আমার প্রথম সকাল পর্ব-০১

0
112

#আমার_প্রথম_সকাল
#প্রারম্ভ_পর্ব
#ফাহমিদা_মুশাররাত

” ফকিরের মেয়ের সাহস কত বড়, লাজ সরমের মাথা খেয়ে ধেই ধেই করে খেতে বসে গেছে! ”

মাগরিবের আজান হলো মাত্র। সবাই ইফতারি করতে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। কাজের ফাঁকে ইফতারের জন্য সবেমাত্র খেজুর মুখে তুলেছি। ওমনি শ্বাশুড়ি কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে বসলেন। শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলো কর্ণ কুহরে এসে ঠেকতে কামড় বসানো খেজুরের অংশটুকু গলায় বিঁধে গেছে। মনে পড়ল সত্যিই তো! আমি তো ফকিরের মেয়ে। তাদের মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের বউ হয়ে এসেছি ঠিকই, তাই বলে নিজের পারিবারিক অবস্থার কথা ভুলে গেলাম কি করে!

আমাদের সভ্য সমাজের একটা বিশেষ নিয়ম আছে। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর বাবা মা’কে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ঘর সাজিয়ে দিতে হয়, ট্রাক বোঝাই করে প্রতি মৌসুমে ফলফলাদি থেকে শুরু করে দুই ঈদে শ্বশুর বাড়ির লোককে ঈদের জামাকাপড় সমেত, কুরবানির সময় কুরবানির জন্য পশু পর্যন্ত পাঠাতে হয়। নাহলে মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে সুখী দেখার আশা করাটাও যে পাপ। যার বাপের বাড়ি থেকে যত সরঞ্জাম আসবে সে মেয়েটা সংসার জীবনে তত সুখ সাচ্ছন্দ্যে মেতে থাকবে। আর প্রত্যেক বাবা মা-ই চাইবে তাদের মেয়েটা সুখে থাকুক। শ্বশুরবাড়িতে তার একটা ভালো এবং পাকাপোক্ত অবস্থান গড়ে উঠুক। তাই নিজেদের কথা ভুলে গিয়ে তারাও মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসব পাঠাতে কার্পন্যবোধ করেন না। কিন্তু সবার সামর্থ্যের সাথে কি আর সবার বনে?

শ্বাশুড়ি গজগজ করতে করতে বললেন, ” কত করে বললাম বাপের বাড়ি ফোন করে বলতে ইফতারের আইটেম আরো বাড়িয়ে দিতে! শুনল কই? এর জন্য মান সম্মান সব আমার ধুলোয় মিশে একাকার হয়ে গেছে। এভাবে কি দেখ, ইফতার শেষ হলে যাও রাতের রান্নার ব্যবস্থা কর। আমি এসে নাহয় করে দেবো। মায়ের কাছ থেকে তো কিছু ঠিকঠাক শিখেও আসনি যে একটা দিনের জন্য হলেও আমার শরীরটা একটুখানি জিরবে। ”

নিরব সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিলাম ডাইনিং টেবিল ছেড়ে। সারাদিন রোজা রেখে বাসার সব কাজ একা হাতে সামলেছি। তবুও দোষের কোনো অন্ত নেই। খুঁত খুঁজে পাওয়া মাত্র আমার মৃ’ত বাপকে তুলে ঝাড়তে পর্যন্ত ছাড় দেন না শ্বাশুড়ি। বাবা মা’রা গেছেন সেই ছোট বেলায়, তখন আমি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলাম। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বাবার মৃ’ত্যুর পর আমি আর আমার ছোটবোনকে মা একাই দেখাশোনা করতে শুরু করেন। খরচ বলতে প্রতি মাসে বাবার পেনশনের সামান্য টাকাতে ভালোমতো চলে যায় আমাদের মা মেয়ে তিনজনের। মফস্বল এলাকায় থাকার দরুন কি-না! এক বছর হলো বিয়ে করে এ বাড়ি এসেছি। বিয়ের মাস দু’য়েক পর আমার স্বামী জুনাইদ হাসান পাড়ি জমায় প্রবাস জীবনে। তারপর থেকে এ বাড়িতে আমি, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, দেবর মিলে থাকি। ননদ শ্বশুর বাড়িতে। বছরের দুই একবার বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে। গত মাসে অবশ্য তার ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাপের বাড়িতে আগমন ঘটেছে। গত মাসে আমার দেবরের আকন্দ হয়ে গেছে। বউ এখনো তুলে দেয়নি। তবে ঈদের পর জুনাইদ এলে মহা ধুমধামে তারা তাদের মেয়ে তুলে দেবে। মেয়ে আসার আগেই দেবরের শ্বশুর শ্বাশুড়ি মেয়ের ঘর সাজিয়ে দিয়েছেন। তাতেও শ্বাশুড়ি আমাকে কথা শোনাতে কার্পন্য করেননি। বলেছিলেন, ” আত্নীয়তা একেই বলে! এমন পরিবারের সঙ্গে আত্নীয়তা করতে পারাটাও তাদের ছেলের সাত কপালের ভাগ্য। বড় ছেলেটা তো অভাগা। বউটাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছে। নাহলে বউ শ্বশুর বাড়ি আসতে খালি হাতে কেন আসবে? ”

গতকাল বিকেলে আমার মা এবং ছোট বোন ইফতারি নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি এসেছিল। ভ্যানে করে ইফতারির জিনিসপত্র দেখে শ্বাশুড়িকে বেশ সন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল। আমার মা এবং বোনকে বেশ আপ্যায়নও করা হলো ভালোভাবে। শ্বাশুড়ির অবস্থা দেখে স্বস্তি লাগলেও মায়ের চেহারার দিকে তাকাতে নিজেকে ভীষণ হেও মনে হলো। মনে হলো মেয়ে হয়ে জন্মে বুঝি জীবনে সবচেয়ে বড় পাপ করে বসলাম। মায়ের চেহারাটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে কারণ জানতে চাইলে মা বলতে চাইলেন না। পরক্ষণে আমার ছোটবোন রাফা বলে উঠল, ” মা বাবার দেওয়া শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিয়েছে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে। সেখানকার কিছু টাকা তুলে রেখেছে কুরবানির জন্য। ” রাফা কথাটা বলতেই মা তাকে ধমকে উঠলেন, ” তোকে এতো কথা কেউ বলতে বলেছে?”

আমি জানি বাবার মা’কে দেওয়া শেষ স্মৃতিটা ছিল মায়ের হাতের বালা জোড়া। প্রায় আধা ভড়ি স্বর্ণ দিয়ে বানানো ছিল সেটি। মা’কে বললাম, ” মা তাই বলে তুমি বাবার দেওয়া বালাটা বিক্রি করে দিলে? বাবা তো নিজের সবটুকু সম্পদ আমাদের জন্য রেখে গেছে। সেগুলো কি যথেষ্ট নয়? ”

মা জবাবে শুধু এতটুকু বললেন, ” তোরা সুখী হ মা। আমার এর বেশি কিছু চাওয়ার নেই! ”

সন্ধ্যার পর মা এবং রাফা চলে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেল আমার জেঠি শ্বাশুড়ির সঙ্গে। মায়েরা আসার সংবাদ শুনে তিনি এ ঘরে ছুটে এলেন। মা চলে যাওয়ার পর তিনি সবটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন শ্বাশুড়ির সঙ্গে। অতঃপর মন্তব্য করে বসলেন কম হয়েছে! তার ছেলের শ্বশুর বাড়ির গল্প করে শ্বাশুড়িকে ক্ষেপাতে ভুল করলেন না। শ্বাশুড়ি হাসিখুশি মুখটায় আষাঢ় মাসের কালো মেঘে ডাকা পড়ে গেল তাৎক্ষণিক।

চুলার ওপর রান্না চড়িয়ে নামাজের উদ্দেশ্যে নিজ কক্ষে গিয়েছিলাম। তিন রাকাআতের সালাম ফেরানোর পর পর রান্নাঘর থেকে শ্বাশুড়ির চিৎকার শুনে তাড়াহুড়ো করে উঠে রান্নাঘরের দিকে ছুট লাগালাম। মেঝেতে বসে শ্বাশুড়ি পা ধরে ছপছপ করছেন এবং চেঁচাচ্ছেন। উনার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল থেকে রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখে তিনি এবার জোরে জোরে শ্বশুরকে ডাকা শুরু করলেন।

” জুনাইদের বাপ কোথায় আপনি। দেখে যান কোন সর্বনাশীকে ঘরে তুলেছে আপনার ছেলে! ”

শ্বাশুড়ির চিৎকার শুনে শ্বশুর নিজের কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ” কি হয়েছে জুনাইদের মা? দেখি পা কিভাবে কাটল? ”

” একটু আগের শোধ তুলতে ফকিন্নির বাচ্চাটা ইচ্ছে করে এখানে বটি রেখে দিয়েছে। যাতে আমি আসি আর এখানে আমার পা কাটে। হায় হায় জুনাইদের বাপ! ” বলেই শ্বাশুড়ি আর্তনাদ করতে লাগলেন।

শ্বশুর আমার দিকে কটমট করে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। তখনকার মতো শ্বাশুড়িকে নিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে।

” ভালো নেই রে বাবা! তোকে রেখে কি তোর মা ভালো থাকতে পারে বল? ”

জুনাইদ প্রতিরাতে আলাদা করে ভিডিও কলে কথা বলে বাবা মায়ের সঙ্গে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি।

জুনাইদ জানাল, ” কি করব মা? প্রবাসে কাটাতে কার ভালো লাগে বল? কিন্তু চাইলেই তো আসা যায় না। ”

” হ্যাঁ রে বাবা। ” বলে তিনি আঁচলে মুখ গুঁজলেন। মায়ের অশ্রুসজল নয়ন জোড়া নজরে পড়তে অশ্রুপাত বিসর্জনের কারণ জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠল জুনাইদ। ” কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছ কেন? বাড়ির সবাই ঠিক আছে? বাবা কোথায়? উনাকে কোথাও দেখছি না! ”

” এইতো পাশেই আছে। নে ধর কথা বলল। ”

জুনাইদের বাবা জাফর হোসেন স্ত্রীয়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার ইতিবৃত্তি খুলে বললেন। সবটা শুনে জুনাইদের কপাল জুড়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বিগত কয়েকমাস জুড়ে জুনাইদ সকালের সম্পর্কে নেতিবাচক কথাগুলো শুনে আসছে। বাবা মা মিথ্যে বলবে না এমনটিও জানে সে। কিন্তু সকাল নিজেও এসব নিয়ে তার নিকট কোনো অভিযোগ দায়ের করে নি আজ অব্দি। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও বলা হয়ে ওঠে না জুনাইদের।

জাফর হোসেন ছেলেকে নিরব থাকতে দেখে বললেন, ” তোর মা নাহয় তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে ইফতারের আইটেম বাড়িয়ে দিতেই বলেছে। তাই বলে তোর বউ রাগ করে না খেয়ে চলে গিয়ে আবার এভাবে রাগের বদলা নেবে? ”

জাফর হোসেনকে নালিশ করতে দেখে জুনাইদের মা অর্থ্যাৎ রোকেয়া বেগম মেকি কান্নার স্বরে নিষেধ করতে চাইলেন। ” থাক জুনাইদের বাপ। বাদ দেন এসব। কপালে নেই ছেলের বউয়ের খেদমত। শুধু শুধু ছেলেকে বলে কি লাভ! ”

” না রোকেয়া। আমাকে বলতে দেও। এভাবে চুপ করে থাকলে চলবে না। জুনাইদ তুই এর একটা বিহিত করবি। তুই থাকতে তোর বউয়ের এতো বাড় কিভাবে বাড়ে? ”

জুনাইদ ভাবনায় পড়ে গেল। বাবা মায়ের অভিযোগ শুনে তাদের আশ্বাস দিল, ” আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করব। কেন সে এ কাজ করেছে! ”

ছেলের মুখে এ কথা শুনে রোকেয়া বেগম আশ্বস্ত হলেন। এবার মেয়েটা বুঝবে মজা।

চলবে…….?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে