Thursday, August 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1551



ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৭

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০৭

সাবিহা সাবরিন কিচেনে নাশতার আয়োজন করছেন। মিষ্টি তাকে এটা ওটা দিয়ে সাহায্য করছে। মিষ্টির বয়স আনুমানিক সতেরো কি আঠারো হবে। মেয়েটা খুব দ্রুত কাজ শিখে ফেলেছে। সাবিহা সাবরিনকে এখন খুব বেশি প্রয়োজন না হলে রান্নাঘরে ঢুকতে হয় না। মিষ্টি সব সামলে নেয়। আজ কিচেনে ঢুকেছেন কারণ তার ভাসুর , ভাসুরের বউ আর তাদের ছেলে এসেছে। নয়তো মিষ্টিকে দিয়েই রান্নাটা করিয়ে ফেলতেন। অবশ্য মিষ্টিকে একা সব কাজ করতে হয় না। আয়নার মা তাকে সাহায্য করে। তবে তিনি কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই বাসায় চলে যান। আজ আয়নার মা আসেনি। তার মেয়েটা অসুস্থ বলে আজকে ছুটি নিয়েছে।

সানজানা বেগম কিচেনে ঢুকেই বললেন, ‘সাবি! তোর তো অনেক সুবিধা বাসায় কাজের লোক আছে। কোনো টেনশন নাই। সব কাজ ওরাই করে ফেলে।’

সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘ভাবি! কাজের লোক কই দেখছেন?’

‘কেন? মিষ্টির কথা বলছি। তাছাড়া আরো অনেক কাজের লোক তো আছেই।’ সরু চোখে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন সানজানা বেগম।

‘ভাবি, আপনিও কী যে বলেন না! মিষ্টি তো আমাদের পরিবারেরই একজন সদস্য । ওকে তো আমরা কাজের লোক হিসেবে ট্রিটই করি না। তাছাড়া অন্য যারা আছেন তারাও আমাদের পরিবারের সদস্যের মতোই।’ সাবিহা সাবরিন দৃঢ় গলায় বললেন।

‘দেখ সাবি! বাইরের মানুষদের আপন করতে যাস না। ওরা হচ্ছে নিম্ন স্তরের মানুষ। ওদের অতশত বিশ্বাস করতে যাস না যেন।’ সানজানা বেগম সতর্ক গলায় বললেন।

সাবিহা সাবরিন কড়াইতে চিকেন রোল ভাজতে ভাজতে বললেন, ‘ভাবি! আমার ভরসা আছে মিষ্টির উপর। ভরসা না থাকলে এভাবে ওকে নিজের কাছে এনে রাখতাম না।’

‘তুই আসলে খুবই সরল মনের সাবি। তাই আমি আগে থেকেই তোমাকে ওয়ার্ন করলাম । এই আরকি। তাছাড়া তোর ঘরে জোয়ান ছেলে আছে। পরে আবার বলবি আমি তোকে সতর্ক করিনি।’ সানজানা বেগম, মিষ্টির দিকে ত্যাড়ছা চোখে তাকিয়ে বললেন।

‘অনেক ধন্যবাদ ভাবি আপনার অগ্রিম সতর্কতা বাণীর জন্য। আপনার সতর্কবাণী আমার মনে থাকবে।’ সাবিহা সাবরিন মৃদু হেসে বললেন।

মিষ্টি তখন ঝাল পাকোরার ডো তৈরী করছিল। সে একবার তাকাল সানজানা বেগমের দিকে । তার কাছে এই মহিলাকে অনেক বেশি ধূর্ত টাইপের মনে হয়। আর উনার ছেলেকে মনে হয় অতি নিস্মস্তরের মনুষ্য কীট! তবে এরা অতি সাবধানতা অবলম্বন করে। যেমন, সে নিজে এদের খারাপ বললেও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। যার কারণে সে নিজেই দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ভাবে, তার মানুষ চিনতে ভুল হচ্ছে না তো! অনাথ আশ্রমে থাকাকালীন তো কত মানসিকতার মানুষকেই দেখেছে। তাই তার এই অল্প বয়সের জীবনেও সে মানুষ চিনতে শিখেছে, শিখেছে মানুষের দৃষ্টি পড়তে। জীবন মানুষকে অনেককিছু শিখিয়ে দেই। নিজের অপারগতা মানুষকে বাধ্য করে জীবনে চলার পথের প্রতিবন্ধকতা উপড়ে নতুন উপকরণ আহরণ করতে। মিষ্টিও সে পন্থাই অবলম্বন করত এতদিন কিন্তু এই পরিবারে আসার পর থেকে সে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। মনে হয় যেন শত বছর পরে সে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। সাবিহা সাবরিনের কথায় তার চিন্তার রেশ থমকে গিয়ে বাস্তবে ফিরে এলো।

নাশতা তৈরী শেষে সাবিহা সাবরিন মিষ্টিকে ট্রেতে করে ড্রয়িং রুমে নাশতা নিয়ে যেতে বললেন।

ড্রয়িং রুমে বসে সাব্বির আহমেদ তার বড়ো ভাই ওয়াহিদ আহমেদের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করছে দাবা খেলায়। দু’ভাইই এই খেলাতে বেশ দক্ষ। তাই কে জিতবে তা বলা বেশ মুশকিল। শিহরণ আর রাফি বসে খেলা পর্যবেক্ষণ করছে। মিষ্টি নাশতার ট্রে এনে রাখতেই খেলায় মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলো।

সাবিহা সাবরিন এসেই কড়াভাবে বললেন আগে নাশতা শেষ করার জন্য। সবাই তার কথা মেনেও নিল। বহ্নি নিজের রুমে শুয়ে আছে। তাই সাবিহা সাবরিন মিষ্টিকে দিয়ে বহ্নির রুমে নাশতা পাঠিয়ে দিলেন।

‘আগুনমণি আপু! নাশতা নিয়ে এসেছি। খেয়ে নাও।’ মিষ্টি তার মিষ্টি স্বরে বলল।

বহ্নি শুয়ে থাকা অবস্থাতেই চোখ মুখ কুঁচকে তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘ তোকে না বলছি আমাকে আগুনমণি না ডাকতে? এই নামে আমাকে কেবল এক জনই ডাকতে পারবে । আর কেউ ডাকতে পারবে না।’

‘আচ্ছা আর ডাকব না। কিন্তু নাশতা…?’ মিষ্টি দু’চোখের ভ্রু কুঁচকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল।

‘রেখে যা। পরে খাব।’ গমগমে গলায় বলল, বহ্নি।

‘মিষ্টিপু! দেখ না আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। ভিজবে বৃষ্টিতে?’ মিষ্টি ভেজা গলায় বলল।

বহ্নি এবার নরম কণ্ঠে বলল, ‘ওই মিষ্টি তো তোর নাম। আমাকে মিষ্টিপু কেন বলছিস? এখন ভিজলে মা বকা দিবে রে । এমনিতেই শরীরটা খারাপ লাগছে।’

‘তোমাকে আমার খুব মিষ্টি লাগে তাই ডাকি।তাহলে তুমি নাশতা খেয়ে বিশ্রাম নাও।’ এটুকু বলে মিষ্টি দরজার কাছে যেতেই বহ্নি তাকে ডেকে বলল, ‘এই মিষ্টি! ওরা এখনো যায়নি?’

‘না আপু। মাত্র খাওয়ার পর্ব শুরু করেছেন।’

‘কি বলিস?’ বহ্নি চিন্তিত সুরে বলল।

‘হ্যাঁ, আপু।’ বিষণ্ণ গলায় বলল, মিষ্টি।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে যা।’

বহ্নি নাশতা সেরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে । বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে দিয়েছে। দু’হাতের তালুকে নৌকার মতো করে বেঁকিয়ে রেখেছে। সেখানে জমছে সন্ধ্যাকালীন বৃষ্টির কাচের ন্যায় স্বচ্ছ ফোঁটা । একটু রাখতেই হাত ভরে যাচ্ছে। আর বহ্নি সেই পানির ফোঁটাগুলো চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে । এক ধরনের মাদকতা বিরাজ করছে পুরো প্রকৃতি জুড়ে। তার রেশ ছড়িয়ে পড়েছে বহ্নির মাঝেও। তার ঠোঁটে একটা হাসির রেখা দেখা দিয়েছে। গান শুরু করেছে সে। বৃষ্টিকালীন সন্ধ্যায় রিনরিনে মিষ্টি কণ্ঠের সুরেলা গান।

“আজ এ বর্ষায় তুমি এলে
একগুচ্ছ কদম হাতে
আমি চেয়ে আছি পথ তোমার
শত বর্ষ ধরে ও মোর প্রিয়তম
বলো–কবে আসবে তুমি?”

‘থামলে কেন? খুব ভালো লাগছিল শুনতে। তোমার গানের গলা তো দারুণ, বহ্নি ।’ বহ্নি ঘুরে দাঁড়াতেই রাফিকে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।

‘আমার ইচ্ছা।’ দায়সারাভাবে বলল, বহ্নি ।

‘আমার কল রিসিভ করছিলে না কেন?’ শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল রাফি।

রাফিকে নিজের রুমে দেখে বহ্নির এমনিতেই প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই ছ্যাঁচড়া ছেলেটাকে বের করে দিতে। কিন্তু তার হাত বাঁধা সম্পর্কের বাঁধনে । তাই মনের এই চাওয়াটা সে পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ইচ্ছে হয়নি তাই । তুমি আমার রুমে কেন ?’

‘কেন আসতে পারি না?’ বহ্নির খাটে বসে নির্বিকারভাবে বলল, রাফি।

‘না।’ দৃঢ়তার সাথে বলল বহ্নি, ‘পারো না।’

‘অবশ্যই পারি । আফটার অল এটা আমার চাচার বাড়ি।’ দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, রাফি।

‘অনুমতি নিয়েছ তুমি আমার রুমে ঢুকার আগে?’

‘আমার চাচার বাসায় আমার অনুমতি লাগবে কেন?’

‘অবশ্যই , অনুমতি নিতে হবে। কারো বেডরুমে ঢুকতে হলে যে অনুমতি নিতে হয় তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়।’

‘এত জটিল করে কথা বলো কেন তুমি? তুমি কি জানো না আমি তোমাকে পছন্দ করি।’

‘হুম, জানি। আর তাই তোমাকে এটা বুঝাতে চাই যে আমি তোমাকে কেবলই ভাই মনে করি। এর থেকে বেশি কিছু কখনোই সম্ভব নয়।’ বহ্নি বুকের উপর দু’হাত ভাজ করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল।

‘যদি বাসা থেকে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয় তখন কী করবে?’ রাফির পাল্টা প্রশ্ন।

‘কিছুই করতে হবে না আমার। কারণ আমার আব্বু আমার অনুমতি ছাড়া কখনোই আমার বিয়ে দেবার কথা ভাববেনও না।’ প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, বহ্নি।

‘এত বিশ্বাস?’ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, রাফি।

বহ্নি ছোট্ট করে বলল, ‘হুম।’

‘দেখে নিও তোমার এই বিশ্বাস আমি ভাঙবোই।’ তেজী কণ্ঠে বলল, রাফি।

‘হা হা হা।’ বহ্নি সহাস্যে বলল, ‘অপেক্ষায় রইলাম।’

রাফি ধাম করে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল বহ্নির রুম থেকে। রাফি চলে যাওয়াতে বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই রকম ছ্যাঁচড়া কেন তার চাচাত ভাইটা বহ্নি তা ভেবে পায় না। বিড়বিড় করে বলল, ‘তুমি যদি আমার চাচাত ভাই না হতে তবে তূর্ণকে দিয়ে আচ্ছামতো ধোলাই খাওয়াতাম। কিন্তু আফসোস! ভাই বলে পারছি না। তবে তোমার আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে।’

______________________

রাদিদ নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখল ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশ। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো জ্বলছে। একবার আকাশ পানে তাকাল সে। ছাতাটা যে কেন সাথে করে নিয়ে আসেনি সে তার জন্য খুব আফসোস হচ্ছে। অটো বা রিকশা কোনোটাই পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কেমন বোকার মতো কাজটাই না করল সে। যখন নামাযের জন্য বেরিয়েছিল তখনই তার মনে মনে ধারণা হয়েছিল বৃষ্টি নামতে পারে। কিন্তু মনের ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দেয়নি। এখন ভুগতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজলে তো আর কথাই নেই। জ্বর এসে একদম শোচনীয় অবস্থা হয়ে যাবে।

তবে সমস্ত চিন্তা ছাপিয়ে এখন একটাই চিন্তা বাসায় যাবে কী করে! বৃষ্টির মধ্যে রওনা হলে আবার ভিজে একাকার হয়ে যাবে। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল সে। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এদিক ওদিক তাকাল সে, কোনো সাহায্য পাওয়ার আশায় হয়তো। নামায পড়া শেষে অনেকেই ইতোমধ্যে বাড়ি ফিরে গেছে। হঠাৎ পেছন থেকে কারো ভাঙা ভাঙা কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকাল সে। একজন বৃদ্ধ লোক তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুমি ওসমানের বাসায় যাবে না?’

রাদিদ লোকটিকে চিনতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কোনোরকমে বলল, ‘জি, দাদু।’

বৃদ্ধ লোকটি বলল, ‘এসো, আমার সাথে যেতে পারবে। আমি ছাতা নিয়ে এসেছি।’ বলতে বলতে বৃদ্ধ লোকটি ছাতা খুলে ফেলল।

রাদিদ খেয়াল করল ছাতাটাতে করে কোনোমতে একজন মানুষ যেতে পারবে। দুজন মানুষের জায়গা কোনোমতেই তাতে হবে না।

তাছাড়া এই বৃষ্টিতে ভিজলে দাদুটি নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাই রাদিদ না চাইতেও সম্মতি দিল। তারপর বৃদ্ধ মানুষটিকে ধরে ধরে পুরো রাস্তা হেঁটে আসল। রাদিদ ছাতাটা এমনভাবে ধরল যাতে বৃদ্ধ লোকটি না ভিজে যান। এটা করতে গিয়ে সে নিজেই কাকভেজা হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কী! সে যেহেতু এখনো ইয়াং তাই তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি কিন্তু বৃদ্ধ মানুষটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তার চাইতে অনেক কম। তাই সে নিজে ভেজার বেলায় আর কোনো তোয়াক্কা করল না।

হাঁটতে হাঁটতে দাদুটি বলল, ‘তুমি কি করো দাদুভাই?’

রাদিদ সহাস্য বলল, ‘দাদু ! এই তো ছোটোখাটো একটা ব্যাবসা করি। আলহামদুলিল্লাহ, এতেই খুব ভালো চলছে।’

সারা রাস্তা বৃদ্ধ মানুষটি তার সাথে কথা বললেন। তিনি রাদিদকে খুব পছন্দ করলেন। রাদিদের ফুফুর বাসার পরের দুই বাসা পরেই মানুষটির বাসা। বাসায় পৌঁছে দিতেই রাদিদ চলে আসতে উদ্যত হলো। বৃদ্ধ দাদুটি বলল,’ দাদুভাই এক কাপ চা খেয়ে যাও।’

রাদিদ বলল,’ অন্য আরেকদিন খাব। এখন বাসায় না গেলে ফুফু রাগ করবেন ।’

রাদিদ চলে আসতে চাইলে বৃদ্ধ দাদুটি বলল, ‘আরেহ্, দাদুভাই। আমার ছাতাটা সাথে করে নিয়ে যাও।

রাদিদ সহাস্যে ছাতাটা হাতে নিল। প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না।

বৃদ্ধ দাদুটি আবার বলল,’আরেকদিন এসে আমার সাথে একসাথে চা খেতে হবে। মনে রেখ দাদুভাই।’

রাদিদ প্রত্যুত্তরে হেসে বলল, ‘দাদু ছাতা দিতে হলেও আমায় আর একবার আসতে হবে।’

বৃদ্ধ মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে প্রাণবন্ত হাসলেন। রাদিদ বৃষ্টিভেজা কংক্রিটের রাস্তায় ধীর পায়ে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতেই তার মনে হলো সে তো দাদুটির নামটাই জানে না। এতক্ষণ কথা বলল কিন্তু মানুষটির নামটাই জানতে চাইল না সে। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে । চারপাশে প্রকৃতি এক নতুন সজীবতায় যেন উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। আবছা আলোতেও রাদিদ তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। হঠাৎ করে কেঁপে উঠল সে। ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। নির্ঘাত এবার জ্বরের কবলে পড়বে সে।

_______________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৬

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০৬

‘আম্মু! আমার চশমাটা কোথায় দেখেছ?’ অতল তার রুমের সব জায়গায় চশমা খুঁজে না পেয়ে তার মাকে প্রশ্ন করল।

‘আমি কি তোর চশমার পাহারাদার?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন মেহেরুন নাহার রান্না ঘরে সমুচা ভাজতে ভাজতে।

তানিয়া তার ভাইয়ের রুমে ঢুকে বলল,’তোমার চশমা চোখ বের করে তোমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর চিৎকার করে বলছে,’ অন্ধ মানব এই দিকে একটু আসেন আমি যে আপনাকে পথ প্রদর্শন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আপনার ল্যাপটপের উপর অধীর আগ্রহে বসে আছি।’ এটুকু বলেই তানিয়া খিল খিল করে হাসতে লাগল।

অতল রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়ার দিকে। সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,’চশমা ছাড়া কি আমি দেখতে পাই না ভেবেছিস?’

তানিয়া ল্যাপটপের উপর থেকে অতলের চশমাটা নিয়ে অতলের চোখে পরিয়ে দিতে দিতে বলল,’অবশ্যই দেখতে পাও। তবে কেন যে খুঁজে পাও না সেটাই আমি বুঝতে পারি না!’

অতল এবার একটু ভাব নিয়ে বলল,’কে বলল খুঁজে পাই না? আমি তো তোর কাজ করার দক্ষতা কেমন তা জানার জন্য খুঁজে না পাবার ভান করছিলাম ।’

‘হেহ্! বললেই হলো?’ তানিয়া মুখ ভেংচিয়ে বলল, ‘তুমি খুঁজে পাওনা। সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।’

‘তুই কীভাবে জানিস?’ অতল তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছাতে গুছাতে বলল, ‘আমি তো চশমা ছাড়া সব দেখি । তাছাড়া আমি কি বৃদ্ধ যে দেখতে পাই না?’

তানিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ভাইয়া তুমি কিন্তু খুব মিথ্যে কথা বলছ ইদানিং!’ একটু থেমে আবার বলল, ‘ আমার সাহায্য ছাড়া তুমি কিছুই করতে পারো না।’

‘হেহ্! আমার তোর মতো টমেটো সসের সাহায্য নিতে হবে কেন? আমি নিজের কাজ নিজেই বেশ ভালো করতে পারি।’ অতল ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট ইন করতে করতে বলল।

‘টমেটো সস! ভাইয়া এসব কি? আমার কি সুন্দর একটা নাম আছে। তুমি সেটা বাদ দিয়ে টমেটো সস কেন বলো?’ তানিয়া প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতলের পেছনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল।

‘কারণ টমেটো সস আমার খুব প্রিয় । আর তুইও আমার প্রিয় । তাই ডাকি।’ অতল তানিয়ার কান মলে দিয়ে বলল।

তারপর অতল তার রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে বসল। তানিয়াও পিছু পিছু এসে বসল। অতলের মা গরম গরম সমুচা ভেজে এনে রাখলেন তাদের সামনে। অতল সমুচা দেখেই তানিয়াকে বলল, ‘এই টমেটো সস! যা ফ্রিজ থেকে সত্যিকারের সস নিয়ে আয়।’

‘ভাইয়া আবার! আম্মু দেখ না আমাকে আবার টমেটো সস বলে ডাকছে।’ তানিয়া এক হাত কোমড়ে রেখে অপর হাত নেড়ে নেড়ে তার মাকে বিচার দিল।

মেহেরুন নাহার বললেন, ‘ তোদের ভাই বোনের ব্যাপারে আমি একদম নাক গলাব না। একটু বাদেই দুজনের গলায় গলায় ভাব হয়ে যাবে। মাঝখানে আমাকে শত্রু বানানোর পাঁয়তারা চালাস। তাই তোদের ব্যাপার তোরা সামলা।’

তানিয়া মায়ের কথা শুনে বলল, ‘দাঁড়াও আমি আব্বুকে বিচার দেব। আব্বু তখন তোমার কান মলে দিবে। একদম ঠিক হবে তখন। আম্মু তো সব সময় তোমার সাইডেই থাকে। আমি বিচার দিলেই খালি বলে তোদের ভাই-বোনের ব্যাপারে নাক গলাব না।’

অতল একটা সমুচা হাতে নিয়ে খেতে খেতে বলল, ‘আম্মু টমেটো সসকে বিদেয় করার সময় হয়েছে। এবার কিন্তু ভালো থেকে একটা পাত্র দেখতেই হবে।’

‘ভাইয়া!’ তানিয়া ন্যাকা কান্না জুড়ে দিয়ে বলল, ‘ ভালো হচ্ছে না কিন্তু ভাইয়া। আমি আগে বিদেয় হব না। আগে বড়ো ভাইয়ার বউ দেখব তারপর তোমার বউ দেখব। অবশেষে আমার বিয়ে। এর আগে কোনোভাবেই না।’ খানিক থেমেই অতলকে বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে তানিয়া বলল, ‘এত ছোটো একটা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছ। লজ্জা করে না তোমার?’

অতলকে এক মুহুর্তের জন্য বড্ড বিমর্ষ দেখাল। যেন অতীতের কোনোকিছু তাকে ভেতর থেকে খানিকটা নাড়া দিল কিছুসময়ের জন্য! তারপর মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ এহ্! পিচ্চি মেয়ে আর তুই? তোকে এবার সত্যিই সত্যিই বিদায় করতে হবে।’

‘আমি তোমার ছয় বছরের ছোট। তাহলে পিচ্চি না?’

‘আমার কাছে তো তুই সব সময়ই পিচ্চি। কিন্তু বিয়ে তো দিতে হবে। তাই না?’

‘ভাইয়া এখন এসব বিয়ে বিষয়ে কোনো কথা না। আগে বড়ো ভাইয়া আর তোমার বিয়ে তারপর তোমরা সবাই মিলে আমার জন্য পাত্র দেখবে। বলে দিলাম কিন্তু!’

‘আচ্ছা ঠিক আছে আমার টমেটো সস।’

‘আবার?’ তানিয়া কোমড়ে দু’হাত রেখে চোখ বড়ো বড়ো করে অতলের দিকে তাকিয়ে বলল।

‘ওরে বাপরে! আমি তো ভয় পেয়ে গেছি রে। আচ্ছা আর ডাকব না।’ অতল ভয় পাবার ভান করে বলল।

আশরাফ হোসেন গলা খাঁকারি দিতে দিতে ডাইনিং এ এসে বসলেন। বাবাকে দেখেই অতল আর তানিয়া একদম চুপসে গেল। একেবারে ভদ্র, শিষ্ট আর বিনয়ী হয়ে গেল যেন মুহূর্তেই।

মেহেরুন নানার তাই দেখে বললেন, ‘বাবার সামনে কেউ ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না আর আমার সামনে এক একটা দস্যি রূপে অবতার হয়। কপাল আমার!’

কথাটা বলেই তিনি আশরাফ হোসেনকে সমুচা খেতে দিলেন। আর একটা কাপে গরম চা ঢেলে স্বামীর দিকে এগিয়ে দিলেন। আশরাফ হোসেন সমুচা দেখেই গমগমে গলায় বললেন, ‘এই সকালে সমুচা বানালে কেন, আতিকের আম্মা? আলু পরোটা বানাতে । কতোদিন আলু পরোটা খাওয়া হচ্ছে না আমার।’

অতল আর তানিয়া মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। কিন্তু কিছুই বলল না। বাবাকে সবাই ভয় পায়। সব কথা , হাসি-ঠাট্টা সব বাবার অগোচরে করা হয়।

মেহেরুন নাহার বললেন, ‘আচ্ছা অন্য একদিন নাহয় বানাব। আজ সমুচা, টোস্ট, আর পাউরুটি দিয়েই নাশতা সেরে নিন।’

একথা বলে তিনি সাথে সাথেই রান্নাঘরে চলে গেলেন । ঠিক তখনই অতলের সেলফোনে একটা কল এলো। আশরাফ হোসেন গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তোমাকে না কতবার বলেছি খাওয়ার সময় মোবাইল অফ রাখতে।’

‘স্যরি আব্বু ।’ অতল তড়িঘড়ি করে বলল।

‘কী এক স্যরি শব্দ শিখেছ! কথায় কথায় এই ‘স্যরি’ শব্দটাই ঝাড়তে থাক।’ আশরাফ হোসেন বিরক্ত মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন।

মোবাইলের রিং বেজেই চলেছে। অতল মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থতমত খেয়ে আবার বলল, ‘স্যরি আব্বু।’ ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে আবার বলল, ‘দুঃখিত আব্বু ।’

আশরাফ হোসেন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে কলটা রিসিভ করো।’

অতল মোবাইল হাতে নিজের রুমে চলে গেল। কিন্তু কলটা শেষমেশ কেটেই গেল। আয়মান কল করেছে। এত সকালে কেন কল করেছে অতল তা ভেবে পেল না। কিন্তু কল ব্যাক করার প্রয়োজনও সে অনুভব করল না। মোবাইলটা নিজের টেবিলের উপর রেখে আবার ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। তার বাবা আবার ও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘ এবার কি বিসিএস হবে?’

অতল থতমত খেয়ে গেল। একটু সময়ের জন্য সে ভাবনায় পড়ে গেল। বিসিএস যে কী পরিমাণ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তা তার বাবা খুব ভালো করেই জানে তারপরেও কেন যে তিনি এই একই কথা বারবার জিজ্ঞেস করেন অতল তা বুঝতে পারে না।

‘কী হলো? তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো না-কি?’

অতল ভাবনার জগৎ থেকে তৎক্ষনাত বেরিয়ে এলো। বলল, ‘আব্বু সামনেই একটা বিসিএসের ভাইভা দিব। আর একটা তো প্রিলি দিয়েছি । রেজাল্ট পেন্ডিং।’

‘ভালো, বেশ ভালো। তা আর কোনোখানে কি ট্রাই করছ?’

‘নাহ্, আব্বু। আর কোথাও ট্রাই করতে তো আপনি নিষেধ করেছেন।’

‘আহ্! তুমি সকাল সকাল কি চাকরি বাকরি নিয়ে পড়লে ভলো তো। ছেলেটাকে ঠিকমতো নাশতা তো করতে দাও। সারাদিন পড়াশুনা নিয়ে থাকে ছেলেটা।’ মেহেরুন নাহার রান্নাঘর থেকে পায়েশের বাটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন।

অতল নাশতা শেষ করেই প্রয়োজনীয় বইপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেল। পড়াশুনা নিয়ে বেশ ভালোই ব্যস্ত সময় কাটছে তার। ভাইভার ডেট তো দিয়েই দিয়েছে। এবার ভালোই ভালোই পার করতে পারলেই হয়। তাহলেই সহকারি কমিশনার হিসেবে কর্মজীবনের যাত্রা শুরু করতে পারবে।

_______________________

নওশীন হক একবার রাদিদের কাছে জানতেও চাইলেন যে নীরা কি নিয়ে ট্রিট চাইছে। রাদিদ তখন বেশ কষ্টে ফুফুকে কোনোরকমে ম্যানেজ করল। এখন আবার শুরু করেছে এই বিচ্ছুটা! এখন যদি এসব কোনোরকমে আফরিন বিচ্ছুর কানে যায় তবে মহা ক্যাঁচালের মধ্যে পড়বে সে। তাই তার কপালে পড়েছে চিন্তার ভাজ। ভ্রু জোড়া আপনা আপনি কুঞ্চিত হয়ে গেল। যেন এক গভীর চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে সে!

‘কি হলো, রাদিদ ভাইয়া? ট্রিট দেবে না?’ নীরার প্রশ্ন, করুণ কণ্ঠে।

রাদিদ কী যেন ভাবল! তারপর বলল, ‘অবশ্যই দেব। তবে একটা শর্ত আছে।’

নীরা তৎক্ষনাত সোফা থেকে উঠে রাদিদের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, ‘সামান্য ট্রিট দিতেও শর্ত জুড়ে দিলে?’ নীরার কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়। বিস্ময় কাটিয়ে সে হাত নেড়ে বলল, ‘আচ্ছা, বলো কী শর্ত?’

‘বহ্নি যদি আমাকে ভালোবাসে বলে নিজের মুখে স্বীকার করে তবে তোকে বিশাল ট্রিট দেব। একেবারে যা চাইবি তাই দেব। এর বিন্দুমাত্র হেরফের হবে না। ঠিক আছে?’ রাদিদ দুর্বোধ্য হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে বলল।

নীরা এবার ধপাস করে শব্দ করে বসে পড়ল সোফার উপর। ডান হাতটা কাপালের উপর রেখে হতাশ গলায় বলল, ‘হায়রে! কিপ্টে মানব! এ তো ট্রিট দেওয়া আর না দেওয়ার সমান।’

‘সমান কেন হবে? তুই তো বেশ খুশি হয়েছিস। আর খুশির কারণেই তো ট্রিট চাইছিলি। তো যেই কারণে খুশি হচ্ছিলি সেটা তো আগে ঘটুক ।’ এবার রাদিদ নীরার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বাম চোখের ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘ডান?’

নীরা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর হুট করেই বলল,’ওকে, ডান।’

রাদিদের ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসির চিহ্নটা লেগেই রইল। যেন সে মহাখুশি নীরাকে শর্তে রাজী করাতে পেরে।

আফরিন রুমে ঢুকে ওদেরকে এভাবে দেখে বলল,’ কী রে ! এসব কি হচ্ছে? কিসের শর্তে কথা বলছিস ?’

রাদিদ ইশারায় নীরাকে জানাতে নিষেধ করল। নীরা তা দেখে বলল, ‘রাদিদ ভাইয়াকে বলেছি যাতে তাদের বাসায় নিয়ে যায় আমাকে । তুমি কি যাবে, আপু?’

‘ওপস্, নো।’ আফরিন রুমের অন্যপাশের সোফাতে বসতে বসতে বলল, ‘আমি ওখানে গেলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি যেতে পারব না। তোর ইচ্ছে হলে তুই যা। আমাকে যেতে বলিস না।’

আফরিনের কথা শুনে রাদিদের হাসি হাসি মুখের উপর মুহূর্তেই এক অন্ধকার ছায়া পড়ল। বড়োই বিমর্ষ দেখাল তার মুখখানা। নীরা বোধহয় কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। বলল, ‘তোমার দম বন্ধ হয়! আর আমার তো মনে হয় আমি ওখানে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছি। আমি তো অবশ্যই যাব।’

আফরিন ততক্ষণে মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে ফেলেছে। চোখে দু’টুকরো শশা দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে আরাম করে সোফাতেই শুয়ে পড়ল। আলতো করে ঠোঁট নেড়ে বলল, ‘এই নীরা! আম্মু ডাকলে বলিস, আমি এখন নাশতা করব না । একেবারে ডিনার করব।’

নীরা আফরিনের কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না। সে রাদিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী! রাদিদ ভাইয়া! আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবে তো ?’

রাদিদ মলিন হেসে বলল, ‘তুই যেতে চাইলে অবশ্যই নিয়ে যাব।’ হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে রাদিদ পুনরায় বলল, ‘জানিস, মা তোর কথা সব সময় জানতে চায়। তুই গেলে বাসার সবাই খুশি হবে। পিউ তো তোর জন্য একেবারে পাগল।’

কাছের কোনো মসজিদ থেকে আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে বাতাসে ভর করে। কী সুন্দর ও পবিত্র অনুভূতি! মনে হয় যেন সেই ধ্বনি হৃদয়ের কলুষিত অংশটুকুও পবিত্র করে দিচ্ছে। তবে সেই অনুভূতি অনুভব করার জন্য মনোযোগ আবশ্যক।

নীরা সেই সময়টাতে রাদিদকে কিছু একটা বলতে চাইছিল। রাদিদ নীরাকে ইশারায় থামতে বলল। আজানের সময় দুনিয়াবী কথাবার্তা না বলে মনোযোগ সহকারে আযান শুনা উচিত। অথচ আজান দিলেই যেন কথা বেড়ে যায়! চুপচাপ থাকা মানুষটিও যেন সেই মুহূর্তে কথা বলতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে!

নওশীন হক নামাজ শেষ করে সন্ধ্যার নাশতার জন্য দুই মেয়ে আর রাদিদকে ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে শেষমেশ নিজেই এলেন ড্রয়িংরুমে । এসেই দেখলেন একজন রূপচর্চায় ব্যস্ত। আর অন্যজন স্ট্যচু অব লিবার্টি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব বিরক্ত হলেন তিনি। নীরাকে ধমকে বললেন, ‘কী রে! নামায পড়বি না? আজান তো সেই কবে দিয়েছে!

রাদিদকে দেখলেন না তিনি। বোধহয় নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছে। তারপরেও নীরাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাদিদ কি মসজিদে গেছে?’

নীরা মাথা উপর নিচ করে সম্মতি জানিয়ে ছোট্ট করে বলল, ‘হুম।’

নওশীন হক তাড়া দিয়ে বললেন, ‘যাও, গিয়ে নামাজ পড়।’

নীরা ভাল মেয়ের মতো নামাজ পড়তে চলে গেল। তারপর তিনি আফরিনকে ধমকে বললেন, ‘এই যে নবাবজাদী! খালি রূপচর্চা করলেই কি হবে? যাও এবার নামাজটা পড়ে নাও।’

আফরিন নড়ছেও না। সে তার মতো আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। নওশীন হক কাঁধ ধরে ধাক্কা দিতেই আফরিন বিরক্তির সুরে বলে উঠল, ‘উফ্ মা! বিরক্ত করো না এখন। আমি একেবারে ডিনার করার জন্য উঠব। এর আগে না।’

নওশীন হক মেয়ের উত্তর শুনে আহত হলেন। কিন্তু মেয়েটাকে কোনোভাবেই তিনি ঠিক করতে পারছেন না। নীরা কথা শুনলেও আফরিনকে দিয়ে তিনি কখনোই কথা শুনাতে পারেন না। রান্নাঘরের কাজেও নীরা তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে কিন্তু আফরিন কোনোভাবেই না। বড়ো মেয়েটা বাবার লাই পেয়ে পেয়ে একেবারে মাথায় উঠেছে। তিনি ভেবে পান না এই মেয়েকে নিয়ে কী করবেন তিনি! অথচ তার স্বামী কতটা নির্বিকার এখনও । যেন তাদের মেয়ে দুটো এখনও পিচ্চি। আদর আহ্লাদের ঘাটতি হলেই যেন খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে! তিনি জানেন আফরিনকে ডেকে আর কোনো লাভ নেই। এটা তো নিত্যদিনের চিত্র! এই চিত্রটা কবে যে বদলাবে তা তিনি জানেন না বা আদৌ বদলাবে কি না তাও তিনি জানেন না। সময়ের হাতেই সবটা ছেড়ে দিলেন।

যখন মানুষের হাতে আর কিচ্ছু থাকে না তখন সে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয় সমস্তটা। সময়ের স্রোতে ভেসে যদি কোনো এক তীরে ভিড়তে পারে তবেই রক্ষে! আর যদি কোনো তীর পাওয়া না যায় তবে চিরকাল ভাসমান হয়ে থাকতে হবে। যার কোনো কূলই থাকবে না। কূলহীন জীবনের আদৌ কোনো মূল্য আছে কি না নওশীন হক তা ভেবে পান না।

_________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৫

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০৫

দোতলা বিল্ডিংটার বাইরের আবরণটা খুবই স্যাঁতসেঁতে ধরনের। সবুজ রঙের শ্যাওলা যেন রাজত্ব করছে পুরো দেওয়াল জুড়ে । আর ভেতর থেকে ভেসে আসছে নানান আওয়াজ । বাড়ির ঠিক সামনে একটা পুকুর আছে। পুকুরের স্বচ্ছ জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে হাঁসের ঝাঁক। খানিক বাদে বাদেই ডাকছে প্যাঁক প্যাঁক শব্দ করে। পুকুরের চারপাশটা গাছগাছালিতে ভরপুর। একদম ছায়াঘেরা পরিবেশ যাকে বলে। দখিনা হাওয়ায় দোল খেতে খেতে উপরনিচে করছে গাছগুলির পাতলা ডালপালাগুলো। কয়েকটি নাম না জানা পাখি এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে আর খানিক বাদে বাদেই ডাকছে মনকাড়া সুরে।

বিল্ডিংটির দক্ষিণ পাশ জুড়ে নারকেল গাছের সারি। হাওয়ায় দোল খাচ্ছে পাতাগুলি। নারকেল গাছের সারির শেষ মাথায় একটা খামারের মতো। উপরের অংশে একটা সাদা পলিথিনের মতো কিছু একটা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। সম্ভবত বৃষ্টির পানি যাতে ভেতরে প্রবেশ না করে তাই এই ব্যবস্থা! খানিক বাদে বাদেই মুরগির ডাক জানান দিচ্ছে তাদের অবস্থানের। একটা দুটো মুরগি আবার উঠোন জুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। খাবার দেখলেই অমনি তা গোগ্রাসে গিলছে যেন!

উঠোনের এক পাশে একটা পেয়ারা গাছ। পেয়ারা এখনও ধরেনি। ফুল এসেছে সবেমাত্র। গাছটির পাশেই খোলা উঠোনে তিনটা বাচ্চা মেয়েছেলে মাটির তৈরী হাড়ি পাতিল নিয়ে খেলছে। সবার মুখ হাসি হাসি। একটা পিচ্চি চমৎকার চুলোও বানিয়েছে! আর সেখানেই একটা মিষ্টি বাচ্চা মেয়ে পাতিল বসিয়েছে। যেন সত্যিকারের রান্না করছে বাচ্চা মেয়েটা!

‘পিউ! এই পিউ!’ চিৎকার ভেসে আসলো পুরনো বিল্ডিংটার ভেতর থেকে। আর সেই শব্দ শুনেই পিচ্চি বাচ্চার দলের রাঁধুনী বাচ্চা মেয়েটার মুখে পড়েছে ভয়ের ছাপ। তড়িঘড়ি করে সে বলল, ‘এই তোরা খেল। আমি যাচ্ছি। মা ডাকছে ।’ এটুকু বলেই সে দিল ভোঁ দৌড়। অন্য দু’জন বাচ্চা তার ছুটার পানে মুখ হা করে তাকিয়ে রইল।

ঘরের ভেতরে ঢুকেই পিউ বলল, ‘মা, ডেকেছ?’

নীলা তার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মুখের কাঠিন্য আর ধরে রাখতে পারছে না। কেমন অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে মেয়েটা । মনে হয় খুব ভয় পেয়েছে মা বকবে বলে। তারপর যথাসম্ভব চোয়াল শক্ত করে নীলা বলল, ‘সারাদিন খেলা আর খেলা। একটু পরেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে। সেই খবর কি তোর আছে? পড়তে যে বসতে হবে তা কি জানিস না তুই?’

ফাইজা বেগম নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে পিউকে কাছে টেনে কপালে একটা চুমু দিয়ে নীলাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী রে! কী হয়েছে? এমন করে বকছিস কেন মেয়েটাকে ?’

