ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-২০+২১+২২

0
1493

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২০

অহনা পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে, অস্থিরভাবে। আজকেও কল করেনি লোকটা। অথচ এখনই তার কাজটা করার মোক্ষম সময়। সাইফ ভাই নেই; তাই সে এই সময়ে কাজটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন কোনো বাড়তি ঝামেলাও পোহাতে হতো না। অথচ লোকটা কাজ এখনও করতে পারল না। অহনার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। কোন আহাম্মককে সে কাজ দিল–এটা ভাবতেই তার নিজেকেই নিজের তিরস্কার করতে মন চাইছে! তামিম এই আহাম্মকের কাজেরই বাহবা দিচ্ছিল! অদ্ভুত লাগছে তার বিষয়টা। একটু পরপরই উঁকি দিচ্ছে সে জানালা দিয়ে। আচমকা তার মোবাইলটা বেজে উঠল। কাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে কল আসাতেই তার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তিতে ভরা হাসি দেখা দিল মুহূর্তেই। কলটা রিসিভ করেই ওপ্রান্তের ব্যক্তিকে কোনো প্রকার বাক্যব্যয় করার সুযোগ না দিয়ে অহনা বলল, ‘কাজ হয়েছে?’

মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে ওপ্রান্তের ব্যক্তিটি বলল, ‘না, ম্যাডাম। আমরা কাজটা করার সুযোগ পাইনি।’

‘এই সামান্য কাজটাও করতে পারলে না?’ অহনার কণ্ঠ সপ্তমে চড়ে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে বলল, ‘ কাজের কাজ তো কিচ্ছু করতে পারলে না। আবার বড়ো গলায় বলেছ, আমাদের কাজে কোনো ঘাটতি হবে না! আমি বুঝতে পারছি তোমাদের দ্বারা এই কাজ হবে না।’

ফোনের ওপ্রান্তের ব্যক্তিটি প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘আমরা কি করব ম্যাডাম? একজন কার নিয়ে এসেই তো সব ঝামেলা বাঁধিয়ে দিলো। নয়তো আমরা আজকেই আমাদের কাজটা শেষ করে ফেলতাম।’

‘কে এসছিল?’ অহনার কণ্ঠে রাগ উপচে পড়ছিল, ‘স্পষ্ট করে করে বলো।’

‘আমরা তো গাড়ির ভেতরে কে আছে তা দেখিনি। তবে ওটা হোয়াইট কালারের কার ছিল।’

‘গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখেছ?’ অহনার কণ্ঠে কৌতুহল।

‘না, ম্যাডাম। আমাদের তো ওসব দেখার দিকে কোনো মনোযোগ ছিল না। আমরা তো ওই গাড়ি যাবার অপেক্ষায় ছিলাম।’

অহনা কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল! তারপর কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’এর আগের দুই দিনও একই রঙের গাড়ি দেখেছিলে না?’

‘জি, ম্যাডাম। মেয়েটা নিরাপদে বাসায় না আসা পর্যন্ত গাড়িটা অপেক্ষা করে।’

গাড়ির হর্ণ শুনতে পেয়ে অহনা তার রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে পেল ছোঁয়া গেইটের ভেতরে প্রবেশ করছে। গাড়িটা দেখেই সে বুঝতে পারল এটা শিহরণের গাড়ি। তাহলে শিহরণের কারণেই তার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল। মেজাজটা বিগড়ে গেল আবারও। শিহরণের উপরেও তার রাগ হচ্ছে। তার হিসাব এখন মিলে গেছে। সাইফ ভাই নেই। ছোঁয়া একা একা বাসায় ফিরে আর তাই শিহরণ ওর পেছনে থেকেই ওর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। অসহ্য লাগছে অহনার, সবকিছুর প্রতিই বিতৃষ্ণা চলে এলো তার ।

রাগে গজগজ করতে করতে অহনা বলল, ‘তোমাদের মতো গাধা আমি জীবনে দেখি নাই। তোমরা নাকি আবার এই কাজে দক্ষ! তামিম যা বলেছে তা দেখছি খুব ভুল বলেছে তোমাদের সম্পর্কে। তোমাদের হায়ার করারটাই আমার ভুল হয়েছে।’

‘আর একটা সুযোগ দিন ম্যাডাম। এবার আর কোনো মিস হবে না।’ অনুনয় করে বলল ব্যাক্তিটি।

‘না এখন আর কিছু করতে হবে না।’ চিন্তিত সুরে অহনা সতর্ক গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় কেউ বুঝতে পেরেছে বিষয়টা। আমি এখন আর কোনো রিস্ক নিতে চাই না। সময় মতো আমি তোমাদের সাথে আবার যোগাযোগ করব। ততদিন পর্যন্ত তোমরা গা ঢাকা দাও। তোমরা ধরা পড়লে তোমাদের চাইতেও বেশি সমস্যা হবে আমার। তাই এখন তোমাদের আর কিছু করার দরকার নেই।’

‘ঠিক আছে, ম্যাডাম।’
_______________________

বহ্নি, তূর্ণ আর সায়মা ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তূর্ণকে হাপুসহুপুস করে সিঙ্গারা আর সমুচা গিলতে দেখে সায়মা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বহ্নি বিরক্তির সুরে বলল, ‘ আরে বাপ আস্তে খা। এত তাড়া কিসের তোর? আমরা এখনও অপেক্ষা করছি তো। একে তো দেরি করে আসলি। তার উপর এখন বুভুক্ষুর মতো করে গিলছিল। সবাই হা করে তোর খাওয়া দেখছে আর আমরা তো দেখছিই।’

সমুচা চিবুতে চিবুতে তূর্ণ বলল,’তোদের সামনে কিসের লজ্জা বল তো? সকাল থেকে পেটে কিচ্ছু পড়ে নাই । তাই খাওয়ার সময় বিরক্ত করিস না তো।’

‘বিরক্ত করলাম কই?’ ভীষণ অবাক হয়ে বলল, বহ্নি, ‘বলছি, আস্তে ধীরে খা। এখন তো ব্রেক চলছে। দরকার হলে তুই পরের ক্লাসটাও মিস দিতে পারিস। তাও ধীরে সুস্থে খা।’

‘তোরা দুজন চলে যাবি আর আমি একা একা খাব! এটা কি হয় না-কি?’

