আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৭

0
68

#আমার_প্রথম_সকাল (০৭)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
দুনিয়াটা শক্তের ভক্ত নরমের যম! এখানে যতটা নরম আচরণ করা হবে সবার সঙ্গে, ততটাই ঠকতে হবে। এ বাড়িতে আসার পর তা হলফ করে বুঝতে পারছি। জুনাইদ নিজের মায়ের মতে বিয়ে করেছে। তারজন্য সে মায়ের অবাধ্য সন্তানের ন্যায় আচরণ করা তো দূর ভাবতে পারছে না। অন্যদিকে জামিল হলো জুনাইদের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। জুনাইদ শান্ত এবং নম্র স্বভাবের হলেও জামিলের মেজাজ সর্বদা তুঙ্গে চড়ে থাকে। পরিবারের সবার আদরের ছোট ছেলে, কাউকে পরোয়া করার প্রয়োজন মনে করে না। এজন্য শ্বাশুড়ি তাকে সর্বদা বাবা বাবা বলেই তোষামোদ করে চলে। অন্যদিকে সংসারের সম্পূর্ণ ভার থাকে জুনাইদের ওপর। জুনাইদ হলো তাদের কাছে অনেকটা টাকার মেশিন।

শ্বাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম জামিল বাড়িতে এসেছে। সঙ্গে শাড়ি পরিহিতা এক রমনী। বুঝতে বাকি রইল না এটা যে সোমা। সোমাকে দেখে আশ্চর্য হতে বাধ্য হলাম। আর মাত্র ক’টা দিনই তো বাকি! এতদিন অপেক্ষা করতে পারল অথচ সপ্তাহ খানেক অপেক্ষা করতে পারল না সে? বিষয়টি নিয়ে বেশ হাসি পেল। তবে হজম করে নিতে বাধ্য হলাম। জামিল ঘরে ঢুকে শ্বাশুড়িকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন। শ্বাশুড়িও জামিলের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। সোমার মুখ ঘোমটার আড়ালে থাকায় তাকে দেখে শুরুতে চিনতে পারেননি। পরক্ষণে জামিল নিজেই বলল, ” সোমা মা আসছে। ”
সোমা নিচে ঝুঁকে কদমবুসি করতে গেলে শ্বাশুড়ি নিষেধ করলেন। ” থাক মা থাক! এসময় ঝুঁকতে হয়না। বাচ্চার সমস্যা হয়। ”
সোমা সরে গেল। জামিল আমাকে দেখিয়ে বলল, ” ইনি হলেন আমার ভাবী! ”
সোমা মৃদু হেসে বলল, ” হ্যাঁ উনাকে তো চিনি। আসসালামু আলাইকুম ভাবী ভালো আছেন! ”
” আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ভালো আছো? ”
শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি মুখখানি ভার করে রেখেছেন। কেন করেছেন সেটা তিনি নিজেই ভালো জানেন। আমাকে বললেন, ” সকাল, সোমাকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা কর! ” বলে তিনি নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
.

.
ঈদের পরপর ধুমধাম করে জামিলের বউ তুলে আনা হবে, এমনটিই কথা হয়েছিল সোমার বাবা মায়ের সাথে। কিন্তু ঈদের দিন বিকেলেই তারা মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন অনুষ্ঠানের খরচা বাঁচাতে। এসব কথা ভেবে শ্বাশুড়ির বেজায় মুখ ভার। জামিল উনার ছোট ছেলে, বহু আদরের ধন। তার বিয়েতে তিনি আত্নীয় এনে আপ্যায়ন করে ভরিয়ে তুলবেন ভেবেছিলেন। এতোদিন ছেলেকে এসব নিয়ে সবার সাথে গর্ব করে বেড়াতেন কিন্তু সোমার বাবা মা চালাকি করে শ্বাশুড়ির ইচ্ছেটাকে মাটি চাপা দিয়ে ফেলেছেন। শ্বশুর আর জুনাইদ ঘরে ফিরতে তিনি তাদের ডাকলেন, যেহেতু প্রসঙ্গ জামিলকে কেন্দ্র করে তাই তাকে ডাকতেও ভুল করলেন না।

জামিল এলে শ্বাশুড়ি জামিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” কি দরকার ছিল আজকেই তোর বউকে তুলে আনার? আর কয়েকটা দিন পর তো এমনই সবাই মিলে গিয়ে আনতাম। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারলি না? ”
” বউকে আনব না তো কাকে আনব মা? বাহিরের কাউকে তো তুলে আনিনি। এটা নিয়ে তোমার এতো মুখ ভার করে থাকতে হবে কেন? ”
শ্বাশুড়ি জবাব দিলেন না। সেভাবেই মুখ ভার করে রইলেন। শ্বশুরের দিকে তাকাতে তিনি বললেন, ” মুখ ভার করাটা কোনো বিষয় না। বিষয়টা হচ্ছে আত্নীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে। তারা এখন কি বলবে বুঝতে পারছিস? ”
” কি আর বলবে? যা সত্যি তাই বলবে। ” জামিল স্বাভাবিকভাবেই বলল।
শ্বশুর বললেন, ” এতো সহজ না সব কিছু। দুনিয়াদারী দেখছিস কতটুকু তুই? ”
” যতটুকু দেখাইছো ততটুকুই। ”
” কচুটা দেখছো তুমি! যদি দেখতাই তাহলে এমন একটা কাজ করতা না। অন্তত আগে নিজের দিকটা, নিজের পরিবারের দিকটা ভাবতা। ”
জামিল নিজের বাবার কথায় বিরক্ত হলো। মৃদু রাগত স্বরে বলে উঠল, ” আত্নীয়- স্বজন, পাড়া -প্রতিবেশীর আর কাজ কী? এরা তো পারেই আরেকজনের বিষয়ে মাথা ঘামাতে। শোনেন বাবা, সোমাকে আনার দরকার ছিল তাই এনেছি। এতো ঘটা করে লোকজন ডেকে খাওয়ানোর মানে নেই। বিয়েটা আপনাদের উপস্থিতিতে করেছি তাই আর এর বেশি ভাবার ইচ্ছে নেই৷ নিয়ে আসতে এতো খরচা করে পাবো কি সমালোচনা ছাড়া? আর আমার হাতে এখন এতো টাকা পয়সাও নেই। এটা ভাবছেন আপনি আর মা কখনো? ”
শ্বশুর রেগে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ” হ সব তো তুমিই ভাবো। তুমি বেশি বুঝ, বড় হইয়া গেছ তো। এখন আর আমাদের কথা শোনা লাগবে কেন? ”
শ্বাশুড়ি এবার শ্বশুরকে থামাতে বললেন, ” থাক জুনাইদের বাপ। বাদ দেন। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে, এখন আর তাদের কাউকে লাগে না। বড় জনরে তো দেইখা শুইনাও পারলাম না পছন্দ মতো জায়গায় বিয়েটা করাতে। রাস্তা থেকে একজনরে ঘরে তুলে আনছি। ভাবলাম ছোটজন নিজের পছন্দে করে কাজের কাজ করছে। কিন্তু সে যে এমন কাজ করবে কে জানত! ” শ্বাশুড়ি কথাগুলো বলার সময় উনার কণ্ঠস্বর থেকে আপসোস ঠিকরে পড়ল যেন।

জুনাইদ এতক্ষণ নিরব দর্শকের মতো চুপচাপ সব শুনলেও এবার আর থেকে থাকতে পারল না। নিজের মাকে জিজ্ঞেস করে বসল, ” কাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছ আবার? ”
শ্বশুর জুনাইদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ” এটা তো কথার কথা। তুই এখানে কথার ভুল ধরছিস কেন? ”
” বাবা জামিল যা করেছে তা তো করেই ফেলেছে।নিজের বিয়ে করা লিগ্যাল বউকে তো নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে এতো কথা না বাড়ালেই তো হয়। আর আত্মীয় স্বজনরা কিছুই বলবে না। শুধু শুধু এতো চিন্তা করে আপনার শরীর খারাপ করবেন না মা। জামিলের বউ একে তো নতুন, তারওপর প্রেগন্যান্ট। এমতাবস্থায় এসব শুনলে তার ভালো লাগবে না। ”
” এতোক্ষণ তো এসবই বোঝাচ্ছি। কিন্তু তারা শুনলে তো আমার কথা। যাকগে মানলে তো ভালো না মানলে কিছু করার নেই। তবে আমিও সাফসাফ জানিয়ে রাখছি, সোমাকে যদি এ নিয়ে কোনো কথা বলেন আপনি, মা। তাহলে কিন্তু আমি ওকে নিয়ে আলাদা সংসার করতে বাধ্য হব। তখন বাবা কেন? ভাইয়া বা আপু এসে আমাকে বললেও আমি শুনব না বলে দিলাম। ” নিজের বাবা মায়ের মুখের ওপর জামিল কথাগুলো বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
.

.
নতুন বউ আসার খবর পেতেই বাড়ি বয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের ঢল পড়ে গেল। একে একে এসে সবাই সোমাকে দেখে যাচ্ছে। ঘরের ভেরতটায় গরম। মানুষজনের আনাগোনায় আরো গরম লাগবে বিধায় সোমাকে উঠোনে বসিয়ে রেখেছেন শ্বাশুড়ি। সোমার পরণে হালকা গোলাপি রঙের জামদানী শাড়ি। ফর্সা শরীরে বেশ মানিয়েছে তাকে। স্বাস্থ্যটা মোটামুটি ধরনের হওয়ায় শাড়ি পরাতে তার মধ্যে বেশ গৃহস্থ গৃহস্থ একটা ভাব চলে এসেছে। নরমাল জামা কাপড়ে তাকে কম বয়সী কিশোরী লাগে। বোঝার অবকাশ নেই সে যে একজন বিবাহিত নারী। সেই সাথে সন্তান সম্ভবা। এর মাঝে আত্নীয় স্বজনের কাছেও খবর চলে গেছে। নানান জন নানান জায়গা থেকে ফোন করছেন। শ্বাশুড়ি সেসব খুব সুন্দর করে মানিয়ে নিচ্ছেন। কথায় দাপুটে ভাব তার আগের মতোই বজায় আছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে কিছুই ঘটেনি। অথচ শ্বাশুড়ি মা যে তুলকালাম ঘটাতে গিয়েও জামিলের হুমকির তোপে পড়ে আর পারেননি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। উনি উপরটায় যতটা দেখান চালাকি ভাব, প্রকৃতপক্ষে মোটেও সেরকম নয়। শুধু মাত্র কথায় কথায় আমাকে আর আমার বাবা মাকে ছোট করা, খোটা দেওয়া ছাড়া তার মধ্যে বিশেষ কোনো গুণ আমি দেখতেও পাই না।

সন্ধ্যার সময় আর সোমাকে বাহিরে থাকতে দিলেন না শ্বাশুড়ি। ঘরে এনে তাকে আজকে নিজের ঘরে থাকার কথা বললেন৷ আজকের রাতটা সে জামিলের সঙ্গে থাকবে না, থাকবে শ্বাশুড়ির সঙ্গে। আগামীকাল কয়েকজন মেহমান আসবেন বাড়িতে৷ এমনটি জানালে জামিল কিছু বলবে তার আগে জুনাইদ বলল, ” ঘটা করে অনুষ্ঠান করতে না পারিস, অন্তত কিছু লোকের সামনে তো যেতে অসুবিধা হওয়ার কথা না সোমার! ” জামিলও আর কথা বাড়াল না ভাইয়ের কথায় মেনে নিল।

রাত বাড়তে যে যার ঘরে চলে গেল৷ জুনাইদের সঙ্গে বিকেলের পর আমার দেখা হয় রাত বারোটার দিকে। দেখলাম জুনাইদের বদনখানি অশ্বিনী কালো মেঘে ছেয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল, ” এতোক্ষণে আসার সময় হলো.? ”
স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলাম ” কাজ করছিলাম। ”
” বিকেলে তৈরি হতে বলেছিলাম। হওনি কেন? ”
” হয়েছিলাম। আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় কাজ পড়ে যাওয়ায় সাজ বদলে ফেলতে হয়েছে। ”
” কি এমন জরুরী কাজ যে নিজের মাকে দেখতে যাওয়ার সময়টুকুও তোমার হয় না? ” জুনাইদ কপট রাগত স্বরে বলে উঠল।
জুনাইদকে এ প্রথম এভাবে কথা বলতে শুনলাম। অবাক হলেও ফের জবাব দিলাম, ” সেটা নাহয় আপনার মা’কেই গিয়ে জিজ্ঞেস করেন৷ আমার মা’কে নিয়ে আপনার এতো ভাবনা এটা আপনার মাকেও একটু জানান দিন। ”
” সকাল! মানে কি এসব কথার? ”
প্রতিত্তোর না করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। না চাইতেও চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। ভিজে যাচ্ছে মাথার নিচে চাপা পড়া বালিশ। আমার কান্না সম্ভবত জুনাইদের হৃদয় অব্দি পৌঁছাল। এগিয়ে এসে কাতর কণ্ঠে জানতে চাইল, ” তুমি কাঁদছ কেন? আমি তো এভাবে বলতে চাইনি। দেখ ভুল বুঝো না। ”
চোখের পাতা মুছে জবাব দিলাম ” ঠিক আছে। আমি বুঝেছি। ভুল বোঝার মতো কিছু হয়নি। ”
জুনাইদ দম খিঁচে বসে রইল৷ কোনো শব্দ না পাওয়ায় পাশ ফিরতেই দেখতে পেলাম সে কিছু ভাবছে। কৌতুহলী মন জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। ” কিছু ভাবছেন আপনি? ”
জুনাইদ তখনও ভাবনায় নিমজ্জিত। আমি মৃদু ধাক্কা দিয়ে পুনরায় জানতে চাইলাম, ” শুনছেন! ”
জুনাইদ ভাবনার জগৎ ছেড়ে ফিরে এল। বলল, ” না তেমন কিছু না। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি ভাবছি তোমাকে নিয়ে বের হব কিছুদিনের জন্য। ”
” কোথায় যাবেন? ”
” গেলেই দেখতে পাবে। ”
” একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ”
” নির্দ্বিধায় করতে পার! ”
” আপনার না সপ্তাহ খানেক পরে আসার কথা? আগে এলেন যে? ”

চলবে…..?

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে