আমার মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম দিন মুকুল আমাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। বোধ হয় ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে, কারণ তার মায়ের চরিত্র সে খুব ভালো করেই জানে। বেরোনোর সময় অবশ্য আমার শাশুড়ি একটু ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিলেন তবে মুকুল আগে থেকেই সেটার জন্য প্রস্তুত ছিল। একেবারেই তৈরি হয়ে নিচে নেমে নাস্তার টেবিলে বসেই ঘোষণা দিল। অবশ্য কদিন আগে থেকেই বলছিল। কিন্তু উনি শুনেও না শোনার ভান করছিলেন।
আমাদের বাড়িতে মানে, মুকুলদের বাড়িতে আর কি, এখন ওই মোটা মহিলাই নিয়মিত কাজ করছে। তার নাম নাজনীন। এটা অবশ্য আরেকটা কারণ, আমার শাশুড়ির তাকে অপছন্দ করার। তার নিজের নাম মেহেরিন। মেহেরিন জামান। হুট করে কেউ শুনলে মনে করবে দুই বোন। এছাড়া আরেকটা কারণ ও অবশ্য আছে। নাজু আপা ( এই নাম আমিই তাকে দিয়েছি) তাকে খালাম্মা বলে ডাকে, মুকুলকে ভাইজান আর আমাকে ভাবি। ভদ্রমহিলার বয়স আমার শাশুড়ির সমসাময়িক হবে কিংবা বেশি ও হতে পারে। অবশ্য বলা যায় না উনি কিটো ডায়েট করে নিজেকে বেশ ফিট রেখেছেন। বয়স বোঝার কোন উপায় নেই। তা ছাড়া আগেও বলেছি ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী। এখন ছিপছিপে হাওয়াতে আরো সুন্দর লাগে, অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত মুখটা বন্ধ থাকে। একবার মুখ খুলে গেলেই কেল্লাফতে।
মুকুল আমাকে কলেজের সামনে নামিয়ে দিল। গাড়ি থেকে বের হবার কোন প্রয়োজন ছিল না তবু বোধহয় ইচ্ছে করেই বের হল। আমাকে বিদায় জানানোর ভান ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলো। ও কি চাইছে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে গুলো ওকে দেখুক? হল ও তাই। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা জুনিয়ার মেয়েগুলো সব ড্যবড্যব করে তাকিয়ে রইল। আমার একটু বিরক্ত লাগল। এত তাকানোর কি আছে? আমি নিজেও একবার তাকিয়ে দেখলাম। মুকুলকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে। কেমন একটা নায়ক নায়ক ভাব। নিজের উপর খুব রাগ হলো আমার। অবশ্য রাগ হওয়ার কিছু নেই। মুকুল দেখতে ভালো এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে যে জিনিস বাইরে থেকে যত সুন্দর তার ভেতরটা ততটাই কুৎসিত। আমি গেটের কাছে পৌঁছে একবার পেছন ফিরে দেখলাম মুকুল ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছে। আমাকে দেখে হাত নাড়ল তারপর হুস করে গাডি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
অফিস রুমে কিছু ফরমালিটি সেরে ক্লাসে পৌঁছতেই বুঝলাম মেয়েরা সব ওত পেতে বসে আছে আমার বিবাহোত্তর জীবনের মুখরচক গল্প শোনার জন্য। আমি যতই বাড়ি ঘর, শাশুড়ি কিংবা অন্যান্য গল্প করতে চাই ততই তারা গল্পের মোড় ঘুড়িয়ে অন্যদিকে চলে যায়। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এক জায়গায়। আমি প্রচন্ড বিরক্ত হলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না। অহেতুক মেয়েরা ভাববে আমি ভাব দেখাচ্ছি। আমাকে বাঁচিয়ে দেরার জন্যই বোধ হয় ফোনে একটা টেক্সট মেসেজের শব্দ এল। দেখলাম মুকুল মেসেজ করেছে। জানতে চেয়েছে কখন শেষ হবে ড্রাইভারকে পাঠাবে। আমাকে মেসেজ পড়তে দেখে অন্য মেয়েরা গা টিপাটিপি হাসাহাসি করছিল। আমি পাত্তা না দিয়ে উঠে গেলাম। বললাম সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টে যাচ্ছি তিথির সঙ্গে দেখা করতে। আমার আর তিথির বন্ধুত্বের ব্যাপারে সবাই জানে, কাজেই কেউ আর কোন কথা বলল না।
সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে জানতে পারলাম আজ ওদের কোন ক্লাস নেই। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো। আমি ফোন বের করে তিথিকে কল করার বদলে মুকুলকে মেসেজ করলাম একটু আগেই ওকে বলেছিলাম তিথির সঙ্গে ফিরব। লিখলাম তিথি আসেনি আমার আরেকটা ক্লাস বাকি আছ শেষ করে রিক্সা নিয়ে চলে যাব। গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই। মুকুলের বোধহয় অফিসে কোন কাজকর্ম নেই তৎক্ষণাৎ জবাব এলো, ক্লাসের পর অপেক্ষা কর। আমি আসছি।
আমার অসম্ভব বিরক্ত লাগছে কি দরকার ছিল মেসেজ করার। সবকিছু ওকে জানাতেই হবে? নিজের উপর রাগ হচ্ছে ভীষণ। তাছাড়া অফিস ফেলে ও আসবেই বা কি জন্য? আমি আবারো মেসেজ করলাম। অফিস ফেলে আসার দরকার নেই। মুকুল সঙ্গে সঙ্গে জবাবে লিখল, আজ বৃহস্পতিবার। হাফ ডে।
আজীব ব্যপার! আজকাল মনে হচ্ছে সপ্তাহে একাধিক বৃহস্পতিবার আসছে। এইতো সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল মুকুল হাফ ডে অফিস করে ফিরে এসে আমাকে ঘর মুছতে দেখে তুলকালাম করল। এরপর শুক্রবার দিন আমরা ঘুরতে গেলাম। সেদিনের পর থেকে আমি নিজেকে খুব গুটিয়ে ফেলেছি। সেদিন আমি দুটো বিশাল ভুল করেছি। এ ধরনের ভুল আর করা যাবে না।
সেদিন গাড়ি নিয়ে অনেকক্ষণ শহরতলীর এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর মু্কুল একটা বিশাল বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল। ও নিজে গাড়ি থেকে নেমে বাইরে চলে গেল আমাকে একবার কিছু বলল পর্যন্ত না। কিছুক্ষণ বসে থেকে আমিও নামলাম। বিশাল বড় বাড়ি, সামনে লোহার গেট। ভেতরে বিস্তৃত উঠান দেখা যাচ্ছে। গাড়ি বারান্দা পার হয়ে তারপর মূল বাড়ি। মুকুলকে দেখা যাচ্ছে, গেটে দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে কথা বলছে। তারপর দুজন একসঙ্গে বেরিয়ে এলো। ওর সঙ্গে সমবয়সি আরেকটা ছেলে। কাছে এলে মুকুল পরিচয় করিয়ে দিল
ফরহাদ, ও আমার বউ তুলি
আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম
স্লামালিকু্ম ফরহাদ ভাই। কেমন আছেন আপনি?
আমার অতিরিক্ত আন্তরিক ব্যবহার দেখে ভদ্রলোক একটু হককিচয়ে গেলেন। অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
জি ভাবী ভালো আছি। আসেন ভেতরে আসেন। চা খেয়ে যান
আমরা একটু আগেই চা খেয়েছি ফরহাদ ভাই
তাহলে শরবত বা দুপুরে লাঞ্চ…
মুকুলের বোধহয় আমাদের এই অহেতুক আলাপচারিতা ভালো লাগছিল না তাই ও উপসংহার টানতে বলল
না আমাদের আরেক জায়গায় যেতে হবে। ওখানে গিয়ে লাঞ্চ করব। আজ আসি ফরহাদ
আরে যাবি তো, এত তাড়া কিসের? ভাবিকে উপহারটা দে
ফরহাদ ভাই একটা ছোট্ট বেতের ঝুড়ি মুকুলের হাতে এগিয়ে দিল। মুকুল ঝুড়িটা আমার হাতে চালান করে দিয়ে বলল
দেখতো তুলি পছন্দ হয় কিনা?
আমার তর সইছিল না দেখার জন্য যে এর মধ্যে কি আছে, কিন্তু কেন যেন ভয় করছিল। ছোট্ট একটা ঢাকনা দেয়া বেতের ঝুড়ি। কি থাকতে পারে ভেতর? ফুলের ঝুড়ি হলে তো ফুলগুলো বাইরে থেকে দেখা যেত। আমি কাঁপা হাতে ঝুড়িটা নিয়ে ঢাকনা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভেতরে ছোট্ট ফুটফুটে সাদা তুল তুলে একটা বিড়াল ছানা। । ঠিক আমার টুকটুকির মতন। ছোটবেলায় নানু ভাই আমাকে উপহার দিয়েছিল এরকম একটা বিড়াল ছানা। আমি ওর নাম রেখেছিলাম টুকটুকি। নানু ভাই মারা যাবার পর যখন আমরা বাড়ি বদল করে লালমাটিয়ায় যাই সে সময় ওকে কি করা হয়েছিল আমি জানিনা। কিন্তু আমি ওকে আর দেখিনি। কত রাত গেছে, আমি ঘুমের মধ্যে হাত বাড়িয়ে আমার টুকটুকিকে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। আজ হঠাৎ করেই এই ছোট্ট তুলতুলে বেড়াল ছানাটা আমাকে বহু বছর পেছনে নিয়ে গেল। যে আমি পণ করেছিলাম কোনদিন কাঁদবো না এমনকি বিয়ের দিন পর্যন্ত কাদিনি সেই আমি হঠাৎ করেই টের পেলাম আমার দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। আমি এক হাতে বিড়াল ছানাটাকে তুলে নিয়ে অন্য হাতে মুকুলকে জড়িয়ে ধরলাম।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই দেখলাম মুকুল হতভম্ব মুখ করে তাকিয়ে আছে আর ফরহাদ ভাইয়ের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি।
যতই অপ্রস্তুত হই না কেন আমি কখনোই সেটা বাইরে জাহির করি না, আজও করলাম না। ওদের দুজনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে টুকটুকিকে ঝুড়ির ভেতর রেখে গাড়িতে উঠে বললাম
আজ আসি ফরহাদ ভাই আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম অসংখ্য ধন্যবাদ
ফরহাদ ভাই হেসে হাত নাড়লেন। মুকুল ড্রাইভিং সিটে এসে বসেছে। ওর হতভম্ভ ভাব তখনও কাটেনি। রাগে দুঃখে তখন আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে। এত বড় ভুল আমি কি করে করলাম। এতটা আবেগপ্রবণ তো আমার হবার কথা নয়। ও ড্রাইভ করতে করতে একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে বিষয়টা কি। আমি ওকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছি না। টুকটুকি কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছি। যদিও ভেতরে ভেতরে আমার তখন ইচ্ছা করছে নিজের দু গালে দুটো কষে থাপ্পর মারতে। এরকম একটা কাজ আমি কি করে করলাম? সেটাও আবার মাঝ রাস্তায় এত মানুষের সামনে। আর ঐ বদমাইশ ছেলে ফরহাদ আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছিল। আমি ঠিক করলাম জীবনে আর এই কাজ করা যাবে না, যদি করি তাহলে নিজের গালে দুইটা জুতার বাড়ি মারবো। । যেনতেন জুতা নয় একেবারে বাটার জুতা। যদিও দিন শেষে আমার আফসোস হচ্ছিল যে কেন বাটার জুতা পরে আসিনি কারণ দুপুরের পর এই ভুলটা আমি আবারও করলাম।
আজকের সকালটা একেবারেই অন্যরকম। ঘুম ভেঙ্গেই মনে হল আজ ভালো কিছু হবে। অনেক অনেক বছর পর আমার এমন অনুভুতি হল। খুব ছোট বেলায় এমনটা হত। তখন আমারা ধানমন্ডি লেকের ধারে একটা একতলা বাসায় থাকতাম। মায়ের কাছে শুনেছি আমার জন্ম এই বাসাতেই। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়াতে আদর যেমন পেয়েছি তেমনি ছোটবেলা থেকে অনেক দায়িত্বও নিতে হত। আমার যখন পাঁচ বছর তখন থেকে মাকে চাকরি করতে দেখেছি। সেসময় আমি থাকতাম নানুভাই এর সঙ্গে। উনি আমার মায়ের খালা। আমি ছটবেলা থেকেই তাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে দেখেছি। সকাল হলেই মা বাবা দুজনেই অফিসে চলে যেত। আমি আর নানু ভাই থাকতাম। আমাদের একতলা বাড়ির সামনে বিশাল উঠান। উঠান পার হলে রাস্তা। রাস্তার ওপারে লেক।
বাবা মা বেড়িয়ে যাবার পর আমি সারাদিন উঠানে বসে খেলতাম। তখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি। দুপুর হলে নানুভাই গোসল করিয়ে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিত। কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াত দুপুর গড়ালে। ঘুম ভেঙে দেখতাম শেষ বিকেলের কমলা রঙের রোদ আমার বিছানার পাশে মেঝেতে চার কোনা ফুলের নকশা তুলেছে। চোখ ডলে দেখতাম নানু ভাই বারান্দায় ফুল গাছে জল দিচ্ছে। আমাকে দেখে মিস্টি করে হেসে কোলে তুলে নিত। যতদিন নানুভাই বেচে ছিল আমার জীবনটা কেমন স্বপ্নের মতন ছিল। নানু ভাই চলে যাবার পর আমার জীবনটা এমনভাবে বদলে যাবে আমি কোন দিনও ভাবিনি। সে সব ভায়ানক দিনের কথা আমি ভাবতেও চাইনা।
সেই সব দিনের কথা মনে পরতেই সকালের ফুরফুরে মন ভালো হওয়া আমেজটা কেমন নষ্ট হয়ে গেল। আমি কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে গেলাম। নিচের পরিবেশ যেমনটা ভেবেছিলাম একেবারেই তেমন নয়। খাবার টেবিলে গরম গরম রুটি আলু ভাজি, সুজির হালুয়া পরিবেশন করা। আমার শাশুড়ি মুখ গোজ করে বসে আছেন। রান্নাঘর থেকে মোটাসোটা থলথলে এক মহিলাকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম, তার হাতে গরম রুটি। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুকুল বলল
খেতে বস তুলি।
খালি বউরেই কবি, আমারে চোখে দেখস না?
আপনার বাড়ীতে আপনাকে বলতে হবে কেন? নিন খাওয়া শুরু করুন।
উনি আর কথা বাড়ালেন না। রুটি ছিড়ে ভাজি দিয়ে মুখে দিলেন; পরমুহূর্তেই মুখ বিকৃত করে বললেন
এমুন লেপের মতন মোটা রুটি খাওন যায় নাকি? ভাজিতেও তো লবন বেশী।
মোটা মিহিলাটি একটা বিরক্তি সুচক মুখভঙ্গি করল। মুকুল আমার প্লেটে রুটি আর আলুভাজি তুলে দিল। সাত সকালে এই মহিলা কোথা থেকে আমদানি হল আমি ঠিক বুঝলাম না। খাবার মুখে তুলতেই যাচ্ছিলাম এর মধ্যেই আমার শাশুড়ি হুংকার দিয়ে উঠলেন
ওই মাথারি, চিনি কি বাড়ি থেকা লোয়া আইসো? হালুয়ার মধ্যে কেউ এত চিনি দেয়?
এবার বোধহয় মহিলার ধৈর্যের বাধ ভাঙল। সে বেশ উচ্চস্বরেই বলল
যতটুক সুজি ততটুকই তো চিনি দিসি। এমুন ই তো দেই।
ওই বেটি। গলা নামায়া কথা ক
আমি নিরব দর্শকের মত দুজনের নাটক উপভোগ করছিলাম। মুকুলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও খাবারে অতিরিক্ত মনযোগী। যেন এত উপাদেয় খাবার এই জীবনে আর খাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাদের দৃশ্য তখনো চলছে। যবনিকাপাত হয়নি। এক পর্যায়ে মোটা মহিলা দাত মুখ খিচিয়ে বলল
ভাইজান এমুন হইলে কিন্তু আমি আর কাম করুম না
উনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন
করিস না। কে তরে পায়ে ধইরা সাদসে
মুকুল এবার মুখ তুলে বলল
মা অনেক ঝামেলা করে দারোয়ানকে বলে ওকে যোগাড় করেছি। একটু শিখিয়ে টিখিয়ে নেন। অন্তত যতদিন রেবা না আসছে।
আমার শাশুড়ি চকিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন
না আইলে নাই। আমারা তিনটা মোটে মানুষ। কি এমুন কাম?
এত বড় বাড়ি। পরিষ্কার করার জন্য তো একজন লাগে।
ধোয়া মোছা করুক। রান্দনের দরকার নাই। ওই গুয়ের খাওন খাইতে চাই না
মুকুল গম্ভীর গলায় বলল
দরকার আছে। এখন নিশ্চই আপনি রান্না করতে বসবেন না
কেন তর বউয়ের হাতে কি মেন্দি লাগসে?
আমি আর তুলি বাইরে যাব। ফিরতে রাত হবে। আপনি কি খেতে চান খালা কে বলে দিন। কি করে করতে হবে বুঝিয়ে দিন।
একদিন আমি কষ্ট মস্ট কইরা চালায়া লমু। এরে বিদাই কর।
না মা। রেবা না আসা পর্যন্ত ওই থাকবে। তুলি এসব করতে পারবে না। আগামী সপ্তাহ থেকে ওর মাস্টার্সের ক্লাশ শুরু হবে।
আমি চট করে কিছু বলতে পারলাম না। মুকুল এত খবর কোথা থেকে পেল? নিশ্চই তিথি বলেছে। বাবা অবশ্য বিয়ের আগে ওর মা আর ফুপুদের বলেছিল যেন আমাকে মাস্টার্স করার সুযোগ দেয়। এরপর পাশ করে চাকরি বাকরি করব কিনা তা পরে ঠিক করা যাবে। মা অবশ্য এ নিয়ে কথা বাড়াতে চেয়েছিল কিন্তু বাবা দেয়নি। আমিও গাঁ করিনি। কি লাভ ঝামেলা করে। সবাই এক। উনিশ আর বিশ। মুকুল না হয়ে মকবুল হলেও এই হত। ব্যটা ছেলে সবাই এক। যদিও মুকুল সব রকম চেস্টাই করছে যেন আমি এখানে ভালো থাকতে পারি কিন্তু এ আর কয় দিন? আমার সঙ্গে এখনো সুবিধা করতে পারেনি তাই ভালো মানুষের ভঙ্গ ধরে আছে। দুদিন পরে আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে। তবে এত কিছুর পরেও মুকুলের প্রতি আমার ঋণ ক্রমেই বাড়ছে। আজ ও যেটা করল, আমি আশা করিনি। ওর মা হয়ত ধরেই নেবেন আমি ওকে বলে এসব করিয়েছি। যাক ওদের ব্যপার, ওরা বুঝুক।
আমি আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম, খাওয়ায় মনযোগ নেই। মুকুল বোধহয় সেটা লক্ষ্য করেই বলল
তুলি খেতে ইচ্ছা না হলে খেও না।
আমার শাশুড়ি বাকা হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, আমি তার আগেই বললাম
না খাচ্ছি তো। হালুয়া অসাধারন হয়েছে খালা। রুটিটাও নরম তুলতুলে। সিদ্ধ আটা তাই না?
হ ভাবী। খালাম্মার যে কেন পছন্দ হইল না। বুজলাম না।
ওই বেটি, কথা কম ক। যা ফ্রিজ থেকা মুরগি বাইর কইরা ভিজা। আর পেপেটা চিকন কইরা কাট।
খালা গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেল।
মুকুল উপরে যাওয়ার আগে বলল
তুলি খাওয়া হলে রেডি হয়ে নাও।
আমি কথা বাড়ালাম না। চা খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকুলে না। এখন চায়ের কথা বললে আবার কি ঝড় শুরু হয়। বাইরে বের হলে বরং মুকুল কে বলব। মালাই চা কিনে দিতে। একটু অবাক লাগল। আমি কি ওর প্রতি একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। নিজের প্রতি নিজেরই একটু বিরক্ত লাগল। ওর সঙ্গে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না কিন্তু বাসায় থাকার কথা ভাবতেও পারছি না।
আজ রিক্সা না নিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে বেড় হলাম। মুকুল কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। আমরা কোনদিকে যাচ্ছি বুঝতে পারছি না। জিজ্ঞেস করতে ও ইচ্ছা করছে না।
চা খাবে তুলি?
খাওয়া যায়
আজও আমরা রবীন্দ্র সরোবরে দাড়িয়ে চা খেলাম। মুকুল সেদিনের মতো আমার সঙ্গে গল্প করল না। দূরে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলতে লাগল। কি নিয়ে কথা হচ্ছিল জানি না গাড়িতে বসার পরে ও কেমন চুপ করে রইল, তারপর আচমকা বলল
আমার উপহারটা কি তোমার পছন্দ হয়নি তুলি?
হয়েছে তো, হবে না কেন?
বলতে বলতে আমি নাকের উপর হাত রেখে চমকে উঠলাম। আমার নাকফুলটা নেই।এমন তো হবার কথা নয়। নানু ভাই বলতো সোনার গয়না হারানো অশুভ লক্ষন। আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম
সেকি! আমার নোসপিন। কোথায় গেল? হায় আল্লাহ! কোথায় হারালাম আমি।
আমার অবস্থা দেখে মুকুল হেসে ফেলল তারপর আমার হাতটা টেনে নিয়ে পকেট থেকে নোসপিনটা বের করে আমার হাতে রাখল। আমি অবাক হয়ে বললাম
কোথায় ছিল এটা?
বিছানার পাশে মেঝেতে পরে ছিল।
আমি ওটা পরতে পরতে বললাম
আগে বললেন না কেন?
এমনি
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ওর মন খারাপ হয়েছে। আমার কিছু বলা উচিত। হয়ত কোমল কিছু কথা কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি খুব ধৈর্যে ধরে অপেক্ষা করছি ওর মুখোশটা কখন খসে পরে সেটা দেখার জন্য। ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গাড়ি স্টার্ট দিল। আমরা যখন শহর ছেড়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছি তখন আমি আস্তে আস্তে বললাম
আমার কোথায় যাচ্ছি?
তোমার জন্য কিছু অর্ডার করেছিলাম, সেটা আনতে।
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না, তবে এই রকম শহরতলীতে ও আমার জন্য কি অর্ডার করতে পারে সেটা জানতে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। আর যখন জানতে পারলাম তখন আমি এত বেশী খুশী হলাম যে স্থান কাল পাত্র ভুলে মাঝ রাস্তায় আমি, এই কঠিন হৃদয় তমালিকা কায়সার ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
চলবে……
যতটা বিনোদন হবে আশা করেছিলাম বিষয়টা ততটা বিনোদনমূলক হলো না। মুকুল ওর লম্বা লম্বা পা গুলো নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়াল। আমি অবাক হবার ভান করে বললাম
আরে আপনি? এসে গেছেন। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আসুন। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। টেবিলে খাবার দিয়ে দিয়েছি।
মুকুক টেবিলের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা হতভম্ব হল।
আমি নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এই ধরনের নাটকীয় ডায়লগ যে আমি কোনদিন দিতে পারব আশাই করিনি। অবশ্য আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এই ধরনের ডায়লগ পঞ্চাশটা চ্যানেলের অন্তত ত্রিশটা নায়িকা প্রতিদিন বলছে। যদিও এসব ডায়লগ এর পরেও নায়িকাকে প্রতিনিয়তই চর থাপ্পড় খেতে হয়। যে নাটকের নায়িকা যত বেশি নির্যাতিত সেই নাটকের জনপ্রিয়তা ততই বেশী। প্রেম ভালোবাসা দেখতে দেখতে মানুষের চোখ পচে গেছে। এখন সবাই দেখতে চায় নায়ক, নায়িকাকে একটু পর পর থাপ্পর মারছে আর তারপর ঘুমিয়ে পরলে চোখে জল নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সবাই এই টাইপ ভালোবাসা দেখতে পছন্দ করে। মুকুল অবশ্য সিরিয়ালের নায়কদের মতন কিছুই করলো না
থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল
এতসব রান্না তুমি করছো?
ওই আর কি, তেমন কিছু না। আসলে কদিন ধরে রিচ ফুড খাওয়া হচ্ছিল তো তাই মা বললেন……
ঘর মুছতে ও কি মা তোমাকে বলেছে?
না না, ছি! উনি কেন বলবেন? আসলে রেবা ছুটিতে তো তাই………
রেবা ছুটিতে নাকি?
হ্য, কেন আপনি জানতেন না?
মুকুল জবাব দিল না। ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল
নিচে থেকেই শাশুড়ির ঘরের দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ শোনা গেল। কিন্তু ভেতরে কোন উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এর শব্দ পাওয়া গেল না।। এই বাড়ির এই ব্যাপারটা বেশ মজার সবকিছুই ঘটে কেমন নিরবে।
আমার কাজ শেষ। আমি ন্যকড়া বালতি রেখে ঘরে গিয়ে হাত্মুখ ধুয়ে নিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছি তখনই মুকুল ঘরে ঢুকল। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে সোজা ওরাশরুমে ঢুকে গেল।
সমীক্ষায় দেখা গেছে নারীদের গোসলের সময় পুরুষদের চেয়ে দুই মিনিট হলেও বেশী। পুরুষদের যদি সময় লাগে ৬.৩ মিনিট সেখানে নারীদের দরকার হয় ৭.২ মিনিটের। মুকুল নারী পুরুষ সবার মুখে কলঙ্ক লেপে দিয়ে তেত্রিশ মিনিট পর বেল হল। আমি তেপোর ভয়ে মানে তেলাপোকা শাশুড়ির ভয়ে নিচে নামলাম না। মুকুল কতটা কি বলেছে জানি না। এর পুরো প্রভাবটাই আমার উপর এসে পরবে। ডলা ব্যপারটা পুরোটাই নিম্নগামী। এমডি ম্যনেজারকে ডলা দেয়, ম্যনেজার অফিসারকে, অফিসার পিওনকে, পিওন বাড়ি গিয়ে তার বউকে, বউ ছেলেকে ইত্যদি ইত্যাদি। ভেবেছিলাম মুকুল বের হলে একসঙ্গে নামব। কিন্তু সেই আশা মনে হচ্ছে সুদুর চীনে । সময় কাটানোর জন্য আমি একটু সাজগোজ করে নিলাম। সিরিয়ালের নায়িকেদের মত শাড়ি চুড়ি টিপ পরে ফেললাম। মুকুল বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে রীতিমত ধাক্কা খেল। প্রথম দিনের মত খানিকক্ষণ হা করে তাকিয়েই রইল। আমি মিস্টি করে হেসে বললাম
চলেন খেতে যাই
খাবার টেবিলে তেমন কিছুই হল না। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো খেতেই নামবেন না। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে উনি আমাদের সঙ্গে খেতে বসলেন; এমনকি পটলের খোসা দিয়ে চিংড়ি মাছের ভর্তার প্রশংসাও করলেন। মুকুল অবশ্য কয়েকবারই রান্নার প্রশংসা করেছে।
খাওয়া শেষ করে করে মুকুল উপরে চলে গেল। আমি টেবিল গুছিয়ে উপরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখনই আমার শাশুড়ি পেছন থেকে ডেকে বললেন
শুনো, সব কথা জামাইয়ের গলা ধইরা কইতে হয় না। কিছু কথা নিজেগো মধ্যেও রাখোন লাগে। বুঝতে পারসো?
আমি আস্তে করে বললাম
গলা ধরিনি তো, তবে আপনি বললে………
এই বলে আর দাড়ালাম না, একরকম দৌড়ে উপরে চলে এলাম। পেছন থেকে বলতে শুনলাম
বেয়াদ্দব মাইয়া! ফাজিলের ঘরের ফাজিল
আমাকে হাসিমুখে ঘরে ঢুকতে দেখে মুকুল চোখ তুলে তাকালো। তারপর বলল
বাইরে যাবে তুলি?
আমার মুখ শুকিয়ে গেল। এই রে! এই বুঝি আমাকে কোন সিনেমা হলের কোনার সিটে বসিয়ে দেবার তাল করছে। তারপর সিনেমা দেখার চাইতে সিনেমা করাতে ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম
বাইরে কোথায়?
এমনি চল, একটু রিক্সা করে ঘুরে আসি
রিকশার কথা শুনে আমি একটু আশ্বস্ত হলাম, যাক অন্তত সিএনজি তে উঠাতে চায় নি। আমি বললাম
তাহলে চেইঞ্জ করে নেই
চেইঞ্জ করতে হবে না। এমনই সুন্দর লাগছে।
আমরা অনেকক্ষণ রিক্সা করে ধানমন্ডির লেকের এদিক ওদিক ঘুরলাম। রবীন্দ্র সরোবর থেকে চা ও নিলাম। মুকুলের ব্যপার-স্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ মনে হচ্ছে। তিনদিন হয়ে গেল মুকুল একবারের জন্য আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেনি। এমনকি রিক্সায় বসেছে আমার হাত পর্যন্ত ধরার চেষ্টা করেনি। কেমন বন্ধুর মতন আচরণ করছে। এদিক-ওদিককার গল্প করছে। আমার অবশ্য খারাপ লাগল না। তিথির সঙ্গে ওর ভাইয়ের অনেকটাই মিল। কেমন একটা সহজ সাবলীল ব্যাপার আছে দুজনের মধ্যেই।
অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর মুকুল জিজ্ঞেস করল
আর কোথাও যাবে তুলি?
আর কোথায়?
চলো তিথিদের বাসায় যাই
আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আমি ভাবতেই পারিনি মুকুল এই কথাটা বলবে।
তিথিদের বাসায় আজ অনেক লোকের ভিড়। মেঝ চাচার অফিসের কলিগেরা দাওয়াতে এসেছেন। ওদের ফ্ল্যাটে জায়গা হচ্ছে না তাই তিথিদের বাসায় মহিলাদের বসানো হয়েছে। রেহানা আন্টি ভীষণ ব্যস্ত। তবু আমাদের দেখে খুশি হলেন ভীষণ। তিথি সব কাজ ফেলে আমাকে নিয়ে ছাদে চলে গেল।মুকুলকে মেঝচাচা ধরে নিয়ে গেলেন কলিগদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন বলে।
তিথিদের ছাদটা এমনিতেই সুন্দর। রাতের বেলা আরও সুন্দর লাগে। হাসনাহেনার সুগন্ধে মন ভরে যায়। বেশিক্ষণ গল্প করা গেল না, নিচে থেকে ডাক এল। সিড়ি দিয়ে নামার সময় শাড়িতে পা বেঁধে শাড়ি টাড়ি খুলে একাকার অবস্থা হলো। এমনিতে হলে আমি সামলে নিতাম কিন্তু মুকুল তখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল। ওর সামনে এই অবস্থা হওয়াতে অস্বস্তিতে পড়তে হলো খুব। মুকুল হয় বোধ হয় সেটা বুঝতে পেরেই চট করে ভেতরে ঢুকে গেল। তিথি আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল
কিরে তুই ভাইকে দেখে অমন লজ্জা পেয়ে গেলি কেন?
আমি শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে বললাম
লজ্জা না পাওয়ার কি আছে?
বরের সামনে আবার এত লজ্জা কিসের? তোদের মধ্যে সব ঠিক আছে তো? দেখিস আমার ভাইটাকে ঠকাস না। তোকে কিন্তু অসম্ভব ভালোবাসে।
পরের কথাটা আমার কানে গেল না কিন্তু প্রথম কথাটা কেমন মাথার মধ্যে গেঁথে গেল। আমি কি সত্যিই কাউকে ঠকাচ্ছি? এই জীবনে আমি কারো পাওনা বাকী রাখিনি। তা সে আমার সঙ্গে ভালো আচরন করুক কিংবা খারাপ।
ফেরার সময় পুরোটা পথ আমি কেমন আনমনা হয়ে রইলাম। তিথির কথাটা মাথা থেকে সরাতেই পারছিলাম না। রাতের বেলা যখন মুকুল ল্যপটপ নিয়ে অন্য ঘরে যেতে উদ্যত হল, আমি ওকে ডেকে বললাম
কোথায় যাচ্ছেন?
একটু কাজ আছে। তুমি ঘুমিয়ে পর
একটু দাড়ান, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।
হ্য বল।
আপনি এখানে থাকতে পারেন। আমি কারো প্রাপ্য থেকে তাকে বঞ্চিত করি না।
মুকুল প্রথমে আমার কথাটা বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো।
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম
হাসছেন কেন?
হাসির কথা বললে তো হাসবই
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, মুকুল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
আমিও আমার পাওনা ছেড়ে দেই না।তবে আমি বিজনেসের স্টুডেন্ট তো, আপাতত ইনভেস্ট করছি সময়মতো সুদে আসলে উসুল করে নেব।
আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমার মুখের ওপর যে মানুষটা ঝুকে আছে তার দৃষ্টি ভয়ার্ত। আমি তাকিয়ে রইলাম। খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু তার তাকিয়ে থাকার ধরনটা ভীষন অচেনা। আমি প্রায়শই দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে চিৎকার করে জেগে উঠি। চোখ মেলে নানান সময় অনেককেই দেখেছি। তাদের দৃষ্টি অন্য রকম। আজ যাকে দেখছি তার মতো নয়। ওর চখে ভয়, বিস্ময়কে ছাপিয়ে আছে এক গভীর মমতা। সে কিছু বলছে। আমি শুনতে পারছি না। মাথায় ভিতর অজস্র মৌমাছি ভনভন করছে। ওর কথা গুলো দেখতে পাচ্ছি। বর্ণ গুলো ঘরের বাতাসে ইতস্তত ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু বর্ণ জুড়ে আবার শব্দ তৈরী হচ্ছে কিন্তু এলোমেলো শব্দগুলো জুড়ে বাক্য তৈরী করতে পারছি না। আমি সেই চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুমের ঘোরে টের পেলাম কেউ একজন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি চেষ্টা করেও সেই স্পর্শ এড়িয়ে যেতে পারলাম না কিংবা বলা ভালো চাইলাম না।
সারারাত এলোমেলো স্বপ্ন দেখলাম। ভাঙ্গা ভাঙ্গা, টুকরো টুকরো, ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন কিন্তু প্রতিটাই অত্যন্ত বীভৎস। ধূসর আকাশ আর বালুকাময় প্রান্তর। আমি প্রাণপণ চিৎকার করছি। আশেপাশে কেউ নেই। কতগুলো বীভৎস প্রানী আমার দিকে এগিয়ে আসছে ধীর গতিতে। তাদের তিন জোড়া পা। মাথায় বিশাল এন্টেনা কিন্তু মুখ গুলো মানুষের মত। সেই মুখগুলো আমার ভীষণ চেনা। তাদের ঠোটের কোল বেয়ে কষ গড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর তাদের লকলকে জিভ বেরিয়ে আসছে, সেই জিভের ডগাটা চেড়া, অনেকটা সাপের মতন। আমি থেকে থেকে শিউরে উঠছি। চেষ্টা করেও এক পা নড়তে পারছি না। আমার পেছনে গভীর খাঁদ। আর এক পা পিছালেই……
আমি হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। সমস্ত ঘর জুড়ে রোদের হুটোপুটি। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। প্রথমটায় ঠিক চিনতে পারলাম না। আমি সাধারনত নিজের ঘরটা অন্ধকার করে রাখতাম। জানালায় ভারী পর্দা দেয়া থাকত। এমনিতেও আমার ঘরটা ছিল পশ্চিম কোনে। আর এই ঘরটা বোধহয় দক্ষিণ পূর্ব কোনে। বিকেলের দিকে বেশ ঠান্ডা বাতাস দেয় আর সকাল হলেই রোদ।
আমি আশেপাশে কোথাও মুকুলকে দেখতে পেলাম না। মাটিতে পা ফেলতে গিয়ে টের পেলাম শরীর খুব ভারী মনে হচ্ছে। মধ্যাকর্ষণ আমার উপর ভীষণভাবে চেপে বসেছে। কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়েছি তখন দেখলাম মুকুল দরজা ঠেলের ভেতরে ঢুকছে। আমাকে উঠতে দেখে এগিয়ে এসে বলল
তুমি ঠিক আছো তুলি?
আমি জবাব না দিয়ে আস্তে করে মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। সাধারণত এরকম একটা দুঃস্বপ্নময় রাতের পর আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করে। আমি তখন শাওয়ার খুলে অনেকক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। আজ ও তাই করলাম। যতক্ষণ না শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল দাড়িয়েই রইলাম। এরপর খেয়াল হল জামা কাপড় নিতে ভুলে গেছি; এমনকি একটা তোয়ালে পর্যন্ত নেই। আমি বোকার মত এদিক ওদিক তাকালাম। নিজের বাসায় হর হামেশাই এমন হত; কারন আমি ঘরের দরজা লক করে গোসল করি। একবার গোসল শেষে বেরিয়ে দেখেছিলাম আশরাফ আঙ্কেল ঘরে বসে আছেন। আমাকে দেখে একান ওকান হাসি হেসে বলেছিলেন
প্রিন্সেসকে তো আজ জলপরীর মতো লাগছে।
এরপর থেকে এই ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। সে যাই হোক, কিন্তু এখানে কি করব? আমি ভেজা কাপড়ে দরজা খুলে উকি দিয়ে ঘরে কাউকে দেখতে পেলাম না। একটু জোড়েই বললাম
কেউ আছেন? একটু দরকার
মুকুল হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। দরজার কাছের পাপোষে পা পিছলে আবার ড্রেসিং টেবিলের কোনা ধরে কোনমতে সামলে ও নিল। এমন অবস্থাতেও আমি না হেসে পারলাম না। ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
কি? জামাকাপড় নিতে ভুলে গেছ?
হু
মুকুল আর কথা না বাড়িয়ে জামা কাপড় তোয়ালে সব আমার হাতে দিয়ে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় আবার দরজাটা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করেও দিয়ে গেল। আমি একটু দুশ্চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। সাধারণত নববিবাহিত দম্পতিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের দৃশ্য খুব সাধারণ। নাটক সিনেমায় অনেক দেখেছি। নায়ক নিজেও দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছু প্রেমময় দৃশ্যের অবতারণা হয়। এরপর হঠাৎ করেই নায়ক-নায়িকাকে দেখা যায় তুষারাবৃত পাহাড়ের উপর নাচানাচি করতে। একদিকে নায়িকা হার কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যেই শিফনের শাড়ির আঁচল উড়িয়ে কোমর দুলিয়ে নাচতে থাকে অন্যদিকে নায়কও গলায় সোয়েটার বেঁধে তার আশেপাশে লম্ফঝম্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমাদের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হলো না। আমি তড়িঘড়ি পোশাক পাল্টে নিচে চলে গেলাম।। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। কি সর্বনাশ! রেবার মানে আমার না সকালে নাস্তা বানানোর কথা।
নিচের পরিবেশ বেশ থমথমে। মুকুলকে দেখলাম নাস্তার টেবিলে প্লেট সাজাচ্ছে। আমার শাশুড়ি রান্নাঘরে ব্লেন্ডারে কিছু ব্লেন্ড করছে। এত সকালবেলা ব্লেন্ডারে কি ব্লেন্ড করছে ঠিক বুঝতে পারলাম না। সাতসকালে ফ্রুট স্মুদি খাওয়ার মত আধুনিক ওনাকে আমার মনে হয়নি। যদিও যখন বেরিয়ে এলেন আমি পরাজয় মেনে নিলাম শতভাগ। উনাকে যতটা আধুনিক ভেবেছিলাম উনি তার থেকেও বেশি আধুনিক। উনার হাতের ছোট্ট ট্রেটাতে এক কাপ বুলেট কফি। গতকাল সকালে উনাকে ডিম সিদ্ধ, বাদাম ভাজা আর শসা খেতে দেখেছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি আজ ব্যাপারটা ক্লিয়ার হল। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুকুল বলল
বসে পড়ো তুলি
আমি ওর পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়লাম আমার শাশুড়ির মুখোমুখি। উনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকলেন ও না। বুঝলাম এই মৌনতা ঝড়ের পূর্বাভাস। যাক ঝড় যখন আসবে দেখা যাবে ; আপাতত ঝরের আগের সুশীতল বাতাস উপভোগ করি। মুকুল নিজে থেকেই বলল
স্টার কাবাব থেকে নান রুটি আর নেহারি এনেছি,বুঝেছো। সঙ্গে ডাল সবজি ও আছে। তোমাকে কি দেব?
সবই দিন।
আমার শাশুড়ি একবার চোখ তুলে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরে হাসলেন। আমি উনাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে খাবারে মনোযোগী হলাম। যা হবে দেখা যাবে। আমাকে আগ্রহ নিয়ে খেতে দেখে মুকুল বলল
ফিরনী ও এনেছি, খাবে?
অবশ্যই খাব। চা আনেননি?
এনেছি। ফ্লাস্কে আছে।
আমি দ্রুত ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে চুমুক দিলাম। আহ! এই মালাই চা ছাড়া সকালটা জমছিল না।
খাওয়া শেষে মা ছেলে দুজনেই উপরে চলে গেল। আমি টেবিলে গুছিয়ে রেখে আরেক কাপ চা ঢেলে নিলাম। একটু পরে মুকুল নেমে এসে বলল
আমাকে আজকে অফিসে যেতে হবে। আসলে তিন দিনের ছুটিই পেয়েছিলাম। তবে আজ বৃহস্পতিবার তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারবো।
আমি আস্তে করে জানতে চাইলাম
কখন আসবেন?
আড়াইটার মধ্যে চলে আসব। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। কেমন?
আমি মাথা নিচু করে ঘাড় কাত করলাম
মুকুল চলে যাবার ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই আমার শাশুড়ি নিচে নেমে এলেন। যা ভেবেছিলাম তাই। কদিন ধরে পোলাও কোরমা খাওয়া হচ্ছে তাই আজ স্বাস্থ্যকর কিছু রান্না করার ফরমাইস জারি করা হলো। রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম টাটকা বাজার আনা হয়েছে। রান্নার মেনু দেয়া হয়ে গেছে
১ শোল মাছ দিয়ে লাউ
২ বেগুন ভর্তা
৩ পটল ভাজি
৪ পটলের খোসা দিয়ে চিংড়ি মাছের ভর্তা
৫ সাদা ভাত
৬ ঘন করে মুগ ডাল
আমি বিগলিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, স্যলাড করবো না?
উনি ভাবলেশহীন মুখ করে বললেন, মন চাইলে করবা।
রান্নাঘরে এসে ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে নটা বাজে। এই রান্না গুলো করতে আমার বড়জোর তিন ঘন্টা লাগবে। সাথে কোন হেল্পিং হ্যন্ড নেই, তাই সময় আর একটু বেশি লাগতে পারে।
আমি মনে মনে একটু হাসলাম। এই ভদ্রমহিলা বোধহয় আমার ব্যাপারে ভালো মতন খোঁজখবর নেননি। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা দুজনেই চাকরি করতেন বলে রান্না বান্না করার ভালই অভ্যাস হয়েছে আমার। তাছাড়া রান্না করাটা আমার কাছে শখের একটা কাজ। বেলা দুইটার মধ্যেই সব রেডি করে টেবিলে দিয়ে দিলাম।
এরপর তাড়াতাড়ি উপরে গিয়ে পোশাক পাল্টে একটা পুরনো রঙ চটে যাওয়া সুতির জামা পরে নিলাম। রেবা আমাকে সেদিন বলেছিল মপ দিয়ে ঘর মোছা হয়। আমি ইচ্ছা করেই ন্যাকড়া বালতি নিয়ে নিচের হল ঘরটা মুছতে আরম্ভ করলাম।
দরজায় তালা খোলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মুকুল ভেতরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো। আমার অসম্ভব আফসোস হচ্ছে। কেন আমার মাছির মতো অনেক গুলো চোখ হল না? মুকুলের হতভম্ব মুখটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ি আস্তে আস্তে ফাকা হয়ে যেতে শুরু করল। আমার ভালোই লাগছিল। এত লোকজনের ভীড় তার উপর আবার এমন জবরজং শাড়ী গয়না পরে থাকতে হচ্ছে। অতিথিরা সব যাবার আগে আমার কাছে বিদায় নিয়ে হাতে কিছু গুজে দিয়ে যাচ্ছিল। আমি বেশ অবাক হলাম। পরে বুঝলাম এটা ওদের পরিবারের নিয়ম। যাক আমার আর কি করা। মনার মায়ের মতো আমার ও ভালোই আমদানি হল।
সবার শেষে বিদায় নিলেন রেহানা আন্টি। উনি আমার কাছে এসে বললেন
মনার মাকে রেখে যাই। কাল পাঠিয়ে দিস। এখানে তো কেউই নেই। ভাবি নাকি রেবা কে ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
আমি মনে মনে বললাম
ছুটি দেয়নি ছাটাই করে দিয়েছে। আর তার যায়গায় অন্য কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। মুখে বললাম , লাগবে না আন্টি। সব তো আপনি গুছিয়েই দিয়েছেন।
উনি আমাকে কোথায় কি আছে সব বুঝিয়ে দিলেন।
ফ্রিজে বিয়ের অনেক খাবার রয়ে গেছে। ওখান থেকে বের করে রাতে খেয়ে নিস। তারপর কাছে এসে গলা নিমিয়ে বললেন
মনার মা কে কিছু দিয়েছিস? হাতে কিছু দিস। আশা করে আছে।
আমি রান্না ঘরে গিয়ে দেখলাম মনার মা সব গুছিয়ে রাখছে। এই মহিলা কথা বেশী একটা বলে না। তবে কাজে বেশ তুখোড়। অল্প সময়ে অনেক কাজ করে ফেলেছে। আমি এগিয়ে এসে আমার নাকফুলটা ওর হাতে দিয়ে বললাম
এটা ময়না কে দিয়েন।
ময়নার মা ভাবলেশহীন মুখ করে ওর ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট পুটলি বেড় করে সেটাতে ওটা রেখে বলল
আর কিছু করন লাগবো?
আমি হেসে ফেললাম।
না, আর কিছু করা লাগবে না । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সে নিরাসক্ত গলায় বলল
আইচ্ছা। তাইলে গেলাম
আমি ভেবেছিলাম উপহারটা পেয়ে সে হয়ত খুশি হবে। জিনিসটা বেশ দামী। হোয়াইট গোল্ডের উপর পিওর রুবী। আমার বিয়ের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে কেনা। যদিও আমার ইচ্ছা করছিল মুকুলের দেয়া নাকফুলাটাই দিতে কিন্তু ওর প্রতি প্ কৃতজ্ঞতাবশত দিতে পারলাম না। অন্তত প্রথম রাতে ও আমার উপর ঝাপিয়ে পরেনি। এর বিনিময়ে এইটুকুতো ওর প্রাপ্য।
তবে একটা ব্যপার ভেবে মজা লাগল যে আজকাল কেউ সহজে তুস্ট হয়না। মানুষের প্রত্যাশার মাত্রা বেড়ে গেছে। আগেকার দিনের মতন অল্পতেই এখন আর কেউ খুশি হয় না, এমনকি কি বেশিতেও হয় না। তখন মনে হয় আর একটু বেশী হলে ভালো হত।
সবাই চলে যাবার পর আমি ঘরে এসে পোশাক পাল্টে নিলাম। শাড়ী না পরে হালকা শুতির জামা পরলাম। এখানে আসার সময় লাগেজ ভর্তি জামাকাপড় সহ আরো অনেক আনুসাঙ্গিক জিনিস পত্র দিয়ে দিয়েছিল বাসা থেকে।
এতসব জিনিসপত্র কোথায় রাখবো বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আলমারিটা খুলে দেখলাম একটা পাশ ফাঁকা; বুঝলাম হয়তো আমার জন্যই রাখা হয়েছে। আমি সবকিছু বের করে গুছিয়ে রাখলাম। পাশেই একটা ড্রেসিং টেবিল দেখতে পেলাম। দেখে মনে হচ্ছে জিনিসটা নতুন। বোধহয় আমার কথা ভেবেই কেনা হয়েছে। আমি আমার সমস্ত কসমেটিকস গুছিয়ে রাখলাম। লাগেজ খালি হয়ে গেলে সেটাকে আলমারির পাশে দাড় করিয়ে রাখলাম। চারপাশে চোখ বুলিয়ে মনে হল এবার ঠিক আছে। অগোছালো ঘর আমার একেবারেই পছন্দ না। আমার বোধহয় একটু শুচিবাইয়ের মত আছে। বাড়িতেও আমি সবসময় সব গুছিয়ে রাখতাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাঁচটা বেজে গেছে। একটু চা খেতে মন চাইছে। আমি শাশুড়ির ঘর পাশ কাটিয়ে নিচে নামলাম। উনার ঘরের দরজা বন্ধ।
রান্নাঘরে চা বানাতে গিয়ে একটা মজার জিনিস পেয়ে গেলাম। ফ্রিজের সঙ্গে ম্যাগনেট দিয়ে আটকানো জরুরী ফোন নাম্বার গুলোর মধ্যে রেবার ফোন নাম্বারটাও পাওয়া গেল। আমি চা নিয়ে উপরে গিয়ে চট করে রেবাকে ফোন করে ফেললাম। যদিও ফোনটা করেই মনে হল ভুল করে ফেলেছি। মানুষের অ্যাভারেজ টাইপিং স্পিড শু্নেছি মিনিটে চল্লিশ শব্দ। কথা বলার ক্ষেত্রে এমন কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই। যদি থাকত তাহলে নিঃসন্দেহে রেবার স্পিড হত মিনিটে চার হাজার। ামাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও হড়বড় করে কথা বলেই যেতে লাগলো।
হায় আল্লাহ! ভাবী আপ্নে ফোন দিসেন। আমার তো বিশ্বাসই হইতাসেনা। আমার যে কি শক আসিল আপ্নেরে দেহার। খালি আপ্নের ছবি দেখসি ভাইজানের কাছে। মাশাল্লা আপ্নে পরির মতন সুন্দর। খালাম্মা আমারে ছুটি না দিলে এক্ষনি আইসা দেইখা যাইতাম। সবাই যে কি খুশি। আর খুশি হইব না কেন? এমন সুন্দর বউ পাইসে। খালাম্মা তো খুশির ঠ্যলায় আমারে এক মাসের বেতন সহ ছুটি দিয়া দিল। আমি এক মাসের আগেই চইলা আমু। আম্পের লেগা কি আনমু কন ভাবী। আমাগো বস্তির সামনে ঠ্যলাগাড়িতে কইরা আমরা বেচে। গোলাপ ফুলের মত আমরা। হায়রে মজা। কি যেন একটা মশ্লা দেয়। মুখে লাইগা থাকে। আমড়া আলা ব্যটায় বেজায় রসিক। উনার নাম মজিবর। আমারে দেকলে মিচকি মচকি হাসে। আমর সব হাসির জুক কয়। আপ্নে যদি উনার জুক শুনেন হাসতে হাসতে প্যট ফাইটা যাইব। খাড়ান আপনেরে একটা শুনাই…
রসিক মুজিবরের জুক শোনার ব্যপারে আমি বিশেষ উৎসাহ দেখালাম না। ওকে থামিয়ে দিয়ে জরুরী তথ্যগুলো জেনে নিলাম। প্রয়োজনীয় কথা শেষ হবার পরেও অনেকক্ষণ রেবার বকবকানি সহ্য করতে হলো; এমনকি রসিক মুজিবরের একটা জোকও শুনতে হলো।
কথা শেষ হওয়ার পর আমি দীর্ঘশ্বাস খেললাম। তাকিয়ে দেখলাম আমার চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক দফা গরম করব বলে বাইরে বেরিয়ে আচমকাই আমার শাশুড়ির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার হাতে চায়ের কাপ দেখে উনি বললেন
চা খাইতাসো? একবার তো আমারে জিগাইলাও না?
আমার এক্টূ খারাপ লাগল। বাড়ীতে আমরা দুজন মাত্র মানুষ। আমার জিজ্ঞেস করে উচিত ছিল। কিন্তু উনাকে রাগিয়ে দেবার জন্যই বললাম
রেবা তো আপনাকে বিকালের চা দিত না।
উনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন
আমার লগে রং দেহাও? লেজ বেশী লম্বা কইরো না। লম্বা ল্যজ ক্যম্নে কাটতে হয় আমি জানি।
আমি ভালো মানুষের মত মুখ করে জানতে চাইলাম
কি করে কাটতে হয়?
উনি অগ্নি চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
ফাইজলামি কর?
জি না। একটু কৌতূহল বোধ করছিলাম আরকি। মানে লেজের তো প্রকার ভেদ আছে তাই কাটার পদ্ধতি ও নিশ্চই ভিন্ন
উনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন
যখন কাটুম তহন টের পাইবা
কি টের পাব? যে আমার লেজ কেমন? কুমিরের মত কন্টকময় না ঘোড়ার মত রোমশ।
এই কথাটা অবশ্য মনে মনে বললাম। কারন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি রাগে তার শরীর রীতিমত কাঁপছে। আমি মনের মধ্যে এক প্রকার প্রশান্তি অনুভব করলাম। মানুষ তার প্রেমিকাকে রাগিয়ে যেমন আনন্দ পায় আমি ও তেমনি অদ্ভুত আনন্দ পেতে লাগলাম।
পরপর দুকাপ চা খাওয়ার জন্যই বোধহয় রাতে ঘুম এল না। খুব করে চেয়েছিলাম মুকুল আসার আগেই ঘুমিয়ে পরতে। ঘুমের ভান করে পরে থাকলেও স্পষ্ট টের পেলাম ও ঘরে ঢুকেছে।
বিয়ের প্রথম রাতে নববধূকে মানুষ আংটি দেয়; নেকলেস, ব্রেসলেট ,মোবাইল হানিমুন টিকিট আরো অনেক সব উপহার দেয় বলে শুনেছি কিন্তু আমার হাতের মুঠোয় যে জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি সেটা একটা লজেন্স। চিকমিকি কগজে মোড়া ছোট্ট একটা লজেন্স। ছোট বেলায় এই লজেন্স আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। আর বড় হবার পর এই জিনিস দেখলে আমার নাড়িভুঁড়ি উল্টে বমি আসে। এর অবশ্য একটা কারন আছে। এই লজেন্সের সাথে আমার ছেলেবেলার দুঃসহ কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মুকুল বলল
খুলে দেখ
কি?
মুকুল উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি নিতান্ত অনিচ্ছায় মড়োকটা খুললাম এবং আগের চাইতেও বেশী অবাক হয়ে গেলাম। ভেতরে একখণ্ড হীরে ঝিকমিক করছে। আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ও নাকফুলটা তুলে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল
পরে দেখ
নাকফুল আমার খুব প্রিয় একটা গয়না। কলেজে ওঠার পর আমি আর তিথি খুব শখ করে পার্লারে গিয়ে নাক ফুটো করিয়েছিলাম। বলতে একটু লজ্জা করলেও এইরকম একটা নাকফুলের আমার অনেকদিন ধরেই শখ ছিল। যেখানে শুধুমাত্র এক টুকরো হীরে নাকের উপর ঝিকমিক করবে। এই কথাটা কোনদিন কাউকে বলা হয়নি; এমনকি তিথিকেও না। এই লোক এটা জানল কি করে? আশ্চর্য তো! আমাকে চুপ করে ভাবতে দেখে মুকুল পিনটা খুলে এগিয়ে দিল। আমি সাত পাঁচ না ভেবে টুক করে ওটা পরে নিলাম। তাকিয়ে দেখলাম ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু সময় নিয়ে বলল
তোমাকে প্রথমে যেদিন দেখেছিলাম বৃষ্টির এক ফোঁটা পানি তোমার নাকের উপর শেষ বিকেলের আলোতে ঝিকমিক করছিল। সেদিনই ঠিক করেছিলাম বিয়ের পর তোমাকে একটা ডায়মন্ড এর নোসপিন কিনে দেবো। । যেটা তুমি সব সময় পরে থাকবে।
আমি একটু থেমে বললাম
শুধু নাকের উপর ঝিকমিক করাই দেখেছেন, আর কিছু দেখেননি?
এবার ও তার অতিরিক্ত সাদা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল
না আরো অনেক কিছু দেখেছি।
আমি মনে মনে বললাম
বদমা/ইশের বাচ্চা! এজন্য তোরে আমার এত অসহ্য লাগে।
মুকুল আরেকটু এগিয়ে এসে চুলগুলো আমার কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বলল
আজকে আমার একটু…
আমি ওকে কথা শেষ করতে দিলাম না, উঠে দাড়িয়ে বললাম
আমাকে নিচে যেতে হবে। সবাই খাবার জন্য অপেক্ষা করছে
যতক্ষণ দরজার কাছে পৌঁছেছি ও পেছন থেকে ডেকে বলল
ইয়ে মানে তুলি, আজকেও আমার আসতে একটু দেরি হবে। মানে তোমাদের সঙ্গে খেতে বসতে পারবো না। বন্ধুদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে হবে। রাতে তোমাদের সঙ্গে ডিনার করবো। প্রমিস। আই হোপ তুমি কিছু মনে করছ না। একদম দেরি করবো না, দেখো।
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম
এত কৈফিয়ত দেবার দরকার নেই; তবে মিথ্যা কথাটা না বললেও চলত
মুকুল অবাক হয়ে বলল
কি মিথ্যা বললাম?
কাল দেরি হবার জন্যও একই অজুহাত দিয়েছিলেন
না আসলেই। মিথ্যা বলছি না। কাল ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ডদের ট্রিট দিতে হয়েছে আর আজকে ধরেছে হলের বন্ধুরা। আসলে বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত দিতে পারিনি তো। এত তাড়াহুড়ায় সবকিছু হয়ে গেল। উইক ডেতে প্রোগ্রাম করতে হল বলে অনেকে চাইলেও আসতে পারেনি। তাই সবাই মিলে ছোটখাটো একটা…
এই লোক অতিরিক্ত কথা বলে। কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
এত কথা বলার দরকার নেই। আপনি যেখানে ইচ্ছা যান, যতক্ষণ ইচ্ছা থাকুন।
এই বলে আমি আর দাঁড়ালাম না, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হল শেষের কথাগুলো না বললেও পারতাম। এখন নিশ্চয়ই ভেবে বসবে আমি অভিমান করেছি। ফিরে আসার পর মান ভাঙ্গানোর জন্য নানা ভুজুং ভাজুং দেওয়ার চেষ্টা করবে। পুরুষ মানুষের মান ভাঙানো তো আবার সব এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়। যত্তসব!
নিচে নেমে দেখলাম খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন বসেছে। রেহানা আন্টি সবকিছুর তদারকি করছেন। সবকিছু এত নিখুঁতভাবে কি করে হচ্ছে সেই রহস্যটা এতক্ষণে বুঝলাম। উনি বাড়ি থেকে মনার মাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। মনার মা তাদের বাড়ির পুরনো কাজের লোক। তার বড় মেয়ে ময়নার সামনে বিয়ে। এখানে আসার সুবাদে তার অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে। বলাবাহুল্য সবার কাছেই সে বিয়ের কথাটা বলছে এবং এতে করে তার বেশ ভালোই আমদানি হচ্ছে।
এই কারনেই বোধ হয় আজ তার পারফর্মেন্স দুর্দান্ত। বলা মাত্র চোখের নিমিষে সব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে।
তিথি ছোটদের খাওয়াচ্ছে। মুরুব্বিদের খাওয়া হয়ে গেলে আমরা খেতে বসব। তারপর কাছে এসে গলা নামিয়ে বললেন তখন তোর শাশুড়িকেও ডাকিস।
আমি ঘাড় কাত করে সায় দিলাম। মুকুলদের বাড়িটা বেশ বড় আর অনেক সুন্দর। এমন বাসা আমি আগে দেখিনি। আজকাল এত যায়গা নষ্ট করে কেউ বাড়ি বানায় না। ডুপ্লেক্স বাড়ী আমি আগেও দেখেছি কিন্তু এটা একদম আলাদা। নাটক সিনেমায় এমন বাসা দেখেছি কাছ থেকে কখনো দেখিনি। একতলায় বিশাল হলঘরের মতো ড্রয়িং রুম, একপাশে কিচেন সেটাও বেশ বড়। ঘেড়া দেওয়া বিশাল ডাইনিং। একপাশে দুটো ছোট ছোট ঘর। গেস্ট্রুম হবে হয়ত। হলঘরের একদিক দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে উপর তলায়। সেখানে টানা বারান্দা আর তার পাশে তিনটা শোবার ঘর। প্রথমটা আমার শাশুড়ির। দ্বিতীয়টা আমাদের। তারপরেরটা তালা বন্ধ থাকে। কখনো কোন মেহমান আসলে খুলে দেয়া হয়। কাল রাতে সবাই বোধহয় এগুলোতেই মিলেমিশে ছিল।
সামনের ড্রয়িং রুমটার মেঝেতে সব কাজিনরা মিলে খেতে বসেছে । ডাইনিং এ মুরুব্বীরা খাচ্ছেন। ওদের পরিবারে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। মুকুলের বাবা বেঁচে নেই। চার ফুপু। রেহানা আন্টি সবার বড়। দ্বিতীয়জনের বিয়ে হয়েছে তিথির সেজো চাচার সঙ্গে। এই বিষয়টা আমি আগে জানতাম না। অবশ্য জানার কখনো প্রয়োজন ও পড়েনি। অন্য দুই ফুপুর একজন থাকেন বকশিবাজারে অন্যজন নারিন্দায়। কাল রাতে আমদের সঙ্গেই সবাই এসেছেন।মুকুলের মায়ের দিকের কিছু আত্মীয় স্বজন ও আছে কিছু। আমি তাদের আলাদা করে চিনলাম না। তিথিকে দেখলাম সবাই কে খাবার দিচ্ছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল
কিরে মন খারাপ?
আমি ভুরু কুচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। ও হেসে বলল
ভাই চলে গেল দেখলাম। মিস করছিস?
আমি কঠিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। হয়ত এটাই স্বাভাবিক। বিয়ের পরদিন স্বামীর এভাবে চলে যাওয়াটা মন খারাপ করার মতই ব্যপার। হয়ত ও ধরেই নিয়েছে আমাদের মধ্যে ভাব ভালবাসা হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। তিথির নিজের কোন ভাই নেই। ওরা তিন বোন। মুকুলকে ও নিজের ভাই এর চেয়ে ও বেশী ভাবে। মুকুল ও বোনদের অসম্ভব স্নেহ করে। তিথি একথা আমাকে আগে অনেক বার বলেছে। এই বিয়েতে মনে হয় সব চেয়ে খুশি ওই হয়েছে। ওর এত আনন্দ দেখে আমি ওকে কিছুতেই বলতে পারিনি যে মুকুলকে আমার পছন্দ হয়নি। এখন ও কিছু বলতে পারলাম না। আমার হাসির স্টক থেকে একটা লজ্জা লজ্জা হাসি উপহার দিলাম।
কালকে থেকে রেবা আসবে না, সব কাজ তোমাকেই করতে হবে। বুজতে পারসো?
বিয়ের একদিনের মাথায় শাশুড়ির মুখে এই কথে শুনে চমকে গেলেও বিশেষ অবাক হলাম না আমি। ওনার চরিত্র সম্বন্ধে আগেই একটু ধারণা পেয়েছিলাম, আমার বান্ধবী তিথির কাছ থেকে। তিথি আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী। স্কুল-কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়েছি; বিশ্ববিদ্যালয় ও একই কিন্তু ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশিই । এখন তো আবার আত্মীয়তাও হয়ে গেছে। তিথি আমার স্বামীর ফুপাতো বোন।যদিও ওই লোকটাকে স্বামী বলতে আমার একটু ও ইচ্ছে করেনা। কিন্তু এখন আর কি করা; বিয়ে যখন হয়েই গেছে। এখন তো আর ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই। যাক সে কথায় পরে আসছি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে উনি আবারো বললেন
কি কইলাম বুঝতে পারতেসো না?
আমি নির্বিকার কন্ঠে বললাম
জি বুঝেছি। কি কি কাজ করতো রেবা?
সবই করতো
সবই মানে কি?
আমার বলার ধরন দেখে উনি একটু থমকালেন কিন্তু মিইয়ে গেলেন না । কাটা কাটা গলায় বললেন
সকালের নাস্তা বানানো, ধোয়া পাকলা, ঘর মুছা, কাপড় ধোয়া সবই
এই সব এখন থেকে আমাকে করতে হবে?
হ? কেন? কাম কাজ কিছু জান না? বাপ মায়ে কিছু….
কত বেতন দিতেন রেবাকে?
উনি বেশ তেড়ে উঠে বললেন
ক্যন, তোমারে ও বেতন দেওয়া লাগবো নাকি?
রেবা কি বেতন ছাড়াই এসব কাজ করতো?
উনি এবার বেশ ফুসে উঠে বললেন
রেবারে তো ভাত দিতাম না। তুমি তো ভাত ও খাইবা আবার বেতন অ চাও
আমাকে ও ভাত দিতে হবে না
কি বল্লা?
রেবার ফোন নাম্বার টা কি পাওয়া যাবে?
ক্যন ফোন নাম্বার দিয়া কি করবা?
কাজের ডিটেইলস গুলো একটু জেনে নিতাম আর বেতনটাও জানা যেত আপনি যেহেতু বলছেন না
এবার উনি সত্যি সত্যিই রেগে গেলেন। এখন উনাকে একটা অতিকায় তেলাপোকার মতো লাগছে। শুরু দুটো এন্টেনার অভাব।
উনি তেলাপোকার মতো স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর হেসে ফেললেন। বলতে বাধা নেই ভদ্রমহিলা দেখতে বেশ সুন্দরী। ধব ধবে ফর্সা গায়ের রং, ছেলের মতো কালো না। খয়েরী রঙের শাড়ীটা মানিয়েছে ভীষণ। যদিও খয়েরী শাড়ীতে তাকে আরো বেশী করে তেলাপোকা মনে হচ্ছে। তবে একটা কথা না বললেই নয় তার হাসি দেখে আমি রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। আমার ধারনা ছিল এমন হাসি শুধু আমিই হাসতে পারি। যে হাসির অর্থ হল- বাছাধন তুমি জানো না তুমি কার সঙ্গে খেলায় নেমেছো, এতদিন ঘুঘু দেখেছো কিন্তু ফাঁদ দেখোনি। আজ বুঝবে ফাঁদ কেমন হয় বাঁশের কঞ্চির না কাটা তারের। আমি বোধহয় তার হাসি দেখে মুগ্ধ হয়েই আমার বিখ্যাত হাসিটা উপহার দিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি অনেকগুলো হাসি আয়ত্ত করেছি। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে এই হাসি গুলো ভীষণ কাজে দেয়। এর মধ্যে সব চাইতে যেটা ফলপ্রসু এই মুহূর্তে সেটাই ব্যবহার করলাম। এর অর্থ হল আমি ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিনা। উল্টে খাওয়া তো দূরে থাকুক সারাজীবন ভাজা মাছই খাইনি। সিদ্ধ মাছ খেয়ে জীবন পার করেছি। তাও লবন হলুদ ছাড়া। মুহূর্তেই উনার মুখের হাসি মুছে গেল। উনি তীক্ষ কন্ঠে বললেন
এখন নিচে যাও। মেহমানরা খাইয়ে বসবো। অগো সাথে থাকো। খাওয়া শেষ হইলে তারা বিদাই হবে
যাহা আজ্ঞা
এই কথাটা অবশ্য জোরে বললাম না। মনে মনে বললাম। যা বুঝলাম এই মহিলার সঙ্গে থাকতে হলে বেশীরভাগ কথা মনে মনেই বলতে হবে।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় আমার মুকুলের সঙ্গে দেখা হল। ও আমাকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
তুলি একটু উপরে আসবে?
এই লোকের সঙ্গে উপরে যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এমনিতেই একে আমার অসহ্য লাগে এছাড়াও আর একটা কারন, উপর তলায় মা ছেলের ঘর পাশাপাশি। উনি আবার নাগ-মনি পাহাড়া দেবার জন্য ছেলেকে পাশের ঘরে এনে রেখেছেন। যেতে হলে এখন ওই মহিলার ঘরের সামনে দিয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে সেটা করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও আবারো বলল
কি হল এসো, নাকি এখনো রাগ করে আছো?
আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম। রাগ করার বিষয়টা ঠিক বুঝলাম না। ওর উপর রাগ করার কি আছে? ও কে? দুদিন আগে ও তো ওকে আমি চিনতামই না। রাগ তো হচ্ছে আমার বাবা মায়ের উপর। এত করে বলার পরে ও কিছুতেই বুঝল না। এই রকম একটা খোক্কসের গলায় ঝুলিয়ে দিল। যতই আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে ছেলে আমার পছন্দ হয়নি ততই তারা ওর হয়ে ওকালতি শুরু করে। বারবার একই কথা
কেন পছন্দ না? এত সুন্দর ছেলে। ছয় ফুটের উপর লম্বা, শ্যমলা, তোর কি ইদুরের মতো সাদা ছেলে পছন্দ?
রাগে আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়। লম্বা হলেই কি মানুষ সুন্দর হয়ে যায়? কাকতাড়ুয়ার মতো শরীর।কান গুলো খরগোশের মতো। কথায় কথায় দাত কেলিয়ে হাসে। সেই দাত ও মুলোর মতন। ছোটো বেলায় ঠাকুর মার ঝুলিতে পড়েছিলেন। কুলোর মতো কান আর মুলোর মতন দাতের রাক্ষস। এতো তার জমজ ভাই।
শত চেষ্টা করেও আমি বাবা মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি। ছেলে ভেতরে কেমন সেটা কেউ দেখল না। সবাই দেখল তার এম বিএ ডিগ্রি, মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির চাকরি। ঢাকায় তিনতলা বাড়ি। কিন্তু আসল কথাটা তো আমি কাউকে বলতেই পারলাম না। এই ছেলে আমাকে পছন্দ করেছে আমার শরীর দেখে।
স্কুল জীবন থেকেই ক্লাসের পরে আমি তিথিদের বাড়িতে যেতাম। বাবা মা দুজনেই চাকরী করায় বাড়িতে কেউ থাকত না। বাবা অফিস শেষ করে ফিরিয়ে ফিরতে রাত হত। মার স্কুল শেষ হত পাচটায়। বাড়ি পৌছাতে ছটা বেজে যেত। একা বাসায় থাকতে আমার ভয় করত না তবে কেমন একটা অস্বস্তি হত, বিশেষ করে একটা ঘটনার পর থেকে। যাক সে কথা অন্য সময় হবে। কলেজে উঠে ও আমার ওই স্বভাব গেল না। আমি প্রায় প্রতি দিনই ওর সঙ্গে ওদের বাসায় চলে যেতাম। বাবা রাতে ফেরার সময় আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।
তিথিদের বাড়ি পুরানো ঢাকায়। আট কাঠা যায়গার উপর বিশাল বাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে এতটা বড় বোঝা যায় না। সামনের দিকে সব দোকান। এই বাড়ির বয়স প্রায় পঁচাশি বছর। তিথির দাদুর বাবা করেছিলেন এই বাড়ি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়াতে পুরোটাই তিনি পেয়েছেন। তিথির বাবারা চার ভাই। তিথির বাবা সবচাইতে বড়। দাদু উনার সঙ্গেই থাকেন। আগে বাড়ির পেছনের দিকে চারটা ঘর ছিল আর সামনে পুরোটাই উঠান। উঠান ভর্তি আম কাঠালের গাছ। এই সব গল্পই আমি দাদুর কাছ থেকে শুনেছি। পরবর্তীতে সবাই বিল্ডারের কাছে দিয়ে ফ্ল্যট করতে চেয়েছিলেন কিন্তু দাদুর জন্য পারেননি। উনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, যেদিন এই বাড়ির একটা ইট ও ভাঙ্গা হবে সেদিন তিনি ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্নহত্যা করবেন। এই কথা শোনার পর কেউ আর তাকে ঘাটায়নি। পেছনের পুরানো চারটা ঘরের উপর তিন তলা করে তিথিরা থাকে। ছোট তিন চাচা মিলে সামনের দিকে চারতলা বিল্ডিং তুলেছেন। এক এক জন এক একটাতে থাকে। বাকীগুলো ভাড়া।
ওর চাচাত ভাইবোনদের সাথে আমার খুব ভাব। তিথির মা রেহানা আন্টিও আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন। ছোটবেলা থেকেই যাতায়াত ছিল বলে আমি কেমন ওদের পরিবারেরই একজন হয়ে গিয়েছিলাম। ওদের পুরনো বাড়ির ছাদটা আমার ভীষণ প্রিয়। আমাদের নিজেদের বাড়িটা লালমাটিয়ার একটা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে। আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ মজুদ থাকলেও কেমন একটা দম বন্ধ করা ভাব। বিকেলে আমি আর তিথি প্রায়ই পানির টাংকির উপর বসে বসে আচার খাই। মাঝে মাঝে হেড়ে গলায় গান ও করি। তবে আমার সব চাইতে ভালো লাগে এখানে বৃষ্টিতে ভিজতে। বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলে তিথি নিচে থেকে গরম চা নিয়ে আসতো। কেমন একটা স্বর্গীয় অনুভূতি হতো।
এমনই এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে আমি হাসনাহেনা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম, তিথি নিচে চা আনতে গেছিল। আমার পরনের ভেজা শাড়ি শরীরের সঙ্গে লেপ্টে ছিল। চোখ মেলে দেখলাম ছাদের দরজায় দুহাত রেখে ঢ্যঙ্গা মতো একটা ছেলে হা করে তাকিয়ে আছে। আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। রাগে ভয়ে না ঠান্ডায় ঠিক বুঝলাম না। আমাকে চোখ মেলতে দেখেও সে চোখ নামিয়ে নিল না, নির্লজ্জের মত তাকিয়েই রইল।
পরে জানতে পেয়েছিলাম সে তিথির মামাতো ভাই মুকুল। যদিও আগে থেকেই তার অনেক গল্প আমি শুনেছি। এও শুনেছি তিথির ক্লাসের প্রায় মোটামুটি সবাই তার উপর ক্রাশ খেয়েছে। আমার অবশ্য তাকে আহামরি কিছু মনে হয়নি। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যেই মুকুল আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। বাড়ি শুদ্ধ সবাই আমাকে ঘটা করে দেখতে এলেও মুকুল এলো না। আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে ছেলে কি দেখে আমাকে পছন্দ করেছে। এই কথাটা মুখ ফুটে কাউকে বলে বোঝাতে পারলাম না। তবে মনে মনে তার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা জন্মেছিল গোড়া থেকেই।
ঘরে ঢুকে আমি একটু অবাক হলাম। ঘর ঝকঝক করছে। রাতের পুরনো ফুলের চিহ্ন মাত্র নেই। বিছানায় সাদার উপর নীল নক্সি করা সুতির চাদর টানটান করে পাতা। আমি একটু অবাক হলাম রেবা নেই তাহলে এত কাজ কে করল? এই রহস্য অবশ্য উন্মোচিত হল খাওয়ার সময়। যাই হোক, দেখলাম মুকুল আলমারি থেকে কিছু একটা বের করছে। আমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুকুল খাটে বসে অপরাধী মুখ করে বলল
কাল রাতে আমার ফিরতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। তুমি কিছু মনে করো না। আসলে বন্ধুরা এমন করে ধরল। ফিরে এসে দেখলাম তুমি আরাম করে ঘুমাচ্ছ। তাই আর বিরক্ত করলাম না।
বুঝলাম এই লোকের কৈফিয়ত দেবার বিশ্রী অভ্যস আছে। দুই দিনের দেখা আমাকেই যদি এত কৈফিয়ত দেয় তাহলে নিজের মাকে না জানি কি বলে। আম্মা আসলে টয়লেটে কাজ সারার পরে দেখলাম ফ্ল্যস কাজ করছে না। এখন কি করা বলেন। বাধ্য হয়ে দুই বালতি পানি ঢাললাম। এতে লাভ তো হলোই না বরং ভেতরের মাল মশলা সব বাইরে বেরিয়ে এল। সব পরিষ্কার করতে গিয়েই দুই মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড দেরী হয়ে গেল। আর এমন হবে না আম্মা। বিশ্বাস করেন। আমার চাকরির কসম।
তুলি, এই তুলি
মুকুলের ডাকে আমর ধ্যন ভাঙল। কি সব আবোল তাবোল ভাবছি। মুকুল আমার হাত ধরে খাটে এনে বসাল। তারপর বলল
তোমার জন্য একটা উপহার কিনেছিলাম। কাল রাতে তো দিতে পারলাম না, এখন দেই?
আমি হ্য না কিছুই বললাম না
মুকুল আমার হাতের মধ্যে কিছু একটা গুজে দিল। আমি মুঠো খুলে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
#copyrightalert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪০
রেস্টুরেন্টে আটজন এক টেবিলে বসেছে। মুখোমুখি আর্শি ও ইরিনা। খেতে খেতে সবাই টুকটাক গল্প করছে সাথে হাসি-তামাসা তো আছেই। কিন্তু আর্শি চুপচাপ খাচ্ছে আর বারেবারে ইরিনাকে দেখছে। মেয়েটার চোখে-মুখে দুঃখের ছাঁপ বলতে নেই। এতো প্রাণোচ্ছল লাগছে তাকে। আর্শি আসার পর থেকে ইরিনাকে সামনাসামনি দেখে হাই-হ্যালো ছাড়া কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস অবধি পায়নি।
খাওয়া শেষে আর্শি চুপচাপ বসে আছে। তখন ইরিনা আর্শিকে বলে,
“কেন ইউ কাম উইথ মি?”
ইরিনা বিভ্রান্তির দৃষ্টিতে তাকায়। ফের মাথা দুলিয়ে উঠে যায়। দুজনে একসাথে রেস্টুরেন্টের খোলা একটা জায়গায় যায়। দুজনেই কিছুক্ষণ কোনো কথা বলে না। অতঃপর ইরিনা বলে,
“Arshi, you know, love is a beautiful feelings. But you have to move on when a loved one leaves you. Because those with weak hearts naturally experience even more pain. So, you must move on. Thus, I did. Please, don’t feel sorry for me; it was written in my destiny. And I believe that sorrow gives way to happiness.”
বলেই ইরিনা হাসলো। আর্শি এতটুকু সময়ে ইরিনাকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো, ‘যে নিজের জীবনের প্রতিটা ধাপ বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এসেছে, তাকে কেউ সহজে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে না। সে ভেঙে পড়েও আবার সতেজ হয়ে ফিরে।’
আর্শি হুট করেই ইরিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“May Allah give you internal happiness. And always keep you happy.”
ইরিনা খুব সুন্দর করে হাসলো। কিছু হাসি নিজ ভাগ্যের সবকিছু মেনে ভালো কিছুর আশারও হয়।
_______
দেখতে দেখতে দুটোদিন পেরিয়ে গেছে। মিসেস নেহাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। মুশফিকাই উনার সম্পূর্ণ দেখাশোনা করছে। মিস্টার হাসান লোকমারফরত মুশফিকার বোনকেও এখানে নিয়ে এসেছেন। নাহিদের সাথে মুশফিকার বিয়ের কন্ট্রাক্ট শেষের পথে হলেও মিস্টার হাসান মুশফিকাকেই নিজের পুত্রবধূ মানতে শুরু করেছেন। যদিও কন্ট্রাক্ট পেপারে শুধু নাহিদের সাইন! মুশফিকা কৌশলেই নাহিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাইন করেনি। প্রথমে সে লো*ভে পড়ে এমনটা করলেও পরবর্তীতে সেও ওই রুক্ষ ও হিং*স্র মনের মানুষটাতে ভালোবেসে ফেলেছে। নাহিদের মানসিক অবস্থা খুব ভালো না। ডাক্তাররা এখন তাকে হাই ডো*জের মে*ডিসিন ও বিভিন্ন থেরাপি দিয়ে ট্রিটমেন্ট চলছে। আরিয়া ফোন করে মিসেস নেহার খোঁজখবর নেয়। এভাবেই চলছে।
আজ ছুটির দিন। আর্শি, শ্রাবণ, গ্রিণ, ইরিনা ও পিটাররা ঘুরতে বেড়িয়েছে। সবাই সময়টা উপভোগ করলেও পিটার কেমন তার স্বভাব বিরুদ্ধ নিরব থাকছে। আবার হ্যারির ছোটোবোন ক্যামেলিয়া, গ্রিণের সাথে খুব বেশি কথাবার্তা বলছে। গ্রিণ ও ক্যামেলিয়া একটু পেছনে একসাথে হাঁটছে। তা দেখেও হ্যারি নিরুত্তাপ। হ্যারিকে বললে হ্যারির জবাব এমন হয়, ‘ও নিজের মনের মানুষ খুঁজে নিয়েছে তা তো ভালো। সে এখন ১৮ বছরের। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতেই পারে।’
কিন্তু পিটারের এই লাজুক ভাবটা আর্শি ও মোনা কিছুটা সন্দেহ করেছে। তাদের ধারণা পিটার ইরিনাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। যদিও ইরিনা পিটারের থেকে এক বছরের বড়ো!
আর্শি শ্রাবণের হাত জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“যাক, কানাডায় এসে আমার সিঙ্গেল বন্ধুটাও তার মনের মানুষ পেয়ে গেছে। গ্রুপে এখন একজনও সিঙ্গেল থাকবে না।”
শ্রাবণ হেসে ফেলে। তারপর শুধায়,
“কার কথা বলছো?”
“আর কার? পিটারের কথা। বেচারা চার বছর আগে নাকি এক মেয়েকে প্রপোজ করে থাপ্প-ড় খেয়ে সিঙ্গেল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন সে বোধহয় ইরিনাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। দেখুন, দেখুন, কীভাবে তাকাচ্ছে!”
শ্রাবণ চেয়ে দেখলো, সত্যি তাই। পিটার আড়নয়নে বারবার ইরিনাকে দেখছে। ইরিনা মোনা ও হ্যারির সাথে কোনো একটা বিষয়ে কথা বলতে বলতে খুব হাসছে। আর পিটার চুপ করে কিছুক্ষণ পরপর ইরিনার হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। আর্শি বলে,
“পিটার নিজের ফ্রেন্ডদের প্রতি যদি যত্নশীল হয় তবে ভাবুন, নিজের লাইফ পার্টনারের প্রতি কতোটা যত্নশীল হবে? তাছাড়া পিটারের মা ও দাদী অনেক ভালো।”
“তা বুঝলাম কিন্তু ইরিনা কী সিদ্ধান্ত নিবে সেটা ইরিনার উপর। আমরা তাতে কিছু বলতে পারি না।”
“হু!”
আর্শি খানিক মন খারাপ করে শ্রাবণের কাঁধে মাথা রেখে চলতে লাগলো। পথে আইসক্রিম দেখে, এই ঠান্ডার মধ্যেও তার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করে! কিন্তু শ্রাবণ মোটেও আর্শিকে আইসক্রিম খেতে দিবে না। সবাই খেতে পারলেও আর্শি খেতে পারবে না। অতঃপর শ্রাবণের জেদের কাছে হার মেনে আর্শির আর আইসক্রিম খাওয়াও হয় না।
_______
দেখতে দেখতে দুই মাসের কিছু বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মার্চ মাস চলছে এখন। কানাডায় এখন বসন্তরানীর রাজত্বকাল। আর্শি ইটালি ফিরে যায়নি এখনও। এক কথায় শ্রাবণ যেতে দেয়নি। বলেছে তিন মাস থাকতে পারবে(আমার জানামতে ৩মাস থাকতে পারে) তাই শ্রাবণ চায়নি আর্শি এই তিন মাসে জার্নি করুক। তার চোখের সামনে থাকুক। আর্শির রিসার্চের লেখার ভুল-ত্রুটি এসব ফ্যাকাল্টির কাছে অনলাইনে দেখাচ্ছে। প্রেগনেন্সি ইস্যুর জন্য ফ্যাকাল্টিও রাজি হয়েছে। আর্শির এখন ৩০ সপ্তাহ পেরিয়েছে। মাঝেমাঝেই তার পেটে ব্যাথা হয়। আজও ব্যাথা হচ্ছে। শ্রাবণকে বলবে বলবে করে বলা হচ্ছে না। তিনদিন আগে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানোর পর ডাক্তার বলেছিল বেবি হেলদি আছে। বেবির গ্রোথও ভালো হচ্ছে। কিন্তু আজকে হঠাৎ করেই আর্শি খুব ঘামছে। এই শিতল পরিবেশেও তার অস্থির লাগছে। ক্রমশ ব্যাথা বাড়ছে। বারবার শ্বাসেও টান পড়ছে। সে শ্রাবণের নাম্বারে কল করে। শ্রাবণ অফিসে গেছে সবে দুই ঘণ্টা হলো। এখন এই সময় আর্শির কল আসাতে শ্রাবণ কিছুটা বিচলিত হয়। কল রিসিভ করতেই আর্শি বলে উঠে,
“আমার খুব খারাপ লাগছে। তুমি প্লিজ আসো।”
এটুকু বলতেই শ্রাবণ আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। চটচজলদি ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। শ্রাবণের সাথে ইরিনাও ছুটি নিয়েছে। অতঃপর দুজনে আধঘণ্টারও কম সময়ে আর্শির কাছে পৌঁছায়। ইরিনা আগে থেকেই অ্যাম্বুলেন্সে কল করে জানিয়ে দিয়েছিল, অ্যাম্বুলেন্সও চটজলদি চলে এসেছে।
(কানাডায় জমজ বাচ্চা জন্মের খবরটা দেখেছিলাম। যা ৪০ সপ্তাহের মধ্যে ১৮ সপ্তাহ আগে জন্ম নিয়েছে।
________
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর, নার্স এসে শ্রাবণকে জানায় সে কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছে। শ্রাবণ খবরটা শুনে সেখানেই বসে কাঁদতে শুরু করে। ইরিনা এই আনন্দের খবরটা সবার আগে পিটারকে মেসেজ করে জানায়। ইটালিতে আর্শির লেবার পেইনের খবর পৌঁছানো মাত্র ওরা খুব চিন্তিত ছিল। পিটারের সাথে ইরিনার এখন বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। ইরিনা বুঝতে পারে পিটার তাকে পছন্দ করে। তবে সে কিছুটা সময় নিতে চায় বলে বন্ধুত্বেই আটকে আছে।
কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ আর্শির কাছে যায়। আর্শি চোখ বন্ধ করে আছে। শ্রাবণের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে কিঞ্চিত হাসে। শ্রাবণও আর্শির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ওর হাতের আঙুল ধরে বসে থাকে। একটু পর নার্স তোয়ালেতে মুড়ানো ওদের সদ্যজাত কন্যাকে নিয়ে আসে। শ্রাবণ তার মেয়েকে কোলে নিয়ে বেশ আপ্লুত। বাচ্চাটা তার বাবার কোল পেয়ে হাসছে। শ্রাবণ বলে,
“দেখো তোমার মতো হয়েছে।”
আর্শি বলে,
“চোখ দুটো তোমার মতো।”
“হুম।”
শ্রাবণ মেয়ের দিকে অপলক চেয়ে রয়। বাংলাদেশে মিসেস আশালতা ও মিসেস সন্ধ্যার কাছে হোয়াটসএপ গ্রুপ ক্রিয়েট করে ভিডিওকল করে। সবাই খুব খুশি। মিসেস সন্ধ্যা তার স্বামীকে বলে মসজিদে মিষ্টি বিতরণ করান। মিসেস আশালতাও। আরিয়া খুশি হয়েও মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। তার বেবি আগে হওয়ার কথা ছিল, তারপর সে নিজের ছেলের সাথে আর্শির মেয়ের বিয়ে দিবে! কিন্তু এখন আর্শির মেয়ে আগে জন্ম নিয়ে নিয়েছে।
আরিয়া মুখ ফুলিয়ে বলে,
“এখন আমার ছেলের কী হবে বলোতো? বেচারার বউ তার আগে পৃথিবীতে চলে এলো!”
আর্শি হেসে বলে,
“তোর এই বাচ্চামো গেলো না! তোর ছেলে সুস্থ ভাবে আসুক। তারপর যদি বড়ো হয়ে তার যাকে পছন্দ হবে বিয়ে করবে।”
আরিয়া বলে,
“এখন তো আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে বেবির জে*ন্ডার বলে না। তবে পেটের গড়নে আমি বুঝে গেছি আমার ছেলে হবে। এখন ভাগ্যে যা আছে হবে।”
আর্শি ফের হাসলো। তার ঘুম পাচ্ছে। নার্স এসেও বলে গেছে আর্শিকে ঘুমাতে। বেবিকেও নিয়ে যাওয়া হয়।
(৩০ সপ্তাহে জন্ম নেওয়া বেবিকে প্রিম্যাচিওর বেবি বলে। তাদের চোখ না ফু*টলে মাতৃগর্ভের মতো পরিবেশে রাখা হয়। অনেক সময় বেবির চোখ ফু*টলেও জন্ডিস বা কোনো অসুখ হয়। তবে সবার ক্ষেত্রে না।)
_______
সময় খুব জলদি পেরোয়। এইতো সেদিন আর্শির মেয়ে হলো। তার এক মাস পর আজ আরিয়ার ছেলে হলো। মিসেস আশালতা ও রিয়াজউদ্দীন দুই মেয়ের ঘরে নাতি-নাতনির মুখ দেখে মহা খুশি। আদিব ও কলি কানাডা গিয়েছে আর্শি ও শ্রাবণের মেয়ে ‘বারিশ’ কে দেখতে। তাছাড়া আদিব কানাডাতে জব এপ্লাই করে পেয়ো গেছে। তাতে শ্রাবণ বেশ হেল্পও করেছে।
আশিক তার ছেলেকে ভয়ে কোলে নিচ্ছে না। মিস্টার হাসান নাতি কোলে নিয়ে পুরো হসপিটালে মিষ্টি বিলিয়েছেন। রিয়াজউদ্দীন মেয়ের মাথার কাছে কিছুক্ষণ বসে থেকে চোখ মুছতে মুছতে উঠে গেছে। মিস্টার হাসান বলেন,
“আপনার বড়ো মেয়ের ঘরের নাতনিকে যদি আপনার ছোটো মেয়ের ঘরের নাতির পছন্দ না হয় তবে আমার ছেলের ঘরে মেয়ে হলে কিন্তু বিয়ে দিতে হবে!”
মিস্টার রিয়াজউদ্দীন হাসেন। ভবিষ্যতের কথা তিনিও বা কী বলবেন!
হ্যাঁ মুশফিকা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। মুশফিকা চেয়েছিল নাহিদের সন্তানের মা হতে। তাই নাহিদ শেষবার তার কাছে আসার সুযোগটা সে নিয়ে নিয়েছে। এখনও সে নাহিদের সুস্থ হয়ে ফিরে আসার আশা দেখে। যেখানে ডাক্তার বলেছে, নাহিদের সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার চান্স খুব কম। অবস্থার অবনতি হচ্ছে। মিসেস নেহার অবস্থারও কোনো পরিবর্তন নেই।
আর্শি এখন ইটালিতে আছে। দুইদিনের জন্য এসেছে। শুধু রিসার্চ বুক সাবমিট করবে। তারজন্য খুব সাহস করে মেয়েকে কলির কাছে রেখে এসেছে। মেয়ে আবার বাবা ভক্ত। সে তার বাবাকে দেখলে মা-কে যেন ভুলেই যায়! যদিও মেয়ের ব্রে*স্টমি*ল্ক ফিড করাতে সমস্যা হবে না। সে ব্রে*স্টমি*ল্ক পাম্প করে এয়ারটাইট প্যাকেটে ফ্রিজে রেখে এসেছে। (এটা নিয়ে অফে*নসিভ হবেন না। এখন বাহিরের দেশ গুলোতে এভাবে ব্রে*স্টমি*ল্ক সংরক্ষণ করে রাখা হয়।) কলি সেখানে থাকাতে বেবির দেখাশোনার দায়িত্ব কলির। ইটালিকে এসেই যে আর্শি তার ছোটোবোনের এই সুখবর শুনবে তা কল্পনাও করেনি। আরিয়ার ডেলিভারির ডেট ডাক্তার আরও দশদিন পর দিয়েছিল। কিন্তু আগেই হয়েছে। আর্শি আরিয়ার সাথে কথা বলার সময় আবারও একই কথা,
“এই আপু, আমার ছেলের বিয়ের কী হবে?”
আর্শি বুঝে না, তাে বোনের মাথা থেকে তার ছেলের বিয়ের ভূ*ত কেন নামছে না! আর্শি জবাবে বলে,
“মুশফিকার যদি মেয়ে হয়, তবে তোর ছেলের কাছে দুটো অপশন। যাকে পছন্দ হয় বিয়ে করবে। তাও তুই এতো চিন্তা করিস না। রেস্ট নে।”
“মুশফিকা আপুর যদি ছেলে হয়?”
“উফ! থাম তুই। আশিক কই?”
পাশ থেকে আশিক অসহায়ের মতো বলে,
“এইযে!”
“এই তোমার বউকে বুঝাও।”
“বুঝে না আপু! আমাকে ধ*মকে চুপ করিয়ে দেয়!”
এই কথা শুনে আর্শি হেসে ফেলে। সাথে আরিয়াও। আশিক বোকার মতো চেয়ে থাকে।
আর্শি নিজের কাজ শেষে ইটালিতে নিজের পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ফেলেছে। সোহা বাংলাদেশে ফিরে গেছে সপ্তাহখানেক আগে। তাই আর্শির সাথে দেখা হয়নি। আজ আর্শি কানাডাতে ফিরবে তবে একা না। মোনা, লিসা, পিটারের মা-বাবা, ভাই ও দাদি, হ্যারির মা-বাবা ও বোন সবাই আজ আর্শির সাথে যাবে। কারণ পিটারের সাথে ইরিনার বিয়ে ও ক্যামেলিয়ার সাথে গ্রিণের বিয়ে হবে।
পরিশিষ্টঃ
অনাড়ম্বর ভাবেই একইদিনে চার্চে গ্রিণ-ক্যামেলিয়া ও পিটার-ইরিনার বিয়ে হয়। সবাই ওদের বিয়ে পরবর্তী রিচুয়াল উপভোগ করছে। এদিকে শ্রাবণ ও আর্শি মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। সামান্য রোদ উঠেছে। রাস্তার ধারে গাছগুলোতে ফুটে আছে গোলাপি, ল্যাভেন্ডার রঙের হরেক ফুল। মনোমুগ্ধকর আবহাওয়া। গাছের নিচেও ফুলের ছড়াছড়ি। শ্রাবণ মেয়েকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসলো। আর্শি দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আজকের দিনটা খুব সুন্দর না?”
শ্রাবণ প্রত্যুত্তর করে,
“আমার কাছে তোমাদের সাথে কাটানো প্রতিটা দিন সুন্দর।”
আর্শি হেসে ফিরে তাকায়। অতঃপর শ্রাবণের পাশে বসে বাহু জড়িয়ে ধরে। বারিশ তার বাবার কোলে থেকেই হেসে উঠে।
দুঃখের পর সুখ বুঝি এতো মধুর ভাবে ধরা দেয়? যেমনটা রাতের ঝড়ের তাণ্ড*বের পর সূর্য স্নিগ্ধতার পরশ নিয়ে আসে।
সমাপ্ত
গল্পটা আর বাড়াচ্ছি না। কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। গল্পের নামের সাথে সম্পূর্ণ মিলেছে কী-না আপনারাই বলবেন। এখানে লিড জুটি একটা আবার একাধিকও। কারণ পার্শ্বচরিত্রই প্রধান চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করে। আরিয়া ও আশিক এই জুটিটাও শ্রাবণ ও আর্শি জুটির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। নাহিদকে অনেকে ভালো হয়ে গিয়েছে দেখতে চেয়েছিলেন। সবার জীবনে পূর্ণতা হাত ভরে আসে না।
এডিটঃ আমি ৩০ সপ্তাহে বেবি জন্ম নেওয়া নিয়ে বেশি কিছু লিখিনি। আর বেবি জন্মের পর একদম সুস্থ সেটাও উল্লেখ করিনি। মূলত কানাডাতে জমজ বাচ্চা নির্ধারিত ৪০ সপ্তাহের ১৮ সপ্তাহ আগে জন্ম নেওয়ার খবরটা দেখে আমি আর্শির তিন মাস কানাডাতে স্টে করতে পারবে মিলিয়ে লিখেছি।
৩০ সপ্তাহে জন্ম নেওয়া বেবিকে প্রিম্যাচিওর বেবি বলে। তাদের চোখ না ফু*টলে বা কোনো অর্গান পুরোপুরি ডেভলপ না হলে মাতৃগর্ভের মতো পরিবেশে রাখা হয়। অনেক সময় বেবির চোখ ফু*টলেও জন্ডিস বা কোনো অসুখ হয়। তবে সবার ক্ষেত্রে না।
(তারপরও আমার ভুল হতেই পারে। তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।)
#copyrightalert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৯
প্রায় সপ্তাহখানেকের কিছু বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মিসেস আশালতা ও মিস্টার রিয়াজউদ্দীনও দেশে ফিরে এসেছেন। উনারা দেশে ফেরা মাত্রই আরিয়াও তার বাবার বাড়িতে চলে এসেছে। তার এখন ছয় মাস পেরিয়েছে। থার্ড ট্রাইমেস্টার শুরু হয়েছে। এই সময়ে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। তাছড়া ডাক্তার আরিয়াকে আরও সতর্ক তো থাকতেই বলেছে। তাইজন্য আরিয়া তার বাবার বাড়ি চলে এসেছে। ইদানীং মিসেস নেহাও কেমন রুক্ষ মেজাজে থাকেন। নাহিদকে ইটালি পু*লিশ বাংলাদেশের পু*লিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। তারপর সেখান থেকে মে*ন্টাল এসাইলেমে! আরিয়া বুঝতে পারে এক মায়ের মনের অবস্থা। শেষ বয়সে এসে একমাত্র আদরের ছেলের এমন অবস্থা কোনো মায়ের জন্যই সুখকর নয়। মুশফিকাও ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে বেশ কয়েকদিন হয়েছে।
আজ দুপুরের দিকে আরিয়া নামাজ শেষে বসে বসে কোরআন পড়ছিল তখন তার ফোন বেজে উঠে। আরিয়া কোরআনের আয়াত শেষ করে বন্ধ করে ফোন উঠায়। রিসিভ করতেই আশিকের ভীত ও উৎকণ্ঠিত স্বর ভেসে আসে,
“আরিয়া, খালামণি স্ট্রো*ক করেছে!”
কথাটা শোনামাত্রই আরিয়া চমকে উঠে। সে হড়বড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কী বলছো? কখন? এখন কোথায় খালামণি? হসপিটালে নিয়েছো?”
“খালু নিচ্ছেন। আমি হসপিটালের দিকেই যাচ্ছি। হঠাৎ নাকি জোহরের আজানের সময় মুখ বাঁকা হতে শুরু করে, তারপর চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলো। তখন খালু মসজিদে যাবেন তখন দেখে ফেলে জলদি ছুটে এসে ধরে ফেলেন।”
“তুমি জলদি যাও। আমিও আব্বুকে নিয়ে আসছি।”
“তুমি এই অবস্থায় এসো না। তোমাকে জানাতে মানা করেছিল খালু। আমিই টেনশনে বলে ফেলেছি। আমার খুব হাঁসফাস লাগছে। খুব ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু হারিয়ে যাবে!”
বলতে বলতেই আশিক ঢুকরে কেঁদে ফেলে। আরিয়া ফোনের ওপাশ থেকে কী বলবে বলার শব্দ পাচ্ছে না। মা-হারা একটা ছেলে তার দ্বিতীয় মা-কেও হারানোর ভয় পাচ্ছে তাতে কী-ইবা স্বান্ত্বনা দেওয়া যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরিয়া ধরাস্বরে বলে,
“তুমি সাবধানে যাও। কিছু হবে না খালামণির। আমি আসছি। কাঁদবে না। কাঁদলে তোমাকে বোকা বোকা লাগে। একটুও ভালো লাগে না।”
মিসেস আশালতা মেয়েকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে জায়নামাজে বসে কাঁদতে দেখে বিচলিত হন। অতঃপর তিনি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে আরিয়া সবটা বলে। মিসেস আশালতা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে মেয়েকে অল্প পরিমাণে খাবার জোড় করে খাইয়ে তারপর স্বামী, ছেলের বউ ও আরিয়াকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা করেন।
________
আর্শিরন গতকাল কানাডায় এসে পৌঁছেছিল। আর্শির ফ্রেন্ডরা হোটেলে উঠেছে। আসার পর খুব ক্লান্ত থাকায় আর্শি ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে মৃদু ভোরের আলোয় তুষারে আবৃত দৃশ্য দেখছে। তার বরাবরই তুষারে আবৃত প্রকৃতি পছন্দ। কিছুক্ষণ একইভাবে উপভোগ করে বিছানার পাশে খুব সাবধানে ফ্লোরে বসে ঘুমন্ত শ্রাবণকে দেখছে। অপলক দৃষ্টিতে শ্রাবণকে দেখে যেন চোখের তৃষ্ণা বেড়েই চলেছে! ঘুমালে একটা মানুষকে এতো সুন্দর লাগতে হবে কেন? আর্শি শ্রাবণের কপালের চুলগুলো খানিক সরিয়ে সেখানে ঠোঁ*ট ছুঁইয়ে দিলো। তাতে শ্রাবণ নড়েচড়ে উঠলোও বটে! এভাবেই প্রায় কিছুক্ষণ বসে থেকে নামাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বিধায় শ্রাবণকে ডেকে তুলল। ঘুমের মাঝে শ্রাবণ শুধায়,
আর্শি খুব আবদারের সুরে বলল,
“একটু বেরোবো। উঠো না। প্লিজ। পাঁচ মিনিট বেরোবো। প্লিজ প্লিজ!”
শ্রাবণ করুণ মুখ করে তাকিয়ে থেকে ফের চোখ বুজে ফেলে। কিন্তু আর্শি তো ছেড়ে দেওয়ার মতলবে ডাকেনি! অবশেষে শ্রাবণকে উঠিয়েই ছাড়ে। তারপর দুজনে নামাজ পড়ে গরম কাপড়ে আপাদমস্তক মুড়িয়ে বের হয়। আর্শি মোটা গ্লাভস পড়া হাতে মাটি থেকে বরফ নিয়ে গোল গোল করে শ্রাবণের দিকে ঢি*ল ছুঁড়ছে। শ্রাবণ ছুটতে ছুটতে নিজেও আর্শির সাথে এই বরফ নিয়ে খেলায় মেতে উঠে।
________
ডাক্তার জানিয়েছেন, মিসেস নেহার শরীরের এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। মেজর স্ট্রোকই করেছেন। মিস্টার হাসান এটা শোনার পর বেশ ভেঙে পড়েছেন। তাকে আশিক সামলাচ্ছে। আরিয়া ও তার ভাবি পাশেই বসা। আশিক মিস্টার হাসানকে সামলালেও নিজেও বারবার অন্য হাতে চোখ মুছছে। এদিকে মুশফিকা দুপুরেই খবরটা আরিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরে সিলেট থেকে রওনা হয়েছে। এখানে এসে পৌঁছাতে রাত হবে। সন্ধ্যার আগে প্লেনের টিকেট পায়নি। তাই অফিসের গাড়িতেই রওনা করেছে।
মিস্টার হাসানকে জোড় করে কিছু খাইয়ে তার ঔষুধ গুলো খাওয়ায় আশিক। তারপর উনাকে রেস্ট করতে কেবিন বুক করে। আশিক করিডোরে এসে বসতেই আরিয়া তার পাশে বসে। দুজনেই নিরব। আশিক আরিয়ার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকে।
রাত নয়টার পর মুশফিকা হসপিটালে এসে পৌঁছায়। রাতে মিসেস নেহার কাছে মুশফিকা থাকবে। আর মিস্টার হাসানের কাছে আশিক থাকবে। আরিয়া মুশফিকাকে বলে,
“আপু, তুমি যে এসেছ দেখবে খালামণি জলদি সুস্থ হয়ে যাবে।”
মুশফিকা প্রত্যুত্তরে মলিন হাসে। কিছুক্ষণ পর আরিয়াকে নিয়ে মিসেস আশালতা ও রিয়াজউদ্দীন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেন।
________
কানাডায় দুপুর বারোটা। আর্শি ও শ্রাবণ লাঞ্চের জন্য বেরিয়েছে। আর্শির ফ্রেন্ডরা ও শ্রাবণের ফ্রেন্ড গ্রিণ ও ইরিনাও থাকবে। আজ প্রথমবার ইরিনার সাথে আর্শির দেখা হবে। শ্রাবণ নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলে,
“তুমি ইরিনাকে কেন ইনবাইট করলে? ও-কে এসব নিয়ে আর ঘাটানোর কী দরকার? নিজের মতো থাকুক।”
আর্শি বলে,
“এমনিতেই এতো ধৈর্যবতী মেয়েটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। আমাদের সব থেকেও কোনো একটা কিছু হারাতে বসলে দুনিয়া এক করে দুঃখবিলাস করি। আর ও! কিছুই নেই! দুনিয়াকে নিজের বলতে কেউ নেই, তারপরও যাদেরকে আপন করতে চায় তাদেরকেই হারায়। কীভাবে সহ্য করে? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তার কথাতে কী তার জাগতিক না পাওয়া মিশে আছে? তা জানতে ও বুঝতে ইচ্ছে করছে।”
শ্রাবণ মৃদু হেসে বলে,
“তোমার এখন হাসি-খুশি মানুষ দেখা উচিত। তা না করে তুমি ব্রোকেন কাউকে দেখতে চাইছো? যদিও ইরিনা খুব স্ট্রং গার্ল। সে তোমাকে বুঝতেই দিবে না।”
আর্শি কিছু বলল না। এগিয়ে গিয়ে শ্রাবণের বাহু জড়িয়ে মাথা এলিয়ে রাখলো। দুজনের দৃষ্টি সম্মুখের আরশিতে নিজেদের প্রতিবিম্বতে স্থির। কিয়ৎ মুহূর্ত এভাবেই থেকে শ্রাবণ বুকে হাত দিয়ে বলে,
“আরশিতে আমার আর্শিকে এখন একটু হাসি-খুশি দেখা দরকার। নয়তো বুকের বা পাশে বেশ লাগছে!”
#copyrightalert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৭ (পর্দা ফাঁ*স)
প্রায় আধঘণ্টা পর আর্শি স্বাভাবিক হলে প্রথমেই শ্রাবণকে কল করে। মিসেস আশালতা মেয়ের চিন্তায় অস্থির। কী হয়েছে কিছুই জানেন না তিনি। এখন আবার শ্রাবণকে কল করতে দেখে আরও ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি শুধাচ্ছেন,
“কী হয়েছে, আমাকে সত্যি করে বলতো?”
আর্শি জবাব দিবে কী? শ্রাবণ নেটে নেই বলে কল রিসিভ হচ্ছে না। এতে তার মা*থায় চিন্তার পা*হাড় চ*ড়েছে। আর্শি তার মাকে বলে,
“পরে বলব। তুমি যাও প্লিজ। এখন আমি ওসব ব্যাখ্যা করার অবস্থা নেই। তুমি নাহয় আরুর থেকে জেনে নিও। প্লিজ মা।”
রিয়াজউদ্দীন নিজ স্ত্রীকে ইশারা করলেন উঠে আসতে। মিসেস আশালতা চিন্তিত হয়েই উঠে আসলেন। আর্শি বারবার লাগাতার শ্রাবণকে কল করে যাচ্ছে। আবার নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। রাগে ফোন মেঝেতে আ*ছড়ে ফেলতে নিয়েও থেমে গেলো। ফের কল লাগালো।
ওদিকে শ্রাবণকে তার রুমমেট হসপিটালে নিয়ে এসেছে। বেশ কয়েকদিন যাবত শ্রাবণ খাওয়া-দাওয়ায় চরম অনিয়ম করছিল। তারউপর বিগত দুইদিন যাবত পানি ও কড়া কফি ছাড়া কিচ্ছুটি দাঁ*তে কা*টেনি। আজ সকালে শ্রাবণ পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা ও বমি করলে গ্রিণ তাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছে। ডাক্তার বলেছেন, ফুড পয়*জনিং হয়েছে। এখন স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রিণ ভাবলো শ্রাবণের পরিবারের কাউকে তো জানানো দরকার। তাই সে শ্রাবণকে বলে কাউকে জানাতে। কিন্তু শ্রাবণ রাজি হচ্ছিলো না। অতঃপর গ্রিণ একপ্রকার জোড় করেই শ্রাবণকে দিয়ে ফোনের লক খুলিয়ে নেয়। তখনি পরপর ৩০+ কলের নোটিফিকেশন আসে “Brishti” লেখা আইডি থেকে। গ্রিণ অবাক হয়ে বলে,
শ্রাবণ হকচকিয়ে তাকায়। গ্রিণের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে দেখে সত্যি আর্শি তাকে ত্রিশ বারের বেশি কল করেছে। সে দ্রুত কল ব্যাক করে। আর্শি ফোন হাতে নিয়ে পায়চারি করছিল আর মনে মনে দোয়া করছিল যেন শ্রাবণের খারাপ কিছু না হয়। আচমকা শ্রাবণের কল আসাতে তাড়াহুড়ো করে কল করতে গিয়ে কে*টে ফেলে। অতঃপর নিজের উপরই বিরক্তি প্রকাশ করে ফের কল করে। আর্মি ভিডিও কল দিয়েছিল, কিন্তু শ্রাবণ নিজের ক্যামেরা অফ করে কল রিসিভ করেছে। আর্শি উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁ*ড়ে,
“আপনি ঠিক আছেন? কল ধরছিলেন না কেন? কোথায় আপনি? ক্যামেরা অন করুন, আমি দেখব আপনাকে।”
শ্রাবণ অবাক হয়। তবে আর্শি তাকে ভুল বুঝেনি? সে বলে,
“আমি ঠিক আছি। অফিসে আছি বলে কল রিসিভ করতে পারিনি।”
পাশে দাঁড়ানো গ্রিণ কয়েকটা শব্দ শুনে বুঝেছে শ্রাবণ কথা এড়াচ্ছে। গ্রিণ কিছু বলতে চাইলে শ্রাবণ ইশারায় মানা করে। মিউট করে বলে,
“প্লিজ ডোন্ট টেল হার। সি ইজ প্রেগন্যান্ট। ”
অতঃপর গ্রিণ চুপ করে যায়। এদিকে আর্শি শ্রাবণকে পুরো ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে শ্রাবণ হতভম্ব হয়ে যায়। এতো ষ*ড়য*ন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে। মানুষ হিং*সার ও লো*ভের বশবর্তী হয়ে এতোটাও নিচে নামতে পারে! শ্রাবণ চোখ বুজে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। আমি কানাডার পু*লিশকে জানাব। সাথে ইরিনাকেও। শার্লক এতো জঘন্যতম কাজে তার উডবি ওয়াইফকে টেনেছে, এটা ইরিনার জানতে হবে। প্রমানগুলো আমাকে দাও।”
আর্শি তাই করলো। আর্শি ফের বলল,
“এসব শুরু হয়েছে আমার কারণেই। আমাকেই শেষ করতে হবে। নাহিদ যদি নিজে আমাকে দেখাতে চায়, আমি দেখব। নিজ চোখের সামনে তার নাটক দেখব। নিজে তাকে ইটালির পু*লিশে দিব। মান*সিক ভাবে বি*কার*গ্রস্ত এক লোক সে। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এসব করতে পারে না।”
“তুমি এসবে যেও না। ও যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে দেয়? যেও না এসবে।”
“কিছু করতে পারবে না। ওর ক্ষমতা নেই সামনাসামনি কিছু করার। ও একটা ক্রা*উয়া*র্ড! পিঠ পিছে ছু*ড়ি থুপে।”
শ্রাবণ আবারও নিষেধ করতে কিছু বলবে তখন নার্স কেবিনে প্রবেশ করতেই শ্রাবণ তাড়াহুড়ো করে আর্শিকে বলে,
“তুমি সাবধানে থাকো প্লিজ। আমি ইটালিতে জব নিয়ে চলে আসব। ততোদিন কষ্ট করে হলেও নিজের খেয়াল রাখো। এখন রাখছি। একটা ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে।”
দেখতে দেখতে আরও দুটোদিন পেরিয়ে গেছে। শ্রাবণ ইরিনাকে সত্যটা জানিয়েছে। সব দেখিয়েছে। ইরিনা পাথর দৃষ্টিতে সব দেখে মলিন হেসে বলে,
“হোয়াই অলওয়েজ মি? আই অলওয়েজ ড্রিম টু হ্যাভ সামওয়ান হু উড লাভ মি, কেয়ার এবাউট মি।”
শ্রাবণ বিপরীতে কিছু বলল না। সে ইরিনাকে নিজের মতো থাকতে দিয়ে কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেলো। আজ নাহিদ আর্শিকে একটা ক্যাফেতে দেখা করতে বলেছে। নাহিদ আর্শির ভার্সিটিতে এসেছিল। সেখানেই এসে একটু সময় করে যেন দেখা করে তার অনুরোধ করেছিল। আর্শিও রাজি হয়েছে বিকেলে দেখা করার। শ্রাবণ ঘড়িতে সময় দেখলো কানাডায় এখন বেলা দশটা বাজে। তার মানে ইটালিতে এখন বিকেল। তাই শ্রাবণ কানাডার পু*লিশকে ইনফর্ম করতে যায়।
কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে নাহিদ ও আর্শি। কফিশপটা মোটামোটি ফাঁকা। হ্যারি ও পিটার ছদ্মবেশে এসেছে। খানিক দূর থেকে নাহিদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। লিসা ও সোহারা পু*লিশে ইনফর্ম করতে গিয়েছে।
নাহিদ দুই কাপ কফি অর্ডার করে হাসি মুখে আর্শিকে জিজ্ঞাসা করে,
“কেমন আছো?”
প্রত্যুত্তরে আর্শিও হাসিমুখে জবাব দেয়
“আলহামদুলিল্লাহ!”
“আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না, আমি কেমন আছি? ”
“প্রয়োজন বোধ করছি না। কী কারণে ডেকেছেন, সেটা বলেন।”
নাহিদ বাঁকা হেসে বলে,
“এখনো আমার প্রতি এত রাগ? খুব বেশি ভালোবেসেছিলে বুঝি আমাকে?”
এবার আর্শি রেগে উঠে দাঁড়ায়। আর বলে,
“আপনি এসব ফা*লতু আলাপ করতে বুঝি আমায় ডেকেছেন? আপনি বলেছিলেন খুব ইম্পোর্ট্যান্ট কথা আছে। যেটা না জানলে নাকি আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে! এই সেই ইম্পোর্ট্যান্ট কথা?”
নাহিদ আয়েশি স্বরে বলে,
“রেগে যাচ্ছ কেন? বসো কথা তো শুরুই করিনি। একেবারে কি শুরু করা যায়? আগে একটু…”
আর্শি থামায় নাহিদকে। বলে,
“যেটা বলতে এসেছেন, শুধু সেটা বলেন। তার বাহিরে ফা*লতু আলাপ আমার সাথে করবেন না। আপনার হাতে হয়তো অজস্র সময় আছে, কিন্তু আমার হাতে নেই।”
“আচ্ছা বলছি! বলছি! কিছু দেখাবো তোমাকে।”
এই বলে নাহিদ নিজের ফোন বের করে একটা ভিডিও আর্শিকে দেখতে দেয়। আর্শি জানতো এমনটাই হবে। সে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে কয়েক সেকেন্ড দেখে ফোনের স্ক্রিণ বন্ধ করে। অতঃপর বলে,
“বাহ! বেশ ভালো এডিট করেছেন তো? অবশ্য আমি শুনেছিলাম, আ*র্টিফিশি*য়াল ইন্টে*লিজে*ন্টসের মাধ্যমে ফে*ক ভিডিও ও রি*য়েল ভিডিওর মধ্যে পার্থক্য খোঁজা, খালি চোখে সম্ভব না! এখন তো তার প্রমাণও পেলাম! ”
বলেই আর্শি হাসলো। নাহিদ চমকে ওঠার মতো তাকায়। সে হড়বড়িয়ে বলে,
“মানে কী বলতে চাইছো তুমি? এটা ফে*ক ভিডিও হতে যাবে কেন? এটা রি*য়েল ভিডিও। তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে চি*ট করেছে!”
নাহিদের শেষোক্ত কথাটা শুনে আর্শি খানিক উচ্চস্বরেই হেসে ফেলল। অতঃপর বলল,
“রিয়েলি! ওকে মেনে নিলাম যে শ্রাবণ আমার সাথে চি*ট করছে। তো আপনি বাংলাদেশে বসে, কানাডার এই ভিডিওটা কিভাবে পেলেন? মানে কোনো সোর্স তো থাকবে। তাই না? আপনার স্পা*ই কে? কার মাধ্যমে আমার হাজবেন্ডের খুঁটিনাটি সব খবরা-খবর রাখছেন?”
নাহিদ থতমত খেয়ে যায়। কথার খেই হারিয়ে ফেলছে সে। আর্শি যে তাকে দেখার পরেও বিশ্বাস করবে না এটা তার ধারণাতেও ছিল না। এই শীতল পরিবেশেও তার ঘাম ঝরছে। সে টিসু দিয়ে মুছে নিয়ে বলে,
“যেভাবে জেনেছি! সত্যটা তোমাকে জানানো উচিত ছিল, তাই তোমাকে জানিয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি কারো উপকার করাটাও ঠিক না।”
আর্শি বাঁকা হেসে বলে,
“ঠিক বলেছেন। যেচে কারো উপকার করতে যাবেন না। আমাকে নিয়ে বেশি ভাববেন না। আপনি বিয়ে করেছেন, সুখে থাকুন না। আমাকে নিয়ে ভাবার কী দরকার ছিল? যেহেতু কষ্ট করে আমাকে নিয়ে ভেবেই ফেলেছেন, তাহলে এর ভো*গান্তিটাও তো আপনাকে পোহাতে হবে! তাই না?”
এই বলে আর্শি লিসাকে কল করে। অতঃপর লিসা সোহা ও মোনা পু*লিশ নিয়ে ক্যাফের ভেতরে প্রবেশ করে।
#copyrightalert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৮
নাহিদ ক্যাফের ভেতরে পু*লিশ ঢুকতে দেখে আরও ঘাবড়ে যায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত স্বরে বলতে থাকে,
“পু*লিশ! পু*লিশ কেন? তুমি ঠিক করছো না, আর্শি! আমি তোমার ভালোর জন্যই এসেছিলাম। তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। আমি তোমাকে… তোমাকে…”
থেমে থেমে কিছু খুঁজছে। পেছনের টেবিলে সাজিয়ে রাখা কাঁ*টাচামচ দেখে সেখান থেকে খপ করে নিয়ে আর্শিকে আঘা*ত করার প্রয়াস করে। কিছুটা সক্ষমও হয় তাতে। আর্শি নিজেকে বাঁচাতে সামনে হাত আনলে আর্শির ডান হাতের তালুকে কাঁ*টাচা-মচ গেঁথে যায়! আর্শি ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলে পাশের টেবিল থেকে হ্যারি ও পিটার ছুটে আসে। পিটার আর্শির হাতে পানি ঢালছে। নাহিদ আরেকটা কাঁ*টাচা*মচ উঠাতে গেলে হ্যারি গিয়ে তাকে ধরে। নাহিদ অদ্ভুত ভাবে হাসছে আর বলছে,
“আমি ভালো নেই, তুই কেন ভালো থাকবি? তোকে মে*রে তারপর আমি জে*লে যাব!”
এমন অদ্ভুত ধরণের কথা ক্রমাগত বলেই যাচ্ছে। পু*লিশ এসে নাহিদকে নিয়ে যায়। লিসা ক্যাফের ওয়েটারকে বলে ফার্স্টএইড বক্স আনিয়ে আর্শির হাতে ঔষুধ লাগিয়ে দেয়।
বলেই শার্লককে একটা থা*প্পড় দিলো। মহিলা পু*লিশ এসে ইরিনাকে আটকায়। অতঃপর তারা শার্লককে নিয়ে যায়। অতঃপর ইরিনা সেখানেই বসে কাঁদতে থাকে।
শ্রাবণ টরেন্টোর একটা পার্কে বসে আছে। বরফে আচ্ছাদিত প্রায়। ডিসেম্বর থেকে কানাডায় শীতকাল শুরু। বছরের বেশিরভাগ সময়ই কানাডায় বরফে আচ্ছাদিত থাকে। এই ঠান্ডার মধ্যেও সে একটা বেঞ্চিতে বসা। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন বছরের শুরুতেই কানাডাকে বিদায় জানাবে। এটা নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বসের সাথে কথা বলে এসেছে। যদিও বস তাকে পুনরায় বিবেচনা করতে বলেছেন। এই নিরব পরিবেশে হুট করেই জাগতিক মন খারাপেরা ভীড় করলো শ্রাবণের মনের আঙিনায়। এই মন খারাপ ভালো করার জন্য শ্রাবণ আর্শিকে কল করলো। আর্শিকে তখন মিসেস আশালতা খাইয়ে দিচ্ছিলেন। আর্শি কল রিসিভ করে। শ্রাবণ প্রথমেই বলে,
“তুমি ঠিক আছো?”
আর্শি হাতের ব্যাপারটা শ্রাবণকে জানাতে চাইলো না। নয়তো চিন্তা করবে। তাই বলল,
“হু। আপনার কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ লাগছে, শ্রাবণ।”
আর্শি মৃদু হেসে বলে,
“কারণ আপনি প্রাণোচ্ছল। আপনার কণ্ঠস্বরের অস্বাভাবিকতা আমায় ভাবায়। এইযে কিছুদিন আগেই, আমার থেকে লুকাতে কতো কিছু বলে ভুলাতে চাইলেন। পারলেন কী?”
শ্রাবণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আমাদের সাথে শ*ত্রু*তার জেরে অন্যরা কেন কষ্ট পায়?
আর্শি নিরব শুনলো। শ্রাবণ ফের বলল,
“শার্লককে যখন পু*লিশ নিয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি ওর বাড়িতে যাইনি, রাস্তার অপজিটে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শার্লককে নিয়ে যাওয়ার পর ইরিনা রাস্তার ধারের বেঞ্চে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলো। মেয়েটার তো সত্যি কেউ নেই। আমাদের জন্য মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।”
আর্শি এবারেও প্রত্যুত্তর করতে পারলো না। দুই পক্ষেই নিরব হাওয়া বইছে। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ আবার বলে,
“আমি নতুন বছরের শুরুতেই তোমার কাছে চলে আসব।”
আর্শি বলল,
“আমার মনে হয় আমার একবারের জন্য কানাডায় আসা উচিত। আপনি এখনি আসবেন না। আমি সামনের মাসে আসব।”
“ডাক্তারের পারমিশন নিয়েই আসব। তাছাড়া আমার রিসার্চও প্রায় শেষের দিকে। মা-বাবাও চলে যাবে সামনের মাসে।”
(প্রেগনেন্সিতে ট্রাভেল করা ঠিক না। করলেও ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চেকআপ করিয়ে নিতে হবে।)
শ্রাবণ বলল,
“আমাদের একসাথে পথচলার এই মাত্র স্বল্প সময়ের মধ্যে কতোকিছু হয়ে গেলো। আমরা তো এমনটা চাইনি।”
“না চাইলেও অনেককিছু হয়, শ্রাবণ। শ্রাবণ, একটা আবদার করব, রাখবেন?”
“আবদার কেনো বলছো? তুমি রাণী, তুমি হুকুম করবে।”
হাসলো আর্শি। অতঃপর বলল,
“সামনেই পূর্ণিমারাত। আপনি গভীররাতে আমাকে ফোন করে ঘুম থেকে উঠিয়ে গিটার বাজিয়ে শোনাবেন। আমি রাগ করব, ফের মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরের তাল শুনব।”
“এই আবদার তো তুমি আমার তরফ থেকে করে ফেললে।”
আর্শি ভণিতা করে বলল,
“উম.. তা ঠিক বলেছেন!”
অতঃপর দুজনেই হেসে ফেলল।
________
বাংলাদেশে নাহিদের খবরটা পৌঁছানো মাত্রই মিসেস নেহা কাঁদতে কাঁদতে আফসোস করছেন। মিস্টার হাসান পাথরের ন্যায় অনুভূতি শূণ্য হয়ে বসে আছেন। আশিকও চুপ করে আছে। তখন মুশফিকা এসে বলে,
“কাল সকালে আমি চলে যাব। আমাকে নাহিদ এখানে নিজের খারাপ উদ্দেশ্যের জন্য কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে এনেছিল। আর এক মাস পর সেটার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।”
মিসেস নেহা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“তুমি কেন আমাদেরকে আগে এসব জানালে না? আমরা তো ভেবেছিলাম, নাহিদ তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। নাহিদ নিজেকে শুধরে নিয়েছে। আমাদেরকে যদি তুমি আগে জানাতে, তাহলে আজকের এই দিনটা আমাদেরকে দেখতে হতো না।”
তখন মিস্টার হাসান বলে ওঠেন,
“মুশফিকার জন্য এই দিনটা দেখতে হচ্ছে! এটা তুমি কিভাবে বলতে পারো? তুমি নিজের দোষে এটা দেখছো! ছেলেকে যদি ছোটো থাকতে শা*স*ন করতে, তাহলে সে মানু*ষ তৈরি হতো। এমন প*শু তৈরি হতো না। আর এখন তো তোমার ছেলে তো মা*নসিক ভারসাম্য হারিয়েছে! পু*লিশ কী বলল? সে নাকি মাঝ রাস্তায় নিজেকেই গু*লি করে দিয়েছে! এসব কেন হয়েছে জানো, কোনো কিছুতে না শুনতে না পারার অভ্যাস নেই বলে। যা চেয়েছে সাথে সাথে হাজির করেছ।”
স্বামীর কথা শুনে মিসেস নেহা ফের কাঁদতে লাগলেন। মুশফিকাও সেখানে দাঁড়ালো না। উপরে উঠে চলে গেলো। অতঃপর নিজেকে রুম বন্দি করে দুঃখবিলাস করতে মশগুল।
এদিকে আরিয়া বুঝতে পারছে না, মিসেস নেহাকে কী বলবে? মিসেস নেহা কি তাকে দোষারোপ করবে? এই দোটানায় পড়ে সে একা বসে আছে। আশিক রুমে আসলে আরিয়া অস্থির হয়ে বলতে শুরু করে,
“খালামণি কী আমাকে ভুল বুঝবে? আমরা তো চেয়েছিলাম, পুরাতন সব ভুলে থাকতে কিন্তু নাহিদই তো…”
“তুমি অত ভেবো না। খালুজান আছেন খালামণির সাথে। একমাত্র ছেলে তাই খালামণি একটু বেশি ভালবাসেন। তুমি এসব চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করো না। ”
আরিয়া চুপ করে বসলো। সে নিজেও মা হতে চলেছে, একটা মায়ের কাছে সন্তান কী সেটা তো সেও বুঝে। মায়ের কাছে তার সন্তান সবসময় প্রিয়। সেই সন্তান খারাপ হোক বা ভালো।
____
দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেছে। সময়গুলো যেন যান্ত্রিক ভাবেই পেরোচ্ছে। বছর শেষ হতে আর দুই দিন বাকি। রিয়াজউদ্দীন ও মিসেস আশালতা ব্যাগপত্র গুছানো শুরু করেছেন। আর্শিও ডাক্তারের অ্যাপোয়েনমেন্ট নিয়ে চেকআপ করিয়েছে। বেবি হেলদি আছে। কোনো কম্পলিকেশন নেই। ডাক্তারের কাছে ট্রাভেলের বিষয়টা বললে ডাক্তার সতর্ক করেন। এই সময় ট্রাভেলে রিস্ক আছে সেটাও জানান। আর্শি তাও সেই রিস্ক নিতে চায়। তার ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শেষ হবে।(বাংলাদেশে যেমন প্রাইভেট ভার্সিটির সেমিস্টার ফাইনাল ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে শেষ হয় তেমনটা মিলিয়ে লিখেছি।) তারপর রিসার্চের ডাটা এন্ট্রি ও ডিসকাশন লেখা বাকি থাকবে। তাই ছুটি কাটাতে আর্শির সাথে আর্শির ফ্রেন্ডসরাও যাবে। শুধু লিসা ও সোহা বাদে। মোনা, হ্যারি ও পিটার যাবে। সাথে হ্যারির ছোটোবোনও যাবে বলে জানিয়েছে।
আজ পূর্ণিমারাত। আকাশে থালার মতো রূপালী চাঁদ। চন্দ্রমা আজ তার পূর্ণরূপে বিরাজমান। এক প্রণয়াসক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফোনের দুই পাশে বসে দুজন চন্দ্রবিলাশ করছে। একজনের হাতে গিটার। আরেকজনের হাতে আইসক্রিম! গিটারের ঝংকারে আর্শি ব্যালকনিতে বসে বিস্তর আকাশে চাঁদের দিকে চেয়ে চেয়ে এক কাল্পনিক মূহুর্তের কল্পনায় ব্যাস্ত। হুট করে শ্রাবণ গিটার বাজানো থামিয়ে বলে,
“এবার ঘুমাও।”
আর্শি জেদ ধরে বলে,
“উঁহু না।”
“কয়টা বাজে ওখানে সেই খেয়াল আছে?”
“এটা আপনার বাচ্চার জেদ। আপনার বাচ্চা বলে কথা! সে না ঘুমালে আমি কীভাবে ঘুমাব বলেন?”
শ্রাবণ মাথায় হাত দিয়ে বসে। অতঃপর বলে,
“আইসক্রিম খাওয়া থামাও, ঘুমিয়ে যাও। এখানে বসে থাকলে সারারাতেও ঘুমাতে পারবে না।”
“আমার ভালো লাগছে। নাকি আপনার ঘুম পেয়েছে? হুহ?”
“আমি কিন্তু আন্টিকে কল করব!”
আর্শি বিরক্ত হয়ে বলে,
“থাক! আমি ঘুমাচ্ছি! এমন করেন কেন? আম্মু ২ তারিখে চলে যাবে, আর আপনি এখন আমাকে বকা খাওয়াতে চান? পরীক্ষাটা শেষ হোক! তারপর এসে নিই। তখন আপনাকে এতো জ্বা*লাব যে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে যাবেন! হুহ্!”