একসাথেই এক ছাদের নিচে থাকতে শুরু করবে। সে কি চাইলেও পারবে অনি কে এড়িয়ে চলতে। তার মন মানবে তো!
ফরহাত ট্রেনের মধ্যে ঢুকে বলল, “যাই, অনি কে একবার শেষ বিদায় দিয়ে আসি। ট্রেন ছেড়ে দিবে তো!”
সারফারাজ দাঁড়িয়ে ভাবছে, ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। ভাবনার যেন শেষ হচ্ছে না!
.
ট্রেন ছেড়ে দিল। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস থেকে টেন ছুটছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাতের এই অন্ধকারে বাইরের দৃশ্য দেখা বেজায় মুশকিল। অর্নিলা চোখের পানি মুছে জানালার দিকে চেয়ে রইল। দূরের বাড়ি গুলোয় আলো জ্বলছে। চিকচিক সেই আলোর একটু ঝলকানির দেখা মিলছে। সারফারাজ নেই অনেকক্ষণ। অর্নিলা বাইরে চেয়ে দেখল। এক জায়গায় এতোক্ষণ বসে থাকার স্বভাব তার নেই। উঠে দাঁড়াল সে। দরজার সামনে এসে বের হতেই কারো পা চোখে পড়ল। মুখ তুলে তাকাল। ফারাজ ভাই! বুকটা ধক করে উঠল তার। শরীর শিউরে উঠল। দরজার জায়গাটুকু হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। মুখ উঁচু করে চোখ মেলে চেয়ে আছে। দৃষ্টি নামছে না। ফারাজ ভাইয়ের অনেক কাছে দাঁড়িয়ে সে। কতো দিনের অপেক্ষার পর, কতো রাতের ভাবনার পর এভাবে যে দাঁড়িয়ে হিসেব করেনি। আবছা স্বপ্নে দেখা কল্পনা গুলো যেন বাস্তব হতে বেশি দেরি নেই। কতোদিনের স্বপ্ন তার ললাটে এসে ঠেকবে ফারাজ ভাইয়ের ওষ্ঠাজোড়া। বক্ষে টেনে নিবে ফারাজ ভাই। বাহুদ্বোরে আটকে রেখে দিবে তাকে।‌ কতোই না স্বপ্ন তার!

চোখে চোখ পড়তেই বিদ্যুতের ন্যায় সরে গেল ফারাজ ভাই। চোখ নামিয়ে ফেলল অর্নিলা। ফারাজ ভাই বলে উঠল, “কোথায় যাচ্ছো অনি?”

“কোথাও না ফারাজ ভাই। এই একটু হাঁটতে বের হলাম।”

“হাটা লাগবে না অনি। অনেক রাত, ভিতরেই থাকো।

”আচ্ছা।

উল্টো ফিরল অনি। সারফারাজ কি মনে করে বলে উঠলো, “আচ্ছা চলো হেঁটে আসি।”

অনি চমকে উঠল। ফারাজ ভাইয়ের মনে একসাথে কতো কিছু যে থাকে সে বুঝে উঠতে পারে না। দুজনেই একসাথে একটু বেরুলো। একদম শেষের মাথায় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। চল/ন্ত ট্রেন থেকে বাইরে উঁ/কি মারল অর্নিলা। তৎক্ষণাৎ তার বাহু ধরে টে/নে সরিয়ে আনল সারফারাজ। ধমকে/র স্বরে বলল, ”পাগল হলি নাকি? এভাবে উঁকি দেবার কি আছে? পড়ে গেলে আর শরীরের কিছু খুঁ/জে পাওয়া যাবে নাকি?”

অনি মুখ চেপে হেসে উঠল। ভ্রু কুঁচকে ফেলল ফারাজ। সে হাসির কিছু বলেনি। তবুও এই মেয়েটা হাসছে। আশ্চর্য! ফারাজ ভাই এখনো হাত ছাড়েনি। অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। ধড়ফড় করছে তার হৃদয়/খানি। সারফারাজ এবার হাত ধরে টেনে বলল, ”হয়েছে আর হাঁটা লাগবে না। চল!”

“ফারাজ ভাই; তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আমার কিছু হবো না। আমি তো ম/রতে আসিনি।”

কেবিনে এসেই হাতটা ছেড়ে দিল। অর্নিলা বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে বলল, ”ফারাজ ভাই, আপনি ভ/য় পেয়েছেন। ভ/য় পাবেন না। আপনি তো ডাক্তার মানুষ। কতো মানুষের মৃ/ত্যু দেখবেন। আমার মৃত্যু/তে ভয় পেলে চলবে।”

“ডাক্তাররা সবার মৃ/ত্যু সহ্য করতে পারে অর্নিলা। এগুলো দেখতে দেখতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু কাছের মানুষগুলোর মৃ/ত্যু তারাও স/হ্য করতে পারে না। কারণ দিনশেষে তারাও মানুষ। হৃদয় তাদের ও থাকে।”

অনি একগাল হেসে বলল,
“তাহলে বলুন ফারাজ ভাই, আমিও আপনার অনেক কাছের!”
সারফারাজ চেয়ে দেখল অনি হাসছে। কথাগুলো বলার আগে ভাবে নি এখন ভাবতে হচ্ছে। অনেক গভীর কথাই বলে ফেলেছে সে।

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-১০

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১০

ফরহাত সিগারেট ধরালো। সারফারাজ নাক কুঁচকে বলল, “এসব খাওয়া এখনো ছাড়তে পারলি না তুই?”

ফরহাত হাসল। অমায়িক তার হাসি। সারফারাজ বিরক্তি স্বরে বলে উঠল, “তোর প্রেমিকা কি বারণ করে না তোকে। কি সারাদিন এসব খেয়ে খেয়ে ম’রার দিকে চলে যাচ্ছিস। আমাকে তার নাম্বার দিয়ে যাবি, আজই কথা বলে তোর এসব বন্ধ করাবো।”

“কাকে বলবি?”

“কাকে বলবো মানে? ওই তো তোর ওই নায়িকা কে।”

”নায়িকা! হ্যাঁ নায়িকাই বটে। তবে আমি কখনো তার নায়ক ছিলাম না সারফারাজ। আমি তো ছিলাম তৃতীয় পক্ষ। কখন যে তৃতীয় পক্ষ হয়ে গেলাম সেটাও টের পেলাম না!”

কথাগুলো শোনা মাত্র স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সারফারাজ‌। তার পুরো শরীর ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। ফরহাতের আচরণ তাকে অবাক করে তুলছে‌। ফরহাত সিগারেট মুখে দিতেই ধোঁয়া ছাড়ল। সেই ধোঁয়া শূন্যে উড়ে গেল। তার দিকে ফিরে আচমকা হাসল। এই হাসি কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে মাত্র। সফল হলো না। সারফারাজের মনে হলো, সে নিজেকে দেখছে। ঠিক কয়েক বছর আগে এখানে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। বলেছিল কাঁদবে না, সে কাঁদেনি। অথচ তার হৃদয় চূর্ণ/বিচূর্ণ হয়ে গেছিল। জান্নাত তখন কবুল বলে অন্য ঘরের ঘরণী হয়ে গেছিল। অথচ সে কথা দিয়েছিল। বিয়ে শুধু তাকেই করবে, শুধুমাত্র তাকে। আর কাউকে না। কিন্তু জান্নাত কথা রাখেনি। বোকার মতো বিশ্বাস করে ঠকতে হয়েছিল সারফারাজ কে। সে বহু পুরনো কথা। টিনেজার বয়সে নতুন নতুন প্রেম আবেগ ভর্তি হয়। তাই বোধহয় সেই প্রেমের কথা এখনো ভুলতে পারেনি। তবে কষ্টটা ভুলা গেছে। আর ভুলে যাওয়াই উচিত। সে তো এখন তার না। অন্য কারো। কিন্তু ফরহাতের কি হলো? যখন ওর প্রেম হয়েছিল তখন সে টিনেজার মোটেও ছিলো না। এরপরেও প্রেমটা টিকল না তাদের।

ফরহাত হালকা কেশে বলা শুরু করল, “তেমন কিছু না সারফারাজ। আমি বেকার, ওর মা বাবা আমায় মেনে নেয়নি। তাই সে অন্যের হাত ধরে চলে গেছে।”

“তুই তো বোঝাতে পারতি।”

“আমি বুঝায়নি বলছিস। ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরেছিলাম। শুধু সময় চেয়েছিলাম। ও দেয়নি আমায়। আমার মা বাবার তো কম ছিল না ফারাজ। তারাও রাজী ছিল এই বিয়েতে। তবুও এটা হলো না। কেনো হলো না বলতো?”

সারফারাজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ হয়ে। ফরহাত সিগারেট টানছে তখনো। সারফারাজ বলে উঠল, “কারণ সে তোকে চায়নি। আমরা বোকা, তাদের চেয়ে বসি যারা কখনোই আমাদের চায়নি। চাইলে মানুষ কি না পায়। চাইতে তো হয বিধাতার কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। আমরা দুভার্গা। শুধু একপাক্ষিক ভাবে আমরাই চেয়ে গেলাম, আমরাই ভালোবেসে গেলাম। ওরা কখনো আমাদের চায়নি, কখনো না।”

শেষবারের মতো সিগারেট টান দিয়ে নিচে ফেলে দিল ফরহাত। হেসে উঠে বলল, ”আমি তোমায় চেয়েও পাইনি আর তুমি আমায় পেয়েও চাইলে না। আফসোস হয় না তোমার প্রিয়?”

“প্রিয়!” হেসে উঠল সারফারাজ। ফরহাত লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরল। দুই হাতে পিঠ চাপড়ে বলল, ”এখনো প্রিয় বলছিস কোন সুখে। মিথ্যে আশা এসব ফরহাত। সব মিথ্যে। এই প্রেম, ভালোবাসা সব কিছুই মিথ্যে।”

“সত্যিই কি তাই। বাঁচার জন্য কি ভালোবাসার দরকার হয় না। আচ্ছা ফারাজ, তুই তো প্রায় ডাক্তার হয়ে গেছিস। মৃ/ত্যু দেখিস নি। কতো মানুষ তো মরে যায়। তাদের চোখে ম/রার আগে বেঁচে থাকার সুখ দেখতে পাস নি। কতোটা ব্যাকুল হয়ে তারা বাঁচার জন্য ছটফট করে দেখিস নি।”

সারফারাজ চুপসে গেল। তার অন্তর চুপসে গেল ভয়েতে। ভালোবাসা! হায় সেটা বড় করুণ কথা। খুশিতে কেউ ভালোবাসার নাম নেয় না। এই তো কয়েকদিনের আগে, কি ছটফট করেই মা/রা গেলো লোকটা। ম/রার আগে একটি মানুষকে দেখার জন্য কেবল ছট/ফট করছিলো। মৃত্যু পথযাত্রী কে পানি খাওয়াতে হয়, আল্লাহর নাম নেওয়াতে হয়। অথচ সে তার প্রিয়তমার নাম নিতে ব্যস্ত। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা কেঁদে চলছে। শার্টের মধ্যে চোখের জল মুছে আবারো কাঁদতে কাঁদতে বলল, “শা লা ম/রার আগেও ওই মাইয়ার নাম নিতে হয় তোর। ওই কখনো ভালোবাসছিলো তোরে। ভালোবাসলে কি তোরে ছাইড়া চইলা যাইতো। ৬ বছরের সংসার তোগো, এই ৬ বছরে যেই মা** তোরে ভালোবাসতে পারে নাই, আজ কেমনে ভালোবাসবো।”

ফারাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার মুখের দিকে। তার দলের সবাই শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যতটুকু সম্ভব বি/ষ শরীরের ভিতর থেকে বের করা গেছে। তবুও লোকটা বাঁচবে না। তার ৬ বছরের সংসার ভেঙে সে অন্যজনের হাত ধরে চলে গেছে। ৬ বছরের ভালোবাসা নিমিষেই ধুলিসাৎ। এরপরেও ভালোবাসার নাম সে নেয় কি করে? নারী মানেই ছলনাময়ী। তারা অনেক ছল করতে জানে। তার শিক্ষা হয়ে গেছে তাদের দেখতে পেয়ে। কম তো দেখলো না। এই যে ফরহাত! কম ভালবাসতো! কতোই না সাধ ছিলো তার। ভালো, শিক্ষিত ছেলে অথচ বলল কি? বেকার! হাস্যকর! তার মা বাবার যা আছে তা দিয়েও তাদের আরামে ক’বছর চলে যেত। কিন্তু সেই তো চাইলো না। চাইলে কি আর পেতো না! কি অভাগী তারা। এই ভালোবাসার স্বাদ কি না খুঁজতে গেছে অন্য পুরুষের মনে। সত্যিই কি পাবে? হাত কাঁপবে না তাদের। মন কাঁদবে না। শরীরের স্বাদ কি সব! মনের স্বাদ বলে কিছুই কি নেই। মনের কি দাম নেই? এই যে হৃৎপিণ্ডের প্রতিটা ধ্বনি মিনিটে মিনিটে তার নাম উচ্চারণ করে এই বা করবে কজন?

ফরহাত বোধহয় কাঁদছে। ছেলেদের কাঁদলে বিশ্রী লাগে। কিন্তু ফরহাত কে দেখে মায়া হচ্ছে সারফারাজের। ওর কান্না মেয়েদের মতো। ঠোঁট চেপে আছে কান্না ধরে রাখতে, পারছে না। কেঁদেই দিল। সারফারাজ তার পিঠে হাত বুলালো। বলল, “ফরহাত! সত্যি ভালোবাসা কখনো মিথ্যে হয় না। আমাদের তাদের ভালোবাসা উচিত যে আমাদের ভালোবাসে। এই পৃথিবীতে কেউ তোকে ভালোবাসে না এমনটা হতেই পারে না। আড়াল হয়ে দেখ, দেখবি কেউ ব্যাকুল হয়ে খুঁজছে তোকে। তোকে ভালোবাসি বলার জন্য সে ছটফট করছে। তোর এই অশ্রুর দাম ওই অভাগী দিবে না। যে ভাগ্যবতী দেবে তাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাস। দেখবি সব ভালো!”

ফরহাত সামলে উঠল দ্রুত। চোখ মুখ মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। মিনিট দুয়েক পর বলে উঠল, “অনি আসছে!”

ফারাজ চমকে উঠল। ছাদের দরজার দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টিতে। সত্যি সত্যি সেখানে অনির আগমন। ফারাজ অবাক হলো। এটা কি কাকতালীয়, না ফরহাত সত্যিই বুঝতে পারল অনির উপস্থিতি। কি আশ্চর্য! সে বাদে সবাই যেন অনিকে বুঝতে শুরু করেছে!
.
অনি এলো আবার চলেও গেল। এসেছিল চা দিতে। ফরহাত ফুরফুরে মেজাজে চায়ের কাপে চুমুক দিল।
“বেশ চা বানিয়েছে মেয়েটা।”

সারফারাজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়ল। ফরহাত বলে উঠল, ”কি ভাবছিস এতো? আর শহরে ফিরছিস কবে?”

”এই তো কিছুদিন!”

“তা অনি কে নিয়ে যাচ্ছিস তো।

”অনি? কেন? অনি কে নিয়ে আমি কোথায় যাবো?”

“কেন? তোকে কেউ বলে নি। অনিকে তো শহরের ভার্সিটিতে ভর্তি করাবে। সাথে আরাফাত কেও।”

সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, “অনিকে ভার্সিটিতে ও পড়াবে?”

“পড়াবে না কেন? মেয়েটা পড়াশোনায় কতো ভালো। আর আমাদের বংশের কোন মেয়ে কম পড়াশুনা করেছে। তোর মাও তো এমবি এ পাস। আমার মা ও তাই। অনি সেটা তো করবে!”

সারফারাজ কি জানি ভাবল। পরক্ষণে মাথা দুলিয়ে বলল, “তাই তো।”

“হ্যাঁ, তাই। শহরে গেলে তোর সাথে ছাড়া আর কোথায় থাকবে।”

“সেসব আলাপ পড়ে সাড়া যাবে। তুই বল! মন ঠিক আছে এবার।”

ফরহাত একগাল হেসে জবাব দিল, ”মন আবার ঠিক বেঠিক। সে তো হুট করেই খারাপ হয়ে ভালো হয়ে যায়। ওতোসব ধরতে হয় নাকি। বাদ দে তো।”
সারফারাজ এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে দিল। অথচ অন্য প্রসঙ্গ থেকে মন সরাতে পারছে না। সত্যিই কি অনি তার সাথে শহরে যাবে। তারা একসাথে থাকা শুরু করবে। কেমন অন্যরকম লাগছে।
.
এই প্রসঙ্গ আর উঠেনি। দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিল। সারফারাজের শহরে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। একদিন আরিফ হাসান তাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “অনি কে তোমার সাথে করে নিয়ে যাও।”

“আমার সাথে করে?”

”অবাক হচ্ছো নাকি? একদিন তো তুমিই বলেছিলে তোমার স্ত্রীর দায়িত্ব একমাত্র তোমার। নাও এবার দায়িত্ব পালন করো। ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দাও। দেখো, ঠিকমতো খেয়াল রেখো ওর!”

কথাগুলো বলে বাবা চোখ সরিয়ে নিলেন। এর অর্থ এটাই তার শেষ কথা। সারফারাজ কিছু জিজ্ঞেস করল না। কেমন একটা ঘোরের মতো থেকে গেল। বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে। বাইরে এসে দেখল অনি ছোটাছুটি করছে। তার হাতে আচারের বোয়াম। চামচে করে একটু আচার সে খিচুড়ির প্লেটে দিল। এই খিচুড়ি সে নিশ্চিত তার জন্যই বাড়ছে। ফারাজ নিশ্চিত হয়ে রইল, অর্নিলা এখন এসে বলবে, “ফারাজ ভাই আসেন। আপনার জন্য খিচুড়ি রেঁধেছি, খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে!”

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-০৯

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৯

“কি করবো? দেখছিস না পায়েস খাচ্ছি!”

চেয়ার টেনে বসে পড়ল সারফারাজ। অর্নিলার ঠোঁটের কোণে চাপাহাসি ফুটে উঠল। গ্লাসে পানি ঢেলে টেবিলের সামনে এসে রাখল। সারফারাজ গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “হঠাৎ করেই এতো ক্ষিদে লাগল, দেখছিলাম ফ্রিজে কি আছে? পায়েসের বাটিটাই চোখে পড়ল। তুই এতো রাতে এখানে কি করছিস?”

অর্নিলা জবাব দিল না। চেয়ার টেনে বসে পড়ল। গালে হাত রাখল, দৃষ্টি মেলল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। শুধালো “পায়েস কেমন হলো ফারাজ ভাই?”

“কেমন আর হবে? যেমন হয় তেমনি হয়েছে।”

”আমি রাঁধলাম যে।”

“তো? মানুষ তো তুই। রান্না তো ভালোই হবে।”

গাল থেকে হাত সরিয়ে ফেলল। চোখ রাখল হাতের আঙ্গুলের উপর। চাপাস্বরে বলে উঠল, ”কিন্তু সবার হাতের রান্না তো এক হয়না ফারাজ ভাই।”

”কি জানি অনি? আমার কাছে তো একই লাগে। দেখলি না, আজ তোর রান্না করা খাবার খেয়ে বলছিলাম মা রেঁধেছে। এতো সূক্ষ্ম পরীক্ষা আমি পারি না।”

”কিন্তু ফারাজ ভাই, তোমার কাজ তো এর চেয়েও সূক্ষ্ম। সেটা করবে কি করে?”

ফারাজ জবাব দেয় না। পায়েস ফুরিয়ে এসেছে। অর্নিলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”আরেকটু দিবো।”

সারফারাজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। থমকে বলল, ”না।”

”এই যে বললে খিদে পেয়েছে।

”মিটে গেছে। খেলাম তো।

“ওতো টুকুতে পেট ভরে গেল ফারাজ ভাই।

সারফারাজ আবারো জবাব দেয় না। দুজনের সম্পর্কের মাঝে ভাঙ’ন যেন সেই আগেই ধরেছিল। তার প্রভাব এখন মিলছে।‌ সারফারাজ উল্টো পথে হাটা ধরে। অর্নিলা চট করে বলে উঠলো, ”আমি না এলে, তুমি আরেকটু পায়েস খেতে তাই না ফারাজ ভাই।

“বোধহয় খেতাম।” কথাটুকু বলেই ফারাজ বের হয়ে গেল। চেয়ার টাকে শক্ত হাতে ধরে নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার চোখের পাতা কাঁপছে। টিপ টিপ করে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। ফারাজ ভাই ওভাবে না বললেও পারত। না হয় মিথ্যেই বলে দিত। এতো সত্য বলার কি ছিল? ফারাজ কি ইচ্ছে করেই তাকে কষ্ট দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে এই কষ্ট? কি অপরাধ তার। “তুমি মনে রেখো ফারাজ ভাই, আমি তোমার সাথে আর কথা বলব না। যে এভাবে বার বার আমায় কষ্ট দেয় তার সাথে আমি কথা বলি না। তোমার সাথেও বলব না, দেখে রেখো তুমি!” চোখের পানি মুছে ছুটে চলে গেল ঘরের দিকে। আড়াল হয়ে দাঁড়াল কেউ। সূক্ষ্ম চোখে পরখ করে যাচ্ছে। আশপাশ কেউ দেখেনি তো আবার। দুই পা পিছিয়ে গেল। ফারাজ ভাই আর অনির মধ্যে কি হয়েছে? তার সম্পর্ক ভালো চলছে না। চলার মতোও না। যখন তাদের সম্পর্ক গড়েছিল তখন অর্নিলা বুঝত না সম্পর্কের মানে। এখন যখন বুঝতে পারছে তখন মনে হচ্ছে ফারাজ ভাই পিছিয়ে যাচ্ছে! কি অদ্ভুত কাণ্ড! এই মানুষগুলো এমন কেন?
.
পরদিন সকাল বেলা। সকাল সকাল হাঁটতে বেরিয়ে গেল সারফারাজ। ফিরতে ফিরতে সাড়ে ৮ টা বাজল। ঘরে ঢুকেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বিছানা গোছানো। গোসল সেরে কোন জামাটা পরবে সেটাও ইস্ত্রি করে বিছানার উপর রাখা। এতোকিছু কে করেছে? মা! না, মনে হচ্ছে অর্নিলা। একটা চিরকুট রয়েছে পাশে। সারফারাজ সেটা তুলে নিল। স্পষ্ট হাতের লেখা। চেনা চেনা লাগছে। অনি লিখেছে।
‌“ফারাজ ভাই, জলদি তৈরি হয়ে নিচে আসুন। আপনার জন্য গরম গরম পরটার সাথে হাঁসের মাংস রান্না করেছি। ভালো করে গোসল সেরে আসবেন। আর হ্যাঁ, আজ সেভ করবেন। পুরো মুখ আপনার গোছা গোছা দাঁড়িতে ভরে গেছে। বিশ্রী লাগছে। আপনি তো সুদর্শন ফারাজ ভাই। তাহলে চলাফেরা এমন বিশ্রী কেন? আগে তো এমন ছিলেন না। বড্ড বদলে গেছেন…”

সারফারাজ চিরকুট টা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। ধীর স্বরে বলল, “আমি বদলায়নি অনি। তুমিই বদলে গেছো!”

জামাকাপড় হাতে নিয়ে চলে গেল বাথরুমের দিকে। এদিকে অর্নিলা আজ মহাব্যস্ত। তার কাজকর্ম যেন শেষ হচ্ছেই না। এতো ভরে উঠে মেয়েটা কতো কাজ করে ফেলল। বিস্মিত হয়ে চেয়ে আছে আরিফ হাসান। এক হাতে সব কাজ সামাল দিচ্ছে মেয়েটা। তার ছোট মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। সারফারাজ ফ্রেস হয়ে নিচে নামল। দুটো চায়ের কাপ রেখে গেল সিধু। সারফারাজ চায়ের কাপে চুমুক দিল। আরিফ হাসান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “মা চা টা খুব ভালো হয়েছে।”

সারফারাজ কপাল কুঁচকালো। চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে চুমুক দিল। না এই চা তো অর্নিলা বানায় নি। কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। অর্নিলা হেসে জবাব দিল, “আমি চা বানায় নি মামা।”
সারফারাজের মুখের উপর থেকে বিচলিত ভাবটা চলে গেল। ঠোঁটের কোনায় বোধহয় হাসির চিহ্ন দেখা গেল। সত্যিই কি তাই। আরাফাত এসে হাজির হলো। শাহিনুর বেগম ও হাতে হাতে কাজ করতে লাগলেন অর্নিলার সাথে। সকাল বেলা তিনি গিয়েছিলেন গাছে পানি দিতে। ছাদের এক পাশে হঠাৎ করেই বাগান করার শখ উঠেছে তার। এই শখ কতোদিন থাকে সেটাই দেখার বিষয়।

অর্নিলার হাতের রান্না খেয়ে সকলে প্রশংসা করছে। একমাত্র সারফারাজ নিশ্চুপে খেয়ে যাচ্ছে। অর্নিলার উৎসুক আঁখি দুটি খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। সারফারাজ তার মুখের দিকে ফিরে তাকালো না অবধি। হঠাৎ আরাফাত বলে উঠল, “ভাইয়া , আজ তোমায় দেখতে খুব ফ্রেস লাগছে। মনে হচ্ছে বয়স কমে গেছে!“

শাহিনুর বেগম অস্থির হয়ে উঠলেন। বললেন, ”এ কি কথা? ওর বয়স বেশি ছিল কবে?” কু সংস্কারী তার মন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। অনির চোখে এতোক্ষণে পড়ল। সত্যিই তো তাই। ফারাজ ভাই দাড়ি কামিয়েছে। তাকে এখন ঠিক আগের ফারাজ ভাইয়ের মতোই লাগছে। শুধু মুখটা আগের চেয়েও গম্ভীর সাথে চোখ দুটোও। নাহলে সব ঠিক আছে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। কেউ এলো নাকি? সিধু দরজা খুলল। ফরহাত কে দেখা গেল। সারফারাজ খাবার ছেড়ে উঠে গেল। জড়িয়ে ধরল ফরহাত কে। তার পিঠ চাপড়ে ফরহাত বলে উঠল, ”আরে আমাদের ডাক্তার সাহেব চলে এসেছে। এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার!”

সারফারাজ হেসে উঠলো। অর্নিলা স্পষ্ট দেখল ফারাজ ভাই হাসছে। তার হাসি অন্য রকম, একদম সতেজ দেখাচ্ছিল তাকে। মুখের মধ্যে গাম্ভীর্য ভাবটা আর নেই। অনি দেখতেই লাগল। মুগ্ধতা এসে ঘিরে ধরল তাকে। সচরাচর ফারাজ ভাইকে হাসতে দেখা যায় না। ফরহাত ভাইয়ের সাথে থাকলেই হাসতে দেখা যায়। আরো একবার হাসতে দেখেছিল খুব। তখন সে খুব ছোট। অনির বেশ মনে আছে, সেদিন একটা লাল টপস পরা ছিল সে। জান্নাত আপু কি একটা বলে খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। তখন হাসল ফারাজ ভাই ও। অনি অবাক হয়ে দেখতে লাগল। ফারাজ ভাই কে খুব একটা হাসতে দেখা যেত না। কেমন একগুঁয়ে থাকেন সবসময়। সেই ফারাজ ভাই হাসছে। কিন্তু তখন অনির বিরক্ত লাগতে শুরু করল। কারত জান্নাত আপুর এমন আহামরি কিছু বলেনি যে ফারাজ ভাই হাসবে। তখন তার হাসি বোকার মতো লাগল। সেই থেকেই ফারাজ ভাই তার কাছে বোকা। অনেক বোকা!

”নাস্তা করেছিস?”

“করবো বলেই তো এলাম। শুনলাম অনি নাকি হাঁসের মাংস রান্না করেছে।‌ আমায় ফোন করে বলতেই ছুটে এলাম। আমাদের অনি কিন্তু ভালো রাঁধে!”

ফরহাতের প্রশংসা শুনে মুচকি হাসল অনি। সারফারাজ তাল মিলিয়ে বলল, ”হ্যাঁ, ভালোই রাঁধে। এই বাচ্চা যে কোনদিন রেঁধে খাওয়াবে সেই ভাবনা মাথাতেই আসেনি।

আরিফ হাসান বিরক্তি স্বরে বলে উঠলেন, ”আহ এ কি কথা? আমার মা সব কাজ করতে পারে। দেখি মা অর্নিলা, ফরহাত কে নাস্তা দাও।”

“দেই মামা। ফরহাত ভাই বসেন।”

”দেখি বসেই পড়ি। না খেয়ে অনেক তাড়াহুড়োয় এসেছি। খাওয়া দাওয়া শেষে তোর সাথে জমিয়ে আড্ডা হবে।”

সারফারাজ একগাল হেসে পাশে বসে পড়ল। অর্নিলা ফরহাত কে নাস্তা দিল। সারফারাজ পরোটা প্রায় শেষের দিকে। ভাবল ফারাজ ভাই কে আরেকটা পরোটা সাধবে। আবার সবার সামনে ”না” না করে দেয়। তখন বড্ড কষ্ট পাবে সে। অনেক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “ফারাজ ভাই, আরেকটা পরোটা দিই?”

“দে!”

অর্নিলা হেসে উঠল। একটা না দুটো পরোটা তুলে থালায়। হাঁসের মাংস নিয়ে এলো আবারো। ফারাজ ভাই আর ফরহাত ভাই খেতে খেতে গল্প শুরু করেছে।

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-০৮

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৮

প্রায় দু বছর অনি কে দেখে খানিকটা চমকে উঠল সারফারাজ। সে আশা করেনি অনি তাকে চিনবে। চেনার কথাও না। এতো বছর দুজনের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মুখোমুখি তে অনিও কিছুটা ঘাবড়ে গেল। সারফারাজ লক্ষ্য করল অনির চোখের পাতা কাঁপছে। ঠোঁট জোড়াও নড়ছে কেমন।‌ দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল সে। কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। অনি কি তাকে পছন্দ করে না। ঘৃণা করতে শুরু করেছে। তবে এই ঘৃণার ভার সইতে তার বড্ড কষ্ট হবে। অর্নিলা দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় নি। পেছন থেকে শাহিনুর বেগমের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘ সময়ের পর ছেলেকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে বিস্মিত শাহিনুর বেগম। “নিকুঞ্জ নিবাস” যেন হঠাৎ নিষ্প্রাণ হয়ে উঠল। সারফারাজ মায়ের দিকে ফিরে হাসার চেষ্টা করল। অর্নিলার ঘোর কাটল। একটু সরে দাঁড়াতেই শাহিনুর বেগম ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি কাঁপছেন, চোখের অশ্রু টলমল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। দুহাতে ছেলের মুখখানি আগলে ধরলেন তিনি। মৃদু হেসে সারফারাজ বলে শুধালো, “কেমন আছো মা?”

অর্নিলা খানিকটা বদলে গেছে। খানিকটা না অনেকটাই। ওর মধ্যে এবার ম্যাচুরিটি একটা ভাব এসেছে। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। এবারও সারফারাজ কে চমকে দিয়ে অর্নিলা এ+ পেয়ে দেখাল। সারফারাজ সত্যিই খানিকটা হতভম্ব। আরাফাতের এ+ পাওয়ার বিষয়টা ওতো আকৃষ্ট করল না। যেন এটা তার কাছে পাওনাই ছিল। তবুও আরাফাত একটা নতুন ল্যাপটপের আবদার রাখল। সারফারাজ কথা দিলো সে কিনে দিবে।

রাতের খাওয়া দাওয়ার বেশি দেরি নেই। আরিফ হাসানের সাথে কথাবার্তা শেষে সারফারাজ স্টাডি রুম ছেড়ে বের হলো। আশ্চর্য! বাড়ির প্রতিটা জিনিসই যেন একরকমই আছে।‌ কিছু বদলায়নি। শুধু অনিই যেন বড্ড বদলে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে ঘরের কাছে পৌঁছাল সারফারাজ। দরজার বাইরে অনি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু জড়োসড়ো হয়ে গেল সে। শুধালো, “তুই এখানে?”

ভূত দেখার মতো চমকে উঠল অনি। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে তার। সামনে ফিরে দাঁত বের করে হাসল। সারফারাজের মনে হলো, না অনি বদলায় নি। আগের মতোই আছে। ও হাসি এখনো আগের মত। তাহলে বদলে গেলো কি? সূক্ষ্ম চাহনিতে পরখ করতে লাগলো। অবশেষে টের পেলো। অনি অনেকটা শুকিয়ে গেছে। ঠিক শুকিয়ে গেছে বলাও চলে না। শেষবার ওর ওজন প্রায় ৮০ কেজির বরাবর ছিল। এখন দেখে মনে হচ্ছে সেটা ৬০ এ এসে ঠেকেছে। স্বাস্থ্য কমার কারণে অনি কে একটু লম্বা লাগছে। একটু অন্যরকম। মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো সারফারাজ। অনি তার সামনে চুটকি বাজিয়ে বলল, ”ফারাজ ভাই, হা করে কি দেখছেন?”

ফারাজ হাসলো। ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, ”তুই এখানে কি করছিস অনি? চো/রের মতো ঘরে উঁকি দিচ্ছিলো কেন?”

”বাঃ রে? চো/রের মতো উঁকি দিলাম কোথায়? এতোদিন তো এই ঘর আমার ছিল। আমি ঘুমাতাম।”

সারফারাজ বিভ্রান্ত হলো। ভাবলো অনি ওর সাথে মজা করছে। কথাটার গুরুত্ব না দিয়ে শুধায়, ”তুই এতো শুকিয়ে গেছিস কেন রে অনি?”

”আপনার জন্য ফারাজ ভাই!”

না, এবার অবাক না হয়ে পারল না ফারাজ। ভ্রু কুঁচকে ফিরে দেখল অনি হাসছে। ওর হাসিতে কেমন একটা রহস্য আছে। খুব হেঁয়ালি কথাবার্তা বলছে।

”আমার জন্য? কেন রে? আমি কবে তোকে বললাম তুই খুব মোটু। একটু শুকিয়ে যা।”

”বলেন নি। কিন্তু আমার মনে হলো আপনি চিকন মেয়েদের পছন্দ করেন।”

”কেন? আমি তোকে কখনো বলেছিলাম একথা?”

অর্নিলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সে মাথা দুলিয়ে বলল না। সারফারাজের খাতা কলম নিয়ে কি ভেবে বিছানার উপর আসন পেতে বসল। অর্নিলা এখনো সেখানে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারফারাজ তার দিকে ফিরে তাকায় নি অথচ অর্নিলার উপস্থিতি তাকে বিচলিত করছে। আগে কখনো অনি আশেপাশে এভাবে ঘুরঘুর করেনি। আজ একটু বেশিই করছে নাকি সেই বেশি ভাবছে। অনেকদিন পর অনি কে দেখতে পেয়ে বোধহয় তার মন বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।

অনি মলিন কণ্ঠে বলে উঠল, ”বসলেন কেন ফারাজ ভাই? খেতে আসবেন আসুন। মামনী ডাকছে আপনাকে।”

”তুই যা, আমি আসছি!”

অনি নিশ্চুপ হয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। দরজার কাছে এসে ফিরে তাকাল সারফারাজের দিকে। সে জানে, ফারাজ ভাই মোটা মেয়েদের পছন্দ করে না। কারণ জান্নাত আপু মোটেও মোটা না। সে খুব স্মার্ট আর চিকন। উচ্চতায় অনেক লম্বা আর ফারাজ ভাই জান্নাত আপুকে ভালোবাসতো। সে তো আর চাইলেও জান্নাত আপু হতে পারবে না কিন্তু সে চেষ্টা করবে। চেষ্টার কারণেই তো এতো সময়ের মধ্যে এতোখানি শুকিয়ে গেছে। চালচলনে পরিবর্তন এনেছে। আগে সবসময় জিন্স টপস পরে ঘুরাঘুরি করত কিন্তু এখন আর এসব সে পরে না। সুন্দর সুন্দর কামিজ, থ্রি পিস পরে। সুন্দর একটা উড়না গলায় জড়িয়ে রাখে। তার বেশ মনে আছে, জান্নাত আপুও এমন ভাবে তাদের বাসায় আসত। ফারাজ ভাই তখন আড়চোখে আপুকে দেখত। এসব তার জানা। সে তো সবসময় ফারাজ ভাই কে চোখে চোখে রাখত। তার এতো পরিবর্তন কি ফারাজ ভাই লক্ষ্য করেনি। সে যে আজ ফারাজ ভাইয়ের পছন্দের রঙ আকাশী রঙের একটা উড়না গায়ে জড়িয়েছে, ভাই তো একবারও ফিরে তাকায় নি। ভাই ভাবছে সে মিথ্যে বলছে, কিন্তু মিথ্যে না। এতোদিন এই ঘর তার অধীনে ছিল। খুব যত্ন করে ঘরটা গুছিয়ে রেখেছে। একটা জিনিস এখান থেকে ওখানে করেনি তাও ফারাজ ভাই কিছু বুঝল না। এতো বোকা তুমি ফারাজ ভাই!

খাবার টেবিলে বসতেই দেখল বিরাট আয়োজন। সবাই একসাথে খেতে বসেছে। আরিফ হাসান, আরাফাত, শাহিনুর বেগম আর সারফারাজ। সারফারাজ খেয়াল করলো অর্নিলা বসে নি। আগে কখনো এমনটা হয়নি। খাবার টেবিলে সবার আগে অনি বসতো। ওকে খাবার বেড়ে না দেওয়া অবধি কেউ খাবার ছুঁতে অবধি পারত না। সেই মেয়ে আর সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সারফারাজ যেন দেখেও না দেখার ভান করছে। তৃপ্তি করে খেলো সে। শাহিনুর বেগম গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন, “আরেকটু নাও সারফারাজ।”

”না, মা পেট ভরে গেছে। অনেক খেয়েছি।

”অনেক খেলি কোথায়? খাবার কেমন হয়েছে?”

”ভালো হয়েছে। অনেক দিন পর তোমায় হাতের রান্না খেয়ে মুখে রুচি ফিরেছে।”

শাহিনুর বেগম মুখ টিপে হাসলেন। আরাফাত শব্দ করে হেসে বলল, ”মা রান্না করেনি। বুড়ি রান্না করেছে।”

হকচকিয়ে উঠল সারফারাজ। হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আশপাশ চেয়ে দেখল অনি নেই। রান্নাঘরের গেছে। আরাফাত খাতের লোকমা তুলে বলল, ”এখন থেকে বুড়িই রান্না করে। খুব ভালো রান্না করে।”

আরিফ হাসান মলিন কণ্ঠে বলে উঠলেন, ”মেয়েটা বড় হয়ে গেছে।”

সারফারাজ অবাক কণ্ঠে বলল, “এতো পরিবর্তন কি করে?”

শাহিনুর বেগম বললেন, “মেয়েদের পরিবর্তন হঠাৎ করেই হয় সারফারাজ। ওসব তুমি বুঝবে না। ওই তো অর্নিলা পায়েস নিয়ে এসেছে। একটু খেয়ে দেখো।”

পায়েসের বাটিটা সারফারাজের সামনে রাখা হলো। সারফারাজ কিয়ৎকাল বাটির দিকে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমার পেট পুরোপুরি ভরে গেছে মা। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”

”কিন্তু ফারাজ…

সারফারাজ দাঁড়াল না।‌ চলে গেল ঘরের দিকে। অর্নিলা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।‌ আরাফাত উঠে পায়েসের বাটিটা হাতে নিয়ে বলল, ”দে বুড়ি আমি খাই। তোর রান্না করা পায়েসের টেস্ট সেই হয়।”

আরিফ হাসান ও তাল মিলিয়ে বললেন, ”মা আমায় ও একবাটি দে।

”তোমার মিষ্টি খাওয়া বারণ মামা। তুমি খেতে পারবে না।

”দে দে, একটু খেলে কিছু হয় না।”

”একদম না। যাও ঘরে যাও। একটু হাঁটাচলা করে ঘুমাতে যাবে। স্টাডি রুমে থাকবে না একদম। কাল মাঝরাতে তোমার ঘরের আলো জ্বলে থাকতে দেখেছি আমি।

শাহিনুর বেগম বললেন, ”পাশেই তো শুয়ে থাকে। কোনসময় উঠে যে স্টাডি রুমে চলে যায় সজাগ পাই না। হ্যাঁ গো, ওখানে এতো রাতে কাজ কি তোমার? ঘুমাও না কেন?”

আরিফ হাসান জবাব দিলেন না। নিশ্চল চাহনিতে অর্নিলার মুখের পানে চেয়ে শুধালেন, ”মাঝরাতে তুই কি করছিলি মা?”

অর্নিলা জবাব দেয়নি। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মামার মুখের দিকে। এই প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই।
.
রাত তখন অনেক। সারফারাজ বিছানার এদিক থেকে ওদিক ঘুরপাক খাচ্ছে। তার ঘুম আসছে না। ওভাবে পায়েসের বাটি থেকে মুখ সরিয়ে ফেলা যেন মোটেও উচিত হয়নি। অর্নিলার খারাপ লেগেছে নিশ্চয়ই। কে জানে? এমনটা সে কেন করল? কোন কারণে?
বিছানা থেকে এক ধরণের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। খুব পরিচিত লাগছে। হঠাৎ উঠে বসল। হাত দিয়ে বিছানা ছুঁয়ে দেখল। চমকে উঠল সে। অর্নিলা মিথ্যে বলে নি। রাতের পর রাত অনি এইখানেই ঘুমিয়েছে। তার অস্তিত্ব মিলছে। কিন্তু আজ রাতে অনি তার ঘরে ঘুমায় নি। সে বোধহয় ওই পাশের ঘরেই আছে। ঘর তো অনেক ছিল, তাহলে রাতের পর রাত এই ঘরে অনির থাকার কারণ কি? কেন করছে সে এমন? এমন আহ্লাদী করে পায়েস রেঁধে খাওয়ানো, ঘরোয়া মেয়ে হয়ে উঠা, নিজের স্বভাব সাজগোজ সব বদলে ফেলা এসব অনি কার জন্য করছে? তার জন্য? ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারছে না সে।

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরে খানিকক্ষণ পায়চারি করে বের হয়ে গেল। বাড়ির সব আলো বন্ধ। বাবার স্টাডি রুমের আলোও বন্ধ। সারফারাজ একা একা ঘরে পাইচারি করছে। কি মনে করে রান্নাঘরের কাছে ঠেকল সে। আলো জ্বেলে আশপাশ খুঁজতে লাগল। পায়েসের বাটি পাওয়া গেল। একটা চামচ দরকার। চামচে করে খানিকটা মুখে দিয়ে সামনে ফিরতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল সারফারাজ। ইতস্তত বোধ করতে লাগল সে। সামনেই অনি দাঁড়ানো। তার হাতে পায়েসের বাটি। মুখে চামচ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অনি অতি মিষ্টি স্বরে বলে উঠল, ”ফারাজ ভাই, কি করছেন?”

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-০৭

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৭

ফরহাত পিঠ চাপড়ে বলে উঠল, “সাবাশ ব্যাটা! যা করেছিস ভালো করেছিস। একদম বাঘের বাচ্চা। ওর তো এরকমই একটা শিক্ষা হবার দরকার ছিল। তোর বউয়ের দিকে নজর দিবে আর তুই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবি নাকি!”

“চুপ কর। আমার মাথা ব্যাথা করছে!“ তিক্তস্বরে কথাটা বলে উঠল সারফারাজ।

“তোর উচিত এখন গিয়ে বাড়িতে বসে বউয়ের হাতের গরম চা খাওয়া। আহা! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বুঝবি এর স্বাদ। বউয়ের হাতে বানানো গরম চায়ের কাপে প্রথম চুমুক তাকে চুমু খাবার মতোই!”

“তোর লু/চ্চামি কথা রাখ তো।”

“লুচ্চা/মি বউয়ের সাথে করবি না তো কার সাথে করবি। শা লা এতোদিন বসে থেকে কি ঢ্যারা পিটালি, এখন এসে বউয়ের সাথে প্রেম করতে পারো না।”

সারফারাজ বিরক্তি স্বরে জবাব দিল, ”লাইক সিরিয়াসলি ফরহাত! তোর মনে হয় আমি এই বাচ্চার সাথে প্রেম করব। যাকে ক বললে গ বুঝে! এক লাইন বেশি বুঝে বসে থাকে।”

“থাকলে থাকবে। তুই ও পাল্টা চাল দিবি।”

“অসম্ভব! আমি এই মেয়ের কথা আর একবিন্দু ভাবছি না। কালই আমি ঢাকা ফিরছি। এখানে আর একদিনও থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে।”

”আমি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে রাখব?”

“ফাজলামির একটা লিমিট থাকে ফরহাত!”

”আচ্ছা! চুপ আমি। ( বলার পর দু সেকেন্ড চুপ থেকে বলল) ওহ যেটা বলার ছিলো।”

“কি?”

“আঙ্কেল ফোন করেছিলো। শিকদার সাহেব তোমার বাড়ীতে হা/না দিয়েছে। নাও ইউ গেট আউট!”

সারফারাজ তড়িখড়ি করে উঠে দাঁড়াল। আশ্চর্য! কেউ একটা কাজের না। বাবা ফোন করেছে সেই কখন আর ফরহাত এখন এসে তাকে বলছে। ”এতোক্ষণ পর এখন বললি এই কথা!“

“আরে বৎস সামলে। তোমার একটা ভাব আছে না। ডাকবে আর তুমি চলে যাবা এতো তোমায় পেলে তাহলে ঘাড়ে চ/ড়ে বসবে। রিল্যাক্স মুডে বাড়ি ফিরো। দেখো ভাব যেন না চেঞ্জ হয়। তোমার বল তোমার হাতে। আশীর্বাদ করি হে বৎস!” সত্যি সত্যি হাতটা তার মাথায় রেখে দিল ফরহাত। সারফারাজ দাঁত চেপে উঠে দাঁড়াল। শা লার ভীমরতি ধরেছে এই বয়সে। বের হবার পথে চাচী শুধলো, “রাত টা থেকে যাও।”

“না চাচী। বাবা ফোন করেছে।“

“তাহলে রাতের খাবারটা….

“বাবা ফোন করেছে অনেকক্ষণ। আমি আসি!”

বের হয়ে গেল। চাচী আর থামালো না। জানে, কথার নড়চড় হবে না। ফারাজ তার বাবার অতি বাধ্য ছেলে!
.
বাড়িতে ফিরে দেখল মেহমান কঠোর দৃষ্টিতে চোয়াল শক্ত করে বসে আছে সোফার উপরে। বাবার স্টাডি ঘর। বাবা শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। সারফারাজ বাবার সামনে খানিকটা নিশ্চুপ হয়ে গেল। বাবার সামনে তার গলার স্বর উঁচু কি রুক্ষ কখনো হয় না। তবুও তার কঠিন দৃষ্টিপাত শিকদার সাহেবের উপর। আরিফ হাসান ছেলেকে শুধালেন, ”শুনলাম তুমি নিয়াজ কে খুব
মেরে/ছো! এর কারণ কি ফারাজ?”

ইয়াতিম শিকদার তরতর করে উঠলেন। “কি? খুব মা/রছে? বলেন জানো/য়ারের মতো মার/ছে। এই পোলা আমার পোলার মুখ চোখ সব মাইরা ন/ষ্ট কইরা দিছে। পিঠের ছা/ল উঠাইয়া দিছে , বিশ্বাস না করলে চলেন আমার সাথে!”

আরিফ হাসান ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। সারফারাজ শিকদার সাহেবের চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, “আমি সারফারাজ শেহদাত। আপনার ছেলেকে শুধু মারি/নি মে/রে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমার বউয়ের দিকে কেউ খারাপ নজরে তাকালে আমি বসে থাকব এমন শিক্ষা আমার বাবা আমায় দেয়নি।

শিকদার সাহেব চোখমুখ বড় করে কঠিন স্বরে বলল, “মে/রে ফেলতা। দেখলেন আপনে হাসান সাহেব, দেখলেন। আপনার ছেলে আপনার সামনে বলতাছে আমার ছেলেকে মে/রে ফেলতো। তাইলেই বুঝেন এবার।

“ফারাজ! তুমি শুরু থেকে বলো কি হয়েছে?”

সারফারাজ এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার চোখেতে তেজ ফিরেছে। কণ্ঠের স্বর ও এবার খানিকটা রূঢ়। বলে উঠল, “আমার বউয়ের দিকে খারাপ নজ/রে তাকালে আমি তার এমন হালই করব। আমার বউ সে! তোমার বোনের মেয়ে কিংবা তার ভাইয়ের মেয়ে না। আমার বউয়ের দায়িত্ব আমার। ওই রাসকেল, ইডিয়েট টা আমার বউয়ের ঘরে উঁ/কি মারছিলো আর তখন… ঠোঁট চেপে ধরল ফারাজ। রাগে তার ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। বাবার দিকে ফিরে অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ”ছাড়ো বাবা! আমার রুচি হয় না এসব বলার।”

আরিফ হাসান ভ্রু কুঁচকে শিকদার সাহেবের দিকে ফিরলেন। শিকদার সাহেব উঁচু গলায় বলল, ”এসব মিথ্যে কথা! অর্নিলা এসব বলছে!”

“মিথ্যে কেন হবে শিকদার সাহেব। আপনার ছেলে কি এমনটা করতে পারে না। এর আগেও তো এমন রুচিহীন কাজ করে নিজেকে জাহির করেছে। এখন মেনে নিতে আপত্তি কোথায়? আর শিকদার সাহেব,‌এখন অর্নিলার অভিভাবক আমরা না। তার স্বামী! তার স্বামী যা বলবে তাই হবে!”

শিকদার সাহেব দাঁত কিড়/মিড় করতে লাগলেন। বাপ ছেলে দুটো একজোট হয়েছে। তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল, “ঠিক বলছেন ভাই,‌ ঠিক বলছেন। কিন্তু মনে রাইখেন,‌ এক মাঘে শীত যায় না!”
আরিফ হাসান নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শুধু। মৃদু হাসলেন। সেই হাসিতে ছিলো গর্ব, তার ছেলের জন্য তার গর্ব হচ্ছে। নিজের স্ত্রীর দায়িত্ব তার ছেলে কাঁধে নিয়েছে। বিয়ের সিদ্ধান্ত অনেকটা হেলাফেলায় নিলেও, বউয়ের দায়িত্ব হেলাফেলায় যাবে না।

শাহিনুর বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাইচারি করছেন। টেনশনে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেছে। কে জানে ভেতরে কি হচ্ছে? আত্মীয়দের সাথে কথা কাটাকাটি,‌তর্ক তার কোনদিনই পছন্দ না। সবসময় চান শান্তিমতো থাকতে। ছোট থেকে একাই বড় হয়েছেন। কোন ভাই বোন ছিলো না তার। একা বেড়ে উঠার কিশোরীর ইচ্ছে ছিল ভরা জমজমাট একটা বাড়ীতে বিয়ে করবেন। ছোটবেলা যতোটা একা ছিলেন এখন ঠিক ততোই মানুষে তার বাড়ি গম গম করবে। এজন্য কারো সাথে ঝগড়া করে সম্পর্ক ছি/ন্ন করতে বেশ ভয় পান তিনি। সারফারাজ নিয়াজ কে মেরে/ছে। এটা অ/ন্যায় হয়েছে। কিন্তু অবশ্য নিয়াজ ও ভালো কিছু করেনি। সে যা করেছে এটাই তার পাওনা ছিলো। তবুও ভয় আঁকড়ে ধরছে। একটু পর পর আচমকা দরজার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেন। এই মনে হয় দরজা খুলে ফেলার শব্দ। অর্নিলা এখন ঘুমাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাক্তার এসে মেয়েটার হাত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। ওতো বেশি কাটেনি। তার ঘরে শ্রেয়মীকে রেখে এসেছেন। অর্নিলা তার ছেলের বউ হবার আগে তার মেয়ে। ছোট এই অর্নিলা কে তিনিই মানুষ করেছেন। ননদ দুদিন পর পর ঝগড়া করে এই কোলের বাচ্চা কে নিয়ে তার বাড়িতে উঠতো। তখন মেয়েটার পুরো দায়িত্ব থাকত শুধুই তার। খুব শখ ছিলো, অর্নিলার মতো একটা মেয়ে তার নিজের ও হবে। কিন্তু তা কখনোই সম্ভব হয়নি। যেই অপ্রাপ্তি তার মনকে ভার করে তুলছিলো, ছোট শিশু অর্নিলার আগমন তার প্রাণকে ততোটাই জীবিত করে তুলল। মনে হলো এই মেয়ে তো তারই।

ননদের মৃ/ত্যু তাকে ভয়াবহ ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলো। কিন্তু অর্নিলা ছিল তার ননদের মেয়ে। সেই সম্পর্কের জোর এতোটা তিনি দিতে পারে নি। পারলে মেয়েকে নিজের কাছেই আগলে রাখতেন। অর্নিলার বাবা কতোবার চাইল আরেকটি বিয়ে করতে, তখন তারা গিয়ে বার বার বাঁধা দিয়েছিল। বলেছিলো, এই মেয়েকে তারাই মানুষ করবে। এজন্য কোন বিয়ে শাদি করে মা আনার দরকার নেই। সত্যি তারা জানত, নতুন মা আনা তো একটা অজুহাত মাত্র, আসল যুক্তিটা অন্য কোথায়। চরিত্রের দিক দিয়ে ক/লঙ্ক থাকলেও মেয়ের জন্য এতোটুকু হলেও ভালোবাসা ছিল শামসুর শিকদারের মনে। নাহলে তাদের মতো তুচ্ছ মানুষের কথা শুনে দ্বিতীয় বিয়ে থেকে পিছিয়ে আসতে পারতেন না। কিন্তু তবুও তার অ/বৈধ সম্পর্কের অস্তিত্ব কম ছিলো না। এজন্য ছোট মেয়েটা কখনো তাদের বাড়িতে নয়তো কখনো গিয়ে থাকত তার ছোট ফুফুর বাড়িতে। চাচার বাড়ীতে চাচি না থাকায় সেখানে থাকা আর নিজের বাড়িতে থাকা সমান কথা। তখন অর্নিলার মায়ের প্রয়োজন ছিল। শাহিনুর বেগম আর ছোট ফুফু দুজন মা মিলে একজন মায়ের অভাব পূরণ করেছিলো!

দরজায় ধপ করে শব্দ হলো। শাহিনুর বেগম হকচকিয়ে তাকাল। ইয়াতিম শিকদার হম্ভিতম্ভি করে বের হয়ে চলে গেলেন। এই বাড়িতে আর একবিন্দু নয়। শাহিনুর বেগম কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। পরক্ষণেই লক্ষ্য করলেন আরিফ হাসান আর সারফারাজ বের হয়ে আসছে। ছুটে গেলেন সেদিকে। আরিফ হাসান মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “অর্নিলা খেয়েছে?”

”না, ঘুমাচ্ছে। অনেক জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারি নি।”

“অসুবিধে নেই, মাঝরাতে ওর ঘুম ভেঙে যাবে তখন আমি খাইয়ে দিবো।”

শাহিনুর বেগম বিচলিত হয়ে সারফারাজ কে শুধালো, “বাবা, তুমি খাবে না?”

“খাবো মা। একটু ফ্রেস হয়ে আসি!”

মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। তড়িখড়ি করে চলে গেল রান্নাঘরে। খাবার গুলো গরম করা দরকার। আরাফাত কেও ডাকতে হবে। সেও না খেয়ে বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। শ্রেয়মী মেয়েটাও বোধহয় না খেয়েই এসেছে। রাত অনেক হয়েছে!

শ্রেয়মী বিছানার পাশে বসে ফোন টিপছে। বিছানায় শুয়ে আছে অর্নিলা। সারফারাজ ঘরে ঢুকতেই বিছানা ছেড়ে নামল শ্রেয়মী!

“ভাইয়া তুমি?”

“মা তোকে ডাকছে, যা!“ তার মিথ্যে কথায় অবিলম্বে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল শ্রেয়মী। সারফারাজ এগিয়ে এলো। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের অর্ধাঙ্গিনী কে দেখতে লাগল। সুশ্রী মুখ, মায়া কাড়া চেহারা। গলুমলু গাল দুটো আলুর মতো। সে হাসলে তার চোখ দেখা যায় না, শুধু গাল দেখা যায়! আচমকা হেসে উঠল ফারাজ। আবারো বিষণ্ণ হয়ে গেল তার মন। অনির প্রতি তার আজকের আচর/ণ তাকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে। বোধহয় কখনোই পারবে না। পারবে না এই মেয়েটার স্বামী হয়ে উঠতে। স্বামী হওয়া বিরাট বড় কাজ, সারাজীবনের জন্য কোন মেয়ের দায়িত্ব নেওয়াই শুধু নয়, তাকে আগলে রাখাও। তার হাতটা শক্ত করে ধরে সামনের স্বপ্ন গুলো একসাথে দেখা। কিন্তু কই? তারা তো এমন কিছু ভাবে না। এভাবে কি সংসার চলে? তাদের সংসারে তো ভালোবাসাই নেই। ভালোবাসা না থাকলে সংসার চলবে কি করে? কি ভাবে হয়ে উঠবে সে স্বামী! অর্নিলা ডান হাতের তালু সাদা রঙের ব্যান্ডেজ দিয়ে বাধানো। অপ/রাধী হয়ে উঠেছিল ফারাজ। তার হৃদয় কে চূর্ণ/বিচূর্ণ করে দিচ্ছিল তার আত্না। আজকের তার আচরণ তাকে লজ্জায় মাথা নত করতে বাধ্য করছিলো। নিজের এমন আত্ম/ঘাতি কোনভাবেই মেনে নিতে পাচ্ছিল না সে। নিজেই নিজের কাছে বড্ড অপ/রাধী হয়ে উঠল সে। হঠাৎ করেই উত্তেজিত হয়ে উঠল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল দ্রুত। আজকের রাতটা যেন এখানে থাকলে তার দম/বন্ধ হয়ে যায়। এখানে কোনভাবেই থাকতে পারবে না সে। কোনভাবেই পারবে না অনির মুখোমুখি হতে। সে চলে যাবে, থাকবে না এখানে। আর কখনো আসবে না। কখনো না! ঝোঁকের বশে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিল সারফারাজ। রাতেই চলে যাবে সে। এখুনি মানে এখুনি! ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে।
.

দীর্ঘ দু বছর পর বাড়ী ফিরছে ফারাজ। তার চেহারায় অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। চেহারায় খানিকটা গম্ভীরতা ছোঁয়া। থিতুনির দাঁড়ির ঘনত্ব বেড়েছে অনেকখানি। এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার সে। এখনো পুরোপুরি ভাবে ডাক্তার বলা কি ঠিক হবে? ইর্ন্টানশিপ শুরু হতে এখনো এক মাস বাকি। এই একটি মাসের জন্য এখন বাড়ীতে যাওয়া। এই দু বছরে অনেক কিছু বদলেছে। সে বদলেছে, সময় বদলেছে। সবকিছু্ই বদলে গেছে। হয়তো অনিও বদলে গেছে। হ্যাঁ, একদিন আরাফাত বলল অনি নাকি এখন অনেকটা বদলে গেছে। এখন আর আগের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করে না সে, লাফালাফি ও কমেছে অনেকটা। ছিঁচকাদুনে মেয়েটা এখন আর কথায় কথায় কান্না করে না। আগের মতো মায়ের কাছে খাওয়ার বায়নাও করে না। হঠাৎ এমন পরিবর্তনে বাড়ির সবাই একটু হতভম্ব হলো বটে। তবে ধরে নিচ্ছে এটা তার বয়সের প্রভাব। মেয়েটার বুদ্ধি বাড়ছে। সবকিছু বুঝতে শিখেছে। কিন্তু কতোটা?

এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলো, আজ তো রেজাল্ট দেবার কথা। ট্রেন চলছে খুব দ্রুত। কিন্তু মনে হচ্ছে, ট্রেনের গতির চেয়েও তার সময় যেন দ্রুত গেল। এই তো সেদিন রাতে, হঠাৎ ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির হলো সে। তার সিন্ধান্তে সে অটুট। এখনি চলে যাবে। থাকবে না এই বাড়িতে। তার অনেক পড়াশোনা বাকি। এখানে এসে শুধুই সময় নষ্ট হলো আর কিছু না। কারো কথা শুনল না। না খেয়েই বেরিয়ে গেলো রাতের মধ্যে। সেদিন কেন জানি, বাবাও তাকে থামাল না। হয়তো সে টের পেয়েছিল তার মনের কথা।

এই যে বের হলো, আর কখনো ফিরা হলো না। এই অজুহাত, সেই অজুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিল। অনেক পড়াশোনা বাকি তার, সামনেই ফাইনাল পরিক্ষা। সময় নষ্ট করার মতো সময়ও নেই তার হাতে। আর কুরবানী ঈদে আসা হলো না। গরুর হাটে গিয়ে গরু কিনে বাসায় ফিরা এখন স্মৃতি মাত্র। দিন এতোগুলো সব কেটে গেল চার দেয়ালের ঘরের মধ্যে বন্দি থেকে।

দীর্ঘ নিঃশ্বাসে সবকিছু ভুলে গেল। ভাবছে সামনের টুকু নিয়ে। কি হবে এখন? ট্রেন থামল মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে। ব্যাগ পত্র নিয়ে নামল সারফারাজ। আগের থেকেও এখন যেন বেশি খিটখিটে লাগছে তাকে। একটা সিএনজি ভাড়া করে উঠে পড়ল। তার চিরচেনা গ্রাম আর বদলে গেছে। রাস্তাঘাট এখন আগের চেয়েও ভালো। মানুষ ও বদলে গেছে অনেক। শুধু রয়ে গেছে পুরোনো বাড়িটা আগের মতো। তার বাড়ি “নিকুঞ্জ নিবাস!” ভাড়া মিটিয়ে নামল সারফারাজ। ব্যাগ হাতে ঢুকল বাড়ির মধ্যে। মনের মধ্যে বিশাল এক অস্থিরতা। মাথা ভনভন করছে। মন বলছে উল্টো পায়ে চলে যেত। অথচ তবুও দরজায় কড়া নাড়ল সে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। দরজা খোলার শব্দে আচমকা চমকে উঠল সে। হকচকিয়ে তাকাল সামনের দিকে। এক চিরচেনা মুখ ভেসে উঠল সামনে। সময়ের স্রোতে গা ভেসাল সে। সামনের রমনী অবাক চোখে তাকে দেখছে। চেনার চেষ্টা করছে নিশ্চয়ই। সারফারাজ মৃদু হাসি হাসল। সামনের রমনী অবাক কণ্ঠে বলে উঠল, ”ফারাজ ভাই!”

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-০৭

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৭

ফরহাত পিঠ চাপড়ে বলে উঠল, “সাবাশ ব্যাটা! যা করেছিস ভালো করেছিস। একদম বাঘের বাচ্চা। ওর তো এরকমই একটা শিক্ষা হবার দরকার ছিল। তোর বউয়ের দিকে নজর দিবে আর তুই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবি নাকি!”

“চুপ কর। আমার মাথা ব্যাথা করছে!“ তিক্তস্বরে কথাটা বলে উঠল সারফারাজ।

“তোর উচিত এখন গিয়ে বাড়িতে বসে বউয়ের হাতের গরম চা খাওয়া। আহা! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বুঝবি এর স্বাদ। বউয়ের হাতে বানানো গরম চায়ের কাপে প্রথম চুমুক তাকে চুমু খাবার মতোই!”

“তোর লু/চ্চামি কথা রাখ তো।”

“লুচ্চা/মি বউয়ের সাথে করবি না তো কার সাথে করবি। শা লা এতোদিন বসে থেকে কি ঢ্যারা পিটালি, এখন এসে বউয়ের সাথে প্রেম করতে পারো না।”

সারফারাজ বিরক্তি স্বরে জবাব দিল, ”লাইক সিরিয়াসলি ফরহাত! তোর মনে হয় আমি এই বাচ্চার সাথে প্রেম করব। যাকে ক বললে গ বুঝে! এক লাইন বেশি বুঝে বসে থাকে।”

“থাকলে থাকবে। তুই ও পাল্টা চাল দিবি।”

“অসম্ভব! আমি এই মেয়ের কথা আর একবিন্দু ভাবছি না। কালই আমি ঢাকা ফিরছি। এখানে আর একদিনও থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে।”

”আমি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে রাখব?”

“ফাজলামির একটা লিমিট থাকে ফরহাত!”

”আচ্ছা! চুপ আমি। ( বলার পর দু সেকেন্ড চুপ থেকে বলল) ওহ যেটা বলার ছিলো।”

“কি?”

“আঙ্কেল ফোন করেছিলো। শিকদার সাহেব তোমার বাড়ীতে হা/না দিয়েছে। নাও ইউ গেট আউট!”

সারফারাজ তড়িখড়ি করে উঠে দাঁড়াল। আশ্চর্য! কেউ একটা কাজের না। বাবা ফোন করেছে সেই কখন আর ফরহাত এখন এসে তাকে বলছে। ”এতোক্ষণ পর এখন বললি এই কথা!“

“আরে বৎস সামলে। তোমার একটা ভাব আছে না। ডাকবে আর তুমি চলে যাবা এতো তোমায় পেলে তাহলে ঘাড়ে চ/ড়ে বসবে। রিল্যাক্স মুডে বাড়ি ফিরো। দেখো ভাব যেন না চেঞ্জ হয়। তোমার বল তোমার হাতে। আশীর্বাদ করি হে বৎস!” সত্যি সত্যি হাতটা তার মাথায় রেখে দিল ফরহাত। সারফারাজ দাঁত চেপে উঠে দাঁড়াল। শা লার ভীমরতি ধরেছে এই বয়সে। বের হবার পথে চাচী শুধলো, “রাত টা থেকে যাও।”

“না চাচী। বাবা ফোন করেছে।“

“তাহলে রাতের খাবারটা….

“বাবা ফোন করেছে অনেকক্ষণ। আমি আসি!”

বের হয়ে গেল। চাচী আর থামালো না। জানে, কথার নড়চড় হবে না। ফারাজ তার বাবার অতি বাধ্য ছেলে!
.
বাড়িতে ফিরে দেখল মেহমান কঠোর দৃষ্টিতে চোয়াল শক্ত করে বসে আছে সোফার উপরে। বাবার স্টাডি ঘর। বাবা শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। সারফারাজ বাবার সামনে খানিকটা নিশ্চুপ হয়ে গেল। বাবার সামনে তার গলার স্বর উঁচু কি রুক্ষ কখনো হয় না। তবুও তার কঠিন দৃষ্টিপাত শিকদার সাহেবের উপর। আরিফ হাসান ছেলেকে শুধালেন, ”শুনলাম তুমি নিয়াজ কে খুব
মেরে/ছো! এর কারণ কি ফারাজ?”

ইয়াতিম শিকদার তরতর করে উঠলেন। “কি? খুব মা/রছে? বলেন জানো/য়ারের মতো মার/ছে। এই পোলা আমার পোলার মুখ চোখ সব মাইরা ন/ষ্ট কইরা দিছে। পিঠের ছা/ল উঠাইয়া দিছে , বিশ্বাস না করলে চলেন আমার সাথে!”

আরিফ হাসান ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। সারফারাজ শিকদার সাহেবের চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, “আমি সারফারাজ শেহদাত। আপনার ছেলেকে শুধু মারি/নি মে/রে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমার বউয়ের দিকে কেউ খারাপ নজরে তাকালে আমি বসে থাকব এমন শিক্ষা আমার বাবা আমায় দেয়নি।

শিকদার সাহেব চোখমুখ বড় করে কঠিন স্বরে বলল, “মে/রে ফেলতা। দেখলেন আপনে হাসান সাহেব, দেখলেন। আপনার ছেলে আপনার সামনে বলতাছে আমার ছেলেকে মে/রে ফেলতো। তাইলেই বুঝেন এবার।

“ফারাজ! তুমি শুরু থেকে বলো কি হয়েছে?”

সারফারাজ এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার চোখেতে তেজ ফিরেছে। কণ্ঠের স্বর ও এবার খানিকটা রূঢ়। বলে উঠল, “আমার বউয়ের দিকে খারাপ নজ/রে তাকালে আমি তার এমন হালই করব। আমার বউ সে! তোমার বোনের মেয়ে কিংবা তার ভাইয়ের মেয়ে না। আমার বউয়ের দায়িত্ব আমার। ওই রাসকেল, ইডিয়েট টা আমার বউয়ের ঘরে উঁ/কি মারছিলো আর তখন… ঠোঁট চেপে ধরল ফারাজ। রাগে তার ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। বাবার দিকে ফিরে অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ”ছাড়ো বাবা! আমার রুচি হয় না এসব বলার।”

আরিফ হাসান ভ্রু কুঁচকে শিকদার সাহেবের দিকে ফিরলেন। শিকদার সাহেব উঁচু গলায় বলল, ”এসব মিথ্যে কথা! অর্নিলা এসব বলছে!”

“মিথ্যে কেন হবে শিকদার সাহেব। আপনার ছেলে কি এমনটা করতে পারে না। এর আগেও তো এমন রুচিহীন কাজ করে নিজেকে জাহির করেছে। এখন মেনে নিতে আপত্তি কোথায়? আর শিকদার সাহেব,‌এখন অর্নিলার অভিভাবক আমরা না। তার স্বামী! তার স্বামী যা বলবে তাই হবে!”

শিকদার সাহেব দাঁত কিড়/মিড় করতে লাগলেন। বাপ ছেলে দুটো একজোট হয়েছে। তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল, “ঠিক বলছেন ভাই,‌ ঠিক বলছেন। কিন্তু মনে রাইখেন,‌ এক মাঘে শীত যায় না!”
আরিফ হাসান নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শুধু। মৃদু হাসলেন। সেই হাসিতে ছিলো গর্ব, তার ছেলের জন্য তার গর্ব হচ্ছে। নিজের স্ত্রীর দায়িত্ব তার ছেলে কাঁধে নিয়েছে। বিয়ের সিদ্ধান্ত অনেকটা হেলাফেলায় নিলেও, বউয়ের দায়িত্ব হেলাফেলায় যাবে না।

শাহিনুর বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাইচারি করছেন। টেনশনে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেছে। কে জানে ভেতরে কি হচ্ছে? আত্মীয়দের সাথে কথা কাটাকাটি,‌তর্ক তার কোনদিনই পছন্দ না। সবসময় চান শান্তিমতো থাকতে। ছোট থেকে একাই বড় হয়েছেন। কোন ভাই বোন ছিলো না তার। একা বেড়ে উঠার কিশোরীর ইচ্ছে ছিল ভরা জমজমাট একটা বাড়ীতে বিয়ে করবেন। ছোটবেলা যতোটা একা ছিলেন এখন ঠিক ততোই মানুষে তার বাড়ি গম গম করবে। এজন্য কারো সাথে ঝগড়া করে সম্পর্ক ছি/ন্ন করতে বেশ ভয় পান তিনি। সারফারাজ নিয়াজ কে মেরে/ছে। এটা অ/ন্যায় হয়েছে। কিন্তু অবশ্য নিয়াজ ও ভালো কিছু করেনি। সে যা করেছে এটাই তার পাওনা ছিলো। তবুও ভয় আঁকড়ে ধরছে। একটু পর পর আচমকা দরজার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেন। এই মনে হয় দরজা খুলে ফেলার শব্দ। অর্নিলা এখন ঘুমাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাক্তার এসে মেয়েটার হাত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। ওতো বেশি কাটেনি। তার ঘরে শ্রেয়মীকে রেখে এসেছেন। অর্নিলা তার ছেলের বউ হবার আগে তার মেয়ে। ছোট এই অর্নিলা কে তিনিই মানুষ করেছেন। ননদ দুদিন পর পর ঝগড়া করে এই কোলের বাচ্চা কে নিয়ে তার বাড়িতে উঠতো। তখন মেয়েটার পুরো দায়িত্ব থাকত শুধুই তার। খুব শখ ছিলো, অর্নিলার মতো একটা মেয়ে তার নিজের ও হবে। কিন্তু তা কখনোই সম্ভব হয়নি। যেই অপ্রাপ্তি তার মনকে ভার করে তুলছিলো, ছোট শিশু অর্নিলার আগমন তার প্রাণকে ততোটাই জীবিত করে তুলল। মনে হলো এই মেয়ে তো তারই।

ননদের মৃ/ত্যু তাকে ভয়াবহ ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলো। কিন্তু অর্নিলা ছিল তার ননদের মেয়ে। সেই সম্পর্কের জোর এতোটা তিনি দিতে পারে নি। পারলে মেয়েকে নিজের কাছেই আগলে রাখতেন। অর্নিলার বাবা কতোবার চাইল আরেকটি বিয়ে করতে, তখন তারা গিয়ে বার বার বাঁধা দিয়েছিল। বলেছিলো, এই মেয়েকে তারাই মানুষ করবে। এজন্য কোন বিয়ে শাদি করে মা আনার দরকার নেই। সত্যি তারা জানত, নতুন মা আনা তো একটা অজুহাত মাত্র, আসল যুক্তিটা অন্য কোথায়। চরিত্রের দিক দিয়ে ক/লঙ্ক থাকলেও মেয়ের জন্য এতোটুকু হলেও ভালোবাসা ছিল শামসুর শিকদারের মনে। নাহলে তাদের মতো তুচ্ছ মানুষের কথা শুনে দ্বিতীয় বিয়ে থেকে পিছিয়ে আসতে পারতেন না। কিন্তু তবুও তার অ/বৈধ সম্পর্কের অস্তিত্ব কম ছিলো না। এজন্য ছোট মেয়েটা কখনো তাদের বাড়িতে নয়তো কখনো গিয়ে থাকত তার ছোট ফুফুর বাড়িতে। চাচার বাড়ীতে চাচি না থাকায় সেখানে থাকা আর নিজের বাড়িতে থাকা সমান কথা। তখন অর্নিলার মায়ের প্রয়োজন ছিল। শাহিনুর বেগম আর ছোট ফুফু দুজন মা মিলে একজন মায়ের অভাব পূরণ করেছিলো!

দরজায় ধপ করে শব্দ হলো। শাহিনুর বেগম হকচকিয়ে তাকাল। ইয়াতিম শিকদার হম্ভিতম্ভি করে বের হয়ে চলে গেলেন। এই বাড়িতে আর একবিন্দু নয়। শাহিনুর বেগম কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। পরক্ষণেই লক্ষ্য করলেন আরিফ হাসান আর সারফারাজ বের হয়ে আসছে। ছুটে গেলেন সেদিকে। আরিফ হাসান মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “অর্নিলা খেয়েছে?”

”না, ঘুমাচ্ছে। অনেক জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারি নি।”

“অসুবিধে নেই, মাঝরাতে ওর ঘুম ভেঙে যাবে তখন আমি খাইয়ে দিবো।”

শাহিনুর বেগম বিচলিত হয়ে সারফারাজ কে শুধালো, “বাবা, তুমি খাবে না?”

“খাবো মা। একটু ফ্রেস হয়ে আসি!”

মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। তড়িখড়ি করে চলে গেল রান্নাঘরে। খাবার গুলো গরম করা দরকার। আরাফাত কেও ডাকতে হবে। সেও না খেয়ে বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। শ্রেয়মী মেয়েটাও বোধহয় না খেয়েই এসেছে। রাত অনেক হয়েছে!

শ্রেয়মী বিছানার পাশে বসে ফোন টিপছে। বিছানায় শুয়ে আছে অর্নিলা। সারফারাজ ঘরে ঢুকতেই বিছানা ছেড়ে নামল শ্রেয়মী!

“ভাইয়া তুমি?”

“মা তোকে ডাকছে, যা!“ তার মিথ্যে কথায় অবিলম্বে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল শ্রেয়মী। সারফারাজ এগিয়ে এলো। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের অর্ধাঙ্গিনী কে দেখতে লাগল। সুশ্রী মুখ, মায়া কাড়া চেহারা। গলুমলু গাল দুটো আলুর মতো। সে হাসলে তার চোখ দেখা যায় না, শুধু গাল দেখা যায়! আচমকা হেসে উঠল ফারাজ। আবারো বিষণ্ণ হয়ে গেল তার মন। অনির প্রতি তার আজকের আচর/ণ তাকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে। বোধহয় কখনোই পারবে না। পারবে না এই মেয়েটার স্বামী হয়ে উঠতে। স্বামী হওয়া বিরাট বড় কাজ, সারাজীবনের জন্য কোন মেয়ের দায়িত্ব নেওয়াই শুধু নয়, তাকে আগলে রাখাও। তার হাতটা শক্ত করে ধরে সামনের স্বপ্ন গুলো একসাথে দেখা। কিন্তু কই? তারা তো এমন কিছু ভাবে না। এভাবে কি সংসার চলে? তাদের সংসারে তো ভালোবাসাই নেই। ভালোবাসা না থাকলে সংসার চলবে কি করে? কি ভাবে হয়ে উঠবে সে স্বামী! অর্নিলা ডান হাতের তালু সাদা রঙের ব্যান্ডেজ দিয়ে বাধানো। অপ/রাধী হয়ে উঠেছিল ফারাজ। তার হৃদয় কে চূর্ণ/বিচূর্ণ করে দিচ্ছিল তার আত্না। আজকের তার আচরণ তাকে লজ্জায় মাথা নত করতে বাধ্য করছিলো। নিজের এমন আত্ম/ঘাতি কোনভাবেই মেনে নিতে পাচ্ছিল না সে। নিজেই নিজের কাছে বড্ড অপ/রাধী হয়ে উঠল সে। হঠাৎ করেই উত্তেজিত হয়ে উঠল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল দ্রুত। আজকের রাতটা যেন এখানে থাকলে তার দম/বন্ধ হয়ে যায়। এখানে কোনভাবেই থাকতে পারবে না সে। কোনভাবেই পারবে না অনির মুখোমুখি হতে। সে চলে যাবে, থাকবে না এখানে। আর কখনো আসবে না। কখনো না! ঝোঁকের বশে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিল সারফারাজ। রাতেই চলে যাবে সে। এখুনি মানে এখুনি! ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে।
.

দীর্ঘ দু বছর পর বাড়ী ফিরছে ফারাজ। তার চেহারায় অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। চেহারায় খানিকটা গম্ভীরতা ছোঁয়া। থিতুনির দাঁড়ির ঘনত্ব বেড়েছে অনেকখানি। এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার সে। এখনো পুরোপুরি ভাবে ডাক্তার বলা কি ঠিক হবে? ইর্ন্টানশিপ শুরু হতে এখনো এক মাস বাকি। এই একটি মাসের জন্য এখন বাড়ীতে যাওয়া। এই দু বছরে অনেক কিছু বদলেছে। সে বদলেছে, সময় বদলেছে। সবকিছু্ই বদলে গেছে। হয়তো অনিও বদলে গেছে। হ্যাঁ, একদিন আরাফাত বলল অনি নাকি এখন অনেকটা বদলে গেছে। এখন আর আগের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করে না সে, লাফালাফি ও কমেছে অনেকটা। ছিঁচকাদুনে মেয়েটা এখন আর কথায় কথায় কান্না করে না। আগের মতো মায়ের কাছে খাওয়ার বায়নাও করে না। হঠাৎ এমন পরিবর্তনে বাড়ির সবাই একটু হতভম্ব হলো বটে। তবে ধরে নিচ্ছে এটা তার বয়সের প্রভাব। মেয়েটার বুদ্ধি বাড়ছে। সবকিছু বুঝতে শিখেছে। কিন্তু কতোটা?

এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলো, আজ তো রেজাল্ট দেবার কথা। ট্রেন চলছে খুব দ্রুত। কিন্তু মনে হচ্ছে, ট্রেনের গতির চেয়েও তার সময় যেন দ্রুত গেল। এই তো সেদিন রাতে, হঠাৎ ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির হলো সে। তার সিন্ধান্তে সে অটুট। এখনি চলে যাবে। থাকবে না এই বাড়িতে। তার অনেক পড়াশোনা বাকি। এখানে এসে শুধুই সময় নষ্ট হলো আর কিছু না। কারো কথা শুনল না। না খেয়েই বেরিয়ে গেলো রাতের মধ্যে। সেদিন কেন জানি, বাবাও তাকে থামাল না। হয়তো সে টের পেয়েছিল তার মনের কথা।

এই যে বের হলো, আর কখনো ফিরা হলো না। এই অজুহাত, সেই অজুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিল। অনেক পড়াশোনা বাকি তার, সামনেই ফাইনাল পরিক্ষা। সময় নষ্ট করার মতো সময়ও নেই তার হাতে। আর কুরবানী ঈদে আসা হলো না। গরুর হাটে গিয়ে গরু কিনে বাসায় ফিরা এখন স্মৃতি মাত্র। দিন এতোগুলো সব কেটে গেল চার দেয়ালের ঘরের মধ্যে বন্দি থেকে।

দীর্ঘ নিঃশ্বাসে সবকিছু ভুলে গেল। ভাবছে সামনের টুকু নিয়ে। কি হবে এখন? ট্রেন থামল মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে। ব্যাগ পত্র নিয়ে নামল সারফারাজ। আগের থেকেও এখন যেন বেশি খিটখিটে লাগছে তাকে। একটা সিএনজি ভাড়া করে উঠে পড়ল। তার চিরচেনা গ্রাম আর বদলে গেছে। রাস্তাঘাট এখন আগের চেয়েও ভালো। মানুষ ও বদলে গেছে অনেক। শুধু রয়ে গেছে পুরোনো বাড়িটা আগের মতো। তার বাড়ি “নিকুঞ্জ নিবাস!” ভাড়া মিটিয়ে নামল সারফারাজ। ব্যাগ হাতে ঢুকল বাড়ির মধ্যে। মনের মধ্যে বিশাল এক অস্থিরতা। মাথা ভনভন করছে। মন বলছে উল্টো পায়ে চলে যেত। অথচ তবুও দরজায় কড়া নাড়ল সে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। দরজা খোলার শব্দে আচমকা চমকে উঠল সে। হকচকিয়ে তাকাল সামনের দিকে। এক চিরচেনা মুখ ভেসে উঠল সামনে। সময়ের স্রোতে গা ভেসাল সে। সামনের রমনী অবাক চোখে তাকে দেখছে। চেনার চেষ্টা করছে নিশ্চয়ই। সারফারাজ মৃদু হাসি হাসল। সামনের রমনী অবাক কণ্ঠে বলে উঠল, ”ফারাজ ভাই!”

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-০৬

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৬

সারফারাজের কথা শোনার মতো মেয়ে অর্নিলা না। তাকে বারণ করা হলেই সে শুনবে এমনো না। সে উড়নচণ্ডী! যখন তার যা মন চাইবে তাই করে। এতো সুন্দর গোলাপী রঙের জামদানি শাড়িটা উপহার পাবার পর পরে না দেখতে পেলে বড্ড আফসোস লাগবে। তাই ঘর ফাঁকা হতেই সে দরজা বন্ধ করে শাড়ি পরতে শুরু করল। কিন্তু সে তো শাড়ি পরতে জানে না। তাতে কি? এই যুগের ইন্টারনেট কাজে দিবে কবে? মোবাইলে ভিডিও অন করে শাড়ি পরতে ব্যস্ত অর্নিলা!

দু তিনবার শাড়ি প্যাচ দিচ্ছে, কিছুই হচ্ছে না। কুচি দিতে গিয়ে তাল গুলিয়ে ফেলছে। ইশ্! ভিডিতে কি সহজই না মনে হচ্ছে। যেই সে পরতে যাচ্ছে অমনি কতো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একবার তো ভাবল, এর চেয়ে পড়াশোনা সহজ। ওই হিসাববিজ্ঞানের রেওয়ামিল ও বোধহয় এর চেয়ে দ্রুত মিলে যেত, সে মিলিয়ে ফেলতে পারত। বরাবরই হিসাববিজ্ঞানে সে একটু কাঁচা। মনে হতো, আর্থিক বিবরণীর চেয়ে বড় কোন কঠিন বিষয় নেই। আজ মনে হচ্ছে, শাড়ির প্যাচ বোঝার চেয়ে কঠিন বিষয় আর কিছু হতে পারে না। একবার পুরোপুরি শাড়ি পরার পর খেয়াল করল শাড়ি উল্টো পরেছে। আঁচল চলে গেছে কোমরের ভাঁজে। রেগে মেগে অস্থির হয়ে শাড়ি বিছানায় ছুড়ে মারল। চুলো/য় যাক শাড়ি! পরা লাগবে না কিছু হুহ!

ফের দু মিনিট আবারো শাড়ি তার হাতের মুঠোয়। এবার সমস্ত মনোযোগ ওদিকে। ইশ, এতো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে স্যারের কাছে আর মা/র খেতে হতো না। তখন যে মনোযোগ সব থাকে কোথায়? বুঝে উঠতে পারে না। তার ফর্সা শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান কোমরের অংশ ফুটে উঠেছে লাল রঙের ব্লাউজ আর পেটিকোট এ। কে বলে? মোটা মেয়েদের শাড়িতে মানায় না। অর্নিলা কে তো বেশ মানায়। সেদিন প্রথমবার পরেই সে বুঝে গেছে। মামনী কতো আদর করে বলল, ”আমার অনিকে ভারী মিষ্টি লাগছে! ওই তো, হ্যাঁ বিয়ের দিন। কাজল লেপ্টে দিল কানের লতিতে। কারো নজর না লেগে যায় বুঝি!” একাকী হেসে উঠল অর্নিলা। এবার সে শাড়ি পরেই ফেলব। তাকে পরতেই হবে!

শিকদার বাড়ি বাইরে থেকে যেমন আগের যুগের ভেতরেও তাই। এই ঘরের পুরোনো দরজা এখন আর আগের মতো সুরক্ষিত নেই। খুব সহজেই সেই দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলা যায়। বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অর্নিলা যখন শাড়ির প্যাচ বুঝতে ব্যস্ত ঠিক তখনি দরজার আড়াল থেকে উঁকি মারছিলো ব/খাটে নিয়াজ। চরিত্র/হীনের সাথে সাথে লজ্জা শরম ও লোপ পেয়েছে তার। অর্নিলা উল/ঙ্গ কোমর, উদাম পিঠের অংশ নজর কেড়ে নিচ্ছিল তার। মা/তাল চোখে, পাগ/লের মতো তাকে দেখছিলো সে। এতোই গভীর ছিল তার মাঝে, বুঝেনি কখন এসে যমরাজ পিছনে এসে আ/স্তানা বাঁধল। হঠাৎ করেই শার্টের কলার চেপে ধরতেই হুঁশ ফিরল তার। ফারাজ তখনো বুঝতে পারেনি কি দেখছিলো নিয়াজ! অজান্তেই দরজা খুলে ফেলল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে শাড়ি হাতে পিছন ফিরল অর্নিলাও। হতভম্ব সে। শাড়ি তখনো তার হাতের মাঝে। অর্নিলা এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে ফারাজ নিজেও শরম পেয়ে গেল। দ্রুতই দরজা বন্ধ করে দিল সে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি হলো বুঝতে সময় লাগল অর্নিলার। একের পর এক কাণ্ড। বুঝতে পারার পরপরই কোনমতে শাড়ি পেঁচিয়ে নিল শরীরে। দরজার কাছে আসতেই
তট/স্থ সে। শরীর জমে গেছে তার। নিয়াজ ভাইয়ের কান্নার আওয়াজ। তার সাথে ফারাজ ভাইয়ের কঠোর স্বর, ”আমার বউয়ের দিকে নজর দিবি তুই? আমার বউয়ের দিকে। আজ তো তোকে আমি মে/রেই ফেলব!“

শরীর ঝনঝন করে উঠল অর্নিলা। দরজা খুলে বাইরে কি হচ্ছে দেখার সাহস হলো না তার। এক জায়গায় নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। ধস্তা/ধস্তির শব্দ! হুল/স্থুল একটা কাণ্ড বেঁধে গেছে। দরজার আড়াল দিয়ে উঁকি মারল অর্নিলা। তার দম/বন্ধ হবার জোগাড়! ফারাজ ভাইয়ের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। ঘেমে একাকার সে। শার্টের কয়েকটা বোতাম খোলা । তারেক ভাই কোনভাবেই ফারাজ ভাইকে আঁটকে রাখতে পারছে না। হিং/স্র বাঘ যেন শিকা/রকে হাতছাড়া করতে চাইছে না। অর্নিলা শুকনো ঢোক গিলল। তার গায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গেল। শরীর শিউরে উঠল। বাক/রুদ্ধ সে! ফারাজ ভাইকে রাগতে দেখেছে, কিন্তু রেগে মা/রতে কখনো দেখেনি। বরাবরই ভাই রেগে গেলে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকত, কিংবা দু একটা ধ/মক দিত। এমনকি আরাফাতের সাথেও তাকে মারা/মারি করতে দেখেনি। সেই ভাই আজ এতোটা রে/গে আছে!

রাগে ফুঁস/ছে সারফারাজ। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। তারেক পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে। হাতে বেল্ট এখনো শক্ত হাতে। আরেকদফা মার/তে পারলে যেন শান্তি মিলত। কতোটা সাহস! তার বউয়ের দিকে বাজে নজর দিচ্ছে, তার ঘরে লুকিয়ে উঁকি মার/ছে। জঘন্য! বলতেও লজ্জা লাগছে তার। তারেক ছেড়ে দিল ফারাজ কে। তবুও নড়ছে না। মনে হচ্ছে ফারাজ দ্বিতীয় দফায় আবার শুরু করবে। হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দরজার দিকে তাকাল।

হকচকিয়ে গেল অর্নিলা। মনে হলো ফারাজ ভাই তাকেই দেখছে। চমকে উঠল সে। ফারাজ ভাই তো এদিকেই এগিয়ে আসছে। পিছিয়ে গেল দু পা। ধপ করে দরজা খুলে ফারাজ ভাই শক্ত করে তার বাহু চেপে ধরল। কেঁপে উঠল অর্নিলা। এমনটা আগে কখনো হয়নি। দ্রুত ঘরের বাইরে এসে পড়ল। বিধ্ব/স্ত অবস্থায় নিয়াজ পড়ে আছে চাচার কোলে। চাচা যেন রাগে চুপ/সে গেছে। সায়মা ভাবী দূরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনাটা সে নিতে পারছে না। তাদের বাড়িতে এসে তাদের ঘরেই তার দেওর কে এভাবে মা/রল। নিয়াজের চোখ ফুলে উঠেছে। গাল
কে/টে রক্ত পড়ছে। ঠোঁটের কাছেও কা/টা। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। আধো আধো চোখে তাকাল ফারাজের দিকে। ফারাজ তার দিকে তাকিয়েই আঙুল তুলে বলে উঠল, ”এরপর আমার বউয়ের দিকে তাকালে তোর চোখ তুলে ফেল/ব, মনে রাখিস!” কথাটা বলা অবধিই। আর এক বিন্দু এখানে থাকবে না। বেল্ট ছুঁড়ে মার/ল মেঝের দিকে। অর্নিলার হাত চেপে বেরিয়ে এলো শিকদার বাড়ি থেকে। অর্নিলা চুপচাপ চলে এলো। কোন শব্দ করল না, মুখ ফুটে একটা কথাও বের হলো না। এই প্রথম ফারাজ ভাই কে তার এতো ভ/য় লাগছে।

গাড়িতে এসে বসল তারা। গাড়ির ড্রাইভার হম্ভি/তম্ভি করে ছুটে এলো। দূরে কোথাও বুঝি চা খাচ্ছিল। সারফারাজ মৃদুস্বরে বলল, “বাসায় চলো!” ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করল। গাড়ির এককোণে ফারাজ ভাই আর অন্য কোনো অর্নিলা। কোনমতে পেঁচানো শাড়ি পরেই এসেছে সে। এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মন বলছে, বাসায় যাওয়ার পর ফারাজ ভাই তাকেও একধাপ পিটা/বে। যা হয়েছে সব এই শাড়ির জন্য। মানা করেছিলো তো শাড়ি পরতে, কেন যে পাগলামি করে পরতে গেল। প্রাণ আসে আর যায়। কান্না চেপে রাখতে পারল না সে। ফিরে তাকাল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। রক্ত/বর্ণ দৃষ্টিতে ভাইয়া এদিকেই চেয়ে আছে। প্রথমবারের মতো অর্নিলা নিশ্চুপ হয়ে কাঁদতে লাগল। এই প্রথমবার সে নিশ্চুপে কান্না শিখল।
.
শিকদার বাড়ির হাল মোটেও ভালো না। গরম পরিবেশ এখনো গরম, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই। তাদের বাড়ির কাজের লোকের সংখ্যা নেহাত কম না, নিয়াজ যে সবার সামনে সারফারাজের সামনে মা/র খেলো এটা সবাই দেখেছে। কানাঘুষা ও চলছে। ডাক্তার কে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। নিয়াজের চোখ, গাল, ঠোঁটে মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। গায়ের শার্ট খুলতে দেখা গেল পিঠে দা/গ বসে গেছে। শুধু দাগ তাই না, একদম পূর্ণ বেল্টের ছা/প। মাপ দিলেও এক ইঞ্চি মিস হবে না। একটা জানো/য়ার কে এভাবে মারে না, যেভাবে তার ছেলেকে মেরে/ছে। এর প্রতি/শোধ সে না নিয়ে থাকবে? অবশ্যই নিবে! তার নাম ইয়াতিম শিকদার। এতো সহজে ছেড়ে দিবে না। কখনোই না!

আরিফ হাসান বাসায় ছিলেন না। শাহিনুর বেগম ও বিকালের দিকে একটু বের হয়েছেন। আরাফাত সবে বাইর থেকে এসে সোফায় বসল। টিভি ছাড়ার উদ্দেশ্য রিমোট খুঁজতে লাগল। এর মধ্যে দেখল হঠাৎ সিধু ছোটাছুটি করছে। সিধু তাদের বাসায় কাজ করে। বাজার করা থেকে শুরু করে বাগানে পানি দেওয়া, গাড়ি ধোঁয়া অনেক কাজই এই ছেলে একা করে। কাজের ছেলে একটা। সিধু ছুটে এসে বলল, “বড় ভাই আইছে!”

”বড় ভাই মানে? ফারাজ ভাই! তারা না দাওয়াতে গেল দুদিন থাকার কথা। এতো দু ঘণ্টার মধ্যে ফেরত এসে গেল!“

বলতে বলতে দেখল ফারাজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আরাফাত ঘাবড়ে গেল। ভাই কে দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ চ/টে গেছে। তার ভাইয়ের রা/গ যতোই থাকুক, তা কন্ট্রোল করার ধৈয্য আছে। আজ তো মনে হচ্ছে সব ধৈর্য্যের বাইরে। অর্নিলা কে হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা ঘরে ঢুকল সারফারাজ। আরাফাত রীতিমতো চমকে উঠল। কিছু বলার জন্য এগিয়ে যাবার আগেই ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিল। সিধু ভর্য়া/ত কণ্ঠে বলল, “বড়ভাই তো খুব রাইগা গেছে!”

“সিধু, আমার ফোন দেখো সোফার উপরে। এখুনি দাও। মা কে ফোন করতে হবে। ভাইয়া খুব রে/গে গেছে!“

অর্নিলা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে ফারাজ ভাই। সময়ের সাথে সাথে মানুষের রাগ কমে, কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে ফারাজ ভাইয়ের রাগ বে/ড়ে যাচ্ছে। শক্ত গলায় ফারাজ ভাই বলে উঠল, ”তোকে না বলছিলাম, শাড়ি পড়ার দরকার নাই। তাও কেন শাড়ি পড়তে গেলি তুই?”

ফারাজ ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো অর্নিলা। সারফারাজ এক থ/মক দিতেই আবার চুপসে গেল।

“চুপ! একদম চুপ; ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবি না আমার সামনে। এই ঢং গিয়ে আমার বাবার সামনে কর আমার সামনে না।”

অর্নিলা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল, ”ফারাজ ভাই আমি তো..

“কি আমি হ্যাঁ! কি আমি! দরজা বন্ধ করতে জানিস না!”

“আমি তো দরজা বন্ধ করছিলাম ফারাজ ভাই কিন্তু কেমনে যে খুলে গেল….

“চুপ; একদম চুপ! মুখে মুখে আরেকবার তর্ক করলে না?.. বলেই হাত উঠালো সে। অর্নিলা ভ/য়ে চোখ বন্ধ মুখ সরিয়ে নিল। হাত মুঠোয় নিল শাড়িটা। সারফারাজ বহু কষ্টে নিজেকে থামাল। না! এটা পুরুষত্ব না! বউয়ের গা/য়ে হা/ত তুললেই নিজেকে পুরুষত্ব জাহির করা যায় না। ধপ করে পর পর দুটো আওয়াজ হলো। ভ/য়ে চোখ মেলে তাকাল না অর্নিলা। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখল আয়না ভেঙে/চুড়ে মেঝেতে পড়ে আছে। ভাইয়া ডেসিন টেবিলের আয়না ভেঙে ফেলেছে। দরজা খুলে বাইরেও চলে গেছে। তার এবার ভীষণ ভয় লাগছে। চিৎ/কার করে কেঁদে উঠলো সে। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে কাঁদতে লাগল। বেসামাল হয়ে নিচে কাঁচের টুকরো হাত কে/টে গেল। র/ক্ত পড়ছে গড়িয়ে। কান্নার রেশ আরো বেড়ে গেল। আরাফাত আর শাহিনুর বেগম ছুটে এলেন সারফারাজের ঘরের কাছে। বিধ্ব/স্ত অবস্থায় অর্নিলা কে দেখতে পেয়ে দুজনেই হতভম্ব! শাহিনুর বেগম ছুটে এসে অর্নিলা কে বুকে জড়িয়ে নিল। অর্নিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ”আমি কিছু করি নাই মামনী! আমি কিছু করি নাই!”

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-০৫

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫

টুরে সবাই গেলো বান্দরবান অথচ সারফারাজের মন অন্য কোথাও পড়ে থাকার কারণে তাকে মোহনগঞ্জ ফেরত আসতে হলো। অর্নিলার ফোন নাম্বার থাকা সত্ত্বেও তাকে ফোন দিতে পারেনি সে। কেন পারে নি? কারণ কখনোই ফোনে আলাদাভাবে তাদের কথা হয়নি। আচমকা এবার ফোন করাটাও কেমন যেন অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। লজ্জায় কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারছে না,‌ অর্নিলার খোঁজ নিতে তার বড্ড ইচ্ছে হয়। আর কেউই তাকে সেধে জানাতে চায় না অর্নিলার কথা, সবার কাছেই বিয়েটা নামমাত্র। ফারাজের কাছেও তো তাই হওয়া চাই, হচ্ছে না। কেমন যেন সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার আগমনে সবাই হতভম্ব। শাহিনুর বেগম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অবাক স্বরে বললেন, “কখনো তো ফোন ছাড়া আসো না, আজ হঠাৎ? শরীর ঠিক তো তোমার?“

সারফারাজ হাসার চেষ্টা করল। ব্যাগ হতে ভেতরে পা রাখল। এই ভর দুপুরবেলা দরজায় কে এলো দেখার জন্য বাবাও এগিয়ে এলো। দরজার সামনে সারফারাজ কে দেখতে পেয়ে একটু বিভ্রান্ত হলেন। মৃদুস্বরে বললেন, “সাবধানে এসেছো তো।”

শাহিনুর বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে জবাব দিলেন, ”দেখো না। কিছু না বলেই হুট করে চলে এলো। বাবা, তোমার শরীর ঠিক আছে তো?“

”একদম ঠিক আছি। পরিক্ষা শেষে সবাই ঘুরতে গেলো। তাই ভাবলাম আমিও যাই।”

“সবার সাথে তুমি গেলে না কেন?”

বাবার প্রশ্নে একটু হকচকিয়ে গেল সারফারাজ। তার হঠাৎ আগমনে সবাই এতো অবাক হবে বুঝতে পারেনি। কে জানে? কে কি ভাবছে। দ্রুতই সামলে নিল। বলে উঠল, “আমার একটু রেস্ট দরকার বাবা। পড়াশোনায় ঠিক করে হচ্ছে না। তাই একটু বাড়ি চলে এলাম।”

“বেশ, যাও ঘরে যাও। ফ্রেস হয়ে নাও। তোমার মা এবার রান্নাঘরে গিয়ে তোমার জন্য রাঁধতে শুরু করবে। সময় নষ্ট করো না।”

অতঃপর বাবা এগিয়ে গেলেন স্টাডি রুমে। এখন তিনি অবসর প্রাপ্ত। সারাটে দিন বসে বসে বই পড়েই কাটিয়ে দেন। এছাড়া টুকটাক কিছু কাজ। সারফারাজ ব্যাগ হাতে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল। পথিমধ্যে একটু থামল। আচ্ছা, তার ঘরে কি আবার অর্নিলা দখল করে নিয়েছে? না নিশ্চিত এমনটা হবে না। আশঙ্কা খুব কম, তা সত্বেও একটু আশা বাধছিল মনে, হয়তো অর্নিলা কে ঘরে দেখবে। কিন্তু কই? কোথায় অর্নিলা? কোথায় কে? তার ঘর আগের মতোই আছে। বিছানা, বইপত্র অন্যান্য জিনিস সবই জায়গামতো। কিছুই বদলায়নি। বিছানার ‌চাদর‌টা অবধি নষ্ট হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে,‌তার অনুপস্থিতিতে তার ঘরে বিশেষ কারো আগমণ ঘটে নি। বিশেষ কেউ? হ্যাঁ বোঝাই যাচ্ছে সে কে?

ঘরে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নিল সারফারাজ। কাপড় বদলে ঘর ছেড়ে বের হতেই দেখল ডাইনিং টেবিলে বসে আরাফাত খাচ্ছে। পাশেই তার ব্যাগ, এখনি খেয়ে দেয়ে বোধহয় পড়তে যাবে। আরাফাত তার দিকে ফিরে হাসল। কথা বলতে পারল না খাবারের কারণে। তার বোধহয় অনেক তাড়া। শাহিনুর বেগম এসে খাবার বাড়ালেন সারফারাজের জন্য। চেয়ারে বসে এদিক থেকে ওদিক তাকাচ্ছে। অনি কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁটা বরাবর আড়াইটে বাজে। অর্নিলা কি এখনো বাসায় আসেনি। মা না থাকলে আরাফাত কে জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু মা সরছে না। আরাফাতের খাওয়াও শেষ হয়ে যাচ্ছে। একে পরে আর পাওয়া যাবে না। সারফারাজ বলে উঠল, “লেবু কোথায়?”

“লেবু? লেবু খাবে তুমি! তোমার তো লেবু পছন্দ না ফারাজ।”

“জানি, কিন্তু আজ একটা খেয়ে দেখব।”

“আচ্ছা আমি কেটে নিয়ে আসছি।” রান্নাঘরে চলে গেলেন শাহিনুর বেগম। আরাফাত ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে উঠে দাঁড়াল।‌ সারফারাজ মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছিস?”

“কোচিং এ! আজ পরিক্ষা আছে কোচিং এ।”

“ওহ আচ্ছা। এতো জলদিই পরিক্ষা। তোদের তো কলেজ এই সবে শুরু হলো।”

“এই সবে না। অলরেডি চার মাসের মতো ক্রস করে গেছে। আর কলেজেও এক্সাম শুরু হয়ে গেছে।”

“ওহ, তা তোরই শুধু কলেজ আছে। আরেকজন কই?”

”কে? বুড়ি!”

“ও যাবে না তোর সাথে।”

”না‌ ও আমার সাথে যায় না। ওর কোচিং শুরু হয় বিকাল থেকে।”

“তো মেমসাহেব কোথায়? বাড়িতে তো নেই।”

আরাফাত জবাব দিতে যাবে অমনি শাহিনুর বেগম মাঝে এসে শুধালো, ” কে বাড়িতে নেই ফারাজ?”

ফারাজ চুপসে গেল। তার চোখ মুখ শুকনো হয়ে গেল। মনে হলো, খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে সে। এক লুকমা ভাত মুখে দিল। আরাফাত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল, “বুড়ির কথা জিজ্ঞেস করছে মা। আমি যাই এখন!”

“সাবধানে‌ যেও। রাস্তার মাঝে সাইকেল চালানোর কোন দরকার নেই।” একটু উঁচু স্বরেই কথাগুলো বলল, আরাফাতের কানে তাও কথাগুলো যেন গেলো না। দুটো লেবুর টুকরো ফারাজের পাতে দিয়ে পাশে বসে পড়লেন। গ্লাসে পানি ঢেলে বললেন, ”অর্নিলা তো বাসায় নেই। ওর কোন বান্ধবীর বাসায় আজ দুপুরে দাওয়াত ছিল সেখানেই গেছে। বিকেলে এসে পড়ব।”

ফারাজ গম্ভীর স্বরে বলল, “তা‌ জেনে আমি কি করব মা? জিজ্ঞেস করছিলাম ওর পড়াশোনার কথা!”
অনর্গল মিথ্যা কথাগুলো বলে দিল সে। শাহিনুর বেগম ভাবলেন ছেলে বুঝি অভিমানেই কথা গুলো বলল। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ”বাবা! আমরা তোমায় বুঝি। সবই বুঝি, বিয়েটা নিয়ে তুমি এখনো রেগে আছো? রেগে থেকো না। দেখবে একদিন অর্নিলা ঠিকই তোমার যোগ্য হয়ে উঠবে। বেচারি এখনো ছোট তো..

ফারাজ কথা কানে নিল না। নিশ্চুপে খেতে লাগল। বেশি রেগে গেলে এমন নিশ্চুপই হয়ে যায় সে। কিন্তু আজ সে চুপসে গেছে ভয়ে,‌ লজ্জায়! তার খুব লজ্জা লাগছে।
এর আগে কখনোই সে অনির কথা জিজ্ঞেস করেনি। পাশাপাশি এক টেবিলে বসে খেলেও তার সাথে একটা কথাও বলেনি। আজ হঠাৎ এভাবে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে তার স্বর আটকে যাচ্ছে। শাহিনুর বেগম ও তাই চুপসে গেলেন। এই কারণেই ফোনেও অর্নিলার ব্যাপারে কথা বলেন না তিনি। ভয় হয় ভীষণ আবার অর্নিলাকেও ফে/লে দিতে পারেন না। কি য/ন্ত্রণা!
.
বিকেলের দিকে সারফারাজ বসার ঘরেই সোফাতে বসে বই পড়ছিল। দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই ফারাজ উঠে দরজা খুলে দিল। বইয়ের পাতা থেকে মুখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই সেকেন্ড কয়েকের জন্য থমকে গেল সে। খোলা চুলে অর্নিলা দাঁড়ানো। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ফারাজ ভাইয়ের দিকে।‌ পরনে তার লাল কালো রঙের পাতলা একটা শাড়ি। সাজগোজ কিছু না থাকলেও ঠোঁট জুড়ে আছে লাল রঙের আবরণ। এমন সাজ? আশ্চার্যিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সারফারাজ। বিয়ের দিনেও মেয়েটা বোধহয় এতো সাজেনি। আজ হঠাৎ? কি দরকার? সবকিছু তাল গোল পাকিয়ে গেল। সত্যি সত্যি কোন ছেলের সাথে আবার… সারফারাজ তট/স্থ হয়ে গেল। এতো আগেই কিছু ভেবে ফেলা ঠিক না। অর্নিলা অবাক স্বরে বলল, “ফারাজ ভাই, আপনি? কবে এলেন?”

“আজ! তুই কোথায় গেছিলি অনি? আর এতো সেজেগুজে কি করছিলি?“

অনি দাঁত এক পাটি বের করে হাসল। জুতো খুলতে খুলতে বলল, “ওই আমার বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত ছিল না, ওখানে গেলাম।”

“শাড়ি পড়ে গেছিলি?” ভীষণ অদ্ভুত প্রশ্ন। প্রশ্নটা সে নিজেও করে চুপ হয়ে গেল। মনে হলো প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। কিন্তু অনি সহজ গলায় জবাব ও দিয়ে দিল, “না তো! ওই ওদের ওখানে পড়লাম। সবাই শাড়ি পরে ছবি তুলবে তাই আশার আম্মু আমাকেও শাড়ি পরিয়ে দিল।”

অনি সোজা ঘরে ঢুকে গেল। সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে উত্তর শুনলো। অনি কে আরেক দফা দেখে আবার চমকে গেল সে। অনির স্বাস্থ্য একটু ভালো। একটু ভালো না, অনেক ভালোই। তাই ওমন পাতলা শাড়িতে তাকে যেন একটু বেশিই আর্কষনীয় লাগছিল। তবুও চোখ সরিয়ে নিল সে। এদিকে অর্নিলা জিজ্ঞেস করল, “ফারাজ ভাই? আপনি কতোদিন থাকবেন?”

“কেন? এটা কেন জিজ্ঞেস করছিস?”

”আমরা সবাই পিকনিকে যাবো,‌ তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। মানুষ গুনতে হবে তো, আপনি গেলে একজন ম্যামবার বাড়বে।”

সারফারাজ জবাব দিল না। হন হন করে ঘরে চলে গেল। অর্নিলা মুখ ভেংচি কাটল। এই ফারাজ ভাই হঠাৎ হঠাৎ কি মনে করে যে রাগ করে সে বুঝতে না। টেবিলের উপর থেকে টিস্যু নিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে সে ঘরের দিকে গেল। আর জোর গলায় ডাকতে লাগল,‌ “মামনী! মামনী! আমি এসে পড়েছি।”
.
সারফারাজ এসেছি দিন দুয়েক হলো। তার আসার খবর শুনে ফরহাত এসে হাজির। দুই ভাই জমিয়ে আড্ডা দিবে। এর মধ্যেই খবর আসলো, শিকদার বাড়ি থেকে খবর এসেছে। ইয়াতিম শিকদারের‌ বড় ছেলে তারেক শিকদার খবর নিয়ে এসেছে। সারফারাজ এখানে আসার খবর সেই বাড়িতে ইতিমধ্যে চলে গেছে। তারেক এসেছে অর্নিলা আর তার স্বামী কে দাওয়াতে দিতে। কিছুদিন যেন তাদের বাড়িতে গিয়ে বেড়িয়ে আসে। এমন অদ্ভুত দাওয়াতে সারফারাজ একটু অবাকই হলো। ফরহাত হেসে হেসে বলে উঠল, “আরে তোকে ডাকছে কারণ আছে। তুই গেলে অর্নিলা ওই বাড়িতে যেতে পারবে। নাহলে তো অর্নিলা কে একা ওই বাড়িতে যেতে দেওয়া হয় না।”

“এখন না গেলেই বা কি হয়? যাবার দরকার নেই।”

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরিফ হাসান সহজ গলায় বললেন, ”যেতে হবে। না গেলে এই নিয়ে পরে আলাপ আলোচনা হবে। সবাই ভাববে আমরা অর্নিলা কে আটকে রেখেছি। তিল থেকে তাল বানাতে বেশি সময় লাগবে না। আমার কথা তুমি বুঝতে পেরেছো ফারাজ!”

বাবার মুখের উপর কথা বলল না ফারাজ। ফরহাত হেসে মিনমিনিয়ে বলল, “ভালোই তো হলো ব্যাটা। বিয়ের পর তো কোথাও ঘুরতে যেতে পারলি না, ধরে নে এটাই তোর হানিমুন!”

”চুপ করবি তুই।”
ফরহাত চুপ করবে কি? মুখ টিপে হাসতে লাগল। বাবা আচমকা জিজ্ঞেস করে উঠ’লেন, “কি ব্যাপার ফরহাত? তুমি হাসছো কেন?“

“কিছু্ না আংকেল, ওই এমনি।”
আরিফ হাসান ছোট ছোট চোখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বের হয়ে গেলেন। এই ছেলেকে তার পছন্দ আবার পছন্দ ও না। মাঝে মাঝে বড়দের সামনেই বেফাঁস কথা বলে ফেলে।
.
পরদিন অর্নিলা কে সাথে নিয়ে শিকদার বাড়িতে পৌঁছাল সারফারাজ। তারা আসাতে বাড়ির সবাইকে মহাখুশি দেখালো। সায়মা ভাবী এসে অর্নিলার থুতনিতে চুমু খেয়ে আদর করলেন। লাজুক স্বরে বললেন, ”কি ব্যাপার অনি? বর কে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেলে?”

অর্নিলা হাসল। সারফারাজের সামনে ইয়াতিম শিকদার। দুজনেই চাচা কে সালাম দিলো। সায়মা অর্নিলা কে নিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। সারফারাজ কে নিয়ে চাচা বসলেন বসার ঘরে। ফারাজ‌ বার বার আড়চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কোনভাবে নিয়াজ কে দেখা যায় কি না সেটাই দেখার চেষ্টা করছে। নিয়াজ কে আশপাশ পাওয়া গেলো না।‌ চাচার সাথে দুটো কথা বলে সারফারাজ ঘরে ঢুকল। দেখল অর্নিলার হাতে আবারও একটা শাড়ি। গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি। সে আবারো খুশিতে আটখানা হয়ে বলল,‌“‌ফারাজ ভাই, দেখেন ভাবী আমায় এই শাড়িটা দিয়েছে। সুন্দর না!“

“হ্যাঁ খুব সুন্দর! যাও ব্যাগে রেখে দাও।“

”কি ব্যাগে রেখে দিবো। এটা পড়ব এখন!”

সারফারাজ ভাবতে লাগল। সেদিন আচমকা অর্নিলা কে শাড়ি পরা দেখে তার মনে যেই অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল অন্য কোন ছেলের যে তেমন অনুভূতি হবে না তার গ্যারান্টি সে দিতে পারছে না। অর্নিলা সুন্দরী! মোটাসোটা মেয়েটা শাড়ি পরলেই আরো বেশি সুন্দর লাগে। তখন যেকোন ছেলেরই তাল সামলানো মুশকিল হতে পারে। আর এই বাড়িতে তো নিয়াজ স্বয়ং উপস্থিত। কোনভাবেই অর্নিলা কে শাড়ি পড়তে দেওয়া যায় না। সারফারাজ বারণ করে দিল। বলল, ”তুমি তো শাড়ি পরতে পারো না অনি। এটা এখন রেখে দাও, বাসায় গিয়ে মা পরিয়ে দিবে।” যখন অনি কে বুঝিয়ে কোন কথা বলতে যায় তখন ”তুমি” শব্দটা আপনাআপনি চলে আসে। অর্নিলাও লক্ষ্মী মেয়ের মতো মাথা দুলালো।

সারফারাজ ফ্রেশ হয়ে আবারো বেরিয়েছে। ইয়াতিম শিকদার ডেকে খবর পাঠিয়েছে। সারফারাজের কেবল মনে হচ্ছে ইয়াতিম শিকদার তাকে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। কিন্তু সেটা কি? অনির সম্পত্তি বিষয় কিছু?

তার খয়েরী রঙের শার্টটার হাতা ফ্লোট করতে করতে সারফারাজ বেরিয়ে গেল। এই বাড়িতেও এর আগে একবার এসেছিল সে। এই বাড়িটাও খানিকটা তাদের বাড়ির মতোই। তবে তাদের বাড়ির মতো বিশাল বড় না। তার চেয়ে একটু ছোটই হবে। আর তাদের বাড়ির পিছনে কোন দিঘি নেই কিন্তু এই বাড়ির পিছনে আছে। এই দিঘি টা তার খুব ভালো লাগে। ভাবছে বাবা কেও বলবে তার বাড়ির পিছনে একটা দিঘি বানাতে। সেখানে ভালোই জায়গা আছে।

চাচার সাথে বসে পড়ল ফারাজ। তার হাতে‌ চায়ের কাপ।‌সামনে‌ নানা ধরণের কেক, মিষ্টি, বিস্কুট। সারফারাজের কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ আগেই দুপুরের‌ খাবার খেয়েছে।‌ বিকেল ও প্রায় হয়ে গেছে। চাচা কিছু কাগজপত্র নিয়ে তার পাশে এসে বসলেন।‌ এগুলো সারফারাজের হাতে দিয়ে বললেন, “এগুলা সব হইতাছে অর্নিলার সম্পত্তি। কোথায় কি আছে না আছে? কতোটুকু আছে? সবকিছু এই কাগজে লেখা আছে বাবা‌! এতোদিন আমি সব দেখছি এবার তুমি দেখবা!”

”কি দরকার চাচা, আপনি যখন এতোদিন দেখছেন এখনো দেখেন। এসব নিয়ে আমার কোন ইন্টারেস্ট নাই।”

চাচা দাঁত বের করে হাসলেন। ছেলের তারেকের দিকে ফিরে বললেন, ”শুনছোস কথা। না বাবা,‌ এসব এখন তোমাগো দায়িত্ব। তোমরাই বুঝো। দেখি মিষ্টি খাও। খাও না কেন? তুমি এই বাড়ির জামাই। এই তারেক,‌‌তোর বউরে ক, আরো কয়টা মিষ্টি আনতে।”

”দরকার নাই চাচা। আমি অনেক খেয়েছি আর না। এরপর খেলে বদহজম হয়ে যাবে। আমি ঘরে গিয়ে একটু রেস্ট নেই!”

উঠে দাঁড়াল সারফারাজ। চাচার হাতের দিকে তাকাল সে। কাগজপত্র সব যেভাবে শক্ত হাতে ধরে আছে মনে হচ্ছে না তাকে কিছু দিবে। কিন্তু এমনভাবে বলল যেন এই দিয়ে দিচ্ছে। কি অদ্ভুত মানুষ জন। তাদের কি কম কিছু আছে নাকি? অনি কে দেখেশুনে রাখার মতো যথেষ্ট আছে! কথাগুলো ভেবে ঘরের দিকে আগালো সে। কিন্তু একি? ঘরের দরজায় বাইরে এ কেন দাঁড়িয়ে? ঘরে কেমন উঁকিঝুঁকি মার/ছে মনে হচ্ছে।

সারফারাজ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। ধরতে সময় না এটা নিয়াজ। কিন্তু ও ঘরে উঁকি দিয়ে কাকে দেখছে? অনি কে! মাথায় র/ক্ত চড়ে গেলো ফারাজের। সে দ্রুত আচমকা নিয়াজের কলার চেপে ধরল। ধপাস করে দরজা খুলে দিয়ে থতমত সে। তার অক্ষিগোলাক দুটি স্থির হয়ে গেল। অর্নিলা হা হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল সে।‌ ঘন ঘন শ্বাস ফেলে তাকাল নিয়াজের দিকে। নিয়াজের চোখমুখে ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে। রা/গে ফারাজের মাথা ভন ভন করছে। কয়েকটা চড়ে/র চো/টে নিয়াজ থড়মড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। ফারাজে ইচ্ছে করল একটা লা/থি মা/রতে শয়/তানটাকে। এর মধেই ইয়াতিম শিকদার,‌ তারেক আর সায়মাও ছুটে এসেছে। সারফারাজ কোমরের বেল্ট খুলেই বেথ/র পেটা/তে লাগল নিয়াজকে। নিয়াজের আর্ত/নাদ পুরো শিকদার বাড়ি জুড়ে। সকলে হত’ভম্ব হয়ে দেখছে। ফারাজের এই রূ/প কারো জানা ছিল না। সে বে/ঘোরে শুধু মে/রে যাচ্ছে!

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-০৪

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৪

আমি সারফারাজ শেহদাত। বয়স ২২ ছুঁয়েছে। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করছি ঢাকা মেডিকেল এ। পাক্কা দু বছর বাদে আমার ইর্ন্টানশিপ শুরু হবে। তাই পড়াশোনার ভীষণ চাপ। এই চাপের মধ্যেও মোহনগঞ্জ এসেছি পরিবারের সাথে দেখা করতে। যদিও আসা হয় না। তবুও এই বছরের মধ্যে আমার একটু বেশিই আসা হয়েছে। প্রথমবার এসেছিলাম মাস তিনেক আগে। হঠাৎ শামসের শিকদারের মৃ/ত্যু খবর পেয়ে। এসে দেখি তাদের পুরো বাড়ি নিশ্রান্ত। তাদের বাড়ি এ যুগের। এই যুগের কেন বলছি? কারণ আমাদের বাড়ি আদিযুগের। এ বাড়ি বিশাল বড় আর জমিদারি একটা গন্ধ পাওয়া যায়।‌‌আমার বংশের কেউ জমিদার ছিলেন না। আমার দাদা মশাই কোন এক জমিদারের থেকে কম দামে বাড়িটি কিনতে পেরেছিলেন। এরপর আবার সেই বাড়িতে অনেক কাজ হয়েছে। বাইরে দেখে এ যুগের মতো মনে হলেও ভেতরে আদিকালের ব্যাপারট রয়ে গেছে। যেমন আমার চিলেকোঠার সিঁড়ি গুলো এখনো কাঠের সিঁড়ি। বিশাল বড় বড় ঘর। আগের যুগের পুরনো ফার্নিচার। বাড়ির চারপাশে‌ বড় বড় গাছ। গাছের সংখ্যা বেশি নেই তবে যা আছে নেহাত মন্দ না। আর শামসের শিকদারের বাড়ি এ যুগের মানে উঁচু ভবনের বাড়ি। এ ভবনের দ্বিতীয় তলায় তাদের বসবাস বাকি গুলো ভাড়ায় চলে। তিনি বিশাল ধনী ছিলেন, হ্যাঁ আমাদের চেয়েও অবশ্য। তাই মৃ/ত্যু শোকে মানুষের অভাব কম হলো না। তার একমাত্র কন্যা অর্নিলা অথৈ কে দেখছিলাম বাবার লা/শের পাশে বসে কাঁদতে। চিৎকার করে কাঁদে মেয়েটা। আগে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখেনি কিংবা ওর ক্ষেত্রে কখনো মনযোগ দেই নি। মাঝে মাঝে মনে হতো মেয়েটা একটু ঢং করেই চিৎকার করে কাঁদে। সেদিন ওর কান্না দেখে মনে হলো ও সত্যিই বড়ো দুঃখ পেয়েছে। মনের গহীনে বিষণ্ণতা ভরে উঠল। মন চাইল, আমি নিজে গিয়ে ওর কান্না থামিয়ে দিই। মেয়েটা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে।

দিন দুয়েক বাদে ফেরত এলাম। ঈদ উপলক্ষে আবার যাওয়া। কুরবানী ঈদ, না গেলেই নয়। নিজের বাড়িতে কুরবানী দেওয়ার একটা বিশাল ব্যাপার থাকে। আত্নীয় স্বজন সবাই আসে। গরুর হাটে যাওয়া, সকলে সেখান থেকে গরু কিনে ফিরে আসা বড় মস্ত ব্যাপার।‌ রোমাঞ্চকর এসব মূহূর্তের লোভ সামলানো সম্ভব হয়নি। অথচ এই সপ্তাহ খানেক বাদেই আমার টার্ম এক্সাম। হেলাফেলা করার সময় নেই একদম। আজ না ফিরলেই নয়।

তবে এবার বাড়ি এসে ভীষণ বড় এক কাণ্ড ঘটল। আমার বিয়ে হয়ে গেল,‌ কি আশ্চর্য ঘটনা। অথচ বিয়ের কয়েক ঘণ্টা আগেই আমাকে জানালো হলো আমার বিয়ে। বিয়ে নিয়ে তেমন কোন উন্মাদনা নেই আমার মাঝে,‌থাকার‌ কথাও না। মনে হলো এটা নামমাত্র একটা বিয়ে। রাত এখন বাজে সাড়ে ১১ টা। ১১ টা ৪৫ এ ট্রেন ছাড়বে। পুরো ট্রেনের কেবিনে আমি একা। একা থাকতে আমার ভালো লাগে, পুরোপুরি ইন্ট্রোভার্ট স্বভাব আমার নেই কিন্তু আবার বেশি মিশতেও ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ আগেই আমার বাবা আর চাচাত ভাই ফরহাত আমায় বিদায় দিয়ে বাড়ির জন্য রওনা দিয়েছে। ট্রেনের এক কোনে আমি একা বসে। গরম লাগছে। তবুও ফ্লাক্স থেকে গরম গরম চা বের করে চুমুক দিলাম। বেশি গরম লাগলে গরম চা খেতে হয়। বি/ষে বি/ষে বিষক্ষয়।

একা কেবিনে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছি। গায়ে পাতলা একটা চাদর। নিভো নিভো আলো জ্বলছে। অথচ এখন আমার এখানে থাকার কথা ছিলো না। উচিত ছিল একটা সুন্দর ঘরের। যেই ঘর পুরো ফুলের গন্ধে ম ম করবে। সাদা বিছানা জুড়ে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। কোন এক রমনী বিছানার মাঝে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি তার কাছে যাবো, পাশে বসে গল্প করব। কোনো এক বাহানায় তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করব, হুট করে তার কোলে মাথা রাখব, প্রেম প্রেম স্বভাব না থাকলেও তখন মন ভরে প্রেম জাগত হবে। খুব দুষ্টু মিষ্টি কথা বলে তাকে হাসাব। মেয়ে হাসলো মানেই ফাঁদে পড়ে গেল। একটা সুন্দর প্রেমের সূচনা আমার হতেই পারত কিন্তু এমন কিছু হলো না। যার সাথে বিয়ে হলো তাকেও আমার বিশেষত পছন্দ নয়। অপছন্দের কারণ সে নয়,‌তার বাবা! তার বাবার চরিত্র কখনোই ভালো ছিল না। বিভিন্ন নারীর সাথে তার অবৈধ মেলামেশা আর সম্পর্ক। বৃহৎ ধনী হবার এই যেন এক লাভ। নিজের ফুফু কে কখনো সুখী দেখতে পাই নি। প্রায়ই দেখতাম আমাদের বাড়িতে এসে মায়ের পাশে বসে কাঁদত। তার কান্না আমায় বড্ড পীড়া দিত।‌ কিছুদিন পর পরই ফুফার সাথে ঝগড়া করে ফুফু আমাদের বাসায় এসে আশ্রয় নিতেন।

ছোট থেকেই আমি ভীষণ লাজুক অথচ আমার ফুফু
কাছে আমি অনেক মিশুকে। ফুফুর সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যেত। আমার মনে আছে, একবার ফুফু হাসতে হাসতে আমায় বলেছিলো, “শোন বাবা! আমি যদি ম/রে যাই তাহলে তুই বড় হয়ে আমার মেয়ের দায়ভার নিবি!“ কথাটা তখন নেহাত আমি বুঝি নি। পেছন ফিরে দেখি অনি একটা খেলনা গাড়ি নিয়ে আরাফাতের সাথে ঝগড়া করছে। আরাফাত হচ্ছে তার চোখের বালি। কোনদিন তাদের মিশ খায়নি, অথচ দিনশেষে সেই আরাফাতের সাথেই তার অনেক ভাব। সেই ঘটনার পর ফুফু আর একদিন ও বাঁচে নি। রাতেই তার মৃ/ত্যু সংবাদ আমায় নিস্তব্ধ করে দিলো। আমার খুব মনে আছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমি দেখি তখন সবে ১ টা বাজে। মা ঘরের আলো জ্বালাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ছোটাছোটি, কান্না কাটির আওয়াজ। ফুফু আমাদের সেই আদিমযুগের বাড়ির একটা কোনের ঘরে ফ্যানের সাথে ঝু/লে ছিলেন। আরাফাত আমার পাশেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মায়ের কোলে অর্নিলা সেই তার বিখ্যাত ভঙিতে কাঁদছে। মায়ের মৃ/ত্যু কি তখনো বোধহয় সে বুঝে না, তাহলে কেন কাঁ/দছিল? মায়ের কান্না আমার অবাক করেনি, অথচ বাবার চোখে অশ্রুজল আমায় হতবাক করেছিলো। কখনো তাকে কাঁদতে দেখেনি আমি। সেই ঘরটাই আজ বাবার স্টাডি রুম, বিশাল বিশাল কাগজপত্র দিয়ে ভরা সেই ঘর, দিনের বেশির ভাগ সময়ই সেই ঘরে সময় কাটান তিনি। বোনকে কতো ভালোবাসতেন এরপর বোধহয় আর বলার প্রয়োজন নেই। সেই কাঁদো মেয়েটাকে মা আমার বিছানার উপর রেখে চলে গেলেন। দায়িত্ব দিয়ে গেলেন আমাকে। অর্নিলা আমার বিছানার উপর বসে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে। সেদিন প্রথমবারের মতো তাকে আমি আগলে নিয়েছিলাম। জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। সেটাই প্রথম আর সেটাই শেষ। এরপর আর কখনো তাকে আমি অমন আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ধরেনি। অমন করে স্নেহ দোরে তাকে আবদ্ধ করেনি। তার উপর আমার অদ্ভুত এক রা/গ জন্মাতে লাগল।

কারণ ছিল তার বাবা! তার বাবা একজন চরি/ত্রহীন পুরুষ। কাপুরুষ! অথচ সেই কাপুরুষের মৃ/ত্যুতে সেই মেয়ে কাঁদছিলো। আমার রাগ হচ্ছিল। আমার জীবনে তার বাবার চেয়ে বেশি ঘৃ/ণা আমি কাউকে করি নি। অথচ অর্নিলা তার জীবনে হয়তো তার বাবার থেকে বেশি ভালো কাউকে বাসে নি। কি অদ্ভুত অমিল আমাদের। বাবার রক্তই তার শরীরে বইছে। আচ্ছা,‌ সেই কি তার বাবার মতোই হবে? তাদের তো একই বংশ! নিয়াজের সৎচরিত্র আমায় অবাক করেনি। জানা ছিল এমনই হবে। তাদের বংশ কলু/ষিত, নিচ, জ/ঘন্য! পুরো একটা বদ্ধ জলাশয়! এই জলাশয়ে কোন পদ্মফুল ফুটতে পারে না। অর্নিলার থেকে এমনটা আমি আশা করি না। তবুও তাকে পুরোপুরি ঘৃণা করতে পারি না। আমি বোধহয় মাঝামাঝি আছি। না পারছি তাকে পুরোপুরি ঘৃণা করতে না পারছি ভালোবাসতে। কারণ দিনশেষে আমিও আমার ফুফুর একটা ছায়া তার মধ্যে দেখতে পাই। তবুও যদি অর্নিলা আমায় ঠকায় তবুও আমি অবাক হবো না। মেনে নিবো, এটা তার বংশের রোগ, ডিএনএ বলেও তো কিছুই আছে! আনমনে হেসে উঠলাম। অনেক ভাবা হয়েছে আর না। ঘুমাতে হবে। ফোনের মধ্যে এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
সারফারাজ হলে থাকে না, থাকে ভাড়া বাড়িতে। কলেজ থেকে সেই বাসা দূরে নয়। চিৎকার চেঁচামেচিতে তার পড়া হয় না। যখন সে পড়তে বসে তখন চারদিক থাকতে হবে নিস্তব্ধ। তার সমস্ত মনোযোগ থাকে পড়ার মধ্যে। সেই ঘটনার পর দিন পেরিয়ে গেছে। গেছে মাস পেরিয়ে। পড়াশোনার সাথে অধিক ভাব হবার সুবাধে সবার থেকে তার যোগাযোগ অনেক দূরে। ওই রোজ একবার মা ফোন করে খবর নেয়, বাবা ফোন করে পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করে। ব্যস, এতেই সমাপ্ত। কখনো অর্নিলা তাকে ফোন করে কিছু জিজ্ঞেস করেনি, কথাও বলেনি। সেও ফোন করেনি। করার দরকার পড়েনি অবশ্য। রেজাল্ট বের হবার পর আরাফাত একবার ফোন করেছিলো। দুজনেই গোল্ডেন পেয়েছে। বেশ, ভালো! এমনটা আশা করেনি। আরাফাত ভালো ছাত্র হলেও অর্নিলা থেকে কখনোই আশা করা যায় না। অর্নিলা কর্মাসের স্টুডেন্ট আর আরাফাত সাইন্সের। পড়াশোনার সাথে আরাফাতের যতোটা ঘনিষ্ঠতা ঠিক ততোটাই দূরত্ব অর্নিলার সাথে। সারফারাজ তো মুখ বাঁকিয়ে মনে মনেই বলল, “এই মেয়ে পেয়েছে গোল্ডেন! নিশ্চিত পাশে কোন ভালো মেয়ে পড়েছিল। দেখে দেখে লিখেই পাশ করেছে। তা আর নয়তো কি?” সারফারাজ তো নিশ্চিত ছিল, এই মেয়ে ডাব্বা মারবে নয়তবা খুব কষ্টে পাশ করবে। তার এই বিরাট অর্জনে সে একটু বিস্মিত!

ভালোই মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। সারফারাজের তৃতীয় ফেইজ শেষে এবার চতুর্থ ফেইজে পর্দাপণ। এই তো শেষ বছর। কোনমতে এবার দেড়টা বছর কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। ইদানিং পড়াশোনা থেকেও কেমন এক বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। শুভ একথা শুনে ব্যঙ্গ করে হাসল। শাহাদাত তাচ্ছিল্য করে বলল, “বললি বেশ! গ্রেট সারফারাজ শেহদাতের নাকি পড়াশোনায় বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। আয় হায়, এ কি কাণ্ড। দেশবাসী তবে যে এক জ্ঞানীর ছায়া থেকে বিতারিত হলো!” শাহাদাত অনেক কটুক্তি করে। অট্টহাসিতে মেতে উঠল সে। যোগ দিল শুভ নিজেও। বলে উঠল, ”দেখবি, বেশিদিন আর দূরে নেই। খুব জলদিই তুই বড় ডাক্তার হয়ে যাবি। কতো বড় সার্জেন্ট! আর আমরা হবো তোর চ্যালাবেলা!”
আবারও কটাক্ষ! তবু যতই কটাক্ষ করুক, সারফারাজের আর বন্ধু নেই এই দুটি কয়েক ছাড়া। তাদের কথা সে হেসেই উড়িয়ে দিল। তারা তিনজনই নীলক্ষেত থেকে বই কিনে বের হলো। শাহাদাত তার ঘাড়ে হাত রেখে বলে উঠল, “কি ব্যাপার ব্রাদার! এই না পড়াশোনায় বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। এখন দেখি বইপত্র কিনে ফেললি!“

“তোদের চ্যালাবেলা বানাতে হবে না, তাই এই কাজ!”

শুভ চিকনস্বরে বলল, “ওই বিতৃষ্ণা না ছাই! বাড়িতে নতুব বউ রেখে এসেছে। ব্যাটার তর সইছে না। হয়েছে আমরা সব বুঝি। উত্তেজনায় চেক কর ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলো কি না!” সারফারাজ কথা বাড়াল না। শাহদাত ফিসফিসিয়ে বলল, “কি হলো? চুপসে গেলি যে!”

“কিছু না। আমার একটু ওয়েদার চেঞ্জ দরকার। এছাড়া আর কিছু না!”

“তাহলে চলে যা বাড়িতে। দেখে আয় বউকে।”

“না, মোহনগঞ্জ যাবো না। অন্য কোথাও যাই। চল!”

“দেখা যাক, সবাই আমাদের ব্যাচের সবাই নাকি কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছে। দেখি কি প্ল্যান করে তারা। আমারও গা ম্যাচ ম্যাচ করছে। একটা টুর দেওয়া দরকার।”

শাহাদাত বলল, “এ কথা স্যার কে বললাম। স্যার বলল হাসপাতাল পুরোটা দর্শন করে আসো। মন না ভরলে মর্গে যাও। মৃত/দেহ দেখলে শরীরের আচমকা যেন আ/গুন ধরে যায়, তোমারও তাই হবে! নারীর মৃত/দেহ দেখো না বটে, আমি সেটা দেখতে বলি নি!”

সারফারাজ হেসে উঠলো। শুভ ও হেসে উঠল জোরে। শাহাদাত মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “স্যার যে আমায় কি ভাবে, বুঝলাম না!”
.
তিনবন্ধু জট পাকিয়ে গেলো টিএসসির মোড়ে। দুপুরের খা খা রোদ্দুর। রাস্তাঘাটে তেমন লোকজনের ভিড় নেই। একদল কলেজ ড্রেস পড়া মেয়েরা রাস্তার ধারে দিয়ে যাচ্ছে। চোখ পড়ল শহীদ মিনারের দিকে। কয়েক জোড়া ছেলেমেয়ে একসাথে ঘুরছে। মিলেমিশে ছবি তুলছে। ছবি তুলতে গিয়ে গায়ের উপর প/ড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য কারবার। কোন ফাঁকে ছেলেটা মেয়ের কোমরে হাত রেখে ছবি তুলে ফেলল বোঝা গেল না। মেয়ে হাসছে, কিছু বলছে না। সারফারাজ কপাল কুঁচকে ফেলল। শাহাদাত বলল, “এই হচ্ছে নতুন জেনারেশন! কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরাঘুরি। বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, বেস্ট ফ্রেন্ড আর কতো ফ্রেন্ড!”

শুভ বলে উঠল, “কলেজে উঠেই সব উড়নচণ্ডী হয়ে যায়। কলেজে প্রথম বছর তো, উল্লাসে কাটাক। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পড়াশোনার উপর আছাড় খেয়ে পড়বে।”

সারফারাজ ভাবছিলো অন্যকিছু। শাহাদাত আচমকা বলল, ”কিরে ফারাজ! তোর বউ ও তো এবার কলেজে। তা ওর খোঁজখবর নিস তো ঠিক করে। এখনকার যা দিন, দেখিস তোর পিচ্চি বউ না আবার কোন ছেলের ফাঁদে পড়ে যায়।”

সারফারাজ মুখ বাঁকিয়ে বলল, ”সে যাক। জেনেশুনে কেউ নিজেকে বলীর বা/করা বানায় না!”

“কথা শুনে মনে হচ্ছে তোর বউ বহুত ডেঞ্জা/রাস পাবলিক!”

“তা আর বলতে। ছোট মরিচে ঝা/ল বেশি। ওর যা তেজ। ওকে ঘুরাবে কোন ছেলে? এমন সাধ্যি আছে কজনের!”
সহসা কথাগুলো বলে দিলেও মনে একটু ঘটকা লাগল যেন কোথায়। বাসায় ফেরবার পর মনে পড়ল,‌ অর্নিলার কোন ব্যাপারেই তার জিজ্ঞেস করা হয়নি। কোন কলেজে ভর্তি হয়েছে, পড়ালেখা কেমন চলছে এসব কিছু!” বইয়ের স্তূপ গুলো টেবিলে রেখে ফোন হাতে নিল। মায়ের নাম্বার ডায়াল করার পরেও আরাফাত কল করল। আরাফাত ফোন রিসিভ করেই সালাম না দিয়ে বলে উঠল, ”হ্যাঁ বল!”

“বল‌ মানে? সালাম দিতে জানিস না?”

“ওহ আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া। বল এবার কি হইছে?”

“খুব ব্যস্ত নাকি?”

“হ্যাঁ, কোচিং আছে। আমি এখুনি রেডি হয়ে বের হবো।”

“কলেজ কেমন হচ্ছে তোর?”

“ভালোই হচ্ছে।”

“ভালো মতো ক্লাস করছিস তো। রোজ ক্লাস হয়?”

”হ্যাঁ হয়!”

“অনির পড়ালেখার কি খবর?”

“আমি কি করে জানব ওর পড়ালেখার কি খবর? আমি কি ওর কলেজে পড়ি নাকি?”

“কেন? তুই কোন কলেজে?”

“আমার তো বয়েস কলেজ আর ওর হচ্ছে গার্লস কলেজ। এভাবেও বুড়ির পড়ালেখার খবর আমি জানি না। নতুন ফোন পেয়ে সারাদিন ফোন নিয়ে গুঁতোগুতি করে!”

“ও নতুন ফোন পেয়েছে?”

”হ্যাঁ, কেন তুই জানিস না। আমি নাম্বার মেসেজ করে দিই, ওর খবর ওর থেকে নে। আমি রাখলাম!”

বলেই ধপ করে ফোন কেটে দিল।‌ বাবা মহাব্যস্ত সকলে। সারফারাজ ফোনটা টেবিলে রেখে ভাবতে লাগল, অনি ফোন পেয়েছে! কই? তাকে তো কেউ বলল না। আর সারাদিন ফোন নিয়ে গুঁতোগুতি কিসের? কার সাথে আবার কথা বলে এতো! কই? তাকে তো কখনো ফোন করে নি। এর মধ্যে টুং টুং শব্দ এলো। আরাফাতের মেসেজ এসেছে। অনির নাম্বার পাঠিয়েছে সে!

#চলবে….