ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
1540

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৩

বিষণ্ণ চেহারায় হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। তার মনটা ভীষণরকমের খারাপ। চেহারায় এখনও কান্নার জলের শুকনো ছাপ স্পষ্ট। সে ভাবতে পারছে না কিছুই। রাতের অন্ধকারের মতো গাঢ় কালো অধ্যায়টা কি এসে হানা দিয়েছে তাদের জীবনে? সে তো ভেবেছিল সেই কৃষ্ণগহ্বরের ন্যায় তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়টা তাদের জীবন থেকে মুছে গেছে। তার মায়ের মুখে তো সবসময় হাসির রেখাই থাকার কথা, এতটা কাল ছিলও। তাই সে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু এখন সবকিছুই কেমন যেন ধোঁয়াটে লাগছে তার নিজের কাছে।

ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় কয়েকজন পথচারীর আনাগোনা এখনও চলছে নির্নিমেষ। কিন্তু ছোঁয়ার দৃষ্টিটা কেবল অসীমে গিয়ে মিশতে চাইছে।

‘এভাবে আর কতক্ষণ কিছু না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি তুই? গতকালও তেমন কিছুই খাসনি।’ প্রশ্ন করেই বিভ্রান্ত দেখাল মায়াকে। পরক্ষণেই ছোঁয়াকে আশ্বস্ত করতে বলল, ‘আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। দেখিস, আন্টির কিচ্ছু হবে না। অপারেশন তো ভালোমতোই শেষ হলো।’

ছোঁয়া কোনো জবাব দিল না। তার দৃষ্টি অসীমের কোনো এক অজানা বিন্দুতে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ভাবনাতে মাকড়সার জালের মতো নানান দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে গেল সে কিছুই বুঝতে পারছে না কোনোভাবেই! কে আঘাত করেছে তার মাকে সেই চিন্তাটা তার মাথাতে ধুম্রজালের মতো চারিদিকে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘কী হলো? কিছু বলছিস না কেন? হিয়ার অবস্থা দেখেছিস? মেয়েটাকে কাল জোর করে যা একটু কিছু খাইয়েছিস তুই। কিন্তু আজ তো সে কিচ্ছু মুখে দেয়নি। এখনও কান্না করেই যাচ্ছে।’ মায়া আবারও ছোঁয়াকে বুঝানোর এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল।

এবারও ছোঁয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলো না মায়া। তার কিছুটা রাগও হলো। এভাবে ভেঙে পড়লে কি চলে? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো মায়া। নরম গলায় বলল, ‘ এতটুকুতে ভেঙে পড়লে চলবে না ছোঁয়া। তোকে শক্ত হতে হবে।’

‘আমরা এইরকম দুর্বল ছোঁয়াকে তো চিনি না। আমরা যে ছোঁয়াকে চিনি সে তো খুব স্ট্রং।’ সাইফ বলল, দৃঢ় কণ্ঠে।

মায়া সাইফের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছিস। এই বিধ্বস্ত ছোঁয়াকে আমি নিজেই চিনতে পারছি না।’

‘প্লিজ, ছোঁয়া! বি স্ট্রং।’ সাইফ বলল, অনুনয়ের সুরে।

মায়া ছোঁয়ার কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আমরা সবাই তো আমি তোর সাথে। ভয় কিসের? আমরা একসাথে সবাই মিলে সবটা সামলে নিব।’

এবার করুণ দৃষ্টিতে তাকাল ছোঁয়া। তার চাহনি দেখে আঁতকে উঠল মায়া আর সাইফ দুজনেই।

মায়া সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল,’তুই যা ভাবছিস তা নাও হতে পারে। হয়তো কোনো চোর ছিল। আন্টি দেখে ফেলার কারণে পেছন থেকে আঘাত করে পালিয়ে গেছে।’

সাইফ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘চোর হবার সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ তখন বাসায় কেউই থাকার কথা ছিল না। আর এই খবরটা হয়তো কোনো না কোনোভাবে বাইরে থেকে জানাজানি হয়েছিল। আন্টির কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হওয়াতে তিনি বাসায় চলে আসলেন। হিয়া এসেই তো প্রথম দেখল। তারপর তোকে কল করার পরে আমাকে জানাল।’

মায়া মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘শিহরণ আমাকে কল না করলে তো আমি জানতেই পারতাম না।’

সাইফ বলল, ‘শিহরণ কে?’

মায়া আঁতকে উঠল। একটা ছোটোখাটো ভুল করে ফেলেছে সে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আমাদের পুরনো বন্ধু। তুই চিনবি না।’

_____________

শিহরণ হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে খোলা জায়গায় পায়চারি করছিল। তার ভেতরে এক অদ্ভুত রকমের অশান্তির কাঁটা বিঁধছে। ছোঁয়াকে নিয়ে যেদিন আশ্রমে গেল সেদিন তারা মোটামুটি সব কাজ সবাইকে বুঝিয়ে দেবার পরে সন্ধ্যার দিকে ছোঁয়ার নাম্বারে কলটা এলো। কলটা কাটার পরপরই মারাত্মক কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটা। হাঁউ মাউ করে কেঁদেছিল সে। কান্নার দমকে কাঁপছিল মেয়েটা। তার কথা পর্যন্ত শিহরণ বুঝতে পারেনি প্রথমে। ছোঁয়ার এরকম বিধ্বস্ত অবস্থা সে আগে কখনও দেখেনি। শিহরণ অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর কেঁদে কেঁদে কেবল বাসায় যাবে বলেছিল। ঘটনা কী ঘটেছে তা বুঝতে না পারলেও শিহরণ এক মুহূর্তও কালক্ষেপণ করেনি। ছোঁয়াকে নিয়ে সোজা ছোঁয়ার বাসায় চলে এলো। ছোঁয়াকে একা ছাড়তে মন চাইল না তার । তাই তার পিছন পিছন সেও ছোঁয়াদের ঘরে ঢুকল। ঢুকতেই কান্নার শব্দ কানে এলো। ছোঁয়া সোজা ফাহমিদা বেগমের রুমে চলে গেল। পুরো ফ্লোরে রক্ত আর রক্ত। পুরো মেঝে লাল হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, কেউ পেছন থেকে ভারী কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। কিন্তু যেটা দিয়ে আঘাত করেছে সেটা কোথাও দেখতে পেল না শিহরণ। ঘরের জিনিস ছড়ানো ছিটানো। তবে তার মুখোমুখি অর্থাৎ ঘরের জানালাটার গ্রিল কাটা। অর্থাৎ যেই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে সে আচমকা কাজটি করেনি বরং পরিকল্পনা করেই আক্রমণ করেছে। প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে আঘাত করেছে মহিলাকে।

হিয়া আর অহনা তখন কান্না করছিল। ফাহমিদা বেগমের চেতনাহীন দেহ পড়ে আছে ফ্লোরের উপর। ছোঁয়াও তার মাকে জড়িয়ে ধরে হাঁউ মাউ করে কাঁদছে। শিহরণ পাশে বসে নার্ভ চেক করে দেখল, তিনি এখনও জীবিত আছেন। তাই আর কোনো প্রকার বিলম্ব না করেই ফাহমিদা বেগমকে হাসপাতালে নিয়ে এলো।

শিহরণ নিজ দায়িত্বে তাকে এডমিট করাল। তারপর হাসপাতালের সমস্ত ফর্মাল কাজ শেষ করে অপেক্ষা করছিল সে। কিন্তু ছোঁয়া তাকে চলে যেতে বলাতে তার অভিমান হয়েছিল। তাই কোনো প্রকার বাক্যব্যয় না করেই সে বেরিয়ে এসেছিল। তবে মায়াকে কল করে হাসপাতালে যেতে বলার কথা ভুলেনি সে। বাসায় এসেও শান্তি পাচ্ছিল না সে। পুরো একটা দিন অশান্তিতে কাটাল সে। সর্বক্ষণ কল করে খবর নিয়েছে মায়ার কাছ থেকে।

অফিসে গিয়েও কাজে মন দিতে পারেনি সে। ছোঁয়াকে অবশ্য সেই ছুটি দিয়েছে। অফিস শেষে বাসায় গিয়ে আবারও হাসপাতালে এসেছিল সে। ডাক্তারের কাছ থেকেও খবর নিয়েছে। ভদ্রমহিলার অবস্থা খুব একটা ভালো না। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে। অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি ভদ্রমহিলার।

তাই আজকে বিষণ্ণ মনে হাসপাতালের কাছাকাছি জায়গায় পায়চারি করছিল শিহরণ। এখান থেকে সে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে। বিষণ্ণ ধূসর চোখ জোড়া তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। মোবাইলটা বেজে উঠতেই সে তাড়াতাড়ি রিসিভ করল।

‘আমি ওকে বুঝাতে পারছি না শিহরণ, এখন পর্যন্ত ওকে কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। অনেক বুঝিয়েও কোনো কূল করতে পারলাম না। আমার মনে হয় তোমার এখানে থাকা দরকার।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মায়া।

‘আমি এক্ষুণি আসছি, মায়া।’ উত্তেজিত গলায় বলল, শিহরণ।

শিহরণ আসার সময় সবার জন্য খাবারের প্যাকেট আর পানি নিয়ে আসল। মায়ার সাথে দেখা হতেই খাবারের প্যাকেট ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘এগুলো অহনা আর হিয়াকে দাও। আর হ্যাঁ, তুমিও খাবে। আমি প্রিয়তাকে দেখছি।’

মায়া মৃদু হাসার চেষ্টা করল। ছোঁয়া তখনও উদাস নয়নে রাতের শহর দেখছিল। শিহরণ পেছন থেকেই বলল, ‘প্রিয়তার কি খুব মন খারাপ?’

কাঙ্ক্ষিত মানুষটার কণ্ঠ শুনে ছোঁয়া চকিতে তাকাল তার দিকে। কিন্তু কিছুই বলল না। শিহরণ এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’এত সামান্যতে হেরে যাওয়ার মতো কি কিছু হয়েছে?’

ছোঁয়া স্থির দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকল শিহরণের দিকে। পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আবার কেন এসেছ?’

শিহরণ এই কথার জবাবে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আমার ইচ্ছে। আমার ইচ্ছের উপর কারও কোনো জোর নেই।’

তারপর ছোঁয়ার হাত ধরে পাশের বেঞ্চটাতে জোর করেই বসাল। ছোঁয়া শিহরণের এমন কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেল মুহূর্তেই। শিহরণ খাবারের প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খাবার খেয়ে নাও। আজ সারাদিন না-কি কিছুই খাওনি?’

‘তুমি এখানে কি করছ? তোমাকে না যেতে বলেছিলাম?’

‘আমি এখানে যাই করি না কেন তোমার জানার কোনো প্রয়োজন নেই। যা বলছি তা করো।’ তিরিক্ষি মেজাজে বলল, শিহরণ। পরক্ষণেই নিজের কণ্ঠের কাঠিন্যতা দূর করে নরম গলায় বলল, ‘আমাকে যেতে বলেছিলে বিধায় আমি চলেও গিয়েছিলাম কিন্তু তোমার অবুঝের মতো আচরণের কারণে আমাকে আসতে হলো।’

‘আমি খাব না এখন। আমার মায়ের অপারেশন হয়েছে। মায়ের অবস্থা ভালো না। আর তুমি আমাকে খেতে বলছ?’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ছোঁয়া।

‘হুম, বলছি। কারণ আন্টি যদি জানেন তবে তিনি বেশি রাগ করবেন। আর আন্টি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবেন। এই ব্যাপারে আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি।’ ছোঁয়াকে ভরসা দিয়ে বলল, শিহরণ।

‘তুমি কীভাবে জানো? মায়ের মাথায় কতটা আঘাত পেয়েছে দেখেছ? কত রক্ত বেরিয়েছে দেখেছ তুমি?’ এবার কেঁদে ফেলল ছোঁয়া। তাকে দেখে ভীষণ করুণ লাগছে।

‘আমি দেখেছি। তুমি কি ভুলে গেছ, কাল রাতে আমি এখানেই, তোমার সাথেই ছিলাম। আজ সকালে গিয়ে পুলিশ কমপ্লেইনও করে আসলাম।’

ছোঁয়া এ কথার উত্তরে কিছু বলল না। মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। শিহরণ এবার না পারতে খাবারের প্যাকেট খুলে নিজেই খাবার তুলে ধরল ছোঁয়ার সামনে। ছোঁয়া মুখ ফিরিয়ে নিলো।

‘এসব বাহানা একদম চলবে না, প্রিয়তা। খেতে বলছি খাও । ডাক্তারের সাথে এই তো একটু আগেই কথা বলেছি আমি, তিনি বললেন আন্টি তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন। তুমি আগে খাও। তারপর তোমার সাথে কথা বলব আমি।’

‘হিয়া, অহনা, মায়া, সাইফ ওরা খেয়েছে?’

‘হুম।’ শিহরণ ছোট্ট করে বলল। তারপর বিজ্ঞের মতো করে বলল, ‘তুমি যদি না খাও আন্টি কিন্তু ভীষণ বকবে। বকা খেতে চাও?’

বাচ্চাদের মতো করে ছোঁয়া মাথা নাড়ল। তারপর কী মনে করে শিহরণের হাত থেকে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে চুপচাপ খেতে শুরু করল। শিহরণ অভিমানী গলায় বলল, ‘আমার হাত থেকে খেতেও তোমার আপত্তি। তাই না?’

‘হুম।’

‘কেন?’

‘কারণ নেই।’

‘অবশ্যই আছে।’

‘সবকিছুতে কারণ থাকে না ।’

‘অবশ্যই থকে। আর সেটা না বললেও আমি বুঝতে পারছি।’

‘কি বুঝতে পারছ?’

‘তুমি লজ্জা পাচ্ছ। এটাই কারণ।’

‘একদম না।’

‘একদম।’

‘তুমি খেয়েছ?’

‘আমার চিন্তা কি কেউ করে নাকি?’

‘তোমার কি আর আমার জীবনের মতো কোনো দুশ্চিন্তা আছে?’

‘থাকতে পারে না?’

‘না।’

‘কেন?’

‘দেখি না তো কোনো কারণ।’ খেতে খেতে ছোঁয়ার নাকে মুখে খাবার উঠে গেল।

‘আস্তে খাও। ট্রেন ধরতে হবে নাকি?’ শিহরণ পানি এগিয়ে দিল তার দিকে। ছোঁয়া ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পানিটা খেল।

‘তুমি খেয়েছ কি না বললে না তো?’

‘খাইনি বললে কি আর তুমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবে?’

ছোঁয়া অদ্ভুতভাবে তাকাল তার দিকে। কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর খাবার এগিয়ে দিলো তার দিকে। শিহরণের চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তির ঝলক দেখা দিল। খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠল। যা ছোঁয়ার চোখ এড়াল না।

‘এখন কি এভাবেই তাকিয়ে থাকবে? খাবে না?’

শিহরণ খাবারটা মুখে নিল। বলল, ‘আমার জীবনে তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া খাবারের মধ্যে এই খাবারটাও নাম লিখিয়ে নিলো।’

‘মিথ্যে বলা তুমিও শিখেছ।’

‘মিথ্যে মনে হলো কেন?’

‘মিথ্যে বলছ তাই।’

‘তাহলে মিথ্যেই ধরে নাও।’

‘ধরব কেন? মিথ্যেই তো বললে।’

শিহরণ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। তার ঠোঁটে হাসির রেখা। মায়া আর সাইফ দুজনেই দেখল এই দৃশ্যটা।অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সাইফের মনে হঠাৎ একটি প্রশ্নের উদয় হলো, ‘ছোঁয়া আর শিহরণের চোখ কি অশ্রুতে চকচক করছে? না-কি অন্যকিছু?’

_____________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৪

ফাহমিদা বেগম এখন কিছুটা সুস্থ। আশঙ্কা অনেকটাই কেটে গেছে। তবে হাসপাতালে আরও কিছুদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। তাই ডিসচার্জ করা হয়নি।
তবে তিনি এখনও তেমন কিছু খেতে পারছেন না। তরল জাতীয় খাবারই এখন একমাত্র ভরসা। তাও ছোঁয়া অনেকটা জোর করেই খাবার খাওয়ায়। প্রতিদিন মায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদের খাবার নিজ হাতে তৈরী করে আনে মেয়েটা। অথচ ফাহমিদা বেগম খেতে পারেই সামান্যই। বাকিটা অহনা, হিয়া, সাইফরা মিলে গাপুসগুপুস করে খেয়ে সাবাড় করে ফেলে। সাইফ তো সেদিন বলেই ফেলল, ‘তোর হাতের রান্না এতো মজা। মাঝেমধ্যে আমাদের উপর দয়া পরবশ হয়ে হলেও তো রাঁধতে পারিস।’

সাইফের কথা শুনে অহনা মুখে ভেংচি কাটল। মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘আমার হাতের রান্না কিন্তু এর থেকেও বেশি সুস্বাদু, সাইফ ভাইয়া। মনে নেই তোমাকে সেবার পায়েশ খেতে দিয়েছিলাম।’

সাইফ তখন মজার ছলে বলেই ফেলল, ‘গোয়ালার গরুর দুধ কি সে কভু খারাপ বলে?’ চোখে মুখে তীব্র কষ্টের ছাপ এনে আবার বলল, ‘সেই পায়েশের কথা বোধহয় এই জনমে ভুলব নারে অহন! বাথরুমের সাথে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরী হয়েছিল। এটা কি ভুলার মতো কিছু?’ সাইফের কথা শুনে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। তবে ছোঁয়া তখন প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, ‘এটা যে হাসপাতাল সেটা কি ভুলে গেছিস, সাইফ?’

সাইফ ইনোসেন্ট ভাব ধরে রেখেই বলেছিল,’আমি তো পিঁপড়ের বাচ্চার মতো করে কথা বললাম। আর তুই হাতির বাচ্চার অপবাদ দিচ্ছিস। এটা তো ভারি অন্যায় এই অধমের প্রতি।’

‘আবার মজা করছিস! এটা কি মজা করার জায়গা?’
ছোঁয়ার চোখে যেন প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা দেখতে পেল সাইফ। তাই চুপ করে গেল মুহূর্তেই।

মুখে অসহায় ভাব এনে বলল, ‘আচ্ছা, দোস্ত! আজকের মতো মাফ করে দে।’

ছোঁয়া কিছু বলল না। বুকের উপর দু’হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তাই অপারগ সাইফ, কুঞ্চিত ভ্রু আর মুখাবয়বে দুঃখী দুঃখী ভাব এনে তাকাল মায়ার দিকে। মায়া তখন কপট দুঃখিত হবার ভান করে বলল, ‘এই ব্যাপারে আমি অধমের জন্য কিছুই করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত । তবে সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগানো হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হলো ।’

সাইফ তা শুনে খুশিতে বাক বাকুম হয়ে বলল, ‘দ্যা মোস্ট কিউট অ্যান্ড সুইট মায়া। এত্ত সুইট যে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’

‘বাছাধন! অতিরঞ্জন অনাবশ্যক ও বিধ্বংসী।’ টেনে টেনে সাবধানী গলায় বলল, মায়া।

ছোঁয়া মায়ের হাত ধরে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর হাতে চুমো খাচ্ছে। চোখে স্পষ্ট জল। যাতে না ঘুমানোর কারণে চোখের নিচে কালি পড়েছে। ফাহমিদা বেগম চোখ খুলতেই ছোঁয়া বলল, ‘এখন কেমন লাগছে মা?’ ফাহমিদা বেগম কাতর নয়নে তাকালেন ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়া মায়ের উত্তরের অপেক্ষা না করেই পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে, মা। আমি নিজে তোমার দেখাশোনা করব। দেখো, তোমার একটুও কষ্ট হতে দিব না।’

মায়া তখন ওর পাশেই বসে ছিল। সে মনে মনে ভাবছে, ‘সৎ মাকেও এরকম গভীরভাবে কেউ কি ভালোবাসতে পারে!’ পরক্ষণেই মনে এলো, ‘ছোঁয়ার মতো মেয়ে সব পারে। এদের মতো মেয়েদের আপন করে নেবার ক্ষমতা খুব বেশি।’

কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ ইন্টারোগেশন করতে এসেছিল। কিন্তু তেমন কোনো তথ্য জানতে পারেনি। ফাহমিদা বেগম খুব একটা কথা বলতে পারছেন না। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাবার কারণে ডাক্তার তাকে প্রেশার দিতে নিষেধ করেছেন। তারপরেও পুলিশ একটু আধটু প্রশ্ন করেছে। তবে তেমন কোনো তথ্য জানতে পারেননি। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে আক্রমণকারীকে ফাহমিদা বেগম দেখতে চিনতে পারেননি। যদিও মুখ ঢাকা ছিল না। কিন্তু পেছন থেকে হামলা করার কারণে ফাহমিদা বেগম প্রচণ্ডভাবে আঘাত পাবার কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। যার কারণে তিনি প্রায় সাথে সাথেই সেন্সলেস হয়ে যান। তাই ঝাপসাভাবে লোকটার চেহারা দেখতে পারলেও চিনতে পারেননি।

বাকিটা খুঁজে বের করা পুলিশের কাজ। যদিও কোনো প্রকার এভিডেন্সও খুঁজে পায়নি তারা। তবুও অপরাধী কিছু না কিছু ক্লু নিশ্চয়ই রেখে গেছে, সেখান থেকেই তারা খুঁজে বের করবে।

ওই সময়টাতে বাসায়ও কেউ ছিল না। আততায়ীর কাছে এই তথ্যটা ছিল এই বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত। কেউ না থাকার কারণেই নিজের কাজ আদায় করেই জানালা দিয়ে খুব সহজেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্য কী ছিল তার? এটা কোনোভাবেই কেউ অনুমান করতে পারল না। কারণ বাসার কোনো জিনিস লুটপাটের মতো কিছুই চোখে পড়েনি। ভিক্টিম সুস্থ হলেই বোঝা যাবে পুরো ঘটনা।

_________________________

বাসায় যেতে মন চাইছে না অতলের। আজ সকালেও এক প্রস্থ বকাঝকা শুনেছে বাবার কাছ থেকে। সে ভেবে পায় না, তার বাবা তাকে এত বকাঝকা করে কেন? তার দোষটা কী? এখন তো তার বকা খাওয়ার বয়স নেই। সে নিজের ভালোমন্দ নিজেই বুঝতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারপরেও বাবার ইচ্ছার কাছে সে তার নিজের ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়েছে। প্রকোশলী হবার সুপ্ত প্রগাঢ় বাসনা ছিল তার। বাবার ইচ্ছে তাকে একজন গেজেটেড কর্মকর্তা হতে হবে। তাই সে বাবার ইচ্ছের জন্য মুহূর্তেই নিজের স্বপ্নের কথা ভুলে গেল। তারপরেও কেন বাবা এমন করে সে ভেবে পায় না? মাঝেমধ্যে তার মনে প্রশ্ন জাগে, সে কি আদৌ তার বাবা-মায়ের সন্তান না-কি তাকে কুড়িয়ে পেয়েছে? কই আতিক ভাইকে তো বাবা তার মতো ঝাড়ির উপর রাখে না। তানিয়াকে বকা দেয় না বাবা। কেবল তাকেই সমস্ত ঝাড়ি খেতে হয়। মাঝেমধ্যেই সে অতিষ্ট হয়ে পড়ে এসব কারণে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সামলে নেয় নিজেকে। কারণ তার মা তো তাকে ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের জন্য সে সবটা করতে পারে, সবটা সহ্যও করতে পারে। মন খুব খারাপ থাকার কারণে আজ পড়াতেই মন বসেনি তার। লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। সাথে আছে তার নিত্যসঙ্গী আয়মান।

আয়মানকে চলে যেতে বললেও সে যেতে রাজী হয়নি। তার সাথেই আছে। পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করছে।আয়মানের মাথাতে এখনও বহ্নি টপিক আছে। অতলকে বুঝাতে চায় সে, যে মেয়েটা তাকে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু সাহস যুগিয়ে উঠতে পারছে না। কেমন চণ্ডাল রাগ তার বন্ধুর তা তার থেকে ভালো কেউ তো আর জানে না। তাই বন্ধুর উদ্দেশ্যহীন হাঁটাতে সেও সঙ্গী হলো।

অণেকক্ষণ যাবৎ হাঁটার পর একটা পার্কের কাছাকাছি আসতেই অতল থমকে দাঁড়াল। আয়মান বলল, ‘এখানে রাত যাপনের উদ্দেশ্য আছে না-কি?’

আয়মানকে অবাক করে দিয়ে অতল বলল, ‘হুম। আজকে বাসায় যেতে মন চাইছে না। তুই চলে যা। এর পরের রাস্তা কেবল আমার একার।’

অতল পার্কের ভেতরে ঢুকে পড়ল। একটা বেঞ্চে বসে দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল। রাত বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করল আয়মানের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর,’তোর কি মন খারাপ?’

অতল তাকাল না। আরও জোরে মাথাটা চেপে ধরল। আয়মান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,’মাথা ব্যথা করছে? একটু আগেই তো ফার্মেসির ওদিক দিয়ে হেঁটে আসলাম তখন বললেই তো ওষুধ নিতে পারতাম।’

‘তুই চুপ করবি?’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল অতল, ‘আমাকে একটু একা থাকতে দে তো। আমার কাউকে সহ্য হচ্ছে না। কাউকে না।’ কাঁধের ব্যাগটা একটানে ফেলে দিলো সে। তারপর চাপা স্বরে আর্তনাদ করে বলল, ‘আমাকে কেউ ভালোবাসে না। কেউ না। আমার বাবাও ভালোবাসে না। আমার ভাইও ভালোবাসে না। আমি ভীষণ একা। ভেতরে শূন্য কোনো এক ধূ ধূ প্রান্তর।’

আয়মান অতলের এসব কথা শুনে আঁতকে উঠল। ভেতরে ভেতরে সে নিজেও চাপা কষ্ট অনুভব করছে। তার বন্ধু অতল এতটা মানসিক কষ্টে আছে! তা সে কখনও ভাবতেই পারেনি। তার ভেতরে এতটা চাপা কষ্ট আছে! কখনোই আয়মান কল্পনা করেনি।

আয়মান অতলের কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে বলল, ‘প্লিজ, দোস্ত শান্ত হ। এভাবে ভাবছিস কেন? আন্টি তোকে ভালোবাসে, তানিয়া তোকে ভালোবাসে। এই যে আমিও তোকে ভালোবাসি।’ অতল মাথা তুলে তাকাল আয়মানের দিকে। হঠাৎ আয়মান মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘বহ্নি নামের মেয়েটাও তো তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে দোস্ত।’

কথাটা বলেই আয়মান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। আড়চোখে অতলের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু অতলের মুখটা ভাবলেশহীন। আয়মান মনে মনে বলল, ‘যাক বাবা! বাঁচা গেল। খেয়াল করেনি।’

মনের ভেতরে আরও কিছটা সাহস সঞ্চয় করে আয়মান পুনরায় বলল, ‘এটা তোর ভুল ধারণা যে আঙ্কেল তোকে ভালোবাসে না। আঙ্কেল হয়তো উপরে উপরে একটু কঠোর কিন্তু ভেতরে ভেতরে তোকে নিশ্চয়ই ভালোবাসে।’

‘না!’ অতল আবারও চিৎকার করে উঠল, ‘ভালোবাসে না। জানিস বাবা আমাকে কী বলে?’ ছলছল চোখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল অতল।

আয়মান এই দৃষ্টি চিনে না। এমনভাবে অতলকে সে কখনো দেখেনি। আয়মান কোনোরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কী বলে?’

বাবা বলে,’আমি নাকি আমার মায়ের মতো হয়েছি। আমি না-কি তার পরিবারের জন্য একটা ব্যাধি।’ একটা চাপা গোঙানির শব্দ বের হয়ে আসল অতলের গলা থেকে।

‘ব্যাধি বলেছে তোকে?’ আয়মান চমকে উঠল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আরে রাগের মাথায় বলা কথার কোনো গুরুত্ব আছে না-কি?’

অতল প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ আগে ফেলে দেওয়া ব্যাগটা ঝেড়ে কাঁধে তুলে নিল। হিম শীতল গলায় বলল, ‘বাসায় যা এখন। আমিও যাচ্ছি। মা টেনশন করবে। না খেয়েই অপেক্ষা করছে।’

আয়মান কিছু না বলাটাই ঠিক মনে করল। ছোট্ট করে বলল, ‘ওকে।’ দুজন বিপরীত দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আয়মানের মাথায় রাজ্যের প্রশ্ন ও বিস্ময়। তার পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন আর বিস্ময়বোধক চিহ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে। বুকের ভেতর চিনচিন করে একটা সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করল সে। এই ব্যথা তার প্রাণের বন্ধু অতলের অসহায়ত্ব দেখে হচ্ছে না বরং তার প্রাণের বন্ধুর সব কষ্টের ভাগীদার হতে না পারার কষ্ট। অতল যে সব কথা বলে না, তা তো আর তার নিকট অজানা নয়। উপর থেকে সবকিছু ঠিক দেখানো অতল ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া এক মানুষ।

হেঁটে কিছুদূর যাবার পর আয়মান আবার দৌড়ে এসে অতলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কণ্ঠে মনের সমস্ত জোর ঢেলে দিয়ে বলল, ‘এই আয়মানকে তুই সবসময় পাশে পাবি।’ কথাটা বলার সময় আয়মানের চোখ জোড়া ক্ষণিকের তরে চকচক করে উঠল।

_______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৫

দীর্ঘ অসুস্থতা শেষে ফাইজা বেগম হাত পা ঝেড়ে কাজে লেগে পড়েছেন। সকাল সকাল আবিরকে ঘুম থেকে জোর করে তুলে বাজারে পাঠালেন বাজারের একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে। আজ তিনি তার বড়ো খোকার পছন্দের খাবার নিজ হাতে তৈরী করবেন বলেছেন। আজ যে একটা বিশেষ দিন। সেটা সবাই ভুলে গেলেও তিনি ভুলে যাননি।

নীলা পইপই করে বলল, ‘মা! এখনও তোমার শরীর পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। তুমি বিশ্রাম করো। কী খাবার রাঁধবে বলো আমি বানাচ্ছি।’

ফাইজা বেগম প্রশস্ত হেসে বললেন, ‘আমার খোকা চলে এসেছে, এখন আমার আর কোনো অসুখ নেই।’ বাচ্চাদের মতো হাত-পা খানিক নাড়িয়েও দেখালেন সুস্থতার প্রমাণ হিসেবে।

নীলা না পারতে তখন বলল,’আমি তাহলে ভাইকে কল করে বলছি যে তুমি রান্নাঘরে ঢুকেছ।’ পরক্ষণেই চিন্তিত সুরে বলল, ‘রান্নাঘরে কী পরিমাণ গরম! এত গরমে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে তো মা। তখন তোমার বড়ো খোকা নিজেই বকবে।’

‘তোর ভাইকে কে ডরায় বল তো?’ চোখ রাঙিয়ে পরক্ষণেই বললেন, ‘খবরদার! বড়ো খোকাকে কিছু বলতে যাবি না।’

নীলা তখন হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো পরাস্ত ভঙ্গিতে মায়ের কাছে এসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিচ্ছু বলব না। এবার তো বলো কি কি রাঁধবে? আমি তোমাকে সাহায্য তো করতে পারি । তাই না?’

‘আজকে আমার কারও সাহায্য লাগবে না। আমি কি রান্না ভুলে গেছি ভেবেছিস? এখনও আমার বড়ো খোকা আমার রান্না সব থেকে বেশি ভালোবাসে। তুই গিয়ে পিউ কি করছে দেখ। আর সাবরিনা কি এখনও ঘুম থেকে উঠেনি? ওকে ডেকে তোল।’ ব্যস্ত গলায় বললেন, ফাইজা বেগম।

‘আচ্ছা, সব শুনব। এবার তো বলো কি কি রাঁধবে?’ নীলার যেন খুব কৌতূহল হচ্ছে।

‘ইলিশ পোলাও আর ডিমের কোর্মা করব। বড়ো খোকার খুব পছন্দের জানিস তো। কতোদিন ছেলেটা এই পছন্দের খাবারটা খেতে পারে না।’ ফাইজা বেগম ব্যথিত কণ্ঠে বললেন। বলার সময় তার কণ্ঠটা যেন কেঁপে উঠল ক্ষণিকের জন্য, নীলা তা বেশ টের পেল।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রাত দিন খাটে তার ভাইটা। এতে করে যে টাকা আসে তাতে তাদের এসব নিত্য খাওয়া কোনো দুঃস্বাধ্য ব্যাপার নয়। কিন্তু বাবার অসুখের সময় করা ধার-দেনা শোধ করতে করতে তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় । বিশেষ করে তার ভাইটার। কী রকম কষ্ট করে বাবার রেখে যাওয়া সামান্য সঞ্চয় থেকে এই ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে তা তার নিজের চোখে দেখা। এসব ভুলে যাবার মতো কিছু না। তার উড়নচণ্ডী ভাইটা বাবার মৃত্যুতে একদম পাল্টে গেল। তার চিন্তা-চেতনার জগতে এক বিশাল পরিবর্তন চলে এসেছে। যেই ছেলেকে ঠিক করার জন্য তার বাবার রাতের ঘুম হতো না, সেই ছেলেটা বাবার অসুস্থতার কারণে পুরোই পরিবর্তন হয়ে গেছে । যা অভাবনীয়, অকল্পনীয় তাদের সবার জন্য। রাদিদের পরিবর্তিত রূপ দেখে নীলা এখনও আবাক হয়ে যায়। যেই ছেলেটার সবকিছুতেই অভিযোগ ছিল, আজ সবকিছুই তার অথচ তার নেই কোনো অভিযোগ, নেই কোনোকিছুতেই কোনো ভ্রুক্ষেপ। তবে পরিবর্তিত রাদিদই নীলার পছন্দের। মায়ের আদরের বড়ো খোকা আর তার ছোট্ট ভাইটা কবে যে এতটা বড়ো হয়ে গেল, তা কেউ খেয়াল না করলেও নীলা খেয়াল করেছে তার ছোট ভাইয়ের প্রতিটা পরিবর্তন।

‘কী ব্যাপার! এখনও কি দাঁড়িয়ে থাকবি? তোকে কি করতে বললাম?’ ফাইজা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন।

নীলা চলে যেতেই পিউ ধিরিং ধিরিং করে নেচে নেচে কী একটা গান গেয়ে গেয়ে রান্নাঘরে এলো। নানুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘নানু! আজ তুমি রাঁধবে?’

‘হ্যাঁ, নানু।’ নানুর রান্না খাবে তো?’

‘ইয়ে…! কী মজা! কতো দিন পর নানুর হাতের রান্না খাব।’ পিউ যেন আনন্দে আত্মহারা হলো।

আবির থমথমে মুখে বাজারের ব্যাগ হাতে রান্নাঘরে ঢুকল। ফাইজা বেগমের কাছে তার ভাবগতি ভালো ঠেকছে না। এই ছেলেটা এমন কাজ চোরা হয়েছে যে কিছুই বলে কোনো লাভ নেই। বকা দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু তিনি আজ কারও সাথেই মাথা গরম করতে চান না। আজ সবাই মিলে একটু শান্তিতে ভালো-মন্দ কিছু খাবেন। এই জন্য তিনি আজ ভেবেই রেখেছেন কোনোভাবেই কারো সাথে রাগ দেখাবেন না।

তাই শান্ত গলায় আবিরকে বললেন, ‘নাস্তা খেয়ে নে, ছোট খোকা। আর আজ কোথাও যাস না।’

‘মা! আমার আজ বাইরে না গেলে যে হবে না। আজ আমাদের পাড়ায় খেলা আছে।’ আবির বলল, জরুরি গলায়।

‘আজ না গেলে কোনো ক্ষতি হবে না।’ সরু চোখে তাকিয়ে দৃঢ়তার সাথে বললেন,’আজ একটা বিশেষ দিন। তাই আমি চাই তোরা সবাই বাসায় থাক।’

‘বিশেষ দিন?’ আবির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মায়ের দিকে,’কার জন্য?’

‘কার জন্য আবার?’ ফাইজা বেগমের ভাবলেশহীন উত্তর, ‘আমাদের সবার জন্য।’

আবির আর কথা বাড়াল না। বেসিনে হাত ধুয়ে টেবিলে বসে পড়ল নাস্তা করার জন্য। ফাইজা বেগম ছেলেকে নাস্তা বেড়ে দিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লেন। মাছ কুটা থেকে শুরু করে সবকিছুই ফুরফুরে মন নিয়ে দুপুর পর্যন্ত রাঁধলেন। নীলা মশলা বেটে দিলো। সাবরিনা কিছু তো করলই না বরং রান্না ঘরে মোড়ার উপর বসে বসে ঝিমালো। তাই দেখে ফাইজা বেগমের রাগ মাথায় চড়ে গেল। তিনি প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘এতই যখন ঘুম পাচ্ছে। তখন রুমে গিয়ে ঘুমালেই তো পারিস।’

ফাইজা বেগম মুখ থেকে বের করা মাত্রই সাবরিনা উঠে নিজের রুমে চলে গেল। সকালের নাস্তাটা পর্যন্ত সে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে খেয়েছে। ফাইজা বেগম আবির আর সাবরিনার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে মহাবিরক্ত।

রাদিদ এলো দুপুরে। শুক্রবার হওয়াতে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। বাসায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে গেল। নামাজ পড়ে আসতেই পিউ রহস্য মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘বলো তো বড়ো মামা আজ কি দিন?’

‘আজ?’ রাদিদ পিউকে কোলে তুলে নিয়ে একটু ভাবনার ভান করে বলল, ‘আজ তো শুক্রবার।’

‘উফফো!’ পিউ তার পিচ্চি পিচ্চি হাত দিয়ে মাথায় চাপড়ে বলল, ‘তুমি তো দেখছি কিছুই পারো না। আমি বলেছি আজ কি দিন, আজ কি বার বলিনি তো।’

‘কি দিন আর কি বার এর মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে, চ্যাম্প?’ রাদিদ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল।

‘আছে তো।’ বিজ্ঞের মতো করে বলল, পিউ।

‘তাহলে বলে ফেল তো ঝটপট। বড়ো মামা তো এই পার্থক্য জানেই না।’

‘আজ একটা বিশেষ দিন।’

‘কে বলেছে?’

‘নানু বলেছে।’

‘আচ্ছা নানু যখন বলেছে তখন তো অবশ্যই বিশেষ দিন। কিন্তু কার জন্য বিশেষ দিন?’

‘আমাদের সবার জন্য।’ পিউ প্রশস্ত হেসে বলল।

‘এটাও কি নানু বলেছে?’

‘হ্যাঁ, নানু বলেছে। আজ তো নানু নিজ হাতে রান্নাও করেছে।’

‘তাই না-কি?’ রাদিদ ভীষণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

‘হুম। সত্যি বলছি। খাবার মুখে দিলেই বুঝতে পারবে।’

রান্না শেষে নামাজ পড়ে ফাইজা বেগম নিজের রুমে শুয়ে আরাম করছিলেন। রাদিদ পিউকে কোলে নিয়ে ঢুকল। বলল, ‘মা! আজ না-কি কি বিশেষ দিন?’

‘ওহ্, হ্যাঁ।’ ফাইজা বেগম শোয়া থেকে উঠতে উঠতে বললেন, ‘তুই এসে পড়েছিস বড়ো খোকা?’

‘হ্যাঁ, মা। তুমি উঠছ কেন? শুয়ে থাকো।’

‘আরে না। আর কত আরাম করব?’

‘আচ্ছা, মা! তুমি না-কি আজ রান্না করেছ?’

‘কে বলেছে? তোর গুপ্তচর?’

‘আমি বলেছি নানু।’ পিউ রাদিদের কোল থেকে লাফিয়ে উঠে বলল।

‘তোর কথাই তো বলছি। বড়ো মামার গুপ্তচর তো তুইই।’

‘মা ! তোমাকে না কতো বার বলেছি তোমার রান্না করা লাগবে না। তারপরেও তুমি জেদ করো। এটা তো ভালো না মা। নীলা আপাই তো রান্না করতে পারে।’ রাদিদ বলল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে।

‘বেশি কথা বলবি না। আমি একদম সুস্থ আছি। তোরা দুই ভাই-বোন মিলে আমাকে অসুস্থ বানানোর ষড়যন্ত্র করছিস।’

‘আমরা ষড়যন্ত্র করছি?’ ভারি অবাক হয়ে জানতে চাইল রাদিদ।

‘তা নয়তো কী? আচ্ছা চল খাবার দিই।’

‘নীলা আপা দিবে। তুমি আবার উঠতে যাচ্ছ কেন?’

‘আজ কি আমাকে খাবার খেতে হবে না? না-কি তোরাই খাবি শুধু?’

‘এ কী! মা! তুমি এখনও খাবার খাওনি? আপা! এই আপা! তুই এখনও মাকে খেতে দিসনি কেন?’

নীলা মাত্র নামাজ শেষ করে উঠল। রাদিদের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ‘মা যেন আমার কথা খুব শুনে!’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ রাদিদ বুঝতে পারল, মা আজ নিজ থেকে ইচ্ছে করেই রেঁধেছে। তাই বলল, ‘চলো , আজকে আমরা সবাই এক সাথে খাব।’

খাবার টেবিলে রাদিদ নিজের প্রিয় সব খাবার দেখে অবাক হয়ে গেল। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘মা! এত কষ্ট কেন করতে গেলে বলো তো?’

‘একদম কষ্ট হয়নি আমার । এবার খেয়ে বল, কেমন হয়েছে।’ ফাইজা বেগমের চোখে মুখের উত্তেজনার ছাপ রাদিদের চোখ এড়াল না।

‘আমার মায়ের রান্না তো অমৃত। না খেয়েই আমি বেশ বলতে পারি।’

পিউ মাঝখান থেকে বলে উঠল, ‘নানু! এখন থেকে তুমিই রান্না করো। তোমার হাতের রান্না কী ইয়ামি!’

‘বাব্বাহ! পিউ! মায়ের হাতের রান্না কি পচা?’ নীলা প্রশ্ন করল।

‘তোমারটাও ভালো কিন্তু নানুরটা বেশি ভালো।’

পিউর কথা শুনে সবাই একসাথে হাসল। আবির আর সাবরিনা যেন অন্য গ্রহের প্রাণী। তারা চুপচাপ খাচ্ছে কেবল। রাদিদ হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা, মা! কার জন্য বিশেষ দিন বললে না তো?’

‘মনে করতে পারিস কি না দেখ। আমি কেন বলব? তোর ঠিক মনে পড়বে।’

মায়ের কথা শুনে রাদিদ চুপ হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ খেতে লাগল। রাদিদ আবার বলে উঠল, ‘মা আজকের রান্নাটা সত্যিই অমৃত।’

পিউ মুখে এক নলা খাবার দিয়েই প্রশ্ন করল, ‘কেন অমৃত বড়ো মামা?’

‘কারণ এই খাবারের সাথে মা তার সমস্ত ভালোবাসা মিশিয়ে দিয়েছে। তাই অমৃত হয়ে গেছে।’

পিউকে চিন্তিত দেখাল। সে হয়তো বুঝতে পারছে না। আর এদিকে ফাইজা বেগমের চোখ জোড়া আনন্দে চকচক করে উঠল। রাদিদ বলল, ‘মা তোমার চোখে কী যেন গেল!’

___________________________

শিহরণ অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে আজ হাসপাতালে যেতে পারেনি। তবে কল করে খবর নিয়েছে। পুলিশের সাথেও কথা হয়েছে। রাতের দিকে একবার হাসপাতালে যাবার পরিকল্পনা করে রেখেছে। তবে একটু আগের ফোন কলটা তার মাথা পুরোপুরি খারাপ করে দিয়েছে। অসহ্য লাগছে তার। তবে সবথেকে বিস্ময়কর ব্যাপার যেটা ঘটলো সেটা হলো মান্নাতের বলা কথাটা। মান্নাতের বলা কথাটা সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না। মা তাকে না জানিয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমনটা তো হবার কথা না। সারাটাদিন অস্থিরতায় কাটালো সে। বাসায় গিয়ে মায়ের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল।

বিকেলের দিকে ফরিদকে নিয়ে বেরোল হাসপাতালের উদ্দেশে। ছোঁয়া তখনও মায়ের পাশে বসে ছিল। সাইফ দোকানে, অহনা, হিয়া আর মায়াকে জোর করেই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে ছোঁয়া । শিহরণ ছোঁয়াকে ইশারায় বেরোতে বলল। ছোঁয়া বলল, ‘আবার আসলে কেন? অফিস থেকেই এখানে চলে এসেছ?’

‘হুম। না এসে উপায় কি? কেউ একজন নিজের যত্ন নেবার কথা কখনোই মনে রাখে না। তাই তাকে মনে করিয়ে দিতে হয় বারবার।’

‘হুম। তা কতদিনের জন্য এই দায়িত্ব নিলে?’

‘এখনও ঠিক করা হয়নি। ঠিক করলেই কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’

‘ততদিন কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করবে বলে কেন মনে হলো তোমার?’

‘মনে হয়নি তো!’

‘তাহলে বললে যে?’

‘মনে করার উপায় নেই। আমি বরং বিশ্বাস করি।’

‘কিছু কিছু বিশ্বাস ঠুনকো হয়। জানো তো?’

‘জানি। তবে আমার বিশ্বাস কোনোদিক থেকেই ঠুনকো নয় এটা নিশ্চিত থাকতে পারো।’

ছোঁয়া শিহরণের এই কথার প্রত্যুত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না। তাই চুপ থাকল। শিহরণ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আন্টির কী অবস্থা?’

‘এখন অনেকটা ভালো।’

‘তুমি চাইলে বাসায় যেতে পারো। আমি নাহয় অপেক্ষা করি।’

‘দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।’

‘তা তো আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। চোখের নিচে কালি পড়াটা তো ঠিক থাকারই প্রমাণ। তাই না?’

ছোঁয়া নিশ্চুপ। শিহরণ অবাক চোখে দেখছে তাকে। ধীরে ধীরে অন্ধকার জেঁকে বসে রাতের আগমনের জানান দিচ্ছে। কোথা থেকে যেন কেবল এক ঝাঁক ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে!
______________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে