Sunday, August 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 186



উধয়রনী পর্ব-৪৭ + বোনাস পর্ব ১+২

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৭||

৯১।
পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলেন রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি। আহি বাইরে দাঁড়ানো ছিল। তাদের বের হতে দেখে সে সালমা ফাওজিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে ফিরে তাকালো। আহির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে। বাইরে থেকে যে-কেউ দেখলে বুঝবে সে বেশ শক্ত মনের, কিন্তু আহির স্পর্শটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে ভেতর থেকে এখনো অনেকটাই দুর্বল। সে গতকাল সকালে এসেই বাবা, মিসেস লাবণি ও তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের কাউকেই গ্রেফতার করে নি। উলটো তাদের বলে এসেছে, একবার নিজ থেকে থানায় এসে যাতে দেখা করে যায়৷ আর রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি আজই এলেন থানায়। লাবণি থানায় আসার আগে আহিকে ফোন করে বলল, এসে তাদের মুক্তি দেখে যেতে। আহিও মাকে নিয়ে চলে এসেছে। ভেবেছে অন্তত কয়েকদিন তারা ছাড়া পাবে না। কিন্তু এক ঘন্টার জন্যও যে তাদের আবদ্ধ করা হবে না, এটাই বেশ কষ্ট দিয়েছে আহিকে। যারা বছরের পর বছর আহিকে ব্ল্যাকমেইল করে মানসিকভাবে বন্দি করে রেখেছিল, তাদের এক ঘন্টার শাস্তিও হলো না? অন্যদিকে তাজওয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাকে ওসি সাহেব হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন ফলমূল। কাল সন্ধ্যায় তার সহচর সোহাগ এসে সেই হেলমেট পরা আগন্তুকের বিরুদ্ধে মামলা করে গেছে। সাথে প্রমাণস্বরূপ দিয়ে গেছে তাজওয়ারের বাংলো বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ড। এদিকে আহি তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে শুনে তাজওয়ার আহিকে ফোন করে আহত কণ্ঠে বলেছিল,
“সুইটহার্ট যদি এমন স্পাইসি কাজ করে জীবনটা একদম বেদনাদায়ক হয়ে যায়। আমার শরীরে এতো এতো আঘাত, শুধু মনটা অক্ষত ছিল। আর তুমি সেটাও ভেঙে দিলে। থাক, সমস্যা নেই। ভাঙা মনে কীভাবে মানুষকে রাখতে হয়, তা আমি জানি।”

আর আহি উত্তরে কিছু না বলেই কল কেটে দিয়েছিল।

(***)

রিজওয়ান কবির আহির সামনে এসে দাঁড়ালেন। আহি শক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিজওয়ান কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সালমা ফাওজিয়ার দিকে একনজর তাকিয়ে আহিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছো। বেশ বাড়াবাড়ি করছো মনে হচ্ছে।”

আহি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“বাবা শব্দের অর্থ জেনে আসবেন, তারপর না হয় বাবা হওয়ার অধিকার দেখাবেন৷ আমি বাবার বিরুদ্ধে মামলা করি নি। আমি একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছি, যে তার ব্যবসার লাভের জন্য একটা মেয়ের সম্মানে আঘাত করেছে।”

মিসেস লাবণি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“যা করেছো, তার জন্য তোমাকে আর তোমার মাকে অনেক কিছু দেখতে হবে।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“দেখে তো ফেলেছি। সব দেখে ফেলেছি। এবার দেখাতে হবে। তবে আপনাদের দেখাবো না। পুরো পৃথিবীকে দেখাবো। সবাইকে জানাবো, বাবা সবসময় রক্ষক হয় না। কিছু বাবা ভক্ষকও হয়। সব বাবা আগলে রাখতে জানে না, কিছু বাবা ধ্বংস করে দিতে জানে। সতর্ক করতে হবে সবাইকে। হিংস্র মানুষদের আসল চেহারা সবাইকে দেখাতে হবে।”

লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তা, কীভাবে দেখাবে শুনি? কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”

আহি মাথা নিচু করে বলল, “প্রমাণ পেয়ে যাবো।”

লাবণি রিজওয়ান কবিরের হাত টেনে ধরে বলল,
“বাসায় চলো। তোমার মেয়েকে কিছুদিন মুক্তির স্বাদ পেতে দাও। বন্দি থাকতে থাকতে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। না আছে কোনো প্রমাণ, আসছে আমাদের ধমকাতে।”

লাবণি রিজওয়ান কবিরকে নিয়ে সামনে পা বাড়াতে গিয়েই থেমে গেলো। সে পেছন ফিরে আহিকে বলল,
“আহি, ফিরে তো তোমাকে আসতেই হবে। আর এবার ফিরে এলে, পেছনে কাউকে জীবিত দেখবে না। তোমার তিন বান্ধবী, তোমার প্রাণের দুই বন্ধু, তাদের পুরো পরিবার আর তোমার মা ও তার পরিবার, না জানি কার কার কাফনের কাপড় কিনতে হয়৷ এক কাজ করো, আজ থেকেই কেনাকাটা শুরু করে দাও। আর কুলখানির আয়োজন তো হবেই। আমরা না হয় তোমার হয়ে দান করে দেবো।”

কথাটি বলেই তারা গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে বললেন,
“প্রমাণ কোথায় পাবি?”

আহি মায়ের হাতে আলতো হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,
“প্রমাণ তো আমার কাছে আছেই। কিন্তু আমি এতো সহজে সেই প্রমাণ সবার সামনে আনবো না। অনেক বছর তারা আমাকে মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছে। আমি তাদের তিলে তিলে কষ্ট দেবো। রিজওয়ান কবিরের কাছে তার রেপুটেশন, বিজনেস, ইগো, আমার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তার রেপুটেশন, বিজনেস ইগো, সবকিছুই ধ্বংস করে দেবো। মিসেস লাবণি সম্পর্কে আমি যা জেনেছি, একবার যদি সেটা সবার সামনে আনতে পারি, আমার কষ্টগুলো মুক্তি পাবে। আমি তো নিজেকে মুক্ত করে নেবোই। কিন্তু কয়েক বছর পর আমি আর শান্তি পাবো না। তাই আমার নিজের কষ্টগুলোকেও মুক্ত করতে হবে। তারপর আমি শান্তিতে বাঁচতে পারবো।”

(***)

তাজওয়ার কয়েক বার সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ড দেখে ফেলেছে। সে কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না তাকে মারার সাহস কারো থাকতে পারে। সোহাগ তাজওয়ারকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল,
“স্যার, আপনার কাকে সন্দেহ হচ্ছে?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির সাথে জড়িত কেউ এই কাজ করেছে।”

“রাদ?”

তাজওয়ার কিছু একটা ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“হুমম, রাদ। আমার বাংলো বাড়ি সম্পর্কে আহি ছাড়া আর কেউই জানে না। আহি রাদকে এই ইনফরমেশন দিয়েছে, আর রাদই এই কাজ করেছে।”

“স্যার, আপনি অনুমতি দিলে তাকে এক্ষুনি ধরে নিয়ে আসছি।”

তাজওয়ার ফুটেজটা আবার দেখে বলল,
“না, না, না। রাদ হবে না। এই ছেলে রাদ নয়। রাদ অনেকবার আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। হেলমেট পরা এই ছেলেটা আমার সমান৷ আর রাদের হাইট আমার চেয়ে বেশি। হাইট জুতো পরে বাড়ানো যায়, কিন্তু কমানো যায় না। এই ছেলে রাদ হবেই না।”

“তাহলে কে?”

“আহির বন্ধু, কি যেন নাম?”

“লাবীব?”

“হ্যাঁ, লাবীব। ছেলেটার বাইকও আছে। বেশ ভালোই বাইক চালায়।”

“স্যার, আফিফও তো হতে পারে!”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওর কথা আমার মাথায়ও আসে নি। ও এমন কাজ করতে পারবে? ওর কি সেই সাহস আছে?”

“আপনার বাংলো বাড়ি সম্পর্কে মিস আহির চেয়ে আফিফেরই ভালো জানার কথা। এখন তো সে আপনার এসিস্ট্যান্ট হিসেবেই কাজ করছে।”

তাজওয়ার চুপ করে রইলো। সোহাগ তাজওয়ারকে চুপচাপ দেখে বলল,
“কি ভাবছেন, স্যার?”

“আফিফকে আমি বোকা ভেবেছি। এখন ভাবছি, এই বোকাটা যদি সত্যিই চালাক হয়ে থাকে, তবে আমি ওকে আমার এসিস্ট্যান্ট বানিয়ে চরম ভুল করেছি। কারণ ওর কাছে আমার সেভেন্টি ফাইভ পারসেন্ট ইনফরমেশন থাকার কথা। ও আমাকে যে-কোনো মুহূর্তে ফাঁসাতে পারে।”

“স্যার, চিন্তা করবেন না। আফিফ এই কাজ নাও করতে পারে। আমি তো শুধু ওর নামটা জানালাম আপনাকে। আপনি এর আগে ওর আপার সাথে যা করেছেন, তারপর তো সে কিছুই করে নি।”

“করে নি কারণ রেনুকে নিয়াজীর সাথে বিয়ে দিয়ে আমি ওকে হাতে রেখেছিলাম।”

“তাহলে এখনো তো সে হাতেই আছে।”

তাজওয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নেই। মনে হচ্ছে নেই। আহি হুট করে নিয়াজীর বাড়িতে গিয়ে যেই কাজ করলো, এরপর নিয়াজী রেনুকে এখন আর কিছুই করবে না।”

“স্যার, আপনি ওকে মেরেছেন তাই কিছু করবে না। নিয়াজীকে বলে দিন, রেনুকে যাতে হাতছাড়া না করে। রেনু নিয়াজীর সাথে আটকে থাকলে আফিফ শান্ত থাকবে।”

“আর আফিফ দুর্বল থাকলে, আহি নেতিয়ে পড়বে।”

“হ্যাঁ, স্যার। মিস আহি অন্য কোনো ব্যাপারে ভয় পাক না পাক, আফিফের ব্যাপারে বেশ নরম।”

“ভালোবাসা। একেই তো বলে শুদ্ধ ভালোবাসা। এদের ভালোবাসা আমি কোনোভাবেই থামাতে পারি নি। আফিফকে আমি এতো কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু সে আহিকে ঘৃণায় করতে পারলো না। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি, আফিফ নিজেই পদ্মকে বিয়ে করে নিয়েছে।”

“মিস আহি এখনো সত্যটা জানে না।”

“আফিফ নিজেও এই সত্যটা জানে না। সবটাই তো আমার প্ল্যান ছিল।”

“কিন্তু আফিফ এখন পদ্মকে ভালোবাসে। সে কি আহির জন্য এমন কিছু কর‍তে পারে, যা তার পরিবারের জন্য ক্ষতিকর?”

“আরেহ এটা মায়া। এটা সেই ভালোবাসা না, যেটা আফিফের মনে এখনো গেঁথে আছে। আফিফ পদ্মকে ভালোবাসে, তবে সেটা তার স্ত্রী হিসেবে। তার দায়িত্ব হিসেবে। প্রেমিকা আর স্ত্রীর মধ্যে এটাই তো পার্থক্য। আর আহির প্রতি আফিফের অনুভূতি যদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, আমি কোনোভাবেই আহিকে নিজের করে নিতে পারবো না। আর আমার আহিকে চাই-ই চাই।”

“মিস আহির হয়তো আফিফের বোনের ব্যাপারে জানা উচিত। সত্যটা জানলে, সে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।”

তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, এই সত্য আহি জানলে পদ্মকে বিয়ে করার কারণটাও সে জেনে যাবে। আমার সুইটহার্ট অসম্ভব চালাক। দেখায় একদম শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ ধূর্ত। ওতো আমাকে ফাঁসানোর সব প্ল্যান করে ফেলেছে। এখন শুধু সেই প্ল্যানগুলো আমার জানতে হবে।”

৯২।

আহির মুখের সামনে একটা চিপস ধরলো রাদ। আহি রাদের দিকে ফিরতেই রাদ আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আহিও হালকা হেসে আবার মুখটা গম্ভীর করে ফেললো। রাদ তা দেখে বলল,
“সবসময় মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রাখিস কেন? এখন তো হাসতে পারিস। আন্টির সাথে আছিস, আমি আছি তোর পাশে। এখন কিসের কষ্ট?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এখনো অনেক কিছু করা বাকি। ভাবছি, শুরুটা কীভাবে করবো?”

“পরে ভাবিস। আগে খা।”

“তুই একটু বেশিই যত্ন নিচ্ছিস আমার!”

“আগে বন্ধু ছিলি, এখন প্রেমিকা। আর প্রেমিকাদের একটু বেশিই যত্ন নিতে হয়।”

আহি রাদের চোখের দিকে তাকালো। রাদের বাড়ন্ত অনুভূতিটা অনুভব করে খুশি হবে না-কি কষ্ট পাবে, সেটা বুঝতে পারছে না আহি। এভাবেই তো প্রিয় মানুষকে ভালোবাসতে হয়। আহি যেভাবে আফিফকে ভালোবেসেছিল, রাদ ঠিক সেভাবেই আহিকে ভালোবাসতে চায়ছে। আহি জানে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলা কতোটা কষ্টের৷ আহি রাদকে সেই কষ্ট দিতে পারবে না। অথচ তার মনে রাদের প্রতি ভালোবাসাটা শুধুই বন্ধুর মতো। আহির দম বন্ধ হয়ে আসছে। সারাজীবন বাস্তবতার সাথে কম্প্রোমাইজ করে গেছে সে৷ তাজওয়ারকে বিয়ে করার জন্য সম্মতি দেওয়া, মায়ের সাথে থাকতে চেয়েও থাকতে না পারা, আবার এখন রাদকে প্রেমিক হিসেবে মেনে নেওয়া। আর কতো কম্প্রোমাইজ করবে সে? রাদকে কষ্ট দিতে চায় না আহি। আর তাই রাদের অনুভূতিটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। এই মানুষটাই তো নিঃস্বার্থভাবে তাকে ভালোবেসেছে। তার জন্য কি আহি এতোটুকু করতে পারবে না? এসব ভাবতে ভাবতেই আহির চোখ ভিজে উঠলো। রাদ আহির চোখে পানি দেখে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছিস কেন তুই?”

আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার মনটা শান্ত হচ্ছে না, রাদ। আমি কোথায় একটু শান্তি পাবো, বলবি?”

রাদ আহিকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আছি, তাও ভালো লাগছে না?”

আহি এবার রাদকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকালো। আহির গভীর চোখ দু’টি উপচে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রাদ সেই চোখ দু’টি আলতোভাবে মুছে দিয়ে বলল,
“আমি তোর পাশে আছি। পাশে থাকবো।”

আহি মলিন হাসলো। রাদের হাত ধরে বলল,
“খুব ভালোবাসিস আমাকে?”

“হ্যাঁ, খুব।”

আবার আহির অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রাদ আবারও সেই চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“কাঁদছিস কেন, বল? আমার ভালোবাসা কি তোকে কষ্ট দিচ্ছে, আহি?”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“না না, কি বলছিস? আমার তো ভালো লাগছে। ভালো লাগলেও কিন্তু মানুষ কাঁদতে পারে।”

“হ্যাঁ, তুই পারিস হয়তো৷ তোর অশ্রু গ্রন্থিতে অশ্রু একটু বেশিই।”

আহি মনে মনে বলল,
“হ্যাঁ রাদ, আমার চোখে একটু বেশিই অশ্রু। হাসতে চাই, কিন্তু এই অশ্রুগুলো হাসতে দেয় না। আর এবার হয়তো তোকে ভালোবাসতে না পারাটাই আমার অশ্রু হয়ে বের হচ্ছে। তোকে তোর মতো করে ভালোবাসতে পারবো না আমি। তোর সাথে অন্যায় করে ফেলছি হয়তো। কিন্তু তোকে আমি সত্যটা জানালে তুই আরো কষ্ট পাবি। তার চেয়ে ভালো, আমিই কষ্ট পাই৷ কষ্ট সহ্য করার অনেক ক্ষমতা দিয়েই আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। শুধু শুধু অন্যকে সেই কষ্টের ভাগ কেন দেবো আমি? তোর ভালোবাসা পাওয়া যে-কোনো মেয়ের জন্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর দেখ, আমি কতো সৌভাগ্যবতী। অথচ আমি সুখে নেই। আমি কোনো শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না। নিজের মতো করে বাঁচতেও পারছি না।”

(***)

পদ্ম থমথমে মুখে বসে আছে। আফিফ দু’কাপ চা বানিয়ে ঘরে ঢুকে পদ্মকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলল,
“কি হলো? মন খারাপ না-কি?”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকালো। পদ্মের চোখ চিকচিক করছে। আফিফ তা দেখে চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে পদ্মের পাশে বসে বলল,
“কাঁদছো কেন? মা কিছু বলেছে?”

পদ্ম মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“তাহলে মন খারাপের কারণ!”

পদ্ম শান্ত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি, আফিফ।”

আফিফ পদ্মের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“জানি, তো। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।”

“আমি আহিকেও খুব ভালোবাসি।”

“জানি আমি। তুমি সবাইকে খুব বেশিই ভালোবাসো। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমার পদ্মফুল তুমি।”

“মোটেও না। আমি ভালো না, আফিফ। আমি অনেক খারাপ। আমি অনেক খারাপ।”

“কি বলছো তুমি?”

“জানি না, কিচ্ছু জানি না আমি। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব৷ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আহি সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে, এটা যতোবার মনে পড়ছে, আমারই মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

“পদ্ম, এখন আহি ঠিক আছে।”

“আমিই হয়তো এসবের জন্য দায়ী।”

“কি যা তা বলছো? তুমি কেন দায়ী হবে?”

পদ্ম আফিফের চোখের দিকে তাকালো। নিজেকে শান্ত করে আফিফের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসলো। একনজর সামনের দেয়ালে থাকা ছবিটির দিকে তাকালো। বেশ কিছুক্ষণ সেই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আমি আহিকে বাসায় রেখে দিলে, ওর সাথে ওমন ঘটনা ঘটতো না।”

আফিফ পদ্মের গা ঘেঁষে বসে বলল,
“এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। যার অপরাধ, সে শাস্তি পাবেই। এখন চা খাও। আমি তোমার জন্য নিজ হাতে চা বানিয়েছি।”

পদ্ম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আবার সেই ছবিটির দিকে তাকালো। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার মতো মানুষকে নিজের করে পাওয়াটা আমার ভাগ্যে ছিল না। আমি হয়তো কারো ভাগ্য চুরি করেছি।”

আফিফ থমকে গেলো। চায়ের কাপ হাত থেকে রেখে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার এমনটা কেন মনে হচ্ছে?”

“এমনিতেই।”

আফিফ চুপসে গেলো। পদ্ম কি কোনো ভাবে সত্যটা জেনে গেছে? এমন মুহূর্তে সত্যটা জানলে যে আহির জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি হবে! আহি তার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। রাদ যেহেতু আহিকে ভালোবাসে, অন্তত তাদের এক হওয়ায় কোনো বাঁধা দিতে চায় না আফিফ। রাদের সাথে ভালো থাকুক আহি। এটাই চায় সে। কিন্তু পদ্ম যদি অতীতটা জেনে যায়, তাহলে আবার ঝামেলা হবে। আফিফকে এ ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে হবে।

(***)

সোহাগ লাবীব আর আফিফের মোটরসাইকেলের সম্পূর্ণ তথ্য বের করে তাজওয়ারের সামনে রাখলো। তাজওয়ারকে যে মোটরসাইকেল আরোহী মার‍তে এসেছিল, তার মোটর সাইকেলের সাথে লাবীব আর আফিফের মোটর সাইকেলের কোনো মিল নেই। লাবীবের মোটর সাইকেল মোটামুটি দামী। আর আফিফেরটা অনেক পুরোনো মডেলের। আর যেই আগন্তুক তাকে মেরেছে, তার মোটরসাইকেলটা অনেক বেশি দামী। যেই মোটর সাইকেল কেনা আফিফের সামর্থের বাইরে। তবে লাবীব চাইলে কিনতে পারে। তাজওয়ার সব দেখে অনেক ভেবে বলল,
“আহির টিম আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছে। এখনো আফিফ আর লাবীবের মধ্যেই আটকে আছি আমি। আফিফের এই বাইক কেনার কোনো সামর্থ নেই। আর লাবীবের জন্য এই বাইক কেনা একটা স্বপ্ন পূরণ করা। আর এতো দামী বাইক নিয়ে লাবীব অন্তত আমাকে মারতে আসবে না। ও নিজের বাইককে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। মনে হচ্ছে, এই কাজ আফিফই করেছে। আর যদি এটা তার কাজ হয়, তাহলে নিশ্চিত সে এই বাইক কারো কাছ থেকে ধার নিয়েছে। আফিফের বন্ধুদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে, যার বাইকের শো’রুম আছে? বা এমন কোথাও কাজ করে?”

সোহাগ বলল,
“স্যার, দু’একদিন সময় দিতে হবে৷ আমি সব ইনফরমেশন বের করে আপনাকে জানাচ্ছি।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“এই কাজ যদি আফিফের হয়, তাহলে মিস্টার আফিফ রাফাতের কপালে তো দুঃখ নেই৷ তবে অন্য কারো কপালে দুঃখ ঠিকই আছে৷ এবার উলটো পথ ধরবো। আহির জীবনের সুতোটা এমনভাবে ঘুরিয়ে দেবো। আহি সেই সুতোর জট খুলতে আমার কাছেই আসবে।”

(***)

উজ্জ্বলের সামনে এসে দাঁড়ালো কালো হেলমেট পরা এক পুরুষ। উজ্জ্বল তাকে দেখেই বলল,
“আপনি কে? আমাকে এখানে কেন আসতে বলেছেন?”

হেলমেট পরা যুবকটি কিছু ফাইল উজ্জ্বলের দিকে এগিয়ে দিয়ে কোনো উত্তর না দিয়েই মোটরসাইকেলে উঠে চলে গেলো। উজ্জ্বল অবাক হয়ে আগন্তুকটির যাওয়া দেখছে। সে এবার নিজের গাড়িতে উঠে ফাইলটা খুলে দেখলো সেখানে লেখা,

তাজওয়ারের অর্থপাচারের সব রেকর্ড এই ফাইলে আছে। আমি আহির শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনি আহির পক্ষে কেইস নিয়েছেন, তাই আপনাকে এই তথ্যগুলো দেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

উজ্জ্বল ফাইলের ভেতরে থাকা সব তথ্য দেখে সাথে সাথেই আহিকে ফোন করলো। আহি কল রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“প্ল্যান ডি এক্সিকিউট করতে হবে।”

আহি সেই মুহূর্তে সালমা ফাওজিয়ার কোলে শুয়ে ছিল। সে উজ্জ্বলের কথা শুনে মাথা তুলে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“মানে? কিছু হয়েছে?”

“অনেক বড় কিছু হয়েছে। তুমি শুধু শুরু করো। আমি যা পেয়েছি, তা দিয়ে অন্তত চার বছর কাভার হবে। বেশি হলে দশ বছর। পুরো জীবন কাভার করার জন্য প্ল্যান ডি এর পাশাপাশি প্ল্যান সিতে মনোযোগ দিতে হবে। একসাথে দু’টো হলে, আমাদের বেশি সময় লাগবে না।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০১||

৯৩।
আফিফ মোটরসাইকেল নিয়ে তার বন্ধুর শো’রুমের কাছে আসতেই শো’রুমের সামনে তাজওয়ারের গাড়ি দেখে থেমে গেলো। সে মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে একপাশে পার্ক করে শো’রুমটি থেকে কিছুটা দূরে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ালো। এরপর ফোন বের করে তার বন্ধুকে কল করতেই, আফিফের সেই বন্ধু কল ধরে বলল, “তুই কোথায়?”

“শোন, আমার সাথে কানেক্ট থাক। এখন যে এসেছে তোর কাছে, সে কিন্তু সুবিধার না। আমি তোকে যা যা বলছি, তুই কিন্তু তাই বলবি। লাইনে থাক। আর কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখিস। হোয়াটসঅ্যাপে কল করছি আমি। তুই কলটা রিসিভ করে রাখবি শুধু। ওকে?”

“হ্যাঁ ঠিক আছে।”

“আর শোন, ফোনটা হাতে রাখিস। আমি যাতে কথা ভালোভাবে বুঝতে পারি। আর আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে সত্য কথায় বলবি। ভয় পাবি না। আর আরেকটা কথা। যদি তোকে সেই বাইকের ছবি দেখায়। ইনফরমেশন চায়, তুই কিন্তু বলিস না যে বাইকটা তোর শো’রুমের না। ওরা তথ্য নিয়েই এসেছে। তোকে বোঝাতে হবে, তুই এসবের কিছুই জানিস না। তাই তুই বলবি, বাইকটা হয়তো তোর শো’রুমেরই, কিন্তু অন্য ব্রাঞ্চের।”

আফিফের কথামতো তার বন্ধু নিলয় হোয়াটসঅ্যাপের কল রিসিভ করে, ফোনের স্ক্রিন বন্ধ করে দিলো। এরপর সোহাগের সামনে এসে দাঁড়ালো। সোহাগ নিলয়ের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আফিফকে চেনো?”

নিলয় মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ। আফিফ আমার ক্লাসমেট ছিল। আপনি কি ওর পরিচিত?”

“হ্যাঁ, আমরা একই কোম্পানিতে কাজ করি।”

“ওহ আচ্ছা, বসুন বসুন। বাইক কিনতে এসেছেন না-কি?”

সোহাগ চেয়ারে বসেই টেবিলের উপর সেই কালো রঙের মোটর সাইকেলটির ছবি রেখে বলল,
“এই বাইকটা তোমার শো’রুমের?”

নিলয় ভালোভাবে বাইকটা দেখতে লাগলো। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেওয়া ছবি তাই সে কাছে এনে দেখে বলল,
“ছবি তো পরিষ্কার না। কিন্তু মনে হচ্ছে এই বাইকটা আমার শো’রুমেই আছে। তবে এই ব্রাঞ্চে নেই।”

সোহাগ ঝুঁকে বসে বলল, “কোন ব্রাঞ্চে আছে?”

“অক্সিজেনে আমার আরেকটা শো’রুম আছে। ওখানেই থাকতে পারে।”

“আচ্ছা? যাও, তোমার কোম্পানির বেচা-কেনার রেকর্ডটা নিয়ে আসো।”

নিলয় ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“রেকর্ড দেখবেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

সোহাগ গম্ভীরমুখে বলল,
“হুম, বেশি কথা না বলে নিয়ে আসো।”

নিলয় ভেতরে চলে এলো। এরপর ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল,
“আফিফ, কি করবো?”

“শোন, পাঁচ মিনিট পর বের হয়ে বলবি ফাইলটা অক্সিজেনেই। কাগজ-পত্রগুলো তুই ওখানে নিয়ে গেছিস। এরপর যদি তোকে সাথে নিয়ে অক্সিজেন যেতে চায়, তাহলে তুই মেইন রোড দিয়ে যাবি না। আরেকটা ছোট গলি আছে ওদিকে যাবি। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”

নিলয় কল কেটে প্রায় দশ মিনিট পর বেরিয়ে এসে বলল,
“হয়তো ফাইলগুলো ওই ব্রাঞ্চে রেখে এসেছি।”

“ওখানে কেন?”

“একটা জরুরি কাজে নিয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো ওখানেই ফেলে এসেছি।”

“গাড়িতে উঠো। আমার সাথে চলো। ফাইলটা আমার আজই লাগবে।”

নিলয় সোহাগের সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি শো’রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আফিফ তাড়াতাড়ি মোটর সাইকেলে উঠে বসে চাবি ঘোরালো। ধীরে ধীরে গতি বাড়াতে লাগলো আফিফ। আর সোহাগের চোখের আড়াল হয়েই মোটর সাইকেল চালাতে লাগলো। কিছুদূর গিয়ে আফিফ থামলো। সে সোহাগের নম্বরে কল করলো। এদিকে আফিফের কল দেখে সোহাগ গাড়ি থামালো। সে একনজর নিলয়কে দেখে নিলো। নিলয় তো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে।এরপর সোহাগ কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আফিফ বলল,
“তোমাকে হুট করে কল দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমি একটা বিপদে পড়েছি। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। তুমি কি আমাকে বিশ হাজার টাকা ধার দিতে পারবে? আমি এখন অক্সিজেনের এদিকটাই আছি।”

সোহাগ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “হোয়াট রাবিশ?”

“আসলে স্যারকে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শুনলাম, স্যার অসুস্থ। তাই উনার কাছে খুঁজতে পারছি না। উনি যদি ক্ষেপে যান?”

সোহাগ ধমকের সুরে বলল,
“মশকরা করছিস আমার সাথে? আমি তোকে কোনো টাকা ধার দিতে পারবো না। আমি একটা জরুরি কাজে এসেছি।”

“যদি দিতে বেশি উপকার হতো। আমার মা অসুস্থ।”

এরই মধ্যে আফিফ দেখলো একটা মালবাহী গাড়ি এদিকেই আসছে। আফিফ হাতের ইশারায় গাড়িটিকে পাশের রাস্তাটা দেখিয়ে দিলো। এরপর সোহাগকে বলল,
“একটু যদি সাহায্য করতে।”

সোহাগের মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে ছিল। সে আফিফকে অশ্রাব্য একটা গালি দিয়ে কল কেটে দিলো। আফিফ সোহাগের কথা শুনে মুচকি হাসলো। এরপর সে মোটর সাইকেল থেকে নেমে হেলমেট খুললো। পকেট থেকে আরেকটা ফোন বের করলো। এরপর দ্রুত হাতে একটা ফোন থেকে সিম খুলে অন্য ফোনে লাগিয়ে পাশের দোকানদারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল ফোনটা একটু পর এসে নিয়ে যাবো। আপনি মনে করবেন, আমি আপনার দোকানে বসে চা খাচ্ছি।”

দোকানদার হালকা হেসে বলল,
“তোমার জন্য এইটুকু করতে পারবো না? তোমার বাবা আমার বন্ধু মানুষ। তুমি আমার ছেলের মতোই।”

আফিফ হাসলো। সবকিছুই তার পরিকল্পনা মতোই হচ্ছে। চায়ের দোকানদার আফিফের গ্রামের চাচা। উনার সাথে আবার আফিফের বাবার ভালোই কথাবার্তা হতো। আফিফ এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি আনার মূল কারণ এটাই ছিল, যাতে ফোনটা চাচাকে দিয়ে যেতে পারে। এখন পুলিশ তাকে ট্র‍্যাক করলে লাস্ট লোকেশন এখানেই পাবে। আর সে সোহাগকে কলে ব্যস্ত রেখে কিছুক্ষণ থামিয়ে সেই মালবাহী গাড়িটিকেও সময়মত সেই জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এবার আফিফ নিশ্চিন্ত মনে আবার মোটরসাইকেলে উঠে বসলো।

(***)

নিলয় সোহাগকে আফিফের বলা রাস্তা দিয়েই গাড়িটা নিয়ে যেতে বললো। সোহাগও সেদিকে ঢুকলো। গাড়ি সেই রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই আফিফ তার আগের গলি দিয়ে ঢুকে মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে সেই গলির সামনে এনে দাঁড় করালো। এদিকে সেই কালো হেলমেট পরা আগন্তুকটিকে সামনে দাঁড়ানো দেখে সোহাগ বেশ অবাক হলো। সে গাড়ি থামালো। আফিফও হাতের ইশারায় সোহাগকে গাড়ি থেকে নামতে বললো। সোহাগ সাথে সাথে নামলো না। সে প্রথমে গাড়ির সামনের বক্স খুলে তার পিস্তলটা বের করলো। এদিকে নিলয় তো সোহাগের হাতে পিস্তল দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ পর পিস্তল হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো সোহাগ। সোহাগ গাড়ি থেকে নামতেই আফিফ হাত নাড়িয়ে গলা উঁচু করে বলল,
“কেমন আছো, সোহাগ?”

সোহাগ আফিফের দিকে পিস্তল তাক করে বলল,
“বসের গায়ে হাত তুলেছিস, তোর সাহস তো খুব বেড়ে গেছে দেখছি।”

সোহাগ গাড়ির অন্য দরজা খুলে নিলয়ের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামালো। আফিফ মোটর সাইকেলের হাতলে হাত রেখে সোহাগের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহাগ বলল,
“তোর বন্ধুকে উপরে উঠিয়ে দিতে আমি দ্বিতীয় বার ভাববো না।”

আফিফ মোটর সাইকেল থেকে নেমে চাবি হাতে নিয়ে তা শূন্যে উঠিয়ে অন্য হাতে ধরে বলল,
“ওকে ডান। চালা গুলি। দেখি তোর সাহস কেমন!”

নিলয় চোখ বড় বড় করে আফিফের দিকে তাকালো। সোহাগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে পিস্তল চালালো। একবার, দুইবার, তিনবার। পরপর তিনবার পিস্তল চালিয়েও কোনো শব্দ হলো না। সোহাগ ভ্রূ কুঁচকে পিস্তলটা এপাশ-ওপাশ ঘোরাতে লাগলো। আফিফ তার পকেট থেকে একটা ট্রান্সপারেন্ট প্যাকেট বের করে বলল,
“সবটাই তো আমার কাছে, চলবে কীভাবে? ওটা নিয়ে বরং তুই চোর-পুলিশ খেল। তুই হবি পুলিশ, আমি হবো চোর। ধরতে পারলে আমি আউট, ধরতে না পারলে তুই আউট।”

সোহাগ পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
“কি চাস তুই? কেন করছিস এসব?”

আফিফ হাতের ইশারায় নিলয়কে চলে যেতে বললো। নিলয় ছাড়া পেয়ে দৌঁড়াতে লাগলো। সে দ্বিতীয় বার আর পেছন ফিরে তাকালো না। নিলয় চলে যেতেই আফিফ সোহাগের সামনে এসে দাঁড়ালো।

সোহাগ গম্ভীরমুখে বলল, “প্ল্যান কি তোর?”

আফিফ হালকা হাসলো। সোহাগ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমাকে এখনো চিনতে পারিস নি। তুই হয়তো জানিস না, আমি কে?”

“কে তুই? দেখি বল না। একটু শুনি।”

সোহাগ হাসলো। আফিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমাদের কিন্তু তোকে চিনতে ভুল হয় নি। তুই-ই যে এই কাজ করেছিস তা আমরা ধরতে পেরেছিলাম। তবে এটা বিশ্বাস কর‍তে একটু অসুবিধা হচ্ছিলো যে তুই এই কাজ কীভাবে করলি? তোর মতো বোকা, ভীতু এই কাজ… না, না, না। তুই কি আসলেই আফিফ রাফাত?”

আফিফ হেলমেট খুলে বলল,
“এখনো কি কোনো সন্দেহ আছে?”

“আরেহ, তুই ধরা খেয়ে নিজের পরিচয়টায় জানিয়ে দিলি? কি-রে ভয় পেয়ে গেছিস না-কি? হ্যাঁ, পেতেই পারিস। আফটার অল তোর ছোট বোনের ভবিষ্যৎ তোর হাতে।”

“তারপর?”

আফিফের এমন গা ছাড়া ভাব সোহাগের পছন্দ হলো না। সে আফিফের জ্যাকেট টেনে ধরে বলল,
“তোর বড় আপার সাথে কি হয়েছে ভুলে গেলি না-কি?”

“কি হয়েছে আপার সাথে?”

“তোর আপার প্রেমিককে আমিই মোটা অংকের টাকা দিয়েছিলাম। তার নামে মিথ্যে কথা ছড়ানোর জন্য আমিই তার সহকর্মীদের বাধ্য করেছিলাম। আর সেই ভিডিওটা…”

সোহাগ এতোটুকু বলেই থামলো৷ এরপর বিশ্রীভাবে হেসে বলল,
“ভিডিওটাও আমিই বানিয়েছিলাম। তোর আপা…..”

সোহাগের মুখের প্রতিক্রিয়া দেখেই পরবর্তী বাক্যটা আন্দাজ করে ফেলেছে আফিফ। সে আর সোহাগকে কথাটি সম্পূর্ণ কর‍তে দিলো না। সোহাগের নাক বরাবর ঘুষি মারলো সে। সোহাগ নাকে হাত দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। আফিফ তার হেলমেটটা হাতে নিয়ে পরপর কয়েক বার সোহাগের মাথায় আর ঘাড়ে আঘাত করলো। সোহাগ মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই আফিফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তার চোখ দু’টি লাল হয়ে গেছে। সোহাগ জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে হালকা হাসলো। আর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবি না। তোর এই একটা দুইটা আঘাতে আমার কিছুই হবে না।”

আফিফ হাতের গ্লাভস ভালোভাবে আটকাতে আটকাতে বলল,
“আমি কিছুই কর‍তে পারবো না। আমি কিছু করবোও না। তবে সবটা চোখের পলকেই হয়ে যাবে। আমার স্পর্শ ছাড়াই।”

আফিফ সোহাগের কলার ধরে তাকে উঠালো। উঠিয়ে আবার মাটিতে ছেড়ে দিলো। সোহাগের নাক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তেই সে নাকে হাত দিয়ে বলল,
“তুই বাঁচবি না, আফিফ।”

আফিফ হাতের ইশারায় বলল,
“আয় না, উঠে আয়।”

সোহাগ উঠে দাঁড়ালো। আফিফ সজোরে সোহাগের পেটে লাথি মারলো। সোহাগ গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে আবার মাটিতে বসে পড়লো। সে এবার পা ঘুরিয়ে আফিফকে জোরে লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। আফিফ পড়ে যেতেই সোহাগ কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়ালো। সে আফিফের হেলমেটটা হাতে নিয়ে সেটা দিয়েই আফিফকে মার‍তে আসবে তখনই আফিফ দেরী না করে রাস্তায় পড়ে থাকা বালির কণা হাতে নিয়ে সোহাগের চোখের সামনে ছুঁড়ে দিলো। হালকা হাওয়ায় বালির কণা উড়ে এসে সোহাগের চোখে ঢুকতেই সে থেমে গেলো। সে ব্যস্ত হয়ে চোখ কচলাতে লাগলো। আফিফও এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। এরপর হেলমেটটা সোহাগের হাত থেকে নিয়ে বলল,
“আমার আপাকে মেরেছিস। আমি কিছু করতে পারি নি। তোর বস আহির সাথেও একই কাজ করতে চেয়েছে। কিন্তু এবার আমি চুপ থাকবো না।”

সোহাগ চেঁচিয়ে বলল,
“তোর সমস্যা কি এখানে? আহি কি তোর বউ না-কি? আমাদের বসের হবু স্ত্রী সে। বস যা চাইবে, তাই করবে।”

আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো। সে আবার সোহাগের নাক বরাবর ঘুষি দিলো। সোহাগ এক ঘুষিতে আবার মাটিতে পড়ে গেলো। আফিফ তার বুকের উপর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আহি কোনো পুতুল না যে তোর বস যা ইচ্ছে তাই করবে। আর আহিকে প্রটেক্ট করার জন্য আমার কোনো নাম বা ওর সাথে কোনো সম্পর্ক থাকার প্রয়োজন নেই। ওর জন্য আমি এমনিতেই সব করতে পারবো।”

সোহাগ কাঁপা কন্ঠে বলল, “ভালোবাসিস, তাই না?”

আফিফ কোনো উত্তর দিলো না। সে সোহাগের কলার ধরে তাকে টেনে উঠিয়ে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“তাজওয়ার খানের এসিস্ট্যান্ট হয়ে বেশ ভালোই হয়েছে। শান্তশিষ্ট আফিফ রাফাতের আড়ালে যেই ভয়ংকর মানুষটা ছিল, তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে তাজওয়ার খানের দয়ায়। হি ইন্সপায়ারড মি আ লট। আরেহ, এই ভ্যাম্প আফিফের আইডল ম্যান তো তাজওয়ার খানই। এখন বসের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমি আমার দ্বিতীয় মিশনটা কমপ্লিট করবো।”

“কি করবি তুই?”

আফিফ সোহাগকে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিয়ে বলল,
“অর্ণবের এক্সিডেন্টটা আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। ওটা না হয় খাদে পড়ে গিয়েছিল। ভাবছি তোকে খাদে ফেলে লাভ নেই। মাটির উপরে মরে, মাটির নিচে চলে যাবি।”

আফিফ এরপর তার পকেটে থাকা গুলি গুলো সোহাগের পিস্তলে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“গাড়ির আরেকটা চাবি আমার কাছে ছিল। এই গাড়ি তো বসের। আমিও তো চালিয়েছিলাম। এইটুকু বুদ্ধি নেই তোর? আর নিজের পিস্তল সামলে রাখবি না? থাক, ওপাড়ে গিয়ে অন্তত নিজের কর্ম সামলে রাখিস। বলা তো যায় না একটা ভালো কাজ ছুটে গেলেই তোর কপালে দুঃখ। খারাপ কাজের তো ডিগ্রি নিয়ে ফেলেছিস তুই।”

সোহাগ গাড়ি থেকে বের হতে চাইলেই আফিফ তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। সোহাগ চেঁচিয়ে বলল,
“কি করতে চাচ্ছিস তুই?”

আফিফ তার অন্য ফোনটি বের করে কাকে যেন কল করলো। এই ফোনের সিমটা অবশ্য আফিফের ছিল না। সে একজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছে। যার কাছ থেকে ধার নিয়েছে সে আফিফকে চেনে না। দেখেও নি। হেলমেট পরেই আফিফ তার সামনে গিয়েছিল। আফিফ অবশ্য সিম ধার দেওয়া লোকটিকে পেশাদার চোর হিসেবেই চেনে। বন্ধুর মাধ্যমেই সেই চোরের সন্ধান পেয়েছিলো আফিফ। এরপর চোরটিকে কিছু টাকা দিতেই সিমটা ধার দিলো সে।
এদিকে আফিফের কল করার পাঁচ মিনিট পর গলির ভেতরে সেই মালবাহী গাড়িটি ঢুকলো। বেশ দ্রুত গতিতেই গাড়িটা আসছে। আফিফ পিছু সরে সোহাগকে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলো। সোহাগ পেছনে ফিরে দেখার আগেই মালবাহী গাড়িটি সোহাগের গাড়িটিকে খুব জোরে ধাক্কা দিলো। লরির ড্রাইভার সোহাগের গাড়িটিকে ধাক্কা দিয়েই লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। লরিটির গতি বেশি থাকায় সেটা সোহাগের গাড়িটিকে অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলো। আফিফ ড্রাইভারটির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।”

ড্রাইভারটি বলল,
“ওই তাজওয়ার আর তার বন্ধুগুলো আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। আমার মেয়েটা তো বাঁচতে চেয়েছিল। তারা আমার মেয়েকে বাঁচতে দেয় নি। আমি তোমাকে সাহায্য করবো, বাবা। ও শয়তানটা যতোদিন বেঁচে থাকবে, আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে না।”

আফিফ মাথা নাড়লো। এরপর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাস্তা থেকে হেলমেটটা উঠিয়ে তার উপর পানি ঢেলে হালকা লেগে থাকা রক্তগুলো পরিষ্কার করলো। এরপর গ্লাভস ধুয়ে হেলমেটটা পরে পেছন ফিরে সেই বিধ্বস্ত গাড়িটির দিকে তাকালো। গাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আফিফ বুঝতে পারলো, সোহাগের বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। বেঁচে থাকলেও এতো সহজে সে আফিফের বিরুদ্ধে কিছু বলার জন্য দাঁড়াতে পারবে না। তার সেরে উঠতে বেশ সময় লাগবে। আর ততোদিনে আফিফ তার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করে ফেলবে। এই মুহূর্তে আফিফকে তার তৃতীয় মিশনে নামতে হবে। তাজওয়ারকে থামানোর জন্য শেষ একটা পথই খোলা আছে। যেই পথে গেলে তাজওয়ার ক্ষণিকের জন্য শান্ত হবে, আর এই শান্ত হওয়াটাই তাজওয়ারকে আরো এক ধাপ পিছনে ফেলে দেবে।

আফিফ মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে লরির ড্রাইভারটিকে নিয়ে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। এদিকে সন্ধ্যায় খবর পাওয়া গেলো, সোহাগ এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সোহাগের মৃত্যুর খবর পাওয়াটা বেশ স্বাভাবিক ছিল। উলটো সে বেঁচে গেলে, আফিফকে হয়তো আরেকটু খাটতে হতো। সোহাগ মরে গিয়ে উদ্ধার করেছে তাকে।

(***)

দরজার ধাক্কাধাক্কি বাড়তেই পদ্ম এসে বাড়ির দরজা খুলে দিয়ে দেখলো তাজওয়ার খান ও তার পাশে দু’জন ফিটফাট যুবক দাঁড়ানো। তাজওয়ার পদ্মের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আফিফ কোথায়?”

পদ্ম ভীত কন্ঠে বলল, “উনি বাসায় নেই।”

তাজওয়ার পদ্মের গলা চেপে ধরে বলল,
“আমার সাথে মিথ্যে কথা?”

পদ্মের চোখে অশ্রু ভীড় করলো। তাজওয়ার পদ্মকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
“আফিফকে খুব ভালোবাসিস, তাই না? এখন আবার আহির জন্যও মরিয়া হয়ে যাচ্ছিস। এসব অতিরিক্ত ভালোবাসা তোকে নিয়েই ডুববে। আমি যদি আফিফকে সত্যটা বলে দেই…..”

পদ্ম হাত জোড় করে মাথা নেড়ে বলল, “প্লিজ।”

তখনই আফিফ রুম থেকে বের হয়ে দেখলো তাজওয়ার পদ্মের গলা চেপে ধরে রেখেছে। আফিফ তেড়ে এসে তাজওয়ারের কলার চেপে ধরে বললো,
“আমার ওয়াইফের গায়ে হাত দিয়েছিস কোন সাহসে?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। এরপর সে আবার পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম তাড়াতাড়ি আফিফকে তাজওয়ারের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। এরইমধ্যে আফিফা বেগম বেরিয়ে এলেন। আফিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে পদ্মকে বলল,
“তুমি মাকে নিয়ে ভেতরে যাও।”

পদ্ম ভীত চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার তা দেখে বাঁকা হাসলো। তাজওয়ারকে হাসতে দেখে আফিফ বলল,
“এটা কিন্তু ঠিক হয় নি!”

“আর সোহাগের সাথে যা হয়েছে তা?”

“মানে?”

“মানে কিছুই বুঝতে পারছিস না?”

“সোহাগ! আমি শুনেছি সোহাগের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”

“হ্যাঁ, আর ওর ফোনে লাস্ট কল তোর ছিল।”

আফিফ কিছুটা চিন্তিত সুরে বলল,
“হ্যাঁ, আমি কল দিয়েছিলাম। আমি তো বিপদে পড়েই কল করেছি ওকে। আমি কল দেওয়ার পরই কি ওর এক্সিডেন্ট হয়েছিল?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে আফিফকে থানায় নিয়ে গেলো। আফিফ তার সমস্যার কথা দায়িত্বরত অফিসারকে জানালো। সে সোহাগের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে চেয়েছিল, কারণ তার মা অসুস্থ। ঢাকায় ভালো চিকিৎসা করাবে এই আশায় টাকা ধার চাওয়া। এক মাসের মধ্যেই সে টাকাটা ফেরত দিতো। মাসের শেষ দিনগুলো চলছে, তাই হাতে কোনো টাকা ছিল না তার।

এদিকে তাজওয়ারের পীড়াপীড়িতে কল রেকর্ড বের করা হলো। আফিফ আর সোহাগের কথোপকথন শুনে অফিসার তাজওয়ারকে বললেন,
“সোহাগের মৃত্যুটা একটা এক্সিডেন্ট। আপনি হুট করে কাউকে গ্রেফতার করাতে পারবেন না৷ কোনো ভালো প্রমাণ থাকলে ওকে আমরা ছাড়তাম না। আর ওর লোকেশন এক্সিডেন্ট স্পটে ছিল না। তবে আমরা এ নিয়ে ইনভেস্টিগেট করে আপনাকে জানাবো।”

আফিফ থানা থেকে বেরিয়ে এলো। ফোন হাতে পেতেই সে পদ্মকে কল করে বলল, সে ছাড়া পেয়েছে। এদিকে পদ্ম তো চিন্তায় অস্থির। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সে মেঝেতে বসে আছে। আর বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছে,
“আমি আফিফকে হারাতে চাই না। আমি উনাকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দাও, আল্লাহ। আমার ভুলের জন্য হয়তো আজ এতোগুলো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমি আমার ভুলটা শুধরে নেবো। তার জন্য যদি আমাকে আমার জীবনটাই ত্যাগ দিতে হয় কোনো সমস্যা নেই। আমি দিয়ে দেবো। কিন্তু আফিফের সামনে সত্যটা যাতে না আসে। ও যদি কখনো জেনে যায়…. না, না। ভাবতেই পারছি না আমি। ওর সামনে সত্যটা আসা যাবে না।”

(***)

আফিফ রিকশায় উঠতেই তাজওয়ার তার সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফ বলল,
“স্যার, আপনি আমাকে কেন ভুল বুঝছেন আমি জানি না।”

“লোকেশনে দেখা যাচ্ছে তুই সোহাগের আশেপাশেই ছিলি।”

“আমি তো বললামই। আমি এক কাজে ওদিকে গিয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে যদি সোহাগও সেদিকে যায়, আমার তো কিছুই করার নেই।”

“কল রেকর্ডটা যদি না থাকতো, তুই আজকে ফেঁসে যেতি। ইচ্ছে করে ওভাবে কথা বলেছিস তুই, তাই না? যাতে তোকে ফাঁসাতে না পারি?”

আফিফ মুচকি হেসে বলল,
“স্যার, সত্যিই আমি সোহাগের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। আর এতো দুঃসাহস আমার নেই।”

তাজওয়ার চুপ হয়ে গেলো। আফিফ রিক্সা আগাতে বলল। কিছুদূর গিয়ে আফিফ রিক্সা পালটে একটা গাড়ি নিয়ে নিলয়ের শো’রুমে গেলো। নিলয় আফিফকে বলল,
“বাঁচিয়েছিস আমাকে। তুই যদি আমাকে না বলতি আমি ফোনটা নিয়েই বের হতাম। ফোন রেখে যাওয়ায় আমি কোথায় এসে সোহাগের গাড়ি থেকে নামলাম, সেটা কেউ ধরতে পারলো না।”

আফিফ বলল,
“পারবে পারবে। আরেকটু চেষ্টা করলে ধরে ফেলবে।”

“মানে কি? ধরা খেয়ে যাবো না-কি?”

“চিন্তা করিস না। যে কেইস করেছে, সে-ই যদি বিপদে পড়ে, তাহলে আমরা এই জন্মে আর ধরা খাবো না।”

“কি করবি তুই?”

“তাজওয়ারের সব দুর্বল দিকগুলো আমি জেনে গেছি। এখন আজ রাতেই শেষ আঘাতটা দেবো। এরপর তাজওয়ার খান আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।”

“আচ্ছা, এসব আগে করিস নি কেন?”

“তখন কি তাজওয়ার খান আমাকে এসিস্ট্যান্ট বানিয়েছিলো না-কি?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||

৯৪।
আহি আর উজ্জ্বলের মুখোমুখি বসে আছে ফার্জিয়া। তার দৃষ্টি নীচের দিকে। চোখে-মুখে ছেয়ে আছে মলিনতা। আহি ফার্জিয়ার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও, আর মনকে শক্ত করো।”

ফার্জিয়া ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে বলতে লাগলো,
“আমি কখনোই তাজকে ভালোবাসি নি। আমি ওর সাথে সম্পর্কে গিয়েছিলাম ওর টাকার জন্য। বাবার বেতন ভালো ছিল না। আর আমার শখ বেশি ছিল। শখ পূরণের লোভ চেপে বসেছিল মাথায়। তবে আমি ওকে প্রপোজ করি নি। তাজ নিজেই আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। আর সম্পর্কের প্রায় আড়াই মাস পর তাজ আমাকে ইন্টিমেট হওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলো। আমি প্রথমে রাজি হই নি। কারণ বাবা অনেক স্ট্রিক্ট আর সম্মানী মানুষ ছিলেন। কিন্তু লোভের সামনে নিজের পরিবারকেই খুব ছোট মনে হয়েছিল আমার। আমি ভাবতাম, সত্যিই হয়তো তাজ আমাকে ভালোবাসে। আর একদিন বিয়েও করে নেবে। অনেক বছর এভাবেই আমরা ইন্টিমেট হতে থাকি। আর ধীরে ধীরে আমি ভেঙে পড়ি। কারণ তাজের কাছে আসাটা আমাকে মানসিকভাবে আঘাত করছিলো। তখন মনে হচ্ছিলো, আমি একটা মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কারণ আমি সজিবকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বলল, “সজিব!”

আহি বলল,
“তাজওয়ারের বন্ধু, সজিব। ওটাও একটা শয়তান।”

ফার্জিয়া মলিন মুখে বললো,
“হ্যাঁ, তা ঠিক। ওরা সবাই এমনই। সজিব, অর্ণব, জিলান কেউই ভালো ছিল না। কিন্তু সজিবের প্রতি কেন যেন আমার ভালো লাগা কাজ করতো। এরপর ওর সাথে কথাবার্তা বলার পর থেকেই আমি তাজ থেকে দূরত্ব রাখা শুরু করি। তাজ এটা মেনে নিতে পারে নি। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে। আমার কিছু পারসোনাল ছবি ওর কাছে ছিল। ও আমাকে না জানিয়েই আমার মাকে পাঠিয়ে দেয়। ভাগ্যিস বাবাকে পাঠায় নি। নয়তো সেদিনই আমাকে মেরে ফেলতো। মা অবশ্য অনেক মেরেছে। সেদিন আমার ছোট বোন ফার্সা আমাকে মায়ের মার থেকে বাঁচিয়েছিল। এর অনেকদিন পর আমি সজিবকে নিজের অনুভূতির কথা জানাই। তাজের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাহায্য চাই। ও আমাকে আশা দেয়। আর তারপর, আমাদের প্রেম শুরু হয়। এর মধ্যে সজিবের কথায় আমি তাজের সাথেও সম্পর্ক রেখেছিলাম। এরপর আহি দেশে এলো। তাজ কিন্তু আহি আসার পরও আমার সাথে সম্পর্ক রেখেছিল। এরপর সেই ভয়ংকর সত্যটা আমার সামনে এলো।”

উজ্জ্বল কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন সত্য?”

“আমি হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, আমার ছোট বোন ফার্সার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ও আগে হাসিখুশি থাকতো। হঠাৎ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলো। আমি ওকে জিজ্ঞেস করার পর, ও আমাকে সব বলে দেয়।”

উজ্জ্বল আগ্রহী সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলে দেয়?”

“একটা ছেলের সাথে তার প্রেমের ব্যাপারে। আমিও পুরুষ ঘটিত ব্যাপারে মায়ের কাছে মার খেয়েছি। ও মনে করেছে আমি বুঝবো, তাই বলেছিল।”

“এরপর!”

ফার্জিয়া খালি গ্লাসটা হাতে নিলো। আহি বোতল থেকে পানি ঢেলে দিতে দিতে বলল,
“তুমি রিল্যাক্স হয়েই বলো।”

ফার্জিয়া এবারও পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখলো। একটু জোরেই গ্লাসটা রাখলো সে। আর ফার্জিয়ার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে উজ্জ্বল আর আহি কৌতুহলি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফার্জিয়া এবার ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমার বোন ফার্সা যার সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল, সেই মানুষটা তাজই ছিল।”

উজ্জ্বল দুই আঙ্গুল দিয়ে কপালে চেপে ধরে বলল,
“মাই গড, এই তাজওয়ার খান তো আস্ত একটা ইবলিশ।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“হ্যাঁ জানি সেটা। কিন্তু দুই বোনের সাথে একই সময়ে প্রেম করা, এতো বড় দুঃসাহস নিয়ে কীভাবে জন্মেছে সে!”

ফার্জিয়া বলল,
“ও পারে না এমন কোনো কাজই নেই। ফার্সার সাথেও সে ফিজিক্যালি ইনভলভ ছিল।”

আহি বিরক্তির সুরে বলল,
“এতো ইমোশনাল তো আমিও ছিলাম না। একটা ছেলে বলল, আর তোমরা নিজেদের সম্মানের কথা একবারও ভাবলে না। এটা ভালোবাসা না। এটাকে ফাজলামো বলে।”

উজ্জ্বল আহির হাত ধরে আহিকে থামিয়ে দিলো। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীচের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“হ্যাঁ, তুমি বলো ফার্জিয়া। এরপর কি হয়েছে?”

ফার্জিয়া বলল,
“ফার্সা প্রেগন্যান্ট ছিল। তাজ বাচ্চাটা এক্সেপ্ট করতে চাচ্ছিলো না। ফার্সাকে খুনের হুমকি দিয়েছিল সে। আর এজন্যই ফার্সা ভয় পেয়ে এবরশন করিয়ে ফেলে। এরপর তাজ আবার ওর সাথে সম্পর্কে জড়ায়। ফার্সা তখন একটু শক্ত হয়েছিল। ও তাজকে বলেছিল, বিয়ে করলেই তার সাথে দেখা করবে। আর তাজও মেনে নিয়েছিল।”

আহি অবাক কন্ঠে বলল, “সিরিয়াসলি?”

ফার্জিয়া মলিন হেসে বলল,
“ধোঁকা দেওয়ার শেষ সুযোগটা নিয়েছিল।”

“মানে?”

“তাজ সেদিন ফার্সাকে একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল ওখানেই একজন উকিল এসে বিয়ে পড়াবে। কিন্তু সেদিন সেখানে কোনো উকিল আসে নি। এসেছিল তাজের বন্ধুরা। আমার বোনকে রেইপ করেছিল ওরা। সাথে ভিডিও বানিয়েছিল। আমার বোনটা একদম ভেঙে পড়েছিল। অদ্ভুত আচরণ করতো ও। আর এরপরই সে আমাকে সত্যটা জানালো। বাসায় আসার পরই না-কি ওর ভিডিওটা ভাইরাল করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছিল ওকে। আমি সব শুনে তাজের কাছে যাই। পায়ে ধরে ক্ষমা চাই। সজিবেরও পায়ে ধরি। না, ওর মনটাও গলে নি। আমাকেও ওরা পণ্যের মতো ব্যবহার করেছে। অসহ্য লাগছিলো সব। বাজে বাজে গালি দিতো আমাকে। সহ্যের বাইরে চলে যেতেই আমি তোমাকে সব জানিয়ে দেই।”

আহি এবার ফার্জিয়ার পাশে এসে বসলো। বলল,
“রিল্যাক্স। কেঁদো না।”

ফার্জিয়া এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। আর আহি তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। উজ্জ্বল আরেক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। ফার্জিয়া এবার পানি খেলো না। সে আহির হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে বলে দিয়ে জীবনের শেষ ভুলটা করেছিলাম। তাজের কাছে ফার্সার যেই ভিডিওটা ছিল। তাজ ওটা ভাইরাল করে দেয়। আমার বোনটা মা-বাবার সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায় নি। রাতের আঁধারেই ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বোনটা আমার বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যায়। বাবা লাশ আনতে যায় নি। বাবা সবাইকে বলেছে, ফার্সা পালিয়ে গেছে। ওর মুখটাও দেখবে না। কিন্তু ফার্সা তো পালায় নি। ও তো আমাদের ছেড়ে আরো অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। ফার্সার মৃত্যুর পর আমরা শহর ছাড়ি। এই যুগে মিনিটের মধ্যেই এক শহর থেকে অন্য শহরে সব ছড়িয়ে যায়। ইন্টারনেট কতোটা ভয়াবহ, বাবা অন্য শহরে গিয়ে বুঝলেন। যদিও ফার্সাকে কেউ চিনতো না। ওই শহরে কেউ জানতোও না যে ভাইরাল হওয়া মেয়েটা আমার বাবার মেয়ে ছিল। আর ওই মানুষগুলো সেই ভাইরাল হওয়া মেয়েটির বাবার সামনেই তাকে গালি দিতো। ব্যস, বাবা এসব সহ্য করতে না পেরে মারা গেলেন। মা ফার্সার মৃত্যুর পর থেকে আমাকে কথা শোনাতো। কারণ আমার কিছু ব্যক্তিগত ছবি তাজ আগেই মাকে পাঠিয়েছিল। মায়ের ধারণা আমার কারণেই ফার্সা নষ্ট হয়ে গেছে। বাবাও আমার কারণেই মারা গেছেন। মা আমাকে তাড়িয়ে দিলো বাসা থেকে। অনেকদিন পর এক আত্মীয় ফোন করে বলল, মা না-কি অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। আমার মুখটাও না-কি দেখবে না। এখন না-কি বলছে, মৃত্যুর পর আল্লাহর সামনে কীভাবে দাঁড়াবে? আমাদের তো ঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারে নি।”

ফার্জিয়া ফুঁপাতে লাগলো। আহির সামনে হাত জোড় করে বলল,
“আমি ভালো হতে চাই। কিন্তু বাঁচার মতো মানসিক শক্তি আমার মধ্যে নেই। লোভ আমার দ্বারা এতো বড় পাপ করিয়েছে, যার শাস্তি আমি সারাজীবন পাবো। এখনো আমার বোনের ভিডিও শেয়ার হয়, সবাই লিংক খুঁজে। আমার সামনেই এসব চলে। আর আমি শুধু দেখেই থাকি। পরিচয় দিতে পারি না, যে ওই মেয়েটা আমার বোন। বলতে পারি না, আমার সামনে অন্তত এসব বন্ধ করো। এবার ভাবছি, দেশ ছাড়বো। এই দেশের মানুষগুলো আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে তারা। যতোক্ষণ তুমি অপরিচিত, ততোক্ষণ তুমি শান্তিতে থাকবে। যখনই ভাইরাল হবে সেটা ভালো হোক, বা খারাপ হোক, তোমাকে গালি দেওয়ার জন্য অনেকগুলো কাপুরুষ বসে থাকবে। আর তার সাথে মহান কিছু মহিলা।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ফার্জিয়া বলল,
“হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি। সরি, ভুল না৷ পাপ করেছি। অনেক বড় পাপ। এর শাস্তি আমি এখনো পাচ্ছি। কিন্তু ওই মানুষগুলো পাচ্ছে না। তাজওয়ার খান, তার বন্ধু সজিব ওয়াহিদ, জিলান শেখ, অর্ণব পাল, জাস্টিন হ্যারি এরা কেউই শাস্তি পাচ্ছে না।”

উজ্জ্বল বলল, “অর্ণব তো মারা গেছে।”

“ওটা তো এক্সিডেন্টে।”

আহি বলল,
“এক্সিডেন্ট হয় নি, আমার ধারণা তাজওয়ার এই কাজ করেছে।”

“কেন?”

“এসব বাদ দাও। তোমার মনকে শক্ত করতে হবে। অতীত ভুলে যাও। অন্তত নিজের মায়ের জন্য বাঁচো। আমাকে দেখো, তোমার মতো অভিজ্ঞতা হয়তো আমার ছিল না। কিন্তু আমিও অদ্ভুত কিছু সম্পর্ক দেখেছি। প্রিয় মানুষগুলোকে হারিয়েছি। আমি তো অপরাধ না করেও শাস্তি পেয়েছি। পৃথিবীটা এমনই। হয়তো আল্লাহ তোমাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলে, তোমাকে ভালো হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। প্লিজ, বেঁচে থেকো। আমি একটা স্টেপ নিয়েছিলাম, যেটা ভুল ছিল। মরতে গিয়েছিলাম। যদি মরে যেতাম, তাহলে হয়তো আমাকে কষ্ট দেওয়া মানুষগুলো জয়ী হতো। আল্লাহ চেয়েছে, আমি তাদের হারায়। তাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তোমাকেও বাঁচতে হবে, ফার্জিয়া। প্লিজ, তাজের পরিণতি দেখার জন্য বেঁচে থেকো।”

ফার্জিয়া আহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি ভালো, তাই তাজের মতো নোংরা মানুষ তোমাকে স্পর্শ করতে পারে নি। তোমার মন, তোমার সৌন্দর্য স্পর্শ করার অধিকার একমাত্র তারই, যার মনটাও তোমার মতোই। আমি দোয়া করবো, যদিও আমার দোয়া কবুল হবে কি-না জানি না, আমি তো পাপী। তবুও মন থেকে দোয়া করলাম, তুমি তোমার মনের মানুষকে পাবে, ইনশাআল্লাহ।”

আহি ফার্জিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে অশ্রু ভীড় করলো। আহির মনের মানুষ? কীভাবে সম্ভব?
আহি মলিন হেসে ফার্জিয়াকে বিদায় দিলো। ফার্জিয়া যেতেই উজ্জ্বল তার পেছনে লাগিয়ে রাখা ছোট ক্যামেরাটা বের করলো। এরপর সে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে ভিডিওটা শুরু থেকে চালালো। ফার্জিয়াকে ভিডিওতে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। উজ্জ্বল আহির কাছে এসে বলল,
“প্ল্যান ডি সাকসেসফুল। ফার্জিয়ার কথা রেকর্ড হয়ে গেছে। এখন যদি তাজওয়ার নিজের বিরুদ্ধে থাকা সব প্রমাণ শেষ করে দিতে চায়, ফার্জিয়াকে যদি মেরেও ফেলে, তবুও এই ভিডিওটা আমাদের কোর্টে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে৷”

আহি গম্ভীর কন্ঠে বলল, “কিন্তু ওকে বাঁচতে হবে।”

“আহি, প্লিজ। আমরা তো গোয়েন্দাগিরি কর‍তে পারবো না। ও যদি বাই চান্স বেঁচে থাকে, ও আমাদের জন্য সাক্ষ্য দিতে কোর্টে আসবে। আর তাজওয়ার যদি ওকে ম্যানিপুলেট করে, তবুও ওর এই রেকর্ডটা সত্য কথা বলবে। তাই এই রেকর্ড সামলে রাখা তোমার দায়িত্ব।”

“হুম, আমি রাখবো।”

“এখন প্ল্যান সি এক্সিকিউট করতে হবে। কাজ শুরু করেছো?”

“না, ভীষণ অস্থির লাগছে।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”

“আফটার অল, উনি আমার বাবা। বাবাকে কি কষ্ট দেওয়া যায়?”

উজ্জ্বল কপাল চুলকে বলল,
“বাড়াবাড়ি রকমের ইমোশনাল তুমি।”

আহি মুখ ছোট করে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে রইলো। উজ্জ্বল মুচকি হাসলো আর বলল,
“এখন চলো।”

(***)

কালো মোটরসাইকেল নিয়ে নিষিদ্ধ গলিতে ঢুকে পড়লো আফিফ। মোটরসাইকেল সামনে টানতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দু’একটা মেয়ে। আফিফ ধীর গতিতে মোটর সাইকেল চালিয়ে সেই নিষিদ্ধ বাড়িতে ঢুকে পড়লো। আফিফ মোটর সাইকেল থেকে নামতেই একটা মেয়ে তার কাঁধে হাত রেখে নেশালো কণ্ঠে বলল,
“চেহারা দেখাতে কি লজ্জা করছে তোমার! আমার উড়নায় বেঁধে নিয়ে যাবো, না-কি? হুম, হুম?”

আফিফ মেয়েটির হাত সরিয়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই থেমে গেলো। সে ধীর পায়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। আফিফ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আরাফাত তোমার সাথে দেখা করতে বলেছিল। তুমিই কি ঝুনু?”

মেয়েটি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“হ, আমিই ঝুনু, আরাফাতের ঝুনু।”

কথাটি বলেই মেয়েটি হাসতে লাগলো। আফিফের অসহ্য লাগছিলো এই হাসিটা৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তার এখানে আসা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা ছিল না। আফিফ এবার কাঁপা হাতে জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ঠিকানা বের করে তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দিলো। মেয়েটি আফিফের গ্লাভসবন্দী হাতটা ধরে বলল,
“এক্কেবারে পর্দা কইরা আইছেন।”

আফিফ মেয়েটির হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখো, আমার এই মুহূর্তে তোমাকে খুব প্রয়োজন, তাই বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি। তুমি চাইলে আমার সাথে বাইরেও দেখা কর‍তে পারতে।”

“ইচ্ছা কইরা দেখা করি নাই। এই গলি আপনাদের জন্য না, এডাই বুঝাইতে চাইছি। দেখছেন এবার? এই গলিতে সভ্য পোলারা আইতে পারে না। আরাফাত আমারে কইছে, আপনার মাইয়া লাগবো, তাও আবার মহান কাজে। মহান কাজে আমগোরে দিয়া কি হইবো?”

“দেখো, আমি শুধু তোমাকে যার ঠিকানা দিয়েছি, তুমি তাকেই…”

আফিফ একটু থেমে বলল, “বুঝতে পারছো তো?”

“হ, হ, তার লগেই শুইতে হইবো। বেশি সাধু আপনে। সোজাসুজি কইতে পারেন না। শুনেন, ভাইজান এখানের মাইয়াগুলা বহুত ডেঞ্জারাস। তারা আপনের কাঁপা-কাঁপি দেইখায় তো ফিট হইয়া যাইবো। হেলমেট খুইল্লেন না আবার। আমি আপনের কাম কইরা দিমু। আর বেটারে এমন ফাঁসা ফাঁসামু, এই জন্মে আর মাইয়া মাইনসের মুখ দেখতে চাইবো না।”

আফিফ মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেই ঝুনু তার পথ আটকে বলল,
“আরাফাত কিন্তু আমার পুরোনো কাস্টমার। বিয়ে কইরা বেটা এখন ভদ্র সাজতাছে। আমারে বিয়া করবে কইছিলো। তার ফকিন্নি মা, আমারে গালি দিয়া বাইর কইরা দিছে। আরাফাত আমারে কি কইছে জানেন? কইছে, এই গলি থেকে বাইর হইয়া মাইনসের বাসায় কাম কইরা খাইতে।”

আফিফের ঝুনুর কথা শোনার কোনো আগ্রহ ছিলো না। হাত-পা ঘামছে তার। এমন একটা ভয়ংকর কাজ করতে এসেছে, যা করার কথা সে কোনোদিন কল্পনাও করে নি। ঝুনু বলল,
“আরাফাত কে হয় আপনের?”

“কলিগ!”

“কাম করেন একসাথে?”

“আগে করতাম।”

“কেমনে জানেন ও এই আকাম কর‍তে এখানে আইতো?”

“জানিয়েছে আমাকে।”

“বেটার বাচ্চা হইছে, না?”

“হ্যাঁ।”

“ভাইজান, আপনের কাজেই বেটা আমারে ফোন দিছে। আমি তার ফোন পাইয়া যে কি খুশিটাই না হইছি। কাইন্দা দিছি এক্কেবারে। ভাবছি লইয়া যাইবো আমারে৷ শালায় আমারে অন্য বেটার লগে শুইতে কয়।”

আফিফ এবার ঝুনুর দিকে তাকালো। এতোক্ষণ ঝুনুর দিকে ভালোভাবে তাকায় নি সে। একনজর তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এবার তাকাতে বাধ্য হলো। ঝুনুর গলা ভারী হয়ে গেছে। চোখ টলমল করছে। আফিফ তা দেখে বলল,
“তুমি এই কাজ করো, তাই আমি তোমার কাছে এসেছি। তোমাকে যার ঠিকানা, আর ছবি দিয়েছি, সে একটা শয়তান। অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। ভবিষ্যতেও করবে। তোমার কাজ শুধু, তুমি যা করবে তা ভিডিও করে রাখবে। এই ভিডিও ভাইরাল করা হবে। আর এটা অনেক মানুষ দেখবে। আমি আরাফাতকে বলেছিলাম, তোমাকে এই কথাটা আগেই জানাতে। ভিডিও ভাইরাল না করলে এই শয়তানটাকে শাস্তি দিতে পারবো না৷ তোমার আপত্তি নেই জেনেই, আমি এখানে এসেছি।”

“ভিডিওতে আমারে দেখা যাইবো?”

“না, তোমার চেহারা বোঝা না যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।”

“আমার সমস্যা নাই। আমি এমন কাজ আগেও করছিলাম। আমারে দেখা গেলেও সমস্যা নেই। ওই বেটারে ভালোভাবে ফাঁসাইতে পারলেই, আমি শান্তি পামু।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে ঝুনুর দিকে তাকালো। মেয়েটির চোখে জল। হয়তো সে আরাফাতকে ভালোবাসতো। আর ভালোবাসার মানুষটিই তাকে এমন একটা কাজ দিয়েছে।
বেশ তো। ঝুনুদের কি ভালোবাসা যায়? যারা স্বেচ্ছায় কলঙ্কিত, তাদের ভালোবাসা গায়ে মাখাও কলঙ্ক।

(***)

আফিফ নিষিদ্ধ গলি থেকে বেরিয়ে এসেই হেলমেট খুলে মাটিতে ফেলে দিলো। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে মুখে পানি ছিটালো। অপরাধবোধ কাজ করছে তার। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হাতে এই একটাই পথ খোলা ছিল। তাজওয়ারকে সে একই শাস্তি দেওয়া, যেই শাস্তি তাজওয়ার তার বোনকে দিয়েছিল। আফিফ ঘাসের উপর বসে পড়লো। বুকে হাত চেপে বলল,
“তুমি কেন নিজেকে শেষ করে দিতে গেলে, আপা? তোমাকে হারিয়ে আমি একদম ভেঙে পড়েছিলাম। আর দেখো, আহিকে ফিরে পেয়ে সব শক্তি আবার ফিরে পেয়েছি। তুমি যদি বেঁচে থাকতে, আমার জীবনটা অন্য রকম হতো। তোমার মৃত্যুর ভার ভীষণ ভারী ছিল। আহির কিছু হয়ে গেলে, আমি আরো ভেঙে পড়তাম। হ্যাঁ, আমি জানি ও আমার কেউ না। কেউই না। কিন্তু একটা সময় তো আমার জন্য কিছু একটা ছিল। হয়তো একটা অনুভূতি, একটা স্বপ্ন বা একটুখানি আশা। তাজওয়ার খান সব শেষ করে দিয়েছে। আমার আফসোস থাকতো না যদি আহি সুন্দর একটা জীবন পেতো। সত্যিই তখন আমার কোনো আফসোস থাকতো না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি সেদিন আহিকে ছেড়ে এসে, ওকে একদম নিঃস্ব করে দিয়েছিলাম। আপা, আমি তোমাকে হারিয়ে এতোটা ভেঙে পড়েছিলাম যে আমার রেনু আর মাকে হারানোর ক্ষমতা ছিলো না। আমি শুধু আহিকে অনুভব করেই আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ হারিয়েছি, আর ওর হাত ধরলেই তো নিঃস্ব হয়ে যেতাম। আমি তো তাকে খেয়ালে রেখেছিলাম। আমার প্রথম অনুভূতি, জানি না কি ছিল সেটা। কিন্তু যা ছিল, খুব সুন্দর ছিল। আর বিয়েটাও তো তার ভালোর জন্যই করেছিলাম। কিন্তু যাকে বিয়ে করেছি, সেই মেয়েটা যে তার বন্ধু হবে, এটা কখনো ভাবি নি। আমি পদ্মকে ভালোবাসি। হ্যাঁ, এখন আমি পদ্মকে ভালোবাসি। হয়তো বিয়ের পর ভালোবেসেছি। মায়া জমে গেছে ওর প্রতি। মেয়েটা ভালো। আমি ওকে ঠকাতে চাই না৷ কিন্তু আমার কষ্ট হয়। এটা আহিকে না পাওয়ার কষ্ট না। এটা আহির সামনে পদ্মকে ভালোবাসার কষ্ট। কি করবো আমি? ওর তো আমাকে ভুলতে হবে। আমাকে ভুলতে না পারলে, ও তো সেখানেই আটকে থাকবে, যেখানে আমি ওকে ফেলে এসেছিলাম। আমি আহিকে অতীত থেকে বের কর‍তে চাই। আমি চাই একটা সুন্দর জীবন হোক ওর। রাদের সাথে হোক, বা যার সাথেই হোক। অন্তত একটা চমৎকার মানুষ আহি ডিজার্ভ করে। অনেক বেশি ভালোবাসা ডিজার্ভ করে মেয়েটা। অনেক বেশিই ডিজার্ভ করে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||আংশিক পর্ব||

৯৬।
সুনেহরাহর সামনে বসে আছে লিনাশা আর পুষ্প। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারা সুনেহরাহকে দেখছে। সুনেহরাহ ভীত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি হলো, হাবলার মতো বসে না থেকে, যা বলছি তাই করো। নয়তো তোমার বরকে গিয়ে তোমার রঙ্গলীলা জানিয়ে দিতে আমাদের দুই মিনিটও দেরী হবে না।”

সুনেহরাহ বলল,
“প্লিজ এমন করো না। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করি নি। আর আহি? আহিকে আমি খুব পছন্দ করি।”

লিনাশা বলল,
“পছন্দ-অপছন্দ আমাদের দেখার বিষয় না। তোমার একমাত্র পরিচয় তুমি লাবণি মেহেরার পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট। তুমি তার সাথে বিভিন্ন ক্লাবে যাও। ভালোই জানি আমি। এখন এতোটুকু তথ্য তো তোমার কাছে আছেই।”

সুনেহরাহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পুষ্প বলল,
“যদি আগামী চারদিনের মধ্যে লাবণির সব তথ্য আমাদের সামনে এনে না রেখেছো, মনে করবে পাঁচদিনের দিন ভোর হতেই তোমার সংসার খালাস।”

সুনেহরাহ করুণ দৃষ্টিতে পুষ্পের দিকে তাকালো। লিনাশা তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“তুমি তোমার হাসবেন্ডকে চিট করেছো। রিজওয়ান কবিরের কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে তোমার অবৈধ সম্পর্ক আছে। আর তোমাদের প্রেমলীলার লাইভ ভিডিও আমাদের কাছে আছে। মনে থাকে যেন!”

পুষ্প বলল,
“যদি আমরা একবার তোমার প্রেমলীলা টেলিকাস্ট করি, তাহলে তোমার সংসারটা তো ফ্লপ হবেই, কিন্তু আমাদের সিনেমাটা হবে সুপার হিট।”

সুনেহরাহ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমি লাবণি মেহেরার সব তথ্য বের করে দেবো। আমার হাসবেন্ডকে ওসব ব্যাপারে কিছু জানাবে না, প্লিজ।”

লিনাশা বলল,
“তোমার সাথে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো ঝামেলা নেই। সমস্যা লাবণি মেহেরার সাথে। তোমাকে যতোটুকু বলেছি ওতোটুকুই করো। এরপর তোমার যা করতে মন চায়, করো। আমাদের কিছুই আসে যায় না।”

কথাটি বলেই লিনাশা আর পুষ্প উঠে চলে গেলো। আর সুনেহরাহ মলিন মুখে তাদের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।

(***)

তাজওয়ারের বাংলো বাড়ির কাছাকাছি একটা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে ঝুনু। পরণে কটকটে লাল শাড়ি, হাত কাটা ব্লাউজ। শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে প্যাঁচানো। উদর দৃশ্যমান। ঝুনু আরো ভালোভাবেই সেটা উন্মুক্ত করে দিলো। এবার তার নাইমন্ডলটিও দৃশ্যমান হলো। আর তখনই গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করলো তাজওয়ার খান। ঝুনু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর জন্য ইশারা করলো। তাজওয়ার ঝুনুকে দেখে অনেক আগেই গাড়ির গতি কমিয়েছিল। ঝুনুর ইশারা পেয়ে সে এবার গাড়ি থামালো। গ্লাস নামাতেই তার দৃষ্টি আটকালো ঝুনুর উন্মুক্ত দেহ ভাঁজের দিকে। ঝুনু তাজওয়ারের দৃষ্টি উপেক্ষা করে মুখ ছোট করে তার দিকে হালকা ঝুঁকে আহ্লাদী সুরে বলল,
“দেখুন না, আমার হিলটা ভেঙে গেছে। আশেপাশে গাড়িও দেখছি না। কোথায় যে এসেছি, সেটাও জানি না। আমি আবার খালি পায়ে হাঁটতে পারি না। এখন আশেপাশে কোথাও কি হোটেল আছে? যদি আজ রাতে থাকার ব্যবস্থা হতো।”

তাজওয়ার রাস্তায় পড়ে থাকা ঝুনুর ভাঙা হিলের দিকে এক নজর তাকিয়ে বাঁকা হাসি ফেরত দিলো। এরপর গাড়ির দরজা খুলে বের হলো। ঝুনু তাজওয়ারের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাল্প করবেন প্লিজ!”

তাজওয়ার কুৎসিত দৃষ্টিতে ঝুনুকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“সামনে আমার বাড়ি। চাইলে ওখানেই থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। ওটা তোমার স্বর্গ মনে হবে।”

“আই লাভ হ্যাভেন। অফকোর্স।”

তাজওয়ার গাড়ির দরজা খুলে দিতেই ঝুনু গাড়িতে উঠে গেলো। তাজওয়ার কামুক দৃষ্টিতে ঝুনুর দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুনুও বেশ খোলামেলা ভাবেই তাজওয়ারের সাথে কথা বলছে। তাজওয়ার ভালোভাবেই বুঝে গেছে, ঝুনু মেয়েটা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মতো না। তাজওয়ার একটু সাহস দেখিয়ে ঝুনুর হাঁটুতে হাত রাখলো। ঝুনু প্রতিবাদ করলো না। উলটো তাজওয়ারের হাতের উপর আলতো হাত রাখলো। তাজওয়ার ঝুনুর স্পর্শে মুচকি হেসে বলল,
“নাম কি তোমার?”

“জেনিফার।”

“সো কুল।”

গাড়ি বাংলো বাড়িতে ঢুকতেই তাজওয়ার ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে ঝুনুর জন্য দরজা খুলে দিলো। ঝুনু বাড়িটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিউটিফুল হ্যাভেন।”

তাজওয়ার হাসলো। তখনই দেখলো ভেতর থেকে তাজওয়ারের বন্ধু হ্যারি বেরিয়ে আসছে। তাজওয়ার তাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“হ্যারি, হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়া’র?”

“আই কেইম টু মিট ইউ।”

“হোয়াই? এনি প্রবলেম?”

হ্যারি মলিন সুরে বলল,
“একচুয়েলি, আই এম রিয়েলি মিসিং অর্ণব। ইউ নৌ, হি ইজ মাই বেস্ট বাডি।”

তাজওয়ার সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আই নৌ।”

“উই কেইম হেয়া’র। স্পেন্ডিড আ লট অব টাইম। দা’টস দা রিজন, আই কেইম হেয়া’র। আই ফিল হিম হেয়া’র।”

তাজওয়ার দুঃখ ভরা দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে তাকালো। এদিকে হ্যারি ঝুনুকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,
“হো’জ দেট?”

তাজওয়ার ঝুনুর কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“মাই বেবি গার্ল।”

হ্যারি হেসে বলল,
“ভেরি গরজিয়াস। ওকে ম্যান, ইনজয় ইউর নাইট।”

হ্যারি বেরিয়ে যেতেই তাজওয়ার ঝুনুর হাত ধরে তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো। এদিকে হ্যারি গেট দিয়ে বের হতেই তার সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। হ্যারি সেই গাড়িতে উঠতেই গাড়িটি বাংলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। হ্যারি গাড়িতেই তার ব্রান্ডেড সিগারেট ধরালো। তার পাশেই একজন বসে আছে। তাকে চেনা যাচ্ছে না। সিগারেটের ধোঁয়া বের হতেই পাশে থাকা আগন্তুকটি গাড়ির কাচ নামিয়ে দিলো। সড়ক বাতির আলো গাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দৃশ্যমান হলো আগন্তুকটির মুখ৷ আফিফ রাফাত৷ গ্লাস নামিয়ে দিতেই হ্যারি বলল,
“আই হেইট তাজওয়ার খান। আই হ্যাভ ডান দিস, অনলি ফর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। তাজওয়ার কিল্ড মাই ফ্রেন্ড। আই ওয়ান্ট টু সি হিম ডেস্ট্রয়েড।”

আফিফ বলল,
“ইয়েস, এন্ড ইট উইল হ্যাপেন।”

“আই হ্যাভ সেট ক্যামেরাস ইন এভ্রি রুম। হি ক্যান্ট সেইভ হিমসেল্ফ। এন্ড লিসেন আফিফ, আই এম হ্যাল্পিং ইউ টু টেইক মাই রিভেঞ্জ অনলি। নাথিং ইলস।”

আফিফ হাসলো। দৃষ্টি সরিয়ে জানালার বাইরে তাকালো। এখন শুধু নতুন দিনের নতুন সূর্য উদয়ের অপেক্ষা। এরপর মুক্তি পাবে আফিফ। হালকা হবে তার মনের বোঝা। এবার অন্তত সে বলতে পারবে,
“হ্যাঁ, আমি ভাই হওয়ার দায়িত্ব কিছুটা হলেও পালন করতে পেরেছি।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৪৫+৪৬

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৫||

৮৯।
হাসপাতালের করিডরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে তাজওয়ার। তার শার্টে রক্তের দাগ। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হাসপাতাল অথচ তাজওয়ার ঘামাচ্ছে। হঠাৎ তাজওয়ারের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো লিনাশা। এসেই কোনো কিছু না ভেবে তাজওয়ারের কলার চেপে ধরে তাকে ঝাঁকিয়ে বলল,
“তোর জন্য আহির এই অবস্থা হয়েছে। শয়তান, তোকে আমি মেরেই ফেলবো।”

লিনাশার পিছু পিছু নায়ীবও এসেছে। সে লিনাশাকে তাজওয়ারের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“লিনু, শান্ত হও।”

লিনাশা চেঁচিয়ে বলল,
“এই শয়তানটাকে এখান থেকে যেতে বলো। ও এখানে কি করছে? আমার আহিকে তো মেরেই ফেলেছে, এখন কি করতে চায়?”

তাজওয়ার লিনাশার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আহির কিছু হয় নি।”

“চুপ, একদম চুপ। তুই ওর জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিস।”

“আমি আহিকে ভালোবাসি।”

লিনাশা তাজওয়ারের গায়ে হাত তোলার জন্য এগিয়ে যাবে তখনই নায়ীব উঁচু গলায় বলল,
“এসব করে কোনো লাভ হবে না, লিনু। প্লিজ চুপ করো। এটা হসপিটাল। কোনো মাছের বাজার না।”

লিনাশা ধরা কণ্ঠে বলল,
“এই শয়তানের কথা শুনেছো তুমি? সে না-কি আহিকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানে বুঝে এই শয়তানটা? ভালোবাসা কি জানে? ভালো তো আহি বেসেছে। ভালোবাসার মতো ভালোবেসেছে। ভালোবাসায় সব ত্যাগ করেছে। ভালো তো রাদ বেসেছে। যে মুখ বুজে সব সহ্য করছে। ত্যাগ করছে। আর এই শয়তান না-কি ভালোবাসে? ভালোবাসা কি ফাজলামো না-কি?”

তাজওয়ারের হাত মুঠো হয়ে এলো। তাদের কথার মাঝখানে লাবণি ও রিজওয়ান কবির চলে এসেছেন। লিনাশা তাদের দেখে বলল,
“আসুন আসুন। বিশেষ অতিথি এসেছে, দেখছি। আপনাদের জন্য কি বসার ব্যবস্থা করতে হবে?”

লাবণি বিরক্ত মুখে বলল,
“লিনাশা, তোমার দুলাভাইয়ের সাথে ভদ্র ভাবে কথা বলো।”

“দুলাভাই? আমি তো আমার সামনে কোনো ভাইয়া দেখছি না। দেখছি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের সো কল্ড বাবাকে।”

রিজওয়ান কবির শ্রান্ত স্বরে বললেন,
“আহি এমন একটা কাজ করবে তা আমরা কেউ ভাবতে পারি নি।”

“আপনি অন্তত কিছু ভাববেন না। আপনার চিন্তা-ভাবনা আধ্যাত্মিক পর্যায়ে চলে গেছে। আমরা তা স্পর্শও করতে পারবো না সেই ভাবনা। আপনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না, বাবা মানুষটা এমনও হয়। এক আমার বাবা, যে নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে গিয়ে নিজের প্রাণটাই ত্যাগ করেছেন। আর এক আহির বাবা, যে নিজের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার জন্য নিজের মেয়ের সম্মানটাই বিক্রি করে দিচ্ছেন। ছি! এমন বাবা থাকার চেয়ে অনাথ থাকা ভালো।”

(***)

আহির ফোনে বারবার কল দিয়ে যখন লিনাশা আহিকে পাচ্ছিলো না, তখনই সে মুনিয়া খালার নম্বরে কল করলো। মুনিয়া খালার নম্বরটি সে অনেক আগেই সংগ্রহ করেছিল। কারণ আহির বাসায় একমাত্র তিনিই আহির শুভাকাঙ্ক্ষী। মুনিয়া খালা আহির সাথে হওয়া ঘটনাগুলো সব জানানোর পরই লিনাশা লাবণিকে ফোন করে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে চলে এলো। ততোক্ষণে মোজাম্মেল চাচা দরজা খুলে মুনিয়া খালা আর চুনিকে বের করলেন। এদিকে রিজওয়ান কবির আর লাবণি অনেক আগেই বেরিয়েছিলেন। কিন্তু তারা আহির এমন আত্মহননের চেষ্টায় ভীত ছিলেন। তারা হাসপাতালে না এসে সোজা পরিচিত উকিলের সাথে দেখা করতে চলে গেলো। কারণ সালমা ফাওজিয়া সব জানার যদি মামলা করতে যায়, অন্তত তখন যাতে তাদের কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়। তাই এই পূর্ব প্রস্তুতি।

এদিকে লিনাশা মেসেজ দিয়ে আহির আত্মহত্যার ঘটনা পুষ্পকে জানালো। পুষ্প তখন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উজ্জ্বলের সামনে এসে বসলো মাত্র। লিনাশার মেসেজ দেখেই তার হাত ফস্কে চায়ের কাপ মেঝেতে আছড়ে পড়লো। উজ্জ্বল তা দেখে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“কি রে, মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না-কি তোর!”

পুষ্প উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“ভাইয়া, আহি সুইসাইড করেছে।”

কথাটা যেন উজ্জ্বলের কানে শ’খানেক বার ধাক্কা খেলো। কান গরম হয়ে গেলো তার। গতকালই তো আহিকে সুস্থ-স্বাভাবিক দেখেছিল। এক রাতে কি এমন হয়ে গেলো, যে আহিকে আত্মহত্যা করতে হলো?

(***)

প্রতিদিন সন্ধ্যায় লাবীব পুষ্পের সাথে এক ঘন্টা ফোনে কথা বলবে। আজ একটু দেরী হয়ে গেছে। পুষ্প মেসেজে বলেছিল তার কাজিন উজ্জ্বল বাসায় এসেছে। সে উজ্জ্বলের জন্য চা বানিয়েই লাবীবকে কল করবে। অথচ এক ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে পুষ্পের কোনো খবর নেই। লাবীব ফোন দিতেই পুষ্প রিসিভ করলো। সে কিছু বলার আগেই পুষ্প কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আহি সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। ওর অবস্থা খুব খারাপ।”

লাবীব বেশ অবাক হলো। শান্ত কণ্ঠে বলল,
“মজা করছো আমার সাথে? আহি যথেষ্ট স্ট্রং।”

“আমি হাসপাতালে এসেছি। লিনাশা, আহির বাবা-মা সবাই এখানে আছেন। অনেক আগেই ওকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। আমি তো একটু আগে এসেছি।”

“প্লিজ, পুষ্প। এমন মজা করা উচিত না।”

“মজা করছি না। আহিকে নিয়ে কেন মজা করবো? ওই তাজওয়ার খান না-কি আহির সাথে নোংরামি করতে চেয়েছিল, তাই ও এমন একটা স্টেপ নিয়েছে।”

লাবীব স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। তার মাথাটা একদমই কাজ করছে না। সে পুষ্পের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। পথেই সে রাদকে কল করলো। রাদ সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করে বলল,
“ভাই, আহি কল রিসিভ করছে না কেন? আমি কাল রাত থেকে কল দিচ্ছি। ওই তাজওয়ার ওকে গাড়িতে করে যে নিয়ে গেলো, এখন কোনো হদিসই নেই এই মেয়ের।”

লাবীব ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তোকে একটা এড্রেস পাঠাচ্ছি। ওখানে তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

লাবীব কল কেটে রাদকে ঠিকানা পাঠিয়ে দিলো। রাদ মেসেজটা দেখে সাথে সাথেই ফিরতি কল করলো লাবীবকে। লাবীব ফোন ধরতেই সে বলল,
“কিছু হয়েছে? আহির কিছু হয়েছে?”

“হুম!”

রাদ ধরা কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে ওর?”

“সুইসাইড….”

লাবীব আর কিছু বলতে পারলো না। রাদ চেঁচিয়ে বলল,
“ও এমন কিছু করার মেয়ে না, বুঝেছিস? আমি এক্ষুণি আসছি। ওর গালে ঠাসিয়ে একটা চড় লাগাবো। মরার ভূত মাথা থেকে নামাবো ওর।”

রাদ দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে কয়েক সিঁড়ি গড়িয়ে পড়লো। নিচের ফ্ল্যাটের এক ছেলে রাদকে ধরে উঠালো। রাদ বেশ অস্থির হয়ে তাকে বলল,
“ভাই রিয়ান, আমাকে একটা সিএনজি ঠিক করে দাও না?”

তারপর ফোনটা রিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এই এড্রেসে৷ আমার না হাত-পা চলছে না।”

রাদের এমন অবস্থা দেখে রিয়ান গাড়ি ঠিক করে দিয়ে নিজেও রাদের সাথে হাসপাতাল পর্যন্ত এসে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেলো। রাদ উপরে উঠেই দেখলো সবাই মলিন মুখে বসে আছে। লাবীব রাদকে দেখে তার কাছে এসে বলল,
“আহির অপারেশন চলছে। হাত কেটে ফেলেছে। চিন্তা করিস না৷ কিছু হবে না। সব কি এতো সহজ না-কি!”

রাদ ধরা কণ্ঠে বলল,
“ওর কিছু হবে না৷ ওর পুরো জীবনটাই তো দেখতে হবে। ওকে তো বাঁচতে হবে। সুখ না দেখে ও এভাবে চলে যেতে পারবে না। পৃথিবীতে এতোটা নিষ্ঠুর বিচার হয় না।”

(***)

রাত ১টা। কাজ সেরে পদ্ম আফিফের পাশে বসলো। আফিফ স্থির হয়ে বসে আছে। বিকেল থেকেই তার মন ভারী হয়ে আছে। আহিকে এভাবে কষ্ট দিতে চায় নি সে। কিন্তু যা করেছে আহির ভালোর জন্যই করেছে। অন্তত মেয়েটা তার প্রতি মনে বিন্দুমাত্র ভালোবাসাও না রাখুক। রাদকে ওয়াদা করেছিল আফিফ। খুব শীঘ্রই সে আহির জীবন থেকে চলে যাবে। অন্তত যতোদিন আছে, ততোদিনে আহির মন থেকে উঠে যাওয়ার সব চেষ্টা করতে চায় আফিফ। কিন্তু শান্তি পাচ্ছে না। অপরাধবোধ ঝাঁকড়ে ধরেছে তাকে। পদ্ম আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আফিফের সাড়া না পেয়ে সে তার বুকে মাথা রেখে বলল,
“কি হয়েছে আপনার? হঠাৎ মন খারাপ হলো কেন?”

আফিফ পদ্মের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“কোথায়! আমি তো ঠিকই আছি।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনাকে খুব অশান্ত মনে হচ্ছে। এমন তো আগে ছিলেন না। এমন কিছু কি হয়েছে, যা মনের বিরুদ্ধে?”

আফিফ মৃদু হেসে বলল,
“তুমি আমাকে একটু বেশিই বুঝতে চাও।”

“আপনি তো ভীষণ চাপা স্বভাবের৷ আপনাকে বুঝতেই তো আমার যুগ পেরিয়ে যাবে।”

হঠাৎ পদ্মের ফোন বেজে উঠলো। পদ্ম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার ফোনে এতো রাতে কে কল করেছে?”

আফিফের পাশেই পদ্মের ফোনটা ছিল। আফিফ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল,
“তোমার ফ্রেন্ড।”

পদ্ম ফোন হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুষ্প ক্লান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“পদ্ম, তোর ব্লাড গ্রুপ কি বি পজিটিভ?”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ। কেন?”

“আহিকে রক্ত দিতে হবে।”

পদ্ম মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম বলল,
“আহিকে রক্ত দিতে হবে কেন? কি হয়েছে ওর?”

আফিফ পদ্মের মুখে এমন কথা শুনে চমকে উঠলো। ওদিকে পুষ্প বলল,
“গ্রুপে দেখিস নি?”

“না। কি হয়েছে, বল না?”

“সুইসাইড করতে চেয়েছে ও।”

“কি! সুইসাইড?”

আফিফ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে৷ পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“কি পাগলের মতো বলছিস, পুষ্প?”

“চিন্তা করিস না। ডাক্তার আশ্বস্ত করেছেন। আপতত ব্লাড লাগবে। একজন দিয়ে গেছে। কিন্তু আরো এক ব্যাগ লাগবে। তুই দিতে পারলে আমাদের বাইরে খোঁজ নিতে হবে না।”

“কেন দেবো না আমি? আমি এক্ষুনি আসছি। ঠিকানা পাঠা আমাকে।”

পদ্ম কল কাটতেই আফিফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে আহির?”

পদ্ম ভেজা কন্ঠে বলল,
“সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে ওখানে? ওর না-কি ব্লাড লাগবে। আমাদের ব্লাড গ্রুপ সেইম।”

আফিফ বিছানা ছেড়ে উঠে বলল,
“আমি বাইক বের করছি৷ তুমি তাড়াতাড়ি আসো।”

(***)

ভোর ছয়টা। হাসপাতালেই স্থির হয়ে বসে আছে কিছু মানুষ। একজন ব্যতীত কারো সাথেই আহির রক্তের সম্পর্ক নেই। অথচ তারা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিয়েছে। লিনাশা মলিন মুখে বসে আছে করিডোরের সাথে লাগোয়া বেঞ্চে। নায়ীব তার হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। একপাশে পুষ্প বেঞ্চে পা উঠিয়ে পদ্মের কাঁধে মাথা রেখে নিভু নিভু দৃষ্টিতে আহির কেবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সালমা ফাওজিয়া সেই কেবিনের বাইরে মেঝেতে বসে আছেন। তার পাশেই রাদ বসা। আর পেছনের বেঞ্চে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছে লাবীব। আর আফিফ তার পাশেই বসে আছে। উজ্জ্বলকে রাত তিনটায় জোর করে বাসায় পাঠিয়েছিল পুষ্প। সবার জন্য খাবার নিয়ে এসেছিল সে। কিন্তু কারো মুখে দানা-পানি যায় নি। সেও এখন এক কোণায় বসে আছে। এদিকে রিজওয়ান কবির আর লাবণি অনেক আগেই চলে গেছেন। আর রাদ এসেই তাজওয়ারের সাথে হাতাহাতি লাগিয়ে দেওয়ায় তাজওয়ারও বাধ্য হয়ে চলে গিয়েছিল। ডাক্তার অনেক আগেই জানিয়েছে আহি আশংকা মুক্ত। কিন্তু জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কেউ এই কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। সালমা ফাওজিয়া কিছুক্ষণ পর পর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন, সাথে লিনাশা, পদ্ম আর পুষ্পকেও কাঁদিয়ে দিচ্ছেন। মেয়ে তিনটা সারা রাত বসে কেঁদেছে। এতোগুলো মানুষ আহির চিন্তায় অস্থির। অথচ আহির জন্মদাতা যেন নির্বিকার হয়ে আছেন। তিনি সালমা ফাওজিয়ার প্রশ্নের উত্তর থেকে বাঁচতেই চলে গেছেন অনেক আগে। এরই মধ্যে মোজাম্মেল চাচা, মুনিয়া খালা আর চুনি এসেও চলে গেছে।

(***)

ঘড়ির কাঁটা সাতটা সাত মিনিটে এসে থামতেই নার্স বেরিয়ে বলল, আহির জ্ঞান ফিরেছে। সালমা ফাওজিয়া অস্থির হয়ে উঠে কেবিনে যেতে নিবে তখনই নায়ীব তার পথ আটকে বলল,
“আপনাকে দেখলে ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। আপনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনি একটু পড়ে যান৷ রাদ আগে যাক। ও আহিকে স্বাভাবিক করুক।”

নায়ীবের কথায় রাদের দেহে যেন প্রাণ ফিরলো। নায়ীব রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ওই ঘটনা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করো না৷ শুধু ওকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট করতে যাচ্ছো তুমি। যাতে বাকি সবার অভিযোগ নেওয়ার ক্ষমতা তাকে ওর।”

রাদ মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকলো। আহি নিভু নিভু দৃষ্টিতে কেবিনের দরজার দিকে তাকালো। রাদকে দেখে তার চোখ যেন হেসে উঠলো। আহির মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে নিজের অশ্রু আটকালো সে৷ হয়তো এজন্যই নায়ীব তাকে পাঠিয়েছে। আহির ব্যাপারে ধৈর্য ধরার ক্ষমতা নিয়েই হয়তো জন্মেছিল সে। আহিকে দেখলেই তার মন শক্ত হয়ে যায়। বাকিরা তো দুর্বল। তারা কাঁদবে। আহিকেও কাঁদাবে।

রাদ আহির পাশে এসে বসলো। আহি কাঁপা হাতে রাদের হাতটা ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো। রাদ আহির হাতটা ধরেই বলল,
“তোকে একনজর দেখার জন্য আমাকে এক যুগ অপেক্ষা করিয়েছিস মনে হলো। তোর অপেক্ষায় এক রাতেই আমার বয়স বেড়ে গেছে। এই বুড়ো রাদকে একটু ষোলোতে নিয়ে আয়। যেই বয়সে সে তোর সাথে দু’দন্ড কথা বলার জন্য তোর বেঞ্চের সামনে গিয়েও ফিরে আসতো। আচ্ছা, অন্তত একুশে নিয়ে আয়, যেই বয়সে তোর বন্ধু হতে পেরে কয়েক শ’বাচ্চাকে ট্রিট দিয়েছিলো। আচ্ছা, সেটাও বাদ দে। অন্তত সেই বয়সে তো নিয়ে আয়, যেদিন তুই তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলি, তুই পাশে থাকলে আমার নিজেকে অসহায় মনে হয় না। তুই আমার মেডিসিন।”

আহি মৃদু হেসে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বেঁচে ফিরেছি আমি। এই ঘুমে আমি অনেক স্বপ্ন দেখেছি। সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন কি ছিল জানিস?”

“কি?”

“লন্ডনের সেই বাড়ির ছাদে পা ঝুলিয়ে তোর পাশে বসে গল্প করা।”

“এর অর্থ কি!”

“আমি মুক্তি পাবো। আকাশ দেখবো। পাখি দেখবো। শান্তি দেখবো।”

রাদ আহিকে হালকা জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোর জন্য সবাই বসে আছে।”

“কে কে এসেছে আমাকে দেখতে?”

“আন্টি এসেছে, লিনাশা, পদ্ম, পুষ্প, লাবীব সবাই বসে আছে।”

“আর?”

রাদ আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“নায়ীব ভাইয়া, পুষ্পের কাজিন উজ্জ্বলও আছে।”

“আর?”

রাদ এবার কিছুক্ষণ থেমে বলল, “আফিফও আছে।”

আহি বলল,
“না, ও তো নেই। একটা তেলাপোকা আছে।”

রাদ হালকা হাসলো। আহি রাদের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোকে একটু ছুঁয়ে দেখি?”

রাদ আহির দিকে ঝুঁকে দাঁড়াতেই আহি রাদের গাল ধরে বলল,
“এবার বিশ্বাস করেছি, আমি বেঁচে আছি। রাদ, আমাকে আর ওই বাড়িতে যেতে দিস না।”

“যেতে দেবো না তোকে।”

“জানি, তুই যেতে দিবি না।”

“হুম, কখনো যেতে দেবো না। ভালোবাসি তোকে। খুব ভালোবাসি।”

“আমিও তো ভালোবাসি।”

“আমার ভালোবাসাটা তোর মতো না।”

আহি রাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“আমাকে আমার মতো করে ভালোবাসিস না। ভীষণ কষ্ট পাবি। দেখ, আমি কষ্ট পেয়েছি।”

“আমাকে কি তুই ফেলে চলে যাবি?”

“না। কেন চলে যাবো?”

“তাহলে কেন কষ্ট পাবো আমি?”

“তুই যাবি না তো?”

“আমাকে কি তেলাপোকা মনে হয়?”

“তুই যদি তেলাপোকা হতি, আমার ভালোবাসা ফস্কে যেতো না। সুন্দর একটা গল্প হতো আমার।”

“এখন লিখবি। সুস্থ হয়ে লিখবি।”

“আমাকে কিন্তু সময় দিতে হবে।”

“সময় নে। তোর নামে আমি পুরো জীবনটাই লিখে দেবো।”

আহি শুকনো হেসে বলল,
“এতো ভালোবাসিস না, রাদ। অতিরিক্ত ভালোবাসা মানেই ক্ষতি, অভিশাপ, যন্ত্রণা।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৬||

৯০।
সালমা ফাওজিয়ার হাত ধরে আহি ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই তাজওয়ারের মুখোমুখি হলো। তাজওয়ার ফুলের তোড়া আহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“কেমন আছো, সুইটহার্ট?”

আহির শরীর এখনো দুর্বল। কিন্তু তাজওয়ারকে দেখেই তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। আহির রাগান্বিত চোখ দু’টি দেখে তাজওয়ার হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আই প্রমিজ, আমি খুব ভালো হয়ে যাবো। ভবিষ্যতে এমন কিছুই করবো না, যেটা তোমাকে কষ্ট দেবে। তোমাকে ছুঁয়েও দেখবো না।”

রাদ আহির পাশে দাঁড়িয়ে তার এক হাত আলতো ভাবে স্পর্শ করলো। আহি রাদের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে তাকালো। এবার তাজওয়ারের দৃষ্টি আটকালো আহি আর রাদের আবদ্ধ হাতের দিকে। তাজওয়ার রাদের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“তুমি এতো সহজে আমার ভালোবাসাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না। তুমি হয়তো জানো না, আহিকে ভালোবাসা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”

তাজওয়ার এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর আমার কাছে না আসা, তোমার জীবনের শেষ ভুল।”

লিনাশা, পদ্ম আর পুষ্প আহিকে আড়াল করে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। লিনাশা বলল,
“এখন এখানে দাঁড়িয়ে লম্বা-চাওড়া ভাষণ না দিয়ে, ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে নাও। তোমার ঠিকানা হয়তো এখন আর খান বাড়ির গ্যারেজেও হবে না।”

তাজওয়ার বাঁকা হাসলো। তাজওয়ারের হাসি দেখে পুষ্প বলল,
“এতো মুখ বাঁকিয়ে লাভ নেই। পুলিশের ঠেঙ্গানি খেলে মুখটা আর সোজা হবে না।”

তাজওয়ার এবার রাগী দৃষ্টিতে পুষ্পের দিকে তাকালো। এবার পদ্ম বলল,
“দেখুন, এখানে তামাশা করে লাভ নেই। আমরা যদি আট-দশ জন লোক জড়ো করি, আপনাকে খুঁজেও পাওয়া যাবে না।”

পদ্মের কথা শুনে লাবীব বলল,
“আট-দশ জন কেন? এই এক পিসের জন্য আমরাই যথেষ্ট।”

লাবীব কথাটি বলেই হাসলো। রাদ লাবীবের পিঠে চাপড় মেরে সামনে এগিয়ে তাজওয়ারকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“রাস্তা মাপো। আহির আশেপাশেও তুমি আর ঘেঁষতে পারবে না।”

তাজওয়ার মৃদু হাসলো। সে পিছু যেতে যেতে বলল,
“আজ না হয় পুরো ফোর্স নামিয়ে দিয়েছো, কাল কিন্তু কেউ থাকবে না। আমার মুখোমুখি তুমিই থাকবে, আহি। মনে ভীষণ ক্ষোভ জন্মেছে আমার। এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোনো প্রেমিক থাকুক, এটা তো মানা যায় না। আহি শুধু একজনের।”

(***)

সালমা ফাওজিয়া আহিকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। রোকেয়া ফাওজিয়া আহির পাশে বসে আছেন। লিনাশা, পদ্ম আর পুষ্প ছাড়া বাকিরা চলে গেছে। তিন বান্ধবী ব্যস্ত আহিকে হাসাতে। অনেক বছর পর আয়েশ করে আড্ডা দিলো তারা। সালমা ফাওজিয়ার ঘরে উষ্ণ আমেজ ছড়িয়ে পড়লো। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি। আহির ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি হাসি দেখে তার চোখ ভিজে গেলো। এভাবেই যদি মেয়েকে আগলে রাখা যেতো!

এদিকে পদ্ম একটু পর পর আফিফের নম্বরে কল করছে। কিন্তু কল যাচ্ছে না। ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে পদ্মকে। লিনাশা পদ্মের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি রে, কি হয়েছে?”

পদ্ম বলল, “উনি যে কোথায় গেলেন!”

“আরেহ, ভাবিস না। হয়তো অফিসে গেছে।”

“আমার না ভয় করছে। উনি ওই তাজওয়ার খানের কোম্পানিতে কাজ করছেন। উনার যদি কিছু হয়ে যায়?”

“কাজ ছেড়ে দিতে বল?”

“তাজওয়ার খান নিজ থেকে উনাকে বের না করলে, আফিফকে অনেক টাকা দিতে হবে। পাঁচ বছরের চুক্তিতে ঢুকেছেন।”

“এটা তো সমস্যা? কতো টাকা লাগবে?”

“কয়েক লাখ।”

“নায়ীব থেকে ধার নিতে পারে।”

“কি যে বলিস!”

“বিপদে তো বন্ধুই বন্ধুকে সাহায্য করে। পদ্ম, আমার মনে হয় ভাইয়ার ওখানে কাজ করা উচিত হবে না।”

(***)

নিজস্ব বাংলো বাড়ির সামনে বাগানে বসে টি-টেবিলের ওপর পা তুলে চেয়ারে আয়েশ করে বসে সিগারেট ফুঁকছে তাজওয়ার। ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। এই মুহূর্তে বাংলো বাড়িতে সম্পূর্ণ একা থাকে সে। বাড়ির বাইরে প্রহরীরা ছাড়া ভেতরে তাজওয়ার একাই। সোহাগকে জরুরি কাজে পাঠিয়ে সে। আজ তার ছিমছাম গড়নের সুন্দরী রমনীর প্রেমে ডুবে যেতে হবে৷ রাগে তার মাথাটা ভো ভো করছে। আর তাজওয়ারের মাথা ঠাণ্ডা করার জন্যই রমনীর সন্ধানে বের হয়েছে সোহাগ। হঠাৎ ধোঁয়া উঠিয়ে দ্রুতগতিতে একটা মোটর সাইকেল বাংলো বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে তাজওয়ারের বাগানে এসে তার টি-টেবিলে ধাক্কা দিলো। মোটর সাইকেলের ধাক্কা খেয়ে টেবিলটি ভেঙে কয়েক হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো। আকস্মিক ঘটনায় তাজওয়ার চেয়ার থেকে মাটিতে উলটো হয়ে পড়লো। আর তার হাতটি তারই আধ-খাওয়া জ্বলন্ত সিগারেটের উপর পড়লো। হালকা আঁচ লাগায় তাজওয়ার চোখ-মুখ কুঁচকে অশ্রাব্য গালি দিয়ে পেছন ফিরে দেখলো মাথায় কালো হেলমেট, হাতে কালো গ্লাভস, পরনে কালো জ্যাকেট আর ট্রাউজার, পায়ে কালো বুটস পরে তার সামনে এক আগন্তুক দাঁড়িয়ে আছে। হেলমেট আর মোটা জ্যাকেটের কারণে মানুষটির চেহারা আর শারীরিক কাঠামো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তাই তাজওয়ার বুঝে উঠতে পারছে না, কে এই আগন্তুক? তাজওয়ার মাটি থেকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাতেই খেয়াল করলো আগন্তুকটির হাতে একটা স্প্রে। তাজওয়ার তা দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেটের দিকে এগুতেই দেখলো তার প্রহরীরা সব মাটিতে পড়ে আছে। তাজওয়ার তা দেখে আগন্তুকটির দিকে তাকাতেই আগন্তুকটি তার হাতে থাকা স্প্রেটি মাটিতে ফেলে দিলো। এরপর মোটর সাইকেলের চাবি হাতে নিয়ে এক হাতে শূন্যে উঠিয়ে অন্য হাত দিয়ে তা ধরে তাজওয়ারের দিকে এগুতে লাগলো। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কে তুমি? কি চাও?”

আগন্তুকটি তাজওয়ারের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“ডাকাতি করতে এসেছিস?”

আগন্তুকটি সাথে সাথেই তার মুষ্টিবদ্ধ হাত তাজওয়ারের নাক বরাবর বসিয়ে দিলো। তাজওয়ার নাক ধরে কয়েক পা পিছিয়ে আবার অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলল,
“কে তুই? তোর সাহস হলো কি করে আমার গায়ে হাত তোলার? তুই জানিস আমি কে?”

আগন্তুকটি তাজওয়ারের কলার ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে আনলো। আর ইচ্ছেমতো বুকে-পেটে ঘুষি মারতে লাগলো। তাজওয়ার ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে যেতেই আগন্তুকটি মাটিতে পড়ে থাকা চেয়ার তুলে তাজওয়ারের গায়ে ইচ্ছেমতো আঘাত করতে লাগলো। এবারও সে ক্ষান্ত হলো না৷ তার মোটরসাইকেলটির সাথে লাগানো একটা লোহার রড হাতে নিয়ে তাজওয়ারের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তাজওয়ার হাতজোড় করে বলল,
“তোর কি ক্ষতি করেছি আমি? যা, ঘরে যা আছে, নিয়ে যা। তোকে আমি এক্ষুনি কয়েক লাখ টাকার চেক লিখে দিচ্ছি। তুই বল কতো টাকা লাগবে?”

আগন্তুকটি নিঃশব্দে হাসলো। তাজওয়ার তার হাসির শব্দ শুনলো না। অথচ তার শরীর হেলানো দেখেই বুঝলো হেলমেট পরা আগন্তুকটি দিব্যি তার উপর হাসছে। তাজওয়ারের রাগ উঠলো ভীষণ। তবুও সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রইলো। সে কি করবে বুঝে উঠার আগেই লোহার রোডটি দিয়ে অনবরত তার গায়ে আঘাত করতে লাগলো আগন্তুকটি। প্রায় কয়েক মিনিট আঘাত করার পর লোহার রডটি মাটিতে ফেলে দিলো সেই আগন্তুক। এদিকে তাজওয়ার নিভু নিভু দৃষ্টিতে এখনো সেই হেলমেট পরা আগন্তুকটির দিকে তাকিয়ে আছে। আগন্তুকটি তার মোটরসাইকেলের কাছে গিয়ে চাবিটা ঘুরিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে তাজওয়ারের চারপাশে তিন-চার বার ঘুরে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। মোটরসাইকেলটা বের হতে দেখেই তাজওয়ার মাটিতে মাথা ফেলে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো।

(***)

মোটর সাইকেলটা শূণ্য রাস্তায় এসে থামলো। সেকেন্ড খানিক পর মোটর সাইকেল থেকে নামলো সেই আগন্তুক যে ঘন্টাখানেক আগে তাজওয়ার খানকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো। সে একপাশে এসে একটা বোতল বের করে তার গ্লাভসের উপর ঢাললো। রক্ত বেয়ে পড়ছে সেই গ্লাভস বেয়ে। রড দিয়ে মেরে তাজওয়ারের শরীর রক্তাক্ত করে এসেছে সে। শান্তি লাগছে তার। বোতলটা দূরে ছুঁড়ে দিয়ে পরনের জ্যাকেটটা খুললো। জ্যাকেট খুলতেই ঘামে গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা সাদা শার্টটি দৃশ্যমান হলো। এবার সে মোটর সাইকেলে উঠে বসলো। জ্যাকেটটি পেছনে আটকে হেলমেটের উপরের অংশটা খুলে দিলো। এবার তার চোখ দু’টি দৃশ্যমান হলো। সেই গভীর আর শান্ত চোখ। একটু আগে তার এমন ভয়ংকর আক্রমণ দেখে বোঝার উপায় ছিল না, তাজওয়ারের উপর হামলে পড়া মানুষটি আফিফ রাফাত।

আফিফ মোটর সাইকেলে চাবি ঘুরিয়ে সামনে আগালো। গতি যতো বাড়ছে, আফিফের দৃষ্টি ততো সরু হচ্ছে। অঅনেকক্ষণ পর গাড়ি এসে থামলো একটা গ্যারেজের সামনে। তার বন্ধুর মোটর সাইকেলের শো’রুম। আফিফ বন্ধুর হাতে চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“যতোদিন আমার কাজ শেষ হবে না, এই বাইকটা বের করিস না।”

“কি করবি তুই?”

“কাজ আছে।”

“পুলিশ কেস হবে না তো!”

“হতেও পারে।”

“কি বলিস এসব?”

“এবারের ন্যায়টা আমার পক্ষেই আসবে। তুই শুধু এইটুকু সাহায্য কর।”

আফিফ শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বলল,
“আপা, এবার তোমার মৃত্যুর শোধ আমি তুলবোই। আমি তোমাকে হারিয়েছি, দ্বিতীয় বার আর কাউকে হারাতে চাই না। আহির কিছু হয়ে গেলে, আমি শান্তি পেতাম না। জানি না কেন? হয়তো কোনো এক ঋতুতে সে আমার খেয়াল হয়ে ছিল তাই। বর্তমানে আমার জীবনে তার অস্তিত্ব থাকুক না থাকুক। অন্তত যেখানেই থাকুক, যার সাথেই থাকুক, ভালো থাকুক সে। আমি তাজওয়ারের ছায়াও তার আশেপাশে আসতে দেবো না।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪২(১ম ভাগ)||

৮৪।
আহি হাতে মেহেদি লাগিয়ে এক কোণায় বসে নাচ দেখছে। নায়ীব আর লিনাশা পাশাপাশি বসে আছে। দু’জনকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আহি মনে মনে ভাবলো,
“ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার মতো আনন্দ হয়তো অন্য কিছুতে নেই। লিনু আজ কতো খুশি!”

আহি এবার পাশ ফিরে পদ্ম আর আফিফের দিকে তাকালো। তাদের দেখে সে মুচকি হেসে আপন মনে বলল,
“ওরাও কতো সুখী! তাহলে আমি কেন সুখী হতে পারছি না? ইদানীং আফিফকে হারানোর কষ্ট আমাকে ওভাবে কাঁদায় না। তবুও নতুন করে সুখ খুঁজতে পারছি না কেন? আমি কি তাহলে ভয় পাচ্ছি? আবার কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার ভয় কি আমাকে নতুন স্বপ্ন দেখতে বাঁধা দিচ্ছে? না-কি এখনো মনের কোথাও না কোথাও অতীতটাই বসে আছে!”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তখনই তার পাশে এসে বসলো উজ্জ্বল। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকাতেই উজ্জ্বল গাঢ় হাসি দিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু হয়েছে?”

উজ্জ্বল মাথা নেড়ে বলল, “অনেক কিছু হয়েছে।”

“কি!”

“তুমি খুব বোরিং, আহি।”

আহি চোখ সরিয়ে নিয়ে হালকা হাসলো। উজ্জ্বল গভীর দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি আবার উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কি জানো, মানুষের চেহারা আর তার আত্মার চেহারা একই থাকা উচিত।”

“আত্মার আবার চেহারা আছে?”

“হুম, কখনো খুব সুন্দর, কখনো বা খুব কুৎসিত।”

“কীভাবে বোঝা যায় সেটা?”

“মানুষের চেহারায় আত্মার চেহারা ফুটে উঠে।”

“যেমন!”

“এই যে তুমি মেয়েটা, মাশাল্লাহ। কিন্তু তোমার আত্মাটা এতো নির্জীব হয়ে আছে যে, তোমার সৌন্দর্যটাই দাবিয়ে রেখেছে।”

আহি হাসলো। এবারের হাসিতে প্রাণ ছিল। উজ্জ্বল বলল,
“এই তো এটাই। আমি এটাই দেখতে চেয়েছি। মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি হাসি।”

আহি লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেললো। উজ্জ্বল আবার বলল,
“তোমাকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না, তুমি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে।”

“কেন?”

“তোমার মধ্যে সেই ঐশ্বর্যের অহংকার নেই। তোমার মনোভাব, আচরণ একদম সাধারণ মেয়েদের মতোই। এই জন্য বোধহয় তুমি অনেক স্পেশাল।”

“সাধারণ মেয়ে, আবার স্পেশাল?”

“সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়ে সাধারণ হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। ধনীর দুলালিদের উৎশৃঙ্খল হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আহি হওয়াটাই অস্বাভাবিক। তাই তো তুমি স্পেশাল।”

আহি আবারও লাজুক হেসে মাথা নামালো। উজ্জ্বলের এই হাসিটাই বেশ সুন্দর লাগছে। মেয়েদের প্রশংসা করলে, মেয়েরা যে কতোটা খুশি হয়, তা আহির লাজুক হাসিতেই প্রকাশ পাচ্ছে। উজ্জ্বল আবার কিছু বলতে যাবে তখনই একটা হাত আহির দিকে এগিয়ে এলো। আহি মাথা তুলে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। আহি রাদকে বলল,
“এখানে এসে বস।”

“চল ডান্স করি।”

আহি হাত দেখিয়ে বলল,
“হাতে মেহেদি। তোর পাঞ্জাবিটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

রাদ আহির বাহু ধরে ওকে টেনে উঠালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি হয়েছে, রাদ?”

“কিছু না। চল অন্যদিকে গিয়ে বসি।”

“তুই ঠিক আছিস তো?”

উজ্জ্বল উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা বসো আমি আসছি।”

উজ্জ্বল চলে যেতেই আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহি বলল,
“আজকাল বেশ অদ্ভুত আচরণ করছিস?”

তখনই একটা টেবিলের উপর দুইটা চামচ নিয়ে গানের ধুন সৃষ্টি করলো উজ্জ্বল। আর সুরের সাথে গেয়ে উঠলো।

“লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা ।।”

সবার দৃষ্টি স্টেজের সামনে গেলো। সবাই মনোযোগ দিয়ে উজ্জ্বলকে দেখছে। আর উজ্জ্বলের দৃষ্টি আহির দিকে। উজ্জ্বল চামচ দু’টি টুলটির উপর রেখে একটা মাইক নিয়ে আহির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে গাইতে লাগলো,

“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

এবার উজ্জ্বল আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। উজ্জ্বল মুচকি হেসে নিজেই আহির যেই হাতের মেহেদি শুকিয়ে গেছে, সেই হাতটি আলতোভাবে ধরে তাকে সবার সামনে নিয়ে এলো। এরপর আহির পাশে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগল,

“যদি প্রতিদিন সেই রঙিন
হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে
শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের
গানও অসহায়।
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

আহি পেছন ফিরে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা বেশ খুশি। সে নায়ীবকে বলল,
“ওদের বেশ মানিয়েছে, তাই না?”

নায়ীব কোনো উত্তর দিলো না। সে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে উজ্জ্বল হাতের ইশারায় সবাইকে গানের সাথে যোগ দিতে বলল আর নিজেও গাইতে লাগলো,

“যদি অভিযোগ কেড়ে
নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয়
সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলো কে
ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার
বলো কি থাকে আমার?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে
মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে
হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা
গান হয়ে যায়।
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

লিনাশা নায়ীবের হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে এলো। তারাও যোগ দিলো উজ্জ্বলের গানে। উজ্জ্বল আহির দিকে তাকিয়ে গেয়ে যেতে লাগলো,

“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে আছে। গান গাওয়া শেষে করতালি মুখর পরিবেশে সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে আহি আর উজ্জ্বল। কিন্তু কারো দৃষ্টি আটকালো না রাদ আর আফিফের দিকে। রাদের হাত মুঠো হয়ে আছে, চোখে অশ্রু জমবে এমন অবস্থা। অন্যদিকে আফিফকে দেখে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, তার খারাপ লাগার কারণ কি। সে পদ্মের হাত শক্ত করে ধরলো। পদ্ম আফিফের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে তাকালো। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে?”

আফিফ পদ্মের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি ফেরত দিলো। পদ্ম বুঝলো না সেই হাসির অর্থ। সে আফিফের হাত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। এদিকে রাদ ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর পিছিয়ে সে পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে নিতেই তার কাঁধে কারো স্পর্শ পেলো। রাদ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো লাবীব দাঁড়িয়ে আছে। লাবীব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই রাদ বেরিয়ে গেলো। লাবীব এবার আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে হাসি। অনেক বছর পর আহিকে এমন ভাবে হাসতে দেখছে। দেখে মনে হচ্ছে আহি মুগ্ধ হচ্ছে উজ্জ্বলের গানের সুরে। এই মুগ্ধতা কি রাদের অনুভূতির জন্য থামিয়ে দেওয়া উচিত? যেই মেয়েটা এতো বছর পর কারো দৃষ্টিতে নিজেকে হারানোর সুযোগ পেয়েছে, তাকে কি সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা উচিত?

৮৫।

রাত বাড়তেই অতিথিরা বিদায় নিতে লাগলো। উজ্জ্বলের মা মিসেস আমিনা আহির গাল টেনে দিয়ে বললেন,
“পুষ্পের সাথে বাসায় এসো। তোমাকে কতো বছর পর দেখলাম।”

কথাটি বলেই তিনি উজ্জ্বলের দিকে তাকালেন। উজ্জ্বলের ঠোঁটে মৃদু হাসি। তা দেখে পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে ফিসফিস করে উজ্জ্বলকে জিজ্ঞেস করলো,
“হাসছিস কেন এতো?”

উজ্জ্বল হাসি গিলে ফেললো। বাঁকা চোখে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই তোর কাজ কর।”

উজ্জ্বল ও মিসেস আমিনা চলে যেতেই পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“কি হলো এটা আজকে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি হলো?”

“উজ্জ্বল ভাইয়া আর তুই প্রেম-টেম করছিস না-কি?”

রাদ আর লাবীব তখনই আহি আর পুষ্পের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুষ্পের প্রশ্নটা রাদ আর লাবীব দু’জনেই শুনেছে। লাবীবও এবার পুষ্পের কথায় যোগ দিয়ে বলল,
“আহি, সত্যি না-কি?”

আহি অবাক কণ্ঠে বলল,
“পাগল তোরা! একদমই না। আমি প্রেম করবো, আর তোরা জানবি না?”

পুষ্প বলল,
“নাও জানাতে পারিস। আমাকে তো কিছুই জানাস না। লিনাশাকে হয়তো জানিয়েছিস।”

“যা, গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়। ওকেও এমন কিছু বলি নি৷ কারণ এই মুহূর্তে আমার জীবনে কিছুই নেই।”

“হবে হয়তো।”

“তুই জানিস তাজওয়ারের সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”

“তুই তো উনাকে পছন্দ করিস না। আর বিয়ে তো এখনো হয় নি।”

“হ্যাঁ, তাও এমন একটা সিচুয়েশনে আমি প্রেম করবো, এমন পাগল পাগল চিন্তা-ভাবনা তোদের মাথায় কীভাবে আসে?”

লাবীব জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে তোকে দেখে যে অন্য কিছু মনে হলো!”

“কি মনে হলো?”

এবার রাদ বলল,
“তাকিয়ে ছিলি পুষ্পের সেই কাজিনের দিকে। হাসছিলি তাকে দেখে।”

আহি রাদের কথায় হালকা হেসে বলল,
“ধুর, কারো দিকে তাকিয়ে থাকলে আর হাসলে কি প্রেম শুরু হয়ে যায়? আসলে উনার গানের গলা বেশ ভালোই ছিল। আর গানটার অর্থটা আমার অনেক ভালো লেগেছিল। তাই শুনছিলাম। আর এভাবে সবার সামনে টেনে নিয়ে যাওয়াতে ভীষণ লজ্জা পেয়েছি। মনে হয়েছিল, গানটা উনি আমার জন্য গেয়েছেন। নিজেকে ইম্পোরটেন্ট মানুষ হচ্ছিলো। তাই হাসি পেয়েছে। কেউ কখনো আমার জন্য গান গায় নি তো, তাই। এই প্রথম কেউ গেয়েছে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি কখনো গান গাই নি?”

“তুই আর বাকিরা তো আলাদা!”

রাদ আহির কথায় অবাক হলো। বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল,
“আলাদা মানে?”

“তুই আমার ফ্রেন্ড।”

লাবীব রাদকে থামিয়ে দিলো। রাদের ভীষণ অস্থির লাগছে। আহির বন্ধু হয়ে সে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এখন এর মাশুল কি আহিকে হারিয়েই দিতে হবে?

(***)

রাদ বেরুতেই আহিও তার পিছু পিছু এলো। রাদ আহিকে আসতে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি তার মুখে একটা সন্দেশ পুরে দিলো। রাদ সন্দেশটা খেয়ে আহিকে বলল,
“আমাকে বিদায় দিতে এসেছিস?”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“উহুম, তোকে সন্দেশ খাওয়াতে এসেছি। ভেতরে শুধু দু’টো প্যাকেটে সন্দেশ ছিল। তুই তো অন্য মিষ্টি খাস না। তাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”

রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“কিছু জিনিস ভালো লাগলেও সহজে পাওয়া যায় না। খুব করে চাইলেও, তা আমাদের স্পর্শের বাইরে থাকে।”

আহি হেসে বলল,
“সন্দেশ নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করছিস?”

রাদ মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
“তুই তো আমার কাছে সন্দেশই। সন্দেশ যেমন মিষ্টি। তুইও তেমন।”

আহি বলল, “কি হলো?”

“বলছি সন্দেশ যদি নিজ থেকেই আমার কাছে ধরা দেয়, তাহলে আমি তাকে যেতে দেবো না।”

আহি হেসে বলল,
“হ্যাঁ ধরা দিয়েছে তো। তাই তো খেয়ে ফেলেছিস।”

রাদ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে আহির দিকে তাকালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এভাবে হাসছিস কেন?”

রাদ বলল,
“তুই নতুন করে কাউকে ভালোবাসবি না?”

“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“বল না।”

“দেখা যাক।”

“যদি কেউ তোকে ভালোবাসে। তখন?”

“তখন কি?”

“ধর, কেউ একজন তোকে ভালোবাসে। কিন্তু সাহসের অভাবে বলতে পারছে না। কি করবি? সে যদি সাহস করে জানিয়ে দেয়, তখন কি না করে দিবি?”

“তাজওয়ার খানের ঝামেলা মিটলে ভেবে দেখবো।”

রাদ এক গাল হেসে বলল, “সত্যি?”

আহি রাদের হাতে ঘুষি মেরে বলল,
“পাগল না-কি তুই? কে সেই প্রেমিকটা শুনি?”

“আমি তো অনুমান করছি। থাকতেও পারে। আমি শিউর হচ্ছিলাম। তুই কতোটুকু মুভ অন করেছিস ওটা জানার জন্য এমন প্রশ্ন করেছি।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“মুভ অন তো আমি সেদিনই করেছি, যেদিন সমুদ্র তীরে নিজ হাতে পদ্ম আর সেই মানুষটার বাসর সাজিয়েছিলাম। কিন্তু মুভ অন বলতে কি বোঝায়, রাদ? নতুন কাউকে আসতে দেওয়া? পুরোনো মানুষটাকে স্মরণ না করা? আমি চাই এমন কেউ আসুক, যে অন্তত আমার মানুষ হোক। কিন্তু সেই মানুষটা চোখের সামনে থাকলে কীভাবে আমি মুভ অন করবো?”

“আফিফ তো এই শহরেই থাকবে। তাহলে কি করবি?”

“একবার মাস্টার্স শেষ হোক। এরপর তাজওয়ারের থেকে মুক্তি নেবো। বাবার কাছ থেকে মুক্তি নেবো। এরপর নতুন শহরে যাবো। নতুন স্বপ্ন দেখবো। এমন কিছু করবো, যাতে আফিফ মানুষটা কোনোদিনই আমার চোখের সামনে না আসে। মানুষ কতো সহজে বলে ফেলে মুভ অন করে ফেলেছি। আমার কাছে মুভ অন শব্দটার অর্থ, তাকে নিয়ে অশ্রু না ফেলা, রাত জেগে বালিশ না ভেজানো, তাকে চোখের সামনে কল্পনা না করা আর তার সাথে একা একা কথা না বলা। এতোটুকুতেই আমার মুভ অন। কিন্তু একা থাকলে ঠিকই অতীত নাড়া দেয়। তাই আমি মুভ অন নয়, আমি ভুলে থাকবো। আর এটা একদিনে হবে না। কিন্তু খুব শীঘ্রই হবে।”

“আর আমি সেই দিনটার অপেক্ষায় থাকবো।”

(***)

কমলা রঙের লেহেঙ্গা পরে আয়নায় নিজেকে দেখছে আহি। তখনই পেছন থেকে তাজওয়ার এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এখানে?”

“কেন তোমাকে দেখতে আসতে পারি না?”

“আমি ব্যস্ত আছি। আমাকে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।”

“আমিই তোমাকে নিয়ে যাবো।”

“তোমাকে কে বলেছে নিয়ে যেতে?”

“আহি, কি হয়েছে তোমার? তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছো! তাহলে এখন এভাবে কথা বলছো কেন?”

তখনই লাবণি আহির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার লাবণির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“আমার হবু শাশুড়ী মা সেদিন আমাকে পরীক্ষা করছিলেন। আমি না-কি তার পরীক্ষায় পাশ করেছি। তাই আমাকে ফোন করে বললো তোমার পাশের ফলস্বরূপ তোমার রানীকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এসো। সে না-কি বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছে। দু’জন একসাথে বিয়েও এটেন্ড করবে, এরপর একটা ভালো মুহূর্তও কাটাবে।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি রহস্যময় হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“মাই ডিয়ার প্রিন্সেস, তোমার মিস্টার খানের সাথেই লিনাশার বিয়েতে যাওয়া উচিত। তাদেরও তোমার হবুও বরের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেতে হবে। আফটার অল বেস্ট ফ্রেন্ড এর হাসবেন্ডরা অন্তত গুড ফ্রেন্ড তো হতেই পারে।”

আহি তাজওয়ারকে বলল,
“প্লিজ, তুমি যেও না। আমি বিয়ের প্রোগ্রাম শেষে তোমার সাথে দেখা করবো।”

তাজওয়ার বলল,
“আমি তো যাবোই। এমনকি সবাইকে জানাবো, তুমি আমার কে হও!”

তাজওয়ার কথাটি বলেই বেরিয়ে পড়লো। এবার লাবণি আহির মুখোমুখি এসে বলল,
“তোমার বাবা আর তাজওয়ার খানের মধ্যে ঝামেলা বাঁধিয়ে নিজের পথ পরিস্কার করতে চেয়েছিলে, তাই না?”

আহি অবাক দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি হেসে বলল,
“তোমার প্ল্যান ফ্লপ। তোমার বাবাকে তো আমি একটা বুঝিয়ে দিয়েছি। তাজওয়ারকেও তোমার প্ল্যান সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে দিয়েছি। তুমি যে তাকে বিশ্বাস করার অভিনয় করে তাকেই ধোঁকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছো, এই সত্যটা তাজওয়ার জেনে গেছে। এখন যতোদিন তোমাদের বিয়ে হবে না, তুমি আর ইমোশনালি তাজওয়ারকে ফাঁসাতে পারবে না।”

“আপনাকে কে বলেছে, আমি তাজওয়ারকে বিশ্বাস করার অভিনয় করছি?”

“তুমি হুট করে তাজওয়ারকে এতো সম্মান দিচ্ছো! যাকে সহ্য করতে পারতে না, তাকে এতো সময় দিচ্ছো! তাহলে কে বিশ্বাস করবে তুমি তাকে বিশ্বাস করছো?”

আহি দমে গেলো। লাবণি আহির গাল টেনে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার পরিকল্পনা মোটেও খারাপ ছিল না। কিন্তু এই মস্তিষ্কের মাঠে তুমি নতুন খেলোয়াড়। আমি অনেক আগেই নেমেছি। যাই হোক, আমাকে একটা ভালো আইডিয়া দিয়েছো তুমি। এখন তোমার বাবাও মন্ত্রী হয়ে যাবে। আমিও অনেক ক্ষমতা পাবো। আর তাজওয়ার আমার জন্য অপশনাল হয়েই থাকবে। কেমন হবে, যখন নিজের স্বামীকে আমার সাথে দেখবে?”

“তাজওয়ার আর আমার এখনো বিয়ে হয় নি। হবেও না।”

“মিস আহি, তোমাকে হারানোর জন্য তাজওয়ার আর তোমার বিয়ে না দেওয়া অব্ধি আমি শান্তি পাবো না। এরপর তুমি যে ধোঁকা খাবে, সেই ধোঁকা থেকে তুমি চাইলেও মুক্তি পাবে না। এর জন্য যদি আমাকে সব সীমা অতিক্রম করতে হয়, আমি করবো।”

“মিসেস লাবণি মেহেরা, চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড। তাজওয়ার আর আমার যদি বিয়ে হয়, তাহলে আমি সেদিনই নিজ হাতে নিজেকে শেষ করে দেবো। এতোটুকু কনফিডেন্স আমার আছে যে আমি তাজওয়ার খানের নাম শুনে কবুল না বলতে চাইলে, বিয়ের রেজিস্ট্রার পেপারে স্বাক্ষর না করতে চাইলে কেউ বাধ্য করে আমার কন্ঠে সে কবুল শব্দটা আনতে আর আমার সিগনেচার কাগজে জোর করতে তুলতে পারবে না।”

“এতোটা ডেস্পারেট তুমি?”

“আপনাকে চ্যালেঞ্জে হারানোর জন্য এটা আমার জীবনের শেষ সংগ্রাম। এই যুদ্ধে আমি যদি জিতে যাই, আল্লাহর কাছে আমার ওয়াদা আমি জীবনের সব বিলাসিতা ত্যাগ করবো। সৃষ্টিকর্তা আমার জীবনে শান্তি এনে দিলে, আমি জগতের সব মোহ ত্যাগ করতে রাজি। তাহলে আমার নামে থাকা সম্পত্তি, আর তাজওয়ারের প্রাসাদে রানী হওয়ার মতো ঠুনকো ইচ্ছে আমার থাকার কথা নয়। আমার ইচ্ছে, আমি রানী হবো। কিন্তু তার রানী হবো, যে আমার রাজা হওয়ার যোগ্য। না থাকুক তার বাড়ি। আসল রাজাদের বাড়ি নয়, মন থাকতে হয়। আর সেই মনে আমি সম্রাজ্ঞী হয়ে বাস করবো। আর সেদিন আপনার জায়গাটা কোথাও থাকবে না। এই কয়েকদিনের সুখ নিয়ে সুখী হয়ে যান। সামনে চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। কষ্টের পরেই তো স্বস্তি। আল্লাহ যেই কথাটা জানিয়েছেন, সেটা অবিশ্বাস করা যায় না। তাহলে আমার এতো বছরের কষ্টের পর আমি কেন স্বস্তি পাবো না? অবশ্যই পাবো। আপনি নিজ চোখে আমার জয় দেখবেন। আর নিজেকে হারতে দেখবেন।”

লাবণি হেসে বলল, “কি করতে পারবে তুমি?”

“সময় বলে দেবে।”

চলবে-ভ#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪২(১ম ভাগ)||

৮৪।
আহি হাতে মেহেদি লাগিয়ে এক কোণায় বসে নাচ দেখছে। নায়ীব আর লিনাশা পাশাপাশি বসে আছে। দু’জনকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আহি মনে মনে ভাবলো,
“ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার মতো আনন্দ হয়তো অন্য কিছুতে নেই। লিনু আজ কতো খুশি!”

আহি এবার পাশ ফিরে পদ্ম আর আফিফের দিকে তাকালো। তাদের দেখে সে মুচকি হেসে আপন মনে বলল,
“ওরাও কতো সুখী! তাহলে আমি কেন সুখী হতে পারছি না? ইদানীং আফিফকে হারানোর কষ্ট আমাকে ওভাবে কাঁদায় না। তবুও নতুন করে সুখ খুঁজতে পারছি না কেন? আমি কি তাহলে ভয় পাচ্ছি? আবার কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার ভয় কি আমাকে নতুন স্বপ্ন দেখতে বাঁধা দিচ্ছে? না-কি এখনো মনের কোথাও না কোথাও অতীতটাই বসে আছে!”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তখনই তার পাশে এসে বসলো উজ্জ্বল। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকাতেই উজ্জ্বল গাঢ় হাসি দিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু হয়েছে?”

উজ্জ্বল মাথা নেড়ে বলল, “অনেক কিছু হয়েছে।”

“কি!”

“তুমি খুব বোরিং, আহি।”

আহি চোখ সরিয়ে নিয়ে হালকা হাসলো। উজ্জ্বল গভীর দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি আবার উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কি জানো, মানুষের চেহারা আর তার আত্মার চেহারা একই থাকা উচিত।”

“আত্মার আবার চেহারা আছে?”

“হুম, কখনো খুব সুন্দর, কখনো বা খুব কুৎসিত।”

“কীভাবে বোঝা যায় সেটা?”

“মানুষের চেহারায় আত্মার চেহারা ফুটে উঠে।”

“যেমন!”

“এই যে তুমি মেয়েটা, মাশাল্লাহ। কিন্তু তোমার আত্মাটা এতো নির্জীব হয়ে আছে যে, তোমার সৌন্দর্যটাই দাবিয়ে রেখেছে।”

আহি হাসলো। এবারের হাসিতে প্রাণ ছিল। উজ্জ্বল বলল,
“এই তো এটাই। আমি এটাই দেখতে চেয়েছি। মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি হাসি।”

আহি লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেললো। উজ্জ্বল আবার বলল,
“তোমাকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না, তুমি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে।”

“কেন?”

“তোমার মধ্যে সেই ঐশ্বর্যের অহংকার নেই। তোমার মনোভাব, আচরণ একদম সাধারণ মেয়েদের মতোই। এই জন্য বোধহয় তুমি অনেক স্পেশাল।”

“সাধারণ মেয়ে, আবার স্পেশাল?”

“সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়ে সাধারণ হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। ধনীর দুলালিদের উৎশৃঙ্খল হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আহি হওয়াটাই অস্বাভাবিক। তাই তো তুমি স্পেশাল।”

আহি আবারও লাজুক হেসে মাথা নামালো। উজ্জ্বলের এই হাসিটাই বেশ সুন্দর লাগছে। মেয়েদের প্রশংসা করলে, মেয়েরা যে কতোটা খুশি হয়, তা আহির লাজুক হাসিতেই প্রকাশ পাচ্ছে। উজ্জ্বল আবার কিছু বলতে যাবে তখনই একটা হাত আহির দিকে এগিয়ে এলো। আহি মাথা তুলে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। আহি রাদকে বলল,
“এখানে এসে বস।”

“চল ডান্স করি।”

আহি হাত দেখিয়ে বলল,
“হাতে মেহেদি। তোর পাঞ্জাবিটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

রাদ আহির বাহু ধরে ওকে টেনে উঠালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি হয়েছে, রাদ?”

“কিছু না। চল অন্যদিকে গিয়ে বসি।”

“তুই ঠিক আছিস তো?”

উজ্জ্বল উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা বসো আমি আসছি।”

উজ্জ্বল চলে যেতেই আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহি বলল,
“আজকাল বেশ অদ্ভুত আচরণ করছিস?”

তখনই একটা টেবিলের উপর দুইটা চামচ নিয়ে গানের ধুন সৃষ্টি করলো উজ্জ্বল। আর সুরের সাথে গেয়ে উঠলো।

“লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা ।।”

সবার দৃষ্টি স্টেজের সামনে গেলো। সবাই মনোযোগ দিয়ে উজ্জ্বলকে দেখছে। আর উজ্জ্বলের দৃষ্টি আহির দিকে। উজ্জ্বল চামচ দু’টি টুলটির উপর রেখে একটা মাইক নিয়ে আহির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে গাইতে লাগলো,

“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

এবার উজ্জ্বল আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। উজ্জ্বল মুচকি হেসে নিজেই আহির যেই হাতের মেহেদি শুকিয়ে গেছে, সেই হাতটি আলতোভাবে ধরে তাকে সবার সামনে নিয়ে এলো। এরপর আহির পাশে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগল,

“যদি প্রতিদিন সেই রঙিন
হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে
শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের
গানও অসহায়।
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

আহি পেছন ফিরে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা বেশ খুশি। সে নায়ীবকে বলল,
“ওদের বেশ মানিয়েছে, তাই না?”

নায়ীব কোনো উত্তর দিলো না। সে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে উজ্জ্বল হাতের ইশারায় সবাইকে গানের সাথে যোগ দিতে বলল আর নিজেও গাইতে লাগলো,

“যদি অভিযোগ কেড়ে
নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয়
সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলো কে
ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার
বলো কি থাকে আমার?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে
মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে
হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা
গান হয়ে যায়।
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

লিনাশা নায়ীবের হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে এলো। তারাও যোগ দিলো উজ্জ্বলের গানে। উজ্জ্বল আহির দিকে তাকিয়ে গেয়ে যেতে লাগলো,

“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে আছে। গান গাওয়া শেষে করতালি মুখর পরিবেশে সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে আহি আর উজ্জ্বল। কিন্তু কারো দৃষ্টি আটকালো না রাদ আর আফিফের দিকে। রাদের হাত মুঠো হয়ে আছে, চোখে অশ্রু জমবে এমন অবস্থা। অন্যদিকে আফিফকে দেখে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, তার খারাপ লাগার কারণ কি। সে পদ্মের হাত শক্ত করে ধরলো। পদ্ম আফিফের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে তাকালো। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে?”

আফিফ পদ্মের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি ফেরত দিলো। পদ্ম বুঝলো না সেই হাসির অর্থ। সে আফিফের হাত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। এদিকে রাদ ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর পিছিয়ে সে পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে নিতেই তার কাঁধে কারো স্পর্শ পেলো। রাদ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো লাবীব দাঁড়িয়ে আছে। লাবীব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই রাদ বেরিয়ে গেলো। লাবীব এবার আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে হাসি। অনেক বছর পর আহিকে এমন ভাবে হাসতে দেখছে। দেখে মনে হচ্ছে আহি মুগ্ধ হচ্ছে উজ্জ্বলের গানের সুরে। এই মুগ্ধতা কি রাদের অনুভূতির জন্য থামিয়ে দেওয়া উচিত? যেই মেয়েটা এতো বছর পর কারো দৃষ্টিতে নিজেকে হারানোর সুযোগ পেয়েছে, তাকে কি সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা উচিত?

৮৫।

রাত বাড়তেই অতিথিরা বিদায় নিতে লাগলো। উজ্জ্বলের মা মিসেস আমিনা আহির গাল টেনে দিয়ে বললেন,
“পুষ্পের সাথে বাসায় এসো। তোমাকে কতো বছর পর দেখলাম।”

কথাটি বলেই তিনি উজ্জ্বলের দিকে তাকালেন। উজ্জ্বলের ঠোঁটে মৃদু হাসি। তা দেখে পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে ফিসফিস করে উজ্জ্বলকে জিজ্ঞেস করলো,
“হাসছিস কেন এতো?”

উজ্জ্বল হাসি গিলে ফেললো। বাঁকা চোখে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই তোর কাজ কর।”

উজ্জ্বল ও মিসেস আমিনা চলে যেতেই পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“কি হলো এটা আজকে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি হলো?”

“উজ্জ্বল ভাইয়া আর তুই প্রেম-টেম করছিস না-কি?”

রাদ আর লাবীব তখনই আহি আর পুষ্পের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুষ্পের প্রশ্নটা রাদ আর লাবীব দু’জনেই শুনেছে। লাবীবও এবার পুষ্পের কথায় যোগ দিয়ে বলল,
“আহি, সত্যি না-কি?”

আহি অবাক কণ্ঠে বলল,
“পাগল তোরা! একদমই না। আমি প্রেম করবো, আর তোরা জানবি না?”

পুষ্প বলল,
“নাও জানাতে পারিস। আমাকে তো কিছুই জানাস না। লিনাশাকে হয়তো জানিয়েছিস।”

“যা, গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়। ওকেও এমন কিছু বলি নি৷ কারণ এই মুহূর্তে আমার জীবনে কিছুই নেই।”

“হবে হয়তো।”

“তুই জানিস তাজওয়ারের সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”

“তুই তো উনাকে পছন্দ করিস না। আর বিয়ে তো এখনো হয় নি।”

“হ্যাঁ, তাও এমন একটা সিচুয়েশনে আমি প্রেম করবো, এমন পাগল পাগল চিন্তা-ভাবনা তোদের মাথায় কীভাবে আসে?”

লাবীব জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে তোকে দেখে যে অন্য কিছু মনে হলো!”

“কি মনে হলো?”

এবার রাদ বলল,
“তাকিয়ে ছিলি পুষ্পের সেই কাজিনের দিকে। হাসছিলি তাকে দেখে।”

আহি রাদের কথায় হালকা হেসে বলল,
“ধুর, কারো দিকে তাকিয়ে থাকলে আর হাসলে কি প্রেম শুরু হয়ে যায়? আসলে উনার গানের গলা বেশ ভালোই ছিল। আর গানটার অর্থটা আমার অনেক ভালো লেগেছিল। তাই শুনছিলাম। আর এভাবে সবার সামনে টেনে নিয়ে যাওয়াতে ভীষণ লজ্জা পেয়েছি। মনে হয়েছিল, গানটা উনি আমার জন্য গেয়েছেন। নিজেকে ইম্পোরটেন্ট মানুষ হচ্ছিলো। তাই হাসি পেয়েছে। কেউ কখনো আমার জন্য গান গায় নি তো, তাই। এই প্রথম কেউ গেয়েছে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি কখনো গান গাই নি?”

“তুই আর বাকিরা তো আলাদা!”

রাদ আহির কথায় অবাক হলো। বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল,
“আলাদা মানে?”

“তুই আমার ফ্রেন্ড।”

লাবীব রাদকে থামিয়ে দিলো। রাদের ভীষণ অস্থির লাগছে। আহির বন্ধু হয়ে সে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এখন এর মাশুল কি আহিকে হারিয়েই দিতে হবে?

(***)

রাদ বেরুতেই আহিও তার পিছু পিছু এলো। রাদ আহিকে আসতে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি তার মুখে একটা সন্দেশ পুরে দিলো। রাদ সন্দেশটা খেয়ে আহিকে বলল,
“আমাকে বিদায় দিতে এসেছিস?”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“উহুম, তোকে সন্দেশ খাওয়াতে এসেছি। ভেতরে শুধু দু’টো প্যাকেটে সন্দেশ ছিল। তুই তো অন্য মিষ্টি খাস না। তাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”

রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“কিছু জিনিস ভালো লাগলেও সহজে পাওয়া যায় না। খুব করে চাইলেও, তা আমাদের স্পর্শের বাইরে থাকে।”

আহি হেসে বলল,
“সন্দেশ নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করছিস?”

রাদ মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
“তুই তো আমার কাছে সন্দেশই। সন্দেশ যেমন মিষ্টি। তুইও তেমন।”

আহি বলল, “কি হলো?”

“বলছি সন্দেশ যদি নিজ থেকেই আমার কাছে ধরা দেয়, তাহলে আমি তাকে যেতে দেবো না।”

আহি হেসে বলল,
“হ্যাঁ ধরা দিয়েছে তো। তাই তো খেয়ে ফেলেছিস।”

রাদ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে আহির দিকে তাকালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এভাবে হাসছিস কেন?”

রাদ বলল,
“তুই নতুন করে কাউকে ভালোবাসবি না?”

“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“বল না।”

“দেখা যাক।”

“যদি কেউ তোকে ভালোবাসে। তখন?”

“তখন কি?”

“ধর, কেউ একজন তোকে ভালোবাসে। কিন্তু সাহসের অভাবে বলতে পারছে না। কি করবি? সে যদি সাহস করে জানিয়ে দেয়, তখন কি না করে দিবি?”

“তাজওয়ার খানের ঝামেলা মিটলে ভেবে দেখবো।”

রাদ এক গাল হেসে বলল, “সত্যি?”

আহি রাদের হাতে ঘুষি মেরে বলল,
“পাগল না-কি তুই? কে সেই প্রেমিকটা শুনি?”

“আমি তো অনুমান করছি। থাকতেও পারে। আমি শিউর হচ্ছিলাম। তুই কতোটুকু মুভ অন করেছিস ওটা জানার জন্য এমন প্রশ্ন করেছি।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“মুভ অন তো আমি সেদিনই করেছি, যেদিন সমুদ্র তীরে নিজ হাতে পদ্ম আর সেই মানুষটার বাসর সাজিয়েছিলাম। কিন্তু মুভ অন বলতে কি বোঝায়, রাদ? নতুন কাউকে আসতে দেওয়া? পুরোনো মানুষটাকে স্মরণ না করা? আমি চাই এমন কেউ আসুক, যে অন্তত আমার মানুষ হোক। কিন্তু সেই মানুষটা চোখের সামনে থাকলে কীভাবে আমি মুভ অন করবো?”

“আফিফ তো এই শহরেই থাকবে। তাহলে কি করবি?”

“একবার মাস্টার্স শেষ হোক। এরপর তাজওয়ারের থেকে মুক্তি নেবো। বাবার কাছ থেকে মুক্তি নেবো। এরপর নতুন শহরে যাবো। নতুন স্বপ্ন দেখবো। এমন কিছু করবো, যাতে আফিফ মানুষটা কোনোদিনই আমার চোখের সামনে না আসে। মানুষ কতো সহজে বলে ফেলে মুভ অন করে ফেলেছি। আমার কাছে মুভ অন শব্দটার অর্থ, তাকে নিয়ে অশ্রু না ফেলা, রাত জেগে বালিশ না ভেজানো, তাকে চোখের সামনে কল্পনা না করা আর তার সাথে একা একা কথা না বলা। এতোটুকুতেই আমার মুভ অন। কিন্তু একা থাকলে ঠিকই অতীত নাড়া দেয়। তাই আমি মুভ অন নয়, আমি ভুলে থাকবো। আর এটা একদিনে হবে না। কিন্তু খুব শীঘ্রই হবে।”

“আর আমি সেই দিনটার অপেক্ষায় থাকবো।”

(***)

কমলা রঙের লেহেঙ্গা পরে আয়নায় নিজেকে দেখছে আহি। তখনই পেছন থেকে তাজওয়ার এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এখানে?”

“কেন তোমাকে দেখতে আসতে পারি না?”

“আমি ব্যস্ত আছি। আমাকে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।”

“আমিই তোমাকে নিয়ে যাবো।”

“তোমাকে কে বলেছে নিয়ে যেতে?”

“আহি, কি হয়েছে তোমার? তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছো! তাহলে এখন এভাবে কথা বলছো কেন?”

তখনই লাবণি আহির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার লাবণির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“আমার হবু শাশুড়ী মা সেদিন আমাকে পরীক্ষা করছিলেন। আমি না-কি তার পরীক্ষায় পাশ করেছি। তাই আমাকে ফোন করে বললো তোমার পাশের ফলস্বরূপ তোমার রানীকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এসো। সে না-কি বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছে। দু’জন একসাথে বিয়েও এটেন্ড করবে, এরপর একটা ভালো মুহূর্তও কাটাবে।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি রহস্যময় হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“মাই ডিয়ার প্রিন্সেস, তোমার মিস্টার খানের সাথেই লিনাশার বিয়েতে যাওয়া উচিত। তাদেরও তোমার হবুও বরের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেতে হবে। আফটার অল বেস্ট ফ্রেন্ড এর হাসবেন্ডরা অন্তত গুড ফ্রেন্ড তো হতেই পারে।”

আহি তাজওয়ারকে বলল,
“প্লিজ, তুমি যেও না। আমি বিয়ের প্রোগ্রাম শেষে তোমার সাথে দেখা করবো।”

তাজওয়ার বলল,
“আমি তো যাবোই। এমনকি সবাইকে জানাবো, তুমি আমার কে হও!”

তাজওয়ার কথাটি বলেই বেরিয়ে পড়লো। এবার লাবণি আহির মুখোমুখি এসে বলল,
“তোমার বাবা আর তাজওয়ার খানের মধ্যে ঝামেলা বাঁধিয়ে নিজের পথ পরিস্কার করতে চেয়েছিলে, তাই না?”

আহি অবাক দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি হেসে বলল,
“তোমার প্ল্যান ফ্লপ। তোমার বাবাকে তো আমি একটা বুঝিয়ে দিয়েছি। তাজওয়ারকেও তোমার প্ল্যান সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে দিয়েছি। তুমি যে তাকে বিশ্বাস করার অভিনয় করে তাকেই ধোঁকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছো, এই সত্যটা তাজওয়ার জেনে গেছে। এখন যতোদিন তোমাদের বিয়ে হবে না, তুমি আর ইমোশনালি তাজওয়ারকে ফাঁসাতে পারবে না।”

“আপনাকে কে বলেছে, আমি তাজওয়ারকে বিশ্বাস করার অভিনয় করছি?”

“তুমি হুট করে তাজওয়ারকে এতো সম্মান দিচ্ছো! যাকে সহ্য করতে পারতে না, তাকে এতো সময় দিচ্ছো! তাহলে কে বিশ্বাস করবে তুমি তাকে বিশ্বাস করছো?”

আহি দমে গেলো। লাবণি আহির গাল টেনে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার পরিকল্পনা মোটেও খারাপ ছিল না। কিন্তু এই মস্তিষ্কের মাঠে তুমি নতুন খেলোয়াড়। আমি অনেক আগেই নেমেছি। যাই হোক, আমাকে একটা ভালো আইডিয়া দিয়েছো তুমি। এখন তোমার বাবাও মন্ত্রী হয়ে যাবে। আমিও অনেক ক্ষমতা পাবো। আর তাজওয়ার আমার জন্য অপশনাল হয়েই থাকবে। কেমন হবে, যখন নিজের স্বামীকে আমার সাথে দেখবে?”

“তাজওয়ার আর আমার এখনো বিয়ে হয় নি। হবেও না।”

“মিস আহি, তোমাকে হারানোর জন্য তাজওয়ার আর তোমার বিয়ে না দেওয়া অব্ধি আমি শান্তি পাবো না। এরপর তুমি যে ধোঁকা খাবে, সেই ধোঁকা থেকে তুমি চাইলেও মুক্তি পাবে না। এর জন্য যদি আমাকে সব সীমা অতিক্রম করতে হয়, আমি করবো।”

“মিসেস লাবণি মেহেরা, চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড। তাজওয়ার আর আমার যদি বিয়ে হয়, তাহলে আমি সেদিনই নিজ হাতে নিজেকে শেষ করে দেবো। এতোটুকু কনফিডেন্স আমার আছে যে আমি তাজওয়ার খানের নাম শুনে কবুল না বলতে চাইলে, বিয়ের রেজিস্ট্রার পেপারে স্বাক্ষর না করতে চাইলে কেউ বাধ্য করে আমার কন্ঠে সে কবুল শব্দটা আনতে আর আমার সিগনেচার কাগজে জোর করতে তুলতে পারবে না।”

“এতোটা ডেস্পারেট তুমি?”

“আপনাকে চ্যালেঞ্জে হারানোর জন্য এটা আমার জীবনের শেষ সংগ্রাম। এই যুদ্ধে আমি যদি জিতে যাই, আল্লাহর কাছে আমার ওয়াদা আমি জীবনের সব বিলাসিতা ত্যাগ করবো। সৃষ্টিকর্তা আমার জীবনে শান্তি এনে দিলে, আমি জগতের সব মোহ ত্যাগ করতে রাজি। তাহলে আমার নামে থাকা সম্পত্তি, আর তাজওয়ারের প্রাসাদে রানী হওয়ার মতো ঠুনকো ইচ্ছে আমার থাকার কথা নয়। আমার ইচ্ছে, আমি রানী হবো। কিন্তু তার রানী হবো, যে আমার রাজা হওয়ার যোগ্য। না থাকুক তার বাড়ি। আসল রাজাদের বাড়ি নয়, মন থাকতে হয়। আর সেই মনে আমি সম্রাজ্ঞী হয়ে বাস করবো। আর সেদিন আপনার জায়গাটা কোথাও থাকবে না। এই কয়েকদিনের সুখ নিয়ে সুখী হয়ে যান। সামনে চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। কষ্টের পরেই তো স্বস্তি। আল্লাহ যেই কথাটা জানিয়েছেন, সেটা অবিশ্বাস করা যায় না। তাহলে আমার এতো বছরের কষ্টের পর আমি কেন স্বস্তি পাবো না? অবশ্যই পাবো। আপনি নিজ চোখে আমার জয় দেখবেন। আর নিজেকে হারতে দেখবেন।”

লাবণি হেসে বলল, “কি করতে পারবে তুমি?”

“সময় বলে দেবে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪২(২য় ভাগ)||

৮৬।
আহি মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে রেখেছে। আহি কিছুক্ষণ পর পর বিরক্ত হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু তাজওয়ার এসবে পাত্তা দিচ্ছে না। সে তার মতোই আহির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে উজ্জ্বলের মা মিসেস আমিনা আহিকে খুব পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে এসে তাজওয়ার আর আহিকে একসাথে দেখে তিনি দমে গেলেন৷ অন্যদিকে উজ্জ্বল গম্ভীর দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল বেশ বুঝতে পারছে, আহি তাজওয়ারের এমন ব্যবহারে অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু তাজওয়ারকে সরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো অধিকার তার নেই। এদিকে রাদেরও ভীষণ রাগ হচ্ছে। অথচ সে কিছুই করতে পারবে না। এই মুহূর্তে কারো কাছে আহির অস্থিরতা কমানোর কোনো সমাধান নেই। আহি নিজেই কয়েক বার তাজওয়ারের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ঘুরেফিরে তাজওয়ার তার কাছে এসে দাঁড়ায়। আহি এবার বিরক্ত হয়েই বলল,
“কেন এমন করছো?”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“সবাইকে জানাচ্ছি, তুমি আমার কে হও!”

“এখানে কেউ এসব দেখতে আগ্রহী নয়।”

“বেশ বিরক্ত হচ্ছো, মনে হচ্ছে! তার মানে এতোদিন সত্যিই সব অভিনয় ছিল? আমাকে ফাঁসানোর জন্য এমন করেছো?”

আহি তাজওয়ারের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে আবার দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তাজওয়ার আবারও আহির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই পদ্ম সেখানে উপস্থিত হলো। সে আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। তাজওয়ার পিছু পিছু আসতে চায়লে পুষ্প তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, অন্তত আজকের জন্য আপনার মিসেসকে আমাদের সাথে থাকতে দিন। আমরা নতুন দুলাভাইয়ের খাতিরযত্ন করার কিছু প্ল্যান করছি। আপনার বারেও কিন্তু করবো।”

তাজওয়ার হালকা হেসে বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই।”

কিন্তু মনে মনে বেশ বিরক্ত হলো সে। তারা যে ইচ্ছে করে আহিকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তা বেশ বুঝতে পারছে তাজওয়ার।

(***)

আহি পদ্মের সাথে একপাশে এসে দাঁড়ালো। পদ্ম বলল,
“কি হচ্ছে এসব, আহি?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি হয়েছে?”

“আমি আর আফিফ ছাড়াও বিয়েতে অনেক দম্পতি এসেছে। আর তোর সাথে মিস্টার তাজওয়ার খানের বিয়েই হয় নি। এভাবে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা কতোটা বাজে দেখাচ্ছে, জানিস? এটা একটা ফ্যামিলি প্রোগ্রাম। তাও আবার লিনাশার বান্ধবী তুই। ওর আত্মীয়রা কী ভাববে?”

“এখানে আমার কি দোষ? আমি তাজওয়ারকে আনতে চাই নি। ও নিজেই এসেছে।”

“আমার উনাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না।”

“সুবিধার মানুষও না।”

তাদের কথার মাঝখানে আফিফ এসে দাঁড়ালো। আহি একনজর তার দিকে তাকালো৷ আফিফ পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এখন বাসায় চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে। রাতও অনেক হয়েছে৷”

পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“চল তোকে নামিয়ে দিয়ে আসি।”

আহি পেছন ফিরে দেখলো তাজওয়ার তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আফিফও আহির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। তাজওয়ারের দৃষ্টি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠলো। আফিফের রাগ উঠলো খুব। মানুষটা তাকে দিনদিন কোনঠাসা করে রাখছে।
আজ অজানা কারণেই আফিফের মেজাজ বেশ খিটখিটে হয়ে আছে। সে পদ্মের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে। পদ্ম বলল,
“কি হয়েছে আপনার?”

“বাসায় চলো, প্লিজ। ভালো লাগছে না আমার।”

“হঠাৎ!”

আফিফ গম্ভীরমুখে বলল, “চলো, পদ্ম।”

পদ্ম বলল,
“আচ্ছা, একটু পর লিনাশাকে বিদায় দিয়ে দেবে। তারপর চলে যাবো।”

এদিকে লিনাশার বিদায় পর্ব শেষ হতেই তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে গাড়িতে উঠালো। রাদ আর লাবীব ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ তাজওয়ারকে আটকানোর জন্য তাদের গাড়ির কাছে এসে বলল,
“আহি তুই না আমার সাথে যাবি?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আহি আমার সাথে যাচ্ছে।”

কথাটি বলেই গ্লাস টেনে দিলো তাজওয়ার। আহি বিরক্তমুখে বলল,
“তোমার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কি?”

তাজওয়ার গাড়ি ঘুরিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে চলে এলো। আহি বলল,
“সমস্যা কি?”

তাজওয়ার কিছুদূর এসে গাড়ি থামিয়ে আহির চুল টেনে ধরে তার ওষ্ঠদ্বয় কামড়ে ধরলো। আকস্মিক এমন আক্রমণে আহি থতমত খেয়ে গেলো। সে তাজওয়ারকে ছাড়ানোর জন্য তাকে ধাক্কা দিতেই তাজওয়ার আহির গলা চেপে ধরে বলল,
“তুই আমার সাথে অভিনয় করেছিলি? আমার ভালোবাসা তোর কাছে মশকারা ছিল?”

আহির ভীষণ রাগ উঠলো। সে সশব্দে তাজওয়ারের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। তাজওয়ারের রাগ যেন আরো বেড়ে গেলো। সে আহির লেহেঙ্গার ব্লাউজটা পেছন দিক দিয়ে টেনে ধরতেই পেছনের বোতামগুলো ছিঁড়ে গেলো। আহি বুঝতে পেরে সাথে সাথেই উড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিয়ে বলল,
“তুমি আমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবে না, বলছি।”

তাজওয়ার আহির কাছে এসে বলল,
“তুই তো আমাকে বিয়ে করবি না। এখন তোকে বাধ্য করাও তো সম্ভব না। এই মুহূর্তে একটাই উপায় আছে। বিয়ের আগেই তোকে ধর্ষণ করবো।”

আহি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ছি!”

তাজওয়ার আহির গাল চেপে ধরে বলল,
“ছি! আমাকে ছি করছিস? আর ওই আফিফ যখন তোকে স্পর্শ করে, ওটা কি তোর খুব ভালো লাগে?”

“পাগল তুমি? ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক করো তোমার। ও আমাকে কখন স্পর্শ করলো?”

“একটু আগে কি করছিলি তোরা?”

“ও পদ্মের সাথে কথা বলতে এসেছে। পদ্মকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল।”

“আচ্ছা? স্টেজে উঠে যখন ছবি উঠাচ্ছিলি, ও তোর হাত ধরলো কেন?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আ’র ইউ ক্রেজি? তাজওয়ার, তুমি কি অন্ধ? ও আমার হাত ধরেছো দেখেছো। কিন্তু কেন ধরেছে বুঝো নি? লেহেঙ্গা ভারী ছিল আমার। কার্পেটে হিল আঁটকে ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেছিলাম, তাই ও আমাকে জাস্ট নিচে পড়া থেকে বাঁচিয়েছে।”

“আর ও স্পর্শ করলো, তোরও ভালো লাগলো।”

“কি বলছো এসব?”

“তোর চোখে-মুখে ভালো লাগা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। ওকে এখনো ভালোবাসিস, তাই না?”

আহি স্তব্ধ হয়ে গেলো। তাজওয়ার বলল,
“আই হেইট হিম। ও আমার ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছে।”

তাজওয়ার চিৎকার করে উঠলো। বার কয়েক গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের উপর ঘুষি মারলো। আহি সুযোগ পেয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়লো। আহি নেমে যেতেই তাজওয়ারও নেমে পড়লো। আহি তার হিলগুলো খুলে উলটো দিকে দৌঁড়াতে লাগলো। তাজওয়ার গাড়িতে হেলান দিয়ে শব্দ করে হাসছে। আহি একবারো পিছু ফিরে দেখে নি।

(***)

অনেক দূর দৌঁড়ে এসে আহি হাঁপাতে লাগলো। পেছন ফিরে দেখলো তাজওয়ার তার পিছু আসে নি। ব্যাগ, ফোন সব গাড়িতেই ফেলে এসেছে। কাউকে যে ফোন করে সাহায্য নেবে সেই সুযোগটাও নেই। এই মুহূর্তে ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। কোনোভাবে হাত হাতিয়ে ব্লাউজের পেছনের বোতামগুলো লাগানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। উড়নাটা দু’ভাজ করে এবার গায়ে জড়িয়ে নিলো সে। ভাগ্যটাই তার নির্মম। প্রতিবার বান্ধবীর বিয়েতেই তার সাথে ভয়ংকর কিছু ঘটে। পদ্মের বিয়েতেও অন্ধকার রাস্তায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। আজও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে। আহি বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“আমি অশুভ। আমিই অশুভ। আমার মরে যাওয়া উচিত। আমার অসহ্য লাগছে এসব। আর ভালো লাগছে না আমার। আমি পারবো না আর এসব সহ্য করতে।”

হঠাৎ একটা সিএনজি সেই রাস্তা দিয়ে আসতে লাগলো। আহি তা দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই সিএনজিটা থেমে গেলো। আহি আরো ভয় পেয়ে গেলো। সে উলটো দিকে ফিরে আবার দৌঁড়াতে যাবে তখনই পদ্মের কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ালো। পদ্ম সিএনজি থেকে নেমে আহির দিকে দৌঁড়ে এলো। আর আহি পদ্মকে দেখে তাকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আফিফও সিএনজি থেকে নেমে এলো। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এখানে?”

আহি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“তাজওয়ার আমার সাথে বাজে ব্যবহার করছিল। তাই আমি পালিয়ে এসেছি।”

এই কথা শুনে আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো। পদ্ম বলল,
“তুই চল, আমাদের সাথে চল।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ওকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”

পদ্ম বলল,
“না, ওই বাসা ওর জন্য নিরাপদ নয়। কয়েকদিন আহি আমাদের সাথেই থাকুক।”

আহি বলল,
“আমাকে মায়ের বাসায় নামিয়ে দিলেই হবে।”

“আন্টি তোকে এই অবস্থায় দেখে চিন্তায় অস্থির হয়ে যাবেন। বেশি কথা বলিস না তো। চল, আমাদের সাথে।”

পদ্ম আহিকে জোর করে সিএনজিতে বসালো। আহি এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি তাজওয়ার তাকে টেনে নিয়ে যাবে। সে পদ্মের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। আফিফ তা দেখে বলল,
“তুমি চাইলে ওর বিরুদ্ধে কেইস করতে পারো।”

আহি ভেজা চোখে আফিফের দিকে তাকালো আর বলল,
“ওর বিরুদ্ধে কেইস করে কি হবে। ঠিকই কয়েকদিনের মধ্যে বের হয়ে যাবে। কেইস করার জন্য শক্ত প্রমাণ লাগবে, যা আমার কাছে নেই।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি চাইলে তোমাকে সাহায্য কর‍তে পারবো।”

“কীভাবে?”

“আমি তো এখন তাজওয়ারের পিএ। ওর অনেক তথ্য আমার কাছে আছে। যদিও সরাসরি আমার হাতে নেই। কিন্তু আমি জোগাড় কর‍তে পারবো।”

পদ্ম বলল,
“এরপর কি হবে? এসব দিয়ে কি তাজওয়ার খানকে ফাঁসানো যাবে?”

“খুব সেনসিটিভ কেইস। একবার ধরা খেলে দেশে থাকতে পারবে না। দুর্নীতি মামলায় কয়েক বছরের জেল হবে।”

আফিফ এবার মনে মনে বলল,
“এই শাস্তি তাজওয়ার খানের জন্য কিছুই না। তাজওয়ারকে এর চেয়ে ভভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে। তখনই মনকে বোঝাতে পারবো, আমার আপা ন্যায়বিচার পেয়েছে।”

(***)

পদ্ম আহিকে বাসায় নিয়ে এলো। আফিফা বেগম দরজা খুলে আহিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কে এই মেয়ে?”

পদ্ম বলল, “মা আমার বান্ধবী।”

আহি আফিফা বেগমকে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। পদ্ম আহিকে ভেতরে নিয়ে যেতেই আফিফা বেগম ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু হয়েছে?”

“মেয়েটা বিপদে পড়েছে। আজ রাতে এখানে থাকবে।”

“ওহ আচ্ছা।”

পদ্ম আহিকে নিয়ে তাদের রুমে চলে এলো। এরপর আহিকে খাটে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোর জন্য বিছানা করে দিচ্ছি। পাশে একটা ছোট রুম আছে। রেনু আসলে ওখানে থাকে। অনেকদিন আসে না তাই বিছানা গুটিয়ে রেখেছি। তুই এখানে বয়।”

পদ্ম চলে যেতেই আহি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। রুমে একটা খাট। পাশে ছোট একটা টেবিল। টেবিলের উপর আফিফের হাতঘড়ি আর রুমাল। আহি বুঝলো এটা আফিফ আর পদ্মের বেডরুম। সে বিছানা ছেড়ে উঠে পাশের চেয়ারটা টেনে বসতে যাবে তখনই তার চোখ আটকে গেলো দেয়ালে বাঁধানো বড় ফ্রেমটিতে। আহি ধীর পায়ে সেই ফ্রেমটির দিকে এগিয়ে গেলো। তখনই রুমে আফিফ ঢুকলো। আহিকে দেখে আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি এখানে?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“পদ্ম আমাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে রুম ঠিক কর‍তে গেছে।”

আফিফ এবার দেয়ালে লাগানো ছবিটির দিকে তাকালো। আহিও আফিফের দৃষ্টি অনুসরণ করলো। আহি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই আফিফ বলল,
“এটা আমার প্রথম এচিভমেন্ট। তাই দেয়ালে লাগিয়েছি। অন্য কিছু না।”

কথাটি বলেই আফিফ বের হয়ে গেলো। আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। সে ঝাপসা চোখে আবার সেই ছবিটির দিকে তাকালো। এক্সিভিশনের জন্য আফিফের আঁকা আহির সেই ছবিটি আফিফ আর পদ্মের বেডরুমের দেয়ালে ঝুলানো দেখে বেশ অবাক হয়েছিল আহি। কিন্তু খারাপ লাগছে আফিফ আর পদ্মের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে। আলনায় পাশাপাশি পদ্মের শাড়ি, উড়না আর আফিফের শার্ট ঝুলছে। এটাকেই তো সংসার বলে। তার মানুষটা সংসার করছে তার প্রিয় বান্ধবীর সাথে। আর আহি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের গোছানো সংসার দেখছে। এই দিনটিও হয়তো তার দেখার ছিল।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৩||

৮৭।
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রকৃতি নিস্তব্ধতায় মোড়া। নিরবতা ভেঙে মাঝে মাঝে মশকীদের গান ভেসে আসছে আহির কানে। মশারী টাঙানো ছোট্ট বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সে। পরিষ্কার কম্বল টেনে নিজেকে আরেকটু গুটিয়ে নিলো আহি। সে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। অসহ্য লাগছে তার। এবার উঠে বসলো সে। দেয়াল হাতিয়ে বাতি জ্বালালো। রুমে ছোট একটা আয়না আছে। নিজেকে সেই আয়নার সামনে দাঁড় করলো আহি। তার ঠোঁটে রক্ত জমাট বাঁধা। নিজের মুখটা দেখেই চোখে অশ্রু ভীড় করলো তার। গায়ের জামাটা পদ্মের। ঢিলেঢালা পোশাক। কিন্তু সেলোয়ার-কামিজ পরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই তার। সে এবার মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর পর চোখ ভিজে উঠছে তার। কামিজের হাতায় চোখ মুছছে। আর দরজার দিকে তার দৃষ্টি স্থির। হঠাৎ তার চোখ আটকালো খাটের পেছনে দাঁড় করানো ক্যানভাসের দিকে। আহি ক্যানভাসটি বের করে তার সামনে রাখলো। কাগজ দিয়ে মোড়ানো ক্যানভাস। আহি কাগজ সরিয়েই চমকে উঠলো। এটা তো সেই ছবি, যেই ছবি সে নদীর পাড়ে এঁকেছিল। সেই মধ্যাহ্ন বেলার আকাশ। সেই হেমন্তের রং। সে পাহাড়ের গায়ে জন্মানো ছোট ছোট ধূসর-লাল ফুল। আহি মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“আফিফের বাসায় আমার আঁকা ছবি?”

কিছুক্ষণ ভাবার পর আহির মনে পড়লো, সেদিন এই ছবিটা আঁকার পর সে সাথে করে নিয়ে আসে নি। নদীর পাড়েই ফেলে এসেছিল। কারণ ড্রাইভার এসে জানিয়েছিল তার মা সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেদিনই আহি তার ভাইকে হারিয়েছিল। অতীত মনে পড়তেই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। ছবিটি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আফিফ হয়তো জানতোই না, এটা আমার আঁকা ছবি। কিন্তু এতো বছর ধরে ও কতো যত্ন করে রেখেছে এই ছবিটা! পদ্ম খুব ভাগ্যবতী। এমন যত্নবান পুরুষ শুধু ভাগ্যবতীদের কপালেই থাকে। আমি তো অশুভ ছিলাম। তাই আমার ভাগ্যে আফিফ ছিল না।”

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই আহি ক্যানভাসটি একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলতেই পদ্ম রুমে ঢুকলো। আহি পদ্মকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“ঘুমাস নি এখনো?”

আহি মলিন মুখে বললো, “ঘুম আসছে না।”

“আমি জানি তুই এমন পরিবেশে অভ্যস্ত না।”

“মোটেও না। আমি ঠিকই অভ্যস্ত। আমার অনেক ভালো লাগছে এখানে। আসলে আমি কামিজ পরে ঘুমাই না। তাই ঘুম আসছে না। অস্বস্তি লাগছে।”

“আগেই বলতে পারতি। গেঞ্জি পরে ঘুমাস?”

“হ্যাঁ। একটু ঢিলেঢালা হলেই হবে। আছে?”

“থাকবে না কেন? দাঁড়া আমি নিয়ে আসছি।”

পদ্ম কিছুক্ষণ পর ধূসর রঙের একটা টি-শার্ট আহিকে দিয়ে বলল,
“এখন ঘুমিয়ে পড়। রুমে বাতি জ্বলছে দেখেই তোকে দেখতে এলাম। চিন্তা করিস না। আরাম করে ঘুমা। তোর কিচ্ছু হবে না। আর ওই তাজওয়ার খানকে তোর বিয়েই করতে হবে না। আমরা সবাই তোর পাশে আছি।”

আহি পদ্মকে জড়িয়ে ধরলো। আর পদ্ম আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

(***)

সকালে আহি রুম থেকে বের হয়েই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ আহিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। আফিফের চাহনি দেখে আহিও ভ্রূ কুঁচকালো। তখনই পদ্ম এসে বলল,
“চল, নাস্তা খেয়ে নিবি।”

আফিফ এবার পদ্মের দিকে জিজ্ঞাসুক চোখে তাকালো। পদ্ম হালকা হেসে আহিকে টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আফিফ পদ্মের কাছে এসে বলল,
“কি করলে এটা?”

পদ্ম চোখের ইশারায় আফিফকে থামিয়ে দিলো। আহি তাদের এমন ইশারায় কথা বলা দেখে বলল,
“কিছু হয়েছে?”

পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আরেহ না, তুই নাস্তা কর।”

আফিফ নিজেও আহির মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। আহি পদ্মকে জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি নাস্তা করবেন না?”

“মা নাস্তা করে ফেলেছেন। উনি তাড়াতাড়ি নাস্তা করেন। আফিফই শুধু দেরীতে করেন।”

“তুই করবি না?”

“তোরা খা।”

“তুইও বয়।”

“আমি আফিফ যাওয়ার পর নাস্তা করবো।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও।”

তখনই আফিফা বেগম ডাইনিংয়ে এলেন। পদ্ম আফিফা বেগমকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আহি অবাক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকালো। আফিফা বেগম এবার চেয়ার টেনে বসলেন। আহির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এমা তুমি এটা কি পরেছো?”

আহি ইতস্ততভাব নিয়ে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আহি কামিজ পরে ঘুমাতে পারে না, তাই দিয়েছি।”

“তাই বলে স্বামীর জামা দিয়ে দেবে?”

আহি অবাক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা তোর না?”

পদ্ম কিছু বলবে তার আগেই আফিফা বেগম বললেন,
“পদ্মের কেন হবে? বউ মানুষরা কি এমন পোশাক-আশাক পরে?”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ আপন মনে নাস্তা করছে। আশেপাশে কে কি বলছে কিছুই শুনছে না, এমন একটা ভাব নিয়েছে সে।

(***)

আহি মাথা নিচু করে নীরবে খাচ্ছে। আফিফা বেগম আহিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“পদ্ম হচ্ছে এখন বউ। বউদের অন্যভাবে চলতে হয়। তোমার যখন বিয়ে হবে, তুমিও বুঝবে।”

আহি একনজর পদ্মের দিকে তাকালো। আফিফা বেগম আবার বললেন,
“বউদের সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়। স্বামীর সাথে সকালে নাস্তা করা ভালো না। স্বামীকে খাইয়ে দিয়েই খাওয়া উচিত। আগে স্বামীর পেট ভরবে, তারপর বউয়ের। আর তোমরা যে জামা-কাপড় পরো, ওসব তো পরলে লোকে মন্দ কথা বলবে। বউদের বাইরের মানুষের সামনে মাথায় কাপড় দিতে হয়। আর স্বামী ছাড়া বাসা থেকে একা বের হওয়া উচিত না।”

আহি অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ চুপচাপ খাচ্ছে। আহি এবার নিজেই উঠে পদ্মের হাত ধরে তাকে বসালো। তারপর পদ্মের প্লেটে একটা রুটি উঠিয়ে দিয়ে বলল,
“যেই মেয়ে সবার পরে ঘুমিয়ে সবার আগে উঠতে পারে, যেই মেয়ে স্বামীকে খাইয়ে নিজের ক্ষিধে ভুলে থাকতে পারে, যে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, নিজের স্বাধীনতা ভুলে এতোটা বাধ্য জীবন যাপন কর‍তে পারে, তাকে রানীর মতো করে রাখতে জানতে হয়। যারা জানে না তাদের অন্তত পুরুষ বলা যায় না।”

শেষ কথাটি আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল। আফিফ আহির দিকে নির্বিণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আহি এবার আফিফা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সমাজ কি বলে, সংস্কার কি বলে জানি না। এতোটুকু জানি আইন বলে, ধর্ম বলে, অনুশাসন বলে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। এটা তার অধিকার। সকালে উঠুক তাড়াতাড়ি, সংসার করুক, এটা ওর দায়িত্ব। কিন্তু এভাবে অবহেলা করা উচিত না। ওর অধিকার আছে ওর স্বামীর সাথে এক প্লেটে খাওয়ার। আপনার ছেলে তাই এভাবে বলছেন। আপনার মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে একই কথা, আপনার সামনে আপনার মেয়েকে বললে বুঝতে পারতেন।”

আফিফা বেগম চুপ করে রইলেন। পদ্মও চুপচাপ বসে আছে। আফিফ পদ্মের হাত ধরে রেখেছে। সে পদ্মকে চেয়ার ছেড়ে উঠতে দেবে না। এটাই ভালো সুযোগ, পদ্মের জীবনের কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার।

আফিফ তার মাকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে। মায়ের কথা অমান্য করে না। আফিফা বেগম পদ্মকে পছন্দ করেন না। তাই তিনি নিজেই হয়তো পদ্মের জন্য বাড়তি নিয়ম যোগ করেছেন। আফিফ অনেক বার প্রতিবাদ করেছিল। ফলাফলস্বরূপ আফিফা বেগম কান্না জুড়ে দিতেন, কখনো বা দেয়ালে মাথা টুকতেন, কখনো কখনো না খেয়ে থাকতেন। ছেলের উপর অভিমান করে অনেক বার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাই আফিফ মায়ের কথা ভেবেই আর প্রতিবাদ করে নি। কিন্তু আজ আহির জন্য সে সুযোগ পেয়ে গেছে। এখন মা অন্তত অভিমান করে থাকতে পারবেন না। ছেলের সাথে অভিমান করে থাকা যায়, বাইরের কারো সাথে অভিমান করে কি লাভ?

আফিফা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আচ্ছা, খাবে আর কি। এখন থেকে স্বামীর সাথেই খাবে।”

এরপর তিনি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“পদ্ম, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। এরপর সবজিগুলো রান্না করে ফেলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

আফিফা বেগম চলে যেতেই আহি পদ্মকে বলল,
“চুপ থাকিস কেন? কিছু বলতে পারিস না?”

আফিফ গম্ভীর সুরে বলল,
“আমার মায়ের মুখের উপর আমি নিজেই কথা বলি না। পদ্ম কেন বলবে?”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল, “আহি বুঝে নি।”

আফিফ আহিকে বলল,
“থ্যাংক্স, পদ্মের পক্ষ নেওয়ার জন্য। তবে আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি। আমি পদ্মকেও খুব ভালোবাসি। পদ্ম আমাকে বুঝে, তাই ও কোনো অভিযোগ করে না। মাঝে মাঝে শান্তির জন্য কিছু কথা মেনে নিতে হয়। এতে কোনো ভুল নেই। বরং বড়দের কথা মেনে নিলে, তাদের দোয়া পাওয়া যায়।”

আফিফ কথাটা বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। এরপর পদ্মের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই আহি বলল,
“আমার বাসায় ব্রিটিশ শাসন, আর তোর শ্বশুড়বাড়িতে পাকিস্তানি শাসন চলছে। আর তুই আমাকে আফিফের টি-শার্ট দিলি কেন?”

পদ্ম বলল, “তো কি হয়েছে?”

“যাহ, পাগল তুই? বরের জামা কি কেউ বাইরের মেয়েকে পরতে দেয়?”

“তুই আমার বান্ধবী।”

“আরেহ, বান্ধবী, বোন কাউকে দেয় না, পদ্ম। আমার বরের জামা তো আমি কোনো মেয়েকে ধরতেই দিতাম না।”

“আচ্ছা?”

“জ্বি।”

“এসবে কিছুই হয় না। আফিফ তো আমারই। উনার জামা কেউ পরুক না পরুক, উনার মনে তো আমিই আছি।”

আহি নিষ্কম্প চোখে সেকেন্ড খানিক পদ্মের দিকে তাকিয়ে রইলো। কথাটা সত্য হলেও বেশ আঘাত করলো আহিকে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“তা ঠিক। তাও একটু আগলে রাখিস। বরটা তো তোরই। জিনিসপত্রগুলোতেও যেন তোর স্পর্শ থাকে।”

পদ্ম হেসে বলল,
“এসব তো জড়। আমি যতোদিন বেঁচে আছি, জীবন্ত মানুষটা তো আমারই অধিকারে। যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তখন হয়তো সেই অধিকারটা হারিয়ে ফেলবো।”

“তোর কিছু কেন হবে? পাগল না-কি তুই?”

“না রে, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মরে গিয়ে আফিফকে মুক্তি দিতে। উনাকে একটা সন্তান দিতে পারছি না। আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর হবে। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে, আমি কখনোই মা হতে পারবো না। কোনো চিকিৎসা আমার ভাগ্যে মা হওয়ার সৌভাগ্য এনে দিতে পারবে না।”

“সন্তান নেওয়া কোনো লক্ষ্য না। একসাথে সুখে থাকা জীবনের লক্ষ্য। আফিফ তোকে ভালোবাসে, তুই আফিফকে ভালোবাসিস। আর দু’জন ভালোবাসার মানুষের জীবনে কোনো প্রতিকূলতা বাঁধা হয়ে আসে না। সন্তান দত্তক নিতে পারিস। কতো সন্তান বাবা-মার ভালোবাসা পাচ্ছে না। তাদের একটা নতুন জীবন দে। সেই সন্তান অনেক ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী হবে যার মা তুই হবি, যার বাবা আফিফ হবে।”

পদ্ম বলল,
“কিন্তু সে তো আফিফের রক্ত হবে না। ও তো চাইলে বিয়ে করে বাবা হতে পারবে।”

“কখনো না। বিয়ে করলে তোর আফিফ পাগল হয়ে যাবে। এক বউয়ের জন্য মায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না, আরেক বউয়ের জন্য যাবে? দুই বউয়ের অভিমান সহ্য করার ক্ষমতা সব পুরুষের থাকে না। তাই এক নারীতেই আসক্ত হওয়া ভালো।”

পদ্ম মুচকি হাসলো। আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আমি আফিফ নামক মানুষটাকে পাই নি। কিন্তু তার প্রতি অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধা আছে। তোর জায়গাটা একটা সন্তানের জন্য সে যদি অন্য কাউকে দিয়ে দেয়, সেই শ্রদ্ধাটা আর থাকবে না। আমার ভালোবাসাটা মরে যাবে। কিছু ভালোবাসা শ্রদ্ধা হয়ে অন্তত বেঁচে থাকুক।”

(***)

বিকেলে আহি তৈরী হয়ে পদ্মের রুমে এসে দেখলো আফিফ ও পদ্ম ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত পার করছে। আহি তা দেখে তাড়াতাড়ি সরে গেলো। পুরো শরীর শিউরে উঠল তার। ডায়নিংয়ের চেয়ার টেনে বসে জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো। মনে মনে বলতে লাগলো,
“ওরা স্বামী-স্ত্রী। এটা একদম স্বাভাবিক। রিল্যাক্স আহি।”

অভিমানী সুরে আহি বিড়বিড় করে বলল,
“দরজাটা বন্ধ করতে পারলো না? আর আমি কি জানি বিকেলেই আফিফ বাসায় চলে আসবে? আমি ভেবেছি সন্ধ্যায় আসবে।”

আহি আবার রুমে চলে গেলো। অনেকক্ষণ পর পদ্ম আহির রুমে এলো। আহি পদ্মকে দেখে বলল,
“আমি চলে যাবো এখন।”

“তোকে না বলেছি কয়েকদিন থাকতে?”

“না, না। কি যে বলিস। বাসায় যাবো। বাবা হয়তো অনেক রেগে আছে।”

আহি টি-শার্টটা বিছানা থেকে নিয়ে পদ্মের হাতে দিয়ে বলল,
“আমি ধুয়ে দিয়েছি।”

আফিফ তখনই পদ্মকে ডাকার জন্য এলো। আর পদ্মের হাতে সেই শার্টটা দেখে বলল,
“এটা লাগবে না। তোমার কাছেই রেখে দাও।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। আহি অবাক হয়ে বলল,
“না না। আমি কেন নেবো?”

“আমার বউ না বুঝে এমন বোকামি করে ফেলেছে। বরের শার্ট অন্য মেয়েকে দেয় না, এটা ওর বোঝা উচিত ছিল। এটা আমি আর পরবো না।”

আহি মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ বলল,
“পদ্ম এক কাপ চা বানিয়ে দিও। আমার মাথা ব্যথা করছে।”

কথাটি বলেই আফিফ চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“উনার কথায় মন খারাপ করিস না।”

আহি হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কেন মন খারাপ করবো? উনি আমার কোনো আত্মীয় নন। তোর বর। আমার সাথে উনার কোনো সম্পর্ক নেই, তাই হয়তো উনার বিষয়টা ভালো লাগে নি। আর আমি যদি জানতাম এটা তোর না, আমি পরতামও না। কি বিশ্রী একটা কাজ করেছিস!”

পদ্ম মলিন মুখে বলল, “সরি রে।”

“বাদ দে। আমি রেখে যাচ্ছি। ইচ্ছে করলে ফেলে দিস। কতো কাজে লাগে এসব কাপড়। আমি কিন্তু ভালোভাবেই ধুয়ে দিয়েছি।”

আহি বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার আগে সে একবারও আফিফের দিকে তাকালো না। পদ্ম আফিফকে বলল,
“আহিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসুন না।”

আফিফ বের হতে যাবে তখনই আহি বলল,
“আমি একাই যেতে পারবো।”

আহি পদ্মের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আর আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে আহির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৪||

৮৮।
ক্লান্ত শরীরে বাসায় পা রাখতেই মুনিয়া খালা হন্তদন্ত হয়ে আহির কাছে এলেন। আহি মুনিয়া খালার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, খালা?”

তিনি ভীত কন্ঠে বললেন,
“তুমি ঘরে কেন আইছো, মা। পালাইয়া যাও। ওদের মতলব ভালো লাগতেছে না।”

আহি কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মিসেস লাবণি দম্ভভরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে শয়তানি হাসি। আহি তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মিসেস লাবণি আহির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
“প্রেমিকের বাসায় রাত কাটিয়ে এসেছো?”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আপনি কি জানেন গতকাল রাতে আমার সাথে কি হয়েছিল?”

“কি আর হয়েছিল? তোমার হবু স্বামী তোমাকে একটু ভালোবাসতে চেয়েছিল, ব্যস।”

“জোর করতে চেয়েছে, ভালোবাসতে চায় নি। এটাকে ভালোবাসা বলে না।”

“তবে তোমার চোখে ভালোবাসা কি?”

এদিকে রিজওয়ান কবির আহির গলার স্বর শুনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। তার চোখে মুখে ভয়ংকর রাগ। আহি বাবার রাগী চেহারা দেখে বলল,
“বাবা, আমি বিপদে পড়েছিলাম। তাই বাসায় আসতে পারি নি। রাতে পদ্মের বাসায় আশ্রয় নিতে হয়েছে।”

রিজওয়ান কবির গম্ভীরমুখে বললেন,
“এখন কেন এসেছো?”

আহি বাবার প্রশ্নে কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই সে খেয়াল করলো তাজওয়ার খান সিঁড়ি বেয়ে নামছে। আহি তাজওয়ারকে বাসায় দেখে রাগী স্বরে বলল,
“এই মানুষটার জন্য আমি কাল রাতে বাসায় আসতে পারি নি।”

রিজওয়ান কবির বললেন,
“তাজওয়ার তোমার কি ক্ষতি করেছে?”

“কাল রাতে গাড়িতে ও আমার সাথে বেয়াদবি করেছে। আমি নিষেধ করার পরও আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল।”

রিজওয়ান কবির তাজওয়ারের দিকে তাকালেন। তাজওয়ার আহির কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“কাছে আসতে চেয়েছি। আর এর যথেষ্ট কারণ আছে। এর প্রধান কারণ এই মেয়ে আমাকে বিয়ে না করার জন্য তার বন্ধুদের সাথে মিলে আমার বিরুদ্ধে প্ল্যান করছে। আমাকে তো সে ভালোই বাসে না। কারণ তার মনে এখনো তার পুরোনো প্রেমিক।”

তাজওয়ার শেষ কথাটি বলেই আহির গাল চেপে ধরলো। আহি তাজওয়ারের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“ছাড়ো আমাকে। প্লিজ, ব্যথা লাগছে আমার।”

মুনিয়া খালা ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“স্যার ছাইড়া দেন। বুঝে নাই মাইয়াডা।”

তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে মুনিয়া খালার দিকে তাকালো। চুনি তা দেখে ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো। তাজওয়ার এবার লাবণির দিকে তাকালো। ইশারায় কি যেন বললো। এরপর লাবণি মুনিয়া খালার হাত ধরে তাকে পাশের রুমে নিয়ে গেলেন। আহি তা দেখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। সে বুঝতে পারলো, হয়তো আজ তার গায়ে হাত তুলবে সবাই। আহি প্রস্তুত ছিল বাবার মার খাওয়ার জন্য। এই কয়েক বছরে উল্টোপাল্টা কিছু হলেই সে বাবার চড় খেয়েছে। অনেক বছর আগে আফিফের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলায়, আহি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। তখন রিজওয়ান কবির মেয়ের পাগলামো দেখে তাকে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। আহি বাবার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“প্লিজ, বাবা। আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি বিয়ে করবো না বলি নি। কিন্তু তাজওয়ারের সাথে স্বাভাবিক হতে আমার সময় লাগবে। আমাকে একটু তো সময় দেওয়া উচিত।”

রিজওয়ান কবির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,
“তোমাকে আর কোনো সময় দেওয়া হবে না। এখন আমার দায়িত্ব তোমাকে মুক্তি দেওয়া।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“তাজওয়ারের সাথে তোমার বিয়ে হোক না হোক, এখন থেকে আমি তাজওয়ারকে সেই স্বাধীনতা দিচ্ছি। ও এখন থেকে তোমার সাথে যা চায়, তাই করতে পারবে।”

“তুমি বাবা হয়ে এ কথা বলছো? বাবা, ও আমার ক্ষতি করতে চায়ছে।”

এদিকে মিসেস লাবণি চুনি এবং মুনিয়া খালাকে পাশের ঘরে আটকে দিলেন। মুনিয়া খালা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। কারণ তিনি জেনে গেছেন, আজ আহির সাথে কি হতে যাচ্ছে।

(***)

আহি রিজওয়ান কবিরের সামনে হাতজোড় করে বলল,
“এভাবে বলো না, বাবা। তুমি আমার অভিভাবক। একটা মেয়ে তার বাবার কাছেই তো নিরাপদ থাকে।”

তখনই পেছন থেকে তাজওয়ার আহিকে জড়িয়ে ধরে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আজকের দিনটা আমার জন্য খুব স্পেশাল। কারণ আমি তোমাকে পুরোপুরি পেতে যাচ্ছি।”

আহি তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রিজওয়ান কবিরের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলো। খুব ভরসা নিয়ে সে তার বাবার বাহু আঁকড়ে ধরে আছে। তার চোখ ভেজা। সে কাকুতি ভরা স্বরে বলল,
“বাবা, আমার সম্মান নষ্ট হতে দিও না, প্লিজ। তুমি কি আমাকে একটুও ভালোবাসো না?”

রিজওয়ান কবির আহির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
“না, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তোমার মা, আর তোমাকে ঘৃণা করি।”

“কি বলছো এসব, বাবা?”

“হ্যাঁ। মিস্টার আফসার কবির, তোমার দাদা আমার সাথে প্রতারণা করেছিলেন। আর সেটা তোমার মায়ের জন্য হয়েছে। তোমার নানা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। তাই তো বাধ্য হয়ে তোমার মাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। এরপর তোমার দাদা, মৃত্যুর আগে সব সম্পদ তোমার মা আর তোমার নামে লিখে দিয়ে যায়। এই কাজ করে আমাকে অপমান করেছেন তিনি। আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না এই সম্পদের। কিন্তু সবার কাছে আমি ছোট হয়ে গিয়েছিলাম। মিস্টার আফসার কবির মৃত্যুর আগে তোমার মাকে বলে গিয়েছিলেন, আমার মতো শয়তানের হাত থেকে তিনি তার সম্পদ বাঁচাতে চান। আমি না-কি শয়তান। তিনি চেয়েছেন তোমার মা এই নরক থেকে সারাজীবনের জন্য মুক্তি পাক। তিনি তো জানতেন আমি কেমন? আফটার অল, বাবা-মার চেয়ে তার সন্তানদের আর কেউ ভালোভাবে চিনতে পারে না। আর আমিও তার ধারণা ভুল প্রমাণ করি নি। তিনি তো তোমার মাকে মুক্তি দিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছেন। আমার মতো শয়তানের সাথে বিয়ে দিয়ে তো বেশ অনুতপ্ত ছিলেন তিনি৷ আর আমি তার কবরের শান্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছি। তোমার মাকে তো মুক্তি দিয়েছি। তবে শারীরিক ভাবে দিলেও মানসিকভাবে দেই নি। তুমি আমার অপমানের শোধ তুলবে। তুমি আমার ইনভেস্টমেন্ট, আহি। তোমাকে তাজওয়ারের সাথে বিয়ে দিলে তোমার মা আর আমার পরলোকগত বাবার জীবনের চরম ব্যর্থতা আমাকে মানসিক শান্তি দেবে।”

রিজওয়ান কবিরের কথা শুনে আহির চোখ ভিজে উঠলো। সে বাবার হাত ধরে বলল,
“এসব মিথ্যে জেদের কারণে তুমি তোমার মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দেবে?”

“হ্যাঁ। তোমার মাকেই আমি আমার স্ত্রী মানি নি, তাহলে তার সন্তানকে আমি নিজের মেয়ে কেন মানবো? তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে নিজের কাছে কেন রেখেছি?”

“কেন রেখেছো?”

“তোমার মাকে মানসিক ভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য।”

“তা যাই হোক, আমি তো তোমারই মেয়ে।”

“আই ডোন্ট কেয়ার।”

রিজওয়ান কবির এবার তাজওয়ারের দিকে তাকালেন। তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে জোর করে টেনে সিঁড়ি বেয়ে উঠাতে লাগলো। তাজওয়ারের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আহি রিজওয়ান কবিরের পা ধরে বসে বলল,
“বাবা, প্লিজ। তুমি আমার সাথে এমন অন্যায় করো না। আমি তোমার মেয়ে। তুমি আমাকে এভাবে কারো কাছে বিক্রি করে দিও না। আমি এই লোকটাকে বিয়ে করতে চাই না। যাকে আমি বিয়েই করবো না, সে আমাকে কেন স্পর্শ করবে? আর বিয়ে হোক না হোক, একটা মেয়ের সাথে জোরাজুরি করার অধিকার কারো নেই, তার স্বামীরও নেই।”

রিজওয়ান কবির আহির কথায় কান দিলেন না। তিনি আহিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। লাবণিও তার পিছু পিছু উপরে যেতে লাগলো। আর যাওয়ার আগে আহির দিকে তাকিয়ে তীর্যক হাসি হেসে বলল,
“তোমার চ্যালেঞ্জে তুমি হেরে গেছো।”

আহি স্তব্ধ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির কাছে এসে তাকে পাঁজা কোলা করে তুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। উঠতে উঠতেই বলল,
“কংগ্রাচুলেশনস, আজ তুমি পুরোপুরি আমার হতে যাচ্ছো। একবার আমার স্পর্শ পেলে, আর কোনো পুরুষের স্পর্শ সহ্য হবে না তোমার।”

আহি কথাটি শুনেই যেন মনে জোর ফিরে পেলো। সে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগলো। তাজওয়ার তাকে টেনে উপরে এনে তারই বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। আহি উলটো দিকে ঘুরে তাজওয়ারের হিংস্র চেহারার দিকে ঘৃণাভরে তাকালো।
তাজওয়ারের ঠোঁটে বিশ্রী হাসি। সে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। তা দেখে আহির হাত মুঠো হয়ে এলো। সে নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুললো। তাজওয়ার আহিকে উঠতে দেখে তার হাত ধরে ফেললো। আর আহি তাজওয়ারের হাতে কামড় বসিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। তাজওয়ার দরজা চেপে ধরতেই আহি কাঁপা হাতে দরজাটা ভালোভাবে আটকে দিলো। তাজওয়ার জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। ওয়াশরুমের দরজা এতোটাও শক্ত না। এভাবে ধাক্কা দিতে থাকলে আজ আহির রক্ষা নেই। তাই সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কারো কাছে যে সাহায্য চায়বে, সেই উপায়ও নেই। আহি ক্লান্ত হয়ে ওয়াশরুমের মেঝেতে বসে পড়লো৷ তাজওয়ার এবার আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। এবার দরজার লকটা আলগা হয়ে যাচ্ছে। আহি মুখে হাত চেপে কাঁদছে। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে তার। তার আপন বাবা তার সাথে এতো বড় ছল করেছে? তিনি একবারও নিজের মেয়ের সম্মানের কথা ভাবলেন না? এমন জঘন্য মানুষকে সে এতোদিন বাবা বলে ডেকেছে, ভাবতেই তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

আহি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। সে দৃঢ় স্বরে বলল,
“আমি চ্যালেঞ্জে হারবো না। আমি মরে যাবো, তবুও ধর্ষিতা হবো না। আহি এতোটাও ফেলনা নই যে কেউ এসে আমাকে স্পর্শ করে দিয়ে যাবে। এটা আমার সম্মান, আমার শরীর। এখানে শুধু আমার অধিকার। তাই আমি আমার সাথে যা ইচ্ছে করবো, কিন্তু অন্যদের সেই সুযোগ দেবো না।”

আহি এবার এদিক-ওদিক তাকালো। দেয়ালের সাথে লাগানো তাকের উপর হাত হাতড়ে একটা ব্লেড খুঁজে পেলো। ব্লেডটা সে কিছুদিন আগেই সুতা কাঁটার জন্য রেখেছিল। ব্লেডটা হাতে নিয়েই সে চোখ বন্ধ করে শরীরের সব শক্তি দিয়ে হাতের উপর চালালো। একবার নয়, দুইবার নয়, চার-পাঁচবার হাতের উপর ব্লেড চালালো সে। ততোক্ষণে তাজওয়ার দরজা ভেঙে ফেলেছে। সে ভেতরে ঢুকে আহির হাতে রক্ত দেখে তব্ধা খেয়ে গেলো। সেকেন্ড খানিক সে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল। আহি তাজওয়ারের কাছে এসে তার বুক পকেটে ব্লেডটা ঢুকিয়ে দিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তোমার হিংস্র মন কি মৃত মানুষকে ছাড় দেয়?”

তাজওয়ার আহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কি করলে তুমি এটা?”

“তোমাকে হারিয়ে জিতে গেছি। আজ যদি আমি বেঁচে ফিরি, আল্লাহর কসম তোমাদের সবাইকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।”

তাজওয়ার আহিকে কোলে নিয়ে দ্রুত পদে নিচে নেমে এলো। তাজওয়ারের চেঁচামেচি শুনে মিসেস লাবণি ও রিজওয়ান কবির রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তারা বেরিয়েই দেখলেন মেঝেতে রক্ত। আহির হাত থেকে রক্ত বেয়ে বেয়ে মেঝেতে পড়ছে, আর মেঝে লাল হয়ে যাচ্ছে। আহির এখনো জ্ঞান আছে। কিন্তু বেশ ঘুম পাচ্ছে তার। নিভু নিভু দৃষ্টিতে সে আকাশের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“সরি, হয়তো মৃত্যুর পর আমার জন্য অনেক বড় শাস্তি লিখে রেখেছো তুমি। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমাকে একটু যদি সাহায্য করতে তুমি! কতোবার তোমার কাছে কেঁদে কেঁদে চেয়েছি, মুক্তি দাও। মুক্তি দাও। তবে এটাই কি আমার জীবনের মুক্তি ছিল?”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৪০+৪১ + বোনাস পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪০(১ম ভাগ)||

৭৯।
আফিফকে রুম থেকে বের হতে দেখে আহি তার কাছে এসে বলল,
“কোথায় যাচ্ছ? তুমি তো অসুস্থ। তোমার এক্স-রে করা হয় নি এখনো।”

আফিফ সেকেন্ড খানিক আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি।”

আহি অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। রাদও সেই সময় বেরিয়ে এলো। সে আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“একা যেতে পারবেন? আমি আপনাকে গাড়ি ঠিক করে দেই?”

আফিফ বলল,
“না, এর প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারবো।”

আহি বলল,
“রাদ যাক না হয়। আর তুমি পদ্মকে কি বলবে? ও যদি তোমার মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখে কিছু জিজ্ঞেস করে?”

আফিফ ক্ষীণ হেসে বলল,
“পদ্ম আমার ওয়াইফ। দেখি কি বলতে পারি।”

আফিফের খাপছাড়া উত্তর আর শীতল ব্যবহার আহির মনে আঘাত করলো। আহি মনে মনে ভাবলো,
“কি করলাম আমি? হঠাৎ আফিফ এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন আমার সাথে?”

এদিকে সালমা ফাওজিয়া রুম থেকে বের হতেই আফিফ তাকে সালাম দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আন্টি, আমাকে সাহায্য করার জন্য। আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। ভুল কিছু করলে ক্ষমা করবেন।”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“ধন্যবাদ দিতে হবে না। আর এখানে কষ্টের কি হলো? আহি যেমন, পদ্মও আমার কাছে তেমনই। আর পদ্মের স্বামী তো আমার মেয়ের জামাই হলো, তাই না।”

সালমা ফাওজিয়া খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বললেন। কিন্তু এই একটি বাক্যে আহির বুকটা কেঁপে উঠলো। সে আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। আফিফ সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।

(***)

উত্তরের মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর কাঁপছে আফিফের। কিন্তু সে উদ্দেশ্যহীন পথে হেঁটে যাচ্ছে। মনটা ভারী হয়ে আছে তার। মনে হচ্ছে সব হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে। অনেক কিছুই তো ছুটে গেছে। বাধ্য হয়েই অনেক স্বপ্ন অতীতের পাতায় ফেলে আসতে হয়েছে। বর্তমানের জন্যই অনেক মানুষকে জোর করে স্মৃতি থেকে বের করে ফেলতে হয়েছে। আজ যদি অন্য কারো ভালোর জন্য আফিফকে কিছু করতে হয়, তাহলে সে অবশ্যই করবে।

ঘন্টাখানেক আগেই রাদ আর আফিফের কথোপকথন হয়েছিল। কিছু জমানো কথা আফিফ অনেক বছর পর কারো সাথে ভাগ করে নিতে পেরেছে। এতো বছর ধরে চয়নের মৃত্যুর মূল কারণটা সে একাই নিজের মনে দাফন করে রেখেছিল। তাজওয়ার খানকে সামনে পেয়েও সে কিছু করতে পারে নি। কারণ তার হাতে কোনো প্রমাণ নেই, আর তার বোন রেনুর জীবনটা সে এসব জটের মধ্যে ফেলতে চায় না। যে চলে গেছে তার জন্য, যে আছে তার কথা ভুলে যেতে পারবে না আফিফ। কিন্তু আজ তাকে কেউ আবদার করেছে, তার জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আফিফের সাধ্যের বাইরে কিছু চায় নি মানুষটা। তাহলে তো সে মানুষটির এতোটুকু ইচ্ছে পূরণ করতেই পারে।
শূণ্য রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই আফিফের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। রাদের মলিন মুখটি ভেসে এলো চোখের সামনে। রাদ ঘন্টা খানেক আগে তার হাত ধরে বলেছিল,
“আপনি আহিকে পছন্দ করতেন, আপনার ওর প্রতি একটুও আগ্রহ ছিল, এই কথা যাতে ও কোনোদিনই জানতে না পারে। আর তাজওয়ার আহির জন্য আপনার বোনের ক্ষতি করেছে, এটা যদি আহি জানতে পারে, তাহলে ও আরো ভেঙে পড়বে। হয়তো আপনার কেউ একজন আছে, যাকে আপনি আগলে রাখতে পারছেন। আহি নেই তো কি হয়েছে, আপনি পদ্মকে পেয়েছেন। দিনশেষে আপনি হারেন নি। হেরেছে আহি। সে তো আপনাকে পায় নি। আর এখন, আমি হেরে যাচ্ছি। কারণ আহি আপনাকে ভুলতে পারে নি। আপনি আমাকে শুধু একটা সাহায্য করুন। মাস্টার্স শেষ না হওয়া অব্ধি আপনি আহির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবেন না। যদি পরিস্থিতি এমন হয়, আপনাকে আহির মুখোমুখি হতে হয়েছে, আপনি অবশ্যই ওকে ইগনোর করবেন। কষ্ট দিবেন। যেভাবে পারেন, ওকে বোঝাবেন, আহি কোনোদিনই আপনার কাছে স্পেশাল ছিল না। আমি জানি, আপনি এমন কিছু করলে আহি কষ্ট পাবে। কিন্তু ও আপনাকে অন্তত ভুলে যাক। যদি আপনার উপেক্ষা পেয়ে, আহি আপনাকে ভুলতে পারে, তাহলে আপনার সেটাই করা উচিত। আমি আহিকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি আহির মনে সেই জায়গাটা নিতে চাই, যেই জায়গাটা সে আপনাকে দিয়েছিল। আমি আপনার মতো আহিকে ছেড়ে যাবো না। আমি ওকে খুব ভালোবাসবো। যেই ভালোবাসা আহি ডিজার্ভ করে, এর চেয়ে বেশি ভালোবাসবো।”

আফিফ প্রতিত্তোরে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়েছিলো শুধু। উপেক্ষা শব্দটা সেই মুহূর্তে এতো ভারী কেন মনে হয়েছিল, আফিফ নিজেও জানে না। আর সেই উপেক্ষার প্রয়োগে আহির সেই শুকনো মুখের গভীর চাহনি আফিফকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছে, এটাও সে বুঝতে পারছে না। আফিফ হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতে বসে পড়লো। মিনিট খানিক পর ফোন হাতে নিয়ে পদ্মকে কল করলো। পদ্ম কল ধরতেই আফিফ বলল,
“পদ্মফুল, ভালোবাসি।”

পদ্ম অবাক কন্ঠে বলল, “হঠাৎ!”

“এমনিতেই।”

পদ্ম হেসে বলল,
“নিশ্চয় কোনো মেয়ে আমার স্বামীকে আকর্ষণ করতে চায়ছে, তাই তিনি আমাকে ভালোবাসি বলে নিজেকে বোঝাচ্ছেন, আমার একটা পদ্মফুল আছে, তাই না?”

আফিফ হাসলো। বলল,
“তুমি থাকতে, আমাকে আর কেউ আকর্ষণ করতে পারবে না।”

“আর যদি আমি না থাকি?”

“তুমি কোথায় যাচ্ছো!”

“যদি কোথাও চলে যাই?”

“আমাকে ফেলে চলে যাবে?”

“এমন কোথাও, যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। আর গেলে একাই যেতে হয়!”

“এভাবে বলছো কেন, পদ্ম?”

“এমন হলে!”

“এসব কথা রাখো। আমি আসছি বাসায়। আমার অপেক্ষায় থেকো।”

(***)

আহি মলিন মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আফিফের হুট করে এমন শীতল ব্যবহার আহিকে অস্থির করে তুলছে। রাদ আহির পাশে এসে দাঁড়াতেই আহি চমকে উঠলো। আহি কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
“তুই আমাকে কি যেন বলবি বলেছিস!”

রাদ মনে মনে বলল,
“বলবো ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার অন্তত আফিফের যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে। আফিফ বলেছে, মাস্টার্স শেষ করেই সে তোর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। তুই আর কখনোই ওকে খুঁজে পাবি না। আর যেদিন সত্যিই আফিফ হারিয়ে যাবে, আমি সেদিনই তোকে আমার মনের কথা জানাবো। অন্তত সেই মুহূর্তে আমার ভালোবাসা যাতে তোর কাছে বোঝা মনে না হয়।”

আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“তেমন কিছু না। আমার একমাত্র বান্ধবীর জন্য তাজওয়ার খানকে আমার উপযুক্ত মনে হচ্ছে না, তাই চিন্তায় ছিলাম।”

“তো এখন কি চিন্তা শেষ?”

“না। এখন ভাবছি চিন্তা না করে কিছু একটা করবো।”

“কি করবি?”

“তাজওয়ারকে একটা গণপিটুনি খাওয়াতে পারলে ভালো হতো।”

“এতো সাহস!”

“শোন না। আইডিয়া আছে একটা। মনটা শান্তি হবে।”

“কি আইডয়া?”

“কয়েক মাস পর তো ইলেকশন। এখন তো মিছিল-মিটিং কম হচ্ছে না। এমন একটা মিছিলে তাজওয়ারকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসবো। ব্যস, এরপর একটা মারামারি লাগিয়ে দেবো। মার-টার খেয়ে একেবারে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।”

আহি হাসলো। রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসছিস কেন?”

“তুই কি ভেবেছিস, তাজওয়ার তোর মতো বিন্দাস ঘুরে? ওর আগে-পিছে কিছু নাগ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ মারতে আসলেই সেই নাগগুলো দংশন করে দেবে।”

হঠাৎ সালমা ফাওজিয়া বারান্দায় এসে বললেন,
“আহি তোমার ফোনে লাবণির কল আসছে।”

আহি বিরক্ত মুখে ফোন হাতে নিয়ে বলল,
“বললাম আজকে পুষ্পের বাসায় থাকবো, তবুও শান্তি দিচ্ছে না।”

আহি কল রিসিভ করতেই লাবণি অস্থির কন্ঠে বলল,
“কোথায় তুমি? নিউজ দেখেছো?”

“কেন আপনাকে দেখাচ্ছে নিউজে?”

“তোমার ফিয়োন্সেকে দেখাচ্ছে।”

“তাজওয়ার!”

“এক্সিডেন্ট হয়েছে তাজওয়ারের। গাড়ি খাদে পড়ে আগুন ধরে গেছে।”

আহি মুখে হাত চেপে রাদের হাত ঝাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তাজওয়ার শেষ।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“মানে তাজওয়ার মারা গেছে।”

রাদ খুশি হয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ।”

আহি এক গাল হেসে ফোন কানের কাছে আনতেই লাবণি বলল,
“হ্যালো, আহি। শুনছো?”

“হ্যাঁ, শুনে খারাপ লাগলো। দাফন কখন হবে?”

“ওর দাফনে যাবে তুমি? লাশই তো পুড়ে গেছে। ওটা বাদ দাও। তাজওয়ারকে একবার দেখে এসো।”

“পুড়ে যাওয়া লাশ দেখতে দেয়?”

“কি, বলছো এসব? তাজওয়ার কেন পুড়ে যাবে?”

“এই মাত্রই তো বললেন আপনি।”

“আমি তাজওয়ারের বন্ধু অর্ণবের কথা বলছি। তাজওয়ার তো হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরেছে ওর। হালকা ব্যথা পেয়েছে।”

আহি হাঁ করে রাদের দিকে তাকালো। রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আবার কি!”

আহি লাবণিকে বলল, “আচ্ছা, আমি আসছি।”

আহি কল কাটতেই রাদ বলল,
“তুই বেঁচে গেলি, আহি।”

“জ্বি না, তাজওয়ার বেঁচে গেছে। একটু আগে আমার কল্পনায় মারা গিয়েছিল।”

“মানে?”

“মানে কি! এক্সিডেন্টে ওর বন্ধু মারা গেছে, আর ওর তো কৈ মাছের প্রাণ।”

“কীভাবে ভাই?”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আহি এভাবে বলে না। যার হায়াত যতোটুকু, আল্লাহ এসব নির্ধারণ করে রেখেছেন। কারো মৃত্যু কামনা করা উচিত না। তার হেদায়েতের জন্য দোয়া করা যায়।”

আহি বলল,
“তাজওয়ার যেদিন হেদায়েত পাবে, সেদিন পৃথিবীর অর্ধেক পাপ কমে যাবে।”

এদিকে আহি রিজওয়ান কবিরের জোরাজুরিতে রাতে হাসপাতালে এলো তাজওয়ারকে দেখতে৷ তাজওয়ারের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে মনে হচ্ছে, সে এখনো বেঁচে আছে কীভাবে? আর তার চোখ-মুখের উজ্জ্বল চাহনি দেখে আহির সন্দেহ হচ্ছে, এই ছেলের কি আদৌ এক্সিডেন্ট হয়েছে? তাজওয়ারকে দেখতে কেমন ফুরফুরে লাগছে! এক্সিডেন্ট করে মানুষের চেহারায় এতো সতেজতা আসে, তা তাজওয়ারকে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতো না আহি।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪০(২য় ভাগ)||

৮০।
লিনাশাকে দেখে মিসেস লাবণি বাকরুদ্ধ হয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। আহি লাবণির সামনে এসে বলল,
“মাম্মা, কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? খালামণিকে বাসায় নিয়ে এসেছি।”

লিনাশা বুকে হাত গুঁজে লাবণির সামনে এসে দাঁড়ালো আর বলল,
“আপু, কেমন আছো?”

লাবণি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “তুই এখানে?”

“কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?”

“বিশ্বাস তো হচ্ছে না। নিশ্চয় এখানে আসার কোনো কারণ আছে।”

লিনাশা হাসলো। আহির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই দু’জনে জোরে করতল স্পর্শ করে হাসলো। লাবণি বলল,
“ষড়যন্ত্র করছো তোমরা?”

আহি বলল,
“আরেহ, মাম্মা। খালামণি বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছে। আর সে প্রথম বার বোনের শ্বশুড় বাড়িতে এসেছে, আর তুমি এমন রিয়েক্ট করছো?”

“কি মাম্মা, মাম্মা লাগিয়ে রেখেছো?”

“কেন আপনিই তো নিজেকে নিজের বয়সের চার বছরের ছোট একজনকে মেয়ে বলে দাবি করেন। ভাবতেই অবাক লাগছে আপনার যখন চার বছর বয়স তখনই আপনি মা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।”

লিনাশা মুচকি হেসে বলল,
“আপু, তুমি এখনো যথেষ্ট স্মার্ট রয়ে গেছো। দুলাভাইয়ের সাথে বাইরে বের হলে নিজেকে কি বলে পরিচয় দাও?”

লাবণি চোখ পাকিয়ে বলল,
“রিজওয়ান আমার স্বামী।”

“আই নৌ। বাই দা ওয়ে, আমার হবু বরটা যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। তুমি ছবি দেখবে?”

লিনাশা ফোন বের করে নায়ীবের ছবি দেখালো। লাবণি ভ্রূ কুঁচকে লিনাশার ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি বলল,
“লিনু, তোর বিয়েতে তো সেই মজা করবো। এনগেজমেন্ট, হলুদ, মেহেদি, আক্দ, এরপর একটা গার্লস পার্টি, তারপর বিয়ে। আফটার অল বিয়ে নিয়ে সব মেয়েদেরই স্বপ্ন এমন থাকে।”

লিনাশা হেসে বলল,
“হ্যাঁ, সবই হবে। ধুমধাম করে বিয়ে করবো আমি।”

লিনাশা এবার লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপু তোমারও তো সেই স্বপ্ন ছিল!”

লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আয়োজন করে বিয়ে হয় নি তো কি হয়েছে? চট্টগ্রামের নামকরা ব্যবসায়ীর স্ত্রী আমি। আমি চাইলে এর চেয়ে বেশি আয়োজন করে বিয়ে করতে পারি।”

আহি শব্দ করে হেসে উঠলো। লিনাশা আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, দিস ইজ নট ফেয়া’র। এভাবে হাসছিস কেন? আপু চাইলে দুলাভাইয়ের সাথে আবার বিয়ে করতে পারে। সমস্যা তো অন্যদিকে। দুলাভাইকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ কন্ট্রোভার্সি হবে। আর আপুকে শুনতে হবে সুগা…”

আহি লিনাশাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“খালামণি, দিস ইজ নট ফেয়া’র। ভালোবাসা কি বয়স মানে, বলো?”

“রাইট আহি, ভালোবাসা বয়স মানে না। কিন্তু লোকে বলে এসব ভালোবাসা নয়। এসব….টেকা”

এরপর লিনাশা গানের সুরে বলল,
“টেকা ও পাখি তুমি উইড়া উইড়া আসো,
উইড়া উইড়া আইস্সা তুমি আমার ডালে বসো।”

লাবণি চেঁচিয়ে বলল, “জাস্ট শাট আপ।”

লিনাশা আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,
“ওপস, ভয় পেয়েছি। কি হবে এখন আমার? গণপিটুনি দিয়ে আমাকে উপরে পাঠিয়ে দেবে?”

আহি বলল,
“থাম না লিনু, বাদ দে। টাকা কি শুধু বয়ষ্ক শিল্পপতির কাছেই থাকে? আমাকে দেখ। তাজওয়ার খান আমার ফিয়োন্সে। সে খানস গ্রুপের এমডি প্লাস হ্যান্ডসাম, ড্যাসিং, আর খুব রিচ। সে তো উল্টো আমার প্রেমে ডুবে মরছে। বিয়ের পর না-কি তার কোম্পানির অর্ধেক শেয়ার আমার নামে লিখে দেওয়া হবে। আমেরিকাতে বাড়ি কিনছে আমার জন্য। কষ্ট করে আর বুড়ো শিল্পপতির দিকে নজর দেওয়ার কি দরকার বল? আমি তো উলটো বিয়েই করতে চাচ্ছি না। কিন্তু বাবা আর বাবার মিসেস তো আমাকে জোর করেই বিয়ে দিচ্ছে। ভালোই হলো, তাজওয়ার আমাকে রানীর মতো করে রাখবে। আর সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, মিসেস লাবণি আমার সৎ মা হয়েও আমার জন্য একটা ইয়াং রাজা খুঁজে এনেছে।”

লিনাশা আহির হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল,
“আপুর মন একটু বেশিই বড়। আমি আপুর জায়গায় হলে রিজওয়ান কবিরকে নয়, তাজওয়ার খানের মতোই একটা রিচ ছেলেকে খুঁজে নিতাম।”

আহি বলল,
“আরেহ কি যে বলিস! এটা তো ভালোবাসা। ভালোবাসা তো বয়স মানে না।”

আহি লিনাশাকে নিজের রুমে এনে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর দু’জনই গলা জড়িয়ে লাফাতে লাগলো। আহি লিনাশাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“মাম্মা, তো জ্বলে-পুড়ে ছাই ছাই হয়ে যাচ্ছে।”

লিনাশা হেসে বলল,
“এবার যদি মিসেস লাবণি একটু নড়েচড়ে বসে!”

“যদি বসে, সেদিন ব্রেকিং নিউজ আসবে। নিজের স্বামীকে তালাক দিয়ে, সৎ মেয়ের ফিয়োন্সেকে বিয়ে করে নিলো এক লোভী মহিলা। দুইটা আপদ থেকে মুক্ত হলো মিস ওয়াসিকা কবির আহি।”

“হিপ হিপ হুররে।”

“সিরিয়াসলি লিনু, কাল হুট করে আমার মাথায় এই উদ্ভট বুদ্ধিটা কীভাবে যে এলো! যদিও খুব খারাপ বুদ্ধি। কিন্তু এদের নিয়ে ভালো কোনো চিন্তায় আমার মাথায় আসে না। এরা সবাই স্বার্থপর। এবার আমি একটু স্বার্থপর হয়ে নিজেকে বাঁচাই। আর ওই তাজওয়ার খান এখনো আমার স্বামী হয় নি। এর আগেই যদি একটা সেট আপ করতে পারি, তাহলে আমি আমার বাবাকে ফিরে পাবো। আর ওই তাজওয়ার খানকেও আর বিয়ে করতে হবে না।”

“ইনশাআল্লাহ তোর ইচ্ছেটা যাতে পূরণ হয়। চিন্তা করিস না। আমি তোর পাশে আছি। ওই তাজওয়ারকে আমি আমার দুলাভাই বানাবো না। আমার দুলাভাই হবে সুইট।”

আহি হাসলো। বলল,
“দুলাভাই টুলাভাই হবে না। আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। মায়ের কাছে যেতে পারলে, আমি মায়ের সাথেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো।”

“বিয়ে না করে থাকা যায় না। বিয়ে তো সমাজেরই একটা নিয়ম। সমাজে থাকলে বিয়ে করতেই হবে। তোর কোনো পছন্দ নেই?”

আহি মলিন হাসলো আর বলল,
“আপতত তো নেই।”

লিনাশা আহির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি খুঁজে এনে দেবো। দেখিস, রাজকুমার আসবে আমার টুনুমুনুর জন্য।”

আহি চোখ বড় বড় করে বলল, “টুনুমুনু!”

“মনে আছে, আমাদের কলেজের আমিনা ম্যাম তোকে টুনুমুনু বলে ডাকতো! কিছুদিন আগে ম্যামের সাথে দেখা হয়েছিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। আরো বলছিলো, উনার ছেলে না-কি বেশ নামকরা উকিল। বউ খুঁজছে ছেলের জন্য।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমিনা ম্যাম? পুষ্পের চাচী?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। উনিই। পুষ্পের কথাও জিজ্ঞেস করলো।”

“উনার ছেলেই হয়তো উজ্জ্বল। উজ্জ্বল পুষ্পের কাজিন। উনিই আমাকে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছেন। উনার কারণেই আমার কনফিডেন্স বেড়েছে।”

“তাই না-কি! ছেলেটা দেখতে কেমন রে?”

“আছে, ঠিকঠাক।”

“হুম হুম, তোর সাথে মানাবে তো?”

“লিনু, প্লিজ। আমি ওভাবে চিন্তা করি নি।”

“রাদকে নিয়ে কি চিন্তা করিস?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এখানে রাদ এলো কেন?”

“নায়ীব বললো, রাদ বেশ কেয়ার করে তোর।”

“রাদ আমার বন্ধু। শুধু বন্ধু না, খুব ভালো বন্ধু।”

“বন্ধুত্বে কি প্রেম হয় না? জ্ঞানী-গুণীদের মতে ছেলে-মেয়ে শুধু বন্ধু থাকতে পারে না। তারা প্রেমে পড়েই।”

“আমি তো পড়ি নি।”

“তোর মাথাটা ঘেঁটে আগের স্মৃতিগুলো বের করতে হবে। দেখিস, তারপর প্রেমে পড়বি।”

“না রে, প্রেমে আর পড়তে চাই না। এবার যদি কিছু হয় দায়িত্ববোধ থেকেই হোক। অনেকে তো দায়িত্ব নিয়েই মায়ায় জড়ায়। কিন্তু প্রেম বড্ড খারাপ রোগ। একবার প্রেমে পড়লে অনেক কষ্ট পেতে হয়। মানুষটার দেওয়া সব আঘাত মনে হয় পাহাড়ের চেয়েও ভারী, সমুদ্রের চেয়েও গভীর, পাথরের চেয়েও শক্ত। প্রেমে আর পড়তে চাই না। এবার কেউ অধিকার বোধ নিয়েই হাত এগিয়ে দিক। অন্তত প্রেম না থাকলেও বলতে পারবো, মানুষটা আমার। আমার মানুষ, আমার স্বামী, আমার বলতে যেই শান্তিটা অন্যদের পেতে দেখেছি, শুধু সেই শান্তিটা অনুভব কর‍তে চাই। নয়তো দেখা যাবে, আবার প্রেমে পড়েছি, আর মানুষটা হাত ছেড়ে দিলো। সে অন্যের হাত ধরে সুখী হলো, আর আমি আবার সেই অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম।”

লিনাশা আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনমিনিয়ে বললো,
“আমার জীবনে আর কেউ প্রেম হয়ে না আসুক।”

(***)

পলি আপু আজ অনেক বছর পর একত্র হয়েছে। চারজনের চেঁচামেচিতে একপাশে চুপচাপ বসে আছে নায়ীব, রাদ, লাবীব আর আফিফ। আলাদা টেবিলে বসেছে তারা। লিনাশা, আহি, পদ্ম আর পুষ্প নিজেদের সাথে তাদের বসতে দেয় নি। পদ্মের শাশুড়ি আফিফা বেগম পুত্রবধূকে একা বের হতে দেওয়া পছন্দ করেন না। তিনি বেশ রক্ষণশীল মানুষ। তাই আফিফকে বাধ্য হয়ে পদ্মকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসতে হলো। এদিকে আফিফ আসবে শুনে লিনাশা নায়ীবকে সাথে নিয়ে এসেছে। আর পুষ্প তো লাবীবকে ছাড়া কোথাও যায় না। আর লাবীব আর আহি যেখানে যাচ্ছে রাদ তো যাবেই।
মোটামুটি হট্টগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে চার বান্ধবী। পুষ্পের চঞ্চল স্বভাবটা তার হাঁটা-চলায় দৃশ্যমান। কিন্তু পদ্মকে এমন উচ্চস্বরে হাসতে দেখে আফিফ রীতিমতো ঘুরেফিরে দেখছে। তবে এসবের মধ্যে আহিকে অনেকটা শান্ত দেখাচ্ছে। বরাবরের মতোই তার চঞ্চলতা থামিয়ে দেওয়ার জন্য আফিফের এক দর্শনই যথেষ্ট ছিল। নায়ীবও আজ সামনা-সামনি তার রোগীকে আক্রমণ করা ভাইরাসটিকে আবিষ্কার করলো। সে একবার রাদের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার আফিফের দিকে। নায়ীবের এবার বেশ অস্বস্থি লাগছে। তার আশেপাশে এতো এতো মানসিক রোগী যে তার এই মুহূর্তে নিজেকেই রোগী মনে হচ্ছে। আফিফের চোখ-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ মানসিক চাপে আছে, রাদের চোখেমুখেও উদ্বেগ। একমাত্র লাবীবকে দেখেই দু’দণ্ড কথা বলার ইচ্ছে জাগলো নায়ীবের। কিন্তু লাবীব একটু বেশিই ফুরফুরে মেজাজে আছে। সে ব্যস্ত ফোনে গেইমস খেলায়। তা দেখে কৌতুহল নিয়ে নায়ীব রাদকে জিজ্ঞেস করল,
“রাদ, তুমিও কি ফোনে গেইমস খেলো?”

রাদ অবাক হয়ে নায়ীবের দিকে তাকালো। লাবীব নায়ীবের প্রশ্নে ফোন বন্ধ করে একপাশে রেখে দিলো। তার মনে হলো, নায়ীব তাকে খোঁচা মেরে বলেছে। কারণ রাদের কাছেই শুনেছে, নায়ীব একজন ডাক্তার। লাবীবের মনে হয়, ডাক্তাররা বেশিক্ষণ ফোন চালানো পছন্দ করে না। কারণ লাবীবের বাবাও একজন ডাক্তার। তিনি যখনই ঘরে আসেন, লাবীবকে ফোন না চালিয়ে বাইরে ঘুরে আসতে বলেন। লাবীবের কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে বাবার সামনে বসে আছে। সে মনে মনে বলল,
“আমাকে এ কোন গম্ভীর গোল টেবিল বৈঠকে বসিয়ে দিয়েছে, পুষ্প। মনে হচ্ছে আংকেলদের ভীড়ে বসে আছি। বেশি দেরী হলে হয়তো এখানেই ঘুমিয়ে যাবো।”

এদিকে নায়ীব রাদের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। রাদ লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আমিও খেলি।”

নায়ীব এবার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি খেলেন?”

আফিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, “না!”

নায়ীব লাবীবকে ইঙ্গিত করে বলল,
“ওকে দেখে মনে হলো, বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। আর আমার দু’পাশে বসা বাকি দুই জন বেশ গম্ভীর। তাই জানার ইচ্ছে হলো, শুধু ফুরফুরে মেজাজের মানুষগুলো গেইমস খেলে না-কি গম্ভীর মানুষেরাও খেলে। রাদ যখন বললো, খেলে। তখনই বুঝলাম, গেইমস খেলা না খেলা নিয়ে কারো মনের অবস্থা বোঝা যায় না।”

আফিফ আর রাদ এবার স্বাভাবিক হয়ে বসলো। নায়ীব তা দেখে মুচকি হাসলো। আফিফ পরিচয় পর্ব দিয়েই কথাবার্তা শুরু করল। এবার রাদ আর লাবীব হাঁ করে অপর দুই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ আর নায়ীব বেশ জমিয়ে কথাবার্তা বলছে। পদ্ম সেটা খেয়াল করে বলল,
“আমাদের মতো ওদের মধ্যেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।”

লিনাশা এক বার আফিফের দিকে তাকালো। আরেকবার নায়ীবের দিকে। বেশ রাগ উঠলো তার। ইচ্ছে করছিলো নায়ীবের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিতে, আর আফিফের ঠোঁটে আলতারাপ লাগিয়ে দিয়ে বলতে,
“আমার বান্ধবীকে কাঁদিয়েছিস, খচ্চর পোলা। এখন আমার হবু বরের সাথে ভাব জমাচ্ছিস? তুই কখনো আমার বরের বন্ধু হতে পারবি না। শুধু আহির বরই আমার বরের বন্ধু হবে। ইচ্ছে তো করছে স্টেপলার দিয়ে মুখটা একদম বন্ধ করে দিতে।”

আহি লিনাশার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল,
“মনে মনে কাকে গালি দিচ্ছিস?”

“তুই কীভাবে বুঝলি?”

“বাক্য উচ্চারণ না করলেও তোর এক্সপ্রেশন দেখলে যে কেউ বুঝবে।”

লিনাশা হেসে বলল,
“আমার মায়ের প্রথম সন্তানের বোনের দুলাভাইয়ের প্রাক্তন শাশুড়ির ছেলের বোনের মেয়ের জন্য দোয়া করছি, যাতে খারাপ দৃষ্টি থেকে মুক্তি পায়।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে লিনাশার প্যাঁচানো সম্পর্কটা মেলানোর চেষ্টা করছে। যদিও আহি বুঝতে পেরেছে, মেয়েটা আহি নিজেই। কিন্তু সম্পর্কের সূত্রটা মেলানোর আগ্রহ দমাতে পারলো না সে। বেশ আগ্রহ নিয়েই সে সম্পর্ক মেলাচ্ছে। এর মধ্যে পদ্ম আর পুষ্পও যোগ দিয়েছে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪১||

৮১।
ভাংচুরের শব্দে আহির ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে বিকেল তিনটা। দুপুরে নামাজ পড়েই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিল সে। বেশিক্ষণ ঘুমোতেই পারলো না। মেঝেতে পা রাখতেই ভয়ংকর চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেলো।
“আল্লাহ গো, ও আল্লাহ গো,” বলতে বলতে চুনি আহির রুমের কাছে দৌঁড়ে এলো। আহির বুক কেঁপে উঠলো। সে দ্রুত দরজা খুলে দিতেই চুনি এসে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চুনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? এমন করছো কেন?”

“আফা, বাঁচান স্যার রে। খুন কইরা ফেলবো তারা। দুই জনের মাথায় গরম হইয়া আছে।”

আহি চুনিকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “নিচে হচ্ছেটা কি?”

চুনি কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“তাজওয়ার ভাইজান আর স্যারের মধ্যে মারামারি লাগছে। ম্যাডাম, ইস, কি বিচ্ছিরি কামডাই না কইরলো। স্যারের মাথাটা গরম হইয়া আছে। তাজওয়ার ভাইজান রে মারতাছে। আর ভাইজান কি কম? হে-ও স্যারের মাথা ফাটাইয়া দিছে। রক্ত বাইর হইতাছে। তবুও কেউ কাউরে ছাড়ে না। আম্মাও ঘরে নাই। বাজার করতে গেছে চাচার লগে। ঘরে কেউ নাই, আফা। আমার ভয় করতাছে।”

আহি শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুমি আমার রুমে বসে থাকো। কিছু হবে না। এদের কাজই মারামারি করা। এরা কি আমাদের মতো ভালো? সবগুলোই হিংস্র পশু।”

আহি চুনিকে নিজের ঘরে রেখে নিচে নামতেই দেখলো মিসেস লাবণি অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। এলোমেলো চুল, শার্টের বোতামগুলোও খোলা। ভেতরের গেঞ্জিতে রক্তের দাগ। আহি নিচে নেমে মিসেস লাবণিকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“কি হয়েছে? শার্ট-প্যান্ট পরে ইফতারের আগে কোথায় যাচ্ছিলেন? আর আপনার এমন অবস্থা কি করে হলো?”

লাবণির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে আহির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। কারণ শব্দগুলো ওই রুম থেকেই আসছিল। আহি দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখলো তাজওয়ার আর তার বাবা দু’জন দুই সোফায় বসে আছে। তাজওয়ারের হাতে টিস্যু। সে নাক থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত পরিষ্কার করছে। এদিকে তার বাবা রিজওয়ান কবিরের কপাল ফুলে গেছে। গালটাও লাল হয়ে আছে। আহি খুব শান্ত ভঙ্গিতে মাঝখানের সোফায় গিয়ে বসলো। তাজওয়ার আহির দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আহি বুঝতে পারছে তাজওয়ার এখনো বেশ রেগে আছে। এবার আহি রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। তাকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখে-মুখে ভেসে উঠেছে অপমানবোধ। আহি বলল,
“কি হলো, তোমরা মারামারি করলে কেন? বাবা যদি বিয়ের আগেই মেয়ের জামাইয়ের গায়ে হাত তুলে, তাহলে কি বিষয়টা সুন্দর দেখায়?”

তাজওয়ার আহির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। আহি তার পক্ষ নিয়েছে, তাই তার বেশ ভালোই লাগলো। কিন্তু রিজওয়ান কবির ক্ষেপে গেলেন। রাগী স্বরে বললেন,
“তোমার ফিয়োন্সে আমার গায়ে হাত তুলেছে। তোমার বাবার গায়ে হাত তুলেছে। আর তুমি আমাকে এই প্রশ্ন করছো?”

“ছেলেটা তো তোমার পছন্দের। আমাকে কেন এই প্রশ্ন করছ? সব জেনে-শুনেই তুমি আমাকে তার হাতে তুলে দিচ্ছো। মার খাওয়ার মতো অধিকার নিজেই আদায় করে নিচ্ছো।”

তাজওয়ার আহির পাশে এসে বসলো। রিজওয়ান কবির তা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
“তুমি আমার মেয়ের কাছে আসবে না। আমি আর এই বিয়ে হতে দেবো না।”

তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি আর আমার বিয়েতে কেউ বাঁধা দিলে, আমি তাকেই আমার পথ থেকে সরিয়ে দেবো।”

আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বেশ তো। মেরে ফেলো। আমার বাবাকে মারতে চাও তো? কিন্তু তার আগে আমাকে মেরে ফেলো। তোমাকে আমি ভালোবাসি না। তাও মনে হচ্ছিলো, অন্তত আমার ব্যাপারে তুমি সিরিয়াস, সেই বিশ্বাস থেকেই তোমাকে এই কয়েক সপ্তাহ ধরে বোঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি বার-বার আমাকে ভুল প্রমাণ করেছো। আর এখন তুমি আমার বাবার গায়ে হাত তুলে, আমার পাশে এসে বসার সাহস দেখাচ্ছো কীভাবে?”

“আহি, লিসেন।”

“এখনি আমার বাবার কাছে ক্ষমা চায়বে। এরপর আমি শুনবো, কি হয়েছে, আর কার কতোটা অপরাধ।”

“আগে শোনো। কারণ এখানে আমার কোনো দোষ নেই।”

আহি শীতল কন্ঠে বলল,
“আমারও কোনো দোষ ছিল না, তবুও বাবা অনেক বার আমার গায়ে হাত তুলেছে। আমার মায়েরও কোনো দোষ ছিল না, তবুও এই মানুষটাই আমার মাকে পিটিয়েছে। কিন্তু আমি তো কখনো আমার বাবার গায়ে হাত তুলি নি। এতো এতো অপরাধ করার পরও কখনো গলা উঁচু করে তাকে কিছু বলি নি। তাহলে তুমি কে, আমার বাবার গায়ে হাত তোলার?”

তাজওয়ার রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সরি। আমার কোনো অপরাধ ছিল না। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।”

রিজওয়ান কবির মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাজওয়ার আহির কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“আমার কিছুই আসে যাই না, তোমার বাবা আমাকে বিশ্বাস করলো, কি করলো না। কিন্তু তোমার আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।”

“কি হয়েছে, সেটা বলো।”

তাজওয়ার পুরো ঘটনা আহিকে বলতে লাগলো।

(***)

দুপুরে আহির সাথে দেখা করার জন্য বাসায় এলো তাজওয়ার। বেল দিতেই চুনি দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। তাজওয়ার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। এরপর আহির রুমের দিকে পা বাড়াতেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো মিসেস লাবণি। লাবণিকে দেখে তাজওয়ার কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আমার মিসেস এর সাথে দেখা করতে এসেছি। নিশ্চয় এর জন্য অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই!”

লাবণি খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এনি প্রবলেম?”

লাবণি তাজওয়ারের হাত ধরে তাকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। তাজওয়ারও বিনাবাক্যে লাবণির সাথে চলে গেলো। রুমে ঢুকেই লাবণি তাজওয়ারকে তার বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তার সামনে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“আহি তো তোমাকে পছন্দ করে না। হয়তো তোমার এমন কাউকে বেছে নেওয়া উচিত, যে তোমাকে পছন্দ করে।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“যে আমাকে পছন্দ করে, আমার তাকেই পছন্দ হয় না। তাজওয়ার খান ইউনিক জিনিস খুব পছন্দ করে। আর আমার কাছে আমাকে পছন্দ না করাটাই সবচেয়ে ইউনিক। কারণ সবাই আমাকে ভালোবাসতে চায়, আর আমি শুধু আহিকে ভালোবাসতে চায়।”

লাবণি তার শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে দিয়ে বলল,
“তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে পছন্দ করি?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এক্সকিউজ মি। আপনাকে নিয়ে আমি এমন কিছুই ভাবি নি।”

তাজওয়ার কথাটি বলেই উঠে চলে যেতে নেবে তখনই লাবণি তাজওয়ারকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি আহিকে বিয়ে করো, আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি চাই, আমাদেরও একটা সম্পর্ক হোক।”

তাজওয়ার লাবণির দিকে ফিরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি মানুষকে দেখেই বুঝে যায়, সে কেমন। আপনাকে দেখেও আমার এমন একটা ধারণা হয়েছিল। কিন্তু এতো বছর পর সেই ধারণা প্রমাণিত হবে, তা আমি ভাবি নি।”

“দেখো, তুমি চাও আহিকে। আর আমি চাই তোমাকে। তোমার আর আমার এখানে কোনো ক্ষতি নেই। আহির সাথে তোমার বিয়ে হলে, তুমি এমনিতেই আহিকে পাচ্ছো। আর তোমার বাবাও দু’টো বিয়ে করেছে। তুমিও চাইলে করতে পারো।”

“আপনি আহির মা।”

“আমি আহির আপন মা নই। আর আমি রিজওয়ানকে তালাক দিয়ে দেবো। ওর সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবো না।”

তাজওয়ার হেসে বলল,
“আমার রুচি এতোটাও খারাপ নয়। আমি কারো স্পর্শ করা জিনিসে হাত দেই না। আমার জীবনে আসা সব কিছুই নতুন।”

লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আহি কোনো নতুন মানুষ নয়। তুমি কি জানো, আহি অন্য একজনকে ভালোবাসে?”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“জানি। কিন্তু আমার তো আহির ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। আমিই ওকে ভালোবাসবো।”

লাবণি তাজওয়ারের কথায় বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি এতোটা ইমোশনাল হবে, সেটা আমি ভাবি নি।”

“লিসেন, মিসেস লাবণি। আহি সম্পর্কে আমাকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করবেন না। আর আপনার সম্পর্কে তো কিছু জানারই বাকি নেই। আজ সবটাই খোলাসা হয়ে গেছে। আপনি আগ্রহী হলে আমি আমার বন্ধু হ্যারি, সজিব আর জিলানের সাথে কথা বলতে পারি। কিন্তু আমি আপনার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন করতে পারবো না।”

লাবণি তাজওয়ারের হাত ধরতেই তাজওয়ার তাকে সরিয়ে দিলো। এরপর দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিবে তখনই লাবণি তাকে আবার পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো। আর তখনই রিজওয়ান কবির তাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

রিজওয়ান কবির ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণি তাকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই রিজওয়ান কবির তাজওয়ারের কলার ধরে তাকে রুম থেকে টেনে বের করে আনলো। তাজওয়ার কবির সাহেবের এমন ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে গেলো। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আহিকে ডাকতে যাবে, তখনই রিজওয়ান কবির তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে নিচে ফেলে দিলো। তাজওয়ার ভারসাম্য হারিয়ে একদম নিচে গিয়ে পড়লো। রিজওয়ান কবির এবার নিচে নেমে তাজওয়ারকে মারার জন্য এগিয়ে যেতেই লাবণি তার হাত ধরে বলল,
“আমাদের ভুল বুঝছো তুমি?”

রিজওয়ান কবির সশব্দে লাবণির গালে চড় বসিয়ে দিলেন। লাবণিও ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। রিজওয়ান কবির এবার তাজওয়ারকে ইচ্ছেমতো ঘুষি মারলেন। তাজওয়ারের রাগ এবার সীমা ছাড়িয়ে গেলো। সে পালটা আক্রমণ করে বসলো রিজওয়ান কবিরের উপর। দু’জন কেউ কাউকে ছাড়ছে না। লাবণি আটকাতে গেলে দু’জনই তার উপর চড়াও হয়ে যায়। তাই ভয়ে লাবণি সরে দাঁড়ালো। এদিকে চুনি এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে আহিকে ডাকতে চলে গেলো।

(***)

আহি তাজওয়ারের মুখে এমন কথা শুনে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। তিনি চুপ করে বসে আছেন। ভালোবেসেই তো লাবণিকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। যেই নারীর প্রেমে অন্ধ হয়ে প্রথম স্ত্রী, সালমা ফাওজিয়াকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আহির ইচ্ছে করছে বাবার উপর পরিহাস করতে। কিন্তু আহি করলো না। সে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“বাবা, তোমার কি মনে হয়, তাজওয়ার মিথ্যে বলছে? তোমার সামনেই তো সব বললো। তুমি কি অন্য কিছু দেখেছিলে?”

রিজওয়ান কবির চুপ করে আছেন। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বাবার তো এখানে কোনো দোষ নেই। স্ত্রীর এমন কীর্তি-কাণ্ড দেখে কোনো স্বামীই স্বাভাবিক থাকতে পারে না। আর এর জন্য তাজওয়ারকে ভুল বুঝে তার গায়ে হাত তোলাও রাগেরই প্রকাশ ছিল। কিন্তু তাজওয়ার, তুমি বাবার গায়ে হাত তুলে ভুল করেছো।”

তাজওয়ার রিজওয়ান কবিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে পড়লো। রিজওয়ান কবিরও চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। আহি ধীর পায়ে হেঁটে সিঁড়িতে বসে পড়লো। তার চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে সিঁড়ির হাতলে হাত রেখে বলল,
“কিছু বছর আগে, তোমাকে বাবা এভাবেই মেরেছিলো। জানো মা, আমি এতোটাই অবুঝ ছিলাম, এতোটাই দুর্বল ছিলাম যে তোমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসতে পারি নি৷ মানুষটা তোমাকে মেরে কি সুন্দর আবার স্যুট-কোট পরে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতো। কখনো তার গায়ে কেউ হাত তুলতে পারে নি। কিন্তু আজ তাজওয়ার আমার মনটা শান্ত করে দিয়েছে। আমার আজ এতো ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে, আমি আমার মায়ের উপর অত্যাচার করার একটুখানি শোধ তো তুলতে পেরেছি। তাজওয়ারও শাস্তি পেয়েছে। সেদিন আফিফকে বিনা অপরাধে মারার শাস্তি। এভাবে পাপীগুলো নিজেদেরই যদি শেষ করে দেয়, তাহলে কোনো পাপীই আমার জীবনে থাকবে না।”

(***)

লাবণি থম মেরে রিজওয়ান কবিরের পাশে বসে আছে। রিজওয়ান কবির চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছেন। আজকের দৃশ্যটা ভুলতেই পারছেন না তিনি। লাবণি নিরবতা ভেঙে বলল,
“আমার নিয়ত খারাপ ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। এমন কিছু হয়ে যাবে আমি নিজেও ভাবতে পারি নি। আগে জানলে তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে এমন কিছু করতাম। ভেবেছি, আমার প্ল্যানটা তোমাকে রেজাল্ট আসার পর বলবো।”

রিজওয়ান কবির ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালেন। লাবণি বলল,
“আহি একদিন আমাকে এসে বলেছিল, তাজওয়ার না-কি সব মেয়েদের সাথেই অবৈধ সম্পর্ক রাখে। মনে আছে, সরওয়ার বাসায় এসে চুনির সাথে কেমন ব্যবহার করেছিল? আহিই বললো, বিয়ের পর তাজওয়ার যদি চুনি বা আমার সাথে এমন কিছু করতে চায়? তোমার এক সময় বয়স বাড়বে। তখন কি তুমি আর আমাকে প্রটেক্ট করতে পারবে? তাই আমি শিউর হওয়ার জন্য এই নাটক সাজিয়েছি। দেখতে চেয়েছি, আমাকে একা পেলে তাজওয়ার খারাপ কিছু করে কি-না।”

রিজওয়ান কবির উঠে বসলেন। লাবণি চোখের পানি মুছে বলল,
“আমার বুদ্ধিটা হয়তো খারাপ ছিল। কিন্তু ইন্টেনশন খারাপ ছিল না।”

রিজওয়ান কবির লাবণির হাত ধরে বললেন,
“তুমি আমাকে আগে বলো নি কেন?”

“তুমি আমার কথা শুনছিলে? আমাকে চড় মারলে। তাজওয়ারকেও মারলে। ছেলেটা আমাকে এখন কি ভাববে? আমি ভেবেছি, ওর পরীক্ষা নেওয়ার পর, সত্যটা ওকে জানিয়ে দেবো। তোমার জন্য, ও আহির চোখে আরো খারাপ হয়ে গেলো। সাথে আমিও।”

রিজওয়ান কবির শান্ত কন্ঠে বললেন,
“সরি, লাবণি। তোমাকে ভুল বুঝেছি। আমি এক্ষুণি তাজওয়ারকে ফোন করে সত্যটা জানাচ্ছি।”

“জানাতে হবে না। পরে দেখা হলে বলো। এখন ওর মাথাটা খারাপই থাকবে। এসব শুনলে আরো রেগে যাবে। বলবে আহি ওকে বিশ্বাস করে না। আমাকে যা ভাবার ভাবুক, অন্তত আহির সাথে তাজওয়ারের সম্পর্ক ঠিক থাকুক।”

রিজওয়ান কবির লাবণিকে জড়িয়ে ধরলেন। লাবণি মনে মনে হাসলো আর বলল,
“অন্তত এই ওল্ড ফুলকে হাতে রাখা সহজ। কিন্তু তাজওয়ার যে এতোটা অনেস্ট হবে, এটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

(***)

আহি লিনাশাকে ফোন করে আজকের পুরো ঘটনা বলার পর বললো,
“লিনু, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তাজওয়ার এতোটা লয়াল হবে।”

“আমারও। আমার মনে হচ্ছে, ওর প্ল্যান তোকে বিয়ে করা। তাই হয়তো লাবণিকে পাত্তা দেয় নি। কারণ আর যাই হোক, তোর বাবার ওয়াইফ।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কি ভেবেছি, আর কি হয়ে গেলো। ভেবেছি লাবণি যদি তাজওয়ারকে ফাঁসিয়ে ফেলে। দু’জনই আমার পথ থেকে সরে যাবে। কিন্তু এই তাজওয়ার তো আমার পিছুই ছাড়ছে না। আমি না, তাজওয়ারকে বুঝতেই পারছি না। ওর এতোগুলো মুখোশ? কোনটা রিয়েল, কোনটা ফেইক, কীভাবে বুঝবো?”

“এসব বাদ দে। ফেইক আর রিয়েল যাই হোক, আমার সাজেশন, ওই ছেলেকে কোনোভাবেই বিয়ে করা যাবে না। ফার্জিয়া নামের যেই মেয়েটা তোকে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলো, ওই মেয়েটাই এর সবচেয়ে বড় কারণ। যে ছেলে নিজের স্বার্থের জন্য মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলছে, সে কখনোই পারফেক্ট লাইফ পার্টনার হতে পারে না।”

“এখন কি করবো?”

“আপতত চুপ থাক। দেখ কি হয়। মিসেস লাবণি ভীষণ চালাক। তোর বাবাকে এতোক্ষণে ভংচং বুঝিয়ে দিয়েছে। তোর বাবাও দেখবি সব গিলে ফেলবে।”

“যাহ, হাতেনাতে ধরা খাওয়ার পর, বাবা উনাকে বিশ্বাসই করবে না!”

“শোন, সবাইকে নিজের মতো ভাবিস না। যারা ধূর্ত হয়, তারা যে-কোনো মূল্যে নিজের কথার জালে অন্যকে ফাঁসিয়ে ফেলতে পারে। যেটা লাবণির দ্বারা সম্ভব।”

লিনাশার কথায় আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। যদি এবার পরিকল্পনাটা সফল না হয়, তাহলে অন্য কিছু করতে হবে তাকে।

(***)

দেখতে দেখতে ইদ চলে গেলো। ইদের এক সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হলো লিনাশা আর নায়ীবের বিয়ের প্রস্তুতি। বিয়ের কার্ড পছন্দ করে এসেছিলো দুই পক্ষই। ছাপানো শেষ। কয়েকদিনের মধ্যে কার্ডও বিলি করা শেষ। দুই সপ্তাহ পর আনুষ্ঠানিকভাবে লিনাশাকে উঠিয়ে নেওয়া হবে। আজ তাদের আনুষ্ঠানিক এনগেজমেন্ট। একটা রেস্টুরেন্টে সব আয়োজন করা হয়েছে। দায়িত্ব আহি আর রাদ নিয়েছে। সন্ধ্যায় এনগেজমেন্ট৷ ডেকোরেশনের কাজ দেখে আহি একপাশে এসে বসলো। তার পাশে এসে বসলো রাদ।

খোলা ছাদ, অন্ধকার আকাশ, সাদা মেঘ, শীতল হাওয়া, মুহূর্তটা বেশ ভালো লাগছিল আহির। আহি চোখ বন্ধ করে কৃত্রিম সাজসজ্জার ভীড়ে প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা অনুভব করতে লাগলো। তখনই তার কাঁধে মাথা রাখলো রাদ। আহি পাশ ফিরতেই দেখলো রাদের চোখ বন্ধ। আহি বলল,
“ঘুমিয়ে গেলি না-কি!”

রাদ চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। এভাবেই সে শান্তি পাচ্ছে। আহির সাথে এমন মুহূর্ত কাটানো যদি তার ভাগ্যে বাকি জীবনের জন্যও লেখা হয়ে যেতো, তাহলে মন্দ হতো না।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৮২।
গোলাপী বর্ণের লেহেঙ্গা পরে স্টেজে উঠে বসলো লিনাশা। লজ্জা মাখা দৃষ্টিতে সে একটু পর পর তার পাশে বসা নায়ীবকে দেখছে। সাদা শার্টের উপর গোলাপী কোট পরেছে নায়ীব। দু’জনের চোখে-মুখে লাজুকতা। পুষ্প স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“ডাক্তার সাহেবের মনের অবস্থা তো চরম! মনে হচ্ছে তিনি হবু বউকে দেখে অসুস্থ হয়ে গেছেন।”

পদ্ম পুষ্পের হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“বেশি কথা বলিস তুই। চুপ কর।”

এদিকে আহি আজ গাউন পরেছে। সাদা রঙের নেট স্লিভের গাউন। চুলগুলো খোঁপা করেছে সে। আহিকে দেখে লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহিকে দেখে তো রানী এলিজাবেথের নাতনি মনে হচ্ছে।”

পুষ্প লাবীবের কথা শুনে চোখ ছোট করে বলল,
“আর আমাকে?”

“মিকি মাউস।”

“কি!”

“তুমি তো ডল, তাই ডলের সাথে তুলনা করলাম।”

“ওটা একটা কার্টুন!”

“তুমি কার্টুনই তো!”

পুষ্প নাক ফুলিয়ে হনহন করে অন্যপাশে চলে গেলো। এদিকে পদ্ম চুপচাপ একপাশে বসে আছে। আফিফের পছন্দমতো সাদা শাড়ি পরে এসেছে সে। কিন্তু আফিফকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পদ্ম এদিক-ওদিক আফিফকে খুঁজতে লাগলো।

(***)

আহি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই, কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে তার হাতে থাকা আংটির বক্সটা হাত ফসকে পড়ে গেলো। আহি মুখে হাত দিয়ে সিঁড়ি থেকে বক্সটা হাতে নিয়ে দেখলো ভেতরে কোনো আংটি নেই। আহি করুণ দৃষ্টিতে তার সামনে থাকা মানুষটির দিকে তাকালো। আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“সরি। আমি তোমাকে খেয়াল করি নি।”

আহি আর কিছু না বলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়লো। আফিফ আহিকে বসতে দেখে নিজেও বসে পড়লো আর জিজ্ঞেস করলো,
“কি করছো?”

আহি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“পাগল আপনি? নায়ীব ভাইয়ার আংটিটা হারিয়ে ফেলেছি আমি। আপনার সাথে ধাক্কা খেয়ে বক্স থেকে পড়ে গেছে আংটিটা। এই আংটির দায়িত্ব লিনাশা আমাকে দিয়েছে। যদি আংটি হারিয়ে যায়, কি হবে জানেন?”

আফিফ ব্যস্ত হয়ে আংটিটা খুঁজতে লাগল। আহিকেও বেশ অস্থির দেখাচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন লিনাশার মা, রুনা খানম। তিনি আহিকে বললেন,
“নায়ীবের রিংটা দাও তো!”

আহি ভীত চোখে রুনা খানমের দিকে তাকালো। তিনি আহির হাতে বক্সটা দেখে সেটা হাতে নিয়ে নিলেন। আফিফ তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। তিনি আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে বক্সটি খুলে দেখলেন, সেখানে কোনো আংটি নেই। তিনি এবার রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালেন। এমনিতেই তিনি আহির উপর ক্ষ্যাপা। লাবণি রিজওয়ান কবিরের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি আহিকে অপছন্দ করেন। কারণ আহির বাবার জন্যই তার সংসারটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লিনাশা অনেক কষ্টে মাকে রাজি করিয়েছে, আর আহির উপর রাগ না দেখাতে বলেছে। রুনা খানম মেয়ের জোরাজুরিতেই আহিকে সহ্য করছেন। কিন্তু আংটির দায়িত্ব আহিকে দেওয়াটা তার পছন্দ হয় নি। এই মুহূর্তে বক্সে আংটি না দেখে তিনি আর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। রাগী স্বরে বললেন,
“আংটি কোথায়?”

আহি মাথা নিচু করে বলল,
“এখানেই কোথাও পরেছে। হাত ফস্কে বক্সটা নিচে পড়ে গিয়েছিল। আমি এক্ষুণি খুঁজে দিচ্ছি।”

“তুমি এতোটা কেয়ারলেস হবে, তা আমি ভাবি নি। আর তোমার কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু আশাও করা যায় না। আমার মেয়ের জীবনে আবার কেন এসেছো? ওর নতুন জীবন এলোমেলো করতে? আমার একটা মেয়েকে তো তোমার বাবা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আর একটাই মেয়ে আছে, তাকে তো অন্তত শান্তিতে বাঁচতে দাও।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বলল, “সরি, আন্টি।”

রুনা খানম ধমকের সুরে বললেন,
“সবার জীবনের একমাত্র কাঁটা তুমি। তুমি যেখানে থাকবে, সেখানে শুভ কিছু হবেই না। আমি তো চাই নি তুমি বিয়েতে আসো। কিন্তু লিনাশা আমাকে জোর করেছিল, তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে সহ্য করতে হচ্ছে।”

আহি ঠোঁট চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আফিফের সামনে আন্টি তাকে অপমান করেছে এটা আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছে আহিকে। সে কিছু বলবে, তার আগেই আফিফ বলল,
“সরি আন্টি, আমার কারণেই বক্সটা ওর হাত থেকে পড়ে গেছে।”

“তুমি ওর সাফাই দিও না তো। সবার সিম্প্যাথি নিয়েই তো এখনো বেঁচে আছে।”

আফিফ আর কিছু বলতে পারলো না। লিনাশার মায়ের সাথে আজ তার প্রথম পরিচয়। এভাবে তাকে কিছু বলে দেওয়াটা অভদ্রতা। তাই সে বাধ্য হয়ে চুপ করে রইলো। রুনা খানম বক্সটা আহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“আংটি খুঁজে এনে দাও। নয়তো এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে যাও।”

আহি মাথা নেড়ে আংটি খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রুনা খানম চলে যেতেই আফিফ আহির সামনে বসে বলল,
“সরি, আহি।”

আহির চোখ ভিজে গেছে। আফিফ কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে আহির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে উঠে পদ্মের কাছে চলে গেলো। পদ্ম আফিফকে দেখে বলল,
“কোথায় ছিলেন আপনি?”

আফিফ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“একটা বড়সড় ঝামেলা হয়ে গেছে।”

আফিফ পদ্মকে সবটা জানাতেই পদ্ম আহির কাছে এলো। পদ্ম এসে দেখলো আহি একপাশে বসে নিরবে চোখের জল মুছছে। তা দেখে পদ্মের ভীষণ খারাপ লাগলো। সে আহির পাশে বসে বলল,
“চল, চলে যাই আমরা।”

আহি চোখ মুছে বলল, “কোথায়?”

“তোকে অপমান করা মানে, আমাদের অপমান করা। আমরা ভালো বন্ধু, আহি। আফিফ আংটি খুঁজে এনে দেবে। এরপর আমরা এখানে আর থাকবো না।”

“যাহ কি বলছিস! লিনু, কষ্ট পাবে।”

“পাক কষ্ট। ওর কষ্ট তোর চেয়ে বেশি হবে না। ওর জানা উচিত ওর মা ওর বেস্ট ফ্রেন্ডকে কিভাবে অপমান করেছে।”

আহি পদ্মকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি সত্যিই অশুভ। আমার এখানে আসা উচিত ছিল না।”

তখনই আফিফ আংটিটা খুঁজে এনে আহির সামনে ধরলো। পদ্ম আংটিটা নিয়ে বলল,
“আমি পুষ্পকে দিয়ে আসছি।”

পদ্ম উঠে চলে যেতেই আফিফ আহির পাশে বসলো। আহি রাগী স্বরে বলল,
“যাও এখান থেকে। তোমার জন্য আমাকে কথা শুনতে হয়েছে। এখন আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে হবে না।”

আফিফ কিছু না বলে উঠে চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই আহি নিজেই উঠে রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে এলো। এদিকে পুষ্প আর লাবীব আহির সাথে কি হয়েছে তা জানার পর আহিকে খুঁজতে লাগলো। রাদ লিনাশার কাজিনদের সাথে খাবারের আয়োজন দেখাশুনায় ব্যস্ত ছিল। উপরে উঠে সব শুনে সেও আহিকে খুঁজতে লাগলো। পদ্ম আফিফকে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি তো আপনার পাশেই ছিল।”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার কারণে আংটিটা নিচে পড়ে গিয়েছিল, তাই আহি আমার উপর রেগে ছিল। আমিও তাই আর ওকে বিরক্ত করি নি।”

পদ্ম কোমড়ে হাত রেখে বলল,
“ওকে শান্ত করার জন্য, ওর পাশে বসতে বলেছি, আর আপনি ওকে একা ছেড়ে এসেছেন? কোথায় গেছে এখন ও?”

“ফোন করে দেখো।”

পদ্ম ফোন করতেই দেখলো নম্বর ব্যস্ত। কারণ রাদও সেই মুহূর্তে আহিকে ফোন করছিল। এদিকে লিনাশা আর নায়ীবের আংটি বদল শুরু হবে। লিনাশা এদিক-ওদিক আহিকে খুঁজছে। আহি তো বহুদূর, তার কোনো বন্ধুদেরও সে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে না।

(***)

অনেকক্ষণ পর আহির ফোনে রাদের কল ঢুকলো। আহি জানালো, সে বাসায় চলে এসেছে। আহি চলে গেছে শুনে লাবীব আর পুষ্প বাসায়ও চলে গেলো। রাদ, আফিফ আর পদ্মও বের হয়ে গেছে। এদিকে লিনাশা কাউকে না দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রুনা খানম মেয়ের কাছে এসে বললেন,
“এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

“আহি, পুষ্প, পদ্ম কাউকে দেখছি না যে।”

রুনা খানম ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,
“চলে গেছে হয়তো।”

“মানে? চলে কেন যাবে?”

“তুই নায়ীবকে আংটি পরিয়ে দে৷ দেখ, কতো গেস্ট! এসব কথা পড়ে হবে।”

“একদমই না।”

লিনাশা ফোন বের করে আহিকে ফোন করলো। কিন্তু আহি ফোন ধরছে না। এবার সে পুষ্পকে কল দিলো। পুষ্প ফটফট করে সব লিনাশাকে জানিয়ে দিলো। সব শুনে লিনাশা স্টেজ থেকে নেমে নিচে চলে এলো। নায়ীব অবাক কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে? আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছো?”

“যারা আমার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমার মা যদি তাদেরই অপমান করে তাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমারও কোনো অধিকার নেই তাদের আয়োজনে আনন্দ করার।”

নায়ীব লিনাশার হাত ধরে বলল,
“দেখো, আমার ফ্যামিলিও আছে এখানে।”

রুনা খানম লিনাশার হাত ধরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দে, মা। প্লিজ এমন জেদ করিস না। আমি আহির কাছে ক্ষমা চাইবো।”

“আহি তোমার সাথে রাগ করে নি, মা। কিন্তু ওর মনে যেই ক্ষতটা সৃষ্টি হয়েছে, তুমি ক্ষমা চাইলেও সেটা মুছে যাবে না।”

(***)

নায়ীবের জোরাজুরিতে অশান্ত মনে এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান শেষ করলো লিনাশা। এরপর সে বাসায় এসে খুব কাঁদলো। আহি কষ্ট পেয়েছে, ভাবতেই তার কান্না পাচ্ছে। সারারাত ঘুমাতে পারে নি সে। কারণ আহির মনের অবস্থা এমনিতেই ভালো না। তার উপর মা আফিফের সামনেই তাকে অপমান করেছে। রাগ হচ্ছে মায়ের উপর। শুধু একটা আংটি হারানোর জন্য এতো কথা বলার কি খুব প্রয়োজন ছিল?

(***)

আজ লিনাশার হলুদ অনুষ্ঠান৷ লিনাশা মলিন মুখে ছাদে বসে আছে। কাউকে দাওয়াত করে নি সে। সে একা একাই না-কি গায়ে হলুদ করবে। রুনা খানম মেয়ের এমন জেদ দেখে আহিকে ফোন করলেন, আহির কাছে ক্ষমা চায়লেন, বাসায় আসতে বললেন। আহি আসলো না। রাদ কোনোভাবেই আহিকে যেতে দেবে না। সে আহির মন ভোলানোর জন্য তাকে নিয়ে চলে গেলো ফুচকার দোকানে। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বাইরে ঘুরে বাসায় ফিরলো আহি। বাসায় ঢুকেই ড্রয়িংরুমে লাবণির সামনে রুনা খানমকে দেখে বেশ অবাক হলো সে। রুনা খানম আহিকে দেখে তার কাছে এসে বললেন,
“দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। কোথায় ছিলে তুমি?”

“আন্টি, আপনি এখানে?”

“তোমাকে আসতে বলেছি, তারপরও কেন আসো নি?”

“আমি লিনাশার জীবনে কোনো ঝামেলা করতে চাই না।”

“দেখো আহি আমি যা বলেছি তা রাগ থেকে বলেছি। তুমি জানো, আমি স্বামী হারিয়েছি তোমার বাবার জন্য। তোমার উপর রাগ করে থাকাটা একদম স্বাভাবিক, তাই না? কিন্তু তোমাকে এমন করে বলাটা আমার ভুল হয়েছে। এখানে তোমার কোন দোষ নেই। কিন্তু আমি অতীতের সেই দিনগুলো এখনো ভুলতে পারি নি। যা আমি চাই নি, তা আজ আমাকে করতেই হলো। আমি অন্তত এই নির্লজ্জ মেয়ের মুখোমুখি হতে চাই না।”

রুনা খানম মিসেস লাবণির দিকে আঙ্গুল তাক করে কথাটি বললেন। মিসেস লাবনি হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন। রুনা খানম কাতর স্বরে বললেন,
“তোমাকে আমি খুব ভালবাসতাম, আহি। হয়তো তোমার বাবার জন্য তোমার প্রতি আমার একটা বিরক্ত চলে এসেছিল। আমাকে ক্ষমা করে দাও, মা। তুমিও যে ঠিক ততোটাই কষ্ট পাচ্ছো, যেমন কষ্ট আমরা পাচ্ছি, তা আমি বুঝতে পারি নি। আমার মেয়ের জন্যই তো তোমার বাবা তোমার মাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আমার একবারও মাথায় আসে নি, আমার সেই নির্লজ্জ মেয়ের জন্য তুমি কি হারিয়েছিলে। নিজের কষ্টটা এত বেশি বড় করে দেখে ফেলেছি যে অন্যের কষ্ট চোখেই পড়ে নি। খুব স্বার্থপর হয়ে গেছি, তাই না?”

আহি রুনা খানমের হাত ধরে বলল,
“এভাবে বলবেন না, আন্টি। আমি সত্যিই সব ভুলে গেছি।”

“তাহলে কাল সকালে লিনাশার হলুদে এসো। এখন থেকে অতীতের সব তিক্ততা আমি ভুলে যেতে চাই।”

(***)

পরদিন সকালে আহি লিনাশার বাসায় গেলো। নিজ হাতে লিনাশার বাড়ির ছাদ ফুল দিয়ে সাজালো। আহিকে সাহায্য করেছিল পুষ্প আর পদ্ম। সাজানো শেষে তিন বান্ধবী আকাশি রঙের জামদানি শাড়ি পরলো। আর লিনাশাকে হলুদ শাড়ি আর ফুলের গহনা পরিয়ে ছাদে আনা হলো। লিনাশা আর নায়ীবের কাজিনরাও হলুদে ছিল। সবাই ছবি তুলছে আর লিনাশার গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ গান বেজে উঠলো। আর পুষ্প ও লিনাশার দু’জন কাজিন মিলে সেই গানের তালে তালে নাচ শুরু করলো।

“নাচেন ভাল সুন্দরী এই
বাঁধেন ভাল চুল…
.
হেলিয়া দুলিয়া পরে
নাগ কেশরের ফুল
.
সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি
নাচো তো দেখি
বালা নাচো তো দেখি
বালা নাচো তো দেখি।”

গান থেমে যেতেই আবার নতুন গান চালু হয়ে গেলো। এবার আহি আর লিনাশার আরো দু’জন কাজিন এসে নাচ শুরু করলো।

“আশ্বিন ও ফাগুন মাসে
পরান ঘাসে নতুন বিয়ের ফুল ফুটিছে,
উথালি পাথালি মনে
আলতা কোণে নতুন বিয়ের ফুল ফুটিছে।
হেই হো পিয়ালী রে
হেই হো দুলালী রে,
আশ্বিন ও ফাগুন মাসে
পরান ঘাসে নতুন বিয়ের ফুল ফুটিছে।”

এবার গান থামতে নতুন গান শুরু এলো। আহি আর পুষ্প একাই নাচ শুরু করলো। গানটা লিনাশার বেশ পছন্দ। তাই সেও উঠে এলো নাচার জন্য।

“লীলাবালি লীলাবালি
বর অযুবতি সইগো
বর অযুবতি সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?
.
মাথা চাইয়া টিকা দিমু
জড়োয়া লাগাইয়া সইগো
জড়োয়া লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?
.
পিন্দন চাইয়া শাড়ি দিমু
ওড়না লাগাইয়া সইগো
ওড়না লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?
.
কানো চাইয়া কানফুল দিমু
পান্না লাগাইয়া সইগো
পান্না লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে
কানো চাইয়া কানফুল দিমু,
পান্না লাগাইয়া সইগো
পান্না লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।”

৮৩।

বিছানা ভর্তি ডালা সাজিয়ে রেখেছে পদ্ম, পুষ্প আর আহি। একপাশে নায়ীবের মেহেদির জন্য ডালা, অন্যপাশে বিয়ের ডালা। মাঝখানে নায়ীবের পছন্দের কেক নিজ হাতে বানিয়েছে লিনাশা। গামছা, লুঙ্গি, জুতো, ব্যবহারের জন্য যা যা প্রয়োজন সব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যপাশে ফল-ফলান্তি, মিষ্টিজাতীয় খাবার, হাতের পিঠা সাজিয়ে রাখা। একটু পর সব ছেলে পক্ষের বাড়িতে পৌঁছে যাবে।

আজ রাতে মেহেদি অনুষ্ঠান। পুরো বাড়ি রঙ-বেরঙের বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। লিনাশার বাসার একদম সামনেই কমিউনিটি সেন্টার। সেখানেই মেহেদি অনুষ্ঠান হবে। আহি হুড়োহুড়ি করে ক্লাবে ঢুকতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নেবে, তখনই কেউ একজন আহির কোমড় আঁকড়ে ধরলো। আহি চোখ বন্ধ করে বলল,
“সবাই শুধু আমার সাথে কেন ধাক্কা খেতে আসে?”

“বেশি সুন্দরী যে তাই!”

আহি উজ্জ্বলের কন্ঠ শুনে চোখ খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি এখানে?”

“কেন আসতে পারি না?”

“না মানে, এমনিই।”

উজ্জ্বল হাসলো। আহি সামনে এগুতেই পুষ্প উজ্জ্বলের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভাই, তুই এখানে?”

“তোর বান্ধবী বাসায় এসে তার ম্যাডামকে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেছে। আমিও তাই বিয়ে খেতে চলে এসেছি।”

“বাহ, চেনো না জানো না, খাওয়ার জন্য চলে এসেছো?”

উজ্জ্বল পুষ্পের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“আহিকে তো চিনি।”

“আচ্ছা, আহিকে চেনো? আর আমি?”

“তুই কে?”

“আমি তোমার বোন।”

“চিনি না আমি।”

“চিন্তা করো না, আমি তোমাকে ছবি তুলতে বলবো না।”

এদিকে উজ্জ্বল পুরো ক্লাব ঘুরে আবার আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি উজ্জ্বলকে দেখে বলল,
“খেয়েছেন?”

“হুম। তুমি?”

“পরে খাবো।”

উজ্জ্বল আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্যদিকে রাদ ভ্রূ কুঁচকে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে আছে। লাবীব রাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোর মতো বোকা আমি একটাও দেখি নি। এভাবে গবলেটের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে, কখনো তাজওয়ার খান, কখনো কিং খান এসে তোর রানীকে নিয়ে যাবে। আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু পপকর্ণ খাবি।”

রাদ চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব বলল,
“আমার দিকে এভাবে না তাকিয়ে কাজের কাজ কর।”

রাদ মনে মনে বলল,
“কখনো জোঁক, কখনো তেলাপোকা, কখনো মাছি। এতো কীটপতঙ্গ সামনে কিলবিল করছে, আর আমি মানুষটা সামনে আগাতেই পারছি না।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৭||

৭৪।
আহি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফিফের দিকে। আফিফের হাতে টিস্যু। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার দৃষ্টি আফিফ আর আহির দিকে। আহি কিছু বলতে যাবে তখনই তাজওয়ার আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কি হলো, দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি আমার ফিয়োন্সের শাড়িটাই নষ্ট করে দিয়েছো। শাড়িটা তো এই মুহূর্তে পরিস্কার করে লাভ নেই। অন্তত জুতো জোড়া তো মুছে দাও।”

আফিফ হাঁটু গেড়ে বসতেই আহি সরে দাঁড়ালো। তাজওয়ারের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“বেশি বাড়াবাড়ি করছো তুমি!”

“তোমার কেন এতো সমস্যা হচ্ছে!”

“তুমি জানো কেন সমস্যা হচ্ছে। তোমাকে বলেছি আফিফ পদ্মের…”

তাজওয়ার আহির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। এরপর আহির ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বলল,
“অন্যের স্বামীর প্রতি তোমার এতো মায়া থাকা উচিত না।”

আহি তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তার চোখ দু’টিতে স্পষ্টভাবে অশ্রু ভীড় করেছে। তাজওয়ার তা দেখে বাঁকা হাসলো। আহি তাজওয়ারের হাসি দেখে বলল,
“ভেবেছি, তোমার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু না। আমার বাসায় মুনিয়া খালা আর চুনি আছে, ওরা কখনো আমার পায়ে থাকা অবস্থায় আমার জুতোয় হাত দিতে পারে নি। আর তুমি এতোগুলো মানুষের সামনে আমার চেয়ে বয়সে আর সম্মানে বড় একটা মানুষকে বলছো আমার জুতো পরিস্কার করে দিতে? অন্যের স্বামী হোক, আর যাই হোক, আফিফের একটা সম্মান আছে। ও শিক্ষিত ছেলে। ও তোমার অফিসে যোগ্যতা নিয়ে এসেছে। এসব কাজ করতে আসে নি।”

তাজওয়ার জোর গলায় আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে কি কাজ দিয়েছি ভুলে গেছ? তাড়াতাড়ি আহির জুতো জোড়া মুছে দাও।”

আফিফ এবার আহির পায়ে হাত দিলো। তাজওয়ার সরে অন্য পাশে গিয়ে বসলো। তাজওয়ারের বন্ধুরাও বেশ আয়েশ করে বসেছে, যেন তারা কোনো নাটক দেখতে বসেছে।
আহি ইতস্ততবোধ করছিল। আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“অন্য কেউ হলে অপমানিত হতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মোটেও খারাপ লাগছে না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি!”

আফিফ তার হাঁটুর উপর আহির ডান পা’টা উঠালো। ধীরে ধীরে আহির পা মুছে দিতে দিতে বলল,
“তাজওয়ার খান সেদিনের প্রতিশোধ ভালোভাবেই নিচ্ছে।”

আহি আফিফের কথা শুনে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার দূরে বসে আছে। সে আফিফের কথা শুনছে না। আফিফ আবার বলল,
“আমার জন্য তুমি তাকে নিয়াজীর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলে। আমার জন্য তুমি তাকে এমন একটা কাজ করতে বাধ্য করেছিলে, যেটা সে করতেই চায় নি। আমার জন্য তুমি কিছু করলেই, সে তার দ্বিগুণ আমাকে ফিরিয়ে দেবে। তাহলে কেন করছো আমার জন্য এসব?”

আহি পা সরিয়ে ফেলতেই আফিফ উঠে দাঁড়ালো। আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে আর পদ্মকে একা ছেড়ে দাও।”

আহির ভীষণ রাগ উঠলো। সে হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আফিফ একনজর তাজওয়ারের দিকে তাকাতেই দেখলো তাজওয়ার বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে আহি একপাশে এসে দাঁড়ালো। হাতে থাকা ব্যাগটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। মিনমিনিয়ে বলল,
“কি ভেবেছো আফিফ? আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই আমাকে যা ইচ্ছে শোনাবে? আমি তোমাকে আর কখনোই ইম্পোরটেন্স দেবো না। আমাকে পদ্ম বলেছিল, তাই আমি নিয়াজীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর যদি তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকতো, তবুও আমি একটা না একটা স্টেপ নিতাম। আফটার অল আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড বিপদে পড়েছিল! কিন্তু তুমি ভাবছো, তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। তোমার জন্য কি এখন আমি পদ্মের সাথেও যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলবো?”

আহি চোখ মুছে বলল,
“ঠিক আছে। তোমাদের ভালোর জন্য আমি এখন সেটাই করবো। তোমাদের জীবনে ঝড় আসলেও আমি ফিরে তাকাবো না। এখন তোমার বউকে কোলে নিয়ে বসে থাকো তুমি। ইডিয়ট ম্যান।”

আহি পেছন ফিরতেই দেখলো আফিফ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আহি আফিফকে দেখে চেঁচিয়ে বলল,
“যাও এখান থেকে। এখানে কি করছো?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “সরি।”

“তোমার সরি আমার লাগবে না। নিজেকে কি ভাবো তুমি, হ্যাঁ? একমাত্র তুমি ছাড়া কি আমার জীবনে কি কোনো পুরুষ নেই? এখন আর আমার সামনেও এসো না। পদ্মের সাথেও আমি আর যোগাযোগ রাখবো না। তোমরা বউ জামাই মিলে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাও।”

আফিফ হাসলো। আহি চোখ বড় বড় করে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি হাসছো?”

“তোমার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেলো।”

“তুমি আসলেই একটা ইডিয়ট। আজ যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। এখন থেকে প্রতিদিন তাজওয়ার তোমার সাথে এমনই করুক। খুশি হবো আমি।”

আফিফ এবারও মুখ চেপে হাসলো। তা দেখে আহি হনহনিয়ে চলে গেলো।

(***)

হেমন্তের রাত। খোলা আকাশের নিচে মত্ত হয়ে আছে কিছু কপোত-কপোতী। আহি অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন পবিত্র মাসেও তাদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। এমন একটা অসুস্থ পরিবেশে কীভাবে সে তার বাকী জীবন কাটাবে, ভাবতেই তার শরীরটা অসার হয়ে আসছে। আহি তার সামনে থাকা ঝুলন্ত রঙ-বেরঙের বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ তার কোমড়ে কারো স্পর্শ পেতেই আহি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“তাজওয়ার প্লিজ, ভালো লাগছে না এসব।”

কথাটি বলতে বলতেই আহি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, তাজওয়ারের বন্ধু অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। আহি অর্ণবকে দেখে রীতিমতো অবাক হলো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি এখানে?”

অর্ণব বাঁকা হেসে বলল,
“কেন? অন্য কাউকে আশা করেছিলে বুঝি!”

আহি অর্ণবের পাশ কেটে চলে আসতে যাবে তখনই অর্ণব তার হাত ধরে আটকালো। আহি এক ঝটকায় অর্ণবের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার সাথে এমন নোংরামি করবে না।”

অর্ণব হেসে বলল,
“নোংরামির কি দেখলে, আহি!”

অর্ণব এরপর চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রেখে বলল,
“আহ, নামটা উচ্চারণেই এতো শান্তি পাচ্ছি! না জানি তোমার মাঝে ডুব দিলে কতো শান্তি পাবো।”

আহি কথাটি শুনেই সশব্দে অর্ণবের গালে চড় বসিয়ে দিলো। অর্ণব গালে হাত দিয়ে কুৎসিত হাসি হেসে বলল,
“সবাই ড্রাংক। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না।”

অর্ণব আহির হাত চেপে ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“শাড়িতে কোনো মেয়েকে এতো চমৎকার লাগতে পারে, আমি কখনো ভাবতেই পারি নি।”

আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“তাজওয়ার কোথায়!”

অর্ণব হেসে বলল,
“তাজ ব্যস্ত আছে। হয়তো আজ সারারাত সে ব্যস্ত থাকবে। তুমি তো ওকে ভালো রাখতে পারছো না। তাই ভালো থাকার জন্য তাকে অন্য জায়গায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।”

আহি অর্ণবকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাদের মতো অসভ্য ছেলেদের জায়গা নরকে।”

অর্ণব হাসলো আর বলল,
“মনে হচ্ছে তাজকে ইদানীং এসব জ্ঞান একটু বেশিই দিচ্ছো। কিন্তু আমাদের তাজকে এতো সহজে তুমি পরিবর্তন করতে পারবে না।”

আহি উল্টো পায়ে পিছিয়ে যেতেই অর্ণব আহির কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। আহি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। অর্ণব তা দেখে বলল,
“তুমি অন্তত একদিন আমাকে সময় দাও। এরপর তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই এনে দেবো।”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। সে ভেজা কন্ঠে বলল,
“তুমি আমাকে যেমন ভাবছো, আমি তেমন মেয়ে নই। আমাকে ছাড়ো বলছি। আমি এসবে ইন্টারেস্টড নই, প্লিজ।”

অর্ণব আহিকে আরো জোরে চেপে ধরলো। আহি অর্ণবের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। হঠাৎ পেছন থেকে অর্ণবের পিঠে সজোরে কেউ ঘুষি মারলো। অর্ণব ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তেই আহিও ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। কারণ সে আহিকেই ধরে রেখেছিল। কিন্তু আহির পিঠ মাটি স্পর্শ করার আগেই সেই মুষ্টিবদ্ধ হাতটি উন্মুক্ত হলো। মানুষটি শক্ত করে আহির হাতটা আঁকড়ে ধরলো। এরপর আহিকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
“তুমি ঠিক আছো!”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো, “আফিফ, তুমি এখনো যাও নি?”

“যাই নি। ভালোই তো হয়েছে যাই নি। আমি যদি এখন চলে যেতাম, কি হতো?”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমাকে কে বলেছে এখানে আসতে? আহি, এই জায়গা তোমার জন্য না।”

“তাজওয়ার নিয়ে এসেছে আমাকে।”

“আমার চেয়ে তুমি ওকে ভালো করেই চেনো। ও তোমাকে নিয়ে আসতে চাইলে, তুমি আসবে কেন? আর এই কয়েক মাসে আমার ওকে আরো ভালো করেই চেনা হয়ে গেছে।”

এদিকে অর্ণব মাটি থেকে উঠে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“এই ফকিরের বাচ্চা, তোর সাহস কি করে হয়, আমার গায়ে হাত তোলার?”

আফিফ আহিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। অর্ণব আফিফের গায়ে হাত উঠাতে যাবে তার আগেই আফিফ হাত ধরে বলল,
“তোমরা আমাকে অনেক অপমান করেছো, আমি সহ্য করেছি। কিন্তু আমার সামনে কোনো মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবো, এটা আশা করো না।”

অর্ণব হাসলো। শব্দ করেই হাসলো। এরপর আফিফকে হালকা ধাক্কা দিলো। আহি আফিফের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“আফিফ, চলো এখান থেকে চলে যাই। আমি চাই না, আমার কারণে তোমার কোনো সমস্যা হোক।”

(***)

এদিকে অর্ণব জোরে জোরে তাজওয়ারের নাম ধরে ডাকলো। তাজওয়ার একটু পর বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। তাজওয়ারের সাথে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। মেয়েটার পরণের জামা-কাপড় এলোমেলো। মেয়েটাকে দেখে আহির চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। যেই মানুষটার সাথে তার সংসার করতে হবে, সেই মানুষটা যদি এমন হয়, তখন কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। এরই মধ্যে তাজওয়ারের বাকি বন্ধুরাও বেরিয়ে এলো। তাদের মধ্যে সজিব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন, অর্ণব?”

অর্ণব সজিবের কথা উত্তর না দিয়ে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
“তাজ, তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?”

তাজওয়ার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বলল,
“সজিবের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।”

আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মিনমিনিয়ে বলল,
“আড্ডা দিচ্ছে!”

অর্ণব বলল,
“তুই আড্ডা দিচ্ছিস, আর তোর ফিয়োন্সে ব্যস্ত তোর পারসোনাল এসিস্ট্যান্টের সাথে।”

আফিফ আর আহি অবাক দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব রুক্ষ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস, সে একটা ক্যারেক্টার লেস।”

আফিফের এবার রাগ উঠে গেলো। সে অর্ণবের কলার ধরে তাকে ঘুরিয়ে নাক বরাবর ঘুষি মেরে বলল,
“আরেকবার আহিকে নিয়ে বাজে কথা বললে, আমি তোকে মেরে ফেলবো।”

তাজওয়ার এসে আফিফের কলার ধরতেই আহি তাজওয়ারের হাত ধরে বলল,
“তুমি তোমার বন্ধুর কথা বিশ্বাস করো না। তোমার বন্ধু মিথ্যে কথা বলছে। ও নিজে আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। আফিফ তো আমাকে ওর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে।”

অর্ণব বলল,
“তাজ, তুই তো আমাকে চিনিস। আমি কি তোর ফিয়োন্সের সাথে এমন কিছু করতে পারি?”

তাজওয়ার আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে জল। আর তার দৃষ্টি তাজওয়ারের হাতের দিকে, যেই হাত দিয়ে সে আফিফের কলার ধরে রেখেছে। তাজওয়ার এবার চোখ-মুখ কুঁচকে তার এক হাত দিয়ে আফিফের গলা চেপে ধরে অন্য হাত মুঠো করে আফিফের মুখে ঘুষি মারতে লাগলো। আহি তাজওয়ারকে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আহির এই অস্থিরতা তাজওয়ারকে আরো হিংস্র করে তুলছে। সে আফিফকে মাটিতে ফেলে তার পেটে লাথি মারতে লাগলো। এসব দেখে আহি মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো। আফিফকে মার খেতে দেখে আহির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো আহি। অস্থির লাগছিলো তার। হাত-পাও অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। হাত দিয়ে শক্ত করে মাটি আঁকড়ে ধরে আছে আহি। তাজওয়ারের চোখ আহির দিকে পড়তেই সে থেমে গেলো। আহির দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে, দ্রুত তার কাছে এসে বসলো। আহি অস্থিরভাবে ছটফট করছে। আফিফ মাথা তুলে আহিকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করতেই অর্ণব এসে আফিফের পিঠে আরেকটা লাথি মারলো।

এদিকে তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”

আহি নিভু নিভু চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আর শরীরের যতোটুকু শক্তি ছিল সেই শক্তি দিয়েই সে তাজওয়ারের চুলগুলো টেনে ধরলো। তাজওয়ার সজিবকে বলল,
“পানি নিয়ে আয়।”

সজিব পানি আনতেই তাজওয়ার সেই পানি হাতে নিয়ে আহির মুখে ছিটিয়ে দিলো। একটু পর আহি স্বাভাবিক হতেই তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এরপর তার কাঁপা শরীর নিয়ে আফিফের কাছে এসে বসলো। আফিফের মাথাটা উঠিয়ে নিজের কোলের উপর রাখলো, অস্ফুটস্বরে ডাকলো, “আফিফ!”

আফিফ চোখ খুলে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এবার খুশি হয়েছো?”

আহি মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই তাজওয়ার আহির কাছে এসে তাকে টেনে উঠালো। আহি তাজওয়ারকে আবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কাঁপা কন্ঠে বলল,
“যেই ছেলেটা আমাকে বাঁচিয়েছি, তুমি তাকে মেরেছো? তুমি আমাকে কেন এনেছো এখানে? নিলাম করতে এনেছো? আমার বাবা তো আমাকে তোমার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। তুমিও এখানে তোমার বন্ধুদের কাছে আমাকে বিক্রি করতে এনেছো, তাই না?”

(***)

আফিফের নাক ফেটে গেছে। নাক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মাথাটাও ভোঁ ভোঁ করছে তার। সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আহির হাত ধরলো। তাজওয়ার কিছু বলার আগেই আফিফ বলল,
“যদি আমার স্ত্রী বা আমার বোনের সাথে বাইরের কোনো ছেলে খারাপ ব্যবহার করতো, তাহলে আমি আপনার মতো নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতাম না। আর আপনি যাকে ভালোবাসেন, তাকে আপনার বন্ধুদের সাথে একা ছেড়ে অন্য জায়গায় ব্যস্ত হয়ে গেছেন? সরি স্যার, আমি আপনার এসিস্ট্যান্ট মাত্র। কিন্তু এমন অসম্মান আমি দেখে থাকতে পারবো না। আমাকে তো বেশ মারলেন। জানি, আপনার আমার প্রতি কেন এতো রাগ। কিন্তু একবার ওই দিকের সিসি ক্যামেরাটা দেখে আসবেন।”

আফিফের কথা শুনে অর্ণব অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো। বাসাটা জিলানের। কিন্তু এই বাসার প্রতিটা স্থান অর্ণবের মুখস্থ। গাছের সাথে লাগানো সিসি ক্যামেরাটা কখনোই অর্ণব খেয়াল করে নি। সে ভ্রূ কুঁচকে আফিফকে বলল,
“কি বলতে চাইছো তুমি?”

আফিফ তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যটা আগে আপনি জেনে নিবেন, তারপর বিচার করবেন। আর বিচার শেষে আহির সাথে দেখা করবেন৷”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানুষ খারাপ হতে পারে। তার পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকতে পারে। কিন্তু যাকে আমরা একবার বা এক সেকেন্ডের জন্যও ভালোবেসেছি, তাকে অসম্মান করা যায় না। তাকে বিশ্বাস করতে হয়। তাকে আগলে রাখতে জানতে হয়।”

আফিফ এবার তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসা মানে শুধু তার প্রতিই যত্ন নেওয়া, যে আপনার পাশে আছে। ভালোবাসা তো একজন অসৎ মানুষকেও সৎ বানিয়ে ফেলতে পারে। যদি না পারে, তাহলে সেটা ভালোবাসা না। সেটা জেদ আর অহংকার মাত্র।”

তাজওয়ার আহির হাত ধরতে যাবে তার আগেই আফিফ তাকে আটকে দিয়ে বলল,
“আমি আহিকে আপনার সাথে এই মুহূর্তে একা ছেড়ে যেতে পারবো না। আপনি সজ্ঞানে ফিরেই আহির সাথে দেখা করবেন, এর আগে নয়।”

আফিফ আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। আহি ভীত চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার যে তাকে আটকাচ্ছে না, এতেই বেশ অবাক হয়েছে আহি।

৭৫।

গাড়িতে উঠেই আফিফের দিকে তাকালো আহি। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“থ্যাংক ইউ।”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমি কিন্তু এবার তোমাকে এসবে জড়াতে বলি নি।”

আফিফ হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসার মতো কিছু বলি নি।”

আফিফ বলল,
“তখন যা বলেছিলাম, বলে ফেলেছি। মাঝে মাঝে আমি অনেক কথা ভেবে বলি না। রাগ থেকেও এমন কথা বলে ফেলি, যেটার কোনো ভিত্তিই নেই। তাই সরিও বলেছি।”

“সরি বলে মার খেয়ে একদম সব ভুলিয়ে দিয়েছো। সত্যিই আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাজওয়ার কাউকে খুন করতে দ্বিতীয় বারও ভাববে না।”

“সে তোমার সামনে এই কাজ করতো না।”

“তুমি কীভাবে শিউর হলে?”

“সেটা তোমার জানতে হবে না।”

“সাসপেন্স রেখে কথা বলছো কেন?”

আফিফ হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এরপর দু’জনই নিরব। আহি বলল,
“পদ্মকে কি বলবে?”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটাই ভাবছি!”

“ও খুব চিন্তা করবে। আমার জন্য মারামারি লেগেছে শুনলে আমাকে নিয়েও চিন্তা করবে। মেয়েটা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। সেদিন তুমি নিয়াজীর বাড়িতে যাওয়ার পর, ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি পাশ ফিরতেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। আহি বলল,
“সরি।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “সরি কেন?”

“বেশি মেরেছে তাজওয়ার, তাই না?”

“হুম।”

আহি ড্রাইভারকে বলল, হাসপাতালের দিকে ঘুরিয়ে নিতে। আফিফ বাঁধা দিলো না। এই মুহূর্তে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োজন। শরীরটা বেশ ব্যথা করছে তার।

হাসপাতালে পৌঁছে আফিফকে মুখের এক্স-রে করতে বলা হলো। ব্যথার ওষুধও লিখে দেওয়া হলো। আহি ওষুধগুলো কিনে আফিফের হাতে দিয়ে বলল,
“এক্স-রে কাল করতে হবে। চলো, তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”

“তুমি আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে? তোমাকেই তো বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য একজন প্রয়োজন।”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ বলল,
“আহি, আমার একটা হ্যাল্প করতে পারবে?”

“হ্যাঁ, বলো!”

“আজ রাতের জন্য আমাকে বাইরে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে? আসলে আমার তেমন একটা বন্ধু নেই। যে আছে সে এখানে থাকে না। বাসায় মা খুব অসুস্থ। এই অবস্থায় আমাকে দেখলে বেশ চিন্তায় পড়ে যাবে। পদ্মকে তো বুঝিয়ে ফেলতে পারবো। মায়ের তো বয়স হয়েছে। বোঝাতে গেলেও বুঝবে না। তাই আমি এই অবস্থায় বাসায় যেতে চাচ্ছি না। বাসায় বলবো, কাজের জন্য বাইরে আছি।”

আহি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“রাদ তো ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। ওখানে সম্ভব না। লাবীব হোস্টেলে থাকে। ওকে ফোন করবো?”

“হুম, করে দেখো।”

আহি লাবীবকে ফোন করলো। কিন্তু লাবীব রিসিভ করে বলল, সে এখন কক্সবাজার। আফিফ হতাশ হলো। এবার আহি কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, আমার সাথেই চলো।”

“তোমার বাসায় সম্ভব না।”

আহি হেসে বলল,
“জানি। আমার বাসায় একদমই সম্ভব না। কিন্তু মায়ের বাসায় সম্ভব।”

এরপর আহি আফিফের ফোন থেকেই সালমা ফাওজিয়াকে কল করলো। তারপর সে আফিফের ব্যাপারে বলতেই তিনি আফিফকে নিয়ে আসতে বললেন। এরপর আহি আফিফকে নিয়ে তার মায়ের বাসায় এসে পৌঁছালো। আফিফ বলল,
“আন্টি কিছু মনে করবেন না তো!”

“আন্টির রাজকুমারীর জন্য তোমার এই অবস্থা হয়েছে। তোমাকে তো রাজা বানিয়ে রাখবে।”

আফিফ কিছু বললো না। এদিকে সালমা ফাওজিয়া আফিফকে দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন। সোফা গুছিয়ে দু’টো বালিশ দিয়ে বসালেন। ফল কেটে আনলেন। পানি এগিয়ে দিলেন।
এদিকে টুংটাং শব্দ শুনে রোকেয়া ফাওজিয়া ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। সালমা ফাওজিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মা, আহি এসেছে!”

রোকেয়া আহির উপর বিরক্ত হলেও আজ আহিকে সামনা-সামনি দেখে কেঁদেই ফেললেন। নাতনিকে জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে চুমু খেলেন। অতি স্নেহে আহির হাত জড়িয়ে সোফায় বসলেন। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আফসোস করলেন। আফিফ মোটামুটি লজ্জায় পড়ে গেলো। এখানে এসে যে মারাত্মক ভুল করেছে সে। এমন ভাবে তারা আফিফের দেখাশুনা করছে, মনে হচ্ছে সে শ্বশুড় বাড়িতে এসেছে। আহি আফিফের পাশে বসে বলল,
“বলেছি না, রাজার হালে থাকবে।”

“ওরা কিছু মনে করবে না তো!”

“একদমই না। আমি বলে দিয়েছি আমার কারণেই তোমার এই অবস্থা হয়েছে। আর তোমার মা আর বউ তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে চিন্তা করবে তাই বাসায় যাচ্ছো না।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি হেসে বলল,
“তুমি পদ্মের হাসবেন্ড মা জানে। নানুকে এই মাত্র জানিয়েছি। চিন্তা করো না, নেগেটিভ কিছু ভাববে না।”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি উঠে দাঁড়ালো। আফিফ জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“বাসায়!”

“তুমি এখানে থাকবে না?”

“না।”

আফিফ ইতস্ততবোধ করতেই আহি বলল,
“আরেহ, চিন্তা করো না। মনে করবে এটা তোমার নিজের বাড়ি। আমার বাড়ি মানেই পদ্মের বাড়ি। আর পদ্মের বাড়ি মানেই তোমার বাড়ি। হয়ে গেলো তো সলিউশন?”

“তুমি থাকলে হয়তো ভালো হতো। আই মিন, আন্টি আর নানুর সাথে তো আমার তেমন পরিচয় নেই। তাই বলছি।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“মা অনেক ফ্রেন্ডলি। আর আমার এখানে থাকা সম্ভব না। বাবা জানলে সমস্যা হবে। আমি যাই।”

“তুমি একা যাবে?”

“না, রাত বারোটা বেজে গেছে। বাসা থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।”

এরপর আহি সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আহি চলে যেতেই আফিফকে একটা রুম দেওয়া হলো। আফিফ সেখানে ঢুকতেই দেখলো আহির আঁকা একটা ছবি দেয়ালে ঝুলছে। আফিফ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলো। অজানা কারণেই মনটা ভারী হয়ে আসছে তার৷

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৮||

৭৬।
একে একে তিনটা গাড়ি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই সবার দৃষ্টি সেদিকে আটকে গেলো। ক্যাম্পাসের মাঠে হট্টগোলের শব্দ শুনে রাদ নিচে নেমে দেখলো তাজওয়ার খান দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ারকে দেখে রাদ দ্রুত পায়ে আহির ডিপার্টমেন্টের সামনে চলে এলো। এদিকে তাজওয়ার হাতে একটা মাইক নিয়ে বলল,
“আহি কাল যা হয়েছে তার জন্য সরি। তুমি একবার আমার সামনে এসে দাঁড়াও, প্লিজ।”

আহি ক্লাস থেকে বেরিয়ে চার তলা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ারকে দেখে আহি রেগে গেলো। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার মাইক রেখে আহির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আই এম সরি, আহি। আমার জন্য কাল রাতে তোমার অনেক সমস্যা হয়েছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না, তাজওয়ার এতোগুলো মানুষের সামনে কীভাবে তার কাছে ক্ষমা চায়ছে! যার কাছে নিজের আত্মসম্মানবোধ সবার উপরে, তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করাও অকল্পনীয়। আহি তাজওয়ারের হাত ধরে উঠিয়ে বলল,
“আমার ক্যাম্পাসে এসেই তোমাকে এই তামাশা কর‍তে হলো!”

“কি করবো বলো? তুমি কাল পার্টি থেকে চলে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পেরেছি, আমার কতো বড় ভুল হয়েছিল।”

(***)

গতকাল রাতে আফিফ আহিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তোর কি মনে হয় আমি আহির সাথে বাজে ব্যবহার করবো?”

তাজওয়ার ধীর পায়ে অর্ণবের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আর অর্ণব পেছাতে লাগলো। সজিব আর জিলান তাজওয়ারকে থামানোর জন্য বলল,
“তাজ, তোর হয়তো ভুল হচ্ছে, অর্ণব এই কাজ করবে না। এক কাজ করি, আমরা ফুটেজ দেখে আসি।”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“তার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্ণব কি কি করতে পারে, তা তো তোরা ভালো করেই জানিস। আর আহি কেমন মেয়ে তা আমি ভালো করে জানি।”

কথাটি বলেই তাজওয়ার অর্ণবের নাক বরাবর একটা ঘুষি মারলো। অর্ণব তাজওয়ারের পা ধরে বসে পড়লো। ভীত কন্ঠে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দে, দোস্ত। আমি নেশা করে ফেলেছিলাম। আমার হুঁশ ছিলো না।”

তাজওয়ার অর্ণবের কলার ধরে তাকে উঠিয়ে বলল,
“এটা তো জাস্ট ট্রেলার, মুভি তো আগামীকাল রিলিজ হবে। আর এরপর বোঝা যাবে আমার মুভি হিট হয়েছে, না-কি ফ্লপ।”

(***)

তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, সত্যিই আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু অর্ণব আমার অনেক কাছের বন্ধু। ও যখন বলেছে আফিফ তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে চেয়েছে, আমি না হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। তারপর যখন মাথা ঠান্ডা করে ভাবলাম, তখনই বুঝলাম আহি তো আফিফকে বাঁচাতে এসেছিল। কারণ আহি সবসময় তার পক্ষেই থাকে, যা সত্য। অর্ণব যদি সত্য বলতো, তাহলে তো তুমি অর্ণবের পক্ষে দাঁড়াতে।”

আহি চোখ ছোট করে বলল,
“ব্রেনওয়াশ করছো আমার? তুমি ভালো করেই জানো, তোমার বন্ধু কেমন।”

“এজন্যই তো শাস্তি দিয়েছি।”

তাজওয়ার এবার গাড়ির কাছে গেলো। গাড়ির দরজা খুলে অর্ণবকে টেনে বের করলো। আহি অর্ণবকে দেখে অবাক হলো। অর্ণবের চেহারা পালটে গেছে। নাক-মুখ রক্তে মাখামাখি। ক্যাম্পাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা ভয়ে পিছিয়ে গেলো। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন দৃশ্য দেখা ভয়ংকর।

এদিকে তাজওয়ার অর্ণবের ঘাড় ধরে টেনে এনে তাকে আহির পায়ের কাছে ফেললো। সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ এবার আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, আহি?”

“পরে বলছি।”

(***)

অর্ণব আহির পা ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। গাড়ির উপর থেকে মাইকটা আবার হাতে নিলো। মলিন মুখে বললো,
“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, আহি। সেই প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম আমি। এরপর আমার স্বপ্ন সত্যি হলো তোমার আর আমার এনগেজমেন্টের পর। মনে হতে লাগলো তোমাকে পাওয়ার পথ খুলে গেছে। কিন্তু তখনই আমার প্রিয় বন্ধু, যাকে আমি এতো বিশ্বাস করি, সে-ই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলো, তোমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলে কথা বললো। কিন্তু আমি সেই মুহূর্তে তোমাকে বিশ্বাস করলেও চুপ ছিলাম। তার জন্য সরি। কিন্তু এখন আমি অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছি। এবার আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। একটাবার আমার হাত ধরে বলো, ভালোবাসি।”

আহি অবাক চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“আহি, কি বলছেন উনি? তুই ভালোবাসিস উনাকে? আর তোর সাথে খারাপ ব্যবহার কখন করলো? তুই আমাকে এসব বলিস নি কেন?”

“রাদ, আমি তোকে সবটা জানাবো। প্লিজ এখন একটু চুপ কর।”

রাদের এই মুহূর্তে ভীষণ অস্থির লাগছে। তাজওয়ার কেন বললো, আহি তাকে ভালোবাসে? আহি কি তবে তাজওয়ারকে ভালোবেসে ফেলেছে? না, এটা অসম্ভব। আহি যেখানে আফিফকেই ভুলতে পারে নি, সেখানে এতো তাড়াতাড়ি যাকে ঘৃণা করে, তাকে ভালোবেসে ফেলবে, এটা কখনোই হতে পারে না।

এদিকে এখনো আহি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাজওয়ার হতাশ চোখে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ক্যাম্পাসে উপস্থিত একটা ছেলে জোরে বলে উঠল,
“আহি, ভাইয়াকে ক্ষমা করে দাও। আর ভালোবাসি বলে দাও।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে ছেলেটির দিকে তাকালো। এই ছেলেকে আহি চেনেও না, অথচ ছেলেটা তার নাম ধরে ডেকে তাকে এমন কথা বললো! ছেলেটা যেন শুরুটাই করে দিলো, সাথে সাথেই ক্যাম্পাসে উপস্থিত সবাই জোরে জোরে একই কথা বলতে লাগল। আহি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এবার সে বুঝতে পারলো, তাজওয়ার কেন এমন করেছে। আহি বাধ্য হয়ে তাজওয়ারের সামনে এসে বলল,
“ক্ষমা করলাম। এখন যাও।”

তাজওয়ার মৃদু হেসে বলল,
“ভালোবাসি বলে দাও না!”

“ভালোবাসি।”

তাজওয়ার মাইকটা রেখে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহিও তাজওয়ারকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই কাজটা না করলেও পারতে।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শোনার চান্স মিস করলাম না। আর এখন সবাই জেনে গেছে, তাজওয়ার খান কতোটা রোমান্টিক আর অনেস্ট লাইফ পার্টনার। আর সে আহিকে কতোটা ভালোবাসে।”

আহি বলল,
“আর সেই সুযোগে তুমি মেয়েদের সাথে নোংরামি করবে, আর এই কথা কেউ বিশ্বাসই করবে না। কারণ তুমি তো দেখিয়ে দিয়েছো, তোমার আত্মসম্মানবোধ ভালোবাসার কাছে কিছুই না। তুমি আহির জন্য সব কর‍তে পারো, সেখানে একটা মেয়ের সাথে নোংরামি করা তো অসম্ভব।”

“ইউ আ’র টু ইন্টেলিজেন্ট।”

তাজওয়ার এবার অর্ণবকে ইশারায় গাড়িতে বসতে বলল। অর্ণবও ধীর পায়ে গাড়িতে উঠে গেলো। এরপর তাজওয়ার আহির কপালে চুমু খেয়ে ক্যাম্পাসে ভীড় জমানো ছাত্র-ছাত্রীদের হাত দেখিয়ে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। গাড়ি বেরিয়ে গেলো ক্যাম্পাসের বাইরে। কিন্তু তাজওয়ারের গাড়িটা থেমে গেলো কিছুদূর গিয়েই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সেই গাড়ি। হঠাৎ কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো একটি ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে তাজওয়রের গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার গাড়ির গ্লাস নামিয়ে তার হাতে এক হাজার টাকার দুইটা বান্ডেল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“থ্যাংকস।”

ছেলেটা হাসলো। এটা সেই ছেলে, যে সবার প্রথমে চেঁচিয়ে আহিকে বলেছিলো তাজওয়ারকে ক্ষমা করে দিয়ে ভালোবাসি কথাটা বলতে। ছেলেটা চলে যেতেই তাজওয়ার গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে শিস বাজাতে লাগলো। অর্ণব মলিন মুখে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস?”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“আহি শুধু আমার। আহিকে স্পর্শ করার অধিকারও আমার। কেউ যদি ভুলেও আহিকে স্পর্শ করতে চায়, আমি তাকে ক্ষমা করি না।”

কথাটি বলেই তাজওয়ার পকেট থেকে তার রিভলবারটা বের করে অর্ণবের মাথায় ঠেকালো। তাজওয়ার বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস বন্ধু। তোকে ক্ষমা করার মতো উদার মন আমার নেই।”

(***)

গুলির শব্দ গুঞ্জন করে উঠল শূন্য রাস্তায়। গাড়ির সিটে অর্ণবের মৃত শরীরটা পড়ে আছে। গুলি মাথায় আঘাত করতেই সেকেন্ডের মধ্যে অর্ণবের প্রাণটা উড়ে গেলো। তাজওয়ার গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিদায় বন্ধু। পরকালে আবার দেখা হবে।”

তাজওয়ারের বডিগার্ড সিগারেট ধরিয়ে তাজওয়ারের ঠোঁটে পুরে দিলো। তাজওয়ার ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে হাতটা ভালোভাবে ধুয়ে নিলো। পেছন ফিরে একনজর অর্ণবের মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাঁচ মিনিটের অপেক্ষা। এরপর একটা ট্রাক এসে সজোরে ধাক্কা দেবে গাড়িটিকে। সেই ধাক্কায় গাড়িটা গিয়ে পড়বে পাশের খাদে। এরপর তোমরা নিচে গিয়ে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবে। এরপর আসবে ব্রেকিং নিউজ, নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাকের ধাক্কায় তাজওয়ার খানের গাড়ি ছিঁটকে পড়লো খাদে। দুর্ভাগ্যক্রমে গাড়িতে থাকা তাজওয়ার খানের প্রিয় বন্ধু অর্ণব ইন্তেকাল করেছে। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলিহির রাজিউন। টগবগ যুবক অর্ণব সবে একটা কোম্পানি চালু করেছিল। বেশ লাভ হচ্ছিলো, কিন্তু সবটাই শেষ হয়ে গেলো। ভাগ্যক্রমে খানস গ্রুপের এমডি তাজওয়ার খান বেঁচে ফিরেছেন। তিনি এই মুহূর্তে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। তার জ্ঞান ফিরলে পুলিশ তাকে দুর্ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অন্যদিকে ট্রাক ড্রাইভার পলাতক।”

কথাটি বলেই তাজওয়ার হাসলো। তার বিদঘুটে হাসির শব্দ থামলো পাঁচ মিনিট পর তারই পূর্ব পরিকল্পিত পরিকল্পনা সমাপ্ত হতেই। তাজওয়ার অন্য গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল,
“আমাকে একটু মেকাপ করতে হবে। আফটার অল অনেক বড় অভিনয়ের জন্য আমি সিলেক্ট হয়েছি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে আমার সিক্রেট বাড়িতে নিয়ে চলো।”

৭৭।

রাদ আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো ক্যান্টিনে। আহি মলিন মুখে বসে আছে। রাদ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাহিনী কি!”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমেই উজ্জ্বলের পরিকল্পনার ব্যাপারে জানালো। এরপর গত কয়েকদিনে ঘটা সব ঘটনা রাদকে খুলে বললো। রাদ সব শুনে বলল,
“আহি, তোর সাহস কেমন, তুই ওই পার্টিতে চলে গেলি!”

আহি মুখ ছোট করে বসে রইলো। রাদ আবার বলল,
“আফিফ কি এখনো আন্টির বাসায়?”

“হুম, মা ফোন করে বললো, আফিফের না-কি খুব জ্বর এসেছে। পদ্মকে এখনো জানানো হয় নি। মেয়েটা জানলে এখন আমাকেই বকবে। সব আফিফের দোষ! পদ্মকে সব জানিয়ে দিলেই হতো।”

“আফিফ পদ্মকে কি বলেছে?”

“বলেছে কাজের কারণে কক্সবাজার গেছে। আসতে সময় লাগবে।”

“এতো বড় মিথ্যে কথা!”

“সেটাই তো। আফিফ মিথ্যা না বলে অন্তত পদ্মকে জানিয়ে দিতো, ও এসে দেখাশুনা করতো। মা তো এখন অফিসে চলে গেছে। নানুর বয়স হয়েছে। আফিফকে এখন কে দেখবে? ওর তো জ্বর।”

আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

“চল না একটু। বেস্টু না তুই আমার!”

“এখন আমি বেস্টু আর রইলাম কোথায়? আপনার প্রাণের বান্ধবী লিনাশা এসে আমার জায়গা কেঁড়ে নিয়েছে।”

“ভাই, ও আর তুই আলাদা।”

“তাই, আলাদাটা কেমন!”

“আরেহ, তুই ছেলে, আর ও মেয়ে।”

কথাটি বলেই আহি মুখ চেপে হাসলো। রাদ আহির হাতে হালকা ঘুষি মেরে বলল,
“চল, দেখে আসি ওই তেলাপোকাটাকে। আর একটা লাল হিট নিয়ে যাই সাথে করে। মুখের সামনে স্প্রে করে দেবো।”

“চুপ কর তো!”

(***)

দুপুরে আহি আর রাদ সালমা ফাওজিয়ার বাসায় এলো। আহি বাসায় ঢুকতেই রোকেয়া ফাওজিয়া বললেন,
“আহি, ছেলেটার তো খুব জ্বর। সালমা তো অফিসে চলে গেছে। আমি ছেলেটাকে একবার দেখে এসেছি। বেচারা জ্বরে কাঁপছে! সালমা কাকে যেন ফোন করে বলেছিল ওষুধ নিয়ে আসতে, কেউ তো এলোই না।”

আহি বলল,
“নানু, তুমি চিন্তা করো না। আমরা দেখছি।”

রাদ রোকেয়া ফাওজিয়াকে সালাম দিলো। রোকেয়া ফাওজিয়া রাদের থুতনি ধরে বললেন,
“রাদ, তোমাকে আমি প্রথমে চিনতেই পারি নি। তুমি এখানে বসো। আহি যাক। তুমি আমার সাথে কথা বলো, নানু। তোমার মা-বাবা, চাচারা কেমন আছে?”

“জ্বি ভালো।”

রাদ রোকেয়া ফাওজিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে আহি আফিফের ঘরে গিয়ে দেখলো আফিফ কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে। আহি আফিফের পাশে বসে বলল,
“আফিফ, জেগে আছো?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হুম, পদ্ম!’

আহি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,
“আফিফ, তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে? ব্যথা আছে এখনো?”

আফিফ বিড়বিড় করে কি যেন বললো। আহি বুঝলো না। সে আফিফের দিকে ঝুঁকে তার মুখ দেখার চেষ্টা করলো। দেখলো আফিফের নিভু নিভু চোখ দু’টিও কাঁপছে। আহি কাঁপা হাতে আফিফের কপাল স্পর্শ করতেই চমকে উঠল। সে চকিত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তোমার তো ভীষণ জ্বর।”

আশেপাশে থার্মোমিটার খুঁজতে লাগলো আহি। এরপর ড্রয়ার খুলতেই পেয়ে গেলো। থার্মোমিটারটি ধুয়ে আফিফের মুখে ঢুকিয়ে দিলো। আফিফ আহির হাতটা শক্ত করে ধরলো, আর মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“পদ্ম! কাঁদছো কেন? কাঁদে না পদ্ম!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। এক মিনিট হতেই থার্মোমিটার বের করে এনে দেখলো ১০৩ ডিগ্রী জ্বর। আহি ব্যস্ত হয়ে রাদকে ডাকলো। রাদ আহির ডাকে রুমে ঢুকে বলল,
“কি হয়েছে, আহি?”

“আফিফের তো অনেক জ্বর! আমার মনে হয় ওকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত।”

“উনার বাসার কাউকে বলবি না?”

“আমি তো পদ্মকে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু উনি বারণ করেছিল। এখন হয়তো জানাতেই হবে।”

আহি ফোন হাতে নিয়ে আফিফের পাশে এসে বসলো। পদ্মের নম্বরে ডায়াল করতে যাবে তখনই কলিংবেলের শব্দ হলো। রোকেয়া ফাওজিয়া আহিকে ডেকে বললেন,
“আহি, সালমা ওষুধ নিয়ে যাকে আসতে বলেছিল, সে হয়তো এসে গেছে।”

আহি ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দরজা খুলে দিলো। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রাদের সাহায্য নিয়ে আফিফকে ওষুধ খাইয়ে দিলো। সালমা ফাওজিয়া’র পাশের ফ্ল্যাটেই একজন মেডিসিনের ডাক্তার থাকেন। নাম রোকন আহমেদ। তিনিই সেই প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছিলেন।

……..

সকালে ঘুম ভেঙেই সালমা ফাওজিয়া যখন আফিফকে ডাকলেন তখন সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলেন, আফিফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, আর ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে আছে। এরপর সালমা ফাওজিয়া আফিফকে কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেলেন না, তখন পাশ থেকে কাঁথাটা উঠিয়ে নিজেই আফিফের গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আর তখনই তিনি অনুভব করলেন আফিফের শরীরের তাপমাত্রা বেশি। তিনি যখন জ্বর মেপেছিলেন, তখন ১০১ ডিগ্রী জ্বর ছিল। সালমা ফাওজিয়া দেরী না করে তখনই পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে রোকন আহমেদকে আফিফের ব্যাপারে জানালেন। রোকন আহমেদ সেই মুহূর্তে নিজের চেম্বারের উদ্দেশ্যেই বেরুচ্ছিলেন। তিনি তবুও আফিফকে এসে দেখে গেলেন। সেই অনুযায়ী ওষুধও লিখে দিলেন। গতদিনের প্রেসক্রিপশনও দেখলেন, যেখানে আফিফকে এক্স-রে করার জন্য বলা হয়েছিল। তিনি আফিফকে ভালোভাবে দেখে বললেন, যাতে আজই এক্স-রে করিয়ে ফেলে। এরপর তিনি যাওয়ার পর সালমা ফাওজিয়া একজনকে ফোন করে ওষুধগুলো বাসায় এনে দিতে বললেন, কারণ তাকেও অফিসে যেতে হবে। আর আহিও সেই মুহূর্তে ক্যাম্পাসে ছিল।

…………

আফিফকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আহি তার পাশে এসে বসলো। এক গামলা পানি নিয়ে সে আফিফের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাজওয়ার মানুষটা যে কতোটা ভয়ংকর, আফিফের এই অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে!”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এজন্যই তো ভয় পাই আমি।”

“মনে হয় না আফিফের এই জবটা থাকবে।”

“না থাকলেই ভালো। যখন ওর কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিল, তখনই আমি ভাবছিলাম, আফিফের ওখানে কীভাবে চাকরি হলো! তাজওয়ার নিজেও ওমেনাইজার। তার আন্ডারে কাজ করে ওরাও ওমেনাইজার। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া। সোহাগ নামের যেই ছেলেটা তাজওয়ারের এসিস্ট্যান্ট ছিল, আমি সেই ছেলেকে দুইবার রাস্তায় দেখেছি। তাও আবার আলাদা আলাদা মেয়ের সাথে। কেমন চিপকু কিসিমের! রিকশায় বসে….”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ইয়ু বলতেও চাচ্ছি না।”

“আমার মনে হয় ও জেনে-বুঝে আফিফকে পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট বানিয়েছে। ও যখন জানতে পারলো, আফিফ পদ্মের হাসবেন্ড তখন তোকে অন্যদিকে কোণঠাসা করে রাখার জন্য এই কাজ করেছে।”

“ঠিক বলেছিস।”

আহির হঠাৎ মনে পড়লো সে পদ্মকে কল করবে ভেবেছিল। বেল বাজায় সেটা ভুলেই গিয়েছিলো। আহি রাদকে বলল,
“ওপাশ থেকে আমার ফোনটা দে তো! পদ্মকে জানিয়ে দেই।”

পদ্মের নাম শুনে আফিফ ঘুম ঘুম চোখে আহির দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু বলবে?”

“হুম।”

“আমি পদ্মকে ফোন করছি।”

“উহুম।”

“কি উহুম!”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“জ্বরের ঘোরে উনি তোকে কি আর বলবে! কিছু জিজ্ঞেস করিস না তো!”

আহি এবার পদ্মের নম্বরে ডায়াল করতে যাবে, তখনই আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“পদ্মকে বলো না প্লিজ।”

আহি কল কেটে দিয়ে বলল, “কেন?”

আফিফ চোখ বন্ধ করে রাখলো। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বলল,
“তোমাকে আমি ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি!”

“আরেহ না। আমার জন্যই তো তোমার এই অবস্থা হলো। আর পদ্মকে জানানো আমার দায়িত্ব। ও তোমার ওয়াইফ। পরে কখনো জানলে উলটো বুঝে বসে থাকবে। আমি চাই না পদ্ম আমাকে ভুল বুঝুক।”

আফিফ চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমি এই মুহূর্তে এক্সপ্লেইন করতে চাচ্ছি না। একটা রিকুয়েস্ট। পদ্মকে কিছু বলো না।”

রাদ আহিকে ইশারায় ফোনটা রেখে দিতে বললো। আহি ফোন রেখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“এক্স-রে কয়টাই?”

“চারটায় সময় দিয়েছিল। ভাবছি আজ এখানেই থাকি। বাসায় কি বলবো বুঝতে পারছি না। মিসেস লাবণি তো সারাক্ষণ ফণা তোলে বসে থাকে।”

রাদ হেসে বলল,
“তোর লাইফের ট্রাজেডি দেখে একটা ফিল্ম বানাতে ইচ্ছে করছে।”

“বানিয়ে ফেল, দেখবি ফ্লপ হবে। এতো প্যারা নিয়ে কে বাঁচে ভাই? যারা মুভিটা দেখতে আসবে তাদের নাকের পানি, চোখের পানি মোছা টিস্যু পেপারে সিনেমা হল ভর্তি হয়ে যাবে।”

“তোর আজ পর্যন্ত ক’টা টিস্যু বক্স শেষ হয়েছে?”

“ধুর এতো ঢং করে কাঁদি না আমি। ওড়না আর হাত দিয়ে কাজ চালিয়ে ফেলি।”

রাদ হাসলো। হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে পড়লো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই কাউকে বলিস না আবার।”

“তেলাপোকাটা… আই মিন আফিফ শুনছে না।”

আহি আফিফের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বলল,
“না, ঘুমিয়ে গেছে হয়তো।”

রাদ হেসে বলল,
“পুষ্পকে বলবো অন্তত তোর কাছ থেকে যাতে ওড়না ধার না নেয়। আর তোর হাতে বানানো কিছুই খাওয়া যাবে না।”

আহি মুখ ফুলিয়ে রাদের দিকে বালিশ ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
“হ্যান্ডওয়াশ বলেও কিছু একটা আছে। আর শোন, মানুষ ইমোশনাল হলে টিস্যু হাতে নিয়ে বসে থাকে না। আমার প্যারাগুলো খেয়ে দেখিস, টিস্যু কোথায় সেটা দেখার সময় পাবি না, তখন পৃথিবীটাই অন্ধকার লাগবে।”

রাদ চুপ করে রইল। আহির চোখে অশ্রু টলমল করছে। রাদ আহির পাশে বসে বলল,
“সরি, মজা করছিলাম।”

“রাদ প্লিজ, আমি অনেক ঝামেলায় আছি। আমার ফিউচার এমন এক জায়গায় এসে আটকে গেছে, যেখানে আমি কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। সেখানে এসব পরিহাস, আমার জন্য অনেক কষ্টের।”

রাদ মাথা নিচু করে বসে রইলো। আহি রাদকে হালকা ধাক্কা দিতেই রাদ উঠে চলে গেলো। আহি অবাক দৃষ্টিতে রাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৯||

৭৮।
শূণ্য দৃষ্টিতে নভোমণ্ডলের কোমলরূপ দেখছে রাদ। আহি বারান্দায় এসেই রাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। রাদ আহির দিকে না তাকিয়েই বলল,
“তোর কষ্ট হলে আমারও কষ্ট হয়।”

আহি রাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোর কথায় আমি কষ্ট পাই নি, রাদ। তুই আমার মেডিসিন। মেডিসিন রোগ সারায়, রোগ বাড়ায় না।”

“একটা কথা বলি তোকে?”

“বল না। ”

“যখন তোর বিয়ে হয়ে যাবে, তখন কি আমার আর প্রয়োজন হবে না?”

আহি রাদের চোখের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“এখন আমারই মনে হচ্ছে, তুই আমার ভালো থাকার মেডিসিন।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। রাদের হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে তোর?”

রাদ বিরক্তির সুরে বলল,
“তোকে আমি তাজওয়ারের সাথে সহ্য করতে পারি না, আহি।”

“জানি আমি।”

“আহি, তুই যেভাবে বুঝেছিস ওটা না।”

“তাহলে কি? আচ্ছা, বস তুই। আমাকে খুলে বল, কি হয়েছে।”

“আমি তোকে হারাতে চাই না, ব্যস।”

“আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।”

“আহি, আমি ওটা মিন করি নি।”

“তো!”

রাদ আহির চোখের দিকে তাকালো। আহি কিছুক্ষণ রাদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তোকে এখন কিছু বলতে হবে না। তুই এই মুহূর্তে টায়ার্ড। বিশ্রাম কর। ইফতারের পর ঠান্ডা মেজাজে কথা বলবো। এখন ভেতরে চল।”

“তুই যা, আমি আসছি।”

আহি চলে যেতেই রাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বলল,
“আজ যা হওয়ার হোক, আমি তোকে আমার মনের কথা জানিয়ে দেবোই। সহ্য হচ্ছে না আর আহি। আমি কখনোই এতো চাপা স্বভাবের ছিলাম না। কিন্তু তোর ভালোর জন্য আমার মনের কথা এতোদিন আড়াল করে রেখেছি। এখন আর পারছি না আমি।”

এদিকে আহি রাদের অদ্ভুত আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে। আহির মনে হাজারও প্রশ্ন!
“রাদ কি আমার জন্য বিরক্তবোধ করছে? বার-বার আমার সব সমস্যার সমাধানে ওকে জড়াচ্ছি, তাই? না-কি তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হবে ভেবে উদ্বিগ্ন? না-কি রাদ আমাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে! না, না, না। কি ভাবছি আমি?”

আহি নিজের মাথায় ঠোকা মেরে বিড়বিড় করে বলল,
“এভাবে কেন ভাবছি আমি? রাদ শুনলে আমার উপরই কৌতূক করবে।”

আহি আফিফের পাশে বসে তার কপালে হাত রাখলো। আফিফ নিভু নিভু দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। আহি হাত সরিয়ে নিতেই আফিফ তার হাত ধরলো। আহি কিছুটা অবাক হলো। আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“পদ্মফুল, তুমি অনেক ভালো। কে বলেছে তুমি অলুক্ষণে? তোমার কোনো দোষ নেই। সব আমার দোষ। আমি অপরাধী। আমি সবাইকে কষ্ট দিয়েছি। তুমি, আপা, রেনু, মা আর আহি….”

রাদ রুমে ঢুকেই দেখলো আফিফ আহির হাত ধরে রেখেছে। রাদকে দেখে আহি বলল,
“আফিফ জ্বরের ঘোরে আমাকে পদ্ম ভাবছে।”

আফিফ মিনমিনিয়ে বলল, “পদ্ম, সরি।”

রাদ আহিকে সরিয়ে আফিফের পাশে বসে বলল,
“তুই যা। রেস্ট কর। নানুকে দেখছি রান্নাঘরে কি যেন করছে। গিয়ে হ্যাল্প কর। আমি উনার খেয়াল রাখবো, সমস্যা হবে না আমার।”

আহি মাথা নেড়ে চলে গেলো। আফিফ এখনো প্রলাপ বকছে। রাদ ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ বলতে লাগলো,
“আমি কি ছিলাম! আমাকে কি বানিয়ে দিয়েছে।”

রাদ এবার ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। সে আফিফের কাছাকাছি গিয়ে তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে। আফিফ বলতে লাগলো,
“পদ্ম, তুমি আমার সাথে রাগ করোনা। সব দোষ আমার। আমি যদি একবার জানতাম আমার খেয়াল, আমার কল্পনা আমার বর্তমানে আসবে, আমি কখনোই তোমার হাত ধরতাম না। আমি তোমার অজান্তে তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি, আমি আহিকে কষ্ট দিচ্ছি।”

রাদ সোজা হয়ে বসলো। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে উঠে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগিয়ে আবার আফিফের পাশে বসে বলল,
“পদ্মের সাথে কি করেছেন? কীভাবে কষ্ট দিলেন ওকে? আপনি সবচেয়ে বেশি আহিকে কষ্ট দিয়েছেন। আপনার জন্য আহি রাত-দিন কেঁদেছে। আর আপনার মনে এতো সহজে পদ্ম জায়গা করে নিলো।”

আফিফ চুপ করে রইলো। রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কে তুমি? পদ্ম কোথায়?”

“পদ্ম আমার পাশেই আছে। বলুন না কি করেছেন আপনি? আহিকে কেন কষ্ট দিয়েছিলেন?”

আফিফ ভেজা কন্ঠে বলল,
“ইচ্ছে করে দেই নি আমি। আমারই তো অনেক কষ্ট হয়েছে। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি আমি।”

রাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আপনি কষ্ট পেয়েছেন!”

“তাজওয়ার খান… আমার সব কেঁড়ে নিয়েছে। আহিকে বাঁচাতে হবে। আমি তো পারবো না। আমি একদম অসহায়? আমি অপদার্থ। আমি আমার আপাকেই বাঁচাতে পারি নি।”

“কি হয়েছে আপার সাথে?”

“আপা…!”

“হ্যাঁ বলুন না।”

“তাজওয়ার খান আমার আপাকে খুন করেছে। আমার আপাকে মেরে ফেলেছে ওরা। ওরা রেনুকেও মেরে ফেলবে। তখন আমি কি করবো?”

রাদ স্তব্ধ হয়ে গেলো আফিফের কথা শুনে। আফিফ বার-বার সেই একটি বাক্যই আওড়াতে লাগলো। তার চোখ বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রাদ টিস্যু দিয়ে তার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“কেন খুন করেছে তাজওয়ার!”

“জানি না, আমার কি দোষ ছিল! আমার কিছু করতে পারি নি। আপাকে বাঁচাতে পারি নি আমি।”

আফিফ বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো। রাদ থম মেরে বসে আছে। তার মনে হাজারও প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একমাত্র আফিফই দিতে পারবে।

(***)

ইফতারির পর আহি লাবণিকে ফোন করে জানালো, সে পুষ্পের বাসায় থাকবে। পুষ্পকে আগে থেকেই শিখিয়ে দিয়েছে সব। এরপর আহি লাবণির সাথে কথা বলে একবার আফিফকে দেখে এলো। আফিফের এখন জ্বর নেই। সে ঘুমাচ্ছে। রাদ তার পাশেই শুয়ে আছে। রাদ বলেছিল আহির সাথে কথা বলবে। তাই আহি রাদের পাশে বসে তাকে ডাকলো। রাদ সাড়া দেয় নি। আহি ভাবলো, রাদ ঘুমিয়ে গেছে। তাই আর বিরক্ত না করে বাতি নিভিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। এরপর সে সালমা ফাওজিয়ার রুমে এসে শুয়ে পড়লো।

এদিকে আহি চলে যেতেই রাদ উঠে বসলো। এই অস্থিরতা নিয়ে ঘুম হবে না তার। সে এতো বছর আহির অংশটাই শুনে এসেছে। আজ তাকে জানতেই হবে আফিফের অংশটা। কেন আফিফ আহিকে ছেড়ে এসেছিল? রাদ বাতি জ্বালিয়ে আফিফের সামনে এসে বসলো। আফিফ ঘুম। তার ইচ্ছে করছে আফিফকে উঠিয়ে দিতে। কিন্তু অসুস্থ মানুষকে এভাবে ডেকে উঠানো ভালো হবে না। তাই রাদ আফিফের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় আছে।

(***)

রাদকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আফিফ নড়েচড়ে উঠতেই রাদ বলল,
“এখন কেমন লাগছে আপনার?”

আফিফ পুরুষালি কন্ঠ শুনে চোখ খুললো। রাদকে দেখে একনজর আশেপাশে চোখ বোলালো। রাদ বলল,
“আপনি আহির মায়ের বাসায়। আমি আপনাকে দেখতে এসেছি।”

আফিফ উঠে বসলো। রাদ বলল,
“আপনার জ্বর বেশি ছিল, তাই এক্স-রে করাতে পারি নি। এখন কেমন লাগছে?”

“ভালো।”

“সরি, কিন্তু আপনাকে এই মুহূর্তে আমি অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করবো। যদিও এই প্রশ্নটা এই সময়ে করা উপযুক্ত না। কিন্তু আমার কৌতূহল আমি আটকে রাখতে পারছি না।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“তাজওয়ার খান আপনার আপাকে কেন খুন করেছিল? আহিকে আপনি কেন কষ্ট দিয়েছিলেন?”

আফিফ অবাক হয়ে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”

“আপনি নিজেই জ্বরের ঘোরে এসব বলেছেন।”

আফিফ চুপ করে রইলো। চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো তার। রাদ বলল,
“প্লিজ, কি হয়েছিল বলুন!”

“এসব জেনে লাভ নেই। আমি এসব বলতে চাচ্ছি না।”

“প্লিজ, আমি কাউকে এই বিষয়ে জানাবো না। অন্তত আমাকে বলবেন প্লিজ। আহির সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু আমার জানতে হবে। কারণ….”

আফিফ রাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“জানি, তুমি আহিকে ভালোবাসো।”

রাদ চুপ হয়ে গেলো। আফিফ বলল,
“ভালোবাসা সুন্দর। কিন্তু ত্যাগ মানেই যন্ত্রণা আর জেদ তেমনিই ভয়ংকর। আমার জীবনে এই কয়েকটা শব্দ আমার অগোচরেই এসেছে। আর আমাকে না জানিয়ে আমার সব কেঁড়ে নিয়ে গেছে।”

(***)

আফিফ থেমে রাদের দিকে তাকালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আহি জানেই না, ওর ভালোবাসা আমাকে কি দিয়ে গেছে। আমি যদি ওকে জানিয়ে দেই, ও অনেক কষ্ট পাবে। আর আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না।”

রাদ বলল, “কি হয়েছিল?”

আফিফ আজ আবার অতীতের ফেলে আসা অংশটা পুনরায় স্মরণ করলো।

“গ্রামেই বড় হয়েছি আমি। স্কুল-কলেজ ওখানেই শেষ করেছি। পড়াশুনায় ওতো আগ্রহ ছিলো না। ইচ্ছে ছিলো চিত্রশিল্পী হবো। আমার যোগ্যতাও ছিল। বাবা এসব পছন্দ করতেন না। কিন্তু আপা আমাকে খুব সাপোর্ট করতো। সচ্ছল পরিবারেই ছিলাম আমরা। কিন্তু একদিন রোড এক্সিডেন্টে বাবা মারা গেলো। আর এরপর আমার পুরো পৃথিবীটাই উলটপালট গেলো। আমি ছোট ছিলাম। মাকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই আমার মাও বেশিদূর পড়াশুনা করেন নি। বাবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো, তাই কোনো পেনশেন ছিল না। ব্যাংকে যে ক’টা টাকা ছিল, সেই টাকায় আমরা শুধু খেতে পারবো। আমার স্কুল বন্ধ। আপা ভাগ্যিস কলেজ পাশ করে ফেলেছিল। এরপর এক চাচার সাহায্যে শহরের মার্কেটে সেলস গার্লের চাকরি নেয়। এরপর আপা আমাকে পড়াশুনা করাবে সিদ্ধান্ত নেয়। এমনও দিন গিয়েছিল আমরা দু’বেলা ভাত খেতে পারিনি। আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছিলাম তাই কারো কাছে হাত পাততে পারি নি। আর আপা সব ঠিক করে দিয়েছিল। গ্রামের সবাই মাকে প্রশ্ন করতো, শহরে গিয়ে আপা কি কাজ করে? মা বলতো দোকানে কাজ করে। আমিও তাই বলতাম। কিন্তু মানুষের চিন্তা-ভাবনা এতো নোংরা ছিল, তারা আমাদের আড়ালেই ফিসফিস করতো। আমি বুঝতাম না। বয়স কম ছিল তাই। কিন্তু মা বুঝতো। আপার উপরই রাগ ঝাড়তো। কাজ ছেড়ে ভিক্ষা করতে বলতো। আপা কাঁদতো। কিন্তু কাজ ছাড়ে নি। এরপর একদিন আপা আমাকে গ্রামের কলেজে ভর্তি করিয়ে শহরে নিয়ে এলো। এখানে এসে চারুশিল্পে ভর্তি করিয়ে দিলো। কারণ আপার স্বপ্ন ছিল, আমার স্বপ্ন পূরণ করা। আমি কলেজে ক্লাস করতাম না। শুধু পরীক্ষা দেওয়ার জন্যই গ্রামে যেতাম। কিন্তু ওখানে মা আর রেনু ভালো ছিল না। গ্রামের মানুষগুলো বাবা জীবিত থাকাবস্থায় যতোটা ভদ্র আচরণ করেছিল, বাবার মৃত্যুর পর ততোটাই খারাপ হয়ে পড়লো। আপা বাধ্য হয়ে আমাদের শহরে নিয়ে আসে। এরপর খরচ আরো বেড়ে যায়। দিন-রাত আপা বাইরে কাজ করতো। দোকানে বসতো, এরপর স্কুলের আয়া হিসেবে কাজ নিয়েছিল। সব করেছে আপা, শুধু আমাদের জন্য। আর একদিন সেই আপাকেই নিজের সম্মান বিক্রি করে দিতে হলো, আমার জন্য।”

আফিফ এতোটুকু বলেই শার্টের হাতায় চোখ মুছলো। রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি আমাকে কখন ভালোবেসেছে আমি জানি না। কেন ভালোবেসেছে আমি জানি না। কি দেখেছে আমার মধ্যে আমি সেটাও জানি না। কিন্তু যখন ও আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, আমি ওকে ফিরিয়ে দেই নি। কারণ আমি ওর প্রতি কখনোই বিরক্ত ছিলাম না। আমি জানতামও না, আহি কে? আমি তো ওকে দেখিই নি। আমি শুধু অনুভব করেছি।”

রাদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আপনি আহিকে ভালোবাসতেন?”

“ভালোবাসতাম কি-না জানি না। ও আমার আঠারো বছর বয়সের অনুভূতি ছিল। আমি তখন কিশোর মাত্র। কিন্তু ভালো লাগতো সেই চিঠিগুলো। আমি সবগুলো চিঠি যত্ন করে রেখে দিতাম। হয়তো ভালোবাসতাম। আমি জানি না, অনুভূতিটা কেমন ছিল। কিন্তু কখনো আহির মতো করে আহিকে ভালোবাসি নি।”

“আহিকে পছন্দ করলে, ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ!”

“অনেক বড় কারণ। ছোটখাটো বিষয় না। আহির ভালোবাসা আমার পুরো জীবনটাই এলোমেলো করে দিয়েছিল। তাজওয়ার আহিকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। ও আহিকে ফলো করতো। আমি জানি না, ও কি দেখেছিল। কিন্তু ও আপাকে বলেছিল, আহি যেই পরিমাণ আমাকে ভালোবাসে, সেই পরিমাণ ঘৃণা আমার কাছ থেকে পাবে।”

“মানে?”

“একদিন আপা কাজ থেকে ফিরে এসে আমাকে বলেছিল-”

-আফিফ, তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে।

-হ্যাঁ বলো আপা।

-চারুশিল্পে কি কোনো মেয়ে আছে, যে তোকে পছন্দ করে?

আফিফ রাদকে বলল,
“আমি আপাকে চিঠিগুলোর কথা বলতে চাই নি। তাই মিথ্যে বলেছিলাম সেদিন। বলেছিলাম-”

-না আপা।

-দেখ, মেয়েটার কাছ থেকে দূরত্ব রাখবি। যে মেয়েটা তোকে চিঠি দেয়, সেই মেয়েটাকে এখানকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছেলে পছন্দ করে। ছেলেটা না-কি প্রতিদিন মেয়েটাকে ফলো করে। তোকেও দেখেছে। কি দেখেছে আমি জানি না। আমার মালিক বললো আমাকে। ওই ব্যবসায়ীর ছেলে হুমকি দিয়েছে, যেই মেয়েটা তোকে পছন্দ করে, তার পছন্দের মাত্রা যতো বেশি হবে, সে তোর কাছ থেকে ততোটুকু ঘৃণা ফের‍ত পাবে।

-মানে?

-মানে আমি জানি না। তুই শুধু মেয়েটার সাথে কথা বলিস না।

আফিফ আবার রাদের দিকে তাকালো আর বলল,
“এর মানে কি ছিল, তা আমি সেদিন একটুও বুঝি নি। আবেগের বয়স ছিল। তখনও না করি নি আহিকে। উলটো তাকে আমার দেখার আগ্রহ জন্মালো। আমি জানতে চাইছিলাম চিঠির মেয়েটা আসলে কে? আহিকে আমি দেখেছি, কিন্তু জানতেই পারি নি, আহি আসলে সেই মেয়েটা। মা ভীষণ পছন্দ করতো আহিকে। মায়ের হয়তো আহির চেহারা এখন আর মনেই নেই। আমার একবার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আহির মা আমার চিকিৎসা বাবদ খরচ দিয়েছিলেন। তখন আহি রোজ মাকে ফোন করতো। আমার খোঁজ নিতো। মায়ের কাছেই শুনেছিলাম এসব। এজন্য আমার আর পদ্মের বিয়েতে মা তেমন একটা খুশি ছিল না। মায়ের মনে হয়েছিল, সেই ফোনে কথা বলা মেয়েটিই আমার জন্য বেস্ট হবে। পদ্ম এখনও এসব জানে না। সে জানে না, মা আমাদের বিয়েতে রাজি ছিল না। আমার যখন এক্সিডেন্ট হয়েছিল তখন আপা বেঁচে ছিল না। আমি তখনও জানতাম না আপা কেন এতো বড় স্টেপ নিয়েছিল।”

রাদ জিজ্ঞেস করলো,
“উনি আত্মহত্যা করেছিলেন?”

“হুম।”

“তাহলে খুন করেছে কেন বললেন?”

“কারণ জানতাম না আত্মহত্যার মূল কারণ কে!”

“কে!”

“আপা একজনকে ভালোবাসতো। জানি না ছেলেটা কে। শুনেছি দোকানের মালিক। অনেকে বলে আপার সাথেই দোকানে বসতো। অনেকে বলে গ্রামে আপার এক প্রেমিক ছিল সে। আসলে আপা একজনকে ভালোবাসতো এটা সত্য। ফোনে কথা বলতো। এমন অনেক কিছুই খেয়াল করেছিলাম আমি। আমি এখনো জানি না সে কে। এতোটুকু জেনেছি, সে আমার আপার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আপার সাথে দেখা করার বাহানায় কিছু ব্যক্তিগত ভিডিও ধারণ করেছিল। আমি ভিডিও দেখি নি। মা দেখেছিল। আমি তখন জানতাম না, আপার কোনো অপরাধ ছিল কি-না। এদিকে ভিডিওটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার পর মা অনেক ভেঙে পড়েছিল। আমি এসব জানার আগেই আপাকে দেখেছিলাম। আপা আমার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় নি। সেদিন রাতেই আত্মহত্যা করে ফেললো। আমি আবার এতিম হয়ে গেলাম। আপার মৃত্যুর পর বুঝলাম, আসলে কি হয়েছিল। যেই নম্বর থেকে এসব ভিডিও ছাড়া হয়েছিল, তাকে খুঁজে বের করার জন্য টাকা জোগাড় করতে ব্যস্ত ছিলাম আমি। যাতে অন্তত ভিডিওগুলা ডিলিট করে দেয়। এরপর অনেকদিন কেটে গেলো। একদিন সেই মানুষটা আমার সামনে এলো, যে আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিলো।”

“তাজওয়ার খান?”

“হুম। তাজওয়ার নিজেই সব স্বীকার করেছে। বললো, আহিকে পাওয়ার জন্যই এমন করেছে। আহি আমাকে ভালোবাসে এটাই আমার অপরাধ ছিল। এরপর আমাকে হুমকি দিয়ে বলল, আমি যদি এখনই আহিকে নিয়ে ভাবা বন্ধ না করি, আহিকে সুযোগ দেই, একই কাজ সে রেনুর সাথে ঘটাবে। আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এসব পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আমার বয়স খুব কম ছিল। নিজেকে বোকা মনে হচ্ছিলো তখন। ভাবছিলাম, কি করলাম আমি? একটা কল্পনার জন্য আমার আপাকে মরে যেতে হলো? আমি রেনুর বড় ভাই। ওর দায়িত্ব আমার। কিন্তু তাজওয়ার বেশ চালাক। সে নিয়াজীর জন্য প্রস্তাব নিয়ে বাড়ি চলে গেলো। মাও রাজি হয়ে গেলো। আমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করার তার এই একটাই পথ খোলা ছিল, রেনু আর নিয়াজীর বিয়ে। বিয়েটা হয়েও গেলো। এটাও আমি পরে জানতে পারলাম যে তাজওয়ারই নিয়াজীকে বলেছিল রেনুকে বিয়ে করার জন্য। আর এরপর আহিকে না করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। আমি ভেবেছি ও আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু ভুলে নি। এরপর যেদিন আহিকে সামনা-সামনি দেখলাম, সেদিন পদ্ম আর আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমি যদি জানতাম তারা দু’জন বান্ধবী, আমি পদ্মকে বিয়ে করতাম না। পদ্ম অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি পদ্মকে ভীষণ ভালোবাসি। অতীত সবার জীবনে থাকে। আহি আমার ফেলে আসা অতীত। পদ্ম আমার বর্তমান। দু’জনই ভালো। হয়তো তাদের ভাগ্য খারাপ। কারণ আমি তাদের জীবনে এসেছিলাম।”

রাদ আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে সে বুঝতে পারছে না। এতোদিন সে আফিফের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এই মানুষটাই সবচেয়ে বেশি অসহায়।

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৩৫+৩৬+ বোনাস ১+২

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৫||

৭০।
পুষ্প বাসায় এসেই উজ্জ্বলকে আহির ব্যাপারে জানালো। সব শুনে উজ্জ্বলের চোখেমুখে বিষণ্ণতা ছেয়ে গেলো। এমন কিছু শুনবে সে আশাও করে নি। উজ্জ্বল পুষ্পকে বলল,
“আমাকে আহির ফোন নম্বরটা দে।”

পুষ্প বলল,
“সিমটা ওর বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা। ফোনে বেশি কথা না বলাই ভালো।”

“চিন্তা করিস না। দেখা করেই কথা বলবো।”

পরের দিন উজ্জ্বল আহিকে কল করলো। আহি কল রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“তোমার প্রিয় রেস্টুরেন্টের নাম বলো?”

আহি শুরুতেই এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। ওপাশে নিরবতা দেখে উজ্জ্বল বলল,
“আহি, শুনতে পারছো?”

“হ্যাঁ, আপনি!”

“গলার স্বর শুনেও চিনতে পারছো না? ওহ আচ্ছা, ফোনে তো আমাদের প্রথম কথা হলো।”

“আচ্ছা, চিনেছি। উজ্জ্বল ভাইয়া।”

উজ্জ্বল চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“একদম চমৎকারভাবে চিনলে। মনটা লাফিয়ে উঠলো।”

“মানে?”

“মানে টানে পরে হবে৷ আগে দেখা করো। কথা আছে।”

আহি একটা রেস্টুরেন্টের নাম বললো। উজ্জ্বল বলল,
“ওকে, আজই দেখা হচ্ছে তাহলে। বিকেলেই আসি। বিকেলের শহর অনেক চমৎকার। আর কাল থেকে রোজা শুরু। এরপর সব বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আজই দেখা করি।”

আহি হাসলো আর বলল, “আচ্ছা।”

(***)

আহি বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। অনেকদিন পর আবার সেই রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে আহি। লিনাশার সাথে কফি খেতে প্রায় সেখানে যাওয়া হতো। কলেজ ছুটির পর লিনাশা আর আহি সেই রেস্টুরেন্টে এসে এক ঘন্টা বসে আড্ডা দিতো। এখানের বার্গারটাও তাদের প্রিয় ছিল। আহি রিকশা থেকে নেমেই কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টটের গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল। পুরোনো হয়ে গেছে গেটটি। এই কয়েক বছরে শহরে অত্যাধুনিক সব রেস্টুরেন্ট খুলেছে। এই জায়গাটা সেই তুলনায় কিছুই না। শুধু স্বাদের কারণে এখনো টিকে আছে। আহি ভেতরে ঢুকতেই দেখলো সেই ফোন বুথের পাশে রাখা এক জোড়া চেয়ার। রেস্টুরেন্টটির আকর্ষণীয় স্থান এই ফোন বুথ। পুরোনো দিনের স্মৃতি হিসেবে রাখা। এখানে যারা এসেছে, এই বুথে ঢুকে টেলিফোন রিসিভার কানে নিয়ে একটা ছবি না তুলে কখনো যায় নি। আহি আর লিনাশাও এই কাজ করেছে। ছবিটা লিনাশার কাছেই ছিল।
অতীত মনে পড়তেই আহির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। সে এবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে উজ্জ্বলকে খুঁজতে লাগলো। নিচ তলায় বসার জায়গা অল্প। উপরেই বিস্তর পরিসরে বসার ব্যবস্থা আছে। আহি উপরে উঠে দেখলো দক্ষিণের খোলা আসনে আয়েশ করে বসে আছে উজ্জ্বল। আহি তার সামনে এসে দাঁড়াতেই উজ্জ্বল তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আহিকে বসতে বললো।

আহি আর উজ্জ্বল মুখোমুখি বসে আছে। দু’জনই নিরব। সৌজন্যমূলক হাসি হেসে উজ্জ্বল বলল,
“কি অর্ডার করবো?”

আহি মুচকি হেসে বলল, “জাস্ট কফি।”

“আর কিছু?”

“উহুম।”

উজ্জ্বল দু’কাপ কফি অর্ডার করে টেবিলের উপর দুই হাত রেখে ঝুঁকে বসলো। আহি বলল,
“ভালো আছেন?”

উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আমি তো বেশ বিন্দাস থাকি। তুমি বলো, কি অবস্থা তোমার!”

“ভালোই।”

“মোটেও না। পুষ্প আমাকে জানিয়েছে সব।”

আহি মলিন মুখে বললো,
“না ঘুরিয়ে সোজাসুজিই বলি। আমি আসলে তাজওয়ার খানকে বিয়ে করতে চাই না। এর জন্য অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। ওর সম্পর্কে অনেক খারাপ তথ্য আছে। কয়েক মাস আগেই ওর এক্স আমাকে ওর ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছে। ওর নারী আসক্তি বেশি। আর এমন একজনকে জেনেশুনে কেউ বিয়ে করতে চায়বে না। এরপর ওর পারিবারিক পরিবেশ বেশ উৎশৃঙ্খল। ওখানে আমি এডজাস্ট করতে পারবো না। সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার হলো, বাবা আমাকে একপ্রকার বাধ্য করছে। হুমকি দিচ্ছে। তাজওয়ারের বাবা আমার নানাকে গুম করিয়ে ফেলেছে। উনার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই নানু-মামারা আমাকে নিতে চায় না। মাকেও তারা সাহায্য করছে না। আমি এখন কি করব?”

“কখনো পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো নি?”

“মা আর আমি পালিয়ে গেলাম না হয়। কিন্তু এরপর আমার বন্ধুরা, তাদের পরিবার, আমার মায়ের পরিবার, সবার জীবন সংকটে পড়বে।”

“তোমার মনে হয় তোমার জন্য এতোগুলো মানুষের ক্ষতি করবে?”

“রাদ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। প্রথম আঘাত তো ওকেই করবে। আর ওর কিছু হলে আমি কি সহ্য করতে পারবো? মামাদের কিছু হলে মা কি সহ্য করতে পারবে? আর এভাবে পালিয়ে কতোদিন? একটা পার্মানান্ট সলিউশন দরকার।”

উজ্জ্বল চুপ করে রইলো। টেবিলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিনিট খানিক। গম্ভীরমুখে কি যেন ভাবছে সে। আহি হতাশ হয়ে পড়ছে। একটা পথ কি আদৌ খুলবে না-কি উজ্জ্বল অপারগ হবে। নিরবতা ভেঙে উজ্জ্বল বলল,
“তুমি সময় নাও। রিলেক্স থাকো। তাজওয়ারের সাথে এমন একটা ব্যবহার করবে যেন তুমি ওকে ভালোবাসো না, আবার বিশ্বাস করতে চায়ছো। তোমার বাবার ব্যাপারে তুমি যতোটা নেগেটিভ সবটাই তার সাথে শেয়ার করবে। তোমার সৎ মায়ের সাথেও তোমার মনোমালিন্য হয়। তুমি তোমার সেই ফ্রাস্ট্রেশন ওর সামনে প্রকাশ করবে। ও তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য অনেক কিছুই বলবে। তখনই তুমি ওর সান্ত্বনায় শান্ত হয়ে ওকে এটা বোঝাবে, বাবার চেয়ে তুমি ওকে বেশি বিশ্বাস করো। আর এরই মধ্যে ঠান্ডা মাথায় তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। তোমার বাবার আর লাবণির ব্যাংক ডিটেইলস নেওয়া শুরু করো।”

“এসব দিয়ে কি হবে?”

“যারা অনেক টাকার মালিক, তাদের অবৈধ টাকায় তাদের নিয়ে ডুবে। একবার যদি এমন কোনো শক্ত খবর পাওয়া যায়, তোমার বাবা তো সোজা লক আপে। এখন বোকার মতো কেইস করে কোনো লাভ নেই। আগে প্রমাণ যোগাড় করো। বিয়ে তো এখন হচ্ছে না। তাহলে অধৈর্য হচ্ছো কেন? এই একমাসে তুমি এই কাজটিই করবে। আর তাজওয়ার মুসলিম ছেলে। অন্তত রোজার মাসে তোমাকে বিরক্ত করবে না। তুমিও ওকে একটু ধর্মের কথা শোনাবে। এই একমাস তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। প্রথম কাজ তোমার বাবাকে সরানো। আর এই কাজে তোমাকে সাহায্য করবে তাজওয়ার নিজেই। তুমি এমনভাবে ওকে ফাঁসাবে, যাতে ও নিজেই তোমার বাবাকে পথে বসিয়ে দেয়। আর এরপর ওকে ফাঁসানো অনেক সহজ। কিন্তু স্বল্প সময়ের জন্যই পারবে। তাই তাজওয়ারের বিরুদ্ধেও শক্তপোক্ত প্রমাণ লাগবে।”

“আমি কি পারবো এসব করতে?”

“দেখো, তোমাকে তো পারতেই হবে। আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি আমি আমার সাধ্যের মধ্যে সবটা করবো। দেখো আহি, এরা প্রভাবশালী। এদের সাথে বাগবিতণ্ডায় জেতা যায় না। বুদ্ধি দিয়ে খেলতে হয়। তুমি তাদের বিরুদ্ধে যতো ব্রেইন ইউজ করবে। তত তারা তোমার পেছনে থাকবে আর তুমি জয়ের সন্নিকটে পৌঁছাবে। এতেও যদি কাজ না দেয় তাহলে সেই স্টেপটা নিতে হবে, যেটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আমার মনে হয় সেই স্টেপটা আপতত ভুলে যাওয়া ভালো।”

“কোন স্টেপ?”

“এটা আমি এখন তোমাকে বলবো না। দেখা যাবে এটা মাথায় ঢুকলেই তুমি অস্থির হয়ে সেই কাজ করে ফেলবে।”

“সুইসাইড!”

“পাগল তুমি? এটা কোনো সলিউশনই না। খবরদার এমন বোকা বোকা কাজ করলে। আমার উপর আস্থা রাখো। প্রমিজ করছি, তোমাকে আপদগুলোর কাছ থেকে উদ্ধার না করে আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি না।”

আহি হাসলো। উজ্জ্বলের কথায় অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। তার কথায় যে কেউ তাদের দমে যাওয়া সাহস ফিরে পাবে। যেমনটা আহি পাচ্ছে।

(***)

উজ্জ্বল আর আহি কথা বলছিল। এমন সময় একজন যুবক তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহি মুখ তুলে নায়ীব তামজিদকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। নায়ীব হেসে বলল,
“কেমন আছেন, মিস ওয়াসিকা?”

আহি হেসে বলল,
“ভালোই। আপনার কি অবস্থা?”

“আমিও বেশ ভালোই।”

নায়ীব উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বলও কৌতূহলী দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি বলল,
“বসুন না।”

“না, আপনারা বসুন। আমার স্পেশাল গেস্ট আসবে। আপনাকে দেখে এদিকে এলাম।”

“আচ্ছা।”

আহি উজ্জ্বলকে বলল, “উনি আমার ডক্টর।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ডক্টর!”

“সাইকায়াট্রিস্ট।”

উজ্জ্বল অবাক চোখে আহির দিকে তাকালো। নায়ীব উজ্জ্বলের চাহনি দেখে বুঝলো উজ্জ্বল আহির ব্যাপারে বেশিকিছু জানে না। অথচ আহি নির্দ্বিধায় উজ্জ্বলের সামনে এমন একটা বিষয় খোলাসা করে ফেললো। নায়ীব কিছু বলার আগেই পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠের কেউ একজন বলে উঠলো,
“নায়ীব।”

নায়ীব পেছন ফিরে তাকালো। মেয়েলী কন্ঠ শুনে আহিও সামনে তাকালো। এদিকে নায়ীব মেয়েটির দিকে এগিয়ে তার হাত ধরলো। আহি তা দেখে উঠে দাঁড়ালো। আহির চোখে-মুখে বিষ্ময়। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীব সরে দাঁড়াতেই মেয়েটির চোখ এবার আহির দিকে এসে ঠেকলো। মুহূর্তেই থমকে গেলো সে। নায়ীব তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আহির দিকে তাকালো। এরপর তার হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“লিনাশা, কি হলো? দাঁড়িয়ে গেলে কেন?”

আহি টেবিল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কয়েক পা এগুতেই লিনাশা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহিও লিনাশাকে ঘুরে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। উজ্জ্বল উঠে এসে আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“এনি প্রবলেম, আহি?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো, “লিনু।”

লিনাশা নায়ীবের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“নায়ীব, আমি নিচে নামছি। আমার একটা কাজ আছে।”

কথাটি বলেই লিনাশা নিচে নেমে গেলো। নায়ীব একনজর আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহির চোখে-মুখে মলিনতা। ভীষণ অবাক হলো নায়ীব। সেও এরপর নিচে চলে গেলো। উজ্জ্বল বলল,
“মেয়েটাকে চেনো?”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার ফ্রেন্ড, লিনাশা। ও পুষ্পেরও ফ্রেন্ড। আমাদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব। আমার ভাগ্য খারাপ, আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে এই ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, প্লিজ। আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। আমার মতো ভিখারিনী এই পৃথিবীতে নেই।”

(***)

নায়ীব লিনাশার পিছু পিছু এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“লিনাশা, ওভাবে চলে এসেছো কেন?”

লিনাশা নায়ীবকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “সরো তো!”

“তুমি মেয়েটাকে চেনো?”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি মেয়েটাকে কীভাবে চেনো?”

“ও আমার পেশেন্ট ছিল।”

লিনাশা থমকে গেলো। ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানে?”

“তোমাকে বললাম না একটা মেয়ের কথা? একটা ছেলেকে ভালোবাসে। শুধু ভালোবাসে বললে ভুল হবে, প্রচন্ডভাবে ভালোবাসে। মেয়েটা মানসিকভাবে অসুস্থ। পারিবারিক অবস্থাও ভালো না। এটাই সেই মেয়েটা। মিস ওয়াসিকা।”

লিনাশার চোখেমুখে বিষণ্ণতা ছেয়ে গেলো। নায়ীবের হাত ধরে বলল,
“ও তোমাকে সব বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

“ও কি বলেছে ওর একটা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল, যাকে হারিয়ে ফেলেছে?”

নায়ীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ।”

“কেন হারিয়েছে?”

“পারিবারিক সমস্যার কারণে। ডিটেইলসে কিছু বলে নি। এইটুকু বলেছে যে ওর বাবার সাথে তার ফ্রেন্ডের বাবার ঝামেলা হয়েছিলো। যার জন্য তার ফ্রেন্ডের বাবা মারা গিয়েছিল।”

লিনাশা থমথমে কন্ঠে বললো,
“আহিই সেই মেয়ে। আমার বড় আপু আহির বাবাকে বিয়ে করেছিল। তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমার বড় বোন কোথায়? আমার বড় বোন লাবণি মেহেরা, চট্টগ্রামের নামকরা ব্যবসায়ী রিজওয়ান কবিরকে বিয়ে করে, নিজের বাবা-মাকে মার খাইয়ে চলে গেছে। আর আমার বাবা সেটা সহ্য করতে না পেরে, আমাকে আর মাকে ফেলে ওপারে চলে গেছে। আহির কারণে হয়েছে এসব। ওই মেয়েটার কারণে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। না ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হতো, না আমি আমার বাবাকে হারাতাম।”

নায়ীব লিনাশার হাত ধরে বলল,
“বাসায় চলো। পাগল হয়ে গেছো তুমি। বাচ্চাদের মতো কথা বলছো।”

“আমি বাচ্চাদের মতো কথা বলছি?”

“অবশ্যই। তুমি কি বুঝতে পারছো না, আহি অসুস্থ? তোমার বড় বোন যেই কাজ করেছে, তার জন্য তুমি নিজের দিকটাই দেখছো? তুমি বাবা হারিয়েছো? তাহলে আহি কি তার মাকে হারায় নি? তাদের সম্পর্কের কারণে আহিকে কতোটা সাফার কর‍তে হচ্ছে, তুমি কি জানো? মেয়েটা অসুস্থ। আমি ওর ট্রিটমেন্ট করেছি। ওর হ্যালুসিনেশন হয়। এমন জিনিস ভাবে যেটার অস্তিত্বই নেই। কখন হয় এসব? যখন মানুষ ডিপ্রেশনে থাকে। আর মানুষ ডিপ্রেশনে কেন থাকে? যখন আপন কেউ পাশে থাকে না। আহি মাকে হারিয়েছে, তোমার বোনের জন্য। তার বাবাকে হারিয়েছে, তোমার বোনের জন্য। আহির বাবা তাকে এমন এক ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে, যাকে আহি বিয়েই করতে চায় না, তোমার বোনের ইন্সপায়ারে। এতোটুকু তো আহি আমাকে বলেছে। তোমার সাথে বন্ধুত্ব করে কি ও সাফার করছে না? এতোটা স্বার্থপর তুমি!”

নায়ীব গাড়ির দরজা খুলে বলল,
“উঠো গাড়িতে। তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেবো।”

লিনাশা অশ্রু ভেজা দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকিয়ে রইলো। নায়ীব লিনাশার গালে হাত রেখে বলল,
“সরি, তোমাকে বেশি বলে ফেলেছি। আমি তোমাকে সত্যটা বললাম শুধু। ভুল বুঝাবুঝি বন্ধুত্বে হয়, তাই বলে এমন শাস্তি? আমি জানি তুমিও আহিকে মিস করো। তোমার ওয়ালে সেই ছবিটা আহি এঁকে দিয়েছিল, তাই না?”

“তুমি কীভাবে বুঝলে?”

“এই মাত্র বুঝলাম। তুমিই তো বললে আহি তোমার ফ্রেন্ড। আর আমি তো জানি আমার পেশেন্ট ভালো ছবি আঁকে।”

লিনাশা চোখ মুছে আবার রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালো। নায়ীব লিনাশাকে সেদিকে যেতে দেখে গাড়িতে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো, আর আনমনে হাসলো। শেষমেশ তবে দুই বান্ধবীর মিল হতে যাচ্ছে।

(***)

আজ তৃতীয় রোজা। প্রতিদিনের মতো বেলা বারোটায় ঘুম ভাঙলো আহির। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা হাতড়ে ফোন হাতে নিতেই চমকে উঠলো সে। ফোনে পঁচিশটা মিসড কল। রাদ কল করেছে। রাদ এতোগুলো কল কেন করলো? আহি কল ব্যাক করতেই রাদ সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুই কোথায় আহি?”

“এই মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।”

“এক্ষুণি ন্যাশনাল হসপিটালে আয়। লাবীবকে ওখানে এডমিট করিয়েছি।”

আহি অবাক কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে ওর?”

“বাইক এক্সিডেন্ট!”

আহি ভীত কন্ঠে বলল,
“সিরিয়াস কিছু হয় নি তো!”

“মোটামুটি। মাথায় আঘাত পায় নি। হাত-পায়ে ব্যথা পেয়েছে।”

“আমি আসছি এক্ষুণি।”

আহি ফ্রেশ হয়ে বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিলো। রিজওয়ান কবিরও লাবীবের এক্সিডেন্টের খবর শুনে আহির হাতে টাকা দিয়ে, একটা চেক লিখে দিয়ে বললেন,
“প্রয়োজন হলে তুলে নিও।”

আহি গাড়ি নিয়ে হাস্পাতালে পৌঁছে গেলো। কেবিনের বাইরে এসে দেখলো উজ্জ্বল আর পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প আহিকে দেখে দৌঁড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি পুষ্পকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। পুষ্প কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি লাবীবকে ভীষণ ভালোবাসি, আহি। আমার না কেমন লাগছে আমি তোকে বোঝাতে পারবো না। আমার কারণেই এমনটা হয়েছে। আমিই ওর বাইকে উঠতে চাচ্ছিলাম না। আমার রাগ ভাঙানোর জন্য ও স্টান্ট করছিল, তখনই পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো।”

পুষ্প কথাটি বলতে বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। আহি পুষ্পের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“যাকে ভালোবাসিস, তাকে কেন পাগল বানাবি? তার সাথে কীসের অভিমান? এখনই সুযোগ ভালোবাসার। প্রতিটা সেকেন্ড একে অপরের যত্ন নিবি, আগলে রাখবি, ভালোবাসবি। সবার ভাগ্যে ভালোবাসা থাকে না, পুষ্প। তাহলে পেয়ে কেন অবহেলা করিস?”

উজ্জ্বল আহির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আসলেই অসাধারণ। যতোবারই দেখে ততোবারই মুগ্ধ হয়।

(***)

রাদ আহিকে দেখে ওষুধগুলো পুষ্পের হাতে দিয়ে বলল,
“এগুলো নার্সকে দিয়ে আসো।”

এরপর আহির হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলো। আহি বলল,
“টাকা নিয়ে এসেছি।”

“লাগবে না আপতত। রিলিজ দেওয়ার সময় লাগবে। লাবীবের জ্ঞান ফিরেছিল। ও বললো আপতত ওর বাসার কাউকে না জানাতে।”

“আচ্ছা, এদিকে নিয়ে এলি কেন আমাকে?”

“অনেকদিন আমার সাথে কথা বলিস নি। এনগেজমেন্টের পর কেমন যেন পালটে গেছিস। তাজওয়ারকে ভালোবেসে ফেলেছিস না-কি!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“পাগল না-কি তুই? ওই বেটার প্রেমে আমি পড়বো? নো ওয়ে।”

“কাল রেস্টুরেন্টে একসাথে ইফতার করেছিস!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুই আমাকে দেখেছিস!”

“হ্যাঁ।”

“ডাকিস নি কেন?”

“তোর ফিয়োন্সের সামনে কিভাবে যাবো? আর আমার সাথে আমার কলেজের বন্ধুরা ছিল।”

“শখ করে তাজওয়ারের সাথে খেতে যাই নি। কারণ আছে। তোকে সময় করে সব বলবো।”

“বাদ দে এসব। ওই বেটাকে বিয়ে করতে হচ্ছে কেন? চল পালিয়ে যাই।”

আহি বুকে হাত গুঁজে বলল, “তারপর!”

“বিয়ে করে ফেলবো তোকে।”

“তোর বাবা-মাকে মেরে ফেলবে। চিনিস না খান সাহেবকে! এরপর দেখা যাবে আমার জন্য তুই ঝামেলায় পড়েছিস।”

“তুই রাজি থাকলে আমি সব ঝামেলা কাটাতে পারবো।”

“আচ্ছা, হঠাৎ তুই আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস কেন?”

“বিয়ের বয়স হয়েছে, ভাবলাম তোকেই বিয়ে করে ফেলি। পার্মানেন্ট বেস্ট ফ্রেন্ড পেয়ে যাবো। তাজওয়ারকে বিয়ে করলে আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখা তো সম্ভব হবে না। তোর যে কোয়ালিফাইড ফিয়োন্সে! এর আশেপাশেও আমি নেই।”

আহি রাদের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“পৃথিবীর কোনো কোয়ালিফাইড পুরুষ, আমার এই এলোমেলো সুপুরুষ বন্ধুকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না।”

রাদ আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“কীভাবে বলবো আহি? কীভাবে বলবো, তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৬||

৭১।
অগ্রহায়ণের সুশীতল হাওয়া জানালা গলে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। এলোমেলো ঘরে এদিক-ওদিক শপিং ব্যাগ ছড়ানো। ব্যাগগুলো ঠেলে একপাশে রেখে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো লিনাশা। ইদের এক সপ্তাহ পরই নায়ীবের সাথে তার বিয়ে।

নায়ীব আর লিনাশার তিন বছরের প্রেমের সম্পর্ক। তাদের দেখা হয়েছিল বইয়ের দোকানে। শহরে সেই বছর ফাল্গুন মাসে পনেরো দিনের বই মেলা হয়েছিল। লিনাশা সেদিন সন্ধ্যায় তার পছন্দের একটি বই কেনার জন্য মেলায় এসেছিল। ভাগ্যক্রমে একটি স্টলে সেই বইটি পাওয়া গেলো। লিনাশা যে-ই বইটিতে হাত দিতে যাবে, তার আগেই একজন যুবক সেই বইটি নিয়ে নিলো। লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে সেই যুবকটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। অপরিচিত একটি মেয়ের এমন অদ্ভুত চাহনি দেখে ছেলেটি লিনাশাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো সমস্যা?”

লিনাশা বইটি কেঁড়ে নিয়ে বলল,
“এই বইটি কেনার জন্য আমি অনেক দূর থেকে এসেছি।”

এবার ছেলেটি লিনাশার হাত থেকে বইটি টেনে নিলো। আর বলল,
“এটা লাস্ট পিস, আর এটা আমার লাগবেই।”

লিনাশা কিছু বলার আগেই ছেলেটি বইয়ের দাম দিয়ে দিলো। লিনাশা বইটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এদিকে ছেলেটি বই নিয়ে চলে গেলো। আর লিনাশা দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, বইটা কি অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না?”

দোকানদান মাথা নেড়ে বলল,
“এটা লিমিটেড ছিল। বইটি আর বের হবে না।”

লিনাশা মলিন মুখে হাঁটতে লাগলো। মনে মনে লেখককেই বকাবকি করছিলো সে। কেমন লেখক, অল্প কিছু বই বের করেই হারিয়ে গেছে! হঠাৎ লিনাশার সামনে সেই অপরিচিত ছেলেটি এসে দাঁড়ালো। এবার লিনাশা বলল,
“কি সমস্যা?”

“বইটি কি আপনার খুব প্রয়োজন?”

“হ্যাঁ। কিন্তু স্টক আউট।”

“আপনি চাইলে আমি আপনাকে বইটি ধার দিতে পারি।”

“কেন?”

“কারণ আমি কাউকে হতাশ করতে চাই না।”

“আপনি কোথাকার হিতৈষী।”

“এই দেশেরই। এই জেলারই। কাছেই আমার বাড়ি।”

“এতোকিছু জানতে চাই নি। বাই দা ওয়ে, আপনি আমাকে বই ধার দেবেন কীভাবে?”

“এই যে হাত দিয়েই দেবো। আমি আপনাকে হাতে হাতে দেবো, আর আপনি আমাকে হাতে হাতেই ফেরত দেবেন।”

লিনাশা ভ্রূ নাচিয়ে বলল,
“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। আপনি আমাকে কোন আক্কেলে বিশ্বাস করছেন?”

ছেলেটি হাসলো। বলল,
“আমি মানুষ দেখেই বুঝতে পারি, সে কেমন। আমার মনে হলো, আপনি বইটি পড়েই আমাকে ফেরত দেবেন। এমনকি বেশ যত্নও করবেন। বইয়ে দাগ দেওয়ার আগে একশো বার ভাববেন।”

লিনাশা অবাক হয়ে বলল,
“আপনি পাক্কা কোনো জ্যোতিষী।”

ছেলেটি আবার হাসলো। এরপর বুক পকেট থেকে একটা কলম বের করে বইয়ের উপর কিছু একটা লিখে লিনাশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। লিনাশা অবাক চোখে ছেলেটির যাওয়া দেখছে। এরপর আকাশসম বিষ্ময় নিয়ে বাসায় এসে বইটির পাতা উল্টাতেই দেখলো, সেখানে ছেলেটির নাম আর ফোন নম্বর লেখা। লিনাশা তা দেখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। জীবনে প্রথম কোনো ছেলে তাকে ফোন নম্বর দিয়েছে, বেশ ভালোই লাগলো তার৷ বার কয়েক আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো সে। হয়তো অভিনব কৌশলে নম্বর আদান-প্রদান করে প্রেম করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো। বেশ ভাব আসলো লিনাশার। সেই নম্বরটিতে কল দেওয়ার তীব্র বাসনায় দু’দিনেই বইটি শেষ করে ফেললো সে। এরপর দু’দিন পর সন্ধ্যায় কল করলো নম্বরটিতে। বেশ ব্যস্ত মানুষ তো! চার বার কল দেওয়ার পরও ধরলো না? অভিমান হলো লিনাশার। কিন্তু ফিরতি কল এলো রাত দশটার একটু পর। লিনাশার মান-অভিমান ভেঙে গেলো মুহূর্তেই। গলা খাঁকারি দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে কলটা রিসিভ করলো সে। এরপর ওপাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো,
“হ্যালো, নায়ীব তামজিদ বলছি।”

“আমি লিনাশা মেহেরা।”

“জ্বি, কোনো প্রয়োজন!”

“বইটা পড়া শেষ।”

নায়ীব বেশ অবাক হলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। মনে পড়তেই মুচকি হেসে লিনাশার সাথে কুশল বিনিময় করলো। জিজ্ঞেস করলো,
“বইটি কেমন লেগেছে?”

আরো বললো, লিনাশা যেন এক বাক্যে বইটির চমৎকার একটা রিভিউ দেয়। নায়ীবের‍ এমন গম্ভীর কথাবার্তায় লিনাশা হাঁপিয়ে উঠছিল। প্রেমের কথা কম, পড়ালেখার কথায় যেন বেশি ছিল তাদের কথোপকথনে। লিনাশা বেশ বিরক্ত। জীবনে প্রথম কোনো ছেলে তাকে নম্বর দিয়েছে, তাও এমন আঁতেল! লিনাশা কল কেটে ঘুমিয়ে পড়লো। এর কয়েকদিন পর বইটি ফেরত দেওয়ার জন্য তাদের দেখা হলো একটি রেস্টুরেন্টে। বেশ ফিটফাট পোশাক পরেই আগমন ঘটলো নায়ীব তামজিদের। সেদিন নায়ীব লিনাশার হাবভাব দেখেই বুঝে ফেললো, এই সুদর্শন যুবকটিকে লিনাশার ভালো লেগেছে। একজন পুরুষের জন্য এটা বেশ মজার বিষয়, যে কোনো মেয়ে তাকে পছন্দ করেছে, আর সে এটা ধরতেও পেরেছে। তবে নায়ীব বেশ ভদ্র। সে লিনাশার পছন্দের প্রতি সম্মান রাখলো। বেশ ভালোই কথাবার্তা হলো তাদের। আধুনিক যুগের বিস্তর প্রভাবে দু’জনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরও আদান-প্রদান হলো। ব্যস, লিনাশা পেয়ে গেলো সুযোগ। প্রায়ই এটা-সেটা নিয়ে নায়ীবকে মেসেজ করতো সে। নায়ীবও ধীরে ধীরে লিনাশার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লো। দু’জনের বয়সের ব্যবধান মাত্র পাঁচ বছর। আর তখন লিনাশা পড়তো অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। কিন্তু বয়সের তুলনায় বেশ ইম্যাচিউর ছিল সে। আর নায়ীব সেই ইম্যাচিউর মেয়েটিকেই একদিন ভালোবেসে ফেললো।
নায়ীব মনে করে প্রেমিকাদের অন্তত প্রেমিকের সামনে একটু ন্যাকা বোকা হতে হয়। তবেই প্রেম জমে। নায়ীব আর লিনাশা বেশ ভালোভাবেই তাদের প্রেম জমিয়েছে, যার পরিণতি আজ বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে।

(***)

প্রায় আধা ঘন্টা বিছানায় বিষণ্ণ মনে শুয়ে ছিল লিনাশা। আজ রমজানের প্রথম সপ্তাহ শেষ। এক সপ্তাহ আগেই আহির সাথে ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়েছিল তার। নিজের মিথ্যে অহমিকায় সেদিন আহির সাথে কথা না বলেই বেরিয়ে এসেছিল রেস্টুরেন্টটি থেকে। পরবর্তীতে নায়ীব বোঝানোর পর সেখানে আবার গিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে দেখল আহি বেরিয়ে গেছে। লিনাশার ভীষণ খারাপ লাগছে। আহির সাথে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। আরেকবার দেখা হলেই জড়িয়ে ধরবে তার প্রিয় বান্ধবীকে। কতো বছরের জমানো অশ্রু গড়িয়ে পড়া বাকি! এতোগুলো বছরে কতোশত কথা জমে আছে। সবটাই তো আহিকেই শুনাবে সে। আহি ছাড়া কে আছে তার?

(***)

খানস গ্রুপে আজ বেশ বড়সড় ভাবেই ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। ইফতার শেষে তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে সবার সামনে এনে দাঁড় করালো। আহি বেশ বিরক্ত। তবুও উজ্জ্বলের কথামতো সে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে অভিনয় করার চেষ্টা করছে। তাজওয়ার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনারা তো জানেনই এই মাসে আমার এনগেজমেন্ট হয়েছিল। আজ আমি আমার ফিয়োন্সের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেবো। মিট উইথ মাই লাভলী ফিয়োন্সে, ওয়াসিকা কবির আহি। এন্ড ওয়ান এন্ড অনলি বিউটিফুল ডটা’র অব মিস্টার রিজওয়ান কবির।”

আহি উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিতেই ভীড়ের মাঝে তার চোখ আটকে গেলো আফিফের দিকে। অনেকদিন পর আফিফকে দেখলো সে। ইদানীং ক্লাসে যায় না আফিফ। অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে, তাই হয়তো। আহি চোখ সরিয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“খুব শীঘ্রই আহি আমাদের বিজনেস গ্রুপে জয়েন করবে।”

সবাই হাততালি দিচ্ছে। আহি নিচে নেমে আসতেই তাজওয়ার তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
“নেমে এলে যে!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“সবই বুঝলাম, কিন্তু তোমার বিজনেস গ্রুপে জয়েন হচ্ছি, এটা কেন বললে?”

“কেন, ভুল কিছু বলেছি?”

“অবশ্যই। আমি বিজনেস করবো না। আমি আর্টিস্ট হবো, আর এটাই আমার ড্রিম। আর আমার এসব ভালো লাগে না। অন্তত এদিক থেকে কি আমি স্বাধীনতা পাবো না?”

তাজওয়ার আহির কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“সব করতে পারবে তুমি। পাশাপাশি এই বিজনেসটাও দেখবে।”

তাজওয়ার আহির চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। আহি বেশ অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু তাকে সহ্য করতে হবে। নয়তো সে তার আসল ধাপে যেতেই পারবে না।

এদিকে আফিফ অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলো তাজওয়ার আর আহি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য দেখে হুট করেই মনটা ভারী হয়ে এলো তার। আফিফ অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়ালো। কিন্তু গাড়ি ডাকলো না। আনমনেই হাঁটতে লাগলো ফুটপাত ধরে। আহিকে তাজওয়ারের সাথে দেখে কেন খারাপ লাগবে তার? এটাই তো হওয়ার ছিল। আফিফ হাঁটতে হাঁটতেই পা ফসকে ফুটপাত থেকে রাস্তায় পড়ে গেলো। তখনই দু’টি হাত তাকে উঠানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আফিফ মুখ তুলে তাকাতেই দেখলো আহি। আফিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি!”

আহি আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,
“রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন হয়তো। শরীরটা বেশ খারাপ মনে হচ্ছে! বাইক আনেন নি?”

“না।”

“আমি রিকশা ডেকে দিচ্ছি।”

“দরকার নেই।”

“অন্যকিছু ভাববেন না। আপনি একদিন আমাকে রিকশা ঠিক করে দিয়েছিলেন। সেদিন আমি একটু অসুস্থ ছিলাম। আজ মনে হলো, আপনি অসুস্থ। আফটার অল, আপনি আমার বান্ধবীর হাসবেন্ড। এতোটুকু ফর্মালিটি রাখা আমার দায়িত্ব।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ফর্মালিটি!”

আহি রিকশা ঠিক করে দিয়ে বলল,
“কেন ইনফর্মাল কিছু তো আপনি আশা কর‍তে পারেন না!”

আফিফ কিছু না বলেই রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশা চলে যেতেই আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আফিফের মায়া কি সে আদৌ ছাড়তে পারবে? যদিও আজকাল তেমন একটা কষ্ট হয় না। জীবন তাকে এতো বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে যে আর কষ্ট পেয়ে অশ্রু গড়ানোর শক্তিটুকুও তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। কষ্টগুলো এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস হয়েই বেরিয়ে আসে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০১||

৭২।
মলিন মুখে বসে আছে লিনাশা। নায়ীব তার হাত ধরে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমি তোমাকে এভাবে দেখতে পারছি না।”

লিনাশা নায়ীবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে তোমার পেশেন্টের সাথে আমার দেখা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।”

“আমি তোমাকে ফোন নম্বর দিয়েছি। আহিকে তুমি নিজেই কল করতে পারো।”

“তোমার কি মনে হয়, আমি দেই নি? দিয়েছি। কিন্তু কথা বলার সাহস হয় নি। ও হ্যালো হ্যালো করছিলো, আর আমি চুপ করে বসেছিলাম।”

“কেন করলে এমন?”

“এতো বছর পর ফোনে কথা বলা যায় না। সামনা-সামনি বসেই কথা বলা উচিত। আমাদের অনেক গ্যাপ হয়ে গেছে। প্লিজ, দেখা করানোর ব্যবস্থা করো। তুমি ওকে ফোন করে বলো আসতে।”

“তোমার ফ্রেন্ড তুমি বলতে পারছো না?”

লিনাশা নায়ীবের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
“ধুর, যাও তো। লাগবে না তোমার হ্যাল্প।”

নায়ীব লিনাশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে লিনাশার পাশে এসে বসলো। তারপর লিনাশার সামনেই আহির নম্বরে ডায়াল করলো। লিনাশা তা দেখে এক গালে হেসে নায়ীবের দিকে তাকালো। নায়ীব কানের কাছে ফোন নিয়ে লিনাশার দিকে ঘুরে বসলো। কয়েক সেকেন্ড পর কলটা রিসিভ হতেই নায়ীব বলল,
“আহি, আমি ডক্টর নায়ীব বলছি। তোমার সাথে কি আজ ইফতারের পর দেখা করা যাবে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “হঠাৎ!”

“কেউ একজন তোমার সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব।”

লিনাশা চোখ বড় বড় করে নায়ীবের দিকে তাকালো। নায়ীব মুখ চেপে হাসছে। লিনাশা নায়ীবের হাতে কামড় বসিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“এটা কেন বলেছো? তুমি এটা ঠিক করো নি।”

ওপাশে আহি চুপচাপ হয়ে আছে। নায়ীব বলল,
“কি হয়েছে আহি?”

“ওকে একাই আসতে বলবেন। যেখানে আমাদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেই জায়গায়।”

নায়ীব লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা উৎসুক দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকিয়ে আছে। নায়ীব কল কেটে লিনাশাকে বলল,
“তোমাদের স্মৃতি জড়িত স্থান কোনটা!”

“স্কুল!”

“ওখানে দেখা করতে বলেছে!”

“মার্কেটে?”

“তুমি তো বললে স্কুল।”

“স্কুল কি সন্ধ্যায় খোলা থাকে?”

“তোমাদের স্মৃতি জড়িত স্থান কি অনেকগুলো না-কি!”

“হ্যাঁ। স্কুল তো স্বাভাবিক স্মৃতি জড়িতই হবে। কিন্তু স্কুলের পাশে যেই শপিং মলটা আছে, আমরা প্রতিদিন ক্লাস শেষে ওখানে গিয়ে ফুচকা খেতাম। ইদের আগে একসাথে ওখানে গিয়ে শপিং করতাম। ওই মলের প্রায় সব দোকানদাররা আমাদের চিনতো। কলেজের পর সেই রেস্টুরেন্টটা ছিল আমাদের জন্য স্পেশাল, যেখানে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আরেকটা রেস্টুরেন্ট আছে, ওখানে আমরা চারজন একসাথে যেতাম। কিন্তু আমার আর আহির আলাদা কিছু জায়গা আছে। একটা পার্ক আছে ওখানে বসে বাদাম খেতাম আর প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রেম দেখতাম। দিনগুলো ভীষণ ভালো ছিল৷ কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড় এসে আমার আর আহির জীবনটা শেষ করে দিয়ে গেলো। আর ও-তো এতো আনলাকি ছিল, যাকে ভালোবাসতো, সেই ছেলেটাই আমাদের ফ্রেন্ড পদ্মকে বিয়ে করে ফেলে। আহি পাগলের মতো ভালোবাসতো ছেলেটাকে।”

নায়ীব বলল, “এখনো ভালোবাসে।”

“জানি। এতো সহজে কাউকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। আর ওর ভালোবাসার গভীরতা অনেক বেশি। মেয়েটা যাকে ভালোবাসে, তাকে ভীষণভাবে ভালোবাসে। আর আফিফকে একটু বেশিই ভালোবাসতো।”

“বাদ দাও এসব। এখন তোমার উচিত ওর পাশে থাকা। আহির এই মুহূর্তে ভালো বন্ধু প্রয়োজন। তোমার জায়গাটা এতো বছর যে নিয়েছে সেটা বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি হয়ে গেছে।”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“রাদকে চেনো?”

“রাদ কে?”

“তোমাদের স্কুলে পড়তো!”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। কিন্তু রাদ এখানে কেন এলো?”

“ছেলেটাই আহির সাথে এসেছিল। ট্রিটমেন্টের পুরোটা সময় সে আহির পাশে ছিল। ছেলেটাকে দেখে আবার প্রমাণিত হয়ে গেল, ছেলে-মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না। তারা প্রেমে পড়তে বাধ্য। ছেলেটা আহিকে ভালোবাসে। ওর চোখে-মুখে ভীষণ অস্থিরতা দেখেছি আমি। মানসিক ভাবে সেও অসুস্থ। কিন্তু আহির দৃষ্টিতে রাদ শুধুই তার বন্ধু। যদি আহি বিষয়টা মেনে নিতে না পারে, কষ্টটা আহিরই বেশি হবে। মেয়েটা এমনিতে অসুস্থ। সে যদি জানতে পারে রাদ তাকে ভালোবাসে। আর সেই সম্পর্কটা যদি আহি মন থেকে মেনে নিতে পারে, তাহলে ওদের বন্ধুত্বে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হবে। আর এই দূরত্বে সবচেয়ে বেশি আহি কষ্ট পাবে। কারণ মেয়েটা অনেক দিক দিয়েই সাফার করছে।”

(***)

ইফতারের পর আহি আর লিনাশা সেই শপিংমলে চলে গেলো। লিনাশা আগে থেকেই সেই ফুচকার দোকানে বসা ছিল। আহিকে দেখেই সে উঠে দাঁড়ালো। লিনাশা জড়তার ভারে নুইয়ে পড়ছে। কিন্তু আহি এখনো সেই প্রাণবন্ত মেয়েটিই রয়ে গেলো। সে লিনাশাকে দেখেই তার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলো আর ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরলো তাকে। লিনাশাও আহিকে জড়িয়ে ধরলো। দু’জনের চোখে অশ্রু। তারা আজ নিঃশব্দে কাঁদছে না। দু’জনই ফুঁপিয়ে কান্না করছে। যেন বহু যুগ পর দেখা হলো দুই বান্ধবীর। আহি লিনাশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যাস না। সবাই শুধু আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি তো পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ থাকার জন্য আসি নি।”

লিনাশা আহিকে ছেড়ে তার চোখ মুছে দিলো। এরপর আহিকে চেয়ারে বসিয়ে তার পাশেই বসলো। আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“সরি। একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছি।”

লিনাশা নিজের চোখ মুছে বলল,
“তোর বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমি এমন সময়ে তোর হাত ছেড়েছি, যখন তোর সবচেয়ে বেশি আমারই প্রয়োজন ছিল।”

“তুই তো ইচ্ছে করে ছাড়িস নি। আমার ভাগ্যটাই এমন ছিল। আমি কাউকেই বেশিদিন কাছে পাই না। এখানে তোর কোনো অপরাধ নেই। সব অপরাধ আমার। আমি কবির সাহেবের মেয়ে। এটাই আমার জীবনের ভয়ংকর সত্য।”

লিনাশা আহির হাত ধরে বলল,
“এই সত্যটা এই মুহূর্তে ভুলে যা। মনে কর, আজ অনেক বছর পর আবার সেই চৌদ্দ বছরের আহি আর লিনাশা একে অপরের সাথে দেখা করতে এসেছে।”

আহি লিনাশার দিকে তাকিয়ে হাসলো। দু’জন বসে অনেক গল্প করলো। এতো বছরের জমানো কথাগুলো শেষ হতে হতেই কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গেলো।
মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। আহি আর লিনাশা সেখান থেকে বের হয়ে দেখলো নায়ীব গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীব আহি আর লিনাশাকে দেখেই তাদের দিকে এগিয়ে এলো। আহি বলল,
“থ্যাংক ইউ। আপনার জন্যই আমি লিনাশাকে ফিরে পেয়েছি।”

নায়ীব মুচকি হেসে বলল,
“এমন বন্ধুত্ব হারিয়ে যাক, আমি চাই না। এমন বন্ধু আজকাল হয়ও না। ইদানীং সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। কে আছে বান্ধবীর আঁকা ছবি ওয়ালে সাজিয়ে রাখে? কেইবা ফোনের স্ক্রিনে বান্ধবীর আঁকা ছবিটাই রাখে! কে আছে যার স্মৃতিতে পুরোনো বান্ধবীরা বেঁচে থাকে? সত্য তো এটা, বছর না ঘুরতেই যোগাযোগ বন্ধ। আর যোগাযোগ বন্ধ মানেই ভুলে যাওয়া। কিন্তু তোমাদের এতো বছরের দূরত্ব, অথচ কেউ কাউকে ভুলো নি। দু’জনই ল্যাভেন্ডার পছন্দ করে, দু’জনেরই প্রিয় ফুল কাঠগোলাপ।”

আহি আর লিনাশা হাসলো। দু’জনের ঠোঁটেই প্রশান্তির হাসি। এতো বছর পর আহি তার প্রিয় বান্ধবীকে ফিরে পাবে, তা সে আশায় করে নি। সৃষ্টিকর্তা তাকে নিরাশ করেন নি। সে যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। হয়তো সময়টা দীর্ঘ ছিল। আহি আকাশের দিকে তাকালো। বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। আজ তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। তার মন বলছে, সে সব ফিরে পাবে। হয়তো সময়টা আরেকটু দীর্ঘ হবে। কিন্তু একবার যেহেতু সৃষ্টিকর্তা তার এতোদিনের প্রার্থনা কবুল করে ছোট একটা ইশারা দিয়েছেন, তাহলে ভবিষ্যতেও তার পাশেই থাকবেন।

(***)

কয়েকদিন বেশ ফুরফুরে মেজাজে দিন কাটছে আহির। প্রতিদিন তিন ঘন্টা লিনাশার সাথে ফোনে কথা বলে সময় কাটায় সে। আর ইফতারের পর দু’জনই ইদের বাজার করতে বেরিয়ে যায়। যতোক্ষণ মার্কেট খোলা থাকবে ততোক্ষণ দুই বান্ধবী ঘুরাঘুরি করবে। পনেরো রোজার পর থেকে মার্কেট বন্ধ হবে আরো দেরীতে। এখন প্রায় দোকান সেহেরী পর্যন্ত খোলা থাকে। আহি আর লিনাশা সেই সময়টুকু ঘুরে ফিরে সেহেরী করে বাসায় ফিরে। তাদের প্রতিদিনের কথা যেন শেষই হচ্ছে না। বেশ কয়েকদিন যাবত মিসেস লাবণি এসব লক্ষ্য করছেন। লিনাশার সাথে আহির কথাবার্তা হয়, সেটা তিনি জানেন না। তাই লাবণি ধরে নিয়েছেন আহি রাদের সাথেই ঘুরাঘুরি করছে।

আজ ইফতার শেষে আহি নিজের রুমে এসে শুয়ে রইলো। লাবণি হুট করে রুমে ঢুকে বলে উঠল,
“আজ থেকে তোমার বাইরে যাওয়া বন্ধ।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কেন? হরতাল ডেকেছে না-কি!”

“হ্যাঁ। হরতালই হচ্ছে।”

“জরুরি অবস্থা জারি করলেও আমি আপনার সকল আইন প্রত্যাহার করবো।”

“তুমি ইদানীং বেশ উড়ছো।”

“উড়ার সামর্থ থাকলে ধরতেই পারতেন না।”

“আহি, মুখে মুখে কথা বলবে না।”

আহি বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। হঠাৎ কি ভেবে সে মিসেস লাবণির কাছে এসে তার হাত মুড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে আপনি নিজের ইশারায় আর নাচাতে পারবেন না। আমি যা ইচ্ছে, করবো।”

মিসেস লাবণি আহিকে ধাক্কা দিতেই আহি সরে দাঁড়ালো। এরপর পাশ ফিরে টেবিলে রাখা ফুলদানিটা ফেলে দিলো। মুনিয়া খালা আর চুনি শব্দ শুনে উপরে উঠে আসার আগেই আহি ধপ করে ভাঙা কাঁচগুলোর উপর নিজের হাত চেপে ধরলো। লাবণি ভ্রূ কুঁচকে আহির কাণ্ড দেখছে। মুনিয়া খালা এসে আহিকে এই অবস্থায় দেখে তার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। চুনি আর খালা মিলে আহিকে উঠিয়ে বিছানায় বসালো। আহি কাঁদো কাঁদো মুখে লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আপনার খেলনা নই। আপনি আমার সাথে যেমন ইচ্ছে তেমন করতে পারেন না।”

আহি এরপর চাপা স্বরে চুনিকে বলল,
“তাজওয়ারকে কল দিয়ে বলো, লাবণি আমাকে মেরেছে। আমি বলতে বলেছি এটা ভুলেও বলো না।”

চুনি মাথা নেড়ে চলে গেলো। এদিকে লাবণি তো হনহনিয়ে নিচে নেমে এসেছে। তিনি আহির বিরুদ্ধে এক গাদা অভিযোগ নিয়ে বসে আছেন। রিজওয়ান কবির বাসায় এলেই আহির ঠাঁট ছাড়াবেন এই আশায় নিজের ঘরে এসে অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। এদিকে চুনি তাজওয়ারকে ফোন দিয়ে ঘটনায় আরো মশলাযুক্ত করে বলল,
“তাজওয়ার ভাইজান, আমি চাঁদনি কইতেছি। আফারে বাঁচান। রক্তে বইয়া যাইতেছে ঘর। আম্মা আর আমি মিল্লা রক্ত পরিস্কার করতে করতে বেহুঁশ হই যাইতেছি। ছোট ম্যাডাম আফারে যে মারাটাই না মারলো। কেমন জল্লাদ! আমার চোখ ভিজা যাইতাছে। কইবার পারতাছি না আর। আপনে ছাড়া আফার আপন কেউ নাই। ভাইজান তাড়াতাড়ি বাসায় আইয়া পড়েন।”

তাজওয়ার কল কেটে তাড়াতাড়ি আহির বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। চুনি আহির কাছে এসে বলল,
“আফা, বেশি কইয়া ফেলছি। রক্ত-টক্ত আরেকটু চাইপা চুইপা বাইর করন যাই না!”

“মানে!”

“ভাইজান রে কইছি আপনি মাইর খাই রক্তে মাখামাখি হই গেছেন।”

আহি হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“চাঁদনি, আমার ব্যথায় হাত জ্বলে যাচ্ছে। আর তুমি আছো রক্ত আরো বের করার চিন্তায়। তবে এক কাজ করা যায়৷ ঘর পরিস্কার করার জন্য একটা বালতি নিয়ে আসো। এরপর আমার রঙের কৌটা থেকে লাল রং বের করে পানির সাথে মিশিয়ে দাও। অন্তত পানি দেখে ভাববে রক্ত মাখা ঘর পরিস্কার করেছো।”

“সস আছে ফ্রিজে। ওইটাও আনি!”

“পাগল! গন্ধ নাকে গেলেই বুঝবে এসব নাটক করছি।”

“আফা, আপনে কি সত্যিই নাটক করতাছেন?”

“হাতে কি মিথ্যে মিথ্যি কাটা দাগ দেখছো?”

“না, আফা। আগে ছোট মেডাম কিছুই কইলেই আপনে কাঁনতেন। আর আজ হাত কাইটা গেছে, আর আপনের চোখেমুখে শয়তানি হাসি।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে চুনির দিকে তাকালো। চুনি দুই গালে হাত ছুঁইয়ে বলল,
“তওবা তওবা। শয়তান তো ছোট মেডাম। আফনে না। ওই ইংরাজি তো কই না। সিপ সিপ কি জানি।”

“স্লিপ।”

“হ হ ওইটাই। সিপ কইরা বাইর হই গেছে। মুখের দোষ। আমার না।”

আহি চোখ ছোট করে চুনির দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে তাজওয়ার আহিদের বাসায় এসে সোজা আহির রুমে চলে গেলো। তাজওয়ারকে আসতে দেখে চুনি দৌঁড়ে এসে বলল,
“আফা একটু মুখটা বাঁকায় রাখেন। ভাইজান রে ওই শয়তান মেডামের বিরুদ্ধের ভালোমতো বুঝাই দিয়েন। কাঁনদেন আফা, কাঁনদেন।”

তাজওয়ার আহির রুমে এসে দেখলো আহি মুখ অসার করে বসে আছে। তাজওয়ারকে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কেন এসেছো এখানে? যা, এই মুহূর্তে আমি তোমার অত্যাচার নিতে পারবো না।”

তাজওয়ার আহির কাছে এসে তার পাশে বসে বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”

আহি ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলতেই তাজওয়ার আহির হাত উলটে দেখলো, হাতের তালুতে দাগ হয়ে গেছে। পাশে চোখ পড়তেই দেখলো বালতির পানিগুলো লাল হয়ে গেছে। চুনি বালতিটা উঠিয়ে নিয়ে বলল,
“স্যার, যে রক্ত!”

আহি চোখ বড় বড় করে চুনির দিকে তাকালো। তাজওয়ার আহির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চুনি চলে যেতেই আহি বলল,
“প্লিজ তাজওয়ার, আমাকে একা ছেড়ে দাও। একা ছাড়তে না পারলে খুন করে চলে যাও।”

“কি হয়েছে বলবে!”

“হরতাল ডেকেছে। আমি না-কি বাসা থেকে আর বেরুতেই পারবো না। অনেক বছর পর আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে পেয়েছি। সামনে ওর বিয়ে। ওর সাথে ইফতারির পর সময় কাটাচ্ছি। ওটাও মিসেস লাবণির সহ্য হচ্ছে না।”

“কোন ফ্রেন্ড?”

“লিনাশা।”

তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে নিচে নেমে গেলো। তাজওয়ার যেতেই আহি আয়নায় নিজেকে দেখে ঠোঁট উল্টে বলল,
“রানীর উপর আইন চাপানোর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে মিসেস লাবণি। তোমার প্রিয় আদুরে হবু জামাই সাহেবই তোমাকে শায়েস্তা করতে এসেছে।”

আহি তার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই হাতে আজ যন্ত্রণার মেহেদি পরেছি, শুধু আমার শত্রুদের হারানোর জন্য। আর আমি তোমাদের সবাইকে হারিয়েই মুক্ত হবো।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||

৭৩।
তাজওয়ার নিচে নেমেই মুনিয়া খালার মুখোমুখি হলো। মুনিয়া খালাকে দেখে সে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“মিসেস লাবণি কোথায়?”

মুনিয়া খালা মাথা নিচু করে বললেন,
“বড় ম্যাডাম তার ঘরে।”

“আহির এই অবস্থা উনি করেছেন?”

মুনিয়া খালা চুপ করে রইলেন। তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“একটা ছুরি নিয়ে আসো।”

মুনিয়া খালা চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। চুনি পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইজান, মাইরা টাইরা ফেলবেন না-কি!”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি একটা কথা দ্বিতীয় বার বলা পছন্দ করি না।”

মুনিয়া খালা পা বাড়ানোর আগেই চুনি দ্রুত পদে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
“আমি যাইতাছি। আম্মার যাইতে যাইতে সকাল হইয়া যাইবো।”

চুনি একটা ধারালো ছুরি এনে তাজওয়ারের হাতে দিয়ে দ্রুত পিছিয়ে গেলো। তাজওয়ার এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ছুরিটা দেখছে। চুনি ঢুক গিলে মায়ের হাত চেপে ধরে বলল,
“আম্মা, সচক্ষে খুনাখুনি দেইখলে কি পুলিশ আমাগোরে ধইরা নি যাইবো?”

মুনিয়া খালা মেয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“চুপ কর ফাজিল মাইয়া। ছুরি দিতে কইলো, আর তুই দিয়া দিলি?”

তাজওয়ার এবার মুনিয়া খালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা প্লেট নিয়ে আসো। আর প্লেট ভর্তি মরিচ আর লবণ নিয়ে আসবে।”

চুনি হেসে বলল,
“যাও আম্মা, আমরা হুদাই ভয় পাইতাছি। স্যার তো আপেল খাইবো, তাই ছুরি আনাইছে।”

মুনিয়া খালা ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“লবণ মরিচ দিয়া আপেল খাই তোরে কে কইছে? পেয়ারা, আমড়া, আমলকি এইসব খাই শুনছিলাম।”

“টেবিলে তো আপেল ছাড়া কিছুই নাই। ওও, হয়তো স্যারের পকেটে আছে। গ্যারেজে দাঁড়াইয়া থাকে পোলাডার পকেটেও ফল থাকে। চুরি কইরা নিয়া আসে। আমারেও দেয়।”

“এহন কি এইসব কইবার সময়? যা ছোড মারে ডাইকা আন। আমি মরিচ নিয়ে আইতাছি।”

মুনিয়া খালা এক প্লেট মরিচ আর লবণ নিয়ে এসে তাজওয়ারের দিকে এগিয়ে দিলো। তাজওয়ার টেবিলে ছুরি আর প্লেটটি রেখে বলল,
“মিসেস লাবণিকে নিচে ডেকে আনো।”

মুনিয়া খালা মাথা নেড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠার আগেই মিসেস লাবণি নিচে নেমে এলেন। তাজওয়ারকে দেখে তিনি ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“তাজওয়ার, তুমি হঠাৎ এখানে?”

তাজওয়ার চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা তুলে বসে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আপনাকে উপহার দিতে এসেছি।”

মিসেস লাবণি মৃদু হেসে বললেন,
“আমাকে উপহার! কীসের!”

“আপনি ভালো করেই জানেন, আপনি আমাকে কি দিয়েছেন। একটা উপহার তো আপনার পাওনা থাকেই।”

মিসেস লাবণি হেসে বললেন,
“বেশ তো! কি সেই উপহার? আমিও তো আগ্রহী আমার হবু জামাইয়ের উপহার গ্রহণ করতে।”

তাজওয়ার হাসলো। কপালে হাত ঘষতে ঘষতে বলল,
“হাত এগিয়ে দিলেই তো পাবেন।”

মিসেস লাবণি দুষ্টু হাসি হেসে বললেন,
“শাশুড়ির সাথে এমন দুষ্টুমি মানায় না।”

“ইয়াং শাশুড়ির সাথে সবকিছুই মানায়। আফটার অল, শাশুড়ি মা তো আমার বয়সী।”

মিসেস লাবণি হাত এগিয়ে দিলেন। তাজওয়ার চোখের পলকেই টেবিল থেকে ছুরিটা নিয়ে লাবণির হাতের তালুতে চালিয়ে দিলো। মুনিয়া খালা তা দেখে ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। লাবণি চিৎকার করে উঠলো। লাবণির চিৎকার শুনে আহি আর চুনি অবাক দৃষ্টিতে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। এদিকে লাবণি হাত চেপে ধরে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই তাজওয়ার তার হাত ধরে রক্তমাখা স্থানটি লবণ-মরিচ মিশ্রিত প্লেটের উপর এনে রাখলো। লাবণি তাজওয়ারকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তাজওয়ার আরো শক্ত করে তাকে চেপে ধরে বলল,
“আহিকে আঘাত করার অধিকার কারো নেই। যে আহিকে আঘাত করবে, আমি তার অস্তিত্ব মিটিয়ে দেবো। আহিকে ভালোবাসার অধিকার আমার, আঘাত করার অধিকারও আমার।”

আহি নিচে নেমে লাবণির এই অবস্থা দেখে তাজওয়ারের দিকে দৌঁড়ে এগিয়ে এলো। আর চেঁচিয়ে বলল,
“পাগল তুমি!”

তাজওয়ার ভাবলেশহীন সুরে বলল,
“তোমাকে দেওয়া আঘাতের চেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছি আমি। আগামী এক সপ্তাহ বাম হাতেই সব কাজ সারতে হবে।”

আহি চুনির দিকে তাকালো। চুনি মুখ চেপে হাসছে। আহি নিজের হাসি আটকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বলল,
“তুমি কেন আমার জন্য উনাকে আঘাত করছো? আমার জন্য কারো কিছু করতে হবে না। আমার ভাগ্যে এসবই আছে।”

লাবণি চেঁচিয়ে বলল, “অভিনয় বন্ধ করো, আহি।”

তাজওয়ার ভয়ংকর দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকাতেই লাবণি চুপ হয়ে গেলো। তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। চলো আমার সাথে।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, তাজওয়ার। আমার ভালো লাগছে না। তুমি ডাক্তার বাসায় নিয়ে আসো। আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”

এদিকে লাবণি হাত পরিস্কার করে মুনিয়া খালাকে বললেন হাতে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার জন্য। মুনিয়া খালা শশব্যস্ত হয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। লাবণি এবার কাতর মুখে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাজওয়ার কিছু বলার আগেই তিনি বললেন,
“আহি কি তোমাকে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে কিছু বলেছে? দেখো, আমি কিন্তু ওর হাতে ব্যথা দেই নি। ও নিজেই এমন করেছে।”

আহি অবাক দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার কাছে প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ নেই তাই সবাই আমার সাথে যা ইচ্ছে ব্যবহার করছে।”

আহি এবার তাজওয়ারের হাতে সেই ছুরিটা দিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“প্লিজ কিল মি, আমি এসব আর নিতে পারছি না।”

আহি মাথায় হাত চেপে ধরে বলল,
“শরীরটা অবশ হয়ে আসছে আমার।”

তাজওয়ার আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চোখ-মুখ কুঁচকে মনে মনে বলল,
“এই বেটা জড়িয়ে ধরার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করবে না!”

তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “আ’র ইউ ওকে?”

লাবণি বললেন,
“আহি ঠিকই আছে। এসব ওর নাটক। বিশ্বাস করো না ওকে। ও নিজেই নিজের হাত কেটেছে।”

তাজওয়ার রাগী স্বরে বলল,
“কেন কাটবে নিজের হাত? নিশ্চয় আপনিই ওকে বাধ্য করেছেন!”

“বাধ্য করি নি৷ শুধু বলেছি রাদের সাথে সেহেরি পর্যন্ত ঘুরাঘুরি না করতে।”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“রাদ এসবের মধ্যে কেন আসছে? রাদের সাথে আমি ঘুরাঘুরি করি আপনাকে কে বলেছে? যদি এই মুহূর্তে আপনি প্রমাণ করতে পারেন, আমি এতোদিন রাদের সাথে ঘুরেছি, তাহলে আমি এক্ষুণি নিজের প্রাণ নিয়ে নেবো।”

“আচ্ছা, তাহলে তোমার নতুন কোনো প্রেমিক নিশ্চয়?”

তাজওয়ার রাগী স্বরে বলল,
“আহি ওর ফ্রেন্ড লিনাশার সাথে ছিল।”

মিসেস লাবণি তাজওয়ারের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। পরক্ষণেই তিনি বললেন,
“তোমাকে কে বলেছে?”

“আহি বলেছে।”

তাজওয়ারের কথায় লাবণি এবার বিস্তর হাসলেন। এরপর হাসি আটকে বললেন,
“আর তুমি বিশ্বাসও করলে?”

“মানে!”

“আরেহ, লিনাশা আমার বোন। তুমি কি লিনাশার ব্যাপারে কিছু জানো না? লিনাশা আর আহির দেখা হওয়া অসম্ভব। ওদের তো কোনো যোগাযোগও নেই। লিনাশা তো আহিকে সহ্যই করতে পারে না।”

আহি মনে মনে হাসলো। তাজওয়ার আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি এবার চুনিকে বলল,
“চাঁদনি, আমার ফোনটা নিয়ে আসো।”

লাবণি বললেন, “ফোন দিয়ে কি করবে?”

“আমাকে তো লিনাশা সহ্যই করতে পারে না। আমিও সবাইকে জানাতে চাই, লিনাশা আমাকে কি পরিমাণ ঘৃণা করে।”

চুনি ফোন নিয়ে আসতেই আহি ফোনের লগ তাজওয়ারকে দেখিয়ে বলল,
“এটাই ফাইনাল, আজকের পর থেকে কেউ যদি আমার প্রাইভেসি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, না আমি এই বাসায় থাকবো, না আমি তোমাকে বিয়ে করবো। অসহ্য লাগছে এসব! আমি মানুষ, কোনো যন্ত্র নই।”

আহি এবার লিনাশার নম্বরে ডায়াল করলো। এরপর কলটা লাউড স্পিকারে রাখলো৷ লিনাশা হ্যালো বলতেই লাবণি চমকে উঠলো। লিনাশা বলল,
“আহি, আমি একটু পর তোকেই ফোন করতাম। চল আজ রাতে জুয়েলারি শপে যাই। বিয়ের পর পরার জন্য কিছু চুড়ি কিনবো ভাবছি।”

আহি লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আজ বাদ দে। আমার হাত কেটে গেছে।”

লিনাশা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কীভাবে কাটলো?”

“এসব বাদ দে। ওমন কিছু হয় নি। আমি এখ রাখছি। পরে কথা হবে।”

আহি কল কেটে দিয়ে লাবণিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বন্ধুত্বে মান অভিমান থাকে, কিন্তু ঘৃণা করা, অসহ্য লাগা এই শব্দগুলো বন্ধুত্বে মানায় না।”

লাবণি কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাজওয়ার বলল,
“আহির সাথে ফার্দার এমন বিহেইভ করলে, আমি এবার হাতে ছুরি চালিয়েছি মাত্র। পরের বার হাতটাই কেটে দেবো। আহির যা ইচ্ছে করবে, আপনার অনুমতির প্রয়োজন নেই। রানী কারো অনুমতি নেয় না। একমাত্র রাজার আদেশ ছাড়া সে কারো আদেশে চলতে বাধ্য নয়। আর আহি তাজওয়ার খানের রানী।”

তাজওয়ার কথাটি বলে আহির কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়লো। আর যাওয়ার আগে বলল, সে ডাক্তার পাঠিয়ে দেবে।

এদিকে তাজওয়ার চলে যেতেই আহি লাবণির সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবণি ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি লাবণির হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাজা যেই হোক, রানীর ক্ষমতার কাছে তার সবটাই শূন্য। দাবার ঘরে যেমন রানীর আধিপত্য বেশি, এবার আপনার চক্রে আমার আধিপত্য বেশি। এবার দেখা যাক, মিসেস লাবণি মেহেরার আধিপত্য কতোদূর?”

লাবণি রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,
“তোমার এমন পরিণতি করবো, তুমি আর নিজের চেহারাও আয়নায় দেখতে চায়বে না।”

৭৪।

আহি মলিন মুখে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। তাজওয়ার তার সামনে বসা। দু’জনই আজ একসাথে ইফতার করেছে। আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি গতকাল মিসেস লাবণির সাথে যা করেছো ঠিক করো নি। এটা অন্যায়। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না। উনি আমার উপর এতো অত্যাচার করেছে, সেই তুলনায় তার হাতে দেওয়া ক্ষতটা একদম নগন্য।”

আহি তাজওয়ারের হাত ধরে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমি মাকে হারিয়েছি একমাত্র উনার জন্য। শুধু মাকে নয়, লিনাশার সাথেও অনেক বছর আমার যোগাযোগ ছিল না। তোমাকে আমি বিয়ে করতে কেন ভয় পাচ্ছি, জানো? কারণ আমি জানি তুমি সব মেয়েদের সাথেই মেলামেশা করো। বাবাও তেমন ছিল। আর এরপর বাসায় এসে আমার মাকে কষ্ট দিতো। আমি এসব দেখে বড় হয়েছি। আমার মন ভেঙে গেছে, তাজওয়ার। আমি সহ্য কর‍তে পারি না এসব।”

তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“আমি তোমার সাথে এমন করবো না, আহি। তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দেবো না।”

আহি মলিন মুখে বলল,
“বিশ্বাস তো হচ্ছে না। তবুও এই মুহূর্তে তোমাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। কেন করছে, জানি না।”

তাজওয়ার মুচকি হাসলো। আহির হাতে তার ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“তুমি হয়তো আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো, আর এটা তুমি বুঝতেই পারছো না।”

আহি মনে মনে বলল, “বয়েই গেছে আমার!”

এবার তাজওয়ার বলল,
“কাল আমার বন্ধু একটা পার্টি এরেঞ্জ করেছে। তুমি সন্ধ্যার পর তৈরী থেকো।”

“রমযান মাসে কীসের পার্টি!”

“আরেহ ওরকম কিছু না৷ সবাই একসাথে ডিনার করবো।”

“ইফতারের আয়োজন করতে পারতো। আমার এসব বোরিং লাগে। আর তোমার ফ্রেন্ডদের আমি মোটেও বিশ্বাস কর‍তে পারি না। বিয়ের পর অন্তত ওরা যাতে আমার সামনে না আসে।”

তাজওয়ার মুচকি হেসে বলল,
“তুমি যা বলবে, তাই হবে। কিন্তু পার্টিটা এটেন্ড করতেই হবে। প্লিজ আহি, না করো না। তোমাকে অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। আফটার অল, আমাদের এনগেজমেন্টের পর কোথাও ঘোরা হয় নি।”

তাজওয়ারের অনুরোধে পরদিন আহি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলো। কালো জামদানী শাড়ি পরে এসেছে আহি। গাড়ি থেকে নামতেই সে চমকে উঠলো। কারণ তাজওয়ার তাকে মিথ্যে বলেছিল। এটা কোনো সাধারণ অনুষ্ঠান না। আশেপাশে মৃদু আলো জ্বলছে। সুইমিংপুলের পাশে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে। পাশে খোলামেলা পোশাক পরে অনেকগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে নেশাদ্রব্য গ্রহণ করছে। আহি তাজওয়ারের দিকে তেড়ে এসে বলল,
“এটা তোমার বন্ধুর ডিনার পার্টি!”

তাজওয়ার বলল, “রিল্যাক্স।”

তখনই পেছন থেকে আফিফের কন্ঠ ভেসে আসতেই আহি পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো আফিফ সবাইকে ওয়াইন গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে। আহি তা দেখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হচ্ছে এসব?”

তাজওয়ার বলল,
“আরেহ তুমি জানো না? আফিফ রাফাত এখন আমার পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট!”

“পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট কি ওয়েটারের কাজ করে?”

“তাজওয়ার খানের এসিস্ট্যান্টকে সব করতে হয়। তোমার কেন সমস্যা হচ্ছে, আহি?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আফিফ আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড। জিনিসটা দেখতেই দৃষ্টিকটু লাগছে।”

“কাম অন সুইটহার্ট। এমন ফ্রেন্ড বানাও কেন, যাদের ক্লাসই তোমার সাথে ম্যাচ করে না!”

আহি বিরক্ত মুখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আফিফকে ডাকতেই আফিফ আর আহির চোখাচোখি হলো। আফিফ চোখ নামিয়ে ট্রে নিয়ে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার বাঁকা হেসে একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচাতেই মেয়েটি এলোমেলো পা ফেলে আফিফের দিকে এগিয়ে এলো। আফিফের কাছাকাছি আসতেই মেয়েটি আফিফকে হালকা ধাক্কা দিলো, আর ওমনি আফিফের হাতে থাকা গ্লাসটি উলটে গেলো, আর গ্লাসে থাকা সব এলকোহল মেশানো পানীয় আহির শাড়িতে ছিঁটকে পড়লো। আহি কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই আফিফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“সরি, সরি।”

তাজওয়ার হুট করে সবার সামনে আফিফের গালে সশব্দে চড় বসিয়ে দিলো। আফিফ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি নিজেও অবাক। সে তাজওয়ারের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“পাগল হয়ে গেছো?”

“আমাকে পাগল বলছো তুমি? দেখলে না ও কি করলো?”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩২||

৬৩।
হেমন্তের অমত্ত সমীরণ বাতায়ন গলে ঘরে প্রবেশ করছে। ঘরের পর্দাগুলো সেই সমীরণের তালে দুলছে। মনে হচ্ছে ঘরে উপস্থিত মানুষটির অনুভূতির ঢেউ এদের নাড়িয়ে দিচ্ছে৷ উজ্জ্বল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি টেবিলের উপর রাখা স্থির চিত্রটির দিকে। ঠোঁটে তার মৃদু হাসি। চিত্রটির একটা নামকরণ প্রয়োজন। উজ্জ্বল তার চোখ দু’টি বন্ধ করে মনে মনে দু’টো শব্দ আওড়ালো। এরপর চোখ খুলে চিত্রটির দিকে ঝুঁকে বলল,
“হিয়ার পীড়ন।”

উজ্জ্বলের বন্ধু রইস সেই মুহূর্তে তার ঘরে এসে বলল,
“কি রে উজি, তোকে যখনই ফ্রি দেখি তোর সামনে এই ছবিটা থাকবেই। কি আছে এই ছবিতে?”

উজ্জ্বল মুচকি হেসে বলল,
“একটা মেয়ের অনভূতি। বেশ চমৎকার এই অনুভূতিটা! এমনই একজন মেয়েকে কে না চায়!”

“কি আবোল-তাবোল বকছিস? তোর মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে৷ তুই তো আমাকেই পাগল করে দিচ্ছিস।”

উজ্জ্বল আবার হাসলো। রইস উজ্জ্বলের পাশে বসে বলল,
“কি হয়েছে বলবি?”

উজ্জ্বল ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“পুষ্পের ফ্রেন্ড আহি, মনে আছে?”

“হুম।”

“এই ছবিটা সে এঁকেছিল।”

“তো!”

উজ্জ্বল ছবিটির দিকে ঝুঁকে বসে বলল,
“মেয়েটার মনে অনেক কষ্ট। আমি তাকে ছবি আঁকতে বলেছিলাম। আর সে এটাই এঁকেছে। কালো রঙ ব্যবহার করে এই ছবি এঁকেছে। বুঝা যাচ্ছে, তার মন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। ছবির মেয়েটির চোখ দু’টি কেমন ঘোলাটে, দেখ। মনে হচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে চোখ শুকিয়ে গেছে। সেই চোখে এখন খরা। নৌকাটি দেখ, কেমন দুলছে। অথচ নদীতে তরঙ্গ, ঢেউ কিছুই নেই। আমি এর একটা অর্থ দাঁড় করিয়েছি।”

“কি অর্থ?”

“মেয়েটার জীবনে সবকিছুই ভাসা ভাসা। কোনোকিছুতেই সে স্থির হতে পারছে না। এরপর দেখ, তীরে দাঁড়ানো একটা অবয়ব। ভালোভাবে দেখলে বোঝা যাবে, এটা একটা ছেলের অবয়ব। এর অর্থ, আহির জীবনে একটা ছেলের বেশ প্রভাব আছে। এই ছবিতে ছেলেটি নদীর তীরে ভেসে থাকা একটা ফুল তুলছে।”

“এর অর্থ কি!”

“উহুম, বুঝতে পারছি না। হয়তো সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। আহিকে না।”

রইস ভাবলেশহীন সুরে বলল, “তো!”

উজ্জ্বল হতাশ কন্ঠে বলল,
“মেয়েটা ভীষণ কষ্টে আছে।”

“এখন তুই করতে চাচ্ছিস?”

“আহির সাথে আবার দেখা কর‍তে ইচ্ছে করছে। তাই এবারের ছুটিতে আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি না। চট্টগ্রাম যাবো ভাবছি।”

রইস চমকে উঠে বলল,
“সিরিয়াসলি! আমরা সব বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করে ফেলেছি।”

“তোরা যা। এই মুহূর্তে আমার মন যেখানে আটকে আছে, আমার তো তারই সমাধান কর‍তে হবে।”

“প্রেমে পড়ে যাস নি তো আবার!”

উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আপতত তো না। তবে আরেকটু বেশি জেনে গেলে হয়তো সম্ভাবনা আছে।”

“এবার কিন্তু সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিবি। নয়তো আগের বারের মতো প্রেম করতে করতে প্রেমিকা বিয়ে করে শ্বশুড় বাড়ি চলে যাবে।”

উজ্জ্বল মুচকি হাসলো। বলল,
“আফসোস থাকবে না। এমন প্রেমিকা হারিয়ে গেলেও ভালো লাগে।”

“কীভাবে?”

“কারণ এদের ঘৃণা করা যায় না। এদের ভেবে ভেবেই চমৎকার মুহূর্ত কাটানো যায়। এরা বাস্তবেও সুন্দর। কল্পনাতেও।”

রইস উজ্জ্বলের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
“বেশ ভালোভাবেই আহির মায়ায় ডুবেছিস, বুঝা যাচ্ছে।”

(***)

সাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে আসছে পুষ্প। লাবীব সেই মুহূর্তে ক্যাম্পাসের গেটের সামনে তার মোটরসাইকেল থামালো। হেলমেট খুলে ভ্রূ কুঁচকে সে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পও সামনে তাকাতে লাবীবকে দেখে তার দিকে তাকালো। লাবীবের চাহনি দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। লাবীব তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। পুষ্পের সম্পূর্ণ মনোযোগ লাবীবের দিকে তাকায়, সে খেয়াল করে নি তার সাইকেলের সামনের চাকাটি আঁকাবাঁকা ইটের রাস্তার গর্তে আটকে গেছে। আর মুহূর্তেই পুষ্প ভারসাম্য হারিয়ে উলটে পড়লো রাস্তায়। লাবীব তা দেখে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। আহি গেটের কাছেই দাঁড়ানো ছিল। পুষ্পের এই অবস্থা দেখে সে দৌঁড়ে তার কাছে এলো। এদিকে লাবীব হাসতে হাসতে পুষ্পের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“যে কাজ পারো না, সেটা করো কেন?”

পুষ্প মুখ ফুলিয়ে লাবীবের দিকে তাকালো। আহি বিরক্তির সুরে বলল,
“দেখছিস না ও ব্যথা পেয়েছে?”

আহির হাত ধরে পুষ্প উঠে দাঁড়ালো। এরপর সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। কয়েকজন এখনো ঘুরে ঘুরে তাকে দেখছে। লজ্জায় পুষ্পের চোখ ছলছল করে উঠলো। আহি তার সাইকেল উঠিয়ে বলল,
“কি রে, মন খারাপ করছিস কেন? এটা জাস্ট এক্সিডেন্ট।”

পুষ্প চুপ করে রইলো। লাবীব পুষ্পের কাছে এসে নরম সুরে বলল,
“কাঁদছো কেন?”

পুষ্প মুখ ভ্যাংচে বললো, “কাঁদছি না আমি।”

লাবীব পুষ্পের হাত ধরতেই পুষ্প চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আর পুষ্পের ভেজা চোখ দু’টি সাথে সাথেই লাবীবের বুকখানা দগ্ধ করে দিয়ে গেলো। লাবীব বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি পুষ্পের সাইকেল একপাশে রেখে তালা লাগিয়ে চাবিটা পুষ্পের হাতে দিয়ে বলল,
“ব্যথা পেয়েছিস তুই। চল, তোকে মেডিকেল রুমে নিয়ে যাই।”

লাবীব বলল,
“আহি তুই ক্লাসে যা। আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

আহি ‘ঠিক আছে’ বলে চলে গেলো। এরপর লাবীব পুষ্পকে মেডিকেল রুমে নিয়ে গেলো। পুষ্পের কনুইয়ে নিজ হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“হেসেছো, আবার মলম লাগাচ্ছো!”

“সরি।”

পুষ্প জোরে শ্বাস ছাড়লো। লাবীব পুষ্পের দিকে ঝুঁকে বলল,
“আমি তো বলেছিই, আমার বাইক পার্টনার হও। রোজ তোমাকে নামিয়ে দেবো, নিয়ে আসবো।”

“প্রতিদিন এই দায়িত্ব নেওয়ার মতো কি তোমার অধিকার আছে?”

“যদি দাও, নিয়ে নেবো।”

“কিন্তু তুমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসো।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ভালোবাসলেই কি শুধু অধিকার দিতে হয়।”

পুষ্প অভিমানী সুরে বলল,
“লাগবে না আমার এসব আদিখ্যেতা।”

লাবীব পুষ্পের হাত ধরে বলল,
“মেয়েটা যদি তুমি হও, তাহলে কি এই আদিখ্যেতা তোমার ভালো লাগবে?”

পুষ্প লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল, “হুম।”

লাবীব বলল,
“তাহলে ভালো সময় আসুক। আমার আবার সবকিছু একটু ঝাঁকানাঁকা হতে হয়।”

“কখন ঝাঁকানাঁকা হবে?”

“বলে দিলে তো ঝাঁকুনি খেতে পারবে না।”

পুষ্প লাজুক হাসলো। লাবীব পুষ্পের চশমা নিয়ে নিজের শার্টের কোণায় তা মুছে পুষ্পের চোখে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“চলো চশমিশ। ক্লাস শেষে আবার দেখা হবে।”

এদিকে পুষ্পের ফোনে উজ্জ্বলের কল এলো। সে রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“ছুটিতে তোদের বাসায় আসছি।”

পুষ্প উৎসুক কন্ঠে বলল, “ওয়াও, সত্যি!”

“মিথ্যা গল্প বলার জন্য তোকে কখনও ফোন দিয়েছিলাম?”

“হুম, যাক, ভালোই হবে। তোর অপেক্ষায় থাকলাম।”

“শোন, তোর ওই ফ্রেন্ডটার কি অবস্থা!”

“কার কথা বলছিস?”

“আহি!”

পুষ্প হেসে বলল,
“তুই তো আমার বান্ধবীকে বেশ ভালোভাবেই মনে রেখে দিয়েছিস।”

“এতো ন্যাকামি করছিস কেন? সোজাসুজি বল না।”

“আরেহ আছে তো ও। ভালো আছে।”

উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আচ্ছা, রাখছি। ট্রেনে উঠবো রাতে।”

“আচ্ছা।”

(***)

সন্ধ্যায় ছবি আঁকা শেষ করলো আহি। এখন প্রায় প্রতিদিনই সে সন্ধ্যায় ছবি আঁকতে বসে। এক ঘন্টা এঁকে উঠে যায়। আজ এঁকেছে একটা বাড়ির করিডরের চিত্র। পুরো করিডোরটি বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে আলোকিত করেছে। দেয়ালে মিষ্টি গোলাপী রঙ। মেঝের টাইলসটি সেঞ্চুরি পাতার। মাঝখানে একটি গোলাপী বর্ণের লাগেজ রাখা। ছবি আঁকা শেষে ক্যানভাসের নিচে একটা চিরকুট আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলো আহি। সেটিতে লেখা,
“লাগেজে ভরা স্বপ্নগুলো কি এই চাকচিক্যময় আবদ্ধ ক্ষেত্রফলেই আঁটকে থাকবে?”

এরপর আহি ক্যানভাসটি ইজেল থেকে নামিয়ে একপাশে রেখে দিলো। এরপর হাত ধুয়ে এসে ডায়েরির পাতা উল্টালো। লিখলো,
“সেদিনের পর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। ভীষণ জেদ উঠেছে আমার। ঘৃণা শব্দটা নিতে পারি নি আমি। তাই পদ্মকে ফোন করে জানা হলো না, কেমন আছো। কিন্তু দেখো, এতোকিছুর পরও প্রতিদিন তোমার স্মরণে ডায়েরীর পাতায় কিছু না কিছু লিখি। কি করবো, আমি যে তোমাকে ভুলতে পারি না। তুমি মানুষটা সূত্রের মতো মস্তিষ্কে গেঁথে গেছো। এই ব্রহ্মাণ্ডে একেক জনের ভালোবাসা একেক রকম। আর আমার কাছে ভালোবাসার অর্থ ভুলে যাওয়া নয়। ভালোবাসা মানে আরো নতুনভাবে ভালোবাসতে পারে। প্রকাশ্যে না হোক, আড়ালে কেন লুকিয়ে থাকবে আমার অনুভূতি? প্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ভালোবাসাতে পারার আসক্তিটা কখনোই ছাড়া যায় না। যে আসক্তি ছাড়তে পারে, যে ভালোবাসাকে গ্রহণ করেছে নিজের স্বার্থের জন্য। আর আমি তো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি। আমার জীবনে যেই আসুক। আমি তো নিয়তিকে আটকাতে পারবো না। কিন্তু তুমি আমার জীবনে আজীবন প্রদীপের মতো জ্বলবে। এই প্রদীপের তেজ এতো বেশি যে মৃত্যুর পর এই আলোয় আমি তোমাকে খুঁজে নেবো। তখন নিয়তির খেলা শেষ হবে। আমি হয়তো সেদিন তোমাকে আমার করে পাবো।”

৬৪।

আজ ক্যাম্পাসে চলছে কার্তিক উৎসব। এই উৎসবে পুরো ক্যাম্পাসের সব ডিপার্টমেন্ট মিলে মেলার আয়োজন করে। আজ আহি ক্যাম্পাসে এসেছে কমলা রঙের শাড়ি পরে। গলায় ঝুলিয়েছে কাঠের তৈরী মালা। খোঁপায় গেঁথে দিয়েছে ছোট ছোট কাঠগোলাপ। হাতে একগুচ্ছ হলুদ কাচের চুড়ি পরেছে, কপালে লাগিয়েছে হলুদ টিপ। আজ বেশ মানানসই লাগছে আহিকে।

এদিকে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই রাদ আর আহির দেখা হলো। রাদ আহিকে দেখে সেকেন্ড খানিকের জন্য থমকে গিয়েছিল। এরপর আহি রাদের কাছে আসতেই রাদ নিজের বুকে হাত রেখে বলল,
“মেরে ফেলবি না-কি আমাকে!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমি আবার কি করলাম!”

“বেশি সুন্দর লাগছে তোকে।”

আহি শাড়ি আঁচল নাড়িয়ে বলল,
“আমি তো সুন্দরী, সুন্দর তো লাগবেই।”

(***)

আজ আহি ব্যাগ ভর্তি টাকা এনেছে শুধু খাওয়া-দাওয়া করার জন্য। জিনিসপত্রের তুলনায় মেলায় খাবারের চড়া দাম। কারণ ক্যাম্পাসে বাইরেও অতিথি আসে। আর সবার আগ্রহ খাবারের প্রতিই বেশি। এদিকে আহি পিঠার স্টলে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের প্লেট নিয়ে সেখানে দুইটা ভাপা পিঠা, একটা পাটিসাপটা, একটা পাকন পিঠা, তিনটা নারকেল নাড়ু, দুইটা সুজির চমচম, চারটা গাজরের হালুয়া নিয়ে পেছন ফিরতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ একনজর আহির প্লেটের দিকে তাকিয়ে, আবার আহির দিকে তাকালো। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“বাতাসা আর শনপাপড়ি বাদ যাচ্ছে।”

আহি আফিফের কথা শুনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো, ঠিকই তো, সে তো এই দুইটা নিলোই না। এবার আহি চারটা বাতাসা আর সাতটা শন পাপড়ি নিয়ে নিলো প্লেটে।

আফিফ একটা বক্সে শন পাপড়ি নিতে নিতে বলল,
“এতোগুলো মিষ্টি তুমি একা খাবে?”

আহি সেকেন্ড খানিক আফিফের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”

অনেকদিন পর আফিফের সাথে দেখা হয়েছে তার। তাই কিছুটা ইতস্ততবোধ করছিলো আহি।

এরপর আহি স্টল থেকে বের হয়ে একপাশে বসে ইচ্ছেমতো পিঠা খেতে লাগলো। আফিফ দূরে বসে আহিকে খেতে দেখে নিজের খাওয়া ভুলে গেলো। পদ্মের কাছে শুনেছিল, আহি না-কি মিষ্টি পিঠা বেশ পছন্দ করে। কিন্তু তার পছন্দ এমন ভয়ংকর, তা আফিফ জানতোই না। মেয়েটা কি হজম কর‍তে পারবে এতোগুলো পিঠা? এই আগ্রহ নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে আহির খাওয়া দেখছে আফিফ। আহি খেতে খেতে তার আফিফের দিকে চোখ পড়লো। আফিফকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খাওয়া বন্ধ করে দিলো আহি। আফিফ বুঝতে পেরে উলটো দিকে ঘুরে বসলো। আহি চোখ-মুখ ছোট করে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাশাল্লাহ বল তো, রাদ।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”

“যদি পেট কামড়ায়।”

“তোকে রাক্ষসীর মতো খেতে দেখলো কারো লোভ জন্মাবে না। উলটো খাওয়ার শখই মিটে যাবে।”

আহি রাদের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“যাক অন্তত আজ সব মিষ্টি পিঠা আমার জন্যই বেঁচে যাক।”

লাবীব এসে বলল,
“আরেহ মিষ্টি দই তো নিলিই না। ওটা খাবি না? এক কাজ করি, তোকে ডুবিয়ে দেই দইয়ের হাঁড়িতে। সাঁতরে সাঁতরে খাবি।”

আহি চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকালো। এরপর মুখ ফুলিয়ে মুখে শন পাপড়ি পুরে দিলো। যে যাই বলুক, আজ সে খাবেই খাবে।

(***)

মেলার একপাশে ভীড় জমিয়েছে মেহেদি আর্টিস্টরা। আহি আর পুষ্প দুই হাতে মেহেদি লাগিয়ে ধেই ধেই করে রাদ আর লাবীবের কাছে গেলো। রাদ আহির হাতে মেহেদি দেখে বলল,
“বাহ, মনে হচ্ছে তোর হাতে আণুবীক্ষণিক জোক কিলবিল করছে।”

আহি চোখ বড় বড় করে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাদ, বেশি কথা বললে তোর মুখে লাগিয়ে দেবো একদম।”

এদিকে পুষ্পের ফোন বাজছে, সে ঝুঁকে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আছে। লাবীব উঠে এসে পুষ্পের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
“আমি দেখছি।”

লাবীব পুষ্পের ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তার কানের কাছে ধরলো। ওপাশ থেকে কিছু কথা ভেসে এলো। লাবীব তা শুনলো না। সে শুধু শুনলো পুষ্প ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে তাদের ভার্সিটির ঠিকানা বলছে। এরপর পুষ্প কথা শেষ করে লাবীবকে বলল, কল কেটে দিতে। লাবীব কল কেটে দিয়ে বলল,
“তোমার চুল বেঁধে দেবো?”

পুষ্প লাজুক হেসে বলল, “হুম।”

লাবীব দেরী না করে খুব যত্নের সাথে পুষ্পের চুল বেঁধে দিতে লাগলো। তা দেখে রাদ আর আহি অবাক হয়ে গেলো। রাদ বলল,
“এসব কখন থেকে চলছে!”

লাবীব হেসে বলল,
“এখনও শুরু হয় নি। তবে আজ শুরু হবে।”

এরপর লাবীব কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই তাদের ক্লাসের কয়েকটা ছেলে এসে লাবীবের সামনে কয়েকটা ফুলের চারা রেখে চলে গেলো। পুষ্প হাঁ করে লাবীবের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর লাবীব মেলার পাশে দাঁড়ানো একজন চাচার কাছ থেকে তার সব বেলুন কিনে এনে ক্যাম্পাসের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। যদি গ্রহণ করো, তাহলে কাছে এসে হাতটি ধরো। তোমার মেহেদি রাঙা হাতটি না হয় আজ আমায় ছুঁয়ে দিক।”

রাদ আর আহি একে অপরের দিকে তাকালো৷ এদিকে পুষ্প লাজুক হেসে ধীর পায়ে লাবীবের দিকে এগিয়ে গেলো। লাবীব ইচ্ছে করে দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছিল। কারণ পুষ্পের সামনে এসে বসলে মেয়েটা ইতস্ততবোধ করে যদি পালিয়ে যায়, তখন দু’জনই লজ্জায় পড়বে। এখন না হয়, একজনই পড়ুক লজ্জায়। কিন্তু পুষ্প লাবীবকে লজ্জায় ফেলে নি। সে লাবীবের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবীব এবার প্রতিটি চারা থেকে একটি একটি ফুল ছিঁড়ে পুষ্পের দিকে এগিয়ে দিতে লাগলো। পুষ্প সব ক’টি নিলো। ফুলগুলো দেওয়া শেষে লাবীব বেলুনগুলো সব ছেড়ে দিলো। পুষ্প বলল,
“এতোটা চমৎকার হবে আমি আশা করি নি।”

লাবীব বলল,
“বলেছি না। আমার সবকিছুই ঝাঁকা নাঁকা। প্রেমের প্রস্তাবটা ঝাঁকানাঁকা হলো তো!”

পুষ্প হাসলো। কে বলেছে ভালোবাসা শেষ সময়ে আসে না। কিছু ভালোবাসা শেষ মুহূর্তে আসে, যখন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় বিয়ে নামক সম্পর্কে। পুষ্পের পঁচিশ বছরের জীবনে তার প্রথম প্রেম এসেছে পঁচিশ বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর, এক হেমন্ত বেলায়।

আহি তাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“এই হেমন্তের সকালটা যদি আমাদের হতো!”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৩||

৬৫।
উৎসব মুখর ক্যাম্পাসে অনেকেই ব্যস্ত রং খেলায়। আর তাই বাতাবরণে ছড়িয়ে পড়েছে রঙিন হাওয়া। সেই রঙিন হাওয়ায় প্রবেশ করলো একজন অতিথি। পুষ্পের দৃষ্টি সেই অতিথির দিকে পড়তেই সে লাবীবের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো মানুষটির সামনে, আর বলল,
“ওয়েলকাম ব্রাদার।”

উজ্জ্বল তার চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে একনজর পুরো ক্যাম্পাসে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,
“তোদের ক্যাম্পাসটা তো ভারী সুন্দর!”

পুষ্প বলল, “হ্যাঁ।”

এরপর সে লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“লাবীব, এ হচ্ছে আমার কাজিন ব্রাদার।”

উজ্জ্বল লাবীবের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হাই, আমি উজ্জ্বল।”

লাবীব উজ্জ্বলের সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
“আমি লাবীব।”

উজ্জ্বল এবার লাবীবের বাকি পরিচয় জানার জন্য ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“লাবীব আমার ফ্রেন্ড। আমরা একই স্কুলে পড়েছি। আর এখন একই ভার্সিটিতে।”

“হুম, ভালো।”

উজ্জ্বল এবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো আহিকে দেখে। এতোক্ষণ সে আহিকেই খুঁজছিল। আহির স্নিগ্ধ অভিব্যক্তি ও প্রাকৃতিক ভূষণ ভীড়ের মধ্যে তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। পুষ্প উজ্জ্বলের চোখ অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। এরপর গলা ছেড়ে আহিকে ডাকলো। আহি পুষ্পের কন্ঠ শুনে তাদের দিকেই এগিয়ে এলো। তার সাথে রাদও ছিল।

উজ্জ্বলকে দেখেই আহি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আরেহ আপনি? কেমন আছেন?”

উজ্জ্বল মুচকি হেসে বলল,
“ভালো আছি। তোমাকেও বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে তোমার।”

“যেমন!”

“যেমন, এই মুহূর্তে তোমাকে বেশ প্রফুল্ল লাগছে। সিলেটের হাওয়ায় হয়তো বিষাদ ছিল।”

আহি হেসে রাদের দিকে তাকালো। এরপর বলল,
“তা না, তবে ভাবলাম এই চমৎকার দিনগুলো কি বিষন্নতার কারণে হারিয়ে ফেলবো?”

উজ্জ্বল এবার রাদের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“রাদ আহির বেস্টফ্রেন্ড।”

উজ্জ্বল হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নাইস টু মিট ইউ।”

রাদও হাত এগিয়ে দিলো। মোটামুটি পরিচয় পর্ব শেষে পুষ্প আর লাবীব উজ্জ্বলকে মেলা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য নিয়ে যেতে যাবে, তখনই উজ্জ্বল বলল,
“তুই যা। আমি নিজেই ঘুরে দেখি।”

পুষ্প লাবীবকে নিয়ে চলে যেতেই উজ্জ্বল আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি জিজ্ঞেস করলো,
“চট্টগ্রামে কখন এসেছেন?”

“কয়েকদিন হচ্ছে। এবার দেড় মাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। একদম ইদের পর সিলেটে ফিরবো।”

“বেশ তো।”

“এবার কিন্তু আমাকে চট্টগ্রাম ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব তোমার!”

আহি উজ্জ্বলের কথায় হালকা হাসলো। এদিকে রাদ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল আর আহির কথোপকথনে বেশ বোঝা যাচ্ছে, তাদের আগেও ভালো কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু আহি একবারও উজ্জ্বলের ব্যাপারে রাদকে কিছু জানায় নি। বেশ অভিমান হলো রাদের। সে হনহনিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। রাদকে চলে যেতে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। উজ্জ্বল তার মনোযোগ আকর্ষণ করতেই আহি আবার দৃষ্টি সরিয়ে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। এরপর টুকটাক কথা বলতে বলতেই আহি উজ্জ্বলকে তাদের ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখালো।

(***)

বাসায় ঢুকতেই মিসেস লাবণির মুখোমুখি হলো আহি। লাবণিকে সজ্জিত পোশাকে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথাও যাওয়া হচ্ছে?”

লাবণি হালকা হেসে বলল,
“তুমি এই প্রশ্ন আমাকে করছো?”

আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। এরই মধ্যে রিজওয়ান কবির তৈরি হয়ে নিচে নামলেন। সাথে মোজাম্মেল চাচাও দু’টি লাগেজ নিয়ে দু’তলা থেকে নেমে বাইরে চলে গেলেন। রিজওয়ান কবির আহিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ক্যাম্পাসে ভালোই তো মজা করেছো। যাও এবার ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয়ে নাও। সন্ধ্যায় আমাদের ফ্লাইট।”

আহি অবাক কন্ঠে বলল,
“আমাদের ফ্লাইট? কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

লাবণি বলল,
“আহি, তুমি কি অ্যামনেশিয়াতে ভুগছো? তোমার আর তাজওয়ারের এনগেজমেন্ট আমেরিকায় হবে। ভুলে গেছো না-কি? আজই আমরা রওনা দিচ্ছি।”

আহি বাবার কাছে এসে বলল,
“বাবা প্লিজ। আমি এখনো এসবের জন্য প্রস্তুত নই। আমাকে একটুবসময় দাও। আমি মাস্টার্সটা শেষ করি। এরপর আমি নিজের জন্য কিছু করতে চাই।”

রিজওয়ান কবির ভাবলেশহীন সুরে বললেন,
“তোমাকে মাস্টার্স শেষ করতে কেউ নিষেধ করে নি। আর নিজের জন্য তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তোমার কাছে সব নিজে এসেই ধরা দিচ্ছে। তাজওয়ারকে বিয়ে করলে তুমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।”

“স্বপ্ন পূরণের জন্য একটা রেপিস্টের সাথে তুমি আমার বিয়ে দেবে?”

“এসব মিথ্যে খবর তুমি কোথা থেকে পাও, আহি? আর এখন এসবের সময় নেই। যাও তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে এসো।”

কথাটি বলেই রিজওয়ান কবির বেরিয়ে পড়লেন। আহি লাবণির দিকে হতাশ চোখে তাকালো। লাবণি আহির হাতে হাত রেখে বলল,
“কাম অন বেবি গার্ল, তোমার এই সো কল্ড শাড়িটা খুলে, সুনেহরাহ তোমার জন্য যেই ড্রেস সিলেক্ট করে দিয়েছে, ওটা পরে ঝটপট চলে এসো। আর তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নিয়ে নিও। বাকি এনগেজমেন্টের শপিং তো তাজওয়ার করে ফেলেছে।”

আহি লাবণির হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরে এসেই খোঁপায় আটকানো মালাটা টেনে খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো আহি। কয়েক মিনিট ঘরে পায়চারি করে ফোন হাতে নিয়ে রাদকে কল করলো। কল যাচ্ছে, অথচ রাদ ধরছে না। আহি কল দিয়েই যাচ্ছে। হঠাৎ মিসেস লাবণি পেছন থেকে এসে আহির ফোনটা নিয়ে নিলেন। আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার ফোন কেন নিয়েছেন?”

লাবণি বাঁকা হেসে বলল,
“বাংলাদেশ না ফেরা পর্যন্ত এই ফোনটা তুমি আর পাবে না।”

“আপনি কিন্তু অতিরিক্ত করছেন। আমার লাইফে ইন্টা’রফেয়া’র করার আপনার কোনো অধিকার নেই। তবুও আপনি বারবার আমাকে বিরক্ত করছেন। আমি জানি, আপনিই বাবার মাথায় আমার আর তাজওয়ারের বিয়ের ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছেন।”

লাবণি হাসলো। সেকেন্ড খানিক হেসে বলল,
“আহি, তোমার বাবাই তোমাকে নিলাম করছে, তুমি আমাকে এর মধ্যে কেন জড়াচ্ছো? ভুলে যেও না, তোমার আর তাজওয়ারের বিয়ে হলেই তোমার বাবা খানদের বিজনেসে নিজেকে যুক্ত কর‍তে পারবে। তাছাড়া সামনে ইলেকশন। তোমার বাবাও এমপি পদে দাঁড়াচ্ছেন। এই মুহূর্তে খানদের সাহায্য খুব দরকার। ছোট খানকে খুশি করতে পারলেই তো তোমার বাবার উন্নতি। নিজের বাবার উন্নতি কি সহ্য হবে না তোমার?”

“আমি মানুষ। কোনো পণ্য নই। ওই বাড়িটা আমার জন্য নিরাপদ নয়। তাজওয়ারের বড় ভাই একটা দুষ্ট চরিত্রের লোক। ওদের বাসাটার একদম হ-য-ব-র-ল অবস্থা। দোয়েল ভাবির ব্যাপারে কি কিছু জানেন না? তার নিজের স্বামী তাকে বাধ্য করেছে তার বন্ধুদের সাথে থাকার জন্য৷ সেখানে আমার সেইফটির দায়িত্ব কে নেবে?”

“সরওয়ার খান আর তাজওয়ার খানের মধ্যে তুলনা করো না, আহি। আর দোয়েল তার যোগ্যতা অনুসারে যথেষ্ট পেয়েছে। ভিখারিনী এখন রাজরানীর মতো থাকছে। এতো কিছু পাওয়ার পর সে যদি স্বামীর কথায় একটু আধটু স্বামীর বন্ধুদের সন্তুষ্ট করে, সেখানে তো আমি ভুল কিছু দেখছি না।”

আহি কানে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“ফর গড সেইক, লিভ মি এলৌন।”

লাবণি আহির ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে রুমের বাইরে এসে বলল,
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে নিচে নামবে। নয়তো তাজওয়ারকে ফোন করে এখানে আসতে বলবো। আর এরপর এয়ারপোর্টে তার সাথেই যেও। তার সাথে তো অন্তত শক্তির জোরে পারবে না।”

লাবণি চলে যেতেই আহি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। আর বুকে হাত রেখে বলল,
“আল্লাহ, তুমি আমার ভাগ্যে আর কতো ঝামেলা লিখে রেখেছো। আমি আর এসব মানসিক অত্যাচার নিতে পারছি না।”

(***)

বিমানবন্দরের সামনে গাড়ি থামলো। আহি মলিন মুখে নেমে এলো গাড়ি থেকে৷ এদিকে তাজওয়ার গ্লাসের বাইরে আহিকে দেখে মুচকি হাসলো। লাল রঙের ফ্রকে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে আহিকে। কিন্তু মুখে কোনো সাজসজ্জা নেই। আর এই সাজ বিহীন মলিন মুখখানা তাজওয়ারকে মুহূর্তেই ঘায়েল করে ফেললো। আহি বিমান বন্দরে ঢুকতেই তাজওয়ার তার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আর আহি সেই হাতটি এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“আমার থেকে দূরে থেকো।”

তাজওয়ার আহির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি আমার সম্পদ। আমি যখন ইচ্ছে তোমার কাছে আসবো। এর জন্য আমার তোমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।”

“সম্পদের মালিকানা না পাওয়া অবধি অনুমতি নেওয়া শিখো। দেখা যাবে, যাকে তুমি এখন নিজের ভাবছো, তাকে স্পর্শ করার আগেই সে হারিয়ে গেছে।”

তাজওয়ার আহির পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য আমি সব সীমালঙ্ঘন কর‍তে প্রস্তুত৷ আর একবার যদি আমি সীমা ছাড়িয়ে যাই, তাহলে আমাকে আবদ্ধ ক্ষেত্রে আনা সহজ হবে না। আমার সম্পর্কে তোমার আরো বিস্তারিত জেনে নেওয়া উচিত।”

আহি দৃঢ় হাসি হেসে বলল,
“আত্মবিশ্বাস রাখা ভালো। কিন্তু অতিরিক্ত রাখাটা বিপদজনক।”

(***)

বিমানে আহি আর তাজওয়ার পাশাপাশি সিটে বসেছে। আর তাজওয়ার আহির হাত ধরে আছে। যতোক্ষণ তাজওয়ার তার পাশে বসেছিল, আহি নিজের হাতটি তাজওয়ারের হাতের মুঠো থেকে ছাড়াতে পারি নি। এমনকি ওয়াশরুমেও তাজওয়ার আহির পিছু পিছু গেলো। তাজওয়ারকে আসতে দেখে আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোমাকে আমি আমার বডিগার্ড হিসেবে রাখি নি।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তোমার দেহ পাহারা দেওয়ার জন্য আমি তোমার সাথে যাচ্ছি না। আমি জানি, তোমার দেহের পাহারা তুমি নিজেই করতে জানবে। আমি তো তোমার ওয়ার্নিংটা মাথায় রেখে তোমার সাথে সাথে আছি। মনে নেই, তুমি কি বলেছিলে? স্পর্শ করার আগেই হারিয়ে যাবে। আমিও দেখতে চাই, আমার চোখের সামনে থেকে তুমি কীভাবে হারাও।”

(***)

আমেরিকায় পৌঁছানোর দু’দিন পর আহি আর তাজওয়ারের এনগেজমেন্টের প্রস্তুতি শুরু হলো। এদিকে অভিমান করে বসে থাকা রাদ সেদিন ইচ্ছে করেই আহির কল ধরে নি। আর আজ দু’দিন আহির কোনো খোঁজ না পেয়ে সে অস্থির। আহির ফোন বন্ধ। সোশ্যাল একাউন্টগুলোতেও আহি এক্টিভ নেই। ক্লাসেও আসে না। এমনকি পুষ্প, লাবীব কারো সাথেই আহির যোগাযোগ হয় নি৷ চিন্তায় পাগলপ্রায় রাদ আহিকে খুঁজতে খুঁজতে তার বাসায় চলে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখলো গেটে তালা ঝুলানো। বাইরে দারোয়ান দাঁড়ানো শুধু। তারা রাদের প্রশ্নের কোনো উত্তরই ঠিকভাবে দিচ্ছে না। এদিকে রাদের এই অবস্থা দেখে পুষ্প হতাশ হয়ে পদ্মকে সব জানালো। পদ্মের সাথে তো অনেক দিন কথা হয় নি আহির। সেও ঠিকভাবে কিছু জানাতে পারলো না।

পদ্ম বিকেলে বসে বসে আহির কথায় ভাবছিল, তখন আফিফ তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“এমন ব্যাকুল ভাবে কি ভাবছো?”

আফিফের প্রশ্নে পদ্ম চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“দু’দিন ধরে আহির কোনো খোঁজ নেই৷ ওর বাসায় না-কি তালা দেওয়া।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি জানো না আহি কোথায়?”

“না। আপনি এভাবে জিজ্ঞেস করলেন যে! আপনি জানেন ও কোথায়?”

“হুম, আমি তো তাজওয়ার খানের এসিস্ট্যান্ট। আমি তো জানবোই। ওরা আমেরিকায় গেছে। আহি আর তাজওয়ার খানের এনগেজমেন্ট।”

“আর আপনি এটা আমাকে জানালেন না?”

“তুমি জানো না, এটা তো আমি জানতাম না৷ আমি ভেবেছি, আহি তোমাদের জানিয়েছে।”

পদ্ম পুষ্পের নম্বরে ডায়াল করতে করতে বলল,
“মেয়েটা এতো চাপা স্বভাবের কেন? নিজের এনগেজমেন্টের ব্যাপারেও জানালো না।”

এরপর পদ্ম ফোন করে পুষ্পকে আহির খবর জানালো। পুষ্পও দেরী না করে রাদকে কল করে জানিয়ে দিলো। রাদ এই কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সে জানতো এই মাসেই আহির এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা। কিন্তু এভাবে হুট করে আহিকে নিয়ে যাবে, তা কল্পনা করে নি রাদ। এখন তারা যদি এনগেজমেন্টের পাশাপাশি আক্দও করিয়ে দেয়? এই মুহূর্তে নিজের উপর রাগ হচ্ছে রাদের। সে রাগে ফোনটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। আহিকে উজ্জ্বলের সাথে কথা বলতে দেখেই অভিমান করেছিল রাদ। যেই অভিমান সম্পর্কে আহি কিছুই বুঝতে পারে নি। বুঝতে না পারাটাই স্বাভাবিক। সে তো আর জানে না যে রাদ তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর তার এই ন্যাকামো অভিমান দেখাতে গিয়ে যে সে আহির গুরুত্বপূর্ণ কল মিস করে ফেলেছে, সেটার জন্যই এখন আফসোস হচ্ছে তার। এই মুহূর্তে আহির দেশে ফেরার অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৪(১ম ভাগ)||

৬৬।
জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে, শ-খানেক রঙ-বেরঙের বাতির ভীড়ে একখানা মলিন মুখ দাঁড়িয়ে আছে সবার দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে। সাদা রঙের ভারী গাউনে নুইয়ে পড়ছে তার দুর্বল কায়া। তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কারণ তার একটা সিদ্ধান্ত পালটে দিবে অনেকগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ।
আহির হাতটি আলতোভাবে স্পর্শ করলো তাজওয়ার খান। তাজওয়ারের স্পর্শে আহি হতাশ চোখে তার দিকে তাকালো। দেখলো তাজওয়ারের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। শেষমেশ আহি আনুষ্ঠানিকভাবে তার বাগদত্তা হতে যাচ্ছে। যেই স্বপ্ন সে অনেক বছর ধরে দেখে আসছে, তার প্রথম ধাপ আজ সে পার করেছে। এখন আহির নামটিও শিরোনামের পাতায় লেখা হবে, ব্যবসায়ী মিস্টার তাজওয়ার খানের বাগদত্তা হিসেবে। কে না চায় এমন শান্তির নীড়? যেখানে টাকার অভাব নেই, বিলাসিতার অভাব নেই। কিন্তু যে এসবের ঊর্ধ্বে জীবনটাকে দেখতে চায়, একটু শান্তি চায়, তার জন্য শান্তির সেই নীড় কি আদৌ শান্তির? না-কি সমঝোতা মাত্র?

তাজওয়ার আর আহির আংটিবদল হতেই একজন ফটোগ্রাফার তাদের ছবি তুললো। লোকটা মিডিয়ায় কাজ করে। তাজওয়ার তাকে আমেরিকায় এনেছে, তাদের বিয়ের ছবি বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আহির ইচ্ছে করছিলো ফটোগ্রাফারের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে। সে কিছুক্ষণ পর পর এসে ছবি তুলছে। আহি বিরক্ত হয়ে তাজওয়ারকে বলল,
“এই লোকটা একটা নিউজ বের করার জন্য এতোগুলো ছবি কেন তুলছে, পাগল না-কি?”

তাজওয়ার মুচকি হেসে বলল,
“আরেহ, খবরে আমাদের এনগেজমেন্ট এনাউন্স করা হবে, একটা ভালো ছবি তো রাখতেই হয়।”

“এক্সকিউজ মি, তুমি জাস্ট একজন ব্যবসায়ী। কোনো মন্ত্রী বা সেলেব্রিটি নও যে তোমাকে নিয়ে দশ মিনিটের খবর বের হবে।”

“শোনো, মন্ত্রীরাও আমার আগে-পিছে ঘুরে। আর সেলেব্রিটিরা আমার কারণেই সেলেব্রিটি হয়। আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ইনভেস্ট করি। তুমি হয়তো জানো না, আমি অনেক মুভির প্রোডিউসার ছিলাম। জানবে কীভাবে? তোমার গন্ডি তো বেশিদূর ছিল না। তুমি শুধু রং নিয়ে খেলেই সময় পার করেছো।”

“আমার রং নিয়ে খেলা তোমার কাজের চেয়ে বহুগুণ ভালো। অন্তত সেই কাজে মানসিক তৃপ্তি আছে। তোমার টাকায় তুমি শুধু শারীরিক সুখ পেয়েছো। মানসিক সুখ পাও নি।”

“তুমি তো আমার জীবনে মানসিক শান্তি হয়েই এসেছো। আমার আর কোনো শান্তির প্রয়োজন নেই। দিনে শারীরিক সুখ, রাতে মানসিক সুখ। শীঘ্রই আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হবে না।”

আহি চোখ-মুখ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তখনই কয়েকজন ফিটফাট যুবক আহি আর তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার তাদের দেখে এক গাল হাসলো। আহি মুখ বাঁকিয়ে তাজওয়ারের হাসি দেখছে। তাজওয়ার আহির হাত ধরে চাপা স্বরে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থেকো না। মনে হচ্ছে সাপ আর বেজির বিয়ে হচ্ছে।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে চাপা স্বরে উত্তর দিলো,
“মনে হোক। তুমি আমার শখের পুরুষ নও। আমার দৃষ্টিতে তুমি তাইপানের চেয়েও বিষধর।”

তাজওয়ার আহির কথা শুনে সামনে দাঁড়ানো যুবকগুলোর দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আহি, মিট মাই ফ্রেন্ডস।”

আহি বাঁকা চোখে তাজওয়ারের বন্ধুদের দিকে তাকালো। তাদের মধ্যে একজন আহির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যালো, আই এম সজিব।”

আহি ঠোঁট বাঁকিয়ে চাপা স্বরে বলল, “আজিব।”

সজিব আহির ঠোঁটের নড়ন দেখে বলল,
“ইটস সজিব, নট আজিব।”

তাজওয়ার এবার আহির দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। আর আহি সজিবের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। এবার তাজওয়ার পাশের জনের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
“আহি, এ হচ্ছে জিলান শেখ। আমার বিজনেস পার্টনার আর আমার খুব কাছের বন্ধু।”

জিলান আহির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হাই বেইব….”

তাজওয়ারের দিকে চোখ পড়তেই জিলান চুপ হয়ে গেলো। আহি জিলানের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জিলান খচমচে ভাব নিয়ে হেসে বলল,
“আই মিন ভাবী। কেমন আছেন আপনি?”

আহি জিলানের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। এবার পাশের জন বলে উঠলো,
“হাই, আহি। আই এম হ্যারি।”

হ্যারি ভিনদেশী হওয়ায় আহি সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। তখনই হ্যারি আহির কাছে এসে হুট করে তার গালে চুমু খেয়ে বলল,
“নাইস টু মিট ইউ।”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“ইটস কালচার।”

আহি চোখ ছোট করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। এবার হ্যারির পাশের জন্য আপাদমস্তক আহিকে দেখে নিয়ে বলল,
“সো বিউটিফুল।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এন্ড ইটস?”

অর্ণব হেসে বলল, “ইটস কমপ্লিমেন্ট।”

আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“তোমার বন্ধুগুলো কি নেশা করে এসেছে? তাদের চাহনি দেখেছো? দেখেই বোঝা যাচ্ছে এদের চিন্তাভাবনা কতোটা বাজে। এদের সরাও তো আমার সামনে থেকে। নয়তো আমি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে এখান থেকে চলে যাবো। তারপর তোমার স্পেশাল ফটোগ্রাফারকে বলো, শিরোনামে লিখতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে ধাক্কা দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে পড়লো তার বাগদত্তা।”

তাজওয়ার চাপা স্বরে বলল, “ভেরি ফানি।”

তখনই সজিব বলে উঠলো,
“তাজ, তুই সত্যিই ভাগ্যবান। সব ঘাট ঘুরে ভালো জায়গায় নৌকা বেঁধেছিস।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে সজিবের দিকে তাকালো। সজিব হেসে বলল,
“মিস, রাগ করেছেন?”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“নোংরা ডোবায় নৌকা ঠেকলে রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।”

তাজওয়ার আহির কথা শুনে তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এবার জিলান বলল,
“আর যাই বল তাজ, আহি কিন্তু ভীষণ সুন্দরী।”

তাজওয়ার হেসে বলল,
“এজন্যই তো এতো ভালোবাসি।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি এজন্য আমাকে ভালোবাসো? আমি সুন্দর তাই? সিরিয়াসলি, তাজওয়ার?”

তাজওয়ার হেসে আহির সামনে আসা চুলগুলো তার কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“তোমাকে আমি ভালোবাসি, আহি। কেন ভালোবাসি এটা বিষয় না।”

আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“কাল যদি আমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে তোমার জীবনে আসে, তখন?”

“কাল তো এখনো আসে নি। আর যতোই সুন্দরী নারী আসুক, রাজার বড় রানীর অধিকার আর ভালোবাসা ছোট রানীরা নিতে পারবে না।”

আহি কথাটি শুনে তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আর বিড়বিড় করতে কর‍তে চলে গেলো। হোটেল রুমের সামনে এসে আহি মিনমিনিয়ে বলল,
“বিয়ের আগেই এসব শুনছি। বিয়ের পর আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবো। অসভ্য, খাটাশ তাজওয়ার খান। বিয়ের ভূত হজম করিয়ে দেবো তোকে।”

এদিকে লাবণি আহির কাছে আসতেই দেখলো আহি একা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে। সে আহির কাছে এসে বলল,
“কি ব্যাপার? মন খারাপ?”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না ভীষণ ভালো লাগছে আমার। ইচ্ছে করছে থা থা থৈ থৈ করতে।”

লাবণি হাসলো। বলল,
“আমি তো ভেবেছি, তাজওয়ারের বন্ধুরা এসেছে তাই তোমার মন খারাপ। কারণ তোমার বন্ধুদের তো দাওয়াত দেওয়া হলো না। আজ তোমার গুরুত্বপূর্ণ দিনে রাদ, লাবীব, পুষ্প, পদ্ম কেউই তোমার পাশে নেই। কিন্তু আমরাও তো নিরুপায়। ওদের কীভাবে দাওয়াত করি, বলো? রাদ আর লাবীব তো তোমার অন্ধ ভক্ত। তুমি ওদের যা বলবে, ওরা তাই করবে। এখন ওরা এসে তোমার কথায় যদি এনগেজমেন্টে সিনক্রিয়েট করতো, তাহলে বিষয়টা সুন্দর দেখাতো না। এমনও হতে পারে, ওরা তোমাকে ভাগিয়ে নিয়ে গেলো। নাক কিন্তু তোমার বাবার কাটা যেতো, আর মাথা কাটা যেতো তোমার দুই বন্ধুর। তাজওয়ার দু’টোকে উপরে পাঠিয়ে দিতে একবারও ভাবতো না। আর তুমি তো এখনো অবুঝ। তোমার ভুলের জন্য কার ক্ষতি হচ্ছে, সেটা তো বুঝবে না। তাই আমি তাদের না জানিয়ে মনে হয় না ভুল কিছু করেছি। আর অন্যদিকে তোমার বান্ধবী পদ্ম। ও তো এখানে আসা এফোর্ড করবে না। এতো ভালো অবস্থা তো তার নেই যে আমেরিকায় এসে এনগেজমেন্ট এটেন্ড করবে। আর বাকিরা না এলে পুষ্প একা এসে কি করতো, বলো? এমনিতে তাজওয়ারের বন্ধুদের চোখ কিন্তু বেশ ধারালো। একবার যদি তাদের চোখে কোনো শিকার আটকে যায়, তারা সহজে সেই শিকারকে ছাড়ে না। শেষমেশ কি-না এতো বছরের দেহ রক্ষা বান্ধবীর এনগেজমেন্টে এসেই শেষ হয়ে যেতো!”

আহি চোখ বড় বড় করে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি আবার বলল,
“তবে লিনাশাকে আসতে বলেছি। সে কি আর আসবে বলো? এমনিতে বলার বলেছিলাম। আফটার অল তোমার একমাত্র খালা।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অনেক বকবক করেছেন। এখন নিজের গতিহীন মুখ আর ধূর্ত মস্তিষ্ককে একটু বিশ্রাম দিন। আমার বন্ধুরা এসব সো ক্লল্ড এনগেজমেন্টে এটেন্ড হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছে না। বরং এসব অসুস্থ মানুষের ভীড় থেকে তারা যতো দূরে থাকবে, তাদের মস্তিষ্ক ততো ভালো থাকবে।”

আহি কথাটি বলেই হোটেল রুমে ঢুকে লাবণির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।

৬৭।

রুমের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই বিরক্তমুখে দরজা খুলে দিলো আহি। দেখলো তাজওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ারকে দেখে সে আরো কয়েক দফা বিরক্ত হলো। চেঁচিয়ে বলল, “কি চায়?”

তাজওয়ার দরজা ধরে আহির দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমাকে চাই।”

আহি তাজওয়ারের মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। আহি কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাজওয়ার দরজা বন্ধ করে আহিকে দরজার সাথে চেপে ধরলো। আহি তাজওয়ারের মুখের সামনে তার হাত রেখে বলল,
“কাছে আসার চেষ্টা করবে না।”

তাজওয়ার নেশা জড়ানো কন্ঠে বলল,
“তুমি এখন আমার।”

“ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমাদের এখনো বিয়ে হয় নি।”

তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের কাছে আনলো। আহি তাজওয়ারকে ছাড়ানোর জন্য তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে তাজওয়ারের পিঠে ঘুষি মারতে লাগলো। কিন্তু তাজওয়ার এসবের তোয়াক্কা না করে আহিকে কোলে উঠিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। আহি তৎক্ষণাৎ তার দুই হাতে ভর দিয়ে উঠতে যাবে, তখনই তাজওয়ার তার উপরে ভর দিয়ে শুয়ে পড়লো। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“আমি তোকে খুন করে ফেলবো। এসব অসভ্যতা আমার সাথে দেখাবি না।”

তাজওয়ার আহির মুখ চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না। আমি তোমার ফিয়োন্সে। এখন তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আর আমি কি তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্কে যাচ্ছি? আমি তো জাস্ট তোমাকে একটু ভালোবাসার চেষ্টা করছি।”

“এটাকে ভালোবাসা বলে? ছি! আমাকে কি তুমি তোমার প্রেমিকাদের মতো ভেবেছো? আমার কাছে এসব নোংরামি। ভালোবাসা না।”

“দেখো আহি, আমি কিন্তু চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি। আমাকে আটকানোর সাধ্য কারো নেই। কিন্তু তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো। আমি আমার ফিয়োন্সেকে একটু আদর করতে পারবো না?”

তাজওয়ার কথাটি বলেই আহির গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। আহির মেজাজটা আরো বিগড়ে গেলো। সে তাজওয়ারের চুল টেনে ধরে তার মুখটা উঠিয়ে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিলো তাজওয়ারের গালে। তাজওয়ার গালে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আহি উঠে বসলো আর রাগী স্বরে বলল,
“আমি তোর ভোগ্যপণ্য নই। নেক্সট টাইম আমার আগে-পিছেও যদি দাঁড়াস….”

আহি পুরো কথাটা শেষ করার আগেই তাজওয়ার আহির হাতটা শক্ত করে চেপে তাকে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে তার গালে সশব্দে একটা চড় বসিয়ে দিলো। এতো জোরে সে চড় মেরেছে যে আহি সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়লো। গালটা লাল হয়ে গেছে আহির। মনে হচ্ছে কেউ লোহা গরম করে মুখে চেপে ধরেছে। ভীষণ জ্বলছে আহির কোমল গালটি। যন্ত্রণায় তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তাজওয়ার এবার আরো ভয়ংকর হয়ে গেলো। সে আহিকে টেনে তুলে আবার ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। আহির শরীর একদম নিস্প্রভ হয়ে গেছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার এবার আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহির অনুমতি না নিয়ে ইচ্ছেমতো আহির গলায়, মুখে তার অধর ছুঁইয়ে দিলো। ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো সে। আহি স্তম্ভিত ফিরে পেতেই আবার তাজওয়ারকে সরানোর জন্য ধাক্কা দিতে লাগলো। তাজওয়ার এবার আহির ওষ্ঠদ্বয়ে তার অধর ছোঁয়ালো। এদিকে আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাজওয়ার বুঝতে পেরে আহিকে ছেড়ে দিলো। আহি ছাড়া পেয়ে নিজের হাত দিয়ে জোরে জোরে তার ঠোঁট ঘষতে লাগলো। নিঃশব্দে কাঁদছে সে, আর তার হাতটাও কাঁপছে। তাজওয়ার আহির লাল হয়ে যাওয়া গালটিতে তার অধর ছুঁইয়ে বলল,
“সরি। সরি। সরি। এন্ড আই লাভ ইউ, আহি।”

আহি কাঁদছে। তাজওয়ার এবার আহির চোখ মুছে তার চোখে অধর ছোঁয়ালো। আহি এবার উঠে বসলো৷ তাজওয়ারও উঠে বসে বলল,
“কাঁদছো কেন, আহি? আমিই তো তোমার সব। কেন এমন করছিলে বলো? আমার তো তোমার উপর অধিকার আছে। আজ নয়তো কাল আমি আদায় করে নিবোই। তাহলে আজ কেন নয়?”

আহি করুণ দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আহি উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই মানুষটা যে তার অনুভূতি কখনোই বুঝবে না, এটা আজ পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে আহি। আহিকে চুপ দেখে তাজওয়ার আবার বলল,
“কিছু তো বলো?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমার বমি আসছে।”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো, “হোয়াট?”

আহি উঠে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। এরপর পানির কল ছেড়ে মুখে ইচ্ছেমতো পানির ঝাপটা দিলো। ভেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখেই আহির গা গুলিয়ে এলো। গলগল করে বমি করে দিলো সে। তাজওয়ার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
“আ’র ইউ ওকে? আহি, আই এম সরি। দরজাটা খোলো। আমাকে ভেতরে আসতে দাও।”

আহি দেয়ালে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাজওয়ার বলল,
“আমি কিন্তু দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকবো।”

আহি দরজাটা খুলে দিলো। তাজওয়ারকে কাঁপা হাতে সরিয়ে বিছানার দিকে পা এগুতেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ার আগেই তাজওয়ার তাকে ধরে ফেললো। সে আহিকে ঝাঁকিয়ে বলল,
“আহি, কি হয়েছে তোমার?”

তাজওয়ার তড়িঘড়ি করে আহিকে কোলে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আহি জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসি বন্ধ করে জানালাটা খুলে দাও। আমার দম বন্ধ আসছে।”

তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “ওয়েট, ওয়েট।”

তাজওয়ার তাড়াতাড়ি এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিলো। এরপর আহির পাশে বসে তার হাতটা আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল,
“সরি, আহি। তুমি এমন অসুস্থ হয়ে যাবে, আমি ভাবতেও পারি নি। তুমি আমাকে একটু ভালোবাসলে, সবকিছুই তোমার সহজ মনে হতো।”

আহি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“খারাপ লাগছে তোমার?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বলল, “মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

তাজওয়ার চুপ হয়ে গেলো। মিনিট খানিক সে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর মুখ ঘুরিয়ে অন্যপাশে বসলো। এবার তাজওয়ারের হাত কাঁপছে। আহির এই অস্থিরতা দেখে সে নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। ইচ্ছে করছে দেয়ালে ঘুষি মেরে নিজের হাতটা থেঁতলে ফেলতে। তাজওয়ার অনেকক্ষণ পর আহির দিকে ঘুরে বসে বলল,
“আচ্ছা, সরি। আই এম রিয়েলি ভেরি সরি। এই মুহূর্তে শাস্তিস্বরূপ তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই দেবো। তবে শুধু এই মুহূর্তের জন্য। দশ মিনিট সময় আছে তোমার হাতে। যা চাওয়ার চেয়ে নাও। কিন্তু এই দশ মিনিটে নিজের প্রাণ আর তোমার প্রাণ নেওয়া ছাড়া সবকিছুই করতে পারবো আমি।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বলল, “তোমার ফোনটা দাও।”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“কার সাথে কথা বলবে?”

আহি মলিন মুখে বললো, “মায়ের সাথে।”

তাজওয়ার দ্রুত ফোনটা পকেট থেকে বের করে আহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ওহ অফকোর্স। আমারও বলা উচিত। আফটার অল সি ইজ মাই ওয়ান এন্ড অনলি রিয়েল মাদার-ইন-ল।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৪(২য় ভাগ)||

৬৮।
ফোন বেজে উঠতেই সালমা ফাওজিয়া হাত মুছতে মুছতে ফোনের কাছে এগিয়ে গেলেন। স্ক্রিনে অপরিচিত নম্বর ভেসে উঠতেই তিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। খুব আশা নিয়েই ফোনের কাছে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন আহির কল হবে৷ কিন্তু তিনি হতাশ হলেন৷ কলটা রিসিভ করে কানের কাছে আনতেই তিনি থমকে গেলেন। তার বুকটা কেঁপে উঠলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“আহি, মা আমার! কাঁদছো কেন?”

আহি ফোন কানের কাছ থেকে সরিয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে একটু স্পেইস দেবে? আমি একা কথা বলতে চাই। প্লিজ।”

তাজওয়ার সরে যেতেই আহি ফোনটা আবার কানের কাছে আনলো। বললো, “মা।”

“কাঁদছো কেন মা?”

“হয়তো তোমাকে আর ফিরে পাবো না। হয়তো আমার স্বপ্নগুলো শেষ হয়ে গেছে। কতো স্বপ্ন দেখেছি! একদিন মায়ের কাছে ফিরবো। আমাদের দু’জনের ছোট্ট একটা সংসার হবে। সেই সংসারে কোনো হিংসা থাকবে না। কোনো বিবাদ থাকবে না। শুধু শান্তি থাকবে। মা আর মেয়ের ভালোবাসা থাকবে। কিন্তু বাবা আমার সব স্বপ্ন আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। লোকটার সাথে আমার এনগেজমেন্ট করিয়ে দিলো। মা, মানুষটা ভালো না। একদম ভালো না। আমি কি একটু ভালোবাসা ডিজার্ভ করি না? মানুষটা আমাকে ভালোবাসে না। তার জন্য ভালোবাসা মানে সুন্দর মুখ আর দেহ। আমি তো সাধারণ মানুষ চাই। একদম আফিফের মতো। সিম্পল, নব্বই দশকের ভালোবাসা চেয়েছি। যে আমার সাথে চাঁদ দেখবে, গান শুনবে, আমার ছবি আঁকা দেখবে, আমার সাথে সমুদ্র পাড়ে বসে সমুদ্র বিলাস করবে। আমি কি খুব কঠিন স্বপ্ন দেখে ফেলেছি? আমার সাথে ভাগ্য এমন বেইমানি কেন করলো, মা? আফিফকে পাই নি। ঠিক আছে। মেনে নিলাম সেটা। অন্তত একটা ভালো মানুষ তো পেতে পারতাম। মা, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। কেন সেদিন আমাকে মেরে ফেলো নি? কেন আমাকে পৃথিবীতে এনেছো? কেন আমাকে মিস্টার কবিরের কাছে ফেলে চলে গেছো?”

সালমা ফাওজিয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,
“আম্মু, এই আম্মু, এভাবে কাঁদছো কেন? চুপ করো। আমি আছি তো। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আসবো। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলবো।”

“এতোদিন কি পেরেছিলে? তাহলে এখন কীভাবে পারবে? একদিকে বাবা, অন্যদিকে তাজওয়ার খান। বাবার সাথে যুদ্ধ করতে পারো নি, তাহলে ডনের সাথে পারবে? মিস্টার কবির তো আমার বাবা। সে-ই আমার কথা ভাবে নি। আর এই মানুষটা তো আমার কেউ না। সে শুধু তার শখ পূরণের জন্য আমাকে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। নিলাম হয়ে গেছি আমি।”

তাজওয়ার আহির রুমে ঢুকে শেষ কথাটি শুনে ফেললো। আহির সামনে বসে হুট করে ফোনটা টেনে নিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমার কথা শেষ হয় নি।”

তাজওয়ার বলল,
“নিলাম হওয়ার কথা কেন বলছো?”

তাজওয়ার ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল,
“হ্যালো মাদার-ইন-ল, আপনি নিশ্চিন্তমনে ঘুমান। আহিকে আমি রানীর মতো রাখবো।”

সালমা ফাওজিয়া দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“ফেরাউনও রাজা ছিল। আসিয়া ছিল তার রানী। শোনা, আমার মেয়েকে রানীর মতো রাখার জন্য রাজার প্রয়োজন নেই। আর তোমার মতো রাজা কোনো নারীকেই রানী করে রাখতে পারবে না। আমার মেয়েকে সে-ই রানী করে রাখবে, যার যোগ্যতা আছে মনের রাজা হওয়ার। দেশের রাজা নয়।”

তাজওয়ার কল কেটে দিলো। এরপর আহির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
“মাদার-ইন-ল’কে আমার বিরুদ্ধে বেশ কিছু বুঝিয়ে ফেলেছো, দেখছি। এটা ঠিক করো নি, আহি।”

আহি করুণ দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে সালমা ফাওজিয়া কল কেটে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়লেন। ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলেন। তার কান্নার আওয়াজ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন রোকেয়া আফজাল। মেয়েকে কাঁদতে দেখে রোকেয়া ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“আরেহ, কাঁদছিস কেন সালমা?”

সালমা ফাওজিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“আমার মেয়ে ভালো নেই, মা। তোমরা তো কেউ চাও না আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখি। কিন্তু আমার মেয়েটার কি অপরাধ, বলো? ওই রিজওয়ান কবির আমার মেয়েটাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমি কেমন অসহায় মা! আমার মেয়েকে সাহায্য করতে পারছি না। আমার ওই ফেরাউনকে জিজ্ঞেস করা উচিত, কেন এমন করছে।”

রোকেয়া আফজাল কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“পাগল হয়ে গেছিস? তোর ভাইদের মেরে ফেলবে। তোকে মেরে ফেলবে। আমি স্বামী হারিয়েছি। সন্তান হারাতে পারবো না। কতো বছর হয়ে গেছে, তোর বাবার কোনো হদিসই পেলাম না।”

সালমা ফাওজিয়া চোখ মুছে বললেন,
“আমিও স্বামী হারিয়েছি। সন্তান হারাতে পারবো না।”

সালমা ফাওজিয়া রিজওয়ান কবিরের নম্বরে ডায়াল করলেন। তার ফোন বন্ধ। হঠাৎ তার মনে পড়লো, একটু আগে যেই নম্বর থেকে কল এসেছে ওটা বিদেশি নম্বর। সালমা ফাওজিয়া নম্বরটি দেখে বুঝলেন, আমেরিকান নম্বর। তার কাছে রিজওয়ান কবিরের সব দেশের সিম নম্বর আছে। সালমা ফাওজিয়া ফোন বুক ঘেঁটে সেই নম্বরগুলো বের করলেন। তিনটা নম্বর আছে। দ্বিতীয় নম্বরটিতে কল করতেই রিং হলো। এরপর কল কেটে ফোনে বেশি করে টাকা ঢুকালেন। তারপরও মনে হচ্ছে দুই মিনিটের বেশি কথা বলা যাবে না। যতোক্ষণ বলা যায়, তিনি ইচ্ছেমতো শুনিয়ে দেবেন।

সালমা ফাওজিয়া আবার কল করলেন। ওপাশ থেকে রিজওয়ান কবিরের কন্ঠ ভেসে এলো। সালমা ফাওজিয়া রাগী সুরে বললেন,
“কেন আমার মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছো? আর তুমি আমাকে না জানিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। আমি আহির মা।”

রিজওয়ান কবির খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“হাইপার হচ্ছো কেন? এখন তো জেনেছো। বাসায় আসো। মেয়েকে শুভ কামনা দিও। সাথে বিয়েটাও এটেন্ড করবে। আহির মাস্টার্স শেষ হলেই বিয়ে হবে। তোমার কাছে বিশেষভাবে বিয়ের কার্ড পৌঁছে যাবে। আর এনগেজমেন্টে বাইরের মানুষ আসে নি। আর তুমি তো বাইরের একজন। ভুলে যেও না, আহির কাস্টাডি আমি পেয়েছি।”

“পেয়েছো। কিন্তু এখন ও এডাল্ট। ও আমার সাথে থাকতে চাই। আর তুমি ওকে আমার কাছেই আসতে দাও না। এখন তো ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছো। তুমি অনেক অন্যায় করেছো। আল্লাহ তোমাকে ছাড়বে না।”

“দেখা যাক, আল্লাহ আমার কি ক্ষতি করতে পারে?”

সালমা ফাওজিয়া কিছু বলার আগেই কল কেটে গেলো। কল কেটে যাওয়ায় তিনি রাগে ফোনটা দূরে ছুঁড়ে মারলেন। এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“আমি আমার মেয়েকে বাঁচাবো। এর জন্য আমার যা যা করার আমি করবো।”

(***)

তাজওয়ার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। রিজওয়ান কবির তার কাছে গিয়ে বললেন,
“তাজওয়ার, একটু এদিকে এসো। তোমার সাথে কথা আছে।”

তাজওয়ার উঠে রিজওয়ান কবিরের সাথে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রিজওয়ান কবির বললেন,
“আহির কাছে ফোন নেই, তুমি কি ওকে ফোন দিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“তুমি কি জানো, আহি তার মায়ের সাথে কথা বলেছে?”

“হ্যাঁ, জানি।”

“শোনো, তাজওয়ার। আহি যদি ওর মায়ের আশেপাশে থাকে তাহলে কিন্তু, তুমিই ওকে হারাবে।”

“কেন?”

“সালমা যদি আহিকে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে আহি। আমি তো আহিকে ভয় দেখিয়ে আটকে রেখেছি।”

তাজওয়ার হাসলো। রিজওয়ান কবির ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“হাসছো কেন?”

“আমি কিন্তু কাউকে ভয় পাই না। না আইন, না কারো শাসন। আমার রাজ্যে আমিই শাসক, আইনও আমার, দণ্ডও আমিই দেবো। সো ডোন্ট ওয়ারি। আহি এতো সহজে আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। আর আমার প্রিয় মাদার-ইন-ল যা এতো বছর পারে নি, তা এখন আমার রাজ্যে এসে তো কখনোই পারবে না। সো আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমার সম্পদ আমি আগলে রাখতে জানি।”

৬৯।

আজই দেশে ফিরেছে আহি। দেশে ফিরতেই ফোন হাতে পেলো সে। ফোন পেতেই প্রথমে রাদকে কল করলো। রাদ এই কয়েকদিন ফোনের কাছ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও দূরে ছিল না। সবসময় ফোন সাথে রেখেছে। নামাজের সময় বোনের হাতে ফোন দিয়ে বলেছিল, আহির কল আসলেই যাতে রিসিভ করে কথা বলে। অস্থির লাগছিল রাদের। আজ ফোনের স্ক্রিনে আহির নম্বরটি দেখেই দেহে প্রাণ ফিরে পেলো রাদ৷ সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো। আহি ওপাশ থেকে বলল,
“রাদ, দেখা করতে পারবি একটু?”

রাদ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। বল কোথায় আসবো?”

“ক্যাম্পাসের পাশের পার্কটাতে।”

“আচ্ছা, আমি এক্ষুণি আসছি।”

(***)

রাদ আগে এসেই বসে ছিল পার্কে। আহি এই মাত্র রিকশা থেকে নামলো। ভাড়া মিটিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাদকে দেখতে পেয়েই আপনা-আপনি চোখে পানি চলে এলো আহির। মনে হচ্ছে, জেল থেকে বেরিয়ে কোনো আপন মানুষ দেখেছে। আহি আশপাশ না দেখে দৌঁড়ে গেলো রাদের দিকে। দৌঁড়ে যেতে যেতেই কান্না করছে সে। এরপর রাদের কাছে এসে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো,
“আমাকে বাঁচাবি রাদ? আমি সত্যিই এবার বাঁচতে চাই। আমার কিচ্ছু লাগবে না। প্রেম-ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আমার। কাউকে চাই না আমি। শুধু আমার সম্মানটা বাঁচলেই হলো। আমার এই দেহটা বাঁচা। আমার মনটা তো ক্ষত হয়ে গেছে। দেহটাও ক্ষত হয়ে গেলে, আমার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।”

রাদ আহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কি করেছে ও তোর সাথে? আমাকে বল, আহি। আমি মেরে ফেলবো শয়তানটাকে।”

আহি রাদকে ছেড়ে তার হাত ধরে বলল,
“যা করেছে তাতেই আমার দম বন্ধ হয়ে গেছে। যদি সত্যিই এর চেয়ে বেশি কিছু হয়, আই সওয়ার আমি নিজের প্রাণ নিতে বাধ্য হবো।”

এদিকে পুষ্প আর লাবীবও ঘুরতে বের হয়েছিল আজ। কাকতালীয় ভাবে হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্যাম্পাসের পার্কেই ঢুকলো। রাদ এবং আহিকে একসাথে দেখে দু’জনই অবাক। আর আহিকে পা ধাপিয়ে কাঁদতে দেখে আরো অবাক হলো তারা৷ দৌঁড়ে গেলো তাদের দিকে। পুষ্প আর লাবীবকে দেখে আহি আর রাদ চুপ হয়ে গেলো। আহি চোখ মুছে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। পুষ্প তা দেখে আহির হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলো। আহি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প বলল,
“আমাকে দেখে চোখ মুছে ফেলেছিস? কেন আহি? কি হয়েছে, আমাকেও জানা! আমি কি তোর বন্ধু না?”

আহি মলিন মুখে পুষ্পের দিকে তাকালো। কেন যেন কান্নাটা আটকে রাখা দায়। আহি পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। পুষ্প আহির পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। পুষ্প আহিকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে বলল,
“বল, কি হয়েছে!?”

আহি কাঁপা কন্ঠে পুষ্পকে সবটা জানালো। যেই কথা রাদকে পরিষ্কার ভাবে বলতে পারে নি, তার সবটাই পুষ্পকে বললো। সব শুনে পুষ্পের চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে সান্ত্বনার সুরে বলল,
“কাঁদিস না। দেখিস পথ একটা বেরিয়ে আসবেই।”

“কখন আসবে?”

“এই মুহূর্তে একটাই পথ খোলা আছে, যদি তুই পারিস।”

“বল না।”

“কেইস করে দে।”

“বেশ তো। করতে সমস্যা নেই। উকিল কোথায় পাবো?”

“ভাইয়া।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“উজ্জ্বল ভাইয়া অবশ্যই এর সলিউশন বের করবে।”

“তাজওয়ার আর বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সাহস কারো নেই। আমি দেশের সনামধন্য উকিলের কাছে গিয়েছি। সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।”

“দেখ আহি। এসব আমি বুঝি না। সবাই কিন্তু টাকার পেছনেই ছুটে। আমার ভাইটা আলাদা। ও তোর জন্য সব করবে। একবার এই ব্যাপারে জানিয়েই দেখ। আর উজ্জ্বল ভাইয়া অনেক বুদ্ধিমান। একটা কেইসও এখনো হারে নি। সিলেটের চেয়ারম্যানের ছেলের বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছিল। ওটাতে ধরাশায়ী করে দিয়েছিল। পেপারে ছবিও ছাপিয়েছিল ভাইয়ার। ক্রেস্টও পেয়েছে। নিজের চেম্বার নিতে পেরেছিল। বেশ চলছে ওর। নিশ্চিত তোর কেইসটা জিতে যাবে।”

“যদি উনার কিছু হয়ে যায়? আমার জন্য কারো ক্ষতি হোক আমি চাই না।”

“ধুর গাধী। আইন আর বিচার বিভাগের সাথে যারা জড়িত তারা এসব চিন্তা করে না। এসব চিন্তা করলে সুখী ক্যারিয়ার বেছে নিতো। কে বলেছে তাকে উকিল হতে? সিলেটে ভাইয়ার শত্রু কি কম? ভাইয়া এসব পাত্তায় দেয় না। আর একবার কেইস জিতে গেলে তাজওয়ার আর তোর বাবা কিচ্ছু করতে পারবে না। এরপর সু্যোগ বুঝে তুই আন্টিকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবি। আর ভাইয়াও দেশে থাকবে না। উনি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্ল্যান করছে। তোর কেইসটাই না হয় ভাইয়ার দেশের লাস্ট কেইস হবে।”

আহি পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“উনাকে আজই বলিস। আমি আর পারছি না, পুষ্প।”

এদিকে রাদও কাঁদছে। লাবীব তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“দেখ ঠিক হয়ে যাবে সব।”

রাদ বলল,
“এই কথা আর বলিস না। কিচ্ছু নিজের ইচ্ছেমতো হচ্ছে না। আমার কোনো যোগ্যতায় নেই আহিকে বাঁচানোর? কেমন বন্ধু আমি? কোনো কাজের না। বুঝতে পারছি না কি করবো। মাথাটা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে।”

“হুম, শত্রু যদি ক্ষমতাবান হয়, তখন দুর্বল মানুষদের করার মতো কিছুই থাকে না।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৩০+৩১

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩০(১ম ভাগ)||

৬০।
চট্টগ্রামে ফিরেই রাদ আর আহি নায়ীবের সাথে দেখা করতে গেলো। নায়ীব তাদের দেখেই সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আহি মুচকি হেসে বলল,
“আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও কম হবে।”

নায়ীব আহির দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে প্রেসক্রিপশনে কিছু লিখতে লাগলো। রাদ আহির হাত ধরে নায়ীবের উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছে। নায়ীব রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মিস ওয়াসিকা কবির যার সাথে বেশি ভালো থাকে, তার সাথেই সময় কাটাবে।”

নায়ীব এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি বলেছেন বাবা আপনাকে মায়ের সাথে দেখা করতে দেয় না। অথচ আপনি আমার থেরাপি ছাড়াই যতোদিন মায়ের সাথে ছিলেন, ভালো ছিলেন। আসল সমস্যা আপনার বাসায়। আমি আপনাকে শুরুতে জানায় নি, কারণ আপনি যদি এটা মস্তিষ্কে গেঁথে ফেলতেন, তাহলে এই এক্সপেরিমেন্টে কোনো কাজ হতো না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “বাসায় সমস্যা বলতে?”

“আপনি নিশ্চয় সেই স্থানে ভালো নেই। এই মুহূর্তে আপনার জন্য আপনার মায়ের সাথে থাকা জরুরি। যখনই মনে হবে আপনি প্যানিক হচ্ছেন, ভালো লাগছে না। আমি সাজেস্ট করবো মিস্টার রাদ অথবা আপনার মা যাতে আপনার পাশে থাকে। কারণ এই দু’জনই আপনাকে ম্যান্টালি সাপোর্ট করে।”

নায়ীব প্রেসক্রিপশনটি আহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার টিপস ফলো করবেন।”

আহি প্রেসক্রিপশন দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মেডিসিন তো নেই!”

“আপনার মেডিসিন আপনি নিজেই। আর এই টিপসগুলো। সকালে উঠেই প্রয়োজনীয় কাজ সেরে মেডিটেশন করবেন। এটা প্রতিদিনই যাতে দিনলিপিতে যুক্ত হয়। নাস্তা খাওয়ার আগে বাইরে হেঁটে আসবেন। একদমই অলসতা দেখাবেন না। যদি ক্লাস থাকে, সেদিন আরো আগে উঠবেন। তাও এই দুইটা কাজ অবশ্যই করবেন। এরপর বাকি আপনার জরুরি কাজ থাকলে করবেন। কাজের ফাঁকে বাগানে সময় তো দিবেনই। সেই মুহূর্তে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে পারেন বা আপনার প্রিয় গায়ক বা গায়িকার গান। তবে এই জায়গায় আপনি কোরআন তিলাওয়াত শুনতে পারেন। এটা আপনার মনকেও শান্ত করবে, সাথে সওয়াবও পাবেন। আপনার ইচ্ছা, আপনি যেটা করতে ইচ্ছুক। আর অবসরে ভালো কিছু মুভি দেখতে পারেন। প্রেম সম্পর্কিত মুভি না দেখায় আপতত আপনার জন্য ভালো হবে। আর অবশ্যই আপনার শখকে প্রাধান্য দিবেন। যেহেতু আপনি ছবি আঁকেন, তাহলে সেখানেই বেশি ফোকাস করবেন। যেই ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে আপনি মানসিক শান্তি পান, তার সাথে প্রতিদিন কথা বলবেন। আর সে যদি মিস্টার রাদ হয়ে থাকে, তাহলে বলবো, প্রতিদিন একসাথে কোনো এক বেলা খাওয়া-দাওয়া করবেন। সুযোগ না হলে এক কাপ চা একসাথে খাবেন। ট্রাস্ট মি, এর চেয়ে চমৎকার মুহূর্ত আপনি আর পাবেন না। এরপর আসি ভয়ংকর সময়ে, রাত দশটার পর প্রায়ই মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যায়। বা গভীর রাত জাগার অভ্যাস থাকলে আপনা-আপনি মন খারাপ হয়ে যায়। সাজেস্ট করবো, সেই সময় প্যারানরমাল বা থ্রিলার মুভি দেখবেন। অথবা কমিকস পড়বেন। আর যাই করবেন রাতে আপনি গান শুনবেন না, ছবিও আঁকবেন না। সেই মুহূর্তটা আপনাকে আরো বেশি ইমোশনাল করে ফেলবে। কারণ ছবি আঁকার সাথে আপনার অতীতের সম্পর্ক আছে। আর গান শুনলে স্বাভাবিক মনটা আরো ভারী হয়ে আসে। কিন্তু দিনের বেলায় এই কাজ করলে আপনার তেমন অনুভূত হবে না। কারণ আলোর প্রভাব। এবার আসি পরিবেশে। প্রথম কাজ দেয়ালের রং পরিবর্তন করবেন। মনের মতো ঘর সাজাবেন। জানালা খোলা রাখবেন। পর্দা চেঞ্জ করবেন। রাতে বেশি আলো জ্বালাবেন। যেমন দুইটা বাতি জ্বালিয়ে রাখবেন। রঙ-বেরঙের বাতি জ্বালিয়ে রাখতে পারেন। তবে নয়টার পর আলো কমিয়ে দেবেন। অনেকে সাজেস্ট করে বিড়াল পোষার জন্য বা পাখি কিনে আনার জন্য। আমি করবো না। আমার নিজের একটা বিড়াল আছে। ও অসুস্থ হলে, আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই এই মুহূর্তে নিজেকে সময় দিবেন। অন্য কিছুতে না।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ। আমি ফলো করবো এই টিপসগুলো।”

“এবার আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন। আমি মিস্টার রাদের সাথে কিছু কথা বলবো।”

আহি বাইরে যেতেই নায়ীব রাদকে বলল,
“মিস ওয়াসিকা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হোন নি। এমনকি আপনাকে দেখেও মনে হচ্ছে, মানসিক চাপে আছেন। চাপটা যে মিস ওয়াসিকাকে নিয়ে তা আমি বুঝতে পেরেছি। এবার দুইটা কথা বলবো, যতো শীঘ্রই সম্ভব তাকে তার বাবার বাসা থেকে নিয়ে আসা উচিত। মিস ওয়াসিকা সেই ছেলেটাকে এতো সহজে ভুলতে পারবে না। সে শুধু বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। সহজে কাউকে ভুলে যাওয়া যায় না। একজন সুস্থ মানুষ সবকিছুর ভীড়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু প্রাক্তনকে দিনের একটা সময় তার মনে পড়বেই। এটা একদম ন্যাচেরাল। আর সেখানে মিস ওয়াসিকার অনুভূতি অন্য পর্যায়ে চলে গেছে। সেটা এখন আধ্যাত্মিক অনুভূতি। এখান থেকে সহজে বের হওয়া যায় না। যদি একই অনুভূতি সে অন্য কারো জন্য অনুভব করে, তবেই এটা সম্ভব। কিন্তু ন্যাচেরালি মিস ওয়াসিকা অনেক লয়েল। এই দিক থেকে মেয়েটা লয়েল থাকবে৷ এখন বিয়ে বা নতুন কোনো সম্পর্ক এই দুইটা চাপ আপতত তার ঘাড়ে না চাপালেই হলো।”

রাদ নায়ীবের সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক বড় উপকার করেছেন। আমি অবশ্যই আহির খেয়াল রাখবো।”

নায়ীব মৃদু হাসলো। রাদ চেম্বার থেকে বের হয়েই আহির দিকে তাকালো। মনটা ভারী ভারী লাগছে তার। মনে মনে ভাবছে,
“সত্যিই কি আহি আমার প্রেমে পড়বে না? আমি কি এইটুকু স্বপ্ন দেখতে পারবো না? এখন তো বলতেও পারবো না, আমি ওকে ভালোবাসি। যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? যদি ও আবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে?”

৬১।

ভাদ্র বিদায় হলো চোখের পলকে। প্রকৃতি ছেয়ে গেলো উষ্ণ আবহাওয়ায়। আহি ঘেমে নেয়ে ক্যাম্পাস থেকে সবে মাত্র বাসায় ঢুকলো। তখনই চুনি এসে বলল,
“আফা দেহেন গিয়া কে আইছে।”

আহি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
“কে আর আসবে? অতিথি মানেই তো বাবা আর মিসেস লাবণির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার আপন কেউই এই বাসায় আসে না।”

চুনি মুখ চেপে হেসে বলল,
“আপনের আপন মানুষ আইছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মা এসেছে!”

“আরেহ না।”

“তাহলে কে?”

“গিয়া না হয় দেখি আসেন।”

আহি লিভিং রুমে উঁকি দিতেই দেখলো, তাজওয়ার, তার মা রেহানা খান, আর দোয়েল বসে আছে। আহি তাদের দেখে পেছন ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে চুনির দিকে তাকালো। দোয়েল আহিকে দেখেই বলে উঠল,
“আহি চলে এসেছে।”

দোয়েলের ডাকে আহি চোখ-মুখ কুঁচকে লিভিং রুমে ঢুকলো। সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে রেহানা খানকে সালাম দিলো। রেহানা খান আহির কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“রিজওয়ান ভাই, আপনার মেয়েটা বেশি লক্ষ্মী।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে বলল,
“তাই তো তোমার শয়তান ছেলের জন্য আমাকে নিয়ে যেতে চাইছো!”

রেহানা খান আহিকে টেনে নিজের পাশে বসালেন। তাজওয়ার হুট করে রিজওয়ান কবিরের পাশ থেকে উঠে আহির গা ঘেঁষে বসে পড়লো। আহি চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আহির তাকানো দেখে তাজওয়ার মুচকি হাসি ফেরত দিলো। আহি এবার রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। রিজওয়ান কবির ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছেন। আহির রাগ উঠলো। এ কেমন বাবা তার? একটা ছেলে তার গা ঘেঁষে বসে আছে, আর তার বাবার কোনো প্রতিক্রিয়ায় নেই! আহি এবার বিরক্ত মুখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“বিন্দুমাত্র ভদ্রতা নেই এই ছেলের।”

এদিকে রেহানা খান হঠাৎ আহির হাতে একটি সোনার বালা পড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“আগামী মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার তাজওয়ার আর আহির এনগেজমেন্টটা হলে ভালো হয়।”

আহি রেহানার কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। লাবণি আহির চাহনি দেখে বলল,
“আহি এখন থেকেই ড্রেস সিলেক্ট করে ফেলো। তাজওয়ারকে নিয়ে যা যা লাগবে কিনে ফেলো। এনগেজমেন্ট আমেরিকায় হবে। সিরাজ ভাইয়া তো দেশে আসতে পারবেন না তাই।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“দেশে আসবে কিভাবে? আসলেই তো তার ঠিকানা সোজা জেলখানায়।”

আহির কথা শুনে রিজওয়ান কবির রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালেন। তাজওয়ার পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল,
“আহি, আসলেই তুমি অনেক ফানি। তোমার হবু শ্বশুড় কিন্তু এমন মজা অনেক পছন্দ করেন। তুমি এক কাজ করো, আমেরিকায় গিয়ে বাবাকে এরেস্ট করে নিয়ে এসো।”

“যদি ক্ষমতা থাকতো ক্রসফায়ারে দিয়ে দিতাম। এরেস্ট করে সময় নষ্ট করতাম না।”

রিজওয়ান কবির ধমকের সুরে বললেন,
“আহি, এসব কেমন বেয়াদবি?”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি অন্তত এমন অসভ্য লোকের সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করে, আমার কাছ থেকে সভ্য ব্যবহার আশা করবে না। এখন থেকে আমি এভাবেই কথা বলবো।”

রিজওয়ান কবির উঠে দাঁড়িয়ে আহিকে চড় মারতে যাবেন তার আগেই তাজওয়ার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“প্লিজ আংকেল। রিল্যাক্স। আপনি তো এখন আহির দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। ওকে শাসনটাও না হয় আমিই করি।”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“তুমি আমাকে শাসন করার কে?”

তাজওয়ার সবার সামনে আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর আহিকে নিয়ে ছাদে চলে গেলো। ছাদে এসেই আহিকে রেলিঙের উপর বসিয়ে আহিকে আবদ্ধ করে রেলিঙের দুই পাশে হাত রেখে তাজওয়ার বলল,
“তুমি জানো, আমি কতোটা হিংস্র। কিন্তু তবুও আমি বড়দের সামনে ভদ্র আচরণ করি। আর তুমি আমার মায়ের সামনে এভাবে কথা বলছো! মা কি মনে করবে?”

“যা ইচ্ছে মনে করুক। যা ভাবার ভেবে এই বিয়েটা ভেঙে দিক।”

তাজওয়ার হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার বলল,
“তুমি এতোটা বোকা হবে, তা আমি জানতাম না। বিয়েটা আমার ইচ্ছাতেই হচ্ছে। আমার ইচ্ছার উপর কথা বলার সাহস কারো নেই। কেউ মেনে নিক, না নিক। আমি তোমাকে যে-কোনো মূল্যে নিজের করেই ছাড়বো। কারো ক্ষমতা নেই আমাকে আটকানোর।”

আহি বুঁকে হাত গুঁজে বলল,
“ক্ষমতা আছে। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। এই কথা তো জানোই। আল্লাহ যদি আমার সাথে থাকে, তুমি আমাকে স্পর্শও কর‍তে পারবে না।”

তাজওয়ার আহির কোমর আঁকড়ে ধরে আহির গালে জোর করে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
“করলাম স্পর্শ। পেরেছো নিজেকে মুক্ত করতে?”

“তোমার মতো শয়তানরা একবার সফল হয়েই নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে। একবার আমাকে সফল হতে দাও। ওয়াদা করছি, তোমাকে তোমার জায়গা দেখিয়ে দিবো।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“এমন গালগল্প না শুনলে রাতে ঘুম আসে না। এমন গাজাখুরি গল্প শোনার জন্য হলেও আমার তোমাকে চাই।”

(***)

ফোনের স্ক্রিনে আহির নাম ভেসে উঠতেই রাদ তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে আহির কান্না ভেজা কন্ঠ শুনে মুহূর্তেই রাদের বুকটা ভারী হয়ে হলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, কাঁদছিস কেন?”

“ভাই আমার লাইফটাই অভিশপ্ত। যন্ত্রণা শব্দটা থেকে আমি এক সেকেন্ডের জন্যও মুক্তি পাই না।”

“হয়েছে কি বলবি?”

“আগামী মাসে তাজওয়ার আর আমার এনগেজমেন্ট।”

কথাটি শুনেই মুহূর্তের জন্য রাদের মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। পরক্ষণেই সে বলল,
“আরেহ ধুর, আগেও তো এনগেজমেন্ট ফিক্সড হবে বলেছিল, ওটা তো হয় নি।”

“আগের বার বাবা ওদের দাওয়াত দিয়েছিল। এবার ওরাই এসেছে।”

রাদ থমথমে কন্ঠে বলল, “কি করবি এখন?”

“চেয়েছিলাম মাস্টার্স শেষ করেই ইউকে তে শিফট হয়ে যাবো। ওখানে গেলে তাজওয়ার আমার কোনো ক্ষতি করতে পারতো না৷ এখন তো বাবা আমাকে ইচ্ছে করে দেশে এনেছে, যাতে আমি পালাতে না পারি। জানিস, আমার পাসপোর্টটাও আমার কাছে নেই।”

রাদ মলিন মুখে বললো,
“কি সাজেশন দিবো তোকে। আমার নিজেরই তো মাথা ঘোরাচ্ছে।”

“সিনেমাতে কতো দেখি বিয়ের দিন বর-কনে পালটে ফেলা যায়। যদি ওরকম সুযোগ থাকতো!”

“হুহ, তোকে উড়না গায়ে ঝুলাতে দেয় না, আর লম্বা ঘোমটা টেনে বিয়ে কর‍তে বসাবে? আর কবুল বলার সময় নামটা কি সাইলেন্টলি পড়বে না-কি?”

“সিনেমায় যে কীভাবে হয়! এখন কোনো আইডিয়া দে না। ওই অজগরের কাছ থেকে কীভাবে মুক্ত হবো আমি?”

“আমাকে একটু সময় দে ভাবার। তুই চিন্তা করিস না। একদম লাস্ট কোনো অপশন না থাকলে তোকে আমিই বিয়ে করে ফেলবো। মেয়েদের তো আর দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়া যাবে না। তখন তাজওয়ার তোকে আর বিয়েই কর‍তে পারবে না।”

“হ্যাঁ, কতো সাহস তোর! তোকে ওই অজগর গিলে ফেলবে। তারপর আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।”

“আমাকে বাঁচাতে তুইও ওই অজগরের মুখে ঢুকে যাবি আর কি। তারপর আমরা দু’জন ওই অজগরের পেটে ঢুকে তার পেট ফুঁটো করে বেরিয়ে আসবো।”

“বাহ কোন পুরাণকাহিনি বলছিস। এটা একবিংশ শতাব্দী।”

রাদ আহিকে আশ্বস্ত করে বলল,
“দেখ আহি, আমাকে একটু ভাবতে দে। আমি তোকে মুক্ত করবো। এটা আমার প্রমিজ।”

আহির সাথে কথা বলা শেষে রাদ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আজ আর তার ঘুম হবে না। আহি ঠিকই বলেছে, কাউকে ভালোবাসার মতো যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি দ্বিতীয়টা নেই। আহি আফিফকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে, আর রাদ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। রাদের ভালোবাসা প্রকাশ করার মতো ভালো সময়, ঝঞ্জাটহীন পরিবেশ এখন আহির জীবনে নেই। আহি ব্যস্ত নিজেকে তাজওয়ার নামক বিষাক্ত মানুষটির কাছ থেকে মুক্ত করতে। আফিফকে ভালোবেসে আহি কম আঘাত পায় নি। এর মধ্যে রাদ তার ভালোবাসার কথা জানানোর সাহস পাচ্ছে না। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। ভাগ্য তাকে কোন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে! রাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি, আমি না তোকে ভীষণ ভাবে চাই। আশ্বিনের শীতল হাওয়ায়, তোকে খুঁজে পেতে চাই। কুয়াশার ভীড়ে তোর হাতটা ধরতে চাই। বসন্তের ফুল তোকে বিলাতে চাই। জ্যোষ্ঠের রোদ থেকে তোকে বাঁচাতে তোর ঢাল হতে চাই। শ্রাবণ বেলায় তোর সাথে ভিজতে চাই। যতোই দূরত্বের পথ হোক, আমার মনের গন্তব্য তুই। আহি তুই কখন আমার হবি? কখন বাদলা দিনে তোর সিক্ত মুখখানা ছুঁয়ে দিবো? কখন তোকে বলতে পারবো, ভালোবাসি?”

(***)

সকালে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বের হলো পুষ্প। গাড়ির জন্য ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে রইলো সে। হঠাৎ একটা মোটরসাইকেল তার সামনে থেমে তার হাত থেকে তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে নিলো। জোরে টান পড়ায় পুষ্প ভারসাম্য হারিয়ে ফুটপাত থেকে ছিঁটকে পড়লো রাস্তায়। ভাগ্যিস রাস্তায় গাড়ি কম ছিল। নয়তো পুষ্পের জন্য এই দিনটায় শেষ দিন হতো। পুষ্প রাস্তার উপর শুয়ে চেঁচাতে লাগলো। সেই মুহূর্তেই লাবীব তার মোটরসাইকেল নিয়ে সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। পুষ্পকে দেখে সে মোটরসাইকেল থেকে নেমে তাকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বাসায় কি ঘুমানোর জন্য বিছানা ছিল না?”

পুষ্প লাবীবের কথা শুনে তাকে ধাক্কা দিয়ে তার হাতে ঘুষি মেরে বলল,
“ওই অন্ধ খাটাশ, কেউ শখ করে রাস্তায় শুয়ে থাকে না-কি! আমাকে কি পাগল মনে হয়?”

লাবীব মিনমিনিয়ে বলল, “নয়তো কি!”

পুষ্প হুংকার দিয়ে বলল, “কি?”

“আরেহ, তো রাস্তায় কি মরতে এসেছিলে?”

“তোমার সম্প্রদায় আমার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছে।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমার সম্প্রদায় মানে?”

“একটা বাইকওয়ালা।”

“বাইকাওয়ালা আমার সম্প্রদায় কীভাবে হলো?”

“তোমারও তো বাইক আছে। তোমার সম্প্রদায় নয়তো কি!”

লাবীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা বলো, ব্যাগে কি ছিল?”

“বই-খাতা আর একটা ক্যালকুলেটর।”

“ফোন কোথায়?”

“পকেটে। টাকাও ফোনের কাভারের পেছনে রেখেছি।”

“তো তুমি বই খাতা আর ক্যালকুলেটরের জন্য রাস্তায় শুয়ে চেঁচাচ্ছিলে?”

পুষ্প রাগী দৃষ্টিতে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বেচারা বাইকার, লস প্রজেক্ট ধরেছিল।”

পুষ্প চোখ-মুখ কুঁচকে সামনে হাঁটা ধরতেই লাবীব তার হাত ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো? চলো তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দেই।”

“বাসায় যাবো না আমি। ক্লাস টেস্ট আছে।”

“খাতা-কলম ছাড়া টেস্ট দিতে যাবে?”

“কলম কারো কাছ থেকে ধার নিলেও চলবে। আর খাতা তো ক্যাম্পাস থেকেই দিবে। টেস্ট দিয়েই চলে আসবো।”

“আচ্ছা, চলো তোমাকে ক্যাম্পাসেই নামিয়ে দিবো। আমিও তো যাচ্ছি।”

“না, তোমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”

“কিন্তু আমার তো তোমাকেই প্রয়োজন।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“অন্তত একদিনের জন্য আমার বাইকের পেছনে বসে আমাকে একটু ধন্য করো।”

“এতো ধন্য হতে চাওয়ার কারণ?”

“কখনো কোনো মেয়ে আমার বাইকের পেছনে বসে নি। এই শহরে খালি বাইক নিয়ে ঘুরে শান্তি পাই না। তুমি বসলে তোমারও লাভ, আমারও লাভ। আমিও একটু শান্তি পাবো। তুমিও তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে পৌঁছে যাবে। এমনিতে রোডে লুটোপুটি খেয়ে অনেক সময় নষ্ট করেছো।”

পুষ্প চোখ ছোট করে বলল, “আবার?”

লাবীব মুখ ছোট করে তাকিয়ে থাকায় পুষ্প তার মোটরসাইকেলে উঠে বসলো। কিন্তু লাবীব ক্যাম্পাসে না গিয়ে একটা ফার্মেসির সামনে মোটরসাইকেল থামালো। এরপর পুষ্পকে কিছু বলতে না দিয়ে তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। লাবীব বলল,
“সেই কখন থেকে ফটফট করেই যাচ্ছিলে। তোমরা মেয়েরা পারোও বটে। ব্যথা পেয়েছো, বলো নি কেন?”

পুষ্প বলল,
“রাস্তায় ছিঁটকে পড়েছি, ব্যথা তো পাবোই।”

“হুম। বেশি কাবিল তো।”

“আমি ব্যথা পেয়েছি, তুমি কীভাবে বুঝলে?”

“লুকিংগ্লাসে দেখলাম, তুমি ভ্রূ কুঁচকে রেখেছো। বার-বার হাতের দিকে তাকাচ্ছো। আমার সামনে তো বাঘিনী হয়ে থাকো। পেছনে তো বিড়াল ছানার মতো বসে ছিলে।”

লাবীব এবার পুষ্পের দিকে তাকালো। দেখলো পুষ্প হাসছে। এবার সে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমার কথা শুনে হাসছো? আমি তো ভেবেছি মুখ উঠিয়ে দেখবো টমেটোর মতো ফুলে গেছে তোমার মুখটা।”

পুষ্প হেসে বলল,
“তুমি ওতোটাও খারাপ না। অনেক কিছু খেয়াল করো।”

লাবীব উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চলো এবার। টেস্ট আছে তোমার।”

পুষ্প সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। এরপর লাবীব পুষ্পকে নিয়ে ক্যাম্পাসে নামলো। পুষ্প নামতেই লাবীব পুষ্পের হাতে দু’টো কলম ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ধার নিতে হবে না।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বলল, “দান করছো?”

লাবীব হেসে বলল, “গিফট করছি।”

“আচ্ছা, আমি ক্লাস শেষে তোমাকে বার্গার খাওয়াবো।”

“ট্রিট চাই না। অন্য কিছু চাইলে দিও।”

“কি চাও?”

“আমার বাইকের পেছনে যদি প্রতিদিন বসতে।”

পুষ্প চোখ বড় বড় করে বলল,
“প্রেমিকা বানাতে চাও আমাকে?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার মনে এসব ঘুরে? বন্ধুরা কি বসে না বাইকের পেছনে?”

পুষ্প মুখ ফুলিয়ে বলল, “ধুর।”

পুষ্প হনহনিয়ে চলে যেতে লাগলো। লাবীব উঁচু গলায় বলল,
“তুমি প্রেমিকা হতে চাইলেও কিন্তু আমার সমস্যা নেই।”

পুষ্প পেছন ফিরে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“লাগবে না তোমার বন্ধুত্ব।”

লাবীব হাসলো। মনে মনে বলল,
“তুমি তো দেখছি আমার প্রেমে পড়ে গেছো চশমিশ। শেষমেশ তবে এই বসন্তেই আমার একটু গতি হতে যাচ্ছে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩০(২য় ভাগ)||

৬১।
লাবীব ক্লাসে ঢুকে দেখলো রাদ বিষণ্ণ মুখে একপাশে বসে আছে। লাবীব তার পাশে এসে বসলো। কিন্তু রাদের সেদিকে খেয়াল নেই। লাবীব এবার রাদের মুখের সামনে হাত নাড়াতেই রাদের ধ্যান ভাঙলো। এরপর সে লাবীবের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল,
“প্লিজ লাবীব, এসব ফাজলামো ভালো লাগছে না।”

“কেন?”

“কেন মানে? ভালো লাগছে না মানে লাগছে না।”

“তোর হয়েছে টা কি?”

“কিছুই হয় নি।”

লাবীব চোখটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“প্রেমে পড়লে মানুষের এইটাই একটা কমন উত্তর। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে নাক-মুখ সিঁটকে বলবে, না, কিছু হয় নি।”

রাদ চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভেঙাচ্ছিস আমাকে?”

“ভেঙাবো কেন? আমি ভাবছি, আহিকে থেরাপি দিতে গিয়ে তুই-ই দেবদাস হয়ে ফিরলি। কি রে এবার তোর জন্য এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে না-কি?”

রাদ বেঞ্চ থেকে উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়তেই লাবীব তার পিছু আসতে লাগলো। রাদ লাবীবের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার পেছন পেছন এসে ঘ্যানঘ্যান করবি না।”

লাবীব রাদকে টেনে আবার বেঞ্চে বসিয়ে রাদের মুখোমুখি বসে বলল,
“আমি জানি তুই আহিকে ভালোবাসিস। এখন তো যথেষ্ট সময় হয়েছে, ভালোবাসার কথা জানানোর। সেই স্কুল থেকেই তুই ওকে পছন্দ করিস। তারপর একই ইউনিভার্সিটিতে অনার্স করেছিস। বন্ধুত্ব হয়েছে। অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করছিস। এখন তো অন্তত বলা যায়।”

“ভয় পাচ্ছি আমি। ও আমাকে ভালোবাসে না। ও অন্য একজনকে ভালোবাসে।”

“পাগল তুই? সে মানুষটা কি আছে ওর জীবনে? তুই তো বলেছিস, ছেলেটা বিয়ে করে নিয়েছে। তাহলে বাঁধা কীসের?”

“তাজওয়ার খান তো আছে।”

“আরেহ, আহি তো আর তাজওয়ার খানকে ভালোবাসে না। তুই একবার বলেই দেখ। যদি রাজি হয়ে যায়!”

“তুই যেটা মুখে বলছিস, এটা এতো সহজ না। আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেলে? পাগল হয়ে যাবো আমি।”

“এজন্যই বলি বন্ধুত্ব না করে একেবারে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে দেওয়া ভালো। একবার বন্ধুত্ব হয়ে গেলে, প্রেম গলার কাঁটা হয়ে যায়।”

“এখন এসব বাদ দে। আগামী মাসে আহির এনগেজমেন্ট। এখন ওর এনগেজমেন্ট কীভাবে আটকাবো?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আরেহ, শুধু এনগেজমেন্ট হচ্ছে। বিয়ে তো আর হচ্ছে না। রিল্যাক্স। আহিকে বল আংকেলকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে।”

“আরেহ ওর বাবাই তো সব ঝামেলা বাঁধাচ্ছে। উনি আস্কারা দিয়েই তো তাজওয়ারকে মাথায় তুলেছে। উনার জন্যই ওই তাজওয়ার খান আহির উপর অধিকার দেখানোর সাহস পাচ্ছে।”

লাবীব চুপ করে রইলো। আসলেই তারা বুঝতে পারছে না আহিকে কীভাবে এই ঝামেলা থেকে বের করে আনবে। অন্তত রিজওয়ান কবির আহির ইচ্ছের প্রাধান্য দিলে আহির জীবনটা আরো সুন্দর হতে পারতো।

(***)

ডেস্ক থেকে উঠে ফাইল নিয়ে সামনে এগুতেই থমকে দাঁড়ালো আফিফ। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খানস গ্রুপের এমডি তাজওয়ার খান। আফিফ তাজওয়ারকে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তা দেখে তাজওয়ার উঁচু গলায় বলল,
“তোমার কি ম্যানার্স নেই? তোমার সামনে এমডি দাঁড়িয়ে আছে, আর তুমি সালাম করছো না? অদ্ভুত!”

আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সরি স্যার। আসসালামু আলাইকুম।”

তাজওয়ার আফিফের দিকে ঝুঁকে বলল,
“সরি, উত্তরে আমি তোমার শান্তি কামনা করবো না। আমার প্রিয় জিনিসের প্রতি নজর দেওয়া মানুষগুলোকে আমি সহজে ক্ষমা করি না। আর তুমি তো আমার হৃদয়টাই কেঁড়ে নিয়েছো।”

আফিফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজওয়ার বলল,
“আজকে থেকে তুমি আমার পিএ।”

আফিফ অবাক চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“মিস্টার আফিফ রাফাত আজ থেকে আমার পিএ। বর্তমানে যিনি আছেন, তাকে অন্য পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।”

আফিফ হতভম্ব হয়ে গেলো। সাধারণ কর্মচারী থেকে হুট করে এমন একটা পদ দিয়ে দেওয়া একমাত্র তাজওয়ারের পক্ষেই সম্ভব। তাজওয়ার সবাইকে আফিফের নতুন পরিচয় দিয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেলো। এদিকে অফিসের সবাই আফিফকে শুভেচ্ছা দিচ্ছে। সবাই জানতে চায়ছে, কীভাবে সে স্যারকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। কিন্তু আফিফের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সে সোজা এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সিদ্দিক আহমেদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার, এমডি স্যার আমাকে পিএ বানিয়ে দিলেন। আমার কাজটা কি?”

সিদ্দিক সাহেব ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তাজওয়ার স্যারের পিএ তো দু’জন। একজন আমি নিজেই যে কোম্পানির কাজের তথ্য স্যারকে এনে দেই। আর সেক্টরের কাজগুলো দেখি। আমার পদ তো ঠিকই আছে। আরেকজন সোহাগ। ওকে হয়তো সরিয়েছে। ওর কাজ ছিল স্যারের সাথে থাকা। কাজের বাইরেও স্যারকে সময় দেওয়া। তার দ্বারা যে-কোনো কাজ করাতে পারতো স্যার। খুন কর‍তে বললেও ওটাও করতে বাধ্য ছিল। আর অফিসিয়াল কাজে আমার সাথে কথাবার্তা বলতে হতো। বলতে পারো অফিসে আসলে সে আমার এসিট্যান্ট। অফিসের বাইরে স্যারের বডিগার্ড।”

আফিফ চুপসে গেলো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“আমি তো এসবে এক্সপেরিয়েন্সড নই।”

“ধীরে ধীরে শিখে ফেলবে। স্যালারি কতো শুনলে তোমার মাথা ঘুরে যাবো। তোমাকে বিশ হাজার টাকার জায়গায় মাসে সত্তর হাজার টাকা দেওয়া হবে। সোহাগ মাসে সত্তর হাজার টাকা পেতো। পাঁচ মাস পর স্যালারি বাড়িয়ে দেবে। আর এরপর তোমার কাজের উপর ডিপেন্ড করে স্যালারি বাড়াবে। স্যারকে সন্তুষ্ট করতে পারলে কোটি টাকার মালিক হতে পারবে। নয়তো স্যার পথে বসিয়ে দেবেন।”

আফিফ চুপ করে রইলো। সিদ্দিক সাহেব বললেন,
“এখন বাসায় যাও। তোমার সব কাগজপত্র রেডি করতেও সময় লাগবে। তোমার কেবিন কিন্তু পাশের রুমটা। আর তোমাকে গাড়ি আর একটা ফ্ল্যাট দেবে অফিস থেকে। আপতত বাসায় যাও। বাকীটা তোমাকে আমি ফোন করে জানাবো।”

আফিফ মাথা নেড়ে চলে গেলো। সে যে মারাত্মক বিপদে পড়েছে তা আর কেউ না বুঝলেও আফিফ ভালোভাবেই বুঝে গেছে। এই খবরটা কি খুশির না-কি দুঃখের সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না।

(***)

ক্লান্ত শরীরে বাসায় ঢুকলো আফিফ। বাসায় ঢুকতেই পদ্মের চিন্তিত মুখ খানি দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু হয়েছে?”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“বাসায় আসুন আগে। তারপর মায়ের রুমে যান।”

আফিফ তার অফিস ব্যাগ পদ্মের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোজা মায়ের রুমে চলে গেলো। সেখানে গিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেলো আফিফ। আফিফা বেগম খাটে পা তুলে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছেন। তার পাশে শুয়ে আছে রেনু। রেনুর মুখে কালসিটে দাগ পড়ে আছে। আফিফ দৌঁড়ে বোনের কাছে আসতেই রেনু কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া উনি আমাকে খুব মেরেছেন। আমি আর ও বাড়িতে যাবো না। মাকে বলো, আমাকে যাতে জোর করে আর ও বাড়িতে না পাঠায়।”

আফিফ রেনুর হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“তোকে যেতে হবে না ও বাড়িতে। আমিই তোকে যেতে দেবো না।”

কথাটি বলেই আফিফ রেনুর গালে হাত রাখতেই রেনু ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“ভাইয়া লোকটা নেশাখোর। সারাদিন মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর কতো বছর সংসার করবো আমি? আমি কি তোমাদের কাছে বোঝা?”

আফিফ ব্যস্ত হয়ে বলল,
“কখনো না। তুই কেন বোঝা হবি? তুই আমার দায়িত্ব।”

“তাহলে আমাকে আর যেতে দিও না। মা আমাকে বার-বার জোর করে ওই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে মায়ের দিকে তাকালো। আফিফা বেগম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ পাঠিয়ে দেই। আফিফের সংসার চালানোর মতো টাকা থাকতে হবে তো! তোর চারটা বাচ্চা পড়ালেখা করানোর মতো সামর্থ আছে তোর ভাইয়ের? তুই একা আসতে পারলে চলে আয়। আমি তো বলি নি মার খেতে।”

আফিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তার মানে আগেও এমন হয়েছে? রেনুকে আগেও মেরেছিল?”

আফিফা বেগম মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
“এতো বছরের সংসারের মাত্র সাত-আটবার।”

“কি বলছো মা এসব? সাত-আটবার! আর আমি এসব কিছুই জানি না?”

আফিফ পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিও তো আমাকে জানাও নি!”

আফিফা বেগম বললেন,
“আমি বারণ করেছিলাম জানাতে। তোকে বাড়তি চাপ দিতে চাই নি।”

আফিফ মাথায় হাত চেপে ধরলো। রেনু বলল,
“শুধু সাত-আটবার মার খেয়ে বাসায় এসেছি। আরো কতো বার মার খেয়ে সহ্য করেছি সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। একটু উল্টো-পাল্টা হলেই তিনি চড়-থাপ্পড় মারেন। উনি গত সপ্তাহে উনার বন্ধুদের সামনে আমাকে লাথি মেরেছিলেন। আমি তো মাকে এটা জানায়ও নি। ছেলেটা আমার বড় হয়েছে। এসব দেখে দেখে ও বড় হচ্ছে।”

আফিফা বেগম বললেন,
“এতো কাঁদিস না তো। স্বামীরা বউকে মার‍তে পারে। মা-বাবার পরই তো তার স্থান। এসবে পুরুষ মানুষের অধিকার আছে।”

মায়ের কথা শুনে আফিফের এবার রাগ উঠে গেলো। সে রাগী স্বরে বলল,
“কি বুঝে বলছো এই কথা? এতো বছরের সংসারে আমি কি একবারো পদ্মের গায়ে হাত তুলেছি?”

আফিফ রেনুর হাত ধরে বলল,
“রেনু, তুই চিন্তা করিস না। আমি ওকে ছাড়বো না এবার। ওকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।”

আফিফা বেগম ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“এ কথা বলিস না আফিফ। উনার সাথে ঝামেলা করে লাভ নেই। সুন্দরভাবে সমাধান করে ফেল। নিয়ে আয় রেনুকে। জামাই বাবার অনেক প্রভাব। উনার তো কিছুই হবে না। উলটো তোর ক্ষতি হবে। আমি আমার স্বামী হারিয়েছি। একটা মেয়ে হারিয়েছে। তোকে হারানোর মতো শক্তি নেই আমার।”

“তাহলে ওমন ছেলের সাথে রেনুর বিয়ে কেন দিয়েছিলে? আমার বোনটাকে পড়াশুনাটাও করতে দাও নি।”

“কি করবো আমি? চয়ন যেই কাজ করেছে এরপর তোর মনে হয় রেনুকে আর কেউ বিয়ে করতো? দুর্নাম রটিয়ে মরেছিল তোর বড় আপা। ছি! ছি! কতো মাস ভাত খেতে পারি নি আমি।”

আফিফের হাত মুঠো হয়ে গেলো। সে রেনুর দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুই আরাম কর। আমি তোকে আর ওই জাহান্নামে যেতে দেবো না। আমরা না খেয়ে থাকি। তাও তুই আমাদের সাথেই থাকবি। আমি তোকে যা খাওয়াতে পারি খাওয়াবো। আর বাচ্চাদের নিয়ে ভাবিস না। আমি ওদের নিয়ে আসবো। ওদের আমিই লেখাপড়া করবো।”

আফিফ এই কথা বলে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। পদ্মও আফিফের পিছু পিছু রুম থেকে বের হলো। এরপর সে আফিফকে গেটের কাছে যেতে দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“এই মাত্রই তো এলেন। আবার কোথায় যাচ্ছেন?”

“রেনুর সাথে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এসব। এর বিহিত তো করতেই হবে।”

“ওরা আপনাকে মেরে ফেললে?”

“মারবে না। আর প্রয়োজনে হলে আমি থানায় যাবো। আমার বোনকে কি ওদের মানুষ মনে হয় না?”

আফিফ হনহনিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। পদ্ম চিন্তায় পড়ে গেলো। যদি আফিফের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? পদ্ম মনে মনে ভাবলো,
“আহির বাবা তো অনেক বড় মাপের মানুষ। আহি যদি উনাকে বলেন, তাহলে রেনুর সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে।”

পদ্ম এবার আহিকে কল করার জন্য ফোন হাতে নিলো।

এদিকে আহি সিঁড়ি বেয়ে নামতেই শুনতে পেলো মিসেস লাবণি ফোনে বলছে,
“তোর আগামী মাসে আক্দ, অথচ তুই একবারো তোর আপুকে জানালি না? আমার তো তোর সম্পর্কে এখন বাইরের মানুষ থেকে শুনতে হচ্ছে।”

আহিকে নিচে নামতে দেখে লাবণি এক গাল হেসে বলল,
“তোর প্রাক্তন বান্ধবীর সাথে কথা বলবি?”

লাবণি আবার হেসে বলল,
“জানিস ওরও এনগেজমেন্ট তাজওয়ার খানের সাথে।”

আহি শীতল দৃষ্টিতে মিসেস লাবণির দিকে তাকিয়ে রইলো। মিসেস লাবণি হুট করে উঠে আহির কানে ফোন দিয়ে বলল,
“যাও কথা বলো। শুভ কামনা দাও তোমার খালাকে।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“হাই, লিনু.. লিনাশা।”

ওপাশ থেকে কিছুই শোনা গেলো না। আহি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো লিনাশা এখনো কল কাটেনি। আহি এবার ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল,
“শুভকামনা নতুন জীবনের জন্য।”

লিনাশা ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দিলো, “থ্যাংকস।”

এইটুকু বলেই কল কেটে দিলো লিনাশা। আহি মলিন মুখে মিসেস লাবণির দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবণি বাঁকা হেসে বলল,
“কি হলো, বেস্টু ইনভাইটও করলো না?”

আহি ফোনটা টেবিলে রেখে আবার নিজের রুমে চলে গেলো। এদিকে লিনাশা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ওয়ালপেপারে আহির আঁকা আহি আর তার ছবিটা এখনো আছে। চার বছর ধরে এই একটা ওয়ালপেপার সে কখনোই পরিবর্তন করে নি। লিনাশার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমি হয়তো একটু বেশিই করে ফেলেছিলাম তোর সাথে, আহি। কতোগুলো বছর চলে গেছে জীবন থেকে। কিন্তু তুই ছাড়া আজ পর্যন্ত বেস্ট ফ্রেন্ড কেউ হয় নি। আই লাভ ইউ আহি। আই মিস ইউ সো মাচ।”

অন্যদিকে আহি ঘরে এসে আলমারির চাবিটা হাতে নিলো। তার আলমারির চাবিটির সাথে সবসময় লিনাশার দেওয়া শেষ ফ্রেন্ডশিপ বেল্টটি বাঁধা থাকে। সে কখনোই সেই বেল্টটি খুলে রাখে নি৷ আহি বেল্টটি আলতো হাতে স্পর্শ করে বলল,
“এই সুতার বেল্ট যতোই মলিন হয়ে যাক, তোর স্মৃতি আর তুই সবসময় আমার জীবনে অক্ষত থাকবি। এই অভিশপ্ত আমিটা তো বন্ধু ডিজার্ভ করি না। কিন্তু যাদের পেয়েছি, তারা আমাকে অনেক সুন্দর মুহূর্ত দিয়েছে। ভাগ্যিস, আল্লাহ আমাকে এতো চমৎকার বন্ধু দিয়েছিল, নয়তো আমার আর কোনো অস্তিত্বই থাকতো না। লিনু, আই মিস ইউ এন্ড আই লাভ ইউ সো মাচ।”

(***)

ফোন বেজে উঠতেই আহি কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে পদ্ম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,
“একটা সাহায্য করবি?”

“হুম, বল!”

পদ্ম আহিকে রেনুর ব্যাপারে সবটাই জানালো। সব শুনে আহি বলল,
“রেনুর স্বামীর নাম কি? কি করে?”

“উনার নাম নিয়াজী তালুকদার। যখন বিয়ে হচ্ছিল, তখন রয়েল গ্রুপের ম্যানেজার ছিল। এখন নিজের বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। কোম্পানির নামটা মনে নেই৷ কিন্তু ওই যে একটা রেস্টুরেন্ট আছে না, টুইস্ট প্যালেস। ওইটা উনার।”

আহি চমকে উঠে বলল,
“রিয়েলি? টুইস্ট প্যালেসের মালিকের সাথে তাজওয়ারের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বাবা তো প্রায়ই বিজনেস মিটিং ওখানেই করে।”

পদ্ম বলল,
“এই বিষয়ে কি আংকেল সাহায্য করতে পারবেন?”

আহি মিনমিনিয়ে বলল,
“সব বিজনেসম্যান একই গোয়ালের গরু।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কিছু বলেছিস!”

“হ্যাঁ, বললাম সব গুলো এমনই। আচ্ছা, আমি দেখছি। আমাকে একটু সময় দিস।”

পদ্ম বলল,
“তোর গলা ভারী হয়ে আছে, মনে হচ্ছে। মন খারাপ?”

“না।”

“মিথ্যে বলছিস কেন?”

“মিথ্যে বলছি না। ঠান্ডা লেগেছে, হয়তো এজন্য গলা ভারী লাগছে।”

“উহুম, আহি। তুই যতোই কথা ঘুরিয়ে ফেল, ধরা কিন্তু খাবিই। লিনাশা ছাড়া কি কখনো আমাদেরও বন্ধু ভেবেছিস!”

“ভাবি তো। তোরা সবাই আমার বন্ধু।”

“তাহলে বল, কি হয়েছে?”

“শুনলাম লিনাশার না-কি আক্দ। আসলে মিস করছিলাম ওকে। একটু আগে কথা হয়েছে ফোনে। কয়েক বছর পর ওর কন্ঠ শুনলাম। তাই একটু মন খারাপ ছিল।”

পদ্ম বলল,
‘লিনু তো আমাদের বলেই নি। অবশ্য এই কয়েক দিন আমিও ওকে মেসেজ দেই নি। মেয়েটাকে মেসেজ না দিলে, নিজ থেকে কথায় বলবে না।”

আহি মলিন হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“আমার জন্যই তো এমন করছে। আমি যদি পুষ্প আর পদ্মের কমন ফ্রেন্ড না হতাম, তাহলে লিনাশা সবার সাথেই যোগাযোগ রাখতো। আমি তো ওর বন্ধুগুলোও কেঁড়ে নিয়েছি। শাপগ্রস্ত মানুষ আমি!”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩১||

৬২।
নিয়াজী তালুকদারের বাড়ির গেটের সামনে নামলো আফিফ। দারোয়ান তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইজান, কেমন আছেন?”

আফিফ বলল,
“জ্বি ভালো। নিয়াজের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

দারোয়ান গেট খুলে দিতেই আফিফ সোজা ভেতরে ঢুকে পড়লো। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই সে উঁচু গলায় ডাকতে লাগলো নিয়াজকে।
নিয়াজী তালুকদার আফিফের চেয়েও বয়সে বড়। তবুও আফিফের এমন সম্বোধনে বাড়ির কেউই অবাক হলো না। নিয়াজী দৃপ্ত পদে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। আফিফকে দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। আফিফ নিয়াজীর সামনে এসে বলল,
“আমার বোনের গায়ে হাত তোলার সাহস তোকে কে দিয়েছে?”

নিয়াজী ভাবলেশহীন সুরে বলল,
“তোরাই তো দিয়েছিস। বিয়ে করা বউ আমার। আমার যা ইচ্ছে করবো, ভালো না লাগলে রেখে দে।”

“রেখে তো দিবোই। রেনু আর এ বাড়িতে আসবে না।”

নিয়াজী অট্টহাসি হেসে বললেন,
“তোর বোনের কোনো যোগ্যতাও নেই এই বাড়িতে আসার৷ কখনো ছিলও না। ভাগ্য ভালো তোর বোনের। আমি বিয়ে করেছি বলেই সংসার চোখে দেখেছে। তোর বড় বোন যেই কীর্তি করেছে, তোদের দশ বংশের মেয়েকেও কেউ ঘরের বউ করে ঘরে তুলবে না।”

আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো নিয়াজের কথা শুনে। সে দাঁতে দাঁত চেপে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে আছে। নিয়াজী বললেন,
“কে জানে সব দোষ গোড়ায় আছে কি-না। তোর তো বাবা নেই। কে বলতে পারে মারা গেছে, না-কি ছিলও না কখনো!”

আফিফ আর সহ্য করতে পারলো না। নিয়াজের কলার ধরে তাকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে মারতে লাগলো। নিয়াজকে বাঁচানোর জন্য বাড়ির কাজের লোকরা আফিফকে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আফিফের এই রূপ যেন প্রথম দেখেছে তারা। আফিফকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে কারো গায়ে হাত তুলতে পারে। এদিকে নিয়াজীর বোন পরিস্থিতি দেখে রেনুকে ফোন করে সব জানালো। রেনু সব শুনে চিন্তায় পড়ে গেলো। সে মাকে কিছু না জানিয়ে পদ্মকে গিয়েই সব বললো। আফিফ আর নিয়াজের মারামারি লেগেছে এই কথাটা শুনেই পদ্মের অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। সে তাড়াতাড়ি বোরকা পরে রেনুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রেনুর শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে সে আবার আহিকে ফোন করলো। আহি তখন একটি বই হাতে নিয়ে বসেছিল মাত্র। বইটির নাম ইকিগাই। বইটিতে জাপানিজদের দীর্ঘজীবন লাভ এবং জীবনে সুখী হওয়ার বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলা আছে। আহি পদ্মের কল দেখে বইটি একপাশে রেখে কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই পদ্মের কাঁদো কাঁদো কন্ঠ শুনে থমকে গেলো। পদ্ম কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আহি, প্লিজ আংকেলকে বল সাহায্য করতে।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“কাঁদছিস কেন? বাবা তো অফিসে। রাতে আসলেই বলতে পারবো।”

“আফিফ ওখানে গেছেন।”

“উনাকে ফোন করে বল চলে আসতে।”

“ফোন দিয়েছি। ধরছে না। রেনুর ননদ ফোন দিয়ে বললো, আফিফ আর নিয়াজের মারামারি লেগেছে। এখন উনার কিছু হয়ে গেলে?”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“মারামারি লেগেছে মানে? ওয়েট কিচ্ছু হবে না আফিফের। আমি যাবো। এড্রেস দে আমাকে।”

“তুই যাবি আহি? তোর কথা শুনবে? তোকে চিনবে তো!”

আহি বুকে হাত দিয়ে বসে আছে। নিয়াজী তো তাকে চিনবেই না। কিন্তু তাজওয়ারকে চিনবে। এই মুহূর্তে তাজওয়ারই আহিকে সাহায্য করতে পারবে। আহি পদ্মকে বলল,
“আমি আসছি। তোর রেনুকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। আমাকে শুধু এড্রেসটা দে। প্লিজ ওখানে যাবি না তোরা।”

আহি কল কেটে তাজওয়ারের নম্বরে ডায়াল করতে গিয়ে থেমে গেলো। এই নম্বরটা তাজওয়ারই জোর করে তার ফোনে সেইভ করিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এই নম্বরে আহি নিজ থেকে কখনো কল দেয় নি। কিন্তু আজ তার প্রিয় মানুষটা বিপদে পড়েছে। আফিফের কিছু হয়ে গেলে আহি পাগল হয়ে যাবে। তাই সে বাধ্য হয়েই তাজওয়ারকে কল করলো।

(***)

স্ক্রিনে আহির নাম ভেসে উঠতেই তাজওয়ার রীতিমতো অবাক। সে ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ নামটির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এসিস্ট্যান্ট সোহাগের দিকে ফোনটা তাক করে বলল,
“দেখ তো, কার কল এসেছে!”

সোহাগ মনোযোগ দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্যার, আহি ম্যামের নাম দেখা যাচ্ছে।”

তাজওয়ার মৃদু হাসলো। ফোনের স্ক্রিনে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“এখন যা, আমি একটু কথা বলি তোর ম্যামের সাথে।”

সোহাগ যেতে যেতেই কলটা কেটে গেলো। আহি কল কেটে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে একটা ওড়না গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো। গাড়ির কাছে আসতেই তাজওয়ার নিজেই কল করলো। আহি সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করে বলল,
“তোমাকে একটা এড্রেস দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি ওখানে আসো প্লিজ। এই মুহূর্তেই তোমাকে আসতে হবে। অনেক বড় বিপদে পড়েছি।”

তাজওয়ার আহিকে কিছু বলার আগেই আহি কল কেটে দিলো। এদিকে আহি গাড়িতে উঠেই তাজওয়ারকে সেই ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিলো। তাজওয়ার ঠিকানা দেখে ভ্রূ কুঁচকে মনে মনে বলল,
“এই জায়গায় আহির কি কাজ!”

তাজওয়ার আবার আহিকে কল করলো। আহি রিসিভ করতেই তাজওয়ার বলল,
“নিয়াজীর বাড়ির এড্রেস কেন দিয়েছো আমাকে?”

“উনার সাথে বোঝাপড়া আছে আমার।”

“তুমি তাকে কীভাবে চিনো? তোমার সাথে তো তার বোঝাপড়া থাকার কথা না।”

“তুমি কি এখন আসবে?”

“আমি এখন দূরে আছি। আসবো তো অবশ্যই। তুমি বলেছো আর আমি আসবো না, সেটা তো হয় না। আমার আসতে প্রায় ঘন্টা খানেক লাগবে। যদি জ্যাম না পড়ে, তাহলে আধা ঘন্টায় পৌঁছে যাবো।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এমনিতে তো অসময়ে মাথার উপর উঠে বসে মগজ খেয়ে ফেলো। এখন প্রয়োজনে তোমাকে পাওয়ায় যাচ্ছে না।”

আহি কল কেটে দিলো। মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছে আফিফ যাতে সুস্থ থাকে। আহির গাড়ি দশ মিনিটের মধ্যে নিয়াজীর বাড়ির সামনে এসে থামলো। গাড়ি থেকে নেমেই আহি দারোয়ানকে বলল,
“প্লিজ, আমাকে ভেতরে যেতে দিন।”

“কাকে চান আপনি?”

“নিয়াজী তালুকদার আছেন না বাসায়?”

“জ্বি, স্যার তো আছেন।”

আহি অনেক দ্বিধা নিয়ে বলল,
“আমি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে।”

আহি জানে না দারোয়ান তার বাবাকে চিনবে কি-না বা এতোটুকু তথ্যে তার জন্য গেট উন্মুক্ত করে দিবে কি-না। তাই সে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর দারোয়ান গেট খুলে নিজেই আহির সাথে ভেতরে ঢুকলো। নিচে থাকা একজন মহিলাকে বলল,
“নিয়াজী স্যারের সাথে দেখা কর‍তে এসেছে।”

মহিলাটি বলল, “স্যার রুমে আরাম করছেন।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “আফিফ কোথায়?”

মহিলাটি ভ্রূ কুঁচকাতেই আহি বলল,
“রেনুর ভাইয়ার কথা বলছি।”

মহিলাটি বলল, “আপনি তার কে হোন?”

আহি ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড। ওকে নিতে এসেছি।”

মহিলাটি বাগানের দিকে ইশারা করে বলল,
“তাকে তো পুলিশে ধরিয়ে দেবে। আপতত বাগানে ফেলে রেখেছে। সে স্যারের গায়ে হাত তুলেছে।”

“আচ্ছা, আপনি আমাকে অন্তত তার সাথে দেখা করতে দিন।”

মহিলাটি আহিকে বাগানে যেতে বলল। আহি দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে দেখলো আফিফ মাটিতে পড়ে আছে। আর তার পাশে একটা লোক লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি আফিফের কাছে গিয়ে দেখলো আফিফের শার্টে রক্তের দাগ। আহি তার কাঁপা হাতটি আফিফের দিকে এগিয়ে দিতে গিয়েই থেমে গেলো। সে ক্ষীণ কন্ঠে ডাকলো, “আফিফ।”

আফিফ চোখ খুলে আহিকে দেখে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি এখানে?”

আহি নরম সুরে বলল, “উঠো।”

আফিফ উঠতে যাবে তখনই দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি লাঠি দিয়ে সজোরে আফিফের পিঠে আঘাত করলো। আফিফ আবার ঢলে পড়লো। আহি ব্যস্ত হয়ে আফিফকে জড়িয়ে ধরে লোকটির দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি মানুষ না-কি পশু?”

লোকটি মাথা নিচু করে বলল,
“স্যারের আদেশ। আপনি আটকালে আপনার গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হবো। যতোক্ষণ সে স্যারের কাছে ক্ষমা চায়বে না, ততক্ষণ তাকে এই শাস্তি দেওয়া হবে।”

আহি আফিফকে উঠিয়ে বসালে। এরপর লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার স্যার কোথাওকার রাজা, যে তার কথায় সবাইকে উঠবস করতে হবে? ডাকো তোমার স্যারকে। আমিও তার গালে কয়েকটা লাগিয়ে দেই।”

আফিফ আহিকে থামানোর জন্য উঠতে গিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। আহি আফিফের গোঙানোর শব্দ শুনে তার কাছে এসে বসলো। আফিফ বলল,
“কেন এসেছো এখানে? কে বলেছে আসতে?”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। আফিফের কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। মুখে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। আহি বলল,
“কথা বলো না তো। তোমার কষ্ট হচ্ছে। আর আমাকে পদ্ম বলেছিল আসতে। ও তোমার চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরতে হবে। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”

কথাগুলো বলতে বলতেই আহির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। আফিফ দুর্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো আর কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি কাঁদছো কেন? আমাকে তো নিঃস্ব করে দিয়েছো তুমি। তোমার ভালোবাসা আমাকে আর আমার পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বলছো তুমি, আফিফ!”

আফিফ মলিন মুখে বললো,
“আহি প্লিজ, তুমি যা ইচ্ছে করো। অন্তত আমার থেকে দূরত্ব রাখো। প্লিজ।”

“আমি তোমার কাছে এসেছি কখন? দূরেই তো ছিলাম। আর তুমি বলতে চাইছো, এসব আমার কারণে হয়েছে? সিরিয়াসলি আফিফ?”

আফিফ সেকেন্ড খানিক চুপ থেকে ম্রিয়মান কন্ঠে বলল,
“খুনী যখন নিজেই জানে না সে খুনী তাহলে কি তার উপর আরোপ লাগানো যায়? আমার অবস্থাটাও এমন। সব তোমার কারণেই হয়েছে, আহি। তুমিই আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছো। অথচ আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারছি না। তোমার উপর রাগ দেখাতে পারছি না। কিন্তু আমার উচিত তোমাকে ঘৃণা করা।”

আহি আফিফের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমার কাছে কোনো আবদার রাখি নি। তাহলে আমার অপরাধটা কোথায়?”

“আবদার করো নি, এতেই এই অবস্থা। আবদার করলে তো আমার অস্তিত্বই থাকতো না।”

“ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলছো কেন? সোজাসুজি বলো কি হয়েছে?”

“এখন এসব বলে লাভ নেই। শুধু এতোটুকু জেনে রেখো, তোমার ভালোবাসা আমাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। আমার আপার মৃত্যু, আমার ছোট বোনের সাথে যা হয়েছে সবকিছুর জন্য তুমি অনেকাংশে দায়ী। তোমার জন্য হয়েছে সব, আহি। আমি আর পারছি না এসব যন্ত্রণা নিতে। কেউ হয়তো আমার কষ্টটা বুঝবে না। তখন বুঝতো যখন তার প্রিয় মানুষটা তার চোখের সামনে মারা যেতো। তখন বুঝতো, যখন সে জানতে পারতো, সেই মৃত্যুটা তারই কোনো এক ভুলের কারণে হয়েছে। এরপর তো তার জন্য বেঁচে থাকাটায় কষ্টকর হয়ে যাবে, তাও না? কিন্তু তবুও তাকে বাঁচতে হবে। তার ক্ষমতা থাকবে না সেই অন্যায়ের শাস্তি দেওয়ার, অথচ সে রাত-দিন নিজের অক্ষমতায় ধুঁকে ধুঁকে মরবে। আর তখনই সে আমার কষ্টটা বুঝতে পারবে।”

আফিফ কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো। এদিকে তাজওয়ার গাড়ি থেকে নামতেই দেখলো আহির গাড়ি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে তাজওয়ারকে দেখে দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছে। সে দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকে বলল,
“নিয়াজ কোথায়!”

তাজওয়ারকে দেখে একজন নিয়াজীকে ডাকতে গেলো। আর তাজওয়ার এদিক-ওদিক আহিকে খুঁজতে লাগলো। নিয়াজ কয়েক মিনিটের মধ্যে নিচে নামতেই তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আহি কোথায়?”

নিয়াজ বললেন,
“তাজওয়ার ভাই, আপনি হঠাৎ! আর আপনি কার কথা বলছেন?”

“তোমার সাথে দেখা করতে কোনো মেয়ে আসে নি?”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলা কর্মচারী তাজওয়ারকে বলল,
“সে বাগানের দিকে গেছে।”

তাজওয়ার দ্রুত পায়ে সেদিকে গিয়ে দেখলো আহি একটা ছেলের পাশে বসে আছে। তাজওয়ার সেখানে গিয়ে দেখলো, ছেলেটা আফিফ। আফিফ তাজওয়ারকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নেবে তখনই আহি তাকে ধরে ফেলল। আফিফ একনজর আহির দিকে তাকিয়ে আবার তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ারের মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে। আফিফ তা দেখে আহির কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিজের কাছে এনে বলল,
“তুমি এসবের জন্য আমাকে ডেকেছো?”

“হ্যাঁ, নিয়াজী তালুকদার তোমার পরিচিত৷ তাই তোমাকে আসতে বলেছিলাম।”

তাজওয়ার চেঁচিয়ে বলল,
“তোমার জন্য আমি শহরের এক প্রান্ত থেকে দৌঁড়ে এসেছি, আর এসে দেখলাম তুমি এই ভিখারির বাচ্চার জন্য আমাকে ডেকেছো!”

আহি রাগী দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আফিফ মলিন মুখে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। ক্ষমতার অভাবে আজ সে কতো কথা শুনছে। তার মায়ের চরিত্রে আঙ্গুল তুলেছে, তার বোনকে পেটানো হয়েছে, আর সে প্রতিবাদ করতে এসে নিজেই মার খেয়ে বসে আছে। এবার আহি বুকে হাত গুঁজে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি আমার ফ্রেন্ডের জন্য এখানে এসেছি। আফিফ পদ্মের হাসবেন্ড। তোমাকে এর বিহিত করতেই হবে৷ আফিফের বোনকে মেরেছে ওই নিয়াজী তালুকদার। একটা নারীর সাথে অন্যায় হয়েছে। আমি এখানে একটা মেয়ের জন্য এসেছি।”

তাজওয়ার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সিরিয়াসলি! সমাজে হতভাগা নারীর অভাব নেই। তুমি বললে, আমি তোমাকে খুঁজে এনে দেবো। ওদের জন্য তোমার যা করার করো। আমি পাশে থাকবো। অন্তত এই কথা বলো না যে তুমি এর বোনের জন্য এসেছো। কারণ আমি ভালো করেই জানি, তুমি ঠিক কার জন্য এসেছো।”

আফিফ দুর্বল দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি আফিফের জন্যই এসেছি।”

আহি এবার তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তো এখন কি করবে তুমি? আমার যার জন্য ইচ্ছে হয় আমি আসবো। তোমার কি? তুমি বরং চলে যাও। এন্ড সরি, তোমাকে টেনে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এনেছি।”

আহি কথাটি বলেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির হাত থেকে লাঠি টেনে নিয়ে বলল,
“ঠিক যতোটা দাগ রেনুর শরীরে পড়েছে, ঠিক যতোটা আঘাত আফিফকে দেওয়া হয়েছে, সুদেআসলে মিটিয়ে দেবো আমি। এটা আমি করবো তাজওয়ার খান। তোমার যদি জ্বলে, পুড়ে, ছাই হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, তাহলে শুভকামনা রইলো।”

আহি এই কথা বলে হনহনিয়ে নিয়াজের বাড়ির দিকে গেলো। নিয়াজ তাজওয়ারের অপেক্ষায় বারান্দার সোফায় বসেছিল। আহি নিয়াজকে দেখেই বলল,
“তুমি নিয়াজী তালুকদার, রাইট?”

নিয়াজী তালুকদার চমকে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ।”

আহি ঠাস করে নিয়াজীর গালে চড় মেরে বলল,
“জ্বলছে খুব? একটা মেয়ের চামড়ায়ও একই পীড়া হয়। তোমার শক্তি তো আরো বেশি হওয়ার কথা। ধরে নাও এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।”

নিয়াজী সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগে আহি তার পেটে লাথি মেরে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো আর বলল,
“খেয়ে খেয়ে শরীরে চর্বি বাড়িয়ে একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না? কাপুরুষ লোক।”

আহি লাঠি দিয়ে আঘাত করতে যাবে তার আগেই নিয়াজের লোক এসে আহিকে ধরে ফেললো। আহি একনজর তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“ডোন্ট টাচ মি।”

তাজওয়ার রেগেমেগে তেড়ে এসে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আর বলল,
“ডোন্ট টাচ হা’র। সি ইজ মা’ই লেডি।”

আহি এবার নিয়াজীর বুকের উপর পা রেখে বলল,
“পুরুষত্ব দেখাতে ইচ্ছে করলে উঠে আমার গায়ে হাত তোল।”

তাজওয়ার আহিকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“পাগলামো করছো কেন আহি?”

“তাহলে তুমি আমার হয়ে এই বদমাশ লোকের মুখটা লাল-নীল করে দাও। নয়তো আমিই এই কাজ করবো। আর যদি আমাকেই এই কাজ করতে হয় ভবিষ্যতে তোমাকে তো আমার বিশ্বাসই হবে না।”

তাজওয়ারের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। সে আহির হাত থেকে লাঠি নিয়ে ইচ্ছেমতো নিয়াজকে পেটাতে লাগলো। আর আহি একপাশে দাঁড়িয়ে মনে মনে হাসছে। তাজওয়ারের মার খেলে রেনুর গায়ে ভবিষতে যে আর এই বাড়ির কেউ হাত তুলবে না, এই ব্যাপারে নিশ্চিত আহি।
এদিকে আফিফ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি একনজর আফিফের দিকে তাকালো। শরীর কাঁপছে আফিফের। সে পদ্মকে মেসেজ করে বলল,
“আফিফ ঠিক আছে, কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাবো ওকে। একটু ব্যথা পেয়েছে। তুই চলে আসিস ওখানে। আমি তোকে এড্রেস লিখে দিবো একটু পর। আর চিন্তা করিস না। নিয়াজকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি। এই জন্মে তো রেনুকে রানী হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। চট্টগ্রামের জুনিয়র ডন এসেই শায়েস্তা করছে বেটাকে।”

(***)

তাজওয়ার ঘেমে নেয়ে শেষ। নিয়াজকে ইচ্ছেমতো পিটিয়ে লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। আহি নিয়াজের কাছে এসে তার মুখের উপর ঝুঁকে বলল,
“নেক্সট টাইম বউ পেটালে হাসপাতালের আইসিউতে পৌঁছে যাবে। আর যদি এই ব্যাপারে বাইরের কেউ জানে তোমাকে গুম করিয়ে দেবো।”

আহি এবার তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বাবা তো আবার মানুষ গুম করতে পারদর্শী। তিনি নিজের হবু পুত্রবধূর নানাকে গুম করিয়ে ফেলেছেন। এই সামান্য মানুষটাকে পারবে না?”

তাজওয়ার ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “আহি প্লিজ।”

“যদি আমার সাথে করা অন্যায়গুলোর এতো ভারী না হতো, আজ সত্যিই আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু তোমার বাবা তো আমার ছোটবেলা কেঁড়ে নিয়েছে। আজ আমার মা যদি আমার থেকে দূরে থাকে, তাহলে তোমার বাবার কারণে। আর তুমি সেই বাবার আদর্শ ছেলে।”

তাজওয়ার আর কিছু বললো না। আহি আফিফের কাছে এসে বলল,
“জানি না আমি তোমার এই অবস্থার জন্য কীভাবে দায়ী। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না। তবুও মানুষ আমার কারণেই কষ্ট পাই। আমি নিজেও খুব একটা সুখী নই। অন্তত আমাকে ঘৃণা করো না। আমার ভালোবাসা গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা তোমার ছিল না। ঘৃণা করার মতো মনও রেখো না৷ তোমার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবো না আমি।”

আহি নিয়াজের বাড়ি থেকে বের হয়ে ড্রাইভারকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল, আপনি প্লিজ উনাকে হাসপাতালে দিয়ে যান। যা খরচ হয়, এখান থেকেই করবেন।”

তাজওয়ার বের হয়ে আহির কাছে আসতেই আহি বলল,
“আমাকে নাসিরাবাদ নামিয়ে দিতে পারবে? আমার একটা কাজ আছে।”

তাজওয়ার আফিফের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“ড্রাইভার আংকেল উনাকে হস্পিটালে নিয়ে যাবেন। আমি আমার ফ্রেন্ডকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি।”

তাজওয়ার আহির কথায় বেশ খুশি হলো। আহি যে আফিফের সাথে যাচ্ছে না, তার সাথে যাচ্ছে, এটাই তাজওয়ারের জন্য অনেক বেশি। যদিও আফিফ যেতে চাইছিলো না, কিন্তু আহি জোর করে আফিফকে গাড়িতে উঠালো। এরপর গাড়ির দরজা বন্ধ করে জানালার হাত রেখে বলল,
“পদ্ম আমাকে বলেছিল আপনার সাহায্য করার জন্য, তাই আপনাকে হস্পিটালে পৌঁছে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”

আফিফ আহির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জীবনটা আফিফকে এমন পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সে বুঝতেই পারছে না কি করবে। আহিকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বলতে বাধ্য করেছে।

(***)

আহি তাজওয়ারের গাড়িতে উঠে বসলো। নিজেই গাড়ির জানালা খুলে দিয়ে বলল,
“আমার দম বন্ধ লাগছে।”

তাজওয়ার আহির উড়ন্ত চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে যাবে আহি তার হাত আটকে দিয়ে বলল,
“এই মুহূর্তে আমার এসব ভালো লাগছে না।”

তাজওয়ার আর কিছু বললো না। আহিকে ড্রাইভার নাসিরাবাদ নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আহি রাস্তার মোড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। এই রাস্তা ধরে সে কতোবার যে আফিফের পিছু নিয়েছিলো, তার হিসেব নেই। তার সব অনুভূতি তো মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল, এখন নতুন করে কেন সে জানলো আফিফ তাকে ঘৃণা করতে চায়ছে।

আহি হাঁটতে লাগলো সেই রাস্তা ধরে। আজ সেই রাস্তা ধরে হাঁটছে না সেই কিশোরী। আজ হাঁটছে একটি ভাঙা হৃদয়ের তরুণী। আজ নেই তার সামনে আঠারো বছরের সেই ছেলেটি। সে তো ধুলোয় মিশে গেছে।

(***)

আহি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো চারুশিল্পের সামনে। গেটটির মুখোমুখি চায়ের দোকানটিতে গিয়ে বসলো সে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো গেটটির দিকে আর মনে মনে বলল,
“ঘৃণা আছে। থাকুক না হয়। কিন্তু আমার ভালোবাসার মৃত্যু কখনো হবে না। প্রিয় মানুষ পৃথিবী থেকে মুছে গেলেও তাদের ভালোবাসা বেঁচে থাকে। তাহলে আমি তোমার ঘৃণা নিয়ে কেন তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না, এআর? পাওয়ার আশায় তো সবাই ভালোবাসে না। কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশ্যেও হয়। আমার ভালোবাসা অধরা থাকুক। জানি না আমি তোমার জীবনটা কীভাবে এলোমেলো করে দিয়েছি। হয়তো করেছি। কিন্তু আমার মন ভাঙার অপরাধে আমি তোমাকে কোনো শাস্তি দেবো না। তোমাকে কখনো ঘৃণা করবো না। কারণ ভালোবাসার মানুষকে ঘৃণা করা যায় না।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-২৮+২৯ + বোনাস পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৮||

৫৫।
গাড়িটা হাসপাতালের সামনে এসে থামতেই আফিফ ভাড়া মিটিয়ে আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহি সেকেন্ড খানিক আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তোমার হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে, তাই!”

আহি আফিফের হাতটা শক্ত করে ধরলো। আজ এই হাতটা শুধু সাহায্যের জন্য এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদি অধিকারের হাত হতো, আহি হয়তো কখনোই ছাড়তো না। আফিফ আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই একজন নার্স এসে একটা হুইলচেয়ার এগিয়ে দিলো। আফিফ আহিকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আহির নাম এন্ট্রি করলো। নার্স আহিকে একটা কেবিনে নিয়ে তার হাঁটু আর হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। আফিফও এরপর ভেতরে এসে বসলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে আহিকে দেখে বলল,
“মানসিক চাপে আছেন আপনি?”

আহি ব্যস্ত হয়ে বলল, “না!”

এরপর আফিফের দিকে তাকালো। ডাক্তার আফিফকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি উনার কে হোন?”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড। আমি ঝর্ণার গিয়ে পিছলে পড়েছি, তাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”

ডাক্তার ব্যথার ওষুধ লিখে দিয়ে বলল,
“ব্যথা না কমা পর্যন্ত খাবেন। আর একটা ওয়েনমেন্ট লিখে দিলাম, সেটা লাগাবেন যেখানে ব্যথা লেগেছে। আর আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, মানসিকভাবে সুস্থ নন। মানসিক চাপ নিবেন না।”

ডাক্তার চলে যেতেই আহি চুপ করে বসে রইলো। সেকেন্ড খানিক নীরবতা বিরাজ করলো রুমটিতে। আফিফ নীরবতা ভেঙে বলল,
“মানসিক চাপ কেন নিচ্ছো?”

আহি আফিফের প্রশ্নে চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি এখনো মুভ অন করতে পারো নি!”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ নিজেও আর কি বলবে বুঝতে পারছে না। আহি এবার মলিন মুখে উত্তর দিলো,
“পদ্ম যদি আপনার জীবনে অনেক পরে এসে থাকে, তাহলে সেদিন কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন? কেন একটা বারের জন্যও আমাকে দেখতে চান নি?”

আফিফ চুপ করে রইলো। আহি বলল,
“হয়তো আপনার উত্তর আমাকে মুক্তি দেবে।”

আফিফ মুখ ঘুরিয়ে বসলো। আহির চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এতোই যদি সমস্যা থাকে, তাহলে চিরকুটগুলো কেন গ্রহণ করেছিলেন? কেন ছিঁড়ে ফেলে দেন নি? কেন যত্নের সাথে বুক পকেটে রেখে দিতেন? যদি একবারের জন্য আপনার চোখে আমি বিরক্তি দেখতাম, চিরকুট তো বহুদূর, স্বপ্নও দেখতাম না। আমার অপেক্ষা, আশা এক রাতেই শেষ হয়ে গেলো। সেদিন আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর সেই আড়াইটা বছর আমার মনে আপনি একই স্থানে ছিলেন। অথচ আপনার জীবনে পদ্ম এসে গেছে।”

আফিফ হাত মুঠো করে বসে আছে। তার গলা কাঁপছে। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি তোমাকে ঘৃণা কর‍তে পারতাম, কিন্তু করি নি। তোমার জন্য আমি অনেক কিছু হারিয়েছি, আহি। এতোটুকুই বলবো, তোমাকে ভালোবাসার যোগ্যতা নেই আমার। যাকে ভালোবাসার যোগ্যতা আছে, তাকে ভালোবেসেছি। আমি খুব সাধারণ মানুষ। সাধারণ জীবন যাপন করি। আমার কোনো শত্রু নেই। শত্রু চাইও নি। এতো ক্ষমতা নেই যে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াবো। আমি ছাড়া আমার মায়ের আর কেউ নেই। আমাকে ক্ষমা করে দিও যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি।”

আফিফ কথাগুলো বলেই উঠে চলে গেলো। আহি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তার জায়গায়। তার চোখটা লাল হয়ে গেছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গালটা মরিচা রাঙা হয়ে গেছে। কাঁদলে নাকি অনেক মেয়েকেই সুন্দর লাগে। কিন্তু আহিকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম মনে হয়। আহির ঠোঁটে হাসিই মানানসই। কিন্তু তার ভাগ্যটা বড়োই করুণ! হাসি তার ঠোঁটে বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হাসলেও সেই হাসিতে প্রাণ থাকে না। কারণ তার প্রাণ তো সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে।

(***)

আফিফ কেবিনের বাইরে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। জোরে জোরে বার-কয়েক শ্বাস ছাড়লো সে। পুরুষ মানুষ যেখানে সেখানে কাঁদতে পারে না। তাই আফিফ দ্রুত পায়ে হেঁটে করিডোরের অন্য প্রান্তে চলে গেলো। দেয়াল আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। পাশে একটা পানির কল ছিল। আফিফ পানি ছেড়ে মুখে পানির ছিঁটে দিলো।

এদিকে রাদ আর পদ্ম হাসপাতালে এসে পৌঁছাতে আহিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহি পদ্মের গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“তুই অনেক ভালো। তোর বরও অনেক ভালো। উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিস আমার পক্ষ থেকে।”

পদ্ম এদিক-ওদিক তাকিয়ে আফিফকে খুঁজতে লাগলো। আহি বলল, “বাইরে গেছে।”

পদ্ম আহিকে রাদের সাথে একা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি, রাদ।”

“কীসের উত্তর?”

“আফিফ কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল!”

“কেন?”

“হয়তো জেনে গেছে আমি এই সমাজের এক অভিশপ্ত মানুষ।”

“কি বলছিস এসব?”

“আমার জন্য না-কি ও অনেক কিছু হারিয়েছে। আমার জন্য সবাই সব হারিয়ে ফেলে৷ এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কি হতে পারে? আমি যা স্পর্শ করতে যাবো, সেটাই ঝরে যাবে। আমার জন্য মা সব হারিয়েছে, লিনু তার বাবাকে হারিয়েছে। আফিফও হয়তো কিছু একটা হারিয়েছে। আমি বিশ্বাস করেছি ওর কথা। রাদ, আমি কেন বেঁচে আছি? না আমি শান্তি পাচ্ছি, না কাউকে শান্তি দিচ্ছি। মনে হয় আমাকে হারতে হবে। আমার ভবিষ্যৎ আমার চোখের সামনে। তাজওয়ারকে বিয়ে করে ওর কাছে হেরে যাওয়া। এরপর আমি আর আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ দিনশেষে আমি অনেক টাকার মালিক হবো। সেই টাকা দিয়ে সব কিনে নিতে পারবো। শুধু ভালোবাসা আর সুখ কিনতে পারবো না।”

“এভাবে কেন বলছিস আহি? তাজওয়ারকে বিয়ে করতে হবে না তোর।”

আহি কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,
“তুই দূরে থাকিস আমার থেকে। কখন তুইও সব হারিয়ে ফেলিস আমার জন্য। তোর ঘৃণা নিতে পারবো না আমি, রাদ।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রাদ আহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আহি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি এমন এক অভিশপ্ত মানুষ যে পাপ না করেও পাপী। খুন না করেও খুনী।”

আফিফ আর পদ্ম কেবিনে ঢুকেই দেখলো আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। পদ্ম বলল,
“কি হয়েছে তোর?”

আহি রাদকে সরিয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললো।রাদও চোখ মুছে আহির দিকে তাকালো। আহি মাথা নিচু করে রেখেছে। আফিফ পদ্মকে বলল,
“আমরা বের হই বরং।”

পদ্ম আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল, “একটু দাঁড়ান।”

পদ্ম এবার আহির কাছে এসে রাদকে জিজ্ঞেস করলো, “আহি কাঁদছে কেন?”

রাদ বলল,
“ওর বাসায় ঝামেলা হবে হয়তো এই এক্সিডেন্টের কথা শুনে তাই।”

পদ্ম আহির পাশে বসে বলল,
“আমাকে বল আহি, কি হয়েছে? কেমন বাসা তোর? কিসের ঝামেলা? আংকেল কি তোকে বুঝে না?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“কেউ বুঝে না আমাকে। আমি কাউকে বোঝাতেও চাই না। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। তুই চলে যা তোর বরকে নিয়ে। আমি রাদের সাথে আলাদাভাবে যাবো।”

“কিন্তু…”

রাদ পদ্মকে বলল,
“যদি আমাদের একটু সময় দেওয়া যেতো!”

পদ্ম রাদের দিকে তাকালো। এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর পাশে আমি আছি। আমরা সবাই আছি। তোকে আমি বুঝবো। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক।”

আহি পদ্মের গালে হাত রেখে বলল,
“তুই অনেক ভালো। পৃথিবীর সব সুখ তোকে ছুঁয়ে দিয়ে যাক। এখন যা। আমি রাদের সাথে থাকি।”

পদ্ম আর আফিফ বেরিয়ে গেলো। আফিফ বের হওয়ার আগে আহির দিকে একনজর তাকালো। আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। সেই হাসি দেখেই আফিফের মনটা আরো ভারী হয়ে গেলো। তারা চলে যাওয়ার পর রাদ আহিকে নিয়ে হোটেলে চলে এলো।

(***)

একা একা সমুদ্রের তীরে হাঁটছে আফিফ। পদ্ম হিমছড়ি থেকে ফিরেই ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। সমুদ্রের ঢেউ স্পর্শ করে দিচ্ছে আফিফের পা যুগল। সে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“খেয়াল, তোমাকে হয়তো তোমার মতো করে ভালোবাসিনি, কিন্তু যতোদিন ছিলে অনুভব করেছিলাম ঠিকই। না দেখে হয়তো এতোটা ভালোবাসা যায় না। তুমি যেদিন বাস্তবে এসেছিলে, সেদিন আমার মনে শুধুই পদ্মফুল ছিল। তাই তুমি আমার খেয়াল হয়েই রয়ে গেছো। তোমার চিঠিগুলো আমাকে বিরক্ত করতো না। আমি তো উত্তর দেওয়ারই ঠিকানা পাই নি। তাই নিজেই সব উত্তর লিখে রেখেছিলাম একটা ডায়েরীতে। পদ্মকে ভালোবাসার পর মনে হয়েছিল এই অনুভূতি রাখাটাই পদ্মের সাথে ছল করা হবে। তাই ডায়েরীটা ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহস হয় নি। ভাগ্যিস চিঠিতে আমার নাম লিখি নি। তাই ছবি আঁকার শেষ স্যালারি দিয়ে আমি একটা নামহীন বই বের করেছিলাম। যেটা সবার কাছে বই। শুধু আমার কাছে খেয়াল। বইটির নাম দিবো ভেবেছি। কিন্তু সেই অধিকার আমার নেই। কখনো হবেও না। আমি চাই তুমি ভালো থেকো। আমাকে ভুলে যাতে সুখী হতে পারো।”

আহি বিছানায় শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি ফ্যানের দিকে। সে মনে মনে বলছে,
“আমি শরতের পত্রঝরা বৃক্ষ। হালকা হাওয়া লেগে ধীরে ধীরে আমার স্বপ্নগুলো ঝরে যাচ্ছে। কখন যে আমিই স্বপ্নহীন, হৃদয়হীন মানুষ হয়ে পড়ি! যদি হতে পারতাম, তাহলে এতো কষ্ট হতো না। বাবা, মিসেস লাবণি, তাজওয়ার কারোই তো হৃদয় আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তাদের দেখে মনে হয় বেশ সুখেই আছে। হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর মানুষগুলো বেশি সুখী হয়। আমারও এবার হৃদয়হীনা হতে হবে। আমিও এরপর সুখী হবো।”

অন্যদিকে রাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
“আমি এমন এক ভোরের সূর্যের অপেক্ষায় আছি, যেই আলোতে আহির জীবনের কুয়াশাচ্ছন্ন অতীত মুছে যাবে। এমন এক উষ্ণ বায়ুর অপেক্ষায় আছি, যেই বায়ু আহির মনের সব শীতল অনুভূতিগুলোকে বিলীন করে দেবে। আমি আহির পাশে থাকতে পারবো কি পারবো না জানি না। কিন্তু যদি নাও পারি, আহিকে তার মনঃযুদ্ধে জয়ী দেখতে চাই।”

৫৬।

রাতে ছাদে ছোট একটা পার্টি রেখেছে আহি। হোটেলে উপস্থিত অতিথিরাও সেখানে এসেছে। সুইমিংপুলের উল্টোদিকে ছোট একটা মঞ্চ করা হয়েছে। ওখানে এসে অতিথিদের মধ্যে যাদের ইচ্ছে হবে, গান গাইবে। স্লো ডান্স করছে অনেকে। আহি চুপচাপ একপাশে বসে আছে। রাদ তার পাশেই বসে আছে। পদ্ম আর আফিফ নিজেদের মতো কথা বলছে। পুষ্প আর লাবীব কি খাবে, কি খাবে না সেটাই দেখছে। রাদ আহিকে বলল,
“এখন কেমন লাগছে তোর?”

আহি রাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“মনটা হালকা লাগছে। ভাবছি মনটাকে আরো হালকা করবো।”

“কীভাবে?”

রাদ প্রশ্ন করতেই হোটেল ম্যানেজার আহির কাছে এসে বলল,
“ম্যাম, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”

আহি বলল,
“জিনিসগুলো সুইমিংপুলের ওই পাশটাই রাখবেন। একটা আরামদায়ক চেয়ারও যাতে থাকে।”

“জ্বি ম্যাম।”

ম্যানেজার চলে যেতেই রাদ জিজ্ঞেস করলো,
“কি করবি তুই?”

আহি বলল,
“নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে চাচ্ছি।”

আহি এবার উঠে দাঁড়ালো। ম্যানেজার তার হোটেলের বয়কে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় কি রাখতে হবে। বয়টি সুইমিংপুলের পাশে একটা ইজেল রাখলো। পাশে একটা টুলের উপর ক্যানভাস আর কিছু রং আর বিভিন্ন প্রকারের তুলি। সাথে একটা বসার চেয়ার। আফিফ খেয়াল করলো এসব। সে ভ্রূ কুঁচকে সেই ইজেলটির দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই আহি সেই জায়গায় গিয়ে বসলো। সে ধীরে ধীরে ইজেলটির উপর ক্যানভাসটি বসালো। পুরো ছাদে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। পছন্দ মতো রং বের করে একটার সাথে আরেকটা মেশালো। তারপর তুলি গুলো বের করে টুলের উপর ছড়িয়ে রাখলো। আহি এবার চোখ বন্ধ করলো। মনে মনে বলল,
“আজ আমি আবার নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে চাই। তবে এবার গল্পটা আমার আর আফিফের হবে না। এবার গল্পটা আমার আর প্রকৃতির হবে। যেখানে আফিফ রাফাত একজন অতিথি পাখি। যে হুট করে এসেই আমার মনের অনেকাংশ দখল করে নিয়েছে। অনেকাংশ কেন বলছি? পুরোটাই তো দখল করে নিয়েছে। এখন আবার ঋতুর পরিবর্তনে সে উড়াল দিয়েছে তার ঠিকানায়। সে আমার জীবনে আসা এক অতিথি পাখি।”

আহি রং মাখিয়ে সাদা ক্যানভাস রাঙিয়ে দিচ্ছে। মনের সব জানালা খুলে দিয়ে সে ছবি আঁকছে। আজ এই তুলি কাউকে ভয় পেয়ে থেমে যাবে না। আজ সে ক্যানভাস ফুটিয়ে তুলবে তার শিল্পীর মনের কথায়।

(***)

ছবি আঁকা শেষে আহি ক্যানভাস থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। সামনে তাকাতেই দেখলো আফিফ আর পদ্ম সুইমিংপুলে পা ডুবিয়ে কথা বলছে। পদ্ম শক্ত করে আফিফের হাত আঁকড়ে ধরেছে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই অধিকারটা আমার ভাগ্যে ছিল না। তুমি আমাকে তোমার জীবনের কোন অংশে স্থান দিয়েছিলে আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে সেই অংশটা ভালোবাসা মনে হয় নি। যদি সত্যিই ভালোবাসা হতো, তাহলে একবার হাত এগিয়ে দিয়ে দেখতে পারতে, আমি তোমার জন্য সবার সাথে যুদ্ধ করতাম। কিন্তু তুমি পালিয়ে গেছো। হয়তো এর পেছনে কোনো বড় কারণ ছিল। যাক, আমি তো আমার কষ্টদের মুক্ত করে দিয়েছি। দেখো আফিফ, আমি হাসছি। আমার এই হাসি আজ লোক দেখানো নয়। আমার মন হাসছে। জানি না কেন? হয়তো বেশি ধাক্কা খেয়ে ফেলেছি, তাই আর নিজেকে শক্ত করা ছাড়া উপায় ছিল না। আজ থেকে আমি সজ্ঞানে মেনে নিয়েছি, আমি যাকে ভালোবাসতাম, সে তুমি নও। সে তো রাতের আকাশে জেগে থাকা তারা। যেই তারা ভূমিতে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করা অকল্পনীয়। আবার সেই তারাটিই একদিন বিলীন হয়ে গেলো মৃত তারাদের মাঝে।”

আহি চেয়ার ছেড়ে উঠে তার ক্যানভাসটি ইজেল থেকে নামালো। তারপর হাত ধুয়ে এসে দেখলো, কয়েকজন তার আঁকা ছবির আশেপাশে জটলা পাকিয়েছে। আহি ক্যানভাসটি হাতে নিয়ে বলল,
“ছবি কেমন হয়েছে?”

সবাই মাথা নাড়িয়ে আহিকে বলতে লাগলো,
“আপনি তো ভালো ছবি আঁকেন।”

আহি প্রতিত্তোরে বলল,
“অনেক বছর পর এঁকেছি। এতেই যদি এতো ভালো হয়, তাহলে দ্বিতীয়বার আমাকে হতাশ হতে হবে না।”

আহি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে রাদকে ছবিটি দেখলো। রাদ হাতের ইশারায় বলল, “দারুন।”

আহি বলল,
“এটা আমার অতীত গল্পের সমাপ্তি চিত্র। এটা আমি নিজের কাছে রাখবো না।”

রাদ আহির কথায় ভ্রূ কুঁচকালো। আহি পেছন ফিরে আফিফ আর পদ্মের দিকে তাকালো। তারপর ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সেদিকেই পা বাড়ালো। আফিফ আহিকে আসতে দেখে পদ্মের হাত ছেড়ে দিলো। পদ্ম আহিকে দেখে বলল,
“আহি, ভীষণ সুন্দর করে সাজিয়েছে ছাদটা।”

আহি বলল,
“হুম। তোকে আর আফিফকে আমার পক্ষ থেকে একটা উপহার দিতে এসেছি।”

পদ্ম আর আফিফ উঠে দাঁড়ালো। আহি ছবিটি পদ্ম আর আফিফের দিকে ঘোরাতেই পদ্ম ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“বাহ, বেশ সুন্দর।”

আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম ছবিটি হাতে নিয়েই আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি বলল,
“অনেকদিন পর নিজের প্রতিভা প্রকাশ করলাম। একটা সময় রং তুলি আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। এবার ভাবছি, নতুন জগতে এই প্রতিভা থাকুক নতুনত্বের সাথে।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বলেছি না আপনাকে, আহি অনেক ভালো ছবি আঁকে? দেখেছেন?”

আহি বলল,
“আফিফ, আমরা তো শুনেছি, আপনিও ভালো ছবি আঁকেন। তাহলে এখন আঁকেন না কেন?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “সময় পাই না।”

“সময় করে নেবেন। নিজের প্রিয় কাজ নিজেকে যতোটা আনন্দ দেবে, আর কোনো কাজই সেই আনন্দ দেবে না।”

আহি পদ্মের থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“কতো চমৎকার একটা মানুষ আপনার জীবনে এসেছে। তার স্বপ্ন পূরণ করুন। জীবনে শুধু টাকার পেছনে ছুটলে হয় না। স্বপ্নের পেছনেও ছুটতে হয়। দেখবেন, তখন টাকাটাও আপনার হাতে এসে ধরা দেবে।”

পদ্ম বলল,
“দেখেছেন, আহি আপনাকে ভালোই মোটিভেট করছে।”

পুষ্প পেছন থেকে এসে বলল,
“আহি কিন্তু সবাইকে অনেক মোটিভেট করে। ভাইয়া, আপনার প্রতিভা আমরা কখন দেখছি তাহলে? শুধুই তো শুনেছি আপনি ছবি আঁকেন। কখনো তো দেখি নি। আমাদের বান্ধবী দেখেছে কি-না তাও সন্দেহ।”

পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“দেখেছি তো। উনি আগে কতো ছবি এঁকেছেন, সব আছে। আর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে কোনটা জানিস? সেই ছবিটা, যেটা নিয়ে ওদিন প্রশ্ন করেছিলাম!”

আফিফ পদ্মের কথায় থতমত খেয়ে গেলো। সে পদ্মকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করবো ছবি আঁকার।”

এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ এই ছবিটি উপহার দেওয়ার জন্য। তুমি ভীষণ ভালো ছবি আঁকতে পারো।”

পুষ্প ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, ছবিটির নাম কি?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“অতিথি পাখির ঘরে ফেরা।”

আফিফ আহির কথা শুনে সেকেন্ড খানিক স্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পের কথায় তার ঘোর কাটলো। পুষ্প বলল,
“ঘরে কোথায় ফিরছে?”

আফিফ ছবিটি সরিয়ে নিয়ে বলল,
“কিছু ছবির অর্থ সবাই বুঝে না। যারা ছবি আঁকে তারাই বুঝে। দেখে অন্য কিছু মনে হলেও নামের সাথে ছবিটির বেশ মিল আছে। মানতেই হচ্ছে, আহি ভালো ছবি আঁকতে পারে।”

লাবীব বলল,
“আমাদের অর্থটা বুঝিয়ে দেবেন, ভাইয়া?”

আহি বলল,
“ধুর, সিলেবাসের বাইরে চলে যাচ্ছিস তোরা। আমার আঁকা ছবি নিয়ে তোদের রচনা লিখতে হবে না।”

(***)

আফিফ আহির আঁকা ছবিটি হোটেলে নিয়ে এলো। পদ্ম ওয়াশরুমে গেছে। এই সুযোগে ছবিটি ছুঁয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু আফিফ ছবিটিতে হাত লাগালো না। রং নষ্ট হয়ে যাবে।
ভীষণ কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে আহি এই ছবিতে। এই কষ্ট ছুঁয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আফিফের নেই। ছবির একপাশে একটা ভাঙা দালান। সেই দালানের মূল দরজার রঙটা হলুদ। আর সেই হলুদ গেট ঘেঁষে লাগানো একটা বৃক্ষ। যেই বৃক্ষে একটি পাতাও নেই। পাশে একটা রাস্তা। যেটা কোথায় মিলিত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। আর অন্যপাশে একটা ঝিল। যেই ছিলে একটি মাত্র পদ্মফুল উঁকি দিচ্ছে। বৃক্ষটির উপর একটা পাখি হয়তো বসে ছিল, সেটাই উড়াল দিয়ে নামছে ঝিলের দিকে। ছবি দেখে বুঝা যাচ্ছে, পাখিটি নামতে গিয়েই তার পাখার ঝাপটা লেগে গাছের শেষ পাতাটিও ঝরে পড়ছে।
আফিফ বুঝতে পারলো, এটা আহি আর তার জীবনের ক্ষুদ্র গল্প। সেই হলুদ গেটটি চারুশিল্পের গেট। যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি আহি নিজেই। সেই গাছে একদিন একটা অতিথি পাখি বসেছিল। যেই পাখিটি আফিফ। সেই গাছে কোনো প্রাণ নেই। কোনো স্বপ্ন নেই। একটাই স্বপ্ন ছিল, যেটা পাখিটা উড়ে যেতেই ঝরে পড়লো। আর সেই স্বপ্নটা ছিল ঝরে পড়া পাতাটি। অন্যদিকে রাস্তাটি হচ্ছে তাদের গন্তব্যহীন পথ। আর ঝিলটি আফিফের সংসার। পদ্মফুলটি পদ্মের প্রতিচ্ছবি। এক কথায় অতিথি পাখির ঘরে ফেরা ছবিটির মূল অর্থ, আফিফ তার সংসারে ডুব দিয়েছে আহির স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে।

আফিফ শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিলো। এই ভালোবাসা গ্রহণ করার ক্ষমতা কেন সৃষ্টিকর্তা তাকে দেয় নি, সে জানে না।

এদিকে আহি রাতে ছাদে একা একাই বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর রাদ এসে আহির পাশে বসলো। নীরবতা ভেঙে রাদ বলল,
“জীবনটা নতুন করে কবে শুরু করবি? কখন সেই মানুষটাকে ভালোবাসা ছাড়বি?”

আহি হালকা হেসে বলল,
“আমি ভালোবাসতাম তাকে, ভালোবাসি এখনো, যতোদিন বেঁচে আছি তাকেই ভালোবাসবো। তবে এবার আমার ভালোবাসা আমার মনটা ভেঙে দিবে না। আমাকে মুক্তি দিবে। আমি ভালোবাসি বলেই তো ভালোবাসাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। চাইলে কি পারতাম না, আমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিতে? কিন্তু কেন করব? এখানে তো আমারই ক্ষতি।”

আহি এবার নিজের হাতের রেখার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাগ্যে কি আছে আমি জানি না। জানতে চাইও না। কিন্তু আমি ভালো থাকবো, এটা ভেবে যে, আমি দিনশেষে আমার ভালোবাসাকে হারতে দেই নি। পৃথিবীর কাছে আমি আমার ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করি নি। আমার প্রিয় মানুষটাকে প্রতারক হতে দেই নি। আমার ভালোবাসা আমার কাছে মিষ্টি এক অনুভূতি। আর আফিফ আমার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরুষ। আমি এই দু’টোকে কলুষিত করতে পারবো না। তাই মুক্ত করে দিয়েছি দু’টোকেই। প্রকৃতি যদি চাইতো তাহলে আমি তাকে হারাতাম না। আমাদের এক হওয়ার থাকলে, এতো অপেক্ষাও করতে হতো না। যদি সে আমার হয়, তাহলে হবেই। কিন্তু আমি হারবো না। তার বিবেককেও আমি হারতে দেবো না। পৃথিবী জানবে এক উন্মাদ প্রেমিকা তার প্রেমিককে বাঁচিয়েছে তাকে ত্যাগ করে। সুন্দর না আমার প্রেমের গল্পটা?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৯||

৫৭।
জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখছে আহি। তার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তার। যদিও পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। পায়ের ব্যথা মোটামুটি কমেছে তার।
আহি এবার ব্যাগ থেকে তার পছন্দের সোনালি রঙের টপসটা বের করলো। ঘন্টাখানেক আয়নার সামনে বসে নিজেকে সাজালো সে। কতো বছর পর নিজেকে সময় দিচ্ছে! রুম থেকে বের হতেই পুষ্পের সাথে দেখা। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“চল, একসাথে নামি। ব্যথা কমেছে তোর?”

আহি মৃদু হেসে বলল, “কাল থেকে কিছুটা কমেছে।”

আহি নিচে নামতেই পদ্ম আর আফিফকে দেখতে পেলো। পুষ্প আর আহি তাদের টেবিলে বসতেই পদ্ম আহিকে বলল,
“আহি, তোর তো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।”

আহি বলল,
“কাল থেকে অনেক ভালোই হাঁটতে পারছি। কাল তো পা’টা সোজাসুজি ভাবে বসাতেই পারি নি।”

নাস্তা সাজাতে সাজাতে রাদ আর লাবীবও এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। রাদ আহির দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল, “ভালো আছিস?”

আহি হেসে বলল, “হুম।”

আহির ঠোঁটে আজ অন্য ধরণের হাসি দেখছে রাদ। এমন ভাবে হাসতে আহিকে আগে কখনোই দেখে নি সে। আহি কি তাহলে সেই ট্রমা থেকে নিজেকে বের করে নিয়েছে?
সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তখনই লাবীব বলে উঠলো,
“এভাবে চুপচাপ বোরিং লাগছে। চল, আমরা একটা গেইমস খেলি।”

পুষ্প বলল, “কি গেইমস!”

“একটা শব্দ বলবো, যেমন ধরো আমি বললাম রোগী। রোগী শব্দটা শুনেই প্রথম যেই শব্দ মাথায় আসবে ওইটাই হবে পরের শব্দ। সেই শব্দে শুনে যেটা মাথায় আসবে ওটা হবে তৃতীয় শব্দ।”

“বাহ, বেশ তো। চলো শুরু করি।”

লাবীব আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাইয়া, আপনিও কিন্তু খেলছেন।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“চলুন না।”

আফিফ মাথা নাড়তেই লাবীব শুরু করলো,
“প্রথম শব্দ নাস্তা।”

রাদ বলল, “ডিম।”

আফিফ বলল, “কুসুম।”

পদ্ম বলল, “ফুল।”

পুষ্প বলল, “গোলাপ।”

আহি বলল, “লাল।”

লাবীব বলল, “রক্ত।”

রাদ বলল, “খুন।”

আফিফ বলল, “আপা।”

আফিফের কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকালো। পদ্ম কথাটা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, “চয়ন।”

পুষ্প কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “নাম।”

আহি বলল, “আহি।”

লাবীব বলল, “রোগী।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“হাসপাতাল।”

আফিফ বলল, “ব্যান্ডেজ।”

পদ্ম বলল, “আহি।”

আহি হেসে বলল,
“সবসময় আমার নামটা কেন আসে, ভাই? এটা হবে না। একটা শব্দ দ্বিতীয় বার ব্যবহার করা যায় না।”

পদ্ম বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। ওয়াসিকা কবির।”

পুষ্প এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওয়াসিকা ইজ ইকুয়াল টু বান্ধবী।”

আহি বলল, “লিনাশা!”

আহি কথাটি বলেই থেমে গেলো। পদ্ম আর পুষ্প আহির দিকে তাকালো। লাবীব বলল,
“লিনাশা দিয়ে কি বলবো? আচ্ছা, স্কুল।”

রাদ বলল, “স্মৃতি।”

আফিফ বলল, “ছবি।”

পদ্ম বলল, “সিনেমা।”

পুষ্প বলল, “ভিলেন।”

আহি বলল, “তাজওয়ার খান।”

আহির কথা শুনে সবাই এবার তার দিকে তাকালো। আহি হেসে বলল,
“ফরগেট ইট। চল এসব খেলা বাদ দে এখন।”

রাদও কথাটা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করলো। সবাই রাদের কথায় মনোযোগ দিলেও আফিফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহির দিকে। তাজওয়ার খান নামটা বেশ চেনা চেনা লাগছে তার। কোথায় শুনেছে এই নাম?

(***)

পদ্ম, পুষ্প আর আহি নাস্তা শেষে একসাথে বসে হাসাহাসি করছে। রাদ দূরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহির মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আর আজকের এই পরিবর্তনের জন্য একটা মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি। আর সে হলো নায়ীব তামজিদ। রাদ নায়ীবকে ফোন করে বলল,
“আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও কম হবে। আপনি আমাকে কি ফিরিয়ে দিয়েছেন, আপনি জানেন না।”

নায়ীব মুচকি হেসে বলল, “এটা আমার দায়িত্ব।”

এদিকে বিকেলে সবাই বসে গল্প করছিলো। তখন আহি তার ফোনটা রেখে ওয়াশরুমে গেলো। আর সেই মুহূর্তে ফোনে এলো মিসেস লাবণির কল। ফোনের স্ক্রিনে লাবণির ছবি দেখে পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আরেহ, এটা তো লিনাশার আপু! আহি না বললো, ওর সাথে লিনাশার কোনো যোগাযোগ নেই? তাহলে আপুর কল ওর ফোনে কেন আসছে?”

রাদ ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা লাবণির ছবি দেখে বলল,
“আরেহ উনি লিনাশার আপু না। উনি আহির মা।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির মা? উনাকে আমরা চিনি।”

লাবীব বলল,
“আরেহ, এটা ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী!”

পুষ্প আর পদ্ম চোখ বড় বড় করে লাবীবের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“এটা লিনাশার আপু। আমরা উনাকে সামনা-সামনি দেখেছি।”

মুহূর্তেই সবার মাঝে নীরবতা ছেয়ে গেলো। আহি এসে দেখলো তার ফোন পুষ্পের হাতে। পুষ্প ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
“তোর ফোন এসেছে।”

“কার কল!”

“লিনাশার আপু।”

আহি তড়িৎ গতিতে ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেলো আহি। পদ্ম বলল,
“লিনাশার সাথে তোর তো যোগাযোগ নেই।”

আহি থমথমে কন্ঠে বললো,
“আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না।”

আহি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আহি চলে যেতেই পুষ্প বলল,
“আজ বুঝলাম, লিনু আর আহির এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে কেন ফাঁটল ধরেছে। ওদের জীবনে এতো বড় ঘটনা ঘটে আছে, আর ওরা দু’জনেই এই ব্যাপারে কাউকে জানায় নি?”

রাদ বলল,
“আমার মনে হয় যেটা ওরা জানাতে চায় না, এই বিষয়ে প্রশ্ন করে ওদের বিরক্ত না করা উচিত। আমি তোমাদের দু’জনকে রিকুয়েষ্ট করছি, আহিকে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, প্লিজ। ও এমনিতেই অনেক চাপে আছে। এতোদিন আমরা যেভাবে হাসিখুশি স্বাভাবিক ছিলাম, এখনো ওরকমই যাতে থাকি।”

পদ্ম বলল,
“হুম, আমরা কিছু বলবো না। কিন্তু ওদের ভুল বুঝাবুঝি দূর করা তো আমাদের দায়িত্ব।”

রাদ বলল,
“আমরা তো জানি না কি হয়েছে। আহি কখনো এই ব্যাপারে কিছু বলে নি। আমার মনে হয় এসবে আমাদের না জড়ানো উচিত। প্লিজ, আমি আহিকে মানসিক ভাবে দুর্বল দেখতে চাই না। ওর মন ভালো করার জন্য এখানে এনেছি। ওকে অন্তত এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করে আবার ওর মন ভেঙে দিও না।”

আফিফ রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদের আকুতিভরা কন্ঠ শুনে অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাদ আহিকে ভালোবাসে না। ভীষণ ভালোবাসে সে আহিকে। তাই তো আহির জন্য এতোটা উদ্বিগ্ন। আফিফ রাদকে আশ্বস্ত করে বলল,
“তুমি ওর কাছে যাও। পদ্ম এ ব্যাপারে আহিকে কোনো প্রশ্ন করবে না।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ তার হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল,
“কারো দুর্বলতা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করা ভালো।”

রাদ আফিফের কথা শুনে মৃদু হাসলো। মানুষটা বুঝদার। তার এক কথায় পদ্ম আর পুষ্প তাদের উৎসাহ কমিয়ে ফেলেছে। নয়তো মেয়েদের এই এক স্বভাব। পরিস্থিতি যতোই জটিল হোক, উত্তর না পাওয়া অব্ধি শান্ত হবে না। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়ে পদ্ম আর পুষ্প চুপচাপ বসে থাকার মতো মেয়ে নয়। এখানে রাদের অনুরোধও ভিত্তিহীন তাদের কাছে। অথচ আফিফের এক বাক্যে দু’জনই আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। তারা যে এবার আর আহিকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না এ ব্যাপারে রাদ নিশ্চিত।

(***)

আহি রুমে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাদ আহির রুমে ঢুকেই দেখলো আহি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সে ব্যস্ত হয়ে আহির কাছে বসে বলল,
“কাঁদছিস কেন?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুই কি ওদের বলেছিস উনি আমার বাবার স্ত্রী হোন?”

রাদ মাথা নিচু করে বলল,
“হুম, আমি আসলে বুঝতেই পারি নি। হঠাৎ হয়ে গেলো সব। আর এটা কোনো বিষয় হলো? তুই কেন কাঁদছিস?”

“এবার ওরাও আমাকে ভুল বুঝবে।”

“কেন ভুল বুঝবে? কেউ তোকে ভুল বুঝে নি। বিশ্বাস কর, ওরা এসব মাথায়ও রাখে নি।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, সবাই আবার নিজেদের মতো গল্প করছে।”

আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই বিশ্বাস কর, আমি জানতাম না এসব। বাবা হুট করে এমন কান্ড ঘটিয়েছিল। এমন সময়ে আমি এই ধাক্কাটা খেয়েছি, যখন আমি নিজেই মানসিকভাবে সুস্থ ছিলাম না। আমি সব হারিয়ে ফেলেছিলাম সেই বছর। কিন্তু আমি এখন মন থেকে ভালো থাকতে চাই। প্লিজ, আমাকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিস না আর।”

রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুই। তোর অতীত না। তোর মতো মিষ্টি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করার জন্য এই অতীতটা খুবই দুর্বল। তাই এমন ভিত্তিহীন চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেল যে, আমরা কেউ তোকে ভুল বুঝবো।”

৫৮।

রাতে ডায়েরীর পাতা উল্টালো আহি। এরপর কলম হাতে নিয়ে লিখলো,
“এআর, তুমি হয়তো কখনোই আমার কল্পনায় আসবে না। তারা হয়ে গেলে যে। আজ থেকে আবার আমার অনুভূতিগুলো এই ডায়েরীতে স্থান পাবে। শোনো এআর, তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দিতে পারবো না। হয়তো এজন্য আমার তোমাকে নিয়ে দেখা অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো আহি। স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করবো না, তা তো হয় না। তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো পূরণ হবে, এআর। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করবো আজই। একটা স্বপ্ন ছিল আমার। সাগর পাড়ে তোমার সাথে সমুদ্র বিলাস করবো। এক রাতের জন্য একটা ছোট্ট সাজানো ঘর বাঁধবো সমুদ্র পাড়ে। আজ এই স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার কল্পনায় দেখা তুমিটা এবার বাস্তবে হাসবে। তোমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে তুমি সমুদ্র দেখবে। শুনবে সাগরের আর্তনাদ। তোমার চোখে আটকে থাকবে তোমার ভালোবাসার মানুষটির মিষ্টি হাসি। তোমার বুকে ঝাপটে পড়বে সে। সেই মানুষটা আসবে আজ। তোমার মনের মানুষ আজ তোমার মনের মতো করে সাজবে।”

আহি ডায়েরীটা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আজ তুমি চোখ সরাতে পারবে না। আজ তুমি প্রেমে পড়তে বাধ্য, আফিফ। আর আমি তোমাকে প্রেমে পড়তে দেখবো, এর চেয়ে চমৎকার মুহূর্ত আর কি হতে পারে, বলো?”

আহি হোটেল ম্যানেজারকে বলে সমুদ্রের পাশে একটা বড় তাবু বাঁধালো। সেই তাবুর ভেতর উঁচু একটা বেড বিছিয়ে দিলো। তাবুর সাথে লাগিয়ে দিলো ছোট ছোট মরিচ বাতি। ভেতরে ছোট একটা টেবিল রাখলো। আর তার উপর ছোট ছোট মোম সাজিয়ে সেগুলোতে নিজ হাতে আলো জ্বালাতে লাগলো। গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে বিছানায় ছড়িয়ে দিলো। ম্যানেজার এক গুচ্ছ অলকানন্দা ফুল নিয়ে আসতেই টেবিলের উপর রেখে দিলো আহি। এরপর সব গুছিয়ে চলে এলো হোটেলে। ঢুকলো হোটেলের ড্রেসিংরুমে। আহির হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেট থেকে একটা সাদা শাড়ি বের করলো সে। সাথে লাল রঙের স্লিভলেস ব্লাউজ। যত্নের সাথে শাড়িটা গায়ে জড়ালো। একটা লাল টিপ কপালের মাঝখানে বসালো। হাতে পরার জন্য এক গুচ্ছ চুড়ি নিলো। কানে বড় বড় ঝুমকো ঝুলিয়ে দিলো। কড়া পারফিউম গায়ে লাগালো। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক লাগানোর পর, খোঁপায় বেঁধে দিলো অলকানন্দা ফুলের মালা। আয়নায় দেখে বলল,
“আজ আফিফ প্রেমে পড়বেই।”

কথাটি বলেই আহি মুচকি হাসলো। ম্যানেজারকে শিখিয়ে দিয়েছে আফিফকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আফিফ আগে থেকেই তাবু বেঁধে রাখা জায়গাটিতে চলে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে সে খুব অবাক হলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“কে করেছে এসব!”

তখনই আহি আফিফের সামনে এসে বলল,
“সারপ্রাইজ।”

আহি সরে দাঁড়াতেই আফিফের সামনে দৃশ্যমান হলো পদ্ম। মেয়েটা লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়েছে। প্রথম স্লিভলেস ব্লাউজ পরায় চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত ঢেকে দিচ্ছে। রঙ-বেরঙের আলোর ভীড়ে সাদা শাড়ি পরা পদ্মফুলটিকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। আফিফ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। আহি আফিফের চাহনি দেখে হাসলো। এই হাসিটা সুখের নাকি কষ্টের, বোঝায় যাচ্ছে না। আহি এবার পদ্মের পাশে দাঁড়িয়ে পদ্মকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এবার তোর বরের সাথে সমুদ্রবিলাস কর। এদিকে কেউ আসবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তবে ঘুমানোর আগে তাবুর চেইনটা টেনে দিয়ে ঘুমাবেন।”

পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আফিফ এমন ড্রেস পছন্দ করে না। উনি কি রাগ করবেন?”

“উনার সামনেই তো তোকে এনেছি। আর কেউ তো নেই এখানে। শাল গায়ে জড়িয়ে এসেছিস। সমস্যা হলে গায়ে জড়িয়ে রাখ।”

আহি এবার আফিফকে বলল,
“এটা আমার পক্ষ থেকে স্পেশাল হানিমুন গিফট। গুড নাইট কাপল।”

আহি চলে এলো। আফিফ এবার ধীর পায়ে হেঁটে পদ্মের কাছে এলো। পদ্ম চোখ-মুখ খিঁচে বলল,
“আপনি কি রাগ করেছেন?”

আফিফ মুচকি হেসে বলল, “কেন রাগ করবো?”

“এমন ব্লাউজ…”

“আমার বউ, আমি ছাড়া তো কেউ নেই।”

আফিফ পদ্মকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো। পদ্মও আফিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ বলল,
“তোমাকে একদম আমার স্বপ্নের রানীর মতো লাগছে। তুমি ঠিক সেভাবেই সেজেছো, যেভাবে আমি তোমাকে দেখতে চাই।”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “আহি সাজিয়ে দিয়েছে।”

আফিফ পদ্মকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তোমাকে আহি সাজিয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পদ্মের হাত ধরে তাকে তাবুর ভেতরে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়েই দেখলো টেবিলের উপর অলকানন্দা ফুল। আফিফ সেখান থেকে একটি ফুল নিয়ে পদ্মের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, পদ্মফুল।”

পদ্ম ফুলটি নিয়ে আফিফের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি, আফিফ।”

আফিফ পদ্মের কাছে এসে বসলো। আলতো করে পদ্মের হাত ছুঁয়ে দিয়ে পদ্মের দিকে তাকালো।

আজকের এই রাতটি আফিফ আর পদ্মের জীবনে আসা চমৎকার একটি রাত। সমুদ্র জলে পা ডুবিয়ে হাতে হাত রেখে রাতের আকাশ দেখা, সমুদ্রের গর্জন শুনে ভালোবাসার অধ্যার রচনা করা, আফিফের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকা, তার চোখের আলোতে আটকা পড়ে থাকা পদ্মের লাজুক মুখখানি, তার বুকে পদ্মের মাথা রাখা, আফিফের তার পদ্মফুলকে নিজের মতো করে ভালোবাসা, আজ সত্যিই আহির স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আহির কল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। সে নিজ হাতেই তার ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হৃদয়ে ডুবিয়ে দিয়ে এসেছে।

এরপর আহি নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের খুশিতে ইচ্ছেমতো খাওয়া-দাওয়া করলো। খাওয়া শেষে নিজের পছন্দের শাড়ি বের করলো আহি। ফ্যাকাশে বেগুনি বর্ণের জরজেট শাড়ি। কপালে কালো টিপ পরলো। চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক লাগালো। ব্যাগ থেকে হিল জোড়া বের পরে নিলো। পায়ের ব্যথা এখন আর নেই। তাই ঠিকমতো হাঁটতে পারছে আহি। এবার সে কানে এয়ার বাড গুঁজে ফোনে গান চালিয়ে ছাদে এলো। রাদ, পুষ্প আর লাবীব আগে থেকেই ছাদে ছিল। আহিকে দেখে তিন জনই হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। আহি রাদের কানে অন্য পাশের এয়ার বাডটি গুঁজে দিয়ে বলল,
“লেটস ডান্স।”

(***)

রাদ আর আহি গান শুনে শুনে নাচছে। আর রাদ আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহি রাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কি দেখছিস এভাবে?”

রাদ আহির হাতটি ঘুরিয়ে এনে তাকে পেছন দিক থেকে হালকা জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
“তোকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে।”

আহি হেসে বলল,
“আমার পছন্দ এতোটাও খারাপ না।”

রাদ এবার আহিকে সামনে থেকে ঘুরিয়ে এনে তাকে নিজের দিকে ফিরালো আর বলল,
“তোর পছন্দ আমার পছন্দের চেয়ে বেশি সুন্দর না।”

আহি মুচকি হেসে রাদের কাঁধে হাত রেখে রাদের পেছন দিক থেকে একবার ঘুরে তার সামনে এসে এক পা তুলে রাদের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোর পছন্দ কি?”

রাদ মুচকি হেসে আহির ফোন নিয়ে গান পরিবর্তন করে দিয়ে বলল,
“চল গলা ছেড়ে গাই।”

মিউজিক চালু হতেই আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইশারায় বলল, “এই গানটা কেন?”

রাদ বলল, “শুনলে সমস্যা তো নেই।”

আহি আর রাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে কাঁধ হেলিয়ে তুড়ি বাজিয়ে নাচতে লাগলো। রাদ গাইতে লাগলো,
“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”

আহি রাদের দিকে তাকিয়ে কাঁধ বাঁকিয়ে গাইলো,
“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”

রাদ আহির হাত ধরে গলা ছেড়ে গাইলো,
“আয়ে নাজার চেহেরে হাজার…
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।
হোনা তা পিয়ার…..”

এদিকে পুষ্প আর লাবীব মনোযোগ দিয়ে রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তারা দু’জনেই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। রাদ এবার আহির হাত ধরে তাকে ছাদের এক কোণায় বসিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সুরের সাথে গাইলো,
“তেরে দিল’কে শেহের মে,
ঘার মেরা হো গেয়া,
হো গেয়া….”

আহি প্রতিত্তোরে রাদের কাঁধে তার দুই হাত রেখে বলল,
“স্বাপ্না দেখা যো তুম’নে
ওয়ো মেরা হো গেয়া,
হো গেয়া…”

“ডুবে তো ইউ,
জেসে হো পাড়…
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার…
হোনা তা পিয়ার।”

রাদ এবার আহির হাত ধরে তাকে সুইমিংপুলের পাশে নিয়ে এলো। আহিকে উপরে উঠিয়ে ঘোরাতেই আহি চোখ বন্ধ করে দুই হাত প্রসারিত করে রাখলো। রাদ আহিকে নামিয়ে আহির হাত নিজের বুকের কাছে এনে সুরের সাথে গাইলো,
“থামে দিলো কি বা’হে,
হাম আ’তে সালো মে,
সালো মে…”

আহি রাদের হাত ছেড়ে দিয়ে দুই হাত পেছনে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইলো,
“পায়ে জাবাব হাম নে,
তেরে সাওয়ালো মে,
সাওয়ালো মে….”

এবার রাদ আহির হাত ধরে গাইলো,
“খোয়াবও কি ডোর…”

“খোয়াবও কি ডোর..”

“টুটে না ইয়ার,
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”

“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”

গান শেষ হতেই রাদ আর আহি দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। আহি বলল,
“সব হারিয়ে ফেলার পরও আজ আমি অনেক খুশি। থ্যাংক ইউ রাদ। তুই আমার পাশে না থাকলে আমি বাঁচতাম না রে।”

রাদ আহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোর কিছু হলে আমি কি বাঁচতাম বল?”

“রিয়েলি? তোর কি হতো?”

“আমার একমাত্র মেয়ে বান্ধবী তুই। তুই ছাড়া কে আছে আমার?”

“বাহ, আমাকে পটানোর চেষ্টা করিস না।”

“আমি তো চেষ্টা করি না। আমার যেটা ভালো লাগে, আমি সেটাই করি। তোর যদি মনে হয় আমার উপর পটে গেছিস, তাহলে ডায়েরী লিখে প্রকাশ করিস না আবার। সোজাসুজি বলে দিস। আমি আবার চিঠি পড়ে নিজের বেহাল দশা বানাতে চাই না। হবে তো হবে। প্রেম হলে একবিংশ শতাব্দীর প্রেম হবে। নব্বই দশকের প্রেমিকের মতো চিঠির পেছনে দৌঁড়াতে পারবো না।”

“নব্বই দশকের প্রেম তো আমাকে বোল্ড আউট করে দিয়েছে। এবার যদি প্রেম করি, ছক্কা মেরে দিবো। আউট করলে তাজওয়ার খানকে আউট করবো।”

“আমাকে রান নিতে দিস। আউট করিস না।”

“তুই তো দেখছি আমার প্রেমিক হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিস!”

“তোর মতো করে কেউ ভালোবাসলে, আমি ধন্য হয়ে যেতাম। তাই তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি। আমার প্রেমে পড়ে উদ্ধার করিস আমাকে।”

“আগে তাজওয়ারকে আউট করি, তারপর ভেবে দেখা যাবে।”

আহির কথা শুনে রাদ হাসলো। আহিও শব্দ করে হাসলো। হাসি থামিয়ে রাদ বলল,
“তোকে শাড়িতে কোনো রাজ্যের সম্রাজ্ঞীর মতো মনে হয়।”

“তাহলে সম্রাটটা কে হবে শুনি?”

“আগে রাজ্য জয় করি, তারপর আমার রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবি।”

আহি হেসে বলল, “ঘুরেফিরে তুইই!”

“যাব তাক হে ইস শারীর মে জান,
মে রাহুঙ্গি তোমহারা সম্রাট শাহজাহান।”

আহি আঙ্গুলের ইশারা করতে করতে বললো,
“মুজে নেহি বান্না তোমহারি মামতাজ বেগাম,
পিয়ার নে মুজে ধো ঢালা,
আব চা’লা গেয়া মেরা সুখ, চ্যান ওর গাম।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৫৯।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়েই হোঁচট খেলো আফিফ। পদ্ম ভয়ার্ত চোখে আফিফের দিকে তাকালো। কিন্তু পরক্ষণেই সে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আফিফ নিচে পড়ে নি। একটা শক্ত হাত তাকে ধরে ফেলেছে। আফিফ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়েই থমকে গেলো। আহিও সেই সময় সিঁড়ি দিয়েই নামছিল। নিচে তাজওয়ারকে দাঁড়ানো দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকালো। তাজওয়ার আফিফের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এরপর চোখ সরিয়ে আহির দিকে তাকালো। আহিকে দেখে সে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“সুইটহার্ট, হাউ আ’র ইউ?”

আফিফ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আহি দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার আফিফের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে বলল, “এক্সকিউজ মি।”

আফিফ সরে দাঁড়াতেই তাজওয়ার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আহির সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আই মিসড ইউ, আহি।”

আহি তাজওয়ারের হাতের দিকে একনজর তাকিয়ে নিচে নেমে গেলো। আর তাজওয়ার হাত মুঠো করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে আহি ডায়নিংয়ে এসে বসলো। রাদ, লাবীব, পুষ্প সেখানে আগে থেকেই বসে ছিল। আহি আসার একটু পর আফিফ আর পদ্মও সেখানে এলো। আফিফ একনজর আহির দিকে তাকালো। পদ্ম আহিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, ছেলেটা কে?”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কোন ছেলে!”

তাজওয়ার উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“ইটস মি, তাজওয়ার খান।”

তাজওয়ার এসেই আহির কাঁধে দুই হাত রেখে আহির চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
“সারপ্রাইজ কেমন লাগলো, সুইটহার্ট?”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কে আপনি? এভাবে আহির গায়ে পড়ে কথা বলছেন কেন?”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে থামাতে যাবে তার আগেই তাজওয়ার পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওহ হো, আমি গায়ে পড়ে কথা বলছি? ডোন্ট ইউ নো, হু এম আই?”

তাজওয়ার আহির পাশে বসে বলল,
“সুইটহার্ট, বলো আমি কে?”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা অসভ্য লোক, যার সাথে বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।”

তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার আসল পরিচয় সবাইকে জানালাম। এবার তুমি এখান থেকে যেতে পারো।”

তাজওয়ার চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল,
“আমি তোমাকে সাথে নিয়েই যাবো।”

এরপর আফিফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আফটার অল রানীকে তো যেখানে সেখানে রেখে যাওয়া রাজার পক্ষে সম্ভব না। যদি কোনো দাসের নজর পড়ে যায়?”

আফিফ তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আর আফিফের এমন রহস্যময় চোখাচোখি দেখে রাদ ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার তাজওয়ার বলল,
“আহি তোমার ফ্রেন্ডদের মধ্যে সবাইকে তো চিনি না। রাদ, লাবীব আর পুষ্পের সাথে এর আগেও দেখা হয়েছে। বাকি দু’জন?”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার এতো কিছু জানতে হবে না। প্লিজ যাও এখান থেকে। আমাকে বিরক্ত করো না।”

তাজওয়ার রাগী স্বরে বলল, “আগে বলো, কে এরা?”

পুষ্প তাজওয়ারের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেলো আর সে নিজেই ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,
“পদ্ম, আমাদের ফ্রেন্ড। আর উনি পদ্মের হাসবেন্ড।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“হাসবেন্ড! ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো।।তাজওয়ার সবার সামনেই আহির গালে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আজ আমরা বাসায় ফিরছি তাহলে! আফটার কল খুব শীঘ্রই আমাদের এনগেজমেন্ট। প্রিপারেশনও নিতে হবে।”

তাজওয়ারের কথা শুনে রাদের হাত মুঠো হয়ে এলো। তাজওয়ার কথাটি বলেই চলে গেলো। আহি মলিন মুখে রাদের পাশে গিয়ে বসলো। রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“রিল্যাক্স, আহি।”

পদ্ম বলল,
“আহি, লোকটাকে আমার একদমই ভালো মনে হয় নি।”

আফিফ পদ্মের কথা শুনে তার দিকে তাকালো। পদ্মের উৎকন্ঠা দেখে অজানা ভয় আফিফকে ঝেঁকে ধরেছে।

নাস্তা সেরে আফিফ হোটেল রুমে ঢুকেই ব্যাগপত্র গোছাতে লাগলো। পদ্ম তা দেখে বলল,
“কি ব্যাপার? কোথায় যাচ্ছেন?”

“বাসায় ফিরতে হবে। অনেকদিন তো ঘুরেছি।”

“যাবোই তো। কিন্তু আহি তো বললো সন্ধ্যায় যাবে।”

“আমরা আলাদা ভাবে যাচ্ছি।”

“কেন?”

আফিফ বিরক্তির সুরে বলল,
“এতো প্রশ্ন করছো কেন?”

পদ্ম আফিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফের হাত আলতো ভাবে স্পর্শ করে বলল,
“কি হয়েছে বলবেন? আপনি হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন? আর আপনাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

আফিফ পদ্মের গালে হাত রেখে বলল,
“প্লিজ পদ্ম, চলো। আমার ভালো লাগছে না এখানে।”

“সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কি খুব বেশি দেরী হয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।”

“কি হয়েছে আপনার? আমি তো এভাবে যাবো না। আহিদের সাথে এসেছি, ওদের সাথেই যাবো। এভাবে সবাইকে ফেলে চলে গেলে সুন্দর দেখাবে না।”

আফিফ সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। তার চোখের সামনে এলোমেলো ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে। পদ্ম আফিফের পাশে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আহি অনেক ভালো মেয়ে। কিন্তু আংকেল এমন একটা লোকের সাথে আহির বিয়ে ঠিক করেছেন, যার মধ্যে একটুও ভদ্রতা নেই। এর চেয়ে তো রাদ অনেক ভালো। আহির জন্য রাদই ভালো হবে, তাই না?”

আফিফ রাগী স্বরে বলল,
“তুমি কি আহির অভিভাবক? তুমি কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো? ওর বাবার যেটা ভালো মনে হচ্ছে, সেটাই করছে। আর শোনো, আহি থেকে দূরত্ব রেখে চলবে। ও তোমার জন্য ক্ষতিকর।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি বলছেন আপনি? হঠাৎ কি এমন হলো আপনার? কাল রাতেই ও আমাদের এতো বড় একটা সারপ্রাইজ দিলো। আর আপনি এমন কথা বলছেন?”

“পদ্ম, আমি তোমার স্বামী। আমার কথা শুনতে তুমি বাধ্য।”

“আমি আপনার সব কথা শুনি, আফিফ। কিন্তু ও আমার ছোটবেলার বান্ধবী। ওর বিরুদ্ধে আমি একটা কথাও শুনবো না। কতো সহজে বলে দিলেন, ও আমার জন্য ক্ষতিকর! ক্ষতির কি দেখলেন আপনি?”

আফিফ হাত দিয়ে মুখ গুঁজে রাখলো। পদ্ম আফিফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে বলুন না কি হয়েছে? আপনাকে দেখতে এতো অস্থির লাগছে কেন?”

আফিফ পদ্মের কোলে মাথা রেখে বলল,
“আমি আর কাউকে হারাতে পারবো না, পদ্ম। আমি আর কাউকে হারাতে পারবো না।”

আফিফ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পদ্ম আফিফের গালে হাত রেখে বলল,
“কেন হারাবেন আপনি? কাকে হারাবেন? সবাই তো আপনার সাথেই আছে। আমি না আসলেই বুঝতে পারছি না কি হয়েছে আপনার।”

আফিফ মাথা তুলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“হঠাৎ আপার কথা মনে পড়ে গেলো।”

পদ্ম আফিফের কাঁধে মাথা রেখে তার হাতে নিজের হাত ঘষতে লাগলো। আফিফের চোখ ভিজে উঠলো। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি ভীষণ দুর্বল মানুষ, পদ্ম। কম বয়সে বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি। হুট করে একটা সাজানো সংসার ভেঙে যেতে দেখেছি। আমাদের দু’বেলা খাওয়ানোর জন্য মাকে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি। এরপর আপা সব ছেড়ে ছুড়ে আমাদের দুই ভাই বোনের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করেছে। দেনা বেড়ে যাওয়ায় মা বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল। নিজেকে আমার সেদিন চোর মনে হয়েছিল। কিন্তু আপা সব ঋণ শোধ করে দিয়েছিল। নিজের শখ-আহ্লাদ সব ভুলে গিয়েছিল। পদ্ম, আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম, আমি তার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। কিন্তু পারি নি। সব মৃত্যু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আত্মহত্যা মেনে নেওয়া যায় না। আমি জানি আমার আপা আত্মহত্যা করে নি। খুন হয়েছে তার। শুধু রেনুর জন্য চুপ করে আছি। আমার তো আরেকটা আমানত আছে। বাবা আমাকে কতো বড় দায়িত্ব দিয়ে চলে গেছে। আমি ভীষণ অসহায় হয়ে গিয়েছিলাম, পদ্ম।”

পদ্ম আফিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার কোলে মাথা রেখে বলল,
“হঠাৎ এসব কেন বলছেন? কেন মনে করছেন সেই অতীত?”

“হঠাৎ করেই তো সব হয়ে যায়। সব আমার জীবনে হঠাৎ করেই হয়। আমি সামলে উঠতে পারি না।”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আমার হাত বাঁধা। আমি অতীত, ভবিষ্যৎ কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে চাই না। তোমাদের নিয়েই ভাবতে চাই। তুমি, মা, রেনু আমার শেষ আশ্রয়।”

পদ্ম চুপ করে রইলো। আফিফ খুব শান্ত আর গম্ভীর মানুষ। কখনোই এলোমেলো কথা বলে নি। আজ তাকে ভীষণ এলোমেলো মনে হচ্ছে। কোনো কিছুই গুছিয়ে বলতে পারছে না। চোখ দু’টিও অশ্রুসিক্ত। পদ্ম আফিফকে কখনোই কাঁদতে দেখে নি। কাঁদলে গুরুতর ব্যাপারেই তার চোখ ভিজেছে। কিন্তু আজ কোনো কারণ ছাড়া কেন কাঁদছে সে? আজ কি এমন ঘটেছে, যেটা আফিফকে মানসিক ভাবে ভেঙে দিয়েছে?

(***)

সমুদ্র উত্তাল আজ। বাতাসে ধুলো উড়ছে। আহি দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের বাইরে। হোটেলের বাইরে অনেক বড় পরিসারের জায়গা আছে। এখানে দাঁড়ালেও সমুদ্র দেখা যায়। তবে সৈকত অনেকটা দূরে। কিন্তু আজ সমুদ্র উত্তাল, তাই ঢেউয়ের গর্জন এখানেও শোনা যাচ্ছে। আজই তারা চলে যাবে। যেতে হবেই। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ১নং বিপদ সংকেত চলছে। কিন্তু এতেই যেন সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শহরে ১০নং বিপদ সংকেত দিলেও কোনো খবর হয় না। অথচ উপকূলীয় অঞ্চলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে আফিফ বাইরে এসে আহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। বাতাসে আহির চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে। কেমন দুর্বল মনে হচ্ছে আহিকে। কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস পেলো না আফিফ। উলটো পায়ে আবার হোটেলে ঢুকে পড়লো। আহি কিছুক্ষণ পর চলে আসবে তখনই দেখলো পদ্ম তার কাছেই আসছে। পদ্মের মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে আছে। আহি পদ্মের কাছে এসে বলল,
“কি হয়েছে তোর? মন খারাপ না-কি!”

পদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার তো কিছু হয় নি। কিন্তু আফিফের কিছু একটা হয়েছে!”

“হঠাৎ! কাল রাতের সারপ্রাইজ পছন্দ হয় নি?”

“না রে, ওটা না। সারপ্রাইজ তো আমাদের দু’জনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ উনি অদ্ভুত আচরণ করছেন। বাসায় চলে যেতে চাইছেন। উনাকে আমিই আটকালাম।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কাজ আছে হয়তো!”

“আমার মনে হচ্ছে, তোর হবু বরকে দেখে এমন করছে।”

“কেন আগে দেখে নি না-কি!”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আগে কীভাবে দেখবে?”

“কি যে বলিস, ওদিন না বললি খানস গ্রুপে চাকরি পেয়েছে।”

পদ্ম অবাক কন্ঠে বলল,
“খানস গ্রুপ তোর হবু বরের কোম্পানি?”

“হ্যাঁ, সরওয়ার খান আর তাজওয়ার খানের মিলিত কোম্পানি। তাজওয়ার ওই কোম্পানির নতুন এমডি হয়েছে। এতোদিন সরওয়ার খান ছিল। উনি তাজওয়ারের বড় ভাই। আবার তাদের আলাদা কোম্পানিও আছে।”

“আফিফ তো আমাকে এতোকিছু জানান নি। এজন্যই কি তাহলে চলে যেতে চায়ছেন। হয়তো বসকে দেখে ভয় পেয়েছেন। তাও আবার বসকে তার হবু স্ত্রী এমপ্লয়ির সামনেই অপমান করেছে।”

পদ্ম কথাটি বলেই মুখ চেপে হাসলো। আহি বলল,
“ধুর, আফিফের সাথে তাজওয়ার কোনো ঝামেলা করবে না। আমি যদি নিজেই তার সাথে ঝগড়া করি, এখানে আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ডের দোষ কী? আর তাজওয়ার যদি আফিফের কোনো ক্ষতি করে, আমি তো তার চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ফেলবো।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি হেসে বলল,
“আরেহ, এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? তোর বর দেখেই বলছি। অন্য কারো বর হলে মাথাও ঘামাতাম না। আর ওই তাজওয়ার খানকে আমার একটুও পছন্দ না। কখন যে ওই অসভ্য লোকটা আমার পিছু ছাড়বে!”

(***)

সন্ধ্যায় জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে পদ্ম আফিফকে বলল,
“আহির হবু বর আপনার বস হয়, সেটা আমাকে বলেন নি যে!”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“তাজওয়ার খানের কথা বলছি।”

আফিফ বলল, “উনি তো আমার বস না।”

“আহি তো বললো আপনি উনার কোম্পানিতেই চাকরি নিয়েছেন!”

“কখন?”

“খানস গ্রুপের এমডি তো তাজওয়ার খানই।”

আফিফ অবাক হয়ে পদ্মের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“সরওয়ার খান এমডি।”

“হ্যাঁ, আপনি ওই কোম্পানিতে কাজ করেন, অথচ জানেন না? সরওয়ার খান এমডি ছিল। এখন তাজওয়ার খান নতুন এমডি হয়েছে। ওটা না-কি ওদের দুই ভাইয়ের কোম্পানি।”

আফিফের হাত যেন এবার আর চলছেই না। পাঁচ বছরের চুক্তি করে ঢুকেছে খানস গ্রুপে। এখন কোম্পানি ছাড়লে তাকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিয়ে যেতে হবে। যেটা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব না। কিন্তু তাকে কোম্পানি কেন ছাড়তে হবে? কেন এতো ভাবছে সে? আফিফ আর কিছু ভাবতে চায় না। সে ব্যাগপত্র গুছিয়ে পদ্মকে নিয়ে হোটেলের বাইরে চলে এলো। বাইরে এসে দেখলো তাজওয়ার জোর করে আহির বাহু চেপে ধরেছে। আহি বার-বার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। পুষ্প, রাদ আর লাবীবও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারো বিন্দুমাত্র সাহস নেই তাজওয়ারকে থামানোর। আফিফ খেয়াল করলো, রাদের হাত মুঠো হয়ে আছে। কিন্তু লাবীব তাকে চেপে ধরে রেখেছে। নয়তো তাজওয়ার মুখটা রাদের হাতের নীল হয়ে যেতো। আফিফ এবার তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আসলেই তো মানুষটা রাজার মতো। রাজাকে যেমন প্রজারা ভয় পায়, তেমনি তাজওয়ারকেও সবাই ভয় পায়।

আফিফ এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে ভাবলো,
“আহি অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। আমি চাইবো, ও অন্তত এই দানবের হাত থেকে যাতে মুক্ত হতে পারে।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-২৬ + বোনাস পর্ব + ২৭

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৬||

৪৮।
জীবনের পাতা উল্টাতেই কেটে গেলো তিন সপ্তাহ। এরইমধ্যে প্রকৃতি ছেয়ে গেছে স্নিগ্ধ শীতল গন্ধবহে। শিউলিতলা ভরে গেছে শুভ্র পুষ্প মালায়। পথে পথে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কাশফুল। আর শুভ্র মেঘের ফাঁকে নীল আকাশের পানে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক ভাবুক মন।
আজ আহিদের পরীক্ষা শেষ। সে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখলো রাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি সন্তপর্ণে রাদের কাছে এসে তাকে ভয় দেখানোর জন্য জোরে বলে উঠলো, “ভাউ।”

রাদ বাঁকা চোখে আহির দিকে তাকালো। আহি মুখ ফুলিয়ে বলল, “একটু ভয় পাবি না?”

“তোর কি মনে হয় আমার হার্ট দুর্বল?”

আহি মুখ বাঁকালো। পরক্ষণেই ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আমরা তাহলে এই সপ্তাহে ট্যুরে যাচ্ছি।”

রাদ মাথা নাড়তেই তার সামনে আফিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আহির মনোযোগ সেদিকে না যাওয়ার জন্য রাদ আহির হাত ধরে তাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ঠিক করে আহিকে নিয়ে উঠে পড়লো। আহি বলল,
“এতো হুড়োহুড়ি করছিস কেন?”

“তোকে নিয়ে ভেলপুরি খেতে যাবো।”

আহি রাদের গাল টেনে দিয়ে বলল, “সো সুইট মাই ফ্রেন্ড।”

এদিকে আফিফ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

(***)

আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো আহি। ছোট একটা কালো টিপ পরলো কপালে। ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা একটা অলকানন্দা ফুল চুলের সাথে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিলো সে। এরপর ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ বক্সে ডাক্তার নায়ীবের শেষ মেসেজটির দিকে তাকালো। যেখানে লেখা আছে,
“আজ তুমি সেভাবেই নিজেকে সাজাবে, যেভাবে এতোদিন তুমি অলকানন্দের জন্য নিজেকে সাজাতে চেয়েছিল। আজ কোনো বাঁধা নেই। আজই যেন অলকানন্দের জন্য তোমার নিজেকে শেষ সাজানো হয়। এরপর আর কখনোই তুমি নিজেকে তার জন্য সাজাবে না।”

আহি মেসেজটি পড়ে আবার আয়নার দিকে তাকালো। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। সাদা শাড়ি পরেছে সে। আহি আজ ঠিক সেভাবেই সেজেছে যেভাবে এক্সিভিশনের আগে আফিফের ছবির জন্য নিজেকে সাজিয়েছিলো। আলতা রাঙা হাতটি আয়নার সামনে এনে রাখলো আহি। হঠাৎ তার কানের কাছে ফিসফিস করে সেই পরিচিত কন্ঠস্বর বলে উঠলো,
“অলকানন্দা, ভীষণ সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

আহি মিষ্টি হেসে বলল, “তোমার পদ্মফুল থেকেও?”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। আহি এবার পাশ ফিরে দেখলো কেউ নেই। আহির চোখ ভিজে গেলো। সে বুকে হাত রেখে বলল,
“আমি এই এক সপ্তাহ তোমাকে তোমার পদ্মফুলের সাথে কীভাবে দেখবো, আফিফ? এখনই ভাবতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ডাক্তার নায়ীব কেন এমন এক্সপেরিমেন্ট করতে বলেছে জানি না। কিন্তু তোমাকে আমার ভুলতে হবেই। নয়তো আমি পাগল হয়ে যাবো।”

আহি ব্যাগ নিয়ে বাসের জন্য স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। এখানেই সবাই আসবে। আহি রাদকে ফোন দিতেই দেখলো একটা রিকশা স্টেশনের সামনে এসে থেমেছে। এদিকে রাদ ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে জানালো, রাস্তায় জ্যাম, তাই দেরী হচ্ছে। রাদের সাথে কথা বলে আহি তার ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো, যেই রিকশাটা থেমেছিল, সেটাতে আফিফ আর পদ্ম। আফিফ রিকশা থেকে নেমেই তাদের ব্যাগটাও নামালো। এরপর মানিব্যাগ বের করতেই তার চোখ পড়লো আহির দিকে। আহিকে দেখে সেকেন্ড খানিকের জন্য আফিফ থমকে গেলো। আহিও আফিফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আহির মনে পড়লো ডাক্তার নায়ীবের সেই কথাটি,
“তুমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেই পদ্মের জীবনে ঝড় নেমে আসবে।”

আহি সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। চোখ বন্ধ করতেই তার চোখ ভিজে উঠলো। তাই সে নিজেকে আড়াল করার জন্য দ্রুতপদে স্টেশনের ভেতরে ঢুকে গেলো। স্টেশন রুমটি কাচের গ্লাস দিয়ে ঘেরা। আহি বেঞ্চে বসে সেখান থেকে স্পষ্ট বাইরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। সে দেখলো আফিফ ভাড়া মিটিয়ে পদ্মের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্ম সেই হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে রিকশা থেকে নেমে পড়লো। আফিফ সাদা পাঞ্জাবি পরেছে, আর পদ্ম পরেছে নীল রঙের সেলোয়ার-কামিজ। দু’জনের এমন অমিল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু আহির কাছে অস্বাভাবিক লাগছে।

(***)

পদ্ম স্টেশন রুমে ঢুকে আহিকে দেখে বলল,
“বাহ, কি সুন্দর লাগছে তোকে!”

আফিফ ব্যাগটা চেয়ারে রেখে আহির দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আহি পদ্মকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে!”

“জানিস আহি। আমি তো আফিফকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছি। উনি তো আসতেই চাচ্ছেন না।”

“কেন?”

“এর আগেও আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম তো তাই।”

“ওহ, আচ্ছা। তাহলে না আসলেই হতো। শুধু আমার বান্ধবীটাকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেই চলতো।”

আফিফের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে পদ্মকে বলল,
“তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।”

আফিফ চলে যেতেই পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, এভাবে বললি কেন? উনি মন খারাপ করেছেন। আমি এখন বিবাহিতা। বিয়ের পর মেয়েরা বর ছাড়া কোথাও যায় না।”

“আহা, আমাদের আদর্শ পদ্মবিবি।”

পদ্ম মুখ ছোট করে বলল, “আফিফ রাগ করেছেন।”

আহি মনে মনে বলল,
“রাগ করলে করুক না। আমাকে তো অনেক কাঁদিয়েছে তোর বর। এখন সামান্য একটু রাগ নিতে পারবে না? আমি তো বছর ধরে তার দেওয়া আঘাত মনে জমিয়ে রেখেছি। তার শোধ তো সামান্য এই কথা দ্বারাও মিটবে না, পদ্ম।”

পদ্ম আহির হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“সত্যি উনি রাগ করেছেন। যা না। সরি বল না। আবার যদি যেতে না চান?”

আহি হেসে বলল,
“রাগ করলে আমার সাথেই করবে, তোর সাথে তো আর করবে না। তুই শান্ত হো। তোর বর তোকে কষ্ট দেবে না। দিলে আমাকেই দেবে।”

“কীভাবে?”

আহি মৃদু হেসে বলল,
“ভুলে গেলি না-কি। সে আমার ক্লাসমেট। নোট দিবে না। ক্লাসে না গেলে আমি তো তার কাছেই পড়া বুঝিয়ে নেয়। তখন আমাকে বুঝিয়েও দেবে না।”

“তাই? আমি উনাকে বলবো তোকে পড়ায় হ্যাল্প করার জন্য।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “না না। দরকার নেই।”

তখনই পুষ্প চলে এলো চেঁচাতে চেঁচাতে। পুষ্প স্টেশন রুমে ঢুকেই আহি আর পদ্মকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
“পলি আপুর গেট টুগেদার।”

আহি পুষ্পের কথায় মলিন মুখে বললো,
“লিনু তো নেই।”

পুষ্প বলল,
“হ্যাঁ রে। আমি লিনুকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম আমরা ট্যুরে যাচ্ছি। আসতেও বলেছি। কিন্তু ও না-কি এখন খুলনায়।”

আহি মনে মনে বলল,
“মিথ্যে বললি কেন লিনু? জানি, আমি আছি তাই আসছিস না। আর কতো ঘৃণা করবি আমাকে? এক বিন্দু ভালোবাসা ভাগ্যে জুটছে না। উলটো প্রিয় মানুষের ঘৃণা ফিরে পাচ্ছি।”

পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“জানি না তোর আর লিনুর কি হয়েছে, আশা করি শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা কি এখন আর বাচ্চা আছি? এসব ছোটখাটো ঝামেলা কথা বলে মিটিয়ে ফেলা যায়।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার একটু পরই রাদ আর লাবীব স্টেশনে এসে ঢুকল। গাড়িও কিছুক্ষণ পর ছাড়বে। লাবীব সবার ব্যাগপত্র হ্যাল্পারকে দিচ্ছে। আর রাদ পাশের দোকান থেকে শুকনো খাবার কিনছে। পুষ্প আর পদ্ম বাসে উঠে নিজেদের সিটে বসে পড়েছে। আহি রাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। রাদ ইশারায় আহিকে বলল উঠে বসতে। আহি মাথা নেড়ে বাসে উঠতে যাবে ওমনই তার পা পিছলে গেলো। আহি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নেবে আফিফ এসে আহির হাত ধরে ফেললো। আহি থতমত খেয়ে গেলো। আফিফ চাপা স্বরে বলল,
“শাড়ি সামলাতে না পারলে, পরেছো কেন?”

আহি আফিফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমার ইচ্ছে। আমার শাড়ি, আমি পরবো।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহিও বাসে উঠে পড়লো। রাদ বাসে উঠতেই পুষ্প লাবীবের পাশের সিটে এসে বসে পড়লো। আহি বলল,
“তুই বসবি না?”

পুষ্প বলল,
“আমার লাবীবের সাথে কিছু কথা আছে।”

এরপর রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রাদ, তুমি আমার জায়গায় বসো আপতত।”

রাদ আহির পাশে বসতেই আহি রাদের দিকে তাকালো। তাদের পাশাপাশি সিটেই পদ্ম আর আফিফ বসেছে। রাদ আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর এআর এখানেই আছে। তুইও এখানে আছিস। মনের যতো জানালা আছে খুলে দে। নিজেকে আটকাবি না। তোকে কাঁধ দেওয়ার জন্য আমি আছি। তোর ভেজা চোখ মুছার জন্যও আমাকে পাবি। তোর কাঁপা হাতটা শক্ত করে ধরার মানুষটাও কিন্তু আমি।”

আহি রাদের হাত শক্ত করে ধরলো। রাদ আহির হাতে কপাল ঠেকালো। পদ্ম গলা খাঁকারি দিতেই আহি পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“আমরা কিন্তু পাশেই আছি।”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। রাদ আহির মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

(***)

বাস চলছে আপন গতিতে। পুষ্পের ফোনে মৃদু আওয়াজে গান বাজছে। আহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আফিফও একই ভাবে হয়তো বাইরের দৃশ্য দেখছে, নয়তো অন্য কোনো ভাবনায় ব্যস্ত। পদ্ম আফিফের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। আর রাদ আহির দিকেই তাকিয়ে আছে। আর সবাই শুনছে সেই হৃদয়স্পর্শী গান।

তুমি যাকে ভালোবাসো,
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো,
তার জীবনে ঝড়।
তোমার কথার শব্দ দূষণ,
তোমার গলার স্বর।
আমার দরজায় খিল দিয়েছি,
আমার দারুণ জ্বর।
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।
.
তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্যদল
বাঁচার লড়াই,
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে একটা চালের ভুল
কোথায় দাঁড়াই।
কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়,
তুমি অন্য কারোর গল্পে নায়িকা।

৪৯।

লাবীব পুষ্পের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মোবাইল নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুক্ষণ পর পর তার মুখের ভাবভঙ্গি আঁকাবাঁকা হচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকে দেখে মনে হয় মুখে গ্রহণ লেগেছে, আবার কিছুক্ষণ পর তার মুখটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে যায়। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে মাথা বাঁকিয়ে পুষ্পের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, পুষ্পের এমন গুরুগম্ভীর মুখভঙ্গির কারণ গেইমস। লাবীব ফুঁস করে একটা শব্দ করতেই পুষ্প বাঁকা চোখে তার দিকে তাকালো। লাবীব ঠাট্টার হাসি হেসে বলল,
“সাবওয়ে সার্ফারের যুগ শেষ হয়ে গেছে।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তো!”

“তোমার গেইমস নিয়ে কোনো আইডিয়ায় নেই।”

“থাকতে হবে না আইডিয়া।”

লাবীব মুখে আবার ফুঁস করে একটা শব্দ করতেই পুষ্প ফোন বন্ধ করে লাবীবের দিকে ঘুরে বলল,
“এই তুমি পুসপুস কেন করছো?”

পুষ্প অনেকটা জোরে কথাটা বলায় রাদ ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকালো। লাবীব চাপা স্বরে বলল,
“আস্তে, এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?”

“আমি তোমার পাশে এক সেকেন্ডও বসবো না।”

“বসতে হবে না। তুমি নিজেই তো আমার পাশে বসার জন্য মরে যাচ্ছিলে।”

পুষ্প দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ওহ, রিয়েলি? তুমিই আমাকে বলেছো রাদ আর আহিকে একসাথে বসতে দিতে।”

“তুমি যেমন চাও নি?”

“তুমি আমাকে বলেছিলে, তাই আমি চেয়েছি।”

“ওয়াও, তুমি এতো বাধ্যগত মানুষ তা তো আমি জানতাম না।”

পুষ্প সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাদ বলল,
“কি হয়েছে?”

পুষ্প চেঁচিয়ে বলল,
“এই ফাজিল ছেলেটার পাশে আমি বসবো না।”

রাদ উঠে পুষ্প আর লাবীবের সিটের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবীব পুষ্পকে বলল,
“আচ্ছা সরি। বসো না।”

পুষ্প চোখ ছোট করে বলল, “নো, নেভার।”

পুষ্প এবার আহির পাশের সিটে বসলো। আহি বলল,
“লাবীব একটু মজা করেছে হয়তো। ওর কথায় মাইন্ড করিস না।”

পুষ্প ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“আমি আর কখনোই সাবওয়ে সার্ফার খেলবো না।”

পদ্ম পুষ্পের কথায় হেসে উঠলো। পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই হাসছিস কেন? একবার খেলে দেখিস, তারপর বুঝবি কেন এতো ভালোবাসতাম।”

পদ্ম বলল,
“না বাবা, আমার ওসব গেইমস খেলার সময় নেই। আমার সংসারেই অর্ধেক সময় যায়।”

“ব্যস্ত মানুষ।”

পদ্ম এবার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তুই এখন আর ছবি আঁকিস না?”

পদ্মের কথায় আহি চমকে উঠলো। রাদও পদ্মের কথাটি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আহির দিকে তাকালো। পুষ্প সাথে সাথেই বলে উঠলো,
“পদ্ম, তোর মনে আছে, আহি অনেক ছবি আঁকতো? স্পেশালি একটা ছেলের।”

পুষ্প কথাটি বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। এদিকে পুষ্পের কথা শুনে আফিফ শক্ত হয়ে বসে রইলো আর আহি জানালার বাইরে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আহি, কি হলো? রাগ করেছিস না-কি!”

আফিফ এবার আহির দিকে আঁড়চোখে তাকালো। আহিও সাথে সাথেই আফিফের দিকে তাকালো। দু’জনের চোখাচোখি হতেই আফিফ চোখ সরিয়ে নিলো। পদ্ম এবার বলল,
“তোর এআরের কি অবস্থা? তুই তো সেই স্কুল থেকেই তার জন্য পাগল ছিলি!”

এবার রাদের হাত মুঠো হয়ে এলো। আহিও শক্ত হয়ে বসে আছে। হঠাৎ তার বুকে কাঁপুনি ধরলো। সে কিছুক্ষণ পর পর হাত ঘষছে। আফিফ আহির মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেছে আহি। আফিফের সামনেই এমন প্রশ্ন করার মানে হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় পদ্ম আর পুষ্পের বোধজ্ঞানের অভাব আছে। লিনাশা হলে এমন প্রশ্ন কখনোই করতো না। এবার পুষ্প বলল,
“আর যাই বলিস পদ্ম, আহির ভালোবাসা যে পাবে সে ভীষণ ভাগ্যবান পুরুষ। এআরের প্রতি আহির ভালোবাসা দেখে আমিই অবাক হতাম। ছেলেটার পোড়াকপাল।”

আফিফ এবার ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। কথাগুলোতে আহির যে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে, সেটা আফিফ বুঝতে পারছে। কিন্তু কীভাবে এই মেয়ে দু’টাকে থামাবে সে বুঝতে পারছে না। পদ্ম বলল,
“আহি চুপ করে আছিস কেন? আমাদের সাথে তুই আগের মতো সব কথা শেয়ার করিস না।”

রাদ এবার গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“শেয়ার করার বিষয় হলেই শেয়ার করবে। যে আহির জীবনে নেই, তাকে বার-বার টেনে আনার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।”

পুষ্প বলল,
“তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? জেলাস না-কি?”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললো, পুষ্পকেও চুপ করাতে বলল। আফিফের কথামতো পদ্ম পুষ্পের হাত ধরে তাকে থামালো। অনেকক্ষণ বাস জুড়ে নিরবতা বিরাজ করছিলো। পুষ্প ঝুঁকে একনজর আহির দিকে তাকালো। আহি থম মেরে বসে আছে। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“সরি।”

আহি হঠাৎ সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর পুষ্পকে সরিয়ে রাদের সীটের কাছে গিয়ে বলল,
“বাসটা একটু থামাতে বলবি।”

রাদ সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়ে সামনে চলে গেলো। আহিও রাদের পিছু পিছু সামনে চলে এলো। পদ্ম মাথা বের করে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মনে হয়ে আমরা একটু বেশিই বলে ফেলেছি। আমি বুঝতে পারি নি।”

পুষ্প মলিন মুখে বললো,
“হয়তো ছেলেটার সাথে ওর আর কোনো যোগাযোগ নেই। কিছু একটা হয়েছে হয়তো। কিউরিওসিটি থেকেই তো বার-বার জিজ্ঞেস করি।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। একটু পর বাস থামলো। লাবীব সীট থেকে উঠে সামনে এসে রাদকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? গাড়ি থামাতে বলেছিস কেন?”

“তুই সীটে বয়। আমরা আসছি।”

পুষ্পকে উঠে আসতে দেখে লাবীব বলল,
“বসো, বসো কিছু হয় নি।”

এদিকে আহি বাস থেকে নেমেই গলগল করে বমি করে দিলো। হাত ব্যাগটা রাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ওষুধটা বের করে দে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কীসের ওষুধ? আহি, ডক্টর নায়ীব কিন্তু ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে মানা করেছে। উনি এখনো তোকে কোনো ওষুধ লিখে দেন নি।”

“রাদ, এখান থেকে আমি একা যাবো।”

“তোকে ফেইস করতে হবে, আহি। উত্তর দিলি না কেন? বলতে পারিস নি, ছেলেটা তোর যোগ্য না?”

আহি ছলছল চোখের রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কীভাবে বলবো? আফিফের সামনে কীভাবে?”

“সমস্যা কি বললে?”

“ও যদি কষ্ট পায়?”

“রাখ তার কষ্ট। ও তোকে কি পরিমাণ সুখ দিয়েছে?”

“আমি তো ওর কাছে কিছুই আশা করি নি। করি না। কখনো করবোও না।”

রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“চল বাসে উঠ। আমার পাশে বসিস। লাবীবকে পেছনে বসাবো।”

আহি মুখে পানির ছিঁটে দিয়ে বাসে উঠে পড়লো। রাদ লাবীবকে বলল,
“তুই পুষ্পের পাশে গিয়ে বস তো।”

লাবীব আহির দিকে তাকিয়ে পেছনে গিয়ে বসলো। পুষ্পও কিছু না বলে লাবীবকে সীট ছেড়ে দিলো। লাবীব চাপা স্বরে ব্যাঙ্গ করে বলল,
“নো, নেভার।”

পুষ্প লাবীবকে ভেংচি দিয়ে বলল,
“তুমি এসেছো, আমি না।”

এদিকে আহি আসতেই পদ্ম বলল,
“আহি, তুই ঠিক আছিস তো!”

আহি হালকা হেসে বলল,
“এখন অনেক ভালো লাগছে। মেডিসিন তো আমার কাছেই আছে।”

আহি কথাটি বলেই রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“বাসা থেকে উল্টোপাল্টা খেয়ে এসে বমি করেছে। তাই এমন চুপচাপ ছিল।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোদের কথায় আমি রাগ করি নি।”

আহি একনজর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি যেই ছেলেটার ছবি আঁকতাম, সে হঠাৎ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই বলতে চাই নি তোদের।”

পুষ্প গালে হাত দিয়ে বলল,
“কীভাবে অন্ধ হয়েছিল?”

“মাথায় সমস্যা হয়েছিল তো, তাই হয়তো।”

রাদ আহির কথায় সীটে বসে মুখ চেপে হাসছে। এদিকে আফিফ চোখমুখ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি নিজের সীটে উঠে উল্টো দিক হয়ে সীটের উপর দুই হাঁটু উঠিয়ে পুষ্প আর পদ্মের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো আর বলল,
“জানিস ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছিলো একবার। ইশ বেচারা! আমিও বা কি করবো? সে তো আমাকে আর দেখতেই পায় নি।”

পদ্ম আর পুষ্প বলল, “তারপর!”

“তারপর আর কি! আমি বললাম, আমি তাকে পছন্দ করি। কিন্তু সে তো হাবলার মতো চলে গেলো। চোখে দেখে নি তাই।”

পুষ্প বলল, “কানেও শুনতো না না-কি!”

“হালকা-পাতলা সমস্যা ছিল হয়তো। মাথায় আঘাত লেগেছে। বুঝিস তো স্নায়ুবিক ত্রুটি। একটু পাগল পাগল ভাব ছিল।”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি এবার বলল,
“এরপর একদিন শুনলাম তার বিয়ে হয়ে গেছে। আর পরে জানলাম মেয়েটারও মাথায় সমস্যা আছে।”

পুষ্প বলল, “ওয়াও, পাগল-পাগলীর সংসার!”

পদ্ম বলল,
“শুনেই খুব হাসি পাচ্ছে, তাই না আফিফ?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“এখন তোরাই বল, বাবা কি পাগল ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতো? তবুও ভালোবাসতাম দেখে, তাকে সম্মান করেছি। সে কি আর শখ করে পাগল হয়েছে? মাথায় আঘাত লেগেছিল তাই।”

রাদ আহির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“তোর পাগলের গল্প বন্ধ করে এদিকে এসে বস।”

আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মুখটাতে গ্রহণ লেগেছে। আহি এবার রাদের পাশে বসে চাপা স্বরে বলল,
“ওর মুখটা তো অন্ধকার।”

রাদ বলল,
“তোকে সমাজসেবী হয়ে আলো জ্বালাতে হবে না।”

“খারাপ লাগছে তো।”

“আমার তো বেশ মজা লাগছে। একটা ছবি তুলে ক্যাপশন দিতে ইচ্ছে করছে, ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে যাওয়া মুখ।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৫০।
হোটেলে ঢুকতেই পদ্ম অবাক হয়ে গেলো। তার কাছে এটা প্রাসাদের মতোই সুন্দর। রুমগুলো বেশ বড়। জানালাগুলোও বিশাল। বারান্দা আছে সেটাও চমৎকার। বারান্দায় দাঁড়ালে সমুদ্র দেখা যায়। রুমের সাথে লাগানো লিভিং রুমও আছে। আর চারপাশে বিভিন্ন রঙের বাতি ঝুলছে। ওয়াশরুমে ঢুকেই পদ্ম বলল,
“জানেন, এই প্রথম আমি বাস্তবে এমন রুম দেখেছি।”

আফিফ পদ্মকে বলল,
“এক সপ্তাহে তো অনেক টাকা চলে আসবে।”

পদ্ম বলল,
“এটা আহির বাবার হোটেল। টাকা লাগবে না।”

আফিফ আর কিছু বললো না। কিন্তু তার মনটা ভারী হয়ে আছে। এতোগুলো টাকা আহিকে কীভাবে ফেরত দিবে সে? রুম দেখে মনে হচ্ছে এক রাতে দশ হাজার টাকার মতো আসবে। সাত দিনে আসবে সত্তর হাজার টাকা। এর চেয়ে বেশিও তো হতে পারে। এদিকে আফিফের মাসিক বেতন মাত্র পনেরো হাজার টাকা। তার এই টাকা শোধ করতেই তো দুই বছর লেগে যাবে।

(***)

রাদ আহির হাত ধরে তাকে সমুদ্রতীরে নিয়ে এলো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”

আহি বলল, “তুই আসলে কি?”

“মানুষ!”

“না, সাধারণ মানুষ না তুই।”

“তাহলে কি অসাধারণ?”

“ভাবতে দে।”

আহি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “প্রীতমানব।”

“মানে কি?”

“যে মানুষটা সবসময় হাসি-খুশি থাকে।”

রাদ আহির কথায় হাসলো। আর আহি সমুদ্রের ঢেউয়ে নিজের পা ভেজাতে ব্যস্ত। মিনিট খানিক নীরব থেকে আহি বলল,
“ভাবছি তোর বিয়ে হলে আমার কি হবে?”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “এভাবে বলছিস কেন?”

“তোর বউ তো আমাদের এভাবে একসাথে সহ্য করতে পারবে না।”

“কে বলেছে তোকে?”

“পৃথিবীতে সবকিছুর ভাগ হয়। কিন্তু ভালোবাসার ভাগ কেউ দিতে চায় না। অন্য কাউকে প্রিয় মানুষের পাশে কেউ সহ্য করতে পারে না। যেমন আমি পারছি না।”

“বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা দু’টি ভিন্ন, আহি।”

“কিন্তু ভালোবাসা বন্ধুত্বের কাছে হারতে বাধ্য।”

“আমি এটা মানি না। যদি এমনই হতো তাহলে তোর ভালোবাসা বন্ধুত্বের কাছে হারতো না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ আবার বলল,
“তুই পদ্মের কারণেই তো আফিফকে ভুলে যেতে চাস।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“আফিফকে পাওয়ার চেষ্টা করলে হয়তো পাওয়া যেতো। কিন্তু তার জন্য ক্ষমতা লাগবে। আর এই ক্ষমতা বাবার কাছে আছে। আর বাবা চায়, আমি তাজওয়ারকে বিয়ে করি। আর আফিফ আমাকে কখনই ভালোবাসবে না। যার মনে অন্য কেউ, তাকে আমি জোর করে কীভাবে নিজের করে নেবো? আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমি মিসেস লাবণি হতে চাই না। মিসেস লাবণি আমার মায়ের জায়গাটা নিয়ে ফেলেছে। পদ্ম আর আফিফের তো সন্তান নেই। কিন্তু একটা সংসার তো আছে। আমি আমার ঘরের ইট-পাথরের ভাষাও বুঝি। তারা মাকে চায়। ওটা আমার মায়ের সংসার ছিল। আমার মা আমার অহংকার। আমি আমার মায়ের সন্তান। আমি বাবার মতো হয়ে নিজেকে রিজওয়ান কবিরের সন্তান বলে পরিচয় দিতে চাই না। বরং ওয়াসিকা নামের পাশ থেকে কবির শব্দটাই মুছে দিতে চাই। তাহলে বল, শুধুই কি বন্ধুত্ব? আমার আত্মসম্মানবোধও এখানে জড়িয়ে আছে।”

রাদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
“আফিফ কি পৃথিবীর একমাত্র ছেলে? কি এমন আছে ওর মধ্যে? আফিফের চেয়েও ভালো ছেলে আছে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জানি না ওর মধ্যে কি আছে। কিন্তু আমি তো ভালোবেসে ফেলেছি রাদ। ডক্টর নায়ীব বলেছে এটা রোগ। কিন্তু আমার কাছে এই ভালোবাসা, রোগ না। আমার কাছে এটা অনুভূতি, আমার আবেগ, আমার স্বপ্ন।”

রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যদি ও তোর জীবনে না আসতো, তাহলে কি প্রেমে পড়তি না?”

“পড়তাম তো!”

“কার প্রেমে পড়তি?”

“তোর প্রেমে পড়তাম।”

রাদ আহির দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। আহি হেসে বলল,
“তোর মতো মানুষ ক’জন আছে? তবে অবশ্য তোকে চিনেছি আফিফের কারণেই। আফিফের জন্য রোগী হওয়ায়, তুই মেডিসিন হয়ে এসেছিস। আমার এমন পরিস্থিতিতে পাশে থেকেছিস, যেটা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। লিনাশার সাথেও এতো ভালো বন্ধুত্ব হয় নি আমার।”

“তুই না আমাকে মেডিসিন বলিস? মেডিসিন খেতে খেতে মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে। তুই যদি আসক্ত হয়ে পড়িস?”

“ভয় পাচ্ছিস না-কি?”

“না, আহি।”

“আমি আমাদের বন্ধুত্ব হারাতে চাই না। দেখ না ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি। তোকে হারালে আমি বেঁচেই থাকবো না। তুই একমাত্র মানুষ যার সাথে আমি এতো এতো কথা বলি। তখন কে শুনবে আমার কথা?”

আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। রাদ তা দেখে বলল,
“আমিও তোকে হারাতে চাই না।”

আহি মুচকি হাসলো। রাদকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো। রাদও আহিকে নিজের বুকে আবদ্ধ করে নিলো। তার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আহিকে খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে,
“আমাকে ভালোবেসে দেখ, আহি। আমি তোকে কখনো ফিরিয়ে দেবো না। তুই দেখিস, আমি হারিয়ে যাবো না। আমি তোর গান, তোর চিত্র, তোর ভাস্কর্য, তোর ছন্দ সবকিছু হতে রাজী। শুধু আমার হাতটা ধরে একবার বল, ভালোবাসবি রাদ? দেখিস, আমি তোকে এতো ভালোবাসবো যে তোর সব দুঃখগুলো সুখ হয়ে যাবে।”

(***)

পদ্ম আফিফের হাত ধরে তাকে টেনে সমুদ্র পাড়ে নিয়ে এলো। সেখানে এসে দু’জনই অবাক। তারা দেখলো, আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্ম গলা খাঁকারি দিতেই আহি রাদকে ছেড়ে মাথা তুলে পেছনে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আমরা কিন্তু এখানেই আছি। শুধু আমরা না। অনেকেই আছে।”

আহি আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ আহির দিকে তাকালো না। সে পদ্মের হাত ধরে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাদকে বলল, “চল, সামনে হাঁটি!”

রাদ মুচকি হেসে বলল, “হুম।”

রাদ আর আহি সামনে এগুতেই পদ্ম আফিফের বাহুতে মাথা রেখে বলল,
“ওদের দু’জনকে বেশ মানিয়েছে, তাই না?”

আফিফ মুচকি হেসে বলল, “হুম, ঠিক বলেছো।”

আফিফ মনে মনে ভাবলো,
“আমি তো চাই, আহি অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যাক। তার জীবনে এমন কেউ আসুক, যেই মানুষটা তাকে অনেক ভালো রাখবে। আর যদি সেই মানুষটা রাদ হয়ে থাকে, তাহলে আহি ভাগ্যবতী।”

(***)

রাতে আহি লাল রঙের শর্ট গাউন পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর ঠোঁটে হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিক দিয়ে রুম থেকে বের হলো। তার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো রাতের আকাশে টিমটিমে বাতি ঘেরা আলোকিত ছাদে উঠে একটা ছবি উঠাবে। তার বাসার ছাদে এমন রংবেরঙের বাতি লাগানো নেই। আর হোটেলের ছাদটা অনেক সুন্দর। সুইমিংপুলও আছে। তাই আহি সন্ধ্যায় হোটেল ম্যানেজারকে দুই ঘন্টার জন্য ছাদটা খালি করতে বলেছিল। নোটিশ দেওয়ার পর আহিকে হোটেল বয় এসে জানিয়েছে ছাদ এখন খালি। আহিও তৈরী হয়ে বেরিয়ে এলো। পুষ্প তার ছবি উঠিয়ে দেবে। সে আবার ভালো ফটোগ্রাফার।

আহি রুম থেকে বেরুতেই কয়েক পা এগুতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ আপাদমস্তক আহিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি আফিফকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে তখনই আফিফ আহির পিছু এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালো। আহি তো রীতিমতো অবাক। আফিফ তার পথ আটকে দাঁড়াবে, এটা অকল্পনীয় ব্যাপার। আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ গম্ভীরমুখে বলল,
“এসব কি ড্রেস পরেছো?”

আহি উলটো প্রশ্ন করলো,
“আপনি আমার পথ আগলে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?”

“সেটা বিষয় না। তুমি কি এমন ড্রেস পরে বাইরে বের হচ্ছো?”

“আপনার কোনো সমস্যা?”

“না, আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি পদ্মের ফ্রেন্ড। তাই তোমার কথা ভেবে বলছি। কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

“ছাদে যাচ্ছি।”

“আমি তোমাকে আটকাবো না। আমার কোনো অধিকারও নেই। কিন্তু একটা কথা জানানোর আছে।
আমি সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছিলাম, দেখলাম ওখানে অনেক ধরণের ছেলে উঠেছে। তুমি এমন ড্রেস পরে উপরে উঠলে বাজে কমেন্টের মুখোমুখি হবে।”

আহি আফিফকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আপনার পদ্মফুল নই। আমাকে আমার মতো চলতে দিন। যেখানে অধিকার নেই, সেখানে উদ্বিগ্ন হওয়া মানায় না।”

আফিফ আহির পথ থেকে সরে দাঁড়ালো। আহি দুই সিঁড়ি উপরে উঠে পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানুষ কথার কথা বলে, বাবার হোটেলে ইচ্ছেমতো চলা যায়। তবে আমার ক্ষেত্রে এটা সত্য হয়েছে। বাবার হোটেল, তাই ইচ্ছেমতো সময়ে পুরো ছাদ নিজের জন্য রিসার্ভ করে নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাবে না। আপনার মিথ্যে উদ্বেগ এবার কিছুটা হলেও কমেছে নিশ্চয়।”

আহি কথাটি বলেই উপরে উঠে গেলো। আর আফিফ এখনো তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তো আহির ভালোর জন্য তাকে বারণ করেছিল। কিন্তু আহি তো ডুবে আছে অতীতে। যেই রাগটা ঝাড়ছে আফিফের উপর। আজ যদি পুষ্পের বর আহিকে আটকাতো, তাহলে আহি এভাবে কখনোই উত্তরটা দিতো না।

৫১।

দ্বিতীয় দিন সকালে সবাই একসাথেই নাস্তার টেবিলে এসে বসলো। সবাই গালগল্পে মশগুল। আহি আছে তার কল্পনার জগতে। সে কখনোই ভাবে নি আফিফের সাথে তার এমন দীর্ঘ সময় কাটবে। তাও আবার সেই দীর্ঘ সময় জুড়ে তাদের মাঝখানে থাকবে অদৃশ্য দেয়াল। সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে আহির।
রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে-মুখে মলিনতা। রাদ ফোন বের করো গতদিনের রিপোর্ট দিলো নায়ীবকে। লিখলো,
“ডক্টর, আহি সেই ছেলেটাকে দেখলে আগে অস্থির হয়ে যেতো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অস্থিরতাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। অনেকক্ষণ একসাথে তার মুখোমুখি বসেও আহি শান্ত আছে।”

নায়ীবের উত্তর এলো,
“তাদের একসাথে রাখো। তবে এর মধ্যে আহির ফ্রেন্ডটি যেন অবশ্যই থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দেখে আহি যতো ট্রিগার হবে, ততোই নিজেকে শক্ত করতে পারবে। নুইয়ে পড়তে দিও না। তুমিই কিন্তু ওর মানসিক শক্তি।”

এদিকে নাস্তা আসার পর পদ্ম আফিফকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলো। আহির চোখ দু’টি না চাইতেও যেন একটু পর পর পদ্ম আর আফিফের দিকেই যাচ্ছে। আফিফ পড়েছে এক মহা বিপাকে। সে পদ্মকে থামাতে চায়লে পুষ্প বলল,
“থাক ভাইয়া, বারণ করছেন কেন? আমরা আপনাদের ভালোবাসা দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আফটার অল, আমরাও খুব শীঘ্রই এমন রোমান্টিক ব্রেকফাস্ট করবো যার যার স্পেশাল মানুষের সাথে।”

পুষ্প গালে হাত দিয়ে পদ্ম আর আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“লজ্জা করে না এভাবে তাকিয়ে থাকতে?”

“ওহ, হ্যালো। তুমি আমাকে লজ্জা শেখাতে এসো না। মাংকি একটা!”

“আমি মাংকি?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে তুমি কোথাকার ঘটকী? তোমাকে দেখে তো শিম্পাঞ্জি পালিয়ে যাবে। একদম সজারুর কপি পেস্ট।”

পুষ্প রাগী স্বরে বলল, “আমি সজারু?”

“ওতোটাও না। একটা পার্থক্য আছে। সজারুর গায়ে কাঁটা। আর তোমার মুখে।”

“মানে!”

“মানে, তোমার মুখ নির্গত বানী যেন মধু নয়, এক একটা বিষাক্ত কাঁটা।”

পুষ্প চেয়ার ছেড়ে উঠে চেঁচিয়ে বলল,
“আমি এই বানরের পাশে বসবো না।”

“ওকে, তাহলে আমি তোমার মাথায় উঠে বসি। বানর কিন্তু ভালোই বেয়ে উঠে, বসতে জানে।”

আহি উঁচু গলায় বলল,
“চুপ করবি তোরা? বাচ্চা না-কি, হ্যাঁ? এসব ঝগড়া করার বিষয় না।”

পুষ্প চুপচাপ বসে পড়লো। খাওয়া শেষ হতেই পুষ্প চেয়ার ছেড়ে উঠে হাত ধোয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলো। এদিকে লাবীবও খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে বোতল নিয়ে মুখভর্তি পানি পুরে নিলো। তখনই পুষ্প ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সামনে পা বাড়াতেই লাবীবের সাথে ধাক্কা খেলো। আর সাথে সাথেই লাবীবের মুখের সব পানি বেরিয়ে পুষ্পের উপর ছিঁটকে পড়লো। পুষ্প থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। লাবীব দু’পা পিছিয়ে দৌঁড়ে ডায়নিং থেকে বের হয়ে গেলো। পুষ্প এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহি কয়েকটা টিস্যু এনে পুষ্পের দিকে এগিয়ে দিতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“লাবীবের বাচ্চা লাবীব, আমি তোকে গরম তেলে ফ্রাই করেই ক্ষান্ত হবো।”

আহি ধীর কন্ঠে বলল,
“ফ্রাই তো গরম তেলেই হয়। এতো এডভার্ব যোগ করছিস কেন?”

পুষ্প আহির কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে হনহন করে চলে গেলো।

(***)

নাস্তা সেরে হোটেল থেকে বেরিয়ে বিচের বালির উপর একা একা হাঁটছে আহি। তখনই পদ্ম তার হাত ধরে তার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলো। আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর দু’জনই চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। নীরবতা ভেঙে পদ্ম জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, রাদের সাথে কি তোর কোনো সম্পর্ক আছে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর এমন প্রশ্নের কারণ?”

“মনে হলো।”

“না, আমরা শুধুই বন্ধু। একই সাথে অনার্স করেছি। স্কুলেও তো ও আমাদের ক্লাসমেট ছিল।”

“হুম, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে প্রেম-টেম চলছে। তোর খেয়াল রাখে। মনে হয় তোকে ভালোবাসে।”

“আরেহ না। কি যে বলিস! বন্ধু হিসেবেই ভালোবাসে। বন্ধুরা তো খেয়াল রাখবেই। তবে রাদ একটু বেশিই ভালো। তাই এতো খেয়াল রাখে।”

“হয়তো ভালোবাসে, কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এমন কিছুই না।”

“তোদের দেখে মনে হয় না শুধু বন্ধু। কাল দেখলাম রাদকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলি।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“হয়তো আমরা চোখে যা দেখি, তা শুধুই আকাঙ্ক্ষা হয় না। কারো কাছে এই হৃদ স্পন্দন মানসিক শক্তি, ভরসার আশ্রয় আর কিছু বছর বেশি বেঁচে থাকার প্রেরণা।”

এবার পদ্ম বলল,
“আর যাই বলিস, আফিফের না এসব পছন্দ না। ছেলে বন্ধুর সাথে এতো জড়াজড়ি ভালো না।”

“কেন তোরা কি জড়াজড়ি ছাড়া প্রেম করেছিলি?”

“যাহ! কি বলছিস এসব? ভালোবাসার অর্থ এমন হয় না। আফিফ তো বিয়ের আগে আমার হাতটাও স্পর্শ করে নি।”

আহি পদ্মের কথা শুনে পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ খুব মনোযোগ দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। ছেলেটা এতো ভদ্র কেন সে বুঝতে পারে না। বেশি ভদ্র তাই হয়তো আহি এখনো তার মায়ায় বেঁধে আছে। আহি এবার পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাঝে মাঝে মানুষ মানসিক ভাবে দুর্বল থাকলে, পাশের জন ছেলে না-কি মেয়ে এই জ্ঞানটা থাকে না।”

(***)

দুপুরে রাদ আর আহি সাগর পাড়ে বসে পাল্লা দিয়ে চিংড়ি খাচ্ছে। আফিফ দূর থেকে আহিকে হাসতে দেখছে। রাদের সাথে থাকলে মেয়েটা হাসিখুশি থাকে। হাসলেই তো সুন্দর লাগে আহিকে। কিন্তু সেই হাসিটাই তো আফিফ কেঁড়ে নিয়েছিল। আফিফের মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে। যেখানে তাদের সম্পর্কই শুরু হয় নি, সেখানে আহি এখনো কেন তার স্মৃতিতে ডুবে আছে? তাকে এতো ভালোবাসার কারণ কি? আফিফ জানে না এসবের উত্তর। শুধু এতোটুকুই জানে, আহি কখনোই তার ভাগ্যে ছিল না।

বিকেলে তারা সবাই মিলে শপিং করতে গেলো। আফিফ পদ্মের জন্য তাঁতের শাড়ি দেখছে। আর পদ্ম ব্যস্ত কানের দুল দেখায়। আহি দূরে দাঁড়িয়ে আফিফকে দেখছে। রাদ আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আফিফ শাড়িটা কার জন্য দেখছে?”

আহি মৃদু হেসে বলল, “তার পদ্মফুলের জন্য।”

রাদ আহির উত্তর শুনে তার মুখের দিকে তাকালো। আহির চোখে মলিনতা। কিন্তু ঠোঁটে হাসি। রাদ এবার আহির হাতের দিকে তাকালো। না, আহির হাত কাঁপছে না। রাদের ইচ্ছে করছে এবার আফিফকে মিষ্টি খাওয়াতে। কারণ আহি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। দু’দিনেই এতোটা পরিবর্তন, ভাবা যায় না। কিন্তু পরিবর্তনটা আহির মাঝে লক্ষণীয়। যে কেউ এই পরিবর্তন বুঝবে না। শুধুই রাদই বুঝবে। কারণ সে আহিকে কাছ থেকে দেখেছে।

(***)

কেনাকাটা শেষে মার্কেট থেকে বের হতেই একটা ছেলে পদ্মের সামনে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটার অদ্ভুত চাহনি দেখে পদ্ম কয়েক পা সরে দাঁড়ালো। এদিকে লাবীব গাড়ি ঠিক কর‍তে এক পাশে চলে গেছে। আফিফ অন্যদিকে। রাদ আহি আর পুষ্পের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। তারা খেয়ালই করে নি পদ্ম পিছনে পড়েছিল। এদিকে পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে ছেলেটিকে বলল,
“আমার পথ ছাড়ুন।”

ছেলেটা বুকে হাত দিয়ে বলল,
“আহা, কি চমৎকার কন্ঠ! আরেকবার বলো না।”

আহি কি মনে করে পেছনে ফিরে তাকালো। দেখলো একটা ছেলে পদ্মের হাত ধরতে চায়ছে, আর পদ্ম বার-বার এপাশ-ওপাশ হয়ে সরে আসার চেষ্টা করছে। আহির এটা দেখেই রাগ উঠলো। সে পদ্মের কাছে এসে বলল,
“চল, পদ্ম।”

ছেলেটি বলে উঠলো,
“একটার সাথে আরেকটা ফ্রি।”

তার সাথে এবার আরো দু’টো ছেলে যোগ হয়েছে। রাদ তাদের দেখে সামনে এগিয়ে আসতে যাবে তার আগেই যেই ছেলেটি এতোক্ষণ পদ্মকে বিরক্ত করছিলো, আহি সশব্দে সেই ছেলেটির গালে চড় বসিয়ে দিলো। ছেলেটি রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকাতেই রাদ এসে আহিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। দূর থেকে আফিফ বিষয়টা খেয়াল করে তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হয়ে চলে এলো। আফিফ পদ্মের কাছে আসতেই পদ্ম আফিফকে ঝাপটে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ছেলেটা আমাকে বিরক্ত করছিলো।”

কথাটা শুনেই আফিফের মেজাজ বিগড়ে গেলো। কিন্তু তাকে কিছু কর‍তে হলো না। আহি রাদকে তার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে তার ব্যাগ দিয়েই ছেলেগুলোকে জোরে জোরে মারতে লাগলো আর বলতে লাগলো,
“চোখ দেখাচ্ছিস কাকে? নিজেরা করবি নষ্টামি, আর চোখও দেখাবি? মেরে হাড্ডি গুঁড়ো করে ফেলবো। তোদের মতো ছেলেদের রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পেটানো উচিত।”

রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য কেউ না বুঝলেও রাদ বুঝতে পারছে এই আঘাত আহির মনের আঘাত। আর ছেলেগুলো আহির কাছে তাজওয়ারের প্রতিরূপ। তাজওয়ারের উপর যতো ক্ষোভ জমে আছে, সেসব এই ছেলেগুলোর উপর ঝেড়ে তবেই আহি শান্ত হবে। আফিফ এবার রাদের কাছে এসে বলল,
“ওকে থামাও।”

রাদ বলল,
“মারুক না একটু। বল তো সব জায়গায় প্রয়োগ করা যায় না। যেখানে করা যায়, সেখানে করুক।”

আফিফ অবাক দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। রাদ আহিকে পেছন থেকে চেয়ার আপ করে বলতে লাগলো,
“মার আহি, আরো জোরে জোরে মার। পিঠে আরো কয়েকটা দে। তোর ব্যাগ ছিঁড়ে গেলে, আমি কিনে দেবো।”

মার খেতে খেতে দু’জন পালিয়ে গেছে। একজন রাস্তায় লুটোপুটি খাচ্ছে আর বলছে,
“আহ! বাপরে। মাফ করেন আপা আল্লাহর ওয়াস্তে।”

রাদ ছেলেটির আর্তনাদ শুনে বলল,
“আহা! আহা! কি শান্তি।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭(১ম ভাগ)||

৫২।
“আহি কি মারটাই না দিলি। আমার তো মনে হচ্ছিলো কোনো লাইভ অ্যাকশন সিন দেখছিলাম।”

পুষ্পের কথায় সায় দিয়ে লাবীব বলল,
“আহিকে দেখে মনে হচ্ছিল লো বাজেটের স্টান্ট হিরোইন।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“লো বাজেটের বলছিস? তোকে তো ফ্রীতেও নিবে না।”

পুষ্প লাবীবের দিকে আঙ্গুল তাক করে ব্যাঙ্গ করে হাসতে লাগলো। লাবীব মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তুমি এমন দাঁত দেখিয়ে হাসছো কেন?”

পুষ্প হাসতে হাসতে বলল,
“ফ্রী বাজেটের চা-ওয়ালা মামা।”

লাবীব মুখ ফুলিয়ে দ্রুতপায়ে সামনে চলে গেলো। এবার পদ্ম আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তোর এমন রূপ এই প্রথম দেখেছি। এতো রাগ তো তোর আগে ছিল না।”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহিও তার দিকে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো। আহি চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“প্রকৃতিই আমাকে এই রূপ দিয়েছে। আমিও গ্রহণ করে নিয়েছি। এখন থেকে এই রূপই আমার পরিচয় হবে। আবেগী আহিকে মেরে ফেলতে চাই আমি।”

শেষ কথাটি মিনমিনিয়েই বললো সে। তাই কেউ শুনতে পেলো না।

(***)

পুষ্প রাস্তার পাশে আইসক্রিমের দোকান দেখে লাফিয়ে সেদিকে চলে গেলো। বাকিরাও সেদিকে গেলো। রাদ বলল,
“কে কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম খাবি বল?”

পুষ্প বলল, “মালাই।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো, “বাচ্চাদের আইসক্রিম।”

“মালাই বাচ্চাদের আইসক্রিম? আচ্ছা! তো বড়দের আইসক্রিম কোনটা?”

“ভ্যানিলা!”

পুষ্প অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠল, “কাপের ভ্যানিলা?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আইসক্রিমে বড় ছোটদের ভাগ আছে না-কি! পছন্দে কোনো বয়স হয় না। আর মানুষের বয়স বাড়লেও তাদের মনের বয়স বাড়ে না। আমার তো চকোলেট আইসক্রিমই ভালো লাগে।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কী খাবেন?”

আফিফ বলল, “আগে তুমি নাও।”

“আপনি যেটা নিবেন।”

আফিফ দু’টো স্ট্রবেরি নিলো। রাদ এবার আহির দিকে তাকালো। আফিফের প্রিয় স্ট্রবেরি, তাই এতো বছর ধরে আহি যতোবারই আইসক্রিম খেয়েছে, স্ট্রবেরিই খেয়েছে। আজ প্রথম আহি চকোলেট আইসক্রিম নিলো। রাদ মনে মনে বলল,
“তুই আসলেই পাগল আহি। এতো বছর ধরে তুই নিজের পছন্দগুলো এমন একজনের জন্য দাবিয়ে রেখেছিস যে তোর কখনোই হবে না। নিজেকে এতোটা না হারালেও পারতি। যাক, পরিশেষে ভালোই হয়েছে। আজ আমি প্রথম আসল আহিকে দেখছি। এতোদিন তো সে মুখোশ পরে ছিল। আফিফের ভালোবাসার মুখোশ।”

সবাই গোল হয়ে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প কিছুক্ষণ পর পর লাবীবের দিকে তাকিয়ে হাসছে। লাবীব তো রাগে কিছু বলতেই পারছে না। তার ইচ্ছে করছে কাপটা পুষ্পের মুখে ঢুকিয়ে দিতে। পুষ্প নিজের আইসক্রিমে এক কামড় বসাতেই লাবীব পুষ্পের আইসক্রিমটা অর্ধেক কামড় বসিয়ে দিয়ে খেয়ে নিলো। পুষ্প হাঁ করে লাবীবের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবীব বসা থেকে উঠে বাঁকা হেসে চলে গেলো। পুষ্প মুখ ফুলিয়ে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ আরেকটা আইসক্রিম এনে দিতেই পুষ্প বলল,
“এমন একটা দুলাভাই লাগবে আমার! সো সুইট।”

রাদ চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি বললি তুই?”

পুষ্প তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ আহির কাছে এসে বসে বলল,
“এতো ভাবছিস কেন? বানিয়ে ফেল পুষ্পের সুইট দুলাভাই!”

“মজা করছিস?”

“যদি সিরিয়াস হই?”

“খান সাহেব এই মজাটা সিরিয়াসলি নিয়ে অনেক কিছুই কর‍তে পারে।”

“তাহলে আমি খান সাহেবের বিদায় হওয়ার অপেক্ষায় থাকি?”

আহি প্রতিত্তোরে হাসলো। আর আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে রইলো।

(***)

রাতে হোটেলের ছাদে বসে আছে সবাই। পুষ্প কোথা থেকে একটা কাচের বোতল নিয়ে এলো। লাবীব আর পুষ্প বুদ্ধি বের করেছে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলবে। তাদের ধারণা আহি আর রাদ নিজেদের মধ্যে অনেক কথা জমিয়ে রেখেছে। আজ তারা সব সত্য বের করবে এই খেলার মাধ্যমে।

লাবীব বোতলটা টেবিলের উপর রেখে বলল,
“আগে থেকেই সবাইকে শপথ নিতে হবে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কেমন শপথ?”

“যাহা বলিব সত্য বলিব, মিথ্যে বলিলে নিকটস্থ সময় অন্ধকার।”

“আচ্ছা! তুই কোন কালের জ্যোতিষী রে?”

পুষ্প বলল, “সত্য তো বলতেই হবে।”

আহি বলল, “যদি কেউ ডেয়ার নেয়?”

“ডেয়ার শুধু একবার। দু’বার করে চান্স হবে।”

পুষ্প মনে মনে বলল,
“প্রথম প্রশ্নেই তোদের মনের কথা বের করে ছাড়ছি।”

(***)

খেলা শুরু হয়ে গেলো। লাবীব বোতল ঘোরাতেই প্রথমে থামলো পদ্মের সামনে। পদ্ম মুখে হাত দিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। পুষ্প গালে হাত দিয়ে ভেবে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই আহি জিজ্ঞেস করলো,
“তোর বর কি তোর ছবি এঁকেছিল কখনো?”

আফিফ আর রাদ দু’জনই অবাক দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনাকে তো বিয়ের পর ছবিই আঁকতে দেখি নি।”

“তোদের তো প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের আগে ছবি আঁকে নি?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“উহুম। আমার ছবি আঁকে নি।”

আহি আনমনে হাসলো, আর ভাবলো,
“অন্তত তোমার তুলিতে আমিই প্রথম আর শেষ জায়গাটা নিতে পেরেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আর।”

দ্বিতীয়বার বোতল ঘোরাতে পুষ্পের দিকে পড়লো। পুষ্প কাঁধ ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“আমার এতো সিক্রেট-ফিক্রেট নেই। যতো কঠিন প্রশ্ন করবে এই পুষ্প সহজ ভাষায় ফটাফট উত্তর দিয়ে দেবে।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার উপর ক্রাশ খেয়েছো?”

পুষ্প তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “নো ওয়ে।”

আহি পুষ্পের উত্তরে মুখ চেপে হাসলো। রাদ এবার বোতল ঘোরাতেই আফিফের দিকে থামলো। পদ্ম এবার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি করি?”

পুষ্প বলল,
“তোর বর সম্পর্কে তুই তো সবই জানিস। আবার কি করবি? বরং আমরাই করি।”

“না আমার একটা প্রশ্ন আছে।”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কী প্রশ্ন?”

“ছবিটা কার?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কার ছবি?”

“যার জন্য আপনি প্রথম কবিতা লিখেছিলেন।”

আফিফ থম মেরে বসে রইলো। আহি কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বার-বার তার হাত ঘষছে। তার এমন আচরণ রাদেরও সুবিধের মনে হচ্ছে না। তার নীরবতায় যেন অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। পদ্ম এবার মুখ ফুলিয়ে বলল,
“সব সময় আপনি এই কথাটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আজ না হয় বলেই দিন, ছবিটা কার?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কিসের ছবি?”

পদ্ম বলল, “আফিফ একটা ছবি….”

আফিফ পদ্মকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“একটা খেয়ালের ছবি।”

পুষ্প অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“খেয়াল বলতে!”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“ভাবনা। যারা ছবি আঁকে, তারা অনেক কিছুই ভাবে। সেটাও আমার ভাবনা ছিল।”

পদ্ম বলল,
“মিথ্যে কথা বলা যাবে না কিন্তু।”

আফিফ পদ্মের দুই হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল,
“আমার প্রথম ভালোবাসা কে জিজ্ঞেস করো, আমার উত্তর হবে, পদ্মফুল।”

আফিফের কথাটা আহির বুকে তীরের মতো বিঁধলো। কি সহজেই বলে দিলো, তার প্রথম ভালোবাসা পদ্মফুল। আহির ঠোঁট কাঁপছে। রাদ শক্ত করে আহির হাত ধরলো। আহি পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে রাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তবে এই হাসির পেছনে রাদ দেখতে পেলো ভয়ংকর কষ্ট।

এবার বোতল ঘোরাতে আবার আফিফের কাছে এসে ঠেকলো। লাবীবের কচকচানি মনের প্রশ্নটা সে করেই ফেললো,
“কবিতাটি কি ছিল ভাইয়া?”

আফিফ এই প্রশ্নে যেন আরো চমকে উঠলো। আহির বন্ধুগুলো কি এক রাতেই তার অতীত রহস্য ভেদ করে ফেলতে চায়ছে না-কি। পুষ্প হাততালি দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, আমরা অপেক্ষায় আছি। কবিতাটা শুনতে চাই।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বলল,
“পরের বার যেন তোমাকে এই রূপেই দেখি,
প্রতিবারই তুমি আমার সামনে সেই রূপেই দাঁড়াবে- আমি জানি,
সাদা শাড়ি, আলতা রাঙা হাত,
চুলের ফাঁকে আমার প্রিয় অলকানন্দা ফুল গুঁজে,
আর আমি পথ সাজিয়ে রাখবো কৃষচূড়ায়,
মনে হবে আলতার ছাপ পড়ছে সেই পথের বুকে,
পরের বার যেন তোমাকে এই রূপেই দেখি।”

আহি স্তব্ধ হয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন মুহূর্তেই তার পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। আফিফ চোখ নামিয়ে রেখেছে। অন্তত এবার সে আহির দিকে চোখ তুলে তাকাতে চায় না। পদ্ম আজ যে সর্বনাশটা করে দিলো, তার ভোগান্তি যে আফিফকেই পোহাতে হবে। এদিকে রাদের মনে অজানা কৌতুহল জন্ম নিলো। যদি কবিতাটি পদ্মকে নিয়ে লেখা না হয়, তাহলে আফিফ কাকে নিয়ে এই কবিতা লিখেছে?

রাদ এবার বোতল ঘোরাতেই সবার মনোযোগ আবার সেদিকে গেলো। এবার বোতলটা লাবীবের দিকে এসে থামলো। পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
“কারো প্রেমে পড়েছো?”

লাবীব বলল, “হুম।”

“কে সে?”

“একটা প্রশ্ন, একটা উত্তর, শেষ।”

পুষ্প চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই দুইটা এতো সহজে বেঁচে যাবে, এটা মানা যায় না।”

পরের বার বিসমিল্লাহ বলে বোতল ঘোরাতে আবার পদ্মের দিকে এসে থামলো। পুষ্প বলল,
“তুই আমাদের তোর আর ভাইয়ার প্রেমের গল্প শুনাবি একটু পর। তার আগে এই দু’টার কাছে দুইটা প্রশ্ন করবোই করবো।”

আহি বলল,
“নো নো নো, টাইম ওভার। এখন আর খেলা হবে না।”

লাবীব রাদের কাঁধ চেপে ধরে বলল,
“রাদ, তোকে উত্তর দিতেই হবে। তোদের ভাগ্যেই পড়ে নি! এটা মানা যায় না। নয়তো আমাদের উপর অবিচার হবে।”

রাদ লাবীবকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, কি প্রশ্ন করবি কর।”

লাবীব আর পুষ্প একসাথেই প্রশ্ন করতে যাবে কিন্তু লাবীবই আগে প্রশ্নটা করে ফেললো,
“কাউকে ভালোবাসিস?”

পুষ্প লাবীবের হাতে চিমটি কেটে বলল,
“কাউকে ভালোবাসে এটা শুনে আমরা কি করবো? আহিকে ভালোবাসে কি-না জিজ্ঞেস করতে বলেছি। গাঁধা একটা।”

আহি মুখ চেপে হাসলো। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো তো একজনকে বাসিই। আর আহিকে কেমন ভালোবাসি, তা আর কেউ জানুক না জানুক আমি জানলেই হবে।”

পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসা হচ্ছে!”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আমরা ভালো ফ্রেন্ড, তাই না রাদ!”

রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে ভীতি। সত্যিই যদি রাদ তাকে ভালোবেসে ফেলে, তার জন্য সে এই মুহূর্তে প্রস্তুত নয়। রাদ জানে আগে আহির আফিফকে ভুলতে হবে। তারপর তাজওয়ারের কাছ থেকে মুক্তি পেতে হবে। আর এরপরই তো রাদ তার ভালোবাসার গল্পটা শুরু করবে। এতো ঝামেলার মধ্যে প্রেম হয় না। প্রেম হবে সুস্থ মনে, শান্ত পরিবেশে।

এবার পুষ্প আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছুই নেই। আমার জীবনটাই আমার কাছে রহস্য। তবে দুই লাইন গান শোনাতে পারি, যদি সবাই শুনতে চাস।”

সবাই সায় দিলো। আহি মনে মনে বলল,
“সেই সুযোগে এতো বছর পর আমি আবার তোমাকে আমার মনের কথাটা জানাতে চাই, এআর।”

আহি চোখ বন্ধ করলো, কন্ঠে ধরলো গান।

“আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে,
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
.
ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো,
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটা রে।
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির গান শেষ হতেই সবার মনোযোগ পদ্ম আর আফিফের দিকে গেলো। তাদের প্রেমের গল্পটা আহিও শুনতে চায়। আহি তো নিজের উন্মাদনা দেখেছে। আফিফ হয়তো দেখে নি। এবার সে পদ্মের উন্মাদনা দেখতে চায়। জানতে চায় কি এমন প্রেম হয়েছিল তাদের, যার নেশায় ডুবে আফিফ সেই বেনামি চিরকুটের মেয়েটাকেই ভুলে গিয়েছিল!

(***)

আফিফ আর পদ্মের দেখা হয়েছিল সিঁড়িতে। পদ্ম নামছিল নীল ওড়না মাথায় দিয়ে। এভাবেই তাদের প্রথম দেখা। চোখাচোখিতেই সমাপ্ত। দ্বিতীয় দেখা পাড়ার হিন্দু পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে। আফিফ ছাদে উঠেছিল। পদ্মও সেদিন ছাদে উঠেছিল বিয়ে দেখতে। আফিফকে দেখেই লজ্জায় নেমে পড়েছিল সে।
লাজুক মেয়েরা একটু বেশিই লক্ষী হয়। আফিফও তাই ভাবতো।
তৃতীয় বার তাদের দেখা হয়েছিল রাস্তায়। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন। আফিফ দেখলো পদ্ম রিকশা পাচ্ছে না। নিজের রিকশাটা ছেড়ে দিয়েছিলো পদ্মের জন্য। ব্যস, পদ্মের মনে সেদিনই আফিফ রাফাত তার স্বপ্নের পুরুষের জায়গাটা দখল করে নিয়েছিল।
এরপর পদ্ম প্রায়ই ছাদে চলে যেতো আফিফকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার জন্য। আফিফও তাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলতো। ভীষণ লজ্জা পেতো পদ্ম। আফিফ তা দেখে হাসতো।
ছাদে অলকানন্দা গাছ লাগিয়েছিল আফিফ। অজান্তেই পদ্ম সেই গাছে পানি দিতো। আফিফের গাছের যত্ন নিতো নীরবে নীরবে। আফিফ আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতো পদ্মের কান্ড। আর আনমনে হাসতো। তাদের কথাবার্তা শুরু হয়েছিলো এক শীতের সকালে। কনকনে শীতে শক্ত হয়ে বসে ছিল আফিফ। পদ্ম তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখেই নিজের শালটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “মন খারাপ?”

আফিফ বলল,
“না। ভাবছি কীভাবে মানুষ হওয়া যায়!”

“তো আপনি কি মানুষ নন?”

“এই সমাজে মানুষ তারাই যাদের অনেক টাকা। আর তাদেরই ভালোবাসার অধিকার আছে।”

“যদি বেকার মানুষের জীবনে ভালোবাসা আসে?”

আফিফ প্রতিত্তোরে হেসে বলল,
“বেকারদের জীবনে খেয়াল আসে। স্বপ্ন আসে৷ ভালোবাসা আসে না।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল,
“আমি আপনার ভালোবাসা হতে চাই।”

কিন্তু পদ্ম বলতে পারলো না। এভাবেই কেটে গেলো এক বছর। এই এক বছরে বেশ কথাবার্তা জমলো আফিফ আর পদ্মের। আফিফের মনে হলো পদ্ম প্রেমিকা হিসেবে মন্দ নয়। আর সে এতোটুকু বুঝে গেছে পদ্ম তার কাছে ভালোবাসি শব্দটা শোনার অপেক্ষায় আছে। আফিফও এক বছর পর মাকে এই ব্যাপারে জানালো। আফিফা বেগম অজানা কারণে বার-বার পদ্মকে মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না। আফিফ বেশ বুঝতে পেরেছিলো মায়ের অজানা কারণটা কি। কিন্তু সেই কারণটির কোনো ভিত্তিই নেই। শেষমেশ আফিফের ছোট বোন এসেই মাকে রাজি করিয়েছে। তারপর একদিন আফিফ ভোরে উঠেই পদ্মকে ছাদে আসতে বলল। পদ্ম ছাদে আসতেই আফিফ হাঁটু গেড়ে বসে অলকানন্দা ফুল এগিয়ে দিয়ে পদ্মকে বলল,
“তুমি কি আমার মনের পুকুরের পদ্মফুল হবে?”

পদ্ম এক সেকেন্ডও দেরী করলো না। ফুলটি নিয়েই বলল,
“হুম, অবশ্যই হবো।”

……………….

পদ্ম অতীতের ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো। তারপর মুচকি হেসে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটাই ছিল, আমাদের প্রেমের গল্প। ছোট্ট কিন্তু ভীষণ মিষ্টি।”

আহি উঠে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বলল,
“আর এরপর তুই এসে আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিলি, আর আমি বর্ষার রাতে তোর বিয়ে খেয়ে বাসায় ফিরলাম।”

আফিফ আহির কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি হেসে বলল,
“ভীষণ সুন্দর ছিল তোদের গল্পটা। আমার প্রেমের গল্পটাকেই হার মানিয়ে দিয়েছে।”

পদ্ম বলল, “তোরটা তো সাংঘাতিক ছিল।”

আহি মনে মনে বলল,
“অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো হয় না। যেমন আমার অতিরিক্ত ভালোবাসা হেরে গেছে তোর ছোট্ট আর মিষ্টি প্রেমের কাছে। আমার চিরকুটগুলো হারিয়ে গেছে তোর লাজুক হাসির কাছে। আমার প্রকাশিত অনুভূতিগুলো হেরে গেছে, তোর না বলা অনুভূতির কাছে। আমিই তো হেরে গেছি, আমার প্রেমিকের কাছে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭(২য় ভাগ)||

৫৩।
তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় ঘুরাঘুরি শেষে হোটেলে ফিরলো পুষ্প, লাবীব, রাদ আর আহি। গাড়ি থেকে নামতেই হঠাৎ পুষ্পের হাতটা গাড়ির কোণার সাথে লেগে কেটে গেলো। লাবীব পুষ্পের হাত থেকে রক্ত ঝরতে দেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পুষ্প লাবীবের এমন উৎকন্ঠা দেখে বলল,
“ওই মেয়েটা কি আমি?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন মেয়েটা?”

“যার প্রেমে পড়েছো!”

লাবীব কিছুক্ষণ পুষ্পের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পও যেন ঘোরের মাঝেই চলে যাচ্ছে। তখনই লাবীব হেসে বলল,
“তোমার প্রেমে পড়তে আমার বয়েই গেছে।”

পুষ্প লাবীবের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “ফাজিল ছেলে একটা।”

পুষ্প হনহনিয়ে হোটেলে ঢুকে পড়লো। লাবীব সেখানেই দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে হাসতে লাগলো। রাদ লাবীবের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আসলেই তো! মেয়েটা কে?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোর বউ!”

রাদ চোখ ছোট করে বলল,
“আমার বউ তোর বোনের মতো। সম্মান দিয়ে কথা বল।”

(***)

রাতে হোটেলের ছাদে উঠেই থমকে দাঁড়ালো আহি। আফিফ সুইমিংপুলের পাশে বেতের ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, আর পদ্ম তার বুকে মাথা রেখে কোলে বসে আছে। আফিফ খুব শক্ত করেই পদ্মকে জড়িয়ে ধরেছে। আর পদ্মের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। আহি এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন-মস্তিষ্ক জানে পদ্ম আর আফিফ স্বামী-স্ত্রী। তবুও সে কষ্ট পাচ্ছে। ঠিক তেমনি যেভাবে একজন স্ত্রী তার স্বামীর প্রতারণায় কষ্ট পায়, আর একজন প্রেমিকা তার প্রেমিকের ছলনায় কষ্ট পায়। কিন্তু আফিফ তো আহির কেউ হয় না। তাহলে এই কষ্টটার কি কোনো ভিত্তি আছে? এই কষ্টের কি কোনো সংজ্ঞা আছে? কেউ শুনলে আহির উপরই উপহাস করবে। কিন্তু আহিই জানে এই কষ্টটা কতোটা ভয়ংকর। বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে আহির। গলা কাঁপছে তার। হাতটাও ভীষণ কাঁপছে। আহি ধীর পায়ে পিছাতে লাগলো। সিঁড়ির কাছে আসতেই কেউ একজন তাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। আহি পেছন ফিরে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। রাদ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“উলটো দিকে ফিরে হাঁটছিস কেন?”

রাদ খেয়াল করলো আহির হাত কাঁপছে। আহি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। রাদ আহির দুই গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“আমি তোর পাশে আছি, আহি। কি হয়েছে বল?”

আহি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “আফিফ!”

রাদ আহিকে ছেড়ে ছাদের কাছে যেতেই একই দৃশ্য দেখতে পেলো। রাদ পেছন ফিরে আহির কাছে আসার আগেই আহি দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। রাদ আহির পেছন পেছন দৌঁড়ে এসেও তাকে ধরতে পারলো না। আহি তার আগেই নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। রাদ দরজায় ঠোঁকা দিয়ে বলল,
“উল্টাপাল্টা কিছু করবি না, আহি।”

আহি বুকে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো। তার সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। পদ্ম আফিফের চার বছরের সংসার। তাদের এতোটুকু ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের চোখে কেন দেখবে আহি? সে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো,
“আল্লাহ, তুমি আমাকে ওদের প্রেম কেন দেখালে? তুমি জানো না, মানুষটাকে আমি কারো সাথেই ভাবতে পারি না! আমি জানি তারা একসাথেই আছে। পদ্ম রোজ হয়তো আফিফের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়, রোজ হয়তো তারা কাছাকাছি আসে, রোজ হয়তো আফিফ তার অধর ছোঁয়ায় পদ্মের গালে। কিন্তু এসব আমার কাছে শুধুই হয়তো। কোনোটাই বাস্তব ছিল না। তাহলে আমি কেন দেখবো এসব? আমাকে কেন দেখাচ্ছো? আমার তো সহ্য হচ্ছে না। আমি কল্পনা করতে পারবো না এসব। যতোক্ষণ কেউ কিছু নিজের চোখে না দেখবে, ততোক্ষণ বিশ্বাস না করেও থাকা যায়। কিন্তু এখন এই দৃশ্য আমার চোখের সামনে বার-বার ভাসবে, কারণ আমি দেখে ফেলেছি। আমি কীভাবে এই দৃশ্য আমার মন থেকে মুছে ফেলবো? আমার ভালোবাসার মানুষ আমার সামনে অন্যের হৃদয়ে হারিয়ে গেছে। আর আমার হৃদয়টা খালি করে দিয়েছে।”

আহি দেয়াল ধরে মেঝেতে বসে পড়লো। রাদ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো আহি কান্না করছে। রাদ ভেবেছিল আহি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখে গেছে। কিন্তু এখনো যে তার আফিফ আসক্তি কাটেনি। রাদ তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোন বের করে ডাক্তার নায়ীবের নম্বরে কল করলো। কয়েকবার রিং হতেই নায়ীব কলটা রিসিভ করলো। রাদ ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“ডক্টর নায়ীব, আহির আবার প্যানিক এ্যাটাক এসেছে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।”

নায়ীব জিজ্ঞেস করলো, “কিছু কি হয়েছিল?”

রাদ নায়ীবকে জানালো আহি কি দেখে এমন করছে। নায়ীব সব শুনে বলল,
“রিল্যাক্স রাদ। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। আহির মস্তিষ্কে দু’জন অলকানন্দ। প্রথমজন যাকে আহি খুব ভালোবাসে। দ্বিতীয়জন যে আহিকে ভালোবাসে। প্রথম জনই হল বাস্তব। দ্বিতীয়জন আহির কল্পনা। বাস্তব আর কল্পনা মিশে যাওয়ায় আহি যখন অলকানন্দকে বাস্তবে দেখে সে স্বাভাবিক থাকে না৷ তোমাকে দুইটা উদাহরণ দেই। ধরো, তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসো। ধরো মেয়েটা আহি। আহির সাথে তোমার কাটানো মুহূর্তগুলো বা তুমি আহির জন্য যা করেছো সবকিছুই তোমার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। অন্য আরেকজন ছেলে, ধরো তার নাম এক্স। সে আহিকে সেভাবেই ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের দু’জনের ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। তুমি ভালোবাসায় ডুবে গেছো। ওটাকেই তুমি তোমার লক্ষ্য ধরে নিয়েছো। আর এক্স নামের ছেলেটা বাস্তবতা মেনে নিতে জানে। এমন পরিস্থিতি দু’জনের ভালোবাসাকে শুরুতে ভালোবাসা বলা যায়। কিন্তু শেষে এসে তোমার বাস্তবতা মেনে না নেওয়াটা হয়ে দাঁড়াবে রোগ। যেমনটা আহির হয়েছে। সে আফিফকে হারিয়ে ফেলার ধাক্কাটা নিতে পারে নি। কারণ ওর জীবনের যেই ট্রাজেডি সম্পর্কে জেনেছি, এমন হওয়াটা একদম স্বাভাবিক। আহির বাবা-মার সম্পর্কে ভালোবাসা ছিল না, কিন্তু তারপরও আহি নিজেই একটা ছেলেকে ভালোবেসেছে। আর ওর মস্তিষ্ক চেয়েছে ছেলেটা যাতে তাকে সেভাবেই ভালোবাসে, যেই ভালোবাসা সে তার বাবা-মার মধ্যে দেখে নি। তাই সেই বয়সে প্রেমটাই আহির লক্ষ্য হয়ে গেছে, যার রেশ এখনো কাটে নি। আর শেষমেশ সে যখন ছেলেটাকে হারিয়ে ফেললো, তখন তার মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া সেই অনুভূতিটা তার বেঁচে থাকার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। আর এজন্যই সে তার চারপাশে ছেলেটিকে কল্পনা করা শুরু করলো। ছেলেটির পছন্দে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো, যাতে কাল্পনিক মানুষটি তার উপর সন্তুষ্ট হয়। আর সে যাতে আহিকে ছেড়ে না যায়। আহি জানে ছেলেটা বিবাহিত, তাই একটা সীমার মধ্যে সে ছেলেটাকে কল্পনা করতো, একা একা গল্প করতো, ছেলেটার জন্য নিজেকে সাজাতো। একটা পড়া বার-বার পড়তে পড়তে যেমন মুখস্থ হয়ে যায়, এই এক্সপেরিমেন্টটাও আহির মস্তিষ্কে এই সত্যটা গেঁথে দেওয়ার জন্যই করতে বলেছি। আর আহিকে বোঝানোর জন্য যে তার কাল্পনিক পুরুষটির কোনো অস্তিত্বই বর্তমানে নেই। যাকে সে ভালোবাসতো, সে তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আজ এই ঘটনার পর আহির কাল্পনিক পুরুষটি সেই রূপেই আহির কল্পনায় আসবে, যেভাবে আজ তাকে দেখেছিল। আর সেটা আহি সহ্য করতে পারবে না। আমরা সেই জিনিসই কল্পনা করি, যেটা আমাদের মনকে সন্তুষ্ট করে। অসন্তুষ্ট করার মতো কিছুই আমাদের কল্পনায় জায়গা পায় না। আজ যদি আহি তার কাল্পনিক পুরুষের মুখোমুখি হতে পারে, পরের বার আহির আর হ্যালুসিনেশন হবে না। আর এরপরই আমি ওষুধ লিখে দিতে পারবো।”

রাদ নিজের রুমে গিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। আহি রুম বন্ধ করে কি করছে সে জানে না। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। এখন আর ঘুম হবে না রাদের।

(***)

আহি মেঝেতে শুয়ে আছে। মেঝেতে হাত হাতড়াতে হাতড়াতে আহি বলতে লাগলো,
“তুমি অন্তত আমার কল্পনায় আমাকে ভালোবেসো, আফিফ। আমি জানি, তুমি কাউকে স্পর্শ করো নি।”

আহি মেঝে থেকে উঠে ব্যাগ ঘেঁটে সাদা শাড়িটা বের করে পরা শুরু করলো। এলোমেলো ভাবে শাড়িটা গায়ে জড়ালো আহি। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“আফিফ, প্লিজ লাভ মি, প্লিজ।”

আহি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে আফিফ দাঁড়ানো। আর আফিফের হাতের মুঠোয় পদ্মের হাত। আহি হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে অন্তত কল্পনায় ভালোবেসো।”

আফিফের উত্তর এলো,
“আমি তো শুধু আমার পদ্মফুলকেই ভালোবাসি।”

আহি বুকে হাত রেখে বলল,
“আমি তোমাকে ভুলতে পারছি না, আফিফ।”

আহির কানের কাছে বার-বার একটা বাক্য এসেই ধাক্কা খাচ্ছে,
“আমি পদ্মফুলকে ভালোবাসি।”

আহির নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে সত্যটা মিটিয়ে ফেলতে। সে রাদকে ডাকার জন্য রুমের দরজা খুলে বের হতেই পদ্মের সাথে ধাক্কা খেলো। পদ্ম আর আফিফ ছাদ থেকে নেমে নিজেদের রুমে ঢুকছিল। আফিফ আর পদ্ম আহিকে এমন অবস্থায় দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, কি হয়েছে তোর? তোর এই অবস্থা কেন?”

পদ্মের কন্ঠ শুনে রাদ তড়িৎ গতিতে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আর আহিকে দেখেই সে দৌঁড়ে এলো। আহি আফিফের দিকে ভালোভাবে তাকাতেই পারছে না। আফিফ তাকে এমন অবস্থায় দেখে ফেললো কেন, এটাই ভাবছে সে। আরো অস্থির লাগছে তার। নিজেকে সামলাতে না পেরে শরীরের ভার ছেড়ে দেওয়ার আগেই রাদ এসে জড়িয়ে ধরলো আহিকে। রাদকে দেখে আহির কি হলো সে নিজেও জানে না। সেও রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আহি, তোর কি হয়েছে?”

আহি রাদকে বলল,
“আমাকে আজ তোর সাথে রাখবি, রাদ? আমি মরে যাচ্ছি।”

আফিফ বলল, “কি হয়েছে ওর?”

রাদ রাগী দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। রাদের চাহনি দেখে আফিফ আর একটা বাক্যও উচ্চারণ করার সাহস পেলো না। পদ্মও যেন বেশ অবাক হলো। রাদ আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। আহি রাদের কোলে মাথা রেখে বলল,
“ও আমাকে কেন ভালোবাসে না?”

রাদ আহির মুখটা উপরে উঠিয়ে বলল,
“আমি ভালোবাসি তোকে।”

“আমার সাথে এমন কেন হলো রাদ?”

“ভুলে যা না এসব!”

“ও আমার মনটা ভেঙে দিয়েছে। আমি কার কাছে অভিযোগ করবো? এমন একজনের কাছে যে নিজেই জানে না সে আমার মন ভেঙে দিয়েছে! আমি পাগল হয়ে গেছি, রাদ। ও আমাকে কাঁদতে দেখে ফেলেছে। এই শাড়িটা পরে রুম থেকে বের হয়েছি। ও সব দেখে ফেলেছে। আফিফ জেনে গেছে আমি ওর জন্য কান্না করছি।”

“আহি, ও বুঝবে না এসব। বুঝলে তোকে আজ কাঁদতে হতো না। ও তোকে কখনো বুঝে নি। আফিফ আর পদ্ম এখন এমন এক সম্পর্কে আছে, যেখানে তুই ভিত্তিহীন। যদি বিয়ে না হতো, আমি আফিফকে ধরে বেঁধে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম। এখন কি করবি বল? আমি কি করবো তোর জন্য বল?”

রাদের চোখে অশ্রু টলমল করছে। আহি চোখের পানি মুছে রাদের দিকে তাকালো। রাদ নিজের চোখ মুছে আহির মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তুই কাঁদছিস কেন?”

“তুই আমার সামনে কষ্ট পাবি, আর আমি হাসবো?”

“তুই আমাকে খুব বুঝিস, রাদ।”

“তুইও আমাকে বুঝে দেখ। দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালোবাসা একবার হয় না। বার-বার হয়। তুই শুধু ভালোবাসাকে তোর জীবনে আসতে দে। মনটাকে এক পুরুষে আবদ্ধ করিস না। যদি পুরুষটা তোর হতো তাহলে বিশ্বাস কর, এই মিথ্যে ভালোবাসার শহরে মানুষটা চরম ভাগ্যবান হতো। সে এখন নিজের হাতে ভাগ্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাহলে ক্ষতিটা তার হয়েছে। তোর এই ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার তার নেই। যার অধিকার, তাকে দে।”

“কার অধিকার?”

রাদ আহির চোখ ভালোভাবে মুছে দিয়ে বলল,
“যেদিন বুঝবি, সেদিন দিস। আশেপাশে তাকিয়ে দেখ। ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। শুধু কষ্ট করে খুঁজে নিতে হয়। এখন আমি তোকে ভালোবাসার মানুষ খুঁজে দিতে পারবো না। তবে আমি তোকে ততোদিন ভালোবাসা দেবো, যতোদিন সেই মানুষটাকে তুই খুঁজে না পাবি। যেদিন পাবি আমাদের সম্পর্কে সংযোজন বিয়োজন তো ঘটবেই।”

“কেমন সংযোজন বিয়োজন?”

“এই যে বন্ধুত্বে ভাটা আসবে। তুই নতুন প্রেমিককে সময় দিলে, আমি আর কোথায়!”

আহি হালকা হেসে রাদের হাতে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,
“যাহ পাগল, আমার বন্ধুকে আমি কখনো ভুলবো না।”

রাদ মনে মনে বলল,
“ভুলবি আর কীভাবে? একবার আমার প্রেমে পড়িস। আমার নামটা তুই কখনোই ভুলবি না। দ্বিতীয় কোনো ছেলের নামও আর তোর মনে পড়বে না। তোর মন জুড়ে শুধু আমিই থাকবো। তোকে কাঁদতেও হবে না। কারণ আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

(***)

রাতে আফিফ ঘুমাতে পারলো না। পদ্মও অনেকক্ষণ জেগে ছিল। আহির এমন অবস্থা অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে তাদের মনে। আফিফ নিজেও আহিকে সেই অবস্থায় দেখে অনেকটা অপ্রস্তুত ছিল। আহির চোখ ভর্তি জল। কাজল লেপ্টে গিয়েছিল। শাড়িটাও এলোমেলো। আফিফ তো খারাপ কিছু ভেবে রুমে একবার উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু ভেতরে কেউ ছিল না। তাহলে আহির এই অবস্থার জন্য কে দায়ী?
আফিফ এবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সমুদ্রের ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। বারান্দা থেকেই এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। শীতল হাওয়া শরীর স্পর্শ করে দিয়ে যাচ্ছে তার। আফিফ সেই স্পর্শে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অতীতের সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো, যেদিন এক অপরিচিতা তার জীবনে এসেছিল একটা ছবি নিয়ে। কখনো কেউ তার ছবি আঁকে নি। সেদিন এঁকেছিল এক অদেখা অস্তিত্ব। চিরকুট দিয়েছিল সাথে। আফিফ সেই চিরকুটটি পড়েই সেদিন খুঁজেছিল সেই অস্তিত্বটিকে। কিন্তু পায় নি। পেলেও বা কি হতো? ছুঁয়ে দেখা তো কখনোই সম্ভব না। জীবনের সব সম্ভাবনা যে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিল সে। জীবনটা তার হলেও ইচ্ছে পূরণের অনুমতি তার নেই। না, আর কিছু ভাবতে চায় না আফিফ। সেই ভয়ংকর দিনগুলো সে অতীতের পাতায় ফেলে এসেছে। এদের বর্তমানে জায়গা দিতে চায় না সে। তার বর্তমান জুড়ে পদ্মফুলই থাকুক।

৫৪।

পরদিন পুরো সকাল আহি ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। পদ্ম আফিফকে বলেছিল রাদের কাছ থেকে জেনে নিতে কি হয়েছিল রাতে। কিন্তু রাদ আফিফের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলছে। রাদের হাবভাব দেখে আফিফ আর তার সাথে কথা বলার সাহস পায় নি। শেষমেশ পদ্ম নিজেই রাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আহি সম্পর্কে। রাদ সংক্ষেপে জানালো, বাসায় সমস্যা হয়েছে তাই মন খারাপ ছিল। তার এই যুক্তি ফেলে দেওয়া যায় না। কারণ সবাই জানে আহির পারিবারিক জটিলতার কথা। সৎ মায়ের সংসারে কেই বা আর ভালো থাকে। পদ্ম আহিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য যেতে চায়লে রাদ দৃঢ়ভাবেই জানিয়ে দিলো, রাতের বিষয় নিয়ে যাতে আর কোনো কথা না তুলে। পদ্মও তাই আর কোনো প্রশ্ন করে নি৷

বিকেলে আহি ঘুম থেকে উঠেই খাওয়া-দাওয়া সেরে একা একা বীচে ঘুরে এলো। এদিকে পুষ্প আর লাবীব ঝর্ণায় যাওয়ার জন্য অস্থির। আজ হিমছড়ি যেতে হবেই তাদের। তারা দু’জনই প্রস্তুত। অন্যদিকে রাদ আহির জন্য না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। আফিফ আর পদ্মও তাই তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু আহি হঠাৎ বীচ থেকে ঘুরে এসেই বলল,
“চল ঘুরতে যাই। আর রাতে পার্টি দিবো।”

সবাই আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি বলল,
“ডান্স পার্টি হবো। যাদের নাচতে মন চাইবে নাচবে। আর যাদের খেতে মন চাইবে খাবে।”

পুষ্প বলল, “আমি তো খাবো।”

“আমি ম্যানেজারকে ফোন করে জানাচ্ছি, রাতের খাবারে যাতে সব ধরণের আইটেম থাকে।”

লাবীব এক গাল হেসে বলল,
“আহি লটারি জিতেছিস না-কি! এতো খুশি কেন?”

আহি হেসে বলল, “ভালো ঘুম হয়েছে তাই।”

কথাটি বলেই আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। আফিফ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হলো এটা? তাকে দেখেই এমন করলো কেন? আফিফ এবার আঁড়চোখে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম পুষ্পের সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। আফিফ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভাগ্যিস পদ্ম দেখে নি।

(***)

আহি তৈরী হয়ে আসতেই সবাই মিলে হিমছড়ি গেলো। সেখানে অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি শেষে পুষ্প পদ্মকে টেনে নিয়ে গেলো রাস্তার উল্টো দিকে। হিমছড়ির রাস্তায় সমুদ্রতীরে মানুষ তেমন একটা থাকে না। অন্যান্য জায়গায় বেশ মানুষজন। তাই ভিডিও বা ছবিতে মানুষের ছবি চলে আসে। বীচ খালি দেখে পুষ্প পদ্মকে নিয়ে সেখানে চলে গেলো। তাদের সাথে লাবীবও গেলো। আফিফ রাস্তার পাশে পাথরের উপর বসে ছিল। অন্যদিকে রাদ আর আহি ঝর্ণার পাশে বসে আছে। দু’জনই ব্যস্ত গল্প করতে। এই বিষয়, সেই বিষয়ের কথা বলতে বলতেই হঠাৎ রাদের ফোনে কল এলো। রাদের মা কল দিয়েছে। ঝর্ণার আশেপাশে কোলাহল বেশি হওয়ায় রাদ আহিকে বসিয়ে একপাশে চলে গেলো। রাদ চলে যেতেই আহি কয়েক সিঁড়ি উঠে ঝর্ণার কাছে যেতে লাগলো। কিন্তু পাথরগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে। একটা পাথরের উপর পা রাখতে গিয়েই হঠাৎ আহি পা পিছলে নীচে পড়ে গেলো।

(***)

আফিফ দোকানে পানির বোতল কিনতে এসে খেয়াল করলো ঝর্ণার পাশে ভীড় জমে আছে। আফিফ সেদিকে গিয়েই দেখলো আহি নিচে পড়ে আছে। আফিফ ব্যস্ত হয়ে আহির কাছে যেতেই দেখলো আহি ব্যথায় কাতরাচ্ছে। আফিফ জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে তোমার? হাত তো ছিঁড়ে গেছে! আহি, কি হয়েছে?”

পাশের একটা মেয়ে বলল,
“উপরে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে।”

আফিফ শাসনের সুরে বলল,
“বাচ্চা স্বভাব যাবে কখন তোমার?”

আহি আফিফের কথা শুনে তার দিকে তাকালো। এরপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “রাদ কোথায়!”

আফিফ আহিকে টেনে তুলতে যাবে কিন্তু আহি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না। তাই সে আহিকে বসিয়ে রাদকে খুঁজতে গেলো। কিন্তু আশেপাশে কোথাও রাদকে না দেখে আবার আহির কাছে ফিরলো। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার পায়ে ভীষণ ব্যথা করছে। হাঁটুতে নিশ্চিত কিছু হয়েছে।”

জিন্স পরা ছিল বিধায় হাঁটুতে কি হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে হাঁটুর দিকে জিন্সের অংশটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে হাঁটুর মাংস খানিকাংশ হলেও ছিঁড়ে গেছে। আফিফ আরেকবার এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে রাদকে খুঁজে পায় কি-না দেখে নিলো। এরপর আর কোথাও তাকে না দেখে নিজেই আহিকে কোলে তুলে নিলো।

রাস্তার মোড়ে এসে আফিফ একটা গাড়ি ঠিক করে আহিকে সেখানে বসালো। পদ্ম, পুষ্প আর লাবীবকে রাস্তা থেকেই দেখছে আফিফ। কিন্তু তারা বেশ দূরেই আছে। জোরে ডাকলেও শুনবে না। হাতের ইশারা করার পরও তাদের পালটা উত্তর এলো না। তার মানে তারা আফিফকে দেখেই নি। আফিফ পদ্মকে ফোন করতে গিয়ে দেখলো, পদ্মের ফোন তার কাছেই। বাকি কারো নম্বর আফিফের কাছে ছিলো না। সে এবার গাড়ির কাছে এসে আহিকে বলল,
“কাউকে ফোন করো।”

আহি ফোন বের করে রাদকে কল করলো। দেখলো রাদের নম্বর ব্যস্ত। আহি বিড়বিড় করে বলল,
“জন্মের সব কথা আজই তোকে বলতে হচ্ছে!”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি চোখ ছোট করে বলল,
“আপনাকে বলছি না।”

আহি এবার পুষ্পকে কল করলো। কিন্তু পুষ্প সাথে সাথেই কল কেটে দিলো। আহি রাগী স্বরে বলল,
“ছবি তোলার জন্য আমার কল কেটে দিচ্ছে! দাঁড়া, আজ তোকে দিয়ে হোটেলের সবগুলো বাসন পরিষ্কার করাবো আমি।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, আশেপাশের কোনো হাসপাতালে নিতে যেতে। এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি অন্তত মেসেজ করে বলো, নয়তো সবাই চিন্তা করবে।”

আহি সাথে সাথেই রাদকে মেসেজ করে দিলো। তারপর সিটে হেলান দিয়ে বসলো। আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ব্যথা করছে এখনো?”

আহি শীতল কণ্ঠে বলল,
“কিছু ব্যথা সহজে পিছু ছাড়ে না।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি এটাই করতাম।”

আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এসব সিনেমার কমন ডায়লগগুলো আমার একদম পছন্দ না।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ?”

“জ্বি হ্যাঁ। রাস্তায় এখন অন্য কোনো মেয়ের পা ভেঙে গেলে, আপনি বউ ফেলে কখনোই আসতেন না। আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন, কারণ আমি আপনার বউয়ের ফ্রেন্ড।”

আহি এবার ব্যাঙ্গ করে বলল,
“যে কেউ থাকলে আমি এমনই করতাম।”

আফিফ চোখ ছোট করে আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আপনার ভুল ধরিয়ে দিয়েছি। আমি আপনার পরিচিত তাই আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার জায়গায় পুষ্প থাকলেও আপনি এমন করতেন। কিন্তু যে কেউ না।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি বিড়বিড় করে বলল,
“এমন ভাবে বোঝাচ্ছে, যেন আমি অন্য কিছু মনে করছি।”

আফিফ বলল, “ঠিক এজন্যই বোঝাচ্ছি।”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“আপনি আমার কথা শুনছিলেন?”

“জোরে জোরে কথা বললে কি কানে আসবে না? আমি তো আর বধির না।”

“ওহ হ্যাঁ, আপনি তো অন্ধ। কিন্তু বধির না।”

দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আফিফ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,
“আর কতোক্ষণ লাগবে?”

ড্রাইভার জানালো প্রায় দশ মিনিট লাগবে। এবার আফিফ নিজেও গাড়িতে হেলান দিয়ে বসলো। এদিকে রাদের কল এলো আহির ফোনে। আহি রাদকে বলল, আফিফ তাকে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পাশটা যে কোন পাশ সে নিজেও জানে না। এখনো সেই পাশের হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে নি তারা। আহির কথা শুনে ড্রাইভার লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে একনজর আহিকে দেখে নিলো। আফিফ সেটা খেয়াল করে বলল,
“গাড়িতে বসে এতো কথা বলা ঠিক না!”

আহি চোখ ছোট করে বলল,
“আমার মুখ আমি বলবো।”

আফিফ এবার গুগল ম্যাপ অন করলো। না জানি কোথায় নিয়ে যায় এই ড্রাইভার। এরইমধ্যে পদ্মের কল এলো একটা অপরিচিত নম্বর থেকে। পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আপনি আহিকে একা ছাড়বেন না, প্লিজ। ওর পাশেই থাকবেন কিন্তু।”

আফিফ পদ্মকে আশ্বস্ত করে কল রাখলো। আফিফ আর আহি এবার দু’জনই একে অপরের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“এতোক্ষণ এদের খবর নেই, এখন মরে যাচ্ছে!”

আফিফ মৃদু হেসে বলল,
“পরের বার যে-কোনো অবস্থায় কল রিসিভ করবে। এই ভুল আর করবে না।”

“আমাদের উচিত ছিল ফোন বন্ধ করে তাদের শাস্তি দেওয়া। স্পেশালি পুষ্পের কল তো আমি এই বছর আর রিসিভই করবো না।”

আহি এবার পদ্মের ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্ম ভুলেও আর আপনাকে ফোন দিয়ে কোথাও যাবে না। ফোনটা কেন রেখেছে ও? বরের হাতে রাখার জন্য? আদর্শ বিবি একটা!”

“হুম।”

আফিফের হুম শুনে আহি ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। আহির চাহনি দেখে আফিফ নিজেও ভ্রূ কুঁচকালো। মেয়েটা যে কখন কোন চাহনিতে তাকে খুন করে ফেলে বলা যায় না। আফিফ একটু সরে বসলো। আহি আফিফের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে নিজেও গাড়ির একপাশে চলে গেলো। আফিফ তা দেখে কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আহি এবার বলল,
“আমার আপনাকে ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু ঘটনা তো উলটো হচ্ছে। আপনিই আমাকে ভয় পাচ্ছেন।”

চলবে-