উধয়রনী পর্ব-১৮+১৯

0
98

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৮||

৩১।
লাগেজ থেকে পুরোনো জামা-কাপড় বের করছে পদ্ম। ঘরের বাইরে গেট ধরে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তার ছেলের জন্য এক সেট জামা খুঁজতে এসেছেন। তাই আফিফের পুরোনো শার্টগুলোই বের করছিলো পদ্ম। আফিফ সবে মাত্র ঘরে ঢুকেছে। আর তখনই পদ্ম লাগেজ থেকে একটা বই বের করলো। বইয়ের প্রচ্ছদটি দেখে পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এপাশ-ওপাশ উলটে পদ্ম বলল,
“নাম ছাড়া বই?”

আফিফ তখন শার্টের হাতা ভাঁজ করছিলো। পদ্মের কন্ঠে তার বইটির দিকে চোখ পড়লো। মুহূর্তেই চমকে উঠলো সে। পদ্ম বইটি আফিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার বই?”

আফিফ ঘাবড়ে গেলেও পদ্মের সামনে তা প্রকাশ করলো না। সে বইটি পদ্মের হাত থেকে নিয়ে বলল,
“এটা এই লাগেজে ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“আমি অনেক খুঁজেছিলাম। ভেবেছি বাসা চেঞ্জ করার সময় হারিয়ে ফেলেছি।”

“বইয়ের উপর যে নাম নেই! কার লেখা?”

“নাম ছাড়া বই। লেখকের কোনো পরিচয় নেই। এসব বাদ দাও। লাগেজে কি খুঁজছিলে?”

“আপনার পুরোনো জামা বের করছি। বাইরে একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন না, উনার ছেলের জন্য বের করছিলাম।”

আফিফ প্রতিত্তোরে হাসি ফেরত দিয়ে বইটি হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

গুমোট বাতাবরণ বিরাজ করছে আজ। বারান্দায় দাঁড়ালেই হালকা হাওয়া গায়ে লাগে। দু’তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকে আফিফরা। পুরোনো বাড়ি। উপরে ছাদ থাকায় সূর্যের তাপে ঘর গরম হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে একটু বেশিই কষ্ট হয় তাদের। এই বাসার মালিক দু’মাস পর পর ভাড়া নেন। দুই মাসে দশ হাজার টাকা। নিচতলা থাকার অনুপযোগী। বর্ষাকালে এই রাস্তায় বেশ পানি উঠে। তবে সামনের রাস্তাগুলো উঁচু হওয়ায় বাড়িটা নিচের দিকে চলে গেছে। বাড়ির মালিক ঢাকায় থাকেন। খুব শীঘ্রই তিনি এই জায়গাটা ডেভেলাপারকে দিয়ে দেবেন। যতোদিন দেবেন না, ততোদিন আফিফের জন্যই ভালো। শহর উন্নত হচ্ছে, বাসা ভাড়া বাড়ছে। বাড়ছে না শুধু আফিফের বেতন। যেখানে দু’মাস হচ্ছে তার চাকরি নেই। এই শহরে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। তবুও সে ধৈর্য নিয়ে চাকরি খুঁজছে।

আফিফ খোলা বারান্দার রেলিঙ ঘেষে দাঁড়ালো। হাতে থাকা বইটির প্রচ্ছদে আলতো করে আঙ্গুল ছোঁয়ালো। অস্ফুটস্বরে বলল, “ক্ষণকালের খেয়াল।”

বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়েই থেমে গেলে আফিফ। চোখ বন্ধ করে বলল,
“আমি আমার পদ্মফুলকে ভীষণ ভালোবাসি।”

আফিফ রুমে ঢুকে দেখলো পদ্ম জামাগুলো নিয়ে মহিলাটিকে দিতে চলে গেছে। আফিফ লাগেজটির ভেতরে বইটি রেখে দিয়ে লাগেজটি আবার আলমারীর উপরে তুলে রাখলো। পদ্ম রুমে ঢুকতেই আফিফ তার কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“তুমি এতো লক্ষী কেন বলো তো?”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “হঠাৎ এতো ভালোবাসা!”

আফিফ পদ্মের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বলল,
“হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, আমার তো পদ্মফুল একটাই আছে।”

পদ্ম আফিফের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“একটা কথা বলি আপনাকে?”

আফিফ পদ্মের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“হুম, হুম। বলো।”

পদ্ম বলল,
“আহি বললো চাইলে আমরা অন্যভাবেও বাচ্চা নিতে পারবো।”

আহির নাম শুনে আফিফ পদ্মকে ছেড়ে দিলো। তবে পদ্ম বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নিলো। সেকেন্ড খানিক পর আফিফ নিজেই পদ্মের হাত ধরে তাকে বিছানার উপর বসালো। নিজেও পা গুটিয়ে পদ্মের মুখোমুখি বসলো। পদ্ম আফিফের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“মাকে গিয়ে বলুন না, বাচ্চা নেওয়ার অনেক পদ্ধতি আছে।”

“আচ্ছা, বলবো।”

“শুনুন না।”

“বলো, শুনছি।”

“ওসব পদ্ধতিতে অনেক টাকা লাগে।”

“হুম। লাগবে স্বাভাবিক।”

“তখন আমি নিশ্চিত মা হতে পারবো। এখন তো ডাক্তার দেখাতে গিয়েই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের খরচে সঞ্চয়টাও শেষ হয়ে গেছে। যদি সেই পদ্ধতিতে বাচ্চা নেই, তাহলে আমরা সত্যিই বাবা-মা হতে পারবো। অনিশ্চয়তা নেই।”

“হবো একদিন। তুমি তো আছোই।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি আমার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না। আমি বোঝাতে চাইছি, পদ্ধতিটার জন্য অনেক টাকা লাগবে। আপনার চাকরি দরকার। টাকা ছাড়া কি কিছু হয়?”

আফিফ পদ্মের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,
“জানতেই তো আমি বেকার, তবুও তো বিয়ে করেছিলে। আজও আমি বেকার, একটু তো ধৈর্য রাখো। আমি চাকরি খুঁজছি।”

পদ্ম আফিফের গালে হাত রেখে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমার কি কোনো শখ-আহ্লাদ আছে? আপনিই আমার সব শখ-আহ্লাদ। আপনাকে হারিয়ে ফেললে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। আফিফ, ভয় পাচ্ছি আমি। আপনার বুকে অন্য কেউ মাথা রাখুক আমি সহ্য করতে পারবো না। ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে সহ্য করা যায় না, আফিফ।”

পদ্মের কথায় আফিফ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। পদ্ম আফিফের হাত ঝাঁকুনি দিতেই সে পদ্মকে বলল,
“পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যারা ভালোবাসার মানুষকে পায় না। তারা কিন্তু বেঁচে আছে। ভালোই আছে। এমন অনেকেই আছে যারা ভালোবাসতে না পারলেও কাউকে ভীষণ ভাবে চায়, কিন্তু বাস্তবতা তো কল্পনার ঊর্ধ্বে। আর তারাও কিন্তু নতুন মানুষকে নিয়ে খুব সুখেই থাকে। আর তুমি? তুমি তো আমার পদ্মফুল। পদ্মফুলের অধিকার কেউ নিতে পারবে না।”

৩২।

বাসে উঠেই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো আহি। পুষ্প আহির উৎকন্ঠিত চাহনি দেখে তার হাতটি শক্ত করে ধরলো। আহি পুষ্পের দিকে তাকাতেই পুষ্প বলল,
“ভয় পাচ্ছিস কেন?”

আহি বিচলিত কন্ঠে বলল,
“বাবা যদি কাউকে আমার পিছু পাঠায়?”

“কতোবার বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলি৷ কখনো পাঠিয়েছিল?”

“তখন আর আজ এক নয়, পুষ্প। তখন আমি সত্যিই ঘুরতে গিয়েছিলাম। আর আজ আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”

“আংকেল এতোকিছু ভাবছেনই না। আর আমি তো তোর সাথেই আছি। আচ্ছা, তোর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিলেন না? ওই আন্টিটা কেমন রে!”

আহি পুষ্পের কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। লিনাশার বোনই যে আহির বাবার বর্তমান স্ত্রী এই কথা পুষ্প, পদ্ম কেউই জানে না৷ রাদ আর লাবীব মিসেস লাবণিকে চেনে। কারণ আহি ইউকেতে থাকাকালীন ছুটি পেলেই লাবণি আর রিজওয়ান কবির আহিকে দেখতে যেতো। তবে তারা এটা জানে না, যে সে লিনাশার বোন। কারণ তারা লিনাশার বড় বোনকে কখনো দেখে নি। এদিকে পুষ্প আর পদ্ম অনেকবার লাবণিকে দেখেছিল। যেহেতু তারা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল। লিনাশার বাসায় অনেক বার যাওয়া হয়েছিলো তাদের। সেই সূত্রেই পরিচিতি। তবে পুষ্প আর পদ্ম এতোটুকু জানে রিজওয়ান কবির দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।

পুষ্প আহির মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গেলি?”

আহি মলিন মুখে বলল,
“ভালো না উনি। অনেক জঘন্য। বাবা আগে আমার সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার করে নি। কিন্তু উনাকে বিয়ে করার পর থেকে বাবা পালটে গেছে।”

“বাদ দে। মন খারাপ করিস না। ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে। দেখ, পদ্মের কি অবস্থা! তার শাশুড়ি তার মাথা খেয়ে ফেলছে। তবে একদিকে পদ্মের ভাগ্য ভালোই, তার বরটা ভালো। নয়তো কেউ এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে এতোটা ভালোবাসে, বল?”

আহি মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
“জানি সে ভালো। তাই তো আমার ভালোবাসার জায়গাটা একমাত্র সে-ই দখল করে নিয়েছে। সে সবার চেয়ে আলাদা। তাই হয়তো আমার মন-মস্তিষ্কে সে এখনো গেঁথে আছে। হোক, সে অন্য কারো মানুষ। বাসুক না হয় অন্য কাউকে ভালো। সুখে থাকুক তারা। আমি তাকে তবুও ভালোবাসবো। কল্পনায় সে আমার সেই ফেলে আসা, এআর। আমার ডাইরির প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে প্রাণহীন তার প্রতিটি মুহূর্ত। আমি তাকে যেভাবে অনুভব করেছি আর কেউ সেভাবে অনুভব করতে পারবে না। পদ্ম শুধু তাকে স্পর্শ করতে পেরেছে। কিন্তু আমি তাকে ধারণ করে ফেলেছি। তার প্রিয় রং, প্রিয় ফুল, প্রিয় অভ্যাস, সবই আমার, একান্তই আমার।”

(***)

বাস চলছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। দুই ঘন্টার রাস্তা৷ আহি জানালার পাশে বসেছে। এখন জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। তবুও গরমের উত্তাপ যেন একটুও কমে নি। বাস চলছে বিধায় আরামবোধ করছে আহি। ইচ্ছে করছে হাত বের করে দিয়ে গলায় ঝুলানো উড়নাটি আঙ্গুলের ডগায় ঝুলিয়ে আজকের দিনটি উপভোগ করতে। কারণ আজ সে তার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। কিন্তু আহি এমনটা করতে পারবে না। লোকে দেখলে পাগল বলবে। মানুষের মনে অনেক উদ্ভট ইচ্ছা জন্মে। এসব ইচ্ছেগুলো দমিয়ে রাখতে হয়। সব ইচ্ছে পূরণ করতে গেলে আবার সভ্য সমাজে উন্মাদ আখ্যায়িত হবে সে।

বাস শহর ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় উঠে গেছে। রাস্তার ধারগুলো এতো মায়াবী দেখতে! সারি সারি গাছ, ওপাড়ে সবুজ মাঠ। আহির ইচ্ছে করছে ছবি আঁকতে। কিন্তু হাতে তো রং-তুলি, ক্যানভাস কিছুই নেই। ছবি আঁকতে পারলে নিশ্চয় ছবিটি নাম দিতো আহি। সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল,
“স্বপ্নীল পথ। যেই পথ নিয়ে যায় আপন মানুষের কাছে। সে আহির আপন মানুষ।”

দেড় ঘন্টা পর বাস তাদের চন্দ্রঘোনা নামিয়ে দিলো৷ সেখান থেকে ফেরি পার হয়ে যেতে হয় অন্য পাড়ে। আর সেখানে অনেকগুলো গ্রাম। আহির মায়ের বাড়ি আর রাদের বাবার বাড়ি পাশাপাশি। পাহাড়ি এলাকাও আছে সেইদিকটাই। আহি অনেক বছর পর এসেছে। তাই জায়গাটার নাম জানে না সে। রাদের পিছু পিছু যাচ্ছে তারা। রাদ একটা সিএনজি ঠিক করলো। সিএনজিতে উঠেই তারা ফেরি পার হলো। রাইখালি বাজার পার করতেই তারা রাদের বাড়ির সামনে চলে এলো। পুষ্প সিএনজি থেকে নেমে চোখে সানগ্লাস পরে বলল,
“রাদ, এদিক থেকে তো বান্দরবানও যাওয়া যায়!”

রাদ ভাড়া মিটিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। যাওয়া যাবে। তোমরা তো বেশি সময় নিয়ে আসো নি। আর বান্দরবান একদিনে ঘুরে দেখা যায় না। অন্তত হাতে তিন দিন সময় নিয়ে আসতে হবে। আর এই ঋতুতে ভীষণ অসহ্যকর লাগে ট্যুর দিতে।”

লাবীব বলল,
“বর্ষা শুরু হলে যাওয়া যাবে।”

“বর্ষায় বান্দরবান যাই নি আমি। ওই সময় সীতাকুণ্ডের ঝর্ণাগুলোতে যাওয়া যায়। এদিকে না হয় আবার শরতের শেষে আসবো।”

এদিকে আহি মনোযোগ দিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। সে অনেক বছর পর নানার বাড়ি এসেছে। জায়গাগুলো তার কাছে অচেনা। একটা দোকানের নামফলকে লেখা রাইখালি, কাপ্তাই রাঙ্গামাটি। এতেই বুঝে নিয়েছে সে তার নানার বাড়ির আশেপাশেই আছে। পুষ্প সামনে উঁচু সিঁড়িটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাদ, তুমি কি উপজাতি?”

পুষ্পের প্রশ্নে আহি শব্দ করে হাসলো। আহিকে হাসতে দেখে রাদ তার দিকে তাকালো। কতো বছর পর এই মেয়েটা শব্দ করে হাসছে! কি প্রাণোচ্ছল সেই হাসি! রাদ আর পুষ্পের উপর রাগ করলো না। হালকা হেসে বলল,
“দাদা রাউজান থেকে এসে এখানে বাড়ি করেছেন। তাই এটা আমাদের বর্তমান দাদার বাড়ি।”

“রাউজানে কি হয়েছিল?”

“ওটা দাদার বাবার বাড়ি ছিল। দাদা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছেন। এখন আমার বাবা-চাচা এখানেই আসে।”

পুষ্প সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“তাহলে শ’খানেক সিঁড়ি পার করে তোমাদের উপরে উঠতে হয়।”

রাদ চোখ ছোট করে বলল,
“মাত্র ত্রিশ ধাপ!”

সিঁড়ি পার করতেই দৃশ্যমান হলো কিছু বাড়ি। রাদের বাড়ি ডানদিকে। আর আহির নানার বাড়ির বামদিকের পেছনের অংশ জুড়ে। রাদ বাড়ির লোহার গেটে জোরে জোরে ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে মাঝবয়সী এক নারী বেরিয়ে এলেন। তিনি রাদকে দেখে রীতিমতো অশ্রু ফেলতে লাগলেন৷ ভেতর থেকে চেঁচিয়ে কয়েকজনের নাম ধরে ডাকলেন। ছোট ছোট তিনটে বাচ্চা, দু’জন কিশোরী, দুই জন যুবতী আর একজন বয়ষ্ক পুরুষ বেরিয়ে এলেন। একজন বৃদ্ধাও বাড়ির ভেতর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আহির কাছে সবকিছুই কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এমন ঊষ্ণ অভ্যর্থনা সে জীবনে প্রথম দেখেছে। রাদ বয়ষ্ক লোকটির পা ধরে সালাম করলো। তারপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বড় চাচা।”

আহিও রাদের দেখাদেখি তার পা ছুঁয়ে দিলো। রাদ চাচার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। পুষ্প আর লাবীবও চাচাকে পা ধরে সালাম করতে যাবে তখনই তিনি আটকালেন। রাদের বড় চাচী তাদের ভেতরে নিয়ে গেলো। কিশোরী দু’জন রাদের ছোট চাচার মেয়ে। বড় দুই যুবতীর একজন রাদের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী, আরেকজন রাদের বড় চাচার মেয়ে। সে তার দুই ছেলেকে নিয়ে নাইওরে এসেছে। অন্য বাচ্চা মেয়েটি রাদের চাচাতো ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটির নাম নোহিন। বয়স পাঁচ বছর। আহির মেয়েটিকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সে একটু পর পর মেয়েটির গাল টেনে দিচ্ছে। মেয়েটিও প্রতিত্তোরে আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। গাল টানাটানি তার একদমই পছন্দ না। কিন্তু সে লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। কারণ নতুন মানুষদের সাথে সে অভিমান করতে পারে না। এদিকে নোহিন রাদকেও চিনতে পারে নি। রাদ যখন ইউকেতে যাচ্ছিল, তখন নোহিন মাত্র কয়েক মাসের ছিল।

এদিকে রাদের দাদি রাদকে চিনতে পারছেন না৷ বয়স বেশি হয়েছে তার। স্মরণ শক্তি কমে গেছে। কিন্তু আহিকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। আহির নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। বেশ গল্প জুড়িয়ে দিলেন। হঠাৎ আহিকেই কেন তার এতো পছন্দ হয়েছে, তা কেউই বুঝতে পারলো না।

(***)

অনেকক্ষণ হয়ে গেলো রাদের কোনো খোঁজ নেই। লাবীব আর পুষ্প সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়াচ্ছে, লাবীব তাকে ছবি উঠিয়ে দিচ্ছে। আহি বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
“রাদকে দেখেছিস?”

পুষ্প বলল,
“না। ওকে তো চাচার সাথে বাইরে যেতে দেখলাম।”

আহি মলিন মুখে ঘরে ঢুকলো। তার মন মাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে। সে কিছু একটা ভেবে রাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। তাকে মেইন গেটের কাছে আসতে দেখে পুষ্প বলল,
“এই আহি, কোথায় যাচ্ছিস?”

“তোরা এখানে থাক। আমি একটু হেঁটে আসি।”

লাবীব বলল,
“রাদ তোকে একা বাইরে না যেতে বলেছে। আমরা সহ আসছি।”

লাবীব আর পুষ্পও আহির পেছন পেছন গেলো। আহি বলল,
“পেছনের বাড়িটা আমার নানার বাড়ি, যতোটুকু আমার মনে আছে।”

“এভাবে না জেনে যাওয়ার কি দরকার? রাদ আসুক।”

“আমি অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরেছি। আর পারবো না। আর রাদ এভাবে আমাকে বসিয়ে রেখে কেন চলে গেলো? ওর উচিত ছিল আগে মায়ের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দেওয়া।”

(***)

আহি পেছনের বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালো। দেয়ালে খোদাইকৃত নামফলক, আফজাল নিবাস। আহির নানার নাম।
আহির তিন মামা। বড় মামা দেশের বাইরে থাকেন। মেজ মামা গ্রামে থাকেন। ছোট মামাও এখানেই থাকতেন। আহির বাবা-মার যখন তালাক হয়েছিল, তখন তিনি ঢাকায় চলে যান। আর সালমা ফাওজিয়া আফজাল সাহেবের একমাত্র মেয়ে।

এদিকে আহি নানার নামফলকে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গেটের হাতলটি দিয়ে লোহার গেটে দু’বার ধাক্কা দিলো। একটু পর ভেতর থেকে লোহার গরাদটি টানার শব্দ হলো। আর মুহূর্তেই সে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেললো যেন। হয়তো মায়ের সাথে দেখা হবে সেই উত্তেজনায়। গেট খুলতেই একটি মেয়ে দৃশ্যমান হলো। সে জিজ্ঞেস করলো, “কাকে চান?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সালমা ফওজিয়া থাকেন না এখানে?”

মেয়েটি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ফুপ্পি!”

আহি মেয়েটির হাত ধরে বলল,
“উনি তোমার ফুফু?”

মেয়েটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আহি বলল,
“আমি আহি।”

“আহি আপু?”

“হ্যাঁ।”

মেয়েটি দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেলো। আহিও গেট খোলা পেয়ে ভেতরে পা বাড়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আহির মেজ মামী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি আহিকে দেখে সামনে এগুতে যাবেন তখনই আহির মেজ মামা রাগান্বিত মুখে বাড়ির বাইরে এসে বললেন,
“এই মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দিলি কেন?”

মামী তার হাত ধরে আটকালেন। কিন্তু তিনি চুপ হলেন না। বাজখাঁই সুরে বললেন,
“লম্পট বাবার সাথে থেকে তার মেয়ে লম্পট হয় নি এর নিশ্চয়তা কি?”

মামার মুখে এমন কথা শুনে আহির মুখে অন্ধকার নেমে এলো। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, চল এখান থেকে।”

আহি পুষ্পের হাত সরিয়ে দিয়ে মামার সামনে এসে দাঁড়ালো। আর শান্ত কন্ঠে বলল,
“কেমন আছো মেজমামা? কতো বছর পর দেখলাম!”

আহির প্রশ্নের কোনো উত্তর এলো না। আহি এবার মামীর দিকে তাকালো। ভদ্রমহিলা স্বামীর হাত ধরে রেখেছেন। মনে হচ্ছে এই হাত ছাড়া পেলেই ভদ্রলোক আহিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন। আহি মাথা নিচু করে বলল,
“আমি জানি তোমরা আমার বাবাকে ঘৃণা করো। কিন্তু এখানে আমার কি অপরাধ, বলো? আমার কি ইচ্ছে করে না আমার মায়ের সাথে থাকতে? মাকে দেখতে? মা ছাড়া বড় হচ্ছি আমি। আমি তোমাদের বিরক্ত করবো না। শুধু মায়ের সাথে দেখা কর‍তে এসেছি। মাকে এক নজর দেখেই চলে যাবো। একটু অনুমতি দাও।”

ভদ্রলোক রাগী স্বরে বললেন,
“তোর বাবা আমাদের পথে বসিয়ে দিয়েছে। আমার বোনের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। রিজওয়ান কবিরের ছায়াও আর আমার বোনের জীবনে পড়বে না। দূর হ এখান থেকে। আমাদের জীবনে কখনো ফিরে আসবি না। তোর কোনো মা নেই।”

আহি অশ্রুসিক্ত নয়নে হাতজোড় করে বলল,
“অনেক আশা নিয়ে এসেছি, মামা। প্লিজ, মাকে একটু দেখতে দাও। দূর থেকেই দেখবো না হয়। একটু তো দেখে যাই। প্লিজ মামা।”

আহির কাকুতি মিনতি দেখে পুষ্পের চোখ ভিজে গেলো। লাবীব এখনো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে আহির মামার চেঁচামেচি শুনে ভেতরে ঢুকার সাহস পেলো না। এদিকে আহির মেজ মামা তার কান্নাভেজা চাহনি উপেক্ষা করে স্ত্রীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
“এই মেয়েকে এখনি বের হয়ে যেতে বলো। ও যদি না যায়, আমি নিজেই ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবো।”

আহি মলিন মুখে বাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির মেজ মামী করুণ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“রাদ আসুক। ও নিশ্চিত মামাকে মানিয়ে নেবে।”

আহি কোনো উত্তর দিলো না। সে এলোমেলো ভাবে হেঁটে গেটের কাছে আসতেই তার সেই কিশোরী মামাতো বোনটি দৌঁড়ে এলো। তার হাবভাব দেখে বোঝা গেলো, সে আবার গেট লাগাতে এসেছে। আহি বেরিয়ে যেতেই মেয়েটি গেটের বাইরে হাত বের করে দিয়ে বলল,
“আহি আপু, মা বলেছে তোমাকে দিতে।”

আহি দেখলো মেয়েটির হাতে একটা চিরকুট। আহি চিরকুটটি নিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটি গেট বন্ধ করে দিলো। আহি চিরকুটটি খুলে দেখলো একটা ফোন নম্বর। পুষ্প বলল,
“হয়তো আন্টির নম্বর দিয়েছে।”

লাবীব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে পুষ্প ইশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিলো। এদিকে আহি নম্বরটি দেখেই অস্থির হয়ে গেলো। সে লাবীবকে বলল,
“তোর ফোনটা একটু দে। আমি এই নম্বরে কল দিয়ে দেখি।”

লাবীব বলল,
“আমার ফোন তো রাদের বাড়িতে চার্জে দিয়েছি। তোর ফোন কোথায়?”

“সিমটা বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা। বাবা যদি কল রেকর্ড বের করে ফেলে? বাবা চাইলেই যে-কোনো কিছু করতে পারে।”

পুষ্প তার ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমরটা থেকে ট্রাই কর।”

আহি কাঁপা হাতে নম্বরটি ফোনে তুললো। তারপর ফোনটা কানের কাছে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। কল যাচ্ছে, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ধরছে না। আহির অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। সে আরো অস্থিরভাবে সামনে হাঁটছে। পুষ্প আহির পিছু নিয়েছে। এ মেয়ে যে-কোনো সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। যা ভেবেছে তা-ই হলো। আহি সামনে যেতেই উঁচুনিচু ইটের রাস্তায় উঠলো। আর সেখানেই হোঁচট খেলো। পুষ্প ভয়ার্ত চোখে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। আহি শক্ত করে ফোনটা হাতে ধরে রেখেছে। যেন তার প্রাণটা এই ফোনেই আটকে আছে। আহির হুঁশ ফিরতেই সে দেখলো রাদ তাকে ধরে রেখেছে। আহি রাদের দিকে তাকাতেই সে বলল,
“পাগল না-কি তুই? এভাবে হাঁটছিস কেন?”

আহি হেসে বলল,
“মায়ের নম্বর পেয়েছি। মা হয়তো এখানে নেই। থাকলে আমার কন্ঠ শুনে নিশ্চিত বের হতো।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৯ (১ম ভাগ)||

৩৩।
অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি আটকে আছে দূর পশ্চিমের আকাশে। ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম আভা মেঘেদের ভাঁজে মিশ্র রঙ সৃষ্টি করেছে। সেই লালিমা রেখা হিয়ার কোণে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাদের জাগিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু সব আকাঙ্ক্ষা তো পূর্ণ হয় না। যেমনটা অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছটফট করছে আহি। পুষ্পের ফোনটা হাতের মুঠোয় আবদ্ধ তার। সেই সকাল থেকে অনেক বার মায়ের নম্বরে কল করেছিল আহি। বিকেলে কলটা রিসিভও হয়েছিল। ওপাশ থেকে অপরিচিত ভারী পুরুষালী কন্ঠ শুনে কল কেটে দেয় সে। অজানা ভয়ে আহির মনটা ভারী হয়ে আসছে এখন। বাবার মতো মাও কি তবে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে?

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মুনিয়া খালা ফোন দিয়েছেন বার কয়েক। নিশ্চয় মিসেস লাবণি জেরা করছিলেন কল দেওয়ার জন্য। আহি ইচ্ছে করেই কল ধরছে না। সবকিছু তো আর তাদের নিয়মে চলবে না। ভালো লাগা, মন্দ লাগার অনুভূতি আহিরও তো আছে।
এদিকে আহিকে অনেকক্ষণ ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাদ এবার তার কাছে এলো। আহি রাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,
“আমার সাথে ভাগ্যের কোনো দ্বন্ধ আছে নিশ্চয়। যা-ই আমি চাইবো, তা-ই আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেবে। অভিমান হয় আমার। একটা মানুষের গত কয়েক বছরের একটা ইচ্ছেও পূরণ হচ্ছে না। সে শুধু আঘাতের পর আঘাত পেয়েই যাচ্ছে। তাহলে তার কী বোঝা উচিত? সৃষ্টিকর্তা তার দিকে ফিরেই তাকাচ্ছেন না? একটা মানুষকে এতোটা নিঃস্ব করে দিলে, তার বাঁচার ইচ্ছা থাকে না, রাদ। আমারও বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিলে তো আমারই ক্ষতি। এখানে সহ্য করছি, তখন ওখানেও সহ্য করতে হবে। তবে এতোটা অন্যায় আমার সাথে হওয়া উচিত না।”

ছাদের রেলিঙটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে আহি। মনে হচ্ছে তার মনের ক্ষোভটা সেই ইটের তৈরী রেলিঙের উপরই সে বের করছে। রাদ আহির সেই হাতের উপর হাত রাখলো। আহি মুহূর্তেই শান্ত হয়ে গেলো। রেলিঙের উপর থেকে তার হাতটা আলগা হয়ে এলো। রাদ নিজের হাতটি আহির সেই আলগা হয়ে যাওয়া হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিতেই আহিও সেই হাতটি শক্ত করে ধরলো। রাদ আহির স্পর্শ পেয়ে তার দু’চোখ বন্ধ করে বলল,
“মনে হচ্ছে তোর সামনে অনেক সুখ। এজন্যই বোধহয় এই কষ্টগুলো একের পর এক তোকে সহ্য করতে হচ্ছে।”

আহি মলিন মুখে বললো,
“সুখ! এই শব্দটা এখন আমার জীবনের কৌতূকময় শব্দ। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি, বন্ধুদের হারিয়েছি, মাকে হারিয়েছি, এদের না পেলে আমি সুখী হবো না। আমি সবাইকে একসাথে চেয়েছি। কাউকে হারাতে চাই নি। কিন্তু আমার সুখের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আমার বাবা, তার বর্তমান স্ত্রী, তাজওয়ার খান আর আমারই প্রিয় বান্ধবী। তাহলে আমি কেমন সুখ আশা করবো?”

রাদ এবার আহির দিকে তাকালো। হালকা হেসে বলল,
“ধর, তুই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছিস। তোর শেষ স্বপ্নটা পদ্মের কারণেই আটকে আছে। তখন কি করবি?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“মানুষ পুরোপুরি সুখী হয় না। আর আমি এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছি।”

রাদ আহির গালে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আফিফকে ভুলে যাওয়া যায় না?”

“যদি ভুলে যেতে পারতাম, আমার চেয়ে সুখী কেউ হতো না। বিচ্ছেদের দহনে আমিই কষ্ট পাচ্ছি, ওরা ঠিকই সংসার করছে। আমি ভুলে যেতে পারি না। আমার মনটা ওখানেই আটকে আছে। সেই চারুশিল্পের ইট-পাথরের মাঝে, সেই রং-তুলির ফাঁকে, আর সেই ডায়েরীর ভাঁজে।”

“বিয়ে তো করবিই। তখন?”

“দেবদাসের পারু কি বিয়ের পর তার দেবদাকে ভুলতে পেরেছিল? তার কপালে দেওয়া দেবদাসের সেই আঘাতের চিহ্ন সে মুছে যেতে দেয় নি। আমি তাহলে কিভাবে আমার হৃদয়ে আঁকা প্রিয় ছবিটা মুছে ফেলবো? হুমায়ুন আহমেদের লেখা হিমু চরিত্রটির সাথে রূপার কোনো মিল হতে দেখি নি। কিন্তু যখনই হিমু নামটি আসে, রূপা সেই নামের সাথেই যুক্ত হয়ে যায়। তাহলে আহির সাথে এআরের সম্পর্ক কিভাবে ছিন্ন হবে? পৃথিবীতে কতো শত প্রেমের গল্প! সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে জীবনের সাথেই যুক্ত। হয়তো আমি তাদেরই একটা অংশ। আমার মনে হয় না নতুন কেউ আমার মনে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারবে।”

রাদ শুকনো হাসলো। মনে মনে বলল,
“কাউকে ভালোবাসার চেয়ে কারো ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যে ভালোবাসে, সে তো সব উজাড় করেই ভালোবাসে। আর যে ভালোবাসা পায়, তার মতো সুখী কেউ হয় না। যদি আমার প্রিয় মানুষটা ঠিক এভাবেই আমাকে ভালোবাসতো!”

রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির দৃষ্টি এখনো দূর আকাশের পানেই স্থির। রাদের ইচ্ছে করছে আহিকে শাসন করতে৷ তার উপর অভিমান করতে। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
“দেখ, তোকে ভালোবাসে এমন অনেকেই আছে। আমি আছি। দেখ, আহি, আমাকে দেখ। আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?”

কিন্তু রাদ এসব করবে না। আহিকে সে কিছুই বলবে না। আহি তো তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে কিভাবে অনুভব করেও প্রিয় মানুষকে ভালোবাসা যায়। সেও আহিকে অনুভব করে যাবে। যতোদিন মনের তৃষ্ণা মিটবে না, ততোদিন সে এক তরফা ভালোবেসে যাবে।

(***)

বাসের বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে আহি। অস্বচ্ছ কাচটির মতোই ঝাপসা হয়ে আছে তার জীবন। যার কোনো গতি নেই। পুষ্প আর লাবীব পাশাপাশি সিটে বসেছে। আর রাদ আহির পাশে বসেছে। সে সিটে বসেই ঝিমুচ্ছে। বাড়ির সবাই তাকে থাকতে বলেছিল। কিন্তু আহিকে সে নিজে পৌঁছে না দিয়ে সন্তুষ্ট হবে না। তাই সে চলে এসেছে। এদিকে রাদের মাথাটা একটু পর পর হেলে পড়ছে সামনে। আহি পাশ ফিরে রাদকে ঢুলতে দেখে তার মাথাটা নিজের কাঁধের উপর রেখে বলল,
“এবার ঘুমা।”

আহি রাদের হাতটা ধরলো। রাদ আধো আধো চোখ মেলে আহির দিকে তাকালো। আর ঘুম ঘুম চোখ দু’টি প্রশান্তির আশ্রয় পেয়ে তার ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো।

(***)

নীরবতা ভেঙে পুষ্পের ফোনটা বেজে উঠলো। পুষ্প ফোনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। সিট থেকে উঠে আহির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, ওই নম্বরটা!”

আহি সাথে সাথেই পুষ্পের হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো ফোনটা। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে কলটা ধরেই কানের কাছে আনলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই মায়া মাখা কন্ঠের স্বর। আহি চুপ করে আছে। এদিকে রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি হুট করে বসা থেকে উঠে যাওয়ায় রাদের ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো। তাই সে স্থির হয়ে বসে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে।

এদিকে ওপাশ থেকে আবার ভেসে এলো সেই কন্ঠ,
“হ্যালো। কে বলছেন?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি। আমাকে চিনতে পেরেছো!”

ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা চললো। এই নীরবতা আহির গলায় কাঁটার মতো বিঁধছে। সে একটু পর পর শুকনো ঢুক গিলছে। রাদ এতোক্ষণ পর বিষয়টা বুঝতে পারলো। সে আহির অস্থিরতা দেখে তার এক হাত আলতোভাবে ধরলো। রাদের স্পর্শ পেয়ে আহি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। সে এবার নিজের পরিচয়টা দিতে যাবে তখনই ওপাশ থেকে সেই কন্ঠটি বলে উঠলো,
“আহি! আমার মা?”

মায়ের মুখে নিজের নাম শুনে আহির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আমাকে চিনতে পেরেছো?”

সালমা ফাওজিয়া কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,
“আমার মাকে আমি চিনবো না? তুমি কেমন আছো, মা?”

আহি এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। সে শক্ত করে রাদের হাতটা চেপে ধরলো। রাদ আহিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আহির হাতের উলটো পিঠে আলতোভাবে তার বৃদ্ধ আঙ্গুলটি চালাতে লাগলো। এদিকে আহির গলায় কথা আটকে গেছে। পুষ্প তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাদকে দিলো। রাদ বোতলের ছিপি খুলে আহির দিকে বোতলটি এগিয়ে দিলো। আহি হালকা গলা ভিজিয়ে বলল,
“মা, তুমি আমার পাশে থাকলে হয়তো আমি আরেকটু বেশি ভালো থাকতাম।”

সালমা ফাওজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“যদি সেই সৌভাগ্য হতো আমার!”

“কেমন আছো তুমি?”

“আমার মেয়ে আমার পাশে নেই। তাহলে আমি কিভাবে ভালো থাকবো? আমি তো শুধু বেঁচে আছি।”

“জানো, আমি ভেবেছি তুমি আমাকে ভুলে গেছো।”

সালমা ফাওজিয়া চোখের পানি মুছে বললেন,
“মা তার সন্তানদের ভুলতে পারে না। আর আমার তো তুমিই একমাত্র সম্বল। আর তো কেউ নেই আমার।”

আহি মৃদু হাসলো। বলল,
“কতো বছর পর কথা হচ্ছে আমাদের!”

“তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তোমার বাবা সেই সুযোগ দেন নি।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বলল,
“জানো মা, আমি তোমার সাথে দেখা করতে আজ নানুর বাড়ি গিয়েছিলাম।”

“মামা বকেছে তোমাকে?”

“উঁহুম। ওসব বকা-ঝকা একটু আধটু খাওয়া যায়। বকার পরিবর্তে তোমার নম্বরটা তো পেয়েছি।”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। ওপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ একজন তাকে ডাকলো। আহি মলিন সুরে বলল,
“আচ্ছা, তুমি হয়তো ব্যস্ত।”

সালমা ফাওজিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“না, আমি ব্যস্ত নই। ফোন কেটে না, আহি। শোনো, আমি তোমাকে দেখতে চাই।”

মায়ের এমন কথায় আহির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সে চোখ মুছে বলল,
“আমিও তোমার সাথে দেখা করতে চাই। আর এটা পুষ্পের নম্বর। আমার ফ্রেন্ড পুষ্প, মনে আছে?”

“হ্যাঁ, মনে আছে।”

“আসলে আমার নম্বরটা বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা, তাই সেই নম্বর থেকে কল দেওয়ার সাহস হয় নি।”

“আমি জানি, আহি। চিন্তা করো না। তোমার বাবা কিছুই জানবেন না। আর আমি এখন ট্রেনিংয়ে এসেছি। আমার অফিস থেকে রাজশাহী এনেছে। চট্টগ্রাম এলেই আমি তোমার সাথে দেখা করবো।”

“আচ্ছা। মা, আমি তোমাকে সকালে কল দিয়েছিলাম। অন্য একজন ধরেছিল!”

“ওহ, হ্যাঁ। কামাল ধরেছিল। আমার কলিগ। ওর রুমেই আমার ফোনটা চার্জ হচ্ছিল। হুড়োহুড়িতে চার্জারটাই আনতে ভুলে গিয়েছিলাম।”

“আমি ভেবেছি কি জানো?”

“কি!”

“তুমিও বাবার মতো বিয়ে করে নিয়েছো!”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। বললেন,
“তোমার বাবার সাথে সংসার করে শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।”

কথাটি শুনে আহির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আমি তোমার জন্য নিজেকে দাঁড় করাচ্ছি, মা। সব তোমার জন্য করছি। এই আশা নিয়ে আছি, একদিন হয়তো তোমার বাবার চেয়ে ভালো অবস্থানে গিয়ে তার কাছ থেকে আমার মেয়েটাকে মুক্ত করে আনতে পারবো।”

আহি ঠোঁট চেপে কাঁদতে লাগলো। রাদ হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? আহি না সূচক মাথা নেড়ে সালমা ফাওজিয়াকে বলল,
“ততোদিনে আমি খান সাহেবের রক্ষিতা হওয়া থেকে বাঁচি কি-না দেখো!”

আহির কথায় সালমা ফাওজিয়া চুপ হয়ে গেলেন। আর রাদের বুকটা ধক করে উঠলো।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৯(২য় ভাগ)||

৩৪।
আফিফের মোটরসাইকেল থামলো ক্যাম্পাসের গেটের সামনে। আজ থেকে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম দিনই পদ্ম নিজ হাতে আফিফের ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে। এমনকি লাঞ্চবক্সও হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। আফিফ মোটরসাইকেল থেকে নেমে হাতলে ঝুলিয়ে রাখা লাঞ্চবক্সটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বক্সটি হাতে নিয়ে ক্যাম্পাসের গেটে পা বাড়াতে যাবে তখনই দেখলো ক্যাম্পাসের পার্কিং লটে আহি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনে দাঁড়ানো এক মধ্যবয়সী যুবতী নারী। আফিফ চোখ সরিয়ে সামনে পা বাড়াতে যাবে তখনই আবার তার চোখ আটকালো সেই স্থানে। মধ্যবয়সী সেই যুবতী নারীটি আহির বাহু চেপে ধরে রেখেছে। আহির চোখ-মুখ কুঁচকানো। সে যুবতী নারীটির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আফিফ আহির দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো। কোনো এক অজানা কারণে তার আহির কাছে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। আফিফের দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝখানে সেই যুবতী নারীটি আহির হাত ধরে তাকে টেনে গাড়িতে উঠাতে যাবে তখনই আফিফ আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে সেই গাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালো।
এদিকে কারো উপস্থিতি পেয়ে মিসেস লাবণি ভ্রূ কুঁচকে সেদিকে তাকাল। আহি আফিফকে দেখে লাবণির হাত ফসকে বেরিয়ে এলো। লাবণি আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“হু আ’র ইউ?”

আফিফ ভদ্র ভাষায় বলল,
“আপনি ওর সাথে জোরাজোরি করছিলেন কেন?”

“তো! তোমার কি সমস্যা?”

“আমি কিন্তু পুলিশ কল করবো!”

আহি আফিফের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। লাবণি আফিফের কথায় অট্টহাসি হাসলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে লাবণির দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণি হাসি থামিয়ে আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কে এই ছেলে? তোমার জন্য নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করছে!”

আহি ভীত চোখে আফিফের দিকে তাকালো। লাবণি যদি জেনে যায়, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি আর কেউ নয়, আফিফ। তাহলে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। আহি নিজেকে শান্ত করে প্রতিত্তোরে বললো,
“ও আমার ক্লাসমেট। আমাদের মাত্রই পরিচয় হয়েছে।”

আফিফ আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এবার লাবণি আফিফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ওহ, তাই হয়তো এতোটা সাহস দেখাচ্ছে।”

লাবণি আফিফের সামনেই আহির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“মিস্টার নিউ ক্লাসমেট, আমি আহির মা, মিসেস লাবণি রিজওয়ান কবির। আমি আমার মেয়ের সাথে যা ইচ্ছে তাই করবো। আশা করি তুমি তোমার এই হুমকি দ্বিতীয়বার আমাকে দেওয়ার সাহস দেখাবে না। নয়তো তোমারই ঝামেলা হবে।”

আহি শুকনো মুখে বলল,
“হ্যাঁ, ও জানে না আপনি কে! পরের বার আর এমন করবে না।”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি যাও এখান থেকে।”

আফিফ স্তব্ধ হয়ে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। সবকিছুই যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আফিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহি ইশারায় তাকে চলে যেতে বলল। কিন্তু সে একবিন্দুও নড়লো না। আহির অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়েই রইলো। মিসেস লাবণি আহিকে গাড়িতে উঠতে বললেন। আহি শুকনো মুখে গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই আফিফ তার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে আনলো। লাবণি আফিফের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল,
“তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।”

আফিফ শান্ত কন্ঠে বলল,
“আজ মাস্টার্সের প্রথম ক্লাস। ক্লাস শেষে না হয় সে বাসায় চলে আসবে। জোর করে আপনি ওকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। হয়তো আপনি তার মা। কিন্তু একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে জোরাজুরি করার কোনো অধিকার আপনার নেই।”

আহি আফিফের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহির এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে আফিফের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিতে। ছেলেটা হয়তো জানেই না সে কার সাথে বাড়াবাড়ি কর‍ছে। এদিকে লাবণি আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি লাবণিকে চাপা স্বরে বলল,
“আপনি যে কতোটা নোংরা মানসিকতার মানুষ সেটা দয়া করে বাইরের মানুষকে জানাবেন না। ভদ্র ভাবে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি তাজওয়ারের সাথে কোথাও যাচ্ছি না। আর আজ আমার প্রথম ক্লাস। তাই আমাকে জোর করবেন না।”

লাবণি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তাজওয়ার তোমার অপেক্ষায় আছে।”

“থাকুক।”

“ভুলে যেও না তুমি তোমার বাবার ইনভেস্টমেন্ট।”

“আমি কোনো পণ্য নই। আর আমি তাজওয়ারের সাথে কোথাও যাচ্ছি না। তার‍ যদি ইচ্ছে করে তাহলে সে ঘুরুক তার নষ্ট বন্ধুদের নিয়ে। আমি ওখানে গিয়ে আমার নিজের সম্মান নষ্ট করতে পারবো না। আর এখনো আমাদের বিয়ে হয় নি। তাহলে আমি কেন তার সাথে নাইট ট্যুরে যাবো, যেখানে তার বন্ধুরাও যাচ্ছে?”

“দেখো আহি, তাজওয়ার তোমার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে। সে আমাকে যদি আজ সকালেই জানাতো, তাহলে তোমাকে আমি বাসা থেকেই বের হতে দিতাম না।”

“এখন যেহেতু দেরী করে জানিয়েছে, তাহলে তো হয়েই গেলো! তাকে জানিয়ে দিন, আমি তার জন্য সব কাজ ফেলে বসে নেই।”

আহি এবার আফিফের সামনে এসে বলল,
“ক্লাসে যাওয়া যাক।”

(***)

আফিফ আর আহি একসাথে ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে ঢুকলো। আহি পেছন ফিরে একনজর লাবণির গাড়ির দিকে তাকালো। সবেমাত্র পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে গেলো গাড়িটি। গাড়িটিকে চলে যেতে দেখেই আহি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে আফিফের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“ধন্যবাদ এবং দুঃখিত।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“দুঃখিত বলার কারণ!”

“একটু ইনফরমাল ভাবে কথা বলেছি। মিসেস লাবণি জানেন না আপনি পদ্মের হাসবেন্ড।”

“জানলে কোনো সমস্যা?”

আহি ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল,
“না জানায় ভালো। জীবনে সম্পর্কের দৈর্ঘ্য যতো ছোট, আমার জন্য ততোই ভালো।”

এদিকে রাদ ক্যাম্পাসের মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। আফিফ আর আহিকে একসাথে দেখে সে রীতিমতো অবাক। আহি রাদকে দেখে দৌঁড়ে তার কাছে চলে গেলো। আর আফিফ সেকেন্ড খানিক তাদের দিকে তাকিয়ে ক্লাসে চলে গেলো।

(***)

বুকে হাত গুঁজে আহির দিকে তাকিয়ে আছে রাদ। আহি বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”

“তুই আজ মিস্টার আফিফ রাফাতের সাথে!”

“বলিস না রে। মিসেস লাবণির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি!”

“আহি, আমি তোকে যেটা জিজ্ঞেস করেছি, আগে সেটার উত্তর দে।”

“আমাকে বলার সময়টা তো দে।”

“বল।”

“সকালে ড্রাইভার আংকেল আমাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর আমি ক্যাম্পাসে ঢুকতে যাবো, ওমনি মিসেস লাবণি উড়ে এসে বসলো আমার কাঁধে। আমি বাসা থেকে বের হওয়ার পরই না-কি ওই খানের বাচ্চা খান তাকে কল দিয়ে বলেছে, তারা বন্ধুরা মিলে নাইট ট্যুরে যাচ্ছে। দুই দিন, দুই রাত কক্সবাজার থাকবে। আর মিসেস লাবণি তাই আমাকে জোর করছিলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাজওয়ার খান না-কি আমার জন্য এয়ারপোর্টে বসে আছে। আমি তো সেই বদমাশ খানের সাথে কখনোই নাইট ট্যুরে যাবো না। তুই তো জানিসই ওর বন্ধুগুলো একটার চেয়ে একটা অসভ্য। আমি তো কোনোভাবেই যাবো না। কিন্তু মিসেস লাবণি তো আমাকে জোর করে, ব্ল্যাকমেইল করে গাড়িতে উঠাচ্ছিলেন। আর তখনই উদয় ঘটলো বিশিষ্ট মানবসেবক আফিফ রাফাতের। সে তো আর জানে না, কার সাথে তর্কে যাচ্ছিল। আমি কোনোভাবে তাদের কথা কাটিয়ে বেঁচে ফিরেছি। সাথে তাকেও উদ্ধার করে এনেছি।”

রাদ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বিশিষ্ট মানবসেবক! বাহ, বাহ চমৎকার!”

“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?”

“ওই তেলাপোকাটাকে দেখলেই আমার রাগ উঠে!”

“আর তাজওয়ার খানকে দেখলে বেশি ভালো লাগে, তাই না?”

“ওটাকে দেখলে তো গা জ্বলে যাই। আমি যদি অনেক টাকার মালিক হতাম। অথবা আমি যদি প্রধান মন্ত্রীর ছেলে হতাম, ওই বেটাকে এমন তুলা ধুনা দিতাম। জন্মেও তোর দিকে তাকানোর সাহস পেতো না।”

আহি রাদের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
“ইশ! তুই প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হলে, তোর ভাবসাব এমন হতো, জন্মেও আমার দিকে তাকাতি না। আর এই ভার্সিটি আর সেই সোসাইটির স্কুলে তোকে পড়তেও হতো না। তখন আর আমাদেরও পরিচয় হতো না।”

রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“তোর সাথে পরিচয় না হলে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার মানুষটাকে দেখতে পেতাম না।”

“আচ্ছা! তাই? এখন বল তোর স্টান্ট ম্যান কোথায়?”

“তোর বান্ধবীকে দেখেই সুড়সুড় করে তার পিছু পিছু চলে গেলো।”

“কি ব্যাপার! ওর মতিগতি তো সুবিধার ঠেকছে না। সেদিন বাসেও পুষ্পের পাশে বসে পড়লো!”

“প্রেমে পড়েছে হয়তো!”

“ভালোই তো। তবে পুষ্প কিন্তু খুব কঠিন। এতো সহজে ওকে পটাতে পারবে না।”

“করুক, যা করার। একটা প্রেমও তো বেচারার সফল হয় নি। এখন তো সরাসরি বিয়েই করবে। দেখা যাক, শেষমেশ কি জুটে ওর কপালে!”

“হুম, আচ্ছা আমি ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষে আবার দেখা হবে৷ তোকে কিন্তু আজ সারাদিন আমাকেই সময় দিতে হবে। বাসায় দেরীতে ফিরলে জালে আঁটকে পড়ার আশংকা কম থাকবে।”

৩৫।

সেই বর্ষার দিনগুলো আবার ফিরে এলো বিনা নিমন্ত্রণে। আহি বন্ধ জানালার কাঁচের উপর হাত রেখে বিছানায় বসে আছে। কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলার গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আহি সেই ফোঁটাগুলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমনই এক বর্ষার দিনে তার আফিফের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। আর এমন দিনেই আহি তাকে হারিয়েও ফেলেছিল। তাই মেঘেদের বর্ষণে আহিও কাঁদে। ভীষণ কাঁদে। বাদামি ডায়েরীর পাতা উল্টে আফিফকে স্মরণ করছে আহি। কিছু বছর আগে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সে আফিফকে অনুরোধ করে ডায়েরীতে লিখেছিল,
“প্রিয়, বৃষ্টিস্নাত ফুল দেখেছো কখনো? ভীষণ স্নিগ্ধ লাগে দেখতে, তাই না? আজ না হয় আমার দিকেই তাকিয়ে দেখো। তোমার জন্য হলুদ শাড়ি পরে অলকানন্দা সেজে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মোড়ে। বৃষ্টিতে ভেজা আমাকে দেখে তোমার নিশ্চয় অলকানন্দার কথায় মনে পড়বে। আর তুমি নিশ্চিত আমার প্রেমে পড়বে। যেদিন তুমি আমার প্রেমে পড়বে, সেদিন থেকে আমিই হবো তোমার অলকানন্দা। আর এরপর যখন বৃষ্টি নামবে তুমি আমার হাত ধরে বৃষ্টি বিলাস করবে। করবে না বলো?”

আহি ডায়েরিটা বন্ধ করলো। বালিশের নিচে রেখে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। কান্না পাচ্ছে আহির। আফিফ কি করছে আজ? পদ্মফুলের সাথে বৃষ্টি দেখছে নিশ্চয়! হয়তো খুব সুন্দর মুহূর্ত সৃষ্টি হচ্ছে তাদের। এসব ভাবতে চাচ্ছে না আহি। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। যতোবারই তার মনে পড়ে আফিফ আর কখনোই তার হবে না, ঠিক ততোবার তার মনটা অস্থির হয়ে উঠে।
বালিশে মুখ গুঁজলো আহি। শব্দ করেই কাঁদলো কিছুক্ষণ। মুনিয়া খালা দরজায় কড়া নাড়লেন। আহি সাথে সাথেই চুপ হয়ে গেলো। বালিশ থেকে মুখ তুলে চোখ মুছলো। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলল,
“খালা, কেন ডাকছো?”

“ছোড মা, ভার্সিটি যাইবা না?”

“যাবো খালা।”

আহি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে আলমারি খুললো। ইচ্ছে করছে আজ অলকানন্দা সাজতে। যা ভাবা তাই। আলমারি ঘেঁটে হলুদ টপস বের করলো। কালো জিন্স আর উড়নার সাথে মোটামুটি ভালোই মানিয়েছে আহিকে। বৃষ্টির দিনে সাজগোজ খুবই বেমানান। আহি শুধু কপালে কালো টিপ পরলো। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খোঁপা করলো। বারান্দার দরজা খুলে একটা অলকানন্দা ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজলো। নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগলো আহি। তার ঠোঁটে মলিন হাসি, চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। আহি বুকে হাত রেখে বলল,
“তোমার জন্য সাজতে চেয়েছিলাম। তুমি তো আমার হলেই না প্রিয়। আমি তোমাকে এভাবে চাই নি। আমার একার অধিকার চেয়েছি। তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে না, প্রিয়? আজ আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অনেক বছর পর আবার সেই বর্ষা এলো, যেই বর্ষায় তুমি আমার মুখোমুখি। তোমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হবে না আমার। তুমি হয়তো জানো না, যেদিন বৃষ্টি নামে, আমি সেদিন নিজেকে শান্ত রাখতে পারি না। এই দুই সপ্তাহে তোমার কাছ থেকে নিজেকে কতোবার আড়াল করে রেখেছি। তোমাকে দেখেও দেখি নি। তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে পারি নি। একটা বছর আমি এভাবে তোমার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবো না, আফিফ। একদিন যদি তুমি বুঝে ফেলো, আমার এই চোখ দু’টি এখনো তোমার স্মৃতিতে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে, তখন আমি অনেক দুর্বল হয়ে পড়বো। আর যাই হোক তোমার সামনে দুর্বল হতে চাই না। তোমাকে ভালোবেসে আমি পরিপূর্ণ হয়েছি। তোমাকে অনুভব করেই আমি ভালো আছি। শুধু এতোটুকুই অভিযোগ! কেন বার-বার আমার সামনে এসে দাঁড়াও? আমার অনুভূতি আমার একার থাকুক। তুমি তো আমার জীবনের একটা অংশ। যেখানে তোমার স্মৃতিগুলোই শুধু জীবিত। কিন্তু তুমি কোথাও নেই। তোমাকে দেখার জন্য চারুশিল্পে কতো বাহানা দিয়ে চলে যেতাম। ঝড়-ঝঞ্ঝা কিছুই আমার ভালোবাসায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। কিন্তু আজ আমি মন থেকে চাই, এই মুহূর্তগুলো শীঘ্রই কেটে যাক। তোমার মুখোমুখি হওয়ার এই কাল নিমেষেই হারিয়ে যাক। তোমাকে আর দেখতে চাই না। কারণ ভয় হয় আমার। যদি নিজেকে ধরে রাখতে না পারি। তখন আমার গোছানো ভালোবাসা সবার কাছে পরিহাসের বিষয় হবে। আমি জানি, আমার ভালোবাসা কতোটা গোছানো। আমি কাউকে সুযোগ দেবো না, আমার ভালোবাসায় প্রশ্নবিদ্ধ করার।”

আহি আজ আর ক্যাম্পাসে গেলো না। ওভাবেই ছাদে চলে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজলো। ছাদের মেঝেতে শুয়ে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ছে আহির মুখে। কপালের টিপটা খুলে পরে গেছে। আহির অশ্রু লুকিয়ে গেছে বৃষ্টি কণাদের ভীড়ে। চোখ বন্ধ করলো আহি। অনেকক্ষণ পর সে অনুভব করলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলা আর তাকে স্পর্শ করছে না। কিন্তু ঝমঝম শব্দ সে এখনো শুনতে পাচ্ছে। আহি চোখ খুললো। সামনে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ার ছাতা মেলে তার মুখের উপর ধরে রেখেছে। আহি তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। তাজওয়ার আহিকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“এভাবে ভিজলে অসুস্থ হয়ে যাবে!”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তোমার সমস্যাটা কোথায়? আমার অনুমতি না নিয়ে তুমি এখানে কেন এসেছো?”

“তোমার কাছে আসার জন্য আমার তোমার অনুমতির প্রয়োজন নেই।”

আহি ছাদ থেকে নেমে পড়তে যাবে তখনই তাজওয়ার তার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আহির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
“বৃষ্টিতে ভেজা কোনো মেয়ে এই প্রথম আমার হৃদ স্পর্শ করেছে, আহি।”

“তো, আমি কি করবো!”

“আমার ভালোবাসা উপভোগ করবে।”

“তোমার নষ্টামি উপভোগ করার আগে আমি মরে যাই।”

তাজওয়ার আহির কথায় ভড়কে গেলো। রাগী কন্ঠে বলল,
“তোমার সমস্যা কি আহি? তুমি সবসময় আমার সাথে এমন করো। আমার সাথে কি একটু সুন্দর করে কথা বলা যায় না?”

আহি নরম কন্ঠে বলল,
“আমাকে ছেড়ে দাও, তাজওয়ার।”

তাজওয়ার মুচকি হেসে বলল,
“না, আরেকটু থাকো আমার পাশে।”

আহি এবার চেঁচিয়ে বলল,
“এই জন্যই তোমার সাথে সুন্দর করে কথা বলি না। নরম কথা তো তোমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।”

তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে দিতেই আহি হনহনিয়ে চলে গেলো। আর তাজওয়ার রাগে হাতের ছাতাটা ছাদেই ছুঁড়ে মারলো।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে