আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৫

0
73

#আমার_প্রথম_সকাল (০৫)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
বিয়ের মাস তিনেক না কাটতে বাড়ি বয়ে সুখবর চলে এসেছে, জামিল বাবা হতে চলেছে। শ্বাশুড়ির এই নিয়ে খুশির কমতি নেই। এক কথায় খুশির জোয়ারে তিনি ভেসে বেড়াচ্ছেন যেন। সন্ধ্যেবেলায় খুশিতে খদখদ হয়ে জামিল বাড়ি ফিরল মিষ্টির প্যাকেট হাতে। শ্বাশুড়িকে বলতে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে জামিলের কপালে চুমু খেলেন। মাথায় বুলিয়ে দিলেন স্নেহের পরশ। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন জেঠিদের ঘরের দিকে করে মিষ্টির বাটি হাতে। জামিলের বউয়ের সম্পর্কে গুণগান গেয়ে ঘন্টাখানেক পর নিজ গৃহে ফিরে এলেন। আমার সঙ্গে আজ দু’দন্ড কথাও বললেন না। বিকেলের দিকে উঠোনের দিকে জেঠিকে দেখা গেল। আমাকে দেখতেই তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “কিগো জুনাইদের বউ খবর কি তোমার? ”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনার কি খবর জেঠি? ”

” আমাদের আর কি! তোমার শ্বাশুড়ির কাছে শুনলাম জামিলের বউ নাকি পোয়াতি হইছে। শুনে ভালোই লাগছে। ”
এতটুকু বলে তিনি চুপ করে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখপানে। হয়ত বুঝতে চাইছেন আমাকে কোনো রকম হতাশা গ্রাস করতে পারছে কিনা! কিন্তু আমি এ নিয়ে কোনোরকম অভিব্যক্তি দেখানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না।

আমাকে নিরুত্তর দেখতে পেয়ে তিনি আমার কানের কাছে এসে বললেন, ” তোমার কি কোনো সমস্যা আছে বউ? ”

আমি খানিকটা চমকালাম। কথাটি শুরুতে ধরতে পারিনি বিধায় জিজ্ঞেস করে বসলাম, ” কিরকম সমস্যা? ”

” ওমা। তুমি শিক্ষিত মেয়ে আর এটা জানো না? থাক আমিই খোলাসা করে দেই। তোমার আর জুনাইদের তো জামিলের আগে বিয়ে হইছিল। তাও এখন তখন না। প্রায় বছর খানেক হলো বলে। কিন্তু তুমি তো পারলা না শ্বাশুড়িরে আগে খুশির খবরটা শুনাইতা! ”

প্রতিত্তোরস্বরূপ কি বলা উচিত এ মুহূর্তে আমার নিজেরও জানা নেই। দীর্ঘশ্বাস আড়ালে চেপে রেখে বসে রইলাম একইভাবে। জেঠি তখনোও নিজের মতো বলে যাচ্ছিলেন, ” তোমার শ্বাশুড়ি এ নিয়ে অনেক আপসোস করতেছে বুঝলা? তাই বললাম কোনো সমস্যা আছে কিনা। নাহলে তো এতোদিনে নতুন সদস্য দুনিয়ার আলো দেইখাও ফেলত। যাক আমি এবার যাই ঘরে আমার আবার অনেক কাজ পড়ে আছে। ”

তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় শ্বাশুড়ির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। শ্বাশুড়ি একদম নিচু স্বরে জেঠিকে জিজ্ঞেস করলেন আমার মতামত সম্পর্কে। জেঠি ফুসুরফাসুর শব্দে নিজের মতো যা বলার বলে চলে গেলেন। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে শ্বাশুড়ি এলেন। এসেই রান্নাঘরের বাসন কোসন শব্দ করে রাখতে শুরু করলেন৷ বেসিনে কিছু আধোয়া বাসন ছিল সেগুলোই মূলত মাঝতে লেগে গেলেন। রাগ উঠলে যা প্রায়ই তিনি করে থাকেন, এই যেমন জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর। সেদিনও আমার খুব সখের একটা কাপ তিনি ভেঙে ফেলেছিলেন। কলেজে থাকাকালীন সময়ে ভাড়া থেকে বাচিয়ে জমানো টাকায় মাঝেসাঝে জিনিসপত্র কিনতাম৷ এসবের প্রতি আমার তখন থেকে প্রবল ঝোক ছিল। ঠিক সেরকমই খুব সখ করে এক জোড়া কাপ কিনেছিলাম। নিষেধ করা সত্ত্বেও মা বিয়ের পর পালকির সাঝের সঙ্গে সেগুলোও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার সেই সখের কাপটাকে কিছুদিন আগে শ্বাশুড়ির রাগের বলির পাঠা হতে হলো ঠিক আমার মতোই। শ্বাশুড়ি বিড়বিড় করতে করতে আওড়াতে লাগলেন, ” ছেলেটারে নিজের হাতে খুন করলাম। দেখেশুনে শেষমেশ এক বাঁজা মেয়ে ঘরে তুললাম। এতোদিন জানতাম অপয়া, অর্কমা। এখন দেখি সাথে বাঁজাও। এই জন্যই তো আমি এতোবার বলার পরও কিছু বলত না। মাঝখান থেকে ছেলেটারে সব সহ্য করা লাগতেছে। ”

উনার বিড়বিড়ানিতেও স্পষ্ট সবটা শুনতে পাচ্ছি। চুপচাপ এসব সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। বিয়ের পর প্রায়ই আমাকে বলতেন কিন্তু আমি উনাকে এ নিয়ে কিছু জবাব দিতে পারতাম না। জুনাইদ বিদেশে পাড়ি জমানোর সময়ও একবার শ্বাশুড়ি কথা তুলেছিলেন বাচ্চার ব্যাপারে। জুনাইদ আমার ওপর ব্যপারটিকে আসতে না দিয়ে নিজেই নিজের মতো করে কৌশলে এড়িয়ে গেছে। আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল, ” এতো তাড়াতাড়ি নেওয়াটা ঠিক হবে না। আগে তুমি নতুন পরিবেশের সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নেও, সংসার সামলানো শিখে উঠো ইনশাআল্লাহ তখন আল্লাহ চাইলে সবই হবে! ” জুনাইদের বলা সেই কথাগুলো ভাবছি সেই সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপট মেলাতে চেষ্টা করছি।
.

.
রমজানের সময়গুলো দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায়। ঈদেরও খুব একটা দেরি নেই। এইতো মাত্র দু’টো রমজান পেরোলেই আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসবে ঈদ। ইসস্ গত বছরের এ সময়টাও আমার জীবনে ভিন্ন একরকমের সময় ছিল। সদ্য বিবাহিতা প্রত্যেক মেয়ের মনে থাকাটাও স্বাভাবিক। তবে সেবার আমি এ বাড়িতে ছিলাম না। সেবারই শেষবারের মতো নিজের বাপের ভিটায় মা এবং ছোটবোনের সঙ্গে আনন্দ উৎযাপনে ব্যস্ত ছিলাম। জুনাইদের আর আমার বিয়েটা মূলত ফোনকলে হয়েছিল। এর আগে কেউ কাউকে সামনাসামনি দেখিনি। যতটুকু দেখা সেও ছবিতে। ঈদের পরপর জুনাইদ দেশে এলে আমারও এ বাড়িতে পদার্পন ঘটে। শুরুর দিকে সময়টা স্বপ্নের মতো কেটেছে। কিন্তু তা হলেও ভালো স্বপ্ন গুলোর স্থায়িত্ব কেন যেন খুব ক্ষণস্থায়ী হয়। অথচ দুর্বিষহ জীবন কাটতেই চায় না। শুনেছি কষ্টের পরে সুখ মেলে, কবে মিলবে সে সুখ? আদৌও কি মিলবে? না-কি চিরকাল এভাবেই কেটে যাবে? কথাগুলো কেন জানি না বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আল্লাহর কাছে খুব করে অভিযোগ জানাতে ইচ্ছে করছে। ‘হে পরওয়ারদিগার আমি তো এ জীবন চাইনি আপনার কাছে? চেয়েছি অতি সাধারণ একটি জীবন। যেখানে অর্থের অভাব হলেও সুখের কোনো অভাব হবে না। তাহলে কেন বাড়ছে এমন তিক্ততা! মানুষ তো আপনারই সৃষ্টি, আপনি যখন চান তখনই তাদের আপনার হুকুমে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। সব জেনে তবুও আপনার সৃষ্টিকৃত মানুষগুলো কেন সেসব ভুলে যায়? ‘
মুনাজাতে আল্লাহকে খুব করে বললাম। একমাত্র উনি ছাড়া আমার দুর্বিষহ জীবনের গল্প শোনার মতো যে কেউ নেই। সমাধান যেখানে সমস্যার কথা জানাতেও যে হয় সেখানে। তাই আমার অন্তরের অবস্থা জানুক কেবল আমার অন্তরজামী।

সন্ধ্যারাতে শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে। সোমাকে নিয়ে উনার ভীষণ গর্ব। বড়লোক ঘরের মেয়ে সে। শ্বশুর বাড়িতে আসার পূর্বে থেকে একের পর এক খুশি করার মতো কর্মকান্ড করে চলছে। প্রথমে শ্বশুর বাড়ির সবার চাহিদা মোতাবেক জিনিসপত্র পাঠালো, এখন নতুন সদস্য আসার সংবাদ! শ্বাশুড়ি সবার সামনে আমাকে শুনিয়ে শ্বশুরকে বললেন,
” একেই বলে কপাল বুঝলেন! সোমার মতো মেয়েকে ঘরে তুলতে পেরেছি বিধায় আজ আমাদের বংশের প্রদীপ জ্বলল বলে! নাহলে যে এক অপয়ারে ঘরে তুলছি আদৌও বংশে কেউ আসবে কি-না সন্দেহ! ”
এতোটুকু কথা অব্দি ঠিক ছিল কিন্তু যখন শুনলাম তিনি শ্বশুরের সঙ্গে এক অন্যরকম সলাপরামর্শ শুরু করছেন। তিনি শ্বশুরকে বলছেন, ” শোনেন জুনাইদের বাপ! জুনাইদ বাড়িতে আসলে জুনাইদরে বলতে হবে সকালরে যেন ওর মা’র কাছে দিয়ে আসে। শুধু শুধু এরকম অকেজো একজনের জন্য আমার ছেলের জীবন শেষ হতে দিতে পারি না। ”
শ্বশুর জানতে চাইলেন, ” কেন? কি করেছে সকাল? ঘরের কাজ তো দেখি টুকটাক ভালোই করে। নাকি তোমার সাথে আবার কোনো তর্ক করছে? ”
” আরে আপনি বোঝেন নাই। আমি তো এই কাজের কথা বলতেছিনা। যেখানে আমি এতো করে বলার পরেও একটা নাতির মুখ দেখাইতে পারল না সে। তারে রাইখা লাভ কি বলেন? এর চাইতে আমরা বরং সকালের সাথে জুনাইদের তালাকের পর জুনাইদরে আরেকটা বিয়ে করাবো। আমার ছেলের কোনো বংশধর হবে না এটা তো হতে পারে না। ”
এরই মাঝে কতদূর চিন্তা করে ফেলেছেন তিনি। অথচ বিয়ের স্থায়িত্বকাল ভালো করে একটা বছরও পেরুল না। সংসারে সারাদিন গাধার মতো খাটার পর আমার গায়ে ট্যাগ বসানো হলো, আমি অকেজো, বাঁজা, অভাগী মেয়েমানুষ। আমার জন্য উনার সংসারে যত অশান্তি। তাই আমাকে দূর করতে উনি এখনই কোমর বেঁধে নেমেছেন। মনের কষ্টে সেদিন রাতে ঘুম হয়নি মোটেও। আঁটকে রাখা কান্নাও আজ বাঁধ ছাড়া হয়ে যেতে চাইছে। আল্লাহর কাছে তাই পরিত্রাণ চাওয়া ব্যতিত আমার কাছে কোনো রাস্তা জানা নেই। জায়নামাজ গুটিয়ে ভোররাতের সেহরি প্রস্তুতের জন্য উঠে দাঁড়ালাম।

সেহরিতে সবাই পেটপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমতে চলে গেল। কিন্তু তখনও আমার মনের ভেতরে তুমুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছিল না এদের জন্য কোনো রকম কিছু করতে। কিন্তু দায়িত্বের কাছে আমার হাত পা বাঁধা। তাছাড়া না করলেও জুনাইদের কানে শ্বাশুড়ি ঠিক বানিয়ে বানিয়ে কথা লাগিয়ে দিব্যি প্রশান্তির সুখ অনুভব করতেন। যার খাই তার জন্য হলেও তো করতে হবে আমায়। অন্তত শিক্ষকের সন্তান হয়ে অকৃতজ্ঞের মতো কাজ করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ! সেহরিতে কিছুই খেলাম না। কেবল পানি খেয়ে পেট ভরিয়ে নিলাম। সবাই চলে যেতে টেবিলের থালাবাসন গুছিয়ে রান্নাঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে শুতে গেলাম। রাতে না ঘুমানো এবং সারাদিনের ক্লান্তিতে দুচোখ বুজে এলো আমার। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ অনুভব করলাম কারোর গরম নিঃশ্বাস এসে আমার মুখে পরছে। মনে হচ্ছে কেউ আমার ওপর ঝুঁকে রয়েছে। চোখ মেলতেই যা দেখলাম সেটি দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না…

চলবে….!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে