Saturday, August 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 188



উধয়রনী পর্ব-২+৩+৪

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০২||

০৩।
পুরো সপ্তাহ জুড়ে আহি বিশেষ দু’টি দিনের অপেক্ষায় থাকে। সপ্তাহ শেষে ঝড়-বৃষ্টি, রোগ-শোক উপেক্ষা করে সে চারুশিল্পে চলে যায় শুধু এআরকে দেখার জন্য।
এআর, আফিফ রাফাত, আহির প্রথম প্রেম। প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে আহি তেমন কিছুই জানে না। কখনো ভাবেও নি যে সে প্রেমে পড়বে। তবে আফিফের আঁকা ছবি, তার নিগূঢ় চোখযুগল, তার এলোমেলো চুলগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে আহির ভীষণ ভালো লাগে। এটাকে যদি প্রেম বলে, তাহলে আহি হয়তো প্রেমেই পড়েছে। প্রথম দুই সপ্তাহ আফিফের নাম জানতে পারে নি সে। বাসায় এসে শুধু নামহীন যুবকের নাম কি হতে পারে সেটা ভাবতেই ব্যস্ত ছিল আহি।
সপ্তাহ শেষ হতেই তার অস্থিরতা বেড়ে গেলো। চারুশিল্পে যেদিন ক্লাস থাকে সেদিন কোনো এলার্মের প্রয়োজন হয় না, কারো দরজায় কড়া নেড়ে আহিকে ডাকতেও হয় না। সে নিজ থেকে উঠে ভালো জামা পরে আগেভাগে নাস্তার টেবিলে এসে হাজির হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ায়ও যেন হুলুস্থুল কান্ড। আহির বাবা-মা মেয়ের আচরণে বরাবরই অবাক হোন। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করেন না।

(***)

আজও আহির বাবা, রিজওয়ান কবির মেয়েকে আর্ট স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। আহিও দেরী না করে গাড়ি থেকে নেমে এক দৌঁড়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লো। ক্লাসে এখনো তেমন কেউ আসে নি। তার প্রিয় মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। তখনই আহির নজর পড়লো টেবিলের উপর রাখা খাতাগুলোর দিকে। আগের সপ্তাহে সবাই তাদের আঁকা ছবিগুলো জমা দিয়েই চলে গিয়েছিল। তাহলে এখানেই তার প্রিয়র খাতাটা থাকবে।
আহি খাতাগুলোর উপরে লেখা নামগুলো দেখে নিলো। এতোগুলো নামের মধ্যে তার প্রিয়র নাম কোনটা, সেটাই বোঝা মুশকিল। ক্লাসে চৌদ্দ জন ছেলে। এখানেও চৌদ্দটা নাম। তড়িঘড়ি করে সে সবগুলো নাম মুখস্থ করে নোট টুকে নিলো। স্যাররা আবার আইডি ডেকে খাতা দেন। নাম ধরে ডাকলে আহিকে এতো কাঠখড় পোড়াতে হতো না। আবার মাঝে মাঝে যার খাতা সে এসে নিয়ে যায়। আর তার প্রিয়র আইডিটাও তার মনে নেই। এখন কখন স্যার আইডি ধরে ডাকবেন, কখন সে তার প্রিয়র নাম জানতে পারবে, এতো ধৈর্য তার মধ্যে নেই। সে তো আজই তার প্রিয়র নাম জেনে ছাড়বে।

(***)

ক্লাসে যেই ছেলেগুলো উপস্থিত ছিল স্যার আসার আগে আহি তাদের সাথে পরিচিত হয়ে নিলো। কিন্তু প্রিয়র কাছে গিয়ে তার সাথে পরিচিত হওয়ার সাহসটা সে পাচ্ছিলো না। কতো সহজই না হতো, একদম তার সাথেই কথা বলে নাম জেনে নেওয়া! কিন্তু এই সহজ কাজটা করতে যাওয়ার আগেই হাত-পা কাঁপছিল আহির। সে নিজেও বুঝতে পারছে না কেন তার সাথে এমন হচ্ছে।

স্যার আসার পর পরই তার প্রিয় পুরুষ ক্লাসে ঢুকে তার পাশের সারিতেই বসে পড়লো। আহি তা দেখে নীরবে হাসলো। ঘুরেফিরে আহির পাশের সারিটাই তার প্রিয় মানুষটার জন্য খালি থাকে। এটাই হয়তো নিয়তি।

(***)

আজকের স্কেচ একটা বটবৃক্ষ। আহি মুখ ছোট করে বটবৃক্ষটির দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে,
“এর চেয়ে ভালো আমি পাশের সারিতে বসে থাকা শান্ত চোখের যুবকটির ছবি আঁকি।”

এমন ভাবনা মাথায় আসতেই আহির ঠোঁটে বিস্তর হাসি ফুটে উঠলো। সে স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কেচবুকের একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে খাতার নিচে রাখলো। তারপর সটান হয়ে বসে ছেঁড়া পৃষ্ঠায় তার প্রিয়র ছবি আঁকতে লাগলো।

চারটা বেঞ্চ আগেপিছে। মাঝখানের সারিতে বসা একটা ছেলে। হাতে পেন্সিল। টেবিলে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে রাখা বিভিন্ন মানের পেন্সিল আর রাবার। ছেলেটির খাতায় আঁচড় পড়ছে পেন্সিলের। সে ব্যস্ত বটবৃক্ষের শিকড়ে প্রাণ দিতে।

স্যার ঘুমকাতুরে মানুষ। চেয়ারে বসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছেন। সময় ফুরাতেই তিনি চোখ খুললেন। এখন বিরতি। সবাই যতোটুকু এঁকেছে তা দেখেই তিনি সংশোধন করবেন। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার ছেঁড়া পৃষ্ঠাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললো। স্যার আহির খাতার সামনে এসে ভ্রূ কুঁচকালেন। খাতায় পেন্সিলের হালকা দাগও নাই। আঁকার চেষ্টা করেছে এরও কোনো প্রমাণ নেই। খাতা একদম পরিষ্কার। আহি মুখ ছোট করে স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভীষণ শরীর খারাপ স্যার। চোখ বার-বার ঝাপসা হয়ে আসছে।”

স্যার মাথা নেড়ে বললেন,
“তুমি ছুটি নিয়ে চলে যাও। কাল ভালো লাগলে এসো।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না স্যার। আমি এখানেই থাকি? আসলে বাসায় কেউ নেই। বাবা অফিসে গেছেন। মাও বাসায় নেই।”

“ফোন থাকলে কল দিয়ে বলো।”

“স্যার, শুধু শুধু টেনশন করবে। আমার ভালো লাগছে এখানে। আমি একটু হাত-মুখ ধুয়ে আসি?”

“হুম, যাও।”

আহি একনজর তার প্রিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে পড়লো। স্যারের সাথে সে এতো কথা বললো আর এই ছেলে একবারো তার দিকে তাকালো না। এদিকে স্যার কাকে কি বললো তা শোনার জন্য আহি ব্যস্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। আর এই ছেলের একমাত্র লক্ষ্য যেন তার খাতা, আর তার আঁকা ছবি।

(***)

বিরতির মধ্যেই আরো কিছু ভাইয়ার সাথে পরিচিত হয়ে নিলো আহি। এখন বাকি চার জন। এর মধ্যে তার প্রিয় মানুষটিও আছে। চারটা নাম সে আওড়াতে লাগলো। সোহেল, জয়, দেবাশীষ আর আফিফ। এর মধ্যে দু’জনের হাতে বাঁধা লাল সুতো দেখেই আহি ধরে নিয়েছে এরাই জয় আর দেবাশীষ। বাকী আছে সোহেল আর আফিফ। এর মধ্যে একজন আসেই নি। এখন কীভাবে সে বুঝবে, কে সোহেল, আর কে আফিফ! একটা নাম জানতে তার কতো কিছুই না করতে হচ্ছে। নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য তার পাগল মনে হচ্ছিল। তবুও এই পাগলামো করতেই তার ভীষণ ভালো লাগছে। ক্লাস শেষ হতেই তার ভাগ্য যেন শুভ প্রমাণ হলো। স্যার পেছন থেকে জোর গলায় ডাকলেন,
“আফিফ, এদিকে আসো।”

আহি পেছন ঘুরতেই দেখলো তার প্রিয়ই স্যারের ডাকে সাড়া দিয়েছে। তাহলে প্রিয়র নাম আফিফ? আহি মনে মনে বলল,
“স্যার আগেই যদি নাম ধরে ডাকতেন, শুধু শুধু আমাকে মগজধোলাই করতে হতো না।”

এবার আহি তার টুকে নেওয়া নোটটি খুলে মুচকি হাসলো। এলোমেলো ভাবে লেখা, আফিফ রাফাত। এক রাশ ভালো লাগা ছেয়ে গেলো আহির মনে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই মনে করার চেষ্টা করছিল সকালে যখন এই নামটি হুড়োহুড়ি করে টুকে নিচ্ছিলো, তখন তার হাতটা কি একবারো কেঁপেছিল? ঠোঁট চেপে হাসছে আহি। সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়েই উঠছিল। আহি তাকে দেখেই হাসি গিলে ফেললো। দুই সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মেরে বলল,
“তুমি আমাকে পাগল করে দেবে এআর৷”

০৪।

বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িতে মাত্র পাঁচজন মানুষের বাস। আহির বাবা-মা আর আহি, সাথে থাকেন মুনিয়া খালা ও তার মেয়ে চুনি। মুনিয়া খালা আহিদের বাসায় কাজ করেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর আহির বাবা মুনিয়াকে তাদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকে মুনিয়া তার মেয়ে চুনিকে নিয়ে এই বাড়িতেই আছে। সারাদিন এই বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি পরিষ্কার করতেই ব্যস্ত থাকে মুনিয়া। চুনি ছোট মানুষ, আট কি নয় বছর বয়স। এই বয়সেই সে বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখে সময় পার করে। আহির মা, মিসেস সালমা ফাওজিয়া বইপোকা। তিনি রান্না-বান্নার কাজ সেরে নিজের লাইব্রেরিতে গিয়ে সময় কাটান। আর আহির বাবা, রিজওয়ান কবির ব্যস্ত থাকেন নিজের ব্যবসার কাজে। আহি সারাদিন নিজের ঘরে বসে কি করে না করে তা কেউ দেখতে আসে না। রিজওয়ান কবির নিজেই মেয়েকে এই স্বাধীনতা দিয়েছেন। প্রাইভেসি শব্দটার সাথে আহি ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। শিল্পপতি বাবার একমাত্র কন্যা অল্প বয়সেই ফোন, ল্যাপটপ সবই হাতে পেয়ে যায়। নিজের ঘরে নিজের মতো থাকতেই সে অভ্যস্ত। এমনকি স্কুলে যাওয়ার আগে নিজের ঘরে সে তালা লাগিয়ে যায়। সেই ঘরে প্রবেশের অধিকার কারো নেই। উলটো কেউ যদি ভুলেও পা রাখে তাকে আহির রোষাগ্নিতে পড়তে হয়। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কাজে বিরক্ত হোন। কিন্তু মেয়ের বাবা যেখানে মেয়েকে আস্কারা দিয়ে রেখেছেন, সেখানে তিনি কিছু বললে উল্টো স্বামীর কাছ থেকেই তার বকা খেতে হয়। এমনিতেই স্বামীর সাথে তার বনিবনা হয় না। কিছু বলতে গেলেই হয়তো সংসার বাঁচানো দায় হয়ে যাবে। তাই তিনি চুপ করে থাকেন। কারণ তার মেয়ে আর যাই করুক, পড়াশুনা ঠিকই করছে। পরীক্ষায়ও ভালো করে। তাই তিনি মোটামুটি আহির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তামুক্ত আছেন।

(***)

আহি আর্ট স্কুল থেকে এসেই ব্যাগ থেকে সেই স্কেচটি বের করে তার ক্যানভাসের সাথে আটকে রাখলো। বার কয়েক সেই স্কেচটিতে হাত বুলিয়ে পেন্সিল হাতে নিয়ে নিচের অংশে লিখলো, “এআর।” নামটি লিখতেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।

প্রথম প্রেম হয়তো এমনই হয়। কোনো আশা নেই, কোনো হতাশা নেই, কোনো স্মৃতি নেই, শুধু ভালোবাসতেই ভালো লাগে।

আহির ঘরটি ভালোই বড়সড়। সেই ঘরে আসবাবপত্রের চেয়ে আহির শখের জিনিস বেশি। ঘরের একপাশ দখল করে নিয়েছে তিন-চারটি কাঠের ইজেল। ইজেলের উপর ক্যানভাস রাখা। অন্যপাশ দখল করে নিয়েছে পুরোনো পত্রিকা দিয়ে মোড়ানো আহির আঁকা ছবি। দক্ষিণের জানালা বরাবর খাট। পুরোনো দিনের বাড়িগুলোর মতো গ্রিল ছাড়া জানালা। আহি প্রতিদিনই খোলা চুল জানালার বাইরে বের করে দিয়ে ঘুমায়। তবে নিচেই দারোয়ান চাচার ঘর। আবার দিন-রাত সময় ভাগ করে পাহারাদাররা বাড়ি পাহারা দেন৷ আহির মনে ভূতের ভয় একদমই নেই। সে বিন্দাস থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ছবি আঁকে, কখনো বা কমিক্সের বই পড়ে। আহিকে দেখলে যে-কেউ বলবে, আহির মতো সৌভাগ্যবতী হয় না। আহির বয়সী মেয়েদের যেখানে বাবা-মার বকুনি খেয়ে পড়তে বসতে হয়, সেখানে আহি বকাঝকার নমুনায় কখনো দেখে নি।

……………….

“দিনগুলো কতো চমৎকার ছিল! এখন ভাবছি কেন এতো বড় হলাম।”
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আহির। চোখ বন্ধ করে অতীতের সুখ স্মৃতি হাতড়াতে ভালোই লাগছিল তার। বিমান অবতারণের ঘোষণা হতেই চোখ খুললো সে। পাশ ফিরে একনজর নায়ীবের দিকে তাকালো। তারও হয়তো এই মাত্র ঘুম ভেঙেছে। নিভু নিভু চোখে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এতোগুলো সময় কীভাবে যে কেটে গেলো!”

আহি নায়ীবের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। এ লোকটার প্রশ্ন থেকে সে অন্তত বেঁচে গেছে।

(***)

বিমান থেকে নেমেই গটগট পায়ে বিমানবন্দরে ঢুকে গেলো আহি। জরুরি কাগজপত্র বের করে তা কাষ্টমস অফিসারকে দেখিয়ে কনভেয়ার বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। নায়ীবকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নায়ীব জরুরি কাগজপত্র দেখিয়ে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি ভ্রূকুঁটি মিশ্রিত চোখে নায়ীবের দিকে তাকাতেই নায়ীব বুক পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আহির দিকে এগিয়ে দিলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আহি কার্ডটি নিয়ে নিলো। নায়ীব বলল,
“আমি বেশ বুঝতে পেরেছি আপনি ডিপ্রেশনে আছেন। আর এটা ভয়াবহ সমস্যা। তার চেয়ে বড় সমস্যা, সমস্যার কথাটা কাউকে বলতে না পারা। আপনার সীমাবদ্ধতা কোথায় সেটা আমি জানি না। আপনার সাথে কি হয়েছে, তাও আমি জানি না। কিন্তু মিস ওয়াসিকা কবির, মানুষের মন কিন্তু জানালার মতো। জানালা খুলে দিলে যেমন মিষ্টি হাওয়া প্রবেশ করে, তেমনি বন্ধ রাখলে গুমোট বাতাবরণের সৃষ্টি হয়। জীবনটাও ঠিক তেমন। মনের জানালা খুলে দিবেন, সুখ-দুঃখ অন্যের সাথে ভাগ করে নিবেন, তবেই স্বস্তি পাবেন। আর বন্ধ রাখবেন তো নিজেকেই ধীরে ধীরে হত্যা করবেন।”

আহি ঠোঁটে শুকনো হাসি টেনে কার্ডটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখার জন্য এতো চেষ্টা করছে সে, অথচ তার কষ্টটা আজ অপরিচিত একজন দেখেই বুঝে ফেললো। সে তো কঠিন হতে চায়ছে, তাহলে কেন এই ভালোবাসা তাকে বার-বার দুর্বল করে দিচ্ছে?

(***)

ব্যাগ নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এলো আহি। চারপাশে একবার চোখ বুলালো। তাকে নিতে কেউ আসে নি। আসার কথাও নয়। বাবা ঢাকাতেই আছেন। তিনি জানেন আজ আহি আসবে, সময়টাও আহি জানিয়েছিল। তবুও আসেন নি। তবে বাবার কাছ থেকে কোনো আশা রাখে না সে৷ গেল বছরগুলোতে তার যেই রূপ দেখেছে, আহির আশা-ভরসা সব হারিয়ে গেছে। জীবন যুদ্ধে সে নিজেকে পরিত্যক্ত মাঠে একাই আবিষ্কার করেছে। যার আগেপাছে কেউ নেই।

বিমানবন্দরের সামনে থেকে গাড়ি নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো আহি। গাড়িতে উঠেই ফোনে নতুন সিম ঢুকালো। ফোন চালু করেই বাবার নম্বরে ডায়াল করতে যাবে তখনই ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে পরিচিত নাম দেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্নতায় ভরা ভারী পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
“কি রে ফোন বন্ধ কেন তোর?”

“মাত্রই তো ফোনে সিম লাগালাম।”

“মাত্র কেন? ল্যান্ড তো অনেক আগেই করেছিস।”

“ব্যাগপত্র নিতে গিয়েই তো সময় গেলো।”

“আর আমি এদিকে চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। তুই মানুষ নাকি গরু?”

আহি গাল ফুলিয়ে বলল, “গরু বলবি না আমাকে।”

“আচ্ছা, গাভীই বলবো।”

ওপাশ থেকে হাতাহাতির শব্দ কানে আসতেই আহি ফোন সরিয়ে নিয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
“পাগল ছাগলের দল।”

কল কেটে যেতেই আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রাদের সাথেই এতোক্ষণ কথা বলছিল আহি।
রিদমাম রাদ আহির ছোটবেলার বন্ধু। আর যার সাথে রাদের হাতাহাতি হচ্ছিল, সে লাবীব, আহির আরেক বন্ধু। তারা একই স্কুলে পড়েছিল। রাদ আর লাবীব এতোদিন আহির সাথে লন্ডনে ছিল। একই ইউনিভার্সিটি থেকে তারা পড়াশোনা শেষ করেছে। লাবীবের দাদা মারা যাওয়ায় লাবীব ও রাদ দেশে আগেভাগেই চলে এসেছিল।

(***)

রাদ ফোনের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে লাবীবকে বলল,
“দেখছিলি না কথা বলছিলাম? ফোনটা কেটে গেলো তো!”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আমারও কথা ছিল আহির সাথে।”

“দেখা হলে বলিস। আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করলে নিজের ফোন থেকে কল দে। আমার ফোনে কি?”

(***)

ব্যাগে ফোন রাখতে গিয়েই আহির চোখ পড়লো বাদামী মলাটের ডায়েরীটির দিকে। বেশ মোটা আর ভারী ডায়েরী। ব্যাগের ভারটা বোধহয় এই ডায়েরীর কারণেই একটু বেশি লেগেছিল। ভার হওয়ায় তো স্বাভাবিক। এই ডায়েরীতেই তো বাঁধা পড়ে আছে তার অতীত স্মৃতি। সে যেখানেই যায়, এই ডায়েরী তার সঙ্গী হয়। আহি ডায়েরীটা হাতে নিয়েই মলিন হাসলো। আলতো হাতে মলাটের উপর হাত বুলালো। চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে তাকাতেই তার মনে পড়ে গেলো এই ডায়েরীকে ঘিরে তার সৃষ্টি হওয়া সেই অদ্ভুত দিনটির কথা।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৩||

০৫।
সূর্যকিরণ পিচঢালা রাস্তায় ঠিকরে পড়ছে। পিচের রাস্তা রোদের আলোয় চিকচিক করছে। আহির ঠোঁটে কোমল হাসি। শক্ত হাতে একটা মোটা ডায়েরী আঁকড়ে ধরে আছে সে। স্কুল ছুটি হতেই জমানো টিফিনের টাকা দিয়ে এই ডায়েরী কেনা। এক একটা দোকান, স্কুলের পাশের লাইব্রেরি, শপিংমল ঘেঁটে সে এই বিচিত্র ডায়েরী কিনেছে। মলিন সাদা পৃষ্ঠার বাদামী চামড়ার ডায়েরী। ডায়েরীর মলাটে আর পাতায় ক্লাসিকাল ছাপ। আহি ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“এআর, এক যুগ পর যখন তুমি এই ডায়েরী পাবে, তখন বুঝবে, এই আহি তোমাকে কতোটাই না ভালোবাসতো।”

অকস্মাৎ আহির এলোমেলো ভাবনায় ছেদ ঘটলো। সামনে হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত মুখটি আহির গতিরোধ করলো। আফিফ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। এ তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! এভাবে আফিফের সাথে দেখা হয়ে যাবে, আহি কল্পনাও করে নি।
আহি ঝটপট আশপাশ চোখ বুলিয়ে নিলো। তার চোখ পড়লো জীর্ণশীর্ণ দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সার দিকে। সে রিক্সার কাছে এসে তার কাঁধের ব্যাগটা রিকশার হাতলে ঝুলিয়ে দিলো। তারপর ব্যাগের সাইড পকেট থেকে একটা কলম আর পেন্সিল বের করলো। রিক্সার পাশেই ইটের স্তূপ। হয়তো ইটগুলো ভাঙার জন্য একপাশে জড়ো করে রাখা হয়েছে। আহি চারটা ইট বসিয়ে বসার জায়গা করে নিলো। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে নতুন ডায়েরীটা খুলল। কোলের উপর রেখে সাদা পৃষ্ঠায় কলম চালালো।

“তোমার দিকে তাকিয়ে তোমার আমার প্রেমের গল্প লেখা শুরু করছি। বিষয়টা চমৎকার না? এমন উন্মাদ প্রেমিকা কি আগে দেখেছো? নিশ্চয় দেখো নি। জানো, আজই কিনলাম এই ডায়েরীটা। আর পথে দেখা হয়ে গেলো তোমার সাথে। তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, কথা বলছো কোনো এক অচেনা ছেলের সাথে। আর আমি রৌদ্রতাপ ভুলে রিকশার পাশে তোমাকে দেখা যায় এমন স্থানে বসে আছি। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি তোমাকে। আচ্ছা এআর, মেয়েরা কি এভাবে লুকিয়ে কারো দিকে তাকায়? মেয়েরাও কি এভাবে ভালোবাসে? জানি না, কিন্তু আমার তোমাকে এভাবে ভালোবাসতেই ভালো লাগে।”

লেখা শেষ করে আহি আফিফের দিকে তাকালো। চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে আহি। রোদের তাপে মুখ জ্বালা করছে, তবুও ঠাঁই বসে আছে সে। পেন্সিল হাতে নিতেই দেখলো আফিফ ছেলেটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। আহি দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ছুটলো আফিফের পিছু। কিন্তু অর্ধেক পথ যেতেই আফিফকে হারিয়ে ফেললো। শেষমেশ শুকনো মুখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরলো সে। এরপর বাসায় এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। সালমা ফাওজিয়া আহির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেকেন্ড খানিক নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।

(***)

বিকেলে আহি ডায়েরী খুলে তার লেখাটা একবার পড়ে নিলো। তারপর খালি স্থানগুলোতে গোলাপের পাপড়ি লাগিয়ে একপাশে আফিফের নাম লেখা নোটটি আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলো। আর নিচে লিখলো,

“প্রথম তোমার নাম জানার চেষ্টা। কি সুন্দর নাম! আফিফ রাফাত।”

তারপর একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে আজকের দৃশ্যটা স্কেচ করতে বসে গেলো।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আফিফ। সামনে একটা ছেলের অবয়ব। আহি বসে আছে ইটের উপর। পাশে একটা রিকশা৷

স্কেচ শেষে ডায়েরীটা বন্ধ করে আলমারীতে তুলে রাখলো আহি৷ এরপর ক্যানভাসে আটকানো সেই স্কেচটার দিকে তাকালো যেটা সেদিন বটবৃক্ষের পরিবর্তে এঁকেছিল। স্কেচটা বাঁধিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো সে। যেই ভাবা সেই কাজ। স্কেচটা হাতে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো আহি। সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে চপল পায়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ভ্রূ কুঁচকালেন। আহি পাশের দোকানে গিয়ে স্কেচটা বাঁধাতে দিলো। একদিনের মধ্যেই আফিফ তার ঘরে শোভা পাবে, ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগা কাজ করছিল আহির মনে।

………………………….

জানালার পর্দা দু’পাশে সরিয়ে দিতেই জানালা ভেদ করে রোদের আলোকচ্ছটা আহির মুখে এসে পড়লো। কড়া রোদে মানুষ হাঁসফাঁস করছে। প্রকৃতি কেমন ভ্যাপসা গরম ছড়াচ্ছে। দেশে গরম বোধহয় একটু বেশি। তবে আহির তেমন খারাপ লাগছে না। সে তো অভ্যস্ত এসবে। প্রিয় মুখটা দেখার জন্য কিছু বছর আগেও সে রোদে পুড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
অতীত স্মৃতি থেকে বেরিয়ে শুকনো ঢুক গিললো আহি। বুকটা আবার জ্বালা করছে তার। ঠোঁট দু’টিও কাঁপছে। মাঝে মাঝেই প্যানিক এটাক আসে আহির৷ সেই চার বছর আগে প্রথম এসেছিল। তারপর থেকে প্রতিনিয়ত এই সমস্যায় ভুগছে। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিলো বার কয়েক। এরপর ভেজা মুখেই সে হোটেলের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। রোদের তাপে বারান্দার মেঝেতে পা রাখা যাচ্ছে না। রেলিঙে হাত রাখতেই বুঝলো, গরমের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। চার বছর আগেও প্রকৃতি এতো উত্তপ্ত ছিল না। দিন দিন আবহাওয়ার ভিন্ন রূপ সৃষ্টি হচ্ছে। আজ হয়তো দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আর এদিকে সে নিম্ন মানের হোটেলে উঠেছে। রুমে এসির ব্যবস্থা নেই। ফ্যানটাও খুব আস্তে ঘুরছে। বাবাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিল আহি, কিন্তু তিনি ধরলেন না। তাই বাধ্য হয়েই কাছের একটা হোটেলে উঠতে হলো তাকে। ক্রেডিট কার্ডে অল্প কিছু টাকা ছিল, তা উঠিয়ে নিয়েছিল। সেই টাকা দিয়েই ঢাকায় জরুরী কাজ সেরে চট্টগ্রাম যেতে হবে।

বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে আহি। আর আনমনে বলতে লাগলো,
“দেখো, কেমন পাগল হয়ে যাচ্ছি, এআর। তুমি হয়তো আমাকে মনেই রাখো নি৷ কিন্তু আমি এক পাগল, তোমাকে এতো চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না। আমি তো ভোলার অনেক চেষ্টা করেছি। নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। এর চেয়ে বেশি চেষ্টা করতে গেলে মস্তিষ্ক বের করে তোমার স্মৃতি ঘেরা অংশটা মুছে দিতে হবে৷ এছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। কেন এতো ভালোবেসেছিলাম তোমাকে, বলো না এআর? ভালোবাসার সাগরে ফেলে দিয়েছো ঠিকই, কিন্তু ভুলে যাওয়াটা শিখিয়ে দাও নি। এখন শুধু একটাই চাওয়া, দ্বিতীয় বার যাতে তোমার মুখোমুখি হতে না হয়। তোমার জন্য দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই ফিরতে হলো। নয়তো কখনোই আসতাম না আমি। গ্রীষ্ম শেষ হলে আবার বর্ষার মাস আসবে। এমনই এক গ্রীষ্মে তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আর বর্ষা এসে তোমাকে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেলো। সেদিন শুধু তোমাকে হারায় নি, অনেক মানুষকে একসাথে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি তো কাউকে কষ্ট দেই নি, এআর। তাহলে আমি কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি? আমি এতো অসহায় কেন? মাঝে মাঝে ভাবি, কেন বেঁচে আছি? আমার বেঁচে থাকা না থাকায় কারো কিছুই আসে যায় না। আমি শুধু কিছু মানুষের জন্য ইনভেস্টমেন্ট মাত্র।”

আহি দেয়াল ঘেঁষে বারান্দার মেঝেতে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে৷ দেয়ালে ধীরগতিতে মাথার পেছন ভাগ টুকাতে লাগলো। এতে যদি মাথার চাপ একটু কমে। ভীষণ ভারী ভারী লাগছে মাথাটা।

০৬।

লিনাশা, পদ্ম, আহি আর পুষ্প। তারা মোট চার বন্ধু। স্কুল-কলেজ একসাথেই শেষ করেছিল তারা। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর পরই তারা সবাই আলাদা হয়ে যায়। আর তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে পড়ে। তারা তাদের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তাদের চারজনের এই ছোট বন্ধু মহলটির একটা নামও রেখেছিল, ‘পলি আপু’ নামে। সবাই এই নামটা শুনে হাসাহাসি করতো, আবার অবাক হতো চারজনের বন্ধুত্ব দেখে।
বন্ধু মহলে পদ্ম ছিল সবচেয়ে শান্ত। আর পুষ্প ছিল খুবই চঞ্চল। অন্যদিকে লিনাশা আর আহি ছিল অনেক মিশুক। তবে এই চারজনের মধ্যে লিনাশা আর আহির বন্ধুত্ব একটু বেশিই গভীর ছিল। কিন্তু হঠাৎ কি যেন হলো! আহি চার বছরের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলো। যেই লিনাশার সাথে আহির গলায় গলায় ভাব ছিল, তারা এখন একে অপরের নামও উচ্চারণ করে না। অন্যদিকে পদ্ম বিয়ের পর থেকে সংসার নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর পুষ্পের সাথে আহির খুব কমই যোগাযোগ হয়। কিন্তু আহির ফোনের ওয়ালে এখনো কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে চারজনের একসাথে তোলা শেষ ছবিটি শোভা পায়। ফোন হাতে নিয়ে সেই ছবিটিই দেখছিলো আহি। ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে আহি বলল,
“অন্তত তোরা আমার সাথে থাকলে, আমার জীবনটা এমন এলোমেলো হতো না। পরিবার, বন্ধু, ভালোবাসা সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। এই বিস্বাদ জীবনে কোথাও ছিঁটেফোঁটা আনন্দও নেই।”

ফোনের স্ক্রিনে রাদের নামটা ভেসে উঠতেই আহি ভেজা চোখ মুছে নিলো। ফোন কানের কাছে আনতেই ওপাশ থেকে গম্ভীরমুখে রাদ বলল, “কাঁদছিস!”

রাদের কথায় কান্নার বেগ যেন আরো বেড়ে গেলো আহির। মুখে হাত চেপে নিজেকে সংবরণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো সে। রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“থাক কথা বলিস না। আমার কথা শোন। তোকে একটা গান শোনাই। চোখ বন্ধ করে রাখ। ভালো লাগবে।”

আহি চোখ বন্ধ করতেই অশ্রুগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। রাদ কন্ঠে গান ধরলো,
“খোলা জানালা দখিনের বাতাসে….
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে,
তখন তুমি এসে হেসে বলে দাও
আছি তোমার পাশে।
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা,
চলতে ভীষণ ভয়,
তুমি এসে বলে দাও আছি আমি পাশে
করো না কিছুতেই ভয়।
তখনও বুঝিনি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
তখনও বুঝিনি ফিরে আসবেনা
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।
অনেক পথের পথিক আমি ক্লান্ত সর্বশেষ,
তোমার পথের ঠিকানা খুঁজে, আমি আজ অবশেষ।
তুমি আমার প্রথম ও শেষ জীবনের ভালোবাসা,
তোমার মাঝে তাইতো আমার জীবনের শত আশা।
তখনও বুঝিনি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
তখনও বুঝিনি ফিরে আসবেনা
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।”

আহি ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমার কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিলি, রাদ।”

“তোর কষ্টগুলো ভীষণ ঘাড়ত্যাড়া রে। শুনেছি মানুষ কষ্ট পেতে পেতে পাথর হয়ে যায়। আর তুই বরফ গলা নদী। কখনো শক্ত, কখন গড়িয়ে পড়িস। এভাবে চলবে না, আহি। শক্ত হ। এখন তো তোকে আরো শক্ত হতে হবে। আংকেলের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য তো অন্তত তোকে শক্ত হওয়া দরকার।”

আহি বিড়বিড় করে বলল,
“বাবার সাথে শক্তির জোরে আমি পারবো না। আমি হয়তো হেরে যাবো।”

রাদ এবার ধমকের সুরে বলল,
“আহিনি, তোকে সামনে পেলে রামধোলাই করবো আমি। মিনমিন করে কি বলছিস? হেরে গেলে মার খাবি। তোকে হারাতে হবে।”

“পারবো আমি?”

“কেন পারবি না? যথেষ্ট বড় হয়েছিস তুই। এখন তোর মতামতের একটা মূল্য আছে। আর এসব পরে ভাবিস। আগে চট্টগ্রাম গিয়ে দেখ, বাসার পরিবেশ কেমন। তারপর সুযোগ বুঝে নিজের মত রাখবি। আংকেলের সব অন্যায় কেন মেনে নিবি?”

“তুই বাবাকে চিনিস না। আমি এই চার বছরে তার যেই রূপ দেখেছি, মনে হচ্ছে না আমি তার হাত থেকে মুক্তি পাবো। মনে বলছে সামনে আরো ভয়ংকর কিছু দেখতে হবে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৪||

০৭।
ফোন বাজতেই কপালে ভাঁজ পড়লো আহির। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো বিছানা ছেড়ে। ড্রেসিং টেবিলের পাশে ফোনটা রাখা। কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে ফ্যানের দিকে তাকালো। ধীর গতিতে ফ্যান ঘুরছে। গরমে ঘেমে একাকার আহি। বিছানা ছেড়ে উঠেই ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এলো। তারপর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ফোনের কাছে এলো সে৷ বাবার কল দেখে ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠলো আহির। ফিরতি কল দিলো সেই নম্বরে৷ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠের স্বর ভেসে এলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা তো রিজওয়ান কবিরের নম্বর, তাই না?”

“জ্বি, স্যার এখন ব্যস্ত আছেন। আমি উনার ম্যানেজার বলছি।”

“বাবাকে একটু দেওয়া যাবে। আমি উনার মেয়ে ওয়াসিকা কবির।”

“জ্বি, স্যার এখন কথা বলতে পারবেন না। আপনার জন্য স্যার মেসেজ দিয়েছেন।”

“কি মেসেজ?”

“স্যার আপনার সাথে দেখা করতে পারছেন না। উনি জরুরি কাজে আজই সিলেট যাচ্ছেন। স্যার আপনাকে একাই চট্টগ্রাম যেতে বলেছেন।”

আহি নিঃশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার ঠোঁটের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো।
কাঁপা কন্ঠে বললো, “আচ্ছা।”
এরপর কল কেটে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুকে হাত দিয়ে নিজের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করলো আহি। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। অশ্রুগুলো গাল বেয়ে গড়িয়েই পড়লো। সে মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“কারো কি আমার জন্য একটুও সময় নেই?”

পাশ ফিরতেই আহির নজর পড়লো বাদামী মলাটের সেই ডায়েরীটির দিকে। আহি ঠোঁটে শুকনো হাসি টেনে ডায়েরীটা হাতে নিলো। তারপর সেটা বুকের সাথে জড়িয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ধীর গতিতে ঘূর্ণনরত ফ্যানটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

…………………..

দিনটি ছিল শুক্রবার। চারুশিল্পে ক্লাস শেষ হতেই আফিফ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আহি আফিফের ব্যস্ততা দেখে হুড়োহুড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগে খাতা ঢুকানোর সময়টাও যেন পেলো না। খাতা-পেন্সিল হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়লো আহি। আফিফ সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে পড়লো। আহিও আফিফের পিছু নিয়েছে। কেন পিছু নিয়েছে তা আহি নিজেও জানে না। আফিফ দ্রুতপদে গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আহিও কিছুটা দূরত্ব রেখে আফিফের পিছু পিছু হাঁটছে।
ব্যস্ত রাস্তা, তবে আজ যান চলাচল হালকা। ছুটির দিন, তাই হয়তো। আজ জুমার দিন। মসজিদে তাড়াতাড়ি আযান দিচ্ছে। আফিফ হয়তো তাই এতো দ্রুত গতিতে হাঁটছে। ভাবতেই আহির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। আফিফ কি তাহলে নামাজ পড়বে? কিন্তু আহি তো নামাজ পড়ে না। সেই ছোট বয়সে মায়ের কাছে নামাজ শিখেছিল সে। কিন্তু এখন আর পড়া হয় না। সারাদিন সে এটা-সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মা প্রতিদিন নামাজের সময় হলে বলে যান। কিন্তু আহি মায়ের কথা শুনে না। বকাঝকা করলে আহির বাবা রিজওয়ান কবির মেয়েকে আস্কারা দিয়ে বলেন, মেয়ে এখনো ছোট। বড় হলে পড়বে। যদিও রিজওয়ান কবির নিজেও জুমার দিন ছাড়া মসজিদে দূরে থাক, বাসায়ও নামাজ পড়েন না। বাবার শিক্ষাটায় বোধহয় আহি পেয়েছে।

আফিফ রাস্তার ওপাড়ে। আহি অন্য পাড়ে। সমান্তরাল রাস্তা। যেন কখনোই মিলিত হবে না এই পথ। মাথা নিচু করে হাঁটছে আফিফ। গরমে ঘেমে গেছে সে। পরণের নীল শার্টটা ঘামে ভিজে গায়ের সাথে সেঁটে আছে। কাঁধের একপাশে কালো ব্যাগ। হাতে একটা ধূসর বেল্টের ঘড়ি। পায়ে মলিন স্যান্ডেল। আহি দূর থেকে মুখস্থ করে নিচ্ছে আফিফের প্রতিটি পদচিহ্ন। পাশের একটা মসজিদে ঢুকে পড়লো আফিফ। আহি এপাশ-ওপাশ তাকালো। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আফিফের অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সে রাস্তা পার হয়ে মসজিদের কাছে আসতেই দেখলো অনেকে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে ঢুকছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভীষণ বেখাপ্পা লাগছে তার। তাই সে মসজিদের সামনে থেকেই একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই নিজের ঘরে চলে গেলো আহি।

(***)

মিসেস সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে দুপুরের খাবারের জন্য ডাকতে এসেই দেখলেন আহির ঘরের দরজা খোলা। মিসেস সালমা এমন ঘটনায় ভীষণ অবাক হলেন। কারণ আহি সবসময় দরজা বন্ধ করে রাখে। মিসেস সালমা দরজা হালকা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই চমকে উঠলেন। দেখলেন মেয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে মোনাজাত ধরে রেখেছে। রাতারাতি আহির এমন পরিবর্তন ভীষণ অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তার কাছে। আহির মোনাজাত শেষ হতেই তিনি ধীর কন্ঠে বললেন,
“ভেতরে আসবো, আহি?”

আহি মায়ের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল,
“আসো মা।”

মিসেস সালমা ফাওজিয়া একনজর পুরো ঘরের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন,
“তুমি আজ হঠাৎ নামাজে বসেছো!”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“আজ থেকে আমি নামাজ বাদ দেবো না, মা। আমি যা চাই, আল্লাহর কাছেই চাইবো।”

“বেশ তো! কিন্তু তোমার ঘরে নামাজ পড়লে তো নামাজ হবে না।”

“কেন?”

“এখানে এতো ছবি ঝুলছে! তুমি লাইব্রেরী রুমে গিয়ে নামাজ পড়ো। ওখানে একপাশে নামাজের ব্যবস্থা আছে।”

“মা, আমি নিরিবিলিতে নামাজ পড়বো। আল্লাহর সাথে আমি কিছু সিক্রেট কথা বলবো। ওখানে তো যে-কেউ এসে পড়বে।”

“তুমি যখন নামাজ পড়বে, তখন লাইব্রেরি রুম বন্ধ করে পড়তে পারবে। কেউ তোমাকে বিরক্ত করতে আসবে না।”

“আচ্ছা।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আহির মাথায় চুমু খেলেন। আর আহির ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। সে মনে মনে বলল,
“এআর, এখন তুমি আমার হবেই হবে। আমি আল্লাহর কাছে তোমাকে চেয়ে নিচ্ছি।”

……………………

আহির গাল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে বালিশের উপর আছড়ে পড়লো। কান্নাভেজা কন্ঠে সে বলল,
“আমি সেদিন থেকে তোমাকে চেয়েছি, এআর। একটা রাত, একটা দিনও বাদ যায় নি, যেদিন আল্লাহর কাছে তোমাকে চাই নি। তাহলে তোমাকে কেন পেলাম না আমি? এআর, খুব ইচ্ছে হয় তোমার হাত ধরে হাঁটতে। খুব ইচ্ছে হয় তোমাকে জড়িয়ে ধরতে। তুমি কেন আমার হলে না, এআর?”

আহি শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ডায়েরীটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরে বালিশে মুখ গুঁজলো। হঠাৎ আহির ফোনটা বেজে উঠলো। চোখ মুছে ফোন হাতে নিতেই দেখলো রাদের কল। আহি বোতল থেকে অল্প কিছুটা পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিয়ে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রাদ জিজ্ঞেস করলো,
“দুপুরে খেয়েছিস?”

আহি নিঃশব্দে হাসলো। রাদ বলল,
“এই মুহূর্তে আমার কলটা করা খুব দরকার ছিল।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“তুই না থাকলে আমাকে হয়তো অনেক আগেই পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হতো।”

“আউল-ফাউল কথা বলিস না। আমি আসছি ঢাকা।”

“তুই!”

“হ্যাঁ, আমি। বাসে উঠেছি। রাতে পৌঁছাবো। তোর হোটেলের ঠিকানা দে৷ আমার সাথেই চট্টগ্রাম যাবি। এমন সুন্দরী মেয়েকে আমি কি ঢাকা শহরে একা ছাড়বো না-কি?”

“বাবাদের মতো কথা বলছিস। বাবাও যদি তোর মতো করে ভাবতো!”

“এখন খেয়ে নে। এরপর কড়া এক কাপ চা খাবি। চা খেলে মাথায় যে পোকাটা ঘুরাঘুরি করছে, সে অন্তত কিছু সময়ের জন্য বের হবে।”

(***)

মধ্যাহ্নের শেষভাগ। আহি হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে আশেপাশে হাঁটছে। রাস্তার পাশে খাবারের দোকানগুলো ভীষণ অপরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে তার। কিন্তু ক্ষিধেও পেয়েছে খুব। তাই একটা রেঁস্তোরায় ঢুকে পড়লো। অনুন্নত রেঁস্তোরা, একটা চাপা দুর্গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে। মধ্যাহ্নের সময়, তাই রেঁস্তোরায় তেমন ভীড় নেই। যারা আছে, তারা চা-সিঙ্গারা খাচ্ছে। একটা আট-দশ বছর বয়সী ছেলে আহির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি খাইবেন, আফা?”

আহি ছেলেটিকে ভালোভাবে পরখ করে বলল,
“ভাত হবে?”

“না আফা। শেষ হইয়া গেছে।”

“এখন কী পাওয়া যাবে?”

“সিঙ্গারা, সমুচা, চিকেন রোল….”

আহি ছেলেটিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এসব ছাড়া আর কিছু নেই?”

“ফরোটা আর ভাজি আছে। কিন্তু সময় লাগবো।”

“ওটাই নিয়ে আসো।”

“ফরোটা কইডা আনবো আফা?”

“দুইটা।”

আহি খাবার অর্ডার করে পাশ ফিরে তাকাতেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। পাশের টেবিলে চার-পাঁচটা ওয়ান টাইম কাপ রাখা। আহি কাপগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দিনটি।

…………………….

চারুশিল্প থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের মতো আজও আহি আফিফের পিছু নিয়েছে। রোদের উত্তাপ আজ স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা কম। মৃদু সমীকরণে নির্মল বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। আফিফ রাস্তার পাশে টংয়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। আহিও কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। আফিফ অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা হাওয়ায় আফিফের কপালের সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো দুলছে। আহির মন চায়ছে চুলগুলো আলতো হাতে স্পর্শ করতে আর যত্নের সাথে গুছিয়ে দিতে। টংয়ের দোকানদার একটা প্লাস্টিকের কাপ আফিফের দিকে এগিয়ে দিতেই সে টাকা এগিয়ে দিলো। এরপর সে পাশে থাকা ছোট একটা বেঞ্চে বসে চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আফিফ জানতেই পারলো না, তার চা খাওয়ার দৃশ্যটি কেউ মুগ্ধ চোখে দেখছিলো।

চা খাওয়া শেষ হতেই আফিফ কাপটি বেঞ্চের উপর রেখে চলে গেলো। আর আহি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই কাপটি উঠিয়ে নিলো। এরপর বাসায় এসে টেবিলের উপর কাপটি রেখেই ডায়েরী খুলে লিখতে বসলো।

“ক্লান্ত মুখ। নাকের ডগায় জমে ছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। হালকা হাওয়া তোমার ঘর্মাক্ত কপালটি শুকিয়ে দিয়ে গেলো। আর তোমার ঘামে লেপ্টে থাকা চুলগুলোও মুক্ত হলো। তুমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একটা ভাঙা বেঞ্চে বসলে। কাপে চুমুক দিতেই তোমার চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। চা নিশ্চিত গরম ছিল। কিন্তু তোমার কপালে একটুও ভাঁজ পড়লো না। শুধু চোখ দু’টোই সাড়া দিয়েছিল। আজ কেন যেন মনে হলো তুমি শুধু ক্লান্ত নও। বড্ড ক্লান্ত। তোমার মনে কি ভীষণ কষ্ট, এআর? আমাকে ভাগ দিবে সেই কষ্টের? আমি তোমার কষ্ট নিয়ে নেবো। দেখবে তুমি খুব সুখী হবে। অনেক সুখী হবে। কারণ তোমার জন্য আমি আছি।”

কলম উঠিয়ে নিলো আহি। টেবিলের উপর রাখা প্লাস্টিকের কাপটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এরপর একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে লেখার পাশেই আজকের দৃশ্যটা স্কেচ করতে লাগলো।

একটা ছেলে কাঠের ভেঙে বসে প্লাস্টিকের কাপ হাতে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। পাশে টংয়ের দোকান। আর দূরে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে সেই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে।

স্কেচ শেষ করেই ডায়েরীটা আলমারিতে তুলে রাখলো আহি। আর কাপটাও ওভাবেই প্লাস্টিক পেপারে মুড়িয়ে একটা তালা দেওয়া বাক্সে রেখে দিলো। এই বাক্সটিতে আহি সবসময় তালা ঝুলিয়ে রাখে। খুব প্রয়োজন হলেই সে বাক্সটি খুলবে।

……………………

খাবার আসতেই আহির ঘোর কাটলো। তার চোখে অশ্রু ভীড় করেছে। আট-দশ বছর বয়সী সেই বাচ্চা ছেলেটা কি বুঝলো কে জানে? সে হুট করেই জিজ্ঞেস করে বসলো,
“আফা কারো কতা মনে ফরছে নি?”

আহি হালকা হেসে বলল,
“না, তো। ঝাঁঝালো একটা গন্ধ নাকে লেগেছে। পাশেই তো রান্নাঘর তাই হয়তো।”

“আফা, আমি ওইখান থেইক্কা দেখতাছিলাম আপনারে। আগে কারো সাথে আইছিলেন মনে অয়।”

রেঁস্তোরার মালিক পাশেই ছিলেন। তিনি হয়তো ছেলেটার কথাগুলো শুনে ফেলেছিলেন। তিনি ধমকের সুরে বললেন,
“ওই মিন্টু, ওই টেবিলে চা দিয়া আয়। উনাদের এতোক্ষণ বসায় রাখছোস কেন?”

আহি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। দোকানের মালিককে নীরবে ধন্যবাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে টাকা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতেই ভাবতে লাগলো,
“এআর সত্যিই কি তুমি তোমার সব কষ্ট আমাকে দিয়ে সুখী হয়েছো? দেখো না, আমি এমন একটা মিনিট যায় না, যখন তোমাকে নিয়ে ভাবি না। তুমি আমার রক্তের সাথে মিশে গেছো। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে তোমাকে হারানোর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এমন কোনো স্থান নেই, চেনা-অচেনা যেখানে তোমাকে আমি অনুভব করি না। এভাবে কাউকে ভালোবাসা কি খুব দরকার ছিল? তুমি কি কখনো আমার মতো করে ভালোবাসতে পারতে? পৃথিবীর কেউ কি কখনো এমন উন্মাদের মতো কাউকে ভালোবেসেছিল? এমন কেউ যদি থাকতো, আমি তার কাছে গিয়ে মুক্তির পথ খুঁজতাম। কার ভালো লাগে কষ্ট পেতে? কার ভালো লাগে চোখ ভেজাতে? শুনেছি কাঁদতে কাঁদতে না-কি চোখ শুকিয়ে যায়। কে বলেছে এই কথা? আমার চোখ তো আজও তোমার স্মৃতিতেই ভিজে উঠে। আমার অশ্রু বিরামহীন ভাবে গড়িয়ে পড়ছে। আর হৃদয়টা হয়ে যাচ্ছে বিরান মরুভূমি।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-০১

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০১||

০১।
চার বছর পর দেশে ফিরছে আহি। মনে এলোমেলো ভাবনা। যেই মানুষটার স্মৃতি ভোলার জন্য সে পরিচিত শহর ছেড়ে নতুন শহরে গিয়েছিল, তাকে আজও ভুলতে পারে নি। মনটা অস্থির হয়ে আছে তার। বুকে হাত দিয়ে সে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তার পাশে বসা যাত্রীটি বার কয়েক ঝুঁকে তার দিকে তাকালো। লোকটা হয়তো ভাবছে, আহি শারীরিকভাবে অসুস্থ। একমাত্র আহিই জানে এই অসুস্থতার যন্ত্রণা কতোটা ভয়াবহ।
আহি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। পাশে থাকা অপরিচিত লোকটি পানির বোতল এগিয়ে দিতেই আহি বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে পানি খেতে লাগলো। হুড়োহুড়ি করে খেতে গিয়ে নাকে-মুখে পানি উঠে গেছে। আহি কাশতে শুরু করলে লোকটি তার হাত থেকে পানির বোতলটি নিয়ে বলল,
“এমন তাড়াহুড়ো করছেন কেন? আপনার কি প্লেনে চড়তে সমস্যা হয়?”

আহি হাতের ইশারায় বোঝালো, তার কোনো সমস্যা হয় না। একটু পর স্বাভাবিক হয়ে আহি সিটে হেলান দিয়ে বসলো। আগন্তুকটি স্বাভাবিক সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি হয়তো অনেকদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছেন।”

আহি চকিত দৃষ্টিতে আগন্তুকটির দিকে তাকালো। লোকটা স্মিত হেসে বলল,
“আমি নায়ীব তামজিদ, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।”

আহি বলল, “আমি ওয়াসিকা কবির।”

নায়ীব একটু পর আবার জিজ্ঞেস করলো,
“দেশে কোথায় থাকেন?”

“চট্টগ্রামে।”

“আমিও। এতোদিন লন্ডনে ছিলেন?”

“জ্বি, পড়াশুনা শেষ করে এখন দেশে ফিরছি। আপনি?”

“আমি একটা প্রোগ্রাম এটেন্ড করতে এসেছিলাম।”

আহি সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নায়ীব খেয়াল করলো, আহি তার দুই হাত বার-বার ঘষছে। তার কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নায়ীব ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে জিজ্ঞেস করলো,
“সেই সৌভাগ্যবান মানুষটা কে?”

নায়ীবের প্রশ্নে আহি চমকে উঠলো। পরক্ষণেই তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। অপরিচিত একজন তার প্রিয় পুরুষকে সৌভাগ্যবান সম্বোধন করেছে! আহি ভাবতে লাগলো,
“সত্যিই তো সে সৌভাগ্যবান। আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি। এতোটা ভালোবাসি যে এর চেয়ে বেশি ভালোবাসলে সে আমার উপর আধিপত্য নিয়ে ফেলবে। আর তখন হয়তো আমি নিজের জ্ঞান বুদ্ধি হারিয়ে ফেলবো।”

নায়ীব গলা খাঁকারী দিয়ে বলল, “এতোক্ষণ কি ভাবছেন?”

আহি নায়ীবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে কে বলেছে আমি কারো জন্য ডিপ্রেশনে আছি?”

নায়ীব নিঃশব্দে হাসলো। আহি নায়ীবকে নীরবে হাসতে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নায়ীব বলল,
“আমি তো মোটেও এই কথা বলি নি। আপনি নিজেই স্বীকার করলেন, আপনি কারো জন্য ডিপ্রেশনে আছেন। আপনার চেহারা দেখে আমি বুঝেছি আপনি দীর্ঘদিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। আর আমার প্রশ্নের উত্তরটা আপনি আমাকে এক নিমেষেই দিয়ে দিলেন।”

আহি মিনমিনিয়ে বললো, “কাউকে ভালোবাসা কি মানসিক রোগ?”

নায়ীব মৃদু হেসে বলল,
“ভালোবাসা অবশ্যই কোনো রোগ নয়। ভালোবাসা মানেই শান্তি। ভালোবাসার চেয়ে চমৎকার অনুভূতি দ্বিতীয়টা হয় না। তবে ভালোবাসা ততক্ষণ সুন্দর, যতক্ষণ সেটা ঠোঁটের হাসি ধরে রাখবে, বেঁচে থাকার প্রেরণা দেবে। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লে ভালোবাসার চমৎকার রূপটা হারিয়ে যায়।”

নায়ীবের কথা শুনে আহি নীরবে ভাবলো,
“চার বছর ধরে মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। আমি তো এখনো সেখানেই আটকে আছি, যেখানে তাকে ফেলে এসেছিলাম।”

(***)

নায়ীব আর আহি চুপচাপ বসে আছে। হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে তারা। দেশে পৌঁছাতে প্রায় বারো ঘন্টা সময় লাগবে। আহি নায়ীবের পাশে বসে এই দীর্ঘ সময় পার করতে চায় না। কারণ নায়ীব মনোরোগের চিকিৎসক। যে-কোনো মুহূর্তে তার উদ্ভট প্রশ্নে আহি ফেঁসে যেতে পারে। আর সে তার অতীতের কোনো অংশই কাউকে জানাতে চায় না। প্রিয় মানুষটিকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া অনুভূতিগুলো সে নিজের মাঝে দাবিয়ে রাখা শিখে গেছে। এখন আর সেই স্বভাব সে পরিবর্তন করতে চায় না। অল্প সময়ের পরিচয়ে যদি নিজের মন হালকা করার লোভ চড়ে বসে, তখন দেখা যাবে যখন-তখন তার কাউকে না কাউকে প্রয়োজন হবে। কিন্তু আহির জীবনের একমাত্র সত্য তো এটাই যে সে মানুষের ভীড়েও নিঃসঙ্গ।
নায়ীব প্রায় ঘন্টাখানেক পর আহিকে জিজ্ঞেস করলো,
“যার জন্য ডিপ্রেশনে আছেন, সে কি জানে?”

আহি নায়ীবের দিকে তাকালো। নায়ীব আহির চাহনি দেখে বলল, “খুলে বললে মন হালকা হয়।”

আহি বিনীত হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আমার মনটা ভারী থাকুক। আমি এভাবেই ভালো আছি।”

নায়ীব প্রতিত্তোরে মৃদু হাসলো। আহি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো। তার চোখের সামনে সেই মুহূর্তটি ভেসে উঠলো, যেদিন সে মানুষটিকে প্রথম দেখেছিল।

………………….

মাসটি ছিল বর্ষার মাস। আহির বয়স তখন মাত্র পনেরো। বয়সটাই ছিল বর্ষার মতো ঝড়ে গিয়ে নতুন করে ফোঁটার। বর্ষা যেমন বিদায় নেওয়ার পর এক চমৎকার পরিবেশ দিয়ে যায়, তেমনি এই বয়সটা পার করার পর আহিও হয়তো একটা মূল্যবান বয়সে চলে যাবে, যেই বয়সে সে সব নতুন করে শিখবে। কিন্তু আহি পনেরো বছরের সেই আবেগী বয়সেই দেখেছিল একটা চমৎকার স্বপ্ন। সবার কাছে যেই স্বপ্নটা ছিল আবেগ, তার কাছে ছিল বেঁচে থাকার সমীরণ।
ছোটবেলা থেকেই আহির ছবি আঁকতে খুব ভালো লাগতো। রং পেন্সিল হাতে পেলেই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে তার চারু শিল্পের ছাপ পড়তো। মা, সালমা ফাওজিয়া মেয়ের চারুকলার প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন। স্বামীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তিনি আহিকে ‘চারুশিল্প’ নামে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দেন। রিজওয়ান কবিরের কাছে এসব সময় নষ্ট করা ছাড়া কিছুই নয়। তবুও একমাত্র মেয়ের খুশির জন্য তিনিও আর না করেন নি। পনেরো বছর বয়সেই আহি তার শখের গতি পেয়ে যায়। আর তার এই শখের প্রতি আগ্রহই তাকে তার স্বপ্নের কাছে নিয়ে যায়।

(***)

আহি সপ্তাহে দু’দিন চারুশিল্পে ক্লাস করতে যায়। কারণ সপ্তাহের বাকী দিনগুলোতে স্কুলে ক্লাস থাকে। প্রথম দিন রিজওয়ান কবির মেয়েকে চারুশিল্পে নামিয়ে দিয়ে কর্মস্থলে চলে যান। কবির সাহেব চলে যাওয়ার পরই আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। যেহেতু বর্ষার মাস, তাই থেমে থেমেই বৃষ্টি পড়ছে। ছাতাটা গাড়িতেই ফেলে এসেছিল আহি। তাই বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচার জন্য সে ব্যাগ থেকে প্লাস্টিক মলাটের একটা খাতা বের করে মাথার উপর ধরলো। নতুন খাতা, তাতে ছবিও আঁকা নেই। খাতাটা ভিজলে সমস্যা নেই, কিন্তু তার মাথাটা না ভিজলে হলো।
বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আহি খুব গোছালো। সবসময় পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে। আর সকাল থেকেই সে তার শখের স্কুলে আসবে বলে এক ঘন্টা ধরে চুল বেঁধেছিল। কিন্তু এখন বৃষ্টিতে চুলগুলো ভিজে এলোমেলো হয়ে গেলে, তার এক ঘন্টা বৃথা যাবে।
আহি খাতাটা মাথার উপর ধরে সামনে এগুতে গিয়েই থমকে গেলো। একটা ছেলে খুব ধীর গতিতে স্কুলের মাঠে হাঁটছে। চারুশিল্পের গেট থেকে স্কুল ভবনটির দূরত্ব প্রায় পাঁচশো মিটার। এতো ধীরে হাঁটলে তো সে বৃষ্টিতে ভিজে যাবে। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে, তার ভিজে যাওয়ার কোনো চিন্তা নেই।
ছেলেটা নিজের মনে হেঁটে আহিকে অতিক্রম করে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আর আহিও স্কুল ভবনে ঢুকে পড়লো। ক্লাসে এসে বসতেই সে দেখলো এখানে বিভিন্ন বয়সী ছাত্র-ছাত্রী আছে। কেউ আহির চেয়ে বড়, তো কেউ অনেক ছোট। মূলত স্কুলটিতে ভর্তি করানো হয় চিত্রাঙ্কনের দক্ষতা দেখে। বয়স এখানে কোনো ব্যাপার না।
চারুশিল্পে মোট তিনটি শ্রেণি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। আহি মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ক্লাসে শিক্ষক আসলো। আর সাথে সাথেই ছেলেটিও ক্লাসে ঢুকলো যাকে আহি একটু আগে স্কুলের মাঠে ভিজতে দেখেছিল। ছেলেটিকে দেখেই আহি চমকে উঠলো। সে সেকেন্ড খানিক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ছিল। আর ছেলেটিও এসে তার পাশের সারিতে বসলো। এরপর ক্লাস শুরু হয়ে গেলো। স্কুলের সময় সীমা মোট আড়াই ঘন্টা। এক ঘন্টা ক্লাস শেষে, আধা ঘন্টার বিরতি। তারপর আবার এক ঘন্টা ক্লাস। এরপর ছুটি। প্রথম দিন ক্লাস করে আহির খুব ভালোই লাগলো। আর তার ভালো লাগার মূল কারণটা ছিল তার পাশের সারিতে বসে থাকা সেই ছেলেটি। একটু পর পরই অজানা কারণে আহির চোখ দু’টি তার দিকেই স্থির হচ্ছিল। ছেলেটা আট-দশটা ছেলের মতোই অতি সাধারণ। বিশেষভাবে আকর্ষণ করার মতো কিছুই তার মধ্যে ছিল না। তার পরণের সাদা শার্টটিও ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। তার ভেজা এলোমেলো চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে সে অনেকদিন নিজের যত্ন নেয় নি। তবুও সেদিন ছেলেটির শান্ত চোখ দু’টিতে আহি হাজার হাজার গল্প খুঁজে পেয়েছিল৷ সেদিন বাসায় ফেরার পর থেকেই আহির ভাবনা জুড়ে সেই ছেলেটি স্থান দখল করে নিয়েছিল। আহি তখন ছেলেটির নামটিও জানতো না। অথচ নামহীন কেউ প্রথম দেখায় যে তার মস্তিষ্কে তীব্রভাবে গেঁথে গেছে, এটাই আহির ভাবতে অবাক লাগছিল।

০২।

বিমানবালার কন্ঠে ঘুম ভাঙলো আহির। সে নাস্তার ট্রে দিতে এসেছিল। ট্রে রেখে চলে যাওয়ার পর আহি একনজর নায়ীবের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। ঘুম ভাঙার পর থেকেই আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে সময় পার করছে। নায়ীবের দিকে দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস তার নেই। যদি আবার প্রশ্ন করা শুরু করে? নায়ীব আহির এমন চোরাচাহনি ধরতে পেরে মৃদু হাসলো আর বলল,
“এমন লুকোচুরি করছেন, মনে হচ্ছে আপনার ভালোবাসা চুরি করে নিয়ে যাবো!”

আহি নায়ীবের দিকে আচন্বিত দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল,
“আমি মোটেও লুকোচুরি করছি না।”

“স্বাভাবিক আচরণও করছেন না। আমি আপনাকে চিনি না, তবুও আপনি যখন জানতে পারলেন আমি মনের রোগ সারাতে পারি, তখন থেকেই দেখছি আপনি একটু ইতস্ততবোধ করছেন। আমি যদি আপনার মনের সমস্যা জেনেও যাই, তাহলে খুব একটা ক্ষতি হবে না।”

আহি ঠোঁটে শুকনো হাসি টেনে বলল,
“কেউ একজন আমাকে বলেছিল, যেই ভালোবাসা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, সেই ভালোবাসা প্রকাশ না করাই ভালো। পৃথিবী গোল। কখন কার সাথে আবার দেখা হয়ে যায়, বা কে কার পরিচিত, তাতো বলা যায় না। আমার অনুভূতি আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক। কষ্ট হলে আমার হোক। আজকাল অন্যের কষ্ট দেখার সময় কারো হয় না।”

আহির কথা শুনে নায়ীব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

(***)

পুরোনো কথা মনে পড়তেই আহির মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। কানে ভাজতে লাগলো সেই পরিচিত কন্ঠস্বর,
“তুই কি পাগল হয়ে যাবি নাকি? শোন আহি, যেই ভালোবাসা তোর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, তাকে আর কারো সামনে প্রকাশ করতে যাবি না। এটাই তোর জন্য ভালো হবে। সবকিছুর একটা সীমা থাকে৷ তোর ভালোবাসা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বেহায়া হয়ে যাস না। এমন বেহায়াদের কেউ ভালোবাসে না।”

কথাগুলো গুঞ্জরিত হয়ে কানে পৌঁছাতেই আহির মনে হতে লাগলো, সে কথা শুনছে না, বরং কেউ তার কানে গরম তেল ঢেলে দিচ্ছে। আর সেই তেল গড়িয়ে যেন পুরো শরীরটা ক্ষত করে দিচ্ছে। গলায় কথা আটকে গেছে আহির। হাত কাঁপছে। চোখে অশ্রু জমতে শুরু করেছে। সিট থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো আহি। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো। তারপর নিজের মুখ হাতড়াতে হাতড়াতে বলল,
“আমি বেহায়া না। আমি ভালোবেসেছিলাম। ভীষণ ভালোবেসেছিলাম তাকে। আমার মতো করে কি কেউ ভালোবাসতে পারবে? কেন আমি বেহায়া হবো? আমি তো একবারো তাকে জোর করি নি। আমার ভালোবাসায় তাকে কখনো বন্দী করি নি। আমি তো তাকে ছেড়ে দিয়েছি। স্বাধীনতা দিয়েছি। তবুও সবাই আমাকে বেহায়া কেন বললো? কেউ একবারো আমার ভালোবাসা বুঝলো না? আমার পাঁচ বছরের অপেক্ষাটা বুঝলো না? কেউ যদি আমাকে একটু বুঝতো, আমার ক্ষতের গভীরতাটা যদি দেখতে পারতো, তাহলে কেউ আমাকে বেহায়া বলতো না। আমাকে নিঃস্ব করে কেউ চলে যেতো না।”

চলবে-

চৈত্রের রাঙায় রচিত প্রণয় পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩৩ (শেষ পর্ব )

আরাফাত সকাল বেলা বড্ড ব্যাকুল হয়ে ফিরল সারফারাজের ঘরে। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল অর্নিলা বিছানায় শুয়ে আছে। সারফারাজ তার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে কিছু বলছে। আরাফাত দরজায় কড়া নেড়ে বলল, “আসব!”

“আরাফাত! আয় না।”
“না আসার দরকার নেই। আর তুই শুয়ে থাক। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
“কিন্তু আমি ঠিক আছি ফারাজ ভাই।”
“বললাম না শুয়ে থাকতে। চুপচাপ শুয়ে থাক। মা কে বলে আমি খাবার ঘরে পাঠিয়ে দিবো। আচ্ছা খাবার আমি নিয়ে আসছি। তুই শুয়ে থাক। কিছু খাবি?”
অর্নিলা মাথা দুলাল। সারফারাজ শুধালো, “কি?”
“মিষ্টি! রসগোল্লা, রসমালাই!”
“হয়েছে হয়েছে। এতো সকালে রসগোল্লা কোথায় পাবো?”

অর্নিলা ধপ করে বসে পড়ল। বলল, “কাল না মেহমানদের জন্য এতো এতো মিষ্টি আনল। তখন সেখানে রসগোল্লা ছিল।”
“বুঝেছি। তুই শুয়ে থাক। একদম লাফালাফি করবি না আমি আসছি।”
“তাড়াতাড়ি আসবেন!”
“হুম!”

সারফারাজ ঘর ছেড়ে বের হলো। আরাফাত শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, “অনির শরীর কি এখনো ঠিক হয়নি?”
“হয়েছে মোটামুটি আছে। তুই কি বলবি বল!”
আরাফাত মাথা চুলকালো। চিন্তায় সে অস্থির। অস্থিরতা তার চোখে মুখে ফুটে উঠছে। সারফারাজ সমস্যায় পড়লে শান্ত ভাবে তা মিটানোর চেষ্টা করে। সেদিক থেকে আরাফাত পুরোপুরি উল্টো। বরঞ্চ সে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠল।
“কাল রাত থেকে আনিতা আমার ফোন ধরেনি।”
“ফোন করেছিলি?”
“হ্যাঁ, ফোন বাজছে ধরছে না। ফোন মনে হয় আন্টির কাছে।”
“আব্বু কি বলল কাল।”
আরাফাত মাথা নুইয়ে ফেলল। মিনমিন স্বরে বলল, “আমার আর আনিতার সম্পর্কের কথা আন্টিকে জানিয়েছে আর বলেছে বাকি সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে। সবটা আন্টির কাছে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আন্টি আনিতা কে নিয়ে বিদেশ চলে যাবে। তখন আমার কি হবে বল তো!”
“এটা কি আগে ভাবা উচিত ছিলো না!”পেছন থেকে ফরহাত বলে উঠল। দুজনেই পিছন ফিরল। ফরহাত মুখ টিপে হেসে বলল, ”গাধা তোকে সাধে বলি। আর কোথায়ও পেলি না, বাপের সামনে প্রেমিকাকে চুমু খেতে হলো।”
আরাফাত ভিমড়ি খেয়ে উঠল। আমতা আমতা করে বলল, “কই, এমন তো কিছু না।”
সারফারাজ বলে উঠল, “তুই জানলি কি করে?”
“আমিও তো গেলাম ছাদে। ভাবলাম মুক্ত আকাশে একটু ধোঁয়া উড়ানো যাক। গিয়ে তো দেখি দূরে দাঁড়িয়ে ছেলে প্রেম, রসিকতা করছে আর বাপে দাঁড়িয়ে দেখছে।”
বলেই হেসে উঠল ফরহাত। আরাফাত ঠোঁট কামড়ে ধরল। চোখ মুখ খিচে বলল, “চুপ করো তো। ভাইয়া, তুই কিছু কর।‌ আমি জানি আন্টি তোর কথা ফেলতে পারবে না। এই অনিকে বল না। অনির কথা তার বড় ফুপু কখনো ফেলবে না।”
সারফারাজ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, “দেখছি।”
“তুই কিছু ভাবছিস, তাই না। ভেবে পেলি কিছু?”
“ভাবছি! ওহ হ্যাঁ, ভাবছিলাম। ঘরে রসগোল্লা আছে!”
“রসগোল্লা! সিরিয়াসলি ভাইয়া। আমি তোকে এখানে এতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা কথা বলছি আর তুই রসগোল্লা নিয়ে আছিস।”
ফরহাত শব্দ করে হেসে বলল, “তোর বিয়ের রসগোল্লা আরাফাত!”
“আহা ভাইয়া।”
“আরে অনি রসগোল্লা খেতে চেয়েছিল। বাড়িতে রসগোল্লা আছে।”
আরাফাত দাঁত চেপে বলল, “রান্নাঘরে গিয়ে মা কে জিজ্ঞেস করে দেখ, আমি কিছু জানি না।”
বলেই হন হন করে চলে গেল। ফরহাত হাসতে হাসতে বলল, “ভালো রসিকতা করতে পারিস তুই ফারাজ। ছেলের এভাবেই মরি মরি অবস্থা তুই আবার ঘি ঢালার ব্যবস্থা করছিস!”
.
সারফারাজ ড্রয়িংরুমে এলো। শাহিনুর বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চলে এসেছো। চলো নাস্তা সেরে নাও। অর্নিলা কোথায়? কিছুক্ষণ আগে দেখলাম বাইরে যেতে। এখনো আসেনি।
“ঘরে আছে।
“নাস্তা করবে না?”
“করবে। শরীর টা ভালো নেই। তুমি ওর খাবারটা আমায় দাও। ঘরে নিয়ে যাই।”
“এখনো শরীর ভালো নেই। বলি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে নাকি?”
“হ্যাঁ, কিছুদিন পর যাবো।”
শাহিনুর বেগম খাবার বেড়ে দিলেন। গরম গরম পরোটা আর গরুর গোশত। সারফারাজ প্লেট হাতে নিয়ে বলল, “রসগোল্লা আছে মা?“
“কে খাবে? তুমি।”
“না। অনি।”
“অনি? কিন্তু অনি তো মিষ্টি খায় না।“
“এখন বলল খাবে। থাকলে দাও।”
শাহিনুর বেগম ভাবনায় পড়ে গেলেন।‌ বাটিতে দু পিছ রসগোল্লা রেখে ভাবল, “মেয়েটা ঠিক নেই।‌ শরীরটা ভালো নেই।”

সারফারাজ বসে বসে দেখছে। অর্নিলা টপ টপ দুটো রসগোল্লা মুখে পুড়ল। অথচ এই মেয়ে মিষ্টি জিনিসটাই দেখতে পারে না। কি আশ্চর্য! কতো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অর্নিলা ভ্রু নাচিয়ে বলল, “কি দেখছেন ফারাজ ভাই?”
“কিছু না। এগুলো জলদি খেয়ে নে। আমি বাইরে যাবো।”
“আচ্ছা। ফারাজ ভাই, আপনি খুশি হননি।”
ফারাজ চমকে তাকাল। তার গলা কেমন যেন ধরে আসছিলো। আচমকা ফিরে তাকাল। অর্নিলা নরম দুটো হাত তার গালে রেখে বলল, “আপনি খুব খুশি হয়েছেন তাই না বলুন।”
সারফারাজের চোখে দুটো চকচক করে উঠলো। আলতো করে তার পেটে হাত রাখল। থমথমে কণ্ঠে বলল, “আমার শুধু বিশ্বাস হচ্ছে না অনি। সবকিছু অকল্পনীয় লাগছে।” অতঃপর ফিরে চাইল তার দিকে। কপালে চুমু খেয়ে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। মৃদু স্বরে বলল, “ধন্যবাদ অনি। তোর কারণে আমি বাবা হতে পারব। কিন্তু তোর এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না।”
“পারবেন।
“কিভাবে?”
“আমাকে এতো ভালোবেসে!”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল অর্নিলা। সারফারাজ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল। মনে মনে আওড়ালো, “আমি তোকে অনেক ভালোবাসি। তোকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার। এখন আরো একজন ও আসছে। কথা দিচ্ছি আমি তাকেও দেখে রাখব।”
.
“হ্যালো বড় ফুপু!”
“কে? বাবা সারফারাজ।”
“কেমন আছেন?”
“রসিকতা করো না। অর্নিলা কেমন আছে এখন?”
“ভালো আছে। এসে দেখে যান।”
”না আমি আর আসব না। সামনের সপ্তাহেই চলে যাবো।”
“কেন? আসবেন না কেন?”
“না জানার ভান করো না সারফারাজ। তুমি তোমার ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করলেও এই বিয়েতে আমি রাজি হবো না।”
সারফারাজ হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল। ফোনটা একটু দূরে সরিয়ে বলল, “মামা ফুচকা দিন তো। প্যাকেট করে দিবেন।” ফোন কানে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, ফুপু বলুন।”
“বাইরে আছো।“
“হ্যাঁ, অর্নিলার জন্য ফুচকা কিনছি। শুনুন ফুপু। ছোট ফুপুর বাড়িতে নাকি আম গাছ আছে। আম গাছে শুনলাম ভালোই আম ধরেছে। অর্নিলা সেই আম খাওয়ার বায়না করছে। আপনি ছোট ফুপু কে বলে সেই আম নিয়ে আসুন।”
“কি বলছো এসব? হঠাৎ আমের কথা বলছো কেন?”
“বলছি। নানু হতে চলেছেন। আম, মিষ্টি যা পারে নিয়ে আসুন।”
“কি বললে?”
“ঠিক শুনেছেন। কি এখনো না এসে থাকবেন।“
“সারফারাজ! তুমি আসলেই একটা আহাম্মক। শুভ কথা কেউ এভাবে বলে। আসছি আমি!“
বলেই ফোন কেটে দিল। সারফারাজ হাসছে। বড় ফুপু সবার উপর রাগ করে থাকলেও অর্নিলার উপরে কখনো রাগ করে থাকতে পারেন না। তিনি এখন ছুটে আসবেন। আসবেন বৈকি! দেখা যাক , এই সুবাদে আরাফাতের ব্যাপারটা সামলানো গেলে হয়।
.
নিকুঞ্জ বাড়িতে যেন আবারো খুশির আনন্দে ছেয়ে উঠল। অর্নিলার মা হবার কথা শুনে সকলে আনন্দে মেতে উঠেছে। অর্নিলার কারণেই আরাফাত আর আনিতার বিয়ে ঠিক হলো। বড় ফুপু অর্নিলার কথা ফেলতে পারেননি। নিকুঞ্জ বাড়িতে জোড়া বিয়ের আমেজে মেতে উঠল। ফরহাত, নাজিয়া আর আরাফাত আর আনিতা। জোড়া বিয়ে হবে একসাথে। বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। তার কারণ ও আছে। হাতে এক মাস। মাসখানেক পরেই অর্নিলা আর সারফারাজ দেশের বাইরে চলে যাবে। হ্যাঁ, ভিসাও চলে এসেছে। অর্নিলা দূরে চলে যাবে তাও এমন সময়ে। শাহিনুর বেগম এসব ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। মেয়েটা একা একা থাকবে। আরিফ হাসানকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অর্নিলা বরঞ্চ এখানেই থাক। তাদের কাছে থাক, তারা দেখে রাখবে। কিন্তু আরিফ হাসানের এক কথা। “তোমার চেয়ে বেশি অর্নিলার সারফারাজ কে প্রয়োজন। সারফারাজকে তার পাশে চাই। তুমি নিশ্চিতে থাকো, সারফারাজ থাকতে অনির কখনো অযত্ন হবে না।“
.
অনির এখন ৬ মাস চলে। সে আর সারফারাজ এখনো লন্ডনে অবস্থানরত। দিন ভালোই যাচ্ছে অর্নিলার। এখানে সারফারাজের পাশপাশি তার পড়াশোনাও চলছে। তবে আজকে শরির টা ভালো নেই। উঁহু এটা শুধু একটা ছুতো। আজ সারফারাজ বাসায় তাই সেও বাসায় থাকবে। রান্না ঘর থেকে টুকিটাকি শব্দ কানে আসছে। তবুও ঘুমের ভান করে চাদর মুড়িয়ে রইল। খানিকক্ষণ বাদে কারো উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করতে লাগল। সারফারাজ তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। উঠানোর চেষ্টা করছে। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসল। অগোছালো চুলগুলো সারফারাজ ঠিক করে দিয়ে বলল, “উঠে নাস্তা সেরে নে অনি।

“আরেকটু ঘুমাই না ফারাজ ভাই না থুরি ফারাজ!”
বলেই দাঁত বের করে হেসে দিল। চোখ মেলে তাকাল সবে। গতরাতে ফারাজ তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো, “আর কতোকাল ফারাজ ভাই বলে ডাকবি অনি?” অনি চুপসে ছিল। তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, “আপনাকে আমি সারাজীবন ফারাজ ভাই বলেই ডাকতে‌ চাই। এই ফারাজ ভাই ডাকে যে আবেগ,‌গভীরত্ব, প্রেম প্রেম ভাব আছে সেটা কি ভুলতে পারি।” কিন্তু এই কথাগুলো সে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। উল্টো হেসে বলেছিলো, ”কাল থেকে আর ডাকব না ফারাজ ভাই!” তার কথা সে মনে রেখেছে। কিন্তু ফারাজ বলে ডাকতেই তার শরীরে যেন তরঙ্গ ছুটে গেল। এমন কেন হলো?

“উহু না, এখনি!”
“আপনি আমার কোন কথা শুনতে চান না কেন?”
“বললাম তো উঠতে। এখনি অনি।”
জোরাজুরিতে অনি উঠল। সারফারাজ তাকে হাত ধরিয়ে উঠাল। ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে পৌঁছাল। হুঁ, বিরাট আয়োজন! অনি ধীরে ধীরে খেতে লাগল। সারফারাজ গরম দুধ মগে ঢেলে বলল, “পুরোটা শেষ করবি!”
“গন্ধ আসে তো!”
“হুঁ, কোন অজুহাত না।”

অর্নিলা নিজের পেটের দিকে ফিরে বলল, “দেখলে তোমার বাবা কিভাবে আমায় জ্বালায়। মনে রাখবে সব, বড় হয়ে তুমিও এভাবে জ্বালাবে!”
“হ্যাঁ, তুই না বললেও জ্বালাবে। তুই মা কি না!“
“শুনলে আবারো। তোমার নামে বদনাম করছে। মনে রাখবে হ্যাঁ!” বলতে বলতে কেশে উঠল। সারফারাজ ছুটে এসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাওয়া শেষ করে কথা বল অনি। তাড়ার কি আছে?”
“আচ্ছা আচ্ছা!”
“কোন কথা না, চুপচাপ খাওয়া শেষ করবি এবার। বুঝলি!”
মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা!”

খাওয়া শেষ করে একটু উঠে দাঁড়াল হাঁটাহাঁটির জন্য। হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছাল বারান্দায়। এখান থেকে চারদিক কেবল বরফে ঢাকা। ভালোই তুষারপাত হয়েছে। শীত শীত লাগছে। পেছন থেকে ফারাজ এসে গায়ে একটা চাদর টেনে দিল। বলল, ”এতো ঠান্ডার মধ্যে এখানে কি করছিস? ভেতরে চল।”
“একটু দাঁড়াই না। ভালো লাগছে।”
“শীত করবে না।”
“এক কাজ করুন। আপনি আমায় জড়িয়ে ধরে রাখুন তো। তাহলে আর শীত করবে না। কি হলো? ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছেন কি? ধরুন একটু জড়িয়ে!”

সারফারাজ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। অর্নিলা মুখ খুলে শ্বাস নিল। সারফারাজ তার ঘাড়ে মাথা রেখে বলল, “শরীর ঠিক আছে।”
“খুব আছে।“
“সামনে সোমবার কিন্তু চেকআপের জন্য যেতে হবে। মনে আছে?”
“খুব আছে ফারাজ ভাই!” বলেই জিহ্বা কেটে বলল, “না না হবে না আমার দ্বারা।”
“কি হবে না।”
“এই আপনাকে ফারাজ বলে ডাকা। আচ্ছা একটু শুনুন,‌ আমাদের মেয়ে হলে নাম রাখব ফারিয়া শেহদাত। আমি আপনাকে ডাকব ফারিয়ার আব্বু! সুন্দর না বলুন।“
“আর ছেলে হলে?”
“না না, এবার ছেলে হবে না। মেয়েই হবে। আপনার মতো দেখতে সুন্দর নাদুসনুদুস একটা মিষ্টি মেয়ে। দেখেন না ইদানিং আমি কতো মিষ্টি খাই। দেখবেন মেয়েটাও মিষ্টি হবে। বুঝলেন ফারিয়ার আব্বু!” হেসে উঠল অর্নিলা। সারফারাজ ঠোঁট কামড়ে ধরল। এতো ঠান্ডার মধ্যে তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে লজ্জায়। কেন এতো লজ্জা পাচ্ছে সে। কি জানি? শক্ত করে আঁকড়ে ধরল তাকে।
.
বিকেল বেলা বেরুলো দুজন। বেশি দূর না, এই তো সামনের স্টোরে। কিছু কেনাকাটা করার আছে। দুজন মিলে শপিং করতে ভালোই লাগে। সারফারাজ তার‌ হাতে হাত রেখে সামনে স্টোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা পিছন থেকে খুব জোরে একটা গাড়ি পাশ দিয়ে গেল। কিছু বখাটে ছেলের কারবার। ভাগ্যিস অর্নিলার কিছু হয়নি তবে বেচারি খুব ভয় পেয়েছে। সারফারাজের হাত শক্ত করে ধরে রেখে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। সারফারাজ ব্যাপারটা সামলে নিল কোনভাবে। সামনের এক বেঞ্চেতে তাকে বসিয়ে পানি খাওয়ালো। সামনে ফিরে দেখল ছেলে গুলো আবারো গাড়ি নিয়ে এদিক আসছে। তার হাতে বিয়ারের ক্যান। অর্নিলা কে দেখে ইশারা করে হাসতে লাগল। ব্যঙ্গ করে আবার সরিও বলতে লাগল। সারফারাজ চোয়াল শক্ত করল। অর্নিলা আলতো করে হাতটা ধরে বলল, “বাদ দিন। চলুন ভেতরে যাই। আমাকে আজ একটা আইসক্রিম কিনে দিবেন ঠিক আছে। আসুন না!” সারফারাজ শব্দ করল না। অর্নিলার হাত ধরে স্টোরে ঢুকে গেল।

ঘটনাটি সপ্তাহ খানেক পরের। একটা কফি শপের বাথরুমে কিছু লোকদের আ/হত অবস্থায় পাওয়া গেছে। অবস্থা খুবই ভয়াবহ। প্রায় ৪ ৫ জন ছিলো তারা। আশেপাশের লোকদের বক্তব্য ছিলো তারা এই কয়েকজন নেশা করে শপে এসেছিলো। হয়তো নেশার মধ্যেই একে অপরকে মে/রেছে। তবে তারা জোর গলায় বলছে, তাদের মে/রেছে একটি মাত্র লোক। একটা লোক তাদের এই অবস্থা করেছে! কেউই তাদের কথা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হচ্ছে না। পুলিশরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করে।

সারফারাজ বাড়িতে পৌঁছেই প্রথমে বাথরুমে ঢুকে গেল। কোটের ভেতরে শার্টে র/ক্ত লেগে আছে। এই র/ক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে সে। বার বার পিছন ফিরে চাইছে। অর্নিলার ডাক শোনা যাচ্ছে। সারফারাজ আরো দ্রুত ঘসতে লাগল। অর্নিলার প্রায় এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। সারফারাজ হতভম্ব হয়ে পেছন ফিরল।
“কি হয়েছে ফারাজ ভাই? আপনি ঠিক আছেন তো।”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি। রেডি তুই। আমাদের বের হতে হবে তো।”
“হ্যাঁ, আমি তৈরি। ওই রিপোর্ট গুলো পাচ্ছি না। কোথায় যে রাখলাম।”
সারফারাজ ঘাম মুছল। না অর্নিলা কিছু টের পায়নি। গায়ের শার্ট খুলে ফেলে দিল। গলায় তোয়ালে জড়িয়ে বের হয়ে বলল, “আমি খুঁজে দিচ্ছি। একটু বস!”
“উহুম উহুম! এতো শীতের মধ্যে আপনি দেখি উষ্ণতা ছড়াচ্ছেন। ব্যাপার কি ফারিয়ার আব্বু!”

সারফারাজ জবাব দিলো না। তড়িখড়ি করে আলমারির দিকে পৌঁছাল। হুট করে সামনে এসে অর্নিলা দাঁড়িয়ে বলল, ”উফ,‌আপনি তো দেখি আমার মুড বদলে দিচ্ছেন।”
“আমাদের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে অনি। ঘণ্টা খানেক পর তোর এপোয়েটমেন্ট আছে।”
“হু, গাড়ি দিয়ে যেতে ২৫ মিনিট লাগবে। আমি জানি সেটা। ৫ মিনিট আমায় দিলে কি এতো ক্ষতি হবে বলুন তো!”

সারফারাজ কথা বাড়ালো না। পাশ কেটে এগিয়ে গেলো। কালো রঙের একটা শার্ট গায়ে জড়ালো। দুটো বোতাম লাগিয়ে পেছনে ফিরে দেখল অর্নিলার বিছানার উপর মুখ গুমরে বসে আছে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ”আপনি আমায় একটুও ভালোবাসেন না। সবাই ঠিকই বলে, প্রেগন্যান্সির সময় বর দ্বিমুখী হয়ে যায়। তখন আর ঘরের বউকে ভালো লাগে না। আপনি নতুন কাউকে পেয়েছেন না। বিদেশি ম্যামসাহেব তাই না!”
সারফারাজ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার বিয়ে যখন হয়েছিল তখন অনি বাচ্চা ছিলো,‌বিয়ের এতোগুলো বছর পরেও এ যেন বাচ্চাই যেন। কথা বলতে বলতে তার গাল বেয়ে অশ্রুও ঝরে পড়ল। অশ্রু মুছে ফেলে ফিরে তাকাল। সারফারাজ এদিকেই এগিয়ে আসছে। দৃষ্টি অস্পষ্ট। চোখ বন্ধ করে নিল সে। সে এগিয়ে এসে তার গালে হাত রেখে ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরল। দীর্ঘ অনেক দিনের এমন গভীর চুমুর স্বাদ পেলো অর্নিলা। এতোক্ষণ ধরে সারফারাজের যেই অস্থিরতা তাও যেন ধীরে ধীরে শেষ হলো। কিন্তু অর্নিলার ঠোঁট ছাড়ার নাম নেই। কারোরই বুঝি তাড়া নেই। অর্ধ খোলা শার্টটা আঁকড়ে ধরল অর্নিলা। কিছুক্ষণ বাদে যখন ছাড়া পেল তখন দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমার মনে হলো, আপনি আজ আমায় মেরে ফেলবেন। আরেকটুর জন্য দম বন্ধ হয়নি মারা পড়েনি। কি হলো? হঠাৎ এতো প্রেম!”

সারফারাজের মুগ্ধ দৃষ্টি তখন অর্নিলার ঠোঁটের উপর। না তার স্বাদ এখনো মিটেনি। হাত দিয়ে ঠোঁট দুটো স্পর্শ করছে। মৃদু কণ্ঠে বলল, “আমি সবাইকে মে/রে ফেলতে পারব কিন্তু তোকে কখনো মার/তে পারব না অনি!” অনি শব্দ করে হাসল। হাতের মুঠোয় শার্টটা এখনো। সারফারাজ আবারো এগিয়ে এলো, তাকে থামিয়ে দিল। বলল, ”সময় চলে যাচ্ছে, আমাদের না যেতে হবে!”
সম্মোহিত কণ্ঠে বলে উঠল, ”আরেকটু দেরি হলে এমন কি হবে?” তার ওষ্ঠজোড়ার স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। অর্নিলা যেন বারণ করল না। আজ অনেকদিন পর সারফারাজ তার এতো কাছে। সে ফিরিয়ে দেয় নি। তার আদর মাখা ছোঁয়ায় যেন বার বার কেঁপে উঠছিলো সে!

ডাক্তারের এপোয়েটমেন্ট নিয়ে ঝামেলা হয়নি। পরিচিতি ছিল। বেবী সুস্থ আছে, ভালো আছে। মেয়ে কি না ছেলে সেটা অনি জানতে চায় নি। কারণ তার মন বলছে, তাদের মেয়েই হবে। ফারিয়া নামের দুষ্টু একটা মেয়ে। রাত গভীর হয়ে উঠল। দুজন গাড়ি করে বাড়ি ফিরছে। অর্নিলা সারফারাজের হাত শক্ত করে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। সারফারাজ ধীর গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করছে। চারদিক নিস্তেজ, নিরব। আবারো তুষারপাত হচ্ছে। অর্নিলা দেখলে খুব খুশি হতো। তবে এখন ঘুম ভাঙানোর কোন দরকার নেই। সামনে তাদের সন্তান আসছে। সারফারাজের ভীষণ চিন্তা তাকে নিয়ে। তারা এবার দুজন থেকে তিনজন হবে। তাকে এবার দু’জনকে সামলাতে হবে। ফারিয়ার আব্বু! নামটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে। অনি ভালো নাম রাখতে পারে। মুচকি হাসল। সামনে তাকাল। আকাশ দেখছে। আজ চারদিকে গভীর কালো মেঘে চাঁদ ঢেকে গেছে। ল্যাম্পপোস্ট গুলো আলো দিচ্ছে ধীরে ধীরে। এই গল্পের সমাপ্তির সময় চলে এসেছে। সারফারাজ এমনই থাকবে অনির কাছে। তার দুটো চরিত্রের কথা অনি জানতে পারবে না। কোন এক চৈত্রের শেষ বেলায় যেই প্রেমের সূত্রপাত হয়েছিল আজ সেই প্রেমের সমাপ্তি। এই প্রণয় সহজ ছিলো না। চৈত্রের দুপুরের প্রচণ্ড রোদের তীব্র তাপদাহে শুরু হওয়া এই প্রণয়ের সমাপ্তি এই ঠান্ডা রাতের চাদরে ঢেকে যাবে।

~ সমাপ্তি

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-৩২

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩২

পুলিশ কমিশনার সালাউদ্দিন সাহেবের কেবিনে অর্নিলা কে বসিয়ে রাখা হয়েছে। যদিও তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন এর পুলিশ কমিশনার। তদন্তের খাতিরে মোহনগঞ্জ আসা। এখানকার থানায় অর্নিলা কে নিয়ে আসা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। এখানকার ওসি লিয়াকত হোসেন বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সালাউদ্দিন সাহেব খুবই নরম স্বরে বলেছেন, মিসেস অর্নিলার সাথে তিনি একা কথা বলতে চান। লিয়াকত হোসেন কেবিনের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে দেখল সারফারাজ শেহদাত ভেতরে এসে পড়েছেন। তাকে যথেষ্ট রাগান্বিত মনে হচ্ছে। রিটায়ার্ড জজ আরিফ হাসান কে সকলেই চেনে জানে। তার সম্পর্কে সবার ধারণা স্বচ্ছ ধরণের। তাই সারফারাজ শেহদাত কে নতুন করে চেনার কিছু নেই। লিয়াকত হোসেন এগিয়ে গেলেন তার দিকে। সারফারাজ কে চেয়ারে বসতে বলে মাথা ঠান্ডা করতে বললেন। ভেতরে তাদের কথা শেষ না হওয়া অবধি তিনি যেতে পারবেন না।

“মিসেস অর্নিলা। কি খাবেন বলুন?”
“পানি।”
“শুধু পানি। চা, কফি ঠান্ডা কিছু..
“না দরকার নেই।”
“আচ্ছা নিন।”
পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন সালাউদ্দিন সাহেব। অর্নিলা পুরো পানির গ্লাস শেষ করে ফেলল। অনেক শরীর খারাপ করছে তার। সালাউদ্দিন সাহেব মুচকি হেসে শুধালেন, “আপনি কি অস্বস্তি বোধ করছেন মিসেস অর্নিলা।”

“জি, আমার শরীরটা ভালো নেই।‌ আপনি কি জিজ্ঞেস করবেন দ্রুত করুন।”
“অবশ্যই।” টেবিলের উপর তিনটে ছবি রাখল। “ছবি গুলো জীবন্ত তবে মানুষ গুলো মৃ/ত!” ফট করে কথাটা হেসে বললেন, “চিনেন এদের?”
অর্নিলা মাথা দুলাল। সালাউদ্দিন সাহেব অনেকটা স্বস্তি বোধ করলেন। আবারো শুধালেন, “এরাই তো আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল।”
“হ্যাঁ!”
সালাউদ্দিন সাহেব মৃদু হাসলেন। চেয়ারে আরাম করে বসে বললেন, “আপনার চাচাতো ভাইয়ের কেস টা এখনো ঝুলে আছে। তার সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েই আসছে। ইয়াতিম শিকদারের কাছেই শুনলাম, আপনি কিড/ন্যাপ হয়েছিলেন। অথচ তার আগে আপনার হাসব্যান্ডের সাথে দেখা হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করার তিনি বললেন, আপনি নাকি মোহনগঞ্জ বেড়াতে গেছেন। এরপর আপনাকে টাকার বদলে উদ্ধার করা হলো। আপনি সহী সালামত ফিরে এলেন। কিন্তু লোকগুলো মা/রা গেল। তিনটে লোক!”
“হ্যাঁ, তাদের মৃত্যুর খবর আমি টিভিতে দেখেছি।”
“যাক বেশ ভালো। তাহলে আপনি তো জানেনই তাদেরকে খু/ন করা হয়েছে। খু/ন করার টেকনিক কিন্তু অভিনবভ। তাদের মৃ/ত্যুর পর চারদিকে শুধু ছড়িয়ে রাখা টাকাই পাওয়া গেছে। যা হিসাব করে দেখলাম প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি। আপনি কি জানেন আপনার মুক্তিপণ কতো ছিলো?”
“না।”
“জানেন না। আচ্ছা। ইদানিং খুব গরম পড়েছে খেয়াল করেছেন মিসেস অর্নিলা। এসির রুমে বসেও আপনি ঘামছেন।”
”হুম। আপনি প্রশ্ন করুন। কথা ঘুরানোর দরকার নেই।”
“না না। আমি কথা ঘুরাচ্ছি না। মৃত্যুর পর তাদের সকল জিনিস পুলিশি হেফাজতে আছে। তাদের পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে সায়ানাইড বিষ দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই বিষ আসলো কোথা থেকে?”
“সেটা বের করা তো আপনার কাজ।”
“আমরা তো সেই কাজই করছি ম্যাডাম।”
”অদ্ভুত। তিনজন ক্রিমিনাল এর খুনে/র তদন্ত করছেন এতো উতলা হয়ে।”
“অবশ্যই ম্যাডাম। যেই তিনজন খুন হয়েছে তারা ক্রিমি/নাল। তবে তাদের যে খু/ন সে আরো বড় ক্রিমিনাল। তারা তিনজন মিলে একজনকে খু/ন করেছিলো আর কোন একজন সেই তিনজনকে মে/রে ফেলার ফন্দি এঁটে ছিল। আপনিই বলুন। কে ভয়ং/কর!”
“এখানে আমার যোগ সুত্র এলো কি করে?”
“সব জায়গায় তো আপনিই ম্যাডাম। আপনার‌ ভাইয়ের কেসে প্রথমে আপনি, এখানেও আপনি। কেনো জানো মনে হচ্ছে দুটো কেসের পেছনে একজনই আছে।
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন?”

“চটবেন না ম্যাম। আপনাকে আমরা চটাতে চাই না। এমনও হতে পারে, আপনার অজান্তে আপনার কোন পাগল প্রেমিক এমনটা করছে। যারাই আপনার ক্ষতি করতে চাইছে তাদের সরিয়ে দিচ্ছে। ভেবে দেখেছেন ব্যাপারটা।”
“আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন। কি যা তা বলছেন। আমি ম্যারিড। আমার প্রেমিক আসবে কি করে।”
”সেটাই তো। একজনই তো আছে।”
“কার কথা বলছেন আপনি?
“উত্তেজিত হবেন না মিসেস অর্নিলা। বসুন আপনি। খু/ন কি করে হলো সেটা শুনুন। খুনে/র কারণ তো সায়ানাইড বিষ। কিন্তু এই তিন কেঁচো কিভাবে এই বিষ পেলো সেটা জানবেন না।”

অর্নিলা বিরক্ত মুখে বসে পড়ল। তার গা গুলিয়ে যাচ্ছে। কেমন অস্থির বোধ হচ্ছে। খুব গরম লাগছে। অথচ রুমে এসি চলছে। কি অদ্ভুত! সালাউদ্দিন সাহেবের সব কথা তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সালাউদ্দিন বলতে শুরু করলেন, “আমরা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান করে গেছি। কিছু পাই নি। শেষে যা পেলাম তা দেখে আমরা হতভম্ব। এতো বুদ্ধি এতো মাথা খাটিয়ে কাউকে মা/রার প্ল্যান করা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাদের, গনি এদের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টাকা গুলোর উপর ছড়ানো ছিল সায়ানাইড। তরল সেই বিষাক্ত পদার্থ টাকার উপর সাবধানে ছড়িয়ে দেয় সেই ক্রিমিনাল। আর যখন সেই টাকা কাদের আর ওর দুই লোক ছুঁয়ে দেখে। টাকা গুনতে দিয়ে আঙ্গুল চাটে তখন এই বিষ তাদের শরীরে ছড়িয়ে যায়। আর তাদের অজান্তেই তারা মা/রা যায়। কি ভয়া/নক মৃত্যু!”

”এসব আপনি আমায় কেন বলছেন।”
“কারণ সেই টাকাগুলো ছিলো আপনাদের দেওয়া টাকা গুলো!”
“কিসব আজেবাজে বলছেন আপনি। কতো টাকা দেওয়া হয়েছে তাও আমি জানি না। আপনি নিজের মতো একটা গল্প বানিয়ে দিলেই তো হলো না। আমি তাদের থেকে ছাড়া পাওয়ার তিন কি চারদিন পর তারা মারা গেছে। তো আপনি কি বলতে চাইছেন, এই তিন চারদিন তারা বসে ছিল। টাকা গুলো নিয়ে মাতামাতি করেনি। এমনো তো হতে পারে, এর মধ্যে তারা আরো একজনকে কিডন্যাপ করে তার থেকে টাকা গুলো হাতিয়ে নিয়েছে।”
”মনগড়া গল্প তো আপনি বানাচ্ছেন মিসেস অর্নিলা!”
“হ্যাঁ, ঠিক আপনার মতো। আপনি প্রমাণ যুক্তি ছাড়া নিজের মন মতো গল্প বানিয়ে আমায় শুনাচ্ছেন। অনেক হয়েছে। মনে হচ্ছে না আপনার আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। আমি উঠলাম!”

অর্নিলা উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে এসে পৌঁছাতেই ফারাজ কে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সালাউদ্দিন সাহেব সারফারাজ কে দেখে একগাল হাসলেন।
.
থানার বাইরে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। সালাউদ্দিন সাহেব গরম চায়ের কাপে চুমুক দিলো। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। চায়ের দোকানে একটা আলো জ্বলছে। সেই আলোর তেজ আবার ওতো না। দোকানে লোকজন কম। সারফারাজ চায়ের কাপে চুমুক দিলো। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। চায়ে স্বাদ নেই। না আছে চিনি না মিষ্টি। পানসে লাগছে।‌তবুও খাচ্ছে। সালাউদ্দিন সাহেব কেশে উঠলেন। বললেন, ”চায়ের স্বাদ নেই ডা. সারফারাজ। তবুও দেখছি ভালোই আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছেন।”
“আপনি এতো করে অনুরোধ করলেন তাই।”
”আমার জীবনে প্রথম আমি কোন ক্রিমিনালের সাথে দাঁড়িয়ে এতো ধৈর্য্য সহকারে চা খাচ্ছি। ভালো এক্সপেরিয়েন্স। মন্দ নয়,জীবনে সব রকমের এক্সপেরিয়েন্স থাকতে হয়।
সারফারাজ জবাব না দিয়ে চায়ের কাপে আবারো চুমুক দিলো। সে চাইছে দ্রুত চায়ের কাপ শেষ করতে। অর্নিলা কে গাড়িতে বসিয়ে এসেছে। তাকে কেমন জানি ঠিক লাগছে না। সালাউদ্দিন সাহেব বলে উঠলেন,
“আমি জানি ক্রিমিনাল কে? অথচ ধরতে পারছি না। ডা. সারফারাজ। আমায় একটু বুদ্ধি দিতে পারেন।”
“আপনি কি চাইছেন?”
“জানতে চাইছি। আপনি ঠিক কতো বুদ্ধিমান! বলে না চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন!”

সারফারাজ খালি চায়ের কাপ টেবিলে রাখল। শান্ত স্বরে বলে উঠল, “আপনার কাছে কোন প্রমাণ নেই। আপনি শুধু ধারণার উপর কথা বলছেন।”
”আপনিও তো সবটা ধারণার উপরই করলেন ডা. সারফারাজ। টাকার উপরে আপনি সায়ানাইড ছড়িয়ে দিলেন। মাঝের টাকাগুলোয়। ব্যাপারটা এমন তারা যেন টাকা গুলো পেয়েই খরচ করলে অন্যের ক্ষতি না হয়। এর মধ্যে অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে। সাংঘা/তিক কাজ। আপনার মনে বিন্দুমাত্র দয়ামায়া নেই সারফারাজ। ডাক্তারের দয়া মায়া থাকতে হয়।”

সারফারাজ কিঞ্চিত পরিমাণ হাসল। আলোর মাঝে তার হাসি অস্পষ্ট দেখালো। সালাউদ্দিন সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। সারফারাজ বলল, “আপনি এখনো অনেক দূরে আছেন সালাউদ্দিন সাহেব। তবে যতোই এগিয়ে যান না কেন? লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন না।”
“কি বলতে চাইছেন?”

সারফারাজ কথা বাড়ালো না। ফোন টা বেজে উঠল। আইজিপি সানাউল হকের ফোন। সালাউদ্দিন সাহেব বোধহয় ঘাবড়ে গেলেন। সারফারাজ বিদায় না দিয়ে চলে এলো। ফোন ধরতে ওপাশ থেকে কতো গুলো কথা একনাগাড়ে কেউ বলে গেল। ফোন রেখে দিলেন তিনি। হ্যাঁ, হুঁ ছাড়া আর কিছু বলার ছিলো না।‌ বিরস মুখে বসে পড়লেন। তার সহযোগী তার পাশে এসে বললো, “কিছু হয়েছে স্যার?”
”স্যার ফোন করেছিলেন।”
“কি বললেন?”
“এই কেস থেকে আমাদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তদন্ত এবার তিনি করবেন।”
সহযোগী শব্দ করে শ্বাস ফেলে বললেন, “এটা হবার ছিলো। আরিফ হাসানের যথেষ্ট চেনাজানা আছে। নাম ডাক ও আছে।”
“তাই বলে একটা ক্রিমিনা/লকে এভাবে ছেড়ে দিবো।”
“স্যার, দুঃখ পাইয়েন না। এই ক্রিমিনাল যাদের ধরছে তারা কেউই ভালা মানুষ না। নিয়াজ শিকদারের নামেও ভালো কিছু শুনি নাই।”
*তুমিই যাই বলো। আমি তার পিছু ছাড়ছি না। ওকে তো আমি ধরেই ছাড়ব।”
সহযোগী হাসল। তার মনে হয় না স্যার কিছু করতে পারবে। কারণ এই ক্রিমিনাল খুব চালাক। তাদের থেকেও দুই পা এগিয়ে!
.
গাড়িতে অর্নিলার অবস্থা আরো খারাপ করতে লাগলো। মাঝপথে সারফারাজ গাড়ি থামিয়ে দিল। পানির বোতল বের করে দিল অনিকে। অনি মুখ হাত ধুয়ে নিল। পানি খেল। তবুও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে তার। হঠাৎ বমি করতে শুরু করল। এরপর আরো ক্লান্ত হয়ে গেল। সারফারাজ চিন্তায় অস্থির! হঠাৎ এতো অসুস্থত! সারাদিন এই তীব্র গরমের কারণে নয় তো আবার।

বাসায় ফিরে এলো। কারো সাথে কোন কথাবার্তা হয়নি। এমনকি রাতে খাবার ও খেলো না। জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে। সারফারাজ সারারাত তার পাশে শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ বাদে হাত পা ধরে দেখল। না ঠান্ডাই তো। জ্বর টর আসেনি। গালে হাত রেখে জাগানোর চেষ্টা করল।‌ না গভীর মুখে আচ্ছন্ন। আর ঘামছে না। ভয়ের কোন কারণ নেই তবুও সারফারাজের চোখে ঘুম নেই। শেষ রাতে ঘুমালো সে। পরদিন উঠতে উঠতে সকাল ১০ টা পার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ কচলালো‌।‌ এতোক্ষণ ঘুমালো। কেউ ডাকলো না তাকে। অনি কোথাও? অনি! এই অনি!
বিছানায় অনি নেই।‌ বাথরুম থেকে আওয়াজ আসছে। সারফারাজ এগিয়ে গেল। বাথরুমের দরজা খুলে দাঁড়াল অনি। দুইজন মুখোমুখি। সারফারাজ ঘাবড়ে গেল। অনি কাঁদছে! কেন? এই অনি? কাঁদছিস কেন? আচমকা সে জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা রেখে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। সারফারাজ বুঝল না বটে। হঠাৎ করেই যেন একটু আনমনা হয়ে গেল। অনি আবারো বলল, “আপনি বাবা হবেন। শুনছেন!” কানে সেই মধুর কণ্ঠ ঠেকল।‌ তার সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল।‌ বিস্ময়ে বিমূঢ় সে। অনি লজ্জায় হেসে কুটকুট। সারফারাজ এখনো হতভম্ব!

#চলবে

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-৩১

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩১

অর্নিলা হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে ছাদে এসে পৌঁছাল।ফারাজ ভাইয়ের খোঁজ তো পেলো না। কিন্তু অন্য আরেকজনের খোঁজ ঠিকই পেলো। ছাদে এক নজর ফিরে চলে যাবে অমনি নজরে এলো আরাফাত কে। আরাফাত ছাদে! কার সাথে? চোখ বুলিয়ে দেখল, পাশে এক মেয়েও আছে। এটা আবার কে? আরাফাত কে কোন মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু যেন অবাকই হলো। সচরাচর তো আর দেখা মিলে না। কিন্তু দুজন এখানে একা। নির্ঘাত কোন চক্কর আছে। তৎক্ষণাৎ লুকিয়ে পড়ল সে। ব্যাপারটা ঘেঁটে দেখা দরকার। দেখে তো মনে হচ্ছে আরাফাত মেয়েটিকে শাসাচ্ছে। হুঁ হুঁ লক্ষণ ভালো মেলছে না। দু এক সেকেন্ড পরই মেয়েটার গালে চ/ড় ও পড়ল। অর্নিলা চোখ বন্ধ করে মুখে হাত দিল। সত্যি সত্যি আরাফাত মেয়েটিকে চড়/ মারল। বিশ্বাস হচ্ছে না। ফারাজ ভাই আজ অবধি তার গায়ে হাত তুলে নি। আর এখানে আরাফাত তো দু পা এগিয়ে। আপন ভাই হলে কি হবে? দুজন দুই মেরুর। তাই বলে মেয়েটা কে এভাবে মার/বে। আরাফাত হন হন করে এদিকেই আসছে । অর্নিলা দ্রুত নিচে নেমে পড়ল।

হিসাব কষছে। মিলছে না! এখানে তার অজান্তে অনেক কিছুই চলছে। এখানে কেউ প্রেম করে বিয়ে করে ফেলেছে আরেকদিকে আরেকজন মেয়েকে চ/ড় মারছে। বাহ, চারদিকে দেখি প্রেমের মৌসুম। এরপর আবার কেউ বাচ্চার মা ও হয়ে যাচ্ছে। সে তো দেখি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওই তো! ওখানে ফারাজ ভাই। ছুটে গিয়ে তার বাহু আঁকড়ে ধরল। ফারাজ চোখ দিয়ে ইশারা দিচ্ছে। কি হলো আবার? চারদিক ঘুরে দেখল সবাই গোল হয়ে বসে আছে। বৈঠক বসেছে মনে হচ্ছে। বড় ফুপু হেসে বলছে, “ছেলে আপনাদের এখানকার। ভাবলাম দেখাদেখির কাজটা এখানেই শেষ হোক। শুভ কাজে দেরি কি। আপনারা ও ছেলে দেখে বললেন, ছেলে কেমন?”

আরিফ হাসান হেসে বললেন, “বেশ, তো। আপনার মেয়ে আমার মেয়ে কি বেয়াইন। আপনি যা বলবেন তাই। মেয়ের পাকা দেখা এখানেই হবে। আপনি খালি ছেলেদের আসতে বলুন।”

অর্নিলা এদিক ওদিক ফিরে শুধালো,
“ছেলে আসবে? কাকে দেখতে?”

“কাকে আবার? আনিতা কে দেখতে।”

“আনিতা!” থতমত খেয়ে গেল অর্নিলা।‌ এরই মধ্যে আরাফাত হন হন করে নিচে এসে দাঁড়াল। পিছন ফিরে দেখল দূরে আনিতা দাঁড়ানো। চড়ের কারণ এখন বোঝা যাচ্ছে। ফারাজ ভাইয়ের হাত টেনে ধরে কানে কানে বলল, “এই শুনুন!”

“কি?
“ঘরে চলুন, কথা আছে।
“কি কথা? কি হয়েছে এখন আবার।
“চলুন না।

হেনে হিচড়ে ফারাজ কে ঘরে নিয়ে গেল অর্নিলা। দরজা বন্ধ করে ফারাজের হাত চেপে বলল, “জানেন কি হয়েছে?”
“কি?
“আরাফাত প্রেম করছে।
“হ্যাঁ, কি বললে!
“হ্যাঁ, সত্যি। ওই আনিতার সাথে। আনিতা কে দেখতে ছেলে আসবে না। মনে হচ্ছে ওদের মাঝে ঝামেলা হচ্ছে।”
“তুমি এসব জানলে কিভাবে?
“ওই আমি ছাদে দেখলাম দুজনকে। আপনি প্লিজ কিছু করুন।
“কি করবো?
“কি করবো মানে? ছেলেটার প্রেম ভেঙে যাচ্ছে। বড় ভাই হিসেবে কিছু একটা তো করুন।

ফারাজ মুখ ভেংচি কাটলো। আর কিছু! এখন ছোট ভাইয়ের প্রেম সামলাতে হবে তাকে। “দেখি” বলে বেরিয়ে গেল। ফারাজ বেরিয়ে যাবার পর বাচ্চার কথা মনে পড়ল। কপাল চাপড়ালো। ইশ! সময় থাকতে কেন যে কিছু মনে থাকে না তার!
.
ছেলেরা আজ আসবে। সকাল থেকেই গৃহিণীরা তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। দুপুর থেকে পিঠে বানানো। ছেলে তো দেখতে আসবে শুধু তবুও যেন এলাহী কাণ্ড। অর্নিলা, শ্রেয়মী নিজ হাতে আনিতা কে সাজিয়ে দিয়েছে। তার বাদামী রঙের শাড়িটা আবারো পরিপাটি করে দিচ্ছে। বেচারির মুখ শুকনো। শ্রেয়মী নিচু হয়ে শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে দিচ্ছে। পর্দার আড়ালে দরজার ওপাশে কারো ছায়া যেন পড়ল। অর্নিলা উঁকি মেরে চাইল। হেসে বলল, “আরে আরাফাত! আয় দেখ দেখ, আনিতা কে কেমন লাগছে? বল তো। ছেলে পক্ষ পছন্দ করবে কি না”

আরাফাত তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোয়াল শক্ত করল। ধারালো কণ্ঠে বলল, “সে তোমরা জানো। আমি কি জানি?” বলার পর আবারো হন হন করে চলে গেল। শ্রেয়মী উঠে দাঁড়িয়ে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ওর আবার কি হলো?”
“কি জানি!” বলে ফিরল আনিতার দিকে। বেচারীর চোখ দুটো ছলছল করছে। আহা কি প্রেম!

ছেলে পক্ষ আসবে আসবে করে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা পাড় হয়ে গেল। অথচ ছেলে পক্ষের কোন নাম গন্ধ নেই। আরাফাত সোফায় গম্ভীর মুখে বসে আছে। অর্নিলা পাশে বসে বলল, “কি ব্যাপার বল তো। ছেলে পক্ষ কেন আসছে না।”

“আমি কি জানি। আমায় কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
“তাই। কিছুই জানিস না। আবার হুমকি দিস নি তো। তোকে তো আবার বিশ্বাস নেই।”
আরাফাতের চাহনি এবার খানিকটা নড়বড়ে। এদিক ওদিক ফিরে ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমি কিছু করিনি।”
“সত্যিই কি তাই।”
”অবশ্যই তাই। আর ছেলে পক্ষ এলেই কি বিয়ে হয়ে যাবে নাকি?”
”হুমম তাও বটে।”

বলে পিছন ফিরল। বাড়ির বড়রা অনেক দুশ্চিন্তা করছে। ফারাজ ভাই সেই কখন থেকে ফোনে ট্রাই করছে। কিন্তু ফোন লাগছে না। কোথায় গেলেন তিনি। এদিক ফিরে আরাফাতের সাথে চোখাচোখি হতেই আরাফাত চোখ সরিয়ে নিল। অর্নিলা তার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ”বুঝলি, আমার থেকে কিছু লুকানো এতো সহজ না।”
“বুড়ি! তুই কিন্তু বেশি বলছিস।
“কিছুই তো বলি নি এখনো। এবার বলব।” বলেই কান টেনে ধরল।
“এই কি করছিস!”
*তোর বড় ভাইয়ের বউ আমি। সম্পর্কে তোর ও বড়।”
“হ্যাঁ, তুই তো বুড়িই।“
“হ্যাঁ, আমার অধিকার আছে। আর যদি কখনো দেখি না ওকে চ/ড় মারতে তাহলে একদম মামার কাছে গিয়ে বলে দিবো বুঝলি!”

আরাফাত পরক্ষণেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। নিরবে মাথা দুলাল। মুচকি হাসল অর্নিলা। ফারাজ ভাই ফোন হাতে এগিয়ে এসে বলল, “ছেলেরা নাকি আসবে না। তার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে।”
ছোট ফুপু মুখ ভেংচি কেটে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ”অ্যাহ অসুস্থ নাকি অজুহাত। আসবে না তাই বলে এখন অজুহাত দিচ্ছে। কেন? সকালে জানিয়ে দিলেই তো হতো। এতোক্ষণ ধরে যে বাড়ির মেয়েরা এতো কিছু করল এসবের কোন দাম নেই! কি গো আপা! এই ছেলে খুঁজলে তুমি! এ কেমন বংশের ছেলে।”

শাহিনুর বেগম তার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আহা আপা! আপনি শান্ত হন না।”
“আর শান্ত। সারাদিনের পরিশ্রম সব জলে গেল।”
“জলে কেন যাবে? বাড়ির লোক কি কম আছে। ফারাজ! কবে আসবে কিছু বলল?”
বড় ফুপু হুট করে দাঁড়িয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আর আসার দরকার নেই। এমন ছেলের কাছে আমি মেয়ে বিয়ে দিবো না। কখনোই না!” উঠে চলে গেলেন তিনি। অর্নিলা হাতে আপেল নিয়ে তাতে কামড় বসাল। রুদমিলা আর তার বর কথা বলছে। তাই তো, বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে এটা তখনি জানাত। আসবে সেই বিকেল বেলা। এখন রাত পেরিয়ে গেছে। এতোক্ষণে কি সময় হয়নি কথাটা জানানোর। আরো ফোন করে জানতে হচ্ছে। সবকিছুই কেমন যেন অদ্ভুত। ছেলেরা বোধহয় আসতোই না। আরাফাত এর মধ্যে চট করে উঠে দাঁড়াল। অর্নিলা মিটি মিটি হেসে ফিসফিস করে বলল, “ছাদে আছে!”

ফারাজ আরাফাতের জায়গা দখল করে বসে পড়ল। অর্নিলা শুধায়, ”আপনি কিছু করেছেন?”
“আমার‌ ভাই থাকতে আমি কেন?”
“আরাফাত এই কাজ ও জানে।”
“হু মাল্টি টেলেন্টড!”
আচমকা হেসে উঠল দুজন। গম্ভীর এই পরিবেশে দুজনের হাসি দেখে হকচকিয়ে গেল প্রত্যেকে!
.
ছাদের এক কোনে আনিতা দাঁড়িয়ে। চোখের অশ্রু গাল বেয়ে পড়ছে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর সবোর্চ্চ চেষ্টা করছে। আরাফাত পাঞ্জাবি পকেট থেকে এক হাত বের করে আনিতার থিতুনিতে হাত রাখল। মৃদু স্বরে বলল, “সুন্দর লাগছে।”

“দেখি সরো।”
”আহা রাগ করলি নাকি।”
”কথা বলবে না তুমি। কাল কি জোরে আমায় চ/ড় মারলে।
“মারব‌ না। তুই কেন ঢং করে বলতে গেলি, জানো আমায় দেখতে ছেলে আসবে। কি খুব শখ হয়েছিল নাকি সেজেগুজে ছেলের সামনে যাওয়ার জন্য।”
”আমি মোটেই ঢং করে বলিনি। যেটা সত্যি সেটাই বলেছি। আম্মা বলেছে ছেলে দেখতে আসবে। আমি তো সেটাই বলেছি।‌আমার কি দোষ বলো।” কান্নার আওয়াজ বাড়তে লাগল। আরাফাত এবার অন্য হাত দিয়ে গাল আকড়ে ধরল। চুমু খেল ভিজে ঠোঁটটাতে। নিজের ঠোঁট চেটে বলল, “তোর ঠোঁট এতো নোনতা নোনতা কেন?”
”মানে?”
“ও কেঁদেছিস তো তাই এমন মনে হচ্ছে। যা আমার মুখের টেস্ট খারাপ করে দিলি।”
“থাক, তাহলে আর কষ্ট করে চুমু খেও না। সরো, যেতে দাও আমায়।”
“আরে আরে, আমি তো মজা করছিলাম।”
“না, আমি চলেই যাবো।”
“কোথায় যাবি? শোন না!”

বলেই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। দুজনের রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। আচমকা পাশ থেকে ভারী কণ্ঠ ভেসে এলো। দুজন থতমত খেয়ে তাকাল। স্বয়ং আরিফ হাসান দাঁড়িয়ে। তাকে দেখামাত্র দুজন নিস্তেজ হয়ে গেল। আরাফাত হাত ছাড়িয়ে নিল। আরিফ হাসান গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “তোমরা দুজনে আমার স্টাডি রুমে আসো!”
বলামাত্র চলে গেলেন। রক্তশূন্য চাহনিতে দুজন কপোত কপোতী দেখছে দুজনকে। আজ কি যে আছে!!
.
অর্নিলার ভারী টেনশন হচ্ছে। টেনশনে সে হাতের নখ কামড়াচ্ছে। ফারাজ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “থাম না। এতো টেনশন কেন করছিস?”
“করবো না! বড় ফুপু ভেতরে। আপনি জানেন না তিনি কি মারাত্ম/ক।
”আচ্ছা দেখ না। ব্যাপারটা হ্যান্ডেল হয়ে যেতে পারে।
”কি করে? ছেলে পক্ষ আজই আসেনি। আজই ওদের ধরা পড়তে হলো। আচ্ছা, মামা যদি জিজ্ঞেস করে, আরাফাত ই কিছু করেছে কি না। তখন?”
“তখন আর কি! আরাফাত হ্যাঁ বলবে। এভাবে বাবার সামনে মিথ্যে বলতে পারে না। তবে কথা লুকাতে ওস্তাদ।
“মজা করছেন।”
“তুই থামবি।
”উফ আমার আর ভালো লাগে না। এদিকে বাচ্চার টেনশন অন্যদিকে ওদের টেনশন। ঝামেলায় পড়ে গেছি আমি।”
”বাচ্চার টেনশন?”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ফারাজ। অর্নিলার মনে পড়ে গেল কথাটা। দ্রুত উঠে এসে খাটের উপর বসে পড়ল। দু বার দম নিয়ে ফারাজ ভাইয়ের হাত ধরে বলল, ”মন দিয়ে শুনবেন হ্যাঁ!”
“কি?”
“আমি…
কলিং বেলের শব্দ। ঠোঁট চেপে ধরল। আর কথাটা শেষ করা হলো না। এখন আবার কে এলো? উঠে এসে দরজা খুলল অর্নিলা। তার পিছু পিছু সারফারাজ। স্টাডি রুম থেকে আরিফ হাসান, আরাফাত, আনিতা, বড় ফুপু তারাও বেরিয়েছেন। অর্নিলা সেদিক একবার ফিরে সামনে তাকাল। বিস্মিত সে! সালাউদ্দিন সাহেব এখানে।

“আপনি!
“কেমন আছেন মিসেস অর্নিলা!”
“কি ব্যাপার? আপনারা এখানে?”
সারফারাজ এসে দাঁড়াল পিছনে। আরিফ হাসান ও এলেন। সালাউদ্দিন সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ”আপনাকে যে আমাদের সাথে যেতে হবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আশা করি আপনিও কোওপারেট করবেন।”
“আমি!”
“হ্যাঁ, আপনি। কিছুদিন আগে আপনি কিডন্যাপ হয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ!
“ধন্যবাদ সত্যিটা বলার জন্য। নাহলে আপনার বর তো! যাক গে, এখন যখন বলেই ফেলেছেন তবে চলুন।”

আরিফ হাসান কিছু বলতে যাবেন অমনি সালাউদ্দিন সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমাদের কাছে উপর থেকে অর্ডার আছে।‌ আপনিও তো আইনের লোক। আশা করি বুঝবেন। আর ডাঃ সারফারাজ শেহদাত। স্ত্রী যেহেতু যাচ্ছে আপনিও তো আসবেন। সেখানেই আপনার সাথে কথা হবে। মিসেস অর্নিলা। আপনি চলুন!”

দুজন মহিলা এসে অর্নিলা কে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। সে কিছু বুঝল না। বার বার পিছন ফিরে চাইতে লাগল। সারফারাজ ইশারায় শেষমেষ আশ্বাস টুকু তাকে দিতে পারল না!

#চলবে!

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-৩০

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩০

অনি সারফারাজের বুকের উপর শুয়ে আছে। আধশোয়া সারফারাজ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “অনি,‌‌কি হয়েছে তোর?”
“ভীষণ ভয় লাগছে ফারাজ ভাই।”
“কেন? ভয় করছে কেন?”
“ওরা মা/রা গেল! কিভাবে মা/রা গেলো? কি আশ্চর্যজনক মৃ/ত্যু তাদের।”
“এতে তুই কেন ভয় পাবি? তোর কি কিছু হয়েছে?”
“জানি না ফারাজ ভাই।‌ আমি কেবল জানি আমার খুব ভয় হচ্ছে।”

ভয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিল অর্নিলা। রাত তখন বেশ গভীর। খাটের কোনে ল্যাম্পশেডের আলোখানি জ্বলছে। সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে গেল। অনির দিকে ফিরে ভাবতে লাগল।‌ মৃদু স্বরে হেসে বলল, “ঘুমিয়ে পড় অনি। এখন আর ভয়ের কোন কারণ নেই। তারা বেঁচে নেই। আর কেউ তোকে ভয় দেখাতে পারবে না।”
অনি মাথা তুলে এদিকে ফিরে চাইল।‌ সারফারাজ মৃদু হেসে চুল গুলো কানে গুঁজে দিল। এই যে এতোখানি ভালোবাসা! উন্মাদনা! এসব কি অনি টের পাচ্ছে? তার চোখের পাতা কেমন অদ্ভুত ভাবে নড়ছে। টের না পাওয়াই ভালো। অনি ভয় পেয়ে যাবে। তার এই ভদ্র, সহজ, সরল ফারাজ ভাই তার কাছে শ্রেষ্ঠ। সে কি আর জানে, ফারাজ ভাই তার জন্য কি কি করতে পারে। না জানাই ভালো। সুস্থ মানুষের কাছে এসব অসুস্থতা বলে প্রমাণ পায়। কিন্তু সে তো অসুস্থ নয়। শুধু সহ্য হয় না। তার অনিকে কেউ কিছু বললে তার সহ্য হয় না।‌ এমন তো আগে ছিলো না! অনির ভালোবাসা তাকে উন্মাদ করে ছেড়েছে! “অনি! অনি আমি তোকে বলেছি, আমার ভালোবাসা হচ্ছে চৈত্রের মতো! তার মতোই ভয়ং/কর চারদিক। সবাই তৃষ্ণার্ত হয়ে রয় চৈত্রের রোদে।‌আমার‌ ভালোবাসা মুক্তি পায় সে রোদে।‌ ঝলসানো সেই রোদের তাপে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভালোবাসা পুড়ে হয় আরো পবিত্র। সেই ভালোবাসার উন্মাদনা ছড়িয়ে যায় সমস্ত শরীরে! আমি যে ভালোবাসি! ভয়ং/কর ভাবেই ভালোবাসতে জানি। অনি!”

“কিছু বললেন?”
“হ্যাঁ, কি?”
”বললাম কিছু বললেন/? মনে হলো আপনি‌আমায় ডাকলেন!”
“না তো? এমন কিছু না।”
”এমন করে কেন চেয়ে থাকেন?”
“কেন? তোর ভয় হয়?”
অর্নিলা মুখ টিপে হাসে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ”না তা কেন? বরং আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে করে। জানেন, এতোদিন তারা আমার স্বপ্নে এসে ভয় দেখাত। এখন আর আসবে না বলুন।”
“একদম আসবে না। আমি আসতে দিবো।”

অনি শব্দ করে হাসে। সেই হাসির স্বরে তার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। হৃৎস্পন্দন চলে নিম্নগতিতে। এ যেন ম/রে গিয়েও সুখের দেখা মিলে।
.
পরদিন চারজন মিলে জড়ো হলো নিকুঞ্জ নিবাসে। আরিফ হাসান অর্নিলা কে স্বচোখে দেখে শান্তি পেলেন। শাহিনুর বেগমের চোখ জুড়াল। ছোট ফুপুর কবিরাজিতে ভয়া/বহ বিশ্বাস। কি সব তাবিজ আনিয়ে অর্নিলা কে পড়িয়ে দিচ্ছে। বড় ফুফু গালমন্দ করে বলছে,‌“ধু্র ধুর! ছাড়তো। কি আনলি এসব? এসবে কোন কাজ হয়? টাকা নষ্ট সব।”

“না গো আপা। এ অনেক বড় একখান কবিরাজ। ঢাকা শহর থেকে আনাইছি।”
“কেন রে? এখানে কি কম পড়ছে নাকি? বেক্কল একটা!“
ছোট ফুফু মুখ ভার করে ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখেতে অশ্রু টলমল।‌এই রে, কেঁদেই না ফেলে। সবার সামনে এভাবে না বললেও পারতে ফুফু। বড় ফুফু মুখ ভেংচি কাটলেন। ফরহাত মুখ টিপে হাসছে। অর্নিলা চোখ বড় বড় করে না করছে। এই হাসির স্বর ফুফুর কানে গেলেই এখন সর্বনাশ ঘটবে। তিনি কেঁদেই ছাড়বেন। বড় ফুফুও কম না। তার সামনে বসিয়ে দোয়া দরুদ পড়ে মাথায় ফু দিয়ে চলছেন। অর্নিলার বেশ মজা লাগছে। মায়ের অভাব মাঝে মাঝে হলেও এই ফুফুদের জোরে তার পুষিয়ে নেওয়া যায়। অর্নিলা খুব ভাব করে ফুফুর গলা জড়িয়ে ধরল। ফুফু ছ্যাত করে উঠল।‌

“একি? কি করিস?”
“ফুফু, ও ফুফু! আমায় খুব ভালোবাসো না তুমি।”
“দেখ দেখ, দামড়া ছেড়ির কাহিনী দেখ। কেমনে গলা জড়িয়ে ধরে। দেখি ছাড়, দম বন্ধ হইয়া আসে।”
“এমন করো কেন ফুফু? তোমাগো ওইখানে তো গালে চুম্মা ও দেয়। দাও আমি একটা চুম্মা দেই।”
”এই সর সর। আমার লগে একদম এমন ছেচড়ামি করবি না কইলাম। চুম্মা চাটি করা লাগবে না, সর এখান থেকে। সোহাগ যা করোস তোর জামাইয়ের লগে কর।”
অর্নিলা ও বড় মুখ করে বলে ফেলল,
“তা তো করিই!”
বড় ফুফু পিঠে চড় মেরে বললেন,‌”ছিঃ শরম লজ্জা কিছু নাই। বেত্তুমিজ!”

অর্নিলা হেসে উঠল।‌ফরহাত এবার হো হো করে হাসা শুরু করল। শাহিনুর বেগম চা নিয়ে হাজির হলেন।‌সোফায় বসে বললেন, ”নিয়াজ কেমন আছে আপা? ভাইজানের খবর কি?”
“সে আর কি? ভালোই আছে। ছেলের শোক এখনো ভুলতে পারেনাই। পারব কেমনে? দুইটা মাত্র ছেলে। ছোট ছেলেটার এই হাল দেখলে আমারো কষ্ট লাগে। কি যে হইবো ভবিষ্যৎ?”

সারফারাজ ঘরে ঢুকতেই কথা গুলো কানে গেল। ছোট ফুফু দাঁড়িয়ে ধপ করে বললেন, ”এর চেয়ে ভালো হইত মই/রা গেলে। বাইচা থাকাই এখন বড় কষ্ট। এমন পঙ্গু হইয়া থাকা যায়।“
বড় ফুফু ধমকের স্বরে বললেন, “চুপ কর। আমরা এখনো ম/ইরা যাই নাই। দিনশেষে ও আমার ভাই পুত। আমি ছেড়ে দিই কেমনে? তুই পারবি ছাড়তে?”
”তা পারমু না। কিন্তু আপা, তুমি আর যাই কও, নিয়াজ পুরা ভাইয়ার মতোই হইছে। দেখো, বাপের পাপ এখন পোলায় নিছে। বিয়েটা ভাঙছে।”
বড় ফুফু মুখ সরিয়ে নিলেন। আর ভালো লাগছে না এসব নিয়ে কথা বলতে। প্রসঙ্গ বদলিয়ে বললেন, “ভাবী? ভাইজান আসছিলো একবারও?”

“না আপা। ফোন করে তো সবটাই বলেছিলো তিনি। এরপর অনিকে পাবার পরেও তা জানিয়েছে। এই তো, এরপর আর ফোন দেয় নি।”
“ছেলেকে নিয়েই তো আছে মহা ঝামেলায়। কিভাবে আর ফোন দিবে বলো? আমার সাথেও কথা হয়েছিল। যাক, অনি সুস্থ মতো চলে এসেছে। বাড়িতে একটা মিলাদ পড়ালে কেমন হয়?“
“ভালোই হয়।‌ আমিও ভাবছিলাম। ওই এলাকার এতিমখানা থেকে কিছু বাচ্চাদের আনিয়ে খাইয়ে দিতাম।”
“হ্যাঁ, দাও।”
কথাবার্তা শুনে অর্নিলা একগাল হাসে। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান মানেই সবাই আসবে। হ্যাঁ, তার দারুণ লাগছে এসব শুনে।
.
মামা মামী এসেছে। সাথে শ্রেয়মী। রুদমিলা আর তার বর আশিক ও এসেছে। রুদমিলার একটু স্বাস্থ্য হয়েছে। ইরা আপুও এসেছে। নাজিয়া এসেছে। সে কেমন ভয়ে ভয়ে আছে। বিয়েটা ভেঙেছে কিন্তু তার আর ফরহাতের বিয়ের কথা এখনো কেউ জানে না। বাবা জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না। তখন ঝোঁকের বশে বিয়ে করে এখন পস্তাতে হচ্ছে। এছাড়া আরো একজন এসেছে। আনিতা। আনিতা হচ্ছে বড় ফুপুর মেয়ে। বাড়ির বড়রা রান্নাঘরে কাজ করছে। বিশাল আয়োজন। অর্নিলা চোখের পাতা ফেলে ফেলে রুদমিলা কে দেখছে।‌ ইরা আপু জিজ্ঞেস করল, “কি দেখছিস?”

“রুদমিলার স্বাস্থ্য হয়েছে তাই না বলো!”
“শুধুই কি স্বাস্থ্য?”
“মানে?”
চকচক করে উঠল অর্নিলার চোখ। ইরা আপু হেসে উঠল। রুদমিলাও মিনমিনিয়ে হাসছে। শ্রেয়মী এসে অর্নিলার গাল টিপে বলল, ”তুমি ফুপু হতে চলেছো!”
“কি? বিয়েই তো হলো এই ক মাস! মানে..
হাত দিয়ে গুনতে শুরু করল। ইরা আপু থামিয়ে দিয়ে বলল, “থাম! ও তোর ফারাজ ভাইয়ের মতো না ঠিক আছে। কিছুদিন পর দেখবি ও কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে আর তখনো সারফারাজ তোকেই কোলে নিয়েই ঘুরছে!”

অট্টহাসিতে মেতে উঠল তারা। অর্নিলা অভিমানি স্বরে বলল, “আপা!”
“তো আর কি? তুই এখনো পিচ্চি আর তোর বর তোকে সামলাচ্ছে। তা না হলে এখনো একটা বাচ্চা নিচ্ছিস না কেন? মগা কোথাকার!”
মুখ ফুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। যাও! কথা নেই তোমাদের সাথে। ধপ ধপ করে পা ফেলে বেরিয়ে গেল অর্নিলা। বাড়ির দ্বিতীয় তলা প্রায় খালি। সবাই নিচতলায়। বাচ্চারাও সেখানে। যাবার সময় কারো ফিসফিস কথাবার্তায় থেমে গেল সে। এদিক ওদিক ফিরে তাকাল। আওয়াজ আসছে কোথা দিয়ে? এক দরজার পাশে কান পাতল। ভেতর থেকে কারা যেন কথা বলছে মনে হচ্ছে। ফরহাত ভাই না! সাথে কে? কোন মেয়ে? নাজিয়া! মনোযোগ দিয়ে কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছে অর্নিলা। নাজিয়া আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ”হাত ছাড়ো। আমি আর নিতে পারছি না।”

“নিতে পারছো না মানে? কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে বলছো? তুমি কেন বুঝোনা ফরহাত। এরপর আমাদের বাচ্চা হয়ে গেলে আমি কি করব?“
“বাচ্চা! আসতাগফিরুল্লাহ! আমি তোমার সাথে এমন কি করব যাতে বাচ্চা হয়ে যাবে।‌ কি বলছো এসব?”
“তুমি জানো না কিছু। আমি অনেক শুনেছি, এমন গোপনে বিয়ে করে এরপর বাচ্চা… এরপর আর ছেলেটা মেয়েকে স্বীকার করেনি।”
“তুমি আমায় তেমন ভাবছো? নাজিয়া!”
নাজিয়া থতমত খেয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল, “না মানে..
ফরহাত তার হাত দুটো ধরে বলল, “আমায় বিশ্বাস করো তুমি। আমি তোমার সাথে এমন কিছুই করব না। আর করার প্রশ্নই নেই। সারফারাজ জানে বিয়ের কথাটা আর তার সাথে মামা ও জানে!”
“কি! আঙ্কেল ও জানে বিয়ের কথা।”
”হ্যাঁ, তিনিই তো তোমার বিয়েটা ভেঙে দিল। তুমি নিশ্চিত থাকো,‌আমি তোমায় ঠকাবো না। আর এমন কিছুও করব না যাতে তোমার…. সে যাই হোক। আমি তোমায় এখন শুধু চুমু খাবো। দেখি এদিক আসো।”
”একদম না। ছাড়ো বলছি।”
“আরে একটা চুমুই তো। এতে বাচ্চা হয়না কারো। শুনো না।”
“না বললাম তো!”
”নাজিয়া! নাজিয়া শোন..
এরমধ্যে ফট করে দরজাটা খুলে গেল। ফরহাত আর নাজিয়া হত’ভম্ব হয়ে পিছন ফিরল। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা মাথা বেরিয়ে এলো। অর্নিলার মাথা! সে দুজনের দিকে ফিরে বলল, “তোমার বিয়েও করে ফেলেছো!”

দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। ফরহাত মাথা দুলাল। অর্নিলা নিজেও মাথা দুলিয়ে বলল, “ওহ, কনগ্রেচুলেশন! কবে করলে?”
“তোর কিডন্যাপ হবার একদিন আগে!”
“একদিন আগে। হুমম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কেন বাচ্চার কথা বলছো?“
নাজিয়া দ্রুত মাথা নেড়ে বলে, “না না! কোন বাচ্চা নেই!”
অর্নিলা চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। মাথায় বারি মে’রে বলল, ”ধ্যাত! সবার বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। শুধু আমার আর ফারাজ ভাইয়ের কোন বাচ্চা হচ্ছে না। এই ফারাজ ভাই কোথায়? ফারাজ ভাই!” চেঁচিয়ে উঠে সামনে হাঁটা ধরল।

নাজিয়া ফট করে এসে দরজা বন্ধ করে বলল, “ও কাউকে বলবে না তো।”
“একদম না!“ বলেই হাত ধরে হেঁচকা টান মারল ফরহাত!

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-২৯

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৯

অনি বেশ ভয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পরই চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক চেয়ে দেখে। বার বার মনে হয় আশেপাশে কেউ আছে। অথচ পুরো ঘর শূন্য! ভয়ে কুঁকড়ে উঠে সে। আবার গুমড়ে যায়। আচমকা চেঁচিয়ে উঠে। মনে সন্দেহ জাগে, তার কান্নার আওয়াজ আদৌও কেউ শুনতে পারছে তো? ক্লান্ত দেহ নিমিয়ে যায়। মুখ খুলে শ্বাস নিতে থাকে সে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ। টের পেয়ে তটস্থ হয়ে যায় অনি। কেউ আসছে? মাথা তুলে না সে। নিচু হয়ে থাকে। খানিকক্ষণ বাদে কারো পা জোড়া দেখতে পায়। ভয়ে শিউরে উঠে সে। শুকনো ঢোক গিলে আগের মতোই নিশ্চুপ থাকে। আচমকা লোকটা হাত দেয় তার বুকের মধ্যে। কিৎকর্তব্যবিমূঢ় অর্নিলা সাথে সাথে মুখ তুলে তাকায়। চেঁচানোর আগেই তার মুখ চে/পে ধরে লোকটা। তার রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কি করতে যাচ্ছে লোকটা? অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলে, ”চুপ কর শা লি। মুখ থেইকা একটা আওয়াজ বাইর করলে জান নিয়া নিমু।”

এমন ধমক শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। লোকটা দৃষ্টি দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠে। কিন্তু তাতে অনি একদম দমে যায়নি। দমবে না সে। দুজনের মধ্যে ধস্তা ধস্তি শুরু হয়। গনি মিয়া চেষ্টা করছে অনির মুখ বন্ধ করাতে। পারছে না। শেষমেষ অনি তার হাতে কামড় দিয়ে বসে। রাগে সজোরে এক চ ড় মারে। আবারো দরজা খোলার শব্দ। অনি মুচকি হাসে। চড়ের চোটে ঠোঁট কে টে রক্ত পড়ছে। ওস্তাদ ভিতরে এসে জিজ্ঞেস করে, “কি হইছে?”

“দেহেন ওস্তাদ! শা লি আমারে কামড় মার’ছে।”
“তুই এদিকে কি করোস? আমি না কইছি এদিকে কেউ আইবি না। কিরে নূর?”
“ওস্তাদ, আমি তো জানি না।”
গনি একরোশ রাগ নিয়ে আবারো অশ্রাব্য গালি দেয়। বলে, “ওস্তাদ, এই মাইয়ার একটা ব্যবস্থা এবার আপনারে করতেই হইবো!”

কাদের রক্তবর্ণ চোখে গনি কে দেখে একবার অনিকে। নুরু কে হুকুম দেয় ফোনটা আনতে।
.
“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার! ভালো আছেন?”
“কে? কাদের?“
“জি স্যার। গলার স্বর দেখি চিইনা গেছেন।”
“কি চাও তুমি কাদের?”
“স্যারের হাতে মনে হয় সময় কম। একেবারে আসল জায়গায় হাত দিছেন। আচ্ছা হুনেন, টাকা লাগব।”
“কতো? বলো।”
“বেশি না স্যার, ৫০ লাখ হইলেই হইবো। আপনে স্যার মানুষ, তাই একটু কমাইয়াই চাইছি।”
“আমার মেয়ে? মেয়ে কেমন আছে?”
“ভালা আছে। আমরা হইলার স্যার ব্যবসায়ি মানুষ। সদাই করি। টাকা পাওয়ার লগে লগে মাইয়া হাতে পাইবেন।”
“আমি মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই।”
“কথা কইবেন? হ্যাঁ, কন!“

অনির মুখের সামনে ফোনটা রাখল। অনি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে কম্পিত স্বরে বলল, “বাবা!”
“মা! মা তুমি ঠিক আছো? চিন্তা করো না মা। তোমার বাবা তোমাকে জলদি নিতে আসবে।”

অনি নিরুত্তর। ঠোঁট চেপে কাঁদতে শুরু করে সে। কান্নার আওয়াজ আরিফ হাসান পাচ্ছিলেন। কাদের ফোন নিয়ে একটু দূরে গিয়ে বলে, “টাকা আইজ লাগব। বিকালে। কোথায় পাঠাইবেন পড়ে ফোন কইরা জানামু। এখন রাখি স্যার, আসসালামুয়ালাইকুম!”

ফোনটা কেটে দিল। আরিফ হাসান ফোনের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা শান্ত করার চেষ্টা করলেন। মিনিট দুয়েক ভেবে সারফারাজ কে কল দিলেন। সারফারাজ ফোন তুলে সমস্তটা শোনার পর বলল, “আমি টাকার ব্যবস্থা করছি। টাকা নিয়ে আমিই যাবো।”

“এসব তোমার ভাবতে হবে না। টাকা তোমার অ্যাকাউন্টে ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছে যাবে। তুমি বিকালে তৈরি থেকো সারফারাজ। আর হ্যাঁ, সাবধান!”
ফোন কেটে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। এখন শুধু অনি সুস্থ ভাবে ফিরে আসুক এটাই তার চাওয়া। তার হাতের উপর হাত রাখলেন শাহিনুর বেগম। তার চোখে অশ্রু টলমল। আরিফ হাসান কোমল কণ্ঠে বললেন, “তুমি চিন্তা করো না। আমাদের মেয়ের কিছু হবে না।”
“আল্লাহ করুক সুস্থ মতো চলে আসে। ওরা যা চায় তুমি দিয়ে দাও। আমার মেয়েটা যেন ঠিক থাকে। গতরাতে স্বপ্নে ওর মা কে দেখেছিলাম। বেচারি কাঁদছিল! কতদিন পর যে দেখলাম মেয়েটাকে।
”শান্ত হও। বললাম তো ও ঠিক মতো চলে আসবে। কিছু হবে না ওর। সিধু! এই সিধু।”

“জি স্যার!
“যা তোর ছোটভাইকে ডেকে নিয়ে আয়।”
“আচ্ছা‌!”
“আরাফাতকে?”
”হ্যাঁ, আরাফাত আর ফরহাত কে ঢাকায় পাঠাবো। ওদের দুজনের পাশে কারো থাকা দরকার।“
“চলো না আমরা যাই।”
“এখন না, তোমার শরীর অসুস্থ। একটু সুস্থ হও পরে যাবো।”
“সারফারাজ পারবে তো? ওর না কিছু হয়ে‌ যায়। চিন্তা হয় বড্ড!”

আরিফ হাসান এতোক্ষণ চেয়ারে বসা ছিলেন। সেখান থেকে উঠে এসে খাটের কোণায় বসলেন। শাহিনুর বেগম তার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “সারফারাজ আমার ছেলে। তুমি চিন্তা করো না, ওরা দুজনেই ঠিক থাকবে!”
আরাফাত দরজায় করাঘাত করে বলল, “বাবা আসব?”
.
বিকেল ৪ টা বাজে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে গাড়িতে এসে বসল ফারাজ। টাকার ব্যাগটা গাড়ির পিছনে সিটে রাখল। গাড়ি স্টার্ট দিলো আবারো। ঠিকানা তার চেনা জায়গা নয়। নিশ্চিত নিরিবিলি কোন জায়গা হবে। কোন জঙ্গল ও হতে পারে। ঢাকা শহরে জঙ্গল আবার কোথায়? ম্যাপ দেখে গাড়ি আগাচ্ছে। দেখতে দেখতে রাত হয়ে যাচ্ছে অথচ এখনো তার গন্তব্যে পৌঁছানোর কোন নাম নেই। সারফারাজ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। না এটা জঙ্গল না। গ্রাম সাইডের মতো খানিকটা সম্পূর্ণ না। তবে আশপাশের লোকজন খুব কম। একজায়গায় হঠাৎ দেখল ভিড়। ওহ, চায়ের দোকান! এসবে ভিড় ভালো হয়। বুক তার ধুকপুক করছে। কে জানে অনি কেমন আছে? ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। আর বোধহয় সামনে যাবে না। সামনে সরু গলি। এখানেই থামাতে হবে। এখানে ল্যাম্পপোস্ট নেই। ইয়া বড় একটা বাঁশের মাথায় আলো জ্বলছে। অনি নিয়ে তারা কোথায় এনে রেখেছে? এসব ভাবতেই গায়ে জ্বা/লা দিচ্ছে। টাকার ব্যাগ নিয়ে গাড়ি ছেড়ে নামল। হঠাৎ আকাশে আলোর ঝলকানি। সেকেন্ড পরেই শব্দ। বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ। খোলা আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখে সারফারাজ নিজেও চমকে গেল। এই দৃশ্য মানিকগঞ্জে সচরাচর দেখা যায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। পরক্ষণেই ফোনটা বেজে উঠলো।

“হ্যালো!”
“হ বাপজান। টাকা আনছো?”
“হ্যাঁ, সাথেই আছে। কোথায় আসব?”
“আছো কই?”
“রাস্তার মোড়ে আছে। একটু আগেই একটা চায়ের দোকান পড়েছে।”
“হ্যাঁ, জানি জানি। তোমার পিছনে আমাগো লোক রাখাই আছে। বেশি চালাকি কইরো না। শোন..
“হুম!
“সামনে হাঁটতে থাহো। যতক্ষণ না সামনে আরেকটা রাস্তা আইবো ততোক্ষণ। এরপর রাস্তায় বাম দিক দেইখা দশ পা হাটবা। সেখানে একটা তালগাছ আছে। টাকার ব্যাগ ওদিকে রাখবা!”
“আর অনি? অনি কোথায়?”
“সবুর করো। সেখানে যাইয়া আমারে ফোন দিও। আমি কইয়া দিমু।”
“আপনি নতুন কোন চালাকি করছেন?”

বিকট হাসির শব্দ। ওপাশ থেকে স্পষ্ট হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সারফারাজ কপাল কুঁচকে ফেলল। ধপ করে ফোনটা কেটে গেল। তার মন বলছে, অনির কিছু হয়নি। সে ঠিক আছে। তাকে ঠিক থাকতেই হবে।
সারফারাজ হাঁটতে শুরু করল। তার মনে হচ্ছে সে একাই হাঁটছে কিন্তু লোকটা বলল একজন নাকি পিছনে আছে। সত্যিই বোধহয় আছে। তারা কতোজন জানা হলো না। জানবার দরকার ও নেই। কথা মতো সারফারাজ এসে দাঁড়াল তাল গাছের সামনে। টাকার ব্যাগ এখনো নিচে রাখেনি। এদিক ওদিকে মুখ করে রাস্তার দুদিক দেখছে। ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। আশপাশ বোধহয় ফসলের মাঠ ছাড়া আর কিছু নেই। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি আসবে বলে দিচ্ছে। ব্যাগটা রেখে ফোন করল সে। ওপাশ থেকে গড়গড় করে বলল, ”যেখান থেকে বায়ে মোর নিছো সেখান থেইকা ডানে মোড় নিয়া গুইনা গুইনা ১৭ পা হাটো। ছোট ছোট পা ফেইলো না, আমাগো পা বড় কি না। দেখবা তোমার বউ ওইখানেই আছে…

বাকি কথাটুকু শোনা হলো না। সারফারাজ ছুটতে লাগল। রাস্তার মোড়ে এসে থেমে গেল। ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরল। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। ১৭ পা আসার পর থেমে গেল সে। এখানে কিছু একটা দোকান মনে হচ্ছে, তবে দোকান বন্ধ। ফোনের আলো জ্বালিয়ে ফিরে তাকাল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। উন্মাদ হয়ে ডাকতে লাগল সারফারাজ, “অনি? এই অনি? অনি!!”

কোন সাড়াশব্দ নেই। কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল সে। বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। সারফারাজ আকাশের দিকে ফিরে তাকিয়ে আছে। আচমকা মনে ঠেকল কিছু। কানে ভ্রমের বাজনা। ফোনটা তুলে ধরে বিস্ময় দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল।‌ গায়ে চাদর জড়ানো কেউ। মুখ আড়াল করা।‌ অস্পষ্ট কণ্ঠে সারফারাজ বলে উঠল, “অনি?” মুখের কাপড় সরে গেল। ঝনঝনিয়ে উঠল সারফারাজের শরীর। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল শুধু। অর্নিলা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল তৎক্ষণাৎ। সারফারাজের আঁকড়ে ধরল তাকে। অর্নিলা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “ফারাজ ভাই! ফারাজ ভাই আপনি এসেছেন! আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবে ছিলাম আর কখনো আপনাকে দেখতে পাবো না। ওরা খুব খারাপ লোক ফারাজ ভাই। আমায় খুব কষ্ট দিয়েছে। আমি খুব ভয় পেয়েছি, খুব পেয়েছি! ওরা একটুও ভালো না। আমি খুব পেয়েছি!” এই কথাটুকু বার বার বলে কাঁদতে লাগল অনি। সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার চোখের অশ্রু বৃষ্টির সাথে মিশে গেছে। অর্নিলা যে কেঁদেই যাচ্ছে।তার কষ্ট দেখে সারফারাজের হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। সমান কষ্ট সে যে পাচ্ছে।
.
গাড়ি করে বাড়ি ফিরছে দুজন। বৃষ্টি এখনো পড়ছে। অর্নিলা দুই হাতে ফারাজ কে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ছে। বহুদিন পর আজ যেন সে শান্তির ঘুম ঘুমাবে। সারফারাজ একটু বাদে বাদে তার মুখখানি দেখছে। মৃদু হেসে তাকে আগলে নিচ্ছে। বাড়ি ফিরল মাঝরাতে।‌ আরাফাত আর ফরহাত আগে থেকেই সেখানে ছিলো। আরাফাত অর্নিলা কে দেখা মাত্রই কেঁদে ফেলল। অর্নিলা তার পিঠ চাপড়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ এতো বড় ছেলে হয়ে কাঁদছিস তুই!“

ফরহাত দাঁত পাটি বের করে হেসে বলল, “যাক, আমায় কাঁদিয়ে ফেলিস এই অনেক। যা এবার ফ্রেস হয়ে নে। তোকে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছে।”

সারফারাজ অনিকে খাইয়ে দিচ্ছে আর অনি ভিডিও কলে মা বাবার সাথে কথা বলছে। মা প্রায় কেঁদে ফেললেন। অনি গলা ফাটিয়ে হেসে বলল, “আরে কাঁদার কি হলো? দেখো তোমার মেয়ে অনেক সাহসী। ওরা কিছু করতে পারেনি।”

আরিফ হাসান কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, “হ্যাঁ, আমার মেয়ে খুব সাহসী!”
.
সারফারাজ ঘরের দরজা বন্ধ করল। অর্নিলা দাঁড়িয়ে থেকে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিবরণ দিচ্ছে। এই মেয়েটা কখনো চুপ থাকে না। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে সারফারাজ তাকে ধরে বিছানায় বসাল। ঠোঁট কা/টা দাগ! আর আছে? সে হেসে মাথা দুলিয়ে না করল। বলল, “একটা মাত্র চ ড় খেয়েছি।” মূহুর্তের মধ্যেই অগ্নি শিখার মতো জ্ব/লে উঠল সারফারাজ। রক্ত প্রবাহ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে দেয়। কোমল হাতে স্পর্শ করল ঠোঁট জোড়া। অর্নিলা তার হাতের তালুতে গালটা বাড়িয়ে রাখল। সারফারাজ তাকে কাছে টেনে কপাল চুমু খেলো। হাতে চুমু খেল। অতঃপর হাতে দুটো ঔষধ দিয়ে বলল, “খেয়ে নাও!”

“এই যে, এটাই ভালো লাগল না। এর চেয়ে ভালো আরো দুটো চুমু খান আমায়। আমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবো।”
“এটা তোমার জন্য বেশি দরকার। অনেক ক্লান্ত লাগছে তোমায়। বকবক না করে খেয়ে ফেলো।”
“ইশ ফারাজ ভাই, আমায় হারিয়ে ফেলেও আপনার শিক্ষা হয়নি। এখনো এভাবে বলছেন। যান দেখবেন আবার হারিয়ে যাবো। এবার তো খুঁজে পেয়েছেন এরপর আর খুঁজেও পাবেন না।”

নিবিড় নয়নে সারফারাজ চেয়ে রইল অনির দিকে। অনি এখনো হাসছে। খুব মজার কথা বলেছে সে। আচমকা সারফারাজ তাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে নিল। বলে উঠল, “না! এরপর আর না। কখনো না। আমি তোকে আর কখনো হারাতে দিবো না অনি!“
“এই তো ভদ্র ছেলের মতো কথা। হি হি! দেখি এখন একটা চুমু খান তো আমায়!” বলেই ঠোঁট বাড়িয়ে দিলো সে। সারফারাজ শব্দ করে হেসে উঠলো।
.

অর্নিলা যতই দেখাক সে পুরোপুরি ঠিক আছে, সবার সামনে হাসছে বলেই মনের ক্ষ/ত এতো দ্রুত ঠিক হয়ে গেছে এমন কিছুই না। এখনো সেই ভয়ংকর অতীত ভুলতে পারে নি। রোজ রাতেই ভয়ে কাঁপড়াতে থাকে সে। ঘুমের মধ্যে কথা বলতে থাকে। সারফারাজের শার্ট খামচে ধরে গো/ঙানির মতো আওয়াজ করে। যেন স্বপ্নের মধ্যে কেউ তাকে ভীষণ ভাবে কষ্ট দিচ্ছে। যন্ত্রণা/য় কাতড়ায়! তখন একমাত্র সারফারাজ তাকে নিজের আগলে নেয়। অর্নিলার অজান্তেই সারফারাজ সবসময় তার পাশে থাকতে চায়। পাশে থেকেছে বৈকি। তিক্ত সেই অতীতের সবটুকু ভুলিয়ে দিতে চায় সে। জীবনটাকে আবারো গুছিয়ে নিতে চায়। সেই চঞ্চল, অগোছালো, ছটফট করা অনিকে চায় সে! শুধু অনিকেই!

অনিকে উদ্ধা/রের দুদিনের পরের ঘটনা। আরাফাত আর ফরহাত আজ বাইরে থেকে কাচ্চি আনিয়েছে। সারফারাজ নিয়ে এসেছে আইসক্রিম। অর্নিলা এক হাতে কাচ্চির প্লেট অন্য হাতে আইসক্রিম খেতে খেতে বসার ঘরে ঢুকল। সারফারাজের কাছে প্লেট দিয়ে টিভির দিকে ফিরল। খবরের চ্যানেল চলছে। সাংবাদিক উপস্থাপন করছে,
“লোমহর্ষক এক কাহিনির সাক্ষী হলো মধুপুর গ্রামের লোকজন। অজ্ঞাত তিন লোকের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু/তে স্তম্ভিত গ্রামবাসী। আরো আশ্চর্য জনক কথা হচ্ছে মৃ/ত তিন লোকের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে
আছে অনেক অনেক টাকা। পুলিশ সমস্ত কিছু তাদের হেফাজতে নিয়েছে। অজ্ঞাত লোকদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। গ্রামবাসী ও তাদের চিনে না। পুলিশ ইতিমধ্যেই অভিযান শুরু করে দিয়েছে। এরপর কি হলো জানতে আমাদের সাথেই থাকুন। আমি হচ্ছি শায়লা! সরাসরি বলছি মধুপুর গ্রাম থেকে। নিউজ ২৪!”

খবরের চ্যানেলের দিকে কারো নজর নেই। আরাফাত রিমোট খুঁজে চ্যানেল বদলাতে গেল। আইসক্রিম হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল! সারফারাজ, আরাফাত, ফরহাত তিনজনই অনিকে দেখছে। অনিকে আতঙ্কিত মনে হচ্ছে। ধপ করে সোফায় বসে পড়ল সে। সারফারাজ ছুটে গেল তার কাছে। ফরহাত শুধালো, “কি হয়েছে অনি! কি হয়েছে?”
আরাফাত শুধালো, “কি হয়েছে বুড়ি? খারাপ লাগছে তোর? কি হলো আবার?”
“অনি!”

অনি শুকনো ঢোক গিলল। জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাত তুলে সামনের দিক তাক বলল। অস্ফুট স্বরে বলল, “ওওওরা! ওরা মা/রা গেছে!”
হতভম্ব হয়ে তিনজনই ফিরল। ছোট ছোট চোখ করে সারফারাজ ফিরে চাইল। এরাই তবে তারা, যারা অনিকে কিড/ন্যাপ করেছিলো!

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-২৮

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৮

অর্নিলা নিখোঁজ হয়েছে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এখন অবদি তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।‌ অথচ অর্নিলার মনে হচ্ছে সে এখানে আটকা পড়ে আছে জনম পেরিয়ে গেছে। একটা খাবারের দানা পড়েনি পেটের মধ্যে। পানির তৃষ্ণায় না সে মা’রা যায়। চোখ বুজে যাচ্ছে , মেলে রাখা কষ্টসাধ্য। এতোক্ষণ তাও যা ছোটাছুটি করছিলো সেই শক্তিও এখন ফুরিয়ে গেছে। কোনমতে যেন দম খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। মাথার উপর লাল রঙের একটা বাতি জ্বলছে। এখন রাত না দিন সেটার খবরও তার কাছে নেই। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে সামনে চেয়ে ফিরল। ঝাপসা ঝাপসা চোখে দেখল একজন ভিতরে আসছে। আবারো দরজা বন্ধের শব্দ। কিছু একটা ছুঁড়ে মা’রল মেঝেতে। অর্নিলা ঠিক করে চেয়ে দেখার চেষ্টা করল। ভাত! শুকনো ঢোক গিলল সে। খাবার দেখে পাগল হবার উপদ্রব।পাগলের মতো একবার এদিক চাইছে একবার ওদিক। লোকটা তার চারিদিকে ঘুরে বাঁধন খুলে দিল। কর্কশ গলায় বলে উঠল, “ভাত দিছি, খাইয়া ল!”

অর্নিলা কাঁপতে লাগল ভয়েতে। সংকোচে মেঝেতে এসে বসল। চঞ্চল দৃষ্টি দুটো এদিক ওদিক বার বা ছোটাছুটি করছে। সে হামলে পড়ল ভাতের উপর। গপগপ করে ভাত খেতে লাগল। খেতে দিয়ে গলায় আঁটকে গেল। লোকটা পানির গ্লাস রাখতেই অর্নিলা কেড়ে দিল। বিশ্রী শব্দে হাসতে লাগল। হাসিতে পুরো ঘর কেঁপে উঠছে। কিন্তু এই ভাত পেটে গিয়ে আর সইলো না। তিনদিনের পঁচা ভাত দেখে অর্নিলা হামলে পড়েছিলো, খেয়াল করেনি। যখন দেখল আর তর সয় না, গড়গড়িয়ে বমি করতে লাগল। ওই লোকটার যেন হাসতে হাসতে পেট ফেটে উপক্রম। একজন ভাত খেতে না পেয়ে বমি করে মরছে এতে তার কিছু যায় আসে না। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে। আজ অবধি কখনো ভাতের জন্য কষ্ট করেনি সে। এই কষ্টের ভয়া বহতা তার জানা নেই। রেগে গিয়ে লোকটার কলার চেপে ধরল অর্নিলা। দুজনের মধ্যে হাতা হাতি শুরু। কিন্তু দুর্বল শরীরে আর কতদূর। চিৎকার চেঁচামেচিতে আরেক লোক এসেও হাজির হলো। দুই হাতে টেনে ধরে অর্নিলাকে সরিয়ে আনল। অর্নিলাও দমে নেই। ইচ্ছে মতো খা মছে দিলো লোকটার মুখ জুড়ে। হিং স্র পশু র মত হয়ে উঠল লোকটা। রে গে এগিয়ে আসল অর্নিলার দিকে। সজোরে এক চ ড় পড়তেই অর্নিলা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। লা থি মা রতে যাচ্ছিল অমনি ঘরের মধ্যে ওস্তাদের প্রবেশ।

“কিরে ? তোরা কি করোস?”

“ওস্তাদ! দেহেন না, মাইয়াটা অনেক জ্বালা ইতাছে।

“দেহেন ওস্তাদ, আমার মুখে খামচি মাইরা হারা মজাদি কি করছে। ওরে তো…

“ওই থাম।”

“কন কি ওস্তাদ। আমি এখনো কই ওরে মা ইরা বস্তায় ভইরা খালে ফালাইয়া দিয়া আহি।

“কইসি না চুপ করতে। ওরে আবারো বাইন্ধা রাখ। খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ। পানিও দিবি না ওরে। বুঝছোস। দেহি শালি/র দে/মাগ কতোক্ষণ থাহে। কিরে, কি কইলাম?”
শাসিয়ে উঠে কাদের। গনি আর নুরু ধরে উঠিয়ে অর্নিলাকে আবারো চেয়ারে বেঁধে। রাগে কাঁপছে অর্নিলা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। ফারাজ ভাইয়ের মুখটা বার বার ভেসে উঠছে তার সামনে। কোথায় তিনি?
.
সারফারাজ শহরে এসে পৌঁছাল সকাল ৭ টার দিকে। ৮ টার দিকে সে তার এলাকায় হাজির। হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা ঘুরে দেখছে। অংক কষার চেষ্টা করছে। এই সময় দু একজন মুরব্বির সাথে দেখা হলো। কথাবার্তাও হলো খানিকটা। সারফারাজের জীবনে সবচেয়ে বড় এডভান্টেজ ছিলো তাকে দেখতে অনেকটা ইনোসেন্ট মনে মতো। এর সুযোগ সে কয়েকবার নিয়েছে। সবাই তাকে ভালো ছেলে ভাবার সুবাদে খাতির জমাতে সময় নেয় নি। কিন্তু এসব সে এভাবে এভাবেই করছে না। কারণ আছে, তাকে খোঁজ নিতে হবে। যেভাবেই হোক অনির খোঁজ নিতে হবে। যতটুকু পাওয়া সম্ভব এতে। এলাকার মোড়ে একটা চায়ের দোকানের দেখা মিলল। তাদের এলাকায় চায়ের দোকানের কমতি। সেখানে বসে পর পর দু’কাপ গরম গরম চা খেলো। টানা দুদিন পর তার পেটে কিছু তো পড়ল। খেয়াল হলো সবে, এই প্রথম বাড়ি গিয়ে না খেয়ে ফেরত এসেছে। মায়ের কথা দারুণ মনে পড়ছে। আরাফাত কে কল করে মায়ের কথা জেনে নিল। এখন খানিকটা সুস্থ আছে। বাবার সাথে আছে। মায়ের খবর জানার পরপরই ফারাজ ফোন কেটে দিল। সবাই তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। এই সান্ত্বনা তার চাই না। চাওয়ালা মামার সাথে খানিকক্ষণ কথা হলো। তবে লাভ হলো না কোন। তিনি নাকি কাউকেই দেখেনি। আশ্চর্য! ওতো গভীর রাত ও ছিলো না। এমন সন্ধ্যে বেলা একটা মেয়েকে কেউ তু/লে নিয়ে চলে গেল অথচ কারো চোখেই পড়ল না।

ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে আগাচ্ছে। আশপাশের ভবন গুলোতে দেখছে। এখানকার কিছু কিছু বাড়িতে সিসি টিভি ক্যামেরা লাগানো। কোনভাবে জোগাড় করা যেত? শূন্যে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভাবতে লাগল সারফারাজ। পরক্ষণেই মনে পড়ল বাবার কথা। বাবা বলেছে, তিনি ব্যাপারটা দেখছে। এতো তুচ্ছ বিষয়টা নিশ্চয়ই তার নজর এড়ায় নি। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল ১০ টা বাজতে চলল। এতোখানি সময় পেরিয়ে গেল অনিকে ছাড়া! ফোনের স্ক্রিনে অনির হাস্য উজ্জ্বল মুখখানি দেখে চোখে অশ্রু জমে উঠল সারফারাজের। চশমা খুলে রেখে হাতার জামা দিয়ে চোখ মুছে ফেলল। অতঃপর চশমাটা পড়ে দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগল সে।

ফ্লাটের সামনে এসে দাড়াতেই দেখল কমিশনার সালাউদ্দিন সাহেব দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। শুধু তাই নয়,‌তার সাথে আরো একজন আছে বৈকি। সারফারাজ চোখে মুখে ভাবান্তর নেই। ভাবটা এমন যেন এটা হবারই ছিলো। সালাউদ্দিন সাহেব দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন, “আরে ফারাজ সাহেব যে! আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। আসুন, এই তো বেরিয়ে যেতাম।”

নিরুত্তর ফারাজ এসে ঘরের দরজা খুলল। সালাউদ্দিন সাহেব বলতে লাগলেন, “দরজায় তালা দেওয়া দেখে ভাবলাম বোধহয় বউকে নিয়ে ঘুরতে গেছেন। তা আপনি একা নাকি? মিসেস অর্নিলা কোথায়?”

সারফারাজ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠল, “ভিতরে আসবেন?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই!”

দুজনেই ঘরে ঢুকলেন। চারদিক পরখ করলেন পুলিশি চোখে। হা হা পুলিশের চোখে ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না। সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে এসে বসল সোফাতে। তারা দুজনেও এসে বসল।

“তা‌ মিসেস অর্নিলার কথা কিন্তু এখনো বললেন না? আপনার মুখটা এমন করে কেন রেখেছেন? মনে হচ্ছে বউ ঝগড়া করে চলে গেছে।”

“সেটা হলেও আপনি অবাক হবেন বলে মনে হচ্ছে না!”

“হা হা! কি বলছেন মি ফারাজ সাহেব?

সারফারাজ চোখের চশমা খুলে সামনের টেবিলে রাখল। শান্ত দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো। অথচ তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে র/ক্ত ঝরে পড়ছে। শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল ,
“সালাউদ্দিন সাহেব, আমার বউ আমার সাথে ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। ঝগড়ার সূত্রপাত আপনি জানেন কিংবা বলা যায় সূত্রপাত আপনিই করিয়েছেন। এখন আপনি বলুন কি জানতে এসেছেন।”

সালাউদ্দিন সাহেব অবাক হলেন না। তার মুখের হাসি এখনো নিমিষ হয়নি। অথচ পাশের লোকের মুখ কালো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এভাবে পুলিশের সাথে কথা বলছে মনে হচ্ছে তাকে যেন নিরবে শাসিয়ে দিচ্ছে। সালাউদ্দিন সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, “খুব বেশি না, শুধু দুটো মাত্র কথা জানতে এসেছি।”

“বলুন!”

“যেদিন নিয়াজের এক্সি’ডে’ন্ট হয়েছিল সেদিন নিয়াজ আপনাদের বাসায় এসেছিলো। আপনি তা জানতেন?”

”না, আপনার মুখেই শুনলাম।”

“তবুও অবাক হলেন না?”

“অবাক হবার প্রশ্ন আসছে না। সে আমার আত্মীয়, আসতেই পারে।”

“তা পারে। তবে একবার নিয়াজ কে তার বাড়িতেই আপনি শা/সিয়ে এসেছিলেন। শুনলাম মে/রে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন।”

”দিয়েছিলাম। তবে মে/রে তো আর ফেলেনি।”

পাশে থাকা লোকটা হকচকিয়ে গেল। সালাউদ্দিন সাহেবের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।‌ সারফারাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,‌”আপনার প্রশ্ন শেষ হয়েছে। আপনি এবার আসতে পারেন।”

সালাউদ্দিন সাহেব হেসে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ”বুঝলেন ফারাজ সাহেব। আপনিও জানেন আমিও জানি, কিন্তু কোন প্রমাণ নেই। তাই আপনাকে ধরতে পারছি না। লুকোচুরি খেলাটা ভালোই জমছে।”

“বেশ তো, প্রমাণ খুঁজতে থাকুন। এবার আসুন।”

“লাস্ট প্রশ্ন, অর্নিলা ম্যাম কবে আসবেন?”

“ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। তবুও বলছি, তার রাগ কমে গেলে সে নিশ্চিত ফিরে আসবে।”
.

ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে ভিজে যাচ্ছে সারফারাজ। মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে। মনোযোগ দিয়ে ভাবছে, সেদিনকার কোন কথা বাদ পড়ছে না তো? কিছু হয়তো সে গুলিয়ে ফেলেছিলো? কি হতে পারে? অনি কোথা থেকে হারিয়ে গেল। এখান থেকেই নাকি দূরে কোথাও? চিন্তা করতে লাগল, প্রথম প্রথম অনির ফোন অন ছিলো। সে কল করছিলো, ফোন যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। তাহলে কি তখনই! রেগে গিয়ে দেয়ালে সজোর ঘুসি মার/ল‌ ফারাজ। কিন্তু কোন লাভ নেই এসবের। তবুও যেন রাগ কমছে না। হঠাৎ মনে হলো কলিং বেল বাজছে। এখন আবার কে এলো?

দরজা খুলে দাঁড়িয়ে খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল সে। ডাক্তার সাবিনা! ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ডাক্তার সাবিনা একগাল হেসে বললেন, “কি মিস্টার হ্যান্ডসাম! কেমন আছেন?”

“আপনি?”

“হুঁ, ভাবলাম আপনি অসুস্থ একটু দেখে যাই। এর মধ্যে শুনলাম, আপনার বউ নাকি ঝগ/ড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। একটা হেল্পিং হ্যান্ড তো দরকার। তাই চলে এলাম। কি দাড় করিয়ে রাখবেন নাকি ঘরের সামনে?”

সারফারাজ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। দরজা সরে দাঁড়াল। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত ৮ টা বাজে। এতো রাতে এই মহিলা তার বাড়িতে। কি চায় সে আসলে? স্থির দৃষ্টিতে পরখ করতে লাগলো সে। ডাক্তার সাবিনা ইয়াসমিন ভেতরে প্রবেশ করলেন। বেশভুষায় সবসময়ের মতোই। আজ তার পরনে বেগুনি রঙের শাড়ি। পরিপাটি সাজ! সারফারাজ মৃদুস্বরে শুধায়, “হাসপাতাল থেকে এলেন?”

“হ্যাঁ, সেখান দিয়েই!”

সারফারাজ মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ডাহা মিথ্যে কথা। সে এই মাত্র বাসা থেকে এসেছে তৈরি হয়ে। ব্যাপারটা ধরতে সময় লাগল না। ডাইনিং টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে সামনে এসে রাখল সে। ডা. সাবিনা পানির গ্লাস তুলে নিয়ে আড়চোখে ফিরলেন। বললেন, “শাওয়ার নিচ্ছিলেন নাকি?”

সারফারাজের বোধ হলো, সদ্য গোসল সেরে সে এসেছে। তার চুল গুলো এখনো ভিজে। সরাসরি ফিরে তাকাল ডা. সাবিনার চোখের দিকে। তাকেই তো দেখছে। বলিষ্ঠ দেহ, সুদর্শন পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে। পরনে অগোছালো একটা টি শার্ট। ইস্ত্রি করা হয়নি। সাথে কি বিচ্ছিরি রঙের একটা ট্রাউজার পরা। তবুও তাকে যেন বিশ্বের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ বলেই মনে হচ্ছে। হালকা কেশে উঠলেন ডা. সাবিনা।

“তা আপনার বউ কি এমনই নাকি? না মানে, অসুস্থ বর ফেলে চলে গেলো যে?“

“এগুলো আমার পার্সোনাল বিষয় ম্যাম।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ শিউর। আমি আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলব না। তা ডিনার না করে থাকলে চলুন, একসাথে কোথাও..

“দরকার নেই। আমি এখানেই ঠিক আছি।”

“আচ্ছা। তা আমায় ডিনারের জন্য সাধবেন না?”

নির্মল নয়নে সারফারাজ দেখে যাচ্ছে। এখানে তার আসার কারণ তার কাছে পরিষ্কার। সারফারাজ ফোন হাতে তুলে নিয়ে বলল, “বসুন। আমি খাবার অর্ডার করছি।”

সাবিনা আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, “না না, আপনি দেখছি সিরিয়াসলি নিয়ে নিলেন।”

“তাহলে আপনি ডিনার করতে আসেননি?”

”না, আমি তো আপনাকে দেখতে এসেছিলাম।”

“দেখা হয়েছে?”

আচমকা হেসে উঠলেন। পা বাড়িয়ে বললেন, ”মনে হচ্ছে আমায় তাড়াতে চাইছেন। কি চলছে আপনার মনে ডাক্তার শেহদাত!”

সারফারাজ নিরুত্তর। জবাব দিচ্ছে না। ডাক্তার সাবিনা ইয়াসমিন তার সামনেই দাঁড়ানো। ফারাজ নির্লিপ্ত নয়নে তাকে দেখছে। চুল থেকে পানি টপটপ করে ঘাড় বেয়ে নামছে। ডাক্তার সাবিনা তার হাত বাড়িয়ে চুল গুলো স্পর্শ করতে চাইলেন। সারফারাজ তার হাতটা আচমকা ধরে বলল, “থামুন ম্যাম!”

শিউরে উঠলেন ডাক্তার সাবিনা। আচমকা সারফারাজের স্প/র্শ পেয়ে হতভ/ম্ব তিনি। হতবু/দ্ধির মতো চেয়ে রইলেন।‌সারফারাজ হাতটা সরিয়ে বললেন, “আপনি যা চাইছেন তা কখনো সম্ভব না!”

”সম্ভব না হলে আমার হাত ছুঁয়ে দেখলে কোন বাহানায়?“

“আপনাকে ছোঁয়ার জন্য আমার বাহানার প্রয়োজন নেই। আমি বরাবরই স্পষ্টবাদী আপনি জানেন।”

ডাক্তার সাবিনা চোয়াল শক্ত করলেন। রা/গে তার মাথা ভনভন করছে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে চেয়ে রইলেন। অথচ সারফারাজের চোখে মুখে কোন ভাবান্তর নেই। আচমকা তিনি হেসে উঠলেন। শুধালেন, “আমায় রিজেক্ট করছো?”

”অবশ্যই! আমার জীবনে অনি ছাড়া আর কেউ নেই। আপনি আসতে পারেন।”

“তাড়িয়ে দিচ্ছেন?”

সারফারাজ আবারো নিরুত্তর। ডাক্তার সাবিনা মাথা দুলিয়ে বললেন, “হুম, ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন আমি কি চাই ডাক্তার শেহদাত! এতোই যখন বউয়ের প্রতি টান তবে অন্য নারীর প্রতি আকর্ষ/ণের কারণ কি?”

“আমি মোটেও আপনার প্রতি আকর্ষিত নই ম্যাম। ভুলটা আপনার। আমাকে বাইরে পাঠানোর জন্য আপনি এতো কেন আগ্রহ দেখাচ্ছেন তা আমি জানি। কিছু মাস পর আপনিও বাইরে চলে যাচ্ছেন। এর বাইরে অনেক খবরই আমার জানা। হ্যাঁ, এটা আমার জন্য এডভাইন্টেজ হতে পারে। আমার জন্য আপনি যা করেছেন যা করছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে আমার ভালবাসা শুধু একজনের জন্য। এর ভাগ আমি কাউকেই দিবো না।”

“আমি তো আপনার হৃদয়ের ভাগ চাইতে আসিনি ডাক্তার শেহদাত।”

“আমি তাঁকে ঠকাতে পারব না ডাক্তার সাবিনা!”
ডাক্তার সাবিনা হকচকিয়ে উঠলেন। এই প্রথম মনে হলো সে তার নাম ধরে ডাকল। মৃদু হেসে ব্যাগ কাঁধে নিলেন। অতঃপর বলে উঠলেন, ”হুমম, আইম ইমপ্রেস ডাক্তার শেহদাত!”

অতঃপর তিনি বেরিয়ে গেলেন। সারফারাজ শব্দ করে দম ফেলল। তার মনে হয়েছিল ডাক্তার সাবিনা কে সে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে। কিন্তু না, সে এখনো তাকে ঠিক করে বুঝে উঠতে পারে নি!

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-২৬+২৭

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৬

ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাসায় ফিরে এলো সারফারাজ। একটু একটু করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। হঠাৎ তাদের ফ্লাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। সদর দরজা খোলা! এর মানে কি? অর্নিলা ফিরে এসেছে! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ছুট দিলো ঘরের মধ্যে। সোফার মধ্যে অর্নিলা কে বসে থাকতে দেখে প্রায় বাকরুদ্ধ সে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। নিচু স্বরে তার নাম ধরে ডাক দিলো। সোফায় পা তুলে বসে ছিলো অর্নিলা। সবসময় এভাবেই বসে থাকে সে। নিজের নাম শুনে খানিকটা হকচকিয়ে গেল সে। ফিরে তাকাল এদিকে। সারফারাজ আবারো ছুটে গেল সে। দমকা হাওয়া ঢুকল তীব্র বেগে। পর্দার উল্টানোর শো শো শব্দে থমকে গেল ফারাজ। কে? কে এখানে? না! কেউ নেই তো! সে চলে গেছে। তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ভ্রম কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল তার। অতঃপর নিশ্চুপ সে। দেহ ছেড়ে দিল। ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ল সে। এক হাঁটুর উপর হাত ভর দিয়ে রইল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ করে এখন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। সারফারাজ মুখ খুলে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে অথচ বুকে ব্যাথা করছে। হাত দিয়ে বুকখানা চেপে ধরল। শ্বাস নিতে চাইছে নিতে পারছে না। শার্টের বোতাম খুলে ফেলল। বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মুখ খুলে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। লাভ হচ্ছে না। বেশি টেনশনের কারণে এমন লাগছে। সে কি হার্ট অ্যা’টাক করবে?ব্যাপারটা সেদিকেই আগাচ্ছে। ঝিম ঝিম করছে চারদিক। সারফারাজ চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করছে। ভারে চোখ মেলতে পারছে না। চারদিক কেমন ধোঁয়াশা। সবকিছু ঝাপসা লাগছে। একসময় চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। শূন্য বাড়িতে শূন্য হয়ে রইল সে। গত কয়েক ঘণ্টা তার জীবন যেভাবে দুর্বি/ষহ করে তুলছিলো তার ফলস্বরূপ কি এখানে এভাবেই সমাপ্ত হয়ে রইবে!
.
রাগের মাথায় বাসা থেকে বেরিয়ে গেল অর্নিলা। রাস্তার সামনে ফের ফিরে তাকাল বাসার দিকে। দু’চোখে অশ্রু টলমল। ঠোঁট কামড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে উঠল সে। ফারাজ ভাই কিভাবে পারল তার সাথে এমনটা করতে। কিভাবে? ভালোবেসে বুঝি এভাবে কষ্ট পেতে হয়? কষ্ট কি সে কম পেয়ে আসছিলো। এতোগুলো বছর ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে গেছিলো শুধুমাত্র তার ভালোবাসার জন্য। এখন এখানেও ছলনা! সহ্য না! না, এর চেয়েও যেন মৃ/ত্যু ভালো। কারো ধোঁকা তার কাছে সহ্য হয় না। কেন এতো পাষণ্ড সে?

মুখ ফুরিয়ে নিল। না বাসায় ফিরে যাবে না সে। তবে যাবে কোথায়? আছে তো শুধুমাত্র একটি জায়গা। মোহনগঞ্জ! চলে যাবে সেখানে? মন শক্ত করল। চোখের জল মুছে হাঁটা ধরল সামনের দিকে। তার মাথায় যেন ভূত চেপে বসে ছিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ রইল না এই ভূত। যাকে এতো ভালোবাসে তাকে ছেড়ে কিভাবে দূরে চলে যাবে সে। সম্ভব না! তার পক্ষে আদৌও এটা সম্ভব না। ফারাজ ভাইকে একা ছেড়ে সে কোথাও যেতে পারে না। রাস্তার মোড়ে এসে দাড়িয়ে ভাবছে। ফিরে যাবে? যাওয়াই উচিত। এর মধ্যে অনেকগুলো মিসকল এসে জমা হয়েছে ফোনেতে। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভেবে পা বাড়াল ওদিকে। হঠাৎ থেমে গেল। রাস্তা ওতো অন্ধকার নয়। মৃদু আলোতে কারো গাড়ি যেন দেখতে পাচ্ছে। কি মনে করে রাস্তা থেকে সরে আড়ালে দাঁড়াল। হুঁ, ঠিক ধরেছে। ফারাজ ভাইয়ের গাড়ি। কিন্তু যাচ্ছে কোথায়? তাকে খুঁজতে? বেশ, যাক না। সারা শহর আজ তন্নতন্ন করে খুঁজে আসুক। যখন ফিরে এসে দেখবে সে বাসাতেই আছে তখন ভালো হবে। এটাই হবে উপযুক্ত শা/স্তি। শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। মনস্থির করা হয়ে গেছে। বাসাতেই এবার ফিরবে সে। পা বাড়াল সামনের দিকে।
সরু গলি বেয়ে সে হাঁটছে। এই গলির মুখে মেইন রাস্তা। সেখান থেকে দু মিনিটের পথ বাসার। রাস্তায় জনমানব নেই। আছে বলতে অর্নিলা আর তার পিছন পিছন একটা কুকুরের বাচ্চা। একা হাঁটলে বোধহয় তার ভয় লাগত কিন্তু এখন আর লাগছে না। কুকুরের বাচ্চা টা একটু একটু হাঁটছে, আবার তাকে দেখছে, ঘেউ ঘেউ করছে। এমন রাগের মধ্যেও হাসি পাচ্ছে তার। কুকুরকে সে ভয় পায় না। হুট করে এই অনাকাঙ্ক্ষিত সঙ্গ তার ভালো লাগছে। গলির মোড়ে এসে দাঁড়াল। এদিক থেকে ডানে মোড় নিলো। বোধহয় মিনিটের মধ্যে অনেককিছু ঘটে গেল। একটা সিএনজি এসে দাঁড়াল তার সামনে। অর্নিলা প্রথমে সেভাবে খেয়াল করেনি। খেয়াল হতে হতে দেরি হয়ে গেছে বেশ। কেউ একজন তার মুখে রুমাল চাপা দিতেই অচেতন হয়ে গেল সে। আরেকজন এলো। দুজন এসে তুলে ধরে তাকে সিএনজিতে বসাল। সামনের ড্রাইভার ফিসফিসিয়ে বলতাছে, ”তাড়াতাড়ি, কর শা লা। কেউ দেইখা ফেলব। তাড়াতাড়ি!”
কুকুরের বাচ্চা এবার জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কিন্তু সে ছোট বলে তেমন পাত্তা পেলো না। তাও লাল রঙের শার্ট পরে থাকা লোকটা তাকে লাথি মেরে বলল, “চুপ কর কু/ত্তার বাচ্চা!” সে তবুও চুপ যায়নি। এতো তার কণ্ঠ শক্ত। তীব্র বেগে প্রতিবাদ করছে। কিন্তু নিরীহ এই প্রাণীর ভাষা বুঝল আর কয়জন? সিএনজি এবার দ্রুত গতিতে চলছে। কুকুরের বাচ্চাটা তার পিছন পিছন ছুটছে। কালো রঙের কুকুরের বাচ্চাটা অন্ধকারের মধ্যে নিমিষেই হারিয়ে গেল। অচেনা এই সঙ্গীর জন্য তার মনে ভীষণ মায়া!
.
সিএনজির মধ্যে তিন লোকের কথোপকথন। লাল রঙের শার্ট পরা লোকটা অর্নিলা কে ধরে নিয়ে বসে আছে। অন্য জন তার মুখে কস্টেপ দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ভালোই পেশাদার। হাত গুলোও বেঁধে নিল খুব জলদি। চলন্ত সিএনজি। সামনের লোকটা বলল, “কিরে? তাড়াতাড়ি কর।

“এই সবসময় তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর কইবি না একদম। করতাছি দেখোস না।

সামনের জন্য নিরুত্তর। লাল রঙের শার্ট পড়া লোকটা দাঁত বের করে হাসল। বিশ্রী হাসির শব্দ।
“নুরু দেখলি আমাগো ভাগ্যটা। মেঘ না চাইতেই জল হাজির। দূর থেকেই কইতাছিলাম এইটাই আরিফ হাসানের পোলার বউ। দেখছোস!”

নুরু হেসে কইলো, ”এইবার আরিফ হাসান বুঝবো মজা। হা/লায় বেশি বিচারগিরি দেখাইতে গেছিলো না। এখন আমরা দেখামু বিচার। এই মাইয়ার এমন বিচার করমু সারাজীবন মনে রাখব!”
শব্দ করে হেসে উঠলো নুরু। সামনের কাদের ধমকে উঠল। “ওই, চুপ কর তোরা। মাইয়ার ফোন নিছোস।”

“হ, ফোন আইতাছে বার বার। কি করমু?”

“বন্ধ কইরা দে।”

”না না, নুরু। বাইরে দিয়া ফোনটা ফালাইয়া দে। এই ফোন দিয়া নইলে পুলিশ আমাগোরে ধরব।”

কাদের হঠাৎ করে সিএনজি থামিয়ে দিলো। নির্জন জায়গায় সিএনজি থামতে দেখে নুরু নেমে পড়ল। বাইরে এসেই সিগারেট ধরাল সে। কাদের তার বাটন ফোনটা বের করে নাম্বার ডায়াল করল। নিঃসন্দেহে ফোনটা গেল আরিফ হাসানের কাছে। বেশিক্ষণ না, শুধুমাত্র ৩৯ সেকেন্ডের কথাবার্তা। এরপরেই ফোন কেটে বন্ধ করে দিলো সে। নুরু হাতের সিগারেট তার দিকে বাড়িয়ে দিল। গণি মিয়া বাইরে এসে পরনের প্যান্টটা ঠিক করতাছে। আজ সে এই নতুন প্যান্ট আর লাল রঙের শার্ট পড়েছে। নতুন নতুন জামাকাপড় পরলেই তার মন খুশি হয়ে যায়। আবারো দাঁত বের করে বিশ্রীভাবে হেসে বলল,‌ “কাজ সাইরা আসি!”

বলেই ভেতরের দিকে গেল। কাদের কপাল কুঁচকে সিএনজির ভিতরে তাকিয়ে রইল। শুকনা চিকন চাকন মাইয়াটা। এই নাকি আরিফ হাসানের পোলার বউ। আবার তার বোনের মাইয়া। সম্পর্ক ভালো, একটা টান তো আছেই। নুরু হঠাৎ শুধায়, ”ওস্তাদ, কি করবেন? মাই/রা বস্তায় ঢুকাইয়া ফালাইয়া দিমু। ঢাকা শহরে কিন্তু খালের অভাব নাই। সব গুলাই ময়লা। একটাতে ফেললেই হইলো।”
“পরে দেখা যাইবো। এখন গ্যারেজে চল! এই গণি, আয়!”

গণি হাসতে হাসতে এসে দাঁড়াল। বার বার তার নতুন শার্ট আর প্যান্টের দিকে চাইছে। খুশিতে সে আটখানা।
.
ভোরের আলো তখনো ফুটেনি। ধীরে ধীরে সে চোখ মেলছে। মাথা ভার হয়ে আছে। সাথে তীব্র যন্ত্রণা! বড্ড ক্লান্ত শরীর। কোথায় আছে? কিভাবে আছে? বুঝতে পারছে না। হঠাৎ চোখের সামনে অদ্ভুত ভয়ং/কর এক মুখ থেকেই চিৎকার করার চেষ্টা করল। পরক্ষণেই বুঝতে পারল তার মুখ বাঁ/ধা। শুধু তাই না, হাত ও বাঁ/ধা। ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ভয়ং/কর দেখতে লোকটা বিশ্রী রকম হাসছে। জোরে হাঁক দিলো, “ওস্তাদ, মাইয়া চোখ খুলছে!”
অর্নিলা অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ফিরছে। পাগলের মতো করছে। নিজেকেই ছোটানোর চেষ্টা করছে। এরমধ্যে দেখল গ্যাঞ্জি আর লুঙ্গি পরা এক লোক মুখে ব্রাশ নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। অর্নিলা বিমূঢ়! লোকটা দাঁত ব্রাশ করে থু থু ফেলে আবারো ব্রাশ করতে করতে বেরিয়ে গেল। হতবুদ্ধির মতো কেটে গেল কিছুক্ষণ। ব্যাপারটা খুব জল ঘোলাটে। এখনো পরিষ্কার নয়। সে কি তবে কিডন্যাপ হয়েছে। কখন? রাতে! এখন তার কি হবে? শুকনো ঢোক গিলল সে। শো শো শব্দ করছে কিন্তু কথা বেরুচ্ছে না মুখ দিয়ে। ভয়ং/কর দেখতে লোকটা হঠাৎ তার মুখ তার সামনে নিয়ে এলো। ভয়ে আঁ/তকে উঠল অর্নিলা। চোখ খিচে বন্ধ করে নিল সে। সে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। অর্নিলা চোখ মেলে আশপাশ দেখছে। কোথায় সে? আছে কোথায়? ফারাজ ভাইয়ের থেকে কতো দূরে সে? ফারাজ ভাই কোথায়? কেমন আছে? সে কি জানে অনির খোঁজ? চিন্তায় পাগল হয়ে যাবার উপদ্রব। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে গা কাঁটা দিয়ে উঠল অর্নিলার। সে সামনে ফিরল। এ তো নতুন লোক। অর্নিলা নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে!

#চলবে….

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৭

অর্নিলা মুখ বাঁধা। শত চেষ্টা করেও চোখের কাপড়টা খুলতে পারছে না।‌ অস্থির হয়ে উঠল সে। চেয়ারে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে তাকে। সেখান থেকে ছুটবার জন্য পাগলের মতো করছে। কিন্তু কোন লাভ নেই। অন্ধকার থেকে একটা হাত বাড়িয়ে আসছে তার দিকে। অর্নিলা তা জানে না। কে জানে হাতটা এসে কোথায় গিয়ে ঠেকবে। কিভাবে ছুঁয়ে দেখবে তাকে? চারদিকে স্তব্ধ নিরবতার মাঝে অর্নিলা উম উম করা শব্দ। হাতটা এসে চোখের বাঁধন খুলে দিলো। অর্নিলা আঁতকে উঠে চেয়ে রইল। গলা টিপে ধরল আচমকা। অর্নিলা চোখ মুখ সব শক্ত করে আসছে। চোখে রক্ত জমে উঠছে। ধপ করে বিছানা ছেড়ে উঠে গেল সারফারাজ। অস্থির হয়ে আশপাশ দেখতে লাগল। খুব বাজে স্বপ্ন ছিলো। ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ বোধ হলো সে বিছানায় কি করছে? বেডরুমে তো ছিলো না। দরজায় এসে করাঘাত করল কেউ। সারফারাজ চমকে ফিরে তাকাল। ওহ, ফরহাত! পিছনে এসে দাঁড়াল আরাফাতও। ফরহাত গ্লাসে পানি ঢেলে হাতে ধরিয়ে দিল।

“এসে তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। এভাবে মরা/র মতো পড়ে ছিলো মনে করেছিলাম সত্যি সত্যি ম/রে গেছিস। কি করছিস তুই?”

“অনির খোঁজ পাওয়া গেছে?”

আরাফাত দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “এখনো না। খোঁজ চলছে।”

“ খোঁজ চলছে? আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়া হলো আমি টের ও পেলাম না। আমার মনে একবারও আসলো না। বাবা বার বার বলেছিলো ওর দিকে নজর রাখতে। এর পরেও আমি কিছু করতে পারলাম না। সব ফেলনা হয়ে গেল!”

“তোর কোন দোষ নেই সারফারাজ। একটু রেস্ট নে। তোকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে!”

”না রেস্ট নিলে না। আমি মোহনগঞ্জ যাবো। বাবার সাথে কথা বলব।”

আরাফাত নিচু স্বরে বলল, ”একবার পুলিশকে জানালে হতো না?”

“বাবা বলেছে?”

“না।”

“তাহলে থাক।”

সারফারাজ বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। তিন জনই সকালের মধ্যে মোহনগঞ্জ যাবার জন্য রওনা দিলো। পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা। অন্ধকার প্রহরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার পুরো বাড়ি আজ স্তব্ধ। দরজা এসে খুলে দিল সিধু। ঘরে ঢুকে দেখল অনির বড় চাচী বসার ঘরে পায়চারি করছেন। সারফারাজ কে দেখতে পেয়েই তিনি ছুটে এলেন।

“অনি, অনির খোঁজ পেয়েছো?”

সারফারাজ নিরুত্তর। তার চোখ মুখ বলে দিচ্ছে কোন কিছু এখন অবধি তিনি জানতে পারেনি। ছোট চাচী সোফায় বসে হাহাকার করতে লাগলেন। কাঁদতে শুরু করলেন। তার স্বভাবই হচ্ছে কিছু থেকে কিছু হলে কান্নাকাটি করা। ছোট চাচা অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, “তোমার বাবাকে এতো করে বললাম, পুলিশ/কে জানাতে কিন্তু কোন ভাবান্তর দেখছি না। তুমি একবার গিয়ে বুঝাও তাকে।”

সারফারাজ মাথা দুলালো। আরাফাত শুধালো, “মা কোথায়?”

“শুয়ে আছে। প্রেসার লো। দাঁড়াতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার এসে দেখে গেছে!”

আরাফাত মায়ের ঘরের দিকে আগালো। সারফারাজ গেলো বাবার স্টাডি রুমে। বাবার সাথে তার বোঝাপড়া আছে। সামনাসামনি কথা বলতে হবে। ফরহাত পিছন পিছন এগিয়ে আসলো। দুজন একসাথেই স্টাডি ঘরে ঢুকল। আরিফ হাসান চেয়ারে বসে সিগারেট টান ছিলেন। পুরো ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। আরিফ হাসান সচরাচর এতো ধূমপান করেন না। তার চিন্তিত রূপ দেখে সারফারাজ ঘাবড়ে গেল। বরাবর বাবাকে অনেক কঠিন সময়ে শান্ত দেখেছে। সেই মানুষটার এমন হাল হয়ে থাকলে বুঝতেই হবে পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাচ্ছে। আরিফ হাসান ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আর্ধেক সিগারেট টা এস্ট্রেতে ফেলে বললেন,

“এসো গেছো?”

সারফারাজ পাল্টা প্রশ্ন করল, ”অনির খোঁজ পেয়েছো?”

“না , খোঁজ চলছে। অনি ঢাকায়ই আছে।”

“তা আমিও জানি।”

কপাল কুঁচকে আরিফ হাসান শুধায়,
“তাহলে তুমি এখানে কি করতে এসেছো?”

“আমি জানতে চাই কি হয়েছে। যারা অনিকে নিয়ে গেছে তাদের নিশ্চিত তুমি চিনো। নাহলে তারা আমায় ফোন না করে তোমাকে কেন করবে?”

ফরহাত মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, কথাটা আমার মাথায় ও ঘুরছে। মনে হচ্ছে আপনার শ ত্রু চাচা!”

আরিফ হাসান তুচ্ছ স্বরে বললেন, “শত্রু! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেয়ে গেল তাকে। নিচু স্বরে বলতে লাগলেন, “অন্যা/কি য়ের সাথে কখনো আপোষ করেনি। আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ কেটেছে বিচারপতির দায়িত্ব পালন করে। আমি জানি কে আর কারা কাজটা করেছে। আমিও তাদের খোঁজ চালাচ্ছি।

“পুলিশ কে জানালে ভালো হতো না।”

“না। হিতে বিপরীত হতো। ওদের কোন বড় দল নেই। তিনজনের দল। কাদের, গনি আর নুরু। কাদের হচ্ছে দলের লিডার। এরা তিনজনই একসাথে কাজ করে। কাজ হচ্ছে বড় দলের কাছে লোক পা চার। ভিকটিম কে কিছু করে না। কিন্তু একবার একজনকে কিডন্যাপ করার পর পুলিশ কোনভাবে তাদের ট্রেস করে ফেলে। তাই রেগে সেই ভিকটিম কে তারা মে/রে ফেলার চেষ্টা করে। যদিও ভিকটিম শেষমেষ বেঁচে যায়। এসব অনেক বছর আগের কথা। তখন আমি বিচারপতির দায়িত্বে ছিলাম। তাই ক্ষো/প বসত এখন আমার পিছনে লেগেছে।”

সারফারাজ চোয়াল শক্ত করল। ফরহাত হত’ভম্ব গলায় বলল, “এই কারণেই আপনি পুলিশ কে কথাটা জানাতে দিচ্ছেন না চাচা।”

“না, কিন্তু পুলিশ যে একদমই জানে না তা না। আমার এক পরিচিত ব্যাপারটা দেখছে তবে গোপনে। তিনজনের এই দলে কাদের খুব চালাক। বুদ্ধির জোরে ওর সাথে পাল্লা দেওয়া সহজ বলে মনে হয় না।“

সারফারাজ কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, ”চায় কি ওরা?”

“টাকা চায় আর কিই বা চাইবে। টাকার জন্য সব করতে পারে। আমি ওদের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি। ফোন করে টাকা চাইলেই আমি দিয়ে দিবো।“

ফরহাত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠল, “টাকা পেলেই কি অনি কে দিয়ে দিবে? যদি কোন ক্ষ তি করে?”

আরিফ হাসান সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে শান্ত স্বরে জবাব দিলেন, “অনি এখন ওদের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তার কিছু করবে না। টাকা পেলেই অনিকে দিয়ে দিবে। কারণ একবার জে ল খাটা আসামী দ্বিতীয় বার জে লে যেতে চাইবে না। আর কাদের কে আমি ভালো ভাবেই চিনেছি। ওর বুদ্ধি বেশ তবে তার সাথে সুবিধাবাদী। নিজের ক্ষতি হবে এমন কিছু করবে না। ওর একটাই চাওয়া আমায় হে নস্তা করা।”

“তাহলে আমাদের এখন কি করতে হবে?”

“অপেক্ষা। তবে বেশিক্ষণ না। ওরা ফোন করার সাথে সাথেই আমি তোমাকে জানাব। আপাতত তুমি এখন ঢাকায় ফিরে যাও। ফরহাত,‌ ওর সাথে তুমিও যাও।”

“জি চাচা!“

সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ফরহাত গেলো তার পিছু পিছু। সারফারাজ এসে দাঁড়াল মায়ের ঘরের কাছে। আরাফাত খাটের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। মা ঘুমাচ্ছে। সারফারাজ আর সেখানে গেলো না। বেরিয়ে এলো। তার পাশে পাশে হাঁটছে ফরহাত। ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হুম।” নিচুস্বরে কথাটা বলে কিছু একটা ভাবতে লাগল সারফারাজ। হঠাৎ এর মধ্যে তার ফোনটা বেজে উঠলো। ডাক্তার সাবিনার ফোন। এতো কিছুর মধ্যে হাসপাতালের কথা এক প্রকার ভুলেই গেছিলো সে। ফোন রিসিভ করে নিল।

“ডাক্তার শেহদাত!”

“জি বলুন।”

“কি ব্যাপার বলুন তো? কোন কথাবার্তা ছাড়াই আপনি হুট করে হাসপাতালে আসা বন্ধ করে দেন। কারণ কি?”

“সরি ম্যাম। আমি একটু অসুস্থ। পরশু দিন থেকে হাসপাতালে যাবো।”

ডাক্তার সাবিনা এবার একটু শান্ত হলেন। ডাক্তার শেহদাতের কণ্ঠস্বর শুনেই তাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। অতঃপর মৃদু স্বরে শুধালো, “সব ঠিক আছে ডাক্তার শেহদাত?”

“জি‌। সব ঠিক আছে।”

“হাসপাতালে আজ পুলিশ এসেছো। আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করল আমাকে।”

“ওহ!“

“ওহ বললেন? আপনাকে অনেকটাই শান্ত মনে হচ্ছে। পুলিশের কথা শুনে আপনি একটুও ঘাবড়ে যান নি দেখছি।”

”ঘাবড়ানোর কিছু তো নেই। আমি তো কিছু করিনি। তারা তাদের কাজ করছে আর আমি আমার।”

“হুম। ভেরি গুড ডাক্তার শেহদাত। আইম ইমপ্রেস। যাই হোক, আপনার বউকে বললেন আপনার যত্ন বেশি নিতে। যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেন। রাখি।”

সারফারাজ জবাব দিল না। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার সাবিনা ফোন কেটে দিলো। তাদের চোখে মুখে এবার চিন্তার দাগ ফুটে উঠল। পুলিশ হঠাৎ হাসপাতালে গেলো কি কারণে? কি ঘটছে তার চারপাশে? সারফারাজ আর ভাবতে পারছে না। তার মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। বুকের ব্যাথাটা আবারো জাগান দিচ্ছে। অনিকে ভীষণ মনে হচ্ছে। কে জানে কেমন আছে ও? ফরহাত তার দিকে আশ্চর্য জনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শুধালো, “পরশু দিন থেকে তুই হাসপাতালে যাবি? সিরিয়াসলি ফারাজ! কিরে? তোর কি আবার শরীর খারাপ লাগছে? দেখি!

”আমি ঠিক আছে ফরহাত। তুই বাসায় ফিরে যা। আমি একাই ঢাকায় ফিরব।”

“কেন? আমি তো..

“প্লিজ ফরহাত। বললাম তো আমি পারব।‌ আমায় একা থাকতে দে‌।
ফরহাত দাঁড়িয়ে রইল। সারফারাজ একা একাই ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

#চলবে….

চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-২৪+২৫

0

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৪

ঘুমের ঘোরে ফোন রিসিভ করে সারফারাজ বলে উঠল, “হ্যালো।“

“ফারাজ , আমি বলছি।”

“কে আমি?”

“ফরহাত।

“কি হইছে?”

“অনেক বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেছে।”

“কি কাণ্ড।”

ফরহাতের এলোমেলো স্বর। সারফারাজের ঘুম তখনো পুরোপুরি ভাঙেনি। ফরহাত আমতা আমতা স্বরে বলল, ”একটা কাণ্ড ঘটিয়েছি। আমি আর নাজিয়া বিয়ে করে ফেলেছি।”

“ওহ, কনগ্রেচুলেশন!”
বলেই ধপ করে ফোন কেটে দিল সারফারাজ। আবারো তলিয়ে গেলো ঘুমে। ফোন বেজে উঠল আবারো। রিসিভ করে বলল, “কে?”

“আমি!

”আমি কে?”

“শা লা আমি ফরহাত।”

”কি হইছে? তোকে তো কনগ্রেস করলাম। আবার কেন ফোন দিছিস?”

“পুরো কথা না শুনে ফোন কেটে দিলি কেন? ভালো করে শোন। আমি আর নাজিয়া বিয়ে করেছি।

“শুভকাজ সম্পন্ন করিয়াছেন।”

”পালিয়ে করেছি।”

“আচ্ছা!” কথাটা নিজেই বলার পর চোখ মেলে তাকাল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল। না সে স্বপ্ন দেখছে না। তার বুকের মধ্যে অর্নিলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ফোনের আলোয় তার মুখশ্রীর দেখা মিলছে। সারফারাজ ফোন আবারো কানে রেখে ধীরে স্বরে বলল, “সাব্বাস। খুব ভালো কাজ করেছিস। ট্রিট কবে পাবো?”

“শা লা আমি এখানে পড়েছি বি পদে তুই মজা নিচ্ছিস। জলদি উপায় বল। কি করবো?”

“এখন কি করছিস?”

“মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। নাজিয়া গাড়ির ভিতরে।”

“এই মাঝরাতে তোদের বিয়ে পড়ালো কে?”

”আগেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম।

”বেদ্দ্যব , শা লা খ চ্চর পাবলিক। আগের থেকে বিয়ের প্ল্যান করে রাখলি আর বিয়ের পর কি করবি সেই প্ল্যান করার জন্য আমায় ফোন করলি? মিষ্টি খাওয়ার জন্যও না!”

কথাগুলো বলেই মুখ বন্ধ করে ফেলল। অর্নিলা নড়েচড়ে উঠছে। এই না আবার জেগে যায়। সারফারাজ মুখ ওদিক ফিরিয়ে বলল, ”এখন কি চাই?”

”কি করব সেটা বল! নাজিয়ার ফ্যামিলি বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো। দিনের বেলা ঘর থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দিছে। তাই রাতের বেলা ওকে নিয়ে পালিয়েছি।

“দূরে পালানোর কোন দরকার নাই। ঘরের মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও ঘরে চলে যা। সিঙ্গেলের মতোই থাক আমি সকালে দেখছি।”

“আচ্ছা!”

“এতো খুশি হবার কিছু নাই। কিন্তু আমায় একটা কথা বল, তোর মতো একটা জো চ্চর বিয়ে করলি কি করে? হঠাৎ এতো ভালোবাসা তোর নাজিয়ার জন্য।‌ আশ্চর্য!”

ফরহাত কথা শুনেও জবাব দিলো না। ধপ করে ফোন কেটে দিল। শা লা আসলেই জো চ্চর। ফোনের স্ক্রিনে দেখল ৩ টা বাজে। ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখে এদিক ফিরে অর্নিলাকে জড়িয়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়ল সে।
.
পরদিন সারফারাজ সমস্ত কথা জানালো আরিফ হাসান কে। ব্যাপারটা এখন সে সামলে নিবে। ফরহাত আর নাজিয়ার এমন ঘটনা শোনার পরেও আরিফ হাসানের কথা বার্তায় কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। তিনি আগের মতোই গম্ভীর স্বরে কথা বলছেন। সারফারাজ কিছুটা আঁচ করতে পেরে শান্ত কণ্ঠে শুধালো, ”কিছু হয়েছে আব্বা?”

“না কি হবে? অনি মা কেমন আছে?”

”ভালো আছে। ফোন করে কথা বলে নাও। তোমার শরীর ভালো তো। পেশার মাপিয়েছো। দেখি আম্মা কে দাও, কথা বলব।”

তীব্র কণ্ঠে আরিফ হাসান বলে উঠলেন, “বললাম তো ভালো আছি।” সে নিশ্চুপ। অতঃপর মৃদু কণ্ঠে ফের বলে উঠলেন, ”অনি মায়ের দিকে একটু নজর রেখো। একা একা কোথাও বের হতে দিও না। বুঝলে?”

”জি আব্বা।”

“হুম। তোমার মা বাড়িতে নেই। শিকদার বাড়িতে গেছেন। নিয়াজ কে দেখতে। ওর করুণ অবস্থা দেখে আমি শিহরিত। রাস্তা ঘাটে সাবধানে চলাফেরা করো সারফারাজ। আর অনির দিকেও নজর রেখো। আমি রাখছি। আছো কোথায়?”

“মেডিকেলে।”

“ঠিক আছে। মন দিয়ে কাজ করো। শুনলাম তুমি নাকি ভিসার জন্য এপ্লাই করেছো।”

ওপাশ থেকে সারফারাজ নিরুত্তর। আরিফ হাসান ফের গম্ভীর মেজাজে ফিরে গেছেন। শান্ত অথচ তীব্র কণ্ঠে বললেন, “আমি চাই না তুমি অনি কে ফের একা ফেলে চলে যাও। কিন্তু তোমার দিকটাও আমি ভুলতে পারছি না। আমি বাবা সারফারাজ। স্বার্থপর হতে পারিনা। তোমার একটা ভালো ক্যারিয়ার হোক সেটা আমিও চাই। কিন্তু অনি মা কষ্টে থাকবে সেটাও দেখতে পারব না। অনির সাথে কথা বলেছো?”

“এখনো না।”

“তবে বলে ফেলো। সবটা জানাও। আবারো ভাবো। ভেবে চিন্তে দেখো কি করবে? আমি রাখছি।

“আচ্ছা।”

“হ্যাঁ, অনির দিকে নজর রেখো। বিশেষ ভাবে তাকে বাইরে একা বেরুতে দিও না বুঝেছো।

“বুঝেছি।”

আরিফ হাসান ফোন কেটে টেবিলের উপর রাখলেন। চোখ বন্ধ করে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। কিছু ভাবছেন খুব মনোযোগ দিয়ে। কোন বিপদের আঁচ করতে পারছেন। বিপদ খুব সাং ঘাতিক! ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছেন তবে এখনো ঠান্ডা মাথায় ভাবছেন কি করবেন।
.
অর্নিলা সবে ভার্সিটি থেকে ফিরে ঘরে ঢুকল। টানা বেশ কয়েকদিন ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ভাগ্যিস বৃষ্টির আগেই বাসায় ঢুকে পড়ল। অসময়ে বৃষ্টি মন ভালো করে দেয়। অর্নিলা পরনের জামা ছেড়ে নিলো। ফ্রেস হয়ে এসে দাঁড়াল বসার ঘরে। তার ঘরটা কেমন একটু উল্টো ধরণের। দক্ষিণ দিক হচ্ছে বসার ঘরের দিকে। বিশাল বড় এক জানালা। বাইরে বৃষ্টির তেজ না থাকলেও হাওয়ার বেগ ভালোই বইছে। দমকা হাওয়ায় হালকা হলদে রঙের পর্দা শূন্যে দোল খাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়া এসে লাগল অনির গায়ে। কাঁপুনি উঠে গেল তার। একটু ঘোরের মধ্যেই ছিলো সে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এখন আবার কে হলো? খানিকক্ষণ আগেই তো ফারাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে। তার আসতে নাকি ঢের দেরি হবে। তবে?

দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি মারল প্রথমে। চেনা মুখখানি দেখে খানিকটা গম্ভীরতা এসে ঠেকল কপালের আনাচে কানাচে। কমিশনার সালাউদ্দিন সাহেব! আশ্চর্য! তিনি তাদের বাসার ঠিকানা জানলো কি করে? যদিও পুলিশের পক্ষে কিছুই অসম্ভব না যদি তারা ঠিক করে কাজ করে তখন। সাথে আরেকজনকেও দেখা যাচ্ছে। দুজনেই নরমাল গেটাপে। অর্নিলা দরজা পুরোপুরি ভাবে খুলে লম্বা করে সালাম দিলো।

“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার!”

কমিশনার সাহেব মৃদু হেসে জবাব দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম ম্যাম। ভালো আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা? হঠাৎ আমার বাসায়।”

”হ্যাঁ, এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি ভাবলাম আপনার এখানে একটু চা ই খেয়ে যাই।”

“অবশ্যই, আসুন। ভেতরে আসুন।”

দুজনেই ঘরে ঢুকছিলো। অর্নিলার খোঁচা মারার স্বভাব দীর্ঘকালের। এবারও সেটা হাতছাড়া করল না। বলেই ফেলল, ”তা আমাদের ওপর বোধহয় গোয়ান্দা লাগিয়েছেন। না মানে? বাসা চেনার তো কথা না!”

সালাউদ্দিন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, “ঠিকানা তো ছিলো আমাদের কাছে ম্যাম।”

অর্নিলা মুচকি হাসল। জবাব দিলো না। তার বেশ মনে আছে, বলার সময় ঠিকানায় সে ভুল রাস্তা বলেছিলো। উত্তেজনায় বলেছিলো, ইচ্ছে করে না। পরিস্থিতি টাই এমন ছিলো। তাদের বসার ঘরে বসতে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গিয়ে চুলোয় চায়ের পানি বসাল। বোয়াম থেকে বিস্কুট বের করতে গিয়ে উঁকি মারল বসার ঘরের। হুম, ঠিক ধরছে। একজন বসে আছে আর সালাউদ্দিন সাহেব ঘরে হেঁটে হেঁটে দেখছেন। কি জানে কি খুঁজছেন?

সালাউদ্দিন সাহেব চা খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ! তার সাথের জন চুপচাপ চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছেন। সালাউদ্দিন সাহেব বলতে শুরু করলেন, ”আপনার হাসবেন্ড কি এখনো মেডিকেলে?”

“জি!

“আসে কখন? মানে নির্ধারিত কোন সময়?”

“সন্ধ্যার পর পরই বাড়ি ফিরে আসেন। কেন বলুন তো?”

”না তাহলে আপনি বলছেন সেদিন নিয়াজের সাথে আপনার হাসবেন্ডের দেখা হয়নি। কারণ নিয়াজ তো প্রায় বিকেলের দিকেই এসেছিলো তাই না মিসেস অর্নিলা?”

অর্নিলা চোখ মুখ শক্ত করে ফেলল। সালাউদ্দিন সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন, ”শান্ত হন মিসেস অর্নিলা। আমি তো শুধু বললাম জিজ্ঞেস করিনি। কিছুদিন আগেই তো মোহনগঞ্জ যাওয়া হলো। সেখানেই সব শুনলাম।”

অর্নিলা চোখে মুখে কোমলতা ফিরতে শুরু করল। কিঞ্চিত হেসে বলল, ”হ্যাঁ, সে এসেছিলো। কিন্তু তার সাথে ফারাজ ভাইয়ের কোন দেখা হয়নি?”

“ফারাজ ভাই? ওহ হ্যাঁ, সারফারাজ শেহদাত তো আপনার মামাতো ভাই হয়। তা এখনো ভাই বলে ডাকেন দেখছি?”

”যেটা বলে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি সেটাই।”

”হুম, আপনাদের পার্সোনাল বিষয়। ওসব জানতে চাইবো না।” বলেই চায়ের কাপে চুমুক দিলো। অতঃপর ঠান্ডা গলায় বলল, “মোহনগঞ্জ থেকে অনেক কথাই জানতে পেরেছি। এই যেমন আপনার চাচাতো ভাই, মানে নিয়াজ আপনাকে একবার রে প করার চেষ্টা করেছিলো? কথাটা কি সত্য মিসেস অর্নিলা? আপনার হাসবেন্ড অবশ্যই অবগত এই ব্যাপারে। এর পরেও এমন একটা লোককে আপনার স্বামীর অজান্তে, তার অনুপস্থিতিতে নিজের বাসায় ঢুকতে দেবার কারণ কি হতে পারে মিসেস অর্নিলা?”

অর্নিলার নির্লিপ্ত চাহনি। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি। তার শুষ্ক রুক্ষ মুখের কোন ভাবের ছায়া নেই। কি ভাবছে? মস্তিষ্কে কি বিরাজমান তা টের পাবার কোন অবকাশ নেই। তবুও সালাউদ্দিন সাহেব অর্নিলার ভাব দেখার জন্য চির আগ্রহে বসে আছে। তার ধারণা, না না আত্মবিশ্বাস, সম’স্যা এই পরিবারের মধ্যেই আছে। খু’নি এখানেই। অর্নিলা এখনো ভাবছে। শুকনো ঢোক গিলছে। শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে খুব স্বাভাবিক ভাবে। হঠাৎ কাশির শব্দে চমকে উঠল। দাঁড়িয়ে উঠে বলল,‌ “আমি‌ পানি নিয়ে আসছি!”
সালাউদ্দিন সাহেব শান্ত কণ্ঠে বললেন, “সাথে উওর নিয়ে আসবেন!” অর্নিলার বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। আশ্চর্য! কথাগুলো তার কাছে বড্ড ক ঠোর শুধালো।

#চলবে….

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৫

অর্নিলা পানির গ্লাস এনে রাখল সামনে। পাশের অজ্ঞাত ব্যক্তি ঢকঢক করে পানি খেল। সালাউদ্দিন সাহেব শান্ত শীতল দৃষ্টি রেখে শুধালেন, “উত্তর কি তৈরি মিসেস অর্নিলা?”

অর্নিলা কিঞ্চিত হাসল। তাকে এখন আগের থেকে অনেকটা শান্ত দেখতে লাগছে। শান্তশিষ্ট ভাবে সোফায় বসে কোমল কণ্ঠে বলল, “উত্তর আলাদা করে আর কি হতে পারে? সে তো তার বোনের বাড়িতে আসতেই পারে তাই না। নাকি সেটাও বারণ?”

“বারণ বলছি না মিসেস অর্নিলা। একটু খটকা লাগছে। বুঝতেই পারছেন পুলিশের লোক। স ন্দেহ করাই তো আমাদের কাজ। হা হা ( উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন তিনি। )
অর্নিলার অস্বস্তি বোধ হচ্ছিলো। সে চাইছে না সেদিনকার কোন কথা বলে ফেলতে। মুখ ফসকে বলে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। যদি তারা ভাবে, এই কারণেই সে নিয়াজের সাথে এমনটা করেছে। কি দরকার আগ বাড়িয়ে ঝামেলাকে দাওয়াত দেবার। তার মন বলছে, নিয়াজের উচিত শিক্ষা সে পেয়ে গেছে। পা হারিয়ে ঘরে বসে আছে। এখন আর কোন মেয়ের দিকে নজর দিতে পারবে না সে। অর্নিলা দম নিল। শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “সে শুধু এসেছিলো দেখা করতে। ফারাজ ভাইয়ের সাথে কি কথাবার্তার জন্য জন্য এসেছিলো। ফারাজ ভাই না থাকায় চলে গেছে। বসে নি! কিন্তু সে তো সন্ধ্যার সময়ই চলে গেছিলো। এরপর মাঝরাতে প্রায় ভোরের দিকে তার এক্সি ডেন্টের খবর পাই।”

সালাউদ্দিন সাহেব তার চায়ের কাপের শেষ চুমুক দিয়ে চা খাওয়া সমাপ্ত করলেন। অতঃপর গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলেন। কথাগুলো যেন মিলে যাচ্ছে নিয়াজের সাথে। তাহলে কি নিয়াজ সত্যি কথাই বলছে। হালকা কেশে বললেন, “এক্সি ডেন্ট হয়েছিল রাতের দিকেই। বৃষ্টির মধ্যে! এরপর হাসপাতালে নিয়ে পরিচয় খুঁজে পেতে পেতে সময় লেগেছিলো বেশ। এসব হাসপাতালের থেকে জানা কথা। যাক আজ তাহলে আমরা উঠি!”

সালাউদ্দিন সাহেব আর তার সহকর্মী উঠে দাঁড়ালেন। অর্নিলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। স্বস্তির শ্বাস কেবল নিতেই যাবে অমনি সালাউদ্দিন সাহেব চমকিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “ওটা কি? সি সি ক্যামেরা না?”

সহকর্মী সাহেব চোখে ডাবল পাওয়ারের চশমা পড়েছিলেন। চশমা নড়েচড়ে ভালো ভাবে তাকালেন দেওয়ালের এক কোনে। ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না ওতো। পাশেই একটা ওয়ালম্যাটের পাশে একটা সি সি ক্যামেরা। বেশ সূক্ষ্ম আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না হলে ওদিকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা সকলের হয় না। অর্নিলা ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে তাও যেন দেখতে পারছে না। অবশেষে তার চোখে ধরা পড়ল। বিস্মিতবিমূঢ় হয়ে গেল তার। স্তব্ধ তার মুখস্রী। নির্লিপ্ত চাহনিতে চেয়ে রইল শুধু। তার অবাক চাহনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে কতটা হতবাক। তার ঘরের কোণে একটা সি সি ক্যামেরা অথচ সে জানত না। কি আশ্চর্য জনক! ব্যাপারটা ধরতে পেরে সালাউদ্দিন সাহেব মশকরা শুরু করলেন। দু পাটি দাঁত মিলিয়ে হেসে উঠলেন। বললেন, ”কি ব্যাপার মিসেস অর্নিলা, আপনাকে বাকরুদ্ধ মনে হচ্ছে। ঘটনার ব্যাপারে কি আপনি অবগত নন? আপনার অগোচরে এমন কাজ কার হতে পারে? ওহ, এই বাসায় দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে তো একজনই আছে। আপনার স্বামী! কাজটা বোধহয় তারই। তৃতীয় পক্ষের এই কাজের সাহস হবে বলে মনে তো হচ্ছে না। বউ কে চোখে চোখে রাখার ভালো ফন্দি এটেছে কিন্তু ডা. সারফারাজ শেহদাত।”

অর্নিলা হতবুদ্ধির মতো কথাগুলো শুনছিলো। তার মস্তিষ্কে যেন বসে গেল কথাটা। তার স্বামী তাকে এভাবে নজরবন্দি করে রেখেছে। অবিশ্বাস্য কথা। ঝিম মেরে থাকা পুরো শরীর হঠাৎ সোচ্চার হয়ে উঠল। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলল না সে। সালাউদ্দিন সাহেব হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন। বুঝে গেলেন এখানে কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না। কথা বলতে হবে ডা. শেহদাতের সঙ্গে। তবে আজ না, অন্যদিন!
.
অর্নিলা দৃঢ় মনে অপেক্ষা করতে লাগল ফারাজ ভাইয়ের জন্য। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। পুরো শরীর কাঁপছে যন্ত্রণায়। শারীরিক যন্ত্রণা নয় সেটা। মানসিক যন্ত্রণা! নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। কান্না এসে ঠেকছে গলা অবধি। এই যেন হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে সে। ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোন শব্দের প্রতিঘাত পাওয়া যাচ্ছে না। দরজায় করাঘাত শুনে অর্নিলা দাঁড়িয়ে রইল। নিষ্প্রাণ মানবীর ন্যায় উঠে এসে দরজা খুলল। সারফারাজ মুখে মৃদু হাসির রেখা। সারাদিনের ক্লান্তির দেখা মিলছে না। দেখে অনেক প্রাণ উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। হাতে আইসক্রিমের বক্স। চকলেট ফ্লেভার। অর্নিলার বেশ পছন্দ। এটা দেখে সে ভীষণ খুশি হবে ভেবেই কিনা। কিন্তু একি? তার অনির মুখের হাসির বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। ছাপ পড়েছে কষ্টের, যন্ত্রণার। অশ্রুসিক্ত নয়নের অশ্রু টলমল। সারফারাজ যেন ভেঙে পড়ল মূহূর্তে। কি হলো কি হলো? এগিয়ে এসে আঁকড়ে ধরল তার বাহু। চেঁচিয়ে উঠে বলে উঠল, ”এই অনি? কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? সবকিছু ঠিক আছে? কি হয়েছে বল আমায়?”

সে মুখ ফুটে বলে উঠলো, ”কিছু না!”

“কিছু না! তবে কাঁদছিস কেন?”

কান্না থামানোর সর্বস্ব চেষ্টা। ভারী কণ্ঠে বলে উঠল, ”আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি ফারাজ ভাই।”

“কষ্ট পেয়েছিস? কেন? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে। আচ্ছা মন খারাপ করিস না। দেখ আমি আইসক্রিম এনেছি। বোকা মেয়ে! কিছু হলে এভাবে কাঁদতে হয়?”

বলতে বলতে কাঁধের ব্যাগটা চেয়ারে রাখল। আইসক্রিম বক্স খুলে চামচে করে সামান্য একটু নিয়ে বলল, “দেখ , আইসক্রিম খেলে মন ভালো হয়ে যাবে। তোর প্রিয় চকলেট ফ্লেভার!”

অনি হাত ছুড়ে ফেলে দিল আইসক্রিম বক্সটা। দূরে ছিটকে পড়ল সে। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেই আইসক্রিম! আকস্মিক ঘটনায় সারফারাজ কিৎকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল। টপ টপ করে অশ্রু বেয়ে পড়ল গাল বেয়ে। চিবুক ছাড়িয়ে জামায় গিয়ে মিশ খাচ্ছে তা। চোখ মুখ খিচে রইল অর্নিলা। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, ”হ্যাঁ, আমি বোকা! বোকা বলেই আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারলেন।”

“কি করেছি আমি?”

”কি করেছি জিজ্ঞেস করছেন? ওটা কি? আপনি আমার দিকে নজর রাখছেন ফারাজ ভাই! কেন ? কি কারণে? আমায় বিশ্বাস করেন না আপনি? বিশ্বাস যদি নাইবা করবেন তবে কেন বললেন ভালোবাসি। ছলনা করলেন আমায় নিয়ে। এভাবে কষ্ট দিলেন।”

সারফারাজ স্তব্ধ হয়ে রইল। দক্ষিণ দিকের জানালা এখনো খোলা। সেখান থেকে মৃদু বাতাস ছেয়ে গেল ঘরের মধ্যে। পর্দার উলোটপালোট শব্দ। অর্নিলা চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে আজ ভালোবাসার দেখা মিলছে না। ভয়ং কর ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে সারফারাজ। তার ঠোঁট নড়ছে। ঘটনাটা এমন বিশ্রী রূপ ধারণ করবে সে স্বপ্নে ভাবেনি। ঢোক গিলে শান্ত স্বরে বলে উঠল, “অনি, তুই যা ভাবছিস ব্যাপারটা তেমন নয়। এটার কারণ অন্য কিছু।“

“কোন কারণ ফারাজ ভাই? আপনিই তো বলছিলেন রক্ত কখনো রক্তকে ভুলে না। আমার শরীরে তো আমার বাবার রক্তই বইছে। তাই আমায় বিশ্বাস করতে পারলেন না। ধোঁকা দিলেন আপনি আমায়!”

সারফারাজ সারা শরীরে যেন হুট করেই ক্লান্তি অনুভব করল। এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে তার হাত দুটো ধরে ফেলল। কোমল স্বরে বলল, ”এমন না অনি।‌ আমি সত্যিই তোকে বিশ্বাস করি।”

“তাই!” দুই হাত দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে নিল। শক্ত কণ্ঠে শুধালো, ”তবে বলুন? কেন লাগিয়েছেন এটা এখানে? কোন কারণে?”

সারফারাজ নিশ্চুপ। জবাব দেবার মতো কথা গুছিয়ে নিতে পারছে না সে। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। অর্নিলার চোখে মুখে কঠোরতা ছেয়ে গেল। নিচুস্বরে বলে উঠল, ”আমার জবাব আমি পেয়ে গেছি!” বলামাত্র বাসার দরজা খুলে বেরিয়ে গেল তার। তার অন্ধ্র রন্ধ্র সব যেন প্রতিবাদী হয়ে উঠল। থাকবে না সে এখানে। ফারাজ ভাইয়ের এমন কাজ তার মনকে পিষিয়ে দিয়েছে। ধূলি সাৎ করে দিয়েছে তার ভালোবাসাকে।

সারফারাজ কিয়ৎকাল থমকে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ঘোর ভাঙল। মনে পড়ল অর্নিলা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। কঠিন পদার্থের আইসক্রিম তখন তরল পদার্থে ধারণ নিয়েছে। সারফারাজ ছুটে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। বাইরে এসে এ গলি, ও গলি ছুটল। বেশিক্ষণ তো হয়নি। এতোটুকু সময়ে মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল? তাদের এলাকা আবাসিক এলাকা। রীতিমত সন্ধ্যার পর পুরোটা এলাকা জুড়ে নিস্তব্ধ রূপ ধারণ করে। মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সারফারাজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই ঢাকা শহরে অনির পরিচিত কেউ নেই যার বাসায় গিয়ে সে উঠবে। এক হতে পারে মোহনগঞ্জ! সেখানে চলে যায়নি তো আবার। গাড়ি নিয়ে চারদিক ভালো করে খুঁজতে খুঁজতে রেলস্টেশনে এসে পৌঁছাল। অস্থির হয়ে টিকেট কাউন্টারে এসে ছুটতে লাগল। মোহনগঞ্জের লাস্ট ট্রেন মিনিট দশেক পর ছাড়বে। সারফারাজ ছুটছে। পুরো স্টেশন খুঁজছে। অথচ খুঁজে পাচ্ছে না তাকে। ডান হাতে বারান্তরে ফোন নাম্বার ডায়াল করে যাচ্ছে। ফোন এতোক্ষণ বোধহয় বাজছিলো। এখন আর বাজছে না। হঠাৎ করে এখন থেকেই বন্ধ বলছে। সারফারাজ দাঁড়িয়ে গেল হুট। তার পুরো শরীর কাঁপছে। কিছু একটা গোলমেলে ঠেকছে।

পরনে তার বাদামী রঙের টি শার্ট ঘামে পুরো ভিজে উঠেছে। মাথার ঘন চুলগুলো অবধি ঘামে আঠালো হয়ে উঠছে। অনির হঠাৎ ফোন বন্ধ থাকার বিষয়টা ভালো ঠেকছে না তার কাছে। মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে লাগল। অথচ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছে না। নার্ভ কাজ করছে না। অর্নিলা বাসা থেকে বের হয়েছে এক ঘণ্টার কম সময়। এর মধ্যে রেলস্টেশনে সে এসে পৌঁছাতে পারবে না। পারলেও তার আর সারফারাজের মধ্যে ব্যবধান বেশি নয়। কারণ সারফারাজ সিগন্যাল ভে ঙে হম্ভি তম্ভি করে গাড়ি চালিয়ে এদিকে এসেছে। হঠাৎ স্থির নয়নে পুরো স্টেশনে দৃষ্টিপাত করল। অনি এখানে থাকলে তার আর অনির সাক্ষাৎ না হওয়ার বিষয়টা কাকতালীয় হতেই পারে না। ট্রেন ছেড়ে দিবে এখন। ধীরে ধীরে ট্রেন আগাচ্ছে। সারফারাজ নিশ্চুপ নয়নে খোঁজ চালাচ্ছে। তার মন বলছে অর্নিলা এখানে নেই। এখানে কেন? কোথাও নেই। তার আশপাশে কোথাও অনি নেই? তবে অনি গেলো কোথায়?আচমকা ফোনটা বেজে উঠলো। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে রিসিভ করে কানে দিল। ওপাশ থেকে আরিফ হাসান হম্ভিতম্ভি করে বলে উঠলেন, “সারফারাজ! সারফারাজ অনি কোথায়?”

সারফারাজ নিরুত্তর। তার কাছে কোন জবাব নেই। নিশ্চুপ হয়ে রইল সে। আরিফ হাসান বিরক্তি স্বরে আবারো জিজ্ঞেস করলেন, ”সারফারাজ। এনসার মি? হোয়্যার ইজ অনি? ও কি তোমার সাথে নেই!”

সারফারাজ অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ”না!”

ওপাশ থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ। আরিফ হাসান বোধহয় হত’ভম্ব হয়ে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ধীর স্বরে বলে উঠলেন, “তাহলে কি সত্যি সত্যি তারা অনিকে কিড ন্যাপ করে ফেলল!”
সারফারাজ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। কি বলল বাবা! অনি কিডন্যাপ হয়ে গেছে। বাবা ভুলভাল কি বলছে? নাকি সত্যিই অনি… সারফারাজ ফোনটা নামিয়ে রাখল। তার পাশ বেয়ে দ্রুত গতিতে ট্রেন চলে গেল!

#চলবে….