Sunday, August 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 174



শিশির বিন্দুর জীবন পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0

#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৭(শেষ পর্ব)

রাদ রামিজার মাথায় গাট্টা মেরে বলল
-“হ আমারই বোঝার বয়স হয় নি। তুই তো বুড়া আন্টি। যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।”

রাদ রামিজার রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

রামিজা মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যায়।

————————

কেটে গেছে অনেকটা দিন

আফরিনের পরীক্ষা শেষে ভালো রেজাল্টারে পর ভালো একটা ভার্সিটিতে চান্স ও হয়ে গেছে। কথাবার্তা বলে বিয়ে টাও ঠিক হয়ে গেছে রাদের সঙ্গে। আফরিন আর অমত করেনি।

রাদ রেডি হচ্ছিল আর ইশরা ড্রেসিং টেবিলের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চোখ ছোট ছোট করে ইশরা ললিপপ খেতে খেতে বলল
-“বাবাই তুমি একটু একটু করে হাসছো কেন?”

রাদ অবাক হয়ে তাকালো ইশরার দিকে। ওর গাল ‍টেনে দিয়ে বলল
-“বাবাই তুমি তো তোমার লিপস্টিক খেয়ে ফেলেছো।”

ইশরা আয়নায় দেখে বলল
-“তোমার পকেটে আছে দেও তো আমি আবার দেই।”

রাদ ইশরাকে কোলে তুলে বলল
-“না বাবাই এখন তার দিতে হবে না। তোমার মামুনি আসলে দিও কেমন।”

ইশরা হাসি দিয়ে বলল
-“মামুনি কখন আসবে বা‍বাই!”

রাদ ইশরার চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল
-“এই তো আমরা এখনই যাবো আনতে।”

———————-

আফরিনকে সাজানো হচ্ছে। আরুশা তো সেজেগুজে রেডি। আরুশা চিপস খেতে খেতে বলল
-“কিরে বিয়ে করছিস তাহলে। আমি তো মনে করছিলাম এ জন্মে তোর বিয়ে খেতে পারবো না।”

আফরিন গরম চোখ করে তাকালো আরুশার দিকে আরুশা দাঁত বের করে হাসলো। আর বলল
-“আবির আমারে প্রোপজ করেছে কাল।”

আফরিন অবাক হয়ে তাকালো আরুশা ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল
-“কি আর বেচারা তোরে তো রাদ ভাইয়া নিয়ে যাচ্ছে।”

আফরিন আরুশার কথায় লজ্জা পেয়ে বলল
-“সর তো এখান থেকে”

আরুশা হাসলো।

আফরিনের ফোন বাজছিল। আফরিন কল রিসিভ করে কানে নিলো। রিনরিনে কন্ঠে সালাম দিলো।

অপর পাশ থেকে শুধু তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ পেলো। আফরিন হেলো হেলো করে বিরক্তি নিয়ে কেটে দিলো।

—————-

রাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল আফরিনদের বাসায়।

রাদ ভিতরে ঢুকতেই একটা চিঠি পেলো। চিঠিতে লেখা ছিল

-“বিয়েটা শেষ করে তোমাদের বাসায় গিয়ে ছাদে যাবে। কথা আছে তোমার সাথে আফরিনকে নিয়ে।”

রাদের কপাল কুচকে গেলো এমন চিঠি পেয়ে। কি দিলো এই চিঠি আর কেনই বা দিলো। আর আফরিনকে নিয়েই বা কি ‍বলবে।

রাদের ভাবনার ছেদ ঘটলো আরুশার ডাকে। আরুশা দাঁত বের করে বলল
-“কি দুলাভাই কি ভাবছেন! আরে মিয়া আজ আপনার বউকে পেয়েই যাবেন তো এতো ভাবনা কিসের। চলুন হবু শশুর ডাকছে।”

আরুশার কথায় রাদ সম্মতি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।

—————-

আফরিন ওর রুমে একাই বসে ছিলো। সবাই এসে বিয়ের আসরে নিয়ে যায়। রাদ পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে আফরিনের দিকে। আফরিনকে পাশে বসানোর কিছুক্ষণ পরেই রাদ ওর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল

-“ও হৃদয়হরণী আজ তোমার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়ে বাক‍্যহীন হয়ে যাচ্ছি। আমার হৃদস্পন্দন জানান দিচ্ছে আমি এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যার ঔষধ শুধু তুমি।”

রাদের এমন কথায় আফরিন লজ্জায় লাল হয়ে যায়। রাদ আবারো বলে
-“এমন করে লজ্জা পেলে কিভাবে হয় বলো তো। এভাবে লজ্জা পেলে যে তোমায় আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার মতো লাগে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী চলে আসে। ভালোভাবেই আফরিন আর রাদের বিয়েটা হয়ে যায়।

————————–

রাদ ছাদের কার্ণিশ ঘে‍ষে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণিমার চাঁদে ঝলমল করছে চারপাশের পরিবেশ। তার পাশেই দাড়ানো সুঠাম দেহের সুদর্শন পুরুষ। যদিও বা সেও সুদর্শন কোনো দিক দিয়ে তার থেকে কম নয়। চারপাশে পিনপতন নিরবতা ভেঙে রাদ বলল
-“আপনি কে! ঠিক চিনলাম না তো। আর আফরিনের ব‍্যাপারে কি বলবেন!”

লোকটা চাঁদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-“জানো তো জীবনটা শিশির বিন্দুর ন‍্যায় ক্ষণস্থায়ী। কখন কার মৃত্যু সুখ দুঃখ আসে কেউ বলতে পারেনা।”

রাদ কপাল কুচকে বলল
-“কি বলছেন এগুলো!”

লোকটা বাঁকা হাসলো। চাঁদের আলোতে যা চোখ এড়ালো না রাদের। লোকটা আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-” আমি রিসাদ। তোমার থেকে বয়সে বড় তাই তুমিই বলছি কিছু মনে করো না। কিছু মনে করলেও আমার করার কিছু নেই। জানো তো আজ নিজেকে ব‍্যর্থ বলবো নাকি সফল বলবো বুঝতে পারছিনা। সেই আফরিন যখন স্কুলে পড়ে তখন থেকে আমি ওকে ভালোবাসি।”

কথাটা শুনে রাদ থমকে গেলো। কেন যেন বুকে এক অজানা চিনচিনে ব‍্যথা অনুভব করলো সে। রিসাদ ওর থমকানো মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ‍আবারো বলা শুরু করলো
-“চিন্তার কিছু নেই। আমি ওকে দিয়ে দিছি তোমার কাছে। আমার বাবা অনেক ছোটবেলায় আমার মাকে ডিভোর্স দেয়। ডিভোর্সের কয়েকদিন পর আমার মা বুঝতে পারে আমার বোন হবে। মা আমার বাবাকে আর কিছু জানায় নি। যে মানুষটা নিজের স্বার্থের জন‍্য নিজের মা বাবাকে ছেড়ে সে আমার মাকে কি দেখবে। আমার মাও চলে যায় বোনকে রেখে। স্বার্থপর দুনিয়ায় আমি একা হয়ে পড়ি। মানুষ অবহেলা আর অনাদরে বড় হয়েছি। পরে নিজে কামাই করে বোনকে বড় করি। জীবনের প্রতি এক অনিহা চলে এসেছিল। কিন্তু তখনই আফরিনকে দেখি। পাগলের মতো ভালোবাসি ওকে আমি। আমি ওর সাথে দেখা করার জন‍্য প্রতিদিন ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম। আস্তে আস্তে আমার টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি সব হলো। আফরিনকে পাওয়ার জেদ চেপে গেছিলো আমার মনে। আমি চেয়েছিলাম আজ বিয়ের আসর থেকে ওকে তুলে নিয়ে যেতে কিন্তু।”

রাদ চোখ ছোট ছোট করে শুনছিল রিসাদের কথা। রিসাদ কিছুক্ষণ পর কয়েকটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল

-“তুমি একদিন বৃষ্টির দিন একটা মেয়েকে বাঁচিয়েছিলে না।”

রাদ কিছুক্ষণ ভেবে সম্মতি দিলো। রিসাদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
-“ওটা আমার ছোট বোন ছিল। যে দুইদিন আগে এক্সিডেন্টে মারা যায়।”

রাদ অ‍বাক হয়ে বলল
-“কি বলছেন এগুলো। কিভাবে কি হলো!”

রিসাদ রাদের দিকে একবার তাকিয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল
-“ভার্সিটি থেকে আসার সময় একটা বাস…পরে ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওর শেষ ইচ্ছা রাখতেই আফরিন আজ তোমার।”

রাদ অবাক হয়ে বলল
-“মানে”

রিসাদ এক রহস্যময় হাসি দিলো। তারপর বলতে লাগলো
-“ও আমার পরিকল্পনা জেনে গিয়েছিল। ও ওর শেষ ইচ্ছে হিসেবে আমার কাছে চেয়েছিল যেন আমি আফরিনকে ছেড়ে দিই। তোমার সঙ্গে ওর বিয়ে হলে একটা বাচ্চার গতি হয়ে যাবে। ও বাবা মা পাবে। পরিবারের স‍বাই খুশি থাকবে। আমাদের তো আর পরিবার ছিল না। পরিবারের অভাব আমরা বুঝি।”

রাদ খেয়াল করলো রিসাদের চোখে পানি ঝলমল করছে। রিসাদ মুখে হাসি টেনে বলল
-“যাইহোক বাদ দেও। আফরিনকে ভালো রাইখো। ওকে কোনো কষ্ট পেতে দিও না।”

বলে একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেলো।

রাদের কপালে সূক্ষ ভাজ পড়লো। কেন যেন মনে হচ্ছে রিসাদ সব কথা বলেনি। কিছু রহস্য ছেড়েই চলে গেলো। রাদ তাকিয়ে রইলো রাস্তার দিকে। রিসাদ হেঁটে চলছে সামনের দিকে। রাদ তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ পর্যন্ত রিসাদকে দেখা যায়। রাদ পরপর কয়েক‍টা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিরবির করে বলল
-“থাক না কিছু অজানা রহস্য। যদি সেই রহস্যে শান্তিতে জীবন যাপন করা যায়।”

রাদ নিজের রুমে এসে দেখে আফরিন নেই। এইদিক ওদিকে তাকিয়ে আফরিনকে বারান্দায় দেখতে পায়। রাদ এগিয়ে যায় সেদিকে। পকেট থেকে বেলীফুলের মালা বের করে আফরিনের হাতে পড়িয়ে দেয়। পুনরায় পকেটে হাত দিয়ে আংটির বক্স বের করে পড়িয়ে দেয় আফরিনের হাতে। মাথাটা নামিয়ে নরম ঠোঁটে স্পর্শ বসিয়ে দেয় ওর হাতে। আফরিন লজ্জা নিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে।

রাদ আফরিনের মুখটা উঁচু করে বলল
-“আচ্ছা তুমি কি শুধু ইশরার জন‍্যই বিয়ে করেছো। কখনো যদি কেউ তোমাকে এসে বলে সে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাহলে কি!”

আফরিন রাদের গাল টেনে বলল
-“না মিস্টার, আপনাকে যদি আমার পছন্দ নাই হতো। তাহলে বিয়ে তো দূরের কথা। আপনি আমার সঙ্গে কথাই বলতে পারতেনা।”

রাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো সে আফরিনকে জড়িয়ে ধরে বলল
-“জানো তো জীবন শিশির বিন্দুর মতো। তাই কখনোই ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে নষ্ট করা ঠিক না।”

আফরিন মুচকি হেসে বলল
-“চিন্তা করেন না। একবার যখন নিজেকে আপনার নামে লিখে দিয়েছি তখন মরণ ছাড়া কেউ আমাকে আপনার পিছু ছাড়াতে পারবেনা।”

রাদ আফরিনের মুখটা নিজের দুইহাতে আবদ্ধ করে বলল
-“ভালোবাসি প্রিয়তমা। কখনো ছেড়ে যেও না।”

আফরিন রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
-“আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। প্রাণ থাকতে আপনাকে কখনো ছেড়ে যাবো না।

#সমাপ্ত

শিশির বিন্দুর জীবন পর্ব-০৬

0

#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৬

লোকটা আফরিনের কাজে হো হো করে হাসতে থাকে পাগলের মতো। তারপর পরক্ষণেই চোখ মুখ শক্ত করে বলল
-“তোমাকে তো আমার কাছেই আসতে হবে বেইবি। তুমি যাই বলো আর তাই বলো।”

———————-

আফরিন নাম্বাটাকে ব্লক করে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো। বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল রান্না ঘরে। রান্না ঘরে ওর মা রান্না করছিল। আফরিন ওর মায়ের পাশে গিয়ে দাড়ালো। কাজে সাহায্য করে ওর মায়ের। কলিং বেল বাজতেই ছুটে যায় আফরিন। দরজা খুলেই মুচকি হেসে বলল
-” আসসালামু আলাইকুম,আব্বু।”

আফরিনের বাবা মুচকি হেসে আইসক্রিমের পেকেটটা মেয়ের হাতে দিয়ে রুমে চলে গেলেন। আফরিন ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে আইসক্রিমের পেকেটটা ফ্রিজে রেখে আসে। ঠান্ডা পানি নিয়ে এগিয়ে যায় বাবার দিকে। আফরিনের বাবা ইশরায় ওকে ওনার পাশে বসতে বললেন। আফরিনও ওর বাবার ‍পাশে বসলো। ওনি আফরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-“মা,পরীক্ষাগুলো কেমন গেল?”

আফরিন ঠোঁটে হাসি নিয়েই বলল
-” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই হয়েছে আব্বু।”

আফরিনের কথা ওর বাবা ওকে আদর করে বললেন
-“যাও মা। রেস্ট নেও গিয়ে।”

আফরিন পানির খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল
-“আচ্ছা আব্বু”

কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার শেষে নিজের রুমে আসলো আফরিন। ফ্রেশ হয়ে চুলটা বেধে নিলো। লাইটটা অফ করে শুয়ে পরলো।

ফোনটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। আবারো অপরিচিত আরেকটি নাম্বার থেকে কল এসেছে। আফরিন ভ্রুকুচকে ফোনটা রিসিভ করে চুপ করে রইলো। অপর পাশে এক পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো
-“আমি মেঘ তুমি বৃষ্টি
আমি রাত তুমি দিন
চলো না বিয়ে করি এক দিন”

আফরিন বিরক্ত নিয়ে দাঁত কিটমিট করে বলল
-” আপনার লজ্জা করে না”

লোকটা দাঁত দিয়ে ঠোঁট আকড়ে হেসে বলল
-“লজ্জা থাকলে কিভাবে হবে বলো তো।”

আফরিন বিরক্তি নিয়ে ফোন‍টা কেটে দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরলো।

—————

সকাল নয়টার দিকে রাদ এলো ইশরাকে নিয়ে। রাদ অফিস থেকে যাওয়ার সময় আবার নিয়ে যাবে ইশরাকে তাই বলে চলে গেল।

আফরিন গিয়ে ফ্রিজ থেকে কালকে ওই আইসক্রিমের পেকেটটা বের করে রুমে গেল। আইসক্রিম দেখে ইশরার মুখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো।

আফরিনের মা ইশরার জন‍্য সুজি বানিয়ে নিয়ে এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ইশরা আর আফরিন আইসক্রিম খেয়ে মুখ মাখিয়ে বসে আছে।

আফরিনের মা সুজির বাটিটা পাশের টে‍বিলে রেখে বলল
-“কি অবস্থা করেছিস দুইজন মুখের দেখছিস।”

মায়ের কথা ফোন খুলে আফরিন দেখে নিজেই হেসে দিলো। ইশরাও হাসছে। আফরিনের মা কপালে হাত রেখে বললেন
-“তোর আর বুদ্ধি হলো না। ছোটই রয়ে গেলি তুই।”

আফরিন নিজের মায়ের কথা না শুনে ইশরাকে কাছে ডেকে বলল
-“আসো মামুনি আমরা কয়েকটা পিক তুলি।”

বলেই পিক তুলতে ব‍্যস্ত হয়ে গেল। আফরিনের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-“সুজিটা ওকে খাইয়ে দিস।”

বলেই ওনি ওনার কাজে চলে গেলো।

আফরিন ইশরাকে সুজিটা খাইয়ে দিলো। দুইজন মিলে চলে গেল শয়তানি করতে। টেবিল ফ‍্যানের সামনে দুইজন গিয়ে আ আ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় গেল। পাশের বাসার আন্টি সবজি কিনছে আর ঝগড়া করছে। দুইজন মিলে দুইজনের দিকে তাকিয়ে দুষ্টামি হাসি দিলো।

ইশরা ছুটে গেল রুমে সুজির বাটিটা নিয়ে আবার বারান্দায় গেল। আফরিন একটু সুজি নিয়ে ওই আন্টির গায়ে ফেলে দিলো। আন্টি উপরে তাকাবে তার আগেই দুইজন চুপ শুয়ে পরলো। আন্টি চেচিয়ে বলতে লাগল
-“কাকের কোনো আক্কেল নাই। আমার গায়ে শেষমেশ করে দিলো। তাও আবার পাতলা হাগা। আমার ভালো জামাটা নষ্ট করে দিলো আক্কেল ছাড়া কাক।”

আরো বকবক করতে লাগল। আফরিন আর ইশরা দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসতে লাগলো।

—————-

কেটে গেছে দুই মাস…
আজ আফরিনের এইচএসসি পরীক্ষা। এই দুইমাস রাত দিন এক করে পড়াশোনা করেছে আফরিন। একটু নার্ভাস ফিল হচ্ছে তার। তার বাবা তাকে পরীক্ষার হলে দিতে এসেছে। আফরিন ঢুকেই আরুশাকে দেখতে পেলো। আরুশা একাই কি যেন বকবক করছে।

আফরিন পিছন থেকে একটা গা‍ট্টা মারে। আরুশা রেগেমেগে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আফরিনকে দেখে থেমে যায়। হুট করেই ওকে জড়িয়ে ধরে বলল
-“দোস্ত কতদিন পর তোকে দেখলাম।”

দুইজন মিলে চলে গেল ক্লাসে। পরীক্ষা দিয়ে হাসিমুখেই দুইজন বের হলো। পরীক্ষাটা ভালোই হয়েছে।

আফরিন বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিলো। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলো। ঘুম থেকে উঠে কফির মগ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। ফোনটা বাজতে দেখে খানিকটা বিরক্ত হয়।

রুমে এসে ফোনটা ধরে তখনই অপর পাশ থেকে একটা নেশাক্ত কন্ঠ ভেসে এলো
-“কবে পাইবো বলো তোমারে। তোমারে ছাড়া এই হৃদয় আমার মরুর মতো শুকনো। তুমি যে আমার কাছে বর্ষাকালের বৃষ্টির চেও শীতল স্পর্শ।”

আফরিন কান থেকে ফোন সরিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার। কিন্তু কন্ঠটা চেনা চেনা লাগছে। আফরিন প্রশ্নবোধক কন্ঠে বলল
-“আপনি ওই লোকটা না। যে”

আফরিনের কথায় লোকটি মুচকি হেসে ওর কথার মাঝেই বলে উঠলো
-“এই তো বেইবি আমার কন্ঠ তুমি কেমন চিনে গেছো।”

আফরিন নাকে পাটা ফুলিয়ে বলল
-“আপনি তো ভারি অসহ‍্য আর লজ্জা ছাড়া মানুষ। আপনার দুইটা নাম্বার ব্লক দিছি তাও আপনি আবার ফোন দিচ্ছেন।”

লোকটা গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলো
-“এতোদিন তো দেইনি। যাইহোক বাদ দেও পরীক্ষা কেমন দিলে।”

আফরিন কিছু না বলেই কেটে দিলো। লোকটা পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। সে ধপ করে শুয়ে পরলো। কানে এখনো আফরিনের রিনরিনে কন্ঠ বাজছে। লোকটা নিজের বুকে হাত দিয়ে বিরবির করে বলল
-“তুমি আমাকে চাও বা না চাও। তোমাকে আমার হতেই হবে। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”

—————

আফরিন চোখ বন্ধ করে কয়েকটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বিরবির করে বলল
-“নিজে বাঁচিনা নিজের টেনশনে। আর এগুলো ঝামেলা বিরক্তকর।”

এগুলো কথা ঝেড়ে ফেলে পড়তে বসলো।

—————-

রাদ উল্টো হয়ে শুয়ে ছিল। ইশরা ওর রুমে ছুটে এসে বলল
-“বাবাই, তুমি কি করছো?”

রাদ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো ইশরা টলটলে পানি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে ইশরার কাছে গিয়ে ওকে কোলে নিলো। অস্থির হয়ে জিঙ্গাসা করলো
-“কি হয়েছে তোমার বাবাই। কান্না করছো কেন?”

ইশরা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল
-“পিপি আমার সাথে কথা বলছে না। কথা না বলে শুধু কান্না করছে।”

ইশরার কথায় কপাল কুচকে এলো রাদের। রাদ ইশরাকে জিঙ্গাসা করলো
-“তোমার পিপি কোথায় এখন।”

ইশরা নাক টেনে বলল
-“পিপির রুমে বসে কান্না করছে।”

রাদ ফোনে কার্টুন দিয়ে ইশরাকে নিজের রুমে বসিয়ে দিয়ে রামিজার রুমে চলে গেল।

রামিজা চোখ নাক মুখ লাল করে ফেলেছে কান্না করে। রাদ ধীর পায়ে হেটে গিয়ে রামিজার কাধে হাত রাখলো। রামিজা চমকে পিছনে তাকাতেই রাদকে দেখতে পেলো। ওর কান্নার গতি যেন বেড়ে গেলো। রাদ নিজের কাছে আগলে নিলো রামিজাকে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
-“কি হয়েছে? কেউ কিছু বলছে তোকে?”

রামিজা নাক টানতে টানতে ‍বলল
-“বড় ভাবি আমাকে একটা কানের দুল গিফট করেছিল। আজকে আমি যখন স্কুল থেকে এসে আয়নার সামনে দাড়াই তখন আর খুজে পাচ্ছিনা।”

রাদ বুঝতে পারলো রামিজা কেন কান্না করছে। রাদ রামিজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল
-“পাগলী মেয়ে একটা। খুজে পাবি দেখিস। আর ভাইয়া ভাবি সব থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার তো আমাদের ইশরা। আর কান্না করিস না তো বাচ্চাটাও কান্না করে দিছে। তুই নাকি ওর সঙ্গে কথা বলছিস না। কথা না বলে শুধু কান্না করছিস।”

রামিজা চোখমুখ মুছে বলল
-“কোথায় ও”

রাদ মুচকি হেসে বলল
-“আমার রুমে কার্টুন দেখছে। কি জাদু করছিস একবার কথা বলিস নি তাই বাচ্চা কান্না করে বাঁচেনা।”

রামিজা দাঁত বের করে হেসে বলল
-“তুই বুঝবিনা। আসলে তোর বোঝার বয়সই হয় নি ছোট ভাইয়া।”

রাদ রামিজার মাথায় গাট্টা মেরে ‍বলল

#চলবে

শিশির বিন্দুর জীবন পর্ব-০৫

0

#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৫

রাদ রাতে বাসায় আসতেই রাবেয়া বেগম বললেন
-“কি অবস্থা করেছিস ভিজে। ঠান্ডা জ্বর আসলে কি হবে বল দেখি!”

রাদ কিছু বলতে নিবে তার আগেই সে হাঁচি দিতে শুরু করে। রাবেয়া বেগম কড়া চোখে তাকাতেই রাদ বোকামার্কা হাসি দেয়। রাবেয়া বেগম কোমরে হাত রেখে বলল
-“যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবার টেবিলে দিচ্ছি আমি।”

রাদ নিজের রুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হতেই দেখে রামিজা আর ইশরা বসে আছে বেডে উপর। রাদ মুচকি হাসি দিয়ে ইশরার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই পরপর হাঁচি পড়তে থাকে। রাদ কথাই ‍বলতে পারছেনা। রামিজা হুট করেই হেসে দিলো হো হো করে। রামিজার হাসি দেখে ইশরাও হেসে দিলো।

রাদ চোখ গরম করে রামিজাকে কিছু বলতে নিবে তার আগে আবারো হাঁচি পরে। এতে ওর হাসি আরো বেশি বেড়ে যায়। রাদ রামিজার মাথায় গাট্টা মারে।

রাবেয়া বেগম ওদের হাসির শব্দ শুনে এই কান্ড দেখে রুমে এসে বলল
-“হয়েছে হাসাহাসি। এবার সবাই চলো খাবার খেতে।”

বলেই রাদের দিকে একটা বাটি নিয়ে এগিয়ে আসে। রামিজা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল
-“ছোট ভাইয়া খাও খাও আদার রস।”

রামিজার কথায় রাদ দাঁত কিটমিট করে ওর দিকে তাকায়। নাকমুখ কুচ করে আদার রসটা খায় সে।

——————-

আফরিন এর টেস্ট পরীক্ষা শেষ আজ। আফরিন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বর্ষাকাল হওয়ায় সারাদিনই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তেই আছে। আফরিন আর আরুশা দাড়িয়ে আছে কলেজের সামনের একটি দোকানের ছাউনিতে। আফরিনের মুখে হাসি ঝুলে আছে। আরুশা টিপস খাচ্ছে আর বকবক করছে।

একটা গাড়ি ওদের সামনে দাড়াতেই কপাল কুচকে যায় আরুশার। আরুশা আফরিনকে গুতা দিয়ে বলল
-“দেখ তো গাড়িটা চিনিস নাকি রে।”

আফরিন ঘুরে তাকাতেই রাদকে গাড়ির ভিতরের গ্লাস নামাতে দেখে। আফরিন খানিকটা অবাক হয়। মনে মনে বলে
-“এই লোক আবার এখন এখানে কি করছে।”

রাদ হাত ‍বের করে চিৎকার করে বলল
-“আফরিন তোমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে গাড়িতে আসো। এই বৃষ্টিতে এখন রিক্সা পাবেনা। আমি তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি আসো।”

আরুশা কপাল কুচকে বলল
-“কেরে এই গোলাপি মহিষ!”

আফরিন জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রিনরিনে কন্ঠে বলল
-“ওনি রাহাত ভাইয়ের ছোট ভাই।”

রাদ আবারো চেচিয়ে বলে উঠলো
-“কি হলো আসো। এতো ফরমালিটি করতে হবে না। ইশরাও আছে আমার সঙ্গে।”

ইশরার কথা শুনে আফরিন আর না করতে পারলো না। বাচ্চাটাকে কত দিন দেখে না। আদর করে দেয়না। আফরিন এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে আরুশার হাত ধরে। গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দুইজন উঠে বসে। ইশরা রামিজার কোলে বসে ছিল রাদের পাশের সিটে। আফরিনকে দেখে লাফ দিয়ে ওর কোলে আসে। আফরিন কয়েকটা চুমু বসিয়ে দেয় ইশরার কপালে।

রামিজা পিছনে ঘুরে বলল
-“আপু আজকেই তোমার পরীক্ষা শেষ না।”

আফরিন হাসিমুখে ইশরার হাত নিয়ে খেলতে খেলতে বলল
-“হুম আজকেই শেষ”

রামিজা দাঁত বের করে বলল
-“তাহলে চলো একসঙ্গে খাবার খেয়ে আসি। আমরা আজকে ছোট ভাইয়ার জন্মদিনের ট্রিট খেতে বেড়িয়েছি। রাস্তায় তোমাকে দেখতে পেয়ে তোমাকে তুলে নিতে বললাম।”

আফরিন আরুশার দিকে তাকিয়ে আবার রামিজার দিকে তাকিয়ে বলল
-“কিন্তু আমাদের বাসায় তো জানানো হয় নি। আজ নয় পরে একদিন না হয়।”

আফরিনের কথার মাঝখানেই রাদ লুকিং গ্লাসে আফরিনের দিকে তাকিয়ে বলল
-“তোমার ফ্রেন্ডকে বাসায় জানিয়ে দিতে বলো। আর আম্মুকে বলছি আম্মু আন্টিকে বলে দিবে। সমস্যা হবে না।

আফরিন কিছু বলতে নিবে তখনই রাদ বাম হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-“আমি আর কোনো না শুনতে চাইনা।”

আরুশা দাঁত বের করে রাদকে বলল
-“শুভ জন্মদিন ভাইয়া। আমার খাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আম্মুকে ‍বললেও কিছু বলবেনা। সমস্যা নেই আপনি নিয়ে চলুন।”

আফরিন আরুশাকে গুতা দেয়। আরুশার কান্ডে ঠোঁট টিপে হাসে রাদ। রামিজা তো জোরেই হেসে দেয়। রামিজার হাসিতে ইশরাও হাসে। ইশরাকে হাসতে দেখে আফরিনও হেসে দেয়।

বৃষ্টি থেমে এসেছে। সবাই বসে খেয়ে নিলো। আফরিনের জামায় কিছুটা ময়লা লাগায়। সে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। আফরিন জামাটা ঝাড়তে ঝাড়তে বের হতে নিতেই কেউ একজন ওর পথ আটকিয়ে ধরেছে। আফরিন মুখ তুলে তাকাতেই লোকটা তার সকল দাঁত বের করে বলল
-“সোনা মামুনি চলো আমরা ঘুরে আসি একটু।”

বলেই আফরিনের হাত চেপে ধরলো। আফরিন রক্তবর্ণ চোখ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল
-“হাতটা ছাড়ুন”

লোকটা আরো জোরে করে ধরায় আফরিন দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল
-“কি বললাম বুঝলেন না হাতটা ছাড়ুন।”

রাদ দূর থেকে দেখে এগিয়ে আসতে নেয়। তখনই আফরিন লোকটির গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আফরিন লোকটিকে আঙ্গুল নাচিয়ে বলল
-“বলছিলাম না হাতটা ছাড়তে।”

লোকটা আগুন চোখে আফরিনের দিকে তাকিয়ে হাত আগাতেই আফরিন লোকটা হাত মুচড়ে ধরে। লোকটি ব‍্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। আফরিন দাঁত পিশে বলল
-“মেয়ে মানুষ দেখলেই লালসায় চোখ ভরে উঠে। ভুলে যাস না মেয়েরা মায়ের জাত সকল কষ্ট সহ‍্য করতে পারে। এমনকি নিজের আত্মরক্ষায় যা তা করতে পারে। তাই এরপর থেকে মেয়েদের দেখলে হিসাব করে চলবি। মনে রাখিস নারীরা দূর্বল না।”

বলেই লোকটির হাত ঝাড়ি দিয়ে ফেলে দেয়। লোকটি ব‍্যথায় কুকরে যায়। আফরিন সামনের দিকে চোখ রাখতেই রাদের অবাক করা দৃষ্টি নজরে পরে। এতে আফরিনের কপাল কুচকে যায়। আফরিন তুরি মেরে রাদের উদ্দেশ্যে বলে
-“আপনার আবার কি হলো ভাইয়া। হা করে আছেন কেন! মুখে কিছু ঢুকে যাবে তো।”

রাদ তাড়াতাড়ি করে মুখ বন্ধ করে অবাক করা কন্ঠে বলল
-“তুমি যে এতো সাহসি জানতাম না তো। আবার দেখছি মারামারিও পারো।”

আফরিন স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে উঠলো
-“ও এই কথা। আমি ভাবলাম কি না।”

রাদ আরো অবাক হয়ে বলল
-“আমি ভেবেছিলাম তুমি চুপচাপ,শান্ত মেয়ে। আর এখন দেখছি।”

আফরিন চোখ ছোট ছোট করে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল
-“তো সেটা তো আপনার সমস্যা ভাইয়া। আমি কি জানি।”

বলেই আফরিন চলে ইশরাদের কাছে। রাদ অবাক হয়ে আরো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ওদের কাছে যায়।

সবাই বেড়িয়ে পড়ে ওখান থেকে আরুশা একা যেতে চাইলে রাদ না করে। ও নিজে গিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। আফরিন ইশরাকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে রাদ বলে কাল দিয়ে যাবে। এতে কিছুটা মন খারাপ হয় আফরিনের। আফরিন মন খারাপ করে বাসায় আসতেই ওর মা এগিয়ে এসে বলল
-“কিরে তোর মন খারাপ কেন! কি হয়েছে?”

আফরিন মুখ ফুলিয়ে বলল
-“আমি রাদ ভাইয়াকে বললাম ইশরাকে আমি এখানে নিয়ে আসি। ওনি আনতে দিলেন না। বললেন কাল দিয়ে যাবে।”

আফরিনের মা ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললেন
-“ও এই কারণে মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস। এতে তো তোরই ভালো হলো। তোর উপর দিয়ে তো অনেকটা চাপ গেল এই কয়েকদিন। আজ একটু রেস্ট নে। কাল তো দিয়ে যাবে বলছে।”

আফরিন কি যেন ভেবে কিছু না বলেই চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলো। ঘুমটা দরকার ছিলো তার। পরীক্ষার চাপে কয়েকদিন একদম ঘুম হয়নি। অনেকটা ফ্রেশ লাগছে।

বিছানা থেকে উঠে চোখেমুখে পানি দিয়ে কফির মগটা নিয়ে বারান্দায় গেল। কিছুক্ষণ আগেই ওর মা দিয়ে গেছে। বাহিরে সতেজ সবুজ পরিবেশ উপভোগ করতে করতে কফিটা খেলো সে। আজ মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে।

রুমে এসে ফোনটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। আফরিনের কপাল কুচকে গেলো অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে। দুইবার বেজে থেমে গেলো। আফরিন তৃতীয় বারের বার কলটা রিসিভ করলো। অপরপাশ থেকে একটা গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো
-“কি হলো জান। এতো দেড়ি করে কেন কলটা ধরলা বলো তো। তা আমার জানটা কি করে?”

আফরিন ভ্রুকুচকে প্রশ্নবোধক কন্ঠে বলল
-“কে আপনি! আর কি বলছেন এগুলো! মাথা ঠিক আছে আপনার।”

লোকটা হাসলো। লোকটা নিজের হাত দিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে বলল
-“ইয়েস বেইবি, আমি একদম ঠিক আছি। আর আমি কে তা না পরেই জানবে। আপাতত বলো তো কি করছো?”

আফরিন নিজের রাগকে কন্টোল করে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
-“আপনি একটু নাম্বারটা চেক করে দেখেন। আপনি ভুল নাম্বারে কল করেছেন।”

আফরিনের কথায় লোকটা হো হো করে হাসলো। তারপর বলল
-“নো বেইবি, আমি একদম ঠিক নাম্বারে ঠিক জনের সাথে জেনে শুনেই কথা বলছি।”

আফরিন এবার রাগ কন্টোল করতে না পেরে রেগেই বলে উঠলো
-“ফাজলামি পেয়েছেন।”

বলেই খট করে কল কেটে দিলো।

#চলবে

শিশির বিন্দুর জীবন পর্ব-০৪

0

#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৪

আবির ক‍্যান্টিনে বসে আফরিনের অপেক্ষা করছিল। তখনই গুটিগুটি পায়ে আবিরের সামনের চেয়ারে বসলো। আবির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আফরিনের দিকে। গোলগাল চেহারায় হিজাবটা যেন বেশি ফুটে উঠেছে। কাটছাঁট চেহারার মেয়েটাকে আবিরের চোখে অসম্ভব সুন্দর লাগে। হোক না শ‍্যামবর্ণে তাতে কি আসে যায়।

আবিরকে এমন হাবলুর মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে আফরিন বিরক্তি নিয়ে বলল
-“কিছু কি বলবে নাকি শুধু হাবলুর মতো তাকিয়ে থাকার জন‍্য আসতে বলেছ।”

আবির আফরিনের কথায় থতমত খেয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। এতে আফরিনের বিরক্তি যেন চরম পর্যায়ে উঠে গেলো। আফরিন চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে ‍টেবিলে হাত দিয়ে আঘাত করে বলল
-“হয়েছে তোমার। আমতা আমতা করা আমি একদম পছন্দ করিনা।”

আবির ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে বলল
-“আমি তোমাকে ভালোবাসি”

কথাটা কর্ণপাত হতেই আফরিন আতকে উঠলো। আফরিন কিছু না বলেই চলে গেলে সেখান থেকে। আবির মুখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো আফরিনের যাওয়ার দিকে।

আফরিন ধীর পায়ে ক্লাসে এসে নিজের সিটে ধপ করে বসে পরলো। আরুশা উৎসাহ নিয়ে বলল
-“কিরে কি বলল?”

আফরিন থমকানো সুরে বলল
-“ও নাকি আমাকে ভালো‍বাসে”

আরুশা স্বাভাবিকভাবে বসে চিপস চেবাতে চেবাতে বলল
-“আমি জানতাম এমনটাই বলবে ওই গাধা। চোখ মুখ দেখে আমি আগেই বুঝতে পারছি।”

আফরিন অবাক করা কন্ঠে আরুশার দিকে তাকিয়ে বলল
-“কি বলছিস এগুলো!”

আরুশা ভাব নিয়ে বলল
-“আমি বুঝতে পারি। তুই তো ‍বলদ।”

———————-

ক্লাস শেষ করে রুম থেকে বের হতেই রামিজাকে দেখতে পায় আফরিন। মেয়েটা আগের থেকে অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছে। আফরিন রামিজাকে কাছে ডাকে। মুচকি হাসি দিয়ে বলে
-“এখনো বাসায় যাওনি কেন?”

রামিজা মুচকি হেসে আফরিনের হাত ধরে বলল
-“আম্মু তোমার সঙ্গে যেতে বলছে। তা আপু কেমন আছো?”

আফরিন সামনে এগোতে এগোতে বলল
-“আছি আল্লাহ যেমন রেখেছে। তুমি কেমন আছো?”

কথা ‍বলতে ‍বলতেই আফরিনের নজর পরলো দূরে দাড়িয়ে থাকা রাদের দিকে। রাদ দেখতে খানিকটা অস্বাভাবিক লাগছে। চোখ নাকমুখ লাল হয়ে আছে। রামিজা আফরিনকে বলল
-“ছোট ভাইয়া মনে হয় কিছু নিয়ে রেগে আছে। চলো গিয়ে গাড়িতে বসি।”

আফরিন দৃষ্টি নামিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল রামিজার হাত ধরে। দুইজনকে দেখে রাদ কিছু না বলেই উঠে পরলো গাড়িতে। ওরাও কিছু না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে পরলো।

গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে তখনই রাদ চেচিয়ে বলল
-“আমাকে বিরক্ত করতে না করছিলাম তোকে। তোর মতো ফাউল আর ছেচড়া মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। লজ্জা করেনা তোর। পরবর্তীতে ফোন দিলে খবর আছে তোর।”

বলেই গাড়ি ব্রেক করলো রাদ। আফরিন আর রামিজা ভয়ে কুকরে গেছে। রাদের এমন রেগে কারো সঙ্গে কথা ‍বলতে দেখে দুইজন দুইজনের দিকে তাকাতাকি করলো। রাদ হুট করেই গাড়ি থেকে নেমে পরলো।

রাদ নামতেই আফরিন ঢোক গিলে বলল
-“তোমার ভাই তো দেখি ফায়ার হয়ে আছে।”

রামিজাও মিনমিনে কন্ঠে বলল
-“ছোট ভাইয়া রাগ করে খুব কম। একবার রেগে গেলে অবস্থা খারাপ।আল্লাহ ভালো জানে কার উপর ক্ষেপছে।”

কিছুক্ষণ পর রাদ গাড়িতে এসে পরপর কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে নরম সুরে বলল
-“সরি,আসলে একটু সমস্যা হয়েছিল তো তাই রেগে গিয়েছিলাম। তা কেমন কাটলো দিন।”

রামিজা মিনমিনে সুরে বলল
-“ভালোই কেটেছে, ছোট ভাইয়া।”

গাড়ির লুকিং গ্লাসে রাদ চোখ রেখে আফরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল
-“তোমার কি অবস্থা?”

আফরিন জানালার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল
-“হুম ভালো”

রাদ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল
-“তোমাকে তো আমি বড় ভাবছিলাম। কলেজ ড্রেস পড়ে তো তোমাকে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে।”

আফরিন কোনো উত্তর দিলো না। বাহিরের দিকেই তাকিয়ে রইলো।

আফরিনের এমন প্রতিক্রিয়ায় রাদের ভ্রুযুগল কুচকে গেল। সে বুঝতে পারলো আফরিন তার সাথে কথা বলতে চাইছেনা। রাদ ওর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে রামিজাকে বলল
-“ইশরাকে আম্মু নিয়ে যেতে বলছে। তুই গিয়ে নিয়ে আসিস। আমার কিছু কাজ আছে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসিস। তোকে বাসায় রেখে আমি কাজে যাবো।”

আফরিন এবার রাদের দিকে তাকিয়ে বলল
-“কিছু না খেয়ে এমন খালি মুখে চলে গেলে আম্মু মন খারাপ করবে। কিছু খেয়ে গেলে কিছু হবেনা।”

রাদ কিছু বলতে নিবে তখনই আফরিন আবারো বলল
-“কিছু শুনতে চাইনা”

রাদ আফরিনদের বাসা থেকে তাড়াতাড়ি হুড়া করে শুধু পানি খেয়েই দৌড় দিছে ইশরাকে নিয়ে। রামিজা আর ইশরাকে বাসার সামনে নামিয়ে রাদ ওখান থেকেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেছে।

————————

তীব্র গরমে অস্বাভাবিক জনজীবন অতিবাহিত করছে মানুষ। এই পরিস্থিতিতে প্রশান্তির একরাশ হিমেল স্পর্শ নিয়ে শহর জুড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। রাদ রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়ে গাড়ির পাশে দাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলো। সাদা শার্ট বৃষ্টির পানিতে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছে রাদের। চোখের চিকন ফ্রেমের চশমাটা খুলে মুখটা আকাশের দিকে তুলে চোখ বুজে নেয়।

হুট করেই কেউ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে রাদ। আকস্মিক এমন ঘটনায় অবাক হয়ে রাদ সামনে তাকাতেই দেখে কিছু লোক দৌড়ে আসছে। আর তাকে জড়িয়ে ধরে আছে একটা মেয়ে। মেয়েটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
-“আমাকে বাঁচান দয়া করে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁচান আমাকে।”

রাদ নিজের থেকে মেয়েটিকে ছাড়িয়ে মেয়েটাকে শান্ত করে। ছেলে দুটো উদ্দেশ্যে বলল
-“কিরে কি চাই তোদের!”

বলেই শার্টের হাতা গোটায়। বলিষ্ঠ দেহের রাদকে দেখে বখাটে ছেলে দুটো ভয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতাকি করে।

রাদ বাঁকা হাসি দেয় ওদের কাজে। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠে
-“তুই সরে যা এখান থেকে। আমাদের কাজ আমাদের করতে দে।”

রাদ সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল
-“আমি না করছি নাকি। যা খুশি কর।”

রাদের এমন কথায় মেয়েটা ভয় পেয়ে গেল। লোক দুটো দাঁত বের করে হাসি দিয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসতে ধরে। তখনই রাদ একটা পা ‍বেজে দেওয়ায় একটা ছেলে ধপাস করে পড়ে যায়। এটা দেখে অন‍্য ছেলেটা রেগে রাদের দিকে তেড়ে আসতে নিলো বৃষ্টির পানিতে পা ‍পিছলে ধপাস করে আগের লোকটার উপর পড়ে যায়। এমন ঘটনা দেখে রাদ আবারো বাঁকা হাসি দিয়ে ওদের দিকে এগোতে নিলেই ওরা দুইজন উঠে ভো দৌড় দেয়। ওদের কাজে রাদ হেসে দেয়। রাদ এবার মেয়েটার দিকে ঘুরে গাড়িতে বসতে বলে। রাদ মেয়েটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে।

————————

মায়ের ডাকে হুড়মুড়িয়ে উঠে আফরিন। কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নামাজ পড়ে শুয়েছিল। কখন যে ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি। মাগরিবের আযান দিচ্ছে বলে ওযু করে নামাজ পড়ে নেই। এক মগ কফির জন‍্য রুম থেকে বের হতে নিবে তখনই ওর মা কফির দুটো মগ নিয়ে হাজির হয়ে। ওনি মুচকি হেসে বলেন
-“চল বারান্দায় গিয়ে বসে খাই। ওখানে সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ওখানে গেলে ফুরফুরে লাগবে।

আফরিন ও সম্মতি দিয়ে বারান্দা চলে যায়। ধোয়া উঠা কফিতে এক চুমুক দিতেই আফরিনের মা বলে উঠেন
-“মা আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।”

নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে কপাল কুচকে যায় আফরিনের সে তার মায়ের দিকে ঘুরে জিঙ্গাসা করে
-“কি হয়েছে মা! আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা। আর কি ভুল আর কিসের ক্ষমা।”

আফরিনের মা মুখটা নিচু করে বললেন
-“তোর মতামত ছাড়া রাহাতের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা আমার ঠিক হয় নি। আর ওইদিন রাদের কথা বলাও আমার ঠিক হয় নি। তোর সামনে পরীক্ষা কোথায় তোকে আমি মানসিক ভাবে সাপোর্ট দিবো তা না করে। তুই কি পারিস না তোর অপরাধী মাকে এবারের মতো ক্ষমা করতে।”

বলেই আফরিনের মা কান্না করে দিলেন। আফরিন নিজের হাতের কফির মগটা পাশে রেখে মায়ের দিয়ে ঘুরে বসে মায়ে দুটো হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল
-“তুমি আমার মা। আমি তোমাকে ক্ষমা করার কে বলো তো। আর দোষ তো তোমার না আমাদের সমাজে। আমাদের সমাজে বউ মরে গেলে শালীকে জোর করে হলেও দুলাভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। একবার সেই মেয়েটার কথা চিন্তাও করা হয় না। আর ভাইয়া তো আপুকে ভালোবেসেছিল। সে কিভাবে মেনে নিবে তার ভালোবাসার মানুষের জায়গায় অন‍্যজনকে। যাইহোক তুমি আর এগুলো ধরে রেখে কষ্ট পেয়েও না। যা হওয়ার হয়েছে। এখন শুধু আর বিয়ের কথা বলো না। আর ইশরাকে না আমরা সবাই মিলে মানুষ করে নিবো।”

আফরিনের মা নিজের মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিলেন।

#চলবে

শিশির বিন্দুর জীবন পর্ব-০৩

0

#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৩

কেটে গেছে দুইদিন…
ইশরা এখন রাহাতের বাসায় আছে। ইশরা রাদের কাছেই থাকতে বেশি পছন্দ করে। রাদও সময় দিচ্ছে ইশরাকে। এখন ইশরা অনেকটাই সুস্থ।

রাদ নিজের বিছানায় বসে ইশরার সঙ্গে খেলছিল। হুট করেই তার ফোন বেজে উঠলো। রাদ ফোন রিসিভ করে গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“হেলো, কে বলছেন?”

অপর পাশ থেকে রিনরিনে কন্ঠে ভেসে এলো
-” আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া!”

রাদ শোয়া থেকে উঠে বসে বলল
-“কে!”

অপর পাশ থেকে আফরিন বলল
-“ভাইয়া আমি আফরিন। আন্টিকে ফোন দিছিলাম। আন্টি নাকি কাজে ব‍্যস্ত তাই আপনার ফোন নাম্বার দিলো। আর ইশরা নাকি আপনার কাছে। একটু ভিডিও কল দেওয়া যাবে। আসলে ওকে অনেকক্ষণ দেখিনি তো। তাই একটু দেখতে মন চাচ্ছিল।”

এক নিশ্বাসে কথা বলেই জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। আফরিনের এমন কাজে হাসি পেলো রাদের। ওর কথার ধরন দেখেই রাদ বুঝতে পারলো মেয়েটা তাকে ভয় পায়। রাদ কিছু না বলেই ধপ করে কল কেটে দিলো।

হুট করে রাদ কল কেটে দেওয়ায় আফরিনের খুব খারাপ লাগলো। তাহলে কি ইশরার সঙ্গে কথা হবেনা। অনেক দিধা নিয়ে কল করেও কি ব‍্যর্থ হবে সে।

ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়লো ফোন বাজার শব্দে। আফরিন দেখলো রাদ ভিডিও কল দিয়েছে। আফরিনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে দ্রুত কল রিসিভ করতেই ইশরার চকলেট মাখানো মিষ্টিমুখ ভেসে উঠলো। ইশরা আফরিনকে দেখেই বলে উঠলো
-“মামুনি”

ইশরাকে দেখে আফরিনের বুক‍টা প্রশান্ত হয়ে গেল। আফরিন প্রফুল্ল হাসি নিয়ে বলল
-“মামুনি, তুমি কেমন আছো? কি করছো?”

ইশরা চকলেট খাওয়াতে মনোযোগ দিয়ে বলল
-“চককেট খাচ্ছি। তুমি খাবে!”

আফরিন হাসি নিয়েই তাকিয়ে রইলো ইশরার দিকে।

খানিক সময় পার হয়ে যেতেই রাদ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“মিস, কথা না বলে শুধু তাকিয়ে থাকলে হবে!”

আফরিন হুট করে রাদের এমন কথায় চমকে উঠেও নিজেকে সামলে নিলো। আফরিন জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
-“ভাইয়া ইশরাকে একটু আমার কাছে নিয়ে আসতাম। কিন্তু আন্টি কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা। আপনি একটু কিছু বলবেন।”

রাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
-“তুমি এসে ঘুরে যাও।”

আফরিন নাকোচ করে বলল
-“না ভাইয়া, আমি না হয় গিয়ে ওকে নিয়ে আসি।”

রাদ ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
-“আচ্ছা ঠিক আছে কাল সকালে ওকে দিয়ে আসবোনি তোমাদের বাসায়।”

আফরিন খুশি হয়ে বলল
-“ধন‍্যবাদ ভাইয়া”

———————–

নিশব্দ নিঝুম রাতে অনেকক্ষণ পর পর একটা দুটো গাড়ি শো করে চলে যাচ্ছে। চারপাশে হিমেল বাতাস। শহরের অসহ‍্য গরমে এই রাতের প্রশান্তিময় বাতাস বরাবরই মানুষকে মুগ্ধ করে আসছে। দূর থেকে ভেসে আসছে বেলিফুলের মিষ্টি সুভাষ। শহরের ব‍্যস্ত রাস্তা এখন ফাঁকা মাঠের মতো পড়ে আছে।

এতো মুগ্ধতার মধ্যেও একরাশ মন খারাপ এসে বাসা বেধেছে রাদের মনে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু আজ তা আর বাধা মানছে না রাদের। অঝোর ধারায় নোনা জল গড়িয়ে পরছে। চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে। ছোট থেকে কতো স্মৃতিময় কাহিনী ঘটেছে এই একই জায়গায়। হাসিঠাট্টা,খুনশুটি,রাগ,অভিমান কতো কিছুই না হয়েছে এই একই জায়গায়। কিন্তু আজ পাশে নেই তার প্রাণপ্রিয় ভাই।

রাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে ‍বলতে লাগল
-“কেন এমন করলি ভাইয়া! কেন করলি! সব এমন এলোমেলো করে ছেড়ে গেলি আমাদের। তুই তো এতো দূর্বল ছিলিনা রে। তুই তো সবসময় আমাকে সাহস জোগাতি। আর তুই আজ…”

পকেটে ফোনটা অনবরত বেজেই চলছে। কিন্তু ফোনটা ধরার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই রাদের।

————————-

আফরিন চিৎকার করে বলে উঠলো
-“তোমরা কি পেয়েছ বলো তো! আমাকে তোমাদের মানুষ বলে মনে হয় না। নাকি আমি চুপচাপ থাকি তাই আমাকে নিজেদের হাতের পুতুল ভেবে নিও না। আমার বোনের মেয়ে ইশরা। আমিও ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তাই বলে এই নয় যে আমি নিজের লাইফটাকে নষ্ট করে দিবো। বিয়ে না করলে যে আমি একা ইশরাকে সামলাতে পারবোনা এমনটা তো না। তোমরা এই বিয়ে বিয়ে করে আজ রাহাত ভাইয়া এমন একটা কাজ করলো। আর এখন রাদ ভাইয়াকে বিয়ে করা নিয়ে..,ছি।”

আফরিনের মা আফরিনের কাছে গিয়ে আফরিনের কাধে হাত রাখতেই আফরিন ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়। আফরিনের মা বলল
-“ছেলেটা তো খারাপ না আফরিন!”

আফরিন রক্ত লাল চোখে আবার ও চেচিয়ে বলল
-“ভালো না খারাপ তা আমি বলতে চাইনি। আমি শুধু এইটুকুই বলছি আমি এখন বিয়ে করতে পারবোনা। আম্মু আমার সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। আমার লাইফটা সেট করতে দেও। আমি না করেনি আমাকে একটু সময় দেও। আর আমি ইশরাকে সামলাতে পারবো সমস্যা হবেনা বলছি তো।”

আফরিনের মা কিছু বলতে নিবে তার আগেই আফরিনের বাবা আফরিনের মাকে থামিয়ে বলল
-” অনেক হয়েছে। আমি এতোদিন তোমার অনেক বাড়াবাড়ি সহ‍্য করেছি। তুমি তো নিজের হাতে নিজের মেয়েটাকে শেষ করে দিচ্ছো। আমি তোমার আর একটা কথাও শুনতে চাই না।”

বাবার কথায় কিছুটা সস্থিরতা ফিরে পেল আফরিন। আফরিন আর কিছু না বলে না শুনে গুটিগুটি পায়ে চলে যায় নিজের রুমে। ইশরা ঘুমিয়ে আছে বিছানার মাঝখানে ঘুমিয়ে আছে। কি শান্ত মিষ্টি সেই ঘুমন্ত শিশুটির চেহারা। রাদ আজ সকালেই ইশরাকে দিয়ে যায় এই বাসায়।

আফরিন ওড়নাটা ঠিক করে বারান্দায় গিয়ে বসে। বাহির নিরব রাত্রি প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে যে এখন রাত অনেকটা হয়েছে। হালকা বাতিসে আফরিনের খোলা চুল উড়ছে মৃদু।

হুট করেই ডুকরে কেঁদে উঠলো আফরিন। জীবনটা তো অন‍্য রকমও হতে পারতো। এমন এলোমেলো না হলেও পারতো। গোছানো জীবনটা হুট করেই অগোছালো হয়ে গেল। সামনে পরীক্ষা তার। তার বোন কতো আশা করেছিল সে তাকে সফল হতে দেখবে। আজ সে নেই। কল্পণাও করতে পারেনা সে এখনো। আজ দুইবছর হয়ে গেল তার বোন নেই। চোখে সামনে যে ভাইকে কষ্ট পেতে দেখেছে। সেও নেই। চলে গেছে অনেক দূরে।

আফরিন চোখের পানি মুছে বিরবির করে বলল
-“না না ভেঙে পড়লে হবে না। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে সফল হতে হবে তাকে।”

আফরিন ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বই খাতা নিয়ে বসলো।

——————-

রাবেয়া বেগম ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে ছেলে আর ছেলের বউয়ের ছবির দিকে। তার কি সুন্দর সাজানোগোছানো সংসার ছিল। মিষ্টি একটা বউ সারাদিন মা মা করতো। কত শখ ছিল বাড়িতে নতুন মেহমান আসবে। কিন্তু মিষ্টি মেয়েটা যে এমন করে চলে যাবে তা কে জানতো। আজ ছেলেটাও নেই।

কাধে কারো স্পর্শ পেতেই রাবেয়া বেগম বললেন
-“এখনো ঘুমাসনি।”

রামিজা তার মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল
-“না মা ঘুম ধরছেনা। আর ছোট ভাইয়া তো ফিরলোনা।”

রাবেয়া বেগম চোখ মুছে মেয়ের দিকে ঘুরে মেয়েকে বুকে টেনে বললেন
-“ফিরে আসবে। আমি জানি ও কোথায়। ওর মেনে নিতে সময় লাগছে। ছেলেটা ছোট থেকে ভাই পাগল ছিল..”

বলেই থেমে গেলেন ওনি। রামিজাও মায়ের অবস্থা টের পেয়ে কিছু বলল না। চারপাশে পিনপতন নিরবতা।

—————————-

সকালের আলো ফুটেছে রাদ বাসার দরজার সামনে আসতেই ওর মা দরজা খুলে দিলো। এতে রাদ অবাক হলো না। রাদ জুতা খুলে নিজের রুমে যেতে যেতে বলল
-“মা আমি আর বিদেশ যাবোনা। আমি এখানেই সিফট করবো।”

রাবেয়া বেগম ছেলের কথা শুনে খুশি হলেন। এক ছেলেকে হারিয়েছে আর এক ছেলেকে দূরে পাঠিয়ে মোটেও শান্তি পেতেন না তিনি।

রাদ ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। একটা টাওজার পড়েই এসিটা অন করে শুয়ে পরলো সে। ঘুমটা এখন প্রয়োজন তার।

—————-

দীর্ঘ সাতদিন পরে আজ কলেজে আসলো আফরিন। কয়েকদিন পর টেস্ট পরীক্ষা তার। এই কয়েকদিনের ঘটনায় অনেকটা সময় গিয়েছে। সে ধীর পায়ে গিয়ে নিজের ক্লাসে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর ধপ করে তার পাশে এসে বসলো আফরিনের ফ্রেন্ড আরুশা।

আরুশা কপাল কুচ করে আফরিনের দিকে তাকিয়ে বলল
-“কিরে এতো কিছু হয়ে গেল। আমাকে একবার জানালিনা। আন্টি যখন বলল আমি তো অবাক হয়ে গেছি একবারে!”

আফরিন রিনরিনে কন্ঠে বলল
-“আসলে আমি অনেকটা ডিপ্রেশনে ছিলাম। তোকে সব কিছুই বলতাম।”

আরুশা ফোস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
-“তুই টেনশন নিস না। আল্লাহ আছে। তুই আল্লাহর উপর ভরসা কর। আর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর।”

আফরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাতা কলম বের করলো।

হুট করেই একটা ছেলে আফরিনের সামনে আসলো। ছেলেটা আফরিনের ক্লাসমেট। ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে কপাল কুচকে আফরিন বলল
-“কি হয়েছে আবির! কিছু কি বলবে?”

আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
-“আজ ক্লাসের ব্রেক টাইমে কলেজের ক‍্যান্টিনে একটু দেখা করো তো।”

আফরিন কিছু বলতে নিবে তখনই টিচার চলে আসে। টিচার আসতেই আবির চলে যায়।

——————

রামিজা স্কুল ড্রেস পড়ে রাদের রুমে এসে দেখে রাদ ঘুমাচ্ছে। রাদকে ঘুমাতে দেখে রামিজা আর কিছু বলল না। নিশব্দে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।

রাবেয়া বেগম মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন
-“বাসায় আসার আগে কলেজ ভবনে গিয়ে আফরিনের সঙ্গে দেখা করে আসিস তো। আর শুনে আসিস তো মেয়েটার টেস্ট পরীক্ষা কবে। ইশরাকে এই বাসায় নিয়ে আসবো ভাবছি। মেয়েটাকে পড়াশোনার সময় দেওয়া উচিত।”

রামিজা হ‍্যাঁবোধক জবাব দিয়ে চলে গেল স্কুলের উদ্দেশ্যে।

#চলবে

শিশির বিন্দুর জীবন পর্ব-০২

0

#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০২

আফরিন ইশরার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে আতকে উঠলো। ইশরার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আফরিন আর বসে না থেকে ছুট লাগায় রুমের সঙ্গে লাগানো বাথরুমে। আশেপাশে কোনো পাতলা কাপড় না পেয়ে নিজের ওড়নার এক অংশ ভিজিয়ে আবার ইশরার কাছে এসে বসলো আফরিন। ভেজা ওড়না দিয়ে ইশরার মুখ মুছিয়ে দিলো। কপালে জল পট্টি দিতে লাগলো।

হুট করেই ইশরা বমি করতে লাগলো। আফরিন ইশরার এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। কি করবে সে বুঝতে পারলো না। সে দৌড়ে গেল রুমের বাহিরে রাত আড়াইটা বাজে। আশেপাশে প্রায় সবাই ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়েছে। কিভাবে সে ডাকবে কাউকে।

পাশের রুমে লাইট জ্বলতে দেখে আফরিন কিছু না ভেবেই দৌড়ে রুমে প্রবেশ করলো। দরজাটা আটকানো ছিল না বলে তার আর ধাক্কাতে হলো না।

রুমে রাদ শুয়ে ছিল ওর মায়ের কোলে মাথা রেখে। ওর মা রাবেয়া বেগম আধশোয়া হয়ে চোখ বুজে ছিল। আফরিনের এমন উপস্থিতিতে দুইজনই খানিকটা অবাক হয়। কেউই এটার জন‍্য প্রস্তুত ছিল না।

আফরিন সেইদিকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত বলল
-“ইশরা কেমন যেন করছে। প্লীজ, আপনারা একটু দেখে যান।”

রাবেয়া বেগম আতকে উঠে বলল
-“কি বলছো!”

বলেই হনহনিয়ে রাবেয়া বেগম ইশরার রুমের দিকে যেতে লাগলো। পিছু পিছু আফরিন আর রাদও গেল।

————

ভোর হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনো পযর্ন্ত ইশরার জ্বর কমছেনা। ইতিমধ্যে সবাই চিন্তিত হয়ে হাজির হয়েছে রাহাতের রুমে। রাদ এবার দরজার থেকে এগিয়ে এসে বলল
-“দেখি সরেন তো সবাই। আমি আর অপেক্ষা করতে পারবোনা। অনেক দেখেছি আপনাদের চেষ্টা এখন আর দেখতে পারছিনা। ইশরাকে আমি এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”

বলেই ইশরাকে কোলে নিয়ে রাদ রওনা হলো। দরজার বাহিরে গিয়ে কি যেন মনে করে আবার রুমে এসে আফরিনকে ইশারা করে বলল
-“এই যে মিস, আপনিও আসুন আমার সাথে।”

আফরিন রাদের থেকে চোখ ফিরিয়ে ওর মায়ের দিকে তাকালো। আফরিনের মা বললেন
-“কেন বাবা? ও গিয়ে কি করবে? আমি না হয় যাই।”

রাদ বিরক্তি নিয়ে বলল -“আমি ড্রাইভ করবো। তাই ইশরাকে ধরে রাখার জন‍্য নিয়ে যেতে চাচ্ছি। আপনাদের আর কষ্ট করতে হবেনা।”

আফরিনের মা হ‍‍্যাঁসূচক উত্তর দিতেই রাদ রওনা হলো সামনের দিকে। আফরিনও গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল।

রাদ আফরিনকে গাড়ির দরজা খুলে দিলো বসার জন‍্য। আফরিন এসে গাড়ির পিছনে বসতে নিবে তখনই রাদ খানিকটা রাগী কন্ঠে বলল
-“আমাকে দেখে কি ড্রাইভার মনে হচ্ছে। চুপচাপ সামনে এসে বসো।”

আফরিন কিছু না বলে সামনের সিটে এসে বসলো। রাদ ওর কোলে ইশরাকে দিতে নিলেই ইশরা বলল
-“বাবাই তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

রাদ বুঝতে পারলো জ্বরের ঘোরে এমনটা বলছে। সেইদিকে পাত্তা না দিয়ে ইশরাকে আফরিনের কোলে দিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে নিজে গিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হাসপাতালে পৌঁছে যায়। রাদ তার এক পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করে কথা বলে সব ব‍্যবস্থা করে ইশরাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।

—————

ডাক্তার ইশরাকে কিছু ঔষধ দেয়। আর ওকে হাসিখুশি রাখতে বলে। দুই বছরের বাচ্চা অনুপাতে ও অনেকটা চাপ সহ‍্য করেছে। ওকে সময় দেওয়ার কথাও বলে দেয়।

—————-

রাদ ইশরাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কেবিন থেকে বাড়াতেই দেখে আফরিন চুপ করে একটা চেয়ারে বসে আছে। রাদ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায় আফরিনের দিকে।

আফরিন রাদকে দেখে উঠে দাড়ায়। রাদ ইশরাকে আফরিনের কোলে দিয়ে পাকিং এ যেতে বলে। রাদ কিছু ঔষধ কিনে গিয়ে গাড়িতে বসে।

ইশরা আফরিনের কোলেই ঘুমিয়ে গেছে। ঔষধ গুলো রেখে রাদ গাড়ি চালাতে লাগলো। রাদ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল
-“আমি এই বিষয়টা অনেক অপছন্দ করি।”

আফরিন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে রাদের দিকে তাকালে রাদ বলল
-“বড় বোন মারা গেলে ছোট বোনকে তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। এতে যদি ছোট বোনের মত না থাকে তাহলে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। এটা ভাইয়াও খুব অপছন্দ করতো। একবার কি ছোট বোনের লাইফের কথা ভাববেনা কেউ। আমি আর ভাইয়া বিয়ে নিয়ে নারাজ ছিলাম। কিন্তু কেউ মানে নি। আমি জানি তোমার ফ‍্যামিলিও তোমার মতামত নেয়নি। এইসব অসহ‍্য জিনিসের জন‍্য আমি বিদেশে চলে গিয়েছিলাম। সে যাইহোক ভাইয়া এটা ঠিক করেনি। ইশরার কথা ভাবা উচিত ছিল।”

আফরিন চুপ করে শুধু শুনলো রাদের কথা কিছু বলল না।

বাসায় পৌঁছে ইশরাকে আস্তে করে কোলে নিলো যাতে ওর ঘুম না ভাঙে। আফরিন গাড়ি থেকে নেমে ইশরাকে নিতে চাইলে রাদ বলল
-“সমস‍্যা নেই। তুমি যাও।”

————

বিকেলে সবাই একসঙ্গে বসেছে আলোচনা নিয়ে। আলোচনার বিষয় বস্তু হলো ইশরা। ইশরা এতোদিন নানু বাসায় ছিল। কিন্তু বর্তমানে রাহাতের মা রাবেয়া বেগম নিজের কাছে রাখতে চাচ্ছেন ইশরাকে।

রাবেয়া বেগম বললেন
-“ইশরাকে আমি আমার কাছে রাখি। আপনাদের যখন ওর কথা মনে পড়বে ওর কথা আপনারা ওকে দেখতে আস‍বেন। আর বাসা তো বেশি দূরেও না।”

আফরিনের মা নাকোচ করে বলল
-“কিন্তু ইশরা তো আফরিন ছাড়া থাকে না।”

রাবেয়া বেগম বলল
-“সমস‍্য নেই অভ‍্যাস করে ফেললে আর কোনো সমস্যা হবেনা।”

আফরিনের মা কিছু বলতে নিবে তখনই রাদ ইশরাকে কোলে নিয়ে এসে রাবেয়া বেগমকে বললেন
-“আম্মু, আমি ইশরাকে নিয়ে একটু বাহিরে থেকে ঘুরে আসি।”

রাবেয়া বেগম বললেন
-“আচ্ছা যা তাড়াতাড়ি ফিরিস। ওর শরীর‍টা তো ভালো না।”

রাদ হ‍্যাঁসূচক জবাব দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আফরিনের মা বললেন
-“বাহ আপা, ইশরা তো ভালোই আপনার ছোট ছেলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।”

রাবেয়া বেগম ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
-“আপা আমার ছেলেটা বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করে তো। আর রক্তের একটা সম্পর্ক আছে। হয় তো নিজের বাবার ছায়া পাচ্ছে মেয়েটা।

#চলবে

( আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে। 💛)

শিশির বিন্দুর জীবন পর্ব-০১

0

#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ১

রাহাত আকাশের পূর্ণ চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে লাগল

-“আফরিন আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি কখনোই আমার সাত বছরের ভালোবাসাকে ভুলে তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আর তুমি তো ভালো করে জানো আমি তোমাকে সবসময় নিজের ছোটবোন ভেবে এসেছি। আমি কখনো তোমার বোনের জায়গায় তোমাকে বসাতে পারবোনা।”

রাহাতে কথা শুনে আফরিন পানিপূর্ণ চোখে রাহাতে দিকে তাকালো। মুখে তার হাসি ফুটে উঠলো। আফরিন ও চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল

-“ভাইয়া আমি কখনো ভাবতে ও পারিনি যে আমাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে পরতে হবে। ভাইয়া আমি অনেক চেষ্টা করেছি বিয়েটা আটকানোর কিন্তু ফলাফল শূন্য। সবাই খালি ইশরাকে কে দেখবে এই কথা বলে আমাকে আটকে দেয়। আমি কি বিয়ে না করে ওকে মানুষ করতে পারিনা!”

রাহাত বলল
-“অবশ‍্যই তুমি তা পারবে। আমার মা বাবাও আমাকে একই কথা বলছেন। যাইহোক তুমি টেনশন নিওনা। আমি এই বিয়ে প্রাণ থাকতে হতে দিবো না। কথা দিলাম তোমায়।”

——————-

ওই রাতের কথা মনে পড়তেই আফরিন অঝোর ধারায় ইশরাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল। রাহাত তার কথা রেখেছে বিয়েটা সে হতে দেয়নি। তাই তো সে নিথর দেহ নিয়ে পড়ে আছে সাদা কাফন পেঁচিয়ে। আফরিনের মা আফরিনকে ঝাকিয়ে বলল

-“তুই কি বলেছিলি ওকে। যে ছেলেটা সুইসাইড করলো। মুখপুড়ি কি করলি এটা। ছেলেটা আজ তোর জন‍্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

আফরিন আরো হুহু করে কেঁদে উঠলো। কিছু বলতে নিবে তার আগেই রাহাতে মা গম্ভীর কন্ঠে বললেন

-“আপা ওকে কেন বোকছেন। ও কি করেছে। আমার ছেলে নিজের ইচ্ছামতোই এমনটা করেছে। আর ও একটা ছোট্ট মেয়ে। আর আমি আমার ছেলেকে চিনি।”

রাহাতের মায়ের অবাক করা এমন স্বাভাবিক কন্ঠ শুনে অনেকটাই অবাক হলেন আফরিনের মা। আফরিনের মা কিছু বলতে নিলেও কি যেন ভেবে থেমে যায়।

হটাৎ একজনকে দেখে অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় আফরিন। কান্না থেমে হিচকি পড়তে থাকে। ছেলেটা দেখতে একদম রাহাতের মতোই কিন্তু সে একদম ধবধবে ফর্সা আর রাহাত ছিল শ‍্যামলাবর্ণের। তাছাড়া আর কোনো পার্থক্য খুঁজে পেল না আফরিন।

ছেলেটি রাহাতের কাফন মোড়ানো দেহের পাশে ধপ করে বসে পড়লো। ছেলেটির চোখটা লাল বর্ণের ধারণ করেছে। মুখটা ফেকাসে হয়ে গিয়েছে। সবটাই তীক্ষ্ণ চোখে দেখলো আফরিন।

রাহাতের মা ছেলেটা ঘাড়ে হাত রেখে বললেন

-“বাবা, রাদ!”

রাদ রক্তচোখ নিয়ে তাকালো রাহাতের মায়ের দিকে। হুট করেই রাদ রাহাতের মায়ের কোমর জরিয়ে ধরে বলল

-“মা এমনটা কিভাবে হলো। আমার ভাইয়া তো কখননোই এমন করার মানুষ ছিল না। তাহলে কিভাবে এমনটা হলো মা।”

আফরিন আরো অবাক হলো তার জানা মতে রাহাতের ছোট বোন আছে ভাইও যে আছে তার জানা ছিল না।

আফরিনের ভাবনায় ছেদ পড়লো ইশরার কান্নার আওয়াজ শুনে। ইশরার কান্নার গতি বাড়তে দেখে আফরিন উঠে দাড়ালো। কিছু সময় ওকে নিয়ে ঘুরলো। তারপর ও বাচ্চাটা থামছেনা। আফরিনের নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে। ইশরার এমন কান্না দেখে আফরিনের ও চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো। কি করবে সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। পরিস্থিতি কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। ছোট বাচ্চাটা হয় তো আপনজন হারানোর আভাস পেয়েছে।

আফরিন কি যেন ভেবে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গেল। তাড়াহুড়ো করে দুধ গরম করে ফিডারে ঢালতে গিয়ে কিছুটা দুধ তার হাতেও পড়ে গেল। কিন্তু সেদিকে সে পাত্তা না দিয়ে দুধ কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে এনে খাওয়াতে শুরু করলো ইশরাকে। কিন্তু ইশরা কিছুতে খেতে চাইছেনা। এবার আরো কান্না পেল আফরিনের।

অপরদিকে রাহাতকে দাফন করতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আফরিন আবার ছুটে গেল দরজার দিকে। নিজের কোনো ভাই না থাকায় রাহাতকে নিজের আপন বড় ভাই মনে করেছে আফরিন। রাহাতও আফরিনকে নিজের ছোট বোনের মতো স্নেহ করত।

হুট করেই ইশরা থ মেরে গিয়েছে। কান্না করছেনা শুধু চোখে পানি নিয়ে তাকিয়ে রইলো রাহাতকে নিয়ে যাওয়ার দিকে। রাহাত চোখের আড়ালে চলে যেতেই ইশরা

-“বাবা, বা‍বা”
বলে কান্না করতে লাগলো। ইশরার এমন অবস্থা দেখে উপস্থিত সবার চোখে পানি চলে এলো। চারপাশে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানে ইশরার কান্নাটা কেমন একটা শোনাচ্ছে। আফরিন থ মেরে বসে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেল। সবকিছুই স্বপ্নের মতো লাগছে। তার কানে শুধু ভেসে আসছে রাহাতের সেই কথা

-“আমি প্রাণ থাকতে এই বিয়ে হতে দিবো না।”

রাহাতের মনের কথা যদি সে আগে বুঝতে পারতো তাহলে সে কিছু না বলেই বিয়েতে রাজি হয়ে যেতো।

————-

রাত হয়ে এসেছে কিছুক্ষণ আগেই রাহাতের দাফন কাজ সম্পূর্ণ করে সবাই বাসায় ফিরেছে। আফরিনের মা ইশরাকে ঘুম পারিয়ে দিতেছেন। আফরিন সেই বিকাল থেকে রাহাতের রুমে যেখানে রাহাত আর ইশিতার একটা বড় ছবি রয়েছে সেখানে তাকিয়ে বসে আছে। পাশেই ইশরা ঘুমাচ্ছে। আফরিন মনে মনে ছবির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো

-“তোমরা এটা কি করলে বলো তো। একবার ও আমার কথা ভাবলে না। আমার কথা নাই ভাবলে একবার তো তোমাদের বাচ্চাটার কথা ভাবতে পারতে। এখন আমি ওকে কিভাবে সামলাবো। আপু তোর উপর আমি অনেক অভিমান করেছি তুই নিজে চলে গেলি তো গেলি এখন ভাইয়াকেও নিয়ে গেলি।”

বলেই ঠোঁট উল্টিয়ে কান্না করতে লাগলো আফরিন। তার চোখ জ্বলে যাচ্ছে। ইশরার জন‍্যই এই বাড়িতে থাকা তাদের। আফরিন একবার তাকালো ইশরার দিকে। বাচ্চাটার মুখও ফেকাসে হয়ে গেছে। সকাল থেকে কিছু খায়নি। বাবা বাবা করতে করতেই ঘুমিয়ে গিয়েছে কিছু খায়নি।

আফরিন ইশরার কাছে এগিয়ে গিয়ে ইশরার মাথায় হাত রাখতেই আতকে উঠলো

#চলবে

আমার প্রথম সকাল পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#আমার_প্রথম_সকাল (১৩)
#অন্তিম_পর্ব
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
জন্মদাত্রী জননীর চিৎকার চেচামেচিতে সেদিন জুনাইদ ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে যায়নি কিংবা প্রয়োজন মনে করেনি। আমি ভেবেছিলাম হয়ত একবার হলেও যাবে সরাসরি না হোক আড়ালে গিয়ে হলেও মা’কে দেখবে। কিন্তু না আমার চিন্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন পূর্বক জুনাইদ আমাকে নিয়ে চলল নিজের গন্তব্যে। আমার মনে কৌতুহল জন্মাল জুনাইদের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে। যে ছেলে মায়ের একটা ইশারায় ওঠবস করত আজ সে এতো কিছু দেখেও একদম নিশ্চুপ। যেন সে আগে থেকেই জানত এসব হবে। আসার পথে কৌতুহল নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করেও বসেছি। ” আচ্ছা তুমি মা’কে দেখতে গেলে না যে? ”
জুনাইদ বলেছিল, ” মা’কে দেখতে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি। মা তার ছেলেকে নিয়ে ভালো আছেন। আমি গেলে সেখানে ব্যাপারটা খুব খারাপ হতো। এসব তাদের মধ্যকার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাদের মতো তৃতীয় ব্যক্তির আগমন মানে তাদের নিজেদের প্রাইভেসি নষ্ট হওয়া। ” কথাগুলো জুনাইদ অন্যপাশ ফিরে বলেছিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কথাগুলো বলার সময় জুনাইদের কণ্ঠ কাপছিল, চোখ অশ্রুতে টলমল করছে।

” তোমার অন্তত বলে আসা উচিত ছিল। ”
” তাতে লাভ? ”
” লাভ কি জানি না ঠিক। তবে ছেলে হিসেবে এটা তোমার কর্তব্য। তোমাকে আমি কখনোই কর্তব্য পালনে অনীহা করতে দেখিনি। ”
জুনাইদ কিছু বলল না। আমার হাতটাকে শক্ত করে ধরে রেখে কেবল হাসল। পরক্ষণে বলে উঠল, ” তোমার প্রতি যে এতদিন অনীহা দেখালাম। সে বেলায় কিছু বললে না তো! ”
” কর্তব্য পালনের সুযোগ পাওনি বল। এখানে অনীহার প্রশ্নই আসে না। ”
.

.
জুনাইদ একদিন থেকে পরদিন ঢাকার উদ্দেশ্যে চলে গেল। আমার দিনগুলি চলতে থাকল জুনাইদ বিহীন, জুনাইদের অপেক্ষায় ওর আগমনের পথ চেয়ে। কখন আসবে একটা চাকরির সন্ধান নিয়ে? কবে এসে বলবে, চল আমরা দুজন নিজেদের গন্তব্যে পাড়ি জমাই, মিষ্টি স্বরে এসে কানের কাছে গুনগুন করে গান গাইবে, ‘ তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী বিকেল, ক্লান্ত দুপুরবেলা!’ কবে আসবে সে প্রতীক্ষিত সময়? অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে আমার দিনাতিপাত চলতে লাগল। এই বুঝি কোনো ভালো সংবাদ আসে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর জুনাইদের কল আসে। ক্লান্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সারাদিনকার ঘটনা উল্লেখ করে। এমনি করে কেটে গেল অনেকগুলো দিন। সময় আমার আর কাটছে না। এতোদিন কোনোভাবে কাটিয়ে দিতে পারলেও এখন আর যাচ্ছে না। হয়ত এরজন্যই কিনা জানা নেই, সকাল থেকে খেয়াল করলাম আমার শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। সেজন্য সারাটা দিন একনাগাড়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম। উঠে বসার মতো উপক্রম হচ্ছে না কোনোক্রমেই। কেবল মাথা ঘুরছে, অথচ গায়ে জ্বরের ছিটেফোঁটাও নেই। মা এসে বেশ কয়েকবার খেতে ডেকে গেলেন। খাবো না বলে জানিয়েছি। কিন্তু মা তো মা-ই। না খাওয়া অব্ধি তিনি সেধে গেলেন। এক পর্যায়ে জুনাইদের কাছে নালিশটা পর্যন্ত দিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বসলেন। অগত্যা আমাকে উঠে কষ্ট করে খেতে বসতে হলো। কিন্তু খুব একটা খেতে পারিনি, লোকমা দুয়েক মুখে তুলতে গড়গড় করে ভেতর থেকে সব বেরিয়ে এলো। মা নিরাশ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর ক্ষুদ্র করে শ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন। ছোটবোনটা সদ্য কলেজে পা রেখেছে। তার আবার পড়াশোনার প্রতি প্রবল ঝোঁক। তার আগ্রহ দেখে মা তাকে না পাঠিয়েও পারেন না। তবে বোনটা একটু দুষ্টু স্বভাবের আছে। কাজ করতে বললে সরাসরি বই হাতে দাঁড়িয়ে যায়। একাধারে পড়া শুরু করে দেয়। ভাব খানা এমন যেন তার কাছে পড়াশোনা ছাড়া পৃথিবীতে আর দু’টো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় না। তবে যতটুকু পড়ুক না কেন? মনোযোগী হওয়ায় এসএসসিতে স্কুলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। ও দেখতেও আমার চেয়ে ভালো। আজকাল প্রায়ই মায়ের কাছে ভালো ভালো সম্বন্ধ আসে। কিন্তু সে এখন বিয়ে করবে বলে সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। আমার অসুস্থতার সময় ছোটবোনটা বাড়িতে থাকলে মা’কে এত কষ্ট করে কাজ করতে হতো না। নতুবা আমার শরীরটা সামান্য ভালো হলেও চলত। মা’কে একা একা কষ্ট করতে দেখে নিজের কাছেই খারাপ লাগল।

আজ অনেকদিন পর আবার আমার খালা আমাদের বাড়ি এলেন। এসেই মায়ের কাছে নিজের ছেলের বউয়ের বদনাম গাইতে শুরু করে দিলেন। আপসোস করতে করতে এক সময় আমাকে নজরে পড়ে তার। বাড়িতে মেহমান এসেছে শুনে আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলাম ঘরের বাহিরে। অন্যথায় আমার যে খালা তাতে করে আমার মা’কে কথা শোনাতে তিনি এক চুলও ছাড় দেবেন না। তা হলেও যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা নামে। আমাকে দেখামাত্র তিনি হায় হায় করতে লাগলেন।
” কিরে সকাল! তুই এখনো বাপের বাড়ি পড়ে আছিস? যাস নাই? ”
” পড়ে থাকব কেন খালা? বেড়াতে এসেছি ক’দিনের জন্য।। ”
” বাহ্ রে সেদিন না বেড়িয়ে গেলি? ”
মা জবাবে খুশি মনে বললেন, ” তাতে কি হয়েছে। মায়ের মেয়ে মায়ের কাছে এসেছে। যতদিন আমি থাকব ততদিনই তো আসবে। ”
” তাই তো বলি। লোকে যে এত কথা বলে সেগুলো সত্যি না হয়ে কি আর পারে? ”
খালার কথা শুনে আশ্চর্য হলাম। ” মানে? কে কি বলে? ”
” তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তোরে নিয়ে যে ছিঃ ছিঃ করে জানস? ”
” ছিঃ ছিঃ করার কি হয়েছে খালা? বলবেন তো করেছিটা কি? ”
খালা আমার কথায় তোয়াক্কা না করে মায়ের কাছে নালিশ জুড়ে দিতে লাগল, ” বুবু তোমার মেয়েরে যে এখানে রাখছ জানো হের শ্বশুর শ্বাশুড়ির কি অবস্থা? মহিলা বাড়িতে একলা একলা কেঁদে বুক ভাসান। একটা ছেলের বউও নাকি বাড়িত নাই। পাড়াপ্রতিবেশি এসব বলে বলে কান ঝালাপালা করে দেয়। আমার কাছেও খবর আসছে। আমি আবার বলছিলাম আমার বোনঝি এমন না। একন দেখতেছি কথা তাহলে সত্যিই। ”

খালা নিজের ইচ্ছে মতো বানিয়ে বানিয়ে বলতে লাগলেন। খালার ননদের বাড়ি আবার আমার শ্বশুরবাড়ির সাথে। উনার ননদ এসে না-কি সেদিন খালাতে এসব বললেন। আমার শ্বাশুড়িকে নাকি তার বউয়েরা দেখতে পারে না। ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আরো নানান কথা। মা চুপচাপ সব কথা শুনে গেলেও আমি পারিনি চুপ করে থাকতে৷ খালাকে বললাম, ” খালা আপনাকে এতো খবর কে দেয়? এতো আজাইরা সময় আসে কই থেকে? ”
আমার কথায় খালা তেতে উঠলেন, ” হ আমারে জিগাস আমার এত আজাইরা সময় কই থেকে আসে? তুই যে এখনো বাপের বাড়ি পড়ি আছিস তর জামাই জানে? সত্যি কথা বল তো? ”
আমি কিছু বলার আগে খালা নিজে নিজেই বললেন, ” যেদিন ওর জামাই জানবে না বুবু? দেখবা তোমার সকালরে কেমনে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। তখন আবার বইল না হেরা খারাপ! আসল খারাপ তো হইলা গিয়া তুমি বুবু। একজনরে বিয়ে দিয়েও রাখছো নিজের কাছে। আরেকজনরে এখনো পড়াইতেছ। বলি বয়স তো আর কম হইল না এতো পড়াই কি জর্জ ব্যারিষ্টার বানাইবা নাকি? ”
“সেসব নিয়ে তোর এতো ভাবতে হবে না। জীবনেও দেখলাম না কোনোদিন খবর নিতে এখন এসব কথা তোর মুখ দিয়ে বের হয় কেমনে? লজ্জা লাগে না বলতে?আর সকালরে ওর জামাই-ই রেখে গেছে। তোর কথা শেষ হলে এবার তুই যা। ” মায়ের আর সহ্য হলো না। খালার ওপর রেগে গিয়ে তিনিও বলে দিলেন। খালা কথা বলে না পেরে সেদিন রেগেমেগে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলেন।
.

.
জুনাইদ তারপরদিন হুট করে চলে আসে ঢাকা থেকে। এসে আমার অসুস্থতার কথা জানতে পেরে কপট রাগ দেখায় তাকে কেন জানানো হয়নি? আমি বললাম, ” জানালে তুমি চিন্তা করতে যে! ”
এরপর আর কিছু বলেনি সে। জুনাইদ এই ক’দিনে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। হয়তো ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া হয়নি। অনেক দখল গেছে শরীরটার ওপর। প্রবাস থেকে যখন ফিরেছিল তখন তাকে দেখতে যতটা সুদর্শন যুবক বলে মনে হয়েছিল এখন সে সৌন্দর্য অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। চোখের নিচের কালো দাগ বেড়েছে। বোঝা গেছে লোকটা আমাকে আর নিজেকে ভালো রাখতে গিয়ে চিন্তায় গত কদিন ঘুমোয়নি পর্যন্ত৷ কিন্তু গত ক’দিনের তুলনায় আজকে তাকে সবচেয়ে হাসিখুশি বলে মনে হচ্ছে। জুনাইদ এসে, জানাল ওর চাকরি হয়েছে। সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করার দরুনে তার একটি ভালো পত্রিকা অফিসে চাকরি হয়েছে। শুনে নিজের খুশিটা ধরে রাখতে পারলাম না। দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। এতো খুশি বোধহয় গত কদিনে আর একটিবারের জন্যেও হইনি আমি। সেই সঙ্গে তাকে আরো একটা খুশির সংবাদ দিলাম। ছলছল নয়নে বললাম, ” জুনাইদ তুমি বাবা হতে চলেছ! ” আমার কথা শুনতে জুনাইদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। আজ একের পর এক খুশির সংবাদ পাবো হয়তো দুজনের কেউ জানতাম না। ❝ শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এত দিবেন, যে তুমি খুশি হয়ে যাবে। ❞ (সূরা আদ দুহা:৫) আয়াতটি আজ আবারো মিলে গেল।

সেদিন বিশ্রাম নিয়ে দুজনে ফিরে গেলাম বাড়ির পথে। এই ক’দিনে শ্বশুর নাকি কয়েকবার জুনাইদের কাছে খবর পাঠিয়েছেন কবে ফিরবে সে, কবে দু’জনে ফিরে যাবো নিজেদের ভিটায়। বাড়িতে যেতেই দেখলাম শ্বাশুড়ি রুগ্ন হয়ে বসে আছেন ঘরের দুয়ারে। শুরুতে বুঝিনি পরে শ্বশুরের কাছে শুনেছি, সোমা বাপের বাড়ি চলে গেছে আমরা যাওয়ার পরদিনই। জামিলও বাড়ি আসে না। অফিস করে শ্বশুর বাড়ি থেকে আবার শেষ হলে সে পথেই চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে গেছে সোমা সুস্থ না হওয়া অব্ধি এ বাড়িতে আসবে না। জামিলকে শ্বাশুড়ি ফোন করেন। জামিল সেটাও তুলে না। নিজের মতো ব্যস্ত সময় কাটায়। যদি তোলে তখন শ্বাশুড়ি কান্নাকাটি করেন, সোমা না আসুক সে যেন অন্তত আসে। যেন পরে যায়। কিন্তু জামিল সাফ সাফ জানিয়ে দেয় সে সোমাকে ছাড়া আসবে না। তার মায়ের জন্য সোমাকে সে এখানে এনে কষ্ট দিতে চায় না। সোমা নালিশ করেছে শ্বাশুড়ি মা তাকে অকট্য ভাষায় গালাগালি করেছে, তার বাবা মা তুলে গালি গালাজ করেছে। সে আর এখানে থাকবে না। শ্বশুর শ্বাশুড়ি যতদিন থাকবে সে ততদিন আসবেও না।

শ্বশুরের কথা শুনে জামিলের মায়া হলো বোধহয়। আমাকে বলল, ” সকাল চল মা’কে গিয়ে একবার দেখে আসি। ”
আমি না করতে পারিনি। তিনি যতই দূরে ঠেলে দেন না কেন? শত হলেও উনি তো জুনাইদের মা-ই। তাই দুজন মিলে শ্বাশুড়িকে দেখতে গেলাম। জুনাইদ ভেতরে গেলেও আমি আর গেলাম না, বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদে শ্বাশুড়িকে হাউমাউ করে কাঁদতে শোনা গেল। শুনলাম তিনি ডাকছেন বারবার, সকাল নাম ধরে। আমি এগিয়ে যেতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বারবার মাফ চাইতে লাগলেন। আকুতি ভরা কণ্ঠে বলেন, ” আমারে মাফ করে দিও মা। অনেক অন্যায় করছি তোমাদের সাথে। আমি বুঝতে পারি নাই মা। সোমা আর জামিল মিলে আমার চোখ খুলে দিছে। টাকা পয়সা সব সময় সুখ দেয় না রে মা। তোমাদের অভাব দেখে তারা চাইল আমরাও আলাদা করে দিলাম। তোমাদের নাই বলে তোমাদের কাছে যেতাম না৷ যেতামইবা কি করে বল, তোমাদের নিজেদের চলতে যেখানে কষ্ট হয়, সেখানে আমাদের খরচ দিবা কেমনে? আমার জুনাইদের টাকা থাকতেও সে আমারে ভুলে যায় নাই। অথচ যে ছেলের জন্য আমার হীরের টুকরো ধনটারে আলাদা করে দিছি সেই ছেলেটাই আমারে উল্টো বের করে দিছে। ”

শ্বাশুড়ি মায়ের আহাজারিতে মনের ভেতরটায় সোমা এবং জামিলের জন্য খারাপ লাগা জেগে উঠল। সোমা শ্বাশুড়ির থেকে যে যত্নটুকু পেয়েছিল এর কিঞ্চিৎ পরিমাণও যদি আমি পেতাম তবে উনাকে আমি আমার মাথায় করে রাখতাম। আমার বাবা নেই সেই হিসেবে শ্বশুরকে বসাতে পারতাম বাবার আসনে। কিন্তু আপসোস যে যেটা পায় সে সেটার কদর করতে জানে না। সোমা সেই যত্নটুকুর মর্যাদা রাখতে পারেনি। আর জামিল পারেনি নিজের জান্নাতটাকে নিশ্চিত করতে। উল্টো পায়ে ঠেলে দিয়েছে।

জুনাইদ এবং আমি শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিজেদের সাথে থাকতে বলে দিলাম। আজ থেকে আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করার সিন্ধান্ত নিলাম। শ্বাশুড়ি মাথা নত করে রইলেন কেবল। হ্যাঁ, না কোনো বাক্য ব্যয় করলেন না। চোখ থেকে টপটপ করে তার পানি পড়ছে। এমতাবস্থায় জুনাইদ যখন উনাদেরকে উনাদের বংশধর আসার সুসংবাদ দিল তখন তিনি আমার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন। দু’হাত তুলে দোয়া করলেন আমাদের জন্য। সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল এর চেয়ে সুখী মুহূর্ত বোধহয় আর দ্বিতীয়টি হয় না। সেই সঙ্গে তিনি কথা দিলেন, যে আসবে সে ছেলে মেয়ে যেই হোক। তাকে তারা অতি যত্নের সহিত কোলেপিঠে করে মানুষ করবেন।

ভালো এবং খারাপ সময় দু’য়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের দিনগুলো কাটতে লাগল। শ্বশুর শ্বাশুড়ি মফস্বলের বাড়িতে আর আমরা দু’জন ঢাকায়। এ করে সময়গুলো একে একে অতিবাহিত হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম শ্বাশুড়ি আপত্তি করবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জুনাইদকে পইপই করে বুঝিয়ে দিলেন, উনার বউমা এবং নতুন অতিথির খেয়াল রাখতে। আমাদের যদি কোনো সমস্যা হয় শুনেছেন তাহলে জুনাইদের খবর আছে। সোমার একটা ছেলে হয়েছে। শুরু থেকেই একটা নাতির সখ ছিল শ্বাশুড়ির। কিন্তু খবর পেয়েও শ্বশুর শ্বাশুড়ি তাকে দেখতে যাননি। এমনকি সেদিনের পর আর খবরও নেননি। জামিলের করা কাজের কথা মনে পড়লে তিনি দোয়া করতে বসে পড়েন আল্লাহর দরবারে। তাদেরও আল্লাহ ছেলে দিয়েছে সেও যেন বড় হয়ে তাদের সাথে এমনটি করে। তখন তারাও বুঝবে কি করেছে। জুনাইদের সাথে আজ আমার মফস্বলে ফিরে আসার কথা। শ্বশুর শ্বাশুড়ি যাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলেননি তবে তারাও চান আমি আমার এমন দিনে যেন শ্বাশুড়ির কাছে থাকি। আগেরবার সোমার ব্যবহারের দরুন থেকেই সাহস করেননি তারা বলার। তাই দু’জন মিলে তাদের না জানিয়ে চলে এসে চমকে দেই। আমার বাড়ন্ত পেট নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বিধায় জুনাইদ সরাসরি গাড়ি ঠিক করে বাড়ি পর্যন্ত আসে। গাড়ি থেকে নেমে বাকিটা পথে আমাকে আগলে রাখেন শ্বাশুড়ি মা। উনার চোখেমুখে খুশি যেন উপচে পড়ছে। এর প্রায় মাসখানেক বাদে একদিন আমাকে প্রসব বেদনায় কাতরাতে দেখে শ্বাশুড়ি সেদিন হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছেন। নীলার পরামর্শে সেদিন নীলা এবং তার স্বামীসহ আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। জুনাইদের আসার কথা আরো দুদিন বাদে। গত সপ্তাহে ডাক্তার ডেট দিলেও কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি।অগত্যা তাকে ছুটি পিছিয়ে এ সপ্তাহে আসার সিন্ধান্ত নিতে হয়। যাতে এসে দু’দিন বেশি থাকতে পারে। কিন্তু ডাক্তারের দেওয়া সময় থেকে সাতদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আসে সেদিন, যে দিনটার জন্য দু’জন তুমুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম অথচ আজ আমরা দু’জন দুই জায়গায়। এমনি সময়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের দু’জনের জীবনকে রাঙিয়ে দিতে আগমন ঘটল নতুন অতিথি হিসেবে আমাদের মেয়ের। কান্নারত অবস্থায় নার্স তাকে বাহিরে নিয়ে গিয়ে আমার মা বোন এবং শ্বশুর শ্বাশুড়িকে দেখান। শ্বাশুড়ি নাতনি হওয়া সত্ত্বেও আজ বেজায় খুশি। ওই উনার বংশের প্রদীপ। উনার আসল উত্তরাধিকারী। শ্বশুর নাতনিকে কোলে তুলে তার কানের কাছে আজান দেন। কান্না থেমে যায় ছোট্ট মেয়েটার। ডাগরডাগর চোখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে দাদার মুখ পানে। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে জুনাইদ তাৎক্ষণিক ঢাকা ছেড়ে ছুটে আসে। মেয়েকে কোলে তুলে মন ভরে আদর করে। ঘুমন্ত মেয়েকে আমার কোলে তুলে দেয়। আমি মেয়েটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা একদম হুবহু তার বাবার মতো হয়েছে। এই নিয়ে যতবার তাকে দেখেছি ততবার আমার মনে হতে লাগল আমি যেন ছোট্ট আরেকজন জুনাইদকে দেখছি। জুনাইদ আমায় জিজ্ঞেস করল, ” তারপর বল আমার প্রথম সকাল থেকে আমার সন্তানের মা রূপে নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরে কেমন বোধ করছ? ”
মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম” একই প্রশ্ন যদি আমি তোমায় করি? তুমি কেমন বোধ করছ বাবা হতে পেরে? ”
জুনাইদ আমার নিকটে এগিয়ে এলো। কপালে অধর ছুঁইয়ে বলল, ” এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় সকাল। আমাদের অভাবের জীবনে সুখের ছোঁয়ায় ভরপুর করতে নিজের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে আমার মা। যেদিন জানতে পারি বাবা হতে চলেছি সেদিনের চেয়ে অধিক সুখীবোধ করছি আজ ওকে ছুঁতে পেরে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার প্রথম সকাল, আমার মায়ের আম্মু। ”

______________সমাপ্ত_________________

আমার প্রথম সকাল পর্ব-১২

0

#আমার_প্রথম_সকাল (১২)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
একজন মানুষ কতটা অসহায় হলে হাউমাউ করে কাঁদার মতো পরিস্থিতিতে উপনীত হয় তা আমার চেয়ে ভালো বোধহয় দু’জন জানে না। জুনাইদের পেছন পেছন গিয়ে দাঁড়াতে জুনাইদ আমাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। শুনেছি পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই। সেদিক থেকে জুনাইদ নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। যাদের জন্য নিজের সবটা উজাড় করে দিল তারা আজ তাকে এবং তার অর্ধাঙ্গীনিকে অপমান করে দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিল যার দরুন সেও দমিয়ে রাখতে না পেরে বাচ্চাদের ন্যায় কেঁদে দিল। সবচেয়ে আশ্চর্য হতে বাধ্য হলাম যখন জুনাইদ আমায় বলে উঠল, ” সকাল আমায় ক্ষমা করে দিও। ”
জুনাইদের ক্ষমা চাওয়ার কারণ জানতে জিজ্ঞেস করলাম, ” শান্ত হোন! আর ক্ষমা কেন চাইছেন? ”
” আমি তোমাকে চরমভাবে ঠকিয়েছি সকাল। যা ক্ষমার অযোগ্য। আমার জন্য আজও তোমাকে কতগুলো কথা শুনতে হলো। ”
” আমি কিছু মনে করিনি। তাছাড়া এগুলোতে এখন আর কিছু যায় আসে না আমার। আপনার ওপর তো অভিযোগের প্রশ্নই আসে না। আমার কষ্ট একটাতেই। তারা আপনার বাবা মা হয়েও আপনাকে বুঝল না। ”
সকল দূরত্ব গুছিয়ে জুনাইদকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছি। লোকটার দুর্দিনে পরবর্তী দিনগুলোতে এভাবেই পাশে থাকব বলে নিজে নিজের সাথে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। জুনাইদ হালকাবোধ করল কিনা জানি না তবে আমার নিজেকে বেশ হালকা মনে হলো।

আস্তে আস্তে আমাদের অভাবের দিনগুলো কাটতে লাগল। শুনেছি অভাব যখন দরজায় কড়া নাড়ে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। কিন্তু না কথাটা সর্বক্ষেত্রে সমান তালে প্রযোজ্য নয়। বরং এই অভাবটাই জুনাইদের সাথে আমার বৈবাহিক জীবনটাকে আরো মজবুত করে তুলেছে। সব ভুলে দু’জন নিজেদের মতো বাঁচতে শুরু করলাম। আগে পিছে কে আছে ভাবা বাদ দিলাম। জুনাইদ এবং তার সকাল, দু’জন নিজেদের জন্য বাঁচবে বলে সিন্ধান্ত নিল। সেদিনের পর থেকে ওদিকে চেয়ে দেখাটাও আমার জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। জুনাইদ স্বয়ং নিজেই বলেছে ওদিকটায় ফিরেও তাকানোর দরকার নেই। যেখানে গেলে আমাদের এতোটা ছোট হতে হবে সেখানে না গেলে আমরা কেউ মরে যাবো না৷ বরং গেলেই নিজেদের আত্মসম্মানের অপমৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়।

এতো কিছুর মাঝেও শ্বশুর মাঝে মাঝে আসেন এদিকটায়। ছেলের খোঁজ খবর নেন। টাকা পয়সা দিতে চান। কিন্তু জুনাইদ সেসবে ঘোর বিরোধিতা জানায়। সে এই বয়সে এসে বাবার থেকে কোনো টাকা নেবে না। শ্বশুর বোঝান, ‘এ টাকায় তার যথেষ্ট হক আছে। টাকা তো তার কামাই করা থেকে এসেছে। ‘ জুনাইদ তাতেও অস্বীকার জানায়। বোঝায়, ” রেখে দেন বাবা। আমি এখন যথেষ্ট সুস্থ সবল আছি। একটা না একটা ঠিক ব্যবস্থা করে নেবো। আপনারা অসুস্থ হলে এ টাকা তখন আপনাদেরই আগে লাগবে। ‘” শ্বাশুড়ি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। জানলে হয়তো তুলকালাম ঘটাতে দ্বিতীয়বার ভাববেন না। তবে শ্বশুর যে শ্বাশুড়ির এবং তার ছোট ছেলে ও ছেলের বউয়ের ওপর নারাজ সেটা বোঝা যায়।

জুনাইদ সুস্থ হয়ে উঠেছে। মফস্বলে পড়ে থাকলে ভালো কোনো চাকরির ব্যবস্থা হবে না বিধায় সে সিন্ধান্ত নিল ঢাকায় যাবে। এবার আর বিদেশে পাড়ি জমানোর কোনো ইচ্ছে তার নেই। সে জানে সে চলে গেলে আমি একদম একা হয়ে যাবো। আমার যেমন সে ছাড়া কেউ নেই তারও এখন আর সকাল ছাড়া কেউ নেই। জুনাইদের কাছে সকাল এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় মত্ত হওয়ার চেয়ে জরুরী আর কিছুই নয়। যেহেতু সে একজন শিক্ষিত এবং কর্মঠ পুরুষ মানুষ, ঢাকায় গিয়ে ভালো দেখে কোনো চাকরি নেবে। হয়তো বিদেশের মতো ভালো আয় রোজকার আসবে না সংসারে। তবে সুখী হতে হলে দু’জনের মধ্যকার দূরত্বটা অন্তত গুছবে।

জুনাইদ ঢাকায় যাবে বলে ব্যাগ গোছাচ্ছিল। আমি একে একে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে দিচ্ছিলাম। আমার মন জুড়ে আঁকড়ে ধরেছে একাকিত্ব। একা একা থাকব কি করে আমি এ বাড়িতে? জুনাইদ থাকতে ঘর থেকে আমাকে কোথাও বের হতে হয়নি। কেবল রান্নাঘর, কলপাড় এবং পুকুর ঘাট অব্ধি সীমাবদ্ধ থেকেছি৷ গত কয়েকদিন দুজনে যতটা সম্ভব বেশ ভালো সময় কাটিয়েছি। যার দরুন আমার সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে আসতে বাধ্য করিয়েছে জুনাইদ। হোক না সে খুব বেশি দূরে নেই। চাকরিটা হয়ে গেলে সপ্তাহে সপ্তাহে আসবে হয়তো। কিন্তু তবুও আমার নিকট এটাকেই অনেকটা দূরে বলে মনে হচ্ছে। আমাকে অন্যমনস্ক হতে দেখে জুনাইদ বলল, ” কি হয়েছে সকাল? কি ভাবছ? ”
” ভাবছিলাম এখানে একা একা কিভাবে থাকব? তুমি নেই চারপাশ জুড়ে কেবল শূন্যতায় ভরপুর। ”
জুনাইদ টিপ্পনী কাঁটল, ” বাহ্ আমাকে এখন থেকে মিস করা শুরু করে দিয়েছ দেখছি। ”
আমি লাজুক হাসলাম। পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে বললাম, ” আচ্ছা আমাকে নিয়ে গেলে হয় না? ”
” যাবো। তোমাকে নিয়েই যাবো। তবে এখন না। এখন নিলে কোথায় থাকব খাবো নিজেরই ঠিক নেই। তাই আগে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করে নেই। তারপর তোমাকে এসে নিয়ে যাবো। ”
শুনে মনটা আমার খুশিতে নেচে উঠল। আমার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখতে পেয়ে জুনাইদ বলল,
” আরেকটা ভালো খবর দেই তোমায়। ”
” কি খবর? ”
” জামাকাপড় গুছিয়ে নেও। তোমাকে মায়ের কাছে রেখে আসি আমানতস্বরূপ। সেই যে এলে আর তো যাওয়াই হলো না তোমার। তারা মা মেয়েও আমাকে দেখতে এলেন না আর। আমি নাহয় তাদের দেখতে যাব সঙ্গে তোমাকেও রেখে আসব। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে। ”
.

.
জুনাইদের কথা মতো পরদিন আমিও তৈরি হয়ে নিলাম মায়ের কাছে যাবো এই উদ্দেশ্যে। জুনাইদ ঠিক করল সে ঢাকা থেকে ফেরা অব্ধি থাকা হবে ওখানে। বাড়ি থেকে বের হব পথিমধ্যে শোনা গেল ওঘর থেকে শ্বাশুড়ির চিৎকার চেচামেচি। সোমা এবং শ্বাশুড়ির মধ্যে খুব রকমের তর্কাতর্কি চলছে। দুজনের কথার ধরনে বোঝা গেল সোমার বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে শ্বাশুড়ির সাথে তার যত বিপত্তি বাধছে। সোমা শ্বাশুড়িকে বলছে,
” নিয়ম মতো ছয়মাস হলে মেয়েরা বাপের বাড়ি যায়। আমার সাত মাস চলতেছে। এই সময় তো সব মেয়েরা বাপের বাড়িতেই থাকে। তাতে আপনার এতো আপত্তি কিসের? যেখানে আপনার ছেলে মানতেছে?”

সোমার কথার জবাবে শ্বাশুড়ি রাগের মাথায়ও তাকে স্নেহসূলভ শাসনের সহিত বললেন,
” তোমার পেটে আমার বংশের প্রথম বংশধর। আমি আমার কাছে রাখব তারে। তুমি কোথাও যাইতে পারবা না এই কইলাম। ”

তাতেই সোমা রেগেমেগে আগুন। চেচিয়ে বলল,” আপনারে কি আল্লাহ একটাই ছেলে দিছে? ছেলে তো আপনার আরেকটাও আছে। যান তার কাছে যান। তারাও তো যাচ্ছে। গিয়ে তাদেরকে আটকান। আমার এইখানে কি? ”

” তার কাছে যাবো মানে? এই বাড়ি আমার, এই বাড়ির সিন্ধান্ত সব আমার। আমি কই থাকব না থাকব সেটা কি তোমারে বলতে হইব? ”
” আমারে বলবেন না তো কারে বলবেন? খাচ্ছেনটা কার? আমার জামাইরটা খান আবার আমারে ধমক দেন কোন আক্কেলে? ”
শ্বাশুড়িও এবার সমান তালে চেচিয়ে উঠলেন, ” ওই তুমি আমারে খোটা দেও হ্যাঁ? আমি খাই আমার ছেলেরটা আর আমার জামাইরটা। তোমার বাপের বাড়ি থেকে তো আর আনো না। ”
” আমার বাপেরবাড়ি থেকে কম আনছি? কম গিলছেন? আমি আসার আগেই আমার বাপ মায় কত কিছু পাঠাই দিল। সেসবের কোনো দাম নাই? না-কি পেটে চালান দিতে পাইরাই সব ভুইলা গেছেন? ”
” হ তোমার বাপের বাড়ি থেইকা এমন কি দিছে? দেওয়ার ভয়ে মেয়ে বিদায় করছে আবার বড় বড় কথা কও। ছোটলোকের জাত কোনহানকার! ”
” ছোটলোক আমি না ছোটলোক হইলেন গিয়া আপনারা। খাওয়ার পরপর সব ভুলে গেছেন। অকৃতজ্ঞ, হিংসুক বেটি মানুষ। আপনার ছেলেও তো কম দেয় না। এখন নাহয় আমার বাপের বাড়ি থেকে দেয় না৷ এখন খান কারটা। আরেকজনও তো আছে। কই তার কাছে তো যাইতে পারেন না। ”
” ওই এত খোটা দেও কার ছেলেরটা খাই? তোমার জামাই হওয়ার আগে সে আমার ছেলে মনে রাইখ। বাপ মা কিছু শিখাই পাঠায় নাই কেমনে বড়দের সাথে কথা বলা লাগে? বেয়াদব, কম আক্কেল। ”
” আপনারে শিখায় নাই? আপনারে তো খালি শিখাইছে কেমনে ছেলের বউদের জ্বালাইতে হয় সেসব। একজনরে তো ঘর থেকে পার করছেন। এখন আমার পিছে লাগছেন। ”
” আজকে আসুক জামিল৷ যদি এর একটা বিহিত ওর না করে না? ”
” হ যান যান। আমিও দেখবোনে কে কার বিহিত করে। ”

শ্বাশুড়ি এবং বউমা কেউ কারোর চেয়ে কম না। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন তারা। যা আসছে একজন আরেকজনকে বলে যাচ্ছে,আশেপাশের পরিবেশ বিবেচনা না করেই। শ্বাশুড়ির মেয়ে তুল্য বউমা কয়দিনের মাথায় হয়ে গেল ছোটলোকের জাত। সোমাও কম না। বড়ছোট কিছু মানছে না একাধারে শ্বাশুড়িকে সেও বলে যাচ্ছে। আমি যতটুকু সহ্য করেছি সোমার মাঝে তার বিন্দু মাত্র ধৈর্যটুকুও নেই। বিয়ের মাসখানেকের মাঝে জুনাইদ চলে যাওয়ার পরপরই শুরু হয় আমার ওপর শ্বাশুড়ির চক্ষুশূলের ন্যায় আচরণ। যত যাই বলত রাগ উঠলেও কিছু বলতে পারতাম না। কারণ একটাই। আমার বাবা বাড়ির অবস্থান ততটা স্বচ্ছল না। মায়ের কাছে নালিশ গেলে তিনি সব সময় নত হতেন এবং সব জেনেও আমাকে তর্ক করতে নিষেধ করে দিতেন। তাই আমার হয়ে লড়বার মতো দুকূল জুড়ে কেউ নেই। তারপরেও আমার দোষের কোনো শেষ ছিল না শ্বাশুড়ির কাছে। স্বামী যাও দু চারটে আমার হয়ে বলত তাও ছিল আমার জন্য বহুত। তাতেও শ্বাশুড়ি সারাক্ষণ খোঁটার ওপর রাখতেন, আমি নাকি তার ছেলেকে তাবিজ কবজ করে বশ করে রাখছি।

জুনাইদ আর আমি ঘর থেকে দুজনের সব কথা শুনছিলাম। জুনাইদের মধ্যে কোনো প্রকার হেলদোল দেখা গেল না। রওয়ানা দেওয়ার জন্য তাড়া দিতে বলল, ” চল সকাল। আমাদের এসব শুনে কাজ নেই। এসব যার যার নিজস্ব ব্যাপার। আমি না আসা পর্যন্ত তুমিও এখানে আসিও না। নাহলে সোমার কিছু হয়ে গেলে তোমাকে ভুগতে হতে পারে। ”

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

আমার প্রথম সকাল পর্ব-১১

0

#আমার_প্রথম_সকাল (১১)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
নিয়তি বড্ড করুণ। যাদের জন্য উজার করে সব করা হয় খারাপ সময়ে সে মানুষগুলো সবার আগে পল্টি নেয়। পর তো পরই হয় কিন্তু আপনগুলো এর চেয়ে বেশি স্বার্থপর হয়। তবে রক্তের সম্পর্কের বাহিরেও একটা সম্পর্ক থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এমনটিও দেখা যায় রক্তের সম্পর্কের বাহিরের মানুষেরা আমাদের হয়ে যেসব করে সেসব রক্তের সম্পর্কের আপনজনেরাও করতে পারে না। জামিলের পড়াশোনা, চাকরির পূর্ববর্তী সময়ের সকল ভরণপোষণের দায়িত্বের ভার যে ভাইটি নিয়েছিল আজ সে ভাইকেই জামিল নিজের স্বার্থের জন্য ত্যাগ দিল। ছোট ছেলের কথার মতো শ্বশুর শ্বাশুড়ি পরদিন আমাদের সংসার আলাদা করে দিলেন৷ তিনি এসে যখন আলাদা হওয়ার জন্য বলছিলেন, তখন পুরোটা সময় আমি কেবল জুনাইদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম এরপর কি করবে জুনাইদ? কোনো প্রতিবাদ তো করলই না বরং পুরোটা সময় লোকটা মাথা নিচু করে স্তব্ধ হয়ে ছিল। শ্বাশুড়ি চলে যেতে সে মুখ তুলল। তখন তার বদনে ভেসে উঠেছিল ব্যর্থতা এবং একরাশ হতাশা।

আলাদা ঘর, আলাদা হাঁড়ি পাতিল, আসবাবপত্র নিয়ে আমাদের দিনগুলো একভাবে চলতে থাকল। সংসারে আমার ওপর বাড়তি চাপ নেই। দুটো মানুষের খাবার আর কতটুকুই বা লাগে! ভালো মন্দ নাহয় নাইবা খেলাম। ভাত, ডাল এবং ভর্তায় বেশিরভাগ দিনগুলো আমাদের কাটতে লাগল আর জুনাইদের জমানো সামান্য টাকাগুলোয় তার চিকিৎসার খরচ চলতে থাকল। শ্বাশুড়ির অযথা চিৎকার চেচামেচি, জা’য়ের সেবা করা থেকে রেহাই পেলেও রেহাই পেলাম না জুনাইদের হতাশাগ্রস্ত চেহারা দেখা থেকে৷ বাবা মা এবং বাকি সকল সদস্যকে নিয়ে আগে যে লোকটা সামান্য ভর্তা, ডাল, শাক সবজি খেয়েও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল, আজ সে লোকটার চেহারা জুড়ে প্রকাশ পাচ্ছে হতাশার লেশ। আমার কাছে প্রকাশ করতে চায় না সেসব কথা কিন্তু আমার সামনে থাকে বলেই কিনা জানা সম্ভব হয়। দিনকে দিন তার চেহারার লাবণ্য কমে গিয়ে চোখের নিচের কালো দাগগুলো ফুটে উঠতে দেখা যায়। শারীরিক দিক থেকে সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম হলেও আমি সক্ষম হচ্ছি না তাকে মনের দিক থেকে সবল করে তুলতে।

শ্বশুর প্রতিদিন নিয়ম করে দুই থেকে তিনবার এসে বড় ছেলের খোঁজ খবর নিয়ে যান৷ টাকা পয়সা কিংবা খরচাপাতির দরকার পড়লে যেন তাকে জানায় জুনাইদ সেসব ব্যাপারেও আশ্বাস দেন। জুনাইদের নিজের বাবা মা দু’জনের নামে করা দুটো দোকান আছে। এগুলো জুনাইদ অতি রঞ্জিত আবেগের বসে প্রথমবার চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরপর পাওয়া বেতনসমূহ জমিয়ে কিনেছিল। সেসব এখন ভাড়ায় চলে। মাস শেষে যে রোজকার আসে সেগুলো শ্বশুর নিজের কাছেই রাখেন। এদিকে শ্বাশুড়িকে প্রায় দেখা যায় ছোট বউয়ের গুণগান গান সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে। বড় ছেলের কি অবস্থা সেসব দিনে এসে একবার দেখে গেলেও তেমন কিছুই বলেন না। জুনাইদও মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে করুণ চোখে। মায়ের মন গলে না। ছেলেকে কখনো তিনি বলেন না, ” আয় বাবা আমার সাথে দু মুঠো ভাত খাবি! ”

জুনাইদ আমাকে প্রায় বলে, ” সকাল আমার বাবা মা বদলে গেছে সকাল। উনারা আগে মোটেও এমন ছিল না। তুমি উনাদের ভুল বুঝিও না। ”
আমি কেবল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকি জুনাইদের দিকে। সারাজীবন শুনে এসেছি ছেলেমেয়েদের শত অবহেলা সহ্য করেও বাবা মা কখনো নালিশ করে না। তাদের বদদোয়া, অভিশাপ দেন না। এদিক থেকে আমার সামনের ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত। জুনাইদ যত যাই হোক বাবা মা’কে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। জামিল তাকে আলাদা হতে বলেছে এ নিয়ে সে বিন্দুমাত্র রাও করল না আর না করল কোনো অভিযোগ। যেন সে আগেই জানত এমনটি হবেই। তার যত কষ্ট বাবা মাকে ঘিরে।

জুনাইদ এখন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ হলেও হাঁটতে সামান্য কষ্ট হয়। এরজন্য এখনো তাকে আমি বেশিদূর হাঁটতে যেতে দেই না। সব কাজ শেষ করে দু’জন একসাথে বাড়ির ভেতরটায় হাঁটাহাঁটি করি যাতে জুনাইদের হাঁটাটা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়।
রান্নাবান্না শেষ করে জুনাইদের কাছে আসলাম৷ কিছু লাগবে কি-না জিজ্ঞেস করতে। জুনাইদ আমাকে বলল, ” সকাল একটা কাজ করে দিতে পারবে? ”
” বলুন কি করতে হবে? ”
” তেমন কিছু না শুধু এতটুকু জেনে আসো বাবা মা আসলে জামিলের সাথে কেমন আছে, কেমন করে থাকছে? ”
জুনাইদের মুখের ওপর কিছু বলতে গিয়েও লোকটার চেহারা দেখে মায়া লাগল। থাক না। এতটুকু জেনে যদি তার আত্মতৃপ্তি বাড়ে তাহলে তাই হোক। অগত্যা আমাকে উঁকি মেরে দেখতে হলো ও ঘরের ভেতরটায়। কিন্তু ভেতরে উঁকি দিতে সোমার চোখে ধরা পড়ল সেটি। শ্বাশুড়ি সেসময় সোমার পাশে বসা ছিল। আমি দেখলাম তিনি বেশ প্রফুল্ল চিত্তে সোমাকে ফল কেটে দিচ্ছিলেন সাথে খোশগল্প করে তাকে যতটা পারছেন তাকেও প্রফুল্ল রাখছেন। আমাকে দেখে সোমা শ্বাশুড়ির সামনে বলে উঠল, ” ভাবী কি কিছু বলতে আসছেন? ”
সোমার কথা শুনে শ্বাশুড়ি এদিকে তাকালেন। বললেন, ” কী ব্যাপার সকাল? তুমি এখানে কি কর? ”
শ্বাশুড়ির প্রশ্নে কি বলব তাৎক্ষণিক ভেবে পেলাম না। তবুও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না যাওয়ার জন্য বললাম, ” আমি আসলে জানতে এসেছিলাম মা আপনারা কি দুপুরে খেয়েছেন? ”
” কেন ভাবী আপনার কি মনে হয় আমরা উনাদের না খাইয়ে রাখব? ” সোমার জবাব এলো।
” আমি সেটা বলিনি সোমা। খোঁজ খবর নেওয়া যেতেই পারে তাই না? ”
” খুব উদ্ধার করে ফেলছেন খোঁজ খবর নিয়ে ভাবী। খোঁজ খবরের নামে যে আপনি নজর রাখতে এসেছেন আমরা কি খাচ্ছি দাচ্ছি সেসবে। মনে হিংসা তো এখন আসবেই শত হলেও আমরা আপনাদের চেয়ে ভালো থাকছি, খাচ্ছি। বুঝি না মনে করছেন? ”
” বাদ দেও সোমা। ছোটলোকের জাতের আবার স্বভাব বড়োলোকি হবে আশা কর কেমনে? ”
সোমা শ্বাশুড়ির কথায় বেশ মজা পেল। শ্বাশুড়িকে সায় দিতে বলল, ” দেখেন ভাবী, আজকে যা করছেন, করছেন। আর যেন না দেখি আপনারে আমাদের আশেপাশে চোরের মতো এমনে ঘুরঘুর করতে। ”
শ্বাশুড়ি নাহয় মুরুব্বি মানুষ, জুনাইদের মা, তাকে কিছু নাই বলা যাবে। কিন্তু সোমাকে না বলে পারলাম না।
” দেখ সোমা তোমার জিনিসে নজর দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার কোনো কালেও ছিল না। যদি দেওয়ারই হতো তাহলে সে কবেই দিতে পারতাম। ”
সোমাকে বলেও ক্ষ্যান্ত দিতে পারিনি আজ। শ্বাশুড়িকেও কয়েকটি কথা বললাম। এরপর যা হবার পরে দেখা যাবে। ” আর মা আপনাকেও বলে রাখি আমি ছোটলোকের জাতের হলেও খারাপ উদ্দেশ্যে আপনাদের কাছে আসি নাই। খোঁজ খবর নেওয়া যদি ছোটলোকি হয় তাহলে সেটা আপনার কাছে হলেও হতে পারে। নাহলে কোনো মা নিজের ছেলের খারাপ দিনে তাকে এভাবে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে বলে আমার জানা ছিল না। ”

শ্বাশুড়ি আমার কথায় এবার রেগে গেলেন। তেড়ে এসে এবার যা খুশি তাই বলতে শুরু করলেন। ” বাঁজা মেয়ে মানুষের এতো কথা কিসের? নিজে তো পারলই না বাচ্চার মুখ দেখাইতে এখন আমার মেয়ের মতো লক্ষী বউটার দিকে নজর দেওয়া শুরু করছে। ওর বাচ্চার যদি কিছু হয় না হতচ্ছাড়ি? সবে তো ঘর ছাড়া করছি তোরে তখন বাড়ি ছাড়া করতেও সময় নিব না আমি! ”
উনার চেচামেচি শুনে বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেলেন। জুনাইদ পর্যন্ত পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সব শুনে সে স্তব্ধ হয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। তার অনুপস্থিততে আমাকে কত কিছু সহ্য করতে হয় বুঝতে এতটুকুও অবকাশ রইল না। সবার সামনে নিজের অর্ধাঙ্গীনিকে এভাবে অপমানিত হতে দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখল। অথচ তাকে দেখেও শ্বাশুড়ি চুপ করলেন না। বরং সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে নালিশ করা শুরু করে দিলেন, ” তোর বউরে ডাক দিয়ে দিস জুনাইদ। সোমার যদি কিছু হয় তাহলে কিন্তু ওর কপাল থেকে এ বাড়ির ভাত তো উঠবই সাথে তোর বউরে জেলের ঘানিটানাতেও কিন্তু আমি মানা করতাম না। ”
শ্বাশুড়ির সম্বোধনে জুনাইদ স্তব্ধ। আগে তাকে কতটা খাতির করতেন তিনি। কখনো তুমি, বাপ, আব্বা, বাবা ছাড়া ডাকতেন না। আজ তার টাকা কামাইয়ের সামর্থ্য নেই। তাই সেসব সম্বোধন কোথাও উবে গেছে। তার পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে তুইতোকারি। তুই করে ডাকার মাঝে সাধারণত দু’টো অর্থ বহমান৷ একটি আদরের ডাক যেটা সন্তানদের বাবা মা আত্মীয়স্বজন স্নেহভাজন স্বরুপ ডাকেন অন্যটা ডাকা হয় যাকে মানুষ অপছন্দ করেন তাকে। যারা তাদের চোখে নিন্মমানের মানুষ হিসেবে অধিক পরিচিত। জুনাইদের সে হিসেবে বুঝতে বাকি নেই। তার কঠিন দিনগুলো যেন আরো কঠিন হয়ে উঠছে। এতোদিন নিজেকে খুবই হতভাগিনী মনে হতো। বুঝি শ্বশুরবাড়ি সুখ আমার কপালে আল্লাহ রাখেননি৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার চেয়ে বড় হতভাগ্য জুনাইদের। যাকে তার জন্মদাত্রী জননী তিরস্কার করতে ছাড়েন না। সেখানে আমি কোথাকার কে? উনার থেকে ভালো আচরণ আশা করাটাও অন্যায় হবে বোধহয়।

জুনাইদ সব মিলিয়ে আজ চুপ করে থাকল না। মায়ের কথায় জানতে চাইল, ” মা আমার বউ কি করেছে, যার জন্য এতো চেচামেচি করে বাড়ি সুদ্ধ লোক তো জড়ো করলেনই আবার জেলে পাঠানোর হুমকি পর্যন্ত দিতে ছাড়লেন না? ”
” কি করে নাই তোর বউ? তোর বউরে গিয়াই জিগা পারলে.। দেখে শুনে ছোটলোক একটারে ঘরে তুলছি। ”

জুনাইদ আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিল৷ তার চোখে আমি স্পষ্ট পানি টলমল করতে দেখলাম। এই বুঝি তার কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু পুরুষদের তো কাঁদতে হয় না। তাই সেও নিজের দুর্বলতাকে লুকাতে চলে গেল ঘরের ভেতর। এতো অপমান আসলে সহ্য করাও যায় না। তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই ঠিকই কিন্তু তার পাশে থাকা স্ত্রী হিসেবে আমার প্রধান এবং অন্যতম কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। জুনাইদের পেছন পেছন আমিও ঘরের ভেতর চলে গেলাম। ঘরে যেতেই…..

চলবে…..