Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 185



প্রিয় বালিকা পর্ব-৩+৪+৫

0

#প্রিয়_বালিকা |৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পুরোনো প্রাচীরে ঘেরা বাগান বাড়ির সামনে পর পর দুটি গাড়ি এসে থামল।প্রথমে সূর্য এবং রৌদ্র মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।অতঃপর ভাড়া করা কালো মাইক্রোবাসটি।মোটরসাইকেলের পিছন থেকে নেমে বিশাল বাড়ির দিকে দৃষ্টি ফেলল রৌদ্র।রাতের অন্ধকারেও বাড়ির কৃত্রিম আলো চারপাশটা সুস্পষ্ট।রৌদ্র আশেপাশে তাকিয়ে গাছপালা আর বাগান ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না।সূর্যও মোটরসাইকেল থেকে নেমে এসে রৌদ্রের পাশে দাঁড়াল।রৌদ্রকে আশেপাশে তাকাতে দেখে হেসে বলল,
– বাড়ির আশেপাশে দেখার মতো কিছুই নেই বন জঙ্গল ছাড়া।বাগানে ঢুকলে মনে হবে অ্যামাজনে হারিয়ে গিয়েছ।

রৌদ্র তার পাশে থাকা হ্যাংলা পাতলা ছেলেটাকে এক পলক দেখল।ভারি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– কিসে পড়ো তুমি?

সূর্য শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বুক ফুলিয়ে বলল,
– ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি।এখন এডমিশন দিবো।

ছেলেটি তার তীক্ষ্ণ চোখজোড়া ছোট করল।বলল,
– ইন্টার মানে?ও লেভেল?নাকি এ লেভেল?

কপাল কুঁচকে ফেলল সূর্য।রৌদ্রের কথা বুঝতে না পেরে বলল,
– মানেহ্?

এতক্ষণে সকল জিনিসপত্র নামিয়ে গাড়ি থেকে একে একে সকলে নেমে এসেছে।অভয় এক পাশ দিয়ে রৌদ্রের গলা জরিয়ে হেসে বলল,
– আরে ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে তো তাই ইন্টার বুঝে না।

রৌদ্র এবং অভয়ের উচ্চতা একই।তবে শরীরের গঠন রৌদ্রকে হাজার থেকে পৃথক করে।ফাঁপা মাংসপেশি জাগ্রত কলার-বোন, ধারালো চোয়াল রৌদ্রের দাম্ভিকতা বাড়িয়ে দেয় সবার থেকে।তাছাড়া নিজেকে সবার থেকে আলাদা করতে তো তার শিকারী চাহনি যথেষ্ট।রৌদ্র জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে অভয়ের দিকে তাকালো।অভয় রৌদ্রের দৃষ্টি বুঝে বলল,
– এ লেভেলের কথা বলছে।

রৌদ্র সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এইখানের এডুকেশন সিস্টেম সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই।

সূর্য মুখ ভোঁতা করে মনে মনে বলল,”ব্যা’টা!ধারণা নেই যখন তখন জিজ্ঞেস করলি কেন কিসে পড়ি!”
পরমুহূর্তেই মুখে হাসি নিয়ে বলল,
– এতো বছর দেশে আসোনি কেন?

রৌদ্র কিছু বলার আগে অভয় উত্তর দিলো,
– আসলে ওর গার্লফ্রেন্ড কিছুদিন আগে চলে গিয়েছে।যার জন্য ও একটু মেন্টালি ডিস্টার্ব ছিল।তাই ভাবলাম ওকে আমার সাথে নিয়ে আসি।মাইন্ড রিফ্রেশও হবে আবার নিজের মাতৃভূমি দেখাও হবে।

সূর্য তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
– চলে গিয়েছে কেন?

রৌদ্র খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল,
– শী উয়াজ মাই রেন্টেড গার্লফ্রেন্ড।আটচল্লিশ ঘন্টা আমরা একসাথে সময় কাটানোর পর ও আর আমি দেড়মাসের একটি কন্ট্রাক্টে যাই।বাট ও কন্ট্রাক্ট শেষ হওয়ার আগেই চলে গিয়েছে।

সূর্যের চোয়াল ঝুলে গেল বিস্ময়ে।অবিশ্বাস্য সুরে বলল,
– আটচল্লিশ ঘন্টা?মানে কিভাবে ভাই?সিক্রেটটা কি?

অভয় বিরক্তি চাহনিতে সূর্যের মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,
– আরে ব’লদ আটচল্লিশ ঘন্টা ওরা একসাথে ঘোরাঘুরি করছে।সবসময় উল্টো পাল্টা ভাবা!অ’শ্লীল,ন’ষ্ট ব্রেইন!

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে অভয়কে বলল,
– মানুষ রেন্টে গার্লফ্রেন্ড নেয় শুধু ঘোরাঘুরি করার জন্য এটা তোকে কে বলেছে?

রৌদ্রকে আর বলতে দিলো না অভয় হাত টেনে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে রৌদ্রের কানে বলল,
– চুপ যা ভাই।বাচ্চা ছেলে।আর তাছাড়া এখানের কালচার এগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না।এসব এখানের কালচারের সাথে যায় না।ভুলেও এসব নিয়ে এখানে মুখ খুলবি না।বুঝেছিস?আর তোর গার্লফ্রেন্ড যেন কেন চলে গিয়েছে?সো তোদের মধ্যে যে স্পেশাল কিছু হয়নি তা আমি খুব ভালো করেই জানি।

রৌদ্র তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল অভয়ের দিকে কটমট করে বলল,
– কি বলতে চাস তুই?

– আরে কুল ব্রো আমি বলছি তুই অনেক বেশি বোরিং আর আনরোম্যান্টিক দেখেই তোর গার্লফ্রেন্ড তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।

– এটা আমার লাইফের ফার্স্ট ডেট ছিল।আর তাছাড়া ওর জন্য আমার তেমন কিছু ফিলও হতো না।

রৌদ্র কিছুক্ষণ ভেবে আবার বলল,
– এতে অস্বাভাবিকের কি আছে?উই আর অ্যাডাল্ট নাও।আমরা চায়লেই কারো সাথে রিলেশনে যেতে পারি।

– আরে ভাই বুঝতেছিস না কেন?বিয়ে ছাড়া এভাবে একসাথে থাকা এই দেশে খারাপ চোখে দেখা হয়।এসব আমাদের দেশের কালচারে এবং আইনত অবৈধ। মানে বুঝিস তো ইলিগ্যাল।

– আই সি!
অভয় এবং রৌদ্রকে ফুসুরফাসুর করতে দেখে সূর্য বিরক্ত হয়ে ভিতরে চলে গেল।হঠাৎ রৌদ্র নিজে অন্যপাশে কারো অস্তিত্ব পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল।আভা রৌদ্রের অন্যপাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কান খাঁড়া করে অভয় এবং রৌদ্রের কথপোকথন শোনার চেষ্টা করছে।রৌদ্র ভ্রু সংকুচিত করলো।খাটো আভার মাথা রৌদ্রের বুকেরও নিচে পড়ে।রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে দেখে কনুই দিয়ে অভয়ের পেটে গুঁতা দিলো।পূর্বর মতোই ফিসফিসিয়ে অভয়কে বলল,
– লুক এট হার!হু ইজ শী?

অভয় রৌদ্রের অন্যপাশে উঁকি দিয়ে আভাকে দেখে বিরক্ত হলো।নিচের ঠোঁট কামড়ে আভার সম্পূর্ণ মাথাটা নিজের হাতের তালুতে আবদ্ধ করে এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিলো।রাগি দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে তেজি স্বরে বলল,
– কি সমস্যা?আঁড়ি পাতছিস কেন?

থতমত খেয়ে গেল আভা।বাম হাতে নিজের চুল ছুঁয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে বলল,
– বলছি ভিতরে যাবে না?সবাই ওয়েট করছে বাবারা তো ভিতরে চলে গেল।

রৌদ্র আর অভয় আগের মতোই গলা জরা জরি করতে করতে ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আভা এখনও সেখানে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র একবার পিছন ফিরে আভাকে দেখে অভয়ের কানে ফিসফিস করে বলল,
– ও কি কিছু শুনেছে?

অভয়ও রৌদ্রের মতো ফিসফিস করে উত্তর দিলো,
– জানিনা।

রৌদ্র অভয়কে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো।ঝাঁজালো স্বরে বলল,
– সবসময় গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে থাকিস কেন?তোর জেন্ডার নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে!

অভয় বাঁকা হাসি দিলো।যে হাসি রৌদ্রের একদমই পছন্দ হলো না।অভয় আবারও এগিয়ে এলো রৌদ্রের কাছে রৌদ্রকে একপাশ দিয়ে হাত দিয়ে আগলে নিলো।রৌদ্র নাক মুখ কুঁচকে আবারও ধাক্কা দিয়ে অভয়কে সরিয়ে দিলো।তেজি স্বরে বলল,
– দূরে থাক।

বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই প্রেমা দৌড়ে এলো ছেলের কাছে।এতোদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে আলিঙ্গন করতে ভুলল না।চোখে পানি টলমল করছে তার।অভয় মাকে জরিয়ে ধরে রইলো বেশ কিছুটা সময়।কতদিন পর মায়ের শরীরের সেই সুন্দর ঘ্রাণটা পাচ্ছে সে।বুক ফুলিয়ে শ্বাস টানল অভয়।পাশেই দাড়িয়ে থাকা রৌদ্র নির্বাক দর্শক।
আভা বিভিন্ন বিচার বিশ্লেষণ করতে করতে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।

“রেন্টেড গার্লফ্রেন্ড মানে?বিয়ে ছাড়া একসাথে থাকা!ছিঃ!ভাইয়ার ফ্রেন্ড কত খারাপ।নি’র্লজ্জ,বে’হায়া,বে’কুব ছেলেটা লোকসমাজে মুখ দেখাচ্ছে কিভাবে?নিশ্চয়ই ক্যারেক্টারে সমস্যা আছে না হলে এতো বড় পাপকাজ করার পর কেউ লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারে না।”

আভা রৌদ্রের দিকে আঁড় চোখে তাকিয়ে কথা গুলো মনে মনে আওড়াচ্ছে।রৌদ্র আভাকে নিজের দিকে এমন জহুরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু সংকুচিত করে।নিজের কালো শার্ট টেনে নড়েচড়ে দাঁড়ায়।মনে মনে বলে,”মেয়েটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন আমার দিকে?”

– বাবা অভয় কিডনি থেকে আমার জন্য কি এনেছ?

অভয়ের মেঝো চাচির কথায় উচ্চস্বরে হেসে ফেলল বসার ঘরে উপস্থিত সকলে।সূর্য পেট ধরে শরীর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
– আরে মা ওটা কিনডি না সিডনি।আর ভাইয়া মাত্র এসেছে ওকে একটু রেস্ট নিতে দাও তারপর তোমাকে গিফট দিবে বুঝেছ?

বলেই আরো একদফা হেসে ফেলে সকলে।অদূর থেকে দৌড়ে আসে ছোট জমজ দুই বোন।দৌড়ে এসে অভয়কে জরিয়ে ধরে।দুইজন একই সাথে বলে ওঠে,
– অভয় ভাইয়া কেমন আছো?আমাদের জন্য চকলেট এনেছ?

অভয় দু’জনের গাল টেনে বলল,
– হ্যাঁ এনেছি তো। তোমাদের জন্য অনেক চকলেট এনেছি।

মেঝো চাচির দিকে তাকিয়ে বলল,
– চাচি তোমার জন্যেও গিফট এনেছি।সবার জন্য এনেছি।সবাইকে আগে আমার বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

কথাটা বলে অভয় নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে ইশারা করে বলল,
– এটা হলো আমার বন্ধু আফসিন রৌদ্র।আমরা একসাথে পড়ি। ও বাংলা দেশি কিন্তু দেশে আসছে এই প্রথম।ওর জন্য একটা রুম গুছিয়ে দিলে ভালো হয়।

কথাটা শেষ না করতেই উৎফুল্ল কন্ঠে আভার সমবয়সী কিশোরী এগিয়ে এসে বলল,
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমি গুছিয়ে দিবো ভাইয়া।এই সেহরিন থাকতে তোমাদের কোনো চিন্তা করতে হবে না।রৌদ্র তুমি আমার সাথে চলো।

সেহরিনের মুখে আচমকা রৌদ্রের নাম শুনে সকলে চমকে গেল।অচেনা একজনকে এমনভাবে সকলের সামনে নাম ধরে ডাকছে আবার তুমি করে বলছে দেখে কারো কাছে বিষয়টা ভালো লাগল না।রৌদ্র নিজেও ভীমড়ি খেল।হঠাৎই এই মেয়েটা আবার কোথা থেকে উদয়ন করলো? ভাবতে ভাবতে ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো তার।শুঁকনো শরীরের মেয়েটি সকলকে নিজের দিকে এমন বিস্ফোরণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে নড়ে চড়ে উঠলো।আসলে সে জীবনের প্রথম কোনো বিদেশিকে এতো কাছ থেকে দেখে এতোটাই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছে যে তার কর্মকান্ডে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারিনি।দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে বলল,
– মানে বলছি ভাইয়া আপনি আমার সাথে চলুন আমি আপনাকে রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।

রৌদ্র মুখে কিছু বলল না।সেহরিনের পিছু চলে গেল।অভয় মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– মা আমি একটু দাদিকে দেখবো।দাদি কেমন আছেন এখন?

প্রেমা মলিন স্বরে বলল,
– এখন মুটামুটি ভালো আছে তবে অবস্থা অতটা ভালো না।দাদি তার ঘরেই আছে।দেখে এসে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে আয় খাবি।তোর বন্ধু কি যেন নাম?

– রৌদ্র।

– ওকেও নিয়ে আয় অনেক যার্নি করে এসেছিস খিদে লেগেছে নিশ্চয়ই?

– হ্যাঁ আসছি।

অভয় তার দাদির ঘরে গেল দাদিকে দেখবে বলে।বাড়ির সকলেও নিজেদের কাজে চলে গেল।সকলে বসার ঘর থেকে সরে যেতেই আভা বসার ঘরে থাকা টেলিফোন থেকে পূর্ণতার মায়ের নম্বরে কল করলো।এই টেলিফোনটা বহুকাল আগের।এটা দিয়ে সচারচার কেউ কথা বলেনা।আভার ফোন নেই তাই সে মাঝে মাঝেই এখান থেকে পূর্ণতাকে কল করে। পূর্ণতাকে আসার সময় তার বাড়িতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।আভা যদিও জোরাজুরি করেছিল তার সাথে থাকার জন্য কিন্তু পূর্ণতা রাজি হয়নি।পূর্ণতা কল রিভিস করল।বলল,
– কি হয়েছে এতো রাতে ফোন দিয়েছিস কেন?

আভা পূর্ণতার কথার জবাব না দিয়ে নিজেই বিচলিত স্বরে বলল,
– পূর্ণ তুই এমন কোনো মানুষকে দেখেছিস যে বিয়ে না করে একসাথে থেকেছে?

রাত দুপুরে আভার এমন উদ্ভট প্রশ্নে ক্ষেপে গেল পূর্ণতা।তেজি স্বরে বলল,
– পাগল হয়ে গিয়েছিস নাকি? রাত দুপুরে এসব কি বলছিস?আর এমন মানুষ কিভাবে দেখবো?

– জানিস আমি দেখেছি।সে এখন আমাদের বাড়িতেই আছে।মানুষ কত নির্লজ্জ হয় বল?

পূর্ণতার ভ্রু কুঁচকে এলো।তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
– কার কথা বলছিস তুই?

– নাম বলা যাবে না।

পূর্ণতা ভাবতে থাকল কার কথা বলতে চায়ছে আভা।একবার ভাবলো অভয় নয়তো?হতেও পারে বিদেশে গিয়ে হয়তো তার কালচার বদলে গিয়েছে।ভাবতেই ফোঁস করে একটি নিঃশ্বাস ছাড়ল পূর্ণতা।বলল,
– বলবিনা যখন তখন ফোন করেছিস কেন?ফোন রাখ।

আভাকে কথা বলতে না দিয়ে পূর্ণতা নিজেই ফোন কেঁটে দিলো।আভা ফোনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে নিজের ঘরে চলে গেল।

চলবে..

#প্রিয়_বালিকা |৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সকালে খাবার টেবিলে দেখা গেল বাড়ির অধিকাংশ লোককে।শুধু ছোট বাচ্চাগুলোকে চোখে পড়ল না।বিশাল বড় কাঠের টেবিলের এক কোণায় কাঁটা চামচের সাহায্যে ভাত খাচ্ছে রৌদ্র।বাম পাশে অভয় আর ডান পাশে সেহরিন।কিছুক্ষণ পরপরই এটাওটা তুলে রৌদ্রের পাতে দিয়ে চলেছে।বিপরীতে মিলছে রৌদ্রের কড়া দৃষ্টি।প্রচন্ড বিরক্ত সে।কোথা থেকে একটা হাঁটুর বয়সী মেয়ে এসে তার খাওয়ার সময় বিরক্ত করছে।
সকাল সাড়ে আটটা।খাওয়ার ঘরে হাজির হলো আভা।পরণে নীল সাদা স্কুল ড্রেস।ছুটে খাবার ঘরে প্রবেশ করেই রৌদ্রকে নজরে আসতেই নাক কুঁচকে ফেলল সে।বিড়বিড়িয়ে বলল,”নাউজুবিল্লাহ!অস্তাগফিরুল্লাহ!”

ছুটে খাবার ঘরে প্রবেশ করার দরুন সকলের মনযোগ আভার উপর পড়ল।অভয় বলল,
– কি ব্যাপার এভাবে সকাল সকাল দৌড়াদৌড়ি করছিস কেন?

সেহরিন সালাদের পাত্র থেকে একপিস টমেটো উঠিয়ে রৌদ্রের পাতে দিলো।মাথা গরম হয়ে গেল রৌদ্রের।সেহরিনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।সকলে খাবার খাওয়ার জন্য বসার পর একটি চেয়ারই ফাঁকা ছিল।তাও সেটা আভার জন্য।আভা অভয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে খালি চেয়ারের দিকে ছুটে গেল।এই মুহুর্তে একটি শব্দ উচ্চারণ করারা মতোও সময় নেই।এমনিতেই স্কুলে তার বদনামের শেষ নেই।তার উপর যদি আবার দেরি করে যায় তাহলে তাকে ফেল্টুশের সাথে আরো একটি উপাধি প্রদান করা হবে।সেটা হলো “লেট লতিফা” আপাতত সে আর কোনো উপাধি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক না।
রৌদ্রকে হঠাৎ খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে আবারও মনোযোগ ক্ষুন্ন হলো সবার।সবার নজর রৌদ্রের দিকে পড়ল।রৌদ্র কোনো শব্দ ব্যয় ছাড়ায় নিজের চেয়ার ছেড়ে আভার চেয়ারের দিকে অগ্রসর হলো।তবে আভা আগেভাগেই তার চেয়ারটি দখল করে নিলো।রৌদ্র আভার পাশে এসে দাঁড়াল। অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– হু ইজ শী?

অভয় স্বাভাবিক স্বরে জবাব করল,
– আমার ছোট বোন আভা।

রৌদ্র পূর্ণ দৃষ্টি ফেলল আভার দিকে।চুলগুলো অভয়ের সাথে কিছুটা মেলে।গায়ের রং আভার একটু উজ্জ্বল।ঠোঁট দুটো অভয়ের মতোই পাতলা।চোখজোড়াও অভয়ের মতো টানটান। আড় চোখে যতটুকু বিশ্লেষণ করা সম্ভব করে ফেলল রৌদ্র।কিছুসময় বাদে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– শোনো অভয়ের বোন তুমি ঐ চেয়ারটাই গিয়ে বসো।আমার ওখানে প্রবলেম হচ্ছে।

মাথা তুলল আভা।রৌদ্রকে একপলক দেখে তার ইশারাকৃত চেয়ারে দিকে দেখল।পাশে সেহরিনকে ভোঁতা মুখে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো আভা।সেহরিন তার চিকন কন্ঠস্বর যথাসম্ভব নরম করে বলল,
-কেন রৌদ্র এখানে বসলে কি সমস্যা?

রৌদ্র মুখ দিয়ে “চ্” শব্দ করে কর্কশ স্বরে বলল,
– এলার্জি শুরু হয়েছে আমার বুঝছো?এলার্জি চিনো না এলার্জি?ওখানে বসে আমার শরীর জ্বলছে।না শান্তিতে খেতে পারছি!না বসতে পারছি!

রৌদ্রের কথায় ঠোঁট চেপে হাসল অভয়।সে জানে রৌদ্র আসলে কি বোঝাতে চেয়েছে।সেহরিন দুঃখী স্বরে বলল,
– কি বলছ গো?তোমার এলার্জি আছে?আচ্ছা খাবার খেয়ে নাও আমি তোমাকে ওষুধ দিয়ে আসবো।

ঘাড় ডললো রৌদ্র।রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তবু মুখে কিছু প্রকাশ করল না।নিজের শিকারী দৃষ্টিতে সেহরিনকে একপলক দেখে মনে মনে আওড়ালো,”যেই কীটের ভয়ে এত মাইল দূরে পালালাম সেই কীট এখানেও আমার পিছু নিয়েছে।ইচ্ছা করছে থাপ্পড় দিয়ে মুখের মানচিত্রটাই পাল্টিয়ে দিই। ডিজগাস্টিং!”

আরাভ সাহেব মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
– যাও আম্মু।উনি আমাদের অতিথি হয় না?ওনাকে বসতে দাও।

আভা উঠলো না।বরং মুখ ঝামটি দিয়ে বুকে হাত গুঁজে ঠাঁই বসে রইলো।সিদ্ধান্ত নিলো সে এখান থেকে এক পাও নড়বে না।আজ তাকে এখান থেকে কেউ তুলতে পারবে না।সে একদম সুপার গ্লুর মতো চেয়ারের সাথে সেঁটে থাকবে।সেও দেখবে কে তাকে এখান থেকে সরায়।কথাগুলো মনে মনে বিড়বিড় করে আরো একবার মুখ ঝামটি দিলো সে।রৌদ্র এখন তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখে চলেছে।আভার নড়চড় না দেখে অভয় আভাকে ধমক দিয়ে বলল,
– কিরে কথা কানে যায় না?তোকে এখানে এসে বসতে বললো না বাবা?

কথাটা শুনেও না শোনার ভান করলো আভা।সে এখানেই বসে থাকবে আজীবন ভর সে দেখতে চায় কার সাধ্য তাকে এখান থেকে উঠায়।অভয় ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে এসে রৌদ্রের কাঁধে চাপড় দিয়ে কিছু একটা ইশারা করে রৌদ্রের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
– এ সোজা কথার মেয়ে না।চল চেয়ার ওঠা।

বাঁকা হাসল রৌদ্র। যেন সে এই মুহুর্তটার জন্যেই এখানে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।অভয় আর রৌদ্র দু’জন চেয়ারের দুপাশ ধরে আভাকে আকাশে তুলে ফেলল।হঠাৎই হাওয়ায় ভেসে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো আভা,
– আ…আম্মু!মা!এসব কি হচ্ছে।ভাইয়া নামাও আমাকে। আমি যাবো না।আমি এই চেয়ারেই বসবো।যার যা ইচ্ছে সে তাই করে নিক আমি এখান থেকে এক চুলও নড়বো না।আমাকে নামাও।

অভয় রৌদ্রের কাণ্ডে উপস্থিত সকলে হাসিতে ফেটে পড়লো।অভয় এবং রৌদ্র খুব সহজেই আভাকে চেয়ারসহ তুলে টেবিলের অন্যপ্রান্তে বসিয়ে দিলো।আভাকে বসিয়ে দুজনই হাত ঝাড়া দিয়ে বড় এক শ্বাস ফেলল।আভা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।অভয় বাঁকা হেসে বলল,
– ছেলেদের বুদ্ধির সাথে মোটেও পাঙ্গা নিতে আসবি না।একদম কচু’কাটা করে ছেড়ে দিবো।বুঝেছিস?

রাগে ফুঁসছে আভা।অভয়ের কথায় মুখ ঝামটি দিয়ে নিজের খাবারের প্লেট থেকে একমুঠ খাবার তুলে মুখে ঠুসতে থাকলো।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একগাদা খাবার পরপর মুখে পুরে মুখ ফুলিয়ে ধুপ ধাপ শব্দ করে বেরিয়ে এলো খাবার ঘর থেকে।সবাই তার শত্রু।এই বাড়ির সবাই বিভীষণ।বাহিরাগত একটি সাদা চামড়ার ছেলের জন্য তাকে সবার সামনে এভাবে অপদস্ত করলো তার ভাই?আভা মনে মনে বলল,”কোথা থেকে একটা সাদা মুলা এসে বলে কিনা আমাকে ক’চুকাটা করবে?দাড়া স্কুল থেকে এসে নেয় তারপর মজা দেখাবো।”
বলেই ব্যাগ কাঁধে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আভা। বাড়ির কারো সাথে কোনো কথা বলেনি সে।বলবেও না।সবার সাথে আড়ি করেছে সে।বাড়ির সামনের পাকা রাস্তায় ভ্যান গাড়ি জন্য দাঁড়িয়ে রইলো আভা।কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও কোনো যানবাহন চোখে না পড়ায় ধীর পায়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে যেতে রইলো।ক্ষণে ক্ষণে পিছন ফিরে দেখল কোনো ভ্যান গাড়ি আসে কিনা।গ্রাম অঞ্চলে ভ্যান বলতে বোঝা হয় কাঠের তৈরি তিন চাকার যানবাহন।যেখানে চারজন অনায়াসেই যাতায়াত করতে পারবে।বেশ কিছুদূর হাঁটা পরই চোখে একটি ভ্যান গাড়ি।তবে সামনের দুই আসনই পাড়ার সনামধন্য বখাটে ছেলের আয়ত্তে।তা দেখে আভা নাক শিটকাল।আভাকে দেখে ভ্যান গাড়িটিও থেমে গেল।দুটি রোগা পাতলা চোয়াল ভাঙা ছেলে বসা তাতে।পরণে ময়লা শার্ট আর চেক দেওয়া লুঙ্গি।আভাকে দেখে বিশ্রী দাঁতে হাসি দিলো।দু’জনের মধ্যে নিজেকে সর্দার দাবি করা ছেলেটি তার চেলাকে কনুই দিয়ে আঘাত করে নিচু স্বরে বলল,
– তুই পিছনে গিয়ে বস।

নিচু স্বরে বললেও কথাটি কানে গেল আভার।সে একটু সরে গিয়ে ভ্যানওয়ালা বলল,
– আপনি যান মামা।

ভ্যানওয়ালা গেল না।বরং দাঁড়িয়ে থেকে আভাকে ভ্যাটে ওঠার জন্য চাপ প্রয়োগ করল,
– ক্যান?উঠো ভ্যানে।সামনের সিট তো ফাঁকা কইরে দিলো।

ভ্যানওয়ালার সাথে সায় দিয়ে সামনে বসা ছেলেটিও বলল,
– তাই তো তোমার কষ্ট হবে বলে সামনের সিট ফাঁকা করে দিলাম।বইসে পড়ো।

আভা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
– না আমি যাবো না।

এভাবে জোরাজুরির এক পর্যায়ে ছেলেটি আভার হাত ধরে ফেলল।হাত ধরে টেনে বসাতে চায়লো ভ্যানে।আভা ছেলেটি হাতে খাঁমচি দিতে দিতে গলার স্বর উঁচিয়ে বলল,
– এই সজিব আমার হাত ছাড় বলছি তো আমি যাবো না।

সজিব দাঁত খিঁচিয়ে বিশ্রী এক হাসি হেসে বলল,
– ক্যান গো সোনা পাখি ক্যান যাবা না তুমি।

আভা তেজি স্বরে বলল,
– সোনা পাখি হবে তোর মা হাত ছাড় আমার।

তেঁ তেঁ উঠল সজিব ভ্যান থেকে নেমে আভার হাত মুচড়ে দিয়ে দাঁত কিড়মিড় দিয়ে বলল,
– এই মারে একটা বাজে কথা কইবি তো এইহানেই তোর লাশ ফেলে দিবো।চল উঠ ভ্যানে।

হাতে ব্যাথায় চোখ ভরে উঠলো আভার।মোচড়ামুচড়ি করতে থাকল ছাড়া পাওয়ার জন্য।

– এই কীট আমার পিছনে এভাবে লেগে থাকলে কিন্তু আমার পক্ষে তোর বাড়ি থাকা সম্ভব হবে না বুঝেছিস?

কথা বলতে বলতে মাথায় নিজে কালো ক্যাপটি গলিয়ে নিলো রৌদ্র।বাহিরে ভীষণ রোদ।চোখ মেলে তাকানোর জো নেই।রৌদ্রের কথায় স্মিত হাসে অভয়।মশকরা করেই বলল,
– আরে বাচ্চা মেয়ে জীবনের প্রথম বিদেশি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না।তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন?

রৌদ্র নিজের শিকারি দৃষ্টি ফেলল অভয়ের উপর।রক্তিম চোখে তাকিয়ে বলল,
– হাইপার হব না?আমার খাওয়ার মধ্যে এন্টাফেয়ার করে ঐ মেয়ের এতো সাহস।ইচ্ছা করছিল মেরে হাড়গোড় রোস্ট করে ফেলি।

শব্দ করে হেসে অভয়।পকেটে হাত দিয়ে ফোন না পেয়ে বলল,
– রৌদ্র তুই হাঁটতে থাক আমি আসছি।ফোনটা ফেলে এসেছি।তুই হাঁটতে থাক। কিন্তু বেশি দূর যাস না আবার।

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো রৌদ্র।কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল আভা এবং তার পাশে রোগা পাতলা একটি ছেলে যে কিনা এই মুহুর্তে আবার হাত ধরে আছে।ভ্রু কুঞ্চিত হলো রৌদ্রের।বিড়বিড় করে বলল,”ওটা অভয়ের বোন না?ও তো স্কুলে বেরিয়ে ছিল।তাহলে এখানে রাস্তার মধ্যে ছেলেদের হাত ধরা ধরি করছে কেন?”
এগিয়ে এলো রৌদ্র।আভাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– এটা কি তোমার প্রেমিক?

এমন একটা পরিস্থিতিতে কারো ভারি কন্ঠে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্যে ভীমড়ি খেল আভা।দুই ঠোঁটের মাঝে দুরত্ব সৃষ্টি হলো।রৌদ্র নিজের সেই অন্যতম বৈশিষ্ট্যের চাহনিতে ছেলেটিকে পা থেকে মাথা অবধি একঝলক পরখ করল।নাক মুখ কুঁচকে আভার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ইউউ..!তোমার সাথে একদমই মানায়নি।এর থেকে আরো ভালো কিছু ট্রাই করতে পারতে।এনিওয়ে প্রথম প্রেমে সব মানুষই ভুল করে।এটা নিশ্চয়ই তোমার ফার্স্ট ডেট।এম আই রাইট?

রেগে গেল আভা।নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কটমট চোখে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কি বলছেন এসব আজেবাজে কথা ও আমার প্রেমিক না।

রৌদ্র অবাক হয়ে বলল,
– ও তোমার প্রেমিক না?তাহলে তোমার হাত ধরে আছে কেন?

এতোক্ষণে মুখ খুলল সজিব।রৌদ্রের উদ্দেশ্যে বলল,
– ঐ ব্যা’টা তুই কে রে?চল ফুট এখান থেকে।এটা আমার এলাকা।আমার এলাকায় আমি যার হাত ধরি তাতে তোর কি?

সজিবের কথা বলার ধরণ মোটেও পছন্দ হলো না রৌদ্রের।মস্তিষ্কে দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেল।এক ঝটকায় আভার হাত সজিবের হাত থেকে ছাড়িয়ে এক হাতে সজিবের হাত মুচড়ে ধরল।কালবিলম্ব না করে অন্য হাতে সজিবের গলা চেপে ধরল।জিহ্বা বেরিয়ে এলো সজিবের।চোখ পাকিয়ে গোঙানাতে থাকল।ভ্যানওয়ালা ভয়ে সেখানে আর দাঁড়াল না।আভা চোখ বড় বড় করে মুখে হাত দিয়ে জমাট বেঁধে পাথর হয়ে গেল।মনে মনে আওরালো,” হে আল্লাহ্! এতো দেখি গুন্ডা। সবার সামনে তো কত ইনোসেন্ট সেজে থাকে।অথচ সোজা গলা চেপে ধরল?”

রৌদ্র সজিবের জিহ্বা ধরে টান দিলো।দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে বলল,
– তুই এলাকার মালিক হলে তোর বাপ আমি।তোর এলাকায় তোকে মেরে গুম করে দিবো কেউ তোর এক ফোঁটা রক্তও খুঁজে পাবে না।

বলে আবারও জিহ্বা ধরে আরেক টান দিলো রৌদ্র। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠল হাড় বিশিষ্ট সজিবের শরীর।আভার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এলো।ভয়ে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে কালিমা পড়ল সে।রৌদ্র আগের মতোই হিসহিসিয়ে বলল,
– এই জিহ্বা দিয়ে কোনোদিন আর কোনো মেয়েকে কটু কথা বলবি বল?

সজিব মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল।রৌদ্র জিহ্বা ছেড়ে গলার চাপ দৃঢ় করে বলল,
– আর যদি বলিস তো নেক্সট নাই এই জিহ্বায় খুঁজে পাবি না।কথা কানে ঢুকেছে?

শেষ বাক্যটি হুংকার ছেড়ে বললে সজিবের গলা ছেড়ে দিলো রৌদ্র। সজিবের হ্যাংলা চ্যালাটা কোনো দিকবিদিক খুঁজে না পেয়ে তেড়েফুঁড়ে এলো আভার দিকে।এক কদম বাড়াতেই ঘাড় ঘুরিয়ে রৌদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল তার দিকে।শান্ত কন্ঠে বলল,
– মরার পাখনা গজিয়েছে?কসম একটু টাচ করবি তোর হাত জোড়া লাগাতে পারবিনা।

সজিব নিজের চ্যালার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
– এ তোর মাথায় কি গোবর।চল ভাগ এখান থেকে।

কথাটি বলতে দেরি সজিব চ্যালা নিয়ে দৌড় লাগাতে দেরি নেই।রৌদ্র জোরে একটি শ্বাস টেনে মুখের ভঙ্গি স্বাভাবিক করে ফেলল।শার্টের কলার হাত ঠিক করে মাথার ক্যাপ ঠিক করল।আভাকে নিজের দিকে তাকিয়ে এমন তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু সংকুচিত করল।আভার সামনে তুড়ি বাজিয়ে তার স্বাভাবিক ভারি কন্ঠে বলল,
– কি হয়েছে এখানে চোখ ফেড়ে তাকিয়ে আছ কেন?যাও স্কুলে দেরি হচ্ছে না?

মতি ফিরলো আভার।শুঁকনো ঢোক গিলে ছুট লাগালো সে।এখানে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ানো যাবে না।না জানি কখন তার গলাটাও এই গুন্ডাটার দখলে চলে যায়।বয়সী বা কত আভার?জীবনে এখন অনেক কিছু করা বাকি।এখনই নিজের প্রাণ হারাতে চায়না সে।আভাকে দৌড়াতে দেখে বোকা বনে গেল রৌদ্র।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |৫|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

বাড়ির চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছে রৌদ্র।একা একাই দেখছে।অভয় বাড়িতে ঢোকার পর আর ফিরে আসেনি।রৌদ্রও অভয়কে বিরক্ত না করতে নিজে নিজেই চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছে।বিশাল জমি নিয়ে মুন্সি বাড়ি।জমির সামনের দিকটায় তাদের দুইতলা বড় দালান।আর পিছনের দিকটা ঘন বনজঙ্গল।যার জন্যই এলাকায় নাম হয়েছে “মুন্সিদের বাগান বাড়ি”।রৌদ্র ছোট থেকে এডভেঞ্চার খুব ভালোবাসে তাই বন জঙ্গলে একা ঘুরে তার ভালোই লাগছে।বাগানের ভিতরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ল বাঁশঝাড়।তারপর নারকেল গাছ আর সুপারি গাছের সারি।কিছুদূর পাড় হতেই একটি বিশাল বড় জোড়া বটগাছ। দেখে বোঝা গেল তার বয়স অনেক বছর হয়েছে।বটগাছের সামনা সামনিই বিশাল জায়গা জুড়ে পুকুর।পুকুরে নারকেল গাছ দিয়ে ঘাট তৈরি করা।পুকুরটি চোখে পড়তেই কপাল কুঁচকে এলো রৌদ্রের।নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলল,”বাগানের শেষ সীমানায় এতো বড় একটা পুকুর থাকতে পারে তা তো কল্পনাও করিনি।” পুকুরটা এতোটাই বড় যে প্রথম কেউ দেখে দিঘি ভেবে বিব্রত হবে।পুকুরে আশেপাশে কোনো গাছপালা না থাকায় এবং সূর্যের আলো পুকুরের পানিতে পড়ার পর্যাপ্ত সুবিধা থাকায় পুকুরের পানি একদম স্বচ্ছ।পুকুর ঘাটে এগিয়ে গেল রৌদ্র।ঘাট দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে পুকুরের পানিতে হাত ভেজাল।সেই হাত যে হাত দিয়ে সে সজিবের জিহ্বা টেনে ধরেছিল।ঘাটে দাঁড়িয়েই তার তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলল বটগাছটির দিকে।এখানে যে দুইটি বটগাছ একসাথে আছে তা বোঝার উপায় নেই।তবে কিছুক্ষণ মনোযোগ সহকারে খেয়াল করলে বোঝা যাবে।বট গাছের দিকে এক পলক তাকিয়ে পুকুরের অপর প্রান্তে দৃষ্টি ফেলল রৌদ্র।অপর প্রান্তে গাছ ছাড়া কারো অস্তিত্ব দেখা গেল না।রৌদ্র আবারও বট গাছটির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকাল।সেদিন সূর্যের কথা অনুযায়ী সে ধারণা করেছিল বাগানটি অনেক বেশি গভীর হবে। কিন্তু সে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারল বাগানটি অতটাও ঘন নয়।বাড়ির একপাশ দিয়ে বাগানে ঢুকে ঘুরতে ঘুরতে অন্যপাশ দিয়ে বের হলো রৌদ্র।আভার জানালার পাশ দিয়ে আসতেই হাজারো কাগজ চোখে পড়ল তার।কিছু কাগজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে আর কিছু কাগজ এখন চকচক করছে।নতুন কাগজগুলোর মধ্যে থেকেই একটি কাগজ তুলল রৌদ্র।হাতে নিয়ে বুঝতে পারল এটা কোনো কাগজ নয় বরং খাতা।সে বাংলা লেখা দেখে সেভাবে পড়তে পারে না।তবে ছোট থাকতে তার বাবা কিছুটা শিখিয়ে ছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই খাতাটি খোলার সাহস করল রৌদ্র।খাতার একদম উপরিভাগে স্কুলের নাম,ছাত্রীর নাম,রোল,শ্রেণি,শাখা,তারিখ লেখা।চোখ ছোট ছোট করে বানান করে করে সেগুলো পড়ল রৌদ্র,
“আ ভা বি ন তে আ রা ভ।আভা বিনতে আরাভ! রো ল ৮।রোল এইট! শ্রে ণি দ শ ম।ইট মিনস ক্লাস টেন?ইজেন্ট ইট?গট নোস!উফ্ বাংলা পড়া খুবই কঠিন।লিভ ইট। আভা?মানে অভয়ের ছোট বোন?ওর এক্সাম পেপার এখানে কি করছে?”

বিড়বিড় করতে করতে মাথার উপরে থাকা জানালার দিকে তাকাল।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও খাতার দিকে তাকালো।নম্বর দেখে চোখ বেরিয়ে এলো তার।নাক সিটিয়ে বলল,”অনলি ত্রি আউট ওফ হান্ড্রেড?ও মাই গশ!আনবিলিভাবল!”
রৌদ্র খাতাটি হাতে নিয়েই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।

সবে স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরেছে আভা।মন মেজাজ তার বেজায় খারাপ।স্কুলে পূর্ণতার সাথে একরকম কথা কাটাকাটি করে এসেছে সে।তাদের ঝগড়ার উৎস পূর্ণতার একটি বাক্য।তা হলো,”তুই বদলে যাচ্ছিস আভা।আগের মতো আমার সাথে আর তেমন কথা বলতে চাস না।অভয় ভাইয়া আসার আগেও তুই আমার সাথে কত কথা বলতিস।আমি তোকে একদিন বলেছিলাম আমি কখনো এয়ারপোর্ট দেখি তাই তুই আমাকে তোর সাথে করে এয়ারপোর্ট দেখাতে নিয়ে গেলি।তুই কত ভালো ছিলি দুই দিনে তুই এমন হয়ে গেলি কিভাবে?”
সকালের বিষয়টা নিয়ে এমনেই আভার মাথা গরম ছিল। তার উপর পূর্ণতার এমন বেহুদা কথায় রাগটা মাথায় উঠে গেল।আভা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”তোর কি পি’রিয়ড হয়েছে?”
আচমকা এমন প্রশ্নে থমকে গে পূর্ণতা বলল,”মানেহ্?”
আভা চেঁচিয়ে বলল,”তাহলে এসব আজগুবি কথা বলে আমার কান খাচ্ছিস কেন?বে’য়াদব!”
আভার এমন চিল্লানিতে পূর্ণতা বোকা বনে গেল।বোকা চাহনিতে কিছুক্ষণ আভার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ঝামটি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসল।তারপর তাদের মধ্যে আর কথা হয়নি।আভাও আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলেনি পূর্ণতার সাথে।এখন একটা শব্দ উচ্চারণ মানে দুইজনের মধ্যে বিশাল বড় ঝগড়াঝাটি হবে।যা দেখে ফ্রীতে বিনোদন উপভোগ করবে স্কুলের সকলে।বাঙালি ফ্রীর ভাষা ভালো বোঝে কিনা।

প্রতিদিনের মতো আজও স্কুল থেকে ফিরে খেতে বসল আভা।আভার মুখোমুখি চেয়ারে বসেছে তার ভাই অভয় এবং তাদের মা খাবার তার পাতে তুলে দিচ্ছে।আপাতত তারা তিনজনই খাবারঘরে।অভয় চুপচাপ টেবিলে বসে রৌদ্রের জন্য অপেক্ষা করছে।সে আভাকে বলল,
– পড়াশোনা কেমন চলছে রে তোর?

মুখে খাবার তুলে থমকে যায় আভা।গলা দিয়ে খাবার নিচে নামাতে সক্ষম হয় না।মুখ ফুলিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে তার ভাইয়ের দিকে।ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানো তার মা প্রেমাও অনেকটা উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।অভয় চোখ ছোট করে বলল,
– কি হলো?পানি খা।

আভা সামনে থাকা কাঁচের গ্লাস থেকে ঢক ঢক করে পানিটা পান করল।বড় একটা ঢোক গিলে নিচু স্বরে বলল,
– এই তো চলছে।

মনে মনে ভাবল “সামনে এসএসসি পরীক্ষা এখন যদি বলি আমি গণিতে ফেল করেছি আমার আর রক্ষে থাকবে না।আর পড়াশোনা? ও তো ওর মতো চলে আমি আমার মতো চলি।কেউ কাউকে পাত্তা দিই না।ওসব ছোট খাটো বিষয় পাত্তা দেওয়ার সময় নেই।আপতত জীবনের একটাই লক্ষ্য জীবনে অনেক বড় হতে হবে।প্রতিভা দিয়ে পৃথিবীতে নিজের নামের মাইল ফলক তৈরি করতে হবে।” কথাগুলো ভাবতেই বুক ফুলে গেল আভার।পরমুহূর্তেই মনে পড়ল,”কিন্তু আমার তো কোনো প্রতিভাই নেই!” ভাবতেই আভার মুখ মলিন হয়ে গেল।অভয় ফোনে কাউকে কল করতে করতে তার মাকে বলল,
– দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে যাচ্ছে রৌদ্রটার কোনো খবরই নেই।কখন থেকে ফোন করছি ফোনটাও তুলছে না।আশেপাশে খুঁজলাম কোথাও পেলাম না।শুধু ছোট্ট একটা মেসেজে বলল সে নাকি আশেপাশেই আছে এখনই আসছে।

প্রেমা আতংকিত স্বরে বলল,
– এখানের কোনোকিছুই তো চিনে না হারিয়ে গেল না তো?

অভয় মাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– উফ্ আম্মু ও কি ছোট বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাবে?তাছাড়া এখন টেকনোলজি অনেক এগিয়ে। হারিয়ে গেলে গুগল ম্যাপ দেখে চলে আসবে।

প্রেমা আফসোসের সুরে বলল,
– ছেলেটা সেই কখন সকালে খেয়ে বেরিয়েছে এখনো এলো না।দুপুরে কি খাবে না নাকি?

আভা ভাই ও মায়ের কথা শুনছে আর দ্রুততার সহিত খাবার পেটে চালান করছে।আপাতত সে এখানে আর থাকবে চায়ছে না।রৌদ্র এখানে হাজির হওয়ার আগে তাকে এখান থেকে বের হতে হবে।তাছাড়া বাড়ির সকলের রৌদ্রকে নিয়ে করা অতিরিক্ত আদিক্ষেতা তার সহ্য হয় না।তাই যতটা সম্ভব রৌদ্র থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করছে সে।

বাড়ি ঢুকে খাবার ঘরের দরজা দিকে অভয়কে সেখা বসে থাকতে দেখে খাবার ঘরে প্রবেশ করল রৌদ্র।অভয় রৌদ্রকে দেখে হাফ ছাড়ল।বলল,
– কোথায় ছিলি তুই?বেরিয়ে তোকে আর পেলাম না।তাই ফিরে এসেছি।তারপর মেসেজ দিয়ে বললি আশেপাশেই আছি।তারপর উধাও! খাওয়া দাওয়া লাগবে না?আমার পেট জ্বলছে খিদের যন্ত্রণায়।

রৌদ্র স্বাভাবিকভাবেই বলল,
– তুই খেয়ে নিতে পারতিস।আমি তো চারপাশটা একটু ঘুরে দেখছিলাম।বাগানের ভিতরে দেখি একটা পুকুর আছে।

– হ্যাঁ দাদা কাটিয়েছিল।

প্রেমা টেবিলে প্লেট দিতে দিতে বলল,
– খেতে আসো আব্বু।

রৌদ্র হাতের খাতাটি উঁচিয়ে বলল,
– অভয় দেখ আমি একটা দারুন জিনিস পেয়েছি।আই থিংক এটা আভার ম্যাথমেটিক্স এক্সাম পেপার।শী গট অনলি থ্রি আউট ওফ হান্ড্রেড।

বলেই বিদ্রুপের হাসি দিলো রৌদ্র।সঙ্গে সঙ্গে বিষম খেল আভা।কাশতে কাশতে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল।কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে চেয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।অভয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এগিয়ে এলো।রৌদ্রের হাত থেকে খাতাটি নিয়ে সেটায় চোখ বুলালো।মডেল টেস্ট পরীক্ষার গণিত খাতা।খাতার বেশির ভাগ পৃষ্ঠা সাদা।যাও এক দুইটা অংক করেছে তাও ভুল।একটি সৃজনশীলের গ নম্বর সঠিক হওয়ায় কপালে তিনটা মার্ক জুটেছে।আভা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের দিকে।অভয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।সে খাতা নিজের মায়ের সামনে খাতাটা এক প্রকার ছুড়ে দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– দেখো তোমার মেয়ের উন্নতি।

প্রেমা খাতা দেখে রাগি দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে বলল,
– এই খাতা কবে দেখিয়েছে?

আভা মাথা নিচু করে ভয়াতুর স্বরে বলল,
– গত কাল।

– এটা আমাদের দেখাওনি কেন?

অভয় রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কোথায় পেয়েছিস এটা?

রৌদ্রের সোজাসাপটা উত্তর,
– ওর ঘরের পিছে জানালার নিচে।

অভয় ক্ষিপ্র স্বরে বলল,
– দেখেছ এই খাতা ও ফেলে দিয়েছে।কত ছল চাতুরী শিখেছে।বেয়া’দব! সামনে এসএসসি আর এখন সে গণিতে তিন পায়।ওর আর পড়ালেখার দরকার নেই।ওকে ভ্যানওয়ালা দেখে বিয়ে দিয়ে দাও।পড়ালেখা করবে না সারাদিন ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াবে।আমি আগেই বলছি এসব আবর্জনা বাড়িতে রেখে কোনো লাভ নেই ওকে ভ্যান-রিকশা ওয়ালা দেখে বিয়ে দিয়ে দাও।

কথাগুলো আভার ছোট হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিলো।কষ্টে চোখ ভরে উঠলো তার।ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।নিঃশব্দ কান্নায় ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সে।উঠে চলে আসতে পা বাড়ালেই অভয়ের কঠিন কন্ঠে বলা কথা শুনে আবারও বুক ভরে উঠলো তার।
– খাবার ফেলে যেন এখান থেকে এক কদমও না নড়া হয়।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মুখে খাবার পুরছে আভা।কিন্তু গিলতে পারছে না গলায় আঁটকে থাকা একদলা কষ্টের দরুন।সোলানি ত্বরের গাল নোনা জলে ভিজে গিয়েছে।ভেজা মুখ ফুলে আছে একগাদা খাবারে।আভার মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল রৌদ্র।হঠাৎই অনুতাপ হলো তার।এভাবে অভয় আর তার মাকে খাতাটা না দেখালেও পারত সে।নিজের শিকারী চোখ দিয়ে এক দৃষ্টিতে আভার দিকে চেয়ে রইল রৌদ্র।গলাটা ধরে এলো তার।সদ্য পনেরো ছোয়া কিশোরীর কান্না যেন তার বুকে এক সূক্ষ্ম চাপা ব্যাথার সৃষ্টি করল।আভা মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে খাবার ঘর ত্যাগ করতে অগ্রসর হলো।সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রৌদ্রের দিকে ভেজা চোখে একপলক তাকিয়ে কেঁপে উঠলো। রৌদ্র কিছু বলার উদ্দেশ্যে ঠোঁট আলগা করেও কিছু বলতে সক্ষম হলো না।আভার চোখে দেখা গেল রৌদ্রের জন্য এক আকাশ ঘৃণা।ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল সে।অভয় রৌদ্রকে বলল,
– আয় খাবি।

রৌদ্রের মনিল স্বর ভেসে এলো,
– থাক খাবো না খিদে নেই।

কথাটি বলেই থমথমে মুখে খাবার ঘর ত্যাগ করলো সে।জীবনের প্রথম সে কোনো কাজের জন্য এতোটা অনুতপ্ত!

চলবে…

প্রিয় বালিকা পর্ব-১+২

0

#প্রিয়_বালিকা |সূচনা|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

হাই বেঞ্চের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আয়েশ করে মুখে বরই পুরে চোখ বন্ধ করে ফেলল পনেরো বছরের কিশোরী।চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ এমন কায়দায় ফুটিয়ে তুলল যেন সে অমৃত মুখে পুরেছে।চোখ মুখ কুঁচকে এলো তৃপ্তিতে।তবে সে তৃপ্তির ছায়া মুখে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলো না।স্কুলের লম্বা বারান্দা থেকে ছুটে এলো এক স্বাস্থ্যবান ছেলে।বোঝা গেল সে পুরোটাই পুষ্টিতে ভরপুর।যার দরুন দৌড়ে আসতেও তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। দৌড়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে চোখের সামনে কিশোরীকে হাই বেঞ্চের উপর বসে থাকতে দেখে উদ্বেগ স্বরে বলল,
– এই আভা তাড়াতাড়ি বেঞ্চ থেকে নেমে বস।গণিত স্যার আসছে বগলের নিচে এক বান্ডিল খাতা মনে হয় পরীক্ষার খাতা দেখাবে।

কথাটি কর্ণপাত হতেই চমকে উঠলো কিশোরী।আঁখি যুগল বেরিয়ে আসতে চায়লো কোটর থেকে।লাফিয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়ায় সে।মুহুর্তেই চোখেমুখে ভর করে একরাশ ভয়।শুঁকনো ঢোক গিলে নিজের কম্পনরত দেহ খানির ভর ছেড়ে দিয়ে বেঞ্চে বসে পড়লো আভা।স্বাস্থ্যবান ছেলেটির চোখে তার ভয়াতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।ভীত স্বরে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বললো,”মৃণাল স্যার আসছে?খাতা নিয়ে?গণিত খাতা?”

আভার কথায় ছেলেটি তার জলহস্তির মতো মাথাখানি উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।আরো একটি শুঁকনো ঢোক গিলে নেয় আভা।করুণ চাহনি স্থীর হয়ে আঁটকে থাকে কালো বোর্ডের উপর।পরপর ঢোক গিলে নিলো নিজের আগামী অবস্থানের কথা মনে করে।পাশে ভাব ছাড়া হয়ে বসে থাকা মেয়েটির যেন এসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।তার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না কোনো উত্তেজনা!উদ্দীপনা! সে যেন জানে তার খাতায় কত নম্বর দেওয়া হয়েছে।তাই সে নিজের মনে নিজের নোটখাতা থেকে আভার নোট খাতায় গণিত সমাধান তুলছে।পাশে বসা মেয়েটির ভাব ছাড়া আচারণ মটেই মনে ধরলো না আভার।সে ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ কুঞ্চন করে মেয়েটির পা থেকে মাথা অবধি একঝলক পরখ করে নিলো।সে গলা খাঁকারি দিয়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো।তবু মেয়েটির মনোযোগ ক্ষুন্ন হলো না।সে তার মতো করে চকচকে সাদা খাতায় কালো কালির কলম চালিয়ে যেতে রইলো।আভার চোখে মুখে সামান্য রাগের আভাস পাওয়া গেল।সে খপ করে মেয়েটির হাত থেকে কলমটি কেঁড়ে নিলো।এতক্ষণে মেয়েটির সাড়া পাওয়া গেল।বিরক্তির ছাপ ফেলে আভার দিকে তাকালো মেয়েটি।আভা ঠোঁট একদিকে বাঁকিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটিকে বিরক্ত হতে দেখে আভা বলল,
– কিরে পূর্ণতা মনে হচ্ছে তোর খাতা নিয়ে কোনো চিন্তায় নেই!এতো স্বাভাবিক কিভাবে তুই?তোকে দেখে মনে হচ্ছে এবারও তুই ফার্স্ট হবি!

পূর্ণতা গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বুকে হাত গুঁজল।ঘাড় সোজা করে একটু আরাম করে বসে হেয়ালি স্বরে বলল,
– এমন কিছুই হবে তা আমি খুব ভালো করে জানি তাই কোনো চিন্তা আসছে না।আর তোরও তো চিন্তার কোনো কারণ দেখছিনা।তুই যেমন প্রতিবার লোয়েস্ট মার্কের রেকর্ড গড়িস এবারও তো সেই রেকর্ড গড়তে চলেছিস তাহলে এতো চিন্তা করে লাভ কি?

ক্ষিপ্ত হলো আভা কোমরে হাত দিয়ে শরীর ঘুরিয়ে পূর্ণতার দিকে ফিরলো।তেজি স্বরে বলল,
– মজা নিচ্ছিস?যাহ্ কথা বলবিনা আমার সাথে আর!

স্মিত হাসে পূর্ণতা।আড় চোখে আভার ফুলিয়ে রাখা মুখটি একপলক দেখে আহ্লাদী হাতে আভার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে।সে স্পর্শে বিদ্রুপের আভাসও ছিল অবশ্য। যেটা স্পষ্ট অনুভব করে আভা।চোখ মোটা করে পূর্ণতার দিকে তাকাতেই নিচের ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁধ সংকুচিত করে পূর্ণতা।এর মধ্যেই শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করেন নবম শ্রেণীর গণিত বিষয়ের জন্য নির্ধারিত শিক্ষক মৃণাল কান্তি দাস।নীল সাধা চেক দেওয়া শার্টের সাথে কালো একটি ঢোলাঢালা প্যান্ট।মাথার সামনে এবং পিছনে আধো আধো কয়েক গোছা চুল।সেও যেন শোন পাপড়ির মতো পাতলা এবং তেলে চটচটে। মাথার মাঝখানটায় চকচকে এক উদোম মাঠ।আলোর প্রতিফলন পড়তেই জায়গাটি কেমন ঝলকানি দিয়ে ওঠে।ছোট ছোট একজোড়া চোখের সামনে আবার একজোড়া মোটা ফ্রেমের চশমা।বড় বড় মোটা কালো ফ্রেম মুখের কালো ত্বকের সাথে যেন একদম বেমানান। শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করতেই সকলে উঠে দাঁড়ালো। এক সুরে চেঁচিয়ে উঠলো,
– কেমন আছেন স্যার?

চশমার নিচ থেকে ছোট ছোট মণি দুটো বের করে ক্লাসের শুরু থেকে শেষ অবধি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলেন।হাতের ইশারায় সবাইকে বসতে বললেন।জর্দার কবলে নিহত হওয়া কালো দাঁতগুলো বেরিয়ে একটি কৃত্রিম হাসি দিলেন।চশমাটি নাকের গোড়া থেকে ঠেলে উপরে তুললেন।মুখের পান এক সাইড করে বললেন,
– তোমাদের আজ গণিত খাতা দেখানো হবে।তাই সবাই তৈয়ারি হয়ে যাও নিজের কর্মফলের সম্মুখীন হতে।

বলেই তিনি কাঠের ঘুণে খাওয়া টেবিলের উপর থেকে খাতার বান্ডিলে থাকা রশিটি একটানে গিট ছাড়িয়ে ফেললেন।আর সে দৃশ্য দেখে শরীর নাড়িয়ে কেঁপে উঠলো আভা।শুঁকনো ঢোক গিলে নিলো কয়েকটি।ডান হাতে বৃদ্ধ আঙুল দিকে অনবরত বেঞ্চে খোঁচাতে লাগলো।ভীত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মৃণাল স্যারের দিকে।বিড়বিড়িয়ে বলল,
“মৃণাল কান্তি,
কেড়ে নিলো আমার সব সুখ শান্তি!”

তৎক্ষনাৎ বেঞ্চের উপর রাখা হাতে একটি আঘাত পড়লো।পাশ ফিরতেই দেখলো পূর্ণতার সতর্ককরণ চাহনি।ইশারায় চুপ থাকতে বললো।মৃণাল স্যার তার চোখের চশমাটি আবারও এক দফা উপরে ঠেলে দিলেন।বান্ডিলের সর্বপ্রথম খাতাটি হাতে নিয়ে চমশার উপর থেকে মণি বেরিয়ে খাতাটি একবার দেখে নিলেন।খাতাটি উঁচিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
– ৯৬ পেয়েছে।তোমরা কি বলতে পারবে খাতাটি কার?

সকলে একসঙ্গে কন্ঠ উঁচিয়ে বলে উঠলো,
– পূর্ণতা।

হাসলেন স্যার।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে পূর্ণতার দিকে খাতাটি এগিয়ে দিলেন।পূর্ণতা উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সহিত খাতাটি গ্রহণ করলো।তার বর্তমান অনুভূতি অপ্রকাশ্য।বোঝা দায় সে কি নম্বরটি শুনে খুশি হলো নাকি অখুশি হলো।পূর্ণতার অনুভূতি বোঝার জন্য সকলে একপলক পূর্ণতার দিকে তাকালো।তবে বরাবরের মতো পূর্ণতাকে অনুভূতিশূণ্য দেখে ঘাড় ফিরিয়ে নিলো সবাই।একে একে সকলের খাতা হস্তান্তর করা হলো।সর্বশেষ পালা এলো আভার।খাতাটি হাতে নিতে নাক মুখ কুঁচকে ফেললেন মৃণাল কান্তি দাস।চোখ গরম করে দৃষ্টি ফেললেন আভার দিকে।আভা মুখের সামনে হাত দিয়ে নিজে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলো।মৃণাল স্যার এগিয়ে এসে খাতাটি একপ্রকার ছুঁড়ে ফেললেন আভার সামনে।ক্ষিপ্র স্বরে বললেন,
– এটা কি হাতের লেখা?মনে হচ্ছে তেলাপোকার পায়ে কালি মিশিয়ে খাতার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।নম্বরটা দেখ একবার কত পেয়েছ।

পিটপিট করে সংকোচের সহিত খাতার দিকে চায়লো আভা।খাতার একদম উপরিভাগের বামদিকে কোণায় লাল কালিতে বড় করে লেখা রয়েছে দুটি সংখ্যা।একটি শূণ্য এবং একটি তিন।শূণ্যের অবস্থান বরাবরের মতো আগে।তার ঠিক পরই তিন লেখা এবং তার পাশেই একটি বড় হাতে এফ লেখা।খাতার এমন বেহাল দশা দেখে আভা নিজেও নাক কুঁচকে ফেলল।আভার ভাবগতি মটেও মনে ধরলো না মৃণাল স্যারের।রাগি স্বরে আবারও বলতে লাগলেন,
– তোমার ভাইও এই স্কুলের ছাত্র ছিল আর তুমিও এই স্কুলের ছাত্রী।একজন স্কুলের নাম রোশন করে গিয়েছে আর একজন নাম ডুবিয়ে দিচ্ছে।তোমার ভাই গণিতে নব্বইয়ের ঘর থেকে কখনো নড়েনি।আর সেখানে তুমি আজ পর্যন্ত নয়টা মার্কও তুলতে পারলে না।

মলিন মুখে মাথা নত করে সবগুলো কথা হজম করে নিল আভা।গণিত স্যারের এসব বকাঝকা তার কাছে নতুন নয়।সকল সাবজেক্টে সে লেটার মার্ক এমন কি খুবই হাই মার্কও নিয়ে আসে।তবে কথা ওঠে তখন যখন সে গণিতে পাশ মার্কটাও তুলতে অক্ষম।সে আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারে না সে গণিতে এতো বেশি দূর্বল কেন?ছোট থাকতে তো ঠিকই নিরানব্বই-আটানব্বই নিয়ে আসতো।তার প্রিয় বিষয় ছিল গণিত।তাহলে এখন কি হলো?এখন গণিত কেন তার একমাত্র ভয়ের কারণ?মৃণাল স্যার সরে গেলেন আভার পাশ থেকে।বোর্ডে একটি অংক তুলে দিয়ে বললেন,
– এটা সবাই করে দাও এখন।আমি দেখবো।

পূর্ণতা স্বভাব সুলভ অংকটি করতে শুরু করলো।আভাকে জ্ঞান হারিয়ে এক ধ্যানে বসে থাকতে দেখে তাকে একটি ধাক্কা দিলো পূর্ণতা।ধ্যান ভাঙ্গলো আভার।মলিন দৃষ্টিতে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে অংকটি তুলে নিতে খাতায় কলম চালালো আভা।আকস্মিক তার শরীরে শক্ত সাদা একটি বস্তু এসে পড়লো।শরীর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়লো বস্তুটি।সহসা এমন ঘটনায় চমকে উঠলো আভা।পরক্ষণে পায়ের কাছে একদলা কাগজ দেখে হাফ ছাড়ে সে।পিছন ফিরে কাগজটি উড়ে আসার উৎস দেখতে চায়লে দৃষ্টি আঁটকালো তার সারির পরের সারিতে বসা একটি শ্যাবর্ণের ছেলেকে।আভার দিকে নিজের ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে তাকিয়ে আছে।চোখ ছোট করলো আভা।নিচু হয়ে কাগজটি তুলে ভাঁজ খুললো।দেখতে পেলো কাগজে বড় বড় অক্ষরে লেখা,”ফেল্টুশ”
মাথায় খুন চড়ে গেল আভার।ফোঁসফোঁস শ্বাস ছেড়ে চোখ ফেড়ে তাকালো ছেলেটির দিকে।শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে কাগজটি ছুঁড়ে মারলো ছেলেটির দিকে। ছেলেটির গায়ে কাগজটি লাগতেই মৃদু আওয়াজ সৃষ্টি হলো।যে আওয়াজ লক্ষ্য করে ধ্যান দিলেন মৃণাল স্যার।আভাকে ক্ষুব্ধ চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃণাল স্যার যা বোঝার বুঝে গেলেন।হুংকার ছেড়ে আভার উদ্দেশ্য বললেন,
– এই বেয়াদ’ব মেয়ে।ক্লাসের ভিতর কি হচ্ছে এসব?একে তো অংকে করবে ফেল তার উপর অংক করতে দিলেও ক্লাসে তামাশা শুরু করে দেও।যাও বের হয়ে যাও ক্লাস থেকে।আমার ক্লাসেই আর আসবে না তুমি।যাও বাহিরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।বের হও এক্ষুনি।

উঠলো না আভা ঠাঁই শক্ত পাথর হয়ে বসে রইলো।নাক ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে লাগলো।পূর্ণতা করুণ চোখে চেয়ে রইলো তার পাশে থাকা সোনালি বর্ণের মেয়েটির দিকে।মৃণাল স্যার আভার কোনো হেলদোল না দেখে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললেন,
– এই মেয়ে কথা কানে যায় না?বের হয়ে যেতে বলেছি তোমাকে ক্লাস থেকে।গেট লস্ট ফ্রম মাই ক্লাস রাইট নাও।

স্যারের কথা শেষ হতেই ব্যাগ নিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে এলো আভা।টান টান চিকন চোখ দুটো রক্ত বর্ণ ধারণ করলো।অসম্ভব রকম জ্বলতে শুরু করলো তার ঘন কালো পাপড়িতে ঢাকা টানা টানা চোখ দুটি।সরু নাকটির আগাও রক্তিম হয়ে চেয়ে আছে।পাতলা ক্ষীণ ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘাড় আগলে থাকা কোঁকড়ানো চুলগুলোর এক অংশ ডান হাতে চেপে ধরলো সে।এমন অপমান তাকে আগেও করা হয়েছে।কিন্তু আজ যেন তার সকল সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেল।আভাকে দাঁতে দাঁত পিশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতর থেকে মৃণাল স্যার বললেন,
– কান ধরে দাঁড়াতে বলেছি না?শিক্ষকের কথা অগ্রাহ্য করো কত বড় বেয়াদ’ব।দাঁড়াও আজই তোমার মায়ের সাথে কথা বলবো।

মৃণাল স্যারের কথা কানে আভা যেতেই কানে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা উষ্ণ নোনাজল।নাক ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করলো আভা।নিঃশব্দ কান্নায় সারা মুখ ধারণ করলো রক্তিম বর্ণে।তবে গায়ের সোনালীবর্ণের দরুন সে লালিমার সেভাবে বহিঃপ্রকাশ হলো না।লালাভা দুইগালে ছড়িয়ে যেতেই ডান চোখের নিচে থাকা অতি ক্ষুদ্র কুচকুচে কালো তিলটি জাগ্রত হলো দৃঢ়ভাবে।বারান্দা অতিক্রম করার সময় অন্যান্য ক্লাসের কয়েকজন
ফিসফিসিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো,”দেখ আফ্রিকান কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে।”

“মনে হয় ম্যাথ খাতা দেখিয়েছে”

“আমার মনে হয় ও এই ম্যাথের জন্যই আদুবোন হয়ে আজীবন স্কুলে রয়ে যাবে!”

“যা বলেছিস!হা হা..”

আভা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তাদের দিকে তারা বেশ আতংকিত হয়ে একে অপরকে ধরে সেখান থেকে দ্রুত পা চালিয়ে সরে এলো।কিছু সময় পাড় হতেই মৃণাল স্যারের গণিত ক্লাস শেষ হলো।সে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।যাওয়ার সময় দরজার পাশে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে আঁড়চোখে একবার দেখে গেলেন।আভা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।পূর্ণতা করুণ স্বরে তাকে বলল,
– তুই আমার কাছে একঘন্টা করে গণিত করিস প্রতিদিন।আমি তোকে শিখিয়ে দিবো সব।

মাথা তুলে পূর্ণতার চোখে চোখ রাখে আভা।আলতো হেসে জরিয়ে ধরে পূর্ণতাকে।পূর্ণতা কোমল হাত বুলিয়ে দেয় আভার পিঠে।আভা চট করে পূর্ণতাকে ছেড়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
– জানিস আজ কে আসছে?

পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– কে?

– ভাইয়া আসছে আজ রাতে ল্যান্ড করবে।যাবি আমার সাথে এয়ারপোর্টে?

পূর্ণতা আনমনা স্বরে বলল,
– অভয় ভাইয়া আসছে?

পূর্ণতা তার লম্বা দু’টো বেণিতে হাত বুলিয়ে এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরাতে লাগল।আভা তা দেখে মুচকি হাসে।পূর্ণতাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো বল যাবি এয়ারপোর্টে আমার সাথে?গেলে আমি আর তুই একসাথে যাবো আম্মুরা আম্মুদের মতো যাবে।

মুখে কোনো উত্তর দিলো না পূূর্ণতা।ঘাড় ডান দিকে কাত করে বোঝালো সে যেতে ইচ্ছুক।খুশিতে পূর্ণতার সাথে আরো একবার আলিঙ্গন সেরে ফেলল আভা।রওনা হলো বাসার দিকে।

———————————
বাড়িতে বিশাল বড় তোড়জোড় চলছে।বংশের বড় ছেলে আজ দেশে ফিরছে।দুই কাকা-কাকিসহ বাবা-মা সকলের আনন্দ যেন আজ সীমাহীন।মায়ের আনন্দ সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো।সে সবাইকে ধরে ধরে বলছে “আজ আমার ছেলে আসছে!”বাড়িতে এতো তোড়জোড় দেখে বহু উৎসুক জনতাও ভীড় করছে বাড়িতে।বাড়ির বড় বউয়ের এমন বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ দেখে সকলে ঠোঁট চেপে হাসছে।এলাকার লোকও বেশ আগ্রহী প্রবাসী ছেলেটিকে দেখার জন্য।এই গ্রাম থেকে ছেলেটিই প্রথম বিদেশ পাড়ি দিয়েছে।তার করদই আলাদা!তাকে একনজর দেখতে এলাকার মানুষ ভীড় করেছে মুন্সী বাড়িতে।চারবিঘা জমির উপর বিশাল বড় এক দালান বাড়ি।এলাকার সবাই “বাগান বাড়ি” নামে এক নামে চেনে মুন্সী বাড়িকে।এখান থেকে দেড় ঘন্টার পথ অতিক্রম করলেই শহর।সেখানের এয়ারপোর্টেই ল্যান্ড করবে আজ মুন্সী বাড়ির প্রবাসী বড় ছেলে।
বাড়ির সামনে জনসমুদ্র দেখে হতবিহ্বল হলো আভা।কিছুসময়ের জন্য ভাবলো “কি ব্যাপার বাড়িতে এতো ভীড় কেন?কারো কিছু হলো নাকি?” ভাবতেই সবার আগে মস্তিষ্কে এলো দাদির কথা। তার দাদি বেশকিছুদিন ধরে শয্যাশায়ী।আর তার আবদারেরই দেশে ফিরছে বাড়ির বড় ছেলে।শ্বাস ঘন হলো আভার পা চালিয়ে ভিড় ঠেলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।বসার ঘরে ছোট চাচিকে দেখে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ছোট আম্মু দাদি ঠিক আছে?বাড়িতে এতো মানুষ কেন?

আলতো হাসে আভার ছোট চাচি।সহসা ভাসুরকে বসার ঘরে প্রবেশ করতে দেখে কাতান শাড়ির আঁচল টেনে মাথা আগলে নেয়।আভার বিধস্ত চেহারা দেখে আভাকে আশ্বস্ত করে,
– মা ঠিক আছে।ওরা তো অভয়কে দেখতে এসেছে।তুই ঘরে গিয়ে জামা কাপড় ছেড়ে পরিষ্কার হয়ে খেতে আয়।আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।

নাক মুখ কুঁচকে ফেলল আভা।বাইরে তাকিয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
– বুঝলাম না এই বাদরটাকে দেখার কি আছে।ও নিশ্চয়ই আমার থেকে সুন্দর না!হুহ্!

কথাটি শেষ করেই নিজের ঘাড় আগলে থাকা কোঁকড়া চুলগুলো হাত দিয়ে উড়িয়ে মুখ ভেঙচি দিলো।আরাভ মুন্সী মুচকি হেসে এগিয়ে এলেন মেয়ের কাছে।মেয়ের মাথায় হাত রেখে আদুরে সুরে বললেন,
– ঠিকই তো।আমার মেয়ের মতো সুন্দর কেউ নেই।

বুক ফুলালো আভা।কোমরে হাত দিয়ে অহংকারী স্বরে বলল,
– হ্যাঁ। আমার মতো সুন্দর কেউ নেই।কারো গায়ের রং কি সোনালী হয় বলো বাবা?

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো আরাভ মুন্সী।অর্থাৎ কারো গায়ের রং সোনালি হয় না।আভার বাবার সম্মতি পেয়ে আরো অহংকারী হয়ে উঠলো আভা আবার বলতে শুরু করলো,
– আমার গায়ের রং সোনালী।আমার চোখ দেখেছ কত টানা টানা কত চিকন।আর চুল এমন ঘন কালো কোঁকড়া চুল তুমি কোথাও পাবে বলো বাবা?

আরাভ সাহেব একটু ভেবে নিজের মাথা হাত দিয়ে বললেন,
– আমার মাথায়ও তো কোঁকড়া চুল!

দমে গেল আভা।নিজের ভিতর কথা সাজাতে কিছুক্ষণ সময় নিলো।অতঃপর আবার আগের ন্যায় অহংকারী কন্ঠে বলল,
– ওটার ডেট এক্স পেয়ার হয়ে গিয়েছে কিছুদিন পর আর থাকবে না।

মেয়ের কথায় চোখ বড় বড় করে ফেললেন আরাভ।বাবা-মেয়ের কথপোকথনে ফোড়ন কাটলেন আভার মা প্রেমা।বললেন,
– হয়েছে রোজ একবার করে নিজের প্রসংশা করে কি বোঝাতে চাও তা আমি খুব ভালো করেই জানি।

থতমত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো আভা চোখের মণি এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে লাগলো।প্রেমা আবারও বললেন,
– বিয়ের শখ হয়েছে সেটা বারবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাদের না বললেও হবে।

আরাভ মুন্সী বিস্ফোরিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– তোমার আম্মু এসব কি বলছে আভামণি?

আভা তড়িঘড়ি দু’হাত নাড়িয়ে বলল,
– এসব মিথ্যা আব্বু।আমার একটুও বিয়ের শখ হয়নি।আম্মু তুমি এসব ভুলভাল কি বকছো?কিসের মধ্যে কি টেনে আনলে তুমি এটা?

– তাহলে তুমি রোজ রোজ নিজের ঢাক নিজেই বাজাও কেন?মানুষের যখন বিয়ের শখ জাগে তখন সে এমনভাবে নিয়ম করে দিনে পাঁচবেলা নিজের ঢাক নিজে পেটায়।পড়াশোনায় তো রসগোল্লা। আজ কি খাতা দেখিয়েছে?কত পেয়েছ?

প্রেমার কথা শেষ হতেই সেখানে উপস্থিত হলো আভার থেকে তিনবছরের বড় একজন তরুণ।সবে আঠারো ছুঁয়েছে।আভাকে টিটকারি করে বলল,
– আরে বড় আম্মু বিয়ের শখ জাগলেই কি হলো নাকি?বিয়ের বয়সও তো হওয়া লাগবে।এখনো নাক টিপলে দু’ধ বের হবে।

বলতে বলতে ছেলেটি এগিয়ে এসে আভার মাথায় একটি গাট্টা মেরে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠলো আভা,
– আম্মু….

আভাকে চেঁচাতে দেখে ছেলেটিও আভারকে অনুকরণ করে মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
– হাম্মু..সারাক্ষণ শুধু হাম্বা হাম্বা।যাহ্ গিয়ে কাপড় ছাড়!

উপস্থিত সবাই হাসলো আভা এবং ছেলেটির কর্মকান্ডে। প্রেমা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– খেতে আয় সূর্য…

চলবে…?

#প্রিয়_বালিকা |২|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভা ঘরে ঢুকেই সবার প্রথমে ব্যাগ থেকে নিজের গণিত খাতাটি বের করলো।আল্লাহর কাছে মাফ চায়তে চায়তে খাতাটি সুন্দর করে ভাঁজ করে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো।কাঁদো কাঁদো মুখে হাত জোর করে আরো একবার মাফ চায়লো আল্লাহর কাছে।চোখ মুখ খিঁচে মোনাজাত ধরলো।মোনাজাতে তার চাওয়াটা ছিল “হে আল্লাহ এবারের মতো মাফ করে দাও।এবারই শেষ। এরপর যে করেই হোক পাশ করার চেষ্টা করবো।অনেক পড়াশোনা করবো।শুধু তুমি এবারের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দাও।” নিজের মনের সব আর্তনাদ ঝেড়ে পরিষ্কার হওয়ার উদ্দেশ্যে বাথরুমে প্রবেশ করলো।সে খাতা এভাবে ফেলে দিয়ে নিজের কাছেই খুব অপরাধ বোধে ভুগছে।না জানি কত বড় পাপ করে ফেলল!কিন্তু বাড়ির লোককে খাতা দেখালে তো এর থেকে আরো বড় পাপ হবে!বাড়িতে টেকাই দুঃষ্কর হয়ে যাবে।আল্লাহর কাছে পাপের ক্ষমা পাওয়া সহজ কিন্তু মানুষের কাছে মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষমা পাওয়া যায় না।আর এই ধারণাকে পোষণ করেই আভা যা পাপ করার আল্লাহর কাছে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুপুর তিন কি সাড়ে তিন।গোসল সেড়ে খাবার ঘরে প্রবেশ করে আভা।খাবার ঘরে কাউকে দেখা গেল না।খাবার ঘরের পাশে থাকা বড় রান্নাঘরেও কোনো জনমানবের হদিস পাওয়া গেল না।ভ্রু সংকুচিত হয়ে এলো আভার।কিছুক্ষণ ভেবে অনুমান করার চেষ্টা করলো সকলে এই মুহুর্তে কোথায় থাকতে পারে।মস্তিষ্ক ক্লান্ত হতেই হাক ছাড়ল আভা,
– মা ও মা?মা?

মেয়ের ডাকে কোথা থেকে ছুটে এলেন প্রেমা।চটজলদি থালা বের করে খাবার সাজিয়ে দিলেন কাঠের টেবিলের উপর।আভা কাঠের চেয়ারগুলোর একটি চেয়ার টেনে সেখানে খেতে বসলো।খাবার মুখে দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
– তোমরা কখন যাবে?

প্রেমার সহজ স্বাভাবিক জবাব,
– আমরা তো সন্ধ্যার দিকে বের হবো।

প্রেমার মস্তিষ্কে হঠাৎ কোনো কথা ধরা দিতেই সে কপাল কুঁচকে সন্দিহান স্বরে আভাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– কেন তুই যাবি না আমাদের সাথে?

খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে গেল আভা।একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল।গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিল।বাম হাত দিয়ে নিজের চুলের এক পাশ ছুঁয়ে দিলো।ঢোক গিলে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
– যাবো।কিন্তু!

কপালের মাঝে আরো দু’টি ভাঁজ বৃদ্ধি পেল প্রেমার।তার গম্ভীর চাহনিতে আভা নিজের পাতলা দুই ঠোঁট ভাঁজ করে নিলো।প্রেমা প্রশ্ন করলেন,
– কিন্তু কি?

আভা আমতা আমতা করে মায়ের কাছে ধরা দিলো,
– আমি ভেবেছিলাম আমি আর পূর্ণতা যাবো।আমি ওকে আসতে বলেছি।

– ভালো। ও যাবে তাহলে আমাদের সাথে তাতে এতো আমতা আমতা করার কি আছে?

আভা চোরা কন্ঠে বলল,
– বলছি যে আমরা একাই চলে যেতে পারবো।

ব্যস!এই একটা বাক্যই প্রেমার রাগ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো।সে চোখ গরম করে কঠিন স্বরে জবাব দিলেন,
– এই কথাটা বলতেও তোমার বুক কাঁপলো না?এটা কি এখান থেকে পাড়ার স্কুল যে তুমি এখনই যাবে আবার এখনই আসবে?দেড় ঘন্টার পথ একা যেতে চাও?কত বড় হয়ে গিয়েছ তোমরা?দাঁড়াও আজই তোমার বাবাকে বলছি তোমার পাখনা গজিয়েছে।

কথাগুলো বলতে বলতে খাবার ঘর ত্যাগ করলেন প্রেমা।আভা মায়ের যাওয়ার দিকে ভীত চাহনিতে চেয়ে একটি শুঁকনো ঢোক গিলল।মনে মনে ভাবল “মা নিশ্চয়ই বাবাকে কথাটা ইনফর্ম করতে গিয়েছে।মা তো আবার বাবাকে কোনো কথা না বলে থাকতেই পারে না।বাবা মায়ের বেস্টফ্রেন্ড কিনা!” চিন্তায় পড়ে গেল আভা।এবার যদি আভার যাওয়াটাই বরবাদ হয়ে যায় তখন কি হবে?আভা নিজেই নিজের মাথায় একটি চাটি মারলো। দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়িয়ে বলল,”ধূর বাবা!এতো পাকামি করতে কে বলেছিল আভা তোকে?এখন যাওয়াটাই না বরবাদ হয়ে যায়।”

আস্তেধীরে খাবার শেষ করে ঘরে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইলো আভা।যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর সে ঘর থেকে বের হবে না।একেবারে যাওয়ার সময় জামা কাপড় পরে রেডি হয়ে বাহিরে যাবে।পরিপাটি হয়ে বের হলে নিশ্চয়ই তাকে ফেলে চলে যাবেনা।এতোটা নিষ্ঠুর নয় তার বাড়ির লোক।ঘরে বসে বসে নিজেকে যত রকমভাবে শান্তনা দেওয়া সম্ভব সবরকম কৌশল প্রয়োগ করছে আভা।

আসরের আযান পড়তেই বাড়ির সদর দরজায় কড়া নড়ে।দরজা খুললেন বাড়ির ছোট বউ আইরিন সুলতানা।খুবই চুপচাপ গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে তিনি।সংসারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে তিনি সর্বদা সচল।দরজা খুলে পূর্ণতাকে দেখে মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে।হাসির সাথে জিজ্ঞেস করলেন,
– কেমন আছ পূর্ণতা?

পূর্ণতাও আইরিনের হাসির বিনিময়ে এক গাল হাসি উপহার দিলো তাকে।পূর্ণতার কন্ঠে বিনয়ী সুরে জবাব এলো,
– জ্বী আন্টি ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?বাসার সবাই কেমন আছে?

– সবাই ভালো আছে,ভিতরে আসো।

ভিতরে প্রবেশ করলো পূর্ণতা।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– আভা কি ওর রুমে?

অনিশ্চিত জবাব দিলেন আইরিন,
– হয়তো। দুপুরে খাবার খেয়ে সেই ঘরে গিয়েছে আর বের হয়নি।হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।

পূর্ণতা কিছুক্ষণ ভাবলো।তারপর আইরিনকে বলে আভার ঘরে চলে এলো সে।আভা খাটে চিত হয়ে মূর্তির মতো শক্ত হয়ে শুয়ে আছে।চোখের মণি উপরে ঘরের ছাঁদে নিবদ্ধ। পূর্ণতা নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করলো।আভার পাশে বসে ধাক্কা দিলো আভাকে। বলল,
– তুই আমাকে আসতে বলে এখনো শুয়ে আছিস?যাবিনা?সবাই কখন বের হবে?

হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠলো আভা।পূর্ণতাকে দেখে উঠে বসলো।টুকটাক কিছু কথা শেষ করে চলে গেল রেডি হতে।
মাগরিবের আযান দিতে আধ ঘন্টার মতো বাকি।বাড়ির সামনে ভাড়া করে আনা একটি মাইক্রোবাস।পাশেই একটি মোটরসাইকেল।বাড়ির সকলে যাচ্ছে না।শুধু আরাভ মুন্সি এবং তার মেঝো ভাই।সাথে আভা এবং পূর্ণতা।মোটরসাইকেলে যাচ্ছে সূর্য।মোটরসাইকেল চালিয়ে এতোটা পথ যাওয়ার জন্য তাকে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে।বাড়ির সকলের সম্মতি পেতে তাকে নাকের জল চোখের জল এক করতে হয়েছে।দূর থেকে আভা আর পূর্ণতাকে আসতে দেখে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্য নিজের চেহারাটা আয়নায় আরেকবার দেখে নিলো।চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিলো।মুখ বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে নিশ্চিত হতে চায়লো তাকে কোন পোজে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়।আভা এবং পূর্ণতা তার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে সোজা হয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ালো। আভা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– তুই যাচ্ছিস কোন দুঃখে?

সূর্য মুখ উঁচু করে ভাবের সহিত বলল,
– দুঃখে যাবো কেন?ভাই আসছে সেই সুখে যাচ্ছি।

আভা কথা বাড়ালো না অপেক্ষা করতে থাকলো তার বাবা চাচার জন্য।সূর্য তার আঁকা বাঁকা দাত বেরিয়ে এক ভুবন ভুলানো হাসি দিলো।পূর্ণতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– পূর্ণতা তুমি চাইলে আমার সাথে আমার বাইকের পিছনের ছিটে যেতে পারো।দু’জনে মিলে চাঁদের দেশে যাবো।

দম ফাটা হাসি ছাড়লো আভা।পেটে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিল।হাসতে হাসতে পূর্ণতার শরীরের উপর ঢলে পড়লো সে।পূর্ণতাও ঠোঁট চেপে হাসল।আভা হাসি থামিয়ে সূর্যকে বলল,
– তুই যা চান্দের দেশে আমাদের এখন সময় নেই।আমাদের এখন এয়ারপোর্টে যেতে হবে।তুই গিয়ে খুঁটি বসাতে থাক আমরা ভাইকে রিসিভ করেই আসছি।

সূর্য মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো। আভা আর পূর্ণতা হাসি তামাশা করতে করতে মাইক্রোবাসে উঠে বসলো।কিছুক্ষণের মধ্যে মাইক্রোবাস ছেড়ে দিলো নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

একটু আগেই প্লেন ল্যান্ড করেছে।তবে যাত্রীরা এখন এয়ারপোর্টের বাইরে বের হয়নি।মুন্সি বাড়ির বড় ছেলেকে নিতে আসা সকলের দৃষ্টি এই মুহুর্তে এয়ারপোর্টের দরজার দিকে।কখন তাদের ছেলে বেরিয়ে আসবে।সকলে উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে রয়েছে।সবার একটিই উদ্দেশ্য “অভয়কে দেখবে।”প্রায় সাত মাস পর অভয়কে এতো কাছ থেকে দেখবেন তারা।সকলের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে।মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ আসন পেতে বসে আছে।সকলের দীর্ঘ প্রতীক্ষার বাধ ভেঙে দৃশ্যমান হলো সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি।সাদা পোলো শার্টের নিচে কালো প্যান্ট।মাঝারি আকারের শারীরিক গঠন উজ্জ্বল শ্যামলা ছেলেটিকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।মাথার লম্বা লম্বা সামান্য কোঁকড়া চুলগুলো একপাশ করে আঁচড়ে রাখা।হাসি মুখে নিজের পরিবারের দিকে এগিয়ে এলো সে।প্রথমেই নিজের বাবাকে আলিঙ্গন করল।একে একে চাচা এবং সূর্যের সাথে আলিঙ্গন সেড়ে আভাকে জরিয়ে ধরলো।লম্বা ভাইয়ের বগলের নিচে আদুরে আভা বিড়াল ছানার মতো লুকিয়ে পড়লো।অভয় বোনের মাথায় আদুরে স্পর্শ দিতে দিতে বলল,
– আমার আভামনিটা কেমন আছে?

আভা আহ্লাদী স্বরে উত্তর দিলো,
– ভালো আছি ভাইয়া তুমি কেমন আছো?

– ভালো আছি।

অভয়ের নজরে পূর্ণতা আসতেই সে অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
– একিরে তুই এখনো এর সাথে ঘুরিস পূর্ণ?

স্মিত হাসলো পূর্ণতা।বলল,
– কেন? না ঘোরার কথা ছিল নাকি?

অভয়ও হাসলো।আভাকে সরিয়ে বলল,
– আমি তো ভেবেছিলাম তুই হয়তো ফেল্টুশটার সাথে আর মিশবিই না।যে হারে ফেল করে ও।ওর সাথে কেউ মিশলে সেও নির্ঘাত ওর মতো ডাব্বা মার্কা স্টুডেন্ট হয়ে যাবে।

আভা কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
– এসে পারলে না অমনি আমার নামে বদনাম শুরু করে দিলে?

হাসলো অভয়।এতোক্ষণে সকলের নজর আঁটকালো অভয়ের পাশে চুপচাপ গম্ভীর ভঙ্গিতে সকলকে পর্যবেক্ষণ করা বিশাল উচ্চতার ধবধবে সাদা ছেলেটিকে।সাদা ত্বকের সর্বাঙ্গ কালো কাপড়ে মোড়ানো। কালো ক্যাপের নিচ থেকে সকলকে নিজের শিকারি দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে সে।অদ্ভুত সে দৃষ্টিতে থমকে গেল সবাই।অভয় সকলকে নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে নজর দিতে দেখে মৃদু হাসল।বলল,
– ও আমার বন্ধু। আমরা একসাথে পড়ি এবং একসাথে থাকি।

এতক্ষণে ছেলেটি তার মোটা কন্ঠস্বরে ধ্বনি তুলে উচ্চারণ করল,
– আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছেন সবাই?

বিদেশি কোনো ব্যক্তির মুখে সুস্পষ্ট বাংলা শুনে আরো একদফা চমকে উঠলো সবাই।অভয় সকলের চমকানোর কারণ বুঝতে পেরে বলল,
– ওর বাবা-মা বাংলাদেশি।ওর জন্মের আগেই বিদেশে চলে যায়।কিন্তু ও বাংলা পারে।ওরা বাসায় বাংলায় কথা বলে।

সকলের মুখের ভঙ্গি স্বাভাবিক হলো।সকলে অভয়ের বন্ধুর সাথে কুশল বিনিময় সেড়ে ফেলল।আভা থমথমে মুখে গোল গোল চাহনিতে ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে বিশ্লেষণ করে চলেছে।কালো ক্যাপের নিচ থেকে কপাল জুড়ে থাকা কালো চুলগুলোর কিছু অংশ বোধগম্য। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো তার শিকারী চাহনি।ভয়ংকর সে চাহনিতে গা ছম ছম করে উঠলো আভার।শরীরের সব-কটি লোম দাঁড়িয়ে গেল।নিজের হাতের দিকে চেয়ে কেঁপে উঠলো আভা।নিজের ভাইয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের কান ধরে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এলো।অভয়ের ভ্রু কুঁচকে এলো।আভা অভয়ের কানে ফিসফিস করে বলল,
– আচ্ছা ভাইয়া তোমার বন্ধু কি মানুষ খুন করে?

অভয় চোখ গরম করে বোনের দিকে তাকিয়ে তার মতোই হিসহিসিয়ে বলল,
– আজেবাজে কি বলছিস এসব।মুখ বন্ধ রাখ।

অভয়ের বাবার ছেলেটিকে বেশ মনে ধরেছে।হেসে খেলে কত কথা সেড়ে ফেলল ছেলেটির সাথে।হঠাৎই আরাভের কিছু মনে পড়তেই সে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলল,
– দেখেছ এতো কথা বললাম অথচ তোমার নামটাই শোনা হলো না।

ছেলেটি আবার তার সেই ভরাট মোটা কন্ঠে জবাব দিলো,
– আফসিন রৌদ্র।

চলবে..?

উধয়রনী পর্ব-৬১ এবং শেষ পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬১: অন্তিম পর্বের প্রথমাংশ||

১২৮।
হাতে টান অনুভব করলো আহি। হাত ছাড়ানোর জন্য সে ভ্রূ কুঁচকে পিছন ফিরলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আফিফের দিকে। কিন্তু অন্ধকারে আফিফ আহিকে দেখতে পাচ্ছে না। আফিফ কাতর স্বরে বলল,
“আমার কথা শুনবে না?”

আহি পাল্টা জিজ্ঞেস করলো
“আমার কথা শুনতে চেয়েছিলে কখনো?”

“শোধ তুলছো?”

আহি হাসলো। তার হাসির শব্দ আফিফকে ভীষণ মুগ্ধ করলো। এবার তার সাহস বাড়লো কয়েক গুণ। আহিকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আহি আফিফের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তোমার সময়-সু…”

আফিফ আহিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। পাশের দেয়ালে আহির পিঠ ঠেকিয়ে তার অধরে অধর ছোঁয়ালো। আহি চোখ বন্ধ করলো। সে আফিফের কাঁধে হাত রাখলো। তার গলায় লাগিয়ে দিলো তার হাতে লেগে থাকা রঙ। আফিফ আহিকে ছেড়ে দিলো। আহির কপালে কপাল ঠেকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এখনো অনেক সময় আছে, আহি। আমি আমার পুরো জীবনটাই তোমার নামে লিখে দেবো।”

আহি মুচকি হেসে বলল, “আচ্ছা?”

“হুম।”

“আফিফ, তোমার মনে আছে সেই বর্ষার রাত!”

আহির গলা ভারী হয়ে এলো। আহি বলতে লাগলো,
“সেদিন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি ভিজে যাচ্ছিলাম। তোমাকে কতোবার ডাকলাম। কিন্তু তুমি এলে না। সেদিন বলেছিলে, তুমি পদ্মকে ভালোবাসো। আর এখন এতো সহজে আমার নামে তোমার জীবন লিখে দিচ্ছো?”

আফিফ আহিকে ছেড়ে দিলো। আহি সাথে সাথেই আফিফের হাত ধরে বলল,
“বলো, আফিফ। তুমি কি তখন আমাকে ভালোবাসতে না?”

আফিফ নিশ্চুপ। হঠাৎ আহি অনুভব করলো, গরম পানির মতো কিছু একটা তার হাতে এসে পড়েছে। আহি অন্য হাত দিয়ে সেটা স্পর্শ করে বুঝলো আফিফ কাঁদছে। সে আফিফের গাল ছুঁয়ে দিলো। আফিফ মুখ ঘুরিয়ে নিতেই আহি বলল,
“কাঁদছো কেন?”

আফিফ ভেজা কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, তোমাকে ওভাবে ভালোবাসতে পারি নি, যেভাবে তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে। আমি হয়তো তোমার যোগ্য নই। কিন্তু আমি যেই পরিস্থিতিতে ছিলাম, তোমার ভালোর জন্য এটাই আমার কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হয়েছিল। তোমার চিরকুটগুলো বাসায় এসে কতোশত বার পড়তাম। তুমি জানো না, আমার অবুঝ মনে তোমার ওমন করে ভালোবাসা প্রকাশ করাটা কতোটা প্রভাব ফেলেছিল। আমি তখন রাত-দিন তোমাকে কল্পনা করতাম। একদিনও চারুশিল্পে যাওয়া বাদ দেই নি। প্রতিদিন তোমার চিরকুট পড়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে খাতা খুলেছি। তুমি আমার জন্য অদেখা প্রেয়সী ছিলে। যাকে আমি দেখি নি, শুধু অনুভব করেছি। তোমাকে না দেখে যতোটা ভালোবেসেছি, ততোটা আমি দেখেও পদ্মকে ভালোবাসি নি। তবে এটা ঠিক, আমি পদ্মকে ভালোবাসতাম। অস্বীকার করবো না এই কথা। তবে বিয়ের আগে কখনোই না। তাজওয়ার খান আমাকে থ্রেট দেওয়ার পর আমি বুঝেছি, তোমাকে পাওয়া আমার ভাগ্যে নেই। আমি আমার আপাকে বাঁচাতে পারি নি। তোমাকে কীভাবে বাঁচাবো? বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে কোথায় রাখবো? তাজওয়ার আমাকে বাধ্য করেছিল তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে। আমার সামর্থ ছিল না, তবুও আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মা রাজি ছিলো না। সবার মনে হয়েছিল পদ্মকে ভালোবাসি তাই তাড়াহুড়ো করছি। সত্য এটা ছিল না। সত্য ছিল, আমাকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তাই কোনোভাবে মাকে রাজি করিয়েছি। পদ্মের বাবা ওর জন্য ছেলে খুঁজছিলেন। আমার ওকে দেখে মনে হয়েছিল ভালো মেয়ে। আর ওর হাবভাব দেখে বুঝতে পেরেছি, আমাকে পছন্দ করে। আমি তো ছেড়ে দেওয়ার জন্য সংসার করি নি। তাই পদ্মকে বিয়ে করেছি। এরপর ওর সাথে কথা বলতে বলতে ওর প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিল। স্বামী হিসেবে স্ত্রীকে ভালোবাসা আমার দায়িত্ব। আর পদ্ম এতোটা ইনোসেন্ট ছিল, আমাকে কখনো অভিযোগ করার সুযোগ দেয় নি। আমি তো জানতাম না, মেয়েটাই আমাকে সবচেয়ে বড় ধোঁকা দিয়েছিল।”

“আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমাকে কি তখন ভালোবাসতে না?”

“প্রেয়সী সবসময় প্রেয়সীই থাকে। আর দায়িত্ব থেকে মায়ার সৃষ্টি হয়। প্রেয়সীকে সবসময় মনে পড়ে। কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। যারা স্পর্শ করতে চায়, তারা কলুষিত হয়। সাথে কলুষিত হয় প্রেয়সীও। আমি আমার প্রেয়সীকে কলুষিত করতে চাই নি। আহি, সংসার খুবই শক্ত একটা সম্পর্ক। এটা সহজে ভেঙে যায় না। তোমার জন্য পদ্মকে ছেড়ে দিলে, পদ্মের কোনো ক্ষতি হতো না। তোমার আর আমার ক্ষতি হতো। আমাদের ভালোবাসা কেউই বুঝতো না। সবাই দেখতো আমরা প্রতারণা করেছি। আমি আমার সম্পর্কে সৎ ছিলাম। কারণ আমারও বোন আছে। আর আমার মা এমন অসৎ ছেলে জন্ম দিয়ে মানুষের কথা শুনুক, এটা আমি চাই নি। তোমাকে পাওয়াটা একদম দুঃসাধ্য ছিল। এর বড় কারণ তোমার আর আমার স্ট্যাটাস ভিন্ন। আমি তোমার যোগ্য নই। আমি তোমাকে নিয়ে একটু ভাবতে গেলেই আমার ভাবনায় আসে তোমাকে ভালোবাসলে সবাই প্রশ্নবিদ্ধ করবে আমার ভালোবাসায়। সমাজ তো আমার অনুভূতি পড়ে দেখে নি। তোমাকে নিয়ে আমি যা অনুভব করতাম, এটা খুবই স্পেশাল ছিল। আমি আমার ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষকে সমাজের কাছে ছোট করতে চাই নি। তাই ভাগ্য মেনে নিয়েছিলাম। পদ্মকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি। ভালোবাসা আর মায়ার মধ্যে কী পার্থক্য তা আমি জানি না। কিন্তু মায়া সৃষ্টি হয়েছিল, এটাই জানি। আমার জায়গায় তুমি থাকলে এমনটাই করতে। রাদের সাথে যদি কখনো তোমার বিয়ে হয়ে যেতো! তুমি কি ওকে কখনো ছাড়তে পারতে? পারতে না। আমি তোমার সামনে এলে তোমার খুব কষ্ট হতো। কিন্তু তবুও তুমি রাদকে ছাড়তে পার‍তে না। বলো, তুমি কি রাদকে ভালোবাসো? না-কি রাদের প্রতি তোমার মায়া ছিল?”

“ও আমার বন্ধু।”

“বন্ধু সবাই হতে পারে। লাবীবও তোমার বন্ধু। তাহলে রাদ স্পেশাল কেন?”

“রাদ আমার মেডিসিন। আমার জন্য অনেক করেছে। ওর প্রতি আমার আলাদা মায়া জন্মে গিয়েছিল।”

“হুম, পদ্মও আমার জন্য এমনই ছিল। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হলেও সে প্রথমে আমার বন্ধু হয়েছিল। ওর প্রতি আলাদা মায়া জন্মেছিল। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, আমার আপার মৃত্যু। একটা মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে আত্নহত্যা কতোটা মানসিক চাপ, তুমি হয়তো বুঝবে না। আত্মীয়-স্বজন কারো সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না আমাদের৷ আপার আত্মহত্যার কারণ তো তুমি জানোই। বাবা মারা যাওয়ায় দাদার পরিবারের সবাই আমার মাকে দোষারোপ করছিল। আমাদের সবার চরিত্র, আমাদের সবার শিক্ষায় প্রশ্ন উঠছিল। তুমি জানো না, আমরা কতো বছর ধরে এসব সাফার করেছি। পদ্ম ওই সময়টাতে আমার মানসিক শক্তি ছিল। এজন্যই হয়তো আমি ওর মায়ায় পড়েছিলাম। আমি এই মুহূর্তে চাই না, তোমাকে পদ্ম আর আমার সংসারে কি কি হয়েছিল তা বলতে। কারণ সবটাই এখন মিথ্যে। যেখানে মানুষটাই শুরু থেকে আমাকে মিথ্যে বলে গেছে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আফিফ বলল,
“আমি তোমাকে আর জোর করবো না। তোমার যদি মনে হয়….”

আহি আফিফের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল,
“তোমাকে আমি কখনো কোনো সময় দিয়ে বিচার করি নি। কোনো যোগ্যতা দিয়ে বিচার করি নি।”

“তাহলে বলছো না কেন কিছু?”

“কি বলবো?”

“ভালোবাসি, আহি।”

আহি নিরবে হাসলো। আফিফ আহির আরেকটু কাছে এসে বলল,
“তুমি শোধ তুলছো, তাই না!”

“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে শতবার এই একটা কথা বললেও আমার চৌদ্দ বছরের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটবে না।”

হঠাৎ আলোকিত হয়ে গেলো এ আর টি গ্যালারি। আহি সাথে সাথেই ধাক্কা দিলো আফিফকে। এরপর দৌঁড়ে চলে গেলো পাশের রুমে। আফিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে পেছনে তাকালো। চোখ পড়লো কাচের দেয়ালে। বিদ্যুৎ আসায় এখন বাইরে থেকে সব দেখা যাবে। আফিফ আনমনে হাসলো। ধীর পায়ে হেঁটে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি আমার সাথে আর কথা বলবে না?”

আহি ভেতর থেকে বলল,
“বাসায় যাও। কাল সেই হোটেলে চলে এসো।”

“আহি, তুমি সত্যিই উজ্জ্বলকে বিয়ে করছো?”

“আমি তো অনেক বেহায়া হয়েছি। তুমি এই বিয়ে ভাঙার জন্য কতোটা বেহায়া হও, এটাই দেখবো এখন।”

“তুমি আমার হবে তো, আহি?”

“এর নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”

কথাটি বলেই আহি মুখ চেপে হাসলো। আফিফ মলিন হেসে বলল,
“আমি তোমাকে রাজী করানোর সব চেষ্টা করবো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবো। ভাগ্যে থাকলে, তুমি আমারই হবে।”

(***)

ঘড়িতে রাত বারোটা। আহি বাসায় ঢুকতেই দেখলো সালমা ফাওজিয়ার মুখোমুখি সোফায় বসে আছে পদ্ম। অন্য সোফায় লিনাশা আর নায়ীব। আহি পদ্মকে দেখে বেশ অবাক হলো। আর আহিকে দেখে আরো বেশি অবাক হলো পদ্ম। আহির সারা গায়ে রঙ মাখানো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের এই অবস্থা দেখে বললেন,
“আহি, তোমার গায়ে রঙ লেগেছে কীভাবে?”

আহি লাজুক হাসলো। বলল,
“মা তেমন কিছু না। তুমি এখনো ঘুমাও নি?”

“তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আচ্ছা, আমি উপরে যাচ্ছি। তোমার নানুকে দেখে আসছি। পদ্ম এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে।”

সালমা ফাওজিয়া চলে যেতেই লিনাশা হেসে বলল,
“বাহ, তেমন কিছু না?”

পদ্ম অবাক হয়ে লিনাশার দিকে তাকালো। আহি তার গালে হাত রেখে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা বাক্যেই কতো রহস্য লুকোনো থাকে!”

নায়ীব উঠে দাঁড়িয়ে লিনাশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আচ্ছা, আমি ইয়াশের কাছে যাই। তুমি আসো।”

নায়ীব চলে যেতেই লিনাশা বলল,
“বাহ! মিস্টার এআর তো দেখছি, আমাদের ভাবনার চেয়েও বেশি এগিয়ে গেছেন!”

পদ্ম চমকে উঠলো লিনাশার কথায়। সে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এআর! আহি, তুই আফিফের সাথে ছিলি? তোর গায়ে আফিফ রং লাগিয়েছেন? উনি তোকে স্পর্শ করেছেন?”

লিনাশা পদ্মের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ওলে আমার পদ্মফুল, তোমার কেন এতো কষ্ট হচ্ছে, বলো তো দেখি! এদিকে তোমার স্বামী রাত জেগে মশার কামড় খেয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে, তুমি কোথায় তার মশারি হয়ে তাকে পাহারা দেবে, আর তুমি পড়ে আছো, আমার বেস্টির প্রেমিকের দিকে। ক’জন লাগে বলো তো দেখি?”

“চুপ কর, লিনু।”

লিনাশা রাগী স্বরে বলল,
“ডোন্ট কল মি লিনু। তোমার সেই অধিকার নেই।”

আহি লিনাশাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“বাদ দে, লিনু। আমি আমার মুড স্পয়েল করতে চাই না। আজকের রাতটা আমার জন্য খুব স্পেশাল ছিল। আমি তথাকথিত মানুষের জন্য আমার মনটা ভারী করতে চাই না। আচ্ছা, আমাকে ফ্রেশ হতে হবে। কাল সকালে অনেক কাজ আমার। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

আহি এবার জোরে কথাকে ডাকলো। কথা আসতেই আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কথা, আমার খাবার গরম করে আমার রুমে পাঠিয়ে দিও। আর… আশেপাশে কীট পতঙ্গ দেখলে একটু তুলে বাইরে ফেলে দিও। আমার হোয়াইট প্যালেসে কীটপতঙ্গ শোভা পায় না।”

কথাটি বলেই আহি লিনাশাকে হাত নাড়িয়ে বলল,
“গুড নাইট।”

এরপর লিনাশা মুচকি হেসে চলে গেলো, আহিও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। আর পদ্ম সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে অশ্রু ভীড় করছে। আহি আর আফিফ কি তাহলে একে অপরের কাছে এসেছে? সহ্য হচ্ছে না পদ্মের। সে মনে মনে বলল,
“আফিফ, তুমি এতো সহজে আহিকে পেয়ে যাবে? আর আমি তোমাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবো?”

১২৯।

বেল বেজে উঠতেই রেনু এসে দরজা খুলে দিলো। দরজার ওপাশে রঙে মাখামাখি আফিফকে আপাদমস্তক দেখে রেনু মুচকি হাসলো। রেনুকে হাসতে দেখে বেশ লজ্জা পেলো আফিফ। সে কপাল চুলকে ভেতরে ঢুকতেই ওয়াসিফ তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। আফিফ ওয়াসিফকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে যাবে, তখনই ওয়াসিফ বলে উঠলো,
“তোমার গায়ে কে রং লাগিয়েছে, মামা?”

অবুঝ মনের প্রশ্ন, অথচ শুনতে বেশ উদ্ভট লাগলো। রেনু ছেলের প্রশ্নে শব্দ করে হেসে উঠলো। আফিফ তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে গেলো। ওয়াসিফ ভাবুক কন্ঠে বললো,
“মামা দৌঁড়ে পালালো কেন?”

রেনু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার মামার মনে রং লেগেছে, তাই রং দিয়ে গোসল করে এসেছে।”

“সত্যি? মনে আবার রং লাগে কীভাবে? রং খেয়ে ফেললে কি রং লেগে যায়?”

রেনু হাসলো। ওয়াসিফ বলল,
“এবার বুঝেছি, মামা ফুড কালার খেয়েছে। আচ্ছা, মা। এখন যদি মামার পেট ব্যথা করে?”

“আদ্য, যাও ঘুমিয়ে পড়ো। রং নিয়ে গবেষণা করতে হবে না।”

“মামার জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে আমার।”

“ওরে বাবা, আমার ভাইয়ের কতো চিন্তাশীল ভাগ্নে!”

এদিকে আফিফ রুমে ঢুকতেই তার দৃষ্টি পড়লো আয়নায়। মুহূর্তেই মনে পড়লো আহির স্নিগ্ধ মুখখানি। আজ এতো বছর পর সে তার খেয়ালীকে বাস্তবে অনুভব করেছে। যেই অনুভূতি এতো বছর শুধু কল্পনা ছিল, তার বাস্তব রূপ আজ দেখেছে আফিফ। আফিফ আনমনে হেসে বলল,
“আমার খেয়ালী, তোমার অভিমান ভাঙাবো আমি।”

ফোন বেজে উঠতেই আফিফের ভাবনায় বাঁধা পড়লো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“কল কেটে দিবেন না, আফিফ। শেষ একটা কথা জানানোর ছিল।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পদ্ম বলল, “আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”

আফিফ নিরবে হাসলো। পদ্ম বলল, “আপনি কি খুশি হয়েছেন?”

“হুম, শুনে ভালো লাগলো।”

“একটুও কষ্ট হচ্ছে না আপনার?”

“একদম না।”

“এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলেন?”

“আর কিছু বলার আছে?”

“আহিকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছেন, তাই না?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি কি ভুলে গেছো, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে?”

“আপনি দিয়েছেন। আমি তো নিতে চাই নি।”

“হ্যাঁ, তুমি বাধ্য করেছিলে।”

“ভুল করেছিলাম। ক্ষমা করা যায় না?”

“পাগল হয়ে গেছো তুমি?”

“ভালোবাসি আপনাকে।”

“আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”

“কেন, আফিফ?”

“তুমি কি করেছিলে মনে নেই?”

“আমি রেনু আর আহির সাথে অন্যায় করেছি। কিন্তু আপনি আহিকে কেন ভালোবাসছেন? ও কি আপনার বড় আপার সাথে অন্যায় করে নি?”

আফিফ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুমি ইচ্ছে করে করেছো। আর ওসব তাজওয়ার করেছে। আহি এসব জানতোই না। কার সাথে কার তুলনা করছো তুমি?”

“আচ্ছা, এসব বাদ দিন। আগে বলুন, আজ কি আপনি আহির সাথে ছিলেন? আপনি কি ওকে স্পর্শ করেছেন?”

“তুমি আমাকে বরাবরই অবাক করে দাও, পদ্ম। শুনো, নিজের সংসারে মন দাও। আমার বিষয়ে নাক গলাবে না। আমার যা ইচ্ছে আমি করবো। তুমি কেউ নও আমাকে প্রশ্ন করার!”

আফিফ কল কেটে, সাথে সাথেই সিমটা খুলে ফেললো। এই সিমটা আহির জন্যই খোলা রেখেছিল সে। এখন যেহেতু আহিকে কল দেওয়ার অধিকার অর্জন করতে চাইছে, তাহলে অন্য নম্বর থেকেও সে আহিকে কল দিতে পারবে। অন্যদিকে পদ্ম ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। আফিফকে সে হারাতে চায় নি। আফিফকে ভীষণ ভালোবাসে সে। কীভাবে থাকবে আফিফকে ছাড়া? পাগল হয়ে যাবে পদ্ম। নিজের মাথার চুল আঁকড়ে ধরলো সে। শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। আর মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন, আফিফ। আমার আপনাকে ছাড়া চলবে না।”

(***)

ধূসর বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে আহি। চুলে খোঁপা করে লাগিয়েছে কয়েকটা তাজা সাদা পাসকালি। কানে ঝুলছে ধূসর বেগুনি রঙের ঝুমকো। গলার একপাশে লাল হয়ে আছে। আহি হাত রাখলো সেই স্থানে। চোখ বন্ধ করলো সে। শরীর জুড়ে বয়ে গেলো শিরশিরে বাতাস। আহি মুচকি হেসে চোখ খুললো। এরপর চোখে মোটা করে আইলাইনার লাগালো। এরপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দুলিয়ে হাসলো। মনে মনে বলল,
“আজ আবার সেই দিনটি ফিরে এসেছে। সেই বর্ষার মাস, সেই দিন, সেই মুহূর্ত। আমি বর্ষা এলেই এই একটা তারিখ সহ্য করতে পারি না। তোমার আর পদ্মের বিয়ের তারিখ। যেদিন তুমি আমার সামনে এসে পদ্মের হাত ধরে বলেছিলে, পদ্মফুল। আমি সেই দিনটা তোমার আর আমার স্মৃতি থেকে মুছে দিতে চাই, আফিফ। আজ রাতে বৃষ্টি হোক না হোক, তুমি আসবে আমার কাছে। পদ্মফুলের জায়গায় আমাকে ডাকবে। আমার নাম ধরে ডাকবে। আমাকে ভালোবাসবে। আর যদি আজ বৃষ্টি হয়, তাহলে আমার হাত ধরে আমাকে আগলে নিতে আসবে। আমাকে আর একা ভিজতে দেবে না। আমি আর কখনো নিজেকে নিঃস্ব ভাববো না। আমার ডাকে এবার তুমি সাড়া দিবেই।”

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই আহি দরজা খুলে দিলো। দেখলো লিনাশা দাঁড়িয়ে আছে। আহিকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,
“আমার বেস্টির সুখে কারো নজর না লাগুক।”

“আফিফ কি শেষ চেষ্টা করবে না?”

“যদি করে, তাহলে তো হলোই। আর যদি না করে, তাহলে বুঝবি, তোর মতো করে ভালোবাসার যোগ্যতা ওর নেই। এতো কিছু করেছিস তুই, ও কি তোর আর উজ্জ্বলের বিয়ে হতে দেবে? যদিও মিথ্যেমিথ্যি বিয়ে।”

“আমি আজ ওকে ফিরিয়ে দেবো না। আমি আমার ভালোবাসাকে আর হারিয়ে যেতে দেবো না। আমি এই জীবনে সব পেয়েছি। মাকে পেয়েছি, তোকে পেয়েছি, ভালো বন্ধু পেয়েছি, ক্ষমতা পেয়েছি। হেরে গিয়েছিলাম ভালোবাসার কাছে। এবার যদি সেই ভালোবাসার প্রাপ্তি হয়, তাহলে তো আমি আমার জীবনে জয়ী হবো।”

“হুম, হোয়াইট প্যালেসের রানী তার রাজাকে জয় করার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছে। এবার তার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটবে।”

আহি হাসলো। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। কি হবে আজ? আফিফ কি তার জন্য একটু বেহায়া হবে না? আফিফ কি প্রমাণ করবে না, সেও আহিকে ভীষণ ভালোবাসে!

চলবে—

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬১: অন্তিম পর্বের শেষাংশ||

১৩০।
কৃত্রিম আলোয় সুসজ্জিত হোটেলে পা রাখলো আফিফ। সম্পূর্ণ শীততাপনিয়ন্ত্রিত হোটেল, অথচ ঘামতে ঘামতে আফিফের শার্ট ভিজে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তার হাতে পেপার দিয়ে মোড়ানো বড় একটা ক্যানভাস। কপালের একপাশে রঙের দাগ। রাত জেগে আহির জন্য ছবি এঁকেছে আফিফ। রাতে একটুও ঘুমায় নি সে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দুপুর বারোটায় বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই কখন যে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গিয়েছিল, সে বুঝতেই পারলো না। কেউ একটু ডাকলোও না তাকে। এখনো কিছুই খায় নি সে। আফিফ ভুলেই গেছে সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার তার পেটে যায় নি। তাই হয়তো এখন একটু বেশিই শরীর কাঁপছে তার।

হোটেলের বড় অডিটোরিয়ামে ঢুকতেই বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো আফিফের। আহি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। ধূসর বেগুনি রঙের শাড়ি পরিহিতা মিষ্টি হাসির মেয়েটি মুহূর্তেই আফিফের মনে তীব্র অস্থিরতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। আগেও অনেক বার আহিকে দেখে এমন অনুভূত হয়েছিল তার। কিন্তু আজ আফিফের উপর অনেক বড় দায়িত্ব। আজ তার উপর আহিকে ভালোবাসি বলার দায়িত্ব। নয়তো সে আহিকে আর কখনো পাবে না। আর আহিকে না পাওয়ার ব্যর্থতা সারাজীবন তাকে কষ্ট দেবে। আফিফ আহির কাছাকাছি আসতেই উজ্জ্বল আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। থমকে গেলো আফিফ। সামনে এগোনোর সাহস পাচ্ছে না সে। এদিকে উজ্জ্বল আহির হাত ধরে আহিকে নিয়ে অডিটোরিয়ামের বড় স্টেজে উঠে দাঁড়ালো। ক্যামেরা ম্যান ব্যস্ত তাদের ছবি তুলতে। আহি হাসছে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে। মিনিট খানিক আফিফ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। আহিকে কি সে সুখে রাখতে পারবে? সে কি আহির যোগ্য? এমনই সব প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। আফিফ চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো অডিটোরিয়াম থেকে। আফিফকে চলে যেতে দেখে উজ্জ্বল বলল,
“মিস্টার আফিফ তো চলে যাচ্ছেন!”

আহির ভীষণ খারাপ লাগলো। যার জন্য সে এতোটা উন্মাদ, সেই মানুষটা একটু সাহস নিয়ে তাকে ভালোবাসি বলতে পারছে না? আহি স্টেজ থেকে নামতেই হঠাৎ বাইরে থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এলো।

অডিটোরিয়ামের বাইরে মাইক্রোফোন রাখা। পুরো হোটেলের দেয়ালে দেয়ালে নির্দিষ্ট দূরত্বে স্পিকার বসানো। আর আহি সেই কন্ঠ অডিটোরিয়াম থেকেই শুনতে পাচ্ছে। কন্ঠটি আফিফের। আফিফ বলতে লাগল,
“আমি বরাবরই ভীতু গোছের মানুষ। আমাকে দিয়ে কিছুই হয় না। তবুও আজ অনেক সাহস নিয়ে তোমাকে এই কথাগুলো বলছি। আমার জীবনে প্রথম চিরকুট পাওয়া তোমার কাছ থেকেই। হ্যাঁ, তুমিই লিখেছিলে সেটি। সেখানে লেখা ছিল, সেই বেনামী চিরকুটের এক অজ্ঞাতনামা ভক্ত আমার প্রেমে পড়েছে। আর আমি যাতে তার একটা নাম দেই। আমি সেদিনই তার নাম রেখেছিলাম, খেয়ালী। আমার খেয়ালী। তুমি আমার খেয়াল হয়েই ছিলে, আহি। একটার পর একটা চিরকুট, এক একটা স্কেচ আমার হৃদয়ে অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করেছিলো। বয়স খুব বেশি ছিলো না আমার। এই আঠারো-উনিশ হবে। আমার কিশোর বয়সের প্রথম অনুভূতি। একদম বোকাসোকা ছেলে ছিলাম আমি। তোমার চিরকুট পেয়ে তোমাকে এদিক-ওদিক খুঁজতাম। কখনো সামনে এসে দাঁড়াও নি। তবে ভালো লাগতো সেই চিরকুটগুলো। তুমি উত্তর পাঠানোর কোনো ঠিকানা দাও নি। তাই আমি বাসায় ফিরে নিজেই উত্তর লিখে নিজের কাছেই যত্ন করে রেখে দিতাম। ভেবেছিলাম, যেদিন তোমাকে প্রথম দেখবো, আমার সামনে বসে তুমি তোমার চিরকুটের প্রতিত্তোরে লেখা আমার চিঠিগুলো পড়বে। আর তোমার মিষ্টি হাসি দেখতে দেখতেই আমি তোমার একটা ছবি আঁকবো। আমার কিশোর বয়সের স্বপ্ন ছিল এটাই। সামনের ভয়ংকর দিনগুলো নিয়ে আমার কোনো কল্পনায় ছিলো না। এরপর শুরু হলো সেই অদ্ভুত ভয়ংকর দিনগুলো। আমি পার করেছি, তার বিনিময়ে তোমাকে হারিয়েছিলাম। আমি জানতাম না, এমন একটা দিন আমি ফিরে পাবো, যেদিন আমিই আমার মনের কথা তোমাকে জানাবো। আমার অতীত হয়তো তোমার অপছন্দের। কিন্তু তুমি আমার পছন্দের মানুষ ছিলে। শুনেছিলাম, প্রেয়সীদের শুধু অনুভবই করা যায়। আমি তোমাকে সবসময় অনুভব করেছি। তোমার চিরকুটগুলো এখনো নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। তোমার চিরকুট আর আমার উত্তরের সংগ্রহে একটা বই ছাপিয়েছিলাম। নামহীন বই। এখনো বুঝতে পারছি না, কী নাম দেওয়া যায়। তোমার ভালোবাসার কাছে আমি নিতান্তই অযোগ্য প্রেমিক। তাই নাম দেওয়ার ক্ষমতাও, রাখি নি। আমি আর বেশি কথা না বাড়াই। তোমাকে একটা কথা জানিয়ে দিতে চাই। আহি, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। সেই চারুশিল্পে পাওয়া প্রথম চিরকুটের অনুভূতি আজও বর্তমান। মাঝখানে যা হওয়ার হয়েছিল, কিন্তু তোমাকে আমি স্মৃতি থেকে কখনো মুছে ফেলি নি। হয়তো ভালোবাসা প্রকাশে বাঁধা ছিল। মানুষ যখন কোনো সমাজ শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে যায়, তখন শুধু ভালোবাসলেই হয় না। ভালোবাসার মানুষকে সমাজের সব অভিযোগ থেকে মুক্ত করে রাখতে জানতে হয়। তুমি তো সব জানো, আহি। তুমি কি আমাকে আমার অতীতের দুর্বলতার জন্য ক্ষমা করে দেবে না?আচ্ছা, তুমি কি আমার সম্রাজ্ঞী হবে? আমি ভালোবাসি তোমাকে। ভীষণ ভালোবাসি।”

আফিফ দেয়ালের দিকে ফিরে মাইক্রোফোন হাতে কথাগুলো বলে গেলো। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্প, লাবীব, নায়ীব, লিনাশা। সাথে দাঁড়িয়ে আছে পদ্ম। পদ্মের চোখে অশ্রু ভীড় করেছে। এদিকে আহি বেরিয়ে এলো অডিটোরিয়াম থেকে। সামনের হালকা ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসতেই দেখলো আফিফ দেয়ালের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটা ইজেলের উপর রাখা ক্যানভাস। ক্যানভাসে আহির ছবি আঁকা। ছবিটিতে আহির চোখ অশ্রুসিক্ত, ঠোঁটে মিষ্টি হাসি, পরণে সাদা শাড়ি, পেছনে সমুদ্রের ঢেউ। আফিফ পেছন ফিরতেই আহির মুখোমুখি হলো। আফিফের হৃদকম্পন বেড়ে যাচ্ছে। হাত কাঁপছে অসম্ভব ভাবে। এখন আহি যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়? আফিফ চোখ বন্ধ করলো। বলল,
“সেদিন বৃষ্টি ছিল, তুমি কৃষ্ণচূড়ার মতো ফুটেছিলে আমার পথে।
আমি স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি।
সেদিন উত্তপ্ত রোদ ছিল, তুমি অলকানন্দা সেজে এসেছিলে আবদার নিয়ে।
আমি তোমার চোখে চোখ রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি।
সেদিন শরতের সকাল ছিল, তুমি সাদা কাশফুলের মতো বসে ছিলে আমার অপেক্ষায়।
আমি তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি।
সেদিন কুয়াশা জড়ানো সন্ধ্যা ছিল, তুমি মিষ্টি হাসি হেসেছিলে আমার দিকে তাকিয়ে।
আমি বার-বার ফিরে সেই হাসি দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি।
সেদিন বাগানে ফুল ফুটেছিল, তুমি ডেকেছিল প্রিয় অলকানন্দ বলে।
আমি খুব করে তোমাকে প্রিয় অলকানন্দা বলে ডাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি।
আর আজ আকাশ মেঘলা।
তুমি ধূসর বেগুনি শাড়ি পরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো।
আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার হাতটা ধরতে চাইছি,
তোমার চোখে চোখ রেখে তোমাকে ডাকতে চাইছি প্রিয় অলকানন্দা বলে।
তোমার মুগ্ধ হাসি দেখে একটা ছবি আঁকতে চাইছি।
আর বলতে চাইছি, ভালোবাসি খেয়ালী।”

আহির চোখে অশ্রু। সে চোখ মুছে দৌঁড়ে লিফটের দিকে চলে গেলো। আফিফ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সেকেন্ডের জন্য তার মনে হলো, সে আহিকে হারিয়ে ফেললো বুঝি! পদ্ম আফিফের সামনে এসে বলল,
“তুমি আহির কাছে যেও না। ও তোমার চেয়ে ভালো কাউকে…”

লিনাশা পদ্মের হাত চেপে ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। এরপর আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“যার দৃষ্টিতে আপনি রাজা, তার কাছে আপনি শূন্য হাতেও ফিরতে পারেন। আপনার শূন্য হাত সে পূর্ণ করবে আপনার হাতে হাত রেখে। ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকা, তার হাত ধরে বাকী জীবন কাটানোর মতো বড় প্রাপ্তি দ্বিতীয় কোনোটাতেই নেই। আর যেই মানুষের এই প্রাপ্তি হয়, তার চেয়ে বেশি ধনবান কেউ হয় না। মানসিক শান্তিই সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর ক্ষমতা দিয়ে সেই মানসিক শান্তি কেনা যায় না। এর জন্য শখের মানুষের খুব প্রয়োজন। আপনি আহির শখের মানুষ। ওকে একমাত্র আপনিই সম্পূর্ণ করতে পারবেন। আহির কাছে যান। কারো কথায় নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারাবেন না। নয়তো কষ্ট আপনাদের হবে, জয় হবে যাদের হিংসে হয়, তাদের।”

আফিফ পদ্মের দিকে এক নজর তাকিয়ে লিফটের দিকে চলে গেলো। পদ্ম লিনাশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর আমার ভালোবাসা কেউ দেখলো না?”

“যদি তোর মধ্যে বিন্দু পরিমাণ সততা থাকতো, আজ তুই বোরহান আলীর স্ত্রীর পরিচয়ে থাকতি না। আরো ভালো জায়গায় তোর বিয়ে হতো। আর আহি এবং তার এআরের সুখের সংসার হতো। আর আমরা চার বান্ধবীও একসাথে ভালো থাকতাম। তোর জন্য কতো সম্পর্ক নষ্ট হলো, আর কতোগুলো মানুষ কষ্ট পেলো একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ।”

১৩১।

আফিফ ছাদে উঠলো। দেখলো পুরো ছাদ খালি আর আহি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আফিফ তা দেখে ছাদের দরজা বন্ধ করে দিলো। আহি শব্দ শুনে পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো। কারো সামনে তোমার জন্য কাঁদতে চাই নি। অনেক আগেই অন্য কারো সামনে তোমার জন্য কান্না করা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ আমি আমার ভালোবাসাকে দুর্বল দেখাতে চাই না। তবুও কোথাও না কোথাও দুর্বল হয়েই পড়তাম।”

এবার আহি আফিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার গালে আলতো করে হাত রাখলো। এরপর তার বুক স্পর্শ করে বলল,
“তোমাকে স্পর্শ করার, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার কন্ঠে অলকানন্দা ডাক শোনার, তোমার চোখে আমার প্রতি ভালোবাসা দেখার তীব্র অপেক্ষায় আমি কতো রাত জেগেছি, কতো রাত একাকী বসে ছিলাম তার কোনো হিসেব নেই। এক একটা মিনিট আমার কাছে অনেক বিশাল বিশাল মুহূর্ত ছিল। অনেক, অনেক, অনেক বেশি অপেক্ষা করেছি। আমার মস্তিষ্ক, আমার মন কীভাবে যে তোমাতেই এতোটা আসক্ত ছিল, আমি এর কোনো উত্তর পাই নি। আমি আর উত্তর খুঁজতেও চাই না। ভালোবাসার মানুষকে বেশি অপেক্ষা করানো যায় না। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, এআর। তোমার চেয়েও বেশি। তুমি ভাবতেই পারবে না এতোটা ভালোবাসি। আমি খুব শক্ত মনের। কিন্তু তোমার সামনে এলেই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল একটা মানুষ। তুমি আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, আফিফ। আর তোমাকে ভালোবাসা আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। কারণ আমার মতো করে কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারে নি, পারছে না, পারবেও না।”

আফিফ আহির হাত ধরে হাঁটু গেড়ে বসলো। বলল,
“আমি তোমাকে…”

আফিফ থেমে গেলো। আহি আফিফের সামনে বসে বলল,
“এবার ভিন্ন কিছু হোক।”

“কি!”

“আমি জানি, তুমি কি বলতে চাও। এটাও জানি তুমি কেন থেমে যাচ্ছো।”

আফিফ চোখ নামিয়ে নিলো। ইতস্তত কন্ঠে বলল,
“আমার উপর অনেক দায়িত্ব। আমার হয়তো একটা ভালো অবস্থানে যেতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে।”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি, আফিফ। তোমার অবস্থানকে নয়। ওমন হলে, চারুশিল্প থেকে তোমার পিছু নিয়েই ফিরে আসতাম, আর কখনো তোমার দিকে ফিরে তাকাতাম না। তুমি সেখানে রাখলেও কিন্তু আমি ভালো থাকবো। কারণ আমি শুধু তোমাকে চেয়েছিলাম। এবার তো বলো!”

“আমাকে বিয়ে করবে, আহি?”

আহি মুচকি হাসলো। তার চোখে আনন্দাশ্রু। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। তখনই শুরু হলো বৃষ্টি। আহি মেঘেদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আজ কি আমি একা ভিজবো?”

আফিফ আহির কোমড় জড়িয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। দু’জন অনেকটা কাছাকাছি। তাদের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সাথে বাড়ছে বৃষ্টির বেগ। আফিফ এবার আহির কপালে কপাল ঠেকালো। আলতো করে আহির অধর স্পর্শ করলো। এরপর তার গালে হাত রাখলো, তার খোঁপাটাও আলগা করে দিলো। আহি খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আফিফকে। আফিফ মুখ গুঁজলো আহির ঘাড়ে। অদ্ভুত উন্মাদনা চড়েছো দু’জনের মনে। যেই উন্মাদনার সাক্ষী হতে হতেই হলো না বর্ষার বারিধারা। আফিফ মুখ ফিরিয়ে নিলো আচমকা। আহিও সরে গেলো সাথে সাথেই। বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে গেছে তার। উঠে দাঁড়ালো সে। ছাদের পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো আহি। আফিফও উঠে দাঁড়ালো৷ বেশ খানিকক্ষণ বাদে আফিফও পিলারের অন্য পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। দু’জনই চুপ। নিরবতা কাটলো আফিফের ফোন বেজে ওঠায়। আফিফ দেখলো স্ক্রিনে রেনুর নাম ভেসে উঠেছে। কল ধরতেই রেনু বলল,
“ভাইয়া, ছাদের পাশের রুমে জামা চেঞ্জ করে আহির বাড়িতে চলে এসো আহিকে নিয়ে।”

আফিফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রেনু কল কেটে দিলো। এরপর আফিফ ছাদের দরজা হালকা খুলতেই দেখলো লাবীব আর পুষ্প বাইরে দাঁড়ানো। পুষ্প আফিফকে দেখে লাবীবকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে অন্যদিকে ঘুরলো। লাবীব হালকা হেসে বলল,
“এভাবে ভেজা কাপড়ে বাসায় তো যাওয়া যাবে না। কাপড় চেঞ্জ করে নিন। আমরা নিচে নেমে যাচ্ছি। ক্যামেরা অফ করে দিয়েছে আপতত। গাড়ি নিচে আছে। আমাদের তাহলে আহির বাসায় দেখা হচ্ছে!”

কথাগুলো বলে লাবীব পুষ্পকে টেনে নিয়ে গেলো লিফটের দিকে। আফিফ বেশ অবাক হলো, সাথে ভীষণ লজ্জায়ও পড়েছিল। সে এবার ছাদের গেট হালকা লাগিয়ে পাশের রুমে এসে দেখলো আহি আর তার জন্য জামা রাখা। আফিফ রুম থেকে বেরিয়ে আহিকে ডাকলো। আহি আফিফের সামনে এসে দাঁড়াতেই আফিফ চোখ সরিয়ে নিলো। আহিও অন্যদিকে ঘুরে বলল,
“সরি। আজ সবকিছু উল্টাপাল্টা লাগছে আমার কাছে।”

আফিফ বলল,
“পাশের রুমে গিয়ে ভেজা শাড়িটা চেঞ্জ করে এসো।”

আহি ছাদ থেকে বেরিয়ে রুমে ঢুকে পড়লো। দেখলো তার জন্য সাদা রঙের সাদাসিধে একটা গাউন রাখা আছে। আহি সেটা পরে বেরিয়ে আসতেই আফিফ রুমে ঢুকলো। আফিফের ইতস্ততভাব দেখে বেশ মজা পেলো আহি। এতো লাজুক মানুষ! এমন মানুষই তো আহির পছন্দ। না এমন মানুষ নয়, তার তো আফিফকেই পছন্দ। আফিফ খুব তাড়াতাড়ি জামা চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো। এরপর দু’জনই নিচে নেমে এলো। গাড়ির কাছে আসতেই অবাক হলো তারা। গাড়িটি কাঠগোলাপ আর অলকানন্দা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। আহি আর আফিফ তা দেখে মুচকি হাসলো। একে অপরের দিকে তাকালো। আহি আফিফকে সেই সুযোগে আপাদমস্তক দেখে নিলো। সাদা স্যুটে বেশ মানিয়েছে তার এআরকে। আহির ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিতেই তারা গাড়িতে উঠে বসলো। আহি আফিফের হাত আলতো করে স্পর্শ করলো। আফিফ আহির স্পর্শ পেয়ে মুচকি হাসলো। আহি অনেকক্ষণ পর ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে আফিফের বাহুতে ঘুষি মেরে বলল,
“একদম আনরোমান্টিক ছেলে একটা! ওহ সরি। ছেলে না, আনরোমান্টিক লোক একটা!”

আফিফ মুচকি হাসলো। আহির আরেকটু কাছে এসে বসলো। তার দিকে ঝুঁকে তাকালো আফিফ। আহি অভিমানী মুখে বলল,
“তুমি একটা নিস্ক্রিয় পদার্থ। তোমাকে সুড়সুড়ি না দিলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকো।”

আফিফ কপাল চুলকে বলল,
“কি করবো! একটু সময়…”

আহি আফিফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আরো দশ বছর পরও তোমার একটু সময় লাগবে?”

আহির মান-অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে গাড়ি পৌঁছে গেলো আহির হোয়াইট প্যালেসে। বৃষ্টি এখন কমেছে। আহি গাড়ি থেকে নেমেই আফিফের হাত ধরে ভেতরে চলে এলো। তারা ভেতরে ঢুকতেই রেনু, লিনাশা, পুষ্প তাদের গায়ে ফুল ছিটিয়ে দিতে লাগলো৷ একপাশে পদ্ম দাঁড়িয়ে আছে। আফিফের চোখ তার দিকে পড়তেই রেনুও ভাইয়ের চোখ অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। সে পদ্মকে আড়াল করে দাঁড়াতেই আফিফের চোখ পড়লো তার দিকে। রেনু চোখের ইশারায় আফিফকে আশ্বস্ত করলো। আফিফ এবার আহির দিকে তাকালো। বাসায় ঢুকতেই ওয়াসিফ দৌঁড়ে এসে বলল,
“হোয়াইট হোয়াইট আন্টি, তুমি তো দেখছি হোয়াইট কুইন হয়ে গেছো! আর মামাকে তো হোয়াইট কিং মনে হচ্ছে।”

আহি ওয়াসিফের থুতনি ধরে বলল,
“আর তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ব্লু প্রিন্স।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, হোয়াইট হোয়াইট আন্টি! তোমার সাথে কি মামার বিয়ে হবে?”

আহি আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। লিনাশা ওয়াসিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, মিস্টার ব্লু প্রিন্স। তোমার মামার আর তোমার হোয়াইট হোয়াইট আন্টির আজ বিয়ে। এখন তুমি চুপচাপ ভদ্র বাচ্চার মতো বিয়েটা দেখো।”

ওয়াসিফ মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, হুম মজা হবে। আমার জিনি আর বেস্ট মামা একসাথে থাকবে। ওয়াও, আমি তো অনেক মজা করবো।”

এবার সালমা ফাওজিয়া এসে আহির কপালে চুমু খেলেন। ভেজা কন্ঠে বললেন,
“আমার অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। তোমাকে একটা ভালো ছেলের হাতে তুলে দেওয়ায় আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল। যেই ছেলেটা আমার মেয়েকে রানী বানিয়ে রাখবে। যেমন সে আমার চোখে রানি হয়ে ছিল।”

সালমা ফাওজিয়া এবার আফিফের দিকে তাকালেন। আফিফ ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। আফিফা বেগম এবার আহির সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,
“তোমাকে তো অনেক আগেই আমার পছন্দ হয়েছিল। তোমার মিষ্টি কথাগুলো এতো ভালো লেগেছে! আফিফকে তোমার কথা রোজ বলতাম। একটা মায়ের প্রশান্তি এখানেই। তার ছেলেকে কেউ অসম্ভব ভালোবাসুক। আমার হীরার টুকরাকে যদি কেউ এতোটা ভালোবাসতে পারে, সেই মেয়ের সাথে আমার ছেলে সারা জীবন সুখী হবে, এটা আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারি। আমার দোয়া, তোমরা অনেক সুখী হও। তোমাদের জীবনে আর কোনো কালো ছায়া না আসুক।”

পদ্ম আফিফা বেগমের কথায় মাথা নিচু করে নিলো। আজ আহি আর আফিফের বিয়ে। খুব সাদামাটা আয়োজন। আর রাতের খাবারের আয়োজন আহির হোয়াইট প্যালেসেই হচ্ছে। আহির মাথায় লাল ঘোমটা পরিয়ে মুখ পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে রেনু। এরপর আহি আর আফিফকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। একজন হুজুর এসে তাদের বিয়ে পড়াচ্ছেন। কবুল বলতে বলা হলো আহিকে। আহি চোখ বন্ধ করে তিন বার কবুল বললো। এরপর আফিফ এক নিঃশ্বাসে খুব দ্রুত তিন বার কবুল বললো। বিয়ের কাগজে স্বাক্ষর করলো দু’জনই। বিয়ে শেষ হতেই সবাই দু’হাত তুলে মোনাজাত করলো। আহি কাঁদছে। আফিফও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে। আহির ফুঁপানো কান্নার শব্দ সবার কানে এসে ঠেকলো। আফিফ আহির হাত ধরে মাথা নিচু করে রাখলো। এরপরই লিনাশা আহিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। নায়ীবও আফিফের পাশে এসে বসলো। তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“মেয়েটা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমি জানতাম, ও তোমাকে কখনোই ভুলতে পারবে না। আমার কাছে অনেক পেশেন্ট এসেছে। সবার এক এক ধরণের গল্প। কিন্তু আহির গল্পটা সবচেয়ে ভিন্ন। ওর মতো ভালোবাসার মানুষ পাওয়া অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। আজ তুমি একটা ভালো কাজ করেছো, আফিফ। যদিও অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষটা তো ভালোই হলো।”

(***)

অন্ধকার রাত। আকাশে হালকা মেঘ ভাসছে। মোম দিয়ে সাজানো হয়েছে সমুদ্র সৈকতের কিছু অংশ। হাওয়ার তালে মোমগুলো নিভে যাওয়ার উপক্রম। আহি সাদা শাড়ি পরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে বালির উপর। চোখ বন্ধ করে সমুদ্রের আর্তনাদ উপভোগ করছে সে। আফিফের হাতে একটা মোম। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আহির দিকে। আহি পিছু ফিরতেই তার পিঠ ঠেকলো আফিফের বুকে। আফিফ তার কোমড়ে হাত রেখে তার থুতনি আহির কাঁধের উপর রাখলো। আহি ফুঁ দিয়ে আফিফের হাতে থাকা মোমটি নিভিয়ে দিয়ে বলল,
“অল্প সময়ে কতো কিছু হয়ে গেলো!”

“হুম। তোমার বান্ধবীরা করেছে এসব?”

“হুম, লিনু তো জানে আমার স্বপ্ন কি!”

আফিফ এবার আহিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“আর কি কি স্বপ্ন তোমার?”

“আছে অনেক।”

“বলো না!”

“কেন জানতে চাচ্ছো?”

“আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। যতোটা কষ্ট দিয়েছি, তার চেয়ে দ্বিগুণ ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবো।”

আহি মুচকি হাসলো। আফিফের দুই গালে হাত রেখে বলল,
“জানো, আমি সৃষ্টিকর্তার যা-ই চেয়েছি, তাই পেয়েছি। উনি তার বান্দাদের সব ইচ্ছে পূরণ করেন। একটু দেরীতে দিয়েছেন, তবুও অসম্ভব চমৎকার একটা মুহূর্ত দিয়েছেন। তোমাকে ফিরে পাওয়াটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।”

“আমার তো এখনো বিশ্বাসও হচ্ছে না, আমি আমার খেয়ালীকে বাস্তবে ফিরে পেয়েছি। আমার কাল্পনিক প্রাক্তন!”

আফিফ হাসলো। আহিও হেসে বলল,
“কাল্পনিক প্রাক্তনের সাথে বিয়ে, বিষয়টা চমৎকার না?”

“আমাদের গল্পটাই অদ্ভুত সুন্দর, তাই না?”

“অদ্ভুত বলতে ভীষণ অদ্ভুত। ট্রাস মি, আফিফ, আমি হয়তো স্বপ্ন দেখছি। আমাকে একটা চিমটে দাও তো।”

আফিফ হাসলো। আহির গালে হালকা কামড় বসিয়ে দিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে বলল,
“স্বপ্নটা কেমন ছিল, হুম?”

আহি আফিফের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তাই বলে কামড় দেবে?”

“ব্যথা লেগেছে না-কি?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“না। আচ্ছা চলো খেয়ে নেই। তুমি সারাদিন কিছু খাও নি।”

“তোমাকে কে বলেছে?”

“রেনু।”

এবার আহি আফিফের হাত ধরে তার পাশে বালির উপর বিছিয়ে রাখা মাদুরে এসে বসলো। বাকিদের খাওয়া-দাওয়া আহির হোয়াইট প্যালেসে হলেও, আফিফ আর আহির রাতের খাবার আলাদাভাবে এখানে সাজানো হয়েছে। কারণ আহির স্বপ্ন ছিল বিয়ের প্রথম রাত সমুদ্রের ঢেউ দেখে, আর সেই ঢেউয়ের আছড়ে পড়া গর্জন শুনে কাটাবে। এদিকে আহি পাশ ফিরে সমুদ্রের ঢেউ দেখছে। আর আফিফ যত্নের সাথে আহির প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। আহির মনোযোগ সেদিকে পড়তেই সে আফিফের হাত থেকে চামচ নিয়ে বলল,
“ইশ, দেখো তো, কেমন বউ আমি! আমার বর সারাদিন না খেয়ে আছে, আর আমি আত্মভোলা হয়ে আছি।”

আহি আফিফের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে হাত ধুয়ে খাবার মেখে আফিফের মুখের সামনে ধরলো। আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“যখন আমরা চারুশিল্পে পড়তাম, আর তুমি এক্সিডেন্ট করেছিলে, তখন আন্টি, আই মিন আম্মু বলেছিল তোমার না-কি খাইয়ে দিলে পেট ভরে যায়। আমি এখন থেকে তোমাকে খাইয়ে দেবো।”

“প্রতিদিন?”

“তোমার অফিস টাইমে তো সম্ভব না।”

“তুমি খাইয়ে দিলে, আমি ব্রেক নিয়ে বাসায় চলে আসবো।”

“আমিও যেতে পারি অফিসে।”

“তোমার কাজ থাকলে আমি তোমার অফিসে খাবার নিয়ে চলে যাবো।”

“বাহ! আমার হাতে খাওয়ার এতো শখ?”

আফিফ আহির গাল টেনে দিয়ে বলল,
“কিছু শখ দেরীতে পূরণ হয়। আর অনেক কষ্টে ফিরে পাওয়া কোনো কিছুর মূল্য অনেক। আমার কাছে এই শখের মূল্য অনেক বেশি। আমি তো সব কাজ ফেলে বাসায় চলে আসবো।”

আফিফ আর আহির খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। আহি আফিফের কাঁধে মাথা রেখে বসলো। হঠাৎ আহি অনুভব করলো তার গায়ে হালকা বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। আহি চোখ খুলতেই আফিফ বলল,
“বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে হয়তো।”

আহি বলল,
“বর্ষার মাসে বিয়ে করার এটাই সৌন্দর্য। যখন-তখন রোমান্টিক মুহূর্ত সৃষ্টি হয়ে যায়।”

আফিফ আর আহি উঠে দাঁড়ানোর আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আহি আর আফিফ ব্যস্ত হাতে খাবারের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। পাশেই তাদের কটেজ। এদিকে তীব্র হাওয়া দক্ষিণ দিক থেকে ধেয়ে আসছে। আহির শাড়ি আঁচল উড়ছে হাওয়ায়। হঠাৎ আফিফ আহির হাত ধরলো। আহি আফিফের দিকে ফিরে তাকালো। অদ্ভুত উন্মাদনা আফিফের দৃষ্টিতে। আহিও হারিয়ে যাচ্ছে সেই চোখের গভীরে। আফিফ বলল,
“তোমার অসম্ভব চমৎকার রূপ দেখেছি বর্ষায়। তোমার হাসি সুন্দর, তোমার ভালোবাসা সুন্দর, তোমার অশ্রুসিক্ত চোখ সুন্দর, তোমার অভিমান সুন্দর। তুমি বর্ষার জন্যই সৃষ্টি হয়েছো, উধয়রনী।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “উধয়রনী?”

“তুমি তো এতো বছর রানী হয়ে ছিলে, এবার আমার সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকবে। যেই সম্রাজ্ঞী কখনো হেরে যায় না। সে সফল হয়। যার প্রতিটা ইচ্ছে পূরণ হয়। ভবিষ্যতেও পূরণ হবে।”

বৃষ্টির বেগ বাড়লো। আফিফ আহির হাত ধরে দৌঁড়াতে লাগলো কটেজের দিকে। দু’জনই হাসছে। চমৎকার সেই হাসির শব্দ। সেই শব্দে আলোড়ন তুলছে সমুদ্র পার। কটেজের ছাউনির কাছে আসতেই আফিফের বুকে ঝাপ্টে পড়লো আহি। ভিজে গেছে দু’জনই। মুখে পানির বিন্দু বিন্দু কণা। দু’জনেই হাঁপাচ্ছে। আহি আফিফের কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিজেকে শান্ত করলো আর বলল,
“নামটা ভীষণ সুন্দর। আরেকবার আমাকে সেই নামে ডাকবে, এআর?”

হাওয়ার ঝাপ্টা তাদের শরীরে এসে লাগছে। তাদের সেদিকে খেয়াল নেই। আহি ব্যস্ত আফিফের কন্ঠে নতুন সম্বোধন শোনায়, আর আফিফ ব্যস্ত তার খেয়ালীর ছোট্ট মিষ্টি আবদার পূরণ করায়।

আফিফ আহির মিষ্টি আবদারের প্রতিত্তোরে মুচকি হেসে বলল,
“আমার সাদাসিধে জীবনে আমি তোমার সম্রাট আর তুমি আমার উধয়রনী।”

আহি বলল,
“এতোদিন শূণ্য ছিলাম, এবার পূর্ণ হলাম। এবার শুরু হবে এআর আর তার উধয়রনীর মিষ্টি সংসার।”

#সমাপ্ত

উধয়রনী পর্ব-৫৯+৬০

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৯||

১২৩।
পুষ্প আর লিনাশা পদ্মের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মের দৃষ্টি নত। আহি দাঁড়িয়ে পদ্মের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প রাগী স্বরে পদ্মকে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি যাকে ভালোবাসতো, সেই মানুষটা আফিফ ভাইয়া ছিলেন?”

লিনাশা বলল,
“ওকে আর কি জিজ্ঞেস করছিস। সবটাই তো পরিষ্কার। ও সব জেনেশুনে আহির ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছে।”

“কীভাবে করলি এমনটা, পদ্ম? বুক কাঁপে নি তোর? ক্লাস থ্রি থেকে আমরা ফ্রেন্ড। কলেজ পর্যন্ত একসাথে ছিলাম।”

“শুধু বন্ধুত্ব না হারানোর জন্য আহি সেই কলেজে ভর্তি হয়েছে, যেই কলেজে পড়া তুই এফোর্ড করিস।”

“ছি! ছি! আমার রেজাল্ট ভালো এসেছিল। আমাকে বাবা ঢাকায় ভর্তি করাতে চেয়েছিল। লিনাশা আর আহির রেজাল্ট অনুসারে ওরাও ওখানে আসতো। শুধু তোর জন্য আমরা সেই কলেজে পড়েছি।”

“আমার মনে হচ্ছে, আমরা সেদিন বাবা-মার কথা মেনে নিলে, আহিকে কখনোই তার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে হতো না। বন্ধুত্বকে বেছে নিয়ে এতো বড় ভুল করেছে মেয়েটা?”

পদ্ম নিরবে কাঁদছে। আহি তাদের কথার মাঝখানে এসে বলল,
“আমি পদ্মকে ক্ষমা করে দেবো।”

লিনাশা আর পুষ্প চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“কখনো না। এর কোনো ক্ষমা নেই।”

আহি বলল, “করবো। কিন্তু এক শর্তে।”

পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো, “কি শর্ত!”

“আমি আফিফকে ঠিক সেভাবেই পেতে চাই, যেভাবে আমার প্রেমের গল্পটা আমি সাজাতে চেয়েছিলাম।”

পদ্ম নিশ্চুপ। আহি আবার বলল,
“তুই আফিফকে সেখানেই ছেড়ে আয়।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“আহি পাগলের মতো ভালোবাসে তার এআরকে। আগেও ভালোবাসতো। এখনো ভালোবাসে। আমৃত্যু ভালোবাসবে। তুই হাসি-মুখে আফিফের কাছে সম্বন্ধ নিয়ে যাবি। তাও আমার বিয়ের।”

লিনাশা আহির বাহু ধরে বলল,
“এই মেয়েকে তুই আফিফের ব্রেইন-ওয়াশ করতে পাঠাচ্ছিস?”

“আফিফ যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে, তাহলে কারো কথার জালে সে আটকাবে না। এবার আমার মায়ায় ওকে ছুটে আসতেই হবে।”

পদ্ম বলল,
“তুই আমাকে ক্ষমা করছিস, না-কি শাস্তি দিচ্ছিস, আহি।”

“সরি, আমাকে ক্ষমা করে দে, এই একটা বাক্যে কি আমি আমার দশ বছর ফিরে পাবো? চার বছরের এক তরফা ভালোবেসে যাওয়া, এরপর চার বছরের ট্রমা, তারপর এক বছর সামনা-সামনি তার সংসার দেখে যাওয়া, আর এরপর পাঁচ বছর এই ভেবে জীবন কাটানো যে সে আমাকে ঘৃণা করে। মোট দশ বছরের বিচ্ছেদ। চৌদ্দ বছরের একাকীত্ব। এতোগুলো সময় শুধু সরি, আমাকে ক্ষমা করে দে, এই এক বাক্যে শেষ হয়ে যাবে? তোকে সব দেখতে হবে। তুই আমার পাওয়া সব কষ্টকে সুখ হতে দেখবি। এটাই তোর ক্ষমা।”

আহি চলে গেলো। পদ্ম বউ সেজে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে এখনো। লিনাশা পদ্মকে বলল,
“আই হেইট ইউ। পলি আপু গ্রুপ এখানেই শেষ। তুই আমার বেস্টিকে কষ্ট দিয়েছিস। আমিও দিয়েছিলাম একটা সময়। কিন্তু আমার সিচুয়েশন এমন ছিলো না। আমার বাবা মারা গিয়েছিল। আমার কোনো ভাই নেই। আমি ছোট ছিলাম। মা অসুস্থ ছিল। মা বার-বার বলছিল, আহির সাথে বন্ধুত্ব রাখায় আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। ফ্রাস্ট্রেশনে ছিলাম আমি। তাই সব যোগাযোগ শেষ করে দিয়েছি। কীভাবে রাখতাম যোগাযোগ? আহির নতুন মা আমারই বড় আপু। কীভাবে বাবার খুনীর পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখতাম? কিন্তু এমন একদিনও যায় নি, যেদিন আমি আহিকে মিস করিনি। সবসময় চাইতাম, আহি যাতে মুভ অন করতে পারে। কারণ আমি জানি, ওর জীবনে আসা সব ট্রাজেডির চেয়ে ভয়ংকর ট্রাজেডি ছিল আফিফকে হারানো। যেই আঘাতটা তুই ওকে ইচ্ছেকৃত ভাবে দিয়েছিস। আর আমি তোর ভালোর জন্য আহিকে বলতাম, তোর সংসার যাতে না ভাঙে। তুই জেনে গেলে কষ্ট পাবি। বোকা আমি! একবার যদি সত্যটা জানতাম, তোকে খুন করে আহি আর আফিফের পথের কাঁটা সরিয়ে দিতাম। আই হেইট ইউ, পদ্ম।”

পুষ্প বলল,
“আমি তো আর ভাবতেই চাই না, তুই আমার বন্ধু ছিলি। না জানি কখন, কার বরের প্রেমে পড়ে তাকে জীবন থেকেই কেঁড়ে নিস।”

পদ্ম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“ভুল করেছি আমি। কিন্তু যা করেছি, আফিফকে পাওয়ার জন্য করেছি।”

“এখনো নিজেকে ডিফেন্ড করবি? তোর কাছে আশাও কেন করছি? অশিক্ষিত, মূর্খ তুই।”

পদ্ম বলল,
“যা বলার বল। আমি আফিফকে ভালোবাসি। এখনো ভালোবাসি। আমি কখনো চাইবো না, আহি আফিফের হোক। আর আমি আফিফকে রাজী করাবো না।”

“তোর রাজী করানো, না করানোতে কোনো যায় আসে না আহির।”

লিনাশা বলল,
“আহি যেটা চায়, সেটা তোর রাজী হওয়া না হওয়াতে নির্ভর করবে না। সেটা হয়েই যাবে। দুঃখের কথা কি জানিস? তুই আফিফকেই নয়, তিনটে ভালো বন্ধুও হারিয়েছিস। তোর মতো দুর্ভাগা যাতে কেউ না হয়! না আফিফ আছে, না বন্ধু আছে, না নৈতিকতা আছে, না সম্মান আছে, না একটা সন্তান আছে। তুই আলটিমেট লুজার। তাজওয়ার খানের মতো। তাজওয়ার তো অন্তত তোর চেয়ে একটু ভালো। সে যায় করেছে, আহির ক্ষতি করে নি। তুই তো আফিফকে বিক্রি করে দিয়েছিস। তার সম্মান, তার বোনের সম্মান সবটাই তাজওয়ারের হাতে তুলে দিলি। নিজেরটাও ছাড় দিলি না। জেনেশুনে আফিফকে খানস গ্রুপের কাজটা করতে দিলি। এখনো আফিফ লোন শোধ করছে। আসলে তোর মতো ইডিয়ট ভালোবাসারই যোগ্য না।”

১২৪।

আহি পদ্মের স্বামী বোরহান আলী হাতে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো। পদ্ম স্বামীর পাশেই দাঁড়ানো। সে ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্মের স্বামী, বোরহান আলীর বয়স চল্লিশের একটু এপার-ওপার। কাঠ ব্যবসায়ী। যেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না তিনি। দুই সন্তানের পিতা। একটার বয়স সাত। অন্যটার বয়স এক। আহি বোরহান আলীকে বলল,
“আপনার ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আপনি যদি এই কাজটা নেন, বেশ খুশি হবো।”

বোরহান আলী খুশিতে গদগদ। তিনি আহির এগিয়ে দেওয়া কার্ডটি নিয়ে বললেন,
“কাজটা কি!”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“কক্সবাজারে আমার একটা বাংলো বাড়ি আছে। ওখানের জন্য একজন বিশ্বস্ত গার্ড লাগবে। নাইট গার্ড। আপনার থাকার ব্যবস্থা আমিই করে দেবো। বাকিটা আপনি চালাবেন।”

পদ্মের মুখ লাল হয়ে গেলো। বোরহান আলী বললেন,
“বেতন কতো!”

“মাসে ত্রিশ হাজার টাকা। ওভার টাইম করতে চাইলে বাড়িয়ে দেওয়া হবে।”

বোরহান আলী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। পদ্ম বলল,
“অপমান করছিস?”

বোরহান আলী ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালেন। আহি বলল,
“আহি কাউকে অপমান করে না। সাহায্য করে। শোন কোনো কাজই ছোট না। মোজাম্মেল চাচা আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি এখনো শক্ত থাকলে এই কাজ আমি উনাকেই দিতাম। তোর স্বামী আমার ভাইয়ের মতো। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে এই কাজটা অনেক সহজ, আর এর বেতনও অনেক বেশি। সরাসরি কোম্পানিতে কাজ দিলে, খাটতেও হতো, এমপ্লয়িদের কথাও শুনতে হতো।”

বোরহান আলী বললেন,
“আমার এই কাজ খুব পছন্দ হয়েছে। আমি করবো কাজটা।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে হাসলো। লিনাশা চাপা স্বরে আহিকে বলল,
“কেন দিয়েছিস উনাকে কাজ? মরুক না ও।”

“অভাব তো পদ্মের জন্য কিছুই না। পদ্মের অভাব তখন হবে যখন ভালোবাসার অভাবে তার হৃদয়ে খরা হবে। আমি যেভাবে দহন যন্ত্রণায় ছটফট করেছি, পদ্মকেও একই ভাবে ছটফট করতে হবে। তখনই আমি শান্তি পাবো। এবার সব ওর সামনে হবে। এবার ও আমার সংসার দেখবে।”

(***)

দুই দিন চট্টগ্রাম ঘুরে কক্সবাজার ফিরলো পুষ্প, আহি আর লিনাশা। নায়ীব লিনাশাকে দেখেই বলল,
“কেমন বউ তুমি, স্বামী-সন্তান ফেলে চলে গেছো।”

লিনাশা বলল,
“কেন? তোমার ছেলে তো তোমার সাথেই বেশি থাকে।”

লাবীব বলল,
“পিয়ালী তো ছোট। পুষ্প, তুমি তো আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলে!”

পুষ্প বলল,
“এখন বুঝেছো, অফিস আর বাচ্চা একসাথে দেখা আমার জন্য কতোটা কষ্টকর? বাসায় এসে তো শুধু হাত-পা ছড়িয়ে টিভি দেখো। এসে তো রান্নাঘরে একটা প্লেট এগিয়ে দাও না।”

আহি বলল,
“হয়েছে হয়েছে। এতো অভিযোগ! আমি যদি সংসারী হয়, আমার বরকে শুধু রান্না করে খাওয়াবো।”

লিনাশা আর পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি মুখ চেপে হাসলো। নায়ীব আর লাবীব বলল,
“শেখো কিছু আহির থেকে।”

লিনাশা বলল,
“খুব ফ্যান্টাসি লাগছে এখন! সংসার শুরু কর, তারপর বুঝবি।”

আহি নায়ীব আর লাবীবকে বলল,
“ফ্যান্টাসি তো আমার লাগবেই। রানীরা কি করে? রাজার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। ঘরে হেঁটে সময় নষ্ট করে। কারণ তাদের কোনো কিছুর অভাব নেই। আল্লাহ আমাকেও কিছুর অভাব দেন নি। অভাব ছিল ভালোবাসার। জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লে, একটা মেয়ে রানী হয়ে থাকতে পারে না। তাকে রানীর মতো রাখতে জানতে হয়। তারপরই একজন পুরুষ বিনা মুকুটে রাজা হতে পারে। আর রাজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানায় না। ভাইয়ারা, অভিযোগ না করে, রানী করে রাখুন, দেখবেন রাজার হালে থাকবেন। একদিন না হয় সংসারটা একাই করলেন। অন্তত এটা তো বুঝলেন, আমার বান্ধবীদের ছাড়া আপনারা কতোটা ছন্নছাড়া।”

নায়ীব লিনাশার হাত ধরে বলল,
“লিনাশা তো আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।”

লাবীব পুষ্পকে কাছে টেনে এনে বলল,
“সরি, বউ। বেশি বলে ফেলেছি। রাগ করো না। তুমি তো জানোই, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”

আহি দুই বান্ধবীর লাজুক হাসি দেখে মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
“আমার তৃষাতুর কান তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, আফিফ। কখন বলবে আমাকে ভালোবাসো?”

(***)

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে তাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে এলেন। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“হুট করে আমাদের এখানে ফেলে চট্টগ্রাম কেন গিয়েছিলে?”

“জরুরি কাজ ছিল।”

“তোমার সব জরুরি কাজ আমি মেনে নিয়েছি। তোমার সব আবদার আমি মেনে নিয়েছি। মা হয়ে কি আমার এতোটুকু অধিকার নেই? আমার একটা আবদার রাখা যাবে না?”

আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“কি বলছো তুমি? তুমি যা বলবে, আমি তা-ই শুনবো।”

“উজ্জ্বল ছেলেটা ভালো। তোমাকে অনেক সাহায্য করেছে। তাজওয়ার আর লাবণির বিরুদ্ধে কেইসটা ও নিয়েছিলো। তুমি রাজি হয়ে যাও, মা।”

“মা, আমি উজ্জ্বলকে বিয়ে করতে পারবো না।”

“তাহলে তোমার কি করতে ইচ্ছে করছে? বিয়ে না করে সারাজীবন এভাবেই থাকবে? ত্রিশ বছর চলছে তোমার। কয়েকমাস পর একত্রিশ হবে। এই বয়সে এসে তোমার জন্য আমি কোথায় যোগ্য পাত্র পাবো? একটাও তোমার মন মতো হয় না। আমি সারাজীবন বেঁচে থাকবো না। তোমার বাবা নেই। আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। তোমার মামাদের ভরসায় তোমাকে রেখে আমি শান্তিতে মরতে পারবো না। তুমি মা হলে, আমার চিন্তাটা বুঝতে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি বিয়ে করবো।”

সালমা ফাওজিয়া আনন্দিত কণ্ঠে বললেন,
“আমি তাহলে আমিনা আপার সাথে কথা বলি। বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলি?”

“না। আমি বিয়ে করবো বলেছি। উজ্জ্বলকে করবো বলি নি। তবে আমি উজ্জ্বলের সাথে কথা বলবো।”

“তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?”

“হ্যাঁ।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের থুতনি ধরে বললেন,
“আমাকে আগে বলবে না? কি করে ছেলেটা? দেখতে কেমন? পরিবার ভালো তো!”

“কি করে? দেখতে কেমন? পরিবার কেমন? এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তোমার মেয়ের তাকে খুব পছন্দ। আমার পছন্দ কখনো খারাপ হয় না।”

“আলহামদুলিল্লাহ। বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। ছেলের মা-বাবা কেউ থাকলে নম্বরটা দাও। কথা বলি আমি। আর দেরী করো না। তোমার নানু বেঁচে থাকতেই বিয়েটা হয়ে যাক।”

আহি মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো,
“এতো সহজে বিয়ে হবে না। এতো বছরের কষ্টের শোধ তো আমি নেবোই, মিস্টার আফিফ রাফাত।”

(***)

এ আর টি গ্যালারির সামনে বাগানের বেঞ্চে উজ্জ্বল আর আহি পাশাপাশি বসে আছে। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“বিয়ে করছেন না কেন?”

উজ্জ্বল হালকা হেসে বলল,
“বয়স হলেই যে বিয়ে করতে হবে এমনটাও নয়। আমি মনমতো জীবনসঙ্গী পাচ্ছি না।”

“আপনার কেন মনে হলো, আমি আপনার মনের মতো মানুষ?”

“তোমাকে যতোটুকু জেনেছি, তাতেই মনে হলো।”

“আমি একজনকে ভালোবাসি।”

উজ্জ্বল আহির দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক নিরব থেকে বলল,
“আগের সেই মানুষটা? না-কি নতুন কেউ?”

“যাকে ভালোবাসেছিলাম, তাকে ভালোবাসতেই আমার মন ভরে নি। মনে হচ্ছে আরো কিছু বাকি রয়ে গেছে। তাহলে দ্বিতীয় কাউকে কীভাবে সেখানে জায়গা দেই?”

“শুনেছি সে বিবাহিত।”

“এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে।”

উজ্জ্বল হাসলো। বলল, “তাহলে তো ভালোই হলো।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তাকে যতোটা ভালোবাসি, অন্য কাউকে সেভাবে কখনোই ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসার থাকলে আমার জন্য তার পরের স্থানটা রাদেরই হতো। যেখানে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটাই আমার ভালোবাসা পায় নি, আমি অন্য কাউকে কীভাবে সেই স্থান দেবো? অন্যায় হবে, আপনার সাথে, বা অন্য কোনো পুরুষের সাথে। আর আমাকে সেই মানুষটার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসতে পারবে না। যদি বেসে থাকে, তাহলে সেও আমার প্রিয় বন্ধু রাদই ছিল। এবার বলুন, যাকে আমি ভালোবাসি, তাকে না পেলে আমি দ্বিতীয় কোনো মানুষের জীবনে যাওয়াটা তো অন্যায় হবে, তাই না? এটা রাদের সাথে অন্যায় হবে। রাদ খুশি হবে, আমি যদি আফিফের সাথে ভালো থাকি৷ কারণ আমি জানি, সে আফিফ ছাড়া আর কাউকে আমার সাথে সহ্য করতে পারবে না।”

উজ্জ্বল বলল, “আফিফ খুব ভাগ্যবান পুরুষ।”

আহি হাসলো। হঠাৎ তার চোখ আটকালো নন্দনকানন স্কুলের গেটের সামনে। আফিফ ওয়াসিফকে নিতে এসেছে স্কুল থেকে। আহি আফিফকে দেখিয়ে দিয়ে উজ্জ্বলকে বলল,
“মানুষটা মনে করে ও আমার অযোগ্য। ভালোবাসি বলতে ভয় পায়। আমার খুব কষ্ট হয়৷ আমি কতো বার বলেছি, আমি তাকে ভালোবাসি। কতো বার বুঝিয়েছি। সে একবার কি আমাকে ভালোবাসি বলতে পারে না? আমার কি শুনতে ইচ্ছে করে না?”

“জিজ্ঞেস করে দেখো।”

“বলবে না। ওর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে হবে মাথাটা।”

“কীভাবে করবে?”

“জানি না। ছেলেরা ভালোবাসি কখন বলে?”

উজ্জ্বল কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“এমন মুহূর্তে যখন তাকে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনায় নেই। ভালোবাসি বলে মনের চাপ কমিয়ে ফেলে। বা কোনো ইমোশনাল সিচুয়েশনে।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“মানুষটা খুব চাপা স্বভাবের। ও এতো সহজে মুখ খুলবে না।”

“তাহলে?”

“একটা সাহায্য করলে, আমি আপনার একটা উপকার করতে পারি।”

“কেমন?”

আহি উজ্জ্বলকে তার পরিকল্পনাটা বললো। উজ্জ্বল সব শুনে হাসলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো আফিফ এদিকেই তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল বলল,
“মিস্টার আফিফ তো এদিকেই তাকিয়ে আছেন।”

আহি আফিফের দিকে না তাকিয়ে বলল,
“তাহলে প্ল্যান এক্সিকিউট করি।”

“আমার কি উপকার করবে?”

“আপনার আর আমার বিয়েটা একসাথেই না হয় হবে।”

“কীভাবে?”

“আমার জুনিয়র, চয়নিকা। বেশ মিষ্টি মেয়ে। ওর বাসা থেকে ছেলে দেখছে। আমার ওর সাথে পরিচয় আঁকা-আঁকি থেকেই। ভালোই ছবি আঁকে। সংসারীও মনে হয়।”

“তোমার কি মনে হয়, ভালো হবে?”

“হ্যাঁ, আমার তো ভালোই মনে হয়।”

“তোমার পছন্দের উপর আস্থা আছে আমার।”

আহি হাসলো। উজ্জ্বলের দিকে হাত এগিয়ে দিলো। উজ্জ্বল আহির সাথে হাত মেলাতেই আহি বলল,
“আমি চয়নিকার মায়ের সাথে কথা বলবো। আপনার বায়োডাটাটাও পাঠিয়ে দেবেন।”

১২৫।

পরদিন চয়নিকার মায়ের সাথে কথা বললো আহি। উজ্জ্বলের বায়োডাটাও পাঠানো হলো। দুই পক্ষই এক সপ্তাহ সময় নিলো। আহি এই এক সপ্তাহ উজ্জ্বলের সাথে ভালোই সময় কাটালো। প্রতিদিন ওয়াসিফের স্কুল ছুটির আগ মুহূর্তে এ আর টি গ্যালারির বাগানে বসে আহি আর উজ্জ্বল গল্প জুড়িয়ে দেয়। আর প্রায়ই আফিফ তাদের দেখে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। আহির বেশ ভালোই লাগছে এসব। মনে মনে ভাবছে,
“দহন যন্ত্রণায় পুড়িয়েছো আমাকে৷ এবার বুঝো, তোমাকে আর পদ্মকে একসাথে দেখে আমার কতোটা কষ্ট হতো!”

এক সপ্তাহ পর চট্টগ্রামে গেলো উজ্জ্বল। পারিবারিক ভাবে চয়নিকার সাথে দেখা হলো তার। আহি আর পুষ্পও সাথে ছিলো। পনেরো মিনিটের আলাপে চয়নিকা আর উজ্জ্বল বেশ খুশি। কথাবার্তা শেষে বেরিয়ে আসার সময় উজ্জ্বল আহিকে বলল,
“চয়নিকাকে আমার ভালোই লেগেছে।”

আহি হেসে বলল,
“তাহলে বিয়ের কথাবার্তা আগানো যাবে।”

“ওদের রেসপন্সটাও তো জরুরি।”

দু’দিন পর উজ্জ্বলের পরিবার আনুষ্ঠানিকভাবে চয়নিকার পরিবারের সাথে দেখা করতে চাইলো। চয়নিকার পরিবারও রাজি হলো। তাদেরও উজ্জ্বলকে বেশ পছন্দ হয়েছে। এরপর কথাবার্তা পাকাপোক্ত হতেই আহি আবার কক্সবাজার ফিরলো।

আজ বোরহান আলী পদ্মকে নিয়ে কক্সবাজার এসেছেন। আজ থেকেই তিনি নাইট গার্ডের দায়িত্ব নিচ্ছেন। আহি তার বাংলো বাড়ির পাশেই একটা সেমি পাকা বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। তিন রুমের বড় বাড়ি। পাশে আরো কয়েকটা সেমি পাকা বাড়ি আছে। আহি তার বাংলো বাড়ির দারোয়ানদের আর ব্যক্তিগত ড্রাইভারের রেস্ট হাউজ হিসেবে এই সেমি পাকা বাড়িগুলো বানিয়েছিলো। যদিও এখানে থাকার সম্পূর্ণ খরচ আহি নিজেই দেয়। চিকিৎসা খরচও আহি চালায়। কিন্তু পদ্মের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রাখলো আহি। ভেতরের আসবাবপত্রও আহি নিজেই পছন্দ করে কিনে দিয়েছে। বোরহান আলীর বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ চালানোর দায়িত্বও নিয়েছে। সাথে একটা মোটর সাইকেল দিয়েছে বোরহান আলীকে। আপতত মোটর সাইকেল চালানোর জন্য একটা প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করেছে আহি। পদ্ম আহিকে এতোকিছু করতে দেখে বলল,
“কেন করছিস এসব আমার জন্য?”

“অন্তত কেউ নিমকহারামি যাতে করতে না আসে।”

“তুই ভাবছিস এসব করে তুই আমার কাছ থেকে আফিফকে কেঁড়ে নিবি?”

আহি হেসে বলল,
“প্রথমত তুই আমার কাছ থেকে আফিফকে কেঁড়ে নিয়েছিলি। আর এখন আফিফ তোর নেই। তাহলে কেঁড়ে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।”

“আমি উনাকে তালাক দিয়ে আফিফকে আবার বিয়ে করবো।”

আহি হাসলো। একটু জোরেই হাসলো। আহির হাসির শব্দ শুনে পদ্ম অবাক হলো। আহি পদ্মের হাত ধরে বলল,
“বোন, তোর তো আমার চেয়েও বাজে অবস্থা। নায়ীব ভাইয়ার শরণাপন্ন হতে হবে তোকে। বান্ধবীর বর কিন্তু, সাবধান। আমি তাই ছাড় পেয়েছিস, ওদিকে নজর দিলে লিনু তোর চোখ গেলে দেবে।”

“আহি, আফিফ আমার স্বামী ছিল।”

“তোর সেই স্বামী আমার ভালোবাসার মানুষ ছিল।”

“প্রেমিকার চেয়ে স্ত্রীর মর্যাদা অনেক বেশি।”

“এজন্যই তো তখন আমার হাতে কিছু ছিল না। কিন্তু এখন সময়টাও আমার, আফিফও আমার। আর তুই স্ত্রীর কথা বলছিস? মাথা টাথা কি খারাপ হয়ে গেছে না-কি? আফিফ আর তোর ডিভোর্স হয়ে গেছে। কোথাকার স্ত্রী তুই? যা, বোরহান আলীর সেবা কর। মানুষটা ওতোটাও খারাপ না। নয়তো পরে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা হবে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬০|| (১৮+ এলার্ট)

১২৬।
রাত ১টা। আহি ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আফিফের নম্বর। সে ভাবছে, আফিফকে একবার কল দেবে কি দেবে না। অনেক ভাবনার পর সে কল দিয়েই ফেললো। ওপাশে আফিফ তখন অফিসের ফাইল গুছিয়ে অফিস ব্যাগে ঢুকাচ্ছিলো। ফোন বেজে উঠতেই সে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আহির নাম ভেসে উঠেছে। আফিফ তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিলো। বেশিক্ষণ ভাবলো না। ধরেই ফেললো কল। ওপাশে নিরবতা। আফিফও চুপ করে আছে। মিনিট খানিক পর আহি বলে উঠলো,
“তোমাকে ভালোবেসে আমি কি পেয়েছি, বলো তো?”

আফিফ আহির এমন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো। সে কী উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা, তোমাকে বলতে হবে না। আমি বলছি। তোমাকে ভালোবেসে আমি তোমার নির্বিকার ভাব দেখেছি। তোমার থমকে যাওয়া দেখেছি। তোমাকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হয়তো আমি…”

আহি আফিফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“হয়তো তুমি না। তুমিই এমন করেছো। রেনু আমাকে তোমার ব্যাপারে যা বলেছে তা কি আদৌ সত্য?”

আফিফ এবারও নিশ্চুপ। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি এতোটাই নির্লিপ্ত?”

“আমার মনে হয় না তুমি কখনো আমার সাথে সুখী হবে। আমি হয়তো তোমাকে ভালো রাখতে পারবো না।”

আহি হাসলো। বলল,
“এটাই শুনতে চেয়েছিলাম। থাক এসব বাদ দাও। অনেকদিন পর দেখা হয়েছে। অন্তত ক্ষণিকের পরিচিতি তো ছিল। আমার আর উজ্জ্বলের বিয়েতে তোমাকে নিমন্ত্রণ দিয়ে রাখলাম। বিয়ে সেই রিসোর্টে হবে, যেখানে তোমার আর পদ্মের বাসর হয়েছিল।”

আফিফ থমকে গেলো। আহি বলল,
“আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে পাওয়ার জন্য যতোটা করার সবটাই করেছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এক তরফা কিছু হয় না। আর আমি এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।”

আফিফ নিশ্চুপ। আহি আবার বলল,
“আজ যদি তোমার জায়গায় আমি থাকতাম, তাহলে হয়তো বেহায়া হয়েই যেতাম। জীবনে একবার দুঃসাহসিক কাজ করা উচিত। ফল যদি অনুকূলে না থাকে, অন্তত আফসোস থাকবে না। আমি চেষ্টা করি নি, আমার ভালোবাসায় খাদ ছিল, এই আফসোস অন্তত থাকবে না। যার ভালোবাসায় খাদ থাকে, তারা মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পায়। তাদের সাহস নেই। তারা ভীতু। আমি ভীতু ছিলাম না। তাই আমার অনুভূতি প্রকাশে আমি একটুও কার্পণ্য করি নি।”

আফিফ বলল, “আহি, আমি হয়তো….”

“হয়তো, হয়তো বা, এসব বন্ধ করো, মিস্টার আফিফ রাফাত। চৌদ্দ বছর শেষ হয়ে গেছে। আমার জীবন থেকে চৌদ্দটা বসন্ত হারিয়ে গেছে। আমি ভয়ংকর দশটা বর্ষা যেতে দেখেছি। কখনো তো এসে কেউ আমাকে বলে নি, এই অন্ধকার রাতে বর্ষায় ভিজতে হবে না, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি জানো, আমি প্রতি বর্ষায় সেই দিনটিতে রাতভর ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে ছাদে শুয়ে থাকি। আর আমার চোখের সামনে ভাসে, একটা পুরুষ অবয়ব ডোবায় নেমে পদ্মফুল তুলছে। আর সেই দিনটিতে যদি বৃষ্টি না হয়, আমি সারারাত ওয়াশরুমের ঝর্ণায় নিজেকে ভেজাই। কিন্তু কেউ আমার মাথা মুছতে আসে না।”

আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো, “আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দাও।”

“সুযোগ শেষ। সময় আর নেই। শুনো, তোমার আর পদ্মের সংসার দেখেছি আমি। খুব মিষ্টি করে জড়িয়ে ধরতে তাকে। কতো রাত তোমরা প্রেম লীলায় মত্ত ছিলে, নয়তো কি আর এমনি এমনি সন্তান হওয়ার আশায় থাকতে? তুমি আমার সামনে ওর সাথে জড়াজড়ি করতে। হ্যাঁ, তোমার বউ ছিল। আমি তো কেউ না এসব বলার। কিন্তু খারাপ লাগতো। আমার খারাপ লাগতো, আফিফ। কষ্ট হতো খুব। কারণ পদ্মের আগে আমিই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। মেয়েটা হয়তো ভুল করেছে। আজ যদি পদ্ম এমন না হতো? সে যদি সত্যিই ভালো মেয়ে হতো? তখন কি সংসারটা কখনো ভাঙতো? এখন তো তাজওয়ার নেই। তোমাকে থ্রেট দেওয়ারও কেউ থাকতো না। আমাকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ হয়েছে বলো তো? আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য তোমাকে বীরপুরুষ কে হতে বলেছে? যেদিন তাজওয়ার আমার গায়ে হাত দিয়েছিল। আমার গলায় ওর ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ…”

আফিফ আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আহি, প্লিজ।”

“ওমা, বীরপুরুষের এতো গায়ে লাগছে কেন?”

“আমাকে ক্ষমা করে দাও, আহি।”

“মিস্টার আফিফ, আমার বাবা আর তোমার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বাবা জেনেশুনে আমাকে তাজওয়ারের হাতে তুলে দিয়েছিল। আর তুমি আমাকে বাঁচানোর জন্য সেই পুরুষের হাতেই আমাকে তুলে দিলে৷ আমাকে সেদিন ছেড়ে গিয়েছিলে, যাতে তাজওয়ার আমার ক্ষতি না করে। একবারও ভাবো নি, তুমি ছেড়ে দেওয়া মানেই, তাজওয়ারের আমাকে পাওয়া!”

“আহি, আমার এতো ক্ষমতা ছিল না। আমি তাজওয়ারের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে পারতাম না। আমার আর্থিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা কোনোটাই ভালো ছিল না। হ্যাঁ, আমি ভীতু ছিলাম। আমি এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। হিরোইজম ছিল না আমার মধ্যে।”

“তবুও তোমার মতো জিরোকে আমি ভালোবেসেছি।”

আফিফ চুপ হয়ে গেলো। আহি আবার বলল,
“আমার জীবনের গল্পে কোনো হিরো নেই, আফিফ। আমার জন্য আমি একাই লড়াই করেছি। তাজওয়ার যেদিন আমার সাথে জোরাজুরি করতে এসেছিলো, কোথায় ছিলো আমার হিরো? আমি নিজের জীবন দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছি। সেদিন লিনাশার বিয়ে থেকে ফেরার পথে যখন তাজওয়ার আমাকে বিরক্ত করছিলো, আমি একাই পালিয়েছি। আমি একদম একা। তোমার মতো কাপুরুষ, ওপস, বীরপুরুষ। তুমি তো আবার মহান হৃদয়ের মানুষ। তাজওয়ার এসে আমাকে স্পর্শ করলো, আর তুমি কিছুই করতে পারলে না। তুমি তো পদ্মফুলের সাথে জড়াজড়িতে ব্যস্ত ছিলে। এদিকে তুমি রাদের সাথেও আমার বিয়ে ঠিক করে দিতে চাচ্ছিলে। একবারও ভাবো নি, আমি কী চাই। ওকে ফাইন, মিস্টার আফিফ রাফাত। এবার আমি না হয় বিয়ে করে একটা নতুন জীবন শুরু করবো। তুমি সো কল্ড বীরপুরুষ হয়েই থেকো। এবার তুমি যা চাইতে, তাই হবে। আমার বিয়ে হবে। আমাকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে। আমার শরীরে অন্য কারো….”

আফিফ থমথমে কন্ঠে বলল, “আহি প্লিজ। প্লিজ। প্লিজ।”

“ওপস, সরি। আমার প্রাইভেট কথা আমি তোমাকে কেন বলছি? এটা তো একান্ত আমার আর আমার স্বামীর অনুভূতি। আমি কি তোমার পদ্মফুল না-কি? যে রুমের দরজা খোলা রেখে অন্য কারো সামনে স্বামীর সাথে রঙ্গলীলায় মেতে উঠব? আর আমার স্বামী কি সো কল্ড বীরপুরুষ যে অন্য কাউকে মুভ অন করতে বাধ্য করার জন্য রুমের দরজা খোলা রেখে বউকে আদর করবে।”

আফিফ কল কেটে দিলো। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। তিক্ত হলেও সত্য কথায় বলেছে আহি। চাইলে তো সে আহির হাত ধরে রাখতে পারতো। এতোটা দুর্বল মানুষ সে? মেঝেতে বসে পড়লো আফিফ। মাথার চুল আঁকড়ে ধরলো দুই হাত দিয়ে। শরীর কাঁপছে তার। হাত মুঠো করে জোরে জোরে মেঝেতে আঘাত করলো সে। শব্দ শুনে রেনু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আফিফকে এই অবস্থায় দেখে রেনু ভাইয়ের পাশে এসে বসলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ভাইয়া, কি হয়েছে তোমার?”

আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি ব্যর্থ। আমি কাপুরুষ। আমি কিছুই করতে পারি নি। আমার ভয়, ভীতি, আমাকে দুর্বল করে রেখেছে। আমি বোকা। আমার একটুও বুদ্ধি নেই। আমি.. আমি অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমি অনেক ভুল করেছি। আমি আহির সাথে খুব অন্যায় করেছি। সময়গুলো আর ফিরে আসবে না। আমি চাইলেও সময়গুলো ফিরিয়ে আনতে পারবো না। আমার কষ্ট হচ্ছে, রেনু। আমি দুর্বল, আমি একদম দুর্বল।”

আফিফ রেনুর কোলে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো। আফিফা বেগম ছেলের কান্না শুনে ছুটে এলেন। ছেলের পাশে বসে পড়লেন তিনি। ছেলের কান্না সহ্য করার ক্ষমতা নেই তার। তিনি ঘটনা না জেনেই কেঁদে ফেললেন। ছেলের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
“কি হয়েছে, বাবা? আফিফ, কাঁদছিস কেন তুই?”

আফিফ আর কিছু বলতে পারলো না। সে মায়ের হাত ধরে কাঁদছে। রেনু ভাইয়ের কান্না দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ প্রথম তার ভাই এভাবে পাগলের মতো কাঁদছে। এটা এই মুহূর্তে তার জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য খুবই জরুরি ছিল। আহি তাকে আগেই সব বলে দিয়েছিল। রেনু বিছানায় পড়ে থাকা আফিফের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু সময়ের মানসিক যন্ত্রণা থেকে যদি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস সৃষ্টি হয়, তাহলে কোনো ক্ষতি নেই। অন্যদিকে আহি ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে,
“এটাই তোমাকে জাগিয়ে দেওয়ার শেষ সুযোগ। তুমি এবার ফিরে আসতে বাধ্য, আফিফ।”

১২৭।

উজ্জ্বল আর চয়নিকার ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের পরিকল্পনা করেছে উজ্জ্বলের কাজিনরা। আহিকে সাহায্য করবে বলেছিল উজ্জ্বল। সেই সূত্রে কক্সবাজারেই আয়োজন করা হলো সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের। আহির বাবার সেই বিলাসবহুল হোটেলেই তারা উঠেছে। আহি চয়নিকা আর উজ্জ্বলের বাবা-মার সাথে দেখা করে হোটেল ম্যানেজারকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় চয়নিকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। আহি চয়নিকার হাত ধরে বলল,
“ভালো লাগছে তো!”

চয়নিকা মুচকি হেসে বলল,
“হ্যাঁ, আপু। ভালোই লাগছে। একটা কথা শুনেছি মার কাছে।”

“কি কথা?”

“উজ্জ্বলের মা আপনার জন্য প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন!”

আহি হাসলো। চয়নিকার থুতনি ধরে বলল,
“তুমি ভাবছো আমি কেন না করে দিয়েছি? দেখো, এরেঞ্জ ম্যারেজ মানেই মেয়ে দেখা-দেখি। আন্টি আমাকে পছন্দ করেছেন, আমি তার স্টুডেন্ট ছিলাম সেই ক্ষেত্রে। আর তোমার ননদ পুষ্প, আমার খুব ভালো ফ্রেন্ড। আর আমি না করেছি, কারণ আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি। উজ্জ্বল সাহেব অনেক ভালো মানুষ। একজন সাকসেসফুল লয়ার। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কেইসটা উনিই নিয়েছিলেন। উজ্জ্বল সাহেব আমার বন্ধু ছিলেন না। কিন্তু আমার অনেক বড় উপকার করেছেন। আমি খুব একটা সাহসী ছিলাম না। আমার মাঝে যেই বোল্ড আহি লুকিয়ে ছিল, সেটা উনিই দেখিয়েছেন। আরো দু’জন মানুষ আছে। নায়ীব ভাইয়া আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রাদ।”

কথাটি বলেই আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চয়নিকা উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বলল,
“আপু, আপনার উপর আস্থা আছে। নিশ্চয় ভালো হবেন উজ্জ্বল।”

উজ্জ্বল ফোনে কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। চয়নিকা তার দিকে এগিয়ে গেলো। উজ্জ্বল ফোন রেখে চয়নিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। চয়নিকাও পালটা হাসি ফেরত দিলো। তখনই পুষ্প মাঝখানে এসে বলল,
“বিয়ের আগে নো কথাবার্তা।”

কথাটি বলেই চয়নিকাকে টেনে নিয়ে গেলো সে। উজ্জ্বল কপাল চুলকে হাসছে। আহি তাদের চোখাচোখি দেখে হাসতে লাগলো। মনে মনে বলল,
“খুব মনে পড়ছে তোকে, রাদ। খুব বেশি। হুট করে হারিয়ে গেলি তুই। কেন বলেছিলি সেদিন, আমার হাসি দেখতে দেখতেই মরে যাবি? এখনো সেই বাক্যটা আমার কানে বাজে। তোকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না। তুই আমার মেডিসিন ছিলি। আর এখন মেডিসিন ছাড়াই আমি বেঁচে আছি। কেউই চলে যাওয়া মানুষটিকে ভুলতে পারে না, কিন্তু তাকে ছাড়া চলতে শিখে যায়। সত্যি রাদ, খুব মিস করছি তোকে আজ। দেখছিস রাদ, আমার জীবনে সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। শুধু তুই নেই আমার পাশে।”

(***)

মেঘলা আকাশ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে এ আর টি গ্যালারি ছেয়ে গেছে। একটু আগেও গেটের বাইরে জ্বলছিল সোডিয়াম বাতি। হুট করে বন্ধ হয়ে গেলো সব ক’টা। গ্যালারির ভেতর ছোট একটা রুম। রুমটি ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে একের পর এক মোমের আলোতে। আহি দেয়ালের তাকের উপর একের পর এক মোম বসিয়ে সেগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গ্রিল বিহীন খোলা জানালা। আহি জানালা খুলে দিলো। বাইরে এক নজর চোখ বোলালো। শহরে হয়তো বিদ্যুৎ নেই। অবশ্য খবর পেয়েছে সে। কয়েক ঘন্টা এই এলাকায় বিদ্যুৎ থাকবে না। অন্য ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু আহি এই মুহূর্তে নিস্তব্ধতা চাইছে। চাইছে অন্ধকার ঘর। তাই কৃত্রিম ব্যবস্থা বন্ধ রাখলো সে।
বর্ষার মাস শুরু হয়েছে অনেক দিন হলো। এক সপ্তাহ টানা বৃষ্টির পর, আজ একটু বিশ্রাম নিচ্ছে মেঘেরা। আহি জানালার পাশ থেকে সরে তার ইজেলের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইজেলের উপর রাখা ক্যানভাসে অর্ধেক রঙ মাখানো। ভিন্ন একটা ছবি আঁকছে সে। আলো-আঁধারির ভিন্ন রূপের মিশ্রণে আঁকবে একটা ছবি। আহি মোটা ব্রাশ হাতে নিলো। মনোযোগ দিয়ে রং মেশাতে লাগলো। হঠাৎ আহি থমকে গেলো। নিস্তব্ধ ঘরে কারো পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। গ্যালারিতে কেউ হাঁটছে। কে এসেছে এই অসময়ে? গ্যালারির বাইরে রহমান, এ আর টি গ্যালারির নাইট গার্ড। আহি ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়িতে দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। ঠিক দশটায় রহমান বিরতি নেয়। রাতের খাবার খেতে যায়। পাশেই তার বাড়ি। যাওয়ার আগে বাইরের গেট লাগিয়ে দিয়ে যায়। তাহলে কি রহমানের অনুপস্থিতিতে কেউ গেট টপকে ভেতরে এসেছে? গ্যালারিতে কোনো দামি জিনিস নেই। দামি জিনিস মাসে একবারই গ্যালারিতে এনে রাখা হয়। সেদিন গার্ডের সংখ্যাও বাড়ে। কিন্তু আজ কে এসেছে? আহি পাশের টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে হাত মুছলো। হঠাৎ সে অনুভব করলো রুমের দরজাটা খুলে গেছে। ক্যানভাসের পাশের টুলে কাঁচি রাখা। আহি কাঁচিটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। হাতে তুলে নেওয়ার জন্য কাঁচিটির দিকে হাত বাড়াতেই সেই পরিচিত পারফিউমের গন্ধটি নাকে এসে ঠেকলো। আহির হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেলো। অস্ফুটস্বরে বলল,
“আফিফ!”

আহির অনেকটা কাছেই এসে গেছে মানুষটি। নিস্তব্ধ ঘরে নিঃশ্বাসের শব্দ বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আহি তবুও কাঁচিটা হাতে নিলো। একই পারফিউম তো অনেকেই ব্যবহার করতে পারে। আহি পেছন ঘুরতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফকে দেখেই কাঁচিটা হাত থেকে পড়ে গেলো তার। ফাঁকা ঘরে কাঁচি হাত থেকে পড়ার শব্দ বেশ কানে লাগলো। আফিফ নিচের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি ভেবেছিলে?”

আহি বলল, “যা-ই ভাবি, তুমি আসবে ভাবি নি।”

“এসে তো গেছি।”

আহির নিঃশ্বাস আটকে গেলো যেন। এসে তো গেছি, বাক্যটা বুকে এসে বিঁধেছে তার। ইচ্ছে করছিলো আফিফের হাত ধরে বলতে,
“আমাকে ফেলে আর যেও না, এআর। থেকে যাও। আমার হয়ে যাও।”

আহি নিজেকে সামলে নিলো। মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“ভেতরে কীভাবে এসেছো?”

“তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। দারোয়ান আসতে দিচ্ছিলো না। কিন্তু আমার সাথে লিনাশা আর নায়ীব এসেছিল। তাই ঢুকতে পেরেছি। আমি প্রথমে তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তুমি ওখানে ছিলে না। লিনাশা আর নায়ীব আমাকে দেখলো। তারাই গাড়ি নিয়ে আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছে। দারোয়ান হয়তো লিনাশাকে চেনে।”

“হ্যাঁ।”

আফিফ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। আহি ক্যানভাসটি ইজেল থেকে নামিয়ে রেখে বলল,
“কাল আমার এনগেজমেন্ট। আমাকে বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে হবে।”

“তো এখানে কি করছিলে?”

“মন ভালো নেই, তাই ছবি আঁকতে এসেছি।”

“তুমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করছো, তাই না!”

আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার কি মনে হয়, আমি সব বাধ্য হয়ে করি তোমার মতো?”

আহি আফিফকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে আফিফ তার হাত ধরে ফেললো। আহি আফিফের চোখে চোখ রাখতেই আফিফ চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে কথা আছে আমার।”

আহি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“বললাম না, সময় সুযোগ সব শেষ।”

আফিফ আহির দু’বাহু ধরে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“এভাবে বলো না, প্লিজ। অনেক সাহস নিয়ে এসেছি।”

“কেন, বীরপুরুষের সাহস এতোদিন কোথায় ছিল?”

“সরি, রিয়েলি ভেরি সরি, আহি।”

“ডোন্ট বি সরি, আফিফ। তুমি তোমার প্রায়োরিটি চুজ করেছিলে।”

“তুমিই আমার…”

থমকে গেলো আফিফ। আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“এভাবেই থেমে যাবে তুমি। মাঝপথে এভাবেই থেমে যাবে।”

আহি আফিফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই আফিফ টাল সামলাতে না পেরে পাশের ছোট টুলের সাথে ধাক্কা খেলো। টুলটি হালকা ছিল। আফিফের গায়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে সেটা উল্টে নিচে পড়ে গেলো। আর সাথে সাথেই টুলের উপর রাখা রঙগুলো পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। আফিফ মেঝেতে রঙ ছড়িয়ে যেতে দেখে বলল,
“রিয়েলি সরি, আহি।”

আহি কিছু বলার আগেই আফিফ ব্যস্ত হয়ে রঙের বোতলগুলো তোলার জন্য সামনে পা বাড়াতেই রঙের উপর পা পড়লো তার। আর সাথে সাথেই পিছলে পড়লো সে। আহিও মুহূর্তে তার হাতে টান অনুভব করলো। আফিফ নিজেকে পিছলে পড়া থেকে বাঁচানোর জন্য আহির হাত ধরে ফেলেছিলো। এবার দু’জনই মেঝেতে পড়ে গেলো। আফিফের পাশেই আহি উপুড় হয়ে পড়েছে। আফিফের পিঠে লেগেছে খুব। সে পিঠ আঁকড়ে ধরে বলল,
“আহি, তোমার কি খুব লেগেছে?”

আহি দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে আফিফের দিকে তাকাতেই দেখলো আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। আহি ব্যস্ত হয়ে উঠে আফিফের পিঠে হাত রাখলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“ইশ, ব্যথা পেয়েছো?”

এরপর সে আফিফের হাতে হালকা চাপড় মেরে বলল,
“এতো অদ্ভুত কেন তুমি?”

আফিফ চোখ খুললো। আহির চুলগুলো সব তার মুখে এসে পড়েছে। আফিফ হাত দিয়ে তা সরাতেই আহি চুলে টান অনুভব করলো। বিরক্ত মুখে সে আফিফের দিকে তাকাতেই থমকে গেলো। দু’জনই মুখোমুখি। আফিফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, যা মোমের আলোয় চিকচিক করছে। আহির হঠাৎ কি হলো, সে আফিফের গালে হাত রাখলো। আহির হাতে রঙ মাখানো ছিল। আফিফের গালে লেগে গেলো সবটাই। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এমন কেন তুমি?”

আফিফ চোখ বন্ধ করলো। আহি আফিফের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ভিজে আসছে তার। এতোটা কাছ থেকে আফিফকে অনুভব করার অনেক বছরের ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে তার। আহির চোখ বেয়ে হুট করেই অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আফিফ সাথে সাথেই চোখ খুললো। আহির কোমড় আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। আহি আরেকটু ঝুঁকে আফিফের আরো কাছে চলে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশ উন্মাদ করে দিচ্ছে এক উন্মাদ প্রেমিকাকে। আহির অস্থিরতা আফিফের শরীরে প্রবেশ করলো। সে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহিও আফিফের ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। আফিফ আহির চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। আহির ফুঁপানোর বেগ আরো বাড়ছে। আফিফ এবার আহিকে সরিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিলো। এক হাতে ভর দিয়ে আহির দিকে ঝুঁকে আহির চোখ মুছে দিলো। আহি আফিফের হাত ধরে বলল,
“বেশি দেরী করে ফেলেছো তুমি! অনেক বেশি।”

আফিফ এবার আহির গালে হাত রাখলো। আর সাথে সাথেই হাত সরিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালো সে। তার হাতেও রঙ লেগে আছে। আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তোমার স্পর্শ পাওয়ার স্বপ্ন আমার অনেক বছরের পুরোনো।”

আফিফ কথাটি শুনেই আবার আহির গালে হাত রাখলো। আহি চোখ বন্ধ করলো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই আফিফ তার ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে দিলো আহির চোখের দিকে। আফিফের নিঃশ্বাসের ধাক্কা লাগলো আহির কপালে। খামচে ধরলো সে আফিফের শার্ট। আফিফ থেমে গেলো। আহি চোখ খুলে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ তাকিয়ে আছে তার দিকে। আহি বেশ লজ্জা পেলো। চোখ নামিয়ে নিলো সে। আফিফ তার অন্য হাতে ভর দিয়ে উঠে বসতে যাবে, কিন্তু তার হাত মেঝেতে পড়ে থাকা রঙের উপর পড়ায় হাত পিছলে সে আহির উপর এসে পড়লো। তার ওষ্ঠদ্বয় এসে ঠেকলো আহির থুতনিতে। আর আফিফের নাক স্পর্শ করলো আহির অধর। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো দু’জনই। থমকে গেলো কয়েক মিনিটের জন্য। ভারী হয়ে আসছে উভয়ের নিঃশ্বাস। আহি মুখ সরিয়ে নিলো। চুলগুলো আছড়ে পড়লো মেঝেতে। উন্মুক্ত হলো আহির ঘাড়। আফিফের চোখ আটকালো সেদিকেই। চোখ বন্ধ করে নিলো সে।

হঠাৎ দমকা হাওয়া জানালা গলে ভেতরে ঢুকলো। বেশ কয়েকটা মোম নিভিয়ে দিলো এক ধাক্কায়। আরো অন্ধকার হয়ে গেলো রুমটা। আফিফ অনুভব করতে লাগলো অদ্ভুত আকর্ষণ। পুরো ঘর হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য আলোকিত হলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেকেন্ডের মধ্যেই শব্দটা শোনা যাবে। আলোর ঝলকানিই বুঝিয়ে দিচ্ছে শব্দটা খুব জোরে শোনা যাবে। আলো রুমে ঢুকতেই আহি আফিফকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। এরপর বেশ জোরেই শব্দ হলো। আফিফ আহির ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ পেলো আহির তৃষাতুর মন। আহিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আফিফ। তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আহির গালে লাগলো। এমন মিষ্টি স্পর্শে আহি মুচকি হাসলো। আফিফের কাঁধে তার অধর ছোঁয়ালো। আফিফ মিনিট খানিক পর আহির গলায় আলতো করে হাত রাখলো। রঙ লাগিয়ে দিলো আহির গলায়, কাঁধে, ঘাড়ে। এরপর উঠে বসলো আফিফ। আহির কোমড় ধরে টেনে উঠালো। আহি উঠে বসে আফিফের বুকে মাথা রাখলো। আফিফ এবার আহির গালে অধর ছোঁয়ালো। আহি তার বুকে মুখ গুঁজে বলল,
“মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।”

আফিফ আহির কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“স্বপ্ন নয়, এটা সত্যি। আহি, ভালোবাসি।”

আহি আফিফের চোখের দিকে তাকালো। মেঝে থেকে সাদা রঙ তুলে আফিফের গালে লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার প্রিয় রঙ!”

“ভালোবাসি, আহি।”

আহি মুচকি হাসলো। আহি আশেপাশে তাকালো। আরেকটু দূরে হলুদ রঙের কৌটা। আহি সেটা নিয়ে আফিফের সামনে বসে তার কপালে রঙ লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার প্রিয় ফুল, অলকানন্দা।”

“ভালোবাসি, আহি। ভালোবাসি তোমাকে।”

আহি আফিফের কপালে কপাল ঠেকালো। তার গালে গাল লাগিয়ে বলল,
“তোমার সব প্রিয় জিনিস আমার প্রিয়।”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি, আহি।”

আহি মুচকি হাসলো। আহি এবারও উত্তর দিলো না। আফিফ আহির দিকে এগিয়ে এসে তার অধরে অধর ছোঁয়ালো। আহি চমকে উঠলো। আফিফ বলল,
“ভালোবাসি, আহি।”

আহি বলল,
“আমি গত চৌদ্দ বছরে যতোবার এই বাক্যটা উচ্চারণ করেছি, তোমার কয়েক মিনিটে বার-বার বলাতেও সেটা গ্রহণযোহ্যতা পাবে না।”

“তাহলে কি করবো আমি?”

“তুমি জানো না, আমি কি চাই?”

আফিফ নিশ্চুপ। আহি আফিফকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আফিফও সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে আহির হাত ধরে বলল,
“উজ্জ্বলকে বিয়ে করো না, আহি।”

আহি অন্যদিকে ফিরে মুখ চেপে হাসলো। আফিফ আবার বলল,
“কিছু তো বলো! অস্থির লাগছে আমার।”

আহি আফিফের দিকে ঘুরে বলল, “কেন অস্থির লাগছে?”

“ভালোবাসি তাই।”

আহি অবাক কন্ঠে বলল, “হঠাৎ ভালোবেসে ফেললে?”

“আগেও তো বাসতাম।”

“আগে তো অস্থির লাগে নি!”

“লাগতো। কিন্তু আমি বলতে পারি নি।”

“কেন?”

“সাহস ছিল না।”

“এখন এতো সাহস হয়ে গেছে, আমার গ্যালারিতে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছো?”

আফিফ আহির হাত ছেড়ে দিলো। অস্থিরতা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আহির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো আফিফ। জড়িয়ে ধরলো আহির কোমড়। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আমাকে বকো, যা ইচ্ছে বলো। হ্যাঁ, আমি মানছি আমি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেও না, আহি। উজ্জ্বলকে বিয়ে করো না। আমার হাতটা ধরো। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে তোমাকে ভালো রাখবো।”

আহি আফিফের চুলে হাত ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
“সময়-সুযোগ শেষ।”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আহির হাত ধরে বলল,
“প্লিজ, প্লিজ আহি। এভাবে বলো না।”

আহি আফিফকে সরিয়ে দিয়ে সামনে পা বাড়ালো। আফিফ আহির পিছু পিছু আসতে লাগলো। আহি হাসছে মনে মনে। গ্যালারির সাদা মেঝেতে দু’জোড়া পায়ের ছাপ পড়ছে। আহি ঘুরছে পুরো গ্যালারিতে। আর আফিফ তার পিছু নিচ্ছে। কিন্তু ধরতে পারছে না আহিকে।

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৫৭+৫৮

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৭||

১১৯।
ডায়েরীর প্রতিটি পাতায় স্কেচ। কোথাও খোলা মাঠে বসে একটা ছেলে ছবি আঁকছে, আর তার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে বোতল থেকে পানি খাচ্ছে, পাশে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটির দৃষ্টি ছেলেটির দিকে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। কোথাও বা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা একটি ছেলে, অন্যদিকে সেই ছেলের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে।
আহি চারুশিল্পে এমন কোনো বৃহস্পতিবার, শুক্রবার যায় নি, যেদিন আফিফকে ডায়েরীতে ধারণ করে নি। তারিখসহ লেখা আছে৷ প্রতিদিন আফিফের পিছু নেওয়া ছাড়াও, সপ্তাহের বাকি দিনেও টুকিটাকি আফিফকে নিয়ে লেখায় পুরো ডায়েরীর অর্ধেক পাতা ভর্তি। আফিফের চোখে পড়ছে ছোট ছোট বাক্য। কোথাও লেখা,
“এআর, এই ভালোবাসার নাম কি দেওয়া যায়?”

কোথাও লেখা,
“ভালোবাসি, প্রিয় এআর। ইচ্ছে করছে তোমাকে বসিয়ে রাখি আমার সামনে।”

কোথাও বা লেখা,
“কি সুন্দর করে আকাশ দেখো তুমি! আমাকেও একটু দেখো ওভাবে।”

প্রতিটি বাক্য পড়েই আফিফের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। অদ্ভুত ভাবে অশ্রুও ভীড় করছে চোখের কোণে। শার্টের হাতায় মুছছে সে। বেয়ে পড়ার সুযোগ দিচ্ছে না।

ডায়েরীর অনেক পাতা পড়ার পর আফিফ হঠাৎ থমকে গেলো একটি পৃষ্ঠায় এসে। আহি বিভিন্ন মাধ্যমে আফিফের ছবি এঁকেছে ক্যানভাসে। আর সেই ছবিগুলো বের করে ডায়েরীতে আঠা দিয়ে লাগিয়েছে। কিছু কিছু ছবি চারুশিল্পে পড়া অবস্থায় এঁকেছে। আর কিছু কিছু ছবি এঁকেছে পদ্ম আর আফিফের বিয়ের পর। ছবিগুলোর মধ্যে এক্রাইলিক পদ্ধতিতে আফিফের ছবি আঁকার একটি মুহূর্ত এঁকেছে। জলরঙ দিয়ে দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার একটি মুহূর্ত এঁকেছে। সবচেয়ে চমৎকার একটা ছবি ছিল অস্বচ্ছ জলরঙের মিশ্রণে আফিফের মোটর সাইকেলের উপর বসে থাকা। কক্সবাজারে আফিফের সমুদ্র দেখার একটা তৈলচিত্রও এঁকেছে আহি। প্যাস্টেল রঙের ধারণ করেছে মাস্টার্সের ক্লাসে একা একা বসে থাকা। কাঠের উপর আফিফের খোঁদাই করা ছবি, ফটোরিয়্যালিজমেও আফিফকে আঁকা বাদ যায় নি তার। এসব দেখে আফিফের বুক ভারী হয়ে এলো।
কয়েক পৃষ্ঠা পর আফিফের চোখ আটকে গেলো আহির একটি লেখায়। আহি লিখেছে,
“আজ থেকে আমার প্রিয় রঙ হয়ে গেলো সাদা। এতোদিন ধূসর বেগুনি ছিল আমার পছন্দের রঙ। কিন্তু এখন আমি শুধু সাদা জামায় পছন্দ করি। প্রতি সপ্তাহে সাদা জামা পরেই চারুশিল্পে যাচ্ছি, অন্তত এআরের দৃষ্টি আকর্ষণের লোভে। কিন্তু সে তো আমাকে দেখেই না। ইশ, রং যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে তাকে গিয়ে বলতো, দেখো আফিফ। মেয়েটা তোমার জন্য বেরঙিন হয়েছে। তুমি কি তার জীবনটা রাঙিয়ে দিতে আসবে না?”

আফিফ এতোটুকু পড়েই মলিন হাসলো। চোখ মুছে মনে মনে বলল,
“সরি, তোমাকে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আমি তোমার পাশে ছিলাম না। নিজেকে এতোদিন তোমার অযোগ্য মনে হয়েছিল। এখন তো মনে হচ্ছে তোমার মুখোমুখি দাঁড়ানোরও কোনো যোগ্যতা নেই আমার।”

আফিফ পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখলো ডায়েরীতে কয়েকটা অলকানন্দা ফুলের পাপড়ি আঠা দিয়ে লাগানো। তার মাঝখানে লেখা,
“এআর, সেদিন দেখলাম তুমি অলকানন্দা ফুলের চারা কিনছো। আমি আগে কখনো এই ফুল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। সেদিন চিনেছি। এটাও জানলাম, অলকানন্দা তোমার প্রিয় ফুল। জানো, এখন আমার বাগানে এতো এতো অলকানন্দা গাছ! আমি তোমার মাঝে এতোটাই ডুবে গেছি যে তোমার প্রিয় ফুল স্পর্শ করেই আমার সকাল শুরু হয়। আমার খুব ইচ্ছে তোমার ফুল হওয়ার। তোমার অলকানন্দা হওয়ার। অন্তত আমাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেই হবে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো আফিফ। পরের পৃষ্ঠায় যেতেই আফিফ খুব বড়সড় ধাক্কা খেলো। এমন কিছু সে কখনো কল্পনা করে নি। সেখানে লেখা ছিল,
“তোমাকে তো স্পর্শ করা যায় না। আমার কল্পনায় তুমি যাওয়া আসা করো। আর এভাবে দ্বিমাত্রিক ছবি এঁকে আমি তোমাকে অনুভব করতে পারছি না। মনে হচ্ছে তুমি অনেক দূরে। আমার এবার একটু সম্রাট শাহজাহান হতে ইচ্ছে করলো। সম্রাট যেমন তার প্রেমের সাক্ষী রূপে তাজমহল বানিয়েছে। আমিও একই কাজ করে ফেলেছি। কি করেছি জানো? হুম, তোমার ভাস্কর্য বানিয়েছি। একদম তোমার প্রতিরূপ। সাদা শার্ট সেই ভাস্কর্যের গায়ে। একটা অলকানন্দা ফুল গুঁজে দিয়েছি খাঁজ কাটা পকেটে। তোমাকে স্পর্শ করার এটাই একমাত্র সুযোগ। এআর, এখন তুমি শুধু আমার। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকার শুধুই আমার।”

আফিফ ডায়েরীটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত তিনটা। ইচ্ছে করছে আহির নম্বরে একবার ডায়াল করতে। এখনো কি এভাবেই আহি তাকে ভালোবাসে? তার কি আহির সাথে একবার কথা বলা উচিত?

(***)

এক্সিভিশনের আগে জায়গা খুঁজে আফিফের জন্য নিজেকে সাজিয়ে ছবি তোলার ঘটনাগুলোও ডায়েরীতে লিখেছে আহি। কিন্তু এরপর অনেকদিন আহি ডায়েরীতে হাত দেয় নি। পরের বার লিখেছে, আফিফের কার্ড রিজেকশনের ঘটনা। লেখাগুলো পড়তেই আফিফের গলা কাঁপছে। আহি লিখেছে,
“এভাবে না করে দিলে আমাকে? জানো, খুব কেঁদেছি আমি। আচ্ছা, আমি দেখতে কেমন ওটাও কি জানতে ইচ্ছে করে নি? খুব রাগ হচ্ছে আমার। তোমার ভাস্কর্যটা জড়িয়ে ধরে কতো বার করে বললাম, আমার ভালোবাসা মেনে নাও। আমি তোমাকে খুব সুখে রাখবো। কিন্তু তুমি তো শুনলেই না। মুভিতে দেখায় না, নায়িকা কিছু ভাবছে, আর নায়ক অনুভব করছে। আচ্ছা, বাস্তবেও এমন হয় না কেন? একটু কি বুঝবে না আমার অনুভূতি। গলায় কথা আটকে যাচ্ছে আমার। কলম চলছে না। কিন্তু এসব তো তুমি সামনে থাকলেই বুঝতে। চার দেয়ালের ফাঁকে আমার আর্তনাদ কেউ শুনছে না। কতোবার কলম হাত নিয়ে রেখে দিচ্ছি। লিখতে গেলেই কান্না পাই। কথা বললেই গলা কাঁপে। মা বুঝেছে আমি কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে না। মা-বাবাও হ্যাপি না। আমিও হ্যাপি না। আমি মায়ের মতো কষ্ট পেতে চাই না। আমি তোমার ভালোবাসা চাই। আমাকে একটু ভালোবাসো, প্লিজ। কি করবো আমি?”

এতোটুকুই লিখেছে আহি। আফিফ বুঝতে পারলো এতোটুকু অসমাপ্ত লেখা। আহি আরো কিছু লিখতো। কিন্তু পারে নি। হয়তো সেদিন বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল। হয়তো ভাস্কর্যটির সামনে সারারাত দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে বলেছিল, আমার ভালোবাসা মেনে নাও। এসব ভাবতেই নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে আফিফের। পরের পৃষ্ঠায় কি থাকবে আফিফ জানতে চাচ্ছে না। এতোটুকু পড়েই তার কষ্ট হচ্ছে, বাকীগুলো কীভাবে পড়বে?

তারপরের বিশ পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল আহির আফিফকে একা একা অনুভব করার ঘটনা। আফিফের রিজেকশনের পর আড়াই বছর আহি আফিফের পিছু করেছে। কখনো আফিফের ক্যাম্পাস, কখনো ফেইসবুকের ছবিগুলো ছাপিয়ে বের করা বা স্কেচ করা, কখনো আফিফের টাইমলাইনে লেখা ছোট ছোট স্ট্যাটাসের দেয়ালিকা তৈরী করার ঘটনা। বিশ পৃষ্ঠার পরের পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, সেই ভয়ংকর রাতের মুহূর্তটি। উপরে খুব সুন্দর করে আহি লিখেছে,
“আমার এআরের বিয়ে তার পদ্মফুলের সাথে।”

আফিফ আর পড়তে পারবে না। এতোটুকু বর্ণনায় যদি তার বুক কাঁপিয়ে দেয়, তাহলে পরের গুলোতে কি হবে। ডায়েরী রেখে দিলো আফিফ। মেঝেতে শুয়ে পড়লো সে। নীরবে কাঁদলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো তার। অপরিচিত নম্বর। ঘড়ির দিকে তাকালো আফিফ। ফজরের আযান দেবে একটু পর। আফিফ কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো পদ্মের কণ্ঠ।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৮ (১ম ভাগ)||

১২০।
পদ্মের কন্ঠ শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আফিফের। এমনিতেই আহির ডায়েরীটা পড়ে মন ভালো নেই, তার উপর আহিকে হারিয়ে ফেলার মূল কারণ পদ্ম এখনো তার পিছু ছাড়ছে না। এই মুহূর্তে পদ্মকে তার উপদ্রব মনে হচ্ছে। পদ্ম ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“আফিফ, মা আমাকে আজ ভীষণ মেরেছে। আমাকে একটু বাঁচান। জানি, আমি আপনার অপরাধী। কিন্তু এতোটাও তো খারাপ নই যে আমাকে এমন বিপদ থেকে বাঁচাতে আসবেন না।”

আফিফ গম্ভীর সুরে বলল,
“তুমি যদি তাজওয়ারের মতো নরপশুর মার খেয়ে আমাকে ফোন করতে তাহলে ভেবে দেখতাম। কিন্তু তুমি এখন তোমার অভিভাবকের হাতে। ওরা তোমার ভালো তোমার চেয়ে বেশি বুঝবে। মার খেয়েছো, বুঝে নাও ভালোর জন্যই খেয়েছো।”

কথাটা বলেই আফিফ কল কেটে দিলো। ওপাশে পদ্ম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার অপরাধের শাস্তি সে পাচ্ছে। আফিফকে হারিয়ে ফেলায় তার শাস্তি। কিন্তু কখনো যদি আফিফ সংসারী হয়ে যায়? তখন তো চাইলেও আফিফকে পাওয়া সম্ভব না৷ এখন যেহেতু তালাক হয়ে গেছে, আফিফকে দ্বিতীয় বার পাওয়ার একমাত্র সুযোগ, অন্য কাউকে বিয়ে করে তার কাছ থেকে তালাক নেওয়া। পদ্ম মনে মনে ভাবছে,
“বাবা যে প্রস্তাবটা এনেছে আমি কি তাহলে সেই লোকটাকে বিয়ে করে নেবো? তারপর না হয়, তাকে ছেড়ে দিলাম। এরপর আফিফের সাথে আবার বিয়ে হবে।”

এমন ভাবনা আসতেই পদ্মের মন ভালো হয়ে গেলো। পদ্ম ভুলেই গেলো আবেগের তাড়নায় অবাস্তব চিন্তা করছে সে।

(***)

“ভাবতেই পারি নি সেদিন আমাকে জীবনের এতোটা ভয়ংকর অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে। বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক দিন। আমি একা থাকি। বাবা দেরী করে বাসায় আসে। আমার জীবনে কোনো সার ছিলো না। কোনো আনন্দ ছিল না। লিনাশা ছিল হাসির কারণ। সেও নেই এখন। কেউ নেই। সবাই চলে গেছে আমাকে ফেলে। এই মুহূর্তে আমার শরীরে জ্বর প্রায় ১০২ ডিগ্রী। আমি ডায়েরী লিখছি এমন অবস্থায়৷ গত কয়েক সপ্তাহে আমার জীবনে অদ্ভুত ঝড় বয়ে গেছে। আর এতো ঝড়-ঝাপটার কাছে ১০২ ডিগ্রী জ্বর খুবই হাস্যকর। বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়াটা আমার ভাবনার মধ্যে ছিল। বরং তাদের বিচ্ছেদ না হওয়াটাই আমাকে ভাবাতো। ভাবতাম মা কিভাবে এতো কম্প্রোমাইজ করছে? কিভাবে সহ্য করছে বাবাকে? এখন তো বুঝতে পারছি, বাধ্য হয়েই করেছে। যেমন আমাকে কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে, সত্যটা বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে। বর্ষার রাত। পদ্মের বিয়েতে আমি একাই গিয়েছি। দেখলাম পদ্মকে নিতে তার বর এসেছে। পদ্মের দিকে হাত এগিয়ে দিলো মানুষটা। আমি থমকে গেলাম তাকে দেখে। আমার ভালোবাসার মানুষ, পদ্মের বর। আক্দ আরো অনেক মাস আগেই হয়ে গিয়েছিল। এখন তো পদ্মকে নিয়ে যাবে। সরি, পদ্ম না। পদ্মফুল। এখন তো পদ্ম আমার কাছে পদ্মফুল। যেই সম্বোধন তার, সেই সম্বোধন আমারও হওয়া উচিত। তার ভালো লাগার সবকিছুকেই নিজের ভালো লাগা ভেবে নিয়েছিলাম। পদ্মকে যদি ফুলের মতো না দেখি, তাহলে হিংসে হবে। ঘৃণা জন্মাবে। কেন শুধু শুধু তার প্রিয় মানুষকে নিজের অপ্রিয় করবো? তার প্রিয় রং, তার প্রিয় ফুল, তার প্রিয় সবটাই যেহেতু আমার প্রিয়, তবে তার প্রিয় মানুষটা কেন আমার প্রিয় হবে না? সেদিন বর্ষার রাতে আমি তার আর পদ্মফুলের বিয়েতে গেলাম। যেই কন্ঠ শুনে আমার ফ্রেমে তুলে রাখতে ইচ্ছে হতো, সেই কন্ঠে শুনলাম, পদ্মফুল। যার স্পর্শ পাওয়ার লোভে ভাস্কর্য বানিয়েছিলাম, সেই মানুষটা ধরলো অন্য কারো হাত। তাদের বিয়ের খাবার গলা দিয়ে নামছিলো না। জোর করে খেয়েছি। কেঁদেছিও ভীষণ। পদ্মের বড় আপুকে বললাম, আমার ঝাল লেগেছে। আসলেই তো। ভীষণ ঝাল লেগেছে। আমার ভালোবাসা যাকে আমি মিষ্টি অনুভূতি ভাবতাম, সে আমাকে মরিচ লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। হা হা হা। হাসি পাচ্ছে খুব। হাসিটা শুনলে ভয়ংকর লাগবে। পাগলের হাসি। বিশ্রী হাসি। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি একটু আগে। মোটেও কম সুন্দরী নই আমি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে দেখলে মনে হবে মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা পাগল। আচ্ছা, তারপর বলি। কিভাবে যেন সেদিন আফিফ জেনে গেলো আমি সেই মেয়েটি। আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম, ওতো কিছু মনে পড়ছে না। হয়তো পদ্ম আমার পরিচয় দিয়েছিল। আমি তো এতোকিছু খেয়াল করি নি। আমার শুধু মনে আছে, তার হাসি হাসি চেহারায় আমার নাম শুনে গ্রহণ লেগেছিল। সে ভেবেছিল, আমি তার পদ্মফুলকে বলে দেবো, আমার ভালোবাসার কথা। তার সংসার ভেঙে দেবো। এরপর আমি তাকে সত্যটা সামনা-সামনি জানিয়েছিলাম। যা বুঝলাম, সে আমাকে চায় না। আমি তার জীবনে এক্সিস্টও করি না। চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো নিজের গালে। চলে এলাম বৃষ্টির মধ্যে। ভিজতে ভিজতে দামী লেহেঙ্গা কাঁদায় মাখামাখি অবস্থা। লেহেঙ্গাটা আমি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি। ব্যাড লাক সিম্বল রেখে কী লাভ? কাউকে দেবো না এই লেহেঙ্গা। কারণ আমি চাই না, আমার শত্রুও এমন ব্যাড লাকের মুখোমুখি হোক। বিভীষিকাময় রাত ছিল সেদিন। এরপর যখন জ্ঞান ফিরলো। একের পর এক ধাক্কা খেলাম। জানলাম আমি ব্রেইন স্ট্রোক করেছি। এরপর বাবা বিয়ে করলো লিনাশার বড় আপুকে। লিনাশার বাবা মারা গেলো। আমাদের বন্ধুত্বও ভাঙলো। সব হারালাম। আর এখন আমি বড়লোক ভিখারিনী। যার সব আছে, অথচ কিছুই নেই। কেউ আমাকে ঠকায় নি। আমার ভাগ্য আমাকে ঠকিয়েছে। তাহলে আমি কাকে অপরাধী বলবো? তবে আমার জীবনের এক অংশের জন্য আমি একজনকে অপরাধী ভাবতে পারি। লাবণি মেহেরা। সারাজীবন ঘৃণা করতে থাকবো তাকে৷ অন্য অংশের জন্য কাকে দায়ী করবো? আফিফকে হারিয়ে ফেলার জন্য কাকে দায়ী করবো আমি?”

এতোটুকু পড়েই আফিফ নিজের আলমারিতে যত্নের সাথে ডায়েরীটা রেখে দিলো। এরপর ওজু করে নিলো। নামাজে দাঁড়ালো। সেজদায় কাঁদলো অনেকক্ষণ। মোনাজাত ধরলো। চাইলো, যেটা সঠিক, যেটা সবার জন্য ভালো, সেটাই যাতে হয়। দিনশেষে আহি যাতে সুখী হয়। আর সেই সুখ আহি যার মাঝে খুঁজে পায়, তাকেই যাতে আহি জীবনসঙ্গী করে নেয়।

১২১।

ভোর ৬টা। আহি সবে মাত্র একটা ছবি এঁকে শেষ করলো। ছবি আঁকা শেষ করেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে। ভাবতে লাগলো কি নামকরণ করা যায় ছবিটির। অদ্ভুত এক ছবি। প্রথম দেখায় মনে হবে শুধু রং ছড়িয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে খুঁজে পাওয়া যাবে একটা স্যাঁতসেঁতে ডোবায় একটি মেয়ে চিত হয়ে ভাসছে। তার চুলগুলোও ভাসছে। চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা রঙের ফুল। আহি কালো কালি দিয়ে পাশে নিজের স্বাক্ষর করলো। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো কাচের আলমারির তাকে। খটকা লাগলো তার। তড়িৎ গতিতে আলমারি খুলে আশেপাশে ঘাঁটতে লাগলো। বিড়বিড় করে বলল,
“ডায়েরীটা তো এখানেই রেখেছি।”

আহির স্পষ্ট মনে আছে, কাল ওয়াসিফের কাছ থেকে নিয়ে ডায়েরীটা সে এখানেই রেখেছিল। আহি এবার পাশ ফিরে খেয়াল করলো তার ড্রেসিংয়ের টুলটা বাঁকানো। কাল আর আজ একবারো সে সেই টুলে বসে নি। তাহলে কি ওয়াসিফ নিজের সাথে তার ডায়েরীটাও নিয়ে গেছে? এমন সাংঘাতিক কাজ করবে ছেলেটা? আহি বিশ্বাস করতে পারছে না। সে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো তার ডায়েরী। রুমের বাইরে এসেও খুঁজলো। আহির নিজের নিরাপত্তার জন্য পুরো ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিলো। সাথে নিজের রুমেও লাগিয়েছিল। আহি ল্যাপটপ চালু করে গতদিনের ফুটেজ দেখলো। সত্যিই গতকাল আহি রুম থেকে বেরুতেই ড্রেসিংয়ের সেই টুল টেনে কাচের আলমারি খুলে সেই ডায়েরীটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছিল ওয়াসিফ। আহি ল্যাপটপ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অবশ্য এখানে বাচ্চাটারও দোষ নেই। হয়তো আহির ডায়েরী খুলে স্কেচগুলো দেখে তার আগ্রহ জন্মেছিল, তাই নিয়ে গেছে। আহির অস্থির লাগছে। এই ডায়েরীটা দেখেই সে অনুভব করে আফিফ তার আশেপাশে আছে। আহি এবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে ছয়টা বাজছে। এতো সকাল সকাল কাউকে ফোন দেওয়াটা অভদ্রতা। আহি অপেক্ষা করলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। সময়টা যাচ্ছেই না। এরপর রুমে এসে ঘড়িতে দেখলো সকাল সাতটা মাত্র। এই মুহূর্তে কান্না পাচ্ছে তার। ওয়াসিফের মায়ের নম্বর ফোনের ডায়াল লিস্টে আছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ফোন করতে। কিন্তু আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়ছে সে।

(***)

আহির ডায়েরীর অনেকাংশ জুড়ে লেখা আফিফের ভাস্কর্য আর আহির নিরব কথোপকথন। আহি প্রায়ই ভাস্কর্যটির সামনে বসে ডায়েরী লিখতো। এটাই শেষ সম্বল ছিল তার। কিন্তু একদিন সেটাও ভেঙে ফেললো আহির বাবা। পাগল প্রায় আহি ডায়েরীর পাতা উলটে আফিফকে বের করে আনতে চাচ্ছিলো। কিন্তু সে নিরুপায়। ভাস্কর্যের ভাঙা অংশগুলো হাতড়ে হাতড়ে কেঁদেছিল বেশ কয়েক ঘন্টা। লিনাশা এসে শান্ত করেছিল তাকে আর বলেছিল, সে না-কি বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। আফিফ এখন আর তার নেই। আহি সেদিনই চোখ মুছলো। দৃঢ় সংকল্প করল। কাঁদবে, তবে নিরবে। মানুষ যেহেতু তার ভালোবাসা, তার পাগলামো, এতোদিনের অপেক্ষাকে বেহায়াপনা বলছে, তাহলে কি দরকার তাদের এসব দেখানোর? আহি কাঁদলো না। বেশ মানসিক চাপ পড়লো তার মস্তিষ্কে। ফলাফলস্বরূপ আহির হ্যালুসিনেশন হতে লাগলো। ইউকে গিয়েও প্রায়ই আফিফের সাথে কথাবার্তা বলা। তাকে অনুভব করা। একা একা হাসা। সবটাই ডায়েরীতে লিখেছে আহি। আর আফিফ শক্ত হয়ে বসে শুধু পড়ছে সেই লেখাগুলো।

(***)

আহির দৃষ্টি ঘড়ির দিকে। ভদ্রতার মানদণ্ডে অপরিচিত কাউকে ফোন করার সময় সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা হওয়া উচিত। কিন্তু আহির জন্য দুই ঘন্টা অপেক্ষা করাই অনেক কষ্টকর ছিল। ঘড়িতে আটটা ছুঁইছুঁই হতেই সে ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলো নাওফা রেনুকার নম্বরে। প্রথম বার কল করলো, দ্বিতীয় বার করলো, তৃতীয় বার করলো, কিন্তু রিসিভ হলো না। পাগল পাগল লাগছে আহির। এবার তো সহ্যই হচ্ছে না তার। হাত কাঁপছে ভীষণ৷ ব্যস্ত পায়ে সে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। সালমা ফাওজিয়া আহিকে সকাল সকাল বের হতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাচ্ছো, আহি?”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আমার ডায়েরী! আমি তোমাকে এসে বলছি, মা।”

আহি বেরুতে বেরুতে আবার কল করলো সেই নম্বরে। এবার কলটা রিসিভ হলো। আহি কথা বলতে বলতেই গাড়িতে উঠলো।

(***)

“প্রিয়, বৃষ্টিস্নাত ফুল দেখেছো কখনো? ভীষণ স্নিগ্ধ লাগে দেখতে, তাই না? আজ না হয় আমার দিকেই তাকিয়ে দেখো। তোমার জন্য হলুদ শাড়ি পরে অলকানন্দা সেজে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মোড়ে। বৃষ্টিতে ভেজা আমাকে দেখে তোমার নিশ্চয় অলকানন্দার কথায় মনে পড়বে। আর তুমি নিশ্চিত আমার প্রেমে পড়বে। যেদিন তুমি আমার প্রেমে পড়বে, সেদিন থেকে আমিই হবো তোমার অলকানন্দা। আর এরপর যখন বৃষ্টি নামবে তুমি আমার হাত ধরে বৃষ্টি বিলাস করবে। করবে না বলো?”

আফিফ ডায়েরী বন্ধ করে ফোনটা হাতে নিলো। বসকে কল দিয়ে জানালো, আজ তার শরীর খারাপ আসতে পারবে না। অফিসে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা নেই তার। আফিফা বেগম নাস্তা খাওয়ার জন্য দরজায় ঠোকা দিচ্ছেন। আফিফ এক বাক্যেই বলল,
“মা, এখন খেতে পারবো না।”

এরপর আফিফ ডায়েরী খুললো। ইউকে থেকে ফিরে আহির চার বছর পর আফিফকে দেখা, বার-বার আফিফের মুখোমুখিতে আহির মানসিক অবনতি, মানসিক অস্থিরতা কাটানোর জন্য নায়ীবকে দেখানো, এরপর কক্সবাজারের পরিকল্পনা, আর আফিফ আর পদ্মকে একসাথে দেখে আরো বেশি আঘাত পাওয়া আর তাদের নিয়ে মধুচন্দ্রিমার আয়োজন করাটাও ডায়েরীতে লিখেছে আহি।

“এআর, তুমি হয়তো কখনোই আমার কল্পনায় আসবে না। তারা হয়ে গেলে যে। আজ থেকে আবার আমার অনুভূতিগুলো এই ডায়েরীতে স্থান পাবে। শোনো এআর, তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দিতে পারবো না। হয়তো এজন্য আমার তোমাকে নিয়ে দেখা অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো আহি। স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করবো না, তা তো হয় না। তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো পূরণ হবে, এআর। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করবো আজই। একটা স্বপ্ন ছিল আমার। সাগর পাড়ে তোমার সাথে সমুদ্র বিলাস করবো। এক রাতের জন্য একটা ছোট্ট সাজানো ঘর বাঁধবো সমুদ্র পাড়ে। আজ এই স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার কল্পনায় দেখা তুমিটা এবার বাস্তবে হাসবে। তোমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে তুমি সমুদ্র দেখবে। শুনবে সাগরের আর্তনাদ। তোমার চোখে আটকে থাকবে তোমার ভালোবাসার মানুষটির মিষ্টি হাসি। তোমার বুকে ঝাপটে পড়বে সে। সেই মানুষটা আসবে আজ। তোমার মনের মানুষ আজ তোমার মনের মতো করে সাজবে।”

এরপর চারটা পৃষ্ঠায় শুধু কলমের দাগ পড়েছে। চারটা পৃষ্ঠার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,
“আমার গায়ের গন্ধ লেগেছে বলে ফেলে দেবে তোমার টি-শার্টটা? আমি তো পরতে চাই নি। পদ্ম দিয়েছিল, তাই পরেছি। জানি, কোনো অধিকার নেই। কিন্তু যতোক্ষণ তোমার টি-শার্ট গায়ে ছিল, মনে হয়েছিল তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছো। তোমার আর পদ্মের সংসার দেখেছি আজ। ভীষণ সুন্দর সংসার। আমি এই সংসারে নজর দেবো না। চিন্তা করো না।”

দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা,
“তোমার স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতিটা আমাকে আজীবনের জন্য তোমার করে দিয়েছে, আফিফ। কাপ্তাইয়ে ঘটা আজকের প্রতিটি মুহূর্ত আমি মনে রাখবো। কারণ সেই মুহূর্তে তুমি আমার পাশে ছিলে।”

তৃতীয় পৃষ্ঠায় লেখা,
“সত্যিই কি তুমিও আমায় ভালোবাসতে, এআর? তাজওয়ার কেন বললো এ কথা?”

চতুর্থ পৃষ্ঠায় লেখা,
“এতোটা ঘৃণিত আমি? আমার চেহারাটাও দেখতে চাও না? আর তোমার চেহারা না দেখে যে আমি অস্থির হয়ে যায়? বেশ তো। আসবো না তোমার সামনে। আর কখনো লিখবোও না তোমাকে নিয়ে। তুমি তো চলে যাচ্ছো অন্য জায়গায়। এই শহরটা রেখে যাচ্ছো আমার জন্য। যেই শহরে তোমার সাথে প্রথম দেখা। আমার এক তরফা ভালোবাসার গল্প লেখা। আমার স্বপ্ন ভাঙা। আমার তোমাকে বার-বার হারিয়ে ফেলা।”

এরপরের সব পৃষ্ঠা খালি। অর্থাৎ আহি গত পাঁচ বছরে ডায়েরিতে আফিফকে নিয়ে কিছুই লিখে নি। আফিফ ডায়েরী বন্ধ করলো। আয়নার সামনে দাঁড়ালো। লাল হয়ে আছে তার চোখ দু’টি। তখনই বেল বেজে উঠলো। দু’বার বেল পড়তেই আফিফ মুখ ধুয়ে রুম থেকে বের হলো। এদিক-ওদিক তাকালো। বাসায় কি কেউ নেই না-কি? আফিফা বেগমও তখন বেরিয়েছেন। ছেলেকে দেখে বললেন,
“খুলছিস না কেন? আদ্য এখনো ঘুম। রেনু নাস্তা করে আবার শুয়েছে। আমিও শুয়েছিলাম।”

আফিফ বলল,
“আচ্ছা, আমি দেখছি কে এসেছে!”

আফিফ দরজা খুললো। সামনে তাকাতেই থমকে গেলো সে। আফিফের মুখোমুখি এলোমেলো দৃষ্টি জোড়াও যেন থমকে গেলো সামনের মানুষটিকে দেখে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলো উভয়েই। আফিফ অস্ফুটস্বরে বলল, “আহি!’

আহি কিছু বলতে পারলো না। অশ্রু ভীড় করলো তার চোখে। আবার কেন দেখা হলো মানুষটার সাথে? এখন কি আবার হারিয়ে ফেলবে তাকে?

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৮ (২য় ভাগ)||

১২১।
থমকে আছে মুহূর্ত। নিস্তব্ধ চারপাশ। কারো মুখে কথা নেই। আফিফকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আফিফা বেগম দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। আহি আফিফা বেগমকে দেখে সালাম করলো। তিনি সালাম নিয়ে আহিকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কে? তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি!”

আহি আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ ভেতরে ঢুকে গেলো। হাত কাঁপছে তার। অকারণেই ঘামছে সে। কপাল মুছে নিজের রুমের দিকে যেতেই রেনু বেরিয়ে এলো। সে আফিফকে জিজ্ঞেস করলো,
“কে এসেছে?”

আফিফের গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। রেনু ভাইয়ের চোখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বাইরে থেকে আহি বলল,
“ওয়াসিফের আম্মুর সাথে কথা বলা যাবে?”

রেনু আহির কন্ঠ শুনে দরজার কাছে যেতেই চমকে উঠলো। আহি রেনুকে দেখে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ওয়াসিফ ভুলে হয়তো আমার একটা ডায়েরী নিয়ে এসেছে। একটু এনে দিন। আমি চলে যাচ্ছি।”

আফিফ ওপাশে দাঁড়িয়ে আহির কথাগুলো শুনলো। এরপর রুমে ঢুকে ওয়াসিফের ব্যাগে আহির ডায়েরীটা ঢুকিয়ে দিলো। রেনু আফিফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আহির হাত ধরে তাকে ভেতরে ঢুকালো। আহিকে কিছু বলার সুযোগটাও দিলো না। আহি ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল,
“আমাকে ডায়েরীটা দিয়ে দিলেই আমি চলে যাবো।”

রেনু আহির কথার তোয়াক্কা না করে তাকে বসার ঘরে নিয়ে সোফায় বসালো। আফিফা বেগম রেনুর কান্ড দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। রেনু এবার আহির পাশে বসে বলল,
“এতো ফর্মালিটি কেন, আহি?”

আহি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফের মুখোমুখি হতে চায় নি সে। তবুও আজ তাকে আফিফের সামনে এসে দাঁড়াতে হলো। নিশ্চয় আফিফ বিরক্ত হয়েছে। মনটা খচখচ করছে আহির। রেনু আহির মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল,
“তোমার খোঁজ নিতে চেয়েছি। ভাইয়াকে কতোবার বললাম, তোমার সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু করলো না।”

আহি রেনুর দিকে তাকালো। মলিন হেসে বলল,
“আমার খোঁজ কেন নেবে? আমার জন্য তোমাদের জীবনে এতো ঝামেলা হয়েছে।”

আফিফা বেগম বলে উঠলেন,
“তুমিই সেই আহি? আমার এজন্যই তো তোমাকে চেনা চেনা লাগছিল, মা। তুমিই ওই মেয়ে যে মেয়েটা আমাকে ফোন করতো, আমার ছেলের খোঁজ নেওয়ার জন্য।”

আহি চকিত দৃষ্টিতে তাকালো আফিফা বেগমের দিকে। ওই মুহূর্তেই আফিফ ভেতর থেকে রেনুকে ডাকলো। রেনু উঠে চলে গেলো। আফিফা বেগম আহির পাশে এসে বসলেন। আহির হাত ধরলেন আলতো করে। চোখ চিকচিক করে উঠলো তার। কাঁদো কাঁদো মুখ। কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“আমি কতো চেয়েছি তুমি আমার ছেলের বউ হও। এতো মিষ্টি লাগতো তোমার কন্ঠ। বয়স হয়েছে, তাও আধো আধো মনে পড়ে।”

আহি হালকা হাসি ফেরত দিলো। আফিফা বেগমের কথাগুলো বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে তার। ওদিকে রেনু আফিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফ রেনুর হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এখানে আছে হয়তো!”

রেনু ব্যাগটা একপাশে রেখে বলল,
“ভাইয়া, চলো। সত্যটা জানাও।”

“কি জানাবো?”

“তুমিও ভালোবাসতে আহিকে।”

“না। কখনো না।”

“ভাইয়া, আহি তোমাকে এখনো ভালোবাসে।”

“তোকে কে বলেছে?”

“তুমি ওর চোখের দিকে তাকাও নি? যদি সত্যিই ভালোবাসা না থাকতো, তাহলে কেন এতো লুকোচুরি? তোমাকে আবার হারিয়ে ফেলার ভয় কেন ওর চোখে?”

“তুই জানিস না, আহি কি করে। ও অনেক ভালো ছেলে ডিজার্ভ করে। আমি ওর যোগ্য না।”

আফিফের চোখে অশ্রু টলমল করছে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আহিকে কোনো মানসিক চাপ দিতে চাচ্ছি না। এই মুহূর্তে আহি যদি জানে আমি ওকে ভালোবাসি, খুব স্বার্থপর শুনাবে কথাটা। যখন ওর আমাকে প্রয়োজন ছিল, তখন আমি কোথাও ছিলাম না। আর এখন ওর সব আছে। আমার এই মুহূর্তে ওর সামনে দাঁড়ানোরও যোগ্যতা নেই।”

“ভালোবাসায় যোগ্যতা দেখে না, ভাইয়া। তুমি যদি আহির ভালোবাসা বুঝতে এই কথা বলতে না। সব মেয়ের ভালোবাসা পদ্মের মতো না। কিছু মেয়ে স্বার্থহীন ভাবেও ভালোবাসে। যেমন আহি। এখন মনে হচ্ছে, আসলেই আহিকে বোঝার সেই যোগ্যতা তোমার নেই।”

আফিফ রেনুকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। এরপর দেয়ালে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“তুই বুঝবি না, রেনু। বুঝবি না আমার মধ্যে কি যাচ্ছে। আমি কতো বড় অপরাধী। আমি ওর পাশে ছিলাম না, যখন ওর একমাত্র আশ্রয় আমি মানুষটা হওয়া উচিত ছিলাম। শুধুমাত্র আমার জন্য, আমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে মেয়েটা এতো কষ্ট পেয়েছে। আমিই তো সব সমস্যার মূল। এখন তো আহি লিনাশাকেও পেয়েছে, ওর মা আছে। ক্ষমতা আছে ওর। যা ওর কাছে সেই সময় ছিল না। এই মুহূর্তে আমি ওর সামনে এসে যদি বলি, ভালোবাসতাম। স্বার্থপর শুনাবে কথাটা। অবশ্যই আমাকে বলবে, তখন কোথায় ছিল সেই ভালোবাসা? তখন কেন একলা ফেলে চলে গিয়েছিলাম? কেন পদ্মকে বিয়ে করে সংসার বেঁধেছিলাম? আহি কি বিশ্বাস করবে আমি সেই মুহূর্তে কতোটা অসহায় ছিলাম? যদি মনে করে মিথ্যে বলছি। আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। আর পদ্ম কি কখনো আহিকে বলবে, সে কতো বড় অন্যায় করেছে? পদ্ম না বলা পর্যন্ত আহি কি শুধু আমার কথায় বিশ্বাস করবে, আমি সেই মুহূর্তে কোন অবস্থায় গিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম?”

(***)

রেনু আহির সামনে এসে ব্যাগ থেকে ডায়েরীটা বের করতেই আহি সেটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রেনু বলল,
“একটু বসো।”

আহি ভেতরের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, আমি কাউকে বিরক্ত করতে আসি নি। আমি তো জানতামও না, এটা পদ্মের স্বামীর বাড়ি। ভালো থাকবেন আপনারা।”

রেনু আহির পথ আটকে দৃঢ় স্বরে বলল,
“এটা পদ্মের স্বামীর বাড়ি না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“তুমি জানো না, পদ্ম আর ভাইয়ার পাঁচ বছর আগে তালাক হয়ে গেছে?”

কথাটা শুনে আহি ভীষণ অবাক হলো। বিষ্ময়ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”

রেনু তার গলার উড়না সরিয়ে দিলো। আহি রেনুর ঝলসে যাওয়ার বুকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কীভাবে হলো এটা?”

“তুমি কি বিশ্বাস করবে আমার কথা?”

“কেন বিশ্বাস করবো না?”

“তোমার বান্ধবী পদ্ম আমাদের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে।”

পদ্ম কীভাবে ছল করে আফিফকে বিয়ে করেছে। কীভাবে রেনুকে নিয়াজীর সংসারে আটকে রেখেছিল। কীভাবে তাজওয়ারের সাথে মিলে আফিফ আর আহিকে আলাদা করেছে, সবটাই জানালো রেনু। আহি সব শুনে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। রেনু আহির পায়ের কাছে বসে বলল,
“আমার ভাইয়া আমার সামনে কাঁদে নি। মানুষটা এতোটা চাপা স্বভাবের। সব চুপচাপ সহ্য করে গেছে। আমাকে, মাকে কিছু জানায় নি। তোমার বিশ্বাস হবে না হয়তো আমার কথা। পদ্ম তোমার ছোটবেলার বান্ধবী। তাই ভাইয়া ভয় পায়। তুমি বিশ্বাস করবে না। তাই তোমার সামনে যায় নি। কতোবার বলেছি চট্টগ্রাম গিয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে। আমি অসুস্থ, নয়তো আমিই যেতাম। তোমার ফোন নম্বর ভাইয়ার কাছে আছে। তোমার কলের অপেক্ষায় ছিল। তুমি হয়তো ফোন দেবে। গত পাঁচ বছরে সিমটা চেঞ্জ করে নি ভাইয়া।”

আহি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। রেনু বলল,
“আমার ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে, আহি।”

আহি দ্রুত পায়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে এলো। আহি চলে যেতেই রেনু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মিনমিনিয়ে বলল,
“হয়তো আমিই ভুল ছিলাম।”

(***)

আহি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। ঘোরের মধ্যে হাঁটছে সে। বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো ডায়েরীটা। নিচে নেমে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আফিফ। আহি হুট করে চার তলার বারান্দার দিকে তাকালো। আফিফ সরে গেলো সাথে সাথেই। আহি বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে বিশ্বাস করবো না আফিফ? কীভাবে ভাবলে তোমাকে বিশ্বাস করবো না? যখনই ভালোবাসার সংজ্ঞা জেনেছি, তোমাকেই ভালোবেসেছি। আর ভালোবাসার মানুষকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি। তোমাকে জেনেই তো তোমার প্রেমে পড়েছি। কীভাবে অবিশ্বাস করবো তোমাকে? আমি পদ্মকে জিজ্ঞেস করবো, কেন কেঁড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে আমার প্রিয় অলকানন্দকে। আমি জিজ্ঞেস করবো। ওকে আমার অপ্রিয় বর্ষার রাতের প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। যেই পদ্ম আফিফের অপ্রিয়, সে আমার প্রিয় কখনোই না।”

১২২।

আহি বাসায় ফিরতেই পুষ্পকে দেখে অবাক। পুষ্প আহির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আন্টি আর নানু কক্সবাজার এসেছে ভাবলাম দেখা করতে আসি।”

“হুম। ভালো করেছিস।”

“আমি একা আসি নি। উজ্জ্বল ভাইয়া আর চাচীও এসেছে।”

আহি থতমত খেয়ে গেলো বেশ। ভেতরে ঢুকেই উজ্জ্বলকে দেখে মুচকি হাসলো। এরপর সে মায়ের দিকে তাকালো। সালমা ফাওজিয়ার ঠোঁটে রাজ্য জয়ের হাসি। নিশ্চয় মা বিয়ের জন্য আজ তাকে পীড়াপীড়ি করবে। আহি এসব পরিস্থিতিতে পড়তে চায় না। সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। ব্যাগ বের করে গুছিয়ে নিলো। তিন দিনের যাত্রা। উদ্দেশ্য, পদ্মের বাড়ি যাওয়া। লিনাশাকেও মেসেজ করে দিলো। লিখলো,
“পদ্মের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি। পাশে থাকলে তুই পুষ্পকে নিয়ে চলে আসিস। আমি ঠিকানা বলে দেবো।”

আহি উজ্জ্বলের সামনেই বেরিয়ে এলো। উজ্জ্বলের বেশ খারাপ লাগলো। একটু কথাও বললো না? গাড়িতে উঠতেই পুষ্পের কল। আহি রিসিভ করতেই বলল,
“আমাকে অপমান করলি তুই।”

“তুই আর তোর জামাই আমার বাসায় ওয়েলকাম। উজ্জ্বল সাহেবও ওয়েলকাম। কিন্তু ঘটক আর পাত্রদের আমি ওয়েলকাম করি না। আমার পথের কাঁটা এরা।”

কথাটা বলেই আহি কল কেটে দিলো। ড্রাইভারকে বললো ঠিকানা। কয়েক ঘন্টার পথ। আহি ফোনের স্ক্রিনে আফিফের নম্বরটির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,
“এতো অপেক্ষা কেন করেছো, এআর? আমার মতো একবার না হয় বেহায়া হয়ে দেখতে। আমি কিন্তু তোমাকে ফিরিয়ে দিতাম না।”

এদিকে আফিফ থম মেরে বসে আছে মেঝেতে। রেনু ধীর পায়ে ভাইয়ের রুমে এসে তার পাশে বসলো। আফিফ মলিন হেসে বলল,
“আমি বলেছি না, ও আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। আর পদ্ম ওকে সত্যটা বলবে না।”

রেনু ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“মন মানছে না ভাইয়া। আহির চোখে তোমার প্রতি সেই ভালোবাসা এখনো কীভাবে আছে?”

“ভালোবাসা হয়তো পাঁচ বছর আগেই আমি হারিয়ে ফেলেছি। এরপর হয়তো আমাকে নিয়ে সে ভাবেই নি।”

পরক্ষণেই আফিফের মনে প্রশ্ন জাগলো, তাহলে ডায়েরীটা এখনো কেন যত্নের সাথে রেখে দিয়েছে আহি?

(***)

পদ্মের বাড়িতে এসে অবাক হলো আহি। বাড়িতে তোড়জোড় চলছে। সবাই ব্যস্ত। আহি উঠানে এসে দাঁড়াতেই পদ্মের আপাকে দেখলো। আহিকে দেখে বেশ অবাক হলেন তিনি। ছুটে এসে বললেন,
“আহি, তুমি?”

আহি আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“এতো আয়োজন? কোনো প্রোগ্রাম হচ্ছে?”

“তোমাদের সাথে তো কোনো যোগাযোগ রাখে নি পদ্ম। তাই হয়তো জানো না। পদ্মের আগের সংসার ভেঙে গেছে। আজ ওর দ্বিতীয় বিয়ে।”

আহি চমকে উঠলো। আপা বললেন,
“আজ সকালেই হ্যাঁ বললো। এরপর বাবা তাড়াতাড়ি আয়োজন করে ফেললেন। একটু পর আক্দ। তারপরই রাতে উঠিয়ে দেবে।”

আহি কিছু বলার আগেই পদ্মের আপা আফসোসের সুরে বললেন,
“মা হতে পারবে না, তাই আমার বোনটাকে ছেড়ে দিয়েছে।”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “শুধুই কি মা হতে না পারা?”

“আর নয়তো কি!”

“পদ্মকে জিজ্ঞেস করেন নি?”

পদ্মের আপা থমকে গেলেন। তিনি হয়তো জানতেন না, আহি সব সত্য জেনেই এসেছে। মাথা নিচু করে বললেন,
“তোমরা ওর ছোটবেলার বান্ধবী। তোমরা ওকে ভালো করেই চেনো। তোমার কি মনে হয়, পদ্ম কোনো খুনীর সাথে যোগাযোগ করবে? আমার বোনটা না-কি নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছে।”

“আপু, আপনি কিছু জানেন না হয়তো। আমি আক্দ শেষে পদ্মের সাথে দেখা করবো। আমি চাই না, ওর অতীত ওর সুন্দর মুহূর্তে এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়াক।”

পদ্মের আক্দ শেষেই আহি তার সামনে এসে বসলো। পদ্ম আহিকে দেখে চমকে গেলো। আহি সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“আফিফকে কেন আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছিলি?”

পদ্ম চুপ করে রইলো। আহি আবার জিজ্ঞেস করলো,
“ছোটবেলার বান্ধবী আমরা। অনেক ভালোবাসতাম তোদের। তাহলে আমার ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছিলি কেন?”

পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“মিথ্যে কথা। আমি কেন কেঁড়ে নেবো? আফিফ তো আমাকে ভালোবাসতেন। আমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন।”

“তাহলে তোকে ছেড়ে দিলো কেন?”

“তুই কি জানিস না উনার মা কেমন মহিলা? যখন জেনেছেন, আমি ধর্ষিতা তখন আমাকে মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না। আফিফকে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন। আফিফ বাধ্য হয়ে আমাকে ছেড়েছেন।”

“তোর কি মনে হয়, আমি সত্য না জেনে এসেছি?”

“তোর কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”

“তাজওয়ার আমাকে বলেছিল।”

পদ্ম থতমত খেয়ে বলল,
“কখন? কখন বলেছে? ও তো মারা গেছে।”

“একটা রেকর্ড করেছিলো আমার জন্য। দু’দিন আগে পেয়েছি।”

পদ্ম থমকে গেলো। আহি পদ্মের বিমর্ষ মুখখানা দেখেই হাসলো। তার বানোয়াট কথা বিশ্বাস করে ফেলেছে পদ্ম। মেয়েটা আসলেই বোকা। বোকা প্রেমিকা যখন প্রেমে ভুলভাল কাজ করে, তখন তার জীবনের পরিণতি হাস্যকর হওয়ায় স্বাভাবিক। আহি বলল,
“এমনটা আমার সাথে না করলেও পারতি।”

পদ্ম ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমিও ভালোবেসেছি। আমার জায়গায় তুই হলে, এমনটাই করতি।”

“যদি আমি তোর মতো হতাম, আফিফ অনেক আগেই আমার হতো।”

“কখনোই হতো না, কারণ আমার সাথে উনি রেনুর জন্য আটকে ছিলেন।”

“আমার ক্ষমতা ছিল, রেনুকে বের করে আনার।”

“আফিফ ভিতু। উনি ভেবেছেন, তোকে পেতে চাইলে, তোর জীবনটা এলোমেলো করে দেবে তাজওয়ার। কারণ তাজওয়ার আফিফকে হুমকি দিয়েছে, সে যদি সরে না যায়, তাহলে তাজওয়ার তোর সাথে ঠিক তেমনই করবে, যেমনটা আফিফের বড় আপুর সাথে করেছে।”

“আমি আহি। আমি হেরে যাই না। হারিয়ে দেই। হারিয়ে প্রমাণ করেছি। শেষ জয়টাও আমারই হবে। আফিফকে পাওয়ার একমাত্র কাঁটা আমাকে সরাতে হয় নি, আল্লাহ নিজেই সরিয়ে দিয়েছেন। দেখ, কে কেঁড়ে নিয়েছে, আর কার ভাগ্যেই লেখা ছিল। তুই তো চুরি করেছিস। চুরির কোনো কিছুই হজম হয় না।”

পদ্ম আহির সামনে হাত জোড় করে বলল,
“ক্ষমা করে দিস। তোর এখন কোনো কিছুর অভাব নেই। আর আমার তো অভাবের শেষ নেই। আমার জন্য আফিফকে ছেড়ে দে।”

“যখন আমার জীবনে সবকিছুর অভাব ছিল৷ আমি নিঃস্ব ছিলাম। তখন কি তুই আফিফকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলি?”

“তখন আমি ওর স্ত্রী ছিলাম।”

“আর এখন তুই অন্য কারো স্ত্রী। আফিফ একা, আমার মতোই। আর দু’জন নিঃসঙ্গ মানুষ একে অপরের জন্য পারফেক্ট।”

“আমি ওই লোকটাকে ছেড়ে দেবো।”

“ছেড়ে দিস। ডিভোর্স হতেও তিন মাস সময় লাগে। মাত্র তো বিয়েই হলো। আর আমাদের এক হতে সময়ও লাগবে না।”

“আহি, প্লিজ। এমন করিস না।”

“কেন?”

“আমি ভালোবাসি আফিফকে।”

“আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসলে, আজ আফিফ তোরই থাকতো। খাদ ছিল, তাই হারিয়েছিস।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৫৬+ বোনাস ১+২

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৬||

১১৫।
আজ আহির এ আর টি গ্যালারিতে বিক্রয়ের দিন। মোটামুটি ভীড় জমেছে গ্যালারির সামনে। আজ আহি এসেছে ভিন্ন সাজে। কালো শাড়ি, কালো ঝুমকো, সাজসজ্জা বিহীন, আলগা খোঁপা বেঁধে। আহির দশটা ছবি বিক্রি হচ্ছে, আর বাকি বারোটি অন্যান্য চিত্রকরদের। আহি ক্রেতাদের সাথে তার ছবির বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলছে, তখনই তার দৃষ্টি আটকালো গ্যালারির প্রবেশমুখে। আহি তার সামনে দাঁড়ানো ক্রেতার দিকে তাকিয়ে বিনয়ী হাসি হেসে একটু সময় চেয়ে নিলো। এরপর প্রবেশমুখের কাছে যেতেই কৌতুহলি দৃষ্টিতে আহিকে খুঁজতে থাকা ওয়াসিফ দৌঁড়ে এলো তার দিকে। আহি ওয়াসিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতেই ওয়াসিফ জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি, আজ কি এখানে ইদ হচ্ছে?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“তোমার কেন মনে হচ্ছে ইদ হচ্ছে?”

“মিস বলেছে, ইদ মানে আনন্দ। ইদ মানে খুশি। ইদ মানে নতুন জামা-জুতো। ইদের সময় সবাই অনে-ক অনে-ক নতুন জিনিস কিনতে আসে। বাইরে চিকচিক লাইট জ্বলে।”

আহি হাসলো। ওয়াসিফের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ বাইরে তো চিকচিক লাইট জ্বলছে। কিন্তু আজ তো ইদ না। আর দেখো এখানে সবাই ছবি কিনতে এসেছে। জামা-জুতো এখানে পাওয়া যায় না।”

“আমিও একটা ছবি কিনবো।”

“আচ্ছা?”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াসিফের হাত ধরে তাকে গ্যালারির দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা কয়েকটা ছবির সামনে এনে দাঁড় করালো আর বলল,
“এখান থেকে কোনটা কিনবে?”

ওয়াসিফ আহির হাত ছেড়ে দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো। গালে হাত দিয়ে ভাবুক হয়ে একবার বামে, আরেকবার ডানে কয়েক বার হেঁটে গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার তো ছবিগুলো ভালো লাগছে না।”

আহি ওয়াসিফের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“তাহলে তুমি বলো, কেমন ছবি চাও?”

“আমার ডোরেমন ভালো লাগে। আমাকে ডোরেমনের ছবি এঁকে দেবে?”

আহি গালে হাত দিয়ে বলল,
“ও! বাবুর ডোরেমনের ছবি চায়?”

ওয়াসিফ মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ, হুঁ।”

“আচ্ছা, আমি তোমার জন্য কাল ডোরেমনের ছবি এঁকে নিয়ে আসবো।”

ওয়াসিফ তার কনিষ্ঠ আঙ্গুল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পিংকি প্রমিজ।”

আহি মুখ চেপে হেসে ওয়াসিফের দিকে তার কনিষ্ঠ আঙ্গুল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পিংকি পিংকি প্রমিজ।”

ওয়াসিফের দৃষ্টি আটকালো কাচের দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আফিফের দিকে। ওয়াসিফ সেদিকে তাকিয়ে আফিফকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার মামা।”

আহি সেদিকে তাকাতেই তার এসিস্ট্যান্ট রুবি তার সামনে এসে বলল,
“ম্যাম, কাস্টমাররা আপনার অপেক্ষা করছেন।”

আহি উঠে দাঁড়ানোর আগেই ওয়াসিফ দৌঁড়ে গ্যালারি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আহিকে বলল,
“বাই, আন্টি।”

আহিও হাতের ইশারায় বিদায় দিলো ওয়াসিফকে। এরপর ক্রেতাদের কাছে চলে গেলো। এদিকে ওয়াসিফ বেরিয়ে আসতেই দেখলো আফিফ বুকে হাত গুঁজে মোটর সাইকেলের উপর বসে আছে। ওয়াসিফ তার কাঁধের ব্যাগ দোলাতে দোলাতে আফিফের সামনে এসে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। আফিফ এতো টুকুন বাচ্চা ছেলের গম্ভীরমুখ দেখে বলল,
“আদ্য, মামা, কি হয়েছে তোমার?”

ওয়াসিফ মাথা নেড়ে অভিমানী মুখে বলল,
“মামা, তোমরা আমাকে ডোরেমনের খেলনা কিনে দাও না। আর দেখো, ওই খানের হোয়াইট হোয়াইট আন্টিটা আমাকে কি বলেছে!”

আফিফ ওয়াসিফের সামনে ঝুঁকে বলল, “কি বলেছে?”

ওয়াসিফ এক গাল হেসে বলল,
“আমাকে ডোরেমনের ছবি এঁকে দেবে।”

আফিফ তার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“এখন চলো বাসায়।”

“ভেতরে যাবে না? ভেতরে অনেক সুন্দর। সব হোয়াইট হোয়াইট।”

আফিফ হতাশ দৃষ্টিতে এ আর টি গ্যালারির প্রবেশপথের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, অন্যদিন যাবো।”

আফিফ ওয়াসিফকে মোটর সাইকেলে উঠিয়ে চাবি ঘোরালো। হেলমেট মাথায় দিলো। এরপর একবার পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো আহি বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। পরণে কালো শাড়ি। মৌমাছির মতো লাগছে দেখতে। আফিফ মৃদু হাসলো। সামনে তাকিয়ে চালু করলো মোটর সাইকেল। চলে এলো সেই জায়গা থেকে, আর সম্মুখ দর্পণ পেছন ফেলে আসছে আহির অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব।

(***)

সারাদিনের ধকলের পর গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম আহির চোখে এসে ভীড় করলো৷ ঘুম আসবে আসবে এমন মুহূর্তেই দরজায় কড়া নাড়লো সিস্টার মুরলি। আহি এলোমেলো পোশাকে দরজা খুলে দিতেই মুরলি বলল,
“ম্যাম আপনার সাথে দেখা কর‍তে মিস্টার এন্ড মিসেস লাবীব এসেছেন। তাদের সাথে একটা মেয়ে শিশু আছে। আমরা কি তাদের ভেতরে আসার অনুমতি দেবো?”

“অবশ্যই। ওরা আমার ফ্রেন্ড। ওয়েট আমি ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি। তুমি সুধী আর কথাকে বলো ওদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে।”

“ওকে ম্যাম।”

এদিকে পুষ্প আর লাবীব বাড়ির ভেতরে ঢুকেই বাড়িটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। প্রাসাদের মতো দেখতে আহির বাংলো বাড়ি। স্বচ্ছ মেঝেতে আলোকচ্ছটা এসে পড়ছে। হলঘরটি দেখতে বেশ খোলামেলা। মাঝখান দিয়ে বড় সিঁড়ি। সিঁড়ির পেছনে দেয়ালের সাথে লাগানো কাচের আলমারি। সেখানে স্তরে স্তরে বই সাজানো। মাথার উপর বিভিন্ন রঙের ঝাড়বাতি। একপাশে বসার জন্য সোফাসেট রাখা। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে সোফাসেট ব্যবহার করা হয় না। চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। সোফার পাশে কাঠের আলমারি। আহির তৈরি ছোট ছোট ভাস্কর্য ওখানে স্থান পেয়েছে। অন্যপাশে হয়তো রান্নাঘর। পাশে আরেকটা দরজা। ওখানে হয়তো ডায়নিং। উপরের তলায় দু’টো রুম, আহি আর সালমা ফাওজিয়ার জন্য। তৃতীয় তলায় আহি ছবি আঁকার জন্য বড় একটা রুম করেছে। আর তার পাশের রুমে লাইব্রেরি করেছে মায়ের জন্য। অন্যদিকে চার তলায় ছাদ।

সিস্টার মুরলি সোফার উপর থেকে চাদর সরিয়ে দিয়েই বিনয়ের সুরে বলল,
“ম্যাম, স্যার আমি দুঃখিত। আহি ম্যাম খুব একটা এখানে আসেন না। তাই সবকিছুই এভাবে ঢেকে রাখা।”

পুষ্প হালকা হেসে বলল, “সমস্যা নেই, তুমি যাও।”

পুষ্প এবার পিয়ালীকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে লাবীবকে বলল,
“আমাদের বান্ধবীর যা বড়লোকি ব্যাপার-স্যাপার। আমরা দু’জন চাকরি করেও জীবনে এতোকিছু করতে পারবো না।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“সবটাই ওর সৌভাগ্য। পৈতৃক সম্পত্তি থাকলে পরের দুই প্রজন্ম বসে খাওয়া যায়। আর আমাদের খেটেখুটে পিয়ালীকে বিয়ে দিতে হবে।”

“আর যাই বলো, মেয়েটার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আনতেও দশবার ভাবতে হয়। সবগুলোই ওর যোগ্যতার নিচে। এখন আমাদের সাথে কি কোনো শিল্পপতির পরিচয় আছে, যে ওর জন্য ওমন বাড়ির সম্বন্ধ আনবো?”

“কিন্তু আন্টি তো আমাদের উপরই সব দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছেন।”

পুষ্প হতাশ হয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা বায়োডাটা বের করলো। ছেলের নাম আরবান খান। যথেষ্ট সুদর্শন। নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকায় গাড়ি-বাড়ি আছে। আহির চেয়ে কম হলেও অন্তত আহির ভালো থাকার মতোই অবস্থা। পুষ্পের ইচ্ছে ছিলো না এই সম্বন্ধে। তবুও সে সালমা ফাওজিয়ার কথায় আহির সাথে দেখা কর‍তে এসেছে। সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে সরাসরি বলতে পারছেন না। তাই পুষ্পকে বলেছেন। পুষ্প আহিকে বাসায় আসতে বলেছিল, কিন্তু আহি সেখানে যাওয়ার সময় পাচ্ছিলো না, তাই পুষ্প নিজেই লাবীবকে নিয়ে আহির বাড়িতে এসেছে। পুষ্প মন থেকে চায়, আহি সুখী হোক। আরবান ছেলেটা দেখতে ভালোই। সালমা ফাওজিয়া খোঁজ নিয়েছেন। খারাপ কিছু পান নি। কিন্তু পুষ্পের মাথায় ঘুরছে তার ভাই উজ্জ্বলের চেহারা। সে জানে উজ্জ্বল আহিকে পছন্দ করে। যদিও উজ্জ্বলের সাথে আহির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। কথাবার্তাও তেমন হয় না। আর এমন কিছু না যে আহিকে না পেলে উজ্জ্বল বিয়েই করবে না। তবে সে আহিকে পছন্দ করে। আর তার পছন্দের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

আহি সিঁড়ি বেয়ে নেমে পিয়ালীকে কোলে নিয়ে বসে পড়লো। ইচ্ছেমতো আদর করলো পিয়ালীকে। পুষ্প বলল,
“আমাদের তো দেখছিসই না।”

“চুপ কর, আগে আমি আমার মা’টাকে আদর করি। আমার টুনটুনি বাবু। উম্মাহ।”

লাবীব বলল,
“টুনটুনির খালাম্মা ওরফে ফুফু একবার নিজের দিকেও নজর দিন।”

“বল না। আর তোরা আসবি, সেটা আগেই বলতে পারতি। আমি সব ক্লিন করে রাখতাম।”

পুষ্প আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“সবটাই তো ক্লিন লাগছে।”

“আচ্ছা এসব বাদ দে। কি অবস্থা বল?”

“ভালোই। তোর কি অবস্থা? মাসে একবার এসে চলে যাস, দেখাও করে যাস না। আসিস সেটাও বলিস না।”

“প্রচুর কাজ থাকে। আর তোকে বলি সবসময়। মিথ্যে বলিস না তো। আর বাসায় যাই না, তুই থাকিস না তাই। তোরা দু’জন অফিসে থাকিস। আমি কোথায় পাবো তোদের?”

লাবীব বলল,
“পিয়ালীকে দেখে যেতে পারিস। মায়ের সাথেই থাকে।”

“আচ্ছা, বাদ দে। অভিযোগ রাখ এখন।”

সুধী নাস্তার ট্রে টি-টেবিলের উপর রেখে চলে গেলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“তুই ভালোই মেইড পেয়েছিস। আমি তো টর্চ দিয়ে খুঁজেও পাই না। আর ছোট বুয়া যাদের রাখি, ওদের ফাইফরমাশ তো হাজার খানেক। আসলে যাওয়ার তাড়া। ফাঁকিবাজ সব।”

আহি হাসলো। পুষ্প বলল,
“এদের পরিচিত কেউ থাকলে একটা মেয়ে খুঁজে দিতে বল।”

“এরা এখানের না। একটা আশ্রম থেকে এনেছি। এতিম মেয়ে। ওদের থাকার জায়গা নেই। ওরা এখানে নিজেদের বাসার মতো থাকে। ওদের ওভাবে বলতে পারবো না। তুই চাইলে আমি চিটাগং থেকে একটা এনে দিতে পারবো। মেয়েটাকে আরবি শেখাতে হবে। ওর মা আমার কাছে এসেছিল। এখন আমি তো বাসায় খুব একটা থাকি না। আলাদা আরবি শেখানোর হুজুর বাসায় আসাটা একটু সমস্যা। মুনিয়া খালাও চলে গেছেন চুনির কাছে।”

“তোর বাসায় কাজ করে কে?”

“বুয়া আসে একটা। আমি বাসায় থাকলে ফোন দেই উনাকে।”

লাবীব বলল,
“আচ্ছা, আরবি শেখাবো না হয়। দেখিস তো একটু। অফিস থেকে ফিরে পুষ্পের সব কাজ করতে হয়। মাও অসুস্থ। সব সামলাতে পারছেন না। সামনে লিমনের জন্যও বউ আনার চিন্তাভাবনা করছে।”

“ভালো।”

পুষ্প ভালোই সুযোগ পেলো। বলেই ফেললো,
“লিমনও বিয়ে করে ফেলবে। আর তুই? টুনটুনিকে এতো আদর করিস। নিজের একটা টুনটুনি থাকা ভালো না?”

আহি মলিন হাসলো। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আচ্ছা, লিনাশা আসবে নেক্সট ফ্রাইডে। নায়ীব ভাইয়ার কাজিনের বিয়ে না-কি! মেয়েটাকে কতো বছর দেখি না। দু’জনই জার্মান সেটেল্ড হয়ে গেছে।”

“বিয়ের পর সবাই এমন কাজে-সংসারে ব্যস্ত হয়ে যায়।”

এবার পুষ্প ভনিতা না করে বায়োডাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আন্টি বলেছে, এবার তোকে রাজি করাতে।”

আহি বায়োডাটা একনজর দেখে বলল,
“আরবান খান! শোন, আমি ঢাকায় বিয়ে করবো না।”

লাবীব বিরক্ত হয়ে বলল,
“বিয়েই করিস না তুই। এটা খুব বাজে সিদ্ধান্ত, আহি। তোর বাবা, ভাই, দাদা এমনকি দাদার সম্পর্কে কোনো আত্মীয় নেই। আন্টির উপর অনেক বড় দায়িত্ব তোকে বিয়ে দেওয়া। আমি তোর ভাইয়ের মতো, আহি। বোনকে বিয়ে দেওয়া অনেক বড় দায়িত্ব। আন্টির উপর মানসিক চাপ বাড়াস না। উনি তোর বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন।”

আহি বায়োডাটাটি একপাশে রেখে বলল,
“আচ্ছা, চিন্তা করিস না। আমি দেখবো এই বায়োডাটা। এবার একটু অন্য বিষয়ে কথা বলি।”

পুষ্প আর আহি বেশ গল্প করলো। হঠাৎ পুষ্প বলে উঠলো,
“আচ্ছা, পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে পদ্মের কোনো খোঁজ নেই। জানিস কিছু?”

“না।”

“ওর নম্বর বন্ধ। আচ্ছা, ভাইয়ার নম্বর আছে তোর কাছে?”

আহি চমকে উঠলো। আফিফের নম্বর মুখস্থ আহির। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সেই নম্বরে ডায়াল করার সাহস হয় নি তার। পদ্মের সাথেও যোগাযোগ করে নি। কি দরকার খোঁজ নিয়ে? ভালোই আছে হয়তো আফিফ তার পদ্মফুলের সাথে। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার কাছে কারো নম্বর নেই।”

পুষ্প বলল,
“আচ্ছা, মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়। না জানি কেমন আছে।”

“ভালোই থাকবে। যার জীবনে আফিফের মতো মানুষ আছে, সে কি খারাপ থাকতে পারে?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০১||

১১৬।
নন্দন কানন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখছে সে। আজই তার চট্টগ্রাম ফিরতে হবে। ওয়াসিফের সাথে দেখা করেই সে চলে যাবে চট্টগ্রামে। এখন সে স্কুল ছুটির অপেক্ষা করছে। দপ্তরি ঘন্টা বাজাতেই ছোট ছোট বাচ্চারা বেরিয়ে আসতে লাগলো। অনেকক্ষণ পর ব্যাগ দুলিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে এলো ওয়াসিফ। আহি হাতের ইশারা করতেই ওয়াসিফ আহিকে দেখে দৌঁড়ে এলো। এসেই জড়িয়ে ধরলো তাকে। আহি ওয়াসিফের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“বাবু, মন খারাপ তোমার?”

ওয়াসিফ মাথা তুলে আহির দিকে তাকিয়ে বলল, “হুঁ!”

“কেন?”

“মায়ের শরীর ভীষণ খারাপ।”

“কি হয়েছে তোমার মায়ের?”

“মায়ের বুক জ্বলে গেছে, তারপর থেকেই অসুস্থ থাকে। খেতে পারে না। কথা বলতেও কষ্ট হয়।”

আহি চিন্তিত হয়ে ওয়াসিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“কখন হয়েছে এসব?”

“নানু বলেছে আমি হওয়ার আগে। মা অনেক কান্নাকাটি করে, জানো?”

আহি ওয়াসিফের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“তুমি তো একটা মিষ্টি বাচ্চা। তুমি মন খারাপ করো না। মাকে সাহস দেবে, আদর করবে, দেখবে মা সুস্থ হয়ে যাবে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, সত্যি। আচ্ছা, তোমার জন্য ডোরেমন এনেছি। দেখবে না?”

ওয়াসিফ মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ, হুঁ!”

আহি ব্যাগ থেকে একটা নুড়ি পাথর বের করে ওয়াসিফের দিকে এগিয়ে দিলো। পাথরের গায়ে আঁকা ডোরেমনের ছবি। ওয়াসিফ লাফিয়ে বলল,
“এটা আমার ডোরেমন?”

“হ্যাঁ, এটা সবসময় তুমি নিজের কাছে রাখতে পারবে। তোমার বক্সে, তোমার পকেটেও রাখা যাবে।”

ওয়াসিফ তার প্যান্টের পকেটে নুড়ি পাথরটি ঢুকিয়ে বলল,
“আমি সবসময় নিজের কাছে রাখবো।”

আহি ওয়াসিফের থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“বাই মিষ্টি বাবু। আবার দেখা হবে।”

“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“আমি আমার বাসায় চলে যাচ্ছি।”

“তুমি কাল আবার আসবে?”

“না, বাবু।”

“তাহলে কি এর পরের দিন আসবে?”

“না, বাবু। আমার বাসা তো অনেক দূরে। আসতে সময় লাগবে?”

ওয়াসিফ কিছু একটা ভেবে বলল,
“তাহলে এতোদিন তুমি বাসায় ছিলে না?”

“হ্যাঁ ছিলাম তো। আশেপাশেই একটা বাসায় ছিলাম। এখন আমি আমার দূরের বাসায় চলে যাচ্ছি।”

ওয়াসিফ আহির হাত ধরে বলল,
“তুমি কালও এসো। তোমার সাথে অনে-ক গল্প করবো। ওদিকে পার্কে খেলবো। আমি আমার খেলনা আনবো তোমার জন্য।”

ওয়াসিফের কথা শুনে বেশ মায়া লাগলো আহির। সে ওয়াসিফের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ভালো থেকো। বাই।”

ওয়াসিফ হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলো আহিকে। আহির গাড়ি চলে যেতেই আফিফ মোটর সাইকেল সামনে আনলো। এতোক্ষণ সে আহির যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। আফিফকে দেখে ওয়াসিফ তার কাছে এসে তার দিকে পাথরটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মামা, হোয়াইট হোয়াইট আন্টি আমাকে কি দিয়েছো দেখেছো?”

আফিফ মুচকি হেসে বলল, “বেশ সুন্দর তো!”

“হোয়াইট হোয়াইট আন্টি কত্তো ভালো।”

আফিফ ওয়াসিফকে কোলে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আদ্য। আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, মামা!”

“হুম বলো।”

“তুমি সেই আন্টিকে হোয়াইট হোয়াইট কেন বলো?”

ওয়াসিফ গালে হাত দিয়ে হাসলো। বলল,
“আন্টির নাম তো ভুলেই গেছি। আন্টির আমার মতোই অনেক বড় একটা নাম। তুমি বলো, আমার একটুখানি মাথায় কি এতো বড় নাম ঢুকবে? আমার নামই তো আমার মুখস্থ করতে অনেক কষ্ট হয়েছে।”

“তাই তুমি হোয়াইট হোয়াইট নাম রেখেছো?”

“হ্যাঁ, আন্টি হোয়াইট হোয়াইট সু’জ পরে এসেছিল। আমারও লাগবে হোয়াইট হোয়াইট সু’জ।”

“আচ্ছা? ঠিক আছে। আমার মামাকে আমি হোয়াইট হোয়াইট সু’জ কিনে দেবো।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ একদম সত্যি। আচ্ছা, আরেকটা কথা বলো তো।”

“হ্যাঁ, বলো।”

“তোমার হোয়াইট হোয়াইট আন্টিকে এতো ভালো লাগে কেন?”

ওয়াসিফ এ আর টি গ্যালারি দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কতোবার ওখানে যেতে চেয়েছি। কেউ আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় নি। শুধু হোয়াইট হোয়াইট আন্টিই আমাকে ভেতরে নিয়ে গেছে। কত্তো ভালো না আন্টি?”

আফিফ হেসে বলল,
“হ্যাঁ, খুব ভালো তোমার আন্টি। একদম তোমার মতোই মিষ্টি।”

(***)

আহি গম্ভীরমুখে বসে আছে এক আজব কিসিমের মানুষের সামনে। কিছুক্ষণ পর পর হাত ঘড়ি দেখছে। দূরে বসে আছে লিনাশা এবং নায়ীব। দু’জনই এক সপ্তাহ আগে দেশে এসেছে। ঢাকায় নায়ীবের এক মামাতো বোনের বিয়ে। সেই উপলক্ষেই দেশে আসা। আহিও ঢাকায় এসেছে কোম্পানির কাজে। এখন মায়ের অনুরোধে আরবান খানের সাথে দেখা করা। তবে আহি একা আসে নি। নায়ীব আর লিনাশাকেও সাথে নিয়ে এসেছে। লিনাশা দূর থেকে আহির হাবভাব দেখে নায়ীবকে বলল,
“মনে হয় না, আহির ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে।”

নায়ীব বলল,
“আমারও পছন্দ হয় নি। ছেলেটার একটু নিজেকে জাহির করার স্বভাব আছে। দেখো নি, পরিচয় দেওয়ার সময় কীভাবে বার-বার বংশের নাম ডাক নিয়ে কথা বলছিলো। আহি এমন ছেলে পছন্দ করবে না।”

“তুমি আমার বান্ধবীকে তো খুব চেনো!”

“যেই মেয়ে আফিফের মতো ছেলের প্রেমে পড়ে, তার জন্য এসব ছেলে কিছুই না। আফিফ আর এই ছেলে দুই মেরুর। আহির জন্য যদি পাত্র দেখতে হয়, আফিফের মতো খুঁজতে হবে।”

“আচ্ছা? এখন আফিফের বৈশিষ্ট্য লিখে গুগলে সার্চ করবো আমরা?”

“রেগে যাচ্ছো কেন?”

লিনাশা মুখ ছোট করে নায়ীবকে গুঁতো দিয়ে বলল,
“যাও, ফোন দিয়ে দেখো তোমার ছেলে কোথায়!”

নায়ীব ফোন করলো তার গুণধর পুত্রকে। ওপাশ থেকে কল ধরলো চার বছর বয়সী ইয়াশ তামজীদ। নায়ীব বলল,
“হ্যালো, পাপা। কোথায় তুমি? কি করো?”

ইয়াশ ঠোঁট ফুলিয়ে নানুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“পাপা, তোমরা আমাকে একা রেখে কেন চলে গেছো?”

“আচ্ছা, সরি। আমরা একটা কাজে এসেছি। এক্ষুণি আসছি। তোমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসবো সাথে।”

“পাপা, তুমি না আমাকে বলেছো সি দেখাবে।”

নায়ীব হেসে বলল,
“অফকোর্স পাপা। আমার পাপাকেই তো আমি সি দেখাবো।”

লিনাশা বাবা-ছেলের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এদিকে আহি আরবান খানের সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি প্রচুর টায়ার্ড। আপনি প্লিজ আমাকে অনুমতি দিন।”

আরবান বলল,
“এক্সকিউজ মি! খুব বোর হয়েছেন মনে হচ্ছে।”

“আপনার হাই ক্লাস ড্রিমের গল্প শোনার মতো ধৈর্য আমার নেই। এখন আপনি যাবেন?”

“বিল?”

“ওয়েট, আমি বিল দিয়ে দিচ্ছি। প্লিজ গৌ।”

আরবান খান মুখ লাল করে উঠে চলে গেলো। আরো কিছু বলতো, কিন্তু আহির পেছনেই তার বডিগার্ড বসে আছে। তাই সে বাধ্য হয়েই বেরিয়ে গেলো। আরবানকে চলে যেতে দেখে নায়ীব আর লিনাশা আহির সামনে এসে বসলো। আহি বিরক্তমুখে বলল,
“মা এসব আজব লোক কোথা থেকে ধরে আনে? ছেলে নামি-দামি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কি লাভ হলো? চিন্তাভাবনা কতো নোংরা!’

লিনাশা বলল,
“আমরা বুঝতে পেরেছি ছেলেটার কথা শুনে। বাদ দে। দেখা হলেই কি বিয়ে হয়ে যায়?”

নায়ীব এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মাথা ঠান্ডা করো, আহি। এদিকে আমার ছেলে সি দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“জার্মানেও তো সমুদ্র আছে।”

লিনাশা বলল,
“আছে, কিন্তু আমরা বলেছি আমাদের দেশের সমুদ্র সৈকত সবচেয়ে দীর্ঘতম। এখন সে বায়না ধরেছে কতোটা দীর্ঘ তা দেখবে।”

“বেশ তো, কক্সবাজার নিয়ে যা।”

“হ্যাঁ, পুষ্পের সাথেও দেখা হবে। চল তুই সহ।”

“না রে। মাত্র এলাম। তিন সপ্তাহও হচ্ছে না।”

“তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে চল না। ঘুরাঘুরিও হবে।”

“না। আমার নেক্সট মান্থে এমনিতেই যেতে হবে। সেল হবে ওখানে। একটা স্পেশাল বিষয় নিয়ে আঁকছি। ওটাতে সময় দিতে হবে।”

“কেন তোর বাড়ি আছে না ওখানে?”

নায়ীব বলল,
“আরেহ তোমার বেস্টি এতো করে বলছে, চলো। আফটার অল, আমরা আবার জার্মান চলে যাবো। এর মধ্যে তোমার বিয়েটা হয়ে গেলে বেশ ভালো হতো। এক মাসের ছুটিতে এসেছি। পরে আবার কখন আসবো!”

আহি হাসলো। বলল,
“আমার বিয়েতে আবার ছুটি নিয়ে আসবেন।”

লিনাশা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“এখন যাবি? গেলে কিন্তু সময় নিয়ে যেতে হবে। আমরা বেশ কয়েকদিন কক্সবাজার ঘুরবো।”

“আচ্ছা, আমি এমডি সাহেবের সাথে কথা বলি। উনি হয়তো আমার অনুপস্থিতিতে সব হ্যান্ডল করতে পারবেন। তাহলে মা আর নানুকেও নিয়ে যাবো ভাবছি। নানুর তো শরীর খারাপ। যদিও বাড়িতে থাকতে চাইছেন। আমার মনে হচ্ছে, কক্সবাজার গেলে মন ভালো হবে উনার।”

“নানুর জানি কি হয়েছে?”

“ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ৷ ট্রিটমেন্ট করাচ্ছি তবুও ভয় হচ্ছে। উনিও চাচ্ছেন না ট্রিটমেন্ট করতে। কিন্তু সব চেষ্টা করছি।”

“বয়স তো হয়েছে উনার।”

“হুম। মা একা হয়ে যাবে নানুর কিছু হলে।”

“এজন্যই বিয়ে করছিস না?”

“না, সেজন্য না। বিয়ের বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিয়ের জন্য মনের বয়স এখনো হয় নি।”

“মনের বয়স কখন হবে?”

“যেদিন কোনো পুরুষ মানুষকে দেখে বয়স্ক কিশোরী হতে ইচ্ছে করবে।”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বয়স্ক কিশোরী বলতে!”

“প্রেম প্রেম অনুভূতি, অথচ বেশ গম্ভীর প্রকাশ। উড়ুউড়ু মন, অথচ বাইরে স্থিরতা। আবেগী চাওয়া-পাওয়া, অথচ অনুভূতির শেষাংশে গভীর স্পর্শ।”

নায়ীব হাসলো। লিনাশা বলল, “কবি হয়ে যাচ্ছিস!”

“শিল্পীদের একটু কবিও হতে হয়। মা অনেক বই পড়ে। মাঝে মাঝে আমিও ঘেঁটে দেখি। ভালো সময় কাটে আমার।”

আহি কথাটি বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহির এই দীর্ঘশ্বাস অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিলো নায়ীব আর লিনাশাকে।

(***)

ওয়াসিফ বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। ছেলেটা বেশ অভিমানী। আফিফ তার পাশে শুয়ে একটু পর পর তাকে গুঁতো দিচ্ছে, আর সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ওয়াসিফ খিলখিল করে হেসে বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে আবার মুখ ভার করে ফেলছে। আফিফ তার হাত ধরে টেনে তাকে নিজের কাছে এনে বলল,
“আদ্য, এভাবে মুখ ভার করে বসে থাকলে কিন্তু মামা রাগ করবো!”

ওয়াসিফ হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করে বলল,
“রাগ করলে করো। হুহ।”

“কি চাই আমার মামাটার?”

“বললাম না, হোয়াইট হোয়াইট আন্টিকে এনে দাও।”

“দু’দিনের দেখায় তুমি হোয়াইট হোয়াইট করতে করতে অস্থির হয়ে যাচ্ছো।”

“সেদিন আন্টি বলেছে আসবে। তাই আমি প্রতিদিন পার্কে বসে থাকি, কিন্তু আসেই না। দেখেছো, কেউ আমার কোনো বন্ধু হয় না। হোয়াইট হোয়াইট আন্টির সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবো ভেবেছি, উনি তা কাট্টি করেই চলে গেলো।”

“কাট্টি?”

ওয়াসিফ তার কনিষ্ঠ আঙ্গুল দেখিয়ে শরীর দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, কাট্টি।”

এরপর সে তার পাথরের ডোরেমনটি হাতে নিয়ে বলল,
“কেউ আমার বন্ধু হয় না।”

আফিফ ওয়াসিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কি তোমার বন্ধু না?”

“না, তুমি তো মামা।”

“মামা কি বন্ধু হতে পারে না?”

ওয়াসিফ সাথে সাথেই আফিফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মামা, আমার কোনো বন্ধু নেই। ক্লাসের কেউ আমার সাথে খেলে না।”

“কেন খেলে না?”

“আমি জিরো পাই তাই।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কোথায় জিরো পাও? সবসময় তো নাইন্টি প্লাস পাও।”

“মামা, ওই জিরো না।”

“তাহলে কোন জিরো?”

“ক্লাসে মিসরা ওয়ান-জিরো গেইমস খেলে। যে আগে পড়া দিতে পারবে, তাকে ওয়ান দেবে। আর আমি সবসময় জিরো হই। তাই কেউ আমাকে পাত্তা দেয় না।”

আফিফ হোঁ হোঁ হাসতে লাগলো। আফিফকে হাসতে দেখে ওয়াসিফ বলল,
“তোমাকে আমি এমনি এমনি বেস্ট বলি। তুমি খুব পঁচা। আমি জিরো পেয়েছি শুনে তুমি হাসছো?”

আফিফ হাসি থামিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
“কি করবো তাহলে?”

ওয়াসিফ তার কাছে এসে তার ঠোঁটের দুই পাশ টেনে ধরে বলল,
“স্যাড স্যাড ফেইস। হুম। এখন বেস্ট লাগছে।”

“এর আগে কেমন লেগেছিল?”

“জিরো বেস্ট।”

আফিফ হাসলো। ওয়াসিফের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“আদ্য পন্ডিত।”

(***)

আহি দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে সালমা ফাওজিয়া এবং রোকেয়া ফাওজিয়াকে নিয়ে কক্সবাজার এলো। সাথে এসেছে নায়ীব, লিনাশা আর তাদের ছেলে ইয়াশ এবং এসেছেন রুনা খানমও। আহির বাংলো বাড়ির পাশেই একটা গেস্ট হাউজ করেছে সে। ওখানেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। সব গুছিয়ে আহি পরদিন দুপুরে তার গ্যালারিতে এলো। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বের হতেই তার ওয়াসিফের কথা মনে পড়লো। স্কুল ছুটি হবে এমন মুহূর্তেই এসেছে সে। মিনিট খানিকের মধ্যে দপ্তরি ঘন্টা বাজালো। বেরিয়ে এলো ওয়াসিফ। আহি ওয়াসিফকে দেখে হাতের ইশারায় ডাকলো,
“এই যে বাবু!”

ওয়াসিফ দূর থেকে আহিকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। আহির দিকে ছুটে আসতে যাবে, ওমনি ইটের রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়লো সে। ওয়াসিফকে পড়ে যেতে দেখে আহি দৌঁড়ে গেলো সেখানে। ধরে বসালো তাকে। ওয়াসিফ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, জানো না? তুমি কেন আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, বলো তো!”

আহির বুকটা মুহূর্তেই ধক করে উঠলো। সে ওয়াসিফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ওয়াসিফকে কোলে নিয়ে বলল,
“বাবু, তুমি আমাকে মনে রেখেছো?”

“হ্যাঁ।”

“পায়ে বেশি ব্যথা করছে?”

ওয়াসিফ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “হুম।”

আহি ওয়াসিফকে গ্যালারির ভেতরে নিয়ে গেলো। ইটের ঘষা খাওয়া হাঁটু পরিষ্কার করে দিলো। পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করে একটা অয়েন্টমেন্টের নাম নিলো। রুবিকে বললো ফার্মেসি থেকে নিয়ে আসতে। এরপর সে যত্নের সাথে অয়েন্টমেন্টটি লাগিয়ে দিলো হাঁটুতে। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেলো। ওয়াসিফের মামা আসছে না। বেশ ক্ষুধা পেয়েছে ওয়াসিফের। সে পেটে হাত দিয়ে বলল,
“আমার তো ক্ষিধে লেগেছে। মামাকে বলবে আমাকে নিয়ে যেতে?”

আহি ওয়াসিফের ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে সেখানে লেখা নম্বরে ডায়াল করলো। ডায়েরিতে লেখা ছিল, নাওফা রেনুকা। ওয়াসিফের মায়ের নাম। আহি কল করতেই রেনু কল ধরলো। ওয়াসিফের ব্যাপারে জেনেই রেনু ব্যস্ত হয়ে আফিফকে কল করলো। আফিফ জানতো রেনু কল দেবে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। আহি যতোক্ষণ আদ্যের পাশে আছে, সে কীভাবে যাবে তাকে নিতে? এদিকে আহি কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
“কেমন মামা তোমার? একদম ইরেস্পন্সিবল। আচ্ছা, ওয়াসিফ। তুমি আমার সাথে চলো। আমার বাসায় যাবে?”

“তুমি আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ। ওখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করবে। এরপর তোমার মামার যখন ইচ্ছে তোমাকে এসে নিয়ে যাবে।”

ওয়াসিফ মাথা নাড়লো। সে আহির সাথে চলে গেলো আহির বাংলো বাড়িতে। আফিফ তাদের যেতে দেখে অবাক হলো। কি এক বিপদে পড়েছে সে। আহির সাথে দেখা করে ওয়াসিফকে কীভাবে আনবে? মা আর রেনুকেও পাঠানো সম্ভব না। আহি তো সবাইকে চেনে। আফিফ মিনমিনিয়ে বলল,
“এই আদ্যের বাচ্চাটা কি এক ঝামেলা পাঁকিয়ে দিলো!”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||

১১৭।
আহির বাংলো বাড়িটি অবাক হয়ে দেখছে ওয়াসিফ। সালমা ফাওজিয়া ওয়াসিফকে দেখে আহিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আহি, ছেলেটা কে?”

আহি বলল,
“মা, গ্যালারির পাশে একটা স্কুলে আছে না? ওখানে পড়ে। ওর মামা নিতেই আসে নি ওকে। কেমন দায়িত্ব-জ্ঞানহীন লোক দেখেছো? বেচারা বাচ্চাটা আমার কাছে দৌঁড়ে আসতে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। ক্ষিধেও পেয়েছে তার। দুপুর দেড়টা বাজে, দেখেছো? এইটুকুন একটা বাচ্চা এতো সময় ধরে না খেয়ে কীভাবে থাকবে?”

আহি গলা উঁচু করে সুধীকে ডাকলো। সুধী আসতেই আহি বলল,
“কথাকে বলো, বাচ্চাটাকে ফ্রেশ করিয়ে দিতে। আর তুমি খাবার তৈরী করো। জিজ্ঞেস করো ও কি কি খাবে।”

সুধী মাথা নেড়ে ওয়াসিফের কাছে গেলো। ওয়াসিফ সুধীকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“তুমি কি সিনড্রেলা?”

সুধী ওয়াসিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“না, বাবু। আমি সুধী।”

সুধী ওয়াসিফের কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল,
“কি নাম তোমার?”

“নাওফাত ওয়াসিফ আদ্য। তোমার নাম কি?”

“সুধী।”

“সুধী আবার কেমন নাম?”

সুধী মুচকি হেসে বলল,
“নাওফাত ওয়াসিফ আদ্য আবার কেমন নাম?”

ওয়াসিফ বুকে হাত গুঁজে বলল,
“যেমন নাম হয়, তেমন।”

“আমারটাও যেমন নাম হয় তেমন।”

ওয়াসিফ মুখ চেপে হেসে বলল,
“আমাকে কপি করছো? ব্যাড ম্যানার্স।”

সুধী ওয়াসিফের নাক চেপে ধরে বলল,
“আচ্ছা দুষ্টু বাবু, কি খাবে?”

ওয়াসিফ গাল ফুলিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে দুষ্টু বলেছো?”

“আদর করে দুষ্টু বলে।”

ওয়াসিফ অবাক হয়ে বলল, “আদর করে দুষ্টু বলা যায়?”

“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বলা যায়।”

“না, বলা যায় না। আদর করে মিষ্টি বাবু বলে। ওই যে হোয়াইট হোয়াইট আন্টি যেমন আমাকে মিষ্টি বাবু বলে। আমি দুষ্টু না, বুঝেছো? তুমি দুষ্টু, তোমার বাবা দুষ্টু, তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী দুষ্টু, দুষ্টু, দুষ্টু।”

“এমা, তুমি এই কথা কোথায় শিখেছো?”

“আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে বলে এই কথা। কারো সাথে ঝগড়া হলে বলে। আমারও তোমার সাথে ঝগড়া।”

আহি ওয়াসিফের কাছে আসতেই ওয়াসিফ তাকে বলল,
“আন্টি, আন্টি, দেখো না। ওই পঁচা সুসিটা আমাকে দুষ্টু বলেছে।”

আহি ওয়াসিফের পাশে বসে বলল, “সুসি কে?”

“এই যে, এই মেয়েটার নাম সুসি।”

আহি হাসলো। সুধীও হাসলো। সুধীকে হাসতে দেখে ওয়াসিফ বলল,
“আন্টি, ওকে বকে দাও তো। দেখো, ও হাসছে!”

আহি গলা উঁচু করে বলল,
“এই সুসি, তুমি ওকে দুষ্টু বলেছো কেন? এক্ষুণি সরি বলো মিষ্টি বাবুকে?”

সুধী দু’কান ধরে বলল, “সরি।”

ওয়াসিফ বলল, “হুম, ইটস ওকে।”

এরপর হাতের ইশারায় না দেখিয়ে বলল,
“বাট নট সরি। উঁহু।”

আহি বলল, “এটার মানে কি?”

“পরের বার সরি নিবো না।”

আহি মুচকি হেসে বলল, “আচ্ছা নিও না।”

সুধী এবার বলল, “কি খাবে বলো?”

ওয়াসিফ বলল, “তোমাকে কেন বলবো?”

আহি জিজ্ঞেস করলো, “আমাকেও বলবে না?”

“হ্যাঁ, তোমাকে তো বলবোই।”

“তাহলে বলো?”

ওয়াসিফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“চিকেন ফ্রাই। মা আমার জন্য প্রতিদিন ফ্রাই করে।”

“চিকেন ফ্রাইয়ের সাথে বিফ বিরিয়ানি খাবে?”

“বিরিয়ানি? ওয়াও, আমার আর মামার ফেভারিট।”

“আচ্ছা? তোমার আর কি কি ফেভারিট?”

“আমার তো চিকেন ফ্রাই বেশি ভালো লাগে। কিন্তু মামা কি খায়, জানো?”

“কি খায়?”

“হোয়াইট হোয়াইট রাইসের সাথে ইয়েলো ইয়েলো পটেটো। সাথে ডাল।”

আহি থমকে গেলো। ওয়াসিফ আবার বলল,
“মামা তো নানুকে সবসময় বলে আমার জন্য আলুভর্তা করো, আলুভর্তা করো। জানো, আমিও একবার খেয়েছি। কি ঝাল! আমার চোখে পানি এসে গেছে। এমন ঝাল কেউ খায়, বলো?”

আহির বুকটা ধকধক করছে। আজ ভীষণ মনে পড়ছে আফিফের কথা। আফিফের প্রিয়ও তো আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে সাদা ভাত। একদম সাদামাটা পছন্দ তার। সাদা রঙ, হলুদ অলকানন্দা। মানুষটা খুব সাধারণ। আহি তাই খুব শখ করেই এই বাংলো বাড়িটা সাদা টাইলস, এবং সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আর বাড়ির দেয়ালে সাদা রঙ করেছে। বাইরে থেকে দেখলে সাদা রাজপ্রাসাদ মনে হবে। এ আর টি গ্যালারিটাও আফিফের নামে করেছে। এজন্যই আর্ট শব্দটিকে ভেঙে ভেঙে লিখেছে সে। অন্তত এ আর যাতে আগে উচ্চারিত হয়।

(***)

ওয়াসিফের জন্য নতুন জামা আনিয়েছে আহি। ওয়াসিফ গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়ার পর আহির রুমে ঢুকলো। চার দেয়ালের পরিবর্তে দুই দেয়াল। বাকি দুই পাশে বড় কাচের জানালা।
গ্রিল বিহীন খোলা জানালা। জানালার পাশে লাগোয়া বিছানা। একপাশের দেয়ালের সাথে লাগোয়া কাচের আলমারিতে আহির ব্যবহারের জিনিসপত্র, জামা-কাপড়। অন্যপাশের দেয়ালে বড় একটা আয়না। তার পাশে ছোট পড়ার টেবিল। সেখানে কয়েকটা বই রাখা, একটা ফুলদানি আর একটা মোটা ডায়েরী রাখা। পাশে ছোট একটা গলির মতো স্থান। সেই গলির একপাশের দেয়ালে আহির আঁকা বিভিন্ন ছবি ঝুলছে। অন্যপাশে ওয়াশরুম। গলির ওপাড়ে খোলা বারান্দা।

ওয়াসিফ অবাক দৃষ্টিতে আহির রুম দেখে বলল,
“আচ্ছা আন্টি, তুমি কি কুইন?”

আহি ওয়াসিফকে তার পাশে বসিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি তো রানী। এই ছোট প্রাসাদের রানী।”

“আচ্ছা, তাহলে তোমার রাজা কোথায়?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“সব রানীর রাজা থাকে না। কিছু রানী একা থাকে।”

“আর যাদের রাজা থাকে তাদের কি বলে?”

“সম্রাজ্ঞী বলে। রাজার সম্রাজ্ঞী।”

“তুমি কখন সম্রাজ্ঞী হবে?”

“যেদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়া-পাওয়ার সবটাই আদায় হয়ে যাবে। নতুন আবদারের ইচ্ছে জাগবে। নতুন করে সুন্দর কিছু মুহূর্তের আবদার করতে ইচ্ছে করবে।”

আহির গলা ভারী হয়ে এলো। ওয়াসিফ বলল,
“তোমার মন খারাপ কেন হলো?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“কোথায়? আমি তো ঠিকই আছি।”

আহি এরপর ফোন হাতে নিয়ে নাওফা রেনুকার নম্বরে আবার ডায়াল করলো। রেনু কল ধরে বলল,
“আমার ভাইকে ফোন দিয়েছি। ও না-কি ইমার্জেন্সি কাজে আটকে গেছে। ওর বন্ধুকে পাঠাচ্ছে।”

“বন্ধু? এমন অপরিচিত কারো হাতে আমি আপনার ছেলেকে দিয়ে দেবো?”

“আপনি আদ্যকে একটু ফোনটা ধরিয়ে দিন।”

আহি লাউড স্পিকারে দিলো। রেনু ওয়াসিফকে বলল,
“আদ্য, বাবা। তোমার মামা তো যেতে পারছে না। মা তো অসুস্থ, বাবা। তুমি অলয় আংকেলের সাথে চলে আসবে?”

ওয়াসিফ বলল, “আচ্ছা, মা।”

রেনু কল কেটে দিতেই আহি ওয়াসিফকে জিজ্ঞেস করলো, “অলয় কে?”

“অলয় মামার কলিগ। মামার অনেক ভালো ফ্রেন্ড।”

আহি মনে মনে ভাবলো,
“আমার বাসার এড্রেস তো নিলোই না উনি।”

আহি রেনুকে আবার ফোন করে ঠিকানা দিয়ে দিলো। রেনু বেশ অবাক হলো। আফিফ বললো, সে অলয়কে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাহলে পাঠালো’টা কোথায়? হয়তো স্কুলে পাঠিয়েছে। রেনু আফিফকে মেসেজে ঠিকানা পাঠিয়ে দিলো। আফিফ মেসেজটি দেখে কপাল চাপড়ালো। ঠিকানা না নিয়ে অলয়কে পাঠিয়ে দিলে আহি নিশ্চিত সন্দেহ করতো। পরক্ষণেই ভাবলো, কেন সন্দেহ করবে? এ আর টি গ্যালারি থেকে কি আহির ঠিকানা নেওয়া সম্ভব নয়? মাথাটা একদম এলোমেলো হয়ে গেছে আফিফের।

(***)

ওয়াসিফ আহির টেবিলের কাছে যেতেই মোটা একটা ডায়েরী পেলো। বেশ সুন্দর ডায়েরীটা। বাদামি মলাটের। মলাটের চামড়া বেশ আকর্ষণীয়। ওয়াসিফ ডায়েরীটা খুলেই অবাক। এতো সুন্দর সুন্দর স্কেচ? কিসব লেখাও আছে পাশে। এখনো রিডিং পড়তে পারে না সে। ওয়াসিফ জোরে জোরে উচ্চারণ করলো,
“এ স্বর আ ব বিন্দু র।”

আহি চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো। সে লাফিয়ে উঠে বসলো। ওয়াসিফের হাতে ডায়েরীটা দেখে তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে, সেটা টেনে নিয়ে ফেলল। ওয়াসিফ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহির দিকে। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“সরি বাবু। এটা ধরো না। ঠিক আছে?”

আহি ডায়েরীটা তার কাচের আলমারিতে রেখে দিলো। আর ওয়াসিফ এক দৃষ্টিতে সেই ডায়েরীটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কাচের আলমারি হওয়ায় কিছুক্ষণ পর পর তার দৃষ্টি সেদিকে আটকাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবছে,
“হোয়াইট হোয়াইট আন্টি, এভাবে কেন বুকটা নিয়ে নিলো? কত্তো সুন্দর কার্টুন আঁকা ওখানে। আমার তো লাগবেই বুকটা।”

ঘন্টাখানেক বাদে আমিন এসে ওয়াসিফকে নিয়ে গেলো। ওয়াসিফ চলে যেতেই আহি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। আর হারিয়ে গেলো ঘুমের রাজ্যে।

১১৮।

আমিন অর্ধেক পথ গিয়েই গাড়ি থামালো। ওয়াসিফ গাড়ি থেমে যেতে দেখে বলল,
“আংকেল, তুমি কি আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে না?”

আমিন বলল,
“না, তোমার মামা নিয়ে যাবে। ওই যে দাঁড়িয়ে আছে তোমার জন্য।”

ওয়াসিফ গাড়ি থেকে নেমে দেখলো আফিফ মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে আফিফের কাছে গিয়ে বলল,
“মামা, তোমার জরুরি কাজ শেষ?”

আফিফ ওয়াসিফকে মোটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ।”

আমিনকে ধন্যবাদ দিয়ে আফিফ বাকি পথ ওয়াসিফকে নিয়ে গেলো। ওয়াসিফ আফিফকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলল,
“মামা, তুমি এইটুকুর জন্য আমিন আংকেলকে কেন আসতে বলেছো? চলে এলেই পারতে। জানো, আমি আজ কোথায় গিয়েছি?”

আফিফ জোরেই বলল, “চুপচাপ বসে থাকো।”

“মামা, শুনবে না?”

“বলো, বলো।”

“হোয়াইট হোয়াইট আন্টির হোয়াইট হোয়াইট প্যালেসে। জানো, প্যালেসটা একদম ধবধবে সাদা।”

“সাদা প্যালেসে ভূত থাকে, জানো না?”

ওয়াসিফ অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ, হোয়াইট প্যালেসে হোয়াইট ভূত থাকে। আর যাবে কখনো হোয়াইট হোয়াইট আন্টির সাথে?”

ওয়াসিফ ঝাঁকরে ধরলো আফিফকে। আফিফ মৃদু হাসলো। বাসায় পৌঁছেই আফিফ ওয়াসিফকে নামিয়ে দিলো মোটর সাইকেল থেকে। ওয়াসিফ কোনো কথা না বলে দৌঁড়ে চলে গেলো উপরে। চার তলা নিজেই উঠলো। আফিফ চাবি আর হেলমেট নিয়ে উঠে দেখলো, দরজা খোলা। আফিফা বেগম ছেলেকে দেখে বললেন,
“আদ্যকে এতোক্ষণ পর কেন আনলি? আর ওর জামা পালটে দিয়েছিস কেন?”

“আমি তো পালটাই নি। যার বাসায় গেছে ওরা হয়তো পালটে দিয়েছে।”

এদিকে ওয়াসিফ রুমে ঢুকে গভীর মনোযোগ দিয়ে ডোরেমনের নুড়ি পাথরটি দেখতে লাগলো। রেনু ছেলেকে ঘরে ফিরতেই পাথর নিয়ে বসে থাকতে দেখে বলল,
“বাবা, কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? তোমাকে নিয়ে গেছেন উনি কে? চেনো?”

ওয়াসিফ রেনুর সামনে বসলো। গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার মাথায় এবার সব সাঁই সাঁই করে ঢুকছে। সব ডোরেমনের গ্যাজেটের জন্য হয়েছে।”

ওয়াসিফ নুড়িপাথরটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা ডোরেমনের গ্যাজেট। এটা আজ আমি স্কুলে নিয়ে যাই নি, তাই জিনি এসেছে আমার খোঁজ নিতে।”

“জিনি?”

“হুঁ, হুঁ। হোয়াইট হোয়াইট আন্টি কোনো মানুষ নয়। উনি একজন জিনি। জিনি সবার উইশ পূরণ করে। আমার উইশ ছিল স্কুলের পাশে ওই সুন্দর বাসাটাতে যাওয়া। আন্টি আমার উইশ পূরণ করেছে। এরপর আমাকে এই ডোরেমনের গ্যাজেট দিয়েছে। এটা থাকলে উনি বুঝতে পারে, আমি বিপদে পড়েছি কি-না। আজ গ্যাজেটটা নিয়ে যাই নি। আর উনিও এসেছে। ওয়াও, আমার একটা জিনি আছে।”

আফিফ ওয়াসিফের কথা শুনে দরজায় দাঁড়িয়ে হোঁ হোঁ করে হাসতে লাগলো। ওয়াসিফ মামার কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি হাসছো কেন? জিনির বাসায় একটা দুষ্টু পেত্নীও আছে। ওটাও আজ হেসেছিল। জানো, জিনি আমাকে সেই পেত্নীর হাত থেকে বাঁচিয়েছে।”

“এখন তোমার হোয়াইট হোয়াইট আন্টি তোমার জিনি হয়ে গেলো?”

“হ্যাঁ, আন্টি তো ভেরী গুড। তাই গুড পেত্নী।”

“পেত্নী আবার গুড হয়?”

ওয়াসিফ ভাবুক কন্ঠে বলল,
“হুম, হয়তো উনাকে আটকে রেখেছে দুষ্টু পেত্নীরা।”

“ওরে আমার বাবারে, মাফ করো আমাকে।”

আফিফ নিজের ঘরে চলে এলো। সন্ধ্যায় ওয়াসিফের ব্যাগটা খুললো আফিফ। আফিফই তাকে পড়ায়। ওয়াসিফ নাস্তা করছে এখনো। আফিফ ব্যাগ থেকে ওয়াসিফের স্কুলের ডায়েরী আর খাতা বের করতেই ভেতরে কিছু একটা খেয়াল করলো। ভারী আর মোটা ডায়েরী। আফিফ সেটা বের করলো। ভ্রূ কুঁচকে সে ডায়েরীটির দিকে তাকালো। এজন্যই ব্যাগটা এতো ভারী ছিল? সে উলটো ভাবছে, ওয়াসিফ সব বই-খাতা নিয়ে স্কুলে গেছে কি-না। আফিফ চেয়ার টেনে বসলো। বাদামি মলাটের ডায়েরী। আফিফ ডায়েরীটার পৃষ্ঠা উল্টালো। প্রথম দু’পৃষ্ঠা খালি। তৃতীয় পৃষ্ঠায় লেখা।

“সেদিন তাকে প্রথম দেখেছি। ধীরগতিতে হাঁটছিল। বৃষ্টির আঁচ লাগছিল তার শরীরে। কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না তার৷ আমার দৃষ্টি তার দিকে বার-বার আটকাচ্ছিল। সাদা শার্ট লেপ্টে ছিল তার শরীরের সাথে। এলোমেলো চুলগুলো দেখে অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করেছিল সেদিন। এতো সাধারণ একটা ছেলেকে নিয়ে আমি এতো ভাবছি কেন?”

এতোটুকু পড়ে আফিফ থমকে গেলো। তার হৃদকম্পন বেড়ে গেলো যেন। পরের পৃষ্ঠা খুলতেই দেখতে পেলো ডায়েরীর সাথে সেঁটে রাখা একটা স্কেচ। নিচে লেখা,
“খসড়া স্কেচ। এই স্কেচটি বাঁধিয়ে ফেলেছি।”

পাশে লেখা,
“সেদিন ক্লাসে বটবৃক্ষ আঁকতে দেওয়া হয়েছিল। আর আমি জানি না, কেন সেদিন তাকেই এঁকেছিলাম।”

পরের পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা,
“পাঁচশো টাকা দিয়ে এই ডায়েরীটা কিনেছি। কার জন্য? ফর মাই লাভ।”

তার অপর পাতায় গোলাপের পাপড়ি আঠা দিয়ে লাগানো। পাশে একটা চিরকুট লাগানো। সেটাতে লেখা, “আফিফ রাফাত।”

নিচেই লেখা,
“প্রথম তোমার নাম জানার চেষ্টা। কি সুন্দর নাম! আফিফ রাফাত।”

পরের পৃষ্ঠায় লেখা,
“তোমার দিকে তাকিয়ে তোমার আমার প্রেমের গল্প লেখা শুরু করছি। বিষয়টা চমৎকার না? এমন উন্মাদ প্রেমিকা কি আগে দেখেছো? নিশ্চয় দেখো নি। জানো, আজই কিনলাম এই ডায়েরীটা। আর পথে দেখা হয়ে গেলো তোমার সাথে। তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, কথা বলছো কোনো এক অচেনা ছেলের সাথে। আর আমি রৌদ্রতাপ ভুলে রিকশার পাশে তোমাকে দেখা যায় এমন স্থানে বসে আছি। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি তোমাকে। আচ্ছা এআর, মেয়েরা কি এভাবে লুকিয়ে কারো দিকে তাকায়? মেয়েরাও কি এভাবে ভালোবাসে? জানি না, কিন্তু আমার তোমাকে এভাবে ভালোবাসতেই ভালো লাগে।”

তার পাশেই আফিফের স্কেচ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আফিফ। সামনে একটা ছেলের অবয়ব। আহি বসে আছে ইটের উপর। পাশে একটা রিকশা৷

(***)

আফিফের হাত কাঁপছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবুও ঘামাচ্ছে সে। সেই মুহূর্তেই দৌঁড়ে রুমে ঢুকলো ওয়াসিফ। মামার হাতে ডায়েরীটা দেখে বলল,
“মামা, এটা জিনির ডায়েরী।”

আফিফ শক্ত কন্ঠে বলল,
“আদ্য, তুমি না বলে এই ডায়েরী নিয়ে এসেছো কেন?”

ওয়াসিফ মুখ ছোট করে বলল,
“আমার সুন্দর লেগেছিল তাই।”

“ব্যাড ম্যানার্স।”

ওয়াসিফ মাথা নিচু করে নিলো। আফিফ আরো কিছু বলার আগেই সে দৌঁড়ে চলে গেলো রুমের বাইরে। ওয়াসিফ চলে যেতেই আফিফ ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো।

পরের পৃষ্ঠায় লেখা ছিল আফিফের মসজিদে যাওয়ার মুহূর্তটি। আহি আফিফের পরণের শার্ট, ঘামে ভিজে যাওয়া শরীর, কাঁধের ব্যাগ, পায়ের মলিন স্যান্ডেল, হাতের ঘড়িটাও সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে ডায়েরীতে সেই বিষয়ে উল্লেখ করেছে। এবার আফিফের চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো,
“মেয়েটা আমার পিছু করতো, আর আমি টেরই পাই নি?”

পরের দু’পৃষ্ঠা পর লেখা,
“ক্লান্ত মুখ। নাকের ডগায় জমে ছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। হালকা হাওয়া তোমার ঘর্মাক্ত কপালটি শুকিয়ে দিয়ে গেলো। আর তোমার ঘামে লেপ্টে থাকা চুলগুলোও মুক্ত হলো। তুমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একটা ভাঙা বেঞ্চে বসলে। কাপে চুমুক দিতেই তোমার চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। চা নিশ্চিত গরম ছিল। কিন্তু তোমার কপালে একটুও ভাঁজ পড়লো না। শুধু চোখ দু’টোই সাড়া দিয়েছিল। আজ কেন যেন মনে হলো তুমি শুধু ক্লান্ত নও। বড্ড ক্লান্ত। তোমার মনে কি ভীষণ কষ্ট, এআর? আমাকে ভাগ দিবে সেই কষ্টের? আমি তোমার কষ্ট নিয়ে নেবো। দেখবে তুমি খুব সুখী হবে। অনেক সুখী হবে। কারণ তোমার জন্য আমি আছি।”

পাশে একটা স্কেচ আঁকা। যেখানে আফিফ কাঠের বেঞ্চে বসে প্লাস্টিকের কাপ হাতে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। পাশে টংয়ের দোকান। আর দূরে দাঁড়িয়ে আহি তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্কেচের নিচে লেখা,
“কাপটা চুরি করে ফেলেছি আমি। তুমি কাপটা এভাবে ফেলে গেলে! আমি তো এখন এই কাপটার দিকে তাকিয়েই তোমাকে অনুভব করবো।”

পরের পৃষ্ঠায় আফিফের স্কেচ। যেখানে সে হাসছে। নিচে লেখা,
“তুমি একদম হাসো না। ভালোই হয়েছে কম হাসো। এতো চমৎকার হাসি। মনে পড়লেই পাগল হয়ে যাই। সারাদিন তো আমার মাথায় তোমার সেই হাসি-হাসি চেহারাটাই ঘুরছে।”

এরপর দু’পৃষ্ঠা খালি। পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই থমকে গেলো আফিফ। লেখা ছিল,
“আজ আমি তোমার পিছু নিয়েছি। তোমার জন্য বাসে চড়েছি, কাঁদায় স্যান্ডেল হারিয়ে এসেছি। আর তুমি? একবারো আমার দিকে তাকাও নি। এআর, সত্যিই কি আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি? আমার না তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। তুমি পাশে থাকলে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। আজকে যতোক্ষণ তুমি আমার কাছে ছিলে, আমি ততোক্ষণ শুধু হেসেছি। এই হাসি মনের হাসি। আমার মনটা চমৎকার ভাবে হাসে, জানো? তোমাকে দেখলে আমার মন হাসে। তোমাকে কিন্তু সারাজীবন আমার মনকে হাসাতে হবে।”

পাশেই একটা স্কেচ। যেখানে একটি বাসের ভেতরে অনেক যাত্রী। যাত্রীদের ভীড়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। তার পেছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্কেচটির নিচে লেখা,
“প্রথম স্পর্শ পেয়েছি তোমার, আর এই স্পর্শ আমার আত্মাকে স্পর্শ করে ফেলেছে।”

পরের পৃষ্ঠায় লেখা, “আমি তোমার প্রেমে পড়েছি, এআর।”

পেছনের এক পৃষ্ঠা পর আরেকটা স্কেচ। সেখানে আঁকা, খোলা মাঠে একটি বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে একটি ছেলে। পাশে লেখা,
“কেন কেঁদেছো তুমি? কি এমন কষ্ট তোমার? আমাকে দিয়ে দাও তোমার কষ্ট। আমি আমার সুখগুলো তোমার সাথে ভাগ করে নেবো।”

আফিফ পরের পৃষ্ঠাগুলো পড়ে গেলো। সেখানে আহির দেওয়া প্রথম চিরকুটের অনুভূতি, লিনাশার সেই চিরকুট লিখে দেওয়া, ক্লাসে পলি আপু গ্রুপে এই নিয়ে হাসাহাসি এসব কথার উল্লেখ ছিল। পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই আফিফ একটা ভাঁজ করা কাগজ পেলো। সেটা খুলতেই দেখলো একটা মলিন স্কেচ। যেটা দেখতেই আফিফের মনে পড়লো, এটা সে-ই স্কেচটি যেটা আহি তাকে প্রথম দিয়েছিল। আর সে হারিয়ে ফেলেছিল। সেই স্কেচের নিচে লেখা,
“তোমার কাছে আমার গুরুত্ব এতো কম কেন, এআর? আমি তোমার ফেলনা যত্নে রাখি, আর তুমি আমার আঁকা স্কেচটিও আগলে রাখতে পারলে না?”

এর পরের পৃষ্ঠায় আঁকা রাস্তার উপর একটা স্যান্ডেলের স্কেচ। তার পাশেই লেখা,
“তোমার ফেলনাও আমার কাছে অনেক মূল্যবান, এআর। আজ তুমি স্যান্ডেলটি ফেলে গিয়েছিলে। আর আমি কুঁড়িয়ে নিয়েছি। ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে তোমায় দেখতে গিয়েছি। রাস্তায় এক কোমর জল, তাই বাবা গাড়ি দেয় নি। আমি পানিতে ভেসে গেলে তুমি কিন্তু হারিয়ে ফেলতে এক উন্মাদ প্রেমিকা। ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে, এআর। আজ তোমাকে চারুশিল্পে দেখেই আমার সারাদিনের ধকল কেটে গেছে।”

আফিফ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। ডায়েরী বন্ধ করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে বলল,
“কিছুই নেই আমার মধ্যে। তবুও আমাকে কেন এতো ভালোবেসেছিলে? আমি তো জানতাম, তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু এভাবে? আমি তো এবার নিজের সাথেই চোখ মেলাতে পারছি না। আমি অপরাধী, আহি। আমি তোমার অপরাধী।”

(***)

সারারাত ঘুমায় নি আফিফ। ওয়াসিফকেও পড়ায় নি।এদিকে ওয়াসিফ মামা বকেছে তাই মুখ ভার করে বসে আছে। তার অভিমান বাড়ছেই। বকুনি দেওয়ার পর তো মামা অন্তত তার অভিমান ভাঙাতে আসে। কিন্তু আজ আসছেই না। মামা-ভাগ্নে আজ রাতে খায় নি। আফিফা বেগম আর রেনু এ নিয়ে চিন্তায় অস্থির। অন্যদিকে আফিফ মেঝেতে বসে আছে আহির ডায়েরী হাতে। পড়ছে আহির উন্মাদনার গল্প।

প্রথম আফিফকে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দেওয়া আর সেই চিরকুট, আফিফের এক্সিডেন্টে আহির ছুটাছুটি, আফিফের রক্ত লেগে থাকা সেই জামাটা যত্ন করে তুলে রাখতে চাওয়া, মুনিয়া খালা সেই জামা ধুয়ে ফেলায় আহির কান্নাকাটি, আবার সেই জামা পরেই আফিফের স্কেচ আঁকার প্রত্যেকটি ঘটনা সেই ডায়েরীতে লেখা। এরপর কয়েক পৃষ্ঠা পর লেখা,
“প্রথম তোমার চোখাচোখি।”

তার নিচে লেখা ছিল চারুশিল্পের মেলায় আফিফের ক্যালিগ্রাফিগুলো কেনার কথা। কীভাবে সালমা ফাওজিয়াকে রাজি করিয়ে আফিফের ক্যালিগ্রাফি সব কিনে নিয়েছিল আহি! পরের পাতায় লেখা ছিল,
“আমাদের চোখাচোখি হলো। আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল, অথচ তুমি আমার হৃদকম্পন শুনলে না। আমার ভেতরটা কীভাবে উত্তাল হাওয়ার মতো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, অথচ তুমি বুঝলে না। তুমি কি আমাকে একটুও খেয়াল করো না?”

আফিফ ডায়েরীটা বন্ধ করে বালিশের নিচে রাখলো। দমবন্ধকরা অনুভূতি। পড়েই আফিফের ভেতর‍টা চুরমার হয়ে যাচ্ছে, তাহলে আহির কি অবস্থা হয়েছিল? ডায়েরীটা অনেক বড়। এক রাতে শেষ হবে না। আফিফের চোখ জ্বালা করছে। অস্থির লাগছে। ইচ্ছে করছে, ছুটে গিয়ে আহিকে জড়িয়ে ধরতে। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তখন কেন আফিফ আহির পাশে ছিল না? আফসোস হচ্ছে খুব। জীবনের অনেক সিদ্ধান্তে আজ খুব আফসোস হচ্ছে তার।

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৫৪+৫৫

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৪||

১১২।
রক্তাক্ত প্যাকেটের ভেতর থেকে রাদের দেওয়া শাড়িটা বের করলো আহি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা খুলে গায়ে জড়ালো সে। শেষ মুহূর্তে রাদের বলা কথাটি মনে পড়লো তার।
“সব শাড়ি আর এই শাড়ি এক না। এই শাড়িটা আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে। অনেক বছর পর যখন তুই এই শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়াবি, আমার মনে পড়বে আমার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের কথা। মনে পড়বে নিজের টাকায় তোর জন্য আমার প্রথম গিফট কেনার মুহূর্তটি। তোর হাসি দেখতে দেখতে আমি মরেই যাবো বোধহয়। এতো মিষ্টি হাসি তোর! আমার হৃদয়টাই কাঁপিয়ে দেয়।”

আহি শাড়িটা ভাঁজ করে নতুন প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। এরপর আলমারি খুলে প্যাকেটটা ড্রয়ারে রেখে তার উপর আলতোভাবে হাত রাখলো আর বলল,
“আমি জানতে চাই না তুই কোথায় আছিস। আমি সবসময় মনে করবো, তুই আছিস আমার আশেপাশে। তোকে কখনো দেখতে চাইবো না আর। কারণ সত্যটা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। লোকে বলে, তুই নেই। আমার জন্য তুই বেঁচে আছিস। বেঁচে থাকবি আমার মেডিসিন হয়ে। আমি তোকে ভালোবাসতে পারি নি। তার মানে এই না যে আমি তোকে হারিয়ে ফেলতে চেয়েছি। তোর মতো বন্ধু পাওয়ার জন্য ভাগ্য লাগে। আমি সব হারিয়েছিলাম, রাদ। লিনাশা ছিল না, আমার ভালোবাসা ছিল না, মা ছিল না, শান্তি ছিল না। শুধু তুই ছিলি। এখন মা আছে, লিনাশাও আছে। কিন্তু তুই নেই। সৃষ্টিকর্তা সবসময় কাউকে পূর্ণতা দেয় না। কিছু না কিছু রেখেই দেয়। তোকে কেন রেখে দিলো রে? আমাকে তো ফেলেই চলে গেলি, রাদ। একবার কথা বলার সুযোগ হতো। বলতাম, সব ভালোবাসায় প্রণয় থাকে না। কিছু ভালোবাসা আত্মার সাথে আত্মার হয়। সব ভালোবাসায় চাওয়া-পাওয়া থাকে না। পাশে থাকলেই শান্তি লাগে। সব ভালোবাসায় স্পর্শ থাকে না। কিছু ভালোবাসা কথার ভীড়েই থাকে। তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তোর পাশে আমি শান্তি পাই। তোর সাথে কতো কথা বলি। শুধু একটা কমতি ছিল। আমি তোর স্পর্শ নিতে চাই নি। আমি তোকে ওভাবে চাই নি, রাদ। তাই বলে এভাবে ফেলে চলে যাবি? সেদিন আমার ব্লেড দিয়ে নিজের হাত না কেটে তাজওয়ারের গলা কাটা উচিত ছিল। যাই হতো, এট লিস্ট তুই তো বেঁচে থাকতি। আমার না, ইউকে যাওয়ায় উচিত হয় নি। ইউকে না গেলে তোর সাথে বন্ধুত্ব এতো গাঢ় হতো না। তোকে আর ফিরে এই দেশে আসতেও হতো না। সব হয়তো আমার জন্যই হয়েছে। আমি তোর জীবনে না আসলে কি এমন হতো? রাদ, প্লিজ দোস্ত। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তোকে তোর মতো করে ভালোবাসতে পারি নি। কিন্তু যতোদিন বেঁচে থাকবো, তুই আমার স্মৃতিতে বেঁচে থাকবি। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে, আমার পাশে থাকবি। মানুষ মরে যায়, কিন্তু তার কাজ তাকে বাঁচিয়ে রাখে। তোর মূল্য কার কাছে কেমন, আমি জানি না। আমার কাছে তুই অমূল্য। তুই কার জীবনে কতোদিনের স্থায়ীত্ব ধরে রেখেছিস, জানি না। আমার মৃত্যু অব্ধি তুই আমার মনে সবচেয়ে ভালো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবি। তোকে কখনো ভালোবাসি বলা হয় নি। এটাই শুনতে চেয়েছিলি, তাই না? আমি মিথ্যে আশা দিতে পারি না। একজনকে খুব ভালোবেসেছি। তার ঠোঁটে হাসি দেখে আশা নিয়ে ছিলাম, সেও আমায় ভালোবাসে। হয়তো বাসতো, কিন্তু এখন আমার স্থান তার হৃদয়ে কোথাও নেই। তবে যেই আশাটা ছিল, আর সেটাই আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে। আমি তাই তোকে মিথ্যে আশা দেই নি। তবে পাশে থাকার আশা দিয়েছিলাম। যেই আশা ভাগ্য পূরণ করতে দেয় নি। আমি তোকে ভালোবাসি, রাদ। বন্ধুর মতো ভালোবাসি। যেই ভালোবাসায় আত্মার সম্পর্ক থাকে, প্রণয়ের নয়। আর বন্ধু তো প্রিয় পুরুষের চেয়েও আপন হয়। আর কারো আপন মানুষ হওয়াটাই চমৎকার ব্যাপার। পৃথিবীতে প্রেমিক পুরুষ সবারই থাকে, আপন মানুষ সবার থাকে না৷ আমি হেরে যাওয়া একজন আহি, যার জীবনে তুই রাদ হয়ে আসা এক আশীর্বাদ।”

(***)

আহির কাছে বাঁধাই করা ক্যালিগ্রাফি পাঠিয়ে দিলো পদ্ম। সে আজ বেশ খুশি। সে জানে আহি চিঠি পড়ার পর কোনোদিন আফিফের সাথে দেখা কর‍তে আসবে না। দু’দিন পর আফিফ চাকরির জয়েনিং লেটার পেলো। অনলাইনে এসেছে। রাজশাহীতে তার পোস্টিং। এক সপ্তাহের মধ্যেই জয়েন করতে হবে আফিফকে। পদ্ম বেশ খুশি। সবকিছুই তার ইচ্ছেমতো হচ্ছে। জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিয়েছে পদ্ম। আফিফা বেগমও টুকটাক ব্যাগে ঢুকাচ্ছেন। রেনু মায়ের পাশে বসে আছে থম মেরে। আফিফা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বললেন,
“জানি তোর কেন এতো খারাপ লাগছে। ছেলে দুইটাকে দেখতে পারবি না, তাই! নিয়াজী থেকে দূরে থাকায় ভালো। তোর অনাগত সন্তানটা তোর সাথেই তো থাকবে। নিয়াজী তো বললো, এই সন্তান তোর কাছেই রাখবে।”

রেনু ধরা কন্ঠে বলল,
“নিয়াজীর কাছ থেকে দূরে থেকে কি হবে, জীবন ধ্বংসকারী যদি আশেপাশেই থাকে?”

“কি বলছিস এসব?”

রেনু উঠে দাঁড়ালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কিছু না। অনেক হিসেব বাকী আছে। সব তুলতে হবে আমার। রাত-দিন শরীরের আঘাত নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকার শোধ তুলতে হবে। বছরের পর বছর চোখের পানি ফেলার শোধ তুলতে হবে।”

রেনু কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। আফিফা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন হতভম্বের মতো। রেনুর বলা কথাগুলো কিছুই বুঝলেন না তিনি।

১১৩।

কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে পদ্মকে দেখতে এলো আহি। আহিকে বারান্দা থেকে দেখে রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লো পদ্ম। চিঠি পাঠানোর পরও আহি কেন এলো এখানে? আহির মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না তার। পদ্ম আফিফের কাছে এসে বলল,
“আহি কেন এসেছে, বলুন তো!”

আফিফ অবাক হয়ে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম আফিফের পায়ের কাছে বসে বলল,
“আমি আহিকে সব বলে দিয়েছি। আপনি কসম করেছেন, আমি সব জানিয়ে দিলে, আপনি আহির কাছে ফিরে যাবেন না। এখন যান, ওকে আপনি তাড়িয়ে দিন। আপনি এখন যদি আহিকে বের না করেন, আমি নিজের প্রাণ নিয়ে নিবো।”

আফিফ পদ্মকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো তুমি?”

“আমি সত্যি এই কাজ করবো। কারণ আপনি ছাড়া আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।”

“তুমি আমাকে পাগল করে দিচ্ছো, পদ্ম। আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও।”

“শান্তিই তো হবে। এরপর সব শান্তি হবে। আহিকে তাড়িয়ে দিন। এটাতো ওর আর আপনার জন্যই ভালো। আহি বুঝবে, আপনি ওকে এখন আর পছন্দ করেন না। এরপর আহি মুভ অন করতে পারবে। আর আপনাকে তো বলেছিই, আপনি ওর যোগ্য নন।”

আফিফের বুকটা ভারী হয়ে এলো। পদ্ম আফিফকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“যাবেন আপনি? আমি যদি সুইসাইড করি, আপনার জেল হবে। চাকরিটাও যাবে আপনার। রেনু আর মায়ের কি হবে তখন? একবার জেল হলে নতুন চাকরি পেতেও সমস্যা হবে। কেউ কি জানতে চাইবে কে অপরাধী? পেছনের কারণটা কি? সবাই জানবে, আপনি আমাকে মানসিক অশান্তিতে রেখেছেন, তাই আমি সুইসাইড করেছি। বেশিদিন জেল না হোক, অন্তত একদিনের জেলই তো আপনার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেবে।”

আফিফ পদ্মের কথা শুনে ধপ করে বিছানায় বসে বলল,
“তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসো নি। তোমার এই আচরণ দেখে আমার তো মনে হচ্ছে না তুমি আমাকে ভালোবেসেছো। সবটাই তোমার জেদ। আহির সাথে জেদ ধরেছো তুমি। আমি কোনো খেলনা নই পদ্ম যে তোমরা দুইজন আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে।”

পদ্ম শীতল দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে ড্রয়ার ঘেঁটে একটা ব্লেড বের করলো। আফিফ ভীত চোখে সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“পাগলামো করছো?”

“আমি সবাইকে বলে যাবো, আমার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী। আমার রেইপ হয়েছে, তাই আপনি আমাকে স্পর্শ করছেন না। আপনার মা আমাকে মানসিক অত্যাচার করেছে, কারণ আমি সন্তান দিতে পারবো না।”

আফিফ হাতজোড় করে বলল,
“মাফ চাই, আল্লাহর ওয়াস্তে এসব করো না।”

“তাহলে যান। আহিকে বের করে দিন। অপমান করে বের করবেন, যাতে দ্বিতীয় বার আপনার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস না থাকে।”

আফিফ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। পদ্ম চেঁচিয়ে বলল, “যাবেন?”

আফিফের পা চলছে না। ধীর পায়ে সে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো। বুকটা ভারী হয়ে আসছে তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে কোনো গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছে, যেখান থেকে বেরুনোর কোনো পথ নেই। আহি বসার ঘরে ছিল। রেনু দরজা খুলে দিয়েছে। আফিফকে দেখে আহি উঠে দাঁড়ালো। রেনু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অন্য রুমে চলে গেলো। রেনু যেতেই আহি একটা মিষ্টির প্যাকেট আফিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ আমি কোম্পানির সিইও হিসেবে জয়েন করেছি। তাই মিষ্টি নিয়ে এলাম। পুষ্প বলল, তোমার না-কি রাজশাহীতে চাকরি হয়েছে। কংগ্রাচুলেশন। পদ্ম তো চাকরির ব্যাপারে আমাকে কিছু বললোই না। আমার সাথে রাগ করেছে হয়তো। যাই হোক, মিস করবো।”

আহি আফিফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্মকে।”

আফিফের বুকটা খালি হয়ে গেলো। নিজেকে শক্ত করে মিষ্টির প্যাকেটের দিকে এক নজর তাকিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো প্যাকেটটি। আহি আফিফের এমন কাজে অবাক হলো খুব। আফিফের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই আফিফ আহির বাহু চেপে ধরে বলল,
“প্লিজ, যাও আমার জীবন থেকে। বের হয়ে যাও। আর কতো বার তোমার মুখটা দেখতে হবে? তোমাকে দেখলে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। আমার আপার মৃত চেহারাটা ভেসে আসে চোখের সামনে। কখন ছাড়বে আমার পিছু?”

আহি আফিফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। আহির চোখের দিকে তাকানোর সাহস পেলো না আফিফ। সে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই রেনুর মুখোমুখি হলো। রেনু কিছু বলার আগেই আহি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়লো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আহিকে বেরিয়ে যেতে দেখেই পদ্ম স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। আর আফিফ সেখানেই বিধ্বস্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। রেনু ভাইয়ের কাছে এসে বলল,
“কি বলেছো, ভাইয়া? আহিকে কি বলেছো তুমি? মিষ্টিগুলো এভাবে ফেলে দিলে কেন?”

আফিফ মেঝেতে বসে পড়লো। চুল খামচে ধরে বলল,
“আমি ক্লান্ত। আমি খুব ক্লান্ত।”

রেনু আফিফের গালে হাত রেখে বলল,
“ভাইয়া, ওই মহিলাকে ছেড়ে দাও তুমি।”

আফিফ রেনুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। রেনু কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“এতো বড় পাপ করেছে, আর তুমি তাকে সহ্য করছো? আমি পারবো না ওই মহিলাকে দেখতে। আমার গায়ে এখনো বেল্টের দাগ। তুমি তাকে মেরেছো কখনো? অথচ তার জন্যই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমি একটা জানোয়ারের সাথে সংসার করে গেছি। বাধ্য করেছে আমাকে ওই মহিলা।”

আফিফ রেনুর মাথায় হাত রেখে বলল,
“আর কষ্ট করতে হবে না তোকে। আমি আমার বোনকে নিয়ে এসেছি তো।”

“তো? আমার স্বপ্ন তো শেষ। আপাকে তো হারিয়ে ফেলেছো। আমি বেঁচে আছি, কার ভরসায়? আমার জীবনে কি আছে? সংসারটাও ঠিকিয়ে রাখতে পারি নি। গ্রামে গেলে মানুষ কি ভাববে আমাকে? তোমার বউ আমার কপাল থেকে স্বামীর সুখ কেঁড়ে নিয়েছে। তার জন্য আমি একটা অমানুষের স্ত্রী হয়ে পড়ে ছিলাম, আর সে সুখের সংসার করবে? আর আমি বসে বসে দেখবো?”

আফিফ অবাক হয়ে বলল, “তুই কীভাবে জানলি এসব?”

“চিঠি পড়ে জেনেছি।”

রেনু উঠে তার রুমে গিয়ে সেই চিঠিটা নিয়ে এলো যেটা পদ্ম আহিকে লিখেছিল। সেদিন পদ্ম চিঠি লিখে প্যাকেটে ঢুকানোর পর রেনু সেই রুমে গিয়ে প্যাকেটে কি আছে দেখতে গিয়েই চিঠিটা পেলো। সে চিঠিটা সরিয়ে একটা সাদা কাগজ ভাঁজ করে প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। পদ্ম শেষবার প্যাকেটটি স্টেপল করার আগে সেই সাদা কাগজটাকে চিঠি ভেবে আহির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। রেনু চিঠিটা এনে আফিফকে দিলো। আফিফ চিঠিটা পড়তে পড়তেই পদ্ম রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আফিফ চিঠি পড়া শেষে পদ্মের সামনে চিঠিটা মুচড়ে ফেলে বলল,
“আর কতোটা নিচে নামবে, পদ্ম?”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে রেনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে? কি বলেছো তুমি আমার বিরুদ্ধে?”

রেনু বলল,
“তোমার বিরুদ্ধে কিছুই বলার নেই। তুমি নিজেই তোমার বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো কাজ করেছো। তুমি একটা কালসাপিনী।”

“রেনু! আমি তোমার ভাবী।”

“আমি তোমাকে ভাবী মানি না।”

আফিফ রেনুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“রেনু, আমি আমার সিচুয়েশন হ্যান্ডল করে নেবো। তুই প্লিজ, আমার জন্য নিজের ক্ষতি করিস না। তোর এই মুহূর্তে রেস্ট নিতে হবে।”

রেনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফিফ তাকে থামিয়ে দিলো। রেনু চলে যেতেই আফিফ পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।”

পদ্ম আফিফের পা ধরে বলল, “মরে যাবো আমি।”

“তোমার সাথে থাকলে আমি মরে যাবো, পদ্ম।”

(***)

আহি গাড়ি থামালো জনমানবহীন খোলা মাঠে। গাড়ি থেকে নামতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আহি দৌঁড়ে গেলো সামনে। মাঠের মাঝখানে এসে দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লো মাটিতে। বুকে হাত দিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো সে। আহির কান্নার শব্দ আর বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আফিফ ছাদের মেঝেতে শুয়ে আছে। বৃষ্টির তেজ তার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধছে। আর তার হৃদয়ের হাহাকার ক্রমাগত বাড়ছে। সে কাঁদতে পারছে না। কিন্তু ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে ভেতরের সব রাগ, কষ্ট বের করে দিতে। দু’জনের বুক চিরেই বেরিয়ে আসছে একটা প্রশ্ন।

“তোমাকে কি আর জীবনেও দেখার সৌভাগ্য হবে না আমার?”

আফিফা বেগমের চিৎকারে আফিফের হুঁশ ফিরলো। সে ভেজা কাপড়ে ছাদ থেকে নেমে পড়লো। রান্নাঘরের মেঝেতে ছটফট করছে রেনু। পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে গরম তেলের কড়াই। রেনু চিৎকার করে যাচ্ছে। আফিফ বোনকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। উদ্দেশ্য হাসপাতাল। পদ্ম দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। ভয়ে তার শরীর নেতিয়ে পড়ছে। আফিফা বেগম আফিফের পিছু পিছু বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লেন। আজকের এই বর্ষণ মুখর দিনটি কখনোই ভুলবে না তারা।

১১৪।

রেনুর ছেলে হয়েছে। আফিফ রেনুর ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের বারান্দায়। ডেলিভারির সময়ের আগেই হয়ে গেছে বাচ্চাটা। ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিলো আফিফ। আফিফা বেগম তা দেখে বললেন,
“কি মিষ্টি ছেলেটা! নানুভাইয়ের নাম কি হবে?”

আফিফ শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল, “আদ্য।”

“আদ্য কেন?”

“নতুন সূচনা। আদ্য মানেই শুরু। আদ্য আমাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। রেনুর জীবনের নতুন সূচনা হবে আদ্য।”

আহি বৃষ্টি ভেজা শরীর নিয়ে বাসায় ঢুকলো মাত্র। আর সাথে সাথেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো মোজাম্মেল চাচার নাম৷ কল ধরতেই মোজাম্মেল চাচা যা বললেন, তা শুনেই আহির পুরো পৃথিবী থমকে গেলো।

এদিকে ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই আফিফ ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে গেলো। ডাক্তার রেনুর বর্তমান অবস্থা জানালো। মেয়েটার শরীরটা জ্বলে গেছে অনেকখানি। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। এদিকে আফিফকে কাল রাজশাহী যেতেই হবে। এই মুহূর্তে চাকরিটা আরো বেশি প্রয়োজন। রেনুর চিকিৎসার খরচ জোগাড়ের জন্য অন্তত চাকরিটা লাগবে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে রেনুকে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ হলো। পুরো সময়টাতে নিলয় সাহায্য করলো তাকে।

(***)

গাড়ির গতি বাড়ালো আহি। ভেজা কাপড়েই পৌঁছে গেলো সুবর্ণ মঞ্জিল। সে গাড়ি থেকে নামতেই দৌঁড়ে এলো মোজাম্মেল চাচা। আক্ষেপের সুরে বললেন,
“স্যার এইডা কি করলো মা?”

আহি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত বাড়িটির দিকে। সুবর্ণ মঞ্জিল, যেখানে তার বেড়ে উঠার গল্প, যার ইট-পাথরের ফাঁকে বাঁধা পড়ে আছে আহির শৈশব। সেই ঘর, যেখানে তার অনুভূতিরা আটকে আছে। আজ সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি এসেছে। ভেতর থেকে রিজওয়ান কবিরের চিৎকার ভেসে আসছে। আহি কানে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। যারা বাড়ির আশেপাশে ভীড় জমিয়েছে, তারাই বলছে রিজওয়ান কবির নিজেই ঘরে আগুন ধরিয়েছেন। সালমা ফাওজিয়া আহির পিছু পিছু এসেছেন। মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে তিনি দৌঁড়ে এলেন। মায়ের স্পর্শ পেয়ে আহি নেতিয়ে পড়লো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, মা। সবাই শুধু আমাকে একা রেখেই চলে যাচ্ছে।”

সালমা ফাওজিয়া শক্ত কন্ঠে বললেন,
“তোমার বাবা তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করছে। তোমার কষ্ট পেতে হবে না, মা। তুমি তো তার ক্ষতি করো নি। সে হয়তো বুঝে গেছে, তার অন্যায়টা কতো বেশি ছিল।”

সালমা ফাওজিয়া কাঁদছেন না। শান্তি লাগছে তার। এতো বছর পর তার বাবার সাথে হওয়া অন্যায়ের শোধ উঠেছে। তার আর আহির জীবনে আসা সব কষ্টের শোধ উঠেছে। রিজওয়ান কবির নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। তিনি একা মরেন নি, সাথে নিয়ে গেছেন তার কোটি টাকার বাড়ি। যদিও এই জায়গাটাও আহির নামে। কিন্তু বাড়িটা রিজওয়ান কবির শখ করেই বানিয়েছিলেন।

এদিকে ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে আফিফ। পেছনে পদ্ম আর আফিফা বেগম বসে আছেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আর পেছনে পড়ে যাচ্ছে সেই চিরচেনা শহর। আফিফের মনটা ভারী হয়ে আছে খুব। এলোমেলো ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। জানালার বাইরে তাকালো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলল,
“ভালো থেকো, খেয়ালী।”

আহি এখনো সেই পোড়া বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। লিনাশা আহির পাশে বসে বলল,
“যা হয়েছে ভুলে যা। এখান থেকে জীবনের নতুন সূচনা কর।”

আহির দৃষ্টি তার দু’তলা জানালার দিকে। যেই জানালার বাইরে চুল ছড়িয়ে ঘুমাতো সে। আর সেই ঘরে বসেই সে তার এআরের ছবি আঁকতো। আহি সেদিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,
“সুখী হও, প্রিয় অলকানন্দ। তোমার জীবনের নতুন সূচনায় আমার সূচনা হবে। ভালো থেকো, এআর। তোমাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করেছি। আর তুমি আমার জীবনে আসা দুঃস্বপ্ন হয়েই রয়ে গেলে। যেই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হয় নি। অন্তত তোমাকে দেখার মতো ক্ষমতা দিতে। এখন তো তোমার সামনেও আর দাঁড়াতে পারবো না। এই এক আকাশের নিচে তুমি আর আমি। অথচ কতো দূর আমাদের চলার পথ। তোমাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করেছি আমি। ভুলে যাওয়াটা যদি দুঃসাধ্য না হতো!”

পাঁচ বছর পর……….

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৫||

১১৪।
এ আর টি গ্যালারির সামনে ভীড় জমিয়েছে নন্দনকানন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা। নার্সারির ড্রয়িং ক্লাস হচ্ছে এ আর টি গ্যালারির সামনের ছোট বাগানে। স্কুলটি এ আর টি গ্যালারির পাশেই। প্রশান্তিময় একটা জায়গা। এ আর টি গ্যালারির পেছনে খোলা অরণ্য। বিভিন্ন গাছগাছালির ভীড়ে তৈরী হয়েছে বাচ্চাদের জন্য পার্ক। অশ্বত্থ গাছের সাথে ঝুলন্ত কাঠের দোলনা। একপাশে বাচ্চাদের খেলার সামগ্রী৷ অন্যপাশে সারি সারি নারকেল গাছ। শান বাঁধানো ঘাট। আর পুকুরে শাপলাপাতা ছড়িয়ে আছে। একটা দু’টো শাপলাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এ আর টি গ্যালারির বাম পাশেই নন্দন কানন স্কুল। আর ডানপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা বাগান। বাগানে নানা পদের ফুলের মধ্যে বিরাট অংশ জুড়ে আছে, সূর্যমুখী আর অলকানন্দা ফুলের বাগান। একপাশে কাঠগোলাপ আর বেলীফুলের বাগান। বাগানের সামনের অংশটা খালি। সেখানেই ছাউনি দিয়ে বেঞ্চ বসানো। এই জায়গায় নন্দন কাননের ছোট ছোট বাচ্চাদের অংকন শেখানো হয়।

দপ্তরি ঘন্টা বাজাতেই স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো এ আর টি গ্যালারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরে প্রদর্শনী হচ্ছে। কাচের দেয়াল ধরে যতোটুকু প্রদর্শনী দেখা যায়, তা দেখার চেষ্টা করছে বাচ্চারা। ভেতরে উপস্থিত চারুকলা অনুষদের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী। আজ এ আর টি গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসবেন। ছয়মাসে একবার এই আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হয়। আর মাসে একবার চড়া দামে ছবি বিক্রি হয়। বাকি দিনে সাধারণ মানুষের জন্য এই গ্যালারি খোলা থাকে। তারা এসে ঘুরে যায়। পছন্দ হলে আগে থেকেই ছবি বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। মাসের কাঙ্ক্ষিত সেই দিনটিতেই ছবিটা বিক্রি হয়।

গাড়ির হর্ণ শোনা গেলো। সাদা রঙের দামী গাড়ি এসে থামলো এ আর টি গ্যালারির সামনে। প্রহরীরা ব্যস্ত বাচ্চাদের সরানোর জন্য। মোটামুটি জটলা বেঁধে গেছে প্রবেশমুখে। গাড়ির দরজা খুলে দিলো ড্রাইভার। গাড়ির বাইরে নেমে এলো সাদা স্নিকার্স পরিহিত দু’টি পা। এ আর টি গ্যালারির প্রবেশপথ থেকে বাচ্চাদের সরালো স্কুলের ড্রয়িং শিক্ষিকা রেহেনা পারভিন। শিক্ষিকার রাগী দৃষ্টি দেখে বাচ্চারা দৌঁড়ে স্কুলের দিকে চলে গেলো। শুধু গেলো না একজন। তার দৃষ্টি আটকে আছে সাদা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা স্নিকার্স জোড়ার দিকে। সে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। গাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। বয়স ত্রিশ, অথচ বেশভূষায় মনে হবে তার বয়স একুশ কি বাইশ। পরণে সাদা টি-শার্ট আর জিন্স। গলায় ঝুলছে লাল উড়না। গাড়ি থেকে নেমেই সে চোখে পরলো ধূসর বর্ণের সানগ্লাস। মেয়েটি এগিয়ে আসতে লাগলো এ আর টি গ্যালারির দিকে। এদিকে রেহানা পারভীন দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাটির হাত ধরে টান দিয়ে বললেন,
“ওয়াসিফ, ক্লাসে চলো।”

তখনই মেয়েটি ওয়াসিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। ওয়াসিফকে দেখে সানগ্লাস খুললো সে। হাত এগিয়ে দিলো ওয়াসিফের থুতনিতে। আলতো আদর দিয়ে বলল,
“বাবু, কেমন আছো?”

ওয়াসিফ এক গাল হাসলো। বলল,
“আন্টি এই শু’স আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি মাকে বলেছি এমন হোয়াইট হোয়াইট শু’স কিনে দিতে। মা তো আমাকে নিয়েই যায় না।”

মেয়েটি ওয়াসিফের সামনে হালকা ঝুঁকে বলল,
“তোমার মায়ের নম্বর দিও, আমি বলে দেবো কিউট বাবুকে হোয়াইট হোয়াইট শু’স কিনে দিতে।”

ওয়াসিফ মাথা নাড়লো। মেয়েটি ওয়াসিফের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি নাম কিউট বাবুটার?”

“মাই নেইম ইজ নাওফাত ওয়াসিফ আদ্য।”

“ওয়াও, কি সুন্দর নাম!”

“আমার নামটা খুব বড় তাই না?”

মেয়েটি গালে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল, “হ্যাঁ, তাই তো।”

“সবাই বলে আমার নাম অনে-ক বড়। আমার মতো বড় নাম কারো নেই।”

রেহানা পারভীনকে দেখিয়ে দিয়ে ওয়াসিফ বলল,
“মিসরাও বলে।”

মেয়েটি তা শুনে মুচকি হেসে বলল,
“তাই না-কি? আমার নামটাও তো অনে-ক বড়। তোমার মতো।”

“তাই? তোমার নাম কি?”

“আমার নাম ওয়াসিকা কবির আহি।”

“তোমার নামটাও তো অনেক সুন্দর। আচ্ছা, তোমার নামটাও কি তোমার মামা রেখেছে?”

ওয়াসিফের প্রশ্নে আহির মুখে বিষণ্নতা ছেয়ে গেলে। পরক্ষণেই সে মুচকি হেসে বলল,
“না, আমার নামটা আমার বাবা রেখেছে।”

“তোমার বাবা আছে?”

“হ্যাঁ আছে।”

“কোথায়?”

“ওই দূর আকাশে তারাদের ভীড়ে লুকিয়ে আছে।”

ওয়াসিফ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন তো তারা দেখা যাচ্ছে না। তুমি কি রাতেই তোমার বাবাকে দেখতে পাও?”

“না। রাতে-দিনে কখনো দেখতে পাই না। সে তো লুকিয়ে আছে। আর তারা তো দিনেও থাকে। কিন্তু সূর্য্যি মামার জন্য দেখা যায় না।”

“ওহ, আমার বাবা নেই। কিন্তু আমার মামা আছে। আমার মামা অনেক ভালো। হি ইজ দা বেস্ট।”

ওয়াসিফের আদুরে কথাবার্তা আহির বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু তার হাতে সময় কম। আজ তার আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হচ্ছে। তার জন্য বসে আছে সবাই। আর কাল তার ছবি বিক্রি হবে। প্রতি মাসে সব কাজ ফেলে সে কক্সবাজার চলে আসে তার আর্ট গ্যালারিতে সময় দিতে। নিজের আঁকা ছবিগুলো সাথে নিয়ে আসে। বিক্রি হয় চড়া দামে। দেশে-বিদেশে আহির আঁকা ছবির বেশ সুনাম। ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ডও পেয়েছে সে গত বছর। তিন বছর আগেই সে কক্সবাজারে এই আর্ট গ্যালারিটি স্থাপন করেছিল। আর সে বছরই নন্দনকানন স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য মোটা অংকের টাকা দিয়েছে সে। যদিও এই স্কুলে আরো দু’জনের ভাগ আছে। স্কুলের চেয়ারম্যান আহির বড় মামা। আহি শুধু চেয়েছে স্কুলের ড্রয়িং ক্লাসটা যাতে তার বাগানে হয়। তার ধারণা বাচ্চারা বাগানে বসে ছবি আঁকলে, তাদের শিল্পীমন গভীর হবে।

কিছুক্ষণ পর এ আর টি গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এলো আহির এসিস্ট্যান্ট রুবি। সে আহির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ম্যাম, আপনাকে ভেতরে আসতে হবে। সবাই অপেক্ষা করছে।”

এসিস্ট্যান্টটির কথা শুনে রেহানা পারভীন ওয়াসিফের হাত ধরে বলল,
“এবার ক্লাসে যাও, ওয়াসিফ। ম্যামকে যেতে হবে।”

আহি ইশারায় রেহানা পারভীনকে বলল ওয়াসিফের হাতটা ছেড়ে দিতে। রেহানা পারভীন হাত ছেড়ে দিতেই আহি বলল,
“বাবু, আমি যাই। পরে কথা হবে।”

ওয়াসিফ গ্যালারির প্রবেশমুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আন্টি, আন্টি।”

“হ্যাঁ, বলো।”

“আমাকে ভেতরে যেতে দেবে?”

রেহানা পারভীন গলা উঁচু করে বললেন,
“ওয়াসিফ, বললাম না বাচ্চারা ভেতরে যায় না।”

আহি তাকে ইশারায় আবার থামিয়ে দিয়ে ওয়াসিফের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে নিয়ে যাবো, কিন্তু আমাকে প্রমিজ করতে হবে তুমি ভেতরে গিয়ে কোথাও হাত দেবে না।”

ওয়াসিফ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“হাত দিলে কি হবে?”

“হাত দিল ছবি নষ্ট হয়ে যাবে, অথবা নিচে পড়ে ভেঙে যাবে। তখন আন্টি খুব কষ্ট পাবো। তুমি কি আন্টিকে কষ্ট দেবে?”

“না, একদম না। আমি লক্ষী বাচ্চাদের মতো তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো। আমাকে শুধু ভেতরে যেতে দিলেই হবে। আমার খুব ইচ্ছে ওখানে কি আছে দেখার। ওই যে টিভিতে ছবি দেখাচ্ছে, ওগুলো চুপচাপ বসে বসে দেখবো।”

আহি ওয়াসিফের চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে তার হাত ধরে ভেতরে চলে গেলো।

(***)

আহি চারুকলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো। অংকন নিয়ে চললো গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। কথাবার্তা শেষে আহি বেরিয়ে প্রদর্শনী রুমে এলো। দেখলো চেয়ারে বসে প্রজেক্টের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে ওয়াসিফ। ওয়াসিফকে পাহারা দিচ্ছে রুবি। আহিকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। আহি ওয়াসিফের পাশে বসে বলল,
“বাবু, তোমার স্কুল তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে। তোমাকে কেউ নিতে আসবে না?”

ওয়াসিফ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মামা বলেছে, লম্বা কাঁটাটা সিক্সে এসে দাঁড়ালে আসবে।”

আহি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“আচ্ছা। এখনো তো লম্বা কাঁটাটা থ্রিতে বসে আছে। মামার আসতে তো অনেক সময় লাগবে। তুমি একা একা কি করবে?”

“আমি খেলবো পার্কে গিয়ে।”

“আচ্ছা। তোমার মামা এতো দেরী করে আসে?”

“না। কিন্তু আজ দেরীতে আসবে বললো। মামার অফিসে অনেক কাজ থাকে। আমাকে বাসায় দিয়ে আবার অফিসে চলে যায়।”

“আচ্ছা। চলো তোমাকে পার্কে দিয়ে আসি। তোমার সাথে কিছুক্ষণ খেলবো।”

আহি ওয়াসিফকে নিয়ে পেছনের পার্কে গেলো। দু’জনেই বেশ কিছুক্ষণ মজা করলো। হঠাৎ আহির ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো পুষ্পের নাম। আহি কল ধরতেই পুষ্প বলল,
“আহি, লাঞ্চ এখানে এসে করবি কিন্তু।”

আহি বলল, “আজকে আমার কাজ বেশি।”

“কোনো এক্সকিউজ দিবি না। ফাজিল মেয়ে একটা। লাবীব আমাকে বলে গেছে। আর তোকে এখানেই থাকতে হবে যতোদিন থাকবি।”

“মাত্র দু’দিন।”

“তো দু’দিন তুই ওই ভূতের বাড়িতে থাকবি?”

“পুষ্প!”

“তোর ওই বাংলো বাড়িটা ভূতের বাড়ির মতো দেখতে। রাতে একা কীভাবে থাকিস? লাবীবের অফিসে যাওয়ার পথেই তোর বাংলো বাড়িটা পরে। আমাকে তো প্রায়ই বলে এভাবে সুনসান রাস্তার উপর জঙ্গলের মাঝখানে কেউ বাড়ি করে? বসতিস্থল থেকে কতো দূর তোর বাংলো বাড়িটা।”

“আরেহ, রিল্যাক্স। গার্ডস আছে, মেইডরা আছে। আমি তো একা থাকি না। আর যখনই কক্সবাজার আসি, মা তো সাথেই আসেন। এবার বাড়িতে গেছে মা। নানার বার্ষিকী করছে। নানু খুব অসুস্থ। জানিস তো ডাক্তার বলেছে হাতে বেশিদিন সময় নেই। শেষ মুহূর্তগুলো বাড়িতে থাকতে চাচ্ছেন। মাও তাই ওখানেই থাকবে।”

“তার মানে তুই চট্টগ্রাম একা থাকবি?”

“হ্যাঁ। আপতত।”

“পাগল তুই? এখানেই থাক। আমাদের সাথে থাকবি। ব্যাগপত্র নিয়ে চলে আয় আমার বাসায়।”

“কি যে বলিস তোর শ্বশুড়-শাশুড়ি আছে। দেবর আছে। এভাবে থাকলে সুন্দর দেখাবে না।”

“লাবীবকে বলবো?”

“আরেহ না। এসব বাদ দে, তোর টুনি কেমন আছে রে?”

“পিয়ালী? খুব অসুস্থ রে আমার মেয়েটা। ঠান্ডা লেগেছে। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি ওর জন্য।”

“ডাক্তার দেখাস নি?”

“দেখালাম তো। সিজনাল প্রবলেম। ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা, বাসায় আয় তো। অনেক কথা হবে।”

“আচ্ছা, আসবো। কিন্তু আজকে পারবো না। কাল আসবো।”

“আজ কি সমস্যা?”

“আমার মিটিং আছে একটা। ওখানেই লাঞ্চ করবো। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়েই বেরুতে হবে।”

“বুঝলাম, খুব ব্যস্ত মানুষ তুই। কিন্তু নিজেকে একটু সময় দে। বিয়ে-টিয়েও করছিস না। কখন করবি বিয়ে? উজ্জ্বল ভাইয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে আসবে আগামী সপ্তাহে। চাচা-চাচী এবার ভাইয়াকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। তোর জন্য অনেক অপেক্ষা করেছে বেচারা। তোকে বলার সাহস পায় নি। আমি সিউর এবারও পাবে না। চাচী তো আন্টিকে বলেছিল। আন্টি কোনো সাড়া দেয় নি দেখে তারাও চুপ হয়ে গেছে।”

আহি হেসে বলল,
“তোর ভাইয়া তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য বসে থাকার কোনো দরকার ছিল?”

“বিয়ে যখন করতেই হবে করে ফেল না।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মায়ের হতাশ চেহারাটা ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। এখন আর কোনো কিছুর অভাব নেই আহির। অনেক টাকার মালিক সে। দাদা ও বাবার সম্পত্তির পাশাপাশি নিজেও অনেক কিছু করেছে। বাংলাদেশের ধনী নারীদের তালিকায় এখন আহির নামও যুক্ত। যেই প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য কয়েক বছর আগেও তাকে কোনঠাসা হয়ে থাকতে হয়েছিল, আজ আহির হাতে সেই ক্ষমতা আছে। সে এখন রানী। তার রাজ্যের একমাত্র রানী আহি একাই। এতো কিছুর ভীড়ে যদি কোনো কমতি থাকে, তাহলে তা একজন ভালোবাসার মানুষের। গত পাঁচ বছরে অহরহ বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আহির জন্য। সালমা ফাওজিয়া সেসব আহির সামনে রাখার সাহস পান নি। অনেক প্রস্তাব এতোটা যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল যে সালমা ফাওজিয়া নাকচ কর‍তে চান নি। কিন্তু আহির জন্য বাধ্য হয়েছিলেন।

(***)

পুষ্পের সাথে কথা বলা শেষ হতেই আহি পেছন ফিরে দেখলো পার্কে বাচ্চাটি নেই। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দারোয়ানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“বাচ্চাটা কোথায় গেলো?”

দারোয়ান বলল,
“ম্যাম, এই মাত্র ওর মামা এসে নিয়ে গেছে।”

“ওহ আচ্ছা।”

আহি বেরিয়ে এলো পার্ক থেকে। সামনে হেঁটে তার গাড়ির কাছে আসতেই দেখলো ওয়াসিফ একটা মোটর সাইকেলের পেছনে বসা। মাথায় ছোট হেলমেট। ঝাঁকড়ে ধরে আছে সামনের মানুষটিকে। মুহূর্তেই আহির শিরদাঁড়া বেয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হাত-পা অসার লাগছে যেন। বুকটাও কাঁপছে বেশ। পেছন দিক থেকে কি মানুষ চিনতে ভুল হয়? তাহলে কেন চেনা চেনা লাগছে এই মানুষটাকে? আহির ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে একবার মানুষটির চেহারা দেখতে। যদি সে হয়? না, সে হলে আহির কোনো অধিকার নেই সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। শেষবার তো খুব কড়া ভাবেই মানুষটা বলেছিল, তার সামনে না যেতে। তাহলে কেন যাবে আহি?

মোটর সাইকেলটি চলে গেলো। আহিও গাড়িতে উঠে গেলো। এখন আর অশ্রুসিক্ত হয় না চোখ জোড়া। বেশ শক্ত হয়েছে সে। কিন্তু অস্থিরতা এখনো কাটে নি। মানুষটা ভাবনায় এলেই তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়। এজন্যই বিয়ে করছে না সে। কাউকে ঠকানোর ইচ্ছে নেই তার। মনে একজনকে রেখে, অন্য একজনকে জীবনে এনে সে অন্যায় করতে চায় না। তার চেয়ে একাই ভালো আছে। সুখে আছে।

(***)

ওয়াসিফ তার মামার পিঠে হেলান দিয়ে বসে আছে। দশ মিনিট পর মোটর সাইকেলটি ঢুকলো একটি ছ’তলা ভবনে। নিচ তলায় গ্যারেজ। গ্যারেজে মোটর সাইকেল থামিয়ে ওয়াসিফকে নামালো সে। ওয়াসিফ মামার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“মামা, আমি আজকে অনেক অনেক ছবি দেখেছি। আমাকে ওই সুন্দর জায়গাটায় নিয়ে গিয়েছিল আন্টিটা। আন্টিটা একদম হোয়াইট হোয়াইট ছিল।”

ওয়াসিফের মামা তার হেলমেট খুলে দিতে দিতে বলল,
“এ নিয়ে দশ বার বলেছো এই একটা কথা।”

ওয়াসিফ আঙ্গুলে গুণতে লাগলো, আর বলল,
“দশ বার বলেছি?”

ওয়াসিফের মামা তাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। চার তলায় ভাড়া থাকে তারা। চার তলার দরজার সামনে এসেই মামার কোলে বসে বেল বাজালো ওয়াসিফ। দরজা খুলে দিলো তার নানী। ওয়াসিফকে দেখেই তিনি বললেন,
“আমার নানু ভাই এসে গেছে।”

ওয়াসিফ কোল থেকে নেমে দৌঁড়ে ঢুকে গেলো বাসায়। ছুটে গেলো তার মায়ের কাছে। এসেই মাকে জড়িয়ে ধরলো সে। ওয়াসিফ মায়ের গালে চুমু খেতেই, তার মা এগিয়ে এসে ছেলের কপালে চুমু খেলো। তা দেখে ওয়াসিফের নানু, আফিফা বেগম আফসোসের সুরে তার ছেলেকে বললেন,
“আজ আমার রেনুর এই অবস্থা হয়েছে শুধু ওই ডাইনির জন্য। যতোবার রেনুকে দেখি ততোবারই মনে পড়ে ওই ডাইনি রাক্ষসীটা কিভাবে আমার সংসারটা এলোমেলো করে দিয়ে গেছে।”

পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেনুর ভাই। বলল,
“শুধু শুধু তার কথা কেন তুলছো, মা? সে তো আর আমাদের জীবনে নেই।”

“আফিফ! সে নেই। কিন্তু এখনো পিছু তো ছাড়ছে না। তালাক হওয়ার পরও তোকে ফোন দিচ্ছে। বিয়ে করে ফেল, বাবা। ওই ডাইনির আর সাহস হবে না ফোন দেওয়ার।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হতাশ দৃষ্টিতে রেনুর দিকে তাকালো। পাঁচ বছর আগের এক দুর্ঘটনায় রেনুর এই অবস্থা। গরম তেল ছিটকে পড়েছিল রেনুর শরীরে। জ্বলে গেছে শরীরের অনেকাংশ। গলা থেকে পেট পর্যন্ত চামড়া কুঁচকে গেছে তার। মুখেও ছিঁটেফোঁটা পড়েছিল। এখন প্রায়ই অসুস্থ থাকে রেনু। বাসার বাইরে যেতে চায় না। বোনের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছে সে। যদি পদ্মকে বিয়ে না করতো, তাহলে আজ তার বোনের এই পরিণতি হতো না।

পাঁচ বছর আগে, রেনু যখন জানতে পারলো তার জীবন ধ্বংসের মূলে আছে তার ভাবী পদ্ম। সে চুপ থাকে নি। সে প্রতিবাদ করেছে। সেদিন পদ্মের সাথে খুব বাগবিতণ্ডা হচ্ছিলো রেনুর। রাগের মাথায় পদ্ম চুলায় থাকা গরম তেলের কড়াইটি রেনুর দিকে ছুঁড়ে দিলো। আর সাথে সাথেই চামড়া গলে গেলো তার। পদ্ম কড়াই ছুঁড়ে দিয়েই দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। সে ভেবেছে, রেনু আর বাঁচবে না। ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা তার। রাজশাহী মেডিকেলে অনেক যুদ্ধের পর বেঁচে ফিরলো রেনু। জ্ঞান ফিরতেই তার এই অবস্থার জন্য দায়ী পদ্মকে দেখিয়ে দিলো। আফিফ মামলা করলো নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে। পুলিশ এসে পদ্মকে ধরে নিয়ে গেলো। আফিফ তালাকের সিদ্ধান্ত নিলো। পদ্ম কারাগারে থাকা অবস্থায় আফিফ আর তার তালাক হয়ে গিয়েছিল। পদ্ম ছাড়া পাওয়ার পর তার বাবা তাকে নিয়ে গেছেন গ্রামে। পড়াশুনা শেষ করে নি, তাই চাকরি পাচ্ছে না সে। বাবার সংসারেও বোঝা। তার কুকর্মের ব্যাপারে জেনে তার পরিবারের সবাই ক্ষিপ্ত। শেষমেশ সে গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছে। প্রায়ই আফিফকে ফোন দেয়। এরই মধ্যে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে তার জন্য। পাত্র দুই সন্তানের বাবা। স্ত্রীর মৃত্যুতে সন্তান লালন-পালনের জন্য বিয়ে কর‍তে চাইছে। পাত্র কাঠের ব্যবসা করে। অবস্থা ওতো ভালো না। কিন্তু পদ্মের বাবা-মা মেয়েকে রাখতেই চাচ্ছেন না। পদ্ম তাই আফিফকে ফোন দিয়ে তাকে সাহায্য কর‍তে বলছে। এ নিয়ে ছয়টা নম্বর ব্লক করেছে আফিফ। এবার হয়তো সিমটা পরিবর্তন করতে হবে তার। নম্বরটা খোলা রাখার কারণ একটাই, একটা কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকে ফোন আসা। প্রতিবারই অপরিচিত নম্বর দেখলে তার মনে হয়, সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি কল করেছে। কিন্তু না। কল আসে না তার। তবে আফিফ প্রায়ই তাকে দেখে। দূর থেকে দেখে। বেশ নাম-ডাক তার। আফিফের যোগ্যতা নেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। দূর থেকে দেখেই চলে আসে। আগের চেয়ে বেশ সুন্দর হয়েছে সে। মলিন ভাবটা আর নেই। শুধু এখনো বিয়ে করে নি। কেন বিয়ে করে নি জানে না আফিফ। কিন্তু সে চায়, মেয়েটা সুখী হোক। নতুন সংসার হোক তার। জীবনে যেই কষ্ট পেয়েছে সে কষ্টটা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যাতে কেউ আসে তার জীবনে।

রুমে এসে গা এলিয়ে দিলো আফিফ। আজ আর অফিসের কাজ নেই। হালকা ঘুমিয়ে নেবে সে। উঠেই আবার বেরুতে হবে বাজারের জন্য। আফিফ বিছানায় শুয়ে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, আজকে বেশ সুন্দর লাগছিলো তাকে। প্রতি মাসে সে কাঙ্ক্ষিত এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। কবে আহি কক্সবাজারে এসে এ আর টি গ্যালারিতে আসবে। আর সে দূর থেকে আহিকে দেখবে।

সময়টা ঘুরে গেছে। পনেরো বছর আগে আহি যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, আজ আফিফ সেখানে এসে দাঁড়ানো। পার্থক্য শুধু এতোটুকুই, আহি সেই সময় ধরে নিয়েছে আফিফ তার হবেই। কিন্তু এখন আফিফ জানে, আহি তার কখনোই হবে না। কারণ তার সেই যোগ্যতা নেই।

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৫২+৫৩ + বোনাস পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫২||

১০৮।
ধুমধাম আয়োজন করে চুনিকে দিদার বারেকের হাতে তুলে দেওয়া হলো। আহি বিয়েতে কোনো কমতি রাখে নি। চুনির ইচ্ছাতেই ঘোড়া গাড়ির ব্যবস্থা করেছে সে। এখন ঘোড়া গাড়িতে চড়ে শ্বশুড় বাড়ি যাচ্ছে চুনি। মেয়ের বিদায়ে মুনিয়া খালা কাঁদছেন। সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়া তাকে মৃদু সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আহি রুমে এসে এলোমেলো জিনিসপত্র গোছাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো লিনাশা। লিনাশাকে আপাদমস্তক দেখে সে বলল,
“তুই কখন এলি?”

লিনাশা হেসে আহির বিছানায় পা উঠিয়ে বসে বলল,
“যখন আমার বেস্টু ঘটকালি শেষে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।”

আহি হেসে বলল, “নায়ীব ভাইয়া আসেন নি?”

“সে তো মহা ব্যস্ত। আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো চেম্বারে। তার না-কি ভিআইপি পেশেন্ট এসেছে।”

“আচ্ছা, ভালো তো।”

“হ্যাঁ সবই তো ভালো। এখন বল, তোর ভালো কখন হবে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার আবার কি ভালো হবে?”

লিনাশা এবার গম্ভীরমুখে বলল, “বিয়ে করবি?”

আহি থমকে গেলো। লিনাশার পাশে বসে বলল,
“তুই জানিস, আমি আগ্রহী না।”

“পরে করলেও সমস্যা নেই। কিন্তু করবি তো!”

“দেখা যাক। তুই হঠাৎ এতো রাতে বাসায় এসে আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছিস!”

“হ্যাঁ। কীভাবে বলবো, বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আগে বল, তুই কি রাদকে ভালোবাসিস?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ওকে আমি বন্ধুর মতো ভালোবাসি।”

“আমি জানতাম, তোদের সম্পর্কটা কাইন্ড অব, ইউ এন্ড মি, রাইট?”

“ইয়েস।”

লিনাশা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“উজ্জ্বলকে কেমন লাগে তোর!”

আহি এবার চোখ বড় বড় করে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা আহির চোখ দেখে বলল,
“ওয়েট, ওয়েট, এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। উজ্জ্বলের আম্মু, মানে আমাদের ম্যাডাম আর পুষ্পের চাচি, মাকে এসে তোর কথা বলেছেন।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কী বললেন?”

“বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। মা কাল না-কি আন্টির সাথে কথা বলতে আসবে। এখন বিয়ে না করলেও সমস্যা নেই। এট লিস্ট কথাবার্তা ঠিক হয়ে যাক।”

আহির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। সে চেঁচিয়ে বলল,
“বাঁচতে দিবি আমাকে তোরা? এতোদিন তাজওয়ার মাথার উপর ঘ্যানঘ্যান করছিল। এখন রাদ ওর অনুভূতি নিয়ে আমার দিন-রাত অস্থির করে তুলছে। এদিকে তুই এসেছিস বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে! তোরা কি অন্ধ? তোরা কি আমাকে দেখছিস না? আমার মন কী চাই, একবার জানতে চেয়েছিস? আমি কি চাই, কেউ জানে?”

লিনাশা বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আহির হাত ধরে বলল,
“আমি জানি তোর মন কী চায়। কিন্তু যেটা তুই চাস, ওটা কি আদৌ পাওয়া সম্ভব?”

আহি থেমে গেলো। গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। লিনাশা আহির চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“আফিফ তোর ভাগ্যে নেই।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“আফিফ আমার ভাগ্যে না থাকুক, ওকে ভালোবাসা আমার ভাগ্যে আছে। হ্যাঁ, আজ আমি স্বীকার করে নিলাম না হয়, আমি এখনো ভুলতে পারি নি আফিফকে। ওকে ভুলে যাওয়ার সুযোগটাই তো ভাগ্য আমাকে দিলো না। আর বিয়ে জীবনের একমাত্র সমাধান নয়। আমার মনে হয়, নিজের মনকে ভালোবাসা, নিজের আত্মাকে ভালোবাসা, নিজের ইচ্ছের প্রাধান্য দেওয়ায় মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমি আফিফকে চাই না। আমি একা থাকতে চাই। কারণ এখন আমি নিজেকে ভালোবাসতে চাইছি। জানিস, আমি কখন সুখে থাকবো?”

“কখন?”

“একা থাকলে।”

“সারাজীবন কি একা থাকা সম্ভব, আহি?”

“মা তো থাকছে। মা কি আর বিয়ে করেছে?”

“আন্টির জন্য তো তুই আছিস? কিন্তু তোর কে আছে?”

আহি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো লিনাশার দিকে। লিনাশা আহির দুই গালে হাত রেখে বলল,
“নায়ীব বলেছে আমাকে, আফিফ অনেক ভালো একটা ছেলে। ও যদি তোর হতো, আমি অনেক খুশি হতাম। পদ্মের চেয়ে আমি তোকে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু পদ্ম তো এক্জিস্ট করে।”

আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“এনাফ ম্যাচিউর আমি। নিজের ভালোটা বুঝি। পদ্ম আফিফের স্ত্রী, আমি জানি। এটাও জানি, আফিফ আমার হবে না। তার মানে এই না যে, তোরা বললি আর আমি হুট করে বিয়ে করে নিলাম, নতুন জীবন শুরু করলাম? তুই নায়ীব ভাইয়াকে ভালোবেসেছিস, পদ্ম আফিফকে ভালোবেসেছে, পুষ্প লাবীবকে ভালোবেসেছে। কিন্তু আমি আফিফকে ভালোবাসি নি। আমি আমার হৃদয়টাই দিয়ে দিয়েছি৷ তোরা কি কেউ পারবি, আমার মতো করে তোদের প্রিয় মানুষকে ভালোবাসতে? এক তরফা, কোনো ইশারা, কোনো আশা, কোনো ফলাফল ছাড়া, পারবি ভালোবাসতে? কেউ পারবে? আমি স্পেশাল। তাই আমি পেরেছি। এটা আমার অহংকার। আর এটাতেই আমি নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবি। জানিস লিনু, আহি কেন সবার চেয়ে ভিন্ন? কারণ আহি আফিফকে ভালোবাসে। আমি যদি ভালোবাসাই ছেড়ে দেই, তাহলে আমার স্পেশালিটি আর থাকবে না। দেবদাস হয়েছে কতো জন, এবার না হয় আহির জন্ম হোক।”

“দেবদাস হওয়া সহজ। কিন্তু আহি হওয়া না। কারণ তুই একটা মেয়ে। আর দেবদাস মরে প্রমাণ করে দিয়েছে, সে তার শেষ নিঃশ্বাস অব্ধি পার্বতীকে ভালোবেসেছিল।”

“আমি আহি। কোনো দেবদাসী নই। আমি নিজেকে শেষ করে দেবো না। আমি বাঁচবো নিজের জন্য। স্বপ্ন দেখবো নিজের জন্য৷ শুধু ভালোবাসাটা হৃদয়ে দাফন হয়ে থাকবে। যেই অদৃশ্য মাটিতে আমার কয়েক বছরের পাগলামো, আমার স্বপ্ন, হাতে আঁকা প্রিয় ছবিগুলো, চারুশিল্প, সেই পথ সব, সবটাই দম ছাড়বে। আর সেই মৃত স্মৃতিগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”

লিনাশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি মুচকি হেসে বলল,
“তোর বর আমার জীবনে এসে অনেক বড় উপকার করেছে।”

“কী?”

“আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে আবেগ ধরে রাখতে হয়। আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে অলকানন্দাকে ভালোবেসে কাঠগোলাপকে আগলে রাখতে হয়। শিখিয়েছে কীভাবে সাদার ভীড়ে ধূসর বেগুনিকে খুঁজতে হয়।”

“আর?”

“আর রাদ, ও তো আমার মেডিসিন। আমাকে সাপোর্ট করেছে অনেক। এখন বল, আমি কি করবো? মেডিসিন তো রোগ সারায়৷ যেমন বন্ধুত্ব হতাশা কাটায়। রাদও আমার এলোমেলো জীবনটাতে একটু গতি এনেছে। বন্ধুর মতো পাশে থেকেছে। তুই তো ছিলি না পাশে। জানিস, অতিরিক্ত সবকিছুই মান হারায়। আমার অতি ভালোবাসাও মান হারিয়েছে। তবে এবার আমি ভুল করছি না। আমার যদি নিতেই হয়, আমি মেডিসিন নিবো। তবে এতো বেশি না, যেটা আমার মনে সাইড ইফেক্ট করবে। আর যেখানে আমি রাদকেই ভালোবাসতে পারছি না, সেখানে উজ্জ্বল বা পৃথিবীর অন্য কোনো পুরুষ দাঁড়ানোর যোগ্যতায় রাখে না।”

(***)

আজ শিক্ষা জীবনের সমাপ্তিতে রাদ, লাবীব, পুষ্প আর আহি ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছে। মাস্টার্সের সার্টিফিকেট তুলতে ক্যাম্পাসে এসেছে তারা। ক্যান্টিনে বসে তারা অনেক আড্ডাও দিলো। আড্ডার বিষয় লাবীব আর পুষ্পের বিয়ে। আড্ডা শেষে রাদ উঠে দাঁড়ালো। আহির হাত ধরে বলল,
“তোকে একটা জিনিস দেবো।”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কি?”

রাদ আহিকে একপাশে টেনে এনে বলল,
“আগে একটা সুখবর শোন।”

“হুম, বল।”

“আহি, আমার চাকরি হয়েছিল একটা।”

আহি আনন্দিত কণ্ঠে বলল,”সত্যি? কখন?”

“হ্যাঁ, একমাস আগেই হয়েছে। ভেবেছি আজই তোকে বলবো। আর তোকে সেই গিফটটাও দেবো।”

“রিয়েলি, গিফট! দেখি তো কি সেটা?”

রাদ ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আহির হাতে দিলো। আহি প্যাকেটটা খুলে দেখলো একটা ধূসর বেগুনি রঙের সুতির শাড়ি। সাথে সোনালী রঙের ব্লাউজ। আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“তোকে ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়িতে খুব মানায়। আমার জন্য পরবি কিন্তু একদিন।”

“আমার তো ছিলোই শাড়ি।”

“সব শাড়ি, আর এই শাড়ি এক না। এই শাড়িটা আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমার প্রথম সাফল্যের স্মৃতি। অনেক বছর পর যখনই তুই এই শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়াবি, আমার মনে পড়বে আমার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের কথা। মনে পড়বে নিজের টাকায় তোর জন্য আমার প্রথম গিফট কেনার মুহূর্তটির কথা।”

আহি হতাশ দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। ছলছল করে উঠলো আহির চোখ দু’টি। রাদ তা দেখে বলল,
“চল, তোকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। এতো আবেগী হতে হবে না তোকে।”

রাদ আহির হাত ধরলো। সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো কয়েক ধাপ। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আহির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো সে। পুরো মাঠ খালি। আজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী কম। মাঠের মাঝখানে এক আকাশস্পর্শী স্বপ্ন দেখা যুবক, আর তার হাতে আবদ্ধ তার প্রেয়সীর হাত। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“তোর হাসি দেখতে দেখতে আমি মরেই যাবো বোধহয়। এতো মিষ্টি হাসি তোর! আমার হৃদয়টাই কাঁপিয়ে দেয়।”

রাদ কথাটি বলেই সামনে তাকালো। আহিও সামনে তাকিয়ে থমকে গেলো। ক্যাম্পাস গেটের সামনে তাজওয়ার দাঁড়ানো। আহি অবাক কন্ঠে বলল,
“তাজওয়ার এখানে?”

মুহূর্তেই ঠা ঠা শব্দ ধ্বনিত হলো নিরব ক্যাম্পাস জুড়ে। আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঢিলে হয়ে এলো তার হাতটি। তার চোখের সামনে এই মাত্র হাসিমাখা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি ক্যাম্পাসের ইটের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। সাথে সাথেই আহির পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। তাজওয়ার আহির দিকে বন্দুক তাক করে বলল,
“আমি ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোনো প্রেমিক থাকতে পারবে না।”

আহি অস্থির হয়ে রাদের হাত হাতড়াতে লাগলো। ঝাঁকাতে লাগলো তার নিথর শরীর। ঠা ঠা শব্দে ক্যাম্পাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো অনেকেই। লাবীব ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সামনে এগুতেই পুষ্প তার হাত চেপে ধরলো। তাদের চোখের সামনে ঝড়ে গেলো এক প্রেমিক, যেই প্রেমিক শুধু ভালোবাসার অপরাধে প্রাণ দিয়েছে। তাজওয়ার দৃপ্ত পায়ে হেঁটে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। আহি রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“রাদ, এই রাদ। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, একটু চোখটা খোল। আমি তোকে এক্ষুণি হস্পিটালে নিয়ে যাবো।”

লাবীব দৌঁড়ে এলো। আহি লাবীবকে দেখেই গাড়ির জন্য উঠে দাঁড়াতে, ক্যাম্পাসের কয়েকটা ছেলে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহৃত এম্বুল্যান্সের জন্য পরিবহন কমিটির সাথে দেখা করতে বললো। আহি দৌঁড়ে গেলো সেদিকে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে রাদকে তুললো স্ট্রেচারে। আহির শরীর যেন চলছেই না। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেই পুষ্প তাকে শক্ত করে ধরলো। আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
“ও..ওর কিছুই হবে না। আমি পাগল হয়ে যাবো ওর কিছু হলে। পাগল হয়ে যাবো আমি। কি.. কি করবো আমি? রা.. রাদ আসবে। ঠিক হয়ে যাবে ও।”

পুষ্প আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি শরীরের ভার ছেড়ে দিতেই পুষ্প ভীত কন্ঠে বললো,
“আহি? এই আহি?”

আহি জ্ঞান হারিয়েছে। এরপর আহিকে ক্যাম্পাসের মেডিকেল রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।

(***)

অনিশ্চিত জীবন। হুট করে যে কীভাবে সব এলোমেলো হয়ে যায়! রাদের হঠাৎ মৃত্যু সবাইকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এদিকে আহি ব্রেইন স্ট্রোক করে দু’দিন হাসপাতালে ভর্তি। এ নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো আহি স্ট্রোক করেছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, প্রথম বারের স্ট্রোকের সাথে দ্বিতীয় বারের স্ট্রোক করার সময় ব্যবধান অনেক বছর হওয়ায় আহি মোটামুটি আশঙ্কামুক্ত। কিন্তু কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যদি আবার স্ট্রোক করে, তাহলে আহির মৃত্যুও হতে পারে, আর বেঁচে গেলে পঙ্গু হয়ে যাবে। আহি এখনো জানে না, রাদের মৃত্যু হয়েছে। সে ধরে নিয়েছে রাদ বেঁচে আছে। আহিকে রাদের মৃত্যুর সংবাদ দেয় নি কেউই। দেওয়ার ক্ষমতাও নেই কারো।

(***)

রাদের কুলখানি আজ। আহিকেও হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হলো। আজ বেশ শান্ত দেখাচ্ছে আহিকে। সালমা ফাওজিয়ার দিকে তাকিয়ে সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“রাদ কোথায়?”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“ওর সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে।”

“মা, আমি দেখেছি, ওর কপালে গুলি লেগেছে। ও বেঁচে আছে তো?”

সালমা ফাওজিয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “হ্যাঁ।”

“চিন্তা করো না, মা। আমি মরবো না। আমি তো আগে থেকেই মৃত ছিলাম। আমাকে একটু বলো তো, তাজওয়ার জেল থেকে পালালো কীভাবে? ও কোথায় এখন?”

“পুলিশ ধরতে পারে নি ওকে।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বলল,
“জানোয়ারটা আমাকে শেষ করে দিয়ে গেছে, মা। কোন অলুক্ষণে দিনে আমি তার সামনে এসে পড়েছি জানি না। সে কখন আমাকে দেখে এতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেলো যে আমার জন্য সে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মার‍তে এলো! ও তো জানোয়ার না। তাহলে ও কি, মা? ও কি সাইকো? হ্যাঁ, ও একটা সাইকো কিলার।”

“শান্ত হো, আহি।”

আহি শান্ত হলো। চোখ বন্ধ করলো সে। সেকেন্ড খানিক পর মায়ের দিকে তাকালো। বলল, “তাজওয়ারকে কে পালাতে সাহায্য করেছে আমি জানি। এখন তাজওয়ার কোথায় আছে, আমি সেটাও জানি।”

আহি উঠে দাঁড়ালো। এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। সালমা ফাওজিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
“কি খুঁজছিস?”

“আমার ফোন!”

সালমা ফাওজিয়া আহির ফোনটা এনে দিলেন। আহি ফোন পেয়ে সাথে সাথেই উজ্জ্বলের নম্বরে ডায়াল করলো। উজ্জ্বল ওপাশ থেকে কিছু একটা বললো। আর আহিও কল কেটে দিয়ে মাকে বলল,
“মা, আমাকে যেতে হবে।”

“তুই এই কাজটা করিস না, আহি।”

“এই দেশে কোনো আইন নেই। কোনো বিচার নেই। রাদের বিচার আমি করবো। এবার যা হওয়ার হোক। দেখবো আমি, আইন আমাকে কি শাস্তি দেই।”

“পাপ হবে, আহি।”

“পাপ! সিরিয়াসলি? ঠিক আছে, যদি পাপ হয়৷ হোক। এমন পাপ আমি করবোই করবো।”

আহি বেরিয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়া এদিকে অস্থির হয়ে গেলেন। তিনি ব্যস্ত হয়ে ফোন হাতে নিলেন। কিছু একটা ভেবে একটা নম্বরে ডায়াল করলেন।
রিং যাচ্ছে। সেকেন্ড খানিক পর ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দ শোনা যেতেই সালমা ফাওজিয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলতে লাগলেন সবটাই।

চলবে-

(পরের পর্বে সব ক্লাইমেক্স শেষ হবে। আর এরপর সমাপ্তি অংশগুলো আসবে।)ভ#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫২||

১০৮।
ধুমধাম আয়োজন করে চুনিকে দিদার বারেকের হাতে তুলে দেওয়া হলো। আহি বিয়েতে কোনো কমতি রাখে নি। চুনির ইচ্ছাতেই ঘোড়া গাড়ির ব্যবস্থা করেছে সে। এখন ঘোড়া গাড়িতে চড়ে শ্বশুড় বাড়ি যাচ্ছে চুনি। মেয়ের বিদায়ে মুনিয়া খালা কাঁদছেন। সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়া তাকে মৃদু সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আহি রুমে এসে এলোমেলো জিনিসপত্র গোছাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো লিনাশা। লিনাশাকে আপাদমস্তক দেখে সে বলল,
“তুই কখন এলি?”

লিনাশা হেসে আহির বিছানায় পা উঠিয়ে বসে বলল,
“যখন আমার বেস্টু ঘটকালি শেষে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।”

আহি হেসে বলল, “নায়ীব ভাইয়া আসেন নি?”

“সে তো মহা ব্যস্ত। আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো চেম্বারে। তার না-কি ভিআইপি পেশেন্ট এসেছে।”

“আচ্ছা, ভালো তো।”

“হ্যাঁ সবই তো ভালো। এখন বল, তোর ভালো কখন হবে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার আবার কি ভালো হবে?”

লিনাশা এবার গম্ভীরমুখে বলল, “বিয়ে করবি?”

আহি থমকে গেলো। লিনাশার পাশে বসে বলল,
“তুই জানিস, আমি আগ্রহী না।”

“পরে করলেও সমস্যা নেই। কিন্তু করবি তো!”

“দেখা যাক। তুই হঠাৎ এতো রাতে বাসায় এসে আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছিস!”

“হ্যাঁ। কীভাবে বলবো, বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আগে বল, তুই কি রাদকে ভালোবাসিস?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ওকে আমি বন্ধুর মতো ভালোবাসি।”

“আমি জানতাম, তোদের সম্পর্কটা কাইন্ড অব, ইউ এন্ড মি, রাইট?”

“ইয়েস।”

লিনাশা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“উজ্জ্বলকে কেমন লাগে তোর!”

আহি এবার চোখ বড় বড় করে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা আহির চোখ দেখে বলল,
“ওয়েট, ওয়েট, এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। উজ্জ্বলের আম্মু, মানে আমাদের ম্যাডাম আর পুষ্পের চাচি, মাকে এসে তোর কথা বলেছেন।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কী বললেন?”

“বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। মা কাল না-কি আন্টির সাথে কথা বলতে আসবে। এখন বিয়ে না করলেও সমস্যা নেই। এট লিস্ট কথাবার্তা ঠিক হয়ে যাক।”

আহির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। সে চেঁচিয়ে বলল,
“বাঁচতে দিবি আমাকে তোরা? এতোদিন তাজওয়ার মাথার উপর ঘ্যানঘ্যান করছিল। এখন রাদ ওর অনুভূতি নিয়ে আমার দিন-রাত অস্থির করে তুলছে। এদিকে তুই এসেছিস বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে! তোরা কি অন্ধ? তোরা কি আমাকে দেখছিস না? আমার মন কী চাই, একবার জানতে চেয়েছিস? আমি কি চাই, কেউ জানে?”

লিনাশা বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আহির হাত ধরে বলল,
“আমি জানি তোর মন কী চায়। কিন্তু যেটা তুই চাস, ওটা কি আদৌ পাওয়া সম্ভব?”

আহি থেমে গেলো। গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। লিনাশা আহির চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“আফিফ তোর ভাগ্যে নেই।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“আফিফ আমার ভাগ্যে না থাকুক, ওকে ভালোবাসা আমার ভাগ্যে আছে। হ্যাঁ, আজ আমি স্বীকার করে নিলাম না হয়, আমি এখনো ভুলতে পারি নি আফিফকে। ওকে ভুলে যাওয়ার সুযোগটাই তো ভাগ্য আমাকে দিলো না। আর বিয়ে জীবনের একমাত্র সমাধান নয়। আমার মনে হয়, নিজের মনকে ভালোবাসা, নিজের আত্মাকে ভালোবাসা, নিজের ইচ্ছের প্রাধান্য দেওয়ায় মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমি আফিফকে চাই না। আমি একা থাকতে চাই। কারণ এখন আমি নিজেকে ভালোবাসতে চাইছি। জানিস, আমি কখন সুখে থাকবো?”

“কখন?”

“একা থাকলে।”

“সারাজীবন কি একা থাকা সম্ভব, আহি?”

“মা তো থাকছে। মা কি আর বিয়ে করেছে?”

“আন্টির জন্য তো তুই আছিস? কিন্তু তোর কে আছে?”

আহি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো লিনাশার দিকে। লিনাশা আহির দুই গালে হাত রেখে বলল,
“নায়ীব বলেছে আমাকে, আফিফ অনেক ভালো একটা ছেলে। ও যদি তোর হতো, আমি অনেক খুশি হতাম। পদ্মের চেয়ে আমি তোকে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু পদ্ম তো এক্জিস্ট করে।”

আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“এনাফ ম্যাচিউর আমি। নিজের ভালোটা বুঝি। পদ্ম আফিফের স্ত্রী, আমি জানি। এটাও জানি, আফিফ আমার হবে না। তার মানে এই না যে, তোরা বললি আর আমি হুট করে বিয়ে করে নিলাম, নতুন জীবন শুরু করলাম? তুই নায়ীব ভাইয়াকে ভালোবেসেছিস, পদ্ম আফিফকে ভালোবেসেছে, পুষ্প লাবীবকে ভালোবেসেছে। কিন্তু আমি আফিফকে ভালোবাসি নি। আমি আমার হৃদয়টাই দিয়ে দিয়েছি৷ তোরা কি কেউ পারবি, আমার মতো করে তোদের প্রিয় মানুষকে ভালোবাসতে? এক তরফা, কোনো ইশারা, কোনো আশা, কোনো ফলাফল ছাড়া, পারবি ভালোবাসতে? কেউ পারবে? আমি স্পেশাল। তাই আমি পেরেছি। এটা আমার অহংকার। আর এটাতেই আমি নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবি। জানিস লিনু, আহি কেন সবার চেয়ে ভিন্ন? কারণ আহি আফিফকে ভালোবাসে। আমি যদি ভালোবাসাই ছেড়ে দেই, তাহলে আমার স্পেশালিটি আর থাকবে না। দেবদাস হয়েছে কতো জন, এবার না হয় আহির জন্ম হোক।”

“দেবদাস হওয়া সহজ। কিন্তু আহি হওয়া না। কারণ তুই একটা মেয়ে। আর দেবদাস মরে প্রমাণ করে দিয়েছে, সে তার শেষ নিঃশ্বাস অব্ধি পার্বতীকে ভালোবেসেছিল।”

“আমি আহি। কোনো দেবদাসী নই। আমি নিজেকে শেষ করে দেবো না। আমি বাঁচবো নিজের জন্য। স্বপ্ন দেখবো নিজের জন্য৷ শুধু ভালোবাসাটা হৃদয়ে দাফন হয়ে থাকবে। যেই অদৃশ্য মাটিতে আমার কয়েক বছরের পাগলামো, আমার স্বপ্ন, হাতে আঁকা প্রিয় ছবিগুলো, চারুশিল্প, সেই পথ সব, সবটাই দম ছাড়বে। আর সেই মৃত স্মৃতিগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”

লিনাশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি মুচকি হেসে বলল,
“তোর বর আমার জীবনে এসে অনেক বড় উপকার করেছে।”

“কী?”

“আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে আবেগ ধরে রাখতে হয়। আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে অলকানন্দাকে ভালোবেসে কাঠগোলাপকে আগলে রাখতে হয়। শিখিয়েছে কীভাবে সাদার ভীড়ে ধূসর বেগুনিকে খুঁজতে হয়।”

“আর?”

“আর রাদ, ও তো আমার মেডিসিন। আমাকে সাপোর্ট করেছে অনেক। এখন বল, আমি কি করবো? মেডিসিন তো রোগ সারায়৷ যেমন বন্ধুত্ব হতাশা কাটায়। রাদও আমার এলোমেলো জীবনটাতে একটু গতি এনেছে। বন্ধুর মতো পাশে থেকেছে। তুই তো ছিলি না পাশে। জানিস, অতিরিক্ত সবকিছুই মান হারায়। আমার অতি ভালোবাসাও মান হারিয়েছে। তবে এবার আমি ভুল করছি না। আমার যদি নিতেই হয়, আমি মেডিসিন নিবো। তবে এতো বেশি না, যেটা আমার মনে সাইড ইফেক্ট করবে। আর যেখানে আমি রাদকেই ভালোবাসতে পারছি না, সেখানে উজ্জ্বল বা পৃথিবীর অন্য কোনো পুরুষ দাঁড়ানোর যোগ্যতায় রাখে না।”

(***)

আজ শিক্ষা জীবনের সমাপ্তিতে রাদ, লাবীব, পুষ্প আর আহি ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছে। মাস্টার্সের সার্টিফিকেট তুলতে ক্যাম্পাসে এসেছে তারা। ক্যান্টিনে বসে তারা অনেক আড্ডাও দিলো। আড্ডার বিষয় লাবীব আর পুষ্পের বিয়ে। আড্ডা শেষে রাদ উঠে দাঁড়ালো। আহির হাত ধরে বলল,
“তোকে একটা জিনিস দেবো।”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কি?”

রাদ আহিকে একপাশে টেনে এনে বলল,
“আগে একটা সুখবর শোন।”

“হুম, বল।”

“আহি, আমার চাকরি হয়েছিল একটা।”

আহি আনন্দিত কণ্ঠে বলল,”সত্যি? কখন?”

“হ্যাঁ, একমাস আগেই হয়েছে। ভেবেছি আজই তোকে বলবো। আর তোকে সেই গিফটটাও দেবো।”

“রিয়েলি, গিফট! দেখি তো কি সেটা?”

রাদ ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আহির হাতে দিলো। আহি প্যাকেটটা খুলে দেখলো একটা ধূসর বেগুনি রঙের সুতির শাড়ি। সাথে সোনালী রঙের ব্লাউজ। আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“তোকে ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়িতে খুব মানায়। আমার জন্য পরবি কিন্তু একদিন।”

“আমার তো ছিলোই শাড়ি।”

“সব শাড়ি, আর এই শাড়ি এক না। এই শাড়িটা আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমার প্রথম সাফল্যের স্মৃতি। অনেক বছর পর যখনই তুই এই শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়াবি, আমার মনে পড়বে আমার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের কথা। মনে পড়বে নিজের টাকায় তোর জন্য আমার প্রথম গিফট কেনার মুহূর্তটির কথা।”

আহি হতাশ দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। ছলছল করে উঠলো আহির চোখ দু’টি। রাদ তা দেখে বলল,
“চল, তোকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। এতো আবেগী হতে হবে না তোকে।”

রাদ আহির হাত ধরলো। সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো কয়েক ধাপ। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আহির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো সে। পুরো মাঠ খালি। আজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী কম। মাঠের মাঝখানে এক আকাশস্পর্শী স্বপ্ন দেখা যুবক, আর তার হাতে আবদ্ধ তার প্রেয়সীর হাত। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“তোর হাসি দেখতে দেখতে আমি মরেই যাবো বোধহয়। এতো মিষ্টি হাসি তোর! আমার হৃদয়টাই কাঁপিয়ে দেয়।”

রাদ কথাটি বলেই সামনে তাকালো। আহিও সামনে তাকিয়ে থমকে গেলো। ক্যাম্পাস গেটের সামনে তাজওয়ার দাঁড়ানো। আহি অবাক কন্ঠে বলল,
“তাজওয়ার এখানে?”

মুহূর্তেই ঠা ঠা শব্দ ধ্বনিত হলো নিরব ক্যাম্পাস জুড়ে। আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঢিলে হয়ে এলো তার হাতটি। তার চোখের সামনে এই মাত্র হাসিমাখা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি ক্যাম্পাসের ইটের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। সাথে সাথেই আহির পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। তাজওয়ার আহির দিকে বন্দুক তাক করে বলল,
“আমি ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোনো প্রেমিক থাকতে পারবে না।”

আহি অস্থির হয়ে রাদের হাত হাতড়াতে লাগলো। ঝাঁকাতে লাগলো তার নিথর শরীর। ঠা ঠা শব্দে ক্যাম্পাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো অনেকেই। লাবীব ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সামনে এগুতেই পুষ্প তার হাত চেপে ধরলো। তাদের চোখের সামনে ঝড়ে গেলো এক প্রেমিক, যেই প্রেমিক শুধু ভালোবাসার অপরাধে প্রাণ দিয়েছে। তাজওয়ার দৃপ্ত পায়ে হেঁটে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। আহি রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“রাদ, এই রাদ। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, একটু চোখটা খোল। আমি তোকে এক্ষুণি হস্পিটালে নিয়ে যাবো।”

লাবীব দৌঁড়ে এলো। আহি লাবীবকে দেখেই গাড়ির জন্য উঠে দাঁড়াতে, ক্যাম্পাসের কয়েকটা ছেলে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহৃত এম্বুল্যান্সের জন্য পরিবহন কমিটির সাথে দেখা করতে বললো। আহি দৌঁড়ে গেলো সেদিকে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে রাদকে তুললো স্ট্রেচারে। আহির শরীর যেন চলছেই না। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেই পুষ্প তাকে শক্ত করে ধরলো। আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
“ও..ওর কিছুই হবে না। আমি পাগল হয়ে যাবো ওর কিছু হলে। পাগল হয়ে যাবো আমি। কি.. কি করবো আমি? রা.. রাদ আসবে। ঠিক হয়ে যাবে ও।”

পুষ্প আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি শরীরের ভার ছেড়ে দিতেই পুষ্প ভীত কন্ঠে বললো,
“আহি? এই আহি?”

আহি জ্ঞান হারিয়েছে। এরপর আহিকে ক্যাম্পাসের মেডিকেল রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।

(***)

অনিশ্চিত জীবন। হুট করে যে কীভাবে সব এলোমেলো হয়ে যায়! রাদের হঠাৎ মৃত্যু সবাইকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এদিকে আহি ব্রেইন স্ট্রোক করে দু’দিন হাসপাতালে ভর্তি। এ নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো আহি স্ট্রোক করেছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, প্রথম বারের স্ট্রোকের সাথে দ্বিতীয় বারের স্ট্রোক করার সময় ব্যবধান অনেক বছর হওয়ায় আহি মোটামুটি আশঙ্কামুক্ত। কিন্তু কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যদি আবার স্ট্রোক করে, তাহলে আহির মৃত্যুও হতে পারে, আর বেঁচে গেলে পঙ্গু হয়ে যাবে। আহি এখনো জানে না, রাদের মৃত্যু হয়েছে। সে ধরে নিয়েছে রাদ বেঁচে আছে। আহিকে রাদের মৃত্যুর সংবাদ দেয় নি কেউই। দেওয়ার ক্ষমতাও নেই কারো।

(***)

রাদের কুলখানি আজ। আহিকেও হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হলো। আজ বেশ শান্ত দেখাচ্ছে আহিকে। সালমা ফাওজিয়ার দিকে তাকিয়ে সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“রাদ কোথায়?”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“ওর সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে।”

“মা, আমি দেখেছি, ওর কপালে গুলি লেগেছে। ও বেঁচে আছে তো?”

সালমা ফাওজিয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “হ্যাঁ।”

“চিন্তা করো না, মা। আমি মরবো না। আমি তো আগে থেকেই মৃত ছিলাম। আমাকে একটু বলো তো, তাজওয়ার জেল থেকে পালালো কীভাবে? ও কোথায় এখন?”

“পুলিশ ধরতে পারে নি ওকে।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বলল,
“জানোয়ারটা আমাকে শেষ করে দিয়ে গেছে, মা। কোন অলুক্ষণে দিনে আমি তার সামনে এসে পড়েছি জানি না। সে কখন আমাকে দেখে এতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেলো যে আমার জন্য সে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মার‍তে এলো! ও তো জানোয়ার না। তাহলে ও কি, মা? ও কি সাইকো? হ্যাঁ, ও একটা সাইকো কিলার।”

“শান্ত হো, আহি।”

আহি শান্ত হলো। চোখ বন্ধ করলো সে। সেকেন্ড খানিক পর মায়ের দিকে তাকালো। বলল, “তাজওয়ারকে কে পালাতে সাহায্য করেছে আমি জানি। এখন তাজওয়ার কোথায় আছে, আমি সেটাও জানি।”

আহি উঠে দাঁড়ালো। এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। সালমা ফাওজিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
“কি খুঁজছিস?”

“আমার ফোন!”

সালমা ফাওজিয়া আহির ফোনটা এনে দিলেন। আহি ফোন পেয়ে সাথে সাথেই উজ্জ্বলের নম্বরে ডায়াল করলো। উজ্জ্বল ওপাশ থেকে কিছু একটা বললো। আর আহিও কল কেটে দিয়ে মাকে বলল,
“মা, আমাকে যেতে হবে।”

“তুই এই কাজটা করিস না, আহি।”

“এই দেশে কোনো আইন নেই। কোনো বিচার নেই। রাদের বিচার আমি করবো। এবার যা হওয়ার হোক। দেখবো আমি, আইন আমাকে কি শাস্তি দেই।”

“পাপ হবে, আহি।”

“পাপ! সিরিয়াসলি? ঠিক আছে, যদি পাপ হয়৷ হোক। এমন পাপ আমি করবোই করবো।”

আহি বেরিয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়া এদিকে অস্থির হয়ে গেলেন। তিনি ব্যস্ত হয়ে ফোন হাতে নিলেন। কিছু একটা ভেবে একটা নম্বরে ডায়াল করলেন।
রিং যাচ্ছে। সেকেন্ড খানিক পর ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দ শোনা যেতেই সালমা ফাওজিয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলতে লাগলেন সবটাই।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৩||

১০৯।
রাগান্বিত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে আহি। আহিকে এর আগে কখনোই এতোটা রোষাগ্নি মেজাজে দেখে নি আফিফ। সে আহির হাত ধরে শান্ত স্বরে বলল,
“কি করতে যাচ্ছো তুমি?”

আহি ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
“কেন আটকাচ্ছো আমাকে? কাকে বাঁচাতে চাইছো? ওই ফেরাউনকে?”

“তোমাকে বাঁচাতে এসেছি আমি।”

“আমার জন্য এতো ভাবতে হবে না তোমার।”

“আহি, আন্টি আমাকে কল দিয়েছিলেন। আন্টির সাথে কথা বলে আমি উজ্জ্বলকে কল দিয়েছি। তারপর জানলাম তুমি এদিকে এসেছো। শুনো আহি, তুমি হুট করে এমন ডিসিশন নিয়ে তোমার জীবনটা এলোমেলো করে দিও না।”

আহি করুণ দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তাজওয়ার রাদের উপর কেন গুলি চালালো, জানো?”

আফিফ চুপ করে রইলো। আহি কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“কারণ রাদ আমাকে ভালোবাসে। দেখেছো, আমি একটা অভিশপ্ত মেয়ে। আর কতোবার প্রমাণিত হবে, আমিই সবার পথের কাঁটা? আমার জন্য লিনাশার বাবা মারা গিয়েছিল। আমার জন্য পদ্মের সাথে এতো বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে, আর এখন রাদ!”

আফিফ আহির হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“পদ্মের সাথে যা হয়েছে, তার জন্য তুমি নিজেকে দায়ী করছো?”

“আমার জন্যই তো হয়েছে সব।”

“মোটেও না। তোমার জন্য পদ্মের কিছুই হয় নি। ও তো নিজের কাজের শাস্তি পেয়েছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ বলল,
“তুমি পদ্মকে যতোটা ভালোবাসো, মেয়েটা ঠিক সেভাবে তোমাকে ভালোবাসে না, আহি।”

“কি বলছো তুমি?”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উজ্জ্বলের গাড়ি সেখানে এসে পৌঁছালো। উজ্জ্বলকে দেখে আফিফ থেমে গেলো। এদিকে উজ্জ্বল গাড়ি থেকে নেমে আহির দিকে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে। এতো সহজে তুমি এমন একটা ডিসিশন নিয়ে নিলে? পুলিশ তাজওয়ারকে খুঁজছে। তার উপর ও এখন একটা খুন করেছে।”

কথাটি বলেই উজ্জ্বল থমকে গেলো। আহি মলিন মুখে বলল,
“খুন! রাদ বেঁচে আছে। মা বলেছে, ও হাসপাতালে ভর্তি।”

উজ্জ্বল আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, খুন করার চেষ্টা করেছে, ওটাই বোঝাতে চেয়েছি।”

আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই আহি তড়িৎ গতিতে তা মুছে ফেললো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“রাদ নেই, এটা আমি মানতেই পারবো না। আর তাজওয়ারকে আমি আর জীবিত দেখতে চাই না। আমি ওকে নিজের হাতে শেষ করে দেবো।”

“তুমি জানো তাজওয়ার খান এই মুহূর্তে কোথায়?”

“হ্যাঁ, এই মুহূর্তে তাজওয়ারের আপনজন তো একজনই আছে। লাবণি মেহেরা। তাজওয়ার এরেস্ট হওয়ার পরই ওর বড় ভাই সরওয়ার খান, নিজের ওয়াইফ আর মাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছে। কারণ সে নিজেও এমন ক্যারেক্টারের লোক। এরপর এখনো তারা দেশে ফিরে নি। আর তাজওয়ারের মতো লোকের কোনো বন্ধু হয় না। সজিব আর জিলান তাজওয়ারকে জেল থেকে বের করার কোনো চেষ্টায় করবে না। করবে শুধু একজনই। লাবণি মেহেরা। কারণ তার আর কোনো পথই খোলা নেই। বাবা উনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। এখন উনার তো তাজওয়ার খানই একমাত্র ভরসা।”

“সব বুঝলাম, কিন্তু লাবণি মেহেরার তো কোনো ক্ষমতা নেই। সব ক্ষমতা তোমার বাবার ছিল। ক্ষমতা ছাড়া তাজওয়ারকে জেল থেকে বের করাটা অসম্ভব।”

আহি কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“তাজওয়ারকে যেই কারাগারে রাখা হয়েছে, ওখানের দায়িত্বরত কারারক্ষীদের মধ্যে যে প্রধান তাকে আমি চিনি। মঈনুল বাগ। লোকটার ক্যারেক্টর সম্পর্কে আমার ভালোই ধারণা আছে। লোকটা বাবার এমপ্লয়ির ভাই। অনেক বার অফিসে এসেছিল। নোংরা দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকাতো। আর লাবণি মেহেরা এমন লোকেদের ভালোই হ্যান্ডেল করতে পারেন। উনার ক্যারেক্টারের সাথে মঈনুল একদম ফিট বসে।”

উজ্জ্বল বলল, “এটা তোমার ধারণাও হতে পারে।”

“আপনি কি ভাবছেন, তাজওয়ার এই মুহূর্তে লাবণির সাথে থাকবে না?”

“যদি থাকে, তাহলে তো আমরা তাকে এরেস্ট করাতে পারবো৷”

“এরেস্ট? আবার পালানোর সুযোগ দিয়ে দেবো? নো ওয়ে। আই উইল কিল হিম।”

এবার আফিফ বলল,
“ওকে ফাইন। কিন্তু তাজওয়ারকে মেরে তুমি আইন যদি নিজের হাতে তুলে নাও, তোমারই তো শাস্তি হবে। তাজওয়ারকে এমন ভাবে মারতে হবে, যাতে ওর মৃত্যুর জন্য তোমাকে দায়ী করা না যায়।”

আহি আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“লাবণি মেহেরা। উনাকে তো ফাঁসানো যাবে। এক তীরে দু’জনই মরলো।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“লাবণি মেহেরা তাজওয়ারকে ছাড়ানোর পর তাজওয়ারকে খুন করবে এটা ভাবা যায়? এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে?”

“অবশ্যই করবে। কারণ প্ল্যানটাই আমাদের ওরকম হবে।”

আহি তার পরিকল্পনাটা উজ্জ্বল আর আফিফকে শোনালো। আহির পরিকল্পনা শুনে উজ্জ্বল বলল,
“আমার একদিন সময় নিতে হবে।”

আফিফ উজ্জ্বলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি তাহলে সাক্ষী জোগাড় করো। আমরা কল রেকর্ডটা বের করবো।”

আফিফ এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বাবা কি তোমাকে এই কাজে সাহায্য করবেন?”

আহি বলল,
“লাবণির বিরুদ্ধে বাবা যে-কোনো কিছুই করবেন। তবে আমাকে এক্ষুণি গিয়েই বাবার সাথে কথা বলতে হবে। আর বাবার একটা ফোন কলেই কাজ হয়ে যাবে। আমি এতো বড় কোনো দায়িত্ব তো দিচ্ছি না বাবাকে।”

(***)

মোজাম্মেল চাচা গেট খুলে আহিকে দেখে অবাক হলেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“ছোট মা, তুমি এইখানে? কোনো সমস্যা হইছে?”

আহি বলল,
“বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

মোজাম্মেল চাচা উপরের তলায় এক নজর তাকিয়ে বললেন,
“স্যার কেমন যেন হইয়া গেছে, মা। দেহো তো কেমন আছে। কথাটথাও কয় না।”

আহি বাসায় ঢুকলো। অনেক দিন পর আবার এই বাড়িতে পা রেখেছে আহি। অস্থির লাগছে তার। নিচে বড় একটা ডায়নিং। এই ডায়নিংয়ে বসে বাবার সাথে সকালের নাস্তা সেরে স্কুলে যেতো সে। ডায়নিংয়ের একপাশে রান্নাঘর, অন্যপাশে বসার ঘর। আহির কেন যেন মনে হলো রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে মা আর মুনিয়া খালার ব্যস্ততা। আর বসার ঘরের কার্পেটে বসে চুনি হিন্দি সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে সেখান থেকে চুনির হাততালির শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চয় চুনির মন মতো কিছু একটা ঘটছে। কোণার ঘরটি চুনি আর মুনিয়া খালার। ও ঘরটি থেকে ভেসে আসছে মা-মেয়ের খুঁনসুঁটি। আহি সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠলো। দু’তলার ডানপাশে আহির ঘর। মাঝখানে বিশাল বড় একটা লাইব্রেরি আর বামপাশে বাবা-মায়ের রুম। আহির মনে হলো সেই রুমে হয়তো এখনো কিশোরী আহি একটা ক্যানভাসে তার প্রিয় অলকানন্দের ছবি আঁকছে। লাইব্রেরীতে হয়তো মা বসে বই পড়ছে। আর বাবা হয়তো রুমে বসে টিভি দেখছে, হয়তো-বা অফিসের কাজ করছে। এই মুহূর্তে সবটাই আহির কল্পনা। বর্তমান শুধু পুরো ঘরের নিস্তব্ধতা। আহি নিরবতা কাটিয়ে মৃদু পদ শব্দ তুলে বাবার ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো। কটকট শব্দ হতেই ভেতর থেকে হালকা শব্দ করলেন রিজওয়ান কবির। আহি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে মদের বোতল। আর রিজওয়ান কবির রকিং চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। আহিকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়াতেই ভারসাম্য হারিয়ে রকিং চেয়ারে বসে পড়লেন। আহি রিজওয়ান কবিরের পাশে এসে বসলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“কি অবস্থা করে রেখেছো নিজের?”

রিজওয়ান কবির আহির দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালেন। আহি বলল,
“বাবা, কি করছো এসব? তুমি এখন মন্ত্রী। এখন তো অন্তত এসব ছাড়ো।”

রিজওয়ান কবির ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,
“এখন খুব দেরী হয়ে গেছে। এখন এসবই আমার সংসার, আমার সঙ্গী।”

আহি নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো রিজওয়ান কবিরের দিকে। রিজওয়ান কবির আহিকে নীরব দেখে বললেন,
“তুমি এখানে কেন এসেছো?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই মুহূর্তে তোমার সাহায্যের খুব প্রয়োজন।”

আহি রিজওয়ান কবিরকে সবটা খুলে বললো। সব শুনে রিজওয়ান কবির বললেন,
“লাবণি যে তাজওয়ারকে ছাড়ানোর জন্য মঈনুলের সাথে রাত কাটিয়েছে, এটা আমি অবিশ্বাস করবো না। কারণ মঈনুলের হাবভাবে বোঝা যায়, সে আমার চেয়ে বেশি লাবণিকে চেনে। যতোবার দেখেছি, ততোবারই আমাকে বুঝিয়েছে, সে লাবণিকে কতোটা চেনে। আমিই বুঝি নি তখন। মোহগ্রস্ত ছিলাম। এখন তো সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেদিন তাজওয়ারকে যে লাবণিই সিডিউস কর‍তে চেয়েছিল, সেটাও এখন বুঝতে পারছি।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিজওয়ান কবির আবার বললেন,
“আমি আমার কাছের মানুষদেরই ভুল বুঝেছি। অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি।”

আহি বাবার হাত ধরে বলল, “সময় তো এখনো আছে।”

রিজওয়ান কবির কথা কাটিয়ে বললেন,
“আমাকে কি করতে হবে বলো।”

আহি লাবণির কল রেকর্ডগুলো বের করার জন্য রিজওয়ান কবিরের সাহায্য চাইলো। কারণ কোনো সিম কোম্পানিই সাধারণ কারো হাতে কল রেকর্ড দেবে না। আর পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে এই বিষয়ে যুক্ত করলে আহির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে যাবে।

এদিকে রিজওয়ান কবির লাবণির সিমের কল রেকর্ডগুলো বের করতে আহিকে সাহায্য করলেন। এরপর সালমা ফাওজিয়ার বাসায় আফিফ, আহি, উজ্জ্বল, সালমা ফাওজিয়া, লিনাশা, নায়ীব, লাবীব এবং পুষ্প একসাথে গোল হয়ে বসে এক একটা রেকর্ড শুনতে লাগলো। কয়েক ঘন্টার পরিশ্রমের পর কাঙ্খিত রেকর্ডটি পাওয়া গেলো। আহি রেকর্ডটি নিয়ে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে পেন ড্রাইভে সেইভ করে নিলো। কাজ শেষে উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কীভাবে জানলে লাবণি মেহেরা ফোনে এমন কিছু বলেছিল?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“ভাগ্যক্রমে সেদিন আমি তার আশেপাশেই ছিলাম।আমার কানে এসেছিল তার প্রতিটা কথা। হয়তো আল্লাহ আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন, আজকের এই দিনটার জন্য।”

১১০।

কালো হেলমেট পরে আহির সামনে এসে দাঁড়ালো আফিফ। আহি আপাদমস্তক আফিফকে দেখে নিয়ে বলল,
“সেদিন তাজওয়ারের উপর তুমিই আক্রমণ করেছিলে?”

আফিফ হেলমেটের উপরিভাগ উন্মুক্ত করে বলল, “হ্যাঁ।”

“কেন?”

আফিফ মোটর সাইকেলে উঠতে উঠতে বলল,
“একটু মেরে আসতে ইচ্ছে হলো। এসিস্ট্যান্ট বানিয়ে প্রচুর অত্যাচার করেছে। তাই সব শোধ তুলে নিতে গিয়েছি।”

আহি আফিফের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে বলল,
“তোমার এতো সাহস কখন হলো?”

“তোমার কি আমাকে ভীতু মনে হয়?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সাহসীও মনে হয় নি।”

আফিফ মোটর সাইকেল জোরে টান দিতেই আহি আফিফের সাথে ধাক্কা খেলো। আহি শক্ত করে আফিফের শার্ট খামচে ধরলো। আফিফ বলল,
“সরি, ঠিকভাবে বসো।”

আহি আফিফকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। এরপর আফিফ মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে এলো আহির দেখানো ঠিকানায়।
শহরের বাইরে একটা দু’তলা বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল থামালো আফিফ। আহি মোটর সাইকেল থেকে নেমেই গেটের কাছে চলে এলো। গেট খোলা। আহি গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। আফিফও পিছু পিছু এলো।
পুরোনো দিনের বাড়িগুলোর মতো শ্যাওলা জমে আছে দেয়ালে। আহি সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে নিচ তলা থেকে। আহির গা গুলিয়ে এলো। মুখ চেপে পেছনে ঘুরতেই আফিফের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো সে।
আফিফ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো?”

আহি বলল, “বিদঘুটে গন্ধ!”

আফিফ পকেট থেকে তার রুমাল বের করে আহিকে দিয়ে বলল,
“নাক বেঁধে ফেলো।”

আহি রুমালটি নিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “চলো।”

আহি রুমালটি নাকের কাছে আনতেই থেমে গেলো। আফিফের শরীরের গন্ধ লেগে আছে এই রুমালে। আহির সাহস হলো না আর। সে আবার আফিফকে রুমালটি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“লাগবে না আমার।”

আহি রুমালটি দিয়েই দ্রুত পায়ে উপরে উঠে গেলো। আফিফ রুমালটির দিকে এক নজর তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

দু’তলায় এসে কড়া নাড়লো আহি। পীপহোল বাইরে থেকে চেপে ধরে রেখেছে সে। যাতে ভেতর থেকে কেউ না দেখে। অনেকক্ষণ পর ওপাশ থেকে ভেসে এলো লাবণির কন্ঠ, “কে? কে?”

আহি কোনো উত্তর দিলো না। দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। আহি ধীরে ধীরে গ্লাভসটা পরে হাতে একটা পিস্তল নিলো। লাবণি দরজা খুলতেই আহি ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পিস্তল ঠেকালো লাবণির কপালে। লাবণি চেঁচিয়ে উঠলো। আফিফ ভেতরে ঢুকলো। দু’রুম পর একটা ঘরের দরজা খুলতেই আহির কথা সত্য প্রমাণিত হলো। তাজওয়ার, সজিব আর জিলান একটা রুমে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর নেশাদ্রব্য পান করছে। তাজওয়ার আফিফকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুই এখানে?”

তাজওয়ারের কন্ঠ শুনে আহি দরজাটা বন্ধ করে লাবণির গালে কষে একটা চড় বসিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। এদিকে তাজওয়ার আফিফকে মারার জন্য এগিয়ে আসতে যাবে তখনই আহি রুমে ঢুকলো। আহিকে দেখে তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“সুইটহার্ট, তুমি এখানে?”

আহি তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সশব্দে তার গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আই উইল কিল ইউ।”

তাজওয়ার গালে হাত বোলাতে বোলাতে আহির দিকে তাকালো। ভীষণ রেগে গেছে সে। আহির গালে হাত চেপে ধরতে যাবে তার আগেই আফিফ তাজওয়ারের হাত ধরে বলল,
“এই সাহস নেই তোর।”

তাজওয়ার দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোর এতো সাহস!”

আফিফ বাঁকা হেসে বলল,
“আমার এখন অনেক সাহস।”

তাজওয়ার হাসলো। আহি তাজওয়ারের কপালে পিস্তল ঠেকাতেই তাজওয়ারের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। সে ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ পিস্তলটির দিকে তাকিয়ে আরো দ্বিগুন জোরে হাসতে লাগলো। তাজওয়ারের দেখাদেখি সজিব আর জিলানও হাসতে লাগলো। তাজওয়ার হাসি থামিয়ে সজিব আর জিলানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখ, দেখ কে এসেছে! আফিফ রাফাত এসেছে। কে এই আফিফ?”

সজিব বলল,
“বোনের ভিডিও দেখে মায়ের আঁচলে লুকিয়ে যাওয়া অবোধ বালক।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে সজিবের দিকে তাকালো। এদিকে আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো। তাজওয়ার তা দেখে বলল,
“এতো রাগ কেন, আফিফ? তোর বোনের সাথে কি করেছি মনে নেই?”

আহি আফিফের দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে আফিফের বোনের?”

“কেন সুইটহার্ট? তুমি জানো না কি হয়েছে? তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে শহীদ হয়েছে আফিফের বোন। যেমন রাদ হয়েছে কিছুদিন আগে।”

আহি অবাক হয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ এক দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“কি বলতে চাইছো তুমি?”

তাজওয়ার বলল,
“সুইটহার্ট, তুমি জানো আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি। সেই শুরু থেকে, যখন থেকে তোমাকে দেখেছি। আর তুমি কি করছিলে? এই ক্ষ্যাতটার পেছনে সময় নষ্ট করছিলে। আমি একবার ওয়ার্ন করেছিলাম, বলেছিলাম আহি শুধু আমার। কিন্তু এই বোকা তো বুঝে নি। তার বড় আপা বারণ করার পরও সে তোমার চিঠিগুলো নিতো। তোমাকে আরো সুযোগ দিতো। এখন সোজা আঙ্গুলে যেহেতু ঘি উঠে নি, আঙ্গুল তো বাঁকাতে হবে। ব্যস, আমি আমার জিনিস কেঁড়ে নিয়েছি, বিনিময়ে আফিফ তার বোনকে হারিয়েছে।”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজওয়ার আফিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আফিফ সেদিন বাধ্য হয়ে তোমার দেওয়া সেই কার্ডটি ফেলে গিয়েছিল, সুইটহার্ট। কারণ সে এই কাজ না করলে, আমি তার ছোট বোনের সাথেও একই কাজ করতাম।”

আহির চোখ ভারী হয়ে এলো অশ্রুতে। সে আফিফের দিকে তাকালো। কিন্তু আফিফ তার দিকে তাকালো না। তাজওয়ার এবার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি যদি চুপচাপ আমার হয়ে যেতে, আজ এতোগুলো মানুষের জীবন এলোমেলো হতো না।”

আহি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। সজোরে ধাক্কা দিলো তাজওয়ারকে। হঠাৎ ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে তাজওয়ার মেঝেতে পড়ে গেলো। আহি তাজওয়ারের বুকের উপর পা রেখে বলল,
“সেদিন কি বলেছিলে তুমি, গল্পটার সমাপ্তি তুমিই করবে, তাই না? হ্যাঁ, তাজওয়ার খান, আমার এলোমেলো জীবনের গল্পটার সমাপ্তি তুমিই করবে। তোমার মৃত্যুতে শেষ হবে এই গল্প।”

আহি পিস্তলের চারটা গুলি তাজওয়ারের বুকে আর কপালে চালিয়ে দিলো, ঠিক যেভাবে রাদের উপর গুলি চালিয়েছিল তাজওয়ার। গুলির শব্দ হতেই সজিব আর জিলান ঘাবড়ে গেলো। লাবণি মেহেরাও একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আফিফ সজিবের কলার চেপে ধরলো। দেয়ালে ঠেকালো তাকে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে সজিবের মাথাটা দেয়ালের সাথে বার-বার ঠুকাতে লাগলো। জিলান আফিফকে ঝেঁকে ধরেছে। আফিফ হাতের কনুই দিয়ে ইচ্ছেমতো মারলো জিলানকেও। সজিবের মাথা ফেঁটে দেয়াল রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো। লাবণি চেঁচিয়ে পালাতে যাবে তার আগেই আহি লাবণির হাত ধরে বলল,
“তুমি কোথায় পালাচ্ছো? তোমার পালানোর দিন শেষ।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই উজ্জ্বল কিছু পুলিশ সদস্য নিয়ে ঢুকলো সেই বাড়িতে। আহত অবস্থায় জিলান আর সজিবকে উদ্ধার করলো তারা৷ তাজওয়ারের মৃত শরীরটা বের করে মরদেহ পরিবহনে উঠানো হলো। আর লাবণিকে গ্রেফতার করা হলো। লাবণি চেঁচিয়ে বলল,
“আমি কিছুই করি নি। তাজওয়ারকে আহি মেরেছে।”

একজন সিনিয়র পুলিশ আহির হাত থেকে পিস্তলটি নিয়ে বলল,
“মিস লাবণি মেহেরা, এটা আপনারই লাইসেন্স গান। আর তাজওয়ারকে আপনিই খুন করেছেন। আর এর চাক্ষুষ সাক্ষী আমরা। আপনি তাজওয়ারকে মারার জন্য মঈনুল বাগের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এরপর তাজওয়ারকে এখানে এনেছেন, যাতে তাকে খুন করতে পারেন। কারণ সে আর তার বন্ধুরা আপনার সাথে প্রতারণা করেছে। আপনাকে ব্যবহার করেছে। আপনার কল রেকর্ড আছে আমাদের কাছে, যেখানে স্পষ্ট আছে, আপনি তাজওয়ারকে মারার থ্রেট দিচ্ছিলেন। যেখানে আপনি বলেছিলেন, তাজওয়ার যদি আপনাকে বিয়ে না করে, আপনি তাকে খুন করবেন। এমনকি তার বন্ধুদেরও আপনি খুন করার হুমকি দিয়েছেন, কারণ তারা আপনার সু্যোগ নিয়েছিল।”

লাবণি অবাক কন্ঠে বলল,
“এসব আমি তাজওয়ারকে এমনিই বলেছি। আমার কোনো ক্ষমতা নেই তাজওয়ারকে মারার। তাজওয়ারকে আহি মেরেছে। মিথ্যে সাক্ষী কেন দিচ্ছেন, ইন্সপেক্টর?”

সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাটি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। উজ্জ্বল লাবণির দিকে তাকিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাটিকে বলল,
“ধন্যবাদ বন্ধু।”

লাবণি অবাক হয়ে বলল, “মিথ্যে সব।”

উজ্জ্বল হেসে বলল,
“কেন মিস লাবণি মেহেরা, পাওয়ার কি সব একা তোমার? আমরা কি ঘাস কাটার জন্য জন্ম নিয়েছি? ক্ষমতা অর্জন করে নিতে হয়। তুমি তো অন্যের ঘাড়ে চড়ে, নিজের সম্মান বিক্রি করে ক্ষমতা কিনে নিয়েছো। আর আমরা সম্মানের সাথে নিজেদের মগজ খাটিয়ে ক্ষমতা অর্জন করেছি।”

এরপর লাবণিকে ধরে নিয়ে গেলো পুলিশ। শেষ হলো এক ফেরাউনের গল্প।
তাজওয়ার খান প্রেমিকা লাবণি মেহেরার গুলিতে মারা গেলো। শিরোনাম জুড়ে শুধু এই একটাই খবর। আহত সজিবের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বেঁচে ফিরলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এদিকে জিলান সুস্থ, কিন্তু তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা থাকায় সে ছাড়া পেলো না। খবরে এই শিরোনামটি দেখেই টিভি বন্ধ করলো পদ্ম। ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। অস্থির লাগছে তার। অন্যদিকে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে আফিফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। আফিফ এসবের উত্তর দেবে না জানে। তাই আহি জিজ্ঞেস করলো না। শুধু কয়েক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে। এই জল জিজ্ঞেস করছে,
“তবে কি তুমিও আমায় ভালোবেসেছিলে, এআর? আমার মতো করে আমাকে অনুভব কর‍তে?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

১১১।
আদালতে লাবণির শাস্তির রায় দেওয়া হলো, সাত বছরের কারাদন্ড। সজিবের মাথায় আঘাত লাগায় তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়, যার ফলে তাকে মেডিক্যালি মৃত ঘোষণা করা হয়। জিলানকে দশ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অবৈধ কাজের জন্য। এদিকে তাজওয়ার খানের দাফনের জন্য তার মা আর বড় ভাই-ভাবী দেশে এসেছে। কিন্তু তাকে দাফন করা সম্ভব হয় নি। রাদের বন্ধু আর কাজিনসহ কিছু সাধারণ মানুষ ঘেরাও করে ফেলে তাজওয়ারের মরদেহ পরিবহনটি। পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় পরিবহনে। তাদের একটাই দাবী, এমন পাপীর স্থান মাটিতেও নেই। পুলিশ কাউকেই চিহ্নিত করতে পারে নি। সবার মুখেই রুমাল বাঁধা ছিল। সবাই আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তাজওয়ারের বিলাসবহুল বাড়ির সামনে তাজওয়ারের মরদেহ পরিবহনটি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। শত শত প্রহরী, দেহরক্ষী কেউ এসে আজ এই মৃত শরীরটা বাঁচাতে পারে নি। প্রাসাদের মতো বাড়ি, রাজার বেশে চলা, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবটাই মুছে গেছে সেকেন্ডেই। আহি টিভি বন্ধ করে সালমা ফাওজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখেছো মা, আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। তাজওয়ার সেই হিসেবে অনেক ছাড় পেয়েছে। তাকে ছেড়ে দিলেই অন্যায় হতো। ইতিহাস সাক্ষী ফেরাউনকে মাটি, পানি কোনো কিছুই গ্রহণ করে নি। আর আজ আমার জীবনে আসা এই ফেরাউনের ভাগ্যেও মাটি ছিল না। ছাই হয়ে গেছে সে। তার অস্তিত্ব, তার দেহ সবটাই মিশে গেছে।”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“তাজওয়ার খানকে খুন করার অপরাধে লাবণি যেই শাস্তিটা পেয়েছে, ওটা তো তোমারই পাওয়ার কথা ছিল। সাত বছরের জেল! কিন্তু তুমি ওকে ফাঁসালে কীভাবে? শুধুমাত্র কল রেকর্ডের উপর ভিত্তি করে কারো রায় হয় না।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“লাইসেন্স গানটি লাবণি মেহেরার ছিল। বাবা যেদিন তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল, সেদিন তিনি সেটা সাথে নিয়ে যান নি। পিস্তলটি বাবার কাছেই ছিল। সেদিন বাবার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আর তখনই বাবা আমাকে সেটা দিয়ে বলেছিল, যাতে পিস্তলটি কাজে লাগায়। সেই মুহূর্তে আমার মাথায় এই বুদ্ধিটা এলো। এরপর উজ্জ্বলের পুলিশ বন্ধুটিও তো সাহায্য করলেন। প্রমাণ মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু সাক্ষী মিথ্যে হয় না।”

“কিন্তু জিলানের কনফেশন?”

“পদ্ম, ফার্জিয়া, ফার্সাসহ অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে জিলান, সজিব, হ্যারি আর অর্ণব। বাকিরা তো তাদের শাস্তি পেয়েই গেছে। এখন আইন শুধু জিলানকে শাস্তি দিচ্ছে। আর তাজওয়ার তো এসবের মাস্টারমাইন্ড ছিল। ও যদি বেঁচে থাকতো, কোনো না কোনো একদিন জেল থেকে বের হয়েই যেতো। ওর ফাঁসি কখনো হতোই না। কারণ ও অনেক নামি-দামি উকিল হায়ার করার ক্ষমতা রাখে। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এই কেইস পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওর শাস্তি কমে যেতো। তার চেয়ে মৃত্যুই ওর জন্য সবচেয়ে ভালো শাস্তি। এই পৃথিবীতে সে ক্ষমতাবান হতে পারে, সৃষ্টিকর্তার সামনে তাজওয়ার খান কিছুই না।”

(***)

বারান্দার মেঝেতে বসে আছে আফিফ। নতুন চাকরির জন্য চেষ্টা করছে সে। খানস গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েক মাস হচ্ছে। সংসার চালানোর মতো কোনো টাকা নেই তার হাতে। তার উপর সে রেনুকে নিয়ে এসেছে নিয়াজীর বাড়ি থেকে। বোনকে আর ওই বাড়িতে রাখবে না আফিফ। এদিকে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা রেনু। তার বড় দুই ছেলে বাবার সাথেই থাকবে। নিয়াজী ছেলেদের রেনুর সাথে আসতে দেয় নি। আইনগত ভাবে ছেলেদের নিজের কাছে রাখার আবেদন করেছে নিয়াজী। রেনু অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় তালাকের আবেদন করা সম্ভব হচ্ছে না। বাচ্চা হওয়ার পরই তালাকের কার্যক্রম শুরু করবে। আফিফের উপর এখন সংসার চালানোর চাপ বেড়েছে। রেনু ও তার অনাগত সন্তানটির দায়িত্ব এখন আফিফের উপর। আবার কাঁধে চেপেছে অনেক ঋণ। সে তার বন্ধু নিলয়ের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিল। যদিও নিলয় বলেছে, সময় নিয়ে দিলেও সমস্যা নেই। কিন্তু টাকা পরিশোধের জন্য টাকা আয় তো করতে হবে। তবে সে বিভিন্ন কোম্পানিতে সিভি পাঠিয়েছে। ইন্টারভিউ দিয়েছে দু’একটা। চাকরিটাও ঠিক পেয়ে যাবে একদিন।

আফিফকে বারান্দায় অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে পদ্ম তার পাশে এসে বসলো। পদ্মের উপস্থিতিতেই আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পদ্ম আফিফের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“আমার শরীরে এখন কলঙ্ক লেগে আছে, তাই আমাকে সহ্য হয় না আপনার, আমি জানি।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কলঙ্ক তো লেগেই গেছে। যে স্বেচ্ছায় কলঙ্ক লাগায়, তাদের কলঙ্ক তো লেগেই থাকে। কখনো মুছে যায় না।”

“আমার এই বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, আমি মরে যাবো। আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।”

“চিন্তা করো না। বাসা এমনিতেই চেঞ্জ করতে হবে।”

পদ্ম ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার তো এই শহরেই ভালো লাগছে না।”

আফিফ শীতল দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“প্লিজ, আফিফ। আমরা এই শহরটা ছেড়ে দেই? আফিফ, আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। আমি জানি, আমি অপরাধ করেছি। কিন্তু তার শাস্তি কি মৃত্যু? আমি যদি এই শহরে আরো কয়েক সপ্তাহ থাকি, নিশ্চিত আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। আমি বেরুতে পারি না। আমার ভয় হয়। আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়।”

পদ্ম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আফিফ পদ্মের দিকে ঘুরে বসলো। পদ্ম হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন? আপনি তো আমাকে আর আগের মতো নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে নেন না।”

আফিফের কোনো হেলদোল না দেখে পদ্ম আফিফের বুকে হাত রেখে বলল,
“এই বুকে কি এখন অন্য কেউ মাথা রাখে?”

আফিফ পদ্মকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পদ্মও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার জন্য কয়েক পাতা ঘুমের ওষুধ নিয়ে এলেই হবে, আমি চুপচাপ ঘুমিয়ে যাবো। আপনাকে একদম বিরক্ত করবো না।”

আফিফ চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। সে গম্ভীরমুখে বলল,
“আমি এই শহর ছেড়ে দেবো। কিন্তু তুমি যাওয়ার আগে আহিকে সব সত্য বলে দেবে। আমি চাই না, আহি তোমার জন্য আফসোস করুক। মেয়েটা তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য নিজেকে দায়ী করছে। এতো বোঝা ওর উপর চাপিয়ে দিয়ে আমি যাবো না। তুমি ওকে সত্যটা জানাবে।”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“আমি আহিকে সব জানাবো। বলবো, আমি খারাপ, আমি সব করেছি। কিন্তু আপনাকে কসম করতে হবে, আপনি আমাকে ছাড়বেন না। আর আহির কাছে যাবেন না।”

আফিফ পদ্মের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম আফিফের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“ওয়াদা দিন।”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, যেই মেয়েটাকে আমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি। যাকে আমি ভালোবেসেছি। সেই মেয়েটা তুমি ছিলে। তোমাকে পদ্মফুল নাম কেন দিয়েছি, জানো? ফুল যেমন নিষ্পাপ, স্নিগ্ধ, মায়াবি হয়, তোমার মধ্যেও আমি সেসব গুণ দেখেছি। কিন্তু আমি মিথ্যের মাঝে আবদ্ধ ছিলাম। তুমি তো ফুল ছিলেই না। কাঁটা ছিলে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাঁটা।”

পদ্ম শুকনো হেসে বলল,
“এই কাঁটার সাথেই আপনাকে থাকতে হবে। আহি কি কখনো পদ্মের সংসার ভাঙবে, বলুন? ও কি কখনো বিশ্বাস করবে, আমি ওর সাথে এমন করেছি? ও ভাববে, আমি ধর্ষিতা, তাই আপনি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন। আর তাজওয়ার তো বেঁচে নেই। আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই নেই। শুধু আপনি আছেন। আর আপনি আহিকে গিয়ে এসব বললেও লাভ হবে না। আপনি ওর যোগ্য না, আফিফ। আহি কখনো আপনার এই সংসারে থাকতে পারবে না। আপনার সেই সামর্থ নেই। রিজওয়ান কবিরের একমাত্র বংশধর আহি। ওর দাদা ওর নামে সব লিখে দিয়েছে। ও এখন চট্টগ্রামের ধনী নারী। গাড়ি, বাড়ি কোনো কিছুর অভাব নেই। আপনিই বলুন, আপনি কি ওর যোগ্য? বামুন হয়ে চাঁদ ধরার জন্য হাত বাড়াবেন? লোকে আপনার ভালোবাসা দেখবে না। আহির সম্পদের লোভে আপনি আহির কাছে এসেছেন, এটাই দেখবে। কেউ জানে না আপনার হৃদয়ে কি আছে। সবাই দেখবে আহির আর আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স।”

পদ্ম কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“আমি আপনার সাথে আছি, আফিফ। আমি তো পারছি থাকতে। সারাজীবন পারবো। আমার কষ্ট হচ্ছে না। কারণ আমি শুধু ভালোবাসি না, আমি আপনার যোগ্যও। শুধু ভালোবাসলে হয় না, যোগ্যতাও লাগে। সালমা আন্টি কি তার মেয়ের হাত এমন এক পুরুষের হাতে দেবেন, যার আগে বিয়ে হয়েছে, যার কিচ্ছু নেই? যার নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা?”

আফিফের চোখ লাল হয়ে এলো। আহিকে পাওয়ার স্বপ্ন সে কখনোই দেখে নি। কিন্তু এভাবে আঙ্গুল দিয়ে তার অবস্থা দেখিয়ে দিয়ে, পদ্ম আফিফের অনুভূতিগুলোকেই মূল্যহীন করে দিয়েছে। আফিফ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আফিফের লাল হয়ে যাওয়া চোখ দু’টি রেনুর দৃষ্টির আড়াল হলো না। সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে পদ্মের বলা কথাগুলো। পদ্ম এভাবে কেন তার ভাইয়াকে আহির ব্যাপারে বললো? নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।

(***)

সন্ধ্যায় পদ্ম কয়েকটা খালি পৃষ্ঠা নিয়ে বসলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো আহিকে সব জানাবে, যেহেতু আফিফ সেটাই চায়। আর আহি জানলেও কোনো সমস্যা নেই। তার মনে হয় না সে আফিফকে এতো কিছু বলার পর আফিফ আর আহির দিকে আগানোর সাহস পাবে। আর আহিকেও সে এমনভাবে বলবে, যাতে আহি নিজেও আফিফের কাছে না আসে। পদ্ম কলম হাতে নিয়ে চিঠি লেখা শুরু করলো।

“তোর জীবনের অপ্রিয় মুহূর্তের সাক্ষী আমি। সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলতে পারবো না, তাই চিঠিতে লিখছি।”

ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। পদ্ম চিঠি লিখছে। চিঠিতে স্থান পাচ্ছে অতীতের সেই মুহূর্তগুলো।

“আহি, মনে আছে বিয়ের দিন তোকে কি বলেছিলাম? তোর এআরের সাথে আমার বরের বন্ধুত্ব করিয়ে দেবো। মিথ্যে বলেছিলাম আমি। তাদের বন্ধুত্ব তো সম্ভবই না। তারা তো একজনই ছিল। আর আমি সেটা অনেক আগেই জেনেছিলাম। সেদিন তোর হাত ধরে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম স্টেজে। খুব কষ্ট হচ্ছিলো তোর, তাই না? আমি ইচ্ছে করে তোকে কষ্ট দিতে চাই নি। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলো না। আমি আফিফকে ভালোবাসতাম। তাই আমি তোকে বোঝাতে চেয়েছি, উনি আমাকে কতোটা ভালোবাসেন। সেদিন ইচ্ছে করে আফিফের সামনে এআরের কথা উঠিয়েছি। উনাকে জানাতে চেয়েছি, মেয়েটা তুই। কেন জানিস? কারণ উনি জেনে যাওয়ার পর তোকে যেই অবহেলাটা ফেরত দিতো, সেই অবহেলা তোর জন্য খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। তোকে চিনতে না পেরে, তোর আসল পরিচয় না জেনে যদি তোর সাথে কথা বলতো, তোর মায়া আরো বাড়তো। এখন আফিফের অবহেলা দেখে তুই আর সাহস করেও আফিফের কাছে আসবি না। এজন্যই সেদিন এআরের কথা তুলেছিলাম। এরপর চার বছর পর হুট করে আবার চলে এলি আমাদের জীবনে। তোকে একটা কথা বলা হয় নি।”

পদ্ম এইটুকু লিখে কলম হাত থেকে রাখলো। রুমের দেয়ালে আফিফের আঁকা আহির ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেদিন লাগেজ থেকে বইটি বের করতেই আফিফ আমার হাত থেকে নিয়ে ফেলেছিলেন। আমিও আগ্রহ হীন স্ত্রীর মতো বইটি আবার লাগেজে তুলে রেখেছিলাম। আফিফ ভেবেছে, তার পদ্মফুল কতো ভালো। স্বামীর জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করে না। আমি তো সেই বইটি আগেই পড়ে ফেলেছিলাম। তাই সেদিন আর পড়ি নি।”

পদ্ম আবার কলম চালালো সাদা পৃষ্ঠায়। লিখলো তাজওয়ারের সাথে মিলে কীভাবে আফিফকে বাধ্য করেছে বিয়ে করার জন্য। রেনুর সাথে ঘটা সব ঘটনা লিখলো। কারণ রেনুই ছিল পদ্মের একমাত্র হাতিয়ার। রেনুকে নিয়াজীর সংসারে আটকে রেখে আফিফকে নিজের কাছে ধরে রাখতে চেয়েছিল সে।

“আহি, কক্সবাজারে যাওয়ার মুহূর্তগুলো মনে আছে? স্টেশনে এসে তোকে বলেছিলাম, উনার কক্সবাজার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমরা আগেও গিয়েছি ওখানে। আসলে আমি তোকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, আফিফ আমার যত্ন নেয়। আমাকে নিয়ে ঘুরতে যায়। কিন্তু সত্য তো এটাই আফিফের মনে তুই কোথাও না কোথাও তখনও বেঁচে ছিলি। তুই যখন বলেছিলি, শুধু আমাকে পাঠিয়ে দিলেই হতো, উনি কেন এসেছেন। খুব কষ্ট পেয়েছিলেন আফিফ। তবে আমার ভালোই লেগেছিল। কারণ আমি চাইতাম, তোর কথায় উনি কষ্ট পেয়ে আমার কাছে আসুক। আমার কাঁধে মাথা রাখুক। আফসোস করুক, কেন তোকে ভালোবেসেছিলো। সেদিন বাসে উঠার সময় শাড়ি সামলাতে না পেরে তুই পড়ে যাচ্ছিলি। উনি খুব যত্ন নিয়ে ধরেছিলো তোকে। আর তুই শুনিয়ে দিলি ইচ্ছে মতো। উনার কষ্টটা সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম, তাই তো বাসে এআরের ব্যাপারে কথা উঠিয়ে আফিফের সামনে তোকে অপমান করেছি, আর তোকে বুঝিয়ে দিয়েছি, আফিফ শুধু আমার। তুই আমাদের কক্সবাজার নিয়ে গিয়ে ভালোই করেছিস। আফিফ ওখান গিয়ে বুঝে গিয়েছেন, তোর জন্য রাদ আছে।
রাদের সাথে তোকে দেখে আফিফের দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। আর আফিফের সাথে আমাকে দেখে তোরও একই অনুভূত হচ্ছিল, আমি জানি। জানিস, আফিফ আমার যত্ন নেয় ঠিক। কিন্তু নিজ থেকে কখনো আমাকে কাছে টেনে নেয় নি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরে উনি আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে বোঝান নি, আমি তার প্রেয়সী। কিন্তু উনি কক্সবাজার যাওয়ার পর তোকে দেখানোর জন্য আমাকে স্পর্শ করেছিলেন, আমার যত্ন নিয়েছিলেন। আফিফকে আমি খুবই আনরোমান্টিক ভাবতাম। মূলত উনি আমাকে কাছে টেনে নেওয়াটাও দায়িত্বের মধ্যে রেখেছিলেন। মুখে তো বলেন, ভালোবাসি। তাহলে আমি কেন বুঝি নি সেই ভালোবাসা? এবার বলি কেন মনে হয় নি। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার গেইমসে উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একটা ছবি সম্পর্কে। ছবিটা তোর ছিল। উনি এক্সিভিশনে এঁকেছিল সেই ছবি। আমাদের বিয়ের পরও সেই ছবি উনি দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছেন। আবার কবিতাও লিখেছেন। তোর চিরকুটগুলোর উত্তর লিখেছিলেন, একটা ডায়েরীতে। সেই ডায়েরী বই আকারে বাঁধিয়েছেন। এতো কিছু কেন আহি? তোর জন্য। আমার জন্য একটা কবিতা লিখেন নি, কখনো আমার একটা ছবি আঁকেন নি। তাহলে তো আমি বুঝেই নিবো, আফিফ আমাকে ভালোবাসে নি। শেষ দিন তোকে বাসায় এনে আফিফের শার্ট দিয়েছিলাম পরার জন্য। আফিফ সেটা লুকিয়ে রেখেছে। ফেলে দেয় নি। দেখেছিস, এখনো কতো ভালোবাসে তোকে। কিন্তু সামনা-সামনি তোকে ঠিকই অপমান করেছে। আসলে উনি চেয়েছেন উনাকে ভুলে তুই রাদের সাথে ভালো থাক। আমিও তাই চেয়েছি। এখনো তাই চাচ্ছি। আহি, প্লিজ আসিস না আমার সংসারে। প্লিজ আহি। এই চিঠি উনার অনুরোধে আমি লিখেছি। উনি বলেছেন তোকে সত্যটা জানানো উচিত। তোর জানা উচিত আমি কতোটা স্বার্থপর। হ্যাঁ, আমি স্বার্থপর, আহি। কিন্তু আমি তো ভালোবাসি আফিফকে। আমি উনাকে ভালো রাখবো। আসিস না আর আমাদের সামনে। চলে যা। তুই আমাদের জীবনে এলে, আমার মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে হবে। তুই কি চাস, আবার কেউ তোর জন্য মারা যাক?”

পদ্ম চিঠিটা ভাঁজ করে একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। সেই প্যাকেটে আহির জন্য একটা ক্যালিগ্রাফি ছিল, আফিফের আঁকা। পদ্ম মনে মনে বলল,
“আমি তোকে ভালোবাসি, আহি। তাই তো তোকে জানিয়েছি, আফিফও তোকে ভালোবাসে। এখন এই সত্য নিয়ে তুই আরো ভালোভাবে বাঁচতে পারবি। তোর কষ্ট কম হবে।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৫০+৫১

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫০||

১০২।
ভোর পাঁচটা। দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। আশেপাশে নিরবতা ছেয়ে আছে। আর এসবের মধ্যে সোফায় স্থির হয়ে বসে আছেন রিজওয়ান কবির। তার মুখোমুখি বসে হাঁসফাঁস করছে লাবণি। তার বুক ধড়ফড় করছে। হাত কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। আহি লাবণির পাশে বসে চাপা স্বরে বলল,
“মাম্মা, কেনাকাটা কি শুরু করে দেবো? চারদিন পর মনে হয়, আপনার কুলখানিটা খেতে হবে।”

লাবণি রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। সে উঠে রিজওয়ান কবিরের পায়ের কাছে বসে বলল,
“তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না, রিজওয়ান?”

রিজওয়ান কবির তার হাত থেকে ক্যামেরাটি টেবিলের উপর রেখে বললেন,
“বিশ্বাস? তাজওয়ার আর তোমার নোংরামি দেখার পরও আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো? এতোটা অন্ধ ভেবেছো আমাকে?”

“আমি কিচ্ছু করি নি। সবটাই তোমার মেয়ের সাজানো নাটক।”

রিজওয়ান কবির উঠে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে মুনিয়া খালাকে ডাকলেন। মুনিয়া খালা দৌঁড়ে বসার ঘরে এলো। রিজওয়ান কবির তাকে বললেন,
“এই অসভ্য মহিলাকে এক্ষুণি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে বের করে দাও।”

লাবণি তা শুনে রিজওয়ান কবিরের হাত ধরতে যেতেই রিজওয়ান সশব্দে লাবণির গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আহি তা দেখে চোখ বন্ধ করলো। ঠিক এভাবেই এক সকালে, দেরীতে টেবিলে নাস্তা আসায় বাবা তার মায়ের গায়ে হাত তুলেছিল। খুব আত্মসম্মানী নারী সালমা ফাওজিয়া। মুনিয়া খালা আর চুনির সামনে চড় খাওয়াটা সহ্য করতে পারেন নি তিনি। তবুও আহির জন্য সংসারটা ছাড়তে পারছিলেন না। কিন্তু আজ তার উপর হওয়া অন্যায়ের শোধ তুলেছে এই একটা চড়ের গুঞ্জন।

লাবণি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিজওয়ান কবির বললেন,
“তোকে আমি তালাক দিলাম। তোকে আমি তালাক দিলাম। তোকে আমি তালাক দিলাম।”

লাবণি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহির ঠোঁটে বিজয়ের হাসি, আর চোখে অশ্রু টলমল করছে। যেই নারীর জন্য তার মায়ের সংসার ভেঙেছে, আজ সেই নারীর পরিণতি দেখার মতো সৌভাগ্য সৃষ্টিকর্তা আহিকে দিয়েছেন। তাই হয়তো সেদিন সে বেঁচে ফিরেছিল। এদিকে লাবণি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি কোথায় যাবো, রিজওয়ান?”

আহি বলল,
“কেন, তাজওয়ার খান তো আছেই। আপনি না হয় তার কাছেই ফিরে যান।”

আহি অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,
“ওপস, আমি তো ভুলেই গেছি। তাজওয়ার খান তো আপনাকে শুধু রক্ষিতা হিসেবেই রেখেছিল।”

“জাস্ট শাট আপ, আহি। সব তোমার জন্য হয়েছে। আমি তোমাকে ছাড়বো না।”

রিজওয়ান কবির লাবণির বাহু চেপে ধরে বললেন,
“কি করবে তুমি? তোমার কী ক্ষমতা আছে? আমার টাকায় তোমার যতো জোর ছিল। এখন সেসবও থাকবে না।”

লাবণি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি তোমার জন্য সব ছেড়ে এসেছি, রিজওয়ান। আর তুমিই আমাকে ছেড়ে দিচ্ছো?”

আহি বলল,
“বাবার জন্য আপনি কিছুই ছাড়েন নি৷ ছেড়েছেন নিজের স্বার্থের জন্য। নিজের উচ্চাকাঙ্খা পূরণের লোভ চেপে বসেছিল আপনার মাথায়। তাই তো দু’টো সুন্দর সংসার আপনি ভেঙে দিয়েছিলেন। আমার জীবনটাও শেষ করে দিতে যাচ্ছিলেন।”

(***)

লাবণিকে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিলেন রিজওয়ান কবির। গতকাল রাতে দেড়টায় কাপ্তাই থেকে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল আহি আর আফিফ। ভোর চারটা নাগাদ আফিফ আহিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। বাসায় পৌঁছে লাবণিকে দেখে গা জ্বলে উঠলো আহির। লাবণি রাতেই বাসায় ফিরে এসেছিলো। এদিকে আহি জোরে জোরে চেঁচিয়ে বাবাকে ডাকলো। আর রিজওয়ান কবির বেরিয়ে আসতেই সেই ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওটা বাবাকে দেখালো আহি। লাবণি ভাবতেই পারে নি আহি কিছু ভিডিও করে রাখবে। সে ভেবেছিল, আহি শুধু তাকে আর তাজওয়ারকে একসাথে দেখে ফেলেছিল, আর বাসায় এসেই এসব রিজওয়ান কবিরকে বলবে। এজন্যই বাসায় ফিরে রিজওয়ান কবিরের ব্রেইন ওয়াশের জন্য কি কি বলবে তা গুছিয়ে নিয়েছিল লাবণি। কিন্তু এখন তো সব উলটো হয়ে গেছে। আহি লাবণির ক্লান্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বাবাকে ফাঁসিয়ে আমার মায়ের সংসার ভেঙেছিলে। আমার বাবার মাথা খেয়েছো তুমি। কি ভেবেছিলে? কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে? বাবা জেনে গিয়েছিল তুমি কেমন মহিলা! তোমার এর আগের দুই প্রেমিকের সাথে করা লটরপটরগুলোর ছবি আরো আগেই বাবাকে দেখিয়েছিলাম। বাবা সব জানতো। আমি চেয়েছি, তোমার আর তাজওয়ারের প্রেমলীলাটাও বাবার সামনে নিয়ে আসি। এজন্য সময় চেয়েছিলাম তার কাছে। আর দেখো, সেই সুযোগটা নিয়ে একদম হাতেনাতে তোমাদের লীলা ফাঁস করে দিয়েছি। ভিডিওটা তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। তুমি আর তাজওয়ার খান বসে পপকর্ন খেতে খেতে দেখো। বাই।”

আহি কথাটি বলেই লাবণির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।

(***)

রিজওয়ান কবির চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলেন। মুনিয়া খালা আহিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“এহন এই ঘরে ফেরেশতারা আইবো। আমার মা’টাও থাকবো।”

আহি মুনিয়া খালার হাতে আলতো হাত রেখে বলল,
“খালা, আমি আর এখানে থাকবো না। আমি ছেড়ে দিচ্ছি এই বাসা। সকালে আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে আমি চলে যাবো।”

চুনি আহির কাছে এসে বলল,
“তুমি যাইয়ো না আফা। আমার এখানে ভালা লাগে না একা একা।”

আহি চুনির থুতনি ধরে বলল,
“চাঁদনি, আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি আছি। বেশিদূর কোথায়? এই শহরেই থাকবো। শুধু এই বাসাটা ছাড়ছি। তোর বিয়ে দেবো আমি। তোর স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব আমার। একটু সময় লাগবে শুধু।”

আহি সকালেই তার জিনিসপত্র নিয়ে মায়ের বাসায় চলে এলো। জিনিসপত্র ফ্ল্যাটে উঠিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে যাবে তখনই তাজওয়ারের কল এলো। আহি কল রিসিভ করতেই তাজওয়ার বলল,
“তোমার খুব সাহস বেড়ে গেছে দেখছি। তুমি এমনটা কেন করেছো? তুমি কি ভেবেছিলে, তোমার বাবা আমার ব্যাপারে জেনে গেলে আমাদের বিয়েটা হবে না? দেখো আহি, আমি কিন্তু তোমার বাবাকে ভয় পাই না। আর তোমাকে আমি যেকোন মূল্যে নিজের করেই ছাড়বো।”

আহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুমি আমার বাবাকে ভয় পাও না, আর আমি তোমাকে ভয় পাই না। তোমার যা ইচ্ছে করো। কিন্তু শুধু শুধু এমন মিথ্যে স্বপ্ন দেখো না। শোনো, তুমি আমাকে এই জন্মে তো আর পাচ্ছই না। আর পরের জন্মে তোমার ঠিকানা কোথায় হবে, সেটা তুমি নিজেও জানো না। দেখা যাবে, সেখানে তুমি নিজের পাপের ক্ষমা চাইতে চাইতেই আধমরা হয়ে গেছো।”

আহি এই বলে কলটা কেটে দিল। তাজওয়ার দাঁত কটমট করতে করতে এবার আফিফকে কল করলো। আফিফ তাজওয়ারের কল ধরলোই না। উলটো মেসেজ পাঠিয়ে বলল,
“আমি আর আপনার কোম্পানিতে কাজ করছি না। সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে কাজ ছাড়ছি, তাই আপনি আমার কাছ থেকে বিশাল অংকের টাকা পাবেন। আমি সেই টাকাটাও আপনাকে দিতে পারছি না। কিন্তু সেই টাকা না দেওয়ার জন্য আপনি আমার উপর কোনো মামলা করতে পারবেন না। যদি করেন তাহলে আপনার মানি লন্ডারিংয়ের সব তথ্য আমি ফাঁস করে দেবো। আশা করবো, আমার মত অসহায় মানুষের কাছ থেকে এত টাকা নিয়ে আপনার তেমন কোনো লাভ হবে না। আপনি এমনিতেই কোটিপতি। কিন্তু আপনার মানি লন্ডারিংয়ের সব তথ্য যদি আমি ফাঁস করে দেই, আপনাকে পথে বসাতে আমার বেশি সময় লাগবে না। আর পরিশেষে ধন্যবাদ, আমাকে আপনার এসিস্ট্যান্ট বানানোর জন্য।”

তাজওয়ার আফিফের মেসেজ থেকে তব্ধা খেয়ে গেলো। রাগে তার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেয়েছে। সে ফোনটা জোরে ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো তাজওয়ারের ফোনটি। সবকিছুই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হচ্ছে। এমনটা হতে দেওয়া যাবে না। আজ পর্যন্ত সে যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। ভবিষ্যতেও তাজওয়ার সেটাই চায়। সে যদি আহিকে না পায়, তাহলে আহির জীবনে দ্বিতীয় কোন পুরুষকে সে জীবিত রাখবে না। আর আফিফকেও তার অতীত মনে করিয়ে দিতে হবে।

১০৩।

এক সপ্তাহ কেটে গেলো। আফিফ খুব সূক্ষ্মভাবে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে জমিয়ে রাখা সব প্রমাণ সাজিয়েছে। আহি গেল সপ্তাহে তাজওয়ারের নামে হয়রানীর মামলা করে এসেছিল। সেই মামলা এখনো চলছে। এখন এই তথ্যগুলো দিলে, তাজওয়ার আরো কিছু মামলায় ফেঁসে যাবে। অন্যদিকে উজ্জ্বলও তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের ফাইলটি এখনো কোর্টে জমা দেয় নি। তাজওয়ারকে অন্য মামলায় ফাঁসানোর জন্য সাক্ষী খুঁজছে উজ্জ্বল। সাক্ষী পাওয়ার পর প্রমাণগুলো রাখবে। সাক্ষী ছাড়া প্রমাণ ভিত্তিহীন। সমস্যা ওই এক জায়গায়। তাজওয়ারকে সবাই এতো ভয় পায় যে কেউ সাক্ষী দিতেই আসে না। এদিকে আফিফ সব প্রমাণ তার ফাইলে ঢুকিয়ে আহিকে কল করে বলল,
“আহি, সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। আজ সবগুলো উজ্জ্বলকে দিয়ে দেবো।”

আহির সাথে তাজওয়ারের বিষয়ে আরো কিছু কথা বলে কল কেটে দিলো আফিফ। এরপর ফাইলটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো সে। আফিফ চলে যাওয়ার পর পদ্ম রুমে এলো। ড্রয়ার খুলে ফাইলটা বের করলো। এতক্ষণ সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আফিফ আহিকে যা যা বলেছে সব শুনছিলো।

পদ্ম ফাইলটা হাতে নিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“যদি তাজওয়ার ফেঁসে যায়, তাহলে আহি আর আফিফের জীবন থেকে সে সরে যাবে। আফিফ যেই ভয়ে আহিকে ছেড়ে এসেছিলেন, সেই কারণটা তাদের জীবন থেকে চলে গেলে, তারা তো আবার এক হতে চাইবে। এখন আফিফ জেনে গেছেন, আমি তাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছিলাম। উনি আমাকে এখন আর ভালোবাসেন না। আহি তো খুব সহজেই সেই জায়গাটা নিয়ে নেবে। যাকে পাওয়ার জন্য এতোকিছু করলাম, সেই মানুষটা যদি আমার হয়েও না হয়, তাহলে আমি তো হেরে যাবো। হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি তো ভালোবেসেছিলাম। আফিফ আমার ভালোবাসাটা দেখছে না কেন? থাক, না দেখুক। আমি বসে থাকবো না। রাদ আহিকে ভালোবাসে। আমি চাই, আহি রাদের সাথে ভালো থাকুক। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যদি তাজওয়ারকে না বাঁচাই, তাহলে আমি আফিফকে হারিয়ে ফেলবো। এখন তাজওয়ার খানই আমাকে সাহায্য করবে।”

পদ্ম ফোন বের করে তাজওয়ারকে কল করে আফিফের সংগ্রহ করা প্রমাণের ব্যাপারে সবটা জানালো। তাজওয়ার বলল,
“আমি তোমাকে ঠিকানা দিচ্ছি। তুমি প্রমাণগুলো নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো। তুমি তো জানো, আমার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। আমি বাসা থেকে বের হতে পারছি না। তাই তোমাকে আসতে বলছি।”

পদ্ম খুব সাহস নিয়ে ফাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার আগে আফিফা বেগম কয়েকবার ডাক দিয়েছিলেন পদ্মকে। পদ্ম শুনলো না। সে চলে গেলো দ্রুত পদে। আধাঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলো তাজওয়ারের ফ্ল্যাটে। পদ্ম বেল দিতেই দরজা খুলে দিলো একটা ছেলে। পদ্ম তার দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল,
“তাজওয়ার খান আছেন?”

তাজওয়ার ভেতর থেকে ডেকে বলল,
“পদ্ম, আসো ভেতরে।”

পদ্ম ভেতরে এসে বসলো। ফাইলটা তাজওয়ারের সামনে রেখে বলল,
“আফিফের কোনো ক্ষতি করবেন না। আহিরও কোনো ক্ষতি করবেন না। আমি আহির ভালো চাই। ও যার সাথেই ভালো থাকে, থাকুক। কিন্তু ও কখনো আফিফের সাথে ভালো থাকবে না।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“যার সাথে ভালো থাকে! আহি তো শুধু আমার সাথেই ভালো থাকবে। ইনফ্যাক্ট, আমিই আহির সাথে ভালো থাকবো।”

পদ্ম চুপ করে রইলো। তখনই দরজা খুলে দেওয়া ছেলেটি বসার ঘরে এসে বসলো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“হাই, আমি সজিব।”

পদ্ম মাথা নিচু করে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আচ্ছা, আমি এখন যাই।”

পদ্ম উঠে দাঁড়ালো। সে দরজার দিকে পা বাড়াতেই সজিব আর জিলান সোফায় আয়েশ করে বসে বলল,
“তাজ, মেয়েটা কে?”

তাজওয়ার ফাইলটি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলল,
“আফিফের বউ।”

সজিব বলল, “সেই তো!”

জিলান বলল, “রেখে দে না।”

তাজওয়ার ফাইল দেখা বন্ধ করে পদ্মের দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে বলল,
“সুযোগ যদি পায়ে হেঁটে আমার কাছে চলে আসে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কি বলিস?”

সজিব হেসে বলল, “হ্যাঁ, সেটাই তো।”

তাজওয়ার জিলানকে ইশারা করতেই সে পদ্মকে পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে গিয়ে ভালোভাবে দরজা বন্ধ করে দিলো। পদ্ম দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দরজা আটকে দিলেন যে!”

জিলান বিদঘুটে হাসি হেসে বলল,
“তোমাকে মিষ্টি না খাইয়ে যেতে দিচ্ছি না।”

পদ্ম কয়েক পা পিছিয়ে তাজওয়ারের কাছে গিয়ে বলল,
“আমাকে দরজাটা খুলে দিন।”

তাজওয়ার হেসে বলল,
“নো। আজ রাতটা না হয় এখানেই থাকো৷ কাল যেও। আই প্রমিজ, তোমার আফিফ কখনোই আমার আহির হবে না। আমি হতে দেবোও না।”

পদ্ম ভীত চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি।”

“আমার কাছে?”

তাজওয়ার অট্টহাসি হেসে বলল,
“আমার নিজেরই তো সাহায্যের প্রয়োজন। তোমার সাহায্য। আহি তো আমার কাছে আসছে না। আর তাই আমার অন্যদিকে চোখ পড়ছে। তুমি এই মুহূর্তে আমাকে শান্ত করতে পারবে।”

তাজওয়ার পদ্মের কোমড় ধরে তার কাছে আসার চেষ্টা করতেই পদ্ম তাকে ধাক্কা দিয়ে অন্য রুমের দিকে দৌঁড়ে গেলো। কিন্তু পারলো না। জিলান পদ্মের উড়না টেনে ধরে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। সজিব আর তাজওয়ার তাকে টেনে নিয়ে গেলো পাশের রুমে। এরপর তিন বন্ধু ভেতরে ঢুকেই ধড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। আর এরপর পদ্মের ক্রন্দন বেঁধে গেলো চার দেয়ালের ফাঁকে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫১ (১ম ভাগ)||

১০৪।
বাসায় ফিরে পদ্মকে আশেপাশে কোথাও না দেখে রান্নাঘরে গেলো আফিফ। আফিফকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখেই আফিফা বেগম বললেন,
“তোর বউ আজকাল বড্ড বেড়ে গেছে দেখছি। আমার অনুমতি না নিয়ে সে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কোথায় গেছে?”

“তুই জানিস না? তার মানে তোকেও বলে যায় নি? মেয়েটার মতিগতি ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। শোন, তুই ওকে নিয়ে এতো মাথা ঘামাস না তো!”

আফিফা বেগম এবার ছেলের কাছে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“একটা মেয়ে দেখেছি আমি। বেশ পছন্দ হয়েছে আমার।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মা, প্লিজ। আমি তোমাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আমি আরেকটা বিয়ে করতে পারবো না।”

“তোর কি বাবা হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই?”

“বাবা হওয়ার জন্য আমাকে আরেকটা বিয়ে কর‍তে হবে?”

“পদ্ম কি তোকে সন্তান দিতে পেরেছে?”

“না পারুক। ও আমার স্ত্রী। আমার দায়িত্ব। যদি আমার কোনো অপারগতা থাকতো পদ্ম কখনোই আমাকে ছেড়ে যেতো না। আমিও আমার দায়িত্ব ফেলে দিতে পারবো না।”

“কে বলেছে পদ্মকে ছেড়ে দিতে? দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে হয় না।”

“মা, আমার সমান অধিকার দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। তাই আমি পদ্মের বর্তমানে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবো না।”

আফিফ কথাটি বলেই নিজের ঘরে চলে এলো। আজ সন্ধ্যায় উজ্জ্বলকে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে বাকী প্রমাণগুলো দিতে হবে। এজন্যই সে বাসায় এসেছে সেই ফাইলটি নিতে, যেটিতে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ আছে। কিন্তু বাসায় এসে পদ্মকে না দেখে বেশ অবাক হলো আফিফ। পদ্ম সম্পর্কে সব সত্য জেনে যাওয়ার পর থেকেই আফিফ পদ্মের কাছ থেকে দূরত্ব রাখছে। কিন্তু পাঁচ বছরের এই সংসারটা মিথ্যে দিয়ে শুরু হলেও একটা দায়িত্ববোধ আর মায়া তো সৃষ্টি হয়েছেই। আফিফ যেই ড্রয়ারে ফাইলটি রেখেছিল, সেটা খুলতে খুলতেই পদ্মের নম্বরে ডায়াল করলো। পদ্মের ফোনে রিং হচ্ছে। কিন্তু আফিফের মনোযোগ আঁটকে গেলো শূন্য ড্রয়ারে। আফিফ ব্যস্ত হয়ে ড্রয়ার ঘেঁটে দেখলো কোথাও সেই ফাইলটি নেই। বেশ অবাক হলো সে। আজ সকালেই ফাইলটি সে ড্রয়ারে রেখে বাসা থেকে বের হয়েছিল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে কি ফাইলটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সম্ভব? আফিফ তার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো পদ্ম কল ধরে নি। রিং হয়ে কেটে গেছে। আফিফ আবার কল করলো পদ্মের নম্বরে। এবার সাথে সাথেই কলটা রিসিভ হলো। আফিফ কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে পদ্মের চাপা আর্তনাদ ভেসে এলো। পদ্ম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমাকে বাঁচান, আফিফ। আমি মরে যাবো।”

আফিফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে? কোথায় তুমি!”

পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার সব শেষ হয়ে গেছে। তাজ….”

কথাটা শেষ করার আগেই পদ্ম চেঁচিয়ে উঠলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো পুরুষের কন্ঠ স্বর। আফিফ কন্ঠ শুনেই চিনে ফেলেছে ওপাশের কণ্ঠটি কার। আফিফ চেঁচিয়ে বলল,
“সজিব ওখানে কি করছে পদ্ম? কোথায় তুমি? হ্যালো। হ্যালো।”

আফিফ এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। দৌঁড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আফিফা বেগম ছেলেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। কি যে হচ্ছে তার ঘরে, কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।

(***)

আহি ছাদে দাঁড়িয়ে হালকা হাওয়ায় দোলায়মান ডায়ান্থাস ফুলগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। তখনই তার পাশে দু’কাপ চা নিয়ে এসে দাঁড়ালো রাদ। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি ফেরত দিলো। রাদ চায়ের কাপ দু’টি ছাদের কার্নিশে রেখে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু বলবি?”

রাদ আহির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার উড়ন্ত চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“আমাকে আর তুই করে ডাকিস না। আমি এখন এই ইনফরমাল সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।”

আহির গলা কাঁপছে। মায়ের কথা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

“অন্তত একা থাকো, তবুও এমন কাউকে তোমার জীবনে রেখো না, যাকে ভালোবাসো না।”

আহি রাদের দিকে তাকালো। এতো ভালোবাসে কেন ছেলেটা তাকে? এই ভালোবাসা উপেক্ষা করলে তো পাপ হবে তার। সৃষ্টিকর্তা কেন যে তাকে মন ভাঙার ক্ষমতা দেয় নি!
রাদ আহির আরেকটু কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। আহি কিছুটা দূরে সরে যেতেই রাদ আহির হাতটা ধরে তাকে আটকালো। আহি বলল,
“রাদ, আমি তোকে…”

রাদ আহির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল,
“আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস না। কিন্তু আমি তো বাসি। আমাকে একটু ভালোবাসতে দে। আই প্রমিজ, তুই একদিন আমার প্রেমে পড়বি।”

আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। গলায় কথা আটকে গেছে তার। এদিকে রাদ আহির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। রাদের নিঃশ্বাসের ধাক্কা আহির বুক কাঁপিয়ে দিয়েছে। না, এমন অন্যায় সে করতে পারে না। যেখানে তার মন-মস্তিষ্ক সাড়া দিচ্ছে না, সেখানে সে কীভাবে নিজেকে ঠেলে দিবে? হোক কষ্ট, কিন্তু সারাজীবনের অপরাধবোধ নিয়ে সে বেঁচে থাকতে পারবে না। আহি রাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোকে ভালোবাসি। কিন্তু বন্ধুর মতো। এমন না যে আমি অন্য একজনকে ভালোবাসতাম দেখে তোকে ভালোবাসতে পারছি না। যাকে ভালোবাসতাম, তাকে পাওয়ার কোনো আশা নেই আমার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি একটু নিজেকে ভালোবাসতে চাই। তুই তো আমাকে গত কয়েক বছর ধরে দেখেছিস। আমার উন্মাদনা দেখেছিস। আমার এক তরফা পাগলামো দেখেছিস। বল না রাদ, তোর কি মনে হয় নি, আফিফকে ভালোবাসতে বাসতে আমি নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গেছি?”

রাদ চুপ করে রইলো। আহি রাদের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো আর বলল,
“আমার তোকে বিয়ে কর‍তে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এখন আমি বিয়ে করবো না। আমি কিছু বছর নিজেকে দিতে চাই। একান্ত নিজেকে। এরপর না হয় ভেবে দেখবো।”

“যদি তখন আমি না থাকি?”

আহি রাদের কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“তুই যদি মুভ অন করিস, আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“আমি বেঁচে থাকতে এই মনে তোর জায়গা কাউকে দিতে পারবো না।”

আহি রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ বলল,
“আমি যদি না থাকি! যদি ততোদিন না বাঁচি?”

“কি বাজে কথা বলছিস? আমার লাইফ-লাইন তুই। প্রেমিক পুরুষকে ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি গভীর আর শক্ত একটা মনের মতো বন্ধুকে ভালোবাসা। তুই জানিস, তুই আমার মেডিসিন। আমার জীবনে যদি তুই আরো আগে আসতি, আমি নিজেকে এতোটা নিঃস্ব ভাবতাম না। তোর মতো প্রেমিক পুরুষ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমার তোর মতো চমৎকার একজন পুরুষের প্রেমিকা হওয়ার জন্য নিজেকে চমৎকার ভাবে সাজাতে হবে। সময় দিস কিন্তু।”

(***)

আহি চায়ের কাপে চুমুক দিতে না দিতেই ফোনে টুংটাং মেসেজ আসতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ারের একাউন্ট থেকে কিছু ছবি আর ভিডিও এসেছে। আহি চায়ের কাপ নামিয়ে স্ক্রিন অন করতেই ভিডিওটা চালু করলো। রাদ পাশেই দাঁড়ানো। ভিডিওতে চলমান শব্দ কানে আসতেই রাদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহির যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। তার মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। রাদ আহির কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিন বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“মেয়েটা কি পদ্ম?”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় কর‍তে লাগলো। রাদ আহির হাত ধরলো। আহির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল,
“আমি একটা জলজ্যান্ত অভিশাপ, রাদ। আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাজওয়ার পদ্মের এতো বড় ক্ষতি করেছে! আমার খুব অস্থির লাগছে, রাদ। তাজওয়ার ফার্সার সাথে যা করেছে, ঠিক একই কাজ যদি পদ্মের সাথে করে? আমার ওকে থামাতে হবে। ওরা আমার সব প্রিয় মানুষগুলোকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছে। আমার মানুষগুলো সব আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে শুধু ওই তাজওয়ার খানের জন্য। আই উইল কিল হিম।”

আহি ফোন হাতে নিয়ে ছাদ থেকে নামতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে যেতে নিবেই তখন রাদ পেছন থেকে আহিকে ধরে ফেললো আর বলল,
“আহি, শান্ত হো।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আর বলল,
“আমি এই মুখ নিয়ে পদ্মের সামনে কীভাবে দাঁড়াবো? আমি ওর অপরাধী।”

আহি এলোমেলো ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠে বসলো। রাদও আহির পাশে বসেছে। ড্রাইভারকে তাজওয়ারের ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিতেই তারা সেদিকে রওনা হলো। এদিকে আফিফ অস্থির হয়ে আছে। সে তাজওয়ারকে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে, কিন্তু তাজওয়ার কল ধরছে না। সে সোফায় পা তুলে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলতে লাগল,
“এক দেশে ছিল এক বাঘ। তার ছিল এক বাঘিনী। বাঘিনী পড়েছে এক শেয়ালের প্রেমে। আর শেয়ালের বউ গাভী ফন্দি করতে এসেছে বাঘের গর্তে। বাঘ ছিল বেশ ক্ষুধার্ত। সে গাভীকে খেয়ে ফেললো। তাই বউকে বাঁচাতে শেয়াল আসছে ছুটে। বাঘিনীও শশব্যস্ত। বাঘের গর্তে শীঘ্রই পড়বে শেয়াল-বাঘিনীর পা। বাহ, চমৎকার এক মিলনায়তন হবে বাঘের বাড়িতে। গাভীর চামড়া গুলো মাটিতে খসে পড়েছে। রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। এবার শেয়ালের সেই শুকনো মুখটা দেখবে বাঘ। আর বাঘিনী আমার ফিরে আসবে বিড়ালের বেশে৷”

সজিব হেসে বলল,
“আহিকে হাতে আনার এতো চমৎকার প্ল্যান!”

“এবার কাজি এনে বিয়ে পড়ানোর পরই ভিডিও ডিলিট করবো। একবার আহি আমার হোক, তারপর আমি আহিকে বুঝিয়ে দেবো, আমার সাথে বেইমানি করার শাস্তি কি!”

(***)

আহি আর রাদ তাজওয়ারের ফ্ল্যাট বাড়ির কাছে আসতেই দেখলো, আফিফ পুলিশ নিয়ে সেখানেই এসেছে। আফিফকে দেখে থমকে গেলো আহি। আফিফ আহির কাছে দৌঁড়ে এসে বলল,
“তাজওয়ার পদ্মকে এখানে নিয়ে এসেছো। ওর ফোনের লোকেশন এখানে দেখাচ্ছে। আমি পদ্মকে ফোন করেছিলাম। ওর কন্ঠ শুনে মনে হয়েছে, ও বিপদে আছে। আমি তাজওয়ার খানকে মেরে ফেলবো, যদি ও পদ্মের গায়ে হাতও লাগায়।”

আহি নির্বাক তাকিয়ে আছে আফিফের দিকে। পুলিশ কন্সটেবল বাড়িতে ঢুকলো। আফিফও তাদের পিছু পিছু গেলো। আহি আর পা বাড়াতে পারছে না। রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“তুই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ওই তাজওয়ার জানোয়ারটাকে জিতিয়ে দিবি? এবার কিছু একটা করতেই হবে।”

আহির শুকনো মুখটা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে তাজওয়ারের ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়ালো আহি।

(***)

ফ্ল্যাটের দরজায় বার-বার ধাক্কা দিচ্ছে পুলিশের লোকেরা। তাজওয়ার পীপহোল দিয়ে তাদের দেখে নিলো। সজিব আর জিলান ভীত কন্ঠে বললো,
“আমরা তো শেষ।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“রিল্যাক্স গাইস, এই সামান্য কন্সটেবল আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। এরা বেশি হলে আমাকে থানায় নিয়ে যেতে পারবে। আর ভেতরে ঢোকানোর আগেই আমি মুক্ত। আর আমি মুক্ত হলেই তোরাও মুক্ত। এসব বস্তিবাসীদের মামলায় রাজার সিংহাসন কাঁপে না।”

তাজওয়ার দরজা খুলে দিতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ তাজওয়ারের নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে বলল,
“পদ্মকে এখানে কেন এনেছিস?”

পুলিশের এক কন্সটেবল আফিফ আর তাজওয়ারের হাতাহাতি থামিয়ে দিতেই আহি আর রাদ উপরে উঠে এলো। তাজওয়ার আহিকে দেখে বলল,
“মাই সুইটহার্ট, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম।”

আহি তাজওয়ারের কথায় পাত্তা না দিয়ে দৌঁড়ে ভেতরের রুমে চলে গেলো। আফিফও আহির পিছু পিছু ভেতরে গেলো। শুধু রাদ সেখানে দাঁড়িয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাজওয়ারের দিকে।

১০৫।

আহি আর আফিফ একসাথেই সেই বন্ধ দরজা খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো মেঝেতে বিবস্ত্র পড়ে আছে পদ্ম। আফিফের পৃথিবীটা যেন সেখানেই থমকে গেলো। সামনে এগুনোর সাহস হলো না তার। সে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মেঝেতেই বসে পড়লো। আহি ছুটে গেলো পদ্মের কাছে। গায়ের উড়না খুলে পদ্মকে পেঁচিয়ে নিলো। উড়নাটা পদ্মের ত্যক্ত শরীরটা ঢাকতে ব্যর্থ হলো। আহি পাশের বেডশিটটা টেনে নিয়ে পদ্মের গায়ে জড়িয়ে দিলো। পদ্ম কারো স্পর্শ পেয়ে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকালো। আহির মুখখানা দেখে বুকের ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো পদ্মের। আহি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। দৃঢ় স্বরে বলল,
“আল্লাহর কসম, ওই শয়তানকে আমি খুন করে ফেলবো।”

পদ্মের দৃষ্টি আটকালো আফিফের শুকনো মুখের দিকে। মানুষটা নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পদ্মের কষ্ট হলো খুব। এদের ঠকানোর শাস্তি পেয়েছে সে। কান্না করার অধিকার নেই তার। এটা মেনে নিতে বাধ্য পদ্ম। আহি পদ্মকে ছেড়ে তার দুই গালে হাত রেখে বলল,
“তুই আমার স্ট্রং গার্ল। মনকে শক্ত কর। আমরা সবাই তোর পাশে আছি। আফিফও আছে।”

আহি পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফকে দেখে বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো তার৷ পদ্মকে শক্ত করে ধরে রাখলো সে। মেয়েটা যদি ভুল কিছু করে ফেলে?

প্রায় মিনিট খানিক পর রুমের দরজায় খট করে শব্দ হলো। পদ্ম আহিকে শক্ত করে চেপে ধরলো। আফিফ উঠে দরজা খুলতেই একজন কন্সটেবল রুমে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। আফিফ বলল,
“একজন মহিলা কন্সটেবল লাগবে এখানে।”

পুরুষ কন্সটেবলটি ফোন করে একজন মহিলা কন্সটেবলকে তাজওয়ারের বাড়ির ঠিকানা দিলো। সে না আসা অব্ধি পদ্ম ভেতরেই থাকবে। এদিকে আফিফ রুম থেকে বের হয়েই তাজওয়ারকে জোরে একটা লাথি দিলো। পুলিশ কন্সটেবলের লোকগুলো আফিফকে ধরে বলল,
“এই কাজ তো আপনার না।”

রাদ আফিফকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল,
“আফিফ, প্লিজ শান্ত হও। ঠান্ডা মাথায় এই জানোয়ারটাকে শাস্তি দিতে হবে। তুমি দেখো ওর মুখের দিকে। বিন্দুমাত্র ভয় নেই। কারণ ওর কাছে পাওয়ার আছে। ও জানে ও বেরিয়ে আসবে।”

আফিফ শক্ত মুখে বলল,
“ও যদি বের হয়, আমি ওকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলবো।”

প্রায় ঘন্টাখানেক পর পুলিশ তাজওয়ার, জিলান আর সজিবকে থানায় নিয়ে গেলো। মহিলা কন্সটেবলটি পদ্মকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। পদ্ম থম মেরে বসে আছে। সে উত্তর দিতে পারছে না। আফিফ বসার ঘরে পায়চারি করছে। হঠাৎ তার চোখ আটকালো মেঝেতে পড়ে থাকা আধপোড়া একটি কাগজের দিকে। আফিফ মেঝে থেকে কাগজটি তুলতে গিয়ে দেখলো এটা তাজওয়ারের বিরুদ্ধে সংগ্রহ করা প্রমাণগুলোর একটি পৃষ্ঠা। আফিফ পাশেই ডাস্টবিন দেখতে পেলো। সেদিকে গিয়ে দেখলো আশেপাশে ছাই। ভেতরে পুড়ে যাওয়া সেই ফাইলটি। আফিফ কাগজটি হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করলো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। তখনই মহিলা কন্সটেবলটি বেরিয়ে এসে আফিফকে বলল,
“আপনার ওয়াইফ কিছুই বলছে না। উনি এখানে কীভাবে এলেন জিজ্ঞেস করেছি, সেটাও বলছে না। আমাদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে হবে। বাড়ির গেটে, সিঁড়িতে, লিফটে সবখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো। আমার মনে হয়, আপনার স্ত্রী এখনে শকে আছে।”

আফিফ মিনমিনিয়ে বলল,
“আর এই শক থেকে পদ্ম জীবনেও বেরুতে পারবে না।”

(***)

পদ্মকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে আহি। আফিফা বেগম এসব জানলে আরো ঝামেলা বাড়বে, তাই পদ্মকে ওখানে যেতে দেয় নি সে। পদ্মকে একটা রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আহি তার পাশে বসে বলল,
“কিচ্ছুই হয় নি তোর। তুই রেস্ট নে। দেখবি, একটু ঘুমালে ভালো লাগবে।”

পদ্ম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আফিফ রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই আহি উঠে বেরিয়ে গেলো। আফিফ দরজাটা আটকে দিয়ে পদ্মের পায়ের কাছে মেঝেতে বসলো। পদ্ম আফিফের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আফিফ হতাশ কণ্ঠে বলল,
“একটু আগেও মনে হচ্ছিল, তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য হয়তো আমিই দায়ী। কিন্তু এখন কি মনে হচ্ছে জানো? তুমি স্বেচ্ছায় নিজেকে ধ্বংস করতে তাজওয়ারের বাড়িতে গিয়েছিলে।”

পদ্ম আফিফের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে নিলো। আফিফের গলা কাঁপছে। চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে। সে পদ্মের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“অতীত সবার থাকে। আমারও ছিল। তুমি আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছো, মানলাম। একদিন হয়তো সব ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু এতো বড় প্রতারণা! এটা তো আগের চেয়েও বেশি সাংঘাতিক। পাগল না-কি তুমি, পদ্ম? কাকে বিশ্বাস করেছো? তোমার ছোটবেলার বান্ধবীকে তুমি বিশ্বাস করতে পারলে না? তোমার কি মনে হয় মেয়েটা তোমার সংসার ভাঙবে? আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না? যার সাথে পাঁচ বছর সংসার করেছো, সেই মানুষটাকে বিশ্বাস করতে পারলে না? কাকে বিশ্বাস করতে গেলে? ওই তাজওয়ার খানকে? কতো মানুষের প্রাক্তন থাকে! আহির সাথে তো আমার কোনো প্রেমের সম্পর্কই ছিল না। শুধু একটা অনুভূতি ছিল, যেটা তুমি আর তাজওয়ার খান মিলে শেষ করে দিয়েছো। আমি তো তোমার সাথে সুখী হতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলে, পদ্ম?”

পদ্ম বিছানা ছেড়ে উঠে আফিফের সামনে এসে মেঝেতে বসে বলল,
“শাস্তি হয়ে গেছে আমার। আমাকে তালাক দিয়ে দিন। আমি চলে যাই আপনার জীবন থেকে। এক কাজ করুন, আমাকে বিষ এনে দিন। আমি খেয়ে মরে যাই। আপনাকে ভালোবাসার শাস্তি পেয়েছি আমি। আপনাকে বেঁধে রাখার শাস্তি পেয়েছি আমি। আহি যেমন আপনার ভালোবাসায় ছাই হয়ে গেছে, আমিও হয়ে গেছি। আমার পুরো শরীর থেকে এখন পোড়া গন্ধ বেরুবে। আহির মতো টাকা নেই আমার। বাবার গাড়ি-বাড়ি নেই। আপনি ছেড়ে দিলে আমার ঠিকানা হবে রাস্তায়।”

আফিফের দমবন্ধ হয়ে এলো। সে পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে ছাড়বো না, পদ্ম। তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকতা করবো না আমি।”

(***)

তাজওয়ার নিজেকে এক ঘন্টার মধ্যে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার প্রমাণ করে দিলো সে কতো ক্ষমতাবান পুরুষ। আহি ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তাজওয়ার ছাড়া পেয়েই আহিকে মেসেজ লিখেছে,
“কবুল বলবে, না-কি ভিডিও ভাইরাল করবো? এখন তো শুধু গুটি কয়েক মানুষ জানে। তখন পুরো পৃথিবী জানবে। আমার কাছে চ্যানেল আছে কিন্তু। লাইভ টেলিকাস্ট করতেও সমস্যা হবে না।”

আহি আফিফকে মেসেজটা পাঠালো। আফিফ সাথে সাথেই আহিকে কল করে বলল,
“এই দেশে ওর শাস্তি হবে না। ওকে মেরে…”

আহি আফিফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার মাথায় এমন একটা বুদ্ধি এসেছে, যেটা তাজওয়ারকে ফাঁসাবেও, আর তার পাওয়ারটাও আর কাজ দেবে না।”

“কি বুদ্ধি?”

“দেখা করো। উজ্জ্বলও আসবেন। সেখানেই বলি।”

পরদিন আফিফ, উজ্জ্বল আর আহি একসাথে বসলো। আহি তার বুদ্ধিটা আফিফ আর উজ্জ্বলকে শোনালো। আফিফ বলল,
“তুমি এতো বড় রিস্ক নিবে?”

“নিতে হবে। আমি চাই না পদ্মের ব্যাপারে কেউ জানুক। তাই আমি এই কাজটা করবোই।”

আফিফ আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে এই কাজ করতে দেবো না। তুমি জানো, এটা কতো বড় ডিসিশান? তোমার ভবিষ্যৎ থেমে যাবে।”

“কিছুই হবে না আমার। আমার ভবিষ্যৎ থেমে গেছে অনেক আগেই। এখন আমি আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। যা হওয়ার আজ হবে। আমার জীবনে আগামীকালের কোনো অস্তিত্বই নেই। আর আমি যা করছি পদ্মের জন্য না। আমার নিজের জন্য। তাজওয়ারের ফাঁদে ফেঁসে যাওয়া প্রতিটা মেয়ের জন্য। ভবিষ্যতে ওর হাত থেকে আরো অনেক মেয়েকে বাঁচানোর জন্য।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫১ (২য় ভাগ)||

১০৬।
উজ্জ্বল চলে যেতেই আহি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আফিফ তার পথ আটকে ধরে বলল,
“তুমি কি বুঝতে পারছো, তুমি কি কর‍তে যাচ্ছো?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি বুঝেশুনেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“আমি পারবো না তোমাকে এই কাজে সাহায্য করতে।”

আহি সেকেন্ড খানিক আফিফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“ঠিক আছে। তোমাকে যেতে হবে না। উজ্জ্বল আমাকে সাহায্য করবেন।”

আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“মানে! তুমি না করলে উজ্জ্বল করবেন।”

আফিফ ধমকের সুরে বলল, “আহি!”

আফিফ কপালে কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি বলল,
“তুমি কেন আমাকে বাঁধা দিচ্ছো? আমার জন্য তোমার এতো চিন্তা কেন? আমাদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? তুমি তো পদ্মের হাসবেন্ড। তোমার উচিত তোমার বউকে নিয়ে মাথা ঘামানো।”

আফিফ আর আহি এক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ চোখ সরিয়ে নিতেই আহি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। চোখ ছলছল করছে আহির। রাগও হচ্ছে বেশ। সাহায্য তো করবে না, আবার ধমকাচ্ছেও? আহি আফিফকে পাশ কেটে চলে যেতে নিবে তখনই আফিফ বলল,
“দাঁড়াও, আহি।”

আহি বলল, “যা বলার বলে ফেলো।”

“উজ্জ্বলকে কিছু বলো না। আমি থাকবো তোমার সাথে। কাজটা আমিই করবো।”

আহি আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে যাবে, কখনোই ভাবি নি। কোথাও একটু শান্তি পাচ্ছি না।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যেখানে আমি আছি সেখানে শান্তি নেই। চিন্তা করো না, খুব শীঘ্রই তোমাদের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাবো।”

কথাটি বলেই আহি চলে গেলো। আর আফিফ এখনো সেই জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আহির কথাটা তার মনে ভীষণভাবে আঘাত করেছে। সে শূন্য দৃষ্টিতে আহিকে রেস্টুরেন্টের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখছে। ভাগ্য এতোটা নির্মম বিচার কি করে করলো তার সাথে? এভাবে কি আক্ষেপে সারা জীবন কাটানো সম্ভব? এখনি দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বাকী জীবন কীভাবে কাটাবে?

পুরুষ মানুষের কোনো দমবন্ধ করা অনুভূতি থাকতে পারে না। অনুভূতি লুকিয়ে রাখা তাদের বৈশিষ্ট্য। আর আফিফ তো অনেক বছর আগেই অনুভূতি লুকোনো শিখে ফেলেছে।

(***)

বাসায় এসেই তাজওয়ারকে কল করলো আহি। তাজওয়ার ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল। আহির নম্বরটি দেখে তড়িঘড়ি করে কলটা রিসিভ করে বলল,
“মাই ডিয়ার সুইটহার্ট, আমি তোমার কলের অপেক্ষায় ছিলাম।”

আহি গম্ভীরমুখে বলল,
“তুমি পদ্মের ভিডিওগুলো ডিলিট করে দাও।”

তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“এটা কোনো কথা হলো? আমি তোমার সামনে একটা শর্ত রেখেছি। ভুলে গেছো?”

“হ্যাঁ, মনে আছে। আর আমি রাজি আছি। আমি তোমাকে বিয়ে করবো।”

তাজওয়ার নড়েচড়ে বসলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে বিয়ে করবে, আহি?”

“হ্যাঁ, করবো। কিন্তু আমার ভালোবাসা তুমি কখনো পাবে না।”

তাজওয়ার হেসে বলল,
“তোমার ভালোবাসা পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। আমি তো তোমাকে চাই, আহি। ভীষণভাবে চাই।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বিয়েটা গোপনে হলে ভালো হবে। আমি মাকে এই ব্যাপারে কিছু জানালে, মা অনুমতি দেবে না। আর বাবা তো তোমাকে সহ্যই করতে পারে না।”

“আচ্ছা, সমস্যা নেই। তুমি চিন্তা করো না। আমি কাউকে জানাচ্ছি না। একবার বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর না হয় ধীরেসুস্থে সবাইকে জানাবো।”

আহি কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি যা করেছো, এরপর তোমার বাংলোতে যাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তুমি আমার ফ্ল্যাটে এসে সব ব্যবস্থা করো। আর তোমার সো কল্ড বন্ধুদের নিয়ে আসবে না, প্লিজ।”

“সাক্ষী তো লাগবে, তাই না?”

“তুমি অন্য কাউকে জোগাড় করো। তোমার বন্ধুদের মুখও দেখতে চাই না আমি।”

আহি এই বলে কল কেটে দিলো। এরপর ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“তাজওয়ার কি বিশ্বাস করতে পেরেছে, আমি ওকে বিয়ে করবো?”

(***)

পদ্ম সামনের বারান্দায় বসে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেদিনের মুহূর্তটি, যেদিন খানস গ্রুপে চাকরি পাওয়ার পর আফিফ তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল। সেদিন আহিও সেই রেস্টুরেন্টে সালমা ফাওজিয়ার সাথে গিয়েছিলো। পদ্ম সেদিন আহিকে দেখেই বেশ অবাক হয়েছিলো। আফিফ বিয়ের পর পদ্মকে নিয়ে খুব একটা ঘুর‍তে বের হতো না। পদ্ম অভিমানী মুখে বসে থাকলে, আফিফ তাকে নিয়ে বের হতে বাধ্য হতো। সেদিনও পদ্ম অভিমান করে ছিল, তাই আফিফ তাকে নিয়ে বের হয়েছিল। একান্ত সময় কাটানোর ইচ্ছে ছিল তার আফিফের সাথে। বাসায় আফিফা বেগমের জন্য আফিফের পাশে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আর এমনও তো নয় যে চার বছরের সংসারে আফিফ তাকে সময় দেয় নি। এটা শুধু দায়িত্বের জন্য কাছে আসা। সেই কাছে আসায় পদ্ম কখনোই ভালোবাসা খুঁজে পায় নি। পদ্মের এজন্যই আহির প্রতি নিরব ক্ষোভ ছিল। মুখে ভালোবাসি বললেও, সে কখনোই চায় নি আহি দেশে ফিরে আসুক। সংসারের অজুহাতে পুষ্প, লিনাশার সাথেও যোগাযোগ রাখে নি সে৷ শুধু আফিফকে হারানোর ভয়টাই ছিল তার মনে। অন্যদিকে তাজওয়ার আহি কি করে, কোথায় যায়, এসব খবরাখবর রাখার জন্য লোক নিয়োগ করেছিলো। তারাই আফিফ আর আহির একই সাথে মাস্টার্স করার খবরটা তাজওয়ারকে অনেক আগেই দিয়েছিল। আর তাজওয়ার এজন্যই আফিফকে তার কোম্পানিতে কাজ দিয়েছিল, যাতে কাজের চাপে আফিফ ক্লাসে যেতে না পারে। আর পদ্ম ছিল আহির জীবনের নীরব ঘাতক। সে আহিকে বার-বার আফিফের সামনেই এআরের কথা মনে করিয়ে দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল,
“যাকে তুই ভালোবেসেছিস, সে আমার স্বামী। আমার সংসার। যেখানে তোর ভালোবাসা ভিত্তিহীন।”

পদ্ম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি, সেদিন রেস্টুরেন্টে তোর সাথে দেখা হওয়ার পর আমি ইচ্ছেকৃত ভাবেই তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই এআরের সাথে এসেছিস না-কি? আমি তো জানি এআর, আর আফিফ এক। আমি তোকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, তুই কতোটা একা। বোঝাতে চেয়েছি, তোর এআর আমার ভালোলাগার কতোটা গুরুত্ব দেয়। আমি তোকে কষ্ট দিয়েছি অনেক। তুই যদি রাদকে ভালোবেসে ফেলতি, আমি তোকে কষ্ট দিতাম না। কেন আমি তোর চোখে আফিফের প্রতি ভালোবাসা দেখেছি? কেন দেখেছি? তোর স্মৃতি উনার মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলার জন্য আমি উনাকে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম স্ত্রীর অধিকার তোর উন্মাদ ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। হ্যাঁ, আহি। আমি ঠিক ছিলাম। অনেক বেশি শক্ত এই সম্পর্ক। কিন্তু এমন একটা সম্পর্ক, যেখানে শুধু দায়িত্ববোধ আছে। সেই অনুভূতি আমি খুঁজে পাই নি, যেই অনুভূতির কথা উনি বইয়ে তোর জন্য লিখেছিল। আমি জানি আফিফ তোকে ভালোবাসে। কিন্তু ওভাবে ভালোবাসে না, যেভাবে তুই ভালোবেসেছিস। তোরগুলো প্রকাশিত। তুই করেছিস। আমরা দেখেছি। সেই চারুশিল্পের প্রতিটি ইট-পাথর তোর ভালোবাসার সাক্ষী ছিল হয়তো। কিন্তু আফিফ কিছুই করে নি। শুধু অনুভব করেছে। আর তার প্রমাণ সেই বইটি। আমি খুব ভয় পেতে লাগলাম, যখন জানলাম তুই আর উনি একই সাথে মাস্টার্স করছিস। দিন-রাত অস্বস্তিতে কেটেছে আমার। ইচ্ছে করে খাবার নিয়ে তোদের ক্যাম্পাসে চলে আসতাম। উনাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতাম। তোকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, আফিফ শুধু আমার মানুষ। তুই এসব দেখে কাঁদতি। খুব কষ্ট পেতি। আর আফিফ কি করতো জানিস? মানুষটা মুষড়ে পড়তো। আমার হাতের খাবার গলা দিয়ে নামতো না তার। আমি জোর করে খাইয়ে দিতাম। ভীষণ কষ্ট পেতো তোর জন্য। আমি সহ্য কর‍তে পার‍তাম না তার কষ্ট। চার বছরের সংসারে আমার প্রতি ভীষণ সম্মান ছিল তার। যত্ন নিতো আমার। সত্যিই মানুষটা অনেক ভালো রে। কিন্তু আমাকে ভালোবাসে নি। তোর ছবিটা দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে। তোর জন্য কবিতা লিখেছে। কিন্তু সেই রঙ মাখিয়ে কখনো আমাকে তার ক্যানভাসে তুলে নি। কারণ তার মস্তিষ্কেই শুধু আমি ছিলাম। মনে তো তুই জায়গা করে নিয়েছিস। বিয়ের পর আমাকে কখনো হানিমুনে নিয়ে যায় নি। গিয়েছিল, তোর জন্য। আবার সেদিনের বাসরটাও কেন ছিল? শুধু তোকে বোঝানোর জন্য, যে তিনি আমার সাথে সুখে আছেন। তার মনে তো ঝড় বয়ে যাচ্ছিল সেদিন। রাদ আর তোকে একসাথে দেখে একদম ভেঙে পড়েছিলেন। কেন আহি? কেন এমন হলো আমার সাথে? তোর উন্মাদনা না জেনেই শুধু চিরকুট পড়ে উনি তোকে এতোটা ভালোবেসেছে। যদি কখনো জেনে যায়, তুই কি কি করেছিস, তখন তো আমাকে ফেলে চলে যাবে উনি। আমার কষ্ট হবে খুব। আমিও তো ভালোবেসেছিলাম। এখনো ভালোবাসি। হয়তো আমার ভালোবাসা আদায় করার ধরণটা ভুল ছিল। কিন্তু ভালো আমিও বেসেছিলাম।”

(***)

ঘর্মাক্ত শরীরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেল বাজাচ্ছে আফিফ। প্রায় পাঁচ মিনিট পর দরজা খুলে গেলো। আফিফ সামনে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আহি আফিফের চাহনি দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তাড়াতাড়ি আসো।”

আফিফ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“কি পরেছো এটা?”

আহি বিরক্ত মুখে বলল, “শাড়ি!”

“সেটা তো আমিও দেখতে পারছি, কিন্তু এটা কেমন শাড়ি?”

“তাজওয়ার দিয়েছে।”

“আহি, তুমি কোনো ভালো শাড়ি পরে এসো। এমন পাতলা শাড়ি পরে তুমি….”

আহি আফিফকে থামিয়ে দিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“আমি জানি আমাকে কি করতে হবে।”

আহি সোজা নিজের রুমে চলে এলো। আফিফও তার পিছু পিছু এলো। এরপর আহি সিঁড়ি বের করে আফিফকে ফলস স্লাবে উঠে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে উপরে উঠে গেলো। ফলস স্লাবের ভেতরে ঢুকে ক্যাটডোরটি হালকা খোলা রাখলো। আহি সিঁড়িটা সরিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর আবার কলিংবেল বেজে উঠলো। আহি দরজা খুলতেই উজ্জ্বল ঘরে ঢুকলো। উজ্জ্বল সেকেন্ড খানিক আহির দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“তুমি এই শাড়িটা পরো না।”

আহি বলল, “তাজওয়ার পাঠিয়েছে।”

“ওর কথা শুনতে হচ্ছে কেন?”

আহি প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আপনি কেন এসেছেন? আপনার তো বাইরে অপেক্ষা করার কথা!”

“আমি বারান্দায় থাকবো। পাশের রুমের বারান্দাটা খুলে দাও। তোমাকে ওই শয়তানের সাথে একা ছাড়ার সাহস নেই আমার।”

“আফিফ তো আছেই।”

“ও যেখানে আছে, ওখান থেকে সরে গেলেই তো সমস্যা। ভিডিওটা তো ও-ই করবে।”

আহি উজ্জ্বলকে পাশের রুমের বারান্দাটা খুলে দিলো। এরপর বারান্দার দরজা আটকে দিয়ে চাবিটা জানালা দিয়ে উজ্জ্বলের হাতে দিয়ে বলল,
“তাজওয়ার যদি বারান্দায় আসতে চায়? এই নিন, চাবিটা রাখুন। ওদিক থেকেও খোলা যাবে।”

“তোমার কাছে চাবি চাইলে?”

“বলবো, এটা মায়ের রুম। চাবিটা মায়ের কাছে।”

হঠাৎ বেল বেজে উঠলো। আহি রুম থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে এসে পীপহোলে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। আহি দরজা খুলে দিলো। তাজওয়ার আহিকে দেখে বাঁকা হেসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই লোকটা কে?”

তাজওয়ার পাশের লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরেহ, ইনি তো আমাদের বিয়ে পড়াবেন।”

আহি তাজওয়ারকে বলল,
“আগে তুমি আসো। উনাকে বাইরে দাঁড়াতে বলো।”

তাজওয়ার লোকটাকে ইশারায় বাইরে দাঁড়াতে বলে ভেতরে ঢুকে গেলো। তাজওয়ার ভেতরে ঢুকতেই আহি জোরে দরজা বন্ধ করে দিলো। তাজওয়ার আহির রাগ দেখে বাঁকা হাসি হেসে বলল,
“এতো রাগ!”

আহি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। তাজওয়ারও আহির পিছু পিছু এসেছে। আহি বলল,
“কি খাবে? শরবত না-কি কফি?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমার জন্য তুমি শরবত বা কফি বানাবে? ইন্টারেস্টিং!”

“দেখো এতো সাসপেন্স রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি আমাকে শর্ত দিয়েছো। তাই আমি তোমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে চাইছি। আর তোমার খেতে ইচ্ছে না করলে আমি কিছু বানাবো না। আমার কোনো ইচ্ছেও নেই।”

তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“কেন বানাবে না? অবশ্যই বানাবে। এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাবো।”

আহি তাজওয়ারের সামনেই শরবতটা বানালো। তাজওয়ার আহির সামনে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস শরবত শেষ করে ফেললো। আহি আগে থেকেই চিনির সাথে নেশাদায়ক ট্যাবলেট গুঁড়ো করে রেখেছিল। নায়ীব থেকেই নিয়েছে সে ট্যাবলটটি। তাজওয়ার যাতে তাকে সন্দেহ না করে, তাই আগে থেকেই এমন ব্যবস্থা করে তাজওয়ারের সামনেই শরবত বানিয়েছিল। এবার আহি বসার ঘরে এসে বলল,
“আমাকে ভিডিওগুলো দাও। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তোমাকে আমি ভিডিওগুলো দিয়ে দেবো, আর তুমি আমাকে বিয়েই করবে না!”

আহি বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করবো। আমার উপর বিশ্বাসটা রাখো। কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি জানো, আমি কেমন মেয়ে! আর আমিও জানি তুমি কেমন মানুষ। তুমি নিজেই ভেবে দেখো, কার প্রতারণা করার সম্ভাবনা বেশি।”

“যদি তুমি ভিডিওগুলো দেওয়ার পর আমাকে বিয়ে কর‍তে না চাও?”

“তাহলে তুমি আমার জোরাজুরি করো। সেদিন যেই ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারো নি, তা করে নিও। আজ আমি মরতে যাবো না।”

তাজওয়ার হাসলো। আহির প্রস্তাবটা তার পছন্দ হলো। সে ঘরে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। সব রুমে ঢুকলো, বারান্দায়ও উঁকি দিলো। আহির রুমের পাশের রুমটির বারান্দার সামনে গিয়ে বলল,
“দরজা বন্ধ!”

“হ্যাঁ, বারান্দার দরজা বন্ধ করেই তো গিয়েছি। আমরা তো এখনো এই ফ্ল্যাটে উঠি নি।”

“তোমার রুমেরটা তো খোলা!”

“কারণ আজ সারাদিন আমি রুমেই ছিলাম। বারান্দায় গিয়েছি। খোলা তো থাকবেই।”

“এই বারান্দার চাবি কোথায়?”

“মায়ের কাছে। এটা মায়ের রুম।”

“তাহলে রুমের দরজা খোলা কেন?”

“বারান্দার দরজা আটকে রাখি। যাতে কোনো অঘটন না ঘটে।! যাতে চোর-ডাকাত আসতে না পারে। রুমের দরজা কেন বন্ধ করবো? বারান্দা দিয়ে আসতে না পারলে, রুমে ঢুকবে কীভাবে?”

তাজওয়ার জানালা খুলে উঁকিঝুঁকি মারলো। উজ্জ্বল একপাশে পা তুলে বসে রইলো। তাজওয়ার তাকে দেখলো না। তাজওয়ার এবার আহির রুমে গেলো। জিনিসপত্র ঘাঁটতে লাগলো। আহি বলল,
“কি খুঁজছো?”

“দেখছি কোনো সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছো কি-না! তুমি তো আবার ক্যামেরা নিয়ে ঘুরো।”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“যা করার করো, আগে আমাকে পদ্মের ভিডিওগুলো সব দাও।”

তাজওয়ার আহির দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। আহি তাজওয়ারের ফোন থেকে পদ্মের ভিডিওগুলো ডিলিট করে ফেললো। আহি বলল,
“আর কোথায় আছে?”

“আমার ফোনেই ছিল, আহি। এই ফোন থেকেই ভিডিওটা রেকর্ড করেছিলাম। নতুন ফোন কিনেছিলাম। বেশ ভালো ভিডিও হয়। এই ভিডিও আর কোথাও নেই। আমি জানতাম, এই ভিডিও থাকলে তুমি আমার কাছে আসতে বাধ্য হবে। আমি তো এজন্যই পদ্মের ভিডিও করেছি। নয়তো তুমিই বলো, পদ্ম তো তোমার বান্ধবী, আমার বোনের মতো।”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ। একদম চুপ। বোনের মতো বলে বোনদের অপমান করো না। তুমি কারো ভাই হওয়ার যোগ্য না। আর তোমার মতো অসভ্য মানুষকে আমি কখনো বিয়ে করবো না।”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“রিয়েলি? বাসায় কিন্তু কেউ নেই। আমি তোমাকে ছাড়বো না, আহি।”

“তোমার সেই সাহস নেই। তুমি আহিকে স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখো না।”

“চ্যালেঞ্জ করছো আমাকে?”

আহি বাঁকা হেসে বলল, “চ্যালেঞ্জ করছি।”

(***)

তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। আহি নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তাজওয়ার আহিকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। আহি সরে যেতেই তাজওয়ার আরো হিংস্র হয়ে উঠলো। আহির শাড়ির আঁচল ধরে টেনে তাকে পেছন দিকে থেকে জড়িয়ে ধরলো। আহিকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলল,
“আজকে তোমাকে আমি নিজের করেই ছাড়বো, আহি।”

আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো। তাজওয়ার আহির গলায় কামড় বসিয়ে দিতেই আহি চিৎকার করে উঠলো। উজ্জ্বল আহির চিৎকার শুনে চাবি ঘুরিয়ে বারান্দা থেকে রুমে ঢুকলো। এদিকে আহি গলা চেপে ধরে রেখেছে। তাজওয়ার আহির শাড়ির আঁচল টেনে ধরতেই তার মাথায় জোরে টেবিল ঘড়ি ছুঁড়ে দিলো উজ্জ্বল। তাজওয়ার মাথায় হাত দিয়ে আহির উপর থেকে উঠে আসতেই ভিডিও করা বন্ধ করলো আফিফ৷ চোখ লাল হয়ে গেছে তার। চোখ বেয়ে গরম অশ্রুজল বেরিয়ে পড়লো নিঃশব্দেই। ঘামে ভিজে গেছে তার পুরো শরীর। ফলস স্লাবের দেয়ালে গাঁথা পেরেকের উপর সব রাগ ঝেড়েছে সে। তাই রক্ত বেয়ে পড়ছে তার হাত থেকে। আফিফকে ফলস স্লাবে উঠানো হয়েছে ভিডিওটা ভালোভাবে ধারণ করার জন্য৷ কারণ আহি জানে তাজওয়ার এমন কিছু করার আগে পুরো ঘরে ক্যামেরা আছে কি-না তা দেখে নেবে। তাই ক্যামেরা লাগানোটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আহি জানে এই ভিডিও ধারণ করার ক্ষমতা উজ্জ্বল বা আফিফের থাকবে। কারণ তারা খুবই ধৈর্যশীল। রাদকে এই কাজ দিলে ভিডিওটা কখনোই সম্পূর্ণ করা যেতো না। তাই সে তার পরিকল্পনাটা আফিফ আর উজ্জ্বলকেই শুনিয়েছে। যদিও আফিফ কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলো না। কিন্তু আহির কথা শুনে বাধ্য হলো।

(***)

তাজওয়ার পেছনে ফিরে দেখলো পুষ্পের কাজিন, উজ্জ্বল দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার উজ্জ্বলকে দেখে কিছু বলতে যাবে উজ্জ্বল তার আগেই তাজওয়ারের নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। ফলস স্লাবের দরজা খুলেই ক্যামেরাটা সেখানে রেখে লাফিয়ে নিচে নামলো আফিফ। মেঝেতে পড়ে থাকা তাজওয়ারকে ইচ্ছেমতো মার‍তে লাগলো সে। উজ্জ্বল একনজর আহির দিকে তাকালো। আহি কোনোভাবে শাড়ি ঠিক করে উঠে বসলো। উজ্জ্বল তা দেখে তাজওয়ারের কলার ধরে তাকে টেনে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে এলো। তাজওয়ারের নেশা চড়তে শুরু করেছে। শরীর দুর্বল হয়ে গেছে তার। শরবতের প্রতিক্রিয়া এখন ধীরে ধীরে হচ্ছে। তাই সে উঠে উজ্জ্বলের উপর পাল্টা আক্রমণ করতে পারলো না। এদিকে আহি বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই শাড়ির কুঁচি আটকে মেঝেতে পড়ে যাওয়ার আগেই আফিফ তাকে ধরে ফেললো। আহির উন্মুক্ত কোমড়ে আফিফের হাতের স্পর্শ লাগতেই আহির পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। এদিকে আহির চোখে জল দেখে আফিফের বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। আজ সব বাঁধা যেন আফিফ নিজেই কাটিয়ে দিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আহিকে। আফিফের এমন প্রতিক্রিয়া আহিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিয়েছে। আফিফের শরীরের কম্পন অনুভব কর‍তে পারছে আহি। আহির খুব ইচ্ছে করছে আফিফকে জড়িয়ে ধর‍তে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,
“আমাকে কি এভাবে তোমার সাথে বেঁধে রাখা যায় না? তোমাকে একটুখানি স্পর্শ করার লোভে কতো রোদ-ঝড় উপেক্ষা করে তোমাকে ভালোবাসতে গিয়েছিলাম। তোমাকে স্পর্শ করার ব্যর্থতায় তোমার আদলে ভাস্কর্য বানিয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিলাম। তুমি তো কখনো আমাকে ছুঁয়ে দাও নি। আমাকে সেই সুযোগটাও দাও নি। আজ কেন, এআর? কেন আমার হৃদয়ে ঝড় তুলছো? আমি তো তোমাকে ভালোবেসে বড্ড ভাবে কলঙ্কিত হয়েছি। এখন আমাকে স্পর্শ করে কেন আমার কলঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিচ্ছো? তোমার এই স্পর্শ হয়তো আরো কয়েক যুগ তোমাকে আমার মনে বেঁধে রাখবে।”

আফিফ আহিকে ছেড়ে দিলো। তার চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। আহি দেখলো আফিফের হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে তোমার হাতে?”

আফিফ আহির গলায় রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া কামড়ের দাগটির দিকে তাকিয়ে আহির চোখের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“হাতে ব্যথা পেয়েছো কীভাবে?”

আফিফ আহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সরে দাঁড়ালো। আহি বলল,
“আফিফ..!”

আফিফ আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি শাড়িটা পালটে এসো। ক্যামেরাটা ফলস স্লাবে রেখে এসেছি।”

কথাটি বলেই আফিফ বেরিয়ে গেলো। আফিফ বেরুতেই আহি দরজা আটকে দিলো। বুকে হাত রাখলো সে। এরপর নিজের শরীর আঁকড়ে ধরলো সে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আহি। মিনমিনিয়ে বলল,
“মেঘ। তুমি আমার কাছে মেঘ হয়েই থেকে গেলে, আফিফ। তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়া মানেই হারিয়ে ফেলা। আর আজ আমি তোমাকে সত্যিই হারিয়ে ফেলেছি। মনে হচ্ছে, আর মাত্র কয়েকটা দিন। এরপর তোমাকে আমি আর কখনো দেখবো না। কেউ যদি একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতো আমার শেষ ইচ্ছে, আমি আমার প্রতিটা ইচ্ছেতেই তোমাকে চাইতাম। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতো, আমার স্বপ্ন সম্পর্কে। আমি বলতাম, আমার সব স্বপ্ন তোমার মাঝেই এসে থেমে যায়।”

(***)

উজ্জ্বল পুলিশ ডেকে আনলো। তাজওয়ারকে আধমরা অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। আহি সেদিনই তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করে এলো। প্রতিবারের মতো এবারও তাজওয়ার সুস্থ হয়ে থানায় এসে হাজির হলো। পুলিশকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলো। আর এই সুযোগটার অপেক্ষায় ছিল আহি। সেদিন রাতেই আহি রুমের দরজা বন্ধ করলো। তার ফোনের ক্যামেরাটা স্থির ভাবে বসিয়ে লাইভে এলো। লাইভ অন হতেই জয়েন হতে লাগলো একজন, দুইজন করে প্রায় কয়েকশো জন। আহির অশ্রু, গলায় কালসিটে দাগ, ঠোঁটের ফোলা অংশ আর বিমর্ষ মুখখানা দেখে এই লাইভটি শেয়ার হলো কয়েকশো বার। ভিউয়ার্স বাড়তে লাগলো। কমেন্টে আসতে লাগলো একটাই বাক্য,
“তাজওয়ার খানের শাস্তি চাই।”

আহি আনমনে হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“যার বিচার আদালতে হয় না। যার বিচার আইন করে না। তার বিচার জনগণ করবে। মিস্টার তাজওয়ার খান, যেই ক্ষমতার বলে দিয়ে তুমি আইন কিনে নিয়েছো, আমি তোমার সেই ক্ষমতা মিডিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। তোমার শাস্তি এবার হবেই। এখন কোনো আইন, কোনো শাসক, কোনো মন্ত্রী তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমি বলেছি না, আমি বেঁচে ফিরলে তোমাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো। শুভ দিন এসে গেছে। আজ রাতেই তোমার পা চাঁটা অন্ধ ভক্তরাই তোমাকে বন্দি করবে।”

পরদিন সকালে রাদ আর লাবীব ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আহির ন্যায়বিচারের জন্য সমাবেশ করলো। লিনাশা-নায়ীব, পুষ্প বিভিন্ন পেশার মানুষকে নামিয়ে দিলো ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশে। মিডিয়ায় রাতারাতি ছড়িয়ে পড়লো ঘটনা। গণমাধ্যমের শিরোনামে এলো আহির সেই লাইভ ভিডিও। অস্পষ্টভাবে ছাড়া হলো সেই ভিডিওটি, যেখানে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে তাজওয়ার আহিকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। আদালতে উঠলো মামলা। তাজওয়ারকে গ্রেফতার করা হলো আরো আগেই। আহির পক্ষে উকিল হলো উজ্জ্বল। বিচারকের সামনে প্রমাণস্বরূপ রাখা হলো ভিডিও। সাথে দেওয়া হলো তাজওয়ারের অন্য সব অবৈধ কাজের প্রমাণ। কয়েক সপ্তাহ মামলা ঘুরে রায় হলো কয়েক বছরের কারাদণ্ডের। আহি আপিল করলো। তাজওয়ারের জন্য এই কারাদন্ড কিছুই না। তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হোক। এবার সাক্ষী হলো ফার্জিয়া, আর ফার্সার ভাইরাল ভিডিও, এবং আরো কিছু নির্যাতিত নারী। পদ্ম পরিচয় গোপন করে নিজের অত্যাচারের অংশটুকু কর্তৃপক্ষকে শোনালো। যদিও সে আফিফের চাপাচাপিতেই বাধ্য হয়ে এই কাজ করেছে। শেষমেশ কয়েক মাস মামলা চালিয়ে তাজওয়ারের মৃত্যুদন্ডের রায় দেওয়া হলো। এই পুরো সময়টা জুড়ে মিডিয়া আর সাধারণ মানুষ আহির পক্ষে আন্দোলন করে গেছে।

কোর্ট থেকে বের হয়ে আহি রাদের মুখোমুখি হলো। রাদ শক্ত করে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ সেখানেই দাঁড়ানো। রাদকে আহির কাছে আসতে দেখে শুকনো হাসলো সে। যেই হাসিতে কোনো প্রাণ ছিল না। শুধু সমঝোতা ছিল। বাস্তবতার সাথে সমঝোতা। উজ্জ্বল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আহির জয়ে অনেক খুশি সে। নিজের শেষ কেইসে জয়ের চেয়ে বেশি শান্তি পাচ্ছে আহির চোখে হাসি দেখে। অল্প সময়েই মায়ায় বেঁধে ফেলেছিল মেয়েটা। এই মায়া কাটানো অসম্ভব। আহি সাধারণ মেয়েদের থেকে ভিন্ন। অসাধারণ একটা মেয়ে। ভাগ্যবান কেউই, আহিকে জীবনসঙ্গী করে পাবে। হয়তো সেই ভাগ্যবান পুরুষ রাদই হওয়ার ছিল।

তাজওয়ারকে কোর্ট থেকে বের করে আনা হলো। তাকে এখান থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। তাজওয়ার আহিকে দেখে থেমে গেলো। সে একনজর রাদ আর আহির আবদ্ধ হাতের দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে বলল,
“আমি ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোনো প্রেমিক পুরুষ থাকবে না, আহি। আমি তোমাকে ভালোবেসে কারাবন্দী হয়েছি। আমি অমর হয়ে যাবো। আমি ইতিহাস লিখবো। এক রাজা তার রানীর জন্য.. ওপস। গল্পটা এখনো শেষ হয় নি, আহি। এর শেষ অংশটা আমিই লিখবো।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||আংশিক পর্ব||

১০৭।
মিষ্টি রঙের শাড়ি পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো আহি। কপালে একটা কালো টিপ পরলো। তখনই তার রুমে ঢুকলো নীল জামদানি পরা চুনি। আহি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ভীষণ সুন্দর লাগছে চুনিকে। একদম চাঁদের মতো। তাই হয়তো মেয়েটা নিজেই নিজের নাম রেখেছে চাঁদনি।

এক সপ্তাহ হচ্ছে চুনি আর মুনিয়া খালা সালমা ফাওজিয়ার বাসায় এসেছে। এখন থেকে তারা এখানেই থাকবে। এখান থেকেই চুনিকে বিদায় দেবেন মুনিয়া খালা।
আজ চুনির আংটি বদল আর আক্দ অনুষ্ঠান। চুনির বিয়ে হচ্ছে আহিরদের বাড়ির দারোয়ান, মোজাম্মেল চাচার ভাইয়ের ছেলের সাথে। ছেলে বর্তমানে প্রবাসী। ওখানে ভালোই আয় হচ্ছে তার। চুনিকে বিয়ের কয়েক বছর পর নিয়ে যাবে বলছে। কয়েক মাস হলো ছেলেটা সেখানে গেছে। গিয়েই তিন মাসের ছুটিতে এসে বিয়ে করছে চুনিকে। চুনির বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তাই আহি নিজের খরচে জমকালো আয়োজনে চুনিকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আহির সামনে এসে দাঁড়ালো চুনি। মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বলল,
“আফা, ভালা লাগতেছে আমারে?”

আহি চুনির গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ভীষণ ভালো লাগছে। শাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে?”

“পছন্দ হইবো না? এত্তো সুন্দর একখান শাড়ি।”

চুনি আহির ড্রেসিংয়ের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“দেখছো আফা, সাজাইছে আমারে ভালা কইরা। কত্তো সুন্দর কইরাই না সাজাইছে! আমি আগে কখনো সাজি নাই এরকম কইরা।”

আহি চুনির চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“তুমি এখন থেকে খুব সাজবে। তোমার বর ভীষণ ভালো। আমি কথা বলেছি তার সাথে। মনে হচ্ছে, তোমাকে ভালো রাখবে। ছোট্ট সংসার হবে তোমার। তুমি ভালোই থাকবে। আর মোজাম্মেল চাচা বলেছেন, তোমার জন্য দিদারের চেয়ে ভালো কেউই হবে না।”

“আফা, আমার বরের নাম দিদার?”

“কেন তুমি জানো না?”

“বারেকই তো হুনছিলাম।”

“দিদার বারেক।”

চুনি এক গাল হেসে বলল,
“কি সুন্দর নাম আফা! আমি ছবি দেখছি শুধু। না, না, ছবি তো রোজ দেহি। আমি তো তারে দূর থেইকাও দেখছি। আমার দিকে তাকাইয়া হাসছিল। কি সুন্দর হাসি, আফা! আম্মা আমারে দেহা করতে দে নাই। কইছে বিয়ের পর করিস দেহা। তুমি কও আফা, একটু কথা হইলে ভালো হইতো না?”

“সমস্যা কোথায়? আজ না হয় বলবে।”

“আজ ক্যান? আগে ক্যান না? তুমি তো কথা কও ভাইজানের লগে! আমি কেন পারবো না?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ভাইজান!”

“ওই যে এখানে আহে, চিকন কইরা, শিং মাছের মতো শরীলডা।”

আহি হাসলো। শব্দ করেই হাসলো। হাসতে হাসতে বলল, “রাদ?”

“হ, আফা। ভাইজান রে কইয়ো না আবার এইডা। ভাইজান কিন্তু ওই শয়তানডার থেইকা ভালা আছে।”

“রাদ তো আমার বন্ধু।”

“ক্যান? তোমাদের বিয়ে হইবো না?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চুনির প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই আহির কাছে। রাদকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু তার মনটাই তো সায় দিচ্ছে না এই সম্পর্কে। জোর করে একটা সম্পর্ক শুরু করলে আহি শুধু কষ্ট পাবে। রাদকেও কষ্ট দেবে। জীবনের সাথে অনেক সমঝোতা করেছে সে। বাস্তবতা মেনে অনেক কিছুই ত্যাগ করেছে। কখনো নিজের কথা ভাবে নি। এবার একটু মনের কথা শুনবে আহি। তার মন যেখানে আটকাবে, সেখানেই পা বাড়াবে সে। আর এই মুহূর্তে আহির মন-মস্তিষ্ক জুড়ে বিরাজ করছে জীবনের একটা গতি। তার নিজের জন্য কিছু করা। তার স্বপ্ন পূরণ করা। ভালোবাসা, বিয়ে এসব থেকে সে দূরত্ব রাখতে চাইছে আপতত। যখন সময় হবে তখন আবার না হয় ভেবে দেখবে।

(***)

সন্ধ্যায় চুনির আংটি বদল আর আক্দ সম্পন্ন হলো। ঘরোয়া ভাবেই আয়োজন হয়েছে। ছাদে ছেলে পক্ষের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। এদিকে আজ লাবীবের বাবা-মা পুষ্পের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছেন। সেই প্রস্তাব কতোটুকু এগিয়েছে তা শোনার জন্য চুনির শ্বশুড় পরিবারের সবাইকে বিদায় দিয়েই আহি পুষ্পকে ফোন করলো। পুষ্প কল রিসিভ করেই মলিন মুখে বললো,
“আহি, গণ্ডগোল হয়ে গেছে।”

“কি? আংকেল-আন্টি রাজি হয় নি?”

“বাবা হয়েছিল। কিন্তু মা আবার উল্টে গেছে। লাবীবের বাবা-মার সামনে কতো সুইট ছিল। আর এখন?”

“সমস্যাটা কি!”

“সমস্যা একটাই, চাকরি! মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হয় নি ওর। ও তো ওর আংকেলের বিজনেস ধরেছে আমাকে বিয়ে করার জন্য। মা বলছে এসব বিজনেসম্যান না-কি ভালো লাগে না তার।”

“এই মুহূর্তে চাকরি তো হবেও না। সময় তো লাগবে। ও তো ইন্টারভিউ দিচ্ছে।”

“হুম। আচ্ছা, তোর কোম্পানিতে একটা কাজ দিয়ে দে না, আহি।”

আহি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
“আমি এখনো বাবার কাছ থেকে কোম্পানিটা নেই নি।”

“জানি। কিন্তু ওটা তোর কোম্পানি। আই মিন তোর দাদা তো সব কিছু তোর নামেই করে দিয়েছেন। লাবীবকে একটা পজিশন দিলে, হয়তো মা রাজি হয়ে যাবে। আফটার অল, তোর কোম্পানিটা বাংলাদেশের টপ কোম্পানির মধ্যে একটা। নাম আছে বেশ। ওই কোম্পানির এমপ্লয়ি হওয়াটাও অনেক বড় ব্যাপার।”

“হ্যাঁ, কিন্তু আমি এসবের কিছুই বুঝি না এখনো। আমাকে কিছুদিন সময় নিয়ে বুঝতে হবে। আমি তো মাত্র কয়েকদিন হলো ওখানে যাচ্ছি। বাবাও না-কি যায় না ওখানে। বাবা কোম্পানি থেকে নিজের অংশ সরিয়ে ফেলেছে। এখন কোম্পানি ডাউন পজিশনে আছে। তবে ম্যানেজার আংকেল খুব ভালো। আমি উনার সাথে কথা বলে লাবীবকে একটা কাজ দিয়ে দেবো। আর আমি যদি কোম্পানির পুরো দায়িত্বটা নেই, তাহলে লাবীবকে আরো ভালো পজিশন দিতে পারবো। ও তো অনার্সে ভালো গ্রেট পেয়েছে। ওর এক্সপেরিয়েন্সও ভালো। একটা কাজ কর। তুই সময় নে। কয়েক মাস তো অপেক্ষা করা যায়৷ মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হবে সামনে। এরপর তুই নিজেও তো চাকরি খুঁজবি। বাসায় বলে রাখ, আরেকটু সময় লাগবে।”

“হুম, আচ্ছা, তুই কি অন্য কিছু করবি না? শুধু কোম্পানির দায়িত্বটাই নিবি?”

“হুম, দেখি। আমার যদি ভাই থাকতো, তাহলে ও সামলাতে পারতো সব। এখন তো আমাকে বাধ্য হয়েই এসব দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। কিন্তু আমার স্বপ্ন তো আর্টিস্ট হওয়া। সব গুছিয়ে আমি ওদিকেই মনোযোগ দেবো। আর তুই চিন্তা করিস না। আমি আন্টির সাথে কথা বলবো। লাবীব পড়াশোনায় অতো খারাপ ছিল না। ইউকে তো ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিল ওর৷ পড়াশোনায় তো ও রাদের চেয়েও ভালো। দেখিস, আমি আন্টিকে রাজি করিয়ে ফেলবো।”

চলবে-

উধয়রনী পর্ব-৪৮+৪৯ + বোনাস পর্ব

0

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৮||

৯৭।
বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে আহি। তার দৃষ্টি আটকে আছে ফোনের স্ক্রিনে। আহির হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সালমা ফাওজিয়া। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে?”

আহি ফোনটা টেবিলের উপর রেখে অবিশ্বাস্য হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“মা, তুমি ভাবতেই পারবে না কি হয়েছে!”

“কি হয়েছে, বলো!”

“তাজওয়ার আর একটা মেয়ের….”

আহি কিছুক্ষণ থেমে ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তাজওয়ারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এখন ওর মান-সম্মান সব শেষ। আমার খুব শান্তি লাগছে।”

তখনই আহির ফোনে উজ্জ্বলের কল এলো। আহি সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করে বলল,
“নিউজ দেখেছেন!”

উজ্জ্বল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কিন্তু এই কাজটা করলো কে?”

“ওর কি শত্রুর অভাব আছে?”

“আর যাই বলো! যে করেছে, তার খুব সাহস আছে। তাজওয়ারের মতো কঠোরভাবে প্রাইভেসি মেইনটেইন করা ছেলের ভিডিও ভাইরাল হওয়া সহজ কথা না। ওর বাসা, এক্সট্রা ফ্ল্যাট, বাংলো বাড়ি সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। বাইরের কেউ এই কাজ কখনোই করতে পারবে না। ওর কাছের কেউ এই ভিডিও করেছে।”

আহি হেসে বলল,
“যেই করেছে, ভালো করেছে। এখন অন্তত ওর দাম্ভিকতা কমবে। খুব তো অহংকার তার! আমাকে সবার সামনে নিজের ফিয়োন্সে হিসেবে পরিচিত করানোর জন্য মিডিয়া নিয়ে এসেছিলো। এখন সেই মিডিয়া থেকেই পালাবে।”

(***)

রুমের জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছে তাজওয়ার। কোনোভাবেই তাকে আটকানো যাচ্ছে না। চাকর-বাকর জড়োসড়ো হয়ে তার রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। রেহানা খান ছেলের হাত ধরে রেখেছেন। তাজওয়ার মাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“কেউ আমাকে থামানোর চেষ্টা করবে না।”

রেহানা খান ছেলের চিৎকারে কেঁপে উঠলেন। দোয়েল ভেতরে ঢুকে রেহানা খানকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। রাগের মাথায় তাজওয়ার কি না কি করে বসে, বলা তো যায় না। কারণ তাজওয়ার আজ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। নিজের পরাজয় মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। এতো বছর সে মেয়েদের সম্মান নিয়ে খেলেছে, আর আজ তার সম্মানে এতো বড় প্রশ্ন! যদিও এটা কয়েক বছর পর সবাই ভুলে যাবে। কিন্তু সাময়িক সময়ের জন্য সে দশজনের সামনে দাপট দেখিয়ে চলতে পারবে না। তাকে মিডিয়ার আড়ালে থাকতে হবে। তাজওয়ার গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“যে এই কাজ করেছে, আজ তার শেষ দিন।”

তাজওয়ার ড্রেসিংয়ের ভাঙা আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাঙা কাচ তাজওয়ারের চেহারা ধারণ করার চেষ্টায় ব্যস্ত, আর তাজওয়ারের মস্তিষ্ক ব্যস্ত সেই মানুষটিকে খুঁজতে যে তার এতো বড় ক্ষতি করেছে। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো তিনটি মুখ। আফিফ, লাবীব অথবা রাদ। নিশ্চয় এদের তিনজনের মধ্যে কেউ এই কাজ করেছে। তাজওয়ার চেয়ারে শান্ত হয়ে বসলো। কিছু একটা ভেবে বলল,
“সেই কালো হেলমেট পরা ছেলেটিই এই কাজ করেছে। আর সে আফিফ ছাড়া কেউ না।”

তাজওয়ারের ভাবনার মাঝে তার রুমের দরজায় কড়া নাড়লো আফিফ। তাজওয়ার রুমের দরজার কাছে আফিফকে দেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। আফিফ বিনয়ের সুরে বলল,
“আসতে পারি, স্যার?”

তাজওয়ার তেড়ে এসে আফিফের কলার ধরে তাকে রুমে ঢুকিয়ে তার নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। আফিফ সেকেন্ড খানিক মেঝেতে অচেতন হয়ে ছিল। সেকেন্ড খানিক পর আফিফ মাথা তুলে বলল,
“স্যার, আই এম সরি। আজ আমার ডিউটি ছিল, তাই এসেছি।”

তাজওয়ার আফিফের বুকে লাথি মেরে তাকে আবার মেঝেতে শুইয়ে দিলো। এবার সে আফিফের বুকে পা রেখে বলল,
“আমার সাথে এমন কেন করেছিস? প্রতিশোধ নিয়েছিস, তাই না?”

আফিফ ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
“স্যার, আপনার মতো দুঃসাহস আমার নেই। তবে আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য বিন্দুমাত্র আফসোস নেই আমার। হয়তো আল্লাহ আপনাকে শাস্তি দিয়েছেন।”

তাজওয়ার কথাটি শুনেই আফিফের মুখ সজোরে একটা লাথি দিলো। এরপর আফিফকে ছেড়ে আলমারি খুলে তার পিস্তলটি বের করল। আফিফ কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে সন্দেহ হওয়ার কারণ কি, স্যার?”

তাজওয়ার পিস্তলে গুলি ভরে আফিফের দিকে পিস্তল তাক করে বলল,
“কারণ তুই আমার প্রথম শত্রু।”

আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,
“শত্রু তো আপনি। আপনি আমার আপার ক্ষতি করেছেন, আমার ছোট বোনের জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছেন। আর আমার…..”

আফিফ থেমে গেলো। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তোর কি? হুম, বল? ডোন্ট সে, আহি তোর ভালোবাসা। আহি শুধু আমার। আর শোন, আমি তোকে আহির কাছে যেতে দেই নি, এটা ঠিক। কিন্তু তুই চাইলে আহির কাছে যেতে পারতি। তুই কি জানতি আহি তোকে কতোটা ভালোবাসতো? শুধু চিরকুট পড়েছিস। বাকিটা জানিস? এক তরফা ভালোবাসার সব সীমা অতিক্রম করেছে আহি, শুধু তোকে ভালোবেসে। ও তোর জন্য কি কি করেছে, তা আমি দেখেছি। আর যতোবার দেখেছি, ঠিক ততোবার তোকে খুন করতে ইচ্ছে করেছিল। কারণ আহির ভালোবাসা শুধু আমি ডিজার্ভ করি। আর কেউ না।”

আফিফ কোনো উত্তর দিলো না। তাজওয়ার আফিফের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল,
“তুই যদি জানতি, নিশ্চয় আহিকে ফিরিয়ে দিতি না। তুই কি জানতি তোর ফিরিয়ে দেওয়ার পরও আহি তোর অপেক্ষায় ছিল?”

তাজওয়ার কথাটি বলে হাসলো। আফিফের কপাল থেকে পিস্তল সরিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো। সে আরো শব্দ করে হাসছে। হাসতে হাসতে জোরে জোরে তালি দিচ্ছে। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার দুই হাতের উপর ভর দিয়ে বিছানায় শুয়ে দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মুখ ঘুরিয়ে নিতেই তাজওয়ার বলল,
“পদ্মকে ভালোবেসেছিলি?”

পদ্মের নাম শুনে আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হেসে বলল,
“যদি বলি, তোর পদ্মফুল সব জানতো।”

আফিফ অবাক দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হেসে বলল,
“পদ্মফুল নামটা কেন দিয়েছিস বল তো? ফুলের মতো পবিত্র, তাই?”

তাজওয়ার কথাটি বলে আবারও হাসতে লাগলো। আফিফ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“পদ্ম এই বিষয়ে কেন আসছে?”

তাজওয়ার উঠে বসে বলল,
“পদ্ম আসবে না? পদ্মই তো আমাকে…..”

তাজওয়ার থেমে গেলো। উঠে আফিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর আফিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়া’র। আহি আফিফকে ভালোবাসে। কিন্তু তাজওয়ার ভালোবাসে আহিকে। পদ্ম আফিফকে ভালোবাসে, কিন্তু আফিফ ভালোবাসে… কাকে? হুম?”

আফিফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্ম কি করেছে?”

“ইউজ ইউর ব্রেইন, আফিফ।”

তাজওয়ার সেকেন্ড খানিক থেমে বলল,
“ওপস, তুই বাঁচলেই তো ব্রেইন ইউজ করবি। তুই আমার এতো বড় ক্ষতি করে পার পেয়ে যাবি?”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ইউজ ইউর ব্রেইন ঠু। যেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেই ভিডিওটা রেকর্ড করার জন্য, বা ক্যামেরা সেট করার জন্য কি একবারো আমি আপনার সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম?”

তাজওয়ার থেমে গেলো। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো হ্যারির মুখটি। হ্যারি গিয়েছিল সেদিন রাতে। আবার সকালেই এসেছিল নাস্তা নিয়ে। অর্থাৎ এসব হ্যারি করেছে? তাজওয়ার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ বলল,
“আপনি সিসিটিভি ফুটেজ দেখুন, আমি ওই বাড়ির আশেপাশেও যাই নি।”

তাজওয়ার কিছুই বললো না। তার পিস্তলটি বিছানা থেকে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাজওয়ার চলে যেতেই আফিফ হালকা হাসলো। কিন্তু তার হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। তার মাথায় এই মুহূর্তে শুধু একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। আর সেটা হলো,
“পদ্ম কি করেছে, যার জন্য তাজওয়ার ওর নাম নিলো? পদ্ম কী জানতো?”

৯৮।

মেঝেতে শুয়ে আছে পদ্ম। শরীর-মন কিছুই চলছে না তার। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে আহির নম্বর। পদ্ম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই নামটির দিকে। তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে, একটি নাম। খেয়ালী। না, ভাবতে পারছে না পদ্ম। ফোনটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সে। ধাক্কা খেয়ে ফোনটি দরজার কাছে গিয়ে থামলো। তখনই রুমে ঢুকলো আফিফ। আফিফকে দেখে পদ্ম উঠে বসলো। ব্যস্ত হাতে চোখ মুছলো। মেঝেতে পড়ে থাকা পদ্মের ফোনটি হাতে নিলো আফিফ। স্ক্রিনে আহির নাম দেখে সে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম আমতা-আমতা করে বলল,
“মাথা ব্যথা করছিল তাই।”

আফিফ নিঃশব্দে দরজা আটকে দিলো। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে পদ্মের সামনে এসে দাঁড়ালো। পদ্ম উঠে দাঁড়াতে যাবে, তখনই আফিফ তাকে বসতে বললো। সে নিজেও পদ্মের সামনে পা গুটিয়ে বসলো। পদ্ম ভীত চোখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ পদ্মের চোখের দিকে তাকালো। পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

আফিফ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আহির ফোন ধরছিলে না কেন?”

“খেয়াল করি নি।”

“পদ্ম, তুমি হয়তো কিছু জানো, যা আমি জানি না। আমাকে বলো প্লিজ।”

পদ্মের চোখ ছলছল করে উঠলো। তাজওয়ার কি আফিফকে সব জানিয়ে দিয়েছে? আফিফ পদ্মের হাত স্পর্শ করে বলল,
“আমি তোমাকে চিনতে ভুল করি নি তো!”

পদ্ম আফিফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি, আফিফ। আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

“ভালো তো সবাই বাসে। কারো ভালোবাসা সুন্দর, আর কারোটা কুৎসিত।”

পদ্ম উঠে দাঁড়াতে যাবে তখনই আফিফ পদ্মকে শক্ত করে চেপে ধরলো। পদ্ম বলল,
“আমাকে মেরে ফেলুন, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।”

“এজন্যই এই কয়েকদিন বেশ ভয়ে ছিলে, তাই না? যখন জানতে পারলে আহি আর তাজওয়ারের বিয়ে হবে না, তখন থেকেই তুমি খুব চিন্তিত। নিজের বান্ধবীর ক্ষতি করার মতো মেয়ে তো তুমি নও, পদ্ম।”

“আমি আহির কোনো ক্ষতি করি নি।”

“তাহলে কেন তুমি তাজওয়ারকে ভয় পাচ্ছো? লিনাশা, পুষ্প ওদের চোখে তো সেই ভীতি নেই। তাহলে তোমার চোখে কেন এতো ভয়?”

পদ্ম চুপ করে রইলো। আফিফ পদ্মকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
“আমি চাইলে নিজেই সব তথ্য বের করতে পারতাম। কিন্তু তখন আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যেতো। এখন নিজেই সত্যটা বলো। তোমার মুখ থেকেই সব জানতে চাচ্ছি। বলো, প্লিজ।”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“ভালোবাসি আপনাকে। ভীষণ ভালোবাসি। আমি কিছু করি নি।”

“পদ্ম প্লিজ।”

পদ্ম কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“আমি জানতাম আহি আপনাকে ভালোবাসে। আপনিও আহিকে ভালোবাসতেন, তাই না?”

আফিফ চুপ করে রইলো। পদ্ম দেয়ালে লাগানো আহির সেই ছবিটির দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“এক্সিভিশনে যেই মেয়ের ছবি এঁকেছেন, মেয়েটা আহি ছিল। আপনাকে ছবি তুলে পাঠিয়েছিল ও। আমার বান্ধবীর ছবি আমি চিনবো না? পড়েছি আপনার সেই নামহীন বইটা। বিয়ের আগেই পড়েছিলাম। যেদিন জানলাম, আহির সেই এআর আপনি, সেদিন আমার কেমন লেগেছে আপনাকে বোঝাতে পারবো না। কতোবার আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আপনার দৃষ্টি শুধু এই দেয়ালের ফ্রেমে আটকে থাকতো। আহিকে ভালোবাসতেন আপনি। এই সত্যটা সহ্য হয় নি আমার। বিয়ের আগেই আমি অনেকবার আপনার ঘরে এসেছিলাম। মিষ্টি, নাস্তা এসব দেওয়ার বাহানায় আপনাদের বাসায় চলে আসতাম। ভীষণ ভালোবাসতাম আপনাকে। যেদিন টেবিলে আপনার সেই বইটি পেলাম, দম বন্ধ হয়ে এসেছিল আমার। আমি জানতাম, আপনি আমাকে কখনোই খুঁজবেন না। এই ছবির আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখটিকেই খুঁজবেন। তাই আমি আপনাকে আহির ব্যাপারে জানাই নি। আহি প্রতিদিন ক্লাস শেষে আপনার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার খুব অস্থির লাগতো। যদি আপনি আহিকে দেখে ফেলেন? যদি জেনে যান, মেয়েটা কে? যাকে না দেখে এতোটা ভালোবাসলেন, তাকে জেনে গেলে কি পাগলের মতো ভালোবাসতেন না?”

আফিফের চোখ লাল হয়ে আসছে। সে এক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“বইটি পড়ে জেনেছি, আপনার আপার সাথে যা হয়েছে সেসবের জন্য কোনো না কোনো অংশে আহি দায়ী। তাজওয়ার খানই এসব করেছে। রেনুকেও নিয়াজীর সাথে বিয়ে দেওয়ায় তার হাত ছিল। তাজওয়ার খান ভেবেছিল, রেনুকে হাতে রাখলে আপনি আর আহির কাছে যাওয়ার সাহস পাবেন না। কিন্তু আমি তো জেনে গেছি সব। আমি জানতাম, আপনি আহিকে পাওয়ার জন্য, রেনুকে সেই সম্পর্ক থেকে বের করে আনতে চাইছিলেন। আমি ভয় পেয়ে যাই। যদি একবার রেনু নিয়াজীর বাড়ি থেকে চলে আসে, আর আপনি যদি জেনে যান, আহি তখনো আপনার অপেক্ষায় ছিল, আমার হয়তো আপনাকে আর পাওয়ায় হবে না।”

আফিফ থমথমে কন্ঠে বলল,
“তাই তুমি মাকে বুঝিয়েছো, রেনুর উপর হওয়া অন্যায়ের কথা আমাকে জানালে, আমি রেনুকে নিয়ে আসবো। তুমি আমার বোনটাকে সেই জাহান্নামে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস থাকতে বাধ্য করেছিলে?

পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
” না, না। মা নিজেই আপনার উপর এতো চাপ ফেলতে চান নি। আমি তো নিষেধ করি নি। শুধু এইটুকু বলেছি, আমাদের সংসার তো চলছে না। রেনুর তিনটা সন্তান, আফিফ কীভাবে চালাবে? যদি রেনু সন্তান রেখে আসে, তাহলে তো সহজ হবে।”

“আর তুমি জানো, রেনু কখনো নিজের সন্তানদের ওই বাড়িতে রেখে আসবে না।”

পদ্ম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,
“এজন্যই হয়তো আমি কখনো মা হতে পারবো না। আমার পাপের শাস্তি আমি পেয়ে গেছি, আফিফ। আমাকে ছেড়ে দিবেন না। আমি সহ্য করতে পারবো না।”

“তাজওয়ারকে তুমি কি বলেছিলে?”

“আপনি এখনো আহিকে ভালোবাসেন। বইটাতে যা ছিল, সব বলেছি।”

“কি লাভ হলো এসব করে?”

“এরপরই তাজওয়ার আপনাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলো। বললো, যদি আপনি একমাসের মধ্যে কাউকে বিয়ে না করেন, তাহলে আহির সাথে সেই একই কাজ করবে, যেটা আপনার আপার সাথে করেছিল। আপনিও ভয় পেয়ে গেলেন। বিয়ের জন্য মাকে বোঝালেন। আমিও সুযোগ পেলাম। আপনার সামনে বার-বার চলে আসতাম। কথা বলতে চাইতাম। আগেও এমনটা করতাম। কিন্তু তখন আপনি বুঝেন নি। শুধু প্রতিবেশীই বানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তাজওয়ার আপনাকে চাপ দেওয়ার পর, আপনি আমাকে খেয়াল করলেন। আপনার মনে হলো, আমি আপনার যোগ্য। আপনার শূণ্য হাত ধরার ক্ষমতা আমার আছে। আপনার ভেঙে যাওয়া মনটা জোড়া লাগানোর ক্ষমতাটাও আমার হাতে। এরপর কি সুন্দর করেই না আপনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। এরপর মাকে বোঝালেন। কিন্তু মা রাজী হলেন না। তিনি তো সেই ফোন কলের ওপাড়ে থাকা মেয়েটিকেই মনে মনে পছন্দ করে রেখেছিলেন। তবে তাতে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এতো ভালোবাসার পরও আপনাকে পাওয়ার ক্ষমতা আহির ছিল না, অথচ আমার হলো। আর এর চেয়ে বড় জয় তো কোনো কিছুতেই নেই। আর এরপর তো আপনি তাজওয়ারকে দেখানোর জন্য কাজী অফিসে গিয়ে আমাকে বিয়ে করলেন। আর এরপর ধীরে ধীরে আমি আপনার মন থেকে আহিকে বের করে নিজের জায়গাটা করে নিলাম।”

(***)

আফিফ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। পদ্ম তার সামনে বসা। আফিফের চোখে অশ্রু ভীড় করেছে। পদ্ম তা মুছে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই আফিফ তার হাত আটকে দিয়ে বলল,
“ভালোবেসে বিয়ে করি নি। কিন্তু তোমাকে ভালো মেয়ে ভেবেই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। আমি তো ঠকে গেছি, পদ্ম।”

“না, আফিফ। আমি এতোটাও খারাপ না।”

“তুমি রেনু আর আহির কথা ভাবলে না? এটা কেমন সম্পর্ক!”

“আমার চেয়ে কি এখন আহি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো? আমি আপনার স্ত্রী। আহি কেউ না।”

“রেনু আমার বোন। আহি কেউ হোক না হোক। অন্যায় তো করেছো তুমি। আমার বিশ্বাসটা ভেঙে দিয়েছো।”

“আমি আপনাকে সত্য বলেছি। আপনি একটু আগে কি বললেন, আমি সত্য বললে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে না।”

আফিফ শার্টের হাতায় চোখ মুছে বলল,
“তুমি আমাকে ঠকিয়েছো। পদ্মফুল নাম দিয়েছি তোমার! ফুল ভেবেছি তোমাকে। আর তুমি অপমান করেছো আমাকে।”

আফিফ উঠে দাঁড়াতেই পদ্ম আফিফের পা ধরে বলল,
“আপনি আমাকে ছেড়ে দিলে, আমি নিজের প্রাণ নিয়ে নেবো।”

“নীরবে নীরবে তো তুমি অনেকের প্রাণ নিয়ে নিয়েছো। তুমি তো তাজওয়ারের চেয়েও ভয়ংকর।”

(***)

হ্যারির কপালে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে তাজওয়ার। হ্যারি ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার তা দেখে বলল,
“আ’র ইউ রেডি টু গো টু হেল?”

“ইউ কিল্ড মাই ফ্রেন্ড। আই হ্যাভ এক্সপোসড ইউ।”

“এন্ড আই উইল কিল ইউ, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড হ্যারি।”

“আই ডোন্ট কেয়া’র।”

হ্যারি কথাটি বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, আর তখনই তাজওয়ার তার পিস্তল চালালো।

পরদিন সন্ধ্যায় হ্যারির মৃত শরীরটা হোটেল রুম থেকে বের করলো পুলিশ। স্পষ্ট তাজওয়ারই এই খুন করেছে। কারণ সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ডে তাজওয়ারই শেষবার হ্যারির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকা দেওয়ায় তারা রেকর্ডটা ডিলিট করে দেয়৷ আর শেষমেশ পুলিশও ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে মিডিয়াতে চালিয়ে দেয়। হ্যারির পক্ষে তাজওয়ার ছাড়া কেউই ছিল না। অজ্ঞাত আমেরিকান যুবক হ্যারি। বাবা-মার কোনো পরিচয় নেই। তাজওয়ারের সাথে আমেরিকায় একসাথে পড়াশুনা করেছিল। সেই সূত্রেই তাদের বন্ধুত্ব। এরপর দেশে আসা। তাজওয়ার পোস্টমর্টেমের সুযোগ দেয় নি। মিডিয়ার হুড়োহুড়ির জন্য ঘর থেকে বের হতে পারে নি সে। তার উপর হ্যারির মৃত্যুটাও তাজওয়ারকে কয়েক সপ্তাহ প্রতিটি গণমাধ্যমে আলোচনায় রাখবে। তাই গোপনেই কয়েক সপ্তাহের জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো তাজওয়ার।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯ (১ম ভাগ)||

৯৯।
শেষমেশ রিজওয়ান কবিরের স্বপ্ন পূরণ হলো। গতকাল মন্ত্রীর পদে শপথ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। আর আজ চট্টগ্রাম ফিরে একটা সভার আয়োজন করবেন। এই সুযোগ ব্যবহার করে তিনি সহজে আহিকে নিজের সাথে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারবেন। লাবণি বিকেলে বারান্দায় বসে আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তখনই তার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে এলো একটি নাম। চুনি সেই মুহূর্তে এসে নামটি আর সেই নামের পেছনের ছবিটি দেখে ফেললো। লাবণি ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তড়িৎ গতিতে পাশ ফিরলেন। চুনি চোখ সরিয়ে নিলো আরো সেকেন্ড খানিক আগেই। সে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়ার ভান ধরেছে। লাবণি কফির কাপটা রেখে ফোন হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। লাবণি চলে যেতেই চুনি দুই গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলল,
“তওবা, তওবা, এই কথা তো ছোট আফারে কইতেই অইবো। এতো মজার নিউজ পাইলেই আফা আমারে অস্কার দিবো।”

দুই দিন পর সভা অনুষ্ঠিত হলো। রিজওয়ান কবিরকে নতুন মন্ত্রী হওয়ার শুভকামনা দিচ্ছে সবাই। রিজওয়ান কবির সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে দেশের উন্নতির জন্য কি করবেন, সেই বিষয়ে কিছু নীতিমালা পড়ে শোনালেন। হঠাৎ রিজওয়ান কবিরের মাইক্রোফোন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তিনি কিছুক্ষণ পর পর মাইক্রোফোনটির উপর ঠোকা দিচ্ছেন। কিন্তু তার কথা উপস্থিত কেউই শুনতে পারছে না। রিজওয়ান কবির বিরক্ত হলেন। ব্যবস্থাপকদের মনে মনে ইচ্ছেমতো বকে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু ঠোঁটে তার সরল হাসি। তবে তার হাসিটা স্থায়ী হলো না। তাকে ভীষণভাবে ধাক্কা দিলো হুট করে মাইকে ছড়িয়ে পড়া বাক্যগুলো। রিজওয়ান কবির থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লাবণি বসার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সভায় উপস্থিত মানুষজন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। মাইকে ছড়িয়ে পড়ছে আহি আর রিজওয়ান কবিরের কথোপকথন। যেখানে রিজওয়ান কবির বলেছিলেন,
“তুমি যদি ইলেকশনের পর পর আমার কাছে ফিরে না আসো, তাহলে তোমার মাকে আর জীবিত দেখবে না।”

“আপনি যদি মন্ত্রী হয়েও যান, তবুও আপনাকে ভয় পাই না। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ অসৎ মানুষদের জয়ী হতে দেয় না।”

“এতো বছর তো আমিই জয়ী হয়েছি। তোমার নানাকে সিরাজ খানের সাহায্যে গুম করিয়ে ফেলেছিলাম। জানতে চাও না, কোথায় তিনি? তোমার মাকে বলো, তার বাবার লাশটা যাতে তার বিয়ের কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে থাকা জঙ্গল থেকে তুলে আনে। এতোদিনে হয়তো কঙ্কালটা পাওয়া যাবে।”

রিজওয়ান কবির চমকে উঠলেন। চেঁচিয়ে বললেন,
“বন্ধ করো। মাইকটা বন্ধ করো।”

লাবণি ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। না জানি তিনিও কখন ফেঁসে যান। রেকর্ডিংটা আরো কিছুক্ষণ চলার আগেই মাইক বন্ধ করে দেওয়া হলো। ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে যে ছিল সে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রাদ আর লাবীব মিলেই তাকে বেধড়ক পিটিয়ে মাটিতে ফেলে রেখেছে। রিজওয়ান কবিরের সহচররা গিয়ে তাকে উঠালো। আর তারাই মাইকটা বন্ধ করলো।

রিজওয়ান কবির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সভার দুই পাশে চেয়ার রাখা। মাঝখানে লাল কার্পেটের রাস্তা। কার্পেটে ফুলের পাপড়ি ছিটানো। আহি দৃঢ় পা ফেলে কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। পেছনে সালমা ফাওজিয়া দাঁড়ানো। আহি সভার মঞ্চে উঠে উপস্থিত জনসাধারণের দিকে তাকালো। রাদ একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আহিকে দিলো, আর তার হাতে একটা ছোট মাইক। অন্তত সভায় উপস্থিত মানুষদের কানে যাতে আহির বলা শব্দগুলো পৌঁছায়। আহি বলল,
“এই হলো, আপনাদের পছন্দে নির্বাচিত হওয়া দেশের রক্ষক। আদৌ কি এই লোকটা দেশের রক্ষক হতে পারে?”

রিজওয়ান কবির আহির বাহু চেপে ধরে বললেন,
“তোমাকে আজকের কাজটার জন্য অনেক কিছু দেখতে হবে।”

আহি মাইক্রোফোন রাদের হাতে দিয়ে বলল,
“আপনার মতো বোকা, আমি এই জীবনে দ্বিতীয়টা দেখি নি। আপনি অতীতে যা করেছেন, আমার সাথে, মায়ের সাথে, সব আপনার ইগো হার্ট হয়েছে বলে করেছেন। দাদার সাথে রাগ করে আপনি এতোগুলো জীবন নষ্ট করেছেন। একটা মানুষ ভালোবাসা ছাড়া থাকতে পারে না। আপনি কাউকে ভালোবাসেন না, এমন তো নয়।”

আহি লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসেন। কিন্তু যেদিন বুঝবেন, আপনার ভালোবাসা আপনাকে কতোটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে, কতোটা হিংস্র বানিয়েছে, সেদিন নিজের ভালোবাসায় ঘৃণা জন্মাবে। আপনি আমার মাকে ঠকিয়েছেন। ঠকিয়ে অন্তত একজনকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসেছেন। কিন্তু যারা ঠকায়, তাদের শাস্তি ঠকেই হয়। আপনাকে আইন শাস্তি দেবে না। আপনি নিজেই নিজেকে সেই শাস্তি দেবেন।”

রিজওয়ান কবির রাদের কাছ থেকে মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“এই কণ্ঠ আমার এর প্রমাণ কি? আজকাল প্রযুক্তি এতো উন্নত হয়েছে, এসব মিথ্যে ভয়েস রেকর্ডে কোনো কাজ হবে না।”

আহি মাইক্রোফোনটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“যদি আমি সবাইকে সেই ভয়েসের আড়ালে থাকা ভিডিওটা দেখাই?”

রিজওয়ান কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“তুমি ভিডিও বানিয়েছো!”

“আমাকে কি এখনো সেই ভীত-সন্ত্রস্ত আহি ভেবেই বসে আছেন? আমি আপনার কাছ থেকে এতো বড় ধাক্কা খেয়ে উঠেছি, মৃত্যুর মতো ভয়ংকর মুহূর্তকে এতোটা কাছ থেকে দেখেছি, আপনি তো তার সামনে কিছুই না। আপনার মতো শ’খানেক রিজওয়ান কবির আসুক, এখন আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”

রিজওয়ান কবির হনহনিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে সালমা ফাওজিয়ার মুখোমুখি হলেন। সালমা ফাওজিয়া রাগী স্বরে বললেন,
“আমার বাবার হত্যাকারীকে আমি ছাড়বো না।”

রিজওয়ান কবির তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“একটা রেকর্ডিং, আর একটা ভিডিও আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি এখন মন্ত্রী।”

কথাটি বলেই তিনি চলে গেলেন। এদিকে রাদ আহির পাশে এসে বলল,
“আন্টি তো কেইস করবেই।”

“হুম, কিন্তু কিছু হবে না। বাবার দুর্বলতা লাবণি মেহেরা। আগে ওটাকে শিক্ষা দিবো, তারপর বাবা আপনা-আপনি নিজের ভুল বুঝতে পারবে।”

“বাবা বলছিস?”

আহি রাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এই মানুষটাই আমার কাছে একটা সময় হিরো ছিলো। খুব কম সময়ই তো হলো তার রূপ পরিবর্তন হয়েছে। আমার জীবনের আঠারো বছরে একবারো মনে হয় নি, আমার বাবা আমাকে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে। শেষ কয়েকটা বছর কি আঠারো বছরের ভালোবাসার কাছে হেরে যাবে? আমি সত্যিই তাকে ভালোবাসি। বাবার সাথে আমি যুদ্ধ করছি না। উনার ভেতরের নিকৃষ্ট আত্মাটার সাথে আমার যুদ্ধ। একবার সেই আত্মা মুক্তি নিক। ভালো আত্মাটা জেগে উঠুক। আমি আমার পরিবার ফিরে পাবো। বাবা, আমি আর মা।”

“আংকেল-আন্টির ডিভোর্স হয়ে গেছে, আহি।”

“আমার বাবা-মা হয়ে থাকার পরিচয়টা তো হারিয়ে যায় নি।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯ (২য় ভাগ)||

১০০।
বেশ কয়েকদিন ধরেই আফিফ দেরীতে বাসায় ফিরছে। চুপচাপ হয়ে গেছে সে। পদ্মের সাথে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলছে না। পদ্মের এসব সহ্য হচ্ছে না। যাকে পাওয়ার জন্য সে এতো বড় দুঃসাহসিক কাজ করেছে, আজ সেই মানুষটাই তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আহির ক্ষতি করার কথা সে জীবনেও ভাবে নি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল, আফিফকে না পেলে সে সুখী হবে না। এজন্যই তাজওয়ারকে সাহায্য করেছিল পদ্ম।

আফিফ রান্নাঘরে এসে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনে পদ্ম দৌঁড়ে গেলো। দেখলো আফিফ কিছু একটা খুঁজছে। পদ্ম আফিফের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে বলুন না, কি লাগবে। আমি খুঁজে দিচ্ছি।”

আফিফ চুপ করে রইল। পদ্ম আফিফের হাত স্পর্শ করার আগেই আফিফ সরে দাঁড়ালো। তখনই তারা দেখলো রান্নাঘরের বাইরে আফিফা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। আফিফা বেগমকে দেখে আফিফ বলল,
“মা, তুমি? চা খাবে?”

আফিফা বেগম বললেন,
“তুই এখানে কি করছিস?”

“চা বানাতে এসেছি।”

“তুই কেন চা বানাবি? পদ্ম আছে না?”

“আমার বানাতে ইচ্ছে করছিল।”

আফিফা বেগম পদ্মের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি আমার ছেলেকে রান্নাঘরে কেন ঢুকতে দিলে? সারাদিন কাজ করে এসে ক্লান্ত হয়ে যায় আমার ছেলেটা। যাও, আফিফ আর আমার জন্য কড়া করে দুই কাপ চা বানিয়ে আনো।”

পদ্ম মাথা নেড়ে বলল, “জ্বি, আচ্ছা।”

পদ্ম যেন এই সুযোগটাই চাচ্ছিলো। সে ক্ষিপ্র গতিতে দুই কাপ চা বানিয়ে আফিফের সামনে এনে রাখলো। আফিফ এক কাপ মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। পদ্ম আফিফের চলে যাওয়া দেখে সেও তার পিছু পিছু গেলো। আফিফা বেগম পদ্ম আর আফিফের মধ্যে চলা শীতল সম্পর্ক আন্দাজ করতে পেরে মনে মনে খুশি হলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
“এবার অন্তত আমার ছেলেটা একটা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিক।”

এদিকে আফিফ বারান্দায় গিয়ে বসতেই পদ্ম তার পাশে এসে বসলো। আফিফ চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“আপনি বলেছিলেন, সত্যটা স্বীকার করলে আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”

আফিফ কোনো উত্তর দিলো না। পদ্ম আফিফের গালে হাত রেখে বলল,
“আহিকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু আপনার চেয়ে বেশি না। আপনারও কি উচিত না, আমাকে আহির চেয়ে বেশি ভালোবাসা।”

আফিফ এবার ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আমি আপনার স্ত্রী।”

“তুমি আমার স্ত্রী কীভাবে হয়েছো? আমাকে ঠকিয়ে, আমার সাথে প্রতারণা করে। এখন আমাদের সম্পর্কটাই তো মিথ্যে হয়ে গেছে।”

“কিন্তু তবুও আমি আপনার স্ত্রী।”

আফিফ কাপটা ধপ করে বারান্দার মেঝেতে রাখলো। পদ্ম কেঁপে উঠে বলল, “মা শুনবে।”

আফিফ রুমের ভেতরে যেতে চাইলেই পদ্ম তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”

“তুমি যদি আমাকে সেই দিনটা ফিরিয়ে দিতে পারো, তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো।”

পদ্ম আফিফকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“সেই দিনটা মানে? কোন দিনটা? আপনি কি আবার আহিকে ফেরত চাচ্ছেন?”

“আমি আহিকে চাচ্ছি না। আমি সেই দিনটা চাই, যেদিন তোমার চোখ, তোমার হাসি, তোমার কথাবার্তা দেখে মনে করেছিলাম, তোমার মতো ইনোসেন্ট মেয়ে হয়তো আল্লাহ খুব কম বানিয়েছেন। কিন্তু এখন যদি সেই দিনটা ফিরে পাই, আমি আবার ভালোভাবে তোমাকে দেখতে চাই। জানতে চাই, কি এমন ভুল ছিল আমার চোখে যে আমি তোমার অভিনয়টাই ধর‍তে পারলাম না।”

পদ্ম চুপ করে রইলো। আফিফ বলল,
“তুমি তো আগে থেকেই সব জানতে! তাহলে অজ্ঞ থাকার জন্য তুমি ঠিক কি কি অভিনয় করেছিলে, বলবে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তোমার মধ্যে কোন সত্তাটা সত্য, কোনটা মিথ্যে। তোমাকে আমি চিনতেই পারছি না, পদ্ম। আমাদের সংসারটাই তুমি মিথ্যে দিয়ে শুরু করেছো। পাঁচ বছরের সংসার আমার কাছে এক মুহূর্তেই মিথ্যে হয়ে গেছে। আমি এই সম্পর্কে আর কোনো আগ্রহ পাচ্ছি না।”

“আপনি বলেছিলেন, আপনি আমাকে ছাড়বেন না।”

“ছাড়বো না বলেছিলাম। কিন্তু তোমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। পারবোও না। বিশ্বাস ছাড়া বাকি জীবন কাটানো খুব কষ্টকর হয়ে যাবে। আর হয়তো এটাই আমার শাস্তি। তোমাদের দুই বান্ধবীর সাথে দেখা হওয়ার শাস্তি। বিনা অপরাধে তুমি আর ওই তাজওয়ার খান মিলে ইচ্ছেমতো কিছু মানুষকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছো। আমাদের জীবনটা কি তোমাদের বাবার নামে লেখা ছিল?”

“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আগে তো কখনো এভাবে আমার সাথে কথা বলেন নি!”

“তখন কি জানতাম, তুমি কি কি করেছো আমার সাথে?”

“কি করেছি আমি? শুধু আপনার ডায়েরী পড়েছি। আহিকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য তাজওয়ারকে আপনার ভালোবাসার কথা জানিয়েছি। তাজওয়ার তো আহির কোনো ক্ষতি করতো না। ও শুধু আপনাকে ভয় দেখিয়েছিল। আর রেনুর ব্যাপারে আমার জায়গায় আহি থাকলে একই কাজটাই করতো।”

“কখনো না। আহি আর তোমার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। মেয়েটা তোমার জন্য নিজের আবেগটা কীভাবে ধরে রেখেছে, তুমি ভাবতেও পারবে না। কি করে নি সে? একবারো আমাকে এসে বলে নি, পদ্মকে ছেড়ে দিয়ে আমার হাত ধরো। একবারো বলে নি। ও যদি সত্যটা জানে, ঘৃণা করবে তোমাকে। ইনফ্যাক্ট, আহি ঘৃণায় কর‍তে জানে না। ও তো তোমাকে ক্ষমা করে দেবে। সে তো আবার মহানুভবতার জ্বলন্ত মূর্তি! তবে একটা কথা কি জানো, ওর মতো একটা মেয়েকে ফ্রেন্ড হিসেবে অন্তত তুমি ডিজার্ভ করো না। তোমার ভাগ্যটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের ভালো, তাই আহির মতো একটা বান্ধবী পেয়েছো। আহির জায়গায় তুমি থাকলে আমার সংসার যেদিন মা ক্যাম্পাসে গিয়েছিল, সেদিনই ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল। মেয়েটা তোমাকে ঊর্ধ্বে রাখার জন্য, মায়ের সামনে নিজেকে ছোট করেছে। মাকে বুঝিয়েছি, সে পদ্মের মতো নম্র, ভদ্র, শালীন ঘরের মেয়ে নয়। সে তোমার চরিত্রকে ফুলের মতো দেখানোর জন্য রাদকে জড়িয়ে ধরে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।”

“আর আপনার সেটা ভালো লাগে নি।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ভালো লাগে নি। একদম ভালো লাগে নি। আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে সুখী দেখতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু উৎশৃঙ্খল দেখতে চাই না।”

“তার মানে আপনি আহিকে ভালোবাসেন?”

“তুমি না আমার ডায়েরী পড়েছিলে? তুমি তো সব জেনে গেছো। এখন আবার এমন অভিনয় করছো কেন?”

“আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”

“ভালোবাসতাম। এখন আমার দায়িত্ব তুমি, তাই আহির প্রতি ভালোবাসা দেখানোর আমার কোনো অধিকার নেই। আমি আমার ভালোবাসা নোংরা কর‍তে চাই না। তোমাদের মতো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজের ব্যক্তিত্বকে নিচে নামানোর ইচ্ছে আমার নেই। যাকে পাওয়ার ক্ষমতা নেই৷ তাকে ধরে রাখি না আমি। আহির প্রতি মায়া আমার এখনো আছে। মায়া থাকার অর্থ এই না যে আমি ওর সাথে প্রেম করবো, নোংরামি করবো, তোমার আড়ালে গিয়ে ওর সাথে ঘুরাঘুরি করবো। মায়া মানে যত্ন করা, তার ভালো চাওয়া, তার বিপদে সাহায্য করা। তোমাকে কেন বলছি এসব? তুমি কি বুঝবে মায়া আর ভালোবাসা। তোমার আর তাজওয়ারের মধ্যে মায়া আর ভালোবাসা নেই। জেদ আছে। শুধুই পাওয়ার জেদ। আর ভালোবাসা মানে ত্যাগ কর‍তে জানা।”

(***)

সুনেহরাহ লিনাশার হাতে লাবণির কিছু গোপন তথ্য দিয়ে বলল,
“এখানে সব আছে। ফাইলস, রেকর্ডিং সবটাই। লাবণি মেহেরা অনেক ছেলের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত ছিলো। আর এখন তার নতুন বয়ফ্রেন্ড তাজওয়ার খান।”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির সাথে তো তাজওয়ারের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।”

“হ্যাঁ, কিন্তু লাবণি মেহেরা তো বিয়ের করার জন্য কারো সাথে সম্পর্কে যায় নি। জাস্ট ইনজয়…”

লিনাশা সুনেহরাহকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাদের কাছে যেসব সম্পর্ক সো কল্ড ইনজয়মেন্ট, অনেকের কাছে সেই সম্পর্ক জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তোমাদের মতো মেয়েরা ছেলেদের সিডিউস করে তাদের চরিত্র নষ্ট করবে আর তাদের সংসারও ভাঙবে। তবে আমি তাজওয়ারকে ভালো বলবো না। খারাপ হওয়ার থাকলে মেয়েদের এক ইশারায় ছেলেদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আর যারা আলটিমেট ভালো, তাদের সামনে হাজার বার কোমড় দুলিয়ে গেলেও তোমাদের মতো চিপ ক্যারেক্টরের মেয়েদের দিকে তারা চোখ তুলে তাকাবে না। আর তোমরা পাবেও তোমাদের মতো চিপ ম্যান।”

সুনেহরাহ চোখ-মুখ শক্ত করে লিনাশার কথা হজম করে যাচ্ছে। লিনাশা ধমকের সুরে বলল,
“যাও। তোমার প্রেম লীলা আপতত আমাদের কাছেই থাকুক। যতোদিন লাবণিকে এই প্রমাণগুলো দ্বারা ফাঁসাতে না পেরেছি, তোমাকে তোমার কুকর্ম থেকে মুক্তি দেওয়া যাচ্ছে না। বলা তো যায় না, আমরা তোমার কুকর্মের সব তথ্য তোমাকে দিয়ে দিলাম, আর তুমি অনেস্ট চামচি হয়ে তোমার সো কল্ড ম্যাডামকে আমাদের কথা বলে দাও। যাও এবার। তোমার মুখটা দেখার রুচি চলে গেছে।”

সুনেহরাহ ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলো। দরজার কাছে গিয়ে সে পেছন ফিরে বলল,
“তাজওয়ার আর লাবণি ফিজিক্যালিও ইনভলভড।”

লিনাশা চমকে সুনেহরাহর দিকে তাকালো। সুনেহরাহ বলল,
“তাজওয়ার খান তার একটা বাংলো বাড়ি লাবণির নামে করে দিয়েছিলো। ওখানে তাদের প্রায়ই যাওয়া হয়। ক্লাবে যাচ্ছে বলে, লাবণি মেহেরা সেখানেই যায়।”

সুনেহরাহ কথাটি বলেই চলে গেলো। লিনাশা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। কেমন অস্থির লাগছে তার। লাবণির বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণগুলো টেবিলের উপর রেখে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি কখন থেকে এতো খারাপ হলে আপু? আমার আপু তো এতোটা খারাপ ছিল না। নিজেকে তোমার বোন বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা করছে। আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকেরা যখন জানবে, আমার বড় আপু এতো নীচ চরিত্রের, আমাকে কি একটুও কথা শুনতে হবে না? লোকে কি বলবে না, একই মায়ের সন্তানে এতো পার্থক্য কীভাবে? ওরা কি আমাকেও সন্দেহ করবে না? নায়ীব কি আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস কর‍তে পারবে? কখনো কি একটুও খোঁচা খেতে হবে না? তুমি শুধু নিজেকে কলঙ্কিত করো নি, আপু। আমাকে ডুবিয়েছো, বাবা-মার সম্মানও ডুবিয়েছো। কেন এমন পালটে গেলে তুমি?”

(***)

তাজওয়ারের দেশে আসার খবরটা আফিফ পেয়ে গেছে। দেশে এসে সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। তাজওয়ার খুব বাজে একটা পরিকল্পনা করেই যে দেশে এসেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত আফিফ। যে করেই হোক এক সপ্তাহের মধ্যে তাজওয়ারকে গ্রেফতার করাতে হবে। নয়তো সে যে কারো ক্ষতি করতে পারে। আফিফ নিলয়ের সাহায্যে অনেক গবেষণার পর বের করলো তাজওয়ার তার নতুন বাংলো বাড়িতে উঠেছে। জায়গাটা কাপ্তাইয়ের কাছাকাছি। নিলয় বলল,
“পাশেই বিজিবি ক্যাম্প আছে। একটু রিস্কি হয়ে যাবে৷ তুই এই বাইক নিয়ে ওখানে যেতে পারবি না। কারণ তাজওয়ার কিন্তু আগেই সেই কালো বাইকারের উপর কেইস করে রেখেছে।”

“আমি জাস্ট যাবো, আর জেনে আসবো ও ওখানে কি ষড়যন্ত্র করছে।”

“অনেক সিকিউরিটি। ফেঁসে যাবি তুই।”

“কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ। তাজওয়ার মুহূর্তেই যে কোনো কিছু করতে পারে। ওকে আগে থেকেই হাতে রাখতে হবে।”

“আর তোকে কে বলেছে ওখানে গেলেই তুই সব তথ্য পাবি?”

“অন্তত দেখে আসা যায়।”

“কি দেখবি গিয়ে?”

“আমার মনে হচ্ছে ও যেহেতু ওখানে গেছে, নিশ্চিত ওখানে কিছু একটা থাকবে যেটা অত্যন্ত গোপনীয়৷ আর বিজিবি ক্যাম্প পাশের রাস্তায়। ওর বাংলোটা আরো আগে। কিছু হবে না।”

“আর ওখানে ওর বডিগার্ডরা!”

“আগে যাই। এরপর বুঝবো ভেতরে কীভাবে ঢুকতে হবে। না গিয়ে তো আর আন্দাজ করতে পারছি না৷ আর ওই জায়গাটা সেইফ। তাজওয়ার হয়তো ওতো সিকিউরিটি রাখবে না। কারণ প্রটেকশন দরকার এমন জায়গায় ওর সিকিউরিটি খুব দুর্বল।”

“কেন? ও কি মনে করে কেউ ওর ক্ষতি করবে না?”

“ওভার কনফিডেন্স আছে তাজওয়ারের। ও মনে করে একমাত্র ওর মাথায় মগজ আছে। বাকিরা গরু।”

“তুই গরুই তো ছিলি। এতো বছর কিছু করিস নি।”

আফিফ চোখ ছোট করে নিলয়ের দিকে তাকালো। বলল,
“আমি দুর্বল ছিলাম। আমি স্বীকার করতে বাধ্য, আমার মনের জোর কম ছিল। কিন্তু আমি জানি না, সেদিন আহিকে দেখে আমার কি হয়েছিল। সেদিন ও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে শুনেই আমার আমিটাই পরিবর্তন হয়ে গেলো। মনে অদ্ভুত রকমের সাহস জন্মালো। ভেবে নিয়েছি, এবার আমি মরে গিয়েও ওই তাজওয়ারের হাত থেকে আহিকে মুক্ত করে যাবো। আর কোনো কিছুর পরোয়া করবো না। কারণ আপার জায়গায় আমি আর কাউকে দেখতে চাই না।”

“আহিকে এখনো ভালোবাসিস?”

আফিফ নিলয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় তার একমাত্র বন্ধু, যাকে সে আহির ব্যাপারে হালকা জানিয়েছিলো। পুরোটা জানানোর আগেই সে আহিকে হারিয়ে ফেলেছিল। নিলয় এর অনেক পরেই আহির জন্য আফিফের জীবনে আসা ভয়ংকর অধ্যায়গুলো সম্পর্কে জেনেছিল। ততোদিনে পদ্ম আফিফের স্ত্রী। পদ্মকে ভাবী হিসেবে বেশ পছন্দ নিলয়ের। তবে আফিফ এখনো পদ্মের সত্যটা কাউকে জানায় নি। জানাতে পারবেও না। কারণ শত খারাপ হলেও পদ্ম এখনো তার স্ত্রী।

(***)

রাদকে না বলে আহি একাই চলে এসেছে কাপ্তাই। রাদ ইদানীং একটু বেশিই আধিপত্য বিস্তার কর‍তে চাইছে আহির উপর। দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে আহির পাশে থাকতে চাইছে। কিন্তু আহি রাদকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতেই পারছে না। রাদের স্পর্শে শান্তি পাচ্ছে না সে। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দ্বিধাদ্বন্ধ বুঝতে পেরে বলেছিলেন, আপতত বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না তার। আগামী কয়েক বছরেও তিনি বিয়ের জন্য আহিকে চাপ দিবেন না। আহি প্রশান্তির হাসি হেসে সালমা ফাওজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“আমি কখনোই বিয়ে করতে চাই না। আমার মনটা এখন মৃত সাগর। এখানে শুধু ভাসা যায়৷ ডুবা যায় না। এই মনে একজনকে ডুবিয়েই তো এর মৃত্যু ঘটিয়েছি। কেউ চাইলেই কি সেই অনুভূতির গভীরতা স্পর্শ করতে পারবে? কিন্তু আমি রাদকে বন্ধু হিসেবে অনেক ভালোবাসি। আমার জন্য অনেক করেছে ছেলেটা। তাই আমি কি এই মনটা আরেকটু মেরে ফেলতে পারি না ওর জন্য? তুমি তো বাবার সাথে কম্প্রোমাইজ করে অনেক বছর সংসার করেছিল। আর রাদ তো মানুষ ভালো।”

কথাটি শুনেই আহির ভেতরের তীব্র দহন উপলব্ধি করলো সালমা ফাওজিয়া। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“একা থাকো। তবুও এমন কাউকে জীবনে এনো না, যাকে ভালোবাসা যায় না। তার চেয়ে একা থাকো, ভালো থাকো। মানসিক তৃপ্তি পাবে। আমি তো আছিই তোমার পাশে। আবার যদি সেই ভালোবাসা খুঁজে পাও, সেদিন আমিই তোমার বিয়ে দেবো। আহি, একদিন তুমি আবার ভালোবাসবে। নতুন করে ভালোবাসবে। তখন আর কেউ তোমাকে আটকাবে না। না তাজওয়ার খান, না তোমার বাবা।”

এদিকে লিনাশার কাছ থেকে তথ্য নিয়েই কাপ্তাই এসেছে আহি। কাপ্তাইয়ে তাজওয়ারের একটা বাংলো বাড়ি আছে। যেখানে সে লাবণিকে নিয়ে এসেছে। চুনিকে ফোন করে জেনে নিয়েছে লাবণি এখন বাসায় নেই। সে না-কি তার বান্ধবীদের নিয়ে তিন দিনের ভ্রমণে বের হয়েছে। কয়েক দিন আগে চুনি তাকে ফোন করে বলেছিল, লাবণির ফোনে না-কি তাজওয়ারের কল এসেছে। তাজওয়ারের নাম সেইভ করা ছিল হার্ট দিয়ে। ইংরেজিতে ছিল তাই চুনি পড়তে পারে নি। তবে আহি তাকে ইংরেজি বর্ণমালা চিনিয়েছিল। তা দেখেই সে আহিকে বলেছিল, সেই নামটিতে এইচ ই এ আর টি এই বর্ণগুলো ছিল। আর পেছনে তাজওয়ারের ছবি। আহি শুনেই লাবণি আর তাজওয়ারের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আর সুনেহরাহ বলার পর যেন মাত্রাতিরিক্ত নিশ্চিত হয়েছে। তাজওয়ার আর লাবণির সম্পর্ক যে এতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে সেটা ভাবতেই পারে নি আহি। আর যাই হোক, লাবণি আহির বাবার স্ত্রী। সেই সূত্রে তার সৎ মা। তার বাবার সম্মান। আহির এবার লাবণির সত্যটা তার বাবাকে দেখাতেই হবে। তাই সে কাপ্তাই চলে এসেছে, তাদের হাতেনাতে ধরে তার বাবার সামনে লাবণির মুখোশটা উঠানোর জন্য।

(***)

বিকেলেই বাংলো বাড়ির কাছে চলে এলো আহি। গাড়ি নিয়ে আসে নি। সিএনজি থেকে অর্ধেক রাস্তায় নেমে ড্রাইভারটির নম্বর নিয়ে নিয়েছিলো সে। প্রয়োজন হলে ফোন করবে বলে বিদায় করেছিল তাকে। এরপর হেঁটে হেঁটেই বাংলো বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো। পাশে ঘন জঙ্গল। গেট টপকে যাওয়া অসম্ভব। গেটের কাছেই পাহারাদার। তাদের হাতে বন্দুকও আছে। আহি পাশের জঙ্গলে ঢুকলো। সে জঙ্গল ঘুরে বাংলো বাড়ির সীমানায় এসে দাঁড়ালো। কয়েক ফুট উঁচু দেয়াল। এই দেয়াল টপকানোর জন্য পায়ের জুতো খুলে অনেক কারসাজি করে আহি দেয়ালের উপর উঠলো। দেয়ালের উপর সূচালো ফলার মতো গ্রিল লাগানো। আহি শক্ত করে ওইগুলো ধরে উঠে দাঁড়ালো। এরপর নিজেকে সূচালো ফলা থেকে বাঁচিয়ে লাফিয়ে পড়লো অন্য সীমানায়। এদিকে পাহারা দেওয়ার কেউ নেই। আহি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সিসি ক্যামেরাও কোথাও লাগানো নেই। পাহারাদাররা পাহারা দিচ্ছে শুধু গেটের কাছেই। আহি ভালোভাবে নিজেকে ঝোপঝাড়ে আড়াল করে রাখলো। অন্ধকার হলেই ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে ঢুকবে। এদিকে কয়েক ঘন্টা কেটে গেলো। সন্ধ্যা নামতেই আহি ভেতরে ঢুকলো। পেছনের জানালা হাতিয়ে হালকা ফাঁকা জায়গা পেয়েই বাড়ির ভেতরে চোখ দিলো আহি। ভেতরে তাকাতেই আহির লোম দাঁড়িয়ে গেলো। লাবণি মেহেরা একটু বেশিই খোলামেলা পোশাক পরেছেন। আহি চাইলে এখুনি ভিডিও করতে পারে। কিন্তু সে আশেপাশে তাজওয়ারকে দেখছে না। আর তাজওয়ার সহ ভিডিওতে না এলে তার বাবা কখনোই তার কথা বিশ্বাস করবে না। ভেতরে ঢুকার কোনো ব্যবস্থায় নেই। পাশে একটা পানির পাইপ আছে। ওটা বেয়ে বারান্দায় যাওয়া যাবে। আহি অনেক ভেবে সেই পাইপটা বেয়ে উপরে উঠলো। বারান্দায় উঁকি মার‍তেই বুঝলো এই রুমে কেউ থাকে না। আহি রুমে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। সাবধানে রুমের দরজা খুললো। ধীরে ধীরে রুমের বাইরে মাথা বের করে দেখলো উপরের তলায় কেউ নেই। আহি হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এসে নিচে তাকালো। দেখলো তাজওয়ার বিশ্রীভাবে সোফায় শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি টিভির স্ক্রিনে। লাবণি দু’টি কাপ হাতে নিয়ে তাজওয়ারের পাশে বসলো। তাজওয়ার লাবণির স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিচ্ছে। স্পষ্ট ভাবে লাবণির চেহারা বোঝা যাচ্ছে। আহি ক্যামেরা বের করে তাদের প্রেমলীলা রেকর্ড করে নিলো। মনে মনে হাসলো আহি আর বলল,
“তুমি তো গেছো লাবণি মেহেরা। এতো বড় ফিল্ম রিলিজ হলে, তুমি তো সুপারস্টার হয়ে যাবে। আর আমি আমার প্রথম হিট ফিল্মের জন্য এওয়ার্ড পাবো। ওয়াও।”

আহি ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকানোর মুহূর্তেই লাবণির দৃষ্টি উপরে গেলো। আহির চেহারা না দেখলেও সে কারো হাত স্পষ্টভাবে খেয়াল করেছে। লাবণি অস্থির হয়ে পড়লো। ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কে ওখানে?”

তাজওয়ার তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো। এদিকে আহি বুঝতে পারলো লাবণি তাকে দেখে ফেলেছে। সে ভয় পেয়ে গেলো। দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে পাশের রুমে ঢুকে পড়লো। ভেতরে ঢুকে বারান্দার কাছে যেতেই খেয়াল করলো, রুমের দরজাটা সে বেখেয়ালিতে জোরে বন্ধ করে ফেলেছে। এদিকে রুমের দরজা জোরে বন্ধ হওয়ায় তাজওয়ার আর লাবণি বুঝে ফেললো উপরে কেউ আছে। তাজওয়ার দেরী না করে দ্রুত জামা গায়ে দিয়ে তার ড্রয়ার থেকে পিস্তল বের করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আর লাবণিকে বলল, উপরে উঠে দেখতে। আহি ততোক্ষণে লাফিয়ে নিচে নেমে এসেছে। লাফিয়ে পড়তেই পা মুচড়ে গেছে আহির। জোর পাচ্ছে না হাঁটার। এদিকে তাজওয়ার চেঁচিয়ে পাহারাদারদের বলল, বাড়িতে কেউ ঢুকেছে। আহির কানে সব শব্দ আসছে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে তার। কোনোভাবে সে সরে জঙ্গলের দিকে যেতেই তাজওয়ার সেখানে চলে এলো। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় শুধু অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। তাজওয়ার পিস্তল তাক করে ইচ্ছেমতো গুলি ছুঁড়তে লাগলো। আহি দৌঁড়ে ঝোপঝাড়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না। হঠাৎ কোমড়ে কারো স্পর্শ পেলো আহি। কিছু বলার আগেই সে অনুভব করলো তাকে কোলে নিয়ে কিছু একটা বেয়ে উঠে যাচ্ছে একটা মানুষ। আহি শব্দ করলো না। দেয়ালের এপাড়ে এসে অন্ধকারেই বেঁধে রাখা রশিটা টেনে তুললো হেলমেট পরা এক যুবক। আহি কিছু বলার আগেই গোলাগুলির শব্দ বাড়লো। জঙ্গলের দিকেই তাজওয়ারের পাহারাদারগুলো এগিয়ে আসছে। আহি কিছু বুঝে উঠার আগেই পাশের যুবকটি তার হাত ধরে দৌঁড়াতে লাগলো। কিছুদূর গিয়েই ঢালু পথের কাছে এসেই দু’জনেরই পা ফসকে গেলো। আর তারা ঢালু অংশ বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আহির পা চলছে না। মুচড়ে যাওয়া পায়ের উপর জোর দিয়ে হাঁটায় হয়তো তার পা’টাই অসার হয়ে গেছে। এখন শরীরের কিছু অংশে যেন শুধু আঘাত পাচ্ছে। সে অনুভব করলো একটা হাত তার হাত ধরে তাকে কাছে টেনে আনলো। আহির এবার শুধু পিঠেই আঘাত হচ্ছে। তার হাত দু’টি কারো বুকের সাথে সেঁটে আছে। হেলমেট থাকায় যুবকটি মাথায় আঘাত পাচ্ছে না। সে খুব শক্ত করে আহির মাথাটা তার হাত দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। অনেক দূর গড়িয়ে পড়ার পর হেলমেট পরা যুবকটি নিজের ভারসাম্য ধরতে পারলো। আহি বুঝলো তারা অনেক ধাক্কা খেয়ে ঢালু পথ পার করতে পেরেছে। সে এবার মাথা তুলে যুবকটির দিকে তাকালো। হেলমেট পরা যুবকটি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। এদিকে আহির শরীরে ভীষণ ব্যথা। তবুও সে কষ্ট করে যুবকটির বুকের উপর থেকে নেমে পাশে শুয়ে পড়লো। ঘোলাটে লাগছে সবকিছু। নিভু নিভু দৃষ্টিতে পাশ ফিরে একবার আগন্তুকটির দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

১০১।
শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। হাত-পা অসার হয়ে আছে। মাথাটা নরম কিছুর উপর রাখা। হাত হাতড়ে মাথার নিচে থাকা নরম বস্তুটি স্পর্শ করার শক্তিটুকুও নেই। চোখ খুলতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তবুও চোখ দু’টি খুললো আহি। চোখ খুলতেই দৃশ্যমান হলো একটি পুরুষালী অবয়ব। আহি স্থির দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই মানুষটিও আহির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারে তার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। আহি মাথা তুলতেই অনুভব করলো তার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। সে অস্ফুটস্বরে গোঙিয়ে উঠলো। আহির গোঙানির শব্দ শুনেই সেই মানুষটি ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“কোথাও ব্যথা লেগেছে তোমার?”

আফিফের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো আহি। অবয়বটির দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আফিফ তুমি!”

অবয়বটি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
“হ্যাঁ। চিনতে পারো নি?”

“হুড়োহুড়িতে বুঝতে পারি নি। কিন্তু তুমি এখানে কি করছো?”

“আমি একটা কাজে এসেছি। তুমি কেন এসেছো?”

আফিফের প্রশ্নে আহি অনুভব করলো, তার কাঁধে ব্যাগটি নেই। ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লো আহি। উঠে বসতেই আফিফ আহিকে ধরে বসিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”

আহি উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “আমার ব্যাগটা!”

“তোমার ব্যাগটা আমার কাছে আছে। তোমার অস্বস্তি লাগবে ভেবে, আমি ব্যাগটা খুলে নিয়েছি।”

“আচ্ছা, দাও তো ব্যাগটা। ওখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস আছে।”

আফিফ তার হ্যালমেটের খোলা অংশে ঢুকিয়ে রাখা ব্যাগটি বের করে আহির হাতে নিতেই সে ব্যস্ত হাতে ব্যাগের চেইন খুলে ভেতর থেকে ক্যামেরাটি বের করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আফিফ বলল,
“কি ওখানে?”

“আমার মুক্তির স্বাদ।”

আফিফ কিছুক্ষণ আহির দিকে তাকিয়ে রইলো, যদিও অন্ধকারে তার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তবুও তাকিয়ে আছে। মিনিট খানিক পর আফিফ উঠে হেলমেট পরে বলল,
“আমাদের বের হতে হবে। এদিকটা ঘন জঙ্গল। আর বুনো হাতিও থাকতে পারে। ভোর হতে অনেক সময় লাগবে। এখন মাত্র এগারোটা ছুঁই ছুঁই। চলো।”

“এদিকে শুনলাম ডাকাত বেশি।”

“আমি আছি তো!”

আফিফ আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। অন্ধকারে হাতটি আন্দাজ করে আহি সেই হাত স্পর্শ করলো। আফিফ টেনে উঠালো আহিকে। ভালোভাবে দু’পায়ে ভর দিতে পারছে না সে। ঝুঁকে পড়লো আফিফের দিকে। আফিফের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আহির কপালে এসে পড়ছে। আহি সেই নিঃশ্বাসের স্পর্শে জমে গেলো। তার দম আটকে যাওয়ার উপক্রম। আফিফ বলল,
“হাঁটতে অসুবিধে হবে?”

আহি কিছু একটা ভেবে বলল,
“অসুবিধে হলেও তো হাঁটতে হবে।”

আফিফ সেকেন্ড খানিক নিরব থেকে আহিকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিলো। আহি শক্ত করে আফিফের কাঁধ জড়িয়ে রেখেছে। আফিফ সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“তাজওয়ার যদি তোমার উপর গুলি চালিয়ে দিতো?”

“দিলে দিতো।”

“তোমার তো আবার খুব সাহস। হাত কেঁটে প্রমাণ করে দিয়েছিলে।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“আমার কাছে সেদিন আর কোনো পথ খোলা ছিল না।”

“সরি।”

“সরি কেন?”

“সেদিন তোমাকে আটকাই নি।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“আটকে রেখে কি করতে? আমার তো যাওয়ার ছিল। বান্ধবীর স্বামীর বাড়ি কি বেশিদিন থাকা যায়? এক রাতও যেন অনেক বেশি ছিল।”

আফিফের হাঁটার গতি কমে এলো। পদ্মের মুখটা ভেসে উঠতেই মনটা ভারী হয়ে এলো তার। যেই মেয়েটা পদ্মকে এতো ভালোবাসে, সেই মেয়েটা যদি জানে তার প্রিয় বান্ধবী তার সাথে কি করেছে, ভীষণ কষ্ট পাবে। আফিফ নিরবতা কাটিয়ে বলল,
“থাক, যা হওয়ার ভালোই হয়েছে। তোমার সেদিনের সেই ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া, আজ হয়তো তোমাকে অনেক কিছু ফিরিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ভুল সিদ্ধান্ত থেকে মানুষ শিখে, আবার মাঝে মাঝে হেরে যায়। আল্লাহ সহায় ছিলেন, তাই তুমি হেরে যাও নি।”

তারা রাস্তায় উঠে আসলো। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“একটা গাড়িও নেই।”

“থাকলেও কি নিরাপদ হতো? এই মুহূর্তে ড্রাইভারদেরও বিশ্বাস করা যাবে না। অনেকটা পথ এভাবেই পার করতে হবে।”

“তোমার কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”

“না।”

“হলে বলো, আমাকে নামিয়ে দাও।”

“তারপর?”

“আমি হেঁটে যাবো।”

“তুমি কচ্ছপের গতিতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবে, আর একটু পর খেয়াল করবে, আমরা অন্ধকার কক্ষে পৌঁছে গেছি।”

“মানে?”

“ডাকাতের দল তুলে নিয়ে যাবে।”

আহির হুট করে ভয় হলো। সে আফিফের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বলল,
“তাহলে কথা বলো না। চুপচাপ হাঁটো। তোমার কথা শুনে যদি আশেপাশের ডাকাত এদিকে চলে আসে?”

আফিফ চুপ হয়ে গেলো। আহি আঙ্গুল সরিয়ে নিলো। আফিফ আর কথা বললো না। প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর তারা লোকালয়ে প্রবেশ করলো। আশেপাশের সমভূমিতে কারো আনাগোনা নেই। পাহাড়েই বাড়ি। পাহাড়ের উপরে জ্বলছে সোডিয়াম বাতি। আফিফ বুঝলো ওদিকে হয়তো উপজাতিরা থাকে। সাহস করে সে পাহাড় কাঁটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। আহি বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”

“এখান থেকে পায়ে হেঁটে বের হওয়া অসম্ভব। আর আমাদের এতোক্ষণ কোনো ডাকাত পাই নি, এটাই সৌভাগ্য। গাড়ি ছাড়া আমরা দ্রুত এই রাস্তা ছাড়তে পারবো না। আমার বাইকটাও তাজওয়ারের বাংলো বাড়ির অনেক সামনে রেখে এসেছি। ওদিকে গেলে তাজওয়ার ধরে ফেলবে। এতোক্ষণে হয়তো আমার বাইকটা দেখে ফেলেছে।”

“আরেহ, আমার জুতোগুলোও দেখে ফেলেছে হয়তো। লাবণি তো দেখেই চিনে ফেলবে।”

“বাদ দাও। বাকিটা পরে দেখা যাবে। আগে আমরা নিরাপদে শহরে ফিরি।”

“এখন উপরে উঠছো কেন?”

“এদিকে যদি কেউ আমাদের সাহায্য করে! গাড়ি ঠিক করে দেয়, তাহলে তো আজই আমরা শহরে পৌঁছে যাবো। আর এক কাজ করো, তোমরা ক্যামেরাটা একটু আলাদাভাবে নাও। মানে লুকিয়ে রাখো। যদি ওরা আমাদের কাছ থেকে জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়, তোমার ক্যামেরাটা যাতে হাতছাড়া না হয়। তুমি না বললে, ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

“হুম।”

আহি ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল, কোথায় লুকাবে। ক্যামেরাটা ছোট হওয়ায় সহজেই যেকোনো জায়গায় আটকে থাকবে। আফিফ বলল,
“তোমার চুল তো বেশ ঘন। এক কাজ করো চুলে পেঁচিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকে দাও।”

“পড়ে গেলে?”

“পড়বে না। অন্য কোথাও রাখার উপায় নেই। রাখলেও তুমি কমফোর্ট ফিল করবে না। আর ওদের যদি সত্যিই আমাদের জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা থাকে। তাহলে তোমার অস্বস্তি দেখেই বুঝে ফেলবে, তুমি কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছো। তখন আরো সমস্যা হবে।”

“বেশি জানো দেখছি!”

“না একবার স্কুলে একটা মেয়ে নকল নিয়ে এসেছিল। স্যান্ডেলের নিচে স্কচটেপ দিয়ে আটকে রেখেছিল কাগজটা। স্যার মেয়েটাকে হঠাৎ ডাকলো। মেয়েটা অস্বস্তি নিয়ে হাঁটছিল। স্যার দেখেই বুঝে গেলো, ও নকল করবে। ব্যস, ওকে আপাদমস্তক দেখে তার স্যান্ডেলের নিচ থেকে সেই কাগজটি বের করলো। আর আমার আরেক ফ্রেন্ড একই পরীক্ষায় প্যান্টের পকেটে কাগজ নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এমন জায়গায় রেখেছে, যেটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে নি। ভালোই পরীক্ষা দিয়েছে ও।”

আহি হাসলো।

(***)

আফিফ আহিকে নিয়ে পাহাড়ে উঠেই দেখলো এক মধ্যবয়সী মহিলা চাঁটাই বিছিয়ে কাঁথা সেলাই করছেন। আফিফ আর আহিকে দেখে মহিলাটি উঠে দাঁড়ালেন। আফিফ আহিকে নামিয়ে দিয়ে মহিলাটিকে বলল, তারা বিপদে পড়েছে। আর তাদের এই মুহূর্তে যাওয়ার কোনো পথ নেই। এরপর আহির আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলো দেখিয়ে বলল, অন্তত আহিকে যাতে থাকতে দেয়, বা পরিচিত কারো সাহায্য নিয়ে যাতে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়। মহিলাটি ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মহিলাটির স্বামী বেরিয়ে এলেন। তিনি আফিফকে আশ্বস্ত করে বললেন যে আজ রাতেই গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন। তার না-কি পরিচিত সিএনজি ড্রাইভার আছে। সে না আসা পর্যন্ত আফিফ আর আহিকে ভেতরে বসতে বললেন। তারা ভেতরে গেলো। মাটি ও কাঠের তৈরী বাড়ি। মেঝে মাটির, দেয়ালটা কাঠের। আহি আর আফিফ সামনের ঘরটিতে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। দু’জনের দৃষ্টি আটকালো পাশে রাখা কাঠের খাটের দিকে। খাটটিতে একটা মলিন কাঁথা বিছানো। আহির পায়ে এখনো বেশ ব্যথা। পায়ে ভর দিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। আফিফও অনেকক্ষণ হেঁটেছে। তাই তারও এই মুহূর্তে বসা উচিত। ঘরটিতে আর কোনো বসার ব্যবস্থা না থাকায় দু’জনই সেই খাটের উপর বসলো, আর ওমনি খাটটি উলটে দু’জনই ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। আফিফের বুকের উপর এসে পড়েছে আহি। ব্যথায় এমনিতে নড়াচড়া করতে পারছে না, তার উপর আবার উলটে পড়েছে। মনে হচ্ছে শরীরের কলকব্জা সব ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। আহি চোখ বন্ধ করে আফিফের বুকের উপর ভর দিয়ে শুয়ে আছে। আফিফ নিজেও বেশ ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। ঘরের কর্তা তাদের এই অবস্থায় দেখে বললেন,
“এটা বসার জন্য না। আমার বউ এটাতে মরিচ-মশলা শুকায়।”

আফিফ আহিকে উঠানোর জন্য হাত ধরতেই আহি মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো,
“হাতটা এতো শক্ত করে ধরেছো কেন? এমনিতেই ভেঙে গেছে।”

আফিফ আহিকে সরিয়ে কোনোভাবে উঠে আহিকেও উঠালো। ভদ্রলোক পাশের ঘরটি দেখিয়ে দিতেই আফিফ আহিকে ধরে সেদিকে নিয়ে গেলো। রুমটিতে আলো আঁধারীর খেলা। ছোট একটা টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। আহি আর আফিফ পাশাপাশি একটা খাটে বসে আছে। দু’জনই চুপ করে আছে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ তাদের নিরবতাকে স্পষ্ট করে তুলছে। আহি পাশ ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

আফিফ খাট থেকে উঠে বসে বলল,
“তুমি ঘুমাও।”

আহি খাটে পা তুলতে গিয়েই আবার মৃদু আর্তনাদ করলো। আফিফ আহির কাছে এসে তার পা দু’টি আলতো হাতে ধরে খাটের উপরে উঠিয়ে দিলো। আহি নিজের ব্যাগটা মাথায় নিচে রাখলো। আফিফ বলল,
“বালিশটা নাও।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“না, আমি অন্যের বালিশে ঘুমাতে পারি না।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। বালিশটির দিকে তাকিয়ে বুঝলো কেন আহি এই কথা বলেছে। আহি মাথাটা রাখতেই পারছিলো না। আফিফ খাটে বসে তার মাথাটা উঠিয়ে তার কোলের উপর রাখলো। আহি অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ তা দেখে বলল,
“বিপদে পড়লে অনেক কিছু এডজাস্ট করে নিতে হয়।”

আহি আফিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ বলল,
“তুমি না বললে ঘুমাবে?”

আহি চোখ সরিয়ে নিলো। আর কিছু ভাবতে পারলো না সে। অনুভব করার শক্তিটিও নেই তার মনে। ঘুমিয়ে পড়লো আহি। আফিফ ঘুমালো না। সে আহির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাগ্য তাদের এমন এক রাস্তায় নিয়ে এসেছে, যেই রাস্তার কোনো দিক নেই, কোনো সমাপ্তি নেই, কোনো নাম নেই। আফিফ আহির কপালে হাত ছোঁয়াতে গিয়েও ছোঁয়ালো না। একটা চুল লেপ্টে আছে আহির নাক বরাবর। সরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস পাচ্ছে না সে। যদি আহির ঘুম ভেঙে যায়!

ফোন ভাইব্রেট কর‍তেই পকেট থেকে ফোন বের করলো আফিফ। স্ক্রিনে পদ্মের নাম। কল রিসিভ করতেই পদ্ম বলল,
“কোথায় আপনি?”

“একটা কাজে আটকে গেছি।”

“আহির সাথে?”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আহির সাথে এটা জিজ্ঞেস করার কারণ কি? তাজওয়ার নিশ্চয় কিছু বলেছে!”

“হ্যাঁ, আহি আর আপনি কাপ্তাই তাজওয়ারের বাংলো বাড়িতে গিয়েছিলেন।”

“তারপর?”

“আহির জুতা আর আপনার বাইক দেখেছে।”

“হ্যাঁ, তোমার প্রশ্ন শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম।”

“এতো রাতে আহির সাথে কি করছেন?”

“গাড়ি পাচ্ছি না। পেলে বাসায় চলে আসবো।”

পদ্ম চেঁচিয়ে বলল,
“আমার সহ্য হচ্ছে না আফিফ।”

“আমি তো খুব সহ্য করেছি এতোদিন। এখন তুমিও সহ্য করা শিখে ফেলো।”

“আহি নিশ্চয় আপনাকে খুব ভালোবাসা দিচ্ছে, তাই না? এতো রাতে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কিইবা করতে পারে?”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমাকে আমি প্রতিদিন একটু নতুন করেই চিনছি। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে না, আমি পদ্মের সাথে কথা বলছি। আরো আগে যদি তোমাকে চিনতে পারতাম?”

“চিনে ফেললে, কি হতো? সেদিন কক্সবাজারে রাতটা আহির সাথেই কাটাতেন।”

আফিফ ফোন কেটে দিলো। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। যাকে স্ত্রী হিসেবে ভালোবেসেছে, যাকে ফুল ভেবে সম্মান করেছে, সেই মানুষটার এমন রূপ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। আফিফ আহির মাথাটা আস্তে করে সরিয়ে উঠে ঘরের বাইরে চলে এলো।

(***)

ঘুম ভাঙতেই নিজেকে হালকা অন্ধকার ঘরে আবিষ্কার করে ভয় পেয়ে গেল আহি। তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে উঠে বসলো সে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে ডাকলো,
“আফিফ, আফিফ!”

আহি খাট থেকে নামতেই শরীরের ভারসাম্য ধরতে না পেরে পড়ে যাওয়ার আগে আফিফ ঘরে ঢুকে আহিকে ধরে ফেললো। আহি আফিফকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ খেয়াল করলো আহির শরীর কাঁপছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় হয়তো ভয় পেয়েছে। আফিফ আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কি হয়েছে? ভয় পেয়েছো না-কি?”

আহি কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমি ভেবেছি আমাকে ডাকাত তুলে নিয়ে গেছে।”

আফিফ নিঃশব্দে হাসলো। আহি এখন আফিফকে জড়িয়ে ধরে আছে। আফিফ বলল,
“আমরা এখনো আগের জায়গায় আছি। গাড়ি কাছাকাছি চলে এসেছে। গাড়ি চলে এলেই আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।”

আহি এবার আফিফকে ছেড়ে দিল। আফিফকে ছেড়ে দিয়েই তার চোখের দিকে তাকালো। আফিফ চোখ সরিয়ে নিল। এবার দু’জন দু’পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। যেই ভাগ্য তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তাদের কি প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কাছে আসা উচিত? প্রকৃতি যদি চায়, তবেই তারা একে অপরের দিকে উন্মাদ দৃষ্টিতে তাকাবে। যেই দৃষ্টি সরিয়ে ফেলার কোন প্রয়োজন হবে না৷ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যাবে ঘন্টার পর ঘন্টা। যেই মুগ্ধতায় কোনো ভয়, কোনো সংশয় থাকবে না।

চলবে-