উধয়রনী পর্ব-৫৬+ বোনাস ১+২

0
67

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৬||

১১৫।
আজ আহির এ আর টি গ্যালারিতে বিক্রয়ের দিন। মোটামুটি ভীড় জমেছে গ্যালারির সামনে। আজ আহি এসেছে ভিন্ন সাজে। কালো শাড়ি, কালো ঝুমকো, সাজসজ্জা বিহীন, আলগা খোঁপা বেঁধে। আহির দশটা ছবি বিক্রি হচ্ছে, আর বাকি বারোটি অন্যান্য চিত্রকরদের। আহি ক্রেতাদের সাথে তার ছবির বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলছে, তখনই তার দৃষ্টি আটকালো গ্যালারির প্রবেশমুখে। আহি তার সামনে দাঁড়ানো ক্রেতার দিকে তাকিয়ে বিনয়ী হাসি হেসে একটু সময় চেয়ে নিলো। এরপর প্রবেশমুখের কাছে যেতেই কৌতুহলি দৃষ্টিতে আহিকে খুঁজতে থাকা ওয়াসিফ দৌঁড়ে এলো তার দিকে। আহি ওয়াসিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতেই ওয়াসিফ জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি, আজ কি এখানে ইদ হচ্ছে?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“তোমার কেন মনে হচ্ছে ইদ হচ্ছে?”

“মিস বলেছে, ইদ মানে আনন্দ। ইদ মানে খুশি। ইদ মানে নতুন জামা-জুতো। ইদের সময় সবাই অনে-ক অনে-ক নতুন জিনিস কিনতে আসে। বাইরে চিকচিক লাইট জ্বলে।”

আহি হাসলো। ওয়াসিফের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ বাইরে তো চিকচিক লাইট জ্বলছে। কিন্তু আজ তো ইদ না। আর দেখো এখানে সবাই ছবি কিনতে এসেছে। জামা-জুতো এখানে পাওয়া যায় না।”

“আমিও একটা ছবি কিনবো।”

“আচ্ছা?”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াসিফের হাত ধরে তাকে গ্যালারির দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা কয়েকটা ছবির সামনে এনে দাঁড় করালো আর বলল,
“এখান থেকে কোনটা কিনবে?”

ওয়াসিফ আহির হাত ছেড়ে দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো। গালে হাত দিয়ে ভাবুক হয়ে একবার বামে, আরেকবার ডানে কয়েক বার হেঁটে গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার তো ছবিগুলো ভালো লাগছে না।”

আহি ওয়াসিফের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“তাহলে তুমি বলো, কেমন ছবি চাও?”

“আমার ডোরেমন ভালো লাগে। আমাকে ডোরেমনের ছবি এঁকে দেবে?”

আহি গালে হাত দিয়ে বলল,
“ও! বাবুর ডোরেমনের ছবি চায়?”

ওয়াসিফ মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ, হুঁ।”

“আচ্ছা, আমি তোমার জন্য কাল ডোরেমনের ছবি এঁকে নিয়ে আসবো।”

ওয়াসিফ তার কনিষ্ঠ আঙ্গুল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পিংকি প্রমিজ।”

আহি মুখ চেপে হেসে ওয়াসিফের দিকে তার কনিষ্ঠ আঙ্গুল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পিংকি পিংকি প্রমিজ।”

ওয়াসিফের দৃষ্টি আটকালো কাচের দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আফিফের দিকে। ওয়াসিফ সেদিকে তাকিয়ে আফিফকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার মামা।”

আহি সেদিকে তাকাতেই তার এসিস্ট্যান্ট রুবি তার সামনে এসে বলল,
“ম্যাম, কাস্টমাররা আপনার অপেক্ষা করছেন।”

আহি উঠে দাঁড়ানোর আগেই ওয়াসিফ দৌঁড়ে গ্যালারি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আহিকে বলল,
“বাই, আন্টি।”

আহিও হাতের ইশারায় বিদায় দিলো ওয়াসিফকে। এরপর ক্রেতাদের কাছে চলে গেলো। এদিকে ওয়াসিফ বেরিয়ে আসতেই দেখলো আফিফ বুকে হাত গুঁজে মোটর সাইকেলের উপর বসে আছে। ওয়াসিফ তার কাঁধের ব্যাগ দোলাতে দোলাতে আফিফের সামনে এসে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। আফিফ এতো টুকুন বাচ্চা ছেলের গম্ভীরমুখ দেখে বলল,
“আদ্য, মামা, কি হয়েছে তোমার?”

ওয়াসিফ মাথা নেড়ে অভিমানী মুখে বলল,
“মামা, তোমরা আমাকে ডোরেমনের খেলনা কিনে দাও না। আর দেখো, ওই খানের হোয়াইট হোয়াইট আন্টিটা আমাকে কি বলেছে!”

আফিফ ওয়াসিফের সামনে ঝুঁকে বলল, “কি বলেছে?”

ওয়াসিফ এক গাল হেসে বলল,
“আমাকে ডোরেমনের ছবি এঁকে দেবে।”

আফিফ তার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“এখন চলো বাসায়।”

“ভেতরে যাবে না? ভেতরে অনেক সুন্দর। সব হোয়াইট হোয়াইট।”

আফিফ হতাশ দৃষ্টিতে এ আর টি গ্যালারির প্রবেশপথের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, অন্যদিন যাবো।”

আফিফ ওয়াসিফকে মোটর সাইকেলে উঠিয়ে চাবি ঘোরালো। হেলমেট মাথায় দিলো। এরপর একবার পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো আহি বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। পরণে কালো শাড়ি। মৌমাছির মতো লাগছে দেখতে। আফিফ মৃদু হাসলো। সামনে তাকিয়ে চালু করলো মোটর সাইকেল। চলে এলো সেই জায়গা থেকে, আর সম্মুখ দর্পণ পেছন ফেলে আসছে আহির অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব।

(***)

সারাদিনের ধকলের পর গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম আহির চোখে এসে ভীড় করলো৷ ঘুম আসবে আসবে এমন মুহূর্তেই দরজায় কড়া নাড়লো সিস্টার মুরলি। আহি এলোমেলো পোশাকে দরজা খুলে দিতেই মুরলি বলল,
“ম্যাম আপনার সাথে দেখা কর‍তে মিস্টার এন্ড মিসেস লাবীব এসেছেন। তাদের সাথে একটা মেয়ে শিশু আছে। আমরা কি তাদের ভেতরে আসার অনুমতি দেবো?”

“অবশ্যই। ওরা আমার ফ্রেন্ড। ওয়েট আমি ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি। তুমি সুধী আর কথাকে বলো ওদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে।”

“ওকে ম্যাম।”

এদিকে পুষ্প আর লাবীব বাড়ির ভেতরে ঢুকেই বাড়িটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। প্রাসাদের মতো দেখতে আহির বাংলো বাড়ি। স্বচ্ছ মেঝেতে আলোকচ্ছটা এসে পড়ছে। হলঘরটি দেখতে বেশ খোলামেলা। মাঝখান দিয়ে বড় সিঁড়ি। সিঁড়ির পেছনে দেয়ালের সাথে লাগানো কাচের আলমারি। সেখানে স্তরে স্তরে বই সাজানো। মাথার উপর বিভিন্ন রঙের ঝাড়বাতি। একপাশে বসার জন্য সোফাসেট রাখা। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে সোফাসেট ব্যবহার করা হয় না। চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। সোফার পাশে কাঠের আলমারি। আহির তৈরি ছোট ছোট ভাস্কর্য ওখানে স্থান পেয়েছে। অন্যপাশে হয়তো রান্নাঘর। পাশে আরেকটা দরজা। ওখানে হয়তো ডায়নিং। উপরের তলায় দু’টো রুম, আহি আর সালমা ফাওজিয়ার জন্য। তৃতীয় তলায় আহি ছবি আঁকার জন্য বড় একটা রুম করেছে। আর তার পাশের রুমে লাইব্রেরি করেছে মায়ের জন্য। অন্যদিকে চার তলায় ছাদ।

সিস্টার মুরলি সোফার উপর থেকে চাদর সরিয়ে দিয়েই বিনয়ের সুরে বলল,
“ম্যাম, স্যার আমি দুঃখিত। আহি ম্যাম খুব একটা এখানে আসেন না। তাই সবকিছুই এভাবে ঢেকে রাখা।”

পুষ্প হালকা হেসে বলল, “সমস্যা নেই, তুমি যাও।”

পুষ্প এবার পিয়ালীকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে লাবীবকে বলল,
“আমাদের বান্ধবীর যা বড়লোকি ব্যাপার-স্যাপার। আমরা দু’জন চাকরি করেও জীবনে এতোকিছু করতে পারবো না।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“সবটাই ওর সৌভাগ্য। পৈতৃক সম্পত্তি থাকলে পরের দুই প্রজন্ম বসে খাওয়া যায়। আর আমাদের খেটেখুটে পিয়ালীকে বিয়ে দিতে হবে।”

“আর যাই বলো, মেয়েটার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আনতেও দশবার ভাবতে হয়। সবগুলোই ওর যোগ্যতার নিচে। এখন আমাদের সাথে কি কোনো শিল্পপতির পরিচয় আছে, যে ওর জন্য ওমন বাড়ির সম্বন্ধ আনবো?”

“কিন্তু আন্টি তো আমাদের উপরই সব দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছেন।”

পুষ্প হতাশ হয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা বায়োডাটা বের করলো। ছেলের নাম আরবান খান। যথেষ্ট সুদর্শন। নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকায় গাড়ি-বাড়ি আছে। আহির চেয়ে কম হলেও অন্তত আহির ভালো থাকার মতোই অবস্থা। পুষ্পের ইচ্ছে ছিলো না এই সম্বন্ধে। তবুও সে সালমা ফাওজিয়ার কথায় আহির সাথে দেখা কর‍তে এসেছে। সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে সরাসরি বলতে পারছেন না। তাই পুষ্পকে বলেছেন। পুষ্প আহিকে বাসায় আসতে বলেছিল, কিন্তু আহি সেখানে যাওয়ার সময় পাচ্ছিলো না, তাই পুষ্প নিজেই লাবীবকে নিয়ে আহির বাড়িতে এসেছে। পুষ্প মন থেকে চায়, আহি সুখী হোক। আরবান ছেলেটা দেখতে ভালোই। সালমা ফাওজিয়া খোঁজ নিয়েছেন। খারাপ কিছু পান নি। কিন্তু পুষ্পের মাথায় ঘুরছে তার ভাই উজ্জ্বলের চেহারা। সে জানে উজ্জ্বল আহিকে পছন্দ করে। যদিও উজ্জ্বলের সাথে আহির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। কথাবার্তাও তেমন হয় না। আর এমন কিছু না যে আহিকে না পেলে উজ্জ্বল বিয়েই করবে না। তবে সে আহিকে পছন্দ করে। আর তার পছন্দের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

আহি সিঁড়ি বেয়ে নেমে পিয়ালীকে কোলে নিয়ে বসে পড়লো। ইচ্ছেমতো আদর করলো পিয়ালীকে। পুষ্প বলল,
“আমাদের তো দেখছিসই না।”

“চুপ কর, আগে আমি আমার মা’টাকে আদর করি। আমার টুনটুনি বাবু। উম্মাহ।”

লাবীব বলল,
“টুনটুনির খালাম্মা ওরফে ফুফু একবার নিজের দিকেও নজর দিন।”

“বল না। আর তোরা আসবি, সেটা আগেই বলতে পারতি। আমি সব ক্লিন করে রাখতাম।”

পুষ্প আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“সবটাই তো ক্লিন লাগছে।”

“আচ্ছা এসব বাদ দে। কি অবস্থা বল?”

“ভালোই। তোর কি অবস্থা? মাসে একবার এসে চলে যাস, দেখাও করে যাস না। আসিস সেটাও বলিস না।”

“প্রচুর কাজ থাকে। আর তোকে বলি সবসময়। মিথ্যে বলিস না তো। আর বাসায় যাই না, তুই থাকিস না তাই। তোরা দু’জন অফিসে থাকিস। আমি কোথায় পাবো তোদের?”

লাবীব বলল,
“পিয়ালীকে দেখে যেতে পারিস। মায়ের সাথেই থাকে।”

“আচ্ছা, বাদ দে। অভিযোগ রাখ এখন।”

সুধী নাস্তার ট্রে টি-টেবিলের উপর রেখে চলে গেলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“তুই ভালোই মেইড পেয়েছিস। আমি তো টর্চ দিয়ে খুঁজেও পাই না। আর ছোট বুয়া যাদের রাখি, ওদের ফাইফরমাশ তো হাজার খানেক। আসলে যাওয়ার তাড়া। ফাঁকিবাজ সব।”

আহি হাসলো। পুষ্প বলল,
“এদের পরিচিত কেউ থাকলে একটা মেয়ে খুঁজে দিতে বল।”

“এরা এখানের না। একটা আশ্রম থেকে এনেছি। এতিম মেয়ে। ওদের থাকার জায়গা নেই। ওরা এখানে নিজেদের বাসার মতো থাকে। ওদের ওভাবে বলতে পারবো না। তুই চাইলে আমি চিটাগং থেকে একটা এনে দিতে পারবো। মেয়েটাকে আরবি শেখাতে হবে। ওর মা আমার কাছে এসেছিল। এখন আমি তো বাসায় খুব একটা থাকি না। আলাদা আরবি শেখানোর হুজুর বাসায় আসাটা একটু সমস্যা। মুনিয়া খালাও চলে গেছেন চুনির কাছে।”

“তোর বাসায় কাজ করে কে?”

“বুয়া আসে একটা। আমি বাসায় থাকলে ফোন দেই উনাকে।”

লাবীব বলল,
“আচ্ছা, আরবি শেখাবো না হয়। দেখিস তো একটু। অফিস থেকে ফিরে পুষ্পের সব কাজ করতে হয়। মাও অসুস্থ। সব সামলাতে পারছেন না। সামনে লিমনের জন্যও বউ আনার চিন্তাভাবনা করছে।”

“ভালো।”

পুষ্প ভালোই সুযোগ পেলো। বলেই ফেললো,
“লিমনও বিয়ে করে ফেলবে। আর তুই? টুনটুনিকে এতো আদর করিস। নিজের একটা টুনটুনি থাকা ভালো না?”

আহি মলিন হাসলো। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আচ্ছা, লিনাশা আসবে নেক্সট ফ্রাইডে। নায়ীব ভাইয়ার কাজিনের বিয়ে না-কি! মেয়েটাকে কতো বছর দেখি না। দু’জনই জার্মান সেটেল্ড হয়ে গেছে।”

“বিয়ের পর সবাই এমন কাজে-সংসারে ব্যস্ত হয়ে যায়।”

এবার পুষ্প ভনিতা না করে বায়োডাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আন্টি বলেছে, এবার তোকে রাজি করাতে।”

আহি বায়োডাটা একনজর দেখে বলল,
“আরবান খান! শোন, আমি ঢাকায় বিয়ে করবো না।”

লাবীব বিরক্ত হয়ে বলল,
“বিয়েই করিস না তুই। এটা খুব বাজে সিদ্ধান্ত, আহি। তোর বাবা, ভাই, দাদা এমনকি দাদার সম্পর্কে কোনো আত্মীয় নেই। আন্টির উপর অনেক বড় দায়িত্ব তোকে বিয়ে দেওয়া। আমি তোর ভাইয়ের মতো, আহি। বোনকে বিয়ে দেওয়া অনেক বড় দায়িত্ব। আন্টির উপর মানসিক চাপ বাড়াস না। উনি তোর বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন।”

আহি বায়োডাটাটি একপাশে রেখে বলল,
“আচ্ছা, চিন্তা করিস না। আমি দেখবো এই বায়োডাটা। এবার একটু অন্য বিষয়ে কথা বলি।”

পুষ্প আর আহি বেশ গল্প করলো। হঠাৎ পুষ্প বলে উঠলো,
“আচ্ছা, পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে পদ্মের কোনো খোঁজ নেই। জানিস কিছু?”

“না।”

“ওর নম্বর বন্ধ। আচ্ছা, ভাইয়ার নম্বর আছে তোর কাছে?”

আহি চমকে উঠলো। আফিফের নম্বর মুখস্থ আহির। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সেই নম্বরে ডায়াল করার সাহস হয় নি তার। পদ্মের সাথেও যোগাযোগ করে নি। কি দরকার খোঁজ নিয়ে? ভালোই আছে হয়তো আফিফ তার পদ্মফুলের সাথে। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার কাছে কারো নম্বর নেই।”

পুষ্প বলল,
“আচ্ছা, মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়। না জানি কেমন আছে।”

“ভালোই থাকবে। যার জীবনে আফিফের মতো মানুষ আছে, সে কি খারাপ থাকতে পারে?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০১||

১১৬।
নন্দন কানন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখছে সে। আজই তার চট্টগ্রাম ফিরতে হবে। ওয়াসিফের সাথে দেখা করেই সে চলে যাবে চট্টগ্রামে। এখন সে স্কুল ছুটির অপেক্ষা করছে। দপ্তরি ঘন্টা বাজাতেই ছোট ছোট বাচ্চারা বেরিয়ে আসতে লাগলো। অনেকক্ষণ পর ব্যাগ দুলিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে এলো ওয়াসিফ। আহি হাতের ইশারা করতেই ওয়াসিফ আহিকে দেখে দৌঁড়ে এলো। এসেই জড়িয়ে ধরলো তাকে। আহি ওয়াসিফের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“বাবু, মন খারাপ তোমার?”

ওয়াসিফ মাথা তুলে আহির দিকে তাকিয়ে বলল, “হুঁ!”

“কেন?”

“মায়ের শরীর ভীষণ খারাপ।”

“কি হয়েছে তোমার মায়ের?”

“মায়ের বুক জ্বলে গেছে, তারপর থেকেই অসুস্থ থাকে। খেতে পারে না। কথা বলতেও কষ্ট হয়।”

আহি চিন্তিত হয়ে ওয়াসিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“কখন হয়েছে এসব?”

“নানু বলেছে আমি হওয়ার আগে। মা অনেক কান্নাকাটি করে, জানো?”

আহি ওয়াসিফের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“তুমি তো একটা মিষ্টি বাচ্চা। তুমি মন খারাপ করো না। মাকে সাহস দেবে, আদর করবে, দেখবে মা সুস্থ হয়ে যাবে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, সত্যি। আচ্ছা, তোমার জন্য ডোরেমন এনেছি। দেখবে না?”

ওয়াসিফ মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ, হুঁ!”

আহি ব্যাগ থেকে একটা নুড়ি পাথর বের করে ওয়াসিফের দিকে এগিয়ে দিলো। পাথরের গায়ে আঁকা ডোরেমনের ছবি। ওয়াসিফ লাফিয়ে বলল,
“এটা আমার ডোরেমন?”

“হ্যাঁ, এটা সবসময় তুমি নিজের কাছে রাখতে পারবে। তোমার বক্সে, তোমার পকেটেও রাখা যাবে।”

ওয়াসিফ তার প্যান্টের পকেটে নুড়ি পাথরটি ঢুকিয়ে বলল,
“আমি সবসময় নিজের কাছে রাখবো।”

আহি ওয়াসিফের থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“বাই মিষ্টি বাবু। আবার দেখা হবে।”

“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“আমি আমার বাসায় চলে যাচ্ছি।”

“তুমি কাল আবার আসবে?”

“না, বাবু।”

“তাহলে কি এর পরের দিন আসবে?”

“না, বাবু। আমার বাসা তো অনেক দূরে। আসতে সময় লাগবে?”

ওয়াসিফ কিছু একটা ভেবে বলল,
“তাহলে এতোদিন তুমি বাসায় ছিলে না?”

“হ্যাঁ ছিলাম তো। আশেপাশেই একটা বাসায় ছিলাম। এখন আমি আমার দূরের বাসায় চলে যাচ্ছি।”

ওয়াসিফ আহির হাত ধরে বলল,
“তুমি কালও এসো। তোমার সাথে অনে-ক গল্প করবো। ওদিকে পার্কে খেলবো। আমি আমার খেলনা আনবো তোমার জন্য।”

ওয়াসিফের কথা শুনে বেশ মায়া লাগলো আহির। সে ওয়াসিফের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ভালো থেকো। বাই।”

ওয়াসিফ হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলো আহিকে। আহির গাড়ি চলে যেতেই আফিফ মোটর সাইকেল সামনে আনলো। এতোক্ষণ সে আহির যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। আফিফকে দেখে ওয়াসিফ তার কাছে এসে তার দিকে পাথরটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মামা, হোয়াইট হোয়াইট আন্টি আমাকে কি দিয়েছো দেখেছো?”

আফিফ মুচকি হেসে বলল, “বেশ সুন্দর তো!”

“হোয়াইট হোয়াইট আন্টি কত্তো ভালো।”

আফিফ ওয়াসিফকে কোলে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আদ্য। আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, মামা!”

“হুম বলো।”

“তুমি সেই আন্টিকে হোয়াইট হোয়াইট কেন বলো?”

ওয়াসিফ গালে হাত দিয়ে হাসলো। বলল,
“আন্টির নাম তো ভুলেই গেছি। আন্টির আমার মতোই অনেক বড় একটা নাম। তুমি বলো, আমার একটুখানি মাথায় কি এতো বড় নাম ঢুকবে? আমার নামই তো আমার মুখস্থ করতে অনেক কষ্ট হয়েছে।”

“তাই তুমি হোয়াইট হোয়াইট নাম রেখেছো?”

“হ্যাঁ, আন্টি হোয়াইট হোয়াইট সু’জ পরে এসেছিল। আমারও লাগবে হোয়াইট হোয়াইট সু’জ।”

“আচ্ছা? ঠিক আছে। আমার মামাকে আমি হোয়াইট হোয়াইট সু’জ কিনে দেবো।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ একদম সত্যি। আচ্ছা, আরেকটা কথা বলো তো।”

“হ্যাঁ, বলো।”

“তোমার হোয়াইট হোয়াইট আন্টিকে এতো ভালো লাগে কেন?”

ওয়াসিফ এ আর টি গ্যালারি দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কতোবার ওখানে যেতে চেয়েছি। কেউ আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় নি। শুধু হোয়াইট হোয়াইট আন্টিই আমাকে ভেতরে নিয়ে গেছে। কত্তো ভালো না আন্টি?”

আফিফ হেসে বলল,
“হ্যাঁ, খুব ভালো তোমার আন্টি। একদম তোমার মতোই মিষ্টি।”

(***)

আহি গম্ভীরমুখে বসে আছে এক আজব কিসিমের মানুষের সামনে। কিছুক্ষণ পর পর হাত ঘড়ি দেখছে। দূরে বসে আছে লিনাশা এবং নায়ীব। দু’জনই এক সপ্তাহ আগে দেশে এসেছে। ঢাকায় নায়ীবের এক মামাতো বোনের বিয়ে। সেই উপলক্ষেই দেশে আসা। আহিও ঢাকায় এসেছে কোম্পানির কাজে। এখন মায়ের অনুরোধে আরবান খানের সাথে দেখা করা। তবে আহি একা আসে নি। নায়ীব আর লিনাশাকেও সাথে নিয়ে এসেছে। লিনাশা দূর থেকে আহির হাবভাব দেখে নায়ীবকে বলল,
“মনে হয় না, আহির ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে।”

নায়ীব বলল,
“আমারও পছন্দ হয় নি। ছেলেটার একটু নিজেকে জাহির করার স্বভাব আছে। দেখো নি, পরিচয় দেওয়ার সময় কীভাবে বার-বার বংশের নাম ডাক নিয়ে কথা বলছিলো। আহি এমন ছেলে পছন্দ করবে না।”

“তুমি আমার বান্ধবীকে তো খুব চেনো!”

“যেই মেয়ে আফিফের মতো ছেলের প্রেমে পড়ে, তার জন্য এসব ছেলে কিছুই না। আফিফ আর এই ছেলে দুই মেরুর। আহির জন্য যদি পাত্র দেখতে হয়, আফিফের মতো খুঁজতে হবে।”

“আচ্ছা? এখন আফিফের বৈশিষ্ট্য লিখে গুগলে সার্চ করবো আমরা?”

“রেগে যাচ্ছো কেন?”

লিনাশা মুখ ছোট করে নায়ীবকে গুঁতো দিয়ে বলল,
“যাও, ফোন দিয়ে দেখো তোমার ছেলে কোথায়!”

নায়ীব ফোন করলো তার গুণধর পুত্রকে। ওপাশ থেকে কল ধরলো চার বছর বয়সী ইয়াশ তামজীদ। নায়ীব বলল,
“হ্যালো, পাপা। কোথায় তুমি? কি করো?”

ইয়াশ ঠোঁট ফুলিয়ে নানুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“পাপা, তোমরা আমাকে একা রেখে কেন চলে গেছো?”

“আচ্ছা, সরি। আমরা একটা কাজে এসেছি। এক্ষুণি আসছি। তোমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসবো সাথে।”

“পাপা, তুমি না আমাকে বলেছো সি দেখাবে।”

নায়ীব হেসে বলল,
“অফকোর্স পাপা। আমার পাপাকেই তো আমি সি দেখাবো।”

লিনাশা বাবা-ছেলের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এদিকে আহি আরবান খানের সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি প্রচুর টায়ার্ড। আপনি প্লিজ আমাকে অনুমতি দিন।”

আরবান বলল,
“এক্সকিউজ মি! খুব বোর হয়েছেন মনে হচ্ছে।”

“আপনার হাই ক্লাস ড্রিমের গল্প শোনার মতো ধৈর্য আমার নেই। এখন আপনি যাবেন?”

“বিল?”

“ওয়েট, আমি বিল দিয়ে দিচ্ছি। প্লিজ গৌ।”

আরবান খান মুখ লাল করে উঠে চলে গেলো। আরো কিছু বলতো, কিন্তু আহির পেছনেই তার বডিগার্ড বসে আছে। তাই সে বাধ্য হয়েই বেরিয়ে গেলো। আরবানকে চলে যেতে দেখে নায়ীব আর লিনাশা আহির সামনে এসে বসলো। আহি বিরক্তমুখে বলল,
“মা এসব আজব লোক কোথা থেকে ধরে আনে? ছেলে নামি-দামি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কি লাভ হলো? চিন্তাভাবনা কতো নোংরা!’

লিনাশা বলল,
“আমরা বুঝতে পেরেছি ছেলেটার কথা শুনে। বাদ দে। দেখা হলেই কি বিয়ে হয়ে যায়?”

নায়ীব এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মাথা ঠান্ডা করো, আহি। এদিকে আমার ছেলে সি দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“জার্মানেও তো সমুদ্র আছে।”

লিনাশা বলল,
“আছে, কিন্তু আমরা বলেছি আমাদের দেশের সমুদ্র সৈকত সবচেয়ে দীর্ঘতম। এখন সে বায়না ধরেছে কতোটা দীর্ঘ তা দেখবে।”

“বেশ তো, কক্সবাজার নিয়ে যা।”

“হ্যাঁ, পুষ্পের সাথেও দেখা হবে। চল তুই সহ।”

“না রে। মাত্র এলাম। তিন সপ্তাহও হচ্ছে না।”

“তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে চল না। ঘুরাঘুরিও হবে।”

“না। আমার নেক্সট মান্থে এমনিতেই যেতে হবে। সেল হবে ওখানে। একটা স্পেশাল বিষয় নিয়ে আঁকছি। ওটাতে সময় দিতে হবে।”

“কেন তোর বাড়ি আছে না ওখানে?”

নায়ীব বলল,
“আরেহ তোমার বেস্টি এতো করে বলছে, চলো। আফটার অল, আমরা আবার জার্মান চলে যাবো। এর মধ্যে তোমার বিয়েটা হয়ে গেলে বেশ ভালো হতো। এক মাসের ছুটিতে এসেছি। পরে আবার কখন আসবো!”

আহি হাসলো। বলল,
“আমার বিয়েতে আবার ছুটি নিয়ে আসবেন।”

লিনাশা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“এখন যাবি? গেলে কিন্তু সময় নিয়ে যেতে হবে। আমরা বেশ কয়েকদিন কক্সবাজার ঘুরবো।”

“আচ্ছা, আমি এমডি সাহেবের সাথে কথা বলি। উনি হয়তো আমার অনুপস্থিতিতে সব হ্যান্ডল করতে পারবেন। তাহলে মা আর নানুকেও নিয়ে যাবো ভাবছি। নানুর তো শরীর খারাপ। যদিও বাড়িতে থাকতে চাইছেন। আমার মনে হচ্ছে, কক্সবাজার গেলে মন ভালো হবে উনার।”

“নানুর জানি কি হয়েছে?”

“ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ৷ ট্রিটমেন্ট করাচ্ছি তবুও ভয় হচ্ছে। উনিও চাচ্ছেন না ট্রিটমেন্ট করতে। কিন্তু সব চেষ্টা করছি।”

“বয়স তো হয়েছে উনার।”

“হুম। মা একা হয়ে যাবে নানুর কিছু হলে।”

“এজন্যই বিয়ে করছিস না?”

“না, সেজন্য না। বিয়ের বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিয়ের জন্য মনের বয়স এখনো হয় নি।”

“মনের বয়স কখন হবে?”

“যেদিন কোনো পুরুষ মানুষকে দেখে বয়স্ক কিশোরী হতে ইচ্ছে করবে।”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বয়স্ক কিশোরী বলতে!”

“প্রেম প্রেম অনুভূতি, অথচ বেশ গম্ভীর প্রকাশ। উড়ুউড়ু মন, অথচ বাইরে স্থিরতা। আবেগী চাওয়া-পাওয়া, অথচ অনুভূতির শেষাংশে গভীর স্পর্শ।”

নায়ীব হাসলো। লিনাশা বলল, “কবি হয়ে যাচ্ছিস!”

“শিল্পীদের একটু কবিও হতে হয়। মা অনেক বই পড়ে। মাঝে মাঝে আমিও ঘেঁটে দেখি। ভালো সময় কাটে আমার।”

আহি কথাটি বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহির এই দীর্ঘশ্বাস অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিলো নায়ীব আর লিনাশাকে।

(***)

ওয়াসিফ বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। ছেলেটা বেশ অভিমানী। আফিফ তার পাশে শুয়ে একটু পর পর তাকে গুঁতো দিচ্ছে, আর সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ওয়াসিফ খিলখিল করে হেসে বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে আবার মুখ ভার করে ফেলছে। আফিফ তার হাত ধরে টেনে তাকে নিজের কাছে এনে বলল,
“আদ্য, এভাবে মুখ ভার করে বসে থাকলে কিন্তু মামা রাগ করবো!”

ওয়াসিফ হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করে বলল,
“রাগ করলে করো। হুহ।”

“কি চাই আমার মামাটার?”

“বললাম না, হোয়াইট হোয়াইট আন্টিকে এনে দাও।”

“দু’দিনের দেখায় তুমি হোয়াইট হোয়াইট করতে করতে অস্থির হয়ে যাচ্ছো।”

“সেদিন আন্টি বলেছে আসবে। তাই আমি প্রতিদিন পার্কে বসে থাকি, কিন্তু আসেই না। দেখেছো, কেউ আমার কোনো বন্ধু হয় না। হোয়াইট হোয়াইট আন্টির সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবো ভেবেছি, উনি তা কাট্টি করেই চলে গেলো।”

“কাট্টি?”

ওয়াসিফ তার কনিষ্ঠ আঙ্গুল দেখিয়ে শরীর দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, কাট্টি।”

এরপর সে তার পাথরের ডোরেমনটি হাতে নিয়ে বলল,
“কেউ আমার বন্ধু হয় না।”

আফিফ ওয়াসিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কি তোমার বন্ধু না?”

“না, তুমি তো মামা।”

“মামা কি বন্ধু হতে পারে না?”

ওয়াসিফ সাথে সাথেই আফিফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মামা, আমার কোনো বন্ধু নেই। ক্লাসের কেউ আমার সাথে খেলে না।”

“কেন খেলে না?”

“আমি জিরো পাই তাই।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কোথায় জিরো পাও? সবসময় তো নাইন্টি প্লাস পাও।”

“মামা, ওই জিরো না।”

“তাহলে কোন জিরো?”

“ক্লাসে মিসরা ওয়ান-জিরো গেইমস খেলে। যে আগে পড়া দিতে পারবে, তাকে ওয়ান দেবে। আর আমি সবসময় জিরো হই। তাই কেউ আমাকে পাত্তা দেয় না।”

আফিফ হোঁ হোঁ হাসতে লাগলো। আফিফকে হাসতে দেখে ওয়াসিফ বলল,
“তোমাকে আমি এমনি এমনি বেস্ট বলি। তুমি খুব পঁচা। আমি জিরো পেয়েছি শুনে তুমি হাসছো?”

আফিফ হাসি থামিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
“কি করবো তাহলে?”

ওয়াসিফ তার কাছে এসে তার ঠোঁটের দুই পাশ টেনে ধরে বলল,
“স্যাড স্যাড ফেইস। হুম। এখন বেস্ট লাগছে।”

“এর আগে কেমন লেগেছিল?”

“জিরো বেস্ট।”

আফিফ হাসলো। ওয়াসিফের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“আদ্য পন্ডিত।”

(***)

আহি দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে সালমা ফাওজিয়া এবং রোকেয়া ফাওজিয়াকে নিয়ে কক্সবাজার এলো। সাথে এসেছে নায়ীব, লিনাশা আর তাদের ছেলে ইয়াশ এবং এসেছেন রুনা খানমও। আহির বাংলো বাড়ির পাশেই একটা গেস্ট হাউজ করেছে সে। ওখানেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। সব গুছিয়ে আহি পরদিন দুপুরে তার গ্যালারিতে এলো। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বের হতেই তার ওয়াসিফের কথা মনে পড়লো। স্কুল ছুটি হবে এমন মুহূর্তেই এসেছে সে। মিনিট খানিকের মধ্যে দপ্তরি ঘন্টা বাজালো। বেরিয়ে এলো ওয়াসিফ। আহি ওয়াসিফকে দেখে হাতের ইশারায় ডাকলো,
“এই যে বাবু!”

ওয়াসিফ দূর থেকে আহিকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। আহির দিকে ছুটে আসতে যাবে, ওমনি ইটের রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়লো সে। ওয়াসিফকে পড়ে যেতে দেখে আহি দৌঁড়ে গেলো সেখানে। ধরে বসালো তাকে। ওয়াসিফ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, জানো না? তুমি কেন আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, বলো তো!”

আহির বুকটা মুহূর্তেই ধক করে উঠলো। সে ওয়াসিফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ওয়াসিফকে কোলে নিয়ে বলল,
“বাবু, তুমি আমাকে মনে রেখেছো?”

“হ্যাঁ।”

“পায়ে বেশি ব্যথা করছে?”

ওয়াসিফ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “হুম।”

আহি ওয়াসিফকে গ্যালারির ভেতরে নিয়ে গেলো। ইটের ঘষা খাওয়া হাঁটু পরিষ্কার করে দিলো। পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করে একটা অয়েন্টমেন্টের নাম নিলো। রুবিকে বললো ফার্মেসি থেকে নিয়ে আসতে। এরপর সে যত্নের সাথে অয়েন্টমেন্টটি লাগিয়ে দিলো হাঁটুতে। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেলো। ওয়াসিফের মামা আসছে না। বেশ ক্ষুধা পেয়েছে ওয়াসিফের। সে পেটে হাত দিয়ে বলল,
“আমার তো ক্ষিধে লেগেছে। মামাকে বলবে আমাকে নিয়ে যেতে?”

আহি ওয়াসিফের ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে সেখানে লেখা নম্বরে ডায়াল করলো। ডায়েরিতে লেখা ছিল, নাওফা রেনুকা। ওয়াসিফের মায়ের নাম। আহি কল করতেই রেনু কল ধরলো। ওয়াসিফের ব্যাপারে জেনেই রেনু ব্যস্ত হয়ে আফিফকে কল করলো। আফিফ জানতো রেনু কল দেবে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। আহি যতোক্ষণ আদ্যের পাশে আছে, সে কীভাবে যাবে তাকে নিতে? এদিকে আহি কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
“কেমন মামা তোমার? একদম ইরেস্পন্সিবল। আচ্ছা, ওয়াসিফ। তুমি আমার সাথে চলো। আমার বাসায় যাবে?”

“তুমি আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ। ওখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করবে। এরপর তোমার মামার যখন ইচ্ছে তোমাকে এসে নিয়ে যাবে।”

ওয়াসিফ মাথা নাড়লো। সে আহির সাথে চলে গেলো আহির বাংলো বাড়িতে। আফিফ তাদের যেতে দেখে অবাক হলো। কি এক বিপদে পড়েছে সে। আহির সাথে দেখা করে ওয়াসিফকে কীভাবে আনবে? মা আর রেনুকেও পাঠানো সম্ভব না। আহি তো সবাইকে চেনে। আফিফ মিনমিনিয়ে বলল,
“এই আদ্যের বাচ্চাটা কি এক ঝামেলা পাঁকিয়ে দিলো!”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||

১১৭।
আহির বাংলো বাড়িটি অবাক হয়ে দেখছে ওয়াসিফ। সালমা ফাওজিয়া ওয়াসিফকে দেখে আহিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আহি, ছেলেটা কে?”

আহি বলল,
“মা, গ্যালারির পাশে একটা স্কুলে আছে না? ওখানে পড়ে। ওর মামা নিতেই আসে নি ওকে। কেমন দায়িত্ব-জ্ঞানহীন লোক দেখেছো? বেচারা বাচ্চাটা আমার কাছে দৌঁড়ে আসতে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। ক্ষিধেও পেয়েছে তার। দুপুর দেড়টা বাজে, দেখেছো? এইটুকুন একটা বাচ্চা এতো সময় ধরে না খেয়ে কীভাবে থাকবে?”

আহি গলা উঁচু করে সুধীকে ডাকলো। সুধী আসতেই আহি বলল,
“কথাকে বলো, বাচ্চাটাকে ফ্রেশ করিয়ে দিতে। আর তুমি খাবার তৈরী করো। জিজ্ঞেস করো ও কি কি খাবে।”

সুধী মাথা নেড়ে ওয়াসিফের কাছে গেলো। ওয়াসিফ সুধীকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“তুমি কি সিনড্রেলা?”

সুধী ওয়াসিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“না, বাবু। আমি সুধী।”

সুধী ওয়াসিফের কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল,
“কি নাম তোমার?”

“নাওফাত ওয়াসিফ আদ্য। তোমার নাম কি?”

“সুধী।”

“সুধী আবার কেমন নাম?”

সুধী মুচকি হেসে বলল,
“নাওফাত ওয়াসিফ আদ্য আবার কেমন নাম?”

ওয়াসিফ বুকে হাত গুঁজে বলল,
“যেমন নাম হয়, তেমন।”

“আমারটাও যেমন নাম হয় তেমন।”

ওয়াসিফ মুখ চেপে হেসে বলল,
“আমাকে কপি করছো? ব্যাড ম্যানার্স।”

সুধী ওয়াসিফের নাক চেপে ধরে বলল,
“আচ্ছা দুষ্টু বাবু, কি খাবে?”

ওয়াসিফ গাল ফুলিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে দুষ্টু বলেছো?”

“আদর করে দুষ্টু বলে।”

ওয়াসিফ অবাক হয়ে বলল, “আদর করে দুষ্টু বলা যায়?”

“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বলা যায়।”

“না, বলা যায় না। আদর করে মিষ্টি বাবু বলে। ওই যে হোয়াইট হোয়াইট আন্টি যেমন আমাকে মিষ্টি বাবু বলে। আমি দুষ্টু না, বুঝেছো? তুমি দুষ্টু, তোমার বাবা দুষ্টু, তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী দুষ্টু, দুষ্টু, দুষ্টু।”

“এমা, তুমি এই কথা কোথায় শিখেছো?”

“আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে বলে এই কথা। কারো সাথে ঝগড়া হলে বলে। আমারও তোমার সাথে ঝগড়া।”

আহি ওয়াসিফের কাছে আসতেই ওয়াসিফ তাকে বলল,
“আন্টি, আন্টি, দেখো না। ওই পঁচা সুসিটা আমাকে দুষ্টু বলেছে।”

আহি ওয়াসিফের পাশে বসে বলল, “সুসি কে?”

“এই যে, এই মেয়েটার নাম সুসি।”

আহি হাসলো। সুধীও হাসলো। সুধীকে হাসতে দেখে ওয়াসিফ বলল,
“আন্টি, ওকে বকে দাও তো। দেখো, ও হাসছে!”

আহি গলা উঁচু করে বলল,
“এই সুসি, তুমি ওকে দুষ্টু বলেছো কেন? এক্ষুণি সরি বলো মিষ্টি বাবুকে?”

সুধী দু’কান ধরে বলল, “সরি।”

ওয়াসিফ বলল, “হুম, ইটস ওকে।”

এরপর হাতের ইশারায় না দেখিয়ে বলল,
“বাট নট সরি। উঁহু।”

আহি বলল, “এটার মানে কি?”

“পরের বার সরি নিবো না।”

আহি মুচকি হেসে বলল, “আচ্ছা নিও না।”

সুধী এবার বলল, “কি খাবে বলো?”

ওয়াসিফ বলল, “তোমাকে কেন বলবো?”

আহি জিজ্ঞেস করলো, “আমাকেও বলবে না?”

“হ্যাঁ, তোমাকে তো বলবোই।”

“তাহলে বলো?”

ওয়াসিফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“চিকেন ফ্রাই। মা আমার জন্য প্রতিদিন ফ্রাই করে।”

“চিকেন ফ্রাইয়ের সাথে বিফ বিরিয়ানি খাবে?”

“বিরিয়ানি? ওয়াও, আমার আর মামার ফেভারিট।”

“আচ্ছা? তোমার আর কি কি ফেভারিট?”

“আমার তো চিকেন ফ্রাই বেশি ভালো লাগে। কিন্তু মামা কি খায়, জানো?”

“কি খায়?”

“হোয়াইট হোয়াইট রাইসের সাথে ইয়েলো ইয়েলো পটেটো। সাথে ডাল।”

আহি থমকে গেলো। ওয়াসিফ আবার বলল,
“মামা তো নানুকে সবসময় বলে আমার জন্য আলুভর্তা করো, আলুভর্তা করো। জানো, আমিও একবার খেয়েছি। কি ঝাল! আমার চোখে পানি এসে গেছে। এমন ঝাল কেউ খায়, বলো?”

আহির বুকটা ধকধক করছে। আজ ভীষণ মনে পড়ছে আফিফের কথা। আফিফের প্রিয়ও তো আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে সাদা ভাত। একদম সাদামাটা পছন্দ তার। সাদা রঙ, হলুদ অলকানন্দা। মানুষটা খুব সাধারণ। আহি তাই খুব শখ করেই এই বাংলো বাড়িটা সাদা টাইলস, এবং সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আর বাড়ির দেয়ালে সাদা রঙ করেছে। বাইরে থেকে দেখলে সাদা রাজপ্রাসাদ মনে হবে। এ আর টি গ্যালারিটাও আফিফের নামে করেছে। এজন্যই আর্ট শব্দটিকে ভেঙে ভেঙে লিখেছে সে। অন্তত এ আর যাতে আগে উচ্চারিত হয়।

(***)

ওয়াসিফের জন্য নতুন জামা আনিয়েছে আহি। ওয়াসিফ গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়ার পর আহির রুমে ঢুকলো। চার দেয়ালের পরিবর্তে দুই দেয়াল। বাকি দুই পাশে বড় কাচের জানালা।
গ্রিল বিহীন খোলা জানালা। জানালার পাশে লাগোয়া বিছানা। একপাশের দেয়ালের সাথে লাগোয়া কাচের আলমারিতে আহির ব্যবহারের জিনিসপত্র, জামা-কাপড়। অন্যপাশের দেয়ালে বড় একটা আয়না। তার পাশে ছোট পড়ার টেবিল। সেখানে কয়েকটা বই রাখা, একটা ফুলদানি আর একটা মোটা ডায়েরী রাখা। পাশে ছোট একটা গলির মতো স্থান। সেই গলির একপাশের দেয়ালে আহির আঁকা বিভিন্ন ছবি ঝুলছে। অন্যপাশে ওয়াশরুম। গলির ওপাড়ে খোলা বারান্দা।

ওয়াসিফ অবাক দৃষ্টিতে আহির রুম দেখে বলল,
“আচ্ছা আন্টি, তুমি কি কুইন?”

আহি ওয়াসিফকে তার পাশে বসিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি তো রানী। এই ছোট প্রাসাদের রানী।”

“আচ্ছা, তাহলে তোমার রাজা কোথায়?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“সব রানীর রাজা থাকে না। কিছু রানী একা থাকে।”

“আর যাদের রাজা থাকে তাদের কি বলে?”

“সম্রাজ্ঞী বলে। রাজার সম্রাজ্ঞী।”

“তুমি কখন সম্রাজ্ঞী হবে?”

“যেদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়া-পাওয়ার সবটাই আদায় হয়ে যাবে। নতুন আবদারের ইচ্ছে জাগবে। নতুন করে সুন্দর কিছু মুহূর্তের আবদার করতে ইচ্ছে করবে।”

আহির গলা ভারী হয়ে এলো। ওয়াসিফ বলল,
“তোমার মন খারাপ কেন হলো?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“কোথায়? আমি তো ঠিকই আছি।”

আহি এরপর ফোন হাতে নিয়ে নাওফা রেনুকার নম্বরে আবার ডায়াল করলো। রেনু কল ধরে বলল,
“আমার ভাইকে ফোন দিয়েছি। ও না-কি ইমার্জেন্সি কাজে আটকে গেছে। ওর বন্ধুকে পাঠাচ্ছে।”

“বন্ধু? এমন অপরিচিত কারো হাতে আমি আপনার ছেলেকে দিয়ে দেবো?”

“আপনি আদ্যকে একটু ফোনটা ধরিয়ে দিন।”

আহি লাউড স্পিকারে দিলো। রেনু ওয়াসিফকে বলল,
“আদ্য, বাবা। তোমার মামা তো যেতে পারছে না। মা তো অসুস্থ, বাবা। তুমি অলয় আংকেলের সাথে চলে আসবে?”

ওয়াসিফ বলল, “আচ্ছা, মা।”

রেনু কল কেটে দিতেই আহি ওয়াসিফকে জিজ্ঞেস করলো, “অলয় কে?”

“অলয় মামার কলিগ। মামার অনেক ভালো ফ্রেন্ড।”

আহি মনে মনে ভাবলো,
“আমার বাসার এড্রেস তো নিলোই না উনি।”

আহি রেনুকে আবার ফোন করে ঠিকানা দিয়ে দিলো। রেনু বেশ অবাক হলো। আফিফ বললো, সে অলয়কে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাহলে পাঠালো’টা কোথায়? হয়তো স্কুলে পাঠিয়েছে। রেনু আফিফকে মেসেজে ঠিকানা পাঠিয়ে দিলো। আফিফ মেসেজটি দেখে কপাল চাপড়ালো। ঠিকানা না নিয়ে অলয়কে পাঠিয়ে দিলে আহি নিশ্চিত সন্দেহ করতো। পরক্ষণেই ভাবলো, কেন সন্দেহ করবে? এ আর টি গ্যালারি থেকে কি আহির ঠিকানা নেওয়া সম্ভব নয়? মাথাটা একদম এলোমেলো হয়ে গেছে আফিফের।

(***)

ওয়াসিফ আহির টেবিলের কাছে যেতেই মোটা একটা ডায়েরী পেলো। বেশ সুন্দর ডায়েরীটা। বাদামি মলাটের। মলাটের চামড়া বেশ আকর্ষণীয়। ওয়াসিফ ডায়েরীটা খুলেই অবাক। এতো সুন্দর সুন্দর স্কেচ? কিসব লেখাও আছে পাশে। এখনো রিডিং পড়তে পারে না সে। ওয়াসিফ জোরে জোরে উচ্চারণ করলো,
“এ স্বর আ ব বিন্দু র।”

আহি চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো। সে লাফিয়ে উঠে বসলো। ওয়াসিফের হাতে ডায়েরীটা দেখে তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে, সেটা টেনে নিয়ে ফেলল। ওয়াসিফ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহির দিকে। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“সরি বাবু। এটা ধরো না। ঠিক আছে?”

আহি ডায়েরীটা তার কাচের আলমারিতে রেখে দিলো। আর ওয়াসিফ এক দৃষ্টিতে সেই ডায়েরীটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কাচের আলমারি হওয়ায় কিছুক্ষণ পর পর তার দৃষ্টি সেদিকে আটকাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবছে,
“হোয়াইট হোয়াইট আন্টি, এভাবে কেন বুকটা নিয়ে নিলো? কত্তো সুন্দর কার্টুন আঁকা ওখানে। আমার তো লাগবেই বুকটা।”

ঘন্টাখানেক বাদে আমিন এসে ওয়াসিফকে নিয়ে গেলো। ওয়াসিফ চলে যেতেই আহি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। আর হারিয়ে গেলো ঘুমের রাজ্যে।

১১৮।

আমিন অর্ধেক পথ গিয়েই গাড়ি থামালো। ওয়াসিফ গাড়ি থেমে যেতে দেখে বলল,
“আংকেল, তুমি কি আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে না?”

আমিন বলল,
“না, তোমার মামা নিয়ে যাবে। ওই যে দাঁড়িয়ে আছে তোমার জন্য।”

ওয়াসিফ গাড়ি থেকে নেমে দেখলো আফিফ মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে আফিফের কাছে গিয়ে বলল,
“মামা, তোমার জরুরি কাজ শেষ?”

আফিফ ওয়াসিফকে মোটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ।”

আমিনকে ধন্যবাদ দিয়ে আফিফ বাকি পথ ওয়াসিফকে নিয়ে গেলো। ওয়াসিফ আফিফকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলল,
“মামা, তুমি এইটুকুর জন্য আমিন আংকেলকে কেন আসতে বলেছো? চলে এলেই পারতে। জানো, আমি আজ কোথায় গিয়েছি?”

আফিফ জোরেই বলল, “চুপচাপ বসে থাকো।”

“মামা, শুনবে না?”

“বলো, বলো।”

“হোয়াইট হোয়াইট আন্টির হোয়াইট হোয়াইট প্যালেসে। জানো, প্যালেসটা একদম ধবধবে সাদা।”

“সাদা প্যালেসে ভূত থাকে, জানো না?”

ওয়াসিফ অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ, হোয়াইট প্যালেসে হোয়াইট ভূত থাকে। আর যাবে কখনো হোয়াইট হোয়াইট আন্টির সাথে?”

ওয়াসিফ ঝাঁকরে ধরলো আফিফকে। আফিফ মৃদু হাসলো। বাসায় পৌঁছেই আফিফ ওয়াসিফকে নামিয়ে দিলো মোটর সাইকেল থেকে। ওয়াসিফ কোনো কথা না বলে দৌঁড়ে চলে গেলো উপরে। চার তলা নিজেই উঠলো। আফিফ চাবি আর হেলমেট নিয়ে উঠে দেখলো, দরজা খোলা। আফিফা বেগম ছেলেকে দেখে বললেন,
“আদ্যকে এতোক্ষণ পর কেন আনলি? আর ওর জামা পালটে দিয়েছিস কেন?”

“আমি তো পালটাই নি। যার বাসায় গেছে ওরা হয়তো পালটে দিয়েছে।”

এদিকে ওয়াসিফ রুমে ঢুকে গভীর মনোযোগ দিয়ে ডোরেমনের নুড়ি পাথরটি দেখতে লাগলো। রেনু ছেলেকে ঘরে ফিরতেই পাথর নিয়ে বসে থাকতে দেখে বলল,
“বাবা, কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? তোমাকে নিয়ে গেছেন উনি কে? চেনো?”

ওয়াসিফ রেনুর সামনে বসলো। গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার মাথায় এবার সব সাঁই সাঁই করে ঢুকছে। সব ডোরেমনের গ্যাজেটের জন্য হয়েছে।”

ওয়াসিফ নুড়িপাথরটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা ডোরেমনের গ্যাজেট। এটা আজ আমি স্কুলে নিয়ে যাই নি, তাই জিনি এসেছে আমার খোঁজ নিতে।”

“জিনি?”

“হুঁ, হুঁ। হোয়াইট হোয়াইট আন্টি কোনো মানুষ নয়। উনি একজন জিনি। জিনি সবার উইশ পূরণ করে। আমার উইশ ছিল স্কুলের পাশে ওই সুন্দর বাসাটাতে যাওয়া। আন্টি আমার উইশ পূরণ করেছে। এরপর আমাকে এই ডোরেমনের গ্যাজেট দিয়েছে। এটা থাকলে উনি বুঝতে পারে, আমি বিপদে পড়েছি কি-না। আজ গ্যাজেটটা নিয়ে যাই নি। আর উনিও এসেছে। ওয়াও, আমার একটা জিনি আছে।”

আফিফ ওয়াসিফের কথা শুনে দরজায় দাঁড়িয়ে হোঁ হোঁ করে হাসতে লাগলো। ওয়াসিফ মামার কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি হাসছো কেন? জিনির বাসায় একটা দুষ্টু পেত্নীও আছে। ওটাও আজ হেসেছিল। জানো, জিনি আমাকে সেই পেত্নীর হাত থেকে বাঁচিয়েছে।”

“এখন তোমার হোয়াইট হোয়াইট আন্টি তোমার জিনি হয়ে গেলো?”

“হ্যাঁ, আন্টি তো ভেরী গুড। তাই গুড পেত্নী।”

“পেত্নী আবার গুড হয়?”

ওয়াসিফ ভাবুক কন্ঠে বলল,
“হুম, হয়তো উনাকে আটকে রেখেছে দুষ্টু পেত্নীরা।”

“ওরে আমার বাবারে, মাফ করো আমাকে।”

আফিফ নিজের ঘরে চলে এলো। সন্ধ্যায় ওয়াসিফের ব্যাগটা খুললো আফিফ। আফিফই তাকে পড়ায়। ওয়াসিফ নাস্তা করছে এখনো। আফিফ ব্যাগ থেকে ওয়াসিফের স্কুলের ডায়েরী আর খাতা বের করতেই ভেতরে কিছু একটা খেয়াল করলো। ভারী আর মোটা ডায়েরী। আফিফ সেটা বের করলো। ভ্রূ কুঁচকে সে ডায়েরীটির দিকে তাকালো। এজন্যই ব্যাগটা এতো ভারী ছিল? সে উলটো ভাবছে, ওয়াসিফ সব বই-খাতা নিয়ে স্কুলে গেছে কি-না। আফিফ চেয়ার টেনে বসলো। বাদামি মলাটের ডায়েরী। আফিফ ডায়েরীটার পৃষ্ঠা উল্টালো। প্রথম দু’পৃষ্ঠা খালি। তৃতীয় পৃষ্ঠায় লেখা।

“সেদিন তাকে প্রথম দেখেছি। ধীরগতিতে হাঁটছিল। বৃষ্টির আঁচ লাগছিল তার শরীরে। কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না তার৷ আমার দৃষ্টি তার দিকে বার-বার আটকাচ্ছিল। সাদা শার্ট লেপ্টে ছিল তার শরীরের সাথে। এলোমেলো চুলগুলো দেখে অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করেছিল সেদিন। এতো সাধারণ একটা ছেলেকে নিয়ে আমি এতো ভাবছি কেন?”

এতোটুকু পড়ে আফিফ থমকে গেলো। তার হৃদকম্পন বেড়ে গেলো যেন। পরের পৃষ্ঠা খুলতেই দেখতে পেলো ডায়েরীর সাথে সেঁটে রাখা একটা স্কেচ। নিচে লেখা,
“খসড়া স্কেচ। এই স্কেচটি বাঁধিয়ে ফেলেছি।”

পাশে লেখা,
“সেদিন ক্লাসে বটবৃক্ষ আঁকতে দেওয়া হয়েছিল। আর আমি জানি না, কেন সেদিন তাকেই এঁকেছিলাম।”

পরের পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা,
“পাঁচশো টাকা দিয়ে এই ডায়েরীটা কিনেছি। কার জন্য? ফর মাই লাভ।”

তার অপর পাতায় গোলাপের পাপড়ি আঠা দিয়ে লাগানো। পাশে একটা চিরকুট লাগানো। সেটাতে লেখা, “আফিফ রাফাত।”

নিচেই লেখা,
“প্রথম তোমার নাম জানার চেষ্টা। কি সুন্দর নাম! আফিফ রাফাত।”

পরের পৃষ্ঠায় লেখা,
“তোমার দিকে তাকিয়ে তোমার আমার প্রেমের গল্প লেখা শুরু করছি। বিষয়টা চমৎকার না? এমন উন্মাদ প্রেমিকা কি আগে দেখেছো? নিশ্চয় দেখো নি। জানো, আজই কিনলাম এই ডায়েরীটা। আর পথে দেখা হয়ে গেলো তোমার সাথে। তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, কথা বলছো কোনো এক অচেনা ছেলের সাথে। আর আমি রৌদ্রতাপ ভুলে রিকশার পাশে তোমাকে দেখা যায় এমন স্থানে বসে আছি। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি তোমাকে। আচ্ছা এআর, মেয়েরা কি এভাবে লুকিয়ে কারো দিকে তাকায়? মেয়েরাও কি এভাবে ভালোবাসে? জানি না, কিন্তু আমার তোমাকে এভাবে ভালোবাসতেই ভালো লাগে।”

তার পাশেই আফিফের স্কেচ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আফিফ। সামনে একটা ছেলের অবয়ব। আহি বসে আছে ইটের উপর। পাশে একটা রিকশা৷

(***)

আফিফের হাত কাঁপছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবুও ঘামাচ্ছে সে। সেই মুহূর্তেই দৌঁড়ে রুমে ঢুকলো ওয়াসিফ। মামার হাতে ডায়েরীটা দেখে বলল,
“মামা, এটা জিনির ডায়েরী।”

আফিফ শক্ত কন্ঠে বলল,
“আদ্য, তুমি না বলে এই ডায়েরী নিয়ে এসেছো কেন?”

ওয়াসিফ মুখ ছোট করে বলল,
“আমার সুন্দর লেগেছিল তাই।”

“ব্যাড ম্যানার্স।”

ওয়াসিফ মাথা নিচু করে নিলো। আফিফ আরো কিছু বলার আগেই সে দৌঁড়ে চলে গেলো রুমের বাইরে। ওয়াসিফ চলে যেতেই আফিফ ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো।

পরের পৃষ্ঠায় লেখা ছিল আফিফের মসজিদে যাওয়ার মুহূর্তটি। আহি আফিফের পরণের শার্ট, ঘামে ভিজে যাওয়া শরীর, কাঁধের ব্যাগ, পায়ের মলিন স্যান্ডেল, হাতের ঘড়িটাও সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে ডায়েরীতে সেই বিষয়ে উল্লেখ করেছে। এবার আফিফের চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো,
“মেয়েটা আমার পিছু করতো, আর আমি টেরই পাই নি?”

পরের দু’পৃষ্ঠা পর লেখা,
“ক্লান্ত মুখ। নাকের ডগায় জমে ছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। হালকা হাওয়া তোমার ঘর্মাক্ত কপালটি শুকিয়ে দিয়ে গেলো। আর তোমার ঘামে লেপ্টে থাকা চুলগুলোও মুক্ত হলো। তুমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একটা ভাঙা বেঞ্চে বসলে। কাপে চুমুক দিতেই তোমার চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। চা নিশ্চিত গরম ছিল। কিন্তু তোমার কপালে একটুও ভাঁজ পড়লো না। শুধু চোখ দু’টোই সাড়া দিয়েছিল। আজ কেন যেন মনে হলো তুমি শুধু ক্লান্ত নও। বড্ড ক্লান্ত। তোমার মনে কি ভীষণ কষ্ট, এআর? আমাকে ভাগ দিবে সেই কষ্টের? আমি তোমার কষ্ট নিয়ে নেবো। দেখবে তুমি খুব সুখী হবে। অনেক সুখী হবে। কারণ তোমার জন্য আমি আছি।”

পাশে একটা স্কেচ আঁকা। যেখানে আফিফ কাঠের বেঞ্চে বসে প্লাস্টিকের কাপ হাতে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। পাশে টংয়ের দোকান। আর দূরে দাঁড়িয়ে আহি তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্কেচের নিচে লেখা,
“কাপটা চুরি করে ফেলেছি আমি। তুমি কাপটা এভাবে ফেলে গেলে! আমি তো এখন এই কাপটার দিকে তাকিয়েই তোমাকে অনুভব করবো।”

পরের পৃষ্ঠায় আফিফের স্কেচ। যেখানে সে হাসছে। নিচে লেখা,
“তুমি একদম হাসো না। ভালোই হয়েছে কম হাসো। এতো চমৎকার হাসি। মনে পড়লেই পাগল হয়ে যাই। সারাদিন তো আমার মাথায় তোমার সেই হাসি-হাসি চেহারাটাই ঘুরছে।”

এরপর দু’পৃষ্ঠা খালি। পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই থমকে গেলো আফিফ। লেখা ছিল,
“আজ আমি তোমার পিছু নিয়েছি। তোমার জন্য বাসে চড়েছি, কাঁদায় স্যান্ডেল হারিয়ে এসেছি। আর তুমি? একবারো আমার দিকে তাকাও নি। এআর, সত্যিই কি আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি? আমার না তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। তুমি পাশে থাকলে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। আজকে যতোক্ষণ তুমি আমার কাছে ছিলে, আমি ততোক্ষণ শুধু হেসেছি। এই হাসি মনের হাসি। আমার মনটা চমৎকার ভাবে হাসে, জানো? তোমাকে দেখলে আমার মন হাসে। তোমাকে কিন্তু সারাজীবন আমার মনকে হাসাতে হবে।”

পাশেই একটা স্কেচ। যেখানে একটি বাসের ভেতরে অনেক যাত্রী। যাত্রীদের ভীড়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। তার পেছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্কেচটির নিচে লেখা,
“প্রথম স্পর্শ পেয়েছি তোমার, আর এই স্পর্শ আমার আত্মাকে স্পর্শ করে ফেলেছে।”

পরের পৃষ্ঠায় লেখা, “আমি তোমার প্রেমে পড়েছি, এআর।”

পেছনের এক পৃষ্ঠা পর আরেকটা স্কেচ। সেখানে আঁকা, খোলা মাঠে একটি বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে একটি ছেলে। পাশে লেখা,
“কেন কেঁদেছো তুমি? কি এমন কষ্ট তোমার? আমাকে দিয়ে দাও তোমার কষ্ট। আমি আমার সুখগুলো তোমার সাথে ভাগ করে নেবো।”

আফিফ পরের পৃষ্ঠাগুলো পড়ে গেলো। সেখানে আহির দেওয়া প্রথম চিরকুটের অনুভূতি, লিনাশার সেই চিরকুট লিখে দেওয়া, ক্লাসে পলি আপু গ্রুপে এই নিয়ে হাসাহাসি এসব কথার উল্লেখ ছিল। পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই আফিফ একটা ভাঁজ করা কাগজ পেলো। সেটা খুলতেই দেখলো একটা মলিন স্কেচ। যেটা দেখতেই আফিফের মনে পড়লো, এটা সে-ই স্কেচটি যেটা আহি তাকে প্রথম দিয়েছিল। আর সে হারিয়ে ফেলেছিল। সেই স্কেচের নিচে লেখা,
“তোমার কাছে আমার গুরুত্ব এতো কম কেন, এআর? আমি তোমার ফেলনা যত্নে রাখি, আর তুমি আমার আঁকা স্কেচটিও আগলে রাখতে পারলে না?”

এর পরের পৃষ্ঠায় আঁকা রাস্তার উপর একটা স্যান্ডেলের স্কেচ। তার পাশেই লেখা,
“তোমার ফেলনাও আমার কাছে অনেক মূল্যবান, এআর। আজ তুমি স্যান্ডেলটি ফেলে গিয়েছিলে। আর আমি কুঁড়িয়ে নিয়েছি। ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে তোমায় দেখতে গিয়েছি। রাস্তায় এক কোমর জল, তাই বাবা গাড়ি দেয় নি। আমি পানিতে ভেসে গেলে তুমি কিন্তু হারিয়ে ফেলতে এক উন্মাদ প্রেমিকা। ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে, এআর। আজ তোমাকে চারুশিল্পে দেখেই আমার সারাদিনের ধকল কেটে গেছে।”

আফিফ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। ডায়েরী বন্ধ করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে বলল,
“কিছুই নেই আমার মধ্যে। তবুও আমাকে কেন এতো ভালোবেসেছিলে? আমি তো জানতাম, তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু এভাবে? আমি তো এবার নিজের সাথেই চোখ মেলাতে পারছি না। আমি অপরাধী, আহি। আমি তোমার অপরাধী।”

(***)

সারারাত ঘুমায় নি আফিফ। ওয়াসিফকেও পড়ায় নি।এদিকে ওয়াসিফ মামা বকেছে তাই মুখ ভার করে বসে আছে। তার অভিমান বাড়ছেই। বকুনি দেওয়ার পর তো মামা অন্তত তার অভিমান ভাঙাতে আসে। কিন্তু আজ আসছেই না। মামা-ভাগ্নে আজ রাতে খায় নি। আফিফা বেগম আর রেনু এ নিয়ে চিন্তায় অস্থির। অন্যদিকে আফিফ মেঝেতে বসে আছে আহির ডায়েরী হাতে। পড়ছে আহির উন্মাদনার গল্প।

প্রথম আফিফকে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দেওয়া আর সেই চিরকুট, আফিফের এক্সিডেন্টে আহির ছুটাছুটি, আফিফের রক্ত লেগে থাকা সেই জামাটা যত্ন করে তুলে রাখতে চাওয়া, মুনিয়া খালা সেই জামা ধুয়ে ফেলায় আহির কান্নাকাটি, আবার সেই জামা পরেই আফিফের স্কেচ আঁকার প্রত্যেকটি ঘটনা সেই ডায়েরীতে লেখা। এরপর কয়েক পৃষ্ঠা পর লেখা,
“প্রথম তোমার চোখাচোখি।”

তার নিচে লেখা ছিল চারুশিল্পের মেলায় আফিফের ক্যালিগ্রাফিগুলো কেনার কথা। কীভাবে সালমা ফাওজিয়াকে রাজি করিয়ে আফিফের ক্যালিগ্রাফি সব কিনে নিয়েছিল আহি! পরের পাতায় লেখা ছিল,
“আমাদের চোখাচোখি হলো। আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল, অথচ তুমি আমার হৃদকম্পন শুনলে না। আমার ভেতরটা কীভাবে উত্তাল হাওয়ার মতো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, অথচ তুমি বুঝলে না। তুমি কি আমাকে একটুও খেয়াল করো না?”

আফিফ ডায়েরীটা বন্ধ করে বালিশের নিচে রাখলো। দমবন্ধকরা অনুভূতি। পড়েই আফিফের ভেতর‍টা চুরমার হয়ে যাচ্ছে, তাহলে আহির কি অবস্থা হয়েছিল? ডায়েরীটা অনেক বড়। এক রাতে শেষ হবে না। আফিফের চোখ জ্বালা করছে। অস্থির লাগছে। ইচ্ছে করছে, ছুটে গিয়ে আহিকে জড়িয়ে ধরতে। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তখন কেন আফিফ আহির পাশে ছিল না? আফসোস হচ্ছে খুব। জীবনের অনেক সিদ্ধান্তে আজ খুব আফসোস হচ্ছে তার।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে