Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1550



ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-২৯+৩০+৩১

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৯

ছোঁয়া অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে নদীর ঘাট থেকে উঠে হাঁটতে লাগল! হঠাৎ কেউ একজন তার সামনে একগুচ্ছ পদ্মফুল ধরল। চোখের সামনে একগুচ্ছ পদ্মফুল দেখে ভীষণ অবাক হলো সে। ফুলের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাতেই আরেক দফা অবাক হলো সে। শিহরণ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাতে একগুচ্ছ পদ্মফুল নিয়ে। এই ভর সন্ধ্যায় পানিতে নেমেছে শিহরণ শুধু তার জন্য; এটা ভাবতেই একটা শীতল স্রোত মেরুদণ্ড দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল। মনজুড়ে একটা অদ্ভুত ভালো লাগার শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। শিহরণের কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল থেকে পানি ঝরে পড়ছে। কিন্তু তার চোখে মুখে এক ধরনের তৃপ্তির রেখা। মিটিমিটি হাসছে সে। উফ! অসহ্য ঠেকছে ছোঁয়ার কাছে। এই হাসিটা কেন যে হাসে ছেলেটা!

‘কী হলো?’ শিহরণ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘এতক্ষণ তো এদের দিকেই তাকিয়ে আক্ষেপ করছিলে মনে মনে। এখন নিচ্ছ না কেন?’

ফুলগুলো হাতের কাছে পেয়ে ছোঁয়ার খুব ভালো লাগছে এই কথাটা যেমন সত্যি। ঠিক তেমনি সে কষ্টও পেয়েছে। কারণ শিহরণ ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। স্কুলে একসাথে কাটানো সময়গুলোতেই গল্প করার সময় এই বিষয়টা জানতে পেরেছিল সে। তারপর একবার বৃষ্টির দিনে নিজের চোখে দেখেছে শিহরণের বেহাল অবস্থা।

স্কুলে থাকাকালীন ছোঁয়া পরপর কয়েক দিন স্কুলে না যাওয়ায় শিহরণ তাকে দেখতে তার বাসায় পৌঁছে যায়। সেদিন দুপুরে ছোঁয়া ঘুমিয়ে ছিল। বাসায়ও কেউ ছিল না। তাই শিহরণ বেল বাজালেও কেউ দরজা খুলেনি। যার কারণে শিহরণ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামল। শিহরণ তবুও দাঁড়িয়েই ছিল বৃষ্টির মধ্যে। সন্ধ্যার দিকে যখন ছোঁয়ার ঘুম ভাঙল তখন সে জানালা দিয়ে তাকাতেই শিহরণকে দেখে ভড়কে গেল। দ্রুত ছাতা মাথায় বেরিয়ে গেল সে।

ছোঁয়া শিহরণকে ধমকে বলল, ‘এই ছেলে! তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কী করছ?’

শিহরণ তখন ঠান্ডায় কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘সেই দুপুর থেকে এইখানে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার বাসার বেল বাজালাম আধাঘন্টা ধরে। তারপর বৃষ্টিতে ভিজেছি আধাঘন্টা যাবৎ। একে তো দরজা খুলোনি। তার উপর আবার আমাকে ধমকাচ্ছ!’

ছোঁয়া ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, ‘তোমাকে আমার বাসার সামনে কে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে? আমি বলেছি?’

‘তুমি বেশ কয়েকদিন স্কুলে যাওনি। তাই আমার খুব টেনশন হচ্ছিল।’ শিহরণ বলল, মৃদু স্বরে ।

‘তো তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে কেন? বাসায় চলে যেতে পারনি?’ ছোঁয়া বলল, শাসন করার ভঙ্গিতে।

‘তোমাকে একবার না দেখে কী করে যেতাম?’ শিহরণ বলল, অদ্ভুত হিম শীতল গলায়।

ছোঁয়ার তখন এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি হলো। সে চোখ বুজে একটা গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। এবার তো আমাকে দেখেছ। এখন বাসায় যাও তাড়াতাড়ি।’

‘তুমি ভীষণ কিপ্টে! তুমি কি জান এটা, ছোঁয়া?’ শিহরণ বলল, অভিযোগের সুরে।

‘আমি আবার কিপ্টেমির কী করলাম?’ বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল ছোঁয়া ।

‘এই যে আমি তোমাকে দেখার জন্য এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর বৃষ্টিতে ভিজলাম। আর তুমি একবারের জন্যও আমাকে তোমার বাসায় যেতে বলছ না। অন্ততপক্ষে এক কাপ কফি বা চা তো অফার করতে পারতে। তাই না?’ শিহরণ হাত নেড়ে নেড়ে বলল, প্রতিবাদের সুরে।

‘বাসায় কেউ নেই এখন। আমি একা। তাই আসতে বলিনি। বুঝতেই পারছ নিশ্চয়ই।’ ছোঁয়া বলল, বিব্রত ভঙ্গিতে।

‘ঠিক আছে। যাচ্ছি। তুমি আসলেই কিপ্টে।’ যেতে যেতে শিহরণ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘বাসায় কেউ নেই। হাহ্! আমি কি তোমাকে খেয়ে ফেলতাম একা ঘরে?’

‘একদম বিড়বিড় করবে না। সোজা বাসায় যাও। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।’ ছোঁয়া বলল, আদেশ দেবার ভঙ্গিতে।

তারপরের তিন দিন পর্যন্ত শিহরণ স্কুলে আসেনি। খবর নিয়ে ছোঁয়া জানতে পেরেছে শিহরণের প্রচণ্ড জ্বর। সুস্থ হবার পরে স্কুলে আসলে তখন ছোঁয়া জানতে পারে শিহরণ একদম ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। ঠান্ডা লাগলে তার ভয়াবহ অবস্থা হয়ে যায় ।

তাই এই মুহুর্তে শিহরণের চিন্তা করে তার ভীষণ খারাপ লাগছে। ছোঁয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘শিহরণ! তুমি এগুলো আনতে পানিতে নেমেছ কেন?’

‘পানিতে না নামলে কি এই ফুলগুলো তোমার সামনে এনে দিতে পারতাম?’ শিহরণ বলল, উৎসাহী গলায়।

‘তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে তো।’ ছোঁয়া ভীষণ চিন্তিত হয়ে গেল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে বলল, ‘দ্রুত চুলগুলো মুছে নাও। কাপড় চেঞ্জ করা লাগবে তোমার। উফ! তুমি যে কীসব করো না মাঝেমধ্যে! আমি তোমাকে একদম বুঝতে পারি না।’

‘আগে ফুলগুলো তো হাতে নাও। নয়তো পানিতে নামার কষ্টটাই মাটি হয়ে যাবে।’ অসহায় মুখ করে বলল, শিহরণ।

শিহরণ কাঁপছে। ছোঁয়ার ভয় লাগতে শুরু করল। সে পুনরায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। কোনোকিছু খুঁজে না পেয়ে সে তার ওড়নার অগ্রভাগ দিয়ে শিহরণের মাথাটা মুছে দিল। এদিক সেদিক তাকিয়ে তার কাপড়ের সন্ধান করতেই দেখল নদীর কাছে ঘাসের উপরে রাখা। ছোঁয়া দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে তার শার্টটা নিয়ে শিহরণের দিকে এগিয়ে দিল। শিহরণ অধৈর্য গলায় বলল, ‘এবার তো ফুলগুলো হাতে নাও। নয়তো আমি এক হাতে শার্টটা পরব কী করে?’

ছোঁয়া ফুলগুলো নিজের হাতে নিল। তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘থ্যাংক্স। বাট নো থ্যাংক্স।’

শিহরণ শার্ট পরে নিল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আরাভ ঠিক বলছিল। এবার বুঝতে পারলাম।’

‘কী বলছে পিচ্চিটা?’ উৎফুল্ল গলায় জানতে চাইল, ছোঁয়া।

‘সিক্রেট। তোমাকে বলা যাবে না। আর তুমি যাকে পিচ্চি বলছ! সে তো তোমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে। আর তুমিও বোধহয় দেখছ। তার দেয়া গোলাপের মধ্যেই তো ডুবে আছ।’ শিহরণ ব্যথিত কণ্ঠে বলল, ‘এত কষ্ট করে নদীর মাঝখান থেকে আমার আনা ফুলগুলো তো তোমার কোনো এটেনশনই পাচ্ছে না।’

ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এখন আর এত কথা বলতে হবে না। তোমাকে দ্রুত এখান থেকে বাসায় পৌঁছাতে হবে। নয়তো তোমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।’

‘তোমাকে বলেছে! আমার অবস্থা খারাপ হবে না। হলে এমন কী-ই-বা হবে বলো তো? তিন চার দিন জ্বর থাকবে এই তো? থাকুক। সমস্যা কী ? আমার কাছে আমার ওষুধ আছে। তোমার আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না।’ ছোঁয়াকে খোঁচা দিতে বলল, ‘তুমি বরং তোমার আরাভকে নিয়ে ভাবতে থাক।’

‘ঠিক আছে ভাবব। আপাতত আমার সব ভাবনা তোমাকে নিয়ে।’ ছোঁয়া বলল, দ্বিধাহীন চিত্তে।

‘আমাকে নিয়ে কবে থেকে ভাবছ আবার?’

‘আমার জন্য পদ্মফুল এনেছ। তাই তোমার সুস্থতা নিয়ে আমাকেই তো ভাবতে হবে। তাই না? আমি চাই না তুমি আমার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ো।’ ছোঁয়া বলল, চিন্তিত সুরে।

‘এবার বুঝেছি।’ মলিন কণ্ঠে বলল শিহরণ, ‘দায় সারতে চাইছ। ওকে, নো প্রবলেম। গেট ইন দ্যা কার।’

‘এত্ত অভিমান কীসের?’

‘আমার তো কোনো অভিমান নেই। অভিমান তো তার থাকে যার অভিমান ভাঙানোর মানুষ থাকে। আমি অভিমান করলে তো আর কারও কোনো কিছু যাই আসে না। তাই না?’

‘এত প্যাঁচাও কেন তুমি? আর এত কথা বাড়াচ্ছ। তোমার শরীরের তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে তো। প্লিজ, শিহরণ তাড়াতাড়ি বাসায় চলো।’

শিহরণের হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তাই সে আর কোনো কথা বলল না। সোজা ড্রাইভ করে প্রথমে ছোঁয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় চলে গেল। যাবার সময় ছোঁয়া বলল, ‘দ্রুত কাপড় পাল্টে নিবে। আর নিজের খেয়াল রাখবে। আমি কল করব তোমাকে। ঠিক আছ?’

শিহরণ জবাবে কিছু বলেনি। তাই ছোঁয়ার মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেল। সে ভাবল, ‘এই ছেলের মুড বুঝা বড়ো দায়। একদম বুঝতে পারি না এই ছেলেটাকে আমি। কখনও মনে হয় ওর মতো আপন আর কেউ নেই আবার কখনও মনে হয় তাকে আমি চিনিই না।’

__________________

ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্ট বসে আছে বহ্নি । এসেছে প্রায় পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল। এরই মধ্যে দু’কাপ কফি শেষ করে ফেলেছে। অথচ অতল এখনও আসছে না । বহ্নি বারবার ঘড়ি দেখছে। আধাঘন্টা অতিক্রম হতেই সে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা ঠেলে চশমা পরা ছেলেটাকে ভেতরে ঢুকতে দেখল বহ্নি। ডার্ক ব্লু কালারের টিশার্ট সাথে ব্ল্যাক প্যান্ট পরেছে। চোখ দুটো বিষণ্ণ। সিল্কি চুলগুলোর কিছু কপালের উপর পড়ে আছে অবহেলায়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঠিকমতো ঘুমায় না। তবে এসব তার সৌন্দর্য কমাতে সক্ষম হয়নি।

অতলের মনটা এখন প্রায় খারাপ থাকে। সে শুধুমাত্র ভালো থাকার অভিনয় করে বেড়ায়। কোথাও শান্তি পায় না সে। দুদিন ধরে ফোন অফ রেখেছিল। খুলতেই বহ্নির মেসেজ দেখতে পায়। তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। দিশেহারা ভাবটা কাটাতে সে ভাবল–একবার দেখা করেই ফেলবে।

অতল বহ্নির সামনে এসে দাঁড়িয়েই হেসে বলল, ‘চলে যাচ্ছিলি? আমার উপর বিরক্ত হয়েছিস নিশ্চয়ই?’

বহ্নি চশমার আড়ালে থাকা ওই চোখদুটোতে ডুব দিয়েছিল। অতলের প্রশ্নে ফিরে এলো ধরণীতে। মৃদু হেসে বলল, ‘আমি ভেবেছি তুমি আসবে না। তাই চলে যাচ্ছিলাম।’

‘প্রচণ্ড জ্যাম! জ্যামের কারণেই দেরি হয়েছে।’ একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, ‘কিছু অর্ডার করেছিস? ও হ্যাঁ, শুধু কফি। দু’কাপ শেষ করে ফেলেছিস! আচ্ছা, এবার আমি অর্ডার করছি। কি খাবি বল?’

‘আমি কিছু খাব না। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। তাই দেখা করতে বলেছিলাম।’

বহ্নির কথা শুনে অতল অদ্ভুতভাবে হাসল। বলল, ‘আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তোর! আচ্ছা আজ তোর সব কথা শুনব। আগে অর্ডার করি কিছু একটা।’

অতল ওয়েটারকে ডেকে চাওমিন, একটা বার্গার আর দুটো কফি অর্ডার করল। বহ্নি বলল, ‘অতল ভাইয়া! এতকিছু কিসের জন্য? আমি অলরেডি দু’কাপ কফি শেষ করেছি। আর এখন খিদে নেই।’

‘কফি তো তুই একা খেয়েছিস। আমার সাথে তো খাসনি। আমার সাথে না খেলে তো হবে না। আর চাওমিন তোর খুব প্রিয় তাই অর্ডার করেছি।’ পরক্ষণেই সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘এখন কি ভালো লাগে না?’

‘তুমি এখনও মনে রেখেছ আমার পছন্দের খাবারের নাম?’ বহ্নি বলল, কণ্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে।

‘কিছুই ভুলিনি এখনও। সবকিছু মনে আছে। তাই কষ্টটা খুব বেশি অনুভব করি এখনও।’ বিমর্ষ কণ্ঠে বলল, অতল।

‘এসব মনে কেন রেখেছ এখনও। ছোটোখাটো ভুলের শাস্তি কি সারাটা জীবন ধরে বয়ে বেড়াবে? এটা তো ভারি অন্যায়। সব ভুলে যেতে পারো না তুমি? সবকিছু ভুলে নতুন করে আবারও তোমাদের বন্ধুত্ব শুরু করতে পারো তো। তাই না? এটা করলে তোমার নিজেরই ভালো লাগবে। কষ্ট কমে যাবে।’ বহ্নি বলল, বিজ্ঞের মতো করে।

‘কষ্টটা এমন কারও কাছ থেকে পেয়েছি যা আমি চাইলেও ভুলতে পারি না। চেষ্টা করেও পারিনি। আর হয়তো কখনোই পারব না।’ অতল বলল, বিষণ্ণ কণ্ঠে।

‘আমি যদি বলি, তুমি চেষ্টা করোনি।’ বহ্নি বলল, অভিযোগের সুরে।

অতল প্রশস্ত হাসল। হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি ভুলে গিয়েছি যে আমি শিহরণের বোনের সাথে কথা বলছি। যার ভাই আমাকে ধোঁকা দিয়েছিল। প্রথমে আমাকে অবিশ্বাস করেছে তারপর আমাকে ধোঁকা দিয়েছিল।’

‘কিরকম ধোঁকার কথা বলছ তুমি? শিহরণ ভাইয়া এরকম কখনোই করতে পারে না। আমি আমার ভাইকে ভালোভাবে চিনি। জানি এবং বিশ্বাস করি সে কখনোই জেনে বুঝে কাউকে কষ্ট দিতে পারে না।’ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, বহ্নি।

‘ধোঁকার কথা শুনতে চাস তুই? সহ্য করতে পারবে তো?’ অতল বলল, ক্রোধান্বিত হয়ে।

‘তুমি বলেই দেখ না।’

এর মধ্যেই ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল। অতল বলল, ‘আগে খাবার শেষ কর। তারপর বলছি।’

বহ্নি বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘বলেছি তো খিদে নেই। খাব না এখন।’

অতল দৃঢ় গলায় বলল, ‘আগে খেতে হবে। নয়তো বলব না।’

বহ্নি পরাস্ত হয়ে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

অতল বার্গার শেষ করে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তুই যখন এতো করে জানতে চাইছিস তখন আজ তোকে বলেই ফেলি।’ বার কয়েক গভীর নিঃশ্বাস নিল সে। তারপর বলতে শুরু করল, ‘তুই নিশ্চয়ই জানিস আমি ছোঁয়াকে ভালোবাসতাম। এই কথাটা শিহরণও খুব ভালো করে জানত। শুধু শিহরণ কেন স্কুলের সবাই জানত এই কথাটা। তারপরেও শিহরণ আমি যাকে ভালোবাসি তার দিকে হাত বাড়াল। এটা কি সে অন্যায় করেনি? এটা কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়? সবকিছু জেনে বুঝেও শিহরণ ছোঁয়ার সাথে গোপনে দেখা করত, কথা বলত। অথচ আমি এর কিছুই জানতাম না। সবকিছু আমার অগোচরে হতে থাকল। আমি বোকার মতো অপেক্ষা করছিলাম, ছোঁয়ার ভালোবাসা পাবার আশায়। অথচ, আমার ভালোবাসা তো আমার বন্ধুই কেড়ে নিল আমার কাছ থেকে। যেই বন্ধুকে আমি নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসতাম তার কাছ থেকে পাওয়া এই আঘাতটা আমি সহ্য করতে পারিনি। ভেতর থেকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছিলাম।’

অতল টেবিলের উপর রাখা পানির বোতলটা খুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিল। তারপর বলল, ‘এবার বল সব দোষ কি আমার?’

বহ্নি স্তব্ধ, হতভম্ব, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে অতলের দিকে। অতলের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। বহ্নির দিকে তাকিয়ে অতল বিদ্রুপাত্মক হেসে বলল, ‘কিছু বলার নেই তোর? ভাইয়ের দোষ সম্পর্কে জানতে পেরেই কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল তোর? না-কি এখানেও আমারই দোষ খুঁজে পাচ্ছিস?’

বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। সে বলল, ‘এখনও ছোঁয়া আপুকেই ভালোবাস?’

অতল ঝট করে তাকাল বহ্নির দিকে। এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। নিজের মনের মধ্যে এক ধরনের জটিলতা খুঁজে পেল সে। বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে অতলকে। প্রসঙ্গ পাল্টে বহ্নি বলল, ‘শুধু শিহরণ ভাইয়ার দোষ ছিল না। তোমারও দোষ ছিল। ভাইয়া তোমার সাথে কতোবার দেখা করতে গিয়েছে, তার কি কোনো হিসেব আছে? তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, দেখা পর্যন্ত করোনি! ভাইয়া এই একটা কারণে কতো কষ্ট পেয়েছে তুমি কি জানো? জানো না। জানতে চাওনি তুমি। তুমি শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। মাঝেমধ্যে নিজের কষ্ট ভুলে অন্যের কষ্টের দিকেও তাকাতে হয়। নয়তো কখনোই জানতে পারবে না পৃথিবীতে শুধু তুমিই দুঃখী নও আরও অনেকেই দুঃখী আছে। নিজের কষ্টকে সবসময় বড়ো করে দেখলে তুমি কখনও জীবনে আনন্দের ছোঁয়া পাবে না।’

বহ্নি খানিক থামল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘ছোঁয়া আপুকে ভাইয়ার ভালোবাসার বিষয়টা ইচ্ছাকৃত ছিল না। এই বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত। মনের উপর কি কারো হাত থাকে? না-কি কোনো জোর চলে? তারপরেও আমি এই বিষয়টার কোনো ব্যাখ্যা দেব না। আমি চাই এটা তোমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নাও। কারণ কিছু বিষয় আছে যা শুধু ভাইয়া আর তুমি জানো। ওই বিষয়গুলো নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’

‘বড়ো হয়ে গিয়েছিস। সত্যিই তো সেই ছোট্ট বহ্নি এখন আর ছোটো নেই।’ অতল যেন স্বগতোক্তি করল।

বহ্নি বলল, ‘আমি কি সারাজীবন ছোটোই থেকে যাব ভেবেছিলে?’

অতল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি জানতাম তুই তোর ভাইয়ের পক্ষেই কথা বলবি। আমি কে যে তুই আমার পক্ষ নিবি? আমি তো কেউ না। আমার কষ্টে কেউ কষ্ট পায় না। আমার কথা কেউ ভাবে না। আমি আসলে বড্ড একা। এখনও অবধি আমি একা।’

বহ্নি অতলের হাতের উপর নিজের হাতটা রাখল। অতল তার হাতের উপর রাখা বহ্নির হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ তারপর তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। বহ্নির চোখের দেয়ালে জলের উপস্থিতি অতলের চোখ এড়াল না। ছলছল চোখে বহ্নি বলল, ‘মনে রেখো তোমার কষ্টে কেউ একজন গভীরভাবে আঘাত পায়। খুব গভীরভাবে! তুমি হয়তো তার কথা কখনোই জানতে পারবে না। হয়তো তুমি বুঝতে চাও না। তবুও মনে রেখ সে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।’

এটুকু বলেই বহ্নি দ্রুত পায়ে হেঁটে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। অতল বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল তার যাওয়ার পানে। বহ্নির বলা কথা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। কেউ একজন তাকে ভালোবাসে! কে সে! পরক্ষণেই অতল এই চিন্তা মাথা থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলল। চোখের চশমাটা ঠিক করে নিজের মধ্যে জাগ্রত হওয়া সমস্ত আবেগ ঝেড়ে ফেলল সে। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। তৃণার নাম্বার থেকে অসংখ্য মিসড কল এসেছে। সাথে সাথেই তৃণাকে কল ব্যাক করল। বলল, ‘সুইটহার্ট! আমার সাথে এক্ষুণি দেখা করো।’

__________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩০

অপেক্ষার প্রহর বড্ড যন্ত্রণার!
জ্বলে পুড়ে ছারখার হয় হৃদয় প্রান্তর।
আর ভগ্ন হৃদয়!
সে তো দহনের পর দহনে ছাই হয়ে যায়।
অস্তিত্বহীনতা গ্রাস করে ফেলে মুহূর্তেই।

অতল অধীর আগ্রহে তৃণার জন্য অপেক্ষা করছিল।
বহ্নি ওভাবে চলে যাবার পর এক নিগূঢ় বিষণ্ণতা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে। তার জীবনের সমস্ত কষ্ট আর অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাগুলো চাপা আর্তনাদ স্বরূপ হাহাকার হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। বুকের মধ্যে পাহাড় সদৃশ স্তুপাকারে জমান চাপা কষ্টগুলো ফের বেড়ে গিয়ে তার সমস্ত সত্তাকে অস্থির করে দিচ্ছিল। এমন বিবশ অবস্থায় একটা মুখোশের বড্ড প্রয়োজন হলো তার। তাই সে মুহূর্তেই কেয়ারলেস নামক একটা মুখোশের আড়ালে থাকা অতলে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এমন নিগূঢ় কষ্টে আচ্ছন্ন থাকার চেয়ে ভালো থাকার অভিনয় করাটা তার কাছে ঢের ভালো মনে হলো। তাই তার গার্লফ্রেন্ড তৃণাকে কল করল সাথে সাথেই। অনেকদিন যাবৎ সে তৃণাকে এভয়েড করছিল। বহ্নির সাথে দেখা হবার পর থেকেই এক ধরনের অদ্ভুত আবেগের বশবর্তী হয়ে পড়েছিল সে। যার দরুণ সে তার তথাকথিত প্রেম চালাতে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছিল। এমনটা কেন হলো–জানে না অতল! সে তা জানতে চায়ও না। কিছু প্রশ্ন সারাজীবন প্রশ্নই থেকে যায়।

কিন্তু এখন তার মনে হলো, সে ভুল করেছে। ক্ষণিকের তরে আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়ে সে বড্ড বেশি ভুল করে ফেলেছে। এই ফেইক রিলেশনশিপ তাকে তার কষ্ট ভুলে থাকতে একটু হলেও সাহায্য করে। এসব আকাশ পাতাল ভাবনা-চিন্তা আর ভেতর থেকে বের হওয়া অসংখ্য চাপা আর্তনাদ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নিজেকে শান্ত করতে বার কয়েক লম্বা শ্বাস নিল সে। তারপর টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে সবটা পানি খেয়ে নিল। তবুও যেন তৃষ্ণা মিটছে না। অতলের মনে হলো, সে বড়োই তৃষ্ণার্ত। সে তৃষ্ণার্ত; সেই ছোটোবেলা থেকেই। আর সেই তৃষ্ণা হলো ভালোবাসার তৃষ্ণা। মনে মনে সে ভালোবাসার কাঙাল। একটু ভালোবাসা চায় সবার কাছে। অথচ ভালোবাসা অধরাই রয়ে যায়।

মানুষ যা চায় তা পায় না আর যা পায় তা চায় না! চাওয়া ও পাওয়ার এই সমন্বয়হীনতা জীবনের সুখ কিংবা দুঃখের মাত্রা নির্ধারণ করে। এই দুইয়ের ব্যবধান যতই বাড়বে, দুঃখ ততই বাড়বে। আবার ব্যবধান যত কম হবে দুঃখও তত কম হবে।

অতল চোখ দুটো বুজে বিড়বিড় করে বলল, ‘কবে ঘুচবে এই ব্যবধান! কবে ঘুচবে এই যোজন যোজন দূরত্ব? কবে?’

বিকেলের রোদ মরে এসেছ। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে পশ্চিশ দিগন্তে। রেস্টুরেন্টে এখন বেশ কিছু মানুষ প্রবেশ করছে। অতল কোনো কারণ ছাড়াই এদিক সেদিক তাকাল বার কয়েক। অধিকাংশই প্রেমিক যুগল। ভীষণ অবাক লাগতে শুরু করল তার। তার জীবনে সে যাকে চাইল তাকে পেল না। ছোঁয়া! তার জীবনের সবচাইতে অধিক আকাঙ্ক্ষিত! তার সাথে সে আত্মার বাঁধনে বাঁধা পড়তে পারল না। সে তো আত্মার বন্ধনই চেয়েছিল। কিছুই হলো না! ফলস্বরূপ কিছু অপ্রয়োজনীয় সম্পর্ক করে বেড়িয়েছে সে। কিন্তু কারো সাথেই মনের মিল হয়নি। টেবিলের উপর দু’হাতের কনুই রেখে মাথাটা চেপে ধরল সে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চারদিকে শান্ত দৃষ্টিতে চোখ বুলাল। ঠিক তখনই তার চোখ গেল রেস্টুরেন্টের কোণায় বসে থাকা এক যুগলের দিকে। অতল নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। বাবা তো দিন-রাত এই মানুষটার উদাহরণই দেয়। অতল কোনোকিছু না ভেবেই প্যান্টের পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে ঝটপট একটা নাম্বার ডায়াল করল। পরপর তিনবার কলটা কেটে দেওয়া হলো। অতল আবারও কল দিল।

নীলাভ্র অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বসে আছে আফরিনের সামনে। আফরিন ঝাঁঝাল গলায় বলল, ‘এখন মাথা নিচু করে আছ কেন?’

নীলাভ্র নিরুত্তর। আফরিন তাতে আরও বেশি তেতে উঠে বলল, ‘কী হচ্ছে? তুমি এরকম মাথা নিচু করে আছ কেন?’

নীলাভ্র মাথাটা তুলল। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল, ‘জান! প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। আমার আব্বুটা খুব রাগী! অতিরিক্ত বদমেজাজী যাকে বলে। আমি আসলে আব্বুর সাথে কীভাবে কথা শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না।’

‘তার মানে তুমি আমাদের ব্যাপারটা তোমার বাসায় জানাবে না?’ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল আফরিন।

নীলাভ্র আফরিনের হাতের উপরে নিজের হাতটা রেখে তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘অবশ্যই বলব। আমাকে আর কিছুটা সময় দাও, প্লিজ।’

আফরিনের মেজাজ বিগড়ে গেল। প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে সে বলল, ‘তোমার আর কতো সময় লাগবে বলো? আমি বরং আম্মুর পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে ফেলি। এটাই সমাধান।’

‘না।’ চাপা আর্তনাদ করে উঠল নীলাভ্র। আফরিনের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘প্লিজ, আফরু! এরকম কথা বলো না। আমি তোমাকে ছাড়া একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। আমি যেভাবেই হোক বাসায় ম্যানেজ করব। কথা দিচ্ছি তোমকে।’

আফরিন নিভল। তবে তার রাগ এখনও পুরোপুরি পড়েনি। সে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় নিলাভ্রের মোবাইলটা বেজে উঠল। এমন সময়ে কল আসাতে নীলাভ্রের মাথায় যেন আগুন ধরে গেছে। সে কলটা কেটে দিয়ে পুনরায় আফরিনের দিকে মনোযোগ দিল। কিন্তু বারবার কল আসাতে শেষমেশ প্রচণ্ড অনীহা নিয়ে মোবাইলটা রিসিভ করে ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘কল কেটে দিচ্ছি তারপরেও বারবার কল করছিস কেন?’

‘তুমি এখন কোথায় ভাইয়া?’ হিম শীতল গলায় প্রশ্ন করল অতল।

‘আমি যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছি।’ দাঁতে দাঁত চেপে নীলাভ্র বলল, ‘তোর সমস্যা কী বল?’

‘আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু জানতে চাইছি তুমি এখন কোথায়?’ নির্বিকার ভঙ্গিতে পুনরায় প্রশ্ন করল, অতল।

‘আমি যেখানেই থাকি না কেন তোকে জানতে হবে কেন?’ নীলাভ্র তিক্ত গলায় বলল।

‘আসলে একটা রেস্টুরেন্টে ঠিক তোমার মতো এক জনকে দেখছি তো তাই জানতে চাইলাম।’ অতল বলল, অনুযোগের সুরে।

নীলাভ্র এপাশ ওপাশ ঘুরে ঘুরে দেখল প্রথমে। অতল ততক্ষণে সরে গেল তার জায়গা থেকে। রেস্টুরেন্ট কোথাও অতলকে দেখতে না পেয়ে নীলাভ্র একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ক্রোধিত কণ্ঠে বলল,
‘আমি অফিসে এখন। আর তোর মাথা কি ঠিক আছে?’

‘তুমি ব্যাংক বাদ দিয়ে কবে থেকে রেস্টুরেন্ট কাজ করা শুরু করে দিয়েছ?’ ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে প্রশ্ন করল, অতল।

আফরিন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এই মোবাইল রাখ তো। কার কাছে এত কৈফিয়ত দিচ্ছ?’

আফরিনের কথা শুনে নীলাভ্র কলটা কেটে দিল। তারপর বলল, ‘একটা বাজে ছেলে কল করেছে। যে আমার বাড়িতে থেকে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছে।’

‘তাহলে এটাই কি তোমার অফিস? টেবিলের উপর হাত দিয়ে টোকা মেরে বলল, অতল।

নীলাভ্র অতলকে নিজের সামনে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আফরিন অবাক হয়ে দেখল উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকা চমশা পরা ছেলেটাকে। কী হচ্ছে তা সে বুঝতে না পেরে বলল, ‘নীলাভ্র! এটা কে?’

আতিক বলল, ‘কেউ না আফরিন! ও আমার কেউ হয় না।’

অতল ভারি অবাক হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘এই হলে আসল তুমি। নিজে প্রেম করে বেড়াও অথচ আমি করলেই দোষ!’ অতলের কণ্ঠে রাগ উপচে পড়ছে, ‘বাবার সামনে সাধু সেজে আমাকে সবসময় বকা খাওয়াও। আজ বাবাকে আমি এই বিষয়টা জানাবই।’

নীলাভ্র মারমুখো হয়ে বলল, ‘যা খুশি বল গিয়ে। তোর কথা কে বিশ্বাস করে আমি দেখব। যত্তসব আজাইরা কাজকর্ম করে বেড়াস!’ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নীলাভ্র আবারও বলল, ‘এই তুই কি আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছিস? সবসময় আমি কোথায় এটা কেন তোর জানা লাগে?’

অতল আর নীলাভ্রের এমন চিৎকার চেঁচামেচিতে রেস্টুরেন্টের সবাই ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সবার মধ্যেই এক চাপা কৌতূহল বিরাজ করছে।

‘তুমি তো বাবার সাধু ছেলে।’ অতল ব্যঙ্গ করে চেঁচিয়ে বলল, ‘ওপস্! আদর্শ ছেলে! তাই আদর্শ ছেলেটা যখন
লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে বেড়ায় অথচ বাসায় মিথ্যে কথা বলে আদর্শ সাজার চেষ্টা করে তখন একটু অবাক তো হতেই হয়। তাই না?’

ততক্ষণে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার এসে তাদের থামতে বলল। অতল আর দাঁড়াল না। হনহন করে হেঁটে বেড়িয়ে গেল।
_________________________________

বাসায় পৌঁছে ছোঁয়া শিহরণের দেওয়া ফুলগুলো বিছানার উপর রাখল। গোলাপটা ফ্লাওয়ার ভাজে রেখে এক ফাঁকে শাওয়ার সেরে নিল। তারপর ভেজা চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে বেঁধে শিহরণের দেওয়া পদ্মফুল হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে রইল সে। যেন ফুলগুলোর সমস্তটা জুড়ে শিহরণের অস্তিত্ব অনুভব করছে সে। ফুলগুলোকে নিজের মুখে স্পর্শ করাল। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে তার মন ছেঁয়ে গেল। হিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছোঁয়ার রুমে ঢুকল। ছোঁয়াকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে সে অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘এই ফুলগুলোর মধ্যে এমন কী আছে? এমনভাবে মগ্ন হয়ে কী দেখছ?’

ছোঁয়া তখনও মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে আছে এক নজরে ফুলগুলোর দিকে। হিয়া ওর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ফুলগুলো কে দিয়েছে বলো তো?’

ছোঁয়া উঠে দাঁড়াল। আবার বসে পড়ল। আমতা আমতা করে বলল, ‘কেন ? তোর লাগছে কেন?’

‘ফুলগুলো নিশ্চয়ই স্পেশাল কেউ দিয়েছে। নয়তো এতটা মন্ত্রমুগ্ধ তো তুমি হতে না। আমি সেই স্পেশাল মানুষটার নাম জানতে চাই।’ হিয়া ছোঁয়ার পাশে বসে বলল।

ছোঁয়া বিছানা থেকে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। হিয়াও তার পেছন পেছন গেল। বলল, ‘তুমি বলতে না চাইলেও আমি কিন্তু ধারণা করতে পারছি এই ফুলগুলো কে দিতে পারে।’

‘কে? কে দিয়েছে বল?’ ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল ছোঁয়া।

‘আমি জানি এটা শিহরণ ভাইয়া দিয়েছে। কি ঠিক বললাম তো?’

ছোঁয়া নিরুত্তর। হিয়া ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই। আমি জানি সব।’

‘মানে? কী জানিস?’

‘এই যে তুমি শিহরণ ভাইয়াকে পছন্দ কর।’

‘একদম না। ভুল জানিস। এই ফুলগুলো আমার খুব পছন্দের তাই দেখছি।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। মেনে নিলাম। তবে আমি জানি তুমি বাইরে থেকে যতই অস্বীকার করো না কেন ভেতর থেকে তুমি স্বীকার করো যে, তুমি শিহরণ ভাইয়াকেই উচ্চতর পর্যায়ের পছন্দ করো।’

‘উচ্চতর পছন্দ আবার কি?’

‘ভালোবাসা যাকে বলে।’

‘উঁহু! একদম না।’ ছোঁয়া বলল, বিব্রত ভঙ্গিতে।

‘হু! একদম।’ হিয়া বলল, আমুদে কণ্ঠে।

________________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩১

ভেবেছিলাম একদিন তুমি আমি মিলে একাকার হব;
দু’টো হৃদয় একসাথে একীভূত হয়ে বাঁধা পড়বে।

ভালোবাসা পুঞ্জীভূত হয়ে এক অন্যরকম অনুভূতির পাহাড় হবে।
সেই পাহাড়েই বানাব ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষিত আলয়।

হৃদয় থেকে হৃদয়ে পৌঁছুবে ভালোবাসার শিহরণ;
হৃদয়ের গহীনে জমান অনুভূতির আবেশ ছড়িয়ে দেব তোমার দেহ মনে।

আমার অনুভূতিকে না বোঝার শাস্তি স্বরূপ-
ভালোবাসা নামক অনলের দহনে পোড়াব তোমায়।

তবুও তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখি–তোমায় নিয়েই ভাবি,
কোনো এক পূর্ণিমার রাতে তোমার কাঁধে মাথা রেখে,
রাতের আকাশ দেখব আর গুণব লক্ষ কোটি তারা,
চোরাচোখে দেখব তোমায় পূর্ণিমার চাঁদের রূপালি আলোয়,
আর মাখব গায়ে সেই রুপালি আলোর স্পর্শ।

অবশেষে তোমায় বলব কানে কানে, চুপটি করে,
ভালোবাসি যতখানি-অনুভব করি তার চাইতেও বেশি।

অথচ দেখই না আজ তুমি নির্বিকার, বড্ড অবুঝ।
পরিশেষে আবারও সত্য অনুধাবন করলাম তুমি নও বরং আমিই অবুঝ।

ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা সম্মোহন করবে তোমায়,
হবে তুমি মন্ত্রমুগ্ধ–হবে তুমি কেবল আমাতেই নিঃশেষ।

অবশেষে বুঝলাম আমার ভালোবাসায় নেই কোনো সম্মোহন,
তাইতো মোহাবিষ্ট হওনি তুমি–কেবল আমিই ছিলাম মোহাবিষ্ট তোমার প্রতি।

ভালোবাসা নামক দহনে পুড়ছে হৃদয়–ভাঙছে প্রাচীর;
সেই ধ্বংসাত্মক শব্দ কি তোমার কর্ণকুহরে পৌঁছায়?

‘কী রে! টুন, মুন? আমাকে একদম ভুলে গেছিস?’ বহ্নি চড়ুই পাখি দুটোকে উদ্দেশ্য করে বলল। পাখি দু’টো কী বুঝল কে জানে ডেকে উঠল তারস্বরে। বহ্নি হাসল। নিষ্প্রাণ সেই হাসি! চোখের দেয়াল তখন বর্ষার অথৈ জলে নিমজ্জিত। বহ্নি বাঁধ তৈরী করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তবুও চোখের কোণে জমেছে অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত দু’ফোঁটা অশ্রুকণা।

বিষণ্ণ কণ্ঠে বহ্নি পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘কবিতাটা ভালো লেগেছে তোদের?’ ঠোঁট উল্টে আদুরে ভঙ্গিতে বলল, ‘একটু বেশি বিষাদময় হয়ে গেছে। তাই না?’

পাখি দুটো আবারও ডেকে উঠল। বহ্নি বলল, ‘কই আজ তো একটা শব্দও করিসনি, আমি কবিতা আবৃত্তি করার সময়।’ এবার পাখি দুটো নীরব। বহ্নি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘বুঝেছি তোদের ভালো লাগেনি। কষ্ট পেয়েছিস। তাই না?’

এবার পাখি দুটো এদিক সেদিক তাকাল। বহ্নি এবার মলিন হাসল। দরদমাখা কণ্ঠে হঠাৎ সে বলল, ‘কেন হলো আমার সাথে বল তো? কেন?’

অন্ধকার জেঁকে বসেছে তখন পুরো ছাদ জুড়ে। গাছের ঝোপঝাড়েও অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসেছে। সোডিয়াম লাইটের আবছা আলোতে সমস্ত প্রকৃতি যেন নির্জীব হয়ে পড়েছে। সমস্ত কিছুই নিষ্প্রাণ আর নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে তার কাছে।

‘কী করছে আমার বার্বি ডলটা?’ শিহরণ প্রশ্ন করল বহ্নির ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে।

বহ্নি সতর্ক হয়ে গেল মুহূর্তেই। নিজের চেহারার সমস্ত বিষণ্ণতা লুকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে তাকাল শিহরণের দিকে। সহস্যে বলল, ‘টুন আর মুনের খবর নিচ্ছিলাম।’

বহ্নির চেহারা দেখে শিহরণের বুকটা ধ্বক করে উঠল।
সে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তাই? কোনো কারণে তোর মন খারাপ নয়তো?’

‘আমার! আমার কেন মন খারাপ হতে যাবে?’ প্রশস্ত হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে পাল্টা প্রশ্ন করল বহ্নি ।

এবার গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল শিহরণ, ‘তুই কি কিছু লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে?’ বহ্নির গালে হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘তোর মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন? তোর মন খারাপ কেন বল তো? আর তুই কাঁদছিলি কেন?’ শিহরণ সাবধানী গলায় বলল, ‘খবরদার! আমার কাছে কিছু লুকানোর চেষ্টা করবি না।’

বহ্নি এবার শিহরণের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘ভাইয়া! তুমি কি ছোঁয়া আপুকে এখনও ভালোবাস?’

শিহরণ থমকাল হঠাৎ বহ্নির মুখে এমন প্রশ্ন শুনে। স্তব্ধতা যেন ওকে ঘিরে ধরল হঠাৎ করেই। বহ্নি আবারও প্রশ্ন করল, ‘কী হলো, ভাইয়া? বলছ না কেন?’

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’ ভারি অবাক হয়ে জানতে চাইল শিহরণ।

‘উত্তর জানতে চেয়েছি। প্রশ্ন শুনতে চাইনি।’ দৃঢ়তার সাথে বলল বহ্নি, ‘ছোঁয়া আপু তো আমাদের অফিসে তোমার সঙ্গেই কাজ করে। তাই জানতে চাইলাম।’

শিহরণ ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘হুম।’

‘আপুকে জানিয়েছ?’

শিহরণ বহ্নির প্রশ্নটা শুনে তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ছাদের মাঝবরাবর রাখা টেবিলের দিকে নিয়ে আসল। তারপর দু’জন দু’টো চেয়ারে বসল। শিহরণ বহ্নির হাত ধরে বলল, ‘কাপকেক! তোকে আজকে কিছু কথা বলব। মন দিয়ে শুনবি। তুই আজকে যখন এই প্রশ্নটা করেছিস তখন আমার মনে হচ্ছে কিছু বিষয় তোকে জানান উচিত।’

বহ্নি একটু নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘হ্যাঁ, বলো। আমি শুনছি।’

‘ছোঁয়া আর আমার সম্পর্কটা একদম ভিন্ন, একটু অদ্ভুতও বটে। আমার পক্ষে তা ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়। তারপরেও আমি কিছুটা বলার চেষ্টা করব। আমি ছোঁয়াকে পছন্দ করি সেই স্কুল লাইফ থেকে। তবে স্কুলের দিনগুলোতে আমি আমার মনের এই অনুভূতিগুলোকে পাত্তা দিতাম না কারণ আমি জানতাম অতল ছোঁয়ার প্রতি দুর্বল যদিও ছোঁয়া তাকে কখনোই ভালোবাসেনি। তারপরেও আমি সবসময় তাকে এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু আমাদের দূরত্ব একটা সময় ঘুচে গেল। মোসাদ্দেক স্যার যখন আমাদের একসাথে পানিশমেন্ট দিলেন তখন আমি আর আমার অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে পারিনি। তবে এটাও ঠিক যে আমি আমার অনুভূতি প্রকাশও করিনি।’

শিহরণ একটু থামল। তাকে খুব বিষণ্ন দেখাচ্ছে। বিষাদভরা কণ্ঠে সে বলল, ‘তারপর অতলের সাথে আমার ঝামেলা হলো তোকে নিয়ে। এরপর তোর সাথে আমার দূরত্ব বাড়ল। আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে আমি ছোঁয়াকেও ভীষণভাবে মিস করা শুরু করলাম। এরপর একদিন আমি ভাবলাম আমার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে দিব ছোঁয়ার কাছে ঠিক তখনই আমি ছোঁয়াকেও ভুল বুঝি অকারণে এক অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে। অথবা বলতে পারিস আমাকে ভুল বুঝান হয়েছিল। তারপর থেকে আমি আর ছোঁয়ার দিকে চোখ তুলেও তাকাইনি। তারপর একদিন আমি ছোঁয়ার ডায়েরি খুঁজে পাই। স্কুলে ফেলে এসেছিল সে। সেদিন ক্লাসে আমিই ছিলাম তাই আমার হাতে পড়েছিল। ভাগ্যিস! ডায়েরিটা পেয়েছিলাম।
সেই ডায়েরিতে ছোঁয়া তার সমস্ত অনুভূতি লিখে রাখত।’ শিহরণ থামল। চোখ বুজে ফেলল। টেবিলের উপরে রাখা পানির জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নিল এক নিঃশ্বাসে।

বহ্নি অধৈর্য গলায় বলল, ‘তারপর কী হলো?’

শিহরণ মৃদু হাসল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি ছোঁয়ার ব্যাপারে সবকিছু জানতে পারলাম তার ডায়েরিটা পড়ে। ডায়েরিটা এখনও আমার কাছেই আছে। তখন আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। আমার ভুলটা ভেঙ্গে যায়। এর মধ্যে মোহনা আমার সাথে যোগাযোগ করে। তারপর আমি আর মোহনা মিলে আমার আর অতলের মাঝে ঝামেলা কে বাঁধিয়েছে তা বের করে ফেললাম। ঝামেলাটা কে বাঁধিয়েছে তা জানার পর আমার নিজের প্রতি খুব রাগ হলো। কিন্তু সেটা ইচ্ছাপ্রণোদিত কাজ ছিল জানার পর থেকেই আমি এক ধরনের চাপা কষ্টে ভুগছিলাম। সবচাইতে বেশি দুঃখ লাগত এটা ভেবে যে সে আমাদেরই বন্ধু ছিল। তারপর থেকে তো আমি অতলের সাথে অনেকবার দেখা করার চেষ্টা করেছি। অগণিতবার তার বাসায় গিয়েছি কিন্তু অতল আমার সাথে আর একটা বারের জন্যেও দেখা করেনি।’

‘কে ছিল?’ বহ্নি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শিহরণের দিকে।

‘প্রিয়।’ শিহরণের ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য হাসি। অদ্ভুতভাবে হেসে সে বলল, ‘জানিস? সবাই ভেবেছিল ওটা রাদিদের কাজ! তবে রাদিদ সেদিন কিছুই করেনি। বরং সেদিন রাদিদ অদ্ভুত আচরণ করেছিল। মোহনা বিষয়টা খেয়াল করেছিল। তবে এর পেছনের কারণটা সে জানতে পারেনি। এর পর থেকেই রাদিদ কেমন যেন একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করল। তার পুরো কারণ অবশ্য জানা নেই। তবে তার বাবার প্রথমবার হার্ট এট্যাক হবার পর থেকে সে ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল। ঠিকমতো হাসতো না, কথাও ঠিকমতো বলতো না। এক পর্যায়ে তো সে তার গ্রামের বাড়ি চলে যায়। এর পর থেকে তো আর কোনো যোগাযোগ হয়নি তার সাথে।’

বহ্নি অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘রাদিদ ভাইয়ার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতোই। তবে প্রিয় আপু কেন এই কাজ করেছে তা জানতে পেরেছ?’

‘প্রিয় তোর উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। এমনকি আমার উপরেও।’ তিক্ত গলায় বলল, শিহরণ।

‘আমার উপর?’ ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইল বহ্নি।

‘হুম।’ শিহরণ তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘তুচ্ছ কারণে তার ইগো হার্ট হয়েছিল। যার ফলাফল স্বরূপ অতল আর আমার বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেল।’

‘তারপর?’ বহ্নি ধৈর্যহীন হয়ে বলল, ‘তোমার আর ছোঁয়া আপুর কী হলো?’

‘একটা অদ্ভুত বিষয় কী জানিস?’ শিহরণ বহ্নির উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বলতে শুরু করল, ‘ছোঁয়াকে আমার কাছে ভুল প্রমাণিত করতে চেয়েছিল অতল। হয়তো আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আর এই কাজটা সে কার তাড়নায় করেছে তাও আমি জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু ডায়েরি পড়ে ছোঁয়ার ব্যাপারে সবটা জানার পরে আমার সমস্ত ভুল ধারণা শেষ হয়ে যায়। আমার কাছে একে একে সমস্ত ঘটনা পরিষ্কার হতে থাকল। অতলের এই অন্যায়টা জানার পরেও আমি তাকে মনে মনে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। ওর সাথে বারবার যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তার চারপাশে এক অভেদ্য প্রাচীর তুলে দেয়। যে দেয়ালটা সে না চাইলে আমার পক্ষে ভাঙা সম্ভব ছিল না। আর হলোও তাই। একদিন শুনলাম ওর বাবা ট্রান্সফার হওয়ায় ওরা সবাই রাঙ্গামাটি চলে গেছে।’

শিহরণের চোখের কোণে অশ্রু হানা দিল। বহ্নি ওর হাতের উপর নিজের একটা হাত রেখে বলল, ‘তারপর কী হলো ভাইয়া?’

শিহরণ পুনরায় বলতে শুরু করেছে, ‘অতলের কাহিনি ওখানেই শেষ। তবে একটা বিষয় কী জানিস?’

বহ্নি বলল, ‘কী?’

‘অতলের ভুল ধারণাটা ভাঙা দরকার। নয়তো সে অযথাই আমাকে ভুল বুঝে যাবে সারাজীবন।’ শিহরণ বলল বিমর্ষ কণ্ঠে।

‘ভাঙবে একদিন। দেখে নিও।’ বহ্নি বলল, শিহরণকে আশ্বস্ত করতে, ‘তারপর কী হলো?’

‘এরপর বেশ কিছুদিন আমি প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ছিলাম। অতলের মতো বন্ধুকে হারিয়ে ফেলাতে আমার নিজের উপর যেমন রাগ হচ্ছিল। তেমনি আমি চাপা কষ্টে ভুগছিলাম। এই সময়টাতে মোহনা আমাকে সাহায্য করেছিল। একজন প্রকৃত বন্ধু হিসেবে ওকে কাছে পেয়েছিলাম। মায়াও অবশ্য পাশে ছিল। এরপর কষ্টগুলো কিছুটা ম্লান হতেই আমি নিজের আর ছোঁয়ার মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিই। কেন যেন সমস্ত অঘটনের জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। ছোঁয়াকে ভুলার চেষ্টা করতে থাকলাম। ব্যর্থ হয়েছিলাম। বারবার ব্যর্থ হয়েছিলাম। মোহনা আর মায়া তখন আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তারা আমার মধ্যে জাগ্রত হওয়া গিল্টি ফিলিংসটা দূর করতে সাহায্য করল। আমি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে মেডিটেশন শুরু করেছিলাম। ওটা অবশ্য বেশ কাজে দিয়েছিল। তারপর আমার চিন্তাশক্তি স্বাভাবিক ফ্লোতে আসার পর আমি ছোঁয়ার বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবলাম। পুরো এক সপ্তাহ ধরে ভেবেছিলাম।’

‘কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে?’ বহ্নির কণ্ঠে কৌতূহল।

‘আমি আমাদের মধ্যের দেয়ালটাকে দেয়াল হিসেবেই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’ দৃঢ়তার সাথে বলল, শিহরণ।

বহ্নি চিৎকার করে বলল, ‘কেন?’

‘কারণ আমি চেয়েছিলাম ও যেন নিজ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হোক। আমি জানতাম ও কখনোই আমাকে ভুলবে না। জানি না কেন! তবে কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার বিশ্বাস ছিল, সে আমারই থাকবে। আমি ওকে কখনোই হারাব না। তাই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখাটা আমার জন্য কঠিন হলেও অসাধ্য ছিল না। আর সবচাইতে দারুণ ব্যাপার হলো, আমার বিশ্বাস প্রমাণিত হয়েছে।’

শিহরণ উঠে দাঁড়িয়ে তার মাথার ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুলগুলো ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করল। হাসতে হাসতে বলল, ‘সবচাইতে অদ্ভুত ব্যাপারটা কি জানিস?’

বহ্নি বলল, ‘কী?’

‘আমি এখনও ছোঁয়াকে বলিনি আমি ওকে, কেবল ওকেই ভালোবাসি। অথচ ও বুঝে, জানে। আমি এটা অনুভব করতে পারি।’ আমুদে গলায় বলল, শিহরণ।

‘তুমি এরকম সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলে? এর পেছনে নিশ্চয়ই আরও যৌক্তিক কোনো কারণ ছিল?’

‘যৌক্তিক কারণ তো অবশ্যই ছিল। আমি তো ছোঁয়ার ব্যপারে সবটা জানতাম। ওর সৎ মা আর সৎ বোনেরা ওকে পছন্দ করে না। ওর উপর নানান অত্যাচার করত। ফিজিক্যালি টর্চার পর্যন্ত করত। আমি নিজেও তো দেখেছি। তাই আমি ওর সাথে নিজেকে জড়িয়ে তাকে দুর্বল করতে চাইনি। আমি ওকে স্ট্রং হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। ছোঁয়া আবেগে ভেসে যাক তা আমি কখনোই চাইনি। তাই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি চাইনি আমার কারণে তার ক্যারিয়ার বাধাগ্রস্ত হোক। তাহলে তো আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করে পারতাম না।’

শিহরণ থামল। পুনরায় বলল, ‘তবে একটা মজার ব্যাপার কী জানিস?’

‘কী ভাইয়া?’

‘আমার যখনই ওকে দেখতে মন চাইত ছুটে যেতাম ওকে এক পলক দেখার জন্য। কখনো অবশ্য সামনাসামনি দেখিনি। সবসময় লুকিয়ে দেখেছি। আর এক্ষেত্রে অমাকে কে সাহায্য করেছে জানিস?’

‘কে?’ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল বহ্নি।

‘মায়া। ছোঁয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড।’

‘ছোঁয়া আপু জানে?’

‘জানে না। আমিই বলতে নিষেধ করেছি। ছোঁয়াকে দূর থেকেই সাহায্য করার জন্য আমার মায়ার সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখতে হয়েছে। অবশ্য মায়া তো আমারও বন্ধু। আর তার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। ও যখন ভেঙ্গে পড়ত তখন ওকে সান্ত্বনা দেওয়া থেকে শুরু করে ওর অর্জনে ওকে অনুপ্রেরণা দেওয়া সবটা করেছি মায়ার মাধ্যমে।’

‘ছোঁয়া আপুকে জানালে কি সমস্যা ছিল?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল বহ্নি।

‘সমস্যা তো ছিল।’ শিহরণ বার কয়েক লম্বা শ্বাস নিল। তারপর বলল,’ আজকের ছোঁয়া আর দশ বছর আগের ছোঁয়ার মধ্যে যেমন তফাৎ ছিল ঠিক তেমনি তফাৎ ছিল তার পারিপার্শ্বিক অবস্থাতে। আমি তার চারপাশের পরিবেশ তার জন্য জটিল করতে চাইনি। আমি সবসময় চেয়েছি ওর চারপাশের পরিবেশ সহজ স্বাভাবিক হোক।’

‘জটিল বলতে?’ বহ্নি ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল।

‘আমার সাথে সম্পর্ক আছে এই বিষয়টা ওর বাসায় একবার জানতে পারলেই ওর উপর অমানুষিক নির্যাতন হতো। এটা বোঝার ক্ষমতাটা আমার ছিল। তাই ছোঁয়ার কাছ থেকে দূরে থেকেছি অনিচ্ছাসত্ত্বেও।’ শিহরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘ভাইয়া! তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।’ বহ্নি বলল, দ্বিধান্বিত কণ্ঠে।

‘সংকোচ করছিস কেন? যা ইচ্ছে বলে ফেল।’ শিহরণ বলল, স্মিত হেসে।

‘আমি অতল ভাইয়ার সাথে দেখা করেছি।’ বহ্নি বলল, প্রগাঢ় কণ্ঠে।

_____________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-২৬+২৭+২৮

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৬

রাতেও মায়ের হাতের রান্না খেয়েছে রাদিদসহ বাড়ির সকলে। মায়ের হাতের রান্না খেয়ে সে বহুদিন পরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। মা অসুস্থ তাই সে সত্যিই চায় না মা রান্না করুক। কিন্তু মনে প্রাণে সে মায়ের রান্নাকে ভীষণ মিস করে। প্রতিটি সন্তানই তার মায়ের হাতের রান্না মিস করে। মায়ের হাতে তৈরী খাবারের স্বাদ, গন্ধ কখনোই ভুলার নয়। আর মা যাই রাঁধুক না কেন তা সবসময় অমৃত তুল্য হয়ে থাকে। এই যেমন আজ রাদিদের মনে হলো সে অমৃত খেয়েছে। এখনও স্বাদ জিহ্বাতে লেগে আছে। আজ অনেক দিন পরে অতীতের ধুলো পড়া মোটা স্তরের বর্তমানের মরচে পড়া জীবনের সামান্য স্তর যেন কিছুটা পরিষ্কার হলো।

বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে, কাপালের উপর ডান হাতটা রেখে ভাবনায় মশগুল ছিল সে। হঠাৎ করেই পিউর ‘বড়ো মামা’ বলে চিৎকার শুনতেই কপাল থেকে হাতটা নামিয়ে দরজার দিকে তাকাল। রাদিদ কিছু বুঝে উঠার আগেই পিউ হুড়মুড় করে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাদিদের উপর। রাদিদ ধড়ফড়িয়ে উঠল। পেটের উপর ব্যথাও পেয়েছে সে। কিন্তু তা পিউকে বুঝতে দিল না। আদুরে গলায় পিউকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,’এটা কী হলো, চ্যাম্প? এভাবে কি কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে? একটু হলেই তো ব্যথা পেতে।’

‘একটুও ব্যথা পাইনি আমি।’ পিউকে একটু চিন্তিত দেখাল। পরক্ষণেই বলল, ‘তুমি ব্যথা পেয়েছ, বড়ো মামা?’

রাদিদ পিউকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘একটুও না, চ্যাম্প।’

‘সত্যি বলছ তো?’ পিউ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল।

‘একদম সত্যি।’ রাদিদ পিউর নাকটা টেনে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, চ্যাম্প! তুমি আজ এত রাত অবধি জেগে আছ কেন?’

‘ঘুম আসছে না তো।’ ঠোঁট উল্টে আদুরে ভঙ্গিতে বলল, পিউ।

‘মা কোথায়?’ রাদিদ পিউর এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে প্রশ্ন করল।

‘মা তো কবেই ঘুমিয়ে পড়েছে।’ পিউ হাত নেড়ে নেড়ে হতাশ ভঙ্গিতে বলল।

‘তাহলে তুমি কীভাবে এলে?’ রাদিদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল পিউর দিকে।

পিউ নিজের মুখটা রাদিদের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি চুপিচুপি দরজা খুলে চলে এসেছি।’

‘এটা তো ভারি অন্যায়।’ রাদিদ কপট রাগ দেখাল। পরক্ষণেই আবার বলল, ‘তা কেন এসেছ চুপিচুপি? কারণটা কি জানতে পারি?’

‘আগে বলো, তুমি বকবে না তো?’ পিউ একটা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘প্রমিস করো।’

‘বকা দেবার মতো কোনো কথা কি?’

‘বলো না বকবে না তো?’ পিউ অধৈর্য গলায় বলল।

‘আচ্ছা, চ্যাম্প! বকব না। এবার তো বলো কী বলতে এসেছ এত রাতে এসেছ?’

‘আগে প্রমিস করো।’ পিউ একটা হাত এগিয়ে দিয়ে পুনরায় বলল।

‘আচ্ছা, প্রমিস করলাম।’ রাদিদ অগত্যা পিউর হাতে হাত রাখল শেষমেশ।

‘আচ্ছা, বড়ো মামা! আমার বাবা কোথায়?’ পিউ চোখদুটো পিটপিট করে রাদিদের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে জানতে চাইল।

রাদিদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এই প্রশ্নটা পিউর মাথায় আসাটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয় কিন্তু রাদিদ কী জবাব দেবে? তার কাছে তো কোনো উত্তর নেই। নিজেকে খুব আসহায় মনে হচ্ছে তার।

পিউ রাদিদের হাত ঝাঁকুনি দিতে দিতে পুনরায় প্রশ্ন করল,’বলো না বড়ো মামা, বাবা কোথায়? বাবা দেখতে কেমন?’

‘পিউ! কেউ কিছু বলেছে বাবাকে নিয়ে?’

পিউ মাথা নিচু করে ফেলল। রাদিদ তার মুখটা এক হাত দিয়ে তুলতেই দেখতে পেল পিউর চোখে জল।

‘কাঁদছে কেন আমার চ্যাম্প? পিউর চোখে এরকম জল একদম ভালো লাগে না। এবার চ্যাম্পের জন্য অনেক চকলেট আনব। ঠিক আছে?’ রাদিদ প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করল।

পিউর কান্নার দমক এবার বেড়ে গেল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘না! পিউর চকলেট চায় না, পিউর বাবা চায়।’

রাদিদ বাকরুদ্ধ । পিউকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘বাবা পরীর দেশে গেছে, পিউ তো পরীর মতো দেখতে কিন্তু পিউর কোনো ডানা নেই। বাবা তার পরীর মতো দেখতে মেয়ের জন্য ডানা নিয়ে আসবে।’

‘সত্যি?’ আহ্লাদী গলায় বলল, পিউ।

‘একদম সত্যি।’ রাদিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এবারের মতো বাঁচাতে সে নিজে রিল্যাক্সড ফিল করছে। তবে এরকম আর কত দিন? এই প্রশ্নটাই তার মাথাতে ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘তাহলে কবে আসবে বাবা?’

‘খুব তাড়াতাড়ি।’

পিউ ঘুমিয়ে পড়াতে রাদিদ তার বিছানাতেই শুইয়ে দিল তাকে। আগের মতো করেই সে নিজেও শুয়ে পড়ল। তার গলার কাছটাতে কাঁটার মতো কিছু একটা বিঁধছে। কী সেটা? বাচ্চা মেয়েটার মনে এত কষ্ট! যদি রাদিদের এমন কোনো জাদু জানা থাকত, যা দিয়ে সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করা যায় । তবে সে পিউর সবগুলো ইচ্ছেকেই আগে পূর্ণ করে দিত।

এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়ল সে মোবাইলটা চেক করেনি দুদিন যাবৎ। সেদিন কেউ একজন মেসেজ পাঠিয়েছে তাও দেখা হয়নি। তাই শোয়া থেকে উঠে সে ওয়্যারড্রবের ওপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে তার রুমের সাথে লাগোয়া ছোট্ট বারান্দাটাতে গিয়ে বসল । আজকের বাতাসটা গায়ে লাগতেই কেমন শীত শীত লাগছে। একদম শরীরের চামড়াতে গিয়ে আঁচড় কাটছে রাতের শীতল সমীরণ। তবে রাদিদের এতে মন্দ লাগছে না বরং বেশ ভালোই লাগছে।

মোবাইলের ম্যাসেজ বক্সটা খুলতেই দেখল বেশ কয়েকটা মেসেজ জমা হয়েছে। কলও এসেছে কয়েকটা। মেসেজের অধিকাংশই নীরার কাছ থেকে এসেছে। কলও সেইম, নীরাই করেছে। ফিডব্যাক না পেয়েই কল করেছে, তা বুঝতে রাদিদের কষ্ট হলো না। এক পর্যায়ে সে মেসেজগুলো পড়তে শুরু করল।
জন্মদিনের উইশ করা মেসেজ এসেছে একটা। কিন্তু নাম্বারটা অপরিচিত। আজ তার জন্মদিন? তার এই ব্যাপারে কোনো খেয়ালই ছিল না। এই জন্য মা এত কষ্ট করে তার প্রিয় সব খাবার রেঁধেছে! অপরিচিত নাম্বারটা কার তা জানার জন্য কৌতূহল হলো না রাদিদের। সে নীরার পাঠানো সবগুলো মেসেজ পড়ল এক নাগাড়ে। সব মেসেজের সারমর্ম হলো নীরা বহ্নির সাথে নিজ দায়িত্বে দেখা করে তার নাম্বার নিয়েছে এবং একদিন তাকে কল করে নিজের পরিচয়টাও দিয়েছে। রাদিদ মনে মনে বলল, ‘কেন যে এই নীরাটা এসব করছে! সবকিছুই অযথা। শুধু শুধুই নিজের সময় নষ্ট করছে মেয়েটা।’

এরপর অপরিচিত নাম্বারটা ওপেন করতেই সেই নাম্বার থেকে পাঠানো মেসেজটা পড়তে শুরু করল রাদিদ।

ব্যর্থতা নামক শব্দটা কখনো না আসুক,
সফলতা নামক শব্দটা তোমাকে ঘিরে রাখুক।

তোমার মুখের প্রাণোচ্ছল হাসিটা রেখো;
আর কিছু রাখো আর না রাখো
এই হাসিটাই যে তোমার বিশেষত্ব।

তোমার জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে
আনন্দের ঝলকানি যেন থাকে ভাঁজে ভাঁজে।
এটাই কামনা, এটাই চাওয়া, এটাই প্রার্থনা।
শুভ জন্মদিন 🎂

ইতি
তোমার কেউ না।

বি.দ্র. আমি কি কখনও তোমাকে বলেছি যে তুমি হাসলে তোমার চোখও হাসে? যদি বলে থাকি তবে ভুল বলেছি। এখন তোমার চোখ হাসে না, কারণ তুমিই তো হাসো না। কী ভেবেছ? তোমাকে হাসতে বলব? বলব না। আমি এখন হস্তক্ষেপ করা ছেড়ে দিয়েছি। তোমরা তো আমায় আপন ভাব না তাহলে আমি কেন ভাবব?

এই ক্ষুদে বার্তায় কিছু তো ছিল। যা রাদিদের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসির কারণ হয়ে গেল মুহূর্তেই।

রাদিদ মনে মনে বলল, ‘ ইতি তোমার কেউ না কে বলেছে? ইতি তোমার সবকিছু হবে কথাটা।’

আমার শহরটা লণ্ডভণ্ড
এই শহরে আসতে বারণ
অট্টালিকায় থাকা রাজকন্যার।

আমার শহরে ছড়িয়ে থাকা হারানো বিজ্ঞপ্তি
শুধু পাগলাটে খ্যাপাটে বাতাসে উড়ে বেড়ায়
শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ;
হারিয়ে যাওয়া মানুষটার খোঁজ মেলে না।

এই এলোমেলো, অগোছালো শহরে
পরীদের আসতে বারণ
আমার শহরেই আমি একাই আছি বেশ।

রাদিদ এই কবিতা লিখে ফেলল যেন ঘোরের বশে। লিখে ফেলার পরেই আচমকা ভাবতে থাকল, ‘আমি এটা কেন লিখলাম?’

ভাবুক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কতক্ষণ কে জানে? উদাস নয়ন জোড়া শুধু হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে কাঙ্ক্ষিত মানুষকে। হঠাৎ ভুলবশত হাতের চাপ লাগল মেসেজ অপশনের সেন্ড বাটনে। ব্যস, রচিত কবিতাখানা নিজ গন্তব্যে পৌঁছে গেল মুহূর্তেই।

_______________________________

অতল ঘরে এসে পৌঁছাল কেবল। দুইবার ঘরের বেল চাপতেই মেহেরুন নাহার এসে দরজা খুলে দিলেন। পাশাপাশি এটা ওটা প্রশ্ন করতেই আছেন। অতলকে কোনো কথার উত্তর না দিতে দেখে তিনি শেষমেশ বললেন, ‘ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি।’

অতল বেসিন থেকেই মুখে পানির ঝাপটা দিলো। ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। মেহেরুন নাহার বললেন, ‘একটু বোস। আমি খাবারটা গরম করে দিচ্ছি।’

আশরাফ হোসেন হঠাৎ নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তার চেহারায় স্পষ্ট ক্রোধের ছাপ। অতল তা দেখেই চোখ নামিয়ে নিল।

‘এত রাত পর্যন্ত কি বাইরে থাকে কোনো সভ্য পরিবারের ছেলে?’ আশরাফ হোসেন উত্তেজিত গলায় বললেন।

অতল মাথা নিচু করে আছে। কী বলবে সে? তার তো বলার কিচ্ছু নেই। কেউ শোনার নেই, তাই বলারও নেই।

‘কী হলো?’ আশরাফ হোসেন বজ্রকণ্ঠে জানতে চাইলেন,’কথা বলছ না কেন? দিন দিন বেয়াড়া হয়ে উঠছ শুধু। এখনও একটা চাকরি পর্যন্ত যোগাড় করতে পারলে না। সারাদিন যে কি কি করে বেড়াও তা তো আমার মুখে আনতেও লজ্জা লাগছে।’

অতলের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে এবার। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখেই সে প্রশ্ন করল, ‘আমি কী করেছি বাবা?’

‘কী করেছ?’ গগণবিদারী চিৎকার দিলেন আশরাফ হোসেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, ‘কোনো কাজ তো তোমার দ্বারা হয় না। আবার মুখে মুখে তর্ক করছ! বড়োদের নূন্যতম রেসপেক্ট দেবার জ্ঞানটুকুও কি নেই তোমার?’

‘আমি কী করেছি সেটা তো একবার বলেন?’ অতল অসহায় মুখ করে করুণ স্বরে জানতে চাইল।

‘তুমি আসলেই আমার পরিবারের জন্য একটা ব্যাধি। সংক্রামক ব্যধি । তোমার থেকে কার মধ্যে যে ছড়াবে সেই চিন্তায় রাতে আমার ঘুম আসে না।’ আশরাফ হোসেন রাগে গজগজ করতে করতে বললেন।

অতলের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। মাত্র খেতে বসেছিল সে। খাবার এখনও বাড়া হয়নি। কিন্তু এখন আর খাবার গলা দিয়ে নামবে না। আজ রাতে না খেয়েই থাকতে হবে তা বেশ বুঝতে পারছে সে।

‘কী শুরু করেছেন আপনি? মাত্র তো খেতে বসেছে ছেলেটা। খাওয়াটা অন্তত শেষ করুক।’ মেহেরুন নাহার ভাতের প্লেটটা অতলের দিকে দিয়ে শান্ত গলায় বললেন।

‘তুমি চুপ করো। এত আদর দিতে যেও না। আদর দিয়ে দিয়েই তো এমন হয়েছে।’ মেহেরুন নাহারকে প্রচণ্ড এক ধমক দিলেন আশরাফ হোসেন।

বাবার চিৎকার চেঁচামেচিতে আতিক আর তানিয়া এসে দাঁড়াল ডাইনিং স্পেসে। অতল যেন কোনো এক হাস্যকর বস্তুতে পরিণত হয়ে গেল। কখনো করুণার, তো কখনো কারো হাসির খোরাক। অসহ্য! এ জীবন। অসহ্য সবকিছু। আজ ‘জীবন’ নামক শব্দটা বড্ড ভারী মনে হলো অতলের। মায়ের দু’চোখের কোণে কী যেন চকচক করে উঠল। বাল্বের আলোতে, নিজের চোখের ঝামসা দেয়ালও তা দেখা হতে তাকে বিরত করতে পারল না।

আশরাফ হোসেন রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন। অতল ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তানিয়া বলল, ‘ভাইয়া! আজ আব্বুর মেজাজ গরম ছিল তাই বকেছে। তুই কিছু মনে করিস না। এসব বাবার মনের কথা নয়।’

আতিক এসে বলল, ‘আব্বু যেমন চায় তেমন করে চললেই তো পারিস। এত রাত অবধি বাড়ির বাইরে থাকার কী দরকার ছিল? যত্তসব আজাইরা কাজ করে বেড়াস সারাদিন। রাতের বেলাও কি এসব আজাইরা ঘোরাঘোরি না করলে তোর চলে না? তোর জন্য আমার ঘুমের বারোটা বেজে গেছে।’

অতল নিশ্চুপ। তার মাথা কাজ করছে না। শুধু চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। তানিয়া আতিকের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কী শুরু করছিস ভাইয়া? দেখলি না অতল ভাইয়াকে বাবা বকেছে। তুই এসেছিস কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে? অদ্ভুত লাগছে তোর এই ধরনের আচরণ আমার কাছে।’

‘এই তুই চুপ কর। বেশি কথা শিখেছিস তাই না? অতলের চামচি কোথাকার। আমার সাথে গলা উঁচু করে একদম কথা বলবি না। আমি এসব মোটেই সহ্য করব না। বলে দিলাম।’ তানিয়াকে পাল্টা ধমক দিয়ে বলল, আতিক ।

‘তোমাকে ডরাই না-কি আমি? একশ বার বলব।’ তানিয়াও ছেড়ে কথা বলল না।

‘এই তোরা ঘরে যা। আর কোনো কথা বলার দরকার নেই।’ মেহেরুন নাহার বললেন, ভাঙা গলায়। একটু কান্না করলেই তার গলাটা ভেঙে যায়।

মেহেরুন নাহার অতলের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বাবার কথায় রাগ করে থাকিস না বাবা। এসব তোর বাবার মুখের কথা। এখন খেতে বোস।’

‘জানো মা! আমার খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু এখন আর গলা দিয়ে খাবার নামবে না।’ অতল বলল দুর্বল কণ্ঠে, মাকে জড়িয়ে ধরে।

‘এমন কথা বলিস না বাবা। না খেলে শরীর খারাপ করবে তো।’ মেহেরুন নাহার বললেন, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ।

‘আমি ঠিক অছি মা। আমাকে আজকে অন্তত খেতে বলো না। আমি পারব না, মা।’

‘বোস না বাবা, আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছি। আজ তোর প্রিয় তরকারি রেঁধেছি। রূপচাঁদা মাছের কোফতা খুব পছন্দ করিস না? ওটা দিয়ে আজ তোকে আমি নিজ হাতে খাইয়ে দেব। বোস না, বাবা অতল।’ মেহেরুন নাহার আকুতি ভরা কণ্ঠে বললেন।

‘মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি আজ কোনোভাবেই খেতে পারব না। ‘ অতলকে বিপন্ন দেখাল। তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল।

মেহেরুন নাহার শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে কান্না আটকে দ্রুত পা চালালেন নিজের রুমের দিকে। ছেলেটার কষ্টে তার নিজের বুকের ভেতর প্রচণ্ড ব্যথা করছে। মাঝেমধ্যে একের দোষের বোঝা অন্যকে বয়ে বেড়াতে হয়। যেমন তার ছেলেটা বয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না। তার কিছুই করার নেই, নীরবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। নিজের রুমে গিয়েও ছেলের চিন্তাতে তার ঘুম আসছে না। তাই ছেলের রুমে গেলেন ঘুমিয়েছে কি না দেখার জন্য। অতল বসে ছিল। তার কাছে সবকিছু বিষাক্ত লাগছে।

মেহেরুন নাহার আদর মিশ্রিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘এখনও ঘুমাসনি কেন, বাবা?’

‘ঘুম আসছে না, মা।’ অতল বলল, বিষণ্ণ কণ্ঠে।

‘তুই শুয়ে পড়। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’

অতল বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়ল। মেহেরুন নাহার ছেলের শিয়রে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। অনেক দিন পরে মায়ের হাতের ছোঁয়া পেয়ে অতলের ভীষণ ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। মনের আকাশে জমে থাকা মেঘও হয়তো কমতে শুরু করবে। কেবল বৃষ্টি নামার অবকাশ।
___________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৭

আজকের আবহাওয়াটা খুব দারুণ। সমীরণের স্নিগ্ধ আবেশ ছড়িয়ে পড়ছে শরীর থেকে মনে। বহ্নি উৎফুল্লতার সহিত মেসেজ পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে বসে অ্যাসাইনমেন্ট করছিল। তার পরীক্ষার খুব দেরি নেই। তার জন্য পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে সে। এর মধ্যেই আবার তাদের আশ্রমের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কোম্পানি থেকে বিশাল একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে। সে চাইলেও খুব বেশি কিছু করতে পারবে না এবার। অন্যান্য সময় সে নিজে সকলের সাথে মিলে সাজানো-গোছানোর কাজগুলো করত। তবে এবার তা হবে না। শিহরণকে সে আগেই বলে দিয়েছে তার অপারগতার কথা। জবাবে শিহরণ হেসে বলেছিল, ‘বুঝলাম, বার্বি ডল। এবার আমার বার্বি ডলটা সত্যিকারের বার্বি ডল হয়ে বসে থাকবে। আর অনুষ্ঠান উপভোগ করবে।’

বহ্নি কপট রাগ দেখাতেই শিহরণ পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমার ছোট্ট বোনটি এবার আমার গেস্ট হতে চাইছে। তাকে আমি নিজেই না হয় অভর্থ্যনা জানাব।’ একটু থেমে ভ্রু কুঁচকে বহ্নির দিকে তাকিয়ে বলেছে, ‘এবার ঠিক আছে, কাপকেক?’

পরক্ষণেই বহ্নি আহ্লাদী গলায় প্রশ্ন করেছিল, ‘আমি হোস্ট হতে পারছি না বলেই আমাকে গেস্ট বানিয়ে দিলে?’

‘একদম না।’ শিহরণ প্রশস্ত হেসে বলেছিল, ‘তোকে গেস্ট বানিয়ে তোর সেবা করার সুযোগ খুঁজছি। হাজার হলেও প্রিন্সেস বলে কথা। আমি তো ভাই সবসময়ের প্রজাস্বরূপ মানব । তাই সর্বদা সেবা করার সুযোগ খুঁজে বেড়ায়।’

শিহরণের বলা কথা মনে পড়তেই বহ্নি একচোট হাসল। তারপরেই তার ভাবনাতে উঁকি দিলো রাদিদ।
সে ভাবতে লাগল, রাদিদ ভাইয়া কি বুঝতে পারবে, কে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে! বুঝতে না পারার তো কিছু নেই। নীরা নিশ্চয়ই জানিয়েছে; নাম্বার দেবার কথাটা। এসব আকাশ পাতাল ভাবনার মধ্যে হুট করে তার মোবাইলটা বিপ বিপ শব্দ করে নড়ে উঠল। দ্রুত হাতে সে মোবাইলটা নিল। মেসেজ তো হরহামেশাই আসে। তূর্ণ, সায়মা তো সবসময় মেসেজ পাঠাতে থাকে। তাই মেসেজ চেক করার তাড়া কখনোই থাকে না। তবে আজ কী মনে করে যেন সাথে সাথে মেসেজ বক্সটা খুলে দেখল সে! রাদিদের নাম্বার থেকে মেসেজটা এসেছে দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। বহ্নি কৌতূহল আর চেপে রাখতে না পেরে, মেসেজটা ওপেন করল।

আমার শহরটা লণ্ডভণ্ড,
এই শহরে আসতে বারণ!
অট্টালিকায় থাকা রাজকন্যার।

আমার শহরে ছড়িয়ে থাকা হারানো বিজ্ঞপ্তি
শুধু পাগলাটে, খ্যাপাটে বাতাসে উড়ে বেড়ায়
শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত!
তবুও হারিয়ে যাওয়া মানুষটার খোঁজ মেলে না!

এই এলোমেলো, অগোছালো শহরটাতে
পরীদের আসতে বারণ
আমার শহরেই আমি একাই আছি বেশ।

কবিতার চরণের মতো কিছু লাইন । কবিতা বলা যায়। তবে তা দেখে বহ্নির মনে প্রথমেই প্রশ্ন জাগল, রাদিদ ভাইয়া কবে থেকে কবিতা রচনা শুরু করেছে? করলে করতেও পারে। তবে এই কবিতা তাকে পাঠানোর মানে কী?

রাদিদের নাম্বার থেকে পাঠানো মেসেজটা পড়তেই বহ্নি কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। তার কাছে সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে, আবছা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন লাগছে । কবিতার চরণের অর্থ কোনোভাবেই সে বুঝতে পারছে না। আর তাকে পাঠানোর মানেটাই বা কী! ভাবনাতেই মশগুল ছিল অনেকক্ষণ। তবুও কোনো উত্তর মেলেনি। হঠাৎ তার মনে হতে লাগল তার প্রিয় মানুষগুলো রহস্যে ঘেরা। বড়ো হবার পর কাছ থেকে সে তাদের জানার সুযোগ পায়নি তা ঠিক। তবে একটা সময় তো তারা তার কাছের মানুষ, আপনজনের মতোই ছিল। অথচ দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান ও দূরত্ব সবকিছুই যেন পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই যেমন, অতল আর রাদিদ। এই দুজনের পরিবর্তন তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলে। তবে এর রহস্য ভেদ করার জন্যে তো তাদের কাছে থাকা আবশ্যক। তবে কারণ যাই হোক না কেন ওদের মধ্যেকার পরিবর্তন বহ্নির কাছে কখনোই খারাপ ঠেকেনি। মনে হয়েছে; এটাই সকলের জন্য ভালো ছিল।

লণ্ডভণ্ড! সত্যিই কি লণ্ডভণ্ড? রাদিদ ভাইয়ার কি বড়ো কোনো সমস্যা আছে? উফ! কী দুর্বিসহ এসব চিন্তা। একটা প্রশ্নের উত্তরও তার কাছে নেই। নিজেকে একলা একাকী পথিকের মতো দিশেহারা লাগছে। বহ্নি বুঝতে পারল তাই তার মস্তিষ্ক কবিতার চরণগুলোর অর্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই দিশেহারা অবস্থা থেকে বের হতে সে মেসেজটির চিন্তা বাদ দিয়ে পুনরায় অ্যাসাইনমেন্টে মনোযোগ দিলো।

‘আসব?’ বহ্নির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, রাফি।

বহ্নি চকিতে তাকাল। রাফি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। বহ্নি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, ‘কিছু বলবে, রাফি ভাইয়া?’

‘হুম, বলার তো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু তুমি শুনতে চাও না! এটাই আমার দুঃখ।’ রাফি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মলিন কণ্ঠে বলল।

‘কোনো কাজের কথা হলে বলতে পারো। নয় তো যেতে পারো।’ বহ্নি চোয়াল শক্ত করে কণ্ঠে কাঠিন্য ঢেলে দিয়ে বলল।

‘কাজের কথাই তো বলেছি এতদিন । তবে তুমি সেটাকে কাজের কথা মনে করছ না। এটাই সমস্যা।’ হতাশ কণ্ঠে বলল, রাফি।

‘এসব আবোলতাবোল কী বলছ?’ বহ্নি পাল্টা প্রশ্ন করল, ক্রুদ্ধ হয়ে।

রাফি এবার রুমে ঢুকল, ধীর পায়ে। একটা চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা তুলে বসল। তারপর মুখের নিচে ডান হাতটা ঠেকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বহ্নির দিকে। বহ্নি অধৈর্য গলায় বলল, ‘কী হয়েছে? তুমি এরকম করে কী দেখছ? তুমি কি যাবে না-কি আম্মুকে ডাকব?’

রাফির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়েই আছে। বহ্নি এবার চেঁচিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? এমন পাগলের মতো আচরণ করছ কেন? অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে তোমার এমন আচরণ।’

‘পাগল!’ রাফি এবার মুখ খুলল। মোহাবিষ্ট গলাতেই বলল, ‘পাগল আমাকে তুমি বানিয়েছ, বহ্নি! এটা কি তুমি বুঝতে পারছ না?’

বহ্নির মাথাটা যেন ঘুরে উঠল। চারপাশটা মুহূর্তেই আবছা হতে থাকল। এই মুহূর্তটার ভয়েই সে রাফিকে এভয়েড করত সবসময়। অথচ তার এতসব কিছু সত্ত্বেও মুহূর্তটার মুখোমুখি তাকে হতেই হলো। আত্মীয়তার সম্পর্কের জেরেই সে সবচেয়ে সহজ উপায়টা বেছে নিয়েছিল। তারপরেও…!

‘আই এম ইন লাভ উইথ ইউ, বহ্নি।’ রাফি চেয়ার থেকে উঠে বহ্নির সামনে দাঁড়িয়ে হিম শীতল গলায় বলল।

‘স্টপ, রাফি ভাইয়া।’ বহ্নি পরিস্থিতি সামালানোর জন্য ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে কেবল ভাই হিসেবেই দেখি। এর থেকে বেশি নয়। আজকে যা বলেছ, তা আর কখনোই মুখে আনবে না। এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ।’

‘প্লিজ, বহ্নি। এভাবে আমার ভালোবাসাকে তিরস্কার করো না। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।’ আকুল কণ্ঠে বলল, রাফি।

‘রাফি ভাইয়া!’ বহ্নির রাগ যেন তার কণ্ঠে উপচে পড়ছে। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে সে বলল, ‘তোমার এসব নাটক বন্ধ করো। আর কখনোই আমার সামনে এই ধরনের নাটক করবে না। আর আজকে যা বললে তা কখনোই আমার সামনে বলার সাহস করবে না। প্রথমবারের মতো তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম। দ্বিতীয় বার এই ধরনের স্পর্ধা দেখালে আব্বুর কানে কথাটা যেতে সময় লাগবে না। আর আব্বু ক্ষেপে গেলে তোমার কী হাল হতে পারে তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়।’

রাফি বহ্নির রাগান্বিত কণ্ঠে তব্দা খেয়ে গেল। এরকম রিয়েক্ট করবে তা সে ভাবেনি। নির্বাক হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। কিছু বলতে চাইছে, তবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।

বহ্নি তার কণ্ঠে কাঠিন্য বজায় রেখে আবারও
বলতে শুরু করল,’মনে নেই আমাদের কলেজের ফাহাদের কথা? আমার পিছু নেবার অপরাধে তাকে যে শাস্তি পেতে হয়েছিল তা নিশ্চয়ই তুমি পেতে চাইবে না?’

রাফি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এভাবে তার কাজ হবে না। ভালো সাজাটা তাকে স্যুট করছে না। এবার তার কাছে বিষয়টা স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। বহ্নিকে সে সত্যিই পছন্দ করে। কিন্তু এই কথাটা তাকে বিশ্বাস করানোটা পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ মনে হচ্ছে তার কাছে। রাফি মনে মনে ভাবল, ‘সঠিক সময়ের অপেক্ষা তাকে করতেই হবে।’

রাফি ঘর থেকে বের হবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই
বহ্নি হিম শীতল গলায় বলল, ‘আমার বলা কথাগুলো মনে রেখ। তাতে তোমারই মঙ্গল হবে।’

বহ্নির কথার প্রত্যুত্তরে কোনো কিছু না বলে রাফি একটা বাঁকা হাসি হেসে বেরিয়ে পড়ল।
_________________________________

ফাহমিদা বেগম এখন পুরোপুরি সুস্থ। বাসায় এসেছেন দুদিন হলো। তবে তিনি খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন সবসময়। একদম অন্যমনস্ক হয়ে থেকে কী যেন ভাবেন সর্বক্ষণ! ছোঁয়া তার মায়ের পুরোপুরি খেয়াল রাখছে তবে মাকে এরকম দেখতে তার নিজের খুব খারাপ লাগছে। ছোঁয়ার সাথে সাথে হিয়াও যথাসম্ভব খেয়াল রাখছে। অহনা তার নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল তবে এক দুইবার এসে মায়ের খবর নিতে ভুলেনি। মায়ের মন ভালো করার উদ্দেশ্যেই ছোটোখাটো একটা আয়োজন করে ফেলল হিয়া, সাইফ, মায়া, ছোঁয়া আর অহনা।

ফাহমিদা বেগম নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলেন।
ছোঁয়া এক বাটি ভেজিটেবল স্যুপ তৈরী করে এনে মায়ের দিকে এগিয়ে বলল, ‘মা এটা তাড়াতাড়ি শেষ করো তো।’

ফাহমিদা বেগম শোয়া থেকে উঠে বসে উদাস নয়নে তাকালেন ছোঁয়ার দিকে। তার মেয়েটাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। একদম যেন পরীর মতো। সাদা ফুল স্লিভ ব্লাউজের সাথে আকাশী রঙের জামদানি শাড়ি পরেছে ছোঁয়া। চুলগুলো খোপা করেছে। সামনের কয়েক গোছা ছোটো ছোটো চুল অবাধ্য হয়ে মুখের সামনে চলে আসছে বারেবারে। তা দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। আনন্দে আটখানা হয়ে বললেন, ‘শাড়িটাতে তোকে একদম নীল পরীর মতো লাগছে।’

‘এসব বলে আমাকে ভোলানো সম্ভব হবে না, মা। একটু আগে হিয়া আর মায়া দুজনে জোর করেছে এই শাড়িটা পরার জন্য। তাই বাধ্য হয়েই পরতে হলো।’

ফাহমিদা বেগম প্রচণ্ড অনীহা ভরা কণ্ঠে বললেন, ‘এখন আর খাওয়া সম্ভব নয়। একটু আগেই তো নাস্তা করলাম।’

‘মোটেই একটু আগে খাওনি। প্রায় দু’ঘন্টা আগে নাস্তা করেছ। এখন ঝটপট খেয়ে শেষ করো প্লিজ মা।’ ছোঁয়া বলল, ব্যস্ত ভঙ্গিতে।

হিয়া দ্রুতবেগে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘ছোঁয়া আপু! বিরিয়ানি রাঁধবে না তুমি? মায়া আপু ডাকছে তোমাকে।’

‘আসছি হিয়া। মা স্যুপ খেয়ে শেষ করুক তারপর আসছি।’

হিয়া মায়ের পাশে বসে বলল, ‘আচ্ছা, কী হয়েছে মা? এরকম মনমরা হয়ে থাকছ কেন?তোমার জন্যই তো আজকে ছোটোখাটো এই আয়োজন করা হয়েছে। এখন তুমি যদি এরকম মন খারাপ করে বসে থাকো তাহলে কীভাবে হবে বলো তো?’

‘আমি একদম ঠিক আছি।’

‘তুমি ঠিক নেই মা।’ হিয়া বলল, মায়ের কোলে মাথা রেখে।

‘ঠিক আছি বলছি তো মামণি। আচ্ছা দে আমি এখনই খাচ্ছি।’ ফাহমিদা বেগম ছোঁয়ার হাত থেকে স্যুপের বাটিটা নিলেন।

‘তাহলে এমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকছ কেন?’ হিয়া বলল, অভিমানী গলায়।

‘সত্যি বলতে আমার উপর কে এট্যাক করল সেটা নিয়ে ভাবছি। আমার জীবনের কালো অধ্যায়টা কি আবার খুলতে যাচ্ছে!’ ফাহমিদা বেগম চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন।

‘এসব নিয়ে একদম ভাববে না মা। এরকম কিছুই হবে না। আমি তোমাকে বলছি তো।’ ফাহমিদা বেগমকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল ছোঁয়া।

‘যদি হয়ে থাকে তো?’ ফাহমিদা বেগম সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন।

‘প্রথমত এরকম কিছুই হবে না। আর যদি হয়েও থাকে তবে আমরা আছি তো তোমার পাশে। একবার যখন সব ঠিক হয়েছে তখন দরকার হলে আবার ঠিক করব। আর পুলিশ কিন্তু তাদের কাজ করছে। তাই
এটা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করো না তো মা।’ ছোঁয়া বলল, সতর্ক গলায়।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আর টেনশন করব না।’ পরাস্ত ভঙ্গিতে বললেন, ফাহমিদা বেগম।

‘কথা দিচ্ছ তো?’ ছোঁয়া প্রশ্ন করল, সন্দিগ্ধ কণ্ঠে।

ফাহমিদা বেগম ছোট্ট করে জবাব দিলেন, ‘হুম।’

‘হিয়া, মায়ের পাশে বস তুই। আমি কিচেনে যাচ্ছি। মা স্যুপ শেষ করলে মাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসিস। সবার সাথে কথা বললে মায়ের খুব ভালো লাগবে।’ হিয়াকে কথাগুলো বলেই ছোঁয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

মায়া চুলো থেকে চিংড়ির দোপেয়াজা নামিয়ে রাখল। ছোঁয়াকে রুমে ঢুকতে দেখে সে বলল, ‘বিরিয়ানি কখন বসাবি? দুপুর হয়ে যাচ্ছে তো।’

‘তুই একটা কাজ কর পেঁয়াজ আর মরিচগুলো কেটে দে। আমি বাকিসব রেডি করে চুলোয় বসিয়ে দিচ্ছি।’

‘এতক্ষণ লাগে এসব করতে? আমি হলে এতক্ষণে সব রান্না শেষ হয়ে যেত। খেয়ে ভাত ঘুমও হয়ে যেত। এরপর বিকেলে চা নাস্তা করে গল্পের আসর জমাতে পারতাম।’ সাইফ বলল, কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে।

‘চাপাবাজি কি শেষ? শেষ হলে যেতে পারেন।’ ছোঁয়া বলল, ব্যঙ্গ করে।

‘সত্যি কথা বললেই চাপাবাজি!’ অসহায় মুখ করে বলল, সাইফ।

‘মায়া তোর পেঁয়াজ কাটা লাগবে না সাইফ কাটবে। ওর তো পেঁয়াজ ধরা মাত্রই কাটা হয়ে যাবে। তাই না, সাইফ?’ ছোঁয়া ত্যাড়ছা চোখে তাকিয়ে দেখল সাইফের দিকে।

পেঁয়াজ কাটার কথা শুনে সাইফের চেহারার রঙ পাল্টে গেল মুহূর্তেই। তারপরেও প্রেস্টিজ রক্ষার্থে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘আচ্ছা দে। তোদের থেকে দ্রুত চপ করতে পারব । এতে কোনো সন্দেহ নাই।’

সাইফ কিচেনের একপাশে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজ কাটছে আর একটু পর পরই চোখ মুছছে। তা দেখে মায়া আর ছোঁয়া ঠোঁট টিপে হাসছে। কিন্তু হিয়া কিচেনে এসে তা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তারপর বলল, ‘সাইফ ভাইয়া! পেঁয়াজ কি জীবনে প্রথম কাটছ? কাটতে যখন পারো না তখন কেন যে বাহাদুরি দেখাতে যাও বলো তো?’

সাইফ হিয়াকে ধমকে উঠে বলল, ‘এই চুপ কর। তুই কি আমার থেকে বেশি পারিস?’

‘আরেহ্ না, হিয়া! ও সবসময় কাটে । এসব ওর জন্য কোনো ব্যাপার না। তাই না সাইফ? ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল, মায়া।

সাইফ রাগে ছুরি ফেলে দিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে ক্রমাগত। আর বলছে, ‘উফ্! কী যে জ্বালা করছে চোখ দুটো। একে তো তোদের সাহায্য করতে এলাম আর তোরা মজা নিচ্ছিস আমার সাথে।’

‘মুখে অনেকে অনেককিছুই বলে দিতে পারে। তবে কাজ করতে গেলেই বুঝা যায় কোন কাজটা কত কঠিন আর কোন কাজটা সহজ। কাজ না করার আগ পর্যন্ত কঠিন আর সহজ নির্ধারণ করা বোধহয় সম্ভব নয়। তাই না মায়া?’ ছোঁয়া বাকি পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলল।

‘একদম ঠিক।’ মায়া বলল, উৎফুল্ল কণ্ঠে ।

অনেক দিন পরে সবাই একসাথে খাবার খেতে বসে খুব উৎফুল্ল অনুভব করল। খাবারের প্রশংসা করে ফাহমিদা বেগম বললেন, ‘ছোঁয়া মামণি! বিরিয়ানিটা জাস্ট অসাধারণ হয়েছে।’

ছোঁয়া প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসল। সাইফকে উদ্দেশ্য করে মায়া বলল, ‘সাইফ তোকে আরেকটু বিরিয়ানি দিব?’

সাইফ ত্যাড়ছাভাবে বলল, ‘আমার লাগলে আমি নিজেই নিতে পারব।’

‘ভালা মাইনষের দাম নাই! হাহ্! কথাখান হাছাই কইছে।’ মায়ার কথা শুনে এবার সবাই হাসল।

সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছোঁয়া বলল, ‘বিরিয়ানি খাবার পরে ডেজার্ট খেতে হবে। আজকে সবাইকে ছোঁয়া স্পেশাল ডেজার্ট খাওয়াব। তাই সবাই একটু করে জায়গা খালি রাখিও। আ’ম ফুল বললেও তখন আমার কিছু করার থাকবে না জোর করে খাওয়ানো ছাড়া। সো আগে থেকেই সতর্কবাণী দিয়ে দিলাম।’

হঠাৎ মায়া ভুলবশত বলে বসল, ‘আজকের আয়োজনে শিহরণ থাকলে একদম পূর্ণ হতো।’

হিয়া বলল, ‘মায়া আপু একদম ঠিক বলেছ। আমার মনে ছিল না। মনে থাকলে আমি নিজেই তাকে ইনভাইট করতাম। মায়ের অসুস্থতার সময় শিহরণ ভাইয়া অনেক হেল্প করেছে। আমি তো কখনোই তার এই সাহায্য ভুলব না। অবশ্য এটা ভোলার মতোও নয়।’

অহনা এবার মুখ তুলে তাকাল। বলল, ‘ইশ! আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। নয়তো আমি নিজেই ইনভাইট করতাম শিহরণকে।’

হঠাৎ নাম ধরে ডাকার কারণে ছোঁয়া, মায়া আর হিয়া তিন জন একসাথে তাকাল অহনার দিকে। তিন জোড়া চোখকে সে মোটেই পরোয়া করল না। আবার খেতে শুরু করল।

ফাহমিদা বেগম কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বললেন, ‘আসলেই ছেলেটা আমার জন্য অনেক খাটুনি খেটেছে। অথচ আমি ছেলেটাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলাম না। ওকে আজ আসতে বলা দরকার ছিল। আমার মাথাতেও তো আসলো না কথাটা।’

ছোঁয়া মাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘পরে কোনো একসময় জানিয়ে দিও। তাহলেই তো হলো। এতো আপসেট হবার কিছু নেই। ও এসব কিছু মনে করে না। মনে রাখেও না।’

সাইফ অবাক দৃষ্টিতে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়ার বলা কথাতে সে শিহরণের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস, ভরসা আর নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে। তবে কি তার ধারণাই ঠিক?
______________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৮

শিহরণ অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। মান্নাতের পরিবার আসাতে তাদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তার মা। অথচ মায়ের সাথে তার খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। সে যা শুনেছে তা যদি সত্যি হয়? এটা ভাবতেই সে অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ছে। কখনও মায়ের অবাধ্য হয়নি সে। ছোটোখাটো দুষ্টামির মধ্যেই সবকিছু সীমাবদ্ধ ছিল। সেগুলোর জন্য পর্যন্ত মা বকতে ভুলেনি। আর এখন তাকে না জানিয়ে মা যদি তার জীবনের এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তবে সে কী করবে? আর বাবা যদি মাকে সমর্থন করে তো? তবে তাকে অবাধ্য হতেই হবে। কিন্তু সে অবাধ্য হতে চায় না। তাই ব্যাপারটার সত্যতা যাচাই করাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। অথচ সে কোনো সুযোগই পাচ্ছে না মায়ের সাথে কথা বলার। দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে কথা বলার। একটিবারের জন্যেও সুযোগ পায়নি সে।

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে কিছুটা সময় পার করল সে। কিন্তু তাতেও মন বসছে না। তারপরও অবহেলায় স্ক্রল করতেই থাকল। একসময় কয়েকটা ছবি দেখে সে থমকে গেল। তার মনে এক ধরনের প্রশান্তি বয়ে গেল। ছবিগুলো আপলোড করেছে মায়া। মোট তিনটে ছবি আপলোড করেছে সে। একটাতে ছোঁয়ার পুরো ফ্যামিলি, অন্য দুটোর মধ্যে একটাতে ছোঁয়া, মায়া আর সাইফ, অপরটাতে শুধু ছোঁয়া। কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে দাঁড়িয়ে কফি মেকারে কফি বানাচ্ছে এমন সময় তোলা একটা ছবি। আকাশী রঙের শাড়িটাতে ছোঁয়াকে এক চিলতে নীল আকাশ মনে হলো শিহরণের। যে আকাশে সে একা বিচরণ করতে চায় সারাজীবন। সে ভাবল, নিশ্চয়ই ছোঁয়ার নাকের উপর জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এই ঘর্মবিন্দুর প্রতিও তার ভীষণ হিংসে হলো। তারা যখন তখন ইচ্ছে হলেই ছুঁয়ে দিতে পারে অথচ সে চাইলেও পারে না! এই প্রথম ছোঁয়াকে শাড়ি পরা দেখল সে। কিন্তু সামনাসামনি না দেখতে পাওয়ায় তার ভীষণ আফসোস হচ্ছে।

শিহরণ ছোঁয়ার ছবিটা সেভ করে রাখল। এখন এটাই তার মন ভালো করার ওষুধ। অন্ততপক্ষে যতদিন তার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত।

মেসেঞ্জারে ঢুকতেই মায়াকে একটিভ দেখে শিহরণ ঝটপট করে থ্যাঙ্কস লিখে পাঠিয়ে দিল। সাথে সাথে রিপ্লাই এলো, ‘ইট ওয়াজ আপলোডেড ফর ইউ।’

‘ধন্যবাদও সে কারণেই দিয়েছি।’

‘তুমি বুঝতে পেরেছ?’

‘না পারার কিছু নেই।’

‘ব্রিলিয়ান্ট!’

‘আর শুনতে ভালো লাগে না।’

‘মিথ্যে বলব? আচ্ছা, ঠিক আছে। ডাফার বলব এখন থেকে।’

‘আমাকে ইনভাইট করেনি কেন তোমার বান্ধবী? ইনভাইট করলে আজকের দিনটা আমাকে মিস করতে হতো না।’

‘তাকেই বরং জিজ্ঞেস করিও।’

‘জানতে চাইলেই কি সে বলবে? যেমন ঘাড়ত্যাড়া হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। অবশ্য সব ত্যাড়ামি খালি আমার সাথেই করে।’

‘তুমিও কি কম ত্যাড়া?’

‘আমি মোটেই ত্যাড়া না। আমি একদম ইনোসেন্ট।’

‘ইনোসেন্ট শব্দের অর্থটা আরেকবার পড়ে নিও।’

‘এত করে বলছ যখন তখন পড়ে নিব না হয়।’

মায়া কফি খেতে খেতে শিহরণের সাথে চ্যাট করছিল। তাকে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত দেখে ছোঁয়া বলল, ‘কী রে! আমার দুলা ভাইয়ের সাথে চ্যাট করছিস না-কি?’

‘না! আমার দুলাভাইয়ের সাথে চ্যাট করছি।’ মায়া সহাস্যে বলল, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখে।

‘মানে?’ ছোঁয়া অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘মানে কিছু না।’ প্রশস্ত হেসে মায়া বলল, ‘মজা করছিলাম তোর সাথে।’ এটুকু বলেই সাথে সাথে মোবাইলটা রেখে দিল সাইড টেবিলের উপর।

‘তুইও যা শুরু করেছিস ইদানিং! যখন তখন দেখি মোবাইল নিয়ে কীসব করিস। জানতে চাইলেই বলিস, কিছু না। এটা কিন্তু একদম ঠিক না। বন্ধুদের সাথে এরকম মিথ্যা বলা একদম উচিত না। আর তুই তো জানিস আমি মিথ্যা বলা একদম পছন্দ করি না। যে মিথ্যা বলে তাকেও পছন্দ করি না।’ ছোঁয়া বলল, গম্ভীর গলায়।

কেমন একটা গমগমে পরিবেশ হয়ে গেল মুহূর্তেই। ছোঁয়া এরকম সিরিয়াস হয়ে যাবে তা মায়া বুঝতে পারেনি। সাইফ বুঝতে পারল মায়ার বিহ্বল অবস্থা । পরিস্থিতি সামলাতে সে বলল, ‘তুই এত সিরিয়াস হয়ে যাস কেন সবসময়?’ পরক্ষণেই কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘স্যান্ডউইচ বানিয়েছিস না-কি স্যান্ড দিয়ে উইচ বানিয়েছিস। খাওয়া যাচ্ছে না পর্যন্ত।’

‘কী!’ ছোঁয়া ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ‘কেউ তো বলেনি খেতে খারাপ হয়েছে। তাছাড়া আমার নিজেরও তো ভালো লেগেছে।

‘তুই কষ্ট পাবি বলে কেউ বলেনি আরকি। গোয়ালার গরুর দুধ কি সে কখনও খারাপ বলে? আমি তো বাবা ঠোঁট কাটা মানুষ । তাই সবকিছু স্পষ্ট বলে ফেলি।’ সাইফ গম্ভীর হবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল।

হিয়া বলল, ‘সাইফ ভাইয়া মিথ্যা কথা বলছে ছোঁয়াপু। খেতে অনেক ভালো লাগছে।’

ছোঁয়া তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘খেতে যখন ভালো হয়নি তখন খাচ্ছিস কেন? যা খেয়েছিস পারলে সব বের কর। আর একটা স্যান্ডউইচও খাবি না। আমি এগুলো সব অন্যদের খাওয়াব। যারা এটা পেয়ে খুশি হবে তাদেরকে দিব। তুই একটাতেও হাত দিবি না আর।’ এটা বলেই ছোঁয়া সাইফের হাতের স্যান্ডউইচটা কেড়ে নিল। সামনের প্লেটটাও সরিয়ে নিল।

সাইফ বিড়বিড় করে বলল, ‘যাক বাবা! মায়াকে বাঁচাতে গিয়ে আমি নিজেই ফেঁসে গেলাম। এখন অভুক্ত থাকতে হবে।’ মনে মনে প্রচণ্ড আফসোস করে বলল, ‘ খাবারের বদনাম করাটা ঠিক হয়নি। এখন তো জান গেলেও তাকে খেতে দিবে না। অন্ততপক্ষে আজকের জন্য খাবার অফ।’

মায়ার দিকে সাইফ অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। সাইফের অসহায় দৃষ্টি দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
_______________________________

সকালের দিকে ছোঁয়া অফিসে আসলে শিহরণ তাকে সরাসরি বলল, ‘এবার আমাদের কাজে মনোযোগ দেওয়া উচিত। কী বলেন?’

‘অবশ্যই, স্যার।’ পুনরায় আপনিতে পদার্পণ হতে দেখে ছোঁয়া নিজে এবার বিষম খেল। শিহরণ তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘আন্টি এখন কেমন আছেন?’

‘ভালো।’ ছোঁয়া বলল, মলিন কণ্ঠে। তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

শিহরণ ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘আশা করছি তিনি শীঘ্রই একদম পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন।’

‘হুম।’ ছোট্ট করে জবাব দিল ছোঁয়া ।

‘কে এট্যাক করেছে তা পুলিশ এখনও ধরতে পারেনি। আসলে কোনো ক্লু-ই তো পাওয়া যায়নি। আর আপনার পরিবারের সাথে কারও কোনো পুরনো শত্রুতা আছে কি না এই প্রশ্নের জবাবে আপনার মা বলেছেন, আপনাদের কোনো শত্রু নেই। সন্দেহের তালিকাতেও কাউকে পাওয়া যায়নি। তাই আপাতত কেসটা বন্ধ করতে হয়েছে।’ শিহরণ বলল, এক নাগাড়ে।

‘জি, স্যার। এটাই ভালো হবে সবার জন্য। আসলে মা তার অতীত সম্পর্কে মনে করতে চায় না। সঙ্গত কারণেই তিনি এসব কাউকে বলতে রাজী নন। তাই এই কেসটা বন্ধ করে দেওয়াটাই মঙ্গল। তাছাড়া এটা হয়তো চুরির ঘটনাই ছিল। আমরা সবাই এটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছি তাই মাও আতঙ্কে ছিলেন, সাথে আমরাও।’ ব্যাখ্যা করল ছোঁয়া ।

‘অতীতটা কি আমি জানতে পারি? অবশ্যই যদি আপনার আপত্তি না থাকে।’ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল শিহরণ।

‘আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি এই ব্যাপারে আপনাকে জানাতে পারছি না বলে।’ ছোঁয়া বিব্রত ভঙ্গিতে নিজের অপারগতার কথা জানাল।

‘আপনি বিব্রতবোধ করছেন কেন? বলতে না পারলে কোনো সমস্যা নেই।’ শিহরণ বলল, দ্বিধাহীনভাবে।

‘যাইহোক, এই বিষয়টা ক্লোজ। এবার আমাদের মেইন টার্গেট হলো আমাদের অনুষ্ঠানটা ভালোভাবে আয়োজন করা। কী বলেন?’ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, শিহরণ।

‘অবশ্যই, স্যার।’ ছোঁয়া দৃঢ় কণ্ঠে সম্মতি জানাল।

‘তাহলে যাওয়া যাক।’ শিহরণ নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল।

‘কোথায়?’ বিহ্বল দেখাল ছোঁয়াকে।

‘যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে।’ ভ্রু উঁচিয়ে বলল, শিহরণ।

‘ওকে। আমি ব্যাগ নিয়ে আসছি।’ ছোঁয়া বুঝতে পেরে বলল।

আশ্রমে পৌঁছে স্টেজ সাজানোর সমস্ত জিনিস স্তুপাকারে দেখতে পেল ছোঁয়া আর শিহরণ। কাজ প্রায়ই শেষের দিকে। ফরিদ আর রাফি সেখানেই ছিল। তাদের দুজনকেই কাজের তদারকি করার দায়িত্ব দিয়েছে শিহরণ।

ছোঁয়ার মায়ের উপর এট্যাক হওয়ার কারণে শিহরণ একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে কাজ দিয়ে দিয়েছে। এই কারণে সে এতদিন নিশ্চিত ছিল। স্টেজটা তৈরী করা হয়ে গেছে। আশ্রমের কয়েকজন ছেলেমেয়েও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকদের সাথে কাজে যোগ দিল। বিকেল হতে হতে সবাই মিলে সব কাজ শেষ করে ফেলল। সারাদিনের কাজের শেষে সবাই ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছে। সবাই যখন স্ন্যাকস খাওয়াতে ব্যস্ত তখন ছোঁয়া একাই হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

অনেকগুলো বাচ্চা একসাথে খেলছিল। ছোঁয়া সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখছে। খেলা শেষে অল্পক্ষণের মধ্যেই ছোঁয়ার সাথে জমে গেল আশ্রমের বাচ্চাগুলোর সাথে। ছোঁয়া ঘাসের উপর বসে বাচ্চাগুলোর সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।

বাচ্চাদের মধ্যে আরাভ নামের এক পিচ্চি বারবার এসে ছোঁয়ার সাথে কথা বলছে। ছেলেটার বয়স আট কি নয় হবে হয়তো। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ছোঁয়ার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলল। ছোঁয়াকে খুঁজতে খুঁজতে শিহরণও সেখানে এসে দাঁড়াল। আসার সময় সব বাচ্চাদের জন্য চকলেট নিয়ে এসেছে ছোঁয়া। ব্যাগ থেকে বের করে সবাইকে চকলেট দিল। কিন্তু আরাভ নিল না। সে খুব ভাব দেখিয়ে বলল, ‘আ’ম নট আ কিড।’

ছোঁয়া অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে তুমি কি?’

আরাভ বলল, ‘আমি এখন অনেক বড়ো হয়েছি।’

আরাভের কথা শুনে ছোঁয়া অনেকক্ষণ হাসল। অন্য বাচ্চাগুলোও বেশ মজা পেল। তবে আরাভের একটুও ভালো লাগেনি। তা তাকে দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে।

ছোঁয়া তা বুঝতে পেরে বলল, ‘ওকে। তোমাকে কি বলে ডাকা যায় বলো তো?’

আরাভ প্রশস্ত হেসে বলল, ‘আমাকে শুধু আরাভ বলে ডাকবে।’

শিহরণ দাঁড়িয়ে থেকে আরাভের কাণ্ড দেখছে । আরাভ আশ্রমের পাশের একটা আবাসিক এলাকায় থাকে। প্রতিদিন বিকেলে আশ্রমের বাচ্চাদের সাথে খেলার জন্যই সে এখানে চলে আসে। এই আরাভ হচ্ছে একটা বদের হাড্ডি; শিহরণের তা অজানা নয়। পুঁচকে বাচ্চা হলে কী হবে! নিজেকে বাচ্চা বলে সে মানতেই চায় না।

শিহরণ এক পর্যায়ে আরাভকে ডেকে বলল, ‘সমস্যা কী তোর?’

আরাভ ডোন্ড কেয়ার ভাব দেখিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘শিহরণ ভাইয়া! আমার কোনো সমস্যা নেই।’ তারপর চিন্তিত সুরে বলল, ‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সমস্যা আপনার!’

শিহরণ যারপরনাই অবাক। কোনোরকমে বলল, ‘আমার আবার কীসের সমস্যা?’

‘দ্যাট নাইস লেডি ইজ ইওর প্রবলেম । রাইট? আমাকে তোমার চাইতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তাই তোমার ভয় হচ্ছে।’ আরাভ গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলল।

আরাভের কথা শুনে শিহরণ বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘আমার ভয় হচ্ছে। কেন?’

‘তোমাকে যদি ছেড়ে দেয় আমার জন্য। সেই ভয়।’ আরাভ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘আফটার অল আ’ম মাচ মোর হ্যান্ডসাম দ্যান ইউ।’

শিহরণ আরাভের কথা শুনে বোকা বনে গেল। এই বয়সেই এত এডভান্সড এই ছেলে সামনে কী করবে সে!

‘আরাভ! বাবু তুমি কোথায়?’ আরাভের মা তাকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে এলো।

মাকে দেখতে পেয়ে আরাভ খুব বিরক্ত হলো। এই সময়েই তার মাকে এন্ট্রি নিতে হলো! সে এখনও একটু কথা পর্যন্ত বলতে পারল না। তার মধ্যেই মা খুঁজতে চলে এলো। আর দশটা মিনিট পরে আসলেই তো হতো। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আরাভ বলল, ‘আম্মু! তোমাকে কতোবার বলেছি আমাকে বাবু ডাকবে না। আমি তো বড় হয়েছি। তাই না?’

‘আচ্ছা, বাবু! আর বাবু বলে ডাকব না।’

‘উফ্! আম্মু। তুমি তো আবারও বাবু বলেই ডাকছ।’ আরাভের প্রেস্টিজ ধুয়ে দেওয়াতে তার খুব রাগ হলো।

শিহরণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আরাভ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল তার দিকে। যেন চোখ দিয়েই তাকে খুন করবে। শিহরণ নিজের হাসি আটকে গম্ভীর গলায় বলল, ‘বাবুকে বাবু বলেই তো ডাকবে। বাবু এবার আম্মুর সাথে বাসায় যাও।’

‘হ্যাঁ, বাবু চলো।’ আরাভের মা শিহরণের সাথে গলা মেলাল।

‘আম্মু, আমি এই নাইস লেডিকে একটু চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাই তারপর বাসায় আসব।’ আরাভ ঠোঁট বাঁকিয়ে মিনতি করে বলল।

ছোঁয়া বেশ মজা পাচ্ছিল। বাচ্চাটাকে বেশ মজার লাগল তার । সে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময়
শিহরণ বাগড়া মেরে ছোঁয়ার হাত ধরে বলল, ‘সো নাইস অফ ইউ। তোমার এই নাইস লেডিকে আমিই চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাব। ঠিক আছে?’

‘একদম ঠিক নেই। মাম্মি, প্লিজ। লেট মি ডু ইট।’ মায়ের কাছে মিনতি করতে করতে আরাভ চোখ রাঙিয়ে একবার তাকাল শিহরণের দিকে। যেটা স্পষ্ট হুঁশিয়ারি ছিল শিহরণ যাতে ছোঁয়ার হাত ছেড়ে দেয়।

‘তোমার টিচার আসবে এখন। বাসায় চলো। শিহরণ ভাইয়া তোমার আপুকে ঘুরিয়ে দেখাবে।’ আরাভের মা বলল, আরাভকে আশ্বস্ত করতে।

‘আপু! প্লিজ মম, ডোন্ট কল হার আপু। শি ইজ সো ইয়াং অ্যান্ড আ ভেরি বিউটিফুল লেডি আফটার অল।’ আপু বলাতে আরাভ যেন খুব কষ্ট পেল।

আরাভের মা তাকে টেনেটেনে নিয়ে যাচ্ছে। আরাভ বারবার পেছনে ফিরে দেখছিল ছোঁয়াকে। ছোঁয়া সহাস্যে তাকে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। একটা গোলাপ গাছ দেখতেই আরাভ তার মায়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গোলাপ গাছটা থেকে একটা লাল গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে ছোঁয়ার দিকে
দৌড়ে আসল। তারপর গোলাপ ফুলটা ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দিস রোজ ইজ ফর এনাদার বিউটিফুল এন্ড এলাইভ রোজ।’

ছোঁয়া তার হাত থেকে গোলাপটা নিল। তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘থ্যাংক্স ইউ লিটল স্টার।’

আরাভ গাল ফুলাল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘প্লিজ, রোজ! ডোন্ট কল মি লিটল স্টার। ওয়ান ডে আই উইল ম্যারি ইউ। রিমেম্বার ইট।’

ছোঁয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘ওকে। আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য।’

আরাভের মা এসে তাকে নিয়ে গেল। আরাভ যেতে যেতে শিহরণকে ওয়ার্ন করে গেল। তার কাছে এসে কানেকানে বলল, ‘শী ইজ মাইন। ডোন্ট ফরগেট ইট। আমার রোজের কাছ থেকে দূরে থাকবে শিহরণ ভাইয়া।’

আরাভ চলে যেতেই শিহরণ বলল, ‘তোমার নতুন প্রেমিককে দিয়ে আমাকে তো ভালো মতোই শাসালে।’

ছোঁয়া অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। বলল, ‘প্রেমিক! ও একটা বাচ্চা ছেলে, শিহরণ।’

‘বাচ্চা! বাচ্চা আর সে! ছোটা প্যাকেট বড়া ধামাকা।’ শিহরণ বলল, স্মিত হেসে।

প্রথম যেদিন এসেছিল সেদিনই ছোঁয়ার খুব ইচ্ছে ছিল পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখার। কিন্তু তা হলো না। কিন্তু এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন তো অনায়াসেই ঘুরে দেখা যায়। হাঁটতে হাঁটতে আশ্রমের পেছনের দিকে পৌঁছে গেল সে। ছোঁয়ার পেছন পেছন হাঁটছে শিহরণও। একজন গভীরভাবে নিবিষ্ট প্রকৃতির মাঝে, অপরজন নিবৃষ্ট তার প্রকৃতিপ্রেমী প্রিয়তার মাঝে।

আশ্রমের পেছন দিকটাতে বয়ে গেছে একটা নদী।
নদীতে ঘাট বাঁধা। ছোঁয়া সেখানে গিয়ে বসল। আশেপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নাম না জানা হরেক রকমের গাছগাছালি। মৃদু বাতাসে গাছের হালকা ডালগুলো নড়ে উঠছে। কিছু নাম না জানা পাখি থেকে থেকে ডেকে উঠছে তারস্বরে। বিকেলের রোদটা মরে এসেছে। ছায়াশীতল পরিবেশ আরও বেশি মনোমুগ্ধকর হয়ে গেছে শীতল স্নিগ্ধ বাতাসে। আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোঁয়া মুগ্ধ হয়ে
সেদিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।

‘ভালো লাগছে এখানে?’ শিহরণ জানতে চাইল, মৃদু স্বরে ।

ছোঁয়া ফিরে তাকাল না। জানে তার আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাই তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর তা তার দেখার প্রয়োজন নেই। সে না দেখেই বেশ অনুভব করতে পারে।

বেশ কিছু সময় পরে শিহরণ ছোঁয়ার পাশে বসল। ছোঁয়ার দৃষ্টি তখন নদীর ঠিক মধ্যেখানে ফুটে থাকা পদ্মফুলের দিকে। নদীটাতে যেন পদ্মফুলগুলো রাজত্ব করছে। কী মোহনীয় লাগছে ফুলটাগুলোকে। আরাভের দেয়া গোলাপটা এখনও ছোঁয়ার হাতেই শোভা পাচ্ছে। ছোঁয়া পদ্মফুল থেকে নজর সরিয়ে গোলাপ ফুলটা দেখতে থাকল।
__________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-২৩+২৪+২৫

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৩

বিষণ্ণ চেহারায় হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। তার মনটা ভীষণরকমের খারাপ। চেহারায় এখনও কান্নার জলের শুকনো ছাপ স্পষ্ট। সে ভাবতে পারছে না কিছুই। রাতের অন্ধকারের মতো গাঢ় কালো অধ্যায়টা কি এসে হানা দিয়েছে তাদের জীবনে? সে তো ভেবেছিল সেই কৃষ্ণগহ্বরের ন্যায় তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়টা তাদের জীবন থেকে মুছে গেছে। তার মায়ের মুখে তো সবসময় হাসির রেখাই থাকার কথা, এতটা কাল ছিলও। তাই সে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু এখন সবকিছুই কেমন যেন ধোঁয়াটে লাগছে তার নিজের কাছে।

ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় কয়েকজন পথচারীর আনাগোনা এখনও চলছে নির্নিমেষ। কিন্তু ছোঁয়ার দৃষ্টিটা কেবল অসীমে গিয়ে মিশতে চাইছে।

‘এভাবে আর কতক্ষণ কিছু না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি তুই? গতকালও তেমন কিছুই খাসনি।’ প্রশ্ন করেই বিভ্রান্ত দেখাল মায়াকে। পরক্ষণেই ছোঁয়াকে আশ্বস্ত করতে বলল, ‘আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। দেখিস, আন্টির কিচ্ছু হবে না। অপারেশন তো ভালোমতোই শেষ হলো।’

ছোঁয়া কোনো জবাব দিল না। তার দৃষ্টি অসীমের কোনো এক অজানা বিন্দুতে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ভাবনাতে মাকড়সার জালের মতো নানান দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে গেল সে কিছুই বুঝতে পারছে না কোনোভাবেই! কে আঘাত করেছে তার মাকে সেই চিন্তাটা তার মাথাতে ধুম্রজালের মতো চারিদিকে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘কী হলো? কিছু বলছিস না কেন? হিয়ার অবস্থা দেখেছিস? মেয়েটাকে কাল জোর করে যা একটু কিছু খাইয়েছিস তুই। কিন্তু আজ তো সে কিচ্ছু মুখে দেয়নি। এখনও কান্না করেই যাচ্ছে।’ মায়া আবারও ছোঁয়াকে বুঝানোর এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল।

এবারও ছোঁয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলো না মায়া। তার কিছুটা রাগও হলো। এভাবে ভেঙে পড়লে কি চলে? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো মায়া। নরম গলায় বলল, ‘ এতটুকুতে ভেঙে পড়লে চলবে না ছোঁয়া। তোকে শক্ত হতে হবে।’

‘আমরা এইরকম দুর্বল ছোঁয়াকে তো চিনি না। আমরা যে ছোঁয়াকে চিনি সে তো খুব স্ট্রং।’ সাইফ বলল, দৃঢ় কণ্ঠে।

মায়া সাইফের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছিস। এই বিধ্বস্ত ছোঁয়াকে আমি নিজেই চিনতে পারছি না।’

‘প্লিজ, ছোঁয়া! বি স্ট্রং।’ সাইফ বলল, অনুনয়ের সুরে।

মায়া ছোঁয়ার কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আমরা সবাই তো আমি তোর সাথে। ভয় কিসের? আমরা একসাথে সবাই মিলে সবটা সামলে নিব।’

এবার করুণ দৃষ্টিতে তাকাল ছোঁয়া। তার চাহনি দেখে আঁতকে উঠল মায়া আর সাইফ দুজনেই।

মায়া সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল,’তুই যা ভাবছিস তা নাও হতে পারে। হয়তো কোনো চোর ছিল। আন্টি দেখে ফেলার কারণে পেছন থেকে আঘাত করে পালিয়ে গেছে।’

সাইফ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘চোর হবার সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ তখন বাসায় কেউই থাকার কথা ছিল না। আর এই খবরটা হয়তো কোনো না কোনোভাবে বাইরে থেকে জানাজানি হয়েছিল। আন্টির কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হওয়াতে তিনি বাসায় চলে আসলেন। হিয়া এসেই তো প্রথম দেখল। তারপর তোকে কল করার পরে আমাকে জানাল।’

মায়া মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘শিহরণ আমাকে কল না করলে তো আমি জানতেই পারতাম না।’

সাইফ বলল, ‘শিহরণ কে?’

মায়া আঁতকে উঠল। একটা ছোটোখাটো ভুল করে ফেলেছে সে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আমাদের পুরনো বন্ধু। তুই চিনবি না।’

_____________

শিহরণ হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে খোলা জায়গায় পায়চারি করছিল। তার ভেতরে এক অদ্ভুত রকমের অশান্তির কাঁটা বিঁধছে। ছোঁয়াকে নিয়ে যেদিন আশ্রমে গেল সেদিন তারা মোটামুটি সব কাজ সবাইকে বুঝিয়ে দেবার পরে সন্ধ্যার দিকে ছোঁয়ার নাম্বারে কলটা এলো। কলটা কাটার পরপরই মারাত্মক কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটা। হাঁউ মাউ করে কেঁদেছিল সে। কান্নার দমকে কাঁপছিল মেয়েটা। তার কথা পর্যন্ত শিহরণ বুঝতে পারেনি প্রথমে। ছোঁয়ার এরকম বিধ্বস্ত অবস্থা সে আগে কখনও দেখেনি। শিহরণ অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর কেঁদে কেঁদে কেবল বাসায় যাবে বলেছিল। ঘটনা কী ঘটেছে তা বুঝতে না পারলেও শিহরণ এক মুহূর্তও কালক্ষেপণ করেনি। ছোঁয়াকে নিয়ে সোজা ছোঁয়ার বাসায় চলে এলো। ছোঁয়াকে একা ছাড়তে মন চাইল না তার । তাই তার পিছন পিছন সেও ছোঁয়াদের ঘরে ঢুকল। ঢুকতেই কান্নার শব্দ কানে এলো। ছোঁয়া সোজা ফাহমিদা বেগমের রুমে চলে গেল। পুরো ফ্লোরে রক্ত আর রক্ত। পুরো মেঝে লাল হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, কেউ পেছন থেকে ভারী কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। কিন্তু যেটা দিয়ে আঘাত করেছে সেটা কোথাও দেখতে পেল না শিহরণ। ঘরের জিনিস ছড়ানো ছিটানো। তবে তার মুখোমুখি অর্থাৎ ঘরের জানালাটার গ্রিল কাটা। অর্থাৎ যেই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে সে আচমকা কাজটি করেনি বরং পরিকল্পনা করেই আক্রমণ করেছে। প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে আঘাত করেছে মহিলাকে।

হিয়া আর অহনা তখন কান্না করছিল। ফাহমিদা বেগমের চেতনাহীন দেহ পড়ে আছে ফ্লোরের উপর। ছোঁয়াও তার মাকে জড়িয়ে ধরে হাঁউ মাউ করে কাঁদছে। শিহরণ পাশে বসে নার্ভ চেক করে দেখল, তিনি এখনও জীবিত আছেন। তাই আর কোনো প্রকার বিলম্ব না করেই ফাহমিদা বেগমকে হাসপাতালে নিয়ে এলো।

শিহরণ নিজ দায়িত্বে তাকে এডমিট করাল। তারপর হাসপাতালের সমস্ত ফর্মাল কাজ শেষ করে অপেক্ষা করছিল সে। কিন্তু ছোঁয়া তাকে চলে যেতে বলাতে তার অভিমান হয়েছিল। তাই কোনো প্রকার বাক্যব্যয় না করেই সে বেরিয়ে এসেছিল। তবে মায়াকে কল করে হাসপাতালে যেতে বলার কথা ভুলেনি সে। বাসায় এসেও শান্তি পাচ্ছিল না সে। পুরো একটা দিন অশান্তিতে কাটাল সে। সর্বক্ষণ কল করে খবর নিয়েছে মায়ার কাছ থেকে।

অফিসে গিয়েও কাজে মন দিতে পারেনি সে। ছোঁয়াকে অবশ্য সেই ছুটি দিয়েছে। অফিস শেষে বাসায় গিয়ে আবারও হাসপাতালে এসেছিল সে। ডাক্তারের কাছ থেকেও খবর নিয়েছে। ভদ্রমহিলার অবস্থা খুব একটা ভালো না। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে। অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি ভদ্রমহিলার।

তাই আজকে বিষণ্ণ মনে হাসপাতালের কাছাকাছি জায়গায় পায়চারি করছিল শিহরণ। এখান থেকে সে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে। বিষণ্ণ ধূসর চোখ জোড়া তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। মোবাইলটা বেজে উঠতেই সে তাড়াতাড়ি রিসিভ করল।

‘আমি ওকে বুঝাতে পারছি না শিহরণ, এখন পর্যন্ত ওকে কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। অনেক বুঝিয়েও কোনো কূল করতে পারলাম না। আমার মনে হয় তোমার এখানে থাকা দরকার।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মায়া।

‘আমি এক্ষুণি আসছি, মায়া।’ উত্তেজিত গলায় বলল, শিহরণ।

শিহরণ আসার সময় সবার জন্য খাবারের প্যাকেট আর পানি নিয়ে আসল। মায়ার সাথে দেখা হতেই খাবারের প্যাকেট ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘এগুলো অহনা আর হিয়াকে দাও। আর হ্যাঁ, তুমিও খাবে। আমি প্রিয়তাকে দেখছি।’

মায়া মৃদু হাসার চেষ্টা করল। ছোঁয়া তখনও উদাস নয়নে রাতের শহর দেখছিল। শিহরণ পেছন থেকেই বলল, ‘প্রিয়তার কি খুব মন খারাপ?’

কাঙ্ক্ষিত মানুষটার কণ্ঠ শুনে ছোঁয়া চকিতে তাকাল তার দিকে। কিন্তু কিছুই বলল না। শিহরণ এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’এত সামান্যতে হেরে যাওয়ার মতো কি কিছু হয়েছে?’

ছোঁয়া স্থির দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকল শিহরণের দিকে। পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আবার কেন এসেছ?’

শিহরণ এই কথার জবাবে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আমার ইচ্ছে। আমার ইচ্ছের উপর কারও কোনো জোর নেই।’

তারপর ছোঁয়ার হাত ধরে পাশের বেঞ্চটাতে জোর করেই বসাল। ছোঁয়া শিহরণের এমন কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেল মুহূর্তেই। শিহরণ খাবারের প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খাবার খেয়ে নাও। আজ সারাদিন না-কি কিছুই খাওনি?’

‘তুমি এখানে কি করছ? তোমাকে না যেতে বলেছিলাম?’

‘আমি এখানে যাই করি না কেন তোমার জানার কোনো প্রয়োজন নেই। যা বলছি তা করো।’ তিরিক্ষি মেজাজে বলল, শিহরণ। পরক্ষণেই নিজের কণ্ঠের কাঠিন্যতা দূর করে নরম গলায় বলল, ‘আমাকে যেতে বলেছিলে বিধায় আমি চলেও গিয়েছিলাম কিন্তু তোমার অবুঝের মতো আচরণের কারণে আমাকে আসতে হলো।’

‘আমি খাব না এখন। আমার মায়ের অপারেশন হয়েছে। মায়ের অবস্থা ভালো না। আর তুমি আমাকে খেতে বলছ?’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ছোঁয়া।

‘হুম, বলছি। কারণ আন্টি যদি জানেন তবে তিনি বেশি রাগ করবেন। আর আন্টি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবেন। এই ব্যাপারে আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি।’ ছোঁয়াকে ভরসা দিয়ে বলল, শিহরণ।

‘তুমি কীভাবে জানো? মায়ের মাথায় কতটা আঘাত পেয়েছে দেখেছ? কত রক্ত বেরিয়েছে দেখেছ তুমি?’ এবার কেঁদে ফেলল ছোঁয়া। তাকে দেখে ভীষণ করুণ লাগছে।

‘আমি দেখেছি। তুমি কি ভুলে গেছ, কাল রাতে আমি এখানেই, তোমার সাথেই ছিলাম। আজ সকালে গিয়ে পুলিশ কমপ্লেইনও করে আসলাম।’

ছোঁয়া এ কথার উত্তরে কিছু বলল না। মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। শিহরণ এবার না পারতে খাবারের প্যাকেট খুলে নিজেই খাবার তুলে ধরল ছোঁয়ার সামনে। ছোঁয়া মুখ ফিরিয়ে নিলো।

‘এসব বাহানা একদম চলবে না, প্রিয়তা। খেতে বলছি খাও । ডাক্তারের সাথে এই তো একটু আগেই কথা বলেছি আমি, তিনি বললেন আন্টি তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন। তুমি আগে খাও। তারপর তোমার সাথে কথা বলব আমি।’

‘হিয়া, অহনা, মায়া, সাইফ ওরা খেয়েছে?’

‘হুম।’ শিহরণ ছোট্ট করে বলল। তারপর বিজ্ঞের মতো করে বলল, ‘তুমি যদি না খাও আন্টি কিন্তু ভীষণ বকবে। বকা খেতে চাও?’

বাচ্চাদের মতো করে ছোঁয়া মাথা নাড়ল। তারপর কী মনে করে শিহরণের হাত থেকে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে চুপচাপ খেতে শুরু করল। শিহরণ অভিমানী গলায় বলল, ‘আমার হাত থেকে খেতেও তোমার আপত্তি। তাই না?’

‘হুম।’

‘কেন?’

‘কারণ নেই।’

‘অবশ্যই আছে।’

‘সবকিছুতে কারণ থাকে না ।’

‘অবশ্যই থকে। আর সেটা না বললেও আমি বুঝতে পারছি।’

‘কি বুঝতে পারছ?’

‘তুমি লজ্জা পাচ্ছ। এটাই কারণ।’

‘একদম না।’

‘একদম।’

‘তুমি খেয়েছ?’

‘আমার চিন্তা কি কেউ করে নাকি?’

‘তোমার কি আর আমার জীবনের মতো কোনো দুশ্চিন্তা আছে?’

‘থাকতে পারে না?’

‘না।’

‘কেন?’

‘দেখি না তো কোনো কারণ।’ খেতে খেতে ছোঁয়ার নাকে মুখে খাবার উঠে গেল।

‘আস্তে খাও। ট্রেন ধরতে হবে নাকি?’ শিহরণ পানি এগিয়ে দিল তার দিকে। ছোঁয়া ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পানিটা খেল।

‘তুমি খেয়েছ কি না বললে না তো?’

‘খাইনি বললে কি আর তুমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবে?’

ছোঁয়া অদ্ভুতভাবে তাকাল তার দিকে। কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর খাবার এগিয়ে দিলো তার দিকে। শিহরণের চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তির ঝলক দেখা দিল। খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠল। যা ছোঁয়ার চোখ এড়াল না।

‘এখন কি এভাবেই তাকিয়ে থাকবে? খাবে না?’

শিহরণ খাবারটা মুখে নিল। বলল, ‘আমার জীবনে তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া খাবারের মধ্যে এই খাবারটাও নাম লিখিয়ে নিলো।’

‘মিথ্যে বলা তুমিও শিখেছ।’

‘মিথ্যে মনে হলো কেন?’

‘মিথ্যে বলছ তাই।’

‘তাহলে মিথ্যেই ধরে নাও।’

‘ধরব কেন? মিথ্যেই তো বললে।’

শিহরণ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। তার ঠোঁটে হাসির রেখা। মায়া আর সাইফ দুজনেই দেখল এই দৃশ্যটা।অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সাইফের মনে হঠাৎ একটি প্রশ্নের উদয় হলো, ‘ছোঁয়া আর শিহরণের চোখ কি অশ্রুতে চকচক করছে? না-কি অন্যকিছু?’

_____________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৪

ফাহমিদা বেগম এখন কিছুটা সুস্থ। আশঙ্কা অনেকটাই কেটে গেছে। তবে হাসপাতালে আরও কিছুদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। তাই ডিসচার্জ করা হয়নি।
তবে তিনি এখনও তেমন কিছু খেতে পারছেন না। তরল জাতীয় খাবারই এখন একমাত্র ভরসা। তাও ছোঁয়া অনেকটা জোর করেই খাবার খাওয়ায়। প্রতিদিন মায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদের খাবার নিজ হাতে তৈরী করে আনে মেয়েটা। অথচ ফাহমিদা বেগম খেতে পারেই সামান্যই। বাকিটা অহনা, হিয়া, সাইফরা মিলে গাপুসগুপুস করে খেয়ে সাবাড় করে ফেলে। সাইফ তো সেদিন বলেই ফেলল, ‘তোর হাতের রান্না এতো মজা। মাঝেমধ্যে আমাদের উপর দয়া পরবশ হয়ে হলেও তো রাঁধতে পারিস।’

সাইফের কথা শুনে অহনা মুখে ভেংচি কাটল। মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘আমার হাতের রান্না কিন্তু এর থেকেও বেশি সুস্বাদু, সাইফ ভাইয়া। মনে নেই তোমাকে সেবার পায়েশ খেতে দিয়েছিলাম।’

সাইফ তখন মজার ছলে বলেই ফেলল, ‘গোয়ালার গরুর দুধ কি সে কভু খারাপ বলে?’ চোখে মুখে তীব্র কষ্টের ছাপ এনে আবার বলল, ‘সেই পায়েশের কথা বোধহয় এই জনমে ভুলব নারে অহন! বাথরুমের সাথে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরী হয়েছিল। এটা কি ভুলার মতো কিছু?’ সাইফের কথা শুনে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। তবে ছোঁয়া তখন প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, ‘এটা যে হাসপাতাল সেটা কি ভুলে গেছিস, সাইফ?’

সাইফ ইনোসেন্ট ভাব ধরে রেখেই বলেছিল,’আমি তো পিঁপড়ের বাচ্চার মতো করে কথা বললাম। আর তুই হাতির বাচ্চার অপবাদ দিচ্ছিস। এটা তো ভারি অন্যায় এই অধমের প্রতি।’

‘আবার মজা করছিস! এটা কি মজা করার জায়গা?’
ছোঁয়ার চোখে যেন প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা দেখতে পেল সাইফ। তাই চুপ করে গেল মুহূর্তেই।

মুখে অসহায় ভাব এনে বলল, ‘আচ্ছা, দোস্ত! আজকের মতো মাফ করে দে।’

ছোঁয়া কিছু বলল না। বুকের উপর দু’হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তাই অপারগ সাইফ, কুঞ্চিত ভ্রু আর মুখাবয়বে দুঃখী দুঃখী ভাব এনে তাকাল মায়ার দিকে। মায়া তখন কপট দুঃখিত হবার ভান করে বলল, ‘এই ব্যাপারে আমি অধমের জন্য কিছুই করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত । তবে সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগানো হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হলো ।’

সাইফ তা শুনে খুশিতে বাক বাকুম হয়ে বলল, ‘দ্যা মোস্ট কিউট অ্যান্ড সুইট মায়া। এত্ত সুইট যে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’

‘বাছাধন! অতিরঞ্জন অনাবশ্যক ও বিধ্বংসী।’ টেনে টেনে সাবধানী গলায় বলল, মায়া।

ছোঁয়া মায়ের হাত ধরে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর হাতে চুমো খাচ্ছে। চোখে স্পষ্ট জল। যাতে না ঘুমানোর কারণে চোখের নিচে কালি পড়েছে। ফাহমিদা বেগম চোখ খুলতেই ছোঁয়া বলল, ‘এখন কেমন লাগছে মা?’ ফাহমিদা বেগম কাতর নয়নে তাকালেন ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়া মায়ের উত্তরের অপেক্ষা না করেই পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে, মা। আমি নিজে তোমার দেখাশোনা করব। দেখো, তোমার একটুও কষ্ট হতে দিব না।’

মায়া তখন ওর পাশেই বসে ছিল। সে মনে মনে ভাবছে, ‘সৎ মাকেও এরকম গভীরভাবে কেউ কি ভালোবাসতে পারে!’ পরক্ষণেই মনে এলো, ‘ছোঁয়ার মতো মেয়ে সব পারে। এদের মতো মেয়েদের আপন করে নেবার ক্ষমতা খুব বেশি।’

কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ ইন্টারোগেশন করতে এসেছিল। কিন্তু তেমন কোনো তথ্য জানতে পারেনি। ফাহমিদা বেগম খুব একটা কথা বলতে পারছেন না। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাবার কারণে ডাক্তার তাকে প্রেশার দিতে নিষেধ করেছেন। তারপরেও পুলিশ একটু আধটু প্রশ্ন করেছে। তবে তেমন কোনো তথ্য জানতে পারেননি। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে আক্রমণকারীকে ফাহমিদা বেগম দেখতে চিনতে পারেননি। যদিও মুখ ঢাকা ছিল না। কিন্তু পেছন থেকে হামলা করার কারণে ফাহমিদা বেগম প্রচণ্ডভাবে আঘাত পাবার কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। যার কারণে তিনি প্রায় সাথে সাথেই সেন্সলেস হয়ে যান। তাই ঝাপসাভাবে লোকটার চেহারা দেখতে পারলেও চিনতে পারেননি।

বাকিটা খুঁজে বের করা পুলিশের কাজ। যদিও কোনো প্রকার এভিডেন্সও খুঁজে পায়নি তারা। তবুও অপরাধী কিছু না কিছু ক্লু নিশ্চয়ই রেখে গেছে, সেখান থেকেই তারা খুঁজে বের করবে।

ওই সময়টাতে বাসায়ও কেউ ছিল না। আততায়ীর কাছে এই তথ্যটা ছিল এই বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত। কেউ না থাকার কারণেই নিজের কাজ আদায় করেই জানালা দিয়ে খুব সহজেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্য কী ছিল তার? এটা কোনোভাবেই কেউ অনুমান করতে পারল না। কারণ বাসার কোনো জিনিস লুটপাটের মতো কিছুই চোখে পড়েনি। ভিক্টিম সুস্থ হলেই বোঝা যাবে পুরো ঘটনা।

_________________________

বাসায় যেতে মন চাইছে না অতলের। আজ সকালেও এক প্রস্থ বকাঝকা শুনেছে বাবার কাছ থেকে। সে ভেবে পায় না, তার বাবা তাকে এত বকাঝকা করে কেন? তার দোষটা কী? এখন তো তার বকা খাওয়ার বয়স নেই। সে নিজের ভালোমন্দ নিজেই বুঝতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারপরেও বাবার ইচ্ছার কাছে সে তার নিজের ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়েছে। প্রকোশলী হবার সুপ্ত প্রগাঢ় বাসনা ছিল তার। বাবার ইচ্ছে তাকে একজন গেজেটেড কর্মকর্তা হতে হবে। তাই সে বাবার ইচ্ছের জন্য মুহূর্তেই নিজের স্বপ্নের কথা ভুলে গেল। তারপরেও কেন বাবা এমন করে সে ভেবে পায় না? মাঝেমধ্যে তার মনে প্রশ্ন জাগে, সে কি আদৌ তার বাবা-মায়ের সন্তান না-কি তাকে কুড়িয়ে পেয়েছে? কই আতিক ভাইকে তো বাবা তার মতো ঝাড়ির উপর রাখে না। তানিয়াকে বকা দেয় না বাবা। কেবল তাকেই সমস্ত ঝাড়ি খেতে হয়। মাঝেমধ্যেই সে অতিষ্ট হয়ে পড়ে এসব কারণে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সামলে নেয় নিজেকে। কারণ তার মা তো তাকে ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের জন্য সে সবটা করতে পারে, সবটা সহ্যও করতে পারে। মন খুব খারাপ থাকার কারণে আজ পড়াতেই মন বসেনি তার। লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। সাথে আছে তার নিত্যসঙ্গী আয়মান।

আয়মানকে চলে যেতে বললেও সে যেতে রাজী হয়নি। তার সাথেই আছে। পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করছে।আয়মানের মাথাতে এখনও বহ্নি টপিক আছে। অতলকে বুঝাতে চায় সে, যে মেয়েটা তাকে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু সাহস যুগিয়ে উঠতে পারছে না। কেমন চণ্ডাল রাগ তার বন্ধুর তা তার থেকে ভালো কেউ তো আর জানে না। তাই বন্ধুর উদ্দেশ্যহীন হাঁটাতে সেও সঙ্গী হলো।

অণেকক্ষণ যাবৎ হাঁটার পর একটা পার্কের কাছাকাছি আসতেই অতল থমকে দাঁড়াল। আয়মান বলল, ‘এখানে রাত যাপনের উদ্দেশ্য আছে না-কি?’

আয়মানকে অবাক করে দিয়ে অতল বলল, ‘হুম। আজকে বাসায় যেতে মন চাইছে না। তুই চলে যা। এর পরের রাস্তা কেবল আমার একার।’

অতল পার্কের ভেতরে ঢুকে পড়ল। একটা বেঞ্চে বসে দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল। রাত বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করল আয়মানের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর,’তোর কি মন খারাপ?’

অতল তাকাল না। আরও জোরে মাথাটা চেপে ধরল। আয়মান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,’মাথা ব্যথা করছে? একটু আগেই তো ফার্মেসির ওদিক দিয়ে হেঁটে আসলাম তখন বললেই তো ওষুধ নিতে পারতাম।’

‘তুই চুপ করবি?’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল অতল, ‘আমাকে একটু একা থাকতে দে তো। আমার কাউকে সহ্য হচ্ছে না। কাউকে না।’ কাঁধের ব্যাগটা একটানে ফেলে দিলো সে। তারপর চাপা স্বরে আর্তনাদ করে বলল, ‘আমাকে কেউ ভালোবাসে না। কেউ না। আমার বাবাও ভালোবাসে না। আমার ভাইও ভালোবাসে না। আমি ভীষণ একা। ভেতরে শূন্য কোনো এক ধূ ধূ প্রান্তর।’

আয়মান অতলের এসব কথা শুনে আঁতকে উঠল। ভেতরে ভেতরে সে নিজেও চাপা কষ্ট অনুভব করছে। তার বন্ধু অতল এতটা মানসিক কষ্টে আছে! তা সে কখনও ভাবতেই পারেনি। তার ভেতরে এতটা চাপা কষ্ট আছে! কখনোই আয়মান কল্পনা করেনি।

আয়মান অতলের কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে বলল, ‘প্লিজ, দোস্ত শান্ত হ। এভাবে ভাবছিস কেন? আন্টি তোকে ভালোবাসে, তানিয়া তোকে ভালোবাসে। এই যে আমিও তোকে ভালোবাসি।’ অতল মাথা তুলে তাকাল আয়মানের দিকে। হঠাৎ আয়মান মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘বহ্নি নামের মেয়েটাও তো তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে দোস্ত।’

কথাটা বলেই আয়মান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। আড়চোখে অতলের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু অতলের মুখটা ভাবলেশহীন। আয়মান মনে মনে বলল, ‘যাক বাবা! বাঁচা গেল। খেয়াল করেনি।’

মনের ভেতরে আরও কিছটা সাহস সঞ্চয় করে আয়মান পুনরায় বলল, ‘এটা তোর ভুল ধারণা যে আঙ্কেল তোকে ভালোবাসে না। আঙ্কেল হয়তো উপরে উপরে একটু কঠোর কিন্তু ভেতরে ভেতরে তোকে নিশ্চয়ই ভালোবাসে।’

‘না!’ অতল আবারও চিৎকার করে উঠল, ‘ভালোবাসে না। জানিস বাবা আমাকে কী বলে?’ ছলছল চোখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল অতল।

আয়মান এই দৃষ্টি চিনে না। এমনভাবে অতলকে সে কখনো দেখেনি। আয়মান কোনোরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কী বলে?’

বাবা বলে,’আমি নাকি আমার মায়ের মতো হয়েছি। আমি না-কি তার পরিবারের জন্য একটা ব্যাধি।’ একটা চাপা গোঙানির শব্দ বের হয়ে আসল অতলের গলা থেকে।

‘ব্যাধি বলেছে তোকে?’ আয়মান চমকে উঠল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আরে রাগের মাথায় বলা কথার কোনো গুরুত্ব আছে না-কি?’

অতল প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ আগে ফেলে দেওয়া ব্যাগটা ঝেড়ে কাঁধে তুলে নিল। হিম শীতল গলায় বলল, ‘বাসায় যা এখন। আমিও যাচ্ছি। মা টেনশন করবে। না খেয়েই অপেক্ষা করছে।’

আয়মান কিছু না বলাটাই ঠিক মনে করল। ছোট্ট করে বলল, ‘ওকে।’ দুজন বিপরীত দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আয়মানের মাথায় রাজ্যের প্রশ্ন ও বিস্ময়। তার পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন আর বিস্ময়বোধক চিহ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে। বুকের ভেতর চিনচিন করে একটা সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করল সে। এই ব্যথা তার প্রাণের বন্ধু অতলের অসহায়ত্ব দেখে হচ্ছে না বরং তার প্রাণের বন্ধুর সব কষ্টের ভাগীদার হতে না পারার কষ্ট। অতল যে সব কথা বলে না, তা তো আর তার নিকট অজানা নয়। উপর থেকে সবকিছু ঠিক দেখানো অতল ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া এক মানুষ।

হেঁটে কিছুদূর যাবার পর আয়মান আবার দৌড়ে এসে অতলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কণ্ঠে মনের সমস্ত জোর ঢেলে দিয়ে বলল, ‘এই আয়মানকে তুই সবসময় পাশে পাবি।’ কথাটা বলার সময় আয়মানের চোখ জোড়া ক্ষণিকের তরে চকচক করে উঠল।

_______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৫

দীর্ঘ অসুস্থতা শেষে ফাইজা বেগম হাত পা ঝেড়ে কাজে লেগে পড়েছেন। সকাল সকাল আবিরকে ঘুম থেকে জোর করে তুলে বাজারে পাঠালেন বাজারের একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে। আজ তিনি তার বড়ো খোকার পছন্দের খাবার নিজ হাতে তৈরী করবেন বলেছেন। আজ যে একটা বিশেষ দিন। সেটা সবাই ভুলে গেলেও তিনি ভুলে যাননি।

নীলা পইপই করে বলল, ‘মা! এখনও তোমার শরীর পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। তুমি বিশ্রাম করো। কী খাবার রাঁধবে বলো আমি বানাচ্ছি।’

ফাইজা বেগম প্রশস্ত হেসে বললেন, ‘আমার খোকা চলে এসেছে, এখন আমার আর কোনো অসুখ নেই।’ বাচ্চাদের মতো হাত-পা খানিক নাড়িয়েও দেখালেন সুস্থতার প্রমাণ হিসেবে।

নীলা না পারতে তখন বলল,’আমি তাহলে ভাইকে কল করে বলছি যে তুমি রান্নাঘরে ঢুকেছ।’ পরক্ষণেই চিন্তিত সুরে বলল, ‘রান্নাঘরে কী পরিমাণ গরম! এত গরমে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে তো মা। তখন তোমার বড়ো খোকা নিজেই বকবে।’

‘তোর ভাইকে কে ডরায় বল তো?’ চোখ রাঙিয়ে পরক্ষণেই বললেন, ‘খবরদার! বড়ো খোকাকে কিছু বলতে যাবি না।’

নীলা তখন হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো পরাস্ত ভঙ্গিতে মায়ের কাছে এসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিচ্ছু বলব না। এবার তো বলো কি কি রাঁধবে? আমি তোমাকে সাহায্য তো করতে পারি । তাই না?’

‘আজকে আমার কারও সাহায্য লাগবে না। আমি কি রান্না ভুলে গেছি ভেবেছিস? এখনও আমার বড়ো খোকা আমার রান্না সব থেকে বেশি ভালোবাসে। তুই গিয়ে পিউ কি করছে দেখ। আর সাবরিনা কি এখনও ঘুম থেকে উঠেনি? ওকে ডেকে তোল।’ ব্যস্ত গলায় বললেন, ফাইজা বেগম।

‘আচ্ছা, সব শুনব। এবার তো বলো কি কি রাঁধবে?’ নীলার যেন খুব কৌতূহল হচ্ছে।

‘ইলিশ পোলাও আর ডিমের কোর্মা করব। বড়ো খোকার খুব পছন্দের জানিস তো। কতোদিন ছেলেটা এই পছন্দের খাবারটা খেতে পারে না।’ ফাইজা বেগম ব্যথিত কণ্ঠে বললেন। বলার সময় তার কণ্ঠটা যেন কেঁপে উঠল ক্ষণিকের জন্য, নীলা তা বেশ টের পেল।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রাত দিন খাটে তার ভাইটা। এতে করে যে টাকা আসে তাতে তাদের এসব নিত্য খাওয়া কোনো দুঃস্বাধ্য ব্যাপার নয়। কিন্তু বাবার অসুখের সময় করা ধার-দেনা শোধ করতে করতে তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় । বিশেষ করে তার ভাইটার। কী রকম কষ্ট করে বাবার রেখে যাওয়া সামান্য সঞ্চয় থেকে এই ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে তা তার নিজের চোখে দেখা। এসব ভুলে যাবার মতো কিছু না। তার উড়নচণ্ডী ভাইটা বাবার মৃত্যুতে একদম পাল্টে গেল। তার চিন্তা-চেতনার জগতে এক বিশাল পরিবর্তন চলে এসেছে। যেই ছেলেকে ঠিক করার জন্য তার বাবার রাতের ঘুম হতো না, সেই ছেলেটা বাবার অসুস্থতার কারণে পুরোই পরিবর্তন হয়ে গেছে । যা অভাবনীয়, অকল্পনীয় তাদের সবার জন্য। রাদিদের পরিবর্তিত রূপ দেখে নীলা এখনও আবাক হয়ে যায়। যেই ছেলেটার সবকিছুতেই অভিযোগ ছিল, আজ সবকিছুই তার অথচ তার নেই কোনো অভিযোগ, নেই কোনোকিছুতেই কোনো ভ্রুক্ষেপ। তবে পরিবর্তিত রাদিদই নীলার পছন্দের। মায়ের আদরের বড়ো খোকা আর তার ছোট্ট ভাইটা কবে যে এতটা বড়ো হয়ে গেল, তা কেউ খেয়াল না করলেও নীলা খেয়াল করেছে তার ছোট ভাইয়ের প্রতিটা পরিবর্তন।

‘কী ব্যাপার! এখনও কি দাঁড়িয়ে থাকবি? তোকে কি করতে বললাম?’ ফাইজা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন।

নীলা চলে যেতেই পিউ ধিরিং ধিরিং করে নেচে নেচে কী একটা গান গেয়ে গেয়ে রান্নাঘরে এলো। নানুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘নানু! আজ তুমি রাঁধবে?’

‘হ্যাঁ, নানু।’ নানুর রান্না খাবে তো?’

‘ইয়ে…! কী মজা! কতো দিন পর নানুর হাতের রান্না খাব।’ পিউ যেন আনন্দে আত্মহারা হলো।

আবির থমথমে মুখে বাজারের ব্যাগ হাতে রান্নাঘরে ঢুকল। ফাইজা বেগমের কাছে তার ভাবগতি ভালো ঠেকছে না। এই ছেলেটা এমন কাজ চোরা হয়েছে যে কিছুই বলে কোনো লাভ নেই। বকা দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু তিনি আজ কারও সাথেই মাথা গরম করতে চান না। আজ সবাই মিলে একটু শান্তিতে ভালো-মন্দ কিছু খাবেন। এই জন্য তিনি আজ ভেবেই রেখেছেন কোনোভাবেই কারো সাথে রাগ দেখাবেন না।

তাই শান্ত গলায় আবিরকে বললেন, ‘নাস্তা খেয়ে নে, ছোট খোকা। আর আজ কোথাও যাস না।’

‘মা! আমার আজ বাইরে না গেলে যে হবে না। আজ আমাদের পাড়ায় খেলা আছে।’ আবির বলল, জরুরি গলায়।

‘আজ না গেলে কোনো ক্ষতি হবে না।’ সরু চোখে তাকিয়ে দৃঢ়তার সাথে বললেন,’আজ একটা বিশেষ দিন। তাই আমি চাই তোরা সবাই বাসায় থাক।’

‘বিশেষ দিন?’ আবির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মায়ের দিকে,’কার জন্য?’

‘কার জন্য আবার?’ ফাইজা বেগমের ভাবলেশহীন উত্তর, ‘আমাদের সবার জন্য।’

আবির আর কথা বাড়াল না। বেসিনে হাত ধুয়ে টেবিলে বসে পড়ল নাস্তা করার জন্য। ফাইজা বেগম ছেলেকে নাস্তা বেড়ে দিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লেন। মাছ কুটা থেকে শুরু করে সবকিছুই ফুরফুরে মন নিয়ে দুপুর পর্যন্ত রাঁধলেন। নীলা মশলা বেটে দিলো। সাবরিনা কিছু তো করলই না বরং রান্না ঘরে মোড়ার উপর বসে বসে ঝিমালো। তাই দেখে ফাইজা বেগমের রাগ মাথায় চড়ে গেল। তিনি প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘এতই যখন ঘুম পাচ্ছে। তখন রুমে গিয়ে ঘুমালেই তো পারিস।’

ফাইজা বেগম মুখ থেকে বের করা মাত্রই সাবরিনা উঠে নিজের রুমে চলে গেল। সকালের নাস্তাটা পর্যন্ত সে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে খেয়েছে। ফাইজা বেগম আবির আর সাবরিনার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে মহাবিরক্ত।

রাদিদ এলো দুপুরে। শুক্রবার হওয়াতে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। বাসায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে গেল। নামাজ পড়ে আসতেই পিউ রহস্য মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘বলো তো বড়ো মামা আজ কি দিন?’

‘আজ?’ রাদিদ পিউকে কোলে তুলে নিয়ে একটু ভাবনার ভান করে বলল, ‘আজ তো শুক্রবার।’

‘উফফো!’ পিউ তার পিচ্চি পিচ্চি হাত দিয়ে মাথায় চাপড়ে বলল, ‘তুমি তো দেখছি কিছুই পারো না। আমি বলেছি আজ কি দিন, আজ কি বার বলিনি তো।’

‘কি দিন আর কি বার এর মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে, চ্যাম্প?’ রাদিদ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল।

‘আছে তো।’ বিজ্ঞের মতো করে বলল, পিউ।

‘তাহলে বলে ফেল তো ঝটপট। বড়ো মামা তো এই পার্থক্য জানেই না।’

‘আজ একটা বিশেষ দিন।’

‘কে বলেছে?’

‘নানু বলেছে।’

‘আচ্ছা নানু যখন বলেছে তখন তো অবশ্যই বিশেষ দিন। কিন্তু কার জন্য বিশেষ দিন?’

‘আমাদের সবার জন্য।’ পিউ প্রশস্ত হেসে বলল।

‘এটাও কি নানু বলেছে?’

‘হ্যাঁ, নানু বলেছে। আজ তো নানু নিজ হাতে রান্নাও করেছে।’

‘তাই না-কি?’ রাদিদ ভীষণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

‘হুম। সত্যি বলছি। খাবার মুখে দিলেই বুঝতে পারবে।’

রান্না শেষে নামাজ পড়ে ফাইজা বেগম নিজের রুমে শুয়ে আরাম করছিলেন। রাদিদ পিউকে কোলে নিয়ে ঢুকল। বলল, ‘মা! আজ না-কি কি বিশেষ দিন?’

‘ওহ্, হ্যাঁ।’ ফাইজা বেগম শোয়া থেকে উঠতে উঠতে বললেন, ‘তুই এসে পড়েছিস বড়ো খোকা?’

‘হ্যাঁ, মা। তুমি উঠছ কেন? শুয়ে থাকো।’

‘আরে না। আর কত আরাম করব?’

‘আচ্ছা, মা! তুমি না-কি আজ রান্না করেছ?’

‘কে বলেছে? তোর গুপ্তচর?’

‘আমি বলেছি নানু।’ পিউ রাদিদের কোল থেকে লাফিয়ে উঠে বলল।

‘তোর কথাই তো বলছি। বড়ো মামার গুপ্তচর তো তুইই।’

‘মা ! তোমাকে না কতো বার বলেছি তোমার রান্না করা লাগবে না। তারপরেও তুমি জেদ করো। এটা তো ভালো না মা। নীলা আপাই তো রান্না করতে পারে।’ রাদিদ বলল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে।

‘বেশি কথা বলবি না। আমি একদম সুস্থ আছি। তোরা দুই ভাই-বোন মিলে আমাকে অসুস্থ বানানোর ষড়যন্ত্র করছিস।’

‘আমরা ষড়যন্ত্র করছি?’ ভারি অবাক হয়ে জানতে চাইল রাদিদ।

‘তা নয়তো কী? আচ্ছা চল খাবার দিই।’

‘নীলা আপা দিবে। তুমি আবার উঠতে যাচ্ছ কেন?’

‘আজ কি আমাকে খাবার খেতে হবে না? না-কি তোরাই খাবি শুধু?’

‘এ কী! মা! তুমি এখনও খাবার খাওনি? আপা! এই আপা! তুই এখনও মাকে খেতে দিসনি কেন?’

নীলা মাত্র নামাজ শেষ করে উঠল। রাদিদের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ‘মা যেন আমার কথা খুব শুনে!’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ রাদিদ বুঝতে পারল, মা আজ নিজ থেকে ইচ্ছে করেই রেঁধেছে। তাই বলল, ‘চলো , আজকে আমরা সবাই এক সাথে খাব।’

খাবার টেবিলে রাদিদ নিজের প্রিয় সব খাবার দেখে অবাক হয়ে গেল। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘মা! এত কষ্ট কেন করতে গেলে বলো তো?’

‘একদম কষ্ট হয়নি আমার । এবার খেয়ে বল, কেমন হয়েছে।’ ফাইজা বেগমের চোখে মুখের উত্তেজনার ছাপ রাদিদের চোখ এড়াল না।

‘আমার মায়ের রান্না তো অমৃত। না খেয়েই আমি বেশ বলতে পারি।’

পিউ মাঝখান থেকে বলে উঠল, ‘নানু! এখন থেকে তুমিই রান্না করো। তোমার হাতের রান্না কী ইয়ামি!’

‘বাব্বাহ! পিউ! মায়ের হাতের রান্না কি পচা?’ নীলা প্রশ্ন করল।

‘তোমারটাও ভালো কিন্তু নানুরটা বেশি ভালো।’

পিউর কথা শুনে সবাই একসাথে হাসল। আবির আর সাবরিনা যেন অন্য গ্রহের প্রাণী। তারা চুপচাপ খাচ্ছে কেবল। রাদিদ হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা, মা! কার জন্য বিশেষ দিন বললে না তো?’

‘মনে করতে পারিস কি না দেখ। আমি কেন বলব? তোর ঠিক মনে পড়বে।’

মায়ের কথা শুনে রাদিদ চুপ হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ খেতে লাগল। রাদিদ আবার বলে উঠল, ‘মা আজকের রান্নাটা সত্যিই অমৃত।’

পিউ মুখে এক নলা খাবার দিয়েই প্রশ্ন করল, ‘কেন অমৃত বড়ো মামা?’

‘কারণ এই খাবারের সাথে মা তার সমস্ত ভালোবাসা মিশিয়ে দিয়েছে। তাই অমৃত হয়ে গেছে।’

পিউকে চিন্তিত দেখাল। সে হয়তো বুঝতে পারছে না। আর এদিকে ফাইজা বেগমের চোখ জোড়া আনন্দে চকচক করে উঠল। রাদিদ বলল, ‘মা তোমার চোখে কী যেন গেল!’

___________________________

শিহরণ অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে আজ হাসপাতালে যেতে পারেনি। তবে কল করে খবর নিয়েছে। পুলিশের সাথেও কথা হয়েছে। রাতের দিকে একবার হাসপাতালে যাবার পরিকল্পনা করে রেখেছে। তবে একটু আগের ফোন কলটা তার মাথা পুরোপুরি খারাপ করে দিয়েছে। অসহ্য লাগছে তার। তবে সবথেকে বিস্ময়কর ব্যাপার যেটা ঘটলো সেটা হলো মান্নাতের বলা কথাটা। মান্নাতের বলা কথাটা সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না। মা তাকে না জানিয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমনটা তো হবার কথা না। সারাটাদিন অস্থিরতায় কাটালো সে। বাসায় গিয়ে মায়ের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল।

বিকেলের দিকে ফরিদকে নিয়ে বেরোল হাসপাতালের উদ্দেশে। ছোঁয়া তখনও মায়ের পাশে বসে ছিল। সাইফ দোকানে, অহনা, হিয়া আর মায়াকে জোর করেই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে ছোঁয়া । শিহরণ ছোঁয়াকে ইশারায় বেরোতে বলল। ছোঁয়া বলল, ‘আবার আসলে কেন? অফিস থেকেই এখানে চলে এসেছ?’

‘হুম। না এসে উপায় কি? কেউ একজন নিজের যত্ন নেবার কথা কখনোই মনে রাখে না। তাই তাকে মনে করিয়ে দিতে হয় বারবার।’

‘হুম। তা কতদিনের জন্য এই দায়িত্ব নিলে?’

‘এখনও ঠিক করা হয়নি। ঠিক করলেই কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’

‘ততদিন কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করবে বলে কেন মনে হলো তোমার?’

‘মনে হয়নি তো!’

‘তাহলে বললে যে?’

‘মনে করার উপায় নেই। আমি বরং বিশ্বাস করি।’

‘কিছু কিছু বিশ্বাস ঠুনকো হয়। জানো তো?’

‘জানি। তবে আমার বিশ্বাস কোনোদিক থেকেই ঠুনকো নয় এটা নিশ্চিত থাকতে পারো।’

ছোঁয়া শিহরণের এই কথার প্রত্যুত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না। তাই চুপ থাকল। শিহরণ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আন্টির কী অবস্থা?’

‘এখন অনেকটা ভালো।’

‘তুমি চাইলে বাসায় যেতে পারো। আমি নাহয় অপেক্ষা করি।’

‘দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।’

‘তা তো আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। চোখের নিচে কালি পড়াটা তো ঠিক থাকারই প্রমাণ। তাই না?’

ছোঁয়া নিশ্চুপ। শিহরণ অবাক চোখে দেখছে তাকে। ধীরে ধীরে অন্ধকার জেঁকে বসে রাতের আগমনের জানান দিচ্ছে। কোথা থেকে যেন কেবল এক ঝাঁক ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে!
______________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-২০+২১+২২

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২০

অহনা পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে, অস্থিরভাবে। আজকেও কল করেনি লোকটা। অথচ এখনই তার কাজটা করার মোক্ষম সময়। সাইফ ভাই নেই; তাই সে এই সময়ে কাজটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন কোনো বাড়তি ঝামেলাও পোহাতে হতো না। অথচ লোকটা কাজ এখনও করতে পারল না। অহনার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। কোন আহাম্মককে সে কাজ দিল–এটা ভাবতেই তার নিজেকেই নিজের তিরস্কার করতে মন চাইছে! তামিম এই আহাম্মকের কাজেরই বাহবা দিচ্ছিল! অদ্ভুত লাগছে তার বিষয়টা। একটু পরপরই উঁকি দিচ্ছে সে জানালা দিয়ে। আচমকা তার মোবাইলটা বেজে উঠল। কাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে কল আসাতেই তার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তিতে ভরা হাসি দেখা দিল মুহূর্তেই। কলটা রিসিভ করেই ওপ্রান্তের ব্যক্তিকে কোনো প্রকার বাক্যব্যয় করার সুযোগ না দিয়ে অহনা বলল, ‘কাজ হয়েছে?’

মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে ওপ্রান্তের ব্যক্তিটি বলল, ‘না, ম্যাডাম। আমরা কাজটা করার সুযোগ পাইনি।’

‘এই সামান্য কাজটাও করতে পারলে না?’ অহনার কণ্ঠ সপ্তমে চড়ে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে বলল, ‘ কাজের কাজ তো কিচ্ছু করতে পারলে না। আবার বড়ো গলায় বলেছ, আমাদের কাজে কোনো ঘাটতি হবে না! আমি বুঝতে পারছি তোমাদের দ্বারা এই কাজ হবে না।’

ফোনের ওপ্রান্তের ব্যক্তিটি প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘আমরা কি করব ম্যাডাম? একজন কার নিয়ে এসেই তো সব ঝামেলা বাঁধিয়ে দিলো। নয়তো আমরা আজকেই আমাদের কাজটা শেষ করে ফেলতাম।’

‘কে এসছিল?’ অহনার কণ্ঠে রাগ উপচে পড়ছিল, ‘স্পষ্ট করে করে বলো।’

‘আমরা তো গাড়ির ভেতরে কে আছে তা দেখিনি। তবে ওটা হোয়াইট কালারের কার ছিল।’

‘গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখেছ?’ অহনার কণ্ঠে কৌতুহল।

‘না, ম্যাডাম। আমাদের তো ওসব দেখার দিকে কোনো মনোযোগ ছিল না। আমরা তো ওই গাড়ি যাবার অপেক্ষায় ছিলাম।’

অহনা কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল! তারপর কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’এর আগের দুই দিনও একই রঙের গাড়ি দেখেছিলে না?’

‘জি, ম্যাডাম। মেয়েটা নিরাপদে বাসায় না আসা পর্যন্ত গাড়িটা অপেক্ষা করে।’

গাড়ির হর্ণ শুনতে পেয়ে অহনা তার রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে পেল ছোঁয়া গেইটের ভেতরে প্রবেশ করছে। গাড়িটা দেখেই সে বুঝতে পারল এটা শিহরণের গাড়ি। তাহলে শিহরণের কারণেই তার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল। মেজাজটা বিগড়ে গেল আবারও। শিহরণের উপরেও তার রাগ হচ্ছে। তার হিসাব এখন মিলে গেছে। সাইফ ভাই নেই। ছোঁয়া একা একা বাসায় ফিরে আর তাই শিহরণ ওর পেছনে থেকেই ওর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। অসহ্য লাগছে অহনার, সবকিছুর প্রতিই বিতৃষ্ণা চলে এলো তার ।

রাগে গজগজ করতে করতে অহনা বলল, ‘তোমাদের মতো গাধা আমি জীবনে দেখি নাই। তোমরা নাকি আবার এই কাজে দক্ষ! তামিম যা বলেছে তা দেখছি খুব ভুল বলেছে তোমাদের সম্পর্কে। তোমাদের হায়ার করারটাই আমার ভুল হয়েছে।’

‘আর একটা সুযোগ দিন ম্যাডাম। এবার আর কোনো মিস হবে না।’ অনুনয় করে বলল ব্যাক্তিটি।

‘না এখন আর কিছু করতে হবে না।’ চিন্তিত সুরে অহনা সতর্ক গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় কেউ বুঝতে পেরেছে বিষয়টা। আমি এখন আর কোনো রিস্ক নিতে চাই না। সময় মতো আমি তোমাদের সাথে আবার যোগাযোগ করব। ততদিন পর্যন্ত তোমরা গা ঢাকা দাও। তোমরা ধরা পড়লে তোমাদের চাইতেও বেশি সমস্যা হবে আমার। তাই এখন তোমাদের আর কিছু করার দরকার নেই।’

‘ঠিক আছে, ম্যাডাম।’
_______________________

বহ্নি, তূর্ণ আর সায়মা ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তূর্ণকে হাপুসহুপুস করে সিঙ্গারা আর সমুচা গিলতে দেখে সায়মা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বহ্নি বিরক্তির সুরে বলল, ‘ আরে বাপ আস্তে খা। এত তাড়া কিসের তোর? আমরা এখনও অপেক্ষা করছি তো। একে তো দেরি করে আসলি। তার উপর এখন বুভুক্ষুর মতো করে গিলছিল। সবাই হা করে তোর খাওয়া দেখছে আর আমরা তো দেখছিই।’

সমুচা চিবুতে চিবুতে তূর্ণ বলল,’তোদের সামনে কিসের লজ্জা বল তো? সকাল থেকে পেটে কিচ্ছু পড়ে নাই । তাই খাওয়ার সময় বিরক্ত করিস না তো।’

‘বিরক্ত করলাম কই?’ ভীষণ অবাক হয়ে বলল, বহ্নি, ‘বলছি, আস্তে ধীরে খা। এখন তো ব্রেক চলছে। দরকার হলে তুই পরের ক্লাসটাও মিস দিতে পারিস। তাও ধীরে সুস্থে খা।’

‘তোরা দুজন চলে যাবি আর আমি একা একা খাব! এটা কি হয় না-কি?’

‘এখন কি দোকা খাচ্ছিস?’ সায়মা বলল বিস্মিত হয়ে,’ আমরা তো কেবল দু’চোখ ভরে এক খাদকের খাবার গেলা দেখছি।’

‘দেখছিস বহ্নি! জেলাস সে আমার প্রতি, আমার খাবারের প্রতি।’ বহ্নিকে নালিশ দিয়ে সায়মাকে উদ্দেশ্য করে তূর্ণ বলল, ‘তোকে কে খেতে নিষেধ করেছে ? খা, তুইও খা। ক্যান্টিনে তো আর দুর্ভিক্ষ পড়ে নাই। যথেষ্ট খাবার আছে। খেয়ে মোটাতাজা হলে তখন আর আমি তোকে চিকনি চামেলি বলে ডাকব না।’

সায়মা রাগী গলায় বলল,’তোর প্রতি আর তোর খাবারের প্রতি আমি জেলাস হতে যাব কোন দুঃখে?তোর মধ্যে না জেলাস হবার মতো কিচ্ছু নাই, দোস্ত।’

‘আচ্ছা, বাদ দে তো এসব। ক্লাস টাইম হয়ে আসছে। তূর্ণ তুই দ্রুত খাবার শেষ কর।’ বহ্নি তাড়া দিয়ে বলল।

‘এই তো লাইনে আসছিস। তুই এরকম দ্রুত খেতে বলবি বলেই আমি প্রথম থেকেই দ্রুত খাচ্ছিলাম।’

বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তূর্ণর সাথে কথা বলে পারা যাবে না। এক কথার পিঠে হাজার কথা সে বলতেই থাকবে। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। নীরা ক্যান্টিনের এক কোণায় বসে দেখছিল ওদের। তূর্ণ ছেলেটাকে তার কাছে বড্ড পাঁজি বলে মনে হয়। এখন কেমন গাপুসগুপুস করে খাচ্ছে! যেন হাজার বছর ধরে তার পেটে কোনো খাবার পড়েনি!

নীরা আজ বহ্নির সাথে কথা বলবে বলেই মনস্থ করেছিল। কিন্তু ভার্সিটিতে আসার পর থেকে কেমন যেন দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে। কী বলবে? কীভাবে শুরু করবে কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না! রাদিদের কথা স্মরণ করে সে মনে মনে বলল,’ দেখ, রাদিদ ভাইয়া! তোমার জন্য আমায় কতো কিছু করতে হচ্ছে। আর তুমি আমাকে খালি বকতে থাকো। হুহ্!’

একটা পর্যায়ে সে সাহস করে উঠে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো বহ্নিদের টেবিলের কাছাকাছি। তাকে দেখেই বহ্নি সহাস্যে প্রশ্ন করল,’কিছু বলবে আপু?’

‘জি আপু। আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

‘না তো। চেনার কথা ছিল?’ নীরার পাংশুটে চেহারা দেখে বহ্নি মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, ‘আসলে, তোমাকে দেখেছি কয়েকবার কিন্তু ঠিক পরিচয় হয়ে উঠেনি বোধহয়।’

নীরার নিজেকে বোকাবোকা লাগছে। আশ্চর্য, এখানে এতো দ্বিধার কি আছে? ঝটপট পরিচয় পর্ব সেরে নিলে তো চলে। আসলেই সে একটা বুদ্ধু! খুব বড়ো গলা করে রাদিদ ভাইয়ার কাছে হেন তেন কত কিছু বলেছে। অথচ, আজ তার কী একটা অবস্থা!

নীরা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘জি আপু। পরিচয় হয়নি। আপনি আমাকে না চিনলেও আমি চিনি।’

তূর্ণ খাওয়া বাদ দিয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার কাছে এই মেয়েটাকে খুব মিষ্টি লাগে। তার এই গাপুসগুপুস খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা নীরা দেখে ফেলেছে কী না সেই বিষয়ে সে মারাত্মক রকমের চিন্তিত! তার নিজের উপরেই এখন রাগ হচ্ছে। মেয়েটা ক্যান্টিনে ছিল অথচ সে খেয়ালই করেনি। নীরার চেহারাতে দ্বিধা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে। তা দেখে তূর্ণ বলল, ‘কী বলবে বলে ফেল। আমরা কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখছি। তোমার এতো লজ্জা পেতে হবে না?’

নীরা মুহূর্তেই চোখ তুলে তাকাল তূর্ণর দিকে। তার রাগ হলো খুব। তেজী গলায় সে বলল, ‘ভাইয়া! লজ্জা পাবার মতো তো কিছু বলব না। তাই আপনার কানে আঙ্গুল না দিলেও চলবে। এত কষ্ট করতে হবে না আপনার।’

নীরার মুখে ভাইয়া ডাক শুনে তূর্ণর চারপাশে তোলা স্বপ্নের প্রাসাদ মুহূর্তেই ভেঙে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেল। যত তাড়াতাড়ি প্রাসাদ বানাল তত তাড়াতাড়িই তা ভেঙে গেল। তৃর্ণ এতে আহত হলো মনে মনে। তার এখন অসহ্য লাগছে মেয়েটাকে। তূর্ণর সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলছে! এত্ত বড়ো স্পর্ধা পেল কোথা থেকে সে!
একটা ধমক দিয়ে সে বলল, ‘কি বলবে তাড়াতাড়ি বলে ফেল। এখানে স্ট্যাচু অব লিবার্টি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি। আমাদের ক্লাস আছে তো।’

বহ্নি তূর্ণর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, ‘তুই মেয়েটাকে ধমকাচ্ছিস কেন? ও তোর সাথে তো কথা বলছে না।’ তারপর নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তূর্ণ তোমার সাথে দুষ্টামি করছিল। ওর কথায় কিছু মনে করো না।’

‘না না আপু। আমি একদম কিছু মনে করিনি। আমি জানি উনি এমনই। আগে জানতাম উনি খালি মেয়েদের দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। এখন দেখছি ভাইয়া ডাক শুনে ধমক দিতেও পছন্দ করে।’ নীরা বলল, নিঃশ্বাস বন্ধ করে।

নীরার কথা শুনে তূর্ণর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই পিচ্চি মেয়ে তাকে এত্ত বড়ো অপমান করল তার বন্ধুদের সামনে! এটা ভাবতেই তার রাগ চড়ে যাচ্ছে সপ্তমে। অথচ তার বন্ধুরা হাসছে প্রাণখুলে যেন লাইভে কোনো কমেডি শো চলছে।

তূর্ণ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নীরার দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘এই মেয়ে আমি কার দিকে তাকিয়েছি?’

নীরাও দমবার পাত্রী নয়। সেও দ্বিগুণ স্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখেছি। অনেকবার দেখেছি তাকাতে।’

‘কার দিকে তাকিয়েছি? বলো তাড়াতাড়ি।’

‘বাব্বাহ্! আপনি নিজেই জানেন না কার দিকে তাকিয়েছেন!’ মক করে বলল, নীরা, ‘তাহলে কপালের নিচের চোখ দুটো রেখে আর লাভ কি ? ওদের কাজ নেই তো।’

‘এই মেয়ে! তুমি কি নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবতেছ?’

বহ্নি আর সায়মা ওদের ঝগড়া দেখে মজা পাচ্ছিল। ঝগড়ার গতি বাড়তে দেখে বহ্নি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘থামো তোমরা।’ তারপর নীরাকে প্রশ্ন করল, ‘কি কথা যেন বলতে চাইছিলে? বলো আপু।’

সায়মা তখন ঘড়িতে টাইম দেখে বলল, ‘এই ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে। চল।’

বহ্নি সায়মাকে হাত ধরে থামাল। বলল, ‘বস। এখনও টাইম আছে।’

নীরা বলল, ‘আপু! আমার সময় লাগবে। এখন তো মনে হয় আপনাদের ক্লাস আছে। পরে বলব।’

বহ্নি ঘড়িতে সময় দেখল। তারপর বলল, ‘ঠিক বলেছ। এখন তো এমনিতেও সময় হবে না। তুমি বরং পরেই বলো। ঠিক আছে?’

সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তূর্ণ রাগে গজগজ করতে করতে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে! নীরা বলল, ‘আপু। আপনার মোবাইল নাম্বারটা কি দেয়া যাবে?’

তূর্ণর তখন বলতে ইচ্ছে করল,’আমার বন্ধুরা যাকে তাকে মোবাইল নাম্বার দেয় না।’ কিন্তু সে কিছুই বলল না কারণ সে জানে বহ্নি নীরাকে তার মোবাইল নাম্বার অবশ্যই দিবে।

নীরার কথা শুনে বহ্নি ঘুরে দাঁড়াল। সহাস্যে বলল,’কেন দেয়া যাবে না আপু? অবশ্যই দেয়া যাবে।’

বহ্নি তৎক্ষনাৎ তার ব্যগ থেকে প্যাড বের করে সেখানে তার মোবাইল নাম্বারটা লিখে নীরার দিকে এগিয়ে দিল। কাগজটা হাতে নিয়ে নীরা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ আপু।’

তূর্ণ আড়চোখে তাকাচ্ছিল নীরার দিকে। মনে মনে বলল,’কত মিষ্টি করে হাসছে বহ্নির সাথে অথচ আমার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করছিল। ধানী লঙ্কার তেজ বেশি কথাটা মিথ্যা না।’

_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২১

‘তুমি করে বলাতে কি খুব অবাক হয়েছিলে?’ দুষ্টু হাসি ঠোঁটের কোণে রেখে প্রশ্ন করল শিহরণ।

ছোঁয়া গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আচমকা প্রশ্নে তৎক্ষনাৎ ডাগর চোখের বিস্ময় নিয়ে তাকাল শিহরণের দিকে। তাকিয়েই থাকল কেবল। কোনো জবাব দিলো না। ভেতরটা ফাঁকা মনে হলো তার। দেবার মতো কোনো উত্তর খুঁজেই পেল না সে।

‘কী! উত্তর খুঁজে পাচ্ছ না? না-কি ভাবছ হঠাৎ এতটা স্বাভাবিকভাবে কথা বলছি কেন? কোনটা ভাবছ বলো তো?’ স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সামনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে পুনরায় প্রশ্ন করল শিহরণ।

সকালটা বড্ড স্নিগ্ধ। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ বাতাসে ভর করে এসে লাগছে নাকের কাছে । কিছুটা মাদকতাও যেন মেশানো হয়েছে সকালের স্নিগ্ধ শীতলতা প্রদানকারী সমীরণে। সেই সমীরণের মাদকতা মেশানো ঘ্রাণে উন্মত্ত হচ্ছে দুটো হৃদয় । অথচ প্রকাশে যেন যোজন যোজন দ্বিধা, কুণ্ঠা আর সংকোচ! নির্লিপ্ত চাউনিতে নির্বাক চেয়ে আছে ছোঁয়া শিহরণের ভাবলেশহীন মুখের পানে। হঠাৎ ছোঁয়ার কেবল মনে হচ্ছে এই মানুষটা তার পাশে ছিল সবসময়, প্রতিটা মুহূর্তে, তার অস্তিত্ব ছিল তার অস্তিত্বে মিশে, সে শুধু বুঝতে পারেনি। না-কি বুঝার চেষ্টা করেনি?

‘কিছু তো বলো?’ অধৈর্য কণ্ঠের ঝংকার এসে লাগল ছোঁয়ার কানে।

‘সত্যি করে বলব?’ নয়ন জোড়াতে একরাশ বিস্ময় আর কণ্ঠে শতো বছরের কুণ্ঠা, দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল ছোঁয়া।

‘তুমি কি মিথ্যে বলাও শিখে গেছ?’ উদ্ধত কণ্ঠ তীরের শূলের মতো বিঁধল ছোঁয়ার বুকের মধ্যেখানে।

ছোঁয়ার খুব রাগ হলো। শিহরণের দিকে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সহসা। চোখ দুটো প্রতারণা করে বসল তার সাথে। কেমন যেন ভরা বর্ষার নদীর ন্যায় জলে থৈ থৈ করে উঠতে চাইছে ক্ষণিকের আবেগে। চোখ বুজে নিজেকে প্রবোধ দিলো সে। আর শুনবে না, আর ভাববে না। এতদিন তো সে বেশ ছিল। কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না, ছিল না আবেগের বশবর্তী হওয়ার কোনো সুযোগ। হালকা সবুজাভ চোখ জোড়া আর মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলো ছেলেটাকে সে দিব্যি ভুলে ছিল! সত্যিই কি ভুলে ছিল সে? অবাধ্য মন প্রশ্ন করে বসল সহসা নিজেকেই। না, সে কোনোভাবেই আর নিজের অবাধ্য, অপূরণীয় ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিবে না, দিবে না কোনো প্রশ্রয়।

‘এখনও কি কথা কমই বলো?’ ছোঁয়াকে রাগানোর চেষ্টাতে শিহরণ যেন বদ্ধপরিকর আজকের এই মিষ্টি সকালের মাদকতা মেশানো হাওয়ার ভুবনে।

ক্রোধান্বিত হয়ে ছোঁয়া বলল, ‘মোটেই না। যার সাথে আমার মনের মিল হয় না তার সাথেই কথা কম বলি।’

‘তাহলে তোমার মনের সাথে মিল আছে এমন কয়েকজনের নাম তো অন্তত বলো। জেনে ধন্য হোক জীবন।’ পুনরায় তীর্যক মন্তব্য করল শিহরণ।

‘আপনাকে ধন্য করার ইচ্ছে ও সাধ্যি কোনোটাই যে আমার নেই।’ ছোঁয়াও এবার ছেড়ে কথা বলল না।

‘ইচ্ছে নেই সেটা কিছুটা সত্য। কিন্তু সাধ্যি নেই কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। সাধ্য তোমার শতভাগ আছে। আর ইচ্ছেটাও হতে কতক্ষণ বলো?’ হাসি চেপে রেখে কোনোরকমে বলল শিহরণ।

শিহরণের এমন ঘোর প্যাঁচের কথায় ছোঁয়ার মরি মরি অবস্থা। ভীষণ রাগ হচ্ছে এই কাঠখোট্টা ছেলেটার প্রতি তার। প্রচণ্ড অনীহা নিয়ে প্রতিবাদের সুরে সে বলল, ‘ইচ্ছে হবে না কখনও।’

‘আবারও মিথ্যে!’ জোরে ব্রেক কষলো শিহরণ। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিয়ে পেট্রোল ভরে দিতে বলল, পেট্রোল পাম্পে কর্মরত ব্যক্তিটিকে। তারপর ছোঁয়ার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলল, ‘তুমি মিথ্যে বলা শিখেছ মানলাম। কিন্তু তাই বলে সত্য কথা বলতে ভুলে যাবে এটা তো হতে পারে না।’

অসহ্য লাগছে ছোঁয়ার। কী শুরু করেছে শিহরণ! কেমন উল্টাপাল্টা কথা বলেই যাচ্ছে নির্নিমেষ। নিষ্পলক তাকিয়েও আছে তার দিকে। তার বিব্রত বোধ হচ্ছে খুব। এটা কী বুঝতে পারছে না জনাব রাইয়্যান আহমেদ শিহরণ?

ছোঁয়ার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ সহ্য করেছে সে। আর না। প্রচণ্ড রাগে হড়বড় করে সে বলল,’ আমি মিথ্যে বলি কিন্তু সত্য কথা বলা ভুলে যাইনি। হুম, আমি অবাক হয়েছি। আমি আপনার প্রতিটি কথা ও কাজে অবাক হই । ভীষণ অবাক হই! আমি আপনাকে বুঝতে পারি না। একদম পারি না। আপনি আসলে কি চান তাও আমি বুঝতে পারি না। আমি বুঝতে পারি না যে আপনি কি আমাকে বুঝেন না, না-কি বুঝেও না বুঝার ভান করেন? আমি একদম বুঝি না আপনাকে। বলুন এটাকে কি মিথ্যে বলে? যদি বলে তবে আমি মিথ্যে বলি। আমাকে এই মিথ্যেটা বলতেই হবে।’

এতো কথা একসাথে বলাতে ছোঁয়া হাঁপাতে লাগল।।তার দু’চোখের দেয়াল ফেটে কান্না আসছে প্রচণ্ড পরিমাণে। কিন্তু শিহরণের সামনে সে কোনোভাবেই কান্না করতে চায় না।

‘বাব্বাহ! এত্ত রাগ?’ শিহরণ ঠোঁট টিপে হাসছে। ছোঁয়া ছলছল চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। দু’জোড়া চোখ মিলিত হলো আবারও ক্ষণিকের তরে। শিহরণের হৃদয়ের ঠিক মধ্যেখানে গিয়ে আঘাত করল ছোঁয়ার অশ্রুসিক্ত নয়ন।

‘হাসি পাচ্ছে আপনার? বাহ্! হাসি তো পাবেই। হাসি পাবার যথেষ্ঠ ও যৌক্তিক কারণও হয়তো আছে আপনার কাছে। আপনি তো আবার সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করেন।’ ছোঁয়া কান্নাভেজা কণ্ঠ আর নীল বিষাদে ভরপুর সমুদ্রের ন্যায় গভীর ধূসর নয়নে তাকিয়ে বলল।

শিহরণ আর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না ওই বিষাদে ভরা সমুদ্র পানে। সে একটা পানির বোতল এগিয়ে দিলো ছোঁয়ার দিকে। হিম শীতল গলায় বলল,’ পানি খাও। ভালো লাগবে। ‘

ছোঁয়া পানির বোতল নিলো না। মুখ ফিরিয়ে নিলো শিহরণের দিকে থেকে । তার খুব রাগ হচ্ছে এই উদ্ধত, একগুঁয়ে, নির্মম ছেলেটার উপর। এই সকল সম্বোধন সে না দিয়ে পারল না। অন্যদের প্রতি তার আচরণ যাই হোক না কেন তার প্রতি সে এমনই আচরণ করে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

‘আমাকে মনে মনে বকা দেওয়া কি শেষ? নাকি আরও কিছু বাকি আছে?’

ছোঁয়া চকিতে তাকাল শিহরণের দিকে। সন্দিগ্ধ চোখের তারায় ফুটে উঠল রাজ্যের বিস্ময়। বিস্মিত ছোঁয়া বাকরুদ্ধ। ছোঁয়াকে এমনভাবে তাকাতে দেখে শিহরণের বেশ মজা লাগছে। সে গাড়িটা একটা নির্জন জায়গায় থামাল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,’তুমি কি জানো কেও একজন তোমাকে প্রচণ্ডভাবে মিস করে? তোমার চোখের পানে তাকিয়ে সেই গভীর ধূসর রঙা সমুদ্রে ডুব দিয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে চায়?’

ছোঁয়া কাঁপছে। মনের মধ্যে ভালোলাগার প্রজাপতিরা উড়ছে হন্য হয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। একটা মধুর সুর ভেসে আসছে বাতাসের ভেলায় চড়ে। কোনো এক ফুলের তীব্র মিষ্টি ঘ্রাণ মাতাল করে দিচ্ছে তাকে। মাদকতা যেন ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের ধমনী, শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত প্রতিটি রক্তকণিকায়। সে কোনোরকমে তোতলাতে তোতলাতে প্রশ্ন করল, ‘জানি না। কে সে?’

‘আবারও মিথ্যে বলছে! তুমি জানো সে কে।’ শিহরণ বলল, প্রগাঢ় কণ্ঠে।

‘হেঁয়ালি করছেন কেন? যা বলবার স্পষ্ট করে বলুন।’ সমস্ত ভালোলাগাকে ছাপিয়ে ক্রোধ প্রকাশ পেল মুহূর্তেই।

‘সবকিছু কি মুখে বলতেই হবে। বুঝে নিতে পারো না?’ অদ্ভুত কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

‘মুখে না বললে বুঝে নেবার অনুভূতি তো তৈরী হবে না। বুঝে নেবার অনুভূতি তৈরী করার জন্যই তো মুখে বলাটা আবশ্যক।’ সবুজাভ চোখের অতলে নিঃশব্দে ডুবতে গিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে বলল ছোঁয়া।

‘তুমি আমাকে এখন থেকে তুমি করে বলবে সবসময়। আফটার অল উই ওয়্যার ক্লাসমেইটস।’ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল শিহরণ।

‘বাট নট নাও।’

‘ইয়েস স্টিল নাও। উই আর ওয়ার্কিং টুগেদার। দ্যাটস দ্যা মোস্ট ইমপর্ট্যান্ট ম্যাটার। নট দ্যাট?’

‘নো, দিস ইজ দ্যা ওর্স্ট থিং এভার।’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘তার মানে তুমি আমার সাথে কাজ করতে আগ্রহী নও?’ বিচলিত শোনাল, শিহরণের কণ্ঠ।

‘আমি তা বলিনি। আর আমি তো কেবল আপনার সাথে কাজ করছি না। আপনি ছাড়াও অফিসে অনেকেই আছেন। যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দ করি এবং তারাও আমাকে খুব পছন্দ করে।’

‘আচ্ছা, ছোঁয়া। তোমার একটা ডায়েরি ছিল মনে আছে? স্কুলে থাকতে তুমি ওটাতে ইচ্ছেমতো গালমন্দ করতে আমাকে। এখনও কি আমাকেই গালমন্দ করা করা হয় না-কি অন্য কাউকে?’ কৌতূহল মিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল শিহরণ।

ছোঁয়ার মাথায় এবার পুরো আকাশটাই যেন ভেঙে পড়ল। সে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল শিহরণের দিকে। দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে বলল, ‘ডায়েরির কথা তুমি জানলে কি করে? ডায়েরি তো সেই কবেই হারিয়ে ফেলেছি। তারমানে কি তুমি আমার ডায়েরি নিয়েছ?’

‘কী! আমি কেন তোমার ডায়েরি নিতে যাব?’

‘তাহলে তুমি যে বললে আমি তোমাকে গালমন্দ করতাম?’

‘তারমানে কি সত্যিই গালমন্দ করতে না-কি?’ অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইল শিহরণ,’আমি তো আন্দাজে বললাম।’

ছোঁয়া মুহূর্তেই জিহ্বায় কামড় দিলো। নিজের গোপন কথা সে নিজেই ফাঁস করে দিচ্ছে। বলল, ‘আমি তোমাকে কেন গালমন্দ করতে যাব? তুমি কে? তুমি আমার কেউ না। যারা আমার কেউ না তাদের আমি গালমন্দ করি না।’

‘বুঝতেই পারছি আমি যে তোমার কেউ না। তবে তুমি কি বুঝতে পারছ যে তুমি আমাকে তুমি করে বলা শুরু করে দিয়েছ?’ রহস্যময় হাসি ঠোঁটের কোণে রেখে বলল,শিহরণ ।

ছোঁয়া এবার নিজের কপালে চাপড়াল। এই শিহরণ তাকে পুরোই কনফিউজড করে দিচ্ছে। প্রচণ্ড বিরক্ত সে এই উদ্ধত ছেলেটার উপর। নিজের উপরেও বিরক্তবোধ করছে সে। বলল, ‘আপনাকে আমি আবার কখন তুমি করে বললাম? আপনাকে আজই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’

‘আবারও মিথ্যে। ইশ! কী পরিমাণ মিথ্যে বলটাই না শিখেছ তুমি! মনে হচ্ছে এই মিথ্যে বলাতে তুমি ডিগ্রি নিয়েছ প্রিয়তা।’

‘এই কি বললে তুমি? প্রিয়তা কে?’ ছোঁয়া আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করল।

শিহরণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আবারও তুমি করে বলেছ প্রিয়তা?’

‘ঠিক আছে মানলাম, তুমি করে বলেছি। একটু আগেই তো বলেছ, আমরা ক্লাসমেইট ছিলাম। এখন একসাথে কাজ করছি। তাই তুমি করে বললেই ভালো। এবার বলো প্রিয়তা কে?’

‘প্রিয়তা! আমার প্রিয়তা, যাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা বৃথা সে।’

‘তাহলে তুমি আমাকে কেন প্রিয়তা বলে ডাকলে?’

‘এসে পড়েছি প্রিয়তা। এবার ঝটপট কাজে লেগে পড়তে হবে।’

‘আমার প্রশ্নের উত্তর?’

‘যারা আমাকে পছন্দ করে না তাদের প্রশ্নের উত্তর আমি দিই না, প্রিয়তা।’

‘আমি তোমাকে পছন্দ করি না কে বলল?’

‘পছন্দ করলে তো আর গালমন্দ করতে না। তাই না?’ সহাস্যে বলল, শিহরণ।

‘উফ্! পুরোই বিরক্তিকর তুমি। তোমার সাথে আর কোনো কথাই বলব না।’ এটুকু বলে ছোঁয়া প্রচণ্ড শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলল, তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে।

শিহরণ হাসতে লাগল ছোঁয়ার এমন ব্যবহারে। পুরোই বিভ্রান্ত করে দিলো সে ছোঁয়াকে। অবশ্য সে দারুণ উপভোগ করেছে পুরো সময়টা। তার প্রিয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রিয় কিছু মুহূর্তের তালিকায় লিখে নিল এই সময়টুকু। আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে। এতদিন দূর থেকেই সে তার প্রিয়তাকে দেখেছে। আর এখন, খুব কাছে তার প্রিয়তা। তার ভীষণ পছন্দের মানুষটির সাথে তার দূরত্ব এখন কেবল সময়ের।
_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২২

ইদানিং ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে রাদিদের। কাজের মধ্যে একদমই অবসর মিলছে না। ফাঁকফোকরে যতটুকু অবসর মিলে সেই সময়টাতে সে খোঁজ নেয় মা আর ছোট্ট পিউর। কিন্তু আজ কোনো অবসর তো মিললই না। উপরন্তু সারাদিন ধরে মুঠোফোনটা বেজেই চলেছে ক্লান্তিহীনভাবে। একটা সময় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে মুঠোফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো। সন্ধ্যার দিকে একটু অবসর পেতেই মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে প্রায়ই সাতচল্লিশটা মিসড কল। সবগুলোই আবিরের নাম্বার থেকে।

এতগুলো কল দেখে রাদিদ রীতিমতো ভড়কে গেল। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাও হলো। প্রথমেই মায়ের চিন্তা এলো মাথায়। মায়ের কিছু হয়নি তো? তাই কল ব্যাক করার জন্য নাম্বার ডায়াল করতে গেলেই অন্য একটা নাম ভেসে উঠল তার মুঠোফোনের স্ক্রিন জুড়ে। রাদিদ কলটা কেটে দিল মুহূর্তেই। কোনো প্রকার বিলম্ব না করেই সে আবিরকে কল ব্যাক করল।

রাদিদের কল রিসিভ করেই আবির ঝাঁঝাল গলায় বলল, ‘ভাইয়া! এতক্ষণ ধরে কল করছি তুমি কল রিসিভ করছ না কেন?’

‘মায়ের কিছু হয়েছে? এতবার কল দিয়েছিস যে?’ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্বরে প্রশ্ন করল, রাদিদ।

‘মা ঠিক আছে। মায়ের আবার কী হবে? আমি আমার প্রয়োজনে কল করেছি।’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আবির।

আবিরের উত্তর দেবার ধরনে রাদিদের মন আর মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে গেল। বলল, ‘আমি তো আর তোর মতো অবসর সময় কাটাচ্ছি না ভাই । আমাকে কাজ করতে হয় তো। জানিস বোধহয় কিছুটা। তাই না?’

রাদিদ পাল্টা উত্তর এভাবে দিবে আবির তা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। তাই সে পরক্ষণেই নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বলল, ‘আসলে ভাইয়া আমার কিছু টাকা লাগবে। তাই কল করেছি।’

রাদিদ নিঃশব্দে হাসল। বলল, ‘এখন টাকা লাগবে কেন?’

‘আমাদের ভার্সিটি থেকে ট্যুরে যাচ্ছে। আমি যেতে চাইনি। কিন্তু সবাই খুব জোর করেছে আজ। তাই না করেও কোনো সুবিধা করতে পারলাম না।’ আবির বলল, অত্যন্ত বিনম্র কণ্ঠে।

রাদিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কণ্ঠের হতাশা লুকিয়ে বলল, ‘কত টাকা লাগবে?’

‘এই তো পাঁচ হাজারের মতো।’

ভারি অবাক হলো রাদিদ। এত টাকা দিয়ে কী করবে সে কোনোভাবেই ভেবে পেল না! দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘এত টাকা কিসের জন্য? কোথায় যাচ্ছিস তোরা যে এত টাকা দরকার? ট্যুর ফি কত?’

‘ভাইয়া এতকিছু জেনে তুমি কি করবে বলো তো? তুমি কি এসবের আগামাথা কিছু বুঝবে বলো?’ আবির বিরক্ত গলায় বলল।

‘বাহ্! খুব ভালো বলেছিস। আসলেই ভাই, আমি এসবের কিছুই বুঝব না। তোর মতো ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ তো আমি পাইনি। তাই না বুঝাটাই বরং স্বাভাবিক।’ প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে বলল, রাদিদ।

‘এত কথা বলছ কেন ভাইয়া? তুমি টাকা দিবে কি না বলো?’ অধৈর্য গলায় বলল, আবির।

‘আমার কাছে এখন তো এত টাকা হবে না। বড়ো জোর দুই হাজার টাকা দেওয়া যাবে। এর বেশি দেওয়া যাবে না। তাছাড়া দু’মাস আগেই তুই একটা ট্যুর থেকে এসেছিস। এটা কি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গিয়েছিস? তোদের ভার্সিটিতে কি বছরে দুই তিন বার শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়?’ ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইল রাদিদ।

‘এত টাকা নেই বললেই তো হবে না। তুমি যেহেতু ব্যবসা দেখাশুনা করছ তাই টাকা তো তোমার কাছেই থাকে। এখন তুমি না দিলে তো আর হবে না।’ উদ্ধত শোনাল আবিরের কণ্ঠ।

আবিরের উদ্ধত আচরণে রাদিদ কেবল অবাক হচ্ছে না তার খুব আক্ষেপও হচ্ছে। বলল, ‘যত টাকা দিব বলেছি তা নিতে চাইলে নিতে পারিস। এর বেশি এক টাকাও না। লাগলে নিয়ে যাস।’

রাদিদ কলটা কেটে দিল। আবিরের সাথে কথা বলে এমন বিরক্ত হলো যে মোবাইলের মেসেজ চেক করার কথা সে ভুলে গেল। ফুফু নাম্বার থেকে কল এসেছিল। কিন্তু এখন মেজাজ এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে সে কোনোভাবেই শান্তভাবে কথা বলতে পারবে না। তাই কল ব্যাক না করার সিদ্ধান্ত নিলো। মাথা ঠান্ডা হলেই কল করবে।

হাঁপিয়ে উঠেছে সে। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। যেখানে নিজের মতো করে একটু বাঁচতে পারবে, নিজের মতো একটু নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। দূষিত, কলুষিত চিন্তার কোনো মানুষ যেখানে থাকবে না ঠিক তেমন জায়গায় যেতে মন চাইছে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা পায় না, যা পায় তা চায় না। চাওয়া আর পাওয়ার এই ব্যবধান মানব জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নির্ধারণ করে দেয়, যার জীবনে এই ব্যবধান যত কম সে তত সুখী।
__________________________

আসন্ন অনুষ্ঠানে অতলকে নিমন্ত্রণ করার জন্য উতলা হয়ে আছে বহ্নি। ঘড়িতে রাত প্রায় দশটা। মোবাইল হাতে নিয়ে ভাবনাতে মশগুল হয়ে পড়েছে সে, এখন এত রাতে কল করা ঠিক হবে কি না ভাবছে। এই সময়েই তার নাম্বারে কল এলো। তূর্ণ কল করেছে। বিরক্ত হয়েই রিসিভ করল বহ্নি। তারপর বলল, ‘এত রাতে কল করেছিস কেন?’

‘বাহ্ রে! আমি কল করার জন্য রাত-দিন, সকাল-বিকাল কবে থেকে বিচার করা শুরু করেছিস?’

‘এখন এসব প্যাঁচাল পারিস না। ভালো লাগছে না। কিছু বলার থাকলে বল। নয়তো ভাগ।’

‘এই তূর্ণ ভেগে যাবার ছেলে না। এটা তো জানিস ভালো করেই।’

‘হুম, জানি রে দোস্ত। এবার বল কী বলবি?’

‘তোর কি কিছু হয়েছে?’ তূর্ণ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল,’কোনো কারণে কি আপসেট তুই?’

‘এটা কেন মনে হলো তোর?’ ভারি অবাক হয়ে জানতে চাইল বহ্নি।

‘আমি প্রশ্ন করেছি তোকে, তুই উত্তর না দিয়ে উল্টে আমাকেই প্রশ্ন করছিস?’ হতাশ গলায় জানতে চাইল তূর্ণ।

‘আমি কোনোভাবেই আপসেট না। এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। রাখছি আমি।’ বহ্নি বলল, সতর্ক গলায়,’কাল কথা বলব। ঠিক আছে?’

তূর্ণ আর কথা বাড়াল না। হিমশীতল গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। তুই বলতে না চাইলে আমি জোর করব না। কিন্তু যখন মনে হবে তোর এই অধম বন্ধু শোনার যোগ্য তখন না হয় বলবি! আমি অপেক্ষা করব।’

বহ্নির ইদানিং মাঝেমধ্যেই মনটা হুট করে খারাপ হয়ে যায়। বিষয়টা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কাউকে কিই বা জানাবে, সে নিজেই তো জানে না! এখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। সাহস করে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটা সে ডায়াল করেই ফেলল শেষমেশ।

___________________________

অতলের চোখ লেগে এসেছিল কেবল। কিন্তু মোবাইল নামক যন্ত্রটির তীব্র আওয়াজে তাও চটে গেল। আজকাল ভীষণ দুর্বল লাগে তার। পড়াশোনাতে কি বেশি এনার্জি খরচ হচ্ছে? কে জানে! আজকেও দুর্বল লাগছিল বলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। মুহূর্তেই দুচোখের পাতা এক হয়ে গেল। কিন্তু তা স্থায়ী হতে পারল না। ঘুম ঘুম চোখে নাম্বারটা না দেখেই রিসিভ করল সে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠেই সে বলল, ‘হ্যালো! কে বলছেন?’

ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এলো। সেই মিষ্টি সুরে অতলের চোখ থেকে ঘুম পালাল। সে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখল। সেইভ করা নেই। মনে পড়ে গেল নাম্বার বিনিময় করা হলেও সে নাম্বারটা সেইভ করেনি।

‘হ্যালো! অতল ভাইয়া! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?’

অতল মোবাইলটা কানে দিল। বলল, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। বল কি মনে করে কল করেছিস?’

‘কারণ ছাড়া কি আমি তোমাকে কল করতে পারি না?’

‘পারিস। তবে এখন, এত রাতে কোনো না কোনো কারণেই নিশ্চয়ই কল করেছিস?’

‘তার মানে আমি কল করাতে তুমি বিরক্ত হয়েছ। তাই না?’

‘আরে না! আসলে একটু চোখ লেগে এসেছিল।’

‘এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?’

‘কেন ঘুমাতে পারি না?’

‘না, মানে মাত্র সাড়ে দশটা বাজে।’

‘হুম, আসলে দুর্বল লাগছিল তাই । আচ্ছা, আমার কথা বাদ দে, তুই কেমন আছিস বল?’

‘আমি ভালো আছি। এত রাতে কল করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।’

‘দুঃখিত হবার কী আছে? যখন ইচ্ছে তখনই কল করতে পারিস। কোনো সমস্যা নাই।’

‘বলছ?’

‘কী?’

‘এই যে যখন খুশি তখন কল করতে পারি তোমাকে।’

অতল মনে মনে ভাবল,’বহ্নি এখনও সেই আগের মতোই রয়ে গেছে । একটুও বদলায়নি।’

‘কিছু বলছ না কেন?’ অভিমানী কণ্ঠে প্রশ্ন করল, বহ্নি।

‘হুম, পারবি। যখন খুশি তখন। এবার খুশি তো?’

‘অনেক।’ স্মিত হেসে বলল, বহ্নি।

‘আচ্ছা, কিছু বলার ছিল তোর?’

‘হুম, বলার তো ছিল।’

‘বল। আমি শুনছি।’

‘আগে বলো তুমি ‘না’ করবে না?’

‘আরে, আগে কথাটা তো শুনি। কথা রাখার মতো হলে তো অবশ্যই রাখব। তোর কথা কি কখনও ফেলেছি বল?’

বহ্নি এবার একটু ভরসা পেল। তাই সাহস করে কথাটা বলেই ফেলল, ‘আমাদের আশ্রমের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে তোমাকে আসতেই হবে। তুমি না আসলে আমি তোমার উপর ভীষণ রাগ করব।’

বহ্নির আমন্ত্রণের কথা শুনে অতলের প্রথমেই মনে হলো শিহরণের কথা। কেন যেন সে শিহরণের মুখোমুখি হতে চাইছে না। একটা দ্বিধা কাজ করছে মনের মধ্যে। চুপ করে রইল সে, অনেকক্ষণ।

বহ্নি আবার বলল, ‘কী হলো? আসবে না?’

‘আমি আসা আর না আসাতে কী আর এমন হবে বল তো?’

‘তুমি আসলেও বিশেষ কিছু হবে না আবার না আসলেও বিশেষ কিছু হবে না। কিন্তু আমি চাই, তুমি আসো। এখন বলো, আমার জন্য কি তুমি আসবে না?’

অতল পড়ল মহা মুশকিলে। পিচ্চিটার কথা সে ফেলতে চেয়েও যেন পারছে না! নানান চিন্তা করে শেষমেশ ঝোঁকের বশে বলল, ‘আসব। আমি অবশ্যই আসব। শুধু তোর জন্য।’

__________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-১৭+১৮+১৯

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৭

বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার ক্ষণ। আকাশটা ঘনকালো মেঘে ছেয়ে গেছে। থেকে থেকে বৃষ্টি পড়ছে। বর্ষাঋতু যেন আসবে আসবে করছে। ঝুম বৃষ্টি এখন থেকেই বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। বৃষ্টির ফোঁটা জানালার কাচে গড়িয়ে পড়ছে। শিহরণ বর্ষার ধারার জলবিন্দু গড়িয়ে পড়া জানালার কাচ ভেদ করে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সন্ধ্যার আকাশপানে। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা, মনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা পূরণের তীব্র চাওয়া, প্রত্যাশিত মানুষটির আমূল পরিবর্তনের জোয়ার দেখে। মন কেবল ছুটে যাচ্ছে সেই মায়াবীর হৃদয় হরণকারী হাসির দিকে, তার কথা বলা চোখের দিকে।

শিহরণ ভারি অবাক হলো ছোঁয়ার আজকের আচরণে। তবে এজন্য তার কোনো খারাপ লাগছে না বরং মনের মধ্যে এক দুর্জ্ঞেয় ভাল লাগার অনুভূতি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আগের ছোঁয়া আর এখনকার ছোঁয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ দেখে তার অন্তকরণ আজ ভীষণ তৃপ্ত, ভীষণ রকমের আত্মতুষ্ট । ছোঁয়ার মধ্যে যে পরিণত ভাব এসেছে তাতে সে অবাক হয় ক্ষণে ক্ষণে যদিও তার অবাক হওয়ার কথা নয়। এই পরিণত ভাব আর পক্বতার জন্য সে অপেক্ষা করেছে, একটা দীর্ঘ সময় ধরে, নিজেকে বানিয়েছে এক প্রতীক্ষা মানব। যার জন্য সে প্রতীক্ষা করছে সেই মানুষটিও যখন তার জন্য অপেক্ষা করছে এই শাশ্বত সত্যটা উন্মুখ হয়ে তার কাছে ধরা দেবার পর, তার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বই সহজ কিছু ছিল না। তবে সে চেয়েছিল ছোঁয়া পরিণত হোক, কারও উপরেই নির্ভরশীল না হোক এমনকি তার নিজের উপরেও না। তাই এত বছরের অপেক্ষা, একাকীত্ব আর আত্মগ্লানিতে নিমগ্ন থাকার অভিপ্রায়, অভিসন্ধিতে নিমজ্জিত ছিল সে। তার অপেক্ষা বিফলে যাচ্ছে না, এই আশ্বস্ত বাণী প্রশান্তি প্রদানকারী বার্তাবাহকরূপে কাজ করেছে প্রতি দুঃসহ আর যন্ত্রণাদায়ক ক্ষণে। প্রতিটি পদে পদে সে প্রমাণ পেয়েছে, ছোঁয়ার আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠার, নিজের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকা আকাশসম আবেগে গা না ভাসিয়ে লক্ষ্য পূরণের দৃঢ় অঙ্গীকারের । আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে। এক অন্যরকম আত্মতৃপ্তিতে ছেয়ে গেছে তার মন আর মস্তিষ্ক। ছোঁয়ার জীবনের প্রতিটি অর্জন, প্রতিটি পদের ইউ টার্ন এ শিহরণ ছিল অগোচরে। সামনে না এসেই সে তাকে সাহস জুগিয়েছে এক ভিন্ন উপায়ে, ভিন্ন পদ্ধতিতে, ভিন্নতর মাত্রায়।

ছোঁয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই শিহরণের ঠোঁটের কোণে এক মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। তার মনে পড়ে গেল আজ সকালে ছোঁয়ার বলা শেষ কথাটা, ‘হাসবেন সবসময়। হাসলে আপনাকে ভাল লাগে। তাছাড়া হাসতে কোনো প্রকার ট্যাক্স গুনতে হয় না কিন্তু!’ কথাটা মনে পড়তেই সে প্রাণখুলে হাসতে লাগল। ঝুম বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে শিহরণের হাসির শব্দ। আর সেই জোরালো ঝংকার সৃষ্টিকারী হাসির শব্দের আওয়াজ বর্ষার ঝুম বৃষ্টিকে ছাপিয়ে অন্য একজনের কানে কোনো এক বাদ্যযন্ত্রের সুরেলা কণ্ঠের ন্যায় প্রতীয়মাণ হলো। মুহূর্তেই সেই সুরেলা কণ্ঠ তার জাদুকরী ক্ষমতায় তার নিজের অধরদ্বয়ে সংক্রমিত হয়ে পড়ল। সাথে সাথেই এক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হলো অবাধ্য, অনিয়ন্ত্রিত মনের কোণে। ছোঁয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেঁটে এগিয়ে এলো শিহরণের কেবিনের দিকে। দরজা ভেজানো ছিল। ছোঁয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়েই বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, কোনোরকম শব্দ করা ব্যতিরেকেই, তার চোখে মুখে খেলল মুগ্ধতার রেশ। অবচেতন মনেই নিজের পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে শিহরণ আচমকা হাসি থামাল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ছোঁয়াকে। তার অবাক, বিমোহিত, আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টি দেখে শিহরণ প্রচণ্ড লজ্জা পেল। এভাবে একা একা হাসতে দেখে কী ভাবছে কে জানে! সমস্ত সঙ্কোচ আর দ্বিধা লুকিয়ে শিহরণ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করল, ‘ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?’ কিছুটা অবাক হয়ে পুনরায় বলল, ‘একি! আপনি এখনও যাননি কেন?’

ছোঁয়া নিজের মুগ্ধতা লুকিয়ে কাটাকাটা গলায় জবাব দিল, ‘হাসির আওয়াজ পেয়ে দেখতে এলাম কে হাসছে! কিন্তু…!’

ছোঁয়া নিজের কথাটা পূর্ণ করতে পারল না। শিহরণ বলিষ্ঠ পায়ে হেঁটে তার কাছে চলে এলো। ছোঁয়ার থেকে এক হাত পরিমাণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘোর ধরা গলায় বলল, ‘কিন্তু কী?’

‘কিন্তু…কিছু না। বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে এতে কী করে বের হব সেটাই ভাবছিলাম।’ শিহরণের কথাটা এড়িয়ে গেল ছোঁয়া।

শিহরণ ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার দেখল জানালার বাইরে। প্রবল বর্ষণ। এই অবস্থায় ওকে একা ছাড়াটা ঠিক হবে না। কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলল, ‘কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। আমার কিছু কাজ আছে তা শেষ করেই আমি বের হব। আপনাকে ড্রপ করে দিব। নো প্রবলেম।’

‘আমি একাই যেতে পারব। আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। বৃষ্টি কমলেই বেরিয়ে পড়ব।’ ছোঁয়া বলল, দায়সারাভাবে।

‘ইটস্ নট অ্যা রিকুয়েস্ট। ইটস্ এন অর্ডার। জাস্ট ওয়েট ফাইভ মিনিটস্। আই উইল ড্রপ ইউ।’ শিহরণ ছোঁয়ার কথা সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে বলল।

ছোঁয়া নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল। তার রাগ হচ্ছে শিহরণের উপর। সবসময় ধমকানোর সুরে কথা বলে কেন? সুযোগ পেলে সেও ছাড়বে না! এটা ভাবতেই তার রাগ উবে গেল। দ্রুত নিজের ফাইলসহ সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে শিহরণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

অফিসের দরজায় নক করার শব্দ শুনে শিহরণ ফাইল থেকে চোখ তুলে তাকাল। ফরিদ দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে। ফরিদ তাদের বাড়ির ড্রাইভার মোতালেব চাচার ছেলে। মোতালেব চাচার পরে ফরিদই ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছে তাদের বাড়িতে। ফরিদকে দেখে শিহরণ বলল, ‘কী ব্যাপার! ফরিদ ভাই! তুমি এখানে?’

ফরিদ মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলল, ‘স্যার! আজকে বাসায় যাবেন না? বড়ো স্যার বলেছেন, আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

শিহরণ কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘ফরিদ ভাই! তুমি কেন এসেছ আবার?আমি নিজেই তো ড্রাইভ করতে পারি। তাই না?’

ফরিদ আবারও একগাল হেসে বলল, ‘স্যার পাঠাতে চাননি আসলে ম্যামের জোরাজুরিতে স্যার আসতে বলেছেন। বৃষ্টি বেশি হচ্ছে তাই আপনাকে গাড়ি চালাতে নিষেধ করেছে।’

‘আম্মুটাও যে কি না! এই সামান্য বৃষ্টি দেখেই তোমাকে পাঠিয়ে দিল।’

‘আসলে ম্যাম খুব চিন্তা করছেন আপনার জন্য। বাইরের আবহাওয়া তেমন ভাল নয়। তাই দ্রুত বাসায় যেতে বলেছেন। আপনাকে কয়েকবার কল করেছেন কীন্তু আপনি ফোন রিসিভ করছেন না দেখে তিনি আরও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।’ ফরিদ বলল আড়ষ্ট গলায়।

শিহরণ তার টেবিলের উপর থেকে নিজের সেল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল মায়ের পনেরটা মিসডকল। দেরি না করেই দ্রুত ব্যাক করল সে। ওপাশ থেকে ধমকের সুরে সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘এখন কি মায়ের কলটাও রিসিভ করার সময় নেই তোমার?’

শিহরণ অপরাধীর সুরে বলল,’আম্মু আসলে মোবাইল সাইলেন্ট করা ছিল। তাই দেখতে পাইনি। ইদানিং প্রচণ্ড কাজের চাপ আম্মু।’

‘এত কীসের কাজ বলো তো? এই খারাপ আবহাওয়া দেখেও তোমার বাসায় আসতে মন চাইছে না।’

‘আম্মু! এখনই রওনা দেব। কিন্তু ফরিদ ভাইকে কেন পাঠালেন?’

‘দরকার আছে তাই পাঠিয়েছি। তুমি তো আমার কলটাই রিসিভ করছিলে না। এবার ঝটপট বাসায় চলে আসো।’

‘জি, আম্মু! আসছি।’

শিহরণ ফরিদকে ইশারা করতেই সে গাড়ি বের করতে বেরিয়ে পড়ল। শিহরণ ছোঁয়ার ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে নক করে বলল, ‘মিস ছোঁয়া! কাম ফাস্ট।’ এটুকু বলেই বলিষ্ঠ পাদদেশ ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

ছোঁয়া নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুত হাঁটা দিল শিহরণের পিছু পিছু। অফিস থেকে বেরিয়ে দেখল, বৃষ্টির বেগ দ্বিগুণ হয়েছে। গাড়িতে ঢুকতে গিয়েই তারা দুজন এক প্রস্থ ভিজে গেল। শিহরণ গমগমে গলায় ফরিদকে বলল, ‘ফরিদ ভাই! আগে মিস ছোঁয়াকে নামিয়ে দিবেন।’

ফরিদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। জানালার কাচ তুলে দেওয়া। গাড়ির ভেতরটা গুমোট হয়ে আছে। গ্রীষ্মের শেষে ধরণী বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়েছে। তাই এই বৃষ্টি বাইরে যতটা শীতলতা প্রদান করছে বদ্ধ গাড়ির ভেতর ঠিক ততটাই গুমোট পরিবেশ তৈরী করেছে। ছোঁয়ার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। সে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। শিহরণ আড়চোখে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল, মেয়েটার অস্বস্তি হচ্ছে। গাড়ির সামনের ওয়াইপার দুটো যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি সরাতে সরাতে। জানালা খুলে দিলেই তো বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়বে গাড়ির ভেতর। তাই শিহরণ অপেক্ষা করতে লাগল বৃষ্টি কমার জন্য। বৃষ্টির বেগ কমতেই সে কোনো প্রকার সময়ক্ষেপণ না করেই জানালার কাচ নামিয়ে দিল।

তারপর বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। শব্দরা যেন ছুটিতে গিয়েছে। ছোঁয়া মুগ্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। কেউ কারো মুখ দেখছে না।
কেবল বাতাসের শো শো শব্দ কানে বাজছে। আর দুজনের হৃদয়ে তুলছে এক অন্যরকম বাজনার সুর। শিহরণ গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। মোবাইলের ভাইব্রেশনের কারণে নিস্তব্ধতার রেশ কাটিয়ে উঠল কিছুটা, শিহরণ নড়েচড়ে বসল। সে খেয়াল করে দেখল, তার মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে না। সে এবার ছোঁয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টিস্নাত হাওয়া মোহনীয়ভাবে তার ঘনকালো কেশ ছুঁয়ে দিচ্ছে, স্পর্ধিত হয়ে আঁচড় কাটছে তার শরীরে। আবছা অন্ধকারে এই দিব্য দৃশ্য মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল শিহরণ। আচমকা ফরিদের হাঁচির শব্দে শিহরণের ঘোর কাটল। তার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল মুহূর্তেই। ছোঁয়ার মোবাইলটা তখনও ভাইব্রেট হচ্ছিল। শিহরণ ভাবল, এমনকি ভাবছে মেয়েটা! মোবাইলে ভাইব্রেশন হচ্ছে অথচ তার কোনো খবর নেই। শিহরণ তার ঝংকার ছড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কলটা রিসিভ করুন।’

ছোঁয়া মুহূর্তেই তার দিকে ড্যাবড্যাব চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। শিহরণ ভ্রু উঁচিয়ে পুনরায় বলল, ‘ইওর কল, মিস ছোঁয়া।’

ছোঁয়া তৎক্ষনাৎ মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল ফাহমিদা বেগম বেশ কয়েকবার কল করেছে। আবার কল এলো। ছোঁয়া একবার শিহরণের দিকে তাকিয়েই কলটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে চিন্তিত সুরে ফাহমিদা বেগম বলে উঠলেন,’কবে আসার সময় হবে তোর? বাইরের অবস্থা এতো খারাপ। কীভাবে আসবি? সাইফকে কি যেতে বলব?’

ছোঁয়া আশ্বস্ত করে বলল, ‘না, মা। আমি বাড়ির পথেই। বৃষ্টি তো কমে এসেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব।’

_______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৮

ছোঁয়া বাসায় ফিরল একেবারে কাকভেজা হয়ে। শিহরণের গাড়ি থেকে নামার পরেই আবার ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তখন ওই ঝুম বৃষ্টি ভিজিয়ে দিলো তাকে। আঙিনার অংশটুকু দৌড়েই পার হলো সে। তবুও শেষ রক্ষে হলো না।

ছোঁয়া চলে যেতেই শিহরণ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ফরিদ ভাই! তুমি ছাতা নিয়ে আসোনি কেন?’

ফরিদ খানিক ইতস্তত করে বলল, ‘স্যরি স্যার! আসলে ম্যাম বলেছিল কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুলে গিয়েছি।’

বাসায় পৌঁছতেই ফাহমিদা বেগম বললেন, ‘একি! তুই তো ভিজে একসা হয়ে গিয়েছিস। দ্রুত গিয়ে কাপড় পাল্টে নে। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি তোর জন্য গরম চা নিয়ে আসছি।’

ছোঁয়া নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আজকের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। সাথে ঠোঁটের কোণে দেখা দিচ্ছে মৃদু হাসির রেখা। হৃদয়ের প্রতিটি কোণায় কোণায় এক ঝাঁক প্রজাপতি ভালোবাসার গান গাইতে গাইতে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে। ছোঁয়া শুনতে পাচ্ছে তাদের গুনগুন শব্দ। কী ভীষণ ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে মনেপ্রাণে! কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে তার। যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, নেই কোনো প্রকাশ। তবুও আছে অনুভূতি আর অনুভবের রীতি।

ফাহমিদা বেগম চায়ের কাপ হাতে করে হেঁটে এসেই ছোঁয়াকে মিটিমিটি হাসতে দেখে একটু অবাক হলেন। আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার! আজ আমার মেয়েটার মন কি খুব বেশি ভাল?’

ছোঁয়া হাসি চেপে রাখার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল। ফাহমিদা বেগমের দিকে অস্থির চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘না, মা। তেমন কিছু হয়নি।’

‘ছেলেটা কে?’ ফাহমিদা বেগমের প্রশ্ন।

‘কোন ছেলে?’ ছোঁয়া বুঝেও যেন না বোঝার ভান করল।

‘যার জন্য তোর ঠোঁটের কোণে হাসি।’ ফাহমিদা বেগম উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন।

‘মা! তুমি কিসব বলছ, আমি একদম বুঝতে পারছি না।’ ছোঁয়া তোতলাতে তোতলাতে বলল।

‘তোর কোনো পছন্দ নেই তাহলে?’

ছোঁয়া ভাবল খানিক। পরক্ষণেই মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তার ঠিক কি বলা উচিত সে ভেবে পেল না। ফাহমিদা বেগম হয়তো বুঝতে পারলেন, ছোঁয়ার দ্বিধান্বিত অবস্থা। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। চায়ের কাপটা ছোঁয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন। দরজার কাছে গিয়ে আবার কী মনে করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভরাসা দেবার সুরে বললেন, ‘যখন ইচ্ছে হবে তখন বলিস।’ পরক্ষণেই আবার চোখে মুখে চিন্তার রেশ ফুটিয়ে বললেন, ‘কিন্তু খুব বেশি দেরি করিস না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে তার জন্য বিরাট খেসারত দিতে হয়। আমি চাই না তোর ক্ষেত্রে এমন কিছু হোক। তাই আগে থেকেই সাবধান করলাম।’

ছোঁয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসল। চুল থেকে তোয়ালেটা খুলে নিয়ে পাশেই রাখল। তার দৃষ্টি এখন অসীমের কোনো কিছু দেখার প্রয়াসে বদ্ধপরিকর। কিন্তু চোখের দেয়াল তখন ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হচ্ছে। বৃষ্টির বড়ো বড়ো বিন্দুগুলোও এখন সেই ঝাপসা পর্দায় পৃথক করা সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল তার। কী করবে সে? কীভাবে করবে? কিছুই তার ভাবনার জগতের মধ্যে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো, আবেগে ভেসে যাবে না সে কোনোভাবেই।

এই ভাবনাটা মনের গহীনে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা তৈরী করল। তবুও ভালোলাগার প্রজাপতিগুলোকে এভাবে ডানা মেলে উড়তে দেয়া যাবে না। ছোঁয়া এই কাজটি করবে না বলেই মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। মানসিক দ্বন্দ্বে পড়ে ভাবনায় মশগুল হওয়ার কারণে ছোঁয়ার গরম চা ঠান্ডা হয়ে গেল সেদিকে অবশ্য তার কোনো খেয়াল নেই। নিজেকে ধাতস্থ করেই সে চায়ের কাপের সবুটুকু চা এক চুমুকে শেষ করে ফেলল।

__________________________

‘তোমাকে যা বললাম বুঝেছ?’ অহনা বলল সতর্ক গলায় ।

‘জি, ম্যাডাম। আপনার কাজ হয়ে যাবে। আপনি টেনশন নিবেন না। খালি আমাদের পেমেন্টটা ঠিকমতো করে দিলেই হবে।’

‘আজ বিকেলে অর্ধেক পেমেন্ট করে দেব। টাকা দেবার ঠিকানা মেসেজ করে পাঠিয়ে দেব। বাকিটা কাজ শেষ হওয়ার পর।’ অহনা যথেষ্ঠ সাবধানী গলায় বলল, ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে।

‘ঠিক আছে, ম্যাডাম। আমার হাতে কাজ আসা মনেই হলো আপনার চিন্তার অবসান হওয়া।’ তোষামুদে গলায় বলল, ব্যক্তিটি।

‘এতো তোষামোদ করার দরকার নেই।’ অহনা তার কণ্ঠের মৃদু তিরস্কার ছাপিয়ে সাবধানবাণী দেবার সুরে পুনরায় বলল, ‘আমার কাজ হলেই হলো। তবে মনে রাখবে কোনোভাবেই যাতে আমার নাম না আসে।আর কাজে কোনো ত্রুটি করলে বাকি টাকা পেমেন্ট করা হবে না। কথাটা মনে থাকে যেন।’

‘ম্যাডাম, আমাদের কাজে এখনও পর্যন্ত কোনো গণ্ডগোল হয়নি । ভবিষ্যতেও হবে না। আপনি টাকা রেডি রাখবেন।’ ওপাশের ব্যক্তিটি হুমকি দিয়ে বলল, ‘আর মনে রাখবেন আমাদের সাথে কোনো চালাকি করবেন না। চালাকির ফল কিন্তু ভালো হবে না। বলে রাখলাম।’

‘আপনি বেশি কথা বলেন!’ অহনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। পরক্ষণেই নিজের গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ‘কাজে কোনো প্রকার ত্রুটি যেন না হয়। আই ওয়ান্ট হার টু সাফার ব্যডলি।’

ঠিক তখনই হিয়া চায়ের কাপ হাতে অহনার রুমে ঢুকল। বলল, ‘কাকে সাফার করতে দেখতে চাও?’

অহনা দ্রুত কলটা কেটে দিলো। জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘কেউ না। তামিমের সাথে কথা বলছিলাম শ্রেয়াকে নিয়ে। তামিম এবারও শ্রেয়াকে উইশ করতে ভুলে গেছে। তাই সে সাফার করছে, নিজের করা ভুলের জন্য।’

‘কিন্তু তুমি আমাকে দেখে এভাবে ভয় পেয়ে গেলে কেন?’ হিয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে চাইল অহনার দিকে।

পূর্বের জোরপূর্বক হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে অহনা বলল,’আমি ভয় পাব কেন? তোকে ভয় পাওয়ার কি আছে?’

হিয়া চায়ের কাপটা অহনার হাতে দিয়ে সহাস্যে বলল, ‘ওকে। আই ডোন্ট নিড এনি মোর ক্লারিফিকেশন সিস্টার। আম্মু ডাকছিল তোমাকে চা খেতে কিন্তু তুমি তো শুনতেই পাচ্ছিলে না তাই আমাকে পাঠাল।’

হিয়া চলে যেতেই অহনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চায়ের কাপটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে হাতের মোবাইলটা নিয়ে কল লিস্ট থেকে নাম্বারটা ডিলিট করে দিলো। ব্যস! এবার কাজটা হয়ে গেলেই শান্তি। তখন আর এইসব নিত্য প্যারা নিতে হবে না অহনাকে।

আজ শিহরণের সাথে ছোঁয়াকে দেখে অহনার মেজাজটা পুরোই বিগড়ে গেল। প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ল সে। ছোঁয়াকে তার সহ্য হয় না, এ কথা সত্য, তবুও কষ্ট করে বহুদিন সহ্য করেছে। কিন্তু সবখানেই এই মেয়েটাকে প্রাধান্য পেতে হবে কেন? কেন সবার কাছেই এই মেয়েটাকে মহীয়সী সাজতে হয়? এবার দেখা যাক, কী করে সবার কাছে প্রাধান্য পায় সে! অহনা আর কোনোভাবেই এই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারছে না, পারছে না এ ধরনের বাড়াবাড়ি মেনে নিতে। তাই শেষমেশ এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
_______________

আজ দোকান বন্ধ করতে দেরি হয়ে গেল অনেক। এতোদিন ফুফুর বাসায় থাকার কারণে দোকানের কাজ জমেছিল। অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হলো রাদিদকে। দেনাদার-পাওনাদারের হিসাবনিকাশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী হিসেবে তার সুনাম আছে এলাকায়। তবে এতোদিন এখানে উপস্থিত না থাকায় দোকানের যাচ্ছেতাই অবস্থা। দোকানের ছেলেটা কোনো ডেলিভারি ঠিকঠাক মতো দেয়নি। একে একে সবাই তাকে ফোন করে নালিশ জানিয়েছে। প্রচণ্ড বিরক্ত হলো সে। নিজের ভাইটাই যখন দোকানের কাজ ঠিকমতো করেনি তখন বাইরের ছেলেগুলোকে সে কী দোষ দিতে পারে! তাই সমস্ত রাগ, সমস্ত ক্ষোভ ঢোক গিলে নিজের ভেতরেই ঢুকিয়ে নিলো। সব ডেলিভারি দিতে দিতেই তার এতো দেরি হয়ে গেল। তাছাড়া বৃষ্টির কারণে সবাইকে ডেলিভারি দিতে পারেনি গতকাল। আজও যাচ্ছেতাই অবস্থা। তাদের কাছে ফোন করে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চেয়ে নিলো। যাদের কাছ থেকে সময় চেয়েছিল তাদের সকলকে আজকে ডেলিভারি দেওয়া শেষ। আর তাই নিজেকে নির্ভার মনে হলো তার। কেমন হালকা হালকা অনুভব হচ্ছে। সমস্ত হিসাবনিকাশ করা শেষে দোকান বন্ধ করল সে। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। দোকানের ছেলে দুটো অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। সে-ই অবশ্য যেতে বলেছে। তাদের বাসা একটু দূরে, তাই এই খারাপ আবহাওয়ার রিস্কটা সে নিলো না।

বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বের হতে হলো রাদিদকে। ছাতা অবশ্য সাথে আছে। কিন্তু বৃষ্টির তোড়ের কাছে এই ছাতাটা একেবারেই নস্যি। বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থা খারাপ। তাও ভাল যে শেষমেশ বাসায় পৌঁছাতে পেরেছে। বাসায় পৌঁছতেই ভেজা পরিচ্ছদ পাল্টে নিলো রাদিদ। তারপর মায়ের রুমে গিয়ে দেখল, তার মা বাচ্চাদের মতো করে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। মায়ের ঘুমন্ত মুখটা দেখতেই তার মন প্রশান্তিতে ভরে উঠল। মায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ, নীরবে। বেশ কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে মায়ের কপালে একটা চুমু এঁকে দিলো। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল। ডাইনিং স্পেসে আসতেই দেখল নীলা পিউকে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত। রাদিদকে দেখে নীলা বলল, ‘হাত মুখ ধুয়েছিস, ভাই? খেতে বস। আমি খাবার দিচ্ছি।’

রাদিদ একটা চেয়ার টেনে বসতেই পিউ অনুযোগের সুরে বলল, ‘বড়ো মামা! আজ এত দেরি করেছ কেন?’

রাদিদ প্রশস্ত হেসে উত্তর দিলো, ‘আজ অনেক কাজ ছিল চ্যাম্প। তাই আসতে দেরি হয়ে গেল।’

পিউ বিজ্ঞের মতো করে বলল, ‘বড়ো মামা! ছোট মামাকেও কাজে নিতে পারো তো। দুজন একসাথে কাজ করলে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

রাদিদ জবাবে হাসল কেবল। পিউ আবারও বলল, ‘বড়ো মামা! কিছু বলছ না কেন?’ কপালে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে একটু চিন্তা করে বলে,’হুম, ছোটো মামা কি কাজ করতে চায় না? সারাদিন তো ঘরে এমনিতেই বসে থাকে। তার চাইতে কাজ করলেই ভাল। তাই না বড়ো মামা?’

নীলা ধমকে উঠল, ‘এতো কথা কিসের পিউ? বড়োদের নিয়ে এরকম কথা বলতে নেই। তাড়াতাড়ি পানি খেয়ে উঠে পড়।’

মায়ের ধমক খেয়ে পিউ গাল ফুলিয়ে বসে থাকল। রাদিদ তাই দেখে হেসে ফেলল। ঠোঁটে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, ‘লিটল চ্যাম্প কাল স্কুলে যেতে হবে তো। তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাও।’

রাদিদের কথা শুনে পিউ বাধ্য বাচ্চার মতো পানি খেয়ে রুমে চলে গেল ঘুমোতে। রাদিদকে খাবার বেড়ে দিয়ে নীরা তার পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, কোনো একটা প্রতীক্ষিত সংবাদ শোনার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট দৃশ্যমান। রাদিদ হাত দিয়ে ভাত মাখতে মাখতেই বলল, ‘আম্মু খেয়েছে?’

নীলা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপর চেহারায় উদ্বিগ্ন ভাব এনে বলল, ‘কোনো খবর পেয়েছিস?’

রাদিদ ব্যাথাতুর চোখে তাকাল বোনের দিকে। সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেলল। এই এক ‘না’ সে আর কতোবার বলবে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না! খাবার মুখে পুরলেও বোনের এই প্রশ্ন শুনে খাবার আর গলা দিয়ে নামছে না। তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল মুহূর্তেই।

নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুই কেন মন খারাপ করছিস? এতে তো তোর কোনো দোষ নেই, ভাই।’ চাপা আর্তনাদ করে সে বলল, ‘আমার ভাগ্যটাই খারাপ। বাবা থাকতেও আমার মেয়েটাকে বাবা ছাড়াই বড়ো হতে হচ্ছে। এমন কোনোদিন যায় না যখন পিউ তার বাবার কথা জানতে চায় না।’ নীলা কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

রাদিদের চোখের কোণেও কোথা থেকে যেন অশ্রুবিন্দু জমা হলো, তার নিজের অজান্তেই। খাবার তার গলা দিয়ে আর নামল না। বেসিনে হাত ধুয়ে সে নিজের রুমে গিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। বাবা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করে আসা কোনো ঝড়ের মতো করেই সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেল। ঘর বাঁধার আগেই বোনের ঘরটা ভেঙে গেল। তার বোনের সাথে কেন এমন হলো! ঢাকায় যাওয়ার পেছনে তার অন্য একটি কারণ হলো তার বোনের স্বামীকে খুঁজে বের করা। রাদিদ বারবার বলেছে যে পিউ’র বাবা তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু নীলা তা কোনোভাবেই মানতে রাজি নয়। তার এক কথা নিশ্চয়ই পিউ’র বাবা কোনো বিপদে পড়েছে, তাই তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। আজ পাঁচটা বছর যাবৎ সে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার বোনের স্বামীকে। কিন্তু প্রতিবারই তাকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে।

চোখ দুটো প্রায় লেগে এসেছিল রাদিদের। কিন্তু ফোনের তারস্বরে বেজে ওঠাতে সেটাও চটে গেল। প্রথমবার অলসভাবেই শুয়েছিল সে, ইচ্ছে করল না কে কল করেছে তা দেখার। কিন্তু কলকারী বড্ড হঠকারিতার পরিচয় দিলো। পুনরায় কল করে বসল। রাদিদ এবার মাথার উপর বালিশ চাপা দিলো। কোনোভাবেই শোয়া থেকে উঠে ওয়্যারড্রবের উপর থেকে মোবাইলটা নিতে ইচ্ছে করছে না তার। বড্ড ক্লান্ত সে, সবকিছুর জন্য, মানসিক আর শারীরিক উভয় দিক থেকেই। কিন্তু মোবাইলটা বেজেই চলেছে। শেষমেশ মাথার উপর থেকে বালিশটা সরিয়ে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে পেল নীরার নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। তার মেজাজটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেল। সে কলটা রিসিভ করেই তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘এই তোর কোনো কমন সেন্স নাই? এতো রাতে কল করছিস কেন? কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারিস নাই?’

নীরা উল্টে বিরক্ত হলো রাদিদের উপর। সে তার সমস্ত রাগ কণ্ঠে ঢেলে চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমাকে কল করার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। আমার আম্মাজান আদরের ভাইপোর খবর নিতেই আমাকে বারবার তাগাদা দেবার কারণেই বাধ্য হয়ে কল করেছি।’

রাদিদ নিভল। বলল, ‘ফুফু কল দিতে বলেছে? আগে বলবি না।’ একটু হাসার চেষ্টা করল সে।

নীরা এবার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। তেজী গলায় বলল, ‘বলার সুযোগ দিলে তো বলব!’

‘আচ্ছা, ফুফু কই ? ফুফুকে দে। তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’

‘ইচ্ছে করবে না তো। প্রয়োজন ফুরালে এই নীরাকে আর কারও গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করে না।’ ব্যথাতুর গলায় বলল, নীরা।

নওশীন হক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ঝগড়া শুনছিলেন। ফোন হাতে নিয়ে বললেন, ‘রাদিদ! ঘুমিয়ে পড়েছিলি না-কি?’

‘ওই একটু চোখ লেগে এসেছিল। আজ কাজের চাপ একটু বেশি ছিল তাই।’

‘তুই কেমন আছিস? ভাবির শরীর কেমন এখন? নীরার কাছে শুনলাম জ্বর উঠেছিল।’

‘হ্যাঁ, ফুফু। এখন সুস্থ আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। তুমি টেনশন নিও না। আমি ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছ?’

‘আমিও ভালোই আছি, আলহামদুলিল্লাহ। বাসায় যাওয়ার পর মাকে পেলে তো আর ফুফুর কথা মনে পড়ে না তোর। একদম ভুলে যাস।’

রাদিদ ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘একদম না ফুফু। এই কয়দিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তাই কল করার সুযোগ হয়ে উঠেনি।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার ঘুমিয়ে পড়।’

নীরা মায়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। কঠিন গলায় বলল, ‘দেখি কারও আমাকে আর প্রয়োজন হয় কি না!’ খানিক থেমে রহস্যময় কণ্ঠে বলল, ‘আমি তো খুব শিগগিরই আমার প্ল্যান এক্সিকিউট করা শুরু করে দিব। তখন দেখব কেউ আমার কাছে কিছু জানতে চায় কি না। যদি জানতে চায় তবে আমি আগে থেকেই বলে দিচ্ছি তাকে আমি কোনো তথ্যই দেব না। এভাবে ফ্রি কোনো কাজ এই নীরা করে না। মনে থাকে যেন।’ এটুকু বলেই নীরা কলটা কেটে দিলো।

রাদিদ হাসতে থাকল। নীরাটা একদম পাগল। বাচ্চাদের মতোই এখনও বায়না ধরে বসে যখন তখন। তার এই বোনটা তার নিকট ভীষণ প্রিয় কিন্তু সবসময় তা প্রকাশ হয়ে উঠে না। বলা যায়, সে কিঞ্চিতই প্রকাশ করে। অবশ্য বেশি প্রকাশ করলে সে বাঁদরামি শুরু করে দিবে, এটা রাদিদ শতভাগ নিশ্চিত । তখন সামলাবে কী করে! এই যেমন এখনও এমন কিছু কথা বলল যা কখনোই হবার নয়। পাগলি মেয়েটা! বুঝতেই পারছে না সে কী বলছে! রাদিদ হাসছে। এই নীরার সাথে কথা বলা এড়িয়ে যেতে চায় সে ইদানিং, কারণ কথা বললেই তার কথার ওয়ান এন্ড অনলি টপিক বহ্নি। তখন রাদিদের মাথা ধরে যায়, কাজে মন বসতে চায় না, মন তখন রঙিন কোনো এক স্বপ্নময় রাজ্যে তার স্বপ্নের রাজকন্যাকে নিয়ে বিচরণ করতে চায় শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তাই সে ইদানিং নীরাকে ধমকের উপর রেখেছে। কিন্তু কিছু বলেও কাজ হয় না। নীরাকে বোঝানো তার সাধ্যে নেই। সে একবার যা বুঝে, তাই ঠিক ভাবে।

____________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৯

সাব্বির আহমেদ বিশেষ তলব করেছেন পরিবারের সকলকেই। তাদের অরফানেজের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এই ব্যাপারে সকলের মতামত জানাটা আবশ্যক বলে মনে করেন তিনি যদিও তার কথার ব্যতিক্রম কেউ করবে না। আয়োজনটা নিজেদের হাতে সম্পন্ন করতে পারলে বেশ হবে। তাই কীভাবে, কোথায় সমস্তকিছু আয়োজন করলে আশ্রমের সকলের জন্য ভাল হবে সেই বিষয়টাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এই বিশেষ কারণেই আজকের এই বিশেষ তলব।

সাব্বির আহমেদ নিজেই চাইছেন এবারের অনুষ্ঠানটা ব্যতিক্রমী ও বেশ বড়ো আকারে আয়োজন করতে। কারণ আশ্রম থেকে এবার বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে পড়াশোনা শেষে ভাল চাকরি পেয়েছে, যোগদান করেছে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে, কয়েকজন আবার এসবিএ এন্টারপ্রাইজেও নিজেদের যোগ্যতাগুণে চাকরি পেয়েছে। তাই আশ্রমের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান পালনের পাশাপাশি তাদের সংবর্ধনা দেবার অনুষ্ঠানটাও আয়োজন করা হবে। এটা একটা বিশাল অর্জন। তাই নিউজ কাভারেজ হবে। এটা নিয়ে নিউজ ছাপা হবে বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকাতেও। বেশ কয়েকজন সুশীল সমাজের মানুষসহ রাজনৈতিক কর্মকর্তাকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে। যার কারণে বিশাল আয়োজনে কোনো প্রকার ত্রুটি থাকা যাবে না। আর সাব্বির আহমেদ চান এই অনুষ্ঠানটা পরিবারের সদস্যরা মিলেই সম্পন্ন করুক। আশ্রমের ছেলে মেয়েগুলো এক একজন এক এক কাজে দক্ষ, এবার তাদের দক্ষতার প্রমাণ দেখানোর সময় এসেছে।

ড্রইং রুমে সবাই চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে সাব্বির আহমেদের দিকে। সাব্বির আহমেদ কেশে গলা পরিষ্কার করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘এবারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পেছনে অবশ্য বেশ কয়েকটি কারণ আছে।’

সবাই তন্ময় হয়ে শুনছিল সাব্বির আহমেদের কথা। কিন্তু রাফি বোকার মতো জিজ্ঞেস করল, ‘কী কারণ চাচ্চু?’

রাফির প্রশ্ন শুনে সবাই সাব্বির আহমেদের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে রাফির দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শিহরণ ভীষণ আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘তোমার তো জানার কথা। তাই না?’

রাফি আশ্রমের বিভিন্ন কাজ করে থাকে। আশ্রমের তদারকির কাজটা মাঝেমধ্যেই ওকে দিয়ে সম্পন্ন করানো হয়। কিন্তু কাজের প্রতি তার ভীষণ অনীহা। ভুলে যাওয়াটা তার জন্য অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। সকলের হতবিহ্বল দৃষ্টির তোপের মুখে পড়ে বোধহয় তার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করা শুরু করেছে । সে তাৎক্ষণিক কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘ওহ্! মনে পড়েছে।’ এটুকু বলেই সে হাসার চেষ্টা করল।

সাব্বির আহমেদ ভারিক্কি গলায় শিহরণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যেহেতু এই অনুষ্ঠানটা আমাদের জন্য বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই আয়োজনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে তুমি। বাকি সব কাজ তুমি অন্যদের উপর অর্পণ করবে।’ শিহরণ কাঁধে ভরসা দেবার ভঙ্গিতে একটা হাত রেখে বললেন,’তোমার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আমি জানি তুমি অপাত্রে দায়িত্ব অর্পণ করবে না।’

নিজের উপর বাবার এমন অগাধ বিশ্বাস শিহরণকে বারংবার বিমোহিত করে। যখনই তার বাবা তাকে এমন আশ্বস্ত করেন তখনই সে বুঝতে পারে তার আত্মবিশ্বাস আর কাজ করার প্রবণতা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। তার বাবার মুখ নিঃসৃত প্রতিটি কথাতেই সে নিজের মধ্যের সত্তাটির দ্বিগুণ স্পিডে কাজ করার উদ্দীপনা খুঁজে পেতে দেখেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাঝেমধ্যে সে খুব করে প্রশ্ন করতে চায় তার বাবাকে ‘কেন তিনি শিহরণকে এত ভরসা করেন? কেনই বা তাকে এতটা যোগ্য মনে করেন?’ এই প্রশ্নগুলো তার নিজের মনে উদ্রেক হয় আর নিজের মনের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে হৃদয়ের কোনো এক ক্ষুদ্র কোণে চুপটি মেরে আত্মগোপন করে। প্রশ্ন আর করা হয় না তার। তবুও সে গর্বিত এমন একজন বাবা পেয়ে, যে বাবা তাকে বিশ্বাস করে, ভরসা করে, তাকে নতুন উদ্যমে চলতে সাহায্য করে, ঠিক যেমনি কোনো শিশুকে আঙ্গুল ধরে পথ চলা শেখায় তার পিতা-মাতা এখনও ঠিক তেমনি আছে তার বাবা। সে নিজে জানে তার বাবা তার জন্য কী! ‘প্রত্যেক সন্তানের জন্য তার বাবা সুপারম্যান’ এমন একটা কথা সে শুনেছিল কোথাও। বাস্তবিক অর্থে নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছে যে, সে এমন একজন সুপারম্যানকে বাবা হিসেবে পেয়েছে। একজন বন্ধু হিসেবেও সে বাবাকে পাশে পেয়েছে। তার এখনও মনে পড়ে যখন অতলের সাথে ছোঁয়াকে শেষবার দেখেছিল আলিঙ্গনরত অবস্থায়। শিহরণের মাথা তখন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছুই সে ভাবতে পারছিল না, শুধুই মনে হচ্ছিল এক বিশ্বাসঘাতককে সে তার বন্ধু ভেবেছিল। যে বিশ্বাঘাতক একই সাথে তার দুজন প্রিয় ও খুব কাছের মানুষের সাথে অভিনয় করে বেড়াচ্ছে। ছোঁয়ার উপরও সেদিন পাহাড়সম অভিমান জমেছিল। ভেতর থেকে একটা সত্তা বারবার ধিক্কার দিচ্ছিল–এমন একজনকে ভালোবাসার জন্য। সেই প্রলয়ঙ্কারী কণ্ঠস্বর শুনে নিজের মধ্যের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। নিজেকে আঘাত করতেও পিছপা হয়নি সে। প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ঠিক কোনো এক এঞ্জেলের মতো তার বাবা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল চোখের সামনে যা কিছু দৃশ্যমান হয় সবসময় তা সত্যি হয় না। প্রতিটি মুদ্রার যেমন এপিঠ ওপিঠ, দুটো পিঠ থাকে। ঠিক তেমনি প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকে। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে একজন নেতিবাচক মানুষ যেমন ইতিবাচক বিষয়কে নেতিবাচকভাবে নিতে পারে, তেমনি একজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষও নেতিবাচক বিষয়ের মধ্য থেকে ইতিবাচক বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে।

পরবর্তীতে অবশ্য সে তার বাবার বলা প্রতিটি কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে। তাই সে বরাবরই তার বাবাকে নিয়ে গর্বিত। তার নিজের যোগ্যতা কতটুকু সে কখনোই পরিমাপ করতে পারবে না। তবে তার উপর তার বাবার বিশ্বাস, ভরসা, বাবার দেয়া অনুপ্রেরণার বদৌলতে সে অসম্ভব কাজও করে ফেলতে পারবে বলে মনে মনে বিশ্বাস করে। আজ সে যা কিছু সমস্তই তার বাবার জন্য। সন্তানের প্রতি পিতামাতার আস্থা এক অনন্য থেরাপি অর্থাৎ প্যানেসিয়ার ন্যায় কাজ করে। যা সন্তানের জীবনকে এক উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর করতে সাহায্য করে।

‘কী হয়েছে? পারবে না তুমি?’ সাব্বির আহমেদের সন্দিগ্ধ কণ্ঠে করা প্রশ্নে শিহরণের ভাবনার জাল মুহূর্তেই ছিন্ন হলো।

শিহরণ জবাবে হাসল। একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমার আব্বু সাথে থাকলে আমি সবকিছু করতে পারব এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’

সাব্বির আহমেদ ছেলের কাঁধে বারকয়েক চাপড়ালেন। বললেন, ‘ইম্প্রেসিভ মাই চাইল্ড।’

বহ্নি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘সব ভালোবাসা কেবল ভাইয়ার জন্য বরাদ্দ আমার জন্য কিচ্ছু নেই।’

শিহরণ হেসে সাথে সাথেই বলল, ‘প্রজাদের সামনে রাজকন্যার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে নেই । তাই অনুগ্রহ পূর্বক এই প্রজাকে ইর্ষা করবেন না রাজকুমারী।’ শেষ বাক্যটি শিহরণ বাউ করার ভঙ্গিতে বলল।

বহ্নি সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। শিহরণের দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘ভাইয়া! তুমি সবসময় এমন করো।’ সাব্বির আহমেদের দিকে তাকিয়ে নালিশ দেবার মতো করে বলল, ‘আব্বু ! ভাইয়াকে কিছু বলছ না কেন?’

সাব্বির আহমেদ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘শিহরণ একদম ভুল বলেনি। তুমি তো আমার প্রিন্সেস। একদম ঠিক বলেছে, শিহরণ।’

‘আব্বু, তুমিও?’ অনুযোগের দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল বহ্নি। শিহরণের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘দাঁড়াও আম্মুকে বিচার দিচ্ছি।’

সাবিহা সাবরিন নাস্তার ট্রে হাতে ডাইনিং স্পেস দিয়ে হেঁটে আসছিলেন। বহ্নির কথা শুনতে পেয়ে বললেন, ‘এবার আমিও সবার সাথে একমত, প্রিন্সেস।’

বহ্নি এবার গাল ফুলিয়ে বুকের উপর দুহাত ভাজ করে বলল, ‘ঠিক হচ্ছে না কিন্তু। কেউ আমার পক্ষে নেই। সবাই ভাইয়ার পক্ষে। আমি এহেন অন্যায় কক্ষনো মানব না।’

রাফি ভেতরে ভেতরে রাগে গজগজ করছিল। সে আজকে আসতেও চাইনি। তার বাবা তাকে এক প্রকার জোর করে পাঠিয়েছে তিনি আসতে পারবেন না বলে। সে অতিষ্ট হয়ে মনে মনে বলল, ‘এত্ত ঢং এদের। প্রত্যেকটা মানুষ চরম বিরক্তিকর।’ কিন্তু মুখে কৃত্রিমতায় ছোঁয়ানো হাসি হেসে বলল, ‘বহ্নি! আমি আছি তো তোমার পক্ষে।’

বহ্নি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাফির উপর।বলল, ‘তোমাকে আমার পক্ষে থাকতে হবে না। তুমি এমনিতেও কারও পক্ষেই থাকো না। তুমি কেবল নিজের পক্ষে থাকো।’

সাবিহা সাবরিন চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘বহ্নি! এসব কী ধরনের কথা?’

বহ্নি নিভল খানিক। মাকে সে বরাবরের মতোই ভয় পায়। রাফি বলল, ‘চাচি! ও দুষ্টামি করে বলেছে। আমি একদম কিছু মনে করিনি। ও তো প্রায়ই এমন দুষ্টামি করে।’

বহ্নি তখন চুপ করে ছিল। তার খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘মোটেও দুষ্টামি করিনি রাফি ভাই। আমি একদম মনের কথাটাই বলেছি।’

ঠিক তখন সাব্বির আহমেদের মোবাইলটা বেজে উঠল। কথা শেষ করে তিনি শিহরণকে উদ্দেশ্য করে উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আয়োজন শুরু করে দাও। হাতে সময় কম তবে কাজ বেশি। কোনো ভুল করলে চলবে না এবার। সিকিউরিটির বিষয়টি মাথায় রাখবে। ঠিক আছে?’

শিহরণ দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘ঠিক আছে আব্বু। আমি সব সামলে নিব।’

কথা শেষ করেই সাব্বির আহমেদ বেরিয়ে পড়লেন। সকালের নাস্তা সেরে শিহরণও অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল। মায়ের আদেশে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বহ্নি রাফিকে সাথে নিয়ে চলে গেল তার ভার্সিটিতে।
____________________

অফিসে ঢুকেই শিহরণ প্রথমে আড়চোখে ছোঁয়াকে দেখল। মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে মেয়েটা। নিজের কেবিনে গিয়ে প্রথমেই পেন্ডিং কাজগুলো সেরে নিলো শিহরণ। তারপর বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবল অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যাপারে। ছোঁয়াকে তার প্রয়োজন হবে এই কাজে–তার অবচেতন মন এটাই বারংবার বলছে। মনের কথা অগ্রাহ্য করার সময় ও ইচ্ছে দুটোই শেষ হয়ে গেছে। এখন তার মনকুঠুরীর সমস্ত বাসনা পূরণের সময় হয়েছে। মনোরাজ্যে আজ হরেক রঙের ঝলকানি।

সকালের মিষ্টি কোমল রোদ জানালার পর্দা ভেদ করে শিহরণের কেবিনে প্রবেশ করেছে। তাই রোদ্দুরের তীব্রতা অনুধাবন করা যাচ্ছে না। শিহরণ জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়াল পর্দাটা না সরিয়েই। কেবিনের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে লাগানো গোলাপের গাছটাতে পাঁচটা কলির সাথে একটা মাত্র ফুটন্ত লাল গোলাপ আছে। তাছাড়া অন্যান্য ফুলের গাছ ও ক্যাকটাস জাতীয় গাছও লাগানো হয়েছে এই ছোট্ট ব্যালকনিটাতে। ফরিদই এনে লাগিয়েছে গাছগুলো। শিহরণ এই অফিসের ছোট্ট ব্যালকনিতে গাছগুলো লাগানোর কারণ জানতে চেয়েছিল। প্রত্যুত্তরে সে বলেছিল, ‘ফুলের গাছ আশেপাশে থাকলে কাজ করতে বেশ আরাম লাগে। মন ফ্রেশ থাকে। মাথা কাজ করে বেশি। আর ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে আসলে তো কাজ করার স্পৃহা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।’

শিহরণ ফরিদের কথায় হেসেছিল সেদিন। তার ফুল, পাখি, গাছপালা ভীষণ পছন্দের। এটা সে কাউকেই খুব একটা বলে না, ভালোলাগার বিষয়গুলো প্রকাশ করতে তার ভীষণ রকমের কুণ্ঠা, দ্বিধা। তবে একজনকে বলেছিল, তার ফুল ভীষণ পছন্দের বিশেষ করে লাল গোলাপ।

সকালের রোদ্দুর কোমল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে গোলাপ গাছটাতে ফুটন্ত লাল গোলাপটাতে। কী সুন্দর না দেখাচ্ছে ফুলটাকে! এই মনোহারিনী দৃশ্যটা তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে দিলো। মনে মনে ফরিদের প্রতি কৃতজ্ঞ হলো সে।

পরক্ষণেই মনোরাজ্যের সমস্ত জ্বল্পনা, কল্পনা এক পাশে রেখে সে ছোঁয়াকে ডাকল। সাথে সাথে হাজির হলো ছোঁয়া। শিহরণ সাবলীল কণ্ঠে বলল, ‘আই নিড ইওর হেল্প, মিস ছোঁয়া। কুড ইউ?’

‘হোয়াই নট?’ ছোঁয়া প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এটাই তো আমার কাজ। কিন্তু কোন কাজে সাহায্য লাগবে স্যার?’

শিহরণ নিজের চেয়ারে বসে পেপার ওয়েটটা হাত দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, ‘আসলে এটা অফিসের কাজ নয়। তাই আপনি ভেবে নিন, আপনি আসলে পারবেন কি না।’

‘আমাকে কী করতে হবে সেটা বলুন স্যার?’

‘ডেকোরেশন ও এরেঞ্জমেন্টে সাহায্য লাগবে। ঠিক সাহায্যও নয় সহযোগিতা চাই আপনার। আমাদের অরফানেজের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে আমরা সবাই মিলে কাজ করি, এটা আমার আব্বু চাইছে। তাই এই কাজে আপনার সহযোগিতা চাইছি।’ শিহরণ বলল, এক নিঃশ্বাসে।

টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা দ্রুত তার দিকে এগিয়ে দিলো ছোঁয়া। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার! পানি খেয়ে তারপর ধীরে ধীরে বলুন। অফিস টাইম তো এখনও শেষ হয়নি। অযথা তাড়াহুড়োর কি আছে?’

শিহরণ পানি খেল এক নিঃশ্বাসে ঠিক যেমনি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেছিল তেমনি। তারপর বলল, ‘রাজী?’

‘অবশ্যই স্যার।’ উত্তর যেন তৈরী ছিল ছোঁয়ার জিহ্বার ডগাতে। তারপর হেসে বলল, ‘কবে থেকে আয়োজন শুরু করবেন স্যার?’

‘এই তো কিছু দিনের মধ্যেই।’ শিহরণ বলল, কণ্ঠে জোর দিয়ে।

‘ওকে স্যার। আমাকে জানালেই হবে কেবল।’ ছোঁয়া শিহরণের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এবার কি আমি যেতে পারি?’

‘সিউর। ইউ ক্যান।’ শিহরণ হাত নেড়ে দরজা দেখিয়ে বলল।

______________________

ইদানিং শপে সময় দিতে হচ্ছে ছোঁয়াকে । সাইফ তার বাড়িতে যাবার কারণেই ছোঁয়াকে বেশ ভালো রকমের ধকল পোহাতে হচ্ছে। অফিস করে এসে দোকানে যেতে হচ্ছে। কষ্ট হলেও যেতে হচ্ছে। নয়তো দোকানের সমস্ত কাজ এলোমেলো হয়ে যাবে। দোকানের মেয়ে দুটো সন্ধ্যার পর পরই চলে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে সাইফ আর ছোঁয়া দুজন মিলে দোকান সামলে নেয়। কিন্তু সাইফ না থাকাতে পুরোটা সময় ছোঁয়াকেই দেখতে হচ্ছে সমস্ত কাজ। চাইলে দোকান বন্ধও রাখতে পারে সে। তবে হিয়ার পড়াশুনার খরচ, তাদের বাড়িটার বন্ধক ছাড়ানোসহ বেশ কিছু খরচ এখনও বাকি আছে। তাই সে কোনো রিস্ক নিতে চাইছে না। আর্থিক টানাপোড়েন যে কী পরিমাণ অসহনীয় তা ছোঁয়া খুব ভাল করেই জানে!

কিন্তু রাতে বাসায় ফেরার পথে তার মনে হলো কেউ তাকে ফলো করছে। পেছনে ফিরলেই আর কাউকে দেখতে পায় না। দুদিন ধরেই এমনটা মনে হচ্ছে তার। বেশ অস্বস্তিকর অবস্থা। আজও ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে আজও তাকে কেউ ফলো করছে। পেছনে ফিরতেই তার থেকে বেশ দূরত্বে দুটো বাইক দেখতে পেল। বাইক দুটোতেই আরোহী দুজন করে মোট চারজন। ছোঁয়া ভাবল, এমনিতেই সাধারণ কেউ হয়তো। তারপর আবার হাঁটা শুরু করল। কিন্তু পরক্ষণেই একটা কার এসে থামল তার পাশে। ছোঁয়া দেখল, গাড়িটা শিহরণের। মনে মনে একটা ধাক্কা খেল প্রথমেই, শিহরণ এখানে কী করছে? প্রথমেই তার মাথাতে এই প্রশ্নটা এলো। তাকে অবাক করে দিয়ে শিহরণ বলল, ‘আমি ড্রাইভ করছিলাম তোমাকে দেখে মনে হলো তোমার লিফ্ট দরকার তাই চলে এলাম লিফ্ট দিতে।’

‘তোমাকে।’ এই শব্দটাই প্রথমে তার মস্তিষ্ক ধারণ করল। বাকি সব কথা কর্পূরের ন্যায় ভ্যানিশ হয়ে গেল। তার কোনোকিছুই সে ধরতে পারেনি, পারেনি উপলব্ধি করতে। সে ভুলে গেল কেউ তার পিছু নিচ্ছিল।

শিহরণ তাড়া দিয়ে শব্দ করে বলল, ‘জলদি উঠে এসো।’

ছোঁয়া সম্বিৎ ফিরে পেতেই কোনো প্রকার বাক্যব্যয় না করে সম্মোহিত মানুষের মতো উঠে পড়ল শিহরণের গাড়িতে। শিহরণ ফ্রন্ট মিররে দেখল বাইক দুটো এখন আর নেই। সে বলল, ‘এত রাত অবধি বাইরে থাকার কী দরকার?’

ছোঁয়ার কর্ণকুহরে যেন কিছুই প্রবেশ করছে না। সে সম্মোহিত মানবীর ন্যায় বসে আছে।

____________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-১৪+১৫+১৬

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৪

মেঘমুক্ত আকাশটা তারায় তারায় আলোকিত হয়ে আছে। উৎসবমুখর মনে হচ্ছে পুরো অন্তরীক্ষকে। মনে হচ্ছে যেন কোনো এক বিশেষ উৎসব পালন করা হচ্ছে। সমস্ত তারকারাজির মধ্যেখানে থালার মতো চাঁদটা যেন নিজের স্বতন্ত্রতার প্রমাণ দিচ্ছে। বহ্নি ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। আজ এতগুলো বছর পরে অতলের সাথে দেখা হওয়াতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। মনের মধ্যে ভালোলাগার প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। হাতের মোবাইলটার দিকে বারংবার তাকাচ্ছে সে। ভাগ্যিস মোবাইল নাম্বারটা নিয়েছে সে। এবার আর খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হবে না। যখন ইচ্ছে তখন কথা বলতে পারবে। এটা ভাবতেই তার মনের মধ্যে এক ধরনের দুর্জ্ঞেয় ভালো লাগা কাজ করছে। অতলকে কল করার ইচ্ছেটাকে দমন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে সে। কিন্তু বহ্নি সব থেকে বেশি অবাক হয়েছে অতলের পরিবর্তন দেখে! আর চোখের চশমাটা দেখেও বেশ অবাক হয়েছে। চাশমিশ বলাতে খ্যাপে গিয়েছিল খানিকটা। বহ্নির তখন বেশ মজা লাগছিল। অন্ধকার ঘামটি মেরে বসেছে ছাদের চারপাশে গাছপালার ঝোপের মধ্যে। চাঁদের আলো সমস্ত অন্ধকারকে দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বহ্নি ঝোপের মধ্যে থাকা চড়ুই পাখির বাসাটার দিকেও কয়েকবার তাকাল। বিশেষ সুবিধা হলো না। মনে হচ্ছে পাখির বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। টুন আর মুনের সাথে কথা বলতে না পেরে তার ভীষণ খারাপ লাগল। তবে নিজেকে সামলে নিল।

‘কী হয়েছে কাপকেক?’ শিহরণের প্রশ্নে বহ্নি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বলল, ‘দেখ, ভাইয়া! আজ আকাশে কতগুলো তারা। যেন মেলা বসেছে।’

বহ্নির কথা শুনে শিহরণ তাকাশ আকাশের দিকে। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘হুম। ঠিক বলেছিস। খুব সুন্দর লাগছে।’

‘ভাইয়া! গিটার তো সাথেই এনেছ। একটা গান তো হতেই পারে। কী বলো?’

‘হুম, হতে পারে। আমার বোনের জন্য একটা কেন শত শত গান হতে পারে।’ শিহরণ বহ্নির পাশে দাঁড়িয়ে বলল।

‘শত শত গান দরকার নেই। একটা হলেই চলবে।’ বহ্নি সহাস্যে বলল।

‘ওকে, ডিয়ার সিস্টার। বাই দ্যা ওয়ে, টুন আর মুন কই? ওরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’

‘হুম।’ মলিন মুখে বলল, বহ্নি, ‘গান শুরু করো। হয়তো গানের সুরে ওরা জেগেও যেতে পারে।আর একবার জাগলে তো ওরাও মন দিয়ে শুনবে।’

‘ওকে, ডিয়ার সিস্টার।’

শিহরণ চোখ বুজে ধীরে ধীরে গিটারে সুর তুলছে। আর গাইছে তার প্রিয় শিল্পীর একটা গান।

Almost heaven, West Virginia
Blue Ridge Mountains, Shenandoah River
Life is old there, older than the trees
Younger than the mountains, growin’ like a breeze

Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads

All my memories gather ’round her
Miner’s lady, stranger to blue water
Dark and dusty, painted on the sky
Misty taste of moonshine, teardrop in my eye

Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads

I hear her voice in the mornin’ hour, she calls me
The radio reminds me of my home far away
Drivin’ down the road, I get a feelin’
That I should’ve been home yesterday, yesterday

Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads

Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads

Take me home, down country roads
Take me home, down country roads

_____by John Denver

‘বাহ্! দারুণ গেয়েছ ভাইয়া।’

‘সত্যি বলছিস?’

‘মিথ্যে বলব কেন ভাইয়া? ইউ আর রিয়েলি আ স্টার।’

‘এবার কিন্তু একটু বেশিই বলে ফেলছিস।’

‘ভাইয়া, একদম বেশি বলিনি।’

‘আচ্ছা, ভাইয়া। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আম্মু তোমার বিয়ে ঠিক করছে মান্নাত আপুর সাথে।’

শিহরণ চমকাল প্রচণ্ডরকমভাবে। আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী বলছিস এসব?’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া। আড়িপেতে শোনা খুবই খারাপ অভ্যাস। তবুও তোমার নামটা শুনে নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। শুনেই ফেললাম আম্মুর কথা ‘

‘এটা সম্ভব নয়। মান্নাত আমার কাজিন। দ্যাটস ইট। এর থেকে বেশি কখনোই সম্ভব নয়।’

‘আচ্ছা, কেন সম্ভব নয়?’ বহ্নির কণ্ঠে কৌতুহল ।

শিহরণ অদ্ভুতভাবে তাকাল। বহ্নি পুনরায় বলল, ‘না, মানে তুমি তো কাউকে পছন্দ করো না। আম্মু যেহেতু মান্নাত আপুকে পছন্দ করেছে তোমার জন্য তাহলে সমস্যা কোথায়?’

‘সমস্যা আছে। আমি মান্নাতকে ওভাবে কোনোদিন দেখিনি। তাছাড়া তার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা আমার সাথে যায় না।’

‘আচ্ছা, ভাইয়া। সত্যি করে বলো তো তুমি সত্যিই কি এখন কাউকে পছন্দ করো না।’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল, বহ্নি।

‘মিথ্যে বলার কি আছে এটা নিয়ে?’

‘না, মানে আমি স্কুলে থাকতে শুনতাম ছোঁয়া নামের মেয়েটা তোমাকে পছন্দ করে। সবাই বল তো না। কেউ কেউ বলতো। এই যেমন অহনার কাছে শুনেছিলাম।’

শিহরণ মুখটা ফিরিয়ে নিল। বলল, ‘অহনা বলেছে?’ কৌতুহল যেন পেয়ে বসেছে তাকে,’ আর কি কি বলেছে?’

‘বলেছিল তো অনেককিছুই। আমি খুব একটা পাত্তা দিইনি। আমি জানি তুমি আমাকে বলবে। আগে হোক বা পরে বলবে এটাতে আমি নিশ্চিত ছিলাম। এই যেমন ধরো তুমি ওদের বাসায় গিয়েছ বেশ কয়েকবার এটাও বলেছে।’

শিহরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘বলার মতো কিছু নেই। থাকলে তো তোকে বলতাম আমি।’

___________________________

বাসায় পৌঁছে অতল সোজা নিজের বেডরুমে চলে গেল। কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা রাখল বেডের উপরেই। জুতো জোড়া ছুড়ে ফেলল। কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে! সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। সমস্ত কিছু বিক্ষিপ্ত, ছড়ানো-ছিটানো, এলোমেলো। সে নিজেও বিক্ষিপ্ত, তার চিন্তা-ভাবনাও। কৈশরের ঘটনাটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। তাকে পরিণত করেছে অন্য এক মানুষে। প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা তৈরী হয়েছে তার এক সময়কার প্রাণের বন্ধু শিহরণের প্রতি। শান্ত ছেলেটা কেমন যেন অশান্ত হয়ে পড়েছে। এখন আর কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায় না। কোনো বন্ধুকে আপন ভাইয়ের মতো মনে করতে ইচ্ছে করে না। অবশ্যই ভাইয়ের মতো ভালোবাসতো কেবল একজনকে আর সে হচ্ছে কেবল এবং কেবলই শিহরণ। আর সেই মানুষটাকে এখন সবচাইতে বেশি ঘৃণা করে। হুম, ঘৃণা! খুব ভারী শব্দটা, তবুও এখন সে সত্যিই ঘৃণা করে তাকে। তাকে অযথাই দোষারোপ করেছিল সে। তার গায়ে হাত তুলেছিল, করেছিল রক্তাক্ত তার শরীর। শরীরের আঘাতটা তো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সেরে গেছে। কিন্তু মনের ক্ষতটা? ওটা হয়তো কখনোই সারবার নয়। ওটা এখনও জ্বলন্ত, রক্তাক্ত। এমন বিক্ষিপ্ত চিন্তারা ভিড় করেছে অতলের চিন্তা রাজ্যে। আর প্রচণ্ড ক্লান্তিতে সে তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে! চেতনা ফিরে পেল তানিয়ার ডাকে।

‘অতল ভাইয়া! আম্মু ডাকছে তো।”

অতল চোখ না খুলেই প্রচণ্ড বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল, ‘যা তো এখান থেকে। ঘুমোতে দে আমাকে।’

‘সেই সন্ধ্যেবেলা ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনও কি ঘুম পূর্ণ হয়নি?’

‘যেতে বললাম তো তোকে।’ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলতে বলতে সে বালিশে ভাল করে মুখ গুঁজল।

তানিয়া ও কম যায় না। সে সুন্দর করে অতলের মাথার নিচ থেকে বালিশটাই কেড়ে নিল। তারপর গলার স্বর যথাসম্ভব উঁচু করে বলল, ‘আব্বু ডাকছে ভাত খেতে।’

অতল রাগী চোখে তাকাল তানিয়ার দিকে। কিন্তু তানিয়া কী বলেছে বুঝতে পেরে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে গেল। তারপর বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘একটু পরে আসছি।’

‘পরে টরে হবে না। আব্বু বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। সবাইকে একসাথে ডিনার করতে হবে।’

‘আব্বু বসে আছে? আতিক ভাইয়া এসেছে?’ বাথরুম থেকেই চেঁচিয়ে বলল, অতল।

‘হ্যাঁ, ভাইয়া তো সন্ধ্যায় চলে এসেছে।’

‘আচ্ছা, টমেটো সস! আমি এখনই আসছি।’

তানিয়া আর বেশি বকবক করল না। অতলকে শেষবারের মতো সতর্ক করে বলল, ‘অতল ভাইয়া! পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়েই আসো।’

রাতের খাবার শেষে অতল আতিকের রুমে গেল। আতিক তখন ল্যাপটপে কাজ করছিল। অতলকে দেখে বলল, ‘কী রে! কিছু বলবি?’

অতল আমতা আমতা করে বলল, ‘নাহ্! তেমন কিছু বলার নেই। এই তো তোমার খোঁজ নিতে এলাম।’

অতলের মনে চলছে তখন অন্য কথা। কিন্তু নানান কথা ভাবতে ভাবতে তার চিন্তার জন্য নিজেকেই মনে মনে একটা ধমক দিল। পরক্ষণেই বলল, ‘কেমন আছ, ভাইয়া?’

আতিক ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল অতলের দিকে। বলল, ‘ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’

‘আমি তো বেশ আছি।’ বিছানার উপর বসে বলল, অতল।

‘পড়াশোনার কী খবর?’ ল্যাপটপে চোখ রেখেই প্রশ্ন করল, আতিক।

‘খুব ভালো।’ অতল চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল।

অতলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইল আতিক, ‘তোর ভাইভার ডেইট কবে?’

‘এখনও দেয়নি। আশা করছি শীঘ্রই দিয়ে দেবে।’

‘এখন কিন্তু সিরিয়াসলি পড়তে হবে। নো হেলা ফেলা। ইটস্ আ ভেরি ইমপর্ট্যন্ট স্টেজ ইনডিড।’

‘সো ট্রু।’ মাথা চুলকে বলল অতল।

‘আর কিছু বলবি?’ ব্যস্ত দেখাল আতিককে।

‘তোমার কাজ আছে?’ সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অতল।

‘কাজ তো আছেই।’ সহাস্যে বলল আতিক ।

‘ঠিক আছে তাহলে। কাজ করো।’ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল অতল।

‘কিছু বলার থাকলে বলতে পারিস।’ কী-প্যাডে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল, আতিক।

‘না, ভাইয়া! এমনিতেই বলছিলাম। আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছিল।’

‘ওহ্, আচ্ছা। তাহলে একটু অপেক্ষা কর। আমি কাজ শেষ করেই আসব তোর রুমে।’

‘আমাকে ফেলে তোমরা দুইভাই মিলে কি প্ল্যান করছ?’ আতিকের দরজায় দাঁড়িয়ে তানিয়া বলল, কপট রাগ দেখিয়ে ।

‘টমেটো সসকে কোনো পরিকল্পনায় রাখা উচিত বলে মনে হয় না।’ ঠাট্টার সুরে বলল অতল।

‘অতল ভাইয়া! তুমি সবসময় এমন করো। আতিক ভাইয়া তুমি অতল ভাইয়ার কান মলে দাও। একদম উচিত শিক্ষা হবে তখন।’

আতিক তানিয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা, দিব। আমি কাজ শেষ করেই আচ্ছামতো কান মলে দিব।’

অতল তানিয়াকে টানতে টানতে আতিকের রুম থেকে নিয়ে গেল। বলল, ‘আমাকে কান মলা খাওয়াতে তোর খুব মজা লাগে। তাই না?’

‘লাগেই তো। তুমি যেমন মজা পাও আমাকে টমেচো সস বলে ডাকতে।’

অতল নিজের ব্যালকনিতে বসে ছিল অনেকক্ষণ। আতিক এলো না। তানিয়া কফি করে নিয়ে এলো দুজনের জন্য। দুজনে মিলে বেশ অনেকক্ষণ গল্প করল। পড়াশোনা, ভবিষ্যতের কার কী লক্ষ্য এইসবই ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। আতিককে আসতে না দেখে তানিয়া আতিকের রুমে গিয়ে দেখল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখ গোমড়া করে অতলকে বলল, ‘ভাইয়া তো ঘুমিয়ে পড়েছে।’

অতল খানিক ভাবল। পরক্ষণেই বলল, ‘ক্লান্ত ছিল বোধহয়। অন্য কোনোদিন তিন ভাইবোন ভিলে আড্ডা দেয়া যাবে। ঠিক আছে টমেটো সস?’

‘ঠিক আছে।’

‘বাহ্! শেষমেশ মেনে নিলি তাহলে?’

‘কী মেনে নিয়েছি?’ তানিয়াকে বিভ্রান্ত দেখাল,’ ভাইয়া ভালো হচ্ছে না কিন্ত…!’

‘আচ্ছা, আজকের মতো আড্ডা টপিক শেষ। আমার ঘুম আসছে খুব। তুই ঘুমোতে যা। আব্বু দেখলে আমাকে এক প্রস্থ বকাঝকা করবে। তোকে তো কেবল আদুরে বকা দিবে।’

‘হুম, বলেছে তোমাকে।’ কফির মগ দুটো হাতে নিতে নিতে বলল, তানিয়া।

‘বলতে হবে কেন? তোর ভাই সব বুঝে।’ শার্টের কলার উঁচু করে দাপটের সাথে বলল অতল।

‘হুহ্! মা তো তোমাকে আদুরে বকাও দেয় না। তুমি তো আম্মুর জান।’ তানিয়া ভেংচি কেটে বলল।

‘আম্মুর জন্য আমরা তিনজনই সমান। আম্মু আমাদের তিনজনকেই সমান ভালোবাসে। এতে কোনো দ্বিধা নেই।’ অতল দৃঢ়তার সাথে বলল।

‘নাহ্! তোমাকে বেশি।’

‘একদম না।’

‘একদম।’

‘আর কোনো কথা না।’ অতল বিছানায় ধপাস করে শব্দ করে শুয়ে পড়ল।

‘এখনও রাত বারোটাও বাজেনি, ভাইয়া। তুমি এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ছ?’

অতল বালিশে মুখ গুঁজতে গুঁজতে বলল, ‘সকালে আমাকে লাইব্রেরিতে যেতে হবে রে বোন। আর বিরক্ত করিস না।’

তানিয়া মন খারাপ করে নিজের রুমে চলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আবারও দেখল অতলের দিকে। এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তানিয়া ভাবল, এত তাড়াতাড়ি কীভাবে সম্ভব!
___________________________

ছোঁয়া নিজের রুমের ব্যালকনিতে টবে লাগানো গাছে পানি দিচ্ছিল। হঠাৎ করেই তার নাম্বারে রিং বাজতে লাগল। ছোঁয়া তৎক্ষনাৎ কল রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করল না। সে অর্কিড আর গোলাপ গাছগুলোর বিশেষ যত্ন নেয়। গোলাপ তার প্রিয় ফুল, অর্কিডের অবস্থান তার পরেই। গোলাপ গাছে ফুটন্ত লাল গোলাপ ফুলগুলোতে স্প্রে করার সময় তার মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। ছোঁয়া এক প্রকার বিরক্ত হয়েই বেডরুমে ঢুকল। মোবাইল হাতে নিতেই দেখল সাইফ কল করেছে। প্রচণ্ড বিরক্ত হলো সে। তবুও কল রিসিভ করল। বলল, ‘কী রে! এই সময়ে কল করছিস কেন?’

‘তোকে কল করার জন্য এখন আমাকে টাইম দেখতে হবে না-কি?’ সাইফ ও দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে প্রশ্ন করল।

‘পয়েন্টে আয়।’ ছোঁয়া ভীষণ ব্যস্ত গলায় বলল।

‘কিসের পয়েন্ট?’ ইচ্ছে করেই বোকা সাজার চেষ্টা করল সাইফ।

‘আরে বাপ! তুই কেন কল করেছিস বল তো? আমি গাছে পানি দেব।’ বিরক্ত হয়ে বলল, ছোঁয়া।

‘কেমন আছিস?’ সাইফ মুখ টিপে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।

ছোঁয়া বুঝতে পারল সাইফের কুটনামি। তাই সেও বাধ্য মেয়ের মতো বলল, ‘ভালো আছি। এখন রাখছি।’

‘আরে শোন…!’ ছোঁয়া সাইফকে কিছু বলতে না দিয়ে কলটা কেটে দিল। তারপর আবার বারান্দায় গেল গাছে স্প্রে করার জন্য।

কিন্তু আবারও মোবাইলটা বেজে উঠল। বাজতে বাজতেই প্রথম কলটা গেল। ছোঁয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরে আবার মোবাইলটা বেজে উঠল। ছোঁয়া ভাবল এবারও সাইফ কল করেছে। তাই এবার সাইফকে কিছু কড়া কথা বলার মানসে মোবাইলটা পিক করেই বলল, ‘এই তোর সমস্যা কী রে? বললাম না আমি গাছে পানি দিচ্ছি। কানে যায় না কথা?’

এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল সমস্ত কথা। ফোনের ওপাশে পিনপতন নীরবতা। ছোঁয়া আবারও বলল, ‘কী রে ? কথা বলছিস না কেন?’

‘আমি শিহরণ বলছি।’ ভীষণরকম গম্ভীর শোনালো সেই কণ্ঠটা।

এটুকুই যথেষ্ট ছিল ছোঁয়ার অনুভূতি জাগ্রত করতে। বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। একটা নামই সমস্ত অনুভূতির শহরটা মুহূর্তেই পরিবর্তন করে দিল। এরই নাম কি ভালোবাসা? ছোঁয়ার মন প্রশ্ন করল তার অজান্তেই, অগোচরে।

‘হ্যালো! আর ইউ দেয়ার?’ শিহরণ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

‘ইয়েস। শুনছি বলুন।’ ছোঁয়া বলল, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে।

এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব। কেউ কিছু বলছে না। যেন শব্দেরা চুক্তি করে পালিয়েছে দুজনের মনের অভিধান থেকেই। নীরবতা থেকেই যেন দুজন দুজনের
মনের ভাবটা বুঝে নিচ্ছে!

‘কোনো প্রয়োজন ছিল স্যার?’ ছোঁয়াই প্রশ্নটা করল প্রথমে।

‘ইয়েস। আপনাকে আজ যে প্রেজেন্টেশনের কাজ দিয়েছি তাতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’ কোনো কথা ভেবে না পেয়ে বলল, শিহরণ।

‘আসলে স্যার আমি তো কাজটা শুরুই করিনি এখনও।’ ছোঁয়া আক্ষেপের সুরে বলল।

‘প্রেজেন্টেশন স্লাইডগুলো কালকের মধ্যেই দরকার।’ কি বলতে ফোন করেছে সে আর কী বলছে! শিহরণ নিজের মাথায় নিজেই চাটা মারল।

‘জি, স্যার। আপনি কালকের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।’ ছোঁয়া আশ্বস্ত করল।

‘ওকে, তাহলে রাখছি।’ আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না শিহরণ।

‘জি।’ ছোট্ট করে বলল ছোঁয়া।

শিহরণ তারপরেও কলটা কাটছে না। কিছু বলতে চায়। কিন্তু পারছে না। কেন এই দ্বিধা, কেন এই দ্বিচারিতা শিহরণ বুঝতে পারছে না। শিহরণ এইসব প্রফেশনাল আলোচনা করার জন্য কল করেনি। অথচ, সে বলছে কী! নিজের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে সে। এই রকম ভ্যাবলাকান্ত কবে থেকে হলো সে ভেবে পেল না। হঠাৎ করেই ছোঁয়ার কণ্ঠটা শুনতে মন চাইল তাই শেষমেশ কল করে বসেছে সে। অথচ, কল করে কী সব আবোলতাবোল কথা বলছে সে!

‘স্যার, আর কিছু বলবেন?’ ভীষণ প্রফেশনাল শোনাল ছোঁয়ার কণ্ঠটা।

‘না। রাখছি।’ বিরক্তির ছোঁয়া বোঝা গেল, শিহরণের কণ্ঠে।

_______________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৫

অতল লাইব্রেরিতে বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল। আয়মান কেবল বইয়ের পৃষ্টা গুনছে। এটা তার পুরনো অভ্যাস। একটা বই; তা যেই আকারেরই হোক না কেন আয়মান প্রথমেই চলে যাবে শেষ পৃষ্ঠায়; পৃষ্ঠার সংখ্যা দেখার জন্য। পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখার পরেও তার পৃষ্ঠা গোনার অভ্যাসের কোনো হেরফের হয় না। এক পেইজের পড়া পড়তে পড়তেই পৃষ্ঠা গোনার কাজ চালু থাকে।

অতল আড়চোখে দেখছিল আয়মানের কাণ্ড। ঝাড়ি দিয়ে বলল, ‘তোর এই অভ্যাস আর গেলো না।’

আয়মান বইয়ের পাতার ভাজ থেকে চোখ তুলে তাকাল অতলের দিকে। দাঁত বের করা হাসি দিয়ে অতলের কথায় সম্মতি জানাল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘বইয়ের পাতা না গুনলে আমার শান্তি লাগে না। তুই তো জানিস, পড়তে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। এর থেকে কষ্টকর কাজ বোধহয় এই পৃথিবীতে আর নেই।’

‘পৃষ্ঠা গুনে কি সেই কষ্ট কম হয়?’ স্থির চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অতল।

‘কষ্ট কম হয় না তবে পড়ার সময় কষ্টের অনুভূতি কম হয়।’ আয়মান বলল, বিজ্ঞের মতো করে।

‘বাহ্! দারুণ তো।’ অতল অবাক হবার ভান করল। পরক্ষণেই বলল, ‘যত্তসব ফালতু নিয়ম তোর।’

‘তোর কাছে ফালতু মনে হলো?’ আয়মান ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘নয়তো কী?’ ভ্রু কুঁচকে বলল, অতল।

‘এটা সত্যিই কাজে দেয়।’ আয়মান জোর গলায় বলল, ‘তোর তো আর এই পদ্ধতির প্রয়োজন নেই। তুই তো রোবট মানব। পড়তে কোনো ক্লান্তি নেই তোর।’ গলার স্বর খাদে নামিয়ে প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে আয়মান বলল,’আহা! আমারও যদি পড়তে কষ্ট না হতো তোর মতো!’

অতল নির্বিকার। এবার সে মানসিক দক্ষতার প্রবলেম সলভ করতে মনোযোগী । আয়মান চুপ হয়ে গেল। ভাবল, আর কথা চালিয়ে কোনো লাভ হবে না। রোবট মানব আর কোনোভাবেই উত্তর দেবেন না। তা সে শতভাগ নিশ্চিত। তাই সেও এক পলক এদিক সেদিক তাকিয়ে পৃষ্ঠা গুনতে গুনতে পড়ার কার্যক্রম চালু রাখল।

___________________

ফাইজা বেগমের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। নীলা সেবাযত্ন করতে কোনো কার্পণ্য করছে না। কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে বললেই তিনি বেঁকে বসেন। ব্যাকপেইন, হাঁটু ব্যথাসহ নানান ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তার। তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘার মতো জ্বর উঠেছে গতকাল রাত থেকে। সারারাত কেবল কেঁপেছেন প্রচণ্ড ঠান্ডায়। তারপরেও বড়ো খোকাকে কল করেননি একটিবারের জন্য। তিনি জানেন, তার ছেলেটা মায়ের কষ্টের কথা শুনতে পেলেই সবকিছু ছেড়ে উনার কাছে চলে আসবে। নীলা বারকয়েক চেয়েছিল রাদিদকে জানাতে । কিন্তু ফাইজা বেগমের কঠোর নির্দেশ অমান্য করার সাহস তার আর হয়ে উঠেনি। যতটুকু সম্ভব হয়েছে নিজে, একা হাতে মায়ের সেবা করেছে।

রাদিদ বাসায় পৌঁছেই মায়ের রুমে গেল। মায়ের গায়ে হাত দিতেই আঁতকে উঠল সে। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তার মনটা সাথে সাথেই খুবই খারাপ হয়ে গেল। খুব আক্ষেপ হচ্ছে তার। মাকে একলা রেখে এভাবে ফুফুর বাসায় থাকাটা একদম উচিত হয়নি তার। মায়ের কথা মাথায় রাখা উচিত ছিল তার। এখন অন্তর্দহনে পুড়ছে সে। কী নিদারুণ কষ্ট এই অন্তর্দাহ! রাদিদ জানে খুব ভালো করে।

মায়ের শিয়রের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল, ‘মা! তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?’

প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা নিয়ে স্থানীয় এক ডাক্তারকে কল করল। ডাক্তারের সাথে পরিচয় থাকার সুবাদে তিনি না করলেন না। ডাক্তার আসার পরেই চেকআপ করে বললেন, ‘কোনোভাবেই যাতে রোগীকে মানসিক প্রেশার দেয়া না হয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিলে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’ একটু বিরতি নিয়ে ডাক্তার আবার বললেন, ‘প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দিয়েছি। ওগুলো খাইয়ে দেবেন। আর সবগুলো ওষুধ ভরা পেটে খাওয়াবেন।’

রাদিদ আবিরকে ডেকে বলল ডাক্তার সাহেবকে এগিয়ে দিতে। আবির অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডাক্তার সাহেবকে এগিয়ে দিতে গেল। রাদিদ মায়ের পাশ থেকে নড়ল না পর্যন্ত। ফাইজা বেগম বললেন, ‘বড়ো খোকা! তুই কতটা পথ জার্নি করে এসেছিস। নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে । যা তো গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নে।’

‘না মা আমার একদম কষ্ট হচ্ছে না। তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমার কোনো বিশ্রাম নিতে হবে না।’ রাদিদ মায়ের কপালে জলপট্টি দিতে দিতে বলল।

‘আহা! আমি এখন ভালো আছি তো। তুই এসেছিস এখন সমস্ত অসুখকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করব।’ ফাইজা বেগম হাসার চেষ্টা করলেন।

‘মা! তুমি এই জ্বরের মধ্যেও এসব বলছ?’

‘তুই তো আমার আসল ওষুধ রে খোকা।’ একুট থেমে নীলাকে ডেকে বললেন, ‘যা তো তোর ভাইয়ের জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আয়।’

নীলা তৎক্ষনাৎ রান্নাঘরে চলে গেল। পিউ হুট করে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রাদিদের কোলে। ঠোঁট উল্টে বলল, ‘বড়ো মামা! তুমি এসে আমার সাথে দেখা করোনি কেন?’

‘মাই লিটল চ্যাম্প। তাই আমি জানতাম আমার চ্যাম্প ঠিকই আমাকে খুঁজে নিবে।’

‘বড়ো মামা! আমার জন্য কী এনেছ?’

‘তোমার জন্য যা এনেছি তা সিক্রেট। এখন বলা যাবে না।’

‘সিক্রেট?’ টেনে টেনে বলল পিউ।

‘হুম, সিক্রেট। আমি সময়মতো তোমাকে দেব। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে, বড়ো মামা।’

‘তাহলে এখন খেলতে যাও। বিকেলে আমরা একসাথে খেলব। ওকে চ্যাম্প?’

‘ওকে।’ উৎফুল্ল গলায় বলল, পিউ।

নীলা চা এনে রাদিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাই, চা-টা গরম গরম খেয়ে নে। ভালো লাগবে।’

রাদিদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল সে। মাকে অসুস্থ দেখে তার নিজের অতিরিক্ত খারাপ লাগছে। নিজের উপর রাগও লাগছে। একদিন আগে আসলে তার মা এমন কষ্ট পেত না। আফসোস হচ্ছে তার। ভীষণ আফসোস!

_____________________

‘আচ্ছা, বহ্নি মেয়েটা কে রে? তুই সেদিনও তার সম্পর্কে তেমন কিছুই বললি না।’ আয়মানের কণ্ঠের কৌতুহল ছাপিয়ে দেখা দিল গভীর আক্ষেপ।

‘কেউ না।’ অতলের একগুঁয়ে উত্তর ।

‘কে হয় বল না দোস্ত?’ আয়মানের কণ্ঠে আবারও আক্ষেপ দেখা দিল, ‘আশ্চর্য তো ও সায়মার বান্ধবী কিন্তু সায়মা তার বান্ধবীর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমাকে একটা শব্দ পর্যন্ত বলেনি। সেও মাঝেমধ্যে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেয়। বিশেষ করে বন্ধুত্বে প্রাইভেসির ক্ষেত্রে।’

‘বললাম তো কেউ হয় না আমার।’ জোর দিয়ে বলল, অতল।

‘তাহলে সে তোর সাথে ওভাবে কথা বলছিল কেন?’ আয়মান যেন প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ক্ষান্ত হবে না।

‘ইচ্ছে হয়েছে বলেছে। আমি অতীত নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না আয়মান। তোকে এই শেষবার ওয়ার্ন করলাম।’

‘আমার মনে হয় মেয়েটা তোকে পছন্দ করে।’

‘করতেই পারে।’

‘তেমন পছন্দ নয় যেমনটা তুই ভাবছিস। আই থিঙ্ক সি ইজ সো মাচ ইনটু ইউ।’

অতল তখন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আয়মানের কলার ধরে ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ওর মুখে একটা ঘুষি মারল। আয়মান ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। বলল, ‘আর ইউ ম্যাড, অতল? আমি কি এমন বলেছি যে তুই আমার গায়ে হাত তুললি?’

অতল তৎক্ষনাৎ চোখ দুটো বুজে ফেলল। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভুলতে চাওয়া অতীতটা আবারও তার বিদখুটে পাতা তার চোখের সামনে তুলে ধরেছে। নাহ্! অতল দেখবে না এটা। কোনোভাবেই না। কোনোভাবেই না।

অতল দু’হাত দিয়ে তার মাথাটা চেপে ধরেছে। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতরে। আয়মানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। অতলের মারটা লেগেছে খুব। কিন্তু অতলকে এভাবে ছটফট করতে দেখে সে নিজের ব্যথা ভুলে গেল। অতলের কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করল,’কী হয়েছে তোর? খারাপ লাগছে?’

আয়মান দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কী করবে বুঝতে পারছে না! অতল হুট করে মেঝেতে বসে পড়ল। নিজেকে শান্ত করছে সে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের কষ্টকর অনুভূতি থেকে রেহাই পেতে। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ দুটো মেলল সে। আয়মানকে বিচলিত হতে দেখে বলল, ‘আমি ঠিক আছি। আমার কিছু হয়নি।’

আয়মানের গালের একপাশে ফুলে গেছে। অতলের এবার খুব খারাপ লাগছে। সমব্যথী গলায় বলল, ‘খুব ব্যথা পেয়েছিস তাই না? অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে নিস। ব্যথা কমে যাবে।’

‘আরেহ্ ! ও কিছু না। সেরে যাবে।’ নিজের গালে হাত রাখল আয়মান। ব্যথায় ছোট্ট একটা শব্দ ‘আহ্’ তার নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসল।

‘চল তোকে ডিসপেন্সারিতে নিয়ে যাই।’

‘লাগবে না দোস্ত। আমি বাসায় গিয়ে লাগাব। এরকম মার তো তুই আমাকে প্রথম মারিসনি।’ হাসতে হাসতে বলল সে, ‘তবে এবারেরটা জব্বর মেরেছিস। আল্লাহ জানে রাতের খাবার খেতে পারব কি না! চোয়াল তো দারুণ ব্যথা হয়ে গেছে।’

‘আর কখনও ওই কথাটা মুখ দিয়ে বের করবি না।’

আয়মান প্রথমে বুঝতে না পেরে সবিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল অতলের দিকে। পরক্ষণেই মাথায় আসলো ব্যাপারটা। জবাবে কিছুই বলল না সে। মনে মনে বলল, ‘কী এমন ভুল বলেছি আমি! সত্য কথা বললেই মার খেতে হয়। ভালোমানুষির দাম নাই।’

‘স্যরি দোস্ত। রাগের মাথায় তোকে আঘাত করে ফেললাম। খুব স্যরি।’

‘আরেহ্ সমস্যা নাই। মাফ করে দিলাম এবারের মতো।’

অতল আয়মানের কাঁধে হাতটা রেখে বলল, ‘থ্যাঙ্কস দোস্ত। ইউ আর রিয়েলি গ্রেট।’

‘সম্বোধনটা তোর মুখ থেকে ঠিক মানাল না।’ মুখ বেঁকিয়ে বলল আয়মান।

‘মার খাওয়ার পরেও তোর অভ্যাস গেল না।’ অতল মৃদু হাসতে হাসতে বলল।

‘বদলাবেও না। অন্তত তোর ক্ষেত্রে না।’ অতলের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, আয়মান ।

‘হয়তো।’ অতল বলল অন্যমনস্কভাবে ।

___________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৬

এ যেন কোনো এক শুভ্রতার রাজ্য! পেজা তুলো শুভ্র নীরদ আকাশের বুকে ভেলার ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে ।ছোঁয়া নিজেকে সেই শুভ্রতার রাজ্যে আবিষ্কার করল। চারিদিকে শুভ্র কাশফুল ছেয়ে রয়েছে। শীতলতা প্রদানকারী হাওয়ায় দোল খাচ্ছে কাশফুলগুলো। একটু আলতো পরশ বুলিয়ে দিলো আদুরে ভঙ্গিতে দুলতে থাকা শুভ্র ফুলগুলোকে। বিকেলের মিষ্টি রোদ মরে শেষ বিকেলের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। ছোঁয়া এমন এক অপার্থিব সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে মোহাবিষ্ট হয়ে গেছে। পিটপিট করে চোখ মেলে দূর থেকেই দেখতে পেলো সাদা শার্ট পরিহিত একটা ছেলেকে। আনমনে চেয়ে আছে সে স্রোতস্বিনীর নীল রঙা জলের পানে। গোধূলি লগ্নের লালিমা আবির্ভূত হতে হতে এক রহস্যাবৃত সৌন্দর্যের চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে।

ছেলেটা কে তা জানার জন্য মনের মধ্যে এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করল ছোঁয়া। মনটা ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছে তার। হাঁটতে লাগল ছেলেটার উদ্দেশে, তাকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিবারণের নিমিত্তে। যতই কাছে যাচ্ছে মনে হচ্ছে দূরত্ব ততই বাড়ছে। অথচ স্থির, মোহগ্রস্তের মতোই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। তার অন্য কোনো দিকে মনোযোগ নেই। রংহীন জলের উপর আকাশের নীল রাজত্ব করছে। আর সেই নীলেই যেন হারিয়ে গেছে শুভ্রতার আবেশে মোড়ানো ছেলেটা। ছোঁয়াও নিজেকে এক মোহাবিষ্ট মানবীরূপেই আবিষ্কার করল।

হঠাৎ ছেলেটার পাশে পৌঁছাতেই ছোঁয়া নিজের মধ্যে এক অন্য রকম অনুভূতি খুঁজে পেল। পেছন থেকে সে দারুণভাবে উপলব্ধি করতে পারছে, এই ছেলেটা তার ভীষণ আপন, ভীষণ চেনা, যেন জন্ম-জন্মান্তরের পরিচয় তার সাথে। আচমকা ছেলেটা তার দিকে ফিরে তাকাল, স্মিত হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে, চোখে মুখে মুগ্ধতার রেশ নিয়ে। হাওয়া যেন থমকে দাঁড়াল ঠিক তখনই । বাতাসের গুনগুন শব্দটা প্রকট আকার ধারণ করল আচমকা। যেন কোনো এক বাদ্যমানব ভীষণ ভালোবেসে বাদ্য বাজাচ্ছে আপনমনে। এক অবর্ণনীয় স্নিগ্ধ অনুভূতি ছড়িয়ে দিলো দুটো হৃদয়ে, একই সাথে, একই সময়ে। দু’জন হারিয়ে গেল দু’জনার চোখের তারায়। দু’জোড়া চোখ এক হলো মুহূর্তেই। ধূসর চোখ জোড়া ডুবে গেল হালকা সবুজাভ চোখের মধ্যে নিমিষেই। আচমকা সেই সবুজাভ চোখের অধিকারী ছেলেটি একটা হাত বাড়িয়ে দিল ছোঁয়ার দিকে। আলতো স্পর্শে তার একটা হাত নিলো নিজের হাতের মুঠোয়। ছোঁয়া মোহাবিষ্টের মতো নিজের হাতটা তার সেই হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হতে দেখতে থাকল। তারপর কিছুক্ষণের নীরবতা। মনে হলো যেন নীরবতা কথা বলছে। সবুজাভ চোখের অধিকারী ছেলেটা মৃদু ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বলতে শুরু করেছে, ‘আর একটু অপেক্ষা করতে পারবে না?’ ভ্রু জোড়া কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল তার দিকে, উত্তরের অপেক্ষায়

ছোঁয়া ছলছল চোখে মাথা দুলাল উপর নিচে। চোখের কোণে মুক্তোর কণা সগর্বে স্থান করে নিয়েছে। কেবল গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। সহসা ছেলেটি নিজ হাতে মুছে নিলো সেই মুক্তো কণা। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ওই চোখের তারায় কেবল আমারই বসবাস।’ একটা মুক্তো কণা হাতের তর্জনীর মাথায় নিয়ে বলল,’ওতে এদের আনাগোনা নিষিদ্ধ। ফের যেন না দেখি এদের এই দৃষ্টিতে!’

চকিতে অভিযোগ দেখা দিলো ছোঁয়ার কণ্ঠে, ‘আর কত অপেক্ষা করতে হবে আমায়?’

সবুজাভ চোখ জোড়ায় দেখা দিলো স্মিত হাসি। আশ্বস্ত করার সুরে বলল, ‘অপেক্ষার ফল যে বড্ড মিষ্টি হয় ।’

এবার ছোঁয়া যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। কান্নার সুরে বলল ছোঁয়া, ‘আর অপেক্ষা করতে চাই না। এখনই চাই। একটু তেতো হলেও চলবে।’

জবাবে ছেলেটা মুষ্টিবদ্ধ হাতের বাঁধন আরও শক্ত করল। দিলো ভরসা, বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। ছোঁয়া আবারও অধর জোড়া ফাঁক করল কিছু একটা বলতে কিন্তু ততক্ষণে শুভ্র ছেলেটা ক্রমেই অস্পষ্ট হচ্ছে চোখের দৃশ্যপট থেকে। ছোঁয়ার ভীষণ খারাপ লাগছে। এবারও কি ছেড়ে চলে যাবে? এমন কেন করে বারবার! কেন বুঝে না এই ছেলেটা তার মনের আকুতি, আক্ষেপ আর অপেক্ষায় অন্তর্দহনের ব্যথা। ব্যথাতুর কণ্ঠে আর্তনাদ করে চিৎকার করে বলল ছোঁয়া, ‘যেও না। এবার অন্তত যেও না আমাকে ছেড়ে। প্লিজ, যেও না।’

শুভ্র ধোঁয়ার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। তার অবয়ব ক্রমশ অস্পষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। ছোঁয়া সবুজ ঘাসের উপর ধপাস করে শব্দ করে বসে পড়ল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘শিহরণ! যেও না। প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যেও না।’

‘ছোঁয়া! এই ছোঁয়া! আজকে কি সকাল হবে না তোর? কাকে যেতে নিষেধ করছিস?’

ছোঁয়া লাফ দিয়ে উঠে বসল বিছানায়। ভূতগ্রস্তের মতো দেখাচ্ছে তাকে। ঘেমেনেয়ে একাকার সে। চোখের পলক ফেলছে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে। ফাহমিদা বেগম তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে মামণি? স্বপ্ন দেখেছিস না-কি?’

ছোঁয়া জবাবে কিছুই বলছে না। যেন সে নিজেকে এখনও ধাতস্থ করতে পারেনি। আবার স্বপ্ন দেখাটা শুরু হয়ে গেল। একটু ভাবনা, একটু দর্শন দীর্ঘ সময়ের স্বপ্নরূপে ধরা দেয় স্বপ্নরাজ্যে। কেন এমন হয় তার ব্যাখ্যা আছে। এই ব্যাখ্যাটা পৃথিবীর সহজ বিষয়গুলোর মধ্যে সহজতর। এই বিষয়টা বুঝার জন্য সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।

ফাহমিদা বেগম সাইড টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলেন ছোঁয়ার দিকে। বললেন, ‘পানিটা খেয়ে নে। ভাল লাগবে।’

ছোঁয়া পানির গ্লাসটা কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে সবটা পানি খেয়ে ফেলল একসাথে। ফাহমিদা বেগম চিন্তিত সুরে বললেন, ‘ভয়ংকর কিছু দেখেছিস? এত ভয় পেয়েছিস কেন? কাকে দেখেছিস স্বপ্নে?’

ছোঁয়া একটু ধাতস্থ হয়ে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে একপলক তাকিয়ে দেখতেই তার টনক নড়ল। আটটা বেজে গেছে। তার অফিসে যেতে হবে। শপে যাওয়ার দরকার। অথচ সে আজ ঘুম থেকে উঠতেই খুব দেরি করে ফেলেছে। সব শিহরণের দোষ। ঘুমের মধ্যে এসেও তাকে কষ্ট দেয় । একটা স্টুপিড সে। তাকে সবসময় অপেক্ষা করায়। অপেক্ষা করাতেই যেন তার ভীষণ আনন্দ। ব্যস্ত গলায় বলল, ‘মা! তেমন কিছু না। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। তুমি নাস্তা দাও। আজ ঘুম থেকে উঠতে খুব দেরি হয়ে গেল।’

ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে অভিযোগের সুরে বলল, ‘এত বেলা হয়ে গেছে তুমি আমাকে ডাকোনি কেন মা?’

‘কী বলছিস এসব?’ ভীষণ আবাক হয়ে বললেন, ফাহমিদা বেগম, ‘হিয়া ডেকে গেল। তারপর আমি ডাকলাম। অথচ আজ তোর কোনো খবরই হলো না।’

মায়ের কথা শুনে ছোঁয়ার পিলে চমকানোর মতো অবস্থা। সে বুঝতে পারছে রাইয়ান আহমেদ শিহরণের জন্য তার আজকের এই অবস্থা। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে মনে মনে ভাবল সে, ‘জনাব শিহরণ, কাজটা আপনি ভালো করেননি। তমসাময় যামিনীতেও আপনি আমাকে একা ছাড়েন না। অথচ দিবসের রঙিন আলোয় বড্ড অপরিচিত। হুহ্! এটা তো অন্যায় জনাব।’

নিজের ভাবনাতে নিজেই চমকাল। ভাবল, ‘তুমি আমার কে বলতো? কেউ না, কিচ্ছু না।’ আনমনেই ভেতর থেকে একটা বলিষ্ঠ ও দৃঢ় আওয়াজ বেরিয়ে এলো, ‘অথচ সবকিছু । কেন এমন বল তো?’

হিয়া এসে ধুপধাপ করে ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে আর বলছে, ‘ছোঁয়াপু! তাড়াতাড়ি বের হও। সাইফ ভাইয়া এসেছে।’

ছোঁয়া তার ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।’

আজ আবহাওয়া দারুণ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণ। বাইকের পেছনে বসে সেই মিষ্টি ঘ্রাণে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল সে। বাতাসে কীসের যেন একটা সুর ভেসে বেড়াচ্ছিল। ছোঁয়ার মনে হলো সেই সুর ওকে কিছু একটা বলছে কানে কানে, চুপিসারে, খুব গোপনে। ছোঁয়ার অফিসের সামনে যেতেই সাইফ বাইক থামাল। ছোঁয়া নেমে গেল। সাইফ তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আজ কিন্তু তোকে শপে আসতেই হবে। মাস শেষ হতে চলেছে। কিছু হিসাব নিকাশ না দেখালেই নয়। কর্মচারীদের পেমেন্ট আর আগামী মাসের ইনগ্রেডিয়েন্টস কেনার ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে। তাই না?’

‘ওকে সাইফু! তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না একদম। আমি ঠিক সময়েই হাজির হয়ে যাব।’ ছোঁয়া আশ্বস্ত করল।

‘তাহলে কি আমি এখন যেতে পারি রাজকন্যা?’ সাইফ বিশেষ কায়দায় বলল।

ছোঁয়া প্রত্যুত্তরে হাসল। কোনো জবাব দিল না। সাইফ বাইকে স্টার্ট দিয়ে সহাস্যে পুনরায় বলল, ‘তো বিকেলে দেখা হচ্ছে। এখন গেলাম।’

কাচের জানালা ভেদ করে এক জোড়া চোখ ওদের দেখছিল। ভীষণ রেগে যাচ্ছিল সে। হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। রাগ উঠছে তার। ছোঁয়ার ব্যাপারে এতটা পজেজিভ কেন সে নিজেই বলতে পারে না। একটা মাত্র মেয়ের জন্য সে তার নিজের মধ্যের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে মুহূর্তেই। অন্য কারো সাথে এই মেয়েটাকে সে সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে সেই মানুষটা যদি এই বিশেষ মেয়েটার প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকে তো আর কোনো কথাই নেই। তার রাগের মাত্রা আগ্রহের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায়। নিজেকে শান্ত করল এই বলে যে, ‘আর মাত্র কিছুদিন! তার পরেই ছোঁয়া তোর, সারাজীবনের জন্য। তখন তার উপর সমস্ত অধিকার কেবল এবং কেবলই তোর, শিহরণ।’

এই কথাগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করল। তার রাগ উবে গেল। পেশীগুলো রিল্যাক্সড হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। মেজাজের সাথে পাল্লা দিয়ে মনটাও ফুরফুরে হয়ে গেল মুহূর্তেই। দারুণ একটা ট্রিক পেয়ে নিজেকে নিজেই বাহবা দিলো সে।
_______________________

অফিসে ঢুকতেই সোজা নিজের ডেস্কে চলে গেল ছোঁয়া। প্রয়োজনীয় ফাইল হাতে নিয়ে শিহরণের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ সে উপলব্ধি করল, তার বুকটা ধুকুপুক করছে, দ্রিম দ্রিম আওয়াজ বেরিয়ে আসছে নির্নিমেষ। এটা কি তবে স্বপ্নের ফল। এতটা নার্ভাস তো সে এত বছর পরে শিহরণের সাথে দেখা হওয়ার সময়েও ছিল না। তবে আজ এতটা নার্ভাস কেন? দরজার নবে হাত রাখতেই হঠাৎ তার মনে হলো সে কাঁপছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো সে। তারপর দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে গম্ভীর অথচ বলিষ্ঠ ঝংকারের ন্যায় একটা শব্দ ভেসে এলো, ‘কাম ইন।’

ছোঁয়া ভেতরে ঢুকেই শিহরণের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাতের ফাইলগুলো তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এতে আপনার প্রয়োজনীয় সব তথ্য আছে।’

শিহরণ ল্যাপটপে কাজ করছিল তখন। ছোঁয়ার দিকে না তাকিয়েই ফাইলগুলো হাতে নিল। তারপর কয়েক মুহূর্ত অতিক্রম হয়ে গেল। ছোঁয়ার রীতিমতো আপমানজনক মনে হচ্ছে। তাকে বসতেও বলছে না আবার যেতেও বলছে না। তাই সে একটু কঠিন গলায় বলল, ‘স্যার আমি কি চলে যাব?’

শিহরণ এবার চোখ তুলে তাকাল। গলায় কাঠিন্য এনে বলল, ‘না!’ পরক্ষণেই কিছুটা কৌতুক মেশানো কণ্ঠে বলল, ‘আরে আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।’

ছোঁয়া গভীর আক্ষেপ নিয়ে মনে মনে বলল, ‘আহা! কী পরিমাণ ফরমাল! আমরা তো পরিচিত না-কি এত ফরমালিটির কী আছে বুঝতে পারছি না।’

ভেতরের আক্ষেপ লুকিয়ে মুখে বলল, ‘আপনিই তো বসতে বলেনি।’ কণ্ঠে নিজের ভেতরের সমস্ত বিরক্তি ঢেলে দিয়ে বলল, ‘বসতেও বলছেন না আবার যেতেও বলছেন না। অফিসের বস হওয়ার এই এক সুবিধা। আর এমপ্লয়ি হওয়ার এটা একটা অসুবিধা।’

‘আপনি রেগে যাচ্ছেন! রাগতেও পারেন? জানা ছিল না।’ শিহরণ ঠোঁট টিপে হেসে বলল। এটা ছোঁয়ার চোখ এড়াল না। সে দ্বিগুণ রেগে গেল। বলল, ‘আমার মনে হয় ফাইলগুলোই আপনার কাজের জন্য যথেষ্ট। আমার কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলে আমি আজ উঠছি।’

‘আপনাকেই তো সবথেকে বেশি প্রয়োজন আমার।’ শিহরণ নিজেকে সংশোধন করে আবার বলল, ‘ফাইলের তথ্যের ক্লারিফিকেশনের জন্য।’

ছোঁয়া একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল কেন সে আগে আগে সব ভেবে নেয়। কেন সে এমন একজন মানুষকে পছন্দ করে যে তার একদম পরোয়া করে না। কেন নির্বিকার, এই ছেলেটা। আর সমস্ত নির্বিকারহীনতা পুরস্কার স্বরূপ সেই যেন বিধাতার নিকট থেকে পেলো!

শিহরণ বুঝতে পারছে ছোঁয়ার মানসিক দ্বন্দ্ব। ছোঁয়াকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, ‘কাউকে বকছেন?’

ছোঁয়া থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘না! কী যে বলেন? কাকে বকতে যাব আমি?’

‘এই ধরুন আমাকে।’ শিহরণ হাসল, সাথে তার চোখ দুটোও হেসে উঠল।

এই দৃশ্যটা ছোঁয়াকে প্রশান্তি দিলো। ভীষণ ভালো লাগল তার। কতদিন পর! ধুর! কত বছর পর হাসতে দেখল তার প্রিয় মানুষটিকে। হাসলে কত সুন্দর দেখায় তাকে অথচ সবসময় রোবটের মতো ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন করে রাখে। যেন হাসলে ট্যাক্স গুণতে হব!

ছোঁয়া বলেই ফেলল, ‘হাসবেন সবসময়। হাসলে আপনাকে ভাল লাগে। তাছাড়া হাসতে কোনো প্রকার ট্যাক্স গুনতে হয় না কিন্তু!’

শিহরণ চমকাল খানিক। কেশে উঠল সে। ছোঁয়া হন্তদন্ত হয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। শিহরণ এক চুমুক পানি খেল। ছোঁয়া খানিক ব্যঙ্গ করে বলল, ‘সত্য কথা শুনলেই আপনি এত চমকে যান কেন সবসময় ? সত্যকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে শিখুন।’
___________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-১২+১৩

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১২

রাদিদ, নীরা আর আফরিন ভার্সিটিতে যখন পৌঁছাল তখন প্রায় দশটা বেজে গেছে। আফরিন বিরক্তিসূচক শব্দ উচ্চারণ করছে বারংবার। ভার্সিটির গেইটের সামনে আসতেই তার মোবাইলে কল এলো। রিসিভ করেই সে বলল, ‘আমি এখনই আসছি।’

কলটা কেটে রাদিদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘রাদিদ ভাইয়া! আমার এক বন্ধু আসছে। ওকে একটু রিসিভ করে নিই। বেচারী এখানের রাস্তাঘাট তেমন একটা চিনে না তাই।’

রাদিদ মাথা নেড়ে সায় দিল। নীরা বলল, ‘তোমার বন্ধু এতটুকু পথ আসতে পেরেছে আর এখন এইটুকু আসতে পারছে না! এটা কেমন কথা?’

‘তুই চুপ থাক। আমি কি তোর সাথে কথা বলছি?’ ধমকের সুরে বলল, আফরিন।

তারপর হনহন করে হেঁটে চলে গেল। সেই যে গেলো এখনো আসার নাম নেই। রাদিদ অনুষ্ঠানে কিছু সময়ের জন্য থাকলেও পরে বেরিয়ে এসেছে। তার ভালো লাগছিল না এসব। তাই বেরিয়ে ক্যাম্পাসে পায়চারি করছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চোখ দুটো আটকে গেল তার ঘুম কেড়ে নেওয়া রাজকন্যাকে দেখে। কেমন ধীর লয়ে হাঁটছে সে। যেন কোনো ছন্দের তালে হেঁটে যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত কোনো এক গন্তব্যে! রাদিদ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল কেবল। নাহ! শুধু মুগ্ধ নয়। এটা মুগ্ধতার এক চরম মাত্রা। রাদিদ তো সেই শেষ মাত্রাটাও কবে যেন অতিক্রম করে ফেলেছে সে নিজেই জানে না। ভালোবাসাটাও তার দারা সম্ভব হয়ে গেল শেষমেশ । সে ভীষণ অবাক হয়ে যায় নিজের এই আমূল পরিবর্তনে! সত্যিই জীবন মানুষকে অনেককিছু শিখিয়ে দিয়। আর সেই তার প্রকৃষ্ট উদারহণ। সে তো নিজের জীবন দিয়ে শিখেছে। তার মাথার উপর থেকে ‘বাবা’ নামক বটবৃক্ষের ছায়া সরে যেতেই সে ধীরে ধীরে জানতে শিখেছে, জীবনকে বুঝতে শিখেছে, হুট করেই সমস্ত খামখেয়ালিপনা ইস্তফা দিয়ে সেই যে চিরতরে বিদায় জানাল আর কখনোই তার পথ মাড়ায়নি। ফলশ্রুতিতে তার চরিত্র পরিবর্তন হতে হতেই আজকের এই রাদিদ। জীবন পরিবর্তনশীল, আর সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া হোক সূক্ষ্ম কি বৃহৎ মানুষের চরিত্রেও তার প্রভাব পড়ে।

রাদিদের দৃষ্টি সেই রাজকন্যার পদচারণ অনুসরণ করছে কেবল। জাফরানি রঙটাতে কেমন মোহনীয় দেখাচ্ছে তাকে। চুলের খোঁপায় লাগানো গাজরাটা তার শ্রী অনিকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। কী মিষ্টিই না দেখাচ্ছে তাকে! রাদিদের মনে হলো প্রথম ও শেষবারের মতো দুঃসাধ্য কিছু একটা করে ফেলতে! তার মনটা খুব করে চাইছে বহ্নির হাতটা একটিবারের জন্য ধরতে। ধরে কেবল বলতে, ‘তুমিই, কেবল তুমিই আমার মনের সিংহাসনে আসীন রাজকন্যা। যার কারণে হয়েছি আমি নিরুদ্দেশ। হারিয়ে গেছি শতবার তোমার শহরে, তোমাকে খুঁজতে গিয়ে তবুও মিলল না দেখা। আর হারানো বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে গেছে আমার মনের শহর। যেই শহরে কেবল তোমারই বসবাস। তবুও পাই না খুঁজে তোমার উদ্দেশ।’

মনে মনে এমন ভাবনা আসাতেই রাদিদ নিজেই অবাক হলো। একট গোপন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। তার দৃষ্টি এখনও তার মনের রাজকন্যার পদচারণ অনুসরণ করছে। কিন্তু রাজকন্যা তার মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল আবারও। ঘাসের উপর নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকা একটা ছেলের হাত ধরে। রাদিদের মনের শহরে আচমকাই এক তুফান শুরু হলো। নিমিষেই লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল সাজানো গোছানো সমস্ত কিছু। হারানো বিজ্ঞপ্তিগুলো মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মনের শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। রাদিদ কেবল তাকিয়ে আছে খুব দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরা হাতের দিকে।

নীরা পাশ থেকে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া! ছেলেটা কে চিনতে পেরেছ?’

নীরার আচমকা প্রশ্নে একটু কেঁপে উঠল রাদিদ। তার চোখের তারায় ফুটে ওঠা বিষাদের চিহ্নটুকু মুছে নিয়ে বলল, ‘তুই কবে এলি?’

‘তুমি যখন মনে মনে শত শত কবিতা লিখছিলে তখন।’ নীরা কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলল, ‘আচ্ছা বলো তো ছেলেটাকে চিনো না-কি?’

রাদিদ প্রথম দেখায় চিনতে না পারলেরও পরে একটু ভালোভাবে তাকাতেই চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এ যে আর কেউ নয় বরং বহ্নির হৃদয়ের মণিকোঠায় রাজত্ব করা অতল। সে ভাবলেশহীনভাবে বলল, ‘অতল, আমার বন্ধু।’

নীরার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল । সে মনে মনে কত শত পরিকল্পনা করেছিল তার রাদিদ ভাইয়ার জন্য। অথচ এই অতল সব ভেস্তে দিল। তার কী দরকার ছিল এই সময়ে উদয় হওয়ার ! নীরার মনে গভীর আক্ষেপ দেখা দিল।

‘রাদিদ ভাইয়া! তোমার কি মন খারাপ?’

‘নাহ্! মন খারাপ হবে কেন?’

‘এই যে তোমার বন্ধু অতলকে দেখে?’

‘না! বরং ভালো লাগছে।’

‘তাহলে কথা বলবে?’

‘নাহ্!’ রাদিদ দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আমার এখন আর বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর মতো সময় নেই। তুই তো জানিস সব। তাই না ?’

‘হুম।’ ছোট্ট করে জবাব দিল নীরা।

‘চল। এবার বাসায় যাওয়া যাক।’ রাদিদ মনের শহর বিষাদগ্রস্ত। সেই বিষাদ ফুটে উঠল তার কণ্ঠে।

‘তাহলে অন্তত বহ্নি আপুর সাথে একবার দেখা করো। একটু কথা হলেও বলো।’ আকুল কণ্ঠে বলল, নীরা।

‘নাহ্! তার সাথে তো আমার আর কখনোই কথা হবে না।’ বিষণ্ন শোনাল রাদিদের কণ্ঠ।

‘কেন হবে না? হতেও তো পারে।’

‘হবে না। কথা হোক তা আমি চাই না।’

‘তুমি চাও না সেটা মিথ্যা।’ প্রগাঢ় কণ্ঠে নীরা বলল।

রাদিদ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। খানিক নীরব থেকে বলল, ‘আফরিনকে কল দে। ওকে তাড়াতাড়ি আসতে বল। বাসায় যাব।’

নীরা কথা না বাড়িয়ে আফরিনকে কল দিল। রিং পড়ছে কিন্তু কল রিসিভ করছে না সে। রাদিদকে বলতেই তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাল।

নীরা রাদিদকে আশ্বস্ত করতে বলল, ‘ভাইয়া! আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি।’

রাদিদ অতল আর বহ্নির উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ের স্বস্তি পাচ্ছে না। যেন তার ভিতরের একটা সত্তা অশান্ত হয়ে গেছে। আর তাই সেও অশান্ত হয়ে পড়ছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে ক্রমাগত। সে মনে মনে ঠিক করল সে এই শহর থেকে খুব দ্রুতই চলে যাবে। খুব দ্রুত।

______________________

অতল আর আয়মান গাড়িতে উঠল বাসায় যাবার জন্য। আয়মান বসল উইন্ডো সিটে আর অতল তার পাশে বসল। আয়মান বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ করে কিছু একটা দেখে সে অতলকে বলল, ‘দেখ তো ওই কমলা রঙের টপ পরা মেয়েটার সাথে ছেলেটা আতিক ভাইয়া না?’

অতল তৎক্ষনাৎ ফিরে তাকাল। কিন্তু ততক্ষণে কমলা রঙের টপ পড়া মেয়েটা আর তার সাথের ছেলেটা তাদের দৃশ্যপটের বাইরে চলে গেল।

অতল আয়মানকে বলল, ‘তুই চোখে বেশি দেখছিস ইদানিং।’

‘সত্যি বলছি। আমি পেছন থেকে যতটুকু দেখেছি তাতে আমি নিশ্চিত যে ছেলেটা তোর ভাই আতিক।’

‘তুই চুপ করবি? আতিক ভাই এখানে কী করে আসবে বল তো। তার তো এখন অফিসে থাকার কথা।’

‘দেখ, আতিক ভাই নীল রঙের শার্ট পরেছে। তুই একটু মনে করে দেখ তো আজ আতিক ভাই কি কালারের শার্ট পরেছিল।’ আয়মানের কণ্ঠে কৌতুহল ।

‘ধুর! এসব কি শুরু করেছিস? শার্টের কালার দিয়ে কী বুঝাতে চাইছিস? একই কালারের শার্ট কি দু তিনজন পরতে পারে না?’

‘তা পারে। তবে আমি নিশ্চিত ওটা আতিক ভাইয়া।’ আয়মান নিশ্চিত গলায় বলল।

‘আচ্ছা, দাঁড়া । ভাইয়াকে কল দিচ্ছি এখনি।’

অতল সাথে সাথে তার ভাইয়ের নাম্বারে কল করল। প্রথমবার কলটা কেটে গেল। অতল আবার ডায়াল করল। তৃতীয়বার রিং পড়তেই আতিক কল রিসিভ করল।

অতল ব্যস্ত গলায় বলল, ‘ভাইয়া! তুমি কোথায় এখন?’

‘কেন? এখন আমি কোথায় থাকব তুই জানিস না?’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া। আসলে তোমাকে…!’

‘এখন রাখছি। আমি অফিসে আছি।’

অতল কিছু বলার আগেই আতিক কলটা কেটে দিল। আয়মানকে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘দেখলি তো?’

আয়মান একগুঁয়ে স্বরে আবারও বলল, ‘ওটা আতিক ভাইয়া ছিল। আমি নিশ্চিত।’

‘আচ্ছা, হলে হবে। তাতে কী?’ অতল আয়মানের কথা পাত্তা দিল না।

‘আচ্ছা আতিক ভাইয়ার কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু আজকের ওই মেয়েটার কথা তো বলতেই পারি। তাই না?’ আয়মান বলল, উৎসাহী গলায়।

‘কোন মেয়ের কথা?’

‘আরে ব্যাটা! এখনই ভুলে গেলি?’

‘কোন মেয়ে বললে বল নয়তো বাদ দে। এখন একটু চুপচাপ বসে থাক।’

‘আমার মনে হচ্ছে বহ্নি তোকে পছন্দ করে।’ আমান দ্রুত গতিতে বলল।

‘হুম, পছন্দ করতেই পারে। তাতে কী?’ অতলের ভাবলেশহীন উত্তর।

‘আরেহ্! তেমন পছন্দ না যেমন তুই ভাবছিস। আই থিঙ্ক সি ইজ সো মাচ ইনটু ইউ।’

‘জাস্ট স্টপ রাইট দেয়ার। আর কখনও বলবি না এই কথা। গট ইট?’ গম্ভীর গলায় বলল, অতল।

আয়মান কথা বাড়াল না। দুজনেই চুপ থাকল পুরো জার্নিতে।
_________________________

শিহরণের নতুন অফিসে কাজের চাপ অত্যন্ত বেশি। তাদের কোম্পানির সাথে এই ছোট কোম্পানির মার্জ করার কারণে বেশ কিছু কাজ জমে গেছে। কোম্পানির লিগ্যাল ডকুমেন্ট ঠিক করাসহ বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে বন্টন করার মতো ঝামেলাপূর্ণ কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। তাই কাজের চাপ মারাত্মক রকমের বেশি বলা চলে। আর এই সব কাজ সাব্বির আহমেদ শিহরণকে দিয়েছেন। শিহরণ যদিও বেশ কয়েকবার না করেছে তবুও সাব্বির আহমেদ তার কথা গ্রাহ্য করেননি। তিনি তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন,’ আমি জানি আমার আব্বুটা দক্ষতার সাথে সব কাজ সামলে নিতে পারবে।’

শিহরণ বাবার কথায় ভরসা পেয়েছে। বাবার বলা প্রতিটি কথাতে সে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায় । কিন্তু এখন ঝামেলা বাঁধিয়েছে মান্নাত। বলেছে শিহরণের অফিস শেষে তার সাথে শপিং করতে যাবে। এখানে এসে সুপার গ্লু এর মতো আটকে আছে। শিহরণের রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছে। সে কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। এভাবে বেবি সিটার হয়ে বসে থাকার মধ্যে মানুষ কী এমন আনন্দ পায় শিহরণের তা জানা নেই!

কোনোরকমে একটা ম্যাগাজিন ধরিয়ে দিয়েছে তাকে। এতক্ষণ ধরে তার সামনের চেয়ারে বসে তার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল। এত কথা কেমনে বলতে পারে মেয়েটা! তবে অধিকাংশ কথাবার্তাই আজাইরা!

ছোঁয়া নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছে। তবে মন পড়ে আছে অন্য জায়গায়। খানিক পরে পরেই সে হাতের কলমটা মুখে দিয়ে কামড়াচ্ছে। অমনোযোগী হয়ে পড়লে সে এমনটাই করে । শিহরণের সাথে মান্নাতকে দেখে তার মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ্ম অথচ তীব্র খারাপ লাগা কাজ করছে। উপরন্তু মেয়েটাকে তার কাছ খুবই ক্লামজি মনে হলো। আর একটা ধূর্ত ভাবও আছে। যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ছোঁয়া তার ডেস্কের উপর রাখা ফাইলগুলো নিয়ে শিহরণের কেবিনের দিকে এগুলো। দরজায় নক করার সাথে সাথেই ভেতর থেকে গম্ভীর এক কণ্ঠ ভেসে এলো।

‘কাম ইন।’

ছোঁয়া ফাইল নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। শিহরণ ল্যাপটপে কাজ করছে খুবই মনোযোগ সহকারে। সে ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল, ‘ফাইলগুলো রেখে যান। আমি ফ্রি হয়ে সাইন করে দিব।’

ছোঁয়া বিষম খেলো । শিহরণ এক বারের জন্য ল্যাপটপ থেকে চোখ সরায়নি। তাহলে তাকে দেখল কী করে! প্রচণ্ড অবাক হলো সে। থতমত খেয়ে বলল, ‘স্যার, ইটস্ ভেরি আর্জেন্ট।’

মান্নাত ম্যাগাজিনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে ছোঁয়াকে আপাদমস্তক দেখছে। ভালোভাবে তাকাতেই সে ভারি অবাক হয়ে গেল। এখন তার কাছে কিছু বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শিহরণ সেদিন এই মেয়েটাকেই দেখছিল। এই বিষয়টা সে এখন শতভাগ নিশ্চিত। অফিসে ঢোকার সময়ও সে একটু ভালোভাবে তাকে দেখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সামনের চুলগুলোর জন্য মুখটা ভালো করে দেখতে পারেনি। তাই প্রথম দেখায় চিনতে পারেনি। চিনতে পারার পর সে এবার ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘তোমাকে ফাইল রেখে যেতে বলেছে রেখে চলে যাও না। কেমন এমপ্লয়ি তুমি…!’

শিহরণ তার ডান হাতটা উঁচু করে থামতে বলল মান্নাতকে। তারপর ছোঁয়ার হাত থেকে ফাইলগুলো নিয়ে বলল, ‘প্লিজ সিট ডাউন। আমি এখনই সাইন করে দিচ্ছি।’

এটুকু বলেই শিহরণ সাইন করতে শুরু করল। ছোঁয়া ছোট্ট করে বলল, ‘থ্যাঙ্কস স্যার।’

‘ইটস্ অ্যাবসোলিউটলি ফাইন। আজকে আর কোনো মিটিং আছে?’

‘নো, স্যার।’

মান্নাত বসে বসে বিরক্ত হচ্ছে। শিহরণ এই মেয়েটাকে কেন এতটা প্রায়োরিটি কেন দেয় সেটা ভাবতে ভাবতে তার প্রচণ্ড ক্রোধ উপচে পড়ছে। মনে মনে সে ছোঁয়ার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে। কিন্তু এখন সঠিক সময় নয় তার রিয়েকশন দেখানোর। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল।

শিহরণ তার হাতের সবগুলো ফাইলে সাইন করার পর ফাইলগুলো ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আমি আপনাকে একটা ছোট্ট কাজ দিয়েছিলাম। সেটা হয়েছে?’

‘কোন কাজের কথা বলছেন?’ ছোঁয়াকে বিভ্রান্ত দেখাল।

‘এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?’ ভারিক্কি গলায় বলল, শিহরণ।

ছোঁয়া ভাবল খানিক। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার মনে পড়ল। ঝটপট বলল, ‘না, স্যার। এখনও শেষ হয়নি। তবে শীঘ্রই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।’

‘ভেরি গুড। ইটস্ রিয়েলি ইম্প্রেসিভ ।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।’

সাইন শেষ হতেই শিহরণ ফাইলগুলো ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিল। ছোঁয়া ফাইলগুলো হাতে নিয়ে শিহরণের কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল। নিজের ডেস্কে বসেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।

_____________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১৩

পড়ন্ত বিকেল। পশ্চিমাকাশে সূর্য মামা হেলে পড়ছে। ছায়াঘেরা পরিবেশ মুখরিত করে রেখেছে চারদিকে। মৃদুমন্দ বাতাস শরীরে আঁচড় কাটছে, প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে মন ও শরীর জুড়ে। রাদিদের চেহারাতে সেই ভালোলাগার ছোঁয়া দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। চোখ দুটোতে ভীষণ রকমের বিষণ্নতার ছোঁয়া দৃশ্যমান। তবে নীরা বেশ উপভোগ করছে এই প্রশান্তি ছড়ানো বিকেলটা। চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় হেঁটে বেড়াচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। কেউবা একদল বন্ধু মিলিত হয়ে ফুচকা, চটপটি আর ঝালমুড়ি খেতে খেতে গল্পের আসর জমিয়েছে।

রাদিদ আর নীরা আফরিনের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু আফরিন এলো না। আফরিনকে না পেয়ে শেষমেশ ওরা বাসার উদ্দেশে রওনা দিল। তবে বাসায় পৌঁছানোর পর ওরা খুবই অবাক হলো। আফরিন বাসায় চলে এসেছে। নওশীন হক ওদের দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার! তোরা কোথায় ছিলি? আফরিন তোদের খুঁজে না পেয়ে বাসায় চলে এসেছে।’

রাদিদ আর নীরা প্রচণ্ড অবাক হলো। নীরা কিছু একটা বলতে মুখ খুলতেই আফরিন বলল, ‘তোদের আমি কোথায় না খুঁজেছি বল তো। ছিলি কোথায়? আমার কত কষ্ট করে বাসায় আসতে হলো। তোদের খুঁজে না পেয়েই তো একা চলে আসলাম বাসায়।’

‘আমরা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। প্রথমে কল রিসিভ করলে না পরে তো তোমার ফোনটাও অফ ছিল। আমরা কী করে তোমাকে খুঁজি বলো তো?’ নীরা বলল, অবাক হয়ে।

‘হুম। এখন সব দোষ আমার। মোবাইল অফ হয়ে গেছে সেটাও এখন আমার দোষ। তাই না?’ ঝগড়াটে গলায় বলল, আফরিন।

নীরা আর আফরিনের তর্ক-বিতর্কে বিরক্ত হয়ে নওশীন হক বললেন, থামো তোমরা! যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি নাস্তা দিচ্ছি টেবিলে।’

রাদিদ শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে। তার মনটা ভীষণ রকমের খারাপ। এই শহরে তার ভালো লাগছে না। এই শহরে ভালোবাসা নেই। তাই সে মনে মনে এই শহর ছেড়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নওশীন হক ভাইপোর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে বললেন, ‘কি রে! তোর কী হলো? মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?’

নীরা অভিযোগের সুরে বলল, ‘আম্মু! রাদিদ ভাইয়াকে কত করে বললাম ভাত না খাও অন্তত নাস্তা তো করো। কিন্তু করেনি। বলেছে বাসায় গিয়ে তারপর খাবে।’

ফুফুকে আশ্বস্ত করতে রাদিদ বলল,’ ফুফু! আমি একদম ঠিক আছি। তখন ক্ষিধে ছিল না তাই খাইনি।’

‘ভাবি তো বলবে তোকে আমি না খাইয়ে শুকনো বানিয়ে ফেলেছি। যা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আয়। ভাত খাবি এখন। একদম দেরি করবি না। এখনই আসবি।’ আদেশের সুরে বললেন, নওশীন হক।

রাদিদ মুখ লটকিয়ে অসহায়ের মতো বলল, ‘এখন ভাত খেতে হবে?’

‘আর একটা কথাও বলবি না। যা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আয়।’ চোখ বড়ো বড়ো করে ধমকের সুরে বললেন, নওশীন হক।

‘একদম ঠিক হয়েছে। আমার কথা তো না শুনে পেরেছ। এখন আম্মুর কথা তো শুনতেই হবে।’ নীরা ভেঙচি কাটল।

আফরিন থমথমে গলায় বলল, ‘আম্মু! তুমি খালি তোমার ভাইপোর কথা ভাবলেই হবে? আমাকে নাস্তা দাও তো আম্মু।’

‘আচ্ছা, দিচ্ছি। তোর আব্বুকে ডেকে নিয়ে আয়।’

রাদিদ নীরবে নিজ রুমে চলে গেল। এখন কোনো কথা বলেও লাভ হবে না। তাই চুপ থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করল সে।

নওশীন হক নীরার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নীরা মা জলদি ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে আয় তো আম্মুকে সাহায্য করতে।’

নীরা প্রশস্ত হেসে বলল, ‘আসছি, আম্মু।’

__________________________

শিহরণের মেজাজটা প্রচণ্ড রকমের বিগড়ে গেল। মান্নাত সারাদিন ওকে বিরক্ত করেছে। অফিস শেষে শপিং মলেও যেতে হলো। মেয়েটার শপিং শেষ হবারই নাম নিচ্ছিল না। মাসে যে কতোবার শপিং করা লাগে এই মেয়েটার শিহরণ তা ভেবে পায় না! শিহরণের ইচ্ছে হলো মান্নাতকে রেখেই চলে আসতে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার আম্মুর বকার কথা মনে করে মান্নাতের সাথে ছিল। বাসায় আসার পরেই প্রচণ্ড ক্লান্তি ওকে পেয়ে বসেছে। দ্রুত শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হলো সে। ফ্রেশ হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। কপালের উপর ডান হাতটা রেখে চোখ বুজে ছিল কিছুক্ষণ। চোখের দৃশ্যপটে ভিজ্যুয়ালি চলছে মনের মানুষটার আনাগোনা। কেমন করে অবলীলায় ভাসছে তার মুখাবয়ব। মায়াবী মুখখানা দেখে শিহরণ বারবার শিহরিত হয়। তার ইচ্ছে করে সমস্ত পরিকল্পনার কথা ভুলে নিজের মনের অদম্য ইচ্ছেটাতে সায় দিতে। একটিবার, কেবল একটিবার ওই মায়াবীর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিতে। প্রবল ইচ্ছেকে যে কীভাবে সে দমন করছে তাতে সে নিজেও বেশ অবাক হয়ে যায়! আরাম করে শুয়ে শুয়ে স্বপ্নরাজ্যে যেন হারিয়ে যাচ্ছে শিহরণ!
কিন্তু এই আরামটাও তার জুটল না। ক্ষুদে যন্ত্রটা বেজে উঠল তারস্বরে। শিহরণের বিরক্তির মাত্রা তখন চরমে। সে ভেবে পেল না এই সময়ে তাকে কে কল করছে আবার। মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই মায়ার নামটা দেখল। সাথে সাথেই সমস্ত বিরক্তি দূর হয়ে গেল। দেরি না করে ঝটপট কলটা রিসিভ করল সে।

‘তোমার সঠিক সময় কবে হবে বল তো, শিহরণ?’ মায়া বলল, ঝগড়াটে গলায়।

‘মায়া! তুমি কি ঝগড়া করার জন্য কল করেছ? আমি কেমন আছি একবার জানতেও চাইলে না!’ শিহরণ শোয়া থেকে উঠে বসে ভারি অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘হুম, তুমি যদি এটাকে ঝগড়া বলতে চাও তাহলে ঝগড়াই। কিন্তু আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই। আজকে উত্তর না পেলে আমি কোনোভাবেই কল কাটব না। আর তুমি যে ভালো আছ তা আমি জানি।’ তেজী গলায় বলল, মায়া।

শিহরণ কৌতুকের স্বরে বলল, ‘আজ এতটা রাগী গলায় প্রশ্ন করছে আমাদের মায়মাণি! ব্যাপার কী?’

‘আজ তুমি কোনোভাবেই প্রশ্ন এড়াতে পারবে না শিহরণ। তোমাকে বলতেই হবে কেন তুমি এখনও অবধি কনফেস করছ না।’ ঝাঁঝালো গলায় বলল, মায়া।

শিহরণ বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সূর্য মামা তখন পশ্চিম আকাশে তার লালিমা ছড়িয়ে দিয়েছে। রক্তিমাকাশের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শিহরণ বলল, ‘কারণ তো একটা আছেই । তবে সিরিয়াস কোনো কারণ না। আমি কনফেস কেন করিনি তার কিছুটা তো তুমি নিজেই জানো। আর একটা গৌণ কারণ আছে সেটা তোমার না জানলেও হবে।’

‘হুম, আমি জানি কারণটা। তবে এখন তো আর সেসব কারণের অস্তিত্ব নেই। ছোঁয়া তো এখন আর অসহায় মেয়ে নয়। শি ক্যান হ্যান্ডল এভরিথিং ভেরি স্মার্টলি। ইউ নো, রাইট?’ মায়া বলল, প্রগাঢ় কণ্ঠে।

‘ইয়েস, আই নো, মায়া! বাট প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড ইটস্ নট দ্যা রাইট টাইম ইয়েট।’ অনুনয় ভরা কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

‘সিরিয়াসলি, শিহরণ! ছোঁয়ার মা তার জন্য পাত্র খুঁজছে। তুমি কি জানো সেটা?’ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, মায়া।

‘পাত্র খুঁজলে খুঁজুক। খুঁজলেই কি বিয়ে হয়ে যাবে? আর আমি জানি ছোঁয়া কখনোই রাজি হবে না। তুমিও জানো এটা। বরং বলা ভালো তুমি আমার চাইতে আরও বেশি ভালো জানো।’ দৃঢ়তার সাথে বলল, শিহরণ।

‘আমার বন্ধুকে আর অপেক্ষা করাইও না। প্লিজ, শিহরণ।’ মিনতির সুরে বলল, মায়া।

‘ওকে, ডিয়ার মায়ামণি। আমি একজনের অপেক্ষা করছি। আমি জানি সে ছোঁয়াকে দেখা মাত্রই পুনরায় তাকে পাবার চেষ্টা করবে। আমি শতভাগ নিশ্চিত এই ব্যাপারে।’

‘তুমি কি অতলের কথা বলছ?’ সন্দিহান কণ্ঠে বলল, মায়া। ।

‘হুম, অতল। ও যা করেছে তা ঠিক করেনি। খুব ভুল করেছিল সে।’ মৃদু ক্রোধ ঝড়ে পড়ছিল শিহরণের কণ্ঠে ।

‘সে ভুল করেছে। তুমিও তো ভুল করেছিলে তাকে বিশ্বাস না করে। তোমার রাগ হতে পারে ওর কি রাগ হতে পারে না?’ প্রতিবাদের সুরে বলল, মায়া।

‘পারে। রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমি তার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। সে আমার সাথে আর একটিবার দেখা করেনি। জেদ ধরে বসেছিল। আমার মুখোমুখি হয়নি সে। তখন হয়নি তাতে কি হয়েছে? এবার তো তাকে আমার মুখোমুখি হতেই হবে। এবার আর সে পালাতে পারবে না। ‘ শিহরণের কণ্ঠে ভয়ংকর কিছু একটার ইঙ্গিত প্রকাশ পেল।

মায়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল,’তুমি কি অতলের কোনো ক্ষতি করার কথা ভাবছ?’

‘একদমই না। সে আমার বন্ধু। আমার ভাইয়ের মতো। আমি শুধু তার ভুল ধারণা বর্জন করতে তাকে সাহায্য করব। এতে যদি সে কষ্ট পায় তবে পাবে। এই কষ্টটুকু তাকে সহ্য করতেই হবে।’ অবিচলিত কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

‘আমার কিন্তু খুব ভয় করছে শিহরণ। তুমি হয়তো ভালো কিছু করার চেষ্টা করছ। কিন্তু যদি হিতে বিপরীত হয়! তাই আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।’

‘চিন্তার কিছু নেই। এটা হবার ছিল এবং হবে। ফলাফল যাই হোক আমাদের তা মেনে নিতে হবে।’ গম্ভীর গলায় বলল, শিহরণ।

‘হুম, তা ঠিক বলেছ। কিন্তু আমি তোমাকে ওয়ার্ন করছি ছোঁয়া যাতে কোনোভাবেই কষ্ট না পায়।’ মায়া বলল, সতর্ক গলায়।

‘তুমি আমাকে চিনো মায়া। আমি কোনোভাবেই ছোঁয়াকে কষ্ট পেতে দিতে পারি না। তা ভালো করেই জানো তুমি।’

‘জানি। তারপরও আমার ভয় হচ্ছে খুব। তুমি তো জানো আমার বিয়ের কথা চলছে। আমার বিয়ে হয়ে গেলে ও খুব একা হয়ে যাবে। মেয়েটা নিজের অনুভূতিগুলো কারো সাথেই শেয়ার করতে পারবে না তখন। যদিও সাইফ আছে। তারপরও ভীষণ চিন্তা হয় ওর জন্য। ও তো কারো ক্ষতি করার কথা ভাবতেই পারে না। বরং নিজের ক্ষতি করে হলেও অন্যের ভালো করতে বদ্ধপরিকর সে।’

‘সাইফের নাম নিবে না একদম। ছেলেটাকে অসহ্য লাগে আমার।’ তিক্ততা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

‘শিহরণ! সাইফ আমাদের বন্ধু। ওকে নিয়ে কোনো বাজে কথা আমি শুনব না।’

‘ও তোমাদের বন্ধু, আমার না।’ শিহরণ মায়াকে সংশোধন করে দিল।

‘সাইফ খুবই ভালো একজন বন্ধু। ওকে নিয়ে বিদ্বেষ পোষণ করবে না একদম।’

‘ঠিক আছে সব। তবে আমার সাইফকে ভালো লাগে না। সত্যটা তোমাকে জানিয়ে দিলাম।’

‘ঠিক আছে। তোমার ভালো লাগতে হবে না। আমরা ওকে খুব পছন্দ করি। আর ও খুবই হেল্পফুল একজন বন্ধু।’

‘বাহ্! সাইফের তো ভালোই গুণগান করছ।’ ব্যঙ্গ করে বলল, শিহরণ।

‘ভালোকে তো ভালো বলতেই হবে। তাই না?’ তীক্ষ্ম স্বরে বলল, মায়া।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। এবার রাখছি।’ ব্যস্ত গলায় বলল, শিহরণ ।

‘হুম, রাখতে পারো। তবে আর দেরি করিও না প্লিজ।’ কাতর কণ্ঠে বলল, মায়া।

‘ঠিক আছে, মায়া।’ মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে বলল, শিহরণ ।

কলটা কেটেই শিহরণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। মায়ার বলা প্রতিটা কথাতে যুক্তি আছে, শিহরণ তা ভাল করেই জানে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে নিজেদের ঠিকানায়, নিজেদের নীড়ে। আকাশের বুকে একটা মাত্র তারা এই সন্ধ্যেবেলাতেই মিটিমিটি করে জ্বলতে জ্বলতে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আচমকাই শিহরণে এসবকিছু খুব ভালো লাগছে। মনের মধ্যে এক ধরনের ভালোলাগার আবেশ আর স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে হঠাৎ করেই। ছোঁয়ার কথা ভাবতেই, তার কথা বলতেই এই ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে তার মনজুড়ে।

______________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-১০+১১

1

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-১০

বহ্নি জাফরানি রঙের শাড়ি পরেছে। একদম পুতুলের মতো আদুরে লাগছে তাকে। সাবিহা সাবরিন মেয়ের রুমে ঢুকে তাকে দেখেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘আমার পরীটাকে তো একদম সত্যিকারের পরীর মতো লাগছে।’

‘আম্মু!’ বহ্নি ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি বলছ?’

তিনি মুহূর্তেই চোখের কোণা থেকে কাজল নিয়ে বহ্নির কানের পেছনে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কারো যেন নজর না লাগে আমার মেয়েটার উপর।’ খানিক সময় মুগ্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বললেন, ‘মিথ্যে বলব কেন? মিথ্যে বলার তো কোনো প্রয়োজন নেই। আমার মেয়েটা হচ্ছে ডানাহীনা পরী।’

শিহরণ ঠিক তখনই বহ্নির রুমে আসলো। এসেই বুকের উপর দু’হাত ভাজ করে চুপ করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। বহ্নি তাকে দেখেই বলল, ‘কী রে ভাইয়া! তুমি এভাবে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

শিহরণ ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা বেলি ফুলের মালাটা খুব সন্তর্পণে নিয়ে বহ্নির চুলে লাগিয়ে দিল। তারপর সহাস্যে বলল, ‘এখন সত্যিকারের পরীর মতো লাগছে আমার পিচ্চি বোনটাকে।’ তারপর ভ্রু কুঁচকে কপট হতাশ গলায় বলল, ‘কেবল ডানার অভাব। সমস্যা নেই। ওটারও ব্যবস্থাও করে ফেলব।’

‘ভাইয়া?’ বহ্নি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘তুমি সুযোগ পাওয়া মাত্রই শুরু করে দাও। এটা কিন্তু একদম ঠিক না। আম্মু ভাইয়াকে কিছু বলো।’

সাবিহা সাবরিন শব্দ করে হাসলেন। শিহরণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার আব্বুটা ভুল কিছু তো বলেনি।’

‘আচ্ছা চল তোকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিই। আমি তো অফিসে যাচ্ছি। তোকে নামিয়ে দিয়ে তারপর অফিসে যাব।’

‘ঠিক আছে ভাইয়া।’ বহ্নি সম্মতি জানাল।

সাবিহা সাবরিন, শিহরণ আর বহ্নি ড্রইংরুমে আসতেই মিষ্টি মৃদু চিৎকার করে বলল, ‘ও আল্লাহ্! আপু গো তোমাকে কী যে সুন্দর লাগতেছে! আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম।’

‘তোকে ভাষা হারানো অবস্থাতেই ভালো লাগে। দোয়া করি তুই যেন তোর ভাষা কখনো খুঁজে না পাস।’ বহ্নি বলল, মৃদু কৌতুকের স্বরে।

ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। সাবিহা সাবরিন মিষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মিষ্টি দেখ তো কে এসেছে।’

মিষ্টি পা বাড়ায় দরজা খোলার জন্য। দরজা খুলতেই মান্নাতকে দেখতে পেল। মান্নাত মিষ্টিকে ধমকে বলল, ‘এত দেরি করিস কেন দরজা খুলতে? যত্তসব গেঁয়ো ক্ষ্যাত।’

মিষ্টিকে পাশ কাটিয়ে মান্নাত ভিতরে ঢুকে পড়ল। মিষ্টি দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘দরজা খুলতে দেরি করলাম কখন? বেল বাজার সাথে সাথেই তো দরজা খুললাম।’

সাবিহা সাবরিন মান্নাতকে দেখে খুব খুশি হলেন। মৃদু হেসে বললেন, ‘আরেহ্! মান্নাত মামণি তুমি এসেছ? অনেকদিন পরে এলে। এসো, নাস্তা করতে বসো।’

‘জি, আন্টি। একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই আসা হয়নি।’ মান্নাত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে শিহরণ ও বহ্নির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’।

বহ্নি বলল, ‘আমার ভার্সিটিতে আজ নবীনবরণ অনুষ্ঠান। নবীনদের বরণ করার দায়িত্ব পড়েছে আমাদের উপর। তাই সেখানেই যাচ্ছি।’

‘বাহ্! দারুণ তো।’ প্রচণ্ড উৎসাহ ভরা কণ্ঠে বলল মান্নাত।

‘আম্মু!’ শিহরণ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আব্বুকে দেখছি না যে?’

সাবিহা সাবরিন আলুর পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, ‘তোর আব্বু নাস্তা করে অফিসে চলে গেছে। তোকে নতুন অফিসে যেতে বলেছে।’

‘জি, আম্মু।’ শিহরণ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমি ওখানেই যাব।’

নাস্তা খাওয়া শেষে শিহরণ আর বহ্নি উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথেই মান্নাত বলল, ‘আমিও যাব তোমাদের সাথে।’

শিহরণ প্রচণ্ড বিরক্তবোধ করল। মৃদু তিরস্কারের সুরে বলল, ‘আমরা তো ওখানে বেড়াতে যাচ্ছি না। আমি যাব অফিসে আর বহ্নি ওর ভার্সিটিতে।’

সাবিহা সাবরিন আদেশের সুরে বললেন, ‘নিয়ে যা না ওকে তোদের সাথে। নিয়ে গেলে তো আর কোনো সমস্যা নেই।’

শিহরণ চুপসে গেল। মৃদু স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে আম্মু।’

শিহরণ ড্রাইভিং সিটে বসল। মান্নাত ওর পাশে বসতে চাইতেই বলল, ‘এখানে বহ্নি বসবে।’ বহ্নিকে ডেকে বলল, ‘কাপকেক! তুই আমার পাশে বসবি।’

বহ্নি ঝামেলা এড়াতে বলল, ‘থাক না ভাইয়া। মান্নাত আপু যখন বসতে চাইছে বসুক না।’

‘বহ্নি!’ শিহরণের গলা খানিক চড়ে গেল। নিজেকে সংযত করে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বসতে বলেছি যখন বসতেই হবে।’

অগত্যা বহ্নিকে সামনের সিটে বহতেই হলো। মান্নাত পেছনের সিটে বসে প্রচণ্ড শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করল। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভাই-বোনের এত ঢং দেখে আর বাঁচা যায় না। তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে তখন কী করো দেখব! তারপর তো তোমার পাশের সিটেই আমাকে বসাতে হবে। এই সবকিছুর শোধ নেব তখন।’

মান্নাতের এরকম জেদ পূর্বক গাড়ির দরজা আটকানোর কারণ শিহরণের কাছে অস্পষ্ট নয়। সে মনে মনে বলল, ‘ তোমার ইচ্ছে অপূর্ণই থাকবে মান্নাত। কিছু ইচ্ছে কখনোই পূর্ণ হবার নয়। তা পূরণ করার স্বার্থে তুমি যাই করো না কেন সবকিছুই ভেস্তে যাবে।’

_____________________________

আফরিনের মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেছে। তার মা তার সাথে এসব কী শুরু করেছে, সে নিজেই বুঝতে পারছে না। ঘরের মধ্যে সে পায়চারি করছে আধ ঘণ্টা যাবৎ। মোবাইলটা ক্রমাগত বেজে চলেছে । কিন্তু সে রিসিভ করছে না। নীলাভ্র কল করছে। কিন্তু আজ তার মেজাজের সাথে সাথে মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। আধ ঘন্টা ধরেই কল করছে নীলাভ্র। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠে নীলাভ্র বলল, ‘কী হলো আফরিন? তুমি কল রিসিভ করছ না কেন?’

‘ইচ্ছে হয়নি আমার তাই করছি না।’ দায়সারাভাবে বলল, আফরিন।

‘ইচ্ছে হয়নি মানে কি?’ নীলাভ্র জেদী কণ্ঠে জানতে চাইল।

‘ইচ্ছে হয়নি মানে, হয়নি। তোমাকে যখন বলি আমাদের ব্যাপারে তোমার বাবা-মাকে বলতে তখন তো তুমি ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারো না। তখন তোমার তাদের কিছুই জানাতে ইচ্ছে করে না। তোমার বাবাকে তুমি বাঘের মতো ভয় পাও। আমিও খুঁজে খুঁজে একটা ভীতুর ডিমের সাথে প্রেম করে বসলাম।’ আফরিন একসাথে এত কথা বলে হাঁপাতে লাগল।

‘আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ব্যাপারটা? কি হয়েছে তা তো বলো?’ নীলাভ্র উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল।

‘কী আবার হবে? আমার কি কিছু হতে পারে?’ আফরিনের একগুঁয়ে উত্তর।

‘কী আশ্চর্য! বলো তো কী হয়েছে?’

‘মা আমাকে বিয়ে দিবে বলছে।’

‘বিয়ে? এত তাড়াতাড়ি! কেন?’

‘তা তুমি আমার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিও।’ আফরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল।

‘আশ্চর্য!’ নীলাভ্র ভ্যাবলাকান্তের মতো করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমি কি তোমার আম্মুর সাথে কথা বলি যে জানতে চাইব?’

‘এখন কথা বলো না তো কী হয়েছে? কথা কি বলবে না?’ আফরিনের গলা চড়ে যাচ্ছিল।

‘বলব। সময় হলেই বলব।’ প্রশান্ত কণ্ঠে বলল, নীলাভ্র।

‘কখন সময় হবে তোমার?’ চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল, আফরিন।

নীলাভ্র চুপ। কোনো কথাই বলছে না। তার মনে হাজারো শঙ্কা। সে বাইরের কারো সাথে যতই কথা বলুক না কেন। বাবাকে তো প্রচণ্ড ভয় পায়। বাবার সামনে গেলেই তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোতে চায় না। এতে সে কী করবে! সে তো আসহায়। একমাত্র বোনটাই কিছুটা কম ভয় পায় বাবাকে। নয়তো তারা দু’ভাই বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পায়।

‘আচ্ছা, তুমি কি আমাদের কথা বলবে না বাসায়? নাহলে আমি বিয়েতে রাজী হয়ে যাব। এটাই তোমার জন্য লাস্ট ওয়ার্নিং, নীল।’ আফরিন কঠিন গলায় বলল।

‘আচ্ছা, বলব। আমি আব্বুর সাথে আজই কথা বলব।’ পরক্ষণেই কাঁচুমাচু হয়ে বলল,’আজ কি দেখা হবে, আফরু?’

আফরিনের রাগ তখনো পড়েনি। কিন্তু নীলাভ্র তাকে আফরু বলে ডাকলে সে ভেতর থেকে প্রচণ্ড রকমের দুর্বল হয়ে পড়ে। নীলাভ্রের মিষ্টি কথার জালে আটকে যায় মুহূর্তেই । সে জানে ছেলেটা ভীতু হলেও তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাকে না করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই আফরিন কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘দেখা হবে। মা যদিও আমাকে যেতে নিষেধ করেছে। তবুও আব্বুকে বলে ম্যানেজ করে নেব।’

নওশীন হকের কাছে গিয়ে দেখল তিনি চুলায় চা চড়িয়েছেন। রান্নাঘরের দরজায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সে। তারপর মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে এটা ওটা এগিয়ে দিল সে। নওশীন হক বললেন, ‘এত খাতির কিসের জন্য সেটা বলে ফেল।”

‘আম্মু! এমনিতে কি আমি কোনো কাজ করি না?’

‘প্রশ্নটা বোধহয় নিজেকে করলেই বেশ ভালো একটা সাজানো গোছানো উত্তর পাওয়া যাবে।’ সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন নওশীন হক।

‘আম্মু….!’

‘কী বলতে এসেছ বলে ফেল।’

‘আমি একটু বাইরে যাব।’

‘বাইরে কোথায়?’ নওশীন হক অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে।

আফরিন গতকাল শুনেছিল নীরার ভার্সিটির নবীনবরণের কথা । তাই ঝটপট বলল, ‘নীরার ভার্সিটিতে যেতে চাইছি আম্মু। শুনেছি বেশ ভালো আয়োজন করবে এবার। তাই ওদের অনুষ্ঠান দেখতে ইচ্ছে করছে।’

নওশীন হক কী যেন ভেবে বললেন, ‘যেতে পারবে তবে একটা শর্ত আছে।’

‘কি শর্ত, আম্মু?’

‘তোমাকে সারাক্ষণ রাদিদ আর নীরার সাথে থাকতে হবে।’

আফরিন তৎক্ষনাত বলল, ‘ঠিক আছে।’
মনে মনে এই ভেবে খুশি হলো যে তার মা খুব সহজেই রাজী হয়ে গেল

____________________

নীরা রেডি হচ্ছিল ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য । লাল পাড়ের হলুদ জমিনের একটা শাড়ি পড়েছে সে। চুলে খুব সুন্দর করে খোপা করেছে। তাতে পেঁচিয়েছে রজনী ও গোলাপ ফুল দিয়ে তৈরী করা একটা সুন্দর গাজরা । শাড়ি পরা আর সাজগোজ শেষ হতেই সে রাদিদের রুমে হানা দিল। সকাল সকাল তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে সে। রাদিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ভাইয়া! কেমন লাগছে বলো তো?’

‘সুন্দর লাগছে।’ হামি তুলতে তুলতে রাদিদ নির্বিকার উত্তর দিল।

‘এটা কি রকম কথা হলো? প্রশংসা করার ক্ষেত্রেও কিপ্টেমি! প্রশংসা করতে তো আর টাকা পয়সা খরচ করতে হয় না। একটু ঠিকমতো প্রশংসা করতেই পারো তোমার এই আদরের বোনটার।’ অভিযোগের সুরে বলল, নীরা।

‘খুব সুন্দর লাগছে। এবার ঠিক আছে?’ দায়সারাভাবে বলল, রাদিদ।

‘মনে হলো তোমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে আমি নিজের প্রশংসা শুনছি।’ নীরা হতাশ গলায় বলল।

‘আর কীভাবে প্রশংসা করব বল তো?’ অসহায় দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকাল রাদিদ।

‘এখন আমার জায়গায় যদি বহ্নি আপু হতো তাহলে তো ঠিকই কাব্যিক ভাষায় প্রশংসা করতে। হয়তো কয়েকখানা কবিতাও রচনা করে ফেলতে। আজ আমি তোমার বোন বলে…!’ নীরার কণ্ঠে গভীর আক্ষেপ।

প্রসঙ্গ পাল্টাতে রাদিদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘ভার্সিটিতে যাবি তো না-কি? না গেলে আমি আজই বাসায় চলে যাব।’

‘না যাওয়ার কথা একদম ভাববে না।’ হুমকি দেবার ভঙ্গিতে বলল নীরা, ‘আমার সাথে তোমাকে যেতেই হবে।’

নীরা মনে মনে বলল, ‘দেখি আজ বহ্নি আপুকে দেখে তোমার রিয়েকশন কেমন থাকে!’

আফরিন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ‘এই তোরা যাওয়ার সময় আমাকে বলিস। আমিও যাব তোদের সাথে।’

রাদিদ ও নীরা কিছুটা অবাক হলো। নীরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘মা তো আজ তোমাকে ভার্সিটি যেতে নিষেধ করেছিল? এখন যেতে চাইছ যে? মা জানে তো তুমি যে যেতে চাইছ?’

‘তোকে আমি সবকিছু বলতে আমি বাধ্য নই। আর তুই এর প্রশ্ন করছিস কেন? তোকে কি সবকিছু বলতে হবে না-কি?’ গলার স্বর উঁচু করে বলল, ‘আমার যা ইচ্ছা তাই করব। তুই কে এসব জানতে চাওয়ার?’

আফরিনের এরকম আচরণে নীরা একদম অবাক হয়ে গেল। অবশ্য এরকম অবাক সে সবসময় হয়ে থাকে। একদম ঠান্ডা গলায় সে বলল, ‘আমি কেউ না?’

‘না!’ আফরিন অবিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে প্রশ্ন করার অধিকার আমি কাউকেই দিইনি।’

রাদিদের ভালো লাগছে না এসব। ঝামেলা দেখলে তার ভিতরে প্রচণ্ড রকমের অশান্তি শুরু হয়ে যায়। নিজের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে সে। সে শূন্যতায় কেবল এবং কেবলই এক ধূ ধূ মরুভূমির উত্তপ্ত প্রান্তরের ন্যায় খা খা করে। সে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে ডাকব।’

আফরিন আর দাঁড়াল না। ধুপ ধাপ করে যেমন হেঁটে এসেছিল তেমনি পায়ে হেঁটে চলে গেল।

নীরা, আফরিন আর রাদিদ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নওশীন হক বললেন, ‘রাদিদ , তোর বোনদের দেখে রাখিস। এমনিতেই দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে। মেয়েরা ঘরের বাইরে থাকলেই মনটা আনচান করে। চিন্তার কারণে কোনো কাজে মন বসাতে পারি না।’

রাদিদ তার ফুফুকে আশ্বস্ত করতে বলল, ‘ঠিক আছে ফুফু। দেখে রাখব।’

ঠিক তখনই রাদিদের মোবাইলটা বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকৈ তাকাতেই নীলার নামটা ভেসে উঠল। রাদিদ ইশারায় আফরিন আর নীরাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে কলটা রিসিভ করল। ফোনের ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠ ভেসে এলো।

‘কেমন আছে আমার খোকাটা?’

‘আমি ভালো আছি আম্মু। তুমি কেমন আছ?’

‘আমিও ভালো আছি । আজ দুদিন ধরে কল করিসনি কেন? নাম্বারটাও অফ করে রেখেছিস। সত্যি করে বল তো কোনো অসুখ করেনি তো তোর ?’ খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শোনাল ফাইজা বেগমের কণ্ঠ।

‘না, আম্মু। আমি একদম ভালো আছি।’ মাকে আশ্বস্ত করতে দৃঢ় কণ্ঠে বলল রাদিদ। জ্বরের কথাটা ইচ্ছে করেই জানায়নি সে। জানালে প্রচণ্ড টেনশন করবে তার মা। সেটা তার কাছে অজানা নয়। তাই জ্বরের বিষয়টা চেপে গেল।

ফাইজা বেগমের কাছ থেকে নীলা মোবাইলটা নিয়ে বলল, ‘ফুফুর বাসায় গেলে তো আমাদের একদম ভুলেই যাস। পিউ তো তোর কথা বলতে বলতে আমাকে জ্বালিয়ে মারছে।’

রাদিদ মৃদু হাসল। বলল, ‘আমার লিটল চ্যাম্পকে দাও তো আপা।’

‘দিচ্ছি। না দিলে তো আজ সারাদিন আমার মাথা চিবিয়ে খাবে।’

পিউ পিচ্চি পিচ্চি হাতে মোবাইলটা ধরেই আদুরে গলায় বলল, ‘বড়ো মামা! কেমন আছ তুমি?’

‘আমি ভালো আছি, লিটল চ্যাম্প। তুমি কেমন আছ?’

‘বড়ো মামা! তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছে না। তুমি কোথায় গিয়েছ? তাড়াতাড়ি চলে আসো না আমাদের কাছে।’

‘আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব, পিউ। তোমার জন্য কি আনব বলো তো?’

‘আমার জন্য…? বেশি করে চকলেট এনো। ঠিক আছে মামা?’

‘হ্যাঁ, একদম ঠিক আছে পাকনা বুড়ি।’ রাদিদ শব্দ করে হাসতে হাসতে বলল।

‘মামা! আমাকে বুড়ি বলবে না একদম। আমি এখনও ছোট্ট। ছোট্ট পিউ।’

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আফরিন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সে বলল, ‘এত কথা বললে তো আজ আমাদের যাওয়া হবে না। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করো তো।’

রাদিদ তখন তাড়া দিয়ে পিউকে বলল,
‘আচ্ছা ছোট্ট রানি, এবার আপাকে দাও তো ফোনটা।’

‘আচ্ছা, দিচ্ছি।’

নীলা ফোন নিতেই বলল, ‘হ্যাঁ, ভাই বল।’

‘আপা, মাকে দেখে রেখো। সময়মতো ওষুধ খাইয়ে দিও। আর বাসার সবার খেয়াল রেখো।’

‘ঠিক আছে, ভাই। তোর এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।’

‘আচ্ছা, আপা। এখন রাখছি। পরে আবার কথা হবে। আম্মাকে টেনশন নিতে নিষেধ করিও।’

এটুকু বলেই রাদিদ কলটা কেটে দিল। তারপর আফরিন, নীরাকে নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হলো।

___________________________

শিহরণের গাড়িটা ভার্সিটির গেইটে পৌঁছাল। বহ্নি নেমে গেল সাথে সাথে। মান্নাত নামছে না দেখে শিহরণ প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার! তুমি নামবে না?’

মান্নাত বলল, ‘না। আমি তোমার সাথে যাব।’

‘আশ্চর্য!’ প্রচণ্ড বিরক্তিতে শিহরণের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’আমি তো অফিসে যাব।’

‘আমিও তোমার সাথে তোমার অফিসেই যাব।’

‘ওটা কি ঘুরে বেড়ানোর জায়গা? এখানেই তো থাকতে পারো তুমি।’

বহ্নি বলল, ‘ভাইয়া। নিয়ে যাও তোমার সাথে।’

সায়মা, রিয়া আর তূর্ণ এসে দাঁড়ালো বহ্নির পাশে। রিয়া বলল, ‘হেই ক্রাশ ব্রো! হাউ আর ইউ?’

শিহরণ রিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বলল, ‘ফাইন। ইউ?’

রিয়া সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া! আজ এখানেই থাক না। খুব মজা হব। প্লিজ ভাইয়া।’

সায়মা রিয়ার একটা হাত খামচে ধরল। রিয়া উফ করে শব্দ করে উঠল। সায়মার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপু! খামচি দিচ্ছিস কেন?’

সায়মা ইশারায় রিয়াকে থামতে বলল। রিয়া তা বুঝলই না। বরং শিহরণকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ভাইয়া, গাড়িটা পার্ক করে এসো। আজ আমি তোমাকে আমাদের পুরো ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাব।’

শিহরণ রিয়ার বাচ্চামি দেখে মনে মনে হাসল। বলল, ‘আপু, অন্যদিন দেখব । আজ একদম সময় নেই।’

শিহরণের না শুনে রিয়ার মন খারাপ হলো। খুব খারাপ হলো। মুখটা গোমড়া করে ফেলেছে সে মুহূর্তেই। তাই দেখে শিহরণ বলল, ‘সায়মা! রিয়াকে নিয়ে বাসায় এসো একদিন। এখন তো একদম বাসায় আসো না।’

সায়মা মৃদু হেসে বলল, ‘ঠিক আছে ভাইয়া। আসব আমরা।’

তূর্ণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বহ্নির পাশে। শিহরণ তূর্ণকে আদেশের সুরে বলল, ‘হেই তূর্ণ! আমার বোনকে দেখে রাখবে। ওকে?’

বহ্নি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ভাইয়া! আমি কি কোনো বাচ্চা মেয়ে যে আমাকে দেখে রাখতে হবে?’

শিহরণ একগাল হেসে বলল, ‘আমার কাছে তো আমার বোন এখনও পিচ্চি।’

পেছনে বসে বসে মান্নাত বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে আবারো বলল, ‘একবার বিয়ে হোক তারপর দেখব এতো ভালোবাসা কীভাবে থাকে!’

তূর্ণ শিহরণকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘ব্রো! নাউ ইটস্ মাই ডিউটি টু টেক কেয়ার অফ হার।’

শিহরণ প্রত্যুত্তরে হাসল। বহ্নি তাকে বিদায় দিল। শিহরণ আর দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দিল।

______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-১১

অতলের জন্য সকালে বাবার সাথে নাস্তা করতে বসা মানে হলো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো ব্যাপার। বাবা খেতে খেতে হাজারো প্রশ্ন করে বসে তাকে। প্রতিদিন একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত, শ্রান্ত। তবুও উত্তর দিতে হয়। ভবিষ্যতেও দিতে হবে। না দেবার কোনো উপায় নেই। প্যান্টের পকেটে মোবাইলটা ক্রমাগত ভাইব্রেট হচ্ছে। ‘উম উম’ করে শব্দ হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন। সাইলেন্ট করেছিল সে কিন্তু সাইলেন্ট করতে গিয়ে ভাইব্রেশন চালু হয়ে গিয়েছে। তাড়াহুড়ো করলে যা হয় আরকি! সকালে নাস্তা করার সময় কল আসলে এক প্রস্থ বকাঝকা শুনতে হয় বাবার কাছ থেকে। সারা দুনিয়ার কাছে অতল খুবই সাহসী হলেও বাবার সামনে সে তো ভেজা বেড়াল। নাহ্! অতলের একদম ভালো লাগছে না নিজেকে বিড়ালের সাথে উপমা দিতে। কিন্তু সত্য তো সত্যই! অতল চাইলেও তা উপেক্ষা করতে পারবে না।

‘ভাইয়া! তোর কল আসছে মনে হয়।’ তানিয়া বলল, গলার স্বর খাদে নামিয়ে।

অতল বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল তার দিকে। যেন চোখ দিয়েই তাকে গিলে খাবে!

‘কী ব্যাপার!’ গমগমে গলায় বললেন আফজাল শেখ, ‘না খেয়ে বসে আছ কেন? খাবার খাওয়ার সময় এত ফিসফিসানি কিসের?’

অতল জানে এই সময় তাকে কেবল এক জনই কল দিতে পারে। আর সে হলো আয়মান। সে মনে মনে ইচ্ছেমতো গালাগাল করল আয়মানকে। তারপর একদম বাধ্য ছেলের মতো বাবার দিকে তাকিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে সহাস্যে বলল, ‘খাচ্ছি আব্বু। তানিয়া ওর পরীক্ষার কথা বলছিল।’

অতলের মিথ্যা কথা শুনে তানিয়া অতলের হাতে খামচি দিল। অতল তা একদম গ্রাহ্য করল না।

‘খাবার খাওয়ার সময় এত কথা বলার দরকার নেই। চুপচাপ খাবার শেষ করো।’ আদেশের সুরে বললেন আফজাল শেখ।

আতিককে উদ্দেশ্য করে আফজাল শেখ আবারও বললেন, ‘তোমার বড়ো ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু শিখ। দেখেছ কেমন চুপচাপ খাচ্ছে।’

আতিক অতলের দিকে তাকিয়ে চাপা হাসল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আম্মু! আর একটা পরোটা দাও তো।’

মেহেরুন নাহার আতিককে পরোটা এগিয়ে দিলেন। তারপর স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এবার একটু ঠিক মতো খেতে দেন তো আমার ছেলেটাকে।’

আফজাল শেখ আর কথা বাড়ালেন না। সবাই নীরবে খেতে লাগল। অতল মায়ের প্রতি মনে মনে ভীষণ কৃতজ্ঞ হলো।

নাস্তা শেষ করেই লাইব্রেরিতে চলে গেল অতল। আয়মানকে দেখতেই ক্ষেপে গেল। খ্যাপাটে গলায় বলল, ‘শালা! তুই কল করার আর টাইম পাস না। প্রতিদিন আমি নাস্তা করতে বসলেই তুই কল করিস। কোনোদিনই কি তোর আক্কেল হবে না।’

আয়মান ভারি অবাক হলো। তবে এটাও ঠিক যে অতল বেশ কয়েকবার তাকে নিষেধ করেছে সকালে নাস্তা খাওয়ার টাইমে কল না করতে। কিন্তু আয়মান সবসময় ভুলে যায়। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘স্যরি দোস্ত। দিস ওয়াজ দ্যা লাস্ট টাইম।’

অতল ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘এরকম লাস্ট টাইম তোর জীবনে ডেইলি আসে আর ডেইলি যায়।’

আয়মান অতলের হাত ধরে ফেলল। আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত প্লিজ। তুই না আমার জিগরি দোস্ত। এবারের মতো ভুলে যা।’

অতলের অভিমানের পাহাড় গলতে শুরু করল। আয়মান বুঝতে পেরেই বলল, ‘দোস্ত চল আজকে মন রিফ্রেশ করার জন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাব তোকে।’

অতলের শত নিষেধ সত্ত্বেও আয়মান তাকে জোর করে নিয়ে গেল তার সাথে। অতল তখন পইপই করে বলল যে তার পড়া আছে। সামনেই বিসিএসের ভাইভা দিতে হবে। প্রচুর খাটতে হবে তার জন্য। সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপারটা হলো এবার যদি সে ভাইভাতে না টিকে তবে তাকে আরও বেশি পড়তে হবে। আর বাসায় তো আব্বুর বকাঝকা চলতেই থাকবে। এসবকিছু আয়মানকে শোনানোর পর সে আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত! মনে কর না তোর গার্লেফ্রেন্ড এর সাথে সময় কাটাতে যাচ্ছিস।’

অতল ভারি অবাক হলো আয়মানের কথা শুনে। অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘যখন ব্যাপারটা ঘটছেই না তখন আমি মনে করব কেন?’

আয়মান অনুরোধের স্বরে বলল, ‘আরেহ দোস্ত! এত প্যাঁচাল পারিস না তো। যেতে বলেছি মানে যেতে হবে।’

অতল তখন আশ্চর্য রকমের অবাক। সে অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তোর গার্লেফ্রন্ড সায়মার সাথে দেখা করবি। এই তো?’

আয়মানের মাথায় যেন আকাশটা ক্রমাগত ভেঙে পড়ছিল। অমন পাংশুটে চেহারা নিয়ে সে বলল, ‘বুঝলি কি করে?’

‘খুব সহজ ছিল। তবে ব্যাপারটা তোর না জানলেও চলবে।’

‘আচ্ছা, এখন যাবি তো না-কি?’

‘হুম, চল। বেশিক্ষণ থাকতে পারব না আগে থেকেই বলে রাখলাম।’ ব্যস্ত গলায় বলল, অতল।

আয়মান আর অতল তখন সায়মার ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। চারদিকে প্রচণ্ড ভীড়। আয়মান ভীড়ের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে খুঁজল সায়মাকে। না পেয়ে হতাশ হলো আয়মান। আর এদিকে অতল মহাবিরক্ত হচ্ছে। প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে সে বলল, ‘আরে তুই ফোন দে না ওরে।’

আয়মান যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সায়মা বলেছিল ভার্সিটির গেইটের সামনেই থাকবে। তাই সে এতক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল। তবে অতল ঠিকই তো বলছে। এত খোঁজাখুঁজি না করে কল করলেই পারে সে। অথচ তার মনেই ছিল না। সে দ্রুত ডায়াল করল সায়মার নাম্বারে। সায়মা কল রিসিভ করতেই বলল ক্যাম্পাসে অপেক্ষা করতে। অনুষ্ঠান শেষ হলেই বেরোবে সে।

অতল আর আয়মান একটা নির্জন জায়গা বেছে নিল। চারপাশে সারি সারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া ফেলেছে সবুজ, সতেজ ঘাসে ছেয়ে ফেলা মাঠের উপর। মাথা উঁচু করে থাকা বৃক্ষের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ্দুর উঁকিঝুঁকি মারছে। আলো-ছায়ার এক মিষ্টি খেলা চলছে। বেশ ভালো লাগছে অতলের। আরও বেশি ভালো লাগছে
পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে সবুজ আর সতেজ ঘাসের রাজত্ব দেখে। একটা জায়গা বেছে নিয়ে অতল বলল, ‘এখানেই বসে পড়।’

আয়মান দ্বিমত করল না। অতলের পাশে বসে পড়ল। তারপর তার ব্যাকপ্যাক থেকে একটা ম্যাগাজিনের বই এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধর, এটা পড়। আর কোনো বইখাতা নেই রে দোস্ত।’

অতল মুখটা বিরক্তিতে কুঞ্চিত করে বলল, ‘দোস্ত! আজ মেজাজটা যথেষ্ট খারাপ।’

আয়মান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘কেন কী হয়েছে? রিয়ানা আবার কিছু করেছে না-কি?’

‘নাহ্!’ দৃঢ়তার সাথে বলল অতল, ‘ও আমার কিছুই করতে পারবে না।’

‘তাহলে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোকে?’

‘জীবনটাই তো চিন্তার এক মহড়া। চিন্তা-ভাবনাহীন তো জীবন হয় না।’ অতল বলল, বিজ্ঞের মতো করে।

‘হুম। তারপরেও কিছু একটা খুব খারাপ হয়েছে বোধহয়।’

‘খারাপ কিছু হয়নি। আব্বু ভাইয়ার জন্য…!’

আয়মান অতলকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দোস্ত সায়মা আসছে। তুই এখন চুপ থাক।’

অতল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সায়মাকে। এর আগে সামনাসামনি অবশ্য দেখা হয়নি। আয়মান ছবি দেখিয়েছে। সায়মা হচ্ছে আয়মানের কাজিন। তাই তাদের পরিবারে আয়মানের অবাধ বিচরণ। তাদের সম্পর্কের কথা তাদের পরিবারে মোটামুটি সবাই জানে।

তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অতল থমকালো। স্তব্ধ হয়ে গেল। সায়মার পাশে ধীর পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসা জাফরানি রঙের শাড়ি পরিহিত মেয়েটাকে দেখে। তার দুচোখ আটকেই থাকল মেয়েটার উপর। তার কাছে চেনা চেনা লাগছে মেয়েটাকে। যেন খুব চেনা কেউ। কিন্তু চিনতে কষ্ট হচ্ছে তার। দীর্ঘ সময় পর খুব পরিচিত কাউকে দেখলে এমনই হয়। মস্তিষ্ক বিভ্রান্তিতে পড়ে। কাজ করতে চায় না সাথে সাথে। অতলেরও তেমনই হচ্ছে।

বহ্নি আর সায়মা এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। বহ্নি অতলকে দেখে প্রচণ্ড অবাক হলো। সাথে সাথেই ভীষণ রকমের বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলল, ‘অতল ভাইয়া!’

এই কণ্ঠটা অতলের পরিচিত। খুব পরিচিত। অতল বিস্মিত হলো এত বছর পরে বহ্নিকে দেখে। তৎক্ষনাৎ সে কোনো কথা বলতে পারল না। তার মনের সমস্ত কথা যেন ফুরিয়ে গেছে। যেন সমস্ত শব্দ একসাথে চুক্তি করে পালিয়ে গেছে তার মনের ডায়েরি থেকে। নিষ্পলক সে তাকিয়ে রইল। যেন অতল কোনো এক গহ্বরে হারিয়ে গেছে সে।

‘অতল ভাইয়া! চিনতে পারছ না আমাকে? আমি তোমার আগুনমণি।’ বহ্নি বলল, ভীষণ খুশিতে গদগদ হয়ে।

আগুনমণি শব্দটা যেন অতলের মস্তিষ্কে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দিয়েছে। অতল সাথে সাথেই সম্বিৎ ফিরে পেল। শত কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে ভেসে আসা কোনো কণ্ঠের ন্যায় সে বলল, ‘চিনতে পেরেছি, আগুনমণি।’ একটু ধাতস্থ হয়েই পুনরায় বলল, ‘কেমন আছিস?’

‘এই তো ভালো আছি।’ বহ্নি অতলের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘তুমি কেমন আছ?’

‘আমি?’ অতল যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল। বিষণ্ন কণ্ঠে বলল, ‘ভালো আছি। খুব ভালো আছি।’

‘আমি তোমার সাথে খুব রাগ করেছি।’ আহ্লাদী গলায় বলল, বহ্নি।

অতল হাসল। কিছুই না বলে উপরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বহু বছর আগের একটা ঘটনা তার মনকে আবারও এত বছর পরে নাড়া দিয়ে উঠল। যেন কোনো এক আলো-ছায়ার খেলায় তাদের জীবন অবরুদ্ধ হয়ে আছে। বিশেষ করে তার জীবনটা। কেমন হয়ে গেল সে! তার নিজেরই ভাবতে অবাক লাগে। ক্লাসের ভীতু ছেলেটা আর ভীতু নেই। সবার ভালো চাইতে থাকা ছেলেটা আর কারও ভালো চায় না। ভীষণ রকমের পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। ভীষণ রকমের পরিবর্তন! আর সে কোনো বাধা দেয়নি। সমস্ত পরিবর্তনের জোয়ারে কেবল গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতেই আজকের এই অতল!

বহ্নি পুনরায় বলল,’ কেন রাগ করেছি জানতে চাইবে না?’

অতল প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘নাহ্।’

‘না বলে চলে গিয়েছিলে কেন?’ বহ্নি আচমকা অতলের একটা হাত ধরে প্রশ্ন করল।

আয়মান আর সায়মা অবাক হয়ে দেখছিল ওদের। সায়মা জানে বহ্নি অতলকে পছন্দ করে ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু এখনও কী পছন্দ করতে পারে! এতটা বছর পরেও। এটা কি আদৌ ভালোবাসা না-কি কেবলই ভ্রান্তি। সায়মা তা বুঝতে পারছে না। এমনিতেই এত জটিল চিন্তা তার জন্য না।

‘বলার সময় ছিল না। ইচ্ছে হয়নি তাও বলতে পারিস।’ কাটাকাটা গলায় উত্তর দিল অতল।

‘ইচ্ছে হবে না তো। আমি তোমার কে যে আমাকে বলতে যাবে।’ অভিমানী গলায় বলল, বহ্নি।

অতল হাসল তার দিকে তাকিয়ে । প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘সুন্দর লাগছে তোকে।’

‘হুম, আমি জানি আমাকে সুন্দর লাগছে।’

‘তুই তো অনেককিছুই জানিস। খুবই বুদ্ধিমতী তুই। তা আমার অজানা নয়।’ অতল বলল প্রগাঢ় কণ্ঠে।

___________________

সারপ্রাইজ ! কার কেমন লেগেছে জানাবেন।

আরও সারপ্রাইজ আছে আপনাদের জন্য। যারা গঠনমূলক মন্তব্য করবেন তাদের জন্যেও একটা বিশেষ সারপ্রাইজ আছে।

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৯

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
শব্দ সংখ্যা:২৩৯০
পর্ব-০৯

শিহরণ সকাল সকাল মর্নিং ওয়াকের জন্য বেরিয়েছে। রাতে ঘুমোতে খুব দেরি না হলে সচরাচর তার মর্নিং ওয়াকটা মিস হয় না। আজও মিস হয়নি। সকালের সতেজ হাওয়াতে এমনিতেই মন প্রাণ জুড়ে এক ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শরীর ও মন জুড়ে। এই অনুভূতির ক্ষেত্রে শিহরণ নিজেও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতি তাকে দারুণভাবে টানে। তবে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি সে অন্য একজনের মধ্যে বুঁদ হয়ে গেছে। তার জন্য কনফেস করাটা খুব বড়ো কোনো ডিল নয়। তবুও কেন যে সে এতটা অপারগ তা সে নিজেই বুঝতে পারে না! এই যে তার চারপাশের জগত জুড়ে কতো মোহনীয়, সৌন্দর্যে ভরপুর কতো তরুণীরা ঘুরঘুর করতে থাকে। শিহরণ তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপই করে না। তার ওসব বিরক্ত লাগে। ওদের এহেন আচরণ তার কাছে ন্যাকামির মতো মনে হয়। কিন্তু কেন যেন তার সামনে নির্বিঘ্নে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে থাকা মেয়েটার প্রতি তার দুর্বার আকর্ষণ। দশ বছর! কতটা বেশি সময়। স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ , ভার্সিটি লাইফ তিন তিনটা লাইফেও সে এই মেয়েটার প্রতি থাকা তার আকর্ষণকে দমন করে পারেনি। অথচ এই দুর্দমনীয় আকর্ষণের কারণেও সে কখনো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি । সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অথচ আজ তাকে কাছ থেকে দেখে তার নিজেকে বড্ড বেশি ধৈর্যহীন মনে হয়েছে। যদিও সে সর্বক্ষণ নির্বিকার থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। তবুও সে যে দুর্বল হয়ে পড়েছিল তা অন্য কেউ না বুঝলেও সে তো জানে।

সেদিন অফিসের কফি কর্নারে যখন ছোঁয়া কফি তৈরী করছিল তখন তার মনে হয়েছিল একবার ছোঁয়ার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে, ‘ভালোবাসতাম।আজও ভালোবাসি। ভবিষ্যতেও ভালোবাসব।’

তবে সে কিছুই বলতে পারেনি। কেবল মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল ছোঁয়াকে। যা সে করে আসছে প্রতিনিয়ত। তাই যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণহীন মনে হলো তখন খুব দ্রুত সরে পড়ল তার সামনে থেকে। দূর থেকেও ভালোবাসা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয় সে নিজেই! এই যে এতটা বছর ধরে নিজের মনের মধ্যে ছোঁয়াকে লালন করে আসছে। তাতে তো তাকে সেই উপাধিটা দিতেই হয়। তাই না ?

এই যেমন এখনও হাঁটতে হাঁটতে যখন এই পার্কটার কাছাকাছি আসলো তখন ছোঁয়াকে দেখে থমকে দাঁড়াল। একটা ছোটখাটো ঝোপ আছে এদিকটায়। শিহরণ সেই ঝোপের আড়াল থেকেই মুগ্ধ হয়ে দেখছে ছোঁয়াকে। কালো ট্রাউজার আর মেরুন রঙের একটা ফতুয়া পরেছে সে। চুলগুলো উঁচু করে বেঁধেছে। সামনের দিকে কয়েক গোছা চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে অযত্নে। ঘর্মাক্ত মুখের উপর সকালের সোনালি রোদ আদর মেখে দিচ্ছে। শিহরণের বড্ড ইচ্ছে হলো ওই চুলগুলো নিজ হাতে ছোঁয়ার কানের পেছনে গুঁজে দিতে। কিন্তু…সংবরণ করল নিজের এই অবাধ্য ইচ্ছেটাকে বহু কষ্টে কেবল সঠিক সময়ের অপেক্ষায়।

এক্সারসাইজ শেষে ছোঁয়া পার্কে একটা বেঞ্চে বসে পানি খাচ্ছিল। সাইফ এসে তার পাশে বসল। বলল, ‘রাউন্ড শেষ?’

ছোঁয়া মাথা ঝাঁকাল। মৃদু তিরস্কার করে বলল, ‘তোর মতো না-কি?’

সাইফ বিরক্তি মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘আই নো আ’ম লেইট লতিফ। সো ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু রিমাইন্ড মি দ্যাট।’

‘ওকে, বস। গো এহেড।’ ছোঁয়া পরাস্ত ভঙ্গিতে বলল।

সাইফ রাউন্ড দিতে দ্রুত দৌড়ানো শুরু করল।
সাইফকে ছোঁয়ার পাশে দেখেই শিহরণের মাথা খারাপ হয়ে গেল। একদম সকাল সকালই মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। শিহরণ ঝোপের আড়াল থেকেই ছোঁয়াকে পর্যবেক্ষণ করছে। ছোঁয়া হয়তো তাকে দেখেওনি। তবে সাইফ দ্রুত প্রস্থান করাতে শিহরণের হৃদয়ের উপর থেকে একটা বিশাল আকারের পাথর সরে গেল। সে মুহূর্তেই খুব হালকা অনুভব করল। তারপর বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। এখনও ঠিক সময় আসেনি। তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো চলবে না। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে ওই প্রাণোচ্ছল মুখটা দেখলে সে নির্ঘাত নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে যাবে।

সাইফ রাউন্ড শেষে ছোঁয়ার সামনে এসে হাঁপাতে লাগল। ছোঁয়া তা দেখে তিরস্কারের সুরে বলল, ‘তুই তো মোটুও না! তারপরেও এত দুর্বল ক্যান? আর তোকেই কি না মা আমার বডি গার্ড বানাল! হাহ্!’

সাইফ তখন তার টি শার্টের হাতটা ভাজ করে বাহু দেখিয়ে বলল, ‘দেখ! আমার বডিগার্ডের মতো শরীর বলেই তো আমাকে বডিগার্ড বানিয়েছে।’

‘তুই কি নিজেকে সালমান খান ভাবিস? ভুলেও ভাববি না!’ ছোঁয়া যেন সাইফকে সতর্ক করল।

সাইফ হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি সালমান খান কেন ভাবব নিজেকে? আমার তো একটা বিশেষ পরিচয় আছে না-কি?’

‘হুম! আছে বইকি। আমার বডিগার্ড। আমার এমপ্লয়ি। আমার কাজিন। আরও বলতে হবে জনাব?’

‘নো মোর আইডেন্টিটি ইজ নিডেড ফর মি, দ্যা মোস্ট বিউটিফুল প্রিন্সেস।’ সাইফ রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল।

ছোঁয়া সাইফের কথার উত্তর না দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল। তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে সাইফ আবার বলল, ‘তো আজ কি প্রিন্সেস শপে আসবেন?’

ছোঁয়া বিরক্তির সুরে বলল, ‘এসব কি শুরু করেছিস? আ’ম নট এনি কাইন্ড অব প্রিন্সেস। আ’ম জাস্ট এ অর্ডিনারি গার্ল।’

সাইফ এবার পরাস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘খালামণির জন্য তো তুই প্রিন্সেসই।’

ছোঁয়া বলল, ‘হুম। বাট নট ফর ইউ। গট ইট?’

সাইফ বলল, ‘ওকে। দ্যান ইউ আর দ্যা মোস্ট ইরিটেটিং গার্ল অব দ্যা ওয়ার্ল্ড।’

ছোঁয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘নাউ ইটস্ সাউন্ড মাচ ব্যাটার দ্যান প্রিন্সেস। বাই দ্যা ওয়ে, আই লাইকড ইট।’

সাইফ তার বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে ঘায়েল হওয়ার অভিব্যক্তি করল। বলল, ‘তেরি বো মুচকান ঘায়েল কর দিয়া মুঝে।’

ছোঁয়া গম্ভীর কণ্ঠে এবার বলল, ‘এবার কিন্তু ওভার এক্টিং হয়ে যাচ্ছে সাইফ!’

সাইফ বাধ্য ছেলের মতো আর একটা কথাও বলল না। ছোঁয়া তা দেখে মুচকি হাসছে। অবশ্য সাইফ তা দেখল না।
______________________

শিহরণ ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে বাসায় ফিরেছে । বাসায় এসেই সে নিজের রুমে চলে গেল। শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হতেই ড্রয়িং রুমে এসে বসল। টিভিটা ছাড়তেই নিত্যদিনের সেই পরিচিত সংবাদ শুনতে পেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত এক ছাত্রীকে খুন করা হয়েছে। খুনের দায়ে অভিযুক্ত তার শ্বশুর ও স্বামী। শিহরণ ভেবে পেল না মানুষ এতটা নির্মম কী করে হতে পারে!

এই তো সেদিন সন্ধ্যায় আবার শুনতে পেল বাবা সন্তানের কাছে টাকা চেয়েছে তাই তার তিন সন্তান আর সন্তানের স্ত্রী মিলে সেই বৃদ্ধ লোকটিকে বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে। মানুষ এতটা নির্মম কী করে হতে পারে! শিহরণ ভেবে পায় না! এসব দেখলেই তার খুব কষ্ট লাগে। ইচ্ছে করে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে। কিন্তু এই প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব তো তার না। সে বুঝতে পারে না প্রশাসন করেটা কী! এত এত অন্যায় অবিচার হয়ে যাচ্ছে চারদিকে অথচ প্রশাসনের টনক নড়ছে না। ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি, পারিবারিক কলহ এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাব্বির আহমেদ অফিসের জন্য রেডি হয়ে এসে বসলেন ড্রয়িংরুমে। শিহরণের ভ্রু কুঞ্চিত দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ কী হয়েছে আমার আব্বুটার?’

শিহরণ বাবার দিকে তাকিয়ে নৈরাশ্য মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা, আব্বু! মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে? এভাবে একজন মানুষ অন্য আরেকজন মানুষকে কীভাবে খুন করে ফেলতে পারে? শুধুমাত্র জাগতিক সুবিধা লাভটাই কি সব? মানবতা, নৈতিকতা, মনুষ্যত্ববোধ বলে কি কিছুই নেই?’

সাব্বির আহমেদ ছেলেকে জহুরি চোখে পরখ করলেন। তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই আছে। মানবতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, নৈতিকতা সব কিছুই আছে। আবার লোভ, ঈর্ষা আর হিংস্রতাও আছে। যার দরুন মানুষ জাগতিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে নিজের মধ্যের ভালো সত্তাকে লুকিয়ে বা ধ্বংস করে খারাপ সত্তাটার বহিঃপ্রকাশ করে থাকে।’ একটু থেমে তিনি আবারও গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘প্রতিটি মানুষের মধ্যেই দুটো সত্তা সমানভাবেই থাকে। এখন কে কোন সত্তার বহিঃপ্রকাশ করবে সেটা তার উপর নির্ভর করে। অথবা তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপরে নির্ভর করে।’

বহ্নি তার বাবার সাথে সুর মিলিয়ে বলল, ‘আব্বু একদম ঠিক বলেছে। সত্যিই একজন মানুষের মধ্যে দুটো সত্তা থাকে। মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে তার মধ্যের কোন সত্তাটি প্রাধান্য পাবে আর কোনটি প্রাধান্য পাবে না। আর এই কারণেই তো আমরা এক এক সময় মানুষের এক একটা রূপ দেখি।’

সাব্বির আহমেদ বহ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘একদম ঠিক বলেছে আমার আম্মুটা।’

বহ্নি হেসে বলল, ‘আব্বু এসব তো তোমার কাছ থেকেই শিখেছি।’

শিহরণ বহ্নিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট সিস্টার।’

‘উঁহু! ইউ আর ফার মোর ব্রিলিয়ান্ট দ্যান মি।’ বহ্নি প্রতিবাদের সুরে বলল।

‘একদম না। তুই বেশি ব্রিলিয়ান্ট ।’

‘তুমি বেশি ব্রিলিয়ান্ট।’

‘থামো তোমরা। দুজনেই সমান ব্রিলিয়ান্ট। আর দুজনেই সমান আবেগী।’ সাব্বির আহমেদ ছেলে আর মেয়ের ঝগড়া থামাতে উঁচু কণ্ঠে বললেন।

বহ্নি অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘আবেগী আর আমি? আব্বু তুমি ঠিক আছ তো? আমাকে আবেগী বলছ?’

‘হুম! অবশ্যই তুইও খুব আবেগী।’

‘আমি তো আমার ভেতরে কোনো আবেগ খুঁজে পাই না আব্বু?’ বহ্নি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বলল।

‘পাবি। আমার আব্বুটার চাইতেও আম্মুটা বেশি আবেগী।’ সাব্বির আহমেদ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।

শিহরণ প্রাণ খুলে হাসল বাবার কথা শুনে। সহাস্যে বলল, ‘এবার দেখেছ আমার বার্বি ডলটা ও আবগী। হা হা হা।’

‘ভাইয়া…!’ বহ্নি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘এখন একদম এসব বলবে না। আমি মোটেও আবেগী না। বুঝেছ?’

শিহরণ ভয় পাবার ভঙ্গি করে বলল, ‘ওপস্! খুব ভয় পেয়েছি। চোখ দিয়েই কি খুন করবি?’ বহ্নিকে জড়িয়ে ধরে বলল,’মাই কিউট ভ্যাম্পায়ার সিস্টার। আচ্ছা তোর ভ্যাম্পায়ারের মতো বড়ো বড়ো দাত আছে না-কি দেখা তো!’

‘আব্বু দেখ তো। ভাইয়া সবসময় এমন করে।’

সাব্বির আহমেদ শিহরণ আর বহ্নির দিকে তাকিয়ে হাসলেন শুধু। কিছুই বললেন না। মনে মনে বললেন, ‘ভাই বোনের এই বন্ধন যেন চিরকাল অটুট থাকে।’

ভাইবোনের খুনশুটিতে বাধা দিল মিষ্টি। সে এসে চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনাদের খেতে ডাকতেছে আন্টি। শুনতে পান না?’

শিহরণ বলল, ‘আসছি। তুই যা।’

নাশতা খেতেই আসতেই সাবিহা সাবরিন অভিযোগ করে বললেন, ‘আজ আমাকে বাদ দিয়েই বাবা আর ছেলে মেয়ে মিলে মজা করলে। আর এদিকে আমি নাশতা বানাতে বানাতে অজ্ঞান হবার দশা।’

মিষ্টি না বুঝে বলল, ‘আন্টি! তাহলে তোমার হুঁশ ফিরল কি করে?’

মিষ্টির কথা শুনে সবাই একযোগে হাসতে লাগল। সাবিহা সাবরিন ধমকে বললেন, ‘এবার হাসাহাসি বন্ধ করো সবাই। খাবার খেয়ে তারপর না হয় আবার শুরু করবে। এখন চুপচাপ খাবার শেষ করো।’

মিষ্টি কাঁচুমাচু হয়ে আবার বলল, ‘বহ্নি আপু! আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’

বহ্নি হাসতে হাসতে বলল, ‘না রে মিষ্টি তুই ভুল বলিসনি । তুই মিষ্টি কথা বলেছি। তাই আমরা সবাই মজা পেয়েছি।’

মিষ্টি শিহরণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি ভাইয়া?’

‘নয়তো কি? একদম সত্যি।’ শিহরণ হাসি চেপে রেখে বলল।

মিষ্টি যেন আশ্বস্ত হলো শিহরণের কথায়। সে এবার সবার সাথে নাশতা খেতে শুরু করল।

________________________

মাহফুজ হক ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসেই খবরের কাগজে বুঁদ হয়েছিলেন। একটু বয়স হলেই বোধহয় খবরের কাগজের প্রতি কেমন যেন একটা বন্ধন তৈরী হয়। রাদিদ ফুফাকে দিন দুনিয়া ভুলে খবরের কাগজে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখে প্রতিবারই মনে মনে ভাবে এই একটা কথা। তার জ্বর সেরে গেছে। সকালে উঠেই গোসল সেরে ফেলেছে । তাই নিজেকে সতেজ ও প্রাণবন্ত লাগছে তার। সে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসতেই মাহফুজ হক খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে দৃষ্টি দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার? জ্বর সেরেছে?’

রাদিদ মৃদু স্বরে বলল, ‘জি , ফুফা। এখন ভালো লাগছে।’

‘তোমার কাজ কি হয়েছে? দোকানের মালপত্র সব কিনেছ তো?’ মাহফুজ হকের অনুসন্ধানী কণ্ঠ।

‘জি, ফুফা। মোটামুটি সব কেনাকাটা শেষ।’

‘ভালো করে দেখে নিয়েছ তো? ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি কিনতে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। মাল খরাপ পড়লে তো তোমার পক্ষে আবার ঢাকায় আসতে বেশ ধকল পোহাতে হবে।’

‘জি, ফুফা। কোনো সমস্যা নেই। মানুষটা আমার পরিচিত তাই সমস্যা হবে না। খারাপ পড়লে এক্সচেঞ্জ করা যাবে। অতটুকু বিশ্বাস করা যায়।’

‘ব্যবসায় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে নেই। তার উপর তোমার এসব ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি কেনার কোনো অভিজ্ঞতা তো নেই। বিশ্বাসী মানুষেরাই তো একসময় বিশ্বাসঘাতকতা করে। তাই চোখ কান খোলা রাখবে। এমনিতেই তো তুমিও তোমার মায়ের মতো খুবই নরম মনের। আর সবাইকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেল। তাই সতর্ক করলাম।’

নীরা নাশতার ট্রে এনে রাখল টেবিলের উপর। নওশীন হক চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে আসছিলেন। তিনি রাদিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোর ফুফার এই কথার সাথে আমি একদম একমত।’

‘আফরিন কই?’ নীরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন নওশীন হক,’এখনও ঘুম থেকে উঠেনি মেয়েটা?’

নীরা বলল, ‘ না আম্মু।’

‘ডাকিসনি কেন ওকে?’ ধমকে বললেন তিনি।

‘আম্মু আমি তো ডেকেছি। কিন্তু আপু আমাকে বালিশ ছুঁড়ে মেরেছে। বলেছে আর যদি ওকে ঘুম থেকে ডাকতে যাই তাহলে আমার গলা
টিপে ধরবে।’ নীরা সোজাসাপ্টা উত্তর।

‘দেখেছেন?’ অভিযোগের সুরে বললেন নওশীন হক, ‘আপনার লাই পেয়ে পেয়ে মেয়েটার সর্বনাশ হচ্ছে। আমি এই মেয়েকে আর ঘরে রাখব না।’

‘তাহলে কোথায় রাখবে?’ মাহফুজ হক বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলেন।

‘হ্যাঁ, ফুফু। ঘরে না রাখলে তাকে রাখবে কোথায়?’ রাদিদও ফুফার সাথে যোগ দিল।

‘কোথাও রাখব না। পড়াশুনাতেও তো তার মনোযোগ নেই তাই ওর বিয়ে দিয়ে দিব। আমি শীঘ্রই ওর বিয়ের ব্যবস্থা করব।’ নওশীন হক তার স্বামীর দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘এই বিষয়ে আমি আর আপনার কথা শুনব না। মনে রাখবেন?’

‘ইয়ে! তাহলে তো বেশ হবে। আপুর বিয়ে তো অনেক মজা করব আমরা সবাই মিলে। ইয়ে।’ নীরা খুশিতে লাফিয়ে উঠল।

রাদিদ চুপ করে বসে ছিল। নীরা রাদিদের হাত ধরে বলল, ‘ভাইয়া! তোমরা সবাই আসবে কিন্তু । মামিকেও আনবে।’

মাহফুজ হক নীরকে ধমকে উঠলেন। বললেন, ‘সবসময় তোমার ফাজলামি। কোনো বিয়ে হবে না এখন। আমার মেয়ে পড়াশোনা শেষ করার আগে কোনো বিয়ে হবে না।’

আফরিন চোখ কচলাতে কচলাতে ডাইনিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে জড়ানো গলায় বলল, ‘এই সকাল বেলা তোমরা কার বিয়ের কথা বলছ?’

নীরা আগ্রহী গলায় বলল, ‘আপু! আম্মু বলছে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে।’

আফরিনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। তার চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেছে। ভূতগ্রস্তের মতো কতক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আব্বু! এসব কী শুনছি?’

মাহফুজ হক খুব ভালো করেই চিনেন নিজের মেয়েকে। তাই পরিস্থতি সামলাতে তিনি বললেন, ‘আরেহ্! না রে মা। আমরা তো রাদিদের বিয়ের কথা বলছি। আমার আম্মুকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।’

রাদিদ ভ্রু কুঁচকে কপালে ভাজ ফেলে বলল, ‘আমার বিয়ে মানে…?’

মাহফুজ হক রাদিদের কথা সম্পূর্ণ করতে দিলেন না। বললেন, ‘আচ্ছা, আফরু! তুমি কি দেখবে তোমার ভাইয়ের জন্য মেয়ে?’

আফরিন চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘নো ড্যাড! ওদের ফ্যামিলিতে কোনো মেয়ে থাকতে পারবে না! সো মাচ লো ক্লাস! তার উপর কেমন একটা ঘর। পুরো দম বন্ধ হবার জোগাড় হয়ে যায়।’

নওশীন হক তৎক্ষনাত ধমকে বললেন, ‘এসব কী কথা? দিন দিন এত অভদ্র হচ্ছ তুমি, আমি অবাক হচ্ছি কেবল। আর আমি মোটেই রাদিদের বিয়ের কথা বলছি না। আমি তোমার বিয়ের কথা বলছি। তুমি পড়াশুনাও করবে না তাহলে তোমাকে এখানে বসিয়ে রেখে তো লাভ নেই। স্বামীর ঘরে যখন যাবে তখন আপনা থেকেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন এই উগ্র চালচলনে কোনো কাজ হবে না।’

‘ড্যাড!’ আফরিন গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে বলল, ‘দেখলে তো মা সবসময় আমাকে বকে। আর আমি তোমার পছন্দে বিয়ে করব না। আমি আমার পছন্দে বিয়ে করব।’

রাদিদের এসব শুনতে খুবই খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছে একটা নীল রঙা কষ্টের দলা গলার ঠিক কাছটাতে আটকে আছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তাদের আর্থিক অবস্থা এতটাও খারাপ না যে কথায় কথায় এমন অপমান সহ্য করা লাগবে। তবে সে মনে মনে পরিকল্পনা করে রেখেছে নতুন আরেকটা বিজনেস করার। যার কারণেই এবার ঢাকায় আসা। একটা কম্পিউটারের দোকান শুরু করতে যাচ্ছে সে। স্থানীয় একটা সরকারি ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণও নিয়েছে সে। ফুফু বকা দেয় বলেই সে এখানে এসে উঠে। আর নীরা তো তাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। এই যেমন এখন তার আর এখানে থাকতে মন চাইছে না। তবুও সে যেতে পারবে না। কারণ এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একজনের কথা শুনতে তার খারাপ লাগলেও অন্য তিনজন মানুষ তো তাকে অনেক বেশিই ভালোবাসে। আর নীরা তো তার জান!

নীরা রাদিদের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারছে তার রাদিদ ভাইয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তাই সে বলল, ‘রাদু ভাইয়া! চলো তো আমার সাথে আমার রুমে। আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আমি কোন শাড়িটা পড়ব তা একটু বলে দাও। আমি একদম বুঝতে পারছি না।’

রাদিদ আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি শাড়ির কী বুঝি বল তো?’

‘তুমি সব বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকা মানুষ। আমি সব না বুঝলেও এটা খুব ভালো করে জানি।’ নীরা বিজ্ঞ মানুষের মতো করে বলল।

তারপর রাদিদকে টানতে টানতে নীরা নিজের রুমে নিয়ে গেল। নওশীন হক একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। তিনি এটা ভেবে খুশি হলেন যে নীরা পরিস্থিতি বুঝে রাদিদকে নিয়ে গেল। একটু হলেও বুঝে তার ছোট মেয়েটা অথচ বড়ো মেয়েটা বড্ড অবুঝ। দুই মেয়ে যেন চুম্বকের দুই বিপরীত মেরু!

__________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৮

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
শব্দসংখ্যা: ২২০৮
পর্ব-০৮

আজকের প্রেজেন্টেশন শেষ করতেই সমস্ত ক্লান্তি যেন পেয়ে বসেছে ছোঁয়াকে। তাই সে শপেও যায়নি। অফিস শেষে সোজা বাসায় চলে এসেছে। এসেই লং শাওয়ার নিল। শাওয়ার নেওয়ার পরেই বেশ রিল্যাক্সড ফিল করছে সে। কিচেনে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এসে বসল বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতেই আজকের দিনের সমস্ত ঘটনা তার মস্তিষ্ক ভিজ্যুয়ালাইজ করছে। ছোঁয়া চাইছে তার চিন্তার গাড়িটা থামাতে। কিন্তু সে ছুটে চলেছে নিজ গতিতে। থামবার নাম নেই। মোবাইলের তারস্বরে বাজার শব্দে সে সম্বিৎ ফিরে পেল। সাইফ কল করছে। ছোঁয়া নিজের মাথায় চাটি মারল। সে ভুলেই গিয়েছিল সাইফকে কল করার কথা। কলটা রিসিভ করতেই সাইফ তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘কই তুই? আমাকে তো এখন একেবারে তোর এমপ্লয়ি বানিয়ে ফেলেছিস।’

‘স্যরি দোস্ত! আমি ভুলে গিয়েছিলাম। খুব ক্লান্ত ছিলাম রে।’ ছোঁয়া অপরাধীর সুরে বলল।

‘কী এমন রাজকার্য সাধন করেছিস? বল তো। যার কারণে এত ক্লান্ত তুই।’ চেঁচিয়ে বলল, সাইফ।

‘দোস্ত বলছিলাম না আজ একটা প্রেজেন্টেশন ছিল তার উপর নতুন বস। সব মিলিয়ে একদম রুদ্ধশ্বাস অবস্থা ছিল।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এমনিতেই তো আমি উদার মানসিকতার তাই এবারের মতো মাফ করলাম।’ সাইফ শার্টের কলার উঁচিয়ে বলল ফোনের ওপাশে যদিও ছোঁয়া তা দেখতেই পেল না।

‘দোস্ত দিস ওয়াজ দ্যা লাস্ট টাইম।’ মিনমিনে কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘এরকম কত লাস্ট টাইম ছিল মনে আছে তোর?’

‘ওই একটু হয় আরকি। তুই তো আছিস আমার জিগরি দোস্ত। আমার বডি গার্ড।’

‘শেষমেশ বডি গার্ডের উপাধিটাও দিয়ে দিলি!’ সাইফ প্রাণবন্ত হেসে বলল।

‘না দিয়ে উপায় নেই রে। মা তো তোকে এমনিতেও সত্যিকারের বডিগার্ড বানিয়ে রেখেছে আমার জন্য।’ ছোঁয়া প্রশান্ত কণ্ঠে বলল।

‘খালামণি আসলে তোকে নিয়ে খুব চিন্তা করে। তাই আমাকে বডিগার্ড বানিয়ে দিয়েছে। তবে আমার কিন্তু এই দায়িত্ব পালন করতে বেশ লাগে। সুন্দরী রাজকন্যার বডিগার্ড হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু।’ সাইফ অবিচলিত কণ্ঠে বলল।

‘আবার শুরু করলি?’ ছোঁয়া বলল, অভিযোগের সুরে।

‘শুরু করার কি আছে? আমি তো সত্যি কথাই বলছি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। এবার ক্ষান্ত হও জনৈক সত্যবাদী মহাপুরুষ।’ ছোঁয়া বলল, দুষ্টুমির স্বরে।

‘কী ব্যাপার! আমাকে রেখেই দুই বন্ধুতে জম্পেশ আড্ডা চলছে? কী স্বার্থপর রে তোরা!’ মায়া বলল, কপট তিরস্কার করে।

মায়াকে দেখে ছোঁয়া সাইফকে বলল, ‘দোস্ত রাখছি। মায়ারানী বাসায় এসে গেছে। কাজ শেষে তুইও চলে আসিস।’ এটুকু বলেই ছোঁয়া কল কেটে দিল।

‘আচ্ছা, এবার বল। কী হয়েছে?’ মায়া ছোঁয়ার পাশে বসে জানতে চাইল।

‘আর বলিস না। আজ আমার শ্বাসরুদ্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল।’ ছোঁয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল।

‘কেন ? কী হয়েছে? জলদি বল। আমার শান্তি ভ্রষ্ট করিস না।’ মায়া বলল, ব্যস্ত ভঙ্গিতে ।

‘শোন, তোকে বলেছিলাম না আমার নতুন বসের কথা?’

‘হ্যাঁ বলেছিলি। কী করেছে সে? উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে তোকে?’ মায়া এক নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে বসল।

‘আরে থাম তো। এত প্রশ্ন একসাথে! আমি কি পালিয়ে যাব না-কি? ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেই তো পারিস।’

‘আচ্ছা, কী করেছে সেটা তো বল।’

‘কী করেছে না । কে সে সেটা জানিস?’

‘না বললে জানব কী করে?’

ছোঁয়া দম আটকে চোখ বন্ধ করে বলল, ‘হি ইজ নান আদার দ্যান শিহরণ।’

‘হোয়াট?’ মায়া চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘তুই সত্যি বলছিস।’

‘হুম। মিথ্যে বলব কেন? আমি তো তাকে দেখেই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি। আমার চারপাশটা থমকে গিয়েছিল। বহু কষ্টে প্রেজেন্টেশন কমপ্লিট করেছি।’

‘ওয়েট। তুই কি এখনো পছন্দ করিস শিহরণকে?’

‘পছন্দ? শিহরণকে?’ ছোঁয়াকে বিভ্রান্ত দেখাল।

‘পছন্দ করিস কি না বল।’ মায়ার একরোখা প্রশ্ন।

‘জানি না রে দোস্ত।’ ছোঁয়া হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি একদম বুঝতে পারছি না।’

‘তাহলে তুই অমন ফিল করছিলি কেন?’ মায়া ছোঁয়ার এক হাত চেপে ধরে জানতে চাইল।

‘হয়তো অনেকদিন পরে হঠাৎ দেখা হয়েছিল বলে।’ ছোঁয়া প্রসঙ্গ এড়াতে বলল।

‘যাইহোক তোর ব্যাপারটা বাদ দে। শিহরণের অভিব্যক্তি কেমন ছিল?’ মায়ার চোখে মুখে রাজ্যের কৌতূহল খেলল নিমিষেই।

‘এই ছেলেটাকে আমি একদম বুঝতে পারি না। আমাকে দেখার পর তার আলাদা কোনো অভিব্যক্তি আমার চোখে পড়েনি। তাছাড়া তার ভাবখানা এমন ছিল যে আমাকে দেখা তার জন্য এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।’

‘উঁহু! ব্যাপারটা হয়তো এমন যে, সে তোকে চিনতে পারেনি বা হয়তো তুই ওর জন্য বিশেষ কেউ না।’

‘হতে পারে। বাদ দে। সেও আমার জন্য বিশেষ কেউ না। হি ইজ জাস্ট মাই বস। দ্যাটস ইট।’

‘মায়া আপু! নাশতা খেয়ে তারপর গল্প করো। তোমাদের গল্পের তো শেষ নেই।’ হিয়া নাশতা নিয়ে এসে ডাকল মায়াকে।

হিয়ার ডাক শুনেই ছোঁয়া আর মায়া ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে রুমে এসে দেখল হিয়া টোস্ট, স্যান্ডউইচ আর চা নিয়ে এসেছে।

মায়া বলল, ‘তুমি আবার এসব করতে গেলে কেন আপু? আমি তো নাশতা সেরেই এসেছি।’

‘এই হালকা নাশতা খেলে তেমন কিছুই হবে না।’ হিয়া সহাস্যে বলল।

ছোঁয়া হিয়ার সাথে তার মিলিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছে হিয়া। এই হালকা নাশতা খেলে তোর স্লিম ফিগারের কোনো ক্ষতি হবে না।’

‘মায়া আপু! বিয়ে নিয়ে তো বেশ পরিকল্পনা করে ফেলেছ। কিন্তু তোমার উনার সাথে কবে পরিচয় করাবে?’

‘হিয়া! আমারই এখনো সৌভাগ্য হলো না তাকে দেখার। তোমাকে কীভাবে দেখাই বলো তো? অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলে যা হয় আরকি!’

ছোঁয়া আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলেই বেটার। পালিয়ে যাওয়ার ঝামেলা নেই। মান-অভিমান ভাঙানোর ঝামেলা নেই। কাউকে রাজী করানোর ঝামেলা নেই। সারাক্ষণ মোবাইলের পেছনে পড়ে থাকতে হয় না। লাভ ম্যারেজের বহু ঝামেলা । তার চাইতে বরং অ্যারেঞ্জই ঢের ভালো।’

‘ছোঁয়াপু! তুমি কি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করেবে?’

হিয়ার প্রশ্নে ছোঁয়া যেন একটু ভড়কে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘অবশ্যই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করব। দেখছিস না মা কেমন সার্চ লাইট নিয়ে আমার বর খুঁজতেছে।’

মায়া আর হিয়া হাসতে হাসতে সমস্বরে বলল, ‘তা একদম ঠিক বলেছিস।’

‘একবার পেয়ে গেলেই তোর গলায় ঝুলিয়ে দিবেন।’ মায়া টিপ্পনী কাটল।
___________________________

বৃষ্টিতে ভেজার কারণে রাদিদের জ্বর উঠেছে। নওশীন হক বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ জলপট্টি দিতে দিতে বকলেন। নীরাকে বললেন রাদিদকে জলপট্টি দিতে। তারপর তার জন্য স্যুপ রাঁধতে রান্নাঘরে গেলেন।

নীরা মুখে রাজ্যের বিরক্তি এনে অভিযোগের সুরে বলল ,’আমাদের নবীণবরণ অনুষ্ঠানের আগেই তোমাকে জ্বর বাঁধাতে হলো কেন শুনি?’

রাদিদ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি কি ইচ্ছে করে জ্বর বাঁধিয়েছি? জ্বর কি আসার আগে আমার পারমিশন নিয়েছিল?’

‘হয়েছে, তোমার জ্ঞানগর্ভ ভাষণ নিজের কাছেই রাখ। এমনিতে তো কঞ্জুসরাজা! কিন্তু জ্ঞান বিতরণের বেলায় একেবারে হাজী মুহাম্মদ মহসীন হয়ে যাও।’ নীরা চোখ মুখ কুঁচকে বলল।

‘হাজী মুহাম্মদ মহসীন হওয়া কি এত সোজা? উনার জীবনী পড়ে দেখিস তাহলে বুঝতে পারবি…।’ রাদিদের ভাঙা গলায় দেয়া পাল্টা জবাব মাঝপথেই থামিয়ে দিল নীরা।

সে প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমার এই মহান ব্যক্তির জীবনী পড়ার ইচ্ছে নেই। কারণ তুমি এত উদার একজন মানুষের জীবনে পড়েও কিপ্টেই থেকে গেলে! তাই আমি নিজেকে কিপ্টে বানাতে চাই না। এমনিতেই আমি তোমার চাইতে ঢের বেশি উদার মানসিকতার।’

রাদিদ প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না। চোখ বুজে রইল। নীরা জলপট্টি দিচ্ছে ক্রমাগত। আর
বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘সামান্য ট্রিট চাইলাম। তাতেই হাজী সাহেব আমাকে ধরিয়ে দিলেন শর্তের এক খসড়া!’

‘কিছু বলছিস?’ রাদিদ চোখ বুজেই প্রশ্ন করল।

‘না!’ টেনে টেনে বলল নীরা। তারপর আক্ষেপের সুরে বলল, ‘তোমাকে কিছু বলার সাধ্যি কি আমার আছে?’

‘সাধ্য নেই তারপরেও কতকিছু বিড়বিড় করে বলছিস। সাধ্য থাকলে যে কী হতো কে জানে!’ রাদিদের সোজাসাপ্টা উত্তর।

নওশীন হক স্যুপ নিয়ে আসলেন। কিন্তু রাদিদ খেতে চাইছে না। তিনি ধমকে উঠলেন। বললেন,’তোর এসব ধানাইপানাই আমার কাছে চলবে না। এসবকিছু তোর মায়ের জন্য রেখে দে। ভাবি তো বড়ো খোকা বলতেই অজ্ঞান।’

ফুফুর ধমক শুনে রাদিদ চুপসে গেল। উঠে বসার চেষ্টা করল। নীরা তাকে সাহায্য করল। খাটে হেলান দিয়ে বসতেই নওশীন হক আবার ধমকালেন। বললেন, ‘ছাতা নিয়ে গেলে তো বৃষ্টিতে ভিজতে হতো না। বৃষ্টি যখন এলোই ভিজার কী দরকার ছিল? এমন তো না যে বৃষ্টি আর থামতোই না।’

রাদিদ বৃদ্ধ দাদুর কথাটা চেপে গেল। ছাতাটাও বারান্দায় রেখে দিয়েছে। বললে ফুফু বরং খুশিই হবেন। কিন্তু রাদিদের বলতে ইচ্ছে করল না। মাঝেমধ্যে বকার মধ্যেও গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। একটু বুঝে নিতে হয়। যদিও রাদিদের ফুফুর ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটা প্রচ্ছন্ন নয় বরং প্রকট। তবুও যেসব ক্ষেত্রে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ প্রচ্ছন্ন সেসব ক্ষেত্রে অপরপক্ষের মানুষটিকে বুঝে নিতে হয় ভালোবাসার মানুষটির অব্যক্ত শব্দগুলো। রাদিদ জানে ফুফু তাকে অনেক বেশিই ভালোবাসেন। তাই এসব বকা শুনে তার মধ্যে এক প্রকার ভালোলাগা কাজ করছে।

নীরা তার মাকে বলল, ‘আম্মু! আমি মামিকে কল করে বলি যে রাদিদ ভাইয়ার জ্বর হয়েছে তাই এখানে আরও কয়েকদিন থাকবে।’

নওশীন হক বাধা দিয়ে বললেন, ‘কল করার দরকার নেই। এই জ্বর সেরে যাবে। এত চিন্তার কিছু নেই। খবর দিলে ভাবি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে আবারও অসুখ বাঁধাবে।’

রাদিদকে স্যুপটুকু খাইয়ে দিয়ে তিনি ওষুধ খাইয়ে দিলেন। তারপর আবার কঠিন গলায় বললেন, ‘তোর মাকে কিছু বলিস না। চিন্তা করবে। তারপর নিজেই অসুখ বাঁধাবে। তখন আবার তোরই দৌড়াদৌড়ি করা লাগবে। তোর ছোট ভাই আর বোনটা তো মানুষ হলো না। এদের দিয়ে হালের চাষও করা যাবে না।’

রাদিদ মৃদু স্বরে বলল, ‘ফুফু! মাকে আমি এমনিতেও বলতাম না। মাকে তো আমি চিনি।’

নওশীন হক চলে যাবার আগে রাদিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখন ঘুমিয়ে পড় বাবা।’

নীরা তাই দেখে মুখ ভেংচি কাটল। বিড়বিড় করে বলল, ‘সব আদর ভাইয়ের ছেলেকেই উজাড় করে দেয়। আমি যেন বানের জলে ভেসে আসছি! আমার বেলায় সবাই কিপ্টে!’

রাদিদ তাই দেখে মুচকি হাসল। কিছু বলার জোর নেই। চোখ বুজে রইল। নীরা আদুরে গলায় বলল, ‘ভাইয়া! তুমি আমার সাথে আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যাবে? প্লিজ, ভাইয়া প্লিজ।’ নীরা এই কথা বলে রাদিদের কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতেই থাকল।

রাদিদ আর সহ্য করতে না পেরে চোখ খুলল। নীরার আকুতিভরা চোখ-মুখ দেখে সে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। যাব।’

নীরা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘তোমাকে তো যেতেই হতো।’ তারপর ধীর পায়ে হেঁটে দরজার কাছে যেতেই মৃদু স্বরে স্বগোতক্তি করল, ‘আই হ্যাভ টু কমপ্লিট মাই মিশন বাই হুক অর বাই ক্রুক।’
________________________

অতল লাইব্রেরিতে আসতেই আয়মান ধরল ওকে। দুদিন ধরে কল করে না পাওয়াতে আজ আর কোনো রিস্ক নিল না সে। লাইব্রেরির গেইটের সামনেই পায়চারি করছিল সে। অতলের উপর রাগ করে আছে। প্রচণ্ড আক্রোশ ভরা কণ্ঠে বলল,’শালার ব্যাটা! তোরে কল করতে করতে মইরা গেলেও তোর কোনো খবর থাকে না।’

‘তুই মরবি আমার কেন খবর হবে? খবর তো হবে তোর।’ অতলের নির্বিকার উত্তর।

‘তোর মতো স্বার্থপর একজন মানুষ আমার বন্ধু!’ আয়মানের কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়। বিস্ময় ছাপিয়ে দুঃখ ভরা কণ্ঠে সে পুনরায় বলল, ‘ আমার ভাবতেই কষ্ট লাগতেছে যে তুই আমার বন্ধু। তোরে কত ক্যাঁচাল থেকে বাঁচাইলাম আর তুই আমার লগেই ভাব নিতাছস! সব কপাল আমার।’ শেষ কথাটা বলতে বলতে আয়মান কপাল চাপড়াল।

‘তোর কষ্ট লাগলে লাগুক। আমি এমনই। এমনই থাকব। ভালো মানুষির দাম নাই। তাই আমি ভালো মানুষ আর হতে চাই না।’ অতলের কণ্ঠে বিষাদ ঝরে পড়ছিল। কপালে ভাঁজ পড়ে গেল তার। চোখে খেলল এক অদ্ভুত রকমের দ্বন্দ্ব। কিন্তু মুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিল।

আয়মান নিজের রাগকে সংবরণ করে কোমল সুরে বলল, ‘দোস্ত! তোকে না আমি একদম বুঝতে পারি না। তোর চাইতেও আমার রুবিকিউবের পাজল মেলানো ঢের সহজ মনে হয়।’

‘তোরে নিষেধ করছে কে? যা গিয়ে রুবিকিউব মিলা গিয়ে।’ অতল তেজী গলায় বলতে বলতে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ল।

ব্যাগ থেকে এক এক করে সব বই আর খাতা বের করে পড়া শুরু করেছে সে। আয়মান ভ্যাবলাকান্তের মতো খানিকক্ষণ চেয়ে থাকল অতলের দিকে। মনে মনে ভাবল অতল আসলে ঠিক কোন দেশি পাজল! সে কোনোভাবেই মেলাতে পারে না কেন? তার চরিত্রের কোন দিকটা আসল আর কোন দিকটা নকল সেই বিষয়ে সে রীতিমতো দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। আর শুধু সেই বা কেন? বলতে গেলে তার বন্ধুদের মধ্যে কেউ অতলকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এসব ভাবতে ভাবতেই আয়মান বিড়বিড় করে বলল, ‘শালা! মুখোশধারী কোথাকার!’

অতল সেটা শুনে ফেলল। বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল, ‘আমি মুখোশধারী হলে তোর সমস্যা কোথায়? আমি কি তোর বাপের হোটেলে খাই? আমি আমার বাপের হোটেলে খাই । সো ডোন্ট কল মি দ্যাট এগেইন। গট ইট?’

আয়মান এবার একটু ভড়কে গেল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘দোস্ত, রিয়ানা তোকে খুঁজছিল? পুরো ক্যাম্পাস করেছে ব্যাপারটা।’

অতল প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ল। তার হাতে থাকা মোটাসোটা নতুন বিশ্বের বইটা টেবিলের উপর ধপাস করে রেখে বলল, ‘শালা! এতক্ষণ পরে বলছিস! আগে বলবি না?’

লাইব্রেরিতে এখনো তেমন কেউ আসেনি। কেবল একটা বোরখা পরিহিত মেয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল। এহেন বিকট আওয়াজ হওয়াতে আপাদমস্তক বোরখায় আবৃত মেয়েটা নেকাবের আড়াল থেকে একবার চোখ তুলে তাকাল অতলের দিকে। অতল তার দৃষ্টিকে একেবারেই অগ্রাহ্য করল। মেয়েটা যথেষ্ট বিব্রতবোধ করল এমন বিকট আওয়াজে। পড়াতে ব্যাঘাত ঘটাতে বিরক্ত বোধও করছে বোধহয়। তার চোখে অবশ্য তার দৃশ্যমান প্রকাশ ঘটেছে।

‘বলার জন্যই তো তোকে কল করেছিলাম দুইদিন ধরে। কিন্তু তুই তো চান্দের দেশে ছিলি। তাই বোধহয় রিসিভ করতে পারিস নাই।’ আয়মান এই সুযোগে খোঁচা মারতে ভুলল না।

‘আই নিড টু টক টু ইউ।’ অতল লাইব্রেরিতে রিয়ানাকে দেখে হকচকিয়ে গেল।

থতমত খেয়ে বলল, ‘তুমি এখানে কী করছ?’ পরক্ষণেই কণ্ঠে যথেষ্ট গাম্ভীর্য এনে বলল,’ আই টোল্ড ইউ দ্যাট ইটস্ ওভার।’

‘বাট আই ওয়ান্ট টু নোউ দ্যা রিজন। ইউ ক্যান্ট ডিচ মি উইদাউট এনি সলিড এরর।’

অতল তার বইখাতা গুছিয়ে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে পড়ল। একে একে ছাত্র, ছাত্রীরা প্রবেশ করছে লাইব্রেরিতে। তাই এখানে সিনক্রিয়েট হোক তা সে চায় না। আয়মান আর রিয়ানাও তার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো। বোরখা পরিহিত মেয়েটা ভ্রু কুঞ্চিত করে একবার তাদের যাওয়ার পানে দেখে আবার পড়াতে মনোনিবেশ করল।

লাইব্রেরি থেকে বেশ দূরত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অতিকায় বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অতল। সে ভাবতেও পারেনি মেয়েটা এভাবে লাইব্রেরিতে চলে আসবে!

কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। এত সিরিয়াস হওয়ার কী আছে অতল তা ভেবে পায় না! দ্যাট ওয়াজ অনলি টাইম পাস আফটার অল। রিয়ানা ভাঙা গলায় বলল,’ আই ওয়ান্ট ইউ টু…।

অতল তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বাম চোখের ভ্রু উঁচিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে বলল, ‘ইটস্ ওভার বিকজ আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ক্যারি অন দিস রিলেশন। গট ইট?’

রিয়ানার চোখ ছলছল করে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় সে বলল, ‘অতল! প্লিজ তুমি এমন করো না। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি তো জানো এটা।’

‘প্লিজ, স্টপ রাইট দেয়ার।’ অতল তার ডান হাতটা উপরে তুলে বলল, ‘আমি এসব শুনতে চাই না। আই হ্যাভ মাই নিউ গার্লেফ্রেন্ড । সো ইউ ক্যান চুজ এনাদার ওয়ান। ইউ আর ফ্রি ফর দ্যাট।’

রিয়ানা এবার সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলল। বলল,’ ইউ হ্যাভ টু পে ফর ইট।’

‘আ’ম কাইন্ড অফ রেডি ফর দ্যাট। সো ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু থিঙ্ক এবাউট ইট।’ রুষ্ট কণ্ঠে অতলের নির্বিকার উত্তর।

রিয়ানা ক্রোধে ফেটে পড়ল। কিন্তু ক্রোধকে সংবরণ করে কিছুই না বলে চোখে জল নিয়ে, বুকে পাহাড়সম কষ্ট নিয়ে চলে গেল। তার বন্ধুদের নিষেধ অমান্য করেই সে অতলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। এবার তার ফলাফল সে নিজের চোখেই দেখছে।

আয়মান থমথমে গলায় বলল, ‘দোস্ত! ডোন্ট ইউ হ্যাভ এনি মার্সি?’

অতল বিষাদ ভরা কণ্ঠে বলল, ‘নো। র্যাদার আই এনজয় ইট। ইট হেল্পস্ মি টু রিডিউস মাই পেইন।’

_________________________________