আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৯

0
63

#আমার_প্রথম_সকাল (০৯)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
আমাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে জুনাইদ উঠতে নিলে পেছন থেকে শ্বাশুড়ি তাকে ডাক দিলেন। ” তুই কই যাস? ওরে পাঠায়া দিলেই তো হয়। লেঠা চুকে যায়! ”
” মানবতার খাতিরে হলেও একজন অসুস্থ মানুষকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না মা। ” জুনাইদ ভারী গলায় বলল।
” ওরে এতো অসুস্থ কোথায় দেখস তুই? কই আমি তো একদম সুস্থ তরতাজা দেখতেছি। ”
” দেখা আর জানার মাঝে অনেক পার্থক্য থাকে। ওকে আনার সময় কি ও নিজে থেকে এসেছিল যে ওকে আমি একা পাঠাবো? তাছাড়া এখনো ও আমার আওতায় আছে তারমানে ওর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব এখনো আমার ওপর। আপনি ঘরে যান। এসব আপনাকে ভাবতে হবে না। যান তো যান! ”
জুনাইদের কণ্ঠে এমন কথা শুনে শ্বাশুড়ির মাথায় হাত। যে ছেলে উঠতে বসতে মায়ের অনুমতি নিত সে ছেলে তারই মুখের ওপর এত বড় কথা? তিনি মৌন থেকে আমার দিকে এক নজর কড়া চোখে তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন ঘরের ভেতরে। আমি চলে যাচ্ছি ভেবেই হয়তো আজ আর কোনো কথা শুনালেন না।
.

.
সারাটা রাস্তায় জুনাইদকে ভীষণ হতাশ এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল। এদিকে আমার নিজের অবস্থাটাও বেশ শোচনীয় আকার ধারণ করছে। জুনাইদকে যে কিছু জিজ্ঞেস করব সে সাহসটুকু নিজের মধ্যে সঞ্চার হচ্ছিল না। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া লুকিয়ে রাখাটাও আজ জরুরী মনে হলো না। আমি নিঃশব্দে কাঁদছি বুঝতে পেরে জুনাইদ আমার হাতের উপর নিজের হাত রাখল। হয়তো বলার মতো তার কাছেও কোনো কথা আর অবশিষ্ট নেই। কিয়ৎক্ষণ এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর মুখ খুলল জুনাইদ। মৃদু স্বরে ডাকল, সকাল বলে! জুনাইদের কণ্ঠস্বরে এই ডাকটাকেও আজ ভীষণ দামী বলে মনে হচ্ছে। চাইলেও হয়তো এই ডাকটা আর কখনো শুনতে পাবো না আমি। কান্না এবার ভেতরে থেকে আরো দ্রুত বেগে আসতে চাইছে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে যথাযথ সামাল দেওয়ার চেষ্টায় আছি। নয়তো কাঁদলে আশেপাশের মানুষজন খারাপ ভাববে যে। জুনাইদ হতাশ গলায় বলল, ” বাড়ি গিয়ে মাকে কিছু বলিও না এখন! ”
জুনাইদকে এবার সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ” বলব না। কিন্তু আমি তো জানতে পারি নিজের অপরাধ সম্পর্কে! এতটুকু জানার মতো অধিকার নিশ্চয়ই এখনো আমার আছে? ”
জুনাইদ দম নিল। ” তোমার অধিকার আর কেউ পাবে না সকাল। তুমি আমার প্রথম সকাল তুমি থাকবে শেষ। এই অবস্থানটা সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আর আমাকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময়ই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ”
” তাহলে তালাকনামাটা কিসের জন্য? আমি কি তবে এটা সম্পর্কে এতোদিন ভুল জানতাম? ”
” না। ঠিকই জানো। মায়ের কথায় পাত্তা দিও না। মা যেসব কথা বলেছে ওগুলো সব বানোয়াট। এসবের একটাও আমার বলা কথা না। আমি উনাকে একবারও বলিনি তোমাকে ছাড়বো। ”
এতটুকু বলে জুনাইদ আমার দিকে তাকিয়ে রইল৷ ওর কথাগুলো বিশ্বাস করতে গিয়েও কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে হয়তো আমাকে শান্তনা দিতেই কথাগুলো বলছে। রেখে আসতে পারলে ঠিক ভুলে যাবে। আমাকে ভাবনার জগৎ এ হারাতে দেখে জুনাইদ বলল, ” কি ভাবছ? তোমায় রেখে এসে সব মেনে নেবো? ”
” হ্যাঁ। এমনটি ভাবারই কথা। অস্বাভাবিক কিছু তো না। তাছাড়া আপনি নিজে এসব বলছেন আপনার মায়ের সম্পর্কে? অন্য কেউ হলে অবিশ্বাস্য লাগত না। ”
” আমার চেয়ে অন্যরা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে গেল তোমার কাছে? ”
” নয়তো কি? যে ছেলে মায়ের কথার বরখেলাপ করে না করে কখনো। সে ছেলে আজ এসব কথা বলবে? ”
” দেখ সকাল! বাবা মা, বাবা মা-ই হয়। তাদের কথা শোনা প্রত্যেক সন্তানের জন্য ফরজ। ভুল হলে শুধরে দেওয়াটাও উচিত। ”
” বেশ! আপনার মায়ের কথাগুলো যদি বানোয়াট হয়েও থাকে তাহলে আপনি কেন তখন এর জবাব দিলেন না? ”
” সকাল! সব কথা মুখে বলে দিতে হয় না। কিছু জিনিস এমনও হয় যেগুলো শত বোঝালেও কেউ বুঝে না। করে বোঝাতে হয়। বিয়ে জিনিসটা এতো সহজলভ্য না যে উনি বলেছে বিধায় করেছি আবার উনার কথাতে তোমার ছেড়ে দেবো৷ শুধু তুমি কিছুদিন তোমার মায়ের কাছে থাকো। অনেকদিন তো নাকি বেড়াতে পারোনি। ”
” মাথায় এতো চাপ নিয়ে কেউ বেড়াতে শুনেছেন? ”
” চাপ আমার ওপর ছেড়ে দেও। যা হবে পরে দেখা যাবে। শুধু এতোটুকু বিশ্বাস রাখ তোমার সাথে এমন কোনো কিছুই ঘটতে দেবো না আমি। কথা দিলাম তোমায় আমার প্রথম সকাল! ”
” এ কেমন ডাক? ”
জুনাইদ টিপ্পনী কাটে। ” আমি তো তোমায় এ নামেই ডাকি! আজ নতুন শুনছ নাকি? ”
.

.
বাড়ি পৌছানোর পর সবার সাথে জুনাইদ বেশ স্বাভাবিক থেকেছে। প্রতিবারের মতো মায়ের খোঁজ নিয়েছে, বোনের নিয়েছে। কারোর কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা এমন সব জানতে চেয়েছে। মা’কে বিন্দু পরিমাণেও ঠাওর করতে দেয়নি তার মেয়ের সংসার ভাঙনের পথে। মায়ের অনুরোধে সেদিনটা থাকতে হয়েছে তাকে। এ নিয়ে শ্বাশুড়ি বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে ফোন করেছেন। জুনাইদ প্রথমে তোলেনি পরক্ষণে তুলে আড়ালে কথা বলে এসেছে। কি বলেছে সে ব্যাপারে আমি অজানা। এতোদিন পর মায়ের কাছে এসেছি কোথায় খুশিতে আত্মহারা হওয়ার কথা ছিল সেখানে আমার মনে খুশির ছিটেফোঁটাও নেই। মন জুড়ে আঁকড়ে ধরেছে বিষন্নতা। না চাইতেও কোথা থেকে যেন অবিশ্বাস আমাকে গ্রাস করতে চাইছে। পরদিন জুনাইদ চলে যায় বাড়িতে। যাওয়ার আগে ফের আশ্বাসের সহিত বলে যায় তারওপর বিশ্বাস রাখতে। সে থাকতে আমার সাথে কোনো অন্যায় সে হতে দেবে না।

বিকেলের দিকে উঠোনের এক কোণে বসে আছি। ছোটবোন পাশের বাড়ি গিয়েছে। মা গেছে পুকুরে থালাবাসন ধুতে। তখন বাড়িতে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন আমার খালা। উনাকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে কুশলাদি জানতে চাইলে তিনি মুখ ভার করে জবাব দিলেন, ” কিরে সকাল! শ্বশুরবাড়ি যাস নাই এখনো? ঈদের তো মেলা দিন পার হইল! ”
” খালা বসেন। আমি আসলামই গতকাল। ”
” ও তাই বল। সবাই তো আসে ঈদের দিন বিকালে নয়তো পরদিন। তাই ভাবছি তুইও এমন আসছিলি। তা থাকবি কয়দিন? ”
” এইতো খালা ঠিক নেই। আপনাদের জামাই এসে নিয়ে যাবে। ”
শুনে খালা অবাক হলেন। জানতে চাইলেন, ” তোর জামাই দেশে? ”
উনার সাথে কথা বলার ফাঁকে মা এসে পড়লেন। খালাকে দেখে বললেন, ” কিরে তুই কখন আসলি? ”
” এইতো বুবু মাত্রই। এসেই সকালের সাথে কথা বলতেছি বেশিক্ষণ হয় নাই। ”
খালার দিকে মা বসার জন্য মোড়া এগিয়ে দিয়ে বললেন” বোস। ঘরে প্রচুর গরম। নইলে ঘরেই বসতে বলতাম। ”
আমি ঘরের ভেতর চলে গেলাম উনার জন্য পানি আর বাতাস করার জন্য হাত পাখা আনার উদ্দেশ্যে। আসার পথে শুনতে পেলাম তিনি মা’কে বলছেন, ” সকালের জামাই নাকি দেশে বুবু? ”
” হ্যাঁ। কালকে ওরে নিয়ে আসছিল। একদিন থেকে সকালকে রেখে আজকে গেছে। পরে এসে নিয়ে যাবে। ” মা স্বাভাবিকভাবে বললেন।
” জামাই বাড়িতে থাকতে কোনো বউরে তো আমি আজ পর্যন্ত দেখি নাই বাপের বাড়িতে একলা বেড়াইতে। ঘটনা কি? কবে নিবো আবার বইলাও গেল না। নাকি একবারে দিয়া গেছে খবর নিয়া দেখ। তোমার মেয়েরে ঢাইকা জিগাও বুবু! ”
মা সহজ সরল মানুষ। খালার কথার প্যাচ বুঝেননি। বরং উনার কথায় মায়ের মুখে এবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল। প্রশস্ত হয়ে আসার ঠোঁটের কোণে জমে থাকা হাসিটা নিমিষে গায়েব হয়ে গেছে। খালা মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ” সকালরে যেই বাড়ি পাঠাইছো, কই তারা আর কই তোমরা। কাঁড়ে আর উগিরে যারে কয়! সম্পর্ক হওয়া লাগে সমানে সমান। নাহলে এমন সম্পর্ক টিকবে না জিন্দেগীতেও। আমাদের দেখ না, একদম খাপে খাপ। তাদের সাথে আমাদের হইলে একটা কথা ছিল। তখনই বলছিলাম শুনো নাই। এবার বুঝো ঠ্যালার নাম বাবাজী। ”
মা জবাব দেয়ার আগে আমি নিজেই বললাম, ” খালা পানি নেন। প্রচুর গরম পড়তেছে। গরমে আপনার মাথার ভিতর থেকে আসা আজেবাজে চিন্তা যদি তাতে একটু দূর হয়। ”
” হ দে। ” পানি খেয়ে তিনি গ্লাস ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ” এগুলো মোটেও আজেবাজে চিন্তা না সকাল। সত্যি কইরা বল তো? তোরে তোর জামাই কবে নিবো কিছু বইলা গেছে? ”

খালার প্রশ্নে এবার আমি থমকে গেলাম। সঠিক করে বলতে না পারলেও বলে দিলাম, ” যেদিন নেবে সেদিন তো শুনবেনই। আপনি নাহয় ততদিন এখানে থেকে যান।”
” হ আমার তো আর কাম নাই তোদের বাড়ি পড়ে থাকব। তোদের নিজেদেরই তো ঠিক নাই কেমনে থাকিস খাস আবার আমারে থাকতে বলিস। ”
আমার খালা হলেন আমার নানার দিকের সবচেয়ে বড় স্বার্থপর, নির্দয় একজন মহিলা। যার মনে আমাদের জন্য টান বা মায়ার ছিটেফোঁটাও নেই। বাবা থাকাকালীন সময় তিনি মোটেও এমন ছিলেন না। কোনো দরকার পড়লে ছুটে আসতেন আমার মায়ের কাছে। অথচ যেই বাবা মারা গেল ওমনি উনি আমাদের এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন। সবসময় ভাবতেন আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখলে আমার মা’কে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। যেমন করে উনার স্বামীর ব্যবসার জন্য আমার মা বাবার থেকে সাহায্য পেয়েছিলেন। বাবা যেদিন মারা গেলেন সেদিন এসে তিনি আত্নীয়তার খাতিরে আমাদের একনজর দেখে চলে গেছেন। তারপর মাঝের কতগুলো বছর আর কোনো যোগাযোগ করেননি। উনার এড়ানো দেখে মাও কখনো তাকে বিরক্ত করেনি। শেষবার আমার বিয়েতে এসেছিলেন আর আজ এলেন হুট করে। তার আসার উদ্দেশ্য আমাদের জানা নেই ঠিকই তবে আমাদের ছোট করে কিছু কথা শুনিয়ে যাওয়া ছিল তার এখানে আসার মুখ্য উদ্দেশ্য। খালার নিজেরও তিন ছেলেমেয়ে। মেয়ে দু’টোকে দ্রুতই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মেয়েদের এতো পড়ে কি লাভ! এমন প্রথাকে সামনে রেখে তাদের কাউকেই বেশিদূর পড়াননি। ছেলেটাকে এখনো বিয়ে করাননি৷ মেয়ে দু’টোর স্বামী প্রবাসী। পারিবারিক অবস্থা ভালো হলেও জুনাইদদের মতো অতটা স্বচ্ছন্দ নয়। আর না তো জুনাইদের মতো কেউই শিক্ষিত। জুনাইদের আর আমার বিয়ের বিরূদ্ধে সবার আগে উনিই ছিলেন। মা’কে সরাসরি বলেছিলেন আমরা এতো বড় ঘরে আত্মীয়তা করার মতো যোগ্যতা রাখি না। আমাদের আছেটা কি? না জায়গা জমি আর না তো টাকা পয়সা, বিয়ের পরের দেওয়া নেওয়া করবে কিভাবে মা? তারওপর আমাদের বাড়িটাও না খুব ভালো! বাবা থাকলে একটা কথা ছিল বাবা নেই, কোন সাহসে যায় মেয়েকে আমার মা এতো বড় ঘরে পাঠাতে।

খালা মুখ ঝামটে বলে উঠল,
” আত্নীয়তার খাতিরে তোদের দাওয়াত দিতে এদিকে আসা। আমার ছেলের বিয়ে সামনের শুক্রবারে। নইলে আমার দরকার ছিল নাকি আসার। এই জঙ্গলের ভেতর কোনো মানুষ ঢুকে? ”
খালা এতটুকু বলে আর বসলেন না। উঠে পড়লেন। যাওয়ার পথে আমাকে বলে গেলেন, ” তোর জামাইরে নিয়ে আসিস যদি পারিস। নাহলে পরে তো বলবি খালা মানুষ ভালো না, আমার জামাইরে দাওয়াত করল না! ”

খালা এসে মায়ের মনে চিন্তার বীজ বপন করে গেলেন সেটা উনার চোখের মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। আমাকে মা কিছু জিজ্ঞেস করতে নিয়েও আর করলেন না। সেদিনের মতো এভাবেই ভালো খারাপের মধ্য দিয়ে পার করলাম। রাতটা পার হতে চাইল না চিন্তায়। তাহাজ্জুদ আদায় করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছি। সব ঠিকঠাক করার মালিক কেবলমাত্র তিনি। একেবারে ফজর শেষ করে ঘুমিয়েছি সকালের দিকে। কিন্তু তারপরদিন সকাল হতেই আমার সামনে প্রকাশিত হলো এক অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনার সংবাদ।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে