উধয়রনী পর্ব-২৮+২৯ + বোনাস পর্ব

0
94

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৮||

৫৫।
গাড়িটা হাসপাতালের সামনে এসে থামতেই আফিফ ভাড়া মিটিয়ে আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহি সেকেন্ড খানিক আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তোমার হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে, তাই!”

আহি আফিফের হাতটা শক্ত করে ধরলো। আজ এই হাতটা শুধু সাহায্যের জন্য এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদি অধিকারের হাত হতো, আহি হয়তো কখনোই ছাড়তো না। আফিফ আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই একজন নার্স এসে একটা হুইলচেয়ার এগিয়ে দিলো। আফিফ আহিকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আহির নাম এন্ট্রি করলো। নার্স আহিকে একটা কেবিনে নিয়ে তার হাঁটু আর হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। আফিফও এরপর ভেতরে এসে বসলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে আহিকে দেখে বলল,
“মানসিক চাপে আছেন আপনি?”

আহি ব্যস্ত হয়ে বলল, “না!”

এরপর আফিফের দিকে তাকালো। ডাক্তার আফিফকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি উনার কে হোন?”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড। আমি ঝর্ণার গিয়ে পিছলে পড়েছি, তাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”

ডাক্তার ব্যথার ওষুধ লিখে দিয়ে বলল,
“ব্যথা না কমা পর্যন্ত খাবেন। আর একটা ওয়েনমেন্ট লিখে দিলাম, সেটা লাগাবেন যেখানে ব্যথা লেগেছে। আর আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, মানসিকভাবে সুস্থ নন। মানসিক চাপ নিবেন না।”

ডাক্তার চলে যেতেই আহি চুপ করে বসে রইলো। সেকেন্ড খানিক নীরবতা বিরাজ করলো রুমটিতে। আফিফ নীরবতা ভেঙে বলল,
“মানসিক চাপ কেন নিচ্ছো?”

আহি আফিফের প্রশ্নে চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি এখনো মুভ অন করতে পারো নি!”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ নিজেও আর কি বলবে বুঝতে পারছে না। আহি এবার মলিন মুখে উত্তর দিলো,
“পদ্ম যদি আপনার জীবনে অনেক পরে এসে থাকে, তাহলে সেদিন কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন? কেন একটা বারের জন্যও আমাকে দেখতে চান নি?”

আফিফ চুপ করে রইলো। আহি বলল,
“হয়তো আপনার উত্তর আমাকে মুক্তি দেবে।”

আফিফ মুখ ঘুরিয়ে বসলো। আহির চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এতোই যদি সমস্যা থাকে, তাহলে চিরকুটগুলো কেন গ্রহণ করেছিলেন? কেন ছিঁড়ে ফেলে দেন নি? কেন যত্নের সাথে বুক পকেটে রেখে দিতেন? যদি একবারের জন্য আপনার চোখে আমি বিরক্তি দেখতাম, চিরকুট তো বহুদূর, স্বপ্নও দেখতাম না। আমার অপেক্ষা, আশা এক রাতেই শেষ হয়ে গেলো। সেদিন আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর সেই আড়াইটা বছর আমার মনে আপনি একই স্থানে ছিলেন। অথচ আপনার জীবনে পদ্ম এসে গেছে।”

আফিফ হাত মুঠো করে বসে আছে। তার গলা কাঁপছে। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি তোমাকে ঘৃণা কর‍তে পারতাম, কিন্তু করি নি। তোমার জন্য আমি অনেক কিছু হারিয়েছি, আহি। এতোটুকুই বলবো, তোমাকে ভালোবাসার যোগ্যতা নেই আমার। যাকে ভালোবাসার যোগ্যতা আছে, তাকে ভালোবেসেছি। আমি খুব সাধারণ মানুষ। সাধারণ জীবন যাপন করি। আমার কোনো শত্রু নেই। শত্রু চাইও নি। এতো ক্ষমতা নেই যে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াবো। আমি ছাড়া আমার মায়ের আর কেউ নেই। আমাকে ক্ষমা করে দিও যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি।”

আফিফ কথাগুলো বলেই উঠে চলে গেলো। আহি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তার জায়গায়। তার চোখটা লাল হয়ে গেছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গালটা মরিচা রাঙা হয়ে গেছে। কাঁদলে নাকি অনেক মেয়েকেই সুন্দর লাগে। কিন্তু আহিকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম মনে হয়। আহির ঠোঁটে হাসিই মানানসই। কিন্তু তার ভাগ্যটা বড়োই করুণ! হাসি তার ঠোঁটে বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হাসলেও সেই হাসিতে প্রাণ থাকে না। কারণ তার প্রাণ তো সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে।

(***)

আফিফ কেবিনের বাইরে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। জোরে জোরে বার-কয়েক শ্বাস ছাড়লো সে। পুরুষ মানুষ যেখানে সেখানে কাঁদতে পারে না। তাই আফিফ দ্রুত পায়ে হেঁটে করিডোরের অন্য প্রান্তে চলে গেলো। দেয়াল আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। পাশে একটা পানির কল ছিল। আফিফ পানি ছেড়ে মুখে পানির ছিঁটে দিলো।

এদিকে রাদ আর পদ্ম হাসপাতালে এসে পৌঁছাতে আহিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহি পদ্মের গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“তুই অনেক ভালো। তোর বরও অনেক ভালো। উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিস আমার পক্ষ থেকে।”

পদ্ম এদিক-ওদিক তাকিয়ে আফিফকে খুঁজতে লাগলো। আহি বলল, “বাইরে গেছে।”

পদ্ম আহিকে রাদের সাথে একা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি, রাদ।”

“কীসের উত্তর?”

“আফিফ কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল!”

“কেন?”

“হয়তো জেনে গেছে আমি এই সমাজের এক অভিশপ্ত মানুষ।”

“কি বলছিস এসব?”

“আমার জন্য না-কি ও অনেক কিছু হারিয়েছে। আমার জন্য সবাই সব হারিয়ে ফেলে৷ এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কি হতে পারে? আমি যা স্পর্শ করতে যাবো, সেটাই ঝরে যাবে। আমার জন্য মা সব হারিয়েছে, লিনু তার বাবাকে হারিয়েছে। আফিফও হয়তো কিছু একটা হারিয়েছে। আমি বিশ্বাস করেছি ওর কথা। রাদ, আমি কেন বেঁচে আছি? না আমি শান্তি পাচ্ছি, না কাউকে শান্তি দিচ্ছি। মনে হয় আমাকে হারতে হবে। আমার ভবিষ্যৎ আমার চোখের সামনে। তাজওয়ারকে বিয়ে করে ওর কাছে হেরে যাওয়া। এরপর আমি আর আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ দিনশেষে আমি অনেক টাকার মালিক হবো। সেই টাকা দিয়ে সব কিনে নিতে পারবো। শুধু ভালোবাসা আর সুখ কিনতে পারবো না।”

“এভাবে কেন বলছিস আহি? তাজওয়ারকে বিয়ে করতে হবে না তোর।”

আহি কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,
“তুই দূরে থাকিস আমার থেকে। কখন তুইও সব হারিয়ে ফেলিস আমার জন্য। তোর ঘৃণা নিতে পারবো না আমি, রাদ।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রাদ আহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আহি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি এমন এক অভিশপ্ত মানুষ যে পাপ না করেও পাপী। খুন না করেও খুনী।”

আফিফ আর পদ্ম কেবিনে ঢুকেই দেখলো আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। পদ্ম বলল,
“কি হয়েছে তোর?”

আহি রাদকে সরিয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললো।রাদও চোখ মুছে আহির দিকে তাকালো। আহি মাথা নিচু করে রেখেছে। আফিফ পদ্মকে বলল,
“আমরা বের হই বরং।”

পদ্ম আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল, “একটু দাঁড়ান।”

পদ্ম এবার আহির কাছে এসে রাদকে জিজ্ঞেস করলো, “আহি কাঁদছে কেন?”

রাদ বলল,
“ওর বাসায় ঝামেলা হবে হয়তো এই এক্সিডেন্টের কথা শুনে তাই।”

পদ্ম আহির পাশে বসে বলল,
“আমাকে বল আহি, কি হয়েছে? কেমন বাসা তোর? কিসের ঝামেলা? আংকেল কি তোকে বুঝে না?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“কেউ বুঝে না আমাকে। আমি কাউকে বোঝাতেও চাই না। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। তুই চলে যা তোর বরকে নিয়ে। আমি রাদের সাথে আলাদাভাবে যাবো।”

“কিন্তু…”

রাদ পদ্মকে বলল,
“যদি আমাদের একটু সময় দেওয়া যেতো!”

পদ্ম রাদের দিকে তাকালো। এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর পাশে আমি আছি। আমরা সবাই আছি। তোকে আমি বুঝবো। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক।”

আহি পদ্মের গালে হাত রেখে বলল,
“তুই অনেক ভালো। পৃথিবীর সব সুখ তোকে ছুঁয়ে দিয়ে যাক। এখন যা। আমি রাদের সাথে থাকি।”

পদ্ম আর আফিফ বেরিয়ে গেলো। আফিফ বের হওয়ার আগে আহির দিকে একনজর তাকালো। আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। সেই হাসি দেখেই আফিফের মনটা আরো ভারী হয়ে গেলো। তারা চলে যাওয়ার পর রাদ আহিকে নিয়ে হোটেলে চলে এলো।

(***)

একা একা সমুদ্রের তীরে হাঁটছে আফিফ। পদ্ম হিমছড়ি থেকে ফিরেই ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। সমুদ্রের ঢেউ স্পর্শ করে দিচ্ছে আফিফের পা যুগল। সে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“খেয়াল, তোমাকে হয়তো তোমার মতো করে ভালোবাসিনি, কিন্তু যতোদিন ছিলে অনুভব করেছিলাম ঠিকই। না দেখে হয়তো এতোটা ভালোবাসা যায় না। তুমি যেদিন বাস্তবে এসেছিলে, সেদিন আমার মনে শুধুই পদ্মফুল ছিল। তাই তুমি আমার খেয়াল হয়েই রয়ে গেছো। তোমার চিঠিগুলো আমাকে বিরক্ত করতো না। আমি তো উত্তর দেওয়ারই ঠিকানা পাই নি। তাই নিজেই সব উত্তর লিখে রেখেছিলাম একটা ডায়েরীতে। পদ্মকে ভালোবাসার পর মনে হয়েছিল এই অনুভূতি রাখাটাই পদ্মের সাথে ছল করা হবে। তাই ডায়েরীটা ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহস হয় নি। ভাগ্যিস চিঠিতে আমার নাম লিখি নি। তাই ছবি আঁকার শেষ স্যালারি দিয়ে আমি একটা নামহীন বই বের করেছিলাম। যেটা সবার কাছে বই। শুধু আমার কাছে খেয়াল। বইটির নাম দিবো ভেবেছি। কিন্তু সেই অধিকার আমার নেই। কখনো হবেও না। আমি চাই তুমি ভালো থেকো। আমাকে ভুলে যাতে সুখী হতে পারো।”

আহি বিছানায় শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি ফ্যানের দিকে। সে মনে মনে বলছে,
“আমি শরতের পত্রঝরা বৃক্ষ। হালকা হাওয়া লেগে ধীরে ধীরে আমার স্বপ্নগুলো ঝরে যাচ্ছে। কখন যে আমিই স্বপ্নহীন, হৃদয়হীন মানুষ হয়ে পড়ি! যদি হতে পারতাম, তাহলে এতো কষ্ট হতো না। বাবা, মিসেস লাবণি, তাজওয়ার কারোই তো হৃদয় আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তাদের দেখে মনে হয় বেশ সুখেই আছে। হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর মানুষগুলো বেশি সুখী হয়। আমারও এবার হৃদয়হীনা হতে হবে। আমিও এরপর সুখী হবো।”

অন্যদিকে রাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
“আমি এমন এক ভোরের সূর্যের অপেক্ষায় আছি, যেই আলোতে আহির জীবনের কুয়াশাচ্ছন্ন অতীত মুছে যাবে। এমন এক উষ্ণ বায়ুর অপেক্ষায় আছি, যেই বায়ু আহির মনের সব শীতল অনুভূতিগুলোকে বিলীন করে দেবে। আমি আহির পাশে থাকতে পারবো কি পারবো না জানি না। কিন্তু যদি নাও পারি, আহিকে তার মনঃযুদ্ধে জয়ী দেখতে চাই।”

৫৬।

রাতে ছাদে ছোট একটা পার্টি রেখেছে আহি। হোটেলে উপস্থিত অতিথিরাও সেখানে এসেছে। সুইমিংপুলের উল্টোদিকে ছোট একটা মঞ্চ করা হয়েছে। ওখানে এসে অতিথিদের মধ্যে যাদের ইচ্ছে হবে, গান গাইবে। স্লো ডান্স করছে অনেকে। আহি চুপচাপ একপাশে বসে আছে। রাদ তার পাশেই বসে আছে। পদ্ম আর আফিফ নিজেদের মতো কথা বলছে। পুষ্প আর লাবীব কি খাবে, কি খাবে না সেটাই দেখছে। রাদ আহিকে বলল,
“এখন কেমন লাগছে তোর?”

আহি রাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“মনটা হালকা লাগছে। ভাবছি মনটাকে আরো হালকা করবো।”

“কীভাবে?”

রাদ প্রশ্ন করতেই হোটেল ম্যানেজার আহির কাছে এসে বলল,
“ম্যাম, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”

আহি বলল,
“জিনিসগুলো সুইমিংপুলের ওই পাশটাই রাখবেন। একটা আরামদায়ক চেয়ারও যাতে থাকে।”

“জ্বি ম্যাম।”

ম্যানেজার চলে যেতেই রাদ জিজ্ঞেস করলো,
“কি করবি তুই?”

আহি বলল,
“নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে চাচ্ছি।”

আহি এবার উঠে দাঁড়ালো। ম্যানেজার তার হোটেলের বয়কে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় কি রাখতে হবে। বয়টি সুইমিংপুলের পাশে একটা ইজেল রাখলো। পাশে একটা টুলের উপর ক্যানভাস আর কিছু রং আর বিভিন্ন প্রকারের তুলি। সাথে একটা বসার চেয়ার। আফিফ খেয়াল করলো এসব। সে ভ্রূ কুঁচকে সেই ইজেলটির দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই আহি সেই জায়গায় গিয়ে বসলো। সে ধীরে ধীরে ইজেলটির উপর ক্যানভাসটি বসালো। পুরো ছাদে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। পছন্দ মতো রং বের করে একটার সাথে আরেকটা মেশালো। তারপর তুলি গুলো বের করে টুলের উপর ছড়িয়ে রাখলো। আহি এবার চোখ বন্ধ করলো। মনে মনে বলল,
“আজ আমি আবার নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে চাই। তবে এবার গল্পটা আমার আর আফিফের হবে না। এবার গল্পটা আমার আর প্রকৃতির হবে। যেখানে আফিফ রাফাত একজন অতিথি পাখি। যে হুট করে এসেই আমার মনের অনেকাংশ দখল করে নিয়েছে। অনেকাংশ কেন বলছি? পুরোটাই তো দখল করে নিয়েছে। এখন আবার ঋতুর পরিবর্তনে সে উড়াল দিয়েছে তার ঠিকানায়। সে আমার জীবনে আসা এক অতিথি পাখি।”

আহি রং মাখিয়ে সাদা ক্যানভাস রাঙিয়ে দিচ্ছে। মনের সব জানালা খুলে দিয়ে সে ছবি আঁকছে। আজ এই তুলি কাউকে ভয় পেয়ে থেমে যাবে না। আজ সে ক্যানভাস ফুটিয়ে তুলবে তার শিল্পীর মনের কথায়।

(***)

ছবি আঁকা শেষে আহি ক্যানভাস থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। সামনে তাকাতেই দেখলো আফিফ আর পদ্ম সুইমিংপুলে পা ডুবিয়ে কথা বলছে। পদ্ম শক্ত করে আফিফের হাত আঁকড়ে ধরেছে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই অধিকারটা আমার ভাগ্যে ছিল না। তুমি আমাকে তোমার জীবনের কোন অংশে স্থান দিয়েছিলে আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে সেই অংশটা ভালোবাসা মনে হয় নি। যদি সত্যিই ভালোবাসা হতো, তাহলে একবার হাত এগিয়ে দিয়ে দেখতে পারতে, আমি তোমার জন্য সবার সাথে যুদ্ধ করতাম। কিন্তু তুমি পালিয়ে গেছো। হয়তো এর পেছনে কোনো বড় কারণ ছিল। যাক, আমি তো আমার কষ্টদের মুক্ত করে দিয়েছি। দেখো আফিফ, আমি হাসছি। আমার এই হাসি আজ লোক দেখানো নয়। আমার মন হাসছে। জানি না কেন? হয়তো বেশি ধাক্কা খেয়ে ফেলেছি, তাই আর নিজেকে শক্ত করা ছাড়া উপায় ছিল না। আজ থেকে আমি সজ্ঞানে মেনে নিয়েছি, আমি যাকে ভালোবাসতাম, সে তুমি নও। সে তো রাতের আকাশে জেগে থাকা তারা। যেই তারা ভূমিতে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করা অকল্পনীয়। আবার সেই তারাটিই একদিন বিলীন হয়ে গেলো মৃত তারাদের মাঝে।”

আহি চেয়ার ছেড়ে উঠে তার ক্যানভাসটি ইজেল থেকে নামালো। তারপর হাত ধুয়ে এসে দেখলো, কয়েকজন তার আঁকা ছবির আশেপাশে জটলা পাকিয়েছে। আহি ক্যানভাসটি হাতে নিয়ে বলল,
“ছবি কেমন হয়েছে?”

সবাই মাথা নাড়িয়ে আহিকে বলতে লাগলো,
“আপনি তো ভালো ছবি আঁকেন।”

আহি প্রতিত্তোরে বলল,
“অনেক বছর পর এঁকেছি। এতেই যদি এতো ভালো হয়, তাহলে দ্বিতীয়বার আমাকে হতাশ হতে হবে না।”

আহি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে রাদকে ছবিটি দেখলো। রাদ হাতের ইশারায় বলল, “দারুন।”

আহি বলল,
“এটা আমার অতীত গল্পের সমাপ্তি চিত্র। এটা আমি নিজের কাছে রাখবো না।”

রাদ আহির কথায় ভ্রূ কুঁচকালো। আহি পেছন ফিরে আফিফ আর পদ্মের দিকে তাকালো। তারপর ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সেদিকেই পা বাড়ালো। আফিফ আহিকে আসতে দেখে পদ্মের হাত ছেড়ে দিলো। পদ্ম আহিকে দেখে বলল,
“আহি, ভীষণ সুন্দর করে সাজিয়েছে ছাদটা।”

আহি বলল,
“হুম। তোকে আর আফিফকে আমার পক্ষ থেকে একটা উপহার দিতে এসেছি।”

পদ্ম আর আফিফ উঠে দাঁড়ালো। আহি ছবিটি পদ্ম আর আফিফের দিকে ঘোরাতেই পদ্ম ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“বাহ, বেশ সুন্দর।”

আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম ছবিটি হাতে নিয়েই আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি বলল,
“অনেকদিন পর নিজের প্রতিভা প্রকাশ করলাম। একটা সময় রং তুলি আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। এবার ভাবছি, নতুন জগতে এই প্রতিভা থাকুক নতুনত্বের সাথে।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বলেছি না আপনাকে, আহি অনেক ভালো ছবি আঁকে? দেখেছেন?”

আহি বলল,
“আফিফ, আমরা তো শুনেছি, আপনিও ভালো ছবি আঁকেন। তাহলে এখন আঁকেন না কেন?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “সময় পাই না।”

“সময় করে নেবেন। নিজের প্রিয় কাজ নিজেকে যতোটা আনন্দ দেবে, আর কোনো কাজই সেই আনন্দ দেবে না।”

আহি পদ্মের থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“কতো চমৎকার একটা মানুষ আপনার জীবনে এসেছে। তার স্বপ্ন পূরণ করুন। জীবনে শুধু টাকার পেছনে ছুটলে হয় না। স্বপ্নের পেছনেও ছুটতে হয়। দেখবেন, তখন টাকাটাও আপনার হাতে এসে ধরা দেবে।”

পদ্ম বলল,
“দেখেছেন, আহি আপনাকে ভালোই মোটিভেট করছে।”

পুষ্প পেছন থেকে এসে বলল,
“আহি কিন্তু সবাইকে অনেক মোটিভেট করে। ভাইয়া, আপনার প্রতিভা আমরা কখন দেখছি তাহলে? শুধুই তো শুনেছি আপনি ছবি আঁকেন। কখনো তো দেখি নি। আমাদের বান্ধবী দেখেছে কি-না তাও সন্দেহ।”

পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“দেখেছি তো। উনি আগে কতো ছবি এঁকেছেন, সব আছে। আর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে কোনটা জানিস? সেই ছবিটা, যেটা নিয়ে ওদিন প্রশ্ন করেছিলাম!”

আফিফ পদ্মের কথায় থতমত খেয়ে গেলো। সে পদ্মকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করবো ছবি আঁকার।”

এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ এই ছবিটি উপহার দেওয়ার জন্য। তুমি ভীষণ ভালো ছবি আঁকতে পারো।”

পুষ্প ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, ছবিটির নাম কি?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“অতিথি পাখির ঘরে ফেরা।”

আফিফ আহির কথা শুনে সেকেন্ড খানিক স্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পের কথায় তার ঘোর কাটলো। পুষ্প বলল,
“ঘরে কোথায় ফিরছে?”

আফিফ ছবিটি সরিয়ে নিয়ে বলল,
“কিছু ছবির অর্থ সবাই বুঝে না। যারা ছবি আঁকে তারাই বুঝে। দেখে অন্য কিছু মনে হলেও নামের সাথে ছবিটির বেশ মিল আছে। মানতেই হচ্ছে, আহি ভালো ছবি আঁকতে পারে।”

লাবীব বলল,
“আমাদের অর্থটা বুঝিয়ে দেবেন, ভাইয়া?”

আহি বলল,
“ধুর, সিলেবাসের বাইরে চলে যাচ্ছিস তোরা। আমার আঁকা ছবি নিয়ে তোদের রচনা লিখতে হবে না।”

(***)

আফিফ আহির আঁকা ছবিটি হোটেলে নিয়ে এলো। পদ্ম ওয়াশরুমে গেছে। এই সুযোগে ছবিটি ছুঁয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু আফিফ ছবিটিতে হাত লাগালো না। রং নষ্ট হয়ে যাবে।
ভীষণ কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে আহি এই ছবিতে। এই কষ্ট ছুঁয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আফিফের নেই। ছবির একপাশে একটা ভাঙা দালান। সেই দালানের মূল দরজার রঙটা হলুদ। আর সেই হলুদ গেট ঘেঁষে লাগানো একটা বৃক্ষ। যেই বৃক্ষে একটি পাতাও নেই। পাশে একটা রাস্তা। যেটা কোথায় মিলিত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। আর অন্যপাশে একটা ঝিল। যেই ছিলে একটি মাত্র পদ্মফুল উঁকি দিচ্ছে। বৃক্ষটির উপর একটা পাখি হয়তো বসে ছিল, সেটাই উড়াল দিয়ে নামছে ঝিলের দিকে। ছবি দেখে বুঝা যাচ্ছে, পাখিটি নামতে গিয়েই তার পাখার ঝাপটা লেগে গাছের শেষ পাতাটিও ঝরে পড়ছে।
আফিফ বুঝতে পারলো, এটা আহি আর তার জীবনের ক্ষুদ্র গল্প। সেই হলুদ গেটটি চারুশিল্পের গেট। যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি আহি নিজেই। সেই গাছে একদিন একটা অতিথি পাখি বসেছিল। যেই পাখিটি আফিফ। সেই গাছে কোনো প্রাণ নেই। কোনো স্বপ্ন নেই। একটাই স্বপ্ন ছিল, যেটা পাখিটা উড়ে যেতেই ঝরে পড়লো। আর সেই স্বপ্নটা ছিল ঝরে পড়া পাতাটি। অন্যদিকে রাস্তাটি হচ্ছে তাদের গন্তব্যহীন পথ। আর ঝিলটি আফিফের সংসার। পদ্মফুলটি পদ্মের প্রতিচ্ছবি। এক কথায় অতিথি পাখির ঘরে ফেরা ছবিটির মূল অর্থ, আফিফ তার সংসারে ডুব দিয়েছে আহির স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে।

আফিফ শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিলো। এই ভালোবাসা গ্রহণ করার ক্ষমতা কেন সৃষ্টিকর্তা তাকে দেয় নি, সে জানে না।

এদিকে আহি রাতে ছাদে একা একাই বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর রাদ এসে আহির পাশে বসলো। নীরবতা ভেঙে রাদ বলল,
“জীবনটা নতুন করে কবে শুরু করবি? কখন সেই মানুষটাকে ভালোবাসা ছাড়বি?”

আহি হালকা হেসে বলল,
“আমি ভালোবাসতাম তাকে, ভালোবাসি এখনো, যতোদিন বেঁচে আছি তাকেই ভালোবাসবো। তবে এবার আমার ভালোবাসা আমার মনটা ভেঙে দিবে না। আমাকে মুক্তি দিবে। আমি ভালোবাসি বলেই তো ভালোবাসাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। চাইলে কি পারতাম না, আমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিতে? কিন্তু কেন করব? এখানে তো আমারই ক্ষতি।”

আহি এবার নিজের হাতের রেখার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাগ্যে কি আছে আমি জানি না। জানতে চাইও না। কিন্তু আমি ভালো থাকবো, এটা ভেবে যে, আমি দিনশেষে আমার ভালোবাসাকে হারতে দেই নি। পৃথিবীর কাছে আমি আমার ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করি নি। আমার প্রিয় মানুষটাকে প্রতারক হতে দেই নি। আমার ভালোবাসা আমার কাছে মিষ্টি এক অনুভূতি। আর আফিফ আমার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরুষ। আমি এই দু’টোকে কলুষিত করতে পারবো না। তাই মুক্ত করে দিয়েছি দু’টোকেই। প্রকৃতি যদি চাইতো তাহলে আমি তাকে হারাতাম না। আমাদের এক হওয়ার থাকলে, এতো অপেক্ষাও করতে হতো না। যদি সে আমার হয়, তাহলে হবেই। কিন্তু আমি হারবো না। তার বিবেককেও আমি হারতে দেবো না। পৃথিবী জানবে এক উন্মাদ প্রেমিকা তার প্রেমিককে বাঁচিয়েছে তাকে ত্যাগ করে। সুন্দর না আমার প্রেমের গল্পটা?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৯||

৫৭।
জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখছে আহি। তার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তার। যদিও পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। পায়ের ব্যথা মোটামুটি কমেছে তার।
আহি এবার ব্যাগ থেকে তার পছন্দের সোনালি রঙের টপসটা বের করলো। ঘন্টাখানেক আয়নার সামনে বসে নিজেকে সাজালো সে। কতো বছর পর নিজেকে সময় দিচ্ছে! রুম থেকে বের হতেই পুষ্পের সাথে দেখা। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“চল, একসাথে নামি। ব্যথা কমেছে তোর?”

আহি মৃদু হেসে বলল, “কাল থেকে কিছুটা কমেছে।”

আহি নিচে নামতেই পদ্ম আর আফিফকে দেখতে পেলো। পুষ্প আর আহি তাদের টেবিলে বসতেই পদ্ম আহিকে বলল,
“আহি, তোর তো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।”

আহি বলল,
“কাল থেকে অনেক ভালোই হাঁটতে পারছি। কাল তো পা’টা সোজাসুজি ভাবে বসাতেই পারি নি।”

নাস্তা সাজাতে সাজাতে রাদ আর লাবীবও এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। রাদ আহির দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল, “ভালো আছিস?”

আহি হেসে বলল, “হুম।”

আহির ঠোঁটে আজ অন্য ধরণের হাসি দেখছে রাদ। এমন ভাবে হাসতে আহিকে আগে কখনোই দেখে নি সে। আহি কি তাহলে সেই ট্রমা থেকে নিজেকে বের করে নিয়েছে?
সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তখনই লাবীব বলে উঠলো,
“এভাবে চুপচাপ বোরিং লাগছে। চল, আমরা একটা গেইমস খেলি।”

পুষ্প বলল, “কি গেইমস!”

“একটা শব্দ বলবো, যেমন ধরো আমি বললাম রোগী। রোগী শব্দটা শুনেই প্রথম যেই শব্দ মাথায় আসবে ওইটাই হবে পরের শব্দ। সেই শব্দে শুনে যেটা মাথায় আসবে ওটা হবে তৃতীয় শব্দ।”

“বাহ, বেশ তো। চলো শুরু করি।”

লাবীব আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাইয়া, আপনিও কিন্তু খেলছেন।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“চলুন না।”

আফিফ মাথা নাড়তেই লাবীব শুরু করলো,
“প্রথম শব্দ নাস্তা।”

রাদ বলল, “ডিম।”

আফিফ বলল, “কুসুম।”

পদ্ম বলল, “ফুল।”

পুষ্প বলল, “গোলাপ।”

আহি বলল, “লাল।”

লাবীব বলল, “রক্ত।”

রাদ বলল, “খুন।”

আফিফ বলল, “আপা।”

আফিফের কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকালো। পদ্ম কথাটা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, “চয়ন।”

পুষ্প কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “নাম।”

আহি বলল, “আহি।”

লাবীব বলল, “রোগী।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“হাসপাতাল।”

আফিফ বলল, “ব্যান্ডেজ।”

পদ্ম বলল, “আহি।”

আহি হেসে বলল,
“সবসময় আমার নামটা কেন আসে, ভাই? এটা হবে না। একটা শব্দ দ্বিতীয় বার ব্যবহার করা যায় না।”

পদ্ম বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। ওয়াসিকা কবির।”

পুষ্প এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওয়াসিকা ইজ ইকুয়াল টু বান্ধবী।”

আহি বলল, “লিনাশা!”

আহি কথাটি বলেই থেমে গেলো। পদ্ম আর পুষ্প আহির দিকে তাকালো। লাবীব বলল,
“লিনাশা দিয়ে কি বলবো? আচ্ছা, স্কুল।”

রাদ বলল, “স্মৃতি।”

আফিফ বলল, “ছবি।”

পদ্ম বলল, “সিনেমা।”

পুষ্প বলল, “ভিলেন।”

আহি বলল, “তাজওয়ার খান।”

আহির কথা শুনে সবাই এবার তার দিকে তাকালো। আহি হেসে বলল,
“ফরগেট ইট। চল এসব খেলা বাদ দে এখন।”

রাদও কথাটা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করলো। সবাই রাদের কথায় মনোযোগ দিলেও আফিফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহির দিকে। তাজওয়ার খান নামটা বেশ চেনা চেনা লাগছে তার। কোথায় শুনেছে এই নাম?

(***)

পদ্ম, পুষ্প আর আহি নাস্তা শেষে একসাথে বসে হাসাহাসি করছে। রাদ দূরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহির মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আর আজকের এই পরিবর্তনের জন্য একটা মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি। আর সে হলো নায়ীব তামজিদ। রাদ নায়ীবকে ফোন করে বলল,
“আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও কম হবে। আপনি আমাকে কি ফিরিয়ে দিয়েছেন, আপনি জানেন না।”

নায়ীব মুচকি হেসে বলল, “এটা আমার দায়িত্ব।”

এদিকে বিকেলে সবাই বসে গল্প করছিলো। তখন আহি তার ফোনটা রেখে ওয়াশরুমে গেলো। আর সেই মুহূর্তে ফোনে এলো মিসেস লাবণির কল। ফোনের স্ক্রিনে লাবণির ছবি দেখে পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আরেহ, এটা তো লিনাশার আপু! আহি না বললো, ওর সাথে লিনাশার কোনো যোগাযোগ নেই? তাহলে আপুর কল ওর ফোনে কেন আসছে?”

রাদ ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা লাবণির ছবি দেখে বলল,
“আরেহ উনি লিনাশার আপু না। উনি আহির মা।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির মা? উনাকে আমরা চিনি।”

লাবীব বলল,
“আরেহ, এটা ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী!”

পুষ্প আর পদ্ম চোখ বড় বড় করে লাবীবের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“এটা লিনাশার আপু। আমরা উনাকে সামনা-সামনি দেখেছি।”

মুহূর্তেই সবার মাঝে নীরবতা ছেয়ে গেলো। আহি এসে দেখলো তার ফোন পুষ্পের হাতে। পুষ্প ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
“তোর ফোন এসেছে।”

“কার কল!”

“লিনাশার আপু।”

আহি তড়িৎ গতিতে ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেলো আহি। পদ্ম বলল,
“লিনাশার সাথে তোর তো যোগাযোগ নেই।”

আহি থমথমে কন্ঠে বললো,
“আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না।”

আহি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আহি চলে যেতেই পুষ্প বলল,
“আজ বুঝলাম, লিনু আর আহির এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে কেন ফাঁটল ধরেছে। ওদের জীবনে এতো বড় ঘটনা ঘটে আছে, আর ওরা দু’জনেই এই ব্যাপারে কাউকে জানায় নি?”

রাদ বলল,
“আমার মনে হয় যেটা ওরা জানাতে চায় না, এই বিষয়ে প্রশ্ন করে ওদের বিরক্ত না করা উচিত। আমি তোমাদের দু’জনকে রিকুয়েষ্ট করছি, আহিকে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, প্লিজ। ও এমনিতেই অনেক চাপে আছে। এতোদিন আমরা যেভাবে হাসিখুশি স্বাভাবিক ছিলাম, এখনো ওরকমই যাতে থাকি।”

পদ্ম বলল,
“হুম, আমরা কিছু বলবো না। কিন্তু ওদের ভুল বুঝাবুঝি দূর করা তো আমাদের দায়িত্ব।”

রাদ বলল,
“আমরা তো জানি না কি হয়েছে। আহি কখনো এই ব্যাপারে কিছু বলে নি। আমার মনে হয় এসবে আমাদের না জড়ানো উচিত। প্লিজ, আমি আহিকে মানসিক ভাবে দুর্বল দেখতে চাই না। ওর মন ভালো করার জন্য এখানে এনেছি। ওকে অন্তত এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করে আবার ওর মন ভেঙে দিও না।”

আফিফ রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদের আকুতিভরা কন্ঠ শুনে অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাদ আহিকে ভালোবাসে না। ভীষণ ভালোবাসে সে আহিকে। তাই তো আহির জন্য এতোটা উদ্বিগ্ন। আফিফ রাদকে আশ্বস্ত করে বলল,
“তুমি ওর কাছে যাও। পদ্ম এ ব্যাপারে আহিকে কোনো প্রশ্ন করবে না।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ তার হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল,
“কারো দুর্বলতা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করা ভালো।”

রাদ আফিফের কথা শুনে মৃদু হাসলো। মানুষটা বুঝদার। তার এক কথায় পদ্ম আর পুষ্প তাদের উৎসাহ কমিয়ে ফেলেছে। নয়তো মেয়েদের এই এক স্বভাব। পরিস্থিতি যতোই জটিল হোক, উত্তর না পাওয়া অব্ধি শান্ত হবে না। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়ে পদ্ম আর পুষ্প চুপচাপ বসে থাকার মতো মেয়ে নয়। এখানে রাদের অনুরোধও ভিত্তিহীন তাদের কাছে। অথচ আফিফের এক বাক্যে দু’জনই আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। তারা যে এবার আর আহিকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না এ ব্যাপারে রাদ নিশ্চিত।

(***)

আহি রুমে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাদ আহির রুমে ঢুকেই দেখলো আহি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সে ব্যস্ত হয়ে আহির কাছে বসে বলল,
“কাঁদছিস কেন?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুই কি ওদের বলেছিস উনি আমার বাবার স্ত্রী হোন?”

রাদ মাথা নিচু করে বলল,
“হুম, আমি আসলে বুঝতেই পারি নি। হঠাৎ হয়ে গেলো সব। আর এটা কোনো বিষয় হলো? তুই কেন কাঁদছিস?”

“এবার ওরাও আমাকে ভুল বুঝবে।”

“কেন ভুল বুঝবে? কেউ তোকে ভুল বুঝে নি। বিশ্বাস কর, ওরা এসব মাথায়ও রাখে নি।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, সবাই আবার নিজেদের মতো গল্প করছে।”

আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই বিশ্বাস কর, আমি জানতাম না এসব। বাবা হুট করে এমন কান্ড ঘটিয়েছিল। এমন সময়ে আমি এই ধাক্কাটা খেয়েছি, যখন আমি নিজেই মানসিকভাবে সুস্থ ছিলাম না। আমি সব হারিয়ে ফেলেছিলাম সেই বছর। কিন্তু আমি এখন মন থেকে ভালো থাকতে চাই। প্লিজ, আমাকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিস না আর।”

রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুই। তোর অতীত না। তোর মতো মিষ্টি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করার জন্য এই অতীতটা খুবই দুর্বল। তাই এমন ভিত্তিহীন চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেল যে, আমরা কেউ তোকে ভুল বুঝবো।”

৫৮।

রাতে ডায়েরীর পাতা উল্টালো আহি। এরপর কলম হাতে নিয়ে লিখলো,
“এআর, তুমি হয়তো কখনোই আমার কল্পনায় আসবে না। তারা হয়ে গেলে যে। আজ থেকে আবার আমার অনুভূতিগুলো এই ডায়েরীতে স্থান পাবে। শোনো এআর, তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দিতে পারবো না। হয়তো এজন্য আমার তোমাকে নিয়ে দেখা অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো আহি। স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করবো না, তা তো হয় না। তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো পূরণ হবে, এআর। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করবো আজই। একটা স্বপ্ন ছিল আমার। সাগর পাড়ে তোমার সাথে সমুদ্র বিলাস করবো। এক রাতের জন্য একটা ছোট্ট সাজানো ঘর বাঁধবো সমুদ্র পাড়ে। আজ এই স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার কল্পনায় দেখা তুমিটা এবার বাস্তবে হাসবে। তোমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে তুমি সমুদ্র দেখবে। শুনবে সাগরের আর্তনাদ। তোমার চোখে আটকে থাকবে তোমার ভালোবাসার মানুষটির মিষ্টি হাসি। তোমার বুকে ঝাপটে পড়বে সে। সেই মানুষটা আসবে আজ। তোমার মনের মানুষ আজ তোমার মনের মতো করে সাজবে।”

আহি ডায়েরীটা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আজ তুমি চোখ সরাতে পারবে না। আজ তুমি প্রেমে পড়তে বাধ্য, আফিফ। আর আমি তোমাকে প্রেমে পড়তে দেখবো, এর চেয়ে চমৎকার মুহূর্ত আর কি হতে পারে, বলো?”

আহি হোটেল ম্যানেজারকে বলে সমুদ্রের পাশে একটা বড় তাবু বাঁধালো। সেই তাবুর ভেতর উঁচু একটা বেড বিছিয়ে দিলো। তাবুর সাথে লাগিয়ে দিলো ছোট ছোট মরিচ বাতি। ভেতরে ছোট একটা টেবিল রাখলো। আর তার উপর ছোট ছোট মোম সাজিয়ে সেগুলোতে নিজ হাতে আলো জ্বালাতে লাগলো। গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে বিছানায় ছড়িয়ে দিলো। ম্যানেজার এক গুচ্ছ অলকানন্দা ফুল নিয়ে আসতেই টেবিলের উপর রেখে দিলো আহি। এরপর সব গুছিয়ে চলে এলো হোটেলে। ঢুকলো হোটেলের ড্রেসিংরুমে। আহির হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেট থেকে একটা সাদা শাড়ি বের করলো সে। সাথে লাল রঙের স্লিভলেস ব্লাউজ। যত্নের সাথে শাড়িটা গায়ে জড়ালো। একটা লাল টিপ কপালের মাঝখানে বসালো। হাতে পরার জন্য এক গুচ্ছ চুড়ি নিলো। কানে বড় বড় ঝুমকো ঝুলিয়ে দিলো। কড়া পারফিউম গায়ে লাগালো। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক লাগানোর পর, খোঁপায় বেঁধে দিলো অলকানন্দা ফুলের মালা। আয়নায় দেখে বলল,
“আজ আফিফ প্রেমে পড়বেই।”

কথাটি বলেই আহি মুচকি হাসলো। ম্যানেজারকে শিখিয়ে দিয়েছে আফিফকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আফিফ আগে থেকেই তাবু বেঁধে রাখা জায়গাটিতে চলে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে সে খুব অবাক হলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“কে করেছে এসব!”

তখনই আহি আফিফের সামনে এসে বলল,
“সারপ্রাইজ।”

আহি সরে দাঁড়াতেই আফিফের সামনে দৃশ্যমান হলো পদ্ম। মেয়েটা লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়েছে। প্রথম স্লিভলেস ব্লাউজ পরায় চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত ঢেকে দিচ্ছে। রঙ-বেরঙের আলোর ভীড়ে সাদা শাড়ি পরা পদ্মফুলটিকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। আফিফ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। আহি আফিফের চাহনি দেখে হাসলো। এই হাসিটা সুখের নাকি কষ্টের, বোঝায় যাচ্ছে না। আহি এবার পদ্মের পাশে দাঁড়িয়ে পদ্মকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এবার তোর বরের সাথে সমুদ্রবিলাস কর। এদিকে কেউ আসবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তবে ঘুমানোর আগে তাবুর চেইনটা টেনে দিয়ে ঘুমাবেন।”

পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আফিফ এমন ড্রেস পছন্দ করে না। উনি কি রাগ করবেন?”

“উনার সামনেই তো তোকে এনেছি। আর কেউ তো নেই এখানে। শাল গায়ে জড়িয়ে এসেছিস। সমস্যা হলে গায়ে জড়িয়ে রাখ।”

আহি এবার আফিফকে বলল,
“এটা আমার পক্ষ থেকে স্পেশাল হানিমুন গিফট। গুড নাইট কাপল।”

আহি চলে এলো। আফিফ এবার ধীর পায়ে হেঁটে পদ্মের কাছে এলো। পদ্ম চোখ-মুখ খিঁচে বলল,
“আপনি কি রাগ করেছেন?”

আফিফ মুচকি হেসে বলল, “কেন রাগ করবো?”

“এমন ব্লাউজ…”

“আমার বউ, আমি ছাড়া তো কেউ নেই।”

আফিফ পদ্মকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো। পদ্মও আফিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ বলল,
“তোমাকে একদম আমার স্বপ্নের রানীর মতো লাগছে। তুমি ঠিক সেভাবেই সেজেছো, যেভাবে আমি তোমাকে দেখতে চাই।”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “আহি সাজিয়ে দিয়েছে।”

আফিফ পদ্মকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তোমাকে আহি সাজিয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পদ্মের হাত ধরে তাকে তাবুর ভেতরে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়েই দেখলো টেবিলের উপর অলকানন্দা ফুল। আফিফ সেখান থেকে একটি ফুল নিয়ে পদ্মের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, পদ্মফুল।”

পদ্ম ফুলটি নিয়ে আফিফের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি, আফিফ।”

আফিফ পদ্মের কাছে এসে বসলো। আলতো করে পদ্মের হাত ছুঁয়ে দিয়ে পদ্মের দিকে তাকালো।

আজকের এই রাতটি আফিফ আর পদ্মের জীবনে আসা চমৎকার একটি রাত। সমুদ্র জলে পা ডুবিয়ে হাতে হাত রেখে রাতের আকাশ দেখা, সমুদ্রের গর্জন শুনে ভালোবাসার অধ্যার রচনা করা, আফিফের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকা, তার চোখের আলোতে আটকা পড়ে থাকা পদ্মের লাজুক মুখখানি, তার বুকে পদ্মের মাথা রাখা, আফিফের তার পদ্মফুলকে নিজের মতো করে ভালোবাসা, আজ সত্যিই আহির স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আহির কল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। সে নিজ হাতেই তার ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হৃদয়ে ডুবিয়ে দিয়ে এসেছে।

এরপর আহি নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের খুশিতে ইচ্ছেমতো খাওয়া-দাওয়া করলো। খাওয়া শেষে নিজের পছন্দের শাড়ি বের করলো আহি। ফ্যাকাশে বেগুনি বর্ণের জরজেট শাড়ি। কপালে কালো টিপ পরলো। চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক লাগালো। ব্যাগ থেকে হিল জোড়া বের পরে নিলো। পায়ের ব্যথা এখন আর নেই। তাই ঠিকমতো হাঁটতে পারছে আহি। এবার সে কানে এয়ার বাড গুঁজে ফোনে গান চালিয়ে ছাদে এলো। রাদ, পুষ্প আর লাবীব আগে থেকেই ছাদে ছিল। আহিকে দেখে তিন জনই হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। আহি রাদের কানে অন্য পাশের এয়ার বাডটি গুঁজে দিয়ে বলল,
“লেটস ডান্স।”

(***)

রাদ আর আহি গান শুনে শুনে নাচছে। আর রাদ আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহি রাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কি দেখছিস এভাবে?”

রাদ আহির হাতটি ঘুরিয়ে এনে তাকে পেছন দিক থেকে হালকা জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
“তোকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে।”

আহি হেসে বলল,
“আমার পছন্দ এতোটাও খারাপ না।”

রাদ এবার আহিকে সামনে থেকে ঘুরিয়ে এনে তাকে নিজের দিকে ফিরালো আর বলল,
“তোর পছন্দ আমার পছন্দের চেয়ে বেশি সুন্দর না।”

আহি মুচকি হেসে রাদের কাঁধে হাত রেখে রাদের পেছন দিক থেকে একবার ঘুরে তার সামনে এসে এক পা তুলে রাদের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোর পছন্দ কি?”

রাদ মুচকি হেসে আহির ফোন নিয়ে গান পরিবর্তন করে দিয়ে বলল,
“চল গলা ছেড়ে গাই।”

মিউজিক চালু হতেই আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইশারায় বলল, “এই গানটা কেন?”

রাদ বলল, “শুনলে সমস্যা তো নেই।”

আহি আর রাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে কাঁধ হেলিয়ে তুড়ি বাজিয়ে নাচতে লাগলো। রাদ গাইতে লাগলো,
“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”

আহি রাদের দিকে তাকিয়ে কাঁধ বাঁকিয়ে গাইলো,
“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”

রাদ আহির হাত ধরে গলা ছেড়ে গাইলো,
“আয়ে নাজার চেহেরে হাজার…
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।
হোনা তা পিয়ার…..”

এদিকে পুষ্প আর লাবীব মনোযোগ দিয়ে রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তারা দু’জনেই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। রাদ এবার আহির হাত ধরে তাকে ছাদের এক কোণায় বসিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সুরের সাথে গাইলো,
“তেরে দিল’কে শেহের মে,
ঘার মেরা হো গেয়া,
হো গেয়া….”

আহি প্রতিত্তোরে রাদের কাঁধে তার দুই হাত রেখে বলল,
“স্বাপ্না দেখা যো তুম’নে
ওয়ো মেরা হো গেয়া,
হো গেয়া…”

“ডুবে তো ইউ,
জেসে হো পাড়…
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার…
হোনা তা পিয়ার।”

রাদ এবার আহির হাত ধরে তাকে সুইমিংপুলের পাশে নিয়ে এলো। আহিকে উপরে উঠিয়ে ঘোরাতেই আহি চোখ বন্ধ করে দুই হাত প্রসারিত করে রাখলো। রাদ আহিকে নামিয়ে আহির হাত নিজের বুকের কাছে এনে সুরের সাথে গাইলো,
“থামে দিলো কি বা’হে,
হাম আ’তে সালো মে,
সালো মে…”

আহি রাদের হাত ছেড়ে দিয়ে দুই হাত পেছনে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইলো,
“পায়ে জাবাব হাম নে,
তেরে সাওয়ালো মে,
সাওয়ালো মে….”

এবার রাদ আহির হাত ধরে গাইলো,
“খোয়াবও কি ডোর…”

“খোয়াবও কি ডোর..”

“টুটে না ইয়ার,
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”

“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”

গান শেষ হতেই রাদ আর আহি দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। আহি বলল,
“সব হারিয়ে ফেলার পরও আজ আমি অনেক খুশি। থ্যাংক ইউ রাদ। তুই আমার পাশে না থাকলে আমি বাঁচতাম না রে।”

রাদ আহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোর কিছু হলে আমি কি বাঁচতাম বল?”

“রিয়েলি? তোর কি হতো?”

“আমার একমাত্র মেয়ে বান্ধবী তুই। তুই ছাড়া কে আছে আমার?”

“বাহ, আমাকে পটানোর চেষ্টা করিস না।”

“আমি তো চেষ্টা করি না। আমার যেটা ভালো লাগে, আমি সেটাই করি। তোর যদি মনে হয় আমার উপর পটে গেছিস, তাহলে ডায়েরী লিখে প্রকাশ করিস না আবার। সোজাসুজি বলে দিস। আমি আবার চিঠি পড়ে নিজের বেহাল দশা বানাতে চাই না। হবে তো হবে। প্রেম হলে একবিংশ শতাব্দীর প্রেম হবে। নব্বই দশকের প্রেমিকের মতো চিঠির পেছনে দৌঁড়াতে পারবো না।”

“নব্বই দশকের প্রেম তো আমাকে বোল্ড আউট করে দিয়েছে। এবার যদি প্রেম করি, ছক্কা মেরে দিবো। আউট করলে তাজওয়ার খানকে আউট করবো।”

“আমাকে রান নিতে দিস। আউট করিস না।”

“তুই তো দেখছি আমার প্রেমিক হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিস!”

“তোর মতো করে কেউ ভালোবাসলে, আমি ধন্য হয়ে যেতাম। তাই তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি। আমার প্রেমে পড়ে উদ্ধার করিস আমাকে।”

“আগে তাজওয়ারকে আউট করি, তারপর ভেবে দেখা যাবে।”

আহির কথা শুনে রাদ হাসলো। আহিও শব্দ করে হাসলো। হাসি থামিয়ে রাদ বলল,
“তোকে শাড়িতে কোনো রাজ্যের সম্রাজ্ঞীর মতো মনে হয়।”

“তাহলে সম্রাটটা কে হবে শুনি?”

“আগে রাজ্য জয় করি, তারপর আমার রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবি।”

আহি হেসে বলল, “ঘুরেফিরে তুইই!”

“যাব তাক হে ইস শারীর মে জান,
মে রাহুঙ্গি তোমহারা সম্রাট শাহজাহান।”

আহি আঙ্গুলের ইশারা করতে করতে বললো,
“মুজে নেহি বান্না তোমহারি মামতাজ বেগাম,
পিয়ার নে মুজে ধো ঢালা,
আব চা’লা গেয়া মেরা সুখ, চ্যান ওর গাম।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৫৯।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়েই হোঁচট খেলো আফিফ। পদ্ম ভয়ার্ত চোখে আফিফের দিকে তাকালো। কিন্তু পরক্ষণেই সে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আফিফ নিচে পড়ে নি। একটা শক্ত হাত তাকে ধরে ফেলেছে। আফিফ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়েই থমকে গেলো। আহিও সেই সময় সিঁড়ি দিয়েই নামছিল। নিচে তাজওয়ারকে দাঁড়ানো দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকালো। তাজওয়ার আফিফের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এরপর চোখ সরিয়ে আহির দিকে তাকালো। আহিকে দেখে সে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“সুইটহার্ট, হাউ আ’র ইউ?”

আফিফ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আহি দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার আফিফের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে বলল, “এক্সকিউজ মি।”

আফিফ সরে দাঁড়াতেই তাজওয়ার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আহির সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আই মিসড ইউ, আহি।”

আহি তাজওয়ারের হাতের দিকে একনজর তাকিয়ে নিচে নেমে গেলো। আর তাজওয়ার হাত মুঠো করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে আহি ডায়নিংয়ে এসে বসলো। রাদ, লাবীব, পুষ্প সেখানে আগে থেকেই বসে ছিল। আহি আসার একটু পর আফিফ আর পদ্মও সেখানে এলো। আফিফ একনজর আহির দিকে তাকালো। পদ্ম আহিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, ছেলেটা কে?”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কোন ছেলে!”

তাজওয়ার উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“ইটস মি, তাজওয়ার খান।”

তাজওয়ার এসেই আহির কাঁধে দুই হাত রেখে আহির চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
“সারপ্রাইজ কেমন লাগলো, সুইটহার্ট?”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কে আপনি? এভাবে আহির গায়ে পড়ে কথা বলছেন কেন?”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে থামাতে যাবে তার আগেই তাজওয়ার পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওহ হো, আমি গায়ে পড়ে কথা বলছি? ডোন্ট ইউ নো, হু এম আই?”

তাজওয়ার আহির পাশে বসে বলল,
“সুইটহার্ট, বলো আমি কে?”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা অসভ্য লোক, যার সাথে বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।”

তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার আসল পরিচয় সবাইকে জানালাম। এবার তুমি এখান থেকে যেতে পারো।”

তাজওয়ার চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল,
“আমি তোমাকে সাথে নিয়েই যাবো।”

এরপর আফিফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আফটার অল রানীকে তো যেখানে সেখানে রেখে যাওয়া রাজার পক্ষে সম্ভব না। যদি কোনো দাসের নজর পড়ে যায়?”

আফিফ তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আর আফিফের এমন রহস্যময় চোখাচোখি দেখে রাদ ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার তাজওয়ার বলল,
“আহি তোমার ফ্রেন্ডদের মধ্যে সবাইকে তো চিনি না। রাদ, লাবীব আর পুষ্পের সাথে এর আগেও দেখা হয়েছে। বাকি দু’জন?”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার এতো কিছু জানতে হবে না। প্লিজ যাও এখান থেকে। আমাকে বিরক্ত করো না।”

তাজওয়ার রাগী স্বরে বলল, “আগে বলো, কে এরা?”

পুষ্প তাজওয়ারের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেলো আর সে নিজেই ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,
“পদ্ম, আমাদের ফ্রেন্ড। আর উনি পদ্মের হাসবেন্ড।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“হাসবেন্ড! ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো।।তাজওয়ার সবার সামনেই আহির গালে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আজ আমরা বাসায় ফিরছি তাহলে! আফটার কল খুব শীঘ্রই আমাদের এনগেজমেন্ট। প্রিপারেশনও নিতে হবে।”

তাজওয়ারের কথা শুনে রাদের হাত মুঠো হয়ে এলো। তাজওয়ার কথাটি বলেই চলে গেলো। আহি মলিন মুখে রাদের পাশে গিয়ে বসলো। রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“রিল্যাক্স, আহি।”

পদ্ম বলল,
“আহি, লোকটাকে আমার একদমই ভালো মনে হয় নি।”

আফিফ পদ্মের কথা শুনে তার দিকে তাকালো। পদ্মের উৎকন্ঠা দেখে অজানা ভয় আফিফকে ঝেঁকে ধরেছে।

নাস্তা সেরে আফিফ হোটেল রুমে ঢুকেই ব্যাগপত্র গোছাতে লাগলো। পদ্ম তা দেখে বলল,
“কি ব্যাপার? কোথায় যাচ্ছেন?”

“বাসায় ফিরতে হবে। অনেকদিন তো ঘুরেছি।”

“যাবোই তো। কিন্তু আহি তো বললো সন্ধ্যায় যাবে।”

“আমরা আলাদা ভাবে যাচ্ছি।”

“কেন?”

আফিফ বিরক্তির সুরে বলল,
“এতো প্রশ্ন করছো কেন?”

পদ্ম আফিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফের হাত আলতো ভাবে স্পর্শ করে বলল,
“কি হয়েছে বলবেন? আপনি হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন? আর আপনাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

আফিফ পদ্মের গালে হাত রেখে বলল,
“প্লিজ পদ্ম, চলো। আমার ভালো লাগছে না এখানে।”

“সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কি খুব বেশি দেরী হয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।”

“কি হয়েছে আপনার? আমি তো এভাবে যাবো না। আহিদের সাথে এসেছি, ওদের সাথেই যাবো। এভাবে সবাইকে ফেলে চলে গেলে সুন্দর দেখাবে না।”

আফিফ সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। তার চোখের সামনে এলোমেলো ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে। পদ্ম আফিফের পাশে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আহি অনেক ভালো মেয়ে। কিন্তু আংকেল এমন একটা লোকের সাথে আহির বিয়ে ঠিক করেছেন, যার মধ্যে একটুও ভদ্রতা নেই। এর চেয়ে তো রাদ অনেক ভালো। আহির জন্য রাদই ভালো হবে, তাই না?”

আফিফ রাগী স্বরে বলল,
“তুমি কি আহির অভিভাবক? তুমি কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো? ওর বাবার যেটা ভালো মনে হচ্ছে, সেটাই করছে। আর শোনো, আহি থেকে দূরত্ব রেখে চলবে। ও তোমার জন্য ক্ষতিকর।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি বলছেন আপনি? হঠাৎ কি এমন হলো আপনার? কাল রাতেই ও আমাদের এতো বড় একটা সারপ্রাইজ দিলো। আর আপনি এমন কথা বলছেন?”

“পদ্ম, আমি তোমার স্বামী। আমার কথা শুনতে তুমি বাধ্য।”

“আমি আপনার সব কথা শুনি, আফিফ। কিন্তু ও আমার ছোটবেলার বান্ধবী। ওর বিরুদ্ধে আমি একটা কথাও শুনবো না। কতো সহজে বলে দিলেন, ও আমার জন্য ক্ষতিকর! ক্ষতির কি দেখলেন আপনি?”

আফিফ হাত দিয়ে মুখ গুঁজে রাখলো। পদ্ম আফিফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে বলুন না কি হয়েছে? আপনাকে দেখতে এতো অস্থির লাগছে কেন?”

আফিফ পদ্মের কোলে মাথা রেখে বলল,
“আমি আর কাউকে হারাতে পারবো না, পদ্ম। আমি আর কাউকে হারাতে পারবো না।”

আফিফ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পদ্ম আফিফের গালে হাত রেখে বলল,
“কেন হারাবেন আপনি? কাকে হারাবেন? সবাই তো আপনার সাথেই আছে। আমি না আসলেই বুঝতে পারছি না কি হয়েছে আপনার।”

আফিফ মাথা তুলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“হঠাৎ আপার কথা মনে পড়ে গেলো।”

পদ্ম আফিফের কাঁধে মাথা রেখে তার হাতে নিজের হাত ঘষতে লাগলো। আফিফের চোখ ভিজে উঠলো। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি ভীষণ দুর্বল মানুষ, পদ্ম। কম বয়সে বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি। হুট করে একটা সাজানো সংসার ভেঙে যেতে দেখেছি। আমাদের দু’বেলা খাওয়ানোর জন্য মাকে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি। এরপর আপা সব ছেড়ে ছুড়ে আমাদের দুই ভাই বোনের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করেছে। দেনা বেড়ে যাওয়ায় মা বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল। নিজেকে আমার সেদিন চোর মনে হয়েছিল। কিন্তু আপা সব ঋণ শোধ করে দিয়েছিল। নিজের শখ-আহ্লাদ সব ভুলে গিয়েছিল। পদ্ম, আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম, আমি তার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। কিন্তু পারি নি। সব মৃত্যু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আত্মহত্যা মেনে নেওয়া যায় না। আমি জানি আমার আপা আত্মহত্যা করে নি। খুন হয়েছে তার। শুধু রেনুর জন্য চুপ করে আছি। আমার তো আরেকটা আমানত আছে। বাবা আমাকে কতো বড় দায়িত্ব দিয়ে চলে গেছে। আমি ভীষণ অসহায় হয়ে গিয়েছিলাম, পদ্ম।”

পদ্ম আফিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার কোলে মাথা রেখে বলল,
“হঠাৎ এসব কেন বলছেন? কেন মনে করছেন সেই অতীত?”

“হঠাৎ করেই তো সব হয়ে যায়। সব আমার জীবনে হঠাৎ করেই হয়। আমি সামলে উঠতে পারি না।”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আমার হাত বাঁধা। আমি অতীত, ভবিষ্যৎ কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে চাই না। তোমাদের নিয়েই ভাবতে চাই। তুমি, মা, রেনু আমার শেষ আশ্রয়।”

পদ্ম চুপ করে রইলো। আফিফ খুব শান্ত আর গম্ভীর মানুষ। কখনোই এলোমেলো কথা বলে নি। আজ তাকে ভীষণ এলোমেলো মনে হচ্ছে। কোনো কিছুই গুছিয়ে বলতে পারছে না। চোখ দু’টিও অশ্রুসিক্ত। পদ্ম আফিফকে কখনোই কাঁদতে দেখে নি। কাঁদলে গুরুতর ব্যাপারেই তার চোখ ভিজেছে। কিন্তু আজ কোনো কারণ ছাড়া কেন কাঁদছে সে? আজ কি এমন ঘটেছে, যেটা আফিফকে মানসিক ভাবে ভেঙে দিয়েছে?

(***)

সমুদ্র উত্তাল আজ। বাতাসে ধুলো উড়ছে। আহি দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের বাইরে। হোটেলের বাইরে অনেক বড় পরিসারের জায়গা আছে। এখানে দাঁড়ালেও সমুদ্র দেখা যায়। তবে সৈকত অনেকটা দূরে। কিন্তু আজ সমুদ্র উত্তাল, তাই ঢেউয়ের গর্জন এখানেও শোনা যাচ্ছে। আজই তারা চলে যাবে। যেতে হবেই। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ১নং বিপদ সংকেত চলছে। কিন্তু এতেই যেন সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শহরে ১০নং বিপদ সংকেত দিলেও কোনো খবর হয় না। অথচ উপকূলীয় অঞ্চলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে আফিফ বাইরে এসে আহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। বাতাসে আহির চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে। কেমন দুর্বল মনে হচ্ছে আহিকে। কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস পেলো না আফিফ। উলটো পায়ে আবার হোটেলে ঢুকে পড়লো। আহি কিছুক্ষণ পর চলে আসবে তখনই দেখলো পদ্ম তার কাছেই আসছে। পদ্মের মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে আছে। আহি পদ্মের কাছে এসে বলল,
“কি হয়েছে তোর? মন খারাপ না-কি!”

পদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার তো কিছু হয় নি। কিন্তু আফিফের কিছু একটা হয়েছে!”

“হঠাৎ! কাল রাতের সারপ্রাইজ পছন্দ হয় নি?”

“না রে, ওটা না। সারপ্রাইজ তো আমাদের দু’জনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ উনি অদ্ভুত আচরণ করছেন। বাসায় চলে যেতে চাইছেন। উনাকে আমিই আটকালাম।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কাজ আছে হয়তো!”

“আমার মনে হচ্ছে, তোর হবু বরকে দেখে এমন করছে।”

“কেন আগে দেখে নি না-কি!”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আগে কীভাবে দেখবে?”

“কি যে বলিস, ওদিন না বললি খানস গ্রুপে চাকরি পেয়েছে।”

পদ্ম অবাক কন্ঠে বলল,
“খানস গ্রুপ তোর হবু বরের কোম্পানি?”

“হ্যাঁ, সরওয়ার খান আর তাজওয়ার খানের মিলিত কোম্পানি। তাজওয়ার ওই কোম্পানির নতুন এমডি হয়েছে। এতোদিন সরওয়ার খান ছিল। উনি তাজওয়ারের বড় ভাই। আবার তাদের আলাদা কোম্পানিও আছে।”

“আফিফ তো আমাকে এতোকিছু জানান নি। এজন্যই কি তাহলে চলে যেতে চায়ছেন। হয়তো বসকে দেখে ভয় পেয়েছেন। তাও আবার বসকে তার হবু স্ত্রী এমপ্লয়ির সামনেই অপমান করেছে।”

পদ্ম কথাটি বলেই মুখ চেপে হাসলো। আহি বলল,
“ধুর, আফিফের সাথে তাজওয়ার কোনো ঝামেলা করবে না। আমি যদি নিজেই তার সাথে ঝগড়া করি, এখানে আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ডের দোষ কী? আর তাজওয়ার যদি আফিফের কোনো ক্ষতি করে, আমি তো তার চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ফেলবো।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি হেসে বলল,
“আরেহ, এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? তোর বর দেখেই বলছি। অন্য কারো বর হলে মাথাও ঘামাতাম না। আর ওই তাজওয়ার খানকে আমার একটুও পছন্দ না। কখন যে ওই অসভ্য লোকটা আমার পিছু ছাড়বে!”

(***)

সন্ধ্যায় জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে পদ্ম আফিফকে বলল,
“আহির হবু বর আপনার বস হয়, সেটা আমাকে বলেন নি যে!”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“তাজওয়ার খানের কথা বলছি।”

আফিফ বলল, “উনি তো আমার বস না।”

“আহি তো বললো আপনি উনার কোম্পানিতেই চাকরি নিয়েছেন!”

“কখন?”

“খানস গ্রুপের এমডি তো তাজওয়ার খানই।”

আফিফ অবাক হয়ে পদ্মের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“সরওয়ার খান এমডি।”

“হ্যাঁ, আপনি ওই কোম্পানিতে কাজ করেন, অথচ জানেন না? সরওয়ার খান এমডি ছিল। এখন তাজওয়ার খান নতুন এমডি হয়েছে। ওটা না-কি ওদের দুই ভাইয়ের কোম্পানি।”

আফিফের হাত যেন এবার আর চলছেই না। পাঁচ বছরের চুক্তি করে ঢুকেছে খানস গ্রুপে। এখন কোম্পানি ছাড়লে তাকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিয়ে যেতে হবে। যেটা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব না। কিন্তু তাকে কোম্পানি কেন ছাড়তে হবে? কেন এতো ভাবছে সে? আফিফ আর কিছু ভাবতে চায় না। সে ব্যাগপত্র গুছিয়ে পদ্মকে নিয়ে হোটেলের বাইরে চলে এলো। বাইরে এসে দেখলো তাজওয়ার জোর করে আহির বাহু চেপে ধরেছে। আহি বার-বার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। পুষ্প, রাদ আর লাবীবও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারো বিন্দুমাত্র সাহস নেই তাজওয়ারকে থামানোর। আফিফ খেয়াল করলো, রাদের হাত মুঠো হয়ে আছে। কিন্তু লাবীব তাকে চেপে ধরে রেখেছে। নয়তো তাজওয়ার মুখটা রাদের হাতের নীল হয়ে যেতো। আফিফ এবার তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আসলেই তো মানুষটা রাজার মতো। রাজাকে যেমন প্রজারা ভয় পায়, তেমনি তাজওয়ারকেও সবাই ভয় পায়।

আফিফ এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে ভাবলো,
“আহি অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। আমি চাইবো, ও অন্তত এই দানবের হাত থেকে যাতে মুক্ত হতে পারে।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে