Thursday, August 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 182



তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০১

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

মুক্ত আকাশের নীচে খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে জোবায়দা ভাবছে, ওর জীবনটা রাতের কালো আকাশের মতো হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাতের আকাশে যখন হঠাৎ মেঘ জমে চাঁদের আলোটা ঢেকে যায়। সেসময় গাঢ় কালো তমসাচ্ছন্ন চাদরে পুরো পৃথিবীটা ঢেকে রয়। ওর জীবনের আকাশটাও আজ তেমনি হয়ে আছে। অথচ দু,মাস আগেও এমন ছিলো না। ঊনিশ বছরের জীবনটায় হাসি, আনন্দ, শান্তি কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। দু,মাসের ব্যবধানে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেলো।

গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়ে জোবায়দা এইচএসসি পাশ করেছে। বাবা আলতাফ সাহেব মেয়ের রেজাল্টে ভীষণ খুশী। উনার খুব ইচ্ছে মেয়ে যেন তার অনেক বড় ডাক্তার হয়। দু,ভাই দুবোনের মধ্যে জেবায়দা সবার বড়। এলপিআর শেষ করে চাকরি থেকে পুরোপুরি অবসরের মুহুর্তে প্রতিটি মানুষের মন বিষাদে ঢেকে যায়। আলতাফ সাহেবও এর ব্যতিক্রম নন। উনার চিন্তাটা অন্য সবার থেকে একটু বেশী। কেননা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেষ হয়নি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে এখনও প্রচুর সময় বাকি। অনেকে ভাবে আলতাফ সাহেব লেট ম্যারেজ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিয়ে উনি ঠিক বয়সে করেছেন। কিন্তু বিবাহিত জীবনের দশ বছরের মাথায় জোবায়দার জন্ম হয়। তারপর আড়াই, তিনবছরের ব্যবধানে সবার জন্ম হয়।সেই কারনে সবার ছোটো জাফর কেবল ক্লাস ফোরে পড়ে। ছেলেমেয়েদের মানুষ করার চিন্তাটা ইদানিং আলতাফ সাহেবকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এরকম মুহুর্তে মেয়ের এরকম রেজাল্ট সিনিয়র একাউন্টটেন্ট আলতাফ সাহেব আবারো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। একদিন মেয়ে তার অনেক বড় ডাক্তার হবে।

স্বপ্নের আকাশটা ছোঁয়ার জন্য দিনরাত এককরে জোবায়দা পড়াশোনা করে। অবশেষে স্বপ্নটা ওর হাতে ধরা দেয়। ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চান্স পায়। বাবা, মা ভাই বোন মিলে সবাই সেদিন সেই আনন্দকে সেলিব্রেট করতে ধানমন্ডীর শেফ টেবিলে খেতে গিয়েছিলো। ডিনার শেষ করে বাড়ি ফেরার পর আলতাফসাহেব বুকের ব্যথায় ছটফট করতে থাকে। যদিও উনি ডায়াবেটিস আর হাইপ্রেসারের রোগী। কিন্তু হার্টের কোনো সমস্যা ছিলো না। তাই সবাই ভেবে নিয়েছিলো উনার গ্যাসটিকের ব্যথা উঠেছে। জোবায়দা ওষুধের বক্স থেকে একটা গ্যাসের ট্যাবলেট নিয়ে বাবাকে খাইয়ে দেয়। কিন্তু ব্যথা তো কমে না। একসময় পুরো শরীর ঘামে ভিজে যায়। মা শেফালী বেগম জোবায়দাকে বলে,
—-তোর বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমার কাছে মনে হচ্ছে তোর বাবার হার্ট অ্যাটাক করেছে।
সেই মুহুর্তে আলতাফ সাহেব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। শেফালী বেগম চোখের সামনে স্বামীর এই অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেন। জোবায়দা নিজেকে শক্ত রেখে ছোটোবোন আদিবাকে ডেকে বলে,
—ওমরকে ডেকে বল অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিতে হবে। বাবাকে হাসপাতালো নিতে হবে।
আদিবা দৌড়ে ওমরের রুমে গিয়ে বলে,
—ভাইয়া আব্বুর শরীর খুব খারাপ। আপু অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বলেছে। এখনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আদিবার কাছে এখবর পেয়ে ওমর ছুটে আসে। জোবায়দাকে জিজ্ঞাসা করে,
—-আপু,আব্বাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে?
—আব্বুর যেহেতু ডায়াবেটিস আছে বারডেমে নিয়ে গেলে ভালো হবে।
একথা শুনে শেফালী বেগম ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন,
—তোর বাবার বারডেমের বই করা আছে।
অবশেষে অ্যাম্বুলেন্সে করে আলতাফ সাহেবকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ দেড়মাস আইসিইউতে থেকে বিশ লক্ষ টাকা বিল পরিশোধ করে মোটামুটি সুস্থ করে বাসায় নিয়ে আসা হয়। যদিও শরীরের বাঁপাশটা অবশ হয়ে আছে। আলতাফ সাহেবের একদিকে যেমন সিভিয়ার এ্যাটাক হয়েছে তেমনি আবার স্ট্রোকও করেছেন। এখন প্রতিদিন ফিজিওথেরাপিস্ট এসে উনাকে ফিজিওথেরাপি করাচ্ছেন।
এদিকে আলতাফ সাহেবের একটা বেসরকারী কোম্পানীতে একাউন্টেট হিসাবে চাকরি হয়েছিলো। কথাছিলো এলপিআর শেষ করে ওখানে জয়েন করবেন। সে আর কপালে হলো না। এলপিআর শেষ করে পেনশন বাবদ পঞ্চাশলক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। সেখান থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকা এক ধাক্কায় খরচ হয়ে যাওয়াতে শেফালী বেগম মুষড়ে পড়েন। বাকি পঁচিশ লক্ষ টাকা আর প্রতি মাসে তিরিশ হাজার টাকা পেনশন দিয়ে কিভাবে সংসার চালাবেন? আলতাফ সাহেবের ওষুধের খরচ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, বাসাভাড়া এসব চিন্তায় উনার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। যদিও উনি ভেবেছেন পঁচিশলক্ষটাকা পুরোটা দিয়ে পারিবারিক সঞ্চয় পত্র কিনবেন। ওখান থেকে যে টাকাটা পাবেন সেটা দিয়ে বাসা ভাড়া দিবেন। আর পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চালাবেন। তবে জোবায়দাকে দুটো টিউশনি করাতে বলবেন। তাহলে হয়তো কোনোমতে সংসারের চাকাটা সচল থাকবে।
মানুষ বিপদে পড়লে বন্ধু আর শত্রুকে চিনে নিতে পারে। জোবায়দাদের জীবনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ওরা এখন তাজমহল রোডে ভাড়া থাকে। তিরিশ হাজারটাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। তবে সামনের মাসে এ বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল নোটিশ দিয়েছেন। দু,হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্লাট। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তার সাথে তাল দিয়ে উনিও বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দিবেন। তিরিশ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেওয়াই এখন ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর বাসা ভাড়া বাড়ালে তো আরোও সম্ভব হবে না। তাই শিয়া মসজিদের কাছে একটু ভিতরে বিশহাজার টাকায় একহাজার স্কয়ার ফিটের একটা বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। পুরোনো আমলের চারতলা বিল্ডিং
এর তিনতলা ওরা ভাড়া নিয়েছে। তবে বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের হঠাৎ এভাবে বাসা ভাড়া বাড়ানোর ছুঁতো ধরে ওদেরকে বাসা ছাড়ার নোটিশ দেওয়াটা আর কেউ না বুঝলে জেবায়দা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। বাড়িওয়ালার একমাত্র ছেলে হিমেল এবছর সোহরাওয়ার্দি মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। জোবায়দা ওর কাছেই মেডিকেলে ভর্তির জন্য প্রাইভেট পড়েছে। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল আন্টি দুজনেই জোবায়দাকে অনেক স্নেহ করতো। প্রিপাটরী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ও এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেছে। হিমেলের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য উনারাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জোবায়দার বাবা মাও সানন্দে রাজী হয়। জোবায়দা যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন থেকে এ বাড়ীতে থাকা শুরু হয়। বাড়ীওয়ালাদের কোনো মেয়ে না থাকাতে জোবায়দাকে ওরা খুব স্নেহ করতেন। জোবায়দা দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি ছাত্রী হিসাবে ভীষণ মেধাবী। বিশেষ করে হিমেলের মা জোবায়দাকে ভীষণ ভালোবাসতো। ভালো কিছু রান্না করলে জোবায়দার জন্য আলাদা করে তুলে রাখতো। পরিমানে বেশী থাকলে ওদের বাসায় পাঠিয়ে দিতো। আর কম থাকলে জোবায়দাকে ডেকে খাইয়ে দিতো। এই কারনে হিমেলের কাজিনরা বেড়াতে আসলে জোবায়দাকে দুষ্টুমী করে ভাবী ডাকতো। ওদের মুখে ভাবী ডাক শুনতে জোবায়দার মন্দ লাগতো না। হিমেলও মিটি মিটি হাসতো।
জোবায়দা তখন সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। হিমেল তখন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ইন্টার সেকেন্ডে ইয়ারে পড়ে। সেদিন ও একা স্কুল থেকে রিকশা করে বাড়ির পথে ফিরছিলো। পথের মাঝখানে হিমেল আর ওর বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। ওকে দেখে হিমেলের বন্ধুরা রাঙ্গাভাবী বলে ডাক দেয়। জোবায়দার খুব লজ্জা লাগে। পাশাপাশি হিমেলের উপর ভীষণ রাগ হয়। জোবায়দা তখন একটু বড় হয়ে যাওয়াতে এসব দুষ্টমীর মানে ভালোই বুঝতে পারতো। আর একটু ভয়ও কাজ করতো। যদি বাবা মায়ের কানে যায় তাহলে বিষয়টা কোনদিকে গড়াবে কে জানে। কিন্তু ও রিকশা থেকে দেখতে পায় বন্ধুদের এমন আচরনে হিমেল খুব আনন্দিত অনুভব করছে।

চলবে

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |১৩| [অন্তিম পর্ব]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
_”আপনি আমায় না জানিয়েই চলে গেলেন মিস্টার নুডুলস? কষ্ট পেলাম ভীষণ।”

ইনাম অনলাইন এই ছিলো, মেসেজটা তাই সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলো। রিপ্লাই করলো,
_”বলে আসার কি আছে?”

_”তা নেই, তবে থাকলে থাকতেও পারতো। আপনি চাচ্ছেন না তাই কারণ থাকছেনা।”

_”খাপছাড়া কথাবার্তা কি জন্ম থেকেই বলো?”

_”তা একটু আকটু।”

হাসলো ইনাম। সারা পুনরায় লিখলো,
_”আবার আসবেন কবে?”

_”তুমি জেনে কি করবে?”

_”যখনই আসুন, চুলগুলো নুডুলস বানিয়েই আসবেন। ভালোলাগে দেখতে।”

_”এতদিকে না তাকিয়ে পড়তে বসো পিচ্চি।”

_”এতদিকে কোথায়? তাকালাম তো শুধু আপনার দিকে, আমি আবার ভীষণ লয়াল।”

_”লয়ালিটির কি বোঝো তুমি?”

_”না বুঝলে,আপনি বোঝাবেন। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

সারা এবার হুট করেই ইনামের নিকনেইম দিয়ে দিলো, “মিস্টার নুডুলস”। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো ইনাম, নিজেও কি বুঝে নিকনেইম সেট করলো, “খাপছাড়া “।
_”বাহ, আই লাইক দিস নেইম।”

রিপ্লাই না দিয়েই অফলাইন গেলো ইনাম। মুচকি হাসছে সে, কেন হাসছে? জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে তার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে তাই? মেয়েরা তাকে পছন্দ করেনা তেমনটা নয়, তবে সবাই তাকে মজার নজরে দেখে বেশি, এটাও তার চুলের জন্য। আবারো অনলাইন এ এসে ইনাম টাইপ করলো,
_”আস..”

নিজেই অবাক হলো ইনাম, প্রশ্রয় দিচ্ছে সে মেয়েটাকে? দিলে দিক, মাঝেমধ্যে প্রশ্রয় দেওয়াটা খারাপ নয়।

____
_”র…জ…নী…” (বেশ টান দিয়ে ডাকলো)
ডাইনিং টেবিলে বসে গল্পের বই পড়ছিল রজনী। দর্শন বাহিরে থেকে এলো মাত্র,হাতে ফাইল। এক্সাম দিয়ে এলো বোধ হয়, সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে, মাথা পিছন দিকে এলিয়ে রাখা।
রজনী বইটা রেখে উঠে দাড়ালো, ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিলো। এরপর সেটা নিয়ে গেলো দর্শনের কাছে। দর্শন হাত বারিয়ে পানিটা নিলো। পুরো গ্লাস শেষ করে সেটা টি টেবিলের উপর রেখে ডান হাত ঝাড়া দিলো কয়েকবার। রজনী এগিয়ে এসে বললো,
_”মানে তুমি কষ্ট পাবে ভাইয়া,তাও ডাক্তারের কাছে যাবেনা? বাচ্চাদের মতো করো আসলেই।”

দর্শন সোফায় হেলান দিয়ে ক্লান্ত সুরে বলে,
_”হাতের কথা ছাড় তুই। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যাথা করছে, একটু টিপে দে না।”

দেরি করলোনা রজনী। পিছন দিকে এসে হাত রাখলো দর্শনের মাথায়,সোফায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। ফাহমিদা রান্নাঘর থেকে বেরিয়েই দর্শনের উদ্দেশ্যে বললেন,
_”মেয়েটাকে দিয়ে এতো কাজ করাস কেনো বল তো? ও কি তোর চাকর নাকি?”

দর্শন চোখ খুললো না, রজনীর নরম হাতের স্পর্ষে আরাম লাগছে বেশ। চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
_”কি যে বলোনা আম্মু! ও চাকর হতে যাবে কেনো? ও তো আমার..”

রজনী খানিক জোরে মাথায় চাপ দিতেই চুপ করে যায় দর্শন, নাহয় কি থেকে কি বলে ফেলবে! চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে নেয় দর্শন, রজনী ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে বলে,
_”কোনো সমস্যা নেই ফুপ্পি, তুমি ভেবোনা অতো। প্রি টেস্ট শেষ হলো মাত্র,এখন এমনিতেও পড়ার চাপ কম।”

ফাহমিদা চলে যান নিজের কাজে। দর্শন ভ্রু নাচিয়ে তাকায় রজনীর দিকে। রজনী পুনরায় মাথা টিপতে শুরু করলে সে চোখ বন্ধ করে বলে,
_”কথা শেষ করতে দিলিনা কেন?”

_”তোমার না মাথা ব্যাথা করছে? চুপ করে থাকোনা বাবা তাহলে,এত কথা বলতে যাও কেনো?”

হাসলো দর্শন,কিছুক্ষন বাদে বললো,
_”তোর হাতে জাদু আছে পাখি, মাথা ব্যাথা অর্ধেকটাই গায়েব হয়ে গেলো, স্ট্রেঞ্জ!..”

_”তেল এর দাম বুঝি কমে গেছে ভাইয়া?”

চোখ খুললো দর্শন, রজনী নিজেও হেসে দিলো এবার। দর্শন ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
_”হয়েছে, আর লাগবেনা। আবার হাতে ব্যাথা করবে তোর। ”
সোফা থেকে উঠে দাড়ালো দর্শন,রজনী অবাক মুখে বললো,
_”এই, রাগ করলে?”

দর্শন মুচকি হেসে এগিয়ে এলো রজনীর দিকে। দু’হাতে তার গাল টেনে দিয়ে বললো,
_”তোর উপর? ইম্পসিবল..”

_”উফ,গাল টানবেনা আমার।”
বিরক্ত হয়ে বলে রজনী। দর্শন আবারো হেসে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
_”তাহলে? কিস করবো?”

রজনী হা করে তাকালো দর্শনের দিকে। দর্শন চোখ টিপ মে’রে চলে গেলো নিজের ঘরে। রজনীর বিস্ময় এখনো কাটছে না, এটা কি বলে গেলো দর্শন?

_”হা করে দাড়িয়ে আছো কেন?”

আফিয়া টেবিল গোছাতে এসে বলেন এই কথা। রজনী মুখ বন্ধ করে মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে আসে এবার। ইদানিং আবার তার অদ্ভুত লাগে, অতিমাত্রায় খুশি হয়ে যায় কখনো কখনো। মনের মাঝে রঙিন প্রজাপতিরা উড়ে বেরায় বোধ হয়, তার কিশোরী মনে প্রথমবারের মতো প্রেমের হাওয়া লাগছে বলে কথা!

এই খুশির সূত্র ধরেই আবার নতুন সাধ জাগলো রজনীর মনে, শাড়ি পরার ইচ্ছে হলো খুব। তবে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন দর্শনকে। গুটিগুটি পায়ে দুপুরের পরপর তার ঘরে হাজির হলো রজনী। দর্শন ঘুমোচ্ছে উপুড় হয়ে, তবে তাকে ঘুমোতে দেখতে ইচ্ছে হলোনা। ধীরেধীরে গিয়ে বিছানার পাশে বসলো সে। দর্শনকে ডাকতে যাবে তার আগেই দর্শন বলে ওঠে,
_”কি চাই পাখি? এইসময় আমার ঘরে?”

অবাক হয় রজনী। দর্শন লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে শোয় এবার, তার মানে সে ঘুমায়নি। রজনী হেঁয়ালি না করেই বললো,
_”বাসায় থাকবে বিকেলে? ক’টা ছবি তুলে দিতে পারবে?”

_”সে থাকবো। কিন্তু,হঠাৎ ছবি?”

_”শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে খুব।”

এক ঝটকায় উঠে বসে দর্শন। চোখ দুটো ডলে বলে,
_”আমি জেগে আছি তো? লাইক, তোর শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে?”

_”এত অবাক হওয়ার কি আছে?”

দর্শন বিছানায় হেলান দিয়ে বলে,
_”আম্মু,মামি তো গেলো কোন আন্টির বাসায়। নানুর কাছে শাড়ি পরবি?”

_”দাদুর কাছে কেন পরতে হবে? আমি নিজে পরতে পারিনা বুঝি?”

_”রাতপাখি, তুই শাড়ি পরা কবে শিখলি?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে দর্শন, রজনী হেসে উত্তর দেয়,
_”অনেক আগে,পরিনি শুধু এই যা।”

_”কেন শিখতে গেলি বল তো? বিয়ের পর নাহয় হাজবেন্ড পরিয়ে দিতো।”

সামান্য হেসে বলে দর্শন, রজনী ভাবান্তর ছাড়াই বলে দেয়,
_”থাক, তোমায় আর অতো কষ্ট করতে হবেনা।”

চোখ বড়বড় করে নেয় দর্শন। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
_”আমি কেন কষ্ট করবো? কেন, আমায় বিয়ে করবি বুঝি?”

বিব্রতকর পরিস্থিতি তে পরে যায় রজনী, মুখ ফসকে এটা কি বলে ফেললো? পরিস্থিতি সামাল দিতে উঠে দাড়িয়ে বলে,
_”তুমি বাহিরে যাবেনা কিন্তু। আমি রেডি হয়ে বলবো, তখন ছাঁদে গিয়ে ছবি তুলে দেবে।”

ঘর থেকে বেরোবার আগ মুহূর্তে দর্শনের হাসির শব্দ ঠিকই শুনতে পেলো রজনী, নিজেও হাসলো সামান্য। এত বেশি হাসছে আজকাল,না জানি এত বিপরীতে কত কান্না অপেক্ষা করছে।
গোলাপি রঙের শাড়ি পরে হালকা সাজলো রজনী। হিজাবটা বের করতেই দরজার বাইরে থেকে দর্শনের কণ্ঠ শোনা গেলো,
_”তৈরি তুই?”

রজনী চুপ করে রইলো দু সেকেন্ড, দর্শনকে দেখতে পাচ্ছেনা দরজার পাশে। তারমানে সে কিছুটা দূরে থেকেই বলছে কথাটা। মাথা নিচু করে হাসলো রজনী। সে কখনো দরজা খোলা রেখে চেঞ্জ করবেনা, তবুও দর্শন না বলে ভিতরে আসেনি।
_”হ্যা তৈরি, এসো ভিতরে।”

দর্শন এবার প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে ভিতরে এলো। রজনী আয়নার সামনে গিয়ে হিজাব বাধতে লাগলো এবার, দু মিনিটেই সুন্দর করে হিজাব বেধে নিলো সে। দর্শনের নজর লক্ষ্য করেছে সে,তবে বলেনি কিছু। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে চুড়িগুলো বের করতেই দর্শন এগিয়ে আসে তার দিকে। চুড়িগুলো যত্ন করে পরিয়ে দেয় রজনীর হাতে। সেই হাতের দিকে তাকিয়েই বলে,
_”সাবধানে কি আর সাধে থাকতে বলি তোকে রাতপাখি? এবার সিরিয়াসলি আমার নজর লেগে যাবে।”

মুচকি হেসে রজনীর গালে হাত রেখে দর্শন বলে,
_”মাই নাইট বার্ড, মিষ্টি লাগছে খুব, জাস্ট লাইক আ ডল।”

_”পুতুল শাড়ি পরে?”

_”আমার পুতুল পরে।”

হাসলো দুজনেই। ছাঁদে গেলো একসঙ্গে, বিকেল গরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে প্রায়। তড়িঘড়ি করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দিলো দর্শন।
সন্ধ্যা নামতেই রজনী নিচে যেতে চাইলো, সেখানেও বাঁধা দিলো দর্শন। আবদারের সূরে বললো,
_”রাতপাখি, এখনই যাসনা।”

রজনী ভ্রুযুগল কুঁচকে বলে,
_”তো কি করবো? অন্ধকারে ছবি তুলবো? চেঞ্জ করবো আমি, অস্বস্তি লাগছে এখন।”

_”থাকনা আর কিছুক্ষন। চাঁদের আলোয় একটু দেখি তোকে।”

দর্শনের কথা ফেলতে পারলো না রজনী। এগিয়ে গিয়ে বসে পরলো সেই বেঞ্চটাতে, দর্শন এসে কিছুটা দূরত্ব রেখেই বসলো, ছাঁদের রেলিং এ কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত রেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রজনীর দিকে।
তার অজান্তেই অতিবাহিত হলো অনেকটা সময়। নিরবতা ভাঙলো দর্শন নিজেই। প্রশ্ন করে বসলো,
_”এভাবে যে তোর দিকে তাকিয়ে আছি, খারাপ লাগছেনা রাতপাখি?”

_”ভালো আর খারাপ নজরের মধ্যে পার্থক্য বোঝার মতো ম্যাচিউরিটি অন্তত আমার মধ্যে আছে।”

সরাসরি উত্তর দিলো রজনী। দর্শন মুচকি হেসে বললো,
_”বুঝে গেলি, আমার নজর খারাপ নয়? কি করে?… রাতপাখি, ভালোবেসে ফেলেছিস আমায়?”

_”একই প্রশ্নটা যদি আমি করি?”

_”আমি? সে তো কতো আগে থেকেই বেসেছি।”

_”কবে থেকে?”

অধির আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো রজনী। দর্শন এবার কিছটা এগোলো তার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_”নাটক সিনেমার মতো পিচ্চিকালে প্রথমবার দেখেই ভালোবেসে ফেলিনি,এটুকু সিওর। আমি মুগ্ধ হয়েছি অনেক দেরিতে, এই ধর বছর পাঁচেক আগে। কোনো এক পূর্নিমা কিংবা অমাবস্যা রাতে, তুই ঠিক এভাবেই ছাঁদে বসেছিলি, হয়তো মন খারাপটাই তার কারণ ছিলো। কি হলো আমার জানিনা, তবে আটকে গেলাম যেন। বাঁধা পরলাম সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া এই বালিকার প্রেমে। সেই রাতের কথা সহজ শব্দে এভাবেও বলা যায়,
‘হৃদকোঠরে আঁকড়ে তোকে
চাহিলাম তোর পানে
মনপাখি রূপে চাইলাম তোকে
সেই রজনী দর্শনে’

মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষন দর্শনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরালো রজনী। আপনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো এবার। আর দর্শন? সে’ও আকাশ দেখলো। তার নিজস্ব আকাশ, যার মাঝে চাঁদের পরিবর্তে নিজের ভালোবাসা দেখতে পায় সে।

#সমাপ্ত

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-১২

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |১২|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
রজনী চোখ সরিয়ে নেয় দর্শনের থেকে। দর্শন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে এসে বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। মাথা সামান্য বাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
_”মনে কোনো প্রশ্ন আসেনা তোর? এত কিছু বলি,সব অর্ধেক কথা। পুরোটা জানার ইচ্ছে হয়না রাতপাখি?”

রজনীর হৃদস্পন্দন ক্রমান্বয় বাড়লো বইকি কমলো না। তাকাতে পারলো না দর্শনের দিকে,দৃষ্টি নামিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দর্শন পাশে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কেবল। কিছুক্ষন পর পা বারিয়ে ঠিক রজনীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তার শরীরে জড়িয়ে রাখা ওড়নাটা পিছন থেকে নিয়ে মাথায় তুলে দিলো। অবাক হয়ে তাকালো রজনী, দর্শন পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললো,
_”শুনেছি মেয়েদের নাকি খোলা চুলে দারুণ লাগে, আরো বেশি রূপবতী লাগে তাদের। দ্বিমত পোষণ করলাম এই কথার সঙ্গে, কিছু কিছু মেয়েকে মাথায় ওড়না দেওয়া অবস্থায় অধিক থেকে অধিকতর সুন্দর লাগে। যেমন আমার প্রিয়তমা, পূর্ণিমার আলোয় ওড়নায় আবৃত তার মায়াময় মুখশ্রী, একবার তাকালে চোখ সরাতে ইচ্ছে হয়না। মন চায় যেন একইভাবে তাকিয়ে থাকি তার পানে। তার এই রূপটা আড়ালে থাকুক,নজর লেগে যাবে যে!”

এই প্রথমবারের মতো রজনীর মনে সাধ জাগলো, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে হলো,
_”কে তোমার প্রিয়তমা? মাঝেমধ্যেই তোমার মুখে তার কথা শোনা যায়, এমন নিষ্পাপ ভালোবাসা! আমিও জানতে চাই, কে সেই ভাগ্যবতী।”

প্রশ্নটা করতে পারেনা রজনী, মনে হয় উত্তরটা তার জানা। তবে এই উত্তরটা তার কিশোরী মন সহ্য করতে পারবে তো? অনুভূতির জোয়ারে ভেসে বাস্তবতা ভুলতে বসবে না তো?

_”বড্ড কথা লোকানো শিখেছিস রাতপাখি। মনের মধ্যে প্রশ্ন চেপে যাচ্ছিস কেন?”

রজনী চোখ সরিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
_”এই প্রশ্নের উত্তর তো তুমি কাউকে দেওনা দর্শন ভাই।”

_”কাউকে দেইনা? তোকেও দেবোনা, এটাই ভেবে নিলি?”

দর্শন আজ সব দিক থেকেই ঘিরে ধরছে রজনীকে। যেন তার মাথায় চেপে বসেছে, অনেক করেছে লুকোচুরি, আর নয়। রজনীর থেকে উত্তর না পেয়ে এগিয়ে এলো দর্শন। হুট করেই তার ডান হাতটা সামনে এনে বললো,
_”কি হয়েছে হাতে?”

_”আরু খামচি দিয়েছিলো কাল।”

হাতটা কিছুটা উপরে আনলো দর্শন, চামড়া উঠে গেছে কিছু জায়গার, দু জায়গায় লাল হয়ে আছে, বাচ্চাদের খামচি বলে কথা। সযত্নে সেখানে হাত বোলালো দর্শন। রজনী চোখ সরালো আবারো। আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে তার, দর্শনকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। অন্যদিকে চোখ সরিয়েই ধীর গলায় বললো,
_”ঠিক আছে.. ছাড়ো।”

_”যদি না ছাড়ি রাতপাখি? ধরে রাখতে চাই আজীবনের জন্য? অসন্তুষ্ট হবি তবে?”

লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো রজনী, দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত ঢোক গিললো সে। দমবন্ধ লাগছে যেন, বন্ধ চোখজোড়া থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। দর্শন ব্যস্ত হলোনা, সে চাইলো তার প্রেয়সীর অনুভূতি পরখ করতে।
চোখ খুললো রজনী, দর্শন তার হাতটা ছেরে দিতেই ছুটে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। এই কথাটা কেন বললো দর্শন? না বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত? অনুভূতিকে অপ্রকাশিত রাখতেই পারতো সে চাইলে, তাহলে বললো কেন?

দর্শন দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষন। আটকাতে চাইলো না রজনীকে, থাকুক একটু নিজের মতো। এখনো ছোট সে, দর্শনের সামান্য কথার ভার অনেকটা, এটা স্বিকার করতে তার একটু সময় লাগতেই পারে।
আপাতত রজনীর টেবিল থেকে তার নির্দিষ্ট একটি ডায়েরী হাতে নিলো দর্শন, নিজের পছন্দের বইগুলোর নাম রজনী এখানে লিখে রাখে। দর্শন সেই নামের একটা ছবি তুলে নিলো ফোনে।

জাহিদ বাড়িতে নেই। আফিয়া আর ফাহমিদা একই ঘরে বসেছিলেন। ফাহমিদা কাথা সেলাই করছেন চোখে চশমা দিয়ে, আর আফিয়া বিছানায় বসে আছেন, টুকটাক কথাও বলছে দুজন। রজনী ঘরে এসেই ছুটে এলো মায়ের কাছে। বিছানায় এসে আফিয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো সে। আফিয়া আর ফাহমিদা দুজনেই অবাক হলেন। আফিয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
_”কি হয়েছে মা, এভাবে ছুটে এলে যে।”

রজনী উত্তর দেয়না। তার কানে কেবল একটা কথাই বেজে চলেছে, “সারাজীবন এর জন্য যদি ধরে রাখতে চাই?”
চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় রজনী। আফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
_”কিছু হয়নি। কেন,কিছু না হলে আমি আসতে পারিনা তোমার কাছে? এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করোনা প্লিজ, এভাবেই থাকতে দাও কিছুক্ষন।”

ফাহমিদা আর আফিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে,হঠাৎ কি হলো মেয়েটার। তবে এর উত্তর পায়না কেউ, আফিয়া আর কথা বাড়ালেন না। এমনিতেই মেয়েটার মন খারাপ সকাল থেকে, মায়ের কাছেই তো এসেছে, থাকুক কিছুক্ষন।

_____
মায়ের কোলে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলো তা আর খেয়ালই করেনি রজনী। ঘুম ভাঙে তার মাগরিব এর আযান শুনে, নামাজ পরতে পারবেনা বলে আফিয়া ডাকেনি আগে। ঘুম ভাঙার পর নিজের ঘরে চলে আসে রজনী, এখনো তার মন অশান্ত। অদ্ভুত লাগছে,এমন নয় যে দর্শনের কথায় সে খুব বেশি অবাক হয়েছে। এতটাও ছোট নয় সে, দর্শন প্রতিনিয়ত তার আচার-আচরণ এর মাধ্যমে নিজের মনের কথা বোঝাতে চেয়েছে। তবে সরাসরি তো কিছু বলেনি, আজ তাই বললো। না বললেই পারতো, শুধুশুধু রজনীর মনটাকে অশান্ত করার কি প্রয়োজন ই বা ছিলো?

হাত মুখ ধুয়ে আসতেই রজনীর চোখ যায় টেবিলের উপর।
তিনটে নতুন বই দেখেই পা বারায় সেদিকে, নিশ্চিত এগুলো দর্শন ই এনে দিয়েছে। এই এক ক্ষেত্রে প্রচুর দূর্বল রজনী, মন খারাপ হোক বা যাই হোক না কেনো, বই পেলে সে সবকিছু ভুলে যাবে।
প্রথম বইটা খুলে দেখতেই তার ভিতর থেকে একটা চিরকুট নিচে পরে যায়, রজনী ভ্রু কুঁচকে সেটা খুলতেই দেখে কালো কালিতে কিছু লেখা, হাতের লেখাটা দর্শনের।

“কিছুই তো বললাম না, এতেই আমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছিস রাতপাখি? এখনো তো আরো শতশত মনভোলানো বাক্য শোনা বাকি তোর আমার থেকে। এভাবে পালিয়ে গেলে তা বলবো কি করে?”

কাগজটা ভাজ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো রজনী। অবাক হলো, সে হাসছে কেন? সেই বাক্য কি শুনতে ইচ্ছে করছে তার? লজ্জা লাগছে? নাহ,লজ্জা পাওয়ার মতো তো দর্শন কিছুই বলেনি। যা বলেছে তা কেবলই ভালো লাগার। তাহলে মনটা এমন ফুরফুরে হয়ে গেলো কেন হুট করে? হৃদয়ে শান্তির বাতাস বয়ে গেলো, নাকি প্রেমের বাতাস?

বইগুলো গুছিয়ে রেখে রান্নাঘর এর দিকে গেলো রজনী। আফিয়া আর ফাহমিদা সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছে। রজনীকে দেখেই ফাহমিদা তাকে ডেকে হাতে দুটো পায়েসের বাটি ধরিয়ে বললো,
_”কালকের পায়েস,ফ্রিজ এ ছিলো। তোরা তো আবার ঠান্ডা পায়েস পছন্দ করিস। রাফিনকে আগেই দিয়েছি, দর্শনকে দিয়ে আয় আর নিজেও খেয়ে নে এবার। ঘুম ভালো হয়েছে?”

মাথা নাড়লো রজনী। ফাহমিদার কথামতো পা বারালো দর্শনের ঘরের দিকে। আচমকা পা থেমে যেতে চাইলো তার, তা উপেক্ষা করে দরজার সামনে গিয়ে বললো,
_”আসবো?”

দর্শন খাটে হেলান দিয়ে বসে ফোন স্ক্রোল করছিলো। রজনীর গলার আওয়াজ পেয়ে ফোনটা রেখে সোজা হয়ে বসলো সে। শান্ত গলায় বললো,
_”আয়..”

রজনী ভিতরে এলো। এক হাতের বাটি দর্শনের দিকে এগিয়ে দিলো, তবে তার দিকে তাকালো না। দর্শন মনেমনে হেসে বাটিটা নিতেই রজনী পুনরায় বেরিয়ে যাওয়ায় জন্য পা বারায়। তাকে থামিয়ে দেয় দর্শন, পিছন থেকে বসে ওঠে,
_”কোথায় যাচ্ছিস? বোস এখানে।”

রজনী বসলো খাটের এক পাশে। পায়েসের বাটিতে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো সে। দর্শন আবারো হেলান দিয়ে বললো,
_”বই পছন্দ হয়েছে?”

_”হুম।”

_”আর আমাকে?”

_”হুম?..”
বড়বড় চোখে তাকায় রজনী। দর্শন তার দিকে এগিয়ে বসে বলে,
_”চুপ করে আছিস কেন? অতি লজ্জা ভালো নয়। লজ্জা পাওয়ার কিছু না বলতেই যদি কথা বলা বন্ধ করে দিস তাহলে..”

_”বলছি তো কথা।”

মুচকি হাসলো দর্শন। পায়েসের বাটিটা পাশে নিয়ে রাখলো। রজনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”বেশ, অনেক কথা বলছিস। তবে এবার আমি কিছু কথা বলবো, মন দিয়ে শুনবি। তাকা এদিকে..”

রজনী তাকালো দর্শনের দিকে। দর্শন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখে বজায় রেখে বললো,
_”আমি জানি তুই অবুঝ না, আর এটাও জানি তুই কেন আমার থেকে পালাতে চাইছিস। ঠিক এই কারণে কথাগুলো তোকে বলতে চাইছিলাম না পাখি। এবার জিজ্ঞেস কর, কেন বললাম তাহলে? সেটাও তোর জন্যই। খুব ইচ্ছে না তোর, সবাই তোকে ভালোবাসবে? এই ইচ্ছেটা হয়তো আমি মেটাতে পারবো না কখনো। তবে সকলের ভালোবাসার ঘাটতি মেটাবার চেষ্টা আমি করতেই পারি। স্পষ্টভাবে এটাই জানান দিলাম তোকে, বেঁচে থাকার একটা কারণ বারিয়ে দিলাম।
আমি তোর থেকে কোনো উত্তর চাইনি রাতপাখি, না চেয়েছি তোর ভালোবাসা। তার জন্য অনেক সময় পরে আছে। তুই বুদ্ধিমতী, অনুভূতিকে প্রাধান্য দিতে বারণ করবোনা। তবে তার ভারটা যেনো নিজের স্বপ্নের উর্ধে না চলে যায়। কথাগুলো বললাম, যেন নিজের মাঝে তৈরি হওয়া জড়তাগুলোকে শুরুতেই এক সাইডে সরিয়ে রাখতে পারিস।”

আরো কিছুটা এগোলো দর্শন, মৃদু হেসে বললো,
_”আমার থেকে লুকিয়ে থাকা, লজ্জা পাওয়ার সময় হলে, তা আমি নিজেই বলবো। কেমন?”

রজনীকে কোনো প্রতিত্তর করার সুযোগ দিলোনা দর্শন। মুহূর্তেই সরে এলো সে। রজনীর হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে নিলো। এক চামচ পায়েস তার মুখের সামনে তুলে ধরে বললো,
_”নে, আমিই খাইয়ে দিচ্ছি। বইগুলো পরে সামারি বলিস আমাকে, অতকিছু পড়ার ধৈর্য নেই আমার।”

পায়েসটুকু মুখে নিলো রজনী। একদৃষ্টিতে দর্শনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো সে। তার মধ্যে আর কিছুক্ষন আগের জড়তাটুকু কাজ করছে না, তবে নিজেকে এই মুহূর্তে ভীষন ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। কারণটা হয়তো তার সামনে বসে থাকা ব্যক্তি, যে তাকে মন থেকে ভালোবাসে।

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-১০+১১

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |১০+১১|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
বাকিরা রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করেই চলে গেলো, থাকলো কেবল ইনাম। তাও হালিমা আর জাহিদ জোর করেছে বলেই সে থাকতে বাধ্য হয়েছে। দর্শন আর ইনাম একসঙ্গেই থাকবে আজকে। ইনাম আবার পরেছে মহা যন্ত্রণায়, অনলাইন এ এলেই সারা মেসেজ এর বন্যা জুরে দিচ্ছে। ইনাম না পারছে ওকে ব্লক করে দিতে আর না পারছে এগুলো সহ্য করতে। অনেক্ষন বাদে মেসেজ চেক করলো ইনাম, প্রায় পনেরো টা মেসেজ জমা হয়ছে। শেষের মেসেজ এ লেখা,
“আপনি রিপ্লাই দেবেন না তাই তো? ছেলেরাও এতো ভাব দেখায়? এগুলো মেয়েলি স্বভাব.. এই এই, আপনার কোনো সমস্যা নেই তো?”

চোখ বড়বড় করে মেসেজের দিকে তাকিয়ে রইলো ইনাম, দ্রুত টাইপ করলো,
_”সমস্যা মানে? কি বোঝাতে চাইছো তুমি হ্যা? আমাকে দেখে কোন অ্যাঙ্গেল এ…”

মেসেজ টা সেন্ড করার কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যেই সারা রিপ্লাই দিলো,
_”এইতো মিস্টার নুডুলস,আপনি রিপ্লাই দিয়েছেন। নাহ, তার মানে বোঝা গেলো আপনি একদম ঠিকঠাক আছেন।”

_”বেশি পেকে গেছো তাইনা? সবে তো ক্লাস ১০ এ পড়ো, এত রাতে ফোন ইউজ করছো, কেউ কিছু বলেনা?”

_”আম্মু তো আমার পাশেই ঘুমোচ্ছে। আমি আবার ভীষণ গল্প পড়ি, অনেক ডায়লগ ও মুখস্ত করে রেখেছি। শুনবেন?”

_”আজ্ঞে না, আপনার বাস্তব ডায়লগ গুলোই যথেষ্ট।”

_”আরে এত প্রশংসা করতে পারেন আপনি,মিস্টার নুডুলস! যাহ,লজ্জা লাগে তো আমার। “(সঙ্গে বানর এর লজ্জা পাওয়া ইমোজি)

ইনাম ভ্রু কুঁচকে রিপ্লাই দেয়,
_”প্রশংসা? কখন?”

_”আপনার কথা এতো তেঁতো কেনো হ্যা? আপনি বললেন আর আম্মু জেগে গেলো। এখন ই ফোন নিতে চাইবে।”

_”ভালো তো, পিচ্চি মেয়ে এতো রাতে ফোন ইউজ করতে হয়না।”

_”তা পারবো ও না।”

পুনরায় সারাই মেসেজ করলো,
_”শুনুন মিস্টার নুডুলস..”

_”না জিজ্ঞেস করে কতো কিছুই তো বলছো..”

_”আপনি না খুব কিউট, একদম ক্রাশ ম্যাটারিয়াল। রিপ্লাই দিয়ে রাখুন,সকালে উঠে দেখবো। গুড নাইট..”

মেসেজটা দেখে আনমনেই হাসলো ইনাম। মেয়েরাও এভাবে ফ্লার্টিং করতে জানে, এই মেয়েকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। তবে একটা বিষয় অদ্ভুত, সারার সঙ্গে কথা বলে খারাপ লাগলোনা ইনাম এর, বরং মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো।

ইনাম আবার বেশ ঘুমকাতুরে, ফোন রেখে শুতে দেরি তার ঘুমিয়ে পরতে দেরি নেই। দর্শন টেবিলে সামনে চেয়ার দিয়ে বসে আছে। মাথায় এতো চিন্তা, সবটাই রজনীকে নিয়ে। মেয়েটা খুব বেশি কথা তার থেকে লুকোয় না, তবে কিছু লুকোতে চাইলে দর্শন তা জানার জন্য জোর করেনি কখনো। তবে জন্মদিন এর বিষয়টা এখনো ভাবাচ্ছে দর্শনকে।
দুঃখজনক বিষয়, রজনীর জন্মের দিন বিকেল বেলাই তার দাদা মারা যায়। একেতো সে মেয়ে, এই যুগে এসেও জাহিদ এবং তার মা হালিমা সর্বদা ছেলে চাইতেন, মেয়ে মানুষ মানেই বোঝা,এই কথাতেই তারা আজও বিশ্বাসী, সেই কারণে ছোট থেকে রজনীকে কম অবজ্ঞা সহ্য করতে হয়নি। তার উপর এই ঘটনায় হালিমা ক্ষিপ্ত হন কঠোরভাবে, এই মেয়েই যেন পরিবার এর অভিশাপ, সে এই দুনিয়াতে এসেই তার দাদাকে মে’রে ফেললো। এমন কথা ছোট বেলা থেকে শুনতে হয়েছে রজনীকে। প্রতিনিয়ত জাহিদের ব্রেইন ওয়াশ করে গেছেন হালিমা, তার যেন একটাই উদ্দেশ্য, রজনীকে সে খুশি থাকতে দেবেনা। নির্দোষ রজনীকে তিনি আজও নিজের স্বামীর খু’নি মনে করে। আর তাই ছোটবেলা থেকে কখনো এই বাড়িতে রজনীর জন্মদিন উৎযাপন করা হয়নি। কিছু বছর যাবৎ দর্শন রাতে লুকিয়ে কেক নিয়ে আসতো, গতবছর দুর্ভাগ্যবশত হালিমার চোখে পরে যায় তা। এই নিয়ে তিনি কম কথা শোনায়নি রজনীকে, মেয়েটাকে জন্মদিন এর দিনও কাঁদিয়ে রেখেছেন তিনি। ওর কান্না দেখে বোধ হয় আত্মতৃপ্তি পান হালিমা।

তবে এই সবকিছুর সাথে রজনীর ওভাবে ভয় পাওয়ার বিষয়টা মেলাতে পারলো না দর্শন। বাধ্য হয়ে হাল ছাড়লো সে, ঘর থেকে বেরোতেই হালিমাকে ছাঁদে যেতে লক্ষ্য করলো সে। রাতের বেলা তো রজনী আর দর্শন ছাড়া কেউ ছাঁদে যায়না সচরাচর। হালিমা যেতেই দর্শন ও তার পিছুপিছু ছাঁদে গেলো। তার আগে একবার রজনীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো সে ঘরে নেই, বুঝতে পারলো রজনীও ছাঁদেই আছে। ছাঁদের দরজার সামনে গিয়েও ভিতরে প্রবেশ করলো না দর্শন পাশেই দাড়িয়ে রইলো।

রজনী আজ বেশ আনন্দ নিয়েই ছাঁদে এসেছিলো, মনটা ভালোই আছে আজ। ঠিক তখনি হালিমা এসে তার কাধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘোরালেন,তার চোখমুখ কোঁচকানো। রজনী আকস্মিকভাবে ভয় পেলেও তা সামনে নিয়ে বলে,
_”দাদু তুমি ঘুমোও নি?”

_”ক্যান রে? আমি ঘুমাইলে তোর এইখানে আইসা পিরিত করতে সুবিধা হইবো?”

বিস্মিত চোখে তাকায় রজনী, দর্শনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে মুহূর্তেই। রজনী অবাক কণ্ঠে বলে,
_”দাদু আমিতো এমনিই এসেছিলাম।”

_”হ তুমিতো এমনেই আইবা, পাগল মনে হয় আমারে? ঐযে পোলাডা কতক্ষন ধইরা তাকায় আছে এদিকে, দেখোস নাই?”

হালিমার কথা অনুযায়ী সোজা তাকাতেই রজনী খেয়াল করে চারতলার বারান্দায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। রজনী প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,
_”দাদু উনি তো ফোনে কথা বলছে, আমার দিকে তাকাবে কেনো?”

_”একদম নাটক করবিনা। পোলারা তাকায় থাকলে খুব ভালো লাগে তাইনা? কে জানে রাস্তাঘাটে আরো কি কি কইরা বেরাও তুমি! আমাগো মান ইজ্জত ডুবার আগে কইছিলাম জাহিদরে, মাইয়ার বিয়ার ব্যবস্থা করতে। তা আবার আরেকজন হইতে দিতো না, মেয়ের নাকি বয়স হয়নাই।”

চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পরে রজনীর। অহেতুক হালিমা তাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। হালিমা এবার তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
_”আমি কালকেই আবার জাহিদের লগে কথা কইতাম। মাইয়া মানুষ অতো পড়াশোনা কইরা কি করবো?”

কষ্ট ভুলে গিয়ে ভয়ে আবদ্ধ হয় রজনীর মন। তৎক্ষণাৎ হালিমার হাত ধরে আকুতির স্বরে বলে,
_”দাদু প্লিজ, আব্বুকে এমনটা বলোনা। তুমি বললে আমি আর ছাঁদে আসবোনা, তারপরও আমার পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলোনা প্লিজ।”

হালিমা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেন হাতটা। রাগী কণ্ঠে বলে,
_”সর তো, তোর কান্না নিয়ে থাক তুই। আমিও তোর বিয়া দিয়াই ছাড়ুম, এই কইয়া দিলাম।”

কথাটা বলেই চলে গেলেন হালিমা, দর্শন লুকিয়ে পরায় তাকে আর দেখতে পায়নি তিনি। দর্শন দাঁতে দাঁত চেপে কেবল নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রেখেছে, ইচ্ছে করছিলো তাকে ক’টা কথা শুনিয়ে দিতে। তবে এতে রজনী রাগ করবে, কথা বলবেনা কয়েকদিন। তার মতে হালিমা গুরুজন, সে যাই বলুক না কেন তাকে কোনোভাবে অপমান করা যাবেনা। দু মিনিট ধরে নিজেকে শান্ত করলো দর্শন। দরজার সামনে এসে রজনীর দিকে দৃষ্টি যেতেই হৃদয়ে জোরালো আঘাত এসে লাগে তার, মেয়েটার কষ্টগুলো কোনোভাবে যদি নিজের করে নিতে পারতো!

রজনী দাড়িয়ে আছে একইভাবে। চোখ থেকে অশ্রুকণা বিসর্জন দিচ্ছে নিরবে। মাথা এবং শরীরে শালীনভাবে ওড়না জড়িয়ে রাখা। হালিমা কিনা ইচ্ছে করে তার চরিত্রর দিকেও প্রশ্ন তুললো আজ!
চোখ বন্ধ করে শুকনো ঢোক গিলে দর্শন। সে সামনে গেলেই রজনী নিশ্চিৎ কান্নার পরিমান বারিয়ে দেবে এবার। মেয়েটা বড্ড ভালোবাসার কাঙাল, কারো এতটুকু ভালোবাসা পেলেই সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। তবে নিজের দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গী হিসেবে অধিকাংশ সময় সে দর্শনকেই পেয়েছে।
দর্শন এগিয়ে এলো, দাড়ালো রজনীর সম্মুখে। তা টের পেয়ে চোখ বন্ধ করলো রজনী,একহাতে চোখ মুছে নিলো সে, দর্শন শুনেছে সব কথা,এ বিষয় নিশ্চিত সে। দর্শন ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
_”চুপ করে কেন থাকিস রাতপাখি? নিজে না বলতে পারলে অন্তত আমায় অনুমতি দে।”

দর্শনের প্রশ্নে পাত্তা দিলোনা রজনী। সে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_”আর কি বাকি আছে ভাইয়া? লেখাপড়া নিয়ে তো দাদু আরো বছরখানেক আগে থেকে পরে আছে। এবার আমার ছাঁদে আসাতেও বাঁধা। আচ্ছা, দাদু যদি আমার বই পড়াটাও বন্ধ করে দেয়?”

শেষের কথাটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে রজনী। দর্শন দুদিকে মাথা নাড়াতেই সে পুনরায় বলে ওঠে,
_”আমি তো বেঁচেই আছি বইগুলোর জন্য ভাইয়া। আজ একদম সত্যি কথা বলছি, অন্য কোনো কারণে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। যদি আমার বই পড়া, লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়… আমি বাঁচতে পারবোনা।”

দর্শনের ধারণাই সঠিক হলো, কান্নার বেগ বারলো রজনীর। তার প্রতিটি কথা ভীতির জন্ম দিলো দর্শনের মনে। কিছুটা এগিয়ে রজনীর দু’কাধে হাত রেখে বললো,
_”এভাবে বলেনা পাখি, তুইতো স্ট্রং। এত সহজে ভেঙে পরবি? এখনো তো পুরো জীবন বাকি, নামের আগে প্রফেসর ট্যাগ পাওয়া বাকি তোর। বাঁচতে চাইবিনা এগুলোর জন্য?”

রজনী দর্শনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”ইচ্ছেতো করেনা ভাইয়া,কি করবো আমি?”

_”আমি বুঝতে পারছি তো। আসলে কি বলতো, এই বয়সে অনেক কিছুই সহ্যের বাহিরে চলে যায়। মাথায় সব দুশ্চিন্তা ই আসে, এগুলোকে তো ওভারকাম করতে হবে।”

রজনী চোখ নামিয়ে বলে,
_”আমি আর বাচ্চা নই ভাইয়া। এসব মোটিভেশন পেতে আর ভালোলাগে না আমার, বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি আমি জীবন থেকে।”

_”আমার দিকে তাকা রাতপাখি।”

রজনী তাকালো দর্শন এর দিকে। দুজনের দৃষ্টি এক হলো এবার। দর্শন শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
_”তুই নিজের জন্য বাঁচবি, জীবনকে ভালোবেসে, নিজের স্বপ্ন পূরনের জন্য। তবুও যদি কখনো জীবনের প্রতি বিরক্তি চলে আসে, সেই মুহূর্তে নাহয় অন্য কারোর জন্য বেঁচে থাকতে চাইবি। যারা তোকে ভালোবাসে,তাদের কথা একবার মনে করবি, অন্তত মামির কথা..”

অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রইলো রজনী। দর্শন যেন আটকে গেলো ঐ চোখ দুটির মোহে। ধীর কণ্ঠে বললো,
_”তোর এখনো অনেক ভালোবাসা পাওয়া বাকি রাতপাখি। ভেবে দেখ, কেউ হয়তো চায়, তোকে তার ভালোবাসার চাদরে মুরিয়ে রাখতে, যেখানে কোনো কষ্টেরা থাকবে না। সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য হলেও তোকে বাঁচতে হবে।”

_”আশা দেখিওনা, আমার কোনো স্বপ্ন তো পূরণ হয়না ভাইয়া। মিছে স্বপ্ন দেখে কষ্ট বারিয়ে লাভ কি?”

দর্শন এবার তার একহাত রাখলো রজনীর গালে, চোখের পলক ফেলে বললো,
_”আমি তোকে মিথ্যে আশা দেখাবো পাখি? তেমনটা মনে হয় তোর? এটুকু বিশ্বাস রাখবি না আমার উপর?”

নিরব রইলো রজনী তবে তার অশ্রুধারা বাঁধ মানলো না। দর্শন করুন স্বরে বলে,
_”আর কাঁদিস না প্লিজ। শরীর খারাপ করবে তো।”

দর্শনের হাতটা সরিয়ে দিলো রজনী। চোখ মুছে রেলিং এর দিকে এগিয়ে বললো,
_”হবেনা। তুমি যাও ভাইয়া..”

দর্শন এগিয়ে এসে ঠিক রজনীর পাশে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করে বসলো,
_”কেন যাবো? নিঃসঙ্গতা খুব ভালোলাগছে আজকাল?”

_”জানিনা।”

_”এই অভ্যাস কখনো করতে বলিনি।”

_”হুম, এখন পর্যন্ত বই আমার সঙ্গ ছাড়েনি তো, ভবিষ্যৎ এও থাকবে হয়তো।”

_”আরো কেউ থাকবে হয়তো।”

দর্শনের দিকে একনজর তাকালো রজনী। চোখ সরিয়ে দুদিকে মাথা নাড়ালো সে,তাচ্ছিল্যের সূরে হাসলো সামান্য। সে তো কখনো কারো বিশেষ সঙ্গ চায়নি। কেবল চেয়েছে একটা পরিবার, সবার ভালোবাসা। সেটা কখনোই পায়নি রজনী,হয়তো পাবেও না। দর্শন দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করেই, রজনীও নিশ্চুপ। কিছুক্ষন পরপর তবুও জল গরাচ্ছে তার চোখ থেকে, নিজেই মুছে নিচ্ছে সেটা। দর্শন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল, এছাড়া বিশেষ কিছুই করার নেই তার। তবে আজ প্রথমবারের মতো দর্শনের মনে হলো, রজনীকে নিজের মনের কথা বলে দিলে বোধ হয় ভালো হতো। অন্তত মেয়েটা বেঁচে থাকার একটা ইচ্ছে খুজে পেতো, অপূর্ণ চাওয়াগুলোর মাঝেও একজন তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, এটা ভেবে হয়তো খুশি থাকতে পারতো সে।

______
দর্শনের কথাই সত্যি হলো, বেশি কান্নাকাটির ফলে সেই ঠান্ডা লেগেই গেলো রজনীর। আজ আর স্কুলে যেতে পারলো না সে। মন খারাপ করে সারাক্ষণ ঘরেই বসে থাকলো। এরই মাঝে হালিমা জাহিদের কান ভাঙানো ও শুরু করে দিয়েছেন।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে নিজের ঘরে গিয়ে তৈরি হলো দর্শন, একটু বেরোবে সে। সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করে রজনীর মন ভালো করার, কাজ হয়নি। এবার কিছু বই এনে দেবে, তাতে যদি মেয়েটার মন ভালো হয়।
বেরোনোর আগে রজনীর ঘরে এলো দর্শন। বাকিরা নিজেদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। আফিয়াও বুঝতে পেরেছেন রজনীর মন খারাপের কারণ, তবে আজকাল মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতোও কিছু খুজে পাননা তিনি। কেবল একটাই প্রার্থনা করেন, মেয়েটা যেন একজন ভালো মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পায়। যে তার ইচ্ছের গুরুত্ব দেবে,তাকে ভালো রাখবে।

রজনীর ঘরে এসে দাঁড়িয়ে রইলো দর্শন। তার সামনে দাঁড়িয়ে রজনী নিজের চুল কাটার চেষ্টা করছে। এটা সে আগেও করেছে,তবে সফল হয়নি।

_”আচ্ছা,চুল ছোট করে ফেললেই কি ছেলে হওয়া যায়না?”
বামপাশে এনে রাখা নিজের খোলা চুলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতস্বরে কথাটা বললো রজনী। সামনে ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে সে, সঙ্গে তার পিছনে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনকেও দেখতে পাচ্ছে। রজনীর ডান হাতে মাঝারি আকৃতির কেচি।

এই একই কথা আগেও বলেছে রজনী। মানসিকভাবে অধিক বিষন্ন হয়ে চুল কাটার চেষ্টা করে সে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে চুপ করে রইলো দর্শন। রজনী একবার নিজের চুলের দিকে আরেকবার আয়নার দিকে তাকালো। কাপাকাপা হাতে কেচিটা এগিয়ে নিলো নিজের চুলের দিকে। আয়নার দিকে তাকিয়ে হাতটা আরো কিছুটা এগিয়ে নিতেই অশ্রুজল গড়িয়ে পরলো তার চোখ থেকে।

দর্শন এবার ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে। রজনীর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আয়নায় তাকিয়ে বললো,
_”কাঁদছিস কেন এখন?”

হাতে থাকা কেচির দিকে তাকিয়ে রজনী বললো,
_”মায়া লাগছে খুব।”

হাতটা সামনের দিকে এনে কেচিটা নিয়ে নিলো দর্শন। রজনী চোখ মুছে তার দিকে ঘুরে বললো,
_”কি অদ্ভুত না? সামান্য চুলের জন্য আমার এত মায়া হয়, অথচ গোটা একটা মানুষের জন্যই কারো মনে এতটুকু মায়া নেই!”

কেচি টা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিলো দর্শন। বুকে হাত গুঁজে বললো,
_”দোষটা তোর।”

রজনী অবাক হয়ে বলে,
_”আমার দোষ?”

_”সবার থেকে মায়া আশা করাটাই তোর দোষ। রাতপাখি,বড্ড লোভি হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন।”

তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে ঘুরে দাঁড়ায় রজনী। বারান্দার দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
_”তুমি বুঝবেনা দর্শন ভাই।”

হাত সোজা করে দু কদম এগিয়ে আসে আসে দর্শন। তবুও তাদের মাঝে দূরত্ব খুব একটা কম নয়। আচমকা বাতাসে রজনীর খুলে রাখা চুলগুলো সামান্য উড়তে লাগলো, কিছুটা চোখে মুখে এসে বিরক্ত করলো তাকে। রজনী হাতের সাহায্যে সরিয়ে দিলো সেগুলো। দর্শন তার পানে চেয়ে বলে,
_”তুই চাস, আমি বুঝি?”

ঘাড় ঘুরিয়ে দর্শন এর দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে রজনী। দর্শন চোখ নামিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
_”যেদিন তুই চাইবি, তোকে সবচেয়ে ভালো আমিই বুঝবো রাতপাখি। কথা দিলাম..”

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০৯

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৯|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
সদর দরজা থেকে ভেতরে ঢুকতেই তিন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে রজনীর পা জড়িয়ে ধরলো। রজনী চওড়া হেসে সঙ্গেসঙ্গে কোলে তুলে নিলো তাকে। তার গালে চুমু খেয়ে সামনে তাকাতেই মনটা আরো ভালো হয়ে গেলো তার। বাড়িটা একদম গমগম করছে, এমনিতে সবসময় যেন ম’রা বাড়ি মনে হয়। তবে আত্মীয়রা এলে সবাই কত্ত হাসিখুশি থাকে।
সোফা থেকে ইরা উঠে এসে ইনামের কাঁধে চাপড় মেরে বললো,
_”আপনি অবশেষে এলেন জনাব।”
ইনাম হাসলো সামান্য। ইরা এগিয়ে এসে তার মেয়ে আয়রার মাথায় হাত বুলিয়ে রজনীর গাল টেনে বললো,
_”কেমন আছিস বোনু? কোনো খবর ই তো পাওয়া যায়না তোর,থাকিস কোথায়?”

রজনী মুচকি হেসে বলে,
_”পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি আপু, তুমি কেমন আছো? ভাইয়া আসেনি?”

_”এসেছে তো, এই একটু বাইরে গেলো।”

ইরা রজনীর পাশে দাড়িয়ে থাকা দর্শনের মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
_”তোমাকে তো ঝাঁটাপেটা করা উচিৎ, এখন বলো তুমিও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকো। খোজ নেওয়ার সময় কোথায়!”

দর্শন বিপরীতে ইরার কান টেনে ধরে বলে,
_”আমায় বলা না? নিজে সারাদিন বাসায় বসে কি করিস হুম? একদম আরুর বাহানা দিবিনা..”

_”আহ ভাইয়া ছাড়ো তো।”

দর্শন খানিক ধাক্কার ন্যায় কান ছেড়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। ইফতি সেখানে মনের আনন্দে বসে গেমস খেলছে, ইরার ছোট ভাই সে, এইতো এবার ক্লাস সেভেন এ উঠলো।
রজনী আয়রা কে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসতেই সে কি বুঝে দু হাতে গাল টেনে দিলো রজনীর। রজনী অবাক হয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললো,
_”আরু তুইও!..”

উপস্থিত সবাই হাসতে লাগলো এবার। ইনাম আর ইরা দুদিকে এসে আবারো রজনীর দু’গাল টেনে দিলো। ইরা হাসিমুখে বললো,
_”উফ,তোর গাল এত সফট কেন? দেখলেই গাল টানলে ইচ্ছে করে, দোষ কিন্তু আমাদের না।”

দর্শন সোফায় আরাম করে বসে বলে,
_”বলেছিলাম, আজকে তোর গাল শেষ। থ্যাংক ইউ বল, আমি অন্তত এতটাও বিরক্ত করিনা তোকে।”

_”বাকি আছো কেন? শুরু করে দাও, আমার গাল তো সরকারি জায়গা তাইনা?”

_”নাহ থাক, আমার অতো গাল টানার শখ নেই।”
“তবে অন্যকিছু করতেই পারি” এই কথাটুকু মনেই চেপে রাখলো দর্শন। রজনী আয়রা কে দর্শনের কোলে বসিয়ে দিয়ে ঘরে গেলো হিজাব খুলতে। বড়রা কেউ আসেনি, কেবল ছোটরাই এসেছে, ইরা,ইফতি, ইরার হাজবেন্ড আয়ান আর আয়রা, এখন এলো ইনাম সঙ্গে দর্শন আর রজনী তো আছেই। বলতে গেলে এই হলো তাদের কাজিন সমাজ, যোগাযোগ টা খুব গাঢ় না হলেও একসঙ্গে হলে তারা ভালোই মজা করে থাকে।

দু মিনিট বাদেই রজনী চলে এলো, হিজাব খুলে ওড়না মাথায় জড়িয়েছে এখন। এটা তার ছোটবেলার অভ্যাস, ওড়না মাথায় দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে, মাঝেমধ্যে সাধারণভাবে গলায় জড়িয়ে রাখে।
রজনী এসে সোফায় বসেই আয়রাকে কোলে নিলো। ইফতি এখনো ফোনে মগ্ন,তার এসব গল্পের দিকে কোনো মনোযোগ নেই। ইরা রজনীর হাতের দিকে খেয়াল করে বলে,
_”কিরে রজনী? তোর হাত খালি? সিরিয়াসলি! অদ্ভুত লাগছে।”

_”ঐতো, টাইম পাইনি।”

ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো রজনী। এরই মাঝে আয়ানও উপস্থিত হলো সেখানে,হাতের প্যাকেটে আইসক্রিম নিয়ে। দর্শন আর ইনাম গিয়ে প্রথমেই হাত মেলালো তার সাথে। আয়ান সোফায় এসে বসতেই দর্শন প্রশ্ন করে বসে,
_”তোমার এই বউকে সামলাও কেমনে ভাই? একটুতো নম্র ভদ্র হতে পারলো না এখনো।”

ইরা ভেংচি কেটে বলে,
_”হাহ, আমিও দেখবো তোমার বউ কতো নম্র ভদ্র হয়।”

দর্শন সোফায় বসে বেশ ভাব নিয়ে বললো,
_”হাজারগুণে নম্র ভদ্র হবে আমার বউ। তোর মতোন তিড়িংতিড়িং করা মেয়ে নয় ও।”

ইনামও সঙ্গ দিয়ে বললো,
_”এদিক দিয়ে একমত মামা।”

আয়ান দর্শনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,
_”বাহ ভাই, মেয়ে ঠিক করে রেখেছো নাকি? তা বিয়ে খাচ্ছি কবে?”

_”উমম.. দু বছর পর।”

_”এতদিন! কেন?”

দর্শন একনজর রজনীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
_”অকালে জেলে যাওয়ার শখ নাই আমার।”

_”কবে থেকে শুধু সেই মেয়ের প্রশংসাই তো শুনতেছি। মিলিয়ে নিও, ঐ মেয়ে তোমাকে পছন্দও করবে না।”
ইরার এমন কথায় আবারো হাসলো দর্শন,প্রতিত্তরে বললো,
_”করবে না? ডোন্ট ওরি, পছন্দ করিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমার।”

_”আচ্ছা আচ্ছা কথা পরে, আগে আইসক্রিম টা তো বের করো।”

ইরা গিয়ে আইসক্রিম বের করে সবার হাতে দিলো। তারপর নিজেও সোফায় গিয়ে বসলো। তবে এরই মধ্যে কান্না জুড়ে দিলো আয়রা। তারও এবার আইসক্রিম চাই, রজনী তাকে নিজের আইসক্রিম দিতে চাইলেই ইরা বাঁধা দিয়ে বলে,
_”আরে ওকে দিসনা রজনী, ছোট বাচ্চা আইসক্রিম খেতে হবেনা ওর।”

_”আপু সমস্যা নেই। জানোই তো,আমার এমনিতেই ঠান্ডার সমস্যা। কদিন বাদেই আবার প্রি টেস্ট, এই সময় ঠান্ডা লাগলে মহা ঝামেলায় পরে যাবো।”

রজনী নিজের আইসক্রিম টা হাসিমুখে আয়রা কে দিয়ে দিলো এবার। দর্শন তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে,
_”ভালো কথা মনে করিয়েছিস, কাল রাতে এমনিতেই নাক বন্ধ হয়ে ছিলো। এখন আইসক্রিম খেয়ে গলা নষ্ট করে আর কাজ নেই ভাই।”

আফিয়া আর ফাহমিদা রান্নাঘরে পকোরা বানাচ্ছিলেন, আফিয়া তা নিয়ে আসতেই দর্শন আইসক্রিম টা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
_”এটা ফ্রিজ এ রেখে দাও তো মামি, আয়রাকে পরে দিও।”

ইনাম আড়ালে হাসলো সামান্য, দর্শন এর কোনোকালেই ঠান্ডার সমস্যা ছিলোনা এটা সে ভালো করেই জানে। রজনী আর তাকালো না দর্শনের দিকে, এমনটা সে আগেও করেছে। নতুন কিছুই নয়। আফিয়া আইসক্রিম টা নিয়ে যেতেই দর্শন পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে তা অর্ধেক করে বলে,
_”আমরা বরং অন্য কিছু খাই, নে ধর..”
বলেই অর্ধেক চকলেট এগিয়ে দিলো রজনীর দিকে, রজনী মৃদু হেসে নিলো সেটা। দর্শন নিজের চকলেটটুকু মুখে পুরতেই ইরা বলে ওঠে,
_”সঙ্গে চকলেট নিয়ে ঘোরা হচ্ছে? হুম হুম, ভালো ভালো।”

_”জীবনে তো একটা টিউশনি ও করিয়ে দেখলি না। টিচার দের এমন সাথে কয়েকটা চকলেট রাখতে হয় গিফট হিসেবে,তুই বুঝবি কি করে?”

_”তুমি সবসময় খোঁটা দাও কেনো আমাকে? জামাই এর টাকা খরচ করাও একটা আর্ট। তাইনা?”
আয়ানের উদ্দেশ্যে বললো ইরা,আয়ানও সম্মতি জানিয়ে বলে,
_”অবশ্যই।”

হাসলো সকলে। আগেই সকলে আইসক্রিম খাওয়া শেষ করলো। আয়রা ঘুমিয়ে পরলো তার মাঝেই,ইফতিও ঘুমিয়ে পরেছে। বাকিরা এবার কোয়েশ্চেন এন্সার গেইম খেলবে, রজনী ইরার হাতে মেহেদী দিতে বসলো। এটাও ফিক্সড হয়ে গেছে, ইরা এই বাড়িতে এলেই রজনী হাতে মেহেদী দিয়ে দিতে হবে।
বোতল ঘোরানো হলো এবার। প্রথমেই তা গিয়ে থামলো দর্শন এর দিকে, ইরা খুশি হয়ে তাকে প্রশ্ন করলো,
_”আর কিচ্ছু জানতে চাইনা। শুধু আমাদের হবু ভাবির নামটা বলে দাও।”

দর্শন গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,
_”ওটা বলা যাবেনা।”

_”এটা ঠিক না, আচ্ছা একটা হিন্ট তো দাও।”

_”উমম,একটা গান গাই। তার মধ্য থেকে নাম খুজে বের করতে পারলে কর।”
সোফায় হেলাম দিয়ে বসলো দর্শন,একহাতে মাথা ঠেকিয়ে গেয়ে উঠলো,
“পূর্ণিমা সন্ধ্যায়, তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়,
পূর্ণিমা সন্ধ্যায়, তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়,
তোমার প্রজাপতির পাখা,

তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখের
রঙিন স্বপন মাখা,
তোমার চাঁদের আলোয়..
মিলায় আমার দুঃখ-সুখের সকল অবসান।

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
আমার আপনহারা প্রাণ,
আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।”

ইরা হতাশ শুরে বললো,
_”এতগুলো লাইন থেকে একটা ওয়ার্ড কি করে খুজে বের করবো?”

_”সেটা তুই ভালো জানিস।”

_”পূর্নিমা?”

_”অবশ্যই না।”

_”সন্ধ্যা?”

_”নোপ..”
ইরা এবার রজনীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
_”তুই কিছু বল।”

রজনী মেহেদী দেওয়াতেই মনোযোগী ছিলো, ইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
_”আমি পারবো না গেস করতে, এমনিতেই আমার কোনো ধারণা মিলেনা।”

দর্শন শান্ত করে বলে,
_”ধারণা করলে তো মিলবে!”

ইনাম ফোনটা হাতে নিয়ে তার দিকে নজর দিয়ে বললো,
_”পারবিনা পারবিনা। কেউ পারবিনা।”

_”আরে তুমিতো আরেকজন, জেনেও বলছোনা কিছু। দেখবো দেখবো,বিয়েতে সব কাজ কে করে সেটাও দেখবো।”
বলেই ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ইরা, পরক্ষনেই হাসিমুখে বললো,
_”তোমার ঐ ব্রাউন হেয়ার ক্রাশ এর মতো দেখতে নাকি?”

_”ছ্যাহ..কালো চুলের উপরে কিচ্ছু নেই। এন্ড সি ইজ দা সেকেন্ড মোস্ট বিউটিফুল গার্ল ইন মাই আইজ।”

ইনাম ফোনের থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
_”বোনু? তুই বল, কেমন ভাবি চাই।”

রজনী মুচকি হেসে বলে,
_”কালো চুল হোক আর লাল চুল,তা দিয়ে আমি কি করবো? আমাকে ভালোবাসবে,আদর করবে, স্নেহ করবে এমন একজনকে নিয়ে এলেই চলবে।”

দর্শন তাকালো রজনীর দিকে, শান্ত স্বরে বললো,
_”তোকে ভালোবাসবে, আদর করবে, স্নেহ করবে এমন একজনকেই এনে দেবো,প্রমিজ..”

ইনাম ডাটা অন করতেই দেখলো একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, টু মিউচুয়াল ফ্রেন্ড, আইডির নাম সাহারা ইয়াসমিন,নিকনেইম এ দেওয়া সারা। রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করতেই দটো মেসেজ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। প্রথমে বানরের লজ্জা পাওয়া ইমোজি, তারপর এর টা,
_”হেলো মিস্টার নুডুলস, জলদি রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করুন, নাহলে সত্যি সত্যিই নুডুলস হয়ে যাবেন,আমিন।”

এরই মাঝে বোতল ঘোরানো হলো আবার,এবার প্রশ্ন করা হবে ইনাম কে। ইরা সরাসরি বলে উঠলো,
_”তুমি এই মুহূর্তে কার আইডিতে আছো সেটা বললেই চলবে।”

ইনাম বিরক্তি নিয়ে ক্ষীণ স্বরেই বলে ওঠে,
_”এক খাপছাড়া মেয়ে..”

_”মেয়েএএএএ!”

বেশ টেনে বললো ইরা। ইনাম ফোন থেকে চোখ তুলে দেখলো সবাই হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভ্রুযুগল কুঁচকে নিলো সে। শতভাগ নিশ্চিত,কিছু না হতেই এবার তাকে পঁচানি খেতে হবে..

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০৮

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৮|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
রাত বারোটা বাজতে আর পাঁচমিনিট বাকি। রজনী বিছানায় পা দুলিয়ে বসে গল্পের বই পড়ছে, রাফিন আজকে ঘুমিয়েছে হালিমার সঙ্গে। নাতি আবার তার ভীষণ আদরের,ছেলে বলে কথা!
ঘরের দরজা খোলাই ছিলো,সবসময় খোলাই থাকে। রজনী মনোযোগী বই পড়ার ক্ষেত্রে। ঠিক তখনই গুটিগুটি পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো দর্শন। হাত দুটো দ্বারা পিছনে কিছু আড়াল করেছে সে। রজনীর দৃষ্টি তখনো বই এর দিকে, মুচকি হাসলো দর্শন। কেক এর বক্স টা সাবধানতার সাথে টেবিলে রেখে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো সে। এবারে ধ্যান ভাঙলো রজনীর,পাশ ফিরে তাকালো, তবে দর্শনকে দেখার আগেই হঠাৎ ঘরের লাইট নিভে গেলো, অন্ধকারে ছেয়ে গেলো চারিপাশ। ফ্যান বন্ধ হওয়া দেখে বোঝা গেলো কারেন্ট চলে গিয়েছে।

আকস্মিকভাবে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রজনী, কারণটা শুধুই অন্ধকার নাকি অন্যকিছু তা দর্শনের জানা নেই। কাপাকাপা পায়ে উঠে দাঁড়ায় রজনী, পিছনে এগোতে এগোতে বলে,
_”ক কে ওখানে? দরজা আটকালে কেন?”

রজনীর ভয়ার্ত কণ্ঠ শুনেই তারদিকে এগিয়ে আসে দর্শন। সামনে এসে তার হাত ধরে কিছু বলবে তার আগেই ছিটকে দূরে সরে যায় রজনী। দর্শন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
_”রজনী, আমি। ভয় পাস না।”

দর্শনের কণ্ঠ যেন কানেই গেলোনা রজনীর। অতিরিক্ত ভয় পেয়ে গেলে তার আকস্মিক শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। রজনী জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
_”এদিকে এগোবে না, চ চলে যাও প্লিজ।”

ভ্রুযুগল কুঁচকে নিলো দর্শন। রজনী কি তাকে চিনতে পারছে না? তার কণ্ঠে এবার আরো বিচলিত হলো দর্শন। দ্রুত পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালালো সে। ফোনটা উল্টো করে বিছানায় ছুড়ে ফেলে রজনীর দিকে এগোলো। তার দু কাঁধে হাত রেখে বললো,
_”রাতপাখি, রিল্যাক্স। অন্য কেউ নেই এখানে, আমি আছি। চিনতে পারছিস না আমাকে?”

সামান্য আলোয় দর্শনকে চিনতে পারলো মুহূর্তের মাঝেই, তবুও যেন তার অস্থিরতা কমলো না। ঠোঁটজোড়া কাঁপছে তার,জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে তখনো। দর্শন দ্রুত তাকে বিছানায় বসালো। তারপর নিজে ওর সামনে বসে একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
_”তুই শান্ত হ আগে, কাম ডাউন। কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। টেইক আ ডিপ ব্রিথ।”

দর্শনের কথামতো শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো রজনী, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভেজা ঢোক গিললো সে। সম্পূর্ণরূপে শান্ত হতে পারলো না তখনো। এদিক ওদিক নজর দিয়ে বললো,
_”দ দরজাটা খুলে দাওনা ভাইয়া।”

বিস্মিত চোখে রজনীর দিকে তাকালো দর্শন। রজনী তাকাচ্ছেনা তার দিকে,অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাটা বললো সে। তার গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফেরালো দর্শন, ধীর কণ্ঠে বললো,
_”রাতপাখি? আমাকে ভয় পাচ্ছিস তুই? কি হয়েছে তোর, বল আমায়।”

উত্তর দিলোনা রজনী, সে তখনো অদ্ভুত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। দর্শন দেড়ি করলোনা,সঙ্গে সঙ্গে উঠে দরজা খোলার জন্য পা বাড়ালো। তবে এক কদম পা বাড়াতেই আলো জ্বলে উঠলো ঘরের। এগোলো না দর্শন, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রজনীর দিকে।
রজনী বুকে হাত দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো এবার। তবুও শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হচ্ছেনা তার। দ্রুত বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে কাপাকাপা হাতে ইনহেলার টা বের করলো রজনী। ইনহেলার নেওয়ার কয়েক সেকেন্ড পর ধীরেধীরে স্বাভাবিক হতে পারলো সে, চোখ বন্ধ করে রাখলো তখনো। ধীরেধীরে চোখ খুলতেই দেখলো দর্শন তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিঞ্চিত ঘাবড়ে গেলো সে, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়াতেই দর্শন পুনরায় বসিয়ে দিলো তাকে। মেঝেতে হাটু ভাজ করে বসে রজনীর পানে চেয়ে বলে,
_”ঠিক আছিস এখন?”

মাথা নাড়ায় রজনী, নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”হঠাৎ কারেন্ট চলে গিয়েছিল তো,তাই ভয় পেয়ে গেছিলাম ভাইয়া।”

_”কি মনে হয় রাতপাখি? কতটা চিনি আমি তোকে?”

_”হুম?”

দর্শন তার দৃষ্টি স্থির রাখলো। কিছুক্ষন নিচের দিকে তাকিয়ে পুনরায় উপরে চেয়ে বললো,
_”যেই পরিস্থিতি ই হোক, তুই আমাকে ভয় পাবি! এটা মানতে পারলাম না। কাকে ভয় পাচ্ছিলি তুই?”

_”আমি কাউকে ভয় পাবো কেন? অন্ধকার..”

রজনীর গালে হাত রাখলো দর্শন,থামলো রজনী। দর্শন স্মিত হেসে বললো,
_”এতটুকু তোকে চিনে থাকলে, এটা স্পষ্ট বলতে পারি, আমার থেকে অনেক বড় কিছু লুকোচ্ছিস তুই। আমি যদি অন্তর পড়তে পারতাম,তাহলে খুব ভালো হতো রে।”

_”কিছু লুকোচ্ছিনা ভাইয়া,তুমি ভুল ভাবছো।”
নিচের দিকে তাকিয়ে বললো রজনী। এমন সময় ফোনের টাইমার বেজে উঠতেই দুজনে তাকালো সেদিকে। দর্শন একহাতে ফোন নিয়ে সেটা অফ করে তাকালো রজনীর দিকে। ওষ্ঠাধর প্রশস্ত করে বললো,
_”শুভ জন্মদিন রাতপাখি”

রজনী অবাক চোখে তাকালো, দর্শন উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
_”এবার বল,ভুলেই গিয়েছিলি।”

_”ভুলিনি, কিন্তু আমি ভাবছিলাম আজকে ২৮ তারিখ।”

_”সে যাই হোক,ফার্স্ট উইশ আমার তাহলে?”

হাসলো রজনী,উত্তরে বললো,
_”আর কতজন ই বা আছে উইশ করার?”

কথা বারালো না দর্শন। নিঃশব্দে পাশ থেকে চেয়ার টা এনে সামনে রাখলো, এরপর টেবিল এর উপর থেকে কেকটা এনে চেয়ারের উপর রাখতেই রজনী বলে উঠলো,
_”এসব কেন আনলে ভাইয়া? জানো তো, দাদু বা আব্বু টের পেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমাকেই আবার..”

_”হুশ.. চুপ থাক। ফার্স্ট অফ অল, তারা কেউ কিছু দেখতে পায়নি আর পাবেও না। আর দেখতে পেলেও, কি করবে? তোর আগে আমাকে বকবে, সিম্পল।”

_”কিচ্ছু বলবেনা তোমাকে, যা বলার আমাকেই বলবে।”

_”বললে বলবে, তোর কান দুটো তো। একটা দিয়ে শুনে অন্যটা দিয়ে বের করে দিবি,এবার কেকটা কাট।”

কেকের দিকে তাকালো রজনী। উপরে লেখা, “Happy birthday dear night bird”। মুচকি হাসলো রজনী। ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে দর্শনের হাত থেকে ছুড়িটা নিয়ে কেক কাটলো এবার।

_____
_”স্যার,লিখা শেষ।”
খাতা হাতে দাঁড়িয়ে কথাটা বললো রজনী। ধ্যান কাটলো না দর্শনের, সে একদৃষ্টিতে হাতের মার্কারটা ঘুরিয়ে কিছু ভেবে চলেছে। রজনী কিছুটা সময় অপেক্ষা করে আবারো বললো,
_”স্যার..”

বাস্তবে ফিরলো দর্শন। দু সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,
_”হুম.. শেষ? নিয়ে আ..”
থামলো দর্শন,পুনরায় বললো,
_”এদিকে নিয়ে এসো।”

খাতা নিয়ে সামনে এলো রজনী। দর্শন তাকালো তার দিকে, খাতাটা টেবিলের উপর রাখলো রজনী। দর্শন সেটার দিকে তাকিয়ে ডান হাতটা সামান্য উঁচু করতেই চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিলো সে। আস্তেধীরে হাত কয়েকবার নাড়ানোর চেষ্টা করলো। রজনী ক্ষীণ স্বরে বললো,
_”থাক,সাইন করতে হবেনা।”

_”পেন দে..”
দর্শন ও আস্তে বললো কথাটা,বাকিদের কানে তা যায়নি। রজনী কলম এগিয়ে দিতেই দর্শন বাম হাতে নিলো কলমটা। বাম হাতেই পৃষ্টা উলটে দেখলো, তারপর ছোট করে টিক দিয়ে কলমটা ফিরিয়ে দিলো।
_”ঠিক আছে।”

খাতাটা নিয়ে চলে গেলো রজনী। দর্শন ধীরেধীরে হাত ভাজ করার চেষ্টা করছে তখন। বাকিদের লেখা হয়নি তখনো,আর সারা সেই কখন থেকে কেবল খাতায় আঁকিবুঁকি করে চলেছে। রজনী পাশে এসে বসতেই সে স্বল্প স্বরে বলে,
_”মিস্টার নুডুলস এর এফবি আইডির নামটা কি রে?”

_”কে মিস্টার নুডুলস?”
ভ্রু কুঁচকে বললো রজনী, সারা নিজের কপালে চাপড় মেরে বললো,
_”আরে, ঐযে তোর কাজিন। এসেছিল বাইরে.. তার।”

_”ইনাম ভাইয়া?”

_”হ্যা হ্যা উনি ই”

_”তুই ওর এফবি আইডি দিয়ে কি করবি?”

_”এত প্রশ্ন করিস না তো। খাতায় লিখে দে আইডির নামটা।”

কথাটা বলেই সারা খাতাটা এগিয়ে দিলো, রজনী আর কিছু না বলে লিখে দিলো আইডির নামটা।
ক্লাস চললো আরো কিছুক্ষন। ছুটি হওয়ার পর সবাই বেরিয়ে গেলো একে একে। ক্লাসে থাকলো কেবলই রজনী আর দর্শন। এখন অপেক্ষা করতে হবে ইনাম এর জন্য। রজনী এগিয়ে এসে সামনের বেঞ্চ এ বসলো এবার। দর্শন তখনও হাত স্বাভাবিক ভাবে নাড়াতে পারছিলো না। রজনী তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_”বেশি প্রবলেম হলে ডাক্তার এর কাছে যাও।”

দর্শন বিরক্তির ভাব নিয়ে হাতটা বেঞ্চের উপর রেখে বললো,
_”ধুর, কি করবে সে?”

কিছু বললোনা রজনী, হালকাভাবে ম্যাসেজ করতে লাগলো সে, এই অভ্যাস তার আছে অনেক আগে থেকেই। ছোটখাটো ডাক্তারি করতে ভালোই লাগে, তবে ডাক্তার হওয়ার শখ তার কোনোকালেই ছিলো না।
প্রায় পাঁচমিনিট আলতো হাতে ম্যাসেজ করলো রজনী, দর্শন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সেদিকে তাকালে হয়তো আটকে যেত রজনী নিজেও, তবে সে নিজের কাজে মনোযোগী। পরিশেষে চোখ তুলে বললো,
_”ঠিক আছে এবার? ছেড়ে দেবো?”

_”যদি না বলি?”
কথাটা বলে পরমুহূর্তেই আস্তেধীরে হাতটা সরিয়ে নিলো দর্শন। এখন একটু স্বাভাবিকভাবে নাড়াতে পারছে হাতটা। দু তিনবার হাত ভাজ করে দেখলো দর্শন। রজনী শান্ত স্বরে বললো,
_”কিছু বলছিলে..”

স্মিত হাসে দর্শন। রজনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
_”শুনতে চাস? সিওর?”

কথাটা বলেও রজনীকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিলোনা দর্শন। একহাতে তার গাল টেনে দিয়ে হাসলো সামান্য। রজনী ভ্রুকুঞ্চিত করে বলে,
_”সবাই আমার গাল টেনে কি শান্তি পাও ভাই?”

_”সরি সরি,দেরি হয়ে গেলো একটু।”
ক্লাসে প্রবেশ করে বলে ইনাম। রজনী তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,
_”আরেকটু দেরি করতে,রাতে খেয়েদেয়ে যেতাম।”

ইনাম মাথা চুলকে সামনে এগিয়ে আসে। এরপর রজনীর গাল টেনে দিয়ে বলে,
_”সরি বোনু।”

রজনী একবার ইনামের দিকে তাকিয়ে আবার দর্শনের দিকে তাকায়। দর্শন কিছুক্ষন নিরব থেকে হো হো করে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে উঠে দাড়িয়ে বলে,
_”আরেক গ্রুপ এখনো বাড়িতে অপেক্ষা করছে শুনলাম। তোর গালের মাগফেরাত কামনা করি।”

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০৭

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৭|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
ঘড়িতে সকাল সাতটা বাজে। রজনী স্কুল ড্রেস পরে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে, হিজাবটা শুধুই মাথায় দেওয়া, এখনো বাঁধা হয়নি। হাতের বামপাশে জীববিজ্ঞান বই, তার দিকে দৃষ্টি রজনীর। আফিয়া ডিম আর পরোটা এনে টেবিলে রেখে বললেন,
_”অনেক পড়া হয়েছে, এবার খেয়ে নাও তো। স্কুলে দেরি হয়ে যাবে নাহয়।”

রজনী বইটা বন্ধ করে হাত ধুয়ে এলো, এরপর খাওয়া শুরু করলো। দু মিনিট বাদে সেখানে উপস্থিত হয় দর্শন। এতো তাড়াতাড়ি তার ঘুম থেকে ওঠার কথা নয়, এমনকি বাড়ির কেউই এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। ফাহমিদার শরীরটা ভালো নেই, তাই শুয়ে আছেন এখনো, নাহলে উঠে পরতেন। হালিমা নামায পরে পুনরায় ঘুমোতে যান, আর জাহিদ ওঠেন আটটার দিকে।

দর্শন এসে অপর পাশের এক চেয়ারে বসতেই আফিয়া প্রশ্ন করলেন,
_”কি ব্যাপার, আজ এতো তাড়াতাড়ি উঠে গেলে?”

_”ঘুমোই নি তো মামি।”

রজনী আগেই আন্দাজ করেছিল, নাহয় দর্শন এতোটাও ভদ্র ছেলে নয় যে সকাল সকাল উঠে পরবে। রজনী খাওয়ার মাঝেই বলে ওঠে,
_”কেন? হাতে ব্যাথা ছিলো?”

দর্শন তাকায় রজনীর দিকে। ঠিকই বুঝে গেলো মেয়েটা। কি করে বুঝলো? তার চোখেমুখে কাতরতার ছাপ দেখে? বুঝতেই পারে, অন্য কোনো চিন্তা মাথায় এনেও আনলো না দর্শন। এক বাড়িতেই তো থাকছে ছোটবেলা থেকে, এতটুকু ধারণা এমনিতেও করতে পারে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়লো দর্শন। এই হাতে ব্যাথা তাকে ছয় বছর ধরে ভোগাচ্ছে। ইন্টার পরিক্ষা দেওয়ার পরপরই একটা এক্সিডেন্ট হয় দর্শন এর। শরীরের খুব বেশি ক্ষতি না হলেও,হাত ভেঙেছিল বাজেভাবে। দুবার অপারেশন ও করানো হয়েছে, ছয়মাস এর বেশি সময় লেগেছে এই হাত ঠিক হতে। তাও ছিলো ডান হাত, একবছর গ্যাপ গিয়েছিল তার কারণেই। এখনও অনেক্ষন লিখতে গেলে সমস্যা হয় হাতে, তাছাড়াও মাঝেমধ্যে ব্যাথা হয়,অনেক ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা আবার কিছু ক্ষেত্রে তা দু তিন দিনও স্থায়ী হয়। তেমন ই হয়েছিল কাল রাতে। পড়তে বসেছিল ঠিকই, তবে এক ঘন্টা পড়তেই হাতে ব্যাথা শুরু হয় তার। ঔষধ খেয়ে নিলে তাড়াতাড়ি ই কমে যেতো, তবে অতো রাতে আর বেরোতে ইচ্ছে করেনি।

বেশ অনেক্ষন টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো দর্শন, হাতে ব্যাথা কমেছে খানিকটা। এখন ঘুম পাচ্ছে, আবার পাচ্ছেনা এমন এক অবস্থা। রজনী খাওয়া শেষ করে হিজাবটা বেধে নিলো। এরপর ব্যাগ নিয়ে এসে দর্শন এর উদ্দেশ্যে বললো,
_”হাতে ব্যাথা নিয়ে পড়াতে হবেনা আজকে, ক্যানসেল করবে?”

মাথা তুললো দর্শন। চোখ টেনে বললো,
_”উম হু, সমস্যা হবেনা। পড়াবো আমি।”

_”তাহলে যা বলেছি..”

_”জি ম্যাম, মনে আছে। আপনার কথামতোই কাজ করছি। আপনি নিশ্চিন্তে বিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু করতে পারেন।”

অতি শুদ্ধভাবে বললো দর্শন, রজনী হাসলো সামান্য। আফিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
_”কিসের কথা?”

_”সেটাতো সারপ্রাইজ আম্মু। কিন্তু, আজকে আমি ইনাম ভাইয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসবোই। এটা রজনীর প্রমিস। আসছি হ্যা, টাটা..”

বেরিয়ে গেলো রজনী। দর্শন উঠে ঘরে চলে গেলো এবার, ঘুমোতে হবে এখন, নাহলে কোনো কাজে মন বসবে না।

_____
রজনীর কথামতোই কাজ করলো দর্শন। পাঁচটার আগেআগে ব্যাচ এর সামনে আসতে বললো ইনামকে। উদ্দেশ্য একটাই, ইনামকে রজনীর সামনে দাড় করানো। তারপর বাকিটা রজনী দেখে নেবে।
দর্শন এক্ষেত্রে একটু মিথ্যে বলেছে, আজকে কোনো ব্যাচ পড়াবেনা বলেছে,তবে পাঁচটা বাজেই রজনীদের ব্যাচ পড়তে আসবে এ কথা ইনামকে জানায়নি সে। ইনামও সাড়ে চারটার দিকেই চলে এলো ব্যাচ এর সামনে। দর্শন বাহিরেই বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়েছিলো,তবে আশ্চর্যজনক ভাবে তার একটু পাশে রজনীও দাঁড়িয়ে ছিলো। মহা বিপদে পরলো ইনাম। এখান থেকে চলে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে, আবার অতীতের এক অজানা কারণে রজনীর সম্মুখে দাঁড়াতেও ইচ্ছে করছেনা। রিক্সাভাড়া মিটিয়ে নেমে দাঁড়ালো ইনাম। দৃষ্টি তার এদিক ওদিক বিচরণ করছে, যেন সে পণ করেছে রজনীর দিকে তাকাবেই না।
দর্শন একনজর রজনীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো এখন কি করবি? রজনীও চোখের ইশারায় বোঝালো আগে ক্লাসের ভিতরে বলো। দর্শন হাসমুখে ইনানের উদ্দেশ্যে বললো,
_”সারপ্রাইজটা ভালো না?”

ইনাম রেগে যেতে পারতো, চোখ গরম দিতে পারতো। তবে সে কোনো কিছুই করলো না, কেবল তাকিয়ে রইলো অন্যদিকে। কারণটা দর্শন না বুঝলেও রজনী বুঝেছে ভালো করেই।
বিষয়টা অপরাধবোধ এর,লজ্জার , আর এই চারবছর ধরে সি লজ্জাবোধ থেকেই রজনীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি ইনাম। চেষ্টা করেও পারেনি বলা চলে।

_”এখানে দাঁড়ায় থাকবি মামা? ভিতরে চল। স্টুডেন্ট আসবে আরো বিশমিনিট পর।”

নিঃশব্দে ক্লাসে গিয়ে বসলো ইনাম। সামনের বেঞ্চে বসলো রজনীও। দর্শন চাবিটা টেবিলের উপর রাখতে রজনী বলে উঠলো,
_”ভাইয়া, কিছু খাওয়াবে না? এমনি এমনি বসে থাকবো? চিপস,চানাচুর কিছু নিয়ে আসো।”

রজনী সচরাচর কিছু খাওয়ার আবদার করেনা। দর্শন বেশ ভালোই বুঝতে পারলো সে ইনামের সাথে কথা বলবে বলেই দর্শন কে যেতে বলছে। দর্শন ও, “যাচ্ছি” বলে বেরিয়ে গেলো।

ইনামের নজর এখনো নিচের দিকেই। রজনী মৃদু হেসে বলে,
_”তাকাবেও না আমার দিকে? সাধারণ খোজ খবর টুকুও নেবে না? মানুষ তো দুঃসম্পর্কের বোনের সাথেও এমন করেনা ভাইয়া, আমি তার থেকেও পর?”

চোখ বন্ধ করে নিলো ইনাম। কিভাবে বোঝায় এই মেয়েকে? তার দিকে তাকালেই যে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। তবুও মিথ্যে হাসি মুখে এনে রজনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”আমি বলেছি তা? ছাড়, কেমন আছিস?”

_”কেমন থাকি আমি? তেমন ই আছি। ভালোও বলা চলেনা। আবার অতিমাত্রায় খারাপও বলা চলেনা, কারণ আমার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় মানুষ থাকছে।”

ইনাম আবারো চুপ করে গেলো। রজনী শান্ত কণ্ঠে বললো,
_”আমাকে ভালোবাসার মানুষের খুব অভাব ভাইয়া। তুমি জানো সেটা, তাও সব জেনেশুনে সেই সংখ্যাটাকে আরো কমিয়ে দাও কি করে?”

_”তুই ভুল ভাবছিস বোনু, আমি তেমনটা চাইনি।”

_”কেউ কিছুই চায়না, বিশেষ করে আমাকে চায়না। আমি থাকলে কি আর না থাকলেই বা কি? বলতে পারো, গত একবছরে ঈদ মোবারক জানানো ব্যাতীত একটা কথাও তুমি বলেছো আমার সাথে? আরে দূরের আত্মীয়দের ও মানুষ খোজ খবর নেয়, তুমিতো তাও নেওনা।”

ইনাম নিরবতা বজায় রাখলো,বলার মতো কিছু নেই তার কাছে। রজনী কিছুক্ষন থেমে বললো,
_”নিতে হবেনা আমার খোজ, কথাও বলতে হবেনা আমার সাথে। সবাই আলাদা করেই রাখো আমাকে, কোনো সমস্যা নেই। তুমি শুধু বাসায় চলো একবার..”

_”ঐ বাড়িতে পা রাখার ইচ্ছে হয়না বোনু, একটু বোঝার চেষ্টা কর।”

_”তাহলে, সব দোষ আমার। সেটাই বলছো তো?”

ইনাম ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
_”না না বোনু, তোর দোষ কেন হতে যাবে?”

_”সর্বোচ্চ দোষি তো আমিই ভাইয়া। জন্মটাই তো ভুল, মেয়ে হয়ে জন্মানোটা আরো বড় ভুল।”

রজনীর কণ্ঠ কাঁপলো একবার। ইনাম কিছু বলার আগেই সে পুনরায় বললো,
_”তুমি যদি আজকে বাসায় না যাও, তাহলে আমি ওটাই বুঝবো। আসল দোষি আমি..”

_”ব্লাকমেইল করছিস আমাকে,বোনু?”

রজনী হেসে বলে,
_”ব্লাকমেইল করে সবার ভালোবাসা পাওয়া গেলে,খুব ভালো হতো ভাইয়া। আপাতত তোমাকে বাসায় নেওয়া সম্ভব হলেই চলবে।”

ইনাম উঠে দাড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রজনীর সামনে এসে দাড়ালো,হাত বুলিয়ে দিলো তার মাথায়। মুচকি হেসে জানান দিলো সে যাবে। রজনী তার ভারি আদরের, তাকে নাম ধরে কয়বার ডেকেছে তাও ঠিক মনে পরেনা ইনাম এর। ছোটবেলা থেকে এতো মিষ্টি দেখতে মেয়েটা! সবাই মিলে ওর গাল টানতো শুধু, বিশেষ করে ইনাম আর ইরা। ইরাও তাদেরই চাচাতো বোন,মেজো চাচার মেয়ে। কাজিন গ্রুপে, কারো বাড়িতে যাওয়ার খুব বেশি অনুমতি রজনীকে দেওয়া হয়নি। তাই ভাইবোনেদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও খুব একটা গভীর নয়। তাদের মধ্যে ইনাম আর দর্শন ই ব্যতীক্রম ছিলো। দর্শন এখনো আছে, তবে ইনাম তো বদলে গেলো সেই চারবছর আগেই। রজনী যেন জন্মেছেই এই ভাগ্য নিয়ে, সবার ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার অধিকার তাকে দেওয়াই হয়নি।

দর্শন এলো হাতে তিন প্যাকেট চিপস নিয়ে। চারবছর আগে ঠিক কি হয়েছিল, তা দর্শনের অজানাই রয়ে গেলো। রজনীও বলেনি, না ইনাম বলেছে। এক পর্যায় বাধ্য হয়ে জানার ইচ্ছেই ত্যাগ করলো দর্শন। শুধু একটাই ইচ্ছে, ইনাম স্বাভাবিক হয়ে যাক। ক্লাসে এসে ইনামকে রজনীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে এতটুকু বুঝতে পারলো, একটু হলেও স্বাভাবিক হচ্ছে ইনাম। নইলে তাকে ধরে বেধেও রজনীর সাথে কথা বলাতে পারেনি সে।
দশমিনিট বাদে দু তিনজন স্টুডেন্ট আসতেই রজনী উঠে পিছনের বেঞ্চে চলে গেলো। ইনামও চলে গেলো ক্লাস থেকে। তবে বলে গেছে, ছয়টার দিকে আসবে, একসাথেই বাড়ি যাবে।

দরজা থেকে বেরোতেই ইনাম দেখতে পায় একটা মেয়ে দ্রুত পায়ে আসছে এদিকে, কাধে ব্যাগ নিয়ে। একটু লক্ষ্য করতেই চেনাচেনা মনে হলো মেয়েটাকে, অনেক আগে দেখেছিলো এক দুবার, রজনীর ছোটবেলার বান্ধবী বোধ হয়।
ইনাম ঠিকঠাক চিনতে না পারলেও সারা যেনো পুরোপুরি চিনতে পারলো তাকে। অতিমাত্রায় খুশি হওয়ার ভঙ্গিতে তার সামনে এসে বললো,
_”হায় মিস্টার নুডুলস! আপনি ফাইনালি এসেছেন? আমি কিন্তু রজনীর মুখে আপনার কথা শুনেছি, চুল দেখেই চিনতে পেরে গেছি।”

কোকড়া চুল বলে কিনা মিস্টার নুডুলস বানিয়ে দিলো? ইনাম বিরক্তির স্বরে বললো
_”আমি রজনীর ভাই, সেই হিসেবে তোমারও ভাই। সম্মান দিয়ে কথা বলো মেয়ে..”

_”এতো ভাই দিয়ে কি হবে জীবনে? দু তিনটে তো জামাই ও দরকার।”

_”কিহহহ!”

সারা জীভে কামড় দিয়ে বলে,
_”ওপ্স সরি, একটা তো জামাই ও দরকার। বাই দা ওয়ে, আ’ম সারা।”

_”বোঝাই যায়। নামও যেমন সারা,কথাবার্তাও তেমনি খাপছাড়া”

ইনামের কথায় পাত্তা দিলোনা সারা। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে,ভিতরে যেতে হবে। সারা দ্রুতগতিতে বললো,
_”সে যাই হোক, আপনার চুলগুলো কিন্তু ভীষণ কিউট মিস্টার নুডুলস। লাইক, একবার দেখলেই যে কেউ চুলের প্রেমে পরে যাবে।”

ছুটে ক্লাসে চলে গেলো সারা। ইনাম কিছুক্ষন অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে,
_”এই মেয়ে তো দেখছি আসলেই খাপছাড়া!”

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০৬

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৬| [বোনাস পর্ব]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
_”ছাঁদে গিয়েছিলি কেন?”
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো দর্শন। রজনী দরজা আটকে দিলো, সেও শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো,
_”আকাশ দেখতে,হাওয়া খেতে।”

দরজার থেকে সরে দর্শন এর সামনে দাড়িয়ে বললো,
_”ফ্রে..শ হাওয়া..”

কিছুটা টেনে বললো রজনী। দর্শন দু সেকেন্ড বাদে এই কথার অর্থ বুঝতে পেরে বলে,
_”আররেহ, ইনাম এর সাথে ছিলাম।”

_”বুঝলাম তো, ফুপ্পি বলেছিল। দুজনের ই অকালে লাংস নষ্ট করার শখ জেগেছে সেটাও বুঝতে পারছি।”

দর্শন মাথা চুলকে বলে,
_”শাসন করছিস আমাকে?”

_”ভালো কথা বললেই শাসন হয়ে গেলো? যাকগে,ওসব বলে কাজ নেই আমার। তুমি বলো আসল কথা।”

_”কোন আসল কথা?”

_”ভাইয়া কোথায়? না নিয়েই চলে এলে? একটু জোর করতে পারো না?”

দর্শন বিরক্তি নিয়ে বলে,
_”তোরা কি শুরু করলি আমার সাথে? আচ্ছা আমি করবো টা কি? কোলে তুলে নিয়ে আসবো ওকে? বাচ্চা ও?”

দর্শন এর বিরক্তিমিশ্রিত কথাতেও যেন মজা পেলো রজনী, মুখ চেপে হাসলো হামান্য। দর্শনের উদ্দেশ্যে বললো,
_”জীম করেছিলে না কদিন? চাইলে আনতেই পারো।”

অবাক হলো দর্শন, তবে শান্তিও পেলো। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
_”রজনী, কি হলো বল তো? তোর না মুড অফ ছিলো? ঠিক হয়ে গেলো?”

রজনী আবারো স্মিত হেসে বলে,
_”ওতো একটুখানি। আম্মু এসে সুন্দর করে কথা বললো, তাতেই মন খারাপ দূর হয়ে গেছে। তারপর একটা বই পড়তে নিলাম, এত্ত সুন্দর বইটা! মন আপনাআপনি ভালো হতে বাধ্য।”

দর্শনের চিন্তাটা দূর হলো নিমিষেই। প্রশান্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। মেয়েটা কত অল্পতেই খুশি হয়ে যায়! জগতের নিয়ম ই হয়তো এমন, যেই মানুষগুলো খুব অল্পতেই আনন্দ পায়, তাদের জীবন থেকে সেই স্বল্প আনন্দটুকুও হারিয়ে যেতে চায়।

_”তুমি আমার কথা শুনো।”

দর্শন গিয়ে সোফায় বসে বললো,
_”শুনছি তো”

দর্শন এর পাশে এসে বসলো রজনী, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুখে কিছু বললো, দর্শনকে বোঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। বলা শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলো,
_”বুঝতে পেরেছো?”

_”তুই এতক্ষন এটা বলার জন্য জেগে ছিলি?”

গালে হাত দিয়ে বললো দর্শন। রজনী উঠে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়,
_”না না আমি সত্যিই আকাশ দেখতে গিয়েছিলাম। চাঁদটা খুব সুন্দর লাগছিলো তাই।”

_”ভয় পাসনি?”

_”একটু একটু,খুব বেশি না।”

_”রাত খুব পছন্দ তোর, তাইনা?”
রজনীর পানে নজর রেখে বললো দর্শন, রজনী মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
_”রাত কার না পছন্দ হয়? কেন,তোমার পছন্দ না?”

_”ভীষন, আমার সবচেয়ে প্রিয়।”

কেমন এক অদ্ভুত স্বরে কথাটা বলে দর্শন। মনে পরে যায় প্রায় পনেরো বছর আগের এক ঘটনা। রজনী সবে এক বছর পূর্ণ করেছে, আর দর্শন তখন দশ বছর বয়সী ছেলে। এই বয়সে মনে অনেক প্রশ্ন আসে, তেমনি দর্শন এর ও এসেছিল। তার চিন্তাটা অদ্ভুত, তার ভাবনা ছিলো নাম নিয়ে। সেই কৌতূহল থেকেই একদিন প্রশ্ন করেছিল আফিয়ার কাছে। রজনী তখন গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে পারে, দর্শন তারই পিছন পিছন হাটছিলো। এতটুকু বাচ্চা, যদি হাঁটতে গিয়ে পরে যায়? মামিকে দেখে নাম নিয়ে একই প্রশ্ন মাথায় আসে, রজনীকে কোলে তুলে নিয়ে আফিয়ার কাছে গিয়ে বলে,
_”রজনী মানে কি,মামি?”

আফিয়া কাজ করছিলো তখন। দর্শনের উৎকণ্ঠা নজর দেখে হাসিমুখে উত্তর দেন,
_”রজনী মানে হলো রাত।”

দর্শন রজনীর দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে,
_”রাত? তাহলে ওর নাম রাত কেন রাখলে?”

_”রাত তো সবার পছন্দ হয়, কেন তোমার পছন্দ নয়?”

_”না তো। রাত কেন সবার পছন্দ হয়?”

আফিয়া কিছুটা ভেবে উত্তর দেন,
_”উম..কারণ রাতের বেলা চাঁদ দেখা যায়।”

মেনে নিলো দর্শন, অন্য প্রশ্ন মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করলো,
_”ওহহহ..তাহলে আমার নামের মানে কি?”

_”দর্শনের মানে হলো দেখা।”

জাহিদের ডাক পরতেই হাত মুছে ঘরের দিকে যান আফিয়া। দর্শন দু মিনিট ভেবে আবিষ্কার করে এক নতুন বিষয়। রজনীর দিকে তাকিয়ে অনেক উৎসাহ নিয়ে বলে,
_”মজার তো খুব। রজনী মানে রাত, দর্শন মানে দেখা। আর রাতের বেলাই তো চাঁদের দেখা পাওয়া যায়!”

রজনী কি বুঝেছে,আদতেও কিছু বুঝেছে কিনা তা সম্পূর্নই অজানা। তবে সে হেসেছিল তখন,আর তার হাসি দেখে হেসেছিলো দর্শন নিজেও। কোলে বেশিক্ষণ থাকেনি রজনী, জোর করে নেমে যায় সে, এখন তার হাঁটার বয়স। কোলে মোটেই থাকতে চায়না, দু একবার পড়বে, তবুও হাটবে সে।

_”দর্শন ভাই, কোথায় হারিয়ে যাও তুমি?”

পলক ফেলে দর্শন, চোখ নামিয়ে নেয়। কথা সত্য, ছোটবেলায় রাত একদমই পছন্দ ছিলোনা তার, কেমন চারিদিক অন্ধকার হয়ে থাকে, খেলতে বের হওয়া যায়না, বাসার ভিতর থাকতে হয়। সবটাই ঝামেলা।
তবে কি করে বুঝবে সে? দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আধারে ঢেকে থাকা সময়টুকুই তার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠবে! যতটা রাত তার প্রিয়, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি প্রিয় হয়ে উঠবে নামের সাথে নামের সম্পর্ক জুরে দেওয়ার সঙ্গী মেয়েটি। সেদিন মজার ছলে কথাটা মাথায় এলেও, এখন তা বাস্তবে মিলিয়ে ফেলে দর্শন। রাত ব্যাতীত যেমন চাঁদ দেখা যায়না, তেমনি রজনী বিহীন দর্শনকেও হয়তো খুজে পাওয়া যাবেনা, তারা যেন একে অপরের পরিপূরক।

_”রাত অনেক হয়েছে রাতপাখি, ঘুমোতে যা।”
চোখ তুলে বললো দর্শন। রজনী জিজ্ঞেস করলো,
_”ক’টা বাজে?”

_”দুটোর কাছাকাছি।”

রজনী চোখ বড়বড় করে বলে,
_”এত বেজে গেছে! যাই আমি, দাদি দেখে ফেললে..”

কথা শেষ করতে পারলোনা রজনী। দর্শন উঠে দাড়িয়ে বললো,
_”নানুর জন্য বলিনি। ঘুম প্রয়োজন তোর,তাই বলেছি। সকালে আবার স্কুল আছে না?”

_”হুম”
চলে যেতে নিয়েই আবার থেমে যায় রজনী। আবারো দর্শন এর সামনে এসে বলে,
_”যা বলেছি মনে আছে তো?”

দর্শন মৃদু হেসে রজনীর মাথায় আলতো গাট্টা মেরে বলে,
_”হ্যা হ্যা মনে আছে। ঘুমোতে যা এবার, গুড নাইট। আমার আর আজকে ঘুম নেই, পড়তে বসবো এখন।”

_”আমি বুঝিনা,সারাদিন বাদ দিয়ে তুমি রাতেই কেন পড়তে বসো ভাইয়া?”

_”এটাতো এখন বুঝবি না, ভার্সিটি লাইফ এ গেলে নিজেও এমন ই করবি।”

রজনী চোখ ছোটছোট করে বলে,
_”খাবে কিছু? চা বানিয়ে দিয়ে যাবো?”

_”আমি কি অকর্মণ্য নাকি? নিজেই বানিয়ে নিতে পারবো, তুই যা এখন।”

_”ওকে, গুড নাইট।”

কথাটা বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো রজনী। দর্শন সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরে গেলো। নিজেই চা বানিয়ে ঘরে নিয়ে এলো, কদিন বাদে এক্সাম, তাই বাধ্য হয়েই পড়তে বসতে হচ্ছে।
তবে ঘরে এসেই পড়তে বসলোনা দর্শন,ব্যালকনি তে চায়ের কাপটা নিয়ে বসলো আগে। ঘুম কাটাতে হবে প্রথমে, তারপর বাকিসব। চায়ে চুমুক দিয়ে চেয়ারে হেলান দিলো দর্শন। আজকে রজনীকে করা একটা প্রশ্ন ছিলো,”তোর রাত খুব পছন্দ?”। এই প্রশ্নটা দর্শন আগেও করেছে।

রজনী তখন খুব একটা বড় নয়, বয়স আট ছুঁইছুঁই। দর্শনের তখন পনেরো বছর বয়স,অনেকটাই বড়, বোঝার বয়স হয়েছে তার। রজনীর আবদারেই তাকে নিয়ে ছাঁদে এসেছিলো দর্শন। পাশাপাশিই বসে ছিলো তারা। সেদিনও একই প্রশ্ন করেছিলো দর্শন,
_”তোর রাত খুব পছন্দ, রজনী?”

রজনী হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলো,
_”হ্যা খুব খুব পছন্দ।”

_”কেন বল তো।”

_”কারণ রাতে আব্বু বাড়িতে থাকেনা, আমাকে বকাও দিতে পারেনা।”

কথাটা বলতেই দু হাতে মুখ চেপে ধরে রজনী,মুখ ফসকে বলে ফেলেছে কথাটা। তবে এই কথাটা তখন তার মনের কথা ছিলো, দর্শন যেন নির্বাক হয়ে যায় সেই মুহূর্তে। বুকে গিয়ে লাগে যেন কথাটা। জাহিদ আর্মিতে চাকরি করতেন, বেশিরভাগ সময় নাইট ডিউটি থাকতো তার, রাত আটটার পরপর খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যেতেন আর আসতেন ভোরবেলায়। তিনি রিটায়ার্ড করেছেন এই দু বছর এর কাছাকাছি হলো,তারপর ই জয়েন্ট করেছেন নতুন চাকরিতে।

সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের নিষ্পাপ মনে এমন একটা চিন্তা কি করে আসতে পারে? বাবাকে কতটা ভয় পেয়ে মেয়েটা এমন কথা বলছে বুঝতে সময় লাগলোনা দর্শন এর। রজনী ভয় পাচ্ছিলো হয়তো মনেমনে,যদি দর্শন কথাটা বলে দেয় অন্য কাউকে?
দর্শন রজনীকে বলার মতো কিছুই খুজে পেলোনা, কেবল তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললো,
_”ভয় পাসনা,আমি কাউকে বলবো না।”

কথা রেখেছে দর্শন, কথাটা কাউকেই জানায়নি সে। হয়তো রজনী ভুলেও গেছে তার বলা সেই কথাটা,তবে মনে রেখেছে দর্শন। অনেক কিছুই সে ভুলতে পারেনি, বারবার মনে পড়ে কথাগুলো। কথাগুলো এখন যেন আরো জোরালোভাবে হৃদয়ে আঘাত করে। রজনী চেষ্টা করলেই হয়তো বুঝতে পারতো,তবে সে বোঝেনি। বুঝতে চায়নি, না বুঝুক। সে আরেকটু বড় হোক, সময় হলে দর্শন নিজে থেকেই বলবে তাকে, বলবে মনে পুষে রাখা সমস্ত কথা।
চায়ের কাপে আরো একবার চুমুক দিলো দর্শন। কল্পনা করে সে, রজনীর দুহাত মুঠোতে নিয়ে চোখে চোখ রেখে সেদিন আর্জি জানাবে,
_”রাতপাখি, তুই আমার মনপাখি হয়ে যা, প্লিজ!”

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০৫

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৫|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
মোটা পাইপের উপর বসে আছে ইনাম আর দর্শন। ইনামের একহাতে সিগারেটে,অন্যহাতে ফোন। মনোযোগ সহকারে কোনো এক নিউজ পড়ছে সে।
দর্শনের ফোন তার পকেটেই আছে। বাম হাতে থাকা সিগারেটে টান দিয়ে দু হাতের ভর রাখলো পাইপের উপর। মাথা কিছুটা পিছনের দিকে ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে রইলো আকাশ পানে। এই রাতের আকাশের দিকে তাকালেও কত সুন্দর দৃশ্য তার কল্পনায় আসে। এইতো, দুদিন আগে কুয়াকাটায় রাত দুটোর দিকে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে ছিলো সে, অর্ধচন্দ্র টাও বেশ সুন্দর লাগছে। হঠাৎ ই মনে হলো পাশে রজনী দাঁড়িয়ে আছে। পাশ ফিরতেই তাকে দেখতে পেলো দর্শন, আকাশি রঙের জামা পরিহিত মেয়েটির মাথায় সুন্দর করে ওড়না দেওয়া। ঠোঁটের কোণ হাসির রেখা ফুটে ওঠে দর্শন এর, সেই মুহূর্তে রজনীও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, এই হাসিতে বড্ড মানায় তাকে। রজনী পুনরায় তাকালো আকাশের দিকে, হাসিমাখা কণ্ঠে বললো,
_”ভাইয়া, চাঁদটা খুব সুন্দর লাগছে তাইনা?”

দর্শন ও তাকালো সেদিকে। পিছনে দু’হাত গুঁজে বললো,
_”হুম,ভালোই লাগছে।”

_”আমার থেকেও বেশি সুন্দর?”

নিচের দিকে তাকিয়ে হাসে দর্শন, কল্পনা বলেই রজনী এই কথা বলছে। বাস্তব হলে কখনোই বলতো না। তবুও কল্পনা কে প্রাধান্য দিলো দর্শন, রজনীর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
_”চাঁদের সঙ্গে তোর তুলনা করিনা আমি রাতপাখি। আমার কাছে চাঁদ নয়, বরং পুরো রাতের আকাশটাই তুই। আর তার মাঝে আলোর দর্শনটা হলো আমার ভালোবাসা। চাঁদ তো প্রতিদিন নিজের রূপ বদলায়,তবে আমার ভালোবাসা তেমন নয়, তা সর্বোক্ষন পূর্নিমার ন্যায় উজ্জ্বল। রাতের আকাশেই যেমন চাঁদের অবস্থান, তেমনই তোর মাঝেই আমার ভালোবাসার অবস্থান রাতপাখি।”

হাসি বজায় রাখলো রজনী,কপালে পড়া দু একটা চুল নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নিলো। দর্শন এগোলো না এক পা’ও। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো তার কল্পনায় আসা কিশোরীকে। তাকে স্পর্ষ করলো না দর্শন,এগিয়ে এসে তার দু’গালে হাত রাখলো না, কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো না। কারণ দর্শন জানে, ছুতে গেলেই তার কল্পনা ভেঙে যাবে, তা চাইলো না সে। থাক না, কল্পনাতেই দেখুক আজ প্রেয়সী কে। এই কল্পনা যেদিন বাস্তবে রূপ নেবে, সেদিন নাহয় এগোবে দর্শন। চুলগুলো নিজ হাতে সরিয়ে দেবে, অনেকটা কাছে টেনে নেবে তাকে, নানান কথা বলে লজ্জায় ফেলতে চাইবে প্রিয়তমাকে, গভীরভাবে জড়িয়ে নেবে নিজের সঙ্গে।

এসব কথা মনে করতেই পুনরায় মনে শান্তির বাতাস বয়ে গেলো যেন, সিগারেটে আরো একবার টান দিয়ে সামনের দিকে হাত ছড়িয়ে বসলো দর্শন। ইনাম ফোনটা পাশে রাখলো, দর্শনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
_”কিরে ভাই? সাইলেন্ট হয়ে বসে থাকার জন্য ডাকছি তোরে? এমন এক লুক নিয়ে আছিস, যেন বড়সড় ছ্যাকা খাইছোস।”

ইনাম হেসেই বলে কথাটা,দর্শনও মৃদু হেসে সিগারেট এর ধোয়া ছেড়ে বলে,
_”জীবনে ক্রাশ খেলাম একবার, সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। ব্যাস,ভাল্লেগে গেলো এক সিনিয়র আপুকে। দুদিন বাদে জানলাম, তার নাকি চার মাসের এক বেবি আছে। আহা, কি বড় ছ্যাকাটাই না খেলাম। ঘুমই উড়ে গেলো চোখ থেকে, কষ্ট ভুলে মন শান্ত করতে গেলাম ছাঁদে। ক্ষনিকের অশান্ত মন শান্ত হওয়ার বদলে অশান্ত হয়ে গেলো সারাজীবনের জন্য। ভুল করেছিলাম, মস্ত বড় ভুল। সেই অমাবস্যার রজনীতে ছাঁদে যাওয়াটাই ছিলো আমার সবচেয়ে বড় ভুল, তবে সেটাকেই আমি বলি জীবনের সর্বোত্তম ভুল।”

ঠোঁটে হাসি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো দর্শন। ইনাম তার পিঠে দুবার চাপড় মে’রে বললো,
_”আহা..কি প্রেম! একটা প্রেম করা উচিৎ ভাই।”

_”সব করবি, বাসায় চল আগে।”

হাসি মিলিয়ে গেলো ইনাম এর। হাত সরিয়ে নিয়ে সিগারেট এ টান দিয়ে বললো,
_”মাফ কর ভাই, এই একটা জিনিস আল্লাহর ওয়াস্তে আর বলিস না।”

_”বলবো না, কিন্তু কারণটা তো জানাবি নাকি?”

_”আরে ছাড় তো, আমারে দিয়ে কাজ কি? তুই বল, সবাই কেমন আছে? আর রজনী..”

_”কেন রে? ওর কথা তোর জিজ্ঞেস করা মানায়না। কে ও তোর? আদতেও কেউ হয়? বছরে কদিন মেয়েটার খোজ নিস তুই?”

কিছুক্ষন চুপ করে থাকে ইনাম। একপর ঠোঁট প্রশস্ত করে বলে,
_”তুই খোজ নিলেই চলবে।”

_”শা’লা মাথা গরম করায় দিস তুই। বাট আই সোয়ার, এবার তোকে বাড়িতে আমি নিয়েই ছাড়বো।”

_”পরে দেখা যাবে। এবার বল, বাসার কি অবস্থা?”

দর্শন কঠিন স্বরে উত্তর দেয়,
_”কেমন থাকে? ইদানিং আরো বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে, টলারেট করা যায়না এগুলো। কবে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই আমি, আল্লাহ মাবুদ জানে।”

_”তো আছিস কেন? চলে যা, রজনীকে সাথে নিয়ে যা তাহলেই হয়।”

_”হাহ,এত্ত ইজি? পরে ওর বাপ আমারে পুলিশ এ দিক তাই তো? দাঁতে দাঁত চেপে ওখানে পরে আছিতো শুধু ওর জন্যই। আম্মুকে নিয়ে চাইলেই চলে যেতে পারি, তাও যাচ্ছিনা। কোনোভাবে দুটো বছর পার হোক। আই প্রমিস, এক সেকেন্ড ও রজনীকে ঐ বাড়িতে থাকতে দেবোনা আমি।”

_”আর ততদিন? লুকোচুরি খেলবি?”

হাসলো দর্শন,পাশে তাকিয়ে বললো,
_”কে খেলছে লুকোচুরি? তুই নিজেও জানিস, লুকোনো জিনিসটা আমায় দিয়ে হয়না। আর আমি অতো সিরিয়াসভাবে কিছুই লুকোই নি। রজনীর জায়গায় অন্য মেয়ে হলে এতদিনে কিছু আন্দাজ করেই ফেলতো, ও নিজেই ভাবতে চায়না কিছু। আই অ্যাপ্রেশিয়েট দ্যাট, সি ইজ মোর ম্যাচিউর দ্যান আদার্স। তবে হ্যা, নিজে থেকে জানতে চাইলে আমি কিছু লুকোবো না।”

হাসলো ইনাম ও। দর্শন সিগারেট টা ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে পাইপ থেকে নেমে দাঁড়ালো। ইনামের উদ্দেশ্যে খানিক শান্ত কণ্ঠেই বললো,
_”চল না ভাই।”

_”মাফ কর। যা তুই, আমিও যাই হোটেলে। দুদিন থাকবো, কালকে দেখা হবে।”

বিপরীতে কিছু বললোনা দর্শন। নাছোড়বান্দা ছেলে ইনাম, দর্শনের চেয়ে মাত্র বিশদিন এর ছোট সে। নিজে না চাইলে তাকে জোর করে কোনো কাজ করানো সম্ভব নয় তা দর্শনও ভালো করেই জানে।
অত:পর বিদায় নিয়ে নিজেদের পথে গেলো দুজন। বাড়ি ফিরতে চারমিনিট লাগলো দর্শন এর। এখন আরেক ঝামেলা। রাত একটার বেশি বাজে, দরজা ধাক্কানো যাবেনা। ফাহমিদা কে ফোন করবে ভেবেই পকেট থেকে ফোন বের করতে যাচ্ছিলো দর্শন। কানে গুনগুন গানের আওয়াজ আসতে মাথা উঁচু করে দোতলার ছাঁদের দিকে তাকায় সে। ছাঁদের পাশেই একটা বেঞ্চ বসানো, তার উপরই পা তুলে বসে আছে রজনী। গুনগুন করে গান গাইছে,সঙ্গে পায়ে হাত দিয়ে মেহেদী তুলছে হয়তো।

ফোনটা নামিয়ে তার দিকে তাকালো দর্শন। রাতের আধারে যেন আরো বেশি মায়াবী লাগে মেয়েটিকে। রাতের আধারে মেয়েটা ভয় পায়,আবার কখনো কখনো পায় না। এত রাতে ছাঁদে একাএকা বসে আছে,অথচ তার মাঝে ভয়ের রেশমাত্র নেই। আবার কখনো কখনো ভয় পায় সে, প্রচণ্ড ভয়ে গুটিয়ে যায়। ছোট থাকতে রাতের বেলা ছাঁদে যেতে ইচ্ছে করলে প্রথমে মায়ের কাছে আবদার করতো, তারপর ফাহমিদার কাছে। তারা কাজে ব্যস্ত থাকলে সর্বশেষে যেতো দর্শন এর কাছে। তার পিছুপিছু ঘুরে বেরাতো খানিকক্ষণ, তারপর জিজ্ঞেস করতো সে এখন ব্যস্ত কিনা। উত্তরটা না হলে আবদার জুড়ে দিতো ছাঁদে যাওয়ার জন্য, অধিকাংশ সময় তার আবদার রেখেছে দর্শন, আবার কখনো কখনো রাখেনি। হয়তো সে মন খারাপ করেছে তখন,তবে কোনো অভিযোগ করেনি।

একটু বড় হওয়ার পর থেকে আর এই আবদার করেনা রজনী। নিজেই সাহস করে আসে, আর ভয় পেলে আসেনা। তবে মন খারাপ থাকলে তার ভয়টা কেটে যায়, তখন অনেক রাতেও সে একাএকা ছাঁদে চলে আসে। দর্শন দেখতে পেলে নিজেও আসে পিছন পিছন। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ, কখনো টুকটাক কথা বলে, গান গায়। এতে রজনীর মন ভালো হয় কিনা পুরোপুরি জানা নেই, তবুও চেষ্টা করে দর্শন।
আপাতত সেসব ভুলে অনেকটা সময় সেই মায়াভরা মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলো দর্শন। এমন এক রজনী দর্শনেই তো তার মায়ায় পরে গিয়েছিলো সে। সেই মায়া কাটেনি, বরং বেড়েছে অনেকগুণ।

রজনী এখনো তাকায়নি নিচের দিকে। মা’কে আর ফোন করলোনা দর্শন। দু তিনবার তুড়ি বাজাতেই পাশ ফিরে নিচের দিকে তাকায় রজনী। দর্শন হাতের ইশারায় তাকে দরজা খোলার কথা বলতেই নেমে দাঁড়ায় সে। দ্রুত পায়ে নেমে আসে দরজা খোলার উদ্দেশ্যে।

#চলবে?

সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০৪

0

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৪|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
_”মন ভালো করার উপায় বল, চেষ্টা করে দেখি।”
গালে হাত ঠেকিয়ে বলে দর্শন। রজনী কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
_”মন খারাপ, তা কি বলেছি? ওসব আর খুব বেশি হয়না এখন।”

_”আমার থেকে লুকোচ্ছিস? আমার থেকে?”

_”বলতে ইচ্ছে হয়না।”

_”আর আমার চুপচাপ দেখতে,তোকে। একদমই ইচ্ছে হয়না। বল কি চাই.. বই?”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রজনী বললো,
_”ঐ এক জায়গায় কোনো না নেই। যত মন চায় বই গিফট করতে পারো, খুশি বইকি অখুশি হবোনা।”

ইষৎ হাসলো দর্শন, রজনী এবার টেবিলে থাকা খাতাটা দর্শন এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
_”এখন আপাতত এই অঙ্কটা বুঝিয়ে দিলেই চলবে।”

দর্শন সোজা হয়ে বসে একবার খাতার দিকে তাকায়। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,
_”এত পড়ে হবে টা কি?”

হুট করেই হেসে দিলো রজনী, টেবিল থেকে বই নামাতে নামাতে বললো,
_”প্রফেসর.. প্রফেসর রজনী।”

রজনীর চুলগুলো পিছনে ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছিলো, ওড়না শরীরে জড়িয়ে রাখা। বারান্দার দড়জাটা খোলা, হঠাৎ দমকা হাওয়া ছুটে আসতেই চোখের সামনে চুল এসে বিরক্ত করে রজনীকে। পুনরায় সব চুল একসাথে খোঁপা করে ওড়নাটা টেনে মাথায় দেয় রজনী,উঠে যায় বারান্দার দড়জাটা আটকে দিতে। দর্শন টেবিলে দু হাত রেখে ঝুকে আসে কিছুটা,হাতের উপর থুতনি ঠেকিয়ে তাকিয়ে থাকে রজনীর দিকে। দড়জা আটকে নিয়ে চেয়ারে এসে বসে রজনী, দর্শন ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত করে বলে,
_”সাবধানে থাক রাতপাখি, কবে যেন আমারই নজর লেগে যায়।”

সূক্ষ্ম চোখে তাকায় রজনী, চোখের পলক ফেলে বলে,
_”কি হলো? অঙ্ক বোঝাবে না?”

চোখ নামিয়ে মুচকি হাসে দর্শন। কথাটা সে বলেছে ঠিকই, তবে মনে মনে। চেয়েছিল মুখে বলতে, বলা হলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতেই দর্শনের চোখ যায় রজনীর পায়ের দিকে। আর একটু খেয়াল করে বলে,
_”পা’টা সামনে আন তো।”

ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে পা সামনে আনে রজনী,বাম পায়ের একপাশে সুন্দর করে মেহেদী দেওয়া। একটু আগেই দিয়েছে,শুকিয়ে গেছে এতক্ষনে। দর্শন চোখ তুলে বললো,
_”হাত খালি রেখে পায়ে মেহেদী দেওয়ার লজিকটা বুঝলাম না।”

_”সর্বক্ষণ হাতে মেহেদী থাকাও একপ্রকার ঢং,জানোনা?”

মুখভঙ্গি গম্ভীর হয় দর্শনে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
_”নানু বলছে?”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রজনী। পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”ভালো লাগছিলো না,তাই দিলাম। দাদু বলেছে ঠিকই, তবে সেটা কারণ নয়। হাতে সবসময় মেহেদী রাখতেও ভালো লাগেনা ইদানিং,তাই পায়ে দিলাম। কদিন পর হয়তো সেটাও বন্ধ করে দেবো।”

_”মানলি তাহলে, মন খারাপ।”

_”অস্বাভাবিক?”

উত্তর দিলোনা দর্শন। রজনী এবার করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_”আম্মু আমাকে একবারো জিজ্ঞেস করলোনা জানোতো? এতই বিরক্তির কারণ আমি দর্শন ভাই?”

দর্শন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললো,
_”তোর চোখে এক ফোঁটাও জল নেই,রাতপাখি।”

চোখ সরিয়ে হাসলো রজনী,বলে উঠলো,
_”সামান্য বিষয়, চোখে জল আসবে কেন?”

_”বড় হয়ে যাচ্ছিস।”

_”ভালোই তো, ভালো না? যেমন এখন অল্পতে কাঁদছি না, পরবর্তীতে এর চেয়ে বড় বিষয়েও কাঁদবো না।”

কিঞ্চিত হেসে হাত বারায় দর্শন, আলতো হাতে রজনীর গাল টেনে দিয়ে বলে,
_”বড়দের মতোই কথা বলছিস,এটা আরো বেশি ভালো। আই ওয়ান্ট টু সি ইউ স্ট্রং,নট উইক।”

_”দেখতে পেলে তো..”

থামলো রজনী, মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। ভ্রুযুগল কুঁচকে নিলো দর্শন,কয়েক সেকেন্ড সেভাবে তাকিয়ে রইলো। মুখে কঠিন আভা ফুটে উঠলো তার, ভয় গ্রাস করলো পুরো হৃদয় জুড়ে। এতক্ষনের নরম স্বর মুহূর্তেই কঠিনে রুপান্তরিত হলো। এলোমেলো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
_”রজনী, ইনডিরেক্টলি কি বোঝাতে চাইলি তুই?”

নিচের দিকে মাথা ঝুকিয়ে চোখ বন্ধ করলো রজনী,দর্শন পুনরায় বললো,
_”লুক এট মি, কি বলতে…”

_”কিছুই বোঝাইনি আমি। অঙ্ক করতে ইচ্ছে করছেনা আর। ঘুমোবো আমি, তুমি যেতে পারো।”

পাশে তাকিয়ে কয়েকবার বড়বড় নিঃশ্বাস নিলো দর্শন, শান্ত হয়ে বললো,
_”এদিকে তাকা আগে।”

দর্শনের দিকে ফিরে তাকালো রজনী। দর্শন চেয়ার নিয়ে এগোলো কিছুটা, একদৃষ্টিতে রজনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”মনে যা ঘুরছে,মুখ ফসকে তাই বলতে যাচ্ছিলি। আমি আপত্তি করবোনা, যে কথা মনে আসে তাই বলতে পারিস। কিন্তু তা কেবলই বলা অবধি, বুঝতে পারছিস আমি কি বলছি?”

এতক্ষন স্বাভাবিক থাকা রজনীর চোখ টলমল করে উঠলো এবার,সঙ্গেসঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলো সে। দর্শন ব্যাস্ত হয়ে বলে,
_”আবার কাঁদছিস কেন? আমি বকেছি তোকে? কিছু বলিনি তো।”

কষ্ট করে কান্না আটকে রাখলো না রজনী,লুকোতেও চাইলো না। কার থেকে লুকোবে? যার সামনে ছোটবেলা থেকে কেঁদেছে,তার থেকে আবার লুকোনোর কি আছে?

_”চোখ মোছ রজনী। মামির ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছিস তাই তো? বড় হয়েছিস না তুই? একটু বুঝতে চেষ্টা কর, অনেক সময় মানুষ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায়না। তোর প্রশ্নগুলো এড়াতেই হয়তো মামি কথা বলেনি।”

_”আমিতো প্রশ্ন করতাম না ভাইয়া।”

_”সেটা হয়তো মামি বুঝতে পারেনি। আচ্ছা আমি কথা বলে নেবো মামির সঙ্গে, চোখ মোছ এবার।”

ভেজা ঢোক গিলে চোখ মুছলো রজনী। দর্শন তাকে স্বাভাবিক করার উপায় হিসেবে অঙ্ক করাকেই বেছে নিলো। আর যাই হয়ে যাক, পড়ার ক্ষেত্রে মনোযোগী থাকবে রজনী। খাতাটা নিয়ে একবার অঙ্কটা দেখলো দর্শন, এরপর কলমটা হাতে নিয়ে বললো,
_”একটু প্যাঁচানো। আমি করছি, মনোযোগ দিয়ে দেখ।”

হলোও তাই। কান্না ভুলে অঙ্কের দিকেই মনোযোগ দিলো রজনী। সে যেন পন করে নিয়েছে, দুনিয়া উলটে গেলেও তার প্রভাব পড়ার উপর পরতে দেবেনা সে। একবার বোঝাতেই অঙ্কটা বুঝে গেলো রজনী, দর্শন আর বসলো না সেখানে। রজনী এখন একাএকা পড়বে আরো কিছুক্ষন, মাঝে বেশি কষ্ট হলে হয়তো দু এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দেবে। তারপর ঠিকই ঘুমিয়ে পরবে। দর্শন পাশে থাকলে বরং ঝামেলা বেশি, কথা না বলে সে থাকতে পারবেনা, তাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নিজের ঘরে এসে ফোন চেক করতেই দেখলো ইনাম পাঁচ মিনিট আগে কল দিয়েছিলো দু’বার। রাত বারোটার কাছাকাছি বাজে, দর্শন কল ব্যাক করলো সাথেসাথেই। কল রিসিভ করতেই দর্শন কড়া গলায় বলে,
_”তোরে আমি কল দিছিলাম সন্ধ্যা ছয়টায়,তুই কল ব্যাক করোস বারোটার সময়?”

_”মামা চেতিস না তো, একটু মাঠের পাশে আয়।”

দর্শন অবাক হয়ে বলে,
_”তুই..”

_”আসছি আধা ঘন্টা,খাওয়া দাওয়া করে বসে আছি। আয় একটু আড্ডা দেই।”

_”তুই আগে বাড়িতে আয়।”

_”হুদাই এক কথা বারবার বলিস না তো। ওয়েট করতেছি, আয় তুই।”

ফোন কেটে দিলো ইনাম। দর্শন এর বড় মামা আর রজনীর বড় চাচার ছেলে সে। তারা পরিবার নিয়ে বরিশাল শহরেই থাকে, পটুয়াখালী নিজেদের বাড়িতে কেবল জাহিদ ই থাকেন। বাকি দুই ভাই ভিন্ন শহরে, বিয়ের পরই আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তারা।
বাইকের চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে যায় দর্শন, ফাহমিদা পানি খেতে ড্রইং রুমে এসেছিলেন। ভালোই হয়েছে,তিনিই দরজা আটকে দিয়েছেন। ইনাম এ বাড়িতে আসেনা প্রায় চার বছর হতে চললো। হাজারবার বলা হয়েছে তাকে, কোনো লাভ হয়নি। এমনকি রজনীর সাথে বিশেষ দিন ব্যাতীত কথাও বলে না সে। আগে এমনটা ছিলো না, সবার সাথেই মজার সম্পর্ক ছিলো তার। হুট করে কি এমন হলো তা দর্শন এর ও অজানা।

মাঠের পাশে এসে বাইক থামায় দর্শন। সেখানেই একটা মোটা পাইপের উপর বসে আছে ইনাম। পাশে ল্যাম্পপোস্ট, আলোকিত জায়গাটা। মূলত এখানে বন্ধুমহল নিয়ে এসে ছেলেরাই আড্ডা দেয়। বিকেলের দিকে ফুটবল,ক্রিকেট খেলে অনেক সময়।
ইনাম পরিপাটি বরাবরের মতো,তবে চুলগুলো নুডুলস এর ন্যায় প্যাঁচানো। ছোট বেলা থেকেই এমন, তার চুল এক ভেজা অবস্থায় ছাড়া কখনোই ঠিক রাখা যায়না। চুলের কারণে কম পঁচানি খেতে হয়নি তাকে, আবার অনেকে বলে তাকে এভাবেই মানায়।

ফোনের দিকেই নজর ছিলো ইনাম এর। দর্শন বাইক থেকে নামতেই সেও বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দুই বন্ধুর দেখা অনেকদিন পর, অনেকদিন বলতে এই একমাস।

#চলবে?