প্রিয় বালিকা পর্ব-১৩+১৪+১৫+১৬

0
70

#প্রিয়_বালিকা |১৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পুকুর ধারে দোলনায় বসে আছে “প্রিয় বালিকা”।তবে এখন সে আর বালিকা নেই।সে এখন যুবতী।শারীরিক পরিপক্বতার সাথে মানসিক পরিপূর্ণতা সবকিছুরই বিকাশ ঘটেছে।এমনকি অনুভূতিগুলোও হৃদয় জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে।হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠের শেষ অংশে ঠেকেছে।সেদিনের টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলোর নাম না জানা থাকলেও আজ সে নাম জানে।এই অনুভূতির কারণ জানে।কিন্তু যাকে নিয়ে অনুভূতিগুলো তাকে বলার জন্য সে নেই।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আভা।দোলনা মৃদু দুলছে।সেদিন রৌদ্র চলে যাওয়া বেশকিছু দিন পর সে পুকুর পাড়ে এসে বটগাছের সাথে এই দোলনাটা দেখতে পায়।ভিতরটা আরো ঢুকরে ওঠে তার।সে জানে এটি কে তৈরি করেছে।এরপর অনেকবার দোলনাটা বর্ষার দরুন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।কিন্তু যতবার নষ্ট হয়েছে ততবারই আভা এটাকে ঠিক করেছে।

– এই আভা চল।সবাই রেডি।

সেহরিনের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আভার।উঠে দাঁড়ায় সে।পরণে কালো থ্রি-পিস।অভয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে।অভয় গ্রাজুয়েশন শেষ করে দেশে ফিরেছে বছর খানেক।এখন মাস গেলে মোটা অঙ্কের বেতন পায় সে।সে শহরে থাকে ছুটি পেলে বাড়িতে আসে।এবার এসেছে বিয়ের উদ্দেশ্যে।তার পাত্রীর তালিকায় সর্বপ্রথম পূর্ণতার নাম।অভয় অবশ্য এ নিয়ে রাগারাগি করেছে।সে পূর্ণতাকে বিয়ে করতে চায়না।কিন্তু প্রেমার পছন্দের তালিকায় ছেলের জন্য পূর্ণতাকেই সকলের উপরে রেখেছে।আজ হঠাৎ করেই যাওয়া হচ্ছে তাদের বাড়িতে।এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পূর্ণতাসহ তার পুরো পরিবার রাজধানীতে চলে যায়।প্রেমা কোনোভাবে খবর পেয়েছেন তারা কিছুদিনের জন্য গ্রামে এসেছেন।তাই সে ছেলের বিয়ের কথা নিয়ে আজ পূর্ণতাদের বাড়িতে যাবেন।আভা ধীর পায়ে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় আসে।আজ আর ভাড়া করা মাইক্রোবাসে যাবেনা তারা।আজ তারা নিজেদের গাড়িতে যাবে।
সকলে একে একে বাসে উঠে বসলো।বাড়ির অধিকাংশ লোক যাচ্ছেন।শুধু যাচ্ছে না আইরিন এবং অভয়।
হরেক রকম মিষ্টি নিয়েছেন গাড়ির ডিঁকি ভরে।পূর্ণতা দরজা খুলে আভা এবং তার বাড়ির লোকদের দেখে চমকে গেল।বিস্ময় স্বরে বলে উঠলো,
– আভা?

আভা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
– কোমন আছিস?

পূর্ণতা দরজা থেকে সরে সবাইকে ভিতরে আসতে বলে।আভাকে আলিঙ্গন করে বলে,
– ভালো আছি তুই কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

পূর্ণতা মুন্সি বাড়ির সকলে দেখে ভ্রুকুটি করে।আভাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কিছু হয়েছে কিনা?সকলে হঠাৎ একসাথে?আভা কিছু না বলে পূর্ণতাকে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়।পূর্ণতা এবার নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না।

– কি হয়েছে রে?হঠাৎ বাড়ির সবাইকে নিয়ে?

আভা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– তোকে দেখতে এসেছি।

পূর্ণতা আভার কথা বুঝতে না পেরে বলে,
– মানে?

– ভাইয়ার জন্য তোকে দেখতে এসেছি।

– অভয় ভাইয়া?

– হ্যাঁ।

আকাশ থেকে পড়ে পূর্ণতা।এতো চমকিত সে জীবনে কখনো হয়নি।পূর্ণতা বড় বড় চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে আভার দিকে তাকিয়ে থাকে।আভার মুখের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক।পূর্ণতা পা টিপে টিপে দরজায় দেওয়া পর্দার আড়ালে দাঁড়ায়।তার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করছে।পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাহিরের কথপোকথন শোনার চেষ্টা করে।

প্রেমার সোজাসাপ্টা বাক্য,
– দেখুন পুরো পরিবার নিয়ে যখন এসেছি তখন তো বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই।আমার ছেলে অভয়ের জন্য পূর্ণতাকে নিতে চাই।

কুশল বিনিময় আপ্যায়ন শেষে প্রেমা এমন কোনো কথায় বলবে তা আগেই অনুমান করেছিল পূর্ণতার মা।প্রেমার কথায় সে আমতা আমতা করে ইনিয়েবিনিয়ে বলে,
– দেখুন আমি বলছিনা অভয় ছেলে হিসেবে খারাপ।কিন্তু আমার মেয়েও যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন।তাছাড়া ও কত ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।তাই আমি ওকে এখন মানে এই মুহুর্তে বিয়ে দিতে চাইছি না।

পূর্ণতার মায়ের কথায় বেজার হলেন প্রেমা।মুখে নেমে এলো কালো মেঘ।তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলেন,
– দেখুন আমরা অভয়ের পাত্রীর তালিকায় পূর্ণতাকে সকলের উপরে রেখেছি ওর সকল যোগ্যতা বিশ্লেষণ করেই।অভয়ও পাত্র হিসেবে খারাপ নয়।বিদেশ থেকে পড়ালেখা করে এসেছে।

পূর্ণতার মা সন্দিহান স্বরে বলেন,
– অভয় কি বিয়ের পর বউ নিজের সাথে করে নিয়ে যাবে শহরে?নাকি এখানে আপনাদের সাথে থাকবে?

প্রেমা আমতা আমতা করে বলেন,
– অভয় তো চায় ওর বউ ওর পরিবারের সকলের সাথে থাকুক।

পূর্ণতার মা এবার শক্ত কন্ঠে বলেন,
– মাফ করবেন বোন আমি আমার মেয়েকে এই মুহুর্তে বিয়ে দিতে চাইছিনা।আশা করি অপরাধ নিবেন না।

এতো বোঝানোর পরেও এমন বাক্য অপমান করল মুন্সি বাড়ির লোকদের।প্রেমা আর একমুহূর্তে বসতে পারলেন না সেখানে।মৃদু গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লেন আভার উদ্দেশ্যে,
– আভা আভা।

আভাও এতোক্ষণ সব শুনেছে।পূর্ণতা পর্দার আড়াল থেকে সব কথা শুনে থমকে গিয়েছে।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে গেল নোনাজল।আভা মলিন মুখে এগিয়ে এলো।পূর্ণতার দু’কাঁধ ধরে মলিন স্বরে বলে উঠলো,
– আসছি রে ভালো থাকিস।

ফুঁপিয়ে উঠলো পূর্ণতা।কষ্ট হচ্ছে তার!সে জানে কেন তার কষ্ট হচ্ছে।বাবা ছাড়া প্রথম যাকে বীরপুরুষ হিসেবে যাকে সে মানত সে তার বীরপুরুষ নয় বরং পরপুরুষ।আভা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে এলো।মুন্সি বাড়ির সকলে বেরিয়ে যেতেই পূর্ণতা বেরিয়ে আসে।কিছু না জানার ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করে মাকে,
– মা ওরা কেন এসেছিল?

তার মায়ের সহজ সরল জবাব,
– অভয়ের জন্য তোকে দেখতে।

– কি বললে?

– অভয় যদি বউ নিয়ে শহরে থাকত তবে ভেবে দেখতাম।কিন্তু ও এই অজপাড়াগাঁতে বউ রেখে যাবে।আর আমি আমার মেয়েকে গ্রামে বিয়ে দেব না।তাই না করে দিয়েছি।

পূর্ণতা পাংশুটে মুখে মলিন হাসে।শুঁকনো ঢোক গিলে নিজের ঘরে চলে যায়।

—————
– এখন কি আমাকে বউ পিছে পিছে নিয়ে সবজায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে নাকি?কাজ কাম কিছু করা লাগবে না?নাকি বউ কলে নিয়ে বসে থাকলে আমাকে প্রতিমাসে বাড়ি এসে বেতন দিয়ে যাবে।আগেই বলেছিলাম ঐ মেয়ের বাড়ি যেও না।এখন কি হলো?অন্যকোনো মেয়ে দেখো।এখন তো আমাকে যৌতুক দিলেও আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবো না।

প্রেমা কাচুমাচু মুখে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আজ ছেলের কথা শুনলে এত অপমানিত হতে হতো না।অভয় খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।প্রেমা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলের যাওয়ার পানে।আইরিন সংকোচ নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
– ভাবি একটা মেয়ে আছে।

প্রেমা যেন অন্ধকারে আলোর দিশারা খুঁজে পেল।উৎসাহিত স্বরে বলে উঠলো,
– কে কে?দেখতে কেমন?দোষ গুণ কিছু আছে?

– চলো সোফায় বসো বলছি।

প্রেমা এবং আইরিন বসার ঘরে ফেলা বড় সোফায় বসলো।দু’জনে খুব সতর্কতার সহিত গলা নামিয়ে কথা বলছে।যেন কেউ শুনলে কেলেংকারী হবে।

প্রতিদিনের মতো আজও আভা সোশ্যাল মিডিয়ায় “আফসিন রৌদ্র” নামের কাউকে খুঁজছে।প্রতিদিনের কাজ এটা তার।সে প্রতিদিন ঘুমানোর আগে একবার করে এই নাম লিখে সার্চ করে।যদি কোনো ক্রমে কখনো রৌদ্রের প্রফাইল চোখে বেঁধে যায়।কিন্তু আফসোস!এই তিন বছরে একাবারের জন্যও তার প্রফাইল দেখেনি আভা।আজ হতাশার শ্বাস ফেলে তন্দ্রাঘোরে বিভোর হয় আভা।

বেশ অনেকটা সময় অতিক্রম হলো সেদিনের এলোমেলো অনুভূতিগুলোর নাম খুঁজতে খুঁজতে।তিন তিনটা বছর কেটে গেল একটা শব্দের সত্যতা প্রমাণিত হতে।
আভা এখন আর তার ছিন্ন ভিন্ন অনুভূতিগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত নয়।সে জানে এগুলো কি?এগুলো হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি।ভালোবাসা!
আভা বর্তমানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে পড়ছে।প্রথম ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে এসেছে ছুটি কাটাতে।সে যে গণিত বিভাগে পড়ে তা শুনে প্রথমে অনেকেই চমকে যায়।আভা আর গণিত?দুইটা যেন আকাশ এবং পাতাল।প্রথমবার এমন চমকে দিয়েছিল এসএসসিতে গণিতে ঊননব্বই পেয়ে।সকলের চোখ ছানাবড়া। আর আভা?সে তো বিশাল খুশি।সেদিন তার খুশির বাঁধ ছিল না।

চলবে….#প্রিয়_বালিকা |১৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পুকুর ধারে দোলনায় বসে আছে “প্রিয় বালিকা”।তবে এখন সে আর বালিকা নেই।সে এখন যুবতী।শারীরিক পরিপক্বতার সাথে মানসিক পরিপূর্ণতা সবকিছুরই বিকাশ ঘটেছে।এমনকি অনুভূতিগুলোও হৃদয় জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে।হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠের শেষ অংশে ঠেকেছে।সেদিনের টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলোর নাম না জানা থাকলেও আজ সে নাম জানে।এই অনুভূতির কারণ জানে।কিন্তু যাকে নিয়ে অনুভূতিগুলো তাকে বলার জন্য সে নেই।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আভা।দোলনা মৃদু দুলছে।সেদিন রৌদ্র চলে যাওয়া বেশকিছু দিন পর সে পুকুর পাড়ে এসে বটগাছের সাথে এই দোলনাটা দেখতে পায়।ভিতরটা আরো ঢুকরে ওঠে তার।সে জানে এটি কে তৈরি করেছে।এরপর অনেকবার দোলনাটা বর্ষার দরুন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।কিন্তু যতবার নষ্ট হয়েছে ততবারই আভা এটাকে ঠিক করেছে।

– এই আভা চল।সবাই রেডি।

সেহরিনের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আভার।উঠে দাঁড়ায় সে।পরণে কালো থ্রি-পিস।অভয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে।অভয় গ্রাজুয়েশন শেষ করে দেশে ফিরেছে বছর খানেক।এখন মাস গেলে মোটা অঙ্কের বেতন পায় সে।সে শহরে থাকে ছুটি পেলে বাড়িতে আসে।এবার এসেছে বিয়ের উদ্দেশ্যে।তার পাত্রীর তালিকায় সর্বপ্রথম পূর্ণতার নাম।অভয় অবশ্য এ নিয়ে রাগারাগি করেছে।সে পূর্ণতাকে বিয়ে করতে চায়না।কিন্তু প্রেমার পছন্দের তালিকায় ছেলের জন্য পূর্ণতাকেই সকলের উপরে রেখেছে।আজ হঠাৎ করেই যাওয়া হচ্ছে তাদের বাড়িতে।এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পূর্ণতাসহ তার পুরো পরিবার রাজধানীতে চলে যায়।প্রেমা কোনোভাবে খবর পেয়েছেন তারা কিছুদিনের জন্য গ্রামে এসেছেন।তাই সে ছেলের বিয়ের কথা নিয়ে আজ পূর্ণতাদের বাড়িতে যাবেন।আভা ধীর পায়ে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় আসে।আজ আর ভাড়া করা মাইক্রোবাসে যাবেনা তারা।আজ তারা নিজেদের গাড়িতে যাবে।
সকলে একে একে বাসে উঠে বসলো।বাড়ির অধিকাংশ লোক যাচ্ছেন।শুধু যাচ্ছে না আইরিন এবং অভয়।
হরেক রকম মিষ্টি নিয়েছেন গাড়ির ডিঁকি ভরে।পূর্ণতা দরজা খুলে আভা এবং তার বাড়ির লোকদের দেখে চমকে গেল।বিস্ময় স্বরে বলে উঠলো,
– আভা?

আভা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
– কোমন আছিস?

পূর্ণতা দরজা থেকে সরে সবাইকে ভিতরে আসতে বলে।আভাকে আলিঙ্গন করে বলে,
– ভালো আছি তুই কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

পূর্ণতা মুন্সি বাড়ির সকলে দেখে ভ্রুকুটি করে।আভাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কিছু হয়েছে কিনা?সকলে হঠাৎ একসাথে?আভা কিছু না বলে পূর্ণতাকে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়।পূর্ণতা এবার নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না।

– কি হয়েছে রে?হঠাৎ বাড়ির সবাইকে নিয়ে?

আভা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– তোকে দেখতে এসেছি।

পূর্ণতা আভার কথা বুঝতে না পেরে বলে,
– মানে?

– ভাইয়ার জন্য তোকে দেখতে এসেছি।

– অভয় ভাইয়া?

– হ্যাঁ।

আকাশ থেকে পড়ে পূর্ণতা।এতো চমকিত সে জীবনে কখনো হয়নি।পূর্ণতা বড় বড় চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে আভার দিকে তাকিয়ে থাকে।আভার মুখের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক।পূর্ণতা পা টিপে টিপে দরজায় দেওয়া পর্দার আড়ালে দাঁড়ায়।তার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করছে।পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাহিরের কথপোকথন শোনার চেষ্টা করে।

প্রেমার সোজাসাপ্টা বাক্য,
– দেখুন পুরো পরিবার নিয়ে যখন এসেছি তখন তো বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই।আমার ছেলে অভয়ের জন্য পূর্ণতাকে নিতে চাই।

কুশল বিনিময় আপ্যায়ন শেষে প্রেমা এমন কোনো কথায় বলবে তা আগেই অনুমান করেছিল পূর্ণতার মা।প্রেমার কথায় সে আমতা আমতা করে ইনিয়েবিনিয়ে বলে,
– দেখুন আমি বলছিনা অভয় ছেলে হিসেবে খারাপ।কিন্তু আমার মেয়েও যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন।তাছাড়া ও কত ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।তাই আমি ওকে এখন মানে এই মুহুর্তে বিয়ে দিতে চাইছি না।

পূর্ণতার মায়ের কথায় বেজার হলেন প্রেমা।মুখে নেমে এলো কালো মেঘ।তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলেন,
– দেখুন আমরা অভয়ের পাত্রীর তালিকায় পূর্ণতাকে সকলের উপরে রেখেছি ওর সকল যোগ্যতা বিশ্লেষণ করেই।অভয়ও পাত্র হিসেবে খারাপ নয়।বিদেশ থেকে পড়ালেখা করে এসেছে।

পূর্ণতার মা সন্দিহান স্বরে বলেন,
– অভয় কি বিয়ের পর বউ নিজের সাথে করে নিয়ে যাবে শহরে?নাকি এখানে আপনাদের সাথে থাকবে?

প্রেমা আমতা আমতা করে বলেন,
– অভয় তো চায় ওর বউ ওর পরিবারের সকলের সাথে থাকুক।

পূর্ণতার মা এবার শক্ত কন্ঠে বলেন,
– মাফ করবেন বোন আমি আমার মেয়েকে এই মুহুর্তে বিয়ে দিতে চাইছিনা।আশা করি অপরাধ নিবেন না।

এতো বোঝানোর পরেও এমন বাক্য অপমান করল মুন্সি বাড়ির লোকদের।প্রেমা আর একমুহূর্তে বসতে পারলেন না সেখানে।মৃদু গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লেন আভার উদ্দেশ্যে,
– আভা আভা।

আভাও এতোক্ষণ সব শুনেছে।পূর্ণতা পর্দার আড়াল থেকে সব কথা শুনে থমকে গিয়েছে।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে গেল নোনাজল।আভা মলিন মুখে এগিয়ে এলো।পূর্ণতার দু’কাঁধ ধরে মলিন স্বরে বলে উঠলো,
– আসছি রে ভালো থাকিস।

ফুঁপিয়ে উঠলো পূর্ণতা।কষ্ট হচ্ছে তার!সে জানে কেন তার কষ্ট হচ্ছে।বাবা ছাড়া প্রথম যাকে বীরপুরুষ হিসেবে যাকে সে মানত সে তার বীরপুরুষ নয় বরং পরপুরুষ।আভা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে এলো।মুন্সি বাড়ির সকলে বেরিয়ে যেতেই পূর্ণতা বেরিয়ে আসে।কিছু না জানার ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করে মাকে,
– মা ওরা কেন এসেছিল?

তার মায়ের সহজ সরল জবাব,
– অভয়ের জন্য তোকে দেখতে।

– কি বললে?

– অভয় যদি বউ নিয়ে শহরে থাকত তবে ভেবে দেখতাম।কিন্তু ও এই অজপাড়াগাঁতে বউ রেখে যাবে।আর আমি আমার মেয়েকে গ্রামে বিয়ে দেব না।তাই না করে দিয়েছি।

পূর্ণতা পাংশুটে মুখে মলিন হাসে।শুঁকনো ঢোক গিলে নিজের ঘরে চলে যায়।

—————
– এখন কি আমাকে বউ পিছে পিছে নিয়ে সবজায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে নাকি?কাজ কাম কিছু করা লাগবে না?নাকি বউ কলে নিয়ে বসে থাকলে আমাকে প্রতিমাসে বাড়ি এসে বেতন দিয়ে যাবে।আগেই বলেছিলাম ঐ মেয়ের বাড়ি যেও না।এখন কি হলো?অন্যকোনো মেয়ে দেখো।এখন তো আমাকে যৌতুক দিলেও আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবো না।

প্রেমা কাচুমাচু মুখে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আজ ছেলের কথা শুনলে এত অপমানিত হতে হতো না।অভয় খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।প্রেমা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলের যাওয়ার পানে।আইরিন সংকোচ নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
– ভাবি একটা মেয়ে আছে।

প্রেমা যেন অন্ধকারে আলোর দিশারা খুঁজে পেল।উৎসাহিত স্বরে বলে উঠলো,
– কে কে?দেখতে কেমন?দোষ গুণ কিছু আছে?

– চলো সোফায় বসো বলছি।

প্রেমা এবং আইরিন বসার ঘরে ফেলা বড় সোফায় বসলো।দু’জনে খুব সতর্কতার সহিত গলা নামিয়ে কথা বলছে।যেন কেউ শুনলে কেলেংকারী হবে।

প্রতিদিনের মতো আজও আভা সোশ্যাল মিডিয়ায় “আফসিন রৌদ্র” নামের কাউকে খুঁজছে।প্রতিদিনের কাজ এটা তার।সে প্রতিদিন ঘুমানোর আগে একবার করে এই নাম লিখে সার্চ করে।যদি কোনো ক্রমে কখনো রৌদ্রের প্রফাইল চোখে বেঁধে যায়।কিন্তু আফসোস!এই তিন বছরে একাবারের জন্যও তার প্রফাইল দেখেনি আভা।আজ হতাশার শ্বাস ফেলে তন্দ্রাঘোরে বিভোর হয় আভা।

বেশ অনেকটা সময় অতিক্রম হলো সেদিনের এলোমেলো অনুভূতিগুলোর নাম খুঁজতে খুঁজতে।তিন তিনটা বছর কেটে গেল একটা শব্দের সত্যতা প্রমাণিত হতে।
আভা এখন আর তার ছিন্ন ভিন্ন অনুভূতিগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত নয়।সে জানে এগুলো কি?এগুলো হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি।ভালোবাসা!
আভা বর্তমানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে পড়ছে।প্রথম ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে এসেছে ছুটি কাটাতে।সে যে গণিত বিভাগে পড়ে তা শুনে প্রথমে অনেকেই চমকে যায়।আভা আর গণিত?দুইটা যেন আকাশ এবং পাতাল।প্রথমবার এমন চমকে দিয়েছিল এসএসসিতে গণিতে ঊননব্বই পেয়ে।সকলের চোখ ছানাবড়া। আর আভা?সে তো বিশাল খুশি।সেদিন তার খুশির বাঁধ ছিল না।

চলবে….

#প্রিয়_বালিকা |১৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

অভয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে খুব ঘটা করে।এ পর্যন্ত চারজনকে দেখে ফেলেছে।তারমধ্যে তিনজন অনেক বেশি বাচাল।আরেকজন ঠিকই ছিল।তবে অভয়ের সাথে আলাদা কথা বলতে গিয়ে কি হলো কে জানে?ফিরে এসে মেয়ে ধ্বংস যজ্ঞ শুরু করে দিলো।মুখে একটাই কথা এই ছেলেকে সে নাকি মরে গেলেও বিয়ে করবে না।পাত্রীর এমন উগ্র ব্যবহারে মুন্সি বাড়ির লোকেরা লজ্জায় অপমানে প্রাণহাতে নিয়ে পালিয়ে বাঁচে। মুখোমুখি বসে আছে আভা এবং অভয়।আভা রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভয়ের দিকে।অভয় ভোঁতা মুখে মাথা নিচু করে বসে আছে।আভা রাগি স্বরে বলে,
– এই ভাইয়া তুমি কি বলেছ ঐ মেয়েটাকে?ও তোমার সাথে আলাদা কথা বলার পর এমন করল কেন?

অভয় অবুঝ স্বরে বলে,
– আমি তো কিছুই বলিনি।আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি আপনার আসল গায়ের রং কোনটা হাতেরটা নাকি মুখেরটা?বুঝলাম না এমন করলো কেন?আমি তো জাস্ট হাতের আর মুখের রং ভিন্ন দেখে কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম।তাতে এতো রাগ করার কি হলো?আমার মনে হয় মেয়েটার মাথায় সমস্যা।

আভার ঠোঁট আলগা হয়ে গেল।পরমুহূর্তেই কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
– চুপ!এই কথা তুমি পাত্রী দেখতে গিয়ে বলেছ?তোমাকে ধরে পে’টায়নি সেটাই আমাদের সৌভাগ্য।তুমি জানো একটা মেয়ের কাছে মেকাপ মানে আবেগ,ভালোবাসা,প্রেম সবকিছু।সে করছে নাহয় একটু মেকাপ তাই বলে তুমি তাকে এই কথা বলবে?

অভয় ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
– আরে বললাম তো আমি কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম যে মেয়েটার আসল গায়ের রং কোনটা।মুখেরটা নাকি হাতেরটা।তাই জিজ্ঞেস করেছি।

– গো’বর বু’দ্ধি যাকে বলে একটা।নাহ্ আর তোমাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাওয়া যাবে না।আমাদের দুর্ভাগ্য যে তুমি একটা এবন’রমাল।

অভয় কষে একটা চর বসিয়ে দিলো আভার মাথায়।সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল আভা।নিজেও অভয়ের পিঠে দিয়ে দিলো দু ঘাঁ।শুরু হয়ে গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।দু’জন দু’জনকে চর, খামচি, ঘুষি,লাথি যা পারছে তাই দিয়ে যাচ্ছে।এর মধ্যে আভা একদলা থুতু ছুঁড়ে দিলো অভয়ের গায়ে।অভয় নাঁক মুখ কুঁচকে কটমট চোখে তাকিয়ে রইলো আভার দিকে।আভা জোরে জোরে চিৎকার করছে আর নিজের মাকে ডাকছে,
– আম্মু আম্মু ও মা মা!

অভয় এবার আভার ঘাড় ধরে নিচ করে আভার পিঠে কনুই দিয়ে আঘাত করে।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– আমি তোর বড় ভাই আমাকে এ’বনরমাল বলিস বেয়াদ’ব।খ’য়রাতি মেয়ে।আজকে তোকে হাড়ে হাড়ে বোঝাবো আমার সাথে বেয়াদ’বি করার মজা।

আভা এখনো “মা মা” করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।প্রেমা ছেলে মেয়েদের এমন কিচিরমিচির শুনে বিরক্ত হয়ে ছুটে এলেন।দুইজনকে মা’রামা’রি করতে দেখে রেগে গেলেন।আভাকে অভয়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে বলেন,
– এই তোরা কি শুরু করেছিস এই ভরদুপুরে?বুড়ো বয়সে এইসব করছিস?তোদের থেকে তো তিন্নি আর মিন্নি ভালো।অন্তত এভাবে শেয়াল কুকুরের মতো করে না।অস’ভ্য দু’টো।

অভয় এবং আভা দুজন এখনো একে অপরের দিকে তেড়ে আসছে।ফোঁস ফোঁস করে চলেছে উভয়।অভয় রাগি স্বরে বলল,
– তোমার মেয়ে একটা বেয়া’দব হইছে আমাকে বলে আমি নাকি এবনরমাল?তুই এবনরমাল খ’য়রাতি।তোর মাথায় একটা চুলও যেন না থাকে।সব পড়ে যেন ছাফায় হয়ে যায়।

– ভাইয়া আমার যদি একটা চুলও পড়ছে তাহলে তোমার খবর আছে।তোমারেও টাকলু করে দিবো।

– ম’র খ’য়রাতি!

আভা কিছু বলতে যাবে প্রেমা ধমক দিয়ে উঠল,
– এই চুপ একটা কথাও বলবি না।অভয় যা এখান থেকে নিজের ঘরে যা।

আভা জিহ্বা বের করে অভয়কে ভেংচি দিলো।অভয় হাতে ইশারায় কিছু বাঁধার ভঙ্গি করলো।আভা বুঝতে পারল তার জিহ্বা বাঁধার কথা বলেছে অভয়।তা বুঝে আভা আরো বেশি জিহ্বা নাড়াতে শুরু করল।অভয় বেরিয়ে গেল।প্রেমা আভার দিকে চোখ রাঙিয়ে সেও বেরিয়ে গেলেন।বিছানায় অভয়ের ফোনটা দেখা গেল।আভা কিছু একটা ভেবে ফোন অন করে।ফোনে করো লক নেই।তা দেখে ভিতরে ভিতরে তার মন লাফিয়ে ওঠে।সে চটজলদি কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকে পড়ে।সেখানে একজনের নম্বর সে মরিয়া হয়ে খোঁজে।কিছুক্ষণ স্ক্রল করার পর দেখা গেল একটি নম্বর “রৌদ্র” নামে সেভ করা।আভা টপাটপ সে বিদেশি নম্বর নিজের ফোনে টুকে নেয়।কি নামে সেভ করবে তা নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দে ভোগে।হঠাৎই কিছু মনে পড়তেই দ্রুততার সহিত ফোনের কিবোর্ডে আঙুল চালায়।সেভ করে ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে “লাভ” নামে।কিছুক্ষণের মধ্যে অভয় আবার ফিরে এলো।আভার দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিছানার উপর ফেলা নিজের ফোনটা ঝটকা দিয়ে নিয়ে চলে গেল।আভা চুপচাপ অবুঝের মতো বসে রইলো।যেন এ পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কোনো নিষ্পাপ ব্যক্তি নেই।অভয় যেতেই আভা দ্রুত নম্বরটিতে কল করলো।দুইটি ভাষায় একটি মেয়ে বলল নম্বরটি ব্যস্ত আছে।একবার ইংরেজিতে বলল এবং একবার বাংলায়।অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ লোক ইংরেজি ভাষায় কথা বলায় মেয়েটি ইংরেজিতেই প্রথমে বলল।আভা কল কেটে দিয়ে আবারও কল করল।এবার রিং হলো।কিছুক্ষণের মধ্যে কল রিসিভও হলো।অপর পাশ থেকে শোনা গেল এক যুবকে পরিপক্ব ভারি কন্ঠস্বর,
– হ্যালো।আফসিন রৌদ্র স্পিকিং।হু ইজ দিস?

থমকে গেল আভা।টানা তিনটা বছর পর এই কন্ঠস্বর শুনছে সে।আভার মনে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত অনুভূতিগুলো জাগ্রত হলো।চোখ ভরে উঠলো নোনাজলে।শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পেল।সে বুকের বাম পাশে হাত ঠেকিয়ে অনুভব করল হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক আচারণ।ঢোক গিলে নিলো আভা।রৌদ্র কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আবারও বলল,
– হ্যালো!হু ইজ দিস?বাংলাদেশি নম্বর।অভয় নাকি?

আভা জোরে একটি শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করে ফেলল।কান থেকে ফোন নামিয়ে কল কেটে দিলো।ফোনে রেকর্ড হওয়া রৌদ্রের কন্ঠ বার বার চালু করে শুনল।পন করল সে আর রৌদ্রকে কল করবে না।এই কন্ঠস্বরের ভার সে হাজার মাইল দূর থেকে বয়তে পারবে না।

বেশকিছুদিন পাড় হলো।অবশেষে অভয়ের জন্য পাত্রী পাওয়া গেল।বিয়ের তারিখ ঠিক হলো আগামী মাসের পনেরো তারিখ শুক্রবার।আভা তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে রৌদ্রকে আর কল করেনি।অগণিতবার ফোনে রেকর্ড হওয়া রৌদ্রের কন্ঠস্বর শুনে মুচকি মুচকি হেসেছে।মনে যে রৌদ্রকে কল করার কথা নাড়া দেয়নি তা নয় বরং যতবার নাড়া দিয়েছে সে কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকে রৌদ্রের নম্বরটি সিলেক্ট করেছে।আবারও ফিরে এসেছে।কল করা হয়নি।মনকে শান্ত করতে রৌদ্রের ভয়েস শুনেছে একাধিকবার।

বাড়ির একপাশ পরিষ্কার করা হচ্ছে।কারন আগামীকাল থেকে অভয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে।একপাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে অভয়।এই মুন্সিবাড়ির কিছু অংশের ব্যক্তিগত মালিক সে।নিজের টাকায় কিনেছে সে।সে চলে যাওয়ার পর একমাসের মাথায় তার দাদি মারা যান।তারপর মুন্সিবাড়ির সকল সম্পত্তি ভাগ হয়।সেখান থেকেই মুনৃসিবাড়ির মেঝো ছেলে নিজের ভাগ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।অভয় ফিরে আসে।মুলত তার ফিরে আসার কারণ জায়গা বিক্রি ঠেকানো।সে ফিরে আসে মেঝো চাচার সম্পত্তি কিনে নেওয়া সিদ্ধান্ত নেয়।সেদিন সকল সম্পত্তি কেনার পর মেঝো চাচার মুখোমুখি হয়ে সে শক্ত কন্ঠে বলে,
– আমার দাদা সম্পত্তিতে কোনো বাইরের মানুষকে ঢুকতে দেব না।দাদার ঘাম রক্ত করে এইসব গড়া।আপনার মায়া নাই বা থাকতে পারে আমার আছে।আমি আমার দাদার সম্পত্তি এভাবে ধ্বংস হতে দেব না।

নিজের ছেলের জন্য গর্বে সেদিন আরাভ সাহেবের ছাতি ফুলে উঠেছিল।ছল ছল চোখের কোণায় জমা জলের বিন্দুকণা বৃদ্ধ আঙুলের সাহায্যে মুছে নিঃশব্দে প্রস্থান করেন তিনি।ছেলে তার বড় হয়েছে।শুধু বড় হয়নি অনেক বড় হয়েছে।

চলবে….

#প্রিয়_বালিকা |১৫|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

একমুঠো গাঢ় লাল রং মুখে এসে পড়তেই পা থেমে গেল রৌদ্রের।চোখ বন্ধ করে ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।বমাপাশে গলা থেকে চুল সর্বাঙ্গ লাল রঙে জ্বল জ্বল করছে।শুভ্র পাঞ্জাবিতে ফাঁপা পেশিবহুল পুরুষ।শুভ্রমুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির একাংশ লালরঙে আবৃত।শুভ্র পাঞ্জাবিটারও বামদিকের বুকের অংশ আবিরে জুবুথুবু।রৌদ্র ধীর গতিতে চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে চমকে উঠলো।তার সামনেই লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিহিত যুবতী ঠোঁট প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে।এলোমেলো মৃদু কোঁকড়ানো চুলগুলোর কিছু অংশ পিঠে আবার কিছু অংশ বুক ছাড়িয়ে পেট ছুঁয়েছে।রৌদ্র নিজের শিকারী দৃষ্টি ফেলল যুবতীর চোখে।যুবতী আজ সে দৃষ্টি উপেক্ষা করল না বরং এক দৃষ্টিতে তার চোখে তাকিয়ে রইলো।নিঃশব্দে পাড় হলো কিছু সময়।তবু দু’জনের পলক থমকে রইলো।দু’জনের কেউই ভুলেও একবারের জন্য পলক ফেলল না।রৌদ্র মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে অস্পষ্ট উচ্চারণে একটি নাম বলে,
– আভা!

যুবতীর ঠোঁটের হাসি আরো প্রগাঢ় হয়।আড়পারে পরা শাড়িটিতে যুবতীকে দেখতে যেন কোনো জাদুকরীর মতো লাগছে।চোখের গাঢ় কালো কাজল টানা টানা চোখদুটোকে নেশাক্ত করে তুলেছে।পাতলা ঠোঁট দু’টো লাল রঙে আবৃত।সহসা আভা দৌড়ে চলে গেল বিয়ের ভেন্যুতে করা স্টেজে।চারপাশটা লাল সাদা ফুল আর সোনালী আলোই সজ্জিত।আভা স্টেজে উঠে দাঁড়াতেই বড় বড় দু’টি বক্সে একসাথে গান বেজে উঠলো,”তুম জো আয়ে জিন্দেগী মে বাত বান গায়ে!”
গানের তালে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে নাচে আভা।রৌদ্রের অবস্থান এখনো পূর্বের মতো।সে এখনো কোনো ঘোরের মধ্যে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।আচমকা কেউ এসে তাকে জরিয়ে ধরে।তার ভ্রম কাটে তবে আভার থেকে দৃষ্টি ফেরে না।অভয় রৌদ্রকে জরিয়ে উৎফুল্ল স্বরে বলে,
– বিশ্বাস কর তুই যদি না আসতি আমি বিয়েই বসতাম না।

রৌদ্র আভার দিকে দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,
– ওটা কে?

অভয় ভ্রু কুঁচকে রৌদ্রকে ছেড়ে দেয়।তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আভার দিকে তাকায়।মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বলে,
– আমার একমাত্র খ’য়রাতি বোন।যার পাকামোতে কিনা এইসব কালার ফেস্ট মেস্ট এরেঞ্জ করা হয়েছে।

রৌদ্র অবাক চোখে আভার দিকে তাকিয়ে রইলো।যেন সে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেলেছে।শুঁকনো ঢোক গিলে সে।বুকের ধুকপুকানিটা অস্বাভাবিক হাড়ে বেড়ে চলেছে।এটা আভা?সত্যিই আভা?সেই ছোট চুলে ঝালর দেওয়া ফ্রক পড়ে সাইকেল চালিয়ে বেড়াতো সেই আভা?রৌদ্র পর পর কয়েকটা ঢোক গিলে নিলো।অভয় রৌদ্রের পাঞ্জাবি থেকে রং ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলে,
– আসার পর কিছু খেয়েছিস?

মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় রৌদ্র।সে এসেছে আরো তিনঘন্টা আগে।প্রাণপ্রিয় বন্ধুর বিয়ে বলে কথা না এসে কি আর পারা যায়?তাই চলেই এলো বন্ধুর বিয়ে খেতে।রৌদ্র অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চলে এলো ভেন্যু থেকে।ওয়াশরুমে ঢুকে মুখে পানির ঝাপটা দিলো।চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো আভার স্থির চোখের মণি।ঐ চোখ কি যেন বলে গেল তাকে।কিন্তু সে যেন বুঝেও বুঝল না।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মৃদু ধাক্কা খেল কোনো মেয়েলী শরীরের সাথে।নিচু স্বরে বলে উঠলো,
– এসকিউজ মি সিস!

তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো মেয়েটি,
– ইউ আ’র এসকিউজড!বাট আ’ম নট ইওর সিস!

থেমে গেল রৌদ্র।চোখ তুলে তাকিয়ে আভাকে দেখে হয়ে পড়লো।আভা মিষ্টির তালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সে প্রধানত রৌদ্রকেই মিষ্টি দিতে এসেছে মায়ের আদেশে।আভাকে দেখে রৌদ্র আমতা আমতা করে বলে,
– তুমি?

আভা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– আপনার সেই “প্রিয় বালিকা”।

চমকে ওঠে রৌদ্র।আজ তার গলাটায় খরা চলছে।পর পর ঢোক গিলে শুষ্ক গলা ভেজানোর চেষ্টা করে সে।আভা গভীর দৃষ্টিতে রৌদ্রকে পর্যবেক্ষণ করে।রৌদ্রকে দেখে আগে বয়স বোঝা যেত না।এখন স্পষ্ট বয়সের ছাপ তার সর্বাঙ্গে।সে এখন পরিপূর্ণ যুবক।মুখে ছোট দাঁড়িও দেখা যাচ্ছে।সবকিছুর পরিবর্তন হলেও তার সেই চাহনি পরিবর্তন হয়নি।তবে এখন আর আভার বুক কাঁপে না এ চাহনিতে বরং অন্যরকম অনুভূতির জন্ম নেয়।পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর চাহনি বুঝি এই যুবকের।রৌদ্র আভাকে এভাবে পরখ করতে দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
– কেমন আছো?

– আমার গিফট?

চট করে করা আভার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল রৌদ্র।বুঝে উঠতে পারল না আভা কিসের কথা বলছে।জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আভার দিকে।আভা রৌদ্রের এমন দৃষ্টিতে বলে,
– আগের বার তো জানতেন না অভয়ের ছোট বোন আছে।এবার তো জানতেন এবার আমার গিফট কোথায়?

তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রৌদ্র।কি বলবে সে?এমারজেন্সি ফ্লাইটে এসেছে সে।তাই কারো জন্যই সেভাবে কিছু আনতে পারিনি।শুধু আভার মা-বাবা জন্য কিছু এনেছে।আর ঠিক করেছে অভয়ের গিফটটা এখান থেকে কিনে দিয়ে দিবে।রৌদ্র আমতা আমতা করল।আভা মুখ বাঁকিয়ে গোমড়া মুখে বলল,
– থাক গিফট লাগবে না।আম্মু আপনাকে এটা দিতে বলল।আর কোনো সুবিধা অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন।কারণ ভাইয়া তো এখন বিজি ভাইয়ার বিয়ে তাই আমাকেই জানাবেন কেমন?

আভা বেরিয়ে আসবে সহসা রৌদ্র কি মনে করে বলে উঠলো,
– আভা…কেমন আছো তুমি?

মুচকি হাসে আভা।মুখে হাসি নিয়েই পিছন ঘুরে তাকায়।রৌদ্রের চোখে চোখ রেখে বলে,
– আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আর জানতে চায়বেন না।

রৌদ্র লাজুক ভঙ্গিতে ঠোঁট প্রসারিত করে মাথায় হাত দিলো।রৌদ্রের ঠোঁটের দুইপাশ ঘেঁষে তৈরি হওয়া অতি ক্ষুদ্র টোলদ্বয় দাঁড়ি ভেদ করে দৃশ্যমান হয়।এই প্রথম সেই অসম্ভব সুন্দর ভাঁজ চোখে পড়ে আভার।থমকে যায় সে।আনমনা স্বরে উত্তর করে,
– ভালো না।আপনি?

আভার উত্তরে রৌদ্র ভ্রুকুটি করে।জিজ্ঞেস করে,
– ভালো না কেন?

আভা উদাস ভঙ্গিতে বলে,
– বড় একটা রোগে আক্রান্ত আমি।কোনো চিকিৎসক আমার রোগ শনাক্ত করতে পারছে না।

রৌদ্রের মুখে চিন্তার চাপ ফুটে উঠে।কিছুটা উদ্বেগ স্বরে বলে,
– কি বলছ?কি এমন কঠিন রোগ যা কোনো চিকিৎসক শনাক্ত করতে পারছে না।বাসার সবাইকে জানিয়েছ?

আভা পূর্বের ভঙ্গিতে বলে,
– বাসার সবাইকে বলে কি হবে?চিকিৎসকই রোগ শনাক্ত করতে পারছে না তাহলে বাসার সবাই জেনে কি হবে?

রৌদ্র ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– তাহলে আমার সাথে চলো অস্ট্রেলিয়া তোমাকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে দিবো।

আভা মুচকি হাসে।সে যেন রৌদ্রের থেকে এমন কোনো বাক্যই আশা করেছিল।আশানুরূপ ফল পেয়ে ভিষণ আনন্দিত হলো।সে ঠোঁটে হাসি স্থির রেখে বুকে হাত গুঁজে হেয়ালি স্বরে বলে,
– অস্ট্রেলিয়ার ডাক্তার কেন?পৃথিবীর কোনো ডাক্তারই এই রোগ নিরাময় করতে পারবে না।এ হলো মহামারীর মতো বুঝেছেন তো?এর কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই।এটা শক্তিশালী ছোঁয়াচে রোগ।এখন আমার হয়েছে কিছুদিন পর আপনারও হবে।শুধু ধৈর্য্য ধরে দেখতে থাকুন।

আভা বেরিয়ে গেল।রৌদ্র আভার কথাগুলো সাজিয়ে তার সারমর্ম বোঝার চেষ্টা করল।বিড় বিড় করে বলল,”ছোঁয়াচে রোগ?আমারও হবে?কিহ্?আমারও হবে?না না যে রোগের কোনো ওষুধ নেই তা যেন আমার না হয়।না জানি কত ভয়ংকর রোগ!”

অভয়ের জন্য একটি সুশীল সুন্দরী পাত্রী ঠিক করা হয়েছে।একক পরিবারে মেয়ে মেয়ের বাবা-মা ছাড়া কেউ নেই।তারা অভয়ের যোগ্যতা বিবেচনা করে আর না করতে পারিনি।মেয়ে অনার্স মাস্টার্স পাশ।ভালো রেজাল্ট নিয়েই পাশ করেছে।আপাতত চাকরি বাকরি নিয়ে কিছু চিন্তা ভাবনা করেনি।অভয়ও মনে মনে চায় তার বউ চাকরি না করুক।তবে করলেও তাতে তার কোনো অসুবিধা নেই।মেয়েটির নাম অহনা।এই কয়েকদিনে অভয়ের সাথে বেশ ভালোই খাতির হয়েছে তার।মধ্যরাত পর্যন্ত ফোনে প্রেমালাপ।এছাড়াও লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা সাক্ষাৎ তো আছেই।সব মিলিয়ে অভয়ের জীবন এখন রং ধনুর মতো সাত রঙে রাঙানো।অভয়ের ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল আভা।হঠাৎ শুনতে পেল অভয়ের ন্যাকা স্বরে বলা কিছু বাক্য,
– না না আমি মানবো না জানু।কাল আমাদের গায়ে হলুদ এখনো তুমি আমার সাথে কথা বলতে এতো লজ্জা পাও?তুমি যদি এখন আমাকে চু’মু না দেও তাহলে আমি আজকে রাতে ভাতই খাবো না।অনশনে বসবো আমি।তারপর হাতে স্যালাইন লাগিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে যাবো।

আভার দুই ঠোঁট আলগা হয়ে গেল।তখনই অভয়কে নিচে গাণ্ডেপিণ্ডে খেতে দেখল এখন কিনা বলছে ভাত খাবে না অনশনে বসবে?আভা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠলো,
– ঐ জানু তোমাকে তো তখন নিচে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে দেখলাম ঐগুলো কোনবেলার খাবার ছিল?

আভা একটু জোরেই বলল।যাতে অহনাও শুনতে পায়।অহনা আভার কথা শুনে শব্দ করে হেসে দেয়।অভয় রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আভার দিকে।অহনা কিছু না বলেই কল কেটে দেয়।অভয় ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
– এই খ’য়রাতি তুই আমার আর আমার বউয়ের কথার মধ্যে ঠ্যাং ঢুকাচ্ছিস কেন?আর তোর সাহস তো কম না আমার বউয়ের সামনে আমাকে অপমান করিস কালকের মা’রটা কি ভুলে গিয়েছিস?

আভা আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না।দৌড়ে সরে গেল অভয়ের ত্রিসীমানার বাইরে।এখন এখানে দাঁড়ানো মানে পিঠের ছাল চামড়া আলগা হয়ে যাওয়া।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |১৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সন্ধ্যার পর থেকে অভয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান।ছেলে মেয়ে দু’জনের একসাথে গায়ে হলুদ হবে অভয়দের বাড়িতে।মুন্সিবাড়ির একপাশেই বিশাল বড় বাগান পরিষ্কার করে বিয়ের ভেন্যু তৈরি করা হয়েছে।গতকাল কালার ফেস্টিভ্যাল করা হয়েছিল আভার আবদারে।আজ আবারো ডেকোরেশন পরিবর্তন করে হলুদের ডেকোরেশন করা হয়েছে।
আভার কেনাকাটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।তাই সে সকাল থেকে মায়ের সাথে পিড়াপিড়ি করে চলেছে যাতে সে একবার মার্কেটে যেতে পারে।তার মাও নাছোড়বান্দা সেও মেয়েকে কিছুতেই একা ছাড়বে না।এদিকে অভয়, সূর্য,আরাভ বাড়ির সকল ছেলেরা বিয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত।আর মার্কেট করতে যেতে হলে আভাকে শহরে যেতে হবে।দেড়ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে একা মার্কেটে প্রেমা তার মেয়েকে কিছুতেই যেতে দিবেন না।আভাকে ছুটিতে ভার্সিটি থেকে বাড়ি নিয়ে আসে অভয় বা তার বাবা।ছুটি শেষ হলে আবার দিয়ে আসে।সেখানেও আভার দেখাশোনা করে অভয়।একা একা কোথাও যাওয়া হয়না তার। বাড়ির মেয়েরাও কনেপক্ষের জিনিসপত্র সাজাতে ব্যস্ত।
প্রেমা একবার রান্নাঘর তো একবার বসার ঘর যাচ্ছে।আবার কখনো উপরে ছেলের কাছে যাচ্ছে তো কখনো সাজানো গোছানো তদারকি করছে।পিছন আভাও আছে।সে এক সুরে গান গেয়েই চলেছে,
– ও আম্মু আম্মু যাইনা প্লিজ কিছু হবে না।এই যাবো তো এই আসবো।প্লিজ যাই।

প্রেমা থেমে গেলেন।রাগি কন্ঠে বললেন,
– বললাম তো না।

আভা ভোঁতা মুখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।কিছু একটা ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখল রৌদ্র সোফায় বসে ফোন স্ক্রোল করছে।আভা তার মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় রৌদ্রকে দেখায়।প্রেমা বুঝতে পারেনা তার মেয়ে কি বলতে চায়ছে।আভা আবারও রৌদ্রের দিকে ইশারা করে।প্রেমা বিরক্ত হয়ে উচ্চ স্বরে বলে,
– বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে গিয়েছিস নাকি।চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি বলছিস?মুখে বল।

আভা থতমত খেয়ে মায়ের হাত চেপে ধরে।প্রেমার উচ্চ স্বরে বলা কথায় রৌদ্র একপলক তাদের দিকে তাকিয়ে দেখে।আভা রৌদ্রকে তাকাতে দেখে মেকি হাসে।মাকে নিয়ে একটু সরে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– আহ্ আম্মু আস্তে কথা বলো।

প্রেমা রাগে কটমট করে বলে,
– কি বলছিস মুখে বলতে পারিস না?

আভা আমতা আমতা করে বলে,
– উনি তো চুপচাপ বসে ফোন চালাচ্ছে ওনাকে আমার সাথে যেতে বলো।

– কিহ্? রৌদ্র?ও মেহমান মানুষ এখন ওকেও কাজে লাগিয়ে দিবো?

আভা টিটকারি করে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– প্রাণপ্রিয় বন্ধুর বিয়েতে এসেছে কাজ করবে না?

– তুই চুপ কর।

– প্লিজ আম্মু ওনাকে একটু বলো না আমার সাথে যেতে।

প্রেমা কিছুক্ষণ ভেবে দেখলেন এছাড়া আর কোনো উপায় তার কাচে নেই।সে সংকোচ নিয়ে এগিয়ে এলেন রৌদ্রের কাছে।প্রেমাকে নিজের সামনে দেখে ফোন পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ায় রৌদ্র।ভ্রুকুটি করে বলে,
– কিছু বলবেন আন্টি?

প্রেমা সংকোচ দ্বিধা দ্বন্দ নিয়ে বলে,
– ইয়ে মানে আসলে আব্বু হয়েছে কি আভার শপিং এখনো শেষ হয়নি।তাই ও একটু মার্কেটে যেতে চায়ছিল।জানোই তো মার্কেট এখান থেকে কত দূরে সেই শহরে।তাই বলছি তুমি যদি ওর সাথে একটু যাও।

– আ আমি?আচ্ছা ঠিক আছে।

রৌদ্র আভাকে আড় চোখে দেখল।আভা মুখে ফুটে ওঠে হাসি।সে নাচতে নাচতে ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসে।রৌদ্র এখনও সোফাতেই বসে আছে।হয়তো তার অপেক্ষা করছে।আভা রৌদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে গলা ঝাড়ে।রৌদ্র চোখ তুলে আভাকে একঝলক দেখে।আকাশি ও সাদা রঙের একটি সিল্কের থ্রি-পিস পরেছে সে।উঠে দাঁড়ায় রৌদ্র রওনা হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

– আমরা প্রথমে পূর্ণতাদের বাড়িতে যাবো।ওদের বিয়ের কার্ডটা দিয়ে তারপর।বাস স্ট্যান্ডে।

আভার কথায় রৌদ্র মুখে কোনো জবাব দিলো না।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।আভার রাগ হলো রৌদ্রের এরূপ আচারণে।তবু সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পুলকিত স্বরে বলে উঠে,
– আচ্ছা আপনার আমাকে মনে পড়েছে সিডনি যাওয়ার পর?

রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে দেখে।এবারও কোনো জবাব দেয় না।আভা ঠোঁট চেপে হেসে রৌদ্রের দিকে এগিয়ে আসে।গলার স্বর নামিয়ে বলে,
– আমার কিন্তু আপনাকে অনেক মনে পড়েছে।

থমকে গেল রৌদ্র।আসা থেকে আভার কথাবার্তা কেমন যেন লাগছে তার।আগে তো তার সামনে আসতেও আভার কত সংকোচ ছিল।তার দিকে তাকিয়ে কখনো কথা বলেনি।এখন চোখে চোখ রেখে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে।হেসে হেসে কত কথা বলে।আভার এমন আচারণে রৌদ্র বেশ অবাকই হচ্ছে।রৌদ্র গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে,
– আমি এখন আর সিডনিতে থাকি না।বেলারাতে থাকি পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য ইউনিভার্সিটি চেঞ্জ করেছি।

– পোস্ট গ্রাজুয়েশন এখনো শেষ হয়নি?

– হ্যাঁ শেষ।

– কোন ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন?

– ফেডারেশন ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া।

– আচ্ছা।

পূর্ণতাদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে আভা।কিছুক্ষণ পর পূর্ণতার মা দরজা খোলে।আভা মিষ্টি হেসে কুশলাদি বিনিময়ের পর কার্ডটি এগিয়ে দিয়ে বলে,
– আন্টি আজ ভাইয়ার রিসিপশনের কার্ডটা রাখেন।আঙ্কেলসহ সবাইকে নিয়ে আসবেন।আর পূর্ণতা যদি ফ্রী থাকে তাহলে সন্ধ্যায় ওকে পাঠিয়ে দিবেন ছোট করে একটা হলুদের আয়োজন করা হয়েছে।

পূর্ণতার মা মুখ বাঁকিয়ে কার্ডটি উল্টে পাল্টে দেখে।দায় সারা মুখে ভঙ্গিতে বলে,
– হ্যাঁ দেখি চেষ্টা করবো যাওয়ার।অভয়কে শুভেচ্ছা জানাবে।

আভা মেকি হাসে।ভিতরে উঁকি দিয়ে পূর্ণতাকে খোঁজে কিন্তু পূর্ণতাকে চোখে পড়ে না।আভা হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলে,
– আচ্ছা আন্টি আজ আসি।

– ভিতরে আসবে না।এককাপ চা খেয়ে যাও।এটা কে?

রৌদ্রের দিকে ইশারা করে পূর্ণতার মা।পা থেকে মাথা অবধি পরখ করে রৌদ্রকে।আভা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– ভাইয়ার বন্ধু।

পূর্ণতার মায়ের এমন জহুরি দৃষ্টিতে রৌদ্র বিব্রত হয়।বার বার নিজে কালো টি-শার্টের গলার দিকটা টেনে টেনে উপরে ওঠায়।আভা আবারও বিদায় জানায় পূর্ণতার মাকে,
– আজ আসি আন্টি।

পূর্ণতা এতক্ষণ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিল।আভা চলে যেতেই বেরিয়ে আসে সে।নিঃশব্দে মায়ের হাত থেকে লাল টক টকে কার্ডটি হাতে নিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে সে।ঠোঁট প্রসারিত হয় তাচ্ছিল্যে।মায়ের চোখের আড়ালেই চোখ থেকে একবিন্দু নোনাজল গড়িয়ে পড়ে লাল টকটকে সেই বিয়ের কার্ডে।কার্ডটি খুলতেই দেখা যায় অভয় এবং তার হবু বউয়ের ছবি।ছবির পাশেই আঁকাবাকা নকশাকৃত বর্ণে বর কনের নাম লেখা।পূর্ণতা অভয়ের নামের উপর বৃদ্ধ আঙুল ছোয়াল।পাশেই অহনা এহসান নামটি জ্বল জ্বল করছে।সে নাম চোখে কাঁটার মতো বিঁধে গেল পূর্ণতার।আরো দু তিন ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে থুতনিতে স্তুপ হলো।সে স্তুপ ভারি হতেই খঁসে পড়লো কার্ডটিতে।নিজের নামটাকে অদ্ভুতভাবে ঘৃণা করতে শুরু করল সে।

আভা সেই তখন থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটি থ্রি-পিস পরখ করে চলেছে।পাশেই রৌদ্র গোল গোল চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।দোকানদারও একই দৃষ্টিতে আভার দিকে তাকিয়ে।আভা থুতনিতে তর্জনি ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ বিচার বিশ্লেষণ করে বিচক্ষণের ন্যায় বলে উঠলো,
– হ্যাঁ কাপড়টা ভালোই মনে হচ্ছে।এটার প্রাইস বলেন।

দোকানদার এতোক্ষণে স্বস্তি পেল।বিগলিত হেসে বলে উঠলো,
– দেখুন আপু এটা আমরা সরাসরি পাকিস্তান থেকে এনেছি।একদম খাঁটি মাল।

আভা বিরক্ত হয়ে বলে,
– আরে তা আপনি যেখান থেকেই আনেননা কেন পাকিস্তান বা পোল্যান্ড তা জেনে আমি কি করবো?আপনি প্রাইস বলেন।

– আরে আপু আগে আমার কথাটা একটু শুনেন তো।আপনার তো ড্রেসটা পছন্দ হয়েছে?আপনাকে ড্রেসটাতে মানাবেও খুব।যেই সুন্দর দুধে আলতা গায়ের রং।

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকালো।লোকটার করা আভার বর্ণনা একদমই পছন্দ হলো না তার।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল সে।এমনিতেই তার মাথায় একশো পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রক্ত ফুটছে।সে এতো ভীড়ের মধ্যে কখনো আসেনি।ওদের ওখানে সকলে শো রুম থেকে কেনাকাটা করে তাই এতো ভিড়ভাট্টার সম্মুখীন হতে হয় না।এদিকে এখানে সে দাঁড়াতেই পারছে না মানুষের ধাক্কায়।তার উপর দোকানদারের এমন বেহুদা প্রশংসা তার একদমই পছন্দ হলো না।সে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল,
– দামটা বলবেন নাকি অন্য দোকানে যাবো?

আভা মনে করল তার সম্বন্ধে অন্যকারো প্রশংসা শুনে হয়তো রৌদ্র রেগে গিয়েছে।তাই সে ঠোঁট চেপে হাসল।দোকানদার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠলো,
– বলছি বলছি আপু আপনার থেকে একদমই বেশি চাইবো না মাত্র তিন হাজার টাকা।

রৌদ্র রেগেমেগে পকেট থেকে তিন হাজার টাকা বের করে।সঙ্গে সঙ্গে আভা তার হাত চেপে ধরে।চোখ মোটা করে কিছু ইশারা করে।রৌদ্রের শিরা উপশিরা শিহরিত হয় আভার নরম হাতের ছোঁয়ায়।হঠাৎই তার রাগ অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আভার দিকে।আভা লোকটি বলল,
– দেখুন আমি এটা দুইটা নিবো।দুই হাজার টাকা দিবো।দিবেন?

দোকানদার ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান স্বরে বললেন,
– একটা দুই হাজার?

আভা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে,
– দুইটা দুই হাজার ।

আভার কথায় রৌদ্র নিজেও থতমত খেয়ে যায়।লজ্জিত হয় সে।যেখানে দোকানদার একটা তিন হাজার চায়ছে সেখানে এই মেয়েটা কিনা দুইটা দুই হাজার টাকায় নিতে চায়ছে।রৌদ্র তড়িঘড়ি আভার থেকে হাত সরিয়ে সরে দাঁড়ায়।আবার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে আভার কানে বলে,
– বার্গেনিং করছ কেন?তিন হাজার টাকায় তো।

আভা কঠোর গলায় বলে,
– আপনি চুপ থাকে। ভাইয়া আপনি বলেন দিবেন?

দোকানদার নারাজ স্বরে বলে,
– কি বলেন আপু?এ হলো খাঁটি পাকিস্তানি থ্রি-পিস।এতো কমে আমি দিতে পারবো না।

আভা লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
– তাহলে আপনি আপনার পাকিস্তানি থ্রি-পিস গায়ে দিয়ে ডিসপ্লে করতে থাকেন আমি গেলাম।

দোকানদার এবার একটু গলে গেল মনে হলো।নরম স্বরে বলল,
– আপু আর একশোটা টাকা কি দেওয়া যায়?

রৌদ্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো দু’জনের দিকে।আভা বাঁকা হেসে লোকটাকে টাকা দিয়ে থ্রিপিস নিয়ে বেরিয়ে আছে।রৌদ্র এখনো চোখ ফেড়ে আভার দিকে তাকিয়ে আছে।হয়তো সে আভার এই হিডেন ট্যালেন্ট দেখে শকে চলে গিয়েছে।

একটি শান্ত নির্মল সবুজে ঘেরা পার্কে বসে আছে আভা এবং রৌদ্র।শহরের এক কোণে এমন একটি পার্ক পেয়ে যাবে তারা আশা করেনি।এখানে আভায় রৌদ্রে নিয়ে এসেছে।রৌদ্র আভাকে এখানে আনার কারণ জানতে চায়লে সে শুধু একটাই কথা বলে,
– আমার আপনাকে একটা জরুরী কথা বলার আছে।আপনি কোনো কথা বলবেন না আমার সাথে চলুন।

শপিং শেষে রৌদ্রকে এখানে টেনে এনেছে আভা।জরুরি কথা আছে বলে আনলেও এসে থেকে একটা শব্দ করছে না আভা।রৌদ্র বার বার জিজ্ঞেস করছে কি বলবে বলো।কিন্তু আভার মুখ যেন সুপার গ্লু দিয়ে কেউ আঁটকে দিয়েছে।
আভা মনে পেটে হাজারো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।কিন্তু মুখ খুলে একটি কথা বলার সাহস পাচ্ছে না সে।না জানি রৌদ্র কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে?একটা কষে চড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে ঝিরিঝিরি করে দেয় যদি?অথবা বাড়িতে গিয়ে সবাইকে যদি বলে দেয়?তখন?তখন আভা কি করবে?কোথায় যাবে সে?কার কাছে যাবে?কিন্তু এমন সুবর্ণসুযোগ সে আর কখনো পাবে কিনা কে জানে?রৌদ্রের সাথে এভাবে একা সময় পাবে কিনা সে জানেনা তাই এই সময়টাকে সে হাত ছাড়া করতে চায়না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে