Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 184



প্রিয় বালিকা পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়_বালিকা |অন্তিম|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

খুব জাঁকজমকভাবে সাজানো হয়েছে রৌদ্রের তৈরি রাজকীয় মসজিদটি।একাধিক উঁচু মিনার আর অসংখ্য গম্বুজ দিয়ে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে।মসজিদের বাহির অংশটা না আকর্ষণীয় তার থেকে বেশি আকর্ষণীয় মসজিদের ভিতরের সাজ সজ্জা।অসংখ্য তীব্র পাওয়ারের সোনালি সাদা আলোই ভিতররটি জ্বল জ্বল করছে।রয়েছে বিশাল ঝাড়বাতি। মেঝেতে রয়েছে মোলায়েম কার্পেট।সব মিলিয়ে এ যেন কোনো রাজ প্রাসাদের থেকে কম নয়।আজ এখানেই সকলের থেকে দোয়া নিবে একজোড়া বাবুইপাখি।শুরু করবে এক টুকরো সোনার সংসার।
বর সেজে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র।বুকে হাত গুঁজে রেখেছে।একপা ভাঁজ করে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে।দৃষ্টি সামনে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা আভার দিকে।আভাকে সাজানো হচ্ছে।রৌদ্র করুণ চাহনিতে তাকেই দেখছে।প্রায় একঘন্টা হলো।তখন থেকে মেক-আপ আর্টিস্টগণ আভার মুখে ফোমের মতো একটি জিনিস দিয়ে ঘষামাজা করে করছে।রৌদ্র এবার খানিকটা বিরক্তির সুরে বলল,
– আচ্ছা আর কতক্ষণ লাগবে আপনাদের?

একজন আর্টিস্ট আমতা আমতা করে বলল,
– জ্বী মাত্রই তো বেজ করে আই মেক-আপ টাচ করলাম।আরো খানিকটা সময় লাগবে।

আভা চোখ বন্ধ রেখেই রৌদ্রকে বলল,
– আপনি এতো তাড়া দিচ্ছেন কেন?বললাম তো নিচে থেকে ঘুরে আসুন মেক-আপ শেষ হলে আপনাকে টেক্সট করবো।

রৌদ্র রাগে কটমট করে বলল,
– এখন আমি বর সেজে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াবো নাকি?

সহসা কেউ এসে রৌদ্রের থায়ের সাথে বারি খেল।তাতে রৌদ্র তার জায়গা থেকে কিছুটা সরে সামনে চলে গেল।মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল পুতুলের মতো একটি মেয়ে।যার মাথার ঠিক মাঝখানে গোলাপি রঙের হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে তালগাছের মতো একটি ঝুঁটি বাঁধা।রৌদ্রের থায়ে বারি খেয়ে সে নাকে একটু ব্যাথা পেয়েছে।রৌদ্রের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে নাক ডলছে সে।রৌদ্রের কপাল কুঁচকে এলো।বাচ্চাটা কার ভেবে ঘাড় কাত করল রৌদ্র।বাচ্চাটি রৌদ্রকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে সন্দিহান স্বরে বলল,
– ও আচ্ছা তাহলে তুমিই গ্রুম?ব্রাইড কোথায়?

মেয়েটির আদো আদো স্বরের এমন বাক্যে চমকিত হলো রৌদ্র।বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো বাচ্চাটির দিকে।বিস্মিত স্বরে বলল,
– তুমি কে বাবু?এই ঘরে কি করো?

মেয়েটির গম্ভীর জবাব,
– মাম্মা বলল ব্রাইড এখানে।আর ব্রাইড মাম্মা’স ফ্রেন্ড।

চট করে চোখ খুলে ফেলে আভা।মেক-আপ আর্টিস্টদের থামিয়ে নজর রাখে রৌদ্রের সামনে দাঁড়ানো গোলাপি ফ্রক পরা মেয়েটির দিকে।বলে,
– মাম্মা’স ফ্রেন্ড?তোমার মা কে বাবু?

মেয়েটি রৌদ্রের থেকে নজর সরিয়ে আভার দিকে তাকায়।আভাকেও পা থেকে মাথা অবধি অবকলন করল।বলল,
– তুমি ব্রাইড।

আভা কিছু বলার আগেই রৌদ্র বলল,
– হ্যাঁ ও ব্রাইড।তোমার আম্মুর নাম কি বাবু?

মেয়েটির সহজ সরল জবাব,
– পূর্ণতা।সবাই পূর্ণ বলে ডাকে।

আভা ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।চেয়ার থেকে উঠে সে পুতুলের মতো মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো।গাল টেনে বলল,
– আম্মু কোথায় তোমার?

মেয়েটি তর্জনির ইশারায় দরজার দিকে দেখালো।সকলে নজর ফেলল দরজায় নীল শাড়িতে একটি যুবতীর উপর।সে ঠোঁট প্রসারিত করে আভা এবং তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।রৌদ্র বিগলিত হেসে পূর্ণতাকে বলল,
– কেমন আছো?

পূর্ণতা নম্র স্বরে জবাব দিলো,
– জ্বী ভাইয়া ভালো আছি আপনি কেমন আছেন?

-জ্বী ভালো আছি।ও তোমার মেয়ে?

রৌদ্রের অবাক স্বরে করা প্রশ্নের জবাবে ধীর গতিতে উপর নিচ মাথা নাড়ে পূর্ণতা।রৌদ্রের চোখ আরো বড় হয়ে যায়।অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
– তোমার বিয়ে হলো করে?আর এতো বড় মেয়েই বা হলো কবে?

রৌদ্রের কথায় স্মিত হাসে পূর্ণতা।চোখের ইশারায় বোঝায় একটু পর বলছি।এগিয়ে আসে আভার দিকে।আভা এখনো তব্দা হয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে।সে বিশ্বাসই করতে পারছে না পূর্ণতা তার সামনে।সে পূর্ণতাকে ই-মেইল পাঠিয়েছিল।কিন্তু পূর্ণতা তার ই-মেইল পেয়ে সত্যি সত্যি হাজির হবে তা সে কল্পনাও করেনি।পূর্ণতা আভাকে আলতো জরিয়ে ধরে বলল,
– কেমন আছিস আভা?আমাকে তো হয়তো চিনতেই পারিসনি।

আভা অবাক স্বরে বলল,
– ভালো আছি রে।তুই সত্যি আসবি আমি ভাবতেও পারিনি।ওর বাবাও এসেছে?

পূর্ণতার মেয়ের দিকে ইশারা করে বলল আভা।পূর্ণতা নিচু হয়ে মেয়েকে আদুরে স্বরে বলল,
– আম্মু তুমি বাহির থেকে একটু ঘুরে এসো তো।

মেয়েটি মায়ের আদেশের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও ব্যয় করে না।মায়ের কথা মতো তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করে সে।পূর্ণতা মেয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে উদাসীন স্বরে বলে,
– ওর বাবা নেই।

চমকে ওঠে রৌদ্র আভা উভয়ে।পূর্ণতার কথার মর্মার্থ বুঝতে না পেরে চেয়ে বয় পূর্ণতার দিকে।পূর্ণতা ঘাড় ঘুরিয়ে আভার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে।বলে,
– এখান থেকে যাওয়ার পর বড়লোক ছেলে দেখে মা আমার বিয়ে দেয়।প্রীতি হওয়ার পর আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।এখন ও ওর মতো আছে আমি আমার মতো মেয়েকে নিয়ে বেশ আছি।

আভা আনমনেই বলে,
– সিঙ্গেল মাদার?!

মাথা নেড়ে সায় দেয় পূর্ণতা।কৌতুহলী রৌদ্র জিজ্ঞেস করল,
– ডিভোর্স হলো কেন?

– নারীর মায়া বড়ই বিষাক্ত।কেউ আপনার নারীর বিষাক্ত মায়ায় জরায় তো কেউ পরনারীর বিষাক্ত মায়ায় জরিয়ে আপন নারীকে অস্তিত্বহীন করে।

আভা বলল,
– বিয়ে করিসনি কেন?

– আমি তো বেশ আছি মেয়েটাকে নিয়ে।আমার আর কাউকে চাই না।

রৌদ্র আভা দুজনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ এক শ্বাস।পূর্ণতা থমথমে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল,
– আরে আভা তোকে তো একদম রাজরানি লাগছে রে।আর ভাইয়া আপনাকেও তো রাজার মতো লাগছে।

বলেই হাসে পূর্ণতা। আভা এবং রৌদ্রও হাসে।আভাকে আবার সাজানোর জন্য তোড়জোড় শুরু হয়।

লাল টকটকে ভারি লেহেঙ্গা সাথে সাদা পাথরের গহনায় সাজানো হয় আভাকে।শরীরর প্রতিটি কোণায় অলংকৃত তার।শুধু নাক ছাড়া।গলা,হাত,কান,টিকলি,টায়রা সবকিছুতে একদম অপ্সরা লাগছে।ছোট্ট ছোট্ট ডায়মন্ডে তৈরি ভারি গহনায় আভাকে আরো উজ্জ্বল লাগছে দেখতে।গোল্ডেন শেরওয়ানি পরেছে রৌদ্র।মাথায় বরের টোপর।ঠোঁটে চাপা হাসি।হাতে হাত দিয়ে চলছে দু’জন। পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মসজিদের ভিতরে।ভিতরে প্রবেশ করতেই ইমাম,মুয়াজ্জিন, কাজী তাদের সালাম দিলো।রৌদ্র সবাইকে আলিঙ্গন করে কুশলাদি বিনিময় করলো।সকলের সাথে আরাভ এবং অভয়ও রয়েছে তাদের অপেক্ষায়।মেয়েকে রানী রূপে দেখে খুশিতে চোখ ভরে উঠলো আরাভ সাহেবের।অভয়ও অপলক দৃষ্টিতে বোনকে তৃপ্তি সহকারে দেখছে।কি দেয়নি রৌদ্র তার বোনকে?একদম রানীর মতো তাকে সাজিয়ে তুলেছে।আরাভ এবং অভয়ের মুখে একই সাথে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।রোদেলা গর্বের সাথে বলে উঠলো,
– একে বলে পুরুষ।একটা টাকাও বাবার থেকে নেয়নি।বউয়ের জন্য যা কিছু কিনেছে সব নিজের টাকায় নিজের পছন্দে।

রৌদ্র মাথা নত করে ফেলল মায়ের কথায়।হামিদও হেসে ছেলের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,
– বাবা প্রস্তুত তো আরেকবার কবুল বলার জন্য?আগেরবার তো আমরা দেখতে পারিনি এবার আল্লাহ্ ভাগ্যে রেখেছে।

রৌদ্র বাবাকে আলিঙ্গন করে।হামিদ এবং রোদেলা মাসের এক তারিখেই আগে এসেছে।বিয়ের জন্য সকল কেনাকাটা সবকিছু রৌদ্র এবং তার মা মিলে করেছে।আভার সাথে সাথে সকলেই গিফট দিয়েছে রৌদ্র।আরাভ সাহেব বললেন,
– চলো সবাই বসি।

অভয় গিয়ে অহনার পাশে দাঁড়ায়।অহনার কোল থেকে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তাকে আদর করতে করতে সকলের সাথে গিয়ে বসে।সেদিকে মায়াভরা চাহনিতে তাকিয়ে থাকে পূর্ণতা।মনে মনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাবল তার জীবনটাও হতে পারতো একটু অন্যরকম।একটু সুখের, একটু দুঃখের,একটু খুনসুটি মাখা,একটু সোহাগা।এভাবে তার হাত খোপার মতো অগোছালো না হলেও পারতো।

কিছুক্ষণ হাদিস ও কুরআন সম্পর্কে আলোচনা শেষে আবারো বিয়ে পড়ানো শুরু করলো কাজী সাহেব।নিকাহমানায় তারা স্বামী স্ত্রী তাই এখন কবুল না বললেও চলবে।তবু আরো একবার কবুল বলার আবদার করে রৌদ্র।তাই মুখে মুখেই আবারোও বিয়ে পড়ায় কাজী।রৌদ্রকে কবুল বলতে বলা হলে সে নিজের হাতে থাকা আভার হাতটা জোরে চেপে ধরে আভার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আভার চোখে চোখ রেখে তিন বার “কবুল” বলে দেয় রৌদ্র।আভাও রৌদ্রের চোখে দৃষ্টি রেখে “কবুল” বলে।আবারো স্বামী স্ত্রী হিসেবে একে অপরকে কবুল করলো দু’জন।

বিয়ে শেষে কিছু এতিম দুস্থ মানুষদের ভরপুর খাওয়ানো হয়।রৌদ্র আভা তাদের কাছে গিয়ে তাদের কাছে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে।রৌদ্র সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
– সকলে ভালো করে খাবেন।আর আমাদের জন্য দোয়া করবেন।আমি যেন এই মেয়েটাকে সবসময় সুখী রাখতে পারি দোয়া করবেন।এই মেয়েটা আমার জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত সেরা উপহার।

আভা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে তার স্বামীর দিকে।ইশশ!লোকটাকে আজ একদম রাজার মতো লাগছে।কি সুন্দর ব্যাক্তিত্ব তার।আভা যতবারই তাকে দেখে ততবারই তার ব্যাক্তিত্বের প্রেমে পড়ে।
রৌদ্র আভার কিছু সুন্দর সুন্দর মুহুর্তে ফ্রেমবন্দী করা হলো।আভা রৌদ্রের বুকের বামপাশে নিজের ডান হাত আলতো করে রেখে বলল,
– জীবনে একটা আফসোস রয়ে যেত জানেন?

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কি?

– এই যে আমার বিয়ে হলো কিন্তু আমি সাজলাম না,বেনারসি পড়লাম না,গহনা পড়লাম না।বিয়ে নিয়ে সবার কত স্বপ্ন থাকে আমারও ছিল।কিন্তু পূরণ হলো না এই আফসোসটা রয়ে যেত।

রৌদ্র আভার সামনের চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে নরম সুরে বলল,
– ভাবলে কি করে তোমায় কোনো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দিবো আমি?

পরমুহুর্তেই কিছু ভাবার ভঙ্গিতে বলল,
– এই এক মিনিট তুমি তো বেনারসি পরা না লেহেঙ্গা পরা!তাহলে এখন বেনারসি পরার জন্য কি আরো একবার কবুল বলতে হবে?

আভা শব্দ করে হেসে ফেলে।রৌদ্রের বুকে হালকা আঘাত করে বলল,
– থাক হয়েছে আর কবুল বলতে হবে না।এই নিয়ে ছয়বার বলে ফেলেছি।

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কেন তুমি আমার জন্য আরো তিনবার কবুল বলতে পারবে না?

আভার হাসি চওড়া হলো।সে রৌদ্রের গাল টেনে দিলো।রৌদ্র বিরক্ত হয়।মুখ ফোলায়।আভা হিসহিসিয়ে বলে,
– তা তো পারো তিনবার কেন হাজার বার পারবো কিন্তু এমন ভারি গহনা,জামা,মেকআপ আর করতে পারবো না।

রৌদ্র চোখ বন্ধ করে আভার টিকলির উপর ঠোঁট ছুঁয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে চুম্বন করে।অদুরে স্বরে বলে,
– থাক আর বলতে হবে না কবুল।এখন কবুল বললেও তুমি আমার না বললেও তুমি আমার।

~সমাপ্ত

প্রিয় বালিকা পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮+৩৯

0

#প্রিয়_বালিকা |৩৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

করমজল থেকে শীপ সরাসরি দুবলার চর যাওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে ট্যুর অপারেটরের প্রস্তাবে শীপের গন্তব্য নির্ধারণ করা হয় কটকা সমুদ্র সৈকত।কটকা সমুদ্র সৈকত ঘুরে তারপর শীপ দুবলার চর শুঁটকির স্বর্গে যাবে।শীপ যথাযথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোংলা থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে কটকা সমুদ্র সৈকতের একটি খালে নোঙর তোলে।খাল থেকে ট্রলারে করে দফায় দফায় শীপের সবাইকে নিয়ে আসা হয় কটকা জেটিতে।রৌদ্র ও তার ভ্রমণসঙ্গীরা দ্বিতীয় দফায় ট্রলারে ওঠার সুযোগ পায়।জেটিতে আসতেই চোখে বাঁধে রেস্ট হাউজ।সেখানে স্বল্প খরচে রাত্রি যাপন করা যায়।এই সুন্দর প্রকৃতির মাঝে একটি রাত প্রিয় নারীকে নিয়ে কাটানোর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল রৌদ্রের। কিন্তু হাতে বেশি সময় নেই।এখানে মাত্র তিন থেকে চার ঘন্টা থাকার সুযোগ আছে।তারপরই আবার পাড়ি জমাতে হবে দুবলার চরের উদ্দেশ্যে।আভা শাড়ি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেখে রৌদ্র বেশ ক্ষেপে গেল।ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠলো,
– শাড়ি পরার কি দরকার ছিল?এমনি একটা থ্রিপিস পরে আসলে হতো।

আভাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাশ থেকে লিনডা মুখ বাঁকিয়ে সুর টেনে বলে,
– ঢং!

আভা বিরক্ত হয় লিনডার কথায়।তবু প্রকাশ করে না।টলার থেকে নামতে না পেরে হাত বাড়িয়ে দেয় রৌদ্রের দিকে।রৌদ্রের টাকনুর সামান্য উপর পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে।আভা নামলে তার শাড়িও হাঁটু অবধি ভিজে যাবে।আভা এতো কিছু ভেবে শাড়িটা পরেনি।রৌদ্রের ভালো লাগবে ভেবে পরেছে।এভাবে সকলের সামনে অপদস্ত হতে হবে জানলে শাড়ি নিয়েই আসত না সে।আভা মুখ কালো করে বলে,
– আমাকে আবার শীপে দিয়ে আসতে বলেন না।আমি যাবো না।

রৌদ্র আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেল সবাই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।শুধু তারাই এখনো ট্রলারের কাছে দাঁড়িয়ে।রৌদ্র ট্রলারের নিচে আর আভা ট্রলারের উপরে দাঁড়িয়ে সাত পাঁচ ভেবে চলেছে।রৌদ্র আর কালবিলম্ব করে না।সে সোজা আভার কোমর একহাতে জরিয়ে ধরে।তারপর উঁচু করে ট্রলার থেকে নামিয়ে নেয়।তবে ছাড়ে না ওভাবে উঁচু করে রাখে।আভা রৌদ্রের গলা জরিয়ে ভয়াতুর স্বরে বলে,
– এই কি করছেন পড়ে যাবো।

রৌদ্র “টু” শব্দটাও করে না।একহাতে আভাকে উঁচু করে বড় বড় পা ফেলে শুষ্ক জায়গায় চলে আসে।ধীর গতিতে নামিয়ে দেয় আভাকে।রৌদ্র বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে,
– শুঁটকি মাছের ওজনও তোমার থেকে বেশি।

আভা যেন রৌদ্রকে চিনলোই না এমন ভাব নিয়ে সামনে হাঁটা শুরু করলো।রৌদ্র ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো আভার যাওয়ার দিকে।তারপর গলা উঁচিয়ে বলল,
– আমি না নিয়ে এলে এমন ভাব নেওয়া লাগতো না।

রৌদ্রের কথায় ফিরে তাকায় আভা।বিগলিত হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র দেরি না করে আভার হাতে হাত গলিয়ে দেয়।আভাকে একহাতে জরিয়ে হেঁটে চলে সকলের পিছু পিছু।অভয় রৌদ্রের উদ্দেশ্যে বিদ্রুপের স্বরে বলে,
– কিরে আশিক বউ তো আমাদেরও আছে আমরা তো তোর মতো বগলের নিচে নিয়ে ঘুরি না।তোর বউ কি হুরপরী নাকি?

রৌদ্র আভার দিকে তাকিয়ে হেসে অভয়কে বলে,
– হুরপরী হলেও ছেড়ে দিতাম।

অহনা অভয়ের পেটে গুঁতা দিয়ে বলল,
– দেখছ ভাইয়ার থেকে শিখো কিছু।

অভয়ের মুখটা ভোঁতা হয়ে গেল।সে রৌদ্রকে সকলের সামনে লজ্জায় ফেলতে গিয়ে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেল।সে এবার হালকা কেশে গলা ঝাড়ে আশেপাশে তাকিয়ে মানুষজন দেখে বউয়ের হাত ধরার ইচ্ছাটা উবে যায়।রৌদ্র কিভাবে পারে লোকজনের সামনেও এভাবে বউয়ের সাথে ঢলাঢলি করে হাঁটতে একটুও লজ্জা করে না তার?অভয়ের তো হাত ধরতে গিয়েই ঘাম ছুটে যাচ্ছে।এক মিনিট!মেয়েতে এলার্জি তো রৌদ্রের ছিলো।এ রোগ তাকে আবার কবে আক্রমণ করলো? সে নিজের বউয়ের হাতটাই ধরতে লজ্জায় মরে যাচ্ছে ওদিকে নিরামিষ রৌদ্র কি সুন্দর বউকে বগলের নিচে নিয়ে হেলেদুলে হেঁটে চলেছে।অভয় আবার গলা খাঁকারি দেয়।সাহস করে বউয়ের হাতটা চেপে ধরে।তাতে অবশ্য অহনার উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না।সে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে এতে অভয়ের সংকোচটাও কেটে যায়।

আভা মুখ তুলে রৌদ্রের দিকে চায়ল।রৌদ্র মিষ্টি হেসে ঠোঁট চোখা করে চুমু দেখালো।আভা হেসে বলে উঠলো,
– আপনি এতো ভালো কেন রৌদ্র।

রৌদ্র ভাবুক ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁট বের করে বলে,
– উমম তা তো জানি না।

আভা অপরাধী সুরে বলে,
– সরি কাল আপনাকে যা নয় তাই বলেছি।আ’ম সো সরি।

রৌদ্র আভাকে নিজের সাথে আরো দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে বলে,
– ইট’স ওকে।এটা কোনো ব্যাপার না।সংসারে ঝগড়াঝাটি হবে স্বাভাবিক কিন্তু যতই ঝগড়া হোক আলাদা ঘুমানো যাবে না বুঝলে।

আভা চোখ বড় বড় করে আশে পাশে তাকিয়ে রৌদ্রের হাতে চাপর দিয়ে বলে,
– এখানে ঘুমানোর কথা আসছে কোথা থেকে?

রৌদ্র এক চোখ টিপ দিয়ে আবারো ঠোঁট পাউট করে।শব্দ করে হেসে ফেলে আভা।কিছুদূর হেঁটে যেতেই দেখা মেলে কাঠের ট্রেইল।যে কাঠের ট্রেইল দূর দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত।এটি বেয়ে হাঁটতে শুরু করে সকলে।ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করে সকলে।সকলের একদম সামনে হাঁটছেন টুরিস্ট গাইড।সে সকলকে সুন্দরবন ও কটকা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানাচ্ছেন সকলকে।জঙ্গেলর ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল একঝাঁক হরিণ এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।কয়েকজন টুরিস্ট তাদের ঘাসও খাওয়াল।অভয়ও অহনাও খাওয়ালো ঘাস।আজ রৌদ্র ছবি তুলছে না আজ ক্যামেরা লিনডার কাছে সেই সকল মুহুর্ত ফ্রেমবন্দী করছে।আভা ভয়ে হরিণকে ঘাস খাওয়ানোর সাহস পেল না।সহসা দেখা মিলল সুন্দরবনের সবচেয়ে আলোচিত জিনিস তা হলো সুন্দরী গাছ।ছোট সুন্দরী গাছে চারপাশটা ভরে আছে।আর এই সুন্দরী গাছের কারণেই সুন্দরবনের নামকরণ করা হয়েছে “সুন্দরবন”। আরো কিছু গাছপালা দেখা গেল।যেমন-গোলপাতা,কেওড়া আরো বিভিন্ন বন্য গাছগাছড়া।তারা যত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ততোই নতুন নতুন বিভিন্ন জিনিস চোখে পড়ছে সকলের।বানরেরদল একগাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে,বন্য শুকর চারিদিকে গন্ধ নিয়ে চলেছে খাবারের সন্ধ্যানে।বিভিন্ন জানা-অজানা পাখিদের কোলাহল সবমিলিয়ে মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ।আভা এবং রৌদ্রের পাশাপাশি হাঁটছে এক বিদেশি যুবক।ছেলেটি বারবার তাদের দিকে তাকাচ্ছে বিষয়টি রৌদ্র লক্ষ্য করলে নম্র স্বরে ছেলেটিকে বলে,
– হোয়ার আ’র ইউ ফ্রম?

ছেলে নিজস্ব বাচনভঙ্গিতে উত্তর করে,
– আ’ম ফ্রম লন্ডন।

– আই সি হউ ইজ দিস প্লেস?

ছেলেটি পুলকিত স্বরে বলে,
– আও দিস প্লেস ইজ বিউটিফুল। আই হ্যাব নেভার হ্যাড সাচ আ গুড টাইম বিফোর।এন্ড ওয়ান মোর থিংক ইউ আ’র সাচ আ কিউট কাপল।

রৌদ্র হাসিমুখে বলে,
– থ্যাংক ইউ।

অতঃপর আবারো সকলে চারিপাশ দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জীবটি হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার।কিন্তু বাঘ দেখার সৌভাগ্য সকলের হয় না।আভাও তার ভ্রমণসঙ্গীদেরও বুঝি বাঘ দেখা ভাগ্যে ছিল না।কিন্তু তারা বাঘে থাবায় বালুতে হওয়া ছাপ দেখতে পায়।বাঘ তার বিশাল পায়ের ছাপ ফেলে এই রাস্তা ধরে হেঁটেছে।আভা পায়ের ছাপের দিকে চেয়ে শুঁকনো ঢোক গিলে।শরীরের সবকটা লোম দাঁড়িয়ে যায় তার।রৌদ্রের হাত খামচে ধরে সে।রৌদ্র স্মিত হেসে আভাকে আশ্বাস দেয়,
– বাঘ এখান থেকে হেঁটে চলে গিয়েছে জঙ্গলের আরো ভিতরে।আর আসবে না ভয় পেও না

ঘন্টা চারেক তারা এভাবেই আসেপাশে ঘুরাঘুরি করে রওনা হয় দুবলার চরের জন্য।শীপে উঠেই আভা শাড়ি বদলে ফেলে একটি খয়েরী রঙের সিল্কের থ্রিপিস পরে।বেশ কিছু ঘন্টার ব্যবধানে তারা চরে পৌঁছায়।এখানেও ট্রলারে করে চরে নিয়ে যাওয়া হয়।আভা জুতো খুলে হাতে নেয়।চরে পা রাখতেই পায়ে নরম কিছুর স্পর্শ পায়।লাফিয়ে ওঠে রৌদ্র আভার হাত ধরে আছে আভাকে লাফাতে দেখে বলে,
– কি হলো হঠাৎ?লাফাচ্ছ কেন?

আভা কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিমায় বলে,
– পায়ে যেন কি লাগছে।

আভা পায়ের পাতা পুরো না ফেলে বৃদ্ধ আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।রৌদ্র আভার কথায় হাঁটু ভেঙে বসে বালু থেকে জেলির মতো কিছু একটা তুলে আভার মুখের সামনে ধরে।আভা চিৎকার করে ওঠে ভয়ে।রৌদ্র উচ্চস্বরে হাসছে পাশে অভয় আর অহনা দাঁড়িয়েও হাসছে।লিনডা মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
– এহ্ ন্যাকা!

রৌদ্র জিনিসটি আবার বালুতে ফেলে হাত ঝেড়ে বলে,
– এটা জেলি ফিস।ভাটায় আঁটকে গিয়েছে এখানে জোয়ার এলে আবার চলে যাবে।এখন চলো।

তারা চর বেয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে যার যার নিজস্ব ক্যাপ তৈরি করে।আজ রাত এখানেই থাকবে।বন ফায়ার আর ফিস বারবিকিউ হবে।সকলে খুব বেশি আগ্রহী।দেখতে দেখতে আলো ফুরিয়ে এলো।রৌদ্র-আভা চরের বালুতে বসে সূর্য ডোবা দেখছে।বাতাসে এক মোহনীয় সুঘ্রাণ।যা উত্তপ্ত করে তুলছে রৌদ্রের সারা শরীর।সে ক্ষণে ক্ষণে উষ্ণ স্পর্শ ছুঁইয়ে দেয় আভার কপালে,গালে,চোখে।মাঝে মাঝে সে স্পর্শ আভার থুতনিতেও স্থাণ পায়।বেখেয়ালিতে আবার কখনো অধরের একটুকরো অংশ ছুঁয়ে যায় সে স্পর্শ।কেঁপে ওঠে আভা।শুঁকনো ঢোক গিলে নিষ্পলক চেয়ে থাকে অস্তমিত সূর্যের দিকে।ধীরে ধীরে বিশালাকৃতির সে অগ্নিকুণ্ড পানির অতল গভীরে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে চলেছে।একসময় নিজের সবটুকু বিশাল জলরাশিকে উৎসর্গ করে সে।ধরনীতে নেমে আসে আঁধার কালো রাত।রৌদ্রের অনবরত ঠোঁটের স্পর্শগুলো ভীষণভাবে কাতর করে তোলে আভাকে।নেশাক্ত দৃষ্টিতে রৌদ্রের চোখে চোখ রাখে সে।রৌদ্রের শিকারী দৃষ্টি তাকে হিসহিসিয়ে কিছু বলে তবে তা বিশ্লেষণ করার আগেই ডাক পড়ে তাদের,

– এই যে জোড়া শালিক বারবিকিউ খাবে নাকি পেট ভরা?

ঘোর কাটে দু’জনারই।তবে অনুভূতির প্রখরতা কাটে না এক বিন্দুও বরং সে আকাঙ্খা তীব্র থেকে তীব্র হয়।রৌদ্রের যেন উঠতে অনিহা।সে এখনো আভার দিকে তাকিয়ে ঠাঁই বসে আছে।আভা হেসে রৌদ্রের হাতে বারি দিলো।তারপর নিজেই উঠে দাঁড়ালো রৌদ্রের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
– চলেন ডাকে তো।

রৌদ্র ভোঁতা মুখে নিচের ঠোঁট বের করে বলে,
– না গেলে কি হয়?

আভাও রৌদ্রের মতো একই ভঙ্গিতে বলে,
– গেলে কি হয়?

রৌদ্র অনিচ্ছার শর্তেও উঠলো এবার।আভাকে একহাতে চেপে এগিয়ে গেল সকলের দিকে।সকলে বন ফায়ার জ্বালিয়ে তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে।পাশেই চিকেন বারবিকিউ আর ফিস বারবিকিউ হচ্ছে।মাংস পোড়া ঘ্রাণে মোঁ মোঁ করচ্ছে চারিদিকটা।কারো হাতে গিটার কেউবা প্রিয় মানুষের কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিতে আঁখি যুগল বন্ধ করে আছে।রৌদ্র এবং আভাও সেখানের একটি জায়গায় নিজেদের জন্য জায়গা করে নিলো।গিটারের সুর তুলে সকলে একসাথে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠলো,
“এই সাগরপাড়ে আইসা আমার মাতাল মাতাল লাগে
এই রূপ দেখিয়া মন পিঞ্জরায় সুখের পক্ষী ডাকে

পারতাম যদি থাইকা যাইতাম এই সাগরের পাড়ে
ঝিনুক-মালা গাঁইথা কাটায় দিতাম জীবনটারে

আমার মন বসে না শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাই তো আইলাম সাগরে
তাই তো আইলাম সাগরে!”

বারবিকিউ তৈরি শেষ এবার সকলে ভাগ বাটওয়ার করে খাওয়ার সময়।এদিকে জোয়ারে পাড়ের বেশ খানিকটা পানিতে ডুবে গিয়েছে।আকাশটাও কেমন অশ্রুসিক্ত।রৌদ্র মাথা তুলে আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আকস্মিক ঝুম করে আকাশ ফেটে নেমে এলো রহমতের পানি।সকলে তড়িঘড়ি বারবিকিউসহ প্রয়োজনীয় সকল জিনিস ক্যাম্পে রেখে আনন্দ উল্লাস করতে করতে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল সমুদ্রের পানিতে।আভা রৌদ্রের হাতে টান দিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলল,
– রৌদ্র তাড়াতাড়ি ক্যাম্পের ভিতরে চলেন ভিজে যাচ্ছি।

রৌদ্র আকাশ পানে মুখ তুলে চোখের পাতা বন্ধ করে ঠাঁই বসে রইলো।রাতের আধারে সমুদ্রের পাড়ে বৃষ্টি যেন একটুকরো স্বর্গ এনে দিলো রৌদ্রের হৃদয়ে।সে আচমকা উঠে আভার হাত আঁকড়ে ধরে ছুট লাগালো সমুদ্রের জলে।এতোক্ষণে সকলে ভিজে জুবুথুবু।রাতের আঁধারে এভাবে পানিতে নামা বিপদজনক হলেও তা এখন কারো মস্তিষ্কে কড়া নাড়তে সক্ষম হচ্ছে না।সকলে যার যার নিজেদের মতো সমুদ্রের জলে আনন্দ উল্লাস করতে ব্যস্ত।জোয়ারে সমুদ্রের পানি শান্ত।তবে মাঝে মাঝে উত্তাল স্রোত এসে সকলকে স্থানচ্যুত করছে।রৌদ্র আভা বেশ অনেকটা জলে নেমে গেল।একে অপরের দিকে পানির ছিটে দিয়ে চলেছে।বেশ আনন্দ করছে তারা।আভা প্রথমে ভয়ে নামতে না চাইলেও এখন সেই সবচেয়ে বেশি মজা করছে।এর মধ্যে একমুহূর্তের জন্যও আবার হাত ছাড়েনি রৌদ্র।শক্ত করে নিজের হাতে আবদ্ধ করে রেখেছে সে আভার হাত।হঠাৎই বিশাল এক স্রোতের ধাক্কায় টালমাটাল হয়ে গেল আভা।শরীরের ওজন কম হওয়ায় তাকে স্রোতের নিচে চাপা পড়তে হলো।সবকিছু ভিষণ অদ্ভুত লাগল আভার কাছে।কানে কোনো শব্দ পৌঁছাল না তার।চোখে কাউকে দেখতে পেল না সে।হঠাৎই কোনো এক অজানা অন্ধকূপ তলিয়ে গেল সে।কোনোকিছু অনুভব করার অবস্থায় রইলো না সে।শুধু অনুভব করল তার ডান হাতটা কেউ শক্ত করে চেপে ধরে আছে।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |৩৭|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

প্রবল স্রোতের নিচে আভাকে চাপা পড়তে দেখে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল রৌদ্রের।হৃৎপিণ্ড হালকা হয়ে দেহ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়ল।রৌদ্র শক্ত করে ধরে থাকা আভার হাতটা আরো বেশি শক্ত করে চেপে ধরে।আভাকে টেনে নিজের সাথে আগলে নেয়।স্রোত চরে বারি খেয়ে আবারো ফিরে যেতেই আভাকে জরিয়ে পাড়ে চলে আসে রৌদ্র।আভা অনবরত কেশে চলেছে।সকলের দৃষ্টি যায় আভার দিকে।পাড়ে বসে আভাকে নিজের বুকের সাথে চেপে রৌদ্র কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
– কিছু হয়নি আভা।দেখ সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।

– আভার কি হয়েছে?

অভয়ের প্রশ্নে ভীত হয় রৌদ্র।গলা ঝেড়ে আমতা আমতা করে বলে,
– কিছু না।ঐ স্রোত হলো না তাই একটু পানি খেয়ে ফেলেছে।

সমুদ্রের সামনে থাকা রিসোর্টের কৃত্রিম আলোই চারিদিকটা বেশ আলোকিত।রৌদ্র আভাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে অভয়কে বলল,
– অভয় যা তো একটা গরম কাপড় নিয়ে আয়।

আভা পেট মুচড়ে বমি ঠেলে এলো।সমুদ্রের নোনা পানি পেটে ঢুকেছে।গলা বুক জ্বলে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে।আভা “ওয়াক ওয়াক” করে বমি করার চেষ্টা করে।কিন্তু পেট থেকে পানি ছাড়া কিছুই বের হয়না।আভার কোনো জ্ঞান নেই।জ্ঞান থাকতেও যেন সে বেহুঁশ।আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই অনুভব করতে পারছে না সে।রৌদ্র আভাকে বমি করতে দেখে আভাকে সোজা করে বসানোর চেষ্টা করল।তবে আভা নিজের ভর ধরে রাখতে সক্ষম না হয়ে বারবার এলিয়ে পড়ে রৌদ্রের শরীরে।রৌদ্রের হাত পা এখনো কাঁপছে।গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।কিছুক্ষণ আগের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতেই সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তার।আভা রৌদ্রের বুকে চুপটি করে ঝিমাচ্ছে।রৌদ্র আভার মুখে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভেজা চুলগুলো কম্পনরত হাতে সরিয়ে দিলো।আভার কপালে গভীর চুম্বন শেষে শক্ত করে চেপে ধরে নিজের বুকে।
ধীরে ধীরে সম্মতি ফেরে আভার।হুঁশ হতেই সর্বপ্রথম অনুভব করে রৌদ্রের অস্বাভাবিক গতিতে ছুটে চলা হৃদয় স্পন্দ।দূর্বল আভা চিন্তিত হয়।রৌদ্রের বুকের বামপাশে আলতোভাবে হাত রাখে।ধীর গতিতে মাথা তুলে রৌদ্রের মুখের দিকে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলে,
– আপনি ঠিক আছেন?আপনার হার্ট এতো ফার্স্ট বিট করছে কেন?

আভাকে চোখ খুলতে দেখে জ্বলজ্বল করে ওঠে রৌদ্রের চোখমুখ। বুক আভার মাথা সরিয়ে দু’হাতে আভার মুখমণ্ডল আগলে নিয়ে বলে,
– এখন কেমন লাগছে তোমার?পানি খেয়েছ অনেক?ভয় পেয়েছ?

আভা কিছুক্ষণ কাতর চোখে রৌদ্রের দিকে চেয়ে থাকে।কিছুক্ষণ আগে ঘটা ঘটনাগুলো মনে পড়তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আভা।তৎক্ষনাৎ আভাকে আবারো নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রৌদ্র।শান্তনার স্বরে বলে,
– হুঁশশ! কাঁদে না।দেখ,সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।আমরা পাড়ে। আমি আছি তো ভয়ে পেও না।

আভা রৌদ্রের বুকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নাক টেনে বলে,
– এক্ষুনি সব শেষ হয়ে যাচ্ছিল।আমি আমি ভেবেছি আপনাকে আর দেখতে পাবো না।আপনার সাথে আমার আর সংসার করা হবে না।

– কেঁদো না প্লিজ দেখো তোমার কিছু হয়নি।আমারো কিছু হয়নি।আমরা সবাই ঠিক আছি।তুমি আমার সাথে আছো আমি তোমার সাথে আছি।কারো কিছু হয়নি ওটা জাস্ট সামান্য একটা ঢেউ ছিল।

অভয় ক্যাম্প থেকে তোয়ালে এনে দিলো।রৌদ্র আভাকে বুকে রেখেই তোয়ালে দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে দিলো তাকে।আভা রৌদ্রের দিকে দূর্বল চাহনি দিয়ে ও দূর্বল স্বরে বলে,
– পেট জ্বলছে।ছেহ্ কি লবণ পানি।

আভার মুখ ভঙ্গি দেখে এবং বিবৃতিতে উপস্থিত সকলে হেসে দিলো।রৌদ্রের ঠোঁটেও এতোক্ষণে দেখা গেল মৃদু হাসি।আভাকে ধরে আনা হলো ক্যাম্পের সামনে করা বন ফায়ারের কাছে।ঠান্ডায় কাঁপুনি উঠে গিয়েছে মেয়েটার।ক্যাম্পে গিয়ে কাপড় বদলে আবার আগুনে সামনে জড়ো হয় সকলে।হাতের গরম কফি আর বারবিকিউ যেন কিছুক্ষণ আগের সেই থমথমে পরিবেশটা আবারো প্রাণোচ্ছল করে তোলে।
সুন্দর কিছু মুহূর্ত একসঙ্গে কাটানোর পর সকাল হতেই সকলে আবার রওনা হয় নিজেদের বাড়ির পথে।

বাড়িতে ফিরে লিনডা নিজের দেশে ফিরে যায়।অভয় নিজের কাজে অহনা মুন্সি বাড়িতে ফিরে যায়।প্রবহমান সময় যেন গড়িয়ে যায় চোখের পলকে।রৌদ্র আভার সম্পর্কের বয়স বেড়ে হয় এগারোটা মাস।কিন্তু কারো প্রতি কারো ভালোবাসা,যত্ন,শ্রদ্ধা এক বিন্দু পরিমাণও কমে না।রৌদ্র একটি কোম্পানিতে আইটি এন্ড ইনফরমেশন সিকিউরিটি এইচ.টি.এম.এল. ডেভলপার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে।ছয় সংখ্যার বিশাল বেতন পায় সে।পাশাপাশি সপ্তাহে দুই একটা প্রজেক্ট নিয়েও কাজ করে।রৌদ্রের কথা সত্য প্রমাণ করে থার্ড সেমিস্টারে আভার সত্যিই দুইটি কোর্সে সাপ্লি আসে।তবে রৌদ্র এ নিয়ে তেমন কিছু বলেনি।সে দুই কোর্সে আবারো পরীক্ষা দেয় তবে সিজিপিএ তেমন ভালো হয়না।পরের সেমিস্টারে রৌদ্রের গাইডলাইনে হাই সিজিপিএ তোলে আভা।বড়সড় একটি বাসা নিয়েছে রৌদ্র।জায়গা কিনেছে আভা এবং তার নামে।জীবন বেশ ভালো কেটে যাচ্ছে তাদের।আগামীকাল শুক্রবার হওয়ায় রৌদ্রের ঘুমাতে যাওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই।আভা এই নিয়ে চারবার ডেকে গিয়েছে কিন্তু রৌদ্র তার কম্পিউটার রুমে সেই যে ঢুকেছে তার আর কোনো খোঁজ নেই।আভা এবার পা টিপে টিপে রৌদ্রের কম্পিউটার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো।দরজার সাথে কান লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ভিতরে কি চলছে।কিন্তু কোনো টু শব্দও তার কানে এলো না।আভা আগের মতোই সতর্কতার সহিত নিঃশব্দে রুমের দরজা খুলে মাথা গলিয়ে ভিতরে উঁকি দিলো।রৌদ্র এক ধ্যানে বিশালাকৃতির মনিটারে তাকিয়ে।হাতে একটি ফ্যান্সি গেমিং কন্ট্রোলার।আভা মনিটরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পায় সেখানে কার রেসিং ভিডিও গেইম চলছে।তরতরিয়ে আভার মাথায় রাগ উঠে যায়।এদিকে আভা ডেকে চলেছে আর সে বারবার,
– আসছি দাঁড়াও একটা জরুরি কাজ করছি

বলে বলে এখানে গেইম খেলছে?এটা তার জরুরি কাজ?আভা রেগেমেগে ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়েও থেমে গেল।রান্নাঘরে গিয়ে এককাপ কফি তৈরি করে মুখে একটি কৃত্রিম অমায়িক হাসি ফুটিয়ে রৌদ্রের কম্পিউটার রুমে প্রবেশ করে সে।একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কফিটি কীবোর্ডের পাশে রাখে।রৌদ্র একপলক তাকিয়েও দেখলো না আভাকে।সে গেইম খেলায় এতোটাই মগ্ন যে আভা এসেছে তা সে ঠাওর করতে পারিনি।আভা আরো বেশি চটে গেল।সে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল,
– রৌদ্র এটা আপনার জরুরি কাজ?

এতোক্ষণে রৌদ্র আভার দিকে চায়লো।তবে দৃষ্টি স্থির রাখে না।তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে আবারো মনিটরে তাকায়।আভা তা দেখে ঠোঁট গোল করে একটি শ্বাস ছাড়ে।পূর্বের ভঙ্গিতে বলে,
– আপনার জন্য কফি করে এনেছি।

– আভা একটু ওয়েট করো আর ত্রিশ সেকেন্ড পরেই ফিনিশ লাইন ক্রস করবো আর মিশন কমপ্লিট হবে।

রৌদ্রের ব্যস্ত স্বরে এমন বাক্য পছন্দ হয় না আভার।সে সারা ঘরে চোখের মণি ঘুরিয়ে সুইচবোর্ডে রৌদ্রের কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত প্লাগটির দিকে নজর স্থির করে।মস্তিষ্ক জুড়ে খেলে যায় এক শয়তানি বুদ্ধি।ধীর গতিতে সেদিকে এগিয়ে যায়।সুইচবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে রৌদ্রকে একপলক দেখে।রৌদ্রকে দেখতে বেশ লাগছে আবার হাস্যকরও লাগছে।হাঁটু অবধি কালো ট্রাউজার, খালি গা,এলোমেলো চুল আর বরাবরের মতো চোখে সানগ্লাস। আভা ঠোঁট চেপে হেসে সুইচবোর্ডে থেকে প্লাগটি খুলে দিলো।মাত্রই ফিনিশ লাইনটি ছুঁতে চলেছিল রৌদ্র। আচমকাই কম্পিউটার বন্ধ হয়ে গেল তার।রৌদ্র গেমিং কন্ট্রোলারটি নিজের হাঁটুতে বারি দিয়ে বলে উঠলো,
– হো’লি শি’ট!

আভা মুখে হাত দিয়ে হাসে।রৌদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখী স্বরে বলে,
– কি হলো রৌদ্র? ফিনিং লাইন ক্রস করা হলো না বুঝি?

– আ’ম শিওর এটা তুমি করছো।ইচ্ছা করে করছো।ইশশ!আরেকটু হলে মিশন কমপ্লিট হয়ে যেত।

– আও..!আমি করলাম নাকি?আ’ম সো সরি।
আভা এবার রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
– তখন থেকে ডাকছি আমাকে যেন চোখেই দেখছেন না।এসব বাচ্চাদের মতো গেইম না খেলে তো আমাকে একটু সময় দিতে পারেন।তাহলে আমাদের রিলেশনশীপটা আরো হেলদি হয়।

– রিলেশনশীপ হেলদিই আছে আর হেলদির প্রয়োজন নেই তোমাকে আরেকটু হেলদি হতে হবে।তোমাকে একটু ওয়েট গেইন করতে হবে।

– আমি তো খাই কিন্তু শরীরের না লাগলে আমি কি করবো?

– শোনো আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে।চলো আমরা বেবি নিই তাহলে তুমি মোটা হয়ে যাবে।আমি দেখেছি বেবি হলে সব মেয়েরাই গোলুমোলু হয়ে যায়।

আভার রাগ পড়ে গেল।সে লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নত করে ফেলল।
– বেবি?!

বলেই মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে আভা।রৌদ্র বাঁকা হেসে তার দিকে চেয়ে আছে।আচমকাই গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– হ্যাঁ বেবি। বাট এখন না তোমার গ্রাজুয়েশন শেষ হবে।বাড়ি কমপ্লিট হবে তারপর।

আভার মুখটা কালো হয়ে যায়।ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
– কেন এখন না কেন?গ্রাজুয়েশনের পর কেন?বাবু হলে কি সমস্যা?আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করবো কিন্তু বাবুও হবে।

– না আগে গ্রাজুয়েশন।আর তাছাড়া আমি আরেটু সবকিছু গুছিয়ে নিই তারপর।এখনো অনেককিছু বাকি।

– কি বাকি?

– ওটা সারপ্রাইজ।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রৌদ্র।আভাকে কোলে তুলে বেডরুমের দিকে অগ্রসর হলো।
আভাকে কোল থেকে নামিয়ে কাবার্ড থেকে ছোট একটি বাক্স বের করলো রৌদ্র।বাক্সটি খুলে আভার সামনে ধরলো।দেখা গেল একজোড়া পাথর বসানো চুড়ি।পাথরগুলো জ্বলজ্বল করছে,সম্ভবত ডায়মন্ড।আভা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে সে চুড়ি জোড়ার দিক।রৌদ্র চওড়া হেসে বলল,
– বিয়ের পর সেভাবে কোনো গিফট দেওয়া হয়নি এটা তোমার গিফট।

রৌদ্র চুড়ি দু’টো নিজের আভার হাতে পরিয়ে দিলো।প্রথমে ডান হাতে এবং পরে বাম হাতে।আভা হা করে হাত দু’টো চোখের সামনে ধরে তাকিয়ে আছে।সে শুঁকনো ঢোক গিয়ে রৌদ্রের দিকে তাকায়।রৌদ্র আবার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।হাতে আগে থেকে একজোড়া সোনার চুড়ি ছিল।ডায়মন্ডের চিকন চুড়ির সাথে সোনার চুড়ি দু’টো তেমন মানালো না।তাই আভা সোনার চুড়ি খুলে ফেলল।হাত ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,
– খুব সুন্দর।

– কে পছন্দ করেছে দেখতে হবে না?

– আপনি আমার হাতের মাপ জানলেন কিভাবে?

– আমার তর্জনি আর বৃদ্ধ আঙুল এক করলে যতটুকু গোলহয় তোমার হাত ততটুকুই।তাও একবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য তোমার ঘুমের ঘোরে ফিতার মাপ নিয়েছিলাম।

– অনেক সুন্দর হয়েছে।

– তাহলে আমাকে থ্যাংক ইউ কিসি দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি।

শব্দ করে হেসে ফেলে আভা।রৌদ্র চোখ বন্ধ করে ডান গাল এগিয়ে দেয় আভার দিকে।আভা ধীর গতিতে দু কদম এগিয়ে আসে রৌদ্রের কাছে।মুখ এগিয়ে রৌদ্রের গালে ঠোঁট ছোঁয়ানোর আগেই কি মনে করে থেমে যায়।গালে ঠোঁট না ছুঁইয়ে আচমকা ঠোঁট ছোঁয়ায় রৌদ্রের গলার উঁচু অংশে।স্পর্শ স্থির রাখে অনেকটা সময়।চোখ বড় হয়ে যায় রৌদ্রের।শুঁকনো ঢোক গিলতেই আভার ঠোঁটের নিচে থাকা উঁচু অংশটি কেঁপে ওঠে।রৌদ্র অজান্তেই তার ডান হাত আভার কোমরে বিচরণ করে।আভার ছোট ছোট স্পর্শ রৌদ্রের শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।আজ কতগুলো মাস কাছে আসা হয়,ভালোবাসা হয়।তবু যেন দু’জন দু’জনের ছোঁয়ায় নতুনত্ব খুঁজে পায় রৌদ্র আভা।আভা সরে আসতেই অবিলম্বে রৌদ্র মুখ ডুবিয়ে দিলো আভার মসৃণ গলদেশে।ভালোবাসা নাম মাদকে মস্তিষ্ক বিকল হলো একজোড়া বাবুইপাখির।

রৌদ্রের কেনা জায়গার উপর বিশাল কাঠামোর একটি বিলাসবহুল বাড়ি হবে।আজ প্রথম ইট বসানো হবে বাড়ির দালানে।সকলের আনন্দ বাঁধ ভাঙা।আভা এতোটাই খুশি যে থেকে থেকে কিছুক্ষণ পরপর তার চোখে জল জমা হচ্ছে।রৌদ্র চেয়েছিল তার বাবা-মাও আজ এখানে উপস্থিত থাক।কিন্তু তাদের জরুরি কাজের জন্য তারা আসতে পারবেন না।তাই সর্বপ্রথম আভাকেই দেওয়া হলো ইট বসানোর জন্য।সাদা পাঞ্জাবিতে জুম্মার নামাজ শেষে সকলকে একসাথে এখানে নিয়ে জড়ো হয়েছে রৌদ্র।রৌদ্র একটি ইট আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
– ওখানে দাও।

আভা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে ইটটি বসিয়ে দিলো। এরপর রৌদ্র দিলো।আগামীকাল থেকে জোরদারভাবে শুরু হবে বাড়ি বানানোর কাজ।বাড়ির ভীতে ইট বসানো শেষে রৌদ্র তাকে অন্য একটি জায়গায় নিয়ে গেল।সেখানেও ভীত তৈরি করা হচ্ছে।আভা অবাক স্বরে রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করে,
– এটা কি?এখানে আবার কি হচ্ছে?

– মসজিদ। নাম কি দেওয়া যায় বলো তো?

আভা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র নির্বিকার।আভাকে অবাক হতে দেখে সে আভার নাকে টোকা দিয়ে বলে,
– আচ্ছা নাম পরে ঠিক করবো।এখন চলেন এখানেও কনস্ট্রাকশনের কাজ উদ্ভোদন করবেন আমার গুড লাক।

আভা একাধারে মুগ্ধ এবং অবাক।রৌদ্র এখানে মসজিদ তৈরি করছে?কই সে তো কিছুই জানে না।এই সারপ্রাইজের কথায় কি গতকাল রৌদ্র তাকে বলেছিল?অসম্ভব সুন্দর এ সারপ্রাইজ।হৃদয়ে দাগ কেটে গেল এ সারপ্রাইজ।এই মুহুর্তে আভার আরো আরো আরো বেশি ভালোবাসতে মন চায়লো রৌদ্রকে।

চলবে….

#প্রিয়_বালিকা |৩৮|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

মুন্সি বাড়িতে উৎসবের আমেজ।জোড় কদমে চলছে বাড়ি সাফ সাফাইের কাজ।আজ বাড়িতে নতুন সদস্য আসবে।মুন্সি বাড়ির বংশধর অভয়ের রাজকুমার আজ বাড়িতে আসবে।সাতদিন বয়সী রাজকুমারকে স্বাগত জানাতে সকলে ব্যতিব্যস্ত।গাড়ির শব্দ হতেই সকলের চোখমুখ চকচক করে উঠলো।সকলে তড়িঘড়ি বাড়ির বাইরে চলে গেল।আরাভ সাহেবের কোলে অভয়ের রাজকুমার।অভয় দূর্বল অহনাকে ধরে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করছে।অহনার রক্তস্বল্পতার কারণে খিঁচুনি উঠে যায় যার কারণে সাতদিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়।এখন সুস্থ তবে পর্যাপ্ত বিশ্রামের প্রয়োজন তার।প্রেমা সকলের আগে আরাভ সাহবের থেকে ছেলের রাজকুমারকে কলে তুলে নিলেন।
– দেখি আমার দাদুভাইকে আমার কলে দাও।

– দাদুভাই কি শুধু তোমার একার নাকি?আমাদের সকলের রাজকুমার সে।

অহনা দূর্বল ভঙ্গিতে হাসে।বলে,
– বাবা আপনাদের দাদুভাইয়ের নাম ঠিক করেছেন?

চট করে তিন্নি বলে উঠলো,
– আমি ঠিক করেছি একটা নাম।

– কি নাম?
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল অভয়।সকলের দৃষ্টি তিন্নির দিকে সে কি নাম বলবে সকলে তা শোনার জন্য আগ্রহী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
– যেহেতু ভাইয়ার নাম অভয় তাহলে ভাইয়ার বাচ্চার নাম হওয়া উচিত নির্ভীক কি বলো?একই অর্থ।

আভা বিগলিত হেসে বলে,
– খুব সুন্দর নাম।নির্ভীক মুন্সি।এটাই ভালো হবে।

আভা মায়ের কোল থেকে নির্ভীককে কোলে তুলে নিলো।অহনাকে নিচের একটি ঘর নির্ধারণ করে দেওয়া হলো।আপাতত তার সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।তাই সুবিধা মতো তাকে নিচের ঘর দেওয়া হলো।আভা নির্ভীককে কোলে নিয়ে তার সাথে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছে,
– হ্যালো আব্বু আমি তোমার ফুপি।ফুপি তোমাকে অনেক ভালোবাসে।ফুপি তোমাকে একটা ঘড়ি ব্রেসলেট দিবো।একটা ছোট্ট ব্রেসলেট একটা বড় ব্রেসলেট। কেমন?

রৌদ্র আভাকে দেখছে আর ঠোঁট মেলে হাসছে।আভা রৌদ্রের দিকে এগিয়ে এলো।নির্ভীককে রৌদ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– কোলে নিবেন?

– দাও।

রৌদ্র অতি সতর্কতার সাথে কোলে তুলে নিলো নির্ভীককে।আভা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে দু’জনের দিকে।আনমনে বলে ওঠে,
– আপনাকে তো বাচ্চা কোলে সুন্দর লাগে।

– এসব কথায় চিরা ভিজবে না।আগে গ্রাজুয়েশন শেষ করো।

– উফ্ আপনি এতো কঠিন কেন?আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একটু মনটাকে নরম করে ভাবুন তো।

– বললাম না গ্রাজুয়েশন শেষ করো।তাছাড়া বাড়ি শেষ হোক।আর তো মাত্র এক কি দেড়মাসের মতো লাগবে বাড়ি শেষ হতে।আমার বাচ্চাকাচ্চাকে আমি ভাড়া বাড়ি মানুষ করতে চাই না।আর তোমারও তো মনে হয় চারটা সেমিস্টার বাকি আছে না?এতো সময় লাগে তোমাদের গ্রাজুয়েশনে।

– এতো সময় কই?চার বছর।

– আমি তিন বছরে শেষ করেছি গ্রাজুয়েশন।

– তাহলে দেখেন এখনো চারটা সেমিস্টার মানে এখনো কত দেরি রৌদ্র।এতদিন ওয়েট করতে হবে?

– হ্যাঁ।

আভা ব্যর্থ স্বরে বলে,
– ওকে।

– আচ্ছা ও চোখ খুলে না কেন?এতো ঘুমাই কেন?কখনো দেখি না জেগে আছে।যখন দেখি তখনই ঘুমাচ্ছে।

– বাচ্চারা প্রথম এমনই চোখ বন্ধ করে শুধু ঘুমাই।

– কি শান্তি না ওদের।শুধু ঘুমাও আর খাও।খাও আর ঘুমাও।

আভা হেসে বলল,
– হ্যাঁ ঠিক বলেছে।

রৌদ্র কিছুক্ষণ নির্ভীককে কোলে রেখে নাড়াচাড়া করে আবারো আভাকে দিয়ে দিলো।আভা রৌদ্রকে বলল,
– রৌদ্র ওর সাথে আমার কিছু ছবি তুলে দেন না।

রৌদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।আভা সেগুলো দেখে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
– দেখছেন ওকে আমার কোলে কত সুন্দর মানিয়েছে।

– দেখলাম।

– বুঝেছেন আমি কি বলতে চাইছি?

– বুঝলাম।

– তাহলে এখন আপনার কি সিদ্ধান্ত?

রৌদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
– গ্রাজুয়েশন শেষ হবে তারপর।

– ধূ’র বাবা এক কথা জিকির করে যাচ্ছে।

মুখ গোমড়া করে সেখান থেকে অহনার কাছে চলে গেল আভা।আভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসে রৌদ্র।তিন্নি মিন্নিকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
– কি খবর তিন্নি মিন্নি? পড়ালেখা কেমন চলছে?

– ভালো চলছে ভাইয়া।দুপুরে খেয়েছেন?

– হ্যাঁ।অভয়কে দেখলে বলবে আমি একটু খুঁজেছি।

– আচ্ছা।

তিন্নি মিন্নি চলে যায়।রৌদ্র সোফায় বসে টিভি চালু করে।সংবাদ শোনা হয়ে ওঠে না কিছুদিন।আজ একটু বিজনেস নিউজগুলো দেখবে সে।এর মধ্যে অভয়ও হাজির হয় সেখানে।রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করে,
– খুঁজেছিস নাকি শুনলাম?

– হ্যাঁ আয় বস।

অভয় রৌদ্রের পাশে বসে। রৌদ্র সতসক দৃষ্টিতে আশে পাশে তাকিয়ে দেখে নেয় কপউ আছে কিনা।রৌদ্রকে কিছু বলতে না দেখে অভয় বিরক্ত হয়ে বলে,
– কই কি বলবি বল তাড়াতাড়ি।

রৌদ্র নিচু স্বরে অভয়কে ঝাড়ি দিয়ে বলে,
– আরে বলছি তো দাঁড়া না।

– হ্যাঁ তো বল না!

– শোন, আমি তোর বোন মানে আমার বউকে প্রপোজ করতে চাই।ম্যারেজ প্রপোজাল দিতে চাই।তো অনেক এরেঞ্জমেন্ট করতে হবে।তুই কি আমাকে হেল্প করবি?

– বিয়ে প্রপোজাল মানে তোদের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

– হয়েছে কিন্তু অনুষ্ঠান তো হয়নি।এখন অনুষ্ঠান করতে চাইছি।তো বিয়ের আগে ওকে প্রপোজ করতে চাই।তুই ওকে কিছু বলে দিস না আবার ।ও কিছু জানে না।ওকে সারপ্রাইজ দিবো।

– ওকে করবো হেল্প।কিন্তু প্রপোজ করবি কোথায়?

– শ্যামা নদীর পাড়ে।ঐখানে সুন্দর করে ডেকোরেট করে ঐখানে প্রপোজ করতে চাই।

অভয় তৃপ্তির হাসি দেয়।রৌদ্র যে তার বোনের কতবেশি কেয়ার করে তার প্রমাণ সে ক্ষণে ক্ষণে টের পায়।অভয় হাসিমুখে রৌদ্রের কাঁধে হাত রেখে বলে,
– ওকে আমি সব এরেঞ্জ করে করে ফেলবো।তুই টেনশন নিস না।

হাফ ছেড়ে বাঁচে রৌদ্র। অভয় জিজ্ঞেস করে,
– কবে করতে হবে?

– আগামীকাল সব ডেকোরেশন করে ফেলবি।আমি পরশু ওকে প্রপোজ করবো।

– ওকে কাজ হয়ে যাবে।

– থ্যাংক ইউ রে দোস্ত।

– শুধু থ্যাংকস বললে হবে না গিফটও দিতে হবে।

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কি গিফট?

– একটা ভাগ্নে বা ভাগ্নি গিফট দিতে হবে।

রৌদ্র মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– এখন তুইও তোর বোনের মতো শুরু করিস না প্লিজ।

অভয় শব্দ করে হেসে উঠে যায়।রৌদ্রকে বলে,
– আচ্ছা তুই বস আমি একটু অহনাকে দেখে আসি।কিছু খাবি নাকি?

– না তুই যা।

সকাল থেকে অভয় আর রৌদ্র নিখোঁজ। ফোন করলে ফোন ধরে না।কোনো খোঁজ খবর নেই।এদিকে আভাসহ বাড়ির সকলের দুশ্চিন্তায় ঘাম ছুটছে।দুই দু’খানা তরতাজা জোয়ান ছেলে আচমকা বাড়ি থেকে গায়েব?আভা বসার ঘরে পায়চারি করতে করতে বলল,
– এসবের কোনো মানে হয়?কত রাত হলো এখনো দু’জনর একজনেরও কোনো খবর নেই।

আরাভ মেয়েকে উদ্বিগ্ন হতে দেখে বললেন,
– তুই একটু ঠান্ডা হয়ে বস মা।ওরা চলে আসবে এখনই।হয়তো গিয়েছে দুই বন্ধু মিলে কোথাও।

অহনা চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো,
– তাই বলে ফোনটা ধরবে না?

আভা পূর্বের ন্যায় উদ্বেগ স্বরে বলে,
– কিভাবে শান্ত হই বাবা?সকাল থেকে কোনো খবর নেই এতো রাত হতে চললো তবু বাড়ি ফেরার নাম নেই।ফোনটাও ধরছে না।

সকলের উদ্বেগ্নতা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক তখনই বিধস্ত অবস্থায় বাড়িতে প্রবেশ করে রৌদ্র অভয়।তাদের চোখে মুখে ভর করেছে এক রাশ ক্লান্তি।আরাভ সাহেব তাদের দেখে চট করে বললেন,
– ঐ তো ওরা!

সকলে নজর ঘুরিয়ে তাদের দিকে স্থির করলো।আভা রেগেমেগে রৌদ্রের উদ্দেশ্যে বলল,
– এই আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?আর ফোন ধরেন না কেন?

অভয় এবং রৌদ্র চোর ধরা পড়ার মতো মুখ করে ঢোক গিলে।দু’জন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি বলবে।অভয় চোখের ইশারায় বলে,”আমি দেখছি।”তারপর আভাকে বলে,
– আ আমরা তো একটা কাজে গিয়েছিলাম।

– কি এমন কাজ যে ফোনটাও একটু ধরা যায় না?

– আরে ছেলে মানুষের কত কাজ আছে তোরা মেয়ে মানুষ তা কি করে বুঝবি?যা সর সর এখন।আম্মু খিদে পেয়েছে খেতে দাও।

অভয় প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য চেয়ার টেনে খাবার টেবিলে বসে।রৌদ্রও তার পিছুপিছু বসে।আভা এখনো তাদের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সকলের খাওয়া শেষে যে যার ঘরে চলে যায়।রৌদ্র ল্যাপটপে কিছু টাইপ করছে।আবার কখনো ফোনে কাউকে বলছে,”আচ্ছা ওটার সফট কপি আমাকে মেইল করো আমি দেখি একটু।তারপর তোমাকে বলবো কি কি ইম্প্রুভ লাগবে।আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। আচ্ছা তুমি সেন্ড করো।
আভা রৌদ্র চারপাশে গোল গোল হয়ে ঘুরছে আধঘন্টা হবে।রৌদ্র মাঝে মাঝে কোণা চোখে দেখছে আর নিজের কাজ করছে।এমন একটা ভাব সে ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই।অনেকক্ষণ যাবৎ আভাকে নিজের চারপাশে এমন ঘুরতে দেখে এবার রৌদ্র মাথা তুলে বলল,
– কি হয়েছে আমাকে কেন্দ্র করে এমন গোল গোল হয়ে ঘুরছ কেন?ঘুম নেই?

অমনি বিগলিত হেসে দিয়ে ন্যাকা স্বরে বলল,
– আপনিই তো আমার কেন্দ্রবিন্দু তাই না?আপনাকে কেন্দ্র করে ঘুরবো না তো কাকে কেন্দ্র করে ঘুরবো?

রৌদ্র আঁড়চোখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– কি হয়েছে বলো তো?

আভা এবার বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ায়।রৌদ্রকে জেরা করার ভঙ্গিতে বলে,
– ঘটনা কি?সত্যি সত্যি বলেন।আপনারা দু’জন এমন গায়েব হয়ে গেলেন।তারপর আাবার ফিরেও এলেন।এসে বলেন কাজে আঁটকে ছিলেন।কি চলছে আপনাদের ভিতর?সত্যি সত্যি বলেন…

রৌদ্র মুখ বাঁকিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে,
– প্রেম চলছে নাও হ্যাপি?

আভার চোখ বড় বড় করে বলল,
– নাউজুবিল্লাহ!আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দান করুক।

– মরার দোয়া করে দিলে?

– রাত দুপুরে কি সব উল্টো পাল্টা বকছেন আল্লাহ মাবুদই জানে।

রৌদ্র এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– রাত দুপুরে উল্টো পাল্টা বকছেন আপনি মিসেস আফসিন রৌদ্র।টিপিক্যাল বউদের মতো বরকে জেরা করছেন।কাজ থাকতেই পারে তাই বলে রাত দুপুরে এসব আচরণ শুরু করবেন আপনি?মাথাটা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার।

আভার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো।রৌদ্রের শেষ কথায় দুঃখ নেমে এলো আভার মুখে।করুণ স্বরে বলল,
– চলেন ঘুমাবেন।চুল টেনে দিচ্ছি।

রৌদ্র একপলক আভার দিকে তাকিয়ে লেপটপ বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে সারাদিন আজ রোদের মধ্যে দুজনে মিলে সবকিছু ডেকোরেশন করেছে।রোদের তাপে মাথার শিরা উপশিরা পর্যন্ত দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে।আভা রৌদ্রের পাশে গিয়ে বসে।তারপর রৌদ্র বড় বড় মসৃণ চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেয়।একপর্যায়ে ব্যাথাটা এমন তীব্র আকার ধারণ করে যে ব্যাথায় কাতরাতে থাকে শান্ত রৌদ্র।আভা ভেবে পায় না কি করবে।রৌদ্রকে এমন করতে দেখে ভয়ে গলা দেহ থেকে রুহ্ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার।সে উদ্বেগ স্বরে বলে,
– রৌদ্র কি হয়েছে আপনার?বেশি খারাপ লাগছে?ডাক্তার ডাকতে বলবো?

রৌদ্র কোনোমতে বলে,
– না না তুমি এক কাজ করো বরফ নিয়ে এসো।তারপর আমার কপালের এই রগে কিছুক্ষণ ধরো।খুব ব্যাথা করছে।

আভা কিছুক্ষণ ভাবল কি করবে।এমন করা কি ঠিক হবে?তারপর আর সাত পাঁচ না ভেবে রৌদ্রের কথা মতো বরফ নিয়ে এলো সাতে নিয়ে এলো একটা টাফনিল।ওষুধটা রৌদ্রকে খাইয়ে দিয়ে আইস ব্যাগটি রৌদ্রের মাথায় চেপে ধরে সে।ব্যাথা কমে আসতেই ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় রৌদ্র।তার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে আভা।যাক এতোক্ষণ একটু শান্ত হয়েছে।দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে রৌদ্রের কপালে চুম্বন করে সে।

ঘুমের মধ্যে কেউ আভার হাত,পা,মুখ বেঁধে কাঁধে তুলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।ঘুম ছুটে যেতেই ছটফট শুরু করে সে।মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ করে,
– উম উম উম…

মনে মনে ভাবে কে হতে পারে?রৌদ্র? নাকি অন্যকেউ? না না তার ধারণা মতে রৌদ্রের সামনে থেকে তাকে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার সাহস কেউ করবে না।তাহলে এটা রৌদ্রই হবে।কি করতে চায়ছে লোকটা?কালকের মাথা ব্যাথা কি এখনো রয়ে গেল?যার জন্য এমন পাগলামো করছে সে?

চলবে….

#প্রিয়_বালিকা |৩৯|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভা অনবরত লাফিয়ে চলেছে।তার চোখ,মুখ,হাত এখনো বাঁধা।রৌদ্র কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে আভার দিকে।মেয়েটা শান্ত থাকতে পারে সবসময় তিড়িং বিড়িং করে।রৌদ্র বিরক্ত হয়ে বলে,
– উফ্ লাফানো বন্ধ করবে তুমি?একটু শান্ত হয়ে থাকতে পারো না।এমনভাবে লাফাচ্ছ মনে হচ্ছে কেউ তোমার শরীরে আগুন দিয়ে দিয়েছে।

– উম্ উম্

– দাঁড়াও তো খুলছি।

রৌদ্র কপাল কুঁচকে রেখেই প্রথমে আভার হাতের বাঁধন খুলে দেয়।হাত ছাড়া পেয়ে আভা নিজেই চটজলদি মুখ আর চোখ থেকে বাঁধন খুলে ফেলে।বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়।ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
– আরে আপনি তো দেখছি একেবারে গুন্ডা। আমাকে এভাবে কিডন্যাপ করার মানে কি?আমি আপনার নামে অপহরণের মামলা করবো।

– হয়ে গিয়েছে?শেষ?

রৌদ্রের এমন চড়া বাক্যে আভা ভোঁতা মুখে আমতা আমতা করে বলে,
– হ..হ্যাঁ।

রৌদ্র নাক কুঁচকে বলে,
– দুই মিনিট একটু শান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারো না!উফ্ এতোটুকু আনতে গিয়েই আমার দম বেরিয়ে গেল।

আভা মুখ ভেঙচি দিয়ে চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে দৃষ্টি ফেলল।সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো সে।এতো সুন্দর করে নদীর পাড়টাকে সাজিয়েছে কে?কৃত্রিম সাদা ফুলে সজ্জিত জায়গাটা।সাদাফুলের মধ্যে ভিন্ন রঙের ফুলে সজ্জিত বড় একটি হার্টশেপ।টকটকে লাল রঙের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।গাছে এবং চিকন সুতা টেনে হাতে আভার বিভিন্ন সময়ের ছবি টানানো হয়েছে।রৌদ্রের সাথেও রয়েছে কিছু ছবি।সব ছবিই ক্লিক করেছে রৌদ্র।সবগুলো ছোট ছোট করে বের করে সুতার সাথে ক্লিপ দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।ছবির নিচে এক কি দুই শব্দের ছোট্ট ছোট্ট নোট।আভা এগিয়ে এলো একটি ছবির কাছে।যেটাতে সে এবং রৌদ্রের হাসোজ্জল মুহুর্ত বন্দী। আলতো হাতে ছবিটি ধরে নিচে লেখা নোটটি মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে পড়লো,”হানি এন্ড আইসক্রিম”
আভার ঠোঁট প্রসারিত হলো।সে পিছন ফিরে রৌদ্রের দিকে তাকায়।রৌদ্র তার দিকেই তাকিয়ে।আভাকে তাকাতে দেখে কোমল স্বরে বলে,
– ইউ আ’র মাই হানি,আ’ম ইওর আইসক্রিম।

আভা মৃদু শব্দে হেসে মাথা নত করে ফেলে।ধীর পায়ে রৌদ্রের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
– তা হঠাৎ এসব কেন জনাব?

পরমুহূর্তেই কিছু মনে পড়ে যেতেই আভা অস্থির ভঙ্গিতে বলল,
– এই গতকাল আপনি আর ভাইয়া এইসব করেছেন?

রৌদ্র চোখের ইশারায় এবং মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

– তা এসব কেন শুনি?

– বলছি বলছি দাঁড়াও।

বলতে বলতে রৌদ্র নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দিলো।পকেট থেকে বের করল একটি ছোট্ট বক্স।কালো বক্সটি সাদা ফিতায় বাঁধা।বক্সটি খুলে আভার সামনে এক হাঁটু গেড়ে তা আভার দিকে এগিয়ে দিলো।বক্সটিতে থাকা ছোট পাথরের আংটিতে সূর্যের আলো পড়তেই ঝিলিক দিয়ে উঠলো তা।রৌদ্র ভারি এবং শীতল কন্ঠে বলল,
– উইল ইউ ম্যারি মি মিসেস আফসিন রৌদ্র?

আভা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে।এই মুহুর্তে সে এমন কিছু আশা করেনি।আভা ঘন পলক ফেলে কোনো কিছু না ভেবে বলে উঠলো,
– মানে?

রৌদ্রের রোম্যান্টিক মুডের দফারফা করার জন্য এই একটি শব্দই দরকার ছিল।রৌদ্র নিজেকে সংযত করতে ঠোঁট গোল করে একটি শ্বাস ছাড়ে।তারপর আবার হাসি হাসি মুখ করে থেমে থেমে বলে,
– আই সেইড উইল ইউ ম্যারি মি মিসেস আফসিন রৌদ্র?

রৌদ্রের এমন কথা তৎক্ষনাৎ ধরতে পারে না আভার মস্তিষ্ক।সে তো রৌদ্রেরই বউ তাহলে রৌদ্র আবার তাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করছে কেন?আভা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– নিজেই তো বলছেন মিসেস আফসিন রৌদ্র। আবার বলছেন “উইল ইউ ম্যারি মি” বিয়ে না হলে মিসেস আফসিন রৌদ্র হলাম কি করে?

রৌদ্র আবার তপ্ত শ্বাস ফেলে।ভীষণ রাগ হচ্ছে তার আভার উপর।একটা সামান্য সেন্টেন্স বুঝতে পারে না!রাগটাকে দমিয়ে কটমট করে বলল,
– হ্যাঁ বিয়ে হয়েছে।অনুষ্ঠান তো হয়নি।তাই বাড়ি উঠবো যেদিন সেদিন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সবাইকে তোমার সাথে আমার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।তখন থেকে এটাই বলে যাচ্ছি কিন্তু তুমি এমনই গাঁ’ধা যে একটা সামান্য সেন্টেন্স বুঝতে পারো না।

আভার মুখ গোমড়া হয়ে যায়।মাথা নিচু করে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– আমি কি করে বুঝবো আপনি এতোসব প্লান করেছেন?আমাকে কি কিছু বলেছেন আপনি?

– এবার তাড়াতাড়ি বলেন আপনি কি আমার বউ হিসেবে সবার সাথে পরিচিত হতে রাজি?আরো একবার কবুল বলতে রাজি? হাঁটু ব্যাথা হয়ে গেল আমার!

আভা ঝড়ের গতিতে মাথা নাড়িয়ে রৌদ্রকে ধরে উঠিয়ে দিলো।রৌদ্র চোখ মুখ খিঁচে পা একবার ভাঁজ করছে আরেক বার মেলে দিচ্ছে।পায়ে ব্যাথা হয়ে গিয়েছে তার।আভা রৌদ্রের হাতে থাকা আংটির দিকে তাকিয়ে বলল,
– বাহ্ খুব সুন্দর তো আংটিটা।

রৌদ্র পায়ের ব্যাথায় আংটির কথা ভুলেই গিয়েছিল।আভার কথায় সে আংটির দিকে তাকালো।আংটিটি বের করে বক্সটি আবারো পকেটে ঢুকে আভার সামনে হাত বাড়িয়ে দিলো।আভা রৌদ্রের হাতে হাতের উপর হাত রাখলে অনামিকায় আংটিটি পরিয়ে দিলো রৌদ্র।তৎক্ষনাৎ আংটির উপর মৃদু শব্দে একটি চুমু খেলো।আভার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এবার আমার বউ বউ লাগছে।চুড়ি, রিং পারফেক্ট বিবাহিত নারী।

আভা মুখ ফুলিয়ে বলল,
– বিবাহিত নারী?!কেমন শোনালো যেন।

– তো কি অবিবাহিত বলবো?

– না..বিবাহিত নারীই ঠিক আছে।কিন্তু একটা জিনিস নেই।

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কি?

– নাকফুল।

– নাক ছিদ্র করা আছে?

– না।

– তাহলে থাক দরকার নেই আর ছিদ্র করার।নাকফুল পরতেই হবে এমন কোনো নিয়ম নেই।সো ওটা স্কিপ করলাম।

আভাও এ নিয়ে আর মাথা ঘামালো না।এখন নাক ছিদ্র করতে গেলে সে ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করবে।তার থেকে রৌদ্রের কথায় মানায় শ্রেয়।রৌদ্র আভার দুইহাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে আভাকে নিজের কাছে টেনে নিলো।আদুরে স্বরে বলল,
– হার্টবিটটা একটু গুণে দাও তো।

আভা স্মিত হেসে রৌদ্রের বামপাশে মাথা রাখে।চোখ বন্ধ করে অনুভব করে রৌদ্রের হৃৎস্পন্দন।রৌদ্র শক্ত করে আভাকে নিজের সাথে আগলে নেয়।কয়েক মুহুর্তের দু’জনেই ভুলে যায় পৃথিবীর সকল চিন্তা চেতনা। বুঁদ হয়ে থাকে একে অপরের শরীরের সুমিষ্টঘ্রাণে।দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষে নিরবতা ভেঙে রৌদ্র বলল,
– কতটা হলো?

আভা বুকে মাথা রেখেই জবাব দিলো,
– ৭৮ টা।

ঠোঁট প্রসারিত করে আভাকে বুক থেকে ওঠালো রৌদ্র।আভার কপালে নিজের ঠোঁটের কলঙ্ক ছুঁইয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে।বলল,
– ঠিক তো?

– কোনো সন্দেহ আছে?

– একবারের জন্য মনোযোগ ক্ষু’ন্ন হলো না?

– হলো না।

– কেন?

– কারণ আপনাতে মনোযোগ দিতে আমার কষ্ট হয়না।তাই মনোযোগ ক্ষুন্নও হয় না।

– মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ভালোবাসা বেশি দৃঢ়।কিন্তু কখনো কখনো মনে হয় তোমার ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা স্বাদহীন বিবর্ণ একবিন্দু পানির ফোঁটা মাত্র।

– কখনো কখনো একবিন্দু পানি অভাবে মানুষের প্রাণহীন হয়।আপনার ঐ একবিন্দু ভালোবাসায় আমার জন্য যথেষ্ট রৌদ্র।

রৌদ্র বাকরুদ্ধ হয়ে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে তার প্রিয় বালিকার দিকে।আভার প্রণয় মাখা বাক্যের বিপরীতে সে একটি শব্দই উচ্চারণ করে,
– ভালোবাসি।

আভা কোনো প্রতিত্তোরে করে না।নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে থাকে রৌদ্রের দিকে।মুখে কোনো শব্দ উচ্চারিত না হলেও তার চাহনি রৌদ্রের কানে কানে বলে,
– আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি রৌদ্র।

রোজ রাতে খাওয়ার টেবিলে মুন্সিবাড়ির প্রতিটি সদস্যকে পাওয়া যায়।আজও তার ব্যতিক্রম নয়।সকলে নিশ্চুপ হয়ে খাবার খাচ্ছে।রৌদ্র সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
– আমি ঠিক করেছি বাড়ি হয়ে গেলে একটা অনুষ্ঠান করবো।আভা আর আমার বিয়ে তো হুট করেই হয়ে গিয়েছে।তাই এখন একটু অনুষ্ঠান করে সকলের দোয়া নিতে চাই।

আরাভ সাহেব রৌদ্রের প্রস্তাবে খুশি হয়ে বলেন,
– এ তো খুব ভালো খবর।তা কবে করবে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছ?

– আগামী মাসেই বাড়ি আর মসজিদ কমপ্লিট হয়ে যাবে।আগামী মাসেই করতে চাচ্ছি।

তিন্নি উৎফুল্লতা নিয়ে বলে,
– ভাইয়া বিয়ে কি মসজিদে হবে?

– তেমনটাই ইচ্ছা আছে।

– আমারও না মসজিদে বিয়ে করার খুব ইচ্ছা।

অভয় মুখ বাঁকিয়ে বিদ্রুপ করে বলল,
– এহ্ এখনো মাধ্যমিক শেষ করতে পারলো না আবার বিয়ে!ঠা’স করে লাগাবো কানের নিচে একটা।

তিন্নি ন্যাকা স্বরে প্রেমার দিকে তাকিয়ে বলে,
– বড় মা…

প্রেমা অভয়কে চোখ রাঙিয়ে বলল,
– কিরে অভয় বিয়ে হলো এক বাচ্চার বাপ হলি তাও বাচ্চাদের মতো বোনদের সাথে ঝ’গড়া করা ছাড়তে পারলি না?

আভাও সায় দিয়ে বলে,
– হ্যাঁ তাই দেখো আম্মু আস্ত একটা বে’য়াদব ছেলে।

প্রেমা আভার দিকেও চোখ গরম করে তাকালো।রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে কোমল হেসে বলল,
– আব্বু তোমার বাবা-মাকে জানিয়েছ?তারা কি আসবেন?

– হ্যাঁ জানিয়েছি।আসবে মম আর ড্যাড।

আচমকা আভা বলে উঠলো,
– সাথে আবার ঐ লিনডা ফিনডাও আসবে নাকি?

বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো আভা।আঁড়চোখে বাবার দিকে একপলক তাকিয়ে ধীরে ধীরে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সকলের দিকে তাকালো।সকলে তার দিকেই তাকিয়ে।তা দেখে বোকা হাসি দিলো আভা।রৌদ্র ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
– না ও ওর বয়ফ্রেন্ডে সাথে মালদ্বীপে গিয়েছে।

আভা নিজের মনে মনে বলল,”ভালোই হয়েছে মেয়েটা সবসময় আমাকে এটা ওটা বলে অপমান করত।”

– মা বাবা কবে আসবে?

– মাসের প্রথমেই চলে আসবে।এমনই তো বলল।

তিন্নি উত্তেজিত হয়ে বলে,
– ইয়াহু..!খুব মজা হবে বিয়েতে।অনেক খাওয়া দাওয়া হবে।অনেক ছবি তোলা হবে।

অভয় খোঁচা দিয়ে বলে,
– শুধু খাওয়া আর খাওয়া হচ্ছিস তো ফুটবল।

– ভাইয়া….!

চলবে….

প্রিয় বালিকা পর্ব-৩২+৩৩+৩৪+৩৫

0

#প্রিয়_বালিকা |৩২+৩৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

রৌদ্র বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে বলে,
– আবার লিনডা কেন?অভয় তো উকিল ঠিক করেছে।

রোদেলার পাশে দাঁড়ানো প্যান্ট-শার্ট পরা সোনালি চুলের মেয়েটি রাগে কটমট করে বলে,
– ও ইয়াহ্ অভেয়!হোয়ার ইজ হি?

অভয় কান থেকে ফোন নামাতে নামাতে থানার ভিতরে প্রবেশ করছিল।তার এমন বিকৃত নাম শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে।এগিয়ে এসে গম্ভীর স্বরে বলে,
– এই তো আমি।এমন উদ্ভট নামে কে ডাকে আমাকে?

লিনডা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিছন ঘুরে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় অভয়ের।লিনডাকে এমন সময় এখানে দেখে ঘাবড়ে যায় সে।ভয়ে শুঁকনো ঢোক গিলে মেকি হাসে।বোকা বোকা হাসি দেখে লিনডার মেজাজ আরো বিগড়ে যায়।অভয় বোকা বোকা ভঙ্গিমায় বলে,
– আপু তুমি এখানে?

লিনডা এবার ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে অভয়ের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলে,
– অভেয় তুমি থাকতে আমার ভাইয়ের সাথে এমন দূর্ঘটনা ঘটলো কিভাবে?

রৌদ্র বিদ্রুপের হাসি হেসে নিজে নিজেই বিড়বিড়য়ে বলে,”হাহ্!ও আছে বলেই আমার সাথে সব দূর্ঘটনা ঘটে।সবই তাহার কুদরত।”

এদিকে অভয় লিনডার এমন কড়া প্রশ্নে ঘাবড়ে যায়।আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করে।লিনডা অভয়কে উপেক্ষা করে ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে অফিসারের দিকে এগিয়ে যান।সেগুলো অফিসারকে দেখানো হয়।আভা চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।মাঝে মাঝে গোল গোল চোখে রৌদ্রকে দেখছে।রৌদ্রও কিছুক্ষণ পরপর আভাকে দেখছে।অভয় আভার পাশে এসে দাঁড়ায়।আভা নিচু স্বরে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– ইনি কে?

অভয়ও আভার মতো ফিসফিস করে উত্তর দেয়,
– রৌদ্রের দূরসম্পর্কের খালাতো বোন।

– উকিল?

– হুম।

আবারো নির্বাক হয়ে যায় দু’জনে।বেশ খানিকটা সময় ধরে আলাপ আলোচনা চলে লিনডা এবং অফিসারের মধ্যে।আলাপ আলোচনা শেষে জানানো হয় রৌদ্রের বেল পাশ হয়েছে।অফিসার লিনডা আর রৌদ্রকে আশ্বস্ত করেন তারা চেষ্টা করবে কোন কোম্পানি কম্পিউটারটি ইম্পোর্ট করেছে এবং কে সর্বপ্রথম এই কম্পিউটারটি কিনেছেন তা জানার।আসল দোষীকে খুঁজে বের করবেন বলে আশ্বাস দেন তারা।
ছেলেকে বের করে দিতেই রোদেলা ছেলেকে নিজের বাহুতে আঁকড়ে ধরে।রৌদ্রও নাকে আলিঙ্গন করে।মায়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দেয়।রোদেলা রৌদ্রকে ছেড়ে শক্ত গলায় বলেন,
– তুই এখনই আমাদের সাথে অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবি।

বুকটা মুহুর্তেই ভারি হয়ে আভা এবং রৌদ্রের।রৌদ্র শূন্য দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকায়।আভা দূরে দাঁড়িয়ে মলিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।রৌদ্র একটি ছোট ঢোক গিলে মাকে একনজর দেখে হাতের ইশারায় আভাকে কাছে ডাকে।আভা ভয়,সংকোচ নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় রৌদ্রের কাছে।রৌদ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
– মম, মিট মাই ওয়াইফ আভা বিনতে আরাভ।

রোদেলা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আভাকে পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করে। গম্ভীর ভঙ্গিমায় মুখ ঘুরিয়ে থানার দরজা দিয়ে বাহিরে তাকায়।গলাটা ধরে আসে আভার।চোখে টলমল করে নোনাজল।তবু ভাঙা গলায় বলে,
– আসসালামু আলাইকুম মা।

মায়ের এমন আচারণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রৌদ্র।গলা ঝেড়ে নিচু স্বরে বলে,
– লিসেন মম,ওর পাসপোর্ট ভিসা করা হয়নি তো এখনো তাই আমরা এই মুহুর্তে অস্ট্রেলিয়া ফিরতে পারছিনা।

রোদেলা ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে।রৌদ্র অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নত করে।চট করে মাথা কিছু আসতেই আবারো মাথা তুলে মাকে বলে,
– মম এখানে আমি একটা ফ্লাট নিয়েছি সেখানে কিছুদিন থেকে যাও তুমি আর লিনডা।

রোদেলা গম্ভীর স্বরে বলে,
– না আমার কাজ আছে আমরা আবারো ফ্লাইট ধরবো,লিনডা চল।

কথাটি শেষ করে থানা থেকে বের হয়ে গেলেন রোদেলা।পিছু পিছু সকলে বের হলো।রৌদ্র জোর পায়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আহত স্বরে বলে,
– মম আ’ম সরি। সেদিন ফোনে তোমার সাথে অমন ব্যবহার করাটা আমার উচিত হয়নি।আ’ম সো সরি।প্লিজ ফর গিভ মি।

রোদেলার স্বর কিছুটা নরম হলো,
– ইট’স ওকে।

রৌদ্র আগের ভঙ্গিতে বলে,
– মম কিছু দিন থেকে যাও না আমাদের সাথে প্লিজ।

আভাও রৌদ্রের সাথে সায় দিয়ে রোদেলাকে বলে,
– জ্বী মা কিছুদিন থেকে যান।

লিনডা এতক্ষণ আভাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করছিল।হঠাৎ তার মনে হলো সে কিছুদিন এখানে থাকতে চায়।তাই সে দৌড়ে গেল খালার কাছে।খালার একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানে ফিসফিস করে বলে,
– আন্টি কিছুদিন থেকে যাই না।দেখি এই মেয়ের মধ্যে রৌদ্র এমন কি দেখেছে যে এই মেয়েকে বিয়ে করে এই দেশে সেটেল্ড হয়েছে।আমরাও তো দেখি এই মেয়ের মধ্যে এমন কি আছে।প্লিজ তুমি আর না করো না।

রোদেলা লিনডার যুক্তিসঙ্গত কথায় কিছুক্ষণ ভাবতে বসে আসলেই কি তার এখানে থাকা উচিত কি না।ভাবাভাবি শেষে গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে থাকার জন্য সম্মতি জানায়।সঙ্গে সঙ্গে পুলকিত মনে রৌদ্র আভা দু’জনে দুজনের দিকে চায়।লিনডা মুখ বাঁকিয়ে আভার দিকে এগিয়ে আসে।আভার থুঁতনি ধরে আভার মুখটা উঁচিয়ে এদিকে ওদিকে দেখে।রাস্তার উপর লিনডার আচরণ আভাকে বিব্রত করে।লিনডা এবার আভার কোঁকড়ানো লম্বা চুলগুলো ধরে টেনে টেনে দেখে।রৌদ্রের ভ্রু কুঁচকে আসে।রাগও হয়।আভাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গভীর পরখ শেষে লিনডা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– কার্ল হেয়ার?নাইস।ডার্ক স্কিন, ইট’স হরারেবল!জিরো ফিগার,হা?জিম করো নাকি?উম… নট ব্যাড এট অল।

রাস্তার উপর আভার এমন বর্ণনায় রাগ হলো রৌদ্রের।আভার চোখ ভরে এলো কান্নায়।রৌদ্র কঠিন স্বরে বলে,
– আহ্ লিনডা কি হচ্ছে কি এসব রাস্তার উপর?আমার বউয়ের দর্পন হতে বলেছি তোমাকে?ওর দর্পন হওয়ার জন্য আমি আছি।ওর একমাত্র জীবন্ত দর্পন আমি হবো।

রৌদ্রের এমন প্রেমিক পুরুষের মতো উক্তি পছন্দ হয় না লিনডার।রাগে ক্ষোভে মুখ বাঁকিয়ে রোদেলার হাত ধরে এগিয়ে যায় সামনে।অভয় অফিসারের সাথে এতক্ষণ কিছু কথা বলছিল।কথা শেষ করে বেরিয়ে আসে সে।অপরাধী ভঙ্গিতে ক্ষমা চায় রৌদ্রের কাছে,
– রৌদ্র আমাকে ক্ষমা কর।তখন হুট করে মাথা এতোকিছু আসেনি আমার।আমি যদি বুঝতে পারতাম এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাহলে আমি কখনোই পিসিটি নিতাম না।মাফ করে দে ভাই।

রৌদ্রের মায়া হলো অভয়ের এমন করুণ স্বরে। রৌদ্র কোমল হেসে অভয়ের চুল এলোমেলো করে দেয়।শক্ত আলিঙ্গন করে বলে,
– আরে আমাকে কি তুই বোনের জামাই ভাবতে শুরু করলি নাকি রে অভয়?ওহ্ সরি অভেয়!

রেগে যায় অভয়।রাগি স্বরে বলে,
– রৌদ্র একদম মজা করবি না।আচ্ছা তোরা বাড়ি যা আমি সন্ধ্যার দিকে একবার যাবো।এখন একটু কাজ আছে।

রৌদ্র হেসে অভয়ের পিঠ চাপড়ে বলে,
– অপেক্ষা করবো কিন্তু।

অভয় উপর নিচ মাথা বোনের মাথা হাত বুলিয়ে দেয়।বোনের মাথায় হাত রেখেই রৌদ্রের উদ্দেশ্যে করুণ স্বরে বলে,
– অনেক কাঁদছে মেয়েটা তুই আবার বকাবকি করিস না।

আভা লাজুক ভঙ্গিমায় মাথা নত করে ফেলে।রৌদ্র আড়চোখে আভাকে দেখে অস্পষ্ট হাসে।যে হাসওর চিহ্ন চোখে শুধু চোখে ফুটে ওঠে।ঠোঁটে সে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই।অভয় চলে গেল নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে।রৌদ্র আভার ডানহাতের কব্জি শক্ত করে নিজের হাতে আবদ্ধ করে ফেলে।দূর্বিষহ এক মুহুর্ত শেষে স্বস্তির শ্বাস ফেলে পা ফেলে বাড়ির উদ্দেশ্যে।রোদেলা এবং লিনডাকে একটি ক্যাবে উঠিয়ে ঠিকানা এবং চাবি দিয়ে দেয়।নিজেরাও অপেক্ষা করে আরেকটি ক্যাবের জন্য।আভা চুপচাপ মাথা নত করে রৌদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর রৌদ্র নিঃশব্দে আভাকে একহাতে জরিয়ে শক্ত করে আভার বাহু চেপে ধরল।নরম সুরে টেনে টেনে বলল,
– উফ্ এতো কান্না!আমার জন্য এতো কান্না?যদিও আমার কিন্তু ভালোই লেগেছে।তোমাকে কাঁদলে খুব সুন্দর লাগে।আমার তো এখন ইচ্ছা করছে একটা থাপ্পড় দিয়ে তোমাকে কাঁদিয়ে দিয়ে আমি গালে হাত দিয়ে বসে বসে দেখি।

রৌদ্রের কথা শেষ হতে না হতেই আভা আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রৌদ্র।সে তো মজা করেই বলছিল আভাকে আবারো কাঁদতে দেখবে।কিন্তু আভা যে সত্যি সত্যি এখন এই রাস্তার উপর কান্না শুরু করবে তা সে বুঝতে পারিনি।রৌদ্র তৎক্ষনাৎ কালবিলম্ব না করে আভার সামনে এসে আভার মুখটা নিহের হাতের আদলে নিয়ে নেয়।নিজের বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে যত্নের সাথে চোখের পানি মুছে দেয়।আদুরে স্বরে বলে,
– একি আভা তুমি তো দেখি সত্যি সত্যি কান্নাকাটি শুরু করে দিলে।প্লিজ কেঁদো না।রাস্তার উপর এভাবে কাঁদলে মানুষ ভাববে আমি একটা খারাপ জামাই যে বউ পিটিয়ে তক্তা করে ফেলছে।আর নাহলে ভাববে আমি ছেলেধরা তোমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।

রৌদ্রের কোনো কথায় আভার কান্না থামাতে সফল হলো না।আভা আগের মতোই কেঁদে চলেছে।রাস্তার লোকজন অদ্ভুত নজরে দেখছে আভা এবং রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র তাদের দিকে তাকিয়ে মেকি হাসে।তাদের মধ্যেই একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এলেন।সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দু’জনকে পরখ করে আভার দিকে তাকিয়ে বলেন,
– কি হয়েছে মামনি?এই ছোকরা কি তোমারে বিরক্ত করতেছে? তোমার কি কোনো হেল্প লাগবে?

লোকটি এবার রৌদ্রের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের লাঠি দিয়ে রৌদ্রের পেটে খোঁচা দেয়।অনবরত খোঁচা দিতে দিতে বলেন,
– এই ছোকরা দেখে তো ভদ্রলোক মনে হচ্ছে।তা তোমার বুকে ছাতি ক খানা শুনি?থানার সামনে দাঁড়িয়ে মাইয়াগো লগে টাংকি মারো?থানায় নিয়ে যখন সিদ্ধ ডিম পশ্চাতে প্রবেশ করাইবে তখন বুঝবা আসল মজা।

কথাটি শেষ করেই লোকটি নিজের লাঠি দিয়ে রৌদ্রের থাইয়ের উপর হালকা আঘাত করলেন।রৌদ্র থতমত খেয়ে বড় বড় চোখে বলে,
– আ আ আরে দাদু ও আমার বউ।

বৃদ্ধ রৌদ্র কথা শোনা মাত্রই দ্বিগুণ তেঁ তেঁ উঠলেন,
– ওই ওই অমনি বউ হইয়া গেল?যেই মাইয়া দেখ হেরেই বউ বউ লাগে তাইনা?বুঝি না ভাবছ কিছু?চুল তো আর বাতাসে পাকে নাই।এই বয়স আমিও পাড় করে আসছি।যৌ’বনের জ্বালা বড় জ্বালা।

রৌদ্র বৃদ্ধের লাঠির আঘাত থেকে বাঁচতে আভার চারপাশ ঘুরছে।বৃদ্ধও রৌদ্রের পিছু পিছু ঘুরে ঘুরে তেড়ে যাচ্ছে।রৌদ্র চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে,
– আরে দাদু ও সত্যিই আমার বউ।আরে বউ তুমি কিছু বলো না কেন?

বৃদ্ধ বললেন,
– ওই কি কইবে?তোমারে আইজকা থানায় নিয়ে যদি থার্ড ডিগ্রি না দিছি তই আমার নামও জুলফিকার মোল্লা না।

রৌদ্র দৌড়াতে দৌড়াতে করুণ স্বরে বলে,
– আরে জুকার দাদু ও সত্যি আমার বউ।আর আভা তুমি কেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো?কিছু বলতে পারছ না?

আভা কান্না থামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে মিটিমিটি হাসছে।বৃদ্ধ আবারো লাঠি উঁচিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
– ওই ছোকরা কি বললে তুমি আমি জুকার?তোমারে তো আজকে আমি থার্ড ডিগ্রি দিয়েই ছাড়বো।

আভা এতক্ষণে মুখ খুলে।এবার কাছে একটু বেশি বেশি লাগে।সে রৌদ্রকে আঁটকে নিজের পাশে দাঁড় করায়।বাহু ধরে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়।বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে হাত উঠিয়ে বলে,
– দাদু দাদু থামুন প্লিজ উনি সত্যিই আমার বর।

বৃদ্ধ দমে গেলেন।তীক্ষ্ণ নজরে আভা এবং রৌদ্রকে দেখলেন।রৌদ্র আভার কথার সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে আভাকে নিজের সাথে আরেকটু চেপে ধরে।বৃদ্ধ বলেন,
– তাহলে তুমি কাঁদছিলে কেন?নিশ্চয়ই ঐ তোমাকে মারছে তাইনা?নারী নির্যাতন তাই না?মামনি তুমি ভয় পাইয়ো না।তুমি আমারে কও ঐ তোমার উপর অনেক নির্যাতন করে তাইনা?

রৌদ্র বিস্মিত চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে।সে আর নির্যাতন?বরং তাকে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হচ্ছে।আভা শব্দ করে হাসে।বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে বলে,
– না না দাদু উনি আমাকে মারবে কেন?উনি খুব ভালো।আমি তো এমনই কাঁদছিলাম।আসলে আমার চোখে যে কি হয়েছে শুধু পানি পড়ে।

বৃদ্ধ সন্দিহান দৃষ্টিতে আভা-রৌদ্রকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে।দৃষ্টি ভঙ্গি একই রেখে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– ও এই কথা?ঐ ছোকরা ওরে একটা ভালা ডাক্তার দেখাইতে পারো না?

এর মধ্যে হাজির হয় রৌদ্রের বুক করা ক্যাব।রৌদ্র যেন প্রাণ ফিরে পেল।আভার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বৃদ্ধকে বলে,
– দাদু আজকে আসি।আমাদের ক্যাব চলে আসছে।আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

আভাও পিছন ফিরে মিষ্টি হাসি দেয়।বৃদ্ধের মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে মোলায়েম হাসি।মনে পড়ে যায় রঙিন দিনের সুন্দর সুন্দর স্মৃতি।যেগুলোর ভারে আজ সে নুইয়ে পড়েছে।সেওতো তার স্ত্রী হাত ধরে এভাবে হেঁটেছে কত।আজ দুই বছর তার স্ত্রী নেই।এই লম্বা লাঠিটাই এখন তার হাঁটার সঙ্গি।কথাগুলো এলোমেলো ভাবে মস্তিষ্কে বিচরণ করতেই দীর্ঘ এক শ্বাস বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে।সাদা চুলের বৃদ্ধ লাঠির শব্দ ঠকঠক শব্দ তুলে হাঁটা শুরু করে নিরুদ্দেশ গন্তব্যে।

গাড়িতে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে রৌদ্র।আভা উপর ভিষণ রাগ করেছে সে। আভার জন্য তাকে কত কি শুনতে হলো।আভা বুঝতে পারছে রৌদ্র তার উপর রেগে আছে তাই সেও বেশি ঘাটায় না রৌদ্রকে।কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে গলা ঝাড়ছে সে।আবার কখনো খুক খুক করে কাশছে।রৌদ্র বিরক্ত হয়ে দাঁত কিড়মিড় দিয়ে বলে,
– কি হয়েছে কি?যক্ষা হয়েছে নাকি?

থতমত খেয়ে যায় আভা।মুখে হাত দিয়ে নড়েচড়ে বসে।বলে,
– যক্ষা হবে কেন?এমনই গলাটা কেমন যেন আঁটকে আঁটকে আসছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আভা আবারো উশখুশ করতে করতে বলে,
– আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?

রৌদ্র এবার আভার দিকে ঘুরে বসে।রাগি স্বরে বলে,
– তখন এমন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ন্যাকা কান্না করলে কেন?

আবা ক্ষেপে যায়।কোমরে হাত বেঁধে বলে,
– কি আমি ন্যাকা কান্না করেছি?

– যেটা বলেছি সেটার উত্তর দাও।

– আসলে তখন আমি অনেক্ক্ষণ পর আমার সাথে এতো ভালো করে কথা বললেন যে আমি আর নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না।তাছাড়া আপনি এতো তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন সে খুশিতেও কান্না চলে এসেছে।

আভার কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে রৌদ্র।বিড়বিড় করে বলে,”ড্রামা কুইন!”
কথার মাঝেই বাসায় পৌঁছায় তারা।ফ্লাটে প্রবেশ করলে বসার ঘরে পায় রোদেলা এবং লিনডাকে।রৌদ্র বিস্মিত কন্ঠে বলে,
– একি তোমরা এখন ফ্রেশ হওনি?

রোদেলা বা লিনডা কেউই কোনো উত্তর করে না।রৌদ্র বুঝতে পারে তারা কোন ঘরে ঢুকবে হয়তো তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে।তাই এখনো কোনো ঘরে প্রবেশ করেনি।রৌদ্র এবার তাদের পাশের বড় রুমটি দেখিয়ে বলে,
– মম তোমরা এই রুমটা ইউজ করতে পারো।এটা ফাঁকা থাকে।

রোদেলা আর এক মুহুর্ত দেরি করে না আভার দিকে জহুরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে রুমে চলে যায় সে।লিনডাও একই দৃষ্টি ফেলে আবার দিকে তারপর রোদেলার পিছুপিছু সেও রুমে প্রবেশ করে।আভা কিছু একটা ভেবে ভ্রু কুঁচকায়।ভাবুক স্বরে রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করে,
– আচ্ছা লিনডা আপনি কি খ্রিস্টান?

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।টেবিল থেকে পানি ঢেলে মুখে তুলতে তুলতে বলে,
– হ্যাঁ।অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর লিনডার মা মমকে অনেক হেল্প করেছে তাই ওদের সাথে আমাদের বেশ একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে।

আভা এবার সন্দিহান স্বরে বলে,
– ভাইয়া ওনাকে আপু বলল।আপনি নাম ধরে ডাকেন কেন?

রৌদ্র নাক সিটিয়ে বলে,
– ও আমাদের থেকে বড় তাই অভয় আপু বলে।বাট আমি বলিনা কারণ ছোটবেলা থেকে ওকে নাম ধরে ডাকা অভ্যাস তাছাড়া আমি আবার কাউকে আপু টাপু বলতে পারি না।

আভা মুখ ভেঙচি দিলো।কোনো রকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেল রৌদ্রের মায়ের জন্য রান্না করতে।কিন্তু সেখানে পড়ে আরেক যন্ত্রণায়।কন্টিনেন্টাল রান্না করবে নাকি বাঙালি খাবার রান্না করবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেয়ে গেল সে।অনেক ক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয় সে বাঙালি খাবার রান্না করবে।এতো বছর তো ও দেশে বিদেশি খাবারই খেয়ে এসেছে।এখন দেশে এসেও যদি বিদেশি খাবার খায় তাহলে দেশে থাকার আসল মজাটা পাবে না।তাই আভা খুব যত্ন সহকারে রোদেলা এবং লিনডার জন্য বাঙালি কিছু পদ রান্না করে।রৌদ্র অভয়ের সাথে কম্পিউটার দেখতে বাইরে বের হয়েছে।রাত হয়েছে অনেক কিন্তু আসার নাম নেই।তাই আভা চিন্তা করে রোদেলা ও লিনডাকে আর বসিয়ে না রেখে খাবার খেতে দিয়ে দেওয়া যাক।এক ডাক দুই ডাকের পর টেবিলে আসে রোদেলা লিনডাও রোদেলার পিছুপিছু এসে রোদেলার পাশের একটি চেয়ার টেনে বসে।রোদেলা গম্ভীর স্বরে বলে,
– রৌদ্র এখনো আসেনি?

আভা অতি কোমল স্বরে বিনয়ী ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
– না আসলে ওনার কিছু প্রজেক্ট সাবমিট করার কথা কিন্তু কম্পিউটার তো পুলিশে নিয়ে গিয়েছে তাই নতুন কম্পিউটার দেখতে গিয়েছেন ওনি আর ভাইয়া।

রোদেলা আগে ভঙ্গিতে বলে,
– তাহলে ও আসলে খেতাম।

আভাও তার কোমলতা বজায় রেখে উত্তর করে,
– ওনার আসতে কত সময় লাগবে না লাগবে ততক্ষণ আপনারা বসে থাকবে? তার থেকে আপনারা খেয়ে নেন।উনি আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো।

রোদেলা আর কথা বাড়ায় না।আভা একে একে রোদেলা ও লিনডার প্লেটে খাবার তুলে দেয়।তারা খাবার মুখে তোলে তবে তাদের মুখভঙ্গিতে আভা বুঝতে সক্ষম হয় না খাবারটি তাদের কেমন লেগেছে।কত বছর পর রোদেলা বাঙালি খাবার মুখে তুলেছে।বেশ জব্দ করে রেঁধেছে মেয়েটা খাবারগুলো।তবে সে চোখেমুখে তার অনুভূতি প্রকাশ করে না।লিনডার কাছেও খাবারগুলো বেশ ভালোই লাগে।কিন্তু সেও ভান ধরে বসে আছে।পাথরের মূর্তির মতো দু’জনে খাবার খেয়ে উঠে গেল।কেমন কি হয়েছে একবারের জন্য বলেও না।আভা মনে মনে ভাবে,”মনে হয় খারাপ হয়নি।হলে তো নিশ্চয়ই এমন চুপচাপ খেয়ে উঠে যেত না।আমাকে কচলে কচলে ধুয়েমুছে ফেলত।যখন কিছু বললনা তখন মনে হয় ভালোই হয়েছে।তাছাড়া আমিও তো চেক করে দেখেছি অনেকবার খারাপ হয়নি খেতে।বরং অনেক ভালোই হয়েছে।”

রোদেলা ঘরে যেতে যেতে বলে,
– আমি অনেক টায়ার্ড ঘুমাতে যাচ্ছি।রৌদ্র এলে ওকে খেতে দিও।

লিনডা মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
– রাতের বেলা আবার বাসায় হাঁটাচলা করো না।এমনিতেই নতুন জায়গা তার উপর আমি আবার ভুতে ভয় পায়।

লিনডা কথাটা যে আভার গায়ের রং নিয়ে বলেছে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না আভার।লিনডার কথায় বুক ফেটে কান্না এলো আভার।তবু নিজেকে শক্ত রেখে সে দাঁড়িয়ে মাথা কাঁত করে সায় দেয়।মনে মনে ভাবে,” সে তো এতোটাও কালো না যতটা কালো লিনডা বোঝাতে চেয়েছে।হ্যাঁ সে লিনডার কাছে রৌদ্রের কাছে ভুতুড়ে কালো।কিন্তু এমনিতে তো তার গায়ের রং সোনালি বর্ণের।কালো নয়।” দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আভা।

অনেকটা রাত করে বাড়িতে ফেরে রৌদ্র।ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে টেবিলে হরেক রকম পদ দেখে বলে,
– এতো আইটেম? কখন রান্না করলে?

আভা রৌদ্রের পাতে খাবার তুলে দিতে দিতে বলে,
– এই তো করলাম।ভাইয়া আসেনি কেন?

– বলল কি কাজ আছে নাকি।জোর করলাম তাও এলো না।

– আপনার বাবা আসেনি যে?

– ড্যাড আসছিল। কিন্তু লিনডা আসবে শুনে লিনডাকে টিকেট দিয়ে দিয়েছে।আর ড্যাডের বিজনেস ট্রীপ আছে নাকি একটা সে জন্য আর আসেনি।লিনডা আসছে শুনে নিশ্চিত ছিলো আমার বেল হয়ে যাবে।আর তোমাকে তো একটা কথা বলায় হয়নি।

রৌদ্র কথাগুলো বলতে বলতে কাটা চামচ তুললো।আভা চুপচাপ গম্ভীর ভঙ্গিতে রৌদ্রের পাশে এসে দাঁড়ায়।কোনো কথা না বলে রৌদ্রের থালার খাবার মাখিয়ে রৌদ্রের মুখের সামনে ধরে।রৌদ্র চোখ ফেড়ে তাকিয়ে আছে তার বউয়ের দিকে।আভা বিরক্তি স্বরে বলে,
– কি হলো হা করুন।

রৌদ্র মুচকি হেসে ছোট একটা হা করে।আভা যত্নসহকারে রৌদ্রের গালে খাবার তুলে দেয়।আভা এক নালা দুই নালা করে বেশ অনেকটা খাবার খাইয়ে দেয় রৌদ্রকে।রৌদ্র মুগ্ধ নয়নে চেয়ে খাবার খায়।দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে আলতো হাসেন রোদেলা।নিঃশব্দে আবারো ঘরে চলে যান।খাবার শেষে রৌদ্রের মুখ ওড়না দিয়ে মুছে রৌদ্রের কানে আভা হিসহিসিয়ে বলে,
– আমি কিন্তু এখন সুস্থ।

চট করে রৌদ্র বলে ওঠে,
– গ্রীন সিগনাল দিচ্ছ?

রৌদ্রের এমন বাক্যে লজ্জায় নুইয়ে যায় আভা।হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দৌড়ে ঘরে চলে যায়।রৌদ্র সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।সেদিকে তাকিয়েই কয়েক ঢোক পানি পান করে।টেবিলে খাবার রেখে সেও আভার পিছু পিছু নিজের ঘরে ছোটে।আভাকে পিছন থেকে নিজের বাহুতে আঁকড়ে ধরে আভার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
– গ্রীন সিগনাল দিয়ে এভাবে পালালে তো চলবে না।কোওপারেট করতে হবে তো নাকি?

বলেই রৌদ্র আভার কানে শব্দ করে একটি চুমু খায়।সঙ্গে সঙ্গে সেই শব্দের দাপটে কেঁপে ওঠে আভা।সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে শরীর শীতল হয়ে আছে।আবা লজ্জায় দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলে।ছটফট করে রৌদ্রের বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য।স্পর্শকারত পৃষ্ঠের গভীরতায় রৌদ্রের প্রবেশ আভাকে অসম্ভব আলোড়িত করে তোলে।নিঃশ্বাসের গতি বৃদ্ধি হয় মানব-মানবীর।রৌদ্র আভাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তর্জনির বিচরণ চালায় সর্বত্র মুখমণ্ডলে।ঠোঁট ও নাকের পৃথককারী শূণ্য স্থানে তর্জনি স্থীর রেখে বলে,
– সেদিন এই পর্যন্ত এসেছিলাম না?

আভার কন্ঠনালি থেকে একটি ধ্বনিও উচ্চারিত হয় না।রৌদ্রকে বড্ড অচেনা লাগছে তার।এমন অসভ্য রৌদ্রকে সে আগে কখনো দেখিনি।কি নেশাল তার কন্ঠস্বর!সেই স্বরে বুঁদ হয়ে আছে আভা।রৌদ্র শুঁকনো ঢোক গিলে আভার ওষ্ঠ-অধরে চেয়ে।বিকল মস্তিষ্কে কোনো কিছু ভাবতে না পেরেই স্পর্শ করে সে কোমল মেয়েলি ওষ্ঠ-অধর।তড়িৎ খেলে যায় আভার সারা শরীরময়।রৌদ্রের সময় থমকে যায় আভার মোহিত অধরে!

চলবে….

#প্রিয়_বালিকা |৩৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভা পিটপিট করে চোখ খুলতেই মুখের সামনে রৌদ্রকে অনাবৃত বক্ষে দেখে ঘাবড়ে গেল।রৌদ্র পাশ ফিরে একহাতে তালুতে মাথার ভর দিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।চোখ দু’টো লাল টকটকে হয়ে আছে তার।রৌদ্রের এমন লাল টকটকে চোখ দেখে অবাক হয় আভা।মনে মনে ভাবে “লোকটা কি সারারাত ঘুমাইনি?সারা কি এভাবেই পলকহীন তাকে দেখে চলেছে লোকটা?” ভাবতে ভাবতে আরো বেশি বিস্ময় নেমে এলো আভার চোখে মুখে।গতরাতে রৌদ্রের করা সকল অসভ্যতামির একঝলক চোখের সামনে ধরা দিতেই লজ্জায় নুইয়ে যায় আভা।নাক পর্যন্ত থাকা পাতলা কাঁথাটি টেনে মাথার উপর পর্যন্ত ঢেকে ফেলে।আভাকে কাঁথা নিচে ঢুকে যেতে দেখে আলতো হাসে রৌদ্র।গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে ভারি কন্ঠে বলে,
– আচ্ছা আভা ধরো তোমার সামনে তোমার প্রিয় দশজন মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো।যেমন-তোমার মা,বাবা,ভাই,তোমার ছেলে-মেয়ে আর আমি।তারপর তোমাকে বলা হলো তুমি এখান থেকে যে কোনো একজনকে বাঁচাতে পারবে।তখন তুমি কাকে বাঁচাবে?

সকাল সকাল এমন হাড় ভাঙা কঠিন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল আভা।মাথার ঘিলু জমাট বেঁধে শক্ত পাথর হয়ে গেল।তব্দা খেয়ে কাঁথা থেকে মাথা বের করে সে।রৌদ্র এখনো আগের মতোই হাতের তালুতে মাথার ভর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আভা কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।সকলেই তার প্রিয় মানুষ।একজনকে রেখে অন্যজনকে সে কিভাবে বাঁচাবে?সকাল সকাল রৌদ্রের থেকে এমন প্রশ্ন পেয়ে রৌদ্রের উপর ভিষণ রাগও হয় তার।সে কপাল কুঁচকে বলে,
– সকাল সকাল এমন উদ্ভট প্রশ্ন করার মানে কি?

রৌদ্র মৃদু হেসে বলে,
– আহা বলোই না।

আভা এক ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান স্বরে বলে,
– আমি কি বাঁচবো?

রৌদ্র কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– না ধরো একজনকে বাঁচানোর পর তুমিও মারা যাবে।

আভা এবার ভাবতে শুরু করে তার কাকে বাঁচানো উচিত।কিছুক্ষণ ভাবি ভাবির পর রূঢ়ভাবে বলে,
– আপনাকে তো বাঁচাবো না এটা শিওর।

রৌদ্র আভার এমন উত্তরে সামান্য অবাক হয়।মাথা থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসে।মেকি হাসি দিয়ে বলে,
– কিহ্?নিজের স্বামীকে বাঁচাবে না?কিন্তু কেন?

আভাও উঠে বসে এবার।এলোমেলো মৃদু কোঁকড়ানো চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।শরীরে রৌদ্রে কালো শার্ট।দেখতে অসম্ভব মোহনীয় লাগছে তাকে।আভা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে রৌদ্রকে বোঝাতে শুরু করে কেন সে রৌদ্রকে বাঁচাবে না।
– দেখুন একজনকে বাঁচানোর পর তো আমি বাঁচবো না তাই আমি আপনাকে বাঁচাবো না।

আভার যুক্তির “য” ও বুঝতে পারে না রৌদ্র।চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে আভার দিকে।আভার এমন বেহুদা যুক্তি শুনে বেশ রাগ লাগে তার।রাগি স্বরে বলে,
– মানে কি?তুমি বাঁচবে না বলে আমাকে বাঁচাবে না?

আভা নির্বিকার ভঙ্গিতে টেনে টেনে সুর দিয়ে বলে,
– হ্যাঁ…আপনাকে বাঁচাবো আর তারপর আপনি নতুন আরেকটা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করবেন আর সুখে সংসার করবেন তা তো হবে না।আমি মরলে আপনিও আমার সাথে মরবেন।

আভার এতো গভীর চিন্তা ভাবনা দেখে বিস্ময়ে কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসে রৌদ্রের।পরমুহূর্তেই শরীর কাঁপিয়ে অট্টহাসি দেয় সে।সে হাসছে আর আভার গায়ের উপর ঢলে ঢলে পড়ছে।রৌদ্রের এমন রাক্ষসে হাসির কারণ খুঁজে পায় না আভা।ভ্রু কুঁচকে কোণা চোখে তাকিয়ে দেখে রৌদ্রকে।রৌদ্র কোনো মতে হাসি থামিয়ে বলে,
– আচ্ছা তো কাকে বাঁচাবে?

চট করে জবাব দেয় আভা,
– কাউকেই বাঁচাবো না।নিজেই সু’ইসাইড করবো।

আভার শেষ বাক্যে থমকে যায় রৌদ্র।বাক্যটি পছন্দ হয়নি তার।মুহুর্তের মাঝে গম্ভীর হয়ে যায় সে।চুপচাপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে,
– যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।আমাকে একটার আগে ডাকবে না।

আভা অবাক ভঙ্গিমায় বলে,
– আপনি ফ্রেশ হবেন না?

রৌদ্র মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে তর্জনি দেখিয়ে বলে,
– আমি ফ্রেশ হয়েছি এখন থেকে প্রায় দুইঘন্টা আগে।

আভা আর কোনো উত্তর করে না।বিছানা থেকে নেমে যায়।রৌদ্র কাঁথার ভিতর থেকে শুরু চোখ দু’টো বের করে আভার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে।হাঁটু অবধি রৌদ্রের শার্ট ছাড়া আর কোনো বস্ত্রের আবরণ দেখা গেল না।আভার অনাচ্ছাদিত মেয়েলি পা দেখে শুঁকনো ঢোক গিলে রৌদ্র।চোখ খিঁচে বন্ধ করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বলে,
– শ শোনো প্যান্টস পরো।

আভা রৌদ্রের এমন উক্তিতে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু না ভেবেই বলে,
– কেন?

আভার অবুঝের মতো প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয় রৌদ্র।কঠিন স্বরে বলে,
– এমনিতেই সারারাত তোমার দিকে চেয়ে থেকে তোমাকে পাহারা দিয়েছি।এখন একটু ঘুমাতে চাই বুঝলে?

রৌদ্রের কথায় আভার গাল গরম হয়ে যায়।সে দুই হাতে গাল চেপে ধরে দৌড়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে সকলের জন্য সকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ দু’টো ক্লাস ছিল একটা ক্লাস ক্যান্সেল হয়েছে আর একটা ক্লাস আছে দুইটা ত্রিশে।রান্না শেষ করে আভা সবাইকে সকালের খাবার পরিবেশন করে নিজে রেডি হয়ে নেয়।একটা ত্রিশ বাজে রৌদ্র এখনো ঘুম।খাওয়ার সময় রোদেলা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে রৌদ্রের কথা।রোদেলা ডাকাতে আভাও করেকবার ডেকেছে রৌদ্রকে।না পেরে রোদেলাকেও পাঠিয়েছে ডাকতে।রোদেলা ডাকতে এলেই রৌদ্র ঘুমের ঘোরে বলেছে,
– মম প্লিজ দুপুরের আগে আমাকে ডেকো না।রাতে কাজ করতে হবে।

আভা রেডি হয়ে রৌদ্রকে ডাকে।কয়েকবার নড়েচড়ে আবার উপুড় হয়ে ঘুমায় রৌদ্র।এবার আভা বিরক্ত হয়।রৌদ্রকে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলে,
– রৌদ্র উঠেন রৌদ্র!দেখেন তো ওয়াইফাই কাজ করছে না কেন?রৌদ্র?কই উঠলেন?

রৌদ্র বিরক্তিতে “চ্” শব্দ করে।আভা একাধারে রৌদ্রকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে আর ডেকে চলেছে।রৌদ্র রেগেমেগে উঠে বসে।চোখ দু’টো এখনো ঘুমে বুঁজে আসছে।চোখমুখ ফুলে গিয়েছে তার।বিরক্তিতে ঝাড়ি দিয়ে বলে,
– কি হয়েছে?

– ভার্সিটিতে যাচ্ছি আমি।আর ওয়াইফাই কাজ করছে না কেন একটু দেখেন।

রৌদ্র চোখ ডলতে ডলতে বিছানা ছেড়ে উঠে এলো।আভার হাত থেকে ফোন নিয়ে দেখল কেন কাজ করছে না।যেহেতু রৌদ্রকে হাইস্পিড নেটওয়ার্কে কাজ করতে হয় সে জন্য সে সম্পূর্ণ আলাদা একটি রাউটার ব্যবহার করে।সেই ওয়াইফাই-এ কানেক্ট করে দেখল সেটাতেও সমস্যা।ভ্রু কুঁচকে এলো রৌদ্রের।আভা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে পায়ে বডি লোশন দিচ্ছে আর আয়না থেকে রৌদ্রকে দেখছে।লোকটা এতো বেশি মোহনীয় কেন?তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে।আভা আয়না থেকে রৌদ্রকে দেখতে দেখতে বলে,
– কাল রাত থেকে প্রথমটা সমস্যা আর আজ সকালে সেকেন্ডটায় সমস্যা হয়েছে।

রৌদ্র বিছানায় ফোন ছুঁড়ে ওয়াশ রুমে যেতে যেতে বলে,
– দেখছি।

ফ্রেশ হয়ে একটি গ্রে রঙের পোলো টিশার্ট গায়ে দেয়।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আভাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে বলে,
– এতো সাজতে হবে কেন?ক্লাসে যাচ্ছো নাকি ফ্যাশান শো করতে যাচ্ছো?চলো তাড়াতাড়ি।

আভা অবাক স্বরে বলে,
– আপনিও যাবেন নাকি?না না আপনার যাওয়া লাগবে না।আপনি মা আর লিনডা আপুকে নিয়ে খাবার খান।

রৌদ্র কোনো কথা না বলে শান্ত দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে রইলো।সেই দৃষ্টি দেখেই আভার সব হাওয়া ফুস করে বেরিয়ে গেল।সেও আর বাড়তি কোনো কথা বলে না।ভার্সিটি কাছেই পাঁচ ছয় মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায়।পাশাপাশি হেঁটে চলেছে আভা-রৌদ্র।দু’জনই নিশ্চুপ।আচমকা দু’জন একসাথে বলে ওঠে,
– কিছু বলার ছিল।

দু’জনই অবাক হয়ে গেল।পরমুহূর্তেই দু’জনই মৃদু হাসে।রৌদ্র কোমল স্বরে আভাকে বলে,
– আগে তুমি বলো।

আভাও চিকন স্বরে অতি কোমলতার সহিত বলে,
– বাবা ফোন করেছিল।মা আর সবাইকে নিয়ে যেতে বলেছে।আম্মুও ফোন করে যেতে বলেছে।

রৌদ্র এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেল।হঠাৎই কোনোকিছু চিন্তা ভাবনা করতে বসে গেল।আভা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– আপনি না কি বলবেন?বলুন।

রৌদ্র ভাবুক স্বরে বলে,
– আম্মু যেতে বলেছে কিন্তু আমি আর অভয় তো আগামী সপ্তাহেই সুন্দরবন যাওয়ার প্লান করেছিলাম।

আভা পুলকিত স্বরে বলে,
– সত্যিই আমরা সুন্দরবন যাবো?তাহলে চলেন কাল পরশু বাড়িতে যায় তারপর ঐখান থেকেই নাহয় সুন্দরবন যাবো।আমার আইডিয়া কেমন লাগল বলুন?

রৌদ্র মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– ভালো বাট তোমার যে এই সেমিস্টারে সবগুলা সাবজেক্টে সাপ্লি আসবে এটা আমি শিওর।শুধু শুধু আমার কতগুলা টাকা খরচ হতে চলেছে।

আভা তেঁ তেঁ উঠল।মুখ ভেঙচিয়ে বললো,
– আপনাকে কে বলেছে আমার সাপ্লি আসবে?আর আসলেও কি?আপনার থেকে টাকা নিবো না।আপনার টাকা দেওয়া লাগবে না।

– অ্যান্ডেন্সে পাবে জিরো। আর জিরো পেলে সাপ্লি শিওর।তারপর আবার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমার কতগুলো টাকা খরচা হবে।

রৌদ্রের কথায় শরীর জ্বলে উঠলো আভার।রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে মুখ ঝামটি দিয়ে গটগট করে হেঁটে ডিপার্টমেন্টের ভিতর চলে গেল।বিড়বিড় করে বলল,”ওনার টাকা নেওয়ার জন্য বসে আছি তো আমি।বদ লোক!”রৌদ্র আভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অকৃত্রিম হাসে।চুলে আঙুল চালিয়ে কালো ট্রাউজারের পকেটে হাত পুরে নিজের গভীর কন্ঠে গুণগুণ করে সুর তুলতে তুলতে পদচারণ করে বাসার দিকে।

আভা ক্লাস করে বাড়ি ফিরে চারটার দিকে।বাসায় ঢুকতেই শুনতে পায় রৌদ্র এবং রোদেলার মধ্যে একপ্রকার কথা-কাটাকাটি চলছে।আভাদের বাড়িতে যাওয়া নিয়ে।রোদেলা কিছুতেই যাবে না আভার বাড়ি।এদিকে রৌদ্র তার মাকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে।রোদেলার হাজার কথার এক কথা,
– আমি যাবো না ব্যস।

রৌদ্র করুণ স্বরে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে,
– মম দেখ তারা বার বার ফোন করে বলছে যাওয়ার জন্য না গেলে কতটা ম্যানারলেস দেখায় ভাবতে পারছো তুমি?

ফ্লাটের দরজা খোলায় ছিল।তাই আভা বাইরে দাঁড়িয়েই সবটা শুনতে পায়।আভা গলা ঝেড়ে শব্দ করে ভিতরে প্রবেশ করে।তৎক্ষনাৎ চুপ হয়ে যায় রৌদ্র। আভার দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের কম্পিউটার ল্যাবে চলে যায়।নতুন কম্পিউটার আনা হয়েছে।সেগুলো সব সেট-আপ করতে হবে।রোদেলাও কোণা চোখে আভার দিকে তাকিয়ে ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।আভা চট করে রোদেলাকে জিজ্ঞেস করে,
– মা দুপুরে খেয়েছেন?

রোদেলা আভার দিকে না তাকিয়েই দায়সারাভাবে মুখ দিয়ে শুধু একটা সম্মতিসূচক শব্দ উচ্চারণ করেন,
– হুম।

আভা আবারো বিনয়ী স্বরে জিজ্ঞেস করে,
– লিনডা আপু খেয়েছেন?

এবারো রোদেলা একইভাবে জবাব দেয়,
– হুম।

এরপর আর কোনো কথা বলার সাহস হয় না আভার।রোদেলাও আর একমুহূর্তে সেখানে দাঁড়ায় না।আভা ধীর পায়ে রৌদ্রের কম্পিউটার রুমে ঢোকে।রৌদ্র প্রচন্ড গতিতে কীবোর্ডে আঙুল চালিয়ে কিছু টাইপ করছে।আভা নিঃশব্দে রৌদ্রের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে,
– মা যদি যেতে না চায় তাহলে তাকে জোর করার দরকার নেই।

রৌদ্র আঙুল থামিয়ে দেয়।চোখ বন্ধ করে জোরে একটি শ্বাস নিয়ে বলে,
– আমার কথা হলো কেন যাবে না মম?তারা এতোবার বলার পরও কেন যেতে চায়বে না সে?

– দেখুন রৌদ্র সবাই সবখানে কমফোর্টেবল হবে তার কোনো মানে নেই।মা যেতে চায়না।তাকে জোর করার কোনো দরকার নেই।

রৌদ্র আভাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখল।মেয়েটাকে অনেকটা ক্লান্ত লাগছে।একদিকে পড়াশোনা, ক্লাস,অন্যদিকে সংসার রান্নাবান্না।সব একসাথে কত সুন্দর সামলে নিচ্ছে মেয়েটা।রৌদ্র ছোট্ট একটি শ্বাস ফেলে বলে,
– ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও।

আভা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।বেডরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।রৌদ্রও আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।

চলবে….

#প্রিয়_বালিকা |৩৫|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সুন্দরবনের পথে রওনা হচ্ছে রৌদ্র-আভা,অভয়-অহনা এবং লিনডা।আভাদের বাড়িতে আসার পর এখানে দুইদিন থেকে আজ সেখান থেকেই শীপে করে সুন্দরবন ভ্রমণে বেরিয়েছে পাঁচজন।রোদেলাও শেষ পর্যন্ত আভার বাবার বাড়িতে আসতে রাজি হয়।আভার বাবা-মা তাদের আতিথেয়তা দিয়ে রোদেলার মন জয় করে নেন।তাকেও সুন্দরবন যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল কিন্ত সে কিছুতেই রাজি হয়নি।তিনি আবারও অস্ট্রেলিয়া ফিরে গিয়েছেন।শুধু মাত্র লিনডা যাচ্ছে রৌদ্রদের ভ্রমণসঙ্গী হয়ে সুন্দরবন।শীপ ভাড়া করা হয়েছে তিনদিন দুইরাতের জন্য।শীপ মোংলা হয়ে করমজল, তারপর দুবলার চর যাবে।দুবলার চরে রৌদ্র এবং অভয় ক্যাম্প তৈরি করবে।সকাল ছয়টার কিছু সময় পর শীপে পৌঁছাল সবাই। মাঝারি আকারের শীপটিতে তিনতলা।শীপটি খুব সুন্দর করে গোছানো।বিভিন্ন রঙের আলোতে সজ্জিত।সকলের কাছে আলাদা আলাদা নিজস্ব ব্যাগ।রৌদ্র শীপে উঠে আভার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো।আভা সেই হাতের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে একপলক রৌদ্রের মুখের দিকে চায়ল।সেও ঠোঁট চওড়া করে আভাকে হাত ধরার জন্য ইশারা করে।আভা চোখ সরিয়ে রৌদ্রের হাতে ডুবিয়ে দিলো।যত্নশীল রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে অভয়ের ঠোঁটেও ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।সেও অহনার দিকে হাত এগিয়ে দেয়।অহনা রৌদ্রকে নকল করতে দেখে অভয়ের হাতে ঠাস করে একটি চর মেরে নিজেই উঠে গেল।অভয় হাবলার মতো তখনো হাত পেতে রয়েছে।লিনডা মুখ ভেঙচি দিয়ে অভয়ের সেই পেতে রাখা হাতে ভর দিয়ে শীপে উঠে পড়ল।উপর থেকে আভা এবং রৌদ্র তা দেখে শব্দ করে হেসে ফেলে।অহনা অভয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সে ঠোঁট উল্টিয়ে তড়িঘড়ি শীপে উঠে পড়ে।সাতটা বাজতেই শীপ যাত্রা শুরু করে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে।চওড়া নদী বেয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে শীপ।চারপাশে গাছপালা আর জনবসতি।অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর জনবসতি দেখা গেল না।শুধু গাছপালা আর বন-জঙ্গলের ঠাঁসাঠাসি।রৌদ্র তার ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী করছে প্রতিটি মুহুর্তে।হঠাৎই ফ্রেমে আঁটকে যায় কালো শারী পরিহিত এক রমনী।ধীর পায়ে সে রৌদ্রের দিকেই এগিয়ে আসছে।আভা নায়িকাদের মতো হেলেদুলে এগিয়ে এসে রৌদ্রের চারপাশে একবার চক্কর দিলো।রৌদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে আভাকে দেখছে।আভা একটু দূরে দাঁড়িয়ে মডেলের মতো বিভিন্ন পোজ দেয়।পোজ গুলো অনেকটা্ আবেদনময়ী ছিল।রৌদ্র সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো পোজ ফ্রেমবন্দী করে ফেলে।শব্দ করে হেসে দু হাত মেলে দেয় আলিঙ্গনের উদ্দেশ্যে।আভাও আর দেরি না করে হেসে দৌড়ে রৌদ্রকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে।তারা এই মুহুর্তে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের সামনে থাকা চিকন গলিটিতে রয়েছে।সেখানে তারা ছাড়া আর কেউ নেই।আভা রৌদ্রের বুকে থুতনি ঠেকিয়ে রৌদ্রের মুখের দিকে তাকায়।রৌদ্র সেভাবেই পরম যত্নে আভার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।আরো শক্ত করে আভাকে নিজের সাথে চেপে ধরে বলে,
– ভালো লাগছে?

আভা রৌদ্রের বুকে নাক ঘষতে ঘষতে উত্তর দেয়,
– হুম।

রৌদ্র আভার মাথায় আঙুল চালিয়ে বাহিরে নজর দেয়।বাতাসের তান্ডবে শরীরের ভর শীপে রাখাই দুষ্কর হয়ে উঠেছে।আভাকে একহাতে ধরেই অন্যহাতে ক্যামেরা তুলে আরো কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল।আচমকা উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠলো,
– দেখো হরিণ।

আভা এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে রৌদ্রের বুকে মাথা দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল।এই প্রসস্থ বুকে সে পৃথিবীর সকল সুখ একসাথে খুঁজে পায়।এখানে মাথা রাখার পর দিন দুনিয়ার কোনো চিন্তা,কষ্ট,ক্লান্তি তাকে ছুঁতে পারে না।আপনা আপনিই চোখের পাতা এক হয়ে যায়।রৌদ্রে উৎফুল্ল স্বর শুনে আভাও রৌদ্রের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে চায়।রৌদ্র আচমকা আভাকে ছেড়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আভাকে ছাড়ার সময় সামান্য ধাক্কা অনুভব করে আভা।আভা অবাক চোখে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে নাক ফুলায়।রাগি স্বরে বলে,
– এই আপনি আমাকে ধাক্কা দিলেন কেন?

সহসা আভার এমন কথা শুনে কিছু বুঝে উঠতে পারে না রৌদ্র।বিস্মিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকে আভার দিকে।অবাক স্বরে বলে,
– কোথায় ধাক্কা দিলাম?

আভা এখনো নাক মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে।ফোঁসফোঁস শব্দ করে চলেছে।রৌদ্রের দিকে তর্জনি তুলে শক্ত কন্ঠে বলে,
– আপনি আর আমার কাছে আসুন শুধু দেখবেন আমি কি করি।ধাক্কা দিয়ে আমাকে নিজের থেকে সরিয়ে দেওয়া না?আজ থেকে ভুলে যান আপনার কোনো বউ আছে।

আচমকা আভার এমন আক্রমনাত্মক আচারণ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রৌদ্র।আভা মুখ ঝামটি দিয়ে রুমের ভিতরে চলে যায়।রৌদ্রও আভাকে ডাকতে ডাকতে তার পিছু পিছু যায়।আভা কোনো কিছু শুনতে নারাজ।সে শুধু একটি কথায় বলে যাচ্ছে,
– আপনি ইচ্ছা করেই আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন।

– আরে আমি কেন ধাক্কা দিবো?আমি সত্যি ধাক্কা দিইনি।আমি তো জাস্ট হরিণ দেখে এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম তাই ছবি তুলছিলাম।

– আপনার কাছে আমি বেশি ইম্পর্ট্যান্ট নাকি ঐ হরিণ? আজকে একটা ফয়সালা করতেই হবে আপনাকে।

রৌদ্র বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ আভার এমন ক্ষেপে যাওয়ার কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলো সে।আভা আগের মতোই জেদি স্বরে বলে,
– না না আপবাকে আজকে বলতে হবে আপনার জীবনে কার ইম্পরট্যান্টস বেশি?আমি নাকি হরিণ?

রৌদ্র আভার এসব বেহুদা কথাবার্তায় বিরক্ত হয়।নাক মুখ কুঁচকে বলে,
– আরে তুমি এমন একটা ভাব করছ যেন ওটা হরিণ নয় ওটা তোমার সতিন।

ব্যস এবার আভাকে আর দেখে কে?এমনেই মাথার ঘিলু ফুটছিল।তার উপর রৌদ্রের সতিন তুলে কথায় যেন আভার ঘিলু আগ্নেয়গিরির মতো মস্তক ফেটে বেরিয়ে এলো।এবার শুরু হলো আভার প্রলাপ,
– ওহ্ এই ছিল আপনার মনে?আমি তো জানি আপনার নজর ভালো না।মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না।আমি তো জানি আপনি আমার সতিন আনার প্লানে আছেন।আমি কিছু বুঝিনা বুঝি?কিন্তু আপনি আমাকেও চিনেননি।আপনি কি ভেবেছেন?আপনি আরেকটা বিয়ে করে সুখে সংসার করবেন আর আমি বসে বসে আঙুল চু’ষবো৷এমন কায়দা করবো বিয়ে করার সখ কেন?মেয়ে দেখলে আপনি জলাতঙ্ক রোগীর মতো করবেন।জলাতঙ্ক রোগী যেমন পানি দেখলে ভয় পায় আপনিও তেমন মেয়ে দেখে ভয়ে কাঁপবেন।

রৌদ্র হা করে তাকিয়ে আছে আভার দিকে।আভার মুখে লাগামহীন কথাবার্তা শুনে রাগ হলো তার।তাকে নিয়ে আভার মনে এই ধারণা? সে মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক রাখতে পারে না?এই চার আঙুল মেয়েটা এসব কথা কিভাবে বলতে পারল।রাগে দাঁতে দাঁত কামড়ে হাত মুঠ করে দাঁড়িয়ে রইলো রৌদ্র।কোনো শব্দ বের করে না মুখ দিয়ে।গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যায়।যাওয়ার আগে দরজা এতো জোরে লাগিয়ে যে সে বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে আভা।আভার চোখ ভরে ওঠে নোনাজলে।নাক ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে।ঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পানি আর জঙ্গল দেখে।পাশে তাকিয়ে দেখে গলিতে রৌদ্রকে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে দূর আকাশে চেয়ে আছে।আভার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো।আভা মুখ ঝামটি দিয়ে জানালা থেকে সরে এলো।রৌদ্রও গম্ভীর মুখে সেখান থেকে চলে এলো।অভয় অহনা শীপের একদম সামনের দিকে দাঁড়িয়ে।রৌদ্রকে দেখতেই অভয় উৎফুল্ল ভঙ্গিতে হাতের ইশারায় রৌদ্রকে তাদের কাছে ডাকে।অভয় অহনা হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে লিনডা কোক খাচ্ছে। রৌদ্র কাছে যেতেই অভয় রৌদ্রের দিকে একটি কোক ছুঁড়ে দিলো।রৌদ্র ক্যান খুলে মুখে দিলো।অভয় ভ্রু কুঁচকে বলল,
– আভা কোথায়?

রৌদ্র গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে,
– রুমে আছে যা গিয়ে নিয়ে আয়।

অভয় ভ্রু কুঁচকে রৌদ্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।এগিয়ে এসে পিছন থেকে কাঁধে রেখে বলে,
– সব কিছু ঠিক আছে?

রৌদ্র দূর পানে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দেয়,
– হয়তো।

– হয়তো মানে কি?বল কি হয়েছে?

রৌদ্র বিরক্তি কন্ঠে বলে,
– আরে জানিস না মেয়ে মানুষ হলো এমনই এক আজব প্রাণী যেটা বুঝে কম চিল্লায় বেশি।

তপ্ত শ্বাস ফেলে অভয়।আর কোনো প্রশ্ন না করে চলে যায় বোনকে আনতে।আভা বিছানায় চুপ করে বোম হয়ে বসে আছে।ছোট বিছানা আর একটি ড্রয়ার।খরস্রোতার দাপটে খাট সহ সব দুলে চলেছে।কারো পদধ্বনি কানে আসতেই আভা মুখ ঘুরিয়ে বুকে হাত গুঁজে বসলো।সে ভেবেছে হয়তো রৌদ্র এসেছে।অভয় নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করল।আভার কাছে এসে আভার মাথায় চাটি মেরে বলল,
– কিরে তুই এখানে এমন খিচ মেরে বসে আসিছ কেন খয়রাতি?

আভা মাথায় হাত দিয়ে অভয়ের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে কড়া কন্ঠে বলে,
– ভাইয়া দেখ এখন একদম মজার মুডে নেয়।

অভয় এবার সিরিয়াস মুখ করে আভার পাশে বসে।আভাকে প্রশ্ন করে,
– কি হয়েছে রে?ওদিকে রৌদ্রকে দেখলাম মুখ ভার করে আছে এদিকে তুই এভাবে বসে আছিস কি হয়েছে?

আভা অভয়ের দিকে ঘুরে আসন করে বসে।টলমল চোখে ভেজা কন্ঠে বলে,
– ভাইয়া তোমার বন্ধু আরেকটা বিয়ে করার প্লান করছে।

অভয় অবাক স্বরে বলে,
– কিহ্?

তৎক্ষনাৎ ঘরে প্রবেশ করে রৌদ্র।রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে তার।সে দাঁতে দাঁত কামড়ে অভয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– একদম মিথ্যা কথা।তোর বোন আমাকে তা নয় তাই বলেছে।বলেছে আমার নাকি মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না।আমার নাকি নজর ভালো না তোর বোন এইসব শব্দ কিভাবে আমার জন্য ব্যবহার করতে পারল।

অভয় চোখ বড় বড় করে নিজের বোনের দিকে তাকায়।তার বোন এমন কথা বলতে পারে তার ধারনারও বাইরে।আভা এবার ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল,
– আর আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেননি?

আবারো সেই এক কথা।রৌদ্র বিরক্তির স্বরে বলে,
– আমি কখন ধাক্কা দিলাম?আর ধাক্কা দিলেও আমি ইচ্ছা করে দেয়নি।

অভয়ের মাথা ঘুরতে শুরু করে দুইজনের এমন ভিত্তিহীন ঝগড়াঝাটি শুনে।সে চোখ বড় করে জোরে শ্বাস টেনে ঘর ত্যাগ করে।রৌদ্র বিরক্তির দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে আছে।আভা এখনো ন্যাকা কান্না করে চলেছে।আভার কান্নায় হৃদয় শীতল হয়ে গেল রৌদ্রের।চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টেনে ধীর গতিতে আভার পাশে গিয়ে বসে।আভার হাত ধরতে গেলেই আভা ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়।রৌদ্র হতাশ শ্বাস ফেলে বলে,
– আচ্ছা আমি সরি।কি করেছি জানিনা তাও সরি।হয়েছে এবার?ঘুরতে এসে এমন করে কেউ?

রৌদ্রের শুঁকনো কথায় চিরা ভিজলো না।আভা আগের মতো মটকা মেরে বসে রইলো।রৌদ্রের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো।রৌদ্র আভার এলোমেলো চুলগুলো অদক্ষ হাতে হাত খোঁপা করে দেয়।আপসহীন আভা আবার চুল খুলে দেয়।রৌদ্র আবার চুল খোঁপা করে দেয়।আভা তেজি স্বরে বলে,
– একদম আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না।আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন।

রৌদ্র উঠে আবার মুখোমুখি গিয়ে বসে।আভা মুখ ঘুরিয়ে নিবে তার আগেই দুইহাতের হাতের কব্জি এক করে নিজের বুকে চেপে ধরে।অন্যহাতে আভার নাকে টোকা দিয়ে বলে,
– উফ্! এতো রাগ?

আভা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ছটফট করে।মুখ ঘুরিয়ে রাখে।রৌদ্র আভার বাম গালে ছোট একটি চুমু খায়।সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ তুলে গাল ঘষে আভা।ভ্রু সংকুচিত হয় রৌদ্রের।সে আরো এক ধাপ দূরত্ব ঘুচিয়ে নেয়।আভার নাকে ঠোঁট ছুঁইয়ে সঙ্গে আভার অধরের উষ্ণ ছোঁয়া দেয়।তবে সে ছোঁয়া স্থায়ী হয় এক কি দুই সেকেন্ডের মতো।এতেও আভার রাগ গলে না।সে মুখ ঘুরিয়েই বসে আছে।রৌদ্র ক্লান্ত শ্বাস ফেলে।বিড়বিড় করে নিজে নিজেই বলে,”ভবঘুরে বিয়েও করেছি একটা।”
গলা ঝেড়ে মিনমিন করে বলে,
– আব আভা চলো আমরা বাইরে যায়।এখানে দেখছ না কত গরম।এরজন্য তো তোমার রাগ পড়ছে না বাইরের হাওয়া খেলে দেখবে ভালো লাগবে।

আবার সত্যিই ভিতরে গরম লাগছে।তাই সেও বাইরে যাবে বলে মনে মনে ঠিক করে কিন্তু মুখে কিছু বলে না।রৌদ্র একপ্রকার টেনেটুনে আভাকে বাহিরে নিয়ে আসে।অভয়রা যেখানে রয়েছে অর্থাৎ শীপের একদম সামনে রৌদ্র সেখানে টেনে নিয়ে গেল আভাকে।শীপে আরো অনেক পরিবার,দম্পতি, ফরেনার রয়েছে সকলে সুন্দরবন দেখবে বলে এসেছে।রৌদ্রের আধ খাওয়া ক্যানটির থেকে অবশিষ্ট কোক অভয় খেয়ে ফেলেছে।রৌদ্র আরো একটি কোক চায়ল।অভয় পূর্বের ভঙ্গিতে দুটি কোক ছুঁড়ে দিলো রৌদ্রের হাতে।রৌদ্র একটি খুলে আভার দিকে এগিয়ে দেয়।লিনডা আভার দিকে তাকিয়ে বলে,
– কালো মানুষ কালো শাড়ি?

আভা এবার লিনডার দিকে চায়ল।সে অফ শোল্ডার একটি টপস এবং একটি জিন্সের প্যান্টস পরা।বলা ভালো প্যান্টসটি সে না পরলেও ক্ষতি নেই কারণ সম্পূর্ণ পা টাই দৃশ্যমান। থায় থেকে শুরু করে পায়ের টাকনু সম্পূর্ণ অংশটুকু জ্বল জ্বল করছে।সাদা স্নিকারের দরুন পায়ের পাতা ঢাকা।লিনডাকে পরখ করে আভা চোখ সরিয়ে রৌদ্রের দিকে চায়ল।সে আভার দিকেই তাকে আছে।আভা তাকাতেই রৌদ্র ঠোঁট মেলে এক মোহনীয় হাসি দিয়ে বলে,
– আমার আভা অপরূপ সুন্দর এক রমনী।

আভা ঘাড় ঘুরিয়ে আবারো লিনডার দিকে চায়ল।লিনডা মুখ ভেঙচি দিয়ে চারপাশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
পর দিন সকালে সকলে করমজলে এসে পৌঁছায়।সেখানে গাইডের সাহায্য সম্পূর্ণ জায়গাটি ঘুরে ঘুরে দেখে তারা।দিনটা বেশ মজার মাঝেই কেটে যায় তাদের।শীপ আবারও রওনা হয় দুলবার চরের উদ্দেশ্যে।দুবলার চরে যাওয়ার জন্য আভা সবচেয়ে বেশি উৎকন্ঠিত।সে বঙ্গোপসাগর দেখার জন্য মুখিয়ে আছে।

চলবে…

প্রিয় বালিকা পর্ব-২৮+২৯+৩০+৩১

0

#প্রিয়_বালিকা |২৮+২৯|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

অভয় রৌদ্রের অগোচরে তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন এঙ্গেলে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।রৌদ্র অভয়ের কথায় থতমত খেয়ে সটান শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে যায়।দ্রুতগতিতে আইসব্যাগটি কোমর থেকে সরিয়ে মাথায় দিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
– কো কোমর ভেঙেছে?কোথায়?আমি তো জাস্ট এমনিতেই একটু আইস মানে।আরে তোর বোনটা এতো ব্রিটিশ না শুধু প্যাকপ্যাক করে সারাদিন।মাথাটাই গরম করে দেয় প্যাকপ্যাক করতে করতে তাই তো একটু আইস দিচ্ছি মাথায়।

অভয় বিদ্রুপের হাসি দেয়।মশকরার সুরে বলে,
– বাসর রাতেই মাথায় হাত?এখনো তো দিন বাকি।আজ কোমর ভেঙেছে কাল দেখিস আবার পাটায় পিষে না ফেলে!

রৌদ্র বিরক্ত হয়ে মুখ বাঁকিয়ে আছে।এতো সকালে অভয়কে দেখে ভ্রুকুটি করে বলে,
– তুই এতো সকালে উঠলি কিভাবে?নাকি ঘুমাসনি এখনো?

– ঘুমিয়ে ছিলাম এক দেড় ঘন্টার মতো।বাবা এসেছে ফোন করে গেট খুলতে বলল।তুই ঘুমাসনি?

রৌদ্র উত্তর করে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।অভয় হাই তুলতে তুলতে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে যায়।অভয় চলে যেতেই রৌদ্র চোখমুখ কুঁচকে আইসব্যাগটি মাথা থেকে নামিয়ে আবারো কোমরে চেপে ধরে।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে আভার ঘরের দিকে অগ্রসর হয়।
আভা এতোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।রৌদ্র একটি শ্বাস ফেলে আভার পাশে বসে।আভার দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কোমল হয়ে যায় তার।ঠোঁটে দেখা যায় মুচকি হাসি।এটা তার বউ!তার বউ!বউ! “বউ” শব্দটা বার উচ্চারণ করে সে।ধীরে ধীরে নিচু হয়ে ফিসফিস করে কয়েকবার শব্দটি বলে,”বউ!বউ!”
হঠাৎই আভা মৃদুমন্দ স্বরে অস্পষ্ট শব্দে সাড়া দেয় রৌদ্রের ডাকে।হাসি প্রগাঢ় হয় রৌদ্রের।আভার নাকে নিজের তর্জনির আলতো ছোঁয়া দেয়।নাক ছাড়িয়ে ঠোঁটে নামে তর্জনি।সেখানেও থেমে থাকে না।ধীরে ধীরে গলার দিকে অগ্রসর হয়।আচমকা থেমে যায় তর্জনি।হাত গুটিয়ে আভার মুখের দিকে তাকিয়ে শুঁকনো ঢোক গিলে রৌদ্র।আলতো হাতে আভার মাথা উঠিয়ে নিজের বাম হাত মাথার নিচে রাখে।আভার মাথা নিজের বুকে চেপে শুয়ে পড়ে।উষ্ণ ছোঁয়া দেয় আভার কপালে।আভা নিস্তব্ধ নির্বিকার ঘুমিয়ে আছে রৌদ্রের প্রশস্থ বুকে।

দশটার বেশি বেজে বাড়িতে সকলে ঘুম কাল বেশি রাত করে ঘুমানোর ফলে এখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি।প্রেমা উঠেছেন। নতুন জামাইয়ের জন্য নানা পদের খাবার রান্না করেছেন। কিন্তু মেয়ে কিংবা জামাই কারো কোনো খোঁজ নেই।গতকাল রাত করে ঘুমানোর কথা মাথায় রেখে তিনি কাউকে ডাকতেও পারছেন না।ঘুম ভালো না হলে সারাদিনটা শরীর খারাপ লাগে।তারও কেমন মাথা ঝিম ঝিম করছে।তাই তিনি খাবার টেবিলে সকল খাবার ঢেকে সোফায় গিয়ে একটু গা মেলে বসে পড়লেন।অনেকদিন টিভি দেখা হয়না ভেবে টিভি ছাড়েন তিনি।
আভার ঘুম মাত্রই ভাঙে।চোখ খুলতেই নাকে লাগে এক সুন্দর পুরুষালি সুগন্ধি।সে জানে এটি কার শরীরের ঘ্রাণ তাই চোখ বুঁজে বড় শ্বাস টেনে মুচকি হাসে সে।রৌদ্রের বাম হাতের উপর তার মাথা।প্রথমবারের মতো রৌদ্রকে এতো কাছ থেকে দেখছে সে।রৌদ্রের মুখশ্রীতে নিজের তর্জনি ঘোরাতে ঘোরাতে বিড়বিড় করে রৌদ্রের বর্ণনা করে সে,
– হান্টার আইস উইথ বিউটিফুল ল্যাশেস।ফেরার স্কিন,শার্প জো লাইন,ডিম্পল,থিন লিপস!

ঠোঁট মেলে রৌদ্রের কপালে দীর্ঘ এক চুমু খায় আভা।নিঃশব্দে ধীর গতিতে নেমে আসে বিছানা থেকে।রৌদ্র এখন গভীর ঘুমে তাই তাকে কোনো প্রকার বিরক্ত না করে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আভা।বাড়ির কেউ এখনো ওঠেনি।বসার ঘরে মাকে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় আভা।মায়ের পাশে বসে চুপচাপ।প্রেমা মেয়েকে একপলক দেখে টিভির দিকে তাকিয়ে বলে,
– জামাই এখনো ওঠেনি?

চোখ বড় বড় করে ফেলে আভা।বড় বড় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,”জামাই!” রাতারাতি মায়ের এ পরিবর্তনে ভীমড়ি খায় সে।মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে না বোঝায়।প্রেমা টিভি অফ করে বলেন,
– আচ্ছা চল তুই খাবি খিদে লেগেছে না?

আভা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।সকলে সকালের নাস্তা মিস করে একবারে দুপুরের খাবারের জন্য টেবিলে জড়ো হয়।সকলে আছে দুপুরের খাবারের সময় শুধু অভয় নেই।আভার একহাতে ফোন অন্য হাতে খাবার খাচ্ছে।বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু।রৌদ্র বেশ রেগে আছে আভার এমন আচারণে।বড়দের সামনে এমন আচারণ একদমই গ্রহণযোগ্য নয়।এক পর্যায়ে রৌদ্র রাগি স্বরে বলে উঠলো,
– আভা ফোনটা রেখে খাবার খাও।

আভা একবার রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি দিয়ে আবারো ফোনের দিকে নজর দেয়।রৌদ্রের রাগ দ্বিগুণ হয়।তবু সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে খাবার খায়।হঠাৎ আভা উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।সকলের নজ আভার দিকে পড়ে।প্রেমা রাগি স্বরে বলে,
– দিন দিন সভ্য অসভ্য বলে কিছু আর থাকছে না।কখন থেকে বলছি ফোন রাখ।বাবা,স্বামীর সামনে ফোন চালাতে লজ্জা করে না?

আভার কোনো কথায় কানে যাচ্ছে না।সে মুখে হাত দিয়ে হেসেই যাচ্ছে।আরাভ সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।রৌদ্র বিব্রত হয় আভার এমন হাসিতে।উঠে গিয়ে আভার ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে নেয়।ফোনের স্ক্রিনে চোখ যেতেই সে হতভম্ব হয়ে যায়।স্ক্রিনে তারই ছবি।সে করুণ মুখভঙ্গিতে কোমরে হাত দিয়ে আছে।ক্যাপশনে লেখা,”মেনশন করুন আপনার সেই বন্ধুকে যে বাসর রাতে বউয়ের লা’থি খেয়ে কোমর ভাঙে।”
রৌদ্রের বুঝতে বাকি থাকে না এটা কার কাজ।কারণ উপরে তার প্রফাইলের নাম এবং ছবি জ্বল জ্বল করছে।রৌদ্র দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
– অভয়…!

সোজা হাঁটা ধরে অভয়ের ঘরের দিকে।অহনা ঘরে নেই।তাই কোনোকিছু না বলেই ঢুকে পড়ে ঘরে।অভয় আরাম করে ঘুমিয়ে আছে।রৌদ্র চিৎকার করে ওঠে,
– অভয়ের বাচ্চা….!

সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে ওঠে অভয়।আশেপাশে কাউকে খুঁজতে খুঁজতে উৎকন্ঠিত স্বরে বলে,
– কোথায় আমার বাচ্চা?কোথা আমার বাচ্চা?

রৌদ্র ফোনটা অভয়ের মুখের সামনে ধরে বলে,
– এটা কি?

অভয় ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এটা তো আমার বাচ্চা না।

রৌদ্র জোরে একটি চ’ড় দেয় অভয়ের মাথায়।সঙ্গে সঙ্গে যেন অভয়ের মস্তিষ্কে প্রাণ এলো।কিছুক্ষণ পরেই পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঘর কাঁপিয়ে হাসে সে।ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– সারপ্রাইজটা কেমন লাগল বল?

রৌদ্র রাগে কটমট করে বলে,
– এখনই ডিলিট করবি এটা।নাহলে কিন্তু তোর খবর আছে অভয়।

অভয় এবার বুক ফুলিয়ে সোজা হয়ে বসে।রৌদ্রকে পাত্তা না দিয়ে বলে,
– বড় শা’লা আমি তোর সম্মান দিয়ে কথা বল।

চট করে রৌদ্রের হাতের দখলে চলে যায় অভয়ের গলা।তবে বেশি জোরে চাপ পড়ে না গলায়।তাতে অভয়ের প্রাণ বেরিয়ে যায় যায়।রৌদ্র অভয়ের গলা ধরে ঝঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তেজি স্বরে বলে,
– শা’লার শা’লা ডিলিট করবি কিনা বল?

অভয় তড়িঘড়ি উত্তর করে,
– আরে আরে করছি করছি গলা ছাড় রৌদ্র।

অভয়কে ছেড়ে দেয় রৌদ্র।হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,
– আম্মু খেতে ডাকে তোকে।

– হ্যাঁ যাচ্ছি।

অভয় বিড়বিড় করে রৌদ্রকে গা’লি দিতে দিতে পোস্টটি ডিলিট করে দেয়।ফ্রেশ হয়ে চলে যায় খাবার খেতে।
খাবার টেবিলে একটি সুন্দর প্রস্তাব রাখে অভয়,
– সবাই মিলে ঘুরতে গেলে কেমন হয়?

প্রেমা বলেন,
– আমাদের সময় নেই তোরা চারজন ঘুরে আয়।তুই-অহনা,রৌদ্র-আভা।

আভা চট করে বলে,
– কোথায় যাওয়া যায়?

অভয় কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– সুন্দরবন?

লাফ দিয়ে ওঠে আভা।উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
– সুন্দরবন?হ্যাঁ হ্যাঁ চলো চলো সুন্দরবন যায়।দুবলার চর যাবো বঙ্গোপসাগর দেখবো।

রৌদ্রও সম্মতি জানায়,
– হ্যাঁ,যাবো।কাল শহরে গিয়ে ও কয়েকদিন ভার্সিটিতে যাক আমিও কয়েকটা প্রজেক্ট কমপ্লিট করে নিই।তারপর সবাই মিলে “সুন্দরবন” ঘুরতে যাবো।

– হ্যাঁ তোদের ফ্লাটের মালিকের সাথে কথা বলেছি গতকাল।গিয়ে আমাকে ইনফর্ম করিস।

– আচ্ছা।

খাবার শেষে সকলে নিজের ঘরে।আভা এখনো যায়নি।ইচ্ছা করেই যায়নি।কেমন যেন লজ্জা লাগছে তার।একটা পুরুষ তার ঘরে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে।তার খাটে ঘুমিয়েছে।তাকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়েছে।গতকাল তেমনকিছু মনে না হলেও এখন তার ভিষণ লজ্জা করছে।কি অদ্ভুত তাই না?দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা করে চলেছে আভা।দরজা সামান্য চেপে দেওয়া।আভা চোখ বন্ধ করে জোরে একটি শ্বাস নিয়ে খুব সাবধানতার সহিত দরজা খুলে।উঁকি ঝুঁকি দিয়ে রৌদ্রকে কোথাও দেখতে পায় না সে।ভ্রু কুঁচকে ভাবে, “কোথাও বেরিয়েছে নাকি?” পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করে সে।ওমনি দরজা বন্ধ করে দেয় কেউ।পিছন ফিরে রৌদ্রকে দেখে ঘাবড়ে যায় সে।দূরে সরে যাওয়ার আগেই আভার কোমর নিজের হাতে আবদ্ধ করে ফেলে রৌদ্র।ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– কিরে ছেমড়ি?তোর যে একটা চিকনা চাকনা বর আছে ভুলে গেছিস নাকি হ্যাঁ?

রৌদ্রের এমন কথায় হাসি আসে আভার।দুই ঠোঁট এক করে হাসি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।রৌদ্র বাঁকা হেসে তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।আভা দৃষ্টি নত করে মিনমিনিয়ে বলে,
– ভুলবো কেন?বর কি ভোলার জিনিস?

রৌদ্রের কন্ঠস্বরে মেনে এলো এক অদ্ভুত মোহ।সে স্বর ধ্বনি তুলে সে বলে,
– তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলি শুনি?

আভা চোখ তুলে রৌদ্রের তীক্ষ্ণ আঁখি যুগলে দৃষ্টি ফেলতে পারে না।তার দৃষ্টি রৌদ্রের প্রশস্থ বুকে।রৌদ্রের ডান হাত আভার গলা আর ঘাড় জুড়ে আবৃত হয়।বৃদ্ধ আঙুল বিচরণ করে আভার ডান গালে।চোখের মণিতে দেখা যায় নেশালো কিছু বাক্য।কিন্তু তা পড়তে আভা ব্যর্থ তাই তো দৃষ্টি নামিয়ে থেমে থেমে শ্বাস নেয় সে।রৌদ্র বৃদ্ধ আঙুল দিয়েই আভার থুতনি সামান্য তুলে হিসহিসিয়ে বলে,
– আমার চোখের দিকে তাকাও।

তৎক্ষনাৎ আভার সোজা জবাব পাওয়া যায়,
– না।

মুচকি হাসে রৌদ্র।ঠোঁটের কোণে দেখা মেলে চিরচেনা দু’টি সূক্ষ্ণ ভাঁজ।কোমরের বাঁধন দৃঢ় করে পূর্বের স্বরে বলে,
– কেন?

এবার নিচু স্বরে জবাব এলো,
– আপনার চোখে তাকালে মনে হয় আমার দিকে প্রাণঘাতী বিষ মেশানো তীর ধেয়ে আসছে।

আভার কন্ঠে এমন আবেগি বাক্যে হাসির রেখা বৃদ্ধি পায় রৌদ্রের ঠোঁটে।রৌদ্র কোমল স্বরে বলে,
– দ্বিতীয়বারের মতো যেদিন দেশে এলাম সেদিন তো তাকিয়ে ছিলে,অপলক দৃষ্টিতে।প্রাণ হারিয়েছ?হারাওনি তো,আজও হারাবেনা তাকিয়ে দেখ।

আভা শুঁকনো ঢোক গিলে।চোখের পাতা এক করে মৃদুস্বরে বলে,
– আজ না।

আভার কথায় ভ্রুকুটি করে রৌদ্র।আভার আরো সান্নিধ্যে চলে আসে।ধীরগতিতে আভার কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দেয়।অতঃপর সে স্পর্শ স্থান পায় আভার বন্ধ দু’টি চোখে।প্রথমে ডান চোখ তারপর বাম চোখ।ধীরে ধীরে সে স্পর্শ প্রগাঢ় হয়ে আভার নাকের ডগায় ঠেকে।এই মুহুর্তে আভার শ্বাস কেউ আঁটকে রেখেছে।হৃৎপিণ্ড পাঁজরের সাথে ভীষণ গতিতে বারি খাচ্ছে।রৌদ্রের হৃৎস্পন্দনও বৃদ্ধি পায়।আভার মস্তিষ্ক বার বার বলে,”এবার রৌদ্র কি করবে?সে কি এই স্পর্শের আরো গভীরে যাবে?সে কি নিজের অধরের কলংক ছুঁইয়ে আভার অধরকেও কলংকিত করবে?নাকি এখানেই থেমে যাবে?”
আভার চিন্তা মাঝেই রৌদ্রের অধরের স্পর্শ গাড় হতে থাকে।সে স্পর্শ কিছুক্ষণ থেমে থাকে আভার নাক এবং ঠোঁটকে পৃথক কারী ফাঁকা স্থানে।আভার বুকের ভিতর কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে ভীষণ জোরে জোরে আঘাত করছে।মস্তিষ্ক বিকল হয়েছে অনেক আগেই।হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে।এক নিষিদ্ধ ঘোরে থাকা রৌদ্রের মস্তিষ্ক দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায় এখানেই থেমে যাবে নাকি নিজের অসভ্য অনুভূতিগুলোকে প্রশ্রয় দিবে।
আচমকা বেজে ওঠে রৌদ্রের ফোনটা।ঘোর কেটে যায় তার।শুঁকনো ঢোক গিলে আভার কোমর ছেড়ে দেয়।আভা লজ্জায় মাথা নত করে মুখের সামনে আসা একগোছা ছোট চুল কানের পিছনে গুঁজে দেয়।রৌদ্র গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন রিসিভ করে।অপর প্রান্ত থেকে শোনা যায় তার মা রোদেলার রাগি কন্ঠস্বর,
– রৌদ্র এসব কি দেখলাম আমি।তুমি বিয়ে করেছ?কিভাবে করতে পারলে তুমি এটা?তোমার মম ড্যাডের কি কোনো দাম নেই তোমার কাছে?আমাদের কি কোনো ইনপর্টেন্স নেই তোমার লাইফে?এটা তুমি কিভাবে করতে পারলে?হাউ কুড ইউ রৌদ্র?হাউ কুড ইড?

রৌদ্র একপলক আভার দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।আভা রৌদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো অদ্ভুত চাহনিতে।পরমুহূর্তেই কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়তেই দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে সে।মুখ থেকে হাত সরিয়ে লাজুক হেসে ঠোঁটের উপরে তর্জনি রাখে।এখানে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয়েছিল রৌদ্রের স্পর্শ।এক চিমটি নিচে নামলেই নরম তুলতুলে চিকন দু’টো ঠোঁট স্পর্শ করে ফেলতো রৌদ্র।ভাবতেই গাল গরম হয়ে যায় আভার।দুইহাতে আবারো মুখ ঢেকে ফেলে সে।দ্রুততার সহিত বিছানায় উঠে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে সে।আজ আর রৌদ্র মুখো হওয়া যাবে না।রৌদ্রের সামনে যাবে কি করে সে?

মায়ের একের পর এক প্রশ্নে বিরক্ত রৌদ্র।মুখ দিয়ে “চ্” শব্দ করে বলে,
– মম আমাকে কি কিছু বলার সুযোগ দিবে নাকি নিজেই বলে যাবে?

থেমে যায় রোদেলা।রৌদ্র এবার শান্ত স্বরে বলে,
– তোমাকে কে বলেছে এই কথা?

রোদেলার সোজাসাপটা জবাব,
– কিছুক্ষণ আগে অভয়ের স্ট্যাটাস দেখলাম।ওটা কি সত্যি ছিল?

রৌদ্র নির্বিকার স্বরে বলে,
– হ্যাঁ।

ক্ষেপে যান রোদেলা।রাগে তার সারা শরীর রি রি করতে শুরু করে।রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে বলেন,
– তোমার কি কোনো ধারণা আছে আমরা তোমার জন্য কি না করেছি?আমরা তোমাকে নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করিয়েছি।তুমি যখন যা চেয়েছ তাই দিয়েছি।তুমি স্পোর্টস কার চেয়েছ তোমাকে ইস্ট্যান্ট কার কিনে দেওয়া হয়েছে।তুমি যখন যা করতে চেয়েছ তাই করেছ আমরা কিছু বলিনি।আমাদের কি সামান্য পরিমাণ স্পেকটেশন থাকতে পারে না তোমার থেকে?দুই দিনের ঐ মেয়ের জন্য তুমি তোমার বাবা-মাকে ছেড়েছ,তোমার সুন্দর ক্যারিয়ার ছেড়েছ।কেন রৌদ্র?ঐ মেয়ের কি যোগ্যতা আছে?ঐ মেয়ে তোমার নখেরও যোগ্য নয়।না আছে রূপ না আছে গুণ।পরেও তো মনে হয় ঐ বাংলাদেশের সস্তা ভার্সিটিতে!

রৌদ্র রাগে ফুঁসছে।সে হুংকার ছেড়ে বলে,
– শ্যাট আপ মম।জাস্ট কিপ ইওর মাউথ শ্যাপ।তুমি আভাকে কখনো কাছ থেকে দেখোনি।তাই তুমি অন্তত আভার যোগ্যতা বিচার করতে এসো না।আমার বউ আমার যোগ্য কিনা সেটা আমি বিচার করবো,তুমি না।আর যে সস্তা ভার্সিটির কথা বলছ সেখান থেকেই কিন্তু তুমি আজ ঐখানে বসে ককটেল খাচ্ছো।ম্যানারস ম্যানারস করে মানুষের ইমোশনকে খুন করে ফেলে তোমার উন্নত জীবন।ছেলের সামনে ড্রিংকস করে আসাটাও কি উন্নত জীবনের ম্যানারস?ছেলের সাথে চেয়ার্স বলে ও’য়াইন খাওয়াটাও কি তোমার উন্নত জীবনের ম্যানারস?যদি তাই তাহলে চাই না আমার এমন উন্নত জীবন।আমি আমার সন্তানকে একটা সুস্থ পরিবেশে বড় করতে চাই যেখানে তাদের শুধু আমার টাকার প্রয়োজন থাকবে না।যেখানে তাদের আমার ভালোবাসার প্রয়োজন থাকবে।যেমন আমার প্রয়োজন ছিল।টাকা দেওয়াটাই শুধু বাবা মায়ের কর্তব্য নয়।

রোদেলা গুমরে কেঁদে উঠলেন।ছেলের মধ্যে জমা দুঃখ,কষ্ট,ক্ষোভ আজ আঁচ করতে পারলেন তিনি।করুণ স্বরে বলেন,
– বাবা আমি বুঝতে পেরেছি আমাদের তোমাকে আরো সময় দেওয়া উচিত ছিল।কিন্তু আমরা ভেবেছি তোমার নিজস্ব স্পেস দরকার। তাই তো সাথে তোমাকে তোমার মতো ছেড়ে দিয়েছি সবসময়।

– মম হ্যাঁ লাইফে পার্সনাল স্পেসের দরকার আছে কিন্তু মাঝে মাঝে আঁকড়ে ধরার জন্যেও কাউকে প্রয়োজন।কখনো ম্যানারসের বাইরে গিয়েও ফ্র্যাংকলি কথা বলা প্রয়োজন।বাবা মা ছেলের মধ্যে ফর্মাল রিলেশনশিপ মানায় না।যাইহোক,আমাদের জন্য দোয়া করবে।চায়লে এসে ঘুরে যেতে পারো,রাখছি।

রোদেলা উত্তেজিত স্বরে বলেন,
– দেখ বাবা আমার কথাটা শোনো,তুমি আভাকে নিয়ে চলে আসো অস্ট্রেলিয়া।প্লিজ..!

– সম্ভব নয় মম,রাখছি।

– রৌদ্র…!

কল কেটে দেয় রৌদ্র। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঢোক গিলে।ভালো লাগছে না কিছু।ছোটবেলায় কত ভালো ছিল সে।বাবা মায়ের সাথে কত সুন্দর সুন্দর সময় কাটিয়েছে সে।কোনো দোটানা ছিল না তখন।দিন দিন যত বড় হয়েছে বাবা মায়ের সাথে সম্পর্কটি হয়ে গিয়েছে ততই ফর্মাল।এটা সবসময় কষ্ট দেয় রৌদ্রকে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় আভা,রৌদ্র এবং অভয়।দেড় ঘন্টার মাথায় পৌঁছেও যায়।অভয় চলে যায় নিজের অফিসে।রৌদ্র আভা নিজেদের জন্য ভাড়া নেওয়া ফ্লাটে।ফ্লাটটি দ্বিতীয় তলায় বেশ বড়সড় এবং খোলামেলা।সব ডেকোরেশন আগেই করা হয়েছে।তিন রুমের ফ্লাটের সবচেয়ে ছোট রুমটি রৌদ্রের কম্পিউটার ল্যাব।বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত।এক কোণায় একটি বইয়ের তাক।আভা এসব যন্ত্রপাতি একদমই পরিচিত হয়।সে কম্পিউটার মানে জানে একটা মনিটর,একটা মাউস,একটা,কীবোর্ড,একটা সিপিইউ,একজোড়া সাউন্ড বক্স। কিন্তু এখানে আরো অনেককিছু দেখতে পাচ্ছে সে।রৌদ্র সর্বপ্রথম তার কম্পিউটার সেটআপ চেক করতে এই ঘরে প্রবেশ করে।আভাও তার পিছু পিছু আসে।এসে এতোসব যন্ত্রপাতি আর তার দেখে মাথা ঘুরতে শুরু করে তার।রৌদ্র সব ঠিকঠাক দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,
– যাক বাবা! পি.সি সেট আপ কমপ্লিট এখন ডেটাগুলো নিতে হবে।

আভা নাক সিটিয়ে চলে এলো সেখান থেকে।একে একে ঘুরে দেখে সম্পূর্ণ ফ্লাট।মাঝারি আকারের একটি রান্নাঘর,একটি ড্রয়িং স্পেস যেখানে একটি তিন সিটের সোফা এবং দুই সিটের দু’টি সিঙ্গেল সোফা বসানো।তার কিছুটা দূরেই ডাইনিং টেবিল।বড় দুই রুমের একটির সাথে ওয়াশরুম এবং বেলকনি সংযুক্ত আর সেটাই রৌদ্র আভার বেডরুম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।অন্য ঘরটিতে শুধু মাত্র একটি মাঝারি আকারের বেড ফেলে রাখা হয়েছে।রৌদ্র আভার ঘরে আছে ওয়াল আলমারি,একটি বড় বেড,একটি ড্রেসিং টেবিল আর কিছু সৌখিন আসবাব।যাদের অনুপস্থিতিতে ঘরের সৌন্দর্য একফোঁটাও নষ্ট হবে না।আভা দরজায় দাঁড়িয়ে ঘর দেখছিল।ঠিক তার পিছনে নিঃশব্দে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল রৌদ্র।আজ থেকে শুরু হলো একজোড়া বাবুইপাখির ছোট্ট একটি সংসার।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |৩০|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভা খুব সাবধানে রৌদ্রের কম্পিউটার ল্যাবের দরজা সামান্য খুলে উঁকি দিয়ে দেখছে।রৌদ্র সানগ্লাস চোখে মনিটারের সামনে বসা।সারাঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।মনিটারের কড়া আলোয় রৌদ্রের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।সে খুব মনোযোগ দিয়ে মনিটারে তাকিয়ে আছে।আভা ছোট একটা ঢোক গিলে আবারো খুব সতর্কতার সহিত দরজা বন্ধ করে দেয়।রাত অনেক হয়েছে।আভা মনে মনে ভাবে কিছু রান্না করে রাখা যাক।যেহেতু আগামীকাল তার ভার্সিটিতে পর পর দুইটা ক্লাস আছে তাই আসতে দেরি হবে।ততক্ষণ তো রৌদ্র না খেয়ে থাকতে পারে না তাই এখন রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিলেই ভালো হবে।আভা ওড়না আড়াআড়িভাবে কোমরে বেঁধে নেমে পড়ল রান্না করতে।এক এক করে একপদ তার পর দুইপদ রান্না শেষ করে।তিন নম্বর পদ রান্নার সময় ডাক পড়ে তার,
– আভা… আভা! আভা?

রৌদ্র সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে এদিকে কড়াইয়ে পেঁয়াজ পুড়ে যাচ্ছে।কোন দিকে সামলাবে ভাবতে গিয়ে আরো বেশি গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলে আভা।পুড়া পেঁয়াজ কোনো কিছু না ভেবেই এক মগ পানি ঢেলে দেয়।মেজাজ বিগড়ে যায় মুহুর্তে।চুলো বন্ধ করে ছুট লাগায় রৌদ্রের কাছে।তড়িঘড়ি দরজা খুলে তেজি স্বরে বলে,
– কি হয়েছে?

রৌদ্র চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে একাধারে আভাকে ডেকে চলেছে।আভা ঝাড়ি দিতেই সে অবাক হয়ে বলে,
– এ কেমন এটিটিউড?

আভা আগের মতোই ঝাড়ি দিয়ে বলে,
– রান্না করছিলাম আমি।আপনার ডাকাডাকিতে সব গুলিয়ে গিয়েছে।

রৌদ্র শব্দ করে হাসে।যে হাসি দেখে দ্বিগুণ শরীর জ্বলতে থাকে আভার।পূর্বের ন্যায় ঝাড়ি দিয়ে বলে,
– হাসি বন্ধ করে কি জন্য ডেকেছেন সেটা বলেন।

রৌদ্র হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে যায়।ভ্রু কুঁচকে শান্ত কন্ঠে বলে,
– এই এটিটিউডে আমার সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছি না?যাও এক কাপ কফি নিয়ে আসবে।উইথ এক্সট্রা সুগার এন্ড মিল্ক।

আভা কিছু একটা ভেবে ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো।বুকে হাত গুঁজে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সাথে বলে,
– ওর্ডার করলে দিবো না রিকুয়েষ্ট করেন।

রৌদ্র কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আভাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করল।এই চার আঙুল মেয়েকে এখন রিকুয়েষ্ট করা লাগবে তার?তবে এখন কফিটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।তাই এই রাত দুপুরে ঝামেলা না পাকানোটাই ভালো।এসব ভেবে রৌদ্র একটি মিষ্টি হাসি দিলো যার মধ্যে ছিল ক্ষোভের চিহ্নও।হাসি দিয়ে বারবার চোখের পলক ফেলে মিষ্টি করে বলে,
– আপনার হাতে বানানো এক কাপ কফি কি পেতে পারি,মাই কুইন?

আভার বেশ মনে ধরে রৌদ্রের এমন শিশুসুলভ বাচনভঙ্গি।সেও উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে চলে যায় রৌদ্রের জন্য কফি তৈরি করতে।কিছুক্ষণ পর কফি নিয়ে ফিরেও আসে।কীবোর্ডের পাশে মগটা রেখে মনিটরে তাকায় সে।কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,
– এগুলো কি করছেন?

রৌদ্র মনিটরে চোখ রেখেই বলে,
– একটা অ্যাপ ডিজাইন করছি।

আভা বিস্মিত স্বরে বলে,
– অ্যাপ..?!

রৌদ্র উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।আভার হাত ধরে টেনে তার সামনে বসিয়ে দেয়।কৌতুহলী আভা জিজ্ঞেস আবারো জিজ্ঞেস করে,
– কি অ্যাপ।

রৌদ্র আভার চোখে চোখ রেখে বলে,
– ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট রিলেটেড একটা অ্যাপ।নাম “ইভেন্ট প্লানার”

– এটা দিয়ে কি হবে?

– এটাতে বিভিন্ন ইভেন্ট কোম্পানির প্রফাইল এবং ডেটা থাকবে।সকল ধরণের ছোট বড় কোম্পানি এটাতে প্রফাইল ক্রিয়েট করতে পারবে।তাদের বিভিন্ন জায়গায় করা কাজের কিছু অংশ তারা তাদের প্রোফাইলে শেয়ার করবে। তারপর তাদের রেটিং এবং কাজের নমুনা দেখে ক্লাইন্ট ইন্সট্যান্ট কোনো ঝামেলা ছাড়ায় তাদের পছন্দের ইভেন্ট কোম্পানি হায়ার করতে পারবে।বুঝেছ কিছু?এতে সময়ও বাজবে আবার সুন্দরভাবে কাজও হবে।

আভা কৌতুহলী স্বরে বলে,
– এটা কি আপনি বানাচ্ছেন?

– আইডিয়াটা আমার নয় তবে এর ডিজাইন করার জন্য আমাকে হায়ার করা হয়েছে।এটা অন্যকেউ লঞ্চ করবে আমি করতে পারবো না।এটার ডিজাইনার আমি বাট ওনার অন্যকেউ।

– ওহ্ আচ্ছা। তারমানে এই অ্যাপের মালিক অন্যকেউ?

– হ্যাঁ।কাল ভার্সিটি আছে না?যাও ঘুমাও।আমার দেরি হবে অনেক।

আভার মন খারাপ হয়ে গেল।সে মুখ কালো করেই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।রান্নাঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বেডরুমে চলে যায় আভা।চুপচাপ শুয়ে পড়ে সে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে থম মেরে বসে বিছানায় কিছুক্ষণ বসে রইলো আভা।আশেপাশে রৌদ্রের ছায়া টুকুও নেই।তব্দা খেয়ে আরো কয়েক মিনিট বসে রইলো।সে।মনে মনে ভাবে রৌদ্র কি সারারাত ঘুমাইনি?বড় বড় চোখে বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে যায় সে।রৌদ্র গতকাল রাতে যেখানে বসেছিল এখনো সেখানেই বসে এক ধ্যানে মনিটারের দিকে তাকিয়ে আছে।আশেপাশে চিপসের খালি প্যাকেট আর কোল্ড ড্রিংকসের খালি ক্যান।আভা অবাক সুরে বলে,
– আপনি ঘুমাননি?

রৌদ্র এক নজর আভার দিকে দেখে আবারো মনিটরে তাকায়।কোনো জবাব করে না।আভা হতভম্ব হয়েই চলে আসে সেখান থেকে।খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রৌদ্রকে ডাক দেয়।রৌদ্রকে অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর সে খাবার খেতে আসে।আভাকে তাড়া দিয়ে বলে,
– জলদি খেতে দাও অনেক খিদে লেগেছে।

আভা বর বড় চোখেই খাবার তুলে দেয় রৌদ্রের পাতে।অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
– আপনি সারারাত না ঘুমিয়ে এখনো ঠিক আছেন কিভাবে?

রৌদ্র খাবার মুখে দিতে দিতে বলে,
– আমার অভ্যাস আছে।তাছাড়া একাজগুলো রাতেই আসে।বাংলাদেশে এসে টাইমে একটু ঝামেলা হয়ে গিয়েছে।ওরা যখন ওর্ডার দেয় তখন ওদের ওখানে দিন বাট আমাদের এখানে রাত।বুঝলে?

– আপনি কি ফ্রিল্যান্সিং করেন?

– কিছুটা তেমনই।বুঝলে?

– হাত দিয়ে খান।

আভার এমন কথায় খাওয়া থেমে গেল রৌদ্রের।সে হাত দিয়ে খেতে পারে না।তবু বউ বলেছে তাই সে চামচ পাশে রেখে মুঠোয় খাবার নিয়ে মুখে মুড়ির মতো ছুঁড়ে দিলো।যার ফরে খাবার কিছুটা নিচে পড়ে যায়।আভা চোখ গরম করে তাকায় রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র মেকি হেসে বলে,
– পারি না তো।

আভা মুখ ভেঙচি দিয়ে নিজের খাবার খায়।রৌদ্রের মাথায় কোনো ধুরন্ধর বুদ্ধি খেলে যেতেই মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে তার।নড়ে চড়ে আভাকে বলে,
– তুমি খাইয়ে দাও।

আভা মুখ ঝামটি দিয়ে বলে,
– চামচ দিয়েই খান আমার ক্লাস আছে।

রৌদ্র আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার নিষ্ঠুর,ব্রিটিশ বউয়ের দিকে।মলিন মুখে কাটা চামচ দিয়ে খাবার খেয়ে বেড রুমে যেতে যেতে বলে,
– আমি ঘুমাই তুমি।

চট করে আভা বলে,
– দরজা লক করবে কে?

– বাইরে থেকে লক করে যেও।

– আপনি বের হবেন না?

– না।

রৌদ্র বেডরুমে চলে যায় ঘুমানোর উদ্দেশ্যে।আভা খাবার টেবিল পরিষ্কার করে রেডি হয়ে নেয় ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য।দরজায় কলিং বেল বাজাতে কপাল কুঁচকায় আভা।বিছানায় ঘুমানো রৌদ্রের দিকে একবার তাকিয়ে দরজা খুলতে যায়।দরজা খুলবে কি খুলবেনা নিয়ে দ্বিধায় ভোগে।অনেকক্ষণ অতিক্রম হলে দরজা খোলে আভা।বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একদল তাগড়া পুরুষ।যাদের গায়ে একটি বুলেট প্রুফ কোর্ট যেটাতে বড় বড় করে ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা “র‍্যাব”।ঘাবড়ে যায় আভা।তারা আভার দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে।আভা মিনমিন করে বলে,
– আপনারা?

তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক লোকটি সুন্দর সুশীল ভাষায় উত্তর দেন,
– আমরা র‍্যাব-৬। আপনার সাথে আর কেউ আছেন?

আভা কোনোমতে উত্তর করে,
– হ্যাঁ আমার হাসবেন্ড।

– ডাকুন ওনাকে।

আভা মাথা নাড়িয়ে ঘরে চলে যায়।রৌদ্রকে কয়েকবার ডাক দেওয়ার পর সে ঘুম থেকে উঠে পরে।প্রথমে র‍্যাবের লোকদের দেখে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে যায় সেও।পরমুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করে,
– জ্বী অফিসার বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি?

অফিসারের সোজাসুজি জবাব,
– আমরা আপনার বাসা তল্লাশি করতে চাই।

আভা দ্বিমত করে কিছু বলতে যাবে তৎক্ষনাৎ তাকে ইশারায় থামিয়ে দেয় রৌদ্র।র‍্যাবের লোকদের সম্মতি দিলে তারা পুরো বাসাটা লণ্ডভণ্ড করতে শুরু করে।ডুকরে কান্না বেরিয়ে আসতে চায় আভা।সে কখনো এইসব র‍্যাব,পুলিশ,আর্মি এদের মুখোমুখি হয়নি।রৌদ্র শান্ত দৃষ্টিতে র‍্যাবের লোকদের সকল কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে।রৌদ্রের কম্পিউটার ল্যাব ঘুরে একজন লোক রৌদ্রকে বলেন,
– আপনার কম্পিউটারটি অন করেন।

রৌদ্র কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ নজরে তার দিকে তাকিয়ে থেকে কম্পিউটার অন করে দেয়।তারা কম্পিউটারে কিছু একটা পরখ করে সিনিয়র অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– জ্বী স্যার ডিভাইসের আইপি এড্রেস মিলে গিয়েছে।তবে ইউজার নেম চেঞ্জ করে “আফসিন রৌদ্র” করা হয়েছে।আগে শুধু র‍্যানডম কিছু সংখ্যা ছিল।

ভ্রু কুঁচকে আসে রৌদ্রের।সিনিয়র অফিসার রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– সাইবার ক্রাইমের অপরাধে আপনাকে এরেস্ট করা হলো মি.আফসিন রৌদ্র।

চমকে উঠলো রৌদ্র এবং আভা।রৌদ্র বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
– হোয়াট?

অফিসার খুব স্বাভাবিকভাবেই বলেন,
– আপনার ডিভাইস থেকে একাধিকবার নেটওয়ার্ক সিস্টেম হ্যাকিং এর চেষ্টা হয়েছে।আপনি কি জানেন এর শাস্তি কি হতে পারেন এর শাস্তি কি হতে পারে?যেহেতু আপনি একাধিক এইকাজ করেছেন ফলে আপনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা হতে পারে।এবং সর্বনিম্ন শাস্তি সাত বছরের জেল এবং পঁচিশ লাখ টাকা জরিমানা।

রৌদ্রের মাথায় কিছুই ঢুকছে না।আভা অফিসারের কথা শুনে হু হু করে কেঁদে দেয়।রৌদ্র বিস্মিত স্বরে বলে,
– কিন্তু অফিসার আমি তো গতকালই এটা কিনেছি।তাছাড়া আমি এসবের কিছুই জানি না।

– সরি মি.আফসিন রৌদ্র আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।

আবার কান্নার বেগ বেড়ে গেল।র‍্যাবের বাকি সদস্যরা পিসি সহ আরো কিছু জিনিস সিল করে ফেলে।রৌদ্র আভাকে একহাতে জরিয়ে বলে,
– কান্না করো না।অভয়কে ফোন করো ফোন করে বলো পিসি কোথা থেকে কিনেছে? পিসি সেকেন্ড হ্যান্ড কিনা?

আভা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
– পিসি আপনি কিনেনি?

– আমি সময় পেলাম কোথায়?অভয় কিনেছে পিসি।ওকে ফোন করো দ্রুত।অফিসার আমার ওয়াইফ তো এখানে একা আপনারা কি ওকে একটু ওর ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন?

অফিসার কিছুক্ষণ ভেবে সায় দিলেন।তার সহকারীদের ইশারায় আভাকে পৌঁছে দিতে বলে।আভা জেদি স্বরে বলে,
– না আমি আপনার সাথে যাবো।

সঙ্গে সঙ্গে ধমক দেয় রৌদ্র,
– এইহ্ তুমি আমার সাথে গিয়ে কি করবে?তুমি কি উকিল নাকি যা বলছি তাই করো।

অফিসার রৌদ্রকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।আভাকে নিয়ে বের হলেন র‍্যাবের একজন সহকারী।আভা থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠছে।মুহুর্তেই সবখানে ছড়িয়ে পড়ে এ খবর।রৌদ্রের মা-বাবার কানেও যায় এ খবর।রোদেলা অস্থির হয়ে পড়ে ছেলেকে দেখার জন্য।তৎক্ষনাৎ এমার্জেন্সি টিকেট কেটে ফ্লাইট ধরে রৌদ্র এবং হামিদ।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |৩১|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভাকে অভয়ের অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় র‍্যাবের গাড়ি।আভা অভয়কে একাধিক বার ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু তার কোনো খবর নেই।হয়তো কোনো জরুরি মিটিং-এ সে আঁটকে আছে।বেশ কিছুসময় দাঁড়িয়ে লাগাতার কল করার পর কল রিসিভ হয়।অভয় বেশ চিন্তিত স্বরে আভাকে জিজ্ঞেস করে,
– আভা কি হয়েছে? এতোবার কল করছিস কেন?কোনো প্রবলেম হয়েছে নাকি?

আভা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নাক টেনে বলে,
– ভাইয়া তাড়াতাড়ি নিচে এসো।

অভয়ের চিন্তা বেড়ে গেল।সে উদ্বেগ স্বরে বলে উঠলো,
– কি হয়েছে আভা?

আভা শুধু একই কথা বলে গেল,
– ভাইয়া তুমি নিচে এসো, প্লিজ!

অভয় আর কোনো প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করে না।দ্রুতগতিতে নিচে নেমে আসে।দেখতে পায় বিদধস্ত তার বোন দাঁড়িয়ে।বুকের ভিতর ধক করে হয়ে অভয়ের।উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে আসে আভার কাছে।আভাকে নিজের বাহুডোরে আগলে নিয়ে জানতে চায়,
– কি হয়েছে বোনু?এভাবে কাঁদছিস কেন?রৌদ্র কোথায়?ও কিছু বলেছে তোকে?

আভা কান্নার বেগে কিছু বলতে পারে না।ভাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে সে।অভয়ের উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়।বোনকে সে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখিনি।আভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম স্বরে বলে,
– কি হয়েছে বল আমায় বোনু?রৌদ্র কিছু বলেছে তোকে?আমাকে একবার বল জান নিয়ে নিবো ওর।

শেষের কথাটি কঠিন সুরে বলে অভয়।যা শুনে কেঁপে ওঠে আভা।কান্নার বেগ আরো বৃদ্ধি পায়।হিঁচকি তুলে থেমে থেমে বলে,
– ভাইয়া ওরা রৌদ্রকে নিয়ে গিয়েছে।জেলে নিয়ে গিয়েছে। তুমি তুমি কোথা থেকে কম্পিউটার কিনেছ?ওরা ওটার জন্য রৌদ্রকে নিয়ে গিয়েছে।

অভয় আভার এমন ছাড়া ছাড়া বাক্য প্রথমেই আমলে আনতে ব্যর্থ হয়।স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আভার দিকে।আভার কথাগুলো মস্তিষ্ক মিলিয়ে বলে,
– কম্পিউটারের জন্য নিয়েছে মানে?

আবা পুনরায় থেমে থেমে বলে,
– ওরা বলছে রৌদ্র নাকি পুরো নেটওয়ার্ক সিস্টেম হ্যাক না কি যেন করছে আমি বুঝিনা।তাই ওরা ওনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে।

অভয় বিস্মিত হয়ে বলে,
– রৌদ্র হ্যাক করছে?নেটওয়ার্ক সিস্টেম?

আভা তেজি স্বরে বলে,
– না উনি করেনি।তুমি কম্পিউটার নিয়েছ যার থেকে সে করছে।

অভয়ের মাথায় বাজ পড়ে।চোখ বড় বড় করে শুঁকনো ঢোক গিলে আবাকে বলে,
– রৌদ্র এখন কোথায় আছে?

আভা নাক টেনে বলে,
– র‍্যাম নিয়ে গিয়েছে মনে হয় পুলিশের কাছে থানায়।

অভয় আর এক মুহুর্ত দেরি না করে আভাকে নিয়ে পাশ্ববর্তী থানা চলে যায়।থানায় প্রবেশ করতে করতে আভা ডুকরে কেঁদে উঠে বলে,
– উনি আমার হাতে খেতে চেয়েছিল।আমি কেন খাইয়ে দিলাম না!

অভয় বোনকে ধরে শান্তনা দিতে দিতে থানার ভিতরে চলে যায়।থানার ভিতরে একটা কাঠের বেঞ্চে মাথা নত করে বসে আছে রৌদ্র।র‍্যাব এবং পুলিশ মিলে রৌদ্রকে কোর্টে তোলা এবং জেলে দেওয়ার সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করছেন।পুলিশের একজন কনস্টেবল রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করেন,
– আপনার পক্ষ থেকে কি কোনো ল-ইয়ার হায়ার করা হয়েছে?তার কি কোনো বক্তব্য আছে এ বিষয়ে।

রৌদ্র কোনো উত্তর করে না।কিই বা বলবে সে?তার পক্ষ থেকে ল-ইয়ার যে হায়ার করবে সে কই?এর মধ্যে থানায় প্রবেশ করে আভা এবং অভয়।অভয়কে দেখে প্রাণ ফিরে পায় রৌদ্র।অভয় উৎকন্ঠা হয়ে বলে,
– রৌদ্র এসব কি হচ্ছে?

রৌদ্র বিভ্রান্ত স্বরে বলে,
– আমি কিছু জানি না।সারারাত কাজ করে সকালে ঘুমিয়েছিলাম হঠাৎ করে ওনারা এসে বলেন বাসা সার্চ করবে তারপর তারপর কম্পিউটার সার্চ করে বলেন এই ডিভাস থেকে নাকি কোনো বড় ওয়েব অর নেটওয়ার্ক সিস্টেম হ্যাক করার চেষ্টা হয়েছে।কম্পিউটারটা কি সেকেন্ড হ্যান্ড?

অভয় অপরাধীর মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কাচুমাচু স্বরে বলে,
– কম্পিউটার আমার একজন কলিং কিনে এনেছিল।আমি টাইম বের করতে পারিনি তাই তাকে বলেছিলাম কিনে আনতে।

– ক্যাশ মেমো,ওয়ারেন্টি কার্ড কই?

– আমাকে দেয়নি।বলেছে এটা নাকি ইম্পোর্টেড পিসি।এর পিছনের সিল যতদিন থাকবে ততদিন ওয়ারেন্টি।

বিস্ময়ে চোখ বেরিয়ে এলো রৌদ্রের।অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
– আর তুই এই কথা শুনে এটাকে ঘরে টেনে নিয়ে এলি?তোর মতো একটা শিক্ষিত মানুষকে এভাবে কেউ ঠকাতে পারে তা আমি ভাবতেও পারছি না।

অভয় নত সুরে বলে,
– আমি তকন তাড়াহুড়োয় ছিলাম মাথায় এতোকিছু খেলেনি।তুইও বললি পিসি আর্জেন্ট দরকার।তাই আমি পিসি পেয়ে এতোকিছুর কথা ভুলে গিয়েছিলাম।সরি বন্ধু।

রৌদ্রের রাগে শরীর জ্বলছে।এতক্ষণে সে আভাকে দেখে অভয়ের পাশে দাঁড়িয়ে নাক টেনে টেনে কেঁদে যাচ্ছে।এমনিতে তো অভয়ের কথা শুনে রাগ উঠে গিয়েছে তার উপর আভার কান্না যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিলো।রৌদ্র আভাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে,
– আর তুমি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছ কেন?ভাই-বোন দু’টোই মাথামোটা।

এতে করে আভার কান্না আরো বেড়ে যায়। বিরক্ত হয় রৌদ্র চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ভয়ে চুপসে যায় আভা।অভয় বোনকে একহাতে আগলে রৌদ্রকে বলে,
– ওর উপর রাগ দেখাচ্ছিস কেন?

রৌদ্র আবারো ত্যাড়া স্বরে বলে,
– এটাকে আবার শানিয়ে আনতে হয়েছে কেন?

– তো ওকে কোথায় রাখতাম?কি করবো এখন বল?

– আপাতত কোনো ল-ইয়ার হায়ার করে বেল এর ব্যবস্থা কর।বেল না দিতে চায়লে জামিনের ব্যবস্থা কর।কোথায় ফাঁসিয়ে দিলি শা’লা!

রৌদ্র নিজের চুলে আঙুল চালিয়ে এদিকে ওদিকে তাকায়।আভা গোল গোল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তা দেখে রৌদ্র ত্যাড়া কন্ঠে বলে,
– এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

আভা এবার ক্ষিপ্ত হলো।কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,
– আমার সাথে তেজ দেখাচ্ছেন কেন?

রৌদ্রের আবারো ত্যাড়া জবাব দেয়,
– ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কান্না লাগছে কেন তাহলে?মরে গিয়েছি আমি?

আভার মুখে অসহায়ের ছাপ ভেসে ওঠে।অভয় তার পরিচিত ল-ইয়ারকে ফোন করে সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে আসতে বলে।একজন পুলিশ কর্মকর্তা রৌদ্রের উদ্দেশ্যে বলে,
– আপনি কি কোনো ল-ইয়ার হায়ার করেছেন?

রৌদ্র অতি নরম সুরে বলে,
– জ্বী।খুব শীঘ্রই আসবেন তিনি।

– আচ্ছা তাহলে আপনাকে ততক্ষণ ভিতরে বসতে হবে।

পুলিশ থানায় থাকা লক-আপ দেখিয়ে বলেন।আভা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র সম্মতি জানিয়ে সেদিকে যেতে চায়লে হাত টেনে ধরে আভা।একপ্রকার খামচে ধরে তার হাত।জেদি কন্ঠে বলে,
– না আপনি ভিতরে যাবেন না।

বিরক্ত হয় রৌদ্র।ভ্রু কুঁচকে আভাকে একপলক দেখে পুলিশের দিকে তাকায়।সেও আভার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।রৌদ্র পুলিশের উদ্দ্যেশে বলে,
– স্যার ওনাকে কি এক গ্লাস পানি দেওয়া যায়?

অফিসার বিনয়ী স্বরে বলেন,
– জ্বী অবশ্যই।চলুন ম্যাম আমার সাথে চলুন।

রৌদ্র চোখ গরম করে আভাকে পুলিশের সাথে যেতে বলে।আভাও সভয়ে লোকটির সাথে যায়।
অভয়কে কল করে রৌদ্রের লোকেশন জেনে নেয়।যতদ্রুত সম্ভব চলে আসেন তিনি থানায়।থানায় প্রবেশ করেই হৈ-হুল্লোড় করেন তিনি।বারবার পাগলের মতো প্রলাপ বকেন,
– আমার ছেলে কোথায়?আমার ছেলে এমন কিছু করেনি।

পুলিশ অফিসাররা বেশ বিরক্ত হয় রোদেলার এমন আচারণে। থানার পরিবেশ হঠাৎই গরম হয়ে যেতে দেখে কপাল কুঁচকে আসে রৌদ্রের বাইরে তাকিয়ে মাকে দেখে মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে উচ্চারণ করে,
– মম!

ছেলের করুণ কন্ঠ স্বরে থমকে যান রোদেলা।টলমল চোখে পাশে তাকিয়ে ছেলেকে জেলের শক্তপোক্ত রডের ওপাশে দেখে বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে তার।নিজের ডুকরে আসা কান্নাকে আঁটকাতে না পেরে ভেজা কন্ঠে বলে,
– বাবা!আমি একশোবার নিষেধ করলাম আসিস না আসিস না।দেখলি তো মায়ের কথা না শুনলে কত বিপদে পড়তে হয়!না না তোকে আমি এভাবে দেখতে পারবো না।এখনই তোর বেলের ব্যবস্থা করবে লিনডা।

রৌদ্র বিস্মিত কন্ঠে বলে,
– লিনডা?!

চলবে….

প্রিয় বালিকা পর্ব-২৫+২৬+২৭

0

#প্রিয়_বালিকা |২৫+২৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

ঝুম বর্ষায় ছাতা মাথায় খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে আভা।পাজামার অনেকটা অংশ বর্ষার পানি আর কাঁচা রাস্তার কাঁদার দখলে।বিকেলের দিকে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল সে।হঠাৎ করে আকাশ ফেড়ে নেমে এলো রহমতের পানি।এখনো সন্ধ্যা হয়নি তবে হওয়ারও বেশি বাকি নেই।রৌদ্রের সাথে কথা বলার পর থেকে তার মনটা খুব খারাপ।তারপর কয়েকবার রৌদ্রের ফোনে কল করেছিল সে।কিন্তু কল রিসিভ হয়নি।বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে আর পঁচিশ কি ত্রিশ কদম পাড় হলেই মুন্সি বাড়ি।প্রধান ফটকে এসে থেমে গেল আভা।চোখ জুড়ে নেমে এলো বিস্ময়ের ছাপ।ঠোঁট দু’টো আপনা আপনিই আলগা হয়ে গেল।ছাতা ধরে থাকা হাতটি ঢিল হতে শুরু করে।বর্ষা এবং বাতাসে তৈরি ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে আসছে সুর্দশন যুবক।ওভার সাইজ সাদা টিশার্ট আর ঢোলা ঢালা একটি কালো কার্গো প্যান্টস।পিঠে একটি কালো ব্যাগ। বর্ষায় ভিজে জুবুথুবু।সে কপালে সূক্ষ্ম ভাজ নিয়ে আভার সামনে এসে দাঁড়াল। আভা অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
– আপনি?কখন এসেছেন?

লোকটি আভার কথায় পাত্তা না দিয়ে সোজা আভার হাত ধরে বসে।টেনে মেইন রোডের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বেপরোয়া স্বরে বলে,
– চলো বিয়ে করবো।

যেন আকাশ ভেঙে পড়ে আভার মাথায়।হতভম্ব হয়ে ঠোঁটের ফাঁক বারিয়ে দেয়।মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায় তার। বিস্ময় স্বরে জিজ্ঞেস করে,
– কিহ্!

লোকটা তার কোনো কথাকে গ্রাহ্য করে না।তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।বৃষ্টি থেমে গিয়েছে।আকাশও পরিষ্কার। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান দিবে।মস্তিষ্কে প্রাণ আসতেই দাঁড়িয়ে পরে আভা।টান দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে অস্থির ভঙ্গিতে বলে,
– রৌদ্র কি করছেন আপনি?পাগল হয়ে গিয়েছেন?কি বলছেন এসব?বিয়ে মানে?

রৌদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর করে,
– বিয়ে মানে বিবাহ,নিকা,শাদী,ম্যারেজ বোঝা গেল এবার?চলো।

রৌদ্র আভার হাত ধরে আবারও টেনে নিয়ে যেতে চায়লো।আভা আবারও নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়।পূর্বের ভঙ্গিতে বলে,
– কি বলছেন আপনি এসব?বাড়ির সকলে জানে এই কথা?নাকি হুট করে বিয়ের ভুত চেপেছে আপনার মাথায়?

রৌদ্রের মুখ এবার রাগে লাল হয়ে যায়।তেজি স্বরে বলে,
– আমি বুঝতে পারছি এই ফ্যামিলি,মম,ড্যাড,বাবা,মায়ের জন্য বসে থাকলে জীবনেও আমার বউয়ের ভাত খাওয়া হবে না।আই মিন বউয়ের হাতে রান্না ভাত।একপক্ষ বলে ছেলেকে যেতে দিবো না অন্যপক্ষ বলে মেয়েকে যেতে দিবো না।তার থেকে বরং চলো আমরা বিয়ে করে দুইজন কেটে পড়ি এরা এদের কোন্দল নিয়ে থাক।এখন বেশি কথা না বলে চলো বিয়ে করবো রাত হয়ে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে বাসর রাত মিস হয়ে যাবে।চলো চলো।

রৌদ্র আবারো এগিয়ে এসে আভার হাত ধরতে চায়লে আভা সরে দাঁড়ালো।অবাক স্বরে বলে উঠলো,
– মানেহ্!পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি?আমি এভাবে বিয়ে করবো না।আমার ফ্যামিলি আমার কাছে সবচেয়ে দামি।আমি এভাবে পালিয়ে বিয়ে করলে আমার বাবা মা অনেক কষ্ট পাবে।

রৌদ্র কোনো কিছু বোঝার অবস্থায় নেই।সে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে সে আজ এখনই বিয়ে করবে ব্যস এটাই তার শেষ কথা।সে থুতনিতে তর্জনি ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– শোনো প্রথমে তো একটু কষ্ট পাবেই।কিন্তু যখন একবছর পর দুইটা কোলে ধরিয়ে দিবো না তখন এমনিতেই সব ভুলে যাবে।এখন তুমি প্যাকপ্যাক করে সময় নষ্ট না করে চলো তাড়াতাড়ি।

আভা হা হয়ে বলে উঠলো,
– এক বছরে দুইটা?

রৌদ্র দাঁত বেরিয়ে হেসে বলে,
– হ্যাঁ আমাদের তো জমজ হবে তিন্নি মিন্নির মতো।

– হু আপনাকে বলেছে!

– সত্যি দেখে নিও তুমি।আচ্ছা বেবি প্লানিং নিয়ে ঝগড়া বরং আমরা কবুল বলার পর বাসর রাতে করবো এখন চলো তাড়াতাড়ি লেট হয়ে যাচ্ছে।

আভা চোখ বন্ধ করে একটি বড় শ্বাস নিয়ে ছাতা বন্ধ করে।দীর গতিতে রৌদ্রের কাছে এগিয়ে আসে।শান্ত স্বরে বলে,
– দেখুন রৌদ্র এমন ঝোঁকের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।আমরা দুই জন ফ্যামিলিকে বোঝানোর চেষ্টা করি অবশ্যই তারা বুঝবে।আমার বাবা মাকে ছেড়ে অতদূরে থাকতে কষ্ট হবে তবে আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো।

রৌদ্র দু’হাতে আভার গাল আগলে নেয়।নরম সুরে বলে,
– কিন্তু আভা আমি তো বাংলাদেশেই সেটেল্ড হতে চাই।

আভা চোখ মুখ চক চক করে ওঠে।পুলকিত স্বরে বলে,
– সত্যি?

– হ্যাঁ।তাহলে এখন চলো বিয়ে করবো।

আভার চোখমুখ আবারো কালো হয়ে যায়।দৃষ্টি নত করে গোমড়া মুখে বলে,
– রৌদ্র কি শুরু করেছেন আপনি বলেন তো?মানে বার বার ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ে কেন বলছেন আপনি?

রৌদ্র কপাল কুঁচকে হেসে বলে,
– হোয়াট ছেমড়ি?আই লাইক দিস ওয়ার্ড।তাহলে এখন থেকে তোমাকে আমি ছেমড়ি বলেই ডাকবো।আর শোনো ছেমড়ি আমি না তোমার সাথে মোটেই মজা করছিনা।আমি সত্যিই আজকে তোমাকে বিয়ে করবো।অভয় আর ভাবি ওয়েট করছে আমাদের জন্য।তুমি জানো তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমাকে অভয়ের শক্ত হাতের একটা ঘুষিও খেতে হয়েছে।এই দেখো ঠোঁট ফুলে গিয়েছে।

রৌদ্র তার নিচের ঠোঁট বেরিয়ে দেখায়।সত্যি ঠোঁটটা কেটে গিয়েছে বাজেভাবে।আভা অবাক হয়ে তাকিয়ে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র অভয়কেও সব বলে দিয়েছে?আভা তবু এভাবে বিয়ে করতে চায় না।সে সেখানেই মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে আভাকে পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করে।আভার বুকের উপর থাকা জরজেট ওড়নাটি সহসা টান দিয়ে নিজের হাতে পেঁচিয়ে ফেলে।আচমকা এমন ঘটনাই চমকে ওঠে আভা।দুই হাত আড়াআড়িভাবে বুকের উপর দেয়।চোখ কোটর থেকে খুলে পড়ে যায় যায়।চিৎকার করে ওঠে সে,
– রৌদ্র কি করছেন আপনি এসব?আপনি কিন্তু এবার আপনার সীমা লঙ্ঘন করছেন।আমি বিয়ে করতে রাজি হইনি বলে আপনি আমার সাথে এটা করতে পারেন না।

রৌদ্র বিরক্তি চাহনিতে ওড়নায় প্যাচ দিতে দিতে আভাকে দেখছে।পাশের একটা বড় গাছের নিচে চলে গেল সে।আভা এদিক ওদিকে ছুটোছুটি করছে।রৌদ্রকে গাছের নিচে আরাম করে বসে ব্যাগ থেকে খাতা কলম বেরিয়ে কিছু লিখতে দেখে থেমে গেল সে।ভ্রু কুঁচকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে রৌদ্রের কাছে।রৌদ্র খুব উদাসীন ভঙ্গিতে ছোট একটি কাগজে কিছু লিখছে।আভা উঁকি দিতে দেখতে পেল রৌদ্র গোটা গোটা বাংলা বর্ণে লিখছে,
“প্রিয় বালিকা,
তোমার মাথার স্ক্রু ঢিলা থাকার শর্তেও আমি তোমাকে অনেক ভালোবেসেছি।ভেবেছি বিয়ের পর আমি আর আমার বাচ্চা মিলে স্ক্রু-ড্রাইভার হয়ে তোমার মাথার স্ক্রুগুলো টাইট দিবো।কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে তোমার মাথার স্ক্রু টাইট দেওয়ার সৌভাগ্য আমার নেই।তার আগেই আমি পৃথিবী থেকে নিজেকে বিলীন করে দিচ্ছি।আমি মরে যাচ্ছি তাতে আমার একটুও কষ্ট নেই বিশ্বাস করো।আমার হৃদয় ভাঙা কষ্ট শুধু এটা ভেবে যে তোমার মাথার স্ক্রু ঢিলা রেখেই আমি মরে যাচ্ছি।না জানি কখন ওগুলো খুলে মাটিতে পড়ে যায়।তখন তোমার কি হবে?স্ক্রু ছাড়া তুমি চলবে কিভাবে?এই চিন্তা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। দয়া করে স্ক্রুগুলো সামলে রেখো।

ইতি
তোমার না হওয়া স্ক্রু-ড্রাইভার”

লেখা শেষ করে বড় একটি শ্বাস ফেলে উদাসীন মুখে কাগজটি আভার হাতে ধরিয়ে দিলো রৌদ্র।আভা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে রৌদ্র আরো একটি ছোট কাগজে লেখা শুরু করে,” আমি আফসিন রৌদ্র কবুল করছি যে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী আমার হবু বউ আভা বিনতে আরাভ।আমার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় আমি গলা’য় দ’ড়ি দিয়ে আত্ম’হত্যা করছি।আপনারা তাকে কঠিন থেকে কঠিন শা’স্তি দিবেন।চায়লে তাকেও ফাঁ’সি দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন আমার কোনো আপত্তি নেই।বরং এতে আমি খুশিই হবো।ভু’ত পে’ত্নী দু’জনে মিলে সুখের সংসার গড়বো।সবকথার এক কথা এই ছেমড়ির শাস্তি হওয়া চাই-ই চাই।”
রৌদ্র এবারের কাগজটি ভাঁজ করে আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– এটা পুলিশ আসলে দিবে।

এবার সে লাফিয়ে ওড়নাটা গাছের নিচু ডালের একপাশ থেকে ঘুরিয়ে অন্যপাশে নিয়ে প্যাচ দিয়ে ফেলে।ডালটা এতোটাই চিকন আর নিচু যে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির আভাও সেটার নাগাল পাবে বিনা দ্বিধায়।আভা হা হয়ে তাকে লেখা চিঠিটি সম্পূর্ণ পড়ে।পড়তে পড়তে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার।আবার রৌদ্রের মরার কথা পড়তেই ভয়ে গলা শুঁকিয়ে যায় তার।সে তার হাতের কাগজটি ফেলে ভাঁজ করা কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করে।চোয়াল ঝুলে যায় আভার।রৌদ্র এতোক্ষণে গলার মধ্যে ওড়নার প্যাচ ঢুকিয়ে ফেলেছে।আভাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে চিঠি পড়তে দেখে বিরক্ত হলো সে।ভ্রু কুঁচকে আভা ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
– এখন কি শুধু চিঠিই পড়তে থাকবে নাকি আমাকে বাঁচাবেও?সু’ইসাইড করতে যাচ্ছি আমি।আমাকে না বাঁচিয়ে তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়ছো?মানবতার ফেরিওয়ালা আজ কোথায়?

শেষের কথাটি বেশ করুণ স্বরে বলে রৌদ্র।আভা মুখ তুলে রৌদ্রের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলো। রৌদ্রের গ’লায় ওড়না যা গাছের একটি ডালের সাথে বাঁধা।রৌদ্র এ অবস্থায় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না আভা।হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
– রৌদ্র কি করছেন আপনি এসব?কেন এসব পাগলামো করছেন?প্লিজ সরে আসুন ওখান থেকে।প্লিজ গলা থেকে ওটা খুলে ফেলুন।

রৌদ্র বাঁকা হাসে।গলা’র বাঁধন টাইট দিয়ে বলে,
– না না এতো সহজে তো আসবো না।যে মিশন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি সেই মিশন পূরণ করবো তারপর শ্বাস নিবো না হলে এখনই গ’লায় দ’ড়ি দিবো।বলো দিবো দিবো?তোমার জন্য এতোদূর কিভাবে এসছি তা শুধু আমি জানি।মম পাসপোর্ট লুকিয়ে রেখেছিল।অনেক খুঁজে ওনার জুতার বাক্সে পেয়েছি।পাসপোর্ট না পেয়ে তো আমার হার্টঅ্যাটাক হয়ে গিয়েছিল।এতো স্ট্রাগল করে এখানে এসে যদি মিশন কমপ্লিট না হয় তাহলে এ জীবন রেখে কি লাভ?তাই এখন আমি গ’লায় দ’ড়ি দিবো।বিদায় পৃথিবীবাসি আর আমাকে মনে করো না আমি আর ফিরবোনা।

বলে রৌদ্র পা দু’টো ভাঁজ করে ঝুলে পড়ে।শ্বাস আঁটকে আসতেই কাশতে শুরু করে চোখ চোখ বড় করে ফেলে।আবারো মাটিতে পা রাখে।আভা এতোটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে যে সে খেয়ালই করেনি রৌদ্র মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে।আভা কাঁদতে শুরু করে।কান্না ভেঁজা কন্ঠে বলে,
– রৌদ্র না প্লিজ এমন করবেন না প্লিজ।আমাকে এভাবে একা ফেলে যাবেন না।

রৌদ্র তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
– তাহলে বলো বিয়ে করবে?না হলে এখনই গ’লায় দ’ড়ি দিবো।দিবো?দিবো?

আভা কাঁদতে কাঁদতে তড়িঘড়ি বলে,
– না না প্লিজ।হ্যাঁ বিয়ে করবো।চলুন বিয়ে করবো।প্লিজ এমন করেন না।

রৌদ্র বাঁকা হেসে গলা থেকে ওড়ানাটা খুলে ফেলে।ডাল থেকেও ওড়ানাটা খুলে এগিয়ে এসে আভার গায়ে জড়িয়ে দেয়।আভা কাঁদতে কাঁদতে দু’হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ে।আসলে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে।জীবনের প্রথম সে এমন কোনো পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।রৌদ্রের খারাপ লাগে।সে হাঁটু গেড়ে আভার সামনে বসে।মুখ থেকে আভার হাত সরিয়ে আদুরে স্বরে বলে,
– আভা দেখো আমার কিছু হয়নি।এইতো আমি।আভা দেখো।

আচমকা আভা শক্ত করে রৌদ্রের গলা জরিয়ে ধরে।রৌদ্রের কাঁধে মুখ ডুবিয়ে অঝোরে কাঁদে সে।রৌদ্রের কাঁধটা মুহুর্তেই ভিজে যায়।এই প্রথম আভার তার এতো কাছে।ভাবতেই সারা শরীর হিম শীতল হয়ে যায় তার।একহাতে আভার কোমর জড়িয়ে অন্য হাতে আভার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দেয় সে।নরম সুরে বলে,
– সরি ভয় দেখানোর জন্য।এবার কান্না বন্ধ করো আমার কষ্ট হচ্ছে। দেখো গলা ব্যাথা করছে।

আভার কান্নার বেগ কিছুটা কমে আসে।তবু কেঁপে কেঁপে ওঠে সে।নাক টেনে আচমকা আক্রমণ করে রৌদ্রের উপর।মুখে, গলায়,কাঁধে বড় বড় নখের খামচি বসাতে থাকে আভা।রৌদ্র চিৎকার করে আভাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়
– আহ আভা কি করছ ব্যাথা পাচ্ছি। ওমা কাঁধের চামড়া তুলে ফেলল।আহ্ খুব জ্বলছে।

আভা ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
– শয়’তান ছেলে আর কোনোদিন এমন করবি বল?

– আরে তুমি আগে ঢালটা তো দেখো।কত নিচু আর চিকন দেখো।ওটাতে কখনো ঝোলা সম্ভব?ডাল ভেঙে পড়বো না!

আভা এবার খেয়াল করে দেখে।এবার তো তার রাগ আরো বেড়ে যায়।রাগে ক্ষোভে কিছু বলবে তার আগেই রৌদ্র সতর্ক করে তাকে,
– এখন আর একটা কথাও না তুমি বলেছ তুমি আজই আমাকে বিয়ে করবে।তুমি যদি বিয়ে করো তাহলে আমি কিন্তু এবার সত্যি সত্যি..

চট করে আভা বলে ওঠে,
– আমি কি বলেছি বিয়ে করবো না?

– চলো তাহলে এবার।

রৌদ্র মাটি থেকে চিঠি দু’টো নিয়ে ব্যাগ ঢুকিয়ে ফেলে।ব্যাগ কাঁধে এক হাতে আভার হাত চেপে ধরে।এগিয়ে যায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ সম্পূর্ণ করতে।আভাও গোমড়া মুখে তার পিছন পিছন ধীর কদমে এগিয়ে যায়।

কাজী অফিসে পাশাপাশি বসে অপেক্ষা করছে অভয় এবং অহনা।কাজী সাহেব নেই নামাজ পড়তে গিয়েছেন।অভয় অনেকদিন পর বউকে দেখে যেন বাচ্চা হয়ে গিয়েছে।তখন থেকে বউকে বিরক্ত করে যাচ্ছে।কখনো বউয়ের হিজাব ধরে টানছে তো কখনো চুড়ি নিয়ে টানটানি করছে অহনা এবার বিরক্ত হয়ে হাত ঝাড়া দেয়।মোটা মোটা চোখ করে তাকায় অভয়ের দিকে।অভয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসে।অহনার হাতে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে,
– কেমন আছো বউ?

অহনা আবারো চোখ মোটা করে চায় অভয়ের দিকে।অভয় এবার শার্ট ঠিক করে সোজা হয়ে বসে।কাজী অফিসে প্রবেশ করে আভা এবং রৌদ্র।দু’জনে হাত ধরে আছে।সেদিকে তাকিয়ে চোখ চোখ বন্ধ করে ফেলে অভয়।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজে নিজে বিড়বিড়িয়ে বলে,”কন্ট্রোল অভয় কন্ট্রোল।ও তোর বোনের জামাই।”

অহনা রৌদ্র আভাকে দেখে বিগলিত হেসে বলে,
– তোমরা চলে এসেছ?কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্য।সরি আভা না জেনেই বাবাকে তোমার পছন্দের কথা বলে ফেলেছিলাম।রৌদ্র বলল তোমরা রিলেশনে আছো তখন বুঝলাম সেদিন তুমি রৌদ্রের কথাই বলেছিলে।সরি আভা।

আভা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগি কন্ঠে বলে,
– ভাইয়া তুমি ওনার গায়ে হাত তুলেছ?তুমি ওনার ঠোঁট কেটে দিয়েছ?

অভয় মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে চোরা দৃষ্টিতে আভাকে দেখে।রৌদ্র আর অহনা ঠোঁট চেপে হাসে।রৌদ্র বলে,
– বাদ দাও না।আচ্ছা আভা বউয়ের ভাইকে যেন কি বলে?

– শা’লা

– হ্যাঁ।শা’লা আমার ঝটকাটা সামলে উঠতে পারিনি।তাই একটা ঘু’ষি নাহয় মেরে দিয়েছে।ব্যাপার না।চলো এবার বিয়ে করি।

সকলে এগিয়ে গেল কাজী সাহেবের দিকে।চেয়ার টেনে বসবে ঠিক তখন গম্ভীর মুখে হাজির হয় আরাভ সাহেব।অভয় মৃদু স্বরে বলে,
– বাবা!

সকলে চমকে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।আভার ধুকপুকানির গতি বৃদ্ধি পায়।ভয়ে কেঁদে দিবে বলে।রৌদ্রও কিছুটা ঘাবড়ে যায়।আভাকে একহাতে আগলে তাকিয়ে থাকে আরাভ সাহেবের দিকে।তিনি গম্ভীরমুখে রৌদ্রের দিকে এগিয়ে আসেন।অভয়ও ভীত চোখে তার সাথে সাথে আসেন।তিনি রৌদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে একনজর দেখে গম্ভীর স্বরে বলেন,
– রৌদ্র।

রৌদ্র কোনো শব্দ করে না।তিনি পুনরায় বলেন,
– অভয় আমাকে সবটা বলেছে।তুমি অস্ট্রেলিয়া যাবেনা বলেই কিন্তু আমি শান্ত আছি এ কথার যেন কোনো নড়চড় না হয়।সেদিকে খেয়াল রাখবে।

সকলের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল।সকলের ঠোঁটে ভেসে ওঠে এক চিলতে হাসি।রৌদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে ঝড়ের গতিতে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।আরাভ সাহেবও মৃদু হেসে রৌদ্রের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলেন,
– ছেলে হিসেবে তোমাকে খারাপ বলার মতো এতোটা জা’হিল আমি না।

আরাভ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন হাসেন।রৌদ্র আভা পাশাপাশি চেয়ারে বসে।নেই কোনো আয়োজন, কোনো জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী।শুধু গোটা পাঁচেক মানুষের উপস্থিতি।পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে আভাকে স্ত্রী হিসেবে কবুল করে রৌদ্র।আভাকে কবুল বলতে বললে বারবার থমকে যায় সে।সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে তার কাছে।মাকে খুব বেশি মনে পড়ছে তার।মাথায় কারো স্নেহের স্পর্শ এবং হাতে কারো ভালোবাসা আর ভরসার স্পর্শ পেয়ে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে আভার।মাথায় হাত রেখে তার বাবা তাকে কবুল বলতে আশ্বাস দিচ্ছেন।হাতে হাত রেখে নিজেকে ভরসা ও বিশ্বাস করতে আশ্বাস দিচ্ছে রৌদ্র।আভা টলমল চোখে ঠোঁট মেলে হাসে।নিচু স্বরে তিনবার “কবুল” বলে রৌদ্রকে স্বামী হিসেবে শিকার করে।রৌদ্রের হৃদয় জুড়ে প্রজাপতি ডানা ঝাপটায়।অবশেষে সে তার ডান পাঁজরে হাড়টি খুঁজে পেল।রৌদ্রের চোখেও জমা হয় নোনাজল।প্রাপ্তি সুখ বোধহয় এমনই হয়।না সহ্য করা যায় না দূরে ঠেলা যায়।রৌদ্র-আভা টলমল চোখে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।সবকিছু যেন একটা সুন্দর স্বপ্ন মনে হচ্ছে দুজনের কাছে।অভয় এবং আরাভ সাহেবের চোখেও দেখা গেল জল।আরাভ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
– নাও এখন চলো।আর বাড়িতে গিয়ে কি বলবে ঠিক করে নাও।আমি কিন্তু কাউকে বাঁচাতে পারবোনা।

দুজনে উঠে দাঁড়ায়। অভয় রৌদ্রের সামনে এসে রৌদ্রকে জরিয়ে ধরে।আবেগি স্বরে বলে,
– সরি রৌদ্র তোকে তখন না বুঝেই ঘুষি মেরে দিয়েছি।তোর থেকে ভালো ছেলে আর দু’টো পাবো কিনা জানিনা।তবে আমার বোন তোর সাথে অনেক ভালো থাকবে জানি।

রৌদ্র মুচকি হেসে অভয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।অভয় রৌদ্রকে ছেড়ে বলে,
– যতোই তুই আমার বোনের জামাই হোস না কেন তুই কিন্তু সবার আগে আমার বেস্টফ্রেন্ড বুঝেছিস?

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে বলে,
– হুম।

বাড়ির জন্য রওনা হয় তারা।শহরের একটি কাজী অফিসে এসেছিল তারা।বাড়ি পৌঁছাতে এখনো দেড় ঘন্টার মতো সময় লাগবে।রাত দশটা বাজবে ত্রিশমিনিট বাকি।বাড়ির সকলের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে এখন সেটাই দেখার বিষয়।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |২৭|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

মুন্সিবাড়ির সকলে মোটামুটি মুখ ভার করে আছে।এখন বাজে রাত সাড়ে বারোটা।এতোক্ষণ ধরে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে সকলের মাঝে।প্রেমার ক্ষোভের কাছে টিকতে না পেরে ঘর ছেড়েছেন আরাভ সাহেব।আজ বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাবেন তিনি।বাড়িতে আসলেই বউয়ের খিটমিট মেজাজ তার হজম হবে না।তখন এক কথা দুই কথায় বড়সড় একটা ঝামেলার সৃষ্টি হবে।বুড়ো বয়সে বউয়ের সাথে কোনো রকম ঝামেলা সে চায়না।তাই চুপচাপ সরে যাওয়ায় শ্রেয় মনে করেছেন তিনি।বসার ঘরে সোফায় চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে অভয়,অহনা,রৌদ্র,আভা।প্রেমা দূরে দাঁড়িয়ে নানা ধরনের প্রলাপ বকে চলেছেন।
প্রেমা অভয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
– তুই আমার পেটে হয়ে আমার সাথে এমন বেইমানি কিভাবে করতে পারলি?আমি ভাবতাম সকলে আমার বিপক্ষে থাকলেও তুই আমার ছেলে আমার সাথে থাকবে আর সেই তুই কিনা তোর বাপের সাথে মিলে এই বেইমানিটা করলি!

অভয় কাচুমাচু মুখে বলে,
– আম্মু বেইমানি কিভাবে করলাম?বিয়ে তো হবে অনেক বড় করে।এখন ফর্মালিটিস গুলো সেরে রেখেছি যাতে সামনে কোনো ঝামেলা না হয়।

– চপ একটা কথাও বলবিনা তুই। আমি কে?আমি তো দাসি বান্দি পথে বসে কান্দি!আমার মতামতের কি তো প্রয়োজন আছে?আমারে তোর বাপ এনেছে রান্না করে খাওয়ানোর জন্য।আরে আমি কি কোনো জালিমের ঘরের মেয়ে যে রৌদ্রকে মেয়ে জামাই হিসেবে মেনে নেব না?তোর বাপ এই গাদ্দারিটা কিভাবে করতে পারল?

অভয় হাত ঘড়িতে সময় দেখে রৌদ্র এবং আভার দিকে তাকায়।দু’জনে অপরাধী মুখে চুপচাপ বসে আছে।অভয় মিনমিন করে বলে,
– আম্মু এবার তো থামো।দেখ সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে।নবদম্পতিকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত সোফায় এভাবে বসিয়ে রেখে এমন সিন ক্রিয়েট করার কি কোনো মানে আছে?

প্রেমা এবার কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলেন,
– হ্যাঁ আমি বললেই তো সিন ক্রিয়েট।দেখো না হাঁটছে কোথায় রাত দুপুরে।যখন থাকবো না তখন বুঝবি মায়ের কি মূল্য।রৌদ্র আব্বু খেতে এসো।

এতোক্ষণে রৌদ্রের ঠোঁটে হাসি দেখা গেল।প্রেমা কথা শেষ করার সাথে সাথে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে যায় রৌদ্র।তার খুব খিদে পেয়েছে।তাকে দাঁড়াতে দেখে সকলে তার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে পড়ে।রৌদ্র সামান্য বিব্রত হয়ে বলে,
– কি এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?আম্মু খেতে ডাকছে চল খাবো।

রৌদ্রের মুখে “আম্মু” ডাক শুনে প্রেমার এতোক্ষণের সকল রাগ অভিমান এক নিমিষেই গলে জল হয়ে গেল।সে তৃপ্তির হাসি হেসে চোখের কোণে জমা জলটুকু মুছে টেবিলে একেক করে সকল খাবার এনে রাখলেন।হাতে হাতে সাহায্য করে অহনা এবং আইরিন।তিন্নি মিন্নি বাড়িতে নেই নানু বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে।
খাবার টেবিলে অভয় এবং রৌদ্র পাশাপাশি বসেছে।আভার রৌদ্রের মুখোমুখি। রৌদ্র বেশ বিরক্ত সে তার বউয়ের জন্য জায়গা রেখেছিল হঠাৎ কোথা থেকে এই অভয় এসে বসে পড়েছে।রৌদ্র কাটা চামচ দিয়ে খাবার মুখে দিতে দিতে বলে,
– শহরে তুই যেখানে তার আশেপাশেই একটা ভালো খোলামেলা ফ্লাট দেখিস।

অভয় অবাক হয়।খাওয়া থামিয়ে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুই শহরে থাকবি?

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।খাবার মুখে তুলতে গিয়েও থেমে যায় কিছু একটা ভেবে থেমে যায়।বলে,
– আমার পি.সি. ও সেট-আপ করতে হবে।সিপিইউ এনে দিস বাকিগুলো আমি কিনে নিবো।

– আচ্ছা।কিন্তু আমার মনে হয় আভার ভার্সিটির আসেপাশে থাকলে ভালো হবে।

রৌদ্র এবার চোখ তুলে তাকিয়ে আভাকে একপলক দেখে।আভা অভয় এবং তার দিকেই তাকিয়ে আছে।রৌদ্রও সম্মতি দিয়ে বলে,
– আচ্ছা তাহলে আভার ভার্সিটির আশেপাশেই দেখ।আর আমার সিপিইউ এর কথা যেন মনে থাকে।অনেকগুলো প্রজেক্ট কিন্তু আঁটকে আছে।

– আচ্ছা আচ্ছা মনে থাকবে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় দুইটার কাছাকাছি বেজে গেল।রৌদ্রকে আভার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।তবে সেখানে আভাকে এখনো পাঠানো হয়নি।যেহেতু বিয়েটা তেমন কোনো আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি মেনে হয়নি তাই বাসর ঘরে টাকার জন্য কেউ দাঁড়ায়নি। দাঁড়াবেও বা কে?ছোটরা তো আর কেউ নেই।অভয় তো বড় ভাই তাই তার টাকা চায়তেও বিবেকে বাঁধে।তাই সে চুপচাপই রইলো।অহনা আভাকে হালকা পাতলা সাজিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে।অভয় সুন্দর একটি রাণী গোলাপি রঙের শাড়ি গিফট করেছে আভাকে।সে এটা কাজি অফিসে যাওয়ার আগেই কিনেছিল আভার জন্য।সেটা পরানো হলো আভাকে।সাথে মুখে হালকা পাতলা নু’ড মেকআপ। আভার বিশেষ কোনো অনুভূতি জাগছেনা মনে।তবে সে কিছুটা ভীত।শ্বাসটা ঘন হচ্ছে ধীরে ধীরে।বুকের ভিতরো তেমন ঢিপঢিপ করছে।তবে এগুলো তেমন একটা কাবু করতে পারছে না আভা।হয়তো কাবু করত যদি সে লোকটাকে না চিনতো।সে তো রৌদ্রকে চেনে খুব আগে থেকেই চিনে তাই তেমন একটাও ভয় লাগছে না তার।রাত তিনটার কাছাকাছি আভাকে একগ্লাস দুধ হাতে পাঠানো হলো তার ঘরে।দরজা খুলতেই সহসা কাঁপতে শুরু করে সে।বুকের ভিতর থাকা হৃৎপিণ্ড নামক বস্তুটা অসম্ভব গতিতে ওঠানামা করে চলেছে।দরজা খোলার শব্দ পেয়ে রৌদ্র ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে।তিন বেজে পাঁচ মিনিট।রৌদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– আর আসার দরকার ছিল কি একবারে সকলে আসতে।

রৌদ্রের অভিমানী স্বরে বলা বাক্যে আভার ভয় উড়ে যায়।ঠোঁটে দেখা যায় চাপা হাসি।ধীর পায়ে এগিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়।ঘরের আলো জ্বলে উঠতেই চোখে ঘোর লেগে যায় রৌদ্রের।পলকহীন তাকিয়ে থাকে তার সামনে হেঁটে চলে বেড়ানো রাণী গোলাপি শাড়িতে থাকা তার বউয়ের দিকে।আভা হাতের গ্লাসটি খাটের পাশে থাকা বেড সাইড টেবিলে রাখে।রৌদ্র খাটে পা ঝুলিয়ে বসে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আভা তার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে সাদা পাঞ্জাবির কলার টেনে মুখ ঘুরিয়ে এদিকে ওদিকে করে গলা ঝেড়ে বলে,
– ত তুমি এতো সেজেছ কেন স্ট্রেঞ্জ!

আভার মুখে আবারো সেই চাপা হাসি ভেসে ওঠে।সে খাটের অন্যপাশে যেতে যেতে বলে,
– ঘুমাবো তাই।

রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে দেখতে দেখতে বলে,
– তো ঘুমানোর জন্য কি তোমাকে এক কেজি আটা ময়দা মুখে মাখতে হয়?স্বপ্নে কি ব্লাইন্ড ডেটে যাবে?নাকি সিরিয়ালের শুটিং হচ্ছে এখানে?

আভা খাটে বসে পড়ে রৌদ্রের চোখে চোখ রেখে বলে,
– যেতোও পারি ব্লাইন্ড ডেটে তাতে আপনার কি?আপনি ঐটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন অলরেডি তিনটা বেজে গিয়েছে একটু পরেই ভোর হয়ে যাবে।

আভার দৃষ্টি রৌদ্রের চোখে স্থির হতেই আবারো ঘোরে চলে যায় রৌদ্র।মস্তিষ্ক জুড়ে নেমে আসে হাজারো অসভ্য চিন্তা ভাবনা।এই মেয়েটাকে দেখলেই যত বাজে,খারাপ,নোংরা চিন্তা ভাবনার শুরু হয় রৌদ্রের।মেয়েটা একদমই সুবিধার নয়।রৌদ্র ধীরে ধীরে আভার সান্নিধ্যে চলে আসে।আরেকটু কাছে আসার চেষ্টা করতেই আভা এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় রৌদ্রের দিকে।সহসা বলে ওঠে,
– কি যেন বলেছিলেন?আমার মাথার স্ক্রু ঢিলা?

রৌদ্র আভার সহসা এমন কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।মাথা পিছনে নিয়ে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আভার দিকে।হঠাৎ মেয়েটা এমন কড়া কথা বলছে কেন বুঝতে পারে রৌদ্র।রৌদ্র আভার কথায় না দিকে আভার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে মুখ এগিয়ে নিয়ে যেতেই আভা উঠে খাট থেকে লাফ দেয়।ভ্রু কুঁচকে ফেলে রৌদ্র।রাগি স্বরে বলে,
– এসব কি হচ্ছে আভা?

আভা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে বলে,
– কোনো বাসর টাসর হবেনা।এই বিয়ে আমি আমি না আপনি আমাকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে করছে।

রৌদ্রও খাট থেকে উঠে দাঁড়ায়।আভার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
– কোন সিরিয়ালের ডায়ালগ দিচ্ছ?ব্লাকমেইল করে বিয়ে করি আর যেভাবেই বিয়ে করি বিয়ে করছি মানে বাসর হবে।

আভা দ্বিমত করে বলে,
– না হবে না।

রৌদ্র আভার দিকে এগিয়ে যেতে বলে,
– হবে।

– হবে না।

– হবে।

এমন তর্কাতর্কির মাঝে আভাকে নিজের বাহুতে আঁটকে ফেলে রৌদ্র।ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– এবার?এতো সুন্দর করে আমার জন্য সেজেগুজে এসেছ এখন এই সাজ যদি নষ্ট না করি তাহলে শান্তি পাবো বলো?

আভা সাপের মতো মুচড়ামুচড়ি করতে করতে বলে,
– আমি একদম আপনার জন্য সাজিনি।আমিকে তো ভাবি জোর করে সাজিয়ে দিয়েছে।

– ভাবি আমার জন্যই সাজিয়েছে।

আভা এবার বুকে সাহস জুগিয়ে বলে,
– রৌদ্র ছাড়ুন আমাকে।আমি কিন্তু কুস্তি জানি। আপনি আমার সাথে এভাবে জবরদস্তি করতে পারেন না।নাহলে কিন্তু আমি কুংফু করে দিবো।

রৌদ্র শব্দ করে হাসে।আভাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে।বুজে হাত গুঁজে বলে,
– এতো সুন্দর ডায়ালগ দাও তুমি আভা।তোমাকে আসলে ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রিতে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত।তাহলে জীবনে শাইন করতে পারবে।কই শুরু করো দেখি তোমার কুংফু।

আভা চোয়াল শক্ত করে মুখের সামনে আড়াআড়িভাবে দু-হাত তোলে।পা তুলে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে। মুখ দিয়ে, “হাই, হুই,হুহ্” শব্দ করে।রৌদ্র পেট ধরে শরীর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করে।হাসতে হাসতে তার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। আভা কপাল কুঁচকে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।রৌদ্র হাসি থামিয়ে ঝড়ের গতিতে আভার দুইহাত ধরে ঘুরিয়ে পিছন থেকে চেপে ধরে নিজের সাথে।চমকে ওঠে আভা।ঘটনা এতো দ্রুততার সাথে হয় যে তার কিছুই ঠাওর করতে পারে না আভা।দু’জনের শ্বাস ক্রমেই বৃদ্ধি পায়।দু’জনে শরীরের তাপমাত্রা হু হু করে বেড়ে যায়।রৌদ্র ধীরে ধীরে আভার কাঁধের কাছে নেমে আসে।আভার কানে হিসহিসিয়ে বলে,
– ড্রামা কুইন।

কথাটি শেষ করে নিজের মুখমণ্ডল রাখে আভার কাঁধের এক অংশে।চোখের পাতা এক করে শুঁকনো ঢোক গিলে আভা।রৌদ্রের একহাতে নিজের দুইহাত আঁটকে থাকায় চায়লেও কিছু করার ক্ষমতা পায় না আভা।চোখ বন্ধ করে রৌদ্রে টুকরো টুকরো স্পর্শে কেঁপে ওঠে সে।রৌদ্রের হাত আলগা হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় সে।এক মুহুর্ত কালবিলম্ব না করে রৌদ্রকে জোরে ধাক্কা দেয়।এতোটাই জোরে ধাক্কা দেয় যে রৌদ্র ছিটকে পড়ে মেঝেতে।কোমরের প্রচন্ড ব্যাথাতে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে সে।আভা দৌড়ে খাটের উপর উঠে দুই হাত কুংফু ভঙ্গিতে মুখের সামনে আড়াআড়িভাবে রাখে আবারো।রৌদ্র কোমরে হাত দিয়ে রাগে কটমট করে বলে,
– ইউ…!

আভা দাঁত বের করে হেসে ঘাড় কাঁত করে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
– কেসা লাগা মেরা মাজাক?এতো সহজে তো আমি ধরা দিচ্ছি না স্বামী। আমি কি আর আপনার সেই রেন্টেড গার্লফ্রেন্ড?স্ত্রী আমি আপনার।স্ত্রীকে পাওয়ার জন্য তো একটু কাঠখড় পোড়াতে হবেই।তার উপরে আপনি আমাকে মাথার স্ক্রু ঢিলা বলেছেন।এখন এসেছেন সোহাগ করতে?ব্লাকমেইল করে বিয়ে করেছেন না?বিয়ের অনেক শখ না আপনার?

রৌদ্র চোখ মুখ খিঁচে কোমর ডলছে আর রাগে কটমট করছে।আভা চট করে কাঁথা মুড়ি দিকে শুয়ে পড়ে।রৌদ্রের উদ্দেশ্যে বলে,
– গুড নাইট বস।সি ইউ ইন দ্য মর্নিং।

রৌদ্র চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তর দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে রইলো।মনে মনে ভাবল মেয়েটা কিরকম ব্রিটিশ সেই তিনচার বছর আগের রেন্টে নেওয়া গার্লফ্রেন্ডের কথা নিয়ে এখন খোঁটা দিচ্ছে।মৃদুস্বরে শোনা গেল আযান।রৌদ্র আযান শুনে আভার দিকে তাকিয়ে বলে,
– নামাজ পড়বে না?আযান দেয়।

আভা কাঁথার নিচ থেকে উত্তর দেয়,
– আমার ছুটি চলে।

রৌদ্র থমকে যায় এবার।অপরাধ ভোগে ভুগতে থাকে সে।মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বলে,”আচ্ছা এজন্য তাকে কাছে আসতে দেওয়ায় এতো আপত্তি?”এমনিতেও সে তেমন কিছুই করত না।রৌদ্র ঠোঁটে হাসি রেখেই কোমর চেপে উঠে দাঁড়ায়।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজা খুলে মাথা বের করে দেখে বাইরে কেউ আছে কিনা।আবারো ধীরে ধীরে দরজা লাগিয়ে বের হয় সে।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খাবার ঘরে থাকা বড় ফ্রিজ থেকে আইস ব্যাগে বরফ নিয়ে কোমরে চেপে ধরে।চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছুক্ষণ আগের আভা এবং তার ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে দৃশ্য।ভাবতেই ঠোঁট জুড়ে ছেয়ে যায় এক সুন্দর মোলায়েম হাসি।
হঠাৎ কেউ বলে উঠলো,
– কিরে রৌদ্র বোনটা আমার বাসররাতেই লা’থি মেরে তোর কোমর ভেঙে দিলো নাকি?হা হা।ফাইনালি তাহলে তোর বউয়ের লা’থি খাওয়ার সৌভাগ্য হলো।কেমন সুখ সুখ লাগছে না বল?দেখেছিস বলেছিলাম না বউয়ের লা’থি খাওয়ার মধ্যেও একটা রোম্যান্টিক ব্যাপার আছে।

চলবে…

প্রিয় বালিকা পর্ব-২১+২২+২৩+২৪

0

#প্রিয়_বালিকা |২১|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সকাল সকাল বাড়ির সকলের তোড়জোড় হুড়োহুড়ি দেখে পা থেমে গেল রৌদ্রের।সকালের নাস্তার জন্য নিচে নেমে সে সকলকে কোনো একটি বিশেষ অতিথির জন্য বিভিন্ন আয়োজন করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে।অভয়ের বিয়ের প্রায় পনেরো দিন কেটে গেল।সে এখনো অস্ট্রেলিয়া ফেরেনি।কিসের টানে সে এখনো এখানে পড়ে আছে তা সম্পর্কে সে অবগত।এর মধ্যে অনেকবারই চেষ্টা করেছে আভাকে তার মনে কথা বলতে কিন্তু যতবারই চেষ্টা করেছে ততবারই তার গলা আঁটকে গিয়েছে অজানা আতংকে।রৌদ্রকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রেমা আইরিনকে বললেন,
– আইরিন রৌদ্রকে খেতে দে।

রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– আব্বু খেতে এসো।

রৌদ্র কপালে ভাঁজ রেখেই খাওয়ার টেবিলে বসে।প্রেমাকে জিজ্ঞেস করে,
– আন্টি কেউ আসবে?স্পেশাল কেউ?

প্রেমা মিষ্টি হেসে উত্তর করে,
– হ্যাঁ।আভাকে দেখতে আসবে।গত পরশু ফোন করে বললো।

মাথায় যেন বাজ পড়ল রৌদ্রের।পাথরের মুর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে গেল সে।আভাকে দেখতে আসবে মানে?কয়েক মিনিট নিরবতা পালন করে হুঁশ এলো তার।চট করে বলে উঠলো,
– আভাকে দেখতে আসবে?আভা তো এখনো অনেক ছোট।লেখাপড়াও এখনো শেষ হয়নি।এখনই বিয়ে?

প্রেমা ঠোঁট মেলে বলেন,
– দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হবে যাচ্ছে না।দেখাশোনা হবে কথাবার্তা হবে তারপর বিয়ে।বিয়ে তো আর হুট করে হয়ে যায় না।হাজার কথা না বললে বিয়ে হয় না।আর তারা যদি আমার মেয়েকে লেখাপড়া না করাই তাহলে আমরা ওখানে বিয়ে দেব না।

প্রেমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়না রৌদ্র।নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে এক দু লোকমা খেয়ে উঠে চলে আসে সে।
আভার ঘরের দরজার সামনে থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে রৌদ্র।তার একটা বিষয়ই দেখবার আছে আর তা হলো আভা এ বিয়েতে রাজি কিনা।কিন্তু সে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে।সে ঘরে প্রবেশ করার আগেই আভাকে বাহিরে বের হতে দেখা গেল।সে সুন্দর একটি নীল জামদানী শাড়ি পরে হালকা পাতলা সেজেছে।আভাকে এসে গুঁজে পটের বিবি হয়ে ঘুরতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল রৌদ্র।চোখ বেরিয়ে তাকিয়ে আছে সে আভার দিকে।আভা নির্বিকার।রৌদ্রকে দেখেও যেন দেখছে না।শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে চিকন সুরে গান গেয়ে ওঠে সে,”মে তো রাস্তে সে যা রাহা থা, মে তো ভেলপুরি খা রাহা থা।তুসকো মিরচি লাগি তো মে কেয়া কারু?লা লা লা..”
আভার গান শুনে রৌদ্রের মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেল।মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে।হাতের শিরাগুলো জেগে উঠে দৃঢ়ভাবে।এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত কামড়ে আভাকে জিজ্ঞেস করে,
– এসব কি তামাশা লাগিয়ে রেখেছ?

আভা একপলক রৌদ্রের মুখের দিকে চেয়ে আবারো নিজেকে দেখতে দেখতে বলে,
– দেখুন তো এই শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে?

রৌদ্র চোখ বন্ধ করে একটি শ্বাস নিলো।আগের মতো ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আভার দিকে।রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
– বিচুটি পাতার মতো লাগছে।এই দেখো আমার হাত চুলকাতে শুরু করেছে।

রৌদ্র নিজের ডান হাত এগিয়ে দিলো আভার সামনে।আভা রৌদ্রের রাগের কারণ বুঝতে পেরে চাপা হাসি দেয়।নির্লিপ্ত স্বরে বলে,
– তা আপনার হাত চুলকাক বা সারা শরীর চুকলাতে চুলকাতে ছাল চামড়া খসে পড়ুক তাতে আমার কি?আমার হবু স্বামীর কাছে আমি একদম ঔষধি লতা।সরুন আমার হবু স্বামী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

রৌদ্র চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইলো আভার দিকে।আভা একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে রৌদ্রকে সরিয়ে দিয়ে চলে গেল।রৌদ্র আভার যাওয়ার দিক তাকিয়ে আভাকে ব্যঙ্গ করে বলে,”এহ্ হবু স্বামী..!আসার সময় যেন রাস্তায় মরে।যত্তসব!”

সোফায় মুখোমুখি বসে আছে আভা এবং তার হবু স্বামী আকিব ইমরান।তার পাশেই তার পরিবার বসা।আভার সাথে তারা বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করছে।আভা হেসে হেসে সকলের সাথে কথা বলছে।এদিকে দূরে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য হজম করে চলেছে রৌদ্র।মাথার ঘিলু টগবগ করে ফুটছে তার।সে আর নিতে পারছে না এদের এসব মেলোড্রামা।দাঁতে দাঁত পিষে আভার দিকে তাকিয়ে আছে সে।চোখের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরা উপশিরাগুলো লাল রং ধারণ করেছে। খুব বেশি ভয়ংকর দেখাচ্ছে তার শিকারী চোখ দু’টো।পারিবারিক কথাবার্তা শেষে পালা আসে আভা এবং সীমান্তের নিজেদের মধ্যে আলাদা কথা বলার।সীমান্ত নিজে থেকেই সকলের কাছে এ প্রস্তাব রাখে।সকলের অনুমতিতে তারা বসার ঘর ছেড়ে একান্তে কথা বলার জন্য বাড়ির বাইরে বাগানে চলে যায়।রৌদ্রও পা পিঠে পিঠে তাদের পিছন পিছন যায়।আভা না তাকিয়েও বুঝতে পারে রৌদ্রের উপস্থিতি।সে ঠোঁট চেপে হাসে।আভা সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপনি কি করেন যেন বললেন?

সীমান্ত মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে অতি ভদ্রতার সহিত জবাব দেয়,
– পুলিশ।

আভা এবং সীমান্তকে হেসে কথা বলতে দেখে রাগে শরীর কাঁপতে থাকে রৌদ্রের।শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে ঘামতে শুরু করে সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিজের হাত কামড়ে ধরে সে।এতোটাই জোরে কামড়ে ধরে যে মুহুর্তেই সেখানে রক্তের কণিকারা এসে জমাট বাঁধতে থাকে।মুখ থেকে হাত নামিয়ে পাশের দেয়ালে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করে।সঙ্গে সঙ্গে হাত থেঁতলে যায় তার।গটগট করে হেঁটে নিজের ঘরে চলে আসে।ওয়াশরুমে ঢুকে বালতিতে পানি ভর্তি দেখে বালতি উঠিয়ে সবটুকু পানি নিজের মাথায় ঢেলে দিলো।যাক এবার একটু শান্তি লাগছে!
সীমান্তের জবাবে আভা কোনোকিছু না ভেবেই বলে উঠলো,
– ও আচ্ছা তাহলে চোর ছুটানো আপনার কাজ?

সীমান্ত রাগি দৃষ্টিতে তাকাল আভার দিকে।তবে আভা সে দৃষ্টি দেখতে পেল না।সে সামনে তাকিয়ে আছে।সীমান্ত গম্ভীর স্বরে বলল,
– চলুন ভিতরে যাই।

– চলুন।

সীমান্তের মায়ের আভাকে খুব পছন্দ হয়েছে।তবে সে বার বার একটি কথা বলেছেন তা হলো মেয়ের গায়ের রং চাপা।তিনি যতবার এ কথা বলেছেন প্রেমাসহ বাড়ির সকলে ততবারই অপমানিত হয়েছেন।আভার সাথে একা কথা বলার পর থেকে সীমান্ত গম্ভীর মুখে বসে ছিলো।একটা টু শব্দও করেনি সে।
আভার কেন যেন সীমান্তকে দেখে মনে হয়েছিল সে তাকে পছন্দ করেনি।আভা কপাল কুঁচকে সীমান্তকে দীর্ঘক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে বুঝেছিল সীমান্ত বাড়ি গিয়ে এই বিয়েতে অমত করবে।হলোও তেমনটা।তারা বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পরই আভাদের বাড়িতে কল আসে।তারা জানান আভার ভদ্রতা জ্ঞান বলতে কিছু নেই।থাকলে একজন পুলিশ অফিসারের পেশা বা কাজ নিয়ে এভাবে কথা বলতো না।আর যে মেয়ে হবু স্বামীর কাজ নিয়ে ব্যঙ্গ করে কথা বলে তাকে সীমান্ত বিয়ে করবে না।আভা নির্বাক হয়ে সবটা দাঁড়িয়ে থেকে শোনে।প্রেমার বকাঝকাও শোনে।প্রেমা বকেছে বিয়ে ভেঙে গিয়েছে সে জন্য নয় বরং এভাবে ব্যঙ্গ করে কথা বলার জন্য।আইরিন রাগি কন্ঠে বলে,
– ভাবি উনিও তো বার বার বলছিলেন আমাদের মেয়ের গায়ের রং চাপা।এই সেই।তাহলে তো ওনাদেরও ভদ্রতা জ্ঞান বলতে কিছু নেই।আমাদের মেয়েটা শুধু মজা করেছে তাই মেয়েটাকে কতকিছু বলল।

প্রেমা শক্ত কন্ঠে বলে,
– উনি বলেছেন বলেছেন কিন্তু এখানে প্রশ্নটা আমার শিক্ষা নিয়ে। আমি আমার মেয়েকে কেমন শিক্ষা দিয়েছি যে সে একটি পেশা নিয়ে এভাবে ব্যঙ্গ করে কথা বলে?ভার্সিটিতে গিয়ে অ’সভ্য হয়ে এসেছ।

আভা রাগে ক্ষোভে গটগট করে চলে এলো বসারঘর থেকে।আড়াল থেকে সবটা শুনে একজনের ঠোঁটে দেখা গেল বাঁকা হাসি।

রাত একটা কি দেড়টা।পানি খেতে ঢুলুঢুলু পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে আভা।ঘুমে চোখ ভেঙে যাচ্ছে তার।আবার পিপাসায় গলা বুক শুঁকিয়ে আছে।তাই চোখ বন্ধ করেই ঘুমের মধ্যে আন্দাজ করে করে এগিয়ে যাচ্ছে সে।মাঝে মাঝে পিটপিট করে তাকিয়ে নিজের অবস্থান দেখে নিচ্ছে।আচমকা তার কোমর ছুঁয়ে কেউ নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।সুঘ্রাণ নাকে আসতেই আভা ঠাওর করতে পারল ব্যক্তিটি কে।ব্যক্তিটির বুকের সাথে আভার পিঠ স্পর্শ করে আছে।সে ধীরে ধীরে নিজের মুখ নামিয়ে আভার কানের কাছে নিয়ে এলো।হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
– আই লাভ ইউ টু রৌদ্রাভা।

ঠোঁট মেলে গেল আভার।ঘুম কেটে গিয়েছে অনেক আগেই।তবু চোখ খুলল না আভা।হেসে বলল,
– আজকে হঠাৎ কি মনে করে?

সে পূর্বের মতো হিসহিসিয়ে বলে,
– আজকে একটা বিষয় খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি।

– কি?

সে এবার কন্ঠস্বর আরো নামিয়ে জবাব দিলো,
– তোমাকে এই জীবনে অন্যকারো সাথে দেখার মতো সহ্য শক্তি আমার নেই।

আভা হাসে।হৃদয় জুড়ে শীতল বাতাস বয়ে যায় তার।এই প্রথম রৌদ্র তার এতোটা কাছে।শ্বাস প্রশ্বাস ধীর হয়ে চলেছে তার।শুঁকানো ঢোক গিলে আভা।রৌদ্র আভার আরো সান্নিধ্যে চলে আসে।আভার কানে ঠোঁট ছুঁয়ে আভার কোমর ছেড়ে দেয় সে।কানে রৌদ্রের অধরের স্পর্শ পেতেই কেঁপে ওঠে আভা।মাথা ঘুরতে শুরু করে তার।কিছুক্ষণ নিঃশব্দে অতিবাহিত হতেই ধপ করে নিচে পড়ে যায় আভা।সেদিকে তাকিয়ে সামান্য শব্দে হাসে রৌদ্র।যত্নের সাথে আভার দেহটাকে নিজের বাহুতে তুলে নেয় সে।আভার খাটে শুইয়ে কপালে অধরের স্পর্শ স্থির রাখে বেশ খানিকক্ষণ।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় সে।

সকালে উঠে সারাবাড়ি চিরুনি তল্লাশি করেও রৌদ্রকে খুঁজে পায়না আভা।চোখটা জ্বলে যাচ্ছে লোকটাকে একপলক দেখার জন্য।কিন্তু সে কোথায়?তার তো টিকিটাও নিখোঁজ।আভাকে এভাবে ছুটোছুটি করতে দেখে ভ্রুকুটি করে অভয়।জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে তুই এমন পাগলের মতো একবার এদিকে তো একবার ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছিস কেন?

আভা এতোটাই জলদির মধ্যে ছিল যে সে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অভয়কে জিজ্ঞেস করতে বসে রৌদ্র কোথায়?তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন?অভয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে।আভাকে অভয়কে জিজ্ঞেস করবে তার আগেই অভয়ের ফোন বেজে ওঠে।অভয় কল রিসিভ করে বলে,
– হ্যাঁ রৌদ্র পৌঁছেছিস?

অপরপাশ থেকে বোধ সম্মতিসূচক উত্তর এলো।অভয় বলে,
– আচ্ছা ফ্রী হয়ে কল দিস।

আভা থমকে যায়।রৌদ্র অস্ট্রেলিয়া ফিরে গিয়েছে? তাকে একবার জানাল না?তাহলে কি কালরাতে যা কিছু হয়ে সব তার স্বপ্ন?সব তার ভ্রম?কিন্তু সে তো রৌদ্রের শরীরের মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিল কাল।তাহলে?

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |২২|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পাহাড়ি রাস্তার মতো উঁচু নিচু রাস্তা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাব।
এসে থামল একটি সাদা প্রাচীর ঘেরাও বাড়ির সামনে।বিশাল বড় একতলা বাড়ি।যার প্রায় অধিকাংশ কাঁচে আবৃত।প্রধান ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই বাড়ির সামনে ডানপাশে দেখা গেল একটি সাড়ে তিনফুট গভীর নীল পানির সুইমিং পুল।চারপাশে বিদেশি গাছপালা নিখুঁতভাবে নকশা করে কাঁটা।ছয়টা সিঁড়ি পাড় করে গৃহমধ্যস্থে প্রবেশের জন্য কাঠের দরজা।কলিং বেল বাজাতেই খুলে দিল প্যান্ট শার্ট পরিহিত এক মধ্যে বয়সী নারী।অবাক স্বরে বলে উঠলো,
– রৌদ্র?!

রৌদ্র চোখের কালো সানগ্লাস খুলে হেসে বলল,
– হেই মম!

ভিতর থেকে অবাক দৃষ্টিতে বেরিয়ে এলেন মহিলার সমবয়সী একজন পুরুষ।তাকে দেখে রৌদ্র বলে,
– হাই ড্যাড!

লোকটি হেসে রৌদ্রকে আলিঙ্গন করে।মহিলাটিকেও জরিয়ে ধরে রৌদ্র।সে এখনো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র মায়ের কপালে চুমু খেয়ে মাকে আগলে রেখেই বলে,
– কেমন আছো?

রৌদ্রের মা অবাক স্বরে উত্তর দিলো,
– আ’ম ফাইন।হোয়াট এবাউট ইউ?বাংলাদেশ ট্যুর কেমন হলো?

– আমেজিং।ড্যাড তুমি কেমন আছো?

রৌদ্রের বাবা উত্তর দিলেন,
– নট ব্যাড।তোমাকে দেখে আরো ভালো লাগছে।কতদিন পর এলে।বেলারাত যাওয়ার পর আর দেখা হয়নি।থাকবে নাকি চলে যাবো।

– আজ লাঞ্চ একসাথে করবো।তাছাড়া আমার তোমাদেরকে কিছু বলারও আছে।

রৌদ্রের মা তাকে তাড়া দিয়ে বলে,
– ওকে।আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করে নাও।তারপর আমরা একসাথে বসে কথা বলবো।ডিনারে তোমার ফেবারিট কন্টিনেন্টাল ডিস রাখছি।

– সাউন্ডস গুড।বাট আই থিংক বাংলাদেশি ডিস ইজ টেস্টিয়ার দেন কন্টিনেন্টাল।

রৌদ্রের মা রোদেলা দুই ঠোঁট ফাঁক করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে।রৌদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে সুটকেস দুটি দিয়ে নিজের বিশাল বড় কামরায় চলে গেল।তার ঘরের এক অংশ শুধু কাঁচে আবৃত।সেখান থেকে সূর্যের আলো প্রবেশ করে সারাঘর ঝলমলে করে রেখেছে।আরামদায়ক ফোমের খাটটি বেশি উচ্চতায় নয়। মাথার কাছের দেয়ালটিতে বড় একটি এনিমে ক্যারেক্টর সাটোরু গোজোর ছবি। তার নিচেই পাঁচটি সাদাকালো স্কেটিং বোর্ড।ঘরের বামদিকের কাঠের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই বিশাল বড় ওয়াশরুম এবং ব্লকরুম।যেখানের বিভিন্ন কাবার্ডে রৌদ্রের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস।রৌদ্র ঘাড়ের কালো ব্যাগটি বিছানায় ছুঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।ঠান্ডা পানিতে শীতল করল নিজের দেহ।শাওয়ারের বিন্দু বিন্দু পানি চোখে মুখে পড়তেই চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।চোখের সামনে ভেসে উঠল আভার হাসোজ্জল চেহারা।তার ঠোঁটও প্রসারিত হলো।লম্বা লম্বা চুলগুলো ডানহাতে পিছনে ঠেলে দিলো।ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি দীর্ঘশ্বাস।

দরজায় ঠেস দিয়ে বসে ফোঁস ফোঁস করছে আভা।তখন থেকে রৌদ্রকে কল করে যাচ্ছে সে।প্রতমবার কল কেটে দেওয়া হয়েছিল।তারপর থেকে ফোনে কল ঢুকছেই না।আভা বুকটা ভারি হয়ে আছে।গলার কাছে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে কন্ঠনালিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে।রৌদ্র কেন তাকে না বলে চলে গেল?আর চলেই যখন গেল তখন কেন সে রাতে তাকে ভালোবাসার কথাটা বলল?দু’হাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদে আভা।পরমুহূর্তেই চোখ মুছে সটান শিরদাঁড়া সোজা করে ফেলে।নাক ফুলিয়ে নিজে নিজেই বলে,”আমি আর কাঁদবো না।মটেও কাঁদবো না।বাজে ফালতু লোকটার জন্য মটেও কাঁদবো না।”
আভা উঠে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে।নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আবারো ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে তার।তবু সে নিজেকে সংযত করে চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিচে চলে যায় খাবার খেতে।
টেবিলে সকলকে দেখা গেল।অভয় নেই।তার ছুটি শেষ তাই কাজের তাগিদে তাকে শহরে ফিরতে হয়েছে।নতুন বউটাকে এভাবে রেখে যেতে একদম মন টিকেনি তার।তবু কি আর করা।আভা একটি চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে পড়ে।আভাকে এতো গম্ভীর চুপচাপ দেখে সকলে নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।আরাভ সাহেব মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– তোমার ভার্সিটি খুলবে কবে?

আভা খাবারের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
– আগামী সপ্তাহে শনিবার।

– যাবে কবে?

– শুক্রবার।

– আচ্ছা আমি ট্রেনের টিকেট বুক করে রাখবো।

আভা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।আরাভ সাহেব নিচের ঠোঁট বের করে প্রেমার দিকে চায়লেন।হঠাৎ মেয়েটা এতো চুপচাপ আর গম্ভীর হয়ে গেল কেন?আভার এমন অদ্ভুত আচারণে তারা একে-অপরের পানে চেয়ে ঘার সংকুচিত করেন।

খাবার ঘরে চামচ এবং ছু’রির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না।রোদেলা এবং তার স্বামী হামিদ কিছুক্ষণ পরপ রৌদ্রের দিকে তাকাচ্ছে।রৌদ্র মনোযোগ সহকারে নিজের খাবার খাচ্ছে।হামিদ শশার ছোট টুকরো মুখে দিয়ে বললেন,
– বাংলাদেশ কেমন লাগল বললে না তো?

রৌদ্র বাবার দিকে তাকাল।চোখে মুখে ভিড় হলো একঝাঁক মুগ্ধতা।আনমনা স্বরে বলে উঠলো,
– অপরূপ সুন্দর সে দেশ।মানুষগুলো যেমন কোমল হৃদয়ের দেশটাও তেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।সেখানে আমি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি।সে আমার দেশ।সে আমার শিকড়।যদিও আমি সেখানে জন্মায়নি তবে সেখানে আমি আমার শিকড় খুঁজে পেয়েছি।নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।তাই আমি ঠিক করেছি আমি বাংলাদেশে সেটেল্ড হবো।

এতোক্ষণ রোদেলা এবং হামিদের মুখে হাসি থাকলে রৌদ্রের শেষের বাক্যে হাসও মিলিয়ে গেল তাদের।রোদেলা তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন।রৌদ্র বাবা মায়ের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারল তারা তার বলা কথায় সন্তুষ্ট নন।সে আবারও বলে,
– হ্যাঁ মম আমি বাংলাদেশে থাকতে চাই।বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চাই।

রোদেলার চোখেমুখে দেখা গেল রাগের ছাপ।সে কঠিন স্বরে বলেন,
– পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি রৌদ্র?তোমার লাইফস্টাইলের সাথে তুমি ওখানে কিছুতেই খাপখাওয়াতে পারবেনা।

– কিন্তু মম আমি তো এতোদিন ছিলাম ওখানে।তাছাড়া তোমরা আমাকে যতটা সাহেব মনে করো আমি তেমন নই।আমি খাপখাওয়াতে জানি।আমি সবখানেই খাপ খাওয়াতে পারি।

রোদেলার রাগ বেড়ে গেল।সে আগের মতোই রাগি স্বরে বলেন,
– রৌদ্র দেখ,তোমার উন্নত জীবনের জন্য আমরা অস্ট্রেলিয়া এসেছি।কোথায় অস্ট্রেলিয়া আর কোথায় বাংলাদেশ?আমি তো বুঝতেই পারছিনা তুমি এখানে এমন লাক্সারিয়াস লাইফ রেখে কেন বাংলাদেশের মতো দেশে যেতে চায়ছ?

রৌদ্র তাচ্ছিল্য হাসে।মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে,
– আমার উন্নত জীবন?নাকি তোমাদের উন্নত জীবন?কারণ তোমরা যখন এসেছিলে তখন আমি পৃথিবীতে আসিনি।আর বাংলাদেশের মতো দেশ বলতে তুমি কি বুঝাতে চায়ছ?বাংলাদেশে কি মানুষ বাস করে না?তারা আমাদের থেকে ভালো আছে মানসিকভাবে।তাদের মধ্যে ইমোশন নামক শব্দটা এগজিস্ট করে।তারা আমাদের মতো ইমোশনলেস নয়।

হামিদ ছেলেকে বলেন,
– রৌদ্র তুমি মমকে ভুল বুঝছ।আমি জানি তুমি এখন এডাল্ট তুমি নিজের ডিসিশন নিজে নিতে পারো।কিন্তু তোমার মম যা বলছে তোমার ভালোর জন্য বলছে।

– ড্যাড আমি জানি মম আমার ভালোর জন্য বলছে।কিন্তু আমাকে তো বাংলাদেশ যেতেই হবে।আর সেটা আমার ভালোর জন্যই।

রৌদ্র শব্দহীনভাবে কাঁটা চামচটি প্লেটের পাশে রাখে।চেয়ার ছেড়ে উঠে বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– লাঞ্চ ভালো ছিল।ধন্যবাদ।

রোদেলা বিস্মিত হয়ে হামিদের দিকে তাকালেন।বলেন,
– ধন্যবাদ বলছে ও?ও কি পাগল হয়ে গিয়েছে?ও কি করছে এসব?ওর কোন ধারণা আছে বাংলাদেশ সম্পর্কে? ও কেন যেতে চায়ছে ওখানে?

গভীর ঘুমে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আভার।তবে ঘোর কাটেনি এখনো।ফোন তুলে কানে নিয়ে ঘুম ঘুম স্বরে বলে,
– হ্যালো..

– আমি নেই আর তুমি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছ?কোথায় ভাবলাম আমি না বলে চলে আসায় কেঁদেকেটে চোখে জোয়ার তুলবে তা না আরামসে ঘুম দিচ্ছ?কতটা নির্দয় তুমি আভা।

তেঁ তেঁ উঠল আভা।কন্ঠ স্বরটা শুনেই বুঝতে পেরেছিল এটা কে।আভা রাগে কটমট করে বলে,
– কেন ফোন করেছেন আপনি?আর নির্দয় আমি নই আপনি মি.আফসিন রৌদ্র।

রৌদ্র অবুঝ স্বরে বলে,
– ওমা কেন?আমি আবার কি করলাম?

– কি করলাম মানে?আপনি এভাবে চলে গিয়েছেন কেন?

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |২৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

– তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে তাই তোমাকে বলতে পারিনি।আর আসাটাও জরুরি ছিল।

– রাতে বলতে পারতেন।না বলে এভাবে চলে গেলেন কেন?

– বললাম তো জরুরি ছিল।

– কি জরুরি?না বলে কেন চলে গেলেন?

রৌদ্র এবার বিরক্ত হলো।আভাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠলো,
– বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?বলছি তো জরুরি ছিল তাই আসতে হয়েছে।তখন থেকে বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছ।

আভাও রাগি স্বরে বলে,
– এই মাঝরাতে আমাকে বকাবকি করতে ফোন দিয়েছেন?তাহলে শুনে রাখুন ঘুম হারাম করে আপনার বকা শোনার মতো সময় আমার নেই।গুড নাইট।

আভা ফোন কাটতে যাবে তখন রৌদ্র বলে,
– হ্যাঁ ঘুমাও যত্তসব!

ফোন কেটে দিলো আভা।আপাতত এসব রৌদ্র টৌদ্র বাদ।এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঘুম।আভা ফোনে সময় দেখে নিলো।সাড়ে চারটার কিছু বেশি বেজেছে।মনে মনে ভাবল এখন অস্ট্রেলিয়ায় কত সময় হতে পারে?পরমুহূর্তেই মাথা থেকে সব ঝেড়ে শুয়ে পড়ে সে।কিছুক্ষণ যেতেই আবারও ফোনটা বিকট শব্দে বেজে ওঠে।মাত্রই ঘুম এসেছিল আভার চোখে ফোনের শব্দে আবার ঘুম কেটে গেল তার।এবার সে বড়ই বিরক্ত রৌদ্রের উপর।মানে লোকটা কি ঠিক করেছে তাকে ঘুমাতে দিবে না?আভা ফোন ধরে বিরক্তির সুরে বলে,
– আবার কি হয়েছে?

অপর প্রান্ত থেকে রৌদ্রের রাগি স্বর ভেসে এলো,
– তোমার তো সাহস আছে।তুমি এই টোনে কথা বলো আমার সাথে?

আভা এবার উঠে বসলো।বাঁকা হেসে মশকরা করে বলল,
– আরো বলবো।কিই বা করে নিবেন আপনি?হুহ্!

রৌদ্র কন্ঠ খাদে নামিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
– দূরত্বের সুযোগ নিচ্ছো?

আভা মৃদু হাসে।বলে,
– কিছুটা।

রৌদ্র পূর্বের স্বরেই বলে,
– দাঁড়াও একবার দুরত্বটা ঘুচিয়ে ফেলি তখন দেখবে সুযোগ নেওয়া কাকে বলে।

আভার গাল দুটো গরম হয়ে গেল।ঠোঁট চেপে লাজুক হাসে সে।গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে বলে,
– এতো রাত হয়েছে ঘুমাননি কেন এখনো?

রৌদ্র শব্দ করে হাসে।সে অসম্ভব সুন্দর শব্দ আভার কানে পৌঁছাতেই শিউরে ওঠে সে।চোখ বন্ধ করে অনুভব করে নিজের অস্বাভাবিক গতির হৃৎস্পন্দন।রৌদ্র হাসি থামিয়ে বলে,
– ও ম্যাডাম আমি বাংলাদেশে নেই।এখানে মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে।আচ্ছা তুমি ঘুমাচ্ছিলে ঘুমাও।আর নিজের যত্ন নিবে।যতদিন না আমি আসি।আমি চলে আসলে আমি নিজ দায়িত্বে তোমাকে দেখে রাখবো কেমন?গড নাইট হানি।

“হানি” শব্দটি শুনে আভার শ্বাস বৃদ্ধি পেল।ঠোঁটের লাজুক হাসিও প্রসারিত হলো।গাল দু’টো অস্বাভাবিকভাবে গরম হয়ে যাচ্ছে।সে করুণ স্বরে বলে,
– সাড়ে বারোটা আপনার কাছে মাত্র? আচ্ছা বাদ দেন আগে বলেন কবে আসবেন?

রৌদ্রের ঠোঁটের দেখা যায় তৃপ্তির হাসি।প্রিয় মানুষের চোখে, মুখে,কন্ঠে নিজের জন্য উদ্বেগ দেখাটা বোধ হয় পৃথিবীর সব থেকে প্রশান্তিময় দৃশ্য।রৌদ্র কোমল স্বরে জবাব দেয়,
– চলে আসবো।খুব শীঘ্রই। এসে তোমাকে অর্ধাঙ্গিনী করবো।তোমাকে খুব ভালোবাসবো।

আভার ভারি হয়ে গেল।গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
– আচ্ছা তাহলে এখন ঘুমাই?

রৌদ্র আদুরে স্বরে সায় দিলো,
– ঘুমাও।

আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে আভা।থাকবে না কেন?কাল রাতে যে তার প্রমিকের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে।আজ বেশ ফড়িং এর মতো এদিক সেদিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সে।আর মাত্র চারদিন আছে সে বাড়িতে এটা ভাবলে আবার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আভার।শুক্রবারই তাকে আবার মেসে যেতে হবে।সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু শনিবার থেকে।খাবার টেবিলে বেশ সতেজ ভঙ্গিতে খাবার খাচ্ছে আভা।অহনা আভার প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে বলে,
– কি ব্যাপার আভাকে আজকে অনেক খুশি খুশি লাগছে।

আভা বিগলিত হেসে ভাবির দিকে চায়ল।অহনা ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে?”।আভার উত্তর না দিয়ে ঠোঁট মেলে তাকিয়ে থাকে ভাবির দিকে।অহনা ভ্রু কুঁচকে আভার পাশের চেয়ার টেনে বসে।চারিদিকে সতর্কতার চাহনি দিয়ে স্বর নিচু করে বলে,
– কি ব্যাপার আভামনি?মনে হচ্ছে কোনো সুপুরুষের প্রেমে পড়েছ?

আভা মাথা নত করে লাজুক হেসে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।অহনা চোখ বেরিয়ে এলো বিস্ময়ে।মুক দিয়ে বেরিয়ে এলো অবিশ্বাস্য সুর।সে কন্ঠ স্বরে আরো সতর্কতা এনে বলে,
– কে সে?দেখতে কেমন?

আভা ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়ালো।নিচু হয়ে অহনার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
– সে সোনার নাগর দেখতে চান্দের সমান!

এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না আভা।অহনা ঠোঁট আলগা করে বড় বড় চোখে আভার যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে।

অন্ধকার ঘরে কম্পিউটারের মনিটারের তীব্র আলো ঠেকাতে চোখে সানগ্লাস পরে কীবোর্ড আঙুল চালাচ্ছে রৌদ্র।কীবোর্ডেও লাল-নীল আলো জ্বলছে।খুব মনোযোগ সহকারে
ওয়েব ডেভলপমেন্টের একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে সে। গ্রাজুয়েশনের পর থেকে সে ওয়েব ডেভলপমেন্টের কাজ করছে।এতোদিনে অনেকগুলো প্রজেক্ট জমা হয়েছে।তবে সম্প্রতি নতুন পাওয়া প্রজেক্টির কাজ সে গ্রহণ করেছে।কারণ তার এখন কিছু ডলারের প্রয়োজন। কপালে সূক্ষ্ম একটি ভাঁজ দেখা গেল রৌদ্রের।পরণে কালো টি-শার্ট এবং হাঁটুর নিচ অবধি কালো প্যান্ট।কীবোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে পাশে থাকা কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানে ছোট একটি চুমুক দিলো।রৌদ্রের ঘরের দরজায় দু’বার কড়া নেড়ে কোনো সাড়া পেল না রোদেলা।সংকোচ নিয়ে ধীরগতিতে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে সে।সারাঘর অন্ধকার।শুধু মাত্র খাটের সাথে সেট করা পারপেল আলো আর এক কোণায় রৌদ্রের কম্পিউটারের আলো দেখা যাচ্ছে। কম্পিউটারের সামনে সানগ্লাস চোখে বসে আছে রৌদ্র। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি।এগিয়ে গিয়ে হাতের কফিটি কীবোর্ডের পাশে ফাঁকা জায়গাতে রাখেন। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন রৌদ্রের পাশে।মনিটারে একপলক চোখ রেখে রৌদ্রের দিকে তাকান তিনি।রৌদ্রের কোনো নড়চড় নেই।সে ভাবলেশহীন ভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। রোদেলা নিরবতা ভেঙে রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করেন,
– পিএইচডি নিয়ে কিছু ভেবেছ?

রৌদ্র মনিটরে চোখ রেখে উত্তর করে,
– আপাতত পিএইচডির কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি।

আবারও একটি তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো রোদেলার ভিতর থেকে।সে হতাশ কন্ঠে বলল,
– আর সেই কাজটা?

– কিসের কথা বলছো?

– একটা কোম্পানিতে আইটি এন্ড ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে অফারটা পেয়েছিলে সেটা নিয়ে কি কিছু ভেবেছ?

রৌদ্র বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে,
– এতো ছোট কোম্পানিতে আমি কাজ করবো না।

রোদেলা এবার নিজের রাগ ধরে রাখতে পারলেন না।ক্ষিপ্র স্বরে বলেন,
– তুমি এসব কি করছ রৌদ্র?তোমার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে তুমি সেটাকে এভাবে নষ্ট করছ অবহেলা করছ?আর ওটা কোনো ছোট খাটো কোম্পানি নয় সিডনির খুব ভালো কোম্পানি। তুমি কেন এমন খামখেয়ালি করছ?

রৌদ্র এতোক্ষণে নিজের মায়ের দিকে তাকায়।কীবোর্ডের পাশে থাকা রিমোট চেপে ঘরের লাইট জ্বালায়।চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে,
– মম আমি জানি আমি কি করছি।আমি বাংলাদেশে যেতে চাই আর এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।

রোদেলা আগের স্বরে বলেন,
– কেন যেতে চাও তুমি ওখানে?কি এমন আছে ওখানে?কি এমন পেয়েছ তুমি সেখানে যে তুমি তোমার সুন্দর জীবনটাকে এভাবে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছো?

রৌদ্র কোনো উত্তর করে না।আবারও কীবোর্ড আঙুল চালায় সে।রোদেলা সন্দিহান দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।রৌদ্রকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলে,
– তোমার কি কোনো বাঙালি মেয়েকে পছন্দ হয়েছে?হলে আমাকে বলো আমি তাদের সাথে কথা বলবো।বিয়ের পর তাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে এসো।তাই বলে এতো বড় ভুল করো না।ভবিষ্যতে তোমাকে এর জন্য পস্তাতে হবে।তাছাড়া তুমি সেখানে সেটেল্ড হতে চাইছো তোমার তো সিটিজেনশিপ নেই।

– অ্যাপলিকেশন করেছি।কিছুদিনের মধ্যে চলে আসবে।তোমার এবং ড্যাডের আছে সো আমাকে তেমন কষ্ট করতে হয়নি।

রোদেলা করুণ স্বরে বলে,
– রৌদ্র তুমি ভুল করছো।

রৌদ্র আবারও তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– মম তুমি কি যেন বলছিলে?তুমি আমার প্রেমিকার পরিবারের সাথে কথা বলবে?সত্যি বলবে?বললে খুব উপকার হবে।

রোদেলা ভ্রুকুটি করে বলেন,
– তারমানে তুমি সত্যিই কোনো বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ?

রৌদ্রের দায় সাড়া জবাব,
– হ্যাঁ।

– কে সে?

রৌদ্র খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে দিলো,
– অভয়ের বোন আভা।

রোদেলা গম্ভীর স্বরে বলে,
– আচ্ছা ওর মা বা বাবার নম্বরটা দাও আমাকে।

রৌদ্র নম্বর দিয়ে দিলো।বলল,
– ফোন করে বলবে আমি তাদের মেয়েকে বিয়ে করতে চাই আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই বিয়ের পর আমি বাংলাদেশেই থাকবো।সো তার মেয়ে তাদের কাছেই থাকবে।

রোদেলা কোনো উত্তর দেয় না।নম্বর নিয়ে গম্ভীরমুখে বেরিয়ে আছে রৌদ্রের ঘর থেকে।রৌদ্র রিমোট চেপে ঘরের দরজা লক করে দিলো।তারপর চোখে সানগ্লাস দিয়ে ঘরের আলোও বন্ধ করে দিলো।নিজের কাজে মনোযোগ দিলো পুনরায়।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |২৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

প্রেমা কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করছে এবং স্বামীর খাবারের থালায় খাবার তুলে দিচ্ছে।সকলে সকালের খাবার খেতে খাওয়ার টেবিলে এক হয়েছে।সেখানেই প্রেমা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তখন থেকে হাঁসফাঁস করে চলেছে।আরাভ সাহেব খাওয়া থামিয়ে স্ত্রী দিকে তাকিয়ে বলেন,
– কিছু বলতে চাও?

প্রেমা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।আমতা আমতা করে।কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মিনমিন করে বলে,
– রৌদ্রের মা কাল ফোন করেছিল।

রৌদ্রের নাম শুনে আভা একপলক মায়ের দিকে দেখে।আরাভ স্ত্রীর মুখ পানে চেয়ে বলে,
– রৌদ্রের মা?তা কি বলল?কি হয়েছে?রৌদ্র কেমন আছে?

প্রেমা মেয়ের দিকে আঁড়চোখে দেখে পূর্বের ন্যায় মিনমিন করে বলে,
– বলল রৌদ্র নাকি আভাকে বিয়ে করতে চায়।

মায়ের মুখে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য শুনে ভীমড়ি খায় আভা।অনবরত কাশতে শুরু করে সে।চোখ বড় বড় করে একবার মাকে দেখে তো একবার বাবাকে।বাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকে পড়তেই নিজেকে সামলে নেয় সে।মনে মনে ভাবে,”রৌদ্র এতো তাড়াতাড়ি সবাইকে কথাটা ফাঁস করে দিলো?কোথায় ভাবল কয়েকদিন লুকিয়ে লুকিয়ে মাখো মাখো প্রেম করবে তা না রৌদ্র স্পয়লারটা এভাবে মেরে দিলো?” আভার চোখে মুখ আফসোস আর হতাশায় নিমজ্জিত হয়।আরাভ সাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে থাকেন।তারপর হঠাৎই বিগলিত হেসে বলেন,
– রৌদ্র তো ভালো ছেলে।আমরা ওকে অনেক কাছ থেকেও দেখেছি।চেনা জানা ভালো,ভদ্র ছেলে সে।তাহলে তুমি এমন মুখ ভার করে খবরটা কেন দিচ্ছ?

প্রেমা নিচু স্বরে বলে,
– বিয়ের পর ও আভাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চায়।

আরাভ মুন্সির মুখে নেমে আসে আঁধার কালো মেঘ।একমাত্র মেয়ে তার এতো দূরে একা থাকবে নতুন পরিবেশে?আভার বুকটাও কেঁপে ওঠে মায়ের শেষ কথা শুনে।রৌদ্র তাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চায়?কই সে তো তাকে এমন কিছু বলেনি।কিন্তু সে তো তার বাবা-মাকে ছেড়ে এতো দুরে যেতে চায় না।
আরাভ মুন্সি গম্ভীর মুখে বসে আছেন।প্রেমা কটুণ দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে চেয়ে।হয়তো এবার সে রৌদ্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।অহনা আমতা আমতা করে বলে,
– বাবা জানি আপনাদের মধ্যে কথা বলা ঠিক হবে না তবু আমার কিছু বলার আছে।

সকলের দৃষ্টি এখন অহনার দিকে।আরাভ মাথা নাড়িয়ে বলার অনুমতি দেয়।অহনা আভার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি যতটুকু জানি আভা কাউকে পছন্দ করে।তাই ওর বিয়ের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ওর মতামতটাও নিয়ে নেওয়া উচিত।

আভা চমকে ওঠে।যাক এটারই বাকি ছিল।এখন ষোল কলা পূর্ণ হলো।আরাভ অবাক চোখে আভার দিকে তাকিয়ে বলে,
– তোমার পছন্দের কেউ আছে?

পরমুহূর্তেই স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,
– তাহলে তো রৌদ্রের প্রস্তাব গ্রহণের কোনো প্রশ্নই উঠছে না যেখানে আমার মেয়ের অন্য পছন্দ আছে।নিশ্চয়ই সে আমার মেয়ের যোগ্য তাই আমার মেয়ের তাকে পছন্দ হয়েছে।গ্রাজুয়েশন শেষ করে তুমি তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিও আভা।আর প্রেমা তুমি রৌদ্রের মাকে ফোন করে সব বুঝিয়ে বলে দিও কেমন?এখন আমি উঠি অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে।

– কিন্তু বাবা…!

আভা কিছু বলার আগেই আরাভ মুন্সি উঠে বেরিয়ে গেলেন।প্রেমা প্লেট গুছিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে যাচ্ছে।অহনাও শাশুড়ীর হাতে হাতে সবকিছু এগিয়ে দিচ্ছে।আভা সেখানেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।কতদিক দিয়ে জট লেগেছে ভাবতেই তার মস্তিষ্ক জট পেকে গেল।ঘরে চলে গেল সে।একা একা নানা গবেষণা চালাল নিজের মনে, “রৌদ্র আমাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চায়?আমাকে তো আগে বলেনি।আমি বাবা-মাকে এখানে একা রেখে যেতে চাইনা।বাবা মায়ের আমি আর ভাইয়া ছাড়া কেউ নেই।আমি দূরে চলে গেলে মা বাবার কি হবে?”
আভা নানা কিছু চিন্তাভাবনা করে রৌদ্রকে কল করে।রৌদ্র সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে।আভা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি বলে,
– তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করেন।আপনার নম্বরে অনেক বেশি টাকা কাটে।

রৌদ্র হতভম্ব হয়ে ফোনের স্ক্রিনে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে কল ব্যাক করে।আভা প্রথমে ধীরে সুস্থে রৌদ্রকে সালাম দেয়।রৌদ্রও সালামের উত্তর দিয়ে জানতে চায়,
– কি অবস্থা?সবকিছু ঠিকঠাক?ভার্সিটিতে গিয়েছ?

আভা গম্ভীর স্বরে বলে,
– আপনি আমাদের ব্যাপারে আপনার মাকে জানিয়েছেন?

রৌদ্র ভ্রু কুঞ্চন করে বলে,
– মম ফোন করেছিল?

পূর্বের স্বরে বলে,
– হ্যাঁ।

রৌদ্র সন্দিহান স্বরে বলে,
– কি বলেছে?

– বলেছে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান।

রৌদ্র স্বস্তির শ্বাস ফেলে বিগলিত হাসে।জোরে একটি শ্বাস নিয়ে বলে,
– যাক মম তাহলে একটা কাজের কাজ করল।তো বলেন ম্যাডাম আপনার সারপ্রাইজটা কেমন লাগল?

আভার সোজা জবাব,
– ভালো না।

কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হয় রৌদ্রের।আভা শক্ত কন্ঠে বলে,
– আপনি বলেছেন আপনি বিয়ের পর আমাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চান?দেখুন আপনার সিদ্ধান্ত যদি এটা হয় তবে আপনার সাথে আমার পথচলা এখানেই শেষ করতে হবে।আমি আমার বাবা মাকে একা ফেলে এতো দূরে যাবো না।আমার বাবা মা আমার কাছে সবচেয়ে দামি।আল্লাহ না করুক বাবা মায়ের কোনো সুবিধা অসুবিধা হলে আমি বাবা মায়ের কাছে থাকতে পারবো না।

রৌদ্র বিস্মিত কন্ঠে বলে,
– কিন্তু আমি তো এমন কিছুই বলিনি।আমি তো আরো বললাম যে…!

কলটা কেটে দিলো আভা।রৌদ্র চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।ফোনটা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে।ফোনে কতগুলো দাগ সৃষ্টি হয়।রাগে সারা শরীর ঘামতে শুরু করে তার।ঘর থেকে বের হয়ে হুংকার ছাড়ে,
– মম! মম!ড্যাড!মম!

রোদেলা বা হামিদ কাউকেই আশেপাশে দেখা যায় না।মিনি স্কার্ট পরিহিত গৃহকর্মী এগিয়ে এসে বিনয়ী স্বরে বলেন,
– সরি স্যার।ম্যাম ইজ নট এট হোম।

– ডু ইউ নো হোয়ার ইজ শী?

-নিউ বার ওপেনড ইন টাউন টুডে।স্যার এন্ড ম্যাম ওয়েন্ট দেয়ার ফর লেট নাইট পার্টি।

– ওকে।ইউ মে গো নাও।

– স্যার ডু ইউ নিড কফি?

– নো থ্যাংকস।

তার চারটা বেজে পাঁচ মিনিট।রৌদ্র তার কম্পিউটারে নিজের প্রজেক্টে ফাইনাল টাচ দিচ্ছে।একঘন্টা পরই ক্লায়েন্টকে এটি সাবমিট করবে।বিনিময়ে তার একাউন্টে বেশ বড় অংকের মার্কিন ডলার যুক্ত হবে।মেইন দরজা খুলতেই মৃদু শব্দের একটি এলার্ম বেজে ওঠে।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে রৌদ্র।ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে পায় তার বাবা মা বাড়িতে প্রবেশ করছে।বাবার কাঁধে মা নিজের মাথা রেখে আছে।শরীরের ভরটাও বাবার উপর।হামিদ ছেলেকে দেখে চমকে উঠলো।রোদেলা চোখ পিটপিট করে ছেলেকে দেখে দাঁত বেরিয়ে হাসে।ঢুলতে ঢুলতে ছেলের সামনে এসে নেশাল স্বরে বলে,
– রৌদ্র মাই সন তোমাকে আমি বাংলাদেশে যেতে দিবো না।

রৌদ্র শক্ত কন্ঠে বলে,
– আভার মাকে কি বলেছ তুমি?তোমাকে আমি বলতে বলেছি আমি বাংলাদেশে সেটেল্ড হবো।তুমি কেন বলেছ আমি আভাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসবো?

রোদেলা ঢুলে পড়ে যাওয়ার আগেই রৌদ্র ধরে ফেলল মাকে।নাক মুখ কুঁচকে বলে,
– নিতে পারো না যখন তখন এতো ড্রিংক করো কেন?ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছ না।

রোদেলা রৌদ্রকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বলে,
– তুমি মেয়ের জন্য বাংলাদেশ যেতে চায়ছ না?তাহলে শোনো তোমাকে একটা সিক্রেট বলি।

রোদেলা রৌদ্রের মাথা ধরে নিচে নামিয়ে আসে।কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
– ঐ মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে না। ও অন্য কাউকে পছন্দ করে।হ্যাঁ…!তাই তো ওর মা আমাকে ফোন করে বলল তার মেয়ে অন্য কাউকে পছন্দ করে তাই তারা আমাদের প্রস্তাব গ্রহন করতে পারবে না।তুমি ঐ মেয়েকে ভুলে যাও।কাল তোমার জন্য আমি একটা ব্লাইন্ড ডেট ফিক্সড করেছি।

ঠোঁট ভেঙে ফুপিয়ে রোদেলা ছেলের কপালে চুমু খায়।ছেলে দুহাতে আগলে নিয়ে বলে,
– প্লিজ তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না রৌদ্র।মম ড্যাড তোমাকে অনেক ভালোবাসে।তুমি কেন তোমার মম ড্যাড থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকো?একই শহরে থেকেও তুমি আলাদা থাকো।কেন বাবা।মম তোমাকে খুব ভালোবাসে।মমকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ।

হামিদও স্ত্রীর সাথে সায় দিয়ে আবেগি স্বরে বলে,
– মম ঠিক বলেছে বাবা।তুমি প্লিজ আমাদের সাথে থাকো।

রৌদ্র তপ্ত শ্বাস ফেলে মায়ের কপালে উষ্ণ ছোঁয়া দেয়।বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– মমকে ঘরে নিয়ে যাও।আর তোমাদের কতবার করে বলি এসব ক’কটেইল ম’কটেইল আর খেও না।বয়স হয়েছে তোমাদের।

হামিদ স্ত্রীকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।রৌদ্র তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,
– হায় রে উন্নত জীবন!

কাউকে ফোন করে বলে কাল সকালের এমার্জেন্সি ফ্লাইটের একটি টিকেট বুক করতে।বারবার ভাবে তার মা কি বলল?আভা অন্যকাউকে পছন্দ করে?কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?

তখন থেকে পাসপোর্ট খুজে চলেছে রৌদ্র।কোথাও পাচ্ছে নার পাসপোর্টটা।একটু পরেই তার ফ্লাইট এখন পাসপোর্টাই উধাও। রাগে শরীর জ্বলছে তার।বার বার মনে হচ্ছে ফ্লাইটটা আজ সে মিস করবে।কিন্তু সে কিছুতেই ফ্লাইট মিস করতে চায় না।এবার বাংলাদেশ যাওয়ার পিছনে তার অন্য একটি কারণ আছে।সে বিশাল বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ যাচ্ছে এবার।কিন্তু পাসপোর্ট?সেটাই তো নিখোঁজ।

চলবে..

প্রিয় বালিকা পর্ব-১৭+১৮+১৯+২০

0

#প্রিয়_বালিকা |১৭+১৮|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভা তখন থেকে আমতা আমতা করে যাচ্ছে।না কিছু বলছে আর না এখান থেকে যেতে দিচ্ছে।রৌদ্রের সারা শরীর রাগে ঘামতে শুরু করেছে।যা দেখে আভা আরো ভড়কে গেল।শুঁকনো ঢোক গিলে চোখ মুখ খিঁচে বড় একটা শ্বাস টেনে বুকের ভিতরই আঁটকে রাখল।তারপর এক নিশ্বাসে বলে উঠলো,
– দেখুন আমি সোজা কথার মেয়ে।আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কোনো কথা বলতে পারিনা।আর পেটের ভিতর কোনো কথা আঁটকেও রাখতে পারিনা।পেটের ভিতর কথা আঁটকে রাখলে আমার পেট গুড়গুড় করে।তাও তিনটা বছর পেটের ভিতর এই কথাটা অনেক কষ্টে আঁটকে রেখেছি।আমার আপনাকে খুব ভালো লাগে।আপনাকে ঐরকম ভালো লাগে।মানে আপনি যেমন ভাবছেন আর কি।আমি আপনাকে পছন্দ করি।আমি আপানকে ঐরকম পছন্দ করি মানে যে রকম প্রেমিকা প্রেমিককে করে।আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি?না আপনি বুঝতে পারছেন না।দাঁড়ান আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি আমি আপনাকে ভালোবাসি!ওহ্ আপনি তো আবার বাংলা বুঝেন না দাঁড়ান ইংরেজিতে বলছি আই লাইক ইউ,আই ওয়ান্ট ইউ,আই নিড ইউ,আই লাভ ইউ,”ওয়া আয় নি”।ধুর বাবা চাইনিজ ঢুকিয়ে দিলাম কেন আবার!

আভা চোখ বন্ধ করে বিরতিহীনভাবে এইসব প্রলাপ বকে চলেছে।শেষের কথাটি বলে ঠোঁট উল্টিয়ে নিজের মাথায় একটি চাটি মেরে পিটপিট করে চোখ খুলে আভা।রৌদ্র তার দিকে জহুরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এক ভ্রু উঁচু তার।বুকে হাত গুঁজে সে স্থির চিত্রের মতো দাঁড়িয়ে।আভা চোখ খুলে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলে,
– আপনি কি কিছু বুঝেছেন?প্লিজ আমাকে মারবেন না।

রৌদ্রের ভাবভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন এলো না।সে আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিল আভা তাকে এমন কিছু বলার জন্য এমন হাঁসফাঁস করছে।আমার ভীত মুখটা দেখেই সে বুঝতে পেরেছিল আভা কি বলতে চায়।রৌদ্র দৃষ্টি একই রেখে শান্ত স্বরে ভঙ্গিতে বলে,
– আমি বাংলা বুঝি।ইন ফ্যাক্ট এখন একটু বেশিই ভালো বুঝি।

আবা শুঁকনো ঢোক গিলে যাচ্ছে সমান তালে।রৌদ্রের এমন শান্ত ভঙ্গি যেন তাকে আরো ঘাবড়ে দিচ্ছে।আভা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
– আপনি কি এখন আমাকে মারবেন?

রৌদ্র কিছু বলল না।আভা আবারো সভয়ে বলে উঠলো,
– আপনি এতো শান্ত কেন?আপনি অবাক হননি?আমি আপনাকে এসব কথা বললাম আপনার রাগ হচ্ছে না?

রৌদ্র থুঁতনিতে তর্জনি ঠেকিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,
– ফার্স্ট ওফ অল আমি কোনো টিনাজার নই যে কেউ আমাকে নিরিবিলি পার্কে এনে প্রপোজ করলে আমি তব্দা খেয়ে যাবো।আর আমি এমন কিছুই আশঙ্কা করেছিলাম তোমার গতদিনের আচারণে এবং এখানে আনার পর তোমায় খুঁতখুঁত করতে দেখে।তাই আনফর্চুনেটলি আমি একটুও অবাক হইনি।কিন্তু আমি সারপ্রাইজড তোমার সাহস দেখে।

শেষের কথায় আভার করুণ চাহনি আরো করুণ হয়ে যায়।নিজেকে সাতদিনের অভুক্ত কোনো প্রাণী মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে।কি করবে সে এখন?রৌদ্র তার আগের ভঙ্গিতেই পাশের বেঞ্চটিতে গা মেলে বসে।আভা করুণ চোখে তাকিয়ে তার দিকে।রৌদ্র আভাকে চোখের ইশারায় তাকে পাশে বসতে বলে।ভীত আভা ভয়ে বসতে সাহস পায় না।আভাকে বসে না দেখে ধমক দিয়ে ওঠে রৌদ্র,
– কি হলো বসো।

তড়িঘড়ি বসে পড়ে আভা।রৌদ্র আভার দিকে ঘুরে বসল।আভার চোখে নিজের শিকার চোখের দৃষ্টি গভীর করে।আভাও তার চোখে চোখ রেখে থমকে যায়।রৌদ্র শীতল কন্ঠে বলে,
– এখন আর এই চোখে চোখ রাখতে ভয় করে না?

আভা আনমনেই ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে “না” বোঝায়।রৌদ্রের চোখে মুখে হাসির ঝলক দৃশ্যমান হয় তবে ঠোঁট প্রসারিত করে না সে।কোমল কন্ঠে বলে,
– দেখ আভা তোমার জন্য আমি কিছু ফিল করিনা এই মিথ্যাটা আমি বলতে পারবো না।তবে!

আভা রৌদ্রের কথার প্যাচ উন্মুক্ত করে বাক্যটির আসল অর্থ বুঝতেই ঠোঁট প্রসারিত হয়।কিন্তু শেষের “তবে” টা তাকে এই মুহুর্তে ভাবাচ্ছে।আভা ভ্রুযুগল সংকুচিত করে।রৌদ্র সংকোচ নিয়ে বলে,
– তবে আমি আমার ফিলিং নিয়ে কনফিউজড।

চুপসে গেল আভার মুখ।মুখের সেই মৃদু হাসি মিলিয়ে গেল।মলিন মুখে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো রৌদ্রের দৃষ্টি থেকে।তীব্র অপমাননবোধ করল সে।শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পেল।রাগ হলো নিজের উপর। কেন বলতে গেল সে মনের কথা।না বললে তো এভাবে অপমানিত হতে হতো না।গুম হয় বসে রইলো আভা।আভা দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই রৌদ্র আহত দৃষ্টি ফেলল আভার দিকে।করুণ স্বরে বলল,
– আভা!

আভা তার দিকে তাকাল না।সে একদৃষ্টিতে মাটিতে তাকিয়ে আছে।রৌদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– আভা আমরা এসবে না জড়াই?

গলা আঁটকে গেল আভার।চোখ জ্বলছে ভিষণভাবে।কিন্তু সে কাঁদল না।সে আর কোনো দূর্বলতা প্রদর্শন করতে চায় না এই লোকটার সামনে।আভা সেখা আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না।উঠে সোজা হাঁটা শুরু করল।আভা এতোটাই জোরে হাঁটল যে এক সেকেন্ডই অনেকটা দূরে চলে গেল।রৌদ্র সেখানে বসেই একটি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।তারপর উঠে নিজের আভার পিছন পিছন যায় সে।
বাসে পাশাপাশি বসে আছে আভা এবং রৌদ্র। আভা অনুভূতি শূণ্য হয়ে থম মেরে বসে আছে।রৌদ্র করুণ দৃষ্টি তাকিয়ে আছে তার দিকে।ছোট করে বলল,
– আভা!

আভার থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।সে একই ভঙ্গিতে বসে রইলো।রৌদ্রও আর ঘাটাল না আভাকে।সেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো চুপচাপ।

সোনালি আলোর লাইটিং-এ মুন্সি বাড়ি জ্বল জ্বল করছে।বিয়ের ভেন্যুতে একের পর এক মিডিয়াম ভলিউমে গান বেজে চলেছে।চারিদিকটা একদম রমরমা পরিবেশ।মুন্সি বংশের বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা সারা গ্রামের মানুষের মনে থাকবে না?কাঁচা হলুদ এবং সাদা রঙের আর্টিফিশিয়াল ফুলে গমগম করছে বিয়ের ভেন্যু।স্টেজে পাশাপাশি বসে আছে অভয় এবং অহনা।অভয়ের পরনে কাঁচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে সাদা সুতোর কাজ এবং সাদা পাজামা।অহনা পরেছে কাঁচা হলুদ রঙের বেনারসি শাড়ি।গায়ে কাঁচা ফুলের গহনা।সেই ফুলের সুবাস অহনার সারা শরীরে ছড়িয়ে পরেছে।অভয়ের মুখ থেকে হাসিই যেন সরছে না।সকলে একে একে অভয়ের মুখে হলুদ লাগিয়ে ক্ষীর খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছে।কেউ কেউ ছোট খাটো উপহারও দিলো তাদের।অভয় সকলের চোখের আড়ালে অহনার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
– কাল এমন সময় আমি আর তুমি এক কামরে মে বান্ধ অর চাবি খো যায়ে।

অহনা রাগি চাহনিতে চেয়ে দাঁত পিষে অভয়ের মতোই ফিসফিসিয়ে বলে,
– লজ্জা করে না আপনার সব সময় আমার সাথে লু’ইচ্চামো করতে থাকেন।আমি বলে কিছু বলি না।অন্য মেয়ে হলে কবেই গণ পিটানি খেয়ে পটল তুলতেন।

অভয় নির্লজ্জের মতো দাঁত বের করে হাসে।আগের মতোই নিচু স্বরে বলে,
– বউয়ের সাথে লু’চ্চামো না করলে বংশ বৃদ্ধি হবে কি করে গো জানু?

– ঐ জানু হলুদটা কি তোমার গালে লাগাবো নাকি জিহ্বায়?

আচমকা আভার এমন বক্তব্যে বিরক্ত হয় অভয়।অহনা ঠোঁট চেপে হাসে।অভয় শকুনি দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে।আভা নিজের চকচকে দাঁতগুলো বেরিয়ে বিগলিত হাসে।ঘন পলক ফেলে মিষ্টি একটি ভঙ্গি করে।অভয় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বিড় বিড় করে বলে,”এই মেয়েটা সবসময় আমার আর আমার বউয়ের কথার মাঝে ঠ্যাং ঢুকায়।কোনদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবে ওর ঠ্যাং দু’টো নিখোঁজ সেদিন বুঝবে মজা।”

আভা এক খাবলা হলুদ নিয়ে অভয়ের সারা মুখে ঢলে দেয়।অভয় চোখ মুখ খিঁচে রাগে কটমট করতে থাকে।অহনা চাপা হাসি দেয়।চোখে মুখে হলুদের মাখামাখি দেখে অভয় দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে,
– ওরে খ’য়রাতি…!

আভা অভয়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে হবু ভাবি অহনার মুখে সামান্য হলুদ মাখিয়ে দেয়।হবু ভাবিকে আলতো আলিঙ্গন করে মিষ্টি হেসে বলে,
– মুন্সি পরিবারের নতুন সদস্য,তোমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

অহনা মৃদু হেসে সামান্য হলুদ নিয়ে আভার ডান গালে লাগিয়ে দেয়।আভা নেমে আসে স্টেজ থেকে।তার পরনে একটি সাদা ও হলুদ মিশ্রণের গাউন।মুখে হালকা পাতলা সাজ।শরীরে কোনো গহনা নেই শুধু কানে একটি লাল আর্টিফিশিয়াল ফুলের অলংকার।বিয়ে এই ভেন্যুতে বউয়ের পর সে সকলের নজর কাড়তে সক্ষম।প্রথমত ভাইয়ের একমাত্র বোন।দ্বিতীয়ত দেখতে সোনালি বর্ণের হলেও নাক,চোখ,ঠোঁট, মুখ সব একদম নিখুঁত কাটের।আভা স্টেজ থেকে নেমে আসতেই রৌদ্রের মুখোমুখি হয়।রৌদ্র অভয়ের মতো একটি হলুদ পাঞ্জাবি এবং সাদা পাজামা পরে আছে।আভা রৌদ্রকে দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে চলে আসে।যা রৌদ্রের মোটেও পছন্দ হয় না।তার এখন রাগ লাগছে আভার উপর।তাকে এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার মানে কি?সকালেই তো চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছিল আমি আপনাকে পছন্দ করি, আপনাকে ভালো লাগে,আপনাকে ভালোবাসি এখন যেন দেখেও দেখছে না।চিনেও চিনছে না।বিষয়টা একদমই পছন্দ হলো রৌদ্রের।চাপা রাগের অস্তিত্ব পাওয়া গেল তার চোখে মুখে।অভয় স্টেজ থেকে রৌদ্রের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ে,
– রৌদ্র তাড়াতাড়ি আয় তোর ভাবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

রৌদ্র চাপা রাগটা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে স্টেজে উঠে গেল।অভয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা হলুদ নিয়ে অভয়ের মুখে লাগিয়ে দিলো।অহনার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল,
– আসসালামু আলাইকুম ভাবি কেমন আছেন?

অহনা হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো।অভয় রৌদ্রের হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসায়। গলা জরিয়ে অহনার দিকে তাকিয়ে বলে,
– ভালো করে চিনে রাখো এটা হলো আমার জিগারকা টুকরা। মাই ওয়ান এন্ড অনলি বেস্ট ফ্রেন্ড “আফসিন রৌদ্র”।

রৌদ্র ফিকে হাসে।এই মুহুর্তে তার মাথায় আভা ছাড়া আর কিছু চলছে না।রৌদ্র অভয়ের থেকে নিজে ছাড়িয়ে স্টেজ থেকে নেমে আসে।সঙ্গে সঙ্গে হলুদ ভরা একটি হাত এসে পড়ে রৌদ্রের গালে।সামনে তাকিয়ে সেহরিনকে দেখে প্রথমে ভ্রু কুঁচকে ফেলে রৌদ্র।সেহরিন হেসে বলে,
– কেমন আছেন রৌদ্র ভাইয়া?

কিছুক্ষণ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারে এটা সেই ছোট সেহরিন।অবাক হয় রৌদ্র ভাবে সেই গায়ে পড়া কীটটা তাকে ভাইয়া বলে ডাকছে।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে।রৌদ্র মেকি হেসে বলে,
– জ্বী ভালো আছি ভাইয়া।তুমি কেমন আছো?

– জ্বী ভাইয়া ভালো আছি।আপনি আগের থেকে দ্বিগুণ সুদর্শন হয়ে গিয়েছেন।মুখে এতো গ্লো কিভাবে আনলেন ভাইয়া?কোন কোন প্রডাক্ট ইউজ করেন?বাংলাদেশ কি অস্ট্রেলিয়া থেকে সেগুলো ইম্পোর্ট করে?

এমন সময়ে সেহরিনের এমন বেহুদা প্রশ্নে চটে গেল রৌদ্র।সে যাচ্ছিল আভার সাথে একটু কথা বলতে।আভা তাকে ভালোবাসার কথা বলার পর থেকে তার আভার প্রতি পিপাসাটা তর তর করে বেড়ে উঠেছে।তবু সে মেনে নিতে পারছে না যে সে মানে ” আফসিন রৌদ্র” হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে ভালোবাসে।তাই সে এই অনুভূতিগুলো থেকে একটু দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে।কিন্তু সকালে আভার মুখে ভালোবাসার কথা শুনে অনুভূতিগুলো আরো সতেজ হয়ে উঠেছে।কিন্তু আভা সে তো তাকে পাত্তায় দিচ্ছে না।তাকে জিজ্ঞেসাবাদ করতে চলেছিল রৌদ্র।কেন সে রৌদ্রের সাথে কথা বলছে না।রৌদ্রকে এড়িয়ে চলছে।মাঝে এই মেয়ের এমন বেহুদা কথায় মস্তিষ্ক টগবগ করে ফুটতে শুরু করে তার।রক্তিম চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে,
– কি মাখি?

সেহরিন গদগদ হয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল।রৌদ্র আগের ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার ঘুম থেকে উঠে একবার আর গোসলের পর একবার তিনবেলা নিয়ম করে আলকাতরা মাখি।

সেহরিনের হাসি যেন ঠোঁটে আর ধরল না।সে এতো খুশি হয়েছে।রৌদ্র এক মুহুর্ত দাঁড়াল না সেখানে গটগট করে হেঁটে চলে এলো বাড়ির ভিতর কিছুক্ষণ আগে আভাকে বাড়ির ভিতরেই যেতে দেখেছে।সেহরিন কিছুসময় ভেবে মাথা চুলকে ভাবুক স্বরে বলে,
– আলকাতরা?আলকাতরা মানুষ মুখেও মাখে?হাউ ইন্টারেস্টিং!

আবার খুশিতে গদগদ হয়ে যায় সে।আজই তার বাবাকে আলকাতরা আনতে বলবে।তারপর সে বিদেশিদের মতো ঝকঝকে ফকফকে হয়ে যাবে।তখন নিজের রূপের আগুন কত এমন আফসিন রৌদ্রকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা কয়লা করে ফেলবে।ভেবেই সেহরিনের গর্বে বুক ফুলে ওঠে।মাথা উঁচু করে অতি ভাবের সহিত হাঁটে সে।

– আপনার কি টাওয়াল লাগবে?
আভার কথায় পিছন ফিরে প্রান্তর নামের যুবকটি।অহনার খালাতো ভাই।মুখের হলুদ পরিষ্কার করতে ওয়াশরুমে এসেছে সে।আভার সাহায্যতেই সে ওয়াশরুমে এসেছে।এ বাড়ির মেহমান হিসেবে তার কারো সাহায্য দরকার ছিল ওয়াশরুম খুঁজে বের করার জন্য।সম্বন্ধ চলাকালীন আভার সাথে দু একবার কথা হওয়ায় সে আভার সাহায্য নিতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে।তাই আভার সাথে আসে ওয়াশরুমে।আভা ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর সে ওয়াশরুমের বেসিনে মুখ পরিষ্কার করছে।আভা কথাতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় সে।অর্থাৎ তার টাওয়াল লাগবে।আভা তার জন্য টাওয়াল নিয়ে আসে।সারাবাড়ি ফাঁকা। বাড়ির সবাই বাইরে বিয়ের ভেন্যুতে।বাড়িতে শুধু প্রান্তর এবং আভা।এইমাত্র প্রবেশ করল রৌদ্র।আভাও নিজের মুখ পরিষ্কার করে নিয়েছে।তবে হলুদের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে তার ডান গালে।প্রান্তর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।আভার হাত থেকে টাওয়ালেটা নিয়ে মুখ মুছলো।আভার দিকে দৃষ্টি গাঢ়ো হতেই দেখতে পেল আভার মুখে হলুদের অবশিষ্ট অংশ।ইশারায় মুখ পরিষ্কার করতে বলল সে।আভা ভ্রুকুটি করে মুখে হাত দিয়ে দু একবার ঘষে নিলো।এতে করে হলুদ আরো ছড়িয়ে গেল।তা দেখে প্রান্তর সামান্য হেসে উঠলো।এগিয়ে এসে হাতে থাকা টাওয়ালেটা দিয়ে আভার মুখের হলুদ মোছে সে।আভা অস্বস্তি বোধ করে সরে আসে।সহসা কোনো পুরুষ তার ভারি কন্ঠে কঠিন সুরে বলে,
– কি হচ্ছে এখানে?

কন্ঠের ধারে কেঁপে ওঠে আভা।প্রান্তর উঁকি দিয়ে আভার পিছনে তাকায়।দেখতে পায় একজন সুপুরুষ চোখ মোটা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।প্রান্তর টাওয়াল আভার হাতে নিয়ে বলে,
– আমি যাচ্ছি তুমি এসো।

সাধারণ এই কথাটাও আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল।রৌদ্র তেড়ে এসে প্রান্তরের গলা চেপে ধরল।সহসা রৌদ্রের এমন মেজাজ হারানোই আভা এবং প্রান্তর চমকিত হয়।আভা বড় বড় চোখ করে মুখে হাত চেপে ধরে।রৌদ্র প্রান্তরের গলা চেপে রেখেই তীব্র মেজাজ নিয়ে বলে,
– আমি আসছি তুমি এসো?তুমি এসো?তুই কি ওর আঁতুড়ঘরে গিয়ে ওকে বিয়ে করে এসেছিলি?এতো ক্যাজুয়ালি তুই ওর সাথে কথা বলিস কোন সাহসে?

আভা দৌড়ে গিয়ে প্রান্তরকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল।অনবরত বলল,
– রৌদ্র কি করছেন ছাড়ুন ওনাকে।ছাড়ুন বলছি।

আভা এবার নিজে সর্বশক্তি দিয়ে রৌদ্রের বুকে ধাক্কা দিলো।সঙ্গে সঙ্গে দূরে ছিটকে গেল রৌদ্র।আভা রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
– অনেক হয়েছে কতক্ষণ থেকে বলছি থামতে?উনি আমাদের গেস্ট আপনার সাথে ওনার কোনো লেনদেন নাই বা থাকতে পারে কিন্তু আমাদের আছে।আপনি ওনার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারেন না।আপনিও আমাদের গেস্ট।তাই গেস্টের মতো থাকুন।

আভা প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ক্ষমা করবেন ভাইয়া।দয়া করে বাইরে গিয়ে এ বিষয়ে কিছু বলবেনা।অনুষ্ঠান বাড়ি বুঝতেই তো পারছেন।

প্রান্তর শকুনি দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে নিজের কলার ঠিক ঠিক করতে করতে আভার উদ্দেশ্যে বলল,
– ইটস্ ওকে।তবে আমার মনে হয় তার মেন্টাল ট্রিটমেন্টের দরকার।

রৌদ্র আবার ধেয়ে আসতে চায়ল প্রান্তরের দিকে।আভা তার নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো,
– রৌদ্র।

আজই প্রথম সে রৌদ্রের নাম ধরে ডাকল।রৌদ্র রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে আভার দিকে চেয়ে আছে।আভা আবারো একদফা প্রান্তরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো।প্রান্তর শকুনি দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাড়তে ঝাড়তে চলে গেল।আভা রাগি স্বরে রৌদ্র বলল,
– কি করছেন আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন?

রৌদ্র আভার দুই বাহু চেপে ধরল।তবে সহনীয় ভাবেই ধরল।দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল,
– আগেও বলেছি আমার সাথে এই টোনে কথা বলবে না।তখন তো খুব বলছিলে আপনাকে পছন্দ করি,আপনাকে ভালোবাসি।যখনই আমি না করে দিলাম অমনি অন্য ছেলের সাথে গাল ঘষাঘষি শুরু করে দিলে!শেইমলেস গার্ল!

আভা বাহু থেকে রৌদ্রের হাত সরিয়ে আগের মতোই উচ্চ স্বরে বলল,
– তো কি করবো?এখন আপনার বিরহে আজীবন দেবদাসী হয়ে থাকবো?

রৌদ্র চোখ বন্ধ করে কপালে তর্জনি ঠেকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে,
– টোন ঠিক করো আভা।এটা কিন্তু লাস্ট ওয়ার্নিং।

তৎক্ষণাৎ আভা নিজেকে সংযত করে।ঢোক গিলে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
– আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন না।তাহলে আমি কি করি না করি তাতে আপনার কি?

সঙ্গে সঙ্গে রকেটের গতিতে প্রস্থান করে রৌদ্র।অনেক হয়েছে এই চার আঙুল মেয়ের পাঁচ হাত লম্বা লম্বা কথা শোনা।কি ঠেকে যে সে এই চার আঙুল মেয়েটার সাথে কথা বলতে এসেছিল কে জানে?

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |১৯|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

বর যাত্রী নিয়ে ক্লাবে প্রবেশ করেছে অভয়।অহনার কোনো ভাই-বোন নেই।তবে চাচাতো-মামাতো ভাইবোনদের দাবি দাবা পূরণ করতে হয়েছে তাকে।একপ্রকার যুদ্ধ শেষ করে সে স্টেজে এসে বসেছে।কিছুক্ষণের মধ্যে অহনাও হাজির হয় লাল বেনারসি আর গহনা ভর্তি শরীরে।মুখে ভারি মেকআপ।অভয় তো প্রথমে অহনাকে দেখে চমকে ওঠে।চেনাই যাচ্ছে না তাকে।সোনালি পাঞ্জাবি পরিহিত রৌদ্র ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে অভয় এবং অহনার।পাশে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার বিভিন্ন পোজে ছবি ওঠাচ্ছে অভয় এবং অহনার।রৌদ্র শখের বসেই তার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে।আশেপাশে সবকিছু ক্যামেরা বন্দী করে চলেছে সে।ফ্রেমে একজন যুবতীর মুখমণ্ডল ধরা দিতেই থমকে যায় রৌদ্র।হৃৎপিণ্ড শীতল হয়ে যায় তার।মেয়েটি তার দিকেই এগিয়ে এলো।গাঢ় নীল রঙের নেটের গাউন পরিহিত সে।রৌদ্রের সামনে এসে মেয়েটি হেসে বলে,
– আমার কয়েকটি ছবি তুলে দিবেন?

রৌদ্র ক্যামেরা দেখতে দেখতে গম্ভীর স্বরে বলে,
– দাঁড়াও।

মেয়েটি কিছুটা দুরত্বে মিষ্টি হেসে সুন্দর একটি পোজ দিয়ে দাঁড়ায়।রৌদ্র ক্যামেরার লেন্স ঠিক করে মেয়েটির সুন্দর একটি ছবি ক্যামেরা বন্দী করে।মেয়েটি এগিয়ে এসে উৎফুল্ল কন্ঠে বলে,
– দেখি কেমন হয়েছে।

রৌদ্র ক্যামেরা এগিয়ে দেয় মেয়েটির সামনে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিটি দেখে বলে,
– ভালোই তুলেছেন।আরো কয়েকটি তুলে দেন।

রৌদ্র তার আরো কিছু ছবি তুলে দেয়।সে এগিয়ে এসে বলে,
– আমাকে ডকুমেন্ট করে ছবিগুলো হোয়াটসঅ্যাপে দিবেন।আপনার বাংলাদেশি নম্বরটা দেন।

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তুমি নিজের নম্বর বলো আমি পাঠিয়ে দিবো।

– ওকে টাইপ করুন। সেভ করুন “আভা” দিয়ে।

– তুমি যাও আমি বুঝবো কি নামে সেভ করবো।

আভা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে চলে আসে।রৌদ্র কোণা চোখে তাকিয়ে দেখে আভা চলে গিয়েছে কিনা।আভা চোখের আড়াল হলেই মুখে মুচকি হাসির রেখা ফুটে ওঠে।বৃদ্ধ আঙুল নাড়িয়ে নম্বরটি সেভ করে “রৌদ্রাভা” নামে।নামটি ঠোঁট নাড়িয়ে বার বার উচ্চারণ করে আর কোমল হাসে সে।

অভয় পড়েছে বিপাকে।অহনার চাচাতো-মামাতো ভাইবোনেরা নিজে থেকে এসে তার ধুয়ে দিয়েছে।সে বার বার না করার শর্তেও কেউ তার কথা শুনেনি।সে কতবার বলেছে “আমি একাই হাত ধুতে পারব।”তবু সকলে মিলে তার হাত টেনে ধুয়ে দিয়েছে।সেধে এসে হাত ধুয়ে দিয়ে এখন টাকা চায়ছে তারা।খাবার টেবিলে এই নিয়েই তখন থেকে ঝামেলা চলছে।মেয়ে পক্ষ বলছে টাকা দিতে হবে আর ছেলে পক্ষ বলছে টাকা দিবে না।এদিকে অভয়ের পেটে ইঁদুর বেড়াল আন্দোলন শুরু করেছে।সামনে হরেকরকম খাবার থাকার পরও একটা খাবারও মুখে তুলতে পারছে না সে এই হাত ধোঁয়ার চক্করে।করুণ চোখে খাবারের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে অভয়।বিড়বিড় করে বলে,
– মনে হচ্ছে কাঁচা বাজারে ঢুকেছি।বস্তা ভরে টাকা নিয়ে এসে পকেটে করে বাজার দিয়ে যাচ্ছি।কি একটা অবস্থা এদিকে এতো খাবার চোখের সামনে থাকার পরও কিছু মুখে দিতে পারছি না।

অভয় রৌদ্রের পাঞ্জাবির নিচের অংশ ধরে টেনে রৌদ্রকে নিচু করে।কানে ফিসফিস করে বলে,
– যা চায়ছে দিয়ে দে না আমার অনেক খিদে পেয়েছে। প্লিজ…!

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।সোজা হয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
– আচ্ছা আচ্ছা যা চায়ছেন আপনারা তাই দেওয়া হবে।এখন ওর হাতটা ছাড়ুন।

সঙ্গে সঙ্গে আভা তেঁ তেঁ উঠে বলে বসলো,
– যা চায়ছে তাই দেওয়া হবে মানে?আমার ভাই কি টাকার গাছ নাকি যে নাড়া দিলেই ঝরঝর করে টাকা পড়বে?আমরা টাকা দিবো না।গেটে তো দিয়েছি।

আবারো শুরু হয়ে গেল তর্কাতর্কি।অভয় বেচারা সবার মাঝে অসহায় অভুক্ত হয়ে বসে রইল।তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে রৌদ্র নিজের মেজাজ হারিয়ে ফেলল।আভাকে টেনে ভীড় থেকে বের করে নিয়ে এলো।আভা ছটফট করে চলেছে ছাড়া পাওয়ার জন্য।রৌদ্র আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে কিছু খুঁজলো।টেবিলে প্লেটের পাশেই পেল বড়সড় রুমাল।সেখান থেকে দুইটা রুমাল তুলে নিলো।আভাকে ধরে একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলো।আভা তখন থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছে,
– ছাড়ুন আমাকে।কি করছেন আপনি?ছাড়ুন আমাকে।

রৌদ্র কালবিলম্ব না করে আভার মুখে একটা রুমাল আর অন্যটি দুহাত এক করে বেঁধে দিলো।দাঁতে দাঁত পিষে শক্ত কন্ঠে বলল,
– তখন থেকে বলছি থেমে যাও।অভয় টাকা দিতে বলেছে।আর তুমি ঝগড়া করেই যাচ্ছো।এটা কি তোমার সেই পাকিস্তানি থ্রি-পিস নাকি হ্যাঁ?সবখানে বার্গেনিং করতে থাকো।মাথাটাই গরম করে দিলো!

আভা বড় বড় করে অস্পষ্ট শব্দে কিছু বলার চেষ্টা করল।কিন্তু কিছু বলতে পারে না।রৌদ্র আভার দিকে তাকিয়ে জোরে জোর শ্বাস টেনে অভয়ের কাছে চলে যায়।আভা হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় চেঁচিয়ে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।রৌদ্র অভয়ের কাছে গিয়ে তাদের দাবি করা টাকাটি তাদের হাতে তুলে দেয়।অভয় স্বস্তির শ্বাস ফেলে।সে তো আরেকটু হলে খিদের জ্বালায় মাথা ঘুরে পড়ে যেত।রৌদ্র টাকা দিয়ে আভার কাছে ফিরে আসে।আভা চুপ করে সেখানে থাকা সোফায় নাক ফুলিয়ে বসে আছে।রৌদ্র হাসে।ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।ধীর গতিতে আভার হাত খুলে দেয়।আভা রৌদ্রের দিকে তাকায় না।তবে বারবার আঁড়চোখে রৌদ্রের ভাবগতি দেখে।রৌদ্র মুখে বাঁধন খুলে নরম সুরে বলে,
– সরি।আসলে রাগটা আমার একদমই কন্ট্রোলে থাকেনা।রাগের বশে কি করি না করি কিছু মাথায় থাকে না।

আভা কড়া দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকায়।সে দৃষ্টি দেখে রৌদ্রের হাসি চওড়া হয়।মজার ছলে বলে,
– ওরে বাবা তোমার চোখ দু’টো থেকে মনে হচ্ছে এখনই অগ্নুৎপাত শুরু হবে।

আভা কোনো কথা না বলে উঠে চলে যায়।রৌদ্র শব্দ করে হাসে আভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।নিজে নিজেই বলে,
– বাবা এ তো দেখি একদম আমার উল্টো।আমি রাগ হলে সব বের করে দিই।আর এতো দেখি বোম হয়ে থাকে।একদম শান্ত হয়ে যায়।এই রাগ তো আরো ভয়ংকর!

ক্লাবের সম্পূর্ণ সময়টা একদম দম মেরে থাকে আভা।খাওয়া দাওয়া বিয়ে পড়ানো শেষে আসে বিয়ে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক সময়।মেয়ে বিদায়ের সময়।এই সময়টা মেয়ের বাবা-মায়ের সবচেয়ে কষ্টের সময়।জন্ম দেওয়া থেকে এতোটা বছর পেলে পুষে বড় করার পর মেয়ে হয়ে যায় বাবা মায়ের মেহমান।অহনা মাকে জরিয়ে অঝোরে কাঁদছে।তার বাবা টলমল চোখে সকলের আড়ালে দাঁড়িয়ে মেয়েকে নয়ন ভরে দেখছে।অহনার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে চলেছে।অহনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– আম্মু আমি যাবো না।

পিলে চমকে ওঠে অভয়ের।কি বলে বউ তার?শ্বশুরবাড়ি যাবেনা তার বউ?তাহলে তো তাকে বিয়ে করেও আইবুড়ো হয়ে থাকতে হবে।না না এ অন্যায় তার সাথে তার বউ করতে পারে না।অভয় মেকি হেসে বলে,
– আমাদের সন্ধ্যার আগে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে।

অহনা ছলছল দৃষ্টিতে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার দিকে চায়।বাবাকে ডেকে ফুঁপিয়ে ওঠে সে,
– বাবা।বিদায় দেবে না তোমার মেয়েকে?

অহনার বাবা টলমল চোখে ধীর গতিতে এগিয়ে এলো মেয়ে এবং মেয়ে জামাইয়ের কাছে।চোখের কোণায় জমা নোনাজল সকলের আড়ালে মুছে ফেলল।মেয়ের মাথায় হাত রেখে কাতর স্বরে বলল,
– ভালো থাকিস মা।আর কোনো প্রয়োজন অপ্রয়োজনে আমাকে জানাবি।তোর বাবা সবসময় তোর সাথে আছে।আর আর তোর বাবা তোকে খ..খুব ভালোবাসে।

কথাগুলো বলতে গিয়ে বার বার থেমে যাচ্ছিলেন অহনার বাবা।তিনি অভয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন।অভয়ের মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিলেন।এখন অভয়ের চোখ ভরে উঠলো।
এদিকে অঝোরে কেঁদে চলেছে আভা।বিয়ের এই পর্বে সকলের চোখে পানি দেখে নিজেকে আঁটকে রাখতে পারিনি সে।সেও পাল্লা দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।সহসা তার সামনে কেউ রুমাল এগিয়ে দিলো।আভা সেটা নিয়ে সুন্দর করে চোখ মুখ মুছে নাক পরিষ্কার করে আবারো ফিরিয়ে দিলো যেদিক থেকে এসেছিল রুমলারটা।রৌদ্র নাক কুঁচকে রুমালটির দিকে তাকিয়ে আছে।কাউকে রুমাল ধরতে না দেখে পাশে তাকায় আভা।রৌদ্রকে নাক সিটিয়ে রুমালটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেটা রৌদ্রের আরেকটু কাছে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– নেন।

রৌদ্র তর্জনি এবং বৃদ্ধ আঙুলের সাহায্যে রুমালের এক কোণা চিমটি দিয়ে ধরে।মেকি হেসে রুমালসহ হাতটা নিজের পিছনে নিয়ে আসে।আস্তে রুমালটা ছেড়ে দেয়।নিচে পড়ে যায় সেটা।আভার চোখ আবার ভরে উঠেছে।রৌদ্র আমতা আমতা করে বলে,
– আভা তুমি কাঁদছ কেন?

আভা সামনের দিকে চোখ রেখে নাক টেনে বলল,
– কাঁদব না?কত ইমোশনাল একটা সিন চলছে।

– সিন?এখানে কি কোনো ড্রামার শুটিং চলছে?

আভা রেগে বলল,
– ড্রামার শুটিং চলবে কেন?ভাইয়ার বিয়ে চলছে।আপনি এতো বোকার মতো কথা বলেন কিভাবে?আপনি নাকি আবার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন।হুহ্!

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |২০|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

অভয়ের ঘরের সামনে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে একঝাঁক তরুণ তরুণী।নিজেকে সর্দার দাবি করে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আভা।তার ঠিক পিছনেই রৌদ্র।পাশে সেহরিন।যে কিনা কিছুক্ষণ পরপর রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।আর রৌদ্র?সে তো এক দৃষ্টিতে তার আভার দিকে তাকিয়ে আছে।ঠোঁটে মুগ্ধতার হাসি।আচমকা আভা গলা নামিয়ে সতর্ক সুরে বলে,
– এই এই আসছে আসছে।

সকলে নড়ে চড়ে দাঁড়ায়।ঘোর কাটে রৌদ্রের।সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় অভয় বেশ ফুরফুরে মেজাজে হেলেদুলে ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে।মুচকি মুচকি হাসি তার ঠোঁটে।দরজার আগলে সব ভাইবোনদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কদম থেমে যায় অভয়ের।ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এখানে কিসের আন্দোলন চলছে?

আভা বুকে হাত গুঁজে অতি দাম্ভিকতার সাথে বলে,
– এখনো শুরু হয়নি।তবে তুমি যদি আমাদের দাবি না মান তো শুরু হবে।

অভয় সন্দিহান দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকিয়ে আছে।বোনের পিছনে নিজের প্রিয় বন্ধুকে দেখে তার কপালে আরো একটি ভাঁজ বৃদ্ধি পেল।সন্দিহান স্বরে বলে উঠলো,
– কিসের দাবি?

আভা আগের ভঙ্গিতেই জবাব দেয়,
– আমাদের বিশ হাজার টাকা দাও আর বাসর ঘরে যাও ব্যাস এটুকুই।

অভয়ের চোখ বেরিয়ে এলো।সে অবাক স্বরে বলে,
– কিহ্?বিশ হাজার টাকা?এখন আমাকে উল্টো করে ঝাঁকালেও এতো টাকা পাবি না।সব টাকা বউ আনতে গিয়ে ডাকাতি হয়ে গিয়েছে।

আভাসহ সকলে মাথা নাড়িয়ে প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলো,
– না না তা বললে তো চলবে না।শা’লা-শা’লিদের দিতে পেরেছ আমাদের পারবে না?আমাদেরকেও দিতে হবে।

অভয় কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– আচ্ছা এখন পাঁচ হাজার দিচ্ছি।পরে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাবো কেমন?

রৌদ্র নাকচ স্বরে বলে,
– না চলবে না।বিশ হাজার টাকায় দিতে হবে।

– তুইও ওদের সাথে গিয়ে ভীড়েছিস?তুই না আমার বন্ধু?

– হ্যাঁ আর তাই তো বন্ধু হিসেবে এটা আমার এবং আমাদের দাবি।

সকলে এক সুরে চেঁচিয়ে বলে,”আমাদের দাবি মানতে হবে। মানতে হবে।” অভয় একটি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
– আচ্ছা এখন দশ হাজার দিই।

সকলে নিজের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।আভা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।আপাতত এটা নিয়েই ভাগা ঠিক হবে।না হলে যদি চিল্লাচিল্লিতে তার বাবা একবার চলে আসে তাহলে আমও যাবে ছালাও যাবে।তার থেকে যতটুকু দিচ্ছে ততটুকুই নিয়ে নেওয়া যাক।আভা সন্দিহান স্বরে অভয়কে বলে,
– তুমি কিন্তু পরে আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছ।

– হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে যাবো।

অভয় টাকা দিতেই সকলে টাকা নিয়ে ছুটে পালায়।অভয়ও স্বস্তির শ্বাস ফেলে ঘরে প্রবেশ করে।সারাঘর কাঁচা ফুলে সজ্জিত।কাঁচা ফুলের সুবাসে হৃদয় হালকা হয়ে যায় অভয়ের।ফুলে সজ্জিত খাটে বসে তার বউ তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।হয়তো ভয়ে।বউকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসে অভয়।সে নিজেও ভীত।জীবনের প্রথম কোনো যুবতী নারীর সাথে একঘরে থাকবে সে।এর থেকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বোধহয় দু’টো নেই।অভয় ঘামতে শুরু করেছে।ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক বিকল হয়ে চলেছে তার।নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে গলা ঝাড়ে সে।অহনা খাটে পা ঝুলিয়ে বসে থরথর করে কাঁপছে।সে শুঁকানো ঢোক গিলে অভয়কে সালাম জানাল।অভয়ও কোনো মতে উত্তর দিলো।এরপর কি বলবে দু’জনের কেউ ভেবে পেল না।আচমকা অভয় বলে উঠলো,
– গরম লাগছে না?

অহনা মাথা উপর নিচ মাথা নাড়ায়।অভয় তৎক্ষনাৎ কোনো কিছু না ভেবে বলে,
– তাহলে খুলে ফেল।

অহনা চোখ বড় বড় করে বলে,
– কিহ্!

অভয় ভড়কে যায়।তুতলিয়ে বলে,
– আ আই মিন জানালা।জানালাটা খুলে ফেল।

তপ্ত শ্বাস ফেলে অহনা।ঠোঁট চেপে হাসেও সে।ধীর পায়ে উঠে গিয়ে জানালা খুলে দেয়।সঙ্গে সঙ্গে শীতল বাতাসে ছেয়ে যায় চারপাশটা।নিজের পিছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে কেঁপে ওঠে অহনা।ব্যক্তিটির একটি হাত তার পেটের এক অংশ স্পর্শ করে।অহনার শরীরের কম্পন বৃদ্ধি পায়।ব্যক্তিটি নিজের অধর ছোঁয়ায় অহনার মসৃণ কাঁধে।কাঁধ থেকে সে স্পর্শ ধীরে ধীরে স্থান পরিবর্তন করে গলদেশে প্রবেশ করতেই বিকট আওয়াজে দু’জনেই ছিটকে দূরে সরে যায়।দু’জনের শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পায়।এতক্ষণ কোনো ঘোরের মধ্যে ছিল তারা।অভয় ঢোক গিলে আশেপাশে তাকিয়ে শব্দটির উৎস খোঁজার চেষ্টা করে।বিরক্ত স্বরে বলে,
– এটা কি তোমার ফোন?আজকে ফোনটা বন্ধ রাখতে পারতে। আসহ্য!

অহনা লজ্জায় অভয়ের দিকে তাকাতে পারে না।মাথা নত রেখেই নিচু স্বরে বলে,
– এটা আমার ফোন না।

কপাল কুঁচকে অহনার দিকে তাকায় অভয়।এটা তো তারও ফোন না।আবার অহনা বলছে তার ফোনও না।তাহলে এটা কার ফোন?অভয় অহনাকে বলল,
– খোঁজো তো কোথায় বাজছে।

অহনা এবং অভয় দু’জনে নেমে যায় ফোন খোঁজায়।ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে।কিছুক্ষণ খোঁজার পর খাটের নিচে ফোনটি পায় অহনা।অভয়কে ফোনটি দেখিয়ে বলে,
– পেয়ে গিয়েছি এই যে।

– রিসিভ করো।এতো রাতে ফোন করছে এমার্জেন্সিও হতে পারে।লাউডস্পিকারে দাও।

অহনা সায় জানিয়ে কলটা রিভিস করে লাউড স্পিকারে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে মেয়েলি চিকন স্বর ভেসে এলো,
“দু’টির বেশি নয় একটি হলে ভালো হয়।এই চেতনাকে ধারণ করে জনস্বার্থে কাজ করে চলেছি আমরা।নব দম্পতির বাসর রাতে তাদের সতর্ক করায় আমাদের কাজ।আপনাদের বিবাহিত জীবন মধুর ও সুখময় হোক।তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে আপনাদের বিবাহিত জীবন যেন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকা আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য।ধন্যবাদ।”

খট করে ফোন কেটে দিলো আভা।বিছানায় মুখের ভিতর কাপড় ঢুকিয়ে গোড়াগুড়ি খাচ্ছে রৌদ্র।হাসতে হাসতে তার পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড়।সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে একবার বিছানার এপাশে যাচ্ছে তো ওপাশে।আভা কল রেখে নিজেও অট্টহাসি দিয়ে বিছানায় বসে পড়ল।মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।লোকটা কত হাসিখুশি। শুধু রেগে গেলে মাথা ঠিক থাকে না।রৌদ্র এবার হাসতে হাসতে উঠে বসল।হাসির দাপটে চোখে জল টলমল করছে তার।আভা রৌদ্রের ঠোঁটের দুইপাশের টোল দেখে আনমনে বলে,
– ডিম্পল?!

রৌদ্র ধীরে ধীরে হাসি থামিয়ে দেয়।আভার চোখে চোখ রেখে ঠোঁট প্রসারিত রেখেই প্রশ্ন করে,
– পছন্দ?

তৎক্ষনাৎ জবাব এলো,
– খুব।

কিছুক্ষণ থেমে আভা ঘুরে বসে।রৌদ্রের চোখ চোখের মণি রেখে বলে,
– গোটা আপনিটাই আমার খুব পছন্দের।কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনি বুঝলেন না।

হতাশার শ্বাস ফেলে আভা।রৌদ্র দুই ঠোঁট চেপে কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করে।আমতা আমতা করে বলে,
– আভা তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে।আমি আসলে তোমাকে খুব মানে..আব অভয়…!

দরজার দিকে চেয়ে চোখ বড় করে অভয়ের নাম উচ্চারণ করে রৌদ্র।অভয় রক্তলাল চোখে আভার দিকে তাকিয়ে আছে।রৌদ্র উঠে দাঁড়ালো।আভা শুঁকনো ঢোক গিলে দৌড়ে রৌদ্রের পিছনে চলে গেল নিজেকে বাঁচাতে।অভয় তেড়ে এসে রাগে কটমট করে বলল,
– আজকে ওর একদিন কি আমার একদিন।আজকে ওকে যদি পিটিয়ে ত’ক্তা না করছি তাহলে আমার নামও অভয় না।

আভা রৌদ্রের টিশার্টের পিঠের অংশ খামচে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
– রৌদ্র প্লিজ আমাকে বাঁচান।

রৌদ্র অভয়কে বলল,
– অভয় দেখ শান্ত হ।ঘরে যা ভাবি একা আছে।ও জাস্ট একটু মজা করছিল।

অভয় আগের মতো উগ্র মেজাজ নিয়ে বলে,
– মজারও একটা লিমিট থাকা দরকার।এখন ও বাচ্চা নেই।একটা নতুন এসেছে এই বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সাথে এসব কোন ধরনের মজা?আজকে তোর হাড্ডিগুড্ডি গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবো।বেয়াদ’ব বেরিয়ে আয়।

আভা রৌদ্রের পিছন থেকে উঁকি দিয়ে অভয়কে দেখল।অভয়কে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঢোক গিলল সে।রৌদ্র অভয়কে থামানোর জন্য এটা ওটা বলে চলেছে।একপর্যায়ে অভয় আভার হাত টেনে রৌদ্রের পিছন থেকে বের করে নিয়ে এলো।আভার চোখ থেকে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে।সে শুধু একটু মজা করতে চেয়েছিল কিন্তু এই ছোট মজাটা এমন ভয়াবহ রূপ নেবে সে স্বপ্নেও ভাবিনি।অভয় আভাকে আঘাত করার জন্য হাত তুলতেই হুংকার দিয়ে ওঠে রৌদ্র।
– অভয়!

অগ্নিবর্ষণ দৃষ্টিতে অভয়ের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার।আভাকে আবারও নিজের পিছনে আগলে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে,
– অনেক হয়েছে।কি শুরু করেছিস কি তুই?ও বাচ্চা মেয়ে না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে তাই বলে তুই ওর গায়ে হাত তুলবি?তাছাড়া এটা ও একা করেনি আমিও ছিলাম ওর সাথে।কাল সকালে কথা বলবো এখন যা এখান থেকে।

অভয় দমে যায়।চোখ পাকিয়ে একবার আভার দিকে তাকিয়ে চলে যায় সে।আভা ভীত চোখে রৌদ্রের পিছন থেকে উঁকি দিয়ে নিজের ভাইকে দেখে।অভয় আবারও ফিরে আসে।সন্দিহান দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
– বাই দ্য ওয়ে ও তোর রুমে কি করে?এতো রাতে ও তোর রুমে কেন?

রৌদ্র এবং আভা দুজনই থমকে যায়।রৌদ্রের রাগি দৃষ্টি মিলিয়ে যায়।চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবে কি বলবে।কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– বললাম তো ও একা করেনি এটা।আমিও ছিলাম।এখন যা।

অভয় সন্দিহান দৃষ্টিতে রৌদ্র এবং আভাকে কিছুক্ষণ দেখে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।স্বস্তির শ্বাস ফেলে রৌদ্র।আভা এখনো রৌদ্রের টিশার্ট খামচে ধরে ফুপিয়ে চলেছে।রৌদ্র পিছন ঘুরে আভার মুখোমুখি দাঁড়ায়।আভা মাথা নত করে নাক টানতে টানতে বলে,
– আমি তো শুধু একটু মজা করতে চেয়েছিলাম।

রৌদ্র সযত্নে আভার চোখের পানি মুছে দিলো।কোমল স্বরে আশ্বাস দিয়ে বলে,
– জানি তো।আমি অভয়কে বলবো তুমি আর কেঁদো না।গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

আভা ভীত চোখে মুখ তুলে বলল,
– ভাইয়া যদি আবার আসে?

রৌদ্র মসৃণ হাসে।এক হাতে আভার চোয়াল ধরে উপরে তুলে নিচু স্বরে বলে,
– আসবে না।আসলে দৌড়ে চলে আসবে আমার কাছে কেমন?

রৌদ্র পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে আভার দিকে।চোখের ভেজা পাপড়িগুলো আভার চোখের মায়া আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।ডান চোখের নিচের ছোট তিলটা চক চক করছে।তপ্ত শ্বাস ফেলে রৌদ্র।আভা একহাত রৌদ্রের কাঁধে হাত রেখে বলে,
– ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য।

রৌদ্র আভার হাতের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে।আভার চোখে দৃষ্টি স্থির করে বলে,
– গুড নাইট।

– আপনাকেও শুভরাত্রি।

স্টেজে পাশাপাশি বসে আছে অভয় এবং অহনা।দুজনকে পাশাপাশি অসম্ভব সুন্দর লাগছে।দূরে পাংশুটে মুখে তাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পূর্ণতা।সে আজ একপ্রকার জোর করেই এসেছে অভয়ের রিসিপশনে।তার মা আসতে চায়নি।কিন্তু সে জোর করে এসেছে।সে তার অপূর্ণতাকে স্ব চোখে দেখতে চায়।গলাটা আঁটকে আছে অপূর্ণতার দখলে।ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে ক্ষণে ক্ষণে।সে জানত এই সুপুরুষ কোনোদিনই তার হবার নয়।এতো ভাগ্য নিয়ে সে এই পৃথিবীতে আসেনি।ফিকে হাসিতে এগিয়ে এলো পূর্ণতা।অভয় তাকে দেখে গম্ভীর ভঙ্গিতে উঠে চলে গেল।অভয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে চোখ ভরে উঠলো তার।তবু নিজেকে সামলে অহনার দিকে তাকিয়ে বলল,
– আসসালামু আলাইকুম ভাবি।কেমন আছেন?আমি আভার বান্ধবী।

অহনা মিষ্টি হেসে সালামের জবাব দিলো।পূর্ণতাকে ইশারায় তার পাশে বসতে বললো।পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল,
– গায়ে হলুদ, বিয়েতে আসোনি কেন?

পূর্ণতা মলিন হেসে জবাব দেয়,
– আসলে কিছু কাজে আঁটকে গিয়েছিলাম।

– আভার মুখে তোমার কত কথা শুনেছি।ও সবসময় তোমার জিকির করতে থাকে।তুমি বিয়েতে না আসায় ও কষ্ট পেয়েছে।ওই তো আমাকে বলল ওর ফ্রেন্ড নাকি বিয়েতে আসেনি তাই ওর মনটা খারাপ।

চলবে…

প্রিয় বালিকা পর্ব-১৩+১৪+১৫+১৬

0

#প্রিয়_বালিকা |১৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পুকুর ধারে দোলনায় বসে আছে “প্রিয় বালিকা”।তবে এখন সে আর বালিকা নেই।সে এখন যুবতী।শারীরিক পরিপক্বতার সাথে মানসিক পরিপূর্ণতা সবকিছুরই বিকাশ ঘটেছে।এমনকি অনুভূতিগুলোও হৃদয় জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে।হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠের শেষ অংশে ঠেকেছে।সেদিনের টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলোর নাম না জানা থাকলেও আজ সে নাম জানে।এই অনুভূতির কারণ জানে।কিন্তু যাকে নিয়ে অনুভূতিগুলো তাকে বলার জন্য সে নেই।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আভা।দোলনা মৃদু দুলছে।সেদিন রৌদ্র চলে যাওয়া বেশকিছু দিন পর সে পুকুর পাড়ে এসে বটগাছের সাথে এই দোলনাটা দেখতে পায়।ভিতরটা আরো ঢুকরে ওঠে তার।সে জানে এটি কে তৈরি করেছে।এরপর অনেকবার দোলনাটা বর্ষার দরুন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।কিন্তু যতবার নষ্ট হয়েছে ততবারই আভা এটাকে ঠিক করেছে।

– এই আভা চল।সবাই রেডি।

সেহরিনের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আভার।উঠে দাঁড়ায় সে।পরণে কালো থ্রি-পিস।অভয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে।অভয় গ্রাজুয়েশন শেষ করে দেশে ফিরেছে বছর খানেক।এখন মাস গেলে মোটা অঙ্কের বেতন পায় সে।সে শহরে থাকে ছুটি পেলে বাড়িতে আসে।এবার এসেছে বিয়ের উদ্দেশ্যে।তার পাত্রীর তালিকায় সর্বপ্রথম পূর্ণতার নাম।অভয় অবশ্য এ নিয়ে রাগারাগি করেছে।সে পূর্ণতাকে বিয়ে করতে চায়না।কিন্তু প্রেমার পছন্দের তালিকায় ছেলের জন্য পূর্ণতাকেই সকলের উপরে রেখেছে।আজ হঠাৎ করেই যাওয়া হচ্ছে তাদের বাড়িতে।এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পূর্ণতাসহ তার পুরো পরিবার রাজধানীতে চলে যায়।প্রেমা কোনোভাবে খবর পেয়েছেন তারা কিছুদিনের জন্য গ্রামে এসেছেন।তাই সে ছেলের বিয়ের কথা নিয়ে আজ পূর্ণতাদের বাড়িতে যাবেন।আভা ধীর পায়ে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় আসে।আজ আর ভাড়া করা মাইক্রোবাসে যাবেনা তারা।আজ তারা নিজেদের গাড়িতে যাবে।
সকলে একে একে বাসে উঠে বসলো।বাড়ির অধিকাংশ লোক যাচ্ছেন।শুধু যাচ্ছে না আইরিন এবং অভয়।
হরেক রকম মিষ্টি নিয়েছেন গাড়ির ডিঁকি ভরে।পূর্ণতা দরজা খুলে আভা এবং তার বাড়ির লোকদের দেখে চমকে গেল।বিস্ময় স্বরে বলে উঠলো,
– আভা?

আভা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
– কোমন আছিস?

পূর্ণতা দরজা থেকে সরে সবাইকে ভিতরে আসতে বলে।আভাকে আলিঙ্গন করে বলে,
– ভালো আছি তুই কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

পূর্ণতা মুন্সি বাড়ির সকলে দেখে ভ্রুকুটি করে।আভাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কিছু হয়েছে কিনা?সকলে হঠাৎ একসাথে?আভা কিছু না বলে পূর্ণতাকে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়।পূর্ণতা এবার নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না।

– কি হয়েছে রে?হঠাৎ বাড়ির সবাইকে নিয়ে?

আভা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– তোকে দেখতে এসেছি।

পূর্ণতা আভার কথা বুঝতে না পেরে বলে,
– মানে?

– ভাইয়ার জন্য তোকে দেখতে এসেছি।

– অভয় ভাইয়া?

– হ্যাঁ।

আকাশ থেকে পড়ে পূর্ণতা।এতো চমকিত সে জীবনে কখনো হয়নি।পূর্ণতা বড় বড় চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে আভার দিকে তাকিয়ে থাকে।আভার মুখের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক।পূর্ণতা পা টিপে টিপে দরজায় দেওয়া পর্দার আড়ালে দাঁড়ায়।তার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করছে।পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাহিরের কথপোকথন শোনার চেষ্টা করে।

প্রেমার সোজাসাপ্টা বাক্য,
– দেখুন পুরো পরিবার নিয়ে যখন এসেছি তখন তো বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই।আমার ছেলে অভয়ের জন্য পূর্ণতাকে নিতে চাই।

কুশল বিনিময় আপ্যায়ন শেষে প্রেমা এমন কোনো কথায় বলবে তা আগেই অনুমান করেছিল পূর্ণতার মা।প্রেমার কথায় সে আমতা আমতা করে ইনিয়েবিনিয়ে বলে,
– দেখুন আমি বলছিনা অভয় ছেলে হিসেবে খারাপ।কিন্তু আমার মেয়েও যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন।তাছাড়া ও কত ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।তাই আমি ওকে এখন মানে এই মুহুর্তে বিয়ে দিতে চাইছি না।

পূর্ণতার মায়ের কথায় বেজার হলেন প্রেমা।মুখে নেমে এলো কালো মেঘ।তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলেন,
– দেখুন আমরা অভয়ের পাত্রীর তালিকায় পূর্ণতাকে সকলের উপরে রেখেছি ওর সকল যোগ্যতা বিশ্লেষণ করেই।অভয়ও পাত্র হিসেবে খারাপ নয়।বিদেশ থেকে পড়ালেখা করে এসেছে।

পূর্ণতার মা সন্দিহান স্বরে বলেন,
– অভয় কি বিয়ের পর বউ নিজের সাথে করে নিয়ে যাবে শহরে?নাকি এখানে আপনাদের সাথে থাকবে?

প্রেমা আমতা আমতা করে বলেন,
– অভয় তো চায় ওর বউ ওর পরিবারের সকলের সাথে থাকুক।

পূর্ণতার মা এবার শক্ত কন্ঠে বলেন,
– মাফ করবেন বোন আমি আমার মেয়েকে এই মুহুর্তে বিয়ে দিতে চাইছিনা।আশা করি অপরাধ নিবেন না।

এতো বোঝানোর পরেও এমন বাক্য অপমান করল মুন্সি বাড়ির লোকদের।প্রেমা আর একমুহূর্তে বসতে পারলেন না সেখানে।মৃদু গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লেন আভার উদ্দেশ্যে,
– আভা আভা।

আভাও এতোক্ষণ সব শুনেছে।পূর্ণতা পর্দার আড়াল থেকে সব কথা শুনে থমকে গিয়েছে।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে গেল নোনাজল।আভা মলিন মুখে এগিয়ে এলো।পূর্ণতার দু’কাঁধ ধরে মলিন স্বরে বলে উঠলো,
– আসছি রে ভালো থাকিস।

ফুঁপিয়ে উঠলো পূর্ণতা।কষ্ট হচ্ছে তার!সে জানে কেন তার কষ্ট হচ্ছে।বাবা ছাড়া প্রথম যাকে বীরপুরুষ হিসেবে যাকে সে মানত সে তার বীরপুরুষ নয় বরং পরপুরুষ।আভা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে এলো।মুন্সি বাড়ির সকলে বেরিয়ে যেতেই পূর্ণতা বেরিয়ে আসে।কিছু না জানার ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করে মাকে,
– মা ওরা কেন এসেছিল?

তার মায়ের সহজ সরল জবাব,
– অভয়ের জন্য তোকে দেখতে।

– কি বললে?

– অভয় যদি বউ নিয়ে শহরে থাকত তবে ভেবে দেখতাম।কিন্তু ও এই অজপাড়াগাঁতে বউ রেখে যাবে।আর আমি আমার মেয়েকে গ্রামে বিয়ে দেব না।তাই না করে দিয়েছি।

পূর্ণতা পাংশুটে মুখে মলিন হাসে।শুঁকনো ঢোক গিলে নিজের ঘরে চলে যায়।

—————
– এখন কি আমাকে বউ পিছে পিছে নিয়ে সবজায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে নাকি?কাজ কাম কিছু করা লাগবে না?নাকি বউ কলে নিয়ে বসে থাকলে আমাকে প্রতিমাসে বাড়ি এসে বেতন দিয়ে যাবে।আগেই বলেছিলাম ঐ মেয়ের বাড়ি যেও না।এখন কি হলো?অন্যকোনো মেয়ে দেখো।এখন তো আমাকে যৌতুক দিলেও আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবো না।

প্রেমা কাচুমাচু মুখে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আজ ছেলের কথা শুনলে এত অপমানিত হতে হতো না।অভয় খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।প্রেমা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলের যাওয়ার পানে।আইরিন সংকোচ নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
– ভাবি একটা মেয়ে আছে।

প্রেমা যেন অন্ধকারে আলোর দিশারা খুঁজে পেল।উৎসাহিত স্বরে বলে উঠলো,
– কে কে?দেখতে কেমন?দোষ গুণ কিছু আছে?

– চলো সোফায় বসো বলছি।

প্রেমা এবং আইরিন বসার ঘরে ফেলা বড় সোফায় বসলো।দু’জনে খুব সতর্কতার সহিত গলা নামিয়ে কথা বলছে।যেন কেউ শুনলে কেলেংকারী হবে।

প্রতিদিনের মতো আজও আভা সোশ্যাল মিডিয়ায় “আফসিন রৌদ্র” নামের কাউকে খুঁজছে।প্রতিদিনের কাজ এটা তার।সে প্রতিদিন ঘুমানোর আগে একবার করে এই নাম লিখে সার্চ করে।যদি কোনো ক্রমে কখনো রৌদ্রের প্রফাইল চোখে বেঁধে যায়।কিন্তু আফসোস!এই তিন বছরে একাবারের জন্যও তার প্রফাইল দেখেনি আভা।আজ হতাশার শ্বাস ফেলে তন্দ্রাঘোরে বিভোর হয় আভা।

বেশ অনেকটা সময় অতিক্রম হলো সেদিনের এলোমেলো অনুভূতিগুলোর নাম খুঁজতে খুঁজতে।তিন তিনটা বছর কেটে গেল একটা শব্দের সত্যতা প্রমাণিত হতে।
আভা এখন আর তার ছিন্ন ভিন্ন অনুভূতিগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত নয়।সে জানে এগুলো কি?এগুলো হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি।ভালোবাসা!
আভা বর্তমানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে পড়ছে।প্রথম ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে এসেছে ছুটি কাটাতে।সে যে গণিত বিভাগে পড়ে তা শুনে প্রথমে অনেকেই চমকে যায়।আভা আর গণিত?দুইটা যেন আকাশ এবং পাতাল।প্রথমবার এমন চমকে দিয়েছিল এসএসসিতে গণিতে ঊননব্বই পেয়ে।সকলের চোখ ছানাবড়া। আর আভা?সে তো বিশাল খুশি।সেদিন তার খুশির বাঁধ ছিল না।

চলবে….#প্রিয়_বালিকা |১৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পুকুর ধারে দোলনায় বসে আছে “প্রিয় বালিকা”।তবে এখন সে আর বালিকা নেই।সে এখন যুবতী।শারীরিক পরিপক্বতার সাথে মানসিক পরিপূর্ণতা সবকিছুরই বিকাশ ঘটেছে।এমনকি অনুভূতিগুলোও হৃদয় জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে।হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠের শেষ অংশে ঠেকেছে।সেদিনের টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলোর নাম না জানা থাকলেও আজ সে নাম জানে।এই অনুভূতির কারণ জানে।কিন্তু যাকে নিয়ে অনুভূতিগুলো তাকে বলার জন্য সে নেই।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আভা।দোলনা মৃদু দুলছে।সেদিন রৌদ্র চলে যাওয়া বেশকিছু দিন পর সে পুকুর পাড়ে এসে বটগাছের সাথে এই দোলনাটা দেখতে পায়।ভিতরটা আরো ঢুকরে ওঠে তার।সে জানে এটি কে তৈরি করেছে।এরপর অনেকবার দোলনাটা বর্ষার দরুন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।কিন্তু যতবার নষ্ট হয়েছে ততবারই আভা এটাকে ঠিক করেছে।

– এই আভা চল।সবাই রেডি।

সেহরিনের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আভার।উঠে দাঁড়ায় সে।পরণে কালো থ্রি-পিস।অভয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে।অভয় গ্রাজুয়েশন শেষ করে দেশে ফিরেছে বছর খানেক।এখন মাস গেলে মোটা অঙ্কের বেতন পায় সে।সে শহরে থাকে ছুটি পেলে বাড়িতে আসে।এবার এসেছে বিয়ের উদ্দেশ্যে।তার পাত্রীর তালিকায় সর্বপ্রথম পূর্ণতার নাম।অভয় অবশ্য এ নিয়ে রাগারাগি করেছে।সে পূর্ণতাকে বিয়ে করতে চায়না।কিন্তু প্রেমার পছন্দের তালিকায় ছেলের জন্য পূর্ণতাকেই সকলের উপরে রেখেছে।আজ হঠাৎ করেই যাওয়া হচ্ছে তাদের বাড়িতে।এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পূর্ণতাসহ তার পুরো পরিবার রাজধানীতে চলে যায়।প্রেমা কোনোভাবে খবর পেয়েছেন তারা কিছুদিনের জন্য গ্রামে এসেছেন।তাই সে ছেলের বিয়ের কথা নিয়ে আজ পূর্ণতাদের বাড়িতে যাবেন।আভা ধীর পায়ে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় আসে।আজ আর ভাড়া করা মাইক্রোবাসে যাবেনা তারা।আজ তারা নিজেদের গাড়িতে যাবে।
সকলে একে একে বাসে উঠে বসলো।বাড়ির অধিকাংশ লোক যাচ্ছেন।শুধু যাচ্ছে না আইরিন এবং অভয়।
হরেক রকম মিষ্টি নিয়েছেন গাড়ির ডিঁকি ভরে।পূর্ণতা দরজা খুলে আভা এবং তার বাড়ির লোকদের দেখে চমকে গেল।বিস্ময় স্বরে বলে উঠলো,
– আভা?

আভা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
– কোমন আছিস?

পূর্ণতা দরজা থেকে সরে সবাইকে ভিতরে আসতে বলে।আভাকে আলিঙ্গন করে বলে,
– ভালো আছি তুই কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

পূর্ণতা মুন্সি বাড়ির সকলে দেখে ভ্রুকুটি করে।আভাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কিছু হয়েছে কিনা?সকলে হঠাৎ একসাথে?আভা কিছু না বলে পূর্ণতাকে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়।পূর্ণতা এবার নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না।

– কি হয়েছে রে?হঠাৎ বাড়ির সবাইকে নিয়ে?

আভা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– তোকে দেখতে এসেছি।

পূর্ণতা আভার কথা বুঝতে না পেরে বলে,
– মানে?

– ভাইয়ার জন্য তোকে দেখতে এসেছি।

– অভয় ভাইয়া?

– হ্যাঁ।

আকাশ থেকে পড়ে পূর্ণতা।এতো চমকিত সে জীবনে কখনো হয়নি।পূর্ণতা বড় বড় চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে আভার দিকে তাকিয়ে থাকে।আভার মুখের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক।পূর্ণতা পা টিপে টিপে দরজায় দেওয়া পর্দার আড়ালে দাঁড়ায়।তার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করছে।পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাহিরের কথপোকথন শোনার চেষ্টা করে।

প্রেমার সোজাসাপ্টা বাক্য,
– দেখুন পুরো পরিবার নিয়ে যখন এসেছি তখন তো বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই।আমার ছেলে অভয়ের জন্য পূর্ণতাকে নিতে চাই।

কুশল বিনিময় আপ্যায়ন শেষে প্রেমা এমন কোনো কথায় বলবে তা আগেই অনুমান করেছিল পূর্ণতার মা।প্রেমার কথায় সে আমতা আমতা করে ইনিয়েবিনিয়ে বলে,
– দেখুন আমি বলছিনা অভয় ছেলে হিসেবে খারাপ।কিন্তু আমার মেয়েও যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন।তাছাড়া ও কত ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।তাই আমি ওকে এখন মানে এই মুহুর্তে বিয়ে দিতে চাইছি না।

পূর্ণতার মায়ের কথায় বেজার হলেন প্রেমা।মুখে নেমে এলো কালো মেঘ।তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলেন,
– দেখুন আমরা অভয়ের পাত্রীর তালিকায় পূর্ণতাকে সকলের উপরে রেখেছি ওর সকল যোগ্যতা বিশ্লেষণ করেই।অভয়ও পাত্র হিসেবে খারাপ নয়।বিদেশ থেকে পড়ালেখা করে এসেছে।

পূর্ণতার মা সন্দিহান স্বরে বলেন,
– অভয় কি বিয়ের পর বউ নিজের সাথে করে নিয়ে যাবে শহরে?নাকি এখানে আপনাদের সাথে থাকবে?

প্রেমা আমতা আমতা করে বলেন,
– অভয় তো চায় ওর বউ ওর পরিবারের সকলের সাথে থাকুক।

পূর্ণতার মা এবার শক্ত কন্ঠে বলেন,
– মাফ করবেন বোন আমি আমার মেয়েকে এই মুহুর্তে বিয়ে দিতে চাইছিনা।আশা করি অপরাধ নিবেন না।

এতো বোঝানোর পরেও এমন বাক্য অপমান করল মুন্সি বাড়ির লোকদের।প্রেমা আর একমুহূর্তে বসতে পারলেন না সেখানে।মৃদু গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লেন আভার উদ্দেশ্যে,
– আভা আভা।

আভাও এতোক্ষণ সব শুনেছে।পূর্ণতা পর্দার আড়াল থেকে সব কথা শুনে থমকে গিয়েছে।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে গেল নোনাজল।আভা মলিন মুখে এগিয়ে এলো।পূর্ণতার দু’কাঁধ ধরে মলিন স্বরে বলে উঠলো,
– আসছি রে ভালো থাকিস।

ফুঁপিয়ে উঠলো পূর্ণতা।কষ্ট হচ্ছে তার!সে জানে কেন তার কষ্ট হচ্ছে।বাবা ছাড়া প্রথম যাকে বীরপুরুষ হিসেবে যাকে সে মানত সে তার বীরপুরুষ নয় বরং পরপুরুষ।আভা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে এলো।মুন্সি বাড়ির সকলে বেরিয়ে যেতেই পূর্ণতা বেরিয়ে আসে।কিছু না জানার ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করে মাকে,
– মা ওরা কেন এসেছিল?

তার মায়ের সহজ সরল জবাব,
– অভয়ের জন্য তোকে দেখতে।

– কি বললে?

– অভয় যদি বউ নিয়ে শহরে থাকত তবে ভেবে দেখতাম।কিন্তু ও এই অজপাড়াগাঁতে বউ রেখে যাবে।আর আমি আমার মেয়েকে গ্রামে বিয়ে দেব না।তাই না করে দিয়েছি।

পূর্ণতা পাংশুটে মুখে মলিন হাসে।শুঁকনো ঢোক গিলে নিজের ঘরে চলে যায়।

—————
– এখন কি আমাকে বউ পিছে পিছে নিয়ে সবজায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে নাকি?কাজ কাম কিছু করা লাগবে না?নাকি বউ কলে নিয়ে বসে থাকলে আমাকে প্রতিমাসে বাড়ি এসে বেতন দিয়ে যাবে।আগেই বলেছিলাম ঐ মেয়ের বাড়ি যেও না।এখন কি হলো?অন্যকোনো মেয়ে দেখো।এখন তো আমাকে যৌতুক দিলেও আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবো না।

প্রেমা কাচুমাচু মুখে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আজ ছেলের কথা শুনলে এত অপমানিত হতে হতো না।অভয় খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।প্রেমা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলের যাওয়ার পানে।আইরিন সংকোচ নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
– ভাবি একটা মেয়ে আছে।

প্রেমা যেন অন্ধকারে আলোর দিশারা খুঁজে পেল।উৎসাহিত স্বরে বলে উঠলো,
– কে কে?দেখতে কেমন?দোষ গুণ কিছু আছে?

– চলো সোফায় বসো বলছি।

প্রেমা এবং আইরিন বসার ঘরে ফেলা বড় সোফায় বসলো।দু’জনে খুব সতর্কতার সহিত গলা নামিয়ে কথা বলছে।যেন কেউ শুনলে কেলেংকারী হবে।

প্রতিদিনের মতো আজও আভা সোশ্যাল মিডিয়ায় “আফসিন রৌদ্র” নামের কাউকে খুঁজছে।প্রতিদিনের কাজ এটা তার।সে প্রতিদিন ঘুমানোর আগে একবার করে এই নাম লিখে সার্চ করে।যদি কোনো ক্রমে কখনো রৌদ্রের প্রফাইল চোখে বেঁধে যায়।কিন্তু আফসোস!এই তিন বছরে একাবারের জন্যও তার প্রফাইল দেখেনি আভা।আজ হতাশার শ্বাস ফেলে তন্দ্রাঘোরে বিভোর হয় আভা।

বেশ অনেকটা সময় অতিক্রম হলো সেদিনের এলোমেলো অনুভূতিগুলোর নাম খুঁজতে খুঁজতে।তিন তিনটা বছর কেটে গেল একটা শব্দের সত্যতা প্রমাণিত হতে।
আভা এখন আর তার ছিন্ন ভিন্ন অনুভূতিগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত নয়।সে জানে এগুলো কি?এগুলো হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি।ভালোবাসা!
আভা বর্তমানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে পড়ছে।প্রথম ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে এসেছে ছুটি কাটাতে।সে যে গণিত বিভাগে পড়ে তা শুনে প্রথমে অনেকেই চমকে যায়।আভা আর গণিত?দুইটা যেন আকাশ এবং পাতাল।প্রথমবার এমন চমকে দিয়েছিল এসএসসিতে গণিতে ঊননব্বই পেয়ে।সকলের চোখ ছানাবড়া। আর আভা?সে তো বিশাল খুশি।সেদিন তার খুশির বাঁধ ছিল না।

চলবে….

#প্রিয়_বালিকা |১৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

অভয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে খুব ঘটা করে।এ পর্যন্ত চারজনকে দেখে ফেলেছে।তারমধ্যে তিনজন অনেক বেশি বাচাল।আরেকজন ঠিকই ছিল।তবে অভয়ের সাথে আলাদা কথা বলতে গিয়ে কি হলো কে জানে?ফিরে এসে মেয়ে ধ্বংস যজ্ঞ শুরু করে দিলো।মুখে একটাই কথা এই ছেলেকে সে নাকি মরে গেলেও বিয়ে করবে না।পাত্রীর এমন উগ্র ব্যবহারে মুন্সি বাড়ির লোকেরা লজ্জায় অপমানে প্রাণহাতে নিয়ে পালিয়ে বাঁচে। মুখোমুখি বসে আছে আভা এবং অভয়।আভা রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভয়ের দিকে।অভয় ভোঁতা মুখে মাথা নিচু করে বসে আছে।আভা রাগি স্বরে বলে,
– এই ভাইয়া তুমি কি বলেছ ঐ মেয়েটাকে?ও তোমার সাথে আলাদা কথা বলার পর এমন করল কেন?

অভয় অবুঝ স্বরে বলে,
– আমি তো কিছুই বলিনি।আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি আপনার আসল গায়ের রং কোনটা হাতেরটা নাকি মুখেরটা?বুঝলাম না এমন করলো কেন?আমি তো জাস্ট হাতের আর মুখের রং ভিন্ন দেখে কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম।তাতে এতো রাগ করার কি হলো?আমার মনে হয় মেয়েটার মাথায় সমস্যা।

আভার ঠোঁট আলগা হয়ে গেল।পরমুহূর্তেই কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
– চুপ!এই কথা তুমি পাত্রী দেখতে গিয়ে বলেছ?তোমাকে ধরে পে’টায়নি সেটাই আমাদের সৌভাগ্য।তুমি জানো একটা মেয়ের কাছে মেকাপ মানে আবেগ,ভালোবাসা,প্রেম সবকিছু।সে করছে নাহয় একটু মেকাপ তাই বলে তুমি তাকে এই কথা বলবে?

অভয় ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
– আরে বললাম তো আমি কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম যে মেয়েটার আসল গায়ের রং কোনটা।মুখেরটা নাকি হাতেরটা।তাই জিজ্ঞেস করেছি।

– গো’বর বু’দ্ধি যাকে বলে একটা।নাহ্ আর তোমাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাওয়া যাবে না।আমাদের দুর্ভাগ্য যে তুমি একটা এবন’রমাল।

অভয় কষে একটা চর বসিয়ে দিলো আভার মাথায়।সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল আভা।নিজেও অভয়ের পিঠে দিয়ে দিলো দু ঘাঁ।শুরু হয়ে গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।দু’জন দু’জনকে চর, খামচি, ঘুষি,লাথি যা পারছে তাই দিয়ে যাচ্ছে।এর মধ্যে আভা একদলা থুতু ছুঁড়ে দিলো অভয়ের গায়ে।অভয় নাঁক মুখ কুঁচকে কটমট চোখে তাকিয়ে রইলো আভার দিকে।আভা জোরে জোরে চিৎকার করছে আর নিজের মাকে ডাকছে,
– আম্মু আম্মু ও মা মা!

অভয় এবার আভার ঘাড় ধরে নিচ করে আভার পিঠে কনুই দিয়ে আঘাত করে।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– আমি তোর বড় ভাই আমাকে এ’বনরমাল বলিস বেয়াদ’ব।খ’য়রাতি মেয়ে।আজকে তোকে হাড়ে হাড়ে বোঝাবো আমার সাথে বেয়াদ’বি করার মজা।

আভা এখনো “মা মা” করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।প্রেমা ছেলে মেয়েদের এমন কিচিরমিচির শুনে বিরক্ত হয়ে ছুটে এলেন।দুইজনকে মা’রামা’রি করতে দেখে রেগে গেলেন।আভাকে অভয়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে বলেন,
– এই তোরা কি শুরু করেছিস এই ভরদুপুরে?বুড়ো বয়সে এইসব করছিস?তোদের থেকে তো তিন্নি আর মিন্নি ভালো।অন্তত এভাবে শেয়াল কুকুরের মতো করে না।অস’ভ্য দু’টো।

অভয় এবং আভা দুজন এখনো একে অপরের দিকে তেড়ে আসছে।ফোঁস ফোঁস করে চলেছে উভয়।অভয় রাগি স্বরে বলল,
– তোমার মেয়ে একটা বেয়া’দব হইছে আমাকে বলে আমি নাকি এবনরমাল?তুই এবনরমাল খ’য়রাতি।তোর মাথায় একটা চুলও যেন না থাকে।সব পড়ে যেন ছাফায় হয়ে যায়।

– ভাইয়া আমার যদি একটা চুলও পড়ছে তাহলে তোমার খবর আছে।তোমারেও টাকলু করে দিবো।

– ম’র খ’য়রাতি!

আভা কিছু বলতে যাবে প্রেমা ধমক দিয়ে উঠল,
– এই চুপ একটা কথাও বলবি না।অভয় যা এখান থেকে নিজের ঘরে যা।

আভা জিহ্বা বের করে অভয়কে ভেংচি দিলো।অভয় হাতে ইশারায় কিছু বাঁধার ভঙ্গি করলো।আভা বুঝতে পারল তার জিহ্বা বাঁধার কথা বলেছে অভয়।তা বুঝে আভা আরো বেশি জিহ্বা নাড়াতে শুরু করল।অভয় বেরিয়ে গেল।প্রেমা আভার দিকে চোখ রাঙিয়ে সেও বেরিয়ে গেলেন।বিছানায় অভয়ের ফোনটা দেখা গেল।আভা কিছু একটা ভেবে ফোন অন করে।ফোনে করো লক নেই।তা দেখে ভিতরে ভিতরে তার মন লাফিয়ে ওঠে।সে চটজলদি কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকে পড়ে।সেখানে একজনের নম্বর সে মরিয়া হয়ে খোঁজে।কিছুক্ষণ স্ক্রল করার পর দেখা গেল একটি নম্বর “রৌদ্র” নামে সেভ করা।আভা টপাটপ সে বিদেশি নম্বর নিজের ফোনে টুকে নেয়।কি নামে সেভ করবে তা নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দে ভোগে।হঠাৎই কিছু মনে পড়তেই দ্রুততার সহিত ফোনের কিবোর্ডে আঙুল চালায়।সেভ করে ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে “লাভ” নামে।কিছুক্ষণের মধ্যে অভয় আবার ফিরে এলো।আভার দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিছানার উপর ফেলা নিজের ফোনটা ঝটকা দিয়ে নিয়ে চলে গেল।আভা চুপচাপ অবুঝের মতো বসে রইলো।যেন এ পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কোনো নিষ্পাপ ব্যক্তি নেই।অভয় যেতেই আভা দ্রুত নম্বরটিতে কল করলো।দুইটি ভাষায় একটি মেয়ে বলল নম্বরটি ব্যস্ত আছে।একবার ইংরেজিতে বলল এবং একবার বাংলায়।অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ লোক ইংরেজি ভাষায় কথা বলায় মেয়েটি ইংরেজিতেই প্রথমে বলল।আভা কল কেটে দিয়ে আবারও কল করল।এবার রিং হলো।কিছুক্ষণের মধ্যে কল রিসিভও হলো।অপর পাশ থেকে শোনা গেল এক যুবকে পরিপক্ব ভারি কন্ঠস্বর,
– হ্যালো।আফসিন রৌদ্র স্পিকিং।হু ইজ দিস?

থমকে গেল আভা।টানা তিনটা বছর পর এই কন্ঠস্বর শুনছে সে।আভার মনে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত অনুভূতিগুলো জাগ্রত হলো।চোখ ভরে উঠলো নোনাজলে।শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পেল।সে বুকের বাম পাশে হাত ঠেকিয়ে অনুভব করল হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক আচারণ।ঢোক গিলে নিলো আভা।রৌদ্র কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আবারও বলল,
– হ্যালো!হু ইজ দিস?বাংলাদেশি নম্বর।অভয় নাকি?

আভা জোরে একটি শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করে ফেলল।কান থেকে ফোন নামিয়ে কল কেটে দিলো।ফোনে রেকর্ড হওয়া রৌদ্রের কন্ঠ বার বার চালু করে শুনল।পন করল সে আর রৌদ্রকে কল করবে না।এই কন্ঠস্বরের ভার সে হাজার মাইল দূর থেকে বয়তে পারবে না।

বেশকিছুদিন পাড় হলো।অবশেষে অভয়ের জন্য পাত্রী পাওয়া গেল।বিয়ের তারিখ ঠিক হলো আগামী মাসের পনেরো তারিখ শুক্রবার।আভা তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে রৌদ্রকে আর কল করেনি।অগণিতবার ফোনে রেকর্ড হওয়া রৌদ্রের কন্ঠস্বর শুনে মুচকি মুচকি হেসেছে।মনে যে রৌদ্রকে কল করার কথা নাড়া দেয়নি তা নয় বরং যতবার নাড়া দিয়েছে সে কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকে রৌদ্রের নম্বরটি সিলেক্ট করেছে।আবারও ফিরে এসেছে।কল করা হয়নি।মনকে শান্ত করতে রৌদ্রের ভয়েস শুনেছে একাধিকবার।

বাড়ির একপাশ পরিষ্কার করা হচ্ছে।কারন আগামীকাল থেকে অভয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে।একপাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে অভয়।এই মুন্সিবাড়ির কিছু অংশের ব্যক্তিগত মালিক সে।নিজের টাকায় কিনেছে সে।সে চলে যাওয়ার পর একমাসের মাথায় তার দাদি মারা যান।তারপর মুন্সিবাড়ির সকল সম্পত্তি ভাগ হয়।সেখান থেকেই মুনৃসিবাড়ির মেঝো ছেলে নিজের ভাগ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।অভয় ফিরে আসে।মুলত তার ফিরে আসার কারণ জায়গা বিক্রি ঠেকানো।সে ফিরে আসে মেঝো চাচার সম্পত্তি কিনে নেওয়া সিদ্ধান্ত নেয়।সেদিন সকল সম্পত্তি কেনার পর মেঝো চাচার মুখোমুখি হয়ে সে শক্ত কন্ঠে বলে,
– আমার দাদা সম্পত্তিতে কোনো বাইরের মানুষকে ঢুকতে দেব না।দাদার ঘাম রক্ত করে এইসব গড়া।আপনার মায়া নাই বা থাকতে পারে আমার আছে।আমি আমার দাদার সম্পত্তি এভাবে ধ্বংস হতে দেব না।

নিজের ছেলের জন্য গর্বে সেদিন আরাভ সাহেবের ছাতি ফুলে উঠেছিল।ছল ছল চোখের কোণায় জমা জলের বিন্দুকণা বৃদ্ধ আঙুলের সাহায্যে মুছে নিঃশব্দে প্রস্থান করেন তিনি।ছেলে তার বড় হয়েছে।শুধু বড় হয়নি অনেক বড় হয়েছে।

চলবে….

#প্রিয়_বালিকা |১৫|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

একমুঠো গাঢ় লাল রং মুখে এসে পড়তেই পা থেমে গেল রৌদ্রের।চোখ বন্ধ করে ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।বমাপাশে গলা থেকে চুল সর্বাঙ্গ লাল রঙে জ্বল জ্বল করছে।শুভ্র পাঞ্জাবিতে ফাঁপা পেশিবহুল পুরুষ।শুভ্রমুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির একাংশ লালরঙে আবৃত।শুভ্র পাঞ্জাবিটারও বামদিকের বুকের অংশ আবিরে জুবুথুবু।রৌদ্র ধীর গতিতে চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে চমকে উঠলো।তার সামনেই লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিহিত যুবতী ঠোঁট প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে।এলোমেলো মৃদু কোঁকড়ানো চুলগুলোর কিছু অংশ পিঠে আবার কিছু অংশ বুক ছাড়িয়ে পেট ছুঁয়েছে।রৌদ্র নিজের শিকারী দৃষ্টি ফেলল যুবতীর চোখে।যুবতী আজ সে দৃষ্টি উপেক্ষা করল না বরং এক দৃষ্টিতে তার চোখে তাকিয়ে রইলো।নিঃশব্দে পাড় হলো কিছু সময়।তবু দু’জনের পলক থমকে রইলো।দু’জনের কেউই ভুলেও একবারের জন্য পলক ফেলল না।রৌদ্র মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে অস্পষ্ট উচ্চারণে একটি নাম বলে,
– আভা!

যুবতীর ঠোঁটের হাসি আরো প্রগাঢ় হয়।আড়পারে পরা শাড়িটিতে যুবতীকে দেখতে যেন কোনো জাদুকরীর মতো লাগছে।চোখের গাঢ় কালো কাজল টানা টানা চোখদুটোকে নেশাক্ত করে তুলেছে।পাতলা ঠোঁট দু’টো লাল রঙে আবৃত।সহসা আভা দৌড়ে চলে গেল বিয়ের ভেন্যুতে করা স্টেজে।চারপাশটা লাল সাদা ফুল আর সোনালী আলোই সজ্জিত।আভা স্টেজে উঠে দাঁড়াতেই বড় বড় দু’টি বক্সে একসাথে গান বেজে উঠলো,”তুম জো আয়ে জিন্দেগী মে বাত বান গায়ে!”
গানের তালে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে নাচে আভা।রৌদ্রের অবস্থান এখনো পূর্বের মতো।সে এখনো কোনো ঘোরের মধ্যে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।আচমকা কেউ এসে তাকে জরিয়ে ধরে।তার ভ্রম কাটে তবে আভার থেকে দৃষ্টি ফেরে না।অভয় রৌদ্রকে জরিয়ে উৎফুল্ল স্বরে বলে,
– বিশ্বাস কর তুই যদি না আসতি আমি বিয়েই বসতাম না।

রৌদ্র আভার দিকে দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,
– ওটা কে?

অভয় ভ্রু কুঁচকে রৌদ্রকে ছেড়ে দেয়।তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আভার দিকে তাকায়।মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বলে,
– আমার একমাত্র খ’য়রাতি বোন।যার পাকামোতে কিনা এইসব কালার ফেস্ট মেস্ট এরেঞ্জ করা হয়েছে।

রৌদ্র অবাক চোখে আভার দিকে তাকিয়ে রইলো।যেন সে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেলেছে।শুঁকনো ঢোক গিলে সে।বুকের ধুকপুকানিটা অস্বাভাবিক হাড়ে বেড়ে চলেছে।এটা আভা?সত্যিই আভা?সেই ছোট চুলে ঝালর দেওয়া ফ্রক পড়ে সাইকেল চালিয়ে বেড়াতো সেই আভা?রৌদ্র পর পর কয়েকটা ঢোক গিলে নিলো।অভয় রৌদ্রের পাঞ্জাবি থেকে রং ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলে,
– আসার পর কিছু খেয়েছিস?

মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় রৌদ্র।সে এসেছে আরো তিনঘন্টা আগে।প্রাণপ্রিয় বন্ধুর বিয়ে বলে কথা না এসে কি আর পারা যায়?তাই চলেই এলো বন্ধুর বিয়ে খেতে।রৌদ্র অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চলে এলো ভেন্যু থেকে।ওয়াশরুমে ঢুকে মুখে পানির ঝাপটা দিলো।চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো আভার স্থির চোখের মণি।ঐ চোখ কি যেন বলে গেল তাকে।কিন্তু সে যেন বুঝেও বুঝল না।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মৃদু ধাক্কা খেল কোনো মেয়েলী শরীরের সাথে।নিচু স্বরে বলে উঠলো,
– এসকিউজ মি সিস!

তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো মেয়েটি,
– ইউ আ’র এসকিউজড!বাট আ’ম নট ইওর সিস!

থেমে গেল রৌদ্র।চোখ তুলে তাকিয়ে আভাকে দেখে হয়ে পড়লো।আভা মিষ্টির তালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সে প্রধানত রৌদ্রকেই মিষ্টি দিতে এসেছে মায়ের আদেশে।আভাকে দেখে রৌদ্র আমতা আমতা করে বলে,
– তুমি?

আভা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– আপনার সেই “প্রিয় বালিকা”।

চমকে ওঠে রৌদ্র।আজ তার গলাটায় খরা চলছে।পর পর ঢোক গিলে শুষ্ক গলা ভেজানোর চেষ্টা করে সে।আভা গভীর দৃষ্টিতে রৌদ্রকে পর্যবেক্ষণ করে।রৌদ্রকে দেখে আগে বয়স বোঝা যেত না।এখন স্পষ্ট বয়সের ছাপ তার সর্বাঙ্গে।সে এখন পরিপূর্ণ যুবক।মুখে ছোট দাঁড়িও দেখা যাচ্ছে।সবকিছুর পরিবর্তন হলেও তার সেই চাহনি পরিবর্তন হয়নি।তবে এখন আর আভার বুক কাঁপে না এ চাহনিতে বরং অন্যরকম অনুভূতির জন্ম নেয়।পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর চাহনি বুঝি এই যুবকের।রৌদ্র আভাকে এভাবে পরখ করতে দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
– কেমন আছো?

– আমার গিফট?

চট করে করা আভার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল রৌদ্র।বুঝে উঠতে পারল না আভা কিসের কথা বলছে।জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আভার দিকে।আভা রৌদ্রের এমন দৃষ্টিতে বলে,
– আগের বার তো জানতেন না অভয়ের ছোট বোন আছে।এবার তো জানতেন এবার আমার গিফট কোথায়?

তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রৌদ্র।কি বলবে সে?এমারজেন্সি ফ্লাইটে এসেছে সে।তাই কারো জন্যই সেভাবে কিছু আনতে পারিনি।শুধু আভার মা-বাবা জন্য কিছু এনেছে।আর ঠিক করেছে অভয়ের গিফটটা এখান থেকে কিনে দিয়ে দিবে।রৌদ্র আমতা আমতা করল।আভা মুখ বাঁকিয়ে গোমড়া মুখে বলল,
– থাক গিফট লাগবে না।আম্মু আপনাকে এটা দিতে বলল।আর কোনো সুবিধা অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন।কারণ ভাইয়া তো এখন বিজি ভাইয়ার বিয়ে তাই আমাকেই জানাবেন কেমন?

আভা বেরিয়ে আসবে সহসা রৌদ্র কি মনে করে বলে উঠলো,
– আভা…কেমন আছো তুমি?

মুচকি হাসে আভা।মুখে হাসি নিয়েই পিছন ঘুরে তাকায়।রৌদ্রের চোখে চোখ রেখে বলে,
– আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আর জানতে চায়বেন না।

রৌদ্র লাজুক ভঙ্গিতে ঠোঁট প্রসারিত করে মাথায় হাত দিলো।রৌদ্রের ঠোঁটের দুইপাশ ঘেঁষে তৈরি হওয়া অতি ক্ষুদ্র টোলদ্বয় দাঁড়ি ভেদ করে দৃশ্যমান হয়।এই প্রথম সেই অসম্ভব সুন্দর ভাঁজ চোখে পড়ে আভার।থমকে যায় সে।আনমনা স্বরে উত্তর করে,
– ভালো না।আপনি?

আভার উত্তরে রৌদ্র ভ্রুকুটি করে।জিজ্ঞেস করে,
– ভালো না কেন?

আভা উদাস ভঙ্গিতে বলে,
– বড় একটা রোগে আক্রান্ত আমি।কোনো চিকিৎসক আমার রোগ শনাক্ত করতে পারছে না।

রৌদ্রের মুখে চিন্তার চাপ ফুটে উঠে।কিছুটা উদ্বেগ স্বরে বলে,
– কি বলছ?কি এমন কঠিন রোগ যা কোনো চিকিৎসক শনাক্ত করতে পারছে না।বাসার সবাইকে জানিয়েছ?

আভা পূর্বের ভঙ্গিতে বলে,
– বাসার সবাইকে বলে কি হবে?চিকিৎসকই রোগ শনাক্ত করতে পারছে না তাহলে বাসার সবাই জেনে কি হবে?

রৌদ্র ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– তাহলে আমার সাথে চলো অস্ট্রেলিয়া তোমাকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে দিবো।

আভা মুচকি হাসে।সে যেন রৌদ্রের থেকে এমন কোনো বাক্যই আশা করেছিল।আশানুরূপ ফল পেয়ে ভিষণ আনন্দিত হলো।সে ঠোঁটে হাসি স্থির রেখে বুকে হাত গুঁজে হেয়ালি স্বরে বলে,
– অস্ট্রেলিয়ার ডাক্তার কেন?পৃথিবীর কোনো ডাক্তারই এই রোগ নিরাময় করতে পারবে না।এ হলো মহামারীর মতো বুঝেছেন তো?এর কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই।এটা শক্তিশালী ছোঁয়াচে রোগ।এখন আমার হয়েছে কিছুদিন পর আপনারও হবে।শুধু ধৈর্য্য ধরে দেখতে থাকুন।

আভা বেরিয়ে গেল।রৌদ্র আভার কথাগুলো সাজিয়ে তার সারমর্ম বোঝার চেষ্টা করল।বিড় বিড় করে বলল,”ছোঁয়াচে রোগ?আমারও হবে?কিহ্?আমারও হবে?না না যে রোগের কোনো ওষুধ নেই তা যেন আমার না হয়।না জানি কত ভয়ংকর রোগ!”

অভয়ের জন্য একটি সুশীল সুন্দরী পাত্রী ঠিক করা হয়েছে।একক পরিবারে মেয়ে মেয়ের বাবা-মা ছাড়া কেউ নেই।তারা অভয়ের যোগ্যতা বিবেচনা করে আর না করতে পারিনি।মেয়ে অনার্স মাস্টার্স পাশ।ভালো রেজাল্ট নিয়েই পাশ করেছে।আপাতত চাকরি বাকরি নিয়ে কিছু চিন্তা ভাবনা করেনি।অভয়ও মনে মনে চায় তার বউ চাকরি না করুক।তবে করলেও তাতে তার কোনো অসুবিধা নেই।মেয়েটির নাম অহনা।এই কয়েকদিনে অভয়ের সাথে বেশ ভালোই খাতির হয়েছে তার।মধ্যরাত পর্যন্ত ফোনে প্রেমালাপ।এছাড়াও লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা সাক্ষাৎ তো আছেই।সব মিলিয়ে অভয়ের জীবন এখন রং ধনুর মতো সাত রঙে রাঙানো।অভয়ের ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল আভা।হঠাৎ শুনতে পেল অভয়ের ন্যাকা স্বরে বলা কিছু বাক্য,
– না না আমি মানবো না জানু।কাল আমাদের গায়ে হলুদ এখনো তুমি আমার সাথে কথা বলতে এতো লজ্জা পাও?তুমি যদি এখন আমাকে চু’মু না দেও তাহলে আমি আজকে রাতে ভাতই খাবো না।অনশনে বসবো আমি।তারপর হাতে স্যালাইন লাগিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে যাবো।

আভার দুই ঠোঁট আলগা হয়ে গেল।তখনই অভয়কে নিচে গাণ্ডেপিণ্ডে খেতে দেখল এখন কিনা বলছে ভাত খাবে না অনশনে বসবে?আভা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠলো,
– ঐ জানু তোমাকে তো তখন নিচে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে দেখলাম ঐগুলো কোনবেলার খাবার ছিল?

আভা একটু জোরেই বলল।যাতে অহনাও শুনতে পায়।অহনা আভার কথা শুনে শব্দ করে হেসে দেয়।অভয় রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আভার দিকে।অহনা কিছু না বলেই কল কেটে দেয়।অভয় ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
– এই খ’য়রাতি তুই আমার আর আমার বউয়ের কথার মধ্যে ঠ্যাং ঢুকাচ্ছিস কেন?আর তোর সাহস তো কম না আমার বউয়ের সামনে আমাকে অপমান করিস কালকের মা’রটা কি ভুলে গিয়েছিস?

আভা আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না।দৌড়ে সরে গেল অভয়ের ত্রিসীমানার বাইরে।এখন এখানে দাঁড়ানো মানে পিঠের ছাল চামড়া আলগা হয়ে যাওয়া।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |১৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সন্ধ্যার পর থেকে অভয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান।ছেলে মেয়ে দু’জনের একসাথে গায়ে হলুদ হবে অভয়দের বাড়িতে।মুন্সিবাড়ির একপাশেই বিশাল বড় বাগান পরিষ্কার করে বিয়ের ভেন্যু তৈরি করা হয়েছে।গতকাল কালার ফেস্টিভ্যাল করা হয়েছিল আভার আবদারে।আজ আবারো ডেকোরেশন পরিবর্তন করে হলুদের ডেকোরেশন করা হয়েছে।
আভার কেনাকাটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।তাই সে সকাল থেকে মায়ের সাথে পিড়াপিড়ি করে চলেছে যাতে সে একবার মার্কেটে যেতে পারে।তার মাও নাছোড়বান্দা সেও মেয়েকে কিছুতেই একা ছাড়বে না।এদিকে অভয়, সূর্য,আরাভ বাড়ির সকল ছেলেরা বিয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত।আর মার্কেট করতে যেতে হলে আভাকে শহরে যেতে হবে।দেড়ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে একা মার্কেটে প্রেমা তার মেয়েকে কিছুতেই যেতে দিবেন না।আভাকে ছুটিতে ভার্সিটি থেকে বাড়ি নিয়ে আসে অভয় বা তার বাবা।ছুটি শেষ হলে আবার দিয়ে আসে।সেখানেও আভার দেখাশোনা করে অভয়।একা একা কোথাও যাওয়া হয়না তার। বাড়ির মেয়েরাও কনেপক্ষের জিনিসপত্র সাজাতে ব্যস্ত।
প্রেমা একবার রান্নাঘর তো একবার বসার ঘর যাচ্ছে।আবার কখনো উপরে ছেলের কাছে যাচ্ছে তো কখনো সাজানো গোছানো তদারকি করছে।পিছন আভাও আছে।সে এক সুরে গান গেয়েই চলেছে,
– ও আম্মু আম্মু যাইনা প্লিজ কিছু হবে না।এই যাবো তো এই আসবো।প্লিজ যাই।

প্রেমা থেমে গেলেন।রাগি কন্ঠে বললেন,
– বললাম তো না।

আভা ভোঁতা মুখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।কিছু একটা ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখল রৌদ্র সোফায় বসে ফোন স্ক্রোল করছে।আভা তার মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় রৌদ্রকে দেখায়।প্রেমা বুঝতে পারেনা তার মেয়ে কি বলতে চায়ছে।আভা আবারও রৌদ্রের দিকে ইশারা করে।প্রেমা বিরক্ত হয়ে উচ্চ স্বরে বলে,
– বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে গিয়েছিস নাকি।চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি বলছিস?মুখে বল।

আভা থতমত খেয়ে মায়ের হাত চেপে ধরে।প্রেমার উচ্চ স্বরে বলা কথায় রৌদ্র একপলক তাদের দিকে তাকিয়ে দেখে।আভা রৌদ্রকে তাকাতে দেখে মেকি হাসে।মাকে নিয়ে একটু সরে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– আহ্ আম্মু আস্তে কথা বলো।

প্রেমা রাগে কটমট করে বলে,
– কি বলছিস মুখে বলতে পারিস না?

আভা আমতা আমতা করে বলে,
– উনি তো চুপচাপ বসে ফোন চালাচ্ছে ওনাকে আমার সাথে যেতে বলো।

– কিহ্? রৌদ্র?ও মেহমান মানুষ এখন ওকেও কাজে লাগিয়ে দিবো?

আভা টিটকারি করে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– প্রাণপ্রিয় বন্ধুর বিয়েতে এসেছে কাজ করবে না?

– তুই চুপ কর।

– প্লিজ আম্মু ওনাকে একটু বলো না আমার সাথে যেতে।

প্রেমা কিছুক্ষণ ভেবে দেখলেন এছাড়া আর কোনো উপায় তার কাচে নেই।সে সংকোচ নিয়ে এগিয়ে এলেন রৌদ্রের কাছে।প্রেমাকে নিজের সামনে দেখে ফোন পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ায় রৌদ্র।ভ্রুকুটি করে বলে,
– কিছু বলবেন আন্টি?

প্রেমা সংকোচ দ্বিধা দ্বন্দ নিয়ে বলে,
– ইয়ে মানে আসলে আব্বু হয়েছে কি আভার শপিং এখনো শেষ হয়নি।তাই ও একটু মার্কেটে যেতে চায়ছিল।জানোই তো মার্কেট এখান থেকে কত দূরে সেই শহরে।তাই বলছি তুমি যদি ওর সাথে একটু যাও।

– আ আমি?আচ্ছা ঠিক আছে।

রৌদ্র আভাকে আড় চোখে দেখল।আভা মুখে ফুটে ওঠে হাসি।সে নাচতে নাচতে ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসে।রৌদ্র এখনও সোফাতেই বসে আছে।হয়তো তার অপেক্ষা করছে।আভা রৌদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে গলা ঝাড়ে।রৌদ্র চোখ তুলে আভাকে একঝলক দেখে।আকাশি ও সাদা রঙের একটি সিল্কের থ্রি-পিস পরেছে সে।উঠে দাঁড়ায় রৌদ্র রওনা হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

– আমরা প্রথমে পূর্ণতাদের বাড়িতে যাবো।ওদের বিয়ের কার্ডটা দিয়ে তারপর।বাস স্ট্যান্ডে।

আভার কথায় রৌদ্র মুখে কোনো জবাব দিলো না।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।আভার রাগ হলো রৌদ্রের এরূপ আচারণে।তবু সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পুলকিত স্বরে বলে উঠে,
– আচ্ছা আপনার আমাকে মনে পড়েছে সিডনি যাওয়ার পর?

রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে দেখে।এবারও কোনো জবাব দেয় না।আভা ঠোঁট চেপে হেসে রৌদ্রের দিকে এগিয়ে আসে।গলার স্বর নামিয়ে বলে,
– আমার কিন্তু আপনাকে অনেক মনে পড়েছে।

থমকে গেল রৌদ্র।আসা থেকে আভার কথাবার্তা কেমন যেন লাগছে তার।আগে তো তার সামনে আসতেও আভার কত সংকোচ ছিল।তার দিকে তাকিয়ে কখনো কথা বলেনি।এখন চোখে চোখ রেখে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে।হেসে হেসে কত কথা বলে।আভার এমন আচারণে রৌদ্র বেশ অবাকই হচ্ছে।রৌদ্র গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে,
– আমি এখন আর সিডনিতে থাকি না।বেলারাতে থাকি পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য ইউনিভার্সিটি চেঞ্জ করেছি।

– পোস্ট গ্রাজুয়েশন এখনো শেষ হয়নি?

– হ্যাঁ শেষ।

– কোন ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন?

– ফেডারেশন ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া।

– আচ্ছা।

পূর্ণতাদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে আভা।কিছুক্ষণ পর পূর্ণতার মা দরজা খোলে।আভা মিষ্টি হেসে কুশলাদি বিনিময়ের পর কার্ডটি এগিয়ে দিয়ে বলে,
– আন্টি আজ ভাইয়ার রিসিপশনের কার্ডটা রাখেন।আঙ্কেলসহ সবাইকে নিয়ে আসবেন।আর পূর্ণতা যদি ফ্রী থাকে তাহলে সন্ধ্যায় ওকে পাঠিয়ে দিবেন ছোট করে একটা হলুদের আয়োজন করা হয়েছে।

পূর্ণতার মা মুখ বাঁকিয়ে কার্ডটি উল্টে পাল্টে দেখে।দায় সারা মুখে ভঙ্গিতে বলে,
– হ্যাঁ দেখি চেষ্টা করবো যাওয়ার।অভয়কে শুভেচ্ছা জানাবে।

আভা মেকি হাসে।ভিতরে উঁকি দিয়ে পূর্ণতাকে খোঁজে কিন্তু পূর্ণতাকে চোখে পড়ে না।আভা হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলে,
– আচ্ছা আন্টি আজ আসি।

– ভিতরে আসবে না।এককাপ চা খেয়ে যাও।এটা কে?

রৌদ্রের দিকে ইশারা করে পূর্ণতার মা।পা থেকে মাথা অবধি পরখ করে রৌদ্রকে।আভা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– ভাইয়ার বন্ধু।

পূর্ণতার মায়ের এমন জহুরি দৃষ্টিতে রৌদ্র বিব্রত হয়।বার বার নিজে কালো টি-শার্টের গলার দিকটা টেনে টেনে উপরে ওঠায়।আভা আবারও বিদায় জানায় পূর্ণতার মাকে,
– আজ আসি আন্টি।

পূর্ণতা এতক্ষণ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিল।আভা চলে যেতেই বেরিয়ে আসে সে।নিঃশব্দে মায়ের হাত থেকে লাল টক টকে কার্ডটি হাতে নিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে সে।ঠোঁট প্রসারিত হয় তাচ্ছিল্যে।মায়ের চোখের আড়ালেই চোখ থেকে একবিন্দু নোনাজল গড়িয়ে পড়ে লাল টকটকে সেই বিয়ের কার্ডে।কার্ডটি খুলতেই দেখা যায় অভয় এবং তার হবু বউয়ের ছবি।ছবির পাশেই আঁকাবাকা নকশাকৃত বর্ণে বর কনের নাম লেখা।পূর্ণতা অভয়ের নামের উপর বৃদ্ধ আঙুল ছোয়াল।পাশেই অহনা এহসান নামটি জ্বল জ্বল করছে।সে নাম চোখে কাঁটার মতো বিঁধে গেল পূর্ণতার।আরো দু তিন ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে থুতনিতে স্তুপ হলো।সে স্তুপ ভারি হতেই খঁসে পড়লো কার্ডটিতে।নিজের নামটাকে অদ্ভুতভাবে ঘৃণা করতে শুরু করল সে।

আভা সেই তখন থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটি থ্রি-পিস পরখ করে চলেছে।পাশেই রৌদ্র গোল গোল চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।দোকানদারও একই দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে।আভা থুতনিতে তর্জনি ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ বিচার বিশ্লেষণ করে বিচক্ষণের ন্যায় বলে উঠলো,
– হ্যাঁ কাপড়টা ভালোই মনে হচ্ছে।এটার প্রাইস বলেন।

দোকানদার এতোক্ষণে স্বস্তি পেল।বিগলিত হেসে বলে উঠলো,
– দেখুন আপু এটা আমরা সরাসরি পাকিস্তান থেকে এনেছি।একদম খাঁটি মাল।

আভা বিরক্ত হয়ে বলে,
– আরে তা আপনি যেখান থেকেই আনেননা কেন পাকিস্তান বা পোল্যান্ড তা জেনে আমি কি করবো?আপনি প্রাইস বলেন।

– আরে আপু আগে আমার কথাটা একটু শুনেন তো।আপনার তো ড্রেসটা পছন্দ হয়েছে?আপনাকে ড্রেসটাতে মানাবেও খুব।যেই সুন্দর দুধে আলতা গায়ের রং।

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকালো।লোকটার করা আভার বর্ণনা একদমই পছন্দ হলো না তার।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল সে।এমনিতেই তার মাথায় একশো পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রক্ত ফুটছে।সে এতো ভীড়ের মধ্যে কখনো আসেনি।ওদের ওখানে সকলে শো রুম থেকে কেনাকাটা করে তাই এতো ভিড়ভাট্টার সম্মুখীন হতে হয় না।এদিকে এখানে সে দাঁড়াতেই পারছে না মানুষের ধাক্কায়।তার উপর দোকানদারের এমন বেহুদা প্রশংসা তার একদমই পছন্দ হলো না।সে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল,
– দামটা বলবেন নাকি অন্য দোকানে যাবো?

আভা মনে করল তার সম্বন্ধে অন্যকারো প্রশংসা শুনে হয়তো রৌদ্র রেগে গিয়েছে।তাই সে ঠোঁট চেপে হাসল।দোকানদার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠলো,
– বলছি বলছি আপু আপনার থেকে একদমই বেশি চাইবো না মাত্র তিন হাজার টাকা।

রৌদ্র রেগেমেগে পকেট থেকে তিন হাজার টাকা বের করে।সঙ্গে সঙ্গে আভা তার হাত চেপে ধরে।চোখ মোটা করে কিছু ইশারা করে।রৌদ্রের শিরা উপশিরা শিহরিত হয় আভার নরম হাতের ছোঁয়ায়।হঠাৎই তার রাগ অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আভার দিকে।আভা লোকটি বলল,
– দেখুন আমি এটা দুইটা নিবো।দুই হাজার টাকা দিবো।দিবেন?

দোকানদার ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান স্বরে বললেন,
– একটা দুই হাজার?

আভা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে,
– দুইটা দুই হাজার ।

আভার কথায় রৌদ্র নিজেও থতমত খেয়ে যায়।লজ্জিত হয় সে।যেখানে দোকানদার একটা তিন হাজার চায়ছে সেখানে এই মেয়েটা কিনা দুইটা দুই হাজার টাকায় নিতে চায়ছে।রৌদ্র তড়িঘড়ি আভার থেকে হাত সরিয়ে সরে দাঁড়ায়।আবার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে আভার কানে বলে,
– বার্গেনিং করছ কেন?তিন হাজার টাকায় তো।

আভা কঠোর গলায় বলে,
– আপনি চুপ থাকে। ভাইয়া আপনি বলেন দিবেন?

দোকানদার নারাজ স্বরে বলে,
– কি বলেন আপু?এ হলো খাঁটি পাকিস্তানি থ্রি-পিস।এতো কমে আমি দিতে পারবো না।

আভা লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
– তাহলে আপনি আপনার পাকিস্তানি থ্রি-পিস গায়ে দিয়ে ডিসপ্লে করতে থাকেন আমি গেলাম।

দোকানদার এবার একটু গলে গেল মনে হলো।নরম স্বরে বলল,
– আপু আর একশোটা টাকা কি দেওয়া যায়?

রৌদ্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো দু’জনের দিকে।আভা বাঁকা হেসে লোকটাকে টাকা দিয়ে থ্রিপিস নিয়ে বেরিয়ে আছে।রৌদ্র এখনো চোখ ফেড়ে আভার দিকে তাকিয়ে আছে।হয়তো সে আভার এই হিডেন ট্যালেন্ট দেখে শকে চলে গিয়েছে।

একটি শান্ত নির্মল সবুজে ঘেরা পার্কে বসে আছে আভা এবং রৌদ্র।শহরের এক কোণে এমন একটি পার্ক পেয়ে যাবে তারা আশা করেনি।এখানে আভায় রৌদ্রে নিয়ে এসেছে।রৌদ্র আভাকে এখানে আনার কারণ জানতে চায়লে সে শুধু একটাই কথা বলে,
– আমার আপনাকে একটা জরুরী কথা বলার আছে।আপনি কোনো কথা বলবেন না আমার সাথে চলুন।

শপিং শেষে রৌদ্রকে এখানে টেনে এনেছে আভা।জরুরি কথা আছে বলে আনলেও এসে থেকে একটা শব্দ করছে না আভা।রৌদ্র বার বার জিজ্ঞেস করছে কি বলবে বলো।কিন্তু আভার মুখ যেন সুপার গ্লু দিয়ে কেউ আঁটকে দিয়েছে।
আভা মনে পেটে হাজারো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।কিন্তু মুখ খুলে একটি কথা বলার সাহস পাচ্ছে না সে।না জানি রৌদ্র কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে?একটা কষে চড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে ঝিরিঝিরি করে দেয় যদি?অথবা বাড়িতে গিয়ে সবাইকে যদি বলে দেয়?তখন?তখন আভা কি করবে?কোথায় যাবে সে?কার কাছে যাবে?কিন্তু এমন সুবর্ণসুযোগ সে আর কখনো পাবে কিনা কে জানে?রৌদ্রের সাথে এভাবে একা সময় পাবে কিনা সে জানেনা তাই এই সময়টাকে সে হাত ছাড়া করতে চায়না।

চলবে…

প্রিয় বালিকা পর্ব-৯+১০+১১+১২

0

#প্রিয়_বালিকা |৯|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভা বাকরুদ্ধ হয়ে এক দৃষ্টিতে খাতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আভার কোনো নড়চড় না দেখে ঢোক গিলল রৌদ্র।শক্ত কন্ঠে বলল,
– ওকে না নিলে সমস্যা নেই।আমি নিয়ে যাচ্ছি।

খাতাটা আভার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার আগেই আভা খাতাটি এক টানে কেঁড়ে নিলো।চমকে উঠলো রৌদ্র।পর পর কয়েকটা পলক ফেলে আবার ছোটো ঢোক গিলল সে।আভা খাতাটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে।ছাড়া ছাড়া বাংলা বর্ণে গণিতের খুঁটিনাটি সকলকিছু বিস্তারিতসহ লেখা। যুক্তবর্ণগুলো অনেকটাই অস্পষ্ট।যুক্ত বর্ণগুলো দেখে মৃদু হাসে আভা।আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে রৌদ্রও যুক্তবর্ণগুলোকে দেখে মুখ কালো করে বলল,
– এগুলো দেওয়া খুব কঠিন।তাও যেমন আছে তেমন আঁকানোর চেষ্টা করেছি।জানি খারাপ হয়েছে বাট আই থিংক তুমি বুঝতে পারবে।

আভা চোখ তুলে তাকালো ছেলেটির দিকে।তবে প্রতিবারের মতো দৃষ্টি স্থির রাখতে পারলো না।দৃষ্টি সরিয়ে মাটিতে নিবদ্ধ করলো।চিকন স্বরে বলল,
– বাঙালি না হয়েও তো ভালোই বাংলা লিখেছেন।আমার হাতের লেখা তো এর থেকেও খারাপ।জানেন মৃণাল কান্তি দ্য অশান্তি স্যার কি বলে?আমি নাকি পরীক্ষার হলে তেলাপোকার পায়ে কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিই।

কথাটি বলে মুখে হাত দিয়ে আলতো হাসলো আভা।রৌদ্র আভাকে জিজ্ঞেস করল,
– আচ্ছা ম্যাথমেটিক্সে তুমি এতো কম পেলে কেন?ম্যাথমেটিক্স কি বুঝতে পারো না?

শীতল বাতাস বয়ে গেল আভার হৃদয়ে।আফসোসের সুরে বলল,
– জানেন এভাবে কেউ কখনো জানতে চায়নি কেন আমি এতো কম পাই?কেন আমি মাধ্যমিকে ওঠার পর থেকে গণিতে পাশ করতে পারিনি?যেখানে অন্যান্য সকল সাবজেক্টে আমি লেটার মার্ক নিয়ে আসি সেখানে গণিতে কেন আমি এতো কম পাই?সকলে শুধু দেখে আমি কম পাই!আমি ফেল করি!কেন করি কেউ জানতে চায়না।

ভিতর থেকে একটা তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো আভার।রৌদ্র কিছু বলল না।ইচ্ছা করেই কোনো শব্দ খরচ করতে করলো না সে।মাঝে মাঝে শব্দ খরচ না করে নীরব দর্শক হয়ে থাকার মধ্যেও এক অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করে।আভা কিছুক্ষণ থেমে ভীত স্বরে বলল,
– আমি না বাসা থেকে সব অংক ঠিকঠাক মতো করে যাই।কিন্তু!

– কিন্তু?

– পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র দেখার পর আমার মাথা আর কাজ করে না।সবকিছু কেমন যে গুলিয়ে যায়।মনে হয় সবকিছু আমার অজানা।আর এই জন্য আমি যেগুলো পারি সেগুলোও ভুল করে আসি।আবার অংক করলেও মাঝ পথে সবকিছু গোলমাল হয়ে যায় আর শেষে উত্তর মেলে না।

হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে কথাগুলো বলল আভা।রৌদ্র সূক্ষ্মভাবে পরখ করল তার বাচনভঙ্গি।চাহনি তার স্থির এবং শান্ত।কোনো অনুভূতি নেই এ চহনিতে।পলকহীন চাহনি চক্ষুগোচর হলো না আভার।হবে কিভাবে সে তো এই চাহনির ভয়েই দৃষ্টি নত করে রেখেছে।কখনো এই চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করার সাধ্য বোধহয় তার হবে না।অথবা এই চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করতে তাকে আরেকবার জন্ম নিতে হবে!
রৌদ্র গম্ভীর ও বিচক্ষণ কন্ঠে বলল,
– বুঝলাম।তুমি এক কাজ করবে, তুমি মানুষের সাথে মিশবে বেশি করে।বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলবে।তুমি যত ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে মিশতে পারবে কথা বলবে ততই তুমি নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।এতে করে তোমার এই নার্ভাসনেসটাও কেঁটে যাবে।আর পড়ার সময় বেশি করে পানি খাবে।পানি খেলে ব্রেইনে অক্সিজেন সঞ্চলন ভালো হয়।যার ফলে ব্রেইন সবসময় সক্রিয় থাকে।ব্রেইন দ্রুত পড়াটা ক্যাচ করতে পারে।

আভা মুচকি হেসে বলল,
– ধন্যবাদ আপনাকে।

রৌদ্র এতক্ষণে আভার থেকে দৃষ্টি সরালো।মাথা নিচু করে ক্যাপ ঠিক করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
– ইটস্ ওকে।যাও স্কুলে দেরি হচ্ছে না?

সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে আভা রওনা হলো স্কুলের পথে।সেদিকে অকারণেই পলকহীন চেয়ে রইলো রৌদ্র।হয়তো তার মস্তিষ্ক এই মুহুর্তে তার নিয়ন্ত্রণে নেই।থাকলে হয়তো এভাবে নিজের ব্যক্তিত্বের বাহিরে বেরিয়ে পলকহীন এই বালিকার দিকে চেয়ে থাকতো না।ব্যক্তিত্ব? ব্যক্তিত্বের কথা ভাবতেই থমকে যায় রৌদ্র।কোনো এক অজ্ঞাত কারনেই এই দুহিতার সামনে সে তার নিজের কঠিন ব্যক্তিত্ব ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে।নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন এক ব্যক্তিত্বের মাঝে যার সাথে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত।

প্রসারিত ঠোঁটে হাতের খাতাটি উল্টেপাল্টে দেখছে আভা।হৃদয়ে তার শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে।তবে এই অনুভূতির সাথে সে পূর্বপরিচিত নয়।তাই অনুভূতিটি ঠিক সফলভাবে কাবু করতে পারছে না তাকে।তার পাশেই পূর্ণতা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।আভা একমনে খাতাটি দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।বিরক্ত বোধ করলো পূর্ণতা একটানে আভার সামনে থেকে খাতাটি টেনে নিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
– কি ব্যাপার বল তো তোর?

– কি আবার ব্যাপার হবে?

– অংকের ভয়ে অংক বইটাও কখনো খুলে বসে দেখিনি।এখন হঠাৎ এই অংকে ঠাঁসা খাতাটার দিকে তাকিয়ে তখন থেকে এমন চোরা হাসি দিচ্ছিস কেন বল তো?

মুখ কালো করে ফেলল।আভা নিজেকে স্বাভাবিক করে সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
– আরে কি বলিস না তুই খাতার দিকে তাকিয়ে চোরা হাসি দিবো কেন আমি?খাতা কি কোনো দেখার জিনিস হলো?নাকি ওটা আবার বর যে ওকে দেখে আমি লজ্জায় চোরা হাসি দিবো।

– আমার তো তেমন কিছুই মনে হচ্ছে।

পূর্ণতার কথায় আভা বড় একটা হা করে অবিশ্বাস্য সুরে বলে উঠলো,
– মানে তোর মনে হচ্ছে ওটা আমার বর?

– খাতাটা তোর বর না কিন্তু মনে হচ্ছে খাতাটা দিয়েছে তোর বর।

থমকে গেল আভা।পাথরের মুর্তির মতো স্থির হয়ে গেল সে।খাতার মালিক তার বর?এও কি আদৌ সম্ভব? কল্পনাতেও এ দুর্লভ!কোথায় হাই ক্লাস সোসাইটির বিদেশি রৌদ্র! কোথায় গাঁও গ্রামের আভা!কোথায় আগুন আর কোথায় জল!না না এ ভাবলেও তার মস্তিষ্ক কলংকিত হবে!
আভাকে ঘোরের মধ্যে চলে যেতে দেখে পূর্ণতা একটি ধাক্কা দিলো।বলল,
– কি হয়েছে?হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলি?

আভা মলিন মুখে হাসার চেষ্টা করে বলল,
– কি যে বলিস না তুই?তোর কথার আঁগা মাথা কিছু নেই।

আভা পূর্ণতার হাত থেকে খাতাটি টেনে নিয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।পূর্ণতা ভাবুক দৃষ্টিতে আভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠলো,
– আমি আবার আঁগা মাথা ছাড়া কথা বললাম?

—————

– এই যে ক্যাপ ওয়ালা শুনো…

হঠাৎ এমন সম্বোধনে ভ্রু কুঁচকে এলো রৌদ্রের।পিছন ফিরে দেখল তার সামনে অভয়ের ছোট চাচার জমজ দুইজন দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র আশেপাশে তাকিয়ে নিজের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো,
– আমাকে বলছো?

মেয়েটি কোমরে হাত দিয়ে বড়দের মতো ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
– এখানে তুমি ছাড়া মাথায় ক্যাপ কে পড়ে আছে?আমরা?

রৌদ্র চোখের মণি উঁচিয়ে নিজের ক্যাপটি এক নজর দেখে থতমত খেয়ে গলা খাঁকারি দিলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
– কি বলবে বলো।

মেয়েটি কোমর থেকে ডান হাত সরিয়ে রৌদ্রকে তর্জনির ইশারায় নিজের কাছে ডাকল।রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে রেখেই এক কদম দুই কদম করে এগিয়ে এলো তার সামনে।রৌদ্র লম্বা হওয়ায় মেয়েটিকে ঘাড় তুলে কথা বলতে হচ্ছে।মেয়েটি সেই কষ্ট লাঘব করতেই রৌদ্রকে চোখ গরম দেখিয়ে মাথা নিচু করতে বলল।রৌদ্র হাঁটু ভেঙে তার সামনে বসলো।মেয়েটি কোনো কিছু না ভেবেই রৌদ্রের গালে হাত রাখল।রৌদ্র ভড়কে গেল অবাকও হলো কিছুটা।মেয়েটি রৌদ্রের গালে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলল,
– তোমার গাল কত নরম।তোমার গালে চুল নেই কেন?তুমি কি কেটে ফেলেছ?

হাসলো রৌদ্র।মেয়েটির হাত নিজের হাতের ভিতর আবদ্ধ করে মিষ্টি হেসে আদুরে কন্ঠে বলল,
– নাম কি তোমার?

– মিন্নি।

রৌদ্র পাশে তাকিয়ে মিন্নির মতো দেখতে মেয়েটিকেও জিজ্ঞেস করল,
– তোমার নাম?

মেয়েটি একটু চুপচাপ স্বভাবের।বেশি কথা বলে না।এতক্ষণ সে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল।রৌদ্র নাম জিজ্ঞেস করায় গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
– তিন্নি।

রৌদ্র দুজকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করলো।দু’জনে মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে না পেয়ে আহত স্বরে বলল,
– তোমরা তো দেখতে একদম একই।তাহলে আমি বুঝবো কি করে কোনটা মিন্নি আর কোনটা তিন্নি?

মিন্নি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
– শোনো মনে রাখবে মিন্নি খুব চঞ্চল আর তিন্নি খুব শান্ত। তাহলেই তুমি আমাদের সহজেই চিন্তে পারবে বুঝেছ?

রৌদ্র উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।মিন্নি ভ্রু কুঁচকে রাগি ভঙ্গিতে বলল,
– তুমি তো বললে না তোমার মুখে চুল নেই কেন?

রৌদ্র ভ্রুযুগল উঁচিয়ে ঠোঁট মেলে মিষ্টি হাসি দিলো।আফসোসের সুরে টেনে বলল,
– দাড়ির স্বপ্ন তো আমারও আছে বোন।কিন্তু কি করবো আমি যেখানে থাকি সেখানের আবহাওয়ার কারণে আমার দাড়ি ওঠে না।তাছাড়া সেখানের খাদ্যভাস, আবহাওয়া,লাইফস্টাইলে সবকিছু আলাদা।যার জন্য আমার হরমোন সেভাবে ডেভেলপ হচ্ছে না।বুঝেছো?

– হরমোন কি?

রৌদ্র পড়লো বড় বিপাকে।এখন এই পাঁচ বছরের মেয়েটাকে সে কিভাবে বোঝাবে হরমোন কি?রৌদ্র সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো।আমতা আমতা করে বলল,
– হরমোন হলো দাড়ি ওঠার মেশিন।

– আচ্ছা।তাহলে আব্বুকে বলবো তোমাকে একটা হরমোন কিনে দিতে।তুমি কোথায় যাচ্ছো?

– আমি একটু হেঁটে আসি।

মিন্নি ঠোঁট বাঁকিয়ে তিন্নির হাত ধরে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।রৌদ্র সেদিকে চেয়ে মৃদু শব্দ করে হাসলো।বরাবরের মতোই ঠোঁটের দুইপাশে দেখা গেল ছোট্ট ছোট্ট দু’টো টোল।একদম ঠোঁট ঘেঁষে আছে তারা।পিছন থেকে সাইকেলের বেল বাজিয়ে যাচ্ছে কেউ।অনবরত সে শব্দ কানে আসতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার।পিছন ফিরতেই দেখতে পেল সাইকেলে বসা ছোট চুলের মেয়েটি।রৌদ্র সাইকেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– এটা ঠিক করে দিয়েছে অভয়?

আভা কড়া কন্ঠে জবাব দিলো,
– ঠিক না করে দিলে ওর একটা হাড্ডিও আস্তো থাকতো?

আভার কথায় ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেল রৌদ্রের।আজ কোণা চোখে সেই হাসি দেখার সাহস করলো আভা।তবে সেই চোরা দৃষ্টিও স্থির রাখতে পারলো না।গলা খাঁকারি দিয়ে নড়ে চড়ে বলল,
– আসুন আপনাকে গ্রাম দেখায়।

– এ কয়েকদিনে অনেকবারই গ্রাম চষে ফেলেছি।

– আজকে নাহয় আরেকবার দেখবেন।আপনার রিটার্ন গিফট এটা।চলে আসুন।

রৌদ্র চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
– সাইকেলে?

– হ্যাঁ আসুন।

কি মনে করে রৌদ্র আর না করতে পারলো না।এগিয়ে গেল আভার পিছনের ছিটে বসার জন্য।ঠাট্টা করে বলল,
– তোমার ভাইয়ের মতো আবার আমাকে পঁচা ডোবায় ফেলে দিও না।

– যদি দিইও তাহলে কি আপনি আমাকে মারবেন?

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |১০|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সাইকেল চালিয়ে বেশ অনেকটা পথ একসঙ্গে পাড়ি দিয়ে ফেলল আভা এবং রৌদ্র।গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সাইকেল।পিছনেই স্নিগ্ধ পুরুষটি মুগ্ধ নয়নে চারপাশ চোখ ঘুরিয়ে চলেছে।সজীব গাছপালায় ঘেরা “সুন্দরী” গ্রামের এক পাশ ঘেঁষে যে একটি ছোট্ট নদী বয়ে গিয়েছে তা সম্পর্কে অবগত ছিল না রৌদ্র।আভা নদীটির সামনে এসেই সাইকেল থামিয়ে দিলো।রৌদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
– নামুন।

রৌদ্র নেমে দাঁড়ালো। অবাক সুরে বলল,
– এখানে নদী আছে?

– হ্যাঁ “সুন্দরী” গ্রামের সৌন্দর্য্যের প্রাণকেন্দ্র এই “শ্যামা” নদী।

রৌদ্র নদীটি পূর্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে।নদীর ডান পাশে অনেকটা দূরে ইটের ভাঁটা।প্রথমে লম্বা চওড়া পাইপ থেকে সাদা কালো ধোঁয়া বের হতে দেখে রৌদ্র ধরতে পারল না সেখান থেকে ধোঁয়া কেন বের হচ্ছে।তাই সে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
– একি ওখানে কি আগুন লেগেছে?ধোঁয়া বের হচ্ছে কেন?ওয়েট ফায়ার সার্ভিসকে এক্ষুনি কল করছি।

রৌদ্র উদ্বিগ্নতার সহিত নিজের ফোন হাতে নিতেই ফিক করে হেসে ফেলল আভা।হাসতে হাসতে বলল,
– ওটা ইটের ভাঁটা।ওখানে ইট তৈরি করে তাই ধোঁয়া বের হচ্ছে।

রৌদ্র থেমে যায়।নিজের বোকামি বুঝতে পেরে মুখ কালো হয়ে যায় তার।আভা তার উপর হাসছে দেখে আরো বেশি অপমানিত বোধ করে সে।আভা চোখের পাতা এক করে জোরে শ্বাস টেনে বলল,
– সুন্দরী গ্রামে এসেছেন আর শ্যামা নদী দেখবেন না?

রৌদ্র মুগ্ধ হয়ে আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।নদীর কাণায় কাণায় জলের ছোঁয়া।বিশালাকৃতি নদীর উঁচু পাড়ের এক কোণায় বড় একটি বকুল গাছ।সে গাছটির দিকে এগিয়ে গেল আভা।বকুল গাছের নিচের মাটিটি বুকল ফুলের চাদরে ঢাকা।আভা সেখান থেকেই মুঠো ভর্তি ফুল নিয়ে এগিয়ে এলো রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দুই হাত ভর্তি ফুল নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা মেয়েটির দিকে।আভা ইশারায় রৌদ্রকে হাত মেলতে বলল।রৌদ্র বুঝলো সে চোখের ভাষা।দুই হাত এক করে মেলে ধরলো আভার সামনে।রৌদ্রের হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো আভা।হাতে কোনো রেখা নেই!সম্পূর্ণ হাত টক টকে লাল বর্ণে।আভা মনে মনে ভাবলো লোকটা কি আলতা মেখেছে হাতে?ভাবনা কাটিয়ে নিজের হাতের ফুলগুলো রৌদ্রের হাতে দিয়ে দিলো।আবার রৌদ্রের হাত থেকে দু’টো ফুল তুলে নাকের সামনে ধরে মুগ্ধ কন্ঠে বলল,
– আহ্ কি সুন্দর ঘ্রাণ!

রৌদ্র সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আভার ভাবভঙ্গি খেয়াল করল।আভাকে অনুসরণ করে নিজেও ফুলগুলো নাকের সামনে ধরল।সত্যিই এক অসম্ভব সুন্দর জাদুকরী ঘ্রাণ গ্রাস করে নিলো তার নাসারন্ধ্র। এতো সুন্দর সুবাস সে এর আগে কখনো শুঁকেছে কি না সন্দেহ।রৌদ্র পুলকিত স্বরে বলল,
– সত্যিই ঘ্রাণটা সুন্দর।কি ফুল এটা?

– বকুল ফুল।আমার খুব পছন্দ।

– আচ্ছা?

আভা চোখের ইশারায় সায় জানালো।সূর্যহীন আকাশ রক্তিম বর্ণে ছেয়ে গিয়েছে।আভা আকাশের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
– দেখুন আকাশটা কি সুন্দর লাগছে।

রৌদ্র আভার কথা মতো আকাশ পানে চায়লো।সত্যি আকাশটা দেখে মনে হচ্ছে সূর্য গলে গিয়ে সারা আকাশে রং ছড়িয়ে গিয়েছে।রৌদ্র নিজের ফোন বের করে আকাশের একটি ছবি ফ্রেম বন্দি করে নিলো।আরেকটা ছবি নিলো যেটাতে আভার পিছন পাশ আর আকাশটা দেখা গেল।দূর থেকে আযানের মধূর ধ্বনি শোনা গেল।সবাইকে আল্লাহর ইবাদত করতে আহ্বান করছে দ্বীন প্রচারে নিয়জিত ইমাম।মাগরিবের আযান পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে টনক নড়ে উঠলো আভার।মাথায় হাত দিকে ভয়ার্ত স্বরে বলল,
– হায় আল্লাহ আযান দিয়ে দিলো?এখন কি হবে?যেতে যেতে তো অন্ধকার হয়ে যাবে।

– আমার ফোনের চার্জও শেষ হয়ে আসছে।তাড়াতাড়ি চলো।সাইকেল কি আমি চালাবো?

– না না আমি পারবো।

– জোরে চালাতে পারবে তো?

আভা সাইকেলের স্ট্যান্ড উঠিয়ে সাইকেলে বসে পড়লো।রৌদ্র আগের বারের মতো পিছনে বসলো।পিছনে বসতে তার একটু কষ্ট হয় বটে।লম্বা মাটিতে বার বার ঘষা খায়।এতক্ষণ আভার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে হয়তো জোর খাঁটিয়ে তাকে পিছনে বসাতো।বা মাথা গরম করে দিতো কানের গোড়ায় দু’টো লাগিয়ে।কিন্তু কেন যে সে আজ ভিষণ শান্ত।কেন যেন আজ বারুদে আগুন লাগছে না!রৌদ্র হাতের ফুলগুলো তার দুই পকেটে পুরে ফেলল।সাইকেলে চালাতে শুরু করলো আভা।
– ওজন কত আপনার?

সহসা আভার এমন প্রশ্নে তৎক্ষণাৎ উত্তর করতে পারল না রৌদ্র।প্রশ্নটি মস্তিষ্কে ধরা দিতে বলল,
– ৭২।কেন?

– না মানে আপনাকে নিতে আমার সাইকেল চালাতে অনেক বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে।

– তুমি কি আমাকে মোটা বললে?

– কখন? না তো।একদম না।শুধু বলছি যে একটু কম কম খাওয়া দাওয়া করবেন।কিসে পড়েন আপনি?

– থার্ড সেমিস্টারের এক্সাম শেষ করে এসেছি।সামার ভ্যাকেশন চলছে।

– থার্ড সেমিস্টার মানে?

– ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কম্পিউটার সায়েন্স সেকেন্ড ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টার।আর তিনটা সেমিস্টার হলেই গ্রাজুয়েট এরপর পোস্ট গ্রাজুয়েট তারপর পিএইচডি।

– ভাইয়া তো পিএইচডি করবে না মনে হয়।দেশে ফিরে আসবো।

– হতে পারে।আমি ঠিক জানি না।

– আপনাদের ইউনিভার্সিটির নাম যেন কি?

– দ্য ইউনিভার্সিটি ওফ সিডনি।আমরা আঞ্চলিক ভাষায় বলি ভার্সিটাস সিডনিসিস।

কথা বলতে বলতে রৌদ্র আনমনেই আভার নরম কাঁধে হাত রাখলো।সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হললো আভার শরীরে।গলা শুঁকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল।হাত পাসহ সম্পূর্ণ শরীর অনবরত থর থর করে কাঁপছে তার।নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে সাইকেল চালালো।রৌদ্রের কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো।সে হঠাৎ আভার এমন অদ্ভুতভাবে সাইকেল চালানোর কারণ বুঝতে পারল না।আভার শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হলো।শরীরের তাপমাত্রা হু হু করে বেড়ে গেল।আচমকা সে সাইকেলের হ্যান্ডেল ছেড়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলসহ দু’জনেই মাটিতে পড়লো।রৌদ্রের চোখে বিস্ময় নেমে এলো।আভা আচমকা তাকে এভাবে ফেলে দিবে সে ভাবতেও পারিনি।সাইকেল কাঁত হয়ে পড়ার দুইজনই পায়ে এবং কনুইয়ে ব্যাথা পেল।আভার হাঁটুর চামড়া পিষে গেল।রৌদ্র তেমন গুরুতর ব্যাথা না পেলেও আভা বেশ ভালোই ব্যাথা পেল।হাঁটু ধরে মাটিতে বসে রইলো সে।রৌদ্র মাটি উঠে আভার কাছে এগিয়ে এলো।আতংকিত স্বরে বলে উঠলো,
– পা ভেঙেছে নাকি?

করুণ দৃষ্টি আভা মুখ তুলে রৌদ্রের পানে চায়লো।রৌদ্র ঠোঁট চেপে হাসছে।এই বিদ্রুপের হাসি আভার বুঝতে অসুবিধা হলোনা।রৌদ্রের হাতে থাকা ফোনটা অন করল।যেটা দিয়ে সে এতোক্ষণ আলো দিয়ে চলেছিল।কারণ আধার নেমেছে অনেক আগেই।রৌদ্র ক্যামেরা অন করে আভার একটা ছবি তুলে নিলো।এবারও আভার পারমিশন ছাড়া তার ছবি নিজের ফোনে সংরক্ষণ করলো রৌদ্র।ফোনের ফ্লাস লাইট জ্বালিয়ে আভার হাতে দিয়ে বলল,
– এটা তুমি ধরে পিছনে বসো আমি চালাচ্ছি।এমন সময় এসে তুমি আমাকে ফেলে দিবে আমি ভাবিইনি।

আভা অনেক চেষ্টার পর মাটি থেকে উঠতে সক্ষম হলো।রৌদ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেল।এতে আভার অবশ্য একটু সম্মানে আঘাত লাগলো।একটা মেয়ে পড়ে গেল।তাকে টেনে না তুলে ভ্যাবলার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার কি আছে সেটাই ঢুকলো না আভার ছোট মাথায়।আভা গোমড়া মুখে রৌদ্রের হাত থেকে ফোনটা টেনে নিলো।ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দহীন কি উচ্চারণ করলো বোঝা গেল না।রৌদ্র ঠোঁট একপাশে বাঁকিয়ে হেসে সাইকেলে উঠে পড়লো।কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করল তাড়া।বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল অভয় উদ্বেগ হয়ে কোথাও ছুটছে।রৌদ্রকে সাইকেল নিয়ে ঢুকতে দেখে উত্তেজিত স্বরে বলল,
– এই আভাকে দেখেছিস তুই?কত রাত হয়ে গেল আভার কোনো খবর নেই সেই আসরের আগে বেরিয়েছে।

আভা সাইকেল থেকে নেমে অভয়ের দৃষ্টির নাগালে দাঁড়াল।রৌদ্র ইশারায় বোঝালো,”এই যে তোমাদের আভা।” আভাকে দেখে রাগটা তির তির করে বেড়ে গেল অভয়ের।তেড়ে এসে বলল,
– পাখনা গজিয়েছে তোমার?এতো রাত অবধি কোথায় ছিলে?

আভা অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নত করে রইলো।রৌদ্র সাইকেল দাড় করিয়ে এগিয়ে এলো।অভয়কে আশ্বাস দিয়ে বলল,
– ভয় পাস না।আমি ছিলাম ওর সাথে।ও আমাকে নদী দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।বেলা পড়ে যাওয়ায় একটু দেরি হলো।

অভয়ের দৃষ্টি পরিবর্তন হলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দু’জনের দিকে।সন্দিহান কন্ঠে বলল,
– তোরা একসাথে ছিলি?

আভা অভয়ের এমন কথার কারণ বুঝতে না পারলেও রৌদ্র বুঝতে পারলো। অভয়ের দৃষ্টি ভঙ্গি দেখে ভিষণ আশ্চর্য হলো।অভয় কঠিন সুরে আভাকে বলল,
– আভা ঘরে যা।

আভা নত মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে একবার রৌদ্রের মুখ একবার অভয়ের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।হঠাৎ পরিবেশ এমন থমথমে হওয়ার কারণ তার ছোট মস্তিষ্ক ধরতে পারল না।রৌদ্র শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অভয়ের দিকে।আভাকে যেতে না দেখে অভয় এবার হুংকার ছাড়ল,
– ভিতরে যেতে বলেছি তোকে।

আভা কেঁপে উঠলো সে হুংকারে।শুঁকনো ঢোক গিলে ঘরে চলে গেল।ঘরে প্রবেশ করতেই বসার ঘরে সবাইকে দেখা গেল চিন্তিত ভঙ্গিতে।আভা ঘরে প্রবেশ করতেই বিভিন্ন প্রশ্ন জুড়ে দিলো তারা।সে এতক্ষণ কোথায় ছিলো?কেন এতো দেরি হলো?সবপ্রশ্নের উত্তর নিজের মনে মতো সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সে।অভয়ের হঠাৎ এমন গম্ভীর স্বরে তাকে ধমক দেওয়া কেন যপন হৃদয়ে পিড়া দিতে থাকলো তাকে।হঠাৎ এভাবে রেগেই বা গেল কেন সে?

রৌদ্র নিজের শিকারী চোখের শান্ত দৃষ্টি অভয়ে স্থির রেখেছে।আভা চলে যেতেই অভয় কয়েক কদম এগিয়ে এলো।রৌদ্রের কাধে হাত দিয়ে ভারি কন্ঠে বলল,
– দেখ রৌদ্র আভা এখনো অনেক ছোট।বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।আর না ধারণা আছে বাস্তবতা সম্পর্কে।তাই আমি চাইনা ওর মধ্যে এমন কোনো অনুভূতির জন্ম নিক যাতে ওর সুন্দর ভবিষ্যৎটা নষ্ট হয়ে যাক।তাছাড়া আমি আমাদের বন্ধুত্বটাও শেষ অবধি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

রৌদ্র এখন একই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বুকে হাত গুঁজে হিম কন্ঠে বলল,
– কি এমন দেখে নিলি তুই?যেটা দেখে তোর মনে হলো আভার সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে পারে।আমাদের বন্ধত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে।কি এমন দেখলি?আমাকেও একটু বল আমি তো এমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

অভয় দমে গেল।সত্যিই সে এমন কিছুই দেখেনি যাতে তার মনে এই কথাগুলো আসবে।তবু কেন যেন এতো রাত পর্যন্ত আভা আর রৌদ্রের একসাথে বাইরে নদীর পাড়ে থাকাটা খুব একটা ভালো লাগেনি তার।অভয় আমতা আমতা করে বলল,
– ম মানে তোরা এতোক্ষণ একা একা বাইরে।তাই মনে হলো কথাগুলো আমার বলা উচিত।তুই প্লিজ আমাকে ভুল বুঝিস না।

– শোন অভয় আভা ছোট হলেও আমি ছোট নই।আর তাছাড়া আজকে এমন কিছুই হয়নি যার জন্য তুই আমাকে এই কথাগুলো শোনাবি।আমার দিক থেকে এমন কিছুই যে ঘটবে না তা তোর বোঝা উচিত ছিল।বাট এলাস্!আমাকে নিয়ে তোর বিশ্বাস ভরসা আসলে কতটুকু তার ছোট্ট একটা হিন্টস পেলাম আমি।

রৌদ্র আর দাঁড়াল না।চলে গেল ভিতরে।অভয় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।আজ সে নিজের অজান্তেই নিজের বন্ধুকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।রৌদ্র কষ্ট পেলে কখনো প্রকাশ করে না।সবসময় নিজের মধ্যে অনুভূতি গুলোকে দুমড়েমুচড়ে পিষে ফেলে।যার জন্য বন্ধুমহলে তাকে ইমোশনলেসও বলা হয়ে থাকে।কিন্তু একমাত্র অভয়ই বুঝতে পারে।কখন রৌদ্রের মন খারাপ থাকে আর কখন মন ভালো থাকে।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |১১+১২|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সকালের নাস্তা শেষে বাড়ির বড়দের দেখা গেল বসার ঘরে নকশাকৃত সোফায়।শুধু সেখানে উপস্থিত নেই বাড়ির মেঝো ছেলে এবং তার বউ।তিন্নি মিন্নি বড় বসার ঘরে দৌড়াদৌড়ি করে কিসব খেলছে।আইরিন তাদের খাবার হাতে সোফার এক কোণে চুপটি করে বসে আছে।তিন্নি এবং মিন্নি দৌড়ে এক গলা খাবার নিয়ে আবার নিজেদের আবিষ্কৃত খেলায় মেতে উঠছে।আজ শুক্রবার।তাই সকলে বাড়িতে রয়েছেন।আরাভ মুন্সি গ্রামের পোস্ট অফিসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।ছোট ভাই আহান পুলিশ।অর্থ উপার্জনের দিক থেকে সবার থেকে এগিয়ে আছেন মুন্সি বাড়ির মেঝো ছেলে আহাদ মুন্সি।বিয়ের সময় শ্বশুরের দেওয়া উপহারের টাকা দিয়ে সে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেন।সেখান থেকে লাভবান হয়ে মুনাফার টাকায় তার ব্যবসার ক্ষুদ্র একটি অংশ তিনি শহরে স্থানান্তরিত করেন।সে থেকেই তাকে আর পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি।টাকার মুখ দেখে তার অংহকারের ঝুলি খোলেনি এমন নয়।
আহাদ মুন্সিকে দেখা গেল বসার ঘরে প্রবেশ করতে।পিছনে তার বউ রূপাও আছে।সে অনবরত আহাদ সাহেবকে কিছু বলার জন্য ইশারা করে যাচ্ছেন। আহাদ সাহেব সংকোচ নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন বড় ভাই আরাভ মুন্সির সামনে।দৃষ্টি নত রেখে কাচুমাচু মুখ করে নিচু স্বরে বললেন,
– ভাইয়া কাল আমরা চলে যাচ্ছি।

আরাভ সাহেব কথাটা যেন তেমন গায়ে মাখলেন না।তিনি তার মতো থেকে উত্তর দেয়,
– শুভকামনা রইল তোর জন্য।

– ভাইয়া একটা কথা বলার ছিল।

ভ্রু কুটি করে ফেললেন আরাভ মুন্সি।খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি ফেললেন।বসার ঘরের সকলের দৃষ্টিই এখন আহাদ মুন্সির দিকে।আরাভ মুন্সি বলে,
– হ্যাঁ বল কি বলবি?কোনো সমস্যা?

আহাদ মুন্সি কাচুমাচু ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
– আসলে ভাইয়া মানে বলছিলাম।এভাবে তো আর সব সময় একসাথে থাকা যায় না।আমার ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে তোমারও বড় হচ্ছে।ছোটোর দু’টো মেয়েও দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে।তাই বলছিলাম জায়গা জমি যা আছে সব ভাগ বাটওয়ারা করে যে যা পাবে তাকে তাই দিলে ভালো হয় না?

থমকে গেলন আরাভ সাহেব।এইদিনটার মুখোমুখি তাকে হতে হবে তা সম্পর্কে সে অবগত ছিলেন তবে এতো তাড়াতাড়ি? আরাভ সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেলে শূণ্য অনুভুতিতে বলে উঠলেন,
– দেখ আহাদ মা এখনো বেঁচে আছে।নিথর শরীরটায় এখনো শ্বাস প্রশ্বাস চলছে।মা পৃথিবীতে থাকতে এই কাজটা আমায় করতে বলিস না দয়া করে!

আরাভের কথা পছন্দ হলো না আহাদ এবং রূপার।আহাদ তবু নিজের অনুভূতি নিজের মাঝে চেপে রাখলেও চেপে রাখতে পারলো না রূপা।তেজি কিন্তু নিচু স্বরে বলে উঠলেন,
– এটা কেমন কথা বললেন ভাইয়া।এখন মা দেড় মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছে।আর কতদিন থাকবে আমরা কেউ জানিনা।আপনি তো জানেনই শহরে ব্যবসা নেওয়ার পর ওর কত লোকসান গুণতে হয়েছে।তাহলে আপনি এই কথাটা বললেন কিভাবে?

আহাদ নিজের বউকে ধমক দিয়ে নিচু স্বরে বললেন,
– আহ্ রূপা তোমাকে এখানে কথা বলতে কে বলেছে?আমি তো ভাইয়ার সাথে কথা বলছি।তুমি ঘরে যাও।

রূপ দমলো না বরং দ্বিগুণ ক্ষিপ্ত হয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,
– তুমি চুপ করো।এখন তোমার মায়ের জন্য কি আমরা পথে বসবো?

আহাদ চোখ গরম করে তাকালেন নিজের বউয়ের দিকে।তবে সে দৃষ্টিতে কাজ হলো না।রূপা মুখ ভেঙচি দিয়ে সে দৃষ্টি খুব সহজেই উপেক্ষা করে গেলেন।আরাভ সাহেব গুম হয়ে বসে আছেন।আহাদ আমতা আমতা করে বলে,
– ভাইয়া জানোই তো গতমাসে কত লস হয়েছে।তাই এখন আমার টাকা খুব জরুরি সূর্যের পড়াশোনার খরচ আবার সেহরিনের খরচ তাই বলছি কি যার যার ভাগ তাকে দিয়ে দাও আর মা যতদিন আছে ততদিন নাহয় আমরা ভাগ করে দেখবো।

আরাভ শান্ত স্বরে বললেন,
– জায়গা বিক্রি করবি?

করুন স্বরে জবাজব দিলেন আহাদ,
– ভাইয়া টাকাটা আমার এই মুহুর্তে খুব প্রয়োজন।

আরাভের ভিতর থেকে আরো একটি তপ্ত শ্বাস নির্গত হলো।তার সামনে ভেসে উঠলো সেদিনের চিত্র। যেদিন তার মা তার হাত ধরে করুণ স্বরে বলেছিলেন,”বাপ!আমি কারো ভাগের মা হতে চাই না।তাই আমি যতদিন বেঁচে আছি তোরা কেউ আমাকে ভাগে দেখার কথা ভাবিস না।না পারলে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিস তবু আমাকে ভাগের মা বানাস না।”
সেদিন মায়ে এমন করুণ স্বরে বলা কথার মর্মার্থ বুঝতে না পারলেও আজ সে ঠিকই বুঝতে পারছে তার মা কেন তার হাত জরিয়ে এ কথা বলেছিলেন।
মুহুর্তেই কঠিন শিলার মতো হয়ে গেলেন আরাভ সাহেব।চট করে উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,
– মা যতদিন এই পৃথিবীতে আছেন ততদিন তোদের অপেক্ষা করতেই হবে।আমার মা কোনোদিনও ভাগে মা হবে না।

আচমকা আহাদের রাগটাও যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলল।সেও চোয়াল শক্ত করে ভাইয়ের দিকে তর্জনি তুলে উচ্চস্বরে বললেন,
– এই সব তোমার বাহানা।আমি বুঝিনা ভেবেছ?সব একা ভোগ করবে বলে তোমার দিনের পর দিন যত বাহানা।

চমিকত হলেন আরাভ সাহেব।প্রেমা অসহায় স্বরে বললেন,
– এসব তুমি কি বলছো ভাই?তোমার ভাইকে তোমার এমন মনে হয়?লোকটা নিজের সব আয় উপার্জন নিজের কথা না ভেবে এই সংসারে দেয়।যাতে সকলে একটা ভালো জীবন কাটাতে পারে।নিজের জীবনে শত আফসোস থাকার পরও সে চায় তোমাদের কারো জীবনে কোনো আফসোস না থাকে।তাকে তুমি এ কথাটা কিভাবে বলতে পারলে ভাই?

আহাদ প্রেমার কথার উত্তর দিলো না।দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
– আমি আমার ভাগ চাই ব্যাস!আমাকে আমার ভাগ বুঝিয়ে দিতে হবে না হলে আমি কোর্টে যাবো।

বাড়িতে প্রবেশ করল অভয়।বাড়িতে প্রবেশ করতেই বসার ঘরে মেঝো চাচাকে নিজের বাবার উপর এভাবে চিল্লাতে দেখে দুম করে মাথা গরম হয়ে গেল তার।ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কি হয়েছে এখানে?

তবে তার কথারও কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।আরাভ সাহেব শান্ত দৃষ্টিতে আহাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
– নিজেকে সংযত কর।

আহাদ যেন আরো চটে গেলেন।রাগে ক্ষোভে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললেন,
– সংযত তুমি থাকতে দিচ্ছো না ভাইয়া তোমার সব জারিজুরি আমি ধরে ফেলেছি।কিন্তু কি বলো তো তোমার এসব জারিজুরিতে কোনো কাজ হবে না।আমার ভাগ তো আমি আদায় করেই ছাড়বো।তাতে আমাকে যদি তোমাকে জেলেও পাঠাতে হয় তাও করবো আমি।

ভাইয়ের মুখে এমন উক্তি শুনে কন্ঠ নালি শক্ত হয়ে গেল আরাভের।হতভম্ব হয়ে সে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।এ কি তার ভাই?সেই ছোট ভাইটা?যাকে সে নিজের পাত থেকে খাবার তুলে খাইয়েছে?নাহ্!এ তো সে নয়!চাচা কন্ঠে এমন কথা শুনে রক্ত গরম হয়ে গেল অভয়ের।সেও কিছুটা উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
– চাচা কিভাবে কথা বলছেন আপনি বাবার সাথে?ভুলে যাচ্ছেন সে আপনার বড় ভাই?

আরাভ কঠিন স্বরে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
– অভয় ঘরে যা।

– বাবা এটা কিভাবে কথা বলছে উনি তোমার সাথে?

– এখান থেকে যা অভয়।

রাগে ফোঁস ফোঁস করে সিঙ্গেল সোফায় একটি লাথি দিলো অভয়।সঙ্গে সঙ্গে সোফাটি উল্টে পড়লো। আবারও বেরিয়ে গেল সে।আরাভ লাল লাল চোখে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন,
– সম্পত্তি চাস না?তাহলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাটিতে মায়ের মৃত্যু কামনা কর।

উপস্থিত সকলে কেঁপে উঠলো আরাভের এমন কঠিন ভাষায়।বসার ঘর প্রস্থান করলেন আরাভ মুন্সি।জীবনে অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছে।তবে এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন তা বুঝতে পারেননি।এই শেষ বয়সে তাকে আর কোন কোন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতে হবে তা নিয়ে শঙ্কিত আরাভ মুন্সি।

—————
উদাস মনে পুকুর পাড়ে বসে আছে রৌদ্র।একা একাই বসে আছে।গতকাল রাত থেকে অভয়ের সাথে দেখা করেনি সে।আর না কথা বলেছে।কি এক অজানা বেদনা তার সর্বাঙ্গ বশ করে নিয়েছে।নিজেকে কোনো এক অন্ধকারের লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে তার।যেখানে তাকে কেউ দেখবেনা।ফোঁস করে একটি শ্বাস ফেলল রৌদ্র।ভোঁতা মুখে রৌদ্রের পাশে এসে দাঁড়াল অভয়।রৌদ্র মুখ তুলে একপলক দেখে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে পুকুরের পানিতে রাখল।অভয় করুণ দৃষ্টিতে কতক্ষণ চেয়ে রইলো।তারপর দপ করে রৌদ্রের পাশে বসে পড়ে সে।রৌদ্র দৃষ্টি পানিতে রেখেই বলল,
– কি হয়েছে তোর?

– ভালো লাগছে না আমার আর এই বাড়িতে।সামনের সপ্তাহের ফ্লাইটের টিকিট না কাটলে আজকেই এমার্জেন্সি ফ্লাইট ধরে চলে যেতাম।

– কেন কি হয়েছে?

– মেঝো চাচা বাড়িতে অশান্তি শুরু করেছে।

রৌদ্র আর কোনো কথা বলল না।পারিবারিক বিষয়ে তার কথা না বলাটাই ভালো।তাই সে চুপ থাকে।অভয় আহত স্বরে বলে,
– ভাব তো একটা মানুষের মৃত্যু কামনায় সবাই তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!মানুষ কতটা নিকৃষ্ট প্রাণী।

দীর্ঘ শ্বাস পড়লো রৌদ্রের।আসলেই মানুষ খুব নিষ্ঠুর।তাই সে অভয়ের এই উক্তির সাথে একদম একমত।রৌদ্র হাত ঘুরিয়ে অভয়ের কাঁধ চেপে ধরলো।শান্তনার সুরে বলল,
– থাক মন খারাপ করিস না।তোকে গোমড়া মুখে একদম ভালো লাগে না।হাস তো এবার! নাকি এখন তোকে হাসানোর জন্য তোর বড়কে ভাড়া করে আনতে হবে?

– উফ্ বউয়ের কথা বলে তো তুই কষ্টটা আরো বাড়িয়ে দিলি।কি জানি সে এখন কোথায়?

– মরছে মনে হয়!

অভয় এক ধাক্কায় রৌদ্রকে দূরে সরিয়ে দিলো।রৌদ্র ঠোঁট চেপে হাসে।রাগি দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে কটমট করে বলে,
– গোবর পরুক তোর মুখে।বউ মরুক তোর।আমার বউকে নিজে একটা বাজে কথা বলবি তোকে পুকুরের মধ্যে আটাশ বছর চুবিয়ে রাখবো।

– আহা!এই না হলে মহব্বত!

– চুপ আমার বউকে মরা বলিস?তোর ঘাড় মটকে তোর বউকে বিধবা করে দিবো।

– ছেহ্!মেয়ে মানুষের মতো ঝগড়া করছিস অভয়?থাম এবার।

কটমট চোখে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো অভয়।রৌদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে মিষ্টি হাসি দিলো।জাগ্রত হলো ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে থাকা দু’টি সূক্ষ্ণ ভাঁজ।অভয় আঁড়চোখে রৌদ্রকে দেখে হাঁসফাঁস করছে কিছু বলবে হয় তো।রৌদ্র এক ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে রইলো অভয়ের দিকে।অভয় গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– চল রৌদ্র তোকে ট্রিট দিবো।

চোখ কপালে উঠলে গেল রৌদ্রের।এ কথা কে বলছে?অভয়?রৌদ্র অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
– অভয় তুই বলছিস এই কথা?তুই?আজ পর্যন্ত এককাপ কফি খাওয়ালি না নিজের টাকা দিয়ে।সেই তুই আজকে ট্রিট দিতে চাইছিস?

– আরে চল না আমার সাথে।আর তোকে না সিডনি থাকতে কফি খাইয়েছি?মিথ্যা বললি কেন?

– ওটা তো কথার কথা বলেছি।

– হয়েছে এবার চল আমার সাথে।

অভয় রৌদ্রকে নিয়ে বাড়ি চলে এলো।দু’জনের গায়ে ক্রিম কালারের নকশা করা পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা।রৌদ্র পরতে না চায়লেও অভয়ের জোরাজুরিতে তাকে বাধ্য হয়েই এই পাঞ্জাবি পরতে হয়েছে।লম্বা মসৃণ চুলগুলো আজ কপাল জুড়ে নেই বরং উল্টিয়ে আঁচড়ানো।কপালের উপর চুলগুলো থাকায় রৌদ্রের বয়স অনেকাংশ কম লাগে।আজ রৌদ্রকে যেন পরিপূর্ণ যুবকের ন্যায় লাগছে।নিজেকে নিজে আয়নায় দেখে অবাক হলো রৌদ্র।সামন্য শীতল হাওয়াও বয়ে গেল হৃদয় জুড়ে।খারাপ লাগছে না দেখতে।বরং মনোমুগ্ধকর লাগছে তাকে দেখতে।পাশেই আরেক সুদর্শন যুবক অভয় দাঁড়িয়ে।উজ্জল শ্যামবর্ণের অভয়ের গায়েও রৌদ্রের মতো ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি।চুলগুলো একপাশে ফেলে রেখেছে। মুখমণ্ডলের নিখুঁত কাটই তার সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র।চাপা চোয়াল জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।রৌদ্র আয়না দিয়েই অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এগুলো পরালি কেন?

অভয়ের সোজাসাপটা জবাব,
– একসাথে জুম্মার নামাজ পড়তে যাবো।

– ট্রিট দিবি বললি যে..

– দিবো তো আগে জুম্মার নামাজ পড়বো তারপর ট্রিট।

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।অভয় রৌদ্রের কাঁধে হাত দিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
– শোন রৌদ্র আগে যা করেছিস করেছিস।এখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে দ্বীনের পথে আয়।আর কখনো এসব গার্লফ্রেন্ড টালফ্রেন্ড রেন্টে নিস না এগুলো পাপ।

কেন যেন অভয়ের কথাটা ভালো লাগলো রৌদ্রের।হৃদয় নরম হয়ে গেল তার।মুচকি হেসে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।অভয়ও হেসে আলিঙ্গন করলো প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে।ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই ঘরে প্রবেশ করল আভা।অভয়কে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল সে,
– ভাইয়া! ভাইয়া!

সামনে চোখ রাখতে থমকে গেল আভা।রৌদ্রকে পাঞ্জাবিতে দেখে চোখ বেরিয়ে এলো তার।ঠোঁট দু’টো ফাঁক হয়ে গেল।পলক থমকে গেল তার।নিশ্বাস থেমে গেল।আভাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থমকে যেতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল রৌদ্র।ব্যাক্তিত্ব সংকটে ভুগলো।গলা ঝেড়ে অভয়ের পিঠে আলতো আঘাত করে বলল,
– আমি বাইরে ওয়েট করছি।

অভয় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।আভার নাকে ভেসে এলো অসম্ভব সুন্দর সুগন্ধ।এটা তো সেই আতরের গন্ধ যেটা সে অভয়কে ঈদের সময় দিয়েছিল।বাবকেও একটা দিয়েছিল।অভয় এগিয়ে এসে আভার সামনে তুড়ি বাজালো।কেঁপে উঠলো আভা।অভয় ভ্রুকুটি করে বলল,
– এভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?মনে হচ্ছে কোনো ভয়ংকর ভুত দেখে ফেলেছিস!কি বলবি বল…

আভা ঘোর থেকে বেরিয়ে বলল,
– আম্মু অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে দেখছিল না তাই আমাকে বলল একবার তোমাকে দেখে আসতে।কিছু লাগবে কিনা তোমার বা তোমার বন্ধুর।

– না কিছু লাগবে না।আমরা এখন বাইরে যাচ্ছি।

– কোথায় যাচ্ছো?

– মসজিদে নামাজ পড়তে যাবি?

– আমি কেন মসজিদে যাবো?

– তাহলে ভাগ এখান থেকে।

দৌড়ে বেরিয়ে এলো আভা।ডান হাতটা তার বুক চেপে আছে।হৃৎপিণ্ডটা অস্বাভাবিক গতিতে পাঁজরের সাথে বারি খাচ্ছে। কখন না টুকরো টুকরো হয়ে যায়।শ্বাস আঁটকে আসছে।এমন হচ্ছে কেন বুঝতে পারল না আভা।নিশ্চয়ই তার বড় কোনো রোগে আক্রমণ করেছে।না হলো একজন সামান্য পুরুষ মানুষকে দেখে তার এমন মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে কেন?পরমুহূর্তেই তার মনে পড়লো সে সকাল থেকে কিছু খায়নি।যাক শান্তনার একটা জায়গা খুঁজে পেল।তাহলে অন্যকোনো গন্ডগোল নেই।আভা দৌড়ে গেল রসুইঘরে।ফ্রিজ থেকে শুঁকানো কিছু খাবার পটাপট মুখে দিয়ে দিলো।চোখগুলো এখনো তার বেরিয়ে আছে।মুখভর্তি খাবার নিয়ে রসুইঘর থেকে বের হতেই আবার মুখোমুখি হলো সেই ভয়ংকর সুর্দশন যুবকের।বড় বড় চোখ আরো বড় হয়ে গেল তার।তড়িঘড়ি দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল সে।রৌদ্র আভার যাওয়ার দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান স্বরে বলল,
– কি ব্যাপার? আমাকে কি দেখতে এতোই খারাপ লাগছে যে আমাকে দেখে ভুত দেখার মতো ভয় পেল মেয়েটা।স্ট্রেঞ্জ!

মসজিদে নামাজ শেষে সকলের সামনে একটি করে থালা দিয়ে গেল।রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে থালার দিকে।অভয় দাঁত বেরিয়ে হেসে রসিয়ে রসিয়ে বলল,
– ট্রিট আসছে।

চট করে রৌদ্র বিস্ময় কন্ঠে বলল,
– হোয়াট?

অভয় রৌদ্রের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
– আরে আজকে মসজিদে তেহারি দিবে।সেই জন্যই তো তোকে নিয়ে এলাম।

রৌদ্র বড় বড়সড় ধাক্কা খেল।কিছুটা আওয়াজ করেই বলল,
– হোয়াট?

– হোয়াট হোয়াট পরে করিস এখন তেহারি খা।আহ্ কি সুন্দর ঘ্রাণ।পাচ্ছিস?পাচ্ছিস? আমি তো নামাজে দাঁড়িয়েও পাচ্ছিলাম।

রৌদ্র রক্তিম চোখে তাকিয়ে রইলো অভয়ের দিকে।অভয়ের ভাবগতি পরিবর্তন হলো না।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিষয়টায় খুব মজা পাচ্ছে।রৌদ্র দাঁতে দাঁত পিষে ফিসফিসিয়ে বলল,
– ইউ ইডিয়ট।এটা তোর ট্রিট?

অভয় দাঁত বেরিয়ে হাসল।সে খুব মজা পাচ্ছে রৌদ্রের এমন চেহারায়।মুহূর্তেই নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলল,
– তো এর থেকে আর ভালো ট্রিট হয়?তাছাড়া সবকিছুর অভিজ্ঞতা থাকা উচিত।সব মুসল্লীদের সাথে বসে একসাথে বসে একবেলা আহার করলে কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না বুঝলি।

– এখানে ক্ষতি হওয়ার কথা বলছিনা আমি।তুই মিথ্যা কেন বললি আমাকে স্টুপিড।

– আরে মিথ্যা বলবো কেন? আমি খবর দিয়েছি মানে আমি ট্রিট দিয়েছি।এখন কথা কম বলে খা তো।

অভয় খেল পেট পুরে।কিন্তু রৌদ্র খেতে পারলো না।একে তো এতো মানুষ তার উপর হাত দিয়ে খাবার খাওয়া।তাই সে উঠে চলে এলো।মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল অভয়ের জন্য।

—————
ভোর পাঁচটা।কেউবা গভীর ঘুমে মগ্ন।কেউবা আল্লাহর ইবাদাতে।আবার কারো চোখে এখনো ঘুমই ধরা দেয়নি।
আভার চোখে ঘুম নেই।একের পর এক অংক করে যাচ্ছে সে।রাত জেগে অংক করাটা এখন তার নেশায় পরিনত হয়েছে।প্রতিদিন একবার করে রৌদ্রের লেখা অংক খাতা না খুললে তার ভালো লাগে না।এখন আর অংকের প্রতি তার অনিহা বোধ নেই।বরং বেশ উৎসাহ নিয়েই সে অংক করে।ভালো লাগে।আজও রাত জেগে অংক করে চলেছে সে।এবার হয়তো সে ফেল ঠেকাতে সক্ষম হবে।পাশেই পানির বোতল।অংক করতে করতে যখন ক্লান্তি অনুভব করে তখন গলা ভিজিয়ে নেয় সে।আবারো ফিরে পায় স্পৃহা।আজ যেন একটু বেশিই রাত হলো।কোনো এক অজানা কারণে হৃদয়ে ক্ষত হচ্ছে তার।কারণটা যে একদম অজানা তা নয়।সকাল হলেই রৌদ্র এবং অভয় সিডনির জন্য রওনা হবে।হয়তো এই কারণেই তার হৃদয়টা ভারি।কিন্তু তা মানতে নারাজ আভা।

সকাল সকাল সারাবাড়িতে হৈ-হুল্লোড় পড়ে যায়।বাড়ির ছেলে আবার বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে।সকলের মন ভার।অভয় এবং রৌদ্র তৈরি হয়েই নিচে নামে।অভয় নিজের দাদিকে এক পলক দেখে আসে।দাদির কপালে অধর ছোঁয়াতে ভোলে না সে।দাদির নিথর দেহের দিকে চেয়ে টুপ করে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।সবার অজান্তেই সে জল মুছে নেয় অভয়।এয়ারপোর্টে তাদের ছাড়তে যাচ্ছে আরাভ এবং আভা।আভা অনেকটা জোর করেই যাচ্ছে। সারারাত না ঘুমিয়ে চোখ লাল হয়ে আছে তার।রৌদ্রের মুখটাও কেমন ভার হয়ে আছে।মাথার ক্যাপটা দিয়ে নিজের লাল চোখগুলো ডাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।হয়তো সেও পাড় করেছে এক নির্ঘুম রাত্রি।

এয়ারপোর্টে গাড়ি থামতেই হৃৎপিণ্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় আভার।চোখ ভরে আসে বার বার।বুকটায় কেউ হাজার টনের পাথর বোঝায় হয়ে আছে।আসার পথে একটি কথাও বলেনি রৌদ্র।থম মেরে জানালার বাইরে দৃষ্টি স্থির রাখে সে।ভাড়া করা মাইক্রোবাসটা থেকে নেমে এলো সবাই।আরাভ সাহেব উত্তেজিত স্বরে বললেন,
– আব্বু তুই একটু দাঁড়া আমি কিছু কিনে নিয়ে আসি।সকালে তো কিছুই খেলিনা।

রৌদ্র এতক্ষণে মুখ খুলল,
– আঙ্কেল দরকার নেই ফ্লাইটে খাবার দিবে।

– আরে আব্বু তা তো দিবে এখান থেকেও কিছু দিয়ে যাও।আমার দিতে মন চাইছে তোমরা দিবেনা আব্বু?

– আব আচ্ছা আঙ্কেল।

আরাভ চলে গেলেন ছেলেদের জন্য কিছু কিনে আনতে।অভয় রৌদ্রকে বলল,
– তুই সুটকেসগুলো দেখে রাখ আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।

– আচ্ছা।

সবার পিছনে মাথা গুঁজে দাড়িয়ে ছিল আভা।সকলে চলে যেতেই রৌদ্রের চোখে পড়লো সে।ফোঁস করে একটি শ্বাস ছাড়লো সে।কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল।রৌদ্রের অনুভূতিগুলো গলায় দলা বেঁধে রয়েছে।সে কিছু বলতে গিয়েও বার বার থমকে যাচ্ছে।তবু জোরে একটি শ্বাস টেনে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আভার দিকে।আভা মাথা নত করেই বুঝতে পারলো রৌদ্র তার দিকে এগিয়ে আসছে।রৌদ্রের পা দু’টো তার দিকে এগিয়ে আসতেই শ্বাস থমকে গেল তার।থর থর করে কাঁপতে লাগল সে।রৌদ্র ঠিক আভার সামনে দাঁড়াল। তার শিকারী দৃষ্টি আভায় নিবন্ধ।শীতল কন্ঠে আভার নাম উচ্চারণ করল,
– আভা!

আভা কন্ঠনালি পাথর হয়ে আছে।তাই সে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল।রৌদ্র আলতো হাসে।একই স্বরে বলে,
– সুন্দরী গ্রামে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত আমার স্মৃতির পাতায় আজীবন তাজা হয়ে থাকবে।অভয়ের পর তোমার সাথেই আমি এতো বেশি ইজি হতে পেরেছি।আমার বন্ধুর তালিকায় অজান্তেই কখন তোমার নাম উঠে গেল বুঝতেই পারিনি।অনেক ধন্যবাদ তোমাকে আমার জীবনে সুন্দর সুন্দর কিছু মুহুর্ত উপহার দেওয়ার জন্য।সুন্দরী গ্রামে একজন বালিকাবন্ধু রেখে গেলাম।

থামলো রৌদ্র।চোখ ভরে উঠলো আভার।শরীর তাপমাত্রা তির তির করে বেড়ে চলেছে।রৌদ্রের কন্ঠস্বর আরো কোমল হলো।সে আবারও শান্ত স্বরে বলল,
– ভালো করে পড়াশোনা করবে।আর যেন ফেল করে না।লেটার মার্ক নিয়ে এসো।

বোবা কান্না করলো আভা।রৌদ্রের শীতল কন্ঠের প্রতিটি শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠলো আভা।রৌদ্র নিজের মাথার ক্যাপটি খুলে আভাকে পরিয়ে দিলো।কালো ক্যাপ মাথায় আভাকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে সে।শুঁকানো ঢোক গিলে ফ্যাকাশে কন্ঠে বলে,
– আমার তরফ থেকে একটা ছোট গিফট।আমি তো জানতাম না অভয়ের একটা বোন আছে।জানলে হয়তো আসার সময় কোনো উপহার সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম।
আপাতত আমার কাছে দেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই।আর কখনো দেখা হবে কিনা জানিনা।তাই আমার তরফ থেকে এটা তোমার জন্য।

রৌদ্র নিষ্পলক চেয়ে আছে তার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা পনেরো বছরের বালিকার দিকে।দৃষ্টি স্থির রেখেই সে হিম কন্ঠে বলল,
– তোমাকে অনেক মনে পড়বে আমার “প্রিয় বালিকা”।তবু ধরনীর মঙ্গলে আমাদের আর দেখা না হোক!

চলবে…

প্রিয় বালিকা পর্ব-৬+৭+৮

0

#প্রিয়_বালিকা |৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পুকুর পাড়ে বঁড়শি ফেলে বসে আছে অভয়।পাশেই রৌদ্র উদাসীন মুখে এক দৃষ্টিতে পুকুরের পানির দিকে চেয়ে আছে।রৌদ্রের চোখে বার বার আভার সেই ভেজা চোখের ভেজা পাপড়িগুলো ভেসে উঠছে।আর ভেসে উঠছে আভার তার দিকে নিক্ষেপ করা ঘৃণা মিশ্রিত চাহনি।অভয় পাশ তাকিয়ে রৌদ্রকে একপলক দেখল।চোখ ফিরিয়ে পুকুরে দৃষ্টি রেখে বলল,
– তোর সেই রেন্টেড গার্লফ্রেন্ডকে মিস করছিস বুঝি?

সহসা এমন প্রশ্নে ঘোর কেটে গেল রৌদ্রের।অভয়ের দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– হুম?

অভয় খুব স্বাভাবিকভাবেই রৌদ্রকে একই প্রশ্ন করল,
– তোর রেন্টেড গার্লফ্রেন্ডকে মিস করছিস বুঝি?

ক্ষেপে গেল রৌদ্র।রাগি স্বরে বলল,
– একদম বাজে কথা বলবি না।আর তোর কি আমাকে নিজের মতো মনে হয়?যে সবসময় এসব মেয়ে মানুষ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবো?

অভয় রৌদ্রের দিকে দৃষ্টি ফেলল।অবাক সুরে বলল,
– মানেহ্?আমি সব সময় মেয়ে মানুষ নিয়ে চিন্তা করি?

– তা নয় তো কি?মেয়ে মানুষ নিয়ে না ভাবলে আমাকে মেয়ে মানুষ এর কথা জিজ্ঞেস করলি কেন?

অভয় নাক কুঁচকে বলল,
– রৌদ্র তুই দেখি দিন দিন মেয়ে মানুষের মতো খিট খিট করে ঝগড়া করা শিখছিস।

রৌদ্র তেড়ে এলো অভয়ের দিকে।ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
– তোকে বলেছিনা আমার সামনে মেয়েদের বিষয়ে কোনো কথা বলবি না।মেয়ে মানুষে আমার এলার্জি আছে।মেয়ে মানুষ মানেই হলো ত..তপো..তপোভঙ্গকারিণী।আর একটা আজেবাজে কথা বললে তোকে এই পুকুরে ফেলে দিবো।

অভয় চোখ কপালে তুলে অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
– আরেহ্ ব্যস!তোকে এতো কঠিন বাংলা কে শেখাল?বাংলাদেশে এসে তো দেখছি তোর বাংলার খুব ভালো উন্নতি হয়েছে।সামার ভ্যাকেশন শেষ হওয়ার আগে তোকে কয়েকটা বাংলা গালি শিখিয়ে দিবো।

– গালি মিনস স্ল্যাং?

– হ্যাঁ স্ল্যাং।যেমন ধর বেয়াদ’ব,শা’লা,বা’ল ইটিসি।গালি দিলে রাগের বহিঃপ্রকাশটা নিখুঁত হয় বুঝলি?

কথাটা শেষ করে রৌদ্রের কাঁধে চাপড় দিলো অভয়।রৌদ্র কপাল কুঁচকে বলল,
– এগুলোর মিনিং কি?

– মিনিং জেনে কি করবি?শত্রুরা কি তোর কাছে ওয়ার্ড মিনি শুনতে চায়বে নাকি ভোকাবুলারি টেস্ট নিবে?

রৌদ্র উঠে দাঁড়ালো।নিজের হাত থাপ্পড় দিতে দিতে বলল,
– এখানে অনেক মশা।আর বসতে পারছি না চল বাড়িতে।

অভয় রৌদ্রের প্রস্তাব নাকচ করে বলল,
– আরে না এখন একটা পুঁটিমাছও পেলাম না এতো তাড়াতাড়ি যাবো না।

রৌদ্র বিরক্ততে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল।পুকুরের দিকে এক ঝলক চেয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
– তোর মনে হয় এখানে মাছ আছে?জীবনভর বসে থাকলেও মাছ উঠে না।কিন্তু ম্যালেরিয়ায় তোর মৃত্যু ঠিকই হয়ে যাবে।তাই টাইম ওয়েস্ট না করে ভিতরে চল।

অভয় তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে রৌদ্রের উদ্দেশ্য বলল,
– রৌদ্র তুই ভিতরে যা আমি আসছি কিছুক্ষণের ভিতর।

রৌদ্র আর কথা বাড়ালো না।ধীর পায়ে বিড় বিড় করতে করতে বাগান থেকে বেরিয়ে এলো।”দুইদিন হয়ে গেল মেয়েটাকে একবারের জন্য চোখেও পড়ল না।গেল কোথায়?খাওয়ার সময়ও দেখলাম না!” বিড় বিড় করতে করতে বাগান থেকে বের হতেই আভাকে বাড়ি প্রধান গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখা গেল।রৌদ চোখ বড় বড় করে আনমনেই বলল,”এই তো!”
দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো আভার দিকে।আভা পাড়ার মুদি দোকানে গিয়েছিল মায়ে আদেশে।প্রেমা ছেলেকে না পেয়ে আভাকে সামনে দেখে আভাকে পাঠায় মুদি দোকানে পাঁচ ফোঁড়ন আনতে।সেটা নিয়েই বাড়ি ফিরছিল আভা।হঠাৎই রৌদ্রের মুখোমুখি হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।দুইদিন সে রৌদ্রের থেকে গা বাঁচিয়ে চলেছে।এই লেকটার চেহারাটাও সে দেখতে চায় না।এই লোকটার জন্য তাকে তার ভাই ভ্যানওয়ালার সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছে।আভা কপাল কুঁচকে রৌদ্রকে এড়িয়ে ভিতরে ঢুকতে গেল।কিন্তু রৌদ্র দ্রুতগতিতে এসে আবারও আভার পথ আঁটকালো।বিরক্ত হলো আভা।চোখ তুলে রৌদ্রের মুখের দিকে চায়লো।তবে দৃষ্টি স্থীর করতে পারল না।রৌদ্রের শিকারী চাহনিতে তার আত্মা কেঁপে ওঠে।তাই ঐ চোখে দৃষ্টি ফেলার সাহস নেই তার।মাথা নিচু করে ফেলল আভা।রৌদ হাসফাস করতে লাগল কিছু বলার উদ্দেশ্য।বার বার উচ্চারণ করল,
– স..স..সর..স!

কিন্তু কিছুতেই পুরো কথাটা বলতে পারল না সে।নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলো মনে মনে বলল,”ছোট্ট একটা সরিও বলতে পারিস না আফসিন রৌদ্র।তোর জীবনে কিছু হবে না।ধুর বাবা!বিরক্ত লাগছে।”

আভা বিরক্তির চোখে তাকাল রৌদ্রের দিকে।রাগে কটমট করে বলল,
– কি সমস্যা আপনার?আমার পিছনেই কেন হাত ধুয়ে পড়েছেন আপনি?আমার সাথে আপনার কিসের শত্রুতা?ভাইয়াকে দিয়ে তো এতোগুলো কথা শোনালেন এখন কি ভ্যানওয়ালার সাথে আমার বিয়েটাও দেখতে চান?আপনি এসেছেন এক সপ্তাহও হয়নি এই এক সপ্তাহে আমি ঠিক করে দু’টো ভাতও খেতে পারিনি আপনি আমার পিছনে এমনভাবে পড়েছেন।আমার সাথে আপনার কিসের এতো শত্রুতা?আমাকে বাড়ি ছাড়া করতে চান এখন?কি চান আপনি আমার থেকে?বলুন কি চান?

চিৎকার করে কথাগুলো বলল আভা।আভার কথা বলার ধরণ একদম পছন্দ হলো না রৌদ্রের।মাথাটা চট করেই গরম হয়ে গেল।চোখের ভিতর থাকা চিকন সূক্ষ্ম শিরাগুলো রক্তবর্ণ ধারণ করলো।কেনোকিছু না ভেবেই আভার গাল চেপে ধরল সে।রাগে কিড়মিড়িয়ে বলল,
– আই ওয়ার্নিং ইউ ফর দ্য ফার্স্ট টাইম এন্ড অলসো লাস্ট টাইম ডোন্ট টক টু মি লাইক দ্যাট।নেক্সট টাইম আই’ল নট টলারেট দিস টোন ওফ ইউর ওয়ার্ডস।ডু ইউ গেট ইট?

আভা টলমল চোখে চেয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।সহসা তার মনে রৌদ্রের জন্য জন্মানো ঘৃণা দৃঢ় হলো।আভার ভেজা চোখের দিকে চেয়ে ঘোর কেটে গেল রৌদ্রের।ছেড়ে দিল আভার গাল।ডান চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে চোখের নিচের তিল ছুঁয়ে গেল।রৌদ্রের দৃষ্টি সেই তিল ছুঁতেই থমকে গেল সে।ধীরে ধীরে দৃষ্টি কোমল হয়ে এলো।আনমনেই উচ্চারণ করল,
– সরি!

আভাও বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেলল।আচমকা রৌদ্র তাকে সটি বলবে তা সে ভাবতে পারিনি।তাই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে।নাক টেনে মাথা নত করে ফেলল।চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই রৌদ্র বলল,
– আমি তোমাকে ম্যাথমেটিক্সে সাহায্য করতে পারি।

পা থেমে গেল আভার।তবে সে পিছন ফিরল না।কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুক্ষণ যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে নাক টানতে টানতে মুখ ফুলিয়ে বলল,
– কিভাবে?আপনি কি এখানের ম্যাথ পারেন নাকি?

রৌদ্র মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– কজ,থিটা,সাইন সব দেশেই সেম।আর অন্যান্য ম্যাথ আমি ইংলিশে করেছি আর তুমি বাংলায় করো।এটাই পার্থক্য।বাংলা বুঝতে আমার একটু প্রবেলম হবে বাট ব্যাপার না আমি ট্রান্সলেট করে নিবো।

আভা কোনো উত্তর দিলো না।আভার উত্তর না পেয়ে রৌদ্র সামান্য অপমানিত বোধ করল।তবে পরমুহূর্তেই মনে একটা প্রশান্তি বয়ে গেল।ফাইনালি সে সরি বলতে সক্ষম হয়েছে।ভাবতেই মুখে ফুটে উঠলো কোমল হাসি।যে হাসির দরুণ ঠোঁটের দুইপাশে সৃষ্টি হলো অদ্ভুত সুন্দর দু’টি সূক্ষ্ণ ভাঁজ।যা সচারাচর সবার দেখার সৌভাগ্য হয় না!

রাতে ঘুমের ঘোরে ফুসুরফাসুর শব্দে ঘুম ছুটে এলো অভয়ের।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো সে।এতো রাতে কানের কাছে কারা এমন ফুসুরফাসুর করছে ভেবে দাঁত কিড়মিড় করল সে।ঘুম কেঁটে যেতেই চোখ খুলল।পাশ ফিরে কাউকে দেখতে পেল না।পূর্ণ দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখতেই বুঝতে পারল সে তার রুমে নেই।পরক্ষণেই মনে পড়ল রৌদ্রের জনয় বরাদ্দকৃত ঘরে রৌদ্রের সাথে অনলাইন গেইম খেলতে খেলতে সে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে।পাশে তাকিয়ে রৌদ্রকে না দেখে ভ্রুকুটি করল সে।এতো রাতে রৌদ্র কোথায় গেল?উঠে বসতেই দেখতে পেল তার ডান পাশেই কেউ চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে।অভয়ের কপালে আরো একটি অতিরিক্ত ভাঁজে সৃষ্টি হলো।কিছুক্ষণ খেয়াল করতেই বুঝতে পারল চাদরের ভিতরে আলো জ্বলছে এবং ফুসুরফাসুর শব্দটাও ওখান থেকে আসছে।অভয় চোখ ফেড়ে তাকিয়ে রইলো চাদর মুড়ি দেওয়া ব্যক্তির দিকে।বিড়বিড়িয়ে বলল,”রৌদ্র এখনও ঘুমায়নি?এতো রাতে চাদর মুড়ি দিকে কি দেখছে ও?ভুলভাল কিছু না তো?ছিঃ!ছিঃ!” নাক মুখ কুঁচকে ফেলল অভয়।নিচের ঠোঁট কামড়ে জাপ্টে ধরল চাদর মুড়ি দেওয়া ব্যক্তিকে।বলল,
– এই তো আজকে হাতে নাতে ধরেছি।ছিঃ!ছিঃ! রৌদ্র তুই এসব দেখিস আমি ভাবতেও পারিনি।গজব পড়ুক তোর উপর।

চাদরের ভিতর থেকে শোনা গেল রৌদ্রের রাগি কন্ঠস্বর,
– এই কি করছিস ছাড়।অভয় ছাড় আমাকে।কি বলছিস এসব হাবিজাবি?

অভয়ের প্রতিহত স্বরে বলল,
– না না আজকে তোকে হাতে নাতে ধরেছি এতো সহজে ছেড়ে দিবো না।ছিঃ!ছিঃ! গার্লফ্রেন্ড চলে গিয়েছে বলে তুই এসব দেখবি?ইউ ডার্টি মাইন্ড আজকে তোকে ছাড়ছি না।

রৌদ্র এবার কিছুটা জোরে ধমক দিয়ে বলল,
– অভয়!স্টপ টকিং লাইক বুল’শিট এন্ড লিভ মি রাইট নাও!

দমে গেল অভয়। রৌদ্রকে ছেড়ে দিতেই নিজের উপর থেকে চাদর সরিয়ে ফেলল রৌদ্র।তাকে দেখা গেল একটি খাতা আর কলম হাতে।অন্য হাতে ফোন।ফোনটা অভয়ের দিকে এগিয়ে দিলো।স্ক্রিনে অভয় নবম দশম শ্রেণির গণিত বিষয়ের কিছু ভিডিও দেখতে পেল।ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে।রৌদ্র একটি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
– হেডফোনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |৮|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

– ভাইয়া তুমি এই অবস্থায় একদম ঘরে ঢুকবে না।সারাঘর নোংরা হবে।

আভার নাক মুখ কুঁচকে বলা কথায় ভ্রুকুটি করল অভয়।সামান্য রাগও হলো তার।নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে শক্ত কন্ঠে বলল,
– তাহলে কি এখন আজীবন আমাকে এইখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নাকি?

অভয়ের বেচারি অবস্থা দেখে এমনিতেই রৌদ্রের হাসি থামছে না।তারপর অভয়ের এমন কথা যেন তার হাসি আরো বাড়িয়ে দিলো।সে ফিক করে হেসে ফেলল।অভয় কটমট চোখে রৌদ্রের দিকে তাকাতেই ঠোঁটে আঙুল দিলো সে।গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে বলল,
– শোন আমি বলছি যে তুই পুকুর থেকে একটা ডুব দিয়ে আয়।হ্যাঁ এটাই বেস্ট হবে।বুঝেছিস?

অভয় শুঁকুন দৃষ্টি ফেলল রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র ভয় পাওয়ার ভান করে বলল,
– আমি তো তোর ভালোর জন্য বললাম।এতে ঘরও অপরিষ্কার হবে না আবার তুইও পরিষ্কার হয়ে যাবি।ঐ একটা প্রবাদ আছে না কি কি যে এ এক ঢিলে!হোয়াট এভার ঐটা হবে।

আভা নিচু স্বরে রৌদ্রকে সংশোধন করে দিয়ে বলল,
– এক ঢিলে দুই পাখি।

তৎক্ষনাৎ আভার কথায় জোর সম্মতি জানালো রৌদ্র,
– হ্যাঁ হ্যাঁ ঐটাই।

আভাও রৌদ্রের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল,
– হ্যা ভাইয়া তুমি এটাই করো।ভালো বুদ্ধিই দিয়েছেন উনি।

অভয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল।আর কোনো উপায় না পেয়ে সে রৌদ্রের কথা মতো পুকুরে চলে গেল।এই বিকেলে পুকুরে গোসল!বিষয়টা একদমই মনে ধরলো না অভয়ের।ঠান্ডা লেগে যাওয়ার শঙ্কা আছে।তবু কি আর করার!এ ছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই।
পুকুরে পর পর দু’টো ডুব দিলো অভয়।পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আভা এবং রৌদ্র।আভা নিজের ভাইয়ের জন্য গামছা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে।আভা চারপাশটা ভালোভাবে চোখ বুলালো।এদিকটা তেমন আসা হয় না।হঠাৎ জোড়া বটগাছটা দিকে চোখ যেতেই ভাইয়ের কাছে একটি আবদার করে বসলো সে,
– ভাইয়া আমাকে এই গাছে একটা দোলনা বেঁধে দিবে?

আভার আদুরে কন্ঠের আবদার শুনে চোখের মণি ঘুরিয়ে আভার দিকে চায়লো রৌদ্র।কি সুন্দর সে চাহনি!পরমুহূর্তেই মুখ তুলে তাকালো।অভয় পুকুর থেকে উঠতে উঠতে মশকরা করে বলল,
– বুড়ি বয়সে এখন দোনলা ঝুলার শখ হয়েছে?হ্যাঁ আমি বেঁধে দিই তারপর পড়ে গিয়ে ট্যাং ভেঙে আমাকে বাবার বকা খাওয়াও।

আভা ঠোঁট উল্টিয়ে কিছুটা আহ্লাদী স্বরেই বলল,
– না ভাইয়া একটা দোলনা বেঁধে দাও না।

অভয় বোনকে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
– এহ্!এখন তোর দোলনা ঝুলার বয়স আছে?সামনে না এসএসসি পরীক্ষা যা গিয়ে পড়তে বস।পড়ালেখায় তো ডাব্বা।গণিত পাও তিন লজ্জা করে না এখন এই কথা বলতে?

মুখটা চুপসে গেল আভার।রৌদ্রের সামনে তার ভাই এমনভাবে বলায় কিছুটা অপমানিত বোধ করলো।রৌদ্রের শিকারী দৃষ্টি আভাতে স্থির।মুখে এই মুহুর্তে উল্লেখযোগ্য কোনো ভঙ্গি দেখা গেল না।তবে কিছুটা অনুভূতিশূন্য দেখাল।

সন্ধ্যার পর রৌদ্র তার ঘরে বসে।খাতায় গণিত তুলছে।হাতের লেখা এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।প্রথম প্রথম লিখতে গিয়ে তো তার হাত ভেঙে খুলে পড়ার যোগার হয়েছিল।এখন তাও হাত চালু হয়েছে।গতিও কিছুটা বেড়েছে।রৌদ্র খুব যত্নের সাথে গণিতগুলো খাতায় তুলছে।পাশে বিস্তারিত লিখছে কিভাবে কি হয়েছে।কোন সমীকরণ কিভাবে মিলেছে।সে বর্তমানে দিনের বেলাতে অভয়ের সাথে বাড়ির বাইরে থাকে। আর রাত হলে নিজের ঘরে এসে ঢোকে আর বের হয় না।এর একটাই কারণ সেহরিন থেকে লুকিয়ে চলা।একবার মুখোমুখি হয়ে গেল তো রৌদ্র নিজের রাগের নিয়ন্ত্রণ হারালো।এমনভাবেই কেঁটেছে এ কয়েক দিন।সেহরিন দুইদিন যাবৎ রৌদ্রের নাগাল না পেয়ে নিজেই রৌদ্রের ঘরে এলো।কোনো সাড়াশব্দ না করেই ঘরে প্রবেশ করলো সে।পা টিপে টিপে রৌদ্রের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।কিছুক্ষণ তার লেখা খাতার দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
– ভাউউউ…!

হঠাৎ চিৎকার করায় নড়ে উঠলো রৌদ্র।তবে ভয় পেল না।বরং খাতার দিকে তাকিয়ে তার রাগটা তির তির করে মাথায় চড়ে বসলো।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শকুনি দৃষ্টিতে তাকালো সেহরিনের দিকে।রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– ইউ বাস্টার্ড!কি করলে এটা?

সেহরিন গোল গোল চোখে খাতার দিকে তাকিয়ে দেখল খাতায় কলমের বড় লম্বা একটি দাগ পড়ে গিয়েছে।তবে তাতে আফসোস হলো না সেহরিনের।সে প্রসঙ্গ পাল্টে আহ্লাদী স্বরে বলল,
– তুমি ইদানীং কোথায় থাকো বলো তো?তোমার কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না!তোমাকে কত মিস করি জানো?

রৌদ্র চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।বিরক্ততে নাক মুখ কুঁচকে ফেলল।শক্ত কন্ঠে বলল,
– আমি কোথায় থাকি না থাকি সে কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিবো নাকি?আর আমি তোর কত বড় আমাকে আপনি আপনি করে বলবে।

সেহরিন নাক সিটিয়ে বলল,
– নো নো এটা অনেক ওল্ড।আমি তোমাকে তুমি করেই বলবো।তোমার জন্য একটা দুঃখের খবর আছে জানো!

ভ্রুকুটি করে ফেলল রৌদ্র।জিজ্ঞেস করল,
– কি?

– আমরা আগামী সপ্তাহে শহরে চলে যাচ্ছি।আমি জানি আমাকে তুমি অনেক মিস করবে।বিশ্বাস করো আমিও তোমাকে অনেক মিস করবো।কিন্তু কিছু করার নেই কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড়তে হয়।তেমন আমি তোমাকে ছাড়ছি।কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার!

কথাটা বলেই ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো সেহরিন।রৌদ্র রাগে কর্কশ গলায় বলল,
– আর ইউ ম্যাড ওর হোয়াট?আর তুমি আমার রুমে ডুকেছ কোন সাহসে তাও আবার আমার পারমিশন ছাড়া?এখনই বের হও।

সেহরিন তবু দাঁড়িয়ে রইলো।ন্যাকা কান্না করে বলল,
– আমি বুঝতে পেরেছি আমি চলে যাচ্ছি বলে তুমি এতো রেগে যাচ্ছো তাই না।প্লিজ তুমি এভাবে আমার সাথে রেগে থেকো না তা নাহলে আমি যে যেতে পারবো না।

রৌদ্র চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলো।রাগে তার শরীর সকল রগগুলো ফুলে উঠেছে।গলার সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর শিরাগুলোও ফুলে ফেঁপে চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়ছে।রৌদ্র হাত মুঠো করে আবার একটি শ্বাস নিলো।চোখ খুলেই আচমকা সেহরিনকে টানতে টানতে ঘরের বাইরে বের করে দিয়ে দরজা আঁটকে দিলো।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বিড় বিড় করে বলল,” মেয়েটা কি পাগল নাকি?অসভ্য ম্যানারলেস মেয়ে একটা।কই অভয়ের বোন তো এমন করে না।এই মেয়েটা এমন এবনরমালের মতো বিহ্যাব করে কেন?ইরিটেটিং!”

স্কুলের পথে হাঁটছে আভা।তবে ক্ষণে ক্ষণেই থেমে বিরক্তি ভঙ্গিতে পিছন ফিরছে সে।কারণ সে একা স্কুলের পথে হাঁটছে না।তার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে কিছুটা দুরত্বে রৌদ্রও হাঁটছে।বলা চলে তাকে অনুসর করেই পা ফেলছে বিদেশি যুবকটি।দু একবার পিছন ফিরে দেখার পর কদম থেমে গেল আভার।ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে পিছন ঘুরে রৌদ্রের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।সহসা আভাকে এগিয়ে আসতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রৌদ্র।মাথার ক্যাপ ঠিক করে উল্টো হাঁটা শুরু করলো সে।আভার কপাল কুঁচকে এলো।সে গলা উঁচিয়ে বলল,
– এই যে শুনুন।

রৌদ্র দাঁড়ালো না।বরংচ পায়ে গতি বাড়িয়ে দিলো।নিজের মাথায় নিজেই বারি দিলো সে।দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়িয়ে বলল, “ড্যাম ইট!কি করছিস তুই আফসিন রৌদ্র?একটা মেয়ের পিছু নিয়েছিস তুই?তাও আবার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে?যে কিনা এখনও স্কুলটাও পাড় করতে পারেনি।কিভাবে?আফসিন রৌদ্র কিভাবে পারলি তুই এটা করতে?একবারও বিবেকে বাঁধলো না তো?বুড়ো বয়সে এখন তোর আবেগ কাজ করতে শুরু করেছে নাকি?”

হাজারো প্রলাপ বকতে বকতে জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে রৌদ্র। আভার এবার রাগ হলো।সে কপাল কুঁচকে দৌড়ে এসে দুইহাত প্রসারিত করে রৌদ্রের পথ আঁটকালো।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বলল,
– এই যে আপনাকে ডাকছি না?কানে কালা নাকি আপনি?

আভা আচমকা পথ আঁটকে দিতেই থতমত খেয়ে গেল রৌদ্র।তবে সে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হলো না।উল্টো কপাট রাগ দেখিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
– বাজে কথা বলবে না একদম।আর পথ আঁটকেছো কেন?পথ ছাড়ো আমার।

আভা ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান স্বরে বলল,
– আপনি আমাকে ফলো করছিলেন?কেন?

রৌদ্র চোখে মণি ঘুরিয়ে জোর কন্ঠে বলল,
– ফলো?তোমাকে?তাও আবার আফসিন রৌদ্র?হাও ফানি?

– তাহলে আমার পিছু পিছু আসছিলেন কেন?এটা কি?

আভার রৌদ্রের হাতে থাকা খাতাটি ইশারা করে জানতে চায়লো।রৌদ্র খাতাটি নিজের পিছনে লুকিয়ে ফেলল।আমতা আমতা করে বলল,
– ক কই কিছু না।পথ ছাড়ো আমার।

আভা মুখ বাঁকিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো। রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে একপলক দেখে চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল।পিছন ফিরে শীতল কন্ঠে ডাক দিলো আভাকে,
– আভা!

ভারি কন্ঠে এমন শীতল ডাকে কেঁপে উঠলো আভা।হঠাৎই গলাটা মরুভূমিতে পরিণত হলো।ঢোক গিলে সে মরুভূমিতে সামান্য পানির ছোঁয়া দিতে চায়লো আভা।নিভু নিভু কন্ঠে সাড়া দিলো,
– হুম

তবে তা উপস্থিত দু’জনের একজনও শুনতে পেল না।রৌদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আভার দিকে।আভার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের খাতাটির দিকে তাকিয়ে ছোট ঢোক গিলল।হাজারো সংকোচ নিয়ে খাতাটি ধীরে ধীরে আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে মোটা কন্ঠস্বর কোমল করে বলল,
– এটা তোমার জন্য।বলেছিলাম তোমাকে গণিতে সাহায্য করতে পারি।যদি চাও তাহলে এটা নিতে পারো আশা করি উপকৃত হবে।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |৯|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভা বাকরুদ্ধ হয়ে এক দৃষ্টিতে খাতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আভার কোনো নড়চড় না দেখে ঢোক গিলল রৌদ্র।শক্ত কন্ঠে বলল,
– ওকে না নিলে সমস্যা নেই।আমি নিয়ে যাচ্ছি।

খাতাটা আভার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার আগেই আভা খাতাটি এক টানে কেঁড়ে নিলো।চমকে উঠলো রৌদ্র।পর পর কয়েকটা পলক ফেলে আবার ছোটো ঢোক গিলল সে।আভা খাতাটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে।ছাড়া ছাড়া বাংলা বর্ণে গণিতের খুঁটিনাটি সকলকিছু বিস্তারিতসহ লেখা। যুক্তবর্ণগুলো অনেকটাই অস্পষ্ট।যুক্ত বর্ণগুলো দেখে মৃদু হাসে আভা।আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে রৌদ্রও যুক্তবর্ণগুলোকে দেখে মুখ কালো করে বলল,
– এগুলো দেওয়া খুব কঠিন।তাও যেমন আছে তেমন আঁকানোর চেষ্টা করেছি।জানি খারাপ হয়েছে বাট আই থিংক তুমি বুঝতে পারবে।

আভা চোখ তুলে তাকালো ছেলেটির দিকে।তবে প্রতিবারের মতো দৃষ্টি স্থির রাখতে পারলো না।দৃষ্টি সরিয়ে মাটিতে নিবদ্ধ করলো।চিকন স্বরে বলল,
– বাঙালি না হয়েও তো ভালোই বাংলা লিখেছেন।আমার হাতের লেখা তো এর থেকেও খারাপ।জানেন মৃণাল কান্তি দ্য অশান্তি স্যার কি বলে?আমি নাকি পরীক্ষার হলে তেলাপোকার পায়ে কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিই।

কথাটি বলে মুখে হাত দিয়ে আলতো হাসলো আভা।রৌদ্র আভাকে জিজ্ঞেস করল,
– আচ্ছা ম্যাথমেটিক্সে তুমি এতো কম পেলে কেন?ম্যাথমেটিক্স কি বুঝতে পারো না?

শীতল বাতাস বয়ে গেল আভার হৃদয়ে।আফসোসের সুরে বলল,
– জানেন এভাবে কেউ কখনো জানতে চায়নি কেন আমি এতো কম পাই?কেন আমি মাধ্যমিকে ওঠার পর থেকে গণিতে পাশ করতে পারিনি?যেখানে অন্যান্য সকল সাবজেক্টে আমি লেটার মার্ক নিয়ে আসি সেখানে গণিতে কেন আমি এতো কম পাই?সকলে শুধু দেখে আমি কম পাই!আমি ফেল করি!কেন করি কেউ জানতে চায়না।

ভিতর থেকে একটা তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো আভার।রৌদ্র কিছু বলল না।ইচ্ছা করেই কোনো শব্দ খরচ করতে করলো না সে।মাঝে মাঝে শব্দ খরচ না করে নীরব দর্শক হয়ে থাকার মধ্যেও এক অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করে।আভা কিছুক্ষণ থেমে ভীত স্বরে বলল,
– আমি না বাসা থেকে সব অংক ঠিকঠাক মতো করে যাই।কিন্তু!

– কিন্তু?

– পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র দেখার পর আমার মাথা আর কাজ করে না।সবকিছু কেমন যে গুলিয়ে যায়।মনে হয় সবকিছু আমার অজানা।আর এই জন্য আমি যেগুলো পারি সেগুলোও ভুল করে আসি।আবার অংক করলেও মাঝ পথে সবকিছু গোলমাল হয়ে যায় আর শেষে উত্তর মেলে না।

হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে কথাগুলো বলল আভা।রৌদ্র সূক্ষ্মভাবে পরখ করল তার বাচনভঙ্গি।চাহনি তার স্থির এবং শান্ত।কোনো অনুভূতি নেই এ চহনিতে।পলকহীন চাহনি চক্ষুগোচর হলো না আভার।হবে কিভাবে সে তো এই চাহনির ভয়েই দৃষ্টি নত করে রেখেছে।কখনো এই চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করার সাধ্য বোধহয় তার হবে না।অথবা এই চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করতে তাকে আরেকবার জন্ম নিতে হবে!
রৌদ্র গম্ভীর ও বিচক্ষণ কন্ঠে বলল,
– বুঝলাম।তুমি এক কাজ করবে, তুমি মানুষের সাথে মিশবে বেশি করে।বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলবে।তুমি যত ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে মিশতে পারবে কথা বলবে ততই তুমি নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।এতে করে তোমার এই নার্ভাসনেসটাও কেঁটে যাবে।আর পড়ার সময় বেশি করে পানি খাবে।পানি খেলে ব্রেইনে অক্সিজেন সঞ্চলন ভালো হয়।যার ফলে ব্রেইন সবসময় সক্রিয় থাকে।ব্রেইন দ্রুত পড়াটা ক্যাচ করতে পারে।

আভা মুচকি হেসে বলল,
– ধন্যবাদ আপনাকে।

রৌদ্র এতক্ষণে আভার থেকে দৃষ্টি সরালো।মাথা নিচু করে ক্যাপ ঠিক করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
– ইটস্ ওকে।যাও স্কুলে দেরি হচ্ছে না?

সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে আভা রওনা হলো স্কুলের পথে।সেদিকে অকারণেই পলকহীন চেয়ে রইলো রৌদ্র।হয়তো তার মস্তিষ্ক এই মুহুর্তে তার নিয়ন্ত্রণে নেই।থাকলে হয়তো এভাবে নিজের ব্যক্তিত্বের বাহিরে বেরিয়ে পলকহীন এই বালিকার দিকে চেয়ে থাকতো না।ব্যক্তিত্ব? ব্যক্তিত্বের কথা ভাবতেই থমকে যায় রৌদ্র।কোনো এক অজ্ঞাত কারনেই এই দুহিতার সামনে সে তার নিজের কঠিন ব্যক্তিত্ব ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে।নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন এক ব্যক্তিত্বের মাঝে যার সাথে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত।

প্রসারিত ঠোঁটে হাতের খাতাটি উল্টেপাল্টে দেখছে আভা।হৃদয়ে তার শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে।তবে এই অনুভূতির সাথে সে পূর্বপরিচিত নয়।তাই অনুভূতিটি ঠিক সফলভাবে কাবু করতে পারছে না তাকে।তার পাশেই পূর্ণতা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।আভা একমনে খাতাটি দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।বিরক্ত বোধ করলো পূর্ণতা একটানে আভার সামনে থেকে খাতাটি টেনে নিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
– কি ব্যাপার বল তো তোর?

– কি আবার ব্যাপার হবে?

– অংকের ভয়ে অংক বইটাও কখনো খুলে বসে দেখিনি।এখন হঠাৎ এই অংকে ঠাঁসা খাতাটার দিকে তাকিয়ে তখন থেকে এমন চোরা হাসি দিচ্ছিস কেন বল তো?

মুখ কালো করে ফেলল।আভা নিজেকে স্বাভাবিক করে সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
– আরে কি বলিস না তুই খাতার দিকে তাকিয়ে চোরা হাসি দিবো কেন আমি?খাতা কি কোনো দেখার জিনিস হলো?নাকি ওটা আবার বর যে ওকে দেখে আমি লজ্জায় চোরা হাসি দিবো।

– আমার তো তেমন কিছুই মনে হচ্ছে।

পূর্ণতার কথায় আভা বড় একটা হা করে অবিশ্বাস্য সুরে বলে উঠলো,
– মানে তোর মনে হচ্ছে ওটা আমার বর?

– খাতাটা তোর বর না কিন্তু মনে হচ্ছে খাতাটা দিয়েছে তোর বর।

থমকে গেল আভা।পাথরের মুর্তির মতো স্থির হয়ে গেল সে।খাতার মালিক তার বর?এও কি আদৌ সম্ভব? কল্পনাতেও এ দুর্লভ!কোথায় হাই ক্লাস সোসাইটির বিদেশি রৌদ্র! কোথায় গাঁও গ্রামের আভা!কোথায় আগুন আর কোথায় জল!না না এ ভাবলেও তার মস্তিষ্ক কলংকিত হবে!
আভাকে ঘোরের মধ্যে চলে যেতে দেখে পূর্ণতা একটি ধাক্কা দিলো।বলল,
– কি হয়েছে?হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলি?

আভা মলিন মুখে হাসার চেষ্টা করে বলল,
– কি যে বলিস না তুই?তোর কথার আঁগা মাথা কিছু নেই।

আভা পূর্ণতার হাত থেকে খাতাটি টেনে নিয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।পূর্ণতা ভাবুক দৃষ্টিতে আভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠলো,
– আমি আবার আঁগা মাথা ছাড়া কথা বললাম?

—————

– এই যে ক্যাপ ওয়ালা শুনো…

হঠাৎ এমন সম্বোধনে ভ্রু কুঁচকে এলো রৌদ্রের।পিছন ফিরে দেখল তার সামনে অভয়ের ছোট চাচার জমজ দুইজন দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র আশেপাশে তাকিয়ে নিজের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো,
– আমাকে বলছো?

মেয়েটি কোমরে হাত দিয়ে বড়দের মতো ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
– এখানে তুমি ছাড়া মাথায় ক্যাপ কে পড়ে আছে?আমরা?

রৌদ্র চোখের মণি উঁচিয়ে নিজের ক্যাপটি এক নজর দেখে থতমত খেয়ে গলা খাঁকারি দিলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
– কি বলবে বলো।

মেয়েটি কোমর থেকে ডান হাত সরিয়ে রৌদ্রকে তর্জনির ইশারায় নিজের কাছে ডাকল।রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে রেখেই এক কদম দুই কদম করে এগিয়ে এলো তার সামনে।রৌদ্র লম্বা হওয়ায় মেয়েটিকে ঘাড় তুলে কথা বলতে হচ্ছে।মেয়েটি সেই কষ্ট লাঘব করতেই রৌদ্রকে চোখ গরম দেখিয়ে মাথা নিচু করতে বলল।রৌদ্র হাঁটু ভেঙে তার সামনে বসলো।মেয়েটি কোনো কিছু না ভেবেই রৌদ্রের গালে হাত রাখল।রৌদ্র ভড়কে গেল অবাকও হলো কিছুটা।মেয়েটি রৌদ্রের গালে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলল,
– তোমার গাল কত নরম।তোমার গালে চুল নেই কেন?তুমি কি কেটে ফেলেছ?

হাসলো রৌদ্র।মেয়েটির হাত নিজের হাতের ভিতর আবদ্ধ করে মিষ্টি হেসে আদুরে কন্ঠে বলল,
– নাম কি তোমার?

– মিন্নি।

রৌদ্র পাশে তাকিয়ে মিন্নির মতো দেখতে মেয়েটিকেও জিজ্ঞেস করল,
– তোমার নাম?

মেয়েটি একটু চুপচাপ স্বভাবের।বেশি কথা বলে না।এতক্ষণ সে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল।রৌদ্র নাম জিজ্ঞেস করায় গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
– তিন্নি।

রৌদ্র দুজকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করলো।দু’জনে মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে না পেয়ে আহত স্বরে বলল,
– তোমরা তো দেখতে একদম একই।তাহলে আমি বুঝবো কি করে কোনটা মিন্নি আর কোনটা তিন্নি?

মিন্নি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
– শোনো মনে রাখবে মিন্নি খুব চঞ্চল আর তিন্নি খুব শান্ত। তাহলেই তুমি আমাদের সহজেই চিন্তে পারবে বুঝেছ?

রৌদ্র উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।মিন্নি ভ্রু কুঁচকে রাগি ভঙ্গিতে বলল,
– তুমি তো বললে না তোমার মুখে চুল নেই কেন?

রৌদ্র ভ্রুযুগল উঁচিয়ে ঠোঁট মেলে মিষ্টি হাসি দিলো।আফসোসের সুরে টেনে বলল,
– দাড়ির স্বপ্ন তো আমারও আছে বোন।কিন্তু কি করবো আমি যেখানে থাকি সেখানের আবহাওয়ার কারণে আমার দাড়ি ওঠে না।তাছাড়া সেখানের খাদ্যভাস, আবহাওয়া,লাইফস্টাইলে সবকিছু আলাদা।যার জন্য আমার হরমোন সেভাবে ডেভেলপ হচ্ছে না।বুঝেছো?

– হরমোন কি?

রৌদ্র পড়লো বড় বিপাকে।এখন এই পাঁচ বছরের মেয়েটাকে সে কিভাবে বোঝাবে হরমোন কি?রৌদ্র সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো।আমতা আমতা করে বলল,
– হরমোন হলো দাড়ি ওঠার মেশিন।

– আচ্ছা।তাহলে আব্বুকে বলবো তোমাকে একটা হরমোন কিনে দিতে।তুমি কোথায় যাচ্ছো?

– আমি একটু হেঁটে আসি।

মিন্নি ঠোঁট বাঁকিয়ে তিন্নির হাত ধরে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।রৌদ্র সেদিকে চেয়ে মৃদু শব্দ করে হাসলো।বরাবরের মতোই ঠোঁটের দুইপাশে দেখা গেল ছোট্ট ছোট্ট দু’টো টোল।একদম ঠোঁট ঘেঁষে আছে তারা।পিছন থেকে সাইকেলের বেল বাজিয়ে যাচ্ছে কেউ।অনবরত সে শব্দ কানে আসতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার।পিছন ফিরতেই দেখতে পেল সাইকেলে বসা ছোট চুলের মেয়েটি।রৌদ্র সাইকেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– এটা ঠিক করে দিয়েছে অভয়?

আভা কড়া কন্ঠে জবাব দিলো,
– ঠিক না করে দিলে ওর একটা হাড্ডিও আস্তো থাকতো?

আভার কথায় ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেল রৌদ্রের।আজ কোণা চোখে সেই হাসি দেখার সাহস করলো আভা।তবে সেই চোরা দৃষ্টিও স্থির রাখতে পারলো না।গলা খাঁকারি দিয়ে নড়ে চড়ে বলল,
– আসুন আপনাকে গ্রাম দেখায়।

– এ কয়েকদিনে অনেকবারই গ্রাম চষে ফেলেছি।

– আজকে নাহয় আরেকবার দেখবেন।আপনার রিটার্ন গিফট এটা।চলে আসুন।

রৌদ্র চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
– সাইকেলে?

– হ্যাঁ আসুন।

কি মনে করে রৌদ্র আর না করতে পারলো না।এগিয়ে গেল আভার পিছনের ছিটে বসার জন্য।ঠাট্টা করে বলল,
– তোমার ভাইয়ের মতো আবার আমাকে পঁচা ডোবায় ফেলে দিও না।

– যদি দিইও তাহলে কি আপনি আমাকে মারবেন?

চলবে…