পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। ইয়াতিম শিকদার শুধু পারেনি তাদের শাসিয়ে যেতে। যেভাবেই হোক না কেন, তার ছেলের এমন হাল যে করেছে তাদের খুঁজে বের করতেই হবে। যেভাবেই হোক। পুলিশ কমিশনার সালাউদ্দিন সাহেব কে এই অবধি বোধহয় ৫ বারের মতো ফোন করে ফেলেছেন। সালাউদ্দিন সাহেব রেগে এখন আর ফোন তুলছেন না। ঘটনাটি খুব মর্মা ন্তিক, ছেলের এমন অবস্থায় বাবার অস্থির হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তারাও তো বসে নেই। নিয়াজ শিকদারের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল ও তারা পরিদর্শন করেছে। লাভ হয়নি তেমন। গতরাতের বৃষ্টির পানিতে সব ধুয়ে মুছে গেছে। হতে পারে খু’নির পরিকল্পনীয় ঘটনা। তবে বৃষ্টি আসার ব্যাপারটা কাকতালীয়। নাকি পুরো ঘটনাই কাকতালীয়। মে রে ফেলার ইচ্ছে হলে পুরোপুরি মে রে ফেলতে পারত। আধমরা করে রেখে কোন লাভ হয়নি। নিশ্চিত কোন নেশা ঘোর গাড়ি চালিয়ে আচমকা তু লে দিয়েছে। হ্যাঁ, এটাই হবে হয়তো। কিন্তু ধারণার উপরে সব কিছু ছেড়ে ফেলা যায় না। মিস্ট্রি! জল অনেক ঘোলাটে। নিয়াজ শিকদারের কথাবার্তা আরো অস্পষ্ট। কোথায় গিয়েছিলো? কোথা থেকে এলো কিছুই জানা গেলো না। সালাউদ্দিন সাহেব ফাইল ঘাটছে। ভিক্টিমরা এখানকার নয়। ছেলের বিয়ে ঠিক করতে এখানে এসেছিলো। যাক বিয়ে ঠিক হলেও বিয়ে হবার অবস্থাতে নেই। হাসপাতালে ফোনের মধ্যেই বিয়ে ক্যান্সেল। এক্সি ডেন্ট হতে দেরি বিয়ে ভাঙতে দেরি নেই। সাব্বাস। বিপদে পড়লে মানুষ চেনা যায়। এখানে চেনা জানার মধ্যে আছে কেবল এক আত্মীয়র বাড়ি, যেখানে তারা থাকার জন্য ছিলো। আর এক হচ্ছে ভাইয়ের মেয়ের বাসা। যেখানে তারা দুজন দম্পতি থাকে। ঘটকা লাগার মতো কিছু পাচ্ছে না, অথচ ঘটকা থাকার মতো অনেক কিছু্ই আছে। এই যেমন, সারফারাজ শেহদাত। পেশায় একজন ডাক্তার। ছেলের চাচাতো বোনের জামাই। তাকে দেখে কেমন সন্দেহ হলো। অথচ কোন প্রমাণ নেই। এতো বড় ঘটনায় ভদ্রলোক একদম নিষ্প্রাণ। এখানে খোঁজাখুঁজি করে কোন লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এখানে তেমন কিছু নেই। আশেপাশে সিসি ক্যামেরাও ছিলো না। মোক্ষম জায়গায় মে রে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার বলছে খু ন! হ্যাঁ, খু নের চেষ্টা। এরও কারণ আছে বৈকি। গাড়ি চা পা দিয়ে সোজা চলে যায় নি। আবারো ব্যাক এসেছে। এ কারণে ঘটনাস্থলেই তার পা দুটো আ লাদা হয়ে গেছে। প্রাণে বেঁচেছে এই ঢের। ঢের বলে কি লাভ? কোন ভবিষ্যৎ নেই। কে জানে কত্তদিন এভাবে বসিয়ে খাওয়াবে। দুদিন পর দেখা যাবে মসজিদের সামনে চেয়ার বসিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে!
সন্দেহের তালিকায় আরো আছে। নিয়াজের ভাবী! ভদ্রমহিলার নাম মনে পড়ছে না। হাসপাতালে আসার পরপরই কান্নাকাটি শুরু। ম রে তো যায় নি তবুও ম রা কান্না। এযেন দেখানোর জন্যই কাঁদছে। ভিতরে ভিতরে সমস্যা আছে। সম্পত্তির বিষয় হতে পারে। আবার নিয়াজের বিয়ের কথা চলছে। হতে পারে প্রাক্তন প্রেমিকা রেগে গিয়ে এমনটা করেছে। হতেই পারে, এই পৃথিবীতে কি আবার অসম্ভব। খোঁজ আরো চালাতে হবে। মোহনগঞ্জ যেতে হবে। নিয়াজের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল। পেটে কিছু পরেনি। এবার লাঞ্চ সেরে ফেলা দরকার। যাক উঠতে যাবে,আবারো ফোন বাজে। আবার কে? ওহ, ইয়াতিম শিকদার! থাকুক তার ফোন আর তুলছি না। কি ভাবে? পুলিশরা কি মিরাক্কেল জানে। ৮ ঘন্টার মধ্যে কেস সলভ করে দিবে? হুঁ! এতো সোজা নাকি! সময় লাগবে, ধৈর্য্য লাগবে। দই জমাত বাঁধলে খেতে মজা লাগে। পানসে দইয়ের সাধ আছে নাকি আবার? বেরিয়ে গেল সালাউদ্দিন সাহেব। ক্ষিধে এবার ভালো মতোই পেয়েছে!
.
সারফারাজ দীর্ঘ ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ঢুকল। অর্নিলা ঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। সেই ভোরে বের হয়েছিল। এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে। ক্ষিধেয় পেট চু চু করে করছে। সারফারাজ তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ফ্রেস হয়ে নে। খাবার তো কিনেই এনেছি। ওগুলো খেয়ে ফেলব।”
“গরম করে দেবো?”
“না, গরমই আছে। তুই ফ্রেস হয়ে নে। বেশি খারাপ লাগলে গোসল সেরে নে। তবে তাড়াতাড়ি!”
অর্নিলা মাথা দুলাল। সারফারাজ বাথরুমে ঢুকে পড়ল। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল সে। সারা শরীর ব্যাথা করছে। হাসপাতালে থাকলে যেন খুব ক্লান্ত লাগে। কেন লাগে সে জানে না! তবে ভীষণ ক্লান্ত। চোখ দুটো যেন গর্তের মধ্যে চলে গেছে। মুখে কালচে ভাব। কি কুৎসিত লাগছে দেখতে! আয়নায় নিজের মুখখানা দেখে বিরক্ত হলো। এগিয়ে যাবে অমনি ফোন বেজে উঠল। কার ফোন বাজে? ফারাজ ভাইয়ের! হাতে তুলে নিল ফোনটা। ডা. সাবিনা ইয়াসমিন! রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠসর। থামবার ফুরসত নেই। এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছে, ”ডা. শেহদাত। আপনি আজ হাসপাতালে এলেন না কেন? ইনফর্ম ও করেননি? কারণ কি? ডা. শেহদাত!আমার কথা শুনতে পারছেন? আনসার মি!”
”জি!
“কে?
”আমি। ড. শেহদাতের স্ত্রী বলছি।
”ওহ, হ্যাঁ একটু বরের দিকে নজর দিন। এতো উদাসীন হলে চলে না। কোন রিসপনসিবিলিটি নেই নাকি?
“দু্ঃখিত, আসলে আমার এক আত্মীয় এক্সিডেন্ট করেছিলো। সেখানে গিয়েছিলেন তো তাই আজ যেতে পারেনি।”
“গ্রেট! সেখানে গিয়ে অবশ্যই তিনি রোগীকে বাঁচায় নি। তেমন তো হবার কথাও না। ডাক্তার হিসেবে তাকে এখানে দরকার ছিলো নাকি ওখানে।”
অর্নিলা ভ্রু কুঁচকে নিল। এই মহিলা তো অনেক বকবক করে। ইচ্ছে করে ধপ করে একটা ঝারি দিতে। মাথা যন্ত্রণা উঠে গেছে তার কথা শুনে। বিরক্ত হয়ে সে ধপ করে ফোনটা কেটে দিলো। ওপাশে থাকা ডা.সাবিনা হত’ভম্ব হয়ে গেল। এ কি ধরনের অভদ্রতা। সে তো এখনো কথা শেষ করেন। আবারো ফোন করল ফের। আশ্চর্য! ফোনটাই বন্ধ করে দিয়েছে। রাগ চেপে নিল মনের মধ্যে। ডা. শেহদাতের দেখা পাক, তাকেই বোঝাবে।
খাবার টেবিলে দুজন বসে। অর্নিলা একটু খেয়ে আর খাচ্ছে না। সারফারাজ খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?”
“কিছু না। ভাবছি। খুব আশ্চর্য লাগছে?”
“কোন ব্যাপারে আশ্চর্য লাগছে?”
“এই হঠাৎ করে এক রাতের মধ্যে কতো কিছু হয়ে গেলো বলুন।”
“যে যেমন কর্ম করে, তেমন ফল পায়। কথাটা শুনেছিস।”
“হ্যাঁ, জানি।”
“তাহলে এসব ভাবা বন্ধ দিয়ে চুপচাপ খেয়ে নে। আমার ঘুমাতে হবে। কাল মেডিকেল ও যেতে হবে।
“তো আপনি ঘুমান। আমায় কেন বলছেন?”
“ আশ্চর্য! একা একা ঘুমাবো নাকি?”
“ঘুমাতে বুঝি সঙ্গী লাগে!”
”অবশ্যই লাগে। দু মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ করে ঘুমাতে আয়। দু মিনিট মানে দু মিনিট!
“না এলে কি করবেন ফারাজ ভাই? ঘরে ঢুকতে দিবেন না বুঝি?”
“তোকে তুলে নিয়ে যাবো।”
”অ্যাহ, আসছে। হইছে যান আপনি এখন।”
সারফারাজ খাওয়া শেষ করে উঠে রুমে গেল। অর্নিলা দ্রুত খাওয়া শেষ করল। যা ছিলো ফ্রিজে রেখে দিয়ে হাত ধুতে বেসিনের দিকে গেল। হাত ধুয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই চমকে উঠল। আচমকা সারফারাজ তাকে কোলে তুলে নিল। অর্নিলার দৃষ্টিতে বিস্ময় ঘেরা। সারফারাজ মিটিমিটি হেসে বলল, “বলেছিলাম নাহ, না এলে তুলে নিয়ে যাবো।”
অর্নিলা তার গলা জড়িয়ে ধরে হেসে উঠল। এই প্রথমবার ফারাজ ভাই তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। বেচারী শরমে প্রায় অস্থির হয়ে উঠল। কুণ্ডলী পাকিয়ে তার বুকের মধ্যে লুকিয়ে গেল। সারফারাজ তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
.
পরদিন মেডিকেলে ডা. সাবিনা পেশেন্ট দেখছে। পাশে সারফারাজ দাঁড়িয়ে থেকে খাতায় নোট করছে। লাস্ট পেশেন্ট। প্রায় গত দু ঘন্টা ধরে এই কাজ চলছে। পেশেন্ট দেখে কেবিন থেকে দুজন বেরিয়ে গেলো। দুজনেই পাশপাশি হাঁটছে। ডা. সাবিনা জিজ্ঞেস করলেন, ”আত্মীয় কেমন আছে? যার এক্সি ডেন্ট হয়েছিলো?”
সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ডা. সাবিনা কিভাবে জানল সে বুঝতে পারছে না। তিনি আবার শুধালেন, “কে এক্সি’ডে’ন্ট করেছে? আপন কেউ?”
”না, তেমন কেউ না। আমার স্ত্রীর চাচাতো ভাই।
”বেঁচে আছে?”
“হ্যাঁ, পা দুটো নেই।
“ওহ আচ্ছা।
অতঃপর ডা. সাবিনা নিজের কেবিনের দিকে গেলেন। সারফারাজ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। এই মিস্ট্রি সে সলভ করতে পারছে না। ফোন বের করে কললিস্ট ঘেঁটে দেখল। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। ডা. সাবিনা কল দিয়েছিল আবার কথাও হয়েছে! কখন? অনি কি তবে কথা বলল। হতে পারে। ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সে।
নিয়াজকে নিয়ে ইয়াতিম শিকদার মোহনগঞ্জ ফিরে গেছে আজ দুদিন। শুনল সেখানে তাদের সাথে কমিশনার সালাউদ্দিন ও গেছে। তদন্ত বোধহয় ভালো ভাবেই চলছে। তবে সারফারাজের কোন চিন্তা নেই। সে নিশ্চিতে তার রাতের খাবারের পর এক কাপ কফি বানালো। এই কফি শেষ করে ওই দিকের ঘরের দরজায় নক করবে। সেখানে অর্নিলা দরজা বন্ধ করে বসে আছে। দরজা খুলবে না। আজ নাকি সে আলাদা ঘুমাবে। কি অলক্ষণে কথা। মেয়েটার মাথায় সারাদিন কি যে ঘুর ঘুর করে সে জানে না। কফি টুকু শেষ করে দরজায় টোকা দিল। ওপাশ থেকে অর্নিলা বলে উঠল, “আমি দরজা খুলব না।
“তুই কি সত্যিই আমার সাথে ঘুমাবি না অনি?”
“না, আজ আমি একাই ঘুমাবো।
“কেন?”
অর্নিলা মুখে চানাচুর ঠুসে বলল, “কারণ , কাল আমার এক্সাম।”
“রাতভোর তুই পড়াশোনা করবি? একথা আমায় বিশ্বাস করতে হবে? দরজা খোল।”
“একদম না।
”বেশ, আমি তবে যাচ্ছি। আর সাধবো না তোকে।“
সারফারাজ চলে গেল। অর্নিলা দরজায় আড়ি পেতে শুনল। সত্যি সত্যিই কি চলে নাকি? মুখে চানাচুর চিবুতে চিবুতে দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিল। ওপাশে দরজায় সারফারাজ কে উঁকি মারতে দেখে তার বুক কেঁপে উঠল। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। দরজা খুলে সারফারাজ ঘরে ঢুকে গেল। আচমকা তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, “কি ভেবেছিলি? এতো সহজে ছেড়ে দিবো নাকি?”
“আপনি আমায় এভাবে ঠকালেন ফারাজ ভাই? না এটা হবে না।”.
“বসে বসে চানাচুর খাওয়া হচ্ছিল? এই না তুই পড়াশোনা করছিলি?”
অর্নিলা দাঁত বের করে হেসে বলল, “এই খেয়ে দেয়ে পেট শান্তি করে পড়তেই বসব।
“উহু হচ্ছে না সেটা।”
ফট করে কোলে তুলে নিল। অর্নিলা খুশি মনে তাল গলা জড়িয়ে ধরল। সারফারাজ তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, “তুই ইচ্ছে করে এমনটা করিস, তাই না! যাতে আমি তোকে কোলে তুলে নিই।”
অর্নিলা দাঁত বের করে হেসে মাথা দুলাল। সারফারাজ চোয়াল শক্ত করে বলল, ”বেশ, এরপর থেকে দেখিস কি করি?”
“কি করবেন ফারাজ ভাই?”
ফারাজ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসয়ে বলল, “সারাদিন যেন তোর কাউকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হয় সেই ব্যবস্থা করব।”
অর্নিলা কিছুক্ষণ চোখের পলক ফেলে পিট পিট করে চেয়ে দেখল। তার কান দিয়ে কেন মনে হচ্ছে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। ইশ, ফারাজ ভাই ইদানিং এমন এমন কথা বলে লজ্জায় সে ম রে যায়।
রাত তখন আড়াটে কি তিনটা। সারফারাজের বুকের মধ্যে জায়গা দখল করে ঘুমিয়ে আছে অর্নিলা। সেও ঘুম। কোন হুদিশ নেই। এর মধ্যেই ফোনের টুং টিং শব্দ। ঘুমের ঘোরে ফোনটা রিসিভ করে কানে কানের কাছে নিল। শুধালো, “কে?”
অর্নিলা রান্নায় ব্যস্ত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। ইদানিং তাদের বাসায় খুব গ্যাসের সমস্যা করছে। দুপুর হতেই গ্যাস প্রায় চলেই যাচ্ছে। এই নিভো নিভো গ্যাসে কিছু রান্না করা সম্ভব নয়। তবুও অর্নিলা সব গুছিয়ে রেখে দেয়। মানুষটা আসলে তাকে খেতে দিতে হবে। সে আজ অবধি খাবার নিয়ে কোন অভিযোগ করেনি। দেরি করে খেতে দিলে খেয়ে নিয়েছে। জিজ্ঞেস ও করেনি দেরি হলো কেন। বরং তাড়াহুড়ো দেখলে এসে হাত বাটায়। অনির ভালো লাগে। আবার দুঃখ পায়। ইশ! বাইরে থেকে করে এসেও লোকটা এখন ঘরেও কাজ করবে। ভালো লাগে না তার।
গ্যাস এসেছে সব মাত্র। তোড়জোড় করে রান্না করছে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। অর্নিলার চোখ মুখ চকচক করে উঠল। ফারাজ ভাই এসেছে! হ্যাঁ, কখনো কখনো এই সময়ও আসে। তরকারির চুলো কমিয়ে দিয়ে ছুট দিলো সে। সদর দরজা খুলে নিয়াজ কে কোনভাবেই আশা করেনি। কাজের চোটে শাড়িটাও এলোমেলো হয়ে ছিল। ঠিক করে নিল। নিয়াজের চোখ কোন দিক থেকে কোন দিক যাচ্ছে বোঝা মুশকিল। চোখে কালো সানগ্লাস। অনি অবাক হয়েছে বটে। থমথমে স্বরে বলল, “ভাইয়া আপনি!”
নিয়াজ আমতা আমতা করছিলো। বলল, “ওহ হ্যাঁ, ওই এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম দেখা করে যাই।”
অর্নিলা দু সেকেন্ড চুপ থাকল। বাসায় সে একা, কেউ নেই। নিয়াজ কে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। সবাই বলছে নিয়াজ ভাই বদলে গেছে। সত্যিই কি তাই। বছর পেরিয়েছে। সময় বদলেছে। মানুষের আচরণের কি পরিবর্তন হয় না। ঘড়ির দিকে ফিরে চাইল। ফারাজ ভাইয়ের আসার সময় হয়ে গেছে। ভয় খানিকটা কমছে। অর্নিলা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করল। বলল, “আসেন ভাইয়া ভেতরে আসেন।”
নিয়াজ পায়ের জুতো খুলে ঘরে প্রবেশ করল। অর্নিলা দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাকে সোফায় বসতে বলল। একটু পর পর ঘড়ির দিকে চাইছে। সারফারাজ একটু বাদেই এসে পড়বে। তখন আর ভয় থাকবে না। একদম না। নিয়াজ চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ বলে উঠল, “সারফারাজ বাসায় নেই?”
অর্নিলা যেন হকচকিয়ে গেল। বিস্মিত চাহনিতে ফিরে তাকাল। অস্ফুট স্বরে বলল, “এই তো আসবে। একটু আগেই কল করেছে।” কথাটা বলে মন যেন শান্ত হলো। নিয়াজ চোখের চশমা খুলে সামনে রাখল। অর্নিলার স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে। শুধায়, “চাচা কোথায়?”
“বাসাতেই আছে। বের হবার সময় দেখলাম শুয়ে আছে।”
“ওহ, তো তুমি এখানে কেন ভাইয়া? কি দরকার ছিলো?”
নিয়াজ মুখের দিকে চেয়ে থাকল। নিরুত্তর সে। অর্নিলা হাসার চেষ্টা করল। পরিস্তিতি বদলে যাচ্ছে কেমন করে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তার কপাল জুড়ে। বিচলিত হয়ে রান্না ঘরে ছুটে এলো। এখন মনে হচ্ছে নিয়াজকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে একদম ঠিক কাজ করেনি সে। ভুল করেছে। বিরাট ভুল। গ্লাসে পানি ঢেলে তরতর করে খেয়ে ফেলল। চুলোয় তরকারি টগবগিয়ে রান্না হচ্ছে। ধনেপাতা কুচি পড়ে আছে। এগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। আচমকা পিছনে কারো আভাস। অর্নিলা চমকে পিছন তাকাল। নিয়াজের মুখখানি ভয়ং/কর হিং/স্র ঠেকল তার কাছে। গলা শুকিয়ে গেল। থমকে গিয়ে বলল, “তুমি এখানে?”
সে শান্ত কণ্ঠে বলল, ”অনি আমার কথাটা শোন..
বলেই হাত বাড়াল। অনি চোখ রাঙিয়ে উঠল। ঝাঁঝা/লো কণ্ঠে বলে উঠল, “একদম না। ছিঃ, ভাইয়া। তুমি একটুও বদলাও নি। সবার সামনে ভালো সাজার নাটক করছিলে।”
আচমকা হাত ধরে টানতে লাগলো নিয়াজ। তার কণ্ঠ এখনো শান্ত। বলল, “আমার কথাটা শোন অনি।”
অর্নিলা মুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠলো, ”না না, তোমাকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে আমি ভুল করেছি। একদম উচিত হয় নি তোমাকে বিশ্বাস করে। তুমি বদলাও নি। একফোঁটা বদলাও নি। ছাড়ো…. কথা বলতে পারল না। নিয়াজ বেশ ঠান্ডা মাথার লোক। পরিকল্পনা যেন করাই ছিল। মুখ চিপে ধরে রান্নাঘর ছেড়ে বের করিয়ে আনছে। অনি হাঁস/ফাঁস করছে তার হাত থেকে ছুটতে। বসার ঘরে এসে যেন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল। নিয়াজের হাত ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল। শেষবারের নিয়াজের আ/ক্রমণ এসে ঠেকল তার পিঠেতে। ব্লাউ/জের খানিকটা অংশ যেন ছিঁ/ড়ে পিঠে আঁচ/ড় বসে গেল। সামনের ফুলদানি হাতে নিয়ে ঘুরে তাকাল অনি। দুজনেই নিস্তব্ধ। বদ্ধ ঘরে দুজনের শ্বাস প্রশ্বাস ছাড়া আর কিছুর শব্দ ঠেকছে না। চুলোয় তরকারীর তেজ বাড়ছে। অনি শাসি/য়ে উঠল, “আর এক পা না, আমি কিন্তু আগের মতো আর ছোট নেই। আমার হাত থামবে না।”
নিয়াজ চমকিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে। ঢোক গিলে বলল, ”অনি!”
অর্নিলা ফুলদানি আঁচ/ড়ে মেঝেতে ফেলল। মেঝের চারদিকে ফুলদানির ভা/ঙা টুকরো ছড়িয়ে। সে দ্রুত ভা/ঙা টুকরো হাতে তুলে নিল। নিয়াজ দু পা পিছিয়ে গেল। তার চোখে মুখে এখন খানিকটা ভয়ের আভাস। অনি বড় ঠান্ডা গলায় কড়াভাবে বলল,”বের হও, এখুনি! আর কখনো আসবেনা এখানে!”
নিয়াজ কিৎকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। না, এই অনি আর আগের মতো নেই। বুঝল, এখানে তার জোর ঠেকবে না। নিঃশব্দে সে পালিয়ে গেল। অনি ছুটে এসে দরজা বন্ধ করল। ক্লান্তিতে মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। দরজায় ঠেসে মেঝেতে বসে পড়ল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। এই মানুষ গুলো কেন এতো নোং/রা, এতো কেন কুৎ/সিত! এতো কিছুর পরেও তাদের শিক্ষা হয় না। কেন বার বার তার সাথেই! কাঁদতে কাঁদতে শ্বাস উঠে গেল। শ্বাস নিতেও এবার কষ্ট হচ্ছে। কতোক্ষণ এভাবে ছিলো জানে না। যখন বোধ হলো, সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে রান্না ঘরের দিকে গেল। তরকারির চুলো বন্ধ করে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। পুরো বাসা এবার নিস্তব্ধ, নিঝুম। তবুও এখানে মন খুলে শ্বাস নিতে পারছে না অনি। মেঝে পরিষ্কার করল, পরনের শাড়িখানা বদলে নিল চট করে। ফারাজ ভাইয়ের মাথা গ/রম এমনিতেই। আজকের ঘটনা জানতে পারলে নিয়াজকে প্রাণে মে/রে ফেলবে কোন সন্দেহ নেই। এসব ঝামেলা কিছু চায় না সে। আজকের এই বিষণ্ণ বিকেলের জঘন্য ঘটনাগুলো স্বপ্নের মতো ভুলে যেতে চায়। কোন ঝামেলা চায় না, কোনোরকম না!
তবুও যেন সে আঁসফাঁস করছে। বিকেলে দেখা লোকটাও এখন বেডে শুয়ে। দুটো পা নেই, পঙ্গু হয়ে গেল সারাজীবনের জন্য। বিধাতা এতো তাড়াতাড়ি তার বিচার করে ফেলল? এসব লোকের প্রাপ্ত শাস্তি কি এটাই! ইয়াতিম শিকদার দরজার বাইরে কঠোর মুখে বসে আছে। তিনি যে কতোটা চিন্তিত বুঝানো যাবে না। তার বংশের ছোট ছেলে। বংশ নিয়ে আবার চাচা একটু বেশিই সিরিয়াস থাকে। শুনল, ভাইয়া ভাবী রওনা দিয়েছে। বোধহয় সকালের মধ্যেই চলে আসবে। ফারাজ ভাই আশেপাশে নেই। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছেন। সত্যি বলতে নিয়াজের জন্য অনির একটুও খারাপ লাগছে না। কিন্তু মায়া হচ্ছে তার চাচার জন্য। এই চাচা তার কাছে তার বাপের সমান। চাচার কাছে এগিয়ে এলো। আলতো স্বরে বলল, ”চাচা, মন খারাপ করবেন না। আল্লাহ যা করার করেছে, এখানে তো আপনার হাতে কিছু নেই।”
কথাটুকু কানে যাওয়া মাত্র ইয়াতিম শিকদার ছ্যা/ত করে উঠল। চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল, “ছা ড়মু না, আমার পোলার যে এই হাল করছে তারে ছা ড়মু না। অনি তুই এখানে থাক, আমি থানায় যামু।”
অনি বাঁধা দিতে চাইল। চাচা কথা শোনার পাত্র নন। পেছনে এসে দাঁড়াল সারফারাজ। বলে উঠল, “যাবেন, কিন্তু এই ভোররাতে গিয়ে কাউকে পাবেন বলে মনে হয় না। একটু অপেক্ষা করেন, সকাল হোক।”
ফিরে চাইল সারফারাজের দিকে। এরপর সামনে হেঁটে পাইচারি করতে লাগল। বিরবির স্বরে বলছে, “ছাড় তাম না, কাউরে ছাড় তাম না। আমার পোলার সারাজীবন নষ্ট কইরা দিছে। ওরে আমি ছাড়তাম না!”
অনি ছুটে আসল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। তাকে বিচলিত দেখে সারফারাজ তার মাথায় হাত রাখল। চোখ বুলিয়ে বলল, ”কি হয়েছে?”
”চাচা খুব রেগে আছে।”
”থাকুক রেগে।
“কিছু কি করা যাবে না।”
“একদম না। পা দুটো হারিয়েছে, জীবন হারা য়নি এইই বেশি।
“কি করে হলো বলুন তো।”
“এটা ঢাকা শহর অনি। রাস্তায় অগনিত গাড়ি চলাফেরা করে। তখনি হয়তো..
“বিয়েটা বোধহয় হবে না।
“এই প ঙ্গু ছেলেকে কে বিয়ে করবে অনি? মানুষকে ভালোবাসা যায়। অমানুষ কে না।”
অনি ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থেকে ফারাজ ভাইয়ের কথা শুনছে। সে মৃদু হেসে বলল, “তোর কি খারাপ লাগছে অনি?”
অনি মাথা দুলিয়ে না বলল। ক্ষীণস্বরে জবাব দিলো, “চাচার জন্য খারাপ লাগছে। ছেলের এমন অবস্থায় চাচা ভেঙে পড়েছে একদম।”
সারফারাজ ইয়াতিম শিকদারের দিকে ফিরে তাকাল। ভ্রু কুঁচকালো। তার জন্য বিন্দুমাত্র মায়া তার হচ্ছে না। কারণ এই লোক নিজেও একটা অমা নুষ। ছোট ফুফু যখন ভাইয়ের কৃতকর্মের কথা তাকে জানিয়ে সাহায্য চেয়েছিল তখন সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বলেছিলো “বড় বংশের ছেলেরা এমন একটু করবেই।” এখন দেখুক সেই বংশের ছেলের হাল। অর্নিলা এসব কিছু্ই জানে না বলে তারা মায়া বেশি। বেশ, না জানুক। এই পৃথিবীর অন্ধকারের ছায়ার সাথে যার পরিচয় যতো কম ততোই ভালো। সে ততোই পবিত্র মনের অধিকারী। এমন শুদ্ধ রমনীই তো দরকার ছিলো তার অশুদ্ধ জীবনে। সারফারাজ অনির হাত আগলে ধরল। ভোর হয়ে আলো ফুটছে। কোন প্রমাণ নেই, মেইন রাস্তায় রক্তে র দাগ সব ধুয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে। বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে কিছু্ই দেখা যাচ্ছিল না। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো গুলো অবধি নিভে ছিলো। কোন প্রমাণ নেই, কিছু নেই। তবুও তার কাজে সে সফল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
ইয়াতিম শিকদার পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। হাতে অর্ধেক বিস্কুট। মুখে বিস্কিট চিবাতে চিবাতে বলছেন, “তা কেমন আছো সারফারাজ? ভালো তো।”
“হ্যাঁ, চাচা ভালো। আপনি ভালো আছেন?” তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফিরে এসে পড়ল নিয়াজের দিকে। নিয়াজের দৃষ্টি তখন মেঝেতে। অর্নিলা চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকে বলল, “নিয়াজ ভাইয়ের নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?” সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে নিল। কি আহ্লাদ দেখাচ্ছে অনি? আশ্চর্য! এই হারাম/শয়তান কে ঘরে ঢুকতে দিয়েই তো ভুল করেছে। আবার ঢোল পিটিয়ে বলছে বিয়ের কথা? ও কি ভুলে গেলো ওর সাথে কি হয়েছে? এতো সহজ কেন হচ্ছে অনি? ইয়াতিম শিকদার চায়ের কাপ হাতে তুলে নিলেন। বলে উঠলেন, “হ, পোলা বড় হইছে বিয়া তো করান লাগব। মাইয়া ঠিক করছি, ঢাকা শহরেই থাকে। এখনকার স্থানীয়। নিয়াজ ছবি দেখা তোর বোনরে।”
নিয়াজ পকেট থেকে ছবি বের করছে। সারফারাজ চায়ের কাপ তুলে নিল। ভাবছে, মাথা যন্ত্রণা কম ছিলো না। আরেক য/ন্ত্রণা এসে হাজির হলো। একটা চায়ের কাপ পারবে তো ঠিক করতে? হেসে বলল, “তা চাচা, আমাদের ওখানে কি মেয়ের কমতি ছিলো নাকি? একদম ঢাকাতে চলে এলেন।”
”কি আর করমু কও। ওখানে ভালো মাইয়া পাওন যায় না।”
সারফারাজ মুখ ফুটে হাসল। অ্যাহ, মেয়ে পাওয়া যায় না। তার ছেলের কু-কর্ম পুরো মোহনগঞ্জ জানে। এরপর কে মেয়ে বিয়ে দিবে এই ছেলের কাছে। চরি/ত্রহীন একটা। নিয়াজ ছবি বের করে অর্নিলার দিকে এগিয়ে দিলো। এতো বছর পর এই প্রথম তাদের দুজনের চোখাচোখি! অর্নিলা খুব করে চাইছে সহজ থাকতে পারছে না। জানে ফারাজ ভাই পাশেই আছে, ভয়ের কিছু নেই। তবুও অস্থির হয়ে উঠছে। ছবিটা হাত থেকে নিবে কি না ভাবছে? এই নোং/রা লোকের হাত থেকে কিছু ছুঁয়ে নিতে ঘৃ/ণা লাগে। মনে হয় নিজেও নোং/রা হয়ে যাবে। মিষ্টির প্যাকেট ধরার সময় মনে হচ্ছিল ইচ্ছে করে হাত ছুঁ/তে চায়। নিয়াজ কি তবে বদলায় নি? তবে সবাই যে বলে!
সারফারাজ আচমকা ছবিটা হাত থেকে নিয়ে বলল, “দেখি!”
“দেখো বাবা, মাইয়া কেমন? পছন্দ হইলো কি না।”
সারফারাজ মেয়ের ছবিখানা দেখল। হ্যাঁ ভালোই দেখতে, তবে আফসোস হচ্ছে। এতো ভালো মেয়েটার সাথে এমন বাজে একটা ছেলের বিয়ে হবে ভাবতেই কেমন লাগছে। অর্নিলা আগ্রহ নিয়ে ছবিখানা দেখল। বলল, “বাহ খুব সুন্দরী তো নিয়াজ ভাই! আপনাদের বেশ মানাবে!”
আবারো আহ্লাদি দেখাচ্ছে। সারফারাজের ইচ্ছা করল উঠে একটা চ/ড় বসিয়ে দিক অনির গালে। কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করছে। মাথাও ভন ভন করছে। রাগ সামলাতে পারছে না সে। আবার হেসে হেসে “নিয়াজ ভাই” বলে ডাকা। এই ডাকাই সমস্ত কিছুর মূলে। ইয়াতিম শিকদার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই একটা মাইয়া মনমতো পাইছি।”
“ভালো চাচা। মেয়ে দেখতে ভালো। বংশ পরিচয় ও ভালো মনে হচ্ছে। তা আপনাদের বংশের খবর জানে তো?”
“কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা।” সারফারাজ তীক্ষ্ণ ভাবেই খোঁচাটা মেরেছে। ইয়াতিম শিকদার হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, “জানি বাপজান, জানি। আমাগো উপর তোমার রাগ। এহন দেহো, যা হইছে অনেক বছর আগে হইছে? দিন পাল্টাইছে। আমার পোলাও এখন পাল্টাইছে। শুয়ো/রটা এখন আগে থেকে ভালো হইছে।”
“কি বলেন চাচা, রক্তের দোষ কি এতো সহজে বদলে যায়?”
”হ জানি, কার কথা কইতাছো? অনির বাপের কথা তো। দেহো সব বংশেই এমন একটু থাকে। আমাগো সময় আছিলো অনির বাপ আর এখন আমার পোলা। তাও আমারটা সময় থাকতে বদলাইছে।”
অনির বাবার কথা তুলে যেন খুব একটা ভালো হলো না। কোন এক ফাঁকে অনি চলে গেল আসর ছেড়ে। ফারাজ ভাই কি তার বাবা কে সত্যিই এতো অপছন্দ করে। কিন্তু অনি যে তার বাবাকে অনেক ভালোবাসে। বাবা কখনো খারাপ হতে পারে না। তার বাবাও ভালো মানুষ ছিলেন।অনিকে অনেক ভালোবাসত। অথচ তার চাচা কিভাবে তার বাবার নামে বদ/নাম করছে। অর্নিলার সহ্যের বাইরে এগুলো। সব মেয়েদের কাছে বাবা মানে একটা শান্তির জায়গা। তার বাবা তার আপনজন। মা কে তো পায়নি সে, বাবাকেই পেয়েছে। সেই বাবার নামে খারাপ কথা শুনার ধৈর্য অনির নেই।
সারফারাজ চায়ের কাপ রেখে দিল। ইয়াতিম শিকদার বললেন, “যা হইছে ভুইলা যাও। আমরাও ভুইলা গেছি। আমার ছেলে বদলাইছে এখন আমার আর কোন দুঃখ নাই। এই নাও বিয়ার কার্ড। তোমাগো দাওয়াত দিতে আইছি। তোমার বাপের ও গিয়া দাওয়াত দিয়া আসছি। তোমারে দাওয়াত দিতে কেবল ঢাকা আইছি। আইসো কিন্তু বিয়াতে।”
সারফারাজ মাথা নাড়ল। খেয়ে দেয়ে তারা উঠে গেলেন। চলে যাবে। সারফারাজ শুধায়, “মোহনগঞ্জ ফিরবেন?”
“না, কিছু কাজ আছে। শহরে থাকমু এখন। তা তোমার ডাক্তারি কেমন চলে?”
“ভালো।
“সারাদিন মেডিকেলেই থাকো?”
“হ্যাঁ,এটাই তো কাজ।”
“আচ্ছা!”
বাপ ছেলে চলে যাচ্ছে। ভদ্রতার খাতিরে সারফারাজের জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো, কোথায় থাকবেন? কিছু ঠিক না হলে এদিকে থাকতে পারেন। কিন্তু বলল না। কারণ নিয়াজ কে তার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। সবাই যাই হোক বলুক না কেন? রক্ত এতো তাড়াতাড়ি বদলে যায় না। এদের রক্তে নেশা ছড়িয়ে গেছে। এর থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ না। যেতে যেতে মনে হচ্ছিল নিয়াজ আড়চোখে অনিকে খুঁজছে। ভালোই হবে এখন অনি না এলে। এই হতচ্ছাড়া মুখে কিছু না বলেই চোখ দিয়েই যেন খেয়ে ফেলে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাচা ডাকলেন অর্নিলাকে। সারফারাজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুই তার মনমতো হচ্ছে না!
.
অর্নিলা আনমনে রান্নাঘরে কাজ করছে। রান্না বান্না সেই কখন শেষ। এখনো ইচ্ছে করে এখানে পড়ে আছে। চুলোটা পরিষ্কার করছে। সারফারাজ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। অর্নিলা ফিরেও চাইলো না। সে এগিয়ে আসছে, মুখে কিছু না বললেও চোখে চোখে যেন অনেক কথা হতো। কিন্তু চোখে চোখ পড়ছে না। সে একসময় তার কাছে এসে দাঁড়াল। অনির হৃৎপিণ্ড ধকধক করছে। তবুও সে ফিরে তাকাল না। মুখ ভার! সারফারাজ আদুরে কণ্ঠে বলে উঠল, ”কি হয়েছে অনি?”
“কিছু না।”
সে হাত ধরার চেষ্টা করল। অনি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল। অবাক হলো বটে। অনি তার মানে রেগে আছে। কিন্তু রেগে থাকার কারণ কি? প্রথমবার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় বার হলো না। ধপ করে হাতটা ধরে নিল।
”ছাড়ুন আমার কাজ আছে!”
“তোর কি মন খারাপ?”
“না মন খারাপ হবে কেন?
“তোর কথা শুনে এমনটাই তো মনে হচ্ছে। কি হয়েছে রেগে আছিস? দেখি, ফের আমার দিকে!”
থিতুনি ধরে মুখ ফিরাল এদিকে। অনির অশ্রুসিক্ত চাহনি সারফারাজের হৃদয় ক্ষতবি/ক্ষত করে দিল। সে নিস্তেজ কণ্ঠে বলে উঠল, ”কি হলো? কাঁদছিস কেন?”
“আপনি আবার বাবা কে পছন্দ করেন না, তাই না ফারাজ ভাই?”
“না করি না। এতে তুই কেন কাঁদবি?
”কাঁদব না!“
“না। কেন কাঁদবি? তোকে তো আমার পছন্দ। খুব পছন্দ। ভালো লাগে তোকে। ভালোও তো বাসি। তোর দুঃখ কোথায়?”
অর্নিলা মাথা নিচু করে নিল। আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। সারফারাজ হাতটা ছেড়ে দিল। কাছে টেনে নিলো না। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, “তোর বাবার চরিত্রে দো/ষ আছে অনি! সে আমার ফুফুর সাথে কি করেছে আমি ভুলে যায়নি। রক্ত কখনো রক্তকে ছাড়ে না।”
অর্নিলা চমকে উঠল। বিস্মিতবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল সারফারাজের দিকে। অবাক কণ্ঠে বলে উঠল, “আমার রক্তেও তাহলে দো/ষ আছে ফারাজ ভাই? আপনি বলছেন, আমিও আপনাকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে চলে যাবো?”
”না, তুই যাবি না।
“এতো সহজে কিভাবে বলছেন। যাবো না কেন? এই না বললেন, রক্ত রক্তকে ভুলে না। আমার শরীরে আমার বাবার রক্ত। আমি তো তার মতোই হবো। কি হবে যদি আপনাকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে চলে যাই।”
সারফারাজ রক্ত/বর্ণ দৃষ্টি ধারণ করল। অনি খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। গলার তেজ এখন আগের মতো আর নেই। আচমকা তার কোমর হিচড়ে টেনে ধরল সারফারাজ। আঁত/কে উঠল অনি। তার ঘন ঘন নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। সারফারাজ খুব শান্ত গলায় বলল, “মে/রে ফেলব তাহলে।”
সে তার কানের কাছে চুল গুলো নিয়ে খেলছে। কানে চুল গুঁজে দিয়ে হেসে বলল,
“তাকে! সে তোকে চাইবে। তুই শুধু আমার অনি। এর মাঝে সে আসবে তাকে মর/তে হবে!” কিয়ৎকালের জন্য দম/বন্ধ হয়ে গেল অনির। তার অক্ষিগোলাক দুটি স্থির হয়ে রইল মনিকোঠায়। তার শার্টের উপর হাতটাকে সে খামচে ধরল ভ/য়েছে। ফারাজ ভাই নিছক মজা করছে বলে মনে হলো না। তাকে আজ বড্ড ভয় লাগছে অনির। ডাক্তাররা সর্বকাল ধরে চেষ্টা করে রোগীর প্রাণ বাঁচাতে আর ফারাজ ভাই কি না বলছে মে/রে ফেলবে। কি সাং/ঘাতিক! হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেল। সে চুমু খেল তার ললাটে। হেসে বলল, “অনি? ভয় কেন পাচ্ছিস? আমি তো তোর কিছু করব না। তুই তো আমার হৃৎপিণ্ড! হৃৎপিণ্ড থেমে গেলে মানুষ বাঁচে না। তোর কিছু হলে আমি কি বাঁচব?”
চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সারফারাজ তাকে বুকে আগলে নিল। অজান্তেই কেঁদে উঠল অনি!
.
পরদিন শরীরটা ভালো ছিল না বলে অর্নিলা ভার্সিটিতে যায় নি। সারফারাজ সকালবেলা মেডিকেল এ চলে গেলো। এখানে এসেই ডা. সাবিনার কথাবার্তা তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়ল। রোজ রোজ তিনি একটা কথাই বলছে। ভাবতে, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে। সময় কিন্তু হাতে বেশী নেই। এসব শুনে শাহাদাত হেসে বলল, “মনে হচ্ছে ডা. সাবিনা তোকে কার্ডিয়াক সার্জন করেই ছাড়বে।”
শুভ হেসে বলল, “দেখছিস না, রোজ কেমন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। তা বাবা, তুমি তো তার কথাটা শুনলেই পারো।”
”মজা করিস না। আমি জানি আমার কি করতে হবে।“
”তাহলে ডা. সাবিনাকে বলে দিচ্ছিস না কেন? আমার যা মন চাইবে আমি তাই করব। বউয়ের সাথে এখানেই থাকব।”
শুভর কথা শুনে শাহাদাত হো হো করে হেসে উঠলো। বলল, “সিরিয়াসলি সারফারাজ! বউকে এতো ভালোবাসিস! তার জন্য এখন ক্যারিয়ারকে জলাঞ্জলি দিবি?”
”আমাদের ডা. শেহদাত এবার রোমিও হয়ে গেছে। জুলিয়েট ছাড়া তার চলে না বুঝলি তো!”
সারফারাজ গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। ওই দুই বন্ধুর কথা তার কানে যাচ্ছে না। গায়ের এপ্রোন খুলে টেবিলে ফেলে বলল, ”আমি যাচ্ছি।”
“যাও যাও, বউয়ের জন্য তর সইছে না আমরা বুঝতে পারছি।”
“ভাবীকে আমার তরফ থেকে সালাম দিয়ে দিস ফারাজ।বলিস, একদিন আমরা যাবো রোমিও জুলিয়েট কে দেখতে।”
খোঁচা মেরে কথা বলা দুজনের বহুদিনের স্বভাব। সারফারাজ এসব গায়ে মাখে না। হুলস্থুল করে সে বেরিয়ে গেলো। বাইরে এসে গাড়ি স্টার্ট । ঘামে তার শরীরের শার্ট ভিজে উঠলো। ঘন অন্ধকার রাস্তায় শুধু গাড়ির সামনে দুটো আলো ছাড়া আর কিছুই জ্বলছে না। চারদিক এতো নিস্তব্ধ! এখান এখানে কেউ ম/রে পড়ে থাকলেও কেউ কিছু টের পাবে না। কিন্তু রাস্তা নির্জন। মানুষজন কিছু নেই। এর মধ্যে ঝড়বৃষ্টি। বৃষ্টির পানি পড়ে রাস্তা হয়ে উঠল স্যাঁতস্যাতেঁ। কোন কিছুর ছাপ নেই, প্রমাণ নেই। বৃষ্টির পানিতে সবকিছু ধুয়ে গেল। গাড়ি এসে থামল বাসার সামনে। সারফারাজ গাড়ি ছেড়ে বের হলো। ঘামে তার অর্ধভেজা শার্ট এবার বৃষ্টির পানিতে আরো ভিজে উঠল। কিছুক্ষণ বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়েই ভিজলো সে। পাপ ধুয়ে যেন পবিত্র হতে চায়। নিজেকে শুদ্ধতম বানানোর কি দারুণ ফন্দি। কাকভেজা হয়ে ফিরল। কলিং বেল চাপতেই মনে হলো ওপাশ থেকে কেউ ছুটে আসছে। মনে প্রশান্তি বয়ে গেল। দরজা খুলে দেখল অর্নিলা কে। বৃষ্টিতে ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছে সারফারাজ। অস্থির হয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মাথাটা মুছে দিতে লাগল। আরো কতো কথা! “এভাবে ভিজে গেলেন কি করে? আপনি তো গাড়িতে ফিরলেন। ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে গেলেন কেন ফারাজ ভাই? বৃষ্টির পানি তো আপনার শয় না। দেখবেন এখুনি সর্দি লেগে যাবে।”
বলতে বলতে হাঁচি শুরু। অর্নিলা হাঁপিয়ে উঠলো। ক্লান্তি ভরা কণ্ঠে বলল, ”বসে থাকবেন না। উঠুন। চেঞ্জ করে আসুন। আমি জামা বের করে দিচ্ছি।”
সে ছেড়ে যেতে চাইলো। অমনি সারফারাজ তার কোমর টেনে জড়িয়ে ধরল। গায়ের পানি টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে। সারফারাজের ভিজে কাপড় চোপড়ে জড়িয়ে আছে অনিকে। সেও ভিজে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত! ফারাজ ভাই এমন কেন করছে? আদুরে কণ্ঠে বলে উঠল, ”আমায় ছাড়বেন না ফারাজ ভাই?”
“না, তুই থাক এখানে। আমার কাছে। আমার তোকে চাই অনি।”
বড্ড বেদনাদায়ক সেই কথাগুলো। ফারাজ ভাইয়ের কি হলো আবার? কিসের এতো কষ্ট। খারাপ কিছু কি হলো মেডিকেলে! ঝাপসা ঝাপসা চোখে অর্নিলা সামনে তাকিয়ে রইল। সামনের টেবিলের ফুলদানিটা এখানে আর নেই। ফারাজ ভাইয়ের চোখে পড়বে না তো আবার। তাহলে সে সর্বনা/শ হয়ে যাবে। ভয়ে তার বু্ক কাঁপছে। সারফারাজ তাকে ছেড়ে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরতে যাবে অমনি অনি তাকে আঁকড়ে ধরল আবারো। সে নিশ্চুপ হয়ে রইল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছে। থামবার নাম নেই। একটু বাদে বাদে বিদ্যুৎ চমকানোর বিকট শব্দ। অনেকক্ষণ ধরে নামল বৃষ্টি। এবার সবকিছু চুপ, নিস্তেজ হয়ে গেল। একটু শীত শীত লাগছে এখন। অর্নিলা গুটিশুটি হয়ে সারফারাজের বুকে এসে আশ্রয় নিল। ঘরে আলো বলতে ওই একটা ল্যাম্পশেড। সারফারাজ আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে আছে। তার কোলেতে অনি। এখান থেকে জানালা দিয়ে বাইরে আকাশ দেখছে। আকাশ এখন পরিষ্কার! তাঁরা দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বুঝি চাঁদও দেখা যাবে। অর্নিলার
ন গ্ন বাহুর জড়িয়ে ধরে আছে সে। চোখ পড়ল পিঠের দিকে। আঁচ/ড়ের দাগ দেখে তার রক্ত টগবগিয়ে উঠল। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। স হ্য হচ্ছে না, কিছুতেই স হ্য হচ্ছে না। তার অনিকে অন্য কেউ ছুঁয়ে দেখবে এটা ভাবতেই যেন উন্মা দ হয়ে উঠে। ইচ্ছে করে সবকিছু শেষ করে দিতে। আঁচ ড়ের দাগটা স্পষ্ট। অনির সেটা অবগত ছিলো না। সারফারাজ হাত দিয়ে ঘা পা ছুঁয়ে দেখল। তার ওষ্ঠাদ্বোর ছুঁয়ে দিলো ঘা টুকু। তার অনির সমস্ত ঘা এভাবেই ফুল হয়ে যাক। শুকিয়ে যাক সমস্ত ক্ষ ত। এসব ক্ষ ত নিজের মনে একা নিয়ে সে চলতে পারবে। সারফারাজের আদুরে ছোঁয়ায় অনি নড়েচড়ে উঠল একটু। আবছা ঘুমের মধ্যেই মুচকি হেসে উঠল সে।
ঠিক ঘণ্টাখানেক পর ফোন বেজে উঠল সারফারাজের। ঘুমটা ভেঙে গেল অর্নিলার। আবছা আবছা আলোয় ঘড়ির দিকে ফিরে চাইল। রাত্রির ১ টা বাজে। এতো রাতে আবার কে ফোন করল? বিছানার পাশে ফারাজ ভাই নেই। তাকে হাতড়ে খুঁজছে। ভালো করে চেয়ে দেখল সারফারাজ দাঁড়িয়ে কথা বলছে। চাদরে শরীর ঢেকে নিয়ে অনি উঠে বসল। কথা শেষ করে সে ফিরে তাকাল। ল্যাম্পশেডের অল্প আলোয় তার গম্ভীর মুখ দেখে অনি শুধালো, ”কি হয়েছে ফারাজ ভাই?”
সে বিছানার পাশে এসে বসল। অনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তৈরি হয়ে নে। আমাদের বেরুতে হবে।
”কোথায় যাবো?”
”মেডিকেল এ। নিয়াজ নাকি এক্সি’ডে’ন্ট করেছে।”
চোখ মুখ স্থির হয়ে উঠল অর্নিলার। আকস্মিক ঘটনায় সে হত’ভম্ব! হতবাক হয়ে রইল! মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সারফারাজ তার হাতখানি ধরে বলল, “চিন্তা করিস না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। চল, উঠে তৈরি হয়ে নে!”
ডঃ সাবিনা ইয়াসমিন এর তত্ত্বাবধানে এখন থেকে সারফারাজ শেহদাত থাকবে। কথাটি জানামাত্র সারফারাজ একটু ঘাবড়ে গেল। কারণ সে তো এতোদিন ডঃ শরিফুল ইসলাম এর তত্ত্বাবধানে ছিল কিন্তু কিছুদিন আগেই তিনি দেশের বাইরে গেছেন কোন একটা কাজে। আপাতত এখন তাকে ডঃ সাবিনা ইয়াসমিন এর তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। শুনেছে তিনি অনেকটা রাগী। সে অবশ্য তাকে এখনো দেখেনি যতটুকু লোকজন থেকেই জেনেছে। একটু ভয়েই আছে। সে একা নেই। তার সাথে আরো আছে শাহাদাত আর শুভ। হ্যাঁ, পরীক্ষায় পাস করবে না করবে না বলে ছাগল দুটো ঠিকই এমবিবিএস পাশ করে ফেলেছে আর এখন ইর্ন্টানশিপ ও করছে। আর বেশি দিন বাকি নেই। এই তো ছ’মাস হয়ে গেল। শাহাদাত গলা থেকে স্টেথোস্কোপ নামিয়ে টেবিলে রাখল। সারফারাজ টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একজন রোগীর ফাইল ঘাটছে। শুভ কফি নিয়ে হাজির। সারফারাজ মুচকি হেসে বলল, “খুব টায়ার্ড নাকি?”
কফির কাপ গুলো টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল শুভ। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সে আর বলতে, ইমার্জেন্সিতে আসা পেশেন্ট। কতো কষ্ট করতে হলো বল তো। ভাগ্য ভালো আল্লাহ হায়াত রেখেছিলো।”
শাহাদাত কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “ওই যে দেখে এলাম কান্নাকাটি করছে।
”হ্যাঁ রোগীর আত্মীয়! প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক করল। পরিবারের সামলে উঠতে অনেক কষ্ট হবে।
“হুম। এ অবধি কতো মৃ/ত্যু দেখলাম কতো প্রিয়জনকে কাঁদতে দেখলাম। এখন এসব শয়ে গেছে।
শাহাদাত স্বরে বিরহের সুর পাওয়া যাচ্ছে। শুভ কিঞ্চিৎ ভেবে বলল, “বেড নং ২১ এর পেশেন্ট কি আর…
বাকি কথা বলতে হলো না। শাহাদাতের মলিন হাসি সমস্ত কিছুই বলে দিলো। শুভ নিশ্চুপ হয়ে কফি কাপে চুমুক দিলো। কিছুক্ষণ চারদিক ছেয়ে গেল নিস্তব্ধতায়। একজন ডাক্তার তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে একজন রোগীর প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু শেষমেশ যখন শেষ রক্ষা আর করতে পারেনা, যখন হেরে যায় তখন হতাশায় ডুবে যায় সবকিছু। সারফারাজ গায়ের এপ্রোন খুলে রাখল। বলে উঠল, “কিছু করার নেই। আমাদের হাতে এতোটুকুই। সৃষ্টিকর্তা এর চেয়ে বেশি শক্তি আমাদের দেননি কি করার।”
“আমার মনে হয়, একজন ডাক্তার হতে হলে প্রথমেই মনটা পাথর করে ফেলতে হয়। পাথর না হলে কিছু করার নেই।”
”তা বটে।”
“সারফারাজ! তোর হাতে ওটা কার ফাইল!”
“নতুন এক পেশেন্ট এসেছে। হার্টের সমস্যা কিন্তু সমস্যাটা কি বোঝা যাচ্ছে না। আপাতত কিছু পরীক্ষা দিয়েছি দেখা যাক রিপোর্ট কি আসে।”
“ডঃ সাবিনা চলে এসেছেন। তাকে গিয়ে রিপোর্ট দেখাও এক ঝটকায় বলে দিবেন।
শাহাদাত তড়িখড়ি করে বলল, “এসে গেছে নাকি।
”হ্যাঁ, চলে এসেছে। কেবিনে আছে। একটু পরেই খবর এলো বলে। সারফারাজ তৈরি হও।”
“আমি একা যাবো নাকি? তোরাও তো যাবি।
“না বাবা, যা শুনলাম তার নামে। তবে এটা বলতেই হয়, তিনি একজন এক্সট্রাঅর্ডিনারি! অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।নামকরা একজন কার্ডিওলজিস্ট।”
“তবে নাকি অনেক রাগী!”
”সেটা জানতে হলে তো দেখে আসতে হবে, তাই না!” বলতে বলতে খবর চলেও এলো। প্রথমে ডাক পড়ল সারফারাজ। সারফারাজ এপ্রোন পরে হাতে ফাইল নিয়ে বেরিয়ে গেল। শুভ যাবার আগে বলে উঠল, ”দোয়া করি বৎস!“
“চুপ কর!“
হেসে উঠল তারা দুজন। সারফারাজ ডঃ সাবিনা ইয়াসমিন এর কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে নক করল। অনুমতি পেয়ে ভেতরে ঢুকে চমকে গেল বটে। তার ব্যাপারে শুনে যেমনটা ধারণা করেছিলো সে মোটেও তেমন নয়। নীল রঙের শাড়ির উপর তার সাদা এপ্রোন, গলায় ঝুলছে স্টেথোস্কোপ। এসেই কি পেশেন্ট দেখা শুরু করে দিয়েছে নাকি। হাতে একটা ফাইল ও দেখা যাচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ফাইল দেখছিলেন। চোখ মেলে এদিকে তাকালেন। চোখের চশমা খুলে শুধালেন, “ডঃ শেহদাত!”
“জি।”
“আসুন , বসুন।”
কণ্ঠস্বর অনেকটাই ধারালো। সারফারাজের খানিকটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ডঃ সাবিনা নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন। সারফারাজের হাতে ফাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কোন পেশেন্ট?”
সারফারাজ ফাইল এগিয়ে দিল। বলে উঠল, “নতুন পেশেন্ট। একটা পরীক্ষা করেছিলো তার রিপোর্ট। আমি আরো কিছু পরিক্ষা করতে দিয়েছি।”
“আপনার কি ধারণা, কি হয়েছে?”
“সমস্যা টা দেখে মনে হচ্ছে হার্ট ব্লক। ৫০% চান্স আছে। পুরোপুরি শিউর হবার জন্যে রিপোর্টের অপেক্ষা করছি।”
ফাইলের থেকে চোখ সরিয়ে বলে উঠলেন, ”হার্ট ব্লক। আমি ১০০%। যাই হোক, নতুনদের জন্য আরো কিছুটা সময়ের দরকার। আমি বলছি অভিজ্ঞতা থেকে।”
”আপনার অভিজ্ঞতা?”
“৮ বছরের!”
সারফারাজ বিস্ময় প্রকাশ করল। দেখে মনে হয়নি তার থেকে এতোটা বড়। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ডঃ সাবিনা মৃদু হেসে বললেন, “ডঃ শরিফুল ইসলামের আন্ডারে আমিও ছিলাম। খুব ভালো একজন ডাক্তার। নিশ্চিত অনেক কিছু শিখতে পেরেছেন।”
“শিখার চেষ্টা করছি।”
”প্ল্যান কি আপনার ডঃ সারফারাজ। যতটুকু জানি আপনি একজন কার্ডিয়াক সার্জন হতে চান। কোথায় যাবেন ঠিক করলেন কিছু? আপনার জন্য কিন্তু ভালো সুযোগ আছে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন শুনলাম।”
“আমি এখনো ভাবছি?”
“এখনো ভাবছেন? আশ্চর্য। আপনার হাতে সময় আছে সবে ৬ মাস। আমি তো বলব এখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে নিন। ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকাতে যাবেন। কমপক্ষে ৪ – ৫ আপনার স্ট্রাগল করতে হবে। আরো কমও হতে পারে কজ আপনি ব্রিলিয়ান্ট। এরপর দেশে ফিরে দেশে নামকরা একজন কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে সবাই চিনবে। কি ব্যাপার অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে?”
“না আমি শুনছি আপনার কথা।
”বিবাহিত!”
“জি।
“কয়বছর হলো? সে যতো বছরই হোক না কেন? পুরুষ মানুষের জন্য তা ব্যাপার হলো নাকি? ম্যারিড মেয়েদের নিয়ে অনেক সমস্যা। অনেক ঝামেলা হয় আপনার তো তেমন কিছু নেই। তাহলে ভাবছেন কি?”
সারফারাজ মুখ ফসকে বলে দিল, “এইজন্যই আপনি তাহলে আনমেরিড!”
“ইমপ্রেসিভ। আমার ব্যাপারে একেকটা খবর খুব ভালো ভাবেই নিয়েছেন দেখছি। বাট মিস্টার হ্যান্ডসাম আপনি কিন্তু ম্যারিড!”
সারফারাজ ইতস্তত বোধ করল। ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। ডঃ সাবিনা হেসে উঠলেন। তাকে দেখে কোনভাবেই মনে হলো না সে রাগী একজন।
“ওকে ওকে, মিস্টার শেহদাত। আপনি তো দেখছেন ঘাম ছুটিয়ে ফেলেছেন। ডাক্তাদের এতো তাড়াতাড়ি অস্থির হলে চলে না। আপনাকে একটা কথা বলি ডঃ শেহদাত। কার্ডিয়াক সার্জনের ছড়াছড়ি কিন্তু দেশে তেমন নেই। কোন হেলাফেলা নয় এটা। আপনাকে আগে দৃঢ় মনোবল বানিয়ে নিতে হবে। যদি কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চান তো নিজের ক্যারিয়ারের দিক দিয়ে সিরিয়াস হন। আপনাকে একটা ভালো সাজেস্ট দিই, আপনি ইংল্যান্ডে গিয়ে FRCS করতে পারেন। FRCS খুবই লিউক্রিটিভ ডিগ্রী। সর্বদেশে সম্মানিত। কিন্তু এটা এতোটা সহজ না। আপনাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে, প্রচুর ঘাটতে হবে। অথচ আপনি এখনো এক জায়গায় গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। ভেরি মাচ ডিসাপয়েন্টিং। আপনার থেকে আরো ভালো আশা করেছিলাম। ডঃ শরিফুল আপনার সম্পর্কে আমায় অনেক বলেছে।”
সারফারাজ মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল। হঠাৎ তার মনে পড়ল অর্নিলার কথা। টানা দুই বছর তাকে ছেড়ে ছিলো সে। আবারো কি ছেড়ে চলে যাবে দূরদেশে। ও এবার মেনে নিতে পারবে তো!
“ডঃ শেহদাত।
”জি।
”কথাগুলো কি রিপিটেটিভ মনে হচ্ছে। আগে কোথাও শুনেছেন?
“ডঃ শরিফুল আমায় অনেক আগেই বলেছেন।
“তারপরেও আপনার এই হাল। এ মাই গড। এরপর ডঃ শরিফুল কিভাবে আপনাকে নিয়ে এতো ভাবতে পারেন আমি সেটাই ভাবছি। আমি হলে কবেই হাল ছেড়ে দিতাম!
”সরি ডঃ।
ডঃ সাবিনা বোধহয় বিরক্ত হলেন। পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ”ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন কখনো?”
“হ্যাঁ মানে না।”
“তাহলে তৈরি হন। আপনি এখন বাসায় যান। বিশ্রাম নিন। রাত দেড়টার দিকে একটা ওপেন হার্ট সার্জারি আছে। আপনি সেখানে আমার সাথে যাবেন। ঠিকানা আমি আপনাকে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিবো।
“আচ্ছা।”
“ভয় পাচ্ছেন?”
”না, ভয় কেন পাবো?
”হুম। তবে আপনাকে দেখে অনেক অস্থির মনে হচ্ছে। কাজ করুন আপনার এড্রেস আমায় দিয়ে যান। রাত্রির ১১ টার দিকে আপনাকে পিকআপ করতে চলে যাবো। ওকে।
“ওকে ডঃ!
ডঃ সাবিনার রুম থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সারফারাজ। এখন মনে হচ্ছে তিনি আসলেই অনেকটা ভয়ানক!
.
হাসপাতাল থেকে বের হয়েই প্রথমে সে কল করল অর্নিলাকে। কিছুদিন আগেই নতুন গাড়ি কিনেছে। কিনেছে বললে ভুল হবে বাবা পাঠিয়েছে। এখানে ওখানে যাবার জন্য গাড়ির দরকার ছিলো। তার লাইসেন্স তো আগে থেকেই ছিল। ভাবছে অর্নিলার লাইসেন্স করিয়ে ফেলবে। ভালোই হবে তাহলে। অর্নিলার ক্লাস শেষ হতে ঘণ্টাখানেক বাকি আছে। সারফারাজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অর্নিলাকে পিকআপ করতে। তার পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেকের মতোই লাগল। ভার্সিটির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে অর্নিলার জন্য। টানা ১৫ মিনিট পর বের হতে দেখল অর্নিলাকে। সারফারাজ হঠাৎ করেই একটু তটস্থ হয়ে গেল। কয়েকটা ছেলেমেয়ে ঘিরে আছে অনিকে। দেখে মনে হচ্ছে বন্ধুবান্ধব। অর্নিলার ছেলে বন্ধুও আছে। কই? সে তো জানে না। ব্যাপারটা যেনো তার পছন্দ না। তারা দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে। অথচ সারফারাজের অস্বস্তি হচ্ছে। হুট করে গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল সে। পানির বোতল বের করে এক নিঃশ্বাসে খেতে লাগল। হঠাৎ গাড়ির জানালায় কেউ কড়া নাড়ল। সারফারাজ ফিরে তাকাল। অনি হাত নেড়ে বলছে, “ফারাজ ভাই!”
#চলবে….
#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২০
সারফারাজ গাড়ি ছেড়ে বের হলো। অর্নিলা তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাহু আঁকড়ে ধরে বলে উঠল, “এই যে আমার বর!” কথাগুলো বলা হলো বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে। সকলে সারফারাজ কে দেখছে। সে মৃদু হেসে বলল, “হ্যালো!”
“আরে বাহ অর্নিলা। তোর বর দেখতে তো খুব স্মার্ট। উহুম হ্যান্ডসাম ও বটে।” একটা মেয়ে হেসে বলে উঠল কথাটা। পাশের মেয়েটা মুখ টিপে হাসল। পেছন থেকে একটা ছেলে এসে তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ”আমি রিয়াদ। যাক, আপনার সাথে দেখা করবার ইচ্ছা ছিল আজ হয়েও গেল।”
“দেখা করার ইচ্ছা মানে?”
”কি আর বলব? অর্নিলা আপনার ব্যাপারে এতো বলে কৌতুহল ধরে রাখতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার ধারণা ছিল আপনাকে দেখতে আরো বয়স্ক মনে হবে।”
কিছুটা ইতস্তত বোধ করল সারফারাজ। অর্নিলা চোখ রাঙিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলে উঠল, ” এ কেমন কথা রিয়াদ?”
”রাগ করছিস কেন? আমি তো শুধু কথার কথা বলছিলাম। ওই আমায় রেহানা বলল তোর বর নাকি তোর থেকে অনেক বড় তাই আমিও ভাবলাম সুগার ড্যাডি কি না?”
রেহানা সহ বাকি সবাই হেসে উঠল। কিন্তু অর্নিলার মোটেও ভালো লাগছে না। তার কেবল মনে হচ্ছে তার বন্ধুরা তার বরকে নিয়ে মজা নিচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে বটে। সারফারাজ তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হেসে বলল, “বন্ধুর জন্য এতো চিন্তা দেখে ভালো লাগল। তবে তুমি নিশ্চিতে থাকো, তোমার বন্ধু কোন সুগার ড্যাডি পায় নি।”
“হ্যাঁ, তা ঠিক। আপনাদের দুজনকে অনেক মানিয়েছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী অর্নিলার খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়াটা বেমানান না!”
“বেমানান কেন হবে? বহু যুগ ধরেই দেশে এমনটা হয়ে আছে। আগে তো আরো কম বয়সেই বিয়ে দেওয়া হত। যেমন ধরো আমার মা, তোমার মা কিংবা তাদের মায়েদের!”
রিয়াদ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, “আমার মা এম এ পাশ! এম এ কমপ্লিট করার পর তিনি বিয়ে করেছেন।”
“আর আমার মা ও এম এ পাস করেছেন। বাবা রিটায়ার্ড জজ। মানে আমার পুরো পরিবার শিক্ষিত।” বন্ধু মহল চুপসে গেল হঠাৎ করে। অর্নিলার মুখে মুচকি হাসি। সারফারাজ বলে উঠল, ”কিন্তু তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারোনি। আমার মা বিয়ের পর এম এ দিয়েছেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা যেমন আছে তেমন ঘরের একজন নিপুণা রমনীও বটে। কম বয়সে সব মেয়েদের বিয়ে মানে এই না তাদের জীবন শেষ। সবার ক্ষেত্রে তা ঘটে না। একজন সঠিক জীবনসঙ্গী অবশ্যই তার অর্ধাঙ্গিনীর জীবন বদলে দেয়। বুঝতে পেরেছো!”
রিয়াদের চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে অনেকটাই চুপসে গেছে। তবুও মুখ ফুটে বলে উঠলো, ”কিন্ত এই মর্ডান যুগে?”
“মর্ডান যুগ! থাক বাদ দাও। আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। এরপর দেখা যাবে তর্ক লেগে যাবে।
রেহানা রিয়াদ কে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “থাম,তোর দম্ভ শেষ। সত্যিই অর্নিলা তোর হাসবেন্ড স্মার্টের আর হ্যান্ডসাম এর সাথে সাথে ইন্টালিজেন্টও বটে।”
অঙ্কিতা হেসে বলল, “আমার এবার তোকে হিংসে হচ্ছে অর্নিলা।
অর্নিলা সারফারাজের বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “একদম না। আমার বরের দিকে নজর দিলে চোখ তু লে দেবো।
“বাব্বাহ! কি ভালোবাসা দেখছিস। তো দুলাভাই। শ্যালিকা হিসেবে আমরা তো ট্রিট পাই। দিবেন না!”
সারফারাজ কিছু বলার আগে অর্নিলা ধপ করে বলে উঠলো, “আজ না আরেকদিন। ও সবে মেডিকেল থেকে ফিরেছে। এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেস হবে। নেক্সট টাইম ওকে।”
অঙ্কিতা বলে উঠল,
“দেখলি রেহানা সবদিকে কতো নজর অর্নিলার। কিরে, তুই যে একদম পাক্কা ঘরের বউ আগে তো জানতাম না।”
সারফারাজ হেসে বলল,”হুম, অনি সবকিছু খুব সুন্দর করে সামলিয়ে নেয়।
”আচ্ছা আচ্ছা। ভালোবেসে অনি ডাকা হয় নাকি আবার!”
অট্টহাসিতে হেসে উঠল সকলে। সারফারাজ খানিকটা লজ্জা পেল বটে। রেহানা বলে উঠল, ”আচ্ছা বাবু, তুই তোর ডাক্তার বর কে নিয়ে বাড়ি ফের গে। আমরা না হয় আরেকদিন ট্রিট নিয়ে নিবো। কি তাই তো।”
সকলে মিলিত কণ্ঠে বলল, ”হ্যাঁ তাই!” সকলে হাসলেও রিয়াদের মুখে তখন হাসি মিলিয়ে গেল। সারফারাজ সেটা লক্ষ্য করল বটে। কে জানে এই ছেলের মনে কি আছে। গাড়ি ড্রাইভ করছে আর ভাবছে, এখনকার ভার্সিটির ছেলেমেয়ে গুলো অনেকটাই উশৃঙ্খল। কিছুদিন আগেই তার এক কলিগ ডা. মাহমুদ সুইসা ইড এটেন্ড করছিলো। ভাগ্যিস সময়মতো তার দেহ থেকে বি ষ বের করা গিয়েছিল। এখনো হাসপাতালে ভর্তি। একজন ডা. যখন সু ইসাইড এটেন্ড করে তখন ধরে নিতে হয় ব্যাপারটা অনেক ভ য়ানক। কারণ ডাক্তারের সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু ডা. মাহমুদের ক্ষেত্রে সব সীমা পার হয়ে গেছে। আশপাশের সবার কথা থেকে যা জানল সেটা হলো, ডা. মাহমুদের স্ত্রী নাকি তাকে তা লাক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে করেছেন। যদিও তাদের সংসারের দীর্ঘ ৮ বছর। একটা বাচ্চাও নাকি আছে। তাদের বিয়ের সময় তার স্ত্রীর বয়স নাকি কমই ছিলো। কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রী পড়াশোনা করতে গিয়ে ভার্সিটির একটা ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। তাকে নিয়েই এখন নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন। তাদের ছোট ৪ বছরের ছেলেটা রোজ বাবার পাশে বসে থাকে। দেখলে বড্ড মায়া হয় সারফারাজের। সে জানত মেয়েদের মায়া নাকি বেশী থাকে কিন্তু সবার না। কোনো মা কিভাবে পারে তার সন্তান কে ছেড়ে থাকতে এই ব্যাপারটি সে বুঝে না। এমন ঘটনা নাকি এখন অহরহ ঘটছে। হঠাৎ তার বুক কেঁপে উঠল। কেন মনে হলো রিয়াদ তাকে আর অর্নিলা কে একসাথে দেখে সহ্য করতে পারছে না। যখন অর্নিলা তার হাত জড়িয়ে ধরল তখন কেন রিয়াদের বিষা ক্ত চাহনি এসে পড়ল তাদের সম্পর্কের মাঝে। তার কটাক্ষ, বলা কথাগুলো যেন নিছক মজা ছিলো না। ছিলো তাকে ছোট করা, বুঝিয়ে দেওয়া অর্নিলার সাথে তাকেই মানাত তাকে নয়। আচ্ছা, অনি আবার তাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?
অনি মিনমিন স্বরে কিছু বলছে। সারফারাজ বলল, ”কি বলছিস?”
“বলছি আমি আর ওদের সাথে চলব না।
“কেন চলবি না? ওরা না তোর বন্ধু!
“তাতে কি? রিয়াদ কিভাবে আপনাকে অপমান করল দেখলেন। আর কথা না ওর সাথে। আমার বরের অপমান মানে আমারও অপমান। মজা করে বললেও রিয়াদ ঠিক করেনি। ও তো আর বাচ্চা নয়।“
সারফারাজ ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা। অর্নিলার কথার মাঝে সে তার উওর পেয়ে বাকরুদ্ধ! অস্ফুট স্বরে কিছু বলল। অর্নিলা ফিরে তাকাতেই তার হাতটা শক্ত করে ধরে নিল। অন্য হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে, দৃষ্টি সামনের দিকে। অর্নিলা মৃদু হেসে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল।
.
সারাদিনের সমস্ত গ্লানি মিটে গেল বিকেলের গোসলের মধ্য দিয়ে। রান্না বান্না সব শেষ করে অর্নিলা খেতে বসেছে। পরনে তাল নীল রঙের একটা গোল জামা। বেশিরভাগ সময় বাইরে গেলে এগুলোই তার পরনে থাকে। ঘরে থাকলেই ইচ্ছে করে শাড়ি পরে। শুধুমাত্র তার ফারাজ ভাইকে দেখানোর জন্য। সারফারাজ খাবার টেবিলে বসে বলে উঠল, “গোসল করলি না অনি?”
“করব। অনেক ক্ষুধা পেয়েছে আগে খেয়ে নেই। দেখুন শিং মাছের ঝোল করেছি। আপনার প্রিয় নাহ অনেক!”
ভাতের থালায় খাবার বাড়ল সে। সারফারাজ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ঘেমে একাকার অনি, তার চুলগুলো ঘেমে ভিজে গেছে। অথচ চোখে মুখে ক্লান্তির রেশটুকু নেই। খুব আনন্দের সাথে খাবার বেড়ে দিচ্ছে সারফারাজ। সে চাইলেই পারত তাকে খাবার বেড়ে দিয়ে চলে যেতে। কিন্তু এমনটা করবে না। দুজন একসাথে বসে খাবে। সারফারাজ কে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের জন্য খাবার বাড়তে গেলো। অমনি সারফারাজ বারণ করে দিয়ে বলল, “নে হা কর!” ভাতের লোকমা তুলে দিল তার সামনে। সুযোগ পেয়ে অর্নিলা চেয়ারের উপর পা তুলে বসে খাবারের লোকমা মুখে নিল। বহুদিন পর আজ ফারাজ ভাই তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। সে না করে এতো সাধ্যি তার কোথায়?
.
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। আকাশের চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। আজ বুঝি রাত্রিটা একটু তাড়াতাড়িই নামল। সবে এখন ৭ টা বাজে অথচ বাইরে দেখলে মনে হচ্ছে কতো রাত। তাদের বাসাটা একটু নির্জন এলাকায়। তাই আশেপাশের শোরগোল কম। এর মধ্যে আজ আকাশে চাঁদ উঠেনি। রাতের আকাশ আজ আগের থেকেও অনেক অন্ধকার লাগছে। সারফারাজ বেলকনি ছেড়ে ঘরে ঢুকল। অর্নিলা এখনো শাওয়ার নিচ্ছে। সারফারাজ বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে বসে বই পড়ছে। সময় যেন আগের থেকেও আরো নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে ঘরের বাতি গুলো নিভো নিভো করে উঠল। বাইরে বিকট শব্দ হলো। ঘরের আলো নিভে গেল। লোডশেডিং! সচরাচর হয় না। বোধহয় কোন সমস্যা! বাথরুম থেকে অর্নিলার চিৎকার। সারফারাজ চার্জার লাইট খুঁজছে। পড়ার টেবিলেই তো থাকে। হ্যাঁ, পেয়ে গেল গেল। আলো জ্বালিয়ে এগিয়ে নিতেই দেখল বাথরুমের দরজা খোলা। অর্নিলা ঘরে ঢুকে গেছে। শাড়ি কোনভাবেই পেঁচানো তার ঠিক করে পরতেও পারেনি। চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। আলোর ওই ঝলকানিতে শুধু অর্নিলার মুখস্রী দেখা যাচ্ছে। সারফারাজ বুঝি সম্মোহিত হয়ে গেল। তবু সামলে উঠল। তার কম্পিত কণ্ঠস্বর। ”অনি”! চমকে উঠল সে। কিন্তু মুখ তুলে চাইল না। লজ্জায় তার মুখ নামানো। ভেজা চুল থেকে পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। সারফারাজ এগিয়ে আসছে। অর্নিলার তার শাড়ি খামচে ধরল। কিন্তু সারফারাজ পাশ ফিরে গেল বিছানায়। টেবিলের উপর চার্জার লাইট রেখে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দরজা বন্ধ করল। নিস্তব্ধ পরিবেশে দরজা বন্ধ শব্দে অর্নিলা কেঁপে উঠল। সে যেন ঘোরেই ছিল। কি চলছিলো তার মনে। সারফারাজ বিছানার কাছে বসে অর্নিলা কে ডাকছে। অর্নিলা শব্দ করছে না। হঠাৎ কারো উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে লাফিয়ে উঠল সে। আচমকা অনি ফিরে তাকাল। সারফারাজ তার হাত ধরে বলল, “এদিকে বস, চুলগুলো এখনো ভেজা। পানি পড়ছে!”
অর্নিলা অনমনে গিয়ে বসল তার পাশে। সারফারাজ তোয়ালে দিয়ে তার মাথা মুছে দিচ্ছে। কি যত্ন! আর সে কি ভাবছিল! সবসময় অধিক চিন্তা ভাবনা তার মাথায় ঘুরঘুর করে। আবারো চমকে উঠল সে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। সেই উষ্ণ ছোঁয়া, এই ছোঁয়া তার চেনা।সারফারাজের নরম ওষ্ঠধর ছুঁয়েছে তার পিঠখানা। শরীর ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে গেল। তার ভেজা ব্লাউজ চিপকে আটকে আছে পিঠখানায়। সারফারাজ গরম হাত দুটো ছুঁয়েছে তার গলার কাছে। অর্নিলা চোখ বুজে ছিল। অথচ টের পাচ্ছিল তার প্রতিটা ছোঁয়া। আজ হঠাৎ তার কি হলো? সে কি পাগল হয়ে গেল। ধীরে তার শরীরখানা বিছানায় এলিয়ে দিল। কানের পাশে চুমু গেল সারফারাজ। তার নিঃশ্বাসের প্রতিটা শব্দ সে শুনতে পারছে। সবকিছু মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হয়ে উঠছে। অর্নিলা ধীর স্বরে বলে উঠল, ”ফারাজ ভাই, আপনি কি করছেন? আপনার না একটু পরেই যেতে হবে? অপারেশন আছে।”
কথাবলার মাঝেই সারফারাজ চুমু গেল তার ওষ্ঠাদ্বোরে।তার সম্মোহিত কণ্ঠে বলে উঠল, ”জানি, অনেক টেনশন হচ্ছে তাই নার্ভ ঠিক করার চেষ্টা করছি।”
দৃঢ় কণ্ঠে অর্নিলা বলে উঠল,
”এটা কোন কথা হলো ফারাজ ভাই?”
সারফারাজ থেমে গেল। দুজন চেয়ে দেখছে দুজনকে। পলক পড়ছে বার বার। সারফারাজ অন্য হাত দিয়ে তার শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলতে লাগল, ”আমার প্রথম হার্ট সার্জারি। খুব উত্তেজিত হয়ে আছি। এর মধ্যে ভেজা চুলে তোর আগমণ। তোর ভেজা শরীরের ঘ্রাণ আমায় পা গল করে তুলেছে। তুই কি চাস অনি, অস্বস্তিতে আমি মা রা যাই?
“ছিঃ ফারাজ ভাই। এ কি কথা? আমায় না পেলে আপনি মা রা যাবেন? এটা কখনো হতে পারে?”
শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। তার উষ্ণ হাতের স্পর্শ পাচ্ছে তখন অর্নিলার চিবুক। সারফারাজ তার কানের কাছে ফিসফিসয়ে বলছে, ”বছরের চৈত্র মাস ভয়ং কর মাস। এ সময়টা রোদের তীব্র উৎপাতে সবকিছু ঝলসে যেতে শুরু করে। আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা সেই চৈত্রের মতোই কিন্তু তার চেয়েও ভয়ান ক। এই ভয়ং কর প্রেমের মাঝে তোর উপস্থিতি বিশাল মরুভূমিতে এক বিন্দু জলের সন্ধান পাবার মতোই। বড় দুর্লভ! চৈত্র মাস সর্বনা শা। চৈত্রের রাঙায় দগ্ধ আমার প্রেম তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে তোকে কাছে পাবার আশায়। অনি, তৃষ্ণা মিটাবি না?”
সারফারাজের কণ্ঠে আজ যেন অন্যকিছুই ছিল। এমনটা অনি আগে কখনো শুনেনি। সারফারাজ সরে গেল একটুখানির জন্য। অর্নিলা চেয়ে দেখল। তার প্রতিটা ঘন ঘন নিঃশ্বাস, আলসতায় ডোবা চোখের চাহনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সারফারাজের বলিষ্ঠ দেহ, উন্মুক্ত বুক সবকিছু আজ টানছে তাকে। অর্নিলা যেন প্রস্তুত হয়ে গেল নিজেকে বিলিয়ে দিতে। চোখ বুজে নিল আবারো।
.
পুরো ঘরে আলোর ঝলকানি। কারেন্ট চলে এসেছে। ট্রান্সমিটার বোধহয় ঠিক করা হয়েছে। লাল রঙের চাদরে আবৃত হয়ে আছে অর্নিলা। বিছানার উপরে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে তার মুখে। সারফারাজ চুলগুলো সরিয়ে মুখখানি দেখার প্রয়াস করল। তৎক্ষণাৎ নড়েচড়ে উঠল সে। সারফারাজ কাছে টেনে নিল তাকে। অর্নিলা তার উলঙ্গ বুকে মুখ লুকাল। সারফারাজ ঘড়ি দেখার চেষ্টা করছে। চোখ যেন ঝাপসা হয়ে উঠছে। এভাবে চশমা ছাড়া ভালোই দেখতে পারে সে। শুধু বই পড়ার সময়ই চশমার দরকার পড়ে। হাত দিয়ে চোখ কচালে নিল। হ্যাঁ ১১ টা বাজতে চলল। তাকে বের হবে। অর্নিলার গভীর ঘুম। তাকে ডাকল না সে। একটু সরিয়ে নিল। মেঝে থেকে শার্টটা তুলে নিল। তৈরি হওয়া দরকার।
খানিকক্ষণ বাদেই জেগে উঠল অর্নিলা। আশপাশ খুঁজে পাচ্ছে সারফারাজ। তার ঘুম ঘুম চোখে ঠিক করে কিছু্ই দেখতে পারছে না। হঠাৎ হাতের ছোঁয়া মিলল। হেসে উঠল সে। সারফারাজ কে তৈরি দেখে এক ঝটকায় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
“কয়টা বাজে?”
”১১ টা। আমায় যেতে হবে অনি। তুই ঘুমিয়ে পর।”
”না। আমি ঘুমাবো কি করে? আমি তো চলে যাচ্ছেন…
আরো কিছু বলার ছিলো। তার ললাটে সারফারাজের চুম্বন তাকে থামিয়ে দিল। চোখ মেলে তাকাল ঠিক করে। সারফারাজ মিটিমিটি হাসছে। অর্নিলা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। ফোন বেজে উঠল। সারফারাজ ফোন হাতে বেলকনির দিকে গেল। নিচে গাড়ি দাঁড়ানো। ডা. সাবিনা বোধহয় চলে এসেছেন। ঘরে ফিরে এসে দেখল অর্নিলার তার শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। সারফারাজ এগিয়ে এসে বলল, “আমি আসছি!”
“সাবধানে যাবেন!”
পিছন পিছন এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে বিদায় দিয়ে দরজা আটকে দিল সে। বুকে হাত রেখে দেখল তার হৃদস্পন্দন ধকধক করে শব্দে করছে। এক ছুটে সে ঘরে চলে গেল। বিছানায় চাদরের তলায় মুখ লুকিয়ে যেন বাঁচল।
.
সারফারাজ গাড়ির দরজা খুলতে যাবে, অমনি ডা. সাবিনা বলে উঠলেন, “ওখানে না, এখানে বসে বসুন ডা. শেহদাত। আমার পাশে। কি অসুবিধে আছে?”
“না অসুবিধে কি থাকবে?” এসে বসল তার পাশে।
“আপনাকে দেখে অনেক ফ্রেস মনে হচ্ছে। বউ খুব যত্ন করে তাই কি।
সারফারাজ হাসল। তিনি বললেন, “ঠিক আছে, এবার হলো না। পরের বার আপনার বউয়ের সাথে দেখা করে যাবো।”
“অবশ্যই!”
গাড়ি চলতে শুরু করল। এসে থামল মেডিকেলের সামনে। তারা দুজন সহ আরো কয়েকজন ছিল। সকলেই সারফারাজ এর সিনিয়র ডাক্তার। সারফারাজ তৈরি হয়ে অপারেশন রুমের কাছে এলো। ডা. সাবিনাও তৈরি। তার দিকে ফিরে বলল, “কি? ভয় করছে ডা. শেহদাত।?
“না।
“টেনশন করবেন। মাথা ঠান্ডা রাখবেন। আজ আপনি হচ্ছেন হেল্পিং হ্যান্ড। শুধু প্রসেস দেখবেন। জ্ঞানের চেয়ে অভিজ্ঞতা বেশী ইম্পর্ট্যান্ট!”
”জানি।
”বেশ , তবে চলুন!”
তারা সকলে ঢুকল অপারেশন রুমে। এরপর সবকিছু নিস্তব্ধতায় কাটল। এতোজন মানুষ একসাথে থাকার পরেও কেউ টু শব্দ করল না। ইশারায় সব কাজ সারল। সারফারাজ ভালো করেছে। ডা. সাবিনার নজরে ছিল সে। তাকে একটিবারেও ঘাবড়া/তে দেখেনি। হতে পারে শুধু দেখেছে তাই। যখন নিজে কাজ করবে তখন তো ঘাম ছুটে যাবে। তবুও প্রথমবারে এতোটুকু সাহস সকলের থাকে না। ডা. সাবিনা ইমপ্রেস হলো বটে।
.
সারফারাজ বাসায় এসে পৌঁছাল সকাল ১১ টার দিকে। দরজার সামনে দু’জোড়া জুতো দেখে খানিকটা খটকা লাগল। কেউ কি এসেছে নাকি? নক করতেই অর্নিলা এসে দরজা খুলে দাঁড়াল।
”আপনি এসে গেছেন?”
“কেউ এসেছে অনি?”
অনি হাসার চেষ্টা করল। একটু সরে দাঁড়াতেই দেখল সোফায় বসে আছে ইয়াতিম শিকদার। সারফারাজের টনক নড়ে গেল নিয়াজ শিকদার কে পাশে বসে থাকতে দেখে। চোখ মুখ থেকে ক্লান্তির রেশ সরিয়ে চোয়াল শক্ত করে নিল সে। ঘরে ঢুকতেই অর্নিলা বলে উঠল, “দয়া করে কিছু বলবেন না। বাবা বলেছে কিছু না বলতে। আমাদের বাসায় তারা মেহমান!”
দীর্ঘ টানা ১২ ঘণ্টা পর নিজের বাড়িতে ফিরল সারফারাজ। সারা শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। ক্লান্ত লাগছে বড্ড, মাথাও কেমন ঘুরছে। ট্রেনে রাতের ঘুমটা তেমন হয়নি। এরপর তো অপারেশন রুমের টেনশন। ঘুমের কথা প্রায় একদম ভুলেই গেছিল। শেষমেষ যখন অপারেশন রুম থেকে বের হয় তখন ক্লান্তি অনুভব হচ্ছিল। আশ্চর্য, এতোটা ক্লান্ত সে মোহনগঞ্জ থেকে ফিরে এসেও হয়নি। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ মেলে রাখতে পারছে না। ঘাড়ে ব্যাথা অনুভব করছে। একটু একটু পা ফেলে এগিয়ে গেল সে। সিঁড়ি বেয়ে ফ্ল্যাটে এসে চোখ বুলাল। ব্যাগ থেকে খুঁজে চাবিখানা বের করে দরজার সামনে তাকাতেই বোধ হলো, দরজায় তো তালা নেই। আচমকা ঘোর কাটল তার। হকচকিয়ে উঠল। দরজায় তালা নেই মানে। ঘরে তার মানে কে আছে। চারদিক স্তব্ধ, সারফারাজ আরো নিশ্চুপ হয়ে গেল। মাথায় একসাথে অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবনা চিন্তায় পড়ে গেল। অবশেষে কলিং বেল বাজাল।
দরজায় একটু কাছে এসে কান পাতল। কারো এগিয়ে আসার শব্দ পাচ্ছে। যতোই গাঢ় শব্দ হচ্ছে ততোই তার হৃৎপিণ্ড কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরজার ওপারে অনাকাঙ্ক্ষিত মুখখানি দেখে বিস্মিতবিমূঢ় হয়ে গেল সারফারাজ। অনি! প্রাণবন্ত মেয়েটার মুখে হাসি, হাতে খুন্তি, শাড়ির আঁচলটাও কোমরে গুঁজা। সহজ গলায় বলে উঠল, ”আপনি এসে গেছেন!”
হতভম্ব কণ্ঠে বলে উঠল, ”তুমি? অনি তুমি এখানে!” সারফারাজের কণ্ঠে আশ্চর্য মিশ্রিত। মাথা ঝাকালো সে। স্বপ্ন দেখছে না তো। অনি এখানে কিভাবে আসবে। আজ তো রুদমিলার বিয়ে। বিয়ে ফেলে অনি একা একা এখানে চলে আসবে। তা হয় নাকি? মা বাবা ওকে আসতে দিল! মনে হাজারো প্রশ্ন। অনি তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। হাতের ছোঁয়া পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল সারফারাজ। এটা অনিই। সে মিথ্যে দেখছে না। অর্নিলা মৃদু হেসে বলল, “তাড়াতাড়ি গিয়ে গোসল সেরে নিন। রান্না প্রায় হয়ে গেছে আপনাকে গরম গরম খেতে দিবো।”
”তুমি সত্যিই বিয়ে রেখে চলে এলে অনি?”
অর্নিলার পিছন পিছন ঘরে ঢুকল সারফারাজ। ব্যাগটা সোফার উপর রেখে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অনি। বলে উঠল, ”তো আর কি করতাম? আপনাকে একা ফেলে ওখানে বসে বিয়ের দাওয়াত খেতাম। তা সম্ভব হতো? আপনাকে দেখত কে ফারাজ ভাই?”
“তাই বলে তুমি এভাবে চলে আসবে! কই আমি তো এতোদিন একাই থাকতাম। কখনো তো অসুবিধে হয় নি।”
হাতের খুন্তি দিয়ে তরকারি নড়াচড়া করছে। এদিক মুখ ফিরিয়ে বলল, ”যখন থাকতেন তখন থাকতেন। তখন তো আর বউ ছিলো না। এখন তো আছে। যান আপনি গিয়ে গোসল করে আসুন।”
“কাজটা তুই ঠিক করিস নি অনি। রুদমিলা কি ভাববে? মেয়েটার বিয়ে অথচ আমরা কেউ নেই। ওর কি মন খারাপ হবে না!“
“না হবে না। মন খারাপ হবে না। ও বরং আরো খুশিই হবে। আপনি বেশি ভাবছেন ফারাজ ভাই!” কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল অর্নিলা। সারফারাজ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। অর্নিলা ক্লান্তি ভরা মুখস্রী তাকে থামিয়ে দিল। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটুখানির জন্য দম ফেলার সময় পায়নি মেয়েটা। অথচ এখনো কাজ করে যাচ্ছে। সারফারাজ এগিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে গেল। গ্লাসে পানি ঢেলে জিজ্ঞেস করল, ”কিভাবে এলি? কে এসেছে তোর সাথে? আরাফাত!”
“না তো। আমি একাই এসেছি!”
হতবাক হয়ে গেল সারফারাজ। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল, “বাবা তোকে আসতে দিলো?”
“কেন দিবে না? আমি বড় হয়ে গেছি না। সব কাজ আমি একাই করতে পারি!” শব্দ করে হেসে ফেলল সে। সারফারাজ মুগ্ধ হয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে গেল তার কথাবার্তা শুনে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মেয়েটা তাকে নিয়ে বড্ড বেশি ভাবে। বড় ভালোবাসে তাকে। তার মায়াবতী সে। তা না হলে কি এভাবে ছুটে আসতে পারে। না শরীরে আর কুলাচ্ছে না। ঘরে এসে সোজা ঢুকল বাথরুমে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো সে। এখন অনেকটা ফ্রেস লাগছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে চোখ পড়ল বিছানার উপর। আর লোভ সামলাতে পারল না সারফারাজ। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে অর্নিলা ভাত বেড়ে তাকে ডেকে এসে দেখে তিনি ঘুমাচ্ছেন। একবার ডাক দিবে বলে ভেবেও তটস্থ হয়ে যায়। না থাক কি দরকার। সে তো ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক না! এখন জাগাতে মায়া লাগছে বড্ড। কিন্তু কিছু খেলো না যে? খালি পেটে ওভাবে ঘুমাবে!
এগিয়ে এলো সে। বিছানার কাছেই তোয়ালে পড়ে আছে। অর্নিলা নরম হাতে তার মাথায় হাত রাখে। ইশ্! চুল গুলো এখনো ভিজে। পানি চুয়ে চুয়ে ঘাড় বেয়ে পড়ছে। তোয়ালে হাতে নিয়ে মুছে দিতে লাগল যত্ন করে। তার নরম হাতের ছোঁয়া জুড়ে যাচ্ছে সারফারাজের কপাল জুড়ে। গতরাতে সারফারাজ চলে আসার পর পরই কোন কিছুতে মন বসাতে পারছিলো না সে। গায়ে হলুদে সবাই নাচছে, গান বাজনা করছে অথচ অর্নিলার মনটা পড়ে আছে সারফারাজের কাছে। তাকে এমন আনমনে দেখে রুদমিলা নিজেই বলে উঠল, “তুই ও তো সারফারাজের সাথে গেলেই পারতিস অনি। শুধু শুধু থেকে গেলি। ছেলেটা ওখানে সামাল দিবে কি করে? তোর মনটা তো ওখানেই পড়ে আছে!” কথাগুলো যেন মনে ধরল অনির। সেই তো, আগে ভেবে দেখল না কেন? সময় নষ্ট করেনি একদম। ভোরের ট্রেনে কাউকে না জানিয়ে ট্রেনে চড়ে গেল। তাকে না পেয়ে যখন আরিফ হাসান হন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন তখনই ফোন করলেন অর্নিলাকে। বেচারি ততোক্ষণে হাতের নাগালে চলে চলে গেছে। বাসায় ফিরতে সম’স্যা হয়নি একদমই। রাস্তা ঘাট ওতো ভালো না চিনলেও জায়গার নাম ঠিকঠাক বলেছে। সিএনজি এসে সোজা থামল বাসার সামনে। যাক চিন্তা রইল না আর।
ফোন বাজছে। রুদমিলার ফোন হয়তো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বিকেল ৪ টা ৪৫ বাজে। ওর বিয়ে তো এতোক্ষণে হয়ে গেছে। নিশ্চিত সে অনেক খুশি। ইশ, বরকে সামনাসামনি দেখা হলো না। যাক তাতে কি? নিজের বর কে দেখে মন ভরানো যাক। নিজের বিয়ের দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। কি করেছিলো সে? রোস্ট নিয়ে ছোটাছোটি করেছিলো? ভাইয়া সবার সামনে তাকে বোকা বানিয়েছিলো? অ্যাহ, এসব মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠলো অর্নিলা। সারফারাজ নড়েচড়ে উঠতেই মুখ হাত দিলো তৎক্ষণাৎ। আরেকটু হলেই বোধহয় ঘুমটা ভেঙে যেত তার!
.
তখন চারদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অর্নিলা তার বারান্দায় দোলনার উপর বসে থেকে আকাশ দেখছে। তার হাতের চিরুনির সাহায্যে একটু একটু করে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে। আচমকা পিছনে কারো উপস্থিতি পেয়ে মাথা তুলল সে। সারফারাজ কে দেখতে পেয়ে খানিকটা ঘাবড়ে গেল।
“কি? ভয় পেলি?”
“ও আপনি!”
“কি করছিস?”
”চুল আচড়াচ্ছি।”
বলেই চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। আচমকা তার হাত থেকে চিরুনি নিয়ে নিল সারফারাজ। আলতো করে তার চুল আঁচড়ে দিতে লাগল। অনি দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসল। বেনী পাকালো। অনেকটা অগোছালো সেই বেনী! কপালে হাত রেখে শুধায়, ”মাথা ধরেছে?”
“হুঁ!”
“চা খাবি?”
”উহু!”
সারফারাজ হাসল। তার মাথা টিপে দিতে লাগল। অর্নিলা চোখ বন্ধ করে নিল। সারফারাজ মৃদু স্বরে বলে উঠল, “দেখ অনি, আমি পুরোপুরি ভালো মানুষ নই। কিন্তু আমার দিক দিয়ে আমি ঠিক আছি। নিন্ততাই এক ভদ্রলোক আমি। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম তাই মা বাবা খুশি। ডাক্তার হতে পেরে আমি খুশি। আমার বন্ধুদের আমি বিশ্বাস করি, তারা আমায় বিশ্বাস করে আমার বন্ধুত্ব সার্থক। আর তোকে ভালোবেসে আমার জীবন সার্থক!”
অনি অনেকটা অমনোযোগ হয়েই কথাগুলো শুনছিলো। শেষের কথাটা তার কানে বাজল। একটু হকচকিয়ে উঠে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। ফারাজ ভাই অমায়িক হাসি দিলেন। অনির চোখে অশ্রু জমে গেল। চোখ সরিয়ে ফেলল সে। কেউ একজন বলেছিলো, যখন তুমি ভালোবাসতে শিখবে তখন দেখবে তোমার হৃদয় অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার কথা শুনে তোমার চোখে অশ্রু জমতে শুরু করবে। সেই অশ্রু একদম মুছে ফেলবে না। সেটা হচ্ছে আনন্দের অশ্রু, তোমার ভালোবাসার সাক্ষী!
“হ্যাঁ, শুনেছি আলাদা নাকি থাকছিস। তা অনেকদিন তো হলো। ছয় মাস ত হতেই চলল। কোনো সুখবর নেই!”
অর্নিলা বুক কেঁপে উঠল। ইরা আপু কথাবার্তা কেমন ধা/রালো ঠেকছে তার কাছে। সে পাশ কাটিয়ে বলল, “হবে। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?”
”কিছু নেই। দু বছরের বেশি হয়ে গেল বিয়ের। এখন নয়তো কখন অনি? আমার ছোট ননদের বিয়ের আজ ৬ মাস যেতে না যেতেই সুখবর পেয়ে গেলাম। তোরটা কবে পাবো?”
অর্নিলা মুখ টিপে হেসে বলল, ”তোমার ননদ তো দেখি আপু অলরাউন্ডার! সবাই কি তার মতো নাকি!”
ঝাঝিয়ে উঠল ইরা। “এসব কি কথা? তুই কি এখনো ছোট কিছু বুঝিস না। এখন নয়তো কবে? যত তাড়াতাড়ি হবে ততোই তো ভালো তাই না!”
”কি হবে গো আপু?”
”মজা করিস না অনি। বাচ্চা হবে। বাচ্চার মা হবি কবে?”
”ওহ এই কথা!”
এদিক ওদিক ফিরে তাকাল সে। খুঁজছে একজনকে। গেলো কোথায়? খানিকক্ষণ বাদে চোখে পড়লে। পাশে ফরহাত ভাই দাঁড়িয়ে তার পাশেই শ্রেয়মী। বিয়ের প্ল্যানিং চলছে। আশপাশ আর কাউকে না দেখে অর্নিলা চেঁচিয়ে উঠল, ”ফারাজ ভাই!” সারফারাজ কথা বলছিলো। থেমে পিছনে তাকাল। সাথে ফরহাত আর শ্রেয়মীও চেয়ে রইল। ইরা আপু এখনো ভ্রু কুঁচকে ভাবছে। অর্নিলা চেঁচিয়ে উঠেই বলল, ”ইরা আপু জিজ্ঞেস করছে বাচ্চার বাবা কবে হবেন? আমায় বাচ্চার মা কবে বানাবেন?”
কথাটুকু বুঝতে একটু সময় লাগল। বুঝতে পেরে তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। শ্রেয়মী কোনভাবে মুখের হাসি থামিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ফরহাত না পেরে জোরে জোরে হাসতে লাগল। ইরা আপু শরমে মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছেন না। অর্নিলা দাঁত বের করে হাসছে। ইরা আপু রেগে তার পিঠে দু একটা কিল ঘু/ষি মেরে বললেন, “চুপ করে বেয়াদব মেয়ে। এসব কথা কেউ এভাবে জোরে চেঁচিয়ে বলে নাকি?”
”আরে বাবা মারছো কেন? ভুল কি বললাম। তুমিই তো জানতে চাইলে। এখন বাচ্চা কি আমি একা পয়/দা করব, বাপ কে তো লাগবে।”
ইরা আপু জিহ্ব কামড় দিলেন। ”ছিঃ ছিঃ এসব কি কথা অনি। তোর মুখে বাঁধছে না এভাবে বলতে। চুপ কর চুপ কর!”
অনি কি আর চুপ করার লোক। ঠিক জায়গা মতো দিয়েছে। ভালোই লাগে তার ফারাজ ভাইকে চাপে ফেলে। ফিরে চেয়ে দেখল সারফারাজ এদিকেই চেয়ে আছে। ভ্রু নাচালো সে। ইরা আপু ইতস্তত বোধ করে সামনে ফিরল। সারফারাজের চোখাচোখি হতেই তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, ”বাচ্চা মানুষ, ওর কথা ধরো না তুমি সারফারাজ!”
”জানি আপু। তুমি বরং এই বাচ্চাকে বড় করো। বড় হলে তবেই না মা হতে পারবে। বাচ্চা কি পারবে আরেক বাচ্চা সামলাতে।”
ইরা আপু অর্নিলার কান ধরে বললেন, ”ঠিক বলেছো। ওকেই আগে বড় করতে হবে। আয় তুই আমার সাথে। এদিকে আয়!”
টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল অর্নিলা কে। অনি মুখ ফিরে চেয়ে আছে সারফারাজের দিকে। সারফারাজ ডেকে উঠে বলল, ”ইরা আপু, তোমার বাচ্চা বোনকে বলে দিও। বড় হতে। বড় হয়ে গেলে দুদিন লাগবে না বাচ্চার মা হতে। ওর বড় হতেই বরং সময় লাগবে!”
”আপনি আবারো আমার ঘাড়ে দোষ দিচ্ছেন। দেখি ইরা আপু ছাড়ো। লাগছে আমার।” কান ছাড়িয়ে এসে দাঁড়াল সারফারাজের সামনে। বলে উঠল, ”কি জানি বলছিলেন?”
”বলছিলাম তোমায় বড় হতে। তুমি এখনো বাচ্চাই আছো।”
“কে বলল আপনাকে আমি বাচ্চা আছি।”
সারফারাজ ঝুঁকে গেল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “নাহলে এসব কথা এসে বরের কানের কাছে বলতে। চেঁচিয়ে না! বোকা মেয়ে।”
অর্নিলা হতভম্ব হয়ে গেল। ফারাজ ভাইয়ের এমন কণ্ঠস্বর তাকে থমকে দিল। চেয়ে দেখল সারফারাজ ভাইয়ের মুখটা তার অনেক কাছে। ঢোক গিলল সে। সারফারাজ মুখ তুলে তাকাল। ফরহাত কে বলে উঠল, “ইদের পরেই তো বিয়ে। চল অনেক প্ল্যান বাকি। এই বিয়ের পর আরেক প্ল্যান করব।”
অর্নিলা আচমকা বলে উঠল, ”কিসের প্ল্যান?”
সারফারাজ তার দিকে ফিরে হাসল। জবাব না দিয়ে চলে গেল। অথচ অর্নিলা অস্থির হয়ে উঠল। সেই হাসিতেই একটা জবাব ছিল। কি ছিলো সেই জবাব?
.
মাঝরাতে সারফারাজ ঘরে এলো। কালই তো ইদ। কাল বলেও লাভ নেই, মাঝরাত তো চলেই গেছে। তাদের বাড়ির ছাদে আজ আলোয় ঝলমল করছে। প্রতিবারই করে। চাঁদরাতে বাড়ির সবাই জাগে অনেক রাত অবধি। ছাদের কোণায় বসে মেয়েরা মেহেদী পড়ছে। রুদমিলা মেহেদী পরছে না, সবাইকে পরিয়ে দিচ্ছে। সে মেহেদী পরতে যাচ্ছে অমনি সবাই বলে বেড়াচ্ছে, তুমি তো দু’দিন পর মেহেদী পরবে। বরের নাম লেখাবে। আজ বরং আমাদের মেহেদী পরিয়ে দাও। বেচারী সেই কখন থেকে বসে মেহেদী পরাচ্ছে। সিরিয়াল কমছে না বরং বাড়ছে। নাজিয়া এক কোণায় বসে নিজ হাতে মেহেদি দিয়ে ফরহাতের নাম লিখে মিটিমিটি হাসছে। ফরহাত বসে আছে ওই দূরে কোণায়। এতো আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও তাদের চোখে চোখে কথা দেখে সারফারাজ শেহদাত অবাক হয়ে গেল। ফরহাতের সাহস আছে বলতে হবে। ছাদের চারদিক খুঁজেও যখন অনি কে দেখতে পেলো না তখনি ঘরে এলো। একটু আগেও যেন তাকে ছাদেই দেখেছিলো।
ঘরে ঢুকতেই দেখল অর্নিলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো করছে। সেকেন্ডের জন্য সারফারাজ ঘাবড়ে গেলো। অতঃপর ভালো করে দেখতে লাগল। না তার অনি পাগল হয়ে যায় নি। ওই বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। মুখের সামনের চুলগুলো সরানোর বৃথা চেষ্টা। দু হাত মেহেদী দিয়ে রাঙানো। সে এগিয়ে এলো। আয়নার সামনে তার প্রতিবিম্ব দেখে পিছন ফিরল অনি। ফারাজ ভাই ততোক্ষণে আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। অনি থমকে গেল। এই নিয়ে দু’দুবার তার এমন অনুভূতি তাকে জাগান দিচ্ছে তার ভালোবাসার। ফারাজ ভাইয়ের তার দিকে এগিয়ে আসার ব্যাপারটা, তাকে কাছ থেকে দেখার বিষয়টা কিংবা তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দিচ্ছে। অর্নিলা নিশ্চুপ হয়ে গেল। সারফারাজ বড় আদুরে স্বরে ডেকে উঠল, ”অনি!”
নিচু গলায় বলে উঠল সে, ”হুম!” হাসল সে। হাত দিয়ে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে কানের লতিতে। এগিয়ে গেল এক পা। পিছিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলে ঠেকল অর্নিলার পিঠটা। একটা রাবার বেন হাতে দিয়ে চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে বেঁধে দিল সারফারাজ। অনি বড় বড় চোখ করে দেখছে। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বরের এতো পরিবর্তন! হুট করেই। বিষয়টা ভাবিয়ে তুলছে তাকে। সারফারাজ পিছিয়ে গেছে সেই কখন অথচ তার কাছে থাকার রেশ এখনো ভুলতে পারেনি অনি। তার মুগ্ধ দৃষ্টির প্রতিটা পলকে যেন তার ভালোবাসার জাগান দিচ্ছে। হঠাৎ তার ঘোর ভাঙে। সে জিজ্ঞেস করছে,
“মেহেদী দেওয়া শেষ?”
অর্নিলা হেসে উঠল। বলল, ”হ্যাঁ, এই তো দেখুন আপনার নাম।”
মেহেদীর মাঝে সারফারাজের নামটা যেন জলজল করছে। সারফারাজ শেহদাত। মৃদু হাসল সে। আবারো পিছিয়ে যাচ্ছে। অমনি অর্নিলা ফট করে বলে উঠলো, “তখন কিসের প্ল্যান করার কথা বললে ফারাজ ভাই?”
”কখন?”
“ওই যে তখন। ফরহাত ভাইয়কে যে বললে।”
বড্ড উৎসুক সেই কণ্ঠ। সারফারাজ ক্ষীণক্ষণ চেয়ে থেকে কাছে এগিয়ে এলো আবারো। অর্নিলার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “ওই, তোমাকে বাচ্চার মা বানানোর প্ল্যান!”
শিউরে উঠল অর্নিলা। হঠাৎ করেই সারফারাজের প্রতিটা কথা, তার কথা বলার স্বর সবকিছু তার শিউরে তুলছে। ভয়ংকর ভাবে সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে সে। সম্মোহিত সেই কণ্ঠ। হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। আরাফাত ঘরে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ”বুড়ি আছিস?”
সারফারাজ স্বরে দাঁড়াল তৎক্ষণাৎ। অর্নিলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কোমল কণ্ঠে বলে উঠল, “হ্যাঁ আছি!”
.
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এসেছে। আগামীকালই তো বিয়ে। সবাই মহাব্যস্ত। পুরো পরিবার মিলে হাজির হয়েছে ফরহাতের বাসায়। তার বোনের বিয়ে। দায়িত্ব তার কিছুও কম না। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে বৈকি। গান বাজছে ধীরে ধীরে। মেহমান সবে আসতে শুরু করেছে। অর্নিলা হলুদ রঙের শাড়ি পরে বের হলো সবে। তার হাতে গাজরা। খুব শখ ফারাজ ভাই নিজ হাতে এই গাজরা তার খোঁপায় বাঁধবে। মনে মনে তার কতো আশা। বিয়ে তো গতকালই শেষ হয়ে যাবে। এরপর সে তার কাছে আসবে। সেদিন নিজেই তো বলল, বিয়েটা শেষ হোক। লজ্জায় নাক কান লাল হয়ে উঠল অর্নিলা। ছিঃ এসব কি ভাবছে সে। মুখ টিপে হেসে এদিক ওদিক খুঁজে যাচ্ছে। কোথায় গেলো সে?
এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে ফরহাতের দেখা মিলল। তার কাছে নিশ্চয়ই তার হুদিশ মিলবে। জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল, ”ওই তো ওদিকে দেখলাম!” অর্নিলা হেসে সেদিকেই পা বাড়াল। কার সাথে ফোনে যেন কথা বলছে মনে হলো। একটু দূরে দাঁড়িয়েই ভাবছে। কথা শেষ হলেই এগিয়ে যাবে। খানিকক্ষণ বাদে কথা বলা শেষ হলো। অর্নিলার উৎসুক চাহনি যেন সবটা বলে দিতে চায়। কিন্তু তার অস্থির মুখখানা দেখে চেপে গেল। শান্ত কণ্ঠে বলল, ”কি হয়েছে ফারাজ ভাই?”
সারফারাজ ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। এক নিঃশ্বাসে কতোগুলো কথা বলল। সবগুলোই যেন অর্নিলার মাথার উপর দিয়ে গেল। শুধু দুটো কথা শুনল সে। সে চলে যাবে। আজ রাতের মধ্যেই তাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। ইমার্জেন্সি পেশেন্ট আছে। কাল অপারেশন! ড. শরিফুল ইসলাম তাকে সেখানে থাকতেই বলেছে। যেভাবেই তো তার থাকা চাই। রাতের শেষ ট্রেনেই সারফারাজ চলে যাবে। একবিন্দু সময় নষ্ট করেনি। কখন যে তারা দুজন বাবা কে জানাল, কখন যে “নিকুঞ্জ নিবাস” ফিরল, কখন সারফারাজ চেঞ্জ করে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ল কিছু্ই মনে করতে পারছে না অনি। শুধু এতোটুকু মনে পড়ে রেলস্টেশনে তার হাতে তখনো সেই গাজরা। এতোক্ষণ হাতের মুঠোয় থাকার কারণে এখন ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। তার কান্না পাচ্ছে ভীষণ। ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে আরো অনেক আগে। আরাফাত তার পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, ”মন খারাপ করিস না বুড়ি, ভাইয়ার কাজটাই তো এমন।” অনি বুঝল। সামলে নিল নিজেকে। তাকে অনেক কিছু্ই বুঝে নিতে হয় নিশ্চুপে কারণ সে বড় হচ্ছে। বড়রা সবকিছু মুখ ফুটে বলতে পারে না। কখনো না!
ঈদের ছুটিতে সারফারাজ আর অর্নিলা ফের এসেছে মোহনগঞ্জ। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। সারফারাজের ছুটি তেমন পাই নি। বিশ রোজ অবধি তো শহরেই ছিল। শাহিনুর বেগম কতোবার করে ফোন করলেন, চলে আসতে। একটাই তো রোজা, তাও বছর ঘুরে। তাও বুঝি দুজনের সময় হলো না। অর্নিলা ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে আর সারফারাজ ব্যস্ত মেডিকেল নিয়ে। অর্নিলা তবুও যেন সকল ব্যস্ততা কাটিয়ে যেতে পারত কিন্তু গেলো না, কেমন করে যাবে? বরকে এখানে একা ফেলে কি যাওয়া যায়। এতোদিন পর গ্রামে নিজ বাড়িতে ফেরত এসেছে যেন বুক ভরে শ্বাস নিল অর্নিলা।রোজার শুরু থেকেই আরাফাত এখানে। আরাফাত চান্স পেয়েছে বুয়েটে। যাক, তার স্বপ্ন পূরণ হলো। তাদের এক জুটির দুই স্বপ্ন ছিল। একজন পূরণ করতে পেরেছে বলে অর্নিলা বেশ খুশি। সেখানে হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করছে সে। অর্নিলা বসার ঘরে এসেই দেখতে পেল আরাফাত চেয়ারে বসে আম খাচ্ছে। অর্নিলা আহম্মক এর মতো কতোক্ষণ চেয়ে রইল। দুপুর গড়িয়ে গেছে। এই রোজার সময় এতো বড় হাবলা ছেলে নাকি রোজা রাখেনি। সোফার কুশন গায়ে ছুঁড়ে মেরে বলল, “কি রে হাবলা! তুই রোজা রাখিস নি কেন?”
আরাফাত উল্টো হাসল। বলল, “খাবি!” এ তার ছেলেবেলার অভ্যাস। সবসময় অর্নিলা কে জ্বালাতন করা তার চাই। অর্নিলা মুখ ভেংচি কেটে বলল, ”আমি তোর মতো নাকি রে? আম্মু জানে তুই এই কাজ করেছিলি। মা! ও মা এসে দেখো। তোমার হাতির মতো ছেলে রোজা না রেখে আম খাচ্ছে!”
সারফারাজ ব্যাগ হাতে নিয়ে ঢুকল। ঘেমে একাকার! ক্লান্ত দেহ নিয়ে সোফায় বসে পড়ল। শাহিনুর বেগম ছেলের পিছন পিছন এসে মাথার উপর ফ্যানটা ছেড়ে দিলেন। ধীরে সুস্থে বললেন, “ওকে বলিস না, ও শরীর ভালো নেই।”
“শরীর ভালো নেই! অ্যাহ, সব ঢং। ছেলে তো তাই দোষ দেখতে পাও না।
“এভাবে কেন বলছিস। আমি কি সবসময় তোর দোষ দেখি বল তো। ছেলেটা গতকাল থেকে ইফতারের পর থেকেই শরীর টা খারাপ। কয়েকবার বমি করেছে। স্যালাইন ও দিয়েছে রাতে একটা। আজকের দিনটা যাক।
“হ্যাঁ, তাই বলে এভাবে রাক্ষসের মতো খাওয়া দাওয়া করবে।
“ভালো হয়েছে। যা ঘরে নিয়ে ফ্রেস হয়ে নে। সারফারাজ ঘরে যাও।”
সারফারাজ উঠে দাঁড়াল। এক হাতে ব্যাগ নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। আরাফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “শরীর কেমন? ভালো তো! প্রেসার লো ছিলো নাকি?”
“হ্যাঁ, তেমনটাই। একদম নিচে নেমে গেছে। এখন ভালো আছি। কিরে বুড়ি? আম খাবি। এই দেখ…
বলেই কামড় বসাল। অর্নিলা মুখ ভেংচি কেটে চলে গেলো। আম তার ভীষণ পছন্দ। আর এই পাকনা ছেলে তাকে এভাবে খোঁচা দিচ্ছে! সারফারাজ মৃদু হেসে বলল, “পড়াশোনার চিন্তা এবার একটু কমিয়ে কর। তাহলেই শরীর ঠিক থাকবে!”
.
তারাবীহ নামায শেষে সারফারাজ, আরাফাত আর আরিফ হাসান একসাথে বাসায় ঢুকলেন। অর্নিলা বেলের শরবত করে রেখেছিল। মা ও নামাজ শেষে ঘর ছেড়ে বের হলেন। বসার ঘরে সবাই একসাথে। দেখে তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। দুদিন বাদে, শ্রেয়মী, রুদমিলা, ফরহাত সকলে চলে আসবে। বাড়ি আরো জমজমাট হয়ে উঠবে। ভাবতেই খুশিতে তার চোখ দুটো ভরে উঠল। দ্রুত চোখ মুছে খাবারের কথা বললেন তিনি। সারফারাজের শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। সে বলে উঠল, ”এখন আর খাবো না। ঘুমাবো। মাঝরাতে একবারে উঠে খাবো।” হাঁটা ধরল ঘরের দিকে। পিছন পিছন এসে হাজির হলো অর্নিলা। সারফারাজ তখন সবে গায়ের পাঞ্জাবী খুলে বিছানার উপর রাখল। অর্নিলা পাঞ্জাবি হাতে তুলে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে। সেও এদিক ফিরল। দুজনের চোখাচোখিতে অর্নিলা মুখ টিপে হেসে উঠল। তার লজ্জা মাখা হাসির মানে দাঁড় করাতে সময় লাগল না সারফারাজের। ড্রয়ার থেকে একটা টি শার্ট নিয়ে অর্নিলার মাথা টোকা মেরে বলল, “রোজার মাসে এসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দে অনি!”
“ওমা আজে বাজে চিন্তা আবার কি ফারাজ ভাই? আমার হক আছে আপনার উপর।”
”রোজার মাসে যেন একটু বেশিই হক নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছিস।”
“অবশ্যই তা তো করতেই হবে। আচ্ছা ফারাজ ভাই, আপনার আমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করে না।”
“ছিঃ ছিঃ রোজার দিনে এসব কী ধরণের কথাবার্তা!”
“তো কি? রোজা তো দিনে ছিলাম এখন তো রাত।”
“রোজার মাসে আল্লাহর দরবারে দোয়া চাইতে হয় অনি। ওসব কর!”
“স্বামীর খেদমত করলেও কিন্তু সোওয়াব আছে ফারাজ ভাই!”
কথাখানি বলেই মুখ টিপে হাসল অর্নিলা। সারফারাজ গম্ভীর মুখে বলে উঠল, ”তোর মতো নির্ল/জ্জ মেয়ে আমি একটাও দেখেনি অনি। কতো মুখ পাতলা মেয়ে তুই!”
”এমন নিরামিষ বর পেলে সব মেয়েরাই নির্ল/জ্জ হয়ে যাবে। আচ্ছা, আপনি কি একটু বলেন। সে তে সেদিন একবার চুমু খেলেন এরপর তো ধারে কাছেও ঠেকলেন না। সোজাসুজি বলুন, আমায় আপনার ভালো লাগে না!”
সারফারাজ শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে উঠল, “তুই নিজেই ভেবে দেখ, এ’কদিন আমি নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকু পেয়েছি কি না!” চলে গেলো ওয়াশরুমে। অর্নিলা চুপ হয়ে ভাবতে লাগল। সত্যিই তাই, এ’কদিনে ফারাজ ভাই তেমন একটা ঘরে থাকেনি। সেই সকাল বেলা ঘর থেকে বের হওয়া লোকটা সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরত। তাকে দেখতেই তখন মায়া লাগত। গায়ের এপ্রোন সহ ভিজে উঠত ঘামে। মেডিকেল এ তার উপর কি ধকল যাচ্ছে সেটা সে বুঝতেই পারছে। এরপর তো রোজ রাতেই পড়ার টেবিলে বসে থাকত। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটা তার ছেলেবেলা থেকেই। সেই স্বপ্নের পিছনে এখনো সে ছুটছে। অথচ টের পাচ্ছে না,তার জন্য ও তো কেউ অপেক্ষা করছে। সেও তো তার মতোই ছোট থেকে তার পাত্তা পাবার চেষ্টা করত। তাও বললে কম হবে। সেদিন মাঝরাতে উঠেও ফারাজ ভাইকে হসপিটাল যেতে হয়েছে। ইমার্জেন্সি ছিল। তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ভোরে চোখ লেগে গেলো টের পায়নি অর্নিলা। অতঃপর যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন তার চক্ষু চড়কগাছ! কলিং বেল বাজছে সেই কখন থেকে। কি গভীর ঘুমেই না ছিলো সে। ফারাজ ভাইয়ের ৪৯ টা মিসকল। আধ ঘন্টার কম তো হবেই না। ছুটে এসে দরজা খুলল সে। চিন্তায় তার বুক ধুক পুক করছিলো। ভেবেছিল এখনি একটা ধমক খাবে। কিন্তু যখন ফারাজ ভাই তার দিকে ফিরে মলিন হাসি হেসে বলে উঠল, ”ঘুমিয়েছিলি নাকি অনি?”
সে তখন মুখ ফুটে শব্দ করেনি, একটা কথাও বের হয়নি তার কণ্ঠ থেকে। শুধু ইচ্ছে করছিলো কাঁদতে। আগে মনে হতো ফারাজ ভাই বুঝি কিছু থেকে কিছু হলেই রেগে যায়। কিন্তু না, সে কখনো রাগতে পারেনা। এমন সহজ সরল একটা মানুষ আবার রেগে থাকে কি করে। এরপর রোজা! এতোগুলো রোজা গেলো, সে প্রতিদিন রোজা রেখে মেডিকেলে ছোটাছোটি করে এসেছে। মাঝে মাঝে তো মাঝরাস্তায়ই মাগরিবের আজান দিয়ে দিত। কে জানে কিভাবে সামাল দিতো। অনি বুঝে পারে না, এই লোকটা এমন কেন? দরজা খোলার শব্দ। ফিরে তাকাল সে। সারফারাজ চেঞ্জ করে বের হয়েছে। পরনে বাদামী রঙের টি শার্ট আর ট্রাউজার। দেখে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। এখনি বিছানা পেলে সে ঘুমিয়ে পড়বে। সত্যি সত্যি তাই হলো। সে ঘুমিয়ে পড়ল। অর্নিলা হেসে উঠল। যাক, এতো বছর অপেক্ষা করতে পারলে আরো কিছুদিন সে অপেক্ষা করতে পারবে। এই নিরামিষ বরকে আমিষ বানিয়ে সে ছাড়বেই!
রাতে ঘুমানোর সময় সারফারাজের কপালে হাত রাখল অর্নিলা। চুমু খেলো তার ললাটে। কপালে হাত বুলাতে লাগল। ক্রমশই তার কোল যেন দখল করে ফেলছিলো ঘুমন্ত সারফারাজ। অর্নিলা মোটেও বাধা দেয়নি। আগলে নিয়েছিল তাকে। তাকে আগলে ধরে চোখ বুজে নিল সে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙল সারফারাজের। নিজেকে অর্নিলার কোলের মাঝে দেখে মোটেও অবাক হয়নি সে। এমনটা এর আগে বহুবার হয়েছে। ঘুম থেকে জাগলে নিজেকে অর্নিলার কাছেই পায় সে। দু হাতে সে আগলে নেয় তাকে। ঘড়ির দিকে ফিরে তাকাল। ৩ টা বাজতে চলল। মা বুঝি এখনি উঠে যাবে। সারফারাজ উঠে নিল। আবারো ফিরে তাকাল অর্নিলার দিকে। ঘুমন্ত অর্নিলার ললাটে চুমু খেল। হাতখানা রাখল থিতুনি। ল্যাম্পশেডের অল্প আলোতে অর্নিলার মুখস্রী উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো। সারফারাজ মায়ার জালে আটকে যাচ্ছিল ক্রমশ। হাতের আঙ্গুল দিয়ে অর্নিলার ওষ্ঠাদ্বোর ছুঁয়ে দেখল। অর্নিলার তখনকার কথাগুলো মনে পড়ল। আচমকা হেসে চুপসে গেল। সত্যিই তার আফসোস হচ্ছিল। অনেকদিন যাবত অনি কে সে সময় দিতে পারছে না। কিন্তু এভাবে আর কদিন। অনি এখন তার বউ, তার সম্পর্কের জটিলতা ভেঙে এখন অনেকটা সহজ। এখনো পিছিয়ে থাকা কি ঠিক! চুমু খেলো ঘুমন্ত অর্নিলার ওষ্ঠাদ্বোরে। তার ঠোঁট দুটো নড়েচড়ে উঠল। এ যেন বলছে, ইশ, এতো ছোট চুমু খেলেন ফারাজ ভাই। আরেকটু খেলে আপনার কি বয়ে যেত।” সারফারাজ হেসে উঠলো। তার এমন কথাবার্তা শুনে সে না হেসে পারে না। উঠে গেল ওযু করতে। এসে তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে অনি কে ডাকতে লাগল। এই মেয়ে উঠেনি। উল্টো চাদরে মাথা ঢেকে হা হুঁ করতে লাগলো। থাক , আর ডাকে নি সারফারাজ। আজ কম ধকল যায় নি। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘর থেকে টুকটাক শব্দ আসছে। মা উঠে গেছে। বাবা বসার চেয়ারে বসে আছেন। আরিফ হাসান ছেলেকে দেখতে পেয়ে কাছে ডাকলেন। শুধালেন, “অনি উঠেনি?”
“না, ঘুমাচ্ছে। থাক আরেকটু পর উঠবে।”
মা রান্না ঘর থেকে বলে উঠলেন, “সারফারাজ, চা খাবে!”
”হ্যাঁ খাবো!” দু কাপ চা নিয়ে মা এলেন। আরিফ হাসান আর সারফারাজ ছেলেকে নিয়ে বারান্দার দিকে গেলেন। বাতি জ্বালালেন। বেতের চেয়ারে বসে বললেন, ”বলো। কেমন আছো? অনির সাথে তোমার সম্পর্ক সহজ হলো আদৌও। সে রাতে যা করেছিলে তার জন্য ক্ষমা চেয়েছো?”
সারফারাজ মাথা দুলিয়ে না করল। সত্যিই সে এখনো ক্ষমা চাইতে পারেনি। তার ক্ষমা চাওয়া উচিত। আরিফ হাসান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ”বসো!” সারফারাজ বসে পড়ল। দীর্ঘদিন পর বাপ ছেলে মুখোমুখি। দু চারটে কথাবার্তা হচ্ছিল তাদের মাঝে। খানিকবাদে মা এসে খেতে ডাকলেন। পিছন পিছন অর্নিলা হাজির। তার ঘুম পুরোপুরি এখনো ভাঙেনি। ইয়া বড় একটা হামি ছাড়ল সে!
.
শ্রেয়মী, রুদমিলা আর ফরহাত চলে এসেছে। সবাই রুদমিলা কে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে। ঈদের পরেই তার বিয়ে। বিয়ের পরেই সারফারাজ আর অর্নিলা কে শহরে যেতে বলছে। ছেলে কি করে? নাম ধাম কি? এসব জিজ্ঞেস করতে করতে অর্নিলা ক্লান্ত হয়ে গেল। সারফারাজ দূরে বসে বলল, “একটু থেমে বল অনি, রোজা রেখে কেউ এতোকথা বলে। কিছুক্ষণ পর দেখবি হুটহাট করে পানি খেয়ে ফেলবি। ধীরে সুস্থে কথা বল!”
অর্নিলা মুখ ভেংচি কাটল। সকলে হাসতে লাগল। এই ভুল অর্নিলা প্রতি রোজায় করে। সবসময় তার এই কাণ্ড নিয়ে হাসিতামাশা হয়। ফরহাত সোফার কোণায় বসে পড়ল। তাকে দেখে বেশ চিন্তিত লাগছে। সারফারাজ শুধালো, ”কিছু হয়েছে?”
”হুম বস। বিরাট কাণ্ড ঘটেছে।
”কি?”
“আমার গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
“ গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে মানে? তুই এর মধ্যেই নতুন জুটিয়ে ফেলেছিস তার বিয়েও ঠিক হয়ে গেল। কি রে? তোর কি পুত্র রাশি নাকি? যেই মেয়েকেই ভালো লাগে তার পিছনেই বর ছুটে বেরায়।
ফরহাত মুখ গম্ভীর করে বলল, ”প্রথমত পুত্র রাশি বলে কোন রাশি নেই। আর আমি কি জানব। যাকেই ভালো লাগে তার ফ্যামিলি উঠে পড়ে লাগে বিয়ের জন্য।”
”তা ভালোই। চাচীকে বল!
”কোন মুখে বলি, রুদমিলার বিয়ে। এখন বলা যায়। ওর বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে বললেও হতো। শা/লার ভাগ্যটাই খারাপ।
“বুঝলাম। মেয়েটা কিন্তু মেয়েটা কে?”
”ওই, না…
সারফারাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “নাজিয়া!”
“হ্যাঁ, তুই জানলি কি করে?” দুজন মুখোমুখি তাকাল। ফরহাত সামনে তাকিয়ে দেখল স্বয়ং নাজিয়া দাঁড়ানো। ওহ নাজিয়া তার দুঃসম্পর্কের বোন। ফরহাত ওকেও ছাড়েনি। হতভম্ব হয়ে ফিরে তাকাল। ফরহাত হেসে বলল, “চুপসে যাবি। আগের কথা কিছু বলবি না হ্যাঁ!”
“ও আমার বোন হয় ফরহাত।“
“তাতে কি? আপন তো না। মেয়েটা ভালো। অনেকদিন ধরেই পিছনে পড়ে ছিল তাই পাত্তা দিলাম।
”তোর পিছনে নাজিয়া পড়ে ছিল! আর কিছু!”
“তুমি আর কি বুঝবা আমার খেল। আমি যে কি তা তো জানো না!”
“ক্যারেক্টারলেস!”
”ছিঃ রোজার মাসে এসব বাজে কথা কেউ বলে নাকি?”
সারফারাজ আড়চোখে তাকাল। ফিরল নাজিয়ার দিকে। বেচারি যেন ফরহাত কে দেখে শরমে মরে যায়। ফরহাত সত্যি তাহলে মিথ্যে কিছু বলেনি। ও পাক্কা প্লে বয়। আত্মীয় স্বজন আরো আসতে শুরু করেছে। অর্নিলা বড় ফুফু, ছোট ফুফু চলে এলো। তাদের ছেলে মেয়ে ও বটে। ছোট ফুপুর মেয়ে ইরা হুট করে অর্নিলার হাত টেনে আড়ালে চলে গেল। জিজ্ঞেস করল, ”কি রে? কি শুনলাম এসব! তোর আর সারফারাজের মধ্যে নাকি কিছুই হয় নাই।”
অর্নিলা অবশেষে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। কিন্তু ঢাবিতে চান্স না পাওয়ার দুঃখ তার কখনোই ঘুঁচবে না এরমধ্যে তো আছেই ফারাজের দুরত্ব তার অবহেলা। এই অবহেলা সইতে সইতে সে এখন ক্লান্ত। মাঝে মাঝে মন চায় অভিমান করতে, আর কথা বলবে না ফারাজ ভাইয়ের সাথে। কিন্তু এমনটা করতে পারে না সে। তার মন মানে। বার বার তার কাছে নেতিয়ে পড়ে। বটগাছের মতো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। মন বলে, কার কাছে এতো দম্ভ দেখাবে সে তো তারই জীবনসঙ্গী! যদি ফারাজ ভাই তাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের প্রতি আসক্ত থাকত তবু না হয় কিছু বলা যেত। তেমন কোন লক্ষণ ও তো নেই। তাও আজ চুপি চুপি গিয়ে ফারাজ ভাইয়ের ফোনটা তুলে চেক করছিলো। ভাইয়া তখন ঘরে ছিলো না। ভালো করে ফোন চেক করছিলো সে। এতো গভীর মনে চেক করছিলো যে ভাইয়া কখন এসে পাশে বসল তার খেয়াল হলো না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও যখন কিছু পাওয়া গেল না, তখন তার মন থেকে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। হঠাৎ পাশ থেকে ভাইয়া যখন বলে উঠল, “চেক করা হলো? নাকি আরো কিছু বাকি আছে?”
তড়ফড় করে লাফিয়ে উঠল অর্নিলা। হতভম্ব হয়ে ফিরে তাকাল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। ভাইয়া কি এতোক্ষণ এখানেই ছিল। ছিঃ ছিঃ, লজ্জায় তার মুখ নিচু হয়ে গেল। ফারাজ ভাই ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, “আর কিছু দেখার নেই?” আর সেখানে দাঁড়াতে পারল না অনি। চট করে চলে এলো নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে বসে রইল। পণ করল, যতক্ষণ না অবধি ফারাজ ভাই ডাকছে ততোক্ষণ সে ঘর ছেড়ে বের হবে না। কিন্তু তার মনস্থির বেশিক্ষণ রইল না। খানিকক্ষণ বাদেই দরজায় কড়া কেউ। অর্নিলা কান পেতে শুনছে। কেউ বোধহয় ঘরে এসেছে। মেয়েলী কণ্ঠ আসছে। অর্নিলা আরো ভালো করে কান পাতল। গলা চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে মেঘলা এসেছে! হ্যাঁ, সেই।
দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি মেরে দেখতে লাগল। ফারাজ ভাই হেসে হেসে মেঘলার সাথে কথা বলছে। অ্যাহ হাসির কি বাহার! সবে মনে পড়ল, ফোনে কি আছে? ফোনে তো কিছু থাকার কথা নেই। মেঘলা বদের হাড্ডিটাই তো এখানে। ফোনে আবার কারো থাকার কি দরকার? যেই ভাবল ঘর ছেড়ে আর বের হবে না অমনি মেঘলার আসতে হলো। ধুর! ঠিক করে অভিমান টাও সে করতে পারছে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বের হলো ঘর থেকে।
মেঘলার দিকে ফিরে একগাল হেসে বলে, ”তা তুমি? কোন কাজে এসেছো নাকি?”
“হ্যাঁ, ওই সারফারাজ ভাইয়ের এসেছি। একটু দরকার ছিল।
”তো দাঁড়িয়ে কেন? বসো না!”
“হ্যাঁ, বসছি!”
অর্নিলা আড়চোখে দেখছে। ঢঙ করে বসছে মেয়েটা। ভালো করে একটু দেখে নিল। চুল গুলো স্টাইল দিয়ে কাটা। নিজের চুল গুলো ছুঁয়ে দেখল। কোমর অবধি তার বেনী করা চুল। পরশু আঁচড়ে বেণী পাকিয়ে রেখেছিলো। ধুয়েছিল কবে তাও মনে পড়ছে না। একটু সংকুচিত হয়ে গেল অনি। আড়চোখে মেয়েটাকে দেখছে। যাতে সে বুঝতে না পারে অনি তাকে দেখছে। ফারাজ ভাই কেমন হেসে হেসে জিজ্ঞেস করছে, ”পড়াশোনার খবর কি তোমার?” কেন? তার পড়াশোনা জেনে আপনার কাজ কি ফারাজ ভাই? এতো কেন জানতে হবে সবকিছু?
মুখ ভেংচি কাটলো। মেঘলা সেজেছে। চোখে লেপ্টে কাজল দিয়েছে। ঠোঁটে ছোঁয়া রঙ। অর্নিলা নিজের ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরল। ঠোঁট ফেটে চামড়া বেরিয়ে গেছে। হঠাৎ মনে হলো, মেঘলা অনেক সুন্দরী। টকটকে তার গায়ের রঙ। একটু ফুল ছুঁইয়ে দিলেই যেন লালচে হয়ে উঠে। এমন মেয়ের দিকে নজর পড়বে না তো কোথায় পড়বে। আশপাশ উসখুশ করছে, একটু আয়নাতে নিজেকে দেখে নিতে ইচ্ছে করছে। কেমন লাগছে কে জানে?
সারফারাজ বলে উঠে, ”অনি? একটু চা নিয়ে আসো মেঘলার জন্য!”
অ্যা! এতো সাধ! আমি আনব ওর জন্য চা। অর্নিলা হাসল। শাড়ি কোমরে গুঁজে বলল, ”যাচ্ছি!” এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, “কিন্তু ফারাজ ভাই, ঘরে তো চা পাতি নেই, সকালেই ফুরিয়ে গেছে।” সারফারাজ আশ্চার্যিত ভঙ্গিতে চেয়ে রইল অর্নিলার দিকে। এমনভাবে মেহমানের সামনে এই কথা অনি বলবে তা ধারণার বাইরে ছিল। হাসার চেষ্টা করল। অনি দাঁত বের করে হেসে তাকিয়ে আছে সারফারাজ শেহদাতের দিকে।
মেঘলা হেসে বলল, ”থাক, সারফারাজ ভাইয়া। আমি চা খাই না!”
“ওহ খাও না। যাক ভালো হলো!” বলেই ধপ করে বসে পড়ল সারফারাজের পাশে। সারফারাজ ধীরে স্বরে বলল, ”আচ্ছা ঠিক আছে,বিস্কুট নিয়ে আসো!”
”ও তো পরশু শেষ হয়ে গেছে!”
সারফারাজের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। একটু বিচলিত হয়ে বলল, ”তাহলে মিষ্টি তো আছে। আমি গতকালই এনেছিলাম..
“ফারাজ ভাই, আপনি জানেন না। আমি মিষ্টি কতো পছন্দ করি। দু পিস ই ছিলো। দুপুরেই আমি খেয়ে ফেলেছি।” বলেই গালভর্তি হাসল। সারফারাজ নিশ্চিত হয়ে গেল অর্নিলা পুরোপুরি মিথ্যে কথা বলছে। মেঘলার সামনে কিছু বলতেই পারছে না। এ যেন গলায় কাঁটা বিধবার মতো হলো। মেঘলা হেসে বলল, “থাক না, আমি খেয়েই এসেছি। এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”
অর্নিলা চটপট জবাব দিলো, ”আমার হাত অনেক ব্যাথা করছে ফারাজ ভাই। আমি এখন রাঁধতে পারব না।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সারফারাজ উঠে দাঁড়ায়। মলিন মুখে বলে, “তুমি বসো মেঘলা। আমি নুডলস্ রেঁধে আনছি।”
অর্নিলা উৎকণ্ঠে বলে, ”ওই সস্তা নুডলস্!” চোখ রাঙিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় সারফারাজ। তাতে অর্নিলার কিছু যায় আসে না। করুক গে রাগ। মেঘলা বোধহয় কিছু বলতে চাইছে। অর্নিলা বাঁধা দিয়ে বলে উঠে, ”আরে মেঘলা, তোমার টেস্ট এক্সাম কেমন গেলো?”
“ভালো!” বলেই রান্নাঘরের দিকে উঁকি ঝুঁকি মারছে। বার বার উসখুশ করছে। অর্নিলা চোখে মুখে বিজয়ের হাসি। ভালোই হয়েছে ফারাজ ভাই কে রান্নাঘরে পাঠিয়ে। এই মেঘলার থেকে ভাইয়া যত দূরে থাকবে ততোই মঙ্গল! এতোক্ষণ তো ভালোই মুখ দিয়ে গড়গড় করে কথা বের হচ্ছিল এখন আর কথা বলছে না। ইশ, ফারাজ ভাই কে দেখলেই মনে হয় মুখটা শুধু চুলকায়। অর্নিলা আবারো জিজ্ঞেস করল, “আন্টি কেমন আছে?”
“ভালো!”
“আর তোমার আব্বা?”
“সেও ভালো!”
অর্নিলা হাসল মেঘলা কে অস্থির হতে দেখে। ইশ,কতোই না সুখ লাগছে না। হঠাৎ সারফারাজের কণ্ঠ। অর্নিলা ঠিক শুনলো, ভাইয়া তাকেই ডাকছে। মেঘলা চট করে দাঁড়িয়ে বলল, “ওই সারফারাজ ডাকছে!” বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। অর্নিশা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ের সাহস তাকে হতবাক করে দিল। রে/গে উঠে দাঁড়ায় সে।
রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মেঘলা। ভেতরে সারফারাজ। সামান্য কিছুক্ষণ রান্নাঘরে থেকেই ঘেমে একাকার সারফারাজ। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সেগুলো শার্টের হাতায় মুছে ফেলল। তাকে দেখতে এখন আরো আকর্ষণীয় লাগছিল। সারফারাজ মনে করল অনি এসেছে। তাই বলে উঠলো, “অনি ওই তেলের বোতলটা কোথায়? আরে তুমি?”
মেঘলা হাসে। খোলা চুল গুলো খোঁপা বাঁধে সারফারাজের সামনে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় সারফারাজ। কিন্তু মেঘলার দিকে নয়, তার পিছনে অনির দিকে। মেঘলা খুশি খুশি মনে বলে উঠে, “বাহ সারফারাজ ভাইয়া! আপনি এতো ভালো রান্না পারেন। জানেন আমার খুব শখ, আমার বর ও রাঁধতে পারবে!”
“তাহলে এমন বর খুঁজে নেও না মেঘলা, অন্যের বরের দিকে আর নজর নাই বা দিলে!”
মুখ তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে উঠে অর্নিলার জবাবে। অর্নিলা তাকে পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে। থমথমে কণ্ঠে সারফারাজ কে বলে, “ওই তো ওই দিকে তেলের বোতল!”
সারফারাজ নিশ্চুপে মাথা নাড়ে। মনে হচ্ছে ঘরের আবহাওয়া ঠিক নেই। অর্নিলা ফের মেঘলার দিকে ফিরে। হেসে বলে উঠে, “তুমি কেন ছুটে এলে মেঘলা? ফারাজ ভাই তো আমায় ডেকেছিলো। শুনো নি? ইশ, এতো ছোট বয়সেই কান দুটো নষ্ট করে ফেললে। সারাদিন কি হেডফোন গুঁজে গান শুনো নাকি?”
সারফারাজ ইতস্তত বোধ করছে। সে কিছু বলতেও পারছে না মেঘলার সামনে। মনে হচ্ছে, এখন কথা বলাই বিপদ/জনক! মেঘলা ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, ”ওই পানি খেতে এসেছিলাম।”
“কিন্তু পানি তো বসার ঘরেও আছে!”
“কিন্তু ফ্রিজ তো এখানে। আমি ঠান্ডা পানির জন্য এসেছিলাম।”
“ঘরের কি কোথায় সব যেন তোমার মুখস্থ!”
”হ্যাঁ, আগে রোজ আসতাম তো তাই!”
”রোজ আসতে?” প্রশ্নটা মেঘলা কে করলেও ফিরে তাকায় সারফারাজের দিকে। অর্নিলার দৃষ্টি যেন ছু/রির চেয়েও ধা/রালো। সারফারাজ ঢোক গিলে।
”হ্যাঁ, সারফারাজ ভাইয়া একা থাকতেন তাই আম্মু মাঝে সাঝেই তার খোঁজ নিতে পাঠাতো তাই!”
অর্নিলা হেসে শুধায়, “জানো? আমার নিচ তলায় একজন নতুন ভাড়াটে এসেছে। বেচারাও একা থাকে। সে কিন্তু আবার মেয়ে! তার খোঁজখবর নিতে যেতেও তো পারো, তাই না। কারণ এখন তো সারফারাজ ভাইয়ার খোঁজ নেওয়ার জন্য তার বউ আছে। তাই এই বাসায় যখন তখন না আসাটাই ভালো!
সোজাসুজি কথাগুলো বলে মেঘলা কে থমকে দিল অর্নিলা। মেঘলা আর এক মূহূর্ত দাঁড়ায় নি। “ভাইয়া, আমি আসি!” বলেই দ্রুত বের হয়ে গেল। অর্নিলা বলে উঠল, “সে কি? ঠান্ডা পানি খাবে না?” কথাখানা তার কানে গেলো কি না জানা নেই কিন্তু পরক্ষণেই ফারাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল। তার রক্ত/বর্ণ দৃষ্টি! অতঃপর চটে বেরিয়ে গেল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। কোন কিছু না করেও আজ সে এমন বাজে ভাবে ফেসে গেল!
অর্নিলা গরম গরম নুডলস্ মুখে দিচ্ছ। গপ গপ করে খাচ্ছে সে। কাজটা করছে রাগে/র বশে। আবারো চামচ ভর্তি ধোঁয়া উঠা নুডলস মুখে দিল। সারফারাজ গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিল। অর্নিলা পানির দিকে ফিরেও তাকাল না। আবারো যেই না নুডলস মুখে দিতে যাবে অমনি সারফারাজ তাকে থামিয়ে দিল। অশ্রুসি/ক্ত নয়নে অর্নিলা ফিরে তাকাল সারফারাজের দিকে। সারফারাজ শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “অনেক হয়েছে! থামো এবার!”
”কেন? কেন থামব? সরুন আমার ক্ষিধে পেয়েছে।”
”তাই বলে এমন রাক্ষ/সের মতো খাবে। আর আমি জানি তোমার মোটেও ক্ষিধে পায়নি। রা/গে তুমি এমনটা করছো।
”বেশ করছি। আপনার কি তাতে?”
“অনি প্লিজ! ও বাচ্চা মানুষ। একটু উড়নচণ্ডী আর চঞ্চল। তাই বলে তুমি তো বাচ্চা নও। তুমিও এমন করবে!“
“ওহ তাই তো। আমি তো এখন বড় হয়ে গেছি ফারাজ ভাই। মেঘলা এখন বাচ্চা, তাই উড়নচণ্ডী। এমন তো করবেই। কই ফারাজ ভাই, যখন আমি এমন করতাম তখন তো আপনি এই কথা বলতেন না। আপনি তো এমন হেসে তখন আমার সাথে কথা বলতেন না। আপনার কাছে ঘেসতেই দিতেন না। দূরে পালিয়ে বাঁচতেন। বলতেন, আমি ছোট। তখন এতো মায়া কোথায় ছিলো? আর এখন বলছেন মেঘলা ছোট। বাহ, চমৎকার!” দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। সারফারাজ নিশ্চুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অনির বলা তী’ক্ষ্ণ কথাগুলো তার বুকে এসে বিঁ/ধেছে। অনি চোখদুটো মুছে উঠে দাঁড়াল। দুই পা এগুতেই হঠাৎ মনে হলো সারফারাজ তার বাহু আকড়এ ধরেছে। অনি পিছন ফিরল। ফারাজ ভাইয়ের মলিন দৃষ্টি তার উপর। কিছু বলার আগে ফারাজ ভাইয়ের হেঁচকা টানে তার কাছে ধরা পড়ল অর্নিলা। ফারাজ ভাই হাত রাখল তার কোমরে। রোজ রোজ ফারাজ ভাইকে দেখানোর জন্যই শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায় সে। কিন্তু কখনো এভাবে ফারাজ ভাই তাকে কাছে টেনে নেয়নি। তার হাত দুটো ফারাজ ভাইয়ের বুকের উপর। কেন জানি সে দৃষ্টি মেলাতে পারছে না। আবারো তার চোখে অশ্রু ভরে উঠছে। আজ এই বাড়িতে প্রায় দেড় মাসের কাছাকাছি। কখনো তো ফারাজ ভাই এমন আবেগে তাকে কাছে টেনে নি। তার উষ্ণ হাতের ছোঁয়া কখনোই এভাবেই তাকে ছোঁয়নি। আজ হঠাৎ কি হলো? অশ্রু গড়িয়ে পড়ল চোখ বেয়ে। কানে ভেসে এলো সেই স্বর, “অনি!” সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে এই কণ্ঠে। তার মনের আবেগ, অনুভূতি সব মিশে একাকার। ফারাজ ভাইয়ের ঠান্ডা হাত তার চিবুকে এসে ঠেকেছে। মুখ তুলে চাইল সে। ফারাজ ভাইয়ের ঝাপসা মুখের দেখা মিলছে। সে বুঝতে পারছে ফারাজ ভাই তার কাছে আসছে, আরো কাছে, অনেক কাছে। আচমকা তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। দু হাতে খাম/চে ধরল সারফারাজের শার্ট। চারদিক তখন নিস্তব্ধ, নিরব ঠেকছে তার কাছে। সেই ঠোঁটের স্বাদ, সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা তার অস্থির মনকে শান্ত করে তুলছে। সে যেন কোন এক ঢেউ খেলানো সমুদ্র। খানিকবাদে ছাড়া পেলো সে। লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারল না। কোমর থেকে হাতটাও আস্তে আস্তে সরে গেল। অনিও ছেড়ে দিল শার্টটা। কি যে বলা উচিত, করা উচিত সারফারাজ সেটা বুঝতে পারল না। চোখের চশমাটা পড়ে এদিক ওদিকে তাকালো সে। হঠাৎ অর্নিলা বলে উঠল, “আরো কিছুক্ষণ চুমু খেতে পারলেন না ফারাজ ভাই? এতো কিসের তাড়া ছিলো আপনার?”
বিহ্বল দৃষ্টিতে অর্নিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সারফারাজ। মেয়েটা কি সহজেই কথাগুলো বলে ফেলল। সে মিনমিনিয়ে বলল, “আমার কাজ আছে!”
বলেই ঘরের দিকে চলে গেল। কিন্তু অর্নিলার হাত থেকে বাঁচা কী এতোই সহজ। সেও নাছড়বান্দা। পিছন পিছন এগিয়ে বলে উঠল, ”এখন কিসের কাজ ফারাজ ভাই? শুনুন না আমার কথাটা। আরেকবার চুমু খান আমায়!”
”অনি চুপ করো!”
”কেন চুপ করব কেন?”
”তোমাকে কিছু বলাই বেকার!” বলেই ধপ করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। অনি চমকে উঠল। একি? এটা কেন হলো? ফারাজ ভাই এটা কি করল? কিছুক্ষণ দরজায় কড়া নেড়েও কোন লাভ হলো না। ভাইয়া দরজা খুলে নি। একরোখা ছেলে একটা। রে/গে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
.
রাতের বেলা ফারাজ ভাইয়ের ঘরের দরজা খোলা দেখতে পেয়েই অনি দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়াল। সারফারাজ পিছন ফিরল। চেয়ে দেখে অর্নিলা বড় পরিপাটি হয়ে একটা বালিশ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মুচকি হেসে বলল, “ফারাজ ভাই, আজ রাতে আমি আপনার সাথে ঘুমাই?”
সারফারাজ জবাব দিলো না , আসলে অর্নিলা জবাবের আশাই করে নি। ফট করে ঘরে ঢুকে সোজা বিছানার উপর বসে পড়ল। বালিশ রেখে চাদর টেনে শুয়ে পড়ল। সারফারাজ কিছুক্ষণ হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। অতঃপর বইয়ের দিকে মনোযোগ দিল। অর্নিলা কিছুক্ষণ পর পরই জিজ্ঞেস করতে থাকল, “ফারাজ ভাই? আপনার পড়া শেষ হয়নি। কখন ঘুমাবেন?”
সারফারাজ জবাব দিলো না।
“ফারাজ ভাই? ও ফারাজ ভাই?”
“আমার দেরি হবে অনি!”
“আচ্ছা!” আনমনে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু ফোন নেড়েচেড়ে দেখল। আবারো ফিরে চাইল, ফারাজ ভাই তখনো বই ছেড়ে উঠেনি। এভাবে অপেক্ষা করতে করতেই সে ঘুমিয়ে গেল। সারফারাজ পিছন ফিরল। অর্নিলার ঘুমন্ত মুখের দিকে ফিরে একগাল হাসল সে। উঠে দাঁড়াল। বিছানার কাছে এগিয়ে এসে তার কপালে একটা চুমু খেল। হেসে বলল, “পাগল মেয়ে একটা!” অর্নিলা তখন একটু নড়েচড়ে উঠল। আলো নিভল। সারফারাজ একপাশে শুয়ে পড়ল। অর্নিলার ঘুম তখনো ভাঙেনি!
বিছানায় এদিক থেকে ওদিক ঘুরে যাচ্ছে অনি। ঘুম আসছে না তার। বিছানা ছেড়ে নেমে পা বাড়াল ফারাজ ভাইয়ের ঘরের দিকে। দরজার কাছে এসে হাত রাখতেই বুঝে গেল দরজা বন্ধ। কি আশ্চর্য! দুটো মানুষই থাকে এই বাড়ির মধ্যে তাও ফারাজ ভাই এভাবে দরজা বন্ধ করে রাখতে পারল। ভ্রু যুগল কুঁচকে মুখ কালো করে ফেলল। ধ্যাত, ছাতার মাথা। ঘুমটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আর ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না এখন। দরজার দিকে চেয়ে রইল একমনে। হঠাৎ মনে হলো দরজা খুলে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি তাই হলো। দরজার খুলে সারফারাজ হত’ভম্ব! হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল অর্নিলা। তার দৃষ্টিতে বিস্ময় ঘুরপাক খাচ্ছে। মনের কথা এভাবে সত্য হয়ে যায় সে জানত না। সারফারাজ গম্ভীর স্বরে শুধায়, “এতো রাতে এভাবে ঘুরাঘুরি কেন করছো অনি?”
“ঘুম আসছে না তাই, কিন্তু আপনি কি করছেন ফারাজ ভাই? আপনিও তো জেগেই আছেন।
”ঘুম না আসলে গিয়ে পড়তে বসো। এখানে ওখানে ঘুরাঘুরির কি আছে? সামনে না তোমার এডমিশন।”
অর্নিলা বাঁকা চোখে ফিরে তাকিয়ে জবাব দিল, ”যাচ্ছি!”
সারফারাজ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলল, “তোমার স্বপ্ন কোনটা অনি? কোন ইউনিভার্সিটি?”
অনি পিছন ফিরে বলল, ”ঢাকা ইউনিভার্সিটি!”
“তাহলে এভাবে আমার পিছু ঘুরাঘুরি না করে পড়তে বসো তাহলে কিছু চান্স থাকবে। যারা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেতে তারা সারা দিনরাত পড়তে থাকে এভাবে ঘোরাঘুরি করে না। যদি তোমার স্বপ্ন সত্যিই পূরণ করতে চাও তাহলে গিয়ে পড়তে বসো।”
অর্নিলা মাথা নাড়ল। ঘরে এসেই বিছানায় বই খাতা নিয়ে বসে পড়ল। এই ঘরে শুধু একটা আলমারি আর বিছানা। কোন টেবিল নেই। বিছানায় বসে কোলের মধ্যে বালিশ নিয়ে বই খুলে পড়তে বসল। সে মোটেও এতোদিন ঘুরাঘুরি করেনি। পড়েছেও বটে। ফারাজ ভাইয়ের চোখ থাকতেও নেই। তার দিকে তো কোন নজরই নেই,দেখবে কি করে? পেন্সিল হাতে নিল, বইটা বের করে পড়তে শুরু করল। খাতায় একটু একটু করে নোট করতে লাগল। আধ ঘন্টা বাদে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। অনি পিছন ফিরে তাকাল। ফারাজ ভাই দাঁড়িয়ে। মুচকি হেসে বলল, ”বউয়ের ঘরে আসতে আবার অনুমতি লাগে নাকি ফারাজ ভাই?”
“আগে তো বউ ছিলো না জানতাম না, জেনে নিলাম!”
এগিয়ে এসে ল্যাম্পশেডের পাশে কফির মগটা রেখে দিল। বলল, “ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পড়, জোর করে রাত জেগে পড়ার কিছু নেই।”
“আপনি বানিয়েছেন আমার জন্য কফি? ভাবা যায়!“
“রাতে ভাত তরকারি রান্না করে খাইয়েছি এখন কফি দেখে তোর ঢং শুরু হলো!” মাথায় টোকা মেরে বলল, ”কোন বই লাগলে তার লিস্ট করে রাখবি। আমি কাল নিয়ে আসব।”
“আপনার ইন্টার্নশিপ কবে থেকে শুরু ফারাজ ভাই?”
”সময় আছে ঢের, সেসব তোকে জানতে হবে না। তুই পড়তে থাক।”
“ক্ষিদে পেয়েছে ভাই!”
”কফি খেয়ে নে।”
“এটা খেলে পেট ভরবে?”
”বিস্কুট নিয়ে আসছি!”
বেরিয়ে গেল ফারাজ। অনি মজা লাগছে। ফারাজ ভাই তাকে ভালো বাসুক আর না বাসুক তাকে তো ভালো বাসিয়েই ছাড়বে। দরকার পড়লে জোর করে আদায় করে নিবে। ফারাজ ভাইয়ের যত্ন তার চাই, ফারাজ ভাই ইচ্ছে করে না করলে সেটাও জোর করে আদায় করে নিবে।
কফি হাতে নিয়ে পাইচারি করতে করতে পড়ছে। অনেক পড়তে হবে, যেভাবেই হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে। এটা শুধু তার স্বপ্নই না, আরো অনেক কিছু। ফারাজ ভাইকে সে চমকে দিবে। ফারাজ ভাই মনে করে তাকে দিয়ে কিছু হবে না, ঢাবিতে চান্স পেয়ে দেখিয়ে দিবে সে নিজেও কিছু কম না। সারফারাজ শেহদাত যদি ঢাকা মেডিকেল এ চান্স পেতে পারে তার বউ অর্নিলা অথৈ শেহদাত ও ঢাবিতে চান্স পেতে পারে, হুহ!
অনেকক্ষণ পেরুলো। বিস্কুট নিয়ে এখনো ঘরের মধ্যে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ নাকে এসে ঘ্রাণ ভিড়ল। অনি একগাল হেসে বিছানায় বসে পড়ল। সারফারাজ বাটিতে করে নুডলস্ নিয়ে হাজির হলো। বলল, “ঘরে বিস্কুট নেই, এটাই খেয়ে নে!”
অনি চামচ দিয়ে নেড়ে দেখল। একগাদা পানি আর মসলা দিয়ে শর্টকাটে বানানো নুডলস। হেসে বলল, “এই সস্তা নুডলস্ বানানো কার কাছ থেকে শিখলেন ফারাজ ভাই!“
“সস্তা নুডলস্ খেয়ে পেট ভরা। আমি গেলাম!”
অনি হাসল। চটপট করতে গিয়ে গরম নুডলস মুখে হা হু করতে লাগল। সারফারাজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুধায়, “অনি, তোর বিছানায় পড়তে কষ্ট হয়?”
“না তো, ভালো লাগে। আরামে শুয়ে বসে পড়া যায়।”
”আরামে থাকলে পড়ালেখা হয় না!”
চলে গেল ফারাজ ভাই। অনি ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো, ”হুহ, আরামে থাকলে পড়ালেখা হয় না, আসছে!” বাটিতে ফুঁ দিয়ে খেতে লাগল সে!
.
ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ। সারফারাজের ঘুম এভাবেই কম। গতরাতে ওতো দেরিতে ঘুমানোর পরেও খুব সকালেই উঠে পড়ল সে। অনির ঘরের সামনে এসে দরজায় হাত বাড়াল। মনে পড়ল গত রাতের কথা, ”বউয়ের ঘরে আসতে আবার অনুমতি লাগে নাকি?” দরজায় কড়া নাড়ল না। পর্দা সরিয়ে উঁকি মারল। অনি বিছানায় ঘুমাচ্ছে এলোমেলো ভাবে। এদিক ওদিক বই ছড়িয়ে আছে। নুডলসের বাটিটাও বিছানায় পড়া, খালি কফি মগটাও সেখানে। নোট, পেন্সিল কিছুই গোছানো নেই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সবকিছু গোছাতে লাগল সারফারাজ। ঘরের কোনের দিকে তাকিয়ে ভাবল। অতঃপর নুডলসের বাটি, মগ তুলে নিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। ফের আবারো ঘরে আসল। অনির মাথার কাছে বালিশ নিচে পড়ে আছে। উঠিয়ে তার মাথায় তলে রাখল। চাদরটা এগিয়ে দিয়ে ফ্যানের বাতাস কমিয়ে দিয়ে চলে গেল সে। তার এতোটুকু যত্ন, আদর, ভালোবাসা কোন কিছুই টের পেলো না অনি। সারফারাজ জানাতেও চায় না। নিশ্চুপে এসে সবকিছু করে দূরে সরে যায়। সে চায় না, কেউ এসব জানুক,জানতে পারুক।
বিকেলের মধ্যে একটা টেবিলের ব্যবস্থা করে দিল অনির জন্য। সারফারাজ কাজের ক্ষেত্রে এতো চালু এটা সে জানত না। শুধু তাই নয়,সন্ধ্যার মধ্যেই একগাদা বই নিয়ে এলো নীলক্ষেত থেকে। নীলক্ষেতের নাম অনেক আগেই শুনেছে অনি। দেখার খুব ইচ্ছে। শুনেছে সেখানে নাকি বইয়ের স্তূপ। নিজের কল্পনায় সাজালো সবটা। বলল, ”ফারাজ ভাই, নীলক্ষেত এ কোন জমির ক্ষেত আছে তার চারদিকে বইয়ের দোকান?”
সারফারাজ না হেসে পারল না। এভাবেই গরমের মধ্যে এভাবে ছুটে এসে বেচারা ক্লান্ত। গায়ের শার্ট ভিজে গেছে ঘামে। এর মধ্যে অর্নিলার বোকা বোকা কথা শুনে সে জোরে হেসে উঠল। অনি খানিকটা লজ্জা পেলো। বুঝতেই পারল বোকামি হয়েছে। বইয়ের স্তূপ টেনে ঘরে চলে গেল। সারফারাজ দরজার কাছে এসে বলল, ”তোকে একদিন নিয়ে যাবো নীলক্ষেত, দেখে আসিস কোন জমির ক্ষেত আছে!”
”ধুর, আমি কোথাও যাবো না আপনার সাথে।”
”আচ্ছা যাস না!”
চলে গেল। কি অদ্ভুত। আরেকবার তো সাধতে পারত। ফারাজ ভাই কি কিছুই বুঝে না!
.
নতুন একটা কোচিং এ ও ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। অর্নিলা রাস্তাঘাট তেমন কিছুই চিনে না। তবে কোচিং টা বাড়ির কাছেই। সপ্তাহে তিন দিন যেতে হয়। বাসার সামনে থেকে একটা রিক্সায় চড়ে সে যায় আবার রিক্সায় চড়েই ফিরে আসে। ইদানিং পড়াশোনা করছে ধুমিয়ে। সারফারাজ সকাল বেলা উঠে নাস্তা বানিয়ে চলে যায় মেডিকেলে। সন্ধ্যার আগে আগেই ফিরে আসে। রান্না চাপায়। এক বেলার রান্নাতেই তাদের হয়ে যায়। দুজন মানুষের আর কতো! অর্নিলার রান্নাঘরে আসা ঘোর বারণ। টেবিল ছেড়ে সে উঠতেই পারে না। সারাক্ষণ পড়াশোনা।
সারফারাজ দেখছে,মেয়েটা প্রচুর পরিশ্রম করছে। এবার যদি টিকে যায় তাহলেই হয়। ওর মতো তো আরো হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও পরিশ্রম করছে। সবার লক্ষ্য একটাই। কিন্তু কার ভাগ্যে আছে বিধাতায় ভালো জানে। তবু নিরাশ হলে চলবে না। প্লেটে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে হাজির হয়। টেবিলের কোণায় রেখে অনিকে দেখে। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখ মেলে তাকাতে পারছে না এমন হাল। তবুও মেয়েটা হাসে। সারফারাজের কি হয় সেই জানে। আনমনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “একটু ঘুমিয়ে নে, অনি!”
”এই তো এই পাতাটা পড়ে শেষ করে নেই, এরপর ঘুমাবো!”
”এতো চিন্তার কিছু নেই, দেখবি তুই পারবি!”
অর্নিলা হাসে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, “তুমি যখন বলেছো তখন আমি পারবোই!”
সারফারাজ দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো খাতা নোট করা, কালো রঙের কলম দিয়ে গুটি গুটি লেখা। অর্নিলা চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খায়। বলে, ”তোমার অনেক কষ্ট হয়, তাই না ফারাজ ভাই। সকাল সকাল এই নাস্তা বানাও, মেডিকেলে যাও আবার এসে ঘরের কাজ করো!”
“ঘরের কাজ আর কোথায় করি,একটু রান্নাবান্না করি। এ আমি আগেও করতাম। তোর এতো ভাবনার দরকার নেই।”
এক চুমুকে চায়ের কাপ শেষ করে বলে, “আচ্ছা!”
“অনি, সামনের সপ্তাহে চট্টগ্রামে পরিক্ষা শুরু হবে? তুই দিতে যাবি না?”
”না ভাই!
”কেন? আবেদন করিস নি? করলি না কেন? আমার বিশ্বাস ছিলো, চট্টগ্রামে পরিক্ষা দিলে তুই টিকতি। রাজশাহী তেও তোর চান্স হতো।”
অর্নিলা উঠে দাঁড়ায়। বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“আমি ঢাকাতেই পড়ব ফারাজ ভাই। ও চান্স পেলেও আমি যাবো না। আপনাকে ছেড়ে আমি দূরে কোথাও যাবো না!”
বালিশে মুখ গুজে সে। সারফারাজ ঈষৎ হতবাক হয়ে যায়। খেয়াল করে,মেয়েটা এক কাপ চা খেয়েও ঘুমাতে চলে গেল। অনেক ক্লান্ত ছিল বোধহয়। সারাটে দিন পড়াশোনা করে যাচ্ছে। টেবিল গুছিয়ে রাখে। অর্নিলার গায়ে চাদর টেনে নিঃশব্দে বের হয়ে যায়।
.
সোফার উপর বসে পড়ছে অর্নিলা। আর দুদিন বাদেই ঢাবিতে পরিক্ষা। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। আগের পড়াগুলো রিভিশন দিচ্ছে। আলস দুপুর। অর্নিলা জোরে জোরে পড়ছে। তার পড়ার আওয়াজ রান্নাঘর অবধি যাচ্ছে। সারফারাজ গরম গরম ভাতের থালা নিয়ে হাজির হলো। সোফায় বসে ভাত মাখিয়ে লোকমা তুলে ধরল অনির সামনে। অনি একদিকে খাচ্ছে অন্যদিকে পড়ে যাচ্ছে। এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো অনেক সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই দেখা যায়, সারফারাজ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর সে পড়ে যাচ্ছে। তার অজান্তেই ফারাজ ভাই তার জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে যেমনটা চাইছিলো তার চেয়েও বেশি কিছু পাচ্ছিল। কিন্তু ওতো মন দিয়ে বোঝার বোধ টা অর্নিলার তখনো হয়নি। হবে কি করে? ভালোবাসা আর কতোটুকুই বুঝে সে। ভালোবাসা যে বিস্তর। সেখানের এক ক্ষুদ্রাংশ সবে মাত্র ছুঁইয়েছে তাকে। এর মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে নেওয়া এখনো যে বাকি!
.
পরীক্ষা শেষ হলো। পরীক্ষার আগে যতো ঝামেলা যতো কিছু গেলো পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ হলো। এবার সে ঘুমিয়েছে। চেঞ্জ অবধি করেনি। কতো ক্লান্ত, মলিন মুখটা শুকিয়ে গেছে। দেখে মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে ঘুমায় না। তার এমন ক্লান্তি মুখ দেখে মায়া হয় সারফারাজের। মেয়েটা সত্যিই বড্ড লড়েছে, সে নিজে সাক্ষী। এবার জিতলেই হয়। কিন্তু সবাই জিতবে না সে নিজেও জানে!
দিনকতেক গেলো। সারফারাজ ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ছুটে আসল অর্নিলার ঘরের সামনে। অনি শক্ত হয়ে বিছানায় বসে আছে। দু একবার ডাক দিলো, “অনি, এই অনি!” অনি সাড়া দিলো না। কাছে এসে দাঁড়াল। অনিল ঘোর ভাঙল। মুখ তুলে তাকানোর আগেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। সারফারাজ চেয়ার টেনে বসে তাকে সামলাতে লাগল। এই হার সে মেনে নিতে পারেনি, তার স্বপ্ন ছিলো এটা, তার জীবন ছিল। এতো পরিশ্রম, এতো রাত জাগা সবকিছুই কি বৃথা হয়ে গেল। বিধাতা এতোটা নির্দয় না হলেও পারত। সারফারাজ জড়িয়ে ধরল তাকে। তার শার্টটা আঁকড়ে ধরে কাঁদছে অনি। সাত্বনা দেবার মতো কিছু নেই। তবুও বলছে, “কিছু হয়নি অনি, কিছু না। এখানে সব শেষ না। এখনো অনেক ভার্সিটি আছে। জাহাঙ্গীরনগর, গুচ্ছ, সাতকলেজ। একটাতে তোর চান্স হয়েই যাবে। এতো কাঁদার কিছু নেই!” বললেই হলো নেই। রাত জেগে যেই স্বপ্ন সে জাগিয়েছিলো তা তো ভেঙে গেল। কখনো চোখে দেখেনি, দেখেনি সেখানকার রাস্তা ঘাট তাও মনের ভেতর সবকিছু সাজিয়েছিল। না দেখেই এতো করে চাইল তবু পেলো না। সারফারাজ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কান্নার রেশ কমেছে কষ্ট নয়। সারফারাজ মলিন কণ্ঠে বলল, “হয়েছে অনি, এতো কাঁদার মতো কিছু হয়নি। যার ভাগ্যে যা ছিল তাই পেয়েছে। গিয়ে দেখো, তোমার চেয়েও কারো কাছে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তুমি হয়তো না পেয়ে ক’দিন কাঁদতে কিন্তু তাকে সারাজীবন ভুগতে হতো। বিধাতা যা করে ভালোর জন্যই করে। এখানে সবকিছুরই শেষ না, থামো!”
অনি মুখ তুলে তাকাল। চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সারফারাজ মুছে দিল অশ্রুকণা। স্বচোখে, তার সামনে কপালে চুমু খেলো আলতো করে। হেসে বলল, ”চল ঘুরে আসি। তৈরি হয়ে নে,আমরা আজ বাইরে যাবো!” অর্নিলা বিস্মিত নয়নে চেয়ে রইল শুধু!
অর্নিলা তাদের নতুন বাসায় পা রাখল। শহরে এবারই বোধহয় তার প্রথম আসা। একটা বড় ভবনের চার তলায় তাদের বাসা। পুরো একটা ফ্ল্যাট! অর্নিলার মনে আজেবাজে চিন্তা ঘুরঘুর করছে। এতো বড় ফ্ল্যাটে ফারাজ ভাই কি একা থাকত? কিভাবে থাকত? কেউ আসত না এখানে? স্ত্রীদের যেন একটা বিশেষ গুণই থাকে অকারণে স্বামীদের স/ন্দেহ করা। অর্নিলা সেখান থেকে বঞ্চিত হয়নি। তবে খানিকটা অবাক হয়েছে। ঘরের টেবিলের উপর বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমনটা হবার কথা না। ফারাজ ভাই সবসময়ই তার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখেন। এই স্বভাবটা তার বেশ ভালো লাগে। কিন্তু এখানে এসে খানিকটা যেন বিগড়ে গেলো। অনেককিছুই অগোছালো। ফারাজ ভাই যেদিন বাড়িতে ছিল সেদিনও বড্ড অগোছালো ছিল।
“তোমার এখন কিছু করা লাগবে না। হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি দোকান থেকে কিছু নিয়ে আসি।”
“কিছু কেন আনবেন? বাজার করে নিয়ে আসুন। সারাটে দিন পড়ে আছে।“
“বাজার করে আনব? এখন!”
“হ্যাঁ, যান। এরপর এসে গোসল সারবেন।“
বলেই একদম ঘরের গিন্নির মতো সব কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিল। একজন দায়িত্বশীল রমনী, সে এসে হাল ধরেছে তার ঘরের। নিজের সংসারের। সারফারাজ একটা মানিব্যাগ বের করে দেখে নিল। হ্যাঁ, হয়ে যাবে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “বন্ধ করে দাও দরজাটা।”
“আসছি!”
ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। ঘরের সব জিনিসপত্র একে একে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিচ্ছে। পাকা হাতের কাজ। কোন কিছু এদিক থেকে ওদিক হচ্ছে না। বালিশের কভার, বিছানার চাদর এসে জমা করল বাথরুমের কাছে। সাবানের গুঁড়া পাওয়া গেল। বেশ, এগুলো সাবান পানিতে ভিজিয়ে আবারো ঘরে গেল। কেমন এক ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে ঘর থেকে। ফারাজ ভাই তাদের ওখানে থেকেছে সেই দিন ও তো কম খানেক না। জানালা খুলে দিল। হুড়মুড়িয়ে বাতাস আসছে। দক্ষিণ দিকের ঘর বোধহয়। এই ফ্ল্যাটের বেডরুম দুটো। মাঝখানে বড় বসার ঘর। একটা বাথরুম এই বেডরুমের ঘরে আরেকটা বসার ঘরে। তার পাশেই রান্নাঘর। ঘর গুলো ভালোই বড়। এদিকে বেলকনি ও আছে দেখা যাচ্ছে। এসবের কোন যত্ন নেওয়া হয়নি। ফারাজ ভাই চাইলেই পারত বেলকনিতে ফুল গাছ লাগাতে। হয়তো সময় হয়নি। বেচারার তো পড়েই সময় শেষ হয় না। এসব করবে কখন। বিছানার চাদর বদলে দিল। বালিশ গুলোর কভারে ভরে ঠিক জায়গায় রাখল। জোড়া জোড়া বালিশ! অথচ মানুষ থাকত একজন! কি আশ্চর্য! এসব ছোট বিষয় নিয়ে এমন মাথা ঘামাতে হয়। তার মন এতোটা ছোট হয়ে যাচ্ছে!
পুরো ঘর ঝাড়ু দিয়ে ময়লা এসে জমাল বসার ঘরে। কাজ এখনো বাকি। ফারাজ ভাই বাজার আনলে রান্না চাপাতে হবে, কতোগুলো আধোয়া কাপড় চোপড় ধুতে হবে। কাজের শেষ নেই, অথচ অর্নিলা সব করে যাচ্ছে আনন্দে। তার আনন্দ হচ্ছে, নিজের ছোট একটা অগোছালো সংসার। এই সংসার নিজ হাতে এখন সে সাজাবে। ভাবতেই আনন্দ পাচ্ছে।
দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। কে এসেছে? ফারাজ ভাই নাকি। হ্যাঁ সময় তো অনেক হলো। কোমর থেকে শাড়ির আঁচল নামিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই এক মেয়েরী কণ্ঠ তার কানে এসে বাজল। “সারফারাজ ভাইয়া, আপনি এসেছেন। মা আপনার জন্য এসব…” মেয়ে থমকে চাইল। অর্নিলাও চেয়ে আছে অদ্ভুত ভাবে। মেয়েটার হাতে ভাতের প্লেট। খাবার নিয়ে এসেছে? কিন্তু কেন?
চোখ ছোট ছোট করে ফেলল অর্নিলা। মেয়েটার গায়ের রং ফর্সা। সুশ্রী চেহারা। গোল গোল দুটো চশমা পড়ে আছে। চোখে মুখে একগাল হাসি। মনে হচ্ছে ফারাজ ভাইয়ের আসায় সে অনেক খুশি। নয়তবা এতো কম সময়ে কিভাবে টের পেলো ফারাজ ভাই এসেছে। এতো নজর রাখে সে।
অর্নিলা প্রশ্ন করার আগে মেয়েটা শুধায়, ”কে তুমি?” অনির শরীর যেন জ্ব/লে উঠলো। কতো সাহস ভাবা যায়। তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে তাকেই জিজ্ঞেস করছে সে কে? অর্নিলা জবাব দিলো না। উল্টো প্রশ্ন করল, “তুমি কে? এখানে কি করছো?”
“সারফারাজের কাছে এসেছি। সে আছে?”
“ফারাজ ভাই তো তোমার ছোট নয়। নাম ধরে কেন ডাকছো?”
“ওহ এভাবেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি বাড়িওয়ালার মেয়ে। এই উপরের তলায় থাকি। সারফারাজ ভাই এসেছে দেখে তার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে এলাম। মা পাঠিয়েছে। অনেকদিন পর এলো তো, হয়তো কিছু জোগাড় করতে পারবে না তাই ভেবে…
অর্নিলা ধপ করে ভাতের প্লেট হাতে তুলে নিতে গেল। অমনি মেয়েটা সরে গিয়ে বলল, ”একি করছো? তুমি এই ময়লা হাতে ভাতের প্লেট ধরছো। দেখি সরো, আমি ভেতরে গিয়ে রেখে আসি!”
অর্নিলা পাশ সরে দাঁড়ায়। মেয়েটা ভেতরে এসে সোফার উপর খাবারের প্লেট রেখে দাঁড়িয়ে আশপাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরে পাইচারি করছে আর একাই একাই বলছে, “আমার নাম মেঘলা! তুমি মনে হচ্ছে পুরো ঘর পরিষ্কার করেছো। বেশ ভালো করেছে। এতোদিন ঘরটা বন্ধ দেখে মনে হয় অনেক ধুলো পড়ে গেছিলো।”
অর্নিলা চুপচাপ তার কথা শুনছে আর মনে মনে আওড়াচ্ছে, “কেন রে? তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে। হলে এসে পরিষ্কার করে দিয়ে গেলি না কেন? এখানে এসে ভাষণ দিচ্ছিস। আর তুই কে হ্যাঁ, আমার ঘরে ঘোরাঘুরি করছিস কেন?”
মেঘলা এবার অর্নিলার দিকে ফিরল। মেঘলা তার চেয়ে বোধহয় ছোটই হবে। তবে খুব উড়নচণ্ডী আর চঞ্চল। আবারো জিজ্ঞেস করল, ”আচ্ছা তুমি কে? সারফারাজের সাথে এসেছো? কি হয় সে তোমার? ভাইয়া। তুমি কি তার দেখা শোনার জন্য এসেছো?”
অর্নিলার ইচ্ছে করল ঘুরিয়ে মেয়েটাকে একটা চ/ড় দিতে। এটা মেয়ে না মাথাব্যাথা। পটর পটর করেই যাচ্ছে। আবারো ফারাজ ভাই কে নাম ধরে ডাকে। আবার জিজ্ঞেস করছে সে কে? অর্নিলা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজল। দুই হাত কোমরে রেখে বলল, ”আমি তোমার সারফারাজ ভাইয়ের বউ মানে তোমার ভাবী! ভাবী এখন থেকে এখানে থেকেই ভাইয়ের দেখাশোনা করবে বুঝতে পেরেছো মেঘু!”
মেঘলার চোখ মুখ যেন আঁতকে উঠল। ঈষৎ বিস্ময়ে সে স্তম্ভিত। তবে চালাক চতুর। দ্রুতই সামলে উঠে বলল, “ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেলো? কই আমাদের তো দাওয়াত দিলো না। কিছু বললও না!”
অর্নিলা এগিয়ে গেল। ভাতের প্লেটের উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে রাখল। বাহ, বেশ ভালো আয়োজন। সবজি ভাজি, মাছের তরকারি, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আবার পাকোড়াও আছে দেখছি। ধপ করে একটা মুখে পুরে বলল, “তোমার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে আজ দুই বছরের বেশি হবে মেঘু।”
মেঘু রক্ত/বর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। রাগ যেন তার শিরায় শিরায়। এর মধ্যে অর্নিলার মেঘু ডাক তার রাগ শতগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে । দাঁত কিড়/মিড় করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে।
অর্নিলার মুখে পৈচা/শিক হাসি। দারুণ লাগছে কথাগুলো বলে। তার মন বলছে, নির্ঘাত এই মেয়ে ফারাজ ভাইয়ের পেছনে সবসময় ছোটাছুটি করত। কু মতলব মনে আটত। এই মেঘু কে একটা শি/ক্ষা দেবার দরকার।
দরজা বন্ধ করতে মনে নেই। ওই পে/ত্নী গেছে এই খানিকক্ষণ আগেই। সারফারাজ এসে দাঁড়াল। বলে উঠল, “দরজা খুলে দাঁড়িয়ে কি ভাবছ অনি?“
“কিছু না, আপনি এসে গেছেন!”
দু হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ। গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে একাকার। কপাল চুঁইয়ে পড়ছে ঘাম। অনির খুব সাধ আঁচল দিয়ে ঘাম টুকু মুছে দিক। সে আগালোও বটে। কিন্তু ততোক্ষণে ফারাজ ভাই হাত দিয়েই মুছে ফেলল ঘাম টুকু। সোফায় এগিয়ে এসে বলল, “ফ্যানটা ছাড়ো অনি, অনেক গরম লাগছে।“
“আপনি এতোসব কিছু বাজার করতে গেলেন কেন?”
“করব না? কিছুই তো নেই ঘরে। একটা চালের দানা ও নেই। সেদিন আমি মোহনগঞ্জ ফিরছিলাম সেদিন ঘরে কিছু না পেয়ে খালি পেটেই রওনা দিয়েছিলাম।“
অনি বিস্ময়ে তাকাল। সাহস করে হাত বিছিয়ে দিল কপালে। সারফারাজ তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। অনি মলিন কণ্ঠে বলে উঠল, ”নিজের এতো অযত্ন কেন করেন ফারাজ ভাই?”
সারফারাজ জবাব দিল না। চেয়ে রইল। দরজায় আবারো কড়া নাড়ার শব্দ। অনি আগালো। এতোক্ষণে ফারাজের চোখ পড়ল টেবিলে। এখানে খাবার পড়ে থাকতে দেখে কিছুটা আন্দাজ করল। হ্যাঁ বাড়িওয়ালা আন্টি এসেছে। তার হাতেও একটা খাবারের থালা। সারফারাজ উঠে এসে তাকে সালাম জানাল। আন্টি অর্নিলার দিকে চেয়ে হেসে বলে উঠলেন, ”মেঘলা বললো তোমার বউ নাকি এসেছে তাই দেখতে এলাম। আমি তো ভাবলাম তুমি একাই এসেছো তাই একজনের খাবার পাঠিয়েছি এখন আবার নিয়ে এলাম।”
সারফারাজ আন্টির থেকে খাবারের থালা এগিয়ে নিল। হেসে বলল, ”কোন দরকার ছিলো না আন্টি। আমরা ব্যবস্থা করেই নিতাম।”
বাজারের ব্যাগগুলো চোখে পড়ল। ঘড়ির দিকে ফিরে বললেন, “আর কখন? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। শুনলাম বউমা একাই নাকি অনেক করেছে। লক্ষী মেয়ে বটে!”
“ও এমনি আন্টি, সারাদিন ঘরের কাজকর্ম নিয়েই থাকে।”
অনি চমকে উঠল। তার মনে হলো ফারাজ ভাই তার প্রশংসা করল। আন্টি চলে গেল। ফারাজ ভাই বলে উঠলেন, “হাত মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে নাও। এরপর যা আছে করো।”
অনি মাথা দুলাল। সারফারাজ ঘরের দিকে চলে গেল!
.
গোসল সেরে বের হতে হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। এক গাদা কাপড় ধুয়ে কোমর ব্যাথা ধরে গেছে অনির। তোয়ালে দিয়ে চুলের পানি মুছতে মুছতে বসার ঘরে এলো। রান্নাঘরের খুঁটিনাটি শব্দ শুনে উঁকি মারল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল সে। রান্নাঘর পরিষ্কারই শুধু বাকি ছিল, ফারাজ ভাই সে সব কাজ মিটিয়েছে। শুধু তাই নয়, বাজারের থলেটাও নেই। মনে হচ্ছে সব গুছিয়ে রেখেছে। চুলোয় ভাত ফুটছে টগবগিয়ে। ফারাজ ভাই বোর্ডের উপর পেঁয়াজ কাটছে। অনির দিকে ফিরে বলল, “তুমি একটু রেস্ট নিয়ে নাও, পারলে একটু ঘুমিয়ে নাও। ততোক্ষণে রান্না হয়ে যাবে।”
অনির কানে কথা ঠেকল। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি। ফারাজ ভাই বোধহয় গোসল সেরে বের হয়েছেন খানিকক্ষণ আগেই। তার ভেজা চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে ঘাড় বেয়ে। অনি হাতের তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে গেল। আচমকা চমকে উঠল সারফারাজ। অনি বলে উঠল, “নড়াচড়া করবেন না ফারাজ ভাই, আপনার চুল গুলো মুছে দিই।”
“এসবের কোন দরকার নেই।”
“আছে বলেই তো করছি।”
সারফারাজ নিচু হয়ে দেখল। অর্নিলা উচ্চতায় তেমন আহামরি কিছু না। পা দু’টো উঁচু করে মাথার চুল মুছে দিচ্ছে সে। দেখে মনে হচ্ছে কোন এক সময় পড়ে গিয়ে একটা কাণ্ড ঘটাবে। সারফারাজ হুট করেই সামনে ফিরতেই তাল সামলাতে না পেরে গেল অর্নিলা। আচমকা তার কোমর আঁকড়ে ধরল সারফারাজ। সব রমনীর মুগ্ধতা থেকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব কিন্তু সবে মাত্র গোসল সেরে আসা রমনীর থেকে নয়। তার ভেজা চুলের ঘ্রাণ, মুগ্ধ শরীরের সুবাস, স্নিগ্ধ মুখের ভাব এসব কিছুই কোন পুরুষের থেকে এড়িয়ে যেতে পারে না। যেকেউ এই ফাঁদে পা দিবে। সারফারাজ নিজেও
ফেঁ/সে গেল। অর্নিলা যেন ছাড়ার বদলে আরো শক্ত করেই জড়িয়ে ধরল। সারফারাজের অস্বস্তি হচ্ছে। সে যতোই চাইছে দূরে সরে যেতে ততোই যেন কাছাকাছি এসে ঠেকছে। বহুকষ্টে সারফারাজ সামলালো নিজেকে। শান্ত স্বরে বলে উঠল, ”যাও ঘরে যাও।”
অনি মুচকি হেসে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ফারাজ বলে উঠল, “ওদিকে না, তোমার ঘর ওদিকে?”
“কেন ফারাজ ভাই? আপনি আর আমি একঘরে থাকব না?”
”আপাতত না। সামনে তোমার পরিক্ষা। রাত জেগে পড়া তোমার স্বভাব, আর রাতে আমার ঘুম প্রয়োজন। সুবিধা হয় তুমি ওই রুমেই থাকো।”
ঈষৎ পরিহাস করে অনি শুধায়,
“এতো অজুহাত দিচ্ছেন ফারাজ ভাই?”
“অজুহাত না অনি। সামনে তোমার এডমিশন! ছেলেখেলা না, একবারই তুমি সুযোগ পাবে। এডমিশন তো আর বার বার আসবে।”
“তো আপনি সারাজীবন থাকবেন তো ফারাজ ভাই!”
সারফারাজ জবাব দিলো না। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল অনির দিকে। মুচকি হেসে অনি পা বাড়াল ঘরের দিকে!