দহন ফুল পর্ব-০৬

0
91

#দহন_ফুল– ৬

আমি বলছি কি?
ওদের দুজনকে কোথাও ঘুরতে পাঠালে কেমন হয় মা প্রভা?

কথাটা প্রথম শ্বশুর বাবাই ওঠালেন , আমিও ভাবলাম, এই কথাটা আমার মাথায় এলো না কেনো?
বললাম
— বেশ হয় বাবা, কিন্তু মা…
— আরে এই শনি বাড়ি নেই বলেই তো বলছি রে মা…. বিগত চার বছরে শুধু গাধার খাটনি খাটিয়েছে,দুজনকে একসাথে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি কখনো।
— কোথাও যায়নি দুজনে?
— গিয়েছিলো বিয়ের প্রথম দিকে একদিন দুরের এক রিসোর্টে একদিন একরাত্রি ছিলো, সে নিয়ে তো চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো।
— তাহলে তো এবারও এমন করার সম্ভাবনা আছে বাবা?
— আরে সেটা দেখা যাবে, একটা কিছু করে ম্যানেজ করে নেবো দুজনে, কি পারবে না?
— জ্বি বাবা বুদ্ধি একটা বের করতেই হবে। চলেন কালই দুজনকে ৬/৭ দিনের জন্য পাঠিয়ে দেই।
— হুমম সেটাই ঠিক হবে সময় তো বেশিদিন হাতে নেই, বড়জোর দশ দিন তারপর শনি এসে ভর করবে এই বাড়িতে।

বাবার কথায় আমি হেসে ফেললাম,
— বাবা মা কি সারাজীবনই এমন ছিলো?
— হুম তা বলতে পারো? আমার মা বোনকে দেখলে বাড়তো এখন বড় বউমাকে পেয়ে বেড়েছে, মানে কথায় আছে না নাপিত দেখলে নখ বড় হওয়া আর কি?
— আপনি কিছু বলেনি না কখনো?
— এই মেয়ে তোমার কি মনে হয় আমি বউ ভেড়ুয়া ( কপট রাগ দেখিয়ে)
— না না বাবা সেভাবে বলতে চাইনি।
— আসলে রে মা সংসারে অশান্তির ভয়ে চুপ থেকে ওর সাহস বাড়িয়ে ফেলেছি। তবে এবার তুমি সাথে আছো, দুজন মিলে জব্দ করবো, পারবো না?
বলেই হা হা হা হা করে শ্বশুর বাবা হেসে ফেললেন।
আমি শ্বশুরের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছি ভেবে হাসিতে যোগ দিলাম।

পরদিন সন্ধ্যার আড্ডায় এই প্রস্তাব রাখতেই সাবির ভাই ও ভাবী সাথে সাথে নাকচ করে দিলো।
— না না বাবা কি বলছো? এটা সম্ভব নয়, মা বাড়িতে নেই। তাছাড়া শুনতে পেলে ঝামেলা হবে ভীষণ।
— আরে নেই বলেই তো যাবি, থাকলে কি আর আমি এই প্রস্তাব রাখতাম।
— না বাবা এটা সম্ভব নয়, তোমার আগের ঘটনা মনে নেই, কি অবস্থা হয়েছিলো। আমি সংসারে অশান্তি চাচ্ছি না।
মাসুমা ভাবী বাবার কাছে এসে বসলো,
— বাবা আপনি আমাদের জন্য চিন্তা করেছেন, তাতেই আমরা খুশি। আপনি আমাদের জন্য সব সময় দোয়া করবেন, আর কিছু চাই না।
— অমত করিস না মা, আমি সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেছি, প্লেনের টিকেট, হোটেল রুম বুকিং, শীপের টিকিট সবকিছু।
— বাবা এটা ঠিক হলো না।

আমি ভাবীর কাছে গিয়ে বসলাম,
— ভাবী কোনো চিন্তা নেই বাবা আর আমি সামলে নেবো।
— না না প্রভা তুমি জানো না কত্তবড় ঝামেলা হবে?
— সে যদি হয় আমি সামলাবো, তাছাড়া উনি আসার আগেই তো আপনারা চলে আসবেন, উনাকে কেউ৷ বলবে না।

অনেক অনুনয় বিনুনয় অভয় দেবার পর ওরা রাজী হলো। পরদিন সকাল ১০টায় ফ্লাইট। রাতে আমি নিজে ভাবীকে নতুন কিছু কুর্তি, ফতুয়া নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্যাকিং করে দিলাম। ভাবীর ডিএকটিভ আইডিটা একটিভ করে হোয়াটসঅ্যাপ অন করে দিয়ে যত ছবি তুলবে আমাকে পাঠাতে বলে দিলাম।
ভাবী মুখে যেতে অপারগতা জানালেও চেহারায় খুশির ছাপ স্পষ্ট ছিলো।

পরদিন সকালে নাস্তা শেষে হাসি খুশি দুজনে বের হলো। সামিরকে অফিসে পাঠিয়ে দিলাম, তারপর শ্বশুর আর বউমা মিলে বসলাম যদি ধরা পড়ে যাই তবে কিভাবে সমাধান করবো তার ফন্দি আটতে। প্রথমে কথা ঠিক হলো, ঘরের কেউ ভুলক্রমে ও তাদের এই আনন্দভ্রমণের কথা মুখে আনবে না। দ্বিতীয়ত যদি ফাঁস হয়েই যায়, সামিরের অফিসের ট্যুর বা এ জাতীয় কিছু একটা বলে দেবো।
তবে সবচেয়ে দুঃখ লাগলো এই ভেবে যে দুজন মানুষ একান্তে নিজের মতো করে সময় কাটাবে, তাতেও অন্যের অনুমতি প্রাধান্য পাচ্ছে, কি অমানবিক।

সারাবাসা খালি খালি লাগছিলো তাই সামিরকে বগলদাবা করে চলে গেলাম দিয়াবাড়ির দিকে, ইচ্ছেমতো ঘুরলাম ফিরলাম। শ্বশুর বাবা রয়ে গেলো বাড়ি পাহারা দেবার জন্য।
ফিরে এসে দেখি বাবারও মন খারাপ তাই উনার সাথে ৬০ এর দশকের পুরনো বাংলা ছবি দেখতে বসে গেলাম। একটা বোলে চানাচুর মুড়ি পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও সরিষা তেল মাখা নিয়ে বসলাম।
বাবার সাথে এতোটা ক্লোজ হতে পারবো আমার ভাবনারও অতীত ছিলো , মজার বিষয় হলো অন্তরঙ্গ কোন সিন আসলে বাবা উঠে এদিকসেদিক হাঁটেন, আবার একটু পর ফিরে আসেন। আমি আর সামির মুখ টিপে হাসতে থাকি।

এদিকে আমি সারাক্ষণ ভয়ে আছি মনির মাকে নিয়ে, উপহার উপটোকণ দিলাম ঘুষ হিসাবে যাতে কোনোভাবেই শাশুড়ী মায়ের কাছে বলে না দেয়। সারাক্ষণ যেহেতু ওকে কাছাকাছি নিয়ে রাখে, যাতে না বলে তাই প্রতিদিন তালিম দিচ্ছি। সেও কিরা কসম খাচ্ছে তিনবেলায় সে নাকি মুখ খুলবে না।

ওদিকে ভাবী বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করছেন আর সমস্ত ছবি আমার কাছে জমা রাখছেন। আমি হলাম গোপন ব্যাংক, যেখানকার তহবিলে সব জমা হচ্ছে । প্রত্যেকটা ছবি এতো সুন্দর বলার মতো নয়। ভাবীর অপরুপ সৌন্দর্যের কারণে আমার এমনিতেই ঈর্ষা হয়, আজ আরো বেশি বেশি হচ্ছে। কুর্তি গাউন ফতুয়ায় ভাবীর অন্যরকম রূপের খোলতাই হচ্ছে।
কক্সবাজার, ইনানী, হিমছড়ি ও সেন্টমার্টিন সব জায়গায় ঘুরেফিরে ঠিক ৭দিনের মাথায় দুজনে ফিরে এলেন। উপহার সামগ্রী আনতে নিষেধ করে দিয়েছিলাম কারণ ওখানে সব কিছু প্রচুর দাম তাই আনেনি। কিছু শুটকি আর বার্মিজ আচার নিয়ে এসেছে, শুটকি রেখেছি ধীরেধীরে খাবার জন্য, কিছু শুটকি মনির মাকেও দিলাম, আর আচারের একটা খোসাও কোথা রাখিনি, সন্দেহ হবার মতো কোনো চিহ্ন নেই ভাই ভাবীর কক্সবাজার যাবার।

ভাই ভাবী ফেরার ঠিক দুদিন পর শাশুড়ী মা ফিরলেন বাবার বাড়ি থেকে ভাতিজার বিয়ে খেয়ে। এসেই সারা বাড়ি একবার টহল দিলেন, কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন না। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে স্বস্তি পেলেন।
রাতে খাবার দাবার শেষে সবাইকে নিয়ে বসলেন, কি কি উপহার পেয়েছেন তা দেখানোর উদ্দেশ্যে। উনি প্রচুর উপহার পেয়েছেন, আর মামা শ্বশুর নাকি দুই ভাগ্নে বউকে ও শাড়ি দিয়েছে, আমার হাতে তুলে দিলেন মোটা পাড়ের টকটকে গোলাপি কাতান শাড়ি। বড় ভাবীকেও হলুদ রঙের একটা একটা কাতান শাড়ি দিলেন।

কিন্তু পরদিন থেকে বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে বারবার স্মরণ করাচ্ছেন, যে বুড়াকালেও তার কতো কদর আছে বাবার বাড়িতে। কারো কারো তো কেউ পোছেও না, দুই পয়সার দামও নাই।
দুইদিন আগে যে গাছটি সতেজ ও তরতাজা ছিলো আজ হঠাৎ করে ঝিমিয়ে যেতে লাগলো। কথার বাণ সবচেয়ে কড়া আঘাত প্রাণ যায় না আবার বেঁচেও থাকতে দিতে চায় না। ভাবী আবার সেই আগের মানুষে পরিণত হতে লাগলেন। যেভাবে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন এখন যেনো প্রতি দমে থমকে যান, যেনো কেউ টুঁটি চেপে ধরে আছে। আমার ভীষণ কষ্ট হতে লাগতে লাগলো কিন্তু আমার কিইবা করার আছে। একজন মানুষ নিজ থেকে উপলব্ধি করতে না পারলে তার ভুলগুলো অন্য মানুষ কতক্ষণ আঙ্গুল তুলে দেখাবে।

ওদিকে আরেক বিপত্তি বাঁধলো, কুকুরের পেটে নাকি ঘি হজম হয় না, মনির মার পেটেও শুটকি হজম হলো না, এত এত উপহার কিরা কসম গোল্লায় গেলো। শাশুড়ী মা অসময়ে চায়ের জন্য রান্নাঘরে এলেন, দুপুরে খাবার জন্য শুটকিভুনা করা হচ্ছিলো , মনির মা মুখ ফসকে বলে ফেলে ,
—বড় ভাবী ভালো শুটকি চেনে, উনার কক্সবাজার থেকে আনার শুটকিগুলো খুব স্বাদ।
আর যায় কই, শাশুড়ী তাকে চেপে ধরলেন, সে বারবার না না বলতে লাগলো, এটাও বললো, ভুল করে ভুল কথা বলে ফেলেছে বাজার থেকে বলতে গিয়ে কক্সবাজার বলেছে। কিন্তু তিনি মানতে নারাজ, মনির মাকে বললেন,
— আল্লার কিরা, তর মায়ের মাথা খাস সত্য বল।
সেই জেরা আর সইতে না পেরে মনির মা বলে দিলো,
— হ খালাম্মা , বড় ভাবী কক্সসোবাজার গেছিলো, হে যাইতে চায় নাই, ছোট ভাবী আর খালু জোর করে পাঠাইছে।

শাশুড়ী মা তেলে বেগুণে জ্বলে বড় ভাবীকে ধরলেন,
— ফকিন্নীর বেটি… আমি বাড়িতে নাই আর পাখনা গজাইয়া গেছে? কতবড় সাহস আমার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে পা দেওয়ার কথা না, আবার কক্সবাজার যায়।
বড় ভাবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
— আমি ইচ্ছে করে যাইনি আম্মা, সবাই জোর করে পাঠাইছে।
— কোন সবাই?

আমি পরিস্থিতি দেখে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম,
— জোর গলায় বললাম, আমি পাঠিয়েছি, আর কেনো পাঠিয়েছি তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন তারপর, যা শাস্তি দেবার দেবেন?
— হ্যা বলো দেখি কি কারণ, যে কারণে তোমাদের কলিজা দশহাত লম্বা হয়ে গেছে।
— আপনার ছেলের অফিস থেকে বেশ কয়েকজন এমপ্লয়িকে সারাবছরের কাজে খুশি হয়ে পাঁচদিনের একটা ফ্যামিলী ট্যুরে যাবার একটা সুযোগ দিয়েছে। অর্ধেক খরচ অফিস দিচ্ছে আর বাকী অর্ধেক এমপ্লয়িরা কিন্তু হঠাৎ আমার মেয়েলি সমস্যা শুরু হয় সাথে পেটব্যথা আর আপনার ছেলের পেটে সমস্যা। কিন্তু আমরা না গেলেও টাকা কেটে নেবে তাই বাবা বললো ভাই ভাবীকে পাঠিয়ে দিতে। আপনিই বলেন এতোগুলো টাকা কি অযথা নষ্ট করবো।
— হুমম বুঝলাম, তবে সত্য মিথ্যে তোমরা জানো। কিন্তু এসব আমাকে বলোনি কেনো?
— আমরা জানি আপনি পরিবারের সবাইকে কত্ত ভালোবাসেন, আপনি আনন্দ করতে গেছেন, এসব বলে আপনাকে অযথা চিন্তায় ফেলতে চাইনি।

শাশুড়ী চুপচাপ সরে গেলেন, আর কিছু বললেন না, এমনকি পরেও এসব নিয়ে আর কোনো কথা বললেন না।

আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে শাশুড়ী এসব বিশ্বাস করেননি, তাই ভেতরে ভেতরে ঝড় ফুসছিলো কিন্তু ঝড় একা আসেনি সাথে সুনামিও নিয়ে এসেছে।
যা বুঝা গেলো মাসখানেক পর।

চলবে

#শামীমা_সুমি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে