Sunday, August 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 187



উধয়রনী পর্ব-২৫ + বোনাস পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৫||

৪৫।
আহি চট্টগ্রামে ফিরেছে দুই দিন হচ্ছে। এই দুই দিনে আহি একবারো ক্যাম্পাসে যায় নি। কিন্তু আজ তাকে যেতেই হবে। এই মাসে অনেকগুলো ক্লাস বাদ দিয়ে ফেলেছে সে। আগামী সপ্তাহ থেকে ক্লাস টেস্ট শুরু হবে। তাই বাধ্য হয়েই সে ক্যাম্পাসে চলে এলো। আহি ক্লাসে ঢুকতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। এতোদিন পর আহিকে দেখে আফিফও চমকে উঠলো।
এদিকে আহি আফিফকে দেখে আবার দুর্বল হয়ে পড়লো। সে এক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহির এমন চাহনি দেখে আফিফ তাকে পাশ কেটে চলে যেতেই আহির ঘোর কাটলো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেঞ্চে এসে বসলো।

(***)

আহি ক্লাস চলাকালীন সময়ে একটু পর পর আফিফের দিকে তাকাচ্ছে। আফিফের চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। যদিও আজ রোদ উঠেছে। তবুও বাতাবরণে মিষ্টি হাওয়ার ছোটাছুটি চলছে। আফিফ কি তবে অসুস্থ? আহির মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সে চোখ বন্ধ করে নিজের বেঞ্চে বসে আছে। আর মনে মনে ভাবছে,
“ভীষণ অস্থির লাগছে আমার। তুমি আমার পাশে থেকেও কেন এতো দূরে? ইচ্ছে করছে যত্নের সাথে তোমার রক্তিম গালটি ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু এই স্পর্শটাও অনুভব করা ছাড়া উপায় নেই।”

ক্লাস শেষ হতেই আফিফ বেরিয়ে পড়লো। লাঞ্চ টাইম শেষে আবার দুই ঘন্টার ক্লাস। আহি আফিফের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো। উদ্দেশ্য ক্যান্টিনে গিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়া৷ আফিফও ক্যান্টিনেই এসেছে। সে খাবার নিয়ে কোণায় গিয়ে বসে পড়লো। আহিও খাবার নিয়ে আফিফের পাশের চেয়ারে এসে বসলো। আফিফ আহিকে তার পাশের চেয়ারে বসতে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি বলল,
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনার অস্থির লাগছে! আপনি কি অসুস্থ?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হুম।”

“কি হয়েছে?”

“হালকা জ্বর।”

আফিফের জ্বর এসেছে শুনেই আহি হাত এগিয়ে দিতে গিয়েই থেমে গেলো। আফিফ দেখেও যেন দেখলো না। সে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আহিও ইতস্ততবোধ নিয়ে খেতে লাগলো। মনে মনে বলল,
“কি দরকার ছিল আফিফের পাশে এসে বসার?”

পরক্ষণেই আহি ভাবলো,
“এটা সৌজন্যমূলক প্রশ্ন! এখানে এতো ভাবাভাবির কিছুই নেই। পরিচিত একজন মানুষকে অসুস্থ দেখলে, যে-কেউ পাশে বসে কথা বলবেই।”

আহি এবার নীরবতা কাটিয়ে বলল,
“অফিস আর ক্লাস একসাথে কীভাবে সামলাচ্ছেন?”

“আমি যেই সেক্টরে কাজ করি, ওখানে আপতত ট্রেনিং চলছে। কয়েক মাস পর চাকরি স্থায়ী হবে। ততোদিনে ক্লাস কর‍তে অসুবিধে হবে না।”

“যখন রেগুলার অফিস করতে হবে তখন?”

“হয়তো ক্লাস গ্যাপ হবে। তখন শুধু পরীক্ষাটাই দিতে আসবো।”

আহি গালে হাত দিয়ে আফিফের কথা শুনছে। এতো বছরের এক তরফা ভালোবাসা, আর এই প্রথম আহি আফিফের মুখোমুখি বসে আছে আর কথা বলছে। মুহূর্তটি আহির কাছে ভীষণ সুন্দর মনে হচ্ছে। যদিও আফিফের সাথে আগেও অনেকবার কথা হয়েছিল তার। কিন্তু এই প্রথম বসে শান্তভাবে কথা বলছে। আহি মনে মনে ভাবছে,
“যদি তোমার স্থায়ী শ্রোতা হতে পারতাম। তুমি বর্ষণের মতো তোমার একের পর এক বাক্য ঝরাতে। আর আমি মুগ্ধ হয়ে সেই বাক্যের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতাম।”

আফিফ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“অনেক দিন ক্লাসে আসো নি!”

আহি মুচকি হেসে বলল, “সিলেট গিয়েছিলাম।”

হঠাৎ পেছন থেকে পদ্মের কন্ঠ শুনে আফিফ আর আহি দু’জনই অবাক হলো। আহি পদ্মকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পদ্ম আহির কাছে এসে বলল,
“কেমন আছিস?”

“আমি তো ভালোই। দেখছি, তোর বর অসুস্থ অনেক।”

“হ্যাঁ, ওর জন্যই তো এলাম।”

পদ্ম আফিফের পাশে বসেই একটা টিফিনবক্স রেখে বলল,
“নাস্তাও করেন নি, আবার লাঞ্চ বক্সটাও না নিয়ে চলে এসেছেন। এখনো রাগ করে আছেন?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকালো। আফিফ এক নজর আহির দিকে তাকাতেই আহি তার প্লেট হাতে নিয়ে চলে যেতে নিবে তখনই পদ্ম বলল,
“আহি, তুইও বসতে পারবি।”

আহি শুকনো হেসে বলল,
“আরেহ না। আমি ক্লাসে উনাকে অসুস্থ দেখলাম, ভাবলাম খেতে খেতে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে। তাই বসা। এখন তো প্রাইভেসি দিতে হবে।”

পদ্ম বলল,
“এমন কিছুই বলবো না। বসতে পারিস।”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে আটকালো। আহি বিষয়টা খেয়াল করতেই তাড়াতাড়ি চলে এলো।

(***)

উল্টোদিকে ফিরে বসেছে আহি। পদ্ম না হয় সৌজন্যমূলক ভাবে বসতে বলেছিল। আহি তো কখনোই তাদের মাঝখানে বসতো না। তাহলে কেন শুধু শুধু পদ্মের হাত ধরে থামাতে হলো আফিফের? বিষয়টা আহির ভীষণ খারাপ লেগেছে। এই মুহূর্তে আহির চোখ দু’টি ছলছল করছে। সে একসাথে খাচ্ছে আর কাঁদছে। আর মনে মনে ভাবছে,
“আমি আর কখনোই নিজ থেকে তোমার সাথে কথা বলতে যাবো না, আফিফ।”

আহি খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখলো পদ্ম আফিফের মুখে লেগে থাকা খাবারগুলো টিস্যু দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আহির বুকটা কেমন যেন কাঁপতে লাগলো। সে হাত ধুয়ে নিচে নামতেই তার মনে হলো গলায় কি যেন আটকে আছে। কয়েক পা এগিয়ে সে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো, আর গলগল করে বমি করে দিলো। প্রায় মিনিট দশেক পর আহি দুর্বল শরীরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই দেখলো পদ্ম আর আহি ক্যান্টিন থেকে নামছে। আর পদ্ম আফিফের হাত ধরে রেখেছে। আহি জানে এই হাত ধরার অধিকার পদ্মেরই। কিন্তু তার মনটা তবুও মানছে না। এতোদিন সে ভালোই ছিল। কিন্তু একাকীত্ব আর আফিফের ভাবনা তাকে আবার রোগী বানিয়ে দিয়েছে। এরপর আহি আর পরের ক্লাসগুলো না করেই বাসায় চলে এলো।

বাসায় এসেই আহি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। নিজের বুকে হাত রেখে বলল,
“বাঁচার জন্য আমার হাতে দুইটা রাস্তা খোলা আছে। এক, আফিফকে ভুলে যাওয়া। দুই, আফিফকে ভুলে থাকার জন্য যা যা কর‍তে হয় সবটাই করা। কিন্তু আমি আফিফকে ভুলে থাকতেই পারছি না। ক্লাসে ওকে দেখা, বাসায় সারাদিন একা একা বসে ওকে ভাবা। যখন মায়ের সাথে ছিলাম, আমি একটুও আফিফকে মনে করে কষ্ট পাই নি। তাহলে আফিফকে ভোলার জন্য আমার মায়ের সাথেই থাকতে হবে। যেটা এই মুহূর্তে মোটেও সম্ভব না। তাহলে আমার হাতে আর একটাই পথ খোলা, সেটা হলো আফিফকেই ভুলে যাওয়া। যেটা আমি পারছি না। কীভাবে ভুলবো আমি ওকে?”

হঠাৎ আহির মনে পড়লো কেউ একজন তাকে বলেছিল,
“মানুষের মন জানালার মতো। জানালা খুলে দিলে যেমন মিষ্টি হাওয়া প্রবেশ করে, তেমনি বন্ধ রাখলে গুমোট বাতাবরণের সৃষ্টি হয়। জীবনটাও ঠিক তেমন। মনের জানালা খুলে দিবেন, সুখ-দুঃখ অন্যের সাথে ভাগ করে নিবেন, তবেই স্বস্তি পাবেন। আর বন্ধ রাখবেন তো নিজেকেই ধীরে ধীরে হত্যা করবেন।”

কথাটি আহির মনে পড়তেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আলমারি খুলে তার হ্যান্ডব্যাগটা বের করলো। এরপর ব্যাগ ঘেঁটে সেই কার্ডটি বের করলো, যেটা সেই প্লেনে থাকা আগন্তুকটি তাকে দিয়েছিল। কার্ডের উপর লেখা, নায়ীব তামজিদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। জামালখানেই তার চেম্বার। আহি এবার রাদকে ফোন করলো। রাদ হ্যালো বলতেই আহি বলল,
“আমি ডাক্তার দেখাতে চাই।”

“হ্যাঁ!”

“আমি ট্রিটমেন্ট শুরু করবো ভাবছি।”

রাদ আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“আমি সত্যিই তোর ডিসিশনে অনেক খুশি। ফাইনালি তুই ওই তেলাপোকাকে ভুলে থাকার জন্য একটা স্টেপ তো নিচ্ছিস! আচ্ছা, আমি দেখছি কোন ডাক্তার ভালো হবে।”

“রাদ, আমি আজই যাবো। বাবা দেশে আসার আগেই আমি ডাক্তার দেখিয়ে ফেলতে চাই। আমার কাছে একজন সাইকায়াট্রিস্টের নম্বর আছে। জামালখান বসে। চল সেখানেই যাই।”

“ওকে, আজ সন্ধ্যায় বসবে তো?”

“হ্যাঁ।”

“ওকে, ডান।”

আহি ফোন কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফিফের ছবি হাতে নিয়ে বলল,
“তোমাকে তো আমি কখনোই ভুলবো না, এআর। কিন্তু আমি চাই না, আমার ভালোবাসা দুর্বল হোক। আমি জুলিয়েট হতে চাই না। এমন প্রেমিকা হতে চাই, যে তার ভালোবাসার মানুষকে স্মৃতিতে রেখেও ভালো থাকবে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আমার দুর্বলতা না হোক, আমার শক্তি হোক। যেটা এতোদিন আমি শক্তি ভেবেছি, সেটাই আমার দুর্বলতা ছিল। তোমাকে দেখার পর থেকে আমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছি। তোমার আর পদ্মের কাছাকাছি আসা আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমি এখনো শক্ত হতে পারি নি। অন্তত তোমার সুখের জন্য আমি শক্ত হবো। আমি চাই না, পদ্ম কখনো জানুক, তুমিই আমার এআর।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৪৬।
নায়ীবের চেম্বারে এসে বসলো আহি। রাদ তার পাশেই বসে আছে। আর নায়ীব উলটো দিকে ঘুরে বসে আছে। আহি একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। রুমটির দেয়ালের রঙটি আহিকে খুব আকর্ষণ করেছে। ঈষৎ হলুদাভ। মেঝেতে ফ্যাকাশে বেগুনি রঙয়ের কার্পেট। যেটাকে সাধারণ ভাষায় ল্যাভেন্ডার কালার বলা হয়। ছাদের রঙটি বাদামি বর্ণের। রুমটির একপাশে একটা আরামদায়ক চেয়ার আছে। যার সামনা-সামনি একটা টুল। পাশে একটা ল্যাম্প আর খালি ফুলের টব। টবটিতে ফুল না থাকায় আহি ভীষণ অবাক হলো।
রুমটির দেয়ালে বিভিন্ন বিষয়ের উপর আঁকা ছবি ঝুলছে। মাথার উপর বিভিন্ন রঙের বাতি। বাইরে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় প্রকৃতি শীতল এবং স্নিগ্ধ। তবে রুমটির বাতাবরণে নাতিশীতোষ্ণ ভাব আছে।

দরজার কাছেই নায়ীবের চেয়ার আর টেবিল। আর তার উল্টো দিকে রোগীদের বসার জন্য দু’টি চেয়ার রাখা, যেই দু’টিতে এই মুহূর্তে আহি আর রাদ বসে আছে। নায়ীব তামজিদ এবার চেয়ার ঘুরিয়ে আহি আর রাদের দিকে ফিরলো। সে টেবিলে দুই হাত রেখে মিষ্টি হেসে আহির দিকে তাকালো। আহি শুকনো হাসি ফেরত দিলো। রাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই নায়ীব বলল,
“মিস, আপনাকে আমি আগে কোথাও দেখেছি।”

আহি মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

নায়ীব সেকেন্ড খানিক ভেবে বলল,
“আমাদের ইউকে থেকে ফেরার পথে দেখা হয়েছিল।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আপনার মনে আছে?”

“আমি সহজে কারো চেহারা ভুলতে পারি না। আর এটা তো মাত্র কয়েক মাস আগের কথা।”

নায়ীব এবার রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“আমি আহির ফ্রেন্ড।”

নায়ীব টেবিলের উপর থেকে একটা কলম নিয়ে তার ডায়েরী খুললো। তারপর আহিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার নামটা?”

“ওয়াসিকা কবির।”

“সবাই কি নামে ডাকে?”

“আহি!”

নায়ীব ভ্রূ কুঁচকে এক নজর আহির দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে নামটা সে কোথায় যেন শুনেছে। নায়ীব আবার জিজ্ঞেস করলো,
“বাসায় কে কে থাকে?”

“বাবা, মা আর আমি।”

“তথ্যগুলো দিতে ভুল করবেন না। বাসায় কি আর কেউ থাকে না?”

“হ্যাঁ, একজন খালা থাকেন, আর তার মেয়ে চুনিও থাকে। তারা আমাদের বাসায় কাজ করে।”

“আপনার বাবা আর মায়ের সম্পর্ক কেমন?”

“আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। যিনি আছেন, তিনি বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী।”

নায়ীব ভ্রূ কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“কি কর‍তে ভালোবাসেন?”

“কিছুই না।”

রাদ আহির দিকে তাকালো। নায়ীব রাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কোনো শখ?”

“আহি ভালো ছবি আঁকতে পারে। কিন্তু এখন আঁকে না।”

নায়ীব এবার আহিকে জিজ্ঞেস করলো, “প্রিয় রং?”

“সাদা।”

নায়ীব টেবিলের নিচ থেকে একটা সাদা রঙের কৃত্রিম ফুল বের করে তার কলম দানিতে রাখলো। আহি সেই ফুলটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নায়ীব আহির চোখের দিকে তাকিয়ে ফুলটি সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আপনার প্রিয় রং কি?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ল্যাভেন্ডার।”

নায়ীব মুচকি হাসলো। কার্পেটের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার খুব কাছের একজন মানুষের প্রিয় রঙও কিন্তু ল্যাভেন্ডার।”

আহি অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “আমারও।”

“তাহলে সাদা রং কেন বলেছিলেন?”

“জানি না।”

নায়ীব মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, “প্রিয় ফুল?”

“অলকানন্দা।”

নায়ীব তার পাশে থাকা বেল বক্সে চাপ দিতেই সেকেন্ড খানিক পর তার সহকারী ভেতরে ঢুকলো। নায়ীব বলল,
“কয়েকটা অলকানন্দা ফুল নিয়ে আসো।”

আহি নায়ীবের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। এবার নায়ীব চেয়ার ছেড়ে উঠে একটা পর্দা টেনে দিলো মাঝখানে। ধূসর রঙের পর্দা। তারপর রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি এখানেই বসুন। আমার মিস ওয়াসিকার সাথে একা কথা বলা উচিত।”

আহি এবার উঠে ভেতরের দিকে চলে গেলো। তারপর নায়ীব তাকে ইশারায় সেই আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসতে বলল। আহি সেই চেয়ারে বসতেই নায়ীব পেছনের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলো। হালকা অন্ধকারে কিছু আলো এসে পড়ছে পাশে থাকা টেবিলটির উপর। সেই আলোতে নায়ীব আর আহি একে অপরকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আশেপাশে সবকিছুই অস্বচ্ছ হয়ে আছে। এদিকে নায়ীবের সহকারীটি কয়েকটা অলকানন্দা ফুল নিয়ে আসতেই নায়ীব ফুলগুলো নিয়ে খালি দানিটিতে রাখলো। আহি সেই ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। নায়ীব এবার বলল,
“তুমি মনে করবে আমি তোমার বন্ধু। বন্ধু ভেবেই কোনো ইতস্তত ভাব ছাড়াই আমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবে। এবার বলো, কেন এসেছো আমার কাছে? এই মুহূর্তে তোমার জীবন নিয়ে কেমন অভিজ্ঞতা হচ্ছে?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার জীবনে অনেক সমস্যা। বাবার সাথে আমার বনিবনা হয় না। বাবার স্ত্রী আমাকে মানসিক চাপে রেখেছে। জোর করে তাদের পছন্দের ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চাইছে। আর ছেলেটাও একদম ভালো নয়। আর বাবা আমাকে আমার আসল মায়ের সাথেই দেখা করতে দেয় না। বাবা অনেক প্রভাবশালী। সে একপ্রকার আমাকে জিম্মি করে রেখেছে। চব্বিশ বছর চলছে আমার। এখনো আমি আমার ইচ্ছেই মায়ের সাথে থাকতে পারি না, দেখা কর‍তে পারি না। আর এই সিচুয়েশন থেকে এতো সহজে আমি মুক্তি পাবো না, সেটা আমি জানি। কিন্তু আসল সমস্যা এই বিষয় নয়। আমার আসল সমস্যা, আর এখানে আসার কারণ আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। তাকে ভুলতে পারছি না। সে প্রতিনিয়ত আমার চোখের সামনে ঘুরাঘুরি করছে।”

“তাকে বলেছো?”

“হ্যাঁ, সে জানে।”

“তাহলে তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ?”

“বিয়ে করে ফেলেছিল।”

“তাহলে তো সে দুর্ভাগা। তোমার মতো মিষ্টি মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছে।”

“সে তো আমাকে কখনোই ভালোবাসে নি।”

“নাম কি তার?”

“বলতে পারবো না।”

“ঠিক আছে, তার এমন একটা নাম দাও, যেটাতে শুধু তুমিই তাকে চেনো। শুধু তুমিই তার এই ছদ্মনামটি জানো।”

“অলকানন্দ।”

নায়ীব এবার অলকানন্দা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে এই ফুলগুলো তার পছন্দের?”

“হ্যাঁ।”

“সাদা রঙটিও তার পছন্দের?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার প্রিয় ফুল কি?”

“কাঠগোলাপ!”

“দেখি বলো, ক’দিন পর নিজের প্রিয় ফুলের নাম নিয়েছো?”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। নায়ীব বলল,
“আগে নিজেকে ভালোবাসতে শেখো, তারপর তোমার ভালোবাসা তোমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তুমি তো তার পছন্দের ভীড়ে ডুবে আছো। তোমার প্রথম কাজ এসব পছন্দ একেবারে ভুলে না গিয়ে তোমার পছন্দগুলো সেখানে জায়গা দেওয়া।”

আহি মলিন মুখে নায়ীবের দিকে তাকালো। নায়ীব এবার জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার বারান্দায় বাগান আছে?”

“হ্যাঁ।”

“নিশ্চয় সব অলকানন্দার চারা লাগিয়ে রেখেছো।”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হ্যাঁ।”

“কাল নার্সারিতে গিয়ে গোলাপ আর কাঠগোলাপের চারা এনে লাগিয়ে দেবে। বাসার ছাদেও একই গাছ লাগাবে। অলকানন্দার পাশাপাশি যাতে কাঠগোলাপেরও জায়গা হয়।”

নায়ীব উঠে গিয়ে কোথা থেকে কিছু কৃত্রিম কাঠগোলাপ এনে সামনে থাকা টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলো। আহি তা দেখে মুচকি হাসলো। নায়ীব এবার বলল,

“তোমার ভালোবাসার গল্পটা শুনাও আমাকে। আমি ভীষণ আগ্রহী। অলকানন্দকে কখন দেখেছো? কখন বুঝেছো তুমি তাকে ভালোবাসো? তোমার সব অনুভূতি আজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে শোনাবে।”

আহি চোখ বন্ধ করলো। তার মনে পড়ে গেলো সেই বৃষ্টি ভেজা সকাল, ভেজা সাদা শার্টের সেই আফিফের শ্রান্ত চেহারা, তার এলোমেলো চুল, তার নাম জানার অনুভূতি, তার আঁকা ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা, প্রথম তার স্কেচ করা, সেই স্কেচ বানিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা, টিফিনের টাকা জমিয়ে তার জন্য ডায়েরী কেনা, রাস্তায় বসে তাকে প্রথম সেই ডায়েরীতে স্থান দেওয়া, প্রতি সপ্তাহে আফিফকে দেখে বাসায় এসে আফিফের স্কেচ করে অনুভূতির কথাটাও ডায়েরীতে লেখা, আফিফকে দেখে প্রথম নামাজ ধরা, প্রতিদিন তার পিছু নেওয়া, ঝড়-ঝঞ্ঝা সব উপেক্ষা করে আফিফকে এক নজর দেখার জন্য কখনো ওর বাসার সামনে, কখনো বা এক কোমড় পানি ঠেলে চারুশিল্পে ক্লাস করতে যাওয়া, আফিফের খাওয়া আর স্পর্শ করা প্রতিটি বস্তু সংগ্রহে রাখা, তার ছেঁড়া স্যান্ডেলটি এখনো যত্নের সাথে বক্সে তুলে রাখা, আফিফের জন্য ভাস্কর্য বানানো, এরপর তাকে বেনামী চিরকুট দেওয়া, তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাওয়া, আফিফের এক্সিভিশনে তার ছবি আঁকা, পরবর্তীতে তাকে দেখতে না চেয়ে সেই কার্ডের কালো বাটনে চাপ দেওয়া, আফিফের পারিবারিক জটিলতা, তারপর আড়াই বছর পর পদ্মকে ভালোবেসে বিয়ে করা, সেই বর্ষার রাতের তার ব্রেইন স্ট্রোক করা। আহি প্রতিটি অংশ নায়ীবকে শোনালো। নায়ীব সব শুনে স্থির দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আর আহি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রুমটি নিরিবিলি থাকায়, আহির সব কথায় রাদের কানে পৌঁছেছে।

আহি কথা বলা শেষ করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নায়ীব এবার সামনে এসে রাদের দিকে তাকালো। নায়ীবকে দেখে রাদ তার চোখ মুছতে লাগলো। নায়ীব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আহিকে বলল,
“মিস, তুমি বাইরে গিয়ে বসো।”

আহি বাইরে যেতেই নায়ীব রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি কাল সকালে মিস ওয়াসিকাকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। আমি চেম্বারে তার ট্রিটমেন্ট করবো না। অন্য জায়গায় যেতে হবে। আমার মনে হচ্ছে তার রিকোভার করতে অনেক সময় লাগবে। এটাকে আমরা ভালোবাসা বলতে পারি না। এটা ভালোবাসা হলে তাকে এখানে আনতেই হতো না। এটা আমাদের ভাষায় রোগ, সাধারণের ভাষায় আসক্তি। নেশা ছাড়াতে যেমন অনেক সময় লাগে, তেমনি তার অতীত থেকে তাকে বের কর‍তে অনেক সময় লাগবে। তার মধ্যে যুক্ত আছে তার পারিবারিক জটিলতা। নিশ্চয় আপনি তার ভালো বন্ধু, তাই আপনি এমন অবস্থায় তার পাশে আছেন। সাজেস্ট করবো, তাকে নিয়ে ঘুর‍তে যান। আপতত সেই ছেলেটার কাছ থেকে মিস ওয়াসিকার দূরত্ব রাখতে হবে।”

রাদ বলল,
“ওরা একই সাথে মাস্টার্স করছে। আর আমি অন্য ডিপার্টমেন্টে।”

“সেকশন থাকলে চেঞ্জ করার ব্যবস্থা করুন। আর এক বছর অনেক সময়। যার জন্য মিস. ওয়াসিকার এমন পরিণতি সে কিন্তু এসব জানে। আর সে জানে তাই মিস. ওয়াসিকা আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে। না জানলে তাকে ফেইস কর‍তে এতো কষ্ট হতো না। কিন্তু আমার মনে হয়, তাকে ফেইস করতে হবে। দূরত্ব রাখাটা ঠিক হবে না।”

(***)

রাদ বেরিয়ে আসতেই আহি রাদের কাছে এসে বলল,
“ডাক্তার কি বলেছে? আমি সুস্থ হয়ে যাবো তো!”

রাদ শুকনো হেসে আহির গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“তোকে আমি সুস্থ করেই ছাড়বো। এখন শুধু মন পরিবর্তন করিস না। মিস্টার নায়ীব কাল তোর সাথে আবার দেখা করবেন। উনি যা যা বলবেন, তোকে তা তা মেনে চলতে হবে। আর কালকে ক্লাস করতে হবে না।”

আহি রাদের হাত শক্ত করে ধরে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি আফিফকে এখনো সেভাবেই ভালোবাসি, যেমনটা আগে ভালোবাসতাম। ডক্টর নায়ীবকে যখন আমি সব বলছিলাম, মনে হচ্ছিল আফিফ আমার পাশেই আছে। আমি হাত বাড়ালেই ওকে ছুঁয়ে দিতে পারবো।”

রাদ আহির হাতটা নিজের বুকের উপর রেখে বলল,
“আপতত আমাকে ছুঁয়ে দে। মনে করিস না এসব। চল এখন, ফুচকা খাওয়াবো তোকে। আজ রাত ন’টা পর্যন্ত রিকশা নিয়ে রাতের শহর দেখবো।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আমার সমুদ্র দেখতে ইচ্ছে করছে।”

“পতেঙ্গা যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। এতো রাতে সুন্দরী মেয়ে নিয়ে আমি যেখানে সেখানে যেতে পারবো না। আমি কিন্তু বডি বিল্ডার নই।”

আহি মুচকি হেসে রাদের গাল টেনে দিলো। এরপর রাতে ঘুরাঘুরি করে বাইরে খাওয়া-দাওয়া সেরেই আহি বাসায় ফিরলো।

(***)

সকাল সকাল কলিংবেল বাজতেই আহি নিচে নেমে এলো। মুনিয়া খালা দরজা খুলতেই দেখলেন রাদ দাঁড়িয়ে আছে।

আহি বলল, “তুই!”

রাদ হাতে থাকা বড় একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আহি জিজ্ঞেস করলো,
“কি এগুলো?”

“তোর বারান্দায় নিয়ে চল।”

আহি রাদকে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। রাদ প্রথম আহির ঘরে ঢুকেছে। পরিপাটি ঘর। আশেপাশে কাগজ দিয়ে মুড়ানো ক্যানভাস মেঝেতে রাখা। রাদ এক নজর আহির দিকে তাকিয়ে বারান্দায় চলে এলো। বারান্দায় আসতেই রাদ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি মাথা নিচু করে নিলো। রাদ আহির বারান্দায় বসে পড়লো। নিজ হাতে অলকানন্দা গাছগুলো সরিয়ে দুই টবে ভাগ করে লাগালো। বেশিরভাগই ফেলে দিলো। আহি আটকাতে যাবে তখনই রাদ বলল,
“আজ থেকে আমার কথা শুনতে তুই বাধ্য।”

আহি চুপ করে রইলো। রাদ এবার নতুন করে মাটি দিয়ে টবগুলোতে কাঠগোলাপের ডাল আর চারা রোপণ করে দিলো। চুনিও মনোযোগ দিয়ে রাদের কাজ দেখছে। রাদ চুনিকে দেখে বলল,
“পানি নিয়ে আসো, গাছে দেবো।”

চুনি বাধ্য মেয়ের মতো এক মগ পানি আনলো। রাদ নতুন চারাগুলোতে পানি ছিটিয়ে দিলো। এরপর হাত মুখ ধুয়ে চলে যেতে নেবে তখনই আহি বলল,
“নাস্তা করবি না?”

“বাইরে করবো।”

“চল, একসাথেই করি। এমনিতেই তো বেরুতে হবে।”

“তাহলে তৈরী হয়ে নে। বাইরেই করি।”

আহি ভালো একটা জামা পরে বেরিয়ে এলো। রাদ আর আহি ছোট একটা রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা সেরে ফুটপাত ধরে অনেকক্ষণ হাঁটলো। আহি রাদের হাত ধরে রেখেছে। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি বলল,
“তুই আমার জন্য এতোকিছু কেন করছিস?”

রাদ মনে মনে বলল, “ভালোবাসি তাই।”

আহি রাদের দিকে তাকাতেই রাদ বলল,
“তোর জন্য আমি অনেক কিছুই করবো। কিন্তু কারণ বলবো না। শুধু এইটুকু মাথায় রাখিস, আমি তোর মুখে হাসি দেখতে চাই। বন্ধুর মুখে হাসি দেখতেই ভালো লাগে। বিপদে তো বন্ধুরাই পাশে থাকে।”

(***)

আহি আর রাদ নায়ীবের চেম্বারে আসতেই নায়ীব উঠে দাঁড়ালো আর বলল,
“তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম।”

আহি বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

“একটা পার্কে যাচ্ছি।”

নায়ীব আহির সাথে বাটারফ্লাই পার্কে চলে এলো। রাদও তাদের সাথেই আছে। কিন্তু সে কিছুটা দূরত্ব রেখেছে। নায়ীব আহিকে নিয়ে ঝিলের পাশে এসে বসলো। আহি এক দৃষ্টিতে ঝিলের অস্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে আছে। নায়ীব আহির দিকে ঘুরে বসে বলল,
“কাল সারারাত আমি অনেক ভাবলাম। ভেবে একটা উত্তরই বের হলো। তোমার সেই অলকানন্দ সেই কার্ডের প্রতিত্তোরে ব্ল্যাক বাটনে চাপ দিয়েছিল। সে কিন্তু জানতো না তোমার আসক্তি কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। পয়েন্ট ওয়ান, সে তোমার চিরকুট পেয়েছে। তোমার ভাষ্যমতে সে চিরকুট দেখে কখনোই বিরক্ত হয় নি। সেই চিরকুটগুলো পড়ার সময় তুমি তার ঠোঁটে অদৃশ্য হাসি দেখেছিলে। এমনকি সে এক্সিভিশনে তোমার কথায় অংশ নিয়েছিল, আর তোমার দেওয়া ছবিটিই এঁকেছিল। এই পয়েন্ট থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, সে তোমাকে পছন্দ করতো। হয়তো সে এটা নিজেও বুঝতে পারে নি। নয়তো অন্য কোনো কারণ হতে পারে। দ্বিতীয় পয়েন্ট তুমি তাকে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দিয়েছিল। আর সেই জোড়া সে সবসময় পায়ে দিয়ে আসতো। এর দুইটা কারণ থাকতে পারে। এক, সে তোমার দেওয়া জিনিসটা আগলে রেখেছে। দুই, তার আসলেই আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তৃতীয় পয়েন্ট তার এক্সিডেন্টের পুরো খরচ তোমার মা দিয়েছিল। এই পয়েন্টটা হয়তো তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তোমাকে ভালো রাখা তার সামর্থ্যের মধ্যে নেই।”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“আমি তাকে চেয়েছিলাম। তার কাছ থেকে অন্য কিছু চাই নি।”

“সেটা তো শুধু তুমিই জানো। সে তো জানে না। তবে এটা একটা সম্পর্কে বাঁধা হওয়ার মুখ্য কারণ নাও হতে পারে। তার পারিবারিক অবস্থা শুনে মনে হচ্ছে, তোমাকে তার জীবনে না আসতে দেওয়ার কারণ পদ্মের প্রতি ভালোবাসা কখনোই ছিল না। অন্য কোনো কারণ আছে। হয়তো পদ্ম তার জীবনে তখন এসেছে, যখন সে ধরে নিয়েছিল, তুমি তার জীবনে কোথাও নেই। তোমাকে মনে না রাখাটাই তার জীবনের ব্যর্থতা বা সার্থকতা।”

“আমি আপনার কথাটা বুঝতে পারছি না।”

“আচ্ছা, অলকানন্দের কথাটা না হয় বাদ দাও। আসি তোমার বিষয়ে। তোমার এই ইমোশনসগুলো কখন তোমাকে আঘাত করে?”

“যখন আমি একা থাকি। নিজের ঘরে থাকি। সেই ঘরে বসেই তো ডায়েরী লিখতাম, ভাস্কর্যটাও সেখানে ছিল, তার ছবিও এঁকেছি সেখানে বসে।”

“এটা তোমার ভুল ধারণা ওয়াসিকা। যদি তোমার ঘরটাই তোমাকে ইমোশনাল করার পেছনে দায়ী থাকতো, তাহলে তুমি ইউকে গিয়ে একই সিচুয়েশনে থাকতে না।”

“তাহলে এর জন্য দায়ী আমার মন? আমি মনকে কীভাবে হারাবো?”

“এটা তোমার অতিরিক্ত ভালোবাসা। ভালোবাসার একটা সীমা আছে। সীমা ছাড়িয়ে গেলে ওটাকে ভালোবাসা বলা যায় না। তুমি অনেক ধৈর্যশীল, তোমার মন-মানসিকতা ভালো, নয়তো তোমার এই সীমাহীন ভালোবাসার সাইড ইফেক্ট কি জানো?”

“কি?”

“এর সাইড ইফেক্ট হলো। তুমি পদ্মের জীবনের একটা অভিশাপ। তুমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেই পদ্মের জীবনে ঝড় নেমে আসবে।”

আহি বিচলিত হতেই নায়ীব বলল,
“রিল্যাক্স ওয়াসিকা। আমি তোমাকে আয়না দেখাচ্ছি। তোমার আয়নায়, তুমি সাদা মনের মানুষ। তাই তোমার আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছো। যেমন, সিগারেট আসক্ত অনেক মানুষ সন্তানদের জন্য নিজের আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাইরে গিয়ে সিগারেট খেয়ে আসে। প্যাকেটগুলো বাচ্চাদের কাছ থেকে দূরে রাখে। যাতে তার সন্তানের কোনো ক্ষতি না হয়। তুমিও ঠিক তেমনি। পদ্মকে তুমি ভালোবাসো বলেই তুমি তোমার অনুভূতি আড়াল করে রেখেছো। তুমি বাইরে এসে, একা বসে কাঁদছো। তাদের একসাথে দেখলে খেতে পারো না, তোমার অস্থির লাগে এসব তোমাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তোমার আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে একদম মাথা ঠান্ডা রেখে। আমি তোমাকে কিছু এক্সপেরিমেন্ট কর‍তে দেবো। রাদকে ডেকে আনো। তোমাদের দু’জনকেই শুনতে হবে।”

আহি রাদকে ডেকে আনতেই নায়ীব বলল,
“ওয়াসিকার ভালোর জন্য কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কেমন এক্সপেরিমেন্ট?”

“ট্যুর।”

আহি অবাক দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকালো। নায়ীব আহিকে আশ্বস্ত করে মুচকি হেসে বলল,
“সাতদিনের এক্সপেরিমেন্ট। তোমরা বন্ধুরা মিলে একটা ট্যুর দিবে। এবং সেখানে অবশ্যই যাতে পদ্ম আর সেই ছেলেটি উপস্থিত থাকে। সাতদিনে সাতটি ভাগের রিপোর্ট আসবে। ওয়াসিকা কি অনুভব করছে? ও কি পরিমাণ দুর্বল হচ্ছে? ওর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কতোটুকু? এটাই এক্সপেরিমেন্টের বিষয়। রিপোর্ট আমি রাদের কাছ থেকেই নিবো। রিপোর্ট অনুসারে আমি তোমাকে মেডিসিন দিতে পারবো। এখন আমি কিছুই দিতে চাচ্ছি না। কারণ তুমি নিজেকে আড়াল করে রেখেছো। তোমাকে সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। সিচুয়েশনটা ফেইস কর‍তে হবে। এখন তুমি যতোই পালাতে থাকবে, ততোই তোমাকে অতীত জাকড়ে ধরবে। তুমি সত্যটা মেনে নিয়ে এর মুখোমুখি হও, দেখবে ধীরে ধীরে তোমার কাছে সব সহজ হয়ে যাবে।”

আহি রাদের দিকে তাকালো। নায়ীব এবার বলল,
“তোমাকে আজ বাইরে এনেছি। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো?”

আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকালো। নায়ীব বলল,
“তোমার চোখে এক বিন্দু অশ্রুও ভীড় করে নি। কিন্তু কাল তুমি কান্না করেছো। এর কারণ কি?”

“কি?”

“চার দেয়ালে আটকে থেকে তুমি ওকে ভুলতে পারবে না। বাইরে বের হও। ঘুরো। বাসায় বসে থেকো না। ক্লাস শেষ, বাইরে বসে ছবি আঁকো, ক্রিয়েটিভ কাজে যোগ দাও। লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়ো। শপিং করতে যাও। যা ইচ্ছে করো, কিন্তু চার দেয়ালের বাইরে বের হয়ে করো। আপতত এটাই সাজেস্ট করবো। আর এক্সপেরিমেন্ট যতো দ্রুত সম্ভব করে ফেলো।”

নায়ীব কথাগুলো বলেই আহি আর রাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“এক্সপেরিমেন্টটা করা কি খুব জরুরি?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই।”

“আফিফ কি আমাদের সাথে বাইরে যেতে চাইবে?”

“না। কিন্তু পদ্মের কারণে ও যেতে বাধ্য হবে। এখন পুষ্পকে বলেই সব ঠিক কর‍তে হবে।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“পুষ্পকে বলিস না যে এআরই আফিফ।”

“আরেহ, কখনো বলবো না।”

রাদ আহির হাত আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোকে কারো কাছে হারতে দেবো না। তোকে সব জয় করতে হবে। আবেগ, কষ্ট সব।”

“শুধু ভালোবাসাটায় অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাকে জয় করা কখনোই সম্ভব না।”

“জীবনে কিছু না কিছু অপূর্ণ থেকে যায়।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, “যদি সব জয় করতে পারতাম।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||আংশিক পর্ব||

৪৭।
মিসেস লাবণি এবং রিজওয়ান কবির আজই দেশে ফিরেছেন। বাসায় ঢুকতেই আহিকে দেখে তারা দু’জনই অবাক হলেন। আহি বাগানে বসে চুনিকে ইংরেজি শিখাচ্ছে। রিজওয়ান কবির বললেন,
“নতুন কাজ নিয়েছো না-কি!”

“হ্যাঁ বাবা। ভাবছি এভাবেই সময় পার করবো।”

“ভালো। তাজওয়ারের অফিসে গিয়েও বসতে পারো। কাজ শিখতে পারো। আফটার অল বিয়ের পর তোমাকে সেই বিজনেসটা সামলাতে হবে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“সরি, আমি কারো বিজনেস সামলাতে পারবো না। যা করবো নিজের জন্য করবো।”

“ওটা তোমারই বিজনেস।”

আহি বিরক্তমুখে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকাতেই মিসেস লাবণি বলল,
“আহা, এসেছি একটু বিশ্রাম নেই। তোমাদের বাবা-মেয়ের বাগবিতণ্ডার জন্য অনেক সময় পরে আছে।”

মিসেস লাবণি আর রিজওয়ান কবির চলে যেতেই চুনি চাপা স্বরে বলল,
“আফা, একটা ইংরাজি কও তো।”

“কীসের?”

“একটা ডাইনি আইসা বুইড়া খাটাশের মাথা খাইছে। এহন বুইড়া খাটাশ খালি ঘ্যানরঘ্যানর করে।”

আহি চোখ ছোট করে বলল, “বুইড়া খাটাশটা কে?”

“বড় সাহেব।”

চুনি কথাটি বলেই দাঁত দিয়ে জিহ্বায় কামড় খেয়ে বলল,
“আফা, বইলা দিও না। আমারে আবার বিয়া দিবো না। আম্মা তো কইছে, বড় সাহেব বিয়া দিলে ধুমধামে আমার বিয়া হইবো। ওই যে টিভিতে দেহায়, বউ এত্তো লম্বা গহনা গলায় ঝুলাইয়া রাখে, চারপাশে বাত্তি জ্বলে, টুসটাস বাজি ফুটে, জামাই আসে ঘোড়ায় চইড়া। আহা কি সুন্দর বিয়া!”

“তুমিও সেভাবেই বিয়ে করবে না-কি?”

“হ, আফা। বহুত শখ আমার। কিন্তু আমার কি টাহা আছে? আম্মাও তো কই, ওভাবে আমাগো বিয়া অয় না।”

আহি চুনির থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“তোমার বিয়ে ওভাবেই হবে।”

“সত্যি আফা?”

“হুম, একদম সত্যি।”

“এহন কও তো ডাইনি ইংরাজি কি হইবো।”

“উইচ।”

“আজকে থেইকা কমু, উইচ কাম, ইট বুইড়া খাটাশ হেড।”

আহি শব্দ করে হাসলো। আর বলল,
“তোমার এই ইংরেজির ভাংচুরগুলো আমার শুধরে দিতে ইচ্ছে করে না। খুব ভালো লাগে শুনতে।”

“আরো দু’একটা কমু?”

“বলো।”

“মিস চাঁদনী শাদি ধুমধাম সাউন্ড। ভেরি বিউটিফুল ইদার ওদার।”

আহি মুখ চেপে হাসছে। চুনির সাথে গল্প করেই আহির ভালো সময় কাটছে। ডাক্তার নায়ীবের পরামর্শে কাজ দিচ্ছে ভালোই।

(***)

গোসল সেরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো পদ্ম। আফিফ বিছানায় বসে ফাইল দেখছে। পদ্ম তার ভেজা চুল ঝাঁকাতেই পানির ছিঁটে আফিফের মুখে এসে পড়লো। আফিফ পদ্মের দিকে তাকাতেই পদ্ম লাজুক হাসলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসছো কেন?”

পদ্ম আফিফের কথায় ঠোঁট ফুলিয়ে তার দিকে ফিরে বলল,
“আনরোমান্টিক বর একটা। আপনি কিছুই বুঝেন না।”

আফিফ মুচকি হেসে পদ্মের দিকে হাত এগিয়ে দিতেই পদ্ম আফিফের কোলে এসে বসে পড়লো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“বেশি রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছো মনে হচ্ছে।”

“হুম, একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“বিয়ের পর আমরা তো হানিমুনে যাই নি।”

“গিয়েছিলাম তো।”

“কোথায়? কক্সবাজার গিয়েছিলাম। তাও আবার আপনার কাজে।”

“তখন চাকরি তো ছিলো না। এখন চাকরি হয়েছে। আমরা খুব শীঘ্রই আবার যাবো।”

পদ্ম অভিমানী সুরে বলল,
“চার বছর সংসার করেছি। শহর আর গ্রামের বাইরে আমি কোথাও পা রাখি নি।”

“তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে পারছি না, তাই সরি। একটু অপেক্ষা করো, পদ্মফুল।”

“অপেক্ষা কেন করবো? সুযোগ তো চলেই এসেছে।”

“কেমন সুযোগ?”

“পুষ্প ফোন করেছিলো। বলেছে একসাথে ঘুরতে যাবে।”

“কোথায়?”

“কক্সাবাজার।”

“তুমি তো গিয়েছিলে ওখানে!”

“আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি, পুষ্প, আহি, আমরা তো কখনো একসাথে যাই নি। আমার খুব ইচ্ছে ফ্রেন্ডদের সাথে কিছুদিন ঘুরবো। কিন্তু তখন বয়স কম ছিল, মা অনুমতি দেয় নি। এখন যদি আপনি সহ যান, তাহলে তো হলোই। আমাদের হানিমুনও হবে, ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরাও হবে।”

আফিফ কিছু বলতে যাবে তখনই পদ্ম অনুনয়ের সুরে বলল,
“প্লিজ। না করবেন না। আমি সত্যিই যেতে চাই। আমারও তো ইচ্ছে হয় ঘুরতে।”

আফিফ পদ্মের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে।”

“নিতে হবে না। আপনার কোম্পানিতে এমপ্লয়িদের শরৎকালীন ছুটি দেয়। ওটাতেই আমরা যাচ্ছি।”

“তোমাকে কে বলেছে শরৎকালীন ছুটি আছে?”

“আহি বললো।”

“ও কীভাবে জানে?”

“সেটা তো আমি জানি না। হয়তো খোঁজ নিয়েছে। আর ওর বাবা তো অনেক বড় ব্যবসায়ী। হয়তো সব কোম্পানিতেই দেয়।”

আফিফের মনে খটকা লাগলো। আহি কি ইচ্ছে করে এমন সময়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে যাতে আফিফও উপস্থিত থাকতে পারে? না-কি পদ্মের জন্যই সে খোঁজ নিয়েছিল?

(***)

বিকেলে রাদ আর আহি রিকশা নিয়ে ঘুরছিলো। হঠাৎ একটা গাড়ি তাদের রিকশার সামনে এসে থামলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে গাড়িটির দিকে তাকালো। তখনই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তাজওয়ার খান। সে রিকশার কাছে এসেই আহিকে টেনে নামালো। রাদ তেড়ে এসে বলল,
“এসব কেমন অসভ্যতা?”

তাজওয়ার শীতল কণ্ঠে বলল,
“অসভ্য লোকের প্রেমিকাকে নিয়ে সভ্য মানুষের উন্মুক্ত ঘোরাফেরা খুব একটা সভ্যতার লক্ষণও নয়।”

তাজওয়ার আহিকে টেনে নিজের কাছে এনে বলল,
“পাব্লিক প্লেসে তোমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করলে নিশ্চয় তুমি খুশি হবে না।”

তাজওয়ারের কথা শুনে রাদের হাত মুঠো হয়ে গেলো। আহি করুণ দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। তাজওয়ার বলল,
“সুইটহার্ট, গাড়িতে উঠো।”

রাদ আহির হাত ধরে বলল, “আহি, চল।”

তাজওয়ার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আহির হাত ছাড়ো, নয়তো পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে তোমার পরিচয় আর থাকবে না?”

রাদও দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কি করবি তুই?”

তাজওয়ার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“তুই? হুহ। বেশি কিছু না, তোমাকে আত্মাদের জগতে পাঠিয়ে দেবো। ভূত হয়ে যাবে, ভূত।”

তাজওয়ার বিশ্রীভাবে হাসলো। আহি রাদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“রাদ তুই যা। আমাদের বন্ধুত্ব দেখে অনেকে মনে করে অন্যকিছু। সবাই তো আর বন্ধুত্বের সীমারেখা জানে না। একসাথে ঘুরলেই যে প্রেমিক-প্রেমিকা হয় না, এটা এমন কুৎসিত মনের মানুষকে বোঝাতে পারবো না আমি। তুই যা, রাদ। শুধু শুধু ঝামেলা করিস না।”

রাদ আহির কারণে যেতে বাধ্য হলো। রাদ চলে যেতেই আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এবার আমার হাতটা ছাড়ো।”

তাজওয়ার আহির হাত ছাড়তেই, আহি রাস্তার পাশ থেকে একটা ইট কুঁড়িয়ে এনে তাজওয়ারের গাড়ির গ্লাসে ছুঁড়ে দিলো। সাথে সাথেই পেছনের গ্লাসটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেলো। ড্রাইভারও তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে এলো। আহি বাঁকা হেসে আরেকটা ইট উঠিয়ে সামনের গ্লাসটিও ভেঙে দিলো। তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি তাজওয়ারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“ডিয়ার উড বি হাব্বি, আমি তোমার ভাঙা গাড়িতে উঠতে পারবো না। তবে তুমি যদি চাও আমরা একসাথে যেতে পারি।”

আহি একটা রিকশা দেখিয়ে বলল,
“ওই যে রিকশা দেখছো, ওটা করে। অনেক তো গাড়ি চালিয়ে আমাকে শহর ঘুরিয়ে দেখিয়েছো। এবার রিকশা চালিয়ে আমাকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসো।”

“আই হেইট দিস আহি।”

আহি গালে হাত দিয়ে বলল,
“ওপস, তাহলে ভ্যান গাড়ি চালাবে? আচ্ছা চলো, আমরা লোকাল বাসে উঠি। তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে, আর আমি বসে বসে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো। তুমি ধাক্কা খাবে, আর আমি সিনেমা দেখবো। সিনেমার নাম হবে বিজনেস টাইকুনের একদিনের লোকাল বাস।”

আহি কথাটি বলেই শব্দ করে হাসলো। তাজওয়ার তার ড্রাইভারকে বলল,
“এখনই আরেকটা গাড়ি নিয়ে আসতে বলো।”

আহি বলল,
“ওপস, আমি থাকতে তুমি গাড়িতে উঠতে পারবে না, মিস্টার খান। রাস্তায় ইট কিন্তু আরো আছে।”

তাজওয়ার বলল,
“যাও তুমি যেখানে যাওয়ার। আমি আটকাচ্ছি না।”

আহি হেসে বলল,
“তাজওয়ার খান দেখছি তার প্রেমিকার চেয়ে বিলাসিতাকেই বেশি ভালোবাসে। একদিন কি আমার আবদার রাখা যায় না?”

“ইয়েস আহি। আই লাভ মাই রেপুটেশন। আমি তোমার জন্য রিকশা চালাতে পারবো না। কিন্তু তুমি চাইলে লাখের বেশি রিকশা কিনে তোমার নামে লিখে দিতে পারবো।”

আহি এবার শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি সেই প্রেমিকের প্রেয়সী হতে চাই, যে আমার নামে টাকা নয়, হৃদয় লিখে দেবে।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-২৩+২৪

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৩||

৪০।
ভারী পুরুষালী স্বর কর্ণগোচর হতেই আহির ঘুম ভেঙে গেলো। সে গায়ে জড়ানো কাঁথাটা হালকা সরিয়েই ভ্রূ কুঁচকালো। এরপর রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো, দরজা খোলা। আহি বার কয়েক পুষ্পকে ডাকলো। কিন্তু পুষ্পের সাড়াশব্দ নেই। আহি এবার কোমরে কাঁথাটা পেঁচিয়ে দরজার কাছে আসতে যাবে তখনই একজন অপরিচিত ছেলের মুখোমুখি হলো। আহি তার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। আগন্তুক ছেলেটি ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো। সে আহির হাসির কারণ বুঝতে না পেরে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি নিজের হাসি গিলে এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে ছেলেটির মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিলো। দরজা বন্ধ করেই কাঁথাটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মারলো আহি। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে পুষ্পকে কিছুক্ষণ বকলো। তার এক বদভ্যাস, রাতে ঘুমানোর সময় হাঁটু অব্ধি প্যান্ট পরেই সে ঘুমায়। এখানে এসেও আহি এমনই করেছে। গতকালই পুষ্পের আপুর বাসায় উঠেছে আহি। তৃষা আপু বাসায় একা থাকেন। তার স্বামী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বাসায় খুব একটা আসতে পারেন না। কয়েক মাস পর পরই আসেন। তাই আহি নিজের বাসায় যেভাবে ঘুমায়, এখানেও ওভাবেই ঘুমিয়েছিলো।

জামা-কাপড় পালটে বিছানায় শান্ত হয়ে বসলো আহি। নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারলো সে। মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই সে ভাবলো, অন্তত বাইরে তাকে একটু শালীন ভাবে চলতে হবে। আজ যদি এই অপরিচিত ছেলেটা তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলতো, তাহলে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হতো আহিকে।

(***)

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই আহি দরজা খুলে দিলো। পুষ্প রুমে ঢুকে বলল,
“উঠেছিস তাহলে?”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“দরজা খোলা রেখে গিয়েছিলি কেন? তুই জানিস না আমি ঘুমাচ্ছিলাম? ছেলে একটা কোথা থেকে চলে এসেছে!”

পুষ্প মুখ ছোট করে বলল,
“সরি আহি। হুড়োহুড়ি করে ছাদে গিয়েছিলাম। আমার জামাগুলো ওখানে শুকানোর জন্য দিয়ে এসেছি। আপুর বারান্দা তো অনেক ছোট। আর আপু অফিসে চলে যাচ্ছিল। ছাদের চাবিটা না-কি বাড়ির মালিককে দিয়ে দিতে হয়। আমি তো মালিককে চিনি না। আপুই দিয়ে যাবে।”

“আচ্ছা, কিন্তু ছেলেটা কে?”

“আরেহ, উনি উজ্জ্বল ভাইয়া।”

“এখানে কেন এসেছে?”

“আমি আসতে বলেছি তাই।”

“কেন আসতে বলেছিস? আমরা তো বাসায় পরশু যাচ্ছি।”

“তো আমরা এখানে এসেছি, একটু ঘুরবো না?”

“তো!”

“আরেহ ভাইয়ায় আমাদের ঘুরাবে। আমি তো এখানকার পথঘাট চিনি না। আর তুইও চিনিস না।”

উজ্জ্বলের কন্ঠে পুষ্প বেরিয়ে পড়লো। আহি মায়ের দেওয়া সেলোয়ার-কামিজ পরেই রুম থেকে বের হলো। উজ্জ্বল আহিকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আহি উজ্জ্বলের তাকানো দেখে হালকা হাসলো। আহিকে হাসতে দেখে সেও হাসি ফেরত দিলো। এদিকে পুষ্প রান্নাঘর থেকে নাস্তা এনে ডায়নিংয়ে রেখে আহির দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। আহি ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি?

পুষ্প জোরেই বলল,
“আহি তুই উলটো জামা পরেছিস?”

আহি চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। তারপর মুখ ছোট করে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। দেখলো উজ্জ্বল মুখ চেপে হাসছে। আহি তা দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে আবার রুমে ঢুকে পড়লো। আহি রুমে ঢুকতেই উজ্জ্বল হাসতে লাগলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“ভাইয়া, তুই হাসিস না তো। তখন মেয়েটা আর ঘুরতেই বের হবে না।”

উজ্জ্বল হাসি আটকে বলল,
“তোর বান্ধবীর মাথা নষ্ট!”

“চুপ কর, আমার বান্ধবীকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলবি না।”

এদিকে আহি জামাটা ঠিকভাবে পরে রুমের দরজা হালকা খুলে পুষ্পকে ডাকলো। পুষ্প আসতেই সে বলল,
“ভাই, আমার নাস্তাটা এদিকে পাঠিয়ে দে। আমি তোর ওই ভাইয়ার সামনে আর যেতে পারবো না।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আহি, রিল্যাক্স। এটা স্বাভাবিক।”

পুষ্প টেনে আহিকে রুম থেকে বের করে ডায়নিংয়ে নিয়ে এলো। আহি চেয়ার টেনে বসতেই উজ্জ্বলও তার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
পুষ্প ডায়নিংয়ে নীরবতা দেখে একনজর আহির দিকে তাকালো, আরেক নজর উজ্জ্বলের দিকে। সে বুঝতে পারলো আহি ইতস্ততবোধ করছে। তাই আহিকে স্বাভাবিক করার জন্য সে বলল,
“আহি, তোকে একটা মজার গল্প বলি, শোন।”

উজ্জ্বল খাওয়া বাদ দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“তখন আমি স্কুলে পড়তাম। ইদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। উজ্জ্বল ভাইয়াও গিয়েছিল। ভাইয়া তখন ভার্সিটিতে পড়তো। আমাদের গ্রামের বাড়িতে গোসলঘরটা বাড়ি থেকে একটু দূরে। ওখানে আবার কাপড় রাখার হ্যান্ডেল থাকে না। জামা-কাপড় দরজায় ঝুলিয়ে রাখতে হয়…..”

উজ্জ্বল গম্ভীরমুখে বলল,
“পুষ্প, খেয়ে নে। খাওয়ার সময় কথা বলিস না।”

পুষ্প বিরক্তির সুরে বলল, “তুই চুপ কর।”

পুষ্প এবার খোশমেজাজে বলল,
“এরপর শোন না আহি। ভাইয়াও গোসল করার জন্য জামা-কাপড় নিয়ে গোসলঘরে চলে গেলো।”

উজ্জ্বল পুষ্পের কথা আটকে দেওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পুষ্পের মুখ চেপে ধরলো। পুষ্প উজ্জ্বলের হাত সরিয়ে দিয়ে গলা উঁচু করে বলল,
“তারপর আমাদের গ্রামের এক চাচা, ভাইয়ার জামা আর প্যান্ট দরজার উপর থেকে নিয়ে পালিয়ে গেলো।”

উজ্জ্বল চোখ রাঙিয়ে পুষ্পের দিকে তাকালো। আর তাকে ধরার জন্য ডায়নিংয়ের চারপাশে ঘুরতে লাগলো। পুষ্পও ডায়নিংয়ের চারদিকে ঘুরছে আর উজ্জ্বলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আহি উৎসুক দৃষ্টিতে দুই ভাই-বোনের খুঁনসুঁটি দেখছে। পুষ্প দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলল,
“তারপর ভাইয়া তো পড়লো এক বিপদে। সেখানে দাঁড়িয়েই সে সবার নাম ধরে ডাকছিল। কিন্তু কেউই সাড়া দিলো না। শেষমেশ কি হলো জানিস?”

পুষ্প কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বলল,
“গোসলঘরের উপরে একটা কলা গাছ ছিল। ভাইয়া ওখান থেকে কলাপাতার ডাল ছিঁড়ে কিভাবে যেন কোমরে পেঁচিয়ে, সেখান থেকে বের হয়েছিল।”

উজ্জ্বল এবার থেমে গেলো। সে আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহি শব্দ করে হাসছে। সে এবার পুষ্পের দিকে চোখ ছোট করে তাকালো। এদিকে আহি উজ্জ্বলকে অবাক করে দিয়ে উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কলাপাতা কেন লাগিয়েছে? যেই কাপড় পরে গোসলঘরে গিয়েছিলো, ওটাই পরে বের হয়ে আসতে পারতো।”

উজ্জ্বল আহির আগ্রহ দেখে সেখানে আর দাঁড়ালো না। সে অন্য রুমে চলে গেলো। পুষ্প উজ্জ্বলকে চলে যেতে দেখে গলার স্বর উঁচু করে বলল,
“ওটাও দরজায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। তাই কলাপাতায় তার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল।”

আহি উজ্জ্বলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এবার পুষ্পের হাত ধরে চাপা স্বরে বলল,
“পুষ্প, থাম। তোর ভাইয়া হয়তো রাগ করেছে। তোর এভাবে বলা উচিত হয় নি। আমি তো অপরিচিত একজন। এসব কথা বাইরের কাউকে বলে না।”

“আরেহ, রিল্যাক্স।”

“না, কীসের রিল্যাক্স? সরি বলে আয়।”

পুষ্প চোখ ছোট করে বলল,
“মায়ের চেয়ে দেখছি মাসির দরদ বেশি।”

উজ্জ্বল যেই রুমে গিয়েছে আহি পুষ্পকে সেদিকে ঠেলে পাঠিয়ে বলল, “যা না।”

পুষ্প বাধ্য হয়ে উজ্জ্বলের কাছে গেলো। এদিকে উজ্জ্বল পুষ্পকে দেখে বলল,
“কেন এসেছিস? তোকে নিয়ে আমি আর কোথাও যাচ্ছি না। আমি এখন নিজের কাজেই বের হবো।”

পুষ্প ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“সরি, সরি, সরি। ভাইয়া, তুই না আমার লক্ষী ভাইয়া। প্লিজ রাগ করিস না। আহি খুব ইতস্ততবোধ করছিল। আর তুইও ওর উপর হেসেছিস। তাই তোর সিক্রেট বলে কাটাকাটি করে ফেললাম।”

“এভাবে কেউ কাটাকাটি করে? ওর কিছুই কাটে নি, উলটো আমার পুরো নাকটাই কেটে দিয়েছিস।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে উজ্জ্বলের নাকের দিকে তাকিয়ে রইলো। উজ্জ্বল বিরক্তির সুরে বলল,
“কি দেখছিস?”

“দেখছি, নাকটা তো আগের জায়গায় আছে।”

উজ্জ্বল বলল,
“যা এখন, বিরক্ত করিস না। আমি এখন আর বের হবো না মানে, হবো না।”

হঠাৎ আহি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পুষ্পের সেই স্কুল থেকেই তার ছেঁড়া। কোথায় কি বলতে হয়, ও জানেই না। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আর এসব ছোটখাটো ঘটনা সবার সাথেই ঘটে। আসলে আমার হাতে বেশিদিন সময় নেই। সিলেট অনেক বড় শহর। এটা তো দু’দিনে ঘুরে দেখা সম্ভব না। তাই দু’দিনে যতোটুকু ঘুরে দেখা যায়। আর আপনি যদি আমাদের নিয়ে না যান, তাহলে আমরা যদি পথে হারিয়ে যাই?”

উজ্জ্বল আহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আহি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ।”

উজ্জ্বল আহির মুখের ভাব দেখে মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা, তোমরা তৈরী হয়ে নাও।”

পুষ্প আহির কাছে এসে তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ! বাহ, বাহ, বাহ! বেশ তো পটিয়ে ফেলেছিস আমার ভাইকে।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আহির কথা কেউ সহজে ফেলতে পারে না।”

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই আহির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“আবার মুখটাকে অন্ধকার করে ফেলেছিস কেন?”

আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নেড়ে মৃদু হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“শুধু তারাই আমার কথা রাখে নি, যাদের আমি খুব বেশিই গুরুত্ব দিয়েছিলাম।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৪(১ম ভাগ)||

৪১।
সবুজবিথীর ভীড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাদা পরী। উজ্জ্বল স্তব্ধ হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির সাদা ওড়নাটি হালকা হাওয়ায় উড়ছে। হঠাৎ পুষ্প তার চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“প্রেমে-টেমে পড়ে যাচ্ছিস না-কি ভাই?”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প এক গাল হেসে বলল,
“আহির প্রেমে পড়বে না এমন ছেলে নেই। মেয়েটা আসলেই ভীষণ মিষ্টি।”

উজ্জ্বল মুচকি হেসে বলল,
“আর আমি মিষ্টি মেয়েদের ভীষণ ভয় পাই।”

“ভাইয়া, সব মেয়ে কিন্তু রীতিকা হয় না।”

“এসব কথা তুলিস না তো।”

“কেন তুলবো না? এতোদিন পর তোর সাথে দেখা হয়েছে। আর আমি এখনো সেই দেবদাসটাকেই দেখছি।”

“ব্রেকাপের পর নতুন সম্পর্কে না যাওয়ার অর্থ এই নয় যে আমি এখনো মুভ অন করতে পারি নি। নিজেকেও সময় দিতে হয়, বুঝলি?”

“বাই দা ওয়ে, রীতিকার কি অবস্থা?”

“বিয়ে করে বরের সাথে সংসার করছে। ওর খবর নেওয়ার সময় আছে না-কি আমার!”

“তৃষা আপু বললো শীঘ্রই তুই মামা হতে যাচ্ছিস।”

উজ্জ্বল বাঁকা চোখে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প হেসে বলল,
“রীতিকার বাচ্চা তো তোকে মামা বলেই ডাকবে। আর যাই বলিস, তোকে বিয়ে করলে সত্যিই কপাল খুলতো ওর।”

উজ্জ্বল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তখন বেকার ছিলাম, তাই চুটিয়ে প্রেম করার সময় পেয়েছি। এখন কাজে ব্যস্ত থাকি, তাই এসব ফাউল কাজে সময় দিতে পারছি না। আর রীতিকার কথা আমাকে বলিস না। ও নিজের সংসারে ভালোই আছে।”

পুষ্প এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি কিন্তু সত্যিই মিষ্টি। তুই ট্রাই করতে পারিস।”

“বেশি মিষ্টি মেয়েরা বাবা-মার বাধ্য সন্তান হয়। এমন বাধ্য সন্তানদের প্রেমে পড়ে দ্বিতীয়বার দেবদাস হতে চাই না।”

পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যদি আহির ভাগ্য রীতিকার মতো হতো!”

“মানে?”

“ওকে দেখ, চা-বাগানে এসেই কেমন হাসছে! ওকে এভাবে হাসতে দেখি না কতো বছর!”

“কি হয়েছে ওর?”

“অনেক কিছুই হয়েছে। কিছু জানি, কিছু এখনো অজানা। মেয়েটা ভীষণ চাপা স্বভাবের। স্কুলে ওকে যেই রূপে দেখেছি, তখন আর এখনের আহির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।”

“কেমন পার্থক্য!”

“মিস্টার রিজওয়ান কবিরকে চিনিস?”

উজ্জ্বল কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“বিজনেসম্যান রিজওয়ান কবিরের কথা বলছিস?”

“হুম।”

“হুম, চিনি তো। তাকে কে না চেনে!”

“উনি আহির বাবা।”

উজ্জ্বল চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“ভীষণ চাপে রেখেছে ওকে। ওর বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে। মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগই পায় না। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করে। এখন খানস গ্রুপের এমডির সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে।”

উজ্জ্বল অবাক কন্ঠে বলল, “তাজওয়ার খান!”

“চিনিস না-কি!”

“হ্যাঁ, ক্রিমিনাল একটা! কতোগুলো কেইস জমেছে জানিস? ভীষণ ডেঞ্জারাস লোক।”

পুষ্প উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“ওই ছেলেটার সাথেই আহির বিয়ে দেবে।”

উজ্জ্বল অবাক দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। এমন হাস্যোজ্জ্বল একটা মেয়ের জীবনে এতো ঝামেলা!

(***)

লাক্কাতুরা চা-বাগান ঘুরে মালনীছড়া চা-বাগান চলে গেলো তারা। আহি ছোট একটা বেঞ্চে একা একা বসে আছে। পুষ্প ছবি তুলতে ব্যস্ত। উজ্জ্বল খেয়াল করলো আহি একা বসে আছে। সে পুষ্পের হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই ছবি উঠাচ্ছিস, আর তোর ফ্রেন্ড একা বসে আছে। ওকে ডাক। ওসহ ছবি উঠাক।”

“ডেকেছি। বললো ভালো লাগছে না।”

“তাহলে তুই নিজের ছবি নিজে উঠা। আমি আর তোর ক্যামেরাম্যান হতে পারবো না।”

উজ্জ্বল কিছুক্ষণ পর আহির পাশে এসে বসলো। আহি একনজর উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়েই পুষ্পের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল নীরবতা ভেঙে বলল,
“তুমি ছবি তুলবে না?”

“না, ভালো লাগছে না।”

“কেন? জায়গাটা পছন্দ হয় নি?”

“হয়েছে। অনেক সুন্দর।”

আহি কথাটি বলেই মলিন হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“মনে আনন্দ না থাকলে, পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যই মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে না।”

উজ্জ্বল কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“বন, পাহাড় আর সমুদ্র এই তিনটির মধ্যে তোমার প্রিয় স্থান কোনটি?”

আহি মুচকি হেসে বলল, “বন।”

“কেন?”

“কারণ বন-বনানীর ভীড়ে অনেক রহস্য লুকিয়ে থাকে।”

“সমুদ্রে বুঝি রহস্য নেই?”

“সমুদ্রের রহস্য ভেদ করা সহজ নয়। কোনো না কোনো অজানা তথ্য থেকেই যায়। আর যেই রহস্য ভেদ করা যায় না, তাকে রহস্য বলা যায় না। তাকে বলতে হয় মায়াজাল। আপনি যতোই সেই জালে নিজেকে জড়াবেন, ততোই হারিয়ে যাবেন। কিন্তু বনভূমির রহস্যগুলো সহজেই খুঁজে বের করা যায়। দরকার শুধু ইচ্ছে শক্তি আর সুযোগ। কিন্তু অনেকেই সেই সুযোগ পায় না বা ইচ্ছেশক্তিই থাকে না।”

উজ্জ্বল ভ্রূ জোড়া কুঁচকে বলল,
“অনেক জটিল কথা। তুমি কি নিয়ে পড়ছো?”

“সাহিত্য নিয়ে।”

“তাই বলি। কথার মধ্যেই আলাদা গভীরতা আছে। সহজ-সরল মানুষ এসব বুঝবে না।”

আহি হাসলো। পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার পড়াশুনা?”

“আমার পড়াশুনা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে আমি একজন লয়ার।”

আহি অবাক হয়ে বলল, “আপনি লয়ার?”

উজ্জ্বল হালকা হেসে বলল,
“হ্যাঁ, অবাক হওয়ার মতো কিছু না।”

আহি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,
“এমন কোনো কেইস পেয়েছেন, যেখানে প্রাপ্ত বয়ষ্ক মেয়ে অভিভাবকের হাতে জিম্মি?”

উজ্জ্বল আহির দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক পর বলল,
“তোমাকে কেউ জিম্মি করে রেখেছে?”

আহি উজ্জ্বলের প্রশ্ন শুনে মলিন মুখে তার দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“আমি এমন কেইস পাই নি। তবে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।”

আহি উজ্জ্বলকে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। উজ্জ্বল আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“অভিভাবক যদি জিম্মি করে রাখে, তাহলে কেইস করার নিয়ম আছে। এমন কোনো আইন নেই, যেখানে অভিভাবক হলেই তার পক্ষে রায় যাবে। সত্যটাও বিচার করে দেখা হয়। আর অনেক বাবা-মা আছেন, যারা তাদের সন্তানদের জন্য ফেরেশতা হয় না, কিছু জালিমও আছে। তাদের জন্যও আইনগত ব্যবস্থা আছে।”

“প্রভাবশালী কারো জন্য আলাদা আইন আছে?”

আহির কথায় উজ্জ্বল চুপ হয়ে গেলো। এই দেশে প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যায়, এটাই নিয়ম। আহি উজ্জ্বলকে চুপ থাকতে দেখে মলিন হাসলো আর বলল,
“দেখেছেন, আপনি উত্তর দিতে পারলেন না। সত্যটা কি জানেন? আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান নয়। আসামী যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে কোনো ধারায় আপনি তাকে দন্ডিত করতে পারবেন না।”

উজ্জ্বল বলল,
“আধুনিক সমাজে একটা শব্দ খুবই প্রচলিত।”

“কি!”

“ভাইরাল।”

আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“মিডিয়া অনেক বড় শক্তি। কেউ যদি ভিক্টিম হয়, আর আইনের দৃষ্টিতে সে যদি সুষ্ঠু বিচার না পায়, তাহলে তার জীবনের একমাত্র শক্তি মিডিয়া আর পাব্লিক। মিডিয়ার দরকার নিউজ, পাব্লিকের দরকার বিনোদন, বিষয় আর হৈ হৈ করার একটা সোর্স। মাঝখানে লাভ হবে সেই ভিক্টিমের। অন্তত কয়েক মাসের জন্য হলেও প্রভাবশালীদের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করা যাবে। আর যদি এর লেজ বের করা যায়, যেমন একটা সূত্র ধরে অন্য একটা তথ্য ফাঁস করার ট্রেন্ড চালু করা যায়। তাহলে অপরাধীর সাহায্যকারীরা তার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আর তখন সে টাকা দিয়েও কোনো মানুষকে কিনতে পারবে না।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে ঘুরে বসে বলল,
“কীভাবে মিডিয়ার কাছে এমন তথ্য পৌঁছানো যাবে?”

“ভাইরাল হতে হবে। তবে এতোটাও সহজ নয়। অনেক শক্ত প্রমাণ, দৃঢ় মনোবল আর মানসিক শক্তি লাগবে। মিডিয়া নয়তো ভিক্টিমকেই রোস্ট করে ছেড়ে দেবে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এতো শক্তি নেই তার। নিজের জন্য একমাত্র সে-ই জীবিত। কাউকে তার জীবনের ঝামেলায় জড়িয়ে সংকটে ফেলতে চায় না আহি।

৪২।

বিকেলে উজ্জ্বল আহি আর পুষ্পকে নিয়ে গেলো ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই আকাশ মেঘলা হয়ে গেলো। পুষ্প নিজের ক্যামেরা উজ্জ্বলকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, তাড়াতাড়ি কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে, আমার সিলেট আসাটাই বৃথা হয়ে যাবে।”

উজ্জ্বল একনজর আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহি একটা পাথরের উপর বসে স্বচ্ছ পানিতে তার পা দু’টি ডুবিয়ে রেখেছে। আর একটু পর পর সে পা দু’টি ঝাঁকিয়ে পানির সাথে খেলছে। উজ্জ্বল পুষ্পকে কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই ভীষণ অস্থির। তোর ছবি তুলে দিতে দিতে আমার হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।”

পুষ্প ঠোঁট ফুলিয়ে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। আর টান দিয়ে নিজের ক্যামেরাটা নিয়ে নিলো। উজ্জ্বল ক্যামেরাম্যানের পদ থেকে মুক্তি পেয়েই ধীর পায়ে আহির কাছে এসে দাঁড়ালো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ছবি তুলে দিচ্ছেন না যে পুষ্পকে!”

উজ্জ্বল বলল,
“অনেক তো উঠিয়ে দিয়েছি। এখন একটু আশেপাশে ঘুরে দেখুক। এতো ছবি দিয়ে যে কি করবে মেয়েটা!”

আহি নিঃশব্দে হাসলো। উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কি ছবি কম উঠাও?”

“হুম, খুব একটা তুলি না। আমার স্ক্যান করতে ভালো লাগে।”

“বেশ তো! স্ক্যান করলে স্মৃতিতে অনেকদিন গেঁথে থাকবে। তবে ছবি একটা তুলে রাখতে হয়।”

আহি হাঁটুতে মাথা রেখে বলল,
“শিল্পীদের ছবি তুলতে হয় না। তারা ছবি বানিয়ে ফেলে।”

উজ্জ্বল আহির পাশে বসে বলল, “তুমি শিল্পী?”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বলল,
“অনেক দিন ছবি আঁকি নি। তবে একটা সময় অনেক ছবি এঁকেছিলাম। ছবি আঁকা আমার স্বপ্ন ছিল, আমার ভালোবাসা ছিল, আমার বেঁচে থাকার শক্তি ছিল।”

“এখন?”

“হারিয়ে ফেলেছি। স্বপ্ন, ভালোবাসা, শক্তি কিছুই আর নেই। আছি শুধু আমি আর আমার অতীত।”

“একটা ছবি এঁকেই না হয় দেখো। দেখবে আবার সব ফিরে পাবে।”

উজ্জ্বলের কথা শুনে আহি চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। উজ্জ্বল আহির চাহনি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। গভীর আর অস্থির নয়ন জোড়া কিছু একটা তো বলতে চায়ছে। ভাসা ভাসা জল জমেছে সেই নয়ন জোড়ায়। উজ্জ্বল চোখ সরিয়ে নিলো। আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিশ্চিত প্রেমে পড়ে যেতো। আহি তার হাঁটু আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমি শত ছবি আঁকলেও কিছুই ফিরে পাবো না। যেটা হারিয়ে যায়, সেটা ফিরে আসে না। যদি আসে, তাহলে হারিয়ে যাওয়াটা বেমানান।”

উজ্জ্বল ভাবুক মনে বলল, “যদি আসে?”

“কি আসবে?”

“যেটা হারিয়ে গেছে!”

আহি মলিন হাসলো। বলল,
“আমার হয়ে আসলে, আমি হারিয়ে যেতেই দেবো না।যদি আমার না হয়, তাহলে সেটা আমি ছুঁয়েও দেখবো না। সব জিনিসই আমার একার চাই। কারো স্পর্শ থাকুক, সেটা আমার সহ্য হয় না। যেমন আমি আমার বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। মা-ও আমার একার, বাবাও একদিক দিয়ে আমারই। ভাগ করে নেওয়া আমি শিখি নি। আমার জিনিসের ভাগ আমি কাউকে দেই না। যেহেতু হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন আমার ভাগের ছিল না, তাই আমি যেতে দিয়েছি।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“স্বপ্নটা কি কোনো মানুষকে ঘিরে?”

আহি ভাবুক কন্ঠে বলল,
“স্বপ্নটাই একটা রহস্য। সেটা অজানা থাকাই ভালো!”

“তোমার ফিলোসোফি আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।”

“লয়ার হয়ে এটুকু নিতে পারছেন না, আসামীদের তালগোল পাকানো কথায় তো পেঁচিয়ে যাবেন।”

“ভাগ্যিস আসামীরা তোমার মতো ফিলোসোফি নিয়ে চলে না। তবে আমি তোমার ফিলোসোফি বুঝে নিয়েছি। কিন্তু প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। যেটা তুমি জানাতে চাও না, সেটা জেনে যাওয়ার অহংকার আমি রাখবো না।”

আহি শব্দ করে হাসলো। পুষ্প আহির হাসির শব্দ শুনে পেছন ফিরে উজ্জ্বলের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। উজ্জ্বল পুষ্পের চাহনি দেখে আহির পাশ থেকে একটু সরে বসলো। পুষ্প মনে মনে বলল,
“দেবদাস বাবু দেখছি এবার জুলিয়েট খুঁজে নিয়েছে।”

(***)

সন্ধ্যার পর উজ্জ্বল আহি আর পুষ্পকে তৃষার বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে উজ্জ্বল গাড়ির কাচ নামিয়ে আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কাল কোথায় যাবে?”

আহি পেছন ফিরে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আপনি যেখানে নিয়ে যান।”

পুষ্প গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ব্যস, ব্যস। অনেক হয়েছে। কাল না হয় দেখা যাবে।”

উজ্জ্বল কপাল কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প গাড়ির কাছে এসে বলল,
“একদিনে রোমিও হওয়া যায় না। একটু সময় নিলে ভালো।”

উজ্জ্বল মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তোর মাথায় গোবর ছাড়া কিছুই নেই। আমি জাস্ট ফরমালিটি মেইনটেইন করছি।”

“খুব ভালো। তোর ফরমালিন যুক্ত ফরমালিটি দেখাতে হবে না।”

“তোর এতো কেন জ্বলছে? ছবি তুলে দেই নি তাই? না-কি দেবদাস থেকে প্রমোশন পেয়ে রোমিও হয়ে যাচ্ছি, আর তুই রীতিকার নাম ধরে আর জ্বালাতে পারবি না তাই! কোনটা?”

“দু’টোই। একটা ছবিও তুই সুন্দর করে তুলে দিস নি। ইচ্ছে করে করেছিস সব।”

“ভালো করেছি। এবার আমাকে ভবিষ্যতে আর ক্যামেরাম্যান বানাবি না।”

পুষ্প মুখ ছোট করে উপরে চলে এলো। এদিকে আহি ফ্রেশ হয়ে মাত্রই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে তখনই তাজওয়ারের কল এলো। তাজওয়ারের নম্বর দেখেই আহির মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে কলটা কেটে রাদের নম্বরে ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে সাথে সাথেই কলটা রিসিভ হলো। আহি বলল,
“ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিলি না-কি?”

রাদ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“বান্ধবীকে পেয়ে বন্ধুর কথা মনেই রাখিস নি!”

“সরি, সকাল থেকেই বাইরে ছিলাম।”

“কোথায় কোথায় গেলি?”

“চা বাগান, সাদা পাথর এই দুই জায়গায় গেলাম।”

“ভালো তো। এখন, কেমন আছিস বল?”

“ভালো আছি। তবে মাকে মিস করছি।”

“কথা হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

রাদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আহিও নীরব। রাদ এবার নীরবতা কাটিয়ে বলল,
“আহি, তোকে অনেক দিন দেখি নি তাই কেমন যেন অস্থির লাগছে।”

“কেন?”

“জানি না।”

“মন খারাপ তোর?”

রাদ মলিন মুখে বললো, “না।”

“তোর এই না মানেই তো হ্যাঁ। বল না রাদ। কি হয়েছে?”

রাদ প্রসঙ্গ পালটে বলল,”তুই কখন আসবি?”

“আসবো তো আগামীকাল।”

“কয়টায় আসবি?”

“রাত হবে।”

“পুষ্পের সাথে আসবি?”

“আসার তো ইচ্ছে আছে। এখন সিচুয়েশনের উপর নির্ভর করছে। বাবা যদি তাজওয়ারকে পাঠায়, তাহলে ওর সাথেই আসতে হবে।”

“রাতে ওই ছেলের সাথে আসবি? ভালো লাগছে না আহি। আসিস না এভাবে।”

“তুই ভয় পাচ্ছিস?”

“অবশ্যই পাচ্ছি।”

আহি নিঃশব্দে হাসলো। বলল,
“কিছু হবে না আমার। ও আমার সাথে খারাপ কিছু করবে না।”

“ওভার কনফিডেন্স রাখা ভালো না। বাসে করে আসিস। ট্রেনে আসলে ক্যাবিন ভাড়া করিস না। ওই ছেলের সাথে একা এক সেকেন্ডও থাকবি না।”

আহি মিষ্টি হেসে বলল,
“তুই যদি আমার বাবা হতি।”

রাদ শব্দ করে হাসলো। আহি বলল, “হাসছিস কেন?”

“তুই যখন পৃথিবীর আলো দেখেছিস, তখন আমি ঠিকভাবে দাঁড়াতেও পারতাম না।”

“ইশ! যদি তুই আমার বাবা হতি।”

“চুপ কর। তুই যদি আমার মেয়ে হতি কয়েশ বার তোর কান মলে দিতাম।”

“সাহস থাকলে দে। আমিও তোর কান মলে, টেনে, ছিঁড়ে কান ছাড়া করে ছাড়তাম।”

“বাবার সাথে বেয়াদবি! কি দিন দেখতে হচ্ছে!”

“মেয়েকে বেশি শাসন করলে এমনই হয়।”

“ছি! ছি! এমন ব্যবহার দেখার আগে আমি মরে কেন গেলাম না। সন্তানের কাছে এমন ব্যবহার মোটেও কাম্য নয়।”

আহি রাদের কথা শুনে হাসতে লাগলো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা রেস্ট নে। পরে কথা হবে।”

আহি কল কেটে দিতেই রাদ ফোনটা বুকের উপর রেখে মুচকি হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“তোর এই মিষ্টি হাসিটাই আমার মন ভালো করার ওষুধ। মিস ইউ আহি।”

রাদের কল কাটতেই আহির ফোনে আবার তাজওয়ারের কল এলো। এবার আহি ফোন সাইলেন্ট করে দিয়ে মনে মনে বলল,
“শ’খানেক কল দেওয়ার পরই আমি তোমার কল রিসিভ করবো, মিস্টার তাজওয়ার খান। তোমাকে বুঝতে হবে, আহির অ্যাপয়েনমেন্ট পাওয়াও এতো সহজ নয়।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৪(২য় ভাগ)||

৪৩।
আহি সিঁড়ি বেয়ে নেমে দেখলো উজ্জ্বল একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আহিকে দেখে উজ্জ্বল মৃদু হাসলো। উজ্জ্বল তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার বন্ধু রইস।”

আহি রইসের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। রইসও হালকা হেসে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। রইসের কৌতূকময় চাহনি দেখে উজ্জ্বল চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালো। রইস তা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এদিকে পুষ্প নিচে নেমে রইসকে দেখে বলল,
“ভাইয়া আপনিও যাচ্ছেন?”

রইস হেসে বলল, “হ্যাঁ।”

পুষ্প এক গাল হেসে মনে মনে বলল,
“ভালোই হয়েছে। রইস ভাইয়াকে বললে উনি নিশ্চিত আমার ছবি উঠিয়ে দেবেন।”

(***)

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট পৌঁছাতেই আহির ফোন বেজে উঠলো। আহি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো তাজওয়ারের পঁচাত্তরতম কল। কাল সারারাত ফোন দিয়েছে সে। আহি ফোন সাইলেন্ট করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সকাল থেকেই অনবরত কল দিচ্ছে তাজওয়ার। একটুও বিরতি দিচ্ছে না। আহি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে তার কল দেখে। এরই মধ্যে মিসেস লাবণিও কয়েক বার ফোন করেছেন। আহি ফোনের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তখনই উজ্জ্বল বলে উঠলো,
“নৌকা ভাড়া করে ফেলেছি। চলো।”

আহি নৌকায় উঠেই একপাশে গিয়ে বসলো। তখনই আবার ফোন বেজে উঠলো। পুষ্প বলল,
“বার বার তোকে কে কল করছে?”

আহি ফোনটা বের করে কাটতে যাবে, দেখলো রিজওয়ান কবির কল দিয়েছেন। বাবার কল দেখেই আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। এদিকে উজ্জ্বল আহির ভীত আঁখি জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আহি কল রিসিভ করতেই রিজওয়ান কবির বাজখাঁই সুরে বললেন,
“তাজওয়ার তোমাকে কল দিচ্ছে তুমি ধরছো না কেন?”

আহি মলিন মুখে বললো,
“এই মাত্র ফোন হাতে নিয়েছি। ফোনটা ব্যাগে ছিল। বিয়ে বাড়ি বলে কথা।”

উজ্জ্বল আর রইস ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। রিজওয়ান কবির বললেন,
“তাজওয়ার সিলেট পৌঁছে গেছে। তুমি ওকে এড্রেস দাও, তোমাকে নিতে যাবে।”

“এখন?”

“হ্যাঁ।”

“বাবা, আমি পুষ্পের সাথে ঘুরতে বের হয়েছি। বাসায় ফিরে দেই?”

“কার বাসায়?”

“আই মিন বাড়িতে। পুষ্পের বাড়িতে গিয়েই দেবো।”

“এখন অন্তত তাজওয়ারকে জানিয়ে দাও। ও অস্থির হয়ে যাচ্ছে।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অস্থির হলে হোক!”

“কি?”

“আচ্ছা, আমি কল ব্যাক করছি ওকে।”

আহি বাবার কল কাটতেই পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলেছে আংকেল?”

আহি বিরক্তির সুরে বলল,
“তাজওয়ার আমাকে নিতে সিলেট চলে এসেছে।”

তখনই আবার আহির ফোনে কল এলো। আহি এবার কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে তাজওয়ার বলল,
“তোমার এই এ্যাটিটিউড তোমাকে নিয়েই ডুববে।”

আহি শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি ফোনের কাছে ছিলাম না।”

তাজওয়ার আহির কন্ঠ শুনেই চুপ হয়ে গেলো। আহি কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল, “মরে গেছো?”

তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“কাইন্ড অব। তোমার মিষ্টি কন্ঠটা শুনলে আমার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়।”

“তাহলে তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত।”

“তুমিই তো আমার ডাক্তার।”

“সো স্টুপিড।”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“আহি, বাইরে আছো মনে হচ্ছে।”

“হ্যাঁ।”

“বাইরে আমার সাথে এমন ভাষায় কথা বলবে না। আই ডোন্ট লাইক ইট।”

আহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এন্ড আই ডোন্ট কেয়া’র।”

আহি কল কেটে দিয়েই ফোনটা বন্ধ করে দিলো। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“রিল্যাক্স আহি। এখন এসব না ভেবে সময়টা উপভোগ কর।”

আহি নৌকার পাঠাতনের উপর উঠে বসলো। সরু খাল বেয়ে নৌকাটি জলাবনে ঢুকে পড়লো। বৃষ্টি পড়ায় পানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। ভেজা গাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। হালকা সমীরণ বয়ে যাচ্ছে। সকালে বৃষ্টি পড়েছিল তাই স্যাঁতসেঁতে ভাবটা এখনো কাটেনি। উজ্জ্বল এবার আহির সামনে এসে বসলো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“জায়গাটা সুন্দর।”

উজ্জ্বল বলল,
“কিন্তু তোমার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বিরক্তিকর জায়গা দ্বিতীয়টা নেই।”

“আমার বন ভালো লাগে। আর এখানে তো বন আর জলের স্বাদ এক সাথেই পাওয়া যাচ্ছে।”

উজ্জ্বল মুচকি হাসলো। পুষ্প বলল,
“আহি একটা গান কর না। অনেক দিন তোর কন্ঠে গান শুনি না।”

উজ্জ্বল অবাক কন্ঠে বলল, “গানও পারো তাহলে?”

আহি বলল, “না। স্কুলে হালকা-পাতলা গেয়েছি।”

“হালকা-পাতলা গান গাওয়া যায় না-কি!”

পুষ্প শব্দ করে হাসলো আর বলল,
“আহি ভালোই গান করতো। চর্চায় থাকলে সংগীত শিল্পীদের হার মানতে হতো।”

এবার রইস বলল,
“তাহলে শুনিয়ে দাও, বনভূমির মাঝখানে জল। সেই জলে ভেসে যাচ্ছে নৌকা। নৌকায় বসে আছে এক তরুণী। তার কন্ঠে মিষ্টি মধুর গান।”

উজ্জ্বল বলল, “আর তার হাত আঁকছে অজানা গল্প।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল তার ব্যাগ থেকে ছোট একটা ক্যানভাস আর কিছু রং ও তুলি বের করলো। পুষ্প মুখে হাত দিয়ে বলল,
“ভাইয়া তুই তো সে-ই কাজ করেছিস।”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমি অনেকদিন ছবি আঁকি নি।”

উজ্জ্বল বলল,
“আজ আঁকবে। শিল্পীদের মন হালকা হয় ছবি এঁকে।”

উজ্জ্বলের জোরাজোরিতে আহি ক্যানভাসটি হাতে নিলো। গাছপালার শাখা-প্রশাখায় ঢেকে আছে শূন্য আকাশের অনেকাংশ। আহি সেই ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখার চেষ্টা করছে। রইস বলল,
“আহি পাশাপাশি গানও গেয়ো।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে এবার পাঠাতনের উল্টোদিকে ঘুরে পা দু’টি ঝুলিয়ে বসলো। সবাই আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি চোখ বন্ধ করলো।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই এক্সিভিশনের দিন, যেদিন আফিফ তার ছবি এঁকেছিল।

আহি এবার কন্ঠে গান ধরলো।

“সবকিছু বদলে গেলো এক রাতের নিমিষে,
তুমি হারিয়ে যাবে বলেছিলে কবে?
আজ তোমায় হারিয়ে আমি একা এই রাতে,
ভাবনাতে তোমাকে খুজেছি কি তবে?
ভাবি তুমি আসবে ফিরে,
ধরবে হাতগুলো,
বলবে তুমি কেঁদো না,
ফিরে এসেছি এই দেখো।
আর বলবে কেঁদো না তুমি,
এবারই তো শেষ কান্না,
বসে আছি আমি তোমার জন্যে…
আসোবনা, ফিরে আসো না,
আসো না, ফিরে আসো না।”

(***)

আফিফ ক্যাম্পাসের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। অনেক দিন আহি ক্লাসে আসে নি। মেয়েটা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে, আফিফ বুঝতে পারছে না। বার-বার তার মনে একটা প্রশ্নই হানা দিচ্ছে,
“আহি কি ভালো আছে?”

আজ চট্টগ্রামের আকাশ মেঘলা। ভোর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আফিফ সেই বৃষ্টির ধারার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আহির সেই কান্না ভেজা চোখ দু’টি। মনে হচ্ছে আকাশটাই আহি, মেঘগুলো তার চোখ আর বৃষ্টির ধারা তার অশ্রুকণা।

এদিকে রাদ আজ ক্যাম্পাসে যায় নি। সেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। আর তার কানে বাজছে সে একই গান।

“ফিরে এসেছি, ভালোবেসে,
তোমায় আমি প্রতিটিবার,
সব ব্যথা ভুলে, সব কষ্ট ফেলে,
এসেছি আজি আমি তোমার কাছে,
তবু তুমি নেই আজ আমার পাশে,
হারিয়ে গেছো তুমি বহুদুরে।
.
ভাবি তুমি আসবে ফিরে,
ধরবে হাতগুলো,
বলবে তুমি কেঁদো না,
ফিরে এসেছি এই দেখো।
আর বলবে কেঁদো না তুমি,
এবারই তো শেষ কান্না,
বসে আছি আমি তোমার জন্যে…
আসোনা, ফিরে আসোনা,
আসোনা, ফিরে আসোনা।”

তিন জোড়া চোখ, বিষন্ন মন, এক আকাশের নীচে।

রাদ বৃষ্টি স্পর্শ করে বলল,
“আহি, তুই কি কখনো আমার হয়ে ফিরবি?”

এদিকে আহি রং মেখে তুলিটা রাঙিয়ে নিলো আর মনে মনে বলল,
“জানি, তুমি কখনোই ফিরে আসবে না।”

অন্যদিকে আফিফ কয়েক পা পিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে আনমনে বলল,
“তোমাকে নিয়ে ভাবার অধিকার নেই। তবুও ভাবছি। কারণ সেই দিনগুলোতে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।”

৪৪।

আহি হাত ধুয়ে ক্যানভাসটি নৌকায় রেখেই নেমে পড়লো। উজ্জ্বল ক্যানভাসটি হাতে নিয়ে বলল,
“রেখে যাচ্ছো!”

আহি পেছন ফিরে ক্যানভাসটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই স্মৃতি ক্ষণিকের। আমি এটা এখানেই রেখে যেতে চাই।”

আহি কথাটি বলেই চলে গেলো। উজ্জ্বল আহির আঁকা ছবিটির দিকে তাকালো। খুব এলোমেলো একটা ছবি৷ হিজিবিজি রং মাখানো। উজ্জ্বলের কাছে কেন যেন মনে হলো এই ছবির কোনো বিশেষ অর্থ আছে। আরো গভীরভাবে ছবিটি দেখলে এর অর্থ বোঝা যাবে। উজ্জ্বল ক্যানভাসটি একটা পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।

(***)

সন্ধ্যায় ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৃষা আপুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নামলো আহি আর পুষ্প। আহির চোখেমুখে বিরক্তি রেখা ফুটে উঠেছে। উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পকে জিজ্ঞেস করলো,
“আহির কি হয়েছে?”

পুষ্প মুখ ছোট করে বলল,
“তাজওয়ার খান নিতে আসবে না-কি!”

“তোর সাথেই তো ফিরতে পারতো।”

“সেটাই তো ভাই। কেউ যদি আংকেলকে এই সহজ কথাটা বোঝাতে পারতো!”

আহি গাড়িতে বসেই চুপ করে রইলো। গন্তব্য রেল স্টেশন। নীরবতা বিরাজ করছে সবার মাঝে। উজ্জ্বল ড্রাইভারের পাশে বসে আছে। পুষ্প আর আহি পেছনে বসে আছে। আহি শক্ত করে পুষ্পের হাত ধরে রেখেছে। পুষ্প ঠিক বুঝতে পারছে, আহি তাজওয়ারের সাথে যেতে চায়ছে না।
হঠাৎ আহির ফোনটা বেজে উঠলো। আহি ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তাজওয়ারই কল দিয়েছে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাজওয়ার বলল,
“কোথায় তুমি?”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “স্টেশনে যাচ্ছি।”

“আমিও এখানে আছি। টিকেট করে ফেলেছি।”

আহি ‘হুম’ বলেই কলটা কেটে দিয়ে পুষ্পের কোলে মাথা রাখলো। পুষ্প আহির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আজ আবার আহির দম বন্ধ লাগছে। তার মনে হচ্ছে তাকে জেলখানায় আটকে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই কয়েকদিন তার ভালোই সময় কেটেছিল। কিন্তু ফিরে গিয়ে আবার সেই আবদ্ধ রুম, আফিফের স্মৃতি ঘেরা শহর, স্বয়ং আফিফই তার সামনে থাকবে। পাশাপাশি তার জীবনকে আরো বিভীষিকাময় করে তোলার জন্য তাজওয়ার খান আর লাবণি মেহেরার প্রভাবটাও ভুলে যাওয়া যায় না।

(***)

গাড়ি স্টেশনে এসে থামতেই আহি ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। ড্রাইভার ব্যাগপত্র নামিয়ে রাখতেই একটা আগন্তুক লোক তাদের দিকে এগিয়ে এলো। আহি লোকটির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আপনি কে?”

লোকটি বলল,
“স্যার আপনার ব্যাগ ট্রেনে উঠিয়ে দিতে বলেছেন!”

আহি তার ব্যাগটা শক্ত হাতে ধরে রাখলো আর বলল,
“আমার কাজ আমিই করতে পারবো।”

এরপর আহি উজ্জ্বলের সামনে এসে দাঁড়ালো আর মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ আমাদের সিলেট ঘুরে দেখিয়েছেন।”

উজ্জ্বলও মুচকি হাসি ফেরত দিলো। হঠাৎ একটা হাত আহির কাঁধ শক্ত করে স্পর্শ করতেই আহি পেছন ফিরে দেখলো তাজওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার উজ্জ্বল আর পুষ্পের সামনেই আহিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে হুট করে তার গালে অধর জোড়া ছুঁইয়ে দিলো।আহি চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হাই।”

পুষ্প হাঁ করে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল পুষ্পের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এবার তাজওয়ার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তোমার ফ্রেন্ডের হয়তো আমাকে পছন্দ হয়েছে।”

আহি এবার ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প একবার না সূচক, আরেকবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তাজওয়ার তা দেখে শব্দ করে হাসলো। এবার উজ্জ্বল বলল,
“পুষ্প ট্রেন ছেড়ে দেবে। উঠে যা।”

তাজওয়ার উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইউ!”

“আমি পুষ্পের কাজিন।”

“তোমার বিয়ে ছিল?”

পুষ্প আর আহি চোখ বড় বড় করে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো এখানে কোনো একটা ঘাপলা আছে। সে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“না, আমার বিয়ে ছিল না। অন্য কাজিনের বিয়ে ছিল।”

আহি উজ্জ্বলের উত্তরে আরো অবাক হলো। সে কী সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যেটা বললো? উজ্জ্বল তো জানেই না আহি এখানে পুষ্পের কাজিনের বিয়ে বলে ঘুরতে এসেছে। তারপরও উজ্জ্বলের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতে মন চায়ছে তার। কিন্তু তাজওয়ারের উপস্থিতিতে সেটাও করতে পারছে না।

(***)

তাজওয়ার আহিকে নিয়ে ট্রেনে উঠলো। আহি কেবিন দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আলাদা কেবিন?”

তাজওয়ার আহির কাছে এসে বলল,
“আমি তোমাকে আলাদা কেবিনে রাখবো? তুমি আর আমি একসাথেই থাকবো।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তারপর হনহন করে কেবিনে ঢুকে পড়লো। ঢুকেই দেখলো পাশাপাশি দু’টো বার্থ। আহি তার ব্যাগ উপরে উঠাতে যাবে তখনই তাজওয়ার তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে তার ব্যাগটা উপরে তুলে দিলো। আহি সরে দাঁড়াতে যাবে তখনই তাজওয়ার তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আহি তাজওয়ারকে সরানোর চেষ্টা কর‍তে লাগলো। কিন্তু সে তো আহিকে ছাড়ছেই না। আহি জোরে জোরে তাজওয়ারকে ধাক্কা দিতে লাগলো। আহির চোখেমুখে রাগ। চোখ দু’টিও ছলছল করছে। আহিকে এভাবে দেখে তাজওয়ারের মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। সে এবার কেবিনের দরজা লক করে আহিকে দরজায় ঠেকালো। আহি সরে যেতে নিবে তার আগেই তাজওয়ার তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো। আহি এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি যদি আমার কাছে আসার চেষ্টা করো, তাহলে অনেক খারাপ হবে।”

তাজওয়ার আহির কথার তোয়াক্কা করলো না। সে আহির অধর ছুঁইছুঁই দূরত্বে এসে থামলো। আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আর তাজওয়ার সেই অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে নেশা জড়ানো কন্ঠে বলল,
“আই লাভ ইউ, আহি।”

তাজওয়ার হুট করেই আহির ঘাড়ে তার অধর ছুঁয়ে দিলো। আহি সাথে সাথেই তাজওয়ারের চুলগুলো খুব জোরে টেনে ধরতেই তাজওয়ার বিরক্ত মুখে বলল,
“আমার চুল ধরার সাহস করবে না, আহি।”

“তুমিও আমাকে স্পর্শ করার সাহস দেখাবে না।”

তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“দেখাবো সাহস। কি করবে তুমি?”

আহির উত্তরের অপেক্ষা না করে তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে বার্থে বসিয়ে আহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আহি এবার রাগী স্বরে বলল,
“দেখো, আমাদের এখনো বিয়ে হয় নি।”

তাজওয়ার আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে চলো, এখনই বিয়ে করে ফেলি।”

“আমি তোমাকে কখনোই বিয়ে করবো না।”

“আমার মধ্যে তো কোনো সমস্যা নেই। আমি যথেষ্ট কুল এন্ড হ্যান্ডসাম।”

আহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুমি একটা অসভ্য লোক। মেয়েদের সাথে নষ্টামি করা বেড়াও। কোন মেয়ে অন্তত তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইবে না।”

তাজওয়ারের এবার রাগ উঠে গেলো। সে আহির কোল থেকে মাথা তুলে আহির চুল টেনে ধরলো। আহি তাজওয়ারের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে বলল,
“তাজওয়ার, চুল ছাড়ো আমার।”

“কেন, বেশি ব্যথা লাগছে?”

আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“আমারও লেগেছিল। কিন্তু আমি সহ্য করেছি। কারণ প্রেমিকার দেওয়া আঘাতও মিষ্টি হয়। আমারটা কি মিষ্টি লাগছে না?”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “বিষধর লাগছে।”

তাজওয়ার আহির চুল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ভালোবাসতে পারো নি তাই। কিন্তু তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আমার। আমিই তোমাকে ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসায় সব ব্যালেন্স হয়ে যাবে।”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“আমারও তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। তোমার মতো অসভ্য লোকের ভালোবাসা চাই না আমি। ছাড়ো আমাকে। তুমি একটা রেপিস্ট।”

তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর শান্ত ভঙ্গিতে নিজের বার্থে এসে বসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি তো জানোই আহি, রাজার অনেক রানী থাকে। আবার অনেক দাসীও থাকে। আর রানীদের এতে কোনো আপত্তিও থাকে না। কিন্তু তোমার আপত্তির শেষ নেই। জেলাস না-কি তুমি?”

আহি অবাক হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আবার বলল,
“আর রাজার যতো রানীই থাকুক, রাজা কিন্তু এক রানীতেই আসক্ত। যেমন সম্রাট আকবর শুধু তার যোধা বেগমকেই ভালোবেসেছিল।”

আহি শীতল কণ্ঠে বলল,
“কীসের সাথে কীসের তুলনা করছো? তারা অন্তত নারীদের সম্মান করতো। যারা দাসী ছিল, তারা স্বেচ্ছায় দাসী হয়েছিলো। আর তুমি হিংস্র পশু, যে বিনা অনুমতিতেই মেয়েদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক করো।”

তাজওয়ার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“চাইলে এখনই আমি তোমার এই অহংকর গুঁড়িয়ে দিতে পারি। এই চলন্ত ট্রেন থেকে তোমার লাফিয়ে পড়ারও সুযোগ নেই। আর আমার শক্তির সাথে তোমার এই কোমলপ্রাণ শরীর জিতবেও না। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরছি। তোমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করার জন্য আমার একটা গভীর সম্পর্ক দরকার, যেখানে কোনো চেঁচামেচি, জোরাজোরি থাকবে না। তুমি স্বেচ্ছায় আমার কাছে আত্মসমর্পণ কর‍তে বাধ্য হবে। আমি সেই সম্পর্কের অপেক্ষায় আছি, আহি। তবুও তুমি আমার উপর দোষ দিয়ে যাচ্ছো।”

তাজওয়ার এবার শান্ত ভঙ্গিতে বসে বলল,
“আমি রেপিস্ট নই। যা করেছে আমার বন্ধুরা করেছে। আমি কাউকে জোর করি নি। যারা আমার জীবন এসেছিল, দাসীর মতো স্বেচ্ছায় এসেছিল। কিন্তু তুমি তো আমার রানী। আমার প্রিয় রানী।”

আহি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহির গা ছাড়া হাবভাব তাজওয়ারের পছন্দ হলো না। সে হুট করে রেগে গেলো। আহির কাছে এসে তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“চাইলে আমি এখনি তোমাকে বিবস্ত্র করে এই ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে পারি, আমার কিচ্ছু হবে না। কিন্তু তুমি পুরো সমাজের চোখে কলংকিত হয়ে যাবে। তোমার এই সভ্য সমাজের মানুষগুলো যতোই বলুক, আমি, তাজওয়ার খান, অসভ্য লোক। তাদের বিন্দুমাত্র সাহস নেই আমার চরিত্রে আঙ্গুল তোলার। কিন্তু তারাই তোমাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে। সভ্য লোকেদের কটাক্ষ শুনতে শুনতে তুমি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার সামনে থাকা এই অসভ্য লোকটা এমন করবে না। আহি, আমি অন্য কারো সাথে যেমনই করি, তোমার সাথে কিছুই করবো না। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি করতে পারবো না এমন কিছুই নেই। যেই আমাদের মাঝখানে আসবে, আমি তার জীবনটাই ধ্বংস করে দেবো। আমি এমন করতে পারি, আহি।”

তাজওয়ার আহির দুই বাহু খুব শক্ত করেই ধরে রেখেছিল। যার দরুন ব্যথায় আহি চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। তাজওয়ার বুঝতে পেরে আহিকে ছেড়ে দিয়ে আহির কোলে মাথা রেখে বলল,
“সরি, আহি। এন্ড আই লাভ ইউ সো মাচ।”

আহি দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“এন্ড আই হেইট ইউ সো মাচ। তুমি নিজেকে যতোই রাজা দাবী করো, আমার রাজ্যে তুমি ভিখেরী মাত্র। আর যদি আমি রানী হয়েই থাকি, তাহলে এই রানী তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছে, সে তার সম্মান, তার অভিমান কারো সামনে নত হতে দেবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষা, মিস্টার তাজওয়ার খান। আমি তোমাকে হারিয়ে তোমার উপর জয় লাভ করবো।”

তাজওয়ার আহির কথা শুনে হাসলো। বিদঘুটে সেই হাসি। আহি শক্ত হয়ে বসে আছে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাজওয়ার তা দেখে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। এরপর আহির কোলে মাথা রেখেই তার ফোন বের করে একটা মেয়েকে কল করলো। ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই তাজওয়ার বলল,
“কাল রাতে তোমার ফ্ল্যাটে আসবো আমি। ভীষণ রাগ উঠেছে আমার। কাল সারারাত রাগ ঝাড়বো তোমার উপর।”

কল কেটে আহির মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“চাইলেই তো আর ফুল স্পর্শ করা যায় না। একদিন ঠিকই ভ্রমর হয়ে ফুল ছুঁয়ে দেবো।”

আহি মুখ চেপে রেখেছে। তাজওয়ার আহির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই ধোঁয়া সহ্য কর‍তে না পারলে তাজওয়ার খানকে চ্যালেঞ্জ করো না। বাই দা ওয়ে, আই লাইক ইট। ভেরি ইন্টারেস্টিং চ্যালেঞ্জ। আর একটা কথা মনে রেখো, বাঘ শিকার শেষে বাঘিনীর কাছেই ফিরে আসে। আর বাঘিনীদের শুধু বাঘের সাথেই মানায়। তোমার এই স্টেটমেন্ট শুনে মনে হচ্ছে আমরাই পারফেক্ট ম্যাচ।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-২০+২১+২২

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২০||

৩৬।
নগরী আজ বাদল ধারায় সিক্ত। যাত্রী ছাউনি আর দোকানের বাইরে ছোটখাটো জটলা। যে যেভাবে পারছে নিজেদের বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ছাতা হাতে নিয়ে দম্ভভরে হেঁটে চলে যাচ্ছে যার যার কাজে। আহি তাদের বিপরীত। টানা এক সপ্তাহ ক্লাসে না গিয়ে আজ সে বাধ্য হয়েই বের হয়েছে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। অর্ধেক যেতেই গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর সে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভার চাচার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে গাড়ি ঠিক করে বাসায় চলে যেতে বলল। ড্রাইভার চাচা রিকশা ঠিক করে দিতে চাইলে আহি না সূচক মাথা নেড়ে চলে এলো। ভারী বর্ষণে ভিজে নুইয়ে পড়েছে আহি। আজও তার ক্যাম্পাসের যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আফিফকে দেখলে যদি দুর্বল হয়ে পড়ে? কিন্তু কেন যে সে বাসা থেকে বের হয়েছে তা আহি নিজেও জানে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন যাত্রায় নেমেছে। বৃষ্টিতে তার পরণের জামাটা আঁটসাঁট হয়ে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। আহি সজ্ঞানে নেই। তার মনে হচ্ছে সে আফিফের পিছু পিছু হাঁটছে। কেমন যেন শরীরটা ভারী ভারী লাগছে তার৷ মাথাটাও ভন ভন করছে। আহির মনে হচ্ছে সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। সে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই তার পিঠটা কারো শরীরের সাথে ঠেকলো। আহি দুর্বল কন্ঠে বললো, “সরি।”

আহি পেছন ফিরে দেখলো তার পেছনে রেইনকোট আর হেলমেট পরা একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আহি তার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দু সাক্ষী, আমি শুধু তোমাকে ভালোবেসেছি।”

আফিফ আহির হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই আহির জ্ঞান ফিরলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কে আপনি? আর এভাবে আমার হাত ধরে আছেন কেন?”

আফিফের হাত থেকে আহি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতেই আফিফ তার হেলমেটটি আংশিক খুলে বলল,
“এখন চিনতে পেরেছো?”

আহি মনে মনে বলল,
“আমি তো তোমাকে আগেই চিনে ফেলেছিলাম। কিন্তু ভেবেছি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছিলো। হায় আল্লাহ! কি লজ্জায় পড়তে হচ্ছে আমাকে। আল্লাহ, মানুষটা না বুঝুক কিছু।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি এভাবে হাঁটছো কেন?”

আহি বিরক্তির সুরে বলল, “কীভাবে হাঁটছি আমি!”

আফিফ শান্ত কন্ঠে বললো, “বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছো।”

“তো!”

আফিফ আহির পালটা উত্তরে দমে গেলো। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ছাতা নিয়ে বের হও নি?”

“ছাতা থাকলে কি এভাবে ভিজতে হতো?”

আফিফ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“ক্যাম্পাসে যাচ্ছো?”

“হ্যাঁ, এতো সকাল সকাল এই ঝড়-বৃষ্টির দিনে কেউ ঘুরতে তো অবশ্যই বের হবে না।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বাইকে উঠো।”

“কেন?”

“আমিও ক্যাম্পাসে যাচ্ছি তাই।”

“রিকশা নিয়েই যাবো আমি। বাইকের পেছনে বসলে আমার সমস্যা হয়।”

আফিফ আহির কথা শুনে মিনিটের মধ্যেই একটা রিকশা ঠিক করে আহিকে উঠতে বলল। আহি তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো।

(***)

ক্যাম্পাসের সামনে নেমেই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো আহি। এমন ভেজা কাপড়ে কোনো মেয়ে কোনো কালে ক্লাস কর‍তে এসেছে কি-না সন্দেহ। রিকশায় রাদকে ফোন করে পুরো ঘটনাটা জানিয়েছিলো সে। রাদ ততোক্ষণে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সে আবার বাসায় ফেরত গিয়ে তার বোনের এক সেট জামা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে চলে এলো। আহি রিকশা থেকে নামতেই রাদ ছাতা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। আফিফও তখন ক্যাম্পাসে তার মোটরসাইকেল নিয়ে ঢুকলো। তাকে মাত্র পৌঁছাতে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। মোটরসাইকেলে চড়ে আফিফের পৌঁছাতে এতো সময় লাগলো কেন? সে কি তাহলে আহির রিকশার পিছু পিছু এসেছিল? এদিকে রাদ ব্যাগ থেকে তার বোনের জামাটি বের করে দিয়ে বলল,
“তোর মতো ছাগলী আমি জীবনে একটাও দেখি নি।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“আমার মাথা ঠিক ছিল না, রাদ। তুই তো জানিস আমি পাগল!”

“তুই পাগল না, তুই হচ্ছিস মাথামোটা। পাগল কখনো নিজেকে পাগল বলে না। এখন তুই নিজের বোকামি ঢাকার জন্য পাগলের আশ্রয় নিচ্ছিস।”

“দোস্ত, তুই এভাবে বকিস না। ঠান্ডা লাগছে আমার।”

“তো যা না। কুম্ভকর্ণের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামা দিলাম তো। গিয়ে চেঞ্জ করে আয়। না-কি এখন কোলে করে নিয়ে যেতে হবে।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লো।

(***)

প্রথম টাইম স্লট শেষ হতেই আহি ক্লাসে ঢুকলো। ক্লাসে ঢুকতেই আহির চোখ পড়লো মাঝখানের সারির প্রথম বেঞ্চে। আফিফ মনোযোগ দিয়ে কি যেন লিখছে। আহি তার দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আহির জন্য প্রথম বেঞ্চটা খালি রেখে দিয়েছে তার সহপাঠীগণ। প্রতিদিনই দ্বিতীয় বেঞ্চ থেকে বসা শুরু করে সবাই। প্রথম বেঞ্চ মানেই অতি মনোযোগী শিক্ষার্থী। এতো মনোযোগী ক্লাসের কেউই হতে চায় না। আর ভাগ্যক্রমে সেই মনোযোগী শিক্ষার্থীদের কাতারে পড়েছে আহি আর আফিফ। দু’জনেই দেরীতে ক্লাসে আসে বিধায় প্রথম বেঞ্চেই সিট খালি পায়৷

আহি আফিফের পাশের সারিতেই বসেছে। আহির উপস্থিতি টের পেয়ে আফিফ তার দিকে ফিরে তাকালো। আহিও আঁড়চোখে আফিফকে খেয়াল করলো। তার মন এখনো কচকচ করছে। ঘোরের মধ্যে সে আফিফকে যা বলেছিল, তা আফিফ না শুনলেই হলো।

কিছুক্ষণ পর ক্লাসে স্যার চলে এলো। দ্বিতীয় স্লটের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আহি চুপচাপ বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার পৃষ্ঠা উলটে শেকসপিয়ারের সনেট ১৪৭ পড়তে লাগলেন।

“𝙈𝙮 𝙇𝙤𝙫𝙚 𝙄𝙨 𝘼𝙨 𝙖 𝙁𝙚𝙫𝙚𝙧, 𝙇𝙤𝙣𝙜𝙞𝙣𝙜 𝙎𝙩𝙞𝙡𝙡”
𝑴𝒚 𝒍𝒐𝒗𝒆 𝒊𝒔 𝒂𝒔 𝒂 𝒇𝒆𝒗𝒆𝒓, 𝒍𝒐𝒏𝒈𝒊𝒏𝒈 𝒔𝒕𝒊𝒍𝒍
𝑭𝒐𝒓 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒍𝒐𝒏𝒈𝒆𝒓 𝒏𝒖𝒓𝒔𝒆𝒕𝒉 𝒕𝒉𝒆 𝒅𝒊𝒔𝒆𝒂𝒔𝒆;
𝑭𝒆𝒆𝒅𝒊𝒏𝒈 𝒐𝒏 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒅𝒐𝒕𝒉 𝒑𝒓𝒆𝒔𝒆𝒓𝒗𝒆 𝒕𝒉𝒆 𝒔𝒊𝒍𝒍,
𝑻𝒉𝒆 𝒖𝒏𝒄𝒆𝒓𝒕𝒂𝒊𝒏 𝒔𝒊𝒄𝒌𝒍𝒚 𝒂𝒑𝒑𝒆𝒕𝒊𝒕𝒆 𝒕𝒐 𝒑𝒍𝒆𝒂𝒔𝒆.
𝑴𝒚 𝒓𝒆𝒂𝒔𝒐𝒏, 𝒕𝒉𝒆 𝒑𝒉𝒚𝒔𝒊𝒄𝒊𝒂𝒏 𝒕𝒐 𝒎𝒚 𝒍𝒐𝒗𝒆,
𝑨𝒏𝒈𝒓𝒚 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒉𝒊𝒔 𝒑𝒓𝒆𝒔𝒄𝒓𝒊𝒑𝒕𝒊𝒐𝒏𝒔 𝒂𝒓𝒆 𝒏𝒐𝒕 𝒌𝒆𝒑𝒕,
𝑯𝒂𝒕𝒉 𝒍𝒆𝒇𝒕 𝒎𝒆, 𝒂𝒏𝒅 𝑰 𝒅𝒆𝒔𝒑𝒆𝒓𝒂𝒕𝒆 𝒏𝒐𝒘 𝒂𝒑𝒑𝒓𝒐𝒗𝒆
𝑫𝒆𝒔𝒊𝒓𝒆 𝒊𝒔 𝒅𝒆𝒂𝒕𝒉, 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒑𝒉𝒚𝒔𝒊𝒄 𝒅𝒊𝒅 𝒆𝒙𝒄𝒆𝒑𝒕.
𝑷𝒂𝒔𝒕 𝒄𝒖𝒓𝒆 𝑰 𝒂𝒎, 𝒏𝒐𝒘 𝒓𝒆𝒂𝒔𝒐𝒏 𝒊𝒔 𝒑𝒂𝒔𝒕 𝒄𝒂𝒓𝒆,
𝑨𝒏𝒅 𝒇𝒓𝒂𝒏𝒕𝒊𝒄-𝒎𝒂𝒅 𝒘𝒊𝒕𝒉 𝒆𝒗𝒆𝒓𝒎𝒐𝒓𝒆 𝒖𝒏𝒓𝒆𝒔𝒕;
𝑴𝒚 𝒕𝒉𝒐𝒖𝒈𝒉𝒕𝒔 𝒂𝒏𝒅 𝒎𝒚 𝒅𝒊𝒔𝒄𝒐𝒖𝒓𝒔𝒆 𝒂𝒔 𝒎𝒂𝒅𝒎𝒆𝒏’𝒔 𝒂𝒓𝒆,
𝑨𝒕 𝒓𝒂𝒏𝒅𝒐𝒎 𝒇𝒓𝒐𝒎 𝒕𝒉𝒆 𝒕𝒓𝒖𝒕𝒉 𝒗𝒂𝒊𝒏𝒍𝒚 𝒆𝒙𝒑𝒓𝒆𝒔𝒔’𝒅;
𝑭𝒐𝒓 𝑰 𝒉𝒂𝒗𝒆 𝒔𝒘𝒐𝒓𝒏 𝒕𝒉𝒆𝒆 𝒇𝒂𝒊𝒓 𝒂𝒏𝒅 𝒕𝒉𝒐𝒖𝒈𝒉𝒕 𝒕𝒉𝒆𝒆 𝒃𝒓𝒊𝒈𝒉𝒕,
𝑾𝒉𝒐 𝒂𝒓𝒕 𝒂𝒔 𝒃𝒍𝒂𝒄𝒌 𝒂𝒔 𝒉𝒆𝒍𝒍, 𝒂𝒔 𝒅𝒂𝒓𝒌 𝒂𝒔 𝒏𝒊𝒈𝒉𝒕.

কবিতাটি শুনে আহির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। সে একনজর আফিফের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“তোমার প্রতি ভালোবাসাও হয়তো আমার রোগ। যেই রোগ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তবুও সেই রোগ থেকে আমি নিজেকে মুক্ত কর‍তে চাই না। সবাই বলেছে ভুলে যেতে, কিন্তু আমার জন্য তোমাকে ভুলে যাওয়া এতো সহজ নয়। কিছু ভালোবাসা রক্তের সাথে মিশে যায়। আমার মৃত্যুতেই হয়তো এই ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটবে। আমি না হয় মানসিক রোগী হয়েই থাকি। কতো কবি তার প্রেমিকাদের ভুলতে পারেন নি। বিচ্ছেদের পরও শেকসপিয়ার তার প্রেমিকাকে নিয়েই কবিতা লিখেছিলেন। সেই হিসেবে আমি তো কিছুই না। তার মতো সৎ সাহস নেই আমার। সবার সামনে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে বলতে পারবো না আমি আমার এআরকে এখনো ভালোবাসি। তারা তো প্রেমের কবিতা লিখে নিজের প্রেম প্রকাশ করেছেন। তাদের তো প্রকাশের ভাষা ছিল, মাধ্যম ছিল। তাদের কষ্ট তারা ভাগ করে নিয়েছেন। কিন্তু আমার আশেপাশের কেউই সেই ভাষা বুঝবে না। কারণ এই সমাজে কষ্টের ভাগ নিতে কেউ জানে না। সবাই শুধু উপহাস করতে জানে। সবাই শুধু সমালোচনা করতে জানে। আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলতে তাদের দু’মিনিটও লাগবে না। আমার মতো প্রেমে পরুক না হয় একবার। কতোটা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি অনুভব করে দেখুক। দু’দিনও বাঁচতে ইচ্ছে করবে না। আফিফ, আমি তো তোমার প্রেমে উন্মাদ প্রেমিকা হয়ে গেছি। যেখানে আমার কিছুই নেই। সবই তোমার অভ্যাসের দাস।”

(***)

ক্লাস শেষ হতেই সবাই একে একে বেরিয়ে পড়লো। আহি এখনো চুপচাপ তার বেঞ্চে বসে আছে। আফিফও বেরিয়ে পড়েছে। এদিকে দশ মিনিট আহি নিজের জায়গায় স্থির হয়ে বসে ছিল। সে আফিফকে চলে যাওয়ার সময় দিচ্ছিলো। এতোক্ষণে হয়তো সে চলেও গেছে। সিঁড়িতে তার মুখোমুখি হতে চায় না আহি। তাই এতোক্ষণ ক্লাসে বসে ছিল।

ক্লাস এই মুহূর্তে একদম খালি। আহি তার জিনিসপত্র গুছিয়ে আফিফের বসা বেঞ্চটির কাছে গেলো। আলতো করে বেঞ্চটি স্পর্শ করে বলল,
“তোমাকে স্পর্শ করতে পারি না। কিন্তু এভাবে পরোক্ষভাবে তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়াটাও মিস করতে পারি না।”

আহি আফিফের বসা বেঞ্চটিতে বসলো। মাথাটা ডেস্কের উপর রাখলো। হঠাৎ সেই ভাস্কর্যের কথাটা মনে পড়ে গেলো তার। মিসেস লাবণি কি নির্মম ভাবে ভেঙে দিয়েছিলো সেই ভাস্কর্যটি! আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনমিনিয়ে বলল,
“এভাবে আর পারছি না আমি। আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি, তোমার অধিকার আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে। কিন্তু মানুষ নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পাগলের মতো ছুটতে থাকে, আর আমার এমন এক লক্ষ্য যার জন্য আমি ছুটা তো বহুদূর, চিন্তাও করতে পারি না।”

(***)

আফিফ মোটরসাইকেলে উঠেই চাবি ঘুরাতে যাবে তখনই খেয়াল করলো তার হাত ঘড়িটা নেই। বৃষ্টির ছাঁট না লাগার জন্য ঘড়িটা পলিথিনে মুড়িয়ে পকেটে রেখেছিল। পকেটে হাত দিতেই তার মনে পড়লো, ক্লাসের ডেস্কের নিচে রেখেছিল ঘড়িটা। সে মোটরসাইকেল থেকে নেমে আবার ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলো।

ক্লাস রুমে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো আফিফ। তার বেঞ্চে একটা মেয়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। মেয়েটা যে আহি তা জামা দেখেই চিনে ফেলেছে আফিফ। সে আর সামনে আগালো না। ধীর পায়ে পিছিয়ে ক্লাসের বাইরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। সকালে আহির বলা কথাটি সে শুনে ফেলেছিল। কিন্তু কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, সেটা বুঝতে পারে নি আফিফ। তাহলে কি আহি এখনো তাকে ভালোবাসে?

ধীরে ধীরে আফিফের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে এলো তার ছোট বোনের ক্রন্দনরত মুখ, তার বড় বোনের ফ্যানে ঝুলে থাকা নিথর দেহ আর তার মায়ের আহাজারি। আফিফ দেয়ালে মাথা ঠুকালো বার কয়েক। তার হাত মুঠো হয়ে এলো। শার্টের হাতায় চোখ মুছলো সে। এরপর ক্লাসের বাইরে থাকা ফুলদানিটি হালকা ধাক্কা দিলো। সেটা গড়িয়ে নিচে পড়তেই আফিফ সরে দাঁড়ালো। এদিকে শব্দ শুনে আহি বেঞ্চ থেকে মাথা তুললো। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। নিজের ব্যাগ নিয়ে কৌতূহলী মনে ক্লাসের বাইরে এসে দেখলো টুলের উপর রাখা ফুলদানিটি নিচে পড়ে আছে। আহি ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো। লাবীব দু’দিন আগে বলেছিল খালি ক্যাম্পাসে অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটে। আহির এই কথা মনে পড়তেই সে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে পড়লো।
আহিকে চলে যেতে দেখে আফিফ ক্লাসে ঢুকলো। নিজের বেঞ্চের ডেস্কে হাত রাখতেই দেখলো পানির মতো কিছু তার হাতে লেগেছে। সে বুঝতে পারলো আহি এতোক্ষণ কান্না করেছিল। আফিফ পকেট থেকে রুমাল বের করে ডেস্কের উপরে স্থান করে নেওয়া আহির অশ্রুকণাগুলো মুছে নিলো। তারপর নিচের ডেস্ক থেকে তার ঘড়িটি বের করে রুমালটির সাথে ঘড়িটিও পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।

৩৭।

আজকের দিনটি আহির জন্য চমৎকার একটি দিন। কারণ আজ সে অনেক বছর পর তার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি দু’জনই এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে গেছেন। আর এই সুযোগটা আহি কোনো ভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না। সে প্রথমদিনই মায়ের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো।

এই মুহূর্তে শহরের কম দামী রেস্টুরেন্টে বসে আছে আহি। খোলা পরিবেশটা ভালোই লাগছে তার। তাজওয়ার তার বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে চলে যায়। তাই সে এমন রেস্টুরেন্টে এসেছে, যেখানে তাজওয়ার কখনোই আসবে না। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটির আগমন ঘটলো। আহি সালমা ফাওজিয়াকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

(***)

পরণে কালো সুতির শাড়ি, গায়ে গাঢ় বাদামি বর্ণের চাদর, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় কালো হিজাব, হাতে একটা ছোট ব্যাগ, ঠোঁটের ফাঁকে প্রশস্ত হাসি। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দিকে এগিয়ে আসতেই আহি মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। তিনি কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো করে তার হাত ধরলেন। আহি মায়ের স্পর্শ পেয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারবো?”

সালমা ফাওজিয়া তার হাতের ব্যাগটি টেবিলের উপর রেখে নিজেই আহিকে জড়িয়ে ধরলেন। আহি মায়ের বুকে মাথা রাখতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনিট খানিক পর সালমা ফাওজিয়া আহিকে ছেড়ে দিয়ে তার কপালে চুমু খেলেন। আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“অনেকদিন পর মনে হচ্ছে, আমি মন থেকে খুশি। মনে হচ্ছে আজ এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখী কেউ নেই।”

সালমা ফাওজিয়া এবার চেয়ার টেনে আহিকে বসালেন। নিজেও আহির পাশে এসে বসলেন। এরপর আহির গালে হাত রেখে বললেন,
“মা, শুকিয়ে যাচ্ছো তুমি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করো না?”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“হুম ঠিকভাবেই খাই আমি। মুনিয়া খালাকে তো আমার জন্য রেখে গিয়েছিলে। খালা আমার অনেক খেয়াল রাখেন।”

“আচ্ছা! মুনিয়ার মেয়েটা আছে?”

“হ্যাঁ, চুনি আছে তো। এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।”

“আচ্ছা, ভালো। আর মোজাম্মেল? সে কি এখনো ও বাড়িতে কাজ করে?”

“হ্যাঁ চাচা তো বলে দিয়েছেন, যতোদিন আমি শ্বশুড় বাড়ি যাবো না উনি চাকরি ছাড়বেন না। এখন তো চাচা ঠিক করেছেন, তিনি চুনির বিয়ে দেবেন তার ভাইয়ের ছেলের সাথে।”

“বাহ! বেশ তো। এবার তোমার কথা বলো। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছো?”

“হুম।”

“ক্লাস কেমন যায়?”

“ভালোই। তুমি কোথায় কাজ করো?”

“একটা এনজিওতে। ছোট একটা ব্যবসাও আছে।”

“বাহ, বিজনেস উইমেন।”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। মেয়ের গালে চুমু খেয়ে বললেন,
“আমার মা’টা অনেক সুন্দর হয়ে গেছে।”

“তোমার মতো। তুমিও অনেক সুন্দর হয়ে গেছো।”

“তোমার বাবার ছত্রছায়া থেকে মুক্তি পেয়েছি তাই নিজের যত্ন নিতে পারছি।”

আহি হাসলো। বলল,
“তাহলে আমি মুক্তি পেলে এর চেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে যাবো।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। এদিকে আহি মেন্যু দেখায় মনোযোগ দিলো। সে মায়ের দিকে মেন্যুটা এগিয়ে দিতে গেলেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“তুমি খাবার অর্ডার করো। আজ আমার মেয়ের পছন্দের খাবারই আমি খাবো।”

আহি মুচকি হাসি ফেরত দিয়ে খাবার অর্ডার করলো। সালমা ফাওজিয়া এবার আহির হাত ধরে বললেন,
“তোমার নানু তোমার ছোট মামার বাসায় গেছে। এমনিতে আমার সাথেই থাকে। আমি তো ট্রেনিং থেকে ফিরেছি বেশিদিন হচ্ছে না। উনি না-কি আরো কিছুদিন ওখানে থাকবেন। তোমার ছোট মামার দু’টো জমজ বাচ্চা হয়েছে তো, তাই।”

“ভালো তো।”

“বলছি কি, তুমি না হয় দু’দিন আমার সাথে থাকবে। চলো!”

আহি মলিন মুখে বললো, “বাবা যদি জেনে যায়?”

“আইনগত ভাবে সপ্তাহে দু’দিন তুমি আমার সাথে থাকতেই পারো। কিন্তু মিস্টার রিজওয়ান কবির তো আইন মানেন না। তাই বলবো, তাকে মিথ্যে বলে এসো। ঘুরতে যাচ্ছি বলবে।”

সালমা ফাওজিয়া কথাটি বলেই ফুঁপিয়ে উঠলেন। মেয়ের হাতে চুমু খেয়ে বললেন,
“কি কপাল আমার! নিজের মেয়ের সাথে সময় কাটানোর জন্য পৃথিবীর সাথে ছলনা করতে হচ্ছে। একদিকে তোমার নানু জানলে আমাকে বকবেন। অন্যদিকে তোমার বাবা জানলে তোমার সমস্যা হবে।”

আহি মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“আমি মিথ্যে বলবো। নিজের ভালো থাকার জন্য একটা মিথ্যে বলা যায়। এমনিতেই কতো মিথ্যে বলি।”

সালমা ফাওজিয়া আহির থুতনিতে হাত রাখলেন। বললেন,
“সত্যিই আমার মেয়েটা সুন্দর হয়ে গেছে। চুলগুলোও অনেক লম্বা হয়েছে। বেণি কে করে দেয়?”

“আমিই করি। মা তো আমার পাশে নেই৷ তাই নিজের কাজ নিজেই করি।”

মেয়ের কথায় সালমা ফাওজিয়ার বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। মনে মনে বললেন,
“আমার রাজকন্যাকে আমি সেই ফেরাউনের হাত থেকে কখন মুক্ত কর‍তে পারবো?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২১||

৩৮।
আহি রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুম থেকে বের হতেই থমকে দাঁড়ালো। তার সামনের টেবিলে পদ্ম আর আফিফ বসে আছে। আর পদ্ম আফিফকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। আহি সেকেন্ড খানিক সেদিকে তাকিয়ে সামনে পা বাড়াতে যাবে তখনই পদ্ম তাকে দেখতে পেলো। পদ্ম আহির নাম ধরে ডাক দিতেই আফিফ থতমত খেয়ে গেলো। সে সামনে তাকিয়ে আহিকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। আহি পদ্মের ডাক শুনে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেও তাদের টেবিলের কাছে গেলো না। পদ্ম এবার নিজেই উঠে এলো। এরপর আহির কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“কি রে, আমাকে দেখেও দেখছিস না মনে হচ্ছে।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“আরেহ, এমন কিছু না। কেমন আছিস তুই?”

“ভালো রে। তুই কেমন আছিস?”

আহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। পদ্ম একনজর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা খুশির খবর আছে জানিস?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তুই প্রেগন্যান্ট!”

পদ্ম মলিন মুখে বলল, “না রে। অন্য একটা।”

আহি পদ্মের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“সরি। বল না, কি খবর?”

পদ্ম আহির হাত ধরে তাকে আফিফের সামনে নিয়ে এলো। আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আফিফও প্রতিত্তোরে মৃদু হাসলো। এবার পদ্ম আহিকে বলল,
“আফিফের চাকরি হয়ে গেছে।”

আহি মৃদু হেসে বলল, “বাহ। ভালো তো!”

“হ্যাঁ রে। তবে যেমন তেমন চাকরি নয়। চট্টগ্রামের নামকরা কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। আফিফ তাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।”

আহি শুকনো মুখে আফিফের দিকে তাকালো। এদিকে আফিফ কিছুক্ষণ পর পর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। পদ্ম আফিফের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”

আফিফ পদ্মের কথা শুনে জোরপূর্বক হাসলো। আহি তা দেখে বলল,
“আচ্ছা, আমি তাহলে যাই।”

পদ্ম বলল,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস? চল না একসাথেই লাঞ্চ করি।”

“না, আসলে আমি একা আসি নি।”

পদ্ম মজার ছলে বলল,
“ওহো, তাই না-কি? কেউ এসেছে তাহলে! কে সে? আমার বান্ধবীর এআর?”

আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। আহি আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে শুকনো হেসে বলল,
“মায়ের সাথে এসেছি।”

পদ্ম অবাক হয়ে বলল,
“তাই না-কি! আন্টিকে অনেক দিন দেখি নি। আচ্ছা, তুই যা। আন্টি অপেক্ষা করছেন হয়তো।”

আহি মাথা নেড়ে বিদায় নিয়ে নিজের টেবিলে চলে এলো।

(***)

সালমা ফাওজিয়া অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছেন আহি ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার পরই তার চোখে-মুখে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তিনি আহির হাত ধরে বললেন,
“আমার মায়ের কি হয়েছে?”

আহি হালকা হেসে বলল,
“কিছু হয় নি। চলো খাই।”

সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহির প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। আহি চামচ নিতে যাবে, তখনই সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরে বললেন,
“আজ আমি আমার মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবো।”

মায়ের কথা শুনে আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সালমা ফাওজিয়া হাত ধুয়ে এসে আহির মুখের সামনে খাবার মেখে ধরলেন। আহি আশেপাশে তাকাতেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আশেপাশে কি দেখছো, আহি? আমার মেয়েকে আমি খাইয়ে দিচ্ছি। কতো বছর পর আমি আবার মা হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই অনুভূতি কেউ বুঝবে না।এখন কি আমি আমার মেয়েকে একটু আদর করে খাইয়ে দিতে পারবো না?”

আহি মায়ের কথা শুনে মৃদু হেসে মুখ খুললো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহির চোখ মুছে দিলেন। এদিকে পদ্ম আর আফিফের খাওয়া শেষ হতেই পদ্ম আফিফের সামনে একটা বক্স বের করে রাখলো। আফিফ বক্সটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি এটা!”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল,
“আমি আপনার জন্য কেক বানিয়েছি। আপনি যখন বললেন নতুন চাকরি উপলক্ষে আজ আমরা বাইরে খাবো, তখনই এই কেকটা বানিয়েছিলাম। ভেবেছি একসাথে কাটবো। চলুন না ওখানে গিয়ে কাটি!”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কোথায়?”

“আহি আর আন্টিও তো আছেন। অনেক বছর আন্টিকে দেখি নি। উনার সাথেও দেখা হয়ে যাবে। আপনার সাথেও উনার পরিচয় করিয়ে দেবো।”

“কি দরকার, পদ্ম?”

“চলুন না। উঠুন তো!”

আফিফ যেতে না চাইলেও পদ্ম তাকে জোর করে আহিদের টেবিলের সামনে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে তারা দেখলো সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহিকে খাইয়ে দিচ্ছেন। পদ্ম আর আফিফকে দেখে আহি নিজের চোখ মুছে নিলো। পদ্ম সালমা ফাওজিয়াকে সালাম দিয়ে বলল,
“কেমন আছেন আন্টি?”

সালমা ফাওজিয়া সালামের উত্তর নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “পদ্ম?”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “জ্বি।”

সালমা ফাওজিয়া হেসে বললেন,
“আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, মা?”

“আমিও ভালো।”

“বসো, বসো।”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে তাকে জোর করে বসালো। সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি!”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“মা পদ্মের হাজবেন্ড। ছবিতে দেখেছো হয়তো।”

সালমা ফাওজিয়া আহির কথায় আফিফের দিকে তাকালেন। আফিফ শুকনো হেসে সালাম দিলো। সালমা ফাওজিয়া সালামের উত্তর নিয়ে এবার আহির দিকে তাকালেন। তিনি খেয়াল করলেন আফিফকে দেখে আহি বার-বার তার দুই হাত ঘষছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই ছেলেটাই সে-ই, যাকে আহি ভালোবাসতো। আহি নিজেই তাকে আফিফের কথা বলেছিল। আর তিনি মুনিয়া খালার কাছে শুনেছিলেন, পদ্মের বিয়ে থেকে ফেরার পরই আহির শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তারও তখন জানিয়েছিলো, আহির মানসিক অবস্থা ওতোটা ভালো নয়। তাহলে আফিফকে পদ্মের স্বামী হিসেবে দেখেই সেদিন আহির এমন অবনতি হয়েছিলো?

সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরলেন। আহি মায়ের দিকে তাকালো। তখনই পদ্ম কেকটা সামনে রেখে বলল,
“আন্টি, উনার চাকরি হয়েছে। তাই আমি নিজের হাতে এই কেক বানিয়েছিলাম। চলুন না, একসাথে কাটি।”

সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে আফিফকে বললেন,
“কংগ্রাচুলেশনস। কোথায় চাকরি হয়েছে?”

আফিফ বলল, “খানস গ্রুপে।”

সালমা ফাওজিয়া আর আহি দু’জনই অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো।

(***)

তমসাচ্ছন্ন গগন, বাতাসে ভেজা মাটির ঘ্রাণ, মৃদু সমীরণে বাগানের ফুটন্ত অলকানন্দাগুলো দোল খাচ্ছে। আহি বারান্দার স্লাইডিং ডোর খুলে দিয়ে তার এক পা বের করে রাখলো। বৃষ্টির ছাঁট তার সেই পায়ে এসে পড়ছে। আর আহি চোখ বুজে সেই স্পর্শ অনুভব করছে।

আহি অলকানন্দা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
“এআর, খুব তো সুখেই আছো। তুমি কি কখনো গভীর রাতে বৃষ্টি দেখতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলে?”

আহি পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“কেনই বা দাঁড়াবে? তোমার শরীরে উষ্ণ স্পর্শ দেওয়ার মানুষ তো তোমার পাশেই আছে। তুমি তো আর আমার মতো একাকীত্বে নেই, যে গভীর রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখবে। এআর দেখো, আজ আকাশে কতো শত মেঘ ভীড় জমিয়েছে। ঠিক সেই রাতের মতো। এমনই এক রাতে আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। একদম নিঃস্ব।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো হতাশার অশ্রু।

(***)

বারান্দায় এসে দাঁড়ালো আফিফ। বৃষ্টি আসায় বারান্দার মেঝেতে পানি জমে গেছে। আফিফ রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে সেই জমে থাকা পানিগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে শূণ্যতা। মনটা ভারী হয়ে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আহির অশ্রুসিক্ত চোখ। চার বছর আগে সে প্রথম সেই মেয়েটিকে দেখেছিল, যে তার জীবনের ক্ষণকালীন খেয়াল হিসেবে এসেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তগুলো আফিফের কাছে ভীষণ চমৎকার ছিল।
কিছু সুন্দর মুহূর্ত চোখের পলকে হারিয়ে যায়। আফিফও হারিয়ে ফেলেছিল সেই বেনামী চিরকুটের মেয়েটিকে। তবে হারিয়ে ফেলে নি, ইচ্ছে করেই হারাতে চেয়েছিল। চাইলে তো সে ধরে রাখতে পার‍তো। কিন্তু ধরতে পারে নি। আফিফের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে তার মাথাটা বারান্দার বাইরে বের করে দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আফিফের মুখে সেই বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা জায়গা করে নিচ্ছে।

(***)

আহি বারান্দায় এসে রেলিঙে হাত রাখলো। রেলিঙে জমে থাকা পানিগুলো স্পর্শ করতে করতে বলল,
“এই বৃষ্টি তোমাকে স্পর্শ করলে বুঝবে, আমি তোমাকে স্পর্শ করছি। আমি তো আর বৃষ্টি হয়ে তোমাকে স্পর্শ করতে পারছি না। কিন্তু এই আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আমার ভালোবাসার গল্প। আর আমার সেই গল্পটাই মেঘ হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দেবে। এভাবে যদি তোমাকে পাওয়া যায়, তাহলে এভাবেই হোক।”

আহি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেঘ, যাও না ও বাড়ি। তোমার সখী পবনমালাকে বলো, ঘুমন্ত এআরকে স্পর্শ করে দিয়ে আসতে। পবনমালার স্পর্শে একটু যদি তার চোখের পাতা নড়ে উঠে, এক রাত যদি সে আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখে, যেই স্বপ্নে তুমি তাকে জানিয়ে দেবে আমি ভালো নেই। আমি তাকে ভালোবেসে মরুভূমি হয়ে গেছি। যেই মরুভূমিতে বৃষ্টির স্পর্শ মরীচিকার মতো। যা ধরতে গেলেই মিথ্যে হয়ে যাবে।”

(***)

আফিফের মুখে বিন্দু বিন্দু জল। আহির মেঘমালা হয়তো নিজে এসেই তার আবদার পূরণ করে দিয়েছে। ছুঁয়ে দিয়েছে আহির প্রিয় অলকানন্দকে। আফিফ চোখ খুলে শূণ্য আকাশের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“কেন আমাকে মনে রেখেছো, খেয়াল? আমি তো তোমাকে কখনোই ভালোবাসতে পারি নি। তাহলে কেন মনে রেখেছো আমায়? কেন কষ্ট দিচ্ছো নিজেকে? আমি তো ভেবেছি, তুমি আমাকে মনেই রাখো নি। এতো বছর হয়ে গেছে। আমি তো পদ্মফুলকে নিয়ে ভালোই আছি। তুমি শুধু কিছু বেনামি পত্রের ভীড়েই রয়ে গেছো। পদ্মফুল আমার জীবনে আসার পর থেকে কোনো নারী আমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারে নি। তোমার জায়গাটা আমার জীবনে ক্ষণকালের জন্য ছিল। কিছু চিরকুটের ভীড়ে, কিছু বইয়ের পাতায়, কিছু রঙের ফাঁকে। আমি এখন সেগুলো স্পর্শও করি না। কারণ আমার পদ্মফুল আছে। আমি চাই তোমার জীবনেও এমন কেউ আসুক, যে তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসবে। তখন তুমি আমাকে মনে করার আর সময় পাবে না।”

(***)

আহি একটি অলকানন্দা ফুল স্পর্শ করলো। আর মলিন হেসে বলল,
“যতোবার তোমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি, ততোবারই দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার এই অশ্রুগুলো ঝরে গিয়েই তো আমাকে শান্তি দিচ্ছে। আমার জীবনে যদি একটু শান্তি থাকতো, তাহলে আমি হয়তো তোমাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু দেখো না, তুমি তো নেই-ই, মাও নেই, লিনাশা নেই, পদ্ম থেকেও নেই, কারণ ওকে দেখলেই মনে হয়, তুমি আর আমার নও। যারা আছে তারা শুধু আমার মনটা আরো ভেঙে দেওয়ার জন্যই আছে। অসুস্থ বাড়িতে, অসুস্থ মানুষের ভীড়ে, আমি এক অসুস্থ প্রেমিকা। তাহলে কীভাবে ভুলবো তোমাকে, বলো? একটু তো সুখী হতে পারি আমি। কোনো এক দিক দিয়ে তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে পরিপূর্ণ করতে পার‍তেন। আমার জীবনটা এখন একটা পরিহাস! যা-ই আমি চাইবো, তা-ই কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাবে, আর দিয়ে যাবে শিশির কণার মতো দুঃখ। যেই দুঃখ কেউ স্পর্শ করতে এলেই ধ্বংস হয়ে যাবে।”

(***)

আহি সকালে উঠেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে পুষ্পকে ফোন করলো। কাল ক্যাম্পাসেই সে আজকের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছিলো পুষ্পকে। পুষ্প আহির বাসায় আসতেই রিজওয়ান কবিরকে ফোন করলো আহি। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“বাবা, পুষ্পের কাজিনের বিয়ে। ও আমাকে ইনভাইট করেছে। বলছে সব প্রোগ্রামে যাতে থাকি।”

রিজওয়ান কবির বললেন,
“থাকো। এটা তো জানানোর বিষয় না।”

“থাকি বলতে, আমি কিছুদিনের জন্য ওখানেই শিফট হচ্ছি।”

“কোথায়?”

“পুষ্পের দাদার বাড়ি।”

“কোথায় ওর দাদার বাড়ি?”

“সিলেট।”

আহি হাতের ইশারা করতেই পুষ্প ওপাশ থেকে ন্যাকা কান্না জুড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, চল না, দোস্ত। লিনাশার সাথেও যোগাযোগ হয় না। পদ্ম তো এখন বিয়ে করে ফেলেছে। ও কি স্বামী ছাড়া আসতে পারবে? তুই চল না, প্লিজ। তুই ছাড়া আমার তো কোনো বন্ধুই নেই।”

আহি রিজওয়ান কবিরকে শুনিয়েই গলার স্বর নামিয়ে বলল,
“বাবাকে জানাচ্ছি। ওরা তো দেশে নেই।”

“আংকেল তো ভালোই। উনি বারণ করবেন না। তুই-ই যেতে চাচ্ছিস না। তাই তো কাল থেকে আমাকে ইগ্নোর করছিস। কি আছে এ বাড়িতে? আংকেল-আন্টিও নেই।”

আহি পুষ্পের কথায় মুখ চেপে হাসলো। পুষ্পও হাসছে। তাদের দেখে মুনিয়া খালা নিঃশব্দে হাসছেন আর চুনিকে নিয়ে কিছু বক্সে খাবার বাড়ছেন। এদিকে ওপাশ থেকে রিজওয়ান কবির বললেন,
“আহি, তুমি পুষ্পের সাথেই চলে যেও। সিলেটও ঘুরে আসবে। প্রোগ্রাম শেষ হলে আমি তাজওয়ারকে বলবো তোমাকে নিয়ে আসতে।”

আহি বাবার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। আহি ইশারায় পুষ্পকে থামিয়ে বাবাকে বলল,
“ও না আসলেও হয়। আমার ফ্রেন্ডের বাড়ির লোকেরা দেখলে কি ভাববে? যা-ই হোক, আমি যাচ্ছি তাহলে। আজই বের হবো। পুষ্প আমাকে আজই নিয়ে যাবে। সন্ধ্যায় না-কি সিলেটের জন্য বাসে উঠবে।”

আহি কথাটি বলেই কল কেটে দিলো। পুষ্প বলল,
“কথা শেষ?”

“হুম।”

“মুখটা বাঁকিয়ে ফেলেছিস কেন? আংকেল তো রাজী হয়েছে!”

“তাজওয়ারকে পাঠাবে আমাকে নিয়ে আসার জন্য।”

“তাজওয়ার, মানে তোর বাবার বন্ধুর ছেলে? আংকেল যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করতে চাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ।”

“এখন কি করবি? তোকে তো এবার মিথ্যেমিথ্যি সিলেট যেতেই হবে।”

“যাবো, না হয়। কিন্তু তোর বোনের বিয়ে মিথ্যেমিথ্যি কীভাবে হবে?”

পুষ্প কিছু একটা ভেবে বলল,
“আরেহ ওটা নিয়ে ভাবিস না। আমাকে বলিস কোনদিন সিলেট যাবি, আমি চলে যাবো। আমার দু’জন কাজিন ওখানেই থাকে। উজ্জ্বল ভাইয়া আর তৃষা আপু। আপু তো ওখানেই চাকরি করে। একা থাকে। আমি ওখানেই উঠবো। তুইও ওখানে চলে আসবি। তারপর উজ্জ্বল ভাইয়াকে ফোন করবো। উনি আমাদের স্টেশনে নামিয়ে দেবেন। আর তুই তাজওয়ারকে সেই ঠিকানায় দিস। সেখান থেকে নিয়ে গেলে সন্দেহ করার কোনো চান্সই থাকবে না।”

আহি হেসে বলল,
“ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষগুলোর মাথায় অনেক কিছু থাকে।”

আহি এবার তৈরী হয়ে এলো। মুনিয়া খালা তার হাতে বক্সগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এগুলা বড় মেডামের জন্য। ছোড মা, তুমি কইয়ো মেডামরে, আমরা তারে এহনো মনে রাখছি। তারে ছাড়া এই বাড়ি খালি খালি লাগে।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“হুম, আর খালা, আপনি আর চুনি ছাড়া কেউ জানে না আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। চাচাকেও বলবেন না। উনার বয়স হয়েছে। যদি ভুলে কাউকে বলে দেন, তাহলে অনেক ঝামেলা হবে।”

“চিন্তা কইরো না। আমরা কাউরে কিছু কমু না। তুমি যাও, মা। মায়ের লগে ভালো সময় কাটাইয়া আসো।”

আহি পুষ্পের সাথে বেরিয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়া আহিকে কলেজ রোডের সামনে থেকে এসেই নিয়ে গেলেন। মায়ের সাথে রিকশায় বসে আছে আহি। বৃষ্টি ভেজা শহরে রিকশায় চড়ার প্রশান্তি অনুভব করছে আহি। কারণ পাশে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে। আহি জানে, সামনের এই কয়েকটা দিন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো হতে যাচ্ছে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২২||

৩৯।
শূণ্যতা কেটে গেছে নতুন আবেশে। বায়বীয় জগতে যোগ হয়েছে নতুন ছন্দ। আর আহি বাঁধছে নতুন সুর। সেই সুরে সালমা ফাওজিয়ার আঁধার ঘেরা ফ্ল্যাটে ঠিকরে পড়ছে রবিকর।

সূর্যের আলো আহির চোখে এসে পড়তেই আবার আলোটা মিলিয়ে গেলো। আহি আধো চোখ মেলে জানালার দিকে তাকাতেই দেখলো সালমা ফাওজিয়া পর্দা টেনে দিচ্ছেন। আহি বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“তুমি আরেকটু ঘুমিয়ে নাও।”

আহি উঠে বসে বলল,
“অনেক বছর পর কাল রাতেই আমি শান্তিতে ঘুমিয়েছি। মনে হচ্ছিলো, এতো ভালো ঘুম আমার কখনোই হয় নি। মা, তুমি তো দেখছি শুধুই মেডিসিন নও, একদম এন্টিবায়োটিক।”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। আহি তার হাত ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে তার কোলে মাথা রাখলো। সালমা ফাওজিয়া আহির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আহি মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা, তুমি কি আমাকে এভাবেই তোমার কাছে রেখে দিতে পারবে না?”

সালমা ফাওজিয়া মলিন হাসলেন। মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
“একদিন অবশ্যই পারবো। তোমার জন্যই তো এতো পরিশ্রম করছি।”

আহি মাথা তুলে সালমা ফাওজিয়ার হাত ধরে বলল,
“এর আগে যদি তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হয়ে যায়?”

“তোমার অনুমতি ব্যতীত তোমাকে বিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারো নেই।”

“আমার ইচ্ছায় আজ পর্যন্ত কিছুই হয় নি। ওরা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে। কখনো তোমার ক্ষতি করবে বলে, কখনো রাদ আর লাবীবের ক্ষতি করবে বলে। লিনাশাকে হারিয়ে ফেলার পর রাদ আমার খুব কাছের বন্ধু। সাড়ে চার বছর আগে আমার জন্যই লিনাশার জীবনের দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। রাদের সাথেও যদি এমন কিছু হয়, তাহলে আমি আরো নিঃস্ব হয়ে যাবো।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,
“রাদের কিছু হবে না। ওরা শুধু তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে, আহি। তোমাকে আরো স্ট্রং হতে হবে। এখন উঠো, নাস্তা দিচ্ছি আমি।”

(***)

আজ আকাশ পরিষ্কার। মিষ্টি রোদ বারান্দা ছুঁয়ে দিচ্ছে। আহি সেই মিষ্টি রোদ তার গায়ে মাখানোর জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সালমা ফাওজিয়াও কিছুক্ষণ পর আহির পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি আহির চুলে হাত রেখেই বললেন,
“এতো অযত্ন কেন, আহি? আসো, আমি তোমার চুলে তেল লাগিয়ে দেই।”

আহি বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের পিছু পিছু চলে এলো। সালমা ফাওজিয়া তেল নিয়ে সোফায় বসলেন। আর আহি মেঝেতে বসলো। সালমা ফাওজিয়া হাতে তেল মেখে আহির মাথায় লাগিয়ে দিতে লাগলেন। আহি চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আহি তেল দেওয়া একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু আজ সে নিষেধ করবে না। কারণ এই মুহূর্তগুলোই তার কাছে অমূল্য।

সালমা ফাওজিয়া আহির চুলে তেল লাগিয়ে দিয়ে তার চুলে বেণি করে দিলেন। আহি পেছন ফিরে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল,
“এভাবে যদি রোজ তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, তাহলে আমার মাথাটা ঠান্ডা থাকতো।”

“আচ্ছা? এতোদিন বুঝি গরম ছিল?”

“উহুম, নষ্ট ছিল।”

(***)

বিকেলে সালমা ফাওজিয়া একটি ক্যাসেট নিয়ে এলেন। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মুভি?”

সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে বললেন,
“হুম। খুব সুন্দর মুভি।”

“কি নাম?”

“নাম ছাড়া মুভি। দেখার পর বরং তুমিই নাম ঠিক করো।”

আহি টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। সালমা ফাওজিয়া ক্যাসেটটি চালু করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আহির ছোটবেলার ছবি। সালমা ফাওজিয়া এবার আহির পাশে এসে বসলেন। দু’জন বসে সেই ভিডিও গুলো দেখতে লাগলো। আহির জন্মের আগে সালমা ফাওজিয়া প্রতি মাসে একটা করে ভিডিও তৈরী করেছিলেন। প্রতি মাসে আহির বেড়ে উঠার অনুভূতিটা কেমন সেটা তিনি ভিডিওতে ধারণ করেছিলেন। ভিডিওগুলো দেখেই আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে মায়ের কোলে মাথা রাখলো। এরপর স্ক্রিনে ভেসে উঠতে লাগলো আহির হাসপাতাল থেকে প্রথম ঘরে ফেরা, তার প্রথম হামাগুড়ি দেওয়া, বসতে শেখা, দেয়াল ধরে দাঁড়ানো, কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে সালমা ফাওজিয়ার কোলে ঝাপিয়ে পড়া। এসব দেখে আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে মায়ের হাত ধরে বলল,
“দিনগুলো অনেক সুন্দর ছিল, তাই না? আমি আবার কখন তোমাকে আগের মতো করে কাছে পাবো? আমি বাবার সাথে থাকতে চাই না।”

“আমিও তো তোমাকে নিজের কাছেই আনতে চেয়েছি। কিন্তু তোমার বাবা তোমাকে কখনোই হাতছাড়া করবেন না।”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“সব ঝামেলার মূল ওই তাজওয়ার খান৷ ওর জন্যই বাবা আমাকে বন্দি করে রেখেছে।”

সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কি বলছো, আহি? তাজওয়ারের জন্য কেন বন্দি করবে?”

“তুমি জানো না?”

“না।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মনে আছে আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই তাজওয়ার আমার পিছু নিতো! বাবা তো তখন থেকেই ওকে পছন্দ করতো। আমাকে বলতো আমি যাতে তার সাথে বন্ধুত্ব করি। কিন্তু আমি যখন স্কুলে, ওর তখন পড়াশুনা শেষের দিকে। এতো বড় ছেলের সাথে তো আমি কখনোই বন্ধুত্ব করবো না। আর তুমি যতোদিন বাসায় ছিলে, ততোদিন তাজওয়ারও বাসায় আসার সাহস পায় নি। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর খানদের বাসায় আসা যাওয়া যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গিয়েছিলো। বাবাকে তখন থেকেই আমি সহ্য করতে পারতাম না। বাবা সেই ছেলেকে হুটহাট আমার রুমে পাঠিয়ে দিতো। আর ছেলেটাও আমার অনুমতি ছাড়া আমার বিছানায় শুয়ে পড়তো। এমন ভাব দেখাতো, যেন আমার উপর একমাত্র তারই অধিকার। এসবে আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তুমি তো জানো, আমি এসব একদমই পছন্দ করি না। এমন অভদ্র ছেলের সাথে বাবা তখনই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। সিরাজ খান না-কি আলটিমেটাম দিয়েছেন, আমার সাথে তাজওয়ারের বিয়ে দিলে, খানস গ্রুপের ত্রিশ ভাগ অংশ বাবার নামে লিখে দেবেন। আর তাজওয়ার তার সবকিছু আমার নামে লিখে দেবে। আর এরপর থেকেই বাবা পালটে গেছে। মা, তাজওয়ারের কাছে থাকলে আমি একদম সেইফ ফিল করি না। ও কেমন যেন! ওর সম্পর্কে অনেক খারাপ তথ্য পেয়েছি। রিসেন্টলি ওর প্রাক্তন প্রেমিকা আমাকে ফোন করে জানিয়েছে, তাজওয়ার না-কি তার সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভ ছিল। এরপর আমি ইউকে থেকে ফেরার পর তাজওয়ার আর সম্পর্ক রাখতে চায় নি। কিন্তু মেয়েটা ওকে ছাড়ছিল না, তাই ওর বন্ধুদের দিয়ে মেয়েটার সাথে অনেক জঘন্য কাজ করেছে, যেটা তোমাকে বলতেই পারছি না।”

আহি কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“মা, তুমিই বলো, এমন একটা ছেলের সাথে কোনো বাবা কি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়?”

সালমা ফাওজিয়া চুপ করে রইলেন। আহি আবার বলল,
“এমনিতেই আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকে হারিয়ে ফেলেছি। সেই ট্রমা থেকে এখনো বের হতে পারছি না। তাহলে নতুন করে তাজওয়ার নামক টক্সিক মানুষটাকে আমার জীবনে এনে আমি কেন আরো ট্রমার মধ্যে থাকবো? মা, আমি ওই বাড়িতে গেলে পাগল হয়ে যাবো। ওপেনলি ওরা বাড়িতে মেয়ে এনে, যাচ্ছেতাই করে। এমন পরিবেশে আমি বিয়ে করবো, আমার সন্তান আসবে, এটা আমি মানতেই পারছি না। যেখানে তোমার আর বাবার অসুস্থ সম্পর্কের কারণে আমার কৈশোরকাল, যৌবনকাল সব শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই একই পরিবেশ দিতে চাই না।”

সালমা ফাওজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তোমার বাবাই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু। তাজওয়ার সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানি না। কিন্তু সিরাজ খান ভালো মানুষ নয়, এটা অনেকেই জানে। তাহলে তার ছেলে আর কেমনই বা ভালো হবে? কিন্তু তোমার বাবা সেই শুরু থেকেই তোমাকে ব্যবহার করছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“তোমার মনে আছে, তোমার বাবা আমাকে একবার বেধড়ক পিটিয়েছিল, আর এরপর আমি আমার আট মাসের বাচ্চাটা হারিয়ে ফেলেছিলাম?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার বাবা আমাকে কেন মেরেছে জানো?”

“কেন?”

“কারণ তিনি জেনে গিয়েছিলেন, তোমার দাদা তার নামে কোনো সম্পত্তি লিখে দেন নি। আগ্রাবাদে তোমার দাদার একটা বাড়ি আছে। বিশাল বাড়ি। তাছাড়া ঢাকায় তিনি অনেকগুলো জায়গা কিনেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি এমন উইল করেছিলেন, যেখানে লেখা ছিল তোমার বাবার সন্তানরাই শুধু সেই সম্পত্তির মালিক হতে পারবে। তোমার বাবা কিছুই পাবেন না। তাই তিনি ছেলে চান নি। যেখানে বাবা-মা নিজ সন্তানের জন্য খেটেখুটে টাকা সঞ্চয় করে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে পড়ে, সেখানে তোমার বাবা সম্পদ ভাগাভাগি না হওয়ার জন্য সন্তান নেন নি। তোমার বাবা শুধু টাকা ভালোবাসেন। নিজে তো অনেক বড় ব্যবসায়ী। চাইলে তার বাবার সম্পদ ছাড় দিতে পারতো। কিন্তু তার ক্ষোভ জন্মেছিল। তার ইগোতে আঘাত এসেছিল। কেন তার নামে লিখে না দিয়ে তার সন্তানের নামে লিখে দিয়েছে! আর তাই মিস্টার রিজওয়ান কবির আমার বাচ্চাকে আর পৃথিবীতেই আসতে দেন নি। এখন বাকি তুমি। তুমি মেয়ে, তোমার সাথে যার বিয়ে হবে সেও সেই সম্পত্তির মালিক হবে। আর তোমার বাবা এজন্যই তোমাকে আমার সাথে থাকতে দিচ্ছে না। আর তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হলে তোমার বাবা এমনিতেই যে-কোনো ভাবে সেই সম্পত্তি পেয়ে যাবে। আর না পেলেও তার কিছুই আসে যায় না। সে তো এমনিতেই অনেক টাকার মালিক।”

“মা, আমি যদি বাবাকে সেই জায়গা আর বাড়িটা লিখে দেই, তখন কি আমি মুক্তি পাবো?”

“না। তোমার বাবার তো সেই জায়গা লাগবেই না। তার কিসের অভাব আছে, বলো? তোমার বাবা আসলে তোমার দাদাকে হারাতে চায়ছে। তার ইগো তখনই সেটিস্ফাইড হবে, যখন সে তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে। যদি তোমার দাদা সেই উইলটা না করতেন, তাহলে তোমার বাবা তোমাকে আর ধরে রাখতো না। আর তার এতোটা পরিবর্তনও হতো না। হয়তো লাবণীর প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মানুষটা এতোটা নিচু মনের ছিল না। হয়তো বা ছিল, ভালোবাসতাম বলে তাকে চিনতে পারি নি। কিন্তু তোমার বাবা আমাকে কখনোই ভালোবাসে নি, কারণ আমি তার দৃষ্টিতে নিতান্তই সাধারণ ছিলাম। আমি তার চোখে মডার্ন নারী ছিলাম না। কিন্তু লাবণি ছিল ইয়াং মেয়ে, তার ফ্যাশন সেন্স ভালো, সে জিন্স-টপস পরে, দশজন ছেলের সাথে সহজে ওঠাবসা করতে পারে। আমি পারতাম না। আমি শাড়ি পরি, সাধারণ ভাবে চলি। আর আমাদের মতেরও অমিল হতো। আমি অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। শুধু তোমার জন্যই সেই বাড়িতে পড়েছিলাম। এখন দেখো, তোমাকেও সেভাবে চালাচ্ছে।”

আহি মাথা নিচু করে রইলো। সালমা ফাওজিয়া আহির গালে হাত রেখে বললেন,
“অনেক বড় হয়ে গেছো তুমি। এখন একটু শালীন ভাবে চলাফেরা করতে হবে। এই সমাজটা এতোটাও ভালো না, আহি। এই দেশের সংস্কৃতির সাথে তোমার এই পোশাক যায় না। জানি তোমার বাবা তোমাকে এভাবেই চলতে বাধ্য করছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দিতে পারো। একটু স্ট্রং হও। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে তুমি তোমার জন্য স্ট্যান্ড নিতে পারো। এতোটুকু স্ট্যান্ড নিতে না পারলে, তুমি কীভাবে তোমার বিয়ে আটকানোর সাহস দেখাবে? কীভাবে বলছো যে তুমি ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে? আগে নিজেকে শক্ত করো। তুমি শক্ত হলে, তোমার পাশে দাঁড়ানোর অনেকেই আছে। তোমার মা আছে।”

আহি সালমা ফাওজিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। তিনি আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি অনেক সুন্দর আহি। তোমাকে শাড়ি পরলে, সেলোয়ার-কামিজ পরলে ভালোই লাগবে৷ অন্তত লং টপস পরতে পারো, গায়ে ওড়না ঝুলাতে পারো। আর স্লিভলেস পোশাক তো একদমই বেমানান।”

“আমি তো স্লিভলেস পরতে চাই না, ওড়না ঝুলিয়েই আমি বাসা থেকে বের হই। কিন্তু মাঝে মাঝে মিসেস লাবণির পিএ সুনেহরাহ এসেই আমার জামা-কাপড় সিলেক্ট করে দেয়। আমার খাওয়া, পরা, সবকিছুই তাদের পছন্দে হয়। যদিও ইউকে’তে আমি নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পেরেছি। আর ওখানে এমন ড্রেস পড়লে কেউ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে না।”

“তাও, আহি। তোমার বন্ধুরা তো দেশের ছেলে। রাদ, লাবীব, ওরা কি অন্য দেশের? ওরা এই দেশের ছেলে। ওরা তোমাকে সম্মান করে, তাই হয়তো বাজে দৃষ্টিতে তাকায় না। কিন্তু কারো নিয়ত সম্পর্কে তুমি কতোটুকুই বা জানবে?”

“কি করবো আমি এখন?”

“আপতত স্লিভলেস পরো না। ওদিন তুমি এমন পোশাকে রাদের সাথে রিকশা করে কোথায় যেন যাচ্ছিলে। আমি তোমাকে দেখেছিলাম। আমার ভালো লাগে নি, আহি।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“সরি। আমি হয়তো ভালো না।”

“তুমি ভালো। তুমি অনেক লক্ষী একটা মেয়ে। শুধু তোমার পরিবেশটা খারাপ। আমি চাই, আমার মেয়েটা ভালো পরিবেশে থাকুক। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমার জন্য একজন উত্তম সঙ্গী চাই, যে আমার মেয়ের যত্ন নেবে, তাকে ভালোবাসবে, তার সম্মান করবে, আর তাকে সকল খারাপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করবে।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“শুনেছি মায়ের দোয়া কবুল হয়ে যায়৷ তুমি আমার জন্য আরেকটা দোয়া করবে?”

“কি!”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি যাতে আফিফকে ভুলে যেতে পারি।”

কথাটি বলতে গিয়েই আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“তুমি আমার রাজকুমারী। তোমার সব ইচ্ছের জন্য আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইবো। আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথেই থাকবে।”

(***)

চারটা দিন আহির খুব ভালোই কেটেছে। এই চার দিনে সালমা ফাওজিয়া আর আহি অনেক গল্প করেছে, একসাথে বই পড়েছে, সালমা ফাওজিয়া রান্না করলে আহি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করেছে, টুকটাক শিখেও নিয়েছে, আর রাতে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। আজ তার এই বাড়িতে শেষ দিন। আহি সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছে। এদিকে পুষ্প সিলেট পৌঁছে তাকে কয়েকবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। সেখানে তারা দু’দিন থাকবে।

হঠাৎ সালমা ফাওজিয়া এসে আহির মুখে একটা মিষ্টি পুরে দিলেন। আহি মিষ্টি মুখে নিয়েই মায়ের দিকে তাকালো। সালমা ফাওজিয়া একগাল হেসে বললেন,
“কেমন হয়েছে?”

আহি মিষ্টিটা খেয়ে বলল, “ভীষণ মজা!”

“তুমি বললে না, লাবণি তোমাকে মিষ্টি খেতে দেয় না। তাই আমি এটা তোমার জন্য বানিয়েছি।”

“তুমি বানিয়েছো? কখন?”

“তুমি যখন ঘুম ছিলে। ভোরেই বানিয়ে রেখেছি।”

“তুমি মিষ্টিও বানাতে পারো?”

“না, দু’দিনে শিখেছি। কাল বানিয়েছিলাম, কিন্তু ভালো হয় নি, তাই তোমাকে আর দেই নি। আজকেরটা মোটামুটি ভালো হয়েছে।”

আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“ভাবছি, যাদের মা আছে, তারা রোজ এমন যত্ন পাচ্ছে। আর আমি আজ থেকে আবার একা হয়ে যাবো।”

সালমা ফাওজিয়া আহির গালে চুমু খেয়ে বললেন,
“কেন একা হবে? যখনই তোমার মন চায়বে, আমার কাছে চলে আসবে। আর আমি তোমার জন্য নতুন সিম কিনেছি। এখন তুমি আমাকে সেই নম্বর থেকেই ফোন করতে পারো।”

“আচ্ছা।”

সালমা ফাওজিয়া এবার নিজের ঘরে গেলেন। একটা প্যাকেট এনে আহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এটা পরে নাও। তোমাকে নিয়ে বের হবো।”

আহি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বলল,
“আমরা তাহলে ঘুরতে যাচ্ছি?”

সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে বললেন, “হুম।”

(***)

লাল হলুদাভ শাড়ি পরে আহির সামনে এসে দাঁড়ালেন সালমা ফাওজিয়া। মায়ের দিকে তাকিয়ে আহি অবাক হয়ে বলল,
“একদম একই শাড়ি!”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“হুম, তোমার জন্য কিনেছিলাম। তার সাথে মিলিয়ে আমিও একটা কিনেছি। মা-মেয়ের টুইনিং হয়ে গেলো।”

“বাহ! আমার মা তো দেখছি বেশ স্মার্ট।”

“তা তুমি শাড়িটা পরো নি কেন?”

আহি মুখ ছোট করে বলল, “পরতে পারি না।”

সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরে তাকে নিজের সামনে দাঁড় করালেন। এরপর শাড়িটা হাতে নিয়ে আহির হাতে দিলেন। তারপর শাড়ির কুঁচি ধরে আহিকে শিখিয়ে দিতে লাগলেন।

(***)

শূণ্য আকাশে কালো মেঘেরা ভাসছে। সেই সাথে বাতাবরণে যোগ হয়েছে শীতল হাওয়া। হাওয়ার তালে বারান্দার পর্দাটি দোল খাচ্ছে।

নিস্তব্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে আছে আহি। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের সামনে বসে কুঁচি ঠিক করছেন। তাদের কথোপকথনে নীরব ঘরটিতে মৃদু গুঞ্জন সৃষ্টি হলো। পুরো ফ্ল্যাটে সেই গুঞ্জন বাতাসের তালে ছড়িয়ে পড়েছে, আর প্রতি কোণায় গিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে আজ বিদায় বেলা।

মেয়েকে আয়নার সামনে বসিয়ে খোঁপা বেঁধে দিলেন সালমা ফাওজিয়া। তারপর নিজ হাতে সেই খোঁপায় গাদা ফুলের মালা লাগিয়ে দিলেন। আহি মায়ের হাত ধরে বসালো। মাকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলো সে। এবার সালমা ফাওজিয়া আহির হাতে হলুদ ও লাল কাচের চুড়ি পরিয়ে দিলেন। আর আহি মায়ের জুতার ফিতা বেঁধে দিলো। দু’জনই হাত ধরে নেমে পড়লো ভেজা রাস্তায়। ফুটপাত ধরে হাঁটলো কিছুক্ষণ। তারপর টংয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দু’জনই চা খেলো। রিকশা নিয়ে সদ্যস্নাত শহরে মধ্যাহ্নবেলা উপভোগ করলো।
এরপর সালমা ফাওজিয়া আহিকে নদীর পাড়ে নিয়ে গেলেন। দু’জনই নৌকায় উঠে বসলো। মাঝিকে বললেন পাড় ঘুরিয়ে আনতে। আহি নৌকার পাঠাতনে বসে আঙ্গুল ডুবিয়ে স্রোতস্বতীকে অনুভব করতে লাগলো। সালমা ফাওজিয়া মনে মনে বললেন,
“এই নদী আজ সার্থক হয়েছে। কারণ মা তার সন্তানকে কাছে পেয়েছে। এই চারটি দিন আমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার দিন হয়ে থাকবে। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে আমার মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। যদি রিজওয়ান কবিরকে দেখাতে পারতাম, সব সুখ টাকা দিয়ে কেনা যায় না, কিছু সুখ ভালোবাসা দিয়েও কেনা যায়, তাহলে আমি পুরোপুরি সার্থক হতাম।”

মা-মেয়ে নদীর পাড়ে হেঁটে সূর্যাস্তের সময়টুকু পার করলো। তারপর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দু’জনই ফুচকা খেয়ে বাসায় ফিরলো। বাসায় এসেই আহি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। এরপর কাপড় পাল্টে এসে ব্যাগ নিয়ে বের হতেই দেখলো, সালমা ফাওজিয়া সোফায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আহি মাকে কাঁদতে দেখে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। তারপর দু’জনই অনেকক্ষণ কাঁদলো। এরপর আহি চোখ মুছে বললো,
“ট্রেন ধরতে হবে আমাকে।”

সালমা ফাওজিয়া আর কিছু বললেন না। আহি এবার মায়ের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“এই চারদিনে আমার নিজেকে একটুও একা মনে হয় নি। আমার মনে যতো দুঃখ জমানো ছিল, আমার মধ্যে থাকা সব হতাশা, আক্ষেপ সবকিছুই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। মা, আমার সুখী হওয়ার সবচেয়ে বড় মেডিসিন তুমিই। তোমাকে পেলে আমার আর কিচ্ছু লাগবে না। আমরা এখান থেকে পালিয়ে যদি বাইরের দেশে সেটেল্ড হয়ে যাই, তখন বাবা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। তার সব দাপট দেশেই। বাইরের দেশে সে কিছুই না।”

সালমা ফাওজিয়া মলিন মুখে বললেন,
“বাইরের দেশে যাওয়া, চাকরি নেওয়া, খরচ, এতো টাকা কোথায় পাবো? তোমার বাবার টাকায় তুমি ইউকে থেকে পড়াশুনা করে এসেছো। তোমার নিজের কিছুই নেই।”

আহি সালমা ফাওজিয়ার কথায় দমে গেলো। সে মনে মনে ভাবতে লাগলো, কখন তার জীবনে আশার আলো ফিরে আসবে! কখন সে মুক্তি পাবে এই হিংস্র মানুষগুলোর হাত থেকে!

(***)

নয়টার ট্রেনে উঠে পড়লো আহি। সালমা ফাওজিয়া ট্রেন ছাড়া অব্ধি স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতেই তার বুকটা খালি হয়ে গেলো। আহিও নিঃশব্দে অশ্রু ফেললো।

মা-সন্তানের এমন বিচ্ছেদও কি হয়? প্রবাসী সন্তানকে বিদায় দিতে এসে কতো মা নীরবে কাঁদেন, হোস্টেল ফেরা সন্তানদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে কতো মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু এই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভয়ংকর। যেখানে মা-মেয়ে একই শহরে থেকেও অনেকদূরে, যেখানে দু’দন্ড কথা বলতে গেলে শকুনের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে হয়। স্বাধীন দেশে, এমন পরাধীন জীবনটাই যে ভয়ংকর। যেখানে একটাই ভীতি, যদি প্রিয় মানুষটিকে কাছে পেতে চাইলে, তার নিথর শরীর ফেরত আসে?

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-১৮+১৯

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৮||

৩১।
লাগেজ থেকে পুরোনো জামা-কাপড় বের করছে পদ্ম। ঘরের বাইরে গেট ধরে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তার ছেলের জন্য এক সেট জামা খুঁজতে এসেছেন। তাই আফিফের পুরোনো শার্টগুলোই বের করছিলো পদ্ম। আফিফ সবে মাত্র ঘরে ঢুকেছে। আর তখনই পদ্ম লাগেজ থেকে একটা বই বের করলো। বইয়ের প্রচ্ছদটি দেখে পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এপাশ-ওপাশ উলটে পদ্ম বলল,
“নাম ছাড়া বই?”

আফিফ তখন শার্টের হাতা ভাঁজ করছিলো। পদ্মের কন্ঠে তার বইটির দিকে চোখ পড়লো। মুহূর্তেই চমকে উঠলো সে। পদ্ম বইটি আফিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার বই?”

আফিফ ঘাবড়ে গেলেও পদ্মের সামনে তা প্রকাশ করলো না। সে বইটি পদ্মের হাত থেকে নিয়ে বলল,
“এটা এই লাগেজে ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“আমি অনেক খুঁজেছিলাম। ভেবেছি বাসা চেঞ্জ করার সময় হারিয়ে ফেলেছি।”

“বইয়ের উপর যে নাম নেই! কার লেখা?”

“নাম ছাড়া বই। লেখকের কোনো পরিচয় নেই। এসব বাদ দাও। লাগেজে কি খুঁজছিলে?”

“আপনার পুরোনো জামা বের করছি। বাইরে একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন না, উনার ছেলের জন্য বের করছিলাম।”

আফিফ প্রতিত্তোরে হাসি ফেরত দিয়ে বইটি হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

গুমোট বাতাবরণ বিরাজ করছে আজ। বারান্দায় দাঁড়ালেই হালকা হাওয়া গায়ে লাগে। দু’তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকে আফিফরা। পুরোনো বাড়ি। উপরে ছাদ থাকায় সূর্যের তাপে ঘর গরম হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে একটু বেশিই কষ্ট হয় তাদের। এই বাসার মালিক দু’মাস পর পর ভাড়া নেন। দুই মাসে দশ হাজার টাকা। নিচতলা থাকার অনুপযোগী। বর্ষাকালে এই রাস্তায় বেশ পানি উঠে। তবে সামনের রাস্তাগুলো উঁচু হওয়ায় বাড়িটা নিচের দিকে চলে গেছে। বাড়ির মালিক ঢাকায় থাকেন। খুব শীঘ্রই তিনি এই জায়গাটা ডেভেলাপারকে দিয়ে দেবেন। যতোদিন দেবেন না, ততোদিন আফিফের জন্যই ভালো। শহর উন্নত হচ্ছে, বাসা ভাড়া বাড়ছে। বাড়ছে না শুধু আফিফের বেতন। যেখানে দু’মাস হচ্ছে তার চাকরি নেই। এই শহরে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। তবুও সে ধৈর্য নিয়ে চাকরি খুঁজছে।

আফিফ খোলা বারান্দার রেলিঙ ঘেষে দাঁড়ালো। হাতে থাকা বইটির প্রচ্ছদে আলতো করে আঙ্গুল ছোঁয়ালো। অস্ফুটস্বরে বলল, “ক্ষণকালের খেয়াল।”

বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়েই থেমে গেলে আফিফ। চোখ বন্ধ করে বলল,
“আমি আমার পদ্মফুলকে ভীষণ ভালোবাসি।”

আফিফ রুমে ঢুকে দেখলো পদ্ম জামাগুলো নিয়ে মহিলাটিকে দিতে চলে গেছে। আফিফ লাগেজটির ভেতরে বইটি রেখে দিয়ে লাগেজটি আবার আলমারীর উপরে তুলে রাখলো। পদ্ম রুমে ঢুকতেই আফিফ তার কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“তুমি এতো লক্ষী কেন বলো তো?”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “হঠাৎ এতো ভালোবাসা!”

আফিফ পদ্মের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বলল,
“হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, আমার তো পদ্মফুল একটাই আছে।”

পদ্ম আফিফের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“একটা কথা বলি আপনাকে?”

আফিফ পদ্মের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“হুম, হুম। বলো।”

পদ্ম বলল,
“আহি বললো চাইলে আমরা অন্যভাবেও বাচ্চা নিতে পারবো।”

আহির নাম শুনে আফিফ পদ্মকে ছেড়ে দিলো। তবে পদ্ম বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নিলো। সেকেন্ড খানিক পর আফিফ নিজেই পদ্মের হাত ধরে তাকে বিছানার উপর বসালো। নিজেও পা গুটিয়ে পদ্মের মুখোমুখি বসলো। পদ্ম আফিফের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“মাকে গিয়ে বলুন না, বাচ্চা নেওয়ার অনেক পদ্ধতি আছে।”

“আচ্ছা, বলবো।”

“শুনুন না।”

“বলো, শুনছি।”

“ওসব পদ্ধতিতে অনেক টাকা লাগে।”

“হুম। লাগবে স্বাভাবিক।”

“তখন আমি নিশ্চিত মা হতে পারবো। এখন তো ডাক্তার দেখাতে গিয়েই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের খরচে সঞ্চয়টাও শেষ হয়ে গেছে। যদি সেই পদ্ধতিতে বাচ্চা নেই, তাহলে আমরা সত্যিই বাবা-মা হতে পারবো। অনিশ্চয়তা নেই।”

“হবো একদিন। তুমি তো আছোই।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি আমার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না। আমি বোঝাতে চাইছি, পদ্ধতিটার জন্য অনেক টাকা লাগবে। আপনার চাকরি দরকার। টাকা ছাড়া কি কিছু হয়?”

আফিফ পদ্মের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,
“জানতেই তো আমি বেকার, তবুও তো বিয়ে করেছিলে। আজও আমি বেকার, একটু তো ধৈর্য রাখো। আমি চাকরি খুঁজছি।”

পদ্ম আফিফের গালে হাত রেখে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমার কি কোনো শখ-আহ্লাদ আছে? আপনিই আমার সব শখ-আহ্লাদ। আপনাকে হারিয়ে ফেললে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। আফিফ, ভয় পাচ্ছি আমি। আপনার বুকে অন্য কেউ মাথা রাখুক আমি সহ্য করতে পারবো না। ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে সহ্য করা যায় না, আফিফ।”

পদ্মের কথায় আফিফ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। পদ্ম আফিফের হাত ঝাঁকুনি দিতেই সে পদ্মকে বলল,
“পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যারা ভালোবাসার মানুষকে পায় না। তারা কিন্তু বেঁচে আছে। ভালোই আছে। এমন অনেকেই আছে যারা ভালোবাসতে না পারলেও কাউকে ভীষণ ভাবে চায়, কিন্তু বাস্তবতা তো কল্পনার ঊর্ধ্বে। আর তারাও কিন্তু নতুন মানুষকে নিয়ে খুব সুখেই থাকে। আর তুমি? তুমি তো আমার পদ্মফুল। পদ্মফুলের অধিকার কেউ নিতে পারবে না।”

৩২।

বাসে উঠেই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো আহি। পুষ্প আহির উৎকন্ঠিত চাহনি দেখে তার হাতটি শক্ত করে ধরলো। আহি পুষ্পের দিকে তাকাতেই পুষ্প বলল,
“ভয় পাচ্ছিস কেন?”

আহি বিচলিত কন্ঠে বলল,
“বাবা যদি কাউকে আমার পিছু পাঠায়?”

“কতোবার বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলি৷ কখনো পাঠিয়েছিল?”

“তখন আর আজ এক নয়, পুষ্প। তখন আমি সত্যিই ঘুরতে গিয়েছিলাম। আর আজ আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”

“আংকেল এতোকিছু ভাবছেনই না। আর আমি তো তোর সাথেই আছি। আচ্ছা, তোর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিলেন না? ওই আন্টিটা কেমন রে!”

আহি পুষ্পের কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। লিনাশার বোনই যে আহির বাবার বর্তমান স্ত্রী এই কথা পুষ্প, পদ্ম কেউই জানে না৷ রাদ আর লাবীব মিসেস লাবণিকে চেনে। কারণ আহি ইউকেতে থাকাকালীন ছুটি পেলেই লাবণি আর রিজওয়ান কবির আহিকে দেখতে যেতো। তবে তারা এটা জানে না, যে সে লিনাশার বোন। কারণ তারা লিনাশার বড় বোনকে কখনো দেখে নি। এদিকে পুষ্প আর পদ্ম অনেকবার লাবণিকে দেখেছিল। যেহেতু তারা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল। লিনাশার বাসায় অনেক বার যাওয়া হয়েছিলো তাদের। সেই সূত্রেই পরিচিতি। তবে পুষ্প আর পদ্ম এতোটুকু জানে রিজওয়ান কবির দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।

পুষ্প আহির মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গেলি?”

আহি মলিন মুখে বলল,
“ভালো না উনি। অনেক জঘন্য। বাবা আগে আমার সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার করে নি। কিন্তু উনাকে বিয়ে করার পর থেকে বাবা পালটে গেছে।”

“বাদ দে। মন খারাপ করিস না। ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে। দেখ, পদ্মের কি অবস্থা! তার শাশুড়ি তার মাথা খেয়ে ফেলছে। তবে একদিকে পদ্মের ভাগ্য ভালোই, তার বরটা ভালো। নয়তো কেউ এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে এতোটা ভালোবাসে, বল?”

আহি মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
“জানি সে ভালো। তাই তো আমার ভালোবাসার জায়গাটা একমাত্র সে-ই দখল করে নিয়েছে। সে সবার চেয়ে আলাদা। তাই হয়তো আমার মন-মস্তিষ্কে সে এখনো গেঁথে আছে। হোক, সে অন্য কারো মানুষ। বাসুক না হয় অন্য কাউকে ভালো। সুখে থাকুক তারা। আমি তাকে তবুও ভালোবাসবো। কল্পনায় সে আমার সেই ফেলে আসা, এআর। আমার ডাইরির প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে প্রাণহীন তার প্রতিটি মুহূর্ত। আমি তাকে যেভাবে অনুভব করেছি আর কেউ সেভাবে অনুভব করতে পারবে না। পদ্ম শুধু তাকে স্পর্শ করতে পেরেছে। কিন্তু আমি তাকে ধারণ করে ফেলেছি। তার প্রিয় রং, প্রিয় ফুল, প্রিয় অভ্যাস, সবই আমার, একান্তই আমার।”

(***)

বাস চলছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। দুই ঘন্টার রাস্তা৷ আহি জানালার পাশে বসেছে। এখন জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। তবুও গরমের উত্তাপ যেন একটুও কমে নি। বাস চলছে বিধায় আরামবোধ করছে আহি। ইচ্ছে করছে হাত বের করে দিয়ে গলায় ঝুলানো উড়নাটি আঙ্গুলের ডগায় ঝুলিয়ে আজকের দিনটি উপভোগ করতে। কারণ আজ সে তার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। কিন্তু আহি এমনটা করতে পারবে না। লোকে দেখলে পাগল বলবে। মানুষের মনে অনেক উদ্ভট ইচ্ছা জন্মে। এসব ইচ্ছেগুলো দমিয়ে রাখতে হয়। সব ইচ্ছে পূরণ করতে গেলে আবার সভ্য সমাজে উন্মাদ আখ্যায়িত হবে সে।

বাস শহর ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় উঠে গেছে। রাস্তার ধারগুলো এতো মায়াবী দেখতে! সারি সারি গাছ, ওপাড়ে সবুজ মাঠ। আহির ইচ্ছে করছে ছবি আঁকতে। কিন্তু হাতে তো রং-তুলি, ক্যানভাস কিছুই নেই। ছবি আঁকতে পারলে নিশ্চয় ছবিটি নাম দিতো আহি। সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল,
“স্বপ্নীল পথ। যেই পথ নিয়ে যায় আপন মানুষের কাছে। সে আহির আপন মানুষ।”

দেড় ঘন্টা পর বাস তাদের চন্দ্রঘোনা নামিয়ে দিলো৷ সেখান থেকে ফেরি পার হয়ে যেতে হয় অন্য পাড়ে। আর সেখানে অনেকগুলো গ্রাম। আহির মায়ের বাড়ি আর রাদের বাবার বাড়ি পাশাপাশি। পাহাড়ি এলাকাও আছে সেইদিকটাই। আহি অনেক বছর পর এসেছে। তাই জায়গাটার নাম জানে না সে। রাদের পিছু পিছু যাচ্ছে তারা। রাদ একটা সিএনজি ঠিক করলো। সিএনজিতে উঠেই তারা ফেরি পার হলো। রাইখালি বাজার পার করতেই তারা রাদের বাড়ির সামনে চলে এলো। পুষ্প সিএনজি থেকে নেমে চোখে সানগ্লাস পরে বলল,
“রাদ, এদিক থেকে তো বান্দরবানও যাওয়া যায়!”

রাদ ভাড়া মিটিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। যাওয়া যাবে। তোমরা তো বেশি সময় নিয়ে আসো নি। আর বান্দরবান একদিনে ঘুরে দেখা যায় না। অন্তত হাতে তিন দিন সময় নিয়ে আসতে হবে। আর এই ঋতুতে ভীষণ অসহ্যকর লাগে ট্যুর দিতে।”

লাবীব বলল,
“বর্ষা শুরু হলে যাওয়া যাবে।”

“বর্ষায় বান্দরবান যাই নি আমি। ওই সময় সীতাকুণ্ডের ঝর্ণাগুলোতে যাওয়া যায়। এদিকে না হয় আবার শরতের শেষে আসবো।”

এদিকে আহি মনোযোগ দিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। সে অনেক বছর পর নানার বাড়ি এসেছে। জায়গাগুলো তার কাছে অচেনা। একটা দোকানের নামফলকে লেখা রাইখালি, কাপ্তাই রাঙ্গামাটি। এতেই বুঝে নিয়েছে সে তার নানার বাড়ির আশেপাশেই আছে। পুষ্প সামনে উঁচু সিঁড়িটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাদ, তুমি কি উপজাতি?”

পুষ্পের প্রশ্নে আহি শব্দ করে হাসলো। আহিকে হাসতে দেখে রাদ তার দিকে তাকালো। কতো বছর পর এই মেয়েটা শব্দ করে হাসছে! কি প্রাণোচ্ছল সেই হাসি! রাদ আর পুষ্পের উপর রাগ করলো না। হালকা হেসে বলল,
“দাদা রাউজান থেকে এসে এখানে বাড়ি করেছেন। তাই এটা আমাদের বর্তমান দাদার বাড়ি।”

“রাউজানে কি হয়েছিল?”

“ওটা দাদার বাবার বাড়ি ছিল। দাদা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছেন। এখন আমার বাবা-চাচা এখানেই আসে।”

পুষ্প সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“তাহলে শ’খানেক সিঁড়ি পার করে তোমাদের উপরে উঠতে হয়।”

রাদ চোখ ছোট করে বলল,
“মাত্র ত্রিশ ধাপ!”

সিঁড়ি পার করতেই দৃশ্যমান হলো কিছু বাড়ি। রাদের বাড়ি ডানদিকে। আর আহির নানার বাড়ির বামদিকের পেছনের অংশ জুড়ে। রাদ বাড়ির লোহার গেটে জোরে জোরে ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে মাঝবয়সী এক নারী বেরিয়ে এলেন। তিনি রাদকে দেখে রীতিমতো অশ্রু ফেলতে লাগলেন৷ ভেতর থেকে চেঁচিয়ে কয়েকজনের নাম ধরে ডাকলেন। ছোট ছোট তিনটে বাচ্চা, দু’জন কিশোরী, দুই জন যুবতী আর একজন বয়ষ্ক পুরুষ বেরিয়ে এলেন। একজন বৃদ্ধাও বাড়ির ভেতর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আহির কাছে সবকিছুই কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এমন ঊষ্ণ অভ্যর্থনা সে জীবনে প্রথম দেখেছে। রাদ বয়ষ্ক লোকটির পা ধরে সালাম করলো। তারপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বড় চাচা।”

আহিও রাদের দেখাদেখি তার পা ছুঁয়ে দিলো। রাদ চাচার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। পুষ্প আর লাবীবও চাচাকে পা ধরে সালাম করতে যাবে তখনই তিনি আটকালেন। রাদের বড় চাচী তাদের ভেতরে নিয়ে গেলো। কিশোরী দু’জন রাদের ছোট চাচার মেয়ে। বড় দুই যুবতীর একজন রাদের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী, আরেকজন রাদের বড় চাচার মেয়ে। সে তার দুই ছেলেকে নিয়ে নাইওরে এসেছে। অন্য বাচ্চা মেয়েটি রাদের চাচাতো ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটির নাম নোহিন। বয়স পাঁচ বছর। আহির মেয়েটিকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সে একটু পর পর মেয়েটির গাল টেনে দিচ্ছে। মেয়েটিও প্রতিত্তোরে আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। গাল টানাটানি তার একদমই পছন্দ না। কিন্তু সে লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। কারণ নতুন মানুষদের সাথে সে অভিমান করতে পারে না। এদিকে নোহিন রাদকেও চিনতে পারে নি। রাদ যখন ইউকেতে যাচ্ছিল, তখন নোহিন মাত্র কয়েক মাসের ছিল।

এদিকে রাদের দাদি রাদকে চিনতে পারছেন না৷ বয়স বেশি হয়েছে তার। স্মরণ শক্তি কমে গেছে। কিন্তু আহিকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। আহির নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। বেশ গল্প জুড়িয়ে দিলেন। হঠাৎ আহিকেই কেন তার এতো পছন্দ হয়েছে, তা কেউই বুঝতে পারলো না।

(***)

অনেকক্ষণ হয়ে গেলো রাদের কোনো খোঁজ নেই। লাবীব আর পুষ্প সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়াচ্ছে, লাবীব তাকে ছবি উঠিয়ে দিচ্ছে। আহি বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
“রাদকে দেখেছিস?”

পুষ্প বলল,
“না। ওকে তো চাচার সাথে বাইরে যেতে দেখলাম।”

আহি মলিন মুখে ঘরে ঢুকলো। তার মন মাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে। সে কিছু একটা ভেবে রাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। তাকে মেইন গেটের কাছে আসতে দেখে পুষ্প বলল,
“এই আহি, কোথায় যাচ্ছিস?”

“তোরা এখানে থাক। আমি একটু হেঁটে আসি।”

লাবীব বলল,
“রাদ তোকে একা বাইরে না যেতে বলেছে। আমরা সহ আসছি।”

লাবীব আর পুষ্পও আহির পেছন পেছন গেলো। আহি বলল,
“পেছনের বাড়িটা আমার নানার বাড়ি, যতোটুকু আমার মনে আছে।”

“এভাবে না জেনে যাওয়ার কি দরকার? রাদ আসুক।”

“আমি অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরেছি। আর পারবো না। আর রাদ এভাবে আমাকে বসিয়ে রেখে কেন চলে গেলো? ওর উচিত ছিল আগে মায়ের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দেওয়া।”

(***)

আহি পেছনের বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালো। দেয়ালে খোদাইকৃত নামফলক, আফজাল নিবাস। আহির নানার নাম।
আহির তিন মামা। বড় মামা দেশের বাইরে থাকেন। মেজ মামা গ্রামে থাকেন। ছোট মামাও এখানেই থাকতেন। আহির বাবা-মার যখন তালাক হয়েছিল, তখন তিনি ঢাকায় চলে যান। আর সালমা ফাওজিয়া আফজাল সাহেবের একমাত্র মেয়ে।

এদিকে আহি নানার নামফলকে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গেটের হাতলটি দিয়ে লোহার গেটে দু’বার ধাক্কা দিলো। একটু পর ভেতর থেকে লোহার গরাদটি টানার শব্দ হলো। আর মুহূর্তেই সে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেললো যেন। হয়তো মায়ের সাথে দেখা হবে সেই উত্তেজনায়। গেট খুলতেই একটি মেয়ে দৃশ্যমান হলো। সে জিজ্ঞেস করলো, “কাকে চান?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সালমা ফওজিয়া থাকেন না এখানে?”

মেয়েটি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ফুপ্পি!”

আহি মেয়েটির হাত ধরে বলল,
“উনি তোমার ফুফু?”

মেয়েটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আহি বলল,
“আমি আহি।”

“আহি আপু?”

“হ্যাঁ।”

মেয়েটি দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেলো। আহিও গেট খোলা পেয়ে ভেতরে পা বাড়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আহির মেজ মামী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি আহিকে দেখে সামনে এগুতে যাবেন তখনই আহির মেজ মামা রাগান্বিত মুখে বাড়ির বাইরে এসে বললেন,
“এই মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দিলি কেন?”

মামী তার হাত ধরে আটকালেন। কিন্তু তিনি চুপ হলেন না। বাজখাঁই সুরে বললেন,
“লম্পট বাবার সাথে থেকে তার মেয়ে লম্পট হয় নি এর নিশ্চয়তা কি?”

মামার মুখে এমন কথা শুনে আহির মুখে অন্ধকার নেমে এলো। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, চল এখান থেকে।”

আহি পুষ্পের হাত সরিয়ে দিয়ে মামার সামনে এসে দাঁড়ালো। আর শান্ত কন্ঠে বলল,
“কেমন আছো মেজমামা? কতো বছর পর দেখলাম!”

আহির প্রশ্নের কোনো উত্তর এলো না। আহি এবার মামীর দিকে তাকালো। ভদ্রমহিলা স্বামীর হাত ধরে রেখেছেন। মনে হচ্ছে এই হাত ছাড়া পেলেই ভদ্রলোক আহিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন। আহি মাথা নিচু করে বলল,
“আমি জানি তোমরা আমার বাবাকে ঘৃণা করো। কিন্তু এখানে আমার কি অপরাধ, বলো? আমার কি ইচ্ছে করে না আমার মায়ের সাথে থাকতে? মাকে দেখতে? মা ছাড়া বড় হচ্ছি আমি। আমি তোমাদের বিরক্ত করবো না। শুধু মায়ের সাথে দেখা কর‍তে এসেছি। মাকে এক নজর দেখেই চলে যাবো। একটু অনুমতি দাও।”

ভদ্রলোক রাগী স্বরে বললেন,
“তোর বাবা আমাদের পথে বসিয়ে দিয়েছে। আমার বোনের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। রিজওয়ান কবিরের ছায়াও আর আমার বোনের জীবনে পড়বে না। দূর হ এখান থেকে। আমাদের জীবনে কখনো ফিরে আসবি না। তোর কোনো মা নেই।”

আহি অশ্রুসিক্ত নয়নে হাতজোড় করে বলল,
“অনেক আশা নিয়ে এসেছি, মামা। প্লিজ, মাকে একটু দেখতে দাও। দূর থেকেই দেখবো না হয়। একটু তো দেখে যাই। প্লিজ মামা।”

আহির কাকুতি মিনতি দেখে পুষ্পের চোখ ভিজে গেলো। লাবীব এখনো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে আহির মামার চেঁচামেচি শুনে ভেতরে ঢুকার সাহস পেলো না। এদিকে আহির মেজ মামা তার কান্নাভেজা চাহনি উপেক্ষা করে স্ত্রীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
“এই মেয়েকে এখনি বের হয়ে যেতে বলো। ও যদি না যায়, আমি নিজেই ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবো।”

আহি মলিন মুখে বাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির মেজ মামী করুণ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“রাদ আসুক। ও নিশ্চিত মামাকে মানিয়ে নেবে।”

আহি কোনো উত্তর দিলো না। সে এলোমেলো ভাবে হেঁটে গেটের কাছে আসতেই তার সেই কিশোরী মামাতো বোনটি দৌঁড়ে এলো। তার হাবভাব দেখে বোঝা গেলো, সে আবার গেট লাগাতে এসেছে। আহি বেরিয়ে যেতেই মেয়েটি গেটের বাইরে হাত বের করে দিয়ে বলল,
“আহি আপু, মা বলেছে তোমাকে দিতে।”

আহি দেখলো মেয়েটির হাতে একটা চিরকুট। আহি চিরকুটটি নিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটি গেট বন্ধ করে দিলো। আহি চিরকুটটি খুলে দেখলো একটা ফোন নম্বর। পুষ্প বলল,
“হয়তো আন্টির নম্বর দিয়েছে।”

লাবীব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে পুষ্প ইশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিলো। এদিকে আহি নম্বরটি দেখেই অস্থির হয়ে গেলো। সে লাবীবকে বলল,
“তোর ফোনটা একটু দে। আমি এই নম্বরে কল দিয়ে দেখি।”

লাবীব বলল,
“আমার ফোন তো রাদের বাড়িতে চার্জে দিয়েছি। তোর ফোন কোথায়?”

“সিমটা বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা। বাবা যদি কল রেকর্ড বের করে ফেলে? বাবা চাইলেই যে-কোনো কিছু করতে পারে।”

পুষ্প তার ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমরটা থেকে ট্রাই কর।”

আহি কাঁপা হাতে নম্বরটি ফোনে তুললো। তারপর ফোনটা কানের কাছে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। কল যাচ্ছে, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ধরছে না। আহির অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। সে আরো অস্থিরভাবে সামনে হাঁটছে। পুষ্প আহির পিছু নিয়েছে। এ মেয়ে যে-কোনো সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। যা ভেবেছে তা-ই হলো। আহি সামনে যেতেই উঁচুনিচু ইটের রাস্তায় উঠলো। আর সেখানেই হোঁচট খেলো। পুষ্প ভয়ার্ত চোখে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। আহি শক্ত করে ফোনটা হাতে ধরে রেখেছে। যেন তার প্রাণটা এই ফোনেই আটকে আছে। আহির হুঁশ ফিরতেই সে দেখলো রাদ তাকে ধরে রেখেছে। আহি রাদের দিকে তাকাতেই সে বলল,
“পাগল না-কি তুই? এভাবে হাঁটছিস কেন?”

আহি হেসে বলল,
“মায়ের নম্বর পেয়েছি। মা হয়তো এখানে নেই। থাকলে আমার কন্ঠ শুনে নিশ্চিত বের হতো।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৯ (১ম ভাগ)||

৩৩।
অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি আটকে আছে দূর পশ্চিমের আকাশে। ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম আভা মেঘেদের ভাঁজে মিশ্র রঙ সৃষ্টি করেছে। সেই লালিমা রেখা হিয়ার কোণে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাদের জাগিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু সব আকাঙ্ক্ষা তো পূর্ণ হয় না। যেমনটা অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছটফট করছে আহি। পুষ্পের ফোনটা হাতের মুঠোয় আবদ্ধ তার। সেই সকাল থেকে অনেক বার মায়ের নম্বরে কল করেছিল আহি। বিকেলে কলটা রিসিভও হয়েছিল। ওপাশ থেকে অপরিচিত ভারী পুরুষালী কন্ঠ শুনে কল কেটে দেয় সে। অজানা ভয়ে আহির মনটা ভারী হয়ে আসছে এখন। বাবার মতো মাও কি তবে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে?

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মুনিয়া খালা ফোন দিয়েছেন বার কয়েক। নিশ্চয় মিসেস লাবণি জেরা করছিলেন কল দেওয়ার জন্য। আহি ইচ্ছে করেই কল ধরছে না। সবকিছু তো আর তাদের নিয়মে চলবে না। ভালো লাগা, মন্দ লাগার অনুভূতি আহিরও তো আছে।
এদিকে আহিকে অনেকক্ষণ ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাদ এবার তার কাছে এলো। আহি রাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,
“আমার সাথে ভাগ্যের কোনো দ্বন্ধ আছে নিশ্চয়। যা-ই আমি চাইবো, তা-ই আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেবে। অভিমান হয় আমার। একটা মানুষের গত কয়েক বছরের একটা ইচ্ছেও পূরণ হচ্ছে না। সে শুধু আঘাতের পর আঘাত পেয়েই যাচ্ছে। তাহলে তার কী বোঝা উচিত? সৃষ্টিকর্তা তার দিকে ফিরেই তাকাচ্ছেন না? একটা মানুষকে এতোটা নিঃস্ব করে দিলে, তার বাঁচার ইচ্ছা থাকে না, রাদ। আমারও বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিলে তো আমারই ক্ষতি। এখানে সহ্য করছি, তখন ওখানেও সহ্য করতে হবে। তবে এতোটা অন্যায় আমার সাথে হওয়া উচিত না।”

ছাদের রেলিঙটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে আহি। মনে হচ্ছে তার মনের ক্ষোভটা সেই ইটের তৈরী রেলিঙের উপরই সে বের করছে। রাদ আহির সেই হাতের উপর হাত রাখলো। আহি মুহূর্তেই শান্ত হয়ে গেলো। রেলিঙের উপর থেকে তার হাতটা আলগা হয়ে এলো। রাদ নিজের হাতটি আহির সেই আলগা হয়ে যাওয়া হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিতেই আহিও সেই হাতটি শক্ত করে ধরলো। রাদ আহির স্পর্শ পেয়ে তার দু’চোখ বন্ধ করে বলল,
“মনে হচ্ছে তোর সামনে অনেক সুখ। এজন্যই বোধহয় এই কষ্টগুলো একের পর এক তোকে সহ্য করতে হচ্ছে।”

আহি মলিন মুখে বললো,
“সুখ! এই শব্দটা এখন আমার জীবনের কৌতূকময় শব্দ। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি, বন্ধুদের হারিয়েছি, মাকে হারিয়েছি, এদের না পেলে আমি সুখী হবো না। আমি সবাইকে একসাথে চেয়েছি। কাউকে হারাতে চাই নি। কিন্তু আমার সুখের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আমার বাবা, তার বর্তমান স্ত্রী, তাজওয়ার খান আর আমারই প্রিয় বান্ধবী। তাহলে আমি কেমন সুখ আশা করবো?”

রাদ এবার আহির দিকে তাকালো। হালকা হেসে বলল,
“ধর, তুই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছিস। তোর শেষ স্বপ্নটা পদ্মের কারণেই আটকে আছে। তখন কি করবি?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“মানুষ পুরোপুরি সুখী হয় না। আর আমি এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছি।”

রাদ আহির গালে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আফিফকে ভুলে যাওয়া যায় না?”

“যদি ভুলে যেতে পারতাম, আমার চেয়ে সুখী কেউ হতো না। বিচ্ছেদের দহনে আমিই কষ্ট পাচ্ছি, ওরা ঠিকই সংসার করছে। আমি ভুলে যেতে পারি না। আমার মনটা ওখানেই আটকে আছে। সেই চারুশিল্পের ইট-পাথরের মাঝে, সেই রং-তুলির ফাঁকে, আর সেই ডায়েরীর ভাঁজে।”

“বিয়ে তো করবিই। তখন?”

“দেবদাসের পারু কি বিয়ের পর তার দেবদাকে ভুলতে পেরেছিল? তার কপালে দেওয়া দেবদাসের সেই আঘাতের চিহ্ন সে মুছে যেতে দেয় নি। আমি তাহলে কিভাবে আমার হৃদয়ে আঁকা প্রিয় ছবিটা মুছে ফেলবো? হুমায়ুন আহমেদের লেখা হিমু চরিত্রটির সাথে রূপার কোনো মিল হতে দেখি নি। কিন্তু যখনই হিমু নামটি আসে, রূপা সেই নামের সাথেই যুক্ত হয়ে যায়। তাহলে আহির সাথে এআরের সম্পর্ক কিভাবে ছিন্ন হবে? পৃথিবীতে কতো শত প্রেমের গল্প! সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে জীবনের সাথেই যুক্ত। হয়তো আমি তাদেরই একটা অংশ। আমার মনে হয় না নতুন কেউ আমার মনে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারবে।”

রাদ শুকনো হাসলো। মনে মনে বলল,
“কাউকে ভালোবাসার চেয়ে কারো ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যে ভালোবাসে, সে তো সব উজাড় করেই ভালোবাসে। আর যে ভালোবাসা পায়, তার মতো সুখী কেউ হয় না। যদি আমার প্রিয় মানুষটা ঠিক এভাবেই আমাকে ভালোবাসতো!”

রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির দৃষ্টি এখনো দূর আকাশের পানেই স্থির। রাদের ইচ্ছে করছে আহিকে শাসন করতে৷ তার উপর অভিমান করতে। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
“দেখ, তোকে ভালোবাসে এমন অনেকেই আছে। আমি আছি। দেখ, আহি, আমাকে দেখ। আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?”

কিন্তু রাদ এসব করবে না। আহিকে সে কিছুই বলবে না। আহি তো তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে কিভাবে অনুভব করেও প্রিয় মানুষকে ভালোবাসা যায়। সেও আহিকে অনুভব করে যাবে। যতোদিন মনের তৃষ্ণা মিটবে না, ততোদিন সে এক তরফা ভালোবেসে যাবে।

(***)

বাসের বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে আহি। অস্বচ্ছ কাচটির মতোই ঝাপসা হয়ে আছে তার জীবন। যার কোনো গতি নেই। পুষ্প আর লাবীব পাশাপাশি সিটে বসেছে। আর রাদ আহির পাশে বসেছে। সে সিটে বসেই ঝিমুচ্ছে। বাড়ির সবাই তাকে থাকতে বলেছিল। কিন্তু আহিকে সে নিজে পৌঁছে না দিয়ে সন্তুষ্ট হবে না। তাই সে চলে এসেছে। এদিকে রাদের মাথাটা একটু পর পর হেলে পড়ছে সামনে। আহি পাশ ফিরে রাদকে ঢুলতে দেখে তার মাথাটা নিজের কাঁধের উপর রেখে বলল,
“এবার ঘুমা।”

আহি রাদের হাতটা ধরলো। রাদ আধো আধো চোখ মেলে আহির দিকে তাকালো। আর ঘুম ঘুম চোখ দু’টি প্রশান্তির আশ্রয় পেয়ে তার ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো।

(***)

নীরবতা ভেঙে পুষ্পের ফোনটা বেজে উঠলো। পুষ্প ফোনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। সিট থেকে উঠে আহির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, ওই নম্বরটা!”

আহি সাথে সাথেই পুষ্পের হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো ফোনটা। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে কলটা ধরেই কানের কাছে আনলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই মায়া মাখা কন্ঠের স্বর। আহি চুপ করে আছে। এদিকে রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি হুট করে বসা থেকে উঠে যাওয়ায় রাদের ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো। তাই সে স্থির হয়ে বসে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে।

এদিকে ওপাশ থেকে আবার ভেসে এলো সেই কন্ঠ,
“হ্যালো। কে বলছেন?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি। আমাকে চিনতে পেরেছো!”

ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা চললো। এই নীরবতা আহির গলায় কাঁটার মতো বিঁধছে। সে একটু পর পর শুকনো ঢুক গিলছে। রাদ এতোক্ষণ পর বিষয়টা বুঝতে পারলো। সে আহির অস্থিরতা দেখে তার এক হাত আলতোভাবে ধরলো। রাদের স্পর্শ পেয়ে আহি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। সে এবার নিজের পরিচয়টা দিতে যাবে তখনই ওপাশ থেকে সেই কন্ঠটি বলে উঠলো,
“আহি! আমার মা?”

মায়ের মুখে নিজের নাম শুনে আহির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আমাকে চিনতে পেরেছো?”

সালমা ফাওজিয়া কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,
“আমার মাকে আমি চিনবো না? তুমি কেমন আছো, মা?”

আহি এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। সে শক্ত করে রাদের হাতটা চেপে ধরলো। রাদ আহিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আহির হাতের উলটো পিঠে আলতোভাবে তার বৃদ্ধ আঙ্গুলটি চালাতে লাগলো। এদিকে আহির গলায় কথা আটকে গেছে। পুষ্প তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাদকে দিলো। রাদ বোতলের ছিপি খুলে আহির দিকে বোতলটি এগিয়ে দিলো। আহি হালকা গলা ভিজিয়ে বলল,
“মা, তুমি আমার পাশে থাকলে হয়তো আমি আরেকটু বেশি ভালো থাকতাম।”

সালমা ফাওজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“যদি সেই সৌভাগ্য হতো আমার!”

“কেমন আছো তুমি?”

“আমার মেয়ে আমার পাশে নেই। তাহলে আমি কিভাবে ভালো থাকবো? আমি তো শুধু বেঁচে আছি।”

“জানো, আমি ভেবেছি তুমি আমাকে ভুলে গেছো।”

সালমা ফাওজিয়া চোখের পানি মুছে বললেন,
“মা তার সন্তানদের ভুলতে পারে না। আর আমার তো তুমিই একমাত্র সম্বল। আর তো কেউ নেই আমার।”

আহি মৃদু হাসলো। বলল,
“কতো বছর পর কথা হচ্ছে আমাদের!”

“তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তোমার বাবা সেই সুযোগ দেন নি।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বলল,
“জানো মা, আমি তোমার সাথে দেখা করতে আজ নানুর বাড়ি গিয়েছিলাম।”

“মামা বকেছে তোমাকে?”

“উঁহুম। ওসব বকা-ঝকা একটু আধটু খাওয়া যায়। বকার পরিবর্তে তোমার নম্বরটা তো পেয়েছি।”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। ওপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ একজন তাকে ডাকলো। আহি মলিন সুরে বলল,
“আচ্ছা, তুমি হয়তো ব্যস্ত।”

সালমা ফাওজিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“না, আমি ব্যস্ত নই। ফোন কেটে না, আহি। শোনো, আমি তোমাকে দেখতে চাই।”

মায়ের এমন কথায় আহির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সে চোখ মুছে বলল,
“আমিও তোমার সাথে দেখা করতে চাই। আর এটা পুষ্পের নম্বর। আমার ফ্রেন্ড পুষ্প, মনে আছে?”

“হ্যাঁ, মনে আছে।”

“আসলে আমার নম্বরটা বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা, তাই সেই নম্বর থেকে কল দেওয়ার সাহস হয় নি।”

“আমি জানি, আহি। চিন্তা করো না। তোমার বাবা কিছুই জানবেন না। আর আমি এখন ট্রেনিংয়ে এসেছি। আমার অফিস থেকে রাজশাহী এনেছে। চট্টগ্রাম এলেই আমি তোমার সাথে দেখা করবো।”

“আচ্ছা। মা, আমি তোমাকে সকালে কল দিয়েছিলাম। অন্য একজন ধরেছিল!”

“ওহ, হ্যাঁ। কামাল ধরেছিল। আমার কলিগ। ওর রুমেই আমার ফোনটা চার্জ হচ্ছিল। হুড়োহুড়িতে চার্জারটাই আনতে ভুলে গিয়েছিলাম।”

“আমি ভেবেছি কি জানো?”

“কি!”

“তুমিও বাবার মতো বিয়ে করে নিয়েছো!”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। বললেন,
“তোমার বাবার সাথে সংসার করে শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।”

কথাটি শুনে আহির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আমি তোমার জন্য নিজেকে দাঁড় করাচ্ছি, মা। সব তোমার জন্য করছি। এই আশা নিয়ে আছি, একদিন হয়তো তোমার বাবার চেয়ে ভালো অবস্থানে গিয়ে তার কাছ থেকে আমার মেয়েটাকে মুক্ত করে আনতে পারবো।”

আহি ঠোঁট চেপে কাঁদতে লাগলো। রাদ হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? আহি না সূচক মাথা নেড়ে সালমা ফাওজিয়াকে বলল,
“ততোদিনে আমি খান সাহেবের রক্ষিতা হওয়া থেকে বাঁচি কি-না দেখো!”

আহির কথায় সালমা ফাওজিয়া চুপ হয়ে গেলেন। আর রাদের বুকটা ধক করে উঠলো।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৯(২য় ভাগ)||

৩৪।
আফিফের মোটরসাইকেল থামলো ক্যাম্পাসের গেটের সামনে। আজ থেকে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম দিনই পদ্ম নিজ হাতে আফিফের ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে। এমনকি লাঞ্চবক্সও হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। আফিফ মোটরসাইকেল থেকে নেমে হাতলে ঝুলিয়ে রাখা লাঞ্চবক্সটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বক্সটি হাতে নিয়ে ক্যাম্পাসের গেটে পা বাড়াতে যাবে তখনই দেখলো ক্যাম্পাসের পার্কিং লটে আহি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনে দাঁড়ানো এক মধ্যবয়সী যুবতী নারী। আফিফ চোখ সরিয়ে সামনে পা বাড়াতে যাবে তখনই আবার তার চোখ আটকালো সেই স্থানে। মধ্যবয়সী সেই যুবতী নারীটি আহির বাহু চেপে ধরে রেখেছে। আহির চোখ-মুখ কুঁচকানো। সে যুবতী নারীটির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আফিফ আহির দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো। কোনো এক অজানা কারণে তার আহির কাছে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। আফিফের দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝখানে সেই যুবতী নারীটি আহির হাত ধরে তাকে টেনে গাড়িতে উঠাতে যাবে তখনই আফিফ আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে সেই গাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালো।
এদিকে কারো উপস্থিতি পেয়ে মিসেস লাবণি ভ্রূ কুঁচকে সেদিকে তাকাল। আহি আফিফকে দেখে লাবণির হাত ফসকে বেরিয়ে এলো। লাবণি আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“হু আ’র ইউ?”

আফিফ ভদ্র ভাষায় বলল,
“আপনি ওর সাথে জোরাজোরি করছিলেন কেন?”

“তো! তোমার কি সমস্যা?”

“আমি কিন্তু পুলিশ কল করবো!”

আহি আফিফের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। লাবণি আফিফের কথায় অট্টহাসি হাসলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে লাবণির দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণি হাসি থামিয়ে আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কে এই ছেলে? তোমার জন্য নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করছে!”

আহি ভীত চোখে আফিফের দিকে তাকালো। লাবণি যদি জেনে যায়, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি আর কেউ নয়, আফিফ। তাহলে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। আহি নিজেকে শান্ত করে প্রতিত্তোরে বললো,
“ও আমার ক্লাসমেট। আমাদের মাত্রই পরিচয় হয়েছে।”

আফিফ আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এবার লাবণি আফিফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ওহ, তাই হয়তো এতোটা সাহস দেখাচ্ছে।”

লাবণি আফিফের সামনেই আহির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“মিস্টার নিউ ক্লাসমেট, আমি আহির মা, মিসেস লাবণি রিজওয়ান কবির। আমি আমার মেয়ের সাথে যা ইচ্ছে তাই করবো। আশা করি তুমি তোমার এই হুমকি দ্বিতীয়বার আমাকে দেওয়ার সাহস দেখাবে না। নয়তো তোমারই ঝামেলা হবে।”

আহি শুকনো মুখে বলল,
“হ্যাঁ, ও জানে না আপনি কে! পরের বার আর এমন করবে না।”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি যাও এখান থেকে।”

আফিফ স্তব্ধ হয়ে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। সবকিছুই যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আফিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহি ইশারায় তাকে চলে যেতে বলল। কিন্তু সে একবিন্দুও নড়লো না। আহির অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়েই রইলো। মিসেস লাবণি আহিকে গাড়িতে উঠতে বললেন। আহি শুকনো মুখে গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই আফিফ তার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে আনলো। লাবণি আফিফের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল,
“তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।”

আফিফ শান্ত কন্ঠে বলল,
“আজ মাস্টার্সের প্রথম ক্লাস। ক্লাস শেষে না হয় সে বাসায় চলে আসবে। জোর করে আপনি ওকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। হয়তো আপনি তার মা। কিন্তু একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে জোরাজুরি করার কোনো অধিকার আপনার নেই।”

আহি আফিফের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহির এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে আফিফের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিতে। ছেলেটা হয়তো জানেই না সে কার সাথে বাড়াবাড়ি কর‍ছে। এদিকে লাবণি আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি লাবণিকে চাপা স্বরে বলল,
“আপনি যে কতোটা নোংরা মানসিকতার মানুষ সেটা দয়া করে বাইরের মানুষকে জানাবেন না। ভদ্র ভাবে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি তাজওয়ারের সাথে কোথাও যাচ্ছি না। আর আজ আমার প্রথম ক্লাস। তাই আমাকে জোর করবেন না।”

লাবণি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তাজওয়ার তোমার অপেক্ষায় আছে।”

“থাকুক।”

“ভুলে যেও না তুমি তোমার বাবার ইনভেস্টমেন্ট।”

“আমি কোনো পণ্য নই। আর আমি তাজওয়ারের সাথে কোথাও যাচ্ছি না। তার‍ যদি ইচ্ছে করে তাহলে সে ঘুরুক তার নষ্ট বন্ধুদের নিয়ে। আমি ওখানে গিয়ে আমার নিজের সম্মান নষ্ট করতে পারবো না। আর এখনো আমাদের বিয়ে হয় নি। তাহলে আমি কেন তার সাথে নাইট ট্যুরে যাবো, যেখানে তার বন্ধুরাও যাচ্ছে?”

“দেখো আহি, তাজওয়ার তোমার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে। সে আমাকে যদি আজ সকালেই জানাতো, তাহলে তোমাকে আমি বাসা থেকেই বের হতে দিতাম না।”

“এখন যেহেতু দেরী করে জানিয়েছে, তাহলে তো হয়েই গেলো! তাকে জানিয়ে দিন, আমি তার জন্য সব কাজ ফেলে বসে নেই।”

আহি এবার আফিফের সামনে এসে বলল,
“ক্লাসে যাওয়া যাক।”

(***)

আফিফ আর আহি একসাথে ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে ঢুকলো। আহি পেছন ফিরে একনজর লাবণির গাড়ির দিকে তাকালো। সবেমাত্র পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে গেলো গাড়িটি। গাড়িটিকে চলে যেতে দেখেই আহি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে আফিফের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“ধন্যবাদ এবং দুঃখিত।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“দুঃখিত বলার কারণ!”

“একটু ইনফরমাল ভাবে কথা বলেছি। মিসেস লাবণি জানেন না আপনি পদ্মের হাসবেন্ড।”

“জানলে কোনো সমস্যা?”

আহি ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল,
“না জানায় ভালো। জীবনে সম্পর্কের দৈর্ঘ্য যতো ছোট, আমার জন্য ততোই ভালো।”

এদিকে রাদ ক্যাম্পাসের মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। আফিফ আর আহিকে একসাথে দেখে সে রীতিমতো অবাক। আহি রাদকে দেখে দৌঁড়ে তার কাছে চলে গেলো। আর আফিফ সেকেন্ড খানিক তাদের দিকে তাকিয়ে ক্লাসে চলে গেলো।

(***)

বুকে হাত গুঁজে আহির দিকে তাকিয়ে আছে রাদ। আহি বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”

“তুই আজ মিস্টার আফিফ রাফাতের সাথে!”

“বলিস না রে। মিসেস লাবণির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি!”

“আহি, আমি তোকে যেটা জিজ্ঞেস করেছি, আগে সেটার উত্তর দে।”

“আমাকে বলার সময়টা তো দে।”

“বল।”

“সকালে ড্রাইভার আংকেল আমাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর আমি ক্যাম্পাসে ঢুকতে যাবো, ওমনি মিসেস লাবণি উড়ে এসে বসলো আমার কাঁধে। আমি বাসা থেকে বের হওয়ার পরই না-কি ওই খানের বাচ্চা খান তাকে কল দিয়ে বলেছে, তারা বন্ধুরা মিলে নাইট ট্যুরে যাচ্ছে। দুই দিন, দুই রাত কক্সবাজার থাকবে। আর মিসেস লাবণি তাই আমাকে জোর করছিলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাজওয়ার খান না-কি আমার জন্য এয়ারপোর্টে বসে আছে। আমি তো সেই বদমাশ খানের সাথে কখনোই নাইট ট্যুরে যাবো না। তুই তো জানিসই ওর বন্ধুগুলো একটার চেয়ে একটা অসভ্য। আমি তো কোনোভাবেই যাবো না। কিন্তু মিসেস লাবণি তো আমাকে জোর করে, ব্ল্যাকমেইল করে গাড়িতে উঠাচ্ছিলেন। আর তখনই উদয় ঘটলো বিশিষ্ট মানবসেবক আফিফ রাফাতের। সে তো আর জানে না, কার সাথে তর্কে যাচ্ছিল। আমি কোনোভাবে তাদের কথা কাটিয়ে বেঁচে ফিরেছি। সাথে তাকেও উদ্ধার করে এনেছি।”

রাদ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বিশিষ্ট মানবসেবক! বাহ, বাহ চমৎকার!”

“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?”

“ওই তেলাপোকাটাকে দেখলেই আমার রাগ উঠে!”

“আর তাজওয়ার খানকে দেখলে বেশি ভালো লাগে, তাই না?”

“ওটাকে দেখলে তো গা জ্বলে যাই। আমি যদি অনেক টাকার মালিক হতাম। অথবা আমি যদি প্রধান মন্ত্রীর ছেলে হতাম, ওই বেটাকে এমন তুলা ধুনা দিতাম। জন্মেও তোর দিকে তাকানোর সাহস পেতো না।”

আহি রাদের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
“ইশ! তুই প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হলে, তোর ভাবসাব এমন হতো, জন্মেও আমার দিকে তাকাতি না। আর এই ভার্সিটি আর সেই সোসাইটির স্কুলে তোকে পড়তেও হতো না। তখন আর আমাদেরও পরিচয় হতো না।”

রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“তোর সাথে পরিচয় না হলে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার মানুষটাকে দেখতে পেতাম না।”

“আচ্ছা! তাই? এখন বল তোর স্টান্ট ম্যান কোথায়?”

“তোর বান্ধবীকে দেখেই সুড়সুড় করে তার পিছু পিছু চলে গেলো।”

“কি ব্যাপার! ওর মতিগতি তো সুবিধার ঠেকছে না। সেদিন বাসেও পুষ্পের পাশে বসে পড়লো!”

“প্রেমে পড়েছে হয়তো!”

“ভালোই তো। তবে পুষ্প কিন্তু খুব কঠিন। এতো সহজে ওকে পটাতে পারবে না।”

“করুক, যা করার। একটা প্রেমও তো বেচারার সফল হয় নি। এখন তো সরাসরি বিয়েই করবে। দেখা যাক, শেষমেশ কি জুটে ওর কপালে!”

“হুম, আচ্ছা আমি ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষে আবার দেখা হবে৷ তোকে কিন্তু আজ সারাদিন আমাকেই সময় দিতে হবে। বাসায় দেরীতে ফিরলে জালে আঁটকে পড়ার আশংকা কম থাকবে।”

৩৫।

সেই বর্ষার দিনগুলো আবার ফিরে এলো বিনা নিমন্ত্রণে। আহি বন্ধ জানালার কাঁচের উপর হাত রেখে বিছানায় বসে আছে। কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলার গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আহি সেই ফোঁটাগুলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমনই এক বর্ষার দিনে তার আফিফের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। আর এমন দিনেই আহি তাকে হারিয়েও ফেলেছিল। তাই মেঘেদের বর্ষণে আহিও কাঁদে। ভীষণ কাঁদে। বাদামি ডায়েরীর পাতা উল্টে আফিফকে স্মরণ করছে আহি। কিছু বছর আগে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সে আফিফকে অনুরোধ করে ডায়েরীতে লিখেছিল,
“প্রিয়, বৃষ্টিস্নাত ফুল দেখেছো কখনো? ভীষণ স্নিগ্ধ লাগে দেখতে, তাই না? আজ না হয় আমার দিকেই তাকিয়ে দেখো। তোমার জন্য হলুদ শাড়ি পরে অলকানন্দা সেজে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মোড়ে। বৃষ্টিতে ভেজা আমাকে দেখে তোমার নিশ্চয় অলকানন্দার কথায় মনে পড়বে। আর তুমি নিশ্চিত আমার প্রেমে পড়বে। যেদিন তুমি আমার প্রেমে পড়বে, সেদিন থেকে আমিই হবো তোমার অলকানন্দা। আর এরপর যখন বৃষ্টি নামবে তুমি আমার হাত ধরে বৃষ্টি বিলাস করবে। করবে না বলো?”

আহি ডায়েরিটা বন্ধ করলো। বালিশের নিচে রেখে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। কান্না পাচ্ছে আহির। আফিফ কি করছে আজ? পদ্মফুলের সাথে বৃষ্টি দেখছে নিশ্চয়! হয়তো খুব সুন্দর মুহূর্ত সৃষ্টি হচ্ছে তাদের। এসব ভাবতে চাচ্ছে না আহি। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। যতোবারই তার মনে পড়ে আফিফ আর কখনোই তার হবে না, ঠিক ততোবার তার মনটা অস্থির হয়ে উঠে।
বালিশে মুখ গুঁজলো আহি। শব্দ করেই কাঁদলো কিছুক্ষণ। মুনিয়া খালা দরজায় কড়া নাড়লেন। আহি সাথে সাথেই চুপ হয়ে গেলো। বালিশ থেকে মুখ তুলে চোখ মুছলো। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলল,
“খালা, কেন ডাকছো?”

“ছোড মা, ভার্সিটি যাইবা না?”

“যাবো খালা।”

আহি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে আলমারি খুললো। ইচ্ছে করছে আজ অলকানন্দা সাজতে। যা ভাবা তাই। আলমারি ঘেঁটে হলুদ টপস বের করলো। কালো জিন্স আর উড়নার সাথে মোটামুটি ভালোই মানিয়েছে আহিকে। বৃষ্টির দিনে সাজগোজ খুবই বেমানান। আহি শুধু কপালে কালো টিপ পরলো। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খোঁপা করলো। বারান্দার দরজা খুলে একটা অলকানন্দা ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজলো। নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগলো আহি। তার ঠোঁটে মলিন হাসি, চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। আহি বুকে হাত রেখে বলল,
“তোমার জন্য সাজতে চেয়েছিলাম। তুমি তো আমার হলেই না প্রিয়। আমি তোমাকে এভাবে চাই নি। আমার একার অধিকার চেয়েছি। তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে না, প্রিয়? আজ আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অনেক বছর পর আবার সেই বর্ষা এলো, যেই বর্ষায় তুমি আমার মুখোমুখি। তোমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হবে না আমার। তুমি হয়তো জানো না, যেদিন বৃষ্টি নামে, আমি সেদিন নিজেকে শান্ত রাখতে পারি না। এই দুই সপ্তাহে তোমার কাছ থেকে নিজেকে কতোবার আড়াল করে রেখেছি। তোমাকে দেখেও দেখি নি। তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে পারি নি। একটা বছর আমি এভাবে তোমার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবো না, আফিফ। একদিন যদি তুমি বুঝে ফেলো, আমার এই চোখ দু’টি এখনো তোমার স্মৃতিতে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে, তখন আমি অনেক দুর্বল হয়ে পড়বো। আর যাই হোক তোমার সামনে দুর্বল হতে চাই না। তোমাকে ভালোবেসে আমি পরিপূর্ণ হয়েছি। তোমাকে অনুভব করেই আমি ভালো আছি। শুধু এতোটুকুই অভিযোগ! কেন বার-বার আমার সামনে এসে দাঁড়াও? আমার অনুভূতি আমার একার থাকুক। তুমি তো আমার জীবনের একটা অংশ। যেখানে তোমার স্মৃতিগুলোই শুধু জীবিত। কিন্তু তুমি কোথাও নেই। তোমাকে দেখার জন্য চারুশিল্পে কতো বাহানা দিয়ে চলে যেতাম। ঝড়-ঝঞ্ঝা কিছুই আমার ভালোবাসায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। কিন্তু আজ আমি মন থেকে চাই, এই মুহূর্তগুলো শীঘ্রই কেটে যাক। তোমার মুখোমুখি হওয়ার এই কাল নিমেষেই হারিয়ে যাক। তোমাকে আর দেখতে চাই না। কারণ ভয় হয় আমার। যদি নিজেকে ধরে রাখতে না পারি। তখন আমার গোছানো ভালোবাসা সবার কাছে পরিহাসের বিষয় হবে। আমি জানি, আমার ভালোবাসা কতোটা গোছানো। আমি কাউকে সুযোগ দেবো না, আমার ভালোবাসায় প্রশ্নবিদ্ধ করার।”

আহি আজ আর ক্যাম্পাসে গেলো না। ওভাবেই ছাদে চলে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজলো। ছাদের মেঝেতে শুয়ে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ছে আহির মুখে। কপালের টিপটা খুলে পরে গেছে। আহির অশ্রু লুকিয়ে গেছে বৃষ্টি কণাদের ভীড়ে। চোখ বন্ধ করলো আহি। অনেকক্ষণ পর সে অনুভব করলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলা আর তাকে স্পর্শ করছে না। কিন্তু ঝমঝম শব্দ সে এখনো শুনতে পাচ্ছে। আহি চোখ খুললো। সামনে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ার ছাতা মেলে তার মুখের উপর ধরে রেখেছে। আহি তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। তাজওয়ার আহিকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“এভাবে ভিজলে অসুস্থ হয়ে যাবে!”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তোমার সমস্যাটা কোথায়? আমার অনুমতি না নিয়ে তুমি এখানে কেন এসেছো?”

“তোমার কাছে আসার জন্য আমার তোমার অনুমতির প্রয়োজন নেই।”

আহি ছাদ থেকে নেমে পড়তে যাবে তখনই তাজওয়ার তার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আহির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
“বৃষ্টিতে ভেজা কোনো মেয়ে এই প্রথম আমার হৃদ স্পর্শ করেছে, আহি।”

“তো, আমি কি করবো!”

“আমার ভালোবাসা উপভোগ করবে।”

“তোমার নষ্টামি উপভোগ করার আগে আমি মরে যাই।”

তাজওয়ার আহির কথায় ভড়কে গেলো। রাগী কন্ঠে বলল,
“তোমার সমস্যা কি আহি? তুমি সবসময় আমার সাথে এমন করো। আমার সাথে কি একটু সুন্দর করে কথা বলা যায় না?”

আহি নরম কন্ঠে বলল,
“আমাকে ছেড়ে দাও, তাজওয়ার।”

তাজওয়ার মুচকি হেসে বলল,
“না, আরেকটু থাকো আমার পাশে।”

আহি এবার চেঁচিয়ে বলল,
“এই জন্যই তোমার সাথে সুন্দর করে কথা বলি না। নরম কথা তো তোমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।”

তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে দিতেই আহি হনহনিয়ে চলে গেলো। আর তাজওয়ার রাগে হাতের ছাতাটা ছাদেই ছুঁড়ে মারলো।

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-১৭ এবং বোনাস পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৭(১ম ভাগ)||

২৭।
চার বছর পর আফিফের মুখোমুখি হলো আহি। মানুষটাকে দেখেই তার মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে গেলো। যাকে আহি চার বছর আগে পেছনে ফেলে এসেছিল, সে কল্পনাও করতে পারে নি সেই মানুষটা আবার তার সামনে এসে দাঁড়াবে। আহির চোখ ছলছল করছে। আফিফ এখনো আহিকে খেয়াল করে নি। সে ব্যস্ত তার হাতে থাকা কাগজপত্র দেখায়। এদিকে রাদ আহিকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে সামনে তাকালো। আহির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে সে কিছুদিন আগেও ক্যাম্পাসের গেটের সামনে দেখেছিল। আহি নিজেই রাদকে দেখিয়ে দিয়েছিল। তাহলে সেদিন আফিফের ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়ানো কোনো কাকতালীয় ব্যাপার ছিলো না। তার সাথে এখনো হয়তো এই ক্যাম্পাসের কোনো যোগসূত্র আছে। রাদ এতোটুকু জানে আফিফ আর আহি একই ডিপার্টমেন্টে। এখন যদি আফিফ ভার্সিটির প্রফেসর হয়, তাহলে আহির মানসিক ভাবে আরো কষ্ট সহ্য করতে হবে।

যন্ত্রণাদায়ক অতীত যদি বর্তমানে চলে আসে, তাহলে বর্তমানটাই এলোমেলো হয়ে যায়। আহি তো আফিফকে অতীত আর কল্পনার মাঝেই রাখতে চেয়েছিল, তাহলে কেন এই মানুষটা আবার তার সামনে এলো? তার কি আরো কষ্ট পাওয়া বাকি আছে? এই মুহূর্তে আহির মনে হচ্ছে সে শূন্যের উপর ভাসছে। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়া প্রবাদটি সে আজ অনুভব করতে পারছে। আদতে মাটি সরে না গেলেও তার মনের শূন্যতা পৃথিবীর ব্যস্ততাকে ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে দিয়েছে। আহির অস্থির মনটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে।

আহির প্যানিক এট্যাক আসার সম্ভাবনা আছে। খালি চোখে আহিকে দেখে কেউ বুঝবেই না তার মনের অবস্থা। কিন্তু রাদ সূক্ষ্মভাবে দেখছে তাকে। আহির হাত কাঁপছে। রাদ আহির কাছে এসে তার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরালো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। রাদ চাপা স্বরে বলল,
“আহি, রিল্যাক্স। প্লিজ নিজেকে শক্ত কর। তোর অবস্থা দেখলে ছেলেটা বুঝে যাবে, তুই এখনো তাকে মনে রেখেছিস। এমন হয় না আহি। ওর সামনে তুই দুর্বল হতে পারবি না।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার এমন লাগছে কেন, রাদ?”

রাদ আহির দুই হাত শক্ত করে নিজের হাতে আবদ্ধ করলো। তারপর মুচকি হেসে বলল,
“আমার এখন ইচ্ছে করছে তোকে জড়িয়ে ধর‍তে।”

আহি রাদের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। রাদ আবার বলল,
“আহি, আমি তোকে ভালোবাসি।”

আহি রাদের হাত ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি বললি!”

রাদ হেসে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ, তোকে শান্ত করতে পেরেছি।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“তুই আসলেই আমার মেডিসিন।”

(***)

আহি উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। পেছনেই আফিফ দাঁড়িয়ে আছে। তাই আহি আর পেছনে তাকালো না। কিন্তু ভাগ্যটা আজ তার বিপক্ষেই দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে তার নাম ধরে মেয়েলী কন্ঠে কেউ একজন ডাক দিলো। আহি কন্ঠটা শুনেই চমকে উঠলো। আহি পেছন ফিরে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু আবার সেই কন্ঠটি আহির নাম ধরে ডাকলো। এবার আর ডাকটি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আহি পেছন ফিরে তাকাতেই সামনে থাকা মেয়েটির চোখে আনন্দাশ্রু ভীড় করলো। আহিও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নিজের অশ্রু আটকে রাখতে পারলো না। দু’জনই প্রায় আবেগী হয়ে গেছে। এবার দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।

পদ্ম চোখের পানি মুছে আহির দিকে তাকালো। কাঁপা কন্ঠে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই? কতো খুঁজেছি তোকে! একটা কল দেওয়া কি যেতো না? কতো স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। সব ভুলে গেলি, আহি?”

আহি পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আমি কখনো তোদের ভুলতে পারি নি। তোরা আমার কাছে বেস্ট ছিলি।”

“বেস্ট, এটাকে বেস্ট বলে? এভাবে যোগাযোগ শেষ করে দূরে চলে যাওয়ার কোনো মানে হয়? সবার কাছেই ফোন আছে এখন। একটা কলও কি দেওয়া যেতো না? আমি তো তোকে অনেক খুঁজেছিলাম। কিন্তু তুই আমাকে ব্লক করে দিয়েছিলি। কেন আহি? আমার অপরাধ কি ছিল?”

“তোর কোনো অপরাধ ছিলো না। আমিই অপরাধী। এখন কারণ জানতে চাস না প্লিজ। এতোটুকু জেনে রাখ, আমার পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিলো না। আর আমিও ভালো ছিলাম না।”

পদ্ম আহির হাতে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“আমার আজ এতো খুশি লাগছে, আমি বলে বোঝাতে পারবো না। এখন বল, কেমন আছিস?”

“ভালো, তুই কেমন আছিস?”

“আমিও ভালো। এই মুহূর্তে আরো বেশি ভালো আছি। কতো বছর পর তোর সাথে দেখা হলো! তুই এমন শুকিয়ে গেছিস কেন? খাওয়া-দাওয়া করিস না না-কি? শুনেছি বাইরের দেশে গেলে মানুষ মোটাসোটা হয়ে ফিরে। আর তোকে দেখে মনে হচ্ছে, সেই দেশে দুর্ভিক্ষ ছিল।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে তাকে জড়িয়ে ধরলো, আর মনে মনে বলল,
“জগতের দুর্ভিক্ষ আমার মনের দুর্ভিক্ষের কাছে হেরে গেছে, পদ্ম। যদি ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় আর চাঁদ ঝলসে যাওয়া রুটির মতো মনে হয়, তবে আমার প্রণয় বিরহে পৃথিবী মরুভূমি আর পদ্মফুল সেই মরুভূমিতে উঠা ধূলিঝড়।”

আহি এবার পদ্মকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তুই তো ভীষণ সুন্দর হয়ে গেছিস। তোর রূপের রহস্য কি?”

পদ্ম লাজুক হেসে পেছন ফিরে তাকালো। আহিও পদ্মের দৃষ্টি অনুসরণ করলো। আফিফ এতোক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে দুই বান্ধবীর উষ্ণ আলিঙ্গন দেখছিলো। দু’টি তৃষার্ত প্রাণকে জল খুঁজে পাওয়ার আনন্দে মত্ত দেখে আফিফের মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল।
পদ্ম আফিফের কাছে এসে তার হাত ধরে তাকে আহির মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো। রাদ একপাশে দাঁড়িয়ে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আর মনে মনে বলছে,
“আল্লাহ, আহিকে ধৈর্য ধরার শক্তি দাও। ও অন্তত দুর্বল না হোক।”

এবার পদ্ম আফিফকে বলল,
“আফিফ, ও আমার ছোট বেলার বান্ধবী, আহি। আপনার মনে আছে, ও আমাদের বিয়েতে এসেছিল!”

পদ্মের কথা শুনে আফিফ সেকেন্ড খানিক আহির দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। পদ্ম বলল,
“আমি আপনাকে ওর কথায় বলতাম। হুট করেই মেয়েটা গায়েব হয়ে গিয়েছিল।”

পদ্ম এবার আহির হাত ধরে বলল,
“এখন আর পালাতে পারবি না তুই।”

আফিফ গলা খাঁকারি দিয়ে পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি কথা বলো। আমি কাজ শেষ করে আসছি।”

আফিফ দ্বিতীয়বার আর আহির দিকে তাকানোর সাহস পেলো না। তার মনটা কেমন যেন কচকচ করছে। সে সোজা ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনে ঢুকে পড়লো। কিন্তু আহির চোখ দু’টি এখনো আফিফের যাওয়ার পানেই স্থির। তার চোখ জোড়া আবার ছলছল করে উঠলো। লজ্জা আর জড়তায় তার গলায় কথা আটকে গেছে। সে মনে মনে ভাবছে, যদি একবার জানতো তাকে আবার কোনো একদিন আফিফের মুখোমুখি হতে হবে, তাহলে চার বছর আগে সেই বর্ষার রাতে কখনোই তার মনে জমিয়ে রাখা কথাগুলো সে আফিফকে জানাতো না। মনের কথা মনেই রেখে দিতো।

পদ্মের কথায় আহির ঘোর কাটলো। সে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর সাথে লিনুর কিছু হয়েছে?”

আহি না সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“এখন এসব কথা রাখ। আগে বল, তুই এখানে কি করছিস?”

পদ্ম বলল,
“এখানে আমি আমার কাজে আসি নি। আফিফের কাজে এসেছি।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“উনি কি এখানে চাকরি নিয়েছে?”

পদ্ম হেসে বলল,
“না। আফিফ এ বছর মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে।”

পদ্মের কথা শুনে আহির বুকটা কেঁপে উঠলো। সে পদ্মকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না। সে যতোদূর জানে আফিফ চার বছর আগে অনার্স শেষ করেছিল। তাহলে চার বছর পর সে মাস্টার্সে কেন ভর্তি হতে এসেছে? যাই হোক, ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু সেই মুহূর্তেই বা কেন, যখন আহিও মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে?কয়েকদিন আগে জানলে আহি কখনোই এখানে ভর্তি হতে আসতো না।
হঠাৎ পুষ্প কোথা থেকে এসে পদ্মকে দেখে চমকে উঠলো। সে চোখ বড় বড় করে বলল,
“পদ্ম! আমাদের নাওশিন পদ্ম যে!”

পুষ্প গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম পুষ্পের এমন কান্ড দেখে হেসে বলল,
“কেমন আছিস তুই?”

পুষ্প ভাব নিয়ে বলল,
“আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি। পলি আপু গ্রুপে আমার চেয়ে সুখী কেউ নেই।”

পদ্ম পুষ্পকে জড়িয়ে ধরলো। পুষ্প পদ্মের গাল টেনে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তো এখানে কেন তুই? চার বছর পর আবার নতুন করে পড়াশুনা শুরু করতে এসেছিস নাকি? তোর ঝগড়ুটে শাশুড়ি এতো ভালো হলো কবে থেকে রে?”

পদ্ম হেসে বলল,
“আরেহ না। আমার বরের সাথে এসেছি।”

পুষ্প অবাক হয়ে বলল,
“দুলাভাই কি আমাদের ক্লাস পাবে নাকি?”

“ধুর, ও মাস্টার্সে ভর্তি হতে এসেছে।”

পুষ্প চোখ দু’টি গোল গোল করে আহির দিকে তাকালো। আহি পুষ্পের এমন মুখভঙ্গি দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
পুষ্পের এই এক অভ্যাস! নতুন কিছু শুনলে সে মুখের এমন ভাবভঙ্গি দেখাবে, মনে হবে কোনো ভয়ংকর খবর শুনেছে। পুষ্পের মুখভঙ্গি দেখে পদ্ম হাসতে হাসতে বলল,
“তোর সেই কার্টুন ভাবটা এখনো গেলো না, তাই না?”

পুষ্প মুখটা স্বাভাবিক করে বলল,
“আচ্ছা, এসব বাদ দে। আগে বল, ভাইয়া কি আমাদের সেইম ব্যাচ নাকি?”

“না, উনি তো আমাদের সিনিয়র।”

“তো এতোদিন পর মাস্টার্স করতে কেন এসেছে?”

“আসলে আমাদের বিয়ের পর উনি চাকরি নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। চাকরিটা ওই সময় খুব দরকার ছিল৷ আর উনি একসাথে দুইটা সামলাতে পারছিলেন না, তাই তখন মাস্টার্স করেন নি।”

“আর এখন কি চাকরি চলে গেছে নাকি?”

পুষ্পের কথা শুনে আহি পুষ্পের মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল,
“তুই এতো প্রশ্ন করিস কেন, ভাই? চুপ কর না।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তোর সমস্যা কি? আমার বান্ধবী, আমি প্রশ্ন করবো না? আর ও তো বিয়ে করেছিল, ভাইয়া যখন বেকার ছিল তখন, তাই না?”

পদ্ম হালকা হেসে মাথা নাড়লো। পুষ্প তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ভাইয়া কিন্তু খুবই ভাগ্যবান পুরুষ। বামুন হয়েই চাঁদ ধরে ফেলেছিলেন।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে ধরা কন্ঠে বললো,
“চাঁদটা ধরা দিয়েছে বলেই তো ধরতে পেরেছে। ধরা না দিলে আজ বামুন ভিন্ন কিছু পেতো।”

পুষ্প বলল,
“কাচ পেতো, কাচ। কোনো মেয়েই ভাইয়াকে পদ্মের মতো ভালোবেসে আগলে রাখতে পার‍বে না।”

আহি মলিন হাসলো। পুষ্প যদি জানতো, আহির এআর, পদ্মের বর, তাহলে আহির সামনে কখনোই এই কথা বলতো না। অগোচরে তার বান্ধবীগুলো তাকে আঘাতের পর আঘাত করেই যাচ্ছে। কিন্তু সে নিরব দাঁড়িয়ে শুধু নিজের ক্ষতের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে।
রাদ আহির দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সে বুঝতে পেরেছে পদ্ম আর পুষ্পের কথোপকথন আহিকে কষ্ট দিচ্ছে। তাই সে এসে আহির হাতটা ধরলো। এই মেয়েটা যে এখন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই! হুট করে কি না কি করে বসে বলা যায় না। রাদই তো তাকে সামলাতে পারবে।

(***)

প্রশাসনিক ভবন থেকে বের হতেই আফিফ আর আহির চোখাচোখি হলো। আহি আফিফকে দেখে আবার দুর্বল হয়ে পড়লো। ছেলেটাকে একটা সময় দেখলেই তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যেতো, আর আজ তার চোখাচোখি হতে আহির প্রাণটাই বেরিয়ে যাচ্ছে।

আফিফ পদ্মের কাছে এসে বলল,
“ওরা বলছে অনার্সে ভর্তি হওয়ার এখনো সময় আছে। চলো তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেই।”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে চাপা কন্ঠে বলল,
“মা যা চান না, আমি তা কেন করবো?”

আফিফ শান্ত কন্ঠে বললো, “মাকে আমি বোঝাবো।”

“না, আফিফ। এখন আমার দায়িত্ব সংসার সামলানো। এমনিতেই আমার উপর মায়ের অভিযোগের শেষ নেই। আমাকে বিয়ে করার পর আপনি মাস্টার্সটা শেষ করতে পারেন নি। এ নিয়ে কি কম কথা শুনেছি? তার ইচ্ছে ছিল, তার ছেলে মাস্টার্স করবে। এখন তার সেই ইচ্ছেটা পূরণ করার দায়িত্ব আপনার। প্রতিবেশীর ছেলে, আপনার বন্ধুরা মাস্টার্স শেষ করে মাকে মিষ্টি খাইয়েছে, আর আপনি নাকি আমার জন্য তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন নি!”

পদ্ম আক্ষেপ নিয়েই কথাগুলো বললো। পদ্মের কথা শুনে আফিফ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। মা তো বুঝে না যে মাস্টার্স ছাড়াও ভালো চাকরি পাওয়া যায়। দেখো, আমি নতুন চাকরি নিয়ে মায়ের ভুলটা ভাঙিয়ে দেবো। মা মনে করছে মাস্টার্স করি নি, তাই চাকরিটা চলে গেছে। কিন্তু আসল কারণ তো কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”

আহি দূরে দাঁড়িয়ে আফিফ আর পদ্মকে দেখছে। এসব দেখতে ভালো লাগছে না তার। সে চোখ বন্ধ করে নিজের আবেগ লুকোনোর চেষ্টা করতে লাগলো। আফিফ তার আবেগ। আর বর্তমানে তার বান্ধবীর বর। আফিফের উপর এখন তার কোনো অধিকার নেই। তাহলে শুধু শুধু এই ছেলেকে ভেবে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে কি তার কোনো লাভ হবে? দিনশেষে তার বুকটাই ভেসে যাবে, আর পদ্মের বুকে আফিফ মাথা রেখে ঘুমাবে। আহির এই খালি বুকটাতে আফিফের কোনো জায়গা নেই। আর প্রকৃতির শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে গিয়ে সে আফিফকে নিজের করেও রাখতে পারবে না।

(***)

পুষ্প ধপাস করে আহির পাশে বসতেই আহি চোখ কচলে চোখের জল আড়াল করে নিলো। পুষ্প আহির কাঁধে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“দেখ, ভাইয়া কিভাবে ফিসফিস করছে পদ্মের সাথে!”

আহি চোখ ছোট করে বলল,
“তো! এসব আমাকে কেন বলছিস?”

“ধুর, বোকা। কিছুই বুঝিস না তুই। মানুষ কখন ফিসফিস করে, বল তো?”

“আমি কিভাবে বলবো?”

“আরেহ, যখন প্রেমের কথা বলে তখন। দেখ, ওদের বিয়ে হয়েছে চার বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো কতো সুন্দর সম্পর্ক তাদের! আর এদিকে আমরা। বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখনো প্রেমিক পুরুষ কপালে জুটে নি। আর তুই কেন বসে আছিস, বল তো? তোর সেই এআরের খবর কি?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জানি না সে কোথায় হারিয়ে গেছে। এসব কথা আর জিজ্ঞেস করিস না।”

আহির দৃষ্টি আবার আফিফ আর পদ্মের দিকেই গেলো। তাদের দেখে আহি মনে মনে বলল,
“হারানো জিনিস হারিয়ে যাওয়ায় ভালো। পেয়ে গেলে হয়তো আগলে রাখতে পারতাম না। ভাগ্য যেখানে আমাকে আগলে রাখে নি, আমি আবার কাকে আগলে রাখবো? পুষ্প ঠিকই বলেছে, আমি আফিফের কাছে কাচ আর পদ্ম চাঁদ। কাচের হৃদয় আজ মরুভূমি। যেখানে ভালোবাসার জল নেই। আছে শুধু হাহাকার। প্রিয় মানুষগুলোকে হারানোর হাহাকার।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৭(২য় ভাগ)||

২৮।
পেছনের চাকা থেকে ধোঁয়া বের করতে করতে একটা মোটর সাইকেল ক্যাম্পাসে ঢুকলো। পদ্ম আর আফিফ ক্যাম্পাসের মাঠেই দাঁড়ানো ছিল। মোটর সাইকেলের ধোঁয়াগুলো সব পদ্মের নাকে-মুখে ঢুকে গেছে। পদ্ম হাত নাড়িয়ে ধোঁয়াগুলো তাড়াতে লাগলো। বাইকটি ক্যাম্পাসে ঢুকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে কয়েক চক্কর দিয়ে থামলো। আহি আর পুষ্প বাইকারটির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প রীতিমতো বাইকারটির চেহারা দেখার জন্য উদগ্রীব। কি চমৎকার ভাবেই না বাইকারটা রোলিং বার্নআউট স্টান্ট করলো! পুষ্পের বরাবরই স্টান্ট বাইকারদের উপর প্রবল আকর্ষণ। আর যদি তার হাতের নাগালেই এমন ছেলে থাকে, তাহলে তাকে পটাতে সে ভীষণ আগ্রহী হবে। কিন্তু পরক্ষণেই পুষ্প ভাবতে লাগলো, সে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। আর এই বাইকারটি যদি অনার্স পড়ুয়া ছাত্র হয়, তাহলে তো তার সব আশা জলে যাবে।

বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলতেই বাইকারের চেহারা দৃশ্যমান হলো। পুষ্প বাইকারকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আরেহ, এটা তো লাবীব!”

লাবীব বাইকের হ্যান্ডেলে দুই হাত উঠিয়ে হালকা ঝুঁকে বলল,
“কেন ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চারদের কি এমন স্কিল থাকতে পারে না?”

লাবীবের কথায় পুষ্পের সেদিন রেস্টুরেন্টে বলা কথাটা মনে পড়ে গেলো। পুষ্পের মুখটা ছোট হয়ে যেতে দেখেই লাবীব হাসলো।
এদিকে আফিফকে লাবীবের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে রাদ আর আহি ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম আফিফকে বার-বার আটকানোর চেষ্টা করছে। আহি বুঝতে পারলো আফিফ ভীষণ রেগে আছে। কিন্তু হঠাৎ তার রেগে যাওয়ার কারণ কি?

(***)

লাবীব বাইক থেকে নামতে যাবে তখনই পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে আফিফ বলে উঠলো,
“ক্যাম্পাসের মতো সুন্দর পরিবেশে এমন অভদ্র ভাবে প্রবেশ করার কি খুব প্রয়োজন ছিল?”

লাবীব পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এক্সকিউজ মি!”

“এটা বাইক স্টান্টের জায়গা নয়। এটা একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।”

“তো! আপনার সমস্যা কোথায়?”

“তোমার বাইকের ধোঁয়া অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়েছে।”

“এই দেশে এতো ধোঁয়া উড়ছে, আর আপনি এসেছেন আমার বাইকের ধোঁয়া নিয়ে কথা বলতে।”

“ভদ্র ভাবে কথা বলো। বাইক আমাদেরও আছে। আমরা তো এভাবে চালাই না।”

“চালাতে জানলেই তো চালাবেন।”

রাদ লাবীবের উত্তর শুনে ভবনের পিলারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে দাঁড়ালো। তার ঠোঁটে হাসি। আহি রাদের কাছে এসে বলল,
“রাদ, লাবীবকে গিয়ে থামা।”

রাদ চাপা স্বরে বলল,
“তোর আলগা পিরিত দেখাতে হবে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখ।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। রাদ দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“আমার এই সিনেমা খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এই বছরের হিট সিনেমা হবে এটা।”

রাদ মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে আহির হাতে দিয়ে বলল,
“যা পপকর্ন কিনে নিয়ে আয়। তারপর আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো।”

আহি টাকাটা রাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে লাবীবের সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফ লাবীবের অভদ্রতা দেখে আরো রেগে যাচ্ছিলো, তখনই আহি লাবীবকে বলল,
“তুই প্রথম দিনেই ঝামেলা করবি?”

লাবীব আফিফের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“উনি আমাকে ভদ্রতার জ্ঞান দিচ্ছে, সেটা দেখছিস না?”

পুষ্প আফিফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া, আমরা দুঃখিত। ও আসলে বুঝে নি ব্যাপারটা। এতো বছর দেশের বাইরে ছিল। এসব ওখানে স্বাভাবিক। লাবীব পদ্মকে বিরক্ত করতে চাই নি।”

লাবীব আহির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“কে এটা!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “পদ্মের হাসবেন্ড।”

“তোর ফ্রেন্ড, পদ্ম?”

“হ্যাঁ।”

লাবীব বাইক থেকে নামতে নামতে বলল,
“ওত্তেরি, আমি কি সবসময় ভুল সময়েই এন্ট্রি নেই না-কি? এখন হিরো সাজতে গিয়ে জিরো হয়ে যাবো না তো!”

“সরি বলে দে। ঝামেলা শেষ।”

লাবীব আফিফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সরি শ্রদ্ধেয় দুলাভাই।”

লাবীবের সম্বোধনে পুষ্প অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। রাদ হাই তুলতে তুলতে বিড়বিড় করে বলল,
“আহিনি, এতো সুন্দর হিট হওয়া সিনেমাটাই তুই ফ্লপ করে দিলি। সব মজা এক নিমেষেই শেষ করে দিলি। ইচ্ছে করছে তোকে আর তোর নিরামিষ তেলোপোকাকে এখনই আমিষ হীন জাদুঘরে রেখে আসতে। ধুর, ভাল্লাগে না।”

এদিকে আফিফ লাবীবকে আর কিছু বললো না। লাবীব এবার পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরেহ, তুই তো আমাদের স্কুলের সেই টু’জি ডিভাইসটা! দেখেছিস, আমার মেমোরি খুব শার্প।”

পদ্ম লাবীবের সম্বোধনে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। সে একটু পর পর আফিফের দিকে তাকাচ্ছে। আহি বুঝতে পেরে লাবীবের হাত ধরলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে সেই হাতের দিকে তাকালো। আহি তার নখগুলো দিয়ে লাবীবের হাতে আঁচড় দিয়ে তাকে চুপ করতে ইশারা করছিলো। কিন্তু লাবীব সেই ইশারা বুঝলো না। সে আহির হাত সরিয়ে দিয়ে পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পদ্ম, ইউর কিলিং আইজ।”

লাবীব এই কথা বলে বুকে হাত রাখলো। পদ্ম লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। লাবীব এবার জিজ্ঞেস করলো,
“তো মিস. ভদ্রমহিলা, কেমন আছেন?”

পদ্ম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আফিফ পদ্মের হাত ধরে বলল,
“বাসায় চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

পদ্ম মাথা নেড়ে আহি আর পুষ্পের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। এরপর আফিফের পিছু পিছু চলে গেলো। এদিকে রাদ এসব দেখে হাসছে। আফিফ আর পদ্ম চলে যেতেই পুষ্প রাগী দৃষ্টিতে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব পুষ্পের চাহনি দেখে বলল,
“খেয়ে ফেলবে না-কি আমাকে?”

“তুমি কোথায় কি বলতে হয় জানো না?”

“আমি আবার কি করলাম?”

“পদ্মের হাসবেন্ডের সামনে অন্তত ভদ্রভাবে কথা বলতে পারতে।”

“আমি কি পদ্মের গালে চড় লাগিয়েছি না-কি!”

আহি লাবীবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“লাবীব, মেয়েটা তোর কথায় অস্বস্তি বোধ করছিলো, তুই খেয়াল করিস নি?”

“অদ্ভুত তো! আমি এমন কি করলাম ভাই?”

রাদ লাবীবের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভীষণ ভালো করেছিস। আমি মজা পেয়েছি।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার মজা পাওয়ার কারণ কি? এমনিতেই পদ্মের সংসারে ঝামেলার শেষ নেই। এখন ভাইয়া যদি বিষয়টা নেগেটিভলি নেন? পদ্মের হাসবেন্ড একটু কন্সার্ভেটিভ। আর একদম সাদা মনের মানুষ। এসব জিনিস উনি সহজে নিবেন কি-না সন্দেহ!”

আহি অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, আমি বাসায় যাই। তোরা থাক। কাল অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে দেখা হবে।”

রাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি দ্রুত পায়ে চলে গেলো।

(***)

আহি ক্যাম্পাস গেট দিয়ে বেরিয়ে দেখলো আফিফ মোটর সাইকেলে চাবি ঘুরাচ্ছে। আহি দৌঁড়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আহিকে দেখে আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পদ্ম সিট থেকে নেমে আহির হাত ধরে বলল,
“কিছু বলবি?”

আহি পদ্মের হাত ধরে আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি প্লিজ লাবীবের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। স্পেশালি পদ্মকে ভুল বুঝবেন না। টু’জি ডিভাইস বলতে ও বুঝিয়েছে ক্লাসে পদ্ম অনেক দেরীতে লেখা শেষ করতো। আর ও ক্লাসে অনেক শান্ত ছিল। চুপচাপ থাকতো। তাই এমন বলেছে।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি পদ্মকে ভুল বুঝি নি। আমি এতোটাও ডোমিনেটিং নই।”

আহি হালকা হেসে পদ্মের কাছ থেকে বিদায় নিলো। পদ্ম যাওয়ার আগে বলল,
“আবার পালিয়ে যাস না কিন্তু। আমি কিন্তু আফিফ থেকে প্রতিদিন তোর খবর নেবো। এখন তো তুই উনার ক্লাসমেট।”

আফিফ পদ্মের কথা শুনে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মোটর সাইকেলে চাবি ঘোরালো। আহি মলিন হেসে হাত নাড়িয়ে পদ্মকে বিদায় দিলো।

রাস্তার মোড়ে যতোক্ষণ আফিফের মোটর সাইকেলটি দেখা যাচ্ছিলো, আহি সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। আফিফ আর পদ্ম চোখের আড়াল হতেই আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে বুকে হাত দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো একজন নিঃস্ব পথিকের মতো। এদিকে দূর থেকে রাদ আহিকে দেখছে। সেও তখন আহির পিছু নিয়েছিল। আর যখন দেখলো আহি আফিফ আর পদ্মের সাথে কথা বলছে, তখন আর সামনে এগিয়ে যায় নি। রাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললো,
“শুনেছি ছেলেদের উন্মাদ প্রেমে মেয়েরা ঘায়েল হয়ে যায়। আর এতো চমৎকার একটা মেয়ের এতো সুন্দর করে ভালোবাসতে পারাটা আপনাকে একটুও টানলো না, মিস্টার আফিফ? আপনি ভাগ্যবান হয়েও দুর্ভাগায় রয়ে গেলেন।”

২৯।

পদ্ম আর আফিফ বাসায় ঢুকতেই আফিফা বেগম নাক সিঁটকে বললেন,
“পড়তে গিয়েছিলি, না-কি বউ নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলি।”

আফিফ শান্ত ভঙ্গিতে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে মায়ের দুই হাত আলতো করে স্পর্শ করলো। আফিফা বেগম ছেলের নিরব আর উষ্ণ ব্যবহারে আবেগী হয়ে গেলেন। হুট করেই তার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল। আফিফ মাকে সোফায় বসিয়ে মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“মা, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়েছিলাম। মাস্টার্সে ভর্তির বাকি টাকাটাও দিয়ে এসেছি। এক বছর পর তুমিও সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতে পারবে।”

আফিফা বেগম পদ্মকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন,
“বউকে ঘরে রেখে যেতে পারিস নি?”

“মা, এরপর আমরা ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলাম। ওকে তো যেতেই হতো।”

আফিফা বেগম উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“ডাক্তার কি বললো? আমি দাদী হতে পারবো?”

পদ্ম শাশুড়ির উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমার সন্তান লাগবে না, মা। তুমি আর পদ্মই আমার সব।”

আফিফা বেগম ছেলের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই অপয়াকে বাঁচাতে চাইছিস? কে সন্তান চাই না, বল? এই মেয়ে তোকে সুখ দিতে পারবে না। তুই আরেকটা বিয়ে করে নে।”

পদ্ম শাশুড়ির কথা শুনে মলিন মুখে নিজের ঘরে চলে গেলো। আফিফ এবার গম্ভীরমুখে বলল,
“আমি পদ্মকে ভালোবাসি, মা। ওর বর্তমানে আমি সেই জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবো না।”

“ভালোবাসলে বাস। তালাক দিতে বলি নি। দুই বউ নিয়ে সংসার করবি!”

“বাস্তবিক দিক দিয়ে আমি একটা সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। যেখানে আমার চাকরিটাও চলে গেছে। সেখানে আমি দুই জনকে চালাতে পারবো না। আর যদি আমার দিক দিয়েই চিন্তা করো, তাহলে আমি নিজেই একসাথে দুইজনকে সমান ভাবে ভালো রাখতে পারবো না। আমি পদ্মকে ভালোবাসি, মা। নতুন কাউকে সেই জায়গাটা এতো সহজে দিতে পারবো না আমি। আর তখন নতুন জনের সাথেই অন্যায় হবে।”

আফিফা বেগম করুন স্বরে বললেন,
“তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোর যদি সন্তান না হয়, আমাকে দাদি বলে ডাকবে কে?”

“তুমি দাদি ডাক শোনার জন্য এমন করছো? আর যে মা ডাক শুনতে পারছে না, তার জন্য কষ্ট হচ্ছে না? তোমার আর আমার চেয়ে পদ্মের কষ্টটা অনেক বেশি। ও আমাকে ভালোবাসে, এই সংসারটাকে ভালোবাসে, তোমাকে ভালোবাসে। তুমি ওর সাথে এমন ব্যবহার করো না।”

আফিফা বেগম ছেলের কথায় দমে গেলেন। কিন্তু তার মন থেকে আফিফকে দ্বিতীয় বিয়ে করানোর সিদ্ধান্তটা এখনো গেলো না। ছেলে মানুষ যেকোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বিয়ে করতে আগ্রহী হবে। এখন তিনি মনে মনে ভাবছেন, ছেলের জন্য এবার তাকে সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে হবে।

(***)

পদ্ম মেঝেতে বসে কাঁদছে। আফিফকে রুমে ঢুকতে দেখে পদ্ম চোখের পানি মুছে নিলো। আফিফ পদ্মের কাছে এসে পা গুটিয়ে তার সামনে বসে পড়লো। পদ্ম আফিফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি তোমাকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না। কিন্তু আমি চাই, তুমি বাবা হও। আমার দুর্বলতাগুলো আমি মেনে নিয়েছি। তুমি এবার বিয়ে করে নাও। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিও না। আমি এই বাড়ির এক কোণায় পড়ে থাকবো।”

আফিফ হালকা হেসে পদ্মকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“পদ্মফুলকে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব। পদ্মফুল আমার জীবনে তখন এসেছিল, যখন আমি একদম নিঃস্ব ছিলাম। যখন মনে হয়েছিল, আমি কাউকে পাওয়ার যোগ্য নই। এমন একদিন পদ্মফুল তার লাজুক মুখখানা আমাকে দেখে আড়াল করেছিল। তার মিষ্টি হাসি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি এতোটাও অযোগ্য নই।”

আফিফের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো। সে পদ্মকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দেয়ালে লাগিয়ে রাখা চিত্রটির দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে তার মন ভারী হয়ে যেতে লাগলো। সে নিজেও জানে না কেন এই ভার তাকে ঝেঁকে ধরেছে। তবে আজ তার মন কাঁদছে। কিন্তু অশ্রুগুলো অদৃশ্য।

(***)

অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে বাদামি শার্ট আর কালো জিন্স পরে এসেছে আহি। আহিকে দেখতেও আজ ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। যদিও আহি তার আজকের পোশাকে একদম সন্তুষ্ট নয়। শার্ট-জিন্স পরতে অভ্যস্ত হলেও সে যতোবারই শার্ট পরেছিল, তার উপরে জ্যাকেট বা কোট পরতো বা গলায় একটা স্কার্ফ থাকতো। কিন্তু আজ সে এসব ছাড়াই বের হয়েছে।স্কার্ফটি পর্যন্ত গলায় ঝুলাতে পারে নি সে। আহি যদিও সেলোয়ার-কামিজ তেমন একটা পরে না। কারণ রিজওয়ান কবির নিজেই চান না মেয়ে দেশীয় পোশাক পরুক। তিনি মনে করেন ওয়েস্টার্ন পোশাক পরলেই আহিকে বেশি স্মার্ট লাগবে। আর তার বেশভূষায় বোঝা যাবে সে দেশের প্রভাবশালীর মেয়ে। যদিও আহি বাবার এই চিন্তা ভাবনা একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহসও পায় না। আর আহির আজকের পোশাকটি লাবণি মেহেরার ব্যক্তিগত সহকারী ঠিক করে দিয়েছে। মেয়েটির নাম সুনেহরাহ। প্রচুর গায়ে পড়া স্বভাব আছে মেয়েটির। লাবণির সামনেই রিজওয়ান কবিরের সাথে রসিয়ে রসিয়ে কথাবার্তা বলে। লাবণির এতে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আহি এসব দেখলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সুনেহরাহ আহিকে খুব পছন্দ করে। তার দৃষ্টিতে যেই মেয়েগুলো সুন্দর, তাকে সে নিজের মতো করে সাজিয়ে রাখতে পারবে। আহি এতোদিন দেশের বাইরে ছিল, তাই সুনেহরাহ তার এই ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারে নি। কিন্তু যখন লাবণি তাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে, আহির আজ অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম আছে, সে সাথে সাথেই সব কাজ ফেলে চলে এসেছে। আহি যদিও তাকে দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছে। আর এসব আদিখ্যেতা তার ভালো লাগে না। সাধারণ একটা প্রোগ্রামের জন্য এতো আয়োজন করার কি আছে সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু লাবণি এসব ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। আহি একজন প্রভাবশালীর কন্যা। যদি কেউ তার ছবি তুলে রাখে? তাই অন্তত আহিকে আকর্ষণ করার মতো নিজেকে তৈরী করে বের হতে হবে। যদিও রিজওয়ান কবির যে আহির বাবা তা তেমন কেউ জানে না। এমনকি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে সম্পর্কেও কোনো তথ্য কারো হাতে নেই।
বাবার জীবনে সে বইয়ের প্রথম পাতা মাত্র। যেখানে কোনো লেখা থাকে না। বিশেষ কারণ ছাড়া যেমন বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় পাঠকের অনুভূতি বা লেখকের শুভেচ্ছা স্বাক্ষর পড়ে না। ঠিক তেমনি রিজওয়ান কবিরও বিশেষ কারণ ছাড়া আহির সাথে কথা বলেন না বা তার ব্যাপারে মাথা ঘামান না। তবুও পাঠকের কাছে বইয়ের বাকি পৃষ্ঠাগুলোর মতো প্রথম শূন্য পাতাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রিজওয়ান কবিরের কাছে আহি সেই পাতা। যাকে তিনি নিজের মতো করেই রাখতে চান। নিজের মতোই তার সাথে ব্যবহার করেন। যা ইচ্ছে তার উপর চাপিয়ে দেন। যেমন আজ সুনেহরাহর কারণে স্কার্ফ ছাড়া তাকে বের হতে হয়েছে। আহি লাবণিকে কয়েকবার বলেছিল, সে অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু তার কথাটা যেন কোনো মূল্যই পেলো না।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৩০।
আহি ক্যাম্পাসে ঢুকার পর থেকে খুব অস্বস্তিবোধ করছিল। নিজের পোশাক নিয়ে আত্মবিশ্বাস না থাকলে যে কাউকেই বেমানান লাগবে। আহিরও নিজেকে তেমনই মনে হচ্ছে। এদিকে প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের অরিয়েন্টেশন আলাদা জায়গায় হচ্ছে। হয়তো পুষ্প, রাদ আর লাবীব তাদের প্রোগ্রামেই ব্যস্ত আছে।
আহি নিজের টোকেন দেখিয়ে অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে ঢুকতে যাবে তখনই আফিফের মুখোমুখি হলো। সে অডিটোরিয়াম রুমের সামনেই দাঁড়ানো ছিলো। আহির চোখাচোখি হতেই সে চোখ নামিয়ে নিলো। আহি ভেতরে ঢুকতেই রাদের কল এলো। সে কল রিসিভ করার জন্য তার টোকেনটা ফেরত নিয়ে বলল,
“আমি একটু পর ঢুকবো।”

আহি এই বলে অডিটোরিয়াম রুমের বাইরে এসে রাদের কল রিসিভ করে বলল,
“রাদ, কোথায় তোরা?”

“আমি আর লাবীব একটু পর প্রোগ্রামে ঢুকবো। তুই কোথায় সেটা জানার জন্যই ফোন দিলাম।”

আহি আমতা-আমতা করে বলল,
“আসলে আমি না ঝামেলায় আছি। একটা হ্যাল্প করবি?”

রাদ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “কি, কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“তুই এদিকে আয় না একটু।”

রাদ ফোন রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আহির ডিপার্টমেন্টে চলে এলো। দূর থেকে আহির হাবভাব দেখে রাদ আন্দাজ করে ফেলেছে সমস্যাটা কি! সে আহির সামনে দাঁড়িয়ে সাথে সাথেই বলল,
“উড়না ছিঁড়ে গেছে?”

আহি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“মিসেস লাবণি আমাকে জোর করে এভাবে পাঠিয়েছেন। গাড়িতেও উনি ছিলেন। নয়তো ড্রাইভারকে বলে একটা কিনে নিতাম। ভাই, আমার অস্বস্তি লাগছে।”

“ব্যাগে করেই নিয়ে আসতি।”

আহি তার হাতের ব্যাগটা উঠিয়ে রাদের সামনে ধরলো। রাদ ব্যাঙ্গ করে বলল,
“এই ব্যাগটা আর না আনলেও পারতি। আমি বুঝি না এতোটুকু একটা ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ারই বা কি আছে? ফোনটা হাতে নিলেও হয়।”

আহি চোখ ছোট করে রাদের দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল,
” ব্যাগটাও সুনেহরাহর পছন্দের।”

রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোর লাইফে এতো ভিলেন কেন, ভাই? আর তুই বোকা আমাকে একটা মেসেজ দিয়ে রাখতে পারতি। আমি আসার সময় কিনে নিয়ে আসতাম।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আজকের দিনটাও আমার খারাপ করে দিয়েছে। আর কতো সহ্য করবো ওদের? ওরা আমাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো নাচাচ্ছে। আমিও তো মানুষ! আমার কষ্ট হয়, রাদ। নিজের বাবাই যেখানে এমন, আমি আর মিসেস লাবণির আলাদাভাবে কি দোষ দেবো?”

রাদ নিজের ব্যাগ আহিকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন আর কি করার আছে? এসব কথা এই মুহূর্তে রাখ। এখন তুই এক কাজ কর। আমার ব্যাগটা ধর, আমি আসছি।”

রাদ আহিকে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। এদিকে আহি মলিন মুখে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। আফিফ অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে দেখলো আহি অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোনো কথা না বলে আহিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আহি দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাদের কন্ঠ শুনেই সে চোখ খুললো। রাদ তার ব্যাগটা নিয়ে একটা কালো উড়না আহির গলায় ঝুলিয়ে দিলো।

আহি জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় পেলি?”

“ভাগ্যিস ক্যাম্পাসের বাইরে একটা হিজাবের ভ্যান ছিল।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“তুই আমার সব রোগের মেডিসিন রে।”

(***)

আফিফ মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে অডিটোরিয়ামের দিকে যেতে লাগলো। সে সামনে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই দেখলো আহি আর রাদ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আর আহি রাদের হাত ধরে রেখেছে। আফিফ তাদের দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়েই তাদের পাশ কেটে চলে যেতে লাগলো। আহি আফিফকে যেতে দেখেই রাদকে বলল,
“আমিও যাই। এন্ড থ্যাংক ইউ সো মাচ, মাই মেডিসিন।”

রাদ আহির গাল টেনে দিয়ে বলল,
“তুই আমার একমাত্র মেয়ে বান্ধবী। তোর জন্য আমি সব করতে পারি। এখন যা।”

রাদ চলে যেতেই আহি অডিটোরিয়ামে ঢুকে গেলো। আফিফও তার সিটে এসে বসলো। এদিকে আহি দেখলো আফিফের পাশের সারিতেই একটা সিট খালি আছে। আহি একবার আফিফের দিকে তাকালো, আরেকবার খালি সিটটার দিকে। তারপর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। আশেপাশে কোথাও সিট খালি নেই। পেছনের দিকে কয়েকটা খালি আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সামনে সিট পেয়েও এতো পেছনে গিয়ে বসাটা সুন্দর দেখাবে না। আর আফিফও বুঝে যাবে, আহি এখনো তার উপর দুর্বল। সে আর যাই হোক আফিফকে বুঝতে দেবে না। তাই সেই সিটেই বসে পড়লো আহি।

প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ মনোযোগ দিয়ে অতিথিদের বক্তব্য শুনছে, আর কেউ কেউ নিজেদের মাঝেই ফিসফিস করছে। আর আহি পাথরের মতো বসে আছে। মনে হচ্ছে সে নিষ্প্রাণ। নয় বছর আগের সেই প্রথম দেখা, চারুশিল্পে একই সারিতে বসা, আফিফের দিকে তাকিয়ে থাকা, সবকিছুই চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো আহির। এসব মনে পড়তেই চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো তার। একটু পর পর জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে সে। এবার আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি সামনে তাকিয়ে থাকলেও আফিফের তার দিকে তাকানোটা খেয়াল করলো সে। ঝাপসা মুখটি স্পষ্টভাবে দেখার জন্য আহিও এবার পাশ ফিরলো। আর আফিফ সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। হঠাৎ আফিফ উঠে পেছনের সারিতে চলে গেলো। আহি বুঝতে পেরে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে তার কষ্টটা দমানোর চেষ্টা করলো। এই মুহূর্তে নিজের উপরই রাগ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে মনটাকে আটকানো এতো সহজ হবে না। সে নিজের বুকে হাত রেখে মনে মনে বলল,
“রিল্যাক্স আহি। রিল্যাক্স।”

আহি হঠাৎ খেয়াল করলো আফিফ তার একদম পাশে এসে বসেছে। পাশে বসা মেয়েটি আপনা-আপনি উঠে চলে যাচ্ছে। আহি সিটের হাতলে হাত রাখতেই আফিফ তার হাতটা ধরে মুচকি হাসি ফেরত দিলো। আহি সামনে তাকালো। আফিফ তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“প্রিয় অলকানন্দা, তোমাকে সুন্দর লাগছে আজ।”

আহি জানে এটা তার হ্যালুসিনেশন। এমন তার সাথে প্রায়ই হয়। সে তো অসুস্থ। সাধারণ মানুষ যেই অসুস্থতাকে পাগলামী বলে। আহি এমনই একজন পাগল প্রেমিকা, যার হুশ-জ্ঞান ঠিকই আছে, শুধু মিছেমিছি তার হারিয়ে ফেলা প্রেমিককে অনুভব করে, যে তার আশেপাশেও নেই।

(***)

অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম শেষ হতেই আফিফ অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়েই দেখলো আফিফা বেগম পদ্মকে নিয়ে তার ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মাকে এখানে দেখে আফিফ রীতিমতো অবাক। সে নিচে নামতেই আফিফা বেগম বললেন,
“আফিফ, তোকে দেখতে এসেছি!”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মা, এখানে আসার কি দরকার ছিল? আমি তো বাসায় আসবোই।”

“জানি তো। এমনিতেই তোর ভার্সিটি দেখতে এসেছি। এখন তোর ক্লাসমেটদের সাথে পরিচয় করিয়ে দে না।”

পদ্ম মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মায়ের এমন আচরণে ভীষণ রেগে গেলো। কিন্তু সে আজ পর্যন্ত মায়ের সাথে উচ্চবাচ্য করে নি। তাই মুখ ঘুরিয়ে কপালে আঙ্গুল ঘষতে লাগলো। পদ্ম বুঝতে পারলো আফিফ রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। সে আফিফা বেগমকে বলল,
“মা, উনি আজই প্রথম এসেছেন। ক্লাসও শুরু হয় নি। হয়তো ধীরে ধীরে পরিচিত হবেন।”

তখনই আহি অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে পদ্মকে দেখে দূর থেকে হাত নাড়লো। পদ্মও আহিকে দেখে ইশারা করলো। আফিফা বেগম পদ্মের দৃষ্টি অনুসরণ করে আহিকে দেখে বললেন,
“মেয়েটা কে?”

আফিফ মায়ের প্রশ্নে পেছন ফিরে আহিকে দেখে আরো ভড়কে গেলো। সে মায়ের হাত ধরে বলল,
“মা প্লিজ, তুমি চেয়েছো আমি পড়াশুনা শেষ করি। তাই তোমার জন্য মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। এখানে এমন কিছু করো না।”

“আরেহ, আমি কি করবো? আমি তো দেখতে এসেছি মাত্র।”

আফিফ মায়ের সাথে আর তর্কে জড়ালো না।
এদিকে আহি নিচে নামতেই পদ্ম আহির কাছে এসে বলল,
“কেমন আছিস?”

“ভালো। তোর কি অবস্থা?”

“হুম।”

পদ্মের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আহি। তখনই আফিফা বেগম বলে উঠলেন,
“কেমন আছো, মা?”

আহি সালাম দিয়ে বলল, “ভালো। আপনি?”

আফিফা বেগম সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,
“আমিও ভালো।”

আহি একনজর আফিফের দিকে তাকালো। এই মানুষটার খবর নেওয়ার জন্যই কিছু বছর আগেও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্র মহিলাকে ফোন করতো আহি। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে তার। যদিও আফিফা বেগমের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি আহিকে চিনতে পারেন নি। চেনার কথাও নয়। সেই স্কুল পড়ুয়া মেয়েটির সাথে বর্তমান আহির কোনো মিলই নেই।

এদিকে আফিফ মাকে আটকানোর জন্য তার হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতে চাইলে, তিনি আহিকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি পদ্মকে কীভাবে চেনো?”

“আমরা স্কুল ফ্রেন্ড।”

“আচ্ছা? তোমার বাবা-মা কি করেন?”

আহি সেকেন্ড খানিক আফিফা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শাশুড়ির এমন উদ্ভট আচরণে পদ্ম লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে। আহি পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্মকে এমন বিমর্ষ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহি আন্দাজ করতে পারলো ব্যাপারটা। কারণ পুষ্পের কাছেই সে পদ্মের শাশুড়ির স্বভাব সম্পর্কে শুনেছিলো। তাই আহি হাসি ফেরত দিয়ে বললো,
“বাবা ব্যবসা করেন। আর মা কি করেন জানি না।”

“সে কি, তোমার মা কি করেন, তুমিই জানো না?”

“মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই। আমার বাবা-মা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছেন। আমি বাবা ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে থাকি। তবে বাবার বর্তমান স্ত্রী কিছুই করেন না। তিনি শুধু বাবার টাকাই খরচ করেন।”

আহির এমন উত্তরে পদ্ম অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। আফিফও ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আফিফা বেগম বিষ্মিত মুখে বললেন,
“আহারে, তোমার খুব কষ্ট হয়, তাই না?”

“না। আমার ভালোই লাগে। আমি ইচ্ছেমতো বন্ধুদের সাথে ঘুরি, পার্টি করি। ওরা আমাকে যথেষ্ট ফ্রিডম দিয়েছে।”

আফিফা বেগম জোরপূর্বক হাসলেন। পদ্ম আহির হাত ধরে ইশারায় বলল, কি বলছিস এসব?

আহি মনে মনে বলল, “মিথ্যে তো আর বলি নি।”

আফিফা বেগম আবার বললেন,
“আচ্ছা, বিয়ে কবে করছো তুমি!”

আফিফ মায়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি প্রতিত্তোরে বলল,
“আন্টি, বিয়ে আর আমি? এক গ্লাস পানি নিয়েই খেতে পারি না। তবে পদ্মের মতো সংসারী হলে তো কথায় ছিলো না। আর বিয়ের সাথে দূর দূরান্তের বিচ্ছেদ।”

আফিফা বেগম হাসলেন। পদ্মও মুখ চেপে হাসলো। আহি যে তাকে বাঁচানোর জন্য এমন কথা বলছে সে বুঝতে পারলো। আফিফ এবার মায়ের হাত ধরে বলল,
“এখন চলো।”

তখনই রাদই তার ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আহির দিকে এগিয়ে এলো। রাদ কাছাকাছি আসার আগেই আহি নিজেই তার কাছে গিয়ে হুট করে তাকে জড়িয়ে ধরে চাপা স্বরে বলল,
“আমাকেও একটু জড়িয়ে ধর। পদ্মের শাশুড়ির সামনে বর্তমান জেনারেশানের একটা নমুনা দেখাই।”

রাদও আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ আর পদ্ম অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। আফিফা বেগম চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছেন। এরপর তিনি নিজেই বিড়বিড় কর‍তে করতে চলে গেলেন। আফিফও মায়ের পিছু নিলো। আফিফা বেগম বলতে লাগলেন,
“আজকাল মেয়ে-ছেলেদের লজ্জা বলতে কিছু নেই। বড়দের সামনেও কেউ এমন করে?

আফিফ মায়ের হাত ধরে বলল,
“তুমি এসবে কেন জড়াচ্ছ? মাথা থেকে আমাকে বিয়ে করানোর চিন্তাটা ফেলে দাও। আর এখানে এসে সবাইকে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে, দেখা যাবে আমার পড়াশুনাটা এবারও থেমে যাবে।”

আফিফা বেগম ছেলের হাত ধরে বললেন,
“এভাবে বলছিস কেন? আর আসবো না আমি।”

আফিফ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“রাগ করো না, মা।”

“তোর সাথে কি আমি রাগ করে থাকতে পারি, বল?”

(***)

আফিফা বেগম আর আফিফ চলে যেতেই আহি রাদকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“মাইন্ড করেছিস?”

রাদ বলল,
“এসবে ছেলেরা মাইন্ড করে না। খুশি হয়!”

আহি রাদের বাহুতে ঘুষি মেরে বলল,
“ফাজিল ছেলে।”

এরপর আহি পদ্মের কাছে এসে বলল,
“তোর শাশুড়ি এমন করছে কেন রে? এগুলো বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”

পদ্ম মলিন মুখে বলল,
“মা হতে পারবো না তাই। এটা হয়তো আমার কোনো কালের শাস্তি।”

“ডাক্তার দেখাস নি?”

“হুম, দেখিয়েছি। সমস্যাটা আমারই। ট্রিটমেন্ট করেও লাভ হচ্ছে না।”

“ভালো ডাক্তার দেখা।”

“ঢাকায় গিয়েছি। তাও কাজ হয় নি। আমি কখনোই সন্তান ধারণ করতে পারবো না। তাই আফিফকে আবার বিয়ে দেওয়ার কথাবার্তা চলছে।”

“তো! দ্বিতীয় বিয়ে কোনো সমাধান নয়। এখন অনেক পদ্ধতি আছে। চিকিৎসা সেবাও অনেক উন্নত হয়েছে। আইভিএফ পদ্ধতিও বাচ্চা নেওয়া যায়।”

“আহি, এসবে অনেক খরচ। এতো টাকা থাকলে তো অনেক আগেই আমরা বাবা-মা হয়ে যেতাম। আফিফের বেতন কম। কোনোভাবে আমাদের চলে যাই। এখন তো উনার চাকরিটাও চলে গেছে।”

“কেন? উনি ছবি আঁকে না এখন?”

পদ্ম মাথা নেড়ে বলল,
“বিয়ের পর থেকে কখনোই আঁকতে দেখি নি। বিয়ের পরই একটা চাকরি নিয়েছিলেন। পিয়নের চাকরি। উনার ছোট বোনের স্বামী অনেক বড়লোক। অনেক টাকার মালিক। সে-ই আফিফকে চাকরিটা দেয়। তারপর একদিন চাকরিটাও চলে যায়। কি হয়েছে জানি না। আমাকে বলে নি। তবে আমার ননদ আর শাশুড়ীর কাছ থেকে শুনেছিলাম, আমার ননদের স্বামীরও একজন বস ছিল, তিনিই না-কি আফিফকে বের করে দিয়েছিলেন।”

“কেন?”

“জানি না। আফিফ তো বলে নি আমাকে।”

“তুই চিন্তা করিস না। তোর শাশুড়িকে বোঝা, বল যে অন্য পদ্ধতিতেও তুই মা হতে পারবি। খরচ বেশি তাই সময় লাগছে। আর একদিন ঠিকই উনার ভালো জব হবে। তখন টাকা জমিয়ে তোদের স্বপ্ন পূরণ করিস। বিয়ে করতে দিস না। দ্বিতীয় স্ত্রীগুলো কখনোই ভালো হয় না।”

আহি কথাটি বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎই তার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। পদ্ম চলে যেতেই আহি রাদকে বলল,
“তোদের বাড়ির পাশেই তো আমার নানার বাড়ি। তুই মায়ের খোঁজ নিয়ে আসবি, রাদ?”

রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“তুই না বললেও আমি যেতাম। হাতে দুই সপ্তাহের ছুটি আছে। আমি বাড়িতে যাবো। অনেক বছর তো যাওয়া হয় নি।”

“আমাকেও নিয়ে যাবি?”

“তোকে যেতে দেবে?”

“ট্যুর বলে যাবো। পুষ্পের সাথে গেলে নিশ্চয় বাঁধা দেবে না।”

“তাহলে চল।”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“মা আমাকে মনে রেখেছে তো!”

“মা কি তার সন্তানকে ভুলতে পারে?”

“আমার জন্য নানাভাইয়ের কোনো খবর নেই। নানু আমাকে পছন্দ করেন না। মামারাও করেন না হয়তো। আচ্ছা, ওরা যদি মাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়?”

“কি বলিস এসব?”

“আজকাল তো মেয়েরাও দ্বিতীয় বিয়ে করে। মাও তো করতে পারেন। মায়ের বিয়ে হয়ে গেলে, আমাকে তো মা মেনেই নেবে না। বাবার কাছ থেকে পালাতে পারলে, আমি তখন কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবো? আমার মনে হয় না আমার কেউ আছে?”

“কেউ থাকুক না থাকুক, যতোক্ষণ আমি আছি তুই কখনো নিজেকে একা ভাবিস না।”

আহি হালকা হেসে অশ্রুগুলো আড়াল করে বলল,
“মেডিসিন একটা।”

রাদ আহির কথায় হাসলো। তারা দু’জনই ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েই দেখলো তাজওয়ার গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আহি রাদকে বলল,
“এই উটকো আপদটার চোখ ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় আছে?”

আহি আর রাদ চোখ ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা করার আগেই তাজওয়ার আহির সামনে এসে দাঁড়ালো। আহি চোখ ছোট করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হালকা হেসে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার গর্জিয়াস লেডিকে শুধু আমার সাথেই মানায়। উড ইউ প্লিজ এক্সকিউজ আজ?”

রাদ আহির দিকে তাকালো। আহি রাদকে ইশারায় চলে যেতে বললো। রাদ চলে যেতেই আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারকে বলল,
“আমি তোমার কেউ নই। আমাকে বিরক্ত করবে না।”

“আমি যতোদিন বেঁচে আছি, তুমি তো আমারই। এই স্টেটমেন্ট আমি কখনোই তুলবো না।”

“তোমার মতো ক্যারেক্টরলেস ছেলেদের স্টেটমেন্টের কোনো বিশ্বাস নেই।”

“আমি ক্যারেক্টরলেস হতে পারি, কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমি খুবই লয়াল। তোমার জন্য আমি সব ছেড়ে দিয়েছি।”

“ফার্জিয়াকেও?”

তাজওয়ার ফার্জিয়ার নাম শুনেই বিরক্ত হলো। সে হালকা রাগ দেখিয়ে বলল,
“আহি, প্লিজ। মেয়েটাই আমার পেছনে পড়ে ছিল। আর এখন ও আমাদের মাঝে আসবেই না। ওকে আমি কড়া ভাবে বলে দিয়েছি, তুমিই আমার সব।”

“আচ্ছা? কড়াভাবে বলেছো? না-কি তোমার বন্ধুদের দিয়েই সব কাজ করিয়েছো?”

তাজওয়ার আহির কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। আহি রাগী কন্ঠে বলল,
“তোমার বন্ধুদের দিয়েই তো ওকে তোমার পথ থেকে সরিয়েছো। এখন ভিডিও বানিয়ে ওকে ব্ল্যাকমেইল করছো। তোমার কড়া হওয়ার ডেফিনিশন দেখে আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। এটাকে যদি কড়া হওয়া বলে, তাহলে তোমার আর হিংস্র পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর এমন পশু একদিন আমাকেও সরানোর জন্য তার বন্ধুদের সাহায্য…..”

তাজওয়ার আহিকে থামিয়ে দিয়ে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“তুমি আর বাকিরা এক নও। তুমি আমার ছাড়া আর কারো হতে পারবে না।”

“আমাকে চ্যালেঞ্জ করো না। আমি তোমাকে বিয়ে না করার জন্য সব সীমা ছাড়িয়ে যাবো। তুমি তো আমাকে কখনোই পাবে না। মিস্টার খান, কিপ ইট ইন ইউর মাইন্ড।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তুমি আমাকে চেনোই নি, আহি। যতোটুকু চিনেছো, আমি এর চেয়ে ভয়ংকর হতে পারি। কিন্তু আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। তবে তোমার আশেপাশে যারা আছে, তাদের কিছু হলে আমি দায়ী নই।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-১৬ এবং বোনাস পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৬||

২৫।
উচ্চতর বিভাগের প্রথম সেশনে উঠেই আহি সিদ্ধান্ত নিলো আফিফের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু হুট করে সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলো না সে। আহি চাচ্ছে আফিফ নিজেই তাকে বলুক সামনে এসে দাঁড়াতে। শেষমেশ অনেক চিন্তা ভাবনার পর আহি চমৎকার একটা বুদ্ধি বের করলো। কাস্টমাইজড করা যায় এমন দোকানে গিয়ে তার পরিকল্পনাটা তাদের জানালো। তারাও আহির কথামতো তাকে একটা কার্ড বানিয়ে দিলো। অনেক সাহস নিয়ে সে পরের সপ্তাহের প্রথম দিনেই কার্ডটি আফিফের খাতার ভাঁজে রেখে দিলো।
আজ তার তিন বছরের এক তরফা ভালোবাসার একটা গতি হতে যাচ্ছে। ভাবতেই আহির হাত-পা আনন্দে কাঁপছিল। তবে আহিকে অবাক করে দিয়ে আফিফ সেদিন ক্লাসে আসে নি। পরের দিনও আফিফ আসে নি। তাই আহি তার কার্ডটা আবার নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর আফিফের কি হয়েছে তা জানার জন্য তার মহল্লায় গেলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলো আফিফ যেই বাসায় থাকতো, সেখানে তালা দেওয়া। পাশে সাইনবোর্ড ঝুলছে, ঘর ভাড়া দেওয়া হবে। সাইনবোর্ডটা দেখেই আহির বুকটা কেঁপে উঠলো। সে কি তাহলে আফিফকে হারিয়ে ফেলেছে? আহি অনেকক্ষণ সেই বাসার নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ একজন মহিলাকে পাশের বাড়িতে ঢুকতে দেখে আহি জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি, আপনি কি জানেন এই বাসায় যারা ছিল, তারা কোথায় গেছে?”

মহিলাটি আহিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন,
“ওরা তো অন্য জায়গায় চইলা গেছে।”

“কোথায়?”

“সেইডা তো বলে নাই।”

“হঠাৎ বাসা ছেড়ে দিয়েছে কেন?”

মহিলাটি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি তাদের কি অও?”

“আমি আফিফের ক্লাসমেট। ও দু’দিন ধরে ক্লাসে আসে নি, তাই ওকে দেখতে এসেছি।”

“তাইলে তুমি ভেতরের খবরডা জানো না!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি খবর?”

“ওরা তো আর এমনি এমনি যায় নাই। বলতে পারো, পালাইয়া গেছে।”

“পালিয়ে গেছে মানে?”

“চয়ন রে চেনো?”

“হ্যাঁ, আফিফের বড় বোন।”

“কেমনে মরছে জানো?”

“না।”

“গলায় দড়ি দিছিলো। হায় আল্লাহ গো, আফিফা আপার পোড়া কপাল! মাইয়াডা মইরা তারে বদনাম কইরা গেছে। কোন না কোন দোকানে চাকরি নিছিলো। ওই দোকানের মালিকরে কাউরে না কইয়া বিয়ে করছে। ওই মালিকের আবার আরেক বউ আছিলো। সেই বউ এখানে আইসা চুল ধইরা যে কি মাইরটাই না দিলো চয়ন রে। তারপর কি হইছে জানো নি? চয়নের ভিডিও একটাও ছাড়ছে। গ্রামের এক পোলার লগে চক্কর ছিল ওই মাইয়ার। মাইয়াডা সুবিধার ছিল না। সে তো চিল্লায় চিল্লায় কইতেছিলো, তার কোনো দোষ নাই। যে পোলার লগে প্রেম ছিল, সে না-কি তারে ধোঁকা দিয়া এমন করছে। আর ভিডিও কইরা ছাইড়া দিছে।”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটি আক্ষেপের সুরে বললেন,
“আরেহ আফিফ পোলাডা বোনের সম্মান বাঁচাইবার জন্য পাগলের মতো দৌঁড়াইছে। টাকা দিয়া ভিডিওটা ওই শয়তান পোলাডার থেকে নিছে। ধার-কর্জ বহুত ছিল তাদের। এই কয়েক মাস আগেই ছোড মাইয়াডারে বিয়া দিয়া দিসে বড় ঘরে।”

আহি অবাক কন্ঠে বলল, “ও তো আফিফের ছোট।”

“হ। আফিফ তো চায় নাই। ওর মা দিয়া দিসে। টাকা নাই, পালবো কেমনে? এক বেলা খাইতে তাদের দুই বেলা খাটতে হয়। আর তারা তো আমগো মতো না। মাইনসের বাড়িত কাম করে খাই না। হাতও পাতে না। বাপ মরার পর অভাবে পইড়া গেছে। আর যাই কও, আফিফ পোলাডা বেশি ভালা।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে আফিফের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“এজন্যই কি তোমার চোখে-মুখে এতো বিষন্নতা ছেয়ে থাকে? এআর, আমি তোমার পাশে আছি। আমার জীবনটাই আমি তোমার নামে লিখে দিয়েছি। আমি তোমাকে এতো ভালোবাসবো যে তোমার অতীতের কিছুই আর মনে থাকবে না।”

এরপর আহি লিনাশাকে ফোন করে পুরো ঘটনা বললো। শুধু চয়নের সাথে কি হয়েছিল সেসব জানালো না। এদিকে সব শুনে লিনাশা বলল,
“চিন্তা করিস না। পরের সপ্তাহে ক্লাসে যায় কি-না দেখ। যদি না যায়, তাহলে স্যারের কাছ থেকে ফোন নম্বরটা নিবি। আর আফিফের মায়ের নম্বর তো আছেই!”

“লিনু, উনার নম্বর কয়েক মাস ধরে বন্ধ। ওই নম্বর খোলা থাকলে তো আমি চিন্তাই করতাম না।”

“এখন!”

“যদি পরের সপ্তাহে না আসে তাহলে স্যারের কাছ থেকে ওর ফোন নম্বরটা নিতে হবে।”

(***)

পরের সপ্তাহে আহি আবার আফিফের সেই খাতাটিতে কার্ডটি রেখে দিলো। আর আফিফ সেদিন আহির চিন্তার রেখা মুছে দিয়ে চারুশিল্পে এলো। প্রতিদিনের মতো আজও আফিফ তার খাতাটা যত্ন নিয়েই খুললো। কিন্তু আজ তো চিরকুট বা স্কেচ কিছুই রাখা নেই। রাখা আছে একটা সাদা রঙের কার্ড। আফিফ সেটা খুলতেই দেখলো ভেতরে লেখা,
“আমি আজ তোমার সামনে আসবো। কিন্তু তোমার অনুমতিতেই। ক্লাস শেষে মাঠে চলে যেও। আমি আশেপাশেই থাকবো। কার্ডে দু’টো বাটন দেখছো না? একটা কালো, আরেকটা সাদা! দু’টো বাটনেই দুই ধরণের উত্তর আছে। তুমি যদি চাও, আমি তোমার সামনে আসি। আমার সুপ্ত অনুভূতির কথা তোমাকে সামনা-সামনি এসে জানাই। তাহলে তোমার প্রিয় রংটিতে চাপ দেবে। আর যদি না চাও, তাহলে কালো বাটনে চাপ দেবে। কালো বাটনে চাপ দিলে আমি হয়তো আর তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে পারবো না। অনেক সাহস নিয়েই তোমার সামনে দাঁড়ানোর চিন্তা করেছি। তোমার হ্যাঁ বা না আমার সাহস বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”

(***)

ক্লাস শেষ হতেই আফিফ মাঠে গিয়ে দাঁড়ালো। আহি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ সাদা জিন্স-টপস পরেই এসেছে। সে জানে আফিফ সাদা বাটনেই চাপ দেবে। আফিফ চায়, আহি তার সামনে আসুক। তাই আহি তৈরী হয়েই এসেছে। সাথে আফিফের পছন্দের অলকানন্দা ফুলের চারা নিয়ে এসেছে। আহি চোখ বন্ধ করে আছে। সাদা বাটনে চাপ দিতেই বাজবে আহির প্রিয় গানের একটি লাইন।

“তুমি আর তো কারো নও শুধু আমার।”

আর কালো বাটনে চাপ দিলে শোনা যাবে আহির কন্ঠ। আফিফের প্রতিক্রিয়া দেখছে না আহি। সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত-পা কাঁপছে। এখন সেই গান তার কর্ণ গুহর স্পর্শ করলেই হয়তো সে নয়ন জোড়া খুলবে। এই গানটি শুনে শুধু তার শ্রবণেন্দ্রিয় সন্তুষ্ট হবে না, তার অস্থির মনটাও কিনারা খুঁজে পাবে। কিন্তু আহিকে অবাক করে দিয়ে আফিফ কালো বাটনে চাপ দিলো। কালো বাটনে চাপ দিতেই আহির কন্ঠ শুনতে পেলো আফিফ। আহি বলছে,
“আমি তবুও তোমাকে ভালোবাসা ছাড়বো না।”

আহি স্তব্ধ হয়ে গাছের আড়ালেই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ জোড়া ভিজে যাচ্ছে। আফিফ কি তাহলে চায় না আহির ভালোবাসা? আফিফ কি তাকে দেখতে চায় না? আহি আড়ালের বাইরে এসে দেখলো মাঠের একপাশে বেঞ্চের উপর কার্ডটি রেখে আফিফ চলে যাচ্ছে। আহি নীরবে দাঁড়িয়ে আফিফের চলে যাওয়া দেখছে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, এটাই আফিফ আর তার ভালোবাসার দূরত্বের সূচনা। কিন্তু এই দূরত্ব আহি চায় না। সে আফিফকে ছাড়া কখনোই ভালো থাকবে না।
সেদিন আহি কার্ডটি নিয়ে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই তার কান্না যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। আফিফের প্রত্যাখ্যান সে মেনে নিতে পারছিলো না। এতোটুকুতেই যদি আহির জীবনটা চলতো, তবুও হতো। কিন্তু সেদিন সে শুধু তার প্রিয় প্রেমিক পুরুষকে হারায় নি। সেদিন সে তার মাকেও হারিয়েছিল।

(***)

আফিফের হাত ধরার অধিকারটা আজ আফিফ তাকে দেয় নি। তাই সে আফিফের ভাস্কর্যটিকেই বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। হঠাৎ নিচ থেকে ভাংচুরের শব্দ শুনতেই আহির কান্না ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলে। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিচে নেমেই দেখলো রিজওয়ান কবির সালমা ফাওজিয়াকে জবানি তালাক দিয়ে দিয়েছেন। সালমা ফাওজিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুনিয়া খালা আহির কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। আহি জানে না এসব কি হচ্ছে! সাধারণ ঝগড়া হচ্ছে ভেবেই সে বাবাকে শান্ত করার জন্য গেলো। আর রিজওয়ান কবির সাথে সাথেই আহিকে সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“তোমার মাকে আমি তালাক দিয়েছি। কাগজে কলমেও এই সম্পর্ক থেকে আমি মুক্তি পাবো। তোমার মাকে বলো, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে যাতে এখনই এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আমার এই বাড়িতে থাকার কোনো ইচ্ছেও নেই। তবে আমি একা যাবো না। আহিও আমার সাথে যাবে।”

রিজওয়ান কবির তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“আহিকে তুমি কখনোই পাবে না।”

বাবার কথার অর্থ সেদিন আহি না বুঝলেও এখন সে বুঝে। রিজওয়ান কবিরের কথায় সেদিন আহির প্রতি ভালোবাসা লুকোনো ছিল না। তিনি তো আহিকে বন্দী করেছেন নিজের স্বার্থে।

এরপর কয়েক মাসের মধ্যেই আহির বাবা-মায়ের আইনগতভাবে তালাক হয়ে যায়। সালমা ফাওজিয়া মায়ের বাড়িতে চলে যান। তিনি আহিকে আইনগত ভাবে পাওয়ার জন্য বড় বড় উকিলের সাহায্য নেন। আহির আঠারো হয়ে যাওয়ায় তার মতামতটাই গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু রিজওয়ান কবির কোনো সুযোগই ছাড়েন নি। তিনি আহিকে সময় দিয়ে তার মন জয় করার চেষ্টা করেন। সালমা ফাওজিয়ার নামেও অনেক উল্টোপাল্টা কথা মেয়েকে বুঝিয়েছেন। আহি জানে তার বাবা মিথ্যে কথা বলছে। সে তার বাবা-মা দু’জনকেই ভালোবাসে। কিন্তু সে মন থেকে মায়ের সাথেই থাকতে চায়। আদালতেও সে মায়ের সাথে থাকার ইচ্ছে পোষণ করেছে। রিজওয়ান কবির যখন দেখলেন, মেয়েকে তিনি নিজের দিকে করতে পারছেন না, তখন তিনি নিজের ভাঙা সংসারটি বড় বড় মন্ত্রীদের সামনে মেলে ধরলেন। আর এরপর বিদ্যুৎ গতিতে ঘটনা মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়াকে প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে দুশ্চরিত্রা উপাধী পেতে হলো। কিন্তু তবুও তিনি আহিকে পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। শেষমেশ তাকে দমানোর জন্য সিরাজ খানের লোকেরা তার বাবাকে গুম করে ফেলে। এখন পর্যন্ত আহির নানার কোনো খবর পাওয়া যায় নি। এরপর আহির মামাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দেন সিরাজ খান। সালমা ফাওজিয়ার মা ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মেয়ের পক্ষ থেকে সরে যান। তিনি নিজে গিয়েই রিজওয়ান কবিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চান। রিজওয়ান কবির আহির মামাকে ছাড়িয়ে আনেন। বিনিময়ে লিখিতভাবে আহির কাস্টাডি পেয়ে যান। এই প্রতিযোগিতার শহরে যেখানে টাকা ছাড়া একদিনও চলা যায় না, সেখানে আহি মাত্র কলেজ ছাত্রী। সে বাবাকে ছাড়লে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মায়ের কাছে যাওয়ারও কোনো পথ নেই। তাই বাধ্য হয়েই তাকে বাবার সাথেই থেকে যেতে হয়েছে। রিজওয়ান কবিরও মেয়ের প্রতি যথেষ্ট নরম ছিলেন৷ তাহলে শুধু শুধু আহি কেন বাবাকে ছেড়ে যাবে? কিন্তু আহি জানতো না এটা তার বাবার একটা পরিকল্পনা ছিল।

এদিকে চারুশিল্পের উচ্চতর বিভাগের প্রথম সেশনের পরীক্ষাগুলো তেমন একটা ভালো হয় নি আহির। বাবা-মার ঝামেলায় সে কয়েক মাস ছবি আঁকা বন্ধ রেখেছিল। ফলাফল স্বরূপ আফিফ দ্বিতীয় সেশনে উঠে যায়, আর আহি তাকে দ্বিতীয়বারের মতো হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আহি তবুও থেমে যায় নি। সে আফিফের নতুন বাসাটিও খুঁজে নেয়। আফিফের ভার্সিটির ঠিকানাও পেয়ে যায়। এরপর থেকে প্রায়ই কলেজ শেষে আহি আফিফের ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আড়ালে দাঁড়িয়ে আফিফকে দেখতো। আর বাসায় এসে তার অনুভূতির কথা সেই ডায়েরীতে লিখতো। আর একা একাই ভাস্কর্যটির সাথে কথা বলতো। এভাবেই নীরব ভালোবাসায় আহির দিনগুলো কাটছিলো।

…………………………….

মলিন মুখে নিজের কাপড় ভাঁজ করছে পদ্ম। ভেতর থেকে তার শাশুড়ি চেঁচিয়ে যাচ্ছেন।

“মুখপুরি মেয়েটা মাথা খেয়েছে আমার ছেলের। ছেলেটা আমার সারাদিন শুধু বউ বউ করে। এই অপয়া মেয়ের জন্য আমার ছেলেটা পড়াশুনা শেষ করতে পারে নি। আমার ছেলের বন্ধুরা সব পড়াশুনা শেষ করে বাইরের দেশে চলে গেছে।”

পদ্ম নীরবে চোখের জল মুছছে। তার শাশুড়ি মা যখন জানতে পারলো সে কোনোদিন মা হতে পারবে না, সেদিন থেকেই সে তার শাশুড়ী মার চক্ষুশূল। বিয়ের পর থেকেই কোনো এক অজানা কারণে পদ্মের শাশুড়ি তাকে দেখতে পারেন না। পদ্ম তার স্বামীকে অনেক বার জিজ্ঞেস করেছিলো, কেন তার উপর এতো ক্ষীপ্ত থাকেন তিনি। কিন্তু পদ্মের স্বামী কোনো উত্তর দিতে পারে নি। বরং সে উত্তরে শুধু তার স্ত্রীর কপালে অধর স্পর্শ করে বলেছিল,
“আমার ভালোবাসা কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়?”

পদ্মের শাশুড়ি ঘরে ঢুকে বললেন,
“যাদুকরী মেয়ে, নতুন বউয়ের মতো দিন-রাত ঘরে বসে না থেকে, রান্নাটা চুলায় বসিয়ে দাও গিয়ে। না-কি আমাকেই তোমাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে?”

পদ্ম মাথা নেড়ে বলল,
“মা, আপনি বিশ্রাম নিন। আমি আসছি।”

“বিশ্রাম! মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে, তাও শান্তিতে মরতে দিচ্ছো না। একমাত্র ছেলে আমার! একটা সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই তোমার! যাদুকরী তুমি। মাথা খেয়ে নিচ্ছো ওর।”

“মা, উনি তো বলেছেন আপনার স্বপ্ন পূরণ করবেন।”

“চুপ করো তুমি। যাও রান্নাঘরে। কাজগুলো সব পড়ে আছে। আর আমার ছেলে আসলে কিন্তু ওকে মেয়ে দু’টোর ছবি দেখিয়েছি না, ওদের ব্যাপারে ভাবতে বলবে। পুরুষ মানুষ ঘরে দু’টো বউ রাখতে পারে। আমার ছেলের সন্তান হলে তোমাকেও মা বলে ডাকবে। মাথায় রেখো কিন্তু।”

শাশুড়ীর কথায় পদ্মের চোখ ভিজে গেলো। পদ্মের শাশুড়ি সেই অশ্রু দেখে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলেন। পদ্ম রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় ভাত বসাতেই তার ফোনে কল এলো। স্ক্রিনে প্রিয় মানুষটির নাম দেখে তার মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি সুরে তার প্রিয় মানুষটি বলল,
“পদ্মফুল, কি করছো?”

“রান্না করছি। আপনি কবে ফিরবেন?”

“আজ ফিরতে রাত হবে। শোনো, তুমি মায়ের কথায় রাগ করো না।”

“আপনি কীভাবে বুঝলেন?”

“আমার পদ্মফুলের ভেজা কন্ঠই আমাকে জানিয়ে দিয়েছে।”

“তাড়াতাড়ি আসবেন। আপনার জন্য ইলিশ ভাজা করে রাখছি।”

কথা বলা শেষ হতেই পদ্ম ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তার ফোনের স্ক্রিনে তার বান্ধবীদের ছবি। আহি, লিনাশা আর পুষ্পের সাথে তার তোলা শেষ ছবিটা এখনো তার ফোনের ওয়ালে শোভা পায়। পদ্ম ছবিটিতে আলতো হাত রেখে বলল,
“তোরা থাকলে আমার জীবনে এতো বিষন্নতা থাকতো না। কতো বছর তোদের সাথে দেখা হয় না। কতো বছর হয়ে গেছে, তোদের ছুঁয়ে দেখতে পারি না। পুরোনো দিনগুলোই সুন্দর ছিল। যদি বাকি পড়াশুনাটাও করতে পারতাম, তোদের সাথে ঠিকই যোগাযোগ রাখতে পারতাম। এখন কোথায় তোরা, আর কোথায় আমি। তবে বরটা আমি ভালোই পেয়েছি। আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি হয়তো তার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই। কিন্তু সে আমাকে বুঝতেই দেয় না সেটা। আহি, লিনু, পুষ্প আমি তোদের হারিয়ে একটা নতুন বন্ধু পেয়েছি। কিন্তু তোদের জায়গা কি কেউ নিতে পারবে, বল? ভীষণ ভালোবাসি তোদের।”

(***)

আহি ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। আজ কোনো কারণ ছাড়াই আফিফের টাইমলাইনে ঢুকলো সে। কতো শত স্ট্যাটাস আর ছবি সে ছেড়েছে। কিন্তু আহি গত চার বছরে একবারো তাকে দেখার জন্য ঢুকে নি। সেই যে বর্ষার রাতে তাকে শেষবার দেখলো, আর দ্বিতীয়বার দেখার সাহস তার নেই। কিন্তু চার বছর আগে এই টাইম লাইনটিতেই আহি প্রতিদিন ঢুকতো। আফিফের দেওয়া প্রতিটা স্ট্যাটাস, শেয়ার করা পোস্ট, আফিফের আপলোড করা ছবি আহি দিনে কয়েকশো বার করে দেখতো। মন না ভরলে, সেই আপলোড দেওয়া ছবিগুলো স্কেচ করে রাখতো, আর যেই স্ট্যাটাসগুলো বেশি ভালো লাগতো সেগুলো স্ক্রিনশট নিয়ে প্রিন্ট করে বের করে দেয়ালিকা তৈরী করতো। দেয়ালিকাটা এখনো তার ঘরের একপাশে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে আছে।
আহি কিছুক্ষণ আফিফের টাইম লাইন ঘেঁটে মাথাটা বিছানায় ফেলে দিলো। সেই ভয়ংকর দিনটির কথা মনে পড়লেই তার শরীরটা নিথর হয়ে আসে। কিন্তু আজ বার-বার সেই মুহূর্তটি তার চোখের সামনে ভেসে আসছে।

……………………….

আহিদের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। সবাই ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর আহি ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করছে। কারণ আফিফও সেই বিভাগেই পড়ছে। আফিফ যা-ই করবে আহিও ঠিক তা-ই করতে পছন্দ করে। এই কয়েক বছরে আফিফের পছন্দই তার পছন্দ হয়ে গেছে। মানুষটাকে স্পর্শ না করেই তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন অনুভব করতে পারে আহি।
দিনটি ছিল আষাঢ়ের মাঝামাঝির বৈরী বেলা। আকাশে ছিলো কালো মেঘের ছোটাছুটি। লিনাশা, আহি আর পুষ্প ভর্তি কোচিং করে সবেমাত্র বের হয়েছে। হঠাৎ লিনাশার নম্বরে পদ্মের কল এলো। লিনাশা কল ধরতেই পদ্ম বলল,
“তোদের সাথে জরুরি কথা আছে। কোথায় তোরা?”

লিনাশা বলল, “আমরা তিনজন একসাথেই আছি।”

“আমি আসছি। কোন জায়গায় আছিস!”

“কি এমন কথা বলবি? ভয় লাগছে আমার।”

“আরেহ না। আগে আসি, তারপর বলছি। এখন কোথায় আসবো সেটা তো বল।”

“চকবাজারেই আছি। চলে আয়। সৈয়দ সেন্টারে উঠে যাচ্ছি আমরা। তুই ওখানেই আসিস।”

প্রায় বিশ মিনিট পর পদ্ম সেখানে চলে এলো। পদ্মকে দেখে সবাই ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পুষ্প পদ্মের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে অন্য চেয়ারে বসলো। পদ্ম বসেই সবার দিকে একবার একবার তাকিয়ে বলল,
“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

আহি, লিনাশা আর পুষ্প চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “সত্যি?”

“হুম।”

পুষ্প পদ্মের হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “দুলাভাই কি করেন?”

“এখনো পড়াশুনা করছে।”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“বেকার ছেলেকে বিয়ে করছিস?”

“উনি আসলে আমাকে বিয়ে করে নিতে চাচ্ছেন।”

আহি গালে হাত দিয়ে বলল,
“তোর উনিটা কে শুনি!”

“আছে একজন।”

“তার মানে তুই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করেছিস?”

“লুকিয়ে প্রেম করি নি। সব হুট করেই হয়ে গেছে।আমাদের অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল। উনি আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। ছাদে গেলে মাঝেমাঝে আমাদের দেখা হতো। ওভাবেই পরিচয় হলো। আর উনি আমাকে পছন্দও করতেন। তারপর আমাকে জানানোর পর আমি আপুকে বলেছিলাম। তোরা তো জানিস, বাবা আমাকে পড়াতে পারবেন না।আমাদের পারিবারিক অবস্থা ওতোটাও ভালো না। আপুকে যখন বলেছি, আমার উনাকে ভালো লাগে। আপু বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফেলেছে। এরপর উনি বাসায় প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। এখন আমার বিয়ে আগামী মাসের শুরুতে।”

লিনাশা আর পুষ্প চেঁচিয়ে বলল,
“আগামী মাসে ঢাকায় আমাদের পরীক্ষা।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“বাহ, আমার জন্য কিন্তু ভালোই হয়েছে। আমার কোনো পরীক্ষা নেই। আমি চট্টগ্রামেই আছি।”

পদ্ম আহির হাত ধরে বলল, “তুই আসিস তাহলে।”

“হুম, অবশ্যই। আমার বান্ধবীর বিয়ে, আর আমি আসবো না, তা কি হয়? তোর বিয়েতে সবুজ লেহেঙ্গা পরে আসবো।”

পদ্ম হেসে বলল,
“বিয়ে কিন্তু গ্রামে হবে। অনুমতি পাবি তো?”

“অবশ্যই। বাবা আমাকে যথেষ্ট ফ্রিডম দিয়েছে। আমি আসবোই।”

এবার পুষ্প বলল,
“কিন্তু ছেলেটা তোকে খাওয়াবে কি? আর এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাচ্ছে কেন?”

“উনি ভালো ছবি আঁকতে পারেন। ছবি বিক্রি করেই উনি অনেক টাকা পান।”

আহি ভাবুক মনে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বিয়ের কার্ড এখনো ছাপানো হয় নি। তোরা আসিস তবুও। তোদের সাথে আর ফর্মালিটি কীসের! এখন আমার ননদ আসবে একটু পর। ও আমাকে নিয়ে বিয়ের বাজার কর‍তে যাবে। আমি যাই তাহলে। তোরা আসবি কিন্তু। বাই।”

পদ্ম চলে যেতেই আহি অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। লিনাশার ঝাঁকুনিতেই আহি নড়েচড়ে বসলো।
সেদিন বাসায় ফেরার পর থেকেই আহির অস্থিরতা কাটে নি। প্রতিদিন সে আফিফের টাইমলাইন ঘুরে দেখেছে। আর নিজেকে বুঝিয়েছে, পদ্ম হয়তো অন্য কারো কথা বলছে। আফিফ তো জানে কেউ একজন তাকে ভীষণ ভালোবাসে। তাহলে সে কেন অন্য কাউকে পছন্দ করতে যাবে?

(***)

শ্রাবণের বারিধারায় রাস্তাঘাট মুক্তো দানার মতো চিকচিক করছে। তিন ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আহি পদ্মের বাড়িতে পৌঁছালো। আজই পদ্মের বিয়ে। সন্ধ্যায় তাদের আক্দ হবে। আর রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর পদ্মকে উঠিয়ে দেবে। গ্রামের রাস্তাঘাট বর্ষার মাসে যে কি পরিমাণ অচল, তা আহি আজ না এলে বুঝতোই না। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমেই বলল, গাড়ি আর ভেতরে নেওয়া সম্ভব না। তাই আহি গাড়ি থেকে নেমেই ড্রাইভারকে চলে যেতে বললো। আজ সে পদ্মের বাড়িতেই থাকবে। সন্ধ্যা হয়েই গেছে। এতোক্ষণে পদ্মের আক্দ হয়ে যাওয়ার কথা। আহি যদি আগে জানতো এখানে পৌঁছাতে তার অনেক সময় লাগবে তাহলে সকালেই বাসা থেকে বের হয়ে যেতো।

(***)

পদ্মের বাড়িতে ঢুকতেই পদ্মের বড় আপু আহিকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। পদ্মকে দেখে আহি গালে হাত দিয়ে বলল,
“বাব্বাহ, আমাদের বউটাকে তো সে-ই লাগছে।”

পদ্ম লাজুক হেসে আহির হাত ধরে বলল,
“আমার কিন্তু খুব ভয় লাগছে, আহি।”

“যাকে ভালোবাসিস তার সাথেই বিয়ে হচ্ছে। ভয় পাওয়ার কি আছে? ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার মতো সুখের অনুভূতি দ্বিতীয়টা হয় না।”

“হুম, আমি আর আমার বর তোর আর তোর এআরের বিয়েতে আসবো।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের মতো আমাদের বরদের মধ্যেও যদি বন্ধুত্ব হয়ে যায়, তাহলে সে-ই হবে।”

পদ্ম মুচকি হাসলো। তারা দু’জন অনেকক্ষণ গল্প করলো। তারা জানতোও না এটাই তাদের শেষ কথোপকথন ছিল। হঠাৎ পদ্মের মা পদ্মের ঘরে এসে বললেন,
“পদ্ম, তোর বর এসেছে।”

পদ্ম শাড়ি গুছিয়ে নিয়ে আহির হাত ধরে বলল,
“তুই সহ যাবি কিন্তু।”

“আমি গিয়ে কি করবো?”

“আমার লজ্জা লাগছে তো ভাই।”

“প্রেম করার সময় তো আর লজ্জা পাস নি!”

“ধুর আহি।”

আহি পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আগে দুলাভাইকে বল সেলামি দিতে। নয়তো এই হাত আমি তার হাতে তুলে দেবো না।”

পদ্মের কাজিনরা আহির কথায় হাসতে লাগলো। তখনই পদ্মের রুমে সাদা শেরওয়ানী পরা এক যুবকের প্রবেশ ঘটলো। পদ্ম আহির হাত ঝাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আহি, তুই নিজেই সালামি খুঁজে নিস।”

আহির হাত আলগা হয়ে এলো। সে স্থির দৃষ্টিতে সামনে থাকা মানুষটিকে দেখছে। কি হচ্ছে এসব? কি দেখছে সে? আফিফ পদ্মের বর?

আহি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “অসম্ভব!”

পদ্ম আহির হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“আহি, আমার হাত ছাড়িস না। আমি পড়ে যাবো। শাড়িটা বেশ ভারী।”

আহি শক্ত করে পদ্মের হাতটা ধরলো। আফিফ পদ্মের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“পদ্মফুল, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”

আফিফের কথা শুনে আহির বুকটা ভেতর থেকেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অশ্রুগুলো বরফের মতো চোখের কোণে জমে আছে। কিন্তু তারা ঝরে যেতে পারছে না।

আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে নিয়ে বিয়ের আসনে গিয়ে বসালো। আহিও ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। বিয়ের স্টেজে উঠতেই পদ্ম আফিফকে চাপা স্বরে বলল,
“আমার ফ্রেন্ড, আহি।”

আফিফ এতোক্ষণ পর আহির দিকে তাকালো। আহিকে দেখেই আফিফ ভ্রূ কুঁচকালো। আহি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে মানুষটাকে দেখার সাহস নেই তার। সে তো আর আহির মানুষ না। সে এখন পদ্মের প্রিয় মানুষ। আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলো না। মেয়েটাকে সে চারুশিল্পে দেখেছিলো। এর চেয়ে বেশি পরিচয় সে জানে না। আহির চোখের অশ্রুগুলো আর বাঁধা মানলো না। টুপ করে গড়িয়ে পড়তেই আহি মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বান্ধবীর খেয়াল রাখবেন। ও অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে।”

আফিফ মুচকি হেসে বলল,
“জানি, মিষ্টি মেয়ে দেখেই তো আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে।”

আহি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“কাঁদছিস কেন?”

“হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না।”

“কেন দেখা হবে না? আমাদের চারজনের বরদের বন্ধুত্ব হওয়া এখনো বাকি। তোর এআরের সাথে আমার বরের বন্ধুত্ব করিয়ে দেবো না!”

পদ্মের কথায় আফিফ চমকে উঠলো। সে অবাক দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। আহি পদ্মকে বলল,
“এআর আমার কল্পনা। যার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তুই ভালো থাকিস শুধু।”

আহি পদ্মকে স্টেজে রেখেই নেমে গেলো। এলোমেলো ভাবে সামনে হেঁটে যেতেই পদ্মের মা তার হাত ধরে বললেন,
“চলো আহি। তোমাকে খেতে বসিয়ে দেই।”

আহি পদ্মের মায়ের পিছু পিছু চলে গেলো। পদ্মের বড় আপু আহির প্লেটে এটা-ওটা বেড়ে দিচ্ছেন। আহির খাবারগুলো দেখেই বমি আসছে। সবই তার পছন্দের খাবার। কিন্তু যেখানে আফিফ তাকে এতো বড় সারপ্রাইজ দিয়ে পেট ভরিয়ে দিয়েছে, সেখানে এই খাবার গলা দিয়ে নামার প্রশ্নই আসে না। তবুও আহি খাচ্ছে। তার প্রিয় মানুষ আর তার প্রিয় বান্ধবীর বিয়ের ভোজন সে করেই যাবে। আহিকে কাঁদতে কাঁদতে খেতে দেখে পদ্মের মা বললেন,
“কি রে, কাঁদছো কেন আহি?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আন্টি, আমি বেশি ঝাল খেতে পারি না।”

“আচ্ছা, তাহলে যাও। মুখ ধুয়ে আসো। আহারে, ঝালে মেয়েটার চোখ-মুখ ফুলে গেছে।”

আহি কোনোমতে ওয়াশরুমে গিয়ে গলগল করে সব বের করে দিলো। শরীরে কোনো শক্তিই তার অবশিষ্ট নেই। অনেকক্ষণ ওয়াশরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ইচ্ছে করছে এখনই পদ্মকে গিয়ে বলতে, আফিফ শুধু তার। আর কারো না। আবার আফিফের মুখে পদ্মফুল সম্বোধনের কথাটা মনে পড়তেই তার বুক ফেটে যেতে লাগলো। দেয়ালে কিছুক্ষণ মাথা ঠুকেও কষ্ট কমলো না আহির। ড্রাইভারকেও চলে যেতে বলেছে। এখন এই তিন ঘন্টার পথ সে কীভাবে পার করবে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। আহির মনে হচ্ছে, আজই হয়তো তার মৃত্যু হবে। এই যন্ত্রণা তো মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর। এর চেয়ে ভালো এখনই সে মরে যাক।

(***)

প্রায় ঘন্টাখানেক পর আহি ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ক্লাবে বিয়ে হচ্ছে না। পদ্মের চাচার বাসার নিচ তলার গ্যারেজে বিয়েটা হচ্ছে। খুব সাদামাটা বিয়ে। এটাই যেন এই এলাকার জন্য জমকালো।
আহি আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো। কি কমতি ছিল তার? পদ্মের চেয়ে সুন্দর আহি। এমনকি সে যথেষ্ট আকর্ষণীয় আর স্মার্ট। তাজওয়ারের মতো ছেলে আহির পেছনে ঘুরঘুর করছে। তাহলে আফিফ কি একবারো তাকে দেখলো না? কেন দেখলো না? আহি নিজেকেই প্রশ্ন করছে। ইচ্ছে করছে পদ্ম হয়ে যেতে। পদ্ম হয়ে যদি আফিফকে পাওয়া যেতো!

পদ্মের বাবা আফিফের হাতে পদ্মকে তুলে দিলেন। পদ্মের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো। আপন মানুষগুলোর গলা জড়িয়ে কাঁদছে সে। আফিফ নিচে নেমে দাঁড়িয়েছে।

(***)

আহির হঠাৎ কি হলো সে নিজেও জানে না, এতোটুকুই জানে আজ সে আফিফকে তার মনের কথা জানিয়েই ছাড়বে। অনুমতি ব্যতীত আজ সে তার ভালোবাসা প্রকাশ করবো। নয়তো এই কথা মনে পুষে রাখলে দম বন্ধ হয়ে আসবে তার। আর এভাবে সে বাকী জীবন কাটাতে পারবে না। পরবর্তীতে কি হবে আহি জানে না। জানতে চায়ও না। কিন্তু আজ আফিফকে এই কথা বলেই সে সামনে পা বাড়াবে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাবে না।

(***)

আহি আফিফের সামনে এসে দাঁড়াতেই আফিফ চমকে উঠলো। আহির চোখগুলো ফুলে গেছে। আফিফ স্থির দৃষ্টিতে সেই ফোলা চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফের চোখ দু’টিও কেমন অস্থির হয়ে আছে। এই অস্থিরতা কীসের? একটা মেয়ের মন ভেঙে দেওয়ার অস্থিরতা, না-কি নতুন জীবনে কোনো ঝড় আগমনের আভাস পাওয়ায় এই অস্থিরতা! সে আহিকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। তার গলায় কথা আটকে গেছে। আহি বলল,
“আমি চলে যাচ্ছি। অনেক দূরে চলে যাবো আমি। চিন্তা করো না। কখনোই পদ্মকে আমি এআরের পরিচয় জানাবো না। কিন্তু একটা কথা তোমাকে জানিয়ে যাবো। কেউ একজন বলেছে, মনের কথা লুকিয়ে রাখলো যন্ত্রণা বাড়ে, প্রকাশ করে ফেললেই শান্তি।”

আফিফ অবাক হলো। এই কথা আফিফ নিজেই কয়েক মাস আগে টাইমলাইনে লিখেছিলো। তাহলে মেয়েটা কি তাকে এখনো মনে রেখেছে? মেয়েটা কি তাকে নীরবে অনুসরণ করে যাচ্ছে?

আহি এবার বলল,
“তুমি সেদিন জানতে চাও নি, আমি কে! কেন জানতে চাও নি, তা আর জানার অধিকার নেই আমার। কিন্তু আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। এখনো ভালোবাসি।”

আফিফ কিছু বলতে যাবে, তখনই আহি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার আর কখনো তোমাকে দেখা হবে না, এআর। আমি আজ শুধু আমার ভালোবাসা হারাই নি, তোমার জন্য আমি আমার ছোটবেলার বান্ধবীকেও হারিয়ে ফেলেছি। আমি আর কখনো পদ্মের সামনে দাঁড়াতে পারবো না। সহ্য হবে না আমার। আমার এতো বছরের শখের মানুষটাকে সে কেঁড়ে নিয়েছে।”

আফিফ কাঁপা কন্ঠে বলল,
“পদ্ম আমাকে ভালোবাসে নি। আমি পদ্মকে ভালোবেসেছি বলেই সে আমাকে ভালোবেসেছে। এখানে ওর কোনো অপরাধ নেই। তোমার সাথে যা হয়েছে, সেটার জন্য কেউ অপরাধী নয়। ভাগ্যে হয়তো এটাই ছিল। তোমাকে নিয়ে আমি কখনোই কিছু ভাবি নি। তুমি যখন আমার জীবনে আসতে চেয়েছিলে, তখন আমার জীবনটা একদম এলোমেলো ছিল। এমন জীবনে কারো আগমন সুখকর হয় না।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“ভালো থাকবেন। পদ্মকেও ভালো রাখবেন।”

আহি তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। অন্ধকার রাস্তা। আহির সবুজ রঙের হালকা কাজের লেহেঙ্গাটা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। আফিফের গলা কাঁপছে। এই অপরাধবোধ নিয়ে সে বাকি জীবন কীভাবে কাটাবে? তার সাহস নেই, সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির মাথায় ছাতা এগিয়ে দেওয়ার, তাকে আটকানোর, তাকে একবার বলার, বৃষ্টি কমলে চলে যেও।
আফিফ এবার পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্মকে দেখেই তার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে বলল,
“আমি আমার পদ্মফুলকে হারাতে চায় না।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

২৬।
ভেজা বাতাসে থরথর করে কাঁপছে আহি। গ্রামের বৃষ্টি স্নাত কর্দমাক্ত রাস্তায় পা ফেলার উপায় নেই। আহির জুতা জোড়া বার-বার কাঁদায় আটকে যাচ্ছে। কিন্তু সে হেঁটে যাচ্ছে। ঘোরের মাঝেই সে সামনে এগুচ্ছে। একবারো ভাবে নি এতো রাতে সে পায়ে হেঁটে শহরে কীভাবে পৌঁছাবে? বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় আহির লেহেঙ্গাটা আরো ভারী হয়ে গেছে। কাঁধ থেকে উড়নাটা রাস্তায় ফেলে দিলো আহি। কষ্টটা ধীরে ধীরে রাগে পরিণত হতে লাগলো তার। বাসায় তো সে এমনই করে। মন মতো কিছু না হলে জিনিসপত্র ছোঁড়াছুড়ি করবে। আর এখন তো তার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদটিই তার কাছে নেই। হাতের ব্যাগটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। আর হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই তার। পিচ ঢালা রাস্তায় উঠেই সেখানে ধপ করে বসে পড়লো আহি। লেহেঙ্গাটা খামচে ধরেছে সে। রাগ সব সেই লেহেঙ্গার উপরই ঝাড়ছে। চিৎকার করে অনেকক্ষণ কাঁদলো আহি। ভাগ্যিস জায়গাটা নিরিবিলি ছিল। গ্রামের পথ, অন্ধকার রাত, ভারী বর্ষণ এই মুহূর্তে কাকপক্ষীরও রাস্তায় থাকার কথা না।
হঠাৎ নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেই দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আহি। ব্যাগটা আবার রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে নিয়ে ফোনটা বের করলো। ফোনটা ভিজে যাচ্ছে। আহি যতোটুকু পারছে বৃষ্টির ছাঁট থেকে ফোনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে অক্ষম। নিজেই যেখানে পুরোপুরি বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, সেখানে ফোনকে রক্ষা করবে কীভাবে!
মোজাম্মেল চাচার নম্বরে ফোন দিলো আহি। ঘড়িতে রাত দশটা। শহরের মানুষ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাবে না। মোজাম্মেল চাচা কল ধরতে দেরী করলেন না। আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“চাচা, আমাকে একটু এসে নিয়ে যাবেন প্লিজ?”

মোজাম্মেল চাচা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“মা, আমি আসতাছি। তুমি চিন্তা কইরো না। সাহেব যখন শুনছে তুমি রাতে গ্রামে থাকবা, তখনই আমারে পাঠাই দিসে।”

আহির ফোন বন্ধ হয়ে গেলো। আহি ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাস্তার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়লো। মুহূর্তটা এতো ভয়ংকর ছিল যা আহি কখনোই ভুলতে পারবে না। সেদিন প্রায় দুই ঘন্টা পর মোজাম্মেল চাচা আহিকে নিতে আসেন। রাস্তায় অচেতন অবস্থায় লেহেঙ্গা পরা একটি মেয়েকে দেখেই তিনি বুঝে ফেলেছিলেন মেয়েটিই আহি। বাসায় পৌঁছাতে দেড় ঘন্টা লেগেছে মাত্র। ড্রাইভার রাস্তা খালি থাকায় দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসেন। পুরো রাস্তা ড্রাইভার আর মোজাম্মেল চাচা উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাসায় আনার পর মুনিয়া খালা আহির কাপড় পালটে দেন। আহির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে দেখে রিজওয়ান কবির তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। এতো রাতে হাসপাতালে কোনো ডাক্তার উপস্থিত ছিলো না। তাদের ফোন করতে হবে। রিজওয়ান কবির পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করলেন। আর নার্সরা আপতত আহিকে দেখে নাঁড়ি পরীক্ষা করে স্যালেইন দিলো। এরপর ডাক্তার এসে চেক আপ করে গম্ভীরমুখে বলল,
“বৃষ্টিতে ভেজার জন্য অচেতন হয় নি। মনে হচ্ছে অন্য কিছু। আমাকে সময় দিন, আমরা আপনাকে জানাচ্ছি।”

আহিকে এরপর আইসিউতে স্থানান্তর করা হলো। রিজওয়ান কবির প্রচন্ড রেগে আছেন। আহির কিছু হলে তিনি যে বিবাহিত দম্পতির সাথে খুব একটা ভালো কিছু করবেন না তা মোজাম্মেল চাচা তার কথার ধরণেই আঁচ করতে পেরেছেন। কিন্তু এখানে তো পদ্মের কোনো দোষ ছিলো না। সে তো জানেই না আহি কেন চলে গেছে। উলটো সে বিদায়ের সময় আহিকে অনেক খুঁজেছিলো। এদিকে সালমা ফাওজিয়াও মুনিয়া খালার কাছ থেকে খবর পেয়ে মেয়েকে দেখতে এসেছেন। তিনি বার-বার রিজওয়ান কবিরকে শাসাচ্ছেন। তার জন্যই না-কি মেয়ের এই পরিণতি হয়েছে।

অনেকক্ষণ পর ডাক্তার এসে জানালো, আহি মাইল্ড স্ট্রোক করেছে। তবে এখন পুরোপুরি সুস্থ আছে। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। ডাক্তার এ-ও বলে দিয়েছেন আহিকে যাতে কোনোরকম মানসিক চাপ দেওয়া না হয়। সেদিনের পর থেকেই আহি সিজোফ্রেনিয়া নামক রোগে ভুগছে।

(***)

আহিকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পরই লিনাশা তাকে দেখতে এলো। আহি লিনাশাকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো। লিনাশা আহির হাত ধরে বলল,
“আগেই বলেছি, জানিয়ে দে, জানিয়ে দে। বোকার মতো চুপ ছিলি। তুই বোকা পদ্ম আর পুষ্পকে আফিফের কথাটা জানাতে দিস নি। আজ যদি পদ্ম আফিফকে চিনতো তাহলে কি তোর ভালোবাসা কেঁড়ে নিতো? ভুল তো তুই করেছিস। আফিফ কেন মনে করবে তুই ওকে এখনো ভালোবাসিস? এটা তোর এক তরফা ভালোবাসা ছিল।”

“আমি ওকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি, লিনু।”

লিনাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভালোবাসা আর উন্মাদের মতো ভালোবাসা দু’টির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তুই আফিফকে ভালোবাসিস এটা হয়তো সে বুঝেছে। কোনো কারণে হয়তো তোকে মেনে নেয় নি। হয়তো তুই যখন ওর লাইফে আসতে চেয়েছিলি, তখন ও প্রস্তুত ছিল না। এরপর কি তুই আর ওর সামনে গিয়েছিলি? আড়াই বছরে একবারো তুই ওকে বলেছিস, তুই এখনো ওর অপেক্ষায় আছিস? ও কি জানতো বিষয়টা, আহি? ছেলেটা তোকে না করে দেওয়ার পর তুই আর দ্বিতীয়বার ওর সামনে যাস নি। তাহলে ও কীভাবে বুঝবে তুই ওকে এখনো ভালোবাসিস? বলতে পারিস, এটা তোর ভাগ্যের দোষ। ও তো জানতো না তোর ওর প্রতি উন্মাদনা কেমন ছিল! জানলে তোকে কখনোই ফেলতে পারতো না।”

লিনাশা এর চেয়ে বেশি সান্ত্বনা দিতে পারবে না আহিকে। কিন্তু সেই সান্ত্বনা আহির কাছে তুচ্ছ। এতো বড় ধাক্কা এতো সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে না আহি। তার ভালোবাসা হারানোর রাগটা পদ্মের উপর ঝাড়লো সে। সব দিক থেকে ব্লক করে দিলো পদ্মকে। পদ্ম অনেকবার লিনাশাকে ফোন দিয়েছিল, আহির খবর নেওয়ার জন্য। লিনাশাও টুকটাক কথা বলেই কল রেখে দিয়েছে। আহির ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে কিছুই বলে নি।
এদিকে আহির দিনগুলো কেমন উষ্কখুষ্ক ভাবেই কাটছে। সারাদিন তার একা একা ছাদে বসে থাকা, খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম, মাঝ রাতে অস্বাভাবিক আচরণ রিজওয়ান কবিরকে ভাবিয়ে তুলছে। এরপর আহিকে ডাক্তার দেখানো হলো। একমাস পরও আহির কোনো পরিবর্তন হলো না। সে সারাদিন আফিফের ভাস্কর্যটির সামনে বসে নিজে নিজে কথা বলেই সময় পার করতো।

(***)

একদিন বিকেলে কলিং বেলের শব্দ শুনে মুনিয়া খালা দরজা খুলে দিয়েই থমকে গেলেন। রিজওয়ান কবিরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে লাবণি মেহেরা। লাবণিকে দেখে মুনিয়া খালা চমকালেন খুব। এই মেয়ে বধূ সাজে কেন? রিজওয়ান কবির আহিকে ডাকলেন। আহি নিচে নেমে লাবণিকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“আপু, আপনি কখন এলেন?”

মুহূর্তেই আপাদমস্তক লাবণিকে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি বিয়ের শাড়ি পরে..!”

লাবণি আহির কাছে এসে থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“এখন থেকে আমি তোমার আপু নই। আমি তোমার মা।”

আহি কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আর ইউ ক্রেজি!”

রিজওয়ান কবির মেয়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“ক্রেজি, হোয়াট? আহি, তুমি লাবণির সাথে ভদ্রভাবে কথা বলবে।”

এবার লাবণি আহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ধীরে ধীরে শিখে যাবে। আমিই আহিকে শিখিয়ে দেবো।”

আহি লাবণিকে সরিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। এরপর লিনাশার নম্বরে কল করলো। লিনাশা প্রায় সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো। আহি কিছু বলতে যাবে তার আগেই লিনাশা বলল,
“আহি, তুই আমার পুরো লাইফটা এলোমেলো করে দিয়েছিস।”

আহি লিনাশার ঝাঁজালো কন্ঠের প্রতিত্তোরে বলল,
“লিনু, কি বলছিস এসব?”

লিনাশা বলল,
“বাবা হসপিটালে ভর্তি। তোর বাবা আমার বাবাকে খুন করতে চেয়েছে।”

“লিনু, আমি….”

লিনাশা আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“চুপ, তোর সাথে বন্ধুত্ব করাই আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। বাবা-মা আমাকে কতো বার বারণ করেছিলো, সেই ক্রিমিনালের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করিস না। কিন্তু আমিই শুনি নি। এখন, কি করলো তোর বাবা? আমার আপুকে বিয়ে করে নিয়ে গেলো? তার লোক এসে আমার বাবা-মাকে মেরেছে। বাবা তাদের বিয়ে মেনে নিচ্ছিলো না দেখে মিস্টার রিজওয়ান কবির আমার বাবাকে মেরেছে। শুধু বাবাকে মারে নি। মাকেও মেরেছে। পুরো সোসাইটিতে আমাদের নাম খারাপ করে দিয়ে গেছে। আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছে। সব কিছুর জন্য তুই দায়ী। তুই যার জীবনে যাবি, তার জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যাবে। আফিফের কপাল ভালো ছিল, তাই তোর মতো মেয়ের কাছ থেকে বেঁচে গেছে।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। লিনাশা আহির কান্নার শব্দ পেয়েই কল কেটে দিলো।

(***)

রিজওয়ান কবির আর লিনাশার বড় আপু লাবণি মেহেরার অনেক দিনের সম্পর্ক ছিলো। লাবণিকে পছন্দ করতেন বিধায় সালমা ফাওজিয়াকে তালাক দিয়েছিলেন তিনি। আহির চেয়ে মাত্র চার বছরের বড় লাবণি। এ বছরেই অনার্স শেষ করে রিজওয়ান কবিরের কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। তাদের সম্পর্কের কথা লিনাশার মা রুনা খানম জেনে যান। লাবণিকে শাসন করার জন্য তার গায়ে হাত তুলেছিলেন তিনি। কারণ প্রথমত রিজওয়ান কবির তার বাবার বয়সী, দ্বিতীয়ত রিজওয়ান কবির একজন অসৎ চরিত্রের লোক, যেটা চট্টগ্রামের প্রায় সবারই জানা। এমন একটা লোকের সাথে সম্পর্ক মেনে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু লাবণি সেই শাসনের প্রতিশোধ নিয়েছে রিজওয়ানের লোকেদের দিয়ে নিজের বাবা-মাকে মার খাইয়ে।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা রুনা খানম। আপন স্বামী যেখানে কখনো তার গায়ে হাত তুলে নি, সেখানে বাইরের কিছু লোক এসে তাকে মারছে, এটা মেনে নিতে পারেন না। এখন তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। লিনাশা মাকে একা সামলাতে পারছে না। নিকট আত্মীয়রা এসে মিসেস রুনাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান। এদিকে লিনাশার বাবা, ফখরুল হক মেয়ের সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ার পর মেয়েকে কিছুই বলেন নি। শুধু শান্তভাবে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু লাবণি বাবার কথার অমান্য হয়ে রিজওয়ান কবিরকে বিয়ে করে ফেললো। ফখরুল হক লাবণির বিয়ের খবর শুনে রিজওয়ান কবিরকে গালিগালাজ করলেন। এ জন্যই রিজওয়ান কবির তাকে মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন। এরপর গুরুতর অবস্থায় ফখরুল হককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। স্ট্রোক করেছিলেন তিনি। তার মস্তিষ্ক একদমই কাজ করছে না। ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তার সাড়া না পেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হবে।

(***)

রাত এগারোটায় পুষ্পের কল দেখে আহি চমকে উঠলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুষ্প বলল,
“আহি, লিনুর বাবা আর নেই।”

আহি খবর পেয়েই হাসপাতালে চলে এলো। এখান থেকেই লিনাশার বাবাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। আহি লিনাশাকে দেখে তার কাছে এসে বলল,
“লিনু, পুষ্প আমাকে ফোন দিয়ে বলল….”

লিনাশা আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার বাবা মারা গেছে। এটাই তো বললো, তাই না? শুনেছিস? খুশি হয়েছিস?”

“কি বলছিস এসব তুই?”

“তোর বাবা একজন খুনী। তুই খুনীর মেয়ে।”

আহি লিনাশার হাত ধরতে যাবে, তার আগেই লিনাশা আহির গালে চড় বসিয়ে দিলো। আহি গালে হাত দিয়ে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা আঙ্গুল তাক করে বলল,
“আই হেইট ইউ, আহি। তোর সাথে বন্ধুত্ব করার পরিণাম এতো খারাপ হবে জানলে, আমি তোর দিকে কখনো ফিরেও তাকাতাম না। আমি আজ আমার বাবাকে হারিয়েছি তোর জন্য। একটা জলজ্যান্ত সুস্থ মানুষ এক রাতেই শেষ হয়ে গেছে, তোর জন্য। আমার মায়ের গায়ে হাত তুলেছে তোর বাবার লোকেরা। আমার সব শেষ হয়ে গেছে, শুধু তোর জন্য। তুই একটা অশুভ। তোর ভাগ্য যেমন, তুইও তেমন। আর কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না। তোর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।”

আহি মাথা নিচু করে কাঁদছে। সে লিনাশার কাছে এসে বলল,
“তুইও আমাকে একা করে দিচ্ছিস, লিনু। প্লিজ…”

লিনাশা গম্ভীর সুরে বলল,
“আরেকটা কথা। আমি আর মা এই শহরে আর থাকবো না। থাকার মতো অবস্থায় আর নেই। পুষ্প এগুলো জানে না। আল্লাহর দোহাই লাগে, এই কথা আর কাউকে বলিস না। স্কুল গ্রুপ, কলেজ গ্রুপের কোনো বন্ধুরা যাতে না জানে আমার আপু তোর বাবাকে বিয়ে করেছে। অন্তত এটা সিক্রেট রেখে আমাকে উদ্ধার করিস।”

(***)

প্রথমে মা, তারপর ভালোবাসা আর আজ প্রিয় বান্ধবীকেও হারিয়ে ফেলেছে আহি। নিজেকে এর চেয়ে বেশি নিঃস্ব কখনোই মনে হয় নি তার। বেশিই সুখ পেয়েছিল এতোদিন। অতি সুখ তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আহি বাসায় ফিরে দেখলো লাবণি হাত ভর্তি চুড়ি পরে বসে আছে। তার সামনে আংটির বক্স। সে বক্সটি থেকে এক একটি আংটি বের করে আঙ্গুলে পরে দেখছে। আহি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,
“আপনি কি জানেন আংকেল মারা গেছেন?”

আহির কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে বসে রইলো লাবণি। তারপর আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“বাবার আয়ু যদি কম থাকে, আমার কি করার আছে?”

“আমি আপনাকে দেখে অবাক হচ্ছি। আপনার মতো জঘন্য মেয়ে আমি একটাও দেখি নি।”

লাবণি এক গাল হেসে বলল,
“আমি এখন আর লাবণি মেহেরা নই। মিসেস লাবণি রিজওয়ান কবির। দেখো, তোমার বাবা আমার জন্য কতোগুলো ডায়মন্ডের রিং এনেছে! আমার বিয়ের গিফট। তুমি একটা পছন্দ করো। এতোগুলো দিয়ে আমি কি করবো? একটা তুমিও নাও।”

আহি ডায়মন্ডের বক্সটি হাতে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। আর সাথে সাথেই আংটিগুলো পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়লো। লাবণি চেঁচিয়ে বলল,
“কতো লাখ টাকার রিং ছিল, জানো?”

আহি বলল,
“জানি, বরং দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি। আপনি হয়তো হঠাৎ দেখেছেন। তাই হজম করতে পারছেন না। হজম করার জন্য নিচে বসে আংটিগুলো কুড়িয়ে নিন। এন্ড ফার্দার, আপনার আদিখ্যেতা আমাকে দেখাবেন না। আর আমার মা হওয়ার চেষ্টা তো কখনোই করবেন না। আই হেইট ইউ মিসেস লাবণি।”

লাবণি আহির কথায় অট্টহাসি দিয়ে বলল,
“তুমি একটু আগে আমাকে জঘন্য মেয়ে বলেছিলে। আমি তোমাকে শীগ্রই আমার সেই জঘন্য রূপটা দেখাবো।”

(***)

আহির দিন কাটছে যন্ত্রের মতো। বেলা করে ঘুম ভাঙছে। দুপুরে নাস্তা করে, আবার ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙলে আফিফের ভাস্কর্যের সাথে কথা বলে সময় কাটাচ্ছে। রাতে খোলা চুলে ছাদের মেঝেতে শুয়ে আকাশ দেখছে। মুনিয়া খালা আহির চিন্তায় অস্থির। চুনি আহিকে দেখলেই পালিয়ে যায়। চোখগুলো ফুলে থাকে তার। চুনির মনে হয় তার ভেতরে লিনাশার বাবার আত্মা ঢুকে গেছে। সে লাবণিকে এই কথা বলতে বলতে তার মাথা খেয়ে ফেলছে। লাবণি নিজেও আহির ব্যবহারে বিরক্ত।
আজ সে আহির ঘরে বিনা অনুমতিতেই ঢুকে গেলো। রুমে ঢুকে দেখলো আহি একটা ভাস্কর্য জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আহিকে এই অবস্থায় দেখে লাবণি বলল,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছো, আহি?”

আহি লাবণির কথায় চমকে উঠলো। লাবণি বলল,
“কার ভাস্কর্য এটা!”

আহি ভাস্কর্যটিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। লাবণি বাঁকা হেসে বলল,
“নিশ্চয় এই ভাস্কর্যে তোমার প্রাণ আটকে আছে। যদি তোমার এই প্রাণটা কেঁড়ে নেই, তাহলে তুমি আমার জঘন্য রূপ সম্পর্কে জানতে পারবে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে লাবণির দিকে। লাবণি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আহি সাথে সাথেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আফিফকে নিয়ে আঁকা ছবি, জিনিসপত্র সবকিছুই সে লুকিয়ে ফেললো। শুধু ভাস্কর্যটি লুকোনোর স্থান খুঁজে পেলো না। লাবণি একটু পর দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো। আহি তা দেখে মুখ চেপে কাঁদছে। এই ভাস্কর্যটি যদি তার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়, তাহলে সে পাগল হয়ে যাবে। এটাই তো আফিফের প্রতিচ্ছবি।

(***)

দরজা ভেঙে রুমে ঢুকলেন রিজওয়ান কবির। আহির রুমে সেই ভাস্কর্যটি দেখে আহির কাছে জিজ্ঞেস করলেন,
“কার ভাস্কর্য এটা?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি ভালোবাসি একটা ছেলেকে। ওর ভাস্কর্য বানিয়েছিলাম।”

“কি করে ছেলেটা?”

আহি মাথা নেড়ে বলল, “বলবো না।”

রিজওয়ান কবির চিৎকার দিয়ে বললেন,
“নাম কি সেই ছেলের?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ও জানেই না, আমি ওকে ভালোবাসি।”

লাবণি রিজওয়ান কবিরের কাছে এসে নিজ হাতে স্বামীর কোমরের বেল্টটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“মেয়েকে শাসন করতে শেখো। বেশি আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছো।”

আহি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনিয়া খালা দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে রিজওয়ান কবিরের পা ধরে বললেন,
“স্যার, ছাইড়া দেন ওরে। বুঝে নাই মাইয়াডা। ছোড মানুষ।”

লাবণি বলল,
“একটা রাস্তার ছেলেকে ভালোবেসে তার প্রতিমূর্তি বানিয়ে ঘরে তুলেছে, আর তুমি বলছো ছোট মানুষ?”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“ও রাস্তার ছেলে না। আপনি রাস্তার মেয়ে।”

আহির কথাটি মুখ থেকে বের করতে দেরী, রিজওয়ান কবিরের বেল্টের আঘাত তার শরীরে পড়তে দেরী হলো না।

২৬।

জীবনে প্রথম আহির বাবা মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন, তাও আবার বেল্ট দিয়ে মেরেই সেই অত্যাচারের সূচনা ঘটিয়েছেন। এই মুহূর্তে আহির শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রিজওয়ান কবির আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,
“একবার এই ছেলের পরিচয় জানতে পারলে, তার লাশ তোমার সামনে এনে রাখবো। ভুলেও সেই ছেলে তোমার মনে যাতে বেঁচে না থাকে। তোমার জন্য আমি অনেক আগেই তাজওয়ারকে পছন্দ করে রেখেছি। তোমার বর্তমান, ভবিষ্যৎ, ভালোবাসা, সবটাই যেন তাজওয়ার হয়।”

রিজওয়ান কবির কথাটি বলেই চলে গেলেন। লাবণি আহির দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার জঘন্য রূপ কেমন লেগেছে, আহি? মারটা হজম হয়েছে? না-কি হজম করার জন্য এই ভাস্কর্যটা ভেঙে দেবো?”

আহি কাঁপা শরীর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“প্লিজ ও এমনিতেই কখনো আমার হবে না। অন্তত এটা আমার সাথে থাকুক। আপনি যা বলবেন, আমি সব মেনে নেবো। এই ভাস্কর্যটার সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্লিজ, এটা ভাঙবেন না।”

লাবণি লোহার গরাদ নিয়ে এসেছিলো সাথে করে। সেটা হাতে নিয়েই ভাস্কর্যের এক হাত ভেঙে দিলো।
আহি তাকে আটকাতে যাবে, তখনই লাবণি বলল,
“সবে তো শুরু আহি। আমার আরো জঘন্য রূপ তুমি দেখবে।”

আহি লাবণির পায়ের কাছে বসে বলল,
“প্লিজ। আমি আর কখনো আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছি। এটা ভেঙে গেলে, আমি কীভাবে বাঁচবো?”

“তো মরে যাও।”

লাবণি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ভাস্কর্যটিতে কয়েকটা আঘাত করল। ভাস্কর্যটি আহির চোখের সামনে গুঁড়িয়ে গেলো। লাবণিও চলে গেল। আহি অঝোর ধারায় কাঁদছে। চিৎকার করে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ নিচ তলা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মুনিয়া খালা চুনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন আর মিনমিনিয়ে বলছেন,
“আল্লাহ, মেয়েডারে বাঁচাও। এই জানোয়ারগুলা থেকে মুক্তি দাও।”

(***)

আহি রাতে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। লাবণি সকালে ঘরে এসে দেখলেন, আহি মেঝে হাতড়াতে হাতড়াতে কাঁদছে। আহির পাগলামো দেখে লাবণি লিনাশাকে কল করলো। লিনাশা বোনের সাথে কথা বলতে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু আহির শোচনীয় অবস্থার কথা শুনে আহিদের বাসায় আসতে বাধ্য হলো। লিনাশা এসেই আহিকে শান্ত করালো। আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“তুই ঠিক বলেছিস, লিনু। আমি অশুভ। সব হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমার বেঁচে থাকার কোনো দরকার নেই। এখন আমি কীভাবে মরবো, বল? ফ্যানে ঝুলে যাবো? ছাদ থেকে পড়ে যাবো? কোনটা করবো!”

লিনাশা আহির হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“তুই কি পাগল হয়ে যাবি নাকি? শোন আহি, যেই ভালোবাসা তোর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, তাকে আর কারো সামনে প্রকাশ করতে যাবি না। এটাই তোর জন্য ভালো হবে। সবকিছুর একটা সীমা থাকে৷ তোর ভালোবাসা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বেহায়া হয়ে যাস না। এমন বেহায়াদের কেউ ভালোবাসে না। আর মরে গিয়ে কি লাভ হবে? আফিফ ঠিকই পদ্মের সাথে সুখে সংসার করবে। দহন হবে তোর।”

“এটা কি দহন না?”

“একদিন ঠিকই সব মায়া কেটে যাবে। মানুষ কেউ কাউকে বেশিদিন মনে রাখে না। এটা তোর আবেগ। আমি আসতাম না আজ। কিন্তু বাধ্য হয়ে এসেছি। প্লিজ আহি, আমাকে আর বাধ্য করিস না। আমার তোকে দেখলে মায়াও হয়, আবার ঘৃণাও হয়। আমাকে শক্ত হতে দে। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। মা জানে না তোর বাসায় এসেছি। জানলে অনেক সমস্যা হবে। তুই নতুন বন্ধু পাবি, ভালোবাসাও পাবি। সুন্দর তুই। একটা না একটা চলেই আসবে।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার বিন্দু বিন্দু গড়া ভালোবাসার মূল্য তোদের কারো কাছে নেই। কি চমৎকার ভাবে বললি, একটা না একটা চলেই আসবে। দেখতে মনে হচ্ছে এটা আবেগ। কিন্তু আমার আবেগ আমাকেই খেয়ে ফেলছে। আমার কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তোরা বুঝবি না। আমি আর কাউকে বলবও না। এটাই শেষ। আমার ভালোবাসা, আমার অনুভূতি আমার মৃত্যুতেই এই পৃথিবী ছাড়বে। আমি শেষ মুহূর্ত অব্ধি আফিফকে ভালোবাসা ছাড়বো না। যেদিন আমার মৃত্যু হবে, আফিফ পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস হারাবে। আফিফকে ভালোবাসার জন্য আমার কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। কারো চাওয়া না চাওয়া আমার ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটাতে পারবে না। আমি বেহায়া হই, আর যাই হই। আমি কখনো ওর সামনে দাঁড়াবো না। ওর কাছে অধিকার চাইবো না। কিন্তু ভালোবাসার অধিকার আমারই আছে। পদ্মও পারবে না আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে।”

“তোর বাবা অন্যের সংসার ভেঙেছে। এখন তুইও ভাঙবি?”

“ছিঃ লিনু। পদ্মকে আমি কষ্ট দিতে পারবো না। পদ্মের জায়গায় অন্য কেউ হলে, আমি হয়তো জোর করেই আফিফকে নিজের করে নিতাম। হয়তো বা নিতাম না। জানি না কি করতাম। মাথায় ঠিক নেই আমার। কিন্তু পদ্ম আমার বান্ধবী। আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। এজন্যই তো আমি ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। না হবে কথা, না হবে দেখা, না মরণ যন্ত্রণার সুযোগ পাবো। দূরত্বই আমাদের ভাগ্যে আছে। আমি কাঁদবো, ভালোও বাসবো। কিন্তু পদ্ম-আফিফের সংসারে ঝামেলা করবো না।”

…………………………………….

আহি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজ সে অলকানন্দার চারা কিনে এনেছে। মানুষটা তার না হোক, কিন্তু তার ভালোলাগাগুলো তো তার সাথেই থাকবে। এভাবেই মিষ্টিভাবে দূর থেকে ভালোবাসে সে আফিফকে। ছোট ছোট অলকানন্দা ফুল ফুটেছে চারায়। আহি সেগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল,
“প্রিয় অলকানন্দ, আমি তোমাকে ভালোবাসতে এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে তোমাকে বলার সুযোগটা হাতছাড়া করে ফেলেছি। আমি তোমাকে দেখতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাকে চোখের সামনে বসিয়ে রাখার সুযোগটাই হারিয়ে ফেলেছি। আমি তোমাতে ডুব দিয়েছিলাম। খেয়াল করি নি তুমি এতোটা গভীর হবে। তোমার এই গভীরতা আমাকে সাঁতার ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর আমি তলিয়ে গেলাম। তুমি কি কখনোই আমার প্রেমে পড়ো নি? আমার কৌতূহলী আবেগ, তোমাতে আটকে থাকা মন, আমার ব্যস্ত চোখ, কিছুই কি তোমাকে আকর্ষণ করে নি? আমি কি তোমার কিছুই ছিলাম না? আমি তবে কাকে ভালোবেসেছি, যার মনে কখনো আমিই ছিলাম না!”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-১৩+১৪+১৫

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৩||

১৯।
তাজওয়ার হতাশ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আর আহি মনোযোগ দিয়ে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছে। তাজওয়ার আহির উপর বিরক্ত। তারা এসেছে শহরের দামি রেস্টুরেন্টে, আর আহি খাচ্ছে আলু ভর্তা দিয়ে সাদা ভাত। দামি রেস্টুরেন্টে আহির পছন্দের এই খাবার না থাকায় তাজওয়ারের আদেশে ম্যানেজার খাবার তৈরীর জন্য কিছু সময় চেয়ে নেন। এরপর প্রায় এক ঘন্টা পর খাবার আসতেই আহি হাত দিয়েই ভাত মেখে খাওয়া শুরু করলো। খাওয়ার মাঝখানে সে আঙ্গুলগুলোও চেটেপুটে খাচ্ছে। তাজওয়ার আহির খাওয়া দেখে নিজের খাওয়ায় ভুলে গেছে। আহি তাজওয়ারের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো আর মনে মনে বলল,
“ভালো করে খাও তুমি। আজকের দিনটা যদি মাথায় থাকে, ভুলেও কখনো আমাকে নিয়ে বের হওয়ার কথা চিন্তা করবে না। মিস্টার খান, এভাবেই আমি তোমার রেপুটেশন ধুলোয় মিশিয়ে দেবো।”

আহি আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এবার সে খুব যত্ন নিয়েই খাচ্ছে। একদম আফিফের মতো করে। আফিফের প্রিয় খাবার গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা। এক্সিডেন্টের পর আহি একবার তাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল। সেদিনই সে জেনেছিল আফিফ আলু ভর্তা খুব পছন্দ করে। এরপর আহি বাসায় এসে মুনিয়া খালাকে বলে ভর্তা আর ভাত নিয়ে হাসপাতালে গেল। কিন্তু সেদিনই আফিফ রিলিজ পেয়ে যায়। আর তাই আফিফের সাথে তার দেখা হয় নি। আর সেদিনের পর থেকেই আহির যখন খুব রাগ উঠতো সে নিজেই আলু ভর্তা বানিয়ে খেতো। কারণ আফিফের প্রিয় কাজগুলোর মাঝেই সে আফিফকে খুঁজে পায়। আর যখন সে আফিফকে অনুভব করে, তখন তার রাগ, কষ্ট সবকিছুই প্রশমিত হয়ে যায়।

(***)

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই রাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাজওয়ার আর আহি দু’জনই অবাক হলো। রাদ আহিকে দেখে বলল,
“এতোক্ষণ লাগে তোর খেতে?”

তাজওয়ার আহিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রাদের মুখোমুখি এসে বলল,
“এক্সিকিউজ মি, তুমি এখনো এখানে কি করছো?”

“আমি আহির সাথে যাবো।”

“আমি ওকে নিয়ে এসেছি, আমি-ই ওকে নিয়ে যাবো।”

আহি রাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার রাদের সাথে একটা কাজ আছে। আজই আমাদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু তোমার জন্য এখানে আসতে হলো।”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি কাজ?”

রাদ উত্তর দিলো,
“ভর্তির ব্যাপার নিয়ে। আমরা মাস্টার্সে ভর্তি হচ্ছি।”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। রাদ একটা রিকশা থামিয়ে আহিকে উঠতে বলতেই তাজওয়ার বলল,
“আহি, তুমি রিকশা করে যাবে?”

আহি তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে বলল,
“আমার রিকশায় চড়তে ভীষণ ভালো লাগে।”

তারপর রাদের হাত ধরে তাকেও রিকশায় উঠতে বললো। তাজওয়ার আহি আর রাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি তাজওয়ারের দৃষ্টি অনুসরণ করে একনজর তাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? রাদ আমার বন্ধু। অন্তত মিস ফার্জিয়া আর তোমার বন্ধুত্বের চেয়ে আমাদের বন্ধুত্বটা অনেকটা শালীন।”

আহির কথায় তাজওয়ারের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে ভাবছে, আহি ফার্জিয়ার কথা কীভাবে জানলো? ফার্জিয়া তার বর্তমান প্রেমিকা। এই মেয়েটাই তার টাকার পেছনে পড়ে আছে।
রিকশা চলে যেতেই তাজওয়ার ফোন হাতে নিয়ে ফার্জিয়াকে কল করলো। আজই এই মেয়ের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করবে সে। সে সব ছাড়তে পারবে, কিন্তু আহিকে ছাড়া তার চলবে না।

(***)

রাদ আর আহি পাশাপাশি বসে আছে। রাদ হঠাৎ রিকশা থামিয়ে নেমে পড়লো। আহি রাদকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রাদ রাস্তার ওপাড়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাতে দু’টো ঝালমুড়ির প্যাকেট নিয়ে ফিরলো। আহি ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে বলল,
“তোর এখনো মনে আছে?”

রাদ রিকশায় উঠে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? তোরা চারজন প্রতিদিন স্কুল ছুটি হলেই ঝালমুড়ি কিনে মাঠে বসে বসে খেতি। আর আমি কতোবার চাইতাম, কিন্তু তোরা ভাগ দিতি না। ভীষণ হারামি ছিলি তোরা।”

আহি হাসলো। রাদ মুগ্ধ হয়ে আহির হাসি দেখছে। আর মনে মনে ভাবছে,
“আহি, সেদিন থেকেই আমার তোকে ভালো লাগতো। কিন্তু আজও এই কথা তোকে বলতে পারলাম না।”

রাদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আনমনে বলল,
“যাকে আমি ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসে না। আর সে যাকে ভালোবাসে, তার মনে আমার ভালোবাসার মানুষটার জায়গা হয় না। কি অদ্ভুত প্রেম লীলা!”

(***)

আহি বাসায় এসে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আর তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“দরজা খোলা আছে।”

চুনি এক কাপ চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ চুনির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির তাকানো দেখে চুনি লাজুক হেসে মেঝেতে বসে চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখলো। আহি পা ভাঁজ করে চুনির দিকে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কেন এসেছো? আমি তো চা খেতে চাই নি।”

চুনি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“বেশি খুশি লাগতাছে আফা মণি।”

“কেন?”

“আপনের বিয়া হইবো। আমি নাচমু, শাড়ি পরমু। আমারে একখান শাড়ি কিন্না দিয়েন আফা।”

“আমার বিয়ে হবে এই কথা তুমি কোথায় শুনেছো?”

“মিছামিছি কথা কই না আমি। আজকেই ম্যাডাম আম্মারে কইলো। আপনের তাজওয়ার স্যারের লগে বিয়া।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“তা আমার বিয়ে হবে শুনে তুমি খুব খুশি, তাই না? আমাকে আসতে না আসতেই বিদায় করে দিতে চাও?”

চুনি গালে হাত দিয়ে বলল,
“ছি! আফা। কি কন এসব? আমি আর আম্মা আপনারে খুব ভালোবাসি। জানি আপনে এই বিয়াতে রাজি না। কিন্তু তাজওয়ার স্যাররে দেখছেন? কি সুন্দর একখান মুখ! রাজকুমারের মতো চেহারা।”

“সুন্দর চেহারার মানুষগুলোর মন সুন্দর হয় না। অগোছালো মানুষগুলোই বেশি সুন্দর হয়।”

আহি কথাটি বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চুনি আহির হাত স্পর্শ করে বলল,
“আফা, আপনে বিয়া না করলে ম্যাডাম হইতো উল্টাপাল্টা কিছু করবো।”

“তুমি ভয় পেও না, চাঁদনি। মিসেস লাবণি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। বেশি হলে কিছু শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। কিন্তু আমার সয়ে গেছে, চাঁদনি। পৃথিবীর সব যন্ত্রণা আমার মনের যন্ত্রণার কাছে তুচ্ছ। আমি ঠিকই এই দিনগুলো কাটিয়ে উঠবো। কিন্তু তাদের কাছে মাথা নত করবো না।”

এরপর আহি চুনির থুতনি ধরে বলল,
“তোমাকে আমি খুব সুন্দর একটা শাড়ি কিনে দেবো। আমার বিয়ে হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে না।”

চুনি গালে হাত দিয়ে আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আফা, আপনে কাউরে ভালোবাসেন?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“একজন রাজাকে ভালোবেসেছিলাম। তার রানী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে প্রজা বানিয়ে ছেড়েছে। তার রাজ্যে আমি কোথাও নেই।”

চুনি চাপা স্বরে বলল,
“ওই পোলাডা, যার ছবি আঁকছিলেন?”

আহি বলল,
“তুমি এখন যাও। আর শোনো, মিসেস লাবণি আর বাবা কাল বাইরে গেলেই গ্যারেজ থেকে আমার ছবিগুলো নিয়ে এসো।”

চুনি মাথা নেড়ে চলে গেলো। সে চলে যেতেই আহি বালিশে মাথা ফেলে দিয়ে বলল,
“পাওয়া না পাওয়া হয়তো আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু এআর, তোমাকে ভালোবাসা আমার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আমি তোমাকে ভালোবেসে বেহায়া হয়েছিলাম। তারপরও ভালোবেসেছিলাম। আমি তোমাকে ভালোবেসে পাগল হয়েছি, তারপরও ভালোবাসতে ভুলি নি। এবার না হয় মৃত্যুও চলে আসুক। তখনো আমি তোমার উন্মাদ প্রেমিকা হয়েই থাকবো। তোমার সেই অজ্ঞাতনামা ভক্ত, যার মনে এখনো দ্বিতীয় কোনো পুরুষ স্থান পায় নি। আমিই সেই যে তোমার স্পর্শ না পেয়েও কলঙ্কিত হয়েছি। তোমাকে ভালোবাসার মতো সুন্দর কলঙ্ক আমার হৃদয়ে লেপ্টে আছে। আর এই কলঙ্ক নিয়েই আমি নিজেকে সম্পূর্ণ মনে করি।অন্ধকার আকাশের গায়ে আলো ছড়িয়ে দেওয়া সেই চাঁদের মতো আমারও ভীষণ অহংকার। কারণ আমার মতো কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আমার এই অহংকার কখনো কেউ ভাঙতে পারবে না।”

২০।

সকালে আহির আঁকা পুরোনো ছবিগুলো আবার তার রুমে ফিরিয়ে আনা হলো। আহি ঠিক আগের মতো করে তার রুমটা গুছিয়ে নিলো। দুপুরের দিকে রুম গোছানো শেষে আহি তার রুমের একপাশে মৃত পড়ে থাকা কাঠের গোল স্ট্যান্ডের উপর বসলো। তারপর চোখ বন্ধ করে আলতো হাতে স্ট্যান্ডটির উপর হাত বুলালো। এই কাঠের স্ট্যান্ডটির উপর দাঁড়িয়ে ছিলো তার প্রিয় মানুষটির প্রতিকৃতি। সেই প্রতিকৃতিটা তো এখন আর নেই। আছে শুধু তার দাঁড়িয়ে থাকার সেই ভিত্তিটি।

……………………..

দুই বসন্ত পেরিয়ে গেছে। আহি এখনো তার মনের কথা আফিফকে জানাতে পারলো না। তবে সেই বেনামী পত্রগুলো আফিফের ঠিকানায় ঠিকই পৌঁছে যায়, যেখানে আহি তার অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছে। তবে আফিফ তার অজ্ঞাতনামা প্রেয়সীকে না চিনলেও আফিফের প্রিয় জিনিসগুলো আহিকে ভালোভাবেই চিনে ফেলেছে। শুধু তাদের বলার ক্ষমতা নেই। নয়তো তারা আহির উন্মাদনার কথা আফিফকে জানিয়ে দিতো।

আফিফ প্রায়ই সাদা শার্ট পরতো। আহি আফিফের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে জানার পর ভেবেছিল, তার হয়তো ভালো জামা নেই। কিন্তু পরে বুঝলো সাদা রং আফিফের ভীষণ প্রিয়। আফিফের পিছু নিতে গিয়ে অনেক বার সে খেয়াল করেছিল আফিফ ভ্যানগাড়ির সামনে দাঁড়ালে সাদা রঙের টি-শার্টগুলোই খুঁজে বের করে। আর এটা জানার পর থেকে আহির প্রিয় রঙ হয়ে গেলো সাদা। এরপর সে প্রতি সপ্তাহে সাদা জামা পরেই চারুশিল্পে যেতে লাগলো, যাতে আফিফের নজরে পড়ে। কিন্তু আফিফ আহির দিকে ভালোভাবে তাকায় না। হঠাৎ তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলে আফিফ চোখ সরিয়ে নেয়। তবে সেদিনের পর থেকে আহি সাদা রঙটায় তার হৃদয়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। রং যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে আফিফকে বলতো,
“দেখো আফিফ। মেয়েটা তোমার জন্য বেরঙিন হয়েছে। তুমি কি তার জীবনটা রাঙিয়ে দিতে আসবে না?”

(***)

একদিন রাস্তার পাশে ফুল গাছের ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। আফিফ সেই ভ্যানের সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ ফেরিওয়ালার সাথে কথা বলে চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই আহি সেই ভ্যানের সামনে এসে লোকটাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, আফিফ না-কি অলকানন্দা ফুল খুঁজছিল। আহি ভাবতে লাগলো, যেই ফুল ভ্যানে নেই, সেই ফুল খোঁজার অর্থ নিশ্চয় সেটা আফিফের প্রিয় ফুল। ব্যস, আহি সেদিনই নার্সারীতে গিয়ে অনেকগুলো অলকানন্দা ফুলের চারা এনে তার বারান্দা সাজিয়ে ফেললো। এখনো আহির প্রিয় ফুলগুলোর মধ্যে অলকানন্দার উপস্থিতি আছে। আগে আহি এই ফুল চিনতোই না। কিন্তু এখন রোজ অলকানন্দাগুলো আহির অনুভূতির সাক্ষী হয়। তারা যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে ফিসফিসিয়ে আফিফকে গিয়ে বলতো,
“দেখো আফিফ, মেয়েটা তোমার মাঝে এতোটাই ডুবে গেছে যে তোমার প্রিয় ফুল স্পর্শ করেই সে তার সকালটা শুরু করে। তুমি কি তার সকাল দেখার সঙ্গী হবে না?”

এই দুই বসন্তেই আহি আফিফের কাছে না এসে তাকে যতোটুকু চিনেছে, ততোটুকু কেউ আদৌ তাকে চিনতে পেরেছে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

(***)

চারুশিল্পে ক্লাস করতে এসেই আফিফকে সপ্তাহে মাত্র দু’দিন দেখাটা আহির কাছে খুব কম মনে হচ্ছে, তাই সে আফিফকে আরো জানতে শুরু করলো। যাতে তাকে আহি আরো বেশি সময় ধরে দেখার সুযোগ পায়। মোটামুটি স্কুলের বিষয়গুলোর বাইরে আহির ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ালো আফিফের ইতিহাস।
এরপর ধীরে ধীরে আহি জানতে পারলো আফিফ বয়সে তার চেয়ে বড়জোর তিন বছরের বড়। ক্লাস হিসেবেই তা আহি আন্দাজ করেছে। কারণ আহি এখন দশম শ্রেণিতে, আর আফিফ ইন্টার পরীক্ষার্থী। আহি চেয়েছে, সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে আফিফের কলেজের সামনে গিয়ে তাকে দেখে আসবে। কিন্তু আফিফ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়েই সে জানলো, আফিফ গ্রামের কলেজে পড়ে। আর তারা গ্রামেই থাকতো। কিন্তু কয়েক বছর আগেই আফিফের বড় বোন চয়ন কাজের সূত্রে শহরে এসেছিল। চয়নের বিয়ে হয় নি। সে কলেজ পর্যন্ত পড়েছিল। তার বয়স ছিল মাত্র বাইশ। গ্রামের এক চাচার সাহায্যে সে একটা মার্কেটে কাজ নিয়েছিল। আর সেখানেই সে মেয়েদের শাড়ি-পোশাক বিক্রির দায়িত্ব পেয়েছিল। এরপর হঠাৎ চয়ন কাজ ছেড়ে দেয়। মেয়ে কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর পরই আফিফা বেগম সেলাই কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি আফিফ টিউশন করাতো। কিন্তু গ্রামের কলেজে পড়ে শহরে ভালো টিউশন পাওয়া দুষ্কর ছিল। শহরের অভিভাবকরা ভালো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই তাদের সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক হিসেবে নির্বাচন করতে চান। তাই আফিফের জীবিকার উপায় হয়ে দাঁড়ালো তার শখ। আফিফ ছবি আঁকতে ভালোবাসে। রং-তুলি তার স্বপ্ন। আফিফের খুশির জন্যই চয়ন তাকে চারুশিল্পে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বলেছিল, জীবনে সে কিছু হোক না হোক, অন্তত একজন ভালো চিত্রশিল্পী হয়ে যাতে বের হয়। আফিফ বর্তমানে ছোট ছোট বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখায়। এতেই সে ভালো আয় করতে পারছে। এই প্রতিযোগিতার শহরে আফিফের ছবি আঁকতে পারার দক্ষতা তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এরপর কয়েক মাস আগেই চয়নের মৃত্যু হয়। মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। চয়ন আত্মহত্যা করেছিল। আফিফ সম্পর্কে এতোটুকু তথ্যই আহি নিতে পেরেছে। কিন্তু চয়নের আত্মহত্যাটা আহির কাছে রহস্য হয়ে গেলো। তবে আহি এতোটুকু বুঝে গেছে আফিফ তার জীবনে প্রচুর কষ্ট করছে। এই মুহূর্তে সে যদি আফিফকে তার ভালোবাসার কথা বলে, তাহলে হয়তো আফিফ তাকে দূরে সরিয়ে দেবে। কোথায় আহির বাবা দেশের প্রভাবশালী মানুষ, আর কোথায় নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের শান্ত ছেলে আফিফ। আহি তো সত্যটা মেনে নিয়েই আফিফকে ভালোবেসে যাচ্ছে। কিন্তু আফিফ যদি সত্যটা মানতে না চায়। তাই আহি সিদ্ধান্ত নিলো, এখন সে তার ভালোবাসার কথা জানাবে না। আরেকটু সময় নেবে। চয়নের মৃত্যুর ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে আফিফের হয়তো আরো কিছু মাস সময় লাগবে। কিন্তু এতোদিন আহি আফিফকে নিজের কাছ থেকে কীভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে? এখন তো তার ভালোবাসা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। তার এই বাড়াবাড়ি প্রেম প্রশমিত করার একমাত্র ওষুধ আফিফকে কাছে পাওয়া। আফিফকে তার চোখের সামনে বসিয়ে রাখা। কিন্তু কীভাবে সে আফিফকে তার সামনে বসিয়ে রাখবে। দ্বিমাত্রিক ছবিগুলো আহিকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। একের পর এক ছবি এঁকেও যেন আহি তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এবার তার সম্রাট শাহজাহান হতে ইচ্ছে করছে। সম্রাট তার প্রেমের সাক্ষী রূপে বানিয়েছিলেন তাজমহল। আর আহি ভালো কারিগর দিয়ে বানিয়েছে আফিফের ভাস্কর্য। হুবহু আফিফের প্রতিরূপ নিয়ে এসেছে সে। ভাস্কর্যটি দাঁড় করানোর জন্য দামী কাঠ দিয়ে একটা গোল স্ট্যান্ড বানিয়েছে আহি। ভাগ্যিস আহি নিজের ঘরে নিজের মতো থাকতো। ভাগ্যিস তার ঘরে তার অনুমতি ব্যতীত কেউ আসতে পারতো না। নয়তো সালমা ফাওজিয়া অনেক আগেই আহির এই অতিমাত্রার পাগলামো কমানোর একটা ব্যবস্থা নিয়ে ফেলতেন।

যেদিন ভাস্কর্যটি বাসায় আনা হয়েছিল, সেদিন রিজওয়ান কবির আর সালমা ফাওজিয়া বাসায় ছিলেন না। আহি তার ঘরে ভাস্কর্যটি নিয়ে আসে। এরপর তার বিছানার মুখোমুখি সেটা দাঁড় করিয়ে রাখলো। তারপর সে তার কৃত্রিম আফিফের জন্য সাদা শার্ট আর প্যান্ট কিনে এনে সেটিকে পরিয়ে দিলো। আর বুক পকেটে গুঁজে দিলো তার বাগানের সেই অলকানন্দা ফুল। এরপর ভাস্কর্যটির হাত ছুঁয়ে দিয়ে আহি বলল,
“তোমাকে স্পর্শ করার এটাই একমাত্র সুযোগ ছিল। এআর, এখন তুমি শুধু আমার। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকার শুধুই আমার।”

………………………….

অতীত স্মৃতি হাতড়ে ভালোই নয়ন ভেজালো আহি। চোখ খুলতেই তার অশ্রুসিক্ত লাল চোখ দু’টি দৃশ্যমান হলো। সে কাঠের স্ট্যান্ড থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অলকানন্দা ফুলগুলো এখন আর নেই। গত চার বছর সে এখানে ছিল না। তাই ফুল গাছগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আহি ছাড়া এ বাসায় আর কারো ফুল গাছের শখ নেই। এই বাড়ির মানুষগুলো টাকার গাছ খুঁজতে এদিক-ওদিক ছুটে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এআর, চার বছর ধরে তোমাকে দেখি না। তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। দূর থেকে দেখলেই আমার চলবে। এমনিতেই তোমার কাছে যাওয়ার সাহস নেই আমার। এই মুখ নিয়ে তোমার সামনে কীভাবে দাঁড়াবো? তুমি নিশ্চিত ঠাট্টা করবে! হাসবে আমার উপর। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার কাছে আমি বেহায়া হলেও, আমার কাছে এটাই বেঁচে থাকার সম্বল। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তো এখনো আমি বেঁচে আছি। নয়তো এই হিংস্র মানুষগুলো অনেক আগেই আমার প্রাণ নিয়ে নিতো।”

(***)

বিকেলে তাজওয়ার আহিদের বাসায় এলো। মিসেস লাবণি আর রিজওয়ান কবির এখনো বাসায় ফেরেন নি। আহি এই মুহূর্তে তাজওয়ারকে দেখে ভীষণ বিরক্তবোধ করছে। কিন্তু এই অসভ্য লোকটাকে সহ্য করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।
এদিকে তাজওয়ার আহিকে দেখে বলল,
“ইউ আর লুকিং ভেরি বিউটিফুল!”

আহি দাঁত কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি তোমার এই অসভ্য কমেন্ট নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখো।”

“তুমি তো দেখছি আমার সাথে অসভ্য শব্দটা ব্যবহার না করে কথায় বলতে পারো না।”

“কারণ এই শব্দটাই তোমার সাথে মানানসই।”

“আর তোমার পাশে আমার মতো এই অসভ্য মানুষটাকেই বেশি মানায়।”

আহি চোখ-মুখ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির মুখশ্রী দেখে বাঁকা হেসে তাকে টেনে বাগানের দিকে নিয়ে গেলো। আহি তাজওয়ারের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আর ইউ ক্রেজি?”

তাজওয়ার হেসে বলল, “অনলি ফর ইউ।”

তাজওয়ার পকেট থেকে সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে বাগানের বেঞ্চে বসে পড়লো। আহি বিরক্ত মুখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে যেতে নেবে, তাজওয়ার তার হাত ধরে তাকে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি কি এখন আমাকে জোর করে সিগারেট খাওয়াবে?”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“খাওয়াবো না। কিন্তু অভ্যাস করতে হবে। তোমার পাশে বসে আমি রোজ রাতে সিগারেট ধরাবো, আর তুমি এই ধোঁয়া হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখবে। ভীষণ চমৎকার একটা দৃশ্য! তুমি নিশ্চিত উপভোগ করবে।”

তাজওয়ার আহির দিকে ফিরে ধোঁয়া ছাড়তেই আহি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। তাজওয়ার হাসলো। আহি গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমার এই স্বভাবটাই আমি ঘৃণা করি। আর মনে রেখো, রোজ রাত কেন? তুমি কোনো রাতেই তোমার এই কুৎসিত স্বপ্ন পূরণ হতে দেখবে না।”

আহি কথাটি বলেই হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। এরপর ঘরে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে সে বার কয়েক মুখে পানির ঝাপটা দিলো। তারপর ভেজা মুখ নিয়ে আয়নার সামনে তাকাতেই তার মনে পড়লো সেই দিনটির কথা।

………………………

সেদিন বাসের জন্য আফিফ রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ একটা লোক তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। আর ওমনি আফিফ কাশতে শুরু করলো। ধোঁয়াটা একদম আফিফের কাছেই ছেড়েছিলো লোকটা। আহির ইচ্ছে করছিলো, সেই মুহূর্তেই লোকটাকে গণপিটুনি খাওয়াতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। তাই সে তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আফিফের দিকে এগিয়ে দিলো। আফিফ পানি খেয়েই আহিকে ধন্যবাদ দিলো। আহির চোখাচোখি হতেই সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে ছিল আফিফ। সে হয়তো ভাবছে, এই মেয়েটা এখানে কি করছে? তাহলে কি এ-ই সেই মেয়ে যে তার পিছু নেয়? আহি আফিফের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সরাতে স্বাভাবিক মুখে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আফিফের আগেই একটা বাসে উঠে পড়লো। বাসে উঠেই আহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আফিফকে একনজর দেখে নিলো। আফিফ হয়তো এখন ভাববে এটা ইচ্ছেকৃত সাক্ষাৎ নয়। এটা হঠাৎ দেখা হওয়া।
এরপর বাস একটু সামনে যেতেই আহি বাস থেকে নেমে আনমনে রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। আর মনে মনে সেই লোকটাকে ধন্যবাদ দিলো। সিগারেটের ছলে সে জানতে পারলো, সিগারেটের ধোঁয়ায় আফিফের সমস্যা হয়। উলটো তার বোতলটিও আফিফের স্পর্শ পেলো। উপরন্তু আফিফের ধন্যবাদও পেলো। তার ইচ্ছে করছে এই দিনটা ফ্রেমে তুলে সাজিয়ে রাখতে।

………………………

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ফোনে টুংটুং শব্দ তুলে একটা মেসেজ এলো। ফোন হাতে নিলো আহি। দেখলো রাদের মেসেজ এসেছে। মাস্টার্সে ভর্তির জন্য একটা ভালো ভার্সিটি খুঁজে পেয়েছে সে। কালই ফর্ম ছাড়বে। আহিকে কাল দেখা করতে বলেছে। ভার্সিটির নামটা দেখেই আহির অস্থিরতা বেড়ে গেলো। এটা তো সেই ভার্সিটি! এই ভার্সিটিতেই আফিফ পড়তো। ফোনটা রেখে আহি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বুকে হাত রেখে জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমিও না, কি ভাবছি! এআর তো অনেক আগেই গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে বের হয়ে গেছে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৪||

২১।
চারুশিল্পের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। তার চোখ দু’টি ভিজে যাচ্ছে। আজ কতো বছর পর আবার এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সে। এই স্থানটি ঘিরে কতো মিষ্টি মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল তার জীবনে। সবুজ গেটটি এখন বিভিন্ন রঙে মিশে গেছে। সিমেন্ট খসে পড়া দেয়ালে এখন কারুশিল্পের ছাপ। আহি ভেতরে ঢুকতেই সেই চেনা-পরিচিত অনুভূতিটি তার হৃদয় স্পর্শ করে গেলো। চারুশিল্প প্রতিষ্ঠানটি এখন অনেক উন্নত হয়েছে। পাশে একটা আর্ট গ্যালারি খোলা হয়েছে। শিল্পীদের আঁকা বাছাই করা ছবিগুলো এই আর্ট গ্যালারিতে স্থান পায়। কারো ইচ্ছে করলে কিনে নিয়ে যায়। তবে আহি যখন চারুশিল্পে পড়তো তখন এই জায়গাটি উন্মুক্ত ছিল। প্যান্ডেল বেঁধে এখানে এক্সিভিশনের আয়োজন করা হতো। আহির জন্য সেই দিনটি ছিল সবচেয়ে চমৎকার একটা দিন। সেই দিনটি ছিল আহির জীবনের প্রথম ও শেষ এক্সিভিশন। যদিও সেই এক্সিভিশন তার ছিল। কিন্তু মুহূর্তটা তারই ছিল। আর সেদিনই সে আফিফের কাছ থেকে মিষ্টি একটা সাড়া পেয়েছিল।

…………………………..

আড়াই বছর পার হয়ে গেছে। আহি এখনো আফিফের সামনে এসে দাঁড়ায় নি। লিনাশা বার-বার আহিকে বলছে আফিফকে ভালোবাসার কথা সামনা-সামনি গিয়ে জানাতে। বেশি দেরী হয়ে গেলে হয়তো আহি আফিফকে হারিয়ে ফেলতে পারে। তবে চিরকুট আর ছবি আঁকা এখনো বন্ধ হয় নি। কয়েক মাসে কতো শত চিরকুট সে আফিফকে দিয়েছিল। আহি দূর থেকে দেখতো, আফিফ সেই চিরকুট পড়ে মিষ্টি হাসি হাসছে। কি মনোমুগ্ধকর সেই হাসি! আফিফ নিজেও আহির চিরকুটে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। যদিও সে কখনো ফিরতি চিরকুট লেখে নি। লিখেই বা কাকে দেবে? দেওয়ার তো কোনো ঠিকানা নেই। বেনামী পত্রগুলো সে পড়েই নিজের বুক পকেটে রেখে দিতো। আর আহি দূর থেকে তা দেখে মনে মনে বলতো,
“তুমি মানো বা না মানো, আমি তোমার অন্তরালেই তোমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছি। আমি জানি, তুমিও আমাকে ভালোবাসো।”

(***)

পৌষ মাসের শুরুতেই চারুশিল্পে এক্সিভিশনের জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গেলো। উচ্চতর বিভাগে যারা পড়ছে, তারা সবাই এক্সিভিশনে ছবি দিচ্ছে। আহি আর আফিফ এখনো মাধ্যমিক বিভাগের শেষ সেশনে। হয়তো তাদের ছবি বাছাই নাও হতে পারে। তবুও আফিফকে স্যার একটু বেশিই পছন্দ করেন। তিনি ক্লাসে এসেই এক্সিভিশনের লিফলেটটি আফিফকে দিয়ে বললেন,
“হাতে এক মাস সময় আছে। একটা ভালো ছবি আঁকো। যদি ছবিটা বাছাই হয়ে যায়, তুমি একটা চমৎকার সুযোগ পেতে পারো। দেশের ভালো ভালো আর্টিস্টদের আমরা ইনভাইট করেছি। তাদের যদি
তোমার আঁকা ছবি পছন্দ হয়ে যায়, মনে করবে তোমার লাইফ সেট হয়ে গেছে।”

আফিফ স্যারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। স্যার আফিফের কাঁধে হালকা চাপড় মেরে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। এদিকে আহি মনোযোগ দিয়ে আফিফকে দেখছে। এতো বড় সুযোগ পেয়েও আফিফ ওতোটা খুশি হয় নি, যতোটা খুশি হওয়া দরকার ছিল। এর পরের সপ্তাহের শুক্রবার ক্লাস শেষ হতেই আফিফ একপাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ স্যারের সাথে কথা বললো। আহি দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। স্যার কিছুক্ষণ পর পর আফিফকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আফিফও একটু পর পর শার্টের হাতায় চোখ মুছছে। এসব দেখে আহির সবকিছুই কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছিল। আফিফ ধীরে ধীরে তার কাছে একজন রহস্যময় পুরুষে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল। যেই রহস্য ভেদ করা আহির কাছে এতোটা সহজ মনে হচ্ছে না।
আফিফ স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতেই আহি সেই স্যারের কাছে গেলো। হুট করে আফিফের কি হয়েছে তা জিজ্ঞেস করা সম্ভব না। তাই সে বলল,
“স্যার, আমাদের সেশন থেকে কেউ এক্সিভিশনে ছবি দেবে না?”

স্যার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আফিফকে বলেছিলাম। কিন্তু ও তো পারছে না।”

“কেন?”

“কিছু সমস্যা আছে হয়তো!”

আহির খুব ইচ্ছে করছিলো স্যারকে জিজ্ঞেস করতে কি সমস্যা তার এআরের? তাকে একবার বললে সে সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু আহি জানে সে যদি স্যারকে জিজ্ঞেসও করে বসে, তবুও তিনি বলবেন না। উলটো স্যারের কাছে এমন প্রশ্ন বেখাপ্পা মনে হবে। তাই সে আর বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটলো না।

(***)

আফিফের প্রতিমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। আলতো হাতে মূর্তিটির হাতের মুঠোয় নিজের হাত পুরে দিলো। তারপর সেই মূর্তিটির কপালে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলল,
“এক্সিভিশনে তোমার ছবি আসবে। যদি সত্যিই তুমি আমাকে একটু হলেও অনুভব করো, তাহলে আমি তোমার তুলিতে জায়গা করে নিতে পারবো।”

এরপর আহি লিনাশাকে নিয়ে চলে গেলো শপিংয়ে। দোকান ঘুরে একটা সাদা শাড়ি কিনলো। শাড়ির সাথে মিলিয়ে কালো চুড়ি, কালো ঝুমকো জোড়া কিনে বাসায় চলে এলো। সেদিনই বাবার কাছ থেকে তার দামী ক্যামেরাটা ধার নিলো। তারপর চলে গেলো সবুজ বনানীর ভীড়ে। মোজাম্মেল চাচাকে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তার এমন একটা জায়গা লাগবে যেখানে সবুজ জঙ্গল থাকবে আর একটা শক্ত ডাল-পালাযুক্ত গাছ লাগবে। মোজাম্মেল চাচা আহিকে সেখানেই নিয়ে গেলেন। তারপর আহি মোজাম্মেল চাচার সাহায্যে সেই গাছে একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিয়ে, সেই দোলনাটির সাথে লতা গাছ পেঁচিয়ে দিলো। ব্যস, আহির প্রাথমিক কাজ শেষ হতেই সে লিনাশার বাসায় গিয়ে সেই সাদা শাড়ির সাথে মিলিয়ে কালো চুড়ি, আর ঝুমকো জোড়া পরে নিলো। তারপর হাতে-পায়ে গাঢ় করে আলতা লাগিয়ে খোলা চুলে কয়েকটা অলকানন্দা ফুল লাগিয়ে নিলো। লিনাশা আহিকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“এআর তো তোকে দেখেই প্রেমে পড়ে যাবে।”

আহি লাজুক হেসে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। লিনাশা আহির হাত ধরে বলল,
“আহি একটা কথা বলি? তুই সত্যিই ওকে না পেলে পাগল হয়ে যাবি। দেরী করিস না দোস্ত। ওকে জানিয়ে দে। তুই ওর জন্য যা যা পাগলামো করছিস, আমার তোর জন্য ভীষণ মায়া লাগছে। যদি দিনশেষে ছেলেটা তোর না হয়ে অন্য কারো হয়ে যায়?”

আহি লিনাশার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আর কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এমন দিন আসবে না লিনু। আমি আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে তাকে চেয়ে নিচ্ছি। আমার বিশ্বাস ও আমারই হবে। উনি কখনো আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন না।”

“প্র‍্যাক্টিকাল কথা বল, আহি। সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা মাঝে মাঝে আমরা বুঝি না। হয়তো আমাদের ভালোর জন্য তিনি এমন কাউকে আমাদের জীবনে আনবেন, যাকে আমরা চাই নি। তখন মেনে নিতে পারবি তো?”

আহি থমথমে কন্ঠে বলল,
“ও আমার এআর। আমি ছাড়া ওর জীবনে কেউ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এটা যদি আমার আশা হয়, তাহলে তা-ই। মানুষ কিন্তু স্বপ্ন দেখেই বাঁচে।”

“সব স্বপ্ন সত্য হয় না, আহি।”

আহি দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“এআরকে আমি শুধু ভালোবাসি নি, ওকে আমি গভীরভাবে ভালোবেসেছি। সূক্ষ্মভাবে অনুভব করেছি। আমার হৃদয়টা যদি ভাগ হয়ে যায় তার এক অংশ জুড়ে সে থাকবে। বাকি অংশেও সে-ই থাকবে। আমার জীবনে তার চেয়ে প্রিয় কেউ নেই। তুই তো জানিস, আমার বাবা-মার সম্পর্ক কতোটা জটিল। তাদের দেখলে ভালোবাসা, অনুভূতি সবকিছুই আমার কাছে কেমন এলোমেলো মনে হয়। আমার এই অনুভূতির সৃষ্টি সেই মানুষটাকে ঘিরেই হয়েছে। আমি ভালোবাসতে শিখেছি তাকে দেখেই। এখন বল, এআরকে না পেলে আমি কেমন থাকবো? তাকে পাওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেলে, আমি স্বপ্ন দেখাই ভুলে যাবো। ও আমার পাশে থাকলে, আমি সব জয় করতে পারবো। ও আমার একমাত্র প্রেরণা।”

(***)

এক সপ্তাহ কেটে গেলো। এক্সিভিশনের জন্য আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। আহি যদি আজ আফিফকে ছবিটা দিতে না পারে, তাহলে তার পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই আজ সে একটু আগেভাগেই চারুশিল্পের জন্য বেরিয়ে পড়লো। ক্লাসে পৌঁছেই আফিফের খাতা খুঁজে বের করে সেখানে ছবি আর চিরকুটটা রেখে বেরিয়ে গেলো। এরপর আফিফ ক্লাসে ঢুকতেই সেও ধীর পায়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লো। আফিফ ডেস্ক থেকে তার খাতাটা যত্ন করে বের করলো। সে জানে এই খাতার ফাঁকে আজও কোনো না কোনো চিরকুট থাকবে। খাতাটা নিয়ে নিজের বেঞ্চে বসে পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়েই চমকে উঠলো আফিফ। আজ শুধু চিরকুট নেই, একটা ছবিও আছে। আফিফ ছবিটা দেখেই থমকে গেলো।
ঘন জঙ্গলের মাঝখানে একটা দোলনা ঝুলছে। সেই দোলনায় পা উঠিয়ে সাদা শাড়ি পরা একটা মেয়ে বসে আছে। তার আলতা রাঙা হাত আর চুলের ফাঁকে অলকানন্দা ফুলগুলো আফিফের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। ছবিটা দেখেই আফিফ হুট করে উঠে দাঁড়ালো।
ব্যস্ত হয়ে এদিক-ওদিক সেই আলতা রাঙা হাতটি খুঁজতে লাগলো। আহি আফিফকে কিছু খুঁজতে দেখেই একটা বই খুলে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর আফিফকে তার বেঞ্চে বসে যেতে দেখে আহি আবার তার দিকে তাকালো। আফিফ এবার চিরকুটটা হাতে নিলো। চিরকুট খুলতেই আফিফের ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। চিরকুটে লেখা-
“প্রিয় অলকানন্দ,
ফুলের নামটা তোমার সম্বোধনে বেমানান। তাই তুমি আমার কাছে অলকানন্দ। আমি না হয় তোমার অলকানন্দা হয়েই থাকবো। শোনো না, তোমার পছন্দে নিজেকে সাজাতে ভালো লাগে। তাই আজ প্রথম তোমার পছন্দে সেজেছি। কি ভাবছো, আমি এতোকিছু কীভাবে জানি? আমার মতো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তোমাকে কেউ ভালোবাসবে না অলকানন্দ। এই প্রিয়, শোনো না, কেন আঁকবে না ছবি? আগামী সপ্তাহে তোমার রং-তুলি ফিঁকে হোক, আমি চাই না। অন্তত আমার এই ছবিটার সৌভাগ্য হোক। কবে তোমার সামনে বসবো, কবে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, তারপর ছবি আঁকবে, সেই অপেক্ষায় থাকতে পারছি না। আমি আজ তোমার কাছে খোলা প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদই তো একটি বই কেনার প্রথম আকর্ষণ হয়, তাই না? আমিও ঠিক তেমনি তোমার শিল্পী হওয়ার প্রথম আকর্ষণ হতে চাই। আমি তোমার মাখানো রঙের ফাঁকে আটকে থাকতে চাই। সাদা শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি আর আলতা রাঙা হাত এসব ছাড়া না-কি কোনো নারী প্রেয়সী হয় না। আর আজ আমি তোমার প্রেয়সী হয়েছি। এখন আমার প্রেম গল্প কি তোমার ক্যানভাসে তুলবে না, প্রিয়?”

এতো চমৎকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের সাধ্য কারো নেই। আফিফেরও হয় নি। সে পরের সপ্তাহে এক্সিভিশনের জন্য সেই ছবিটিই আঁকলো।

(***)

এক্সিভিশনের দিন আফিফের আঁকা ছবিটি প্রথম সারিতে রাখা হয়েছিল। আফিফ দূরে বসিয়ে রাখা চেয়ারে বসে তার ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, আজ অন্তত মেয়েটাকে সে চিনে নিতে পারবে। এতো ছবির মধ্যে নিজের ছবি দেখলে যে কারো অনুভূতি তার চোখে প্রকাশিত হবে। আফিফ সেই মুহূর্তটির অপেক্ষা করছিল। আহি দূর থেকে আফিফকে লক্ষ্য করছে। আফিফ যে তাকে হাতে-নাতে ধরার পরিকল্পনায় আছে, তা সে ভালোভাবেই বুঝে ফেলেছে। আজ অন্তত সে আফিফের মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় না। এখন আহি আফিফের চোখের আড়াল হয়ে ছবিটা কীভাবে দেখবে? তাই লিনাশাকে ফোন দিয়ে আসতে বললো আহি। লিনাশা এসেই আহির কথামতো ছবিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছবিটির দিকে তাকিয়ে লিনাশা হাসলো। আফিফ দূর থেকে লিনাশাকে হাসতে দেখে চমকে উঠলো। সে উঠে দাঁড়াতেই লিনাশা ফোন হাতে নিয়ে আফিফের আঁকা ছবিটি তার ফোনে ধারণ করে নিলো। বাঁধাই করা ছবিটিতে হাত রাখতেই আফিফ লিনাশার সামনে এসে দাঁড়ালো। লিনাশা আফিফকে দেখেই চিনে ফেলেছে। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি এই ছবির মেয়ে নন। তাহলে আপনি কি তাকে চেনেন?”

লিনাশা আমতা-আমতা করে বলল, “কার কথা বলছেন?”

“যার ছবি আমি এঁকেছি।”

“কার ছবি এঁকেছেন?”

আফিফ লিনাশার ফোনটা দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“ছবি কেন তুললেন?”

“ছবিটা দেখতে সুন্দর তাই।”

“এর চেয়ে সুন্দর ছবি এখানে আছে। নিশ্চয় আপনি তাকে চেনেন?”

লিনাশা আফিফের কথায় ঘাবড়ে গেলো। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি এটা কিনে নিতে চাচ্ছি।”

আফিফ ছোট একটা কাগজ লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা বিক্রির জন্য নয়।”

লিনাশা আফিফের গম্ভীর কথাবার্তা শুনে সেখান থেকে পালিয়ে চলে গেলো। আফিফ পিছু নিতে গিয়েও নেয় নি। তার ধারণা সঠিক ছিল। মেয়েটা হয়তো এই ছবির মেয়েটিকে ভালো করেই চিনে। লিনাশাকে আজ আফিফ প্রথম দেখেছে। এই মেয়েটা কখনোই ছবির মেয়েটি হবে না। কারণ যে আফিফকে চিরকুট দেয়, সে চারুশিল্পেই ক্লাস করে।

(***)

লিনাশা আহির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, ছেলেটা তোর অপেক্ষায় বসে আছে। ছেলেটা নিশ্চিত তোর সাথে কথা বলতে আগ্রহী। দেরী করিস না। গিয়ে জানিয়ে দে।”

আহি লিনাশার ফোনে আফিফের আঁকা নিজের ছবিটা দেখে মুচকি হাসলো। ছবির নিচে কিছু একটা লেখা আছে। আহি ফোনে তোলা ছবিটি ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখেও বুঝলো না। লেখাটা ফোনে ঝাপসা হয়ে গেছে। লিনাশা আহিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“বাদ দে। যখন প্রেম শুরু হয়ে যাবে, তখন জিজ্ঞেস করে নিস। হয়তো তোর জন্য কোনো মেসেজ ছিল।”

………………………………..

আহি আর্ট গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাদের ঝাঁকুনিতে আহি তার দিকে তাকালো। রাদ আহির চোখে অশ্রু জমতে দেখে বলল,
“যে তোর নেই, তাকে নিয়ে আর কতো ভাববি, আহি?

আহি মলিন মুখে বললো,
“এখান থেকেই তো আমার প্রেমের গল্পটা শুরু হয়েছিল। আমি ভুলে যাওয়া শিখি নি। তাই ভুলতে পারি না। এই জায়গা, ওখানে বসে থাকা, এই পথ ধরে তার হেঁটে যাওয়া, আমি সব অনুভব করতে পারি। শুধু ওকে স্পর্শ করতে পারি না।”

রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আজ আমার জন্মদিন, আহি। তুই অন্তত আমাকে কষ্ট দিস না।”

“আমি ওর কথা বললে তুই কেন কষ্ট পাবি?”

রাদ মলিন হাসলো। মনে মনে বলল,
“তোকে ভালোবাসি বলে অন্য কারো প্রতি তোর ভালোবাসা দেখলে কষ্ট পাই। আমাকে যদি এভাবে ভালোবাসতি, সব সুখ তোর নামেই লিখে দিতাম।”

আহি রাদের দিকে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“এখানে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট খুলেছে। ভেবেছি দেশে আসলে প্রথম জন্মদিনে তোকে আর লাবীবকে সেখানে ট্রিট দেবো। আগে যদি জানতাম রেস্টুরেন্টটার পাশেই সেই তেলাপোকার বাসা, কখনো তোকে এদিকে নিয়ে আসতাম না।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল, “সরি।”

রাদ হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“যা ভাই। তোর সাথে কথাই বলবো না।”

আহি কান ধরে বলল,
“সরি। ওর কথা আর বলবো না। এখান থেকে বেরিয়ে যাই, চল। এখানে থাকলে আমারও কষ্ট বাড়বে, তোরও মন খারাপ হবে।”

রাদ আহির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই যে আমার কারণে তুই ওই তেলাপোকাকে মাথা থেকে নামিয়ে দিস, ভীষণ ভালো লাগে রে। মনে হয় তোর উপর আমার অধিকার পাকাপোক্ত হচ্ছে।”

আহি রাদের কথায় হাসলো। রাদ আহির হাত ধরে তাকে চারুশিল্পের বাইরের নিয়ে এলো।

২২।

লাবীব আর আহি রাদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিতেই রাদ কেক কাটলো। তারা একসাথে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসেছে। লাবীব চেয়ার্স বলতেই আহির ঠোঁটের হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। দেশে আসার পর প্রথম তারা তিনজন কোথাও বসে আড্ডা দিচ্ছে। কয়েক বছর আগে আহির আড্ডা জমতো পদ্ম, লিনাশা আর পুষ্পের সাথে। কিন্তু আজ আহির জীবনে তাদের তিনজনের স্থান ব্লক লিস্টে। হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে জানালার বাইরে তাকালো।
দু’তলা রেস্টুরেন্ট। কাচের জানালা দিয়ে ব্যস্ত রাস্তা দেখা যাচ্ছে। আহি সেদিকেই তাকিয়ে আছে। পলি আপু গ্রুপটা এখন জীর্ণশীর্ণ হয়ে আছে। কোথায় তারা একসাথে বসে আড্ডা দেওয়ার কথা ছিল, এখন কি হয়ে গেলো! আজকে এমন একটা দিন আসবে তারা হয়তো কখনোই ভাবে নি। হঠাৎ আহি কি মনে করে ফোনটা হাতে নিলো। নতুন একাউন্ট খুলেছে সে। পুরোনোটাতে ঢুকতে ইচ্ছে করে না তার। গত চার বছরে ঢুকেও দেখে নি। কিন্তু পাসওয়ার্ডটা তার এখনো মনে আছে। সেই পাসওয়ার্ডটা টাইপ করতে কষ্ট হবে বলেই ঢুকে নি। কিন্তু আজ একবার সেই ফেইসবুক একাউন্টটাতে ঢুকতে ইচ্ছে করছে। আহি তার এই ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখলো না। পাসওয়ার্ড লিখলো, এআরের অলকানন্দা হতে চাই। সাথে সাথেই লগ ইন হয়ে গেলো। লগ ইন হতেই আহির ভেতরটা হুঁহুঁ করে উঠলো। ইনবক্সে ঢুকতেই সামনে ভেসে উঠলো তিনটা ইনবক্স। উপরেই পুষ্পের মেসেজ। তিন বছর আগে শেষ মেসেজ দিয়েছিল সে। মেসেজগুলো দেখতেই আহির চোখ ভিজে উঠলো। পুষ্প লিখেছিল,
“আহি তুই এভাবে আলাদা হয়ে গেলি কেন? পদ্ম অনেক বার তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে। ও নাকি তোকে খুঁজে পায় না। লিনাশার সাথে তোর কি হয়েছে? ওকে কতোবার জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু ভীষণ রেগে আছে তোর উপর। কি করেছিস তুই? সেদিন দেখা হলো, বললো তুই নাকি সব নষ্টের মূল। কেন আহি? তোদের সম্পর্ক তো এমন ছিল না। আহি অন্তত আমার সাথে যোগাযোগ করিস। ভুলে যাস না যেন। লিনাশা বললো, তুই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিস। হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”

আহি মলিন হাসলো। পরের মেসেজটি এসেছিল লিনাশার কাছ থেকে। শেষ মেসেজ দিয়ে সে লিখেছিল,
“তোকে শেষ একটা কথায় বলবো, আফিফকে ভুলে গেলেই তোর জন্য ভালো হবে। এককালে বন্ধু ছিলাম, তাই বলছি। এখন আর তোর সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

সেদিন আহিকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দেয় নি লিনাশা। সে নিজেই ব্লক করে দিয়েছিল আহিকে। শেষ মেসেজটি ছিল পদ্মের। সে লিখেছে,
“সেদিন যে চলে গেলি, আর কথাও বললি না। লিনাশা বললো, তুই না-কি সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলি। বাড়িতে থেকে যেতে পারতি। মা তো ছিল।”

আহি নিজেই মেসেজটা দেখে পদ্মকে ব্লক করে দিয়েছিল। এরপর আহি ঢুকলো পলি আপু গ্রুপটিতে। তাদের চারজনের গ্রুপ। লিনাশা সবার আগেই সেই গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে লিখেছিল,
“এতোটুকুই হয়তো আমাদের বন্ধুত্বের যাত্রা ছিল।”

পুষ্প আর পদ্ম সেই মেসেজের উত্তরে অনেক প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু লিনাশা সেই যে গ্রুপ ছাড়লো, আর ঢুকে নি। আহি সেই গ্রুপে কোনো মেসেজ দেয় নি। সেও বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখনো আর্কাইভে মৃত পড়ে আছে সেই গ্রুপটি। সেদিন তারা কি অদ্ভুত কাজটাই না করেছিল! ফলস্বরূপ তাদের ছোট বেলার বন্ধুত্বটা এখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্লক লিস্টে স্থান পেয়েছে। এভাবে কি বন্ধু হারিয়ে যায়?

হঠাৎ আহির কানে ভেসে এলো একটি গান। আহি বুঝতে পারছে না, রেস্টুরেন্টে হঠাৎ এই গানটিই কেন ছাড়লো?

“এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে
সকাল-বিকেল বেলা
কত পুরোনো-নতুন পরিচিত গান
গাইতাম খুলে গলা।
কত এলোমলো পথ হেটেছি দু’জন
হাত ছিলো না তো হাতে
ছিল যে যার জীবনে দু’টো মন
ছিল জড়াজড়ি একসাথে।
কত ঝগড়া-বিবাদ, সুখের স্মৃতিতে
ভরে আছে শৈশব
তোকে স্মৃতিতে স্মৃতিতে এখনও তো
ভালোবাসছি অসম্ভব।
কেন বাড়লে বয়স
ছোট্ট বেলার বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন হারাচ্ছে সব,
বাড়াচ্ছে ভীড় হারানোর তালিকায়।
আজ কে যে কোথায় আছি
কোনো খবর নেই তো কারও
অথচ তোর ওই দুঃখগুলোতে
অংশ ছিল আমারও।
এই চলতি জীবন ঘটনাবহুল
দু’এক ইঞ্চি ফাঁকে
তুই তো পাবি না আমায়
আর আমিও খুঁজি না তোকে
কত সুখ পাওয়া হয়ে গেল,
তোকে ভুলে গেছি কতবার
তবু শৈশব থেকে তোর গান যেন
ভেসে আসে বারবার।”

গানটি শুনতে চাচ্ছিলো না আহি। তবুও কানে ভেসে আসছে। অসহ্য লাগছে তার। আজ রাদের জন্মদিন, কিন্তু তার কান্না পাচ্ছে। সে কাঁদতে চাচ্ছে না, তবুও বেহায়া অশ্রুগুলোকে থামাতে পারছে না সে। হঠাৎ আহির কানে একটা পরিচিত কণ্ঠের স্বর ভেসে এলো। আহি অশ্রু আড়াল করে রাদের দিকে তাকালো। দেখলো রাদ অবাক দৃষ্টিতে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। আহি রাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশ ফিরে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো।

সেই পরিচিত কণ্ঠে তাকে আবার ডাকলো সেই পরিচিত মুখটি।

“আহি!”

আহি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাদ আর লাবীবও উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটি আহির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, তুই!”

আহি অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, “পুষ্প!”

(***)

দুই বান্ধবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেলেন। যারাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে তাদেরকেই রাদ উত্তর দিচ্ছে,
“অনেক বছর পর দুই বান্ধবীর দেখা হয়েছে তাই কাঁদছে।”

পুষ্প আহির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? একটা কলও কি দেওয়া যায় না?”

আহি মলিন মুখে বললো,
“সরি রে। অনেক ভুল করে ফেলেছি।”

“দেশে কবে এসেছিস?”

“এই তো এই মাসেই এসেছি।”

“আবার চলে যাবি?”

“জানি না। বাবা যা ভালো মনে করেন।”

“চল না একটু বসি। কিছুক্ষণ কথা বলি।”

আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ চোখের ইশারায় বললো পুষ্পকে সময় দিতে। পুষ্প রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে আমি চিনি মনে হচ্ছে।”

রাদ হেসে বলল,
“রিদমাম, রোল ০৩।”

“আমাদের স্কুলের রিদমাম?”

“হ্যাঁ।”

পুষ্প আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওকে কোথায় পেয়েছিস তুই?”

রাদ বলল,
“আমার সাথে ওর কথা হতো। ওর নানার বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। এরপর ইউকে গিয়ে বন্ধুত্বটা আরো জমলো।”

লাবীব পুষ্পের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে চিনেছো?”

পুষ্প লাবীবের হাতের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“না, কে আপনি?”

লাবীব বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বললো,
“রাদকে তুমি, আর আমাকে আপনি? আমিও সেই স্কুলেই পড়তাম।”

“নিশ্চয় ব্যাকবেঞ্চার। ব্যাকবেঞ্চারদের কেউ মনে রাখে না।”

পুষ্পের কথায় রাদ আর আহি মুখ চেপে হাসলো। আর লাবীবের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই পুষ্প আহিকে বলল,
“চল, তোর সাথে অনেক কথা আছে।”

(***)

“লিনাশার সাথে কথা হয় না তোর?”

আহি পুষ্পের প্রশ্নে মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“পদ্মকে তুই ব্লক করে দিয়েছিস কেন?”

“এমনিতেই।”

“কিছু একটা তো হয়েছে।”

“জানাতে পারবো না, তাই তো ব্লক করে দিয়েছিলাম।”

“আমাকে তো করিস নি।”

“সবাইকে করে দিলে যদি পরে কাউকে খুঁজেই না পাই!”

“খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাহলে?”

“হুম। তোদের কথা খুব মনে পড়ে। এখন তোর কি অবস্থা বল?”

“ভালো। অনার্স শেষ হলো, এখন মাস্টার্সে ভর্তি হবো।”

“আমিও তো।”

“সত্যিই! চল একসাথে ভর্তি হই। যদিও আমাদের আলাদা সাবজেক্ট, তাও অন্তত এক জায়গায় থাকবো। বিশ্বাস কর, আমি গত চার বছরে মনের মতো একটা বন্ধুও পাই নি। তোদের মতো কেউ হয় না রে। আমার মতো এলোমেলো মেয়েটাকে শুধু তোরাই বুঝেছিস।”

“বিয়ে করবি না?”

“আরেহ ধুর, এসব ঝামেলায় কে যাচ্ছে? বাসা থেকেও ওতো চাপ দেয় না। বাবা চায়, আমি আগে চাকরি ধরি। তারপর বিয়ে দেবে।”

“নিশ্চয় ঠিক করে রেখেছে।”

“হ্যাঁ, ওই, সেই ছেলেটা।”

আহি হেসে বলল, “তোর সেই ফুফাতো ভাই?”

“হ্যাঁ রে। সেই ভ্যাবলাটার সাথেই না-কি বিয়ে দেবে। কেন যে একটা প্রেমে পড়লাম না! অন্তত ভ্যাবলাটার হাত থেকে বাঁচতাম। এখন তো বলতেও পারছি না বিয়ে করবো না। অজুহাত দেওয়ার মতোও কোনো ছেলে হাতে নেই।”

আহি পুষ্পের কথায় নীরবে হাসলো। পুষ্প হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর এআরের খবর কি?”

আহি পুষ্পের প্রশ্নে চমকে উঠলো। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“জানি না। এসব কথা বাদ দে। বাকিদের কি খবর? লিনাশা, পদ্ম, কথা হয় ওদের সাথে?”

“হুম, লিনাশার সাথে প্রায়ই কথা হয়। দেখাও হয়। ওর বয়ফ্রেন্ডটা সে-ই স্মার্ট রে। হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ের দাওয়াত পাবো।”

আহি মলিন হেসে বলল, “ভালো। পদ্মের কি অবস্থা?”

“বলিস না ভাই। মেয়েটা ঝামেলায় আছে। ওর তো ইন্টারের পরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, মনে আছে?”

“হুম।”

“সংসার ভালো যাচ্ছে না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন? ওতো প্রেম করে বিয়ে করেছিল।”

“হুম, ছেলেটা ভালো। কিন্তু ছেলের মা ভীষণ খারাপ।”

“কি বলিস!”

“হ্যাঁ রে। পদ্ম মা হতে পারছে না। এতো বছরে একটা বাচ্চাও হয় নি। তাই মহিলাটা ঝামেলা করছে। ছেলেকে না-কি আরেকটা বিয়ে করতে বলছে।”

আহি মলিন মুখে বললো,
“মেয়েটা ভীষণ লক্ষী রে। তিনি হয়তো আসল হীরে চিনতে পারেন নি। সন্তান দিয়ে কি হয়? স্বামী-স্ত্রী সুখে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ ভালো মানুষগুলোকে সন্তান কেন দেন না বুঝি না। যারা সন্তানের মূল্য বুঝে না তাদের সন্তান দিয়ে, উলটো সেই সন্তানের জীবনটাও নরক বানিয়ে দেন।”

(***)

বাসায় ঢুকতেই আহি থমকে দাঁড়ালো। লাবণি হাসিমুখে আহির দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“আহি, দেখো দেখো কারা এসেছে!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ওরা এখানে কি করছে?”

“তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সামনের শুক্রবার তোমার আর তাজওয়ারের আক্দ।”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহলে কি এবার কল্পনায়ও আর আফিফ জায়গা পাবে না? তার আত্মাও কি তার প্রিয় অলকানন্দকে হারিয়ে ফেলবে?

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৫||

২৩।
তাজওয়ার আহির পাশে এসে বসতেই আহি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালো। তাজওয়ার ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আজ আমাদের এনগেজমেন্ট, আহি। তুমি কি খুশি নও?”

আহি গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস ছেলের সাথে বিয়ে হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ হবে। আর নিজের দুর্ভোগ দেখে কেউ খুশি হয় না।”

“তুমি এখনো আমার গুরুত্বটা বুঝতে পারছো না। তবে একদিন ঠিকই বুঝবে। আর আমার এতো তাড়া নেই। এখন তো তুমি আমার পারমানেন্ট পার্টনার হতে যাচ্ছো।”

রেহানা খান তাজওয়ারের হাতে আংটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“বাবা, আহিকে পরিয়ে দে।”

তাজওয়ার আংটিটা হাতে নিয়ে আহির দিকে তাকালো। আহি নিজের হাতটা লুকিয়ে রেখেছে। তাজওয়ার আহির কান্ড দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। তাজওয়ারের হাসি দেখে আহির মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। মিসেস লাবণি আহির পাশে বসে তার হাতটা ধরে বললেন,
“তুমি যদি এই মুহূর্তে কোনো সিনক্রিয়েট করো, তাহলে এর ফলাফল তোমার মা আর তোমার বন্ধুরা ভোগ করবে।”

আহি অসহায় দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি কেমন তুমি তো জানো। এভাবে হুট করে কোনো কিছুই ওর পছন্দ না। বিয়ে নিয়ে ওর কতো স্বপ্ন! তাই হয়তো ও একটু অভিমান করে আছে।”

তাজওয়ার লাবণির কথায় আংটিটা বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো আর বলল,
“তাহলে আহির মতো করে এই এনগেজমেন্টটা হবে। আমার বাগদত্তা খুশি হলেই আমি খুশি।”

তাজওয়ারের কথা শুনে রিজওয়ান কবির ও লাবণি অবাক হয়ে গেলেন। লাবণি বলল,
“আজ না হয় রিংটা পরিয়ে দাও। আহির ইচ্ছেমতো বড়সড় আয়োজন করে আবার না হয় পরাবে।”

তাজওয়ার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“খুব স্পেশাল মুহূর্তগুলো জীবনে একবার আসলেই ভালো। যেমন আহি আমার কাছে স্পেশাল একজন, তেমনি তাকে ঘিরে আমার প্রতিটা মুহূর্ত স্পেশাল। এমন ফিকে এনগেজমেন্ট আমিও চাই না। খুব শীঘ্রই আহির জন্য চমৎকার একটা সারপ্রাইজ নিয়ে আসবো। আর তখন আমাদের এনগেজমেন্টের দিনটা আহির কাছে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

তাজওয়ার আহির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে মিসেস লাবণির রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আহির হাবভাব দেখে তাজওয়ার ও তার পরিবার যাতে কিছু মনে না করে, তাই লাবণি ওমন কথা বলেছিল। কিন্তু তাজওয়ার যে তার কথা শুনে আহিকে আংটি না পরিয়ে চলে যাবে, এটা সে ভাবতেও পারে নি। এদিকে রিজওয়ান কবির লাবণির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আহিকে বিদায় করার জন্য এই দম্পতি যে উঠেপড়ে লেগেছে তা দূর থেকে দেখেই ভালোভাবে বুঝতে পারছেন মুনিয়া খালা। তবে তিনি তাজওয়ারের ক্ষণকালের এই সিদ্ধান্তে মনে মনে খুশি হয়েছেন। এর মধ্যেই যদি আহির কোনো গতি হয়ে যায়, তাতেই হবে।

(***)

রাতের খাবারের আয়োজন করে ফেলেছেন মুনিয়া খালা। রিজওয়ান কবির বসার ঘরে বসে সিরাজ খানের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছেন। সেখানে বসেই রেহানা খান আর লাবণি গল্প করছেন। তাজওয়ার কারো সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। এদিকে আহি নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই দোয়েল তার পেছন পেছন এসে তাকে ডাকলো। আহি দোয়েলকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। দোয়েল আহির কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“তোমার আর তাজওয়ার ভাইয়ের বিয়ে হবে শুনে আমার অনেক ভালো লাগছে। আমি তো আজই এখানে আসার আগে জানলাম তোমাদের বিয়ে হবে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আর আমি গত চার বছর ধরে জানি কোনো একদিন এই ভয়াবহ দিনটা আমার জীবনে আসবে।”

“কি বলছো আহি? ভয়াবহ দিন! তাজওয়ার ভাই তোমাকে খুব ভালোবাসেন। তুমি অনেক সৌভাগ্যবতী।”

আহি দোয়েলের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“যেই মেয়ে জানে তার হবু শ্বশুড় বাড়ির পরিবেশ কোনো নষ্ট বাড়ির চেয়ে কম নয়, যেই মেয়ে জানে তার হবু স্বামীর শরীরে অনেক মেয়ের গন্ধ লেগে আছে, সেই মেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করবে, এটা নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক। আমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই ভাবী। আমার ভালোবাসার বয়স পার হয়ে গেছে। আমার এই মুহূর্তে যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, সেটা হচ্ছে ভালো বন্ধু, সত্য সম্পর্ক আর নিরাপদ আশ্রয়। যার একটাও তাজওয়ার আমাকে দিতে পারবে না। তাহলে আমি কি করবো তার এই তথাকথিত ভালোবাসা দিয়ে? আমি তো সেটা চাই-ই না।”

“ভালোবাসা কে না চায়, আহি?”

“আমার কাছে আত্মসম্মানবোধ ভালোবাসার ঊর্ধ্বে। যার আত্মসম্মানবোধ নেই, সে এমন সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে চায়।”

আহি কথাটি বলেই সেখান থেকে চলে গেলো। আর দোয়েল মলিন মুখে সিঁড়ির কাছে যেতেই পাশের বারান্দা থেকে ফিসফিস শব্দ আসায় থমকে দাঁড়ালো। সে কিছু একটা ভেবে ধীর পায়ে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো। দেখলো সরওয়ার চুনির কোমড় জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর চুনি সরওয়ারকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য দেখে দোয়েলের চোখে অশ্রু জমতে শুরু করলো। সে বারান্দার দরজায় ইচ্ছে করে ধাক্কা দিতেই সরওয়ারের হাত আলগা হয়ে গেলো। আর চুনি মুক্তি পেয়ে দৌঁড়ে নিচে নেমে গেলো। সরওয়ার দরজার কাছে দোয়েলকে দেখে রাগী স্বরে বলল,
“তুই আর আসার সময় পেলি না!”

কথাটি বলেই সরওয়ার দোয়েলকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়েই চলে গেলো। দোয়েল দরজা ধরে দাঁড়িয়ে মলিন হেসে বলল,
“এটাই আমার নিয়তি। তবুও এই মানুষটাকে ভালোবাসি বলেই তার ভালোবাসার কাঙাল হয়ে আছি। আর এই সংসার থেকে বের হয়েই বা কোথায় যাবো? বাবা-মার অভাবের সংসারে আমি অপয়া ছাড়া কিছুই নই।”

এদিকে চুনি আহির কাছে গিয়ে সরওয়ারের বাজে আচরণের কথা জানাতেই আহি ক্ষেপে গেলো। চুনি আহির রাগ দেখে তার হাত ধরে বলল,
“আফা, ওরা ডায়নিংয়ে বসে খাইতাছে। আপনে কিছু কইয়েন না৷ স্যার-ম্যাডাম আমারেই ভুল বুঝবো।”

আহি ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল,
“কে কি বুঝলো, বুঝলো না, ওটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি আজ ওই খান বংশকে তাদের আসল যোগ্যতা দেখিয়েই ছাড়বো।”

আহি হনহনিয়ে নিচে নামতেই তাজওয়ারের মুখোমুখি হলো। তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“তোমাকে ডাকতেই উপরে উঠছিলাম।”

আহি তাজওয়ারকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“আমাকে পারছো না তাই আমাদের বাড়ির মেয়েকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছো?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো?”

“তোমার ভাইকে জিজ্ঞেস করো, সে কি করেছে!”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে সরওয়ারের দিকে তাকালো। আহির কথা শুনে সরওয়ারের গলায় খাবার আটকে গেলো। সে কাশতে শুরু করলে দোয়েল তার দিকে পানি এগিয়ে দিতে যাবে তখনই আহি এসে পানির গ্লাসটা নিয়ে সরওয়ারের মাথায় ঢেলে দিলো। সরওয়ার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই রিজওয়ান কবির চেঁচিয়ে বললেন,
“আহি, এসব কেমন অভদ্রতা?”

আহি সরওয়ারের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“এই অসভ্য লোকটা চুনির সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। জোরজবরদস্তি করতে চেয়েছে।”

মিসেস লাবণি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন,
“কে বলেছে তোমাকে এসব কথা? ওই চুনি বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আর তুমি বিশ্বাস করেছো? এসব মেয়েগুলোকে আমার ভালোই চেনা আছে। বড় ঘরের ছেলেদের সাথে নিজেরাই ঘেঁষতে চাইবে, তারপর একটু স্পর্শ পেলেই ন্যাকা কান্না জুড়ে দেবে।”

মুনিয়া খালা নিজের মেয়ের নামে এমন কথা শুনে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু আহি চুপ থাকলো না। প্রতিত্তোরে বলল,
“আরেহ হ্যাঁ, আপনি তো এসব মেয়েদের ভালোই চিনবেন। নিজেও তো একই কাজ করেছিলেন।”

রিজওয়ান কবির আহির কথা শুনে তার দিকে তেড়ে এসে সশব্দে তার গালে চড় বসিয়ে দিলো। তাজওয়ার আহিকে নিজের কাছে টেনে এনে রাগী কন্ঠে বলল,
“মিস্টার রিজওয়ান কবির, আপনি আমার সামনে আমার ফিয়োন্সের গায়ে হাত তুলেছেন কোন সাহসে?”

আহি গালে হাত দিয়েই তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আহির গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“ওর উপর এখন আমার অধিকার। ওকে শাসন করতে হলে, আমিই করবো।”

এরপর তাজওয়ার সরওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাই, আমি তো জানি তুমি কেমন! তাই তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে নিজের গুণকীর্তন গাইতে হবে না।”

তাজওয়ার এবার রেহানা খানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মা, আজ সবার সামনে জানিয়ে দিচ্ছি। সরওয়ার খান যদি আমার আর আহির কোনো অনুষ্ঠানে আসে, তাহলে আমি খুব বাজে কিছু করে বসবো। আর এই বাড়িতে দ্বিতীয়বার যেন সে না আসে।”

তাজওয়ারের কথায় সরওয়ারের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে হনহনিয়ে আহিদের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। সরওয়ার চলে যেতেই তাজওয়ার লাবণিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মিসেস কবির, প্লিজ আহির কথায় কিছু মনে করবেন না। ও যা বলেছে ফ্রাস্ট্রেশন থেকে বলেছে। কিন্তু মন থেকে ও খুব সফট। একদম ফুলের মতো।”

আহি অবাক হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে টেনে বাগানের কাছে নিয়ে গেলো। আহি সেখানে গিয়েই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য তুমি যে-কোনো কিছু কর‍তে পারো। ইন্টারেস্টিং!”

তাজওয়ার হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“তোমার আর নিজের প্রাণ নেওয়া ছাড়া আমি সব কর‍তে পারবো।”

“নিজের প্রাণ নিয়ে আমাকে উদ্ধার করলে বেশি ভালো হতো।”

“আই লাভ মাইসেল্ফ, আহি। আমি নিজেকে ভালোবাসি বলেই তো তোমাকে চাই। কারণ আমার ভালো থাকা তোমাতেই সীমাবদ্ধ। তুমি ছাড়া আমি শূন্য। আর আমি ছাড়া তুমি ধ্বংস।”

২৪।

আহি আর রাদ ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগেই তারা মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। এদিকে লাবীব আর পুষ্পের মধ্যে চলছে বাগবিতণ্ডা। ছোট একটা বিষয় নিয়েই তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি চলছে। রাদ আর আহি একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আহির চোখ গেলো ভার্সিটির গেটের দিকে। আর মুহূর্তেই তার পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। আহিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাদ তার কাঁধে হাত রাখতেই আহি তার শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। রাদ শক্ত করে আহিকে ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোর!”

আহির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার চোখের সামনে বার-বার সেই বর্ষার রাতটি ভেসে উঠছে। সে উলটো দিকে ফিরে রাদের শার্ট খামচে ধরে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আফিফ রাফাত।”

আফিফের নাম শুনে রাদ সামনে তাকালো। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। পরণে সাদা শার্ট। কাঁধে অফিস ব্যাগ। কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। রাদ চাপা স্বরে বলল,
“এটাই আফিফ।”

আহি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আহির চোখ দু’টি ভিজে যাচ্ছে। রাদ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আহিকে শক্ত করে ধরে বলল,
“আহি রিল্যাক্স। পাব্লিক প্লেসে এমন করিস না। শান্ত হো।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার শরীরটা নিথর হয়ে যাচ্ছে, রাদ। আমাকে বাঁচা। ও কেন আমার সামনে এসেছে? আমি যদি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি, লোকে আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলবে।”

রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“পাগল না-কি তুই!”

“দেখ না, তাজওয়ার জোর করে আমাকে নিজের করে নিতে চাইছে। আর সবাই ওকে বলছে প্রেমিক পুরুষ। এমন ভালোবাসা না-কি সব মেয়েরাই চায়। তাহলে আমি একটু চাইতে গেলে সবাই আমাকে বেহায়া কেন বলে? আমি তো আফিফকে জোর করি নি। আমি তো ওকে শুধু নীরবে ভালোবেসেছি।”

রাদ আহিকে জড়িয়ে ধরতেই লাবীব আর পুষ্প তাদের দিকে তাকালো। পুষ্প গালে হাত দিয়ে বলল,
“বাহ, এদের তো দারুণ রোমান্টিক মুহূর্ত শুরু হয়েছে।”

লাবীব পুষ্পের দিকে তাকালো। সে নিজেই বুঝতে পারছে না হঠাৎ তাদের কি হলো। একটু পর রাদ আহিকে ছেড়ে দিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল,
“চল তোকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। আফিফকে আর দেখা যাচ্ছে না।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“রাদ, ও এখানে কি করছে?”

রাদ গভীর ভাবনায় চলে গেছে। আহি আবার বলল,
“ওর তো অনেক আগেই বের হয়ে যাওয়ার কথা।”

রাদ অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“হয়তো প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“এভাবে বলিস না রাদ। আমি আর ও একই ডিপার্টমেন্টের। ও যদি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর হয়, তাহলে আমি কোথায় যাবো?”

রাদ আহির হাত নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলল,
“তুই একটু শক্ত হো। পৃথিবীটা গোল। একদিন না একদিন তোর আফিফের সামনে দাঁড়াতেই হতো। নিজেকে প্রস্তুত কর। ওর সামনে যাতে তোর দুর্বলতা প্রকাশ না পায়।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-১১+১২ এবং বোনাস পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১১||

১৬।
আহির দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে আছে তাজওয়ার। আহি তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। তাজওয়ার আহির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি আমার কাছে খুবই স্পেশাল, আহি। এতো সহজে আমি তোমাকে পেতে চাই না। ধীরে ধীরে তোমাকে নিজের করে নেবো। তোমার বাবার কাছে হয়তো তুমি ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু আমার কাছে ডায়মন্ড।”

আহি তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তোমার মতো অসভ্য লোকেদের কাছে সব মেয়েরাই ডায়মন্ড। তোমাকে আমি অনেক ভালো করে চিনি, তাজওয়ার খান। তুমি আমাকে তোমার কথার জালে ফাঁসাতে পারবে না।”

“আহি, তুমি আমাকে মানুষ হিসেবে চিনেছো, প্রেমিক হিসেবে চিনো নি। অন্যদের কাছে আমি অসভ্য হলেও তোমার কাছে আমি বরাবরই সভ্য। তুমি মানতে না চাইলে আমার কিছুই করার নেই। তবে মনে রেখো, আমি তোমাকে যে-কোনো মূল্যেই চাই।”

তাজওয়ার কথাটি বলেই আহির গালে তার অধর স্পর্শ করতে যাবে তখনই আহি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তাজওয়ার তাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে ঠেকে গেলো। সে আহির দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“যেই জিনিস আমার ভালো লাগে, তা আমি নিজের করেই ছাড়ি। এর জন্য যদি আমাকে তার ক্ষতি করতে হয়, আমি একবারো ভাববো না।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি মানুষ, কোনো পণ্য নই।”

তাজওয়ার রুমের বাইরে এসে দরজা টেনে দিতে গিয়ে আবার খুলে বাঁকা হেসে বলল,
“তুমি আমার পণ্য। আমি তোমাকে কিনে নিচ্ছি। মাইন্ড ইট।”

তারপর ধড়াম করে দরজা আটকে দিয়ে চলে গেলো। তাজওয়ার চলে যেতেই আহি দৌঁড়ে এসে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। এরপর দরজা ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়লো। সবকিছুই তার শূন্যের উপর ভাসছে। কোন উদ্দেশ্যে সে পৃথিবীতে এসেছে, সেটা সে নিজেই জানে না। বাবা সন্তানের রক্ষক হয়। আর তার বাবা একজন কাপুরুষ। হাঁটুতে কপালে ঠেকিয়ে আহি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। হয়তো কাঁদার জন্যই তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।

(***)

তাজওয়ার খান আহির বাবা রিজওয়ান কবিরের বাল্যবন্ধু সিরাজ খানের ছোট ছেলে। সিরাজ খান নিজেই অনেক বড় ব্যবসায়ী। আবার তার দুই ছেলে সরওয়ার খান আর তাজওয়ার খানের আলাদা ব্যবসা আছে। বংশগত ঐতিহ্যকে ডুবিয়ে দিয়ে তারা অসৎ উপায়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। সিরাজ খান দেশে দূর্নীতি মামলা খেয়ে আমেরিকায় পলাতক আছেন। প্রায় দশ বছর ধরে তিনি দেশেই আসেন নি। স্ত্রী রেহানা খানকে রেখেই তিনি পালিয়েছেন৷ বর্তমানে আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছেন। বিন্দাস চলছেন তিনি। অন্যদিকে তার বড় ছেলে সরওয়ার খান তার অর্ধেক বয়সী গরিব ঘরের এক মেয়েকে বিয়ে করে এনে দিন-রাত তাদের সংসারে খাটাচ্ছে। আহি মেয়েটিকে একবার দেখেছিল। নাম দোয়েল। মেয়েটা দোয়েলের মতোই সুন্দর দেখতে। কিন্তু দেখে মনে হবে না সে শিল্পপতির স্ত্রী। স্বামীর অবহেলায় তার সর্বাঙ্গে মলিনতা ছেয়ে গেছে। প্রতি রাতে সরওয়ার নতুন নতুন মেয়ে ঘরে এনে আমোদ-ফূর্তি করে। আর দোয়েল নীরবে অশ্রু মুছে। সরওয়ারের কাছের দুই বন্ধু ফারিদ আর কাইসারের কুনজর দোয়েলের দিকে সর্বদাই থাকে। স্বামীর কাছে কয়েক বার অভিযোগ করায় উলটো মার খেতে হয়েছে তাকে। সরওয়ার এমন নিচু স্তরের মানুষ যে তার বন্ধুদের এমন আবদারে তার কোনো আপত্তি নেই। তবে দোয়েল শাশুড়ীর কারণেই নিজের সম্মান রক্ষা করে এখনো সেই সংসারে ঠিকে আছে। শাশুড়ি না থাকলে অনেক আগেই সরওয়ারের বন্ধুদের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হতো তার। এদিকে তাজওয়ার খানও কোনো অংশে কম নয়। অনেকগুলো মেয়ের সাথেই তার প্রেমের সম্পর্কের গুঞ্জন মিডিয়াতে মাঝে মাঝেই প্রকাশ পায়। তাজওয়ারের বন্ধুগুলোও নামি-দামি পরিবারের বিগড়ে যাওয়া সন্তান। দুই বছর আগে সবকটার নামে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে তারা জামিন পেয়ে গেছে। পরবর্তীতে যেই মেয়ে এই মামলা করেছিল, তার পুরো পরিবার এখনো নিঁখোজ। বেশ কয়েক মাস ছাত্র-ছাত্রীরা প্লেকার্ড আর ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু এখন মেয়েটা কারো মস্তিষ্কেই আর বেঁচে নেই। নতুন-নতুন মশলাযুক্ত খবর এসে পুরোনো খবরগুলোকে দাফন করে দিয়ে গেছে। তবে তাজওয়ার সেই কলঙ্ক থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়েছিল, কারণ সে বাবার সাথে দেখা করার জন্য সেই সময় আমেরিকায় গিয়েছিল। যদিও সে এই অঘটন ঘটিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল কি-না সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

তাজওয়ার আর তার পরিবার সম্পর্কে এমন ভয়ংকর সব তথ্য আহি ভালোভাবেই জানতো। তাজওয়ার আহিকে ভালোবাসে কি বাসে না, এটা আহির কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে সে কোনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা দিতে চায় না। যদি সে আফিফকে ভালো না বাসতো, তবুও সে এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইতো না। এমনকি কোনো বাবাও নিজের মেয়েকে এমন পরিবারে বিয়ে দিতে চাইবেন না। কিন্তু আহির কপালে এমন মন্দ রেখার স্পর্শ পড়েছে যে তার কোনো দিক দিয়েই পালানোর পথ নেই।

(***)

গভীর রাত। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সুবর্ণ মঞ্জিলের বাইরে পাহারারত দারোয়ানরা ঝিমুচ্ছে। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে বাড়ির ভেতরে সব বাতি নেভানো। জানালাগুলোও সব বন্ধ, শুধু একটা জানালা উন্মুক্ত। আর সেই জানালার বাইরে ঝুলছে ঘন কালো কেশগুচ্ছ। হালকা হাওয়ায় তা নৃত্য করছে। আর অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি অবয়ব সেই জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
আহি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে কেউ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচমকা তার কানের কাছে ভারী নিঃশ্বাস ধাক্কা খেলো। এবার আহির গলা কাঁপতে লাগলো। চোখ খুলবে কি খুলবে না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। আহি তার পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ বন্ধ রেখেই আওয়াজ করতে যাবে তখনই সে তার ঠোঁটে আলতো স্পর্শ পেলো। কেউ তার অধর জোড়ায় আঙ্গুল ছুঁয়ে দিয়েছে। এবার আহির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। তার বুকটা ধরফর করছে। নিঃশ্বাস যেন আটকে আছে। আহি বুঝতে পারছে তার সাথে কি হচ্ছে, কিন্তু সে নিরুপায়। হঠাৎ সেই সুধাময় সুর তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি এসেছো? আমি তোমার অপেক্ষায় কতো রাত জেগেছি। আমাকে ফেলে কেন চলে গিয়েছিলে? তুমি কি জানতে চাও না, আমার উত্তর? জানতে চাও না, তোমাকে নিয়ে আমার অনুভূতি?”

আহি জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। তার শরীর যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। বালিশ শক্ত করে চেপে ধরে চোখ খুললো আহি। চোখ খুলতেই সব আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। অন্ধকার ঘরে আহি ছাড়া কেউ নেই। মাথা তুলে জানালার বাইরে তাকালো আহি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো ঠিকই জ্বলছে। রাস্তায় কোনো অবয়ব নেই। পাহারাদাররা নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। নীরব পরিবেশে দুই পাহারাদারের কথোপকথন হালকা গুজন সৃষ্টি করেছে। তাহলে এতোক্ষণ পুরোটাই কি আহির স্বপ্ন ছিল? আহি ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এ আর নতুন কি! গত চার বছর ধরেই সে মাঝরাতে আফিফের কন্ঠের স্বর শুনতে পায়। লন্ডনেও এমনটা হতো। তার সমস্যাটা রাদই প্রথমে ধরেছিল। লন্ডনে থাকাবস্থায় একদিন রাতে আহির খুব জ্বর এসেছিল। সে বিছানা থেকে উঠতেই পারছিলো না। তাই রাদকে বাসায় আসতে বলেছিল। সেদিন রাতে রাদ খেয়াল করলো আহি নিজের ঘরে একা একা কথা বলছে। আহির ঘরে উঁকি দিতেই রাদ দেখলো আহি এমনভাবে কথা বলছে যেন সামনে কেউ বসে আছে। আফিফের ব্যাপারটা রাদ সেদিনই জানতে পেরেছিল। পরবর্তীতে রাদ নিজেই আহিকে ডাক্তার দেখিয়েছিল। ডাক্তার জানিয়েছে, আহি সিজোফ্রেনিয়া নামক মারাত্মক মানসিক রোগে ভুগছে। তিনি শীগ্রই আহির চিকিৎসা শুরু করতে বলেছিলেন। কিন্তু আহি দ্বিতীয় বার আর সেই ডাক্তারের কাছে যায় নি। এমনকি রাদকে কড়া ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সে যদি না বলে তাকে কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, তাহলে তার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেবে। রাদ বুঝতে পেরেছে আহি মুখে যতোই বলুক, সে আফিফকে ভুলতে চায়। কিন্তু তার মন আফিফকে ভুলতে চায় না। বরং আফিফকে কল্পনা করেই আহি সুখে থাকে।

(***)

আহি চুপচাপ অন্ধকারে বিছানায় বসে আছে। সে তার হাত এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“এআর, আমার হাতটা একটু ধরো। আমার চেয়ে বেশি কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না। আমার ভালোবাসাটা একটু বোঝো। সবে তো চব্বিশ চলছে আমার। আরো কতো যুগ পড়ে আছে। আমি চারটা বছর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এতোগুলো যুগ কীভাবে পার করবো? ভালোবাসি, এআর। হয়তো তুমি সারাজীবন আমার কাল্পনিক প্রেমিক হয়ে থাকবে। তোমাকে একটু ছুঁয়ে দিতে গেলেই তুমি মেঘের মতো মিলিয়ে যাবে। আমি তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য ছুটতেই থাকবো। কিন্তু তুমি কখনো আমার স্পর্শ পাবে না।”

আহি জানালার পাশে এসে বসলো। দুই পা জানালার বাইরে বের করে দিয়ে এক দৃষ্টিতে ল্যাম্পপোস্টগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে গেলো অতীতে।

………………………….

এক বছরের বেশি সময় ধরে আফিফকে চেনে আহি। সেদিন মাধ্যমিক বিভাগের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার সেই পরীক্ষাটা হতো। তাত্ত্বিক বিষয়ের পাশাপাশি চিত্রায়ণ, প্রাচ্যকলা, গ্রাফিক ডিজাইনের পরীক্ষা। কিন্তু আফিফ একটা পরীক্ষাও দেয় নি। আহি আফিফের সিটটা খালি দেখে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষায় দিতে পারছিলো না। এক মাস পর মাধ্যমিক বিভাগের পরের সেশন শুরু হয়ে যায়। আর আহি তৃতীয় স্থান নিয়ে অন্য সেশনে ভর্তি হয়ে যায়। সে ধরেই নিয়েছিল আফিফকে দেখার জন্য তাকে পূর্ব সেশনের ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো ছিল। আফিফ দ্বিতীয় সেশনেই ভর্তি হয়েছে। এরপর স্যার এসে সবাইকে বলল, আফিফের বড় বোন মারা যাওয়ায় সে পরীক্ষা দিতে পারে নি। পরে সে চারদিনের মধ্যে আলাদা ভাবে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় সেশনে ভর্তি হয়েছে। সেদিন আফিফের মুখটা আরো বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সে চোখ তুলে কারো দিকে তাকায় নি। মনে হচ্ছে সে মারাত্মক অপরাধী। এভাবে দু’মাস কেটে গেলো। শীগ্রই ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনী মেলা শুরু হবে। চারুশিল্পে প্রায়ই মেলা হয়৷ ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের আঁকা ছবি বিক্রি করে টাকা আয় করতে পারে। বেশি ছবি বিক্রি করতে পারলে চারুশিল্প থেকেই তাকে পুরষ্কৃত করা হবে।
আফিফ দুই সপ্তাহ ক্লাসে না এসে সেই মেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। দুই সপ্তাহ পর মেলায় আটটা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে এলো আফিফ। প্রতি ক্যালিগ্রাফির দাম পাঁচশো টাকা। নিঁখুত ভাবে সে এঁকেছিল। রঙের মিশ্রণটাই বেশি সুন্দর ছিল। সালমা ফাওজিয়াও মেয়ের সাথে মেলায় এসেছিলেন। আহি তার মাকে বার-বার আফিফের ক্যালিগ্রাফিগুলো কিনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলো। এতো টাকা আহির হাতে সেই মুহূর্তে ছিল না। সে অন্তত একটা কিনতে পারবে। কিন্তু সালমা ফাওজিয়া তো মেয়ের অস্থিরতা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি মেলায় ঘুরতে ব্যস্ত। আহি শেষমেশ নিজেই আফিফের স্টলের সামনে এসে বলল,
“আমি একটা কিনতে চাচ্ছি।”

আহির কন্ঠ শুনে আফিফ তার দিকে তাকালো। এই প্রথম তাদের চোখাচোখি হলো। আফিফের চোখাচোখি হতেই আহির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আফিফ নিজের হাতে কাগজে মুড়িয়ে আহিকে ক্যালিগ্রাফিটা দিয়ে দিলো। যতোক্ষণ আফিফ কাগজ ক্যালিগ্রাফিটা বাঁধায় ব্যস্ত ছিলো, ঠিক ততক্ষণ আহি তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এতো কাছ থেকে আফিফকে দেখার সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় নি। আহি ছয়শো টাকা দিয়ে চলে যেতে নেবে তখনই আফিফ পিছু ডেকে বলল,
“আপনি একশো টাকা বেশি দিয়েছেন।”

আহি আফিফের চোখে চোখ রেখে বলল,
“মাত্র পাঁচশো টাকা দিয়ে বিক্রি করছেন? এর মূল্য তো এর চেয়ে বেশি হওয়া উচিত।”

আফিফ নিরুত্তর ছিল। আহি মনে মনে বলল,
“আমার কাছে তোমার প্রতিটা জিনিসের মূল্য অনেক বেশি, এআর। টাকা দিয়েও এর মূল্য ঠিক করা যাবে না।”

এবার আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফিফকে বলল,
“আমি এমন ক্যালিগ্রাফি অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাই নি। তাই একশো টাকা বেশি দিয়েছি। কারণ আমি যা খুঁজছিলাম, তা আপনার জন্য সময়ের মধ্যে পেয়ে গেছি।”

আফিফ প্রতিত্তোরে মুচকি হেসে ধন্যবাদ দিলো। আহিও পেছন ফিরে চলে এলো। আফিফের দিকে আর তাকানোর সাহস নেই তার৷ আজকের এই চমৎকার দিন আহি কখনো ভুলতে পারবে না। এদিকে সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কর্মকান্ড দেখছেন। একটা ক্যালিগ্রাফি কিনে তার মেয়ে এতো খুশি? তাও আবার সেই ছেলের কাছ থেকে, যার কাছ থেকে এতোক্ষণ ক্যালিগ্রাফি কেনার জন্য আহি জোরাজোরি করছিল। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের খুশির জন্য আফিফের সব ক’টা ক্যালিগ্রাফি কিনে নিলেন। সব বিক্রি হওয়ায় আফিফের চোখেও অশ্রু ভীড় করছে। আহি তা দেখে মায়ের কাছে এসে তার হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ মা। তুমি অনেক ভালো।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের থুতনি ধরে বললেন,
“ছেলেটা কে?”

আহি লাজুক হেসে বলল,
“এখনো তো কেউ না। কিন্তু ও অনেক ভালো। ভালো ছবি আঁকে। বলতে পারো অতি উত্তম।”

সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“তুমি কি এই ছেলের জন্য নামাজ ধরেছিলে?”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, ও তো মসজিদে গিয়ে পড়ে। আমি দেখেছি, মা। ও বাবার চেয়েও ভালো। আমায় কখনো মারবে না।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কথায় থমকে গেলেন। আহিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“এভাবে বলে না, মা। তুমি আমার শাহজাদী। তোমার জীবনে যে আসবে সে তোমাকে সম্রাজ্ঞীর মতো রাখবে।”

(***)

আহি মায়ের সাথে বাসায় ফিরলো না। মায়ের হাতে ক্যালিগ্রাফিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, সে পরে বাসায় আসবে। সালমা ফাওজিয়া বাসায় ফিরে গেলেন। আহি আফিফের অপেক্ষায় বসে আছে। আফিফের সবগুলো চিত্র বিক্রি হয়েছে, তাই সে স্যারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল। স্যার তার নাম টুকে নিয়েছেন। আফিফ আজ ভীষণ খুশি। সে খুশি মনেই বের হয়েছে চারুশিল্প থেকে। আহিও তার পিছু নিয়েছে। আফিফ আজ বাসে উঠলো না। রাস্তার ওপাড়ে যেতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের যাওয়া দেখছে।
ব্যস্ত রাস্তা। ট্রাফিক পুলিশও দেখা যাচ্ছে না। চারদিক থেকে গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। আহি এক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। অজানা ভয় তার মনে ভীড় করতে লাগলো। হঠাৎ চোখের পলকে একটা মিনি বাস এসে আফিফকে ধাক্কা দিলো। রাস্তা ব্যস্ত থাকায় গাড়ির গতি কম ছিল। নয়তো আফিফের শরীরটা হয়তো চাকার নিচেই পড়তো।
আহি এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। দৌঁড়ে আফিফের কাছে গেলো। ততোক্ষণে রাস্তায় ভীড় জমে গেছে। মিনি বাসের ড্রাইভার যাত্রী রেখেই পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যাত্রীরাই তাকে ধরে রেখেছে। রাস্তায় একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“আগে ওকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

ভীড়ের মধ্যে আফিফের নড়নচড়ন না দেখে অনেকেই বলতে লাগলো,
“ছেলেটা হয়তো মারা গেছে।”

আহি আফিফের মাথাটা উঠিয়ে দেখলো মাথার পেছন থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকলে ক্ষতস্থানে সংক্রমণ হবে, তাই আহি আফিফের মাথাটা তার কোলে রাখলো। এরই মধ্যে আফিফকে উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আফিফের কাছে আজকে আয় করা টাকা আর একটা অল্প দামী ফোন ছিল। আহি সেখান থেকেই আফিফের মায়ের নম্বরে কল দিলো। তিনি বিশ মিনিটের মধ্যেই হাসপাতালে চলে এলেন।

(***)

আফিফের মাকে আহি প্রথম দেখছে। আহি তার হাতে আফিফের মানিব্যাগ আর মোবাইলটা দিয়ে বলল,
“আন্টি আমি উনার সাথেই চারুশিল্পে ক্লাস করি। আপনি চিন্তা করবেন না। উনি ঠিক হয়ে যাবেন।”

আফিফের মা, আফিফা বেগম আহির হাত ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,
“আমার ছেলেটা না বাঁচলে আমি শেষ হয়ে যাবো। ও ছাড়া আর কেউ নেই আমার।”

আহি আফিফা বেগমকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল….”

আফিফা বেগম বললেন,
“সে তো অনেক আগেই মারা গেছে। তিন সন্তানকে আমি একাই মানুষ করেছি। আফিফ আমার মেজো ছেলে। আমার বড় মেয়েটা মারা গেছে বেশি দিন হচ্ছে না। এখন আফিফের কিছু হলে আমি বাঁচবো না।”

আফিফা বেগম নিজেই কান্নার সুরে বিড়বিড় করতে লাগলেন,
“আমার ছেলেটা বোনের সম্মান বাঁচানোর জন্য এভাবে পাগলের মতো টাকা জোগাড় করছিল। এখন ওকে বাঁচানোর টাকা আমি কোথা থেকে জোগাড় করবো?”

আহি বেসরকারি হাসপাতালে আফিফকে নিয়ে এসেছিল। হাসপাতালে যেই পরিমাণ খরচ হবে, তা জোগাড় করতেই আফিফা বেগম হিমশিম খেয়ে যাবেন। আহি সেটা বুঝতে পেরে বাসায় এসে মাকে জানালো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের সাথে হাসপাতালে এসে আফিফা বেগমের অগোচরেই কিছু টাকা জমা করিয়ে দিলেন। বাকি টাকা আফিফকে রিলিজ দেওয়ার পর দিতে হবে। আর ওষুধের টাকা তিনি আফিফা বেগমকে নিজ হাতেই দিলেন।
আফিফা বেগম নিরুপায়। হাত পেতে চাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু ছেলের জীবন বাঁচানো এই মুহূর্তে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি বিনাবাক্যে টাকাটা নিয়ে নিলেন। এখন আফিফের রিপোর্ট আসার পরই বোঝা যাবে তার অবস্থা কেমন।

এদিকে বাসায় আসার পর আহি তার পরণের জামাটা খুলে রেখে দিতেই সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কাছে এসে বললেন,
“কি করছো, আহি? মুনিয়াকে জামাটা দিয়ে দাও। ও ধুয়ে দিক।”

আহি চকিত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। সে কোনো ভাবেই এই জামা ধুতে দেবে না। আফিফের রক্ত তার জামায় লেগে আছে। এই জামায় আফিফের স্পর্শ আছে। সে এটাতে ছিঁটেফোঁটা পানিও লাগাবে না। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে বললেন,
“আমার মনে হয় না তোমার বাবা এই সম্পর্ক কখনো মেনে নেবেন। আর তুমি এখনো ক্লাস টেনে পড়ো। তুমি অনেক ছোট। আগে বড় হও। তারপর এসব নিয়ে ভেবো।”

আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“আমার ওকে ছাড়া চলবে না মা। আমি ওকে ভালোবাসি।”

“আমি চাইলে তোমাকে বকা দিতে পারি। কিন্তু দেবো না। একটা কথা মনে রেখো, তোমার বাবার বিরুদ্ধে যাওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখন তোমার জন্য সেই ছেলের কোনো ক্ষতি না হলেই হলো। তুমি বড় হলে আমার কথাটা ঠিক বুঝবে। আপতত তুমি ওর সাথে কোনো সম্পর্কে যেও না। ওকে ভালো একটা ভবিষ্যৎ গড়তে দাও। তুমিও নিজের পায়ে দাঁড়াও, যাতে নিজের ভালোবাসার জন্য সবার বিরুদ্ধে যেতে পারো। এমন একটা ক্যারিয়ার গড়ো, যাতে তোমার নাম তোমার বাবার চেয়েও উপরে থাকে। তখনই তুমি সব জয় করতে পারবে।”

………………….

আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মায়ের কথাটা ঠিক ছিল। বাবার চেয়ে উপরে না উঠলে, সে বাবার বিরুদ্ধে কখনোই যেতে পারবে না।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১২||

১৭।
সূর্যোদয়ের আগমুহূর্তে আকাশটা তার অভূতপূর্ব রূপের প্রকাশ ঘটায়। নীরধর শব্দহীন তরঙ্গের খেলায় মেতে উঠে। তার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় লালচে আভা। যেই আভা নীরধরের রূপ ঝলসে দেয়। আহি মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“গগণের মেঘ আজ মিলেমিশে একাকার।
ভূমিতে বসে আমি তোমার ভাবনায় বেসামাল।
শিল্পী আজ রঙ হারিয়েছে, বে-রঙিন হাল তার।
তোমায় ছুঁতে এতো কারণ, তবে কেন হয়েছিলে আমার প্রিয় বর্ষাকাল?”

“একা একা কার সাথে কথা বলছো?”

রিজওয়ান কবিরের কণ্ঠ শুনে আহি চমকে উঠলো। পাশ ফিরে বাবাকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। রিজওয়ান কবির আহিকে ইশারায় বসতে বললেন। আহিও চুপচাপ বসে পড়লো।

(***)

বাগানের বেঞ্চে রিজওয়ান কবির আর আহি পাশাপাশি বসে আছে। অনেকক্ষণ যাবত দু’জনই নীরব। আহি কখনোই তার বাবাকে অনর্থক বসে থাকতে দেখে নি। বাগানে বসলে তার হাতে পত্রিকা বা ফোন বা ল্যাপটপ যে-কোনো একটা থাকবেই। আজ তিনি হঠাৎ এমন শান্ত হয়ে কেন আহির পাশে বসে আছেন, এই প্রশ্নটাই এই মুহূর্তে আহির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে রিজওয়ান কবির বললেন,
“তুমি অনেকদিন পর দেশে এসেছো। বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাও।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“লিনাশার সাথে কথা হয়েছে?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“সেই পরিস্থিতি তো আর নেই। আপনার জন্য আমি সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি।”

“দেখো আহি, বন্ধুত্ব বলতে কিছুই নেই। সবাই শুধু প্রয়োজনে পাশে থাকে। তুমি নিজেই এর প্রমাণ দেখেছো। আমি কিছু করি নি। তোমার প্রিয় বান্ধবী যদি তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে না চায়, সেখানে আমার দোষ কোথায়?”

আহি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রিজওয়ান কবির বললেন,
“তুমি যদি মনে করো, কেউ তোমাকে ভালোবাসে, এটা তোমার ভুল ধারণা। এই পৃথিবীতে তোমাকে কেউ ভালোবাসে না। তোমার মা তোমাকে রেখেই চলে গেছে। গত চার বছরে একবারো তোমার খোঁজ নেয় নি। লিনাশার সাথে কতো বার দেখা হলো। সে কখনো তোমার কথা জিজ্ঞেস করে নি। আর তোমার সেই বন্ধু… কি নাম যেন? রিদমাম রাদ। শোনো আহি, ছেলেরা কখনো বন্ধু হয় না। সে নিশ্চয় কোনো লোভে পড়ে তোমার আগে-পিছে ঘুরছে।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে লাগলো। রিজওয়ান কবির আবার বললেন,
“একমাত্র তাজওয়ার তোমাকে ভালোবাসে।”

আহি এবার রাগী স্বরে বলল,
“সে আমাকে ভালোবাসে না। তার পৃথিবীর সব মেয়েকেই ভালো লাগে। নিশ্চয় এর চেয়ে বেশি ভেঙে আপনাকে বলতে হবে না! আমি আপনার মেয়ে। কিন্তু আমার মনেই হয় না আমি আপনার আসল সন্তান।”

রিজওয়ান কবির বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তুমি আমার সন্তান, তাই তোমার উপর অধিকার প্রয়োগ করতে পারছি। জীবন আমার কাছে বিজনেস ফিল্ড। যেখানে প্রফিট আমরা সেখানেই আমাদের সম্পদ ইনভেস্ট করি। তাজওয়ারকে বিয়ে করলে তুমি একাই কোটি কোটি টাকার মালিক হবে। সাথে আমিও সেই অংশের ভাগ পাবো।”

আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। রিজওয়ান কবির গম্ভীরমুখে বললেন,
“দুপুরের আগে তাজওয়ার এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”

“অবশ্যই তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য। এছাড়া আর কোনো কারণ তো থাকবে না।”

“বাবা, আমি ওর সাথে সেইফ না।”

“আই ডোন্ট কেয়া’র। সেইফ হও বা না হও। তোমার ডেস্টিনি তাজওয়ার খানই হবে।”

(***)

আড়মোড়া ভেঙ্গে সামনে তাকাতেই আহি চিৎকার করতে যাবে তখনই তাজওয়ার লাফিয়ে এসে আহির উপর উঠে তার মুখ চেপে ধরলো। আহি চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে আহির পাশে শুয়ে পড়তেই আহি ধাক্কা দিয়ে তাজওয়ারকে বিছানা থেকে ফেলে দিলো। তাজওয়ার মেঝেতে শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে দু’হাত মাথার পেছনে দিয়ে বলল,
“ঘুমন্ত আহিকে দেখে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। যাও আরেকটু ঘুমাও। আমি তোমাকে আরেকটু ভালোভাবে দেখবো।”

আহি বিছানার উপর দাঁড়িয়ে কোমড়ে দুই হাত রেখে চোখ ছোট করে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ারের ঠোঁটে হাসি। আহি চেঁচিয়ে ডাকলো,
“চাঁদনি! চাঁদনি…”

তাজওয়ার আহিকে চেঁচাতে দেখে আহির বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লো। আহি লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে রাগী কন্ঠে বলল,
“তোমার এতো বড় সাহস, তুমি আমার রুমে আমার পারমিশন ছাড়া ঢুকেছ?”

“তোমার রুমে, তোমার মনে, এককথায় তুমি মানেই নো পারমিশন।”

এদিকে চুনি আহির ডাকে দৌঁড়ে তার ঘরে ঢুকে তাজওয়ারকে বিছানায় দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো। আহি চুনির চাহনি দেখে বলল,
“তুমি এভাবে কি দেখছো? আর এই ছেলে আমার রুমে কিভাবে ঢুকেছে?”

চুনি উত্তর দেওয়ার আগেই তাজওয়ার বলল,
“চাঁদ, তুমি যাও। আমি আমার মিসেসকে এক্সপ্লেইন করছি।”

তাজওয়ারের মুখে চাঁদ সম্বোধন শুনে চুনি সপ্তম আকাশে উঠে গেলো। সে যাওয়ার আগে নিচু স্বরে বলল,
“স্যার, আপনে ভালো ইংরাজি বলেন। আপনে ঘরে আইলে আমার লগে ইংরাজিতে কথা বইলেন। আমি ইংরাজি ছাড়া কিছু বুজি না৷ আপনেরে ইংরাজিতে একশো দিলাম।”

আহি চেঁচিয়ে চুনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমার ভাংরেজির বিজ্ঞাপন শেষ হলে এখান থেকে যাও।”

চুনি মুখ ছোট করে বলল, “আফাই তো ডাকলেন।”

তাজওয়ার মাথা নেড়ে বলল,
“একদম ঠিক। তুমি নিজে ডেকেই মেয়েটাকে বকে দিলে। আর ভাংরেজি মানে কি?”

আহি বলল, “ভাঙা ভাঙা ইংরেজি।”

“বাহ, তুমি কি শব্দ আবিষ্কারও করো না-কি?”

“এসব এপার-ওপারের কথা রেখে উত্তর দাও, এখানে কিভাবে এসেছো?”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার ইয়াং মাদার-ইন-ল আমাকে তোমার রুমের চাবি দিয়েছিল। এখন থেকে চাবিটা আমার কাছেই থাকবে। আমার যখন ইচ্ছে আমি তখন তোমার কাছে চলে আসবো।”

“আমি দোয়েল ভাবী নই। তাই আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টাও করবে না।”

আহির কথা শুনে তাজওয়ারের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে আহির বিছানা থেকে উঠে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। আহি শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার হুট করে আহির গালে তার অধর ছুঁয়ে দিতেই আহি চমকে উঠলো। সে পিছু যেতে নিবে তখনই তাজওয়ার তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“আমি সরওয়ার খান নই। আমি তাজওয়ার খান। আর তুমি রক্ষিতা নও। তুমি আমার অভিমান।”

“যার কাছে এক নারী রক্ষিতা, তার কাছে অন্য নারী অভিমান হতে পারে না।”

“সব নারীকে ভালোবাসা যায় না। ভালো একজনকেই বাসা যায়।”

“আমি তোমার মতো অসভ্য লোকের ভালোবাসা চাই না।”

“তোমাকে চায়তে কে বলেছে? আমি চাইলেই হলো। এখন ঝটপট তৈরী হয়ে নাও।”

“হবো না।”

তাজওয়ার কপালে আঙ্গুল ঘষে বলল,
“আমি তো তোমাকে সরাসরি জোর করতে পারবো না। তবে ভিন্ন পন্থায় আমার ইচ্ছে পূরণ করেই ছাড়বো। তখন তোমার বাবা যদি কারো ক্ষতি করে বসে, তার জন্য তুমি আর তোমার বাবা দায়ী। আমি এর মধ্যে নেই।”

(***)

আহিকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাজওয়ারের সাথে বের হতে হলো। গাড়িতে উঠেই তাজওয়ার আহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আহি এক নজর ড্রাইভারের দিকে তাকালো। ড্রাইভার মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তবুও আহির ইতস্ততবোধ হচ্ছে। সে বিরক্ত মুখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবো। তখন আশেপাশে কে আছে, কে নেই, এসব পরোয়া করবো না।”

আহি সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরে তাকালো।আর তাজওয়ার মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।
থেমে থেমে গাড়ি চলছে। মাঝে মাঝে হালকা জ্যামে পড়ছে। হঠাৎ গাড়িটা ঘুরে সেই রাস্তার মোড়ে ঢুকলো যেই মোড়ে অনেক বছর আগে আফিফের এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আহির শরীর হঠাৎ কাঁপতে লাগলো। সে এক দৃষ্টিতে সেই স্থানটির দিকে তাকিয়ে রইলো যেখানে আফিফের শরীরটা নিথর পড়েছিল। তাজওয়ার মাথা তুলে আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি ঠিক আছো?”

আহি তাজওয়ারের কাছ থেকে সরে বসে বলল,
“তুমি একটু দূরে থাকো। আমার দম বন্ধ লাগছে।”

তাজওয়ার গাড়ির কাচ নামিয়ে দিয়ে বলল,
“হাওয়া আসলে ভালো লাগবে।”

আহি ব্যস্ত রাস্তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির কোনো সাড়া না পেয়ে সোজা হয়ে বসে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

……………………………….

দু’মাস পর সুস্থ হয়ে আফিফ চারুশিল্পে ক্লাস করতে এলো। এই দু’মাস ছিল আহির কাছে দুই যুগের সমান। সে আফিফা বেগমের নম্বরে প্রতিদিন কল দিয়ে আফিফের খবর নিতো। আফিফা বেগমের এই উষ্ণতা ভালোই লাগতো। তিনি আহির অগোচরেই আহিকে পছন্দ করে ফেললেন। কোনো এক অচেনা মেয়ে তার ছেলের জন্য এতো চিন্তা করছে, ভাবতেই তার আনন্দ হচ্ছিলো। তিনি প্রতিদিন আফিফকে বলতেন,
“আজ মিষ্টি মেয়েটা কল দিয়েছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে।”

আফিফ কোনো উত্তর দিতো না। সে এতোটুকুই আন্দাজ করেছে এই মেয়েটা হয়তো সেই মেয়ে, যে তাকে চিরকুট দিয়েছিল, তার ছবি এঁকেছিল, আবার তার জন্য এক জোড়া স্যান্ডেল কিনেছিল, আর কিছুদিন আগেই মেয়েটা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। আফিফ মায়ের কাছে শুনেছে মেয়েটার মা এসে হাসপাতালের বিল দিয়ে গেছেন। আফিফের যখন রক্তের প্রয়োজন ছিল, তখন তারা দাতা জোগাড় করে এনেছিল। আফিফ এখন ভালোভাবেই জানে মেয়েটা তার সাথেই চারুশিল্পে ক্লাস করে। কিন্তু মেয়েটা কে, সেটা আফিফ এখনো জানতে পারে নি। তবে তার জানার আগ্রহটা ঠিকই বেড়ে গেছে। তাই আজ সে মেয়েটা কে তা জানার জন্য ক্লাস শেষে ক্যানভাস নিয়ে চারুশিল্পের মাঠে চলে গেলো। সেখানে বসেই রঙ মাখাতে লাগলো।
এদিকে আহি আফিফকে আজ মাঠে দেখে অবাক হলো। সে ধীর পায়ে তার দিকে এগুতেই আফিফ হঠাৎ পাশ ফিরতেই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো। আফিফ আহিকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কিন্তু আহি এখনো স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আফিফ কেন দৃষ্টি সরাচ্ছে না, সেই প্রশ্নটাই এই মুহূর্তে আহির মনে ধাক্কা খেতে লাগলো। এভাবে আফিফ তাকিয়ে থাকলে সে তো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। আহির চারপাশ কেমন যেন ঘোলা ঘোলা লাগছে। মনে হচ্ছে তার শরীর থেকে কিছু একটা বের হয়ে যেতে চাইছে। আহি নিজেকে স্বাভাবিক করে আফিফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি সেদিন আমার কাছে একটা ক্যালিগ্রাফি বিক্রি করেছিলেন, মনে আছে?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে কিছু একটা ভেবে বলল,
“হ্যাঁ, মনে পড়েছে।”

“আমার মায়ের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তার জন্মদিনে তাকে গিফট করেছিলাম।”

আফিফ মৃদু হাসলো। আহি নিজেও মনে মনে হাসলো। সে কি সুন্দর করে মুখের উপর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে দিলো, আর আফিফ বুঝলোই না? আহি সেখানে আর দাঁড়ালো না। আফিফ যদি বুঝে যায় চিরকুটের মেয়েটা আহি? তাই নিজের আবেগ দমিয়ে রেখে সোজা সামনে চলে গেলো। চলে যাওয়ার সময় তার বার-বার ইচ্ছে করছিলো পেছন ফিরে তাকাতে। কিন্তু পিছু ফিরলেই সে ধরা খেয়ে যাবে। তাই সে হেঁটে চলে গেলো। সেদিন যদি আহি পিছু ফিরতো তাহলে দেখতে পেতো, আফিফ নামের প্রিয় পুরুষটি এক দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিল।

(***)

আহি বাসায় এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। আজ আফিফ তার দিকে তাকিয়েছে। ইশ! এর চেয়ে চমৎকার মুহূর্ত হয়তো আহির জীবনে খুব কম এসেছে। আহি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে তালা দেওয়া বক্সটি খুললো। পলিথিনে মুড়ানো আহির সেই জামা, যেখানে আফিফের রক্তের অস্পষ্ট দাগ এখনো বর্তমান। সালমা ফাওজিয়া জীবাণু ছড়াবে সেই ভয়ে জামাটা ধুয়ে দিয়েছিলেন। জামা ধুয়ে দেওয়ায় আহি দুই দিন খাওয়া-দাওয়া করে নি। শেষে সেই জামাটার গায়ে অস্পষ্ট যেই দাগ রয়ে গিয়েছিলো, ওটাকেই শেষ সম্বল করে আহি জামাটা বক্সে রেখে দিয়েছিল। এখন আহি সেই জামাটা পরেই ইজেলে নতুন ক্যানভাস বসালো। আর বসে পড়লো আজকের মুহূর্তটার ছবি আঁকতে।

খোলা মাঠে বসে একটা ছেলে ছবি আঁকার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ছেলেটা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে।

ছবিটা এঁকেই আহি বলল,
“এআর, এই ভালোবাসার নাম কি দেওয়া যায়?”

নিজের প্রশ্নে নিজেই হাসলো আহি। গানের সুরে বলল,
“রানী কো রাজা সে পিয়ার হো গেয়া…
পেহলি নাযার মে পেহলা পিয়ার হো গেয়া..
দিল জিগার রানী গায়েল হুয়ে
তেরে নাযার দিলকে পার হো গেয়া…
রানী কো রাজা সে পিয়ার হো গেয়া।”

…………………………….

আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই তাজওয়ার তার গা ঘেঁষে বসলো। আহি চোখ মুছতে যাবে তখনই তাজওয়ার বলল, “কেন কাঁদছো?”

আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে। একটু সরে বসলে খুশি হবো।”

তাজওয়ার সরে বসতেই আহি আবার বাইরে তাকালো আর মনে মনে বলল,
“এআর, তুমি আমার জন্য ছবি হয়েই থাকবে। আর সেই ছবির নাম হবে রানীর অস্পর্শে রাজা।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

১৮।
আহি মনোযোগ দিয়ে খাবারের মেন্যু দেখছে। আর তাজওয়ার আহিকে দেখতে ব্যস্ত। কতো মেয়ের সাথেই তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এমনকি দু’জন মেয়ের সাথে এখনো তার সম্পর্ক আছে। দু’জনের মধ্যে একজন ভালোভাবেই জানে তাজওয়ার এই সম্পর্কে আগ্রহী নয়। কিন্তু টাকার লোভে সে তাজওয়ারকে ছাড়ছে না। আর অন্য মেয়েটা বোকাসোকা প্রকৃতির। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে মেয়েটিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিল তাজওয়ার। আহি দেশে আসার পর অনেক চেষ্টা করেছিল সম্পর্কটা শেষ করতে। কিন্তু ছিঁচকাঁদুনী মেয়েটা তাজওয়ারকে ছাড়া পাগলপ্রায়। হুট করে ছেড়ে দিলে মেয়েটা নিশ্চিত উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে। আর এই মুহূর্তে তার ঘাড়ে মামলা উঠলে আহির মনে জায়গা পাওয়া আরো দুষ্কর হয়ে পড়বে। তাই সে ভেবেচিন্তে প্রতিটা পদক্ষেপ নিচ্ছে। অন্যদিকে আহির সাথে তার কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই। তবুও তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখে তাজওয়ার। কোনো মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে তাজওয়ার কখনো মুগ্ধ হয় নি। এমনকি কোনো মেয়েই আজ পর্যন্ত তাজওয়ারকে উপেক্ষা করতে পারে নি। চেহারায় মোটামুটি আকর্ষণ থাকলেও তাজওয়ার যে কাউকে তার কথা দ্বারায় সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করতে পেরেছে। বোকাসোকা মেয়েরা তার কথার জালে সহজেই আটকা পড়ে যায়। আর ধূর্ত মেয়েদের কাছে তাজওয়ার খানের টাকাটাই আকর্ষণের বিষয়বস্তু৷ কিন্তু আহি এসবের ঊর্ধ্বে। তাই হয়তো তাজওয়ার আহির মায়ায় পড়ে গেছে।
এমনিতেই সহজে পেয়ে যাওয়া কোনো কিছুর মূল্য নেই। মানুষের আগ্রহ দুর্লভ বিষয়ের দিকেই একটু বেশি।

(***)

আহি মেন্যু একপাশে রেখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার এখনো আহির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহি তা দেখে বিরক্তির সুরে বলল,
“অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি তুমি অসভ্যের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছো।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“অসভ্যের মতো তাকিয়ে থাকলে তুমি এই সভ্য রেস্টুরেন্টের পরিবর্তে কোনো হোটেল রুমে থাকতে।”

আহি তাজওয়ারের কথায় রেগে গেলো। সে উঠে চলে যেতে যাবে তখনই তাজওয়ার হাত ধরে বলল,
“তোমার কথার উত্তর দিলাম মাত্র। তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?”

আহি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা কর‍তে লাগলো। কিন্তু তাজওয়ার এতো সহজে এই হাত ছাড়বে না। হঠাৎ একটা হাত এসে তাজওয়ারের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকালো। এদিকে হাত ঢিলে হতেই আহি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। রাদকে দেখে আহি বলল,
“তুই এখানে?”

তাজওয়ার আহির সম্বোধনে স্বাভাবিক হয়ে উঠে দাঁড়ালো। রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আহির ফ্রেন্ড?”

রাদ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?”

তাজওয়ার আহির পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখতেই রাদ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তাজওয়ার আহির দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আহির উড বি হাজবেন্ড।”

আহি তাজওয়ারের হাত সরিয়ে দিয়ে রাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“মোটেও না। এ হচ্ছে উড়ে এসে জুড়ে বসা শকুন।”

তাজওয়ার আহির কথা শুনে তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। আহি তাজওয়ারের দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাদের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“চল, আমরা অন্য কোথাও গিয়ে বসি। বাবা আমাকে জোর করে এই লোকটার সাথে পাঠিয়েছে। আমার একদম ইচ্ছে ছিল না।”

তাজওয়ারের হাত মুঠো হয়ে এলো। সে আহিকে এক ঝটকায় নিজের কাছে টেনে এনে চাপা স্বরে বলল,
“তুমি বদ্ধ ঘরে আমাকে শত অপমান করো, আমি কিচ্ছু বলবো না। কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে এমন ব্যবহার আমি একদম সহ্য করবো না।”

রাদ থমথমে কন্ঠে বললো,
“জোর করে কিছু পাওয়া যায় না মিস্টার ডট ডট ডট।”

তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে দিয়ে রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আই এম তাজওয়ার খান৷ মাইন্ড ইট। এন্ড ডোন্ট ডেয়া’র টু টাচ মাই লেডি।”

“মিস্টার ডট, ওপস সরি। মিস্টার তাজওয়ার খান, সি ইজ মাই ফ্রেন্ড। ইনফ্যাক্ট ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড। সো ইউ ডোন্ট ডেয়া’র টু টাচ মাই ফ্রেন্ড উইদাউট হার পারমিশন।”

তাজওয়ার আর রাদ দু’জনেই রাগী দৃষ্টিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি শক্ত করে রাদের হাত চেপে ধরলো। কারণ রাদ রাগ নিয়ন্ত্রণ করে হয়তো আজকের দিনটা ভুলেও যেতে পারে। কিন্তু তাজওয়ার এই দিনটা মনে রেখেই রাদের উপর হামলা করতে দু’দন্ডও ভাববে না। হঠাৎ লাবীবের আগমনে থমথমে পরিবেশটা জেগে উঠলো। তাজওয়ার স্বাভাবিক হয়ে আহির পাশে বসে পড়লো। রাদ আর লাবীব তাদের মুখোমুখি বসেছে।

লাবীব এক গাল হেসে আহিকে টিটকারি দিয়ে বলল,
“ওই পলস, তুই একদিনেই আস্ত একটা টাল পটিয়ে ফেলেছিস!”

আহি চোখ বড় বড় করে লাবীবের দিকে তাকালো। তাজওয়ার কপাল ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করল,
“টাল মানে?”

“মালের সভ্য সমার্থক শব্দ।”

তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“এই শব্দ কি তুমি আবিষ্কার করেছো?”

“ইয়েস। জিনিয়াস না আমি?”

“ভীষণ।”

রাদ চাপা কন্ঠে লাবীবকে বলল,
“তোর মাথায় কি গোবর আছে?”

“আরেহ, দুলাভাইয়ের সাথে একটু মশকরা না করলে জমে না।”

“দুলাভাই না, এ বাংলাদেশের টপ ক্রিমিনাল সিরাজ খানের ছেলে।”

লাবীব চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “কি?”

তাজওয়ার আর আহি লাবীবের দিকে অবাক চোখে তাকালো। লাবীব মাথায় হাত দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে তাজওয়ারকে বলল,
“শ্রদ্ধেয় দুলাভাই, আপনি কি আমার নাম জানেন?”

তাজওয়ার মাথা নেড়ে বলল,
“না, তুমি বললেই তো জানবো।”

লাবীব আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ। আমি চলি দুলাভাই। অনেক কাজ আছে আমার।”

লাবীব লাফিয়ে উঠে চলে গেলো। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমার বন্ধু তো চলে গেছে। তুমিও এখন যেতে পারো। আসলে আমাদের একটু প্রাইভেসি দরকার।”

অনিচ্ছাসত্ত্বে এবার রাদকে উঠতে হলো।

(***)

মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে রাদের। কি দরকার ছিল লাবীবের লাফিয়ে চলে আসার? এখন তার আহিকে বাধ্য হয়েই একা ছাড়তে হলো! রাদ নিচে নেমে লাবীবের কান মলে দিয়ে বলল,
“ওই মদন, চলে এলি কেন?”

লাবীব কানে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“চলে আসবো না? গুম হয়ে যাবো না-কি! জানিস না, ওরা মানুষ গুম করে দেয়।”

“আহিকে নিয়ে একসাথে বের হতাম। আর ওই ছেলের সাথে আহিকে একা ছাড়ার কোনো মানেই হয় না। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো। যতোক্ষণ আহি বাসায় যাবে না, ততোক্ষণ ওর পিছু নিবো।”

লাবীব মুখ ছোট করে বলল,
“ভাই, এই আহি কি জিনিস রে!”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি জিনিস মানে?”

“ওর পুরো চৌদ্দগোষ্ঠি ক্রিমিনাল। এই মেয়ে কোথা থেকে পদ্মফুল হয়ে সেই গোবরে জন্ম নিলো, বুঝলাম না।”

রাদ বিরক্তির সুরে বলল,
“তুই কিছু বুঝবিও না। তোর মতো মাথা মোটা যেখানেই যাবে, সেখানেই একটা না একটা ভেজাল করে আসবে।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৮+৯+১০

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৮||

১২।
কলিংবেলের শব্দ শুনে শশব্যস্ততা নিয়ে ছুটে এলেন মুনিয়া খালা। দরজা খুলতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো চার বছর আগের সেই প্রিয় মুখখানা। মুনিয়া খালা অতি আনন্দে খাবি খাওয়ার উপক্রম। আহি ব্যাগপত্র টেনে ঢুকাতে গেলে তিনি চেঁচিয়ে চুনিকে ডাকলেন।

“চুনি, ও চুনি। তাড়াতাড়ি আয়। দেখ, দেখ কে আইছে। আমাদের ছোড আফামণি আইছে।”

মুনিয়া খালা চুনিকে ডাকতে ডাকতেই নিজে এগিয়ে এসে আহির ব্যাগপত্র তার হাত থেকে টেনে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকাতে লাগলেন। আহি মুনিয়া খালার উৎকন্ঠা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। জগৎ সংসারে রাদ ব্যতীত তার জন্য উৎকন্ঠিত হওয়া মানুষ আরো একজন আছে দেখে তার মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। মুনিয়া খালা ব্যাগপত্র ঢুকাতে ঢুকাতেই দ্বিতীয় তলা থেকে নুপুরের রুনঝুন শব্দ ভেসে এলো। আহি ঘাড় কাত করে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির দিকে তাকাতেই মুনিয়া খালা এক গাল হেসে বললেন,
“চুনি আইতাছে আফা। মাইয়াডা বড্ড বেয়াদব। কোনহান থেইকা ঝুনঝুনি ঝুলানো কি যে ফইরা থাহে। সারাদিন ঘরে ঝুনঝুনি বাজে।”

আহি মুনিয়া খালার কথায় বিস্তর হাসলো। একটু পরই চুনি নেমে এলো। চুনিকে দেখে আহি মুগ্ধ হলো। মেয়েটাকে শেষবার যখন দেখেছিল, তখন তার বয়স চৌদ্দ ছুঁইছুঁই। আর এখন সদ্য তারুণ্যের স্পর্শ তার সর্বাঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে। কোমল মুখটা আরো উজ্জ্বল হয়ে গেছে। ঠোঁটে হাসির রেশ বেশ স্পষ্ট। কাপড়চোপড়েও সে যথেষ্ট যত্নবান মনে হচ্ছে। বেশ রুচিশীল পোশাক পরেছে চুনি।

আহি চুনিকে দেখে বলল, “কেমন আছো, চুনি?”

চুনি আহির কথা শুনে মুখটা কালো করে মায়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকালো। মুনিয়া খালা চোখ গরম করতেই চুনি মাথা নামিয়ে নিলো। আহি মুনিয়া খালার দিকে তাকাতেই তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,
“ছোড আফা, কিছু মনে কইরো না। এই মাইয়া মেলা প্যাঁচাল করে। কি বলে চুনি ডাকলে তার কি জানি পাঞ্চার হইয়া যায়। কি কই এডারে?”

মুনিয়া খালা চুনির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ওই তুই ইংরাজিতে কি জানি কস?”

চুনি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “প্রেস্টিস।”

আহি চুনির কথায় মুখ চেপে হাসলো। মুনিয়া খালা বললেন,
“হ আফা, ওইডাই নাকি পাঞ্চার হইয়া যায়।”

চুনি লজ্জায় মাথাটা একেবারে নুইয়ে ফেলছিলো। আহি চুনির থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“তা প্রেস্টিজিয়াস তরুণীর কি নাম?”

চুনি ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে চোখ নামিয়ে বলল,
“আফা, আমার নাম চাঁদনি।”

“বাহ, কি সুন্দর নাম! একদম তোমার চেহারার মতো সুন্দর।”

চুনি বিষ্ময়ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আফা, আমি সুন্দর?”

“হ্যাঁ, ভীষণ সুন্দর।”

“আপনেও অনেক সুন্দর। এহন তো আগের থেইক্কা বেশি সুন্দর হইয়া গেছেন।”

আহি হাসলো। চুনি ব্যাগপত্র নিয়ে বলল,
“আফা, ব্যাগগুলা আমি আপনের রুমে রাইখা আসি।”

আহি মাথা নাড়লো। মুনিয়া খালা আহির হাত ছুঁয়ে দিয়ে বললেন,
“ছোড আফা, তুমি এহন আইছো ঘর আলো হইয়া গেছে। এতোদিন আঁধার ছিল।”

আহি মৃদু হেসে বলল,
“মোজাম্মেল চাচা কোথায়? উনাকে দেখলাম না!”

“কইয়ো না আফা, ম্যাডামরে নিয়া বাইরে গেছে। আর ম্যাডাম যে কি দৌঁড়ান দৌঁড়ায়। ঘরে বইয়াই থাহে না। কাল যে গেলো, এহনো আইলো না। রাত-বিরেতে বাইরে যায় গা। স্যার তো আন্ধা। তার দুনিয়ায় আছে খালি টাহা আর টাহা।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎ আহির ফোন বেজে উঠতেই সে চকিত দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকালো। এরপর সে মুনিয়া খালার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“খালা, তুমি আজকে একটু ভালো কিছু রান্না করো। আমার এক ফ্রেন্ড আমার সাথে এসেছে। ও এখন একটা কাজে গেছে। রাতে আসবে।”

“ঠিক আছে আফা। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি এহন ম্যাডামের থেইক্কাও ভালো রাঁধি।”

(***)

আহির ফোনে আবার কল এলো। আহি গম্ভীরমুখে কলটা ধরলো। ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ ভেসে এলো।

“অদ্ভুত তো আহি! এতো বার কল দিচ্ছি, ধরছোই না।”

“মাত্র একবার দিয়েছেন। দ্বিতীয় বারেই ধরেছি।”

“ও, তাহলে তুমি আমার ফোনের হিসেব রাখছো?”

“এসব কথা বলার জন্য তো অবশ্যই আপনি কল দেন না। নিশ্চয় কোনো গুরুতর ব্যাপার আছে। যা বলার জন্য কল দিয়েছেন, তাই বলুন।”

নারী কণ্ঠটি তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো। আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি আমার সাথে যতোই বাজে ব্যবহার করবে, আমাকে তোমার সামনে ততোটাই ভয়ংকর রূপে দেখতে পাবে।”

আহি পাল্টা হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আপনার যেই ভয়ংকর রূপ দেখেছি, তাতে আমার ধারণা হয়ে গেছে, আপনি কেমন। আরো কোনো রূপ দেখানো বাকি থাকলে দেখিয়ে দিন। আমি সহ্য করতে পারবো। আপনাকে সহ্য করতে আমি বাধ্য। বাধ্য না হলে আপনার স্থান আপনাকে দেখিয়ে দিতাম।”

“খুব শীঘ্রই তুমি তোমার স্থান দেখবে। ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড, ডিয়ার ওয়াসিকা।”

(***)

চার বছর পর সেই চেনা-পরিচিত রুমে পা রাখলো আহি। ঘরটি ঠিক আগের মতোই আছে। দেয়ালে সেই রঙ, বিছানাটিও সেদিকেই বিছানো। পরিপাটি ঘরটির দেয়ালে বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটির দিকে চোখ পড়লো আহির। ছবিটির সামনে এসে দাঁড়াতেই চুনি বলল,
“আফা, তুমি যে ছবি আঁকছিলা, ওই ছবিগুলো ম্যাডাম ফেলাইয়া দিতে চাইছিলো। আম্মা ফেলাইতে দেয় নাই। তুমি যাওনের ফর, আম্মা ছবিগুলা দারোয়ান চাচারে দিয়া দিসে। চাচা ছবিগুলা গ্যারাজের পেছনে ছোড একখান ঘর আছে না,? ওইহানে রাখছে। তুমি কইলে, আমি এহনি সব নিয়া আসবো।”

আহি মৃদু হাসলো। চুনির দিকে তাকিয়ে বলল,
“থাকুক যেখানে আছে। ওসবে আমার আর কোনো অধিকার নেই।”

“কি কও আফা? তুমিই না ছবিগুলা আঁকছিলা?”

“চাঁদনি, তুমি এখন যাও। আমি ফ্রেশ হবো।”

চুনি দরজার কাছে এসে পেছন ফিরে বলল,
“আফা তুমি ইংরেজি দেশে ছিলা না?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “হুম।”

“আমারে ইংরেজি শিখাইবা? আমি এক আধখান বলতে পারি। হুনবা?”

আহি হালকা হেসে বলল,
“পরে শুনবো। সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনবো। তুমি এখন যাও।”

চুনি চলে যেতেই আহি দরজা আঁটকে দিলো। পেছন ফিরতেই আবার সেই ছবির দিকে চোখ পড়লো। বড় ফ্রেমে হাস্যোজ্জ্বল পদ্ম, লিনাশা, পুষ্প আর আহি। ছবিটির দিকে তাকাতেই তার চোখ ছলছল করে উঠলো। মনে পড়ে গেলো সেই দিনগুলোর কথা যেদিন তারা একসাথে ছিল। প্রতিদিন লিনাশার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, এক বেঞ্চে গাদাগাদি করে চারজনের বসা, ক্লাসে টিচারের উপস্থিতিতে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে খাতায় লিখে গানের কলি খেলা, চারজনের সেই বৃষ্টি বিলাস, একজন বই না আনলে বাকিরা একসাথে শাস্তি ভাগ করে নেওয়া আর টিফিন ছুটিতে চারজনের ভাগাভাগি করে পদ্মের হাতে বানানো পিঠা খাওয়া। খুব চমৎকার সম্পর্ক ছিল তাদের। কিন্তু সব হুট করেই শেষ হয়ে গেলো।

আহি ছবিটা দেয়াল থেকে নামিয়ে একপাশে রেখে দিলো। ফেলা আসা মানুষগুলোকে সে আর তার জীবনে চায় না। তারা যেখানেই আছে, ভালোই আছে। শুধু ভালো নেই আহি।

(***)

ঘরের জানালাটা খুলে দিলো আহি। বিছানায় শুয়ে আগের মতোই চুলগুলো জানালা দিয়ে বের করে দিলো। ফ্যান ঘুরছে দ্রুত গতিতে। আহির দৃষ্টি সেদিকেই। পলকহীনভাবে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখের কোণে জল ভারী হলো। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে গিয়েও মুছলো না। থাক, কাঁদুক। তার কান্না করা উচিত। এই ঘরেই তো সে কান্নাকাটি করে স্বস্তি পায়। শেষবার এই ঘরের মেঝেতে বসে পাগলের মতো কেঁদেছিল সে। সবাই ভেবেছিল, সেটাই আহির প্রথম ও শেষ কান্না। কিন্তু সবাই ভুল ছিল। আহি এখনো কাঁদে। পার্থক্য শুধু এইটুকুই সেই অশ্রু এখন আর কেউ দেখে না। আহি তার ভেজা চোখ দু’টি বন্ধ করতেই তার চোখের সামনে ভেসে এলো কান্না ভেজা সেই প্রিয় মুখটি।

………………………..

মেঘলা আকাশ। মেঘেদের ঘর্ষণে গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ হচ্ছে। আহি আকাশের দিকে তাকিয়ে চারুশিল্পের গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যদি গেট দিয়ে বের হতেই খুব জোরে বজ্রপাত হয় আর সেই বিদ্যুতের ঝলকানি তাকে ছাই করে দিয়ে যায়? সে শুনেছে বজ্রপাতের ফলে যেই পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়, তা দৈনন্দিন কাজের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎ শক্তির তুলনায় অনেক বেশি। বাসা-বাড়িতে সরবরাহ করা বৈদ্যুতিক খুঁটি ঠিক করতে গিয়ে কতো লোকের প্রাণ গেছে তার ইয়াত্তা নেই। আর বজ্রপাত তো তাকে ধরাশায়ী করে, একেবারে ছাই করে দেবে। সেই ভয়ে আহি গেট ধরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো মাঠের একপাশে বেঞ্চে বসে থাকা আফিফের দিকে। আফিফকে দেখে সে একটু অবাক হলো। সে ভেবেছিল, আফিফ চলে গেছে। কিন্তু সে তো মাঠের একপাশে বসে আছে। আহি মনে মনে ভাবলো,
“আজ বৃহস্পতিবার। আজ তো ওর বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু এভাবে এখানে বসে আছে কেন? বাসায় কি মায়ের বকা খেয়েছে নাকি?”

আহি গেট ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মাঠের কাছাকাছি গেলো। খোলা মাঠে বজ্রপাত হলে আহি মুহূর্তেই অক্কা পাবে, তবুও তার ভীতি আফিফকে দেখেই কেটে গেলো। আফিফ উদাস মুখে বেঞ্চে একা একা বসে আছে। তার দৃষ্টি মাটির দিকে। এভাবে মানুষ কখন বসে থাকে? যখন তার মন ভীষণ খারাপ হয়। আহি আফিফের কাছে যেতেই থমকে গেলো। দেখলো আফিফ তার শার্টের হাতা দিয়ে তার চোখ আড়াল করে রেখেছে। কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর আফিফ হাত সরালো। পকেট থেকে মলিন রঙের একটা রুমাল বের করে চোখ-নাক মুছলো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। ধীর পায়ে বেঞ্চ থেকে উঠে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। আহি স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আর আফিফ তাকে অতিক্রম করে চলে গেলো। সেদিন বাসায় ফিরে প্রতিদিনের মতো আবার সেই ডায়েরী বের করে আহি লিখলো,

“কেন কেঁদেছো তুমি? কি এমন কষ্ট তোমার? আমাকে দিয়ে দাও তোমার কষ্ট। আমি আমার সুখগুলো তোমার সাথে ভাগ করে নেবো।”

এই লেখাটির পাশেই একটি স্কেচ করলো আহি।

খোলা মাঠে একটি বেঞ্চ। বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে একটি ছেলে।

………………………..

আহি বিছানা ছেড়ে উঠে সেই ডায়েরীটা বের করলো। তারপর পৃষ্ঠা উলটে সেই স্কেচটি খুঁজে বের করলো। লেখাটিতে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল,
“স্বার্থপর মানুষ, কষ্ট দিয়ে গেছো, আবার সুখটাও কেঁড়ে নিয়েছো।”

১৩।

ঘর থেকে বের হয়ে নিচে নামতেই রাদের মুখোমুখি বসা মানুষটিকে দেখে চমকে উঠলো আহি। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “বাবা!”

রিজওয়ান কবির আহিকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“বসো, বসো। তোমার বন্ধু এসেছে। কথা বলো ওর সাথে।”

আহি রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি আহিকে পাশ কেটে উপরে চলে গেলেন। আহি এক ধ্যানে সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। রাদ আহির হাত ধরে তাকে পাশে বসালো। আহি শুকনো হেসে বলল,
“লাবীবকে নিয়ে আসিস নি কেন?”

রাদ হেসে বলল,
“ভুলে গেছিস আংকেলকে কি মিথ্যে কথা বলেছিস? লাবীব কি এখানে নাকি? লাবীব তো ঢাকায়। বেচারা দাদা একবার মারা গিয়েছেন, তুই উনাকে দ্বিতীয় বার মারলি।”

“যাহ, রাদ। এসব কথা রাখ। চল খাবি।”

“তোর বাবা তার গুরুগম্ভীর কথায় আমার পেট ভরিয়ে দিয়েছে। আমি এখন যাই।”

“কি বলছিস? খালাকে বলেছি তোর জন্য রান্না করতে।”

“আহি, আমরা কাল দেখা করবো। তখন না হয় একসাথে খাওয়া-দাওয়া হবে। আংকেলকে বলিস আমার কাজ আছে।”

“বাবা তোকে কি বলেছে, বল?”

“এমন কিছু না। প্লিজ আমি যাই।”

রাদ আহির কাছ থেকে জোরপূর্বক বিদায় নিয়ে চলে গেলো। কিছু একটা যে হয়েছে তা আহি বুঝতে পারলো।

(***)

রাতে খাবারের টেবিলে একসাথে বসে আছে রিজওয়ান কবির আর আহি। মুনিয়া খালা নিঃশব্দে তাদের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। চুনি রান্নাঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া দেখছে। রিজওয়ান কবির আর আহি উঠলেই তারা খাওয়া-দাওয়া করবে। এটাই এই বাড়ির নিয়ম।

রিজওয়ান কবির হাতের ইশারায় মুনিয়া খালাকে সরে যেতে বললেন। মুনিয়া খালা এক নজর আহির দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। খালা চলে যেতেই রিজওয়ান কবির গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“আশা করি সেই ছেলের সাথে তোমার কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয় নি।”

রিজওয়ান কবিরের কথা শুনে আহির গলায় খাবার আটকে গেলে। রাগী দৃষ্টিতে সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসব কি বলছেন আপনি?”

“তোমার বন্ধু রাদের কথা বলছি। একসাথেই তো ছিলে।”

আহি খাবারের প্লেট ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
“আমরা শুধু বন্ধু। এমন নোংরা সম্পর্ক আমার কারো সাথেই নেই। আর নিজের মেয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? চার বছরে একবারো আপনি আমার খবর নিয়েছেন? আজ এতো বছর পর দেখা হয়েছে, আর আপনার ব্যবহার দেখে আমি হতাশ।”

আহির চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগলো। মুনিয়া খালা রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে রেখেছেন। চুনি চাপা স্বরে মাকে বলল,
“এই ফেরাউন কহন মরবো, আম্মা?”

মুনিয়া খালা চোখ বড় বড় করে তাকাতেই চুনি চুপ হয়ে গেলো। এদিকে আহি নীরবে অশ্রু ফেলছে। আর রিজওয়ান কবির নীরবে খেয়ে যাচ্ছেন। খাওয়া শেষ হতেই তিনি আহির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তোমার বাবা। আমার এমন প্রশ্নে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজকাল ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এসব সাধারণ ব্যাপার। তুমি সত্যটা স্বীকার করলেও আমি তোমাকে শাস্তি দিতাম না। যাই হোক, তুমি এসেছো আমি তাজওয়ারকে বলেছি। ভালো হবে তুমি সেই ছেলের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে তাজওয়ারের সাথে সময় কাটাও।”

আহি ধরা কন্ঠে বললো,
“আমি আর রাদ বন্ধু। আপনি ভালো করেই জানেন ও আমার স্কুল ফ্রেন্ড। আমরা একসাথে পড়েছি। এর আগেও ও অনেকবার এই বাসায় এসেছে। রাদ আপনার দৃষ্টিতে নতুন কেউ নয়। আরেকটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি, আমি তাজওয়ারের সাথে সময় কাটাতে চাই না। ছেলেটা ভালো না, আর আপনি সেটা ভালো করেই জানেন। আপনি আমাকে বাধ্য করলে আমি….”

রিজওয়ান কবির আহিকে থামিয়ে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,
“তোমার মায়ের কবর খোঁড়ার কাজে দু’একজনকে লাগিয়ে দেই। কালকের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।”

আহি ভীত চোখে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। এরপর অনুরোধের সুরে বলল,
“মায়ের ক্ষতি করবেন না, প্লিজ।”

“তাহলে তুমি তাজওয়ারের সাথে সময় কাটানো শুরু করো।”

রিজওয়ান কবির আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,
“মনে রেখো, আমি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছি এই প্রজেক্টে। আমার লাস্ট ইনভেস্টমেন্ট তুমি। তুমি যদি কাজেই না লাগো, তাহলে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি কেন?”

আহি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
“মেরেই ফেলুন না হয়। আমি ভীষণ খুশি হবো।”

“প্রফিট হাতছাড়া করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৯||

১৪।
ভোর হতেই ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো আহি। পাখির কিচিরমিচির শব্দ নিস্তব্ধতা ভেঙে দেওয়ার খেলায় মত্ত। আর আহি ধীর পায়ে তার ভারী লাগেজ ব্যাগটি টেনে না নিয়ে হাতে নিয়েই নামছে, যাতে শব্দ শুনে রিজওয়ান কবির নিজের রুম থেকে বের না হোন। আহিকে দেখে মুনিয়া খালা ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। তিনি ফজরের নামাজের পর আর ঘুমান না। আহি নিচে নেমে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললো। মুনিয়া খালা চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“কই যাও, ছোড আফা?”

আহি ব্যাগটা নামিয়ে মুনিয়া খালার হাত ধরে বলল,
“মায়ের কাছে যাচ্ছি। বাবাকে বলো না। জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি যাওয়ার সময় বলেছি বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”

“তুমি তো স্যাররে কইয়া যাইতে পারো। মিছা কথা কইলে কি স্যার বুঝবো? স্যার তো তোমারে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে কিছু কইবো না।”

“খালা, কাল রাতেই বাবা আমাকে রাদের সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছে। রাদ আর লাবীব ছাড়া তো আমার আর কোনো বন্ধু নেই। তাহলে বাবাকে এই কথা কীভাবে বলবো?”

“স্যার যদি জানতে ফারে তুমি ম্যাডামের সাথে দেখা করতে যাইতাছো, মাইরা ফেলবো তোমারে।”

আহি করুণ দৃষ্টিতে মুনিয়া খালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সপ্তাহে অন্তত একদিন মায়ের সাথে দেখা করার অনুমতি আছে। এই যুক্তিতে বাবা অবশ্যই হেরে যাবে। কিন্তু এখন বলে গেলে, কিছু একটা করে আমাকে আটকে রাখবে।”

আহি ব্যাগ নিয়ে বাড়ির মেইন গেট খুলতেই লাবণি মেহেরা তার মুখের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবণিকে দেখে আহি চমকে উঠলো। লাবণি আহির হাতে ব্যাগ দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি কাল এসেছো, আর আজই পালিয়ে যাচ্ছো?”

আহি গম্ভীরমুখে বলল, “আমি পালিয়ে যাচ্ছি না।”

“আচ্ছা! তাহলে ব্যাগপত্র নিয়ে চোরের মতো সকাল হওয়ার আগেই বেরিয়ে পড়ছো কেন? তোমার বাবা কি জানেন তুমি কোথাও যাচ্ছো?”

আহি দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আমি কারো কাছে অনুমতি নিতে বাধ্য নই।”

লাবণি বাসায় ঢুকেই মুনিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“যাও, তোমার স্যারকে ডাকো। বলো, ম্যাডাম চলে এসেছে।”

আহি লাবণির কথা উপেক্ষা করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাবে তখনই লাবণি তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। আহি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই লাবণি আরো জোরে তার হাত চেপে ধরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।

(***)

দশ মিনিট পর রিজওয়ান কবির ঘুম ঘুম চোখে নিচে নেমে এলেন। মুনিয়া খালাও নিচে নেমে পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন। লাবণিকে দেখে রিজওয়ান কবির বললেন,
“তুমি চলে এসেছো তাহলে?”

লাবণি আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাগ্যিস আমি ঠিক সময়ে এসে পড়েছি। তা না হলে তোমার মেয়ে তো পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।”

রিজওয়ান কবির আহির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই আহি ক্ষেপে উঠলো। চেঁচিয়ে বলল,
“আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আইনগত ভাবে সপ্তাহে একদিন আমি মায়ের সাথে দেখা করতে পারবো।”

লাবণি চমকে উঠে বললেন,
“মা! তোমার মা তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তুমি ভুলে যেও না এখন একমাত্র আমিই তোমার মা। আন্ডারস্ট্যান্ড?”

আহি কিছু বলতে যাবে তখনই রিজওয়ান কবির তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারো, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তোমাকে এর আগে সেই কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করতে হবে। তোমাকে মেনে নিতে হবে তুমি তাজওয়ারের জন্য সৃষ্টি হয়েছো। তাজওয়ার তোমার ভবিষ্যৎ। ও তোমাকে যা-ই বলবে তুমি মানতে বাধ্য।”

লাবণি রিজওয়ান কবিরের হাত ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
“দেটস লাইক মাই হাসবেন্ড।”

কথাটি বলেই তিনি আহির দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন। আহি তার হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
“আমি কোনো শয়তানের সামনে মাথা নত করবো না।”

রিজওয়ান কবির আহির কাছে এসে হুট করে তার গালে সশব্দে চড় বসিয়ে দিলেন। আহি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মুনিয়া খালা পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আহিকে আগলে ধরে বললেন,
“স্যার, ছোড আফা ভুলভাল বইলা ফেলছে। আপনে আফারে মাইরেন না। মেলা বছর পর দেশে ফিরছে তো তাই মারে দেখতে মন চাইতাছে।”

লাবণি মুনিয়া খালার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“বেশি বকবক করলে তোমার মেয়ের কপাল ভাঙবে। খুব সুন্দর তোমার মেয়ে! মাসে ভালোই ইনকাম করতে পারবে।”

আহি লাবণিকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“সবাইকে নিজের মতো মনে করবেন না, মিসেস লাবণি।”

রিজওয়ান কবির আহির কথায় আবার তার গায়ে হাত তুলতে যাবেন তখনই লাবণি তাকে আটকে দিয়ে বলল,
“তুমি ওর মুখ বন্ধ করতে পারবে না। ওকে ওর মতো বলতে দাও। সময় আসুক। আমি নিজেই ওকে দেখিয়ে দেবো, আমি কে?”

(***)

ধপ করে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো আহি। সে জানতো এমন কিছু হবে, তাই হয়তো বাবা তাকে দেশে আসতে বলেছিলেন। নয়তো আহি কখনোই দেশে ফিরতো না। কতো বার সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু লন্ডনেও তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বাবা লোক রেখেছিলেন। আর আহি পালিয়ে গেলেই সালমা ফাওজিয়াকে বন্দী করবেন রিজওয়ান কবির। চার বছর আগে রিজওয়ান কবির আহিকে নিজের কাছে রাখার জন্য যা করেছিলেন, তারপর আর আহির কোনো কিছুতেই সাহস হয় না। আহি যদিও জানে না তার মা সালমা ফাওজিয়া তাকে আদৌ ভালোবাসেন নাকি ঘৃণা করেন। কারণ আহির জন্যই তো তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।

আহি মাথা তুলে নিজের গালে নিজেই কয়েকটা চড় মারলো। চড় মার‍তে মারতেই সে কাঁদতে লাগলো। আর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
“তুই একটা লুজার, আহি। তোর মতো ইঁদুর কপাল নিয়ে কেউ জন্ম নেয় নি।”

আহি চোখ মুছতেই তার দৃষ্টি আটকালো সামনে থাকা কাঠের স্ট্যান্ডের দিকে। আহি বিছানা ছেড়ে উঠে মেঝেতে বসে পড়লো। কাঠের স্ট্যান্ডটি এখনো আছে, কিন্তু এই স্ট্যান্ডের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটি আর নেই। এক ফুট উঁচু গোল কাঠের স্ট্যান্ডের উপর মাথা রাখলো আহি। বুকে হাত রেখে তার ভেজা চোখ জোড়া বন্ধ করলো সে। হারিয়ে গেলো অতীতের সেই সুখের দিনগুলোতে।

………………………..

আহিকে ঘিরে বসে আছে পুষ্প, পদ্ম আর লিনাশা। তারা গভীর দৃষ্টিতে আহিকে পর্যবেক্ষণ করছে। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোরা আমাকে এভাবে দেখছিস কেন?”

পদ্ম বলল, “এআর কে?”

আহি চোখ বড় বড় করে পদ্মের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“আজকের বিশেষ শিরোনাম, পলি আপু গ্রুপের বিশেষ সদস্য ওয়াসিকা কবির ভয়ংকরভাবে প্রেম রোগে ভুগছেন। জরুরী অবস্থায় তাকে আইসিউতে রাখা হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে তিনি লাইফ সাপোর্টে চলে যেতে পারেন।”

পদ্ম পুষ্পের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“অশুভ কথাবার্তা বলিস না। এআর কি কোনো ভাইরাসের নাম না-কি আহিকে লাইফ সাপোর্টে চলে যেতে হবে?”

লিনাশা পদ্ম আর পুষ্পকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
“সবাই চুপ। আহির কাছে লুকিয়ে আছে এআর ক্যারেটের গোল্ড। এখনই বের করে দে আহি। নয়তো সত্য গোপন করার অপরাধে মামলা টুকে দেবো।”

আহি হাত উঁচিয়ে বলল,
“তোরা চুপ কর। আমি বলছি, শোন।”

আফিফের সাথে তার প্রথম দেখা হওয়া, কীভাবে আফিফের প্রেমে পড়েছে সব তার বান্ধবীদের জানালো আহি। তবে আফিফের জন্য সে কি কি পাগলামো করেছিল, সেসব গোপন রাখলো। ডায়েরীর কথাটাও জানালো না। যদিও আহির এখন আফিফের কথা কাউকে জানানোর পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু খাতায় একটা ছেলের স্কেচের নিচে ভালোবাসি এআর দেখে পুষ্প আহির গোপন প্রেমের রহস্য সবার সামনে উন্মোচন করাই আহিকে বাধ্য হয়ে সব স্বীকার করতে হলো। যদিও আহি লিনাশাকে আফিফের কথা জানাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কারণ তার সাথেই আহি বেশি ঘনিষ্ঠ। কিন্তু লিনাশার সাথে একা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না আহি। এদিকে সবার আগে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিনাশা কেন পায় নি, তাই তার মন খারাপ। সে স্কুল ছুটি হতেই গেট দিয়ে একা একাই বেরিয়ে যাচ্ছিল। আহি ছুটে এসে পেছন থেকে লিনাশার ব্যাগ ধরে তাকে আটকালো। লিনাশা পেছন ফিরে রাগী স্বরে বলল,
“আমি তোর বেস্টু?”

আহি কান ধরে বলল,
“তোকেই জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পদ্ম আর পুষ্পের সামনে জানাতে পারি নি। আমরা একা একা ফিসফিস করলে ওরা মন খারাপ করবে।”

“এখন তো সবাই জেনে গেছে।”

“পুষ্প স্কেচটা দেখে ফেললো, তাই।”

“আর আমি এতো দেরীতে জানলাম?”

“আচ্ছা, সরি। বল, কি খাবি তুই?”

“এই মেয়ে, লোভ দেখাবি না আমাকে।”

লিনাশা গাল ফুলিয়ে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। আহি টেনে তাকে একপাশে এনে বলল,
“পুষ্পের কুখ্যাত চ্যানেলের শিরোনাম হওয়ার ইচ্ছা আছে তোর? দেখা যাবে কাল শিরোনাম হবে, বেস্ট ফ্রেন্ডের গোপন প্রেমের গল্প আগে শুনতে না পারায় গাড়ির নিচে স্বেচ্ছায় ঝাঁপিয়ে পড়লো একটি পাগল মেয়ে।”

লিনাশা ঝাঁকুনি দিয়ে আহির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুই পাগল।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ইউ টু।”

লিনাশা চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “ইউ টু টু।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ইউ টু টু টু।”

লিনাশা চেঁচিয়ে বলল, “ইউ টু ইনফিনিটি।”

দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ। এরপর তারা একসাথে হেসে উঠলো। এবার লিনাশা আহির কাঁধে হাত রাখলো আর রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। লিনাশা বলল,
“এআরকে জানিয়েছিস?”

আহি মাথা নেড়ে বলল, “উহুম।”

“কখন জানাবি?”

“সাহস হচ্ছে না।”

“সে তো কিছুই জানে না। অন্তত কিছু হিন্টস তো দে।”

“কেমন হিন্টস?”

লিনাশা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“ছেলেটার একটা স্কেচ করে ওকে গিফট কর। নাম-পরিচয় দিবি না। অজ্ঞাতনামা প্রেমিকা নামে চিরকুট লিখতে থাক। চিরকুট পেতে পেতে একসময় ও তোর প্রেমে পড়ে যাবে। তারপর হন্যে হয়ে তোকে খুঁজতে থাকবে। আর তুই একদিন তার সামনে গিয়ে সত্যটা জানাবি। ব্যস, হয়ে গেলো আহির প্রেম শুরু।”

“আইডিয়া ভালো দিয়েছিস। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।”

“কি সমস্যা?”

“চারুশিল্পে আমাদের মাঝে মাঝে তাত্ত্বিক বিষয় নিয়েও পড়ায়। পরীক্ষাও নেয়। এখন ও আমার হাতের লেখা চিনে ফেললে?”

লিনাশা কিছুক্ষণ ভেবে দুষ্টু হেসে বলল,
“প্রেম করবি তুই, অনুভূতি হবে তোর। কিন্তু চিরকুটটা আমি লিখে দিবো।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“তোর হাতের লেখা তো অনেক সুন্দর। ও যদি তোর লেখার প্রেমে পড়ে যায়?”

“ধুর বোকা। এতো সহজ নাকি? কেউ আবার লেখার প্রেমে পড়ে? তোর অনুভূতিই ওকে আকর্ষণ করবে। তুই ওর জন্য স্কেচ করবি, ওটাই ওকে প্রেমে ফেলতে বাধ্য করবে। হাতের লেখা কোনো প্রেমে পড়ার জিনিস হলো?”

আহি লিনাশাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই বিকেলে বাসায় আসিস। তোকে আরো অনেক কথা বলার আছে।”

“আচ্ছা। আর তুই তো এআর এর আসল নাম বললি না।”

“ওটা সিক্রেট থাক। যখন ও আমার হবে তখন সবাইকে জানাবো।”

(***)

বিকেলে লিনাশা বাসায় আসার পর আহি আফিফের জন্য কি কি পাগলামো করেছে সবটা বললো। সব শুনে লিনাশা ডায়েরীটা দেখার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলো। কিন্তু আহি দেখালো না। শুধু আফিফের একটা ছবি দেখালো। চারুশিল্পে ভর্তির সময় আফিফ একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দিয়েছিল। আহি অনেক কষ্ট করে সেটা সংগ্রহ করেছে। আফিফের ছবি দেখে লিনাশা বলল,
“ছেলেটা তো নায়কের মতো দেখতে।”

“হ্যাঁ।”

“আহি তাড়াতাড়ি জানিয়ে দে। ওর যদি অন্য কোথাও সম্পর্ক থাকে, তাহলে তোর প্রেমের বারোটা বেজে যাবে।”

এরপর লিনাশা অনেক ভেবে আহিকে একটা বুদ্ধি দিলো। আহিরও লিনাশার বুদ্ধিটা পছন্দ হলো। আহি তার কথামতো আফিফের স্কেচ করলো। আর পরের সপ্তাহের প্রথম ক্লাসেই স্কেচটি আফিফের খাতার মাঝখানে রেখে দিলো। আফিফ ক্লাসে এসেই টেবিলের উপর রাখা জমানো খাতাগুলো থেকে নিজের খাতাটা নিয়ে পাতা উল্টাতেই দেখলো সেই স্কেচ। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে স্কেচটির দিকে তাকিয়ে রইলো। স্কেচের নিচে লেখা,
“ধরে নাও এটা বেনামী চিরকুট। আমি তোমার এক অজ্ঞাতনামা ভক্ত। কি ভাবছো, তুমি কোনো সেলেব্রিটি? হুম, আসলেই তাই। তুমি শুধু আমার সেলেব্রিটি। আমি ভয়ংকরভাবে তোমার প্রেমে পড়েছি। ভাবছো আমি কে? আমার পরিচয় কি? তুমি আমার একটা নাম রাখতে পারো। তোমার যা ইচ্ছে হয়। তোমার দেওয়া নামেই আমার পরিচয় হোক।”

আহি দূর থেকে আফিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে আফিফ চিরকুটটি পড়ছে। চিরকুট পড়া শেষ হতেই সে একবার মুখ তুলে আশেপাশে তাকালো। আহির যেন তখনই আত্মা কেঁপে উঠলো। হাত-পা শিরশির করে উঠলো। লিনাশার কথাটা তাহলে সত্য হচ্ছে। আফিফ তাকে খোঁজা শুরু করেছে। আফিফ জেনে গেছে কেউ তাকে ভীষণ ভালোবাসে।

……………………….

আহি চোখ খুলেই কাঠের স্ট্যান্ডের উপর আলতোভাবে হাত রাখলো, আর বললো,
“আমার জীবনে যদি অনেক সুখ থাকতো, তাহলে হয়তো আমি তোমাকে নিয়ে ভাবার সময়টাও পেতাম না, এআর। কিন্তু এই বেহায়া মনে তুমি ছাড়া আর কোনো ভালো মানুষের জায়গা নেই। তাই তোমার কথা মনে করে নিজেকে বুঝায়, আমার একটা ভালোবাসার মানুষ আছে। যে আমাকে ভালোবাসে আমার কল্পনায়। কল্পনায় ভালোবাসতে পারাটাও কিন্তু চমৎকার। তুমি নিজেও জানো না, আমি তোমাকে নিয়ে মিছেমিছি ভাবি। মনে করি তুমি আমার পাশে আছো, আমাকে বলছো, ‘আহি আমি কোনো তাজওয়ারকে তোমার কাছে ঘেঁষতে দেবো না। তোমার মন-প্রাণ সব আমার দখলে। আমি তোমাকে প্রটেক্ট করবো। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই তোমার পাশে আছি।’ এআর, তুমি কি আমার এই স্বপ্ন কখনো পূরণ করবে না? আমাকে প্রটেক্ট করতে আসবে না? আমি এখনো সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমাকে চাই। জানি, এটা অন্যায়। কিন্তু মন তো ন্যায়-অন্যায় বুঝে না। মন শুধু ভালোবাসা চায়।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১০||

১৫।
আহির হাতে একটা মলিন স্কেচ। স্কেচটি একটি ছেলের। স্কেচটিতে কোঁকড়ানো হালকা বাদামী বর্ণের চুল, ধূসর চোখ জোড়ায় স্বচ্ছ জল উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, আর ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটে উঠেছে। আফিফের পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখেই এই স্কেচটি করেছিল আহি। কি চমৎকার ছিল স্কেচটি! হুবহু আফিফের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আফিফ এই স্কেচটি যত্ন করে রাখতে পারলো না। যেদিন আহি প্রথম আফিফকে এই স্কেচ এঁকে দিয়েছিল, সেদিনই আফিফ সেটা হারিয়ে ফেলেছিল।
প্যান্টের পকেটে ভাঁজ করে সেই স্কেচটি রেখে দিয়েছিল আফিফ। চারুশিল্প থেকে বের হয়েই প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে গিয়ে স্কেচটা মাটিতে পড়ে যায়। ভাগ্যিস আহি প্রতিদিন আফিফের পিছু নিতো। আর এই দৃশ্যটাও তার চোখে পড়ে গেলো। আফিফ সরে যেতেই আহি ভাঁজ করা স্কেচটি মাটি থেকে তুলে নিলো। ততোক্ষণে দু’একজন এর উপর পা মাড়িয়ে চলে গেছে। জুতোর ছাপ পড়ে স্কেচটি মলিন হয়ে গিয়েছিল। ভেজা মাটিতে পড়ায় সাদা পৃষ্ঠায় কেমন ছোঁপ ছোঁপ দাগ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আহি বাসায় এসে চুলার সামনে কাগজটি ধরে রেখে তা শুকিয়ে তার বাদামি মলাটের ডায়েরীর ফাঁকেই রেখে দিয়েছিল। এখনো স্কেচটি সেই ভাঁজেই আছে। গত চার বছরে সে একবারো এই স্কেচটি খুলে দেখে নি। অন্য কিছুতে না হোক, অন্তত এই স্কেচে আফিফের স্পর্শ এখনো বর্তমান। তাই সে এই স্কেচটি ধরার সাহস পায় না। কিন্তু আজ তার মনটা ভীষণ খারাপ। তার ইচ্ছে করছে প্রিয় মানুষগুলোকে অনুভব করতে। তাই স্কেচটি খুলে তাতে হাত বুলিয়ে নিলো আহি।

……………………

সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। আজকাল অল্প একটু বৃষ্টিতেই শহরের রাস্তায় পানি উঠে যায়। রিজওয়ান কবিরের অফিস উঁচু রাস্তায়। তাই তার গাড়ি কোনোদিনই ড্রেনের পানির সংস্পর্শে আসে নি। আহিরা যেই জায়গায় থাকে সেটা যথেষ্ট উঁচু স্থান। কিন্তু আহির আর্ট স্কুলের আশেপাশে পানির স্রোত বয়ে যায়। নালা উপচে পানি রাস্তায় চলে আসে।

এদিকে আহি রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে বৃষ্টি কমার জন্য দোয়া করেছিল। কারণ বৃষ্টির কারণে শহর পানিতে ভাসবে, আর তার বাবা তাকে বাসা থেকে বের হতে দেবেন না। সপ্তাহে মাত্র দু’দিন চারুশিল্পের ক্লাস থাকে। এখন একদিন না গেলে আফিফকে দেখার জন্য তার পুরো এক সপ্তাহ বসে থাকতে হবে। এটা সে কখনোই হতে দেবে না। কিন্তু তার দোয়া অপূর্ণ থেকে গেলো। বৃষ্টিও কমলো না, আর এখন পানিতে পুরো শহর থৈ থৈ করছে। আহি সকাল থেকে জেদ করছিল, সে চারুশিল্পে যাবেই যাবে। রিজওয়ান কবির শেষমেশ রাগী স্বরে বললেন,
“গেলে একা একাই যাও। পায়ে হেঁটে যাও। আমি তোমাকে রিক্সায় উঠার জন্যও টাকা দেবো না। আর আমার গাড়ি তো কখনোই পাবে না।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাতে দুইশো টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন,
“রিকশা করে যেও। হেঁটে যেও না।”

রিজওয়ান কবিরের বিরুদ্ধে গিয়ে টাকা দেওয়ায় তিনি রেগে গেলেন। হুট করে উঠে এসে তিনি সালমা ফাওজিয়ার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আহি সাথে সাথেই টাকাটা রেখে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। পুরো রাস্তায় সে অন্যমনস্ক ছিল। আজ তার জেদের জন্যই তার মাকে চড় খেতে হলো।

(***)

হাঁটতে হাঁটতে চোখের সামনে পানির স্রোত দেখে থমকে দাঁড়ালো আহি। দেখে বোঝার উপায় নেই এটা রাস্তা নাকি কোনো স্রোতস্বিনী। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামনে পা বাড়ালো। হাঁটু ছুঁইছুঁই পানি। আহি ধীর গতিতে সামনে এগুচ্ছে। আফিফকে দেখার জন্য যেই প্রবল উৎসাহ নিয়ে সে বেরিয়েছিল, মাকে চড় খেতে দেখে তার সব ইচ্ছে উবে গেছে। তবুও কেন যে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছে তা নিজেই জানে না। আফিফ নামের মানুষটি যে তার মস্তিষ্ক দখল করে নিয়েছে, সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আহির। সে এই মানুষটার জন্য হয়তো সব সীমা ছাড়িয়ে যাবে।

(***)

অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে পায়ে কিছু একটা বেঁধে ভারসাম্য হারিয়ে বন্যার জলেই ধপ করে পড়ে গেলো আহি। গলা অব্ধি ডুবে গেছে তার। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে নাক চেপে ধরলো সে। সব ড্রেনের পানি, ভাবতেই গা গুলিয়ে এলো তার৷ এভাবে ময়লা ভেজা কাপড় নিয়ে সে চারুশিল্পে গেলে আফিফের নজরে পড়বে। আর এমনভাবে সে আফিফের চোখে পড়তে চায় না।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন তার নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। আহি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো লিনাশা রিকশায় বসে তাকে ডাকছে। আহি লিনাশার কাছে যেতেই লিনাশা তাকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে বলল,
“কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছিস নাকি?”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“আমার ক্লাস আছে আজকে।”

“একদিন মিস দিলে কি এমন ক্ষতি হতো?”

“এআরকে আর দেখা হতো না।”

“ও তোর মতো পাগল না যে এক কোমর পানির মধ্যে ক্লাস করতে আসবে।”

লিনাশা আহিকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে আহি ফ্রেশ হয়ে নিলো। লিনাশা তার পকেটমানির টাকা থেকে কিছু টাকা আহিকে দিয়ে বলল,
“রিকশা করে যা। হেঁটে যাবি না কিন্তু। তোর বাবাটা যে কেমন মানুষ! বাবা তো উনাকে একটুও…..”

লিনাশা কথাটা গিলে ফেললো। আহি বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে নিলো।

নার্সারিতেই লিনাশা আর আহির বন্ধুত্ব হয়েছিল। কিন্তু শুরুতে আহির সাথে মেলামেশা করা লিনাশার বাবা-মা পছন্দ করতেন না। কারণ আহির বাবা একজন প্রভাবশালী মানুষ। আর লিনাশা একজন সাধারণ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আহির বাবা রিজওয়ান কবির দেশে পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে একজন। যার ফলে নৈতিক-অনৈতিক অনেক কথায় তার নামে এরই মধ্যে রটে গেছে। রাজনীতিবিদদের কাছে তিনি ফেরেশতা, আর সাধারণ মানুষের কাছে ফেরাউন। সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও মন্ত্রীদের সহায়তায় তিনি নিজের অবৈধ সম্পদ আর ব্যবসায় অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আর এমন একজন অসাধু লোকের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করাটা কোনো বাবা-মা’ই পছন্দ করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ধীরে ধীরে লিনাশার বাবা, ফখরুল হক আর লিনাশার মা মিসেস রূনা খানম আহির মায়ায় পড়ে যান। এখন লিনাশার বাবা আহিকে দেখলেই বলেন,
“বাবা যেমনই হোক, মেয়েটা ভীষণ লক্ষী।”

(***)

লিনাশার বাড়ি থেকে বের হয়ে আহি রিকশা নিয়ে চারুশিল্পে চলে গেলো। ক্লাসে আজকে মাত্র চারজন এসেছে। তাও আবার যাদের বাসা কাছে ছিল। আফিফকে ক্লাসে না দেখেই আহির চোখে জল ভীড় করতে লাগলো। এতো কষ্ট করে সে আফিফকে এক নজর দেখার জন্য চলে এসেছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। আনমনে খাতা খুলে সাদা পৃষ্ঠায় এবড়ো থেবড়ো দাগ কাটতে লাগলো আহি। হঠাৎ সুধাময় সুর আহির হৃদয় স্পর্শ করলো। আহি তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে দেখলো আফিফ ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। আফিফকে দেখেই স্যার জিজ্ঞেস করল,
“এতো ঝামেলা করে আসার কি দরকার ছিল, আফিফ?”

আহি স্যারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আর মনে মনে বলল,
“ও আমার জন্যই এসেছে।”

আফিফ মলিন মুখে নিজের সিটে বসে পড়লো। আহি এক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফের চোখে-মুখে ইতস্ততভাব। সে পাশের সারিতে বসা একজনের দিকে তাকালো। ধীর গতিতে ব্যাগ থেকে খাতা, পেন্সিল বের করতে লাগলো। স্যারের প্রশ্নে সে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে, তা আহি ঠিকই বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ পর পর আফিফ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে। আফিফের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করতে করতেই ক্লাস শেষ হয়ে গেলো। আফিফও নীরবে বেরিয়ে পড়লো। আফিফ প্রতিদিনই কোনো সাড়াশব্দ ছাড়া ক্লাস করে চলে যায়, ক্লাসের কারো সাথে একটা কথাও বলে না। ছেলেটা এমন কেন? আফিফ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বাড়তে লাগলো আহির।

(***)

আজও আফিফের পিছু নিচ্ছে আহি। আরেকটু সামনে গেলে আবার হাঁটু অব্ধি পানিতে নামতে হবে আহিকে। আহি এসব তোয়াক্কা করলো না৷ সে আফিফের পিছু পিছু নেমে পড়লো হাঁটু ভর্তি পানিতে। কিছুদূর যেতেই আফিফ দাঁড়িয়ে গেলো। এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর হালকা ঝুঁকে পা থেকে এক পায়ের স্যান্ডেল খুলে নিলো। আহি বুঝতে পারলো, অন্য পায়ের স্যান্ডেলটা হয়তো পানিতেই ভেসে গেছে।

আফিফ কিছুদূর গিয়ে বাসের জন্য দাঁড়ালো। বাস আসতেই সে বাসে উঠার আগে হাতের স্যান্ডেলটা রাস্তায় ফেলে দিলো। বাস চলে যেতেই আহি সেই ফেলে দেওয়া মলিন স্যান্ডেলটি হাতে নিয়ে মনে মনে বলল,
“তোমার ফেলনাও আমার কাছে অনেক মূল্যবান, এআর।”

আহি বাসায় এসে ভালোভাবে আফিফের স্যান্ডেলটি পরিষ্কার করে পলিথিন পেপারে মুড়িয়ে রেখে দিলো। তারপর আজকের দিনের অভিজ্ঞতাটাও ডায়েরিতে তুললো। লেখার পাশে প্রতিদিনের মতো স্কেচ করলো। তবে আজ আফিফের ছবি আঁকলো না। আজ আঁকলো রাস্তার উপর একটা পরিত্যক্ত স্যান্ডেলের ছবি।

পরদিন চারুশিল্পে আফিফকে দেখে অবাক হলো আহি। আফিফ আজ ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে ক্লাসে এসেছে। স্যান্ডেলের তলাটিও খসে পড়ার উপক্রম। যার দরুন রাস্তায় হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিলো তার। জুমার দিন তাই নামাজের জন্য পাশের মসজিদে ঢুকে পড়লো সে।

(***)

আজ দোকানপাট সবই বন্ধ। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে রাস্তায় একটা ভ্যানগাড়ি চোখে পড়লো আহির। ফেরিওয়ালা তার ভ্যানে করে জুতা বিক্রি করছেন। আহি একজোড়া চামড়ার স্যান্ডেল কিনে নিলো। ভাগ্যিস কাল আফিফ তার স্যান্ডেলটা ফেলে গিয়েছিল। স্যান্ডেলের গায়ে সাইজ লেখা ছিল বলেই এই নতুন জোড়া কিনতে পেরেছে সে। স্যান্ডেল জোড়া কিনেই মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালো আহি। পাশে একজন মহিলা ভিক্ষার জন্য বসে আছেন। আহি মহিলাটির হাতে দুইশো টাকার নোট দিয়ে বলল,
“আপনি আমার একটা কাজ করে দিলে আপনাকে আরো পাঁচশ টাকা দেবো।”

পাঁচশ টাকা পাওয়ার খুশিতে তিনি সানন্দে আহির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। আহির কথামতো নামাজ শেষ হতেই তিনি আফিফের কাছে গিয়ে নতুন স্যান্ডেল জোড়া তার হাতে দিয়ে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“একটা মাইয়া তোমারে দিতে কইছে।”

আফিফ অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। চিরকুটটি খুলে দেখলো সেখানে ইংরেজিতে লেখা,
“শোনো বালক,
নিজের খেয়াল রাখতে শিখো। এভাবে কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে ক্লাস করতে আসছো, আমি কিন্তু তোমার কপালের ভাঁজ সহ্য করতে পারছি না। এই স্যান্ডেল জোড়া তোমার জন্য। আমি নিজের পকেটমানি বাঁচিয়ে তোমার জন্য কিনলাম। যত্নে রাখবে কিন্তু।”

আফিফ চিরকুটটি পড়ে এদিক-ওদিক তাকালো। চিরকুটটি ইংরেজিতে লেখার কারণ যাতে আফিফ আহির লেখা বুঝতে না পারে। আর আহির বাংলা লেখা আফিফ সহজেই বুঝে ফেলবে। এই মুহূর্তে লিনাশাও পাশে নেই তাই ইংরেজিই তার একমাত্র ভরসা। আফিফ চিরকুটটি ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো। এরপর প্যাকেট থেকে স্যান্ডেলটা বের করে ভিক্ষুক মহিলাটিকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো। ভিক্ষুক মহিলাটিও এদিক-ওদিক তাকিয়ে আহিকে খুঁজতে লাগলো। আফিফ কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আহির দেওয়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই চলে গেলো। আহি কিছুক্ষণ পর ভিক্ষুক মহিলাটিকে পাঁচশ টাকা দেওয়ার জন্য সামনে আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“পোলাডারে তুমি চেনো?”

আহি বলল,
“ওভাবে না। আপনি দোয়া করে দিন, যাতে আরো ভালোভাবে জানতে পারি।”

মহিলাটি আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আহির সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, সত্যিই হয়তো তার ভাগ্য শুভ প্রমাণিত হবে। তবে মহিলাটির দোয়া সত্যিই কবুল হয়েছিল। সে আফিফকে অনেক ভালোভাবেই জানতে পেরেছিল। যতোটুকু সে আফিফ সম্পর্কে জেনেছে, ততোটুকু হয়তো আর কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়।

…………………………

অতীতের স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতেই পুরো বেলা কাটিয়ে দিলো আহি। এর মধ্যে একবারো কেউ তার রুমের দরজায় কড়া নাড়ে নি। সন্ধ্যার পর মুনিয়া খালা দরজার সামনে এসে আহিকে ডাকলেন। আহি দরজা খুলতেই তিনি মলিন মুখে বললেন,
“ছোড আফা, তাজওয়ার স্যার আইছেন।”

তাজওয়ার আসার খবর শুনে আহি মিইয়ে গেলো। সে ফোন হাতে নিয়ে রাদের নম্বরে ডায়াল করতে যাবে তখনই তাজওয়ার হুট করে তার রুমে ঢুকে পড়লো। আহি চমকে উঠে তাজওয়ারের দিকে তাকাতেই সে ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে আহির কাছে এসে বলল,
“তোমার কোমলতা দেখছি চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়েছে। তুমি তো দেখছি ছবির থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে গেছো। এখন মনে হচ্ছে আমি বেশিদিন ওয়েট করতে পারবো না। আংকেলকে বলে শীগ্রই তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো। তুমি চাইলে এখনই নিয়ে যেতে পারি।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৫+৬+৭

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৫||

০৮।
দরজায় কড়ার নাড়ার শব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো আহি। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে রাদের অনেকগুলো মিসড কল আর মেসেজ। আহি মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। কারণ রাতেই রাদের ঢাকায় আসার কথা ছিল। আহি মেসেজগুলো দেখতে লাগলো। মেসেজে কোনো কিছু লেখা নেই, শুধু রাগের ইমোজি পাঠিয়েছে। ছেলেটার মাথাটা এখন চরম খারাপ হয়ে আছে, তা আহি নিশ্চিত। দরজায় এবার খুব জোরেই ধাক্কা পড়লো। আহি থতমত খেয়ে গেলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিল কড়ার নাড়ার শব্দে তার ঘুম ভেঙেছিল। আজকাল মাথাটা ঠিকভাবে কাজই করছে না তার৷ আহি তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুলে দিতেই রাদের রাগী মুখটা তার সামনে দৃশ্যমান হলো। রাদের কপাল ছুঁইয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। আশেপাশে দু’একজন লোক জড়ো হয়েছে। হোটেলের ম্যানেজারও দাঁড়িয়ে আছেন। রাদ এদিক-সেদিক না তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“কি মরার ঘুম ঘুমাচ্ছিলি তুই? আমি তো ভেবে ফেলেছি তুই ফ্যানের সাথে ঝুলে আছিস। আরেকবার দরজা ধাক্কা দেওয়ার পরও যদি না খুলতি এই দরজাটা আজ ভাঙা লাগতো।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ পেছন ফিরে ম্যানেজারকে বলল,
“এখন আসুন আপনার। নাটক শেষ হয়ে গেছে।”

রাদ আহিকে সরিয়ে হনহনিয়ে রুমে ঢুকে পড়লো। আহি ম্যানেজারের দিকে এক নজর তাকিয়ে কাচুমাচু মুখে দুঃখ প্রকাশ করতে যাবে তখনই রাদ হাত ধরে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিলো। আহি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী স্বরে বলল,
“পাগল হয়ে গেলি না-কি?”

রাদ কোনো উত্তর না দিয়ে রুমে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। আহি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“কি খুঁজছিস?”

“মরার চেষ্টা করছিলি কি-না দেখছি।”

রাদ বিছানার নিচে উঁকিঝুঁকি দিয়ে মাথা তুলে বলল,
“রশি কই?”

“কিসের রশি?”

“যেটা দিয়ে ঝুলতে যাচ্ছিলি?”

“ফাজলামো করছিস আমার সাথে?”

“মোটেও না। তুই আমার জান বের করে দিয়েছিলি।”

“তোর কি মনে হয় আমি চার বছর আগের ঘটনার জন্য এখন স্যুসাইড করবো? তাও আবার দেশে এসে?”

“বলা তো যায় না। হয়তো তাই। দেশে তো খবরের অভাব আছে। তাই খবর হওয়ার জন্য এসেছিস। যাতে ওই ব্যাটার নজরে আসে।”

“তুই বাড়াবাড়ি করিস না তো। এখন বল, রাতে কোথায় ছিলি?”

“তোর পাশের রুমেই ছিলাম। ভাগ্যক্রমে ওই রুমটা খালি ছিল। নয়তো সারারাত তোর রুমের বাইরে মশা মারতে হতো। আর হোটেলের যা অবস্থা দেখছি, যে-কোনো ঋতুতেই রুম খালি পাওয়া যাবে।”

আহি চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করলো,
“ক’টায় এসেছিস?”

“সাড়ে বারোটায়। আর তুই তো নিশাচরী, তাহলে কাল রাতে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলি কেন?”

“সরি রে। মাথায় ভীষণ ব্যথা ছিল। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম। তাই খেয়াল ছিল না।”

“রাতে তোকে ডাকিনি লোকে আবার কি-না কি ভাববে তাই। সকাল ছয়টায় ঘুম ভেঙেছিল আমার। ভদ্রতার খাতিরে ন’টা পর্যন্ত বসেছিলাম। ফোনের উপর ফোন দিচ্ছি, তুই মদন ফোনটাও ধরলি না। শেষে অধৈর্য হয়ে রুমের দরজায় ঠোকা দিলাম। আর তোর যে মরার ওষুধের সাইড ইফেক্ট। ঠেলা দিয়েও উঠানো যায় না। আরেকটু হলে পুলিশ, মিডিয়া এসে হাজির হতো। তখন তো তোর সেলেব্রিটি বাবাও সুড়সুড় করে চলে আসতো।”

“এসব কথা বাদ দে৷ নাস্তা খাবি চল। হাত-মুখ ধুয়ে নে। চেহারার যা অবস্থা!”

“জ্বি, আমার চেহারা তোমার জন্য ক্লান্ত হয়েছে। তুমি আছো তেলাপোকার শোকে, আর আমি আছি মৌমাছির চিন্তায়।”

আহি হেসে বলল, “তুই কি তাহলে মশা?”

“আমি কি তোর রক্ত খাইছি? নাকি ওই তেলাপোকার রক্ত খাইছি? মশা তোর বাবা। আমি এসব যেমন-তেমন কীটপতঙ্গদের দলভুক্ত নই। আমি বুদ্ধিমান পতঙ্গ।”

“পতঙ্গ আবার বুদ্ধিমান হয়?”

“পিপীলিকা বুদ্ধিমান হয়, বুঝেছিস? আর তুই এসব বুঝবিও না। তুই আছিস তেলাপোকা নিয়ে ব্যস্ত। এখন চল। না-কি মুখে তুলে দিতে হবে? নিজ হাতে খেতে পারবি তো?”

আহি মুখ বাঁকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।

(***)

নাস্তা খাওয়া শেষে রাদ আহির দিকে তাকালো। আহি এখনো খাচ্ছে। ঠোঁট বন্ধ করে মুখ ঘুরাচ্ছে। রাদ ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“এখানে কি কেউ তোর ভিডিও করছে?”

আহি চকিত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো। তারপর রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কোথায়? কাউকে তো দেখছি না!”

“তাহলে এমন ঢং করে খাচ্ছিস কেন? তাড়াতাড়ি খেয়ে, উঠ না।”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তুই সকাল থেকে আমার উপর চেঁচাচ্ছিস! এখানে কি চেঁচামেচি কর‍তে এসেছিস?”

“হ্যাঁ। তোর মগজের স্ক্রুগুলো একটু শক্ত করতে হবে তো! আবার যদি খুলে পড়ে যায়? তাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্ক্রুগুলো নিজেদের জায়গায় সেট করাচ্ছি।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি যেই কাজে এখানে এসেছি সেটাই বলি।”

“হুম, বল। স্ক্রু তাহলে একটু শক্ত হয়েছে।”

আহি চোখ ছোট করে বলল,
“আতাউল গণির নাম শুনেছিস?”

“না। কে সে?”

“নামকরা উকিল। উনার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

“তোর বাবা জানে?”

“না। পাগল তুই? বাবা জানলে আমাকে একা ছাড়তোই না।”

“আংকেল জিজ্ঞেস করে নি ঢাকায় কেন এসেছিস?”

“হুম, লাবীবের দাদা মারা গিয়েছিল বলেছিলাম। ওর বাড়িতে যাবো বলেছি।”

“মাই গড। কোথায় খুলনা, আর কোথায় ঢাকা। আংকেল যদি তোর সাথে লাবীবের বাড়ি যেতে চাইতো?”

“বাবাকে তুই চিনিস না। আমার সাথে দেখা করবে এই আশা করাও আমার জন্য আকাশ-কুসুম ছিল। লাবীবের বাড়ি নিয়ে যাবে সেটা তো সোনার পাথর বাটি। বাবা এতো পজেজিভ না। আমাকে যথেষ্ট ফ্রিডম দিয়েছে। শুধু একটা জায়গায় আমার সব স্বাধীনতা কেঁড়ে নিয়েছে।”

“আর ওটাই মৌলিক স্বাধীনতা। এগুলো স্বাধীনতা না। এগুলোকে বলে মাথায় উঠিয়ে আছাড় মারা।”

আহি দ্বিরুক্তি করলো না। নিশ্চুপ বসে রইলো। রাদ ধীর কন্ঠে বলল,
“চল, উকিলটার কাছে যাই। তোকে মুক্ত করার দায়িত্ব আমার।”

আহি রাদের হাত ধরে মলিন মুখে বললো,
“আমি বের হতে পারবো তো!”

“চেষ্টা করে দেখ। পারতেও পারিস। তুই এখন এডাল্ট। এখন তোর উপর জোরাজুরি খাটাতে পারবে না।”

“মা যে বললো আমি ফেরাউনের গর্তে পড়েছি। মৃত্যু ছাড়া আমার রেহাই নেই।”

রাদ আহির হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“এই ফেরাউনকে কর্ণফুলীতে ভাসিয়ে দেবো।”

“বাবা কিন্তু সাঁতার জানে।”

রাদ আহির কথায় শব্দ করে হাসলো। রাদের হাসি দেখে আহিও নীরবে হাসলো৷ রাদ নিজের হাসি আটকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আহির হাসি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহির দুই গাল ঈষৎ লাল হয়ে গেছে। নয়ন পল্লব চোখের নিচের অংশ ঢেকে দিয়েছে। নাকের দুই পাশে ভাঁজ পড়েছে। ভীষণ সুন্দর লাগছে আহিকে। রাদ আনমনে বলল,
“এভাবে হাসতে জানলে অনেক আগেই আমাদের প্রেম শুরু হতো, আহি। আর তুই আছিস শুধু ওই তেলাপোকার ভাবনায়।”

০৯।

এডভোকেট আতাউল গণির অফিসের বাইরে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর আহি আর রাদ তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেলো। আহি তার ফাইলগুলো এগিয়ে দিয়ে নিজের সমস্যার কথাগুলো গণি সাহেবকে জানালো। আতাউল গণি ফাইলটি হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখলেন। তারপর কৌতূকময় হাসি ফেরত দিয়ে বললেন,
“মিস্টার রিজওয়ান কবিরের বিরুদ্ধে গিয়ে যদি আমি কোনো কেইস নেই, তাহলে কারোই লাভ হবে না। বরং আমার ক্ষতি হবে। আমার সামনে তার একমাত্র মেয়ে বসে আছে, আর এই কথা যদি তিনি জেনেও যান তাহলে হয়তো পত্রিকায় কোনো খারাপ সংবাদ আসবে না। কারণ সমস্যা তো চার দেয়ালের
মধ্যেই চুকে যাবে। কিন্তু মিস ওয়াসিকা কবির, আপনার পাশের জনের গুম হয়ে যাওয়ার খবরটা তড়িৎ গতিতে নিউজ চ্যানেলে প্রচার হতে পারে।”

গণি সাহেব রাদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,
“সাবধান মিস্টার এক্স, ওয়াই, জেড।”

রাদ আর আহি চকিত দৃষ্টিতে আতাউল গণির দিকে তাকিয়ে রইলো। গণি সাহেব টেবিলে হাত রেখে রাদের দিকে ঝুঁকে বললেন,
“শীঘ্রই এই মেয়ের সঙ্গ ত্যাগ করো। নয়তো তোমার বাবা-মা নিজের সন্তান হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যাবেন।”

আহি তার ফাইলগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলাম, আর আপনি আমাদের হুমকি দিচ্ছেন?”

গণি সাহেব দুই গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে জিহ্বায় হালকা কামড় বসিয়ে মাথা দুলাতে দুলাতে বললেন,
“উপদেশ যদি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমার কিছুই করার নেই। আর আমার চেয়ে তুমি তোমার বাবাকে ভালোই চেনো। নিজের জীবনের মায়া কার না থাকে? এখন তুমি তোমার প্রেমিকের জীবন ভিক্ষা দাও।”

রাদ হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই আহি তাকে থামিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“চল রাদ। আমার সমস্যার কোনো সমাধান নেই।”

রাদ আহির হাত ধরে তাকে নিয়ে আতাউল গণির রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। গণি সাহেবের অফিসের বাইরে এসেই আহি ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়লো। রাদ আহির হাত ধরে তার পাশে বসে বলল,
“তুই এতো ভাবিস না তো। দেখিস, এর চেয়ে ভালো কোনো উকিল আমাদের সাহায্য করবেন।”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“না, রাদ। আমাকে হয়তো এটাই মেনে নিতে হবে। দিনশেষে ক্ষমতার কাছে সবাই হেরে যায়।”

“যে যতোই ক্ষমতাবান হোক, সন্তানের খুশি সবার আগে। চার বছর আগে তুই হয়তো আংকেলের কাছে ছোট ছিলি। এখন তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। দেখিস, আংকেল তোর ইচ্ছের গুরুত্ব দেবে।”

(***)

আহি ব্যাগপত্র নিয়ে টিকেট কাউন্টারে বসে আছে। আধাঘন্টা পর বাস ছাড়বে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। রাদ একটা চিপসের প্যাকেট খুলতে খুলতে তার পাশে বসে বলল,
“এখনো মুখ ভার করে বসে থাকবি?”

আহি মলিন হেসে বলল, “উহুম। আমি ঠিক আছি।”

রাদ আহির দিকে নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহি রাদের চাহনি দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহির প্রশ্নবিদ্ধ নয়নের প্রতিত্তোরে রাদ বলল,
“এই যে একটু আগে হাসলি, এই হাসিটার নাম কি জানিস?”

“কী নাম?”

“নীল হাসি।”

আহি ভ্রূ কুঁচকালো। রাদ বলল,
“শুনেছি নীল রং কষ্টের, হতাশার। তোর মুখে নীল হাসি মানায় না, আহি। তোর মুখে হলুদ হাসি মানায়।”

আহি নিঃশব্দে হাসলো। রাদ আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহি রাদের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“আর তোর মুখে এমন গম্ভীর কথাবার্তা মানায় না, দোস্ত।”

রাদ আহির কথা উপেক্ষা করেই বলতে লাগলো,
“হাস্যরত একজন মানুষের মুখে তার মনের ছায়া দেখা যায়।”

“আচ্ছা!”

“এটা আমার কথা নয়। হুমায়ুন স্যারের কথা।”

“তুই বইও পড়িস না-কি?”

“একটু-আধটু।”

“এতো বছর এই কথা জানলাম না!”

“আমাকে জানার চেষ্টা করেছিস কখনো?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ আহির চোখে হাত রেখে বলল,
“চোখ বন্ধ করে হাসার চেষ্টা কর। দেখবি মনের সব কষ্ট চুটকির মধ্যে মিলিয়ে গেছে।”

আহি মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করলো। রাদ বলল,
“কল্পনা কর, হাসলে মানুষকে কতো সুন্দর লাগে।”

আহি কল্পনা করতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আফিফের সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখ।

………………………

সেদিন চারুশিল্পের ক্লাস শেষে স্যারের সাথে সাবলীলভাবে হেসে কথা বলছিল আফিফ। যেই হাসিতে কোনো জড়তা নেই, কোনো জড়িমা নেই। ভীষণ চমৎকার সেই হাসি! আহি ইচ্ছে করে ধীর গতিতে ব্যাগে খাতা-কলম ঢোকাচ্ছিল। যাতে একটু বেশি সময় ধরে ক্লাসে থাকা যায়, আর আফিফের চমৎকার হাসিটা দেখা যায়। আহির লোভ চড়েছিল ভীষণ। সেই হাসিটা মুখস্থ করতে বাসায় এসে স্কেচ বানিয়েছিল সে। একদম হুবহু সেই হাসির স্কেচ। যে-কেউ দেখলে বুঝে ফেলবে এটাই আফিফ। আহির এআর। ততোদিনে নিঁখুত স্কেচ করা শিখে ফেলেছিল আহি। তবে আহির এই নিঁখুত অংকন সম্পর্কে একমাত্র সে ছাড়া আর কেউই অবগত ছিল না। ক্লাসে সে ঠিকই কোনো না কোনো ভুল করতো, যাতে তাকে উপরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া না হয়। কারণ আফিফকে সে এখনই হারাতে চায় না।

………………………

মচমচ শব্দ কানে আসতেই আহি চোখ খুলে দেখলো রাদ গম্ভীরমুখে আহির দিকে তাকিয়ে চিপস খাচ্ছে। আহি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“চল, বাসে উঠে বসি।”

রাদ কাঁধে ব্যাগ উঠিয়ে নিতে নিতে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম হাসি কল্পনা করতে গিয়ে একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিস।”

আহি চোখ ছোট করে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজেই উদ্ভট সব কাজ করতে বলবে, আবার এখন নিজেই মজা নিবে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৬||

১০।
কার্তিকের মাঝামাঝি দিনগুলো ভীষণ সুন্দর। শীতের আগমনে উত্তরের সমীকরণ প্রকৃতিতে ঊষ্ণ ও আরামপ্রদ বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। আকস্মিক বাদল ধারায় পথঘাট ভিজে না অনেকদিন। ধুলো জমা রাস্তা দেখলে মনে হবে মরুভূমিতে এই মাত্র ধূলিঝড় হলো। শরতের রেশ এখনো রাস্তার ধারে রয়ে গেছে। এখানে সেখানে এখনো কাশফুল দেখা যাচ্ছে। তবে কাশবনের শুভ্র রঙ ধূলি কণায় মলিন হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট তৃষাতুর কাক হয়ে বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটার অপেক্ষায় আছে। তবে জন সাধারণ বেশ সন্তুষ্ট। এমন আরামদায়ক বাতাবরণই সবার পছন্দের। আর আহির কাছে হেমন্তের এই রূপটা ভীষণ প্রিয়। প্রায়ই সে হেমন্তের দুপুরে ইজেল-ক্যানভাস নিয়ে নদীর ধারে চলে আসে।
নদীর পাড়ে ছবি আঁকাটা খুবই সাধারণ ঘটনা। যেকোনো চিত্রশিল্পী জীবনে একবার হলেও নদীর দৃশ্য এঁকেছে। কিন্তু আহি অনন্য। সে নদীর পাড়ে বসে সব বিষয়ের ছবি আঁকে, কিন্তু কখনো নদীর ছবি ক্যানভাসে উঠায় নি। কারণ আহি মনে করে এই নদীর ধীর বহমান স্রোত তাকে রঙ-তুলির ব্যবহার শিখিয়েছে। আর এই ক্ষুদ্র শিক্ষাটা সে কারো কাছেই উন্মুক্ত করতে চায় না৷ নদীর ছবি আঁকলে যদি তার অনুপ্রেরণার উৎসটা হালকা হয়ে যায়? কিছু সৌন্দর্য মনে গেঁথে যাওয়ায় ভালো। সৃষ্টিকর্মে প্রকাশিত হলে এর মাধুর্যতা হারিয়ে যায়। আর এতো চমৎকার দৃশ্য হয়তো আহি কখনোই আঁকতে পারবে না। তাই নদীর পাড়ে গিয়েও সে কখনো নদীর ছবি আঁকে নি। তবে সে হেমন্তের মধ্যাহ্ন দুপুরে নদীর বহমান স্রোতকে সাক্ষী রেখে তার গোপন প্রেমের গল্প করেছে।

(***)

আজ বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতি, শুক্র এই দু’দিন চারুশিল্পে ক্লাস থাকে। কিন্তু আজ নেই। দেশের দুই দলীয় রেষারেষির দরুন আজ হরতাল চলছে। আহির বাবা-মা দু’জনই বাসায় উপস্থিত। তারা একই ছাদের নিচে আছেন মানেই বাসায় ছোটখাটো একটা ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে। তাই আহি চুপচাপ নিজের ছবি আঁকার জিনিসপত্র গুছিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাসায় যা হওয়ার হোক, অন্তত তার হেমন্ত বিলাসে বাঁধা না আসুক।

রিজওয়ান কবিরের মন-মেজাজ সকাল থেকেই চড়াও হয়ে আছে। সালমা ফাওজিয়া যতোবারই তার সামনে পড়ছেন তার কপালে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠছে। যে-কোনো মুহূর্তে কবির সাহেব আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারেন। আহি বাবা-মার ঝগড়াঝাঁটিতে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকেই দেখছে মায়ের মতো শক্ত মহিলাটাও তার বাবার মার খেয়ে নীরবে তার সংসার গুছিয়ে সেই স্বামীর ঘরেই ঘুমোতে যায়। আহি মায়ের আত্মসম্মানবোধের অধঃপতনে মোটামুটি বিরক্ত। তবে বাবার বিশেষ ভালোবাসায় সিক্ত থাকায় বাবা-মার মারামারিতে আহি সবসময় নিরপেক্ষ থাকতো। যা হচ্ছে হোক, তাতে তার কি? মা মার খেতে না চাইলে চলে যাক। কি দরকার বাবার সাথে থাকার? তবে আহি আজ বুঝতে পারছে মা কেন এতো নির্যাতন সহ্য করেও সেই বাড়িতে পড়েছিল। সেই মুহূর্তে নিজের নিরপেক্ষতা আহিকে আজ ভাবতে বাধ্য করছে, সে ভীষণ স্বার্থপর ছিল। তার স্বার্থপর মানসিকতার ফলাফল আজ সে নিজেই ভোগ করছে।

(***)

আহি হরতালের দিনে মধ্যাহ্ন দুপুরকেই বেছে নিয়েছে হেমন্ত বিলাসের জন্য। আঁকছে পাহাড়ের গায়ে জন্মানো কিছু ফুলের দৃশ্য। আহি নিজেও কখনো এই ফুল দেখেনি। এটা তার সৃষ্ট কাল্পনিক ফুল। ফুলের রঙ ধূসর-লাল। ছবি আঁকা শেষ হতেই আহি উঠে দাঁড়ালো। নদীর পাড়ে তরুণ-তরুণীদের প্রেমলীলা চলছে। কেউ চমৎকার ভাবে একে অপরের হাত ধরে রেখে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে, আবার কেউ কেউ ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। তারা একে-অপরের মাঝেই ডুবে যাচ্ছে। আশেপাশের মানুষেরা যে তাদের দেখছে, তাতে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আহি সেই প্রেম লীলায় মত্ত থাকা প্রেমিক-প্রেমিকাদের ছবি আঁকার সিদ্ধান্ত নিলো। ইজেল থেকে সদ্য আঁকা ছবিটি নামাতেই তার সাথে থাকা ড্রাইভারটি দৌঁড়ে এসে বলল, মিসেস সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আহি সব ফেলে ড্রাইভারের সাথে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। পুরো রাস্তায় সে ভেবে যাচ্ছিল, তার বাবা কি তার মাকে মেরে ফেলেছে? তার কি মাকে একা বাসায় রেখে বের হওয়া উচিত হয়েছিল?
হরতাল হলেও শহরের ভেতরে হালকা-পাতলা রিক্সা আর গাড়ি চলাচল করছে। আর রাস্তা অনেকটা ফাঁকা থাকায় গাড়ি দ্রুত হাসপাতালের সামনে পৌঁছে গেলো। সরকারি হাসপাতালে মাকে ভর্তি করানো হয়েছে। হাসপাতালে ঢুকতেই দেখলো মুনিয়া খালা অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। আহি তার কাছে আসতেই তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
“তোমার ভাইটারে বাঁচানো যায় নাই, ছোড আফা। স্যার যে লাথিটাই না মারলো ম্যাডাম রে!”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কি ভাই-বোন আসার কথা ছিল? সে তো এই বিষয়ে কিছুই জানতো না। মায়ের সাথে কি অদ্ভুত সম্পর্ক তার? শুনেছে মায়ের সাতমাস শেষ হয়েছিল। এতোদিন ভেবেছে, মা বোধহয় মোটা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ সে এতো বড় সুসংবাদ পেলো তো পেলো, সেটা দুঃসংবাদে পরিণত হওয়ার পরই পেলো।

দারোয়ান চাচা ভালো মানুষ। নাম মোজাম্মেল। তিনিই সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। আর এখন রক্তের জন্য এদিক-ওদিক ছুটছেন। কিন্তু আহির বাবার কোনো হদিসই নেই। তিনি কি পালিয়েছেন না-কি? রিজওয়ান কবির পালানোর মতো মানুষ নন। তিনি দাপটের সাথে চলাফেরা করেন। দেশের নামকরা ব্যবসায়ী। ভালোই প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে তার। দেশের সব দলের নেতাদের সাথে তার সখ্যতা। যে-কোনো পরিস্থিতিতে তিনি নিরাপদ।

(***)

আহি সেদিনই প্রথম বাবার আসল রূপ দেখেছিল। বাবা যে প্রয়োজনে খুনীও হতে পারেন, সেদিনই প্রথম জেনেছিল সে। সেদিন সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পর বাবার কাছে প্রশ্ন করতে গিয়েছিল আহি। কেন তার ভাইকে মেরে ফেলেছে? সাত মাসের অস্তিত্বটাকে কেন মিটিয়ে দিয়েছে? কিন্তু আহি তার বাবার মুখশ্রী দেখে কিছুই জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। রিজওয়ান কবির এমন এক ভয়ংকর অপরাধ করেও নির্দ্বিধায় ফোনে কারো সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন। বাবার হাসিটা ছিল মারাত্মক কুৎসিত! তাকে দেখতে হিংস্র দানবের মতোই মনে হচ্ছিল। সেদিনের পর থেকেই আহি নীরবে বাবার সাথে সখ্যতা কমিয়ে দিয়েছে। সালমা ফাওজিয়াও সেই যাত্রায় বেঁচে ফিরেছিলেন। কিন্তু সন্তান হারিয়ে তিনি নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন। তার দেহটাই যেন অক্ষত ছিল, আত্মাটা তো সেই কবেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছিল। এদিকে ডাক্তারও জানিয়ে দিয়েছে তিনি আর কোনোদিন মা হতে পারবেন না। এতো বড় দুঃসংবাদ যেন রিজওয়ান কবিরকে একটুও স্পর্শ করলো না। বরং তিনি এই দুঃসংবাদকে সুসংবাদ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।

……………………..

রাদের কন্ঠে আহির ঘোর কাটলো। বাস ঢাকা ছেড়েছে অনেক আগে। জানালার বাইরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহি। মায়ের কান্না মাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বুকটা হুহু করে উঠলো তার। তখন যদি একটু সচেতন হতো, তার জীবনটা এমন এলোমেলো হতো না।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৭||

১১।
বাসের জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা এসে জমছে। আহি হাতটা বাইরে নিয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করতে যাবে তখনই রাদ তার হাত টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ বিরক্ত মুখে বলল,
“তোর কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে?”

আহি বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বললো,
“তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“তোর সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলার মতো তো তুই কিছুই করছিস না। চলন্ত বাসে কেউ জানালার বাইরে বৃষ্টি ধরার জন্য হাত বের করে দেয়? এটা তো বোকামি।”

রাদ নিজের কপালে হালকা চাপড় মেরে বলল,
“কি যা-তা বলছি! বোকারাও এতো বোকা হয় না। কান্ড জ্ঞানহীনরাই এমন কাজ করে। যাদের হুশ জ্ঞান ভালো না, তারাই এমন ঢিলার মতো কাজ করে। আর তুই তো পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে যাওয়া পলস।”

আহি চোখ ছোট করে রাগী স্বরে বলল,
“বেশি বেশি বলছিস!”

“হ্যাঁ, আমি তো একটু বেশি বেশিই বলি। আর যারা বলে না, তারা নিঃশব্দে ধুয়ে দিয়ে যায়।”

“আমার অতীত নিয়ে কথা বলবি না।”

“আগে তুই নিজে সেই অতীত থেকে বের হয়ে আয়। তারপর আর কারো বাপের সাধ্য নেই তোকে খোঁচা দেওয়ার। আর শোন, এটা মেইন রোড। এখানে বাস ঘেষাঘেষি করে চলে। পেছন থেকে একটা বাস এসে তোর হাত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তখন হাত খুঁজতে থাকবি। পাবিও না আর। আর তুই কি এটা তোর বাসার জানালা ভেবেছিস যে মাথার উপর দিয়ে যাবে?”

“আমার বাসার উপর দিয়ে বাস চলাচল করে?”

“হেলিকপ্টার তো যায়। তোর বাবার সেই পারসোনাল হেলিকপ্টার তো ছাদেই ল্যান্ড করে। বড়লোকি হাবভাব।”

আহি রাদকে আর কিছু বললো না। সে যাই বলুক, আহির খারাপ সময়ে মানসিক শক্তি হয়ে তার পাশে ছিল। তাই সে রাদের কথায় মন খারাপ করে না।

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার জানালার বাইরে তাকালো। জানালার কাচ এবার পুরোপুরি ভিজে গেছে। কাচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার কোনো ঠিক নেই। একটু আগে সে গরমে হাসফাস করছিল, আর এখন বৃষ্টির ঝাপটায় পুরো বাতাবরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফোনে গুগল ম্যাপ দেখে বুঝলো তারা এখন যাত্রাবাড়ি পার করছে। হয়তো ঢাকা শহর আর যাত্রাবাড়ির আবহাওয়ায় পার্থক্য আছে, তাই এই হঠাৎ বৃষ্টির আবির্ভাব।

আহি জানালা খুলে দিতেই রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“অন্তত আমার সামনে মরতে যাবি না। আমি রক্তারক্তি সহ্য করতে পারি না।”

আহি হেসে বলল,
“প্রমিস, হাত বের করবো না। একটু বৃষ্টির ঝাপটা আসুক। এভাবে জানালা বন্ধ করে রাখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।”

রাদ আহির দিকে সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আহি রাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখলো।

(***)

যাত্রাবাড়ীতে বোধহয় কয়েক ঘন্টা ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আশেপাশে সব ভেজা। রাস্তায় কাঁদা জমে আছে। মাঝে মাঝে কাঁচা রাস্তা চোখে পড়ছে আহির। সেগুলো কাঁদায় পুরো ডুবে আছে। সেই কাঁদায় মাখামাখি হয়ে রাস্তাগুলো চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতেই আহির চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার জীবনের সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতাটির কথা।

…………………….

দিনটি ছিল শরতের বৃষ্টিস্নাত দুপুর। প্রতিবারের মতো চারুশিল্পের ক্লাস শেষ হতেই আহি আফিফের পিছু নিয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবার আফিফ ক্লাস শেষে বাসে উঠে পড়ে, আর শুক্রবার মসজিদে ঢুকে যায়। আজ বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ আফিফ বাসে উঠবে। আহি ভাবলো সেও আজ আফিফের সাথে বাসে উঠবে। লোকাল বাসে কখনোই চড়া হয় নি তার। বাবার গাড়িতে করেই দীর্ঘ দূরত্বের পথ পাড়ি দিয়েছিল। তাই আজ নতুন অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্যই সে আফিফের পিছু পিছু বাসে উঠে পড়লো। বাসে যাত্রীদের ভীড়। মেয়েদের সিট সব ভর্তি। আহির বসার কোনো জায়গা নেই। তাই সে আফিফকেই অনুসরণ করলো। আফিফ ভীড় ঠেলে পেছনে গিয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ালো। আহিও চুপচাপ পেছনে চলে গেলো। সবাই আহির দিকে একনজর তাকাচ্ছে। সবাই হয়তো ভাবছে, সে আফিফের সাথেই এসেছে। কারণ দু’জনই একসাথে উঠেছে, এখন দু’জনই এক জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের সিট যেহেতু সামনে, তাই তারা সামনেই দাঁড়ায়। এখন আহির এভাবে ছেলেদের ভীড় ঠেলে পেছনে এসে দাঁড়ানোটাই সবার বিষ্ময়ের কারণ। কিন্তু আহি তো এই নিয়ম সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তাই সে আফিফের পাশে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু আফিফের দৃষ্টি একবারো আহির দিকে পড়লো না। সে আছে নিজের ঘোরে ব্যস্ত।

বাস চলছে ভাঙা পথ পাড়ি দিয়ে। বাসের ঝাঁকুনিতে আফিফের সাথে হালকা ধাক্কা লাগছে আহির। আহি চোখ বন্ধ করে আছে। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে তার। এভাবে অজান্তেই আফিফের স্পর্শ তার হাত-পা কাঁপাচ্ছে। ধীরে ধীরে তার গাল গরম হয়ে যাচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠ কপালে ঠেকালো আহি। খুশিতে তার জ্বর উঠে গেছে কি-না দেখে নিলো। কিন্তু হাতটা বরফের ন্যায় জমে গেছে। আহি তার ঠান্ডা হাত দিয়ে নিজের গাল ছুঁয়ে দিলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে তার। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে লাগলো,
“শরীর জুড়ে এমন নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা ছড়াচ্ছে কেন? গাল গরম, হাত ঠান্ডা। শরীরের তাপমাত্রার এই অদ্ভুত কম্বিনেশন কখন হয়?”

আহি নিজের প্রশ্নে নিজেই হাসলো। মনে মনে উত্তর দিলো, “প্রেমে পড়লে হয়।”

আফিফ উলটো দিকে ফিরে দাঁড়ানো। আহি তার ঠিক পেছনে। আহির দৃষ্টি আফিফের চুলের দিকে। তার ঘন চুল। আহির ইচ্ছে করছে হাত ডুবিয়ে দিতে। সে নিজের ইচ্ছে পূরণ করার আশায় হাত বাড়াতেই থমকে গেলো। আফিফ বুঝতে পারলে তাকে মারাত্মক লজ্জায় পড়তে হবে। বাবাকে অভিযোগ করে বসলে তার চারুশিল্পে যাওয়া বন্ধ।
না, ধীরে ধীরে আগানো ভালো। কোনো সম্পর্ক শুরুর পূর্বে তাড়াহুড়ো ভালো না। বিশেষত ভালোবাসায় তাড়াহুড়ো না করাই ভালো। ভালোবাসা ধীরগতিতে জীবনে আসলে দীর্ঘস্থায়ী হয়। আহি চায় আফিফ তার জীবনের দীর্ঘস্থায়ী অংশ হোক। এতো সহজে সে আফিফকে হারাতে চায় না।

(***)

বাস থেকে একজন নামতেই আহি সেই সিটে বসে পড়লো। একদম আফিফের পাশের সিট। আফিফ বসতে চেয়েছিল, কিন্তু পাশে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে সরে দাঁড়ালো। আফিফের এই ভদ্রতা দেখে আবার প্রেমে পড়ে গেলো আহি। দিনে ক’বার যে সে আফিফের প্রেমে পড়ে তার ইয়েত্তা নেই। আফিফের সামনে বসে বেশ ভালোই হয়েছে। তার দিকে তাকানোর ভালোই সুযোগ পাচ্ছে আহি। কিন্তু মাথা উপরে তুলে তাকানোটা অভদ্রতা। তাই আহি ব্যাগ ঘেঁটে তার ছোট আয়নাটা বের করলো। আফিফের শ্রান্ত মুখ দেখা যায় মতো আয়নাটা ধরলো।
এদিকে আফিফের চোখ ব্যস্ত রাস্তার দিকে। উদাস চাহনি তার। কারো উদাস চাহনি কি এতো চমৎকার হতে পারে? আহি যখন মন খারাপ করে থাকে, তখন তার নাক-মুখ ফুলে যায়। ভীষণ রকম বিশ্রী লাগে দেখতে। কিন্তু এই প্রথম কারো উদাস চাহনি দেখে আহির চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে স্ট্যাচু বলে সব থামিয়ে দিয়ে আফিফের মুখের উপর ঝুঁকে তাকিয়ে থাকতে। ডোরেমনের গেজেটটা পেলে ভালোই হতো। আফিফকে পাওয়ার জন্য এতোদিনে সে সব গেজেট ব্যবহার করে ফেলতো।

আফিফের কন্ঠে ঘোর কাটলো আহির।

“দাঁড়ান, এখানে নামবো।”

আহির কানে বাক্যটা কয়েকবার গুঞ্জন করে উঠলো। আহিও উঠে দাঁড়ালো। আহি উঠে দাঁড়াতেই আফিফের গায়ের গন্ধটা তার নাকে এসে ঠেকলো। অনেকটা কাছাকাছি ঘেঁষে পড়েছিল আহি। এদিকে আফিফ ব্যস্ত বাস থেকে নামায়। সে সেকেন্ডের মধ্যেই দূরত্ব রেখে সরে গেলো। আহি বুঝলো, সে বেশি হুড়োহুড়ি করে ফেলেছে। আফিফ যদি বুঝে যায়, আহি তার পিছু নিচ্ছে?

(***)

বাসের হেল্পারকে বারো টাকা দিয়ে নেমে গেলো আফিফ। আহিও একটা বিশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে নেমে হেলো। হেল্পার বলল,
“আপনের আট টাকা লইয়া যান।”

আহি তার কথাটা কানেই নিলো না। আট টাকা দিয়ে সে কি করবে যদি আফিফকেই হারিয়ে ফেলে?
আহি নিজেই জানে না কোথায় এসে বাস থেমেছে। আফিফ বাম পাশের একটা রাস্তায় ঢুকে পড়লো। আহিও তার পিছু পিছু যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হাঁটার পর আফিফ একটা গলির ভেতর ঢুকলো। গলিতে ঢুকতেই দেখলো রাস্তায় কাঁদা জমে আছে। হয়তো কাল রাতের বৃষ্টিতে ড্রেন উপচে ময়লা পানি রাস্তায় উঠে এসেছিল। এখন পানি নেমে সব ময়লা ভেসে উঠেছে। বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে লাগতেই আহির গা গুলিয়ে এলো। আফিফ এমন জায়গায় থাকে? আহি দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছে। এই রাস্তায় পা রাখলে যদি পিছলে পড়ে? অনেক ভাবার পর আহি সন্তপর্ণে রাস্তায় পা রাখলো। আর যাই হোক, বিয়ের পর তো তাকে রোজ এই রাস্তায় আসতে হবে। এমন ভাবনা মনে আসতেই আহির মনে হিম সমীরণ বয়ে গেলো। আহি লাজুক হেসে মনে মনে বলল,
“তখন মিস্টার এআরকে বলবো কোলে করে রাস্তা পার করিয়ে দিতে।”

আহি অর্ধেক পথ যেতেই কাঁদায় তার স্যান্ডেল আটকে গেলো। কোনোভাবেই সে টেনেও বের করতে পারছে না। আহি এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখলো আফিফ একটা বাড়িতে ঢুকে গেছে। এক তলা সেমি পাকা বাড়ি। দেয়াল থেকে সিমেন্ট খসে পড়ছে। আহি উদাস চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। হুট করে তার মাথায় একটা প্রশ্নের উদয় হলো,
“বাবা কি এই জায়গায় তাকে বিয়ে দেবেন?”

পরক্ষণেই সে এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো যে বাবা না মানলে সে পালিয়ে চলে আসবে। তবুও সে আফিফকে ছাড়বে না।

(***)

আহিকে অনেকক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা লোক তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো। তিনি যত্নের সাথে কাঁদার ভেতর থেকে আহির পা উঠিয়ে আনলেন। কিন্তু স্যান্ডেলটা কাঁদায় তলিয়ে গেছে। সেটা নেওয়া সম্ভব না। আহি খালি পায়ে আবার পিছু ফিরে শুকনো রাস্তায় চলে এলো। ফর্সা পা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে আছে। ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করে বাবাকে কল করতে গিয়েও করলো না। সে কোথায় আছে নিজেও জানে না।
পাশের একটা দোকানের বাইরে বালতি ভর্তি পানি। হয়তো দোকানদার বৃষ্টির পানি জমিয়েছেন। আহি সেই পানি দিয়েই পা ধুয়ে নিলো। এরপর দারোয়ান চাচাকে ফোন করে বলল, সে এক বান্ধবীর সাথে তার বাসায় এসেছে। এখন পথ চিনছে না। পাশের দোকানদারকে ফোন এগিয়ে দিতেই তিনি মোজাম্মেল চাচাকে ঠিকানা বললেন। প্রায় একঘন্টা পর মোজাম্মেল চাচা আহিকে নিতে এলেন। এরপর তিনি রাস্তার ভ্যান থেকে আহিকে এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেল কিনে দিলেন। তারপর সিএনজি নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলেন। আহি ঘরে ঢোকার আগেই পেছন ফিরে চাচাকে বললো, বাবাকে যাতে আজকের ঘটনা না জানায়। দারোয়ান চাচা আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“সব কথা স্যারকে বলা যায় না, মা। আমি সেটা জানি।”

(***)

আহি নিজের ঘরে এসে গোসল সেরে ডায়েরী হাতে নিয়ে বসলো। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। কলম হাতে নিয়ে লিখলো,

“আজ আমি তোমার পিছু নিয়েছি। তোমার জন্য বাসে চড়েছি, কাঁদায় স্যান্ডেল হারিয়ে এসেছি। আর তুমি? একবারো আমার দিকে তাকাও নি। এআর, সত্যিই কি আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি? আমার না তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। তুমি পাশে থাকলে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। আজকে যতোক্ষণ তুমি আমার কাছে ছিলে, আমি ততোক্ষণ শুধু হেসেছি। এই হাসি মনের হাসি। আমার মনটা চমৎকার ভাবে হাসে, জানো? তোমাকে দেখলে আমার মন হাসে। তোমাকে কিন্তু সারাজীবন আমার মনকে হাসাতে হবে।”

আহি কলম তুলতেই সালমা ফাওজিয়া দরজায় কড়া নাড়লেন। দুপুরের খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। বিকেলও গড়িয়ে যাচ্ছে। আহি এখনো ঘর বন্ধ করে বসে আছে। সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে খেতে ডাকছেন। আহি মাথা ব্যথা করছে বলে কানে হেডফোন গুঁজে পেন্সিল হাতে নিলো। আজকের দিনটি স্কেচ করবেই সে। এই দিনটা তার জন্য বিশেষ একটা দিন।

বাসের ভেতরে অনেক যাত্রী। যাত্রীদের ভীড়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। তার পেছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্কেচ শেষ করেই আহি স্কেচটির নিচে লিখলো,

“প্রথম স্পর্শ পেয়েছি তোমার, আর এই স্পর্শ আমার আত্মাকে স্পর্শ করে ফেলেছে।”

…………………………

অতীত মনে পড়তেই আহির চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণা স্পর্শ করতেই রাদ তার দিকে ঝুঁকে তাকালো। আহি রাদের তাকানো দেখে তার দিকে ফিরে বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”

“কাঁদছিস?”

“পানির ঝাপটা লেগেছে।”

“চোখ লাল হয়ে গেছে তোর।”

আহি জানালা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“ঝাপটা চোখের ভেতরে লেগেছে তাই।”

রাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “মিথ্যুক।”

আহি মলিন মুখে রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুখ ফিরিয়ে নিলো। আহি সিটে হেলান দিয়ে ধরা কন্ঠে বলল,
“সেই দিনও এমন বৃষ্টি ছিল। রাস্তায় কাঁদা ছিল। আমি সব উপেক্ষা করে তার পিছু পিছু অচেনা পথ ধরেছি। স্বপ্ন দেখেছি, সেই অচেনা পথ একদিন আমার পরিচিত পথ হবে। কিন্তু মানুষটা আমার দিকে তখনও ফিরে তাকায় নি, এখনো ফিরে তাকায় না। আমাকে একটুও অনুভব করতে পারে নি সে। আমি এক তরফা ভালোবেসেছি। আমি বোকা, আমি পাগল। তুই ঠিকই বলিস। আমার মাথায় কিছু নেই।”

রাদ আহির মাথাটা নিজের কাঁধে ফেলে দিয়ে বলল,
“তুই বোকা না। তুই একটা বোকা ছেলের প্রেমে পড়েছিস। তুই পাগল না, ছেলেটা পাগল ছিল বলেই তোকে অনুভব করতে পারে নি।”

“না রাদ, ওর কী দোষ? আমি ভালোবেসেছি বলে তারও যে আমাকে ভালোবাসতে হবে, এমন তো নয়। ভালোবাসায় জোর চলে না, রাদ। ভালোবাসা হুট করে হয়ে যায়। কিন্তু ভালোবেসে ফেলার পর অনেককেই দেখেছি সেই মানুষকে ভুলে যেতে। আর আমার সমস্যা কোথায় আমি নিজেও জানি না। আমি আজও তাকে ভুলতে পারি না। আমি আসক্ত হয়ে গেছি। নেশা যেমন কাটানো সহজ না, আমার এই আসক্তিও তেমন কাটছে না। শুনেছি আসক্ত মানুষকে সুস্থ করার জন্য তার প্রিয় নেশাদ্রব্য তাকে কিছুদিন খেতে দেওয়া হয়, আর আমি তো আমার আসক্তিটা ছুঁয়েও দেখতে পারলাম না। আমি কি তাহলে সারাজীবন এআর আসক্ত থেকে যাবো?”

রাদ চুপচাপ বসে আছে আর আহির কাঁপা কন্ঠের আক্ষেপ শুনছে। আফিফের প্রতি ক্ষোভ যেন রাদের বুকটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আহি রাদের হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমার ব্রেনটা খুলে আফিফের স্মৃতিগুলো মুছে দেওয়া যায় না? যতো টাকা খরচ হবে, আমি করবো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, রাদ। আমার গলা কাঁপছে। আমি গত চার বছর ধরে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারি না, খেতে পারি না। আমি প্রাণ খুলে হাসতেও পারি না। আমাকে একটু বাঁচা, রাদ। বাঁচা আমাকে।”

রাদ আহির হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“তুই যা বলছিস তা তো সম্ভব নয়। তবে একটা কাজ করা যায়। আফিফের সাথে দেখা করে তোর সমস্যার কথাটা খুলে বল। ও যদি তোকে বুঝে, তাহলে সমাধান পেয়ে যাবি।”

আহি রাদের হাত ছেড়ে দিলো। রাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি কখনোই এই কাজ করবে না তা রাদ ভালো করেই জানে। তাই ইচ্ছে করে আহিকে চুপ করানোর জন্য এই কথা বললো। নয়তো এই সমস্যার দ্বিতীয় কোনো সমাধান তার কাছে নেই।

চলবে-