Saturday, August 16, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 175



আমার প্রথম সকাল পর্ব-১০

0

#আমার_প্রথম_সকাল (১০)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
গতকাল থেকে জুনাইদ আমাকে একটিবারের জন্যও ফোন করেনি। এমনকি আমি করলেও সে তোলেনি। কারণটা গতকাল রাতে অস্পষ্ট থাকলেও এখন পুরোপুরি পরিষ্কার। এখান থেকে যাওয়ার পথে জুনাইদ রোড এক্সিডেন্ট করেছে। গতকাল থেকে হাসপাতালে জরুরী বিভাগে ভর্তি আছে, জ্ঞান ফেরেনি এখনো। সংবাদটি কর্ণকুহরের নিকট পৌঁছান মাত্র গোটা পৃথিবী আমার নিকট ঝাপসা হতে লাগল। শ্বাশুড়ি আমাকে উনার ছেলের থেকে আলাদা করতে চাইলেন এদিকে আল্লাহও বোধহয় উনার চাওয়াটা পূর্ণ করতে চললেন। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় মেঝেতে। শব্দ শুনে মা ছুটে আসেন পাকের ঘর থেকে। আমাকে মেঝেতে বসে পড়তে দেখে তিনি বারংবার জিজ্ঞেস করতে থাকেন, ” কি হয়েছে সকাল? এভাবে বসে গেলি কেন? ”
” তোমার জামাই এক্সিডেন্ট করেছে। ” এতটুকু বলা মাত্র চোখের সামনে সবটা ঝাপসা হয়ে গেল। জ্ঞানহীন হয়ে ঢলে পড়লাম মায়ের কোলে। শুধু শুনতে পেলাম আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
.
যখন জ্ঞান ফিরল নিজেকে আবিষ্কার করলাম বিছানার উপর। ছোটবোন পাশে বসে হাত পাখার সাহায্যে বাতাস করছে। মা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছেন। কথার ধরন শুনে বুঝলাম সেটা শ্বাশুড়ির ফোন ছিল। মা বলছিলেন,
” বেয়ান কষ্ট করে হাসপাতালের নামটা বলেন। ”
শ্বাশুড়ি কান্নারত অবস্থায় হাসপাতালের নাম বলে বললেন, ” আসেন দেখে যান আমার লাশের মতো পড়ে থাকা ছেলেটারে। আপনার মেয়েটা আমার ছেলেটারে শেষ করেই ছাড়ল। আজ আমার কাছে থাকলে এমন কিছুই হইতো না।”
মা শান্ত স্বরে বিনয়ের সহিত বলল,” বেয়ান শান্ত হন। আল্লাহর কাছে দোয়া চান। এখন এসব বলবেন না দয়া করে। ”
শ্বাশুড়ি এরপর আর কিছু বললেন না। সেভাবেই ফোন রেখে দিল। এরপর মা’কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাসপাতালের দিকে। ছোটবোনকে বাড়িতে রেখে গেলাম। মায়ের ফিরতে দেরি হলে পাশের বাড়ি থেকে ওর বান্ধবীকে নিয়ে যেন থাকে বলে গেলেন মা।

জুনাইদের ফোন পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে রাস্তাতে। বিপদ দেখে লোকজন ছুটে এসে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। পরিবারের কাউকে জানানো হয়নি। কল লিষ্টের প্রথমে আমার নাম্বার পেয়ে আমাকে ফোন করা হয় আগে। কিন্তু আমার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়ায় শ্বাশুড়ির নাম্বারে ফোন করা হয়। এতে করে জুনাইদের পরিবারের কানে ততক্ষণে খবর পৌছে যায়। জুনাইদের নাম্বার থেকে ফোন আসায় যখন পুনরায় ফোন করি তখন জুনাইদকে নিয়ে আসা একজনের কাছ থেকে জানতে পারি এসব কথা। শ্বশুর শ্বাশুড়ি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান হাসপাতালের দিকে। জুনাইদকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। আজকের মধ্যে জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনার কথা ডাক্তার বলে গেছেন। এদিকে শ্বাশুড়ি জুনাইদের পাশে কাউকে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। বসে রইলেন ছেলের শিহরে, কখন তার জ্ঞান ফেরে এ অপেক্ষায়। পুরো একটা দিন হাসপাতালে জুনাইদের সুস্থতর লক্ষ্যে পড়ে রইলাম। শ্বাশুড়ি নিজেও বাড়ি গেলেন না। আসার পর থেকেই দেখেছি শ্বশুর একা একা ছোটাছুটি করছেন। সঙ্গে জামিল থাকলে একটা কথা ছিল সেও নেই। আমি শিক্ষিত মেয়ে। মফস্বলের সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। তাই কমবেশি জ্ঞান আমিও রাখি। শ্বশুরকে অনুরোধ করলাম, ” আপনি গিয়ে বিশ্রাম করুন। আমি দেখছি। ”
শ্বশুর আমার নেকাবে আবৃত মুখের দিকে তাকালেন.।
” পারবা তুমি? ”
” চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? ”
এরপর তিনি মৌনতা বজায় রাখলেন। পুরো একটা দিন হাসপাতালে কেটে গেল আমার। মাঝে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে বাড়িতে যেতে বলেছিলাম। শ্বাশুড়ি আজ আর আমার কথায় দ্বিমত পোষণ করলেন না। মেনে নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। গতকাল আসার পর থেকে একটিবারের জন্যও তিনি আমায় উনার ছেলের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেননি। যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ তিনিই ছিলেন। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও সরতে চাননি।

আশ্চর্যজনকভাবে পরদিন উনি উঠে যেতেই জুনাইদের জ্ঞান ফেরে। চোখ খুলতেই সে আমাকে দেখতে পায় আগে। হয়তো বলতে চায় আমি এখানে কি করছি?কিন্তু কণ্ঠস্বর অব্দি সে শক্তিটুকু মেলে না। থামিয়ে দিয়ে আমি বলে উঠলাম, ” আপনার কিছু হয়নি। একদম ঠিক আছেন আপনি। ”
জুনাইদ তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক নয়নে। আমি বললাম,
” আমি চলে এসেছি আপনার কাছে। আপনার চিন্তা দূর করতে। একদম চিন্তা করবেন না। আমি আপনার প্রথম সকাল। ”
জুনাইদ পলক ফেলল৷ শ্বাশুড়ি ফিরে আসেন ইতিমধ্যে। আসা মাত্র তার কানে খবরখানা পৌঁছে গেছে। তিনি বাহির থেকে ছুটে এলেন। আমাকে জুনাইদের সাথে দেখে ধমকে উঠলেন, ” সর তো। দেখি আমাকে দেখতে দাও আমার ছেলেকে। ” বলে তিনি ফের কেঁদে দিলেন।
উনার কথা মতো সরে গিয়ে বললাম, ” মা হাসপাতালে এভাবে কাঁদতে ডাক্তার নিষেধ করেছে। নাহলে রোগীর সমস্যা হয়। ”
” বেশি বুঝো তুমি? মায়ের আবেগ তুমি কি বুঝবা? মা হইছো কখনো? ”
আজ আর চুপ করে থাকতে পারলাম না উনার মুখের ওপর বলে দিলাম, ” আল্লাহ চাইলে অবশ্যই আমি মা হলেও হতে পারি। শুধু দোয়া করেন আপনার ছেলে যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়। ” উনাকে কথাটা বলে একরাশ মনঃকষ্ট নিয়ে বেরিয়ে এলাম জুনাইদের কেবিন থেকে। বের হওয়ার সময় খেয়াল করলাম জুনাইদ করুণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার গমন পথে। বাহিরে এসে দেখতে পেলাম শ্বশুর একা বসে আছেন। সকাল থেকে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে ঘামে ভিজে একেবারে জুবুথুবু হয়ে আছেন। ছেলের চিন্তায় মুখটা শুকিয়ে পাংশুটে ধারণ করেছে এই অল্প সময়ের মাঝে। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ” জ্ঞান কি ফিরেছে জুনাইদের? ”
” জ্বি! ফিরেছে। ”
উনার চেহারা দেখে সামান্য মায়া লাগল। শত হলেও তিনি জুনাইদের বাবা। এ বয়সে এসে নিজের শারীরিক অবস্থার কথা তোয়াক্কা না করে ছেলের জন্য তিনি একা একা দৌড়ঝাঁপ করছেন। জুনাইদের জায়গায় উনি থাকলেও হয়তো জুনাইদ এভাবে দৌড়াত। বললাম, ” আপনি তো গতকাল থেকে কম দৌড়ঝাপ করলেন না, ঠিক মতো খেয়েছেন দুপুরে? ”
” খেলাম আর কোথায়? ছেলেকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখলে কোনো বাবা মা কি খেতে পারে? তোমার শ্বাশুড়িও খেতে পারে নাই। আমাকে বারবার বলতেছিল তাড়াতাড়ি চলেন। ছেলেটার কাছে যাই। সকাল বুঝে কিছু? ওর এতো কিছু খেয়াল থাকবে না। ”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ” আপনার ছেলে আগের চেয়ে এখন অনেকটা ভালো আছে। গিয়ে দেখে আসুন। তারপর দু’জন মিলে খেয়ে নিন নাহলে আপনারাও অসুস্থ হয়ে যাবেন যে। ”
” তোমার মা কই? উনি খাবেন না? ”
” মা’কে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ছোটবোন আবার একা তো। ”
.

.
সপ্তাহখানেক চিকিৎসা চলার পর জুনাইদ খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠে। কথাবার্তা আগের মতো বলতে পারলেও শারীরিক অবস্থা এখনো নাজুক অবস্থা। হাঁটাহাঁটিতে বেশ কষ্ট হয়। গত কয়েকদিন জুনাইদকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই কষ্ট করে হলেও হাসপাতালে রয়ে গেলাম। মাঝে বেশ কয়েকবার মায়ের বাড়ি গিয়েছি। শরীরেরও একটা বিশ্বামের দরকার আছে ভেবে জুনাইদ নিজে থেকেই আমায় পাঠিয়েছে। তবে রাতে জুনাইদের সাথেই থেকে গেছি। চাইলেই শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া যেত। কিন্তু জুনাইদ ও বাড়ির মুখো হতে দেয়নি আমায়। শ্বাশুড়ি নিজেও মুখ ফুটে বলেননি একটিবারের জন্যেও। জুনাইদকে আজ এক সপ্তাহ পর রিলিজ দেওয়া হয়। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আজও আমায় মায়ের কাছেই চলে যেতে হবে। চিন্তিত বোধ করলাম এই ভেবে যে, খালার বলে যাওয়া কথাগুলো যে সত্যি, মা নির্ঘাত বুঝে যাবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে শ্বাশুড়ি বলে উঠলেন, ” সকাল তুমি কই যাও? ”
” কেন মা? যেখানে পাঠিয়ে দিছো সেখানেই তো যাবে। ” জুনাইদ জবাব দিল।
” তো তোরে দেখবে কে? স্বামী অসুস্থ এমন অবস্থা বুঝতে পেরে বাপের বাড়িতে যাও কোন আক্কেলে? এমনে আবার নিজেরে আমার ছেলের বউ দাবী করবা? ”
” ঠিকই তো ও এখানে থাকবে কোন আক্কেলে? ওকে তো আপনি নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন বলেছেন আর যেন না নিয়ে আসি। এখন দরকার হতে আপনি নিজেই ওরে ডাকেন কিভাবে? এটা ঠিক না মা। এতদিন তো এই অধিকারবোধ থেকে ও কম কষ্ট করেনি। ”
জুনাইদকে এবার ধমকে উঠলেন শ্বাশুড়ি, ” তুই চুপ থাক। স্বামী অসুস্থ হইলে স্ত্রীদের স্বামীর সেবা করা কর্তব্য। ”
অগত্যা আমাকেও যেতে হলো যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি সে বাড়িতেই। এ যাত্রায় আল্লাহ রহম করেছেন। মনে মনে মায়ের কথা ভেবে শুকরিয়া আদায় করলাম।

জুনাইদকে ডাক্তার বিশ্রামের জন্য অনেক লম্বা সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ঔষধ পত্র রোজকার নিয়ম মাফিক মতো চলছে। জামিল সোমাকে নিয়ে ব্যস্ত তার এতদিকে তাকানোর সময় নেই। এদিকে দুর্ঘটনার কারণে জুনাইদের চাকরিটা চলে গেছে। সংসারের ভার বহন করার দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে জামিলের ওপর। জুনাইদ কর্মঠ হলেও বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা ভালো না। ব্যাংকে সামান্য কিছু জমানো টাকা আছে সেসব দিয়ে তার চিকিৎসার খরচ চলছে।
জুনাইদের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে সবার আচরণ বদলে যেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি দরকার ছাড়া তেমন একটা কথা বলছেন না আগের মতো। দিনে দুই একবার করে এসে দেখে যাওয়া অব্ধি সীমাবদ্ধ থাকছেন। খাওয়া দাওয়ার প্রতি জুনাইদের সখ আগে থেকেই কম। বর্তা, ডাল রাখতে হয় ওর প্রতিদিনকার খাবারে। জুনাইদ এতেই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খায়। সোমাকে নিজের ঘরের বাহিরে এখন আর দেখা যায় না। শ্বাশুড়িকে দেখি ভালো রান্নাবান্না হলে আগে ওর পাতে তুলে দেন। একদিকে ও জামিলের বউ অন্যদিকে সোমা গর্ভবতী। রাজ কপাল যাকে বলে। এদিকে সোমাকে যতটা প্রাধান্য দেন শ্বাশুড়ি ততটা প্রাধান্য তিনি নিজের ছেলে অর্থ্যাৎ জুনাইদকেও দেন না। সবার খাওয়া শেষ হলে জুনাইদ আর নিজের জন্য খাবার নিয়ে নিজেদের ঘরে যাই। জুনাইদ বুঝতে পারে সবই। কিন্তু নিজের দুর্বলতার কারণে চুপচাপ সহ্য করে যায়।

জামিল আজ সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকে ফিরে এসে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে বললেন, ” মা আমি সোমাকে নিয়ে আলাদা থাকতে চাই। ”
শুনে শ্বশুর শ্বাশুড়ি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন.। ” কেন? আলাদা কেন হতে হবে তোদের? ”
” এতো বড় সংসার আমার একার পক্ষে টানা সম্ভব নয়। ”
শ্বশুর কিয়ৎক্ষণ মৌনতা বজায় রাখলেন। শ্বাশুড়ি জামিলকে বোঝালেন। কিন্তু তার এক কথা। সে থাকবে না এক সাথে। এমন পরিবেশে নাকি সোমার সমস্যা হয়। সোমার সমস্যা মানে তার বাচ্চার সমস্যা। সবার জন্য খরচ করতে গেলে সে সোমাকে ভালোমন্দ এনে খাওয়াতে পারে না। শ্বাশুড়ি থেমে যেতে শ্বশুর বললেন, ” ঠিক আছে। তাহলে জুনাইদকে আর সকালকে আলাদা করে দেই। ওরা দু’জন দুজনের মতো থাক। জুনাইদের ইনকাম নাই এজন্য এখন ওরে তোর আর তোর মায়ের দরকার হবে না স্বাভাবিক। ”
জামিল বিরক্তি নিয়ে বলল, ” তারজন্য কি ভাইয়ার খরচ এখন আমারে চালানো লাগবে? ভাবীরে বলেন তার বাপের বাড়ি থেকে এনে দিতে। মানুষ নিজের জামাইর জন্য কত কিছুই করে। ভাবী বুঝে পারে না? ”

” তোর পড়াশোনা থেকে যাবতীয় খরচ একসময় তো ওই বহন করেছিল। ওকে অন্তত সুস্থ হতে দে তারপর নাহয়..” শ্বাশুড়ি কথাগুলো বলতেই জামিল কড়া গলায় বলল, ” সে বড় তাই সে করছে। বড়দের এসব একটু আধটু করাই লাগে। তারমানে এই না আমি নিজের ভবিষ্যত না ভেবে তার পেছনে সব খরচ করব। উনার তো আর বাচ্চাকাচ্চাও নাই ভবিষ্যতের চিন্তাও নাই। ”

আড়াল থেকে সব শুনলাম৷ শ্বশুর শ্বাশুড়ি জামিলের কথার ওপর এরপর আর কোনো কিছুই বললেন না। তাদের নিশ্চুপ থাকা প্রমাণ করে দিল, বেকার ছেলেরা সত্যিকার অর্থেই পরিবারের জন্য বোঝা স্বরূপ!

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৯

0

#আমার_প্রথম_সকাল (০৯)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
আমাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে জুনাইদ উঠতে নিলে পেছন থেকে শ্বাশুড়ি তাকে ডাক দিলেন। ” তুই কই যাস? ওরে পাঠায়া দিলেই তো হয়। লেঠা চুকে যায়! ”
” মানবতার খাতিরে হলেও একজন অসুস্থ মানুষকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না মা। ” জুনাইদ ভারী গলায় বলল।
” ওরে এতো অসুস্থ কোথায় দেখস তুই? কই আমি তো একদম সুস্থ তরতাজা দেখতেছি। ”
” দেখা আর জানার মাঝে অনেক পার্থক্য থাকে। ওকে আনার সময় কি ও নিজে থেকে এসেছিল যে ওকে আমি একা পাঠাবো? তাছাড়া এখনো ও আমার আওতায় আছে তারমানে ওর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব এখনো আমার ওপর। আপনি ঘরে যান। এসব আপনাকে ভাবতে হবে না। যান তো যান! ”
জুনাইদের কণ্ঠে এমন কথা শুনে শ্বাশুড়ির মাথায় হাত। যে ছেলে উঠতে বসতে মায়ের অনুমতি নিত সে ছেলে তারই মুখের ওপর এত বড় কথা? তিনি মৌন থেকে আমার দিকে এক নজর কড়া চোখে তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন ঘরের ভেতরে। আমি চলে যাচ্ছি ভেবেই হয়তো আজ আর কোনো কথা শুনালেন না।
.

.
সারাটা রাস্তায় জুনাইদকে ভীষণ হতাশ এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল। এদিকে আমার নিজের অবস্থাটাও বেশ শোচনীয় আকার ধারণ করছে। জুনাইদকে যে কিছু জিজ্ঞেস করব সে সাহসটুকু নিজের মধ্যে সঞ্চার হচ্ছিল না। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া লুকিয়ে রাখাটাও আজ জরুরী মনে হলো না। আমি নিঃশব্দে কাঁদছি বুঝতে পেরে জুনাইদ আমার হাতের উপর নিজের হাত রাখল। হয়তো বলার মতো তার কাছেও কোনো কথা আর অবশিষ্ট নেই। কিয়ৎক্ষণ এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর মুখ খুলল জুনাইদ। মৃদু স্বরে ডাকল, সকাল বলে! জুনাইদের কণ্ঠস্বরে এই ডাকটাকেও আজ ভীষণ দামী বলে মনে হচ্ছে। চাইলেও হয়তো এই ডাকটা আর কখনো শুনতে পাবো না আমি। কান্না এবার ভেতরে থেকে আরো দ্রুত বেগে আসতে চাইছে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে যথাযথ সামাল দেওয়ার চেষ্টায় আছি। নয়তো কাঁদলে আশেপাশের মানুষজন খারাপ ভাববে যে। জুনাইদ হতাশ গলায় বলল, ” বাড়ি গিয়ে মাকে কিছু বলিও না এখন! ”
জুনাইদকে এবার সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ” বলব না। কিন্তু আমি তো জানতে পারি নিজের অপরাধ সম্পর্কে! এতটুকু জানার মতো অধিকার নিশ্চয়ই এখনো আমার আছে? ”
জুনাইদ দম নিল। ” তোমার অধিকার আর কেউ পাবে না সকাল। তুমি আমার প্রথম সকাল তুমি থাকবে শেষ। এই অবস্থানটা সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আর আমাকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময়ই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ”
” তাহলে তালাকনামাটা কিসের জন্য? আমি কি তবে এটা সম্পর্কে এতোদিন ভুল জানতাম? ”
” না। ঠিকই জানো। মায়ের কথায় পাত্তা দিও না। মা যেসব কথা বলেছে ওগুলো সব বানোয়াট। এসবের একটাও আমার বলা কথা না। আমি উনাকে একবারও বলিনি তোমাকে ছাড়বো। ”
এতটুকু বলে জুনাইদ আমার দিকে তাকিয়ে রইল৷ ওর কথাগুলো বিশ্বাস করতে গিয়েও কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে হয়তো আমাকে শান্তনা দিতেই কথাগুলো বলছে। রেখে আসতে পারলে ঠিক ভুলে যাবে। আমাকে ভাবনার জগৎ এ হারাতে দেখে জুনাইদ বলল, ” কি ভাবছ? তোমায় রেখে এসে সব মেনে নেবো? ”
” হ্যাঁ। এমনটি ভাবারই কথা। অস্বাভাবিক কিছু তো না। তাছাড়া আপনি নিজে এসব বলছেন আপনার মায়ের সম্পর্কে? অন্য কেউ হলে অবিশ্বাস্য লাগত না। ”
” আমার চেয়ে অন্যরা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে গেল তোমার কাছে? ”
” নয়তো কি? যে ছেলে মায়ের কথার বরখেলাপ করে না করে কখনো। সে ছেলে আজ এসব কথা বলবে? ”
” দেখ সকাল! বাবা মা, বাবা মা-ই হয়। তাদের কথা শোনা প্রত্যেক সন্তানের জন্য ফরজ। ভুল হলে শুধরে দেওয়াটাও উচিত। ”
” বেশ! আপনার মায়ের কথাগুলো যদি বানোয়াট হয়েও থাকে তাহলে আপনি কেন তখন এর জবাব দিলেন না? ”
” সকাল! সব কথা মুখে বলে দিতে হয় না। কিছু জিনিস এমনও হয় যেগুলো শত বোঝালেও কেউ বুঝে না। করে বোঝাতে হয়। বিয়ে জিনিসটা এতো সহজলভ্য না যে উনি বলেছে বিধায় করেছি আবার উনার কথাতে তোমার ছেড়ে দেবো৷ শুধু তুমি কিছুদিন তোমার মায়ের কাছে থাকো। অনেকদিন তো নাকি বেড়াতে পারোনি। ”
” মাথায় এতো চাপ নিয়ে কেউ বেড়াতে শুনেছেন? ”
” চাপ আমার ওপর ছেড়ে দেও। যা হবে পরে দেখা যাবে। শুধু এতোটুকু বিশ্বাস রাখ তোমার সাথে এমন কোনো কিছুই ঘটতে দেবো না আমি। কথা দিলাম তোমায় আমার প্রথম সকাল! ”
” এ কেমন ডাক? ”
জুনাইদ টিপ্পনী কাটে। ” আমি তো তোমায় এ নামেই ডাকি! আজ নতুন শুনছ নাকি? ”
.

.
বাড়ি পৌছানোর পর সবার সাথে জুনাইদ বেশ স্বাভাবিক থেকেছে। প্রতিবারের মতো মায়ের খোঁজ নিয়েছে, বোনের নিয়েছে। কারোর কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা এমন সব জানতে চেয়েছে। মা’কে বিন্দু পরিমাণেও ঠাওর করতে দেয়নি তার মেয়ের সংসার ভাঙনের পথে। মায়ের অনুরোধে সেদিনটা থাকতে হয়েছে তাকে। এ নিয়ে শ্বাশুড়ি বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে ফোন করেছেন। জুনাইদ প্রথমে তোলেনি পরক্ষণে তুলে আড়ালে কথা বলে এসেছে। কি বলেছে সে ব্যাপারে আমি অজানা। এতোদিন পর মায়ের কাছে এসেছি কোথায় খুশিতে আত্মহারা হওয়ার কথা ছিল সেখানে আমার মনে খুশির ছিটেফোঁটাও নেই। মন জুড়ে আঁকড়ে ধরেছে বিষন্নতা। না চাইতেও কোথা থেকে যেন অবিশ্বাস আমাকে গ্রাস করতে চাইছে। পরদিন জুনাইদ চলে যায় বাড়িতে। যাওয়ার আগে ফের আশ্বাসের সহিত বলে যায় তারওপর বিশ্বাস রাখতে। সে থাকতে আমার সাথে কোনো অন্যায় সে হতে দেবে না।

বিকেলের দিকে উঠোনের এক কোণে বসে আছি। ছোটবোন পাশের বাড়ি গিয়েছে। মা গেছে পুকুরে থালাবাসন ধুতে। তখন বাড়িতে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন আমার খালা। উনাকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে কুশলাদি জানতে চাইলে তিনি মুখ ভার করে জবাব দিলেন, ” কিরে সকাল! শ্বশুরবাড়ি যাস নাই এখনো? ঈদের তো মেলা দিন পার হইল! ”
” খালা বসেন। আমি আসলামই গতকাল। ”
” ও তাই বল। সবাই তো আসে ঈদের দিন বিকালে নয়তো পরদিন। তাই ভাবছি তুইও এমন আসছিলি। তা থাকবি কয়দিন? ”
” এইতো খালা ঠিক নেই। আপনাদের জামাই এসে নিয়ে যাবে। ”
শুনে খালা অবাক হলেন। জানতে চাইলেন, ” তোর জামাই দেশে? ”
উনার সাথে কথা বলার ফাঁকে মা এসে পড়লেন। খালাকে দেখে বললেন, ” কিরে তুই কখন আসলি? ”
” এইতো বুবু মাত্রই। এসেই সকালের সাথে কথা বলতেছি বেশিক্ষণ হয় নাই। ”
খালার দিকে মা বসার জন্য মোড়া এগিয়ে দিয়ে বললেন” বোস। ঘরে প্রচুর গরম। নইলে ঘরেই বসতে বলতাম। ”
আমি ঘরের ভেতর চলে গেলাম উনার জন্য পানি আর বাতাস করার জন্য হাত পাখা আনার উদ্দেশ্যে। আসার পথে শুনতে পেলাম তিনি মা’কে বলছেন, ” সকালের জামাই নাকি দেশে বুবু? ”
” হ্যাঁ। কালকে ওরে নিয়ে আসছিল। একদিন থেকে সকালকে রেখে আজকে গেছে। পরে এসে নিয়ে যাবে। ” মা স্বাভাবিকভাবে বললেন।
” জামাই বাড়িতে থাকতে কোনো বউরে তো আমি আজ পর্যন্ত দেখি নাই বাপের বাড়িতে একলা বেড়াইতে। ঘটনা কি? কবে নিবো আবার বইলাও গেল না। নাকি একবারে দিয়া গেছে খবর নিয়া দেখ। তোমার মেয়েরে ঢাইকা জিগাও বুবু! ”
মা সহজ সরল মানুষ। খালার কথার প্যাচ বুঝেননি। বরং উনার কথায় মায়ের মুখে এবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল। প্রশস্ত হয়ে আসার ঠোঁটের কোণে জমে থাকা হাসিটা নিমিষে গায়েব হয়ে গেছে। খালা মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ” সকালরে যেই বাড়ি পাঠাইছো, কই তারা আর কই তোমরা। কাঁড়ে আর উগিরে যারে কয়! সম্পর্ক হওয়া লাগে সমানে সমান। নাহলে এমন সম্পর্ক টিকবে না জিন্দেগীতেও। আমাদের দেখ না, একদম খাপে খাপ। তাদের সাথে আমাদের হইলে একটা কথা ছিল। তখনই বলছিলাম শুনো নাই। এবার বুঝো ঠ্যালার নাম বাবাজী। ”
মা জবাব দেয়ার আগে আমি নিজেই বললাম, ” খালা পানি নেন। প্রচুর গরম পড়তেছে। গরমে আপনার মাথার ভিতর থেকে আসা আজেবাজে চিন্তা যদি তাতে একটু দূর হয়। ”
” হ দে। ” পানি খেয়ে তিনি গ্লাস ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ” এগুলো মোটেও আজেবাজে চিন্তা না সকাল। সত্যি কইরা বল তো? তোরে তোর জামাই কবে নিবো কিছু বইলা গেছে? ”

খালার প্রশ্নে এবার আমি থমকে গেলাম। সঠিক করে বলতে না পারলেও বলে দিলাম, ” যেদিন নেবে সেদিন তো শুনবেনই। আপনি নাহয় ততদিন এখানে থেকে যান।”
” হ আমার তো আর কাম নাই তোদের বাড়ি পড়ে থাকব। তোদের নিজেদেরই তো ঠিক নাই কেমনে থাকিস খাস আবার আমারে থাকতে বলিস। ”
আমার খালা হলেন আমার নানার দিকের সবচেয়ে বড় স্বার্থপর, নির্দয় একজন মহিলা। যার মনে আমাদের জন্য টান বা মায়ার ছিটেফোঁটাও নেই। বাবা থাকাকালীন সময় তিনি মোটেও এমন ছিলেন না। কোনো দরকার পড়লে ছুটে আসতেন আমার মায়ের কাছে। অথচ যেই বাবা মারা গেল ওমনি উনি আমাদের এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন। সবসময় ভাবতেন আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখলে আমার মা’কে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। যেমন করে উনার স্বামীর ব্যবসার জন্য আমার মা বাবার থেকে সাহায্য পেয়েছিলেন। বাবা যেদিন মারা গেলেন সেদিন এসে তিনি আত্নীয়তার খাতিরে আমাদের একনজর দেখে চলে গেছেন। তারপর মাঝের কতগুলো বছর আর কোনো যোগাযোগ করেননি। উনার এড়ানো দেখে মাও কখনো তাকে বিরক্ত করেনি। শেষবার আমার বিয়েতে এসেছিলেন আর আজ এলেন হুট করে। তার আসার উদ্দেশ্য আমাদের জানা নেই ঠিকই তবে আমাদের ছোট করে কিছু কথা শুনিয়ে যাওয়া ছিল তার এখানে আসার মুখ্য উদ্দেশ্য। খালার নিজেরও তিন ছেলেমেয়ে। মেয়ে দু’টোকে দ্রুতই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মেয়েদের এতো পড়ে কি লাভ! এমন প্রথাকে সামনে রেখে তাদের কাউকেই বেশিদূর পড়াননি। ছেলেটাকে এখনো বিয়ে করাননি৷ মেয়ে দু’টোর স্বামী প্রবাসী। পারিবারিক অবস্থা ভালো হলেও জুনাইদদের মতো অতটা স্বচ্ছন্দ নয়। আর না তো জুনাইদের মতো কেউই শিক্ষিত। জুনাইদের আর আমার বিয়ের বিরূদ্ধে সবার আগে উনিই ছিলেন। মা’কে সরাসরি বলেছিলেন আমরা এতো বড় ঘরে আত্মীয়তা করার মতো যোগ্যতা রাখি না। আমাদের আছেটা কি? না জায়গা জমি আর না তো টাকা পয়সা, বিয়ের পরের দেওয়া নেওয়া করবে কিভাবে মা? তারওপর আমাদের বাড়িটাও না খুব ভালো! বাবা থাকলে একটা কথা ছিল বাবা নেই, কোন সাহসে যায় মেয়েকে আমার মা এতো বড় ঘরে পাঠাতে।

খালা মুখ ঝামটে বলে উঠল,
” আত্নীয়তার খাতিরে তোদের দাওয়াত দিতে এদিকে আসা। আমার ছেলের বিয়ে সামনের শুক্রবারে। নইলে আমার দরকার ছিল নাকি আসার। এই জঙ্গলের ভেতর কোনো মানুষ ঢুকে? ”
খালা এতটুকু বলে আর বসলেন না। উঠে পড়লেন। যাওয়ার পথে আমাকে বলে গেলেন, ” তোর জামাইরে নিয়ে আসিস যদি পারিস। নাহলে পরে তো বলবি খালা মানুষ ভালো না, আমার জামাইরে দাওয়াত করল না! ”

খালা এসে মায়ের মনে চিন্তার বীজ বপন করে গেলেন সেটা উনার চোখের মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। আমাকে মা কিছু জিজ্ঞেস করতে নিয়েও আর করলেন না। সেদিনের মতো এভাবেই ভালো খারাপের মধ্য দিয়ে পার করলাম। রাতটা পার হতে চাইল না চিন্তায়। তাহাজ্জুদ আদায় করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছি। সব ঠিকঠাক করার মালিক কেবলমাত্র তিনি। একেবারে ফজর শেষ করে ঘুমিয়েছি সকালের দিকে। কিন্তু তারপরদিন সকাল হতেই আমার সামনে প্রকাশিত হলো এক অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনার সংবাদ।

চলবে….

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৮

0

#আমার_প্রথম_সকাল (০৮)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
” একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ”
” নির্দ্বিধায় করতে পার! ”
” আপনার না সপ্তাহ খানেক পরে আসার কথা? আগে এলেন যে? ”
জুনাইদ জবাব দিল, ” বিয়ের পর তোমার সাথে এটাই আমার প্রথম ঈদ। সামনে ছুটি তো আছেই। ভাবলাম দশদিন পর না নিয়ে নাহয় আগেই নিয়ে নেই। তাই অফিস থেকে আগেভাগে ছুটি নিয়ে নিয়েছি। ”
পরদিন সকাল সকাল জুনাইদের বোন অর্থ্যাৎ আমার ননদ নিজের বাপের বাড়ি চলে এলো। শ্বাশুড়ি অবশ্য আমাকে গতকালই কথাটা জানিয়ে রেখেছিলেন। এসেই মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ল। মা মেয়ে মিলে শলাপরামর্শ জুড়ে দিল৷ সোমা আর আমি কিছুক্ষণ পর শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে রওয়ানা হলাম। হাতে করে সামান্য নাস্তা পানীয় নিয়ে। সালাম দিতে সোমাকে তিনি নিজের পাশে বসালেন। নানান কথা জিজ্ঞেস করলেন। এদিকে আমি সেই তখন থেকে নাস্তার ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছি সেটা দেখেও তারা দুই মা মেয়ে দেখেও না দেখার ভাণ করে আছেন। সোমার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে শ্বাশুড়ি আমাকে ধমকে উঠলেন, ” তুমি এখানে দাঁড়ায়া আছো কেন? কী শুনতে আসছ? এখান থেকে শুনে গিয়ে আমার ছেলের কান ভারী করবা ভাবছো? ”
” আমি তো আপার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি! ”
” নাস্তা আনলে রাইখা যাও। কথা গিলবা কেন? এসব ছোটলোকি কাজ কারবার নিয়া আমার ঘরে আর আসবা না কইলাম! ”
ননদের এতোক্ষণে হদিস হলো। তিনি এদিকে তাকিয়ে বললেন, ” তোমার কি অবস্থা ভাবী? ”
” কি আর অবস্থা হবে দেখস না? জিজ্ঞাস করার কি আছে? ” শ্বাশুড়ি ধমকে বললেন।
” আহা মা তুমি থামো। ভাবী তুমি যাও তো। মায়ের মাথাটা ঠিক নেই। ”
” কবে ঠিক ছিল আপনার মায়ের মাথা? ” কথাটা মনে মনে বললেও মুখে বলার সাহস হলো না। নিরবে প্রস্থান করলাম ও ঘর ছেড়ে।
.

.
যতদিন যাচ্ছে সোমাকে নিয়ে শ্বাশুড়ির ততই আহ্লাদ বাড়ছে। সোমার যত্নের কোনো কমতি রাখছেন না তিনি। সোমার গর্ভে বংশের প্রদীপ তাকে তাই যত্ন করাটাও স্বাভাবিক। এদিকে বাড়ির সবার কাজের পাশাপাশি সোমার কাজও আমাকে দিয়ে করাচ্ছেন শ্বাশুড়ি। একই বাড়ির বউ দু’জনেই। একটা বাচ্চার অভাবে সোমা রাজরানী আর আমি চাকরানী। জুনাইদ ঈদের একদিন পর জরুরী কাজে ঢাকায় গিয়েছে। বলে গেছে ফিরতে সপ্তাহখানেক দেরি হতে পারে। এ সুযোগটাকে শ্বাশুড়ি ইচ্ছে মতো কাজে লাগাচ্ছেন। জুনাইদ বাড়ি থাকলে তাকে খুব একটা ঘ্যানঘ্যান করতে শোনা যায় না। দুচারটে ব্যাপার জুনাইদ আসার পর লক্ষ্য করে নিজের মাকে বারণ করেছে। তাতে শ্বাশুড়ি নিজের ছেলের সামনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও শোধ তুলছেন আমার ওপর দিয়ে।

এক গাট্টি কাপড়চোপড় নিয়ে পুকুর পাড়ে বসে আছি। গতকাল রাত থেকে শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। জ্বর এসেছে সম্ভবত। গলা ব্যথা, কাশি অধিক পরিমাণে বেড়েছে। চলার মতো শক্তিটাও গায়ে অবশিষ্ট নেই। শ্বাশুড়ি এসব দেখেও দেখেননি৷ জামাকাপড় নিয়ে আসার সময় বলেছিলাম, ” মা আমার শরীরটা ভালো নেই। একটু কষ্ট করে নিজেদেরটা নিজেরা আজ করে নিন! ”
বসে যাওয়া গলা থেকে বেরিয়ে আসা কাকুতির স্বর শ্বাশুড়ির মনে দয়া মায়া জন্মাল না। বরং বলা মাত্র ওমনি তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ” এতোটুকুতে মানুষ ম’রে যায় না। এর থেকে বেশি কষ্ট আমরা করেছি। আজ যদি পোয়াতি হইতা তাও মানা যাইত৷ বিয়ের এতোদিন হইল এখন অব্দি একটা বাচ্চার মুখও তো দেখাইতে পারলা না আবার আবদার কর কোন মুখে? লাজ হায়া সব কি বস্তা বাইন্ধা মার কাছে রাইখা আইছো? কিছু আনো নাই সঙ্গে কইরা? ”
অগত্যা বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসতে হলো পুকুরঘাট অব্দি। কষ্ট করে যতটুকু পারছি করছি। কিছুক্ষণ বাদে আমার সঙ্গে যুক্ত হলো নীলা। সম্ভবত গোসল সেরে বেরিয়েছে। জামাকাপড়ের বালতি নিয়ে সিড়িতে আমার বরাবর বসল৷ ” কি ব্যাপার ভাবী? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ? ”
জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ” এইতো একটু! ”
” একটু না ভাবী। আপনার চোখ মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে অনেকখানি। কি হইছে? ”
” তেমন কিছু না বোন। জ্বর, আর গলা ব্যথা! ”
” ওওও। ”
” এই জ্বরের মধ্যে এগুলো ধুতে চলে এলেন যে? বাড়িতে আর কেউ নেই? ”
” আমি ছাড়া আপাতত কেউ নেই৷ ”
” ভাইয়া আসবে কবে ভাবী? উনার না আসার কথা আজকে? ”
” শুনেছিলাম তো এমনটাই। হয়তো রাত হবে আসতে আসতে। ”
” বুঝছি। ভাইয়া নাই তো তাই আপনাকে দিয়ে চাচী আম্মা জ্বরের মধ্যেও এগুলো করাচ্ছে। ভাইয়ারে সম্পর্কে জানি তো। আমার শ্বাশুড়ির মুখে শুনেছি উনি কেমন মানুষ। শুধু বাপ মা’র মুখের ওপর কথা বলার সাহস একটু কম। ” কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে নীলাও আমার সাথে হাত লাগিয়েছে। নিষেধ করা সত্ত্বেও মেয়েটা শোনেনি আমার কোনো কথাই। ওর সাহায্য পেয়ে আমার সে মুহূর্তে আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করতে হয়েছে। নীলার জন্য তখন মনে থেকে আপনাআপনি দোয়া চলে এলো। জীবন বড় বিচিত্রময়। যাদের আমার কষ্টের কথা বোঝার কথা তারা বোঝেনি, নাটক ভেবে বসেছে। অথচ নীলা আমার চোখমুখ দেখেই বুঝে ফেলল।

জামাকাপড় মেলে দিয়ে ঘরে আসতে দেখলাম জুনাইদ ঘরে বসে আছে। তাকে দেখামাত্র মনটা ভেতর থেকে কেঁদে উঠল। ইচ্ছে করল তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই। ইচ্ছে করছে তার হাতে পায়ে ধরে কেঁদেকেটে বলতে, ‘ করুণা করে হলেও আপনি দয়া করে আমার জন্য কিছু করুণ। আমার যে এতো দখল আর সহ্য হচ্ছে না। ‘
কিন্তু ভেতরকার কোথাও এক অদৃশ্য জড়তা এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে। জুনাইদের পরিবারের মানুষগুলোর আচরণের কারণে দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। জুনাইদ কি সেসব বুঝতে পারছে না? জুনাইদের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম। তখন তার কণ্ঠস্বরে আমার ভাবনার ছেদ ঘটল।
” কোথায় ছিলে এতোক্ষণ.? ”
” কাপড় ধুতে গিয়েছিলাম। ”
” আচ্ছা! ” এতটুকু বলে জুনাইদ মৌনতা বজায় রাখল কিয়ৎক্ষণ। পরক্ষণে বলে উঠল, ” তোমার চোখ লাল কেন.? এদিকে আসো। ”
জুনাইদের স্থির দৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতে সে আমার হাত ধরে চমকে গেল। ছেড়ে দিতে নিয়েও আর ছাড়ল না। পাশে বসতে বলে কপালে হাত দিয়ে পরখ করে নিল। এতোক্ষণে ঠাওর হলো আমার শারীরিক অবস্থা।
” গায়ে তো প্রচুর জ্বর! ঘরে কি প্যারাসিট্যামল আছে? ”
আমি না সূচক মাথা নাড়ালে সে বলল, ” ঠিক আছে থাকো। আমি এক্ষুনি আসছি। ” কালবিলম্ব না করে ছুটে গেল জুনাইদ। সে চলে যেতে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না কোনো মতেই। কিছুসময় পর ঘুমের ঘোরে আবছা বোঝা গেল জুনাইদ ফিরেছিল হাতে করে ঔষধের প্যাকেট নিয়ে।
.

.
জ্বরের ঘোরে কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। যখন চোখ খুললাম তখন পাশে জুনাইদের উপস্থিতি টের পেলাম। এদিকটা ফিরে শুয়ে আছে। অনুভব করলাম আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থবোধ করছি। তখনি বাহির থেকে দরজা ধাক্কানোর শব্দ শোনা গেল। শ্বাশুড়ি ডাকছেন, ” সকাল, এই সকাল! ক’টা বাজে হ্যাঁ? বিকেল থেকে ঘরে বসে ছিলে কিছু বলিনি দেখে কি এখনো দরজা বসে থাকবে নাকি? ঘরের বাকি কাজগুলো কে করবে? রাতের রান্নাবান্না কার জন্য রাখছো হ্যাঁ? ”
শ্বাশুড়ির চেঁচামেচিতে জুনাইদের ঘুম ভেঙে যায়। আমি উঠতে নিলে জুনাইদ পেছন থেকে হাত ধরে বাঁধা দেয়। তার দিকে ফিরতে সে ইশারা করে, ” বেশিক্ষণ হয়নি। চিন্তা করবে না। তুমি বিশ্রাম কর। ততক্ষণে আমি মায়ের কাছ থেকে আসছি। ”
.

.
সকাল সকাল সেদিনের মতো আজও তৈরি হয়ে বসে আছি জুনাইদের অপেক্ষায়। তবে আজ আর জুনাইদ খুব বেশি দেরি করল না। ফিরে এসেছে খুব কম সময়ের মধ্যে। বাড়ির সামনের দিকটায় রিক্সা দাঁড় করানো নজরে পড়ল। জুনাইদ আমাকে নিয়ে মায়ের কাছে যাবে বলে জানাল। অনেকদিন পর মাকে দেখতে পাবো ভাবতেই মনটা খুশিতে ফুরফুরে হয়ে উঠল৷ কিন্তু ভুলে গেছিলাম আমার যে খুশি হওয়া বারণ! জুনাইদ আমাকে নিয়ে বের হওয়ার সময় শ্বাশুড়ির মুখে এক প্রশান্তির হাসি দেখা গেল। উনাকে এমনভাবে দেখে বেশ অবাক লাগল৷ ভাবলাম হয়তো জুনাইদ গতরাতে বোঝানোয় তিনি বুঝেছেন অন্যথায় ভাণ ধরে আছেন। বাড়িতে তখন তিনি ছাড়া কেউ ছিল না। সোমাও নিজের ঘরে। উনাকে বলে আসতে নিলে তিনি আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে এগিয়ে এলেন। বললেন, “তুমি পুরোপুরি সুস্থ হইলে তালাকনামা পাঠাবে জুনাইদ। তোমার মাকে বলিও প্রস্তুত থাকতে। আমাদের তো ঠকিয়ে তোমার সংসার ভাঙল এরপর যেন এমন ভুল আর না করেন। আরেকটা কথা, কি জন্য এক বছরের মাথায় তোমার বিয়ে ভাঙল সেটাও লুকিয়ে রাখিও না মানুষের কাছে। নাহলে পরে দেখা যাবে যেখানে গিয়া পড়বা সেটাও টিকবে না। ” শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলো কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌছুতে আমার মনে হলো আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল৷ কেউ যেন আমার কানে গরম সীসা এনে ঢেলে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাহলে তিনি আমাকে বিদায় করে তবেই ক্ষ্যান্ত হলেন! কতটা পাষণ্ড মহিলা! একজন মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তিনি শেষমেশ সংসার ভেঙেই ছেড়েছেন। এদিকে জুনাইদকে দেখলাম থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কেন জানি না, তার কপালের রগগুলো ইতিমধ্যে ফুলে উঠেছে। ছলছল করুণ চোখে তার দিকে তাকালাম। সে বুঝল তবে সেভাবেই গম্ভীর স্বরে বলল, ” রিক্সায় ওঠো সকাল। দেরি হচ্ছে! ”
চোখের পানি আড়াল করে রিক্সার দিকে অগ্রসর হলাম। নিয়তিকে মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। জানিনা মা’কে গিয়ে কি জবাব দেবো৷ যখন শুনবেন শ্বশুরবাড়ির লোককে একটা সন্তানের সুসংবাদ না দেখাতে পারার ব্যর্থতায় অকালে সংসার ছাড়া হয়েছে তার মেয়ে। মা আদৌও ঠিক থাকতে পারবেন তো?

চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৭

0

#আমার_প্রথম_সকাল (০৭)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
দুনিয়াটা শক্তের ভক্ত নরমের যম! এখানে যতটা নরম আচরণ করা হবে সবার সঙ্গে, ততটাই ঠকতে হবে। এ বাড়িতে আসার পর তা হলফ করে বুঝতে পারছি। জুনাইদ নিজের মায়ের মতে বিয়ে করেছে। তারজন্য সে মায়ের অবাধ্য সন্তানের ন্যায় আচরণ করা তো দূর ভাবতে পারছে না। অন্যদিকে জামিল হলো জুনাইদের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। জুনাইদ শান্ত এবং নম্র স্বভাবের হলেও জামিলের মেজাজ সর্বদা তুঙ্গে চড়ে থাকে। পরিবারের সবার আদরের ছোট ছেলে, কাউকে পরোয়া করার প্রয়োজন মনে করে না। এজন্য শ্বাশুড়ি তাকে সর্বদা বাবা বাবা বলেই তোষামোদ করে চলে। অন্যদিকে সংসারের সম্পূর্ণ ভার থাকে জুনাইদের ওপর। জুনাইদ হলো তাদের কাছে অনেকটা টাকার মেশিন।

শ্বাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম জামিল বাড়িতে এসেছে। সঙ্গে শাড়ি পরিহিতা এক রমনী। বুঝতে বাকি রইল না এটা যে সোমা। সোমাকে দেখে আশ্চর্য হতে বাধ্য হলাম। আর মাত্র ক’টা দিনই তো বাকি! এতদিন অপেক্ষা করতে পারল অথচ সপ্তাহ খানেক অপেক্ষা করতে পারল না সে? বিষয়টি নিয়ে বেশ হাসি পেল। তবে হজম করে নিতে বাধ্য হলাম। জামিল ঘরে ঢুকে শ্বাশুড়িকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন। শ্বাশুড়িও জামিলের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। সোমার মুখ ঘোমটার আড়ালে থাকায় তাকে দেখে শুরুতে চিনতে পারেননি। পরক্ষণে জামিল নিজেই বলল, ” সোমা মা আসছে। ”
সোমা নিচে ঝুঁকে কদমবুসি করতে গেলে শ্বাশুড়ি নিষেধ করলেন। ” থাক মা থাক! এসময় ঝুঁকতে হয়না। বাচ্চার সমস্যা হয়। ”
সোমা সরে গেল। জামিল আমাকে দেখিয়ে বলল, ” ইনি হলেন আমার ভাবী! ”
সোমা মৃদু হেসে বলল, ” হ্যাঁ উনাকে তো চিনি। আসসালামু আলাইকুম ভাবী ভালো আছেন! ”
” আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ভালো আছো? ”
শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি মুখখানি ভার করে রেখেছেন। কেন করেছেন সেটা তিনি নিজেই ভালো জানেন। আমাকে বললেন, ” সকাল, সোমাকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা কর! ” বলে তিনি নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
.

.
ঈদের পরপর ধুমধাম করে জামিলের বউ তুলে আনা হবে, এমনটিই কথা হয়েছিল সোমার বাবা মায়ের সাথে। কিন্তু ঈদের দিন বিকেলেই তারা মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন অনুষ্ঠানের খরচা বাঁচাতে। এসব কথা ভেবে শ্বাশুড়ির বেজায় মুখ ভার। জামিল উনার ছোট ছেলে, বহু আদরের ধন। তার বিয়েতে তিনি আত্নীয় এনে আপ্যায়ন করে ভরিয়ে তুলবেন ভেবেছিলেন। এতোদিন ছেলেকে এসব নিয়ে সবার সাথে গর্ব করে বেড়াতেন কিন্তু সোমার বাবা মা চালাকি করে শ্বাশুড়ির ইচ্ছেটাকে মাটি চাপা দিয়ে ফেলেছেন। শ্বশুর আর জুনাইদ ঘরে ফিরতে তিনি তাদের ডাকলেন, যেহেতু প্রসঙ্গ জামিলকে কেন্দ্র করে তাই তাকে ডাকতেও ভুল করলেন না।

জামিল এলে শ্বাশুড়ি জামিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” কি দরকার ছিল আজকেই তোর বউকে তুলে আনার? আর কয়েকটা দিন পর তো এমনই সবাই মিলে গিয়ে আনতাম। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারলি না? ”
” বউকে আনব না তো কাকে আনব মা? বাহিরের কাউকে তো তুলে আনিনি। এটা নিয়ে তোমার এতো মুখ ভার করে থাকতে হবে কেন? ”
শ্বাশুড়ি জবাব দিলেন না। সেভাবেই মুখ ভার করে রইলেন। শ্বশুরের দিকে তাকাতে তিনি বললেন, ” মুখ ভার করাটা কোনো বিষয় না। বিষয়টা হচ্ছে আত্নীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে। তারা এখন কি বলবে বুঝতে পারছিস? ”
” কি আর বলবে? যা সত্যি তাই বলবে। ” জামিল স্বাভাবিকভাবেই বলল।
শ্বশুর বললেন, ” এতো সহজ না সব কিছু। দুনিয়াদারী দেখছিস কতটুকু তুই? ”
” যতটুকু দেখাইছো ততটুকুই। ”
” কচুটা দেখছো তুমি! যদি দেখতাই তাহলে এমন একটা কাজ করতা না। অন্তত আগে নিজের দিকটা, নিজের পরিবারের দিকটা ভাবতা। ”
জামিল নিজের বাবার কথায় বিরক্ত হলো। মৃদু রাগত স্বরে বলে উঠল, ” আত্নীয়- স্বজন, পাড়া -প্রতিবেশীর আর কাজ কী? এরা তো পারেই আরেকজনের বিষয়ে মাথা ঘামাতে। শোনেন বাবা, সোমাকে আনার দরকার ছিল তাই এনেছি। এতো ঘটা করে লোকজন ডেকে খাওয়ানোর মানে নেই। বিয়েটা আপনাদের উপস্থিতিতে করেছি তাই আর এর বেশি ভাবার ইচ্ছে নেই৷ নিয়ে আসতে এতো খরচা করে পাবো কি সমালোচনা ছাড়া? আর আমার হাতে এখন এতো টাকা পয়সাও নেই। এটা ভাবছেন আপনি আর মা কখনো? ”
শ্বশুর রেগে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ” হ সব তো তুমিই ভাবো। তুমি বেশি বুঝ, বড় হইয়া গেছ তো। এখন আর আমাদের কথা শোনা লাগবে কেন? ”
শ্বাশুড়ি এবার শ্বশুরকে থামাতে বললেন, ” থাক জুনাইদের বাপ। বাদ দেন। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে, এখন আর তাদের কাউকে লাগে না। বড় জনরে তো দেইখা শুইনাও পারলাম না পছন্দ মতো জায়গায় বিয়েটা করাতে। রাস্তা থেকে একজনরে ঘরে তুলে আনছি। ভাবলাম ছোটজন নিজের পছন্দে করে কাজের কাজ করছে। কিন্তু সে যে এমন কাজ করবে কে জানত! ” শ্বাশুড়ি কথাগুলো বলার সময় উনার কণ্ঠস্বর থেকে আপসোস ঠিকরে পড়ল যেন।

জুনাইদ এতক্ষণ নিরব দর্শকের মতো চুপচাপ সব শুনলেও এবার আর থেকে থাকতে পারল না। নিজের মাকে জিজ্ঞেস করে বসল, ” কাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছ আবার? ”
শ্বশুর জুনাইদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ” এটা তো কথার কথা। তুই এখানে কথার ভুল ধরছিস কেন? ”
” বাবা জামিল যা করেছে তা তো করেই ফেলেছে।নিজের বিয়ে করা লিগ্যাল বউকে তো নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে এতো কথা না বাড়ালেই তো হয়। আর আত্মীয় স্বজনরা কিছুই বলবে না। শুধু শুধু এতো চিন্তা করে আপনার শরীর খারাপ করবেন না মা। জামিলের বউ একে তো নতুন, তারওপর প্রেগন্যান্ট। এমতাবস্থায় এসব শুনলে তার ভালো লাগবে না। ”
” এতোক্ষণ তো এসবই বোঝাচ্ছি। কিন্তু তারা শুনলে তো আমার কথা। যাকগে মানলে তো ভালো না মানলে কিছু করার নেই। তবে আমিও সাফসাফ জানিয়ে রাখছি, সোমাকে যদি এ নিয়ে কোনো কথা বলেন আপনি, মা। তাহলে কিন্তু আমি ওকে নিয়ে আলাদা সংসার করতে বাধ্য হব। তখন বাবা কেন? ভাইয়া বা আপু এসে আমাকে বললেও আমি শুনব না বলে দিলাম। ” নিজের বাবা মায়ের মুখের ওপর জামিল কথাগুলো বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
.

.
নতুন বউ আসার খবর পেতেই বাড়ি বয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের ঢল পড়ে গেল। একে একে এসে সবাই সোমাকে দেখে যাচ্ছে। ঘরের ভেরতটায় গরম। মানুষজনের আনাগোনায় আরো গরম লাগবে বিধায় সোমাকে উঠোনে বসিয়ে রেখেছেন শ্বাশুড়ি। সোমার পরণে হালকা গোলাপি রঙের জামদানী শাড়ি। ফর্সা শরীরে বেশ মানিয়েছে তাকে। স্বাস্থ্যটা মোটামুটি ধরনের হওয়ায় শাড়ি পরাতে তার মধ্যে বেশ গৃহস্থ গৃহস্থ একটা ভাব চলে এসেছে। নরমাল জামা কাপড়ে তাকে কম বয়সী কিশোরী লাগে। বোঝার অবকাশ নেই সে যে একজন বিবাহিত নারী। সেই সাথে সন্তান সম্ভবা। এর মাঝে আত্নীয় স্বজনের কাছেও খবর চলে গেছে। নানান জন নানান জায়গা থেকে ফোন করছেন। শ্বাশুড়ি সেসব খুব সুন্দর করে মানিয়ে নিচ্ছেন। কথায় দাপুটে ভাব তার আগের মতোই বজায় আছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে কিছুই ঘটেনি। অথচ শ্বাশুড়ি মা যে তুলকালাম ঘটাতে গিয়েও জামিলের হুমকির তোপে পড়ে আর পারেননি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। উনি উপরটায় যতটা দেখান চালাকি ভাব, প্রকৃতপক্ষে মোটেও সেরকম নয়। শুধু মাত্র কথায় কথায় আমাকে আর আমার বাবা মাকে ছোট করা, খোটা দেওয়া ছাড়া তার মধ্যে বিশেষ কোনো গুণ আমি দেখতেও পাই না।

সন্ধ্যার সময় আর সোমাকে বাহিরে থাকতে দিলেন না শ্বাশুড়ি। ঘরে এনে তাকে আজকে নিজের ঘরে থাকার কথা বললেন৷ আজকের রাতটা সে জামিলের সঙ্গে থাকবে না, থাকবে শ্বাশুড়ির সঙ্গে। আগামীকাল কয়েকজন মেহমান আসবেন বাড়িতে৷ এমনটি জানালে জামিল কিছু বলবে তার আগে জুনাইদ বলল, ” ঘটা করে অনুষ্ঠান করতে না পারিস, অন্তত কিছু লোকের সামনে তো যেতে অসুবিধা হওয়ার কথা না সোমার! ” জামিলও আর কথা বাড়াল না ভাইয়ের কথায় মেনে নিল।

রাত বাড়তে যে যার ঘরে চলে গেল৷ জুনাইদের সঙ্গে বিকেলের পর আমার দেখা হয় রাত বারোটার দিকে। দেখলাম জুনাইদের বদনখানি অশ্বিনী কালো মেঘে ছেয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল, ” এতোক্ষণে আসার সময় হলো.? ”
স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলাম ” কাজ করছিলাম। ”
” বিকেলে তৈরি হতে বলেছিলাম। হওনি কেন? ”
” হয়েছিলাম। আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় কাজ পড়ে যাওয়ায় সাজ বদলে ফেলতে হয়েছে। ”
” কি এমন জরুরী কাজ যে নিজের মাকে দেখতে যাওয়ার সময়টুকুও তোমার হয় না? ” জুনাইদ কপট রাগত স্বরে বলে উঠল।
জুনাইদকে এ প্রথম এভাবে কথা বলতে শুনলাম। অবাক হলেও ফের জবাব দিলাম, ” সেটা নাহয় আপনার মা’কেই গিয়ে জিজ্ঞেস করেন৷ আমার মা’কে নিয়ে আপনার এতো ভাবনা এটা আপনার মাকেও একটু জানান দিন। ”
” সকাল! মানে কি এসব কথার? ”
প্রতিত্তোর না করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। না চাইতেও চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। ভিজে যাচ্ছে মাথার নিচে চাপা পড়া বালিশ। আমার কান্না সম্ভবত জুনাইদের হৃদয় অব্দি পৌঁছাল। এগিয়ে এসে কাতর কণ্ঠে জানতে চাইল, ” তুমি কাঁদছ কেন? আমি তো এভাবে বলতে চাইনি। দেখ ভুল বুঝো না। ”
চোখের পাতা মুছে জবাব দিলাম ” ঠিক আছে। আমি বুঝেছি। ভুল বোঝার মতো কিছু হয়নি। ”
জুনাইদ দম খিঁচে বসে রইল৷ কোনো শব্দ না পাওয়ায় পাশ ফিরতেই দেখতে পেলাম সে কিছু ভাবছে। কৌতুহলী মন জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। ” কিছু ভাবছেন আপনি? ”
জুনাইদ তখনও ভাবনায় নিমজ্জিত। আমি মৃদু ধাক্কা দিয়ে পুনরায় জানতে চাইলাম, ” শুনছেন! ”
জুনাইদ ভাবনার জগৎ ছেড়ে ফিরে এল। বলল, ” না তেমন কিছু না। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি ভাবছি তোমাকে নিয়ে বের হব কিছুদিনের জন্য। ”
” কোথায় যাবেন? ”
” গেলেই দেখতে পাবে। ”
” একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ”
” নির্দ্বিধায় করতে পার! ”
” আপনার না সপ্তাহ খানেক পরে আসার কথা? আগে এলেন যে? ”

চলবে…..?

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৬

0

#আমার_প্রথম_সকাল (০৬)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
ভোরের আলো সবে মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। চারপাশে ঝিঝি পোকার ঝি ঝি ডাকাডাকির প্রতিধ্বনি। অন্য সময় কাঁচা ঘুমের কারণে এটি বিরক্তি দায়ক মনে হলেও আজ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখ মেলতেই মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা মানুষটির চেহারাটি অক্ষিপটে ভাসমান হওয়া মাত্র বিস্ময়ে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। সে অবস্থায়ই বিছানায় জমে গেলাম যেন। শুরুতে ভীতি আমাকে ঝেঁকে বসলেও এখন সেটি কেটে গিয়ে ভর করেছে বিস্ময়। মেলাতে চেষ্টা করছি আদৌও নিজের চক্ষে যা দেখছি তা সত্যি কিনা। মোটেও বিশ্বাস করতে পারছি না গত এক বছরের মাথায় দেখা ফর্সা মতন সুদর্শন যুবকটি আমার চোখের সামনে। সেও কিনা ঝুঁকে আছে মুখের ওপর। কিয়ৎক্ষণের জন্য হলেও মনে হচ্ছিল আমি বুঝি স্বপ্ন দেখছি! আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত চাহনিতে তাকাতে দেখে ভ্রু কুঁচকে আমায় ইশারা করল জুনাইদ। তার হাবভাবে মনে হলো কিছুই ঘটেনি। ধড়পড় করে আমি উঠে বসলাম। ভাবলাম আমি বোধহয় ভ্রমের মধ্যে রয়েছি। ওঠে বসলে সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে কিন্তু না। ভ্রম আমার কাটলো ঠিকই তবে সেও জুনাইদের ঘর কাঁপান হাসিতে। বুঝতে পারা মাত্রই আমি এবার ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে সালাম দিলাম। সালামের জবাবের অপেক্ষা না করেই ফের জানতে চাইলাম, ” কখন এলেন? ”
জুনাইদ এবার স্বাভাবিক হলো। সালামের জবাব দিয়ে জানাল, ” ঘন্টাখানেক আগে। ”
” ওহহ! ”
জুনাইদকে প্রফুল্ল দেখালেও চেহারা জুড়ে ক্লান্তির চাপ গেঁথে আছে। বোঝা যাচ্ছে লম্বা সময় ধরে সফর করার কারণে তার শরীরটা ভেঙে আসার জোগাড়। অপেক্ষা না করে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জুনাইদের ঠান্ডা হওয়ার ব্যবস্থা করতে লেগে পড়লাম। বাহিরে যেমন গরম পড়ছে তাতে করে ব্যবহৃত সুগন্ধি এবং ঘাম দুয়ের গন্ধ এক হয়ে গা থেকে এক অন্যরকম গন্ধ ভেসে আসছে। রমজানের সময়টা হওয়ায় নাস্তা বা খাওয়া দাওয়ার চিন্তা করতে হলো না। তবুও মনে হতে জিজ্ঞেস করলাম, ” আপনি কি সেহরি করেছিলেন? ”
” কোথায় আর করলাম? সময় পেলে তবেই না করব! ”
” আচ্ছা। তাহলে আপনি ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করুন। কিছুর দরকার হলে জানাবেন। ”
জুনাইদ স্নানাগারে ঢোকার আগ মুহূর্তে বলল, ” তুমি কোথাও যাবে নাকি? ”
” নাহ। আমি এখানেই আছি। ”
” ঠিক আছে! ”
জুনাইদ একেবারে গোসল সেরে বেরিয়ে এলো। এসে সেরকম কোনো কথা বলেনি। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে ঘুনের দেশে তলিয়ে গেল। এদিকে আমার মন নিজেকে নিজে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলছে, জুনাইদের দেশে ফেরার কথা তো আরো এক সপ্তাহ পরে! অর্থ্যাৎ ঈদের পরপর এমনটিই বলেছিল। অথচ চলে এলো আগে কিন্তু একটিবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করল না! জিজ্ঞেস করার জন্য মন বারবার চটপট করলেও পরক্ষণে দমিয়ে রাখলাম নিজেকে। কাঁচা ঘুম থেকে কাউকে জাগানো ঠিক না। পরে ঠিকই জানা যাবে।
.

.
ভোর রাতের পর আর চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। সকাল হতেই কাজে লেগে পড়লাম। আগামীকাল ঈদ সেই সঙ্গে জুনাইদ ফিরেছে, সব মিলিয়ে কাজও বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। এদিকে শ্বাশুড়ি মা এসেও তাড়া দেওয়া শুরু করলেন, জুনাইদ ঘুম থেকে ওঠার আগেই যেন ঘরদোর ঝাড়ামোছা সমেত ঘরের যাবতীয় কাজ যেন শেষ করে ফেলি। তার আবার অপরিষ্কার বাড়িঘর অপছন্দ সেটাও মনে করাতে ভুললেন না। কাজ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে জুনাইদ নিজের ঘর ছেড়ে বেরুলো। তখন আমি মেঝেতে বসে বালতিতে কাপড় ভিজিয়ে ঘর মোছার কাজ করছিলাম। যুগ পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের কাজের উপকরণ পরিবর্তন হয়ে কাজকে সহজ করে দিলেও আমার ক্ষেত্রে শ্বাশুড়ি সেটি হতে দেননি। এখনকার সময় কেউ আর আগের মতো মেঝেতে বসে মোছার কাজ কারবার করে না। কেবল মাত্র আমি ছাড়া। জুনাইদ মাস শেষে বেশিরভাগ টাকা পাঠায় শ্বাশুড়ির একাউন্টে। শ্বশুর সেগুলো তুলে এনে বাজার সদাই হতে যাবতীয় খরচা করেন। আমার নামে একাউন্ট করা হয়নি। বলা বাহুল্য করতে চাইলেও করতে পারেনি জুনাইদ সময়ের অভাবে। জুনাইদ বলে দিলে শ্বশুর মাঝেমধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে হাজার দু’য়েক টাকা হাতে তুলে দেন। শ্বাশুড়ি সেসব ভালো চোখে যে দেখেন না তা বোঝার অবকাশ নেই। তিনি ভাবেন উনার ছেলের টাকা আমি আমার বাপের বাড়ি পাঠাই। আমার বাপের বাড়ির লোক অভাবী, ফকিন্নির বাড়ির মেয়ে আমি পাঠালে পাঠাতেও পারি। তাই তিনি সেসবেও কথা শোনাতে ছাড় দেন না। মাত্র হাজার দু’য়েক টাকার জন্য তিনি হাজারটা কৈফিয়ত চান। কোথায় খরচ করলাম, কিসের খরচ আমার, খাচ্ছি দাচ্ছি সব তো এখানেই, আমার কি কোন জিনিসের অভাব হচ্ছে নাকি? আমায় আলাদা করে খরচ দিতে হবে কেন? শ্বশুরকেও ধোলাই দেন বেশ আচ্ছা মতো। শুনে অশ্রু এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর যে উপায়ও নেই। অথচ আমার স্বামীর টাকায় আমার হক থাকলেও সে টাকা খরচ করা আমার রুচিতে কুলোয় না। ছোট বোনটাকে ইচ্ছে করে কিছু দেই। পরক্ষণে শ্বাশুড়ির কথার জন্য ইচ্ছেটাকে আমার তাৎক্ষণিক মাটি চাপা দিতে হয়।

জুনাইদ খুব সম্ভব শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলে ওঠল, ” সকাল তুমি মেঝেতে কি করছ? আর রোজা রেখে এভাবে কাজ করছ কেন? ”
জুনাইদের কথা শেষ হওয়া মাত্র শ্বাশুড়ির ঘর থেকে আওয়াজ এলো, ” কি ব্যাপার? বেলা কয়টা বাজে? এতটুকু কাজ করতে এতো সময় লাগে কেন হ্যাঁ? এতো ধীর গতিতে কাজ করলে বাকি কাজগুলো কে করবে শুনি? ”
জুনাইদ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকায় তার চেহারার হাবভাব বোঝা গেল না। তবে নিঃশব্দে দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে দেখা গেল।
.

.
পুরো রমজান মাস শেষে ঈদের দিন বিকেল বেলায় একটুখানি জিরবার সুযোগ পেলাম। সারাদিন কাজ শেষে গোসল গা ধুয়ে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতে জুনাইদ বাহির থেকে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” সকাল রেডি হয়ে নেও! ”
প্রতিত্তোরে জানতে চাইলাম, ” কেন? ”
” তোমাকে নিয়ে বের হব। দেরি করবা না বলে দিলাম। ” বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জুনাইদ তাৎক্ষণিক বেরিয়ে গেল।
মনের ভেতরকার দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে জুনাইদের কথা মতো রেডি হয়ে নিলাম। জুনাইদ বেরিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো। এখনো ফেরেনি। ইতিমধ্যে শ্বাশুড়ির কক্ষে ডাক পড়ল,
” নবাবের বেটি কই গেলা? এদিকে যে ডাকি কানে কি কালা হয়ে গেলা? ”
তড়িঘড়ি করে গেলাম শ্বাশুড়ির ডাকে সাড়া দিতে। আমাকে দেখে তিনি মাথা থেকে পা অব্ধি পরখ করলেন। হুট করে তাদের না জানিয়ে তৈরি হতে দেখে তার চোখে বিস্ময় প্রকাশ পেল। বদনখানি গম্ভীর করে বললেন, ” কই যাও কাউরে না জানায়া? এতো রংঢং কিসের জন্যে? ”
” আম্মা আপনার ছেলে বলল রেডি হতে তার জন্যই। ”
” বাহ্ বাহ্! জুনাইদ বলল আর তুমিও ড্যাং ড্যাং কইরা রেডি হইয়া গেলা? ”
যে বাড়িতে সব কাজ শ্বাশুড়ির হুকুমে ঘটবে সে বাড়িতে স্বামীর মতও যে প্রাধান্য পাবে না সেটা আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল। শ্বাশুড়ি নিজের মতো বলে চলল, ” কোথাও যাওয়া হবে না তোমার। কাল আমার মেয়ে আসবে। তুমি এখন গেলে ওদের কে রেঁধে বেড়ে খাওয়াবে শুনি? ”
” কিন্তু মা….
শ্বাশুড়ি জোর গলায় ধমকে বলে উঠলেন, ” আবার কিসের কথা? আমি বলছি হয় নাই? জুনাইদ আমার ছেলে ওরে আমি খুব ভালো করে চিনি। তুমি নিজেই ওরে বলছ বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা। নইলে জীবনেও আমার অনুমতি ছাড়া একটা কাজও সে করে না। বাড়ি ফিরতে ফিরতেই আঁচলে বান্ধার ধান্দা করতেছো! ভাবছো বুঝি না কিছু তাই না? কতদিন এমনে চলবা? যদি একটা বাচ্চার মুখ দেখাইতা তাও তো মানা যাইত। সেটাও তো পারলা না। ”
শ্বাশুড়ির কথা শেষ হওয়ার আগেই সরে এলাম। জানি উনার মেজাজ তুঙ্গে চড়েছে। এখানে থাকলে আরো কিসব শুনতে হবে তারচে চলে আসাই ঢের ভালো মনে হলো। উনার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই উঠানে দেখতে পেলাম…..

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৫

0

#আমার_প্রথম_সকাল (০৫)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
বিয়ের মাস তিনেক না কাটতে বাড়ি বয়ে সুখবর চলে এসেছে, জামিল বাবা হতে চলেছে। শ্বাশুড়ির এই নিয়ে খুশির কমতি নেই। এক কথায় খুশির জোয়ারে তিনি ভেসে বেড়াচ্ছেন যেন। সন্ধ্যেবেলায় খুশিতে খদখদ হয়ে জামিল বাড়ি ফিরল মিষ্টির প্যাকেট হাতে। শ্বাশুড়িকে বলতে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে জামিলের কপালে চুমু খেলেন। মাথায় বুলিয়ে দিলেন স্নেহের পরশ। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন জেঠিদের ঘরের দিকে করে মিষ্টির বাটি হাতে। জামিলের বউয়ের সম্পর্কে গুণগান গেয়ে ঘন্টাখানেক পর নিজ গৃহে ফিরে এলেন। আমার সঙ্গে আজ দু’দন্ড কথাও বললেন না। বিকেলের দিকে উঠোনের দিকে জেঠিকে দেখা গেল। আমাকে দেখতেই তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “কিগো জুনাইদের বউ খবর কি তোমার? ”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনার কি খবর জেঠি? ”

” আমাদের আর কি! তোমার শ্বাশুড়ির কাছে শুনলাম জামিলের বউ নাকি পোয়াতি হইছে। শুনে ভালোই লাগছে। ”
এতটুকু বলে তিনি চুপ করে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখপানে। হয়ত বুঝতে চাইছেন আমাকে কোনো রকম হতাশা গ্রাস করতে পারছে কিনা! কিন্তু আমি এ নিয়ে কোনোরকম অভিব্যক্তি দেখানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না।

আমাকে নিরুত্তর দেখতে পেয়ে তিনি আমার কানের কাছে এসে বললেন, ” তোমার কি কোনো সমস্যা আছে বউ? ”

আমি খানিকটা চমকালাম। কথাটি শুরুতে ধরতে পারিনি বিধায় জিজ্ঞেস করে বসলাম, ” কিরকম সমস্যা? ”

” ওমা। তুমি শিক্ষিত মেয়ে আর এটা জানো না? থাক আমিই খোলাসা করে দেই। তোমার আর জুনাইদের তো জামিলের আগে বিয়ে হইছিল। তাও এখন তখন না। প্রায় বছর খানেক হলো বলে। কিন্তু তুমি তো পারলা না শ্বাশুড়িরে আগে খুশির খবরটা শুনাইতা! ”

প্রতিত্তোরস্বরূপ কি বলা উচিত এ মুহূর্তে আমার নিজেরও জানা নেই। দীর্ঘশ্বাস আড়ালে চেপে রেখে বসে রইলাম একইভাবে। জেঠি তখনোও নিজের মতো বলে যাচ্ছিলেন, ” তোমার শ্বাশুড়ি এ নিয়ে অনেক আপসোস করতেছে বুঝলা? তাই বললাম কোনো সমস্যা আছে কিনা। নাহলে তো এতোদিনে নতুন সদস্য দুনিয়ার আলো দেইখাও ফেলত। যাক আমি এবার যাই ঘরে আমার আবার অনেক কাজ পড়ে আছে। ”

তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় শ্বাশুড়ির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। শ্বাশুড়ি একদম নিচু স্বরে জেঠিকে জিজ্ঞেস করলেন আমার মতামত সম্পর্কে। জেঠি ফুসুরফাসুর শব্দে নিজের মতো যা বলার বলে চলে গেলেন। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে শ্বাশুড়ি এলেন। এসেই রান্নাঘরের বাসন কোসন শব্দ করে রাখতে শুরু করলেন৷ বেসিনে কিছু আধোয়া বাসন ছিল সেগুলোই মূলত মাঝতে লেগে গেলেন। রাগ উঠলে যা প্রায়ই তিনি করে থাকেন, এই যেমন জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর। সেদিনও আমার খুব সখের একটা কাপ তিনি ভেঙে ফেলেছিলেন। কলেজে থাকাকালীন সময়ে ভাড়া থেকে বাচিয়ে জমানো টাকায় মাঝেসাঝে জিনিসপত্র কিনতাম৷ এসবের প্রতি আমার তখন থেকে প্রবল ঝোক ছিল। ঠিক সেরকমই খুব সখ করে এক জোড়া কাপ কিনেছিলাম। নিষেধ করা সত্ত্বেও মা বিয়ের পর পালকির সাঝের সঙ্গে সেগুলোও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার সেই সখের কাপটাকে কিছুদিন আগে শ্বাশুড়ির রাগের বলির পাঠা হতে হলো ঠিক আমার মতোই। শ্বাশুড়ি বিড়বিড় করতে করতে আওড়াতে লাগলেন, ” ছেলেটারে নিজের হাতে খুন করলাম। দেখেশুনে শেষমেশ এক বাঁজা মেয়ে ঘরে তুললাম। এতোদিন জানতাম অপয়া, অর্কমা। এখন দেখি সাথে বাঁজাও। এই জন্যই তো আমি এতোবার বলার পরও কিছু বলত না। মাঝখান থেকে ছেলেটারে সব সহ্য করা লাগতেছে। ”

উনার বিড়বিড়ানিতেও স্পষ্ট সবটা শুনতে পাচ্ছি। চুপচাপ এসব সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। বিয়ের পর প্রায়ই আমাকে বলতেন কিন্তু আমি উনাকে এ নিয়ে কিছু জবাব দিতে পারতাম না। জুনাইদ বিদেশে পাড়ি জমানোর সময়ও একবার শ্বাশুড়ি কথা তুলেছিলেন বাচ্চার ব্যাপারে। জুনাইদ আমার ওপর ব্যপারটিকে আসতে না দিয়ে নিজেই নিজের মতো করে কৌশলে এড়িয়ে গেছে। আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল, ” এতো তাড়াতাড়ি নেওয়াটা ঠিক হবে না। আগে তুমি নতুন পরিবেশের সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নেও, সংসার সামলানো শিখে উঠো ইনশাআল্লাহ তখন আল্লাহ চাইলে সবই হবে! ” জুনাইদের বলা সেই কথাগুলো ভাবছি সেই সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপট মেলাতে চেষ্টা করছি।
.

.
রমজানের সময়গুলো দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায়। ঈদেরও খুব একটা দেরি নেই। এইতো মাত্র দু’টো রমজান পেরোলেই আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসবে ঈদ। ইসস্ গত বছরের এ সময়টাও আমার জীবনে ভিন্ন একরকমের সময় ছিল। সদ্য বিবাহিতা প্রত্যেক মেয়ের মনে থাকাটাও স্বাভাবিক। তবে সেবার আমি এ বাড়িতে ছিলাম না। সেবারই শেষবারের মতো নিজের বাপের ভিটায় মা এবং ছোটবোনের সঙ্গে আনন্দ উৎযাপনে ব্যস্ত ছিলাম। জুনাইদের আর আমার বিয়েটা মূলত ফোনকলে হয়েছিল। এর আগে কেউ কাউকে সামনাসামনি দেখিনি। যতটুকু দেখা সেও ছবিতে। ঈদের পরপর জুনাইদ দেশে এলে আমারও এ বাড়িতে পদার্পন ঘটে। শুরুর দিকে সময়টা স্বপ্নের মতো কেটেছে। কিন্তু তা হলেও ভালো স্বপ্ন গুলোর স্থায়িত্ব কেন যেন খুব ক্ষণস্থায়ী হয়। অথচ দুর্বিষহ জীবন কাটতেই চায় না। শুনেছি কষ্টের পরে সুখ মেলে, কবে মিলবে সে সুখ? আদৌও কি মিলবে? না-কি চিরকাল এভাবেই কেটে যাবে? কথাগুলো কেন জানি না বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আল্লাহর কাছে খুব করে অভিযোগ জানাতে ইচ্ছে করছে। ‘হে পরওয়ারদিগার আমি তো এ জীবন চাইনি আপনার কাছে? চেয়েছি অতি সাধারণ একটি জীবন। যেখানে অর্থের অভাব হলেও সুখের কোনো অভাব হবে না। তাহলে কেন বাড়ছে এমন তিক্ততা! মানুষ তো আপনারই সৃষ্টি, আপনি যখন চান তখনই তাদের আপনার হুকুমে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। সব জেনে তবুও আপনার সৃষ্টিকৃত মানুষগুলো কেন সেসব ভুলে যায়? ‘
মুনাজাতে আল্লাহকে খুব করে বললাম। একমাত্র উনি ছাড়া আমার দুর্বিষহ জীবনের গল্প শোনার মতো যে কেউ নেই। সমাধান যেখানে সমস্যার কথা জানাতেও যে হয় সেখানে। তাই আমার অন্তরের অবস্থা জানুক কেবল আমার অন্তরজামী।

সন্ধ্যারাতে শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে। সোমাকে নিয়ে উনার ভীষণ গর্ব। বড়লোক ঘরের মেয়ে সে। শ্বশুর বাড়িতে আসার পূর্বে থেকে একের পর এক খুশি করার মতো কর্মকান্ড করে চলছে। প্রথমে শ্বশুর বাড়ির সবার চাহিদা মোতাবেক জিনিসপত্র পাঠালো, এখন নতুন সদস্য আসার সংবাদ! শ্বাশুড়ি সবার সামনে আমাকে শুনিয়ে শ্বশুরকে বললেন,
” একেই বলে কপাল বুঝলেন! সোমার মতো মেয়েকে ঘরে তুলতে পেরেছি বিধায় আজ আমাদের বংশের প্রদীপ জ্বলল বলে! নাহলে যে এক অপয়ারে ঘরে তুলছি আদৌও বংশে কেউ আসবে কি-না সন্দেহ! ”
এতোটুকু কথা অব্দি ঠিক ছিল কিন্তু যখন শুনলাম তিনি শ্বশুরের সঙ্গে এক অন্যরকম সলাপরামর্শ শুরু করছেন। তিনি শ্বশুরকে বলছেন, ” শোনেন জুনাইদের বাপ! জুনাইদ বাড়িতে আসলে জুনাইদরে বলতে হবে সকালরে যেন ওর মা’র কাছে দিয়ে আসে। শুধু শুধু এরকম অকেজো একজনের জন্য আমার ছেলের জীবন শেষ হতে দিতে পারি না। ”
শ্বশুর জানতে চাইলেন, ” কেন? কি করেছে সকাল? ঘরের কাজ তো দেখি টুকটাক ভালোই করে। নাকি তোমার সাথে আবার কোনো তর্ক করছে? ”
” আরে আপনি বোঝেন নাই। আমি তো এই কাজের কথা বলতেছিনা। যেখানে আমি এতো করে বলার পরেও একটা নাতির মুখ দেখাইতে পারল না সে। তারে রাইখা লাভ কি বলেন? এর চাইতে আমরা বরং সকালের সাথে জুনাইদের তালাকের পর জুনাইদরে আরেকটা বিয়ে করাবো। আমার ছেলের কোনো বংশধর হবে না এটা তো হতে পারে না। ”
এরই মাঝে কতদূর চিন্তা করে ফেলেছেন তিনি। অথচ বিয়ের স্থায়িত্বকাল ভালো করে একটা বছরও পেরুল না। সংসারে সারাদিন গাধার মতো খাটার পর আমার গায়ে ট্যাগ বসানো হলো, আমি অকেজো, বাঁজা, অভাগী মেয়েমানুষ। আমার জন্য উনার সংসারে যত অশান্তি। তাই আমাকে দূর করতে উনি এখনই কোমর বেঁধে নেমেছেন। মনের কষ্টে সেদিন রাতে ঘুম হয়নি মোটেও। আঁটকে রাখা কান্নাও আজ বাঁধ ছাড়া হয়ে যেতে চাইছে। আল্লাহর কাছে তাই পরিত্রাণ চাওয়া ব্যতিত আমার কাছে কোনো রাস্তা জানা নেই। জায়নামাজ গুটিয়ে ভোররাতের সেহরি প্রস্তুতের জন্য উঠে দাঁড়ালাম।

সেহরিতে সবাই পেটপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমতে চলে গেল। কিন্তু তখনও আমার মনের ভেতরে তুমুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছিল না এদের জন্য কোনো রকম কিছু করতে। কিন্তু দায়িত্বের কাছে আমার হাত পা বাঁধা। তাছাড়া না করলেও জুনাইদের কানে শ্বাশুড়ি ঠিক বানিয়ে বানিয়ে কথা লাগিয়ে দিব্যি প্রশান্তির সুখ অনুভব করতেন। যার খাই তার জন্য হলেও তো করতে হবে আমায়। অন্তত শিক্ষকের সন্তান হয়ে অকৃতজ্ঞের মতো কাজ করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ! সেহরিতে কিছুই খেলাম না। কেবল পানি খেয়ে পেট ভরিয়ে নিলাম। সবাই চলে যেতে টেবিলের থালাবাসন গুছিয়ে রান্নাঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে শুতে গেলাম। রাতে না ঘুমানো এবং সারাদিনের ক্লান্তিতে দুচোখ বুজে এলো আমার। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ অনুভব করলাম কারোর গরম নিঃশ্বাস এসে আমার মুখে পরছে। মনে হচ্ছে কেউ আমার ওপর ঝুঁকে রয়েছে। চোখ মেলতেই যা দেখলাম সেটি দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না…

চলবে….!

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৪

0

#আমার_প্রথম_সকাল (০৪)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সকাল আটটা নাগাদ! শ্বশুর বাজার থেকে দেশি মুরগী এবং মাঝারি আকারের রুই, মৃগেলসহ দুই তিন পদের মাছ কিনে আনলেন। সাধারণত রমজান মাসে এতো সকাল সকাল বাজার বসবার কথা না। শ্বশুর ফজরের নামাজের পর কিছুক্ষণ বিশ্রামের নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন আড়ৎ থেকে তাজা মাছ ক্রয় করতে। জেলেরা সাত সকালে তাজা মাছ এনে আড়ৎতে বিক্রির উদ্দেশ্যে বসে পড়ে। বিকেলে হাটের মাছ হয় বরফ দিয়ে রাখা থাকে যার ফলে ততক্ষণে বেশিরভাগ মাছ কিনে আনার পর নরম এবং অনেক সময় দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে দেয়। নয়তো মাছ পানির মধ্যে মৃত ভেজানো থাকে। সে তুলনায় জ্যান্ত মাছ থাকার সুবিধার্থে সকালে বসা আড়ৎ এর মাছে ভেজালের সম্ভাবনাও খুব কম থাকে। গতকাল জুনাইদের পাঠানো টাকা তুলেছিলেন শ্বশুর। টাকা তুলে আসার পথেই এনেছিলেন যাবতীয় মাসকাবারি ও কিছু কাঁচা বাজার। জুনাইদ যখন দেশে টাকা পাঠায় তখন শ্বশুর দুই হাত ভর্তি বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আজও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। সামনে ঈদ। ঈদের আগে আগে মুরগীর দাম বেড়ে যায়। তাই ঈদের দশ দিন আগেই তিনি কিনে এনে একদম সেরে ফেলেছেন। ঘরের কোণায় শ্বশুরের হাঁক ডাক শুনে অগত্যা সারাদিনের ক্লান্তিতে চক্ষু জুড়ে নেমে আসা শান্তির ঘুমকে বিদায় জানিয়ে ওঠতে হলো আমাকে।

ইতিমধ্যে শ্বশুরকে এভাবে ফিরতে দেখে শ্বাশুড়ি শ্বশুরের সঙ্গে চেচামেচি করা শুরু করে দিয়েছেন। উনার একটাই কথা কি দরকার ছিল এক সাথে এতো বাজার করার। ঈদের পর উনার ছোট ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান তখনই কত খরচ পড়বে সেসব জোগাড় করবেন কোথা থেকে তিনি? শ্বশুর জানালেন, যার বিয়ে সে নিজেই করুক গে। এতো ভেবে কাজ আছে, বাঁচব আর কতদিন? ইচ্ছের অপূর্ণ রেখে মরতে নেই।

শ্বশুরের মুখে এমন কথা শুনে শ্বাশুড়ি তেঁতে ওঠলেন। ” জামি এতো টাকা পাবে কোথায় হ্যাঁ? নিজে তো ঠিকই আমাপা লোকজন ডেকে আনবেন। এসবের বন্দোবস্ত করবেটা কে? ”

শ্বশুর বললেন, ” সে চাকরি করে কিসের জন্য যদি নিজের বিয়েতে খরচ দিতে না পারে? ”

” চাকরিতে আর কত টাকাই বা পায়। ও দিয়ে এখন আর কিছুই হয়না। বিয়েতে প্রচুর খরচাপাতি আছে। তখন তো জুনাইদই একমাত্র ভরসা। এভাবে খরচ করলে কি পরে সব দিতে পারবে? ”

” এখানে জুনাইদ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যা দেবে জামিল দিবে। ”

” জুনাইদ দিতে পারবে না মানে? জামিল জুনাইদের ভাই না.? ভাইয়ের জন্য ভাই খরচ করতে পারবে না। তাইলে সে কিসের ভাই? বাপ হয়ে এতো বড় কথাটা আপনি কোন মুখে বলতে পারলেন? ”

” মা হয়ে তুমি যেই মুখে পারছ সেই মুখে। জুনাইদের মা জুনাইদের ওপর আর চাপ দিও না। এমনিতেই নিজের সব উজাড় করে দিয়ে দিছে ছেলেটা। ওর ও ভবিষ্যৎ আছে। ”

” ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে ভাবা যাবে। আগেভাগে ভাবলে কিচ্ছু হয় না। বড় ছেলেদের সংসারে একটু বেশিই দেওয়া লাগে জুনাইদের বাপ। ”

স্বামী স্ত্রী দুইজন নিজেদের মতো ঝগড়া করে দু’জন দু’দিকে চলে গেছে। দু’জনের ফ্যাসাদের মাঝখানে পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মতো কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। কাজ শেষ না করলে শ্বাশুড়ি এসে আবার আমার ওপর রাগারাগি শুরু করবেন। আপাতত সাতসকালে যেচে পড়ে গালমন্দ খাওয়ার সখ হয়নি। মায়ের কাছে থাকতে একা কখনো এসব করতে হয় নি আমায়। মামা এসে প্রতি মাসে মাসকাবারি বাজার সমেত, মাছ, মাংস যা যা লাগত সব বাজার করে দিয়ে যেতেন। বাড়ির আসেপাশের জায়গায় আমি আর রাফা মিলে সখের বশে কয়েকটা সবজির গাছ যত্নের সহিত লাগিয়েছিলাম। যাতে কাঁচা বাজার শেষ হলে মা’কে কষ্ট করে বেশিরভাগ সময় বাজারে যেতে না হয়। এমনকি সামান্য যত্ন করতে পারায় সেগুলোয় বেশ ভালো ফলনও দিত। যেদিন কলেজ যেতাম সেদিন নিজেদের মন মতো দু-একটা তরকারি কিনে ফেরার পথে নিয়ে আসতাম। মামা মাছ মাংস এনে দিলে ওগুলো আমি আর মা মিলে বসে কেটে ফেলতাম অনায়াসে। কখনো এতো কিছু এক সাথে কাটতে হয়নি আমাকে বিয়ের আগ পর্যন্ত। ভাগ্যিস তখন মায়ের সাথে হাতে হাতে করে সব শিখে নিয়েছিলাম। নাহলে শ্বাশুড়ি এ নিয়েও কথা শোনাতে ছাড় দিতেন না। এখন এতো কিছু পারার পরেও শ্বশুর শ্বাশুড়ির মতে আমাকে আমার মা কোনো কাজই শেখায়নি। না শিখে আসলে তো কথাই ছিল না!

প্রায় ঘন্টা দুয়েকের মতো সময় লেগে যায় আমার সব কিছু কাটাকুটি শেষ করতে করতে। শ্বাশুড়ি একটা বারের জন্যেও এদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখেনি। ঘরে এসব ধুতে ঝামেলা লাগে বিধায় পুকুর পাড়ে চলে গেলাম বটি এবং মাছ মাংসের ঝুড়িসহ। পুকুর পাড়ে এগুলোকে রেখে দূরে ময়লাগুলো ফেলতে গেছিলাম যাতে এদিকটায় দুর্গন্ধ না ছড়ায়। আসার সময় পথে পাশের বাড়ির জুনাইদের দুঃসম্পর্কের এক ফুপুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। দেখা মাত্রই তিনি বলে ওঠলেন, ” কিগো জুনাইদের বউ! এইবার কি ইফতারি খাওয়াইবা না কাউরে? ”

ফুপু একা মানুষ। ছেলেমেয়ে নেই। স্বামী গত হয়েছেন বছর দশেক আগে। সেই থেকে ভাইয়ের ভিটেয় থাকেন। উনার ভাইয়ের পরিবারও হতদরিদ্র। খেটে খাওয়া মানুষ, দিন এনে দিন খায়। তাই তিনি এদিক সেদিক গিয়ে এসে খান। উনার এ নিয়ে সমস্যা হয় না। হাতে হাতে দুই একটা কাজ করে দিলে মাসেও কিছু টাকা পান। ও দিয়েই উনার ঔষধ ও একা মানুষ হিসেবে যাবতীয় ভরণপোষণের খরচা উঠে যায়। সেই থেকে আবার নাকি নিজের ভাইকেও দেন৷

” ফুপু আপনাকে তো দেখাই যায় না। ইফতারের সময় আসিয়েন। ইফতারের দাওয়াত আপনার কেমন? ” তিনি মৌন সম্মতি প্রদান করলে আমিও চলে আসি পুকুর ঘাটে। কিন্তু শেষ রক্ষা বোধহয় হলো না। অঘটন একটা আমার সঙ্গে না ঘটলে বোধহয় খুব একটা ভালো হতো না। পুকুর ঘাটে রেখে যাওয়া মাছের বড় একটি মাথা বিড়াল ইতিমধ্যে মুখে করে নিয়ে গেছে। সেটা দেখেছেন আমার জেঠি শ্বাশুড়ি। তিনি চিৎকার করে শ্বাশুড়িকে ডাকা শুরু করলেন।

” জুনাইদের মা কোথায় গেলি? এই জুনাইদের মা, জুনাইদের মাআআআআআ…..

শ্বাশুড়ি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন পুকুর পাড়ে। ” কি হইছে ভাবী.? এমনে ডাকেন কেন? ”

” দেখ বিড়াল তোগো মাছ নিয়া ভাগছে। ”

শ্বাশুড়ি আঁতকে উঠলেন। ” কেমনে ভাবী? ”

” আরে তোর জুনাইদের বউ মাছ রাইখা বাগানের ভেতর গেছে। তখনই সুযোগ মতো বিড়াল মাছের একটা বড় মাথা নিয়ে ভাগছে। ”

জেঠি শ্বাশুড়ির মুখে এমন কথা শোনা মাত্রই শ্বাশুড়ি রেগে মুহুর্তের ব্যবধানে অগ্নিসর্মা রূপ ধারণ করলেন। ” একটা কাজও কি তুমি ঠিক মতো করতে পারো না সকাল? একলা একলা সব কাটছো ভালো কথা। এইজন্য এমনে পালাই রাখি যাইবাগা? ”

” আমি তো সামনে ময়লা ফেলতে গেছিলাম৷ বেশিক্ষণ হয় নাই আম্মা। ”

” গায়ে লাগে না তো, স্বামীর টাকার প্রতি কোনো দয়ামায়া নাই। আমার ছেলেটা যে কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকাগুলা পাঠায় সেগুলো তো তোমার গায়ে লাগব না। বোঝো তো খালি নিজের বাপের বাড়িরটা, কেমনে না দিয়ে বাঁচতে পারে মা।কেবল এই চিন্তায় থাক। কই বাপের বাড়ি থেকে তো পারলা না একটা কানা কড়িও আনতে। হিম্মত থাকলে বাপের বাড়ি থেকে এনে এমনে পালাই রাখিও তো দেখি কত পারো! সাধে কি আর বলি বেছে বেছে ফকিরের বাচ্চা একটারে ঘরে তুলছি! ”

কথায় আছে জোর যার মুল্লুক তার! শ্বাশুড়ির ক্ষেত্রে যেন সেটি বেশ প্রযোজ্য। তিনি যখন যেভাবে পারছেন কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন শুনিয়েই যাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে দুই একটা কথার জবাব যে দেবো সে পথটাও তিনি অবশিষ্ট রাখেন না। একটা বললে পরবর্তীতে সেই কথাটা ঠিক এমনভাবে ফিরিয়ে দেন যাতে করে নিজের আত্মসম্মানবোধ থেকেও বলা না যায়। বিয়ের আগে কখনো কারোর নিকট আমাকে এতোটা অপদস্ত হতে হয়নি। ষোলকলা যেন এখানেই পূর্ণ করে দেওয়ার পরিকল্পনা আগে থেকে করে রেখেছিলেন সৃষ্টিকর্তা।

বিকেলের দিকে জামিল বাড়ি ফিরে আসে। হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। বোঝা যাচ্ছে বউকে নিয়ে কেনাকাটা করে তবেই বাড়ির দিকে মুখ করেছে। বাড়িতে ঢুকে শ্বাশুড়িকে ডেকে উনার হাতে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল। শ্বাশুড়ি তুলে নিয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে বললেন, ” কি ব্যাপার বাপ! এতো কেনাকাটা কার জন্য? ”

” তোমার আর বাবার জন্য। সোমাকে নিয়ে আজকে মার্কেটে গিয়েছিলাম। বিয়ের পর প্রথম ঈদ। কেনাকাটা না করে দিলে কি আর হয়? তাই ওর আর ওর পরিবারের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করতে হয়েছে। ”

সোমার পরিবারকে দিয়েছেন শুনে শ্বাশুড়ির কৌতুহলের মাত্রা বেড়ে গেল। ” ওদের পরিবারের জন্য মানে? ”

” আরে নতুন জামাই না? না দিলে তো লোকে কত কথা বলবে। তাই দিয়েছি। ”

” হ্যাঁ। তাও বটে। ” শ্বাশুড়ি দম ফেললেন। পরক্ষণে বললেন, ” তোকে কিছু দেয়নি তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ি? ”

” হ্যাঁ। ঈদের কেনাকাটা করতে হাতে টাকা তুলে দিয়েছে। সাত হাজার টাকা! ”

শুনে শ্বাশুড়ির চোখ চকচক করতে লাগল। ” যাক ভালোই হয়েছে। একেই বলে কপাল। শ্বশুড় বাড়ি থেকে মানুষ কত কিছু পায়। খালি আমার জুনাইদটা ছাড়া। ছেলেটার কপাল আসলেই খারাপ। কোন কুক্ষণে যে এমন ফকিন্নি বংশের সাথে আত্নীয়তা করতে গেছি কে জানে? ”
শেষের কথাগুলো শ্বাশুড়ি জোরে জোরে আমাকে শুনিয়ে বলছিলেন। অথচ আমার মা-ও গতবার ঈদ উপলক্ষে মেয়ে জামাইকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জুনাইদ সে টাকা নেয়নি। উল্টো নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে মায়ের হাতে গুঁজে অনুরোধের সহিত দোয়ার আবেদন করে জানিয়েছিল, ” আমাকে ক্ষমা করবেন মা! আপনি এ টাকা নিজের কাজে ব্যয় করবেন। আমাকে আল্লাহ যথেষ্ট দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।। দয়া করে পুনরায় সেধে আমাকে ছোট করবেন না। আমার আত্মসম্মানটা বড্ড বেশি সেখানে আঘাত হানবেন না! ”

খুশিতে সেদিন মায়ের চক্ষুযুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল। জুনাইদ আগে আগে বেরিয়ে এলে মা আমাকে আসার পথে জুনাইদের আড়ালে বলেছিল, ” কোনো পূণ্য না করলে জামাইয়ের মতো জামাই তোর কপালে জুটত না। সবসময় জামাইয়ের দিয়ে খেয়াল রাখবি, মুখে মুখে ভুলেও তর্ক করবি না! ”

কথাটা মা মোটেও মিথ্যে বলেনি। আমার মনে এ নিয়ে হামেশাই প্রশ্ন জাগে জুনাইদের মতো ছেলের জন্ম এমন একটা পরিবারে কিভাবে হলো? যেখানে ওর মা, বাবা, ভাই, তিনজন একই রকম এবং সে এতো ব্যতিক্রমধর্মী। জুনাইদের মাও হয়তো নিজের দাম্ভিকতার আড়ালে বড় কোনো পূন্য করেছিলেন। বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার স্বরূপ জুনাইদের মতো ছেলেকে উনি গর্ভে ধারণ করেছিলেন। আমার চোখে দেখা নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন সৎ পুরুষ জুনাইদ নামক মানুষটি। যার মাঝে অন্যকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মাধ্যমে নিজেকে বড় করবার মতো মনোভাব পোষণ করতে আমি আজ অব্দি দেখিনি!

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৩

0

#আমার_প্রথম_সকাল (০৩)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
জামিল চলে যাওয়ার পরপর ঘরের দুয়ারে দেখা মিলল জেঠি শ্বাশুড়ির। উনি এদিকেই আসছিলেন। সম্ভবত শ্বাশুড়ির সঙ্গে আলাপচারিতার উদ্দেশ্য। উনার নিজের ঘরেও ছেলের বউ আছে। জুনাইদদের পরিবারের আগাগোড়া সবদিক থেকেই তারা বেশ স্বচ্ছল পরিবারের মানুষজন। তবে সবার ভাগ্য আমার শ্বাশুড়ি আর জেঠি শ্বাশুড়ির মতো না। ছেলে এবং বউয়ের ঠ্যাঙ্গানি খেয়ে বাকিগুলো চুপচাপ মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও এই দুইজন সেদিক থেকে ঢের বাঁচা বেঁচে আছেন। তবে জেঠি শ্বাশুড়িও শুনি আজকাল আর ছেলে বউয়ের সঙ্গে লেগে বেশিদূর আগাতে পারেন না। প্রায় শুনি শ্বাশুড়ির কাছে নালিশ করেন, বউ নাকি তার মুখে মুখে তর্ক করেন। ছেলেটা নাকি ঠিক তার বউয়ের নেউটা হয়েছে। মা’কে ভুলে বউয়ের আঁচলের নিচে পড়ে থাকে। শ্বাশুড়ি মা এতে দাম্ভিকতার সহিত জবাব দেন, ” আমার ছেলে বাপু মা ছাড়া কিছু বুঝে না। তাই বউও কিছু বলার সাহস করে ওঠতে পারে না। বলবেই বা কেমন করে? জানে তো বেশি করলে যেমন পছন্দ করে ঘরে তুলেছি তেমন বিদেয় করতেও সময় নেবো না! ”

জেঠি শ্বাশুড়ি বলেন, ” এই দিকে তুই ভালোই করছিস দেখেশুনে এতিম মেয়ে ঘরে তুলছিস। বাপের বাড়ি চলে যেতে নিলে অন্তত হলেও একশবার করে ভাববে। আমিই জীবনে করলে সবথেকে বড় ভুল করছি বড়লোক বাড়ির মেয়ের এনে। কথায় কথায় এখন বাপের বাড়ির তেজ দেখায়। ”

শ্বাশুড়ির এতে বেশ গর্ববোধ হয়। অথচ উনি জানেনই না উনার একেকটা কর্মকান্ড আমার রোজকার একেকটা হাহাকার এবং দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়। আল্লাহ না করুক, এমন কপাল গুণ নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো মেয়ে না জন্মাক।

এতোক্ষণে খেয়াল করলাম জেঠি শ্বাশুড়ির সঙ্গে উনার বউমাও এদিকে আসছেন। উনার হাতে ইফতারির বাড়ি আর বউয়ের হাতে কিছু ফল। সেগুলো নজরে না পড়লেও সঙ্গে করে কেঁটে আনা অর্ধেকটা তরমুজ বেশ বোঝা যাচ্ছে। আমাকে দেখে জেঠি শ্বাশুড়ির বউমা মৃদু হাসল। জেঠি শ্বাশুড়ি এগিয়ে এলেন ঘরের চৌকাঠ মাড়িয়ে। আমার হাতে ইফতারির থালাটা তুলে দিয়ে বললেন, ” কিগো বউ! এখানে দাঁড়ায়া আছো ক্যান এই অসময়ে। আজকে কি ইফতারি বানাও নাই? ”

” জ্বি জেঠি এতোক্ষণ রান্নাঘরেই ছিলাম। জামিল ভাই ডাক দেওয়ায় এদিকে আসলাম। ”

” ওহ্। তা তোমার শ্বাশুড়ি কই? ”

” উনি ঘরেই আছেন। ” বলেই কালবিলম্ব না করে চলে এলাম রান্নাঘরের দিকে। দ্রুত হাতে চুলাটা বন্ধ করে দিয়ে প্রেসার কুকারের ঢাকনাটা খুলে রাখলাম। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসেছিলাম। নাহলে ছোলাগুলো তলানিতে লেগে একেবারে পুঁড়ে যেত। আমার পেছন পেছন কখন নীলা এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। নীলা হলো আমার জেঠি শ্বাশুড়ির ছেলে বউ। নীলা বলল, ” ভাবী ধরেন তরমুজটা কেটে ফেলেন। গরমের দিন কেটে কিছুক্ষণের জন্য ফ্রিজে রেখে দেন। দেখবেন রোজা ভাঙার পর ঠান্ডা ঠান্ডা খেতে ভালো লাগবে। ”

নীলার কথায় সায় দিয়ে তরমুজ কাটতে বসে গেলাম। নিজের কাজে ব্যস্তরত অবস্থায়ই নীলাকে বললাম, ” নীলা তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আসলে কেমন? ” জানি প্রশ্নটা করা ঠিক না। তবুও কৌতুহল থেকে নিজের ভাগ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার এক অবাধ্য প্রচেষ্টা থেকেই করা। নীলার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। জবাবে বলল,
” আর বলবেন না। জানেন ঘরে ঘরে একই কাহিনী। ”

” কিরকম? ”

” আপনার ঘরে যা চলছে আমার ঘরেও তা। বাপের বাড়ি থেকে যত পাঠায় উনাদের পেট ভরে না। একেকটা রাক্ষসের পেট যেন। অথচ কখনো খোঁজ নিয়ে দেখে না ছেলের শ্বশুর শ্বাশুড়ি ঠিক মতো খেল কি খেল না! ”

নীলার কথার ধরনে অবাক হলাম। সেই সঙ্গে এও বুঝলাম, ভাগ্য একা আমারই এমন না। সবাই একই পথের পথিক। সবাই এর ভুক্তভোগী।

নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ” জানেন ভাবী পর পরই হয়। বাবার চেহারার দিকে তাকালে নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে। আগে যে বেতন পেত তা দিয়ে আমার পরিবারটা হাসিখুশি এবং খুব ভালো ভাবে চলতে পারত। অথচ এখন সেই বাপ মাকে আমার জীর্ণশীর্ণ দেখায়। সারাক্ষণ তাদের মাথায় চিন্তা গুরপাক খায়। ছোট বোনের জন্য ভালো জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসে বাবা সম্মতি দেয় না। ছোট ভাইটার সামনে এডমিশন। কোচিং খরচ, ঢাকায় থাকা খাওয়া কমসম খরচ না। তারওপর এনারা তো আছেনই। ”

” তোমার ছোটবোন তো দেখলাম মাশাআল্লাহ বড় হয়ে গেছে। ”

” হ্যাঁ। সে আর বলছি কি! বাবা এক মেয়েকে দেনা করে বিয়ে দিয়েছে, সেই দেনার ভোজা এখনো মাথার ওপর বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেগুলো শোধ না হলে অন্যজনকে কীভাবে পরের বাড়ি পাঠায়? ”

নীলার কথা বলার ফাঁকে জেঠি শ্বাশুড়ির হাঁক ডাক পড়ল। ” এই নীলা ঘরে না গিয়ে ওখানে কি কর? কাজ কাম কি নাই? ”

” আমি আসি ভাবী। পরে সময় করে এসে কথা বলবোনে। ”

জেঠি নীলাকে এমনিতেও বাড়ির কারো সঙ্গে তেমন একটা মিশতে দেন না। উনার ভয় এমনিতেই নাকি নীলা ওনার হাতের নাগালের বাহিরে চলে গেছে এখন যতটুকু পারছেন টাইটে রাখতে, পরে মানুষের পাল্লায় আরো খারাপ হয়ে যাবে। উনার ভাবনা মতে মানুষ উনার ছেলে বউকে ফুসলায় কি-না!

নীলা চলে যাওয়ার পরপর শ্বাশুড়ি মা নিজের কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। নীলার রেখে যাওয়া ফলমূল নেড়েচেড়ে দেখলেন। উনার চেহারার রঙ বদলে গেছে এতোক্ষণে৷ বিড়বিড় করলেন নিজে নিজে, যা আমি শুনেও না শুনার ভাণ করে নিজের কাছে মনোনিবেশ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। ভাবমূর্তির ধরনে বোঝা গেল এসব উনার মোটেও পছন্দ হয়নি। কিয়ৎক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শুনতে পেলাম শ্বাশুড়ি বলছেন, ” হ্যাঁ, মানুষের এসব দেখেই পার করতে হবে। কপালে এতো সুখ নিয়ে আসছি না-কি? তোমার মাও কি মহিলা, নাম মাত্র রোজার জন্য কয়েকপদ এনেই হাত খিচিয়ে বসে আছেন। বলি গরমের দিন আসল তো, ফোন করে বলিও এতো কিপ্টামি না করে সামনে যেন ফলমূল একটু বেশি করে পাঠায়। তোমরা ছাড়া আর খাওয়ার মতো আছে কে তার? ” পেছন ফিরে এক নজর তাকালাম শ্বাশুড়ির মুখের দিকে আর কোথাও যেন নীলার তখনকার বলে যাওয়া কথার সঙ্গে বেশ মিল খুঁজে পেলাম। তিনি পুনরায় বলে উঠলেন, ” এভাবে কী দেখতেছো? এসব কি আমরা খেতে বলছি নাকি? জুনাইদ তখন দেশে থাকবে। ওর এসব দেশি ফলমূল খাওয়ার প্রতি সখ বেশি। মেয়ের জামাইয়ের জন্য এতটুকু পারবে না তোমার মা? ”

কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। উনি জুনাইদের নাম বেঁচে দিব্যি দায় সারা হওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ উনার ছেলে ঠিক কোনটা চায় আর কোনটা চায় না উনি ভেবেছেন সেসব সম্পর্কে আমার এতোদিনে বিন্দু পরিমাণও ধারণা হয়ে ওঠেনি। জুনাইদ যে কোনো কালেও পরের আশা করবার মতো ছেলে না সেসব বোধহয় উনি ওর মা হয়ে ভুলে বসেছেন।

মাগরিবের নামাজ শেষ হওয়ার পর প্রতিদিনকার মতো আমি রান্নার কাজে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। ইফতার শেষ করে শ্বাশুড়ি শ্বশুর তখন নিজেদের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। শ্বাশুড়ি হঠাৎ ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। এসেই জানতে চাইলেন, আমি জামিলকে কি বলেছি।

জামিলের সঙ্গে তখনকার সাক্ষাৎ এর পুরো কথাগুলো বললাম। শ্বাশুড়ি শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ” তুমি পারলা না আমার ছেলেটার জুতোজোড়া আগাই দিতে? তাতে কি তোমার হাত ক্ষয় হয়ে যাইত? ”

” মা আমি তো উনার জুতো চিনিই না। তাহলে আমি কেন আগাই দিতে যাবো? আর উনারও কি উচিত হইছে এই কথাটা আমাকে বলার? বয়সে না হোক সম্মানের দিক থেকে তো আমি উনার ওপরেই তাই না! ”

” কি বললা! সম্মানের কথা যে বললা সে সম্মানটা তুমি আদায় করে নিতে জানছো? সম্মানটা দৌড়াই দৌড়াই আসবে না বুঝছো? আর এতো যে ব্যস্ততার অযুহাত দেখাইলা আমার ছেলেরে, সারাদিন করটা কি? তোমারে দিয়ে কোন কাজ করাই আমি শুধু রান্নাটা ছাড়া? ”

শ্বাশুড়ির চেচামেচি শুনে ও ঘর থেকে জেঠিমা অব্ধি বের হয়ে এসেছেন। জেঠিমাকে দেখা মাত্র আমি সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে রইলাম। বলা বাহুল্য শেষে জেঠিমার সামনে নিজের মা’কে না আবার গালাগাল শুনতে হয়। আমি চুপসে গেলেও এদিকে শ্বাশুড়ি চুপ করে নেই। তিনি নিজের মতো বকেই যাচ্ছেন বকেই যাচ্ছেন।

” বাপ তো সর্গে উঠে পা তুলে বসে আছে, মাও আমার ছেলের ঘাড়ে তুলে দিয়ে দিব্যি শ্বাস ছেড়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে আমার ছেলেটার জীবনটা আমি নিজ হাতে শেষ করে দিছি। ” জুনাইদের জেঠিকে আসতে দেখে তিনি হনহনিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। ঘরে যাওয়ার পরের প্রদক্ষেপটা যে ঠিক কি হতে পারে সেটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি৷

চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০২

0

#আমার_প্রথম_সকাল (০২)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে করে আনা খবরের কাগজের শিরোনামে বেশ কয়েকবার পড়েছিলাম, যৌতুকের জন্য গৃহবধূ নির্যাতন। এখন যুগ বদলেছে এখন আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা গায়ে হাত তোলে না, এখন ছোড়ে কথায় কাদামাটি। হাতের মারের চেয়ে আঘাতের মার বেশ কষ্ট দায়ক। সহজে হজম করে যেমন নেওয়া যায় না তেমনি প্রতিবাদস্বরূপ কিচ্ছুটি বলাও যাবে না। তার কারণ তারা পরেরবাড়ি লোক, মেয়েদের জন্মের মুখ্য উদ্দেশ্যই হলো পরের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে মানিয়ে চলা। পরের বাড়ির লোকজন এবার সে যেমনই হোক। তোমার কর্ম তুমি কর, কিছু বললে কেবল চুপচাপ শুনে যাও। মেয়ে মানুষের এতো মুখে মুখে তর্ক করা সাজে না। নাহলে বাবা মায়ের বদনাম হবে যে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি কিছুক্ষণ আগের খবরখানা তাদের ছেলের কানে তুলে দিতে ভুল করলেন না। যা জুনাইদের জিজ্ঞাসাবাদের ধরণেই স্পষ্টত প্রতীয়মান।

” সকাল! আমি কি শুনছি এসব? ”

” কি শুনছেন? ” আমি কণ্ঠস্বর যথেষ্ট শান্ত রেখে বললাম।

জুনাইদ ভনিতা ছাড়াই আমায় বলল, ” মা বকা দেওয়ায় তুমি না-কি ইচ্ছে করে রান্নাঘরে বটিটা রেখেছ যাতে মায়ের পা কেটে যায়? ”

অধর জুড়ে এবার আমার হাসি ফুটল। কেন হাসছি তা আমি নিজেও জানি না। খুব সম্ভব মাথার স্ক্রু ডিলে হয়ে গেছে। বললাম, ” আর কি কি বলেছে আপনার মা? ”

” মা কিছুই বলেনি আমায়। বলেছে… ” জুনাইদ বোধহয় বুঝল বউয়ের নিকট বাবা মায়ের নালিশের কথা বলতে হয় না! তাই তো ঝটপট কথার প্রসঙ্গ বদলে ফেলল। ” যাকগে বাদ দেও। ঠিক মতো ইফতার করেছ? ”

” হু! ” ইচ্ছে করেই কথাটা লুকলাম। অন্যথায় ওসব খাবার গলায় এ মুহুর্তে বিষের ন্যায় লাগবে যে!

” মিথ্যে বলছ কেন? আমি জানি তুমি খাওনি! ”

” জানলে জিজ্ঞেস করছেন কেন? ”

” আমার জিজ্ঞেস করার অধিকার আছে তাই! ”

” ওহ্হ! ” ছোট করে জবাব দিয়ে মৌনতা বজায় রাখলাম। কথা বলার মতো বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। জুনাইদ সেটাও বুঝল। মিনিট দু’য়েক মৌন থাকার পর ওপাশ থেকে জুনাইদকে নাম ধরে ডাকতে শোনা গেল,
” সকাল! ”

” হুম! ”

” খেয়ে নেও। নাহলে শরীর খারাপ করবে। আমি এসে যেন তোমাকে সুস্থ সবল পাই। ”

” কীভাবে পাবেন শুনি? ”

” মন খারাপ করো না সকাল। আমি বাবা মা’কে বলে দেবো। যাও খেয়ে নেও কেমন? ” বলেই ফোন রাখল জুনাইদ।

মানুষটার সাথে থেকে অন্তত এতটুকু বুঝেছি, সে যথেষ্ট ধৈর্যশীল এবং বুঝদার একজন মানুষ। সন্তান হিসেবে যেমন নিজের অবস্থানটা ধরে রাখতে চেষ্টা করে, স্ত্রীয়ের কাছেও স্বামী হিসেবে তাই! কিন্তু এতো দিকে আসলে সামলে ওঠার ক্ষমতা সব সময় সবার হয়ে ওঠে না। কখনো কখনো কাউকে না কাউকে আত্নত্যাগ করে চলতে হয়। তবে জুনাইদের প্রতি এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। কখনো করতে হয়ওনি। কারণ আমার ধারণা জুনাইদ আগে থেকে সব বুঝে যায়। এও বুঝে যায় সর্বদা দোষ একদিকে থাকে না। কখনো সখনো বিপরীত দিক থেকেও ঘটে থাকে। অভিযোগ আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির প্রতিও না! আছে কেবল আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ওপর। মানুষ সভ্য প্রাণী। বেঁচে থাকতে তাদের দলবদ্ধ হয়ে বাঁচতে হয়। দলবদ্ধতার জের ধরেই উৎপত্তি হয়েছিল সমাজের। অথচ সেই সমাজই একসময় হয়ে ওঠে সমাজের মানুষগুলোরই মানসিক যন্ত্রণার কারণ। সমাজের তৈরি করা অবাঞ্ছিত কিছু নিয়মশৃঙ্খলার কারণেই আজকাল বেশিরভাগ আত্নহত্যার মতো ঘটনাগুলো প্রবল মাত্রায় বাড়ছে। সমাজের কিছু লোকমুখে প্রচলিত মতবিশ্বাসের কারণে অনেক বাবা মাকে মেয়ে সন্তানের চিন্তায় হৃদরোগের জন্য অকালে মরতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করে এহেন সমাজ ব্যবস্থাকে।

শ্বাশুড়ি মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন। জুনাইদ কিছুক্ষণ আগে উনার কাছে ফোন করেছিল। জানিয়েছে শ্বাশুড়ি একাউন্টে কিছু টাকা পাঠিয়েছে, ইফতারি সমেত প্রয়োজনীয় যা যা লাগবে তারা যেন নিজেদের মতো সব কিনে নেয়। সেই সঙ্গে নিজের বউয়ের সম্পর্কে অনুরোধ করে এও বলল, তাকে যেন আর ওসব ব্যাপারে কিছু না বলেন তারা! শ্বাশুড়ি ওপর থেকে ছেলের কথায় সায় দিলেও অন্তর থেকে বেজায় রেগে গেলেন। আমাকে তাই নজরে পড়তে তিনি ফোঁড়ন কাটলেন, ” কী খাইয়ে বশ করেছ আমার ছেলেকে? ”

” কি বলছেন এসব? আমি কেন আপনার ছেলেকে……

” তা নয়ত কী? তোমার মা’কে দিয়ে তাবিজ-কবচের ব্যবস্থাটাও করে ফেললে বাহ্! ”

” আমি আপনার ছেলেকে তাবিজ করতে যাবো কেন? ”

” নাহলে জুনাইদ আমার ছেলে হয়ে নিজের শ্বাশুড়ির গুণগান গাইবে কেন হ্যাঁ? ” রাগে গজগজ করতে করতে তিনি বললেন, ” শোন একটা কথা তোমাকে বলে রাখছি, আমার ছেলেকে একদম আমার থেকে কেড়ে নেওয়ার চিন্তা মাথাতেও আনবা না। তাহলে তো বোঝই! ”

” মা আপনার ছেলে কিন্তু আমারও স্বামী! ” কথাটি না বলে থাকতে পারলাম না। তাতে করে উনার রাগে ভাটা তো পড়লই না বরঞ্চ রাগ উল্টো দাউ দাউ করে বাড়তে লাগল। ” কি বললে! ধমকে যে বললে জুনাইদ তোমার স্বামী! তা স্বামীটা এলো কই থেকে শুনি? ওকে তো আমিই পেটে ধরেছি। দশ মাস পেটে ধরছি, জন্মের পর লালন পালন করে এতদূর এনেছি। আর উনি অল্প কয়দিনে এসেই স্বামী দাবী করে। হুহহহহ একেবারে উনার স্বামী! ” তাচ্ছিল্যের সহিত কথাগুলো বললেন।

উনার কথার প্রতিত্তোরে আর কিচ্ছুটি বলার মুখ রইল না আমার। মৌনতা বজায় রেখে নিজের কাজে মন বসালাম।

রান্নাঘরে আজকের ইফতারের আয়োজন করছিলাম। চুলায় ছোলা এবং আলু প্রেসার কুকারে করে সিদ্ধ করতে দিয়ে নামাজের জন্য যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে আমার দেবর জামিলের ডাক পড়ল। ” ভাবী একটু এদিকে আসেন তো! ”

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জামিল। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও বের হচ্ছে। সাধারণত নিজের ঘরের বাহিরে খুব একটা বের হতে দেখা যায় না তাকে। কিন্তু এখন বোঝাই যাচ্ছে একেবারে আঁটসাঁট বেঁধে তৈরি হয়ে সে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। কাঁধে ঝোলানো একটা ব্যাগও নজরে পড়ল। কৌতুহলের বসবর্তী হয়ে জানতে জিজ্ঞেস করলাম, ” জ্বি! কোথাও যাচ্ছেন আপনি? ”

” হ্যাঁ ভাবী। সোমাদের ওদিকে যাবো। ” সোমা হলো আমার দেবরের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীয়ের নাম। সম্পর্কে আমার জা হয় সে। দেবরের ও বাড়ি যাওয়াটা অবান্তর কিছু নয়। তারওপর প্রেমের বিয়ে বলে কথা! বউয়ের জন্য তাই তার মনটাও সর্বদা উতলা হয়ে থাকে। কিন্তু বের হওয়ায় আগে নিজের মা’কে না ডেকে আমাকে ডাকার কারণটা ঠিক ধরতে করতে পারলাম না। বললাম,
” ভাইয়া কি কিছু বলবেন? নাহলে আমি রান্নাঘরে যেতাম নইলে পানি শুকিয়ে ছোলাগুলো কুকারের তলায় লেগে যাবে যে। ”

কথাটা বলতে বলতে সত্যিই জোরেসোরে পঞ্চমবারের মতো প্রেসার কুকাকের সিটি বাজল। চুলাটা বন্ধ করে দেওয়াটা জরুরী মনে হতেই সেদিকে ছুটে যাচ্ছিলাম ওমনি পেছন থেকে জামিলের ডাক পড়ল, ” জুতার র‍্যাক থেকে আমার নতুন জুতা জোড়া এনে দেন তো! ”

কম না হলেও র‍্যাকে তার জুতার সংখ্যা সাত ছাড়িয়ে। র‍্যাকে কোনো পুরনো জুতো নজরে পড়েনি। এ মুহুর্তে তাই তার নতুন জুতা নির্বাচন করাটাও বিরাট কষ্টসাধ্য কাজ বলে মনে হলো। তারওপর রান্নাঘরে না গেলেও বাড়বে বিপদ। শ্বাশুড়ি টের পেলে খবর করে ফেলবেন।
” ভাবী তাড়াতাড়ি করেন আমার দেরি হয়ে যাবে। ”

” বলছিলাম, ভাইয়া আমি তো আপনার জুতা ঠিক মতো জানব না তাই না? আপনি যদি একটু কষ্ট করে নিয়ে নিতেন? ”

” মানে কি? আমি যদি নিজে গিয়ে নিতে পারতাম তাহলে কি আর আপনাকে ডেকে আনতাম? ”

” তাহলে আপনি একটু দাঁড়ান আমি চুলাটা বন্ধ করে আসি। ”

আমার কথায় জামিল বেজায় বিরক্তবোধ করল। নিজেই নিজের জুতা জোড়া খুঁজে আনতে গেল হনহন করতে করতে আর বলতে বলতে,
” নখরামি বাদ দিয়ে দেন ভাবী। আমার ভাই দেখি আপনারে রাখছে আমি হইলে এই দুয়ার দিয়ে এনে ঐ দুয়ার দিয়ে বের করতাম আপনারে। মা শুধু শুধু আপনার সাথে চেঁচায় না ঠিকই আছে। যে যেমন তার কর্মফলও তেমন! ”

চলবে…….

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

আমার প্রথম সকাল পর্ব-০১

0

#আমার_প্রথম_সকাল
#প্রারম্ভ_পর্ব
#ফাহমিদা_মুশাররাত

” ফকিরের মেয়ের সাহস কত বড়, লাজ সরমের মাথা খেয়ে ধেই ধেই করে খেতে বসে গেছে! ”

মাগরিবের আজান হলো মাত্র। সবাই ইফতারি করতে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। কাজের ফাঁকে ইফতারের জন্য সবেমাত্র খেজুর মুখে তুলেছি। ওমনি শ্বাশুড়ি কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে বসলেন। শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলো কর্ণ কুহরে এসে ঠেকতে কামড় বসানো খেজুরের অংশটুকু গলায় বিঁধে গেছে। মনে পড়ল সত্যিই তো! আমি তো ফকিরের মেয়ে। তাদের মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের বউ হয়ে এসেছি ঠিকই, তাই বলে নিজের পারিবারিক অবস্থার কথা ভুলে গেলাম কি করে!

আমাদের সভ্য সমাজের একটা বিশেষ নিয়ম আছে। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর বাবা মা’কে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ঘর সাজিয়ে দিতে হয়, ট্রাক বোঝাই করে প্রতি মৌসুমে ফলফলাদি থেকে শুরু করে দুই ঈদে শ্বশুর বাড়ির লোককে ঈদের জামাকাপড় সমেত, কুরবানির সময় কুরবানির জন্য পশু পর্যন্ত পাঠাতে হয়। নাহলে মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে সুখী দেখার আশা করাটাও যে পাপ। যার বাপের বাড়ি থেকে যত সরঞ্জাম আসবে সে মেয়েটা সংসার জীবনে তত সুখ সাচ্ছন্দ্যে মেতে থাকবে। আর প্রত্যেক বাবা মা-ই চাইবে তাদের মেয়েটা সুখে থাকুক। শ্বশুরবাড়িতে তার একটা ভালো এবং পাকাপোক্ত অবস্থান গড়ে উঠুক। তাই নিজেদের কথা ভুলে গিয়ে তারাও মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসব পাঠাতে কার্পন্যবোধ করেন না। কিন্তু সবার সামর্থ্যের সাথে কি আর সবার বনে?

শ্বাশুড়ি গজগজ করতে করতে বললেন, ” কত করে বললাম বাপের বাড়ি ফোন করে বলতে ইফতারের আইটেম আরো বাড়িয়ে দিতে! শুনল কই? এর জন্য মান সম্মান সব আমার ধুলোয় মিশে একাকার হয়ে গেছে। এভাবে কি দেখ, ইফতার শেষ হলে যাও রাতের রান্নার ব্যবস্থা কর। আমি এসে নাহয় করে দেবো। মায়ের কাছ থেকে তো কিছু ঠিকঠাক শিখেও আসনি যে একটা দিনের জন্য হলেও আমার শরীরটা একটুখানি জিরবে। ”

নিরব সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিলাম ডাইনিং টেবিল ছেড়ে। সারাদিন রোজা রেখে বাসার সব কাজ একা হাতে সামলেছি। তবুও দোষের কোনো অন্ত নেই। খুঁত খুঁজে পাওয়া মাত্র আমার মৃ’ত বাপকে তুলে ঝাড়তে পর্যন্ত ছাড় দেন না শ্বাশুড়ি। বাবা মা’রা গেছেন সেই ছোট বেলায়, তখন আমি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলাম। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বাবার মৃ’ত্যুর পর আমি আর আমার ছোটবোনকে মা একাই দেখাশোনা করতে শুরু করেন। খরচ বলতে প্রতি মাসে বাবার পেনশনের সামান্য টাকাতে ভালোমতো চলে যায় আমাদের মা মেয়ে তিনজনের। মফস্বল এলাকায় থাকার দরুন কি-না! এক বছর হলো বিয়ে করে এ বাড়ি এসেছি। বিয়ের মাস দু’য়েক পর আমার স্বামী জুনাইদ হাসান পাড়ি জমায় প্রবাস জীবনে। তারপর থেকে এ বাড়িতে আমি, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, দেবর মিলে থাকি। ননদ শ্বশুর বাড়িতে। বছরের দুই একবার বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে। গত মাসে অবশ্য তার ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাপের বাড়িতে আগমন ঘটেছে। গত মাসে আমার দেবরের আকন্দ হয়ে গেছে। বউ এখনো তুলে দেয়নি। তবে ঈদের পর জুনাইদ এলে মহা ধুমধামে তারা তাদের মেয়ে তুলে দেবে। মেয়ে আসার আগেই দেবরের শ্বশুর শ্বাশুড়ি মেয়ের ঘর সাজিয়ে দিয়েছেন। তাতেও শ্বাশুড়ি আমাকে কথা শোনাতে কার্পন্য করেননি। বলেছিলেন, ” আত্নীয়তা একেই বলে! এমন পরিবারের সঙ্গে আত্নীয়তা করতে পারাটাও তাদের ছেলের সাত কপালের ভাগ্য। বড় ছেলেটা তো অভাগা। বউটাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছে। নাহলে বউ শ্বশুর বাড়ি আসতে খালি হাতে কেন আসবে? ”

গতকাল বিকেলে আমার মা এবং ছোট বোন ইফতারি নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি এসেছিল। ভ্যানে করে ইফতারির জিনিসপত্র দেখে শ্বাশুড়িকে বেশ সন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল। আমার মা এবং বোনকে বেশ আপ্যায়নও করা হলো ভালোভাবে। শ্বাশুড়ির অবস্থা দেখে স্বস্তি লাগলেও মায়ের চেহারার দিকে তাকাতে নিজেকে ভীষণ হেও মনে হলো। মনে হলো মেয়ে হয়ে জন্মে বুঝি জীবনে সবচেয়ে বড় পাপ করে বসলাম। মায়ের চেহারাটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে কারণ জানতে চাইলে মা বলতে চাইলেন না। পরক্ষণে আমার ছোটবোন রাফা বলে উঠল, ” মা বাবার দেওয়া শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিয়েছে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে। সেখানকার কিছু টাকা তুলে রেখেছে কুরবানির জন্য। ” রাফা কথাটা বলতেই মা তাকে ধমকে উঠলেন, ” তোকে এতো কথা কেউ বলতে বলেছে?”

আমি জানি বাবার মা’কে দেওয়া শেষ স্মৃতিটা ছিল মায়ের হাতের বালা জোড়া। প্রায় আধা ভড়ি স্বর্ণ দিয়ে বানানো ছিল সেটি। মা’কে বললাম, ” মা তাই বলে তুমি বাবার দেওয়া বালাটা বিক্রি করে দিলে? বাবা তো নিজের সবটুকু সম্পদ আমাদের জন্য রেখে গেছে। সেগুলো কি যথেষ্ট নয়? ”

মা জবাবে শুধু এতটুকু বললেন, ” তোরা সুখী হ মা। আমার এর বেশি কিছু চাওয়ার নেই! ”

সন্ধ্যার পর মা এবং রাফা চলে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেল আমার জেঠি শ্বাশুড়ির সঙ্গে। মায়েরা আসার সংবাদ শুনে তিনি এ ঘরে ছুটে এলেন। মা চলে যাওয়ার পর তিনি সবটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন শ্বাশুড়ির সঙ্গে। অতঃপর মন্তব্য করে বসলেন কম হয়েছে! তার ছেলের শ্বশুর বাড়ির গল্প করে শ্বাশুড়িকে ক্ষেপাতে ভুল করলেন না। শ্বাশুড়ি হাসিখুশি মুখটায় আষাঢ় মাসের কালো মেঘে ডাকা পড়ে গেল তাৎক্ষণিক।

চুলার ওপর রান্না চড়িয়ে নামাজের উদ্দেশ্যে নিজ কক্ষে গিয়েছিলাম। তিন রাকাআতের সালাম ফেরানোর পর পর রান্নাঘর থেকে শ্বাশুড়ির চিৎকার শুনে তাড়াহুড়ো করে উঠে রান্নাঘরের দিকে ছুট লাগালাম। মেঝেতে বসে শ্বাশুড়ি পা ধরে ছপছপ করছেন এবং চেঁচাচ্ছেন। উনার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল থেকে রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখে তিনি এবার জোরে জোরে শ্বশুরকে ডাকা শুরু করলেন।

” জুনাইদের বাপ কোথায় আপনি। দেখে যান কোন সর্বনাশীকে ঘরে তুলেছে আপনার ছেলে! ”

শ্বাশুড়ির চিৎকার শুনে শ্বশুর নিজের কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ” কি হয়েছে জুনাইদের মা? দেখি পা কিভাবে কাটল? ”

” একটু আগের শোধ তুলতে ফকিন্নির বাচ্চাটা ইচ্ছে করে এখানে বটি রেখে দিয়েছে। যাতে আমি আসি আর এখানে আমার পা কাটে। হায় হায় জুনাইদের বাপ! ” বলেই শ্বাশুড়ি আর্তনাদ করতে লাগলেন।

শ্বশুর আমার দিকে কটমট করে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। তখনকার মতো শ্বাশুড়িকে নিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে।

” ভালো নেই রে বাবা! তোকে রেখে কি তোর মা ভালো থাকতে পারে বল? ”

জুনাইদ প্রতিরাতে আলাদা করে ভিডিও কলে কথা বলে বাবা মায়ের সঙ্গে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি।

জুনাইদ জানাল, ” কি করব মা? প্রবাসে কাটাতে কার ভালো লাগে বল? কিন্তু চাইলেই তো আসা যায় না। ”

” হ্যাঁ রে বাবা। ” বলে তিনি আঁচলে মুখ গুঁজলেন। মায়ের অশ্রুসজল নয়ন জোড়া নজরে পড়তে অশ্রুপাত বিসর্জনের কারণ জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠল জুনাইদ। ” কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছ কেন? বাড়ির সবাই ঠিক আছে? বাবা কোথায়? উনাকে কোথাও দেখছি না! ”

” এইতো পাশেই আছে। নে ধর কথা বলল। ”

জুনাইদের বাবা জাফর হোসেন স্ত্রীয়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার ইতিবৃত্তি খুলে বললেন। সবটা শুনে জুনাইদের কপাল জুড়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বিগত কয়েকমাস জুড়ে জুনাইদ সকালের সম্পর্কে নেতিবাচক কথাগুলো শুনে আসছে। বাবা মা মিথ্যে বলবে না এমনটিও জানে সে। কিন্তু সকাল নিজেও এসব নিয়ে তার নিকট কোনো অভিযোগ দায়ের করে নি আজ অব্দি। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও বলা হয়ে ওঠে না জুনাইদের।

জাফর হোসেন ছেলেকে নিরব থাকতে দেখে বললেন, ” তোর মা নাহয় তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে ইফতারের আইটেম বাড়িয়ে দিতেই বলেছে। তাই বলে তোর বউ রাগ করে না খেয়ে চলে গিয়ে আবার এভাবে রাগের বদলা নেবে? ”

জাফর হোসেনকে নালিশ করতে দেখে জুনাইদের মা অর্থ্যাৎ রোকেয়া বেগম মেকি কান্নার স্বরে নিষেধ করতে চাইলেন। ” থাক জুনাইদের বাপ। বাদ দেন এসব। কপালে নেই ছেলের বউয়ের খেদমত। শুধু শুধু ছেলেকে বলে কি লাভ! ”

” না রোকেয়া। আমাকে বলতে দেও। এভাবে চুপ করে থাকলে চলবে না। জুনাইদ তুই এর একটা বিহিত করবি। তুই থাকতে তোর বউয়ের এতো বাড় কিভাবে বাড়ে? ”

জুনাইদ ভাবনায় পড়ে গেল। বাবা মায়ের অভিযোগ শুনে তাদের আশ্বাস দিল, ” আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করব। কেন সে এ কাজ করেছে! ”

ছেলের মুখে এ কথা শুনে রোকেয়া বেগম আশ্বস্ত হলেন। এবার মেয়েটা বুঝবে মজা।

চলবে…….?