Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 183



সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০৩

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৩|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
দর্শন দরজার দিকে না তাকিয়েই বেঞ্চের উপর থাকা মার্কারটা হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে মারলো দরজার দিকে। সারা বিচক্ষণতার সাথে তা হাতে ধরে বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলো দর্শন এর দিকে। দর্শন তখনো দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড বাদে নিজের ভুল বুঝতে পেরে জীভে কামড় দিলো সারা, মেকি হেসে বললো,
_”সরি সরি ভাইয়া,আর বলবোনা।”

দর্শন আশেপাশে আরো কিছু খুজতে নিতেই সারা আবারো তড়িঘড়ি করে বলে,
_”না না, স্যার। আসবো স্যার? একদম দৌড়ে দৌড়ে এসেছি। কি শান্তিতে ঘুমিয়েছিলাম,জোস একটা স্বপ্ন দেখতেছিলাম। আর দেড়ি হবেনা স্যার,আসি এবার?”

_”আর আসা লাগবেনা, দাঁড়ায় থাক বাইরেই।”

কাঁদোকাঁদো দৃষ্টিতে রজনীর দিকে তাকায় সারা,তা দেখে দর্শন বলে,
_”ওর দিকে তাকায় লাভ নাই, আজকে ওখানেই দাঁড়ায় থাকবি তুই। বাজে কয়টা?”

সারা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
_”পাঁচটা দশ।”

_”পড়া কয়টায় ছিলো?”

_”পাঁচটায়।”

নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় সারা। দর্শন কিছুক্ষন বাদে ফোনের দিকে নজর রেখে বলে,
_”আয়, নেক্সট টাইম..”

_”থ্যাংক ইউ স্যার।”

বাকি কথা বলার আগেই রজনীর পাশে এসে বসতে চায় সারা। দর্শন তাকে বাঁধা দিয়ে বলে,
_”উম হু,ওখানে না। সামনে এসে বোস, শাস্তি এটা।”

_”এমন করেন কেন স্যার? আর দেড়ি হবেনা সত্যি, বসি একটু এখানে?”

সারার অসহায় কণ্ঠে বলা কথার উত্তর দিলোনা দর্শন, রজনীর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
_”তুইও আয় সামনে। তেমন কেউ আসবে বলে তো মনে হচ্ছেনা, কি আর ক্লাস করাবো!”

_”আসতেই হবে?”

_”ইয়োর উইশ।”

এবার সারা টেনে দাড় করালো রজনীকে। তার সামনে বসতে সমস্যা নেই, তবে রজনীকে নিয়েই বসবে। রজনীও দ্বিমত করলো না, বোঝাই যাচ্ছে তেমন কেউ আসবে না। সারা,রজনী দুজনেই এসে দ্বিতীয় বেঞ্চ এ বসে পড়লো। ঠিক তখনি ক্লাসে এলো আরো দুটি মেয়ে।

_”মে আই কাম ইন স্যার?”

একসঙ্গে বললো দুজন। দর্শন একবার তাকালো তাদের দিকে। আর বকাঝকা না করেই বললো,
_”কাম ইন।”

সারা রজনীর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
_”আইছে আমাদের মডেল।”

ভুল কিছু বলেনি সারা। রিতা আর টিয়া দুজনেই সবসময় সেজেগুজে আছে ব্যাচ এ, তাদের দেখে যে কেউ বলবে যেকোনো পার্টিতে এসেছে তারা।
রজনীকে সামনের দিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো রিতা, সে তো সামনের দিকে বসেনা কখনো। রিতা আর টিয়া গিয়ে অপর পাশের প্রথম বেঞ্চে বসে পরলো। টিয়া রিতার কানেকানে বললো,
_”ঐ ভাবওয়ালী আজকে সামনে বসছে কেন?”

_”কি জানি! আমাদের জায়গা দখল করছে এসে।”

দর্শন ফোনটা বেঞ্চে রেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_”আর কেউ আসবে বলেতো মনে হয়না। পড়ানো কি শুরু করবো?”

সারা মেকি হেসে বলে,
_”আজকে না পড়ালে হয়না স্যার? না মানে, বাকিরা পড়াটা মিস করবে। নেক্সট ক্লাস এ এসে আপনার কানের বারোটা বাজাবে,আবার সেই বাধ্য হয়ে আপনাকে পড়া রিপিট করতে হবে। শুধুশুধু এত ঝামেলার কি দরকার?”

_”ঠিক আছে না পড়াই, পড়া জিজ্ঞেস করি। বই দাও..”

বোকা বোনে যায় সারা। পাশের বেঞ্চ থেকে টিয়া বলে ওঠে,
_”নাহ স্যার প্লিজ। পড়া তো ছিলো সাত দিনের জন্য, তিনদিনে কি করে শেষ করবো?”

_”স্যার আমার না মনে পরলো, পরিক্ষা সামনে। সিলেবাস বাকি তো এখনো, নতুন অধ্যায় শুরু করা খুবই প্রয়োজন স্যার।”
পাল্টি খেয়ে এমন কথাই বললো সারা। আপাতত পড়া দেওয়ার হাত থেকে বাঁচা অতি গুরুত্বপূর্ণ। দর্শন দুদিকে মাথা নাড়ে এদের ফাঁকিবাজি দেখে। পুনরায় চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করে,
_”কোন অধ্যায় পড়া ছিলো?”

সবাই চুপ করে রইলো, রজনীর নজর বরাবরের মতোই নিচের দিকে। প্রশ্ন করা ব্যাতীত সে নিজে থেকে কখনো কোনো উত্তর দেয়না, বেশ ইন্ট্রোভার্ট সে, আর সেই কারণে ক্লাস এর অনেকেই বলে সে নাকি ভাব নিয়ে থাকে। এসব অবশ্য কানে নেয়না রজনী।

_”রজনী, পড়া কি ছিলো?”

_”একাদশ অধ্যায়।”

সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো রজনী। রজনী পাশ থেকে রাগী চোখে তাকালো তার দিকে। দর্শন রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
_”তুমি বলো, এগারো অধ্যায়ের নাম কি?”

পাশে থাকা টিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো রিতা। সে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো নিজেও জানেনা। অনেক্ষন চিন্তা করে ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো রিতা। দর্শনের বর্তমানে মুড ভালো, মারতে ইচ্ছে হলোনা কাউকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_”আর একদিন টাইম দিচ্ছি শুধু, নেক্সট ক্লাস এ যে পড়া পারবে না তার জন্য স্পেশাল গিফট অপেক্ষা করছে। বই দাও এখন।”

কারোর এখন পড়ার ইচ্ছে নেই, রিতা আর টিয়া বই ও আনেনি ভুলে। আর সারা ইচ্ছে করে দিলোনা বই,বললো সেও বই আনেনি। দর্শন বেঞ্চের উপর মার্কার এর সাহায্যে টোকা দিয়ে হাতের ইশারায় বই চাইলো রজনীর থেকে। রজনী এবার ব্যাগ থেকে বইটা বের করে এগিয়ে দিলো। দর্শন কয়েক সেকেন্ড উলটে পালটে নিজেই বই বন্ধ করে রাখলো। বেঞ্চে হাত রেখে বললো,
_”নাহ, পড়ানোর মুড নাই। বাকিগুলো আবার পরেরদিন এসে কান্নাকাটি শুরু করবে।”

_”ছুটি স্যার? বাসায় যাই?”
উৎসাহিত হয়ে বলে টিয়া। দর্শন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো ত্রিশ মিনিট বাকি। বইটা রজনীর সামনে রেখে দিয়ে বললো,
_”বাসায় ই যাবে তো? আন্টির নম্বর কিন্তু আছে আমার কাছে, ফোন দিলেই বুঝতে পারবো।”

ভয়ে ভয়ে চুপ করে থাকে টিয়া। এর আগে একদিন দর্শন তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়েছিলো। সেদিন বাসায় না গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলো সে, ভাগ্যক্রমে দর্শনের সামনে পরে যায়। তখন কিছু না বললেও এখন যে সেই কথাই উল্লেখ করছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না টিয়ার।
দর্শন দু মিনিটের মতো ফোন স্ক্রোল করে বললো,
_”যাও,ছুটি। কালকে পড়াবো,এই টাইম এই।”

সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়ালো। দর্শন এর উদ্দেশ্যে সালাম দিয়েই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো টিয়া আর রিতা, তারা ঘুরতে যাবে তা বুঝতে পারলো দর্শন। সারা আর রজনী একসঙ্গে বেরোতে গেলো, তবে রজনীর কিছু মনে পরতেই থেমে যায় সে। সারার উদ্দেশ্যে বলে,
_”একটু দাড়া,আসতেছি আমি।”

সারা বের হয় ক্লাস থেকে, রজনীর ব্যাগ কাধে নিয়ে দর্শনের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
_”ফুপ্পি বলেছে, ইনাম ভাইয়াকে কল করে বাড়িতে আসতে বলতে। কারোর কথাই তো শোনেনা,তোমার কথা শুনবে হয়তো।”

_”আমি কি বলিনাই? শা’লা আমার কথাও শুনে না। তুই বলে দেখিস। ওহ,তুই আর কি বলবি,তোর সাথে তো কথাই বলবে না।”

রজনীর দিকে তাকিয়ে বলে দর্শন। এবার কথা ঘুরিয়ে নেয় রজনী, জিজ্ঞেস করে,
_”ক্লাস আছে আর? বাসায় যাবে এখন?”

_”নাহ ক্লাস নাই। যাবো,দশ মিনিট পর।”

রজনী বিরক্তির সাথে বলে,
_”ট্যুরে গিয়ে তোমার অভ্যাস আরো খারাপ হয়ে গেছে।”

_”কথা ভুল না।”

বলেই উঠে দাঁড়ায় দর্শন। শার্ট টানটান করে বলে,
_”থাক, এখনি যাবো।”

_”আমি সারার সাথে যাই?”

_”হুম, যাহ।”

সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো রজনী। টিচার হিসেবে সে যথেষ্ট সম্মান করে দর্শনকে। বাড়ি বেশি দূরে নয় এখান থেকে। হাটতে হাটতেই চলে গেলো রজনী আর সারা। সারার বাসা কাছেই, বাকি পথ রজনী একাই গিয়েছে। আর দর্শন তার বাইক নিয়ে আরো আগেই চলে গেছে বাড়িতে।

____
_”রজনী ক্যাচ..”

কথাটা বলেই রজনীর দিকে আচারের প্যাকেটটা ছুড়লো দর্শন। আকস্মিক হলেও রজনী ধরে ফেললো ক্যাচটা। টেবিলে বসে অঙ্ক করছিলো সে। দর্শন এগিয়ে এলো, বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো রাফিন ঘুমোচ্ছে। হাতে থাকা বাকি আচারের প্যাকেটগুলো থেকে আরো তিনটে টেবিলের উপর রেখে বললো,
_”একটা রাফিনকে দিস, বাকিগুলো তোর।”

দ্বিমত পোষণ করলো রজনী, আচারের প্যাকেট এর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”তা কেন হবে? ওকে একটা দিয়ে আমি তিনটে কেন নেব? আমার দুটো ওরও দুটো।”

চোখ নামিয়ে সামান্য হাসলো দর্শন। আরেকটা আচারের প্যাকেট রজনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
_”এই যে কথাটা বললি, তাই তোর জন্য একটা এক্সট্রা। পাঁচটা দিলাম, তিনটে তোর আর দুটো রাফিন এর।”

চুপ করে আবারো খাতার দিকে তাকিয়ে অঙ্ক করায় মনোযোগ দিলো রজনী। দর্শন কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থেকে পাশে চেয়ার টেনে বসলো। রজনীর উদ্দেশ্যে আদুরে কণ্ঠে বললো,
_”কি হয়েছে রাতপাখি? মন খারাপ? কষ্ট হচ্ছে?”

খাতার দিকে দৃষ্টি রেখেই কিঞ্চিত হাসলো রজনী। দর্শনের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”আমাকে এই প্রশ্নটা করাই অবান্তর দর্শন ভাই। কারণ শেষ কবে আমি ভীষণ আনন্দিত ছিলাম তাই আমার মনে পরেনা”

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০২

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |২|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
থামলো দর্শন,পিছন ঘুরে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”বলো,তোমার কথাই শুনতে চাইছিলাম। নিজেই তো মুখ বন্ধ করে থাকলে।”
সোফায় দৃঢ় মুখভঙ্গি নিয়ে বসে থাকে জাহিদ, দর্শন এগিয়ে এসে তার অপর পাশের সোফায় বসে। খুব মনোযোগ সহকারে জাহিদের কথা শুনতে চাইছে সে।

_”আমার মেয়ের ব্যাপারে অন্য কারোর কথা বলা আমি পছন্দ করছিনা দর্শন। ভালো পরিবার এর ছেলে, রজনী ভালো থাকবে সেখানে।”

_”ও এম জি! রজনীর ভালো থাকা নিয়ে তুমি এত্ত কনসার্ন? পুরাই আনএক্সপেক্টেড মামু।”

চোখ বড়বড় করে বলে দর্শন। জাহিদ ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারো বলেন,
_”তুমি বাগড়া দিতে না আসলে খুশি হবো। বাকিরা এমনিতেই রাজি হয়ে যাবে।”

_”মামি রাজি হয়ে যাবে?”

_”সেটা আমি দেখে নেবো।”

সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো দর্শন, দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,
_”তুমি বোধ হয় আমার কথা বুঝতেই পারোনি মামু। সোজাসাপ্টা বলতে গেলে, তোমাকে ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছি। ভেবোনা নিজের মামা বলে তোমার সব কথা শুনবো আমি। বহুত কষ্টে এখনো রিসপেক্ট দেখাই তোমার প্রতি, বেশিদিন সেটাও থাকবে না।”

_”মুখ সামলে কথা বলো দর্শন।”

কপাট রাগ দেখিয়ে বললেন জাহিদ। দর্শন সোজা হয়ে বসে বললো,
_”সামলেই তো আসছি। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙোনা প্লিজ। কেন যে মেয়ের জন্য তোমার এত চিন্তা উতলে উঠছে তা তো জানি আমি, শুধুশুধু অজুহাত দিয়ে লাভ নেই। আর নানু যে ভালো করেই ব্রেইন ওয়াশ করেছে তাও বুঝতে পারছি।”

ভ্রুকুঞ্চিত করলেন জাহিদ। দর্শন খানিক চিন্তার ভাব নিয়ে থুঁতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে বললো,
_”পুলিশ ও আনার দরকার নেই। জাস্ট বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুটো গলিতে খবর ছড়াতে পারলেই হলো। ভেবে দেখো, বাড়িতে যাই হোক পাড়ায় কিন্তু খুব সম্মান তোমার।”

জাহিদ বেশ ভালোই বুঝতে পারলেন দর্শন শান্ত গলায় হুমকি দিচ্ছে তাকে। এবার হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন জাহিদ, চুপ করেই বসে রইলেন সোফায়। দর্শন বেশি হলে দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করলো। জাহিদকে কিছু না বলতে দেখে বুঝতে পারলো,তিনি একটু হলেও ভয় পাচ্ছেন। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শার্টটা টানটান করে নেয় দর্শন, আরেকবার জাহিদ এর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো ফাহমিদা। তবে বরাবরের মতোই এবারো তিনি নিরব দর্শক এর ভূমিকা পালন করলেন। মনে মনে ছেলের কাজে খুশি হলেও তা মুখ ফুটে বলতে পারছেন না, আবার ভাইয়ের সামনেও গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না, কোনো এক দ্বিধাবোধ আটকে দেয় তাকে। দর্শনের বয়স যখন মাত্র আট বছর,তখনই এক রোড এক্সিডেন্ট এ তার বাবা মা’রা যায়। অল্প বয়সেই ফাহমিদা হারায় তার স্বামীকে, শশুর বাড়ির লোকজন খুব একটা সুবিধার ছিলোনা। দর্শন আর তাকে যেন এক বাড়তি বোঝা মনে করতো তারা, ঠিকঠাক খেতে পর্যন্ত দিতো না। জাহিদই তখন নিজ উদ্যোগে বোনকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। শিক্ষিত ছিলেন ফাহমিদা, টুকটাক টিউশনি করিয়ে ছেলের খরচ চালিয়ে নিতেন, তবে জাহিদ আলাদাভাবে তার থেকে টাকা নেয়নি কখনো। ভাইয়ের প্রতি তাই কৃতজ্ঞ ফাহমিদা, জাহিদের মতের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস এখনো তার হয়ে ওঠেনি। নিজের ঘরে চলে যান ফাহমিদা, ভাইয়ের সংসারে এখন তার আর থাকতেও ইচ্ছে করেনা। তবে এই বাড়ি ছেড়েও যেতে পারছেন না কেবল দর্শনের জন্য। দর্শন যতটুকু স্বাবলম্বী হয়েছে, মাসে যা ইনকাম করে তা দিয়ে মা ছেলে ভালোমতোই শহরে থাকতে পারবে, তবে রাজি হয়না দর্শন। বেশি জোর করতে পারেননা ফাহমিদা, মায়া হয় রজনীর জন্য। তারা চলে গেলে মেয়েটা একদমই একা হয়ে যাবে, সঙ্গে আফিয়াও।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ফাহমিদা। তিনি বরাবরেই নিশ্চুপ প্রকৃতির, কোনো জায়গায় নিজে থেকে হস্তক্ষেপ করেন না। ঝামেলায় জড়ানো তার পছন্দ হয়,দর্শন হয়েছে ঠিক তার বিপরীত। হয়তো বাবার মতো!

____
_”আসবো?”

ক্লাসরুম এ চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রোল করছিলো দর্শন। আগের ব্যাচ শেষ করেছে পনেরো মিনিট হলো, তারপর একটু বেরিয়েছিল সে। পাঁচমিনিট হলো ফিরেছে।
দরজার দিকে না তাকিয়ে দর্শন উত্তর দিলো,
_”আয়।”

ভিতরে এসে শেষের দিকের দ্বিতীয় বেঞ্চ এ বসে পড়লো রজনী, এটাও জানা কথা, সামনের দিকে সে খুব সহজে বসেনা। দর্শন এবার ফোনটা তার সামনের বেঞ্চে রেখে মাথা নুইয়ে রাখলো কয়েক সেকেন্ড,চোখ তুলে তাকালো রজনীর দিকে, সে চুপচাপ বসে আছে। মাথায় সাদা রঙের হিজাব, আর পরনে নিজের বানানো জামা। বয়স কম হলেও, বেশ ভালো সেলাই এর কাজ জানে রজনী, ফাহমিদার থেকে শিখেছে এটা। আবার ইউটিউব এ দেখে বিভিন্ন ডিজাইন এর জামা বানায় সে, অনেক সময় হাতের কাজ করে তাতে। এত কাজ করেও যেন সময় বেঁচে যায় তার। কি করে? সেটা বুঝতেই পারেনা দর্শন।

রজনীকে সামনে আসার কথা একবারো বললোনা দর্শন, বসুক তার সুবিধামতো। ফোনের লক খুলে সময় দেখলো দর্শন, ৫:০৩ বাজে। রজনী ঠিক সময়ই এসেছে,তবে বাকিদের এখনো কোনো খবর নেই। দর্শন চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,
_”একা আসলি যে? বান্ধবী কই তোর?”

_”ফোনে পাইনি,তাই চলে আসলাম।”

_”আর বাকিরা কোথায়? মেসেজ তো অনেকেই সিন করছে।”

_”আমি জানবো কি করে? ওদের বাসায় গিয়ে দেখে আসছি নাকি?”

সোজাসাপ্টা উত্তর রজনীর। দর্শন শার্টের পকেট থেকে দুটো সেন্টার ফ্রেশ বের করলো। একটা খুলে মুখে দিয়ে চিবোতে লাগলো,অন্যটা রজনীর দিকে দেখিয়ে বললো,
_”খাবি?”

রজনী সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
_”নাহ থাক,আমার দরকার নেই। ওটা তোমার ই দরকার।”

দর্শন ইষৎ হেসে বলে,
_”হ্যা দরকার হতেও হবেনা। তবুও কখনো ইন্টারেস্ট জাগলে,বলিস…আমার হাতের ফার্স্ট চর’টা সেদিনই খাবি।”

কথা ভুল বলেনি দর্শন। আজ পর্যন্ত রজনীর গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক,তাকে মজা করে কখনো চিমটিও দেয়নি সে। পড়ার ক্ষেত্রে কখনো মারার মতো ঘটনাই ঘটেনি। দর্শন এমনিতেও তেমন রাগী ছেলে নয়, তাছাড়া রজনী এমন কিছু কখনোই করে নি, যার জন্য তার মাথা গরম হবে।

_”আল্লাহ মাফ করুক, জীবনেও ওসবের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট আসবে না।”

শব্দ করে হাসতে লাগলো দর্শন। হাসি থামিয়ে বেঞ্চে কনুই ঠেকালো সে, গালে হাত রেখে বললো,
_”চ’ড়টা মিস করলি, সো স্যাড..”

রজনী দর্শন এর দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
_”কথাটা শুনলে না এখনো।”

দু সেকেন্ড ভাবতেই দর্শনের মনে পড়লো বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে রজনী তাকে কিছু বলতে চেয়েছিল,
_”ওহ হ্যা। উম..কেউ আসেনি তো এখনো। বল কি বলবি।”

_”তখন ড্রইং রুমে কি কথা বলছিলে তোমরা? আমি স্পষ্ট বিয়ের কথা শুনলাম। তুমিও কিছু বলতে যাচ্ছিলে, আমাকে দেখেই থেমে গেলে।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো দর্শন, আবারো ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,
_”বলেছিলাম,বড়দের কথায় অতো কান দিতে হয়না।”

_”আম্মু গম্ভীর হয়ে আছে,আমার সাথে কথাও বললো না।আব্বুর কথাতো বাদ ই দেই। আমাকে কি এতই বোকা মনে হয়? অবুঝ আমি?”

দর্শন চোখ তুলে তাকায় রজনীর দিকে, শান্ত স্বরে বলে,
_”আচ্ছা, সব বুঝিস?”

_”অনেকাংশই।”

টানটান হয়ে বসে দর্শন,মাথা কিছুটা পিছনের দিকে এলিয়ে বলে,
_”এতকিছু বুঝতে হবেনা। বাজেদিকের ভাবনা মাথায় আনলে তার প্রভাব পড়াশোনার উপরেই পড়বে, লস তোর নিজের। তাই বলি, কিছু কথা এককান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দে।”

_”তাহলে আমি যা ভাবছিলাম তাই ঠিক?”

দৃষ্টি নামিয়ে বললো রজনী, তূর্য একইভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”হুম”

লম্বা নিঃশ্বাস নিলো রজনী। দর্শনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো,
_”তুমি জানলে কি করে? এইজন্যই তাড়াতাড়ি ফিরে এলে?”

_”শিমলা আপা বলেছে।”

দর্শন এর একটা বৈশিষ্ট্য,সে একদমই স্পষ্টভাষী। কারো থেকে কোনোকিছু লুকোনোর খুব বেশি চেষ্টা করেনা সে। তাই আর রজনীর থেকেও লুকোয়নি,জানতে চায় যখন জানুক। শিমলা হলো তাদের বাড়ির কাজের লোক,অনেক বছর ধরে কাজ করেন বাড়িতে,রজনী আর দর্শনকে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। জাহিদ আর হালিমার কথা আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গেই দর্শন কে তাই খবরটা জানান তিনি।

_”জানতে চেয়েছিস,বলে দিলাম। মুড অফ দেখতে চাইছিনা এখন।”

সোজা হয়ে বসে বললো দর্শন,রজনী প্রতিত্তরে স্মিত হাসলো কেবল। তখন ই হুরমুরিয়ে দরজার সামনে এলো সারা,হাপাতে হাপাতে বললো,
_”আসি ভাইয়া?”

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০১

0

#সেই_রজনী_দর্শনে |১|
#সূচনা_পর্ব
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন

নিজের দ্বিগুণ বয়সী একজন লোকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হচ্ছে রজনীর, অথচ এ বিষয়ে কানাকড়ি খবরও তার কান অবধি পৌঁছায়নি। সদর দরজার সামনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে, সম্মুখে থাকা ব্যক্তি পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
_”বললাম না ভিতরে যা, স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
দর্শনের কথায় খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করলোনা রজনী। ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকিয়ে খানিক শান্ত গলায় বললো,
_”কার বিয়ের কথা বলছো তোমরা?”

দু আঙুল দিয়ে কপালে স্লাইড করলো দর্শন, রজনীর দিকে দৃষ্টি এনে আবারো বললো,
_”বড়দের কথা এতো শুনতে হয়না। রাফিনকে নিয়ে ঘরে যা।”

_”তুমি কখন এলে?”

পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো রজনী। দর্শন তার স্বাভাবিক উত্তরে বললো,
_”এসেছি, একটু আগে।”

ড্রইংরুম এ উপস্থিত আফিয়া আক্তার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে মেয়ের কাছে এসে কড়া গলায় বললেন,
_”এক কথা কতবার বলতে হবে তোমায়? বড়রা কথা বলছে তো এখানে, তুমি ঘরে যাবে এক্ষুনি। আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না।”

একনজর চোখ সরিয়ে বাবা জাহিদ হাসানের এর দিকে তাকালো রজনী, তার দৃষ্টি অন্যদিকে। আর কথা বললোনা রজনী,ছোট ভাই রাফিনের হাত ধরে ঘরে চলে গেলো সে। রজনী স্থান ত্যাগ করতেই আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলোনা দর্শন, রজনী আড়ি পেতে কথা শুনবেনা সে জানে। তাই সরাসরি জাহিদের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,
_”তো বলো মামা, তোমার মেয়ের বয়স কত?”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দর্শনের দিকে তাকালো জাহিদ,এই ছেলে তার সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিচ্ছে। এমন কিছু হতে পারে আন্দাজ করেই এবার মা হালিমা খাতুন এর সঙ্গে আলোচনা করে গোপনেই কথাবার্তা এগিয়েছিলেন জাহিদ। ছেলে রজনীকে একবার দেখাতেই পছন্দ করেছে, আরও তার কম বয়সী মেয়েই পছন্দ। ফলে সঙ্গে সঙ্গে জাহিদের নিকট রজনীকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় সে, জাহিদ সেই ছেলের বাবার অফিসেই চাকরি করে। বিয়েটা একবার দিতে পারলে, সর্বোচ্চ স্তরে যাওয়া থেকে জাহিদকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। এমন সব পরিকল্পনা করেই পাত্রপক্ষকে প্রায় সায় জানিয়েই দিয়েছিলেন জাহিদ। দর্শন বাড়িতে নেই, এক সপ্তাহের জন্য ট্যুরে গিয়েছে, এই ফাকেই শুভকাজ সেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি।

তবে তা আর হলো কই? স্ত্রী আফিয়া আর বিধবা বোন মাহমুদাকে ডেকে যেই না বিয়ের কথাবার্তা বলতে যাবে তখনি বাড়িতে এসে হাজির হয় দর্শন। অবাক হয় সকলে, তার তো আরো চারদিন পরে আসার কথা ছিলো।

_”কি হলো এটাও কি জানোনা নাকি? তো মনে করিয়ে দেই, তোমার মেয়ে সবে ষোলো পেরিয়েছে। আগামী বছর সে মাধ্যমিক তথা এস এস সি পরিক্ষা দেবে। আইনত সে এখনো নাবালিকা.. বুঝতে পারছো তো?”

মাহমুদা বিরক্ত হয়ে দর্শনের উদ্দেশ্যে বললেন,
_”এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সরাসরি বল তো হয়েছে টা কি? আর তুই ই বা এত তাড়াতাড়ি কি করে চলে এলি?”

নিজের কাধে থাকা ব্যাগটা সোফার উপর ছুড়ে মারে দর্শন। তার ঘাড়ে,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। ছোট চেক এর শার্টটার এক হাতা কনুই অবধি গোটানো, অন্যটা স্বাভাবিক। জাহিদের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
_”আর দুদিন পরে এলে তো সঙ্গে করে পুলিশ আনতে হতো। নিজের মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেওয়ার চেষ্টা করায় তোমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতো,সেটা খুব ভালো হতো নাকি?”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হালিমা খাতুন তেতে উঠলেন খানিকটা। কপাল কুঁচকে বললেন,
_”এত কথা বলার কি আছে? আগেকার দিনে কি কমবয়সী মেয়েদের বিয়া হয়নাই? আর ঐ মেয়ে এত কচি খুকিও না,যথেষ্ট বিয়ার বয়স হইছে ওর।”

দর্শন মুখে বিরক্তির ছাপ এনে হাতের ইশারায় হালিমাকে থামার উদ্দেশ্য করে বলে,
_”আর তুমিতো চুপই থাকো নানু। নিজেই তো ছেলের কান ভাঙিয়েছো, আমি কি কিছুই জানিনা ভাবছো?”

_”আহ দর্শন, নানুর সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস?”

মাহমুদার কথায় তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে দর্শন। প্রতিত্তরে বলে,
_”যার যেমন ব্যাবহার পাওয়া উচিৎ তেমনটা করলে তো। থাক.. মুখ খুলতে চাইছিনা এখন।”

মাহমুদা কড়া চোখে তাকায় দর্শনের দিকে,সেদিকে খেয়াল করেনা দর্শন। আফিয়া এতক্ষনে ঘটনা অনেকটাই আন্দাজ করতে পেরেছে। এগিয়ে এসে জাহিদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
_”তুমি আবার রজনীর বিয়ের চিন্তা করছো?”

স্ত্রীর দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন জাহিদ। শক্ত গলায় উত্তর দেয়,
_”আমার মেয়ে ও, তাই ওর ব্যপারে সিদ্ধান্ত ও আমিই নেবো।”

দর্শন বুকে হাত গুঁজে বলে,
_”মানতে কষ্ট হচ্ছে নাকি মামু? কিছুই করার নেই,তোমারই মেয়ে। কিন্তু তাই বলে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে যার তার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইবে তা তো হতে পারেনা।”

_”যার তার সঙ্গে কে বললো? এমন বড়লোক বাড়ির প্রস্তাব ভবিষ্যৎ এ পাবো কিনা সন্দেহ।”

কঠিন হলেন আফিয়া,শক্ত গলায় উত্তরে বললেন,
_”বড়লোক হোক আর যাই হোক, মেয়েকে আমি এই বয়সে কোনো ভাবেই বিয়ে দিতে দেবোনা।”

আঙুল উঁচিয়েও তা নামিয়ে নেন জাহিদ,তিনি জানতেন আফিয়া রাজি হবেনা। তাকে জোর করে রাজি করানোও কোনো ব্যাপার না, তবে দর্শনের সামনে তিনি কিছুই করতে পারছেন না। যত যাই হোক, এই ছেলে শুধু মুখে কথা বলবে তেমন নয়, কাজেও করে দেখাতে পারে। তাই এই মুহূর্তে কথা বাড়াতে চাইলেন না তিনি, নিঃশব্দে চলে গেলেন সিঁড়ির দিকে। দর্শন পিছন থেকে বলে উঠলো,
_”যাচ্ছো যাও, কিন্তু নেক্সট টাইম এমন কথা শুনলে কিন্তু আমি বলতে আসবোনা..”

জাহিদের সঙ্গে তার মা হালিমাও চলে গেলেন। মাহমুদা সব কথার মাঝে নিরব দর্শক হিসেবেই রইলেন। ভাইয়ের সংসার, সেখানে তার কথা বলার কোনো ইচ্ছেও নেই।
আফিয়া মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পরলেন, দর্শন না এলে জাহিদ ঠিকই কোনোভাবে তাকে রাজি হতে বাধ্য করতো। দর্শনের কথা মাথায় আসতেই আফিয়া তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
_”কিন্তু দর্শন, তুমি কি করে জানলে এসব?”

দর্শন নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
_”সেটা জানতে হবেনা। যেকোনো ভাবেই হোক, জানতে যে পেরেছি এটাই বড় ব্যাপার।”

আর পিছনে ফিরে তাকালো না দর্শন। অনেক তাড়াহুড়ো করে কুয়াকাটা থেকে ফিরেছে, বর্তমানে সাওয়ার নেওয়া অতিমাত্রায় প্রয়োজন তার জন্য।

____
_”সারাদিন বইয়ের মধ্যেই ঢুকে থাকবি?”

ঘড়িতে দুপুর ৩ টের কাছাকাছি সময়। বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিলো রজনী,হাতে তার গল্পের বই। দর্শনের কণ্ঠ শুনে বইটা নামিয়ে নিলো সে, ততক্ষণে দর্শন বিছানার অন্যপাশে এসে বসেছে।
রজনী বইটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে বললো,
_”তো, কি করবো?”

_”কাজের অভাব আছে দুনিয়ায়?”
সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো দর্শন। রজনীও তেমনভাবেই বললো,
_”বই পড়ার চেয়ে ভালো কাজ দুটো নেই।”

দর্শন কিছু বলার আগেই রজনী পুনরায় প্রশ্ন করলো,
_”তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে কেনো?”

ফোনে কিছু টাইপ করতে করতে দর্শন উত্তর দিলো,
_”টপ সিক্রেট..”

উঠে দাঁড়ালো দর্শন। মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে ফোন পকেটে রেখে বললো,
_”পাঁচটায় পড়াবো,গ্রুপ এও জানিয়ে দিয়েছি। চলে আসিস।”

_”আজই পড়াবে?”

_”হুম, এসেই যখন পরেছি তখন আর বন্ধ দেবো কেনো। প্যারা নাই, পড়া নেবোনা আজ।”

_”তার জন্য না, পড়া তো আগেই শেষ হয়ে গেছে। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”

_”আচ্ছা।”

দর্শন দরজার দিকে পা বাড়াতেই রজনী বলে ওঠে,
_”দর্শন ভাই, একটা কথা বলি?”

ঘাড় ঘুরিয়ে রজনীর দিকে তাকালো দর্শন। হাতে থাকা ঘড়ির দিকে নজর দিয়ে বললো,
_”পরে বলিস? বেরোবো এখন..”

রজনী বিরক্তির ভাব নিয়ে বুকে হাত গুঁজে বলে,
_”এমন বুক ফুলিয়ে চললে, যেন কতো মহান কাজ করতে যাচ্ছো তুমি! ভাবো একটু,এগুলো খাওয়া ভালো না।”

_”আরেহ.. কতো কিছুই তো ভালো না। যেমন প্রেমে পরাও তো ভালো না,তবুও মানুষ প্রেমে পরবেই। তাহলে তোরা এই একটা জিনিস এর দিকেই নজর দিস কেন?”

_”কিসের সাথে কিসের তুলনা!”

হাসলো দর্শন,বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। ড্রইং রুমের দিকে যেতেই জাহিদের সঙ্গে দেখা হয় তার। জাহিদকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই পিছন থেকে তিনি বলে ওঠেন,
_”দাড়াও,আমার কথা আছে তোমার সঙ্গে..”

#চলবে?

আনকোরা কাহিনী পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0

#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

দুলাভাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ভাইয়া তার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বললো, ” কি লাভ পেলেন দুলাভাই? অন্যায় কাজে কি কোন শান্তি আছে? বরং আমায় বোনের জীবনটা উলোটপালোট হয়ে যাবে।”

দুলাভাই কিছু বললেন না। শরিফও মাথা নিচু করে আছে। ভাইয়া আমায় বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। নিজেও আমার পিছন পিছন বেরিয়ে এলো। এখন যা হবার তা কোর্টে হবে। পুলিশের হাতে তেমন কিছু নেই। বড় আপা কি এসব সহ্য করতে পারবে? ভাবতেও ভয় লাগছে।

” রাতুল, আইসক্রিম খাবি?”

” না, ইচ্ছে করছে না। বড় আপার কথা ভাবছি। আপা নিজেকে সামলাতে পারবে তো?”

” আপা খুব শক্ত মেয়ে। যে কোন পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার শক্তি তার আছে। চিন্তা করিস না। ”

” একটা কথা বলো তো। শরিফ সকালবেলা ভাবীকে কল দিলো কেন?”

” রাতে ওর মোবাইল দিয়ে শরিফকে কল দিয়েছিলাম। রিসিভ করেনি। মেয়েদের কন্ঠ শুনলে অনেক পুরুষ গলে যায়। এমনি খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলাম। দুলাভাই কি করছে না করছে। তখনও শরিফকে সন্দেহ করিনি। তাছাড়া তোর ভাবী তো খুব সুন্দরী। শরিফে মতো চরিত্রবান ছেলে সুন্দরী মেয়ে দেখলে গলে যায়। ”

” কিছু বুঝলাম না। ”

” কিছু বুঝতে হবে না। চল, হাসপাতালে যাবো। ”

” তুমি যাও। আমার একটু কাজ আছে। একজনের সাথে দেখা করতে হবে। ”

” কার সাথে? বান্ধবী নাকি?”

” না। আমার কোন বান্ধবী নেই। ”

” দেখি আপা সুস্থ হোক। তোর বিয়ে দিতে হবে। অনেক বড় হয়ে গেছিস। ”

ভাইয়া বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগছে না। এই ছেলে কি আমায়ও সন্দেহ করছে নাকি? নতুন গোয়েন্দাদের মাথায় নানা রকমের ভূত ঘোরে। যে কাউকে সন্দেহ করে বসে।ভাইয়াকে বিদায় দিয়ে থানায় ঢুকলাম। শরিফর কাছে গিয়ে বললাম,” শরিফ, একটা সত্যি কথা বলবে?”

” কি কথা? তুমি আবার ফিরে এলে কেন? সবই তো শুনলে। আর কিছু বাকি নেই।”

” আমার লাল শার্ট তুমি কোথায় পেলে? সত্যি কথা বলো।”

” তোমার ভাবীর কাছ থেকে নিয়েছিলাম। ”

” কিভাবে? ভাবী তোমায় আমার জামা কেন দেবে?”

” এতো কথা তোমায় বলবো কেন? ”

” পুলিশকে তো বলবে, দাঁড়াও ওদের ডাক দিচ্ছি। ”

” হাতি কাঁদায় পড়তে তেলাপোকাও লা’থি মা’রে। একটা শার্টের জন্যই তো তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম। কিন্তু কার কাছে চাইবো বুঝতে পারছিলাম না। অবশ্য চু’রি করা যেত। কিন্তু তুমি তো মুরগির মতো ঘরে বসে থাকো। চু’রি করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তাই নিজের জামায় ইচ্ছে করে পানি ঢেলে দিয়ে তোমার ভাবীর কাছে একটা জামা চাইলাম। সে আমাকে ওই জামাটা এনে দিয়ে বললো,” এটা রাতুলের জামা। আমার কাছে ছিলো। দেওয়া হয়নি। এটা পরো। রাতুল কিছু বলবে না। ”

জামার ব্যাপারে ভাবীকে সন্দেহ করছিলাম। এখন আর সেই সন্দেহ নেই। হাসপাতালে যেতে হবে, ভাইয়া বোধহয় এতক্ষণে চলে গেছে।
ভেবেছিলাম ভাইয়া চলে গেছে কিন্তু না। ভাইয়া রাস্তার ওপাশে একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছে। এই গরমে কেউ চা খায় নাকি!

সবকিছু জানার পর বড় আপা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শান্ত গলায় বললো, ” ওদের কেমন শা’স্তি হবে? ফাঁ’সি হওয়ার সম্ভাবনা আছে? ”

ভাইয়া বললো, ” না আপা। ফাঁ’সি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে যথাসম্ভব জোরালো শা’স্তি আবেদন করবো। ”

” ফাঁ’সি হলেই ভালো হতো। এদের মতো মানুষের জন্য বিধবা মেয়েরা শান্তিতে থাকতে পারে না। তিনুর মায়ের কথাটা একটু ভাব।”

“আপা, তুমি কষ্ট পাচ্ছো না?”

” না ভাই। পাচ্ছি না। বরং শান্তি লাগছে। মুক্তির শান্তি। ”

আপা কথা এতটুকুও মিথ্যে নয়। আপার চোখ-মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হয়তো কোন আশা খুঁজে পেয়েছে।
আপার সুস্থ হতে মাসখানেক লাগলো। তবুও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। দুলাভাইয়ের কোন সুরাহা হয়নি। কে’সের তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছে। আদালত রায় দিচ্ছে না। ওরা খুব নামকরা উকিল ঠিক করেছে। সে ওদের বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মানুষ টাকার কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেয়! ভালো-মন্দ হিসাব করে না।

বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম। এমন সময় বড় আপা এসে আমায় ডেকে তুললো। আদুরে গলায় বললো, ” আমার সাথে একটু যাবি। বেশিক্ষণের কাজ না। ঘন্টাখানেক লাগবে। ”

” কোথায় যাবে? তুমি তো এখনও সুস্থ হওনি।”

” ও বাড়িতে যাবো। কিন্তু জিনিস আনতে হবে। ”

বড় আপা খুব জেদি। একবার কিছু বললে না করা পর্যন্ত শান্ত হয় না। তাই তাকে না করার সুযোগ হলো না। নীল শার্টটা গায়ে ঝুলিয়ে আপার সাথে গেলাম। ও বাড়িতে গিয়ে আপা কারো সাথে কথা বললো না। সোজা নিজের ঘরে ঢুকে সোনার গহনাগাঁটি ব্যাগ ভরতে লাগলো। আপা শাশুড়ি তেড়ে এসে তীক্ষ্ণ গলায় বললো, ” এসব নিচ্ছিস কেন? এসব কি তোর বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিস?”

” হ্যাঁ। এগুলোর বেশিরভাগ জিনিস আমি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। শুধুমাত্র এগুলো নয়। আপনার বসার ঘরে পাতানো সুন্দর সোফাটা আমার বাবার দেওয়া। রান্নাঘরের গ্যাসের চুলা থেকে বেশিরভাগ জিনিস আমি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। আজ তো শুধু গহনা নিয়ে যাচ্ছি। দু’দিন পর এসে এগুলোও নিয়ে যাবো। এছাড়া তিন লাখ টাকা রেডি রাখবেন। আপনার ছেলেকে ব্যবসার জন্য এনে দিয়েছিলাম। ”

আপার শাশুড়ি খানিকটা দমে গেলো। স্বর নিচু করে বললো, ” মাইয়া গো জীবনে স্বামীই সব। ঝগড়া সংসারের বাতির মতো। সবকিছু ভুইলা তুমি এ বাড়িতে চলে আসো। আমরা তো তোমায় ভালোবাসি। ”

” না, আপনারা আমায় ভালোবাসেন না৷ একটা সন্তান হওয়া নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছেন। কত কবিরাজ ওঝার কাছে নিয়ে গেছেন। অথচ সমস্যার আপনার ছেলের। যাইহোক পুরনো কথা তুলতে চাই না। সত্যি কথা কি জানেন, কাঁচা লোহা বেশি পিটালে অ’স্ত্র হয়ে যায়। পরেরবার থেকে সাবধানে থাকবেন। আসি। ”

আপা আর কোন কথা বললো না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। আমি অবাক হয়ে আপাকে দেখছি। মানুষটা কতটা বদলে গেছে। এই আপা একসময় শশুরবাড়ির জন্য পাগল ছিলো। প্রতি রোজায় ইফতার, দুই ঈদে জামাকাপড়। কোন কিছু বাদ যেতো না। বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়া সবকিছু দিয়ে এসেছে। মানুষ কত বদলে যায়।

” কাল একটু থানায় যাবি? কাজ আছে।”

” দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করবে? ”

” তালাকনামা চাইবো। ”

বহুদিন বাদে আপা খুব সুন্দর করে সেজেছে। পরনে হালকা গোলাপি শাড়ি, খোঁপায় বেলি ফুলের মালা, দুটো কাঁচা গোলাপ বসানো। আপা একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া কোন মেয়েকে এতো সুন্দর দেখায় জানা ছিলো না। বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্না হচ্ছে। কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি কে জানে। ভাবী আমায় আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো, ” আজ বড় আপাকে দেখতে আসবে। তুমি ভালো কিছু পরে নাও। বাজারের গিয়ে মিষ্টি নিয়ে এসো। ”

” আপার বিয়ে ঠিক করলো কে? তাছাড়া পাত্র কে?”

” তোমায় ভাইয়ের কলিগ। মিরাজ সাহেব। লোকটা বেশ ভালো। প্রথম বউ মা’রা গেছে। কোন ছেলে-মেয়ে নেই। এখানেই বাসা ভাড়া করে থাকে। ”

” আপা রাজি?”

” হুম। যারা কষ্ট দেয় তাদের জন্য অপেক্ষা করতে নেই। ফিরে যাওয়াটাও বোকামি। যাইহোক।”

মিরাজ সাহেব আসলেই বেশ ভালো মানুষ। হাসিখুশি। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আপার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে, পরক্ষণে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। আগের দুলাভাই মাস চারেক আগে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। সে সময় আপা একটুও কাঁদেনি। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলো। জীবন কত বিচিত্রময়! মানুষ কতশত স্বপ্ন দেখে কিন্তু তার বেশিরভাগ বাস্তবে ধরা দেয় না৷ আপা ওই খারাপ মানুষটাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালেবেসেছে। জীবনের সবকিছু উজাড় করে তার সাথে সুখী হতে চেয়েছে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আচ্ছা আপার জীবনটা কি অন্য রকম হতে পারতো না? হয়তো পারতো, নয়তো পারতো না।

কোন এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় আপার সাথে মিরাজ ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। এ বাড়িতে ওদের বাসর হবে। ছোট আপা অকারণে ছোটাছুটি করছে। তার বয়স বেশ অনেকটা কমে গেছে। বৃষ্টির মধ্যে আমায় দোকানে পাঠালো। ফুল আনতে হবে। বাসরঘর ফুল ছাড়া মানায় না। কাগজের ফুল হলে হবে না। কাঁচা ফুল আনতে হবে। ফুল খুঁজে পেতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হলো। বৃষ্টিতে ফুলের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। অবশেষে কাক ভেজা অবস্থায় বাড়ি ফিরলাম। ছোট আপা দৌড়ে এসে বললো, ” ফুল এনেছিস? এতো দেরি করলি কেন? রাত শেষ হলে ঘর সাজাবো নাকি? ”

” এনেছি৷ ”

ছোট আপা আমার হাত থেকে ফুলের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো। আমার দিকে ফিরে তাকানোর সময় হলো না তার। সকলে বসার ঘরে গল্প করছে৷ ভাবী কারণে অকারণে হাসছে৷ মা’য়ের চোখের কোণে অশ্রু টলটল করছে। বারবার আঁচলে চোখ মুছছে। শুধুমাত্র ছোট আপা এখানে নেই৷ সে ঘর সাজাচ্ছে। কি এমন ঘর সাজাচ্ছে দেখতে সেদিকে উঁকি দিলাম। ছোট দুলাভাই আমায় দেখে বেশ লজ্জা পেলো। তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ছোট আপা স্বাভাবিক গলায় বললো, ” সাজানো শেষ। দেখ তো কেমন হয়েছে। ”

ঘরটা সত্যিই খুব সুন্দর করে সাজানো। বিছানায় আকাশী রঙের চাদর। তাতে সাদা আর লাল ফুলের কাজ। পাশের টেবিলে ফুলদানি ভর্তি গোলাপ ফুল। খাটের কোনায় রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে। ঘরের চারকোণায় চারটে ঘিয়ের প্রদীপ। আবছা আলোয় ঘরটা একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। কে বলছে অপ্রকাশিত ঘটনায় জীবন থেমে যায়? জীবন তো কখনও থামে না। নদীর মতে বয়ে চলে। পাহাড় জঙ্গল ছাড়িয়ে সাগরের খোঁজে। সাগরটাই বুঝি সব সুখের নীড়!

সমাপ্ত

আনকোরা কাহিনী পর্ব-০৬

0

#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-৬

আজ-কাল বড্ড অদ্ভুত লাগে সবকিছু। হঠাৎ চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে যায়। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। যেন কত হাজার বছর না ঘুমিয়ে আছি। কি তীব্র সেই ঘুমের তেষ্টা! ভাইয়ার ঠোঁট থেকে হাসির রেখা মুছে গেছে। একরাশ কালো মেঘ এসে ভীড় করেছে হাস্যজ্বল মুখে।

“ শরিফের সাথে কি কথা বলছিলে?”

ভাইয়ার প্রশ্নে ভাবী একটু ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো, “তেমন কিছু না। এমনি খোঁজ নিচ্ছিলো। তুমি কোথায় আছো জানতে চাইলো।”

“ তুমি কি বললে?”

“ বলেছি বাড়িতেই আছো। কিন্তু শরিফ হঠাৎ তোমার কথা জানতে চাইলো কেন বুঝলাম না।”

“ আমাদের বের হতে হবে। খাবার রেডি করো।”

ভাইয়া আমার হাত ধরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চাপা গলায় বললো, “ আজ অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে বের হতে হবে। না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

“ কোথায় যাবো আমরা? আর তুমি ভাবীর কথা বিশ্বাস করে নিলে? হয়তো শরিফের সাথে অন্য ব্যাপারে কথা হচ্ছিলো।”

“ হলেও জানতে পারতাম। কল রেকর্ড করা থাকবে। চিন্তা করিস না। আজ অপরাধী ধরা পড়বে।”

“ ভাবীকে লাল জামার কথা জিজ্ঞেস করেছিলে?”

“ হ্যাঁ। তার কিছু মনে নেই।”

ভাইয়া নিজের রুমে চলে গেল। ভাবীর ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করলাম। ভাবী কখনও মিথ্যা কথা বলে না। সেবার মা’য়ের ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা হারিয়ে গেল। মায়ের ভীষণ মন খারাপ। কোথায় না কোথায় রেখেছে মনে করতে পারছে না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভাবী বললো, “ টাকাটা আমি নিয়েছি। খুব প্রয়োজন ছিলো। আপনাকে খুঁজেছিলাম কিন্তু পাইনি। বেতন পেলে দিয়ে দেবো।”

সবাই মনে করেছে ভাবী মা’কে স্বান্তনা দিতে চাচ্ছে। কিন্তু না, সে সত্যি বলেছিলো। মা’য়ের ব্যাগ থেকে টাকা নিতে আমি দেখে ফেলেছিলাম। ভাবী অবশ্য আমাকে দেখেনি।

সকালের রান্না শেষ। গরম ভাতের সাথে দুই রকমের ভর্তা, ডিম ভাজা আর পাতলা ডাল। খাবারগুলো টেবিলের ওপর খুব সুন্দর করে সাজানো। দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে। তবে ভাইয়া খাওয়ার সময় দিলো না। হাত ধরে টানতে টানতে বললো, “ চল। দেরি হলে আর পাবো না।”

ভাবী হা করে আমাদের চলে যাওয়া দেখলো। ছোট আপা মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। এ দৃশ্য দেখে সে খুব হাসছে।

“এমন তড়িঘড়ি করে নিয়ে এলে কেন? কোথায় যাচ্ছি?”

“ আপাতত বাসস্ট্যান্ডে, সেখান না পেলে বিমানবন্দর যেতে হবে। সেরকম হলে তুই যশোর যাবি, আমি ঢাকা যাব।”

“ কেন যাবো?”

“ শরিফকে ধরতে। ও দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।”

“ তোমায় কে বললো?”

“ সকালে তোর ভাবীকে কল দিয়ে বলেছে। আমাদের সন্দেহের ব্যাপারে শরিফের ধারণা নেই।”

“ তুমি এতোটা নিশ্চিত হচ্ছো কিভাবে? এটা তো ওর চাল হতে পারে।”

“ পারে না। কাহিনীর খানিকটা আমার কাছ পরিষ্কার হয়ে গেছে। এসব কাজের পিছনে শরিফ দায়ী। কিন্তু কেন তা জানি না। দুলাভাই নিজের ভাইকে বাঁচানোর জন্য নকল পুলিশ নিয়ে এসেছে। ক’দিন পুলিশ পুলিশ খেলা চলবে। এই সুযোগে ভাইকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে।”

“ এতোসব খবর তোমায় কে দেয়?”

“আমার এক বন্ধু দেয়। ওকে একটু খোঁজ নিতে বলেছিলাম।”

“ বাবাহ! পাকা গোয়েন্দা হয়েছো দেখি।”

“ বলছিস?”

“ হ্যাঁ। বললাম। আপার অবস্থা জানো? দুলাভাই কোথায়?”

“ আপা আগের থেকে বেশ ভালো। ক্ষত শুকাতে শুরু করেছে। ক’দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে।”

সকালের রোদ এতো তীব্র হয় জানা ছিলো না। গা পুড়ে যাওয়ার মতো রোদ। অথচ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রিকশা নিয়ে বাসস্ট্যান্ড চলে গেলাম। ভাইয়ার সন্দেহ শতভাগ ঠিক। দুলাভাই শরিফকে নিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শরিফ যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। ভাইয়া ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। হাসি মুখে বললো, “ বেয়াই সাহেব কোথাও যাচ্ছো নাকি?”

শরিফ হাসতে চেষ্টা করে বললো, “ হ্যাঁ বেয়াই। ঢাকায় একটা চাকরি পেয়েছি। ওখানেই থাকবো।”

“ কেমন চাকরি?”

“ ভালো চাকরি। মেয়ের বাপরা এক চান্সে মেয়ে বিয়ে দেবে এমন ভালো।”

“ আমি তোমার বিনা পয়সায় খাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। যদি তুমি চাও।”

দুলাভাই পাশে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে। হয়তো কোন দুশ্চিন্তায় আছেন। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম, “ দুলাভাই শুধু নিজের ভাইকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি কি আপনার পর?”

দুলাভাই হাসলেন। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে মানুষ এমন করে হাসে। তরল গলায় বললেন, “ তোমার জন্যও ব্যবস্থা করবো। সময় আসুক। তোমার আপা সুস্থ হোক।”

আমি হাসলাম। দুলাভাই কিছু একটা ভেবে বললেন, “ তোমায় সন্দেহ করে ভুল করেছিলাম। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওরা তোমার ব্যাপারে কোন সূত্র পায়নি। কিছু মনে করো না ভাই। ওই পরিস্থিতিতে কিছু খেয়াল ছিলো না।”

ভাইয়া দুলাভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো, “ নাকি নিজের ভাইকে বাঁচাতে আমার ভাইকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছিলেন। কাজটা কি ঠিক?”

“ এসব কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?”

“ খুব আছে।”

চার-পাঁচজন পুলিশ এসে আমাদের ঘিরে ধরলো। শরিফ বোধহয় খুব ভয় পেয়েছে। দৌঁড়ে পালাতে গেলো। কিন্তু লাভ হলো না, একজন পুলিশ ওর হাত চেপে ধরলো। পুলিশটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে হাত ভেঙে ফেলবে।

“ দুলাভাই সব খেলা শেষ। আপনার ভাই যেমন আপনার কাছে প্রিয়। আমার ভাই-বোনও আমার কাছে প্রিয়।”

দুলাভাইয়ের চোখেমুখে আতঙ্ক। শেষ রক্ষা করতে না পারার আফসোস। পুলিশের জিপে করে থানায় গেলাম। ওখানেই জিজ্ঞেসাবাদ হবে। দারোগা সাহেব নিজেই আমাদের যেতে বললেন।

দুলাভাই আর শরিফ চেয়ারে বসে আছে। একজন কনস্টেবল লাঠি হাতে ওদের পাশে দাঁড়ানো। দারোগা সাহেব বরফ শীতল গলায় বললেন, “ আশা করি, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে ধারণা আছে। যদি সত্যিটা বলে দাও তাহলে কষ্ট কিছুটা কম হবে। না হলে তো বুঝতেই পারছো।”

শরিফ চাপা গলায় বললো, “ ভাইয়ার কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার।”

“অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করাও একটা অপরাধ। যাইহোক তুমি তোমার কথা বলো।”

“ ভাবীদের বাড়িতে এক মহিলা ভাড়া থাকে। অসম্ভব রূপবতী। আমি তাকে খুব পছন্দ করি। ভালোও বাসি। নানানভাবে প্রস্তাব দিয়েছি। কখনও রাজি হয়নি। ভালোভাবে বুঝিয়েছি, ভয় দেখিয়েছি। কিছুতেই কিছু লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সে ভাবীর কাছে আমার ব্যাপারে নালিশ করলো। ভাবী খুব বাজে ভাষায় আমাকে গা’লা’গা’লি করলো। থা’প্প’ড় মা’রলো। এই পর্যন্ত হলেও ঠিক ছিলো। কিন্তু না, ভাবী থামলো না। মা’কে নালিশ করলো, ভাইয়াকে যা ইচ্ছে তাই বললো। সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি ওই মহিলাকে আমি জব্দ করে ছাড়বো। কিন্তু ভাইয়ার কারণে কখনও ভাবীর কিছু করতে পারিনি।

এরপর থেকে অন্য পরিকল্পনা করলাম। যে ভাবীকে নালিশ করছে তাকে চরম শিক্ষা দেবো। এমন দশা করবো যে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। পথের ফকির বানিয়ে দেবো একদম।

কিন্তু ও বাড়িতে তেমন যাওয়া-আসা ছিলো না। ভাবীর রাগারাগি পর একদমই যেতাম না। ভাবলাম রাতুলের মতো সেজে কাজটা করলে কেমন হয়। রাতের অন্ধকারে সবাই আমাকে রাতুলই ভাববে।
পরিকল্পনা মতো ভাবীদের বাড়ি গেলাম। আমার রাতুলের একটা জামা প্রয়োজন ছিলো। যাতে দূর থেকে আমায় রাতুল মনে হয়। একই পারফিউম, হাতের ওর মতো তিল। দিন-রাত ওকে ফলো করা শুরু করলাম। কিভাবে হাঁটে, কেমন কথা বলে। পরিকল্পনা তৈরিই ছিলো। দরকার ছিলো সুযোগে। কয়েকদিন আগে জানলাম রাতুল নাকি কিসব কান্ড করেছে, ভাই প্রচন্ড রেগে গেছে। তক্ষুনি ভাবীকেও ও বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। আমি ভাবলাম এই সুযোগে মিস করা যাবে না। রাতের থেকে দিনের বেলা বেশি সুবিধা হবে। মুখে চাদর জড়িয়ে নেবো। দূর থেকে কেউ দেখে ফেললে রাতুল ভাববে। ভাবনা মতো রাতুলের জামা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ালাম।

ইচ্ছে ছিলো তিনুদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবো। হাঁস-মুরগি টাকা পয়সা শেষ করে দেবো। তারপর অন্য পরিকল্পনা।

কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না। ভাবী আমাকে তিনুদের ঘরের কাছে দেখে ফেললো। ভাবীকে পুরনো রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। কেন না আজ এই মহিলাকেই শেষ করে ফেলি। কোমরের গোঁজা ছু’রিটা বের করে দিলাম কাজ হাসিল করে।”

শরিফ থামলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এক নাগাড়ে কথা বলায় হাঁপিয়ে গেছে। দারোগা সাহেব ওর দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। দুলাভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ এবার আপনি বলুন। চুপ করে লাভ নেই। আমাদের কথা আদায় করার ধরণ জানা আছে। এর চেয়ে নিজে থেকে বলে দিলেই লাভ।”

দুলাভাই কটমট দৃষ্টিতে শরিফের দিকে তাকালেন। বিড়বিড় করে কয়েকটা গা’লিও দিলেন। হয়তো তিনি এমনটা আশা করেননি। দারোগা সাহেব হাসলেন। ঝলমলে গলায় বললেন, “ এ লোক ভালো কথায় শুনবে না। সেল রেডি করো।”

“ বলছি।”

“বেশ তো শুরু করুন।”

দুলাভাই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন –

“ সকাল থেকেই মাথা গরম ছিলো। খাটে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় শরিফ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। ভিতু গলায় বললো, “ সর্বনাশ হয়ে গেছে। খুব বড় ঝামেলা করে ফেলেছি।”

“ কি হয়েছে? কি করেছিস?”

“ ভাবীকে ছু’রি মে’রেছি।”

“ মজা করিস না। মেজাজ গরম৷”

“ সত্যি কথা বলছি। এক্ষুনি আমায় দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। না হলে”

“ না হলে কি? কি করবি তুই? তোকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত।”

“ তোমার মা’দ’কের ব্যবসার খবরটাও পুলিশে দেওয়া উচিত। ফাঁ’স’লে একসাথে ফাঁসবো। তাছাড়া ভাবীর ওপর এতো প্রেম এলো কবে থেকে? সে ম’র’লে তো তুমিও বেঁচে যাও।”

“ শরিফ! সীমা ছাড়িয়ে যাস না।”

“হাতে সময় নেই। ওরা পুলিশে খবর দিতে পারে। চিন্তা করো না। ভাবীর বেশি লাগেনি। ওরা হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তোমার বউ ম’র’বে না। আমাকে বাঁচাও।”

হাসপাতালে এলাম। মিতালির অবস্থা দেখার পর মনে হলো শরিফের কথা মেনে নেওয়াই ঠিক। মিতালির তেমন কিছু হয়নি। ঠিকমতো ওষুধ খেলে সেরে উঠবে। কিন্তু এসব ব্যাপার নিয়ে জলঘোলা হলে সমস্যা। শরিফ আমার গোপন ব্যাপার ফাঁস করে দিতে পারে। তাই কয়েকজন লোক ভাড়া করলাম। তাঁদের পুলিশ সাজিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কই!”

ভাইয়া শান্ত গলায় বললো, ” দুলাভাই, অপরাধী ঠিকই শা’স্তি পায়। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

দুলাভাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

চলবে

আনকোরা কাহিনী পর্ব-৫

0

#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৫

ভাইয়া হাসপাতালের পেছনে ল্যামপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে তেমন লোকজন নেই। পরিষ্কার রাস্তা। ল্যামপোস্টের আলোয় চিরপরিচিত মানুষটাকে বড্ড অদ্ভুত দেখাচ্ছে। একদম অচেনা। তার ডান হাতে একটা ছু’রি চকচক করছে। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। কি অদ্ভুত সেই হাসি। সারা শরীরের লোক দাঁড়িয়ে যায়। একি! রাস্তাটা এতো দুলছে কেন? রাস্তা কি কখনও দুলতে পারে? না না এ আমার মনের ভুল। আমার মস্তিষ্ক আমায় ভুল দেখাচ্ছে। দু’জনের মাঝে কয়েক মুহুর্তের রাস্তা, অথচ এ পথকে অসীম মনে হচ্ছে। ভাইয়া এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলো। মততা মেশানো ভীতু গলায় বললো, ” ঠিক আছিস? এমন কাঁপছিস কেন? জ্বর নাকি?”

উত্তর দিলাম না। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। ভাইয়া কপালে হাত রাখলো। বরফের মতো ঠান্ডা হাত। ব্যস্ত গলায় বললো, ” গায়ে তো জ্বর। জ্বর বাঁধালি কিভাবে?”

” জানি না। কেন ডেকেছো আমায়? খু’ন করতে চাও? বড় আপাকে মা’র’তে পারোনি বলেই কি আমায় মা’র’তে চাইছো?’

ভাইয়া জোরে চিৎকার করে উঠলো। ব্যস্ত গলায় বললো, ” রাতুল কি হয়েছে তোর? বিড়বিড় করে কি বলছিস? চল, ওদিকটায় গিয়ে বসবি। তোর শরীর ভালো নেই।”

কৃষ্ণচূড়া গায়ের নিচে গিয়ে বসলাম দু’জনে। গাছটার নিচ শান বাঁধানো। ভাইয়া হাতের ছু’রিটা আমার দিকে উঁচু করে ধরে বললো, ” এটাকে চিনতে পারছিস? ”

খুব ভালো মতো দেখে বললাম, ” না। চিনতে পারছি না। ”

” মনোযোগ দিয়ে দেখ। এই ছুরিটা আমরা দু’জনে আব্বার সাথে গিয়ে বানিয়ে এনেছিলাম। ছুরিতে আমাদের নামও খোদাই করা আছে। বিয়ের পর বড় আপা এই ছু’রিটা নিয়ে গেছিলো। এই ছু’রি ছাড়া সে কাজ করতে পারতো না।”

” হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি এটাকে কোথায় পেলে?”

” তিনুদের ঘরের ওদিকে ঝোপের ভেতর। এমনভাবে পড়ে ছিলো যেন কেউ দূর থেকে ছুঁড়ে মে’রেছে। ”

” ছু’রিতে র’ক্ত আছে নাকি? ”

” না নেই। তবে আমার ধারণা আপাকে এই ছু’রি দিয়ে আ’ঘা’ত করা হয়েছে। ”

“কিভাবে বুঝলে?”

” ছু’রিটা আপার বাড়ি থেকে একা একা ওখানে যায়নি। কেউ না কেউ নিয়ে এসেছে। তাছাড়া ওমন ঝোপঝাড়ে কেউ ছু’রি নিয়ে যায় না। ”

” হতেও পারে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। খাপছাড়া খাপছাড়া ভাব।”

” কোন কিছু এলোমেলো হয়ে নেই। সবকিছু পরিকল্পনা করা। শুধু আমাদের চোখে পড়ছে না। এ বড় পাকা হাতে কাজ। সহজে বোঝা যাবে না। ”

“কে করবে এমন? তুমি কি কাউকে সন্দেহ করছো? দুলাভাই তো আমায় সন্দেহ করছে। আমার আবার তাকেই সন্দেহ হয়। বিপরীতমুখী ব্যাপার।”

” আমারও দুলাভাইকে সন্দেহ হয়। লোকটা মোটেও সুবিধার না। আপাকে ঘাড় থেকে নামাতে এমনটা করতে পারে। ”

” তালাক দিলেই বা দোষ কি? সোজা মা’রতে চাইবে কেন?”

” আপা প্রথম থেকেই স্বামী ভক্ত। স্বামীকে ভালোবেসে বাপের বাড়ি থেকে যা পেয়েছে দু’হাতে নিয়ে গিয়েছে। দাদির গহনা থেকে শুরু করে মা’য়ের আংটি পর্যন্ত। এমনকি ওর বরের কথায় ছোট আপার হীরের আংটিও চু’রি করেছে। সবকিছু মিলিয়ে এমন বউকে তালাক দিলে সেসব জিনিসপত্র নিয়েছে সবকিছু ফেরত দিতে হবে। এতে তার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। ”

” ছোট আপার আংটির ব্যাপারটা তুমি জানো? ”

” শুধু জানি না। ছোট আপাকে অমন একটা আংটিও বানিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা আমি আর ছোট আপা বাদে আর কেউ জানে না। আমি কখনও ভাইবোনের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইনি। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। ভালো-মন্দ পর্যন্ত বিচার করিনি। চেয়েছি যেন সবাই ভালো থাকে। ”

” বড় আপা বলছিলো হামলাকারীর পরনে আমার লাল শার্ট ছিলো। সেই শার্ট আবার বড় আপা ভাবীর কাছে দিয়েছিলো। ”

” এ ব্যাপারে কিছু জানি না। তদন্তের ব্যাপারে নিজেকেও বিশ্বাস করতে নেই। বাড়ি গিয়ে ভাবীর কাছে জিজ্ঞেস করে দেখিস। ”

” আচ্ছা বেশ। আমার কি মনে হয় জানো? সবকিছুর সাথে তিনুর মা’য়ের কোন না যোগসাজশ আছে। না হলে এতো জায়গা থাকতে ওর বাসার কাছেই কেন?”

” সবদিক থেকে দুলাভাইকে সন্দেহ হয়। এখন দরকার প্রমাণ। আমি পুলিশে সবকিছু জানিয়েছি। ওরা তদন্ত করছে। দেখা যাক কি হয়!”

” ভাইয়া!”

” বল। ”

” একটু আগে সেই মহিলা পুলিশকে দেখলাম, যে আমাদের বাড়িতে গেছিলো। ”

” আগে বলবি না। চল। কোথায় দেখেছিস?”

সে জায়গায় কাউকে পেলাম না। লোকজনের ভীড়ে মেয়েটা হারিয়ে গেছে। এতোটা দৌঁড়ে আসার ফলে ভাইয়া খুব হাঁপাচ্ছে।

” রাতুল, দু’টো ঠান্ডা কিনে নিয়ে এসে রিকশায় ওঠ। বাড়ি যেতে হবে। ”

” বাড়িতে ভাবী কাঁদছে। তুমি নাকি কোন মেয়ের সাথে পালিয়ে গেছো! ”

” হা হা হা। জানি আমি। ”

” জেনেশুনে এমন করো কেন?”

” ভালো লাগে। ”

” ভাবীকে কাঁদাতে তোমার ভালো লাগে? তুমি তাকে ভালোবাসো না?”

” উহ! আমায় হারানোর ভয়ে কাঁদলে বেশ ভালো লাগে। অন্য ব্যাপারে নয়। তুই এখন বুঝবি না। পরে বুঝছি। তোকেও বিয়ে দিতে হবে দেখছি। ”

একি! আমার এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পাচ্ছি না তো? আয়না থাকলে একবার দেখে নিতাম গাল লাল হয়েছে কি-না। নাকি ছেলেদের গাল লাল হয় না? এটা কি শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে?

ফজরের আজান হয়েছে বেশ আগে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চারদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জানালা গলে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। দরজার ওপাশ থেকে ভাইয়ার গলা শোনা গেল। ফিসফিস করে কথা বলছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।

” কি হয়েছে? এতো সকালে ডাকছো কেন?”

” তিনুর মা’য়ের সাথে কথা বলতে যাব৷ তোর ভাবী কাল রাতে এলার্জির ওষুধ খেয়েছে। আটটার আগে উঠবে না। ছোট আপার কথা তো জানিসই। চলে আয়। ”

ভাইয়ার সাথে তিনুদের ঘরের দিকে গেলাম। তিনুর মা দরজার পাশে বসে কুরআন শরীফ পড়ছে। আমাদের দেখে ঘোমটাটা একটু টেনে দিলো। স্বাভাবিক গলায় বললো, ” কিছু বলবেন? ”

ভাইয়া স্বর নিচু করে বললো, ” তোমার সাথে কথা আছে। খুব জরুরি। ”

” কি কথা? বলেন। ”

” আপার ঘটনার দিন তুমি কোথায় ছিলে?”

” তিনুর সাথে স্কুলে গেছিলাম। চাইলে মাস্টারের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তারা সবাই আমাকে দেখেছে।”

” আহা। আমরা তোমায় বিশ্বাস করছি। তোমার সাথে কি কারো শত্রতা আছে?”

” কেমন শত্রুতা?”

” এমন কেউ যে তোমার ক্ষতি করতে চাইবে। ”

” না ভাই। তেমন কেউ নেই। ”

” মনে করে বলো। একজন মানুষ ম’রতে বসেছিলো। ”

” সত্যি কথা বলতে সবাইকেই আমার শত্রু মনে হয়। তিনুর বাবা মা’রা যাওয়ার পর শশুর মশাই খুব অশ্লীল কাজ করতে চেয়েছিলো। সেই থেকে কাউকে বিশ্বাস করি না। সে বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। তারা আমায় আবার বিয়ে দিতে চায়। কতই বা বয়স আমার, পোলাডা তাদের কাছে থাকবে। কিন্তু আমার মন তাতে সায় দেয়নি। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছি। কিন্তু এই রূপ বড্ড বেশি সমস্যা করেছে আমার জীবনে। কতশত প্রস্তাব পেয়েছি। বিয়ের, প্রেমের। কিছুই ভালো লাগে না। ”

” দুলাভাইও তোমায় কুপ্রস্তাব দিয়েছিলো তাই না?”

তিনুর মা বোধহয় খানিকটা বিব্রতবোধ করলো। স্বর বদলে বললো, ” হ্যাঁ। কিন্তু ঝগড়ার পরে আর দেয়নি। তবে উনার ভাইও খুব অসভ্য। ”

” কে? শরিফ? ”

” হ্যাঁ। আমায় অনেকবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। বিয়েও করতে চেয়েছে। একদিন উপায় না দেখে বড় আপার কাছে নালিশ করলাম। তারপর থেকে সব ঠিকঠাক। ”

” শরিফ তোমায় কোথায় বিরক্ত করতো? সে তো আমাদের বাড়ি আসে না। ”

” সব জায়গা। রাস্তাঘাট। তিনুর স্কুলের পথে। ”

” তোমায় অনেক ধন্যবাদ। ”

তিনুর মা ভালো-মন্দ কিছু না বলে ঘরের ভেতর চলে গেল। বোধহয় সে এখন কিছুক্ষণ কাঁদবে। অশ্রুভেজা চোখ কাউকে দেখাতে চায় না। ভাইয়া চোখ-মুখ চকচক করছে। যেন বিরাট কিছু করে ফেলেছে।

” রাতুল চল। পুকুর পাড়ে গিয়ে খানিকক্ষণ বসি। ”

সিঁড়ি বাঁধানো পুকুর। পুকুরের দু’পাশে ফুল গাছ। সবকিছু ভাইয়ার নিজ হাতে করা। মানুষটা বড্ড গোছালো স্বভাবের৷

” কিছু বুঝতে পারছিস?”

” না। ”

” বিশ্বাস হলো না। যাইহোক, আমিই বলছি। আমার মনে হয় এসবের পেছনে শরিফ জড়িয়ে আছে। তার সাথে দুলাভাই। দু’জনে মিলে এসব করেছে। সম্পূর্ণ দোষ তোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তোর মতো সেজে এসেছিলো। ”

” শরিফ এসেছিলো নিশ্চয়ই। দুলাভাইয়ের যে ভুঁড়ি!”

দু’জনেই শব্দ করে হেসে উঠলাম। ভালো লাগছে। বেশ ভালো। দু’জন মিলে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলাম। ভাবী চুলার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। খানিকটা চুপিসারে বলা চলে। ভাইয়া ভাবীকে হাসতে হাসতে বললো, ” শরিফের সাথে কথা বলছো নাকি? ”

ভাবী চমকে উঠলো। তার হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেলো। ভাইয়া স্বযত্নে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো। কল লিস্ট বের করে আমায় দেখিয়ে বললো, ” কার কল দেখছিস?”

কল লিস্টের শেষ নম্বরটা শরিফ ভাই নামে সেভ করা। কয়েক সেকেন্ড আগেই কথা হয়েছে। আমি হকচকিয়ে গেলাম। কিন্তু ভাইয়া তখনও হাসছে। কি সুন্দর সেই হাসি৷ এই মুহুর্তে কেউ এতো সুন্দর করে হাসতে পারে কিভাবে? নাকি ভাইয়া আগে থেকেই সবকিছু জানে। এসব ওদের পরিকল্পনা নয় তো? ভাবীর মুখেও ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। ছোট আপা কোথায়? আমি তাকে ডাকবো? চিৎকার করবো? মস্তিষ্ক কাজ করছে না কেন? ভালো একটা ডাক্তার দেখাতে হবে। আজ-কাল বড্ড অদ্ভুত লাগে সবকিছু।

চলবে

আনকোরা কাহিনী পর্ব-০৪

0

#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪

রাত এগারোটা। রাত পেরোলেই আপার হাসপাতালে থাকার চার দিন পূর্ণ হবে। সেদিন ঝগড়া পর দুলাভাই এদিকে আসেনি। মা’কে কল দিয়ে বলেছে, ” আপনার মেয়ে আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। আমি এমনটা আশা করিনি। কখনও না। সে কিভাবে একজন অপরাধীকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে। হোক সে নিজের ভাই। অপরাধী তো অপরাধীই হয়। সর্বপরি বলতে গেলে আপনার মেয়ে আমায় কখনও আপন ভাবেনি। আপনারা আপনাদের মতো থাকুন। আমার এইসব আর ভালো লাগছে না। ”

এসব কথা শুনে মা খানিকটা বিচলিত হলেও আপা তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। বরঞ্চ আনন্দেই আছে।

“রাতুল কি ঘুমিয়ে গেছিস?”

” না আপা। জেগে আছি। কিছু বলবে?”

” তোর লাল শার্টটা হারিয়ে গেছিলো না? মনে করে দেখ তো। ”

আমি তেমন কিছু মনে করতে পারলাম না। লাল শার্ট কেনা বাদ দিয়েছে চার বছর হয়ে গেছে। আগের শার্ট এখন গায়ে লাগে না। আগের চেয়ে খানিকটা মোটা হয়েছি। আগের শার্টগুলো টাইট হয়ে যায়। আমায় চুপ থাকতে দেখে আপা বললো,” কি রে? কথা বলছিস না কেন? মনে নেই তোর?”

আমি বললাম, ” না আপা। মনে করতে পারছি না। মাঝরাতে তুমি লাল শার্ট নিয়ে পড়লে কেন? ঘুমাও। ডাক্তার তোমায় রাত জাগতে নিষেধ করেছে। ”

” তোকে বলেছিলাম না। আমার উপর যে হা’ম’লা করেছিলো তার পরনে তোর লাল শার্টটা ছিলো। ”

” হ্যাঁ বলেছিলে। ”

” কিন্তু হুট করে তোর লাল শার্ট চিনে ফেলার কোন যুক্তি নেই। কতশত শার্টের রং লাল তার ঠিক আছে নাকি! ”

” কি বলতে চাইছো? ”

” শেষবার তোর গায়ে ওই লাল শার্ট দেখেছি আমাদের বাড়িতে। মানে তোর দুলাভাইদের বাড়িতে। ঈদের সময়। বাজি পোড়াতে গিয়ে তোর জামার খানিকটা অংশ পু’ড়ে গেছিলো। আমি সেই জায়গাটা লাল সুতা দিয়ে সেলাই করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই ভীষণ রাগ করলি। জামাটা না নিয়েই ফিরে গেলি। ”

” মনে পড়েছে। ”

” ওই জামাটা আমি আলমারি তুলে রেখেছিলাম। পরে ভাবীর কাছে দিয়ে দিয়েছিলাম তোকে দেওয়ার জন্য। ”

” কিসব বলছো? ভাবী তো কখনও কোন জামা দেয়নি।”

” আচ্ছা। এসবের সাথে ভাবী জড়িয়ে নেই তো? পুলিশের ওপর আমার কোন বিশ্বাস নেই। তুই একটু নিজের মতো করে খোঁজ লাগা। মনে হচ্ছে এসব কোন গভীর ষড়যন্ত্র। ”

আমি ভালো-মন্দ কোন উত্তর দিলাম না। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চাঁদের আলোয় শহরটা অন্যরকম লাগে। অদ্ভুত সুন্দর। তবে সে সৌন্দর্য উপভোগ করাটা খুব কঠিন। রাস্তায় ল্যামপোস্টের আলো জ্বলছে।

সকাল হতে না হতেই দুলাভাই এসে হাজির। এসেই মা’য়ের হাত পা ধরে মাফ চাইতে আরম্ভ করেছে। রাগের কারণে তার মাথা ঠিক ছিলো। ইত্যাদি ইত্যাদি। সেসব কথা শুনতে ইচ্ছে করলো না। চুপচাপ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। আপার কথামতো কাজ করতে গেলে একজন গোয়েন্দা খোঁজ করতে হবে। আমার পক্ষে এসব কে’স সমাধান করা সম্ভব না। সবাইকে ধরে ধরে পেঁচানো প্রশ্ন করো। কে কি উত্তর দেয় খেয়াল করে শোনো। খুবই ঝামেলার কাজ!

আমার এক বন্ধুর এসব ব্যাপারে বেশ আগ্রহ ছিলো। শুনেছি কয়েকটা কে’সও সমাধান করেছে। কে’স সমাধান করলে নাকি মোটা টাকা পাওয়া যায়। মোবাইল ঘেঁটে তার নম্বর বের করলাম। ওর সাথে যোগাযোগ নেই অনেকদিন। নম্বরটা চালু আছে কি-না কে জানে। আল্লাহর নাম নিয়ে কল দিলাম। নাহ, রিং হচ্ছে। দু’বার রিন হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে একটা মেয়ের রিনরিনে মিষ্টি গলায় শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে সালাম দিলো। নরম গলায় বললো, ” কে আপনি?”

” এটা কি পারভেজের নম্বর?”

” হ্যাঁ। নম্বরটা তো ভাইয়ার কিন্তু ভাইয়া আপাতত বাসায় নেই। মাগরিবের আগে তাকে পাওয়া যাবে না। খুব বেশি দরকার হলে নদীর পাড়ে চলে যান৷ ভাইয়া সেখানে মাছ ধরছে। রোগা মতো ফর্সা একটা ছেলে। একটা বকুল গাছের নিচে বসে বরশী দিয়ে মাছ ধরছে। রাখছি। ”

কল কেটে গেল। কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা। ভালো-মন্দ কিছু বলার সুযোগই দিলো না। হুট করে দুলাভাই আসার কারণে সকালে খাওয়া হয়নি। মানুষটাকে আমার কাছে মাকড়সার মতো লাগে। মেয়ে মাকড়সা। পেটে ডিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

খাওয়ার জন্য একটা দোকানে ঢুকলাম। একটা পরোটা দশ টাকা। ডিম ভাজা বিশ টাকা। আজকালকার দিনে টাকার কোন মূল্য নেই। পকেটে মাত্র একশো টাকার একটা নোট পড়ে আছে। বেকার অবস্থা না ঘুচলে পকেটের উন্নতি হওয়ার কোন লক্ষণ নেই।

খাওয়া শেষে বাড়ি ফিরে এলাম। পারভেজের সাথে দেখার করতে নদীর পাড়ে যেতে ইচ্ছে করলো না। একবার সন্ধ্যাবেলা ওদের বাড়ি যাবো। আন্টি খুব সুন্দর চা বানায়। চিনি একদম পারফেক্ট থাকে। চায়ের ওপর সর ভাসে না। ভাবীর মোবাইলটা চেক করতে হবে। আপা বোধহয় ভাবীকেই সন্দেহ করেছে। কিন্তু এসব কাজে ভাবীর কি লাভ? আপাদের সাথে ভাবীর গলায় গলায় প্রেম।

“রাতুল কখন এলে? আপার কি অবস্থা? মা’য়ের কোমরে ব্যাথা করেছে?”

” এইতো এক্ষুনি এলাম। আপার অবস্থা আগের চেয়ে বেশ ভালো। মা’য়ের কোমরে ব্যাথা নেই।”

” যাক ভালোই হলো। সকালে খেয়েছো? না খেলে এসো। বিরিয়ানি রান্না করেছি। ”

” তুমি আজ-কাল রান্নাবান্নাও শুরু করেছো। বেশ ভালো। ”

” কেন তোমার ভাবী বুঝি রাঁধতে পারে না?”

” পারলেও তেমন একটা রান্না করে না। ”

” যাইহোক বাদ দাও। আপার খবর শুনে মনটা ভালো লাগছে। তুমি খেতে আসো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে পেট খালি আছে। ”

ভাবি রান্নাঘরে চলে গেলো। আমার পেট খুব একটা খালি নেই কিন্তু বিরিয়ানির নাম শুনে খিদে লাগতে শুরতে করেছে। এই খাবারের সাথে কিছুর তুলনা হয় না। ভাবী প্লেট সাজিয়ে দিলো। খুব সুন্দর পরিবেশনা। প্লেটের কোণায় সালাত, বাটিতে দই। যেন কোন উৎসব বাড়ি। খাবারের স্বাদটাও অসাধারণ।

কয়েক গাল মুখে দেওয়ার পর থেকে অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। কেমন৷ যেন গলা জ্বলছে। শরীরের ভেতর খারাপ লাগছে। বমি পাচ্ছে। খাবার শেষ করতে পারলাম না। তার আগেই বমি শুরু হলো। শব্দ শুনে ভাবী দৌঁড়ে এলো। ব্যস্ত গলায় বললো, ” কি হলো তোমার? খাবারে কোন সমস্যা নাকি?”

” জানি না। খুব খারাপ লাগছে। ”

” মাথায় পানি দিয়ে শুয়ে থাকো। আমি ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। ”

ভাবী দুইটা ওষুধ দিয়ে গেলো। একটা ওষুধের রং সবুজ। দেখলে মনে হয় কোন ফলের বীজ। ওষুধ খেয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত হয়ে গেছে। জালানা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে। আমার মাথার কাছে একজন নারীমুর্তি। পরনের নীলচে শাড়িটা চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। সে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কত স্নেহ মিশে আছে এ ছোঁয়ায়!

” ছোট আপা কখন এলে?”

” বিকেলে। তোর কেমন লাগছে এখন?”

” ভালো লাগছে। তুমি কষ্ট করে আসতে গেলে কেন? দুলাভাই একা থাকবে। ”

” ওসব চিন্তা করতে হবে না। রান্না করে রেখে এসেছি। অফিস থেকে ফিরে খেয়ে নিবে। কিসব হচ্ছে বল তো।”

” কি হচ্ছে? ”

” পুলিশ বড় আপার ব্যাপারে কোন কিছু করতে পারছে না। দুলাভাই আবার বিকেলে আপার সাথে ঝগড়া করেছে। তুই অসুস্থ। ভাবী সন্ধ্যা থেকে কাঁদছে। ”

” ভাবী কাঁদছে কেন?”

” ভাইয়া আসছে না তাই। ”

” ভাইয়া কোথায় গেছে?”

” কোন মেয়েকে নিয়ে নাকি পালিয়ে গেছে। ”

” এসব কি বলছো তুমি? সত্যি নাকি?”

” জানি না। ”

আমার মোবাইল বাজছে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা বের করে কানে ধরলাম। ওপাশ থেকে ভাইয়ার গলা শোনা গেল। ভাইয়া মিনমিনে গলায় বললো, ” রাতুল তুই যেখানেই থাকিস। এক্ষুনি হাসপাতালের পেছনে চলে আয়। কোন প্রশ্ন করবি না। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। চুপচাপ চলে আসবি। কুইক। ”

ফোন নামিয়ে রাখলাম। ছোট আপা বললো, ” কে কল দিয়েছে? ”

” কেউ না। আমার একটু কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে। ”

” কোথায় যাবি?”

” পারভেজের সাথে দেখা করতে। ”

” পারভেজ কে? ”

” আমার গোয়েন্দা বন্ধু। টেনশন করো না। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

ভাইয়ার সাথে কতবার এমনভাবে দেখা করেছি ঠিক নেই। হুট করে কল দিয়ে তার কাছে যেতে বলে। প্রতিবার কোথাও না কোথাও ঘুরতে গেছি, কিছু না কিছু খেয়েছি। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্য রকম লাগছে। কেমন একটা ভয় ভয় করছে।
বের হওয়ার আগে পারভেজকে কল দিলাম। এবারও মেয়েটা কল ধরেছে। রিনরিনে গলায় জানালো তার ভাই এখনও বাড়ি ফেরেনি। কখন ফিরবে বলতে পারছে না। বোধহয় আজ কোনো মাছ পায়নি তাই এখনও ফেরেনি। ভাই আসলে তাকে আমার কথা জানাবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশায় চড়ে বসলাম। রাত খুব বেশি না। রাস্তায় লোকের ভীড়। কেউ কেউ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকা- চটপটি খাচ্ছে। হঠাৎ একটা মেয়ের দিকে চোখ আটকে গেল। সেদিনের সেই মহিলা পুলিশটা। দু-হাত ভরে চুরি পরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ। ওড়নাটা কোমরে বাঁধা। অদ্ভুত লাগলো ব্যাপারটা! পুলিশের এমন সাজ হবে কেন? নাকি কোন অপরাধীকে ধরতে এমন সেজেছে।

ভাইয়া হাসপাতালের পেছনে ল্যামপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে তেমন লোকজন নেই। রাস্তা পরিষ্কার। ল্যামপোস্টের আলোয় ভাইয়াকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ডান হাতে একটা ছু’রি চকচক করছে। আমায় দেখে মুচকি হাসলো। কি অদ্ভুত হাসি। সারা শরীরের লোক দাঁড়িয়ে যায়।

চলবে

আনকোরা কাহিনী পর্ব-০৩

0

#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩

আমি ভালো-মন্দ কিছুই বললাম না। মা আপার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি অসহায় সেই দৃষ্টি!

দুলাভাই নিজের কথা রাখলেন। সকাল হতে না হতে পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন। তার ধারণা আপাকে যে খু’ন করতে চাইছে সে আবার চেষ্টা করবে। পুলিশের হাতে ব্যাপারটা থাকলে হয়তো কিছুটা ভরসা পাওয়া যেতে পারে। দারোগা সাহেব দুলাভাইয়ের পরিচিত। দু’জন কনস্টেবল সাথে নিয়ে তিনি নিজেই এসেছেন। এসে থেকে আপাকে নানান রকমের প্রশ্ন করছেন। আপা সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছে না। মুখ বেজার করে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মা দুলাভাইয়ের কাজে বেশ সন্তুষ্ট। আগ্রহ নিয়ে সব কথা শুনছে। নিজেও কিছু উত্তর দিতে চাইছে।

দুলাভাই কেবিনের ভেতর থাকলেন না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। মাঝেমধ্যে দরজায় উঁকি কথা বলছেন। কর্কশ গলা। খানিকটা কাকের মতো। আমি নিরস মুখে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ শরীরটা ভালো লাগছে না। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। খানিক বাদে নার্সের সাথে দুলাভাইয়ের কথা কাটাকাটি শুরু হলো। সেসব কথার কিছুটা আমার কানেও এলো।

নার্স মেয়েটা কর্কশ গলায় বলছে, ” আপনার হাসপাতালে পুলিশ নিয়ে এসেছেন কেন? পারিবারিক সমস্যা বাড়িতে মেটাতে পারেন না। ”

দুলাভাই গম্ভীর গলায় বললো, ” আমার স্ত্রীকে খু’ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। এসব সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার আপনি বুঝবেন না। তাছাড়া আমরা কেবিন নিয়েছি। আপনাদের সমস্যা হওয়ার কথা না। ”

” না বুঝলে না বুঝবো। কিন্তু এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছেন কেন? কেবিন নিয়েছেন কেবিনের ভেতর যান। ”

” কেবিনের ভেতর এতো লোক ধরে না। ”

” না ধরলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। আপনার চিৎকারে অন্য রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে। ”

দুলাভাই শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে পারলেন না। মেয়েটার কথায় অন্য রকম ঝাঁঝ আছে। এসব মেয়েদের সাথে কথায় পারা যায় না। দুলাভাই গোমড়া মুখে কেবিনে ঢুকলেন। তেঁতো গলায় বললেন, ” আমার ছোট শালাকে সন্দেহ হয়। ওই পরিকল্পনা করে আমার বউকে ও বাড়িতে নিয়ে গেছিলো। ব্যাপারটা একটু দেখবেন। ”

দারোগা সাহেব আমার দিকে তাকালেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, ” সত্যি নাকি? এসব তুমি করেছো?”

” না। আমি কিছু করিনি। আর করলেও আপনারা খুঁজে বের করুন। অপরাধী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের দোষ লুকিয়ে রাখতে চায়। আমি অপরাধী হলে আমিও তাই করার চেষ্টা করবো।”

দারোগা সাহেব হাসলেন। সেই হাসিতে তৃপ্তি লুকিয়ে আছে। মা’য়ের মুখে আগের মতো খুশি খুশি আভা দেখা যাচ্ছে না। পুলিশরা বেরিয়ে যাওয়ার পর মা বললো, ” বাবা তুমি কেমন কথা বললে? রাতুল কেন মিতালিকে খু’ন করতে চাইবে?”

” মা আপনার কাছে নিজের ছেলে-মেয়ে সমান হলেও আমার কাছে আমার বউ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাল সকালে আপনার ছেলে আমায় কল দিয়ে বললো সে নাকি আপনার বিয়ে ঠিক করেছে। আপনি খুব একা অনুভব করেন। আগামী শুক্রবার বিয়ে। আমি যেন পরিবার নিয়ে দাওয়াত খেতে আসি। এমন অস্বাভাবিক কথায় কোন মানুষের পক্ষে শান্ত থাকা সম্ভব না। আমিও পারলাম না। রেগে গিয়ে আপনার মেয়েকে পাঠালাম সবকিছু সামলানোর জন্য। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল! যাইহোক পুলিশ সত্য বের করবে। আমার ধৃষ্টতায় কিছু মনে করবেন না। এখন আপনাদের বাড়িতে যাবো। পুলিশ সেখানে তদন্ত করতে যাবে। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন।”

মা দুলাভাইয়ের সাথে বেরিয়ে গেল। মা’য়ের কোমরে ব্যাথা করছে। ছোট আপা আসছে। সে আসলে আমিও বাড়ি যেতে পারি। সবাই চলে যাওয়ার পর আপা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। নরম গলায় বললো, ” আমি ম’রে গেলেই বা কি হতো! এতো বছর বিয়ে হয়েছে এখনও বাচ্চা হয়নি। কত লোকের কত কথা, কত অপমান। এ জীবনের কি দাম আছে বল তো?”

“বাজে কথা বলো না তো। মেজাজ ভালো নেই।”

” আমার জন্য তোর এতো সমস্যায় পড়তে হলো। আমাকে মাফ করে দিস ভাই। ”

” এভাবে বলছো কেন? আমার কি কিছু হয়েছে নাকি? তাছাড়া তুমি কি করেছো?”

” হতে কতক্ষণ? তুই ওই মানুষটাকে চিনিস না। তোর ক্ষতি করতে ওর বিন্দুমাত্র দ্বিধা কাজ করবে না। ”

” তুমি কি আমাদের সাথে থাকতে পারো না? এতো অপমান, অত্যাচার সহ্য করে ওখানে পড়ে আছো কেন? তাছাড়া একটা বাচ্চা কি সংসারের সব? স্বামী-স্ত্রী মহব্বত বলে কি কিছুই নেই?”

” সংসারে বাচ্চা সবকিছু না হলেও বেশি অনেকটা। আর স্বামী-স্ত্রীর মহব্বত সবার ভেতর থাকে না রে। সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়। ”

” তোমরা ডাক্তার দেখাতে পারো না? আজকাল কতশত সমাধান আছে। ”

” তোর কি মনে হয় ভাই? ওরা আমায় ডাক্তার দেখায়নি? এ শহরের এমন কোন ডাক্তার নেই যে দেখাইনি। শুধু এ শহর কেন? খুলনা, বরিশাল, ঢাকা কোথাও হয়তো আর কোন ডাক্তার বেঁচে নেই। সমস্যা আমার নয়, ওই মানুষটার। সেজন্যই ও বাড়িতে থাকতে পারি। না হলে কবেই আমায় বের করে দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতো। ”

আপা আদর্শ স্ত্রী মতো স্বামীর সব কথা মেনে চলে। শশুরবাড়ির প্রতি তার অশেষ দরদ। এতো বছর বিয়ে হয়েছে এখনও বাচ্চা হয়নি। তবুও দুলাভাই আপাকে চোখেচোখে রাখে। একা একা কোথাও যেতে দেয় না। আমাদের বাড়িতেও আসতে দেয় না। কয়েকদিন আগে আপার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে দুলাভাই তখন বাড়ি ছিলো না। কথা বলার এক পর্যায়ে আপা অভিমানী গলায় বললো, ” তোরা তো আমায় ভুলেই গেছিস। কখনও দেখতে আসিস না। তোর দুলাভাই সময় পায় না। আমিও যেতে পারি না।”

” তুমি খুব আসো মনে হয়। তুমি কি কচি খুকি? একা আসতে পারো না? ”

” কি করবো! তোর দুলাভাই তো সময়ই পায় না। সে আমাকে কখনো একাও ছাড়ে না। ”

” দুলাভাই তোমায় একা ছাড়বে। বাজি ধরতে পারো। ”

” আচ্ছা বাজি। জিতলে তুই যা বলিস তাই। ”

সেদিনের কথা রাখতেই দুলাভাই কল দিয়ে মা’য়ের বিয়ের কথা বলেছিলাম। বড় জামাই হওয়ার সুবাদে বাবা-মায়ের সঙ্গে ওনার সম্মানও বেশ অনেকটা জড়িয়ে আছে। মা’য়ের বিয়ের ব্যাপারটা উনি একদম মেনে নিতে পারবেন না। কিন্তু এমন কিছু হবে ভাবতেও পারিনি। বড় আপাকে কিছু বলতে যাব এমন সময় ছোট আপা কেবিনে ঢুকলো। ব্যস্ত গলায় বললো, ” রাতুল বাড়ি যাও তো। দুলাভাই পুলিশ নিয়ে গেছে। একটু আগে ভাইয়া কল দিলো। দুলাভাই যে কি করে না!”

তড়িঘড়ি হাসপাতালে থেকে বেরিয়ে এলাম। এই ঝামেলা কোথায় গিয়ে শেষ হবে বুঝতে পারছি না।

বাড়ির অবস্থা দেখার মতো। দারোগা সাহেব দু’জন কনস্টেবল আর একজন মহিলা পুলিশ নিয়ে এসেছেন। মহিলা পুলিশটা তিনুর মা আর ভাবীর সাথে কথা বলছে। ভাবী সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কাঁদছে। একবিংশ শতাব্দীর ক্যারিয়ার সফল নারীর এমন কান্না বড্ড বেমানান লাগছে। কনস্টেবল দু’জন বাড়িঘর তল্লাশি করছে। ভাইয়া আর দুলাভাই দারোগা সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনই চুপচাপ। নিরবতা কাটিয়ে দুলাভাই বললে উঠলেন, ” স্যার, আপনাকে যা বলেছিলাম। রাতুলের ব্যাপারটা। ওদিকটায় একটু নজর দিবেন। ”

ভাইয়া কৌতুহলী হয়ে বললো, ” রাতুলের কোন ব্যাপার?”

” আপনার দুলাভাই রাতুলকে সন্দেহ করছে। এ ব্যাপারে আপনার কি মত?”

ভাইয়া গম্ভীর গলায় বললো, ” আমাদের চার ভাই-বোনের মধ্যে কোন সমস্যা নেই। এসব অবান্তর কথায় কান দিবেন না। আর দুলাভাই আপনি এমন কথা ভাবেন কি করে?”

দুলাভাই উত্তর দিলেন না। শুকনো মুখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তাদের নাকি অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার কিসের অফিস কে জানে!

কথাবার্তার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম তিনুর মা সেদিন বাড়িতে ছিলো না। এসব কে’সের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া আপার সাথে তার কোন প্রকার শত্রুতা নেই। তাকে যেন এসব বিষয়ে না জড়ানো হয়। ভাবীও বিশেষ কিছু বলতে পারেনি। দুলাভাই আমার ব্যাপারে কোন প্রমাণ দিতে পারছে না। সবকিছু দেখে দারোগা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পরক্ষণেই ঝলমলে গলায় বললেন, ” সব কে’সের শুরুতে এমন অবস্থা থাকে। আস্তে আস্তে ধোঁয়াশা কেটে যাবে। আর একবার হাসপাতালে যেতে হবে। উনার সঙ্গে কথা বলা খুব জরুরি। তবে আজ আর সময় পাবো না। ”

দুলাভাই দারোগা সাহেবের সাথে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি মুচকি হাসলাম। রহস্যময় হাসি। এ হাসি উনাকে বেশ অস্বস্তিতে রাখবে।

সন্ধ্যা নাগাদ আবার হাসপাতালে গেলাম। আপা অবস্থা আগের চেয়ে বেশ ভালো। এন্টিবায়োটিক ইনজেকশনের কারণে ব্যাথা খানিকটা কমে আসছে। ক্ষত শুকাতে শুরু করেছে। গিয়ে আপার পাশে বসলাম। কপালে হাত রেখে কোমল গলায় বললাম, ” আপা সেদিন তোমায় কে আ’ঘা’ত করেছিলো? তুমি কি তাকে দেখোনি?”

আপা স্বর নিচু করে বললো, ” না দেখিনি। তবে তার গা থেকে তোর গায়ের গন্ধ আসছিলো। পরনে ছিলো তোর লাল শার্ট। লোকটার হাতে তোর মতো তিল। তবুও আমার বিশ্বাস ওটা তুই ছিলি না। সেজন্যই পুলিশকে কিছু বলতে পারছি না। ”

দুলাভাই দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ” ভালোই চলছে তাহলে। আমি ম’রি তার জন্য, আর সে ম’রে। এই কথাটা সত্যি হলেও নেহাৎ কুরুচিপূর্ণ। না হলে শেষ করতে পারতাম। ”

মা দুলাভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। মা’য়ের চোখ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি পানি বেরিয়ে আসবে। কি মমতা সেই চোখে! যেন সাগরের সব পানি দু-চোখে লুকিয়ে আছে।

চলবে

আনকোরা কাহিনী পর্ব-০২

0

#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২

দুলাভাই আমার দিকে তেড়ে আসলো। ভাইয়া এসে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। বারান্দার কোণে ছোট মেয়েটা সেদিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখেমুখে আ’ত’ঙ্ক। শেষ পর্যন্ত ভাইয়া কোন রকমে দুলাভাই শান্ত করে আমার কাছে এলো। হতাশ গলায় বললো, ” তুই বাড়ি চলে যা। দুলাভাইয়ের মাথা ঠিক নেই। কখন কি করে বসে বলা যাচ্ছে না। ”

” বৃষ্টির ভেতর কোথাও যেতে পারবো না। তাছাড়া আপার অবস্থা জানা হয়নি। এই মুহূর্তে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। লাগলে দুলাভাইকে চলে যেতে বলো। ”

” ভাই, একটু বুঝতে চেষ্টা কর। দুলাভাই রেগে পুলিশ ডাকলে ঝামেলা হয়ে যাবে। ”

” আচ্ছা বেশ। আমি উনার সামনে থেকে সরে যাচ্ছি। তুমিও আমার সঙ্গে এসো। ”

” আমাকে লাগবে কেন? ”

” বড় আপার ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলবে। ভালো কথা, ছোট আপাকে খবর দেওয়া হয়েছে? ”

” বাড়িতে এসেছিল। আবার চলেও গেছে। এদের কান্ডকারখানা বোঝা খুব মুশকিলের কাজ। ”

দুলাভাই চেয়ারে বসে কটমট দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে। যেন এক্ষুনি চোখের দৃষ্টিতে আমায় উধাও করে ফেলবে। ভাইয়াকে সাথে নিয়ে উনার চোখের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝামেলা করতে ইচ্ছে করছে না।

” আপাকে পাওয়া গেছিলো কোথায়? তাছাড়া তুমি কিভাবে বুঝলে খু’ন করার চেষ্টা করা হয়েছে?”

” তিনুদের ঘরের পাশে। ফুলের ঝোপের আড়ালে। ”

” আপা তো ওদের সহ্য করতে পারে না। ওদেরকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য মা’কে অনেকবার জোরাজুরি করেছে। কিন্তু মা শোনেনি। ”

” আজকালকার বাজারে কেউ অমন ভাঙাচোরা টিনের ঘরের জন্য পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দেয় নাকি? সেজন্য মা চাইলেও ছাড়তে পারছে না। ”

” কিন্তু আপা তিনুদের ঘরের কাছে গেল কেন? সে তো ওদিকে পা-ও মাড়ায় না। ”

” জানি না। তোর ভাবিকে বলেছিলাম তিনুর মা’কে ভাড়ার কথা বলতে। সে গিয়ে দেখে ফুলের ঝোপের আড়ালে কে যেন কাতরাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখে আপা। সারা শরীরের র’ক্ত মাখানো। ”

” কোথায় আ’ঘা’ত লেগেছে জানো নাকি?”

” পেটে। ”

” ডাক্তার কি বলেছে? মা কোথায়?”

” মা গিয়ে আপার জন্য বেড ধরে বসে আছে। সদর হাসপাতালে বেড পাওয়া বেশ মুশকিলের কাজ। ডাক্তার এখনও কিছু বলেনি। ”

বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে। গাছের পাতাগুলোকে আগের থেকে সতেজ দেখাচ্ছে। ভাইয়াকে বলে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। কয়েকটা কাজ বাকি পড়ে আছে। আপার অবস্থা পরে জেনে নেওয়া যাবে।

বাড়ি ফিরে দেখি ছোট আপা চিন্তিত মুখে পায়চারী করেছে। কখন এসেছে কে জানে। কাছে গিয়ে বললাম, ” আপা তুমি কখন এলে? ”

” নাটক করবে না একদম। তুমি কেমন মানুষ? বড় আপার খবর শুনে আমাকে ফেলে রেখে চলে গেলে? বোন কি তোমার একার?”

” না, বোন তোমারও। ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও এমন হবে না। ”

” আপার কি অবস্থা তাই বলো। ফালতু সাফাই শুনতে ইচ্ছে করছে না। ”

” তুমি শুধু শুধু রেগে যাচ্ছো। নিজেই সবকিছু বললে আর নিজেই এখন রাগ করছো। ”

” হ্যাঁ। আমি তোমাকে পার্কের সামনে দেখা করতে বলেছিলাম। কিন্তু এটা কখনও বলিনি যে কারো বিপদ-আপদ শুনলে আমাকে ফেলে চলে আসবে।”

” বড় আপার অবস্থা জানা যায়নি। ডাক্তাররা কিছু জানায়নি। পেটে আ’ঘা’ত লেগেছে। আর কিছু জানি না। ”

ছোট আপা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লো। আপা আমার চেয়ে চার বছরের বড় কিন্তু আমাদের তুমি তুমি সম্পর্ক। মা’য়ের মুখে শুনেছি, ছোট বেলায় সবাই আমাকে তুই করে বলতো। এ নিয়ে আমি ভীষণ রাগ করতাম। তখন থেকে ছোট আপা তুমি করে ডাকে।
আজ পার্কের সামনে আপার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আপা বলেছিলো আমায় বাড়ির অবস্থা জানাবে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝলাম না। এক সমস্যা ঠিক করতে গিয়ে অন্য সমস্যায় পড়ে গেলাম।

” বেশি চিন্তা না করে খেয়ে নাও। আমার আর ভালো লাগছে না। ভাবিও তখন থেকে ম’রা কান্না কাঁদছে। ”

” ভাবি কাঁদছে কেন?”

” জানি না। সে নাকি র’ক্ত দেখে খুব ভয় পেয়েছে। ”

” হতে পারে। ”

” যাইহোক তুমি খেয়ে নাও। তারপর হাসপাতালে খাবার নিয়ে যাবে। ”

” ছোট দুলাভাই কোথায়? ”

” তাকে কিছু জানানো হয়নি। ”

বিশেষ কিছু খেতে পারলাম না। প্লেটে হাত দেওয়া মাত্র খিদে উধাও হয়ে গেল। মনের মধ্যে খচখচ করছে। দুলাভাই উল্টো পাল্টা কিছু করে না বসে। মানুষটা তেমন সুবিধার না। চরিত্রও খুব বেশি ভালো না। আমাদের ভাড়াটে তিনুর মা’কে নাকি কিসব প্রস্তাব দিয়েছিলো। তাই নিয়ে বিশাল ঝামেলা। তারপর থেকে বড় আপা তিনুর মা’কে চোখে দেখতে পারে না। উনি নাকি দুলাভাইয়ের নামে মিথ্যে কথা বলছে। অথচ আমরা সবাই জানি তিনুর মা মিথ্যে কথা বলছে না। মানুষ হিসাবে মহিলা খুব চমৎকার। দারুণ রূপবতী। স্বামী মা’রা যাওয়ার পর থেকে এক ছেলেকে নিয়ে থাকে। আগের বাপের বাড়িতে থাকতো। কোন এক সমস্যার কারণে ভাড়া বাড়িতে এসে উঠেছে। সেলাই মেশিনের কাজ করে, কিছু হাঁস-মুরগি পালে, স্বামীর জমানো কিছু ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে বেশ স্বচ্ছল পরিবার। আমাদের বাড়ি না ছাড়ার এটাও একটা কারণ। সব বাড়িতে হাঁস-মুরগী পালতে দেয় না।

চোখের পাতা লেগে এসেছিলো। এমন সময় ছোট আপা এসে ডেকে তুললো। ঝলমলে গলায় বললো, ” বড় আপার তেমন কোন সমস্যা হয়নি। পেটের চামড়া কেটেছে শুধু। সেলাই দিলে ঠিক হয়ে যাবে। তবে অনেক র’ক্ত বের হয়েছে। আপাতত সমস্যা নেই কিন্তু পরে র’ক্ত দেওয়া লাগতে পারে। ”

” ভালো খবর শোনালে। এখন দারুণ ঘুম হবে। ”

” ঘুমানোর সময় নেই। ভাবী রান্না করছে। সেগুলো নিয়ে হাসপাতালে যাবে। আর দুলা ভাইয়ের সাথে ঝালেমা করবে না। ”

” ঠিক আছে। ”

ভাবি বাড়িতে তেমন কাজ করে না। কিন্তু আজ কোমর বেঁধে রান্না করেছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে চার পদের রান্না শেষ। এখন চুলার ওপর মুরগির গোশত। সারা ঘর মশলায় গন্ধে ভরে গেছে। ভালোই বুঝতে পারছি এসব খাবার দুলা ভাইয়ের পেটে যাবে। আপা বা মা কিছুই খেতে পারবে না।

হাসপাতালে গিয়ে জানলাম দুলাভাই কেবিন নিয়েছে। ওয়ার্ডে অতো মানুষের ভেতর থাকতে নাকি তার অস্বস্তি লাগবে। তাছাড়া কে কখন বমি করে, থুথু
ফেলে ঠিক নেই। বড়ই ঘেন্নার ব্যাপার!
আপার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। পেটে ছয়টা সেলাই লেগেছে। তবুও ভাগ্য ভালো ভেতরে কোন ক্ষতি হয়নি। মা আপার ঘুমন্ত মুখের সামনে বসে দোয়া কালাম পড়ছে। আমায় দেখে ইশারায় চুপ থাকতে বললো। দুলাভাই কেবিনে নেই।

রাতের দিকে আপার জ্ঞান ফিরলো। মা তখন ঘুমচ্ছে। দুলাভাই এখনও ফেরেনি। মা’কে ডাকতে যাচ্ছিলাম। আপা ইশারায় চুপ থাকতে বললো।

” তোকে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিলাম। তাই না রে ভাই?”

” না তেমন কিছু না। তুমি একটু শুয়ে থাকো। ”

” যে সমস্যা হয়েছে, তাতে আগামী কয়মাস শুয়ে থাকতে হয় আল্লাহ ভালো জানে। তোর দুলাভাই এসেছিল? ”

” এসেছিলো। কিন্তু এখন কোথায় আছে বলতে পারি না। ”

আপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হতাশ গলায় বললো, ” আমাদের এসব না করলেই ভালো হতো। মানুষকে ধোঁকা দিতে গেলে এমনই হয়। ”

” তুমি এসব ভেবো না। আমরা ভুল কিছু করিনি। ”

” আমার জীবনটা এমন কেন হলো রে ভাই? বলতে পারিস কিছু? এতদিন বিয়ে হয়েছে অথচ একটা ছেলেমেয়ে নেই। সংসারে অশান্তি। ”

” সব ঠিক হয়ে যাবে আপা। চিন্তা করো না। ”

” কবে ঠিক হবে ভাই?”

মাথা নিচু করে বসে রইলাম। উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আপা বললো, ” আমি ম’র’লে সবকিছু ঠিক হয়ে যেত। আজ কেন বেঁচে গেলাম। ”

” আপা তুমি থামবে?”

আমাদের কথায় মা জেগে গেছে। চোখ খোলা দেখে নিচু হয়ে আপার কপালে চুমু খেলো। শব্দ করে বললো, ” আলহামদুলিল্লাহ। ”

” আচ্ছা আপা, তোমায় ছু’রি মা’র’লো কে? তাছাড়া তুমি ওদিকে গেছিলেই বা কেন?”

” তিনুর মা’য়ের থেকে দুইটা মুরগি কিনতে চেয়েছিলাম। তোর দুলাভাই দেশি মুরগী খাওয়ার কথা বলছিলো সেদিন। ”

আপা কথা শেষ করার আগে একজন নার্স এলো। রোগা লম্বা মতো একটা মেয়ে। একটা কাঁচের বোতল হাতে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বললো, ” উনাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছেন কেন? এতো কথা বললে তো পেটের সেলাই কেটে যাবে। তখন কি করবেন?”

মা খানিকটা লজ্জিত হলো। আমি মুখে কথা বলার সাথে পেটের সেলাই সম্পর্ক নির্ণয় করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। নার্স মেয়েটা আপাকে ইনজেকশন দিয়ে চলে গেল। এরা প্রয়োজনের বেশি এক মিনিটও দাঁড়ায় না।

দুলাভাই আসলো রাত এগারোটার দিকে। এসেই নিজের ব্যস্ততা বর্ণনা শুরু করলো। ব্যবসার অবস্থা ভালো না। অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। মা উনাকে ভাত বেড়ে দিলো। খেতে বসেও নানান কথা বলছে। মনে হচ্ছে এটা ওনার বাড়ি অথবা পরিচিত কারো বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। মনেপ্রাণে চাচ্ছিলাম উনি যেন কোন নার্সের ঝাড়ি খান৷ কিন্তু কেউ এদিকে এলো না।

খাওয়া শেষ পকেট থেকে পান বের করে মুখে দিলেন। আঙুলের মাথায় চুন লাগাতে লাগাতে বললেন, ” মিতালিকে যে খু’ন করার চেষ্টা করেছে, তাতে আমি ছাড়বো না। দরকার হলে কাঁকড়ার গর্ত থেকে টেনে বের করবো। কার কলিজায় এতো সাহস জানা দরকার। খুব দরকার। ”

আমি ভালো-মন্দ কিছুই বললাম না। মা আপার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি অসহায় সেই দৃষ্টিতে!

চলবে

আনকোরা কাহিনী পর্ব-০১

0

#আনকোরা_কাহিনী
সূচনা পর্ব
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

ভরদুপুরে বড় আপা বাড়িতে এসে তীক্ষ্ণ গলায় বললো, ” এসব কি শুনছি রাতুল? তুই নাকি মা’য়ের বিয়ে ঠিক করেছিস? এখন কি মা’য়ের বিয়ে বয়স? ”

” বিয়ের আবার বয়স আছে নাকি? তাছাড়া মা’য়ের বয়স কত হবে! বড়জোর আটচল্লিশ। ”

” তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অকারণে তুই আমাদেরকে বিব্রত করছিস। ”

” আমি অকারণে কোন কাজ করি না। তোমার হীরার আংটি চুরির ব্যাপারটাও কাউকে বলিনি। ”

আপা খানিকটা আৎতে উঠলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো, ” এসব কি বলছিস তুই? কোন আংটি?”

আপার চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে বারান্দায় জড় হয়েছে। তারাও খানিকটা অবাক হয়ে বললো, ” কিসর কথা বলছিস তুই?”

” ছোট আপার বিয়ের সময় যে আংটিটা চুরি হয়েছিল সেটার কথা বলছি। ”

মা বললো, ” এসব কি বলছিস? মিতালি কেন আংটি চুরি করতে যাবে? সে আংটি নিয়ে কত খোঁজাখুঁজি চললো। পুলিশ ডাকলো। পুলিশও তো কোন সন্ধান দিতে পারেনি। ”

” কেন চুরি করেছে তা তো জানি না। আর পুলিশের ব্যাপারটাও বলতে পারবো না। ”

বড় আপা রাগী গলায় বললো, ” দেখেছো মা? তোমার ছেলের কান্ড দেখেছো? সকালে তোমার জামাইকে কল দিয়ে বলেছে -ও নাকি তোমার বিয়ে ঠিক করেছে। এখন আবার আংটি চুরির কথা বলছে। তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। ভালো কোনো ডাক্তার দেখাও। ”

মা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বোধহয় আপার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। মা বিয়ের ব্যাপারে এখনও কিছু জানে না। সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো মা’য়ের বিয়ে দেওয়া দরকার। কথাটা মনে আসতেই বড় দুলাভাইকে কল দিয়ে পাত্র খুঁজতে বললাম। মা’য়েরও একটা জীবন। সারাদিন সংসারের কাজ করতে করতে মানুষটা বড্ড হাঁপিয়ে উঠছে। ফজর থেকে এশা পর্যন্ত সারাদিন কাজ। দু’দন্ড বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় দু’বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত জীবন তাদের। ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। ভাই-ভাবি দু’জনেই চাকরি করে। সংসারে দেওয়ার মতো সময় তাদের নেই। আমিও বেকার জীবনের রস আস্বাদন করতে খানিকটা ব্যস্ত থাকি। বাবা নেই। তাই মা’কে দেওয়ার মতো সময় কারোর হাতে অবশিষ্ট নেই। বাবা বেঁচে থাকলেও বোধহয় মা’য়ের তেমন লাভ হতো না। শেষ বয়সে বাবার জীবন খবরের কাগজ আর বাজারের থলেতে আটকে গেছিলো। এই দুই থেকে তিনি বের হতে পারেনি। মৃত্যুর সময়ও মুখের ওপর খবরের কাগজ পড়ে ছিলো। মা সেই কাগজ সরিয়ে জানতে পারলেন বাবা আর বেঁচে নেই। সে অনেকদিন আগে কথা, গত আশ্বিনে সাত বছর হয়েছে।

খানিকক্ষণ নিরবতায় কাটিয়ে মা আবার প্রশ্ন করলো, ” এসব কি শুনছি রাতুল? তোমার সাহস দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। তুমি বড় জামাইকে এসব কথা বলেছো কেন? ”

মা আমায় সাধারণত তুই তুই বলে, প্রচন্ড রেগে গেলে তখন তুমি করে কথা বলে। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, ” এমনি বলেছি। মজা করেছি। ”

বড় আপা তিরিক্ষি গলায় বললো,” এসব কোন ধরনের মজা? শশুরবাড়িতে আমার একটা মান-সম্মান আছে। আমি তোর মতো অকর্ম না যে বাপের টাকায় খেয়ে ফালতু কাজ করে বেড়াবো। ”

” বাপের টাকা খাওয়ার প্রসঙ্গ টানছো কেন? তোমার বিয়ের সময় বাবা দশ লাখ টাকা খরচ করেছে। দাদির দেওয়া সাত ভরি সোনার সীতা হারটাও তোমাকে দিয়েছে। এতোকিছুর পরেও তোমার মন ভরেনি। শেষ পর্যন্ত ধার করে তিন লাখ টাকা দিতে হয়েছে তোমার বরকে। সে নাকি ব্যবসা করবে। সেই তুলনায় আমি সামান্যই খরচ করি। ”

” খোঁটা দিচ্ছিস নাকি? আমাকে আমার বাপ দিয়েছে তুই বলার কে? তুই তো আর দিসনি। ”

” আমিও আমার বাপের টাকা খাই। তুমি খোঁটা দেওয়ার কেউ না। ”

আপা খানিকটা চুপসে গিয়ে মা’য়ের দিকে তাকালো। মায়ের চোখে-মুখে মমতা উপচে পড়ছে। সেদিকে এক বার তাকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। কথোপকথনের গোটা সময়টা ভাই আর ভাবি চুপ করে থাকলেও এখন তারা মুখ খুলবে। সেখানে আমার থাকাটা মোটেও শোভা পায় না। আমি থাকলে কথা বাড়বে। ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। তাই এখন বাড়িতে না থাকাই ভালো।
বাইরের প্রচন্ড রোদ। টবের গাছগুলো নেতিয়ে পড়েছে। এমন রোদের ভেতর আপা এ বাড়িতে চলে এসেছে। অথচ সেদিন মা’য়ের অসুস্থতার কথা শুনেও আসতে পারলো না। রোদে পুড়লে তার মাথা ধরে, বমি হয়। সেই মানুষ আজ কাঠফাটা রোদের মধ্যে এ বাড়িতে চলে এলো। ভাবা যায়! হাঁটতে হাঁটতে পার্কের দিকে চলে এলাম। পার্কের কোথাও তেমন ছায়া নেই। বট গাছের নিচে খানিকটা ছায়া থাকলেও সেখানে দু’জন ছেলেমেয়ে বসে আছে। মেয়েটার চোখে-মুখে লাজুক হাসি। ছেলেটাও হাসছে। সেই হাসি আমার কাছে ভালো লাগলো না।

” রাতুল না? ভরদুপুরে পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

পাশ ফিরে দেখি মুনসুর ভাই দাঁড়িয়ে আছে। আমার কলেজের সিনিয়র। লোকটার গলার স্বর খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। হাসার চেষ্টা করে বললাম, ” একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। এক্ষুনি এসে পড়বে। ”

” গার্লফ্রেন্ড নাকি? তা রোদের মধ্যে পার্কে কেন? অন্য কোথাও যেতে। ”

” না ভাই, তেমন কেউ না। পরিচিত একজন। এদিকটায় বাড়ি। ”

” চালিয়ে যাও। হয়ে যাবে।”

মনসুর ভাই হাসতে হাসতে আমার পিঠে একটা চাপড় মারলো। তারপর চলে গেল। কি অদ্ভুত লোক! জানা নেই শোনা নেই, নিজের মতো অনুমান করে নিলো।
অবশ্য আজকাল বেশিরভাগ লোকের স্বভাবই এমন। কিছু একটা বলে দিতে পারলে বেঁচে যায়। তবে উনি একটা কথা মন্দ বলেনি। অন্য কোথাও যেতে পারলে বেশ ভালো হতো। রোদের মধ্যে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। সূর্যের তাপে রাস্তা গরম হয়ে গেছে। বেশ ক’দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। পিপাসাও লেগেছে। মিনিট দুয়েক সামনে হাঁটলে একটা মুদি দোকান। সেখানে গিয়ে এক বোতল পানি কিনলাম। পনেরো টাকা দাম। পানির স্বাধ বেশ ঝাঁঝালো। খানিকটা বৃষ্টির পানির মতো।

” এসেছো কতক্ষণ? ”

কাক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ঝলমলে গলায় বললাম, ” বেশিক্ষণ হয়নি? তোমার আসতে অসুবিধা হয়নি তো?”

” না, তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। তুমি তো দেখছি পাক্কা খিলাড়ী। এক কথায় ঝামেলা শুরু করে দিয়েছে। ”

” বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে দ্বিতীয়বার মা’য়ের বিয়ে মেনে নিতে পারে না। সমাজও ব্যাপারটা একটু বাঁকা চোখে দেখে। তাই চেষ্টা করে দেখলাম। ”

” এসব করে লাভ হবে তো?”

” লাভ না হোক লস হবে না। তাছাড়া চেষ্টা করতে দোষ কী? ”

” চেষ্টায় দোষ কিছু নেই। আংটির ব্যাপারটা কি সত্যি নাকি? বড় আপা আংটি চুরি করেছিলো?”

” খানিকটা সত্যি। যাইহোক চলো কোথাও গিয়ে বসি। পরিচিত কেউ একসাথে দেখলে প্রশ্ন করতে পারে। বাড়ির অবস্থা কি?”

” বড় আপা কাঁদছে। মা তাকে স্বান্তনা দোওয়ার চেষ্টা করছে। মা বরাবর তার বড় মেয়ের প্রতি একটু বেশি দূর্বল। ”

” প্রথম মেয়ে। খানিকটা আহ্লাদী। ”

” কি জানি। মা তোমার বিয়েসাদির কথা বলে না? ”

” বেকার মানুষের বিয়ে কিসের! নিজে খেতে পাই এটাই অনেক। ”

” চাকরির চেষ্টা করো। ”

” চেষ্টা! তা করছি বটে। লাভ হচ্ছে না। ”

” চেষ্টা চালিয়ে যাও। ”

মোবাইল বাজছে। হয়তো বাড়ি থেকে কল দিয়েছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। বোধহয় সেজন্যই। পকেটে থেকে মোবাইল বের করতে করতে কল কেটে গেল। ভাইয়া কল দিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পরে আবারও কল। চেনা রিংটোন। কল রিসিভ করতে ওপাশে থেকে ভাইয়ার আতংকিত গলা শোনা গেল।

” রাতুল কোথায় তুই?”

” হাঁটতে বের হয়েছি। কেন? ”

” ভর দুপুরে কোথায় হাঁটতে গেছিস? কেউ একজন বড় আপাকে মা’র’তে চেষ্টা করেছে। ছু’রি দিয়ে পেটে আ’ঘা’ত করেছে। আপার অবস্থা খুব খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তুই তাড়াতাড়ি আয়। ”

ভাইয়া এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে কল কেটে দিলো। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কে এমন করতে পারে? জানা মতে আপার তো কোন শত্রু নেই। শশুরবাড়ির লোকজনের সাথেও তার মিষ্টি মধুর সম্পর্ক।

” কোন সমস্যা? ”

” বড় আপাকে কেউ মা’র’তে চেষ্টা করেছে। আপার অবস্থা খুব খারাপ। আমাকে এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে। ”

” মা’রার চেষ্টা বলতে?”

” খু’ন করতে চেয়েছে। ”

” কি বলো? কে করেছে?”

” জানি না। ”

পাশ দিয়ে একটা রিকশা যাচ্ছিলো, লাফ দিয়ে তাতে চড়ে বসলাম। বড় আপা কেমন অবস্থায় আছে কে জানে। পেছনে তাকানোর সময় হলো না। পেছনে তাকলে হয়তো দেখতে পেতাম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত একটা মুখ। কি জানি! সেই মুখে রহস্যময় হাসিও লেগে থাকতে পারে।

ভাইয়া হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। ভেতরে ডাক্তার এসেছে। রোগীর অবস্থা জানা যায়নি। ভাইয়া আমায় দেখে এগিয়ে এলো। ধরা গলায় বললো, ” কি একটা অবস্থা দেখেছিস। গতকাল তোর ভাবীকে নিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম আর আজ এইসব। এখন তো মাসখানেক ভেতরও যাওয়া হবে না। ”

” বড় আপার চেয়ে ঘোরাঘুরি করাটা তোমার কাছে বেশি জরুরি নাকি?”

” বুঝতে পারছিস না? আমার বোন হাসপাতালের বেডে জীবন-মরণ খেলা খেলছে আর আমি নাকি ঘুরতে চাচ্ছি। কি অদ্ভুত কথা বলিস! ”

” নিজেই তো বললে মাসখানেক ভেতর যাওয়া হবে না। ”

” কখন বললাম? ওই যে দুলাভাই এসেছে। ”

দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই দুলাভাই এসেছে। পরনে নীল পাঞ্জাবি, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ফেলেছে। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ভাইয়া প্রায় ছুটে তার কাছে গেল। দু’জনের কি কথা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। নতুন রোগী এসেছে। রোগীর আত্মীয় স্বজনরা ডাক্তারের সাথে ঝগড়া করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা ভাঙা চেয়ারে বসে পড়লাম। দুপুরের খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। শরীরটাও বেশি ভালো লাগছে না। বাইরে রোদ নেই, অন্ধকার হয়ে গেছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। বলতে না বলতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। দুলাভাই আমার কাছে এসে বললো, ” তোমার জন্য তোমার বোনের এই দশা। এই খু’নের সাথে তুমি জড়িয়ে নেই তো?”

” আপার সাথে আমার কিসের শত্রুতা? ”

” সাত ভরি সীতাহার। ভুলে গেলে নাকি?”

” দুশ্চিন্তায় আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ঠান্ডা হাওয়ায় বসুন। মাথায় পানি ঢালুন। ”

দুলাভাই আমার দিকে তেড়ে আসলো। ভাইয়া এসে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। বারান্দার কোণে ছোট মেয়েটা সেদিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

চলবে।