‘মা, তুমি ওকে আশকারা দিতে দিতে খুব বাড় বাড়িয়ে দিয়েছ। এখন মেয়েটা আমার কথা শুনলে তো!’ নীলা বলল, আক্ষেপের সুরে।

আবির আর সাবরিনা সন্ধ্যার নাশতার জন্য রুম থেকে চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়েছে মাত্র। আবির হুট করেই বলতে শুরু করল, ‘আপা, তোমরা মা, মেয়ে মিলে আমাদের শান্তি একেবারেই নষ্ট করে দিচ্ছ। একটু শান্তিতে যে দুপুরে ঘুমাব তার কোনো জো নেই। সকাল নেই , বিকাল নেই, তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দাও। এসব নিত্যদিনের ঝামেলা আর ভালো লাগে না।’

ফাইজা বেগম চোখমুখ কঠিন করে তাকালেন আবিরের দিকে। বললেন, ‘বড় আপার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেই ভদ্রতাটুকুও বোধহয় লোপ পেয়েছে তোমার!’

সাবরিনা আবিরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে ডান হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মা, তুমি খুব বেশি করো। তোমার জন্যই তো আপা এখানে এসে পড়ে আছে। বিয়ে দিয়েছ যখন শ্বশুরবাড়ি না থেকে এখানে কি?’

‘আর এখানে যখন আছেই তখন এভাবে আমাদের শান্তি নষ্ট করার তো কোনো মানে নেই। তাই না ,সাবরিনা?’

‘হুম, একদম ঠিক বলেছিস, ভাইয়া। সাবরিনা সম্মতি দিল।

‘এই তোরা, আমার মেয়েকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবি না। এটা ওর বাপের বাড়ি। ও যখন-তখন, এমনকি যতদিন ইচ্ছা, দরকার হলে সারাজীবন থাকবে। তোদের সমস্যা হলে তোরা দুইজন বের হয়ে যা।’ ফাইজা বেগম উঁচু গলায় বললেন।

‘এটা আপার বাপের বাড়ি হলে আমাদেরও বাপের বাড়ি। আমরা কেন বের হব?’ আবির ও সাবরিনা সমস্বরে বলল।

নীলা চিন্তিত সুরে বলল, ‘মা, তুমি আর কথা বাড়িও না। চলো তোমার রুমে চলো। প্রেসার বেড়ে গেলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। তার উপর আমার ভাইটা এত কষ্ট করে উপার্জন করে। সংসারের খরচ চালাতে তো রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে ।’

আবির বলল, ‘বাবার সঞ্চয়পত্রের টাকা দিয়েই তো ব্যাবসা শুরু করেছে। এখানে এতো কনসার্ন হওয়ার কি আছে?’

ফাইজা বেগম বললেন, ‘আমার বড় খোকা যখন ব্যাবসা শুরু করে তখন তার বয়স কত ছিল আর বিশ হবে হয়তো। আর তোদের বাবার সঞ্চয় বলতে ছিল কেবলই লাখ খানেক টাকা। এর পর আমার বড়ো খোকা সবকিছু নিজের চেষ্টাতেই করেছে। এসব যে দিনরাত গিলছিস আরাম-আয়েশ করে এসবকিছু আমার বড় খোকার পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করা টাকা। তার কষ্টের উপার্জন।’

‘বাবার সঞ্চয় না থাকলে তো কিছুই করতে পারতো না, ভাইয়া । তখন আমাদের ভিক্ষা করতে হতো।’ আবির বলল, দম্ভভরে।

‘ভিক্ষা করলেও তোদের করতে হতো না। করতো আমার বড়ো খোকা। তোদের জন্য তো সে জীবনে বিন্দুমাত্র আনন্দ করতে পারল না। জীবনটা সে বিসর্জন দিয়েছে তোদের জন্য, তোদের আয়েশের জন্য। তারপরেও তোদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতাবোধটুকুও নাই। আমার ভাবতেই অবাক লাগে তোরা দুইজন আমার সন্তান!’ ফাইজা বেগম আহত কণ্ঠে বললেন।

নীলা তার মাকে একপ্রকার টানেতে টানতে রুমে নিয়ে গেল। পিউ ডাইনিং টেবিলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। তার খুব খারাপ লাগে বাসায় ঝগড়া লাগলে। অথচ তাদের ঘরে হরহামেশায় ঝগড়া লেগে থাকে। কখনোই যেন মুক্তি মেলে না! শুধুমাত্র বড়ো মামা বাসায় থাকলে একটু শান্তি মেলে। তাও মামাতো বেশিরভাগই বাইরে থাকেন। পিউর ইচ্ছে হয় বড়ো মামা যদি সব সময় বাসায় থাকতেন তবে হয়তো ঝগড়া হতো না। ছোট মামা আর আন্টি তো বড়ো মামার সামনে খুব একটা মুখ নাড়ে না। পিউ বুঝতে পারে না তার ছোট মামা আর আন্টি তাদের মায়ের সাথে সারাক্ষণ মুখে মুখে তর্ক করে অথচ বড়ো মামার সামনে কেমন যেন ভালো মানুষ হয়ে থাকে। পিউর দ্বিধা কখনোই কমে না। তাছাড়া, তাকেও গালমন্দ করে সব সময় । পিউর খুব খারাপ লাগে কিন্তু কেন এমন করে তারা তার কারণ সে কোনোভাবেই খুঁজে পায় না। অনেকবার বড়ো মামাকে এই বিষয়টা সে বলতে চেয়েছে কিন্তু তার মা তাকে সব সময় থামিয়ে দেয়। বড়ো মামাকে বললে নিশ্চয়ই এমনটা হতো না।

ছোট্ট পিউর ছোট্ট মনটাতে এমনই নানান প্রশ্নের খেলা চলে অহরহ! কিন্তু কোনোটারই উত্তর সে পায় না। সংসারের জটিলতা বিশুদ্ধ মস্তিষ্ক যে ধারণ করতে পারে না! ছোট্ট পিউই তার উদারহরণ।

নীলা মাকে তার রুমে রেখে এসে কিচেনে গিয়ে ঝটপট নাশাতা রেডি করে ফেলল। তারপর আবির আর সাবরিনাকে টেবিলে দিয়ে তাদের জন্য ট্রে তে করে নাশতা নিয়ে গের মায়ের রুমে।

নাশতা খেতে খেতে পিউ প্রশ্ন করল, ‘মা, ছোট মামা তোমাদের সাথে ওরকম করে কথা বলে কেন?’

নীলা মেয়ের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু মুহূর্তেই নিজের মুখে কাঠিন্য এনে বলল, ‘পিউ, এসব বড়োদের কথা। তুমি এসব নিয়ে একদম ভাববে না।’

পিউ কী যেন ভাবল! তারপর বলল, ‘বড়ো মামা এলে তাকে জিজ্ঞেস করব। ঠিক আছে মা?’

নীলা এবার ধমকে উঠল। বলল, ‘পিউ, তোমাকে কতো করে বলেছি, বড়োদের কথায় একদম নাক গলাবে না। আমার ভাইয়ের কানে যেন এসব না যায় । বুঝেছ?’

ফাইজা বেগম বিরক্তির সুরে বললেন, ‘আহ্, নীলা! বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে কথায় কথায় ধমকাও কেন?’

‘মা এখন থেকে যদি রাশ টেনে না ধরি তবে আবির আর সাবরিনার পথে চলতে শুরু করবে। আর একবার চলতে শুরু করলে রাশ টেনেও কোনো কাজ হবে না। কথায় আছে না, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাস ঠাস।’

ফাইজা বেগম হতাশ গলায় বললেন, ‘ঠিক বলেছিস। তবে আমি তো কখনো এরকম শিক্ষা দিইনি আমার সন্তানদের। তবে কেন ওরা দুজন এমন হলো?’

নীলা বুঝতে পারছে তার মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। মাঝেমধ্যে কষ্ট চেপে রাখাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে । তখন না চাইতেও চোখ নিজের কাছে জমানো গ্লানিটুকু জলধারারূপে বিসর্জন দেয়। অশ্রু বিসর্জনের পর মানব মনের গ্লানিটুকুও বোধহয় খানিকটা কমে যায়। ঠিক যেন বৃষ্টিবর্ষণের পর মেঘমুক্ত হাস্যোজ্জ্বল আকাশ ভারমুক্ত হয় নিজের কষ্ট থেকে।

আর তাই খাবার শেষ হতেই নীলা পিউকে বলল তাদের রুমে গিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসতে। পিউ লক্ষ্মী বাচ্চার মতো হেঁটে চলে গেল ।

তারপর নীলা মাকে আশ্বস্ত করতে বলল, ‘মা, হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান না হওয়ার উদাহরণ তোমাকে দেব না। তুমি আমার চাইতে অনেক বেশি দুনিয়া দেখেছ। সবকিছু বুঝো, জানো। তবে একটা কথা তোমাকে বলতেই হচ্ছে মা, সন্তানের খারাপ হওয়ার পেছনে সব সময় পিতা মাতার দোষ থাকে না। তবে এটা ঠিক যে, ওরা এসব নোংরামো শিখেছে চাচা-চাচীদের কাছ থেকে। ওরা যেমন সারাক্ষণ ঝগড়া করে বেড়ায়, তেমনি আমার এই ভাই-বোন দুটোও তাদের কাছ থেকেই এই শিক্ষা লাভ করেছে। আবার এটাও ঠিক যে, তারা শক্তের ভক্ত নরমের যম। দেখ না, চাচা-চাচীদের সামনে কেমন মিনমিনে ভান ধরে থাকে।’

‘সে যাইহোক, ব্যর্থতা আমার । আমি আমার সব সন্তানকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারলাম না। তোদের বাবা আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমানোর পর থেকে আমি আসলে তোদের ঠিকমতো দেখাশুনা করতে পারি নাই। উল্টে তোরাই আমার দেখাশুনা করেছিস।’ এটুকু বলেই ফাইজা বেগম নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। চোখ থেকে টপ টপ করে অবাধ্য অশ্রুরা ঝরে পড়ছে।

আবির আর সাবরিনা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনার চেষ্টা করল মা তাদের ব্যাপারে কী বলছে! মায়ের চোখের জল তাদের হৃদয় স্পর্শ করল না। আর এই চরম সত্য প্রকাশ পেয়েছে তাদের বিরক্তমাখা, কুঞ্চিত ভ্রু যুগল দেখে।

কী নিষ্ঠুর পৃথিবী! কী নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর কিছু মানব সন্তানেরা! জন্মদাত্রী জননীর চোখের জল তাদের স্পর্শ করতে পারছে না। ঠিক কী দিয়ে গড়া তাদের হৃদয়খানি! বড্ড দেখতে ইচ্ছে হয়। ইস্পাত কঠিন হৃদয় কি তবে সত্যিই আছে?

‘না, মা। এখানে তোমার কোনো ব্যর্থতা নেই। যে খারাপ হওয়ার সে এমনিতেই খারাপ হবে। তার জন্য খারাপের কোনো উদারহণ থাকতে হয় না। জানোই তো খারাপ কিছু শেখাতে হয় না। আর মানুষকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খারাপ করে তার লোভ। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আবির আর সাবরিনার মধ্যে লোভের উপস্থিতি প্রকট।’ নীলার চোখেও জল, সে মায়ের চোখ মুছতে মুছতে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল।

আবির আর সাবরিনা বোনের কথা শুনে ক্রোধে ফেটে পড়ল। কিন্তু এই মুহূর্তে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না ভেবে চলে গেল নিজেদের রুমে।

চলবে

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৪

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০৪

সাবিহা সাবরিন মুখ গোমড়া করে বসে আছেন নিজের বিছানায়। শিহরণ তার সামনে মুখ নত করে দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, ‘মান্নাতের সাথে তুমি মিসবিহেভ করেছ কেন?’

শিহরণ ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না। মায়ের সাথে তো আর উঁচু কণ্ঠে কথা বলা সম্ভব নয়। মান্নাতের বাচ্চি কি না কি এসে বলেছে কে জানে! শিহরণ খুব ভেবে বলল, ‘আম্মু, আমি কোনো মিসবিহেভ করিনি। আমি শুধু বলেছি ওকে নিজ উদ্দ্যোগে নিজ গন্তব্যে চলে যেতে।’

‘ওটা কি মিসবিহেভ নয়?’ সাবিহা সাবরিন রাগান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘ও যেহেতু তোমার সাথে গিয়েছে তাই ওর দায়িত্ব তোমার উপর ছিল। ওকে পৌঁছে দেয়া ছিল তোমার দায়িত্ব। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করোনি। বরং তাকে অপমান করেছ নিজের গাড়ি থেকে বের করে দিয়ে। এটা তুমি একদম ঠিক করোনি। ও তোমার কাজিন এটা ভুলে যেওনা।’

সাব্বির আহমেদ রুমে ঢুকতেই নিজের স্ত্রীর এমন রূপ দেখেই বুঝতে পেরেছেন যে কিছু একটা ঘাপলা হয়েছে। তাই তিনি পরিস্থিতি সামাল নিতে বললেন, ‘সাবিহা, তুমি দিন দিন প্রচণ্ড মেজাজী হয়ে যাচ্ছ! আগে তো এমন ছিলে না।’

সাথে সাথেই সাবিহা সাবরিন অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাব্বির আহমেদের উপর। তিনি মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে পুনরায় বললেন,’ ওরা তো বড় হয়েছে এখন। ওদের এমন ছোটোখাটো ঝামেলা ওদেরকেই মেটাতে দাও।’ শিহরণের কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে বললেন, ‘আমি চিনি আমার ছেলেকে। সে আর যাই করুক কোনো মেয়েকে অপমান করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।’

বাবার কথা শুনে শিহরণের ভালো লাগার পাশাপাশি খানিকটা খারাপও লাগছে। কারণ সে আসলেই মৃদু অপমান তো করেছিলই। কিন্তু এখন সেই বিষয়টার জন্য মনের মধ্যে আক্ষেপ হচ্ছে। তার বাবার বিশ্বাস সে ভেঙ্গেছে ভাবতেই একরাশ কষ্ট দলা পাকিয়ে বুকের উপর জমাট বাঁধছে ।

সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘তাহলে কি মান্নাত আমাকে মিথ্যা বলেছে?’

সাব্বির আহমেদ তৎক্ষনাত বললেন, ‘মিথ্যে অথবা সত্যের প্রশ্নে আমি যাব না। আমি শুধু তোমাকে একটা কথাই বলতে চাই যে, এরকম ছোটোখাটো একটা বিষয় নিয়ে তোমার কাছে নালিশ করে মান্নাত একদম ঠিক করেনি। এসব বিষয় নিজেরাই মিটিয়ে ফেলা যায় ।’

সাবিনা সাবরিন খুব অবাক হলেন। তবে তিনি কেন যেন আর কিছুই বললেন না। সাব্বির আহমেদ শিহরণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘এবার তুমি যেতে পারো, শিহরণ।’

‘ওকে, আব্বু।’ শিহরণ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল । ভাগ্যিস, তার বাবা সঠিক সময়ে রুমে এসেছিলেন। নয়তো সে কোনো উত্তর খুঁজে পেত না। মনে মনে সে তার বাবাকে অনেক ধন্যবাদ দিল।

______________________

ছোঁয়া আজ শপে না গিয়ে সোজা অফিসে চলে এলো। সাইফ তো আছেই। তাই তেমন একটা চিন্তা করতেও হচ্ছে না তাকে । আজ নতুন বসের সাথে পরিচয় হবার কথা। তাছাড়া নতুন একটা প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশনও করতে হবে তাকে। তাই সে তার ডেস্কে বসে ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশন স্লাইডগুলো তৈরী করছিল।

এবারের প্রেজেন্টেশন নিয়ে ছোঁয়ার বেশ ভালো প্রস্তুতি আছে। এসবিএ এন্টারপ্রাইজের সাথে তাদের কোম্পানি কাজ করছে মাসখানেক হচ্ছে। এতদিন তাদের কোম্পানির বসের সাথেই তাকে কাজ করতে হয়েছে। এসবিএ এন্টারপ্রাইজের বেশ কিছু ছোট প্রজেক্ট সে অবশ্য হ্যান্ডল করেছে। তবে এসবিএ এন্টারপ্রাইজের এমডি সাব্বির আহমেদের সাথে তার মাত্র দু’বার দেখা হয়েছে। ভদ্রলোকের ব্যাবহার অত্যন্ত অমায়িক। তবে কাজের ব্যাপারে তিনি খুবই স্ট্রিক্ট। এইতো বেশ কিছুদিন আগে একজনের ফাইল এরেঞ্জমেন্টে কী যেন সমস্যা হয়েছিল! তাতে তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। ছোঁয়া সেই মুহূর্তটা যেন কেঁপে উঠেছিল। আর এখন সেই স্ট্রিক্ট মানুষটির ছেলে আসবে তার জায়গায় । ভাবতেই তার কেমন যেন অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে। সে ভাবছে এই মহোদয় না জানি কেমন হবে! স্ট্রিক্ট, এরোগ্যান্ট, রুথলেস আর কেমন হতে পারে! না-কি উদারনৈতিক, সহযোগিতাপ্রবণ মানসিকতার হবে?

এরকম আকাশ পাতাল ভাবনা ভাবতে ভাবতে ছোঁয়া নিজের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ ল্যাপটপ হাতে নিয়ে প্রেজেন্টেশন হলের দিকে হাঁটতে থাকল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কয়েকবার লম্বা করে দম নিল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে চলেছে সে। তারপর আলতো হাতে ধাক্কা দিল কাচের তৈরী দরজায় । ধাক্কা দিতেই ক্যাচ করে আওয়াজ হলো। আর সেই আওয়াজ শুনতে পেয়ে প্রেজেন্টেশন রুমে বসে থাকা সকলের দৃষ্টি দরজার দিকেই এসে পড়ল। ছোঁয়া এক নজরেই সকলের অভিব্যক্তি দেখে নিল। তবে একজনের চেহারা দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেল । এ কাকে দেখছে সে! কতগুলো বছর পর দেখছে। ছোঁয়া যেন হার্টের একটা বিট মিস করল। সেই হালকা সবুজাভ চোখ, সেই কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল, ফর্সা মুখ। এখন দেখতে আরো অনেক বেশি হ্যান্ডসাম হয়েছে। ছোঁয়া নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। প্রেজেন্টেশন রুমের সবাই যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

আর ওই বিশেষ মানুষটা গভীর চোখে তাকে যেন পরখ করেই চলেছে। তবে তার দৃষ্টি স্বাভাবিক । যেন ছোঁয়াকে দেখে সে কোনোপ্রকার অনুভূতি অনুভব করছে না। যেন তাকে দেখা অন্য সব ঘটনার মতো এক স্বাভাবিক ব্যাপার!

ল্যাপটপ অন করতে করতেই সে কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করল। তারপর প্রেজেন্টেশন শুরু করল। প্রেজেন্টেশন করার সময় সচরাচর চোখ থাকতে হয় সমান তালে সকল অডিয়েন্সের দিকে পাশাপাশি মনোযোগ থাকতে হয় স্লাইড শো করা ও তার যথাযথ ব্যাখ্যার দিকে । ছোঁয়া এই কাজে বেশ পটু। কিন্তু আজকের প্রেজেন্টেশনে তার চোখ জোড়া হালকা সবুজাভ চোখ জোড়ার সাথে না চাইতেও বারংবার মিলিত হচ্ছে। কী অদ্ভুত! এরকম যে কেন হচ্ছে ছোঁয়া বুঝতে পারছে না। তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে প্রেজেন্টেশন শেষ করল। সবাই হাত তালি দিয়ে তাকে বাহ্বা দিল। মিটিং শেষ হতেই তার অফিসের এমডি জনাব আশফাক হক নতুন এমডির সাথে পরিচয় করানোর পর্ব শুরু করলেন। বললেন, ‘রাইয়ান আহমেদ শিহরণ হচ্ছেন এই কোম্পানির নতুন এমডি।’

শিহরণকে একে একে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন জনাব আশফাক হক। সব শেষে ছোঁয়ার সাথে পরিচয় পর্ব শুরু করতেই শিহরণ তার হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যালো, ম্যাম। ইটস্ নাইস টু মিট ইউ ।’

ছোঁয়া ভাবছে এত স্বাভাবিক কীভাবে যে থাকে! তার ক্ষেত্রেই সব উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটে চলেছে। সেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। ছোঁয়া পরক্ষণেই নিজের চিন্তা সংযত করে হাত এগিয়ে দিল শিহরণের দিকে। বলল, ‘হাই, স্যার। ইটস্ নাইস টু মিট ইউ টু।’

প্রেজেন্টেশন শেষ হতেই ছোঁয়া যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল । মুহূর্তেই সে প্রচণ্ড তেষ্টা অনুভব করল। নিজের ডেস্কে গিয়েই ল্যাপটপ রেখে পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করল। তারপর কফি খাওয়ার জন্য কফি কর্নারে গেল।নিজ হাতে কফি বানানো শেষ হতেই সে ফিরে আসার জন্য উদ্যত হতেই তার কানে আসলো একটা অনুরোধের ভাষা।

‘ক্যান আই হ্যাভ আ কাপ অব কফি, প্লিজ?’ ছোঁয়া মুহূর্তেই ফিরে তাকাল । দেখতে পেল সবুজাভ চোখ জোড়ার অধিকারী ওই ছেলেটি তার থেকে ঠিক এক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মুচকি হাসি লেগেই আছে । ছোঁয়া তৎক্ষনাত বলল,’হুয়াই নট? আমি এখনই বানিয়ে দিচ্ছি। জাস্ট ওয়েট ফর সাম টাইম।’

‘ওকে।’ শিহরণ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘এই অফিসে ঠিক কতদিন যাবৎ আছেন?’

ছোঁয়া একটু বিষম খেল। ‘আছেন’ সিরিয়াসলি? পরক্ষণেই আবার মনকে বুঝাল যে তারা তো অফিসে আছে। সো, অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ মাস্ট। থতমত খেয়ে সে বলল, ‘ইটস্ অ্যারাউন্ড সিক্স মানথ।’

‘ইম্প্রেসিভ ।’ শিহরণ এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। ছোঁয়া ততক্ষণে কফি তৈরী করে নিয়েছে। সে ছোঁয়ার হাত থেকে কফির মগ নিতে নিতে বলল, ‘আই নিড সো মেনি ইনফর্মেশন এবাউট অল অব দ্যা এমপ্লয়ি । ক্যান ইউ হেল্প মি এবাউট দিস?’

‘অফকোর্স।’ ছোঁয়া হেসে বলল, ‘নো প্রবলেম। কজ ইটস্ মাই জব আফটার অল।’

‘ওকে, সি ইউ লেটার।’ শিহরণ কফি শেষ করেই লম্বা পা ফেলে চলে গেল তার নিজের রুমের দিকে। ছোঁয়া তাকিয়ে ছিল তার যাওয়ার পানে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

__________________

অহনার মেজাজটা এখন প্রায় সময়েই বিগড়ে থাকে। বাসায় থাকলে তো কথাই নেই। ছোঁয়ার প্রতি মায়ের আদিখ্যেতা দেখতে দেখতে তার মেজাজটাই খিটখিটে হয়ে গেছে। সে এসব একদমই সহ্য করতে পারছে না। অনেক বার গলাবাজি করেও কাজ হলো না। সামনেও যে হবে না তাতে সে একেবারেই সুনিশ্চিত। কিন্তু চোখের সামনে এসব সহ্য করাটাও দুষ্কর । মাঝেমধ্যে তার মনে হয় সে তার মায়ের আপন মেয়েই না। ছোঁয়া হচ্ছে তার মায়ের আপন মেয়ে । স্কুলের দিনগুলিকে সে ভীষণ রকমের মিস করছে। তখন মাকে ইচ্ছেমতো যা-তা বুঝিয়ে দেয়া যেত। ফলস্বরূপ ছোঁয়াকে দিতে হতো মাশুল। অথচ এখন সম্পূর্ণ চিত্রই পাল্টে গেল।ছোঁয়া কোন জাদুর কাঠি তার মাকে ছুঁইয়েছে কে জানে! এখন ফাহমিদা বেগম যতটা না তার নিজের মা তার চাইতেও বেশি ছোঁয়ার মা হয়ে গেছে ।

তাও তো নাহয় মানা যেত । কিন্তু হিয়াটাও যে কেন ছোঁয়ার পিছনে ঘুরঘুর করে অহনা তা একদমই বুঝতে পারে না। এখন তার নিজেকে বড্ড একা মনে হয়। হিয়া এখন ছোঁয়া বলতে পাগল। অহনা কত কথা বলে ছোঁয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো কথাতেই কাজ হয় না। আরও তার সমস্ত বিরুদ্ধাচারণ কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিয়া তাকে উপদেশ দিতে প্রস্তুত হয়ে যায় । এই দুঃখ যে কাকে বুঝাবে অহনা তা বুঝতে পারে না। নিজের রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে এসব ভাবছিল অহনা।

‘হেই আপু! কি করছ?’ হিয়ার ডাকে ফিরে তাকাল অহনা।

হিয়া একটা সোনালি রঙের গাউন পরেছে। গাউনের উপরে নীল রঙের সুতির কাজ ও বেশকিছু নীল রঙা পাথর বসানো আছে।

অহনা তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘হিয়া! তোকে যা সুন্দর লাগছে ড্রেসটাতে। কবে কিনেছিস এটা?’

‘আমি কিনি নাই তো, আপু।’ হিয়া অহনার পাশে বসতে বসতে বলল।

‘মা এনেছে? আমার জন্যে আনেনি। তাই না?তার সাথে আমি প্রচণ্ড রাগ করব । কথাই বলব না । তোর জন্য এনেছে অথচ আমার জন্য আনেনি।’ অহনা তিরিক্ষি মেজাজে বলল।

হিয়া বসা থেকে দাঁড়িয়ে গাউনের দুপাশ একটু উঁচু করে ধরে ঘুরতে ঘুরতে বলল, ‘এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? এটা মা আনেনি। এটা আমার জন্য ছোঁয়া আপু কিনে এনেছে।’

অহনা মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘ওহ্! আচ্ছা, এভাবেই তাহলে সে আমার মা আর বোনকে হাত করছে? ওকে বলে দিস ওর এসব হাত করার ধান্দা আমার ক্ষেত্রে কোনো কাজ করবে না।’

হিয়া থমথমে গলায় বলল, ‘ছোঁয়া আপু যদি জীবনেও আমাকে এক টাকাও না দেয় না তবুও সে আমার জন্য আপন বোনের চাইতেও বেশি থাকবে। তাকে আমি যতটা না ভালোবাসি তার চাইতেও বেশি শ্রদ্ধা করি তার মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও উদারতার কারণে। মায়ের দিকটা আমি ব্যাখ্যা করব না। তবে এটুকু জেনে রাখ ছোঁয়া আপুকে যদি কাছ থেকে একবার জানার সুযোগ পাস তবে তা মিস করিস না। আমি জানি সে আমার জন্য কি করেছে! আমি জানি সে আমার জন্য কী!’

‘কী এমন করেছে তোর জন্য যে তুই দিনরাত খালি ওর গান গাইতে থাকিস? আমাকে বল । আমিও একটু শুনে দেখি।’ অহনা চুলটা উঁচু করে বেঁধে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে বলল।

‘আমার হাত বাঁধা । তাই তোকে বলতে পারছি না। হয়তো কখনোই বলতে পারব না। তবে জানলে বোধহয় ছোঁয়া আপুর সাথে মিসবিহেভ করতি না।’ হিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

‘তোর এসব লেকচার আমার একদম ভালো লাগছে না। তুই যা এখান থেকে।’ বিরক্তি মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, অহনা।

ঠিক সেই মুহূর্তে ছোঁয়া একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে ঢুকল অহনার রুমে। অহনার কাছে গিয়ে বলল, ‘অহনা, এটা তোমার জন্য। পছন্দ হয়েছে কি না বলো।’

এটা বলে ছোঁয়া একবার হিয়ার দিকে আর একবার অহনার দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল যে এরা তার বিষয়েই ঝগড়া করছিল। তারপর সে হেঁটে অহনার রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে হিয়া বলল, ‘আপু, তুমি তো বললে না আমাকে কেমন লাগছে?’

ছোঁয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। হিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল , ‘আমার পিচ্চি বোনটাকে দেখতে একমদ মিষ্টি লাগছে। ঠিক যেন কোনো পরী!’

‘এবার কিন্তু বেশিই বলে ফেললে আপু। মিষ্টি ঠিক ছিল কিন্তু পরী বেশি হয়ে গেল না?’ হিয়া বলল, অভিযোগের সুরে।

‘একদম বেশি বলিনি।’ প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘কিরে ছোঁয়া, হিয়া, অহনা তোরা কই গেলি? আমি খাবার নিয়ে বসে আছি। এই নিয়ে দুবার খাবার গরম করলাম। আবার ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।’ ফাহমিদা বেগমের কণ্ঠ শুনে ছোঁয়া বলল, ‘চল খেতে যাই। নয়তো মা খুব রাগ করবে।’

ছোঁয়া আর হিয়া বেরিয়ে যেতেই অহনা ধপাস করে শব্দ করে নিজের বিছানায় বসে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল, ‘এ কোন ঝামেলায় পড়লাম আমি! এখানে তো আর আমার কোনো গুরুত্বই নেই। আমার অতি দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। আই হ্যাভ টু ডু সামথিং টু গেট ব্যাক মাই পজিশন।’

______________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৩

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০৩

সূর্য মামা যেই না একটু বিশ্রাম নিতে দিগন্তের কাছে পৌঁছাল অমনি সন্ধ্যা রানী হাসতে হাসতে তার আগমণের জানান দিল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে পথচারীরা যার যার গন্তব্যে যাচ্ছে। ঠিক তখন সাইফ আর মায়া আসলো ছোঁয়ার শপে। ছোঁয়া তখন কিছু একটা হিসাব করছিল। সাইফ আর মায়াকে দেখে সে খাতা বন্ধ করে ডেস্কে রেখে দিল।

একটা টেবিলে বসতে বসতে মায়া বলল, ‘ তাড়াতাড়ি আয় এদিকে। আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে।’

মায়া আর সাইফের টেবিলের দিকে এগুতে এগুতে ছোঁয়া বলল, ‘ এমন কি হয়েছে যে তোরা দুই জন ঘটা করে বলতে এলি?’

‘শোন, সাইফ তো সব সময় বলে যে ওকে কোনো মেয়ে নাকি পছন্দ করে না।’

ছোঁয়া অধৈর্য গলায় বলল, ‘আরেহ্! তুই এত প্যাঁচাস কেন? আসল কথা বল।’

মায়া চোখ রাঙিয়ে বলল,’আমাকে আমার মতো করেই বলতে দে না! নইলে শুনে মজা পাবি না।’

‘আরেহ্! রাখ তোর মজা।’ ছোঁয়া ব্যস্ত ভঙ্গিতে সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই সাইফ, তুই বল।’

সাইফ আমতা আমতা করে যখনই বলতে যাবে তখন মায়া তাকে থামিয়ে বলল,’আজকে সাইফকে এক মেয়ে প্রপোজ করেছে।’

ছোঁয়ার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে যাবে। সে অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘ মানে কি ?’ তারপর সাইফের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি সাইফ?’

সাইফ বিমর্ষ গলায় বলল, ‘ হুম।’

ছোঁয়া হাত নেড়ে বলল, ‘দেখলি তো তোর এত দিনের আফসোস খতম। তো মেয়েটা দেখতে কেমন রে?’

‘ভালোই।’ সাইফ আফসোসের সুরে বলল, ‘ কিন্তু আমি তো তাকে আজই প্রথম দেখলাম। আর আমার মনে হয় সেও আমাকে প্রথম দেখল। তবে কেন সে প্রপোজ করল সেটাই বুঝতে পারছি না!’ সাইফের কণ্ঠে এক গভীর হতাশা।

ছোঁয়া একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘ কোনো বেট নয়তো!’

মায়া এইবার মুখ খুলল। সে বলল, ‘ ঠিক বলেছিস। হতে পারে। সাইফ তো শান্তশিষ্ট। আর আমরা দুজন ছাড়া ওর আর কোনো মেয়ে বন্ধু নাই। তাছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে তো সে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। তাই হতে পারে এটা বেট।’

ছোঁয়া এবার সাইফের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল।।বলল, ‘ সাইফ তোর কী মনে হয়?’

সাইফ ভাবছে। মায়া দুষ্টুমির সুরে বলল, ‘ দিল দে দিয়া কিয়্যা?’

ছোঁয়া মায়ার হাতে আলতো করে মেরে বলল, ‘ এত্ত সোজা মন দেয়া?’ তার পরপরই একটু বেশিই আগ্রহী সুরে বলল, ‘তা দেখতে কেমন মেয়েটা? সেটা তো বললি না!’

সাইফ বিরক্তির সুরে বলল, ‘ বলেছি তো দেখতে ভালোই । কি এক ফালতু টপিক নিয়ে পড়লি তোরা। কাজের কথা বল।’

মায়া বলল, ‘ হ্যাঁ, তাই তো কাজের কথা তো পড়েই থাকল।’ একটু গাল ফুলিয়ে বলল, ‘ মানে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে অথচ কারো কোনো মাথা ব্যাথাই নাই।’

মোবাইলের বাজার শব্দে ধ্যান ভাঙলো তিন বন্ধুর। ছোঁয়া টেবিলের উপর থেকে তার ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনে দেখল ফাহমিদা বেগম কল করেছে। সে তৎক্ষনাত রিসিভ করল। ওপাশ থেকে একটু রাগী রাগী গলায় ফাহমিদা বেগম বললেন, ‘ কি রে তোর আসার সময় হয় নাই এখনো?’

ছোঁয়া তার বাম হাত উল্টিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নিল একবার। তারপর বলল, ‘ মা এখন বাজে মাত্র সাতটা । আমি কি এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি?’

‘কয়টায় আসবি?’ ফাহমিদা বেগমের পাল্টা প্রশ্ন।

‘নয়টা তো বাজবেই।’ ছোঁয়া একটু ভেবে দৃঢ়তার সাথে বলল।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। নাশতা করেছিস?’

‘করব। একটু পরেই করব। সাইফ আর মায়া আছে আমার সাথে তোমার টেনশন না করলেও চলবে।’ ছোঁয়া মৃদু হাসল।

‘আচ্ছা। সাইফকে দে তো একটু ফোনটা।’

‘মা! তুমি তাকে আবার বলবে যাতে আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দেয়। এইতো?’

‘তোকে দিতে বললাম দে।’ ফাহমিদা বেগম একটু জোরেই বললেন।

অগত্যা ছোঁয়াকে ফোনটা সাইফকে দিতে হলো। সাইফ মোবাইল কানে নিতেই ফাহমিদা বেগম আদেশের সুরে বললেন, ‘ ছোঁয়াকে বাসায় পৌঁছে দিবি।’

‘জো হুকুম, খালামণি।’ সাইফ হাসতে হাসতে বলল।

ছোঁয়া একটু কেশে দুই বন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘আচ্ছা শোন। কাল আমার অফিসে নতুন বস আসবে। কাল কিন্তু দেখা সাক্ষাত হবার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। তাই মায়ার বিয়ে নিয়ে যত প্ল্যান সব কালকের পর থেকে শুরু করতে হবে। তাছাড়া বিয়েতে তো এখনো ঢের দেরি। এতো আগে থেকে এত তাড়াহুড়ো করারও কোনো মানে নেই।’ সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কী বলিস, সাইফ?

সাইফ সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘ একদম ঠিক।’

মায়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ মানে কী! আমার বিয়ে আর তোদের কোনো আগ্রহই নাই।’

ছোঁয়া মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ আরে মাইয়া তোর চেয়ে আমরাই বেশি আগ্রহী। আগে আমার বসটারে একটু ফেইস করতে দে। তারপর তোর হবু বরকে ফেইস করব। এবার খুশি তো?’

মায়া প্রশস্ত হাসল। তারপর ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরল। ওদেরকে হাসতে দেখে সাইফও হাসল। বলল,’ কী আশ্চর্য! তোরা আমাকে কেন জড়িয়ে ধরছিস না?’

ছোঁয়া আর মায়া ভ্যাবলাকান্তের মতো কিছু সময় সাইফের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
________________

শিহরণ তাদের বাসার ছাদে একটা চেয়ারে বসে ছিল। ছাদ জুড়ে বাগান। একপাশে একটু ঝোপের মতো হয়ে গেছে। সেখানে চড়ুই পাখির একটা বাসাও আছে। একটু পরপর মা পাখিটা বেরিয়ে যাচ্ছে। আর বাচ্চাগুলো শব্দ করে ডাকছে। শিহরণের বেশ কৌতুহল হচ্ছিল বিষয়টা নিয়ে । সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল । তারপর ওপাশটাতে গিয়ে দেখল বাসাটাতে দুটো ছানা আছে। একদম পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চাগুলো। দেখতে খুব কিউট লাগছে বাচ্চাগুলোকে। অনেক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে, বাচ্চাগুলোর দিকে।

বহ্নি দুকাপ কফি নিয়ে এসে দেখল শিহরণ মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে । সে পাশে এসে দাঁড়াল । তারপর বলল, ‘ কি দেখছ এমন মনোযোগ দিয়ে ।’

শিহরণকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে বহ্নিই আবার বলে উঠল, ‘টুন আর মুনকে?’

শিহরণ ঘুরে দাঁড়াল । তারপর ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল, ‘টুন আর মুন কে?’

‘তুমি যাদের দেখছ।’

‘মানে কি? চড়ুই পাখির ছানা দুটোকে বলছিস?’

‘হুম।’

‘তুই ওদের নামও দিয়ে দিলি!’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া ।’ বহ্নি কফির একটা মগ শিহরণের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘যখন তোমার উপর আমার খুব রাগ ছিল তখন ওদের মা ছিল আমার বন্ধু । এখন ওরাও আমার বন্ধু। ওদের সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে।’

শিহরণ যেন দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। তারপর ছোট্ট করে বলল, ‘হুম।’

‘কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে তো। খেয়ে নাও।’

‘হুম।’ শিহরণ অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘খাচ্ছি।’

কফির মগে চুমুক দিতেই বহ্নি বলল, ‘জানো ভাইয়া, আজ রাদিদ ভাইয়াকে দেখেছি।’

শিহরণ সহসা বহ্নির দিকে ফিরে তাকাল। অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘সত্যি?’

‘হুম।’ বহ্নি মুহূর্তেই গম্ভীর গলায় বলল, ‘ আমি কি কখনও মিথ্যে বলি?”

‘আচ্ছা। কথা হয়েছে তোদের?’ শিহরণ সরু চোখে তাকাল বহ্নির দিকে।

‘হয়েছে।’ বহ্নি চিন্তিত সুরে বলল, ‘ অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। কীভাবে হলো সেটাই বুঝতে পারছি না!’

‘কী রকম পরিবর্তনের কথা বলছিস?’

‘এই যেমন: রাদিদ ভাইয়া আগে ছিল প্লে বয় টাইপ কিন্তু এখন খুবই ভদ্র, সুশীল, নম্র আর বাধ্য হয়ে গেছে মনে হলো।’

‘কী বলিস?’ শিহরণের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, ‘এত পরিবর্তন! কীভাবে হলো?’

‘তা তো জানি না। তবে অনেক বেশিই পরিবর্তন হয়ে গেছে।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, বহ্নি ।

‘হুম।’ শিহরণ হতাশ গলায় বলল, ‘ মোহনা ছাড়া আর কারও সাথেই তো কোনো যোগাযোগ নেই।’

‘তোমরা একে অপরের থেকে দূরে আছো নিজেদের বোকামির কারণে। আমার ভাবতেই অবাক লাগে তোমাকে কেউ আমার বা অতল ভাইয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলল আর তুমি ঝট করে বিশ্বাস করে ফেললে!’

অতলের নাম শুনে শিহরণের মনের মধ্যে এক দুর্জ্ঞেয় ঝড় শুরু হয়ে গেল। কত করে বলতে চেয়েছে সে। কিন্তু শিহরণ তার একটা কথাও শুনেনি। তার উপর আঘাত করেছে বারংবার । এতটা নিষ্ঠুর সে কী করে হতে পারল–শিহরণ তা ভেবে পায় না ! কেন যে সে তার রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না! তার এই অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে আজ তাদের বন্ধুত্বের বিনাশ হয়েছে। রাগের মাথায় সে আসলেই অন্য এক মানুষ হয়ে যায় !

শিহরণ হঠাৎ আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে মেঘ করেছে। ঘন কালো মেঘ। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও আকাশটা ঝকঝকে ছিল। ছিল না মেঘের ছিটে ফোঁটাও । ঠিক এমনই করে তার বন্ধুরা একে অপর থেকে দূরে সরে গেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার।

‘তুই বলিসনি–আমার সাথে দেখা করার জন্য?’ ব্যথাতুর গলায় প্রশ্ন করল শিহরণ ।

‘বলেছি।’ বহ্নি চিন্তিত সুরে বলল, ‘কিন্তু কেন যেন সে দেখা করতে চাইছে না। কারণটা অস্পষ্ট এবং একইসাথে রহস্যময় মনে হলো আমার।’

‘রহস্যময় কেন?’

‘রাদিদ ভাইয়ার জায়গায় যদি অতল ভাইয়া হতো তবে না হয় মানা যেত । কিন্তু রাদিদ ভাইয়া কেন দূরে সরে গেল তা একটু চিন্তার বিষয় না?’

‘তা ঠিক বলেছিস।’

‘তোমার বন্ধুদের ফিরে পাবার চেষ্টা করো।’

‘হুম।’ শিহরণ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ যারা নিজে থেকেই দূরে সরে যায় তাদের ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় বহ্নি ।’

‘আচ্ছা, মান্নাত আপুর সাথে কিছু হয়েছে কি তোমার?’

‘নাহ্! কেন?’

‘আম্মুকে তোমার নামে নালিশ দিতে শুনলাম।’ বহ্নি শিহরণের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, ‘তৈরী থেকো। আম্মু ডাকতে পারে তোমায়।’

শিহরণ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। ফের আকাশপানে তাকিয়ে সাদা মেঘের ভেলার সাথে আকাশের বুকে ওড়াউড়ি করা কালো মেঘের ভেলার এক অদ্ভুত তুলনা করছে। হুট করেই তো আকাশের বুকে কালো মেঘগুলো রাজত্ব শুরু করে দিয়েছে । এখন কেবল বৃষ্টির অপেক্ষা। ঝুম বৃষ্টি এসে ধরিত্রীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেই কালো মেঘগুলো কেটে গিয়ে আকাশের বুক পরিষ্কার হয়ে যাবে । শুধু সময়ের অপেক্ষা! মানুষের জীবনও তো এমনই!

_________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০২

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০২

‘বার্বি ডল!’ শিহরণ বহ্নির রুমের দিকে এগুতে এগুতে ডাকল।

বহ্নির রুমের দরজা ভেজানো ছিল। শিহরণ সেই দরজা হালকা ঠেলে দাঁড়িয়ে বলল,’হেই বার্বি ডল! মাই কিউট কাপকেক।’

বহ্নি তখন কলেজে যাবার জন্য রেডি হচ্ছিল। শিহরণের ডাক সে শুনতে পেয়েছে । কিন্তু কথা বলছে না। দুই ভাই বোনের মান অভিমান কিছু সময়ের ব্যবধানে শুরু হয় আবার শেষ হয়। এ যেন এক নিত্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। শিহরণ এবার রুমে ঢুকে বলল,’কাপকেক! কী করছিস?’

‘দেখতেই তো পাচ্ছ।’ বহ্নি নির্বিকারভাবে বলল।

‘এখনও এরকম করবি?’ শিহরণ অসহায় মুখ করে বলল।

বহ্নি শিহরণের দিকে মুখ ফিরে দাঁড়িয়ে একটা হাত তুলে বলল, ‘দেখ ভাইয়া! আমার আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। দেরি হয়ে যাবে। কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। আমি শুনছি।’

শিহরণ বহ্নির এ কথায় একদম চুপসে গেল। তার এই মুহূর্তে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা নেই। সে এমনিতেই, অকারণে বোনকে দেখতে এসেছিল। তাই মুহূর্তেই কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে সে নিভৃতে বহ্নির রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে বহ্নি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ব্রো! অ্যা’ম রিয়েলি ইন অ্যা হারি। আই উইল টক টু ইউ লেটার।’ শিহরণের মুখের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’ওকে?’

শিহরণের মুখে তৎক্ষনাত হাসি ফুটল। সে বলল,’ওকে, কাপকেক। আজ ছাদে থাকব আমি।’

বহ্নি বলল, ‘ঠিক আছে। অনেক দিন পর তাহলে আজ জম্পেশ আড্ডা হবে। কি বলো?’

‘হুম, ঠিক বলেছিস।’ শিহরণ হাসি হাসি মুখ করে বলল।

শিহরণ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বহ্নি বলল, ‘হেই ! ব্রো। রিয়া হ্যাজ আ গ্রেট ক্রাশ অন ইউ।’

‘সিরিয়াসলি?’ শিহরণ তার চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় এনে বলল, ‘ওই পুঁচকে আমার উপর ক্রাশ খাচ্ছে! আজকালকার বাচ্চা মেয়েগুলো কি যে করে না! ‘

‘এত অবাক হচ্ছো কেন? তুমি তো এমনই; ক্রাশ খাওয়ার মতো।’

‘এবার কি তুইও শুরু করবি?’

‘হা হা হা! আমি আবার কি শুরু করব বলো? আমার ফ্রেন্ডরা পারলে আমাকে ডাকপিয়ন বানিয়ে ছাড়ত। মাঝেমধ্যে একটু স্ট্রিক্ট হই বলে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না।’

‘হুম। এমন স্ট্রিক্ট না থাকলে বোধহয় বেশ ভালো একটা দ্বন্দ্ব হয়ে যেত!’

‘একদম।’ বহ্নি প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ওকে, ব্রো। অ্যা’ম গেটিং লেইট। সি ইউ লেটার।’

‘ওকে, মাই কাপকেক।’
_______________________

বহ্নি ক্লাস শেষে ফেরার পথেই ক্যাম্পাসের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে দেখে থমকে দাঁড়ায় । খুব ভালো করে খেয়াল করতে থাকে সেই ছেলেটাকে। আগের তুলনায় স্বাস্থ্য একটু ভালো হয়েছে। চোখ দুটো উজ্জ্বল । মুখটা হাসি হাসি। কতদিন পর দেখছে তাকে! সেই দিনের অনাকাঙিক্ষত ঘটনা অনেক কিছুই তছনছ করে দেয় । তার ভাইয়ের বন্ধুত্ব, তার সাথে তার ভাইয়ের সম্পর্ক, তার মায়ের সাথে সম্পর্কের নমনীয়তা এছাড়া আরও অনেককিছুই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। সবাই এক এক করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল । সময়ের স্রোতে তার কিছুটা ম্লান হলেও আজও অনেককিছুই ঠিক হয়নি।

ভার্সিটির ক্যাম্পাসের ওই অংশটাতে গাছগাছালির সমাবেশ অনেক বেশি । বিশাল বৃক্ষের ছায়াতে অনেক ছাত্রছাত্রী জটলা হয়ে গল্পগুজব করছে। বন্ধুরা মিলে গোল হয়ে সবুজ, সতেজ ঘাসের উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে কেউ কেউ। ছায়াঘেরা ওই অংশটির গাছপালার পাতার ফাঁক গেলে সোনালি রোদ্দুর যেন ঝরে পড়ছে। বহ্নি ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিল। নানান ভাবনা মস্তিষ্কের মধ্যে নিজেদের রাজত্ব তৈরী করেছিল। সে ভাবনাগুলোকে আপাতত এক পাশে রেখে ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ছেলেটির দিকে।

ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’এতদিন পর কোথা থেকে?’

ছেলেটি মুখ উঁচু করে তাকিয়ে ছিল সোনালি রোদ্দুরের নরম আলোর দিকে। একটা পাখি টিউ টিউ করে ডাকছিল। সেই পাখির ডাকটাই সে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আর পাখিটার গাছের ডালে নাচানাচিও দেখছিল । আচমকা প্রশ্নে সে সামনে তাকিয়ে দেখতেই একটু যেন বিষম খেল। কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা । নিস্তব্ধতার রেশ কাটিয়ে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে ছেলেটা প্রশ্ন করল,’তুমি বহ্নি?’

‘হুম,আমিই বহ্নি । চিনতে পেরেছ তাহলে?’ বহ্নির কণ্ঠে কিঞ্চিত অভিমান।

‘অনেকদিন পরে দেখছি তোকে। চিনতে একটু সময় লেগেছে। এই আরকি!’

‘অনেকদিন?’ ভ্রু কুঁচকে বলল বহ্নি ।

‘দশ বছর!’ দৃঢ়তার সাথে বলল ছেলেটা।

‘আচ্ছা, আমাকে বলো তো তুমি কেন চলে গিয়েছিলে? তোমার চলে যাবার তো কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না আমি।’

ছেলেটা মুচকি হাসল। কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না।

‘তোমার ডেটদের কি অবস্থা? এখনো চলে?’ বহ্নি হাসি হাসি মুখ করে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল।

আবারও ছেলেটা মুচকি হাসল। বলল,’এখন আর ওসব ডেটে আমার হয় না!’

-‘কেন? বিয়ে করে ফেলেছ?’ দুষ্টুমির স্বরে বলল বহ্নি ।

-‘নাহ! এমনিতে বিয়ে করলে বোধহয় ভালোই হতো।’ একটু থেমে বিড়বিড় করে ছেলেটা বলল,’যন্ত্রণা বোধহয় কিছুটা কম হতো।’

-‘বিয়ে করছ না কেন?’ কৌতুকের স্বরে বলল বহ্নি ।

-‘আমাকে কে বিয়ে করবে বল?’ ডানহাতে প্রশ্নবোধক ভঙ্গি করে বলল ছেলেটা।

-‘আমি দেখব মেয়ে?’

-‘না!’

-‘তাহলে বললে যে তোমাকে কে বিয়ে করবে?’

-‘ওই যে চোখ বন্ধ করলেই কেউ একজন চোখের দৃশ্যপটে এসে প্রচণ্ড বিরক্ত করে। তাই!’

-‘কি!’ প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে বলল, বহ্নি, ‘আমি ভাবতে পারছি না। তোমাকে কেউ এসে বিরক্ত করে! সিরিয়াসলি?’

-‘এত হাইপার হচ্ছিস কেন? আমাকে কি কেউ কখনো বিরক্ত করেনি?’

-‘নাহ্! আসলে তোমাকে কেউ বিরক্ত করছে সেটা বড় কথা না। তোমার চোখের ঘুম কেউ কেড়ে নিয়েছে সেটাই বড় ব্যাপার! আমি তো রীতিমতো বাকরুদ্ধ ।’

-‘হয়েছে। আর কিছু বলার বাকি আছে?’ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল ছেলেটা।

-‘হুম। আছে তো। ভাইয়ার সাথে দেখা করবে না?’

-‘না।’

-‘কেন?’

-‘কি দরকার? এত বছর পরে !’

-‘এসব কি বলো? চলো তুমি আমার সাথে।’

-‘নাহ।’

-‘আচ্ছা তুমি এখানে কেন?-

-‘কাজে এসেছি।’

-‘আমার ক্যাম্পাসে তোমার কি কাজ?’

-‘কেন? এই ক্যাম্পাস কি তোর নামে রেজিস্ট্রি করা যে আমরা কেউ আসতে পারব না?’

-‘ওফফো। আমি কি তাই বলেছি?’

-‘আকারে ইঙ্গিতে তো তাই বুঝাচ্ছে।’

-‘আচ্ছা বাদ দাও। কেন এসেছ ? বলো।’

-‘নীরাকে নিতে এসেছি। ফুফু জোর করেই পাঠালেন।’

-‘খুব ভালো করেছে। নয়তো তোমাকে দেখতেই পেতাম না।’

-‘আচ্ছা এবার বাসায় যা।’

-‘তুমি যাবে না?’

-‘নাহ। আর কোনো প্রশ্ন নয়।’

-‘কেন, রাদিদ ভাইয়া? কেন?’

-‘বললাম না। আর কোনো প্রশ্ন নয়।’

-‘তুমি খুব খারাপ। অতল ভাইয়াও খুব খারাপ। তোমরা দুজনেই আমাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলে। আমি তোমাদের সাথে খুব রাগ করেছি। খুব!’

অতলের কথা শুনে রাদিদের কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। বহ্নির সম্পূর্ণ কথা বুঝে উঠতেই তার খেয়াল হলো তবে কি অতলও চলে গিয়েছিল সেই ঘটনার পর! বহ্নি তখন তার থেকে হেঁটে অনেকটা দূর চলে গিয়েছিল । রাদিদ দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’অতল চলে গিয়েছিল মানে?’

-‘তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।’

-‘এত্ত রাগ?’

-‘রাগ কি শুধু তোমরা করতে পারো? আমি পারি না?’

-‘তা পারবি না কেন? আচ্ছা চল , সামনের রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।’

-‘তোমার সাথে কোথাও যাব না।’

-‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তো এমনিতেই চলে যাচ্ছি আজ।’ রাদিদ হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল,’ বাই।’

বহ্নি কিছু না বলেই চলে গেল। রাদিদ শুধু তাকিয়ে দেখছিল পিচ্চিটাকে। কত বড় হয়ে গেছে। আগের চাইতে অনেক সুন্দর হয়েছে। কিন্তু অভিমান, রাগ সব আগের মতোই আছে। কিচ্ছু পরিবর্তন হয়নি।ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাদিদ।
______________________

নীরা তার বন্ধুদের বিদায় দিয়ে রাদিদের পেছন থেকেই বলে উঠল,’তুমি বহ্নি আপুকে চেনো?’

রাদিদ নীরার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই নীরা কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ইনিই কি সেই বহ্নি?’

রাদিদ তার মাথা দুলাল। নীরা একেবারে প্রশস্ত হেসে বলল,’ভাগ্যিস আজ আম্মু তোমাকে জোর করেই আমাকে নিতে পাঠিয়েছে। নয়তো জানতেই পারতাম না আমার এই রাদিদ ভাইয়ার ঘুম কেড়ে নেওয়া রাজকন্যা, এই কিউট আপুটা।’

একটু থেমে নীরা আবার বলল,’হুররে! ভাইয়া আজ কিন্তু ট্রিট চাই তোমার কাছ থেকে। আজ সেলিব্রেশন হবে।’

রাদিদ অবাক হয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল,’এখানে ট্রিট দেবার মতো কী হয়েছে?’

‘হয়েছে। হয়েছে। অনেক কিছু হয়েছে। অনেক কিছু সামনে হবে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।’ নীরা স্মিত হেসে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল।

‘তুইও না। একদম পাগলাটেই থেকে গেলি।’ তারপর আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘যার কথা বলছিস সে যেমন তেমন মেয়ে না। ও সম্পূর্ণ ভিন্ন। একদম আলাদা।’

‘আরে আমার রাদু ভাইয়া । আলাদা বলেই তো তোমার ঘুম কেড়ে নিতে পেরেছে। নয়তো কি পারত?’ নীরা তার হাতের ছাতাটা খুলতে খুলতে বলল।

‘এসব কি? আমার পুরো নাম রাদিদ ইবনে ইফতেখার। রাদু কি? হ্যাঁ?’ রাদিদ প্রচণ্ড রাগ দেখিয়ে বলল।

‘স্যরি! রাদু ভাইয়া। ওহ স্যরি রাদিদ ভাইয়া । আমি একদম অতি পরিমাণে দুঃখিত।’ নীরা ঠোঁট উল্টে আদুরে ভঙ্গিতে বলল।

নীরাকে এরকম বাচ্চাদের মতো আচরণ করতে দেখে রাদিদ হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। চল এবার।’

‘ট্রিট কি পাচ্ছি তাহলে?’ নীরা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।

রাদিদ থমথমে মুখ করে গম্ভীরভাবে বলল, ‘কোনো ট্রিট পাবি না। টাকা উড়ানোর স্বভাব তোদের আর গেল না। যারা কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে কেবল তারাই জানে এর পেছনে কতটুকু শ্রম দিতে হয়। একটা ভাতের দানার কতটুকু মূল্য তা কেবল একটা পথশিশুকে দেখলেই বুঝবি অথবা তাদের দেখলে বুঝবি যারা ঠিকমতো একবেলা খাবার ও খেতে পায় না।’

রাদিদের এমন জ্ঞানগর্ভ ভাষণ নীরার চিন্তা জগতে কোনো প্রতিফলন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। সে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আবারও বলল, ‘দেখ তুমি কিন্তু একদম ট্রিট দিতে চাও না? এত কিপ্টুস কেন তুমি?’

‘একটু আগে কী বললাম?’ রাদিদ সরু চোখে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘এতক্ষণ যা বললাম তা বুঝলে এর পরের প্রশ্ন আর তোকে করতে হতো না। জীবন মানুষকে অনেককিছু শিখিয়ে দেয়। আমাকে দেখেও কি বুঝতে পারিস না?’

নীরা আহত কণ্ঠে বলল,’মাঝেমধ্যে একটু মজা করলে খুব একটা ক্ষতিও হয় না। সেটা তুমি ভুলে গেছ।’

রাদিদ জানে আর কিছু বলে কোনো কাজ হবে না। তাই সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘চল, এবার যাওয়া যাক।’

_____________

আজকের পর্বে প্রশ্ন থাকছে পাঁচটি:

১. কে কে রাদিদকে অতল ভেবেছিলেন?
২. রাদিদের পরিবর্তনের পেছনের কারণ কী হতে পারে?
৩. রাদিদের এত্ত জ্ঞানগর্ভ ভাষণ আপনার কেমন লেগেছে?
৪. নীরাকে কেমন লেগেছে?
৫. শিহরণের বহ্নিকে নানান নামে ডাকাটা কেমন লেগেছে?

____________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০১

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০১

কাক ডাকা ভোর। পাখির কিচিরিচির শব্দে স্নিগ্ধ সকালটা মুখরিত হয়ে আছে। জানালার ফাঁক গেলে সকালের মিষ্টি রোদ্দুর ঢুকে পড়েছে ছোঁয়ার বেডরুমে। মিষ্টি রোদের রুপালি আলো ছোঁয়ার স্নিগ্ধ মুখের উপর পড়েছে। ছোঁয়া ডান হাত দিয়েই চোখ ঢাকল। চোখ বুজেই রইল। তার আজ ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না।মনে হচ্ছে খুব তৃপ্তির ঘুম দিয়েছে সে। বহুকাল পরে, বহু সময়ের ব্যবধানে। চরিদিকের ভোরের মিষ্টি রোদ, পাখির কিচিরমিচির , স্নিগ্ধ সকাল সবকিছু অনুভব করতে পারছে সে। তার অবচেতন মন চাইছে সেই স্নিগ্ধ ভোর উপভোগ করতে কিন্তু দু’চোখ অতৃপ্ত ঘুমের জন্য, ঘুম রাজ্যে বিচরণের জন্য!

সকালের শিশির ভেজা ঘাসের উপর পাদদেশ ফেলে হাঁটার লোভ সামলাতে না পেরে ছোঁয়া এক লাফে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। তার সিল্কি চুল অবিন্যস্ত হয়ে আছে। মুখমণ্ডল যেন বসন্তের গাছপালার নব পল্লবে সজ্জিত সতেজতায় ভরপুর। তার গায়ে পড়া একটা খয়েরি রঙের কুর্তি আর একটা ব্লু কালারের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। সমস্ত অ্যাটায়ারে ছোঁয়াকে বড়ই স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে। ছোঁয়া দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়ল তার ছোট্ট অথচ খুব প্রিয় কাজটি করতে।

ছোঁয়া সাবধানে পা ফেলছে শিশিরভেজা ঘাসের উপর। কী স্নিগ্ধ সেই অনুভূতি ! বিশুদ্ধতায় ভরা বাতাস বইছে । ছোঁয়ার গায়ে আঁচড় কাটছে সকালের সেই স্নিগ্ধ বাতাস। সূর্যের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখতেই মনে এক প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। চারদিকের গাছের চিকন ডালগুলো নড়ছে মৃদু, পাতাগুলো যেন হাসছে। ছোঁয়ার জন্য এই এক নতুন ভোর। সে সেই সব পাতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। বাতাসে ভেসে ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। ছোঁয়া চোখ বুজে বাহু প্রসারিত করে নিঃশ্বাস ভরে নিচ্ছে সেই মিষ্টি ঘ্রাণ।

‘ছোঁয়া, মামুণি। তাড়াতাড়ি এসো, নাশতা খেতে।’ ফাহমিদা বেগমের নরম অথচ উঁচু কণ্ঠের ডাকে ছোঁয়া চোখ খুলল। ফাহমিদা বেগম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন। ছোঁয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল।

ফাহমিদা বেগম এবার কপট রেগে বললেন,’কী হলো? এভাবেই হাসতে থাকলে হবে? অফিস যেতে হবে না?’

ছোঁয়া প্রশস্ত হেসে বলল,’এখনো অনেক সময় আছে। থাকতে দাও না আরো একটু সময় প্রকৃতির কাছে।’

‘এখন ঘড়িতে সাতটা বাজে। শপে যাবি, তারপর আবার অফিসে যাবি। কাজ কি কম বলতো?’ ফাহমিদা বেগম চিন্তিত স্বরে বললেন।

‘মা, তোমাকে এসব নিয়ে একদম ভাবতে হবে না। আমি সব সামলে নেব।’ ছোঁয়ার কণ্ঠে দৃঢ়তা।

ফাহমিদা বেগম ডান হাত দিয়ে কপাল চাপড়ালেন। তারপর হতাশ গলায় বললেন,’হায়! কপাল। এই মেয়ে আমার কথা কবে শুনবে কে জানে!’

‘আচ্ছা , মা। আসছি।’ ছোঁয়া পরাস্ত ভঙ্গিতে বলল।

ছোঁয়া আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। দ্রুত পায়ে নিজ রুমে গেল। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে লম্বা শাওয়ার নিল। তারপর দ্রুত ইউনিফর্ম পরে নিল। চুলটা ছেড়ে দিল। সামনে কয়েক গোছা ছোট চুল ছড়িয়ে আছে কপালের দিকে। ঠোঁটে হালকা বাদামি লিপস্টিক পরলো। কানে এক জোড়া ছোট স্টোনের কানের দুল পরলো। বাম হাতে পরলো তার রিস্ট ওয়াচ। আর অপর হাতে একটা গোল্ডেন ব্রেসলেট। মুখে হালকা হোয়াইট টোন পাউডার দিলো। এছাড়া আর কোনো প্রসাধন নেই। তবুও তাকে দেখতে একদম প্রিন্সেসের মতো মনে হচ্ছে।

ছোঁয়া তার হাত ব্যাগ আর ল্যাপটপ নিয়ে ডাইনিং এ এসে বসল। ফাহমিদা বেগম আজ তার জন্য নিজ হাতে নাশতা বানিয়েছেন। ছোঁয়া এখন খুব স্বাস্থ্য সচেতন । ফ্যাট যুক্ত খাবার বরাবরই সে এড়িয়ে চলে। তবে বাসায় তার এসব ডায়েট চলে না। ফাহমিদা বেগম প্রায় সময় তার জন্য নানান নাশতা ও রিচ ফুড বানান ঘরে। ছোঁয়া নিষেধ করলেও শুনেন না। তার উপর জোর করেই ছোঁয়াকে খাওয়ান। এই মুহূর্তেও টেবিল জুড়ে নানান নাশতার ছড়াছড়ি । অরেঞ্জ জুস, ব্রেড অ্যান্ড বাটার, টোস্ট, নুডলস, স্যুপ, পায়েস আরো নাম না জানা খাবার। এতসব খাবার ফাহমিদা বেগম টেবিলে এনে রাখতেই ছোঁয়ার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।

সে মুখে এক রাশ বিরক্তি এনে বলল,’মা, তোমাকে কতবার বলেছি এত্ত খাবার না বানাতে! তুমি আমার কথা একদম শুনো না।’

ফাহমিদা বেগম আহ্লাদিত কণ্ঠে বললেন,’তোর জন্যেই তো বানালাম। সব খেতে হবে তোকে। না খেলে আমি কিন্তু খুব রাগ করব। আর না খেয়ে খেয়ে কেমন পাতলা হয়ে যাচ্ছিস সেই খবর কি আছে?’

ছোঁয়া প্রচণ্ড অবাক হলো। ফাহমিদা বেগমের সামনে সটান দাঁড়িয়ে বিস্মিত স্বরে সে বলল,’আমাকে এখন একটু ভালো করে দেখ তো। আমার ওয়েট ৫০ কেজি। হাইট ৫ ফিট ৩ ইঞ্চি। তারপরেও তুমি বলবে আমি পাতলা? কত্ত মোটা হয়ে যাচ্ছি, মা। সব তোমার জন্য। তুমি উল্টাপাল্টা সব খাবার খাইয়ে খাইয়ে আমাকে মোটু বানাচ্ছ। তখন দেখবে কিছুদিন পর আমার ওয়েট হবে ৮০ কেজি। সেদিন দূরে নাই বলে দিলাম যেদিন মোটু বলে আমাকে রিজেক্ট করা হবে! আর তখন আমার জন্য পাত্র খুঁজেই পাবে না। এখন থেকেই তো তুমি পাগল প্রায় হয়ে যাচ্ছ পাত্র খুঁজতে খুঁজতে ।’

ফাহমিদা বেগম প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন,’হয়েছে, আর এত পাকনামো করতে হবে না। খেতে বলেছি খাও। এসব কিছু যে তোমার খাবার না খাওয়ার পাঁয়তারা তা আমি খুব ভালোই বুঝতে পারছি।’

ছোঁয়া অসহায় মুখ করে তাকাল ফাহমিদা বেগমের দিকে। ফাহমিদা বেগম সেই দৃষ্টি সহাস্যে উপেক্ষা করে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,’আচ্ছা শুধু আজকে খা। কাল থেকে আর খেতে হবে না।’

ছোঁয়া হতাশ গলায় বলল,’এই একটা কথা তুমি কতবার বলেছ হিসেব আছে?’

ফাহমিদা বেগম প্রত্যুত্তরে শুধু হাসলেন। ছোঁয়াও হাসল। তারপর দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরল এক অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধনে।

সমস্ত হাসি ছাপিয়ে ফাহমিদা বেগমের কপালে পড়ল এক চিন্তার ভাজ। অতীতের কোনো এক বিভীষিকাময় ক্ষণের কথা হয়তো মনে পড়ে গেছে তার। কে জানে! মানুষ কখন কী ভাবে আর কখন কী করে!

____________________

একটা ব্ল্যাক পাজেরো এসে থামল ঠিক মিডিয়াম আকারের আকর্ষণীয় এক শপের সামনে। শপের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে দেখা যাচ্ছে এক প্রাণবন্ত হাস্যোজ্জ্বল সতেজতায় ভরপুর তরুণীর চেহারা। যেই চেহারায় নেই কোনো ক্লান্তি, নেই উদ্বেগ কিংবা কোনো উৎকন্ঠা । তরুণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক। বয়সে সেই তরুণীর সমবয়সী হবে হয়তোবা বছর খানেক বেশি হবে। গাড়ির কাঁচ না নামিয়েই সেই তরুণীর সমস্ত কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করছে গাড়িটির ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটি। তার ঠিক পাশের সিটে বসা একজন রূপবতী, অতি সুন্দরী তরুণী অধৈর্য গলায় বলল,’আনবিলিভেবল! তুমি এভাবে কি বসেই থাকবে?’

নিরুত্তর সেই মানুষটি । সুন্দরী তরুণীর কথার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটি। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ শপের ভিতরের সেই হাস্যোজ্জ্বল তরুণীর দিকে। সে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। স্টিয়ারিং খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে হাত দিয়ে।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির সমস্ত অ্যাটায়ার জহুরি চোখে পরখ করছে সে। সেই তরুণ খুব হাসি হাসি মুখ করে কথা বলছে। যেন খুব করে ভাব জমাতে চাইছে হাস্যোজ্জ্বল তরুণীর সাথে। তরুণীও থেকে থেকে মৃদু হাসছে। একটু আধটু কথাও বলছে। মাঝেমধ্যে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিচ্ছে। আর তা দেখেই ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটির ক্রোধ উপচে পড়ছে স্টিয়ারিং এর উপর।

তার পাশের তরুণী পুনরায় ব্যস্ত গলায় বলল,’তুমি এই ভাবে কী দেখছ?’

মানুষটি এবারও নিরুত্তর। পাশের তরুণী কাঁধ ধরে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিতেই সেই মানুষটি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’হুয়াট দ্যা হেল, মান্নাত! ক্যান্ট ইউ কিপ প্যাশেন্স ফর জাস্ট অ্যা হোয়াইল?’

‘তুমি চিৎকার করছ কেন? আমি তো খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছি মাত্র।’ মান্নাত এটুকু বলে একটু চুপ থেকে আবার বলল,’আমি এই ধরনের ব্যাবহার তোমার কাছ থেকে আশা করিনি।’

‘স্যরি, মান্নাত! আই ওয়াজ আউট অব মাই মাইন্ড ।’

‘আই নিড টু গো। নাউ।’ মান্নাত চেঁচিয়ে উঁচু কণ্ঠে বলল।

মানুষটির প্রচণ্ড রাগ হলো। এভাবে রাস্তাঘাটে চিৎকার , চেঁচামেচি করার কোনো মানে নেই। তাই শান্ত স্বরে বলল, ‘ওকে। দ্যান ইউ ক্যান লিভ।’

‘আমি আন্টিকে বলব তোমার আজকের আচরণ সম্পর্কে ।’ প্রচণ্ড রাগান্বিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল মান্নাত।

‘এজ ইওর উইশ।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে এক হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে অপর হাত প্রসারিত করে বলল মানুষটি।

________________

আজকের পর্বে আপনাদের জন্য প্রশ্ন থাকছে তিনটি:

১. ফাহমিদা বেগম এত্ত সুইট হবার পেছনে কারণ কী হতে পারে?
২. মান্নাতের সাথের ছেলেটা কে?
৩. আজকের পর্বের চরিত্রের প্রেজেন্টেশন কেমন লেগেছে এবং প্রকৃতির বর্ণনা আপনার মনকে ঠিক কতটুকু ছুঁয়েছে?

_________________

অনুভূতির সুপ্ত কোণে পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

2

#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন
অন্তিম পর্ব
.
ঘ্ড়ির কাটা ৬টা ৩০ ছুই ছুই। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে দেখা যাচ্ছে রক্তিম আভা। শহরের কোলাহলপূর্ণ দালানকোঠা পেরিয়ে গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছে সবুজ সমারোহের পরিবেশের দিকে। মেহের অবাক নয়নে উপভোগ করছে পরিবেশটুকু। কিছুটা কৌতুহলের সাথে আদ্রাফের দিকে তাকায় সে। আদ্রাফ আজ ব্লু ডেনিম প্যান্টের সাথে পড়েছে হোয়াইট শার্ট। গলার কাছে ব্রাউন সানগ্লাসটি ঝুলিয়ে রেখেছে। তবে বরাবরের মতো এবার সেই গম্ভীরতাটি আর নেই ; রয়েছে স্মিত হাসি।
——আমরা কোথায় যাচ্ছি আদ্রাফ?
.
——ইটস সারপ্রাইজ !
.
আদ্রাফের প্রতিউত্তরে মেহেরের কৌতুহলতাটি যেন আরও দ্বিগুন হারে বেড়ে যায়। তবুও এবার আদ্রাফকে কিছু জিজ্ঞেস করেনা যেহেতু সে বলেই দিয়েছে যে এটা সারপ্রাইজ। পশ্চিম আকাশের রক্তিম আভাটা এবার অনেকটাই মিলিয়ে গিয়েছে। পরিবেশে ঘনিয়ে পড়েছে অন্ধকার। আর এই আবছা অন্ধকারে মেহেরকে দেখতে খুবই মায়াবী লাগছে। তার পরনে হলুদ কামিজটি যে ফর্সা গায়ে নিঁখুতভাবে ফুটে উঠেছে। আদ্রাফ তা দেখে বলে…….
——মেহু?
——-হুম?
——-আজ তোমায় খুব সুন্দর লাগছে। এক কথায় যাকে বলে হলদে পরী।
——-এই প্রথম আমায় সুন্দর বললে। আর এতদিন তো আমায় উল্টাপাল্টা নাম ধরে রাখতে।
ভ্রু কুচকে ফেলে আদ্রাফ। অবাক স্বরে বলে……….
——যেমন?
.
——এই যে : শাকচুন্নি , ডাইনী ব্লা ব্লা ব্লা।
.
আদ্রাফ সশব্দে হেসে দেয় মেহেরের কথা শুনে। গাড়িটা অন্যদিকে বাকিয়ে বলে……
——-আরও একটা নাম ধরে ডাকতাম।
——–কি?
——-শ্যাওড়া গাছের পেত্নী।
একথা বলেই আদ্রাফ ঠোঁট চেপে হাসি থামানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। মেহের চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে। এই আদ্রাফ যতটা গম্ভীর সেজে থাকে ততটাও গম্ভীর না। ওর হাস্যোজ্জল রূপটা আদ্রাফ শুধু কাছের মানুষের কাছেই প্রকাশ করতে ভালোবাসে। বাইরে ঠান্ডা প্রবাহের কারণে গাড়ির গ্লাসটা আদ্রাফ খুলে দেয়। বাইরে বৃষ্টি বৃষ্টি ঘ্রাণ আসছে। অর্থাৎ যেকোনো সময়ই বৃষ্টির দাপটে এই পরিবেশ উন্মাদনায় মেতে যাবে। গাড়ি যতই দূরে যাচ্ছে ততই ঝিঁঝিঁ পোকার সমাগম যেন বাড়ছে।
মেহের চোখ বাকিয়ে আদ্রাফের দিকে তাকায়। সড়কের লাইটের মৃদু হলদে আলোটি আবছা ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আদ্রাফের শুভ্র রঙের শার্টে। হাতের নীল রগগুলোও অনেকটা আবেদনময় করে তুলছে আদ্রাফকে যার দিকে একটা লম্বা সময় তাকিয়ে ছিলো মেহের।
ভাবতেই অবাক লাগে এই চমৎকার পারসোনালিটির ছেলেটা ওর লাইফ পার্টনার। যার প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রেই রয়েছে শুধুমাত্র মেহুর নাম।
.
গাড়িটি যে কখন থেমে গেলো মেহের যেন তা টেরই পেলো না। একটা লম্বা সময় সে আদ্রাফের ঘোরে ছিলো। আদ্রাফ মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে মেহের একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তাই সে মেহেরের চোখের সামনে চুটকি বাজায়।
——-হ্যালো ! এসে পড়েছি আমরা?
.
——-হুমমমম? এসে পড়েছি?
.
——-হ্যাঁ।
.
——–মেহের গাড়ি থেকে নামতেই আদ্রাফ হাত চেপে মেহেরকে নিজের কাছে নিয়ে আছে। চোখে মুখে রয়েছে কিঞ্চিত অবাকতার ছাপ।
——–এতক্ষণ আমার কথা ভাবছিলে?
.
আদ্রাফের কথায় মেহের বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছে। একে তো এই নীরব পরিবেশে নিজের আর আদ্রাফের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পারছে সে। আমতা আমতা করে সে বলে ওঠে……….
.
———-আ-আ-আসলে এ-একটু অন্য ধ্যানে ছিলাম। এখন এসব কথা রাখো না। আমি একটু দেখতে চাই যে তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এসেছো?
.
——ওকে।
.
.
.
.
একটা অন্ধকার পথ দিয়ে এগোচ্ছে দুজনে। দুজনের হাতেই রয়েছে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট যার আলোতে অন্ধকার কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না।মেহেরের কোতূহলটা এবার রূপ নিয়েছে ভয়ে। কেমন যেন গা ছমছম করা পরিবেশ। এমনিতেও আকাশে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে যার জন্য ওর কেমন যেন লাগছে। আদ্রাফের বাহু খামচে ধরে বলে…….
.
——এই আদ্রাফ ! আমারে কি এখানে খুন করার জন্য এনেছো নাকি?
.
——-What rubbish ! বললাম তো সারপ্রাইজ আছে!
.
—–ধ্যুর ! রাখো তোমার সারপ্রাইজ । ভূতে আমাদের ঘাড় মটকে ওদের বউ বাচ্চা নিয়ে সারপ্রাইজ পার্টি করবে।
.
——করবে না।
.
——কেন?
.
——ভূতে কখনও শ্যাওড়া গাছের পেত্নীর ঘাড় মটকাবে না।
মেহের চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আদ্রাফ সিটি বাজাতে বাজাতে একটু এগোতে গেলেই মেহের চিল্লিয়ে বলে ওঠে…….
.
——এই ছ্যামড়া ! আমারে রেখে যাও কেন?
.
একথা বলেই আদ্রাফের হাত ধরে সে। আদ্রাফ বিনিময়ে আর কিছু না বলে এগিয়ে যেতে থাকে। দু তিন মিনিট কাচা রাস্তা দিয়ে হাটার পরপরই তারা এসে থামে একতল বিশিষ্টবেশ বড়সড় একটি বাড়ির সামনে। আশপাশ নারিকেল আর সুপারি গাছ দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ দিকে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটি খাল। সেখানে একটি বড় বটগাছ দেখে মেহেরর কাছে ওই জায়গাটি ভুতের ডিস্কোক্লাব মনে হচ্ছে।আদ্রাফের দিকে না তাকিয়েই সে বলে……..
.
——এটা কার বাড়ি?
.
——আমার বাড়ি। দেড় বছর আগেই কিনেছি এক বৃদ্ধ দম্পতি থেকে। তারা এখন তাদের ছেলেমেয়ের কাছে আ্যমেরিকায় চলে গিয়েছেন।
.
——ওহ !
.
.
.
বাড়িটা বেশ বড় হলেও অনেক সাদামাটা ধরনের। একমাস পরপর লোক দিয়ে আদ্রাফ এটা পরিষ্কার করায় তবে এখানে ধুলোবালির পরিমাণ কিছুটা কম বলে তেমন অপরিষ্কার হয় না আর সাফ করতেও কষ্ট হয় না। চারটা বেডরুম , সাথে এডজাস্ট ওয়াশরুম , তিনটা বারান্দা , কিচেন আর লিভিং রুম সবমিলিয়ে বাসাটা আসলেই খুব বড়। তবে মেহেরের মনে হচ্ছে বাইরের পরিবেশটা এর থেকে আরও বেশি সুন্দর।
.
——-পছন্দ হয়েছে? [আদ্রাফ]
——-অনেক……………..চমৎকার সারপ্রাইজ এটা।
——-আমি কি একবারও বলেছি এটা আমার সারপ্রাইজ?
.
মেহের অবাক চোখে তাকায় আদ্রাফের দিকে।
——মানে? তাহলে সারপ্রাইজ কোনটা?
আদ্রাফ মেহেরের পেছনে গিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে দেয় মেহেরের। তারপর কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে……..
.
—–Just some more time Mehu……
.
আদ্রাফের কন্ঠ শুনে মেহেরের চাঞ্চল্যতাটি স্থির হয়ে গিয়েছে। তার চোখের সামনে সবকিছু লাগছে অন্ধকার। আদ্রাফের হাত ধরে মেহের এগিয়ে যাচ্ছে বাইরের। একরাশ ঠান্ডা হওয়া মেহেরের দুধে আলতা শরীরটিকে অদ্ভুদভাবে গ্রাস করে নিলো। নাকে ভেসে আসছে বৃষ্টির মৃদু ঘ্রাণ। যতই এগোচ্ছে পানির কলকল শব্দটি আরও গভীরভাবে শুনছেসে। বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ থামে। তার সাথে তাল মিলিয়ে মেহেরও। আদ্রাফ ওর চোখের রুমাল খুলে দিতেই মেহের পিটপিট করে চোখ খুলে।
প্রথম মেহেরের মনে হচ্ছিলো সে যা দেখছে এগুলো সব ভ্রম। কিন্ত না। সে যা দেখছে সবকিছুই সত্যি। মেহেরের সামনে ছোট্ট একটি ছাউনিযুক্ত ঘর দেখতে পাচ্ছে যেখানে শুধু উপরের ছাদটাই ঢাকা আর চারপাশে পিলার হিসেবে চারটি মোটাবাঁশ দেওয়া আছে। সেখানেই রয়েছে অনেকরকম বেলুন দিয়ে সাজানোর কারনে আরও সুন্দর লাগছে। বেতের টেবিলটির ওপর দুটো হা্যরিক্যান রাখা। আদ্রাফ মেহেরের হাত ধরে সেখানে থাকা ঘাসের গালিচায় বসিয়ে দেয়। মেহেরের ঠিক মুখোমুখি হাটু ভেঙ্গে বসে আদ্রাফ। মিহি কন্ঠে বলে ওঠে……………….
.
—–আমি জানি কি ভাবছো তুমি? মনে চলছে তোমার অনেক প্রশ্ন যে কি উপলক্ষে এমন সারপ্রাইজ । তাই না?
.
—–হুমমমম।
.
একটা লম্বা শ্বাস নেয় আদ্রাফ। তারপর শীতল গলায় বলা শুরু করে……….
.
—–আজ ২০ শে মার্চ। আর ঠিক এই দিনেই আরও দশবছর আগে তোমাকে প্রথম দেখি আমি যেদিন তোমার আর নাদিয়া স্কুলে ফার্স্ট টার্ম এক্সাম ছিলো।
এমনি মেঘাচ্ছন্ন দিন ছিলো সেটা। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তখন দাঁড়িয়েছিলাম আমি নাদিয়াকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনই স্কুল ছুটি হওয়ার পর অনেক ছেলে-মেয়ে বের হতে থাকে স্কুল দেখে। হঠাৎই আমি একটা দৃশ্য দেখে ভড়কে যাই। দু বেণী করা স্কুল ড্রেস পরিহিতা এক মেয়ে একটা ছেলের কান টেনে বাইরে নিয়ে আসছে। তারপাশেই কাচুমাচু হয়ে এগিয়ে আসছে নাদিয়া।
আমি একটু অবাক হই এ দৃশ্য দেখে। স্কুল গেট থেকে বের হয়েই ছেলেটার কান ছেড়ে দেয় মেয়েটি। আর চিল্লিয়ে বলে ওঠে……….
.
——-সাহস তো কম না তোর? আমার বেস্টিরে প্রোপোজ করস? একেবারে টেংড়ি ভেঙ্গে দিমু নেক্সট টাইম ওর আশেপাশে দেখলে। এখন দূর হ।
.
ছেলেটা চিল্লিয়ে মেয়েটাকে বলে ওঠে……..
——তোরে প্রপোজ করছি কুত্তী? তোর বান্ধুবীরে করসি তুই চেতস ক্যান?
.
——তুই কুত্তা তোর চৌদ্দ গুষ্ঠি কুত্তা। আমি বলসি ওরে লাইন মারবিনা মানে মারবিনা। সর তো।
.
——তোরে আমি দেইখা নিমু মেহের।
.
——ভালোমতো দেইখা নে যিতে নেক্সট টাইম আমার থাপ্পড় খাইয়া আবার আমারে ভুইল্লা যে না যাস। এখন চোখের সামনে থেকে সরবি নাকি লাথথি মারমু?
.
—–যাইতাসি।
.
আমি জাস্ট হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি সেদিকে। তখনই তোমার দস্যু রূপ প্রথমে দেখেছিলাম আমি। আর দেখো সময়ের তালে সেদিন নাদিয়ার বিয়ের সাথেই তোমার আর আমার বিয়ে হয়ে গেলো”
.
এতটুকু বলেই থামে আদ্রাফ। মেহের ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফ এবার আলতো করে মেহেরের হাত আগলে ধরে বলে………
.
——-তখন থেকেই তোমায় আলাদা চোখে দেখা শুরু করি আমি। তোমার হাসি-কান্না-রাগ-দুষ্টুমি সবকিছুই পাগল করে দিতো আমাকে। আর আজ দেখো? আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন শুধু তোমার বিচরণ।
.
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায় নিস্তব্ধতা। মেহের এখন বসে আছে পুতুলের ন্যায়। তার ধারনাই ছিলো না যে আদ্রাফ তাকে এত আগের থেকেই ভালোবাসতো।
.
.
.
————–
আজ বারে না গিয়ে শাওন বসে আছে ভার্সিটির বড় পুকুরটির সামনে। আকাশে ঘনঘন বজ্রপাত হচ্ছে তবে সেদিকে পরোয়া না করে শাওন উদাসীনভাবে ঢিল ছুঁড়ে মারছে দীঘির টলটলে পানিতে। আজ চিৎকার করে কাদতে মন চাচ্ছে শাওনের যে কেন মেহেরকে সে বলতে পারলো না ওর আসল পরিচয়। কেন ওকে বলতে পারলো না যে—বোন? আমিই তোমার ভাই। কে বলেছে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই?
আফসোস ! শাওন কিছুই বলতে পারবে না। ওর পাশেই অবহেলিতভাবে পড়ে আছে অনেকগুলো আ্যলকোহলের বোতল। কিন্ত মোটেও নেশা হলোনা এতে। শাওন চেয়েছিলো নেশাটা হোক। একবার নেশাটা চড়ে বসলে আর কোনো কষ্টই হতো না।
.
.
——–শাওন?
.
কারও মেয়েলি কন্ঠ শুনে পিছে ঘুরে সে। নিশাকে দেখা যাচ্ছে। শাওন শীতল কন্ঠে বলে ওঠে……..
.
——এখানে কেন এসেছিস?
.
——-তোর জন্য।
শাওন একটা ব্যঙ্গ হাসি দেয়। মুখ ফিরিয়ে বলে ওঠে……..
——-আসতে হবে না আমার জন্য। এই শাওন চৌধুরি বড্ড নিঃস্ব মানুষ। তার কেউ নেই।
নিশির বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে।শাওনের পাশে বসে সে আলতো করে শাওনের মুখ আগলে ধরে। দুর্বল গলায় বলে……….
.
——–ক-ক-কে বলেছে কেউ নেই? সবাই আছি। শোভা , রাতুল , রাহাত…….
.
——–আর তুই?
.
চুপ হয়ে যায় নিশা। শাওনের দৃষ্টিতে রয়েছে হাজারো হাহাকার। নিশি মাথা নাড়ায়।
——-আছি তো। সবসময় থাকবো তোর সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে !
.
——-সত্যি?
.
——-হুমমম।
.
শাওন এবার নিশির কাধে মাথা রাখে। হয়তো সে আজ পেয়ে গিয়েছে তার পথচলার সঙ্গীকে যার সূচনায় একবারও ভালোবাসি কথাটা বলে হয়নি। শুধু এ সম্পর্কের সূচনাটাই হয়েছে অগাধ বিশ্বাসের সাথে।
.
.
.
.
————
টিমটিম বৃষ্টিটি এখন বয়ে যাচ্ছে মুষল ধারায়। আদ্রাফের বুকে মাথা রেখে মেহের ছাউনির নিচে সে দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। বৃষ্টির দাপটে দুজনের জামাই আংশিক ভিজে গিয়েছে। শোঁ শোঁ করে বহমান আল্লাহর দান এই হাওয়া। মেহের এবার আদ্রাফকে বাচ্চা কন্ঠে বলে ওঠে……….
.
——চলোনা বৃষ্টিতে ভিজি?
.
——এই রাতে ভিজবে? বৃষ্টি দেখছো এটাই অনেক।
.
মেহের তবুও হার মানে না। আদ্রাফের নাকে চুমু দিয়ে বলে .
.
——তুমিই দেখো বৃষ্টি। আমি একটু ভিজে আসি।
এটা বলেই মেহের বেরিয়ে আসে ছাউনির বাইরে। দুহাত মেলে উপভোগ করতে থাকে বৃষ্টির ছন্দ। পানিগুলো যেন সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিতে এই প্রথম মেহের রাত করে ভিজলো। যার বর্ণণা মেহের হয়তো নিপুণভাবে দিতেও পারবে না। মেহেরকে এতো প্রাণোচ্ছো্যল দেখে আদ্রারও তৃপ্তির হাসি হাসে। আজ সেও ভিজবে তার হলদে মেহুপরীর সাথে। ছাউনি থেকে বেরোতেই বৃষ্টির ভারী কণাগুণো ওর গা শিরশির করে দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সেও ভিজে গেলো বৃষ্টির স্রোতের ধারায়। সামনের ছোট খালও বৃষ্টির ছন্দে মধুময় লাগছে।
মেহের এবার পিছে ঘুরে তাকায় আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফের নেশাক্ত দৃষ্টিতে যেন নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছে সে। আদ্রাফের সাদা শার্টটি একেবারে গায়ের সাথে লেপ্টে থাকার জন্যে প্রতিটা অ্যাবস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেহের তা দেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। এই ছেলেকে সুন্দর বললে ভুল হবে……………ভয়ঙ্কর রকম সুন্দর লাগছে।
.
মেহেরকে অবাক করে দিয়ে আদ্রাফ মেহেরের কোমড় চেপে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। আলতো হাতে বুলাতে থাকে মেহেরের ঠোঁটযুগল। মেহেরের গোলাপি ঠোঁটদুটো থেকে অবিরাম ধারায় পানি গরিয়ে পড়ছে যার রাজত্ব আদ্রাফ সহ্য করতে না পেরে দখলে নিয়ে নেয় সেই ঠোঁটজোড়া সাথে আঁকড়ে ধরে সেই ঠোঁটজোড়ার মালিককে। দুজনের কাছেই সময়টা যেন থমকে গিয়েছে।
.
বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ মেহেরের ঠোঁট ছেড়ে দিতেই মেহের আদ্রাফের বুকে মিশে গিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। আদ্রাফ তা দেখে মুচকি হাসে। ভাবতেই আজব লাগে এই দুষ্টুমেয়েটাই তার প্রেয়সী।
আদ্রাফ মেহেরকে আগলেই নিজের গলায় সুর তোলে। কেননা আজ মেহেরের উদ্দেশ্যে গান গেতে খুবই ইচ্ছে করছে। আনমনেই সে গান শুরু করে…..
.
” কেন জানিনা………….মিষ্টি এ ব্যাথা!
থাকছি খেয়ালে…………………ভাছি তোর কথা !
….তোর প্রেমে বৃষ্টিতে হায় ভিজছি সারা দিন !
….তোর প্রেমে বৃষ্টিতে হায় ভিজছি সারা রাত !”💕💕💕
.
আর এভাবেই হয়তো চলতে থাকবে মেহেরাদ্রাফের দুষ্টু মিষ্টি অধ্যায়। হয়তো এভাবেই চলমান থাকবে দুজনের খুনশুটিময় ভালোবাসা।
.
.
.
.
.
.
……..*সমাপ্ত*………..
প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে লিখা এই শেষ পর্বটি। আমি শুরুতেই ভেবে রেখেছিলাম গল্পটি অল্প পর্বে শেষ করবো। তাই মেহেরাদ্রাফ ভক্তরা এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করবেননা আশা করি।
আমার আড়াইঘন্টা ধরে লেখার ফলাফলটা আপনাদের আড়াই মিনিটেরও কম লেখা মন্তব্যে পাবো। গঠনমূলক কমেন্ট করবেন আশা করবো। আর কিছুদিন পরেই নিয়ে আসবো নতুন গল্পটির প্রথম পর্ব নিয়ে। অবিরাম ভালোবাসা।

অনুভূতির সুপ্ত কোণে পর্ব-১৯

0

#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
পর্ব : ১৯

” স্বামী স্ত্রীকে সময় দেয় না দেখে স্ত্রীর হাতে স্বামীর নির্মম মৃত্যু”
আদ্রাফ চোখ বাকিয়ে তাকায় মেহেরের দিকে। মেহের রাগে ফোঁস ফোঁস করে চলছে। আদ্রাফ মনে মনে ভাবে যে……….”এই মেয়ে কি ওর খুনের পরিকল্পনায় মেতে আছে নাকি?’
.
.
আদ্রাফ প্রশ্নবোধক কন্ঠে মেহেরকে প্রশ্ন করে……
—-এনি প্রবলেম মেহু?
.
আদ্রাফের শান্ত গলা মেহেরকে যেন আরও চক্রবৃদ্ধিহারে রাগের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটা মেকি হাসি দিয়ে সে প্রতিউত্তরে বলে…….
.
—-নাহ তো? আমার কি প্রবলেম হবে? আমি তো জাস্ট নিউজ পড়ছিলাম।
.
—-ওহ্।
এটা বলেই আদ্রাফ আবার নিজ কাজে মনোনিবেশ করে। মেহেরের রাগ এবার আর ধরে রাখে কে। কত সুন্দর করে আদ্রাফের এটেনশন পাওয়ার জন্য থ্রেড দিয়েছিলো সেটা আর কাজে লাগলো না ভাবতেই মেহেরের মন চাচ্ছে কবর খুঁড়ে মরে যেতে।আদ্রাফকে অবাক করে দিয়ে ওর ট্যাব কেড়ে পাশে থাকা ছোট টেবিলে মেহের ট্যাবটা রেখে দেয়। আদ্রাফ গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে।মেহেরের দিকে ঘাড়টা হালকা কাত করে সে বলে……….
.
—–আমি তো কাজ করছিলাম। ট্যাব নিয়ে নিলে কেন?
.
আদ্রাফের প্রশ্নে ভ্রুক্ষেপ না করে মেহের চড়ে বসে আদ্রাফের ওপরে। মেহেরের কাজের জন্য আদ্রাফের অবাক হওয়ার প্রবণতাটা যেন ধাপে ধাপে বেড়ে গিয়েছে। মেহের হালকা নিচু হয়ে আদ্রাফের মুখের কাছে আসে। পরিবেশটা কেমন যেন স্তব্ধ। মাথার উপর ঘূর্ণায়মান ফ্যান থাকলেও আদ্রাফের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে কান থেকে যেন ধোয়া বের হচ্ছে মেহেরের। মেহের কিঞ্চিত ক্রোধের সাথে বলে ওঠে……….
.
—–এত আনরোম্যান্টিক কেন তুমি? আমার মতো এত কিউট বউ থাকতেও সারাদিন অফিস , ট্যাব , ল্যাপটপ নাহয় ফাইল…………আমারে কি তোমার চোখে পড়ে না।
.
মেহেরের কথা শুনে আদ্রাফ সন্দিহান দৃষ্টিতে বলে……
.
—–তুমি কি রোম্যান্টিকতার ওপর পি.এইচ,ডি করেছো নাকি?
.
আদ্রাফের ভ্রু নাচানো দেখে মেহেরের চোখ বন্ধ করে নেয়। এই ছেলের মারাত্নক চাহিনী কবে জানি তার জানই কেড়ে নিবে। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মেহের বলে……..
.
—–হ্যাঁ করেছি। তো? তোমাকে তো একফোটাও শিখাতে পারলাম না।
.
মেহেরের ঠোঁট উল্টানো দেখে আদ্রাফ দুষ্টু হাসি হাসে। এত বড় অপবাদ সে তো কিছুতেই নিতে পারবে না। আচমকা মেহেরের কোমড় জাপ্টে তাকে বিছানায় ফেলে তার ওপর নিজের ভর ছেড়ে দেয় আদ্রাফ। আদ্রাফের দুষ্টু হাসি দেখে মেহেরের চোখ যেন ছানাবড়া হয়ে গিয়েছে। আদ্রাফ নিজের মুখটা আস্তে করে মেহেরে কানের কাছে নিয়ে যায়। হিসহিসিয়ে বলে………..
.
——আমি অনেক আনরোম্যান্টিক। এটাই তো বললে? তো চলো আজ তোমার থেকে একটু ট্রেনিং নিয়ে নেই। In this Moonlight night………..Just you & me……..
.
মেহেরের রক্তপ্রবাহ যেন স্থির হয়ে গিয়েছে যেন আদ্রাফের কথা শুনে। এতদিনের পুষিয়ে রাখা সাহস আদ্রাফের উত্তপ্ত কন্ঠে নিমিষেই যেন স্রোতপ্রবাহ হয়ে এলো। আদ্রাফের চোখের দৃষ্টির মেহেরকে অন্যকিছুই বোঝাচ্ছে। যেই কালো চোখযুগলের বাহারে রয়েছে একরাশ মায়ার সমাহার। আদ্রাফের শীতল ঠোঁটযুগল চুম্বকের মতো আকৃষ্ঠ করছে মেহেরকে।
একটা শুকনো ঢোক গিলে মেহের আদ্রাফকে প্রশ্ন করে………
.
—–ট-ট-ট্রেনিং ন-নিবে ম-মমানে?
.
আদ্রাফ একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে ওঠে——আমি practically নাহয় দেখাই ?
.
এটা বলেই আদ্রাফ এক এক করে নিজের সমস্ত শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। মেহেরের দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। ওর সব পরিকল্পনা ভাবনাকে বিফলে ফেলে নতুন অনুভূতি বিরাজ করছে আদ্রাফের জন্য। ঘরের মৃদু আলোয় আদ্রাফের শার্টলেস বডি দেখে মেহেরের যেন অজ্ঞান হওয়ার মতো উপক্রম। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয় সে।
.
আদ্রাফ এবার অবুঝ হওয়ার ভান করে বলে ওঠে………
.
—–OMG ! মেহু বেবি……….তুমিই তো বলেছিলে আমি আনরোম্যান্টিক। কই তোমার কাছ থেকে একটু ট্রেনিং নেবো আর তুমিই চোখ খিচে শুয়ে আছো। This is not fair…….
.
—–তোমার fair এর গুষ্টি কিলাই ! আল্লাহর ওয়াস্তে শার্টটা পড়ো আদ্রাফ।
.
মেহের চোখ খিচেই কাতরতার সাথে বলে। মেহেরের এমন ভাবভঙ্গি দেখে আদ্রাফ ঠোঁট কামড়ে হাসছে যা চোখ বন্ধ করে রাখার জন্য মেহের স্পষ্ট দেখতে পারছে না।আদ্রাফ এবার নিজের দুহাত দিয়ে মেহেরের দুহাত বালিশের ভীড়ে আগলে নেয়। মেহেরের কথার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে মুখ ডুবিয়ে দেয় মেহেরের গলায়। মেহের স্পষ্টভাবেই আদ্রাফের আদুরে স্পর্শ অনুভব করতে পারছে। আবেশে আদ্রাফের চুল খামচে ধরতেই আদ্রাফ যেন আরো মাতাল হয়ে যায় ধীরে ধীরে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ আরও গভীর করতেই আদ্রাফ মেহেরের কানের কাছে মৃদু কন্ঠে বলে……
.
——এখন তো আমি রোম্যান্টিক বয় হয়েছি তাই না? এবার নাহয় হটি-নটি বয় হয়ে দেখাই?
.
——মোটেও না।
.
মেহেরের এই কথাটা এতটাই জোরে বলে যে আদ্রাফের কানের পর্দা মোটামোটি ছিড়ে গিয়েছে। খানিকটা বিরক্তিসুরে মেহেরের দিকে তাকাতেই মেহের হালকা উঠে ওর ঠোঁটজোড়ায় কড়াকড়িভাবে একটা কামড় লাগিয়ে দেয়। ব্যস আদ্রাফও তড়িৎ গতিতে সরে আসে মেহেরের কাছে থেকে। অবাকের ন্যয় বলে ওঠে………
.
——তুমি কি মানুষ নাকি পেত্নী ! এভাবে কেউ কামড় দেয়?
.
মেহের উঠে বসে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। আদ্রাফের সান্নিধ্যে আর কিছুক্ষণ থাকলে এখনই ওকে পিজি হসপিটালে ভর্তি হতে হতো। ক্লান্তি কন্ঠে আদ্রাফকে বলে……….
.
—–তো কি করবো আমি? তুমি যা শুরু করেছিলে………..
.
—–কি শুরু করেছিলাম?
.
মেহের চুপসে যায়। আদ্রাফ বেশ ভালোমতোই ক্ষেপে আছে। মেহের এবার এক কানে হাত দিয়ে বলে ওঠে…….
.
—–সরি………..খুব ব্যথা লেগেছে?
.
—–একটা পেত্নী কামড় দিয়েছে আমাকে। ব্যাথা লাগাটা কি স্বাভাবিক নয় !
.
মেহের মুখ চুপসে বসে থাকে। আদ্রাফের গোলাপি ঠোঁটদুটো কামড় দেওয়ার কারনে একেবারে লাল হয়ে আছে। মেহের মিনতির সুরে বলে ওঠে………
.
—–সরি বললাম তো। প্রমিজ আর কখনও এমন করবো না।
.
—–শুধু সরি দিয়ে হবে না।
.
—–তাহলে?
.
মেহেরের কথার উত্তর না দিয়ে মেহেরকে ধাক্কা দিয়ে পুনরায় খাটে ফেলে ওর গলায় মুখ গুঁজে আদ্রাফ শুয়ে থাকে। মৃদু গলায় মেহেরকে বলে………..
.
—–আমার রাগ আর ব্যাথা দুটো কমানোর জন্যই বেস্ট ঔষধ আমার মেহু। So এখন আমি এভাবেই ঘুমাসবো। একটু নড়াচড়া হবে তাহলে একটা লম্বা লাভ ডোজ দিবো।
.
আদ্রাফের উন্মুক্ত বুকের সাথে নিজেকে অনুভব করতেই মেহের যেন নীরব হয়ে যায়। যতই আদ্রাফের ওপর রাগ হয়ে যাক না কেন………..এই ছেলের কথার জালিয়ে মেহের নিজেকে অন্যরাজত্বে হারিয়ে ফেলে। আদ্রাফ চোখ বন্ধ করে প্রায় ঘুমের জগতে পা দিয়েছে। নিঃশ্বাস-প্রঃশ্বাসের খেলার সাথে বারবার ওর ওষ্ঠ্যদ্বয় স্পর্শ করতে মেহেরের গলা আর ঘাড় কে। মেহের একপাশে দুর্ল চোখে শার্টটির দিকে তাকায়। অবহেলায় শার্টটি পড়ে আছে খাটের অপর প্রান্তে। মেহের বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে…………
.
——ওই শার্ট ! তুই আদ্রাফের গায়ে থাকতে পারলি না?এত হট বডি দেখে তো আমারই মাথা হাই ভোল্টেজের হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর নিজের উদ্ভট কথা ভেবে নিজেই খুব অবাক হয়ে যায় মেহের। ভারক্রান্ত হওয়ার কারনে মাথার তার যে ওর ছিড়ে গিয়েছে এই নিয়ে সে একশ পার্সেন্ট নিশ্চিত।
.
.
.
.
আজ ভার্সিটর ক্লাস শেষ করে নাদিয়ার সাথে কথা বলতে বলতেই মেহেরের হঠাৎ চোখ যায় ক্যান্টিনের ওই পরিত্যাক্ত টেবিলটার দিকে। শাওন আর ওর বন্ধুরা সবাই আড্ডা মজলিশে মতে আছে সেখানে। সেই দুর্ঘটনার পর আজই শাওনকে প্রথম দেখলো মেহের। যদিও এই কয়েকদিনে চেহারায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তনের কোনো রেশ দেখা যায়নি তবুও মেহেরের মনে হচ্ছে ছেলেটা মানসিকভাবে হয়তো খুবই দুর্বল। মেহের সেদিকে যেতেই নাদিয়া বাধা হয়ে দাঁড়ায়;
.
—-এই মেহের? শাওন ভাইয়ের কাছে যাচ্ছিস কেন ?
.
—–কথা আছে শাওন ভাইয়ের সাথে?
.
—–দেখ মেহের? ইচ্ছাকৃতভাবে বাঘের খাচায় যাচ্ছিস কেন?
.
বিরক্তিসুরে মেহের বলে….—উহ ! বললাম তো কথা আছে।
.
নাদিয়াকে আর কোনো সাফাই না দিয়ে মেহের শাওনের কাছে যায়। হঠাৎ মেহেরকে এভাবে আসতে দেখে শাওনসহ ওর সব বন্ধুরাই অবাক। শাওন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শোভাকে বলে…….
.
——কি রে শোভা? এই মেয়ে কি নিজ থেকে অপমান হওয়ার জন্য আসছে নাকি?
.
শাওনের বিহেভ থেকে নিশা বরাবরই অবাক হচ্ছে। কত নিঁখুত অভিনয়টাই না শাওন করতে পারে। মেহের শাওনের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ওর মুখের ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে…….
.
—–সেদিন আপনি হসপিটালে আমায় দিয়ে আসার পর আর দেখা করতে আসেননি কেন?
.
—–What ?
.
—-বুঝেননা? আপনি আমায় সেদিন বাঁচিয়েছেন আমি তা জানি। তো এসব নাটক কিসের? আপনি সেদিন আমার সাথে দেখা করতে আসেননি কেন?
.
শাওন মেহেরের কথাটা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতে থাকা বাইকের চাবিটা পকেটে গুঁজে মেহেরের কাছে দাঁড়ায় সে। মেহেরের উৎসুক দৃষ্টি বরাবরই শাওনের বিলাই চোখ দুটোর দিকে। শাওন নির্লিপ্ত গলায় বলে ওঠে……..
.
——কে হও তুমি আমার? যে আমি তোমার সাথে দেখা করে আসবো? বলো , কি হও তুমি আমার?
.
শেষের কথাটিতে শাওন বারবার আটকে পড়লেও তা সবাই বুঝতে পারেনি। মেহের ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে শাওনের দিকে। আসলেই তো। শাওন কি হয় ওর যে এত বড় এক্সপেক্টেশন নিয়ে বসে ছিলো ? অদ্ভুভাবেই শাওনকে মেহেরের বড্ড আপন লাগে যদিও শাওন কখনোই এমন কিছু করেনি।
.
শাওন এবার মেহেরের হাত চেপে ধরে। খুবই জোরে। চিল্লিয়ে বলে ওঠে………..
.
——-চেষ্টা করবে আমার থেকে ১০ হাত দূরে থাকতে। খুবই খারাপ মানুষ আমি। তোমাকে বাঁচিয়েছি তোমার হাজবেন্ট thanks বলেছে ব্যস! You may go now!
.
শাওন মেহেরের হাত ছেড়ে দিতেই মেহের নীরবে চলে যায় সেখান থেকে। শাওন নিজের চোখ ফিরিয়ে নেয়। মেহেরকে তার আসল পরিচয় থেকে দূরে রাখতে আর কোনো উপায় ছিলো না। নিশা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে শাওনের দিকে। শাওনের এত চাপা কষ্ট মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। নিশার বিশ্বাস। এমন একদিন আসবে যেদিন শাওনের অগোছালো মনে কারও জন্য স্মিত হাসি থাকবে।
.
.
.
.
.
.
~চলবে
[আয়াতের পায়ের ওপর নিজের পায়ের ভর রেখে আমি মিশে আছি তার বুকের সাথে। সমুদ্রের উদাসীন ঢেউগুলো দুজনের হাটু বরাবর আছড়ে পড়ছে। তার চোখে মুখে আমি দেখতে পারছি একরাশ মুগ্ধতার হাসি। আচ্ছা………..উনি এতো সুন্দর কেন? সাহিত্যিকরা তো বলে সৌন্দর্য নাকি শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য। তাহলে উনি কেন এক পাহাড় সৌন্দর্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
—-কি ভাবছো?
আয়াতের কথা ধ্যান ভাঙ্গে আমার। তার বুকে নিজের মুখ ডুবিয়ে বলে উঠি…..
—-আপনার সৌন্দর্য নিয়ে গবেষণা করছি।আপনার এই সুদর্শন চেহারা দেখে মাঝে মাঝে আমার প্রচুর হিংসে হয়।
আয়াত সশব্দে হেসে ওঠে। তারপর আমার কানে নেশাতুর কন্ঠে বলে ওঠে……..
—-আমাদের বিয়ের পর তোমার সাথে একেবারে মিশে আমার সৌন্দর্য তোমাতে বিলিয়ে দেবো নে। তখন আর হিংসে করতে হবে না। বুঝেছো মাইশু?
আমি তার ফিসফিসানো কন্ঠ শুনে লজ্জায় গুটিয়ে নেই নিজেকে। রাতের আকাশে চলছে শততারার খেলা। দক্ষিণা হাওয়ার সাথে সমুদ্রের ঢেউয়ের স্পর্শে ক্রমাগত মাতোয়ারা হয়ে পড়ছি আমি।
.
‘আরহাম আয়াত”। যেই নামটা শুনলেই মনে সব আজগুবি চিন্তাগুলো আমার কাজ করে। তার প্রতিটা মুহূর্তই আকর্ষণ করেছে আমার হৃদয় ; যার সূচনা হয়েছিলো এই সিন্ধুপাড়ের কাছেই। মাঝে মাঝে তো ভাবি ; ভাগ্যিস সেই দিন পালিয়ে সদরঘাটের লঞ্চে উঠেছিলাম। না উঠলে হয়তো আয়াত নামের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে জীবনে অনুভবই করতে পারতাম না।
.
.
.
চলবে

অনুভূতির সুপ্ত কোণে পর্ব-১৮

0

#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
পর্ব : ১৮
.
বিদীর্ন এই খোলা প‍্রান্তরে শাওন নিশার কাধে মাথা দিয়ে রাখাতে নিশার মনে খেলা করছে কিছু চাঞ্চল্যকর অনুভূতি।শাওনের উষ্ণ নিঃশ্বাস আর হৃদয়ের কম্পন স্পষ্টভাবে সে গুণতে পারছে। শাওন নির্বিকার ভঙ্গিমায় নিশার এক বাহু জড়িয়ে কিছু একটা ভাবতে মগ্ন। কিছুটা আশা নিয়ে সে শাওনকে প্রশ্ন করে…..
.
—-শাওন কিছু বলছিস না কেন? মেহের তোর বোন হয় তুই এত নিশ্চিত কিভাবে?
.
—-DNA test করার পর।
ভ্রু কুচকে ফেলে নিশা। শাওনের কথাটা সে বুঝেছে কিন্ত ঠিক মানতে পারছে না। শাওন চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে রাখাতে নিশা কিছু বলতেও পারছে না। খানিকাটা বিরক্তি চেপেই সে বলে……..
.
—–এমনি চুপ করে আছিস কেন? আর DNA test মানে? তুই DNA test কবে করলি?
.
—–সেদিন হসপিটালে। আমার ব্লাড নেওয়ার সময়ই যখন আমার test করানো হলো তখনই আমি জানতে পারি। দুজনের সেম report দেখে ডাক্তারও বেশ অবাক হয়েছিলো।পরে রাহাতকে দিয়ে মেহেরের অতীত সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি অনেক। বাট ফলাফল জিরো। তবে এতটুকু জানতে পেরেছি যে মেহেরকে এতিমখানা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে যা ওর বর্মান বাবা-মা ছাড়া কেউই জানে নি।
.
—-তুই জানলি কিভাবে?
.
নিশার প্রশ্ন শুনে শাওন নিশার কাধঁ থেকে মাথা উঠিয়ে সশব্দে হেসে ওঠে। নিশা হৃদকম্পন যেন এবার তড়িৎগতিতে ছুটতে শুরু করলো। নির্জন রাতের খোলা প্রান্তরে চাঁদের মায়াবী আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শাওনের স্ফটিক হাসি। শাওনের বাকা হাসিটা যতটাই না সবার মনে ত্রাসের রাজত্ব করে তেমনি সশব্দে বেরিয়ে আসা এই হাসিটাও যেন ফুটিয়ে তোলে এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্য।
.
—–তোর কি মনে হয় নিশা ; শাওন চৌধুরি আমি। আমার ভয়ে সবার কাপাকাপি শুরু হয়ে যায় আর মেহেরের ওই দত্তক বাবা-মা তো আমার কাছে সামান্য কপাটের মতো। আমার Gun বের করতেই গলগল করে সব উপচে দিয়েছে।
.
নিশা নীরব থাকে। শাওনের এসব অভদ্র কাজকর্মগুলো নিশার কাছে অপছন্দ হলেও মুখ ফুটে বলার মতো দুঃসাহস ওর নেই।
.
—–মেহের কি এই সত্যি জানে?
.
—–না । জানে না। আর কখনও জানতেও পারবে না।
.
হাসির তালে কথাটা শাওন উড়িয়ে দিলেও নিশা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে শাওনের মনের চাপা আর্তনাদ।নিশা জানে ; শাওন কখনই ওর কষ্টা মুখ ফুটে কাউকে বলবে না শুধু হিংস্রতার রূপ নিয়ে আড়াল করে রাখবে তার কষ্টগুলো।নিশা আবারও বললো…….
.
—–কেন জানতে পারবে না?
.
—–আমার so called dad হায়াৎ চৌধুরির জন্য।
.
কিঞ্চিত অবাকের রেশ দেখা গিয়েছে নিশার মধ্যে। কেননা শাওনের তাচ্ছিল্যর হাসিটা নিমিষেই যেন রূপ নিয়েছে এক ভয়াবহ রাগে। এই হায়াৎ চৌধুরিকে বরাবরই ঘৃণ্য বস্তু মনে হয় শাওনের কাছে। আজ তার জন্যই তো শাওনের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো।
.
——হায়াৎ চৌধুরি কি করেছে?
.
হাতে থাকা বিয়ারের ক্যানটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয় শাওন। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে…….
.
——রাইতা যে এখনও বেঁচে আছে এটা জানলেই সে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করবে রাইতা আই মিন মেহেরকে খুন করে……..এই ব্যাপারে I am definitely sure………..সামনে এমনিতেও তার ইলেকশন। এখন মেহেরকে না মারলে তো তার কালোকাজগুলো ফাঁস হয়ে যাবে। আর আমি চাইনা যে রাইতা ফিরে আসুক। ওর পরিচয় এখন মেহের আদ্রাফ এহসান। সেই পরিচয়েই ও আজীবন থাকুক। আমার মতো অনিশ্চিত জীবনের মুখে আমি কখনোই ওকে ফেলতে চাইবো না।
এতটুকু বলেই নিজের কন্ঠস্বর মিলিয়ে ফেলে শাওন। আজও সিগারেটের ধূয়ো উড়োতে মন চাচ্ছে এই নিশিআকাশে। তবে এখন সেই পরিস্থিতিটা আর নেই। এর কারন হয়তো বা নিশা। কেননা নিশার কাছে যেই বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগে শাওন সবসময় চেষ্টা করে তা নিশার সামনে না করতে।
.
—–তুই এতো ভালো কেন রে?
.
নিশার স্বতস্ফূর্ত প্রশ্নে শাওন নির্বিকার। তবুও বিবেকের সাথে তালগোল পাকিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে তাকায় নিশার দিকে।
,
.
—-কে বলেছে আমি ভালো? আমি খারাপ ! অনেক খারাপ ! চাঁদাবাজি করি , টিজ করি, ragging করি……….মানুষ সমাজ না বুজে যেখানে সেখানে ড্রিংক-পার্টি-ক্লাব-সিগারেট এগুলো তো আছেই।
.
—–এতেই কি মানুষ খারাপ হয়ে যায়?
.
—–শাওন নিশ্চুপ।
.
—–থাক ! এসব কথা আমি আর বলবো না। আমি শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করবো মেহের কি তবে কখনই ওর সত্যি জানতে পারবে না?
.
—–কখনোই না।
।শাওন আর নিশা দুজনের মধ্যেই এবার পিনপন নীরবতা। একজনের হয়তো চাপা কষ্টের কারনে আর অন্য একজনের হয়তো নিজের আবেগটাকে উজাড় না করে দেওয়ার কারনে। মনেমনে নিশা বলে ওঠে……….
.
—–আমি আজীবন তোর এই কষ্টের ভাগীদার হতে চাই ; শাওন !
.
.
.
.
———————————
.
দেখতে দেখতেই সময় পার হয়ে গিয়েছে। আদ্রাফ আর তনু বেগমের সযত্নে মেহের এখন পুরোপুরি সুস্থ। তাই বিগত দুদিন ধরেই আদ্রাফ অফিসের চাপে ভালোমতো সময় দিতে পারছে না মেহেরকে। মেহেরের চোখ খোলার আগেই সে চলে যায় ; আর রাতেও ফিরে অত্যন্ত দেরি করে।
মেহের মনেমনে একটু বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করে না। তারও দিন কাটে ভার্সিটি টু বাসা আর টিভি দেখে।
.
এখন রাত প্রায় দেড়টা। মেহের মুখ ফুলিয়ে খাটে বসে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করছে । আর আদ্রাফ খাটের অন্যপাশে নিজের পা জোড়া ক্রস করে মেলে তার উপর নিজের ট্যাবে বিজনেস গ্রাফ চেক করছে। মেহেরে তো এবার বিরক্তির চরম সীমান্তে। এত সুন্দর একটা বউ পাশে বসে থাকতে আদ্রাফ এমনভাবে ট্যাব দেখছে যেন ওটাই মনে হয় ওর বউ। মেহেরের তো এবার ওই ট্যাবকে দেখে প্রচুর পরিমাণে হিংসে হচ্ছে।
.
রাগের বশে ফেসবুকের একটা নিউজ দেখে জোরে জোরে বলে ওঠে……..
.
” স্বামী স্ত্রীকে সময় দেয় না দেখে স্ত্রীর হাতে স্বামীর নির্মম মৃত্যু😤”
.
আদ্রাফ চোখ বাকিয়ে তাকায় মেহেরে দিকে। মেহের রাগে ফোঁস ফোঁস করে চলছে। আদ্রাফ মনে মনে ভাবে যে……….”এই মেয়ে কি ওর খুনের পরিকল্পনায় মেতে আছে?’😒’
.
.
.
.
~চলবে
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।