‘এখন কি দোকা খাচ্ছিস?’ সায়মা বলল বিস্মিত হয়ে,’ আমরা তো কেবল দু’চোখ ভরে এক খাদকের খাবার গেলা দেখছি।’

‘দেখছিস বহ্নি! জেলাস সে আমার প্রতি, আমার খাবারের প্রতি।’ বহ্নিকে নালিশ দিয়ে সায়মাকে উদ্দেশ্য করে তূর্ণ বলল, ‘তোকে কে খেতে নিষেধ করেছে ? খা, তুইও খা। ক্যান্টিনে তো আর দুর্ভিক্ষ পড়ে নাই। যথেষ্ট খাবার আছে। খেয়ে মোটাতাজা হলে তখন আর আমি তোকে চিকনি চামেলি বলে ডাকব না।’

সায়মা রাগী গলায় বলল,’তোর প্রতি আর তোর খাবারের প্রতি আমি জেলাস হতে যাব কোন দুঃখে?তোর মধ্যে না জেলাস হবার মতো কিচ্ছু নাই, দোস্ত।’

‘আচ্ছা, বাদ দে তো এসব। ক্লাস টাইম হয়ে আসছে। তূর্ণ তুই দ্রুত খাবার শেষ কর।’ বহ্নি তাড়া দিয়ে বলল।

‘এই তো লাইনে আসছিস। তুই এরকম দ্রুত খেতে বলবি বলেই আমি প্রথম থেকেই দ্রুত খাচ্ছিলাম।’

বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তূর্ণর সাথে কথা বলে পারা যাবে না। এক কথার পিঠে হাজার কথা সে বলতেই থাকবে। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। নীরা ক্যান্টিনের এক কোণায় বসে দেখছিল ওদের। তূর্ণ ছেলেটাকে তার কাছে বড্ড পাঁজি বলে মনে হয়। এখন কেমন গাপুসগুপুস করে খাচ্ছে! যেন হাজার বছর ধরে তার পেটে কোনো খাবার পড়েনি!

নীরা আজ বহ্নির সাথে কথা বলবে বলেই মনস্থ করেছিল। কিন্তু ভার্সিটিতে আসার পর থেকে কেমন যেন দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে। কী বলবে? কীভাবে শুরু করবে কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না! রাদিদের কথা স্মরণ করে সে মনে মনে বলল,’ দেখ, রাদিদ ভাইয়া! তোমার জন্য আমায় কতো কিছু করতে হচ্ছে। আর তুমি আমাকে খালি বকতে থাকো। হুহ্!’

একটা পর্যায়ে সে সাহস করে উঠে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো বহ্নিদের টেবিলের কাছাকাছি। তাকে দেখেই বহ্নি সহাস্যে প্রশ্ন করল,’কিছু বলবে আপু?’

‘জি আপু। আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

‘না তো। চেনার কথা ছিল?’ নীরার পাংশুটে চেহারা দেখে বহ্নি মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, ‘আসলে, তোমাকে দেখেছি কয়েকবার কিন্তু ঠিক পরিচয় হয়ে উঠেনি বোধহয়।’

নীরার নিজেকে বোকাবোকা লাগছে। আশ্চর্য, এখানে এতো দ্বিধার কি আছে? ঝটপট পরিচয় পর্ব সেরে নিলে তো চলে। আসলেই সে একটা বুদ্ধু! খুব বড়ো গলা করে রাদিদ ভাইয়ার কাছে হেন তেন কত কিছু বলেছে। অথচ, আজ তার কী একটা অবস্থা!

নীরা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘জি আপু। পরিচয় হয়নি। আপনি আমাকে না চিনলেও আমি চিনি।’

তূর্ণ খাওয়া বাদ দিয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার কাছে এই মেয়েটাকে খুব মিষ্টি লাগে। তার এই গাপুসগুপুস খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা নীরা দেখে ফেলেছে কী না সেই বিষয়ে সে মারাত্মক রকমের চিন্তিত! তার নিজের উপরেই এখন রাগ হচ্ছে। মেয়েটা ক্যান্টিনে ছিল অথচ সে খেয়ালই করেনি। নীরার চেহারাতে দ্বিধা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে। তা দেখে তূর্ণ বলল, ‘কী বলবে বলে ফেল। আমরা কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখছি। তোমার এতো লজ্জা পেতে হবে না?’

নীরা মুহূর্তেই চোখ তুলে তাকাল তূর্ণর দিকে। তার রাগ হলো খুব। তেজী গলায় সে বলল, ‘ভাইয়া! লজ্জা পাবার মতো তো কিছু বলব না। তাই আপনার কানে আঙ্গুল না দিলেও চলবে। এত কষ্ট করতে হবে না আপনার।’

নীরার মুখে ভাইয়া ডাক শুনে তূর্ণর চারপাশে তোলা স্বপ্নের প্রাসাদ মুহূর্তেই ভেঙে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেল। যত তাড়াতাড়ি প্রাসাদ বানাল তত তাড়াতাড়িই তা ভেঙে গেল। তৃর্ণ এতে আহত হলো মনে মনে। তার এখন অসহ্য লাগছে মেয়েটাকে। তূর্ণর সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলছে! এত্ত বড়ো স্পর্ধা পেল কোথা থেকে সে!
একটা ধমক দিয়ে সে বলল, ‘কি বলবে তাড়াতাড়ি বলে ফেল। এখানে স্ট্যাচু অব লিবার্টি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি। আমাদের ক্লাস আছে তো।’

বহ্নি তূর্ণর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, ‘তুই মেয়েটাকে ধমকাচ্ছিস কেন? ও তোর সাথে তো কথা বলছে না।’ তারপর নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তূর্ণ তোমার সাথে দুষ্টামি করছিল। ওর কথায় কিছু মনে করো না।’

‘না না আপু। আমি একদম কিছু মনে করিনি। আমি জানি উনি এমনই। আগে জানতাম উনি খালি মেয়েদের দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। এখন দেখছি ভাইয়া ডাক শুনে ধমক দিতেও পছন্দ করে।’ নীরা বলল, নিঃশ্বাস বন্ধ করে।

নীরার কথা শুনে তূর্ণর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই পিচ্চি মেয়ে তাকে এত্ত বড়ো অপমান করল তার বন্ধুদের সামনে! এটা ভাবতেই তার রাগ চড়ে যাচ্ছে সপ্তমে। অথচ তার বন্ধুরা হাসছে প্রাণখুলে যেন লাইভে কোনো কমেডি শো চলছে।

তূর্ণ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নীরার দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘এই মেয়ে আমি কার দিকে তাকিয়েছি?’

নীরাও দমবার পাত্রী নয়। সেও দ্বিগুণ স্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখেছি। অনেকবার দেখেছি তাকাতে।’

‘কার দিকে তাকিয়েছি? বলো তাড়াতাড়ি।’

‘বাব্বাহ্! আপনি নিজেই জানেন না কার দিকে তাকিয়েছেন!’ মক করে বলল, নীরা, ‘তাহলে কপালের নিচের চোখ দুটো রেখে আর লাভ কি ? ওদের কাজ নেই তো।’

‘এই মেয়ে! তুমি কি নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবতেছ?’

বহ্নি আর সায়মা ওদের ঝগড়া দেখে মজা পাচ্ছিল। ঝগড়ার গতি বাড়তে দেখে বহ্নি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘থামো তোমরা।’ তারপর নীরাকে প্রশ্ন করল, ‘কি কথা যেন বলতে চাইছিলে? বলো আপু।’

সায়মা তখন ঘড়িতে টাইম দেখে বলল, ‘এই ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে। চল।’

বহ্নি সায়মাকে হাত ধরে থামাল। বলল, ‘বস। এখনও টাইম আছে।’

নীরা বলল, ‘আপু! আমার সময় লাগবে। এখন তো মনে হয় আপনাদের ক্লাস আছে। পরে বলব।’

বহ্নি ঘড়িতে সময় দেখল। তারপর বলল, ‘ঠিক বলেছ। এখন তো এমনিতেও সময় হবে না। তুমি বরং পরেই বলো। ঠিক আছে?’

সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তূর্ণ রাগে গজগজ করতে করতে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে! নীরা বলল, ‘আপু। আপনার মোবাইল নাম্বারটা কি দেয়া যাবে?’

তূর্ণর তখন বলতে ইচ্ছে করল,’আমার বন্ধুরা যাকে তাকে মোবাইল নাম্বার দেয় না।’ কিন্তু সে কিছুই বলল না কারণ সে জানে বহ্নি নীরাকে তার মোবাইল নাম্বার অবশ্যই দিবে।

নীরার কথা শুনে বহ্নি ঘুরে দাঁড়াল। সহাস্যে বলল,’কেন দেয়া যাবে না আপু? অবশ্যই দেয়া যাবে।’

বহ্নি তৎক্ষনাৎ তার ব্যগ থেকে প্যাড বের করে সেখানে তার মোবাইল নাম্বারটা লিখে নীরার দিকে এগিয়ে দিল। কাগজটা হাতে নিয়ে নীরা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ আপু।’

তূর্ণ আড়চোখে তাকাচ্ছিল নীরার দিকে। মনে মনে বলল,’কত মিষ্টি করে হাসছে বহ্নির সাথে অথচ আমার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করছিল। ধানী লঙ্কার তেজ বেশি কথাটা মিথ্যা না।’

_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২১

‘তুমি করে বলাতে কি খুব অবাক হয়েছিলে?’ দুষ্টু হাসি ঠোঁটের কোণে রেখে প্রশ্ন করল শিহরণ।

ছোঁয়া গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আচমকা প্রশ্নে তৎক্ষনাৎ ডাগর চোখের বিস্ময় নিয়ে তাকাল শিহরণের দিকে। তাকিয়েই থাকল কেবল। কোনো জবাব দিলো না। ভেতরটা ফাঁকা মনে হলো তার। দেবার মতো কোনো উত্তর খুঁজেই পেল না সে।

‘কী! উত্তর খুঁজে পাচ্ছ না? না-কি ভাবছ হঠাৎ এতটা স্বাভাবিকভাবে কথা বলছি কেন? কোনটা ভাবছ বলো তো?’ স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সামনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে পুনরায় প্রশ্ন করল শিহরণ।

সকালটা বড্ড স্নিগ্ধ। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ বাতাসে ভর করে এসে লাগছে নাকের কাছে । কিছুটা মাদকতাও যেন মেশানো হয়েছে সকালের স্নিগ্ধ শীতলতা প্রদানকারী সমীরণে। সেই সমীরণের মাদকতা মেশানো ঘ্রাণে উন্মত্ত হচ্ছে দুটো হৃদয় । অথচ প্রকাশে যেন যোজন যোজন দ্বিধা, কুণ্ঠা আর সংকোচ! নির্লিপ্ত চাউনিতে নির্বাক চেয়ে আছে ছোঁয়া শিহরণের ভাবলেশহীন মুখের পানে। হঠাৎ ছোঁয়ার কেবল মনে হচ্ছে এই মানুষটা তার পাশে ছিল সবসময়, প্রতিটা মুহূর্তে, তার অস্তিত্ব ছিল তার অস্তিত্বে মিশে, সে শুধু বুঝতে পারেনি। না-কি বুঝার চেষ্টা করেনি?

‘কিছু তো বলো?’ অধৈর্য কণ্ঠের ঝংকার এসে লাগল ছোঁয়ার কানে।

‘সত্যি করে বলব?’ নয়ন জোড়াতে একরাশ বিস্ময় আর কণ্ঠে শতো বছরের কুণ্ঠা, দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল ছোঁয়া।

‘তুমি কি মিথ্যে বলাও শিখে গেছ?’ উদ্ধত কণ্ঠ তীরের শূলের মতো বিঁধল ছোঁয়ার বুকের মধ্যেখানে।

ছোঁয়ার খুব রাগ হলো। শিহরণের দিকে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সহসা। চোখ দুটো প্রতারণা করে বসল তার সাথে। কেমন যেন ভরা বর্ষার নদীর ন্যায় জলে থৈ থৈ করে উঠতে চাইছে ক্ষণিকের আবেগে। চোখ বুজে নিজেকে প্রবোধ দিলো সে। আর শুনবে না, আর ভাববে না। এতদিন তো সে বেশ ছিল। কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না, ছিল না আবেগের বশবর্তী হওয়ার কোনো সুযোগ। হালকা সবুজাভ চোখ জোড়া আর মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলো ছেলেটাকে সে দিব্যি ভুলে ছিল! সত্যিই কি ভুলে ছিল সে? অবাধ্য মন প্রশ্ন করে বসল সহসা নিজেকেই। না, সে কোনোভাবেই আর নিজের অবাধ্য, অপূরণীয় ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিবে না, দিবে না কোনো প্রশ্রয়।

‘এখনও কি কথা কমই বলো?’ ছোঁয়াকে রাগানোর চেষ্টাতে শিহরণ যেন বদ্ধপরিকর আজকের এই মিষ্টি সকালের মাদকতা মেশানো হাওয়ার ভুবনে।

ক্রোধান্বিত হয়ে ছোঁয়া বলল, ‘মোটেই না। যার সাথে আমার মনের মিল হয় না তার সাথেই কথা কম বলি।’

‘তাহলে তোমার মনের সাথে মিল আছে এমন কয়েকজনের নাম তো অন্তত বলো। জেনে ধন্য হোক জীবন।’ পুনরায় তীর্যক মন্তব্য করল শিহরণ।

‘আপনাকে ধন্য করার ইচ্ছে ও সাধ্যি কোনোটাই যে আমার নেই।’ ছোঁয়াও এবার ছেড়ে কথা বলল না।

‘ইচ্ছে নেই সেটা কিছুটা সত্য। কিন্তু সাধ্যি নেই কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। সাধ্য তোমার শতভাগ আছে। আর ইচ্ছেটাও হতে কতক্ষণ বলো?’ হাসি চেপে রেখে কোনোরকমে বলল শিহরণ।

শিহরণের এমন ঘোর প্যাঁচের কথায় ছোঁয়ার মরি মরি অবস্থা। ভীষণ রাগ হচ্ছে এই কাঠখোট্টা ছেলেটার প্রতি তার। প্রচণ্ড অনীহা নিয়ে প্রতিবাদের সুরে সে বলল, ‘ইচ্ছে হবে না কখনও।’

‘আবারও মিথ্যে!’ জোরে ব্রেক কষলো শিহরণ। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিয়ে পেট্রোল ভরে দিতে বলল, পেট্রোল পাম্পে কর্মরত ব্যক্তিটিকে। তারপর ছোঁয়ার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলল, ‘তুমি মিথ্যে বলা শিখেছ মানলাম। কিন্তু তাই বলে সত্য কথা বলতে ভুলে যাবে এটা তো হতে পারে না।’

অসহ্য লাগছে ছোঁয়ার। কী শুরু করেছে শিহরণ! কেমন উল্টাপাল্টা কথা বলেই যাচ্ছে নির্নিমেষ। নিষ্পলক তাকিয়েও আছে তার দিকে। তার বিব্রত বোধ হচ্ছে খুব। এটা কী বুঝতে পারছে না জনাব রাইয়্যান আহমেদ শিহরণ?

ছোঁয়ার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ সহ্য করেছে সে। আর না। প্রচণ্ড রাগে হড়বড় করে সে বলল,’ আমি মিথ্যে বলি কিন্তু সত্য কথা বলা ভুলে যাইনি। হুম, আমি অবাক হয়েছি। আমি আপনার প্রতিটি কথা ও কাজে অবাক হই । ভীষণ অবাক হই! আমি আপনাকে বুঝতে পারি না। একদম পারি না। আপনি আসলে কি চান তাও আমি বুঝতে পারি না। আমি বুঝতে পারি না যে আপনি কি আমাকে বুঝেন না, না-কি বুঝেও না বুঝার ভান করেন? আমি একদম বুঝি না আপনাকে। বলুন এটাকে কি মিথ্যে বলে? যদি বলে তবে আমি মিথ্যে বলি। আমাকে এই মিথ্যেটা বলতেই হবে।’

এতো কথা একসাথে বলাতে ছোঁয়া হাঁপাতে লাগল।।তার দু’চোখের দেয়াল ফেটে কান্না আসছে প্রচণ্ড পরিমাণে। কিন্তু শিহরণের সামনে সে কোনোভাবেই কান্না করতে চায় না।

‘বাব্বাহ! এত্ত রাগ?’ শিহরণ ঠোঁট টিপে হাসছে। ছোঁয়া ছলছল চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। দু’জোড়া চোখ মিলিত হলো আবারও ক্ষণিকের তরে। শিহরণের হৃদয়ের ঠিক মধ্যেখানে গিয়ে আঘাত করল ছোঁয়ার অশ্রুসিক্ত নয়ন।

‘হাসি পাচ্ছে আপনার? বাহ্! হাসি তো পাবেই। হাসি পাবার যথেষ্ঠ ও যৌক্তিক কারণও হয়তো আছে আপনার কাছে। আপনি তো আবার সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করেন।’ ছোঁয়া কান্নাভেজা কণ্ঠ আর নীল বিষাদে ভরপুর সমুদ্রের ন্যায় গভীর ধূসর নয়নে তাকিয়ে বলল।

শিহরণ আর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না ওই বিষাদে ভরা সমুদ্র পানে। সে একটা পানির বোতল এগিয়ে দিলো ছোঁয়ার দিকে। হিম শীতল গলায় বলল,’ পানি খাও। ভালো লাগবে। ‘

ছোঁয়া পানির বোতল নিলো না। মুখ ফিরিয়ে নিলো শিহরণের দিকে থেকে । তার খুব রাগ হচ্ছে এই উদ্ধত, একগুঁয়ে, নির্মম ছেলেটার উপর। এই সকল সম্বোধন সে না দিয়ে পারল না। অন্যদের প্রতি তার আচরণ যাই হোক না কেন তার প্রতি সে এমনই আচরণ করে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

‘আমাকে মনে মনে বকা দেওয়া কি শেষ? নাকি আরও কিছু বাকি আছে?’

ছোঁয়া চকিতে তাকাল শিহরণের দিকে। সন্দিগ্ধ চোখের তারায় ফুটে উঠল রাজ্যের বিস্ময়। বিস্মিত ছোঁয়া বাকরুদ্ধ। ছোঁয়াকে এমনভাবে তাকাতে দেখে শিহরণের বেশ মজা লাগছে। সে গাড়িটা একটা নির্জন জায়গায় থামাল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,’তুমি কি জানো কেও একজন তোমাকে প্রচণ্ডভাবে মিস করে? তোমার চোখের পানে তাকিয়ে সেই গভীর ধূসর রঙা সমুদ্রে ডুব দিয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে চায়?’

ছোঁয়া কাঁপছে। মনের মধ্যে ভালোলাগার প্রজাপতিরা উড়ছে হন্য হয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। একটা মধুর সুর ভেসে আসছে বাতাসের ভেলায় চড়ে। কোনো এক ফুলের তীব্র মিষ্টি ঘ্রাণ মাতাল করে দিচ্ছে তাকে। মাদকতা যেন ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের ধমনী, শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত প্রতিটি রক্তকণিকায়। সে কোনোরকমে তোতলাতে তোতলাতে প্রশ্ন করল, ‘জানি না। কে সে?’

‘আবারও মিথ্যে বলছে! তুমি জানো সে কে।’ শিহরণ বলল, প্রগাঢ় কণ্ঠে।

‘হেঁয়ালি করছেন কেন? যা বলবার স্পষ্ট করে বলুন।’ সমস্ত ভালোলাগাকে ছাপিয়ে ক্রোধ প্রকাশ পেল মুহূর্তেই।

‘সবকিছু কি মুখে বলতেই হবে। বুঝে নিতে পারো না?’ অদ্ভুত কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

‘মুখে না বললে বুঝে নেবার অনুভূতি তো তৈরী হবে না। বুঝে নেবার অনুভূতি তৈরী করার জন্যই তো মুখে বলাটা আবশ্যক।’ সবুজাভ চোখের অতলে নিঃশব্দে ডুবতে গিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে বলল ছোঁয়া।

‘তুমি আমাকে এখন থেকে তুমি করে বলবে সবসময়। আফটার অল উই ওয়্যার ক্লাসমেইটস।’ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল শিহরণ।

‘বাট নট নাও।’

‘ইয়েস স্টিল নাও। উই আর ওয়ার্কিং টুগেদার। দ্যাটস দ্যা মোস্ট ইমপর্ট্যান্ট ম্যাটার। নট দ্যাট?’

‘নো, দিস ইজ দ্যা ওর্স্ট থিং এভার।’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘তার মানে তুমি আমার সাথে কাজ করতে আগ্রহী নও?’ বিচলিত শোনাল, শিহরণের কণ্ঠ।

‘আমি তা বলিনি। আর আমি তো কেবল আপনার সাথে কাজ করছি না। আপনি ছাড়াও অফিসে অনেকেই আছেন। যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দ করি এবং তারাও আমাকে খুব পছন্দ করে।’

‘আচ্ছা, ছোঁয়া। তোমার একটা ডায়েরি ছিল মনে আছে? স্কুলে থাকতে তুমি ওটাতে ইচ্ছেমতো গালমন্দ করতে আমাকে। এখনও কি আমাকেই গালমন্দ করা করা হয় না-কি অন্য কাউকে?’ কৌতূহল মিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল শিহরণ।

ছোঁয়ার মাথায় এবার পুরো আকাশটাই যেন ভেঙে পড়ল। সে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল শিহরণের দিকে। দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে বলল, ‘ডায়েরির কথা তুমি জানলে কি করে? ডায়েরি তো সেই কবেই হারিয়ে ফেলেছি। তারমানে কি তুমি আমার ডায়েরি নিয়েছ?’

‘কী! আমি কেন তোমার ডায়েরি নিতে যাব?’

‘তাহলে তুমি যে বললে আমি তোমাকে গালমন্দ করতাম?’

‘তারমানে কি সত্যিই গালমন্দ করতে না-কি?’ অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইল শিহরণ,’আমি তো আন্দাজে বললাম।’

ছোঁয়া মুহূর্তেই জিহ্বায় কামড় দিলো। নিজের গোপন কথা সে নিজেই ফাঁস করে দিচ্ছে। বলল, ‘আমি তোমাকে কেন গালমন্দ করতে যাব? তুমি কে? তুমি আমার কেউ না। যারা আমার কেউ না তাদের আমি গালমন্দ করি না।’

‘বুঝতেই পারছি আমি যে তোমার কেউ না। তবে তুমি কি বুঝতে পারছ যে তুমি আমাকে তুমি করে বলা শুরু করে দিয়েছ?’ রহস্যময় হাসি ঠোঁটের কোণে রেখে বলল,শিহরণ ।

ছোঁয়া এবার নিজের কপালে চাপড়াল। এই শিহরণ তাকে পুরোই কনফিউজড করে দিচ্ছে। প্রচণ্ড বিরক্ত সে এই উদ্ধত ছেলেটার উপর। নিজের উপরেও বিরক্তবোধ করছে সে। বলল, ‘আপনাকে আমি আবার কখন তুমি করে বললাম? আপনাকে আজই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’

‘আবারও মিথ্যে। ইশ! কী পরিমাণ মিথ্যে বলটাই না শিখেছ তুমি! মনে হচ্ছে এই মিথ্যে বলাতে তুমি ডিগ্রি নিয়েছ প্রিয়তা।’

‘এই কি বললে তুমি? প্রিয়তা কে?’ ছোঁয়া আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করল।

শিহরণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আবারও তুমি করে বলেছ প্রিয়তা?’

‘ঠিক আছে মানলাম, তুমি করে বলেছি। একটু আগেই তো বলেছ, আমরা ক্লাসমেইট ছিলাম। এখন একসাথে কাজ করছি। তাই তুমি করে বললেই ভালো। এবার বলো প্রিয়তা কে?’

‘প্রিয়তা! আমার প্রিয়তা, যাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা বৃথা সে।’

‘তাহলে তুমি আমাকে কেন প্রিয়তা বলে ডাকলে?’

‘এসে পড়েছি প্রিয়তা। এবার ঝটপট কাজে লেগে পড়তে হবে।’

‘আমার প্রশ্নের উত্তর?’

‘যারা আমাকে পছন্দ করে না তাদের প্রশ্নের উত্তর আমি দিই না, প্রিয়তা।’

‘আমি তোমাকে পছন্দ করি না কে বলল?’

‘পছন্দ করলে তো আর গালমন্দ করতে না। তাই না?’ সহাস্যে বলল, শিহরণ।

‘উফ্! পুরোই বিরক্তিকর তুমি। তোমার সাথে আর কোনো কথাই বলব না।’ এটুকু বলে ছোঁয়া প্রচণ্ড শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলল, তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে।

শিহরণ হাসতে লাগল ছোঁয়ার এমন ব্যবহারে। পুরোই বিভ্রান্ত করে দিলো সে ছোঁয়াকে। অবশ্য সে দারুণ উপভোগ করেছে পুরো সময়টা। তার প্রিয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রিয় কিছু মুহূর্তের তালিকায় লিখে নিল এই সময়টুকু। আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে। এতদিন দূর থেকেই সে তার প্রিয়তাকে দেখেছে। আর এখন, খুব কাছে তার প্রিয়তা। তার ভীষণ পছন্দের মানুষটির সাথে তার দূরত্ব এখন কেবল সময়ের।
_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২২

ইদানিং ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে রাদিদের। কাজের মধ্যে একদমই অবসর মিলছে না। ফাঁকফোকরে যতটুকু অবসর মিলে সেই সময়টাতে সে খোঁজ নেয় মা আর ছোট্ট পিউর। কিন্তু আজ কোনো অবসর তো মিললই না। উপরন্তু সারাদিন ধরে মুঠোফোনটা বেজেই চলেছে ক্লান্তিহীনভাবে। একটা সময় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে মুঠোফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো। সন্ধ্যার দিকে একটু অবসর পেতেই মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে প্রায়ই সাতচল্লিশটা মিসড কল। সবগুলোই আবিরের নাম্বার থেকে।

এতগুলো কল দেখে রাদিদ রীতিমতো ভড়কে গেল। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাও হলো। প্রথমেই মায়ের চিন্তা এলো মাথায়। মায়ের কিছু হয়নি তো? তাই কল ব্যাক করার জন্য নাম্বার ডায়াল করতে গেলেই অন্য একটা নাম ভেসে উঠল তার মুঠোফোনের স্ক্রিন জুড়ে। রাদিদ কলটা কেটে দিল মুহূর্তেই। কোনো প্রকার বিলম্ব না করেই সে আবিরকে কল ব্যাক করল।

রাদিদের কল রিসিভ করেই আবির ঝাঁঝাল গলায় বলল, ‘ভাইয়া! এতক্ষণ ধরে কল করছি তুমি কল রিসিভ করছ না কেন?’

‘মায়ের কিছু হয়েছে? এতবার কল দিয়েছিস যে?’ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্বরে প্রশ্ন করল, রাদিদ।

‘মা ঠিক আছে। মায়ের আবার কী হবে? আমি আমার প্রয়োজনে কল করেছি।’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আবির।

আবিরের উত্তর দেবার ধরনে রাদিদের মন আর মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে গেল। বলল, ‘আমি তো আর তোর মতো অবসর সময় কাটাচ্ছি না ভাই । আমাকে কাজ করতে হয় তো। জানিস বোধহয় কিছুটা। তাই না?’

রাদিদ পাল্টা উত্তর এভাবে দিবে আবির তা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। তাই সে পরক্ষণেই নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বলল, ‘আসলে ভাইয়া আমার কিছু টাকা লাগবে। তাই কল করেছি।’

রাদিদ নিঃশব্দে হাসল। বলল, ‘এখন টাকা লাগবে কেন?’

‘আমাদের ভার্সিটি থেকে ট্যুরে যাচ্ছে। আমি যেতে চাইনি। কিন্তু সবাই খুব জোর করেছে আজ। তাই না করেও কোনো সুবিধা করতে পারলাম না।’ আবির বলল, অত্যন্ত বিনম্র কণ্ঠে।

রাদিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কণ্ঠের হতাশা লুকিয়ে বলল, ‘কত টাকা লাগবে?’

‘এই তো পাঁচ হাজারের মতো।’

ভারি অবাক হলো রাদিদ। এত টাকা দিয়ে কী করবে সে কোনোভাবেই ভেবে পেল না! দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘এত টাকা কিসের জন্য? কোথায় যাচ্ছিস তোরা যে এত টাকা দরকার? ট্যুর ফি কত?’

‘ভাইয়া এতকিছু জেনে তুমি কি করবে বলো তো? তুমি কি এসবের আগামাথা কিছু বুঝবে বলো?’ আবির বিরক্ত গলায় বলল।

‘বাহ্! খুব ভালো বলেছিস। আসলেই ভাই, আমি এসবের কিছুই বুঝব না। তোর মতো ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ তো আমি পাইনি। তাই না বুঝাটাই বরং স্বাভাবিক।’ প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে বলল, রাদিদ।

‘এত কথা বলছ কেন ভাইয়া? তুমি টাকা দিবে কি না বলো?’ অধৈর্য গলায় বলল, আবির।

‘আমার কাছে এখন তো এত টাকা হবে না। বড়ো জোর দুই হাজার টাকা দেওয়া যাবে। এর বেশি দেওয়া যাবে না। তাছাড়া দু’মাস আগেই তুই একটা ট্যুর থেকে এসেছিস। এটা কি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গিয়েছিস? তোদের ভার্সিটিতে কি বছরে দুই তিন বার শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়?’ ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইল রাদিদ।

‘এত টাকা নেই বললেই তো হবে না। তুমি যেহেতু ব্যবসা দেখাশুনা করছ তাই টাকা তো তোমার কাছেই থাকে। এখন তুমি না দিলে তো আর হবে না।’ উদ্ধত শোনাল আবিরের কণ্ঠ।

আবিরের উদ্ধত আচরণে রাদিদ কেবল অবাক হচ্ছে না তার খুব আক্ষেপও হচ্ছে। বলল, ‘যত টাকা দিব বলেছি তা নিতে চাইলে নিতে পারিস। এর বেশি এক টাকাও না। লাগলে নিয়ে যাস।’

রাদিদ কলটা কেটে দিল। আবিরের সাথে কথা বলে এমন বিরক্ত হলো যে মোবাইলের মেসেজ চেক করার কথা সে ভুলে গেল। ফুফু নাম্বার থেকে কল এসেছিল। কিন্তু এখন মেজাজ এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে সে কোনোভাবেই শান্তভাবে কথা বলতে পারবে না। তাই কল ব্যাক না করার সিদ্ধান্ত নিলো। মাথা ঠান্ডা হলেই কল করবে।

হাঁপিয়ে উঠেছে সে। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। যেখানে নিজের মতো করে একটু বাঁচতে পারবে, নিজের মতো একটু নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। দূষিত, কলুষিত চিন্তার কোনো মানুষ যেখানে থাকবে না ঠিক তেমন জায়গায় যেতে মন চাইছে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা পায় না, যা পায় তা চায় না। চাওয়া আর পাওয়ার এই ব্যবধান মানব জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নির্ধারণ করে দেয়, যার জীবনে এই ব্যবধান যত কম সে তত সুখী।
__________________________

আসন্ন অনুষ্ঠানে অতলকে নিমন্ত্রণ করার জন্য উতলা হয়ে আছে বহ্নি। ঘড়িতে রাত প্রায় দশটা। মোবাইল হাতে নিয়ে ভাবনাতে মশগুল হয়ে পড়েছে সে, এখন এত রাতে কল করা ঠিক হবে কি না ভাবছে। এই সময়েই তার নাম্বারে কল এলো। তূর্ণ কল করেছে। বিরক্ত হয়েই রিসিভ করল বহ্নি। তারপর বলল, ‘এত রাতে কল করেছিস কেন?’

‘বাহ্ রে! আমি কল করার জন্য রাত-দিন, সকাল-বিকাল কবে থেকে বিচার করা শুরু করেছিস?’

‘এখন এসব প্যাঁচাল পারিস না। ভালো লাগছে না। কিছু বলার থাকলে বল। নয়তো ভাগ।’

‘এই তূর্ণ ভেগে যাবার ছেলে না। এটা তো জানিস ভালো করেই।’

‘হুম, জানি রে দোস্ত। এবার বল কী বলবি?’

‘তোর কি কিছু হয়েছে?’ তূর্ণ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল,’কোনো কারণে কি আপসেট তুই?’

‘এটা কেন মনে হলো তোর?’ ভারি অবাক হয়ে জানতে চাইল বহ্নি।

‘আমি প্রশ্ন করেছি তোকে, তুই উত্তর না দিয়ে উল্টে আমাকেই প্রশ্ন করছিস?’ হতাশ গলায় জানতে চাইল তূর্ণ।

‘আমি কোনোভাবেই আপসেট না। এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। রাখছি আমি।’ বহ্নি বলল, সতর্ক গলায়,’কাল কথা বলব। ঠিক আছে?’

তূর্ণ আর কথা বাড়াল না। হিমশীতল গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। তুই বলতে না চাইলে আমি জোর করব না। কিন্তু যখন মনে হবে তোর এই অধম বন্ধু শোনার যোগ্য তখন না হয় বলবি! আমি অপেক্ষা করব।’

বহ্নির ইদানিং মাঝেমধ্যেই মনটা হুট করে খারাপ হয়ে যায়। বিষয়টা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কাউকে কিই বা জানাবে, সে নিজেই তো জানে না! এখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। সাহস করে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটা সে ডায়াল করেই ফেলল শেষমেশ।

___________________________

অতলের চোখ লেগে এসেছিল কেবল। কিন্তু মোবাইল নামক যন্ত্রটির তীব্র আওয়াজে তাও চটে গেল। আজকাল ভীষণ দুর্বল লাগে তার। পড়াশোনাতে কি বেশি এনার্জি খরচ হচ্ছে? কে জানে! আজকেও দুর্বল লাগছিল বলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। মুহূর্তেই দুচোখের পাতা এক হয়ে গেল। কিন্তু তা স্থায়ী হতে পারল না। ঘুম ঘুম চোখে নাম্বারটা না দেখেই রিসিভ করল সে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠেই সে বলল, ‘হ্যালো! কে বলছেন?’

ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এলো। সেই মিষ্টি সুরে অতলের চোখ থেকে ঘুম পালাল। সে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখল। সেইভ করা নেই। মনে পড়ে গেল নাম্বার বিনিময় করা হলেও সে নাম্বারটা সেইভ করেনি।

‘হ্যালো! অতল ভাইয়া! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?’

অতল মোবাইলটা কানে দিল। বলল, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। বল কি মনে করে কল করেছিস?’

‘কারণ ছাড়া কি আমি তোমাকে কল করতে পারি না?’

‘পারিস। তবে এখন, এত রাতে কোনো না কোনো কারণেই নিশ্চয়ই কল করেছিস?’

‘তার মানে আমি কল করাতে তুমি বিরক্ত হয়েছ। তাই না?’

‘আরে না! আসলে একটু চোখ লেগে এসেছিল।’

‘এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?’

‘কেন ঘুমাতে পারি না?’

‘না, মানে মাত্র সাড়ে দশটা বাজে।’

‘হুম, আসলে দুর্বল লাগছিল তাই । আচ্ছা, আমার কথা বাদ দে, তুই কেমন আছিস বল?’

‘আমি ভালো আছি। এত রাতে কল করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।’

‘দুঃখিত হবার কী আছে? যখন ইচ্ছে তখনই কল করতে পারিস। কোনো সমস্যা নাই।’

‘বলছ?’

‘কী?’

‘এই যে যখন খুশি তখন কল করতে পারি তোমাকে।’

অতল মনে মনে ভাবল,’বহ্নি এখনও সেই আগের মতোই রয়ে গেছে । একটুও বদলায়নি।’

‘কিছু বলছ না কেন?’ অভিমানী কণ্ঠে প্রশ্ন করল, বহ্নি।

‘হুম, পারবি। যখন খুশি তখন। এবার খুশি তো?’

‘অনেক।’ স্মিত হেসে বলল, বহ্নি।

‘আচ্ছা, কিছু বলার ছিল তোর?’

‘হুম, বলার তো ছিল।’

‘বল। আমি শুনছি।’

‘আগে বলো তুমি ‘না’ করবে না?’

‘আরে, আগে কথাটা তো শুনি। কথা রাখার মতো হলে তো অবশ্যই রাখব। তোর কথা কি কখনও ফেলেছি বল?’

বহ্নি এবার একটু ভরসা পেল। তাই সাহস করে কথাটা বলেই ফেলল, ‘আমাদের আশ্রমের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে তোমাকে আসতেই হবে। তুমি না আসলে আমি তোমার উপর ভীষণ রাগ করব।’

বহ্নির আমন্ত্রণের কথা শুনে অতলের প্রথমেই মনে হলো শিহরণের কথা। কেন যেন সে শিহরণের মুখোমুখি হতে চাইছে না। একটা দ্বিধা কাজ করছে মনের মধ্যে। চুপ করে রইল সে, অনেকক্ষণ।

বহ্নি আবার বলল, ‘কী হলো? আসবে না?’

‘আমি আসা আর না আসাতে কী আর এমন হবে বল তো?’

‘তুমি আসলেও বিশেষ কিছু হবে না আবার না আসলেও বিশেষ কিছু হবে না। কিন্তু আমি চাই, তুমি আসো। এখন বলো, আমার জন্য কি তুমি আসবে না?’

অতল পড়ল মহা মুশকিলে। পিচ্চিটার কথা সে ফেলতে চেয়েও যেন পারছে না! নানান চিন্তা করে শেষমেশ ঝোঁকের বশে বলল, ‘আসব। আমি অবশ্যই আসব। শুধু তোর জন্য।’

__________________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে