উধয়রনী পর্ব-৩৫+৩৬+ বোনাস ১+২

0
111

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৫||

৭০।
পুষ্প বাসায় এসেই উজ্জ্বলকে আহির ব্যাপারে জানালো। সব শুনে উজ্জ্বলের চোখেমুখে বিষণ্ণতা ছেয়ে গেলো। এমন কিছু শুনবে সে আশাও করে নি। উজ্জ্বল পুষ্পকে বলল,
“আমাকে আহির ফোন নম্বরটা দে।”

পুষ্প বলল,
“সিমটা ওর বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা। ফোনে বেশি কথা না বলাই ভালো।”

“চিন্তা করিস না। দেখা করেই কথা বলবো।”

পরের দিন উজ্জ্বল আহিকে কল করলো। আহি কল রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“তোমার প্রিয় রেস্টুরেন্টের নাম বলো?”

আহি শুরুতেই এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। ওপাশে নিরবতা দেখে উজ্জ্বল বলল,
“আহি, শুনতে পারছো?”

“হ্যাঁ, আপনি!”

“গলার স্বর শুনেও চিনতে পারছো না? ওহ আচ্ছা, ফোনে তো আমাদের প্রথম কথা হলো।”

“আচ্ছা, চিনেছি। উজ্জ্বল ভাইয়া।”

উজ্জ্বল চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“একদম চমৎকারভাবে চিনলে। মনটা লাফিয়ে উঠলো।”

“মানে?”

“মানে টানে পরে হবে৷ আগে দেখা করো। কথা আছে।”

আহি একটা রেস্টুরেন্টের নাম বললো। উজ্জ্বল বলল,
“ওকে, আজই দেখা হচ্ছে তাহলে। বিকেলেই আসি। বিকেলের শহর অনেক চমৎকার। আর কাল থেকে রোজা শুরু। এরপর সব বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আজই দেখা করি।”

আহি হাসলো আর বলল, “আচ্ছা।”

(***)

আহি বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। অনেকদিন পর আবার সেই রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে আহি। লিনাশার সাথে কফি খেতে প্রায় সেখানে যাওয়া হতো। কলেজ ছুটির পর লিনাশা আর আহি সেই রেস্টুরেন্টে এসে এক ঘন্টা বসে আড্ডা দিতো। এখানের বার্গারটাও তাদের প্রিয় ছিল। আহি রিকশা থেকে নেমেই কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টটের গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল। পুরোনো হয়ে গেছে গেটটি। এই কয়েক বছরে শহরে অত্যাধুনিক সব রেস্টুরেন্ট খুলেছে। এই জায়গাটা সেই তুলনায় কিছুই না। শুধু স্বাদের কারণে এখনো টিকে আছে। আহি ভেতরে ঢুকতেই দেখলো সেই ফোন বুথের পাশে রাখা এক জোড়া চেয়ার। রেস্টুরেন্টটির আকর্ষণীয় স্থান এই ফোন বুথ। পুরোনো দিনের স্মৃতি হিসেবে রাখা। এখানে যারা এসেছে, এই বুথে ঢুকে টেলিফোন রিসিভার কানে নিয়ে একটা ছবি না তুলে কখনো যায় নি। আহি আর লিনাশাও এই কাজ করেছে। ছবিটা লিনাশার কাছেই ছিল।
অতীত মনে পড়তেই আহির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। সে এবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে উজ্জ্বলকে খুঁজতে লাগলো। নিচ তলায় বসার জায়গা অল্প। উপরেই বিস্তর পরিসরে বসার ব্যবস্থা আছে। আহি উপরে উঠে দেখলো দক্ষিণের খোলা আসনে আয়েশ করে বসে আছে উজ্জ্বল। আহি তার সামনে এসে দাঁড়াতেই উজ্জ্বল তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আহিকে বসতে বললো।

আহি আর উজ্জ্বল মুখোমুখি বসে আছে। দু’জনই নিরব। সৌজন্যমূলক হাসি হেসে উজ্জ্বল বলল,
“কি অর্ডার করবো?”

আহি মুচকি হেসে বলল, “জাস্ট কফি।”

“আর কিছু?”

“উহুম।”

উজ্জ্বল দু’কাপ কফি অর্ডার করে টেবিলের উপর দুই হাত রেখে ঝুঁকে বসলো। আহি বলল,
“ভালো আছেন?”

উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আমি তো বেশ বিন্দাস থাকি। তুমি বলো, কি অবস্থা তোমার!”

“ভালোই।”

“মোটেও না। পুষ্প আমাকে জানিয়েছে সব।”

আহি মলিন মুখে বললো,
“না ঘুরিয়ে সোজাসুজিই বলি। আমি আসলে তাজওয়ার খানকে বিয়ে করতে চাই না। এর জন্য অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। ওর সম্পর্কে অনেক খারাপ তথ্য আছে। কয়েক মাস আগেই ওর এক্স আমাকে ওর ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছে। ওর নারী আসক্তি বেশি। আর এমন একজনকে জেনেশুনে কেউ বিয়ে করতে চায়বে না। এরপর ওর পারিবারিক পরিবেশ বেশ উৎশৃঙ্খল। ওখানে আমি এডজাস্ট করতে পারবো না। সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার হলো, বাবা আমাকে একপ্রকার বাধ্য করছে। হুমকি দিচ্ছে। তাজওয়ারের বাবা আমার নানাকে গুম করিয়ে ফেলেছে। উনার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই নানু-মামারা আমাকে নিতে চায় না। মাকেও তারা সাহায্য করছে না। আমি এখন কি করব?”

“কখনো পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো নি?”

“মা আর আমি পালিয়ে গেলাম না হয়। কিন্তু এরপর আমার বন্ধুরা, তাদের পরিবার, আমার মায়ের পরিবার, সবার জীবন সংকটে পড়বে।”

“তোমার মনে হয় তোমার জন্য এতোগুলো মানুষের ক্ষতি করবে?”

“রাদ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। প্রথম আঘাত তো ওকেই করবে। আর ওর কিছু হলে আমি কি সহ্য করতে পারবো? মামাদের কিছু হলে মা কি সহ্য করতে পারবে? আর এভাবে পালিয়ে কতোদিন? একটা পার্মানান্ট সলিউশন দরকার।”

উজ্জ্বল চুপ করে রইলো। টেবিলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিনিট খানিক। গম্ভীরমুখে কি যেন ভাবছে সে। আহি হতাশ হয়ে পড়ছে। একটা পথ কি আদৌ খুলবে না-কি উজ্জ্বল অপারগ হবে। নিরবতা ভেঙে উজ্জ্বল বলল,
“তুমি সময় নাও। রিলেক্স থাকো। তাজওয়ারের সাথে এমন একটা ব্যবহার করবে যেন তুমি ওকে ভালোবাসো না, আবার বিশ্বাস করতে চায়ছো। তোমার বাবার ব্যাপারে তুমি যতোটা নেগেটিভ সবটাই তার সাথে শেয়ার করবে। তোমার সৎ মায়ের সাথেও তোমার মনোমালিন্য হয়। তুমি তোমার সেই ফ্রাস্ট্রেশন ওর সামনে প্রকাশ করবে। ও তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য অনেক কিছুই বলবে। তখনই তুমি ওর সান্ত্বনায় শান্ত হয়ে ওকে এটা বোঝাবে, বাবার চেয়ে তুমি ওকে বেশি বিশ্বাস করো। আর এরই মধ্যে ঠান্ডা মাথায় তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। তোমার বাবার আর লাবণির ব্যাংক ডিটেইলস নেওয়া শুরু করো।”

“এসব দিয়ে কি হবে?”

“যারা অনেক টাকার মালিক, তাদের অবৈধ টাকায় তাদের নিয়ে ডুবে। একবার যদি এমন কোনো শক্ত খবর পাওয়া যায়, তোমার বাবা তো সোজা লক আপে। এখন বোকার মতো কেইস করে কোনো লাভ নেই। আগে প্রমাণ যোগাড় করো। বিয়ে তো এখন হচ্ছে না। তাহলে অধৈর্য হচ্ছো কেন? এই একমাসে তুমি এই কাজটিই করবে। আর তাজওয়ার মুসলিম ছেলে। অন্তত রোজার মাসে তোমাকে বিরক্ত করবে না। তুমিও ওকে একটু ধর্মের কথা শোনাবে। এই একমাস তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। প্রথম কাজ তোমার বাবাকে সরানো। আর এই কাজে তোমাকে সাহায্য করবে তাজওয়ার নিজেই। তুমি এমনভাবে ওকে ফাঁসাবে, যাতে ও নিজেই তোমার বাবাকে পথে বসিয়ে দেয়। আর এরপর ওকে ফাঁসানো অনেক সহজ। কিন্তু স্বল্প সময়ের জন্যই পারবে। তাই তাজওয়ারের বিরুদ্ধেও শক্তপোক্ত প্রমাণ লাগবে।”

“আমি কি পারবো এসব করতে?”

“দেখো, তোমাকে তো পারতেই হবে। আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি আমি আমার সাধ্যের মধ্যে সবটা করবো। দেখো আহি, এরা প্রভাবশালী। এদের সাথে বাগবিতণ্ডায় জেতা যায় না। বুদ্ধি দিয়ে খেলতে হয়। তুমি তাদের বিরুদ্ধে যতো ব্রেইন ইউজ করবে। তত তারা তোমার পেছনে থাকবে আর তুমি জয়ের সন্নিকটে পৌঁছাবে। এতেও যদি কাজ না দেয় তাহলে সেই স্টেপটা নিতে হবে, যেটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আমার মনে হয় সেই স্টেপটা আপতত ভুলে যাওয়া ভালো।”

“কোন স্টেপ?”

“এটা আমি এখন তোমাকে বলবো না। দেখা যাবে এটা মাথায় ঢুকলেই তুমি অস্থির হয়ে সেই কাজ করে ফেলবে।”

“সুইসাইড!”

“পাগল তুমি? এটা কোনো সলিউশনই না। খবরদার এমন বোকা বোকা কাজ করলে। আমার উপর আস্থা রাখো। প্রমিজ করছি, তোমাকে আপদগুলোর কাছ থেকে উদ্ধার না করে আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি না।”

আহি হাসলো। উজ্জ্বলের কথায় অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। তার কথায় যে কেউ তাদের দমে যাওয়া সাহস ফিরে পাবে। যেমনটা আহি পাচ্ছে।

(***)

উজ্জ্বল আর আহি কথা বলছিল। এমন সময় একজন যুবক তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহি মুখ তুলে নায়ীব তামজিদকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। নায়ীব হেসে বলল,
“কেমন আছেন, মিস ওয়াসিকা?”

আহি হেসে বলল,
“ভালোই। আপনার কি অবস্থা?”

“আমিও বেশ ভালোই।”

নায়ীব উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বলও কৌতূহলী দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি বলল,
“বসুন না।”

“না, আপনারা বসুন। আমার স্পেশাল গেস্ট আসবে। আপনাকে দেখে এদিকে এলাম।”

“আচ্ছা।”

আহি উজ্জ্বলকে বলল, “উনি আমার ডক্টর।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ডক্টর!”

“সাইকায়াট্রিস্ট।”

উজ্জ্বল অবাক চোখে আহির দিকে তাকালো। নায়ীব উজ্জ্বলের চাহনি দেখে বুঝলো উজ্জ্বল আহির ব্যাপারে বেশিকিছু জানে না। অথচ আহি নির্দ্বিধায় উজ্জ্বলের সামনে এমন একটা বিষয় খোলাসা করে ফেললো। নায়ীব কিছু বলার আগেই পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠের কেউ একজন বলে উঠলো,
“নায়ীব।”

নায়ীব পেছন ফিরে তাকালো। মেয়েলী কন্ঠ শুনে আহিও সামনে তাকালো। এদিকে নায়ীব মেয়েটির দিকে এগিয়ে তার হাত ধরলো। আহি তা দেখে উঠে দাঁড়ালো। আহির চোখে-মুখে বিষ্ময়। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীব সরে দাঁড়াতেই মেয়েটির চোখ এবার আহির দিকে এসে ঠেকলো। মুহূর্তেই থমকে গেলো সে। নায়ীব তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আহির দিকে তাকালো। এরপর তার হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“লিনাশা, কি হলো? দাঁড়িয়ে গেলে কেন?”

আহি টেবিল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কয়েক পা এগুতেই লিনাশা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহিও লিনাশাকে ঘুরে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। উজ্জ্বল উঠে এসে আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“এনি প্রবলেম, আহি?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো, “লিনু।”

লিনাশা নায়ীবের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“নায়ীব, আমি নিচে নামছি। আমার একটা কাজ আছে।”

কথাটি বলেই লিনাশা নিচে নেমে গেলো। নায়ীব একনজর আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহির চোখে-মুখে মলিনতা। ভীষণ অবাক হলো নায়ীব। সেও এরপর নিচে চলে গেলো। উজ্জ্বল বলল,
“মেয়েটাকে চেনো?”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার ফ্রেন্ড, লিনাশা। ও পুষ্পেরও ফ্রেন্ড। আমাদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব। আমার ভাগ্য খারাপ, আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে এই ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, প্লিজ। আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। আমার মতো ভিখারিনী এই পৃথিবীতে নেই।”

(***)

নায়ীব লিনাশার পিছু পিছু এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“লিনাশা, ওভাবে চলে এসেছো কেন?”

লিনাশা নায়ীবকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “সরো তো!”

“তুমি মেয়েটাকে চেনো?”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি মেয়েটাকে কীভাবে চেনো?”

“ও আমার পেশেন্ট ছিল।”

লিনাশা থমকে গেলো। ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানে?”

“তোমাকে বললাম না একটা মেয়ের কথা? একটা ছেলেকে ভালোবাসে। শুধু ভালোবাসে বললে ভুল হবে, প্রচন্ডভাবে ভালোবাসে। মেয়েটা মানসিকভাবে অসুস্থ। পারিবারিক অবস্থাও ভালো না। এটাই সেই মেয়েটা। মিস ওয়াসিকা।”

লিনাশার চোখেমুখে বিষণ্ণতা ছেয়ে গেলো। নায়ীবের হাত ধরে বলল,
“ও তোমাকে সব বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

“ও কি বলেছে ওর একটা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল, যাকে হারিয়ে ফেলেছে?”

নায়ীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ।”

“কেন হারিয়েছে?”

“পারিবারিক সমস্যার কারণে। ডিটেইলসে কিছু বলে নি। এইটুকু বলেছে যে ওর বাবার সাথে তার ফ্রেন্ডের বাবার ঝামেলা হয়েছিলো। যার জন্য তার ফ্রেন্ডের বাবা মারা গিয়েছিল।”

লিনাশা থমথমে কন্ঠে বললো,
“আহিই সেই মেয়ে। আমার বড় আপু আহির বাবাকে বিয়ে করেছিল। তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমার বড় বোন কোথায়? আমার বড় বোন লাবণি মেহেরা, চট্টগ্রামের নামকরা ব্যবসায়ী রিজওয়ান কবিরকে বিয়ে করে, নিজের বাবা-মাকে মার খাইয়ে চলে গেছে। আর আমার বাবা সেটা সহ্য করতে না পেরে, আমাকে আর মাকে ফেলে ওপারে চলে গেছে। আহির কারণে হয়েছে এসব। ওই মেয়েটার কারণে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। না ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হতো, না আমি আমার বাবাকে হারাতাম।”

নায়ীব লিনাশার হাত ধরে বলল,
“বাসায় চলো। পাগল হয়ে গেছো তুমি। বাচ্চাদের মতো কথা বলছো।”

“আমি বাচ্চাদের মতো কথা বলছি?”

“অবশ্যই। তুমি কি বুঝতে পারছো না, আহি অসুস্থ? তোমার বড় বোন যেই কাজ করেছে, তার জন্য তুমি নিজের দিকটাই দেখছো? তুমি বাবা হারিয়েছো? তাহলে আহি কি তার মাকে হারায় নি? তাদের সম্পর্কের কারণে আহিকে কতোটা সাফার কর‍তে হচ্ছে, তুমি কি জানো? মেয়েটা অসুস্থ। আমি ওর ট্রিটমেন্ট করেছি। ওর হ্যালুসিনেশন হয়। এমন জিনিস ভাবে যেটার অস্তিত্বই নেই। কখন হয় এসব? যখন মানুষ ডিপ্রেশনে থাকে। আর মানুষ ডিপ্রেশনে কেন থাকে? যখন আপন কেউ পাশে থাকে না। আহি মাকে হারিয়েছে, তোমার বোনের জন্য। তার বাবাকে হারিয়েছে, তোমার বোনের জন্য। আহির বাবা তাকে এমন এক ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে, যাকে আহি বিয়েই করতে চায় না, তোমার বোনের ইন্সপায়ারে। এতোটুকু তো আহি আমাকে বলেছে। তোমার সাথে বন্ধুত্ব করে কি ও সাফার করছে না? এতোটা স্বার্থপর তুমি!”

নায়ীব গাড়ির দরজা খুলে বলল,
“উঠো গাড়িতে। তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেবো।”

লিনাশা অশ্রু ভেজা দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকিয়ে রইলো। নায়ীব লিনাশার গালে হাত রেখে বলল,
“সরি, তোমাকে বেশি বলে ফেলেছি। আমি তোমাকে সত্যটা বললাম শুধু। ভুল বুঝাবুঝি বন্ধুত্বে হয়, তাই বলে এমন শাস্তি? আমি জানি তুমিও আহিকে মিস করো। তোমার ওয়ালে সেই ছবিটা আহি এঁকে দিয়েছিল, তাই না?”

“তুমি কীভাবে বুঝলে?”

“এই মাত্র বুঝলাম। তুমিই তো বললে আহি তোমার ফ্রেন্ড। আর আমি তো জানি আমার পেশেন্ট ভালো ছবি আঁকে।”

লিনাশা চোখ মুছে আবার রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালো। নায়ীব লিনাশাকে সেদিকে যেতে দেখে গাড়িতে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো, আর আনমনে হাসলো। শেষমেশ তবে দুই বান্ধবীর মিল হতে যাচ্ছে।

(***)

আজ তৃতীয় রোজা। প্রতিদিনের মতো বেলা বারোটায় ঘুম ভাঙলো আহির। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা হাতড়ে ফোন হাতে নিতেই চমকে উঠলো সে। ফোনে পঁচিশটা মিসড কল। রাদ কল করেছে। রাদ এতোগুলো কল কেন করলো? আহি কল ব্যাক করতেই রাদ সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুই কোথায় আহি?”

“এই মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।”

“এক্ষুণি ন্যাশনাল হসপিটালে আয়। লাবীবকে ওখানে এডমিট করিয়েছি।”

আহি অবাক কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে ওর?”

“বাইক এক্সিডেন্ট!”

আহি ভীত কন্ঠে বলল,
“সিরিয়াস কিছু হয় নি তো!”

“মোটামুটি। মাথায় আঘাত পায় নি। হাত-পায়ে ব্যথা পেয়েছে।”

“আমি আসছি এক্ষুণি।”

আহি ফ্রেশ হয়ে বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিলো। রিজওয়ান কবিরও লাবীবের এক্সিডেন্টের খবর শুনে আহির হাতে টাকা দিয়ে, একটা চেক লিখে দিয়ে বললেন,
“প্রয়োজন হলে তুলে নিও।”

আহি গাড়ি নিয়ে হাস্পাতালে পৌঁছে গেলো। কেবিনের বাইরে এসে দেখলো উজ্জ্বল আর পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প আহিকে দেখে দৌঁড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি পুষ্পকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। পুষ্প কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি লাবীবকে ভীষণ ভালোবাসি, আহি। আমার না কেমন লাগছে আমি তোকে বোঝাতে পারবো না। আমার কারণেই এমনটা হয়েছে। আমিই ওর বাইকে উঠতে চাচ্ছিলাম না। আমার রাগ ভাঙানোর জন্য ও স্টান্ট করছিল, তখনই পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো।”

পুষ্প কথাটি বলতে বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। আহি পুষ্পের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“যাকে ভালোবাসিস, তাকে কেন পাগল বানাবি? তার সাথে কীসের অভিমান? এখনই সুযোগ ভালোবাসার। প্রতিটা সেকেন্ড একে অপরের যত্ন নিবি, আগলে রাখবি, ভালোবাসবি। সবার ভাগ্যে ভালোবাসা থাকে না, পুষ্প। তাহলে পেয়ে কেন অবহেলা করিস?”

উজ্জ্বল আহির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আসলেই অসাধারণ। যতোবারই দেখে ততোবারই মুগ্ধ হয়।

(***)

রাদ আহিকে দেখে ওষুধগুলো পুষ্পের হাতে দিয়ে বলল,
“এগুলো নার্সকে দিয়ে আসো।”

এরপর আহির হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলো। আহি বলল,
“টাকা নিয়ে এসেছি।”

“লাগবে না আপতত। রিলিজ দেওয়ার সময় লাগবে। লাবীবের জ্ঞান ফিরেছিল। ও বললো আপতত ওর বাসার কাউকে না জানাতে।”

“আচ্ছা, এদিকে নিয়ে এলি কেন আমাকে?”

“অনেকদিন আমার সাথে কথা বলিস নি। এনগেজমেন্টের পর কেমন যেন পালটে গেছিস। তাজওয়ারকে ভালোবেসে ফেলেছিস না-কি!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“পাগল না-কি তুই? ওই বেটার প্রেমে আমি পড়বো? নো ওয়ে।”

“কাল রেস্টুরেন্টে একসাথে ইফতার করেছিস!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুই আমাকে দেখেছিস!”

“হ্যাঁ।”

“ডাকিস নি কেন?”

“তোর ফিয়োন্সের সামনে কিভাবে যাবো? আর আমার সাথে আমার কলেজের বন্ধুরা ছিল।”

“শখ করে তাজওয়ারের সাথে খেতে যাই নি। কারণ আছে। তোকে সময় করে সব বলবো।”

“বাদ দে এসব। ওই বেটাকে বিয়ে করতে হচ্ছে কেন? চল পালিয়ে যাই।”

আহি বুকে হাত গুঁজে বলল, “তারপর!”

“বিয়ে করে ফেলবো তোকে।”

“তোর বাবা-মাকে মেরে ফেলবে। চিনিস না খান সাহেবকে! এরপর দেখা যাবে আমার জন্য তুই ঝামেলায় পড়েছিস।”

“তুই রাজি থাকলে আমি সব ঝামেলা কাটাতে পারবো।”

“আচ্ছা, হঠাৎ তুই আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস কেন?”

“বিয়ের বয়স হয়েছে, ভাবলাম তোকেই বিয়ে করে ফেলি। পার্মানেন্ট বেস্ট ফ্রেন্ড পেয়ে যাবো। তাজওয়ারকে বিয়ে করলে আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখা তো সম্ভব হবে না। তোর যে কোয়ালিফাইড ফিয়োন্সে! এর আশেপাশেও আমি নেই।”

আহি রাদের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“পৃথিবীর কোনো কোয়ালিফাইড পুরুষ, আমার এই এলোমেলো সুপুরুষ বন্ধুকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না।”

রাদ আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“কীভাবে বলবো আহি? কীভাবে বলবো, তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৬||

৭১।
অগ্রহায়ণের সুশীতল হাওয়া জানালা গলে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। এলোমেলো ঘরে এদিক-ওদিক শপিং ব্যাগ ছড়ানো। ব্যাগগুলো ঠেলে একপাশে রেখে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো লিনাশা। ইদের এক সপ্তাহ পরই নায়ীবের সাথে তার বিয়ে।

নায়ীব আর লিনাশার তিন বছরের প্রেমের সম্পর্ক। তাদের দেখা হয়েছিল বইয়ের দোকানে। শহরে সেই বছর ফাল্গুন মাসে পনেরো দিনের বই মেলা হয়েছিল। লিনাশা সেদিন সন্ধ্যায় তার পছন্দের একটি বই কেনার জন্য মেলায় এসেছিল। ভাগ্যক্রমে একটি স্টলে সেই বইটি পাওয়া গেলো। লিনাশা যে-ই বইটিতে হাত দিতে যাবে, তার আগেই একজন যুবক সেই বইটি নিয়ে নিলো। লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে সেই যুবকটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। অপরিচিত একটি মেয়ের এমন অদ্ভুত চাহনি দেখে ছেলেটি লিনাশাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো সমস্যা?”

লিনাশা বইটি কেঁড়ে নিয়ে বলল,
“এই বইটি কেনার জন্য আমি অনেক দূর থেকে এসেছি।”

এবার ছেলেটি লিনাশার হাত থেকে বইটি টেনে নিলো। আর বলল,
“এটা লাস্ট পিস, আর এটা আমার লাগবেই।”

লিনাশা কিছু বলার আগেই ছেলেটি বইয়ের দাম দিয়ে দিলো। লিনাশা বইটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এদিকে ছেলেটি বই নিয়ে চলে গেলো। আর লিনাশা দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, বইটা কি অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না?”

দোকানদান মাথা নেড়ে বলল,
“এটা লিমিটেড ছিল। বইটি আর বের হবে না।”

লিনাশা মলিন মুখে হাঁটতে লাগলো। মনে মনে লেখককেই বকাবকি করছিলো সে। কেমন লেখক, অল্প কিছু বই বের করেই হারিয়ে গেছে! হঠাৎ লিনাশার সামনে সেই অপরিচিত ছেলেটি এসে দাঁড়ালো। এবার লিনাশা বলল,
“কি সমস্যা?”

“বইটি কি আপনার খুব প্রয়োজন?”

“হ্যাঁ। কিন্তু স্টক আউট।”

“আপনি চাইলে আমি আপনাকে বইটি ধার দিতে পারি।”

“কেন?”

“কারণ আমি কাউকে হতাশ করতে চাই না।”

“আপনি কোথাকার হিতৈষী।”

“এই দেশেরই। এই জেলারই। কাছেই আমার বাড়ি।”

“এতোকিছু জানতে চাই নি। বাই দা ওয়ে, আপনি আমাকে বই ধার দেবেন কীভাবে?”

“এই যে হাত দিয়েই দেবো। আমি আপনাকে হাতে হাতে দেবো, আর আপনি আমাকে হাতে হাতেই ফেরত দেবেন।”

লিনাশা ভ্রূ নাচিয়ে বলল,
“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। আপনি আমাকে কোন আক্কেলে বিশ্বাস করছেন?”

ছেলেটি হাসলো। বলল,
“আমি মানুষ দেখেই বুঝতে পারি, সে কেমন। আমার মনে হলো, আপনি বইটি পড়েই আমাকে ফেরত দেবেন। এমনকি বেশ যত্নও করবেন। বইয়ে দাগ দেওয়ার আগে একশো বার ভাববেন।”

লিনাশা অবাক হয়ে বলল,
“আপনি পাক্কা কোনো জ্যোতিষী।”

ছেলেটি আবার হাসলো। এরপর বুক পকেট থেকে একটা কলম বের করে বইয়ের উপর কিছু একটা লিখে লিনাশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। লিনাশা অবাক চোখে ছেলেটির যাওয়া দেখছে। এরপর আকাশসম বিষ্ময় নিয়ে বাসায় এসে বইটির পাতা উল্টাতেই দেখলো, সেখানে ছেলেটির নাম আর ফোন নম্বর লেখা। লিনাশা তা দেখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। জীবনে প্রথম কোনো ছেলে তাকে ফোন নম্বর দিয়েছে, বেশ ভালোই লাগলো তার৷ বার কয়েক আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো সে। হয়তো অভিনব কৌশলে নম্বর আদান-প্রদান করে প্রেম করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো। বেশ ভাব আসলো লিনাশার। সেই নম্বরটিতে কল দেওয়ার তীব্র বাসনায় দু’দিনেই বইটি শেষ করে ফেললো সে। এরপর দু’দিন পর সন্ধ্যায় কল করলো নম্বরটিতে। বেশ ব্যস্ত মানুষ তো! চার বার কল দেওয়ার পরও ধরলো না? অভিমান হলো লিনাশার। কিন্তু ফিরতি কল এলো রাত দশটার একটু পর। লিনাশার মান-অভিমান ভেঙে গেলো মুহূর্তেই। গলা খাঁকারি দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে কলটা রিসিভ করলো সে। এরপর ওপাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো,
“হ্যালো, নায়ীব তামজিদ বলছি।”

“আমি লিনাশা মেহেরা।”

“জ্বি, কোনো প্রয়োজন!”

“বইটা পড়া শেষ।”

নায়ীব বেশ অবাক হলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। মনে পড়তেই মুচকি হেসে লিনাশার সাথে কুশল বিনিময় করলো। জিজ্ঞেস করলো,
“বইটি কেমন লেগেছে?”

আরো বললো, লিনাশা যেন এক বাক্যে বইটির চমৎকার একটা রিভিউ দেয়। নায়ীবের‍ এমন গম্ভীর কথাবার্তায় লিনাশা হাঁপিয়ে উঠছিল। প্রেমের কথা কম, পড়ালেখার কথায় যেন বেশি ছিল তাদের কথোপকথনে। লিনাশা বেশ বিরক্ত। জীবনে প্রথম কোনো ছেলে তাকে নম্বর দিয়েছে, তাও এমন আঁতেল! লিনাশা কল কেটে ঘুমিয়ে পড়লো। এর কয়েকদিন পর বইটি ফেরত দেওয়ার জন্য তাদের দেখা হলো একটি রেস্টুরেন্টে। বেশ ফিটফাট পোশাক পরেই আগমন ঘটলো নায়ীব তামজিদের। সেদিন নায়ীব লিনাশার হাবভাব দেখেই বুঝে ফেললো, এই সুদর্শন যুবকটিকে লিনাশার ভালো লেগেছে। একজন পুরুষের জন্য এটা বেশ মজার বিষয়, যে কোনো মেয়ে তাকে পছন্দ করেছে, আর সে এটা ধরতেও পেরেছে। তবে নায়ীব বেশ ভদ্র। সে লিনাশার পছন্দের প্রতি সম্মান রাখলো। বেশ ভালোই কথাবার্তা হলো তাদের। আধুনিক যুগের বিস্তর প্রভাবে দু’জনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরও আদান-প্রদান হলো। ব্যস, লিনাশা পেয়ে গেলো সুযোগ। প্রায়ই এটা-সেটা নিয়ে নায়ীবকে মেসেজ করতো সে। নায়ীবও ধীরে ধীরে লিনাশার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লো। দু’জনের বয়সের ব্যবধান মাত্র পাঁচ বছর। আর তখন লিনাশা পড়তো অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। কিন্তু বয়সের তুলনায় বেশ ইম্যাচিউর ছিল সে। আর নায়ীব সেই ইম্যাচিউর মেয়েটিকেই একদিন ভালোবেসে ফেললো।
নায়ীব মনে করে প্রেমিকাদের অন্তত প্রেমিকের সামনে একটু ন্যাকা বোকা হতে হয়। তবেই প্রেম জমে। নায়ীব আর লিনাশা বেশ ভালোভাবেই তাদের প্রেম জমিয়েছে, যার পরিণতি আজ বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে।

(***)

প্রায় আধা ঘন্টা বিছানায় বিষণ্ণ মনে শুয়ে ছিল লিনাশা। আজ রমজানের প্রথম সপ্তাহ শেষ। এক সপ্তাহ আগেই আহির সাথে ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়েছিল তার। নিজের মিথ্যে অহমিকায় সেদিন আহির সাথে কথা না বলেই বেরিয়ে এসেছিল রেস্টুরেন্টটি থেকে। পরবর্তীতে নায়ীব বোঝানোর পর সেখানে আবার গিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে দেখল আহি বেরিয়ে গেছে। লিনাশার ভীষণ খারাপ লাগছে। আহির সাথে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। আরেকবার দেখা হলেই জড়িয়ে ধরবে তার প্রিয় বান্ধবীকে। কতো বছরের জমানো অশ্রু গড়িয়ে পড়া বাকি! এতোগুলো বছরে কতোশত কথা জমে আছে। সবটাই তো আহিকেই শুনাবে সে। আহি ছাড়া কে আছে তার?

(***)

খানস গ্রুপে আজ বেশ বড়সড় ভাবেই ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। ইফতার শেষে তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে সবার সামনে এনে দাঁড় করালো। আহি বেশ বিরক্ত। তবুও উজ্জ্বলের কথামতো সে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে অভিনয় করার চেষ্টা করছে। তাজওয়ার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনারা তো জানেনই এই মাসে আমার এনগেজমেন্ট হয়েছিল। আজ আমি আমার ফিয়োন্সের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেবো। মিট উইথ মাই লাভলী ফিয়োন্সে, ওয়াসিকা কবির আহি। এন্ড ওয়ান এন্ড অনলি বিউটিফুল ডটা’র অব মিস্টার রিজওয়ান কবির।”

আহি উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিতেই ভীড়ের মাঝে তার চোখ আটকে গেলো আফিফের দিকে। অনেকদিন পর আফিফকে দেখলো সে। ইদানীং ক্লাসে যায় না আফিফ। অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে, তাই হয়তো। আহি চোখ সরিয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“খুব শীঘ্রই আহি আমাদের বিজনেস গ্রুপে জয়েন করবে।”

সবাই হাততালি দিচ্ছে। আহি নিচে নেমে আসতেই তাজওয়ার তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
“নেমে এলে যে!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“সবই বুঝলাম, কিন্তু তোমার বিজনেস গ্রুপে জয়েন হচ্ছি, এটা কেন বললে?”

“কেন, ভুল কিছু বলেছি?”

“অবশ্যই। আমি বিজনেস করবো না। আমি আর্টিস্ট হবো, আর এটাই আমার ড্রিম। আর আমার এসব ভালো লাগে না। অন্তত এদিক থেকে কি আমি স্বাধীনতা পাবো না?”

তাজওয়ার আহির কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“সব করতে পারবে তুমি। পাশাপাশি এই বিজনেসটাও দেখবে।”

তাজওয়ার আহির চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। আহি বেশ অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু তাকে সহ্য করতে হবে। নয়তো সে তার আসল ধাপে যেতেই পারবে না।

এদিকে আফিফ অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলো তাজওয়ার আর আহি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য দেখে হুট করেই মনটা ভারী হয়ে এলো তার। আফিফ অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়ালো। কিন্তু গাড়ি ডাকলো না। আনমনেই হাঁটতে লাগলো ফুটপাত ধরে। আহিকে তাজওয়ারের সাথে দেখে কেন খারাপ লাগবে তার? এটাই তো হওয়ার ছিল। আফিফ হাঁটতে হাঁটতেই পা ফসকে ফুটপাত থেকে রাস্তায় পড়ে গেলো। তখনই দু’টি হাত তাকে উঠানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আফিফ মুখ তুলে তাকাতেই দেখলো আহি। আফিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি!”

আহি আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,
“রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন হয়তো। শরীরটা বেশ খারাপ মনে হচ্ছে! বাইক আনেন নি?”

“না।”

“আমি রিকশা ডেকে দিচ্ছি।”

“দরকার নেই।”

“অন্যকিছু ভাববেন না। আপনি একদিন আমাকে রিকশা ঠিক করে দিয়েছিলেন। সেদিন আমি একটু অসুস্থ ছিলাম। আজ মনে হলো, আপনি অসুস্থ। আফটার অল, আপনি আমার বান্ধবীর হাসবেন্ড। এতোটুকু ফর্মালিটি রাখা আমার দায়িত্ব।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ফর্মালিটি!”

আহি রিকশা ঠিক করে দিয়ে বলল,
“কেন ইনফর্মাল কিছু তো আপনি আশা কর‍তে পারেন না!”

আফিফ কিছু না বলেই রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশা চলে যেতেই আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আফিফের মায়া কি সে আদৌ ছাড়তে পারবে? যদিও আজকাল তেমন একটা কষ্ট হয় না। জীবন তাকে এতো বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে যে আর কষ্ট পেয়ে অশ্রু গড়ানোর শক্তিটুকুও তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। কষ্টগুলো এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস হয়েই বেরিয়ে আসে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০১||

৭২।
মলিন মুখে বসে আছে লিনাশা। নায়ীব তার হাত ধরে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমি তোমাকে এভাবে দেখতে পারছি না।”

লিনাশা নায়ীবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে তোমার পেশেন্টের সাথে আমার দেখা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।”

“আমি তোমাকে ফোন নম্বর দিয়েছি। আহিকে তুমি নিজেই কল করতে পারো।”

“তোমার কি মনে হয়, আমি দেই নি? দিয়েছি। কিন্তু কথা বলার সাহস হয় নি। ও হ্যালো হ্যালো করছিলো, আর আমি চুপ করে বসেছিলাম।”

“কেন করলে এমন?”

“এতো বছর পর ফোনে কথা বলা যায় না। সামনা-সামনি বসেই কথা বলা উচিত। আমাদের অনেক গ্যাপ হয়ে গেছে। প্লিজ, দেখা করানোর ব্যবস্থা করো। তুমি ওকে ফোন করে বলো আসতে।”

“তোমার ফ্রেন্ড তুমি বলতে পারছো না?”

লিনাশা নায়ীবের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
“ধুর, যাও তো। লাগবে না তোমার হ্যাল্প।”

নায়ীব লিনাশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে লিনাশার পাশে এসে বসলো। তারপর লিনাশার সামনেই আহির নম্বরে ডায়াল করলো। লিনাশা তা দেখে এক গালে হেসে নায়ীবের দিকে তাকালো। নায়ীব কানের কাছে ফোন নিয়ে লিনাশার দিকে ঘুরে বসলো। কয়েক সেকেন্ড পর কলটা রিসিভ হতেই নায়ীব বলল,
“আহি, আমি ডক্টর নায়ীব বলছি। তোমার সাথে কি আজ ইফতারের পর দেখা করা যাবে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “হঠাৎ!”

“কেউ একজন তোমার সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব।”

লিনাশা চোখ বড় বড় করে নায়ীবের দিকে তাকালো। নায়ীব মুখ চেপে হাসছে। লিনাশা নায়ীবের হাতে কামড় বসিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“এটা কেন বলেছো? তুমি এটা ঠিক করো নি।”

ওপাশে আহি চুপচাপ হয়ে আছে। নায়ীব বলল,
“কি হয়েছে আহি?”

“ওকে একাই আসতে বলবেন। যেখানে আমাদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেই জায়গায়।”

নায়ীব লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা উৎসুক দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকিয়ে আছে। নায়ীব কল কেটে লিনাশাকে বলল,
“তোমাদের স্মৃতি জড়িত স্থান কোনটা!”

“স্কুল!”

“ওখানে দেখা করতে বলেছে!”

“মার্কেটে?”

“তুমি তো বললে স্কুল।”

“স্কুল কি সন্ধ্যায় খোলা থাকে?”

“তোমাদের স্মৃতি জড়িত স্থান কি অনেকগুলো না-কি!”

“হ্যাঁ। স্কুল তো স্বাভাবিক স্মৃতি জড়িতই হবে। কিন্তু স্কুলের পাশে যেই শপিং মলটা আছে, আমরা প্রতিদিন ক্লাস শেষে ওখানে গিয়ে ফুচকা খেতাম। ইদের আগে একসাথে ওখানে গিয়ে শপিং করতাম। ওই মলের প্রায় সব দোকানদাররা আমাদের চিনতো। কলেজের পর সেই রেস্টুরেন্টটা ছিল আমাদের জন্য স্পেশাল, যেখানে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আরেকটা রেস্টুরেন্ট আছে, ওখানে আমরা চারজন একসাথে যেতাম। কিন্তু আমার আর আহির আলাদা কিছু জায়গা আছে। একটা পার্ক আছে ওখানে বসে বাদাম খেতাম আর প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রেম দেখতাম। দিনগুলো ভীষণ ভালো ছিল৷ কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড় এসে আমার আর আহির জীবনটা শেষ করে দিয়ে গেলো। আর ও-তো এতো আনলাকি ছিল, যাকে ভালোবাসতো, সেই ছেলেটাই আমাদের ফ্রেন্ড পদ্মকে বিয়ে করে ফেলে। আহি পাগলের মতো ভালোবাসতো ছেলেটাকে।”

নায়ীব বলল, “এখনো ভালোবাসে।”

“জানি। এতো সহজে কাউকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। আর ওর ভালোবাসার গভীরতা অনেক বেশি। মেয়েটা যাকে ভালোবাসে, তাকে ভীষণভাবে ভালোবাসে। আর আফিফকে একটু বেশিই ভালোবাসতো।”

“বাদ দাও এসব। এখন তোমার উচিত ওর পাশে থাকা। আহির এই মুহূর্তে ভালো বন্ধু প্রয়োজন। তোমার জায়গাটা এতো বছর যে নিয়েছে সেটা বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি হয়ে গেছে।”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“রাদকে চেনো?”

“রাদ কে?”

“তোমাদের স্কুলে পড়তো!”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। কিন্তু রাদ এখানে কেন এলো?”

“ছেলেটাই আহির সাথে এসেছিল। ট্রিটমেন্টের পুরোটা সময় সে আহির পাশে ছিল। ছেলেটাকে দেখে আবার প্রমাণিত হয়ে গেল, ছেলে-মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না। তারা প্রেমে পড়তে বাধ্য। ছেলেটা আহিকে ভালোবাসে। ওর চোখে-মুখে ভীষণ অস্থিরতা দেখেছি আমি। মানসিক ভাবে সেও অসুস্থ। কিন্তু আহির দৃষ্টিতে রাদ শুধুই তার বন্ধু। যদি আহি বিষয়টা মেনে নিতে না পারে, কষ্টটা আহিরই বেশি হবে। মেয়েটা এমনিতে অসুস্থ। সে যদি জানতে পারে রাদ তাকে ভালোবাসে। আর সেই সম্পর্কটা যদি আহি মন থেকে মেনে নিতে পারে, তাহলে ওদের বন্ধুত্বে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হবে। আর এই দূরত্বে সবচেয়ে বেশি আহি কষ্ট পাবে। কারণ মেয়েটা অনেক দিক দিয়েই সাফার করছে।”

(***)

ইফতারের পর আহি আর লিনাশা সেই শপিংমলে চলে গেলো। লিনাশা আগে থেকেই সেই ফুচকার দোকানে বসা ছিল। আহিকে দেখেই সে উঠে দাঁড়ালো। লিনাশা জড়তার ভারে নুইয়ে পড়ছে। কিন্তু আহি এখনো সেই প্রাণবন্ত মেয়েটিই রয়ে গেলো। সে লিনাশাকে দেখেই তার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলো আর ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরলো তাকে। লিনাশাও আহিকে জড়িয়ে ধরলো। দু’জনের চোখে অশ্রু। তারা আজ নিঃশব্দে কাঁদছে না। দু’জনই ফুঁপিয়ে কান্না করছে। যেন বহু যুগ পর দেখা হলো দুই বান্ধবীর। আহি লিনাশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যাস না। সবাই শুধু আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি তো পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ থাকার জন্য আসি নি।”

লিনাশা আহিকে ছেড়ে তার চোখ মুছে দিলো। এরপর আহিকে চেয়ারে বসিয়ে তার পাশেই বসলো। আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“সরি। একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছি।”

লিনাশা নিজের চোখ মুছে বলল,
“তোর বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমি এমন সময়ে তোর হাত ছেড়েছি, যখন তোর সবচেয়ে বেশি আমারই প্রয়োজন ছিল।”

“তুই তো ইচ্ছে করে ছাড়িস নি। আমার ভাগ্যটাই এমন ছিল। আমি কাউকেই বেশিদিন কাছে পাই না। এখানে তোর কোনো অপরাধ নেই। সব অপরাধ আমার। আমি কবির সাহেবের মেয়ে। এটাই আমার জীবনের ভয়ংকর সত্য।”

লিনাশা আহির হাত ধরে বলল,
“এই সত্যটা এই মুহূর্তে ভুলে যা। মনে কর, আজ অনেক বছর পর আবার সেই চৌদ্দ বছরের আহি আর লিনাশা একে অপরের সাথে দেখা করতে এসেছে।”

আহি লিনাশার দিকে তাকিয়ে হাসলো। দু’জন বসে অনেক গল্প করলো। এতো বছরের জমানো কথাগুলো শেষ হতে হতেই কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গেলো।
মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। আহি আর লিনাশা সেখান থেকে বের হয়ে দেখলো নায়ীব গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীব আহি আর লিনাশাকে দেখেই তাদের দিকে এগিয়ে এলো। আহি বলল,
“থ্যাংক ইউ। আপনার জন্যই আমি লিনাশাকে ফিরে পেয়েছি।”

নায়ীব মুচকি হেসে বলল,
“এমন বন্ধুত্ব হারিয়ে যাক, আমি চাই না। এমন বন্ধু আজকাল হয়ও না। ইদানীং সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। কে আছে বান্ধবীর আঁকা ছবি ওয়ালে সাজিয়ে রাখে? কেইবা ফোনের স্ক্রিনে বান্ধবীর আঁকা ছবিটাই রাখে! কে আছে যার স্মৃতিতে পুরোনো বান্ধবীরা বেঁচে থাকে? সত্য তো এটা, বছর না ঘুরতেই যোগাযোগ বন্ধ। আর যোগাযোগ বন্ধ মানেই ভুলে যাওয়া। কিন্তু তোমাদের এতো বছরের দূরত্ব, অথচ কেউ কাউকে ভুলো নি। দু’জনই ল্যাভেন্ডার পছন্দ করে, দু’জনেরই প্রিয় ফুল কাঠগোলাপ।”

আহি আর লিনাশা হাসলো। দু’জনের ঠোঁটেই প্রশান্তির হাসি। এতো বছর পর আহি তার প্রিয় বান্ধবীকে ফিরে পাবে, তা সে আশায় করে নি। সৃষ্টিকর্তা তাকে নিরাশ করেন নি। সে যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। হয়তো সময়টা দীর্ঘ ছিল। আহি আকাশের দিকে তাকালো। বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। আজ তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। তার মন বলছে, সে সব ফিরে পাবে। হয়তো সময়টা আরেকটু দীর্ঘ হবে। কিন্তু একবার যেহেতু সৃষ্টিকর্তা তার এতোদিনের প্রার্থনা কবুল করে ছোট একটা ইশারা দিয়েছেন, তাহলে ভবিষ্যতেও তার পাশেই থাকবেন।

(***)

কয়েকদিন বেশ ফুরফুরে মেজাজে দিন কাটছে আহির। প্রতিদিন তিন ঘন্টা লিনাশার সাথে ফোনে কথা বলে সময় কাটায় সে। আর ইফতারের পর দু’জনই ইদের বাজার করতে বেরিয়ে যায়। যতোক্ষণ মার্কেট খোলা থাকবে ততোক্ষণ দুই বান্ধবী ঘুরাঘুরি করবে। পনেরো রোজার পর থেকে মার্কেট বন্ধ হবে আরো দেরীতে। এখন প্রায় দোকান সেহেরী পর্যন্ত খোলা থাকে। আহি আর লিনাশা সেই সময়টুকু ঘুরে ফিরে সেহেরী করে বাসায় ফিরে। তাদের প্রতিদিনের কথা যেন শেষই হচ্ছে না। বেশ কয়েকদিন যাবত মিসেস লাবণি এসব লক্ষ্য করছেন। লিনাশার সাথে আহির কথাবার্তা হয়, সেটা তিনি জানেন না। তাই লাবণি ধরে নিয়েছেন আহি রাদের সাথেই ঘুরাঘুরি করছে।

আজ ইফতার শেষে আহি নিজের রুমে এসে শুয়ে রইলো। লাবণি হুট করে রুমে ঢুকে বলে উঠল,
“আজ থেকে তোমার বাইরে যাওয়া বন্ধ।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কেন? হরতাল ডেকেছে না-কি!”

“হ্যাঁ। হরতালই হচ্ছে।”

“জরুরি অবস্থা জারি করলেও আমি আপনার সকল আইন প্রত্যাহার করবো।”

“তুমি ইদানীং বেশ উড়ছো।”

“উড়ার সামর্থ থাকলে ধরতেই পারতেন না।”

“আহি, মুখে মুখে কথা বলবে না।”

আহি বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। হঠাৎ কি ভেবে সে মিসেস লাবণির কাছে এসে তার হাত মুড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে আপনি নিজের ইশারায় আর নাচাতে পারবেন না। আমি যা ইচ্ছে, করবো।”

মিসেস লাবণি আহিকে ধাক্কা দিতেই আহি সরে দাঁড়ালো। এরপর পাশ ফিরে টেবিলে রাখা ফুলদানিটা ফেলে দিলো। মুনিয়া খালা আর চুনি শব্দ শুনে উপরে উঠে আসার আগেই আহি ধপ করে ভাঙা কাঁচগুলোর উপর নিজের হাত চেপে ধরলো। লাবণি ভ্রূ কুঁচকে আহির কাণ্ড দেখছে। মুনিয়া খালা এসে আহিকে এই অবস্থায় দেখে তার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। চুনি আর খালা মিলে আহিকে উঠিয়ে বিছানায় বসালো। আহি কাঁদো কাঁদো মুখে লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আপনার খেলনা নই। আপনি আমার সাথে যেমন ইচ্ছে তেমন করতে পারেন না।”

আহি এরপর চাপা স্বরে চুনিকে বলল,
“তাজওয়ারকে কল দিয়ে বলো, লাবণি আমাকে মেরেছে। আমি বলতে বলেছি এটা ভুলেও বলো না।”

চুনি মাথা নেড়ে চলে গেলো। এদিকে লাবণি তো হনহনিয়ে নিচে নেমে এসেছে। তিনি আহির বিরুদ্ধে এক গাদা অভিযোগ নিয়ে বসে আছেন। রিজওয়ান কবির বাসায় এলেই আহির ঠাঁট ছাড়াবেন এই আশায় নিজের ঘরে এসে অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। এদিকে চুনি তাজওয়ারকে ফোন দিয়ে ঘটনায় আরো মশলাযুক্ত করে বলল,
“তাজওয়ার ভাইজান, আমি চাঁদনি কইতেছি। আফারে বাঁচান। রক্তে বইয়া যাইতেছে ঘর। আম্মা আর আমি মিল্লা রক্ত পরিস্কার করতে করতে বেহুঁশ হই যাইতেছি। ছোট ম্যাডাম আফারে যে মারাটাই না মারলো। কেমন জল্লাদ! আমার চোখ ভিজা যাইতাছে। কইবার পারতাছি না আর। আপনে ছাড়া আফার আপন কেউ নাই। ভাইজান তাড়াতাড়ি বাসায় আইয়া পড়েন।”

তাজওয়ার কল কেটে তাড়াতাড়ি আহির বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। চুনি আহির কাছে এসে বলল,
“আফা, বেশি কইয়া ফেলছি। রক্ত-টক্ত আরেকটু চাইপা চুইপা বাইর করন যাই না!”

“মানে!”

“ভাইজান রে কইছি আপনি মাইর খাই রক্তে মাখামাখি হই গেছেন।”

আহি হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“চাঁদনি, আমার ব্যথায় হাত জ্বলে যাচ্ছে। আর তুমি আছো রক্ত আরো বের করার চিন্তায়। তবে এক কাজ করা যায়৷ ঘর পরিস্কার করার জন্য একটা বালতি নিয়ে আসো। এরপর আমার রঙের কৌটা থেকে লাল রং বের করে পানির সাথে মিশিয়ে দাও। অন্তত পানি দেখে ভাববে রক্ত মাখা ঘর পরিস্কার করেছো।”

“সস আছে ফ্রিজে। ওইটাও আনি!”

“পাগল! গন্ধ নাকে গেলেই বুঝবে এসব নাটক করছি।”

“আফা, আপনে কি সত্যিই নাটক করতাছেন?”

“হাতে কি মিথ্যে মিথ্যি কাটা দাগ দেখছো?”

“না, আফা। আগে ছোট মেডাম কিছুই কইলেই আপনে কাঁনতেন। আর আজ হাত কাইটা গেছে, আর আপনের চোখেমুখে শয়তানি হাসি।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে চুনির দিকে তাকালো। চুনি দুই গালে হাত ছুঁইয়ে বলল,
“তওবা তওবা। শয়তান তো ছোট মেডাম। আফনে না। ওই ইংরাজি তো কই না। সিপ সিপ কি জানি।”

“স্লিপ।”

“হ হ ওইটাই। সিপ কইরা বাইর হই গেছে। মুখের দোষ। আমার না।”

আহি চোখ ছোট করে চুনির দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে তাজওয়ার আহিদের বাসায় এসে সোজা আহির রুমে চলে গেলো। তাজওয়ারকে আসতে দেখে চুনি দৌঁড়ে এসে বলল,
“আফা একটু মুখটা বাঁকায় রাখেন। ভাইজান রে ওই শয়তান মেডামের বিরুদ্ধের ভালোমতো বুঝাই দিয়েন। কাঁনদেন আফা, কাঁনদেন।”

তাজওয়ার আহির রুমে এসে দেখলো আহি মুখ অসার করে বসে আছে। তাজওয়ারকে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কেন এসেছো এখানে? যা, এই মুহূর্তে আমি তোমার অত্যাচার নিতে পারবো না।”

তাজওয়ার আহির কাছে এসে তার পাশে বসে বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”

আহি ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলতেই তাজওয়ার আহির হাত উলটে দেখলো, হাতের তালুতে দাগ হয়ে গেছে। পাশে চোখ পড়তেই দেখলো বালতির পানিগুলো লাল হয়ে গেছে। চুনি বালতিটা উঠিয়ে নিয়ে বলল,
“স্যার, যে রক্ত!”

আহি চোখ বড় বড় করে চুনির দিকে তাকালো। তাজওয়ার আহির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চুনি চলে যেতেই আহি বলল,
“প্লিজ তাজওয়ার, আমাকে একা ছেড়ে দাও। একা ছাড়তে না পারলে খুন করে চলে যাও।”

“কি হয়েছে বলবে!”

“হরতাল ডেকেছে। আমি না-কি বাসা থেকে আর বেরুতেই পারবো না। অনেক বছর পর আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে পেয়েছি। সামনে ওর বিয়ে। ওর সাথে ইফতারির পর সময় কাটাচ্ছি। ওটাও মিসেস লাবণির সহ্য হচ্ছে না।”

“কোন ফ্রেন্ড?”

“লিনাশা।”

তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে নিচে নেমে গেলো। তাজওয়ার যেতেই আহি আয়নায় নিজেকে দেখে ঠোঁট উল্টে বলল,
“রানীর উপর আইন চাপানোর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে মিসেস লাবণি। তোমার প্রিয় আদুরে হবু জামাই সাহেবই তোমাকে শায়েস্তা করতে এসেছে।”

আহি তার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই হাতে আজ যন্ত্রণার মেহেদি পরেছি, শুধু আমার শত্রুদের হারানোর জন্য। আর আমি তোমাদের সবাইকে হারিয়েই মুক্ত হবো।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||

৭৩।
তাজওয়ার নিচে নেমেই মুনিয়া খালার মুখোমুখি হলো। মুনিয়া খালাকে দেখে সে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“মিসেস লাবণি কোথায়?”

মুনিয়া খালা মাথা নিচু করে বললেন,
“বড় ম্যাডাম তার ঘরে।”

“আহির এই অবস্থা উনি করেছেন?”

মুনিয়া খালা চুপ করে রইলেন। তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“একটা ছুরি নিয়ে আসো।”

মুনিয়া খালা চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। চুনি পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইজান, মাইরা টাইরা ফেলবেন না-কি!”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি একটা কথা দ্বিতীয় বার বলা পছন্দ করি না।”

মুনিয়া খালা পা বাড়ানোর আগেই চুনি দ্রুত পদে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
“আমি যাইতাছি। আম্মার যাইতে যাইতে সকাল হইয়া যাইবো।”

চুনি একটা ধারালো ছুরি এনে তাজওয়ারের হাতে দিয়ে দ্রুত পিছিয়ে গেলো। তাজওয়ার এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ছুরিটা দেখছে। চুনি ঢুক গিলে মায়ের হাত চেপে ধরে বলল,
“আম্মা, সচক্ষে খুনাখুনি দেইখলে কি পুলিশ আমাগোরে ধইরা নি যাইবো?”

মুনিয়া খালা মেয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“চুপ কর ফাজিল মাইয়া। ছুরি দিতে কইলো, আর তুই দিয়া দিলি?”

তাজওয়ার এবার মুনিয়া খালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা প্লেট নিয়ে আসো। আর প্লেট ভর্তি মরিচ আর লবণ নিয়ে আসবে।”

চুনি হেসে বলল,
“যাও আম্মা, আমরা হুদাই ভয় পাইতাছি। স্যার তো আপেল খাইবো, তাই ছুরি আনাইছে।”

মুনিয়া খালা ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“লবণ মরিচ দিয়া আপেল খাই তোরে কে কইছে? পেয়ারা, আমড়া, আমলকি এইসব খাই শুনছিলাম।”

“টেবিলে তো আপেল ছাড়া কিছুই নাই। ওও, হয়তো স্যারের পকেটে আছে। গ্যারেজে দাঁড়াইয়া থাকে পোলাডার পকেটেও ফল থাকে। চুরি কইরা নিয়া আসে। আমারেও দেয়।”

“এহন কি এইসব কইবার সময়? যা ছোড মারে ডাইকা আন। আমি মরিচ নিয়ে আইতাছি।”

মুনিয়া খালা এক প্লেট মরিচ আর লবণ নিয়ে এসে তাজওয়ারের দিকে এগিয়ে দিলো। তাজওয়ার টেবিলে ছুরি আর প্লেটটি রেখে বলল,
“মিসেস লাবণিকে নিচে ডেকে আনো।”

মুনিয়া খালা মাথা নেড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠার আগেই মিসেস লাবণি নিচে নেমে এলেন। তাজওয়ারকে দেখে তিনি ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“তাজওয়ার, তুমি হঠাৎ এখানে?”

তাজওয়ার চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা তুলে বসে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আপনাকে উপহার দিতে এসেছি।”

মিসেস লাবণি মৃদু হেসে বললেন,
“আমাকে উপহার! কীসের!”

“আপনি ভালো করেই জানেন, আপনি আমাকে কি দিয়েছেন। একটা উপহার তো আপনার পাওনা থাকেই।”

মিসেস লাবণি হেসে বললেন,
“বেশ তো! কি সেই উপহার? আমিও তো আগ্রহী আমার হবু জামাইয়ের উপহার গ্রহণ করতে।”

তাজওয়ার হাসলো। কপালে হাত ঘষতে ঘষতে বলল,
“হাত এগিয়ে দিলেই তো পাবেন।”

মিসেস লাবণি দুষ্টু হাসি হেসে বললেন,
“শাশুড়ির সাথে এমন দুষ্টুমি মানায় না।”

“ইয়াং শাশুড়ির সাথে সবকিছুই মানায়। আফটার অল, শাশুড়ি মা তো আমার বয়সী।”

মিসেস লাবণি হাত এগিয়ে দিলেন। তাজওয়ার চোখের পলকেই টেবিল থেকে ছুরিটা নিয়ে লাবণির হাতের তালুতে চালিয়ে দিলো। মুনিয়া খালা তা দেখে ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। লাবণি চিৎকার করে উঠলো। লাবণির চিৎকার শুনে আহি আর চুনি অবাক দৃষ্টিতে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। এদিকে লাবণি হাত চেপে ধরে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই তাজওয়ার তার হাত ধরে রক্তমাখা স্থানটি লবণ-মরিচ মিশ্রিত প্লেটের উপর এনে রাখলো। লাবণি তাজওয়ারকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তাজওয়ার আরো শক্ত করে তাকে চেপে ধরে বলল,
“আহিকে আঘাত করার অধিকার কারো নেই। যে আহিকে আঘাত করবে, আমি তার অস্তিত্ব মিটিয়ে দেবো। আহিকে ভালোবাসার অধিকার আমার, আঘাত করার অধিকারও আমার।”

আহি নিচে নেমে লাবণির এই অবস্থা দেখে তাজওয়ারের দিকে দৌঁড়ে এগিয়ে এলো। আর চেঁচিয়ে বলল,
“পাগল তুমি!”

তাজওয়ার ভাবলেশহীন সুরে বলল,
“তোমাকে দেওয়া আঘাতের চেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছি আমি। আগামী এক সপ্তাহ বাম হাতেই সব কাজ সারতে হবে।”

আহি চুনির দিকে তাকালো। চুনি মুখ চেপে হাসছে। আহি নিজের হাসি আটকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বলল,
“তুমি কেন আমার জন্য উনাকে আঘাত করছো? আমার জন্য কারো কিছু করতে হবে না। আমার ভাগ্যে এসবই আছে।”

লাবণি চেঁচিয়ে বলল, “অভিনয় বন্ধ করো, আহি।”

তাজওয়ার ভয়ংকর দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকাতেই লাবণি চুপ হয়ে গেলো। তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। চলো আমার সাথে।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, তাজওয়ার। আমার ভালো লাগছে না। তুমি ডাক্তার বাসায় নিয়ে আসো। আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”

এদিকে লাবণি হাত পরিস্কার করে মুনিয়া খালাকে বললেন হাতে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার জন্য। মুনিয়া খালা শশব্যস্ত হয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। লাবণি এবার কাতর মুখে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাজওয়ার কিছু বলার আগেই তিনি বললেন,
“আহি কি তোমাকে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে কিছু বলেছে? দেখো, আমি কিন্তু ওর হাতে ব্যথা দেই নি। ও নিজেই এমন করেছে।”

আহি অবাক দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার কাছে প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ নেই তাই সবাই আমার সাথে যা ইচ্ছে ব্যবহার করছে।”

আহি এবার তাজওয়ারের হাতে সেই ছুরিটা দিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“প্লিজ কিল মি, আমি এসব আর নিতে পারছি না।”

আহি মাথায় হাত চেপে ধরে বলল,
“শরীরটা অবশ হয়ে আসছে আমার।”

তাজওয়ার আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চোখ-মুখ কুঁচকে মনে মনে বলল,
“এই বেটা জড়িয়ে ধরার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করবে না!”

তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “আ’র ইউ ওকে?”

লাবণি বললেন,
“আহি ঠিকই আছে। এসব ওর নাটক। বিশ্বাস করো না ওকে। ও নিজেই নিজের হাত কেটেছে।”

তাজওয়ার রাগী স্বরে বলল,
“কেন কাটবে নিজের হাত? নিশ্চয় আপনিই ওকে বাধ্য করেছেন!”

“বাধ্য করি নি৷ শুধু বলেছি রাদের সাথে সেহেরি পর্যন্ত ঘুরাঘুরি না করতে।”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“রাদ এসবের মধ্যে কেন আসছে? রাদের সাথে আমি ঘুরাঘুরি করি আপনাকে কে বলেছে? যদি এই মুহূর্তে আপনি প্রমাণ করতে পারেন, আমি এতোদিন রাদের সাথে ঘুরেছি, তাহলে আমি এক্ষুণি নিজের প্রাণ নিয়ে নেবো।”

“আচ্ছা, তাহলে তোমার নতুন কোনো প্রেমিক নিশ্চয়?”

তাজওয়ার রাগী স্বরে বলল,
“আহি ওর ফ্রেন্ড লিনাশার সাথে ছিল।”

মিসেস লাবণি তাজওয়ারের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। পরক্ষণেই তিনি বললেন,
“তোমাকে কে বলেছে?”

“আহি বলেছে।”

তাজওয়ারের কথায় লাবণি এবার বিস্তর হাসলেন। এরপর হাসি আটকে বললেন,
“আর তুমি বিশ্বাসও করলে?”

“মানে!”

“আরেহ, লিনাশা আমার বোন। তুমি কি লিনাশার ব্যাপারে কিছু জানো না? লিনাশা আর আহির দেখা হওয়া অসম্ভব। ওদের তো কোনো যোগাযোগও নেই। লিনাশা তো আহিকে সহ্যই করতে পারে না।”

আহি মনে মনে হাসলো। তাজওয়ার আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি এবার চুনিকে বলল,
“চাঁদনি, আমার ফোনটা নিয়ে আসো।”

লাবণি বললেন, “ফোন দিয়ে কি করবে?”

“আমাকে তো লিনাশা সহ্যই করতে পারে না। আমিও সবাইকে জানাতে চাই, লিনাশা আমাকে কি পরিমাণ ঘৃণা করে।”

চুনি ফোন নিয়ে আসতেই আহি ফোনের লগ তাজওয়ারকে দেখিয়ে বলল,
“এটাই ফাইনাল, আজকের পর থেকে কেউ যদি আমার প্রাইভেসি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, না আমি এই বাসায় থাকবো, না আমি তোমাকে বিয়ে করবো। অসহ্য লাগছে এসব! আমি মানুষ, কোনো যন্ত্র নই।”

আহি এবার লিনাশার নম্বরে ডায়াল করলো। এরপর কলটা লাউড স্পিকারে রাখলো৷ লিনাশা হ্যালো বলতেই লাবণি চমকে উঠলো। লিনাশা বলল,
“আহি, আমি একটু পর তোকেই ফোন করতাম। চল আজ রাতে জুয়েলারি শপে যাই। বিয়ের পর পরার জন্য কিছু চুড়ি কিনবো ভাবছি।”

আহি লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আজ বাদ দে। আমার হাত কেটে গেছে।”

লিনাশা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কীভাবে কাটলো?”

“এসব বাদ দে। ওমন কিছু হয় নি। আমি এখ রাখছি। পরে কথা হবে।”

আহি কল কেটে দিয়ে লাবণিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বন্ধুত্বে মান অভিমান থাকে, কিন্তু ঘৃণা করা, অসহ্য লাগা এই শব্দগুলো বন্ধুত্বে মানায় না।”

লাবণি কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাজওয়ার বলল,
“আহির সাথে ফার্দার এমন বিহেইভ করলে, আমি এবার হাতে ছুরি চালিয়েছি মাত্র। পরের বার হাতটাই কেটে দেবো। আহির যা ইচ্ছে করবে, আপনার অনুমতির প্রয়োজন নেই। রানী কারো অনুমতি নেয় না। একমাত্র রাজার আদেশ ছাড়া সে কারো আদেশে চলতে বাধ্য নয়। আর আহি তাজওয়ার খানের রানী।”

তাজওয়ার কথাটি বলে আহির কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়লো। আর যাওয়ার আগে বলল, সে ডাক্তার পাঠিয়ে দেবে।

এদিকে তাজওয়ার চলে যেতেই আহি লাবণির সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবণি ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি লাবণির হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাজা যেই হোক, রানীর ক্ষমতার কাছে তার সবটাই শূন্য। দাবার ঘরে যেমন রানীর আধিপত্য বেশি, এবার আপনার চক্রে আমার আধিপত্য বেশি। এবার দেখা যাক, মিসেস লাবণি মেহেরার আধিপত্য কতোদূর?”

লাবণি রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,
“তোমার এমন পরিণতি করবো, তুমি আর নিজের চেহারাও আয়নায় দেখতে চায়বে না।”

৭৪।

আহি মলিন মুখে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। তাজওয়ার তার সামনে বসা। দু’জনই আজ একসাথে ইফতার করেছে। আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি গতকাল মিসেস লাবণির সাথে যা করেছো ঠিক করো নি। এটা অন্যায়। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না। উনি আমার উপর এতো অত্যাচার করেছে, সেই তুলনায় তার হাতে দেওয়া ক্ষতটা একদম নগন্য।”

আহি তাজওয়ারের হাত ধরে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমি মাকে হারিয়েছি একমাত্র উনার জন্য। শুধু মাকে নয়, লিনাশার সাথেও অনেক বছর আমার যোগাযোগ ছিল না। তোমাকে আমি বিয়ে করতে কেন ভয় পাচ্ছি, জানো? কারণ আমি জানি তুমি সব মেয়েদের সাথেই মেলামেশা করো। বাবাও তেমন ছিল। আর এরপর বাসায় এসে আমার মাকে কষ্ট দিতো। আমি এসব দেখে বড় হয়েছি। আমার মন ভেঙে গেছে, তাজওয়ার। আমি সহ্য কর‍তে পারি না এসব।”

তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“আমি তোমার সাথে এমন করবো না, আহি। তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দেবো না।”

আহি মলিন মুখে বলল,
“বিশ্বাস তো হচ্ছে না। তবুও এই মুহূর্তে তোমাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। কেন করছে, জানি না।”

তাজওয়ার মুচকি হাসলো। আহির হাতে তার ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“তুমি হয়তো আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো, আর এটা তুমি বুঝতেই পারছো না।”

আহি মনে মনে বলল, “বয়েই গেছে আমার!”

এবার তাজওয়ার বলল,
“কাল আমার বন্ধু একটা পার্টি এরেঞ্জ করেছে। তুমি সন্ধ্যার পর তৈরী থেকো।”

“রমযান মাসে কীসের পার্টি!”

“আরেহ ওরকম কিছু না৷ সবাই একসাথে ডিনার করবো।”

“ইফতারের আয়োজন করতে পারতো। আমার এসব বোরিং লাগে। আর তোমার ফ্রেন্ডদের আমি মোটেও বিশ্বাস কর‍তে পারি না। বিয়ের পর অন্তত ওরা যাতে আমার সামনে না আসে।”

তাজওয়ার মুচকি হেসে বলল,
“তুমি যা বলবে, তাই হবে। কিন্তু পার্টিটা এটেন্ড করতেই হবে। প্লিজ আহি, না করো না। তোমাকে অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। আফটার অল, আমাদের এনগেজমেন্টের পর কোথাও ঘোরা হয় নি।”

তাজওয়ারের অনুরোধে পরদিন আহি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলো। কালো জামদানী শাড়ি পরে এসেছে আহি। গাড়ি থেকে নামতেই সে চমকে উঠলো। কারণ তাজওয়ার তাকে মিথ্যে বলেছিল। এটা কোনো সাধারণ অনুষ্ঠান না। আশেপাশে মৃদু আলো জ্বলছে। সুইমিংপুলের পাশে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে। পাশে খোলামেলা পোশাক পরে অনেকগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে নেশাদ্রব্য গ্রহণ করছে। আহি তাজওয়ারের দিকে তেড়ে এসে বলল,
“এটা তোমার বন্ধুর ডিনার পার্টি!”

তাজওয়ার বলল, “রিল্যাক্স।”

তখনই পেছন থেকে আফিফের কন্ঠ ভেসে আসতেই আহি পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো আফিফ সবাইকে ওয়াইন গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে। আহি তা দেখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হচ্ছে এসব?”

তাজওয়ার বলল,
“আরেহ তুমি জানো না? আফিফ রাফাত এখন আমার পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট!”

“পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট কি ওয়েটারের কাজ করে?”

“তাজওয়ার খানের এসিস্ট্যান্টকে সব করতে হয়। তোমার কেন সমস্যা হচ্ছে, আহি?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আফিফ আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড। জিনিসটা দেখতেই দৃষ্টিকটু লাগছে।”

“কাম অন সুইটহার্ট। এমন ফ্রেন্ড বানাও কেন, যাদের ক্লাসই তোমার সাথে ম্যাচ করে না!”

আহি বিরক্ত মুখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আফিফকে ডাকতেই আফিফ আর আহির চোখাচোখি হলো। আফিফ চোখ নামিয়ে ট্রে নিয়ে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার বাঁকা হেসে একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচাতেই মেয়েটি এলোমেলো পা ফেলে আফিফের দিকে এগিয়ে এলো। আফিফের কাছাকাছি আসতেই মেয়েটি আফিফকে হালকা ধাক্কা দিলো, আর ওমনি আফিফের হাতে থাকা গ্লাসটি উলটে গেলো, আর গ্লাসে থাকা সব এলকোহল মেশানো পানীয় আহির শাড়িতে ছিঁটকে পড়লো। আহি কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই আফিফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“সরি, সরি।”

তাজওয়ার হুট করে সবার সামনে আফিফের গালে সশব্দে চড় বসিয়ে দিলো। আফিফ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি নিজেও অবাক। সে তাজওয়ারের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“পাগল হয়ে গেছো?”

“আমাকে পাগল বলছো তুমি? দেখলে না ও কি করলো?”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে