উধয়রনী পর্ব-২৬ + বোনাস পর্ব + ২৭

0
101

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৬||

৪৮।
জীবনের পাতা উল্টাতেই কেটে গেলো তিন সপ্তাহ। এরইমধ্যে প্রকৃতি ছেয়ে গেছে স্নিগ্ধ শীতল গন্ধবহে। শিউলিতলা ভরে গেছে শুভ্র পুষ্প মালায়। পথে পথে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কাশফুল। আর শুভ্র মেঘের ফাঁকে নীল আকাশের পানে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক ভাবুক মন।
আজ আহিদের পরীক্ষা শেষ। সে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখলো রাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি সন্তপর্ণে রাদের কাছে এসে তাকে ভয় দেখানোর জন্য জোরে বলে উঠলো, “ভাউ।”

রাদ বাঁকা চোখে আহির দিকে তাকালো। আহি মুখ ফুলিয়ে বলল, “একটু ভয় পাবি না?”

“তোর কি মনে হয় আমার হার্ট দুর্বল?”

আহি মুখ বাঁকালো। পরক্ষণেই ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আমরা তাহলে এই সপ্তাহে ট্যুরে যাচ্ছি।”

রাদ মাথা নাড়তেই তার সামনে আফিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আহির মনোযোগ সেদিকে না যাওয়ার জন্য রাদ আহির হাত ধরে তাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ঠিক করে আহিকে নিয়ে উঠে পড়লো। আহি বলল,
“এতো হুড়োহুড়ি করছিস কেন?”

“তোকে নিয়ে ভেলপুরি খেতে যাবো।”

আহি রাদের গাল টেনে দিয়ে বলল, “সো সুইট মাই ফ্রেন্ড।”

এদিকে আফিফ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

(***)

আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো আহি। ছোট একটা কালো টিপ পরলো কপালে। ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা একটা অলকানন্দা ফুল চুলের সাথে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিলো সে। এরপর ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ বক্সে ডাক্তার নায়ীবের শেষ মেসেজটির দিকে তাকালো। যেখানে লেখা আছে,
“আজ তুমি সেভাবেই নিজেকে সাজাবে, যেভাবে এতোদিন তুমি অলকানন্দের জন্য নিজেকে সাজাতে চেয়েছিল। আজ কোনো বাঁধা নেই। আজই যেন অলকানন্দের জন্য তোমার নিজেকে শেষ সাজানো হয়। এরপর আর কখনোই তুমি নিজেকে তার জন্য সাজাবে না।”

আহি মেসেজটি পড়ে আবার আয়নার দিকে তাকালো। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। সাদা শাড়ি পরেছে সে। আহি আজ ঠিক সেভাবেই সেজেছে যেভাবে এক্সিভিশনের আগে আফিফের ছবির জন্য নিজেকে সাজিয়েছিলো। আলতা রাঙা হাতটি আয়নার সামনে এনে রাখলো আহি। হঠাৎ তার কানের কাছে ফিসফিস করে সেই পরিচিত কন্ঠস্বর বলে উঠলো,
“অলকানন্দা, ভীষণ সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

আহি মিষ্টি হেসে বলল, “তোমার পদ্মফুল থেকেও?”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। আহি এবার পাশ ফিরে দেখলো কেউ নেই। আহির চোখ ভিজে গেলো। সে বুকে হাত রেখে বলল,
“আমি এই এক সপ্তাহ তোমাকে তোমার পদ্মফুলের সাথে কীভাবে দেখবো, আফিফ? এখনই ভাবতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ডাক্তার নায়ীব কেন এমন এক্সপেরিমেন্ট করতে বলেছে জানি না। কিন্তু তোমাকে আমার ভুলতে হবেই। নয়তো আমি পাগল হয়ে যাবো।”

আহি ব্যাগ নিয়ে বাসের জন্য স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। এখানেই সবাই আসবে। আহি রাদকে ফোন দিতেই দেখলো একটা রিকশা স্টেশনের সামনে এসে থেমেছে। এদিকে রাদ ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে জানালো, রাস্তায় জ্যাম, তাই দেরী হচ্ছে। রাদের সাথে কথা বলে আহি তার ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো, যেই রিকশাটা থেমেছিল, সেটাতে আফিফ আর পদ্ম। আফিফ রিকশা থেকে নেমেই তাদের ব্যাগটাও নামালো। এরপর মানিব্যাগ বের করতেই তার চোখ পড়লো আহির দিকে। আহিকে দেখে সেকেন্ড খানিকের জন্য আফিফ থমকে গেলো। আহিও আফিফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আহির মনে পড়লো ডাক্তার নায়ীবের সেই কথাটি,
“তুমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেই পদ্মের জীবনে ঝড় নেমে আসবে।”

আহি সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। চোখ বন্ধ করতেই তার চোখ ভিজে উঠলো। তাই সে নিজেকে আড়াল করার জন্য দ্রুতপদে স্টেশনের ভেতরে ঢুকে গেলো। স্টেশন রুমটি কাচের গ্লাস দিয়ে ঘেরা। আহি বেঞ্চে বসে সেখান থেকে স্পষ্ট বাইরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। সে দেখলো আফিফ ভাড়া মিটিয়ে পদ্মের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্ম সেই হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে রিকশা থেকে নেমে পড়লো। আফিফ সাদা পাঞ্জাবি পরেছে, আর পদ্ম পরেছে নীল রঙের সেলোয়ার-কামিজ। দু’জনের এমন অমিল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু আহির কাছে অস্বাভাবিক লাগছে।

(***)

পদ্ম স্টেশন রুমে ঢুকে আহিকে দেখে বলল,
“বাহ, কি সুন্দর লাগছে তোকে!”

আফিফ ব্যাগটা চেয়ারে রেখে আহির দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আহি পদ্মকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে!”

“জানিস আহি। আমি তো আফিফকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছি। উনি তো আসতেই চাচ্ছেন না।”

“কেন?”

“এর আগেও আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম তো তাই।”

“ওহ, আচ্ছা। তাহলে না আসলেই হতো। শুধু আমার বান্ধবীটাকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেই চলতো।”

আফিফের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে পদ্মকে বলল,
“তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।”

আফিফ চলে যেতেই পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, এভাবে বললি কেন? উনি মন খারাপ করেছেন। আমি এখন বিবাহিতা। বিয়ের পর মেয়েরা বর ছাড়া কোথাও যায় না।”

“আহা, আমাদের আদর্শ পদ্মবিবি।”

পদ্ম মুখ ছোট করে বলল, “আফিফ রাগ করেছেন।”

আহি মনে মনে বলল,
“রাগ করলে করুক না। আমাকে তো অনেক কাঁদিয়েছে তোর বর। এখন সামান্য একটু রাগ নিতে পারবে না? আমি তো বছর ধরে তার দেওয়া আঘাত মনে জমিয়ে রেখেছি। তার শোধ তো সামান্য এই কথা দ্বারাও মিটবে না, পদ্ম।”

পদ্ম আহির হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“সত্যি উনি রাগ করেছেন। যা না। সরি বল না। আবার যদি যেতে না চান?”

আহি হেসে বলল,
“রাগ করলে আমার সাথেই করবে, তোর সাথে তো আর করবে না। তুই শান্ত হো। তোর বর তোকে কষ্ট দেবে না। দিলে আমাকেই দেবে।”

“কীভাবে?”

আহি মৃদু হেসে বলল,
“ভুলে গেলি না-কি। সে আমার ক্লাসমেট। নোট দিবে না। ক্লাসে না গেলে আমি তো তার কাছেই পড়া বুঝিয়ে নেয়। তখন আমাকে বুঝিয়েও দেবে না।”

“তাই? আমি উনাকে বলবো তোকে পড়ায় হ্যাল্প করার জন্য।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “না না। দরকার নেই।”

তখনই পুষ্প চলে এলো চেঁচাতে চেঁচাতে। পুষ্প স্টেশন রুমে ঢুকেই আহি আর পদ্মকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
“পলি আপুর গেট টুগেদার।”

আহি পুষ্পের কথায় মলিন মুখে বললো,
“লিনু তো নেই।”

পুষ্প বলল,
“হ্যাঁ রে। আমি লিনুকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম আমরা ট্যুরে যাচ্ছি। আসতেও বলেছি। কিন্তু ও না-কি এখন খুলনায়।”

আহি মনে মনে বলল,
“মিথ্যে বললি কেন লিনু? জানি, আমি আছি তাই আসছিস না। আর কতো ঘৃণা করবি আমাকে? এক বিন্দু ভালোবাসা ভাগ্যে জুটছে না। উলটো প্রিয় মানুষের ঘৃণা ফিরে পাচ্ছি।”

পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“জানি না তোর আর লিনুর কি হয়েছে, আশা করি শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা কি এখন আর বাচ্চা আছি? এসব ছোটখাটো ঝামেলা কথা বলে মিটিয়ে ফেলা যায়।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার একটু পরই রাদ আর লাবীব স্টেশনে এসে ঢুকল। গাড়িও কিছুক্ষণ পর ছাড়বে। লাবীব সবার ব্যাগপত্র হ্যাল্পারকে দিচ্ছে। আর রাদ পাশের দোকান থেকে শুকনো খাবার কিনছে। পুষ্প আর পদ্ম বাসে উঠে নিজেদের সিটে বসে পড়েছে। আহি রাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। রাদ ইশারায় আহিকে বলল উঠে বসতে। আহি মাথা নেড়ে বাসে উঠতে যাবে ওমনই তার পা পিছলে গেলো। আহি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নেবে আফিফ এসে আহির হাত ধরে ফেললো। আহি থতমত খেয়ে গেলো। আফিফ চাপা স্বরে বলল,
“শাড়ি সামলাতে না পারলে, পরেছো কেন?”

আহি আফিফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমার ইচ্ছে। আমার শাড়ি, আমি পরবো।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহিও বাসে উঠে পড়লো। রাদ বাসে উঠতেই পুষ্প লাবীবের পাশের সিটে এসে বসে পড়লো। আহি বলল,
“তুই বসবি না?”

পুষ্প বলল,
“আমার লাবীবের সাথে কিছু কথা আছে।”

এরপর রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রাদ, তুমি আমার জায়গায় বসো আপতত।”

রাদ আহির পাশে বসতেই আহি রাদের দিকে তাকালো। তাদের পাশাপাশি সিটেই পদ্ম আর আফিফ বসেছে। রাদ আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর এআর এখানেই আছে। তুইও এখানে আছিস। মনের যতো জানালা আছে খুলে দে। নিজেকে আটকাবি না। তোকে কাঁধ দেওয়ার জন্য আমি আছি। তোর ভেজা চোখ মুছার জন্যও আমাকে পাবি। তোর কাঁপা হাতটা শক্ত করে ধরার মানুষটাও কিন্তু আমি।”

আহি রাদের হাত শক্ত করে ধরলো। রাদ আহির হাতে কপাল ঠেকালো। পদ্ম গলা খাঁকারি দিতেই আহি পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“আমরা কিন্তু পাশেই আছি।”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। রাদ আহির মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

(***)

বাস চলছে আপন গতিতে। পুষ্পের ফোনে মৃদু আওয়াজে গান বাজছে। আহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আফিফও একই ভাবে হয়তো বাইরের দৃশ্য দেখছে, নয়তো অন্য কোনো ভাবনায় ব্যস্ত। পদ্ম আফিফের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। আর রাদ আহির দিকেই তাকিয়ে আছে। আর সবাই শুনছে সেই হৃদয়স্পর্শী গান।

তুমি যাকে ভালোবাসো,
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো,
তার জীবনে ঝড়।
তোমার কথার শব্দ দূষণ,
তোমার গলার স্বর।
আমার দরজায় খিল দিয়েছি,
আমার দারুণ জ্বর।
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।
.
তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্যদল
বাঁচার লড়াই,
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে একটা চালের ভুল
কোথায় দাঁড়াই।
কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়,
তুমি অন্য কারোর গল্পে নায়িকা।

৪৯।

লাবীব পুষ্পের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মোবাইল নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুক্ষণ পর পর তার মুখের ভাবভঙ্গি আঁকাবাঁকা হচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকে দেখে মনে হয় মুখে গ্রহণ লেগেছে, আবার কিছুক্ষণ পর তার মুখটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে যায়। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে মাথা বাঁকিয়ে পুষ্পের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, পুষ্পের এমন গুরুগম্ভীর মুখভঙ্গির কারণ গেইমস। লাবীব ফুঁস করে একটা শব্দ করতেই পুষ্প বাঁকা চোখে তার দিকে তাকালো। লাবীব ঠাট্টার হাসি হেসে বলল,
“সাবওয়ে সার্ফারের যুগ শেষ হয়ে গেছে।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তো!”

“তোমার গেইমস নিয়ে কোনো আইডিয়ায় নেই।”

“থাকতে হবে না আইডিয়া।”

লাবীব মুখে আবার ফুঁস করে একটা শব্দ করতেই পুষ্প ফোন বন্ধ করে লাবীবের দিকে ঘুরে বলল,
“এই তুমি পুসপুস কেন করছো?”

পুষ্প অনেকটা জোরে কথাটা বলায় রাদ ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকালো। লাবীব চাপা স্বরে বলল,
“আস্তে, এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?”

“আমি তোমার পাশে এক সেকেন্ডও বসবো না।”

“বসতে হবে না। তুমি নিজেই তো আমার পাশে বসার জন্য মরে যাচ্ছিলে।”

পুষ্প দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ওহ, রিয়েলি? তুমিই আমাকে বলেছো রাদ আর আহিকে একসাথে বসতে দিতে।”

“তুমি যেমন চাও নি?”

“তুমি আমাকে বলেছিলে, তাই আমি চেয়েছি।”

“ওয়াও, তুমি এতো বাধ্যগত মানুষ তা তো আমি জানতাম না।”

পুষ্প সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাদ বলল,
“কি হয়েছে?”

পুষ্প চেঁচিয়ে বলল,
“এই ফাজিল ছেলেটার পাশে আমি বসবো না।”

রাদ উঠে পুষ্প আর লাবীবের সিটের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবীব পুষ্পকে বলল,
“আচ্ছা সরি। বসো না।”

পুষ্প চোখ ছোট করে বলল, “নো, নেভার।”

পুষ্প এবার আহির পাশের সিটে বসলো। আহি বলল,
“লাবীব একটু মজা করেছে হয়তো। ওর কথায় মাইন্ড করিস না।”

পুষ্প ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“আমি আর কখনোই সাবওয়ে সার্ফার খেলবো না।”

পদ্ম পুষ্পের কথায় হেসে উঠলো। পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই হাসছিস কেন? একবার খেলে দেখিস, তারপর বুঝবি কেন এতো ভালোবাসতাম।”

পদ্ম বলল,
“না বাবা, আমার ওসব গেইমস খেলার সময় নেই। আমার সংসারেই অর্ধেক সময় যায়।”

“ব্যস্ত মানুষ।”

পদ্ম এবার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তুই এখন আর ছবি আঁকিস না?”

পদ্মের কথায় আহি চমকে উঠলো। রাদও পদ্মের কথাটি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আহির দিকে তাকালো। পুষ্প সাথে সাথেই বলে উঠলো,
“পদ্ম, তোর মনে আছে, আহি অনেক ছবি আঁকতো? স্পেশালি একটা ছেলের।”

পুষ্প কথাটি বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। এদিকে পুষ্পের কথা শুনে আফিফ শক্ত হয়ে বসে রইলো আর আহি জানালার বাইরে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আহি, কি হলো? রাগ করেছিস না-কি!”

আফিফ এবার আহির দিকে আঁড়চোখে তাকালো। আহিও সাথে সাথেই আফিফের দিকে তাকালো। দু’জনের চোখাচোখি হতেই আফিফ চোখ সরিয়ে নিলো। পদ্ম এবার বলল,
“তোর এআরের কি অবস্থা? তুই তো সেই স্কুল থেকেই তার জন্য পাগল ছিলি!”

এবার রাদের হাত মুঠো হয়ে এলো। আহিও শক্ত হয়ে বসে আছে। হঠাৎ তার বুকে কাঁপুনি ধরলো। সে কিছুক্ষণ পর পর হাত ঘষছে। আফিফ আহির মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেছে আহি। আফিফের সামনেই এমন প্রশ্ন করার মানে হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় পদ্ম আর পুষ্পের বোধজ্ঞানের অভাব আছে। লিনাশা হলে এমন প্রশ্ন কখনোই করতো না। এবার পুষ্প বলল,
“আর যাই বলিস পদ্ম, আহির ভালোবাসা যে পাবে সে ভীষণ ভাগ্যবান পুরুষ। এআরের প্রতি আহির ভালোবাসা দেখে আমিই অবাক হতাম। ছেলেটার পোড়াকপাল।”

আফিফ এবার ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। কথাগুলোতে আহির যে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে, সেটা আফিফ বুঝতে পারছে। কিন্তু কীভাবে এই মেয়ে দু’টাকে থামাবে সে বুঝতে পারছে না। পদ্ম বলল,
“আহি চুপ করে আছিস কেন? আমাদের সাথে তুই আগের মতো সব কথা শেয়ার করিস না।”

রাদ এবার গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“শেয়ার করার বিষয় হলেই শেয়ার করবে। যে আহির জীবনে নেই, তাকে বার-বার টেনে আনার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।”

পুষ্প বলল,
“তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? জেলাস না-কি?”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললো, পুষ্পকেও চুপ করাতে বলল। আফিফের কথামতো পদ্ম পুষ্পের হাত ধরে তাকে থামালো। অনেকক্ষণ বাস জুড়ে নিরবতা বিরাজ করছিলো। পুষ্প ঝুঁকে একনজর আহির দিকে তাকালো। আহি থম মেরে বসে আছে। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“সরি।”

আহি হঠাৎ সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর পুষ্পকে সরিয়ে রাদের সীটের কাছে গিয়ে বলল,
“বাসটা একটু থামাতে বলবি।”

রাদ সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়ে সামনে চলে গেলো। আহিও রাদের পিছু পিছু সামনে চলে এলো। পদ্ম মাথা বের করে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মনে হয়ে আমরা একটু বেশিই বলে ফেলেছি। আমি বুঝতে পারি নি।”

পুষ্প মলিন মুখে বললো,
“হয়তো ছেলেটার সাথে ওর আর কোনো যোগাযোগ নেই। কিছু একটা হয়েছে হয়তো। কিউরিওসিটি থেকেই তো বার-বার জিজ্ঞেস করি।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। একটু পর বাস থামলো। লাবীব সীট থেকে উঠে সামনে এসে রাদকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? গাড়ি থামাতে বলেছিস কেন?”

“তুই সীটে বয়। আমরা আসছি।”

পুষ্পকে উঠে আসতে দেখে লাবীব বলল,
“বসো, বসো কিছু হয় নি।”

এদিকে আহি বাস থেকে নেমেই গলগল করে বমি করে দিলো। হাত ব্যাগটা রাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ওষুধটা বের করে দে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কীসের ওষুধ? আহি, ডক্টর নায়ীব কিন্তু ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে মানা করেছে। উনি এখনো তোকে কোনো ওষুধ লিখে দেন নি।”

“রাদ, এখান থেকে আমি একা যাবো।”

“তোকে ফেইস করতে হবে, আহি। উত্তর দিলি না কেন? বলতে পারিস নি, ছেলেটা তোর যোগ্য না?”

আহি ছলছল চোখের রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কীভাবে বলবো? আফিফের সামনে কীভাবে?”

“সমস্যা কি বললে?”

“ও যদি কষ্ট পায়?”

“রাখ তার কষ্ট। ও তোকে কি পরিমাণ সুখ দিয়েছে?”

“আমি তো ওর কাছে কিছুই আশা করি নি। করি না। কখনো করবোও না।”

রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“চল বাসে উঠ। আমার পাশে বসিস। লাবীবকে পেছনে বসাবো।”

আহি মুখে পানির ছিঁটে দিয়ে বাসে উঠে পড়লো। রাদ লাবীবকে বলল,
“তুই পুষ্পের পাশে গিয়ে বস তো।”

লাবীব আহির দিকে তাকিয়ে পেছনে গিয়ে বসলো। পুষ্পও কিছু না বলে লাবীবকে সীট ছেড়ে দিলো। লাবীব চাপা স্বরে ব্যাঙ্গ করে বলল,
“নো, নেভার।”

পুষ্প লাবীবকে ভেংচি দিয়ে বলল,
“তুমি এসেছো, আমি না।”

এদিকে আহি আসতেই পদ্ম বলল,
“আহি, তুই ঠিক আছিস তো!”

আহি হালকা হেসে বলল,
“এখন অনেক ভালো লাগছে। মেডিসিন তো আমার কাছেই আছে।”

আহি কথাটি বলেই রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“বাসা থেকে উল্টোপাল্টা খেয়ে এসে বমি করেছে। তাই এমন চুপচাপ ছিল।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোদের কথায় আমি রাগ করি নি।”

আহি একনজর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি যেই ছেলেটার ছবি আঁকতাম, সে হঠাৎ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই বলতে চাই নি তোদের।”

পুষ্প গালে হাত দিয়ে বলল,
“কীভাবে অন্ধ হয়েছিল?”

“মাথায় সমস্যা হয়েছিল তো, তাই হয়তো।”

রাদ আহির কথায় সীটে বসে মুখ চেপে হাসছে। এদিকে আফিফ চোখমুখ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি নিজের সীটে উঠে উল্টো দিক হয়ে সীটের উপর দুই হাঁটু উঠিয়ে পুষ্প আর পদ্মের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো আর বলল,
“জানিস ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছিলো একবার। ইশ বেচারা! আমিও বা কি করবো? সে তো আমাকে আর দেখতেই পায় নি।”

পদ্ম আর পুষ্প বলল, “তারপর!”

“তারপর আর কি! আমি বললাম, আমি তাকে পছন্দ করি। কিন্তু সে তো হাবলার মতো চলে গেলো। চোখে দেখে নি তাই।”

পুষ্প বলল, “কানেও শুনতো না না-কি!”

“হালকা-পাতলা সমস্যা ছিল হয়তো। মাথায় আঘাত লেগেছে। বুঝিস তো স্নায়ুবিক ত্রুটি। একটু পাগল পাগল ভাব ছিল।”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি এবার বলল,
“এরপর একদিন শুনলাম তার বিয়ে হয়ে গেছে। আর পরে জানলাম মেয়েটারও মাথায় সমস্যা আছে।”

পুষ্প বলল, “ওয়াও, পাগল-পাগলীর সংসার!”

পদ্ম বলল,
“শুনেই খুব হাসি পাচ্ছে, তাই না আফিফ?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“এখন তোরাই বল, বাবা কি পাগল ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতো? তবুও ভালোবাসতাম দেখে, তাকে সম্মান করেছি। সে কি আর শখ করে পাগল হয়েছে? মাথায় আঘাত লেগেছিল তাই।”

রাদ আহির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“তোর পাগলের গল্প বন্ধ করে এদিকে এসে বস।”

আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মুখটাতে গ্রহণ লেগেছে। আহি এবার রাদের পাশে বসে চাপা স্বরে বলল,
“ওর মুখটা তো অন্ধকার।”

রাদ বলল,
“তোকে সমাজসেবী হয়ে আলো জ্বালাতে হবে না।”

“খারাপ লাগছে তো।”

“আমার তো বেশ মজা লাগছে। একটা ছবি তুলে ক্যাপশন দিতে ইচ্ছে করছে, ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে যাওয়া মুখ।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৫০।
হোটেলে ঢুকতেই পদ্ম অবাক হয়ে গেলো। তার কাছে এটা প্রাসাদের মতোই সুন্দর। রুমগুলো বেশ বড়। জানালাগুলোও বিশাল। বারান্দা আছে সেটাও চমৎকার। বারান্দায় দাঁড়ালে সমুদ্র দেখা যায়। রুমের সাথে লাগানো লিভিং রুমও আছে। আর চারপাশে বিভিন্ন রঙের বাতি ঝুলছে। ওয়াশরুমে ঢুকেই পদ্ম বলল,
“জানেন, এই প্রথম আমি বাস্তবে এমন রুম দেখেছি।”

আফিফ পদ্মকে বলল,
“এক সপ্তাহে তো অনেক টাকা চলে আসবে।”

পদ্ম বলল,
“এটা আহির বাবার হোটেল। টাকা লাগবে না।”

আফিফ আর কিছু বললো না। কিন্তু তার মনটা ভারী হয়ে আছে। এতোগুলো টাকা আহিকে কীভাবে ফেরত দিবে সে? রুম দেখে মনে হচ্ছে এক রাতে দশ হাজার টাকার মতো আসবে। সাত দিনে আসবে সত্তর হাজার টাকা। এর চেয়ে বেশিও তো হতে পারে। এদিকে আফিফের মাসিক বেতন মাত্র পনেরো হাজার টাকা। তার এই টাকা শোধ করতেই তো দুই বছর লেগে যাবে।

(***)

রাদ আহির হাত ধরে তাকে সমুদ্রতীরে নিয়ে এলো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”

আহি বলল, “তুই আসলে কি?”

“মানুষ!”

“না, সাধারণ মানুষ না তুই।”

“তাহলে কি অসাধারণ?”

“ভাবতে দে।”

আহি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “প্রীতমানব।”

“মানে কি?”

“যে মানুষটা সবসময় হাসি-খুশি থাকে।”

রাদ আহির কথায় হাসলো। আর আহি সমুদ্রের ঢেউয়ে নিজের পা ভেজাতে ব্যস্ত। মিনিট খানিক নীরব থেকে আহি বলল,
“ভাবছি তোর বিয়ে হলে আমার কি হবে?”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “এভাবে বলছিস কেন?”

“তোর বউ তো আমাদের এভাবে একসাথে সহ্য করতে পারবে না।”

“কে বলেছে তোকে?”

“পৃথিবীতে সবকিছুর ভাগ হয়। কিন্তু ভালোবাসার ভাগ কেউ দিতে চায় না। অন্য কাউকে প্রিয় মানুষের পাশে কেউ সহ্য করতে পারে না। যেমন আমি পারছি না।”

“বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা দু’টি ভিন্ন, আহি।”

“কিন্তু ভালোবাসা বন্ধুত্বের কাছে হারতে বাধ্য।”

“আমি এটা মানি না। যদি এমনই হতো তাহলে তোর ভালোবাসা বন্ধুত্বের কাছে হারতো না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ আবার বলল,
“তুই পদ্মের কারণেই তো আফিফকে ভুলে যেতে চাস।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“আফিফকে পাওয়ার চেষ্টা করলে হয়তো পাওয়া যেতো। কিন্তু তার জন্য ক্ষমতা লাগবে। আর এই ক্ষমতা বাবার কাছে আছে। আর বাবা চায়, আমি তাজওয়ারকে বিয়ে করি। আর আফিফ আমাকে কখনই ভালোবাসবে না। যার মনে অন্য কেউ, তাকে আমি জোর করে কীভাবে নিজের করে নেবো? আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমি মিসেস লাবণি হতে চাই না। মিসেস লাবণি আমার মায়ের জায়গাটা নিয়ে ফেলেছে। পদ্ম আর আফিফের তো সন্তান নেই। কিন্তু একটা সংসার তো আছে। আমি আমার ঘরের ইট-পাথরের ভাষাও বুঝি। তারা মাকে চায়। ওটা আমার মায়ের সংসার ছিল। আমার মা আমার অহংকার। আমি আমার মায়ের সন্তান। আমি বাবার মতো হয়ে নিজেকে রিজওয়ান কবিরের সন্তান বলে পরিচয় দিতে চাই না। বরং ওয়াসিকা নামের পাশ থেকে কবির শব্দটাই মুছে দিতে চাই। তাহলে বল, শুধুই কি বন্ধুত্ব? আমার আত্মসম্মানবোধও এখানে জড়িয়ে আছে।”

রাদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
“আফিফ কি পৃথিবীর একমাত্র ছেলে? কি এমন আছে ওর মধ্যে? আফিফের চেয়েও ভালো ছেলে আছে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জানি না ওর মধ্যে কি আছে। কিন্তু আমি তো ভালোবেসে ফেলেছি রাদ। ডক্টর নায়ীব বলেছে এটা রোগ। কিন্তু আমার কাছে এই ভালোবাসা, রোগ না। আমার কাছে এটা অনুভূতি, আমার আবেগ, আমার স্বপ্ন।”

রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যদি ও তোর জীবনে না আসতো, তাহলে কি প্রেমে পড়তি না?”

“পড়তাম তো!”

“কার প্রেমে পড়তি?”

“তোর প্রেমে পড়তাম।”

রাদ আহির দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। আহি হেসে বলল,
“তোর মতো মানুষ ক’জন আছে? তবে অবশ্য তোকে চিনেছি আফিফের কারণেই। আফিফের জন্য রোগী হওয়ায়, তুই মেডিসিন হয়ে এসেছিস। আমার এমন পরিস্থিতিতে পাশে থেকেছিস, যেটা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। লিনাশার সাথেও এতো ভালো বন্ধুত্ব হয় নি আমার।”

“তুই না আমাকে মেডিসিন বলিস? মেডিসিন খেতে খেতে মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে। তুই যদি আসক্ত হয়ে পড়িস?”

“ভয় পাচ্ছিস না-কি?”

“না, আহি।”

“আমি আমাদের বন্ধুত্ব হারাতে চাই না। দেখ না ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি। তোকে হারালে আমি বেঁচেই থাকবো না। তুই একমাত্র মানুষ যার সাথে আমি এতো এতো কথা বলি। তখন কে শুনবে আমার কথা?”

আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। রাদ তা দেখে বলল,
“আমিও তোকে হারাতে চাই না।”

আহি মুচকি হাসলো। রাদকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো। রাদও আহিকে নিজের বুকে আবদ্ধ করে নিলো। তার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আহিকে খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে,
“আমাকে ভালোবেসে দেখ, আহি। আমি তোকে কখনো ফিরিয়ে দেবো না। তুই দেখিস, আমি হারিয়ে যাবো না। আমি তোর গান, তোর চিত্র, তোর ভাস্কর্য, তোর ছন্দ সবকিছু হতে রাজী। শুধু আমার হাতটা ধরে একবার বল, ভালোবাসবি রাদ? দেখিস, আমি তোকে এতো ভালোবাসবো যে তোর সব দুঃখগুলো সুখ হয়ে যাবে।”

(***)

পদ্ম আফিফের হাত ধরে তাকে টেনে সমুদ্র পাড়ে নিয়ে এলো। সেখানে এসে দু’জনই অবাক। তারা দেখলো, আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্ম গলা খাঁকারি দিতেই আহি রাদকে ছেড়ে মাথা তুলে পেছনে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আমরা কিন্তু এখানেই আছি। শুধু আমরা না। অনেকেই আছে।”

আহি আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ আহির দিকে তাকালো না। সে পদ্মের হাত ধরে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাদকে বলল, “চল, সামনে হাঁটি!”

রাদ মুচকি হেসে বলল, “হুম।”

রাদ আর আহি সামনে এগুতেই পদ্ম আফিফের বাহুতে মাথা রেখে বলল,
“ওদের দু’জনকে বেশ মানিয়েছে, তাই না?”

আফিফ মুচকি হেসে বলল, “হুম, ঠিক বলেছো।”

আফিফ মনে মনে ভাবলো,
“আমি তো চাই, আহি অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যাক। তার জীবনে এমন কেউ আসুক, যেই মানুষটা তাকে অনেক ভালো রাখবে। আর যদি সেই মানুষটা রাদ হয়ে থাকে, তাহলে আহি ভাগ্যবতী।”

(***)

রাতে আহি লাল রঙের শর্ট গাউন পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর ঠোঁটে হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিক দিয়ে রুম থেকে বের হলো। তার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো রাতের আকাশে টিমটিমে বাতি ঘেরা আলোকিত ছাদে উঠে একটা ছবি উঠাবে। তার বাসার ছাদে এমন রংবেরঙের বাতি লাগানো নেই। আর হোটেলের ছাদটা অনেক সুন্দর। সুইমিংপুলও আছে। তাই আহি সন্ধ্যায় হোটেল ম্যানেজারকে দুই ঘন্টার জন্য ছাদটা খালি করতে বলেছিল। নোটিশ দেওয়ার পর আহিকে হোটেল বয় এসে জানিয়েছে ছাদ এখন খালি। আহিও তৈরী হয়ে বেরিয়ে এলো। পুষ্প তার ছবি উঠিয়ে দেবে। সে আবার ভালো ফটোগ্রাফার।

আহি রুম থেকে বেরুতেই কয়েক পা এগুতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ আপাদমস্তক আহিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি আফিফকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে তখনই আফিফ আহির পিছু এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালো। আহি তো রীতিমতো অবাক। আফিফ তার পথ আটকে দাঁড়াবে, এটা অকল্পনীয় ব্যাপার। আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ গম্ভীরমুখে বলল,
“এসব কি ড্রেস পরেছো?”

আহি উলটো প্রশ্ন করলো,
“আপনি আমার পথ আগলে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?”

“সেটা বিষয় না। তুমি কি এমন ড্রেস পরে বাইরে বের হচ্ছো?”

“আপনার কোনো সমস্যা?”

“না, আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি পদ্মের ফ্রেন্ড। তাই তোমার কথা ভেবে বলছি। কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

“ছাদে যাচ্ছি।”

“আমি তোমাকে আটকাবো না। আমার কোনো অধিকারও নেই। কিন্তু একটা কথা জানানোর আছে।
আমি সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছিলাম, দেখলাম ওখানে অনেক ধরণের ছেলে উঠেছে। তুমি এমন ড্রেস পরে উপরে উঠলে বাজে কমেন্টের মুখোমুখি হবে।”

আহি আফিফকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আপনার পদ্মফুল নই। আমাকে আমার মতো চলতে দিন। যেখানে অধিকার নেই, সেখানে উদ্বিগ্ন হওয়া মানায় না।”

আফিফ আহির পথ থেকে সরে দাঁড়ালো। আহি দুই সিঁড়ি উপরে উঠে পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানুষ কথার কথা বলে, বাবার হোটেলে ইচ্ছেমতো চলা যায়। তবে আমার ক্ষেত্রে এটা সত্য হয়েছে। বাবার হোটেল, তাই ইচ্ছেমতো সময়ে পুরো ছাদ নিজের জন্য রিসার্ভ করে নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাবে না। আপনার মিথ্যে উদ্বেগ এবার কিছুটা হলেও কমেছে নিশ্চয়।”

আহি কথাটি বলেই উপরে উঠে গেলো। আর আফিফ এখনো তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তো আহির ভালোর জন্য তাকে বারণ করেছিল। কিন্তু আহি তো ডুবে আছে অতীতে। যেই রাগটা ঝাড়ছে আফিফের উপর। আজ যদি পুষ্পের বর আহিকে আটকাতো, তাহলে আহি এভাবে কখনোই উত্তরটা দিতো না।

৫১।

দ্বিতীয় দিন সকালে সবাই একসাথেই নাস্তার টেবিলে এসে বসলো। সবাই গালগল্পে মশগুল। আহি আছে তার কল্পনার জগতে। সে কখনোই ভাবে নি আফিফের সাথে তার এমন দীর্ঘ সময় কাটবে। তাও আবার সেই দীর্ঘ সময় জুড়ে তাদের মাঝখানে থাকবে অদৃশ্য দেয়াল। সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে আহির।
রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে-মুখে মলিনতা। রাদ ফোন বের করো গতদিনের রিপোর্ট দিলো নায়ীবকে। লিখলো,
“ডক্টর, আহি সেই ছেলেটাকে দেখলে আগে অস্থির হয়ে যেতো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অস্থিরতাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। অনেকক্ষণ একসাথে তার মুখোমুখি বসেও আহি শান্ত আছে।”

নায়ীবের উত্তর এলো,
“তাদের একসাথে রাখো। তবে এর মধ্যে আহির ফ্রেন্ডটি যেন অবশ্যই থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দেখে আহি যতো ট্রিগার হবে, ততোই নিজেকে শক্ত করতে পারবে। নুইয়ে পড়তে দিও না। তুমিই কিন্তু ওর মানসিক শক্তি।”

এদিকে নাস্তা আসার পর পদ্ম আফিফকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলো। আহির চোখ দু’টি না চাইতেও যেন একটু পর পর পদ্ম আর আফিফের দিকেই যাচ্ছে। আফিফ পড়েছে এক মহা বিপাকে। সে পদ্মকে থামাতে চায়লে পুষ্প বলল,
“থাক ভাইয়া, বারণ করছেন কেন? আমরা আপনাদের ভালোবাসা দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আফটার অল, আমরাও খুব শীঘ্রই এমন রোমান্টিক ব্রেকফাস্ট করবো যার যার স্পেশাল মানুষের সাথে।”

পুষ্প গালে হাত দিয়ে পদ্ম আর আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“লজ্জা করে না এভাবে তাকিয়ে থাকতে?”

“ওহ, হ্যালো। তুমি আমাকে লজ্জা শেখাতে এসো না। মাংকি একটা!”

“আমি মাংকি?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে তুমি কোথাকার ঘটকী? তোমাকে দেখে তো শিম্পাঞ্জি পালিয়ে যাবে। একদম সজারুর কপি পেস্ট।”

পুষ্প রাগী স্বরে বলল, “আমি সজারু?”

“ওতোটাও না। একটা পার্থক্য আছে। সজারুর গায়ে কাঁটা। আর তোমার মুখে।”

“মানে!”

“মানে, তোমার মুখ নির্গত বানী যেন মধু নয়, এক একটা বিষাক্ত কাঁটা।”

পুষ্প চেয়ার ছেড়ে উঠে চেঁচিয়ে বলল,
“আমি এই বানরের পাশে বসবো না।”

“ওকে, তাহলে আমি তোমার মাথায় উঠে বসি। বানর কিন্তু ভালোই বেয়ে উঠে, বসতে জানে।”

আহি উঁচু গলায় বলল,
“চুপ করবি তোরা? বাচ্চা না-কি, হ্যাঁ? এসব ঝগড়া করার বিষয় না।”

পুষ্প চুপচাপ বসে পড়লো। খাওয়া শেষ হতেই পুষ্প চেয়ার ছেড়ে উঠে হাত ধোয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলো। এদিকে লাবীবও খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে বোতল নিয়ে মুখভর্তি পানি পুরে নিলো। তখনই পুষ্প ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সামনে পা বাড়াতেই লাবীবের সাথে ধাক্কা খেলো। আর সাথে সাথেই লাবীবের মুখের সব পানি বেরিয়ে পুষ্পের উপর ছিঁটকে পড়লো। পুষ্প থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। লাবীব দু’পা পিছিয়ে দৌঁড়ে ডায়নিং থেকে বের হয়ে গেলো। পুষ্প এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহি কয়েকটা টিস্যু এনে পুষ্পের দিকে এগিয়ে দিতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“লাবীবের বাচ্চা লাবীব, আমি তোকে গরম তেলে ফ্রাই করেই ক্ষান্ত হবো।”

আহি ধীর কন্ঠে বলল,
“ফ্রাই তো গরম তেলেই হয়। এতো এডভার্ব যোগ করছিস কেন?”

পুষ্প আহির কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে হনহন করে চলে গেলো।

(***)

নাস্তা সেরে হোটেল থেকে বেরিয়ে বিচের বালির উপর একা একা হাঁটছে আহি। তখনই পদ্ম তার হাত ধরে তার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলো। আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর দু’জনই চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। নীরবতা ভেঙে পদ্ম জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, রাদের সাথে কি তোর কোনো সম্পর্ক আছে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর এমন প্রশ্নের কারণ?”

“মনে হলো।”

“না, আমরা শুধুই বন্ধু। একই সাথে অনার্স করেছি। স্কুলেও তো ও আমাদের ক্লাসমেট ছিল।”

“হুম, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে প্রেম-টেম চলছে। তোর খেয়াল রাখে। মনে হয় তোকে ভালোবাসে।”

“আরেহ না। কি যে বলিস! বন্ধু হিসেবেই ভালোবাসে। বন্ধুরা তো খেয়াল রাখবেই। তবে রাদ একটু বেশিই ভালো। তাই এতো খেয়াল রাখে।”

“হয়তো ভালোবাসে, কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এমন কিছুই না।”

“তোদের দেখে মনে হয় না শুধু বন্ধু। কাল দেখলাম রাদকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলি।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“হয়তো আমরা চোখে যা দেখি, তা শুধুই আকাঙ্ক্ষা হয় না। কারো কাছে এই হৃদ স্পন্দন মানসিক শক্তি, ভরসার আশ্রয় আর কিছু বছর বেশি বেঁচে থাকার প্রেরণা।”

এবার পদ্ম বলল,
“আর যাই বলিস, আফিফের না এসব পছন্দ না। ছেলে বন্ধুর সাথে এতো জড়াজড়ি ভালো না।”

“কেন তোরা কি জড়াজড়ি ছাড়া প্রেম করেছিলি?”

“যাহ! কি বলছিস এসব? ভালোবাসার অর্থ এমন হয় না। আফিফ তো বিয়ের আগে আমার হাতটাও স্পর্শ করে নি।”

আহি পদ্মের কথা শুনে পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ খুব মনোযোগ দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। ছেলেটা এতো ভদ্র কেন সে বুঝতে পারে না। বেশি ভদ্র তাই হয়তো আহি এখনো তার মায়ায় বেঁধে আছে। আহি এবার পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাঝে মাঝে মানুষ মানসিক ভাবে দুর্বল থাকলে, পাশের জন ছেলে না-কি মেয়ে এই জ্ঞানটা থাকে না।”

(***)

দুপুরে রাদ আর আহি সাগর পাড়ে বসে পাল্লা দিয়ে চিংড়ি খাচ্ছে। আফিফ দূর থেকে আহিকে হাসতে দেখছে। রাদের সাথে থাকলে মেয়েটা হাসিখুশি থাকে। হাসলেই তো সুন্দর লাগে আহিকে। কিন্তু সেই হাসিটাই তো আফিফ কেঁড়ে নিয়েছিল। আফিফের মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে। যেখানে তাদের সম্পর্কই শুরু হয় নি, সেখানে আহি এখনো কেন তার স্মৃতিতে ডুবে আছে? তাকে এতো ভালোবাসার কারণ কি? আফিফ জানে না এসবের উত্তর। শুধু এতোটুকুই জানে, আহি কখনোই তার ভাগ্যে ছিল না।

বিকেলে তারা সবাই মিলে শপিং করতে গেলো। আফিফ পদ্মের জন্য তাঁতের শাড়ি দেখছে। আর পদ্ম ব্যস্ত কানের দুল দেখায়। আহি দূরে দাঁড়িয়ে আফিফকে দেখছে। রাদ আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আফিফ শাড়িটা কার জন্য দেখছে?”

আহি মৃদু হেসে বলল, “তার পদ্মফুলের জন্য।”

রাদ আহির উত্তর শুনে তার মুখের দিকে তাকালো। আহির চোখে মলিনতা। কিন্তু ঠোঁটে হাসি। রাদ এবার আহির হাতের দিকে তাকালো। না, আহির হাত কাঁপছে না। রাদের ইচ্ছে করছে এবার আফিফকে মিষ্টি খাওয়াতে। কারণ আহি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। দু’দিনেই এতোটা পরিবর্তন, ভাবা যায় না। কিন্তু পরিবর্তনটা আহির মাঝে লক্ষণীয়। যে কেউ এই পরিবর্তন বুঝবে না। শুধুই রাদই বুঝবে। কারণ সে আহিকে কাছ থেকে দেখেছে।

(***)

কেনাকাটা শেষে মার্কেট থেকে বের হতেই একটা ছেলে পদ্মের সামনে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটার অদ্ভুত চাহনি দেখে পদ্ম কয়েক পা সরে দাঁড়ালো। এদিকে লাবীব গাড়ি ঠিক কর‍তে এক পাশে চলে গেছে। আফিফ অন্যদিকে। রাদ আহি আর পুষ্পের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। তারা খেয়ালই করে নি পদ্ম পিছনে পড়েছিল। এদিকে পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে ছেলেটিকে বলল,
“আমার পথ ছাড়ুন।”

ছেলেটা বুকে হাত দিয়ে বলল,
“আহা, কি চমৎকার কন্ঠ! আরেকবার বলো না।”

আহি কি মনে করে পেছনে ফিরে তাকালো। দেখলো একটা ছেলে পদ্মের হাত ধরতে চায়ছে, আর পদ্ম বার-বার এপাশ-ওপাশ হয়ে সরে আসার চেষ্টা করছে। আহির এটা দেখেই রাগ উঠলো। সে পদ্মের কাছে এসে বলল,
“চল, পদ্ম।”

ছেলেটি বলে উঠলো,
“একটার সাথে আরেকটা ফ্রি।”

তার সাথে এবার আরো দু’টো ছেলে যোগ হয়েছে। রাদ তাদের দেখে সামনে এগিয়ে আসতে যাবে তার আগেই যেই ছেলেটি এতোক্ষণ পদ্মকে বিরক্ত করছিলো, আহি সশব্দে সেই ছেলেটির গালে চড় বসিয়ে দিলো। ছেলেটি রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকাতেই রাদ এসে আহিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। দূর থেকে আফিফ বিষয়টা খেয়াল করে তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হয়ে চলে এলো। আফিফ পদ্মের কাছে আসতেই পদ্ম আফিফকে ঝাপটে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ছেলেটা আমাকে বিরক্ত করছিলো।”

কথাটা শুনেই আফিফের মেজাজ বিগড়ে গেলো। কিন্তু তাকে কিছু কর‍তে হলো না। আহি রাদকে তার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে তার ব্যাগ দিয়েই ছেলেগুলোকে জোরে জোরে মারতে লাগলো আর বলতে লাগলো,
“চোখ দেখাচ্ছিস কাকে? নিজেরা করবি নষ্টামি, আর চোখও দেখাবি? মেরে হাড্ডি গুঁড়ো করে ফেলবো। তোদের মতো ছেলেদের রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পেটানো উচিত।”

রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য কেউ না বুঝলেও রাদ বুঝতে পারছে এই আঘাত আহির মনের আঘাত। আর ছেলেগুলো আহির কাছে তাজওয়ারের প্রতিরূপ। তাজওয়ারের উপর যতো ক্ষোভ জমে আছে, সেসব এই ছেলেগুলোর উপর ঝেড়ে তবেই আহি শান্ত হবে। আফিফ এবার রাদের কাছে এসে বলল,
“ওকে থামাও।”

রাদ বলল,
“মারুক না একটু। বল তো সব জায়গায় প্রয়োগ করা যায় না। যেখানে করা যায়, সেখানে করুক।”

আফিফ অবাক দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। রাদ আহিকে পেছন থেকে চেয়ার আপ করে বলতে লাগলো,
“মার আহি, আরো জোরে জোরে মার। পিঠে আরো কয়েকটা দে। তোর ব্যাগ ছিঁড়ে গেলে, আমি কিনে দেবো।”

মার খেতে খেতে দু’জন পালিয়ে গেছে। একজন রাস্তায় লুটোপুটি খাচ্ছে আর বলছে,
“আহ! বাপরে। মাফ করেন আপা আল্লাহর ওয়াস্তে।”

রাদ ছেলেটির আর্তনাদ শুনে বলল,
“আহা! আহা! কি শান্তি।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭(১ম ভাগ)||

৫২।
“আহি কি মারটাই না দিলি। আমার তো মনে হচ্ছিলো কোনো লাইভ অ্যাকশন সিন দেখছিলাম।”

পুষ্পের কথায় সায় দিয়ে লাবীব বলল,
“আহিকে দেখে মনে হচ্ছিল লো বাজেটের স্টান্ট হিরোইন।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“লো বাজেটের বলছিস? তোকে তো ফ্রীতেও নিবে না।”

পুষ্প লাবীবের দিকে আঙ্গুল তাক করে ব্যাঙ্গ করে হাসতে লাগলো। লাবীব মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তুমি এমন দাঁত দেখিয়ে হাসছো কেন?”

পুষ্প হাসতে হাসতে বলল,
“ফ্রী বাজেটের চা-ওয়ালা মামা।”

লাবীব মুখ ফুলিয়ে দ্রুতপায়ে সামনে চলে গেলো। এবার পদ্ম আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তোর এমন রূপ এই প্রথম দেখেছি। এতো রাগ তো তোর আগে ছিল না।”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহিও তার দিকে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো। আহি চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“প্রকৃতিই আমাকে এই রূপ দিয়েছে। আমিও গ্রহণ করে নিয়েছি। এখন থেকে এই রূপই আমার পরিচয় হবে। আবেগী আহিকে মেরে ফেলতে চাই আমি।”

শেষ কথাটি মিনমিনিয়েই বললো সে। তাই কেউ শুনতে পেলো না।

(***)

পুষ্প রাস্তার পাশে আইসক্রিমের দোকান দেখে লাফিয়ে সেদিকে চলে গেলো। বাকিরাও সেদিকে গেলো। রাদ বলল,
“কে কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম খাবি বল?”

পুষ্প বলল, “মালাই।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো, “বাচ্চাদের আইসক্রিম।”

“মালাই বাচ্চাদের আইসক্রিম? আচ্ছা! তো বড়দের আইসক্রিম কোনটা?”

“ভ্যানিলা!”

পুষ্প অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠল, “কাপের ভ্যানিলা?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আইসক্রিমে বড় ছোটদের ভাগ আছে না-কি! পছন্দে কোনো বয়স হয় না। আর মানুষের বয়স বাড়লেও তাদের মনের বয়স বাড়ে না। আমার তো চকোলেট আইসক্রিমই ভালো লাগে।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কী খাবেন?”

আফিফ বলল, “আগে তুমি নাও।”

“আপনি যেটা নিবেন।”

আফিফ দু’টো স্ট্রবেরি নিলো। রাদ এবার আহির দিকে তাকালো। আফিফের প্রিয় স্ট্রবেরি, তাই এতো বছর ধরে আহি যতোবারই আইসক্রিম খেয়েছে, স্ট্রবেরিই খেয়েছে। আজ প্রথম আহি চকোলেট আইসক্রিম নিলো। রাদ মনে মনে বলল,
“তুই আসলেই পাগল আহি। এতো বছর ধরে তুই নিজের পছন্দগুলো এমন একজনের জন্য দাবিয়ে রেখেছিস যে তোর কখনোই হবে না। নিজেকে এতোটা না হারালেও পারতি। যাক, পরিশেষে ভালোই হয়েছে। আজ আমি প্রথম আসল আহিকে দেখছি। এতোদিন তো সে মুখোশ পরে ছিল। আফিফের ভালোবাসার মুখোশ।”

সবাই গোল হয়ে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প কিছুক্ষণ পর পর লাবীবের দিকে তাকিয়ে হাসছে। লাবীব তো রাগে কিছু বলতেই পারছে না। তার ইচ্ছে করছে কাপটা পুষ্পের মুখে ঢুকিয়ে দিতে। পুষ্প নিজের আইসক্রিমে এক কামড় বসাতেই লাবীব পুষ্পের আইসক্রিমটা অর্ধেক কামড় বসিয়ে দিয়ে খেয়ে নিলো। পুষ্প হাঁ করে লাবীবের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবীব বসা থেকে উঠে বাঁকা হেসে চলে গেলো। পুষ্প মুখ ফুলিয়ে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ আরেকটা আইসক্রিম এনে দিতেই পুষ্প বলল,
“এমন একটা দুলাভাই লাগবে আমার! সো সুইট।”

রাদ চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি বললি তুই?”

পুষ্প তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ আহির কাছে এসে বসে বলল,
“এতো ভাবছিস কেন? বানিয়ে ফেল পুষ্পের সুইট দুলাভাই!”

“মজা করছিস?”

“যদি সিরিয়াস হই?”

“খান সাহেব এই মজাটা সিরিয়াসলি নিয়ে অনেক কিছুই কর‍তে পারে।”

“তাহলে আমি খান সাহেবের বিদায় হওয়ার অপেক্ষায় থাকি?”

আহি প্রতিত্তোরে হাসলো। আর আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে রইলো।

(***)

রাতে হোটেলের ছাদে বসে আছে সবাই। পুষ্প কোথা থেকে একটা কাচের বোতল নিয়ে এলো। লাবীব আর পুষ্প বুদ্ধি বের করেছে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলবে। তাদের ধারণা আহি আর রাদ নিজেদের মধ্যে অনেক কথা জমিয়ে রেখেছে। আজ তারা সব সত্য বের করবে এই খেলার মাধ্যমে।

লাবীব বোতলটা টেবিলের উপর রেখে বলল,
“আগে থেকেই সবাইকে শপথ নিতে হবে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কেমন শপথ?”

“যাহা বলিব সত্য বলিব, মিথ্যে বলিলে নিকটস্থ সময় অন্ধকার।”

“আচ্ছা! তুই কোন কালের জ্যোতিষী রে?”

পুষ্প বলল, “সত্য তো বলতেই হবে।”

আহি বলল, “যদি কেউ ডেয়ার নেয়?”

“ডেয়ার শুধু একবার। দু’বার করে চান্স হবে।”

পুষ্প মনে মনে বলল,
“প্রথম প্রশ্নেই তোদের মনের কথা বের করে ছাড়ছি।”

(***)

খেলা শুরু হয়ে গেলো। লাবীব বোতল ঘোরাতেই প্রথমে থামলো পদ্মের সামনে। পদ্ম মুখে হাত দিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। পুষ্প গালে হাত দিয়ে ভেবে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই আহি জিজ্ঞেস করলো,
“তোর বর কি তোর ছবি এঁকেছিল কখনো?”

আফিফ আর রাদ দু’জনই অবাক দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনাকে তো বিয়ের পর ছবিই আঁকতে দেখি নি।”

“তোদের তো প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের আগে ছবি আঁকে নি?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“উহুম। আমার ছবি আঁকে নি।”

আহি আনমনে হাসলো, আর ভাবলো,
“অন্তত তোমার তুলিতে আমিই প্রথম আর শেষ জায়গাটা নিতে পেরেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আর।”

দ্বিতীয়বার বোতল ঘোরাতে পুষ্পের দিকে পড়লো। পুষ্প কাঁধ ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“আমার এতো সিক্রেট-ফিক্রেট নেই। যতো কঠিন প্রশ্ন করবে এই পুষ্প সহজ ভাষায় ফটাফট উত্তর দিয়ে দেবে।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার উপর ক্রাশ খেয়েছো?”

পুষ্প তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “নো ওয়ে।”

আহি পুষ্পের উত্তরে মুখ চেপে হাসলো। রাদ এবার বোতল ঘোরাতেই আফিফের দিকে থামলো। পদ্ম এবার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি করি?”

পুষ্প বলল,
“তোর বর সম্পর্কে তুই তো সবই জানিস। আবার কি করবি? বরং আমরাই করি।”

“না আমার একটা প্রশ্ন আছে।”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কী প্রশ্ন?”

“ছবিটা কার?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কার ছবি?”

“যার জন্য আপনি প্রথম কবিতা লিখেছিলেন।”

আফিফ থম মেরে বসে রইলো। আহি কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বার-বার তার হাত ঘষছে। তার এমন আচরণ রাদেরও সুবিধের মনে হচ্ছে না। তার নীরবতায় যেন অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। পদ্ম এবার মুখ ফুলিয়ে বলল,
“সব সময় আপনি এই কথাটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আজ না হয় বলেই দিন, ছবিটা কার?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কিসের ছবি?”

পদ্ম বলল, “আফিফ একটা ছবি….”

আফিফ পদ্মকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“একটা খেয়ালের ছবি।”

পুষ্প অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“খেয়াল বলতে!”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“ভাবনা। যারা ছবি আঁকে, তারা অনেক কিছুই ভাবে। সেটাও আমার ভাবনা ছিল।”

পদ্ম বলল,
“মিথ্যে কথা বলা যাবে না কিন্তু।”

আফিফ পদ্মের দুই হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল,
“আমার প্রথম ভালোবাসা কে জিজ্ঞেস করো, আমার উত্তর হবে, পদ্মফুল।”

আফিফের কথাটা আহির বুকে তীরের মতো বিঁধলো। কি সহজেই বলে দিলো, তার প্রথম ভালোবাসা পদ্মফুল। আহির ঠোঁট কাঁপছে। রাদ শক্ত করে আহির হাত ধরলো। আহি পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে রাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তবে এই হাসির পেছনে রাদ দেখতে পেলো ভয়ংকর কষ্ট।

এবার বোতল ঘোরাতে আবার আফিফের কাছে এসে ঠেকলো। লাবীবের কচকচানি মনের প্রশ্নটা সে করেই ফেললো,
“কবিতাটি কি ছিল ভাইয়া?”

আফিফ এই প্রশ্নে যেন আরো চমকে উঠলো। আহির বন্ধুগুলো কি এক রাতেই তার অতীত রহস্য ভেদ করে ফেলতে চায়ছে না-কি। পুষ্প হাততালি দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, আমরা অপেক্ষায় আছি। কবিতাটা শুনতে চাই।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বলল,
“পরের বার যেন তোমাকে এই রূপেই দেখি,
প্রতিবারই তুমি আমার সামনে সেই রূপেই দাঁড়াবে- আমি জানি,
সাদা শাড়ি, আলতা রাঙা হাত,
চুলের ফাঁকে আমার প্রিয় অলকানন্দা ফুল গুঁজে,
আর আমি পথ সাজিয়ে রাখবো কৃষচূড়ায়,
মনে হবে আলতার ছাপ পড়ছে সেই পথের বুকে,
পরের বার যেন তোমাকে এই রূপেই দেখি।”

আহি স্তব্ধ হয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন মুহূর্তেই তার পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। আফিফ চোখ নামিয়ে রেখেছে। অন্তত এবার সে আহির দিকে চোখ তুলে তাকাতে চায় না। পদ্ম আজ যে সর্বনাশটা করে দিলো, তার ভোগান্তি যে আফিফকেই পোহাতে হবে। এদিকে রাদের মনে অজানা কৌতুহল জন্ম নিলো। যদি কবিতাটি পদ্মকে নিয়ে লেখা না হয়, তাহলে আফিফ কাকে নিয়ে এই কবিতা লিখেছে?

রাদ এবার বোতল ঘোরাতেই সবার মনোযোগ আবার সেদিকে গেলো। এবার বোতলটা লাবীবের দিকে এসে থামলো। পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
“কারো প্রেমে পড়েছো?”

লাবীব বলল, “হুম।”

“কে সে?”

“একটা প্রশ্ন, একটা উত্তর, শেষ।”

পুষ্প চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই দুইটা এতো সহজে বেঁচে যাবে, এটা মানা যায় না।”

পরের বার বিসমিল্লাহ বলে বোতল ঘোরাতে আবার পদ্মের দিকে এসে থামলো। পুষ্প বলল,
“তুই আমাদের তোর আর ভাইয়ার প্রেমের গল্প শুনাবি একটু পর। তার আগে এই দু’টার কাছে দুইটা প্রশ্ন করবোই করবো।”

আহি বলল,
“নো নো নো, টাইম ওভার। এখন আর খেলা হবে না।”

লাবীব রাদের কাঁধ চেপে ধরে বলল,
“রাদ, তোকে উত্তর দিতেই হবে। তোদের ভাগ্যেই পড়ে নি! এটা মানা যায় না। নয়তো আমাদের উপর অবিচার হবে।”

রাদ লাবীবকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, কি প্রশ্ন করবি কর।”

লাবীব আর পুষ্প একসাথেই প্রশ্ন করতে যাবে কিন্তু লাবীবই আগে প্রশ্নটা করে ফেললো,
“কাউকে ভালোবাসিস?”

পুষ্প লাবীবের হাতে চিমটি কেটে বলল,
“কাউকে ভালোবাসে এটা শুনে আমরা কি করবো? আহিকে ভালোবাসে কি-না জিজ্ঞেস করতে বলেছি। গাঁধা একটা।”

আহি মুখ চেপে হাসলো। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো তো একজনকে বাসিই। আর আহিকে কেমন ভালোবাসি, তা আর কেউ জানুক না জানুক আমি জানলেই হবে।”

পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসা হচ্ছে!”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আমরা ভালো ফ্রেন্ড, তাই না রাদ!”

রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে ভীতি। সত্যিই যদি রাদ তাকে ভালোবেসে ফেলে, তার জন্য সে এই মুহূর্তে প্রস্তুত নয়। রাদ জানে আগে আহির আফিফকে ভুলতে হবে। তারপর তাজওয়ারের কাছ থেকে মুক্তি পেতে হবে। আর এরপরই তো রাদ তার ভালোবাসার গল্পটা শুরু করবে। এতো ঝামেলার মধ্যে প্রেম হয় না। প্রেম হবে সুস্থ মনে, শান্ত পরিবেশে।

এবার পুষ্প আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছুই নেই। আমার জীবনটাই আমার কাছে রহস্য। তবে দুই লাইন গান শোনাতে পারি, যদি সবাই শুনতে চাস।”

সবাই সায় দিলো। আহি মনে মনে বলল,
“সেই সুযোগে এতো বছর পর আমি আবার তোমাকে আমার মনের কথাটা জানাতে চাই, এআর।”

আহি চোখ বন্ধ করলো, কন্ঠে ধরলো গান।

“আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে,
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
.
ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো,
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটা রে।
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির গান শেষ হতেই সবার মনোযোগ পদ্ম আর আফিফের দিকে গেলো। তাদের প্রেমের গল্পটা আহিও শুনতে চায়। আহি তো নিজের উন্মাদনা দেখেছে। আফিফ হয়তো দেখে নি। এবার সে পদ্মের উন্মাদনা দেখতে চায়। জানতে চায় কি এমন প্রেম হয়েছিল তাদের, যার নেশায় ডুবে আফিফ সেই বেনামি চিরকুটের মেয়েটাকেই ভুলে গিয়েছিল!

(***)

আফিফ আর পদ্মের দেখা হয়েছিল সিঁড়িতে। পদ্ম নামছিল নীল ওড়না মাথায় দিয়ে। এভাবেই তাদের প্রথম দেখা। চোখাচোখিতেই সমাপ্ত। দ্বিতীয় দেখা পাড়ার হিন্দু পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে। আফিফ ছাদে উঠেছিল। পদ্মও সেদিন ছাদে উঠেছিল বিয়ে দেখতে। আফিফকে দেখেই লজ্জায় নেমে পড়েছিল সে।
লাজুক মেয়েরা একটু বেশিই লক্ষী হয়। আফিফও তাই ভাবতো।
তৃতীয় বার তাদের দেখা হয়েছিল রাস্তায়। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন। আফিফ দেখলো পদ্ম রিকশা পাচ্ছে না। নিজের রিকশাটা ছেড়ে দিয়েছিলো পদ্মের জন্য। ব্যস, পদ্মের মনে সেদিনই আফিফ রাফাত তার স্বপ্নের পুরুষের জায়গাটা দখল করে নিয়েছিল।
এরপর পদ্ম প্রায়ই ছাদে চলে যেতো আফিফকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার জন্য। আফিফও তাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলতো। ভীষণ লজ্জা পেতো পদ্ম। আফিফ তা দেখে হাসতো।
ছাদে অলকানন্দা গাছ লাগিয়েছিল আফিফ। অজান্তেই পদ্ম সেই গাছে পানি দিতো। আফিফের গাছের যত্ন নিতো নীরবে নীরবে। আফিফ আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতো পদ্মের কান্ড। আর আনমনে হাসতো। তাদের কথাবার্তা শুরু হয়েছিলো এক শীতের সকালে। কনকনে শীতে শক্ত হয়ে বসে ছিল আফিফ। পদ্ম তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখেই নিজের শালটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “মন খারাপ?”

আফিফ বলল,
“না। ভাবছি কীভাবে মানুষ হওয়া যায়!”

“তো আপনি কি মানুষ নন?”

“এই সমাজে মানুষ তারাই যাদের অনেক টাকা। আর তাদেরই ভালোবাসার অধিকার আছে।”

“যদি বেকার মানুষের জীবনে ভালোবাসা আসে?”

আফিফ প্রতিত্তোরে হেসে বলল,
“বেকারদের জীবনে খেয়াল আসে। স্বপ্ন আসে৷ ভালোবাসা আসে না।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল,
“আমি আপনার ভালোবাসা হতে চাই।”

কিন্তু পদ্ম বলতে পারলো না। এভাবেই কেটে গেলো এক বছর। এই এক বছরে বেশ কথাবার্তা জমলো আফিফ আর পদ্মের। আফিফের মনে হলো পদ্ম প্রেমিকা হিসেবে মন্দ নয়। আর সে এতোটুকু বুঝে গেছে পদ্ম তার কাছে ভালোবাসি শব্দটা শোনার অপেক্ষায় আছে। আফিফও এক বছর পর মাকে এই ব্যাপারে জানালো। আফিফা বেগম অজানা কারণে বার-বার পদ্মকে মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না। আফিফ বেশ বুঝতে পেরেছিলো মায়ের অজানা কারণটা কি। কিন্তু সেই কারণটির কোনো ভিত্তিই নেই। শেষমেশ আফিফের ছোট বোন এসেই মাকে রাজি করিয়েছে। তারপর একদিন আফিফ ভোরে উঠেই পদ্মকে ছাদে আসতে বলল। পদ্ম ছাদে আসতেই আফিফ হাঁটু গেড়ে বসে অলকানন্দা ফুল এগিয়ে দিয়ে পদ্মকে বলল,
“তুমি কি আমার মনের পুকুরের পদ্মফুল হবে?”

পদ্ম এক সেকেন্ডও দেরী করলো না। ফুলটি নিয়েই বলল,
“হুম, অবশ্যই হবো।”

……………….

পদ্ম অতীতের ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো। তারপর মুচকি হেসে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটাই ছিল, আমাদের প্রেমের গল্প। ছোট্ট কিন্তু ভীষণ মিষ্টি।”

আহি উঠে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বলল,
“আর এরপর তুই এসে আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিলি, আর আমি বর্ষার রাতে তোর বিয়ে খেয়ে বাসায় ফিরলাম।”

আফিফ আহির কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি হেসে বলল,
“ভীষণ সুন্দর ছিল তোদের গল্পটা। আমার প্রেমের গল্পটাকেই হার মানিয়ে দিয়েছে।”

পদ্ম বলল, “তোরটা তো সাংঘাতিক ছিল।”

আহি মনে মনে বলল,
“অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো হয় না। যেমন আমার অতিরিক্ত ভালোবাসা হেরে গেছে তোর ছোট্ট আর মিষ্টি প্রেমের কাছে। আমার চিরকুটগুলো হারিয়ে গেছে তোর লাজুক হাসির কাছে। আমার প্রকাশিত অনুভূতিগুলো হেরে গেছে, তোর না বলা অনুভূতির কাছে। আমিই তো হেরে গেছি, আমার প্রেমিকের কাছে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭(২য় ভাগ)||

৫৩।
তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় ঘুরাঘুরি শেষে হোটেলে ফিরলো পুষ্প, লাবীব, রাদ আর আহি। গাড়ি থেকে নামতেই হঠাৎ পুষ্পের হাতটা গাড়ির কোণার সাথে লেগে কেটে গেলো। লাবীব পুষ্পের হাত থেকে রক্ত ঝরতে দেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পুষ্প লাবীবের এমন উৎকন্ঠা দেখে বলল,
“ওই মেয়েটা কি আমি?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন মেয়েটা?”

“যার প্রেমে পড়েছো!”

লাবীব কিছুক্ষণ পুষ্পের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পও যেন ঘোরের মাঝেই চলে যাচ্ছে। তখনই লাবীব হেসে বলল,
“তোমার প্রেমে পড়তে আমার বয়েই গেছে।”

পুষ্প লাবীবের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “ফাজিল ছেলে একটা।”

পুষ্প হনহনিয়ে হোটেলে ঢুকে পড়লো। লাবীব সেখানেই দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে হাসতে লাগলো। রাদ লাবীবের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আসলেই তো! মেয়েটা কে?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোর বউ!”

রাদ চোখ ছোট করে বলল,
“আমার বউ তোর বোনের মতো। সম্মান দিয়ে কথা বল।”

(***)

রাতে হোটেলের ছাদে উঠেই থমকে দাঁড়ালো আহি। আফিফ সুইমিংপুলের পাশে বেতের ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, আর পদ্ম তার বুকে মাথা রেখে কোলে বসে আছে। আফিফ খুব শক্ত করেই পদ্মকে জড়িয়ে ধরেছে। আর পদ্মের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। আহি এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন-মস্তিষ্ক জানে পদ্ম আর আফিফ স্বামী-স্ত্রী। তবুও সে কষ্ট পাচ্ছে। ঠিক তেমনি যেভাবে একজন স্ত্রী তার স্বামীর প্রতারণায় কষ্ট পায়, আর একজন প্রেমিকা তার প্রেমিকের ছলনায় কষ্ট পায়। কিন্তু আফিফ তো আহির কেউ হয় না। তাহলে এই কষ্টটার কি কোনো ভিত্তি আছে? এই কষ্টের কি কোনো সংজ্ঞা আছে? কেউ শুনলে আহির উপরই উপহাস করবে। কিন্তু আহিই জানে এই কষ্টটা কতোটা ভয়ংকর। বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে আহির। গলা কাঁপছে তার। হাতটাও ভীষণ কাঁপছে। আহি ধীর পায়ে পিছাতে লাগলো। সিঁড়ির কাছে আসতেই কেউ একজন তাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। আহি পেছন ফিরে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। রাদ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“উলটো দিকে ফিরে হাঁটছিস কেন?”

রাদ খেয়াল করলো আহির হাত কাঁপছে। আহি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। রাদ আহির দুই গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“আমি তোর পাশে আছি, আহি। কি হয়েছে বল?”

আহি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “আফিফ!”

রাদ আহিকে ছেড়ে ছাদের কাছে যেতেই একই দৃশ্য দেখতে পেলো। রাদ পেছন ফিরে আহির কাছে আসার আগেই আহি দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। রাদ আহির পেছন পেছন দৌঁড়ে এসেও তাকে ধরতে পারলো না। আহি তার আগেই নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। রাদ দরজায় ঠোঁকা দিয়ে বলল,
“উল্টাপাল্টা কিছু করবি না, আহি।”

আহি বুকে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো। তার সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। পদ্ম আফিফের চার বছরের সংসার। তাদের এতোটুকু ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের চোখে কেন দেখবে আহি? সে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো,
“আল্লাহ, তুমি আমাকে ওদের প্রেম কেন দেখালে? তুমি জানো না, মানুষটাকে আমি কারো সাথেই ভাবতে পারি না! আমি জানি তারা একসাথেই আছে। পদ্ম রোজ হয়তো আফিফের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়, রোজ হয়তো তারা কাছাকাছি আসে, রোজ হয়তো আফিফ তার অধর ছোঁয়ায় পদ্মের গালে। কিন্তু এসব আমার কাছে শুধুই হয়তো। কোনোটাই বাস্তব ছিল না। তাহলে আমি কেন দেখবো এসব? আমাকে কেন দেখাচ্ছো? আমার তো সহ্য হচ্ছে না। আমি কল্পনা করতে পারবো না এসব। যতোক্ষণ কেউ কিছু নিজের চোখে না দেখবে, ততোক্ষণ বিশ্বাস না করেও থাকা যায়। কিন্তু এখন এই দৃশ্য আমার চোখের সামনে বার-বার ভাসবে, কারণ আমি দেখে ফেলেছি। আমি কীভাবে এই দৃশ্য আমার মন থেকে মুছে ফেলবো? আমার ভালোবাসার মানুষ আমার সামনে অন্যের হৃদয়ে হারিয়ে গেছে। আর আমার হৃদয়টা খালি করে দিয়েছে।”

আহি দেয়াল ধরে মেঝেতে বসে পড়লো। রাদ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো আহি কান্না করছে। রাদ ভেবেছিল আহি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখে গেছে। কিন্তু এখনো যে তার আফিফ আসক্তি কাটেনি। রাদ তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোন বের করে ডাক্তার নায়ীবের নম্বরে কল করলো। কয়েকবার রিং হতেই নায়ীব কলটা রিসিভ করলো। রাদ ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“ডক্টর নায়ীব, আহির আবার প্যানিক এ্যাটাক এসেছে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।”

নায়ীব জিজ্ঞেস করলো, “কিছু কি হয়েছিল?”

রাদ নায়ীবকে জানালো আহি কি দেখে এমন করছে। নায়ীব সব শুনে বলল,
“রিল্যাক্স রাদ। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। আহির মস্তিষ্কে দু’জন অলকানন্দ। প্রথমজন যাকে আহি খুব ভালোবাসে। দ্বিতীয়জন যে আহিকে ভালোবাসে। প্রথম জনই হল বাস্তব। দ্বিতীয়জন আহির কল্পনা। বাস্তব আর কল্পনা মিশে যাওয়ায় আহি যখন অলকানন্দকে বাস্তবে দেখে সে স্বাভাবিক থাকে না৷ তোমাকে দুইটা উদাহরণ দেই। ধরো, তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসো। ধরো মেয়েটা আহি। আহির সাথে তোমার কাটানো মুহূর্তগুলো বা তুমি আহির জন্য যা করেছো সবকিছুই তোমার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। অন্য আরেকজন ছেলে, ধরো তার নাম এক্স। সে আহিকে সেভাবেই ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের দু’জনের ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। তুমি ভালোবাসায় ডুবে গেছো। ওটাকেই তুমি তোমার লক্ষ্য ধরে নিয়েছো। আর এক্স নামের ছেলেটা বাস্তবতা মেনে নিতে জানে। এমন পরিস্থিতি দু’জনের ভালোবাসাকে শুরুতে ভালোবাসা বলা যায়। কিন্তু শেষে এসে তোমার বাস্তবতা মেনে না নেওয়াটা হয়ে দাঁড়াবে রোগ। যেমনটা আহির হয়েছে। সে আফিফকে হারিয়ে ফেলার ধাক্কাটা নিতে পারে নি। কারণ ওর জীবনের যেই ট্রাজেডি সম্পর্কে জেনেছি, এমন হওয়াটা একদম স্বাভাবিক। আহির বাবা-মার সম্পর্কে ভালোবাসা ছিল না, কিন্তু তারপরও আহি নিজেই একটা ছেলেকে ভালোবেসেছে। আর ওর মস্তিষ্ক চেয়েছে ছেলেটা যাতে তাকে সেভাবেই ভালোবাসে, যেই ভালোবাসা সে তার বাবা-মার মধ্যে দেখে নি। তাই সেই বয়সে প্রেমটাই আহির লক্ষ্য হয়ে গেছে, যার রেশ এখনো কাটে নি। আর শেষমেশ সে যখন ছেলেটাকে হারিয়ে ফেললো, তখন তার মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া সেই অনুভূতিটা তার বেঁচে থাকার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। আর এজন্যই সে তার চারপাশে ছেলেটিকে কল্পনা করা শুরু করলো। ছেলেটির পছন্দে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো, যাতে কাল্পনিক মানুষটি তার উপর সন্তুষ্ট হয়। আর সে যাতে আহিকে ছেড়ে না যায়। আহি জানে ছেলেটা বিবাহিত, তাই একটা সীমার মধ্যে সে ছেলেটাকে কল্পনা করতো, একা একা গল্প করতো, ছেলেটার জন্য নিজেকে সাজাতো। একটা পড়া বার-বার পড়তে পড়তে যেমন মুখস্থ হয়ে যায়, এই এক্সপেরিমেন্টটাও আহির মস্তিষ্কে এই সত্যটা গেঁথে দেওয়ার জন্যই করতে বলেছি। আর আহিকে বোঝানোর জন্য যে তার কাল্পনিক পুরুষটির কোনো অস্তিত্বই বর্তমানে নেই। যাকে সে ভালোবাসতো, সে তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আজ এই ঘটনার পর আহির কাল্পনিক পুরুষটি সেই রূপেই আহির কল্পনায় আসবে, যেভাবে আজ তাকে দেখেছিল। আর সেটা আহি সহ্য করতে পারবে না। আমরা সেই জিনিসই কল্পনা করি, যেটা আমাদের মনকে সন্তুষ্ট করে। অসন্তুষ্ট করার মতো কিছুই আমাদের কল্পনায় জায়গা পায় না। আজ যদি আহি তার কাল্পনিক পুরুষের মুখোমুখি হতে পারে, পরের বার আহির আর হ্যালুসিনেশন হবে না। আর এরপরই আমি ওষুধ লিখে দিতে পারবো।”

রাদ নিজের রুমে গিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। আহি রুম বন্ধ করে কি করছে সে জানে না। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। এখন আর ঘুম হবে না রাদের।

(***)

আহি মেঝেতে শুয়ে আছে। মেঝেতে হাত হাতড়াতে হাতড়াতে আহি বলতে লাগলো,
“তুমি অন্তত আমার কল্পনায় আমাকে ভালোবেসো, আফিফ। আমি জানি, তুমি কাউকে স্পর্শ করো নি।”

আহি মেঝে থেকে উঠে ব্যাগ ঘেঁটে সাদা শাড়িটা বের করে পরা শুরু করলো। এলোমেলো ভাবে শাড়িটা গায়ে জড়ালো আহি। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“আফিফ, প্লিজ লাভ মি, প্লিজ।”

আহি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে আফিফ দাঁড়ানো। আর আফিফের হাতের মুঠোয় পদ্মের হাত। আহি হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে অন্তত কল্পনায় ভালোবেসো।”

আফিফের উত্তর এলো,
“আমি তো শুধু আমার পদ্মফুলকেই ভালোবাসি।”

আহি বুকে হাত রেখে বলল,
“আমি তোমাকে ভুলতে পারছি না, আফিফ।”

আহির কানের কাছে বার-বার একটা বাক্য এসেই ধাক্কা খাচ্ছে,
“আমি পদ্মফুলকে ভালোবাসি।”

আহির নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে সত্যটা মিটিয়ে ফেলতে। সে রাদকে ডাকার জন্য রুমের দরজা খুলে বের হতেই পদ্মের সাথে ধাক্কা খেলো। পদ্ম আর আফিফ ছাদ থেকে নেমে নিজেদের রুমে ঢুকছিল। আফিফ আর পদ্ম আহিকে এমন অবস্থায় দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, কি হয়েছে তোর? তোর এই অবস্থা কেন?”

পদ্মের কন্ঠ শুনে রাদ তড়িৎ গতিতে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আর আহিকে দেখেই সে দৌঁড়ে এলো। আহি আফিফের দিকে ভালোভাবে তাকাতেই পারছে না। আফিফ তাকে এমন অবস্থায় দেখে ফেললো কেন, এটাই ভাবছে সে। আরো অস্থির লাগছে তার। নিজেকে সামলাতে না পেরে শরীরের ভার ছেড়ে দেওয়ার আগেই রাদ এসে জড়িয়ে ধরলো আহিকে। রাদকে দেখে আহির কি হলো সে নিজেও জানে না। সেও রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আহি, তোর কি হয়েছে?”

আহি রাদকে বলল,
“আমাকে আজ তোর সাথে রাখবি, রাদ? আমি মরে যাচ্ছি।”

আফিফ বলল, “কি হয়েছে ওর?”

রাদ রাগী দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। রাদের চাহনি দেখে আফিফ আর একটা বাক্যও উচ্চারণ করার সাহস পেলো না। পদ্মও যেন বেশ অবাক হলো। রাদ আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। আহি রাদের কোলে মাথা রেখে বলল,
“ও আমাকে কেন ভালোবাসে না?”

রাদ আহির মুখটা উপরে উঠিয়ে বলল,
“আমি ভালোবাসি তোকে।”

“আমার সাথে এমন কেন হলো রাদ?”

“ভুলে যা না এসব!”

“ও আমার মনটা ভেঙে দিয়েছে। আমি কার কাছে অভিযোগ করবো? এমন একজনের কাছে যে নিজেই জানে না সে আমার মন ভেঙে দিয়েছে! আমি পাগল হয়ে গেছি, রাদ। ও আমাকে কাঁদতে দেখে ফেলেছে। এই শাড়িটা পরে রুম থেকে বের হয়েছি। ও সব দেখে ফেলেছে। আফিফ জেনে গেছে আমি ওর জন্য কান্না করছি।”

“আহি, ও বুঝবে না এসব। বুঝলে তোকে আজ কাঁদতে হতো না। ও তোকে কখনো বুঝে নি। আফিফ আর পদ্ম এখন এমন এক সম্পর্কে আছে, যেখানে তুই ভিত্তিহীন। যদি বিয়ে না হতো, আমি আফিফকে ধরে বেঁধে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম। এখন কি করবি বল? আমি কি করবো তোর জন্য বল?”

রাদের চোখে অশ্রু টলমল করছে। আহি চোখের পানি মুছে রাদের দিকে তাকালো। রাদ নিজের চোখ মুছে আহির মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তুই কাঁদছিস কেন?”

“তুই আমার সামনে কষ্ট পাবি, আর আমি হাসবো?”

“তুই আমাকে খুব বুঝিস, রাদ।”

“তুইও আমাকে বুঝে দেখ। দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালোবাসা একবার হয় না। বার-বার হয়। তুই শুধু ভালোবাসাকে তোর জীবনে আসতে দে। মনটাকে এক পুরুষে আবদ্ধ করিস না। যদি পুরুষটা তোর হতো তাহলে বিশ্বাস কর, এই মিথ্যে ভালোবাসার শহরে মানুষটা চরম ভাগ্যবান হতো। সে এখন নিজের হাতে ভাগ্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাহলে ক্ষতিটা তার হয়েছে। তোর এই ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার তার নেই। যার অধিকার, তাকে দে।”

“কার অধিকার?”

রাদ আহির চোখ ভালোভাবে মুছে দিয়ে বলল,
“যেদিন বুঝবি, সেদিন দিস। আশেপাশে তাকিয়ে দেখ। ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। শুধু কষ্ট করে খুঁজে নিতে হয়। এখন আমি তোকে ভালোবাসার মানুষ খুঁজে দিতে পারবো না। তবে আমি তোকে ততোদিন ভালোবাসা দেবো, যতোদিন সেই মানুষটাকে তুই খুঁজে না পাবি। যেদিন পাবি আমাদের সম্পর্কে সংযোজন বিয়োজন তো ঘটবেই।”

“কেমন সংযোজন বিয়োজন?”

“এই যে বন্ধুত্বে ভাটা আসবে। তুই নতুন প্রেমিককে সময় দিলে, আমি আর কোথায়!”

আহি হালকা হেসে রাদের হাতে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,
“যাহ পাগল, আমার বন্ধুকে আমি কখনো ভুলবো না।”

রাদ মনে মনে বলল,
“ভুলবি আর কীভাবে? একবার আমার প্রেমে পড়িস। আমার নামটা তুই কখনোই ভুলবি না। দ্বিতীয় কোনো ছেলের নামও আর তোর মনে পড়বে না। তোর মন জুড়ে শুধু আমিই থাকবো। তোকে কাঁদতেও হবে না। কারণ আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

(***)

রাতে আফিফ ঘুমাতে পারলো না। পদ্মও অনেকক্ষণ জেগে ছিল। আহির এমন অবস্থা অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে তাদের মনে। আফিফ নিজেও আহিকে সেই অবস্থায় দেখে অনেকটা অপ্রস্তুত ছিল। আহির চোখ ভর্তি জল। কাজল লেপ্টে গিয়েছিল। শাড়িটাও এলোমেলো। আফিফ তো খারাপ কিছু ভেবে রুমে একবার উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু ভেতরে কেউ ছিল না। তাহলে আহির এই অবস্থার জন্য কে দায়ী?
আফিফ এবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সমুদ্রের ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। বারান্দা থেকেই এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। শীতল হাওয়া শরীর স্পর্শ করে দিয়ে যাচ্ছে তার। আফিফ সেই স্পর্শে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অতীতের সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো, যেদিন এক অপরিচিতা তার জীবনে এসেছিল একটা ছবি নিয়ে। কখনো কেউ তার ছবি আঁকে নি। সেদিন এঁকেছিল এক অদেখা অস্তিত্ব। চিরকুট দিয়েছিল সাথে। আফিফ সেই চিরকুটটি পড়েই সেদিন খুঁজেছিল সেই অস্তিত্বটিকে। কিন্তু পায় নি। পেলেও বা কি হতো? ছুঁয়ে দেখা তো কখনোই সম্ভব না। জীবনের সব সম্ভাবনা যে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিল সে। জীবনটা তার হলেও ইচ্ছে পূরণের অনুমতি তার নেই। না, আর কিছু ভাবতে চায় না আফিফ। সেই ভয়ংকর দিনগুলো সে অতীতের পাতায় ফেলে এসেছে। এদের বর্তমানে জায়গা দিতে চায় না সে। তার বর্তমান জুড়ে পদ্মফুলই থাকুক।

৫৪।

পরদিন পুরো সকাল আহি ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। পদ্ম আফিফকে বলেছিল রাদের কাছ থেকে জেনে নিতে কি হয়েছিল রাতে। কিন্তু রাদ আফিফের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলছে। রাদের হাবভাব দেখে আফিফ আর তার সাথে কথা বলার সাহস পায় নি। শেষমেশ পদ্ম নিজেই রাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আহি সম্পর্কে। রাদ সংক্ষেপে জানালো, বাসায় সমস্যা হয়েছে তাই মন খারাপ ছিল। তার এই যুক্তি ফেলে দেওয়া যায় না। কারণ সবাই জানে আহির পারিবারিক জটিলতার কথা। সৎ মায়ের সংসারে কেই বা আর ভালো থাকে। পদ্ম আহিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য যেতে চায়লে রাদ দৃঢ়ভাবেই জানিয়ে দিলো, রাতের বিষয় নিয়ে যাতে আর কোনো কথা না তুলে। পদ্মও তাই আর কোনো প্রশ্ন করে নি৷

বিকেলে আহি ঘুম থেকে উঠেই খাওয়া-দাওয়া সেরে একা একা বীচে ঘুরে এলো। এদিকে পুষ্প আর লাবীব ঝর্ণায় যাওয়ার জন্য অস্থির। আজ হিমছড়ি যেতে হবেই তাদের। তারা দু’জনই প্রস্তুত। অন্যদিকে রাদ আহির জন্য না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। আফিফ আর পদ্মও তাই তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু আহি হঠাৎ বীচ থেকে ঘুরে এসেই বলল,
“চল ঘুরতে যাই। আর রাতে পার্টি দিবো।”

সবাই আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি বলল,
“ডান্স পার্টি হবো। যাদের নাচতে মন চাইবে নাচবে। আর যাদের খেতে মন চাইবে খাবে।”

পুষ্প বলল, “আমি তো খাবো।”

“আমি ম্যানেজারকে ফোন করে জানাচ্ছি, রাতের খাবারে যাতে সব ধরণের আইটেম থাকে।”

লাবীব এক গাল হেসে বলল,
“আহি লটারি জিতেছিস না-কি! এতো খুশি কেন?”

আহি হেসে বলল, “ভালো ঘুম হয়েছে তাই।”

কথাটি বলেই আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। আফিফ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হলো এটা? তাকে দেখেই এমন করলো কেন? আফিফ এবার আঁড়চোখে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম পুষ্পের সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। আফিফ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভাগ্যিস পদ্ম দেখে নি।

(***)

আহি তৈরী হয়ে আসতেই সবাই মিলে হিমছড়ি গেলো। সেখানে অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি শেষে পুষ্প পদ্মকে টেনে নিয়ে গেলো রাস্তার উল্টো দিকে। হিমছড়ির রাস্তায় সমুদ্রতীরে মানুষ তেমন একটা থাকে না। অন্যান্য জায়গায় বেশ মানুষজন। তাই ভিডিও বা ছবিতে মানুষের ছবি চলে আসে। বীচ খালি দেখে পুষ্প পদ্মকে নিয়ে সেখানে চলে গেলো। তাদের সাথে লাবীবও গেলো। আফিফ রাস্তার পাশে পাথরের উপর বসে ছিল। অন্যদিকে রাদ আর আহি ঝর্ণার পাশে বসে আছে। দু’জনই ব্যস্ত গল্প করতে। এই বিষয়, সেই বিষয়ের কথা বলতে বলতেই হঠাৎ রাদের ফোনে কল এলো। রাদের মা কল দিয়েছে। ঝর্ণার আশেপাশে কোলাহল বেশি হওয়ায় রাদ আহিকে বসিয়ে একপাশে চলে গেলো। রাদ চলে যেতেই আহি কয়েক সিঁড়ি উঠে ঝর্ণার কাছে যেতে লাগলো। কিন্তু পাথরগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে। একটা পাথরের উপর পা রাখতে গিয়েই হঠাৎ আহি পা পিছলে নীচে পড়ে গেলো।

(***)

আফিফ দোকানে পানির বোতল কিনতে এসে খেয়াল করলো ঝর্ণার পাশে ভীড় জমে আছে। আফিফ সেদিকে গিয়েই দেখলো আহি নিচে পড়ে আছে। আফিফ ব্যস্ত হয়ে আহির কাছে যেতেই দেখলো আহি ব্যথায় কাতরাচ্ছে। আফিফ জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে তোমার? হাত তো ছিঁড়ে গেছে! আহি, কি হয়েছে?”

পাশের একটা মেয়ে বলল,
“উপরে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে।”

আফিফ শাসনের সুরে বলল,
“বাচ্চা স্বভাব যাবে কখন তোমার?”

আহি আফিফের কথা শুনে তার দিকে তাকালো। এরপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “রাদ কোথায়!”

আফিফ আহিকে টেনে তুলতে যাবে কিন্তু আহি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না। তাই সে আহিকে বসিয়ে রাদকে খুঁজতে গেলো। কিন্তু আশেপাশে কোথাও রাদকে না দেখে আবার আহির কাছে ফিরলো। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার পায়ে ভীষণ ব্যথা করছে। হাঁটুতে নিশ্চিত কিছু হয়েছে।”

জিন্স পরা ছিল বিধায় হাঁটুতে কি হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে হাঁটুর দিকে জিন্সের অংশটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে হাঁটুর মাংস খানিকাংশ হলেও ছিঁড়ে গেছে। আফিফ আরেকবার এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে রাদকে খুঁজে পায় কি-না দেখে নিলো। এরপর আর কোথাও তাকে না দেখে নিজেই আহিকে কোলে তুলে নিলো।

রাস্তার মোড়ে এসে আফিফ একটা গাড়ি ঠিক করে আহিকে সেখানে বসালো। পদ্ম, পুষ্প আর লাবীবকে রাস্তা থেকেই দেখছে আফিফ। কিন্তু তারা বেশ দূরেই আছে। জোরে ডাকলেও শুনবে না। হাতের ইশারা করার পরও তাদের পালটা উত্তর এলো না। তার মানে তারা আফিফকে দেখেই নি। আফিফ পদ্মকে ফোন করতে গিয়ে দেখলো, পদ্মের ফোন তার কাছেই। বাকি কারো নম্বর আফিফের কাছে ছিলো না। সে এবার গাড়ির কাছে এসে আহিকে বলল,
“কাউকে ফোন করো।”

আহি ফোন বের করে রাদকে কল করলো। দেখলো রাদের নম্বর ব্যস্ত। আহি বিড়বিড় করে বলল,
“জন্মের সব কথা আজই তোকে বলতে হচ্ছে!”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি চোখ ছোট করে বলল,
“আপনাকে বলছি না।”

আহি এবার পুষ্পকে কল করলো। কিন্তু পুষ্প সাথে সাথেই কল কেটে দিলো। আহি রাগী স্বরে বলল,
“ছবি তোলার জন্য আমার কল কেটে দিচ্ছে! দাঁড়া, আজ তোকে দিয়ে হোটেলের সবগুলো বাসন পরিষ্কার করাবো আমি।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, আশেপাশের কোনো হাসপাতালে নিতে যেতে। এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি অন্তত মেসেজ করে বলো, নয়তো সবাই চিন্তা করবে।”

আহি সাথে সাথেই রাদকে মেসেজ করে দিলো। তারপর সিটে হেলান দিয়ে বসলো। আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ব্যথা করছে এখনো?”

আহি শীতল কণ্ঠে বলল,
“কিছু ব্যথা সহজে পিছু ছাড়ে না।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি এটাই করতাম।”

আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এসব সিনেমার কমন ডায়লগগুলো আমার একদম পছন্দ না।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ?”

“জ্বি হ্যাঁ। রাস্তায় এখন অন্য কোনো মেয়ের পা ভেঙে গেলে, আপনি বউ ফেলে কখনোই আসতেন না। আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন, কারণ আমি আপনার বউয়ের ফ্রেন্ড।”

আহি এবার ব্যাঙ্গ করে বলল,
“যে কেউ থাকলে আমি এমনই করতাম।”

আফিফ চোখ ছোট করে আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আপনার ভুল ধরিয়ে দিয়েছি। আমি আপনার পরিচিত তাই আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার জায়গায় পুষ্প থাকলেও আপনি এমন করতেন। কিন্তু যে কেউ না।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি বিড়বিড় করে বলল,
“এমন ভাবে বোঝাচ্ছে, যেন আমি অন্য কিছু মনে করছি।”

আফিফ বলল, “ঠিক এজন্যই বোঝাচ্ছি।”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“আপনি আমার কথা শুনছিলেন?”

“জোরে জোরে কথা বললে কি কানে আসবে না? আমি তো আর বধির না।”

“ওহ হ্যাঁ, আপনি তো অন্ধ। কিন্তু বধির না।”

দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আফিফ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,
“আর কতোক্ষণ লাগবে?”

ড্রাইভার জানালো প্রায় দশ মিনিট লাগবে। এবার আফিফ নিজেও গাড়িতে হেলান দিয়ে বসলো। এদিকে রাদের কল এলো আহির ফোনে। আহি রাদকে বলল, আফিফ তাকে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পাশটা যে কোন পাশ সে নিজেও জানে না। এখনো সেই পাশের হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে নি তারা। আহির কথা শুনে ড্রাইভার লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে একনজর আহিকে দেখে নিলো। আফিফ সেটা খেয়াল করে বলল,
“গাড়িতে বসে এতো কথা বলা ঠিক না!”

আহি চোখ ছোট করে বলল,
“আমার মুখ আমি বলবো।”

আফিফ এবার গুগল ম্যাপ অন করলো। না জানি কোথায় নিয়ে যায় এই ড্রাইভার। এরইমধ্যে পদ্মের কল এলো একটা অপরিচিত নম্বর থেকে। পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আপনি আহিকে একা ছাড়বেন না, প্লিজ। ওর পাশেই থাকবেন কিন্তু।”

আফিফ পদ্মকে আশ্বস্ত করে কল রাখলো। আফিফ আর আহি এবার দু’জনই একে অপরের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“এতোক্ষণ এদের খবর নেই, এখন মরে যাচ্ছে!”

আফিফ মৃদু হেসে বলল,
“পরের বার যে-কোনো অবস্থায় কল রিসিভ করবে। এই ভুল আর করবে না।”

“আমাদের উচিত ছিল ফোন বন্ধ করে তাদের শাস্তি দেওয়া। স্পেশালি পুষ্পের কল তো আমি এই বছর আর রিসিভই করবো না।”

আহি এবার পদ্মের ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্ম ভুলেও আর আপনাকে ফোন দিয়ে কোথাও যাবে না। ফোনটা কেন রেখেছে ও? বরের হাতে রাখার জন্য? আদর্শ বিবি একটা!”

“হুম।”

আফিফের হুম শুনে আহি ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। আহির চাহনি দেখে আফিফ নিজেও ভ্রূ কুঁচকালো। মেয়েটা যে কখন কোন চাহনিতে তাকে খুন করে ফেলে বলা যায় না। আফিফ একটু সরে বসলো। আহি আফিফের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে নিজেও গাড়ির একপাশে চলে গেলো। আফিফ তা দেখে কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আহি এবার বলল,
“আমার আপনাকে ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু ঘটনা তো উলটো হচ্ছে। আপনিই আমাকে ভয় পাচ্ছেন।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে