Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1549



ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৫৯+৬০

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৯

রাত গভীর হতে শুরু করেছে। অন্ধকার এসে ভর করেছে ধরণীতলে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে, কাছেই কোনও জঙ্গল হতে। শিহরণ হাঁটু ভাঁজ করে তার উপরে কনুই রেখে মাথায় সেই হাতটা ঠেকিয়ে রেখেছে। তার চোখের কোণা বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রুবিন্দু শুকিয়ে গেছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় সর্বস্ব খোয়ানো মুসাফিরের ন্যায় দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বসে আছে সে। ছোঁয়ার এহেন অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করতেও কালবিলম্ব করল না তার বেপরোয়া মন। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার।

রাত বেড়ে গেলেও শিহরণ বাসায় না ফেরাতে চিন্তিত হয়ে পড়েন সাবিহা সাবরিন। ছেলের পথ চেয়ে বসে ছিলেন অনেকক্ষণ। নিজের রুমে গিয়েও অস্থির হয়ে পায়চারি করলেন বেশ কিছুক্ষণ। তবুও শিহরণের দেখা পেলেন না। সন্তানের জন্য চিন্তা হলেও মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমানের পাহাড়ের কারণে নিজে থেকে খবরও নিতে পারছেন না। এক সময় বহ্নিকে বললেন কল করে খবর নিতে বলেন। বহ্নি বারবার কল দিলেও শিহরণ ফোন রিসিভ না করায় অতলকে কল দিল। অতলের কাছ থেকে পুরো বিষয়টা জেনে বহ্নি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। মাকে ছোঁয়ার এক্সিডেন্টের বিষয়টা জানিয়ে সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।

একজন নার্স যখন ছোঁয়ার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে এলো। অতল নার্সকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে জিনিসগুলো নিল। তারপর সেগুলো শিহরণকে দিল।

শিহরণ ছোঁয়ার জিনিসগুলো বুকের সাথে চেপে ধরে রাখল অনেকক্ষণ। পুরো হাসপাতাল জুড়ে নিস্তব্ধতা, কারও মুখে কোনো কথা নেই। সবাই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। শিহরণকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে বহ্নির খুব কষ্ট হতে লাগল।

শিহরণের পাশে বসে বহ্নি বলল, ‘ভাইয়া, তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো হবে না। নিজেকে শক্ত করো। ছোঁয়া আপুর কিছুই হবে না। তুমি পাশে থাকলে উনি সুস্থ হয়ে যাবে। আমি বলছি তো তোমাকে।’

শিহরণ নিভু নিভু চোখে তাকাল বহ্নির দিকে। বহ্নি হুট করেই শিহরণকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। এভাবেই কেটে গেল অনেকক্ষণ। অহনা, হিয়া, ফাহমিদা বেগম, সাইফ, অতল, রাদিদ, সবাই নীরব দর্শকের মতো শিহরণকে ভেঙ্গে পড়তে দেখছিল। সবাই মনে মনে যেন একটা কথাই বলল, ‘ভাগ্যিস বহ্নি এসেছিল।’

রাদিদের মন এক অব্যক্ত ভালো লাগায় ছেয়ে গেল। বহ্নির মতো এমন একজন মানুষকে পাশে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। সে যেই ভূমিকাতেই থাকুক না কেন। এসব ভাবনার মাঝেই রাদিদের বুক চিরে এক হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

ওটি থেকে বেরিয়ে ডাক্তার বললেন, ‘অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে, তবে পেশেন্টের জ্ঞান ফেরেনি। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত পা কাটতে হয়নি। তবে পেশেন্ট আর হাঁটতে পারবে বলে মনে হয় না। একটা পা পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়েছে।’

শিহরণ ডাক্তারের কথা শুনে আঁতকে উঠল। বহ্নি শিহরণকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘তেমন কিছুই হবে না, ভাইয়া। তুমি দেখে নিও।’

সবাই সমস্ত কাজ ফেলে হাসপাতালে বসে আছে। মায়া আর সাইফ দুজন মিলে সবাইকে চলে যেতে বলল। কিন্তু কেউ রাজী হলো না। অবশেষে শিহরণ সবাইকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমি আছি আমার প্রিয়তার সাথে। সবাই এখানে থাকা ঠিক হবে না।’

বহ্নিকেও জোর করে পাঠিয়ে দিল সে। রাদিদ অহনা, হিয়া আর ফাহমিদা বেগমকে সাথে করে নিয়ে গেল। সাইফ, মায়াকে পৌঁছে দিতে গেল। যদিও সে বাসায় যাবে না বলে কাঠ হয়ে বসেছিল। অতল আর বহ্নি একসাথে গেল।

_____________________

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অতল হুট করেই বহ্নির হাত ধরে ফেলল। বহ্নি বলল, ‘কী শুরু করেছ? কেউ দেখে ফেলবে তো।’

অতল বহ্নির হাত আরও শক্ত করে ধরে নির্বিকার ভঙ্গিতে ম্লান কণ্ঠে বলল, ‘দেখলে দেখুক। আমার পরীর হাত আমি না ধরলে আর কে ধরবে?’

এতসব বিষণ্নতার মধ্যেও বহ্নি অতলের করা পাগলামির জন্য ক্ষণিকের জন্য ঠোঁট টিপে হাসল। হাসি চেপে রেখে বলল, ‘কেন? পরীর হাত তো অনেকেই ধরতে চাইতে পারে। তাই না?’

‘চাইলে কি সব পারা যায়, এঞ্জেল?’

হঠাৎ করেই বহ্নির মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক বলছ। চাইলেই সব পারা যায় না। ছোঁয়া আপু আর ভাইয়ার জন্য খুব খারাপ লাগছে। এমন কেন হয়? সবকিছু ঠিক হয়েও হয় না। সবাই ভালো থাকতে চেয়েও ভালো থাকতে পারে না। আমি তো জানি ভাইয়া কেমন পাগলের মতো ভালোবাসে আপুকে। ছোঁয়া আপুর কিছু হয়ে গেলে ভাইয়া একদম শেষ হয়ে যাবে।’

অতল দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘ছোঁয়ার কিছুই হবে না। একটু আগেই তো তুমি বলেছ, শিহরণকে। এখন নিজেই ভেঙ্গে পড়ছ!’

‘অন্যকে বোঝানো সহজ। কিন্তু নিজেকে বোঝানো অনেক কঠিন। ভয় হচ্ছে আমার। খুব ভয় হচ্ছে।’

রাদিদ যখন অহনা, হিয়া আর ফাহমিদা বেগমকে নিয়ে গাড়িতে উঠছিল ঠিক তখন চোরা চোখে একবার তাকাল অতল আর বহ্নির দিকে। বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল সে। তবুও সেটাকে পাত্তা দিল না। অবাধ্য দৃষ্টিকে সংযত করে নিল সে।

_____________________

সাব্বির আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইটের জন্য বেরিয়েছেন কেবল। এনাউন্সমেন্ট হবার পর পরই খবরটা পেলেন তিনি। এই বিজনেস ট্যুরটা তার জন্য যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার নিজের সন্তান। সন্তানকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে তিনি বিজনেস ট্যুরে যেতে পারলেন না।

সাব্বির আহমেদ যখন হাসপাতালে পৌঁছালেন তখন রাত প্রায় বারোটা। শিহরণকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে তিনি চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন শিহরণের কাছে। শিহরণ বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়াল, শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আব্বু, ছোঁয়ার কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচব না।’

সাব্বির আহমেদ ছেলের পিঠে চাপড় মেরে বললেন,’আমার ছেলে তো এভাবে ভেঙ্গে পড়ার কথা নয়। আমার বউমার কিচ্ছু হবে না।’

বাবার মুখে উচ্চারিত ‘বউমা’ শব্দটা শুনে শিহরণ আবেগের বশে বাবাকে আবারও জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘সত্যি বলছ, আব্বু?’

সাব্বির আহমেদ প্রশস্ত হেসে বললেন, ‘একদম সত্যি বলছি।’

শিহরণ হঠাৎ মরিয়া হয়ে বলল, ‘আব্বু, ডাক্তার বলেছে ও আর হাঁটতে পারবে না।’

কথাটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না সাব্বির আহমেদ। তবুও নিজেকে সংযত করে নিলেন মুহূর্তেই। স্মিত হেসে বললেন, ‘ছোঁয়া যদি হাঁটতে না পারে তবে কী তার প্রতি তোমার ভালোবাসা কমে যাবে?’

শিহরণ আঁতকে উঠে বলল, ‘কীসব বলছ আব্বু?’

‘এইতো।’ সাব্বির আহমেদ এবার প্রশস্ত হেসে বললেন, ‘ভালোবাসার মানুষ যেমন তাকে তেমনভাবেই গ্রহণ করা উচিত। ও হাঁটতে না পারলেও তোমার ভালোবাসা একটুও কম হবে না। তবে এত চিন্তা কিসের?’

‘আব্বু, ছোঁয়া এটা সহ্য করতে পারবে না।’ মলিন গলায় বলল শিহরণ।

‘এইখানে কাজ না হলে স্পেশালিস্টকে দেখাব। তুমি এত ভেবো না, বাবা।’ একটু থেমে সাব্বির আহমেদ বললেন,’ছোঁয়া হাঁটতে পারুক আর না পারুক এই মেয়েটাই কিন্তু আমার পুত্রবধূ হবে। এই ক্ষেত্রে আমি তোমার আপত্তিও শুনব না।’

এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও শিহরণ হেসে ফেলল। সাব্বির আহমেদ বললেন, ‘এভাবেই সবসময় হাসতে থেকো, বাবা। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কাজের ব্যস্ততা সবকিছু এভাবে উল্টেপাল্টে দেবে তা তো ভাবনাতেই আসেনি। তবে আমি তোমার উপর খুব রাগ করেছি। এই মেয়েটির কথা জানাওনি কেন আমায়?’

শিহরণ মাথা নিচু করে ফেলল। সাব্বির আহমেদ গম্ভীর মুখ করে বললেন, ‘সেই ছোট্ট বেলা থেকে ভালোবাসো অথচ আমাকে জানাওনি। এই কারণে আমি খুবই রুষ্ট হয়েছি তোমার উপর। ছোটোবেলায় তো খুব করে বলেছিলে, এই মেয়েকে তোমার অন্য এক বন্ধু ভালোবাসে, তুমি নও। অথচ বন্ধুর নাম দিয়ে নিজের সমস্যার সমাধান চাইছিলে। এবারও না হয় ঠিক তেমনটাই করতে। এতে অন্তত বিষয়টা আমার জানা হয়ে যেত।’

শিহরণ কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,’তুমি তখন বুঝতে পেরেছিলে?’

‘তোমার বাবাও তো তোমার মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। এটা ভুলে যাও কেন, শিহরণ।’

‘তোমার ফ্লাইটের কী হলো, আব্বু? আর এসব কীভাবেই বা জেনেছ, আব্বু?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল শিহরণ।

‘ফ্লাইট ক্যানসেল করে দিয়েছি। আর যার কাছ থেকেই জানি না কেন, শুধু এটা জেনে রাখো, সে তোমার সবচাইতে বড়ো শুভাকাঙ্ক্ষী। তুমি তো আব্বুকে ভরসা করো না। কিন্তু যে বলেছে, সে ভাবে আমি একজন সুপারম্যান যে সব সমস্যার সমাধান নিমেষেই করে দিতে পারে।’ সাব্বির আহমেদ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললেন।

বাবাকে সব কথা কে জানিয়েছে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকল না শিহরণের। শিহরণ স্মিত হেসে বলল, ‘সত্যিই আব্বু, তুমি আমাদের জন্য সুপারম্যান।’

‘ঠিক আছে। এখন আর এসব লোক শুনানো কথা বলে আমাকে খুশি করতে হবে না। এখন চলো কিছু খাবে।’

‘আমার খিদে নেই, আব্বু।’

‘এখন কি আব্বুর সাথে মিথ্যে কথা বলবে?’

‘সত্যি বলছি তো। আমি এখন কিছু খেতে পারব না। ছোঁয়া ভালো নেই। আমি কী করে খাব, আব্বু?’

‘ছোঁয়ার জন্যই তো খেতে বলছি। সে কিন্তু ভীষণ রাগ করবে যখন জানতে পারবে তুমি সারাদিন ধরে কিছু খাওনি। আমার কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমাকে কম্পানি দিতে অন্তত কিছু মুখে দিও।’

খাওয়ানোর জন্য বাবার ফন্দি দেখে মনে মনে আপ্লুত হলো শিহরণ। বলল, ‘ঠিক আছে। কম্পানি দেওয়া যাবে।’

______________

সাবিহা সাবরিনের চোখ থেকে যেন ঘুম চলে গেছে। মাথার উপরে ফ্যান চলছে। তিনি সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সাব্বির আহমেদ যখন রুমে ঢুকলেন তখন তাকে এত রাতে দেখে সাবিহা সাবরিন চমকে উঠলেন। বললেন, ‘তোমার না অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা? এখানে কীভাবে?’

সাব্বির আহমেদ গমগমে গলায় বললেন, ‘আমি চলে গেলে খুব খুশি হতে নিশ্চয়ই?’

সাবিহা সাবরিন ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, ‘এসব কী বলছ তুমি? আর এভাবে কেনই বা কথা বলছ?’

সাব্বির আহমেদ স্ত্রীর প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি, সাবিহা।’

‘আমি কী করেছি?’ অসহায় গলায় প্রশ্ন করলেন, সাবহা সাবরিন।

‘বাহ্! খুব সুন্দর প্রশ্ন।’ তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন সাব্বির আহমেদ।

‘তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন, সাব্বির?’ সাবিহা সাবরিন ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।

‘শিহরণ কোনো বাচ্চা ছেলে নয়, সাবিহা। তুমি ওর উপর জোর করে যা খুশি তাই করাতে পারো না। ছেলে বাধ্য বলেই কি তার উপর অন্যায় করতে হবে?’

‘এখন সব দোষ তবে আমার।’

‘নিজের বোনের মেয়েকে এতোই পছন্দ হলে তুমি ওই মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারো। তবে আমার ছেলের বউ হিসেবে নয়। আমার ছেলে যাকে ভালোবাসে তার সাথেই তার বিয়ে হবে।’

‘আমি রাফিয়াকে কথা দিয়েছি, সাব্বির।’

‘ওটা ছিল তোমার জীবনে করা সেরা বোকামি। তোমার বোনকে দেওয়া কথা রাখার জন্য আমি আমার ছেলের খুশি মাটি করতে পারব না।’ কাটকাট উত্তর দিলেন সাব্বির আহমেদ।

‘তুমি এটা করতে পারো না, সাব্বির।’

‘আমার ছেলের খুশির জন্য আমি এটা অবশ্যই করব।’ সাবিহা সাবরিনের দু’হাত ঝাঁকিয়ে সাব্বির আহমেদ বললেন, ‘একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখেছ কী অবস্থা হয়েছে তার? মাত্র একটা দিনে ওর কী ভয়ংকর অবস্থা হয়েছে দেখেছে তুমি? তুমি তোমার অভিমান নিয়ে থাকো। আমার যা করার আমি তাই করব।’

সাবিহা সাবরিন বিছানার উপর বসে পড়লেন। সাব্বির আহমেদ আবারও বললেন, ‘তুমি ওই মেয়েটাকে বলেছ মিডল ক্লাস! সিরিয়াসলি, সাবিহা? তুমি কখন থেকে ক্লাস মেইনটেইন করছ? আমার তো তোমার এই অসাধারণ শ্রেণীবিন্যাসের ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না। এমন আর কি কি আছে যা আমে এখনও জানি না? আমাকে জানাও প্লিজ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।’

‘সাব্বির!’ সাবিহা সাবরিন চিৎকার করে উঠলেন। বিষণ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছিলাম। আমার যে ছেলেটা কখনও আবাধ্য হতো না। আজ সেই ছেলেটাকে এতোটা অবাধ্য হতে দেখে আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ওই মেয়ের উপরে আমার প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। তাই রাগের বশে বলে ফেলেছিলাম।’

‘সাবিহা, তুমি কি জানো এই মেয়েটাকে শিহরণ সেই ছোটোবেলা থেকে ভালোবাসো? মাঝখানে কতো ঝামেলা গেল, তবুও সে এই মেয়েটাকে ভুলেনি। ওদের মধ্যেকার এত দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও ওদের ভালোবাসা নিঃশেষ হয়ে যায়নি।’

সাবিহা সাবরিন অসহায় বোধ করলেন। এসবের কিছুই তিনি জানেন না। জানলে হয়তো বোনকে কথা দিতেন না। তাছাড়া মান্নাতকেও তিনি খুবই পছন্দ করেন। এখন তিনি কী করবেন তিনি কোনোভাবেই ভেবে পাচ্ছেন না!

____________________

বি.দ্র. এই পর্বটা ডেডিকেট করলাম রুপুকে। আজকে তার জন্মদিন। হ্যাপি বার্থ ডে রুপু❤।

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৬০

রাত বাড়ছে। নিশাচর পাখিদের ডাক ভেসে আসছে বাতাসে ভর করে। থেকে থেকে ওই ডাক ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ঠিক যেন অতিপ্রাকৃতিক কোনো কিছুর উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। হঠাৎ একরাশ শীতল দমকা বাতাস এসে শীতলতার স্পর্শ দিয়ে গেল শিহরণের শরীরে। শিহরণ একটা জানালা খোলা রেখেছে। তার উদাস দৃষ্টি জানালার বাইরে ঘন জঙ্গলের দিকে নিবদ্ধ। ভয়ংকর এক অন্ধকার গ্রাস করে ফেলেছে সবুজের সমারোহে ঘেরা জঙ্গলটিকে। এমনতর গ্রাসের কথা ভেবে হু হু করে কেঁপে উঠল শিহরণের মর্মদেশ। খুব অদ্ভুত সব মিল খুঁজে বেড়াচ্ছে শিহরণ! তার মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো এবড়ো থেবড়ো হয়ে পড়ে আছে অবহেলায়। সবুজাভ চোখ জোড়া নিষ্প্রভ, নিষ্প্রাণ। যেন বহুদিন যাবত সঞ্চিবনী সঞ্চার হয়নি ও চোখে। মশার দল হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে জানালার ফাঁক গলে। শিহরণ দ্রুত জানালা বন্ধ করে দিল। তারপর ছোঁয়ার শিয়রের পাশে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছোঁয়ার দিকে। এতক্ষণ পরে সে ছোঁয়ার মুখটা খেয়াল করল। ছোঁয়ার মুখের একপাশে বেশ ক্ষত হয়েছে, কালচে দাগ পড়েছে চেহারার বাম পাশের অংশটাতে। চোখের নিচে কালি দৃশ্যমান। শিহরণ বিড়বিড় করে বলল , ‘কিছু কিছু অভিমানের মাশুল বড়ো বেশি ভয়ংকর। যে অভিমান দু’টো মানুষের হৃদয়ে সমানভাবে প্রভাব ফেলে সে অভিমানের ঝড়ো হাওয়া কেন আসে তাদের জীবনে! ভালোবাসার গভীরতা প্রমাণে না-কি ঢুনকো বিশ্বাসের প্রমাণ দিতে?’

সারারাত নির্ঘুম কেটেছে শিহরণের। ছোঁয়ার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মুখের সাথে লাগিয়ে রেখেছে, যেন হাতটা ছেড়ে দিলেই সে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। ভোরের দিকে ছোঁয়ার জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলেই দেখতে পেল শিহরণকে। তার পাশে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথা হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তার হাতটা এখনও শিহরণের হাতের মুঠোয়।
মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো উস্কখুস্ক আর এলোমেলো হয়ে আছে। সেই চুলগুলো দেখে ছোঁয়ার ইচ্ছে হলো এখনি ঠিক করে দিতে অবহেলায় পড়ে থাকা চুলগুলোকে। হালকা সবুজাভ চোখ জোড়া যেন তার সবুজাভ হারিয়ে ম্লান হয়ে আছে, সেখানে শুধুই হাহাকার দেখতে পেল ছোঁয়া। ছোঁয়া হাতটা নাড়াতেই শিহরণ চোখ খুলে তাকাল। শিহরণের মুখে তৎক্ষণাৎ হাসি ফুটে উঠল। ঠিক যেন বহু প্রতীক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির পরশ পেয়ে স্নিগ্ধ, সতেজ হয়ে উঠে প্রকৃতি। শিহরণ ছোঁয়ার কপাল আর মুখে তার ভালোবাসার পরশে সিক্ত করে দিল, বিশেষ করে সদ্য ক্ষত হওয়া মুখের সেই অংশটাতে। ছোঁয়া ম্যাড়মেড়ে গলায় বলল, ‘কী শুরু করেছ? আমার মুখটা কি খেয়ে ফেলার অভিসন্ধি আছে না-কি? আর কী অবস্থা করেছ নিজের? এরকম ভূতগ্রস্তের মতো দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?’

নিজের এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়ও তার কথা ভাবাতে শিহরণ ভারী অবাক হলো। অভিমানে ভরা কণ্ঠে বলল, ‘আমার কথা ভাবতে হবে না তোমার। নিজের কথা ভাবো। একটাবারও ভাবলে না তোমাকে ছাড়া আমার কী হবে?’

‘এখনও কী আমার সাথে রাগ করেই যাবে?’ শিহরণের দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল ছোঁয়া।

‘হুম।’ সংক্ষেপে বলল শিহরণ। পরক্ষণেই ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল, ‘এখন কেমন লাগছে তোমার?’

‘আমি ঠিক আছি।’ কথাটা বলেই ছোঁয়া উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনোভাবেই পা নড়াতে সক্ষম হলো না। ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল শিহরণ। কাতর স্বরে সে বলল, ‘আহা! তুমি উঠছ কেন? ডাক্তার বলেছে
কয়েক মাস অবধি তোমাকে ফুল বেড রেস্টে থাকতে হবে।’

ছোঁয়া আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘আমি পা নাড়াতে পারছি না কেন শিহরণ? আমার পায়ে কী হয়েছে?’

শিহরণ আঁতকে উঠল। তার বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা হতে শুরু করল। চোখ বন্ধ করে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে সে বলল, ‘কিছুই হয়নি ছোঁয়া। এক্সিডেন্টে পায়ে সামান্য ফ্যাকচার হয়েছে। ট্রিটমেন্ট করলে পা আবারও ঠিক হয়ে যাবে।’

ছোঁয়া করুণ চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। চোখ দিয়ে উষ্ণ নোনা জল বেরিয়ে পড়ছে। ছোঁয়ার চোখ উপচে পড়া হৃদয়ের রক্তক্ষরণের চিহ্নস্বরূপ উষ্ণ নোনাজলের উপরে শিহরণ তার শুষ্ক, তৃষ্ণার্ত অধরদ্বয়ের পরশ দিয়ে সেই রক্তক্ষরণ প্রশমিত করার চেষ্টায় লিপ্ত হলো। ছোঁয়া বিদগ্ধ হৃদয়ের মৃদু প্রকাশমান গভীরতর কষ্ট বুকে চেপে রেখে ম্লান কণ্ঠে বলল, ‘আমি আর হাঁটতে পারব না। তাই না, শিহরণ?’

এই প্রশ্নটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শিহরণ। তার বুকের ভেতর এক অজানা ব্যথা থেকে থেকে আছড়ে পড়ছে সমুদ্র তীরে উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ার মতো করেই। সে ছোঁয়ার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘তুমি অবশ্যই হাঁটতে পারবে। আমি আছি তো তোমার সাথে।’

‘মিথ্যে সান্ত্বনা চাই না আমার।’ অভিমানী গলায় বলল ছোঁয়া।

‘আমি কি কখনও তোমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছি?’

ছোঁয়া ছলছল চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। কিছুই বলল না। শুধু তাকিয়েই থাকল। দূর থেকে আজানের সুমধুর ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকল চারপাশের প্রকৃতি। পাখির কিচির মিচির আওয়াজে স্নিগ্ধ সকালের আমেজ বোঝা গেল। দু’টো মানুষ কোনো প্রকার বাক্য ব্যয় না করেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকল নিঃশব্দে, নীরবে দু’টো হৃদয়ের অব্যক্ত কথন শুধুমাত্র দৃষ্টির মাধ্যমে আদান-প্রদান হচ্ছে। এই দৃষ্টির বিনিময় যেন বহু প্রতীক্ষীত ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষারত দু’টো হৃদয়ের তরে। যেখানে বিরাজ করছে ব্যক্ত, অব্যক্ত ভালোবাসার উপাখ্যান। ব্যথা আর আর্তানাদে ভরা এই সঙ্কটময় সময়ের সান্ত্বনা ভরা অব্যক্ত আশ্বাস।

________________

বহ্নি হুট করে এসেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ আব্বু। তুমি ফিরে না এলে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেত। ভাইয়াকে কিছুতেই সামলানো যেত না।’

‘বাবকে কি কেউ ধন্যবাদ দেয়, এঞ্জেল?’

বহ্নি মুচকি হেসে বলল, ‘আব্বুকে ধন্যবাদ দিইনি তো। আমাদের সুপারম্যানকে ধন্যবাদ দিয়েছি।’

‘আমার এঞ্জেল তাহলে কথা এড়াতে শিখে গেছে?’

‘আব্বু!’ বহ্নি মুখ গোমড়া করে বলল, ‘তুমি আমার সত্যি কথাগুলো বিশ্বাস করো না কেন?’

‘এত বড়ো অপবাদ!’ সাব্বির আহমেদ অবাক হবার ভান করে বললেন, ‘আমার মামুণিটার কথা বিশ্বাস না করলে কি ফিরে আসতাম?’

‘হু, তাও ঠিক।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘এরপর কী হবে আব্বু? কিছু ভেবেছ?’

‘আমার বউমাকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া তো আর কিছু আপাতত ভাবতে পারছি না।’

বহ্নি উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘ইউ আর দ্যা বেস্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।’

সাব্বির আহমেদ হেসে বহ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অ্যান্ড ইউ আর দ্যা বেস্ট সিস্টার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।’

বহ্নি এবার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘মাই ব্রাদার অলসো দ্যা বেস্ট ব্রাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।’

সাবিহা সাবরিন বাবা-মেয়ের কথা শুনে মুখটা মলিন করে ফেললেন। মনে মনে ভাবলেন, ‘বাহ্! সবাই কী সুন্দর করে আমাকে ভুলে গেল। সত্যিই দারুণ। বাইরের একটা মেয়ের জন্য আমাকে ভুলে গেল সবাই! সবকিছু ওই মেয়েটার জন্য। যে মানুষটা আমার জন্য পাগল সেই মানুষটাও আমার সাথে ঠিকভাবে কথা বলছে না। আমি ওই মেয়েকে কখনোই মেনে নিতে পারব না।’

কথাগুলো মনে মনে আওড়িয়ে সাবিহা সাবরিন দরজার আড়াল থেকে সরে দাঁড়ালেন। যদি আর কিছুক্ষণ থাকতেন তবে শুনতে পেতেন সাব্বির আহমেদের বলা কথাগুলো।

সাব্বির আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোমার আম্মুও বেস্ট আম্মু এটা ভুলে গেলে চলবে না কিন্তু।’

বহ্নি হেসে বলল,’ভুলে যাওয়ার মতো কোনো অপশন নেই আব্বু।’

____________

সাব্বির আহমেদ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলেন। শিহরণ বাসায় ফিরলে তিনি জরুরি ভিত্তিতে বলেন, ‘দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো। তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’

শিরহণ এতটাই ক্লান্ত ছিল যে কোনো কথা না বলেই শুধুমাত্র মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল ফ্রেশ হতে। সাব্বির আহমেদ ছেলের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেলেন। তাই অবশেষে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন। নয়তো কিছুদিন অপেক্ষা করাই যেত।

সাবিহা সাবরিন বললেন,’কী ভাবছ সাব্বির?’

সাব্বির আহমেদ মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো। সবকিছুই বলব।’

শিহরণ ফ্রেশ হয়ে এসে বসল বাবার পাশে। সাব্বির আহমেদ কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘ডাক্তারের সাথে আমার কথা হয়েছে। ছোঁয়ার পায়ের ফ্র্যাকচারটা বেশি। হাঁটতে পারলেও তাতে সময় লাগবে। কোনও স্পেশালিস্টকে দেখাতে হবে।’

শিহরণ মাথা নিচু করে মলিন কণ্ঠে বলল, ‘আমি জানি আব্বু।’

‘এই অবস্থায় কি তুমি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজী আছ? মানে ছোঁয়াকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি নেই তো?’

সাবিহা সাবরিন চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘তুমি কীসব বলছ? তোমার মাথা ঠিক আছে? যে মেয়েটা হাঁটতে পারবে কি না নিশ্চিত নেই সেই মেয়েটাকে তুমি আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছ?’

সাব্বির আহমেদ একটা হাত তুলে স্ত্রীকে থামার ইশারা করে বললেন, ‘আমি যা করছি আমাদের ছেলের ভালোর জন্যই করছি। একটু আস্থা রাখো আমার উপর।’

শিহরণ এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। কোনো কথাই যেন বেরুতে চাইছে না। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও সে ছলছল চোখে তাকিয়েই থাকল।

সাব্বির আহমেদ পুনরায় বললেন,’ছোঁয়া হয়তো কখনোই হাঁটতে পারবে না। এই সত্য মেনে নিয়েই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবার বলো, ছোঁয়াকে বিয়ে করতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?’

‘আপত্তি!’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল শিহরণ। বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। ধরে আসা গলায় সে বলল, ‘ও যদি কোনোদিন হাঁটতে না পারে তবুও আমার কোনো আপত্তি নেই আব্বু। আমি তো ওর বাহ্যিক সৌন্দর্যের মোহে পড়িনি। আমি ব্যক্তি মানুষটাকে ভালোবেসেছি।’

‘তাহলে এই কথায় রইল।’ সাব্বির আহমেদ বললেন, ‘আমি বাকি কাজটুকু শীঘ্রই শেষ করে ফেলতে চাই।’

সাবিহা সাবরিন বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। অপরদিকে শিহরণ মন্ত্রমুগ্ধের মতন করে বাবার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকল। বহ্নি শিহরণের গা ঘেঁষে বসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘আমার ভাইটা কি খুশি হতে ভুলে গেছে?’

শিহরণ বহ্নির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। বলল, ‘মেন্টাল শক ট্রিটমেন্ট মানুষের বোধশক্তি ক্ষণিকের জন্য লোপ পেয়ে যায়। আমারও এমন অবস্থা হয়েছে আরকি।’

‘তাহলে তো বলতেই হচ্ছে আব্বু বেশ ভালো শক ট্রিটমেন্ট দিতে পারে।’ বহ্নি বেশ ভাব নিয়ে বলল।

‘স্বীকার না করার আর কোনো উপায় তো থাকল না, বার্বি ডল।’

সাবিহা সাবরিন যেন এতক্ষণ পরে সংবিৎ ফিরে পেলেন। ছেলে, মেয়ে, স্বামী কেউই তার কোনো প্রকার তোয়াক্কা করছে না। এই বিষয়টা তিনি মানতেই পারছেন না। হঠাৎ করেই বহ্নির উপরে তার খুব রাগ হলো। এই মেয়েটা বড্ড বেশি বেয়াড়া। কথা শুনতে চায় না। এই সবকিছু এই মেয়ের জন্যই হয়েছে, তিনি এই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত। তিনি নিজে নিজেই স্বগোতোক্তি করে বললেন, ‘তবে কি আমি মেয়েটার লাগাম টানার ক্ষেত্রে ভুল করে ফেললাম?’

এসবকিছু ছাপিয়ে ছোঁয়ার উপরে গিয়ে পড়ল তার সমস্ত ক্রোধ। মাত্র দুদিনের পরিচয়ে এই মেয়েটা তার আপনজনদের জাদুমন্ত্র বলে তার বিপক্ষে নিয়ে গেছে। তিনি কোনোভাবেই এই মেয়েটাকে মেনে নিতে পারবেন না। কোনোভাবেই না! মনে মনে তিনি এক শক্ত প্রতিজ্ঞা করে বসলেন।
_________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৫৬+৫৭+৫৮

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৬

মান্নাতের কথা শুনে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলো শিহরণ। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘সে থাকবে না মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?’

‘তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে। আই মিন ইট, শিহরণ।’ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, মান্নাত।

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ, মান্নাত?’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শিহরণ।

‘হুম, আমি পাগল হয়ে গেছি, তোমার ভালোবাসার জন্য পাগল হয়েছি।’ অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় বলল, মান্নাত।

শিহরণ মেজাজ ক্রমেই পারদস্তম্ভের ন্যায় উর্ধ্বগতিতে আরোহণ হচ্ছিল। সে নিজেকে শান্ত করার প্রাণপ্রণ চেষ্টা করছে। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না। অযথা এমন জেদের বশে আমাদের মধ্যের বন্ধুত্বটা অন্তত নষ্ট করো না।’

‘বন্ধু? তুমি কি আমাকে কখনও বন্ধু ভেবেছ?’ মান্নাতের কন্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে আসতে চাইছে।

শিহরণ ভেবে দেখল সে কখনোই মান্নাতকে বন্ধু ভাবেনি, ভাবতে পারেনি। তার সঙ্গ সে কখনওই পছন্দ করত না, এখনও করে না। পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে দু’চারটে কথা বলা পর্যন্তই সীমিত ছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, ‘তুমি আমার কাজিন তো হও। সেই সম্পর্কটা অন্তত নষ্ট করো না। তোমার প্রতি আমার অনুরোধ এটা।’

মান্নাত শিহরণের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘মেয়েটা কি আমার চাইতেও সুন্দরী?’

‘কী!’ আচমকা অন্য প্রসঙ্গ আসাতে শিহরণ বুঝতে না পেরে তেতে উঠে বলল, ‘কীসব বলছ তুমি?’

‘তুমি যাকে ভালোবাসো সে কি আমার চাইতেও সুন্দরী।’

এমন একটা প্রশ্ন শিহরণ আশা করেনি। সে আচমকা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘এই অদ্ভুত প্রশ্ন কেন করছ, মান্নাত?’

শিহরণকে হাসতে দেখে মান্নাতের খুব রাগ উঠে গেল। তারপরেও সে নিজেকে সংযত করে বলল, ‘প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইছ কেন?’

‘এমন অদ্ভুত আর অবান্তর প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না।’ শিহরণ একটু থেমে আবারও বলল,’বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রসঙ্গে আমি কিছুই বলব না, তবে অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যে সে অতুলনীয়।’

মান্নাত শিহরণের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর ভূতগ্রস্তের মতো তার কাছে ঘেঁষে আবারও বলল, ‘তুমি শুধুই আমার। আর কাউকে তোমার হতে দেব না। তুমি চাইলেও না।’

শিহরণকে হালকা থ্রেট দিলেও শিহরণ সেটা গায়ে মাখল না। মান্নাতের দেওয়া থ্রেটকে সে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। তাতেই মান্নাত তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। সে মনে মনে বেশ কয়েকটা ছক কষে ফেলল। শিহরণের বাসা থেকে বেরিয়েই সে রাফিকে কল করল। রাফি কাল বিলম্ব না করেই মান্নাতের কল রিসিভ করল। মান্নাত বলল, ‘আমার সাথে এখনি দেখা করো।’

রাফি নিজের হাতের ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আমি আধ ঘন্টার মধ্যেই আসছি।’

রাফি আসার পরে মান্নাত পুরো ঘটনা খুলে বলল রাফিকে। রাফি দ্রুত ভাবছে। মান্নাতের মনের মধ্যে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডকে বাড়িয়ে দেবার এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা সে নয়। তাই সে দ্রুত তার মোবাইলটা বের করে ছোঁয়ার ছবিটা দেখাল।
মান্নাত যখন ছোঁয়ার ছবিটা দেখল তখন তার একে একে সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে গেল। শিহরণ এই মেয়েটার উপরেই সবসময় নজর রাখত। অথচ সে কখনোই এই মেয়েটাকে পাত্তা দেয়নি। শিহরণ এমন একটা মিডল ক্লাস মেয়েকে পছন্দ করতে পারে সেই ভাবনা তার মাথাতেই আসেনি। ভুল করেছে সে, মস্ত বড়ো ভুল। কিন্তু এবার সে আর কোনো ভুল করবে না বলেই মনে মনে পণ করল।

মান্নাত রাফিকে বলল, ‘এই মেয়েটার সমস্ত ডিটেইল আমার চাই। ও কখন কোথায় যায়, কী করে সবকিছু। একটা ছোট্ট বিষয়ও যেন বাদ না যায়।’

রাফি দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। মান্নাত ওয়েটারকে ডেকে একটা কোল্ড কফি অর্ডার দিল। এই মুহূর্তে তার মাথাটা ঠান্ডা রাখা খুব জরুরী। তাকে যে শান্ত থাকতেই হবে।

____________________

‘আমার চালচলনে তোমার এতোই সমস্যা থাকলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। গট ইট?’ নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাটা বলেই আমিরাহ নিজেকে শেষবারের মতো আয়নায় দেখে নিল আরও একবার।

আশফাক বিব্রত হয়ে গেল আমিরাহর কথায়। টিয়ার জন্য সে চেয়েছিল তার আর আমিরাহের সম্পর্ককে শেষবারের মতো একটা সুযোগ দিতে। কিন্তু আমরাহ এখনও সেই টিনেজদের মতোই জীবনকে উপভোগ করতে চায়। তার জীবনযাপন পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, বিয়ের এত বছর পরেও।

সে পরাস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘একবার আমাদের মেয়ের কথাটা তো ভাবো, আমিরাহ।’

আমিরাহ ভাবলেশহীন হয়ে বলল, ‘টিয়ার কথা কী ভাবব আমি? ও তো ভালোই আছে। যখন যা চাইছে সব তো পাচ্ছে। তাহলে আর কি লাগবে ওর?’

‘আমার মেয়েটা তার মাকে পাচ্ছে না। বুঝতে পারছ তুমি, টিয়া তার মাকে কাছে চায়, মায়ের সঙ্গ পেতে চায়, অন্য দশটা বাচ্চার মতো। তুমি কি তাকে সেই সময়টা দিচ্ছ, সেই ভালোবাসা দিচ্ছ?’

আমিরাহ রেগে গেল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বলল, ‘টিয়া এখন আর এতোটাও ছোটো না যে তাকে কোলে নিয়ে আমাকে ঘুরতে হবে। এমনিতেই তোমাকে বিয়ে করে আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল করেছি। এখন তোমার কথা শুনে দ্বিতীয় কোনো ভুল আমি করতে চাই না।’

আশফাক নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে বলল, ‘তোমার পাগলামির কারণে আমার জীবনটাই তো শেষ হয়ে গেছে। তোমার ভুলের কারণে শাস্তি তো আমি পেয়েছি। এখন আমার মেয়েও সেই শাস্তি ভোগ করছে।’

‘তুমি শাস্তি পাচ্ছ?’ আমিরাহ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘তুমি আমার একটা ভুল আশফাক। কম বয়সে করা সবচাইতে বড়ো একটা ভুল। তোমার মতো সেকেলে একটা মানুষকে আমি কী করে ভালোবেসেছি আমি সেটা ভাবতেই পারছি না। কী বোকাটাই না ছিলাম আমি!’

আশফাক ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। যেই মেয়ের পাগলামোর কারণে তাকে যার ভালোবাসাকে হারাতে হয়েছে, সেই মেয়েটাই এখন তাকে সহ্য করতে পারছে না, তার নিজের করা ভুলের সমস্ত দায় তার উপরে অর্পণ করছে। তার মনে হলো, এই ঘটনাটা অদৃশ্যের পরিহাস নয়তো আর কী!

আশফাককে কথাগুলো বলেই আমিরাহ গটগট করে হেঁটে পার্টির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। আমিরাহ চলে যেতেই টিয়া এসে আশফাককে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, মা খুব খারাপ। তোমার সাথে ঝগড়া করে সবসময়।’

আশফাকের চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ডান হাতের আঙ্গুলি দ্বারা সেই অশ্রুবিন্দু অতি সন্তর্পণে মুছে নিল আশফাক। মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘মায়ের সম্পর্কে এরকম বলতে নেই, মামুণি।’

টিয়া বলল, ‘মা আমাকে ভালোবাসে না কেন, বাবা?’

কিছু প্রশ্নের উত্তর হয় না। কারও কাছেই সেই সব প্রশ্ন উত্তর থাকে না। তাই সেই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। আশফাকও তার ব্যতিক্রম করল না। সে মুখে কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বলল, ‘চলো মামুণি, আমরা এখন খেলতে যাব। বাবার সাথে খেলবে তো?’

টিয়ার মুখে তৎক্ষণাৎ হাসি ফুটল। মাথা উপর নিচ করে সে সম্মতি জানাল।

__________

ছোঁয়াকে কাছে আসতেই জড়িয়ে ধরল শিহরণ। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। ছোঁয়ার একটু খটকা লাগল। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘কী হয়েছে, শিহরণ? তুমি ঠিক আছ?’

শিহরণ ছোঁয়াকে ছাড়ল না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। ছোঁয়া বলল, ‘সবাই দেখছে তো, জনাব শিহরণ।’

শিহরণ জবাব দিল, ‘দেখুক। দেখলে কী হয়েছে?’

‘আরে বাবা তোমার কী হয়েছে বলবে তো না-কি?’ অধৈর্য গলায় বলল, ছোঁয়া।

শিহরণ এবার ছোঁয়াকে ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ছোঁয়ার দিকে, মায়া ভরা সেই দৃষ্টি। তা দেখে ছোঁয়ার বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। সে বুঝতে পারছে, শিহরণ ঠিক নেই। নিজেকে সামলে নিয়ে সে শান্ত কণ্ঠে শিহরণের গালে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী হয়েছে বলবে আমাকে?’

‘তেমন কিছু না।’ শিহরণ পুরো বিষয়টা লুকাল ছোঁয়ার কাছ থেকে। সে ভালো করেই জানে ছোঁয়া দুশ্চিন্তা করবে। তাই সে তার বিয়ের কথাটা না বলাটাই ঠিক মনে করল। ছোঁয়ার নজর এড়িয়ে উদাস গলায় বলল, ‘ভয় হয় আমার। মাঝেমধ্যে খুব বেশি ভয় হয়।’

‘কেন?’ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘হারিয়ে ফেলার ভয়।’

‘মানে?’

‘আশফাক ভাইয়ার কথা মনে আছে তোমার?’

ছোঁয়া ভাবল খানিক। পরে বলল, ‘মনে পড়ছে না তো।’

‘রাফির আপন ভাই উনি। সেবার ভাইয়াকে বারবার আমাদের আশ্রমের অনুষ্ঠানে আসতে বলার পরেও আসলো না তার কথা বলছি।’

‘ও আচ্ছা। কী হয়েছে উনার?’

‘জানো, ভাইয়া একজনকে ভীষণ ভালোবাসতো। কিন্তু শেষমেশ তাকে হারিয়ে ফেলে এমন একজনের সাথে আছে যাকে সে ভালোবাসে না, যার প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। ভাইয়াকে দেখলেই আমার কষ্ট হয়। কী ভয়ানক কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে তিনি ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে।’

‘কেন এমন হলো উনার সাথে?’

‘সব হয়েছে উনার মা আর বাবার কারণে। আমি এই দুজন মানুষকে একদম পছন্দ করি না। ভাবির টাকার কাছে ওরা সন্তানের ভালোবাসা আর ভালো থাকাকে বিসর্জন দিয়েছে।’

‘আফশফাক ভাই প্রতিবাদ করলেন না কেন?’

‘সবসময় প্রতিবাদ করা হয়ে উঠে না, ছোঁয়া। যখন তোমার অনিষ্টকারী তোমার আপন মানুষগুলো হবে তখন তোমার হার আবশ্যক। সব দিকে থেকেই তোমার হারই হবে। কারণ প্রতিটা মানুষই তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রত্যেকের ভালো থাকা নিয়েই তোমার ভালো থাকা।’ ব্যথাতুর গলায় বলল শিহরণ ।

ছোঁয়া বলল, ‘এখন কী অবস্থা উনার? যাকে ভালোবাসতো সেই বা কোথায়?’

‘জানি না। আমি আর কিছুই জানি না।’ শিহরণকে হতবিহ্বল দেখাল।

ছোঁয়া তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ‘আমরা কি ভাইয়ার জন্য কিছু করতে পারি?’

_______________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৭

মধ্যরাত! চারিদিকে শুনসান নীরবতা। এই নিস্তব্ধ নীরব রাত্রিতে রাদিদের চোখে ঘুম নেই। টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোতে লিখে যাচ্ছে সে। রাতের সেই ভয়ংকর নিস্তব্ধতা ভেদ করে কেবলই
খস খস আওয়াজ হচ্ছে শুধু। রাদিদ লিখছে মনের সমস্ত আব্যক্ত উপাখ্যান নিজের অজান্তেই। তার মনের ক্যানভাসে প্রথম দর্শনের সেই সুদর্শনা কন্যার এক মূর্তিমান ছবি, বারংবার এসে দোলা দিয়ে যাচ্ছে মনের গহীনে। রাদিদ বিমোহিত, বিমুগ্ধ হয়ে সেই প্রতিচ্ছবির উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। কেমন যেন মাতাল করা এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে তার হৃদয় প্রান্তর।

প্রিয়তমা, তুমি পাশে নেই বলে
আজ মরচে মরা পেরেকের মতন জং-ধরা এই আমি।
মনোহারিনী, তুমি স্নিগ্ধ স্বরে ডাকোনি বলে,
মৃত্যুঞ্জয়ের শেষ বিদায়ের মতন শীর্ণ হয়েছে দেহখানি।
উন্মাদিনী, আমায় তোমার প্রেমের মায়ায় জড়াওনি বলে,
বিবর্ণ আমার এই চিরচেনা সবুজ পৃথিবী।
নিশীথিনী, তোমার ছায়া নামক মরীচিকার পানে ছুটেছি বলেই,
আজ আমার আকাশে ওঠা রংধনুটাও বিবর্ণ।
গোধূলীর লালিমাও যেন ম্লান হয়ে গেছে।
প্রিয়া, তুমি আমার পাশে নেই বলে আজ
শতবর্ষব্যাপী নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ, নিথর দেহে
চিরনিন্দ্রায় শয্যাশায়ী হয়ে ঘুমিয়ে আছে মুকুটহীন প্রেমকুমার।
চিরজাগরূক, তুমি নেই তো পাশে, জানি,
তবুও কেন বুুক চিরে বেরোয় দীর্ঘশ্বাস?
তবুও কেন বারংবার খুঁজে ফিরি তোমাকেই?
মনের আঙিনায়, তোমার শহরের অলিগলি কিংবা খোলা প্রান্তরে।
তবুও তোমার পদচিহ্ন পড়েনি তো আমার আঙিনায়
কী পাষণ্ড আমার প্রিয়া, ভাবি, আর কেঁদে মরি!
তাই অসমাপ্ত রয়ে গেছে বহুবছর আগে শুরু করা
আমার প্রিয়ার তরে রচিত আমার প্রেমের এই অব্যক্ত উপাখ্যান।

হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতায় নেমে এলো এক অবর্ণনীয় হৃদয় ভারাক্রান্ত করা বিষাদ। রাদিদ টের পেল তার রচিত কবিতাখানা অন্যায়, নিতান্ত পারিহাস্য, তবুও সে তার ডায়েরির সেই পাতাটি ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েও ছিঁড়ল না। মনে মনে ভাবল, পৃথিবীর শত অন্যায়, অনিয়মের তরে থাকুক না তার এই অন্যায় আবদার মাখা, অন্যায্য দোষারোপে ভরা কবিতাখানা, থাকুক না তার প্রেমের অসমাপ্ত উপাখ্যান হয়ে তার সেই অসমাপ্ত উপন্যাসটির মতন।

কুকুরের করুণ স্বরের আর্তনাদ ভেসে আসছে। গভীর রাতের জানান দিচ্ছে কী? না-কি রাদিদের বুকের মধ্যে ছাইচাপা দেওয়া আগুনটা দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেবার তরে এমন করুণ স্বরে তাকে ভর্ৎসনা করার জন্য উপহাসে মশগুল হলো প্রভুভক্ত খ্যাত এই প্রাণীটি?

রাদিদ তা ভেবে পায় না। অবান্তর, অযৌক্তিক চিন্তারা আজ তার মনন ও মস্তিষ্ককে ভারাক্রান্ত করে তুলছে কেবল এই একটা কথাই তার মনে আসছে। কুকুরটা কেঁদেই চলেছে। রাদিদ জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখতে পেল না, সেই কুকুরের অবয়ব। বহুবার এই প্রাণীটিকে খোঁজার চেষ্টা করে অবশেষে পরাস্ত হয়ে সে জানালা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে গেল। একই সাথে ঝড়, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আচমকা এই পরিবর্তনে রাদিদের ভয় হলো, অহেতুক ভয় না-কি এই ভয়ের পেছনে কোনো কারণ আছে তা রাদিদ জানে না। রাদিদ শুধু জানে, এই মুহূর্তে একজন মনোহারিনীর মুখচ্ছবি দেখতে মরিয়া সে, একদম পাগলপ্রায়। সে জানে এই ইচ্ছে পূরণ হবার নয়, তবুও অবাধ্য মন এহেন অলভ্য নানান বাসনায় সিক্ত করে তোলে মনের অলিগলি। রাদিদের মুখ ফুটে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ‘আমার নিষ্ঠুর প্রিয়ার তরেই না হয় আজীবন লিখে যাব আমার প্রেমের অব্যক্ত উপাখ্যান, যতদিন এই দেহে প্রাণ থাকে ঠিক তত দিন।’

_____________________

বহ্নির এক্সাম, অতলের ভাইভার প্রিপারেশন এসবের মধ্যেই কেটে যাচ্ছে সময়। ওদের মধ্যে যোগাযোগ কমে গেছে অনেকটাই। দুজনেই ইচ্ছাকৃতভাবে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে, পড়ালেখার খাতিরে। এতে অবশ্য বহ্নির ভূমিকাই অগ্রগণ্য ছিল। অতল তো বহ্নি বলতেই চোখে হারায়। কিন্তু বহ্নি অতলকে বেশ কয়েকটা শর্ত জুড়ে দিল। অতল ভাবে, বহ্নিকে সে কী করে বুঝাবে, তাকে ছাড়া তার কাছে সবকিছুই বেরঙের লাগে, সবকিছুই পানসে ঠেকে। সবসময় বহ্নির সান্নিধ্য পেতে মরিয়া অতল সুযোগ পেলেই বহ্নিকে কাছে পেতে চায়। অপরদিকে বহ্নি শক্ত অবস্থানে অনড় থাকে। অতল তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যথিত কণ্ঠে বলে, ‘তুই খুব নিষ্ঠুর, আগুনমণি। আমি তোর কথা ভেবে ভেবেই দিন রাত পার করি। আর তুই আমি একটু কথা বলতে চাইলেও শর্ত, শর্ত আর শর্ত। আমার মনে হচ্ছে, শর্তের বেড়াজালে বন্ধী হয়ে গেছে আমার ভালোবাসা।’

বহ্নি হেসে খানিকটা কৌতুক মেশানো কণ্ঠে বলে, ‘তোমাকে এখন থেকেই লাগাম দিচ্ছি বুচ্ছ? চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত এই লাগাম ছাড়ব না।’

অতল অহসহায় গলায় বলে, ‘কেন এই নিষ্ঠুর আচরণ আমার তরে?’

বহ্নি তখন বেশ ভাব নিয়ে বলে, ‘তোমায় ভালোবাসি বলেই নিষ্ঠুর হয়েছি নিজের তরেও।’

অতল তখন হুমকি দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘এই নিষ্ঠুরতার শোধ সুদে-আসলে তোলা হবে, বলে দিলাম।’

‘ভালোবাসার সেই শাস্তি না হয় আমি মাথা পেতেই নেব।’

অতল কোনোভাবেই বহ্নিকে টলাতে পারে না। অদ্রির ন্যায় সে অটল থাকে নিজের ভাবনাতে, নিজ অবস্থানে। প্রেমে মরিয়া অতল পড়তে বসে ভাবতে থাকে বহ্নির কথা, তার কথা ভাবতে ভাবতেই দিন রাত হয়, রাত হয় ভোর। তবুও যেন প্রেমের এই নেশা ছুটে না। অতল যেন আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল তার হৃদয় সিংহাসনের রাজত্ব করা এই শর্তকন্যার উপর।
__________________________

মান্নাত কোনো প্রকার ভণিতা না করেই সোজাসাপ্টাভাবে ছোঁয়াকে বলল, ‘শিহরণের সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগ রাখবে না। রাখলে তা ভালো হবে না তোমার জন্য।’

মান্নাতকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি ছোঁয়ার। এই মেয়েটাকে সে প্রথম থেকেই সহ্য করতে পারত না। সবকিছুতেই তার মেকি ভাব তার কাছে রীতিমতো বিরক্ত লাগত। আর আজকে এই মেয়ে সোজাসুজি তার কাছে এসে থ্রেট দিচ্ছে ভাবতেই যার ভীষণ অবাক লাগছে।

মান্নাতের এইসব আবোল-তাবোল কথা শুনে
ছোঁয়া বেজায় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এই কথাগুলো তুমি শিহরণকে বলতে পারতে। আমাকে এইসব কথা বলার কোনো কারণ দেখছি না।’

মান্নাত ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘আমি কাকে বলব সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। তোমাকে সাবধান করতে ইচ্ছে হলো তাই করলাম। আমার কথা হালকাভাবে নেওয়ার ভুল করো না।’

মান্নাতের এহেন পাগলামি দেখে ছোঁয়া হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখেই বলল, ‘ঠিক আছে, আমি না হয় শিহরণের সাথে যোগাযোগ করলাম না। কিন্তু শিহরণকে কী করে আটকাবে আমার সাথে দেখা করা থেকে?’

‘ভ্রান্ত ধারণা হয়েছে তোমার। শিহরণ তোমাকে মোটেই ভালোবাসে না। সে আমাকে ভালোবাসে। ওর সাথে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। এমনকি বিয়ের ডেটও ফাইনাল হয়ে গেছে। শিহরণ তোমার সাথে কেবলই টাইম পাস করেছে।’

মান্নাতের কথা ছোঁয়া পাত্তাই দিল না। সে হেসে বলল, ‘এই কথাটা শিহরণ নিজের মুখে বললেও হয়তো আমি বিশ্বাস করব না, মান্নাত।’

মান্নাত ক্ষুব্ধ হল। ক্রোধ উপচে পড়ছে তার চোখ-মুখ থেকে। রাগান্বিত কণ্ঠে সে বলল, ‘আমার সাথেই শিহরণের বিয়ে হবে, এই কথাটা তো আর মিথ্যে করে দিতে পারবে না। তুমি চাইলে শিহরণকেই জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, আমার সাথে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছে কি না।’

কথাটা বলেই মান্নাত বেরিয়ে গেল। ছোঁয়া হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। শিহরণের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, এই কথাটা তার বুকের মধ্যে শেলের মতো বিঁধল। সে তৎক্ষণাৎ শিহরণের নাম্বার ডায়াল করল। শিহরণ কল রিসিভ করল না। শিহরণ মিটিং এ ব্যস্ত থাকায় কল কেটে দিল। কিন্তু ছোঁয়া নাছোড়বান্দার মতন বারংবার তার নাম্বারে কল দিতেই থাকল। অবশেষে ছোঁয়ার কল রিসিভ করে শিহরণ শান্ত স্বরে বলল, ‘আমি এখন ব্যস্ত আছি। ফ্রি হয়ে কল দিচ্ছি।’

শিহরণের ব্যস্ততার কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করেই ছোঁয়া ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন করল, ‘মান্নাতের সাথে কি তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?’

শিহরণ চমকে গেল। এই খবরটা ছোঁয়ার কানে কে দিল তা সে ভাবতে থাকল। পরক্ষণেই ছোঁয়া বাঁজখাই গলায় পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘কী হলো? উত্তর দাও।’

‘ছোঁয়া, আমি এখন মিটিংয়ে আছি। ফ্রি হয়ে তোমাকে কল ব্যাক করছি।’ ব্যস্ত গলায় বলল, শিহরণ।

ছোঁয়া জেদী গলায় প্রশ্ন করল, ‘হ্যাঁ না-কি না?’

শিহরণ বলল, ‘তুমি আমার কথাটা তো শোনো আগে। এই বিষয়টা আমি তোমাকে পরে ব্যাখ্যা করব।’

ছোঁয়া একগুঁয়ের মতন পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘এক কথায় উত্তর দাও, হ্যাঁ না-কি না?’

শিহরণ পরাস্ত ভঙ্গিতে অতি সংক্ষেপে বলল, ‘হ্যাঁ।’
__________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৮

এক ধরনের চাপের মধ্যে থেকেই শিহরণ তার কাজ শেষ করল। ছোঁয়াকে খবরটা কে দিয়েছে তা আর অজানা থাকল না। মান্নাতের উপর তার ক্রোধ উপচে পড়ছে। প্রচণ্ড ক্রোধে তার মাথার শিরা-উপশিরাগুলো দপদপ করছে। মিটিং শেষে ছোঁয়াকে বেশ কয়েকবার কল করল অথচ সে কল রিসিভ করছে না। ছোঁয়ার এহেন আচরণে শিহরণের রাগ আরও কয়েক ধাপ বেড়ে গেল। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মান্নাতের উপর। সে অফিস শেষে সোজা মান্নাতের বাসায় চলে গেল। শিহরণকে নিজের বাসায় দেখে মান্নাতের খুশি ধরে না। সে আহ্লাদে আটখানা হয়ে শিহরণকে বলল, ‘আমি জানতাম তুমি আমার কাছে ফিরে আসবেই।’

মান্নাতের হাসি দেখে শিহরণের রাগ আরও বেড়ে গেল। সে রাগের মাথায় বলল, ‘এতোদিন শুধু তোমাকে বলেছিলাম যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। এখন এই বিষয়টা খালামণিকে আমি নিজেই বলব।’

শিহরণের কথা শুনে মান্নাতের সমস্ত খুশি উবে গেল। মান্নাতের একটু আগের হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় শ্রাবণের মেঘ স্থান করে নিল। শিহরণ ততক্ষণে মান্নাতের মায়ের সাথে কথা বলার জন্য তার রুমের দিকে এগিয়ে গেল। মান্নাত শিহরণকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারল না। মান্নাতের মা ফোনে কথা বলছিলেন। শিহরণকে নিজের রুমে দেখে তিনি ফোন রেখে বললেন, ‘কী হয়েছে, শিহরণ? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

‘খালামণি, তোমার সাথে আমার কথা আছে।’

‘কী কথা বল?’

মান্নাত মাঝখানে ফোড়ন কেটে বলল, ‘মা, ও তেমন কিছু না। আসলে বিয়ের শপিং নিয়ে ওর সাথে আমার একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। তাই সে রেগে একদম ফুলে গেছে।’

মান্নাতের মা হাসতে হাসতে শিহরণেকে বললেন, ‘তোমরা এখনও সেই বাচ্চাই রয়ে গেছ। এই সামান্য বিষয়েও সেই পিচ্চিকালের মতন ঝগড়া করছ?’

শিহরণ কোনো প্রকার সঙ্কোচ ব্যতিরেকে বলল, ‘খালামণি, মান্নাত যা বলছে তা নয়। আসলে আমি তোমাকে অন্যকিছু বলতে চাইছি।’

‘কী বলতে এসেছ বল। আমার আবার একটু বেরোতে হবে।’

মান্নাত তার মাকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘মা, ও তেমন কিছু না। তোমার না মামার বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, মামুণি। তুমি তোমার কাজে যাও। আমি শিহরণের সাথে কথা বলছি। তুমি টেনশন করো না।’

মান্নাতের হেঁয়ালিপনা দেখে শিহরণ এবার রাগের চোটে বলেই ফেলল,’আমি মান্নাতকে বিয়ে করতে পারব না। আমি ওকে কখনোই ওই নজরে দেখিনি, খারামণি।’

মান্নাতের মা থমকে দাঁড়াল। স্তম্ভিত কণ্ঠে বললেন,’তোমরা কী ঝগড়া করেছ? বিয়ের মতো একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে এইরকম ঠাট্টা করা একদম উচিত নয়। এটা তোমাদের সারাজীবনের প্রশ্ন।’

‘না, খালামণি। আমি কোনো দুষ্টামি বা ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। যাকে পছন্দ করি তাকেই বিয়ে করব।’

‘এই কথা কি তোমার আম্মু জানে?’

‘না, আম্মুকে বলিনি। তোমাকেই প্রথমে জানানো উচিত বলে মনে হয়েছে। কারণ মান্নাত এই বিষয়টা জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চাইছে।’

শিহরণ বাসায় আসার পরে সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘এসব কী শুনছি, শিহরণ?’

মায়ের প্রশ্ন করার ধরন দেখেই সে বুঝতে পারল খারামণি মাকে ফোন করে সব কিছু বলে দিয়েছেন। শিহরণ দ্বিধাহীন চিত্তে বলল, ‘যা শুনেছ ঠিক শুনেছ, আম্মু।’

‘তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, শিহরণ।’

‘এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আম্মু। আমি মান্নাতকে বিষয়টা জানিয়েছিলাম কিন্তু সে শুনেনি আমার কথা। তাই বাধ্য হয়েই খারামণিকে জানাতে হলো। আম্মু তুমি মান্নাতকে খুব পছন্দ করো কিন্তু আমি ওকে একদম পছন্দ করি না। যেই মানুষটাকে আমি দু’মিনিটের জন্য সহ্য করতে পারি না সেই মানুষটার সাথে আমি সারাটা জীবন কাটাব কী করে আম্মু?’

সাবিহা সাবরিন শিহরণের এমন ঔদ্ধত্য দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এই ঔদ্ধত্যের কারণ নিশ্চিতভাবেই ওই মিডল ক্লাস মেয়েটা। এই ভাবনার বশবর্তী হয়েই তিনি বলে ফেললেন,’তোমার বিয়ে মান্নাতের সাথেই হবে। এটাই আমার শেষ কথা।’

মায়ের এমন অনড় অবস্থানে শিহরণ খুব আহত হলো। তার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, মা এরকমভাবে কোনোকিছু তার উপর চাপিয়ে দিতে পারে। সে অসহায় গলায় বলল, ‘আম্মু, তুমি এভাবে ওকে আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারো না।’

সাবিহা সাবরিন তেজী গলায় বললেন, ‘ছেলেরা ভুল পথে গেলে তাদের সেই পথ থেকে ফেরানো বাবা-মায়ের কর্তব্য।’

‘বিশ্বাস করো মা, আমি যাকে পছন্দ করি, সে চমৎকার একজন মানুষ। তুমি নিশ্চয়ই তাকে পছন্দ করবে।’ মাথা নিচু করে ব্যথাতুর গলায় বলল, শিহরণ।

সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘সেই মেয়েটা কতোটা চমৎকার তা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তোমার অধঃপতন দেখেই আমি তা বেশ বুঝতে পারছি।’

শিহরণ অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, ‘আম্মু তুমি একবার তার সাথে দেখা তো করো। তারপর না হয় তার সম্পর্কে তোমার মতামত জানিও।’

সাবিহা সাবরিন নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললেন, ‘আমি আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে জানিয়েছি। এবার তুমি কী করবে ভেবে দেখো।’

_______________________

‘রাফি, যেটা করব না ভেবেছিলাম সেটা করতেই হচ্ছে। তারপর দেখি সে কী করে আমাকে বাদ দিয়ে ওই মিডল ক্লাস মেয়েটাকে বিয়ে করে।’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, মান্নাত।

রাফি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে এই বিষয়টা আর একবার ভেবে দেখা উচিত তোমার।’

‘এই বিষয়ে ভাবার কিছু নেই। ওই মেয়ের কারণে আজ মায়ের কাছ থেকে আমাকে তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে। এটা কোনোভাবেই মানতে পারছি না আমি। শিহরণের এই কাজের শাস্তি ছোঁয়াকেই পেতে হবে।’ ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটিয়ে বলল, মান্নাত।

‘ঠিক আছে। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কিন্তু আমার লাভটা কী?’ সুযোগ মতো নিজেরটাও আদায় করার প্রস্তাব দিল রাফি।

‘ওহ, কাম অন, রাফি। তোমার লাভ কোথায় তা তুমি যেমন জানো। আমিও জানি। ইটস্ ইওর লাভ অর সো কলড অ্যাট্রাকশন ফর বহ্নি। এম আই রাইট?’

রাফি হাসল। বিদ্রুপ সেই হাসি। বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসতে হাসতেই সে বলল, ‘লাভ, মাই ফুট।’ খানিক থেমে সে আবারও বলল, ‘বাট আই ওয়ান্ট হার এট এনি কস্ট।’

মান্নাত রাফিকে সাবধান করে দিয়ে সতর্ক গলায় বলল, ‘বিষয়টা যেন পিওর এক্সিডেন্ট দেখায়। পুলিশের যাতে কোনোপ্রকার সন্দেহ না হয়। আনকোরা লোক দ্বারা কাজ করাবে না। যত টাকা লাগে দাও বাট কাজটা প্রফেশনাল কাউকে দ্বারা করাবে।’

_____________________

শিহরণ পড়েছে এক মহাবিপদে, একদিকে তার মা অন্যদিকে তার পছন্দের মানুষ, যাকে ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসে। দুজনেই তাকে ভুল বুঝে বসে আছে। কেউ তার দিকটা ভাবছে না। তাকে বোঝার দায় যেন কারও নেই। সবার মান-অভিমান ভাঙ্গানোর দায় যেন শুধুই তার। একদিকে মা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ছে, অপরদিকে ছোঁয়াও তার কল রিসিভ করছে না। ছোঁয়ার অভিমানের কারণটা সে বুঝে, তবুও তার সাথে এভাবে কথা না বলাটা মেনে নিতে পারছে না শিহরণ।

সকালে নাস্তা না করেই অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল সে। অফিসের ব্যস্ততা থাকায় সে ছোঁয়ার সাথে দেখা করতে পারছে না। ছোঁয়াও অফিসে আসছে না, ছুটি নিয়েছে হুট করেই। তার কারণটা অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না তার। ছোঁয়াকে আশেপাশে দেখতে অভ্যস্ত শিহরণ, তাকে এক ঝলক দেখার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছে। অথচ ছোঁয়া পাষণ্ডের ন্যায় আচরণ করছে। তার দিকটা ব্যখ্যা করার সুযোগটাও দিল না।

বিকেলের দিকে শিহরণের অস্থিরতা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ছোঁয়ার সাথে সারাটা দিনে একবারের জন্যও কথা না হওয়ায় খুব অস্থির লাগছে তার। এমনটা আগে কখনও হয়নি। যখন দূরে ছিল তখনের ব্যাপারটা আলাদা ছিল, কিন্তু এখনের ব্যাপরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত এক ঘন্টা যাবৎ সে ছোঁয়ার নাম্বারে কল করে যাচ্ছে অথচ যতবারই সে কল করছে ততবারই একজন মহিলা যান্ত্রিক কণ্ঠে আওড়াচ্ছে, ‘দ্যা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ নাউ সুইচড অফ। প্রিজ ট্রাই এগেইন লেটার।’

শিহরণের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে ততবার ঠিক যতবার এই যান্ত্রিক কণ্ঠের আওয়াজটি সে শুনছে। এভাবেই অস্থির হয়েই সময় কাটছিল তার। একসময় মায়া, সাইফ দুজনকেই কল করে ছোঁয়ার খবর নিল সে। এমনকি ছোঁয়ার বাসায় পর্যন্ত কল করেছে।
অথচ কারো কাছেই ছোঁয়ার কোনও খবর পেল না। উপরন্তু ছানতে পেরেছে ছোঁয়া বাসায় নেই, সে কাজ বেরিয়েছে। তাই সে আরও বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল।

একসময় অফিসে বসে থাকতে না পেরে গাড়ি নিয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়ল। যেখানে ছোঁয়া যেতে সারে সবখানেই খবর নেওয়া হয়ে গেছে। তবুও কোনও প্রকার খোঁজ না পেয়ে শিহরণ হতাশ হয়ে পড়ল। তার মনে হচ্ছে তার বুক ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এরকম অস্থির সে কখনওই হয়নি। এমনকি ছোটোবেলায় যখন সে ছোঁয়াকে ছেড়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সদর্পে সেই সময়টাতেও না। পেছন থেকে ছোঁয়ার করুণ কণ্ঠে বলা সেই কথাগুলোও তাকে এতোটা অস্থির করতে পারেনি।

সন্ধ্যা রানীর আগমনে হঠাৎ দিনের আলো ম্লান হতে শুরু করেছে। শিহরণ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় ছোঁয়ার নাম্বার থেকে কল আসায় হুট করেই রিসিভ করে ফেলল শিহরণ। ওপাশ থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠের কেউ বলে উঠল, ‘হ্যালো, আপনি কি শিহরণ বলছেন?’

পুরুষালী কণ্ঠের কারও কথা শুনে বিচলিত কণ্ঠে শিহরণ প্রশ্ন করল, ‘জি, আপনি কে বলছেন? ছোঁয়া কোথায়?’

ওপাশের পুরুষটি ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘এই ফোনের মালিকের একটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়েছে।’

শিহরণের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। তার দু’চোখ মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হয়ে গেল। এমন ভয়ংকর একটা কথা শোনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তার হৃদস্পন্দন দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করল। হতবিহ্বল হয়ে শিহরণ ফোন তুলে নিয়ে পুনরায় ছোঁয়ার নাম্বারে কল করল। উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘ছোঁয়া এখন কোথায়?’

লোকটির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েই সে আর একটা মুহূর্তও দেরি করল না, বেরিয়ে গেল প্রচণ্ড বেগে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো এক উল্কার ন্যায়। আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে ছোঁয়াকে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ফাহমিদা বেগম কান্নাকাটি করছেন। হিয়া ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। অহনা চোখজোড়াও অশ্রুসিক্ত। মায়া মহিলাদের জন্য নির্ধারিত নামাজ কক্ষে প্রার্থনা করছে।

শিহরণ উদভ্রান্তের ন্যায় অপারেশন থিয়েটারর সামনের খোলা জায়গায় অস্থির পায়ে পায়চারি করছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে।

ছোঁয়ার এক্সিডেন্টের খবর শোনার পর অতল আর রাদিদও প্রায় ছুটে আসল। আসার সময় অন্য বন্ধুদেরও খবরটা জানিয়ে দিল।

অতল আর রাদিদ তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে চুপটি মেরে বসে আছে। তাদের সকলের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা।

ওটি থেকে বেরিয়ে ডাক্তার মলিন কণ্ঠে বললেন, ‘প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে পেশেন্টের। রক্ত দেওয়া হয়েছে। তবে সেন্স না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাছাড়া দুই পায়ে ফ্রাকচার হয়েছে মারাত্মকভাবে। হাঁটতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। পা কেটেও ফেলতে হতে পারে।’

ডাক্তারের বলা এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল শিহরণেকে ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ করার জন্য। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। ভয়ংকর কোনো ঝড় আসার আগৈর নিস্তব্ধতা ওকে ঘিরে ধরেছে। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। অতল আর রাদিদ ছুটে এসে ওকে ধরল। এই খবরটা শোনার পরে সবার অবস্থা ভয়ংকর রকমের খারাপ হয়ে গেছে। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাটাও যেন হারিয়ে ফেলেছে সবাই।

________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৫৩+৫৪+৫৫

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৩

ছোঁয়ার মুখে সবটা শুনে শিহরণ বেশ কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইল। তার খুব খারাপ লাগছে মায়ার জন্য। ছোঁয়া শিহরণের হাতের উপর নিজের হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘এটাই ভালো হয়েছে, শিহরণ। এই বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়তে ওর লাভই হয়েছে। সাময়িকভাবে একটু খারাপ লাগলেও এটা ভালোর জন্যই হয়েছে। এবার ওর পরিবার ওর উপর রাখা নিষেধাজ্ঞা তো তুলে নিয়েছে। ওকে জব করার অনুমতি দিয়েছে। এবার দেখো ও নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।’

শিহরণ মাথা তুলে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। স্মিত হেসে বলল, ‘তুমি ঠিক বলছ। তাও ভালো যে ওর বাবা ওকে জব করার অনুমতি দিয়েছে। এর আগেরবার তো জব পেয়েও করতে পারেনি সে।’

‘আসলে ওদের পরিবার মেয়েদের জব করা এলাউ করে না। বিয়েটা ভেঙে যাওয়াতে আঙ্কেল একটু নরম হয়েছেন। তাছাড়া মায়ার যুক্তির কাছে তাকে হার মানতেই হলো।’

সাইফ আর মায়াকে আসতে দেখে ছোঁয়া কিছু বলতে চেয়েও আর বলল না। মায়া হেসে বলল, ‘লাভ বার্ডসদের ডিস্টার্ব করে ফেললাম মনে হচ্ছে!’

সাইফও মায়ার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে রে। কাবাবে হাড্ডি হতে চলে এলাম দুজনেই।’

শিহরণ খুব আক্ষেপের সুরে বলল, ‘কাবাবে হাড্ডি হও আর যাই হও না কেন ডিস্টার্ব তো করেই ফেলেছ। কী আর করা? একটু যে লুকোচুরি প্রেম করব তারও সুযোগ পাই না।’

‘আহা রে!’ মায়া কৌতুক মেশানো গলায় বলল, ‘আমাদের প্রেমিক পুরুষের প্রেম করতে কতো অসুবিধা। কতো কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে বেচারাকে।

সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাইফ চল তো আমরা অন্য কোনো রেস্টুরেন্টে চলে যাই। লাভ বার্ডসদেরকে একটু লাভ করার সুযোগ দিয়েই দিই। আমি আবার এতোটাও নির্দয় নই।’

শিহরণ বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘এসেই যখন পড়েছ তখন থেকেই যাও। প্রেম করার মুড তো নষ্ট হয়েই গেল।’

ছোঁয়া দুম করে শিহরণের হাতে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসল। লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘কী শুরু করেছ, শিহরণ?’

মায়া ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ইশ, প্রেম করার মুডও লাগে তোমার।’

শিহরণ চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আগের চাইতেও বেশি ভাব নিয়ে বলল, ‘তা তো লাগবেই। তোমার বান্ধবী কেমন কাঠখোট্টা তা তো জানোই। সেই তো আমার ভালো ভালো মুডের বারোটা বাজিয়ে দেয়।’

শিহরণের কথা শুনে ছোঁয়া তেতে গিয়ে বলল, ‘কী, আমি কাঠখোট্টা?’

‘নয়তো কী?’ শিহরণ বেশ দুঃখের সাথে বলল, ‘একটা চুমুও খেতে দাওনি আজ পর্যন্ত।’

‘ঠিক আছে। যে চুমু খেতে দেবে তার সাথে গিয়ে প্রেম করো।’ ছোঁয়া হুমকি দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার সাথে তোমার আর কোনো সম্পর্ক নাই। এই বলে দিলাম। আমাকে আর কখনও কোনো প্রকার যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।’

শিহরণ আর ছোঁয়ার কাণ্ড দেখে মায়া হাসতে শুরু করল। শিহরণ এক ফাঁকে ওয়েটারকে ডেকে চার জনের জন্য চারটা কফি অর্ডার করার পরে ছোঁয়াকে বলল, ‘তো এখন কি আমাকে রেখে আরাভের কথা ভাবছ না-কি?’

‘আরাভ কে?’

‘তোমার পিচ্চি লাভার বয়।’

‘উফ্! তুমি যে কী শুরু করেছ দিন দিন! ওই বাচ্চা ছেলেটার কথা নিয়ে এখনও খোঁচা দিতে ভুলো না।অদ্ভুত সব কথাবার্তা।’

‘বাচ্চা হলে কী হবে? সে খুবই সিরিয়াস তোমার ব্যাপারে।’

মায়া সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘আমি ভাবছি স্কুলের জবটাতে একবার খোঁজ নিয়ে দেখব। তোমরা কী বলো?’

মায়ার সাথে তিন জনই সম্মতি জানাল। সাইফ বলল, ‘তুই জবটাতে জয়েন করতে চাইলে আমি খোঁজ নিতে পারি। আমার পরিচিত এক আঙ্কেল আছেন। তাকে একটা ফোন করলেই হবে।’

মায়া সাইফের কথায় সম্মতি জানাল। ওয়েটার কফি দিয়ে যেতেই সাইফ আর মায়া কফি খেতে খেতে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হয়ে গেল। মায়াকে দেখতে এখন খুবই প্রাণবন্ত লাগছে। শিহরণ ইশারায় ওদের দুজনকে দেখাল ছোঁয়াকে। তারপর ছোঁয়ার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, ‘মায়ার মুড একটু হালকা করার জন্য মজা করে বললেও কথাগুলো কিন্তু সত্য।’

ছোঁয়া ঠিক তখনই শিহরণের হাতে চিমটি কাটল। শিহরণ বলল, ‘এর শোধ কিন্তু সময়মতো নেওয়া হবে, প্রিয়তা।’

‘আমিও কি তোমায় ছেড়ে দেব ভেবেছ?’ পাল্টা হুমকি দিল ছোঁয়া।

‘নট ব্যাড, প্রিয়তা। আই লাভ টু এক্সেপ্ট চ্যালেঞ্জেস।’

_______________________

পিউ কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসলো। তার চুল এলোমেলো। স্কুলের পোশাক মাটিতে মাখামাখি হয়ে নোংরা হয়ে আছে। নীলা মেয়েকে দেখে আঁতকে উঠল। মেয়ের হাত ধরে তাকে কাছে টেনে বলল, ‘কী হয়েছে, মামুণি? তোমার এই অবস্থা কী করে হয়েছে?’

পিউ মাকে কাছে পেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। নীলা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘কাঁদে না মামুণি, কাঁদে না। কী হয়েছে মাকে বলো?’

ফাইজা বেগম পিউর কান্না শুনে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। পিউর এমন অবস্থা দেখে তিনি আঁচ করতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। তিনি নীলাকে বললেন, ‘নীলা পিউকে গোসল করিয়ে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দে।’

নীলা উৎকণ্ঠা মিশ্রিত গলায় বলল, ‘কিন্তু মা দেখো না ওর কী অবস্থা হয়েছে! মেয়েটা কিছু বলছেই না। আসার পর থেকেই কেঁদে চলেছে। আবিরকে পাঠিয়েছিলাম ওকে আনতে। কিন্তু আবিরকে তো দেখতেই পেলাম না।’

ফাইজা বেগম আদেশের সুরে বললেন, ‘যেটা বলেছি সেটা কর।’

নীলা পিউকে গোসল করানোর পরে খাবার খাইয়ে দেবার সময় পিউ বলল, ‘মা, বাবা কোথায়? বাবা কি আমাদের ফেলে চলে গেছে? বলো না, মা। বাবা কেন আমাদের সাথে থাকে না? আমি বাবার ছবির সাথেই কথা বলি। অথচ আমার বন্ধুরা প্রতিদিন বাবার সাথে খেলে, গল্প করে, ঘুরতে যায়, ওদের বাবারা ওদেরকে অন্নেক আদর করে।’

নীলা উৎকণ্ঠা বলল, ‘স্কুলের কেউ বাবাকে নিয়ে কিছু বলেছে?’

নীলার প্রশ্ন শুনে পিউ মুখটা গোমড়া করে মাথা নিচু করে ফেলল। নীলা মেয়েকে কোলে বসিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে, পিউ? মাকে বলো। ভালো বাচ্চারা
মাকে সবকিছু বলে দেয়।’

পিউ স্কুলের সব ঘটনা বলল। পিউর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে নীলা ভয়ে আঁতকে উঠল। এত ছোটো ছোটো বাচ্চাদের মাথায় কী করে এই ধরনের কথাবার্তা আসতে পারে তা নীলা ভেবে পেল না! তার ছোট্ট মেয়েটা আজকে বাবা না থাকার কারণে স্কুলের অন্যান্য বাচ্চাদের হাতে মার খেয়েছে এই কথাটা তার ভাবতেই ভয় করছে। বাবা-মায়েরা এখন নিজেদের গসিপে এতোটাই নিমগ্ন যে তারা এইটুকুও খেয়াল করে না যে, তাদের কথাবার্তার প্রভাব তাদের সন্তানের মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে তাদের মানবিকতা, মনুষ্যত্ববোধকে বিনষ্ট করে ফেলছে। এতে বাচ্চারা হয়ে উঠছে বেপরোয়া, ক্ষেত্রবিশেষে নিষ্ঠুর ও অমানবিকও হয়ে উঠছে। যার ফলে কিছু কিছু বাচ্চারা তাদের তুলনায় দুর্বল কাউকে দেখলেই তার প্রতি অন্যায় আচরণ করে এক ধরনের নিষ্ঠুর আনন্দ লাভে মরিয়া হয়ে উঠে।

নীলা পিউকে বলল, ‘পিউ মামণি, তোমার বাবা একদিন ঠিক আসবে। তখন তুমিও তোমার বাবার সাথে খেলতে পারবে, ঘুরতে পারবে।’

‘আমাকে অনেক আদর করবে?’ পিউ মুখটা মায়ের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল।

নীলা বিষণ্ন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, অনেক আদর করবে আমার মামুণিকে।’

‘মা, বাবা কবে আসবে?’ আহ্লাদী গলায় পিউ প্রশ্ন করল।

পিউর চোখের কোণে অশ্রু জমলো, বেদনাসিক্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই। নীলা পিউকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আসবে, খুব তাড়াতাড়ি।’

পিউকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নীলা চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল, ‘আসলেই কি আশফাক আসবে তার কাছে, তার মেয়ের কাছে।’

বন্ধ চোখের পাতায় আশফাকের সাথে তার ভালোবাসা, বিয়ে, একসাথে কাটানো সমস্ত সুন্দর মুহূর্তগুলো জীবন্ত চিত্রের ন্যায় এখনও জ্বলজ্বল করছে। এতোটা কালের বিচ্ছেদও তার বুকের মধ্যে এই মানুষটার উপর তার কখনও রাগ হয়নি। মনের মধ্যে যতটুকু আছে সবটাই অভিমান। নীলা ভাবে, যেদিন তার সাথে দেখা হবে, সেদিন খুব করে বকে দেবে সে, এই ভাবনা তার কতদিনের! সে ভেবে রেখেছে দীর্ঘ একমাস যাবৎ মৌনব্রত পালন করবে সে। আশফাকের সাথে কথাই বলবে না। এটাই তার শাস্তি।

সমস্ত ভাবনার বেড়াজালের মধ্যে ও নীলার দু’চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো। ঘুমের মধ্যে সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। আশফাকের পাশে একটা সুন্দরী মহিলা আর একটা পরীর মতো বাচ্চা তাদের চারপাশে দৌড়াচ্ছে। নীলা খুব খেয়াল করে দেখল বাচ্চাটা পিউ নয়। নীলার চোখ পিউকে খুঁজছে। অবশেষে বাগানের একটা কোণে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকা পিউকে দেখতে পেল নীলা। পিউ গোমড়ামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আশফাক আর বাচ্চাটার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পরে আশফাক বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করল। তারপর অন্য এক হাতে সুন্দরী মহিলাটির হাত আঁকড়ে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। পিউ কাঁদছে হাউ মাউ করে। নীলা তার মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দিলেও তার কান্না থামছে না। পিউ হঠাৎ করে ডেকে উঠল, ‘বাবা, আমাদের ছেড়ে যেও না। বাবা, আমাকেও ওর মতো আদর করো। বাবা, আমাকেও ওর মতো কোলে তুলে নাও।’

পিউর শত ডাকেও আশফাক ফিরেও তাকাল না। হয়তো পিউর ডাক আশফাকের কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছায়নি। কিন্তু পিউ হঠাৎ করেই মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে তার বাবার পিছু ছুটতে লাগল।

নীলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। পিউ ঘুমাচ্ছে। নিষ্পাপ দেখাচ্ছে তাকে। নীলা পিউর মাথায় হাত বুলিয়ে তার কপালে চুমু খেলো। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন সে কেন দেখল তা সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ-ই নীলার মনে হলো, তার মানে কি আশফাকের জীবনে অন্য কেউ আছে?

___________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৪

পড়ন্ত বিকেল, সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ। স্নিগ্ধ বাতাসে শিহরিত হচ্ছে শরীর ও মন একই সাথে। অতল বসে আছে একটা লেকের পাশে। চারিদিকে সবুজ গাছগাছালির সমাবেশ। খানিক বাদে বাদেই নাম না জানা কতক পাখি ডেকে উঠছে তারস্বরে। অতলের দৃষ্টি লেকের নীল রঙা পানির উপর নিবদ্ধ। আকাশের নীল রঙ নদীর জলকে নীল রঙে রাঙিয়ে দিয়িছে। কী ভীষণ সুন্দর লাগছে! অতল মোহাবিষ্টের মতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। যেন নীল রঙ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে।

বহ্নির জন্য অপেক্ষা করছে সে। বহ্নির আসার কথা আরও আধ ঘন্টা আগে। কিন্তু এখনও তার দেখা নাই। অতলের রাগ হচ্ছে না। বরঞ্চ লেকের পানির দিকে তাকিয়ে পাখির কলতান শুনতে তার বেশ ভালো লাগছে। অনেকদিন এভাবে প্রকৃতির কাছাকাছি আসা হয়নি তার। অনেকদিন এভাবে ছায়াঘেরা বিকেলে নিজেকে খোঁজা হয়নি। আজ কেবল বহ্নির জন্যই এই সুযোগটা পেয়েছে সে। বাবার বারংবার করা তিরস্কার তার মন ও মস্তিষ্কে এমন এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। যার কারণে সে তার মধ্যে থাকা সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে জানতে পারেনি, বুঝতেও পারেনি, এমনকি এখনও তা কাজে লাগাতে পারেনি। বাবার ভালোবাসা পেতে মরিয়া অতল, একসময় বাবার ভালোবাসা পাবার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। তারপরেও সে খুব করে চাইত বাবা যেন তার সাথে একটু ভালো করে কথা বলে। এতে আর কিছু হোক বা না হোক, বাসায় শান্তি বজায় থাকবে, সেও মন দিয়ে তার কাজ করতে পারবে। অথচ নিয়তির পরিহাস না-কি অতলের চিরায়ত দুর্ভাগ্য কে জানে, অতলের চাওয়া কখনোই পূরণ হয়নি।

অতল অনেকবার ভেবেছে বাবার ভালোবাসা পায়নি তাতে কী হয়েছে, মায়ের ভালোবাসা তো পেয়েছে। কিন্তু অবাধ্য মন বারংবার যেটা পাবার নয় সেটার পানেই ছুটেছে। আর প্রতিবারই সে আঘাত পেয়েছে হৃদয়ের ঠিক কোমল জায়গায়, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছে তার হৃদয় প্রান্তর, তবুও ভালোবাসার বৃষ্টি সেই ধু ধু প্রান্তরে বর্ষিত হয়ে তৃষিত হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়নি।

এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যা পায় না তার পেছনেই সবসময় ছুটতে থাকে, আর না পাওয়ার বেদনায় বেদনাসিক্ত হতে থাকে। এই চিরায়ত নিয়মটির ব্যত্যয় কদাচিৎ-ই দেখা যায়। কারণ মানুষ যা খুব সহজেই পেয়ে যায় তাকে মূল্যহীন ভাবে আর যা পায় না তা যতই মূল্যহীন হোক না কেন সেই অলভ্য জিনিসটাকে ভাবে মহামূল্যবান। এতে করে আমরা অহর্নিশ ভুলে যাই, যে জিনিসটা আমাদের কাছে আছে তার গুরুত্ব মূল্যায়ন করতে।

এতো না পাওয়ার মধ্যেও মরুভূমির ধু ধু প্রান্তরে এক পশলা বৃষ্টির মতো বহ্নি তার জীবনে এলো। তার মনের উপর বিশাল রাজত্ব শুরু করে দিয়েছে পিচ্চিটা। এই ভাবনাটা মনের মধ্যে উঁকি দিতেই অতল হাসল। সেই হাসি তার ঠোঁটের কোণে লেগে রইল অনেকক্ষণ। কী বোকাই না সে, তার জীবনের সবচাইতে বেশি পরম নির্ভরতার মানুষটাকে চিনতে পারেনি সে। এতোটা বছর পরে, তাও তো পেল, এই ঢের। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগের দুর্ঘটনার কথা। বিয়ের কনে বিয়েতে নিষেধ না করলে তাকে ওই মেয়েটাকেই বিয়ে করতে হতো। বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ, অভিমানে সেই মেয়েটাকে একটা বারও দেখার চেষ্টা করেনি, জানারও চেষ্টা করেনি।
বুকের মধ্যে এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল সে। এই চিন্তাটা তার মাথা ভারী করে দিলো মুহূর্তেই। বুকের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করল।

হঠাৎ শেষ বিকেলের এক চিলতে রোদের ঝলক এসে পড়েছে অতলের চোখ বরাবর। চকিতে সে ঘুরে তাকাল। তার ভালোবাসার মানুষটা ধীর পায়ে এক পা দু পা করে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বাতাসে তার নীল শাড়ির আঁচলটা অবাধ্য হয়ে উড়ছে। বহ্নি সামলানোর চেষ্টায় মশগুল। এই চেষ্টা করতে গিয়ে তার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ কানে এসে বাজছে অমর্ত্যলোকের সুর ও ছন্দের ন্যায়। অতল মোহাবিষ্টের ন্যায় তাকিয়ে আছে তার দিকে।

‘স্যরি, শাড়ি পরতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।’ অতলের কাছে এসে বহ্নি বলল, অপরাধীর সুরে।

অতল মুচকি হাসল। বহ্নি তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘হাসছ কেন?’

‘তোকে দেখে?’

‘আমাকে কি সার্কাস দেখানো জোকারের মতো লাগছে?’

অতল এবার হো হো করে হেসে ফেলল। বহ্নি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘এভাবে পাগলের মতো করে হাসছ কেন?’

‘ভালো লাগছে।’

‘কী ভালো লাগছে?’

‘তোকে।’

‘আমাকে?’

‘তো, আর কাকে ভালো লাগতে পারে আমার?’

‘ভালো লাগলে কেউ হাসে?’

‘বেশি ভালো লাগলে হাসে তো। অবশ্য ওটাও আপেক্ষিক।

‘আপেক্ষিক কীভাবে?’

‘ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হয়।’

দু’টো মানুষ পাশাপাশি বসে রইল অনেকক্ষণ, চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে অতল বহ্নির একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখল। তবে কিছু বলল না। দু’জন দু’জনার এতো কাছাকাছি থেকে যেন নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দ অনুভব করছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে অতল মুখ খুলল। বলল, ‘আমার কল্পনা ভুল ছিল না। এই শাড়িটা শুধুই তোর জন্য। আমার নীল পরীর জন্য।’

বহ্নি মৃদু হাসল। বলল, ‘আমিও তোমার জন্য কিছু এনেছি।’

অতল উৎসাহী গলায় বলল, ‘কই, কি এনেছিস দেখি?’

‘এত অধৈর্য হচ্ছ কেন?’ বহ্নি অতলকে চোখ রাঙিয়ে
শাসিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে দিল।

অতল বলল, ‘এতে কী আছে?’

বহ্নি রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি নিজেই খুলে দেখো না।’

অতল র্য্যাপিং পেপার খুলে দেখল বক্সটার ভেতরে একটা সুন্দর ঘড়ি। অতল অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘আমার জন্য ঘড়ি কেন? ঘড়ি তো তোর দরকার।’

বহ্নি মুখ গোমড়া করে বলল, ‘ঠিক আছে। তোমাকে পরতে হবে না। তোমার পছন্দ হয়নি বললেই তো হয়। এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছ কেন?’

অতল বহ্নির রাগ ভাঙাতে নরম সুরে বলল, ‘আরে বাবা, একটু মজা করেছিলাম। আমি কি একটা বারও বলেছি, এই ঘড়িটা আমার পছন্দ হয়নি? তোর পছন্দ সব সময় বেস্ট। এবার বল তো আমাকে ঘড়ি দেবার উদ্দেশ্য কি?’

‘তোমার সবসময়ের সঙ্গী হিসেবে এই ঘড়িটা সবসময় হাতে পরবে। যখনই সময় দেখবে তখনই তোমার মনে হবে এই ঘড়িটার মতো আমিও তোমার সঙ্গে আছি।’

‘জানিস, এটা আমার পাওয়া বেস্ট উপহার। এইটা কখনওই আমার হাত ছাড়া হবে না। আমার নীল পরীর দেওয়া প্রথম উপহার আজীবন আমার সাথেই থাকবে।’

আচমকা আকাশের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করল। ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’ কথাটির সত্যতার প্রমাণ দিতে আচমকা বৃষ্টি এসে হাজির হয়ে গেল। অতল বহ্নিকে নিয়ে দ্রুত একটা গাছের নিচে জায়গা নিল। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে গেলে তারা দুজন আবারও আগের জায়গায় এসে বসল। ঠিক তখন পশ্চিমাকাশে রংধনুর প্রত্যাবর্তন হলো। অতল মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। বহ্নি অতলের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল অতল রংধনুতে মগ্ন হয়ে আছে। বহ্নি প্রশ্ন করল, ‘রংধনু ভালোবাসো?”

‘হুম, খুব। দেখতে ভালোবাসি। সাতটা রঙে রাঙানো এই রংধনু দেখলে আমারও ইচ্ছে হয় রংধনুর রঙে জীবনকে রাঙাতে।’

বহ্নি মনে মনে বলল, ‘তবে আজ থেকে এই রংধনু দেখা আর তার সাত রঙে রঙিন হবার স্বপ্ন আমারও।’

রংধনু যখন বিলীন হয়ে গেল তখন অতল বলল, ‘এঞ্জেল, এবার কিন্তু তোর যাওয়া উচিত।’

বহ্নি দেরি করল না। ঝট করে উঠে দাঁড়াল। অতলকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি যাবে না?’

অতল বলল, ‘আমি আর একটু পরে যাব। তুই বাসায় পৌঁছেই আমাকে কল করে জানাবি।’

বহ্নি হেঁটে বেশ কিছুদূর পথ হেঁটে চলে গেছে। অতল সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। তার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা কথার উদয় হতেই আচমকা অতল দৌড়ে এসে বহ্নিকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কতক্ষণ কে জানে! বহ্নি স্মিত হেসে বলল, ‘একটু আস্তে, জনাব।’

অতল আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বহ্নি এবার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। অতলের কি কিছু হয়েছে? সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো।’

অতল বলল, ‘কিছু হয়নি।’ পরক্ষণেই মাথা নিচু করে ফেলে বলল, ‘স্যরি, পারমিশন নেওয়া হয়নি।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ। বহ্নি চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছে। সে চায় অতল নিজ থেকেই বলুক। অতল বহ্নির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘তোকে হারিয়ে ফেলার কথা ভাবতেই বুকের বাঁ পাশটাতে এক তীব্র ব্যথা অনুভব হয়।’

বহ্নি অতলের কথা শুনে আঁতকে উঠে বলল, ‘আমাকে হারিয়ে ফেলবে কেন? আমি কি তোমাকে ছেড়ে কোথাও চলে যাচ্ছি না-কি? সবকিছু ছাড়লেও তোমাকে ছাড়ব না, মনে রেখ?’

অতল বলল, ‘একটা কথা বলব?’

‘বলো।’

‘তোকে আজ ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। জীবন্ত নীল পরীর মতো।’ তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘যদিও আমি কখনোই পরী দেখিনি।’

অতলের কথা শুনে বহ্নি লজ্জা পেল। তারপরে আবার নিস্তব্ধতা। অতল আবার বলল, ‘এই মুহূর্তে ভয়ংকর একটা কিছু করতে ইচ্ছে করছে।’

বহ্নি অতলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ইচ্ছে করলেই হবে না। ভয়ংকর কিছু বিয়ের আগে করার কথা ভাবলে তোমাকেও ভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে।’

অতল এবারও হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘তোর দেয়া শাস্তি পেতেও আমি মরিয়া হয়ে আছি। তবে আজকের দিনের আমার ভয়ংকর ইচ্ছেটাকেই বুকের মধ্যে দাফন করে ফেললাম। তোর দেওয়া শাস্তির ভয়ে দাফন করেছি ভাবার কোনো কারণ নেই কিন্তু।’

______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৫

মাহফুজ হক স্ত্রীকে দেওয়া কথা রাখতে নীলাভ্র আর আফরিন দুজনকেই বাসায় নিয়ে আসলেন। আফরিনকে দেখে নওশীন হক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন ইচ্ছেমতো। মায়ের কান্না দেখে আফরিনের মনও বোধহয় কিছুটা নরম হলো। সে অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘এখন আর কেঁদো না, আম্মু। আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ আম্মু।’

নওশীন হক প্রত্যুত্তরে কিছুই বললেন না। আফরিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। এক সপ্তাহ মেয়েকে না দেখে তিনি হয়তো সন্তানকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কাবু হয়ে গিয়েছেন। এই মুহূর্তে নীরার মায়ের উপরেও কিছুটা অভিমান হচ্ছে। আফরিন অন্যায় করেছে তবুও তাকে কোনো প্রকার শাস্তি তো দূরের কথা নূন্যতম বকাঝকাও করা হলো না, এটা ভাবতেই তার খারাপ লাগছে। পরক্ষণেই আবার ভাবতে থাকলো, মায়ের মন হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে কোমল জিনিস, যেটা শুধুমাত্র সন্তানের মঙ্গলের কথা ভেবেই বিগলিত হয়ে যায়, সমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত জিনিসও মেনে নেয়, আবার সন্তানের বড়ো ধরনের ভুল ক্ষমাও করে দেয় নিমিষেই। তবে আফরিনের উপর থেকে তার রাগ গেল না। পাশাপাশি তার দুলাভাই নামক লোকটাকেও তার একদম অসহ্য লাগছে। তার ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে। কিন্তু সব ইচ্ছে পূর্ণ হয় না। তাই সে ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়ে সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করছে।

মা-মেয়ের কান্নাকাটির ঠেলায় নীলাভ্রকে যেন ভুলেই গেল সবাই। এই ঘরে পা রাখার পর থেকেই সে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, পা দুটো খসে পড়ে যাবে। কেউ তাকে একটু বসতেও বলছে না। খুবই বিরক্ত লাগছে তার কাছে। এদিকে শ্বশুরবাড়িতে বউ নিয়ে উঠে আসায় তার একটু-আধটু লজ্জা হচ্ছে বৈ কী! তাই মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। আফরিনের উপরেও রাগ হচ্ছে, এই মেয়েটার জন্য সে নিজের বাবার কাছে কালার হয়ে গেল। অথচ সে যে এই বাড়িতে প্রবেশ করার পর থেকেই দাঁড়িয়ে আছে সেইদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই আফরিনের।

নীরা শেষমেশ সকলের জন্য নাস্তা তৈরী করতে কিচেনে চলে গেল। রাদিদ নীলাভ্রকে বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। আপনি চাইলে বিশ্রামও নিতে পারেন।’

নীলাভ্রের মনে হলো এই একটা মানুষ তার কষ্টটা বুঝতে পারল। রাদিদের প্রতি তার মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। তার আসলেই বিশ্রাম দরকার। রাদিদ তাকে আফরিনের রুমে নিয়ে গেল। রাদিদ বলল, ‘আপনি ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিন, নাস্তা রেডি হলেই খেতে ডাকা হবে।’

রাদিদ নীরাকে সাহায্য করতে কিচেনে গেল। নীরা নাস্তা তৈরী করতে করতে রাগে গজগজ করছিল। রাদিদ বলল, ‘কী হয়েছে তোর? বাচালদের মতো এরকম নিজে নিজেই বকবক করছিস কেন?’

‘জানো না তুমি?’ নীরা রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে প্রচণ্ড পরিমাণে তেতে উঠল, ‘আম্মু কী সুন্দর করে আপুকে গলায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে বসে গেছে। আপুর এতো বড়ো অপরাধ ভুলে গেছে। বাবাও ভুলে গেছে, মাও ভুলে গেছে। তোমাকেও দেখে মনে হচ্ছে তুমিও ভুলে গেছ। খালি আমিই ভুলতে পারছি না।’

‘এখন এইসব বলে কী লাভ? তাড়াতাড়ি নাস্তা রেডি কর। সবাই ক্ষুধার্ত।’ আদেশের সুরে বলল রাদিদ।

‘আমাকেই সবাই অর্ডার করতে পারে। আর কেউ তো নেই খায়েশ মঞ্জুর করার জন্য।’ নীরার কণ্ঠে রাগ উপচে পড়ছে।

‘ওরে বাপ্রে! তুই দেখি রাগও করতে পারিস।’ খানিকটা কৌতুকের স্বরে বলল, রাদিদ।

‘রাদিদ ভাইয়া, তুমি কিন্তু আমাকে খুব জ্বালাচ্ছ?’ নীরা চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘বহ্নি আপুকে বিচার দিব কিন্তু…!’

বহ্নির কথা উঠতেই রাদিদের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার এতক্ষণের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা মলিন হয়ে গেল। নীরা তার কথাটা অসম্পূর্ণই রেখে দিল। অপরাধীর সুরে বলল, ‘স্যরি, রাদিদ ভাইয়া।’

রাদিদ কিছু বলল না। নীরবে কিচেন থেকে প্রস্থান করল। নীরার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। একটু পরেই রাদিদ ফিরে এসে স্মিত হেসে বলল, ‘দূর পাগলি, আমি তোর উপর রাগ করিনি। তবে বহ্নির প্রসঙ্গ না আনলেই ভালো। সে আমার কেউ না। আমিও তার কেউ না। এই কথাটা মাথায় ভালো করেই ঢুকিয়ে নে।’

নীরা মলিন স্বরে বলল, ‘বহ্নির কথা ইচ্ছে করে বলিনি, ভাইয়া। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আমি সত্যিই দুঃখিত।’

রাদিদ হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘বহ্নির নামটা শুনলেই কোথাও যেন আগুন জ্বলে। আমি সহ্য করতে পারি না সেই উত্তপ্ত আগুনের দহন। সবসময় ভুলে থাকার চেষ্টা করি। আর তো কিছু করার নেই আমার, তাই না?’

নীরা একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
‘ভুলতেও পারলে কোথায়? সে তো তোমার শয়নে- স্বপনে দিব্যি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তোমার রচিত শত শত কবিতা আর উপন্যাসের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, তোমারই অগোচরে, নীরবে, খুব গোপনে।’

_______________

শিহরণের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল যখন শুনল তার মা মান্নাতের সাথেই তার বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলেছে। খবরটা শোনার পর থেকেই সে অস্থির পায়ে পায়চারি করছে। তার বাবার সাথে কথা বলার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। বাবার সাথে সে অনেকটাই ফ্রি। তাই বিষয়টি বলা অতটা কঠিন হবে না। কিন্তু হুট করেই জানতে পারল তার বাবা বিজনেস ট্যুরে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। এই খবরটা শোনার পর থেকেই তার মনটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। তার ধারণা এর মধ্যে সে বাবার সাথে কোনোমতেই কথা বলতে পারবে না। এই কথাটা ভাবতেই বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছে। ছোঁয়ার সাথে বিচ্ছেদের কথা সে ভাবতেই পারে না। তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কী অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কেটে গেল তার পুরো বিকেলটা! অপরদিকে তার মা মান্নাতের পরিবারের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সে এইসব কিছু সহ্য করতে না পেরে বিশ্রামের কথা বলে নিজের রুমে চলে এসেছে।

‘কী হয়েছে? তুমি এভাবে উঠে আসলে কেন?’ তীক্ষ্ম কণ্ঠে করা প্রশ্নে শিহরণ চমকে তাকাল তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মান্নাতের দিকে।

শিহরণ চোখ বন্ধ করে গম্ভীর শ্বাস ফেলে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, ‘আমি এই বিয়েটা করতে পারব না, মান্নাত।’

মান্নাতের চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিস্ফোরিত নেত্রে শিহরণের দিকে তাকিয়ে মান্নাত প্রশ্ন করল, ‘বিয়ে করতে পারবে না মানে? সব ঠিক হয়ে গেছে, শিহরণ। এসব তুমি কী বলছ?’

শিহরণের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে টেনে টেনে বলল, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। না মানে না। এটা কখনোই হ্যাঁ হবে না। গট ইট?’

‘না, আমি বুঝিনি। বললেই হলো বিয়ে করতে পারবে না, তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে।’ উত্তেজিত কণ্ঠে কথাগুলো বলে শিহরণের কাছে ঘেঁষে মান্নাত বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি শিহরণ। তুমি এভাবে না করো না।’

শিহরণের মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। মান্নাত এবার শিহরণকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারি না শিহরণ। প্লিজ, তুমি এই বিয়েতে রাজী হয়ে যাও। আমি তোমাকে অনেক সুখে রাখব, কথা দিচ্ছি।’

শিহরণ এক ঝটকায় মান্নাতকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না। বুঝতে পেরেছ?’

মান্নাত বেজায় বিরক্ত। সে আবারও শিহরণের কাছে এসে তাঁকে বাহুডোরে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে বলল, ‘আমি জানি তুমি আমাকে মিথ্যে বলছ। আমি জানি তুমি আমাকেই পছন্দ করো, আমাকেই ভালোবাসো।’

‘সিরিয়াসলি?’ শিহরণ ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ‘আমার কোন আচরণটা দেখে আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে মনে হয়েছে তোমার? আমি কি কখনও তোমাকে ভালোবাসি কথাটা বলেছি? কোনো ইঙ্গিত দিয়েছি? কিছু একটা তো বলো।’

মান্নাত কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি এই একটা কারণই যথেষ্ট আমার জন্য।’

‘কিন্তু আমার জন্য যথেষ্ট নয়।’ তেজী গলায় বলল শিহরণ ।

‘কিন্তু কেন?’

‘কারণ আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।’

মান্নাত কথাটা শুনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর চাবি দেওয়া পুতুলের মতো করে বলল, ‘তাহলে তুমি ভুলে যাও যে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কখনও ভালোবেসেছিলে।’

শিহরণ হো হো করে হেসে উঠল মান্নাতের কথা শুনে। দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘এই দেহে প্রাণ থাকতে তা সম্ভব নয় মান্নাত।’

‘যদি যাকে ভালোবাসো সেই না থাকে তো?’ গমগমে গলায় প্রশ্ন করল মান্নাত।

_____________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৫০+৫১+৫২

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫০

সকালে নাস্তা করতে বসেও কেমন যেন নিশ্চুপ, শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল পুরো ঘর জুড়ে। তানিয়ার মতো চঞ্চল মেয়েটাও নীরব ছিল। ইদানিং সেও তার বাবাকে কিছুটা ভয় পেতে শুরু করেছে, হয়তো কিছুটা ঘৃণাও তার মনে স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে সেদিনের পর থেকে। অতল যখন আতিকের বিষয়টা খুব সাহস করে জানাল তার বাবাকে, তখন তিনি নিজের মধ্যে চেপে রাখা সমস্ত রাগ, ক্ষোভ বজ্রপাতের মতো করেই যেন অতলের উপর বর্ষিত করেছিল। অতলের বলা কথাগুলো তিনি বিশ্বাস তো করলেনই না বরং তার গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছিলেন। উপরন্তু তাকে কুলাঙ্গার উপাধি দেওয়া হলো। অতল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে সবকিছু হজম করেছিল। সে বুঝে গিয়েছিল তার বাবার কাছে তার বলা কোনো কথারই মূল্য নেই। আতিক অতলের বলা সমস্ত কথা অস্বীকার করেছিল। তখন আশরাফ হোসেন আতিকের উপর বেশ গর্ব করে বলেছিলেন, ‘এমন ছেলে থাকলে বাবা-মায়ের আর কিছু লাগে না। তোর মতো কুলাঙ্গার সন্তান যেন আর কারও ঘরে না হয়। ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে একটা কথা আছে না। তুই হলি ঘরের শত্রু। তোর মতো শত্রু আর কুলাঙ্গার সন্তান থাকতে আর নতুন কোনো শত্রুর কী দরকার?’

অতল পাথরের তৈরী জীবন্ত মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়েছিল। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু অতি সন্তর্পণে গড়িয়ে পড়েছিল। অতলের কাছে আতিকের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ ছিল। কিন্তু সে আর সেসব প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করল না। আতিকের ব্যাপারটা অতল তার বাবাকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু যখন শুনেছে আতিক বিয়েতে রাজী, তখন সে আতিকের রিলেশনের বিষয়টা বাবাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেবল বাবার মান-সম্মানের কথা ভেবে। কিন্তু তার বাবা তার কথা বিশ্বাস করল না। মেহেরুন নাহার শেষ পর্যন্ত অতলকে টানতে টানতে তার রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন। অতল এর পর থেকে একটা কথাও বলেনি, রাতে ভাতও খায়নি। মেহেরুন নাহার আর তানিয়াও অভুক্ত থেকেছিল। কিন্তু পরদিন সকালে অতল খুব স্বাভাবিক ছিল, যেন কিছুই হয়নি। ছেলের এমন রূপ দেখে মেহেরুন নাহার ভয় পেতে শুরু করেছিলেন। তিনি অতলকে নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকেন। ছেলেটার মানসিক অবস্থা খুবই সেনসিটিভ, কী করতে গিয়ে কী করে ফেলবে সেটা নিয়ে তিনি সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন।

নাস্তার টেবিলে বসে দ্রুত খাবার শেষ করে অতল কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই
আশরাফ হোসেন বাঁজখাই গলায় অতলকে বললেন, ‘আজকে কোথাও যেতে হবে না তোমার। তোমার আম্মুর সাথে শপিং এ যাবে।’

অতল দাঁড়িয়ে পড়ল। বাবার দিকে তাকালও না, আবার কোনো উত্তরও দিল না। মেহেরুন নাহার শুধু বললেন, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি রেডি হয়ে আসছি বাবা।’

অতল নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘তাড়াহুড়ো করো না মা। ধীরে সুস্থে রেডি হও। আমি অপেক্ষা করছি।’

তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে আশরাফ হোসেন বললেন, ‘আমার মামুণিটার কোনো শপিং করতে হবে না? তুমিও যাও মামুণি তোমার আম্মুর সাথে।’

তানিয়া উদাস চোখে তাকাল বাবার দিকে। তারপর একই দৃষ্টিতে তাকাল অতলের দিকে। আতলের দিকে তাকাতেই তার মনটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সে মনে মনে বলল, ‘আমার প্রতি যেই ভালোবাসাটা তুমি দেখাও বাবা, তার এক কোটি ভাগের এক ভাগও যদি আমার এই হতভাগ্য ভাইটার প্রতি দেখাতে তবে এই ভাইটাই তোমার নাম উজ্জ্বল করে দিত। তুমি সারাজীবন উলুবনে মুক্তো ছড়িয়ে এসেছ। একদিন তোমার এই ভুলটা নিশ্চয়ই ভেঙবে। হয়তো তুমি স্বীকার করবে না, তবে বিবেকের দংশনে ঠিক দংশিত হবে। বিবেক কাউকে ছেড়ে দেয় না।’

তানিয়াকে ভাবুক দেখে আশরাফ হোসেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘আমার ছোট্ট মামুণিটা এত কী ভাবছে?’

বাবার কথায় তানিয়া সংবিৎ ফিরে পেল। বলল, ‘যাব, বাবা। আমার ভাই যাচ্ছে শুধু তাই যাব।’

মেয়ের কথা শুনে আশরাফ হোসেন আর কিছু বললেন না। তিনি খুব ভালো করেই জানেন তার মেয়েটা অতলকে ভীষণ ভালোবাসে।

শপিং যখন শেষের দিকে ঠিক তখনই একটা শাড়ির দিকে অতলের চোখ আটকে গেল। নীল রঙের শাড়িটা দেখেই তার বহ্নির কথা মনে পড়ে গেল। মনে হলো এই নীল রঙা শাড়িটাতে বহ্নিকে নীল পরীর মতো দেখাবে, যদিও সে পরী দেখেনি। তবুও তার জীবনে তিনজন জীবন্ত পরী আছে, যাদেরকে দেখে তার মনে হয়েছে, পরীরা ঠিক এরকমই হয়।

মা আর বোনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে শাড়িটা কিনে ফেলল। তার সাথে ম্যাচিং করা কানের দুল আর এক ডজন চুড়িও কিনল। তারপর এক ফাঁকে বহ্নির জন্য কেনা উপহারের প্যাকেটটা অতি সন্তর্পণে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল।

বাসায় আসার পরে তানিয়া তার রুমে এসে বলল, ‘শাড়িটা কার জন্য নিয়েছ, ভাইয়া?’

অতল ভীষণভাবে চমকে গেল। অতলকে চমকাতে দেখে তানিয়া বেশ মজা পেল। অতল যখন শাড়ি চুপিচুপি শাড়ি কিনছিল তখন সে সব দেখেও চুপ ছিল। অতল তানিয়ার মাথায় চাটি মেরে বলল, ‘কীসের শাড়ি? তুই ইদানিং বেশি পটর পটর করছিস, টমেটো সস।’

‘আমি কিন্তু সব দেখেছিলাম, ভাইয়া। তুমি শাড়ি কিনেছ, আবার সেই শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কানের দুল আর চুড়িও কিনেছ।’

‘তোর না চোখে সমস্যা হইছে। আজ বিকেলেই তোকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব।’

‘তুমি প্যাকেটটা কোথায় রেখেছ সেটা বললে তবেই কি বিশ্বাস করবে?’

অতল এবার অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। দুম করে তানিয়ার হাত ধরে আহ্লাদী গলায় বলল, ‘আমার মজার টমেটো সস, তুই এই কথা আর কাউকে বলিস না প্লিজ। এই তোর হাতে ধরলাম।’

‘উফ্, ভাইয়া। টমেটো সস বললে কিন্তু মাকে বলে দিব।’

‘তাহলে কি সয়া সস বলব না-কি চিলি সস বলব? কোনটা শুনতে চাস তুই? যেটা বলবি সেটা বলেই ডাকব তোকে।’

‘এসব কী শুরু করেছ, ভাইয়া। একদম বিরক্ত লাগে। খালি সস সস করো।’

‘আচ্ছা, যা এখন থেকে আর কোনো সস-ই বলব না। তোকে এখন থেকে তানু বলে ডাকব। ঠিক আছে এবার?’

‘একদম ঠিক আছে।’ তানিয়া হাসল।

অতল এক হাতে তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার এই বোনটা হচ্ছে পৃথিবীর বেস্ট বোন।’

‘আর তুমি হচ্ছো আমার বেস্ট ভাইয়া।’

মেহেরুন নাহার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে ভাই-বোনের সব কথাই শুনেছেন। তিনি জানেন তার ছেলেটা খুব বেশিই ইন্ট্রোভার্ট। তানিয়ার উপর তার খুব গর্ব হচ্ছে। মেয়েটা খুব চেষ্টা করে অতলের মন ভালো করার জন্য। তার ছেলেটার জীবনে সত্যিই কেউ এসেছে? এই একটা বিষয় নিয়ে তিনি এখনও শঙ্কিত। প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর তিনি পাবেন না, এই এক জ্বালা উনার। ছেলেটা যে তাকে কিছুই বলতে চায় না।

__________________

বহ্নি অতলের দেওয়া উপহারের প্যাকেটটা খুলল। শাড়িটা দেখেই তার ভীষণ পছন্দ হলো। শাড়িটার উপরে একটা চিঠি। বহ্নি চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করল।

প্রিয় আগুনমণি,

এঞ্জেল, তোকে তুমি করে বলতে পারি না কী করি বল তো? তুই তো সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমার তুই হয়ে আছিস। এই শাড়িটাতে তোকে একদম পরীর মতো লাগবে, নীল পরী। আমার নীল পরী। ভীষণ ভালোবাসি, আমার নীল পরীটাকে।

তুই কিন্তু আমার জীবনের একমাত্র পরী না। আমার জীবনে তিনজন জীবন্ত পরী আছে। একজন আমার মা। মা হচ্ছে সাদা পরী। যখন মা আমার সামনে আসে তখন আমার মনে হয় চারিদিক আলোকিত হয়ে যাচ্ছে শুভ্র আলোকচ্ছটায়।

দ্বিতীয় জন আমার বোন তানিয়া। তানিয়া হচ্ছে লাল পরী। সে যখন আমার সামনে আসে তখন মনে হয় গোধূলি লগ্নের আকাশের লালিমার মতো চারিদিক রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ছে। আমার ভীষণ ভালো লাগে। তাই ওকে আমি টমেটো সস বলে ডাকি। ও কিন্তু এই ডাক শুনে ভীষণ ক্ষেপে যায়। ওকে খ্যাপাতে কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগে।

আর তৃতীয় জন কে হতে পারে, একটু ধারণা কর তো। হুম, ঠিক ধরেছিস। তোর কথাই তো বলছি। তুই হচ্ছিস আমার নীল পরী। নীল পরীটাকে আমি অনেক অনেক সাধনা করে পেয়েছি, যদিও আমার চাইতে আমার পরীর সাধনা অনেক বেশি। তবুও বলছি, ভীষণ ভালোবাসি আমার এঞ্জেলকে, আমার নীল পরীকে।

ওহ, তোকে কী কখনও বলেছি, গোধূলী দেখতে আমি ভীষণ ভালোবাসি? জেনে রাখ, শেষ বিকেলের রংধনু আমার তার চাইতেও বেশি প্রিয়। মাঝেমধ্যে ভাবি, রংধনুর সাতটি রঙে যদি আমার জীবনটাও রঙিন হতো। তুই কি আমার সেই শেষ বিকেলের রংধনু হবি?

বি.দ্র. এই শাড়িটা দেখার পর মনে হয়েছে এটা কেবল এবং কেবলই আমার নীল পরীটার জন্য। এটা পরে আমার সাথে দেখা করতে আসবি।

ইতি
তোর অনেক সাধনার পরে অর্জিত ভালোবাসা

চিঠিটা পড়ে বহ্নির মনটা এক অবর্ণনীয় ভালোলাগায় ছেয়ে গেল। সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণ চাঁদটা যেন পুরো আকাশে তার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। চাঁদের সেই রুপোলি আলো গায়ে মাখছে গাছের সবুজ পাতা।

বহ্নি তার মোবাইলটা বের করে কল করল অতলকে। অতল যেন ওঁত পেতে বসেছিল কল রিসিভ করার জন্য। রিং পড়ার সাথে সাথেই কল রিসিভ করল অতল। বহ্নি বলল, ‘বাইরে আসবে?’

‘বাইরে কোথায়, আগুনমণি?’

‘আরে বাবা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াও। চাঁদটা দেখো। কেমন করে আলো ছড়াচ্ছে।’

অতল আর দেরি করল না। ব্যালকনিতে আসতে আসতে বলল, ‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে, নীল পরী?’

‘ভয়ংকর রকমের পছন্দ হয়েছে।’ বহ্নি হেসে বলল।

‘ভয়ংকর রকমের পছন্দ? সেটা আবার কী রকম?’

অতলের প্রশ্ন করার ধরন শুনে বহ্নি হাসল প্রাণখুলে। তারপর বিজ্ঞের মতো করে বলল, ‘যখন কোনো পছন্দ একজন মানুষের পছন্দের সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করে ফেলে তখন সেটাকে ভয়ংকর রকমের পছন্দ বলে।’ পরক্ষণেই বহ্নি কোনো প্রকার দ্বিধা, সঙ্কোচ ব্যতিরেকে বলল, ‘যেমন তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা। ভয়ংকর রকমের ভালোবাসি তোমায়।’

‘এতো ভালোবাসিস কেন আমায়? আমার মতো অধমকে এতোটা ভালোবাসা কি ঠিক হচ্ছে তোর?’ অতলের কন্ঠস্বর দ্বিধান্বিত শোনাল যেন।

‘ঠিক ভুল কিছু বুঝি না আমি। আমি শুধু জানি ভালোবাসি, ভীষণভাবে ভালোবাসি, ভয়ংকর রকমের ভালোবাসি তোমায়।’

বহ্নির ভালোবাসি কথাটা বলার ধরনে অতল হো হো করে হেসে উঠল। মোবাইলটা অপর হাতে কানে চেপে ধরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রসিকতা করে বলল, ‘আচ্ছা আগুনমণি, আমি যদি কখনও তোর কাছ থেকে হারিয়ে যাই তখন তুই কি করবি? না, মানে ভয়ংকর রকমের ভালোবাসিস বললি তাই জানতে চাইলাম আরকি।’

বহ্নি গম্ভীর কণ্ঠে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আমি তোমাকে কখনোই হারাতে দিব না,

অতল হাসল। বহ্নি বলল, ‘হাসছ কেন?

‘সেকী! তুই কি আমাকে দেখতে পাচ্ছিস?’

‘আবার তুই?’

‘ওহ্, স্যরি। আসলে এত বছরের অভ্যাস কি আর কয়েকদিনে পরিবর্তন হবে?’

‘আচ্ছা, বল তো তুই কি আমাকে দেখতে পাচ্ছিস? মানে আশেপাশে কোথাও চলে আসিসনি তো আবার? তুই যে রকম পাগলি, তোর তো কোনো বিশ্বাস নেই।’

‘হুম, পারছি তো। মনের চোখ দিয়ে দেখছি। আর অনুভব করতে পারছি।’

হঠাৎ অতল প্রশ্ন করে বসল, ‘আমাকে জানাসনি কেন?’

‘কী?’ অতলের করা প্রশ্ন বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করল, বহ্নি।

‘ভালোবাসিস সেটা।’

বুঝতে পেরে বহ্নি লজ্জা পেল। লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি তো অন্য একজনের মধ্যে ডুবে ছিলে। আমার সাহস হয়নি।’

‘ভুল করেছিলি।’ অতল গম্ভীরভাবে ঘন গন বার কয়েক শ্বাস ফেলে বলল, ‘তুই কনফেস করলে আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারতাম।’

‘তখন বললে তুমি বুঝতে পারতে না।’ বহ্নি বলল, দৃঢ়তার সাথে।

‘এতটা নিশ্চিত হচ্ছিস কীভাবে?’

‘তোমাকে আমি তোমার থেকেও বেশি চিনি।’

‘আচ্ছা, তুই আমাকে কোনো প্রকার সম্বোধন ছাড়াই কথা বলছিস কেন?’

‘কী বলে ডাকব তোমায় বলো?’

‘কেন? অতল বলবি।’

‘হুম, আসলে আমারও একটু সমস্যা হচ্ছে কিন্তু। অতল ভাইয়া বলেই তো অভ্যস্ত।’

‘তাহলে অতল ভাইয়া বলেই ডাকতে পারিস। আমার অবশ্য কোনো অসুবিধা নেই।’ কথাটা বলেই অতল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

‘না, অতল ভাইয়া বলে ডাকব না। অতল ডাকব। শুধু অতল।’

‘নো সমস্যা। আমাকে জানু, জান্টুস, মনপাখি যা খুশি তাই ডাকতে পারিস। আমার এত ডাকাডাকি নিয়ে সমস্যা হয় না।’ অতল কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে বলল।

‘এহ্, এত বিচ্ছিরি টাইপ ডাক তোমাকে আমি কখনোই ডাকব না।’ বহ্নি বলল, চোখ মুখ কুঁচকে।

‘জানু বিচ্ছিরি?’ অতল জানতে চাইল অবাক হয়ে।

‘জানু খুব কমন, বাকিগুলো খুবই বিচ্ছিরি।’

‘এই রে, একটা তারা খসে পড়েছে তুমি দেখেছ?’

‘হুম, কিন্তু দেখলেই বা কি?’

‘উইশ করবে না?’

‘এঞ্জেল, আমি এসব একদম বিশ্বাস করি না।’

‘তাতে কি হয়েছে? আমিও করি না তো।’

‘তুই উইশ করেছিস?’

‘না, আমিও বিশ্বাস করি না।’ বহ্নি হাসল।

‘তবে জানতে চাইলি যে?’

‘তুমি বিশ্বাস করো কি না তা জানার জন্য।’

অতল এবার হেসে ফেলল। বারান্দায় একটা অপরাজিতা গাছ লাগিয়েছিল সে। সেই গাছটাতে বেশ অনেকগুলো অপরাজিতা ফুল ফুটেছে। একটা ফুল আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিয়ে অতল বহ্নিকে প্রশ্ন করল, ‘অপরাজিতা ভালোবাসিস?’

‘হুম, খুব।’

‘অপরাজিতার নীল রঙটা কষ্টের প্রতীক জানিস তো?’

‘জানি, তবুও এই নীল আমার ভীষণ প্রিয় । কারণ নীল তোমার পছন্দ। তোমার পছন্দ আমার পছন্দ।’

অতল এবার নিশ্চুপ। মেয়েটা কেন যে তাকে এতো বেশি ভালোবাসে তা অতল জানে না। এখন অবশ্য তা জানতেও চায় না। এখন সে শুধু জানে, এই মেয়েটাকে তার খুব করে চায়, একদম আপন করে নিতে চায় সে তাকে। সে অনুভব করে এই পিচ্চিটার পাগলের মতো ভালোবাসা, বিনিময়ে সেও তাকে পাগলের মতো করে ভালোবাসতে চায়, পাগলিটার চাইতেও বেশি করে। অতল ভাবে তাকে এভাবে পাগলের মতো করে ভালোবাসার মতো কী আছে তার মধ্যে? সত্যিই কি কিছু আছে? না-কি কিছুই নেই, না-কি সে বরাবরের মতোই নিঃস্ব, রিক্ত, নির্জীব এক মানব?

____________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫১

মায়ার বিয়ে উপলক্ষে খুব ছোটোখাটো আয়োজন করা হয়েছে। ছোঁয়া, হিয়া, অহনা আর সাইফ অনেকটা জোর করেই মায়াকে পার্লার থেকে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। মায়া অনেক নিষেধ করা সত্ত্বেও তার কথা কেউ শুনল না। ছোঁয়া তো বলেই বসল, ‘আরে দোস্ত, বিয়ে তো একবারই করবি, সেই একবারও যদি একটু সাজগোজ না করিস তাহলে কেমনে হবে?’

হিয়া মজা করে বলল, ‘তেমন কিছুই হবে না, ছোঁয়াপু। দুলাইভাই শুধু একটু আফসোস করে বলবে, আজকের দিনে একটু সাজলেও পারতেন।’

হিয়ার কথা শুনে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল।
সাইফ মায়াকে বলল, ‘এই তুই এদের কথায় একদম কান দিস না। তুই এমনিতেই অনেক সুন্দর।’

মায়ার বন্ধুদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত কাজ দেখে মায়ার মা আর বাবা বেশ নিশ্চিন্ত হলেন।
______________

নীলাভ্র শেষ পর্যন্ত বরের পোশাক পরে নিজের রুমে বসে ছিল। আফরিন ভিডিয়ো কল করছে বার বার। নীলাভ্র কল রিসিভ করতেই দেখতে পেল আফরিন একটা ব্লেড নিজের হাতের উপর ধরে বলল, ‘এখন বিশ্বাস হচ্ছে তো, নীল?’

নীলাভ্র আঁতকে উঠল। আতঙ্কিত গলায় বলল,
‘আফরিন এটা করো না, প্লিজ।’

আফরিন অপ্রকৃতিস্থের মতো করে হেসে বলল, ‘কেন? ভয় হচ্ছে নীল?’

‘আফরিন, প্লিজ তুমি এটা করো না, প্লিজ আফরিন, প্লিজ।’ অনুনয় ভরা কণ্ঠে বলল নীলাভ্র, ‘নিজের ক্ষতি করো না আফরিন, প্লিজ।’

‘কেন, নীল? কেন? তুমি তো বিয়েটা করবেই, তাই না? তাহলে আমি বেঁচে থেকে কী করব বলো?’ কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল আফরিন।

নীলাভ্র অসহায় গলায় বলল, ‘আফরিন, আমি অপারগ।’

আফরিন ব্লেড হাতে বসিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। সেও গমগমে গলায় বলল, ‘আমিও অপারগ নীল। তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তুমি আমাকে ভালোই বাসোনি কখনও ।’

নীলাভ্র আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ‘আফরিন, তুমি নিজের ক্ষতি করো না, প্লিজ। আমি এই বিয়েটা করব না। আমি তোমার কাছে আসছি।’

আফরিন ব্লেড ছুড়ে ফেলে দিল। মরিয়া হয়ে সে বলল, ‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব, নীল। আজকেই আমরা বিয়ে করব।’
________________

বিয়ে বাড়িতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বরের পরিবার চলে এলেও এখনও বরের দেখা নেই। বরের গাড়িতে ছিল অতল, তানিয়া আর আয়মান। গাড়ি যখন কনের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিল ঠিক তখনই আতিক গাড়ি থেকে নেমে পড়ে, তার অফিসের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে। অতল অনেক জোর করলেও তার কথা না শুনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন আতিক এলো না তখন অতল যখন আতিককে ফোন করল তখন আতিক বারবার তার কল কেটে দিচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত তার ফোনটাই বন্ধ করে রাখল। অতল ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিল, অথচ তার বাবা তার কথা শুনল না। এর পরের অবস্থা কী হবে সেটা নিয়েই সে বেশ উদ্বিগ্ন।

গাড়ি থেকে নেমে সোজা মায়ের কাছে ব্যাপারটা খুলে বললেন। আশরাফ হোসেন বিষয়টা জানতে পেরে থম ধরে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। একটা সময় পরে সবাই জেনে গেল যে, বর আসেনি। তখন মায়ার বাবা শফিক সাহেব আশরাফ হোসেনকে উদ্দেশ্য করে কঠিন গলায় বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে, আশরাফ সাহেব? বিয়েতে কি আপনার ছেলের মত ছিল না? আপনি কি জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলেন? এভাবে আমাদের অপমান করার কী দরকার ছিল বলেন?’

আশরাফ হোসেন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি নতমস্তকে হাত জোর করে ক্ষমা চাইলেন তার এক সময়কার কলিগ শফিক সাহেবের কাছে। শফিক সাহেব কঠিন কিছু কথা শোনালেন তাকে। অবশেষে আশরাফ হোসেন শফিক সাহেবকে বললেন, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে আমার আরেক ছেলের সাথে আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারেন।’

শফিক সাহেব যেন অকূল পাথারে ঠাই খুঁজে পেলেন। তিনি সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলেন। তারপরও বলে গেলেন যে, ‘আপনার এই ছেলে রাজী হবে তো?’

আশরাফ হোসেন বললেন, ‘ও রাজী হবে। আপনাকে ভাবতে হবে না। ছেলে তো বিয়েতে এসেছে। আমি এখনি তার সাথে কথা বলব।’

শফিক সাহেব বললেন, ‘একটু তাড়াতাড়ি করুন, প্লিজ। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর জন্য অনেক্ষা করছেন। আমাদের আত্মীয় স্বজনরাও অপেক্ষা করছেন। আজকে বিয়েটা না হলে আমাদের অনেক অপমানিত হতে হবে।’

বর না আসার বিষয়টা ততক্ষণে মায়া জেনে গেছে। মায়া সেই খবরটা শুনে পাথরের মতো জমে গেল। কারো সাথে কোনো কথা বলল না সে। ছোঁয়া আর সাইফ দুজনেই তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

আশরাফ হোসেন অতলকে ডেকে বললেন, ‘বিয়েটা তোমাকেই করতে হবে। বাবার মান-সম্মান বাঁচাতে এই বিয়েটা করতে নিশ্চয়ই তোমার কোনো আপত্তি নেই?’

অতলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এভাবে হুট করে কীভাবে বিয়ে করতে বলছে তার বাবা তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারল না। সে ইতস্তত করে বলল, ‘বাবা, আমি কি করে বিয়ে করব? কাকে বিয়ে করব? যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তাকে তো আমি দেখলামও না। তাছাড়া আমি এখন বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নই।’

আশরাফ হোসেন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন মেহেরুন নাহারের দিকে। গমগমে কণ্ঠে বললেন, ‘দেখলে তো, খুব তো গর্ব করো এই ছেলেটাকে নিয়ে। আমার নাম ছড়াবে এই ছেলে একদিন। দেখলে তো, এই ছেলে আজ আমাকে এই অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সামান্য বিয়ে করতে পারছে না। এরকম বেকার ছেলেকে কে মেয়ে বিয়ে দেবে বলো তো? শফিক সাহেব শুধু আমার দিকে তাকিয়েই বিয়েটা দিচ্ছেন। এইটাতে শুকরিয়া না করে সে বলছে তার মানসিক প্রস্তুতি নেই।’

অতলের ইচ্ছে হলো একবার বলেই ফেলুক, ‘তাহলে বিয়েটা তুমিই করে নাও বাবা। আমাকে কেন এতো প্রেশার দিচ্ছ?’

কিন্তু সে মুখে বলল, ‘এরকম কিছু হতে পারে মনে করেই তো আমি সেদিন আতিক ভাইয়ের রিলেশনের বিষয়টা জানিয়েছিলাম। তখন তো আমার বিশ্বাস করোনি। বিশ্বাস করলে এরকম তো হতো না, তাই না?’

আশরাফ হোসেন কড়া গলায় বললেন, ‘আমি এতো কিছু শুনতে চাই না। বিয়েটা তোমাকেই করতে হবে। ব্যস, আমার কথা এখানেই শেষ।’

মেহেরুন নাহার বুঝতে পারছেন না তিনি কী করবেন! অতলকে কাছে ডেকে তিনি বললেন, ‘বাবা, বিয়েটা করে নে। তোর ভাই তো আমাদের সবাইকে এই বিপদে ফেলে চলে গেছে। এবার তুই-ই শুধু আমাদের এত্ত বড়ো অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারিস। এতে করে হয়তো তোর প্রতি তোর বাবার দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিবর্তন হবে। তিনি হয়তো বুঝতে পারবেন, যেই ছেলেটাকে দূর দূর করে বারবার অবহেলা করে এসেছেন, সেই ছেলেটাই তার দুঃসময়ের তার পাশে এসে দাঁড়াল। হয়তো তখনই তোর বাবা তোর গুরুত্বটা বুঝতে পারবে।’

অতল নির্বিকারভাবে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মেহেরুন নাহার আবারও বললেন, ‘বাবা, মেয়েটা খুব ভালো। আমি চিনি মেয়েটাকে। খুব লক্ষ্ণী একটা মেয়ে। ওকে বিয়ে করলে তুই কখনও আক্ষেপ করবি না, শুধু এটুকু বলছি।’

কথা শেষ করেই মেহেরুন নাহার চলে গেলেন। অতল সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল, নির্বিকার ভঙ্গিতে, অনুভূতি শুন্য হয়ে। তবে তার চোখের দৃশ্যপটে কেবলই বহ্নির ছবি দেখছে সে। সে যদি অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে তাহলে বহ্নির কী হবে? সে কি তবে তার ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলবে? কেন, তার ভাগ্যটা এতো খারাপ? হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। অতল মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল বহ্নি কল করছে। অতল অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে।

অতলকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে তানিয়া শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া, তোর মনের কথা শুনবি শুধু। বাবা-মা তোকে বলেছে বলেই কিন্তু তোকে বিয়েটা করতে হবে না। বাবা-মায়ের কথা ভেবে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিস না, যার জন্য সারাজীবন আক্ষেপ করতে হয়।’

বাবা আর মায়ের চাপে পড়ে অতল বিয়েতে শেষমেশ রাজী হয়ে গেল।

_________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫২

নীলাভ্র আর আফরিন রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে ফেলল। বিয়ে করার পরেই যেন আসল ভয় পেয়ে বসেছে নীলাভ্রকে। আফরিন অনেকটা জোর করেই নীলাভ্রকে নিয়ে তার বাড়িতে চলে এলো। নীলাভ্রকে দেখে আশরাফ হোসেন বাঁজখাই গলায় বললেন, ‘কুলাঙ্গার কোথাকার। বাপের মান ইজ্জত খেয়ে এখন এখানে কেন এসেছিস তুই? তুই এই বিয়ে করতে পারবি না তো আমাকে বলতে পারতি। এভাবে আমার মান সম্মান কেন ধুলোয় মেশালি?’

আশরাফ হোসেনের বজ্রের ন্যায় কণ্ঠস্বরে যেন নীলাভ্রের কান ঝলসে গেল। সে মাথা নিচু করেই রইল। আফরিন তেজী গলায় বলল, ‘আপনি সবাইকে ধমকের উপর রাখেন বলেই তো সবাই আপনাকে এরকম ভয় পায়। এরকম অকারণ জেদ থাকা ভালো না। এতো বড়ো ছেলেকে বিয়ে দিচ্ছেন অথচ তার কোনো পছন্দ আছে কি না তা একবার জানতে চাইলেন না। কেন বলুন তো? বিয়ে করার পরে সংসার তো আপনার ছেলেকেই করতে হবে। তাই না?’

আশরাফ হোসেনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এভাবে কেউ কোনোদিন তার সাথে কথা বলেনি। হাঁটুর সমান বয়সী মেয়ে তার সাথে মুখে মুখে তর্ক করছে। তিনি তা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারলেন না। প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তোমাদের জায়গা এই বাড়িতে হবে না। বেয়াদব একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্যই তুই আমার মান সম্মানের জলাঞ্জলি দিয়েছিস। তাই না? ঠিক আছে। যার যেমন খুশি তেমন করো। এই বাড়ির দরজা তোর জন্য সারা জীবনের জন্য বন্ধ। ‘

কথাগুলো বলেই আশরাফ হোসেন আফরিন আর নীলাভ্রর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন । নীলাভ্র আর আফরিন দুজনেই দুজনের মুখের দিকে একবার দেখল। উপায়ান্তর না পেয়ে তারা অজানার পথে পা বাড়াল।

নীরব রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নীলাভ্র তার বন্ধুদেরকে কল দিয়ে একটা থাকার জায়গা ব্যবস্থা করে দিতে বলল। কিন্তু কেউই করল না। শেষমেশ ওরা একটা হোটেলে গিয়ে উঠল।

_______________

নওশীন হক মাথায় আইসপ্যাক দিচ্ছেন। বিকাল থেকেই তার মাথাটায় তীব্র যন্ত্রণা করছে। এই যন্ত্রণাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তার মেয়ে আফরিন। মেয়েটা সেই সকাল বেলা বেরিয়েছে। তারপর সন্ধ্যা অবধি তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। মাহফুজ হকেরও যেন এবার টনক নড়েছে। বিজনেস ইস্যু নিয়ে তিনি এতোটাই ব্যস্ত থাকেন যে পরিবারের দিকে নজর দিতে পারেন না। আবার তিনি তার স্ত্রীর কথাকেও খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তাই তার খুব আফসোস হচ্ছে। মেয়েটার জন্যেও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আফরিনের বন্ধু-বান্ধব যারা আছে তাদের সবাইকেই কল করেছে নীরা। কিন্তু তাদের কারো কাছেই যায়নি আফরিন। শেষমেশ নওশীন হক কান্নাকাটি শুরু করলেন মেয়ের জন্য। অবশেষে মাহফুজ হক পুলিশে খবর দিতে যেই পুলিশের নাম্বার ডায়াল করবে অমনি একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলো তার মোবাইলে। মাহফুজ হক কলটা রিসিভ করতেই আফরিন গমগমে গলায় বলে উঠল, ‘আব্বু, আম্মুকে দাও। আম্মুর সাথে কথা আছে আমার।’

নওশীন হক কান্না ভেজা গলায় বললেন, ‘আফরিন মা আমার, তুই কোথায়? এভাবে না বলে কয়ে কেউ কি বাসা থেকে বের হয়ে যায়?’

‘মা, আমি বিয়ে করে ফেলেছি।’ অনুভূতিশূন্য কণ্ঠে বলল আফরিন।

নওশীন হক যেন খবরটা ঠিক ঠাউর করতে পারলেন না। তিনি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কী করে ফেলেছিস?’

‘বিয়ে! বিয়ে করে ফেলেছি আমি। তোমার কাছে আর কখনোই ফিরব না, মা। তোমার জন্য তো নীরাই ভালো। নীরাই তোমার সব। তুমি এখন নীরাকে নিয়েই থাকো। আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম।’ কঠিন গলায় জবাব দিলো আফরিন।

‘কী!’ নওশীন হক একটা বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তার শরীর কাঁপছে। হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেছে। নীরা দৌড়ে এসে তার মাকে ধরে সোফায় বসাল।

মাহফুজ হক চিন্তিত সুরে বললেন, ‘নওশীন, কী হয়েছে তোমার? আফরিন কী বলেছে? ও কোথায়?’

‘আফরিন বিয়ে…!’ কথা শেষ করার আগেই সেন্স হারালেন নওশীন হক।

নীরা মায়ের পাশে বসে মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আব্বু, ডাক্তারকে কল করো এখনি। মা কেমন যেন করছে। প্লিজ আব্বু তাড়াতাড়ি করো। মায়ের কিছু হলে আমি আপুকে কোনোদিনও ক্ষমা করব না। তুমি আপুকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছ। আমি তোমাকেও ক্ষমা করব না।’

মাহফুজ হকের নিজেকে অসহায় লাগতে শুরু করল। তিনি তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন। তার স্ত্রীর কিছু হয়ে গেলে তিনি নিজেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না। তিনি দ্রুত তার ফ্যামিলি ডাক্তারকে কল করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার চলে এলো। ডাক্তার জানালেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সেন্স ফিরে আসবে। অতিরিক্ত দুর্বলতা আর টেনশনের কারণে তার বিপি হাই হয়ে গেছে।’

নওশীন হকের জ্ঞান ফিরতেই তিনি আবারও আফরিন বলে চিৎকার শুরু করলেন। মাহফুজ হক স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। নওশীন হক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তিনি কান্না ভেজা গলায় বললেন, ‘আমার মেয়েকে এনে দাও। আমি জানি না ও কাকে বিয়ে করেছে। ওকে বলো, যাকেই বিয়ে করুক আমি মেনে নেব। আমার মেয়েকে শুধু এনে দাও আমার কাছে।’

মাহফুজ হক স্ত্রীর কাপলে চুমো দিয়ে বললেন, ‘আমি এনে দেব তোমার মেয়েকে। তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি সব ঠিক করে দিব এবার।’

মাহফুজ হক আফরিনের নাম্বারে অনেক বার কল করেছেন। কিন্তু মেয়েটা মোবাইল সুইচড অফ করে রেখেছে। নীরা বাবার কাছে এসে মাথা নিচু করে লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘আব্বু, আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ। তখন আম্মুকে ওভাবে দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’

মাহফুজ হক মেয়ের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। এই মুহূর্তে তার কাছে কোনো শব্দ নেই। তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি তোমার কথায় কিছু মনে করিনি আম্মু। তবে তুমি যা বলেছ সব ঠিকই বলেছ। টাকা পয়সা উপার্জন করলেই হয় না। পরিবারকেও সময় দিতে হয়। বিশাল বিত্ত-বৈভব থাকলেই সুখের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, এটা আমার ভুল ধারণা ছিল। তোমার কারণে আজ সেই ভুলটা ভেঙ্গে গেছে।’

এক সপ্তাহ হয়ে গেছে এখনও আফরিন কোনো যোগাযোগ করেনি। এদিকে নওশীন হকের অবস্থা খুবই করুণ। ফুফুকে এমন অসহায় অবস্থায় দেখে রাদিদ নিজ উদ্যোগে আফরিনকে খুঁজতে বেরিয়ে গেল।

_______________________

বর না আসার সংবাদ শুনে কিছুটা ভেঙ্গে পড়লেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নেয় মায়া। কিন্তু যখন শুনেছে তার বাবা বরের পরিবর্তে বরের ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে দিতে চাইছেন, তখন সে খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে গেল। বাবার সাথে তার এক চোট লেগে গেল। কোনোদিন বাবা-মায়ের সাথে উচ্চস্বরে কথা না বলা মায়াও বলে বসল, ‘বাবা, আমি কি তোমাদের কাছে একজন মানুষ না-কি কোরবানের গরু যে এক জন ক্রেতা কিনেনি বলে অন্য একজনকে গছিয়ে দিতে চাইছ?’

শফিক সাহেব মেয়ের কাছে শত অনুনয় বিনয় করা সত্ত্বেও মায়া রাজী হলো না। হিম শীতল গলায় বাবাকে বলেছিল, ‘বাবা, তুমি কি চাও তোমার মেয়ে কোনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চলে যাক? বিয়েটাই কি জীবনের সবকিছু? এই একদিনেই আমি কি তোমার কাছে বোঝা হয়ে গেছি যে একটা বিয়ে ভেঙ্গে গেছে বলে আমার আর কখনও বিয়েই হবে না বলে ভাবছ?’

শফিক সাহেব তখন অসহায় গলায় বললেন, ‘মা রে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা যে তোরই বদনাম করবে? বলবে মেয়েটারই কোনো দোষ আছে। বাবা হয়ে মেয়ের অপমান কি করে সহ্য করব?’

‘তুমি যাদের কথা বলছ, তারা যদি আমাদের খারাপ সময়ে আমাদের পাশে বন্ধু বেশে না থেকে শত্রু বেশে থাকতে চায় তাহলে তাদের পরোয়া করে জীবনকে একটা অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে বাবা? আর এমন হঠকারিতা দেখানোর জন্যই কি তোমরা মিলে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছ?’ মায়ার প্রশ্নের যৌক্তিকতায় শফিক সাহেব বাকরুদ্ধ। তিনি কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না!

ছোঁয়া বলল, ‘আঙ্কেল, মায়া একদম ঠিক বলছে। ও শিক্ষিত মেয়ে। আপনি চাকরি করতে নিষেধ করেছেন বলেই সে ভালো জব পেয়েও করেনি। এতোদিন সে আপনার কথা শুনে এসেছে। আপনার উপর ভরসা করেছে। এই একটা বার নাহয় আপনি ওর উপর ভরসা করে দেখুন।’

সাইফও একই কথা বলল। বন্ধুদের সাথে পেয়ে মায়ার মনের জোর কয়েকগুণ বেড়ে গেল। সে বাবার হাত ধরে আকুতির স্বরে তার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা, এই একটা বার আমার উপর বিশ্বাস করেই দেখো না। তোমাদের কথামতো এরেঞ্জ ম্যারেজ করতে রাজী হয়ে গিয়েছি। একটা বারও নিজের পছন্দ-অপছন্দ ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের কারণে তোমাদের সিদ্ধান্তের অমর্যাদা করিনি। আমি তো সবকিছুই তোমাদের কথামতো করে এসেছি। এই একটা বার কি তোমরা আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে পারবে না?’

মায়ার কথায় প্রভাবিত হতেই হলো তার বাবা-মাকে। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আটকাতে সক্ষম হলো সে। ছোঁয়া চলে আসার সময় মায়াকে দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিল, ‘এটাই তোর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট মায়া। মনে রাখিস, এই বিয়েটা না হওয়ায় তুই বেঁচে গিয়েছিস। এবার নতুনভাবে জীবন শুরু কর, এবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সময় এসেছে, আর নিজেকে তোর চিরায়ত খোলসের মধ্যে বন্দী করে রাখিস না। এটা তোর কাছে আমার অনুরোধ।’

মায়া মুচকি হেসে সম্মতি জানিয়েছিল। ছোঁয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। মায়ার শক্ত অবস্থানে সে সত্যিই মুগ্ধ হলো আজ।

বিয়ের পোশাক ছেড়ে শাওয়ার নিল মায়া। ভেজা চুলগুলো তোয়ালেতে পেঁচিয়ে জানালার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে দেখল আকাশে থাকা ঘন কালো মেঘগুলো কাটতে শুরু করেছে। ওই তো চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে, বারেবারে। ঘন কালো মেঘ শত চেষ্টাতেও রাতের আঁধারে পথ প্রদর্শনকারী চাঁদকে তার জ্যোতি ছড়াতে বিরত রাখতে পারছে না। স্নিগ্ধ হাওয়া এসে তার গায়ে আঁচড় কাটছে। একটু শীত লাগতে শুরু করল তার। গায়ের সাথে জড়ানো সাদা ওড়নাটা আরও একটু ভালোমতো পেঁচিয়ে নিল সে।

বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হবার পরে তার নিজেকে একদম নির্ভার লাগতে শুরু করল। একটা সময় পরে তার সত্যি সত্যিই মনে হতে লাগল, ‘খারাপ সময় সবসময় সবকিছু ধ্বংস করতে আসে না বরং মাঝেমধ্যে আমাদেরকে আরও শক্ত মজবুত করার জন্যও আসে।’

_____________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৭

‘আমি কি পুরো ঘটনাটা জানতে পারি, মিসেজ শিহরণ?’ পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে প্রশ্ন করল ইন্সপেক্টর ফায়াজ রহমান।

ফায়াজের প্রশ্ন শুনে ছোঁয়া, শিহরণ আর প্রিয় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল তার দিকে। ফায়াজ কিছুই হয়নি এমন ভান করে পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘এভাবে তাকাচ্ছেন কেন আমার দিকে? আমি কি ভুল কোনো প্রশ্ন করেছি? কেইসটা সলভ করার জন্য পুরো বিষয়টা আমাকে জানতে হবে। তাই নয় কি?’

‘মিসেজ শিহরণ? কিসব বলছ ভাইয়া? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?’ প্রিয় বিস্মাভূত মুখ করে বলল।

‘আমি কি ভুল কিছু বলে ফেলেছি?’ বিভ্রান্ত দেখাল ফায়াজকে। নিজেকে শোধরানোর ভঙ্গি করে পরক্ষণেই বলল, ‘ওদের বিয়ে হয়নি এখনও?’

প্রিয় বলল, ‘না, ভাইয়া। তুমিও না!’

ফায়াজ দু’হাত উপরে তুলে বলল, ‘স্যরি, ইট ওয়াজ মাই মিস্টেক।’

ছোঁয়াকে পুরোপুরি বিরক্ত দেখাল। শিহরণ খুব মনোযোগ দিয়ে কী যেন ভাবছে! তার চেহারা দেখে তার মনোভাব বোঝা যাচ্ছে না।

ফায়াজ মুখে গাম্ভীর্য এনে বলল, ‘আমি কিন্তু মোটেই মজা করিনি। সত্যি ঘটনাটা জানতে চেয়েছি কেবল।’

ছোঁয়া গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছে এই বিষয়টা বলতে কিন্তু এই বিষয়টা জানাতেই হচ্ছে পরিস্থিতির চাপে পড়ে। যদি এমন পরিস্থিতি না হতো তবে আমি কখনোই বলতাম না।’ কথাগুলো বলার সময় ছোঁয়াকে খুবই বিমর্ষ দেখাল।

ফায়াজ সিগারেটের একটা শেষ টান দিয়ে ছোঁয়াকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘এখন আবেগী হবার সময় নয়, মিস ছোঁয়া। আপনি পুরো ঘটনাটা আমাকে বলুন, তাহলে আমার পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে।’

প্রিয়’র মামাতো ভাই ফায়াজ পুলিশে আছে। শিহরণের কাছে ছোঁয়ার বিপদের কথা শুনেই সে ফায়াজের কথা বলে। এই কথা বলেও আশ্বস্ত করে যে ফায়াজকে বিশ্বাস করা যায়। সে এরকম বহু কেইস নিজে হ্যান্ডল করেছে।

ছোঁয়ার তার জীবনের তিক্ত সত্যগুলো কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। তবুও আজ তাকে বলতে হচ্ছে। তাছাড়া সে কোনোভাবেই ফাহমিদা বেগমকে কারো কাছে ছোটো করতে চায় না। তাই এই সব ঘটনা তেমন কেউ জানেও না। ছোঁয়াকে দ্বিধান্বিত দেখে শিহরণ তার পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করল। ছোঁয়া উদাস চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। যেই চোখ জোড়াতে সে ভরসা, বিশ্বাস আর নির্ভরতা খুঁজে পেল। ছোঁয়া একটা প্রলম্বিত শ্বাস নিল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘বাবা মারা যাবার পর থেকে মা বিভিন্ন মানুষের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। নানান ধরনের মানুষের সাথে তার উঠাবসা ছিল। সম্পর্কের গভীরতাটা আমি তখনও ঠিক বুঝতাম না। ছোটো ছিলাম, তাই হয়তো এইসব জটিলতা বুঝতে পারতাম না। একটা সময় পরে তানভীর নামে ছেলেটার সাথে মা গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাসায় আসা যাওয়া চলতে থাকল এই লোকটার।।একসময় হিয়ার প্রতি তার নজর পড়ে। হিয়া, প্রথম দেখাতেই ভালো লাগার মতো মেয়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই লোকটা কথাচ্ছলে হিয়ার গায়ে হাত দিত। এক পর্যায়ে এই লোকের আমাদের বাসায় আনাগোনা বেড়ে যায়। মা, হয়তো ধীরে ধীরে এই লোকের হিয়ার প্রতি নোংরা দৃষ্টি বুঝতে পেরে তানভীরের সাথে সম্পর্ক শেষ করতে চায়। কিন্তু এই নোংরা, কুৎসিত লোকটা না মায়ের সাথে সম্পর্ক শেষ করতে চাইছিল, না হিয়ার প্রতি নোংরা দৃষ্টি দেওয়া বন্ধ করতে চাইছিল। তাই সে মাকে ব্ল্যকমেল করা শুরু করে, তাদের সম্পর্কের ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিতে থাকে। একটা সময় মা খুব বেশি ভেঙে পড়েন। দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। সেই সময়টাতে আমি মায়ের সেবা-যত্ন করার সময় কিছু কিছু বিষয় আন্দাজ করতে পারতাম।’

ছোঁয়া থামল। সবার দৃষ্টি ছোঁয়ার দিকে। শিহরণ টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিল। ছোঁয়া এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু পানি শেষ করে ফেলল।

ফায়াজ হিমশীতল গলায় বলল, ‘কথা শেষ করুন, মিস ছোঁয়া।’

ছোঁয়া ফায়াজের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। পুনরায় বলতে শুরু করল সে, ‘তারপর আসে সেই সেই ভয়ংকর রাত। যেদিন ঘরে শুধুমাত্র হিয়া ছিল, অহনা আর মা কোনো একটা ইনভাইটেশন এটেন্ড করতে গিয়েছিল। আমার পরীক্ষার ডেট হয়ে যাওয়াতে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোটসের এর জন্য মায়ার বাসায় গিয়েছিলাম। তবে সেদিন মায়া তার বাসায় না থাকাতেই আমি আবার ফিরে এলাম। ফিরে আসতেই গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলাম। প্রথমে আমি ভড়কে গেলাম এইরকম আওয়াজ শুনতে পেয়ে। পরে একে একে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙার শব্দ শুনতে পাই। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই হিয়ার চিৎকার শুনতে পেলাম। ভেবেছিলাম চোর এসেছে হয়তো। তাই আমি রান্নাঘরে রাখা লাঠি নিয়ে হিয়ার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। রুমের দরজাটা লক ছিল না। কারণ পুরো ঘর খালি ছিল। এই বিষয়টা নিশ্চয়ই তানভীর নামে লোকটা জানতো। তাই সে দরজা লক করেনি। এটাতে আমার বরং সুবিধাই হলো। আমি ভিতরে ঢুকতেই লোকটাকে হিয়ার সাথে…! তখন আমি হতভম্ব হয়ে চেয়েছিলাম কয়েক সেকেন্ড। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সম্বিৎ ফিরে পেতেই আমি একবার লাঠির দিকে তাকায় একবার লোকটার দিকে। আমি বুঝে গেলাম এই লাঠি দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। তখনই হিয়ার দরজার পাশে রাখা ভারী ফুলদানিটা নজরে পড়ল। আমি কোনোকিছু না ভেবেই সেই ফুলদানিটা হাতে নিয়ে তানভীরের মাথায় জোরে আঘাত করে বসলাম। সেই এক আগাতেই লোকটা হুঁশ হারাল। তারপর হিয়ার মোবাইল থেকে আমি মাকে কল করে সবটা জানাই। মা এসে পুলিশকে ইনফর্ম করে। এর পর থেকে হিয়া সিরিয়াস ডিপ্রেশনে চলে যায়। অনেক চিকিৎসা করানোর পরে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। মাও তার অতীত জীবনটাকে ভুলে গিয়ে একটা সুন্দর জীবন শুরু করে। কিন্তু এখন আবার লোকটা এসে হানা দিয়েছে আমাদের বর্তমানে। তাও আবার লুকিয়ে হিয়ার ছবি তুলেছে। এবার আর কোনো ধাক্কা সামলাতে পারবে না আমার বোনটা।’

ফায়াজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘এবার তাহলে আমি উঠি।’

ছোঁয়া তাড়া দিয়ে বলল, ‘আমার কথা শেষ হয়নি এখনও।’

ফায়াজ ছোঁয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আর কী বলার আছে?’

‘আমি চাই লোকটাকে প্রথমে আমরা শাস্তি দিব। তারপর আইনের আওতায় এনে তার স্বাভাবিক শাস্তি যা হবার তা হবে।’

‘আপনারা কী ধরনের শাস্তি দিতে চাইছেন?’

‘আপনার তো জানার কথা এই লোকটা আরও অনেক মেয়ের সাথেই সম্পর্ক করে, গোপন ভিডিও করে, পরে সেগুলো ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করাসহ নানা ধরনের অবৈধ কাজ করায় তাদের মাধ্যমে। তাছাড়া ড্রাগও নেওয়া ও তা পাচারের কাজে সিদ্ধহস্ত এই লোকটা।’

‘আমাদের জানা আছে, মিস ছোঁয়া। কিন্তু এই লোকের রাজনৈতিক ক্ষমতাও আছে। যার কারণে কিছু দিন পর পরই ছাড়া পেয়ে যায়। মেয়েরা এত বোকা কেন বুঝি না। গুড লুকিং হলেই প্রেমে পড়ে যায়। এটা কেমন পছন্দ, অদ্ভুত!’ শেষ বাক্যটা বলার সময় ফায়াজের কণ্ঠে ছিল তাচ্ছিল্য।

ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ‘হিয়া ওই লোকের প্রেমে পড়েনি, মিস্টার ফায়াজ।’

‘আপনার মা তো পড়েছিল, তাই না?’ ফায়াজ বাঁকা হেসে প্রশ্ন করল।

শিহরণ ফায়াজকে সংশোধন করতে গিয়ে বলল, ‘উনি ছোঁয়ার সৎ মা হোন, আপন মা না।’

ফায়াজ শিহরণের দিকে তাকাল রহস্যময় দৃষ্টিতে। তারপর গটগট করে বেরিয়ে গেল।

প্রিয় চেঁচিয়ে বলল, ‘ফায়াজ ভাইয়া, ওকে ধরে এনে আমার হাতে দিও। একদম চাটনি বানিয়ে তারপর ছাড়ব। এরপর মেয়েদের ব্ল্যাকমেল করা তো দূরের কথা মেয়েদের দিকে তাকাতেও পারবে না।’

সবটা শোনার পরে মোহনা কথা বলে উঠল, ‘আরে থাম। তুই তো এমনিতেও দুই তিন কদম আগায় থাকিস।’

শিহরণ প্রিয়র দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোমার ভাই কি পারবে এই কাজ?’

প্রিয় হেসে বলল, ‘ওকে দেখে সন্দেহ হচ্ছে না-কি? ও দেখতে তোমার মতো চকলেট বয় হলে কি হবে, কাজের মধ্যে ওর মতো ভয়ংকর আর কেউ হয় না। সেবার একটা কেসের সময় হয়েছিল কি জানো…?’

মোহনা প্রিয়কে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমাদের জানার দরকার নাই। এই কাজটা ভালোই ভালোই মিটে গেলেই হলো। তোর ভাই তো তোর মুখ থেকে এমনিতেই প্রশংসার ঝাঁপি ঝরে পড়বে তাতে আমাদের অবশ্য কারো সন্দেহ ছিল না।’

প্রিয় রেগে গিয়ে বলল, ‘মোহন! বেশি বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু।’

‘মোহন না কিউটি আমি মোহনা।’ মোহনা প্রিয়র চুল টেনে দিয়ে বলল।

প্রিয় তাতে ক্ষেপে গেল। মোহনা সেখানে আর দাঁড়াল না। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। প্রিয়ও তার পেছন পেছন ছুট লাগাল।

ছোঁয়ার চোখ অশ্রুতে টলমল করছে। শিহরণ তার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তবুও তার কাছে অজানা নয় তার প্রিয়তার মনটা একটা বিষণ্ন। ধূসর মেঘে ঢেকে গেছে তার মনের আকাশটা। শিহরণ ছোঁয়ার কাঁধে হাত রেখে তার দিকে ঘুরাল। ছোঁয়া চকিতে মুখটা নিচু করি ফেলল। চিবুকটা যেন বুকের সাথে লাগিয়ে ফেলবে এমন অবস্থা! শিহরণ তা দেখে স্মিত হাসল। শিহরণ ডান হাত দিয়ে মুখটা তুলে আলতো স্পর্শে চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে বলল, ‘মন খারাপ করো না, প্রিয়তা। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো তোমার পাশে।’

ছোঁয়া চোখ তুলে তাকাল শিহরণের দিকে। তারপর তার দু’হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘তুমি পাশে আছ বলেই তো আমি সাহস পাই। তুমি না থাকলে আমার কি হবে তা আমি ভাবতেই পারি না..!’

শিহরণ মুচকি হেসে বলল, ‘আমি না থাকলে কি হবে তা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করো না, প্রিয়তা। আমি আছি, থাকব। এখন তোমাকে হিয়ার পাশে থাকতে হবে। মেয়েটা খুব ভেঙে পড়েছে। তুমি তো দেখেছই। এখন তুমিও যদি ভেঙে পড়ো তাহলে তোমার মা আর বোনকে কে সামলাবে বলো তো।’

ছোঁয়া শিহরণের কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ।’ চোখের জল মুছে ফেলে বলল, ‘আমি আর ভেঙে পড়ব না।’

‘কথা দিচ্ছ তো?’ ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল শিহরণ।

‘হুম।’ হেসে জবাব দিল ছোঁয়া।

______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৮

আমিরাহ তার উচ্চবিত্ত ক্লাস মেইনটেইন করতেই ব্যস্ত। সারাক্ষণ এই পার্টি, সেই পার্টি করেই তার দিন কাটে। স্বামী বা সন্তানকে দেবার মতো সময় তার কাছে নেই। আশফাক তাকে অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনোভাবেই বুঝাতে সক্ষম হয়নি। তার মতো একগুঁয়ে আর উড়নচণ্ডী মেয়ে খুব কমই দেখেছে সে। মাঝেমধ্যে সে ভাবে, আমিরাহকে বিয়ে করে সে বড়ো ভুল করেছে। পরক্ষণেই আবার ভাবে তার কি-ই-বা করার ছিল! সে তো ছিল বন্দী আপনজনের ইচ্ছের কাছে! সময়ের হাতে অর্থের জন্য, একজন ভীষণ প্রিয় মানুষের জীবনের জন্য। ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং এর চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে এমনই আকাশ পাতাল ভাবনাতে মশগুল ছিল আশফাক। বাসা থেকে বের হবার আগেও তার আর আমিরাহের মধ্যে এক চোট ঝগড়া লেগে গিয়েছিল। বিষয়টা এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, তারা দু’জন যখনই একসাথে হয় তখনই ঝগড়া লেগে যায়। শুধুমাত্র এই একটি কারণে আশফাক যেকোনো জনসমাগম এড়িয়ে চলে। এমনকি ফ্যামিলি মিটিংস বা গেট টুগেদারে পর্যন্ত যায় না। এই তো কিছুদিন আগে এতো বড়ো অনুষ্ঠান হলো, শিহরণ কতো করে বলেছে তবুও সে যায়নি। কারণ সে ভয় পায়। কোথাও সিন ক্রিয়েট হোক তা সে চায় না। এতে করে সে আর তার মেয়েই শুধু তামাশার পাত্র হবে। আমিরাহর কোনো হেলদোল কখনোই ছিল না। ভবিষ্যতে কোনো এক সময় হবে, সেই আশাও আশফাক করে না। টিয়ার বয়স মাত্র চার বছর। এই চার বছরে আমিরাহ ওকে খুব একটা সময় দেয়নি। মাকে কাছে পাবার জন্য মেয়েটা মরিয়া হয়ে ওঠে বারবার। কিন্তু তার মা তার চাইতেও বেশি নিজেকে ভালোবাসে। এই সত্যটা এখন স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে তার কাছে।

টিয়া তার পাশে বসে নানান কথা বলেই চলেছে, আশফাক শুধু হু, হ্যাঁ করে যাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে হাসছে। তার বাচ্চা মেয়েটাও তার মতো ভীষণ একা। এই কথাটা ভাবতেই তার বুক চিরে একটা প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার নিজের জীবনটা এমন হতো না, যদি তার ভালোবাসার মানুষকে সে পাশে পেত। কিন্তু তাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলল আশফাক। এই দুঃখ, যন্ত্রণা কখনোই ভুলবার নয়। অর্থের কাছে তার ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। অথচ আজ এত অর্থ থাকা সত্ত্বেও তার জীবনে কোনো সুখ নেই। মানুষ ভুল বলে, সত্যি বলতে, অর্থ দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না। সুখ নামক আপেক্ষিক জিনিসটা পৃথিবীর সবচাইতে দামী জিনিস। যা শত টাকা থাকা সত্ত্বেও কেনা যায় না, আবার মাঝেমধ্যে টাকা না থাকলেও এই সুখ ধর্না দিয়ে যায় জীবনের আঙিনায়।

আশফাক টিয়াকে নিয়ে একটা পেস্ট্রি শপে ঢুকল। টিয়া পেস্ট্রি শপে ঢুকতেই খুশিতে গদগদ হয়ে একটা প্রেস্ট্রি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘আব্বু, আমি এই পেস্ট্রিটা খাব।’

আশফাক টিয়ার মাথাতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই তো মামুণি, আমি অর্ডার করেছি। আঙ্কেল প্যাক করে দিলেই হবে।’

টিয়া আবারও বলল, ‘বাবা, মা কখন আসবে?’

আশফাক অসহায় চোখে তাকাল তার ছোট্ট মেয়েটার দিকে। মেয়েটার চোখে-মুখে মায়ের ভালোবাসা পাবার এক তীব্র আকুলতা। আশফাকের নিজেকে অপরাধী মনে হলো। ক্লান্ত গলায় সে বলল, ‘আসবে, মা। তুমি একদম চিন্তা করো না। বাবার কম্পানি ভালো লাগছে না, আমার মামুণিটার?’

টিয়া মিষ্টি হেসে বলল, ‘ভালো লাগছে তো, আব্বু।’

আশফাকও মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। টিয়ার একটা হাত খুব যত্ন করে নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রাখল।
___________________________

রাদিদ টিকেট কেনার জন্য বেরিয়েছিল সেই সকাল বেলায়। নিজের কিছু কাজ সেরে তার অতি পরিচিত কাজ করতে হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর টিকেট কেটে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হবার সময় চোখে পড়ল তার এত বছরের আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। মানুষটাকে দেখা মাত্রই তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। নিজের ক্রোধ সংবরণ করার প্রাণপণ প্রচেষ্টাতে লিপ্ত সে। আজ এই মানুষটার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। তার নিজের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আজ এই মানুষটাকে দিতেই হবে। কোনোভাবেই ছাড়বে না এই ঠগবাজ, প্রতারক লোকটাকে।

লোকটা একটা দোকান থেকে বের হচ্ছে। রাদিদ বার্ডস আই ভিউতেই সবকিছু ধারণা করে ফেলল। শপের পাশে রাখা গাড়িটা নিশ্চয়ই তার। তার মানে শপ থেকে বেরিয়ে গেলেই তার হাত ফসকে যাবে এই মানুষটা। সে দ্রুত রাস্তা পার হতে যেতেই একটা বিশাল ট্রাক ধেয়ে আসতে লাগল। একটুর জন্য অঘটন ঘটতে ঘটতে বেঁচে গেল সে। কিন্তু তার সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা ততক্ষণে হাওয়া। কোথায় গেল তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই রাদিদের। সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েই তো সে এই শহর ছেড়ে আবার নিজের চিরচেনা গ্রামে ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। অথচ এই লোকটাকে দেখে তার চলে যাওয়াটা আটকে গেল। এই লোকটিকে তার খুঁজে পেতেই হবে।
এতদিন পরে লোকটিকে দেখে তার যেমন ভালো লাগছে তেমনি বিষণ্ণতাও তাকে ঘিরে ধরেছে । রাদিদ হুট করেই নীলাকে ফোন দিয়ে বসল। নীলা আমুদে গলায় বলল, ‘কী রে ভাই, এত দিন পরে মনে পড়ল আপার কথা?’

রাদিদ নীলার কণ্ঠস্বর শুনে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আপা, আমি খুঁজে পেয়েছি…!”
রাদিদ কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই নীলা প্রশ্ন করে উঠল, ‘কী খুঁজে পেয়েছিস, ভাই?’

নীলার প্রশ্ন শুনেই যেন রাদিদ সম্বিত ফিরে পেল। দ্রুত চিন্তা করতে লাগল সে। লোকটাকে সে দেখেছে তবে এখনও তার সম্পর্কে কিছুই জানে না সে। তাই আপাতত নীলাকে কিছু না জানানোই শ্রেয় মনে করল। রাদিদ জানে, আশা ভেঙ্গে গেলে ভীষণ কষ্ট হয়। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘পিউর পছন্দের খেলনা খুঁজে পেয়েছি আপা।’

নীলা অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘তুই কি কিছু লুকাচ্ছিস, রাদিদ?’

রাদিদ মলিন হাসল। সে হাসি নীলা দেখল না। রাদিদ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘কেন মনে হলো তোর?’

নীলা কপট রাগান্বিত স্বরে বলল, ‘তোর কণ্ঠস্বর খুব সিরিয়াস ছিল। অথচ এখন মনে হচ্ছে আমার সাথে ফাইজলামি করতেছিস।’

‘আপা, পিউ কিন্তু খেলনাটা দেখলে দারুণ খুশি হবে। ওকে বলিস তো ওর জন্য দারুণ একটা খেলনা কিনে আনব। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে দৌড়াবে পুরো ঘরে। আম্মাকে বলিস, আমার আসতে আরও দেরি হবে।’
কথা শেষ করেই রাদিদ হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করল।

‘এত কিসের কাজ বল তো? এত দিন তো তোর থাকার কথা না। ফুফুকেই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করব আমি।’ অবিশ্বাসের সুরে বলল নীলা।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কেউ যদি আমাকে বিশ্বাস করতে না চায় তাহলে আমি তাকে কখনোই জোর করি না আমার কথা বিশ্বাস করার জন্য। তোর যা মন চায় তাই কর। আমার কোনো অসুবিধা নাই।’ রাদিদ বলল কপট রাগ দেখিয়ে। বলেই কলটা কেটে দিল। নিজের মনকে প্রবোধ দিল এই ভেবে যে, লোকটাকে যেদিন সামনাসামনি দেখবে সেদিনই এই লোকটাকে উপযুক্ত শাস্তি দিবে সে। তার মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এই লোকটাকে দিতেই হবে।

রাদিদ ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছে। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। সে জানে এবং বিশ্বাস করে, জীবন মানে যুদ্ধ। তার মানে কি সর্বক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে? একটু সময় কি নিজের জন্য সে পাবে না? একটু নিজের মতো বাঁচতে খুব ইচ্ছে করে তার। কিন্তু সে বাঁচাটা বোধহয় তার ভাগ্যে নেই।

মোবাইলটা তারস্বরে বেজে চলেছে। রাদিদ জানে এই মুহূর্তে তাকে কে কল করতে পারে। তবে সে এই মুহূর্তে কারও সাথেই কথা বলতে চায় না। কিছু সময় একাকী থাকাটাই উত্তম। নয়তো আপনজনদের আঘাত করার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। রাদিদ চায় না, আপন কাউকে আঘাও করতে। তাই সে হেঁটে চলেছে উদ্দেশ্যহীন কোনো এক গন্তব্যের পানে।

_____________________

নীলাভ্র ঘামছে। আফরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘নীলাভ্র, তুমি এতোটা কাপুরুষ জানলে আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসতাম না।’

নীলাভ্র মাথা নিচু করে বসে আছে। আফরিন ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘তুমি আসলে এরকম মাথা নিচু করেই থাকবে আজীবন। আমাদের ভালোবাসার কথাটা তুমি বাসায় জানাতে পারছ না! এটা ভাবতেই আমার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। কোন কুক্ষণে যে আমি তোমাকে ভালোবাসতে গেলাম!’

নীলাভ্র মিনমিনে কণ্ঠে বলল, ‘আব্বু, মানবে না এই সম্পর্ক! আব্বুকে আমি ভীষণ ভয় পাই।’

আগুনে ঘি ঢালার মতো করে দপ করে আফরিনের রাগ আরও বেশি বেড়ে গেল। সে তেতে গিয়ে বলল,
‘এই কথাটা তোর আমার সাথে সম্পর্ক করার আগে মনে ছিল না?’

নীলাভ্র এবারও নিশ্চুপ। তা দেখে আফরিন এবার মারাত্মক খ্যাপানো গলায় বলল, ‘তুই কি করবি আমি জানি না। আমি কোনোভাবেই তোকে অন্য কাউকে বিয়ে করতে দিব না। এখন তুই কি করবি তুই জানিস।’

নীলাভ্র ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আব্বুকে আমাদের সম্পর্কের কথা বললে আমাকে মেরেই ফেলবে।’

‘আর তুই যদি না বলিস তো আমি কি তোকে ছেড়ে দেব ভেবেছিস? আমিও তোকে মেরেই ফেলব। আমাকে কষ্ট দিয়ে তুই ড্যাডিস গুড বয় হয় ঘুরে বেড়াবি আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখব। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, নীলাভ্র!’ নীলাভ্রকে ধমকে উঠে আফরিন আবারও বলল, ‘আরও একটা কথা শুনে রাখো, তোকে শেষ করার পরে আমি নিজেকেও শেষ করে দিব। এখন তুই বল তোর কোন প্রস্তাবটা বেশি ভালো লাগছে?’

‘আমি কী করব আফরিন?’ নীলাভ্র তার দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বলল, ‘না আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না বাবাকে!’ নীলাভ্র আফরিনের হাত ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু আফরিন এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল। নীলাভ্র ব্যথাতুর গলায় বলল, ‘আমি কি করব তুমিই বলো? আমি সত্যিই তোমাকে খুব ভালোবাসি।’

আফরিন রেগে বলল, ‘ভালোবাসো না ছাই! তুমি আমাকে ভালোবাসলে তোমার নাম যে আতিক তা কেন বলোনি? সেদিন তোমার ভাই এসে যদি সামনাসামনি সবকিছু না বলতো তাহলে তো আমি জানতেই পারতাম না। তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি বলেই তোমার সমস্ত দোষ আমি দেখেও দেখি না। কিন্তু সবসময় যে দেখব না তা ভাবার কোনো কারণ নেই। এতোদিন তোমাকে আমি এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি। আজ আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর চাই।’

‘আফরিন শান্ত হও।’ নীলাভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘প্রথমত আমি তোমাকে কোনো প্রকার মিথ্যে কথা বলিনি। তোমাকে ভালোবাসি। মন প্রাণ দিয়েই ভালোবাসি। তাই আজ তোমাকে সবটাই বলছি, আমার পুরো নাম নীলাভ্র হোসেন আতিক। আর তুমি যার কথা ধরে আমাকে সন্দেহ করছ সে আমার ভাই ন। বুঝেছ?’

‘তোমার ভাই না মানে?’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল আফরিন।

‘এখানে না বোঝার কিছু নেই, আফরিন।’ চোখ-মুখ শক্ত করে বলল নীলাভ্র।

‘তুমি আমাকে সবকিছু বলো, নীল।’ শান্ত স্বরে বলল, আফরিন।

‘আমি এই বিষয়ে আর কিছুই বলতে পারব না, আফরু। অতলকে আমি ভাই ভলে কখনোই ভাবিনি। না মন থেকে ওকে ভাই হিসেবে কখনও মেনে নিয়েছি। আর ওর সম্পর্কে কথ বলতে আমি কখনোই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। তাই ওর ব্যাপারে আমাকে আর কখনোই কোনো প্রশ্ন করবে না প্লিজ। এটা আমার অনুরোধ।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করল নীলাভ্র।

‘ঠিক আছে। ওই বিষয়ে আমি কোনো প্রশ্ন করব না। এখন তুমি আমাকে কবে বিয়ে করবে সেটা বলো?’

নীলাভ্র শুকনো ঢোক গিলল আফরিনের প্রশ্ন শুনে। আফরিন তা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘সমস্ত সাহস শেষ হয়ে গেছে তাই না?’ পরক্ষণেই নীলাভ্রের একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘তোমাকে আমি এক সপ্তাহ সময় দিলাম। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা ভাবো। এর মধ্যে যদি আমাকে বিয়ে না করো তো আমি সুইসাইড করব। এটাকে ফাঁকা থ্রেট মনে করবে না আশা করি। তুমি ভালো করেই জানো, আমি কি কি করতে পারি। আর যা বলি তা অবশ্যই করি, এটা তোমার থেকে ভালো কেউ অবশ্য জানে না।’

কথাগুলো বলেই আফরিন হাঁটা শুরু করল। পেছন ফিরে একবারও তাকাল না। যদি তাকাতো তবে দেখতে পেত দুশ্চিন্তায় মাখা নীলাভ্রর মুখটা। হয়তো আফরিন তা দেখতে চায় না। হয়তো তাই সে পেছন ফিরে একটাবারও তাকায়নি। অপরদিকে নীলাভ্রর নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগতে শুরু করল। কী করবে সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না! তার মাথাটা ফাঁকা লাগছে।

_______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৯

পুরো রুম জুড়ে আলো-আঁধারের খেলা চলছে। থেকে থেকে মৃদু গোঙানির আওয়াজ বেরুচ্ছে।
একটা চেয়ারের সাথে হাত-পা-মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে তানভীরকে।

ফায়াজ তানভীরের চুল শক্ত করে মুঠো করে ধরে তার মাথাটা পেছনে নিয়ে বলল, ‘আর কোনো মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করবি কি না বল?’

তানভীরের মুখ বাঁধা থাকার কারণে সে আওয়াজ করলেও অদ্ভুত সব শব্দ বেরুচ্ছে তার মুখ দিয়ে। ফায়াজ যেন ভুলেই গিয়েছে যে তানভীরের মুখটা বাঁধা। তাই সে চাইলেও কথা বলতে পারবে না।

তানভীরের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে ফায়াজ প্রচণ্ড ক্রোধে তানভীরের টুটি চেপে ধরল। ফলে তানভীরের মুখ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো কু কু হয়ে বেরিয়ে আসছে। ঠিক তখনই ছোঁয়া হিয়াকে নিয়ে রুমে ঢুকল। তানভীরকে দেখে প্রথমেই হিয়া ভয়ে ছোঁয়ার পিছনে লুকাল। ছোঁয়া তাকে আশ্বস্ত করল। ছোঁয়া ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘হিট হিম। জাস্ট হিট হিম।’

প্রিয় মারমুখো হয়েই বসে দেখছিল তানভীরকে। হিয়াকে ভয় পেতে দেখে সে হিসহিসিয়ে বলল, ‘তুমি মারতে না পারলে আমাকে বলো আমিই মারছি এই শয়তানটাকে। মেয়েদেরকে কি এরা ফেলনা ভেবেছে। নিজের হাতের পুতুল ভেবেছে! তোর সব ধরনের খায়েশ মিটিয়ে দিব আজ শু*** বাচ্চা।’

প্রিয়র গালি শুনে শিহরণ বলে উঠল, ‘কীসব ভাষা বলছিস, প্রিয়!’

প্রিয় তানভীরের নাক বরারবর একটা ঘুসি দিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলতেছি। এই ধরনের বিকৃত মানসিকতার লোককে এর থেকেও খারাপ সব গালি দেওয়া উচিত। আমি তো তারে তেমন খারাপ গালি দিই নাই।’

প্রিয়র মারে ব্যথায় ককিয়ে উঠল তানভীর। সে নিস্তেজ হওয়া সত্ত্বেও অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়র দিকে। তা দেখে প্রিয় বলল, ‘দেখ, কু*** বাচ্চার কত্তো বড়ো সাহস। সে আমার দিকে এমন চোখ রাঙিয়ে তাকাচ্ছে।’ তারপর তানভীরের দিকে তেড়ে গিয়ে বলল, ‘তুই চিনিস আমাকে? হিয়ার জায়গায় আমি হলে তুই সারাজীবন আফসোস করতি, আমার সাথে পাঙ্গা নেওয়ার কারণে।’

অহনা এসে দাঁড়াল হিয়ার পাশে। হিয়া তাকে দেখে চমকে গেল। অহনা হিয়াকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আজি সবটা জেনে গেছি হিয়া। তুই এখন একা না। আমিও আছি তোদের সাথে।’

অহনা তানভীরের দিকে তেড়ে এসে তার গাল বরাবর একটা ঘুসি বসিয়ে দিল। তাই দেখেই বোধহয় হিয়া কিছুটা সাহস পেল। সে ধীর পায়ে তানভীরের দিকে এগিয়ে গিয়ে মিডল পয়েন্ট বরারব একটা লাথি দিল। এবার প্রচণ্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠল তানভীর।

অহনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘কেমন লাগছে কু*** বাচ্চা? মেয়েদের ব্ল্যাকমেল করে মজা পাস না? লুকিয়ে ছবি তুলছিস আমার বোনের। এখন তোর ছবি তুলে আমি ভাইরাল করব। তোর মজা বাইর করতেছি।’ কথা শেষ করেই সেও একটা লাথি বসিয়ে দিল একই জায়গায়। তানভীর এবারও ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। হাত ছাড়ানোর প্রবল চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পারছে না। হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে গিয়ে সে চেয়ার সমেত কাত হয়ে পড়ে গেল।

শিহরণ চেয়ার সমেত তানভীরকে আবারও সোজা করে বসাল। তারপর হিসহিসিয়ে বলে উঠল, ‘এবার বোঝ, মেয়েদেরকে হেনস্থা করার মজা।’ বলেই সেও একটা ঘুসি বসিয়ে দিল তার নাক বরাবর।

তানভীরের ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে, নাকটাও বোধহয় ফেটে গেছে। মুখ বাঁধা থাকার কারণে তার গলা থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ বের হচ্ছে।

মোহনা আর মায়া এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। তানভীরের নির্জীবতা দেখেও যেন তারা শান্তি পাচ্ছিল না। মোহনা বলে উঠল, ‘তোরা সবাই মারলি আমরা কেন বাদ থাকব। আমাদেরও এই শয়তানকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। কি বলো মায়া?’

মায়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর তারা দুজন ও ইচ্ছেমতো থাপ্পড় লাগাল ওর মুখে। প্রিয় যেন কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছিল না। সে রেগে বলল, ‘কি মাইর দিতেছিস ওরে। লাগতেছে জামাই আদর করতেছিস। ওরে ক্যামনে মারা লাগবে আমি দেখাইতেছি।’ প্রিয় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তানভীরকে ইচ্ছেমতো লাথি মারল।

শিহরণ বলল, ‘তুই কি লাত্থি মারার ট্রেনিং নিছস না-কি?’

‘পুলিশের বোন আমি, হুহ্। এসব বিকৃত ছেলেদের ঠিক করা আমার জন্য চাট্টিখানি ব্যাপার। আমার তো রাগ লাগতেছে এইটা ভেবে যে, এই কু*** বাচ্চা এতোদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াইছে তাই।’ প্রিয় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। ফায়াজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তাদের সবাইকে দেখছে। প্রিয়কে সে বরাবরই উদ্ধত ভেবেছে। ছোটো থেকেই সে যেটা ভালো মনে করে সেটাই করেছে। অন্যদের মতামতের পরোয়া সে কখনোই করেনি। একগুঁয়ে আর জেদী স্বভাবের হওয়ায় ফায়াজ প্রিয়কে খুব একটা পছন্দ করতো না। তবে আজকের এই প্রিয়কে তার ভীষণ ভালো লাগছে। বন্ধুদের সাথে তার সম্পর্ক দেখেও ফায়াজের বেশ ভালো লাগল।

এবার তানভীরের মুখের কাপড়টা খুলে দিল ফায়াজ। অদ্ভুত সব আওয়াজ বের হচ্ছে ওর মুখ থেকে। বেশ কিছুক্ষণ পরে ওরা সবাই বুঝতে পারল যে তানভীর তাদের কাছে ক্ষমা চাইছে। তানভীর ভাঙা গলায় আওড়াতে লাগল, ‘আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ। আমি আর কোনো মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করব না। লুকিয়ে ছবিও তুলব না।’

শিহরণ বলল, ‘এবার ওকে পুলিশের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক।’

ছোঁয়া বলল, ‘একটা কাজ এখনও বাকি আছে।’

সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। সে বলল, ‘লাভার বয়ের ভীষণ প্রিয় চুলগুলোর একটা দফারফা করা উচিত বলে মনে হচ্ছে না তোমাদের?’

অহনা আর প্রিয় হেসে বলল, ‘আহা! একদম মনের কথাগুলোই বলেছ তুমি।’

ছোঁয়া হিয়াকে বলল, ‘এই কাজটা বরং তুই নিজের হাতেই কর। তাহলেই তুই শান্তি পাবি।’

হিয়া ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে প্রিয় বলল, ‘এই মেয়ে তুমি কেন ভয় পাচ্ছ? অপরাধ এই নোংরা লোক করেছে। তুমি করোনি। এইসব বিকৃত মানসিকতার মানুষকে তোমাদের মতো মেয়েরা ভয় পায় বলেই এরা এইসব নোংরামি চালিয়ে যাবার সাহস পায়। রুখে না দাঁড়ালে, প্রতিবাদ না করলে, পাল্টা জবাব না দিলে সবাই তোমাকেই শোষণ করতে চাইবে।’

ছোঁয়া, মায়া, মোহনা আর অহনাও প্রিয়র সাথে সম্মতি জানাল। হিয়া যেন সবাইকে পাশে পেয়ে দ্বিগুণ সাহস পেল। সে তানভীরের মাথার বিভিন্ন অংশের চুল ব্লেড চালিয়ে চুলের দফারফা করে ছাড়ল। হিয়ার সমস্ত ক্রোধ যেন তানভীরের মাথার উপর গিয়ে পড়ল। তার মাথার বিভিন্ন জায়গার চুল তো উঠেছেই, পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় কেটে গিয়ে রক্তারক্তি অবস্থা।

তানভীর বারংবার আর্তনাদ করে উঠছে। কিন্তু তাতেও যেন মন গলছে না কারো। গলবেই বা কেন? যখন দিনের পর দিন এই ধরনের মানুষরূপী পশুগুলো মেয়েদের হেনস্থা করে, গোপন ভিডিয়ো ধারণ করে ভাইরাল করে দেবার ভয় দেখিয়ে নিজেদের অবৈধ ও বিকৃত লালসা মেটায় তখন তো এরাও বিন্দুমাত্র মায়া দেখায় না মেয়েদের প্রতি।

চুল না থাকায় তানভীরকে খুবই বিদখুটে দেখাচ্ছে। এরপর মোহনা বলল, ‘আরো একটা কাজ বাকি আছে। লাভার বয়কে তার নতুন রূপের সাথে একটু সাক্ষাত করানো বাকি আছে।’

সে ঝটপট তার ব্যাগ থেকে একটা আয়না বের করে তানভীরের সামনে ধরল। তানভীর সেদিকে তাকাতেই চাইছে না। তারপর সবাই ধরে জোর করেই তাকে আয়না দেখতে বাধ্য করল। আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে এক ভয়ার্ত চিৎকার দিলো তানভীর। সেই চিৎকার শুনেই যেন সব মেয়েরা শান্তি পেল।

ফায়াজ বলল, ‘হয়েছে আপনাদের? এবার আমাকে আমার কাজ করতে দিন। এবার দীর্ঘ সময়ের জন্যই শ্বশুরবাড়িতে পাঠাব এই লোককে। দেখব ওর কতো ক্ষমতা আছে।’

ছোঁয়া আবারও বলে উঠল, ‘এবার এই সুন্দর চাঁদ মুখখানার কয়েকটা ছবি তুলে ফেলা যাক। তারপর এইগুলো ভাইরাল করতে হবে। এতদিন তো অন্য মেয়েদের ছবি ভাইরাল করে মজা নিছে। এখন ওর নিজের ছবি ভাইরাল হলে কেমন লাগে তাও একটু বুঝুক।’

ছোঁয়ার কথা বলতে দেরি নেই। প্রিয় ঝটপট বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। তারপর তার দিকে তেড়ে গিয়ে বলল, ‘এখন তোর উপর করা টর্চারের ভিডিয়ো প্লাস এই চাঁদ মুখের ছবি ভাইরাল করব।’ মাথায় আঙ্গুল দিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে প্রিয় আবারও বলল, ‘না এখন ভাইরাল করব না। যদি কখনও হিয়া বা তার মায়ের আশেপাশে তোকে দেখা যায় তো আমি ভিডিয়ো আর সমস্ত ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেব। কথাগুলো মনে রাখিস।’

তানভীরকে ফায়াজ সাথে করে নিয়ে গেল। হিয়া ছোঁয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ছোঁয়া তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আরে পাগলি আমি কিছুই করিনি। সব তো শিহরণ আর তার বন্ধুরা করেছে।’

প্রিয়র দিকে এগিয়ে এসে ছোঁয়া বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ প্রিয়। অনেক বড়ো উপকার করলে তুমি।’

প্রিয় হেসে বলল, ‘আমি কিছুই করিনি। সব তো ভাইয়া করেছে।’

অহনা ছোঁয়ার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে তাকে। ছোঁয়া বলল, ‘কিছু বলবে, অহনা?’

অহনা যেন প্রসঙ্গ ফিরে পেল। কিন্তু সে অদ্ভুতভাবে খেয়াল করল, সে কিছুই বলতে পারছে না। গলার কাছটাতে কান্নার দলা আটকে তাকে ভীষণ অসহায় করে ফেলছে। আচমকা সে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরল। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও, ছোঁয়া আপু।’

এই প্রথমবারের মতো অহনার মুখে আপু ডাক শুনে ছোঁয়ার ভীষণ ভালো লাগল। মনে হলো, সে যেন সবকিছু পেয়ে গেছে। তার মতো সুখী যেন আর কেউ নেই। সে বলল, ‘আমি তো তোমার উপর কখনোই রাগ করিনি, অহনা। তোমাকে সবসময় বোনের মতো দেখেছি।’

‘তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ তো, আপু?’ ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অহনা।

‘হুম, করেছি। বোনের উপর কি রাগ করে থাকা যায়? পাগলি বোন আমার।’ ছোঁয়া মাথা উপর নিচে দুলিয়ে বলল।

ছোঁয়া, হিয়া আর অহনা যেন এক নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হলো। যেই বন্ধনে নেই কোনো হিংসা, নেই কোনো ঈর্ষা। তিন বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে যেন এতো দিনের মানসিক দূরত্ব ঘুচাতে চাইছে। যেন আজ বহু বছর পরে তিন বোনের মিলন মেলা চলছে।

‘আজ কি তবে মিলন মেলা চলছে?’ শিহরণ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল মায়াকে।

মায়া ভাবুক গলায় বলল, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে ভাবতেই আমার ভীষণ ভালো লাগছে, শিহরণ। এবার তুমি এই মেয়েটাকে তোমার করে নাও একেবারের জন্য।’

শিহরণ বলল, ‘হুম, এবার তো করতেই হবে।’

প্রিয় ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ফিসফিস করে কি বলাবলি করছ তোমরা? আমাকে কি বলা যায়?’

শিহরণ মুচকি হেসে প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের ভাবিকে ঘরে তোলার প্ল্যান করছি।’

‘ওহ্ হো! দারুণ তো। এবার তাহলে একটার পর একটা বিয়ে খেতেই খেতেই দিন কাটবে। প্রথমে মায়া তারপরেই দ্যা মোস্ট ওয়ান্টেড লাভ বার্ডস ছোঁয়া এন্ড শিহরণ।’ প্রিয় খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল।

মোহনা প্রিয়র পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই তোরা কি নিয়ে হাসাহাসি করছিস?’

প্রিয় দুঃখী গলায় বলল, ‘আরে দোস্ত, আমরা হাসতেছি না, আমরা তো কাঁদতেছিলাম।’

‘মজা নেও?’ মোহনা হাতের কনুই দিয়ে প্রিয়কে গুতা দিয়ে বলল।

‘একদম না। তোর লগে কি আর মজা নেওন যায়? তুই তোর বিয়েতে আমাদের দাওয়াত দিস নাই সেই দুঃখেই আমরা কাঁদতেছি।’ প্রিয়র অসহায় মুখ করে বলার ভঙ্গি দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

_______________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৪

সাইফ কুকিজের পার্সেল প্যাক করার সময় ছোঁয়া দোকানে এলো। সূর্য তখন মাথার উপরে। ছড়াচ্ছে উত্তাপ অহর্নিশ। তখনও কর্মজীবী মানুষগুলো ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ছুটছে নিজ নিজ কাজে। সাইফকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখে তার ফ্রি হবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ছোঁয়া। তারপর নিজের পেন্ডিং কাজগুলোতে হাত দিল। সাইফ কাজ শেষে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে এসে কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, ‘আজ এতো খুশি মনে হচ্ছে কেন? কোনো বিশেষ কিছু ঘটেছে কি?’

ছোঁয়া হিসাবের খাতাটা বন্ধ করে সাইফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘খুশি হবার তো বেশ অনেকগুলো কারণ আছে। কোনটা কোনটা জানতে চাস বল?’

‘আমি তো সবগুলোই জানতে চাই। যদিও আমার কিউরিসিটি বেশি তবুও আমাকে কেউ কিছু জানাতে চায় না। এটা তো আর আমার অজানা নেই।’ সাইফ অভিমানী গলায় বলল।

ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘স্যরি দোস্ত। তুই যে কারণে অভিমান করেছিস ওসবের কিছুই ইচ্ছাকৃত ছিল না। তবে মায়া ইচ্ছাকৃতভাবে লুকিয়েছে সবকিছু। এমনকি আমার কাছ থেকেও! ভাবতে পারিস? ঠিক এই কারণটাতে আমার তার উপর খুব রাগ হয়েছিল প্রথমে। আমি এখনও ভাবতেই পারছি না ও আমার কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়েছে।’

‘মায়ার উপর রাগ করছিসই বা কীভাবে? তোর রোমিওই তো ওকে নিষেধ করেছে তোকে কিছু না জানানোর জন্য। মায়ার কী-ই-বা করার ছিল? যেহেতু তুই আর তোর রোমিও দুজনেই ওর বন্ধু।’ সাইফ হিমশীতল গলায় বলল।

ছোঁয়া সাইফের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল, ‘বাহ্! মায়ার পক্ষ নেওয়া হচ্ছে খুব। মায়া অন্যায় করলেও তা মাফ। আর আমার বেলায় খোঁচা মারতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না।’ এক মুহূর্ত থেমে ছোঁয়া ঝগড়াটে গলায় বলল, ‘আর রোমিও রোমিও বলে কি শুরু করেছিস?।ওর একটা নাম আছে তো না-কি?’

‘স্প্লেনডিড! রোমিওকে তাহলেও রোমিও বলতে পারব না?’ সাইফ ভীষণ রকমের বিস্ময়াভূত হয়ে বলল, ‘রোমিওর জন্য দেখছি জান-প্রাণ সব একীভূত হয়ে আছে! আর মায়ার ব্যাপারে এমন করে বলছিসই বা কেন? মায়ার কোনো দোষ আমি দেখছি না এখানে। তাই এরকম বলেছি। দোষ করলে তো সেটাও অবশ্যই বলতাম।’

‘হুম।’ ছোঁয়া প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল, ‘যাক। ওসব বাদ দে। মায়ার বিয়েটা শেষমেশ পাকা হয়ে গেছে। তাই আজ আমার বেশ আনন্দ হচ্ছে। মন চাইছে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়তে থাকি।’

‘কী!’ সাইফ আঁতকে উঠে বলল, ‘কবে? কখন? মায়া আমাকে জানায়নি কেন?’

‘ওয়েট।’ ছোঁয়া সাইফের সামনে সটান দাঁড়িয়ে বলল, ‘এত হাইপার হচ্ছিস কেন? একটু আগেই আমাকে জানাল। মায়ার বিয়ের খবর শুনে খুশি হোসনি তুই?’

‘খুশি হবো না কেন?’ সাইফ অভিমানের সুরে বলল, ‘রাগ করলেও তোরা তোরা ঠিকই আছিস। আমাকে কল করে জানালো না অথচ তোকে খবরটা ঠিকই দিল।’

‘শুধু আমরা দুজন না বরং আমরা তিনজনই ঠিক আছি। রাগ, অভিমান কোনো কিছুই আমাদের বন্ধুত্বের চাইতে বেশি না। বাচ্চাদের মতো এত অভিমান করিস কেন? এত অভিমান কই থেকে আসে বল তো।’ ছোঁয়া গম্ভীর গলায় বলল।

সাইফ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ছোঁয়ার দিকে ত্যাড়ছাভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আজ কি দেখা হবে মায়ার সাথে?’

‘হুম।’ ছোঁয়া থমথমে গলায় বলল, ‘বিয়ে তো এখনি হয়ে যাচ্ছে না। দেখা নিশ্চয়ই হবে। এত দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু নেই।’

‘মায়া চলে যাবে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে খুব।’ সাঈফ অন্যমনস্ক হয়ে স্বগোতোক্তি করল যেন।

‘তাহলে এক কাজ করলে কেমন হয়?’ হঠাৎ জোর গলায় বলল ছোঁয়া।

‘কী কাজ?’ ভীষণ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল সাইফ।

‘মায়ার বিয়েটা ভেঙে দিই।’ ছোঁয়া ভ্রু কুঁচকে দ্বিধান্বিত হয়ে তাকাল সাইফের দিকে।

‘এটা কি কোনো কাজ হলো? আমরা ওর বিয়ে ভাঙব-ই-বা কেন? আর বিয়ে তো আজ নয়তো কাল করতেই হবে। তাই না?’ সাইফকে বিভ্রান্ত দেখাল ক্ষণিকের জন্য।

‘এক্সেক্টলি।’ ছোঁয়া জোরালো কণ্ঠে বলল, ‘আমিও ঠিক এই কথাটাই তোকে বোঝাতে চাইছি। আজ নয়তো কাল বিয়ে তো হবেই। তাহলে মন খারাপ করে কী লাভ?’

‘হুম, ঠিক বলেছিস।’ সাইফ বিমর্ষ কণ্ঠে সম্মতি জানাল।

‘তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ, সাইফ?’

‘একটু।’ সাইফের দৃষ্টিতে বিভ্রম, ‘তোদের দুজনের বিয়ে হয়ে গেলে আমি খুব একা হয়ে যাব। সেটাই ভাবছি।’

‘এমনভাবে বলছিস যেন তুই জীবনেও বিয়ে করবি না। শুধু আমার আর মায়ার বিয়ে হবে। তুই কি চিরকুমার সভায় নাম লেখানোর ধান্দায় আছিস না-কি?’ ঠাট্টার সুরে বলল, ছোঁয়া।

সাইফ বিস্ফারিত চোখ মেলে ছোঁয়ার দিকে তাকাল। গমগমে গলায় বলল, ‘চিরকুমার সভায় নাম লেখানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তোদের মিস করব খুব।’

‘আরে পাগল আমরা কি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি না-কি? এখানেই থাকব। এই শহর ছেড়ে আমি তো কোথাও যাচ্ছি না। আমি আর মায়া অবশ্য তোর ব্যাপারেও ভাবছি।’

‘কী ভাবছিস?’

‘কিছু একটা তো অবশ্যই ভাবছি দোস্ত।’

‘হুম, কিন্তু কী ভাবছিস?’

‘তোকে দোকা করার কথা ভাবছি।’

‘আমাকে দোকা বানানোর ধান্দায় না পড়ে তোর রোমিওকে কীভাবে সামলাবি সেটাই ভাবতে থাক। তার পেছনে লাগার জন্য তো আর জুলিয়েটের অভাব নেই।’

ছোঁয়া প্রশস্ত হেসে বলল, ‘জুলিয়েট এক জনই । অন্য সবাই জুলিয়েট হতে চাইছে। কিন্তু পারবে না। সো নোউ ওয়ারি!’

‘হোয়াট আ কনফিডেন্ট।’ সাঈফ বলল বিমুগ্ধ হয়ে।

‘ভালোবাসায় এই বিশ্বাসটুকু না থাকলে তা টিকবে কী করে? বন্দীকে পাহাড়া দিতে হয় স্বাধীন সত্তাকে নয়। ভালোবাসার মানুষকে তথাকথিত বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য না করে তাদের মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়ার স্বাধীনতা দিতে হয়। যদি সে তোর হয়ে থাকে তবে দিনশেষে তোর কাছেই ফিরে আসবে। ঠিক যেমন পাখিরা নীড়ে ফিরে গোধূলিলগ্নে।’ ভালোবাসা বিশারদের ন্যায় ব্যাখ্যা করল, ছোঁয়া।

‘তুই এমন ভালোবাসা বিশারদ হলি কবে থেকে?’ সাইফ ঠাট্টার সুরে বলল।

‘যবে থেকে আমার রোমিওর প্রেমে পড়েছি তবে থেকে।’ ছোঁয়া বিমোহিত কণ্ঠে আওড়াল, ‘সেই স্কুলের দিনগুলি থেকেই আমি তাহাতে মুগ্ধ।’

___________________

বিকেলের দিকে ছোঁয়া বাগানে চলে এলো। কয়েকদিন ধরে নানান ব্যস্ততা থাকায় তার বাগানের অবস্থা বেহাল হয়ে গেছে। বাগানের এমন নির্জীবতা দেখে ছোঁয়া কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বেশ আফসোসের সুরে স্বগোতোক্তি করে বলল, ‘আমি কয়েকদিন না থাকায় বাগানটার সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন এটাকে ঠিক করতে আমার বেহাল দশা হবে।’

তারপর ওড়নাটা কোমরে গুঁজে সবগুলো গাছে পানি দিল। আগাছাগুলো কেটে পরিষ্কার করল। ততক্ষণে ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সে। কপাল আর নাকের ডগায় জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘর্মবিন্দু। সেদিকে ছোঁয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে তার কাজে পূর্ণ মনোযোগী। অর্কিডের গাছ গুলো সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছোঁয়ার আফসোস হচ্ছে খুব।

ঠিক সে সময় শিহরণ এসে হাজির হলো। বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ গেটের বিমের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করল তার প্রিয়তাকে। ছোঁয়ার কাজ যখন শেষের দিকে তখন সে উঠে দাঁড়াতেই শিহরণকে দেখল। শিহরণ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। ছোঁয়া এমন সময়ে শিহরণকে দেখে আঁতকে উঠে বলল, ‘এ কী! তুমি এখানে ! কখন এলে? এখানে এই সময়ে কী করছ?’

শিহরণ মুচকি হাসি ঠোঁটের কোণে বহাল রেখেই বলল, ‘চলে এলাম পিয়াসী মনের পিপাসা মেটাতে।’

স্নিগ্ধ সমীরণের বেগ তখন বেড়েছে খানিকটা। বাতাসের ঝাপটা এসে ছোঁয়ার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছিল। শিহরণ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল তার প্রিয়তাকে। মোহাবিষ্টের ন্যায় দৃষ্টি নিবিষ্ট রেখে শিহরণ বলল, ‘প্রিয়তা আমি বড্ড পিপাসার্ত আজ। আমার পিপাসা কী মিটবে আজ?’

‘উফ্! কী একটা অবস্থা। তুমি পানি খেতে এইখানে চলে এসেছ। তোমার অফিস আর বাসা কোথাও কি পানি ছিল না?’ ছোঁয়া কোনোকিছু না ভেবেই বলল।

শিহরণ এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করে হতাশার সুরে বলল, ‘হায়রে কপাল! আমার পানির পিপাসা পায়নি প্রিয়তা। আমার চোখের তৃষ্ণা পেয়েছিল। সেই তৃষ্ণা মেটাতে চলে এলাম।’

শিহরণের কথা শুনে ছোঁয়া বেশ লজ্জা পেল। সাথে সাথেই মুখটা নিচু করে ফেলল। লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘কী অশ্লীলটাই না হচ্ছো তুমি দিন দিন!’

শিহরণ ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ‘কী, অশ্লীল! এখানে অশ্লীলতার কী দেখলে তুমি?’

ছোঁয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তৃষ্ণা মিটলে এবার বিদেয় হও। মা যেকোনো সময় বাইরে চলে আসতে পারে। আমি চাই না তোমাকে এখানে দেখুক।’

‘শ্বশুরবাড়িতে এসে শাশুড়ির সাথে দেখা না করেই চলে যাওয়ার মতো বোকা তো আমি নই জানেমান!’ শিহরণ শার্টের কলারটা খানিকটা উঁচিয়ে দম্ভভরে বলল।

‘তুমি কি যাবে?’ ছোঁয়ার একগুঁয়ে প্রশ্ন।

‘উঁহু! যাবার জন্য তো আসিনি।’ শিহরণও নাছোড়বান্দার মতো করে জবাব দিল।

‘একটু আগে না বললে আমাকে দেখতে এলে।’

‘মোটেই না।’

‘তাহলে কেন এসেছ?’

‘তৃষ্ণা মেটাতে এসেছি।’ শিহরণ বেশ ভাব নিয়ে বলল।

‘ওই একই কথাই তো হলো।’ বিরক্তির সুরে বলল, ছোঁয়া ।

‘একদম না।’ জোর গলায় বলেই শিহরণ মাথা ঝাঁকাল।

‘এত প্যাঁচাচ্ছ কেন?’ শিহরণের দিকে তেড়ে এসে বলল, ছোঁয়া।

‘না প্যাঁচালে কি কেউ আমার কথা শোনে?’ আক্ষেপের সুরে বলল, শিহরণ।

‘আচ্ছা এবার কি চাইছ বলো তো?’ মেইন দরজার দিকে চোখ রেখেই বলল, ছোঁয়া।

‘এইবার লাইনে এসেছ।’ কথাটা বলেই শিহরণ এগিয়ে এলো ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়ার সাথে তার দূরত্ব যখন কমে এলো তখন ছোঁয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে মৃদু চেঁচিয়ে বলল, ‘এই তুমি কাছে আসছ কেন? যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক।’

শিহরণ থমকে দাঁড়িয়ে পুনরায় ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে এসে তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ, প্রিয়তা?’ শিহরণ খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় ছোঁয়ার দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছিল। সে সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। ছোঁয়াকে এমন আচমকা চোখ বন্ধ করতে দেখে শিহরণ মুচকি হাসল। প্যান্টের পকেট থেকে টিস্যু বের করে তা দিয়ে ছোঁয়ার কপালের কাছে লেগে থাকা মাটি মুছে দিয়ে বলল, ‘এবার ঠিক আছে। এবার চোখ খুলতে পারো জানেমান। আমাকে রেহান ভাবার কোনো কারণ নেই, জানেমান। আই হ্যাভ মাই পেশেন্স।’

নিজের নির্বুদ্ধিতায় মনে মনে ইচ্ছেমতো বকলো নিজেকে। ছোঁয়া নিজের মাথাটা নিচু করতে করতে চিবুকটা একদম বুকের সাথে লাগিয়ে ফেলল। তাই দেখে শিহরণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। শিহরণের হাসি দেখে ছোঁয়া প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে বলল, ‘তুমি একটা অসভ্য!’

‘আমি অসভ্য!’ ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করল, শিহরণ।

‘শুধু অসভ্য না, মারাত্মক রকমের অসভ্য তুমি।’

ফাহমিদা বেগম বাগানে এসে শিহরণকে দেখে বেশ খুশি হলেন। আনন্দিত গলায় বললেন, ‘কেমন আছ, শিহরণ? সেই যে হাসপাতালে দেখা হলো এর পর তো আর এলে না?’

শিহরণ প্রশস্ত হেসে ফাহমিদা বেগমকে সালাম দিয়ে অভিযোগের সুরে বলল, ‘আসলে আন্টি আমি তো সবসময় আসতে চাই। কিন্তু আপনার মেয়ে আমি আসলেই খালি তাড়িয়ে দেয়। এই যে দেখুন আমি আজকে আপনার সাথে দেখা করতে আসলাম অথচ আপনার এই মেয়েটা আমি আসার পর থেকেই বলছে বিদেয় হও, বিদেয় হও।’

ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ চোখ রাঙিয়ে তাকাল শিহরণের দিকে। সেই চোখ রাঙানোতে শিহরণ কোনো ভ্রুক্ষেপই করল না। সে বলতে থাকল, ‘আপনার সাথে দেখা করার জন্য আসতে বললেই আপনার মেয়ে বেঁকে বসে।’

ফাহমিদা বেগম ধমকের সুরে বললেন, ‘ছোঁয়া! এইসব কী শুনছি আমি?’

ছোঁয়া আমতা আমতা করে বলল, ‘না, মানে মা আসলে শিহরণ খুব ব্যস্ত থাকে তাই আসতে নিষেধ করেছিলাম।’

‘একদম মিথ্যে কথা আন্টি।’ শিহরণ বাগড়া দিয়ে বলল।

শিহরণকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করলো ছোঁয়া। ফাহমিদা বেগম শিহরণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আচ্ছা, বাবা ভেতরে আসো।’

ছোঁয়া তখনও ভ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। শিহরণের এই স্বভাবটা তো তার অজানা নয়। তারপরেও সে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকল শিহরণের দিকে। ফাহমিদা বেগম তাকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘এই ছোঁয়া, তাড়াতাড়ি আয়। শিহরণকে নাস্তা দিতে হবে তো।’

ছোঁয়া নিজের রুমে গিয়ে ঝটপট রেডি হয়ে কিচেনে গিয়ে কিছু নাস্তা তৈরী করল। তারপর শিহরণের সামনে নাস্তার প্লেট রেখে বলল, ‘খেয়ে উদ্ধার করেন আমাকে। তারপর সোজা বিদেয় হবেন।’

শিহরণ ছোঁয়ার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার শাশুড়ি আম্মাকে ডাকব?’

‘কে তোমার শাশুড়ি, হ্যাঁ? কে? বিয়ে না করেই জামাই আদর পেতে চাইছ? এটা কিন্তু ভীষণ খারাপ অভ্যাস।’

‘তুমি চাইলে এখনই করে ফেলতে পারি। তিনবার কবুল বলব। ব্যস, বিবাহিত জীবনের কাহিনি শুরু হয়ে যাবে। কী বলো?’

‘বিয়ে করার খুব শখ হয়েছে নাকি?’

‘সে তো কবে থেকেই।’

হিয়া আচমকা রুমে প্রবেশ করল। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই প্রশ্ন করল, ‘কার বিয়ে করার শখ হয়েছে ছোঁয়া আপু?’

ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ বলে বসল, ‘এই যে সামনে বসে যিনি গপাগপ গিলছেন তার।’

শিহরণও কম যায় না। সে বলল, ‘হিয়া, তুমি তো ভালো করেই জানো কার বিয়ের শখ হয়েছে। তাই না?’

হিয়া হতবুদ্ধি হয়ে একবার ছোঁয়ার দিকে তো একবার শিহরণের দিকে তাকাচ্ছে। শিহরণ আবারও বলতে শুরু করল, ‘বুঝলে হিয়া, তোমার বোনের জন্যই আজ অফিসটা করতে পারলাম না। ফোন করে করে আমাকে ত্যাক্ত-বিরক্ত করে ফেলেছে একেবারে। আমাকে না দেখতে পেয়ে না-কি তার অজ্ঞান হবার দশা। এইসব শুনলে কি আর কাজে মন বসে? তুমিই বলো।’

‘এই হিয়া, তুই ওর কথা একদম বিশ্বাস করবি না।’ ছোঁয়া সতর্ক গলায় বলল, ‘সব মিথ্যা কথা বলছে, শিহরণের বাচ্চা। আমি এরকম কিছুই বলিনি। আর আমি তো ফোনও করিনি।’

‘শিহরণের বাচ্চা আবার কোথা থেকে এলো?’ শিহরণ যেন যারপরনাই অবাক।

‘এই তোদের আবার কী হলো?’ ফাহমিদা বেগম ড্রয়িং রুমে আসতে আসতে চেঁচিয়ে বললেন।

ফাহমিদা বেগমকে দেখে ছোঁয়া একদম চুপ হয়ে গেল। হিয়া বলল, ‘ওসব কিছু না, মা। আসলে টম এন্ড জেরির অফস্ক্রিন দৌড়-ঝাপ চলছিল।’

‘তোদের এসব ডিজিটাল কথাবার্তা আমার মাথায় ঢুকবে না। শিহরণকে ভালো-মন্দ কিছু খেতে দে। আমি গেলাম বিশ্রাম নিতে।’ ফাহমিদা বেগম ছোঁয়াকে আদেশ দিয়ে আবারও চলে গেলেন।

শিহরণ এই সুযোগে ছোঁয়াঈএ চোখ মেরে বলল, ‘শাশুড়ি আম্মার আদেশ পালন করো জানেমান।’

হিয়া ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘জিজু, তুমি এতো দুষ্ট তা তো জানা ছিল না।’

হিয়ার কথা শুনে শিহরণ হেসে বলল, ‘এবার তো জানলে ।’

‘আমি কিন্তু এখন থেকেই তোমাকে জিজু বলে ডাকব, হু!’

‘আমার তো বেশ ভালো লাগছে তোমার মুখে জিজু ডাক শুনে। কিন্তু কাছাকাছি কেউ হয়তো জ্বলছে। উঁহু, শুধু কী জ্বলছে? জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে একেবারে।’

‘আমিও একটু-আধটু গন্ধ পাচ্ছি বলেই ভনে হচ্ছে।’ শিহরণের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, হিয়া।

ছোঁয়ার রাগ তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই শিহরণ বলল, ‘আমি আমার প্রিয়তাকে ছাড়া কিচ্ছু মুখি দেব না। কথাটা জানিয়ে রাখলাম। এখন কেউ যদি যেতে চায় তাহলে যেতেই পারে। আমি কিন্তু বাধা দেব না।’

ছোঁয়া থমকে দাঁড়াল। পেছন ঘুরতেই দেখতে পেল এক জোড়া সবুজাভ চোখ তখনও তাতেই নিবিষ্ট। ওই চাহনি পড়তে ছোঁয়ার খুব বেশি কষ্ট হলো না। সে কোনো কিছু না ভেবেই শিহরণের পাশে গিয়ে তার ডান হাতটা শক্ত করে ধরল। তার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু মোটেই রাগ করিনি জনাব। রাগ করার অভিনয় করছিলাম কেবল।’

জবাবে শিহরণ হাতের বন্ধন আরও বেশি দৃঢ় করে তার ভালোবাসার জানান দিল। হিয়া সহাস্যে প্রশ্ন করল , ‘বাই এনি চান্স আমি কি কাবাব মে হাড্ডি হচ্ছি?’

হিয়ার কথা শুনে ছোঁয়া আর শিহরণ দুজনেই হেসে ফেলল। হিয়াও সাথে যোগ দিল। ড্রয়িং রুম থেকে আওয়াজ আসায় নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে অহনা। ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে থেকে বেশ কিছুক্ষণ চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। শিহরণ আর ছোঁয়াকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে অহনার তখন মারাত্মক রকমের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তার উপর হিয়াটাও যে আহ্লাদী কাণ্ড শুরু করেছে তা দেখে তার গা জ্বলে যাচ্ছিল।
_____________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৫

বহ্নি ভার্সিটির গেটে পা রাখতেই সায়মা তাকে হাত ধরে এক প্রকার টানতে টানতে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল। বহ্নি বিরক্তির সুরে বলল, ‘কী হইসে? এভাবে টানতেছিস ক্যান?’

সায়মা বহ্নির হাতের উপর নিজের হাতের বন্ধন আরও জোরালো করে ধরে হিসহিসিয়ে বলল, ‘হারামি! তুই একটা স্বার্থপর। তুই আমাকে কিছুই জানাস নাই। আমাকে সব খবর অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে হলো।’

বহ্নি সায়মার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘তুই চুপ করবি? আমার হাতের কি হাল করেছিস দ্যাখ! হাত তো নয় যেন লোহার তৈরী হাতুড়ি!’

তূর্ণ পাশ থেকে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠল, ‘আহা, সায়মা একটু হালকা করে ধরতে পারতি তুই। না হয় সে আমাদের নিজের বন্ধু ভাবে না। তাই বলে তো আর আমরা ওর সাথে এমনটা করতে পারি না। তাই না?’

‘তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?’ বহ্নি দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো দপ করে জ্বলে উঠল, ‘কী হয়েছে বলবি তো না-কি?’

‘কী আবার হবে?’ সায়মা আক্ষেপ সহকারে বলল, ‘কতো কিছু হয়ে গেছে অথচ আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না।’

তূর্ণ অনুযোগের সুরে বলল, ‘বলবে কেন? আমরা তো ওর কেউ না।’

বহ্নি নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘কথা প্যাঁচানো বন্ধ করে কী হয়েছে বল তো আমাকে।’

সায়মা বহ্নির দিকে তেড়ে এসে ঝগড়াটে গলায় বলল, ‘অতল ভাইয়া আর তোর মধ্যে যে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে তা আমাদের কাউকে জানালি না কেন? তার উপর আবার ন্যাকা সাজছিস!’

‘আরে বাবা, সবকিছু এতো দ্রুত ঘটে গেল যে আমি নিজেই তো বুঝতে পারিনি, তোদের কী করে জানাব বল তো? আমি তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, অতল ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে।’ বহ্নি বলল, ভাবুক হয়ে।

‘তা কী করলে বিশ্বাস হবে যে সে তোকে ভালোবাসে?’ তূর্ণ বহ্নির সামনে দাঁড়িয়ে তুড়ি মেরে বলল।

তুড়ি মারার শব্দে বহ্নি ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি রেখে বলল,
‘আরও কিছুটা সময় লাগবে। দ্যা গ্রেট অতল ইজ মাইন, ভাবতেই এক অদ্ভুত ভালো লাগছে।’

তূর্ণ বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘যাহ, এবারের মতো মাফ করলাম তোকে। ভালোবাসার ব্যাপার বলে কথা।’ পরক্ষণেই বহ্নিকে সতর্ক করার ভঙ্গিতে বলল, ‘অনেক সাধনার বিনিময়ে অর্জিত ভালোবাসা বলেই মাফ করছি। মনে রাখবি।’

‘আচ্ছা, বাবা মনে রাখব।’ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, বহ্নি ।

সায়মার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বহ্নি প্রশ্ন করল, ‘আয়মান ভাইয়ার কাছ থেকে জেনেছিস। তাই না?’

‘আমার আপন বলতে তো কেবল সেই আছে।’ ভীষণ হতাশার সুরে বলল, সায়মা।

‘বাব্বাহ, এখন থেকেই দেখছি প্রেমিকের প্রতি দরদ উথলে পড়ছে।’

‘ও শুধু আমার প্রেমিক না আমার কাজিনও। আর ও খুব খুব বেশিই লয়াল। আমার কাছ থেকে একটা কথাও লুকিয়ে রাখে না।’

‘প্রশংসার তীক্ষ্মবাণ ছাড়া আপাতত কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখ তো।’ তূর্ণ রেগে বলল।

‘তোর প্রেমিকা নাই বলে কি আমি আমার প্রেমিকের কথা বলতে পারব না?’ ঝাঁঝালো গলায় বলল, সায়মা।

‘আরে তোরা ঝগড়া থামা তো। বাচ্চাদের মতো এতো ঝগড়া ক্যামনে করিস? এখন পরীক্ষার খবর-টবর কিছু থাকলে বল।’ তূর্ণ আর সায়মার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়ার মীমাংসা করার চেষ্টায় প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, বহ্নি।

হঠাৎ টেবিলের উপর জোরে একটা চাপড় মেরে সায়মা বলে উঠল, ‘জানিস ফাইনাল এক্সামের রুটিন দিয়েছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। এমনিতেই আমার কিছুই পড়া হয়নি।’

‘তোর পড়া জীবনেও হবে না। পরীক্ষার রাতের পড়াই তোর জন্য যথেষ্ট। এর থেকে বেশি পড়া তোর পক্ষে সম্ভব না।’ বহ্নি বলল, বিজ্ঞের মতো করে।

সায়মা মন খারাপ করে বলল, ‘তা যা বলেছিস।’

তূর্ণ ঠাট্টার সুরে বলল, ‘তুই ভালো ছাত্রী বলে কী আমাদের হেয় করলি?’

‘মাইর চিনোস?’ ডান হাতটা তুলে থাপ্পড় দেবার ইশারা করে বলল, বহ্নি।

তুর্ণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘চিনি তো। কিন্তু মারবে কে? তুই? তোর এই হ্যাংলা পাতলা শরীরের চিকনা হাত দিয়ে?’

‘হ্যাংলা বলে আন্ডারস্টিমেট করার ভুল করিস না। মনে নেই সাজ্জাদকে কেমন দিয়েছিলাম পেছন পেছন ঘুরঘুর করছিল বলে।’

‘তা ঠিক আছে। কিন্তু এই তূর্ণকেও আন্ডারস্টিমেট করার ভুল করিস না।’

তূর্ণের দেওয়া সতর্কতা বাণী শুনে বহ্নি আর সায়মা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সায়মা বলল, ‘এবার অতল ভাইয়াকে লাগিয়ে দেবে। ওর কিছুই করতে হবে না।’

‘ওরে বাবা! ওই কাঠখোট্টার কথা আর বলতে! কথাই বলতে চায় না। কী পাবলিক রে মাইরি। মনে হয় কথা বলতেও তার ট্যাক্স গোনা লাগবে।’

‘তূর্ণ!’ সাবধানী গলায় বলে উঠল বহ্নি, ‘খবরদার, অতল ভাইয়াকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছিস তো।’

তূর্ণ হাত তুলে স্যারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল, ‘ওকে, তোর সাধনার ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে ভালো ছাড়া খারাপ বলব না। এবার ঠিক আছে?’

তূর্ণর কথা বলার ভঙ্গি দেখে বহ্নি আর সায়মা উভয়ে ফিক করে হেসে দিল।
________________________

বিকেলের দিকে কিচেনে গিয়ে চা বানাতে গিয়ে হিয়া দেখল চা পাতা শেষ হয়ে গেছে। ফাহমিদা বেগমকে বলতেই তিনি বললেন ছোঁয়াকে ফোন করে জানানোর জন্য। হিয়া নাচতে নাচতে নিজের রুমে এলো। মোবাইলটা খুঁজতেও অনেক কসরত করতে হলো তাকে। শেষ পর্যন্ত বইয়ের ভাঁজের ভেতরে মোবাইলটা খুঁজে পেল।

ছোঁয়াকে কল করার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতেই মেসেজের নোটিফিকেশন দেখতে পেল হিয়া। মেসেজবক্সে গিয়ে মেসেজটা পড়তেই হিয়া কাঁপতে লাগল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এটা কী করে সম্ভব তা কোনোভাবেই তার মাথাতে আসছে না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে আবারও চোখ রাখল মেসেজটাতে।

‘কেমন আছ আমার জান পাখিটা? কী অবাক হচ্ছ? ভেবেছিলে ফিরে আসব না? আমি তো বলেছিলাম ফিরে আসব। ফিরে এসেছি। আহা! এবার জমবে খেলা নতুন করে। ছবিগুলো দেখো তো চিনতে পারো কি না?’

মেসেজের পাশাপাশি এমএমএসটা দেখেই হিয়া চিৎকার করে উঠল। সাথে সাথেই ছুটে গেল মায়ের রুমে। ফাহমিদা বেগম তখন শুয়ে ছিলেন।

হিয়া রুমে ঢুকেই কাঁদতে লাগল। ফাহমিদা বেগম হিয়ার এমন কাণ্ডে ভয় পেয়ে পড়িমরি করে উঠে বসলেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে হিয়া মামণি? এমন করে কাঁদছ কেন?’

‘মা, ওই লোকটা আবার ফিরে এসেছে।’ এটুকু বলেই হিয়া মায়ের কোলে মুখ লুকাল। তার কান্নার বেগ বেড়ে গেছে । ফাহমিদা বেগমের বুকটা অজানা আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে উঠেছে। তিনি হিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলেন, ‘কে এসেছে?’

হিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তানভীর নামের লোকটা।’

নামটা শুনেই ফাহমিদা বেগম আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘এটা কী করে সম্ভব? তার তো জেলে থাকার কথা।’

‘বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আমার মোবাইলের মেসেজগুলো দেখো। দেখো, বিশ্বাস না হলে।’ ফাহমিদা বেগমের দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিল হিয়া।

তারপর আবার মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল হিয়া। ফাহমিদা বেগম মেসেজ পড়ে আর এমএমএসটা দেখে দরদর করে ঘামতে থাকলেন। তার মানে তানভীর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। কথাটা ভাবতেই তার কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিল। মনের মধ্যে বেশ কিছু সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে।

আচমকা হিয়া ফাহমিদা বেগমকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকল, ‘সব তোমার জন্য হয়েছে আম্মু। সবকিছুর জন্য তুমিই দায়ী। তুমি যদি তোমার চাইতে কমবয়সী ওই নোংরা লোকের সাথে সম্পর্কে না জড়াতে তাহলে আমার সাথে ওই ঘটনা ঘটতো না। ওই নোংরা লোক আমার দিকে নজর দিতে পারতো না।’

ফাহমিদা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলেন হিয়ার এমন কাণ্ডে। তিনি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। হিয়ার বলা কথাগুলো সত্য হলেও এই সত্য মেনে নেওয়াটা আজকের দিনে তার জন্য ভীষণ কষ্টের। তিনি কোনোরকমে কম্পিত গলায় বললেন, ‘হিয়া মা, আমি তো ওসবের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলাম।’

‘তোমার ক্ষমা চাওয়াতে কি সব ঠিক হয়ে গেছে মা? কিচ্ছু ঠিক হয়নি। আমি সবকিছু ভুলে গিয়ে যখন নতুনভাবে সব শুরু করেছি ঠিক তখন ওই নোংরা লোকটা আবার আমার পিছু নিয়েছে। আজ থেকে ছয় বছর আগে ওই লোক আমাকে সেক্সুয়ালি অ্যাসাল্ট করেছিল এখন যে তার চাইতে ভয়ংকর কিছু করবে না তার কি নিশ্চিয়তা আছে বলো? তুমি কি এর নিশ্চয়তা দিতে পারবে আমাকে?’

ফাহমিদা বেগম বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হিয়ার কাছে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘তোর কিচ্ছু হবে না মামণি। কিচ্ছু হবে না। আমরা সবাই আছি তো তোর পাশে।’

মায়ের বাহুডোরে হিয়া কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। অতীতটা পুনরায় হানা দিয়েছে বর্তমানে এই চরম সত্যটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ফাহমিদা বেগম মনে মনে বললেন, ‘ছোঁয়াকে এই বিষয়ে জানাতে হবে।’

__________________

তানিয়া আমড়ার আচারের বাটি হাতে নিয়ে অতলের রুমে এলো। অতল ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল, ‘কিছু বলবি, টমেটো সস?’

তানিয়া নিরাশ হয়ে বলল, ‘তুমি তো আমাকে দেখোনি, তাহলে বুঝলে কি করে যে আমি এসেছি?’

‘টমেটো সসের আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে, বুঝলি? সেটা পেলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে আমারে টমেটো সস চলে এসেছে।’

‘আচ্ছা, ভাইয়া একটা কথা বলবে?’

‘কথা বলার আগে তুই কবে থেকে অনুমতি নেওয়া শুরু করেছিস?’

‘সত্যি করে বলবে কি না বলো?’

‘প্রশ্ন পছন্দ হলে অবশ্যই উত্তর দেব।’

‘তোমাকে বেশ কয়েকদিন ধরে একটু অন্যরকম লাগছে। কারণটা আমি যদিও একটু আধটু আঁচ করতে পারছি। তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’

‘অন্যরকম বলতে?’

‘এই যে একটু বেশিই হাসি-খুশি, কাজের প্রতি মনোযোগী, অভিযোগহীন।’

‘ওহ্, তার মানে আমাকে হাসি-খুশি দেখে তোর সহ্য হচ্ছে না!’

তানিয়া অভিমান করে বলল, ‘ভাইয়া, এই কথাটা তুমি বললেই বা কী করে? আমি চাই আমার ভাই সবসময় খুশি থাকুক। তোমাকে হাসিখুশি দেখলে আমার চাইতে বেশি কেউ খুশি হবে না। কিন্তু কারণটাও তো জানা দরকার। তাই জানতে চাইছি। তুমি তো আর নিজ থেকে কিছু বলবে না। সবকিছুই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করতে হয়।’

‘আচ্ছা, আতিক ভাইয়ের ব্যাপারটা বল তো। ও কি বিয়েতে রাজী হয়েছে?’

‘প্রসঙ্গ পাল্টালে তো। ঠিক আছে, আমি ঠিক জেনে নেব।’ তারপর নিজের হাতে ধরে রাখা আচারের বাটিটা অতলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমড়ার আচার খাবে? আমি বানিয়েছি।’

‘নাহ্, ওসব আমি খাই না। জানিস না তুই?’

‘অনেক মজা হয়েছে। না খেলে মিস করবে কিন্তু!’

‘জীবনে অনেক কিছুই মিস করেছি। এটা মিস করলে খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।’

‘ওহ্, হ্যাঁ। আব্বু বলেছে ভাইয়ের বিয়ে আগামী মাসের নয় তারিখ। কথাটা শুনে আতিক ভাইয়া কেমন যেন পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করেছে। আমার মনে হয় কি জানো, ভাইয়া বোধহয় বিয়েতে রাজী না।’

অতল কিছুক্ষণ চুপ থাকল। বিড়বিড় করে বলল, ‘এটা তো হবারই ছিল।’

তানিয়া বুঝতে না পরে বলল, ‘কিছু বলেছ?’

‘নাহ্, আম্মু কী করছে?’

‘আম্মু আবার কী করবে? রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আরও কতো আয়োজন যে করছে তার হিসেব নেই।’

কথাটা বলেই তানিয়া অতলের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অতল নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ দরজার দিকে। তারপর আবারও কাজে মনোযোগ দিল।

একটু বাদেই মোবাইলটা বেজে উঠলো হুট করে । অতল তৃণার নাম্বারটা দেখেই কলটা কেটে দিল। মেয়েটা পিছু ছাড়ছেই না। কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এতটা অস্থির হবার কী আছে সে বুঝতে পারছে না! অতল পরিষ্কারভাবে তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে তাকে ভালোবাসে না। অথচ মেয়েটা তবুও পিছু ছাড়ছে না। শেষমেশ অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল। তবুও কাজ হলো না। মেয়েটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনবরত কল করতেই আছে।

বারবার কল আসতে থাকায় অতল বাধ্য হয়েই কলটা রিসিভ করে ওপাশের কণ্ঠস্বরের কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করেই কঠিন গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না। কথাটা কি তোমার মাথার খুলি ভেঙ্গে মগজে ঢুকিয়ে দেবার পরে বুঝবে? যদি এরকমটা হয়ে থাকে তাহলে আমি না হয় তাই করব। তবুও আমি চাই তুমি বুঝো। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি তোমাকে না। আমি জাস্ট টাইমপাস করেছি এতোদিন। দ্যাটস ইট। এই কথাটা রিলেশন করার আগেই ক্লিয়ার করেছিলাম। করিনি?’

তৃণা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘করেছ কিন্তু আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি, অতল। আমার দিকটা একটু ভাবো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। প্লিজ, অতল তুমি আমার কাছে ফিরে আসো।’

অতলের মন চাইল নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে। মোবাইলটা কানে ধরে রেখেই সে কতক্ষণ এলোমেলোভাবে পায়চারি করল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এটা সম্ভব নয় তৃণা। আমি সত্যিই অন্য কাউকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি। আমার জীবনের চাইতেও বেশি। এতোদিন যাবৎ আমি আমার ভালোবাসাকে চিনতে পারিনি বলে ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে দূরে থেকেছিলাম। নিজেকে কষ্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন যখন তাকে আমি নিজের করে পেয়েছি তখন তার কাছ থেকে দূরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার প্রতিটা হৃদস্পন্দন জুড়ে শুধু তার নাম। আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস জুড়ে সে। আমার বিশ্বাস, কষ্ট, সুখ, দুঃখ সবটা জুড়ে কেবল এবং কেবলই সে। সে ছিল, আছে, থাকবে। এর নড়চড় হবে না। কোনোদিন হবে না।’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল অতল।

তৃণা আক্ষেপের সুরে মলিন কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে আমার ভালোবাসার কী হবে, অতল?’

অতল অসহায় বোধ করল। তৃণার প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। আচমকা চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল সে। গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘তোমার সত্যিকারের ভালোবাসা তুমি নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। যেমনটা আমি খুঁজে পেয়েছি। আমাকে মাফ করি দিও তৃণা। আমার সত্যিই অন্যায় হয়েছে।’

অতলের এমন শান্ত স্বরে বলা প্রতিটি কথার প্রত্যুত্তরে তৃণা হুট করেই কী বলবে ভেবে পেলো না। তবে ভেতরে ভেতরে সে ফুলছে। রাগান্বিত হয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তুমি কখনোই সুখী হবে না অতল। কখনোই না। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যাতে তুমি কখনোই তোমার ভালোবাসাকে না পাও।’
সাথে সাথেই কলটা কেটে দিল তৃণা।

অতল মোবাইলটা বিছানার উপর ছুড়ে মারল। দু’হাত উপরে তুলে মাথাটা চেপে ধরল। তার ভয় হচ্ছে এখন। খুব ভয় হচ্ছে। বহ্নিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। সে কোনোকিছুর মূল্যে বহ্নিকে হারাতে চায় না। যেকোনো মূল্যে আগলে রাখতে চায় তার নিজের শক্ত বাহুডোরে আবদ্ধ করে আজীবন। কিন্তু তার ভাগ্যটা বড্ড অপ্রসন্ন। ভালোবাসার মানুষটির উপর অগাধ বিশ্বাস থাকলেও তার নিজের ভাগ্যের উপর ভরসা নেই। ছোটো থেকেই তো সে অবহেলিত, ভালোবাসা পেয়েও পায় না, আবার পেলেও বুঝতে পারে না। তার জীবনটা বড়োই অদ্ভুত। এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই অতল বিছায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তার সবকিছু বিতৃষ্ণা লাগছে। চোখ দুটো বন্ধ করে রইল সে। বন্ধ চোখের পাতায় তার মনের রানির অবাধ বিচরণ। দুই চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। এই অশ্রু বিসর্জন কেন তা জানা নেই অতলের! হয়তো অনেক অনেক সাধনার পরে অর্জিত ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হবার ভয়! এই পৃথিবীর কেউই নিঃস্ব হতে চায় না। সবাই পরিপূর্ণ হতে চায়।

এই পৃথিবীর সবাই ভালোবাসার কাঙাল। আর অতল তো সেই ছোট্ট বেলা থেকেই ভালোবাসা পেতে মরিয়া ছিল। আর এখন যখন পেয়েছে, তখন তা হারিয়ে ফেলার ভয় জেঁকে বসেছে মস্তিষ্ক ও মন জুড়ে। কী নিদারুণ যন্ত্রণা!

_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৬

ফাহমিদা বেগম সর্বস্ব খোয়ানো মানুষের মতো অসহায় মুখ করে বসে আছেন নিজের রুমে। তাকে দেখতে একেবারেই নির্জীব আর নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। মায়ের মুখটা দেখেই ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল ছোঁয়ার। বাসায় আসার পর পরই হিয়ার মুখে সবটা শুনে ছোঁয়া থ মেরে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। তারপরই মায়ের রুমে এসে মায়ের এমন নির্জীব অবস্থা দেখে সে ভেঙে পড়েছে। যে অধ্যায়টা অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সেটা হঠাৎ করে আবার তাদের সামনে এমন খোলা কোনো পুস্তকের ন্যায় উন্মুক্ত হয়ে দাঁড়াবে তা তাদের কারও কল্পনাতেও ছিল না। মানুষের ভাবনা আর বাস্তবতার বিস্তর ফারাক ঠিক এইখানটাতেই। মায়ের পাশে বসে শুকনো ঢোক গিলে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে ছোঁয়া বলল, ‘তোমাকে এমন বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন, মা? এত সামান্য একটা বিষয় তোমার ভেতরের সমস্ত সজীবতা কেড়ে নিয়েছে তা ভাবতে আমার ভীষণ অবাক লাগছে।’

ফাহমিদা বেগম অনুভূতিশূন্য চোখে তাকালেন ছোঁয়ার দিকে। মৃত্যু পথযাত্রীদের ন্যায় বহু কষ্টে আতংকগ্রস্ত কণ্ঠে আওড়ালেন, ‘তানভীর খুব ভয়ংকর, ছোঁয়া।’

ছোঁয়া মায়ের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘যতই ভয়ংকর হোক না কেন তার পরাজয় আবশ্যক, মা। এবার তাকে আর এমনি এমনি ছেড়ে দেব না। উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে তারপর ছাড়ব।’ এটুকু বলেই ছোঁয়া নিজেকে সংশোধন করে পুনরায় বলল, ‘ও হ্যাঁ, ছাড়ব না, আবারও হাজতে ঢুকাব। তুমি দেখে নিও, এবার ও পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে। বাধ্য হবে সে ক্ষমা চাইতে। আগেরবার হালকার উপর ছাড়া পেয়েছে বলে বুঝতে পারেনি পরিবারের উপর আঘাত এলে পরিবারের অন্য সদস্যরা কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এতদিন তো সে নিজের ভয়ংকর রূপ মানুষকে দেখিয়েছে এবার সময় এসেছে অন্যদের ভয়ংকর রূপ দেখার।’

কথাগুলো শেষ করেই ছোঁয়া বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আবার পেছন ঘুরে বলল, ‘বিশ্বাস রাখতে পারো আমার উপর।’

ফাহমিদা বেগম উদভ্রান্তের ন্যায় তাকিয়ে থাকলেন ছোঁয়ার গমনপথে। ছোঁয়ার উপর বিশ্বাস থাকলেও তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্যই বেশি অনুতপ্ত। নিজের কৃতকর্মের জন্যই তার পাশাপাশি হিয়াকেও এর খেসারত দিতে হচ্ছে। সেদিন এই তানভীরই তাকে আঘাত করেছিল, তিনি এই বিষয়টি কাউকে জানাননি কেবল হিয়ার জন্য। হিয়া এই লোকটার নাম শুনলেই ভয় পাবে বলেই এমন একটা আতংক তিনি মনে মনে রেখেছেন। কারও সাথে শেয়ার করেননি। এমনকি ছোঁয়াকেও বুঝতে দেননি। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। তানভীর তার মেয়েটার দিকে আবারও হাত বাড়াতে চাইছে। তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত, লজ্জিত, নিজের বিবেকের দংশনে দংশিত। এই বিষয়টি তিনি কীভাবে বুঝাবেন!

সাইফ, মায়া আর অহনা হিয়াকে শান্ত করতে ব্যস্ত। মেয়েটা কেঁদেই চলেছে। পুরো বিষয়টা সাইফ আর মায়া জানলেও, অহনার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এমনকি সে কোনো প্রশ্নও করতে পারছে না এই মুহূর্তে। তবে হিয়ার এই রকম অবস্থা দেখে তার নিজেরও ভীষণ খারাপ লাগছে। সন্ধ্যার নাস্তা করা হয়নি কারও। হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘হিয়া, তোর জন্য আমি স্যুপ করে আনছি। গরম গরম স্যুপ খেলে তোর খুব ভালো লাগবে।’

হিয়া তখনও কেঁদে চলেছে। কান্নার দমকে খানিক বাদে বাদেই কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীরটা। অহনা হিয়ার উত্তরের অপেক্ষা করল না। বোনের এমন অবস্থা দেখে তার নিজেকে অসহায় লাগছে। উপরন্তু এর কারণটাও তার কাছে অস্পষ্ট। মায়ের অবস্থাও খুব একটা ভালো না তা সে খুব ভালো করেই জানে। ছোঁয়াকে গুরুত্ব দেবার পর থেকে মায়ের সাথে তার দূরত্ব বেড়েছেই কেবল। তবে আজ মায়ের মলিন মুখটা দেখার পর থেকেই তার খারাপ লাগা বেড়েছে। মনে হচ্ছিল দুঃখে কাতর কেউ একজন ক্রমশ নির্জীব হয়ে পড়ছে। নিজের মা আর বোনকে এমন অবস্থায় সে কোনোভাবেই দেখতে চাইনি। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল অহনা। তারপর কিচেনের উদ্দেশে পা বাড়াল।

ছোঁয়া বেশ অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। হাঁটা থামিয়ে কী যেন ভাবল সে! তারপর আচমকা আবারও হিয়ার মোবাইলটা নিয়ে ছবিগুলো দেখে সে বুঝতে পারল, ছবিগুলো সম্প্রতি তোলা হয়েছে।
সাইফ অস্থির গলায় বলল, ‘কী করবি ভেবেছিস?’

মায়া বলল, ‘পুলিশকে খবর দেওয়া ছাড়া আর কি-ই-বা করতে পারব আমরা!’

ছোঁয়া চোয়াল শক্ত করে কঠিন গলায় বলল, ‘ওকে পুলিশে দেবার আগে একটা শিক্ষা দিতে হবে। যাতে আর কোনো মেয়ের এরকম ছবি তুলতে না পারে। যাতে আর কোনো মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করতে না পারে।’

সাইফ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছিস। এত নোংরা মানসিকতার লোক হয় কি করে! আমার এই বিষয়টাই তো মাথায় আসে না।’

মায়া ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল, ‘নিচু মানসিকতার কথা আর কী বলব বল! এই কয়েক মাসের মধ্যে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনাগুলোতেই এইসব নোংরা আর বিকৃত মানসিকতার মানুষগুলোর হীনতা সম্পর্কে বোঝা যায়।’ মায়া থেমে আবারও চোখ মুখ কুঁচকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, ‘সিলেটের মেডিকেল কলেজে হওয়া গণধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে প্রতিবন্ধী নারীকে ঘরে প্রবেশ করা ধর্ষণ তো সামাজিক অবক্ষয় আর বিকৃত মানসিকতারই ফল। তাই না?’

সাইফ খুব আক্ষেপ নিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছিস। এত এত ধর্ষণের ঘটনা দেখছি যে মনটা বিষিয়ে উঠছে।’

সাইফ আর মায়ার কথোপকথন শুনতে শুনতেই ছোঁয়ার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেল। সে তৎক্ষণাৎ দ্রুত পায়ে ছুটে গেল মায়ের রুমে গেল। ফাহমিদা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, ‘সেদিন তানভীর লোকটাই তোমাকে মাথায় আঘাত করেছিল, তাই না?’

ফাহমিদা বেগম বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন ছোঁয়ার দিকে। তা দেখে ছোঁয়া বিরক্তির সুরে বলল, ‘মা, এবার কোনো মিথ্যে কথা বলো না। সেদিন তুমি সত্যিটা বলে ফেললে ওই নোংরা লোক এতক্ষণে হাজতে থাকত।’

ফাহমিদা বেগম তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘কীভাবে বুঝেছিস?’

‘কঠিন ছিল না, মা। ছবিগুলো দেখেই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি আর বাকিটা মায়া আর সাইফের আলোচনা থেকেই নিশ্চিত হলাম।’ ছোঁয়া বলল, হতাশার সুরে।

ফাহমিদা বেগম আতংকিত হয়ে বললেন, ‘এখন হিয়ার কী হবে?’

ছোঁয়া মাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘কিছুই হবে না। ওই লোককে এবার উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। তুমি এরকম মন মরা হয়ে থেকো না। দেখতে ভালো লাগছে না। হিয়ার সাথে থাকো। ওর তোমাকে প্রয়োজন।’

__________________

অফিসের কাজ শেষে মাত্র বাসায় পৌঁছেছে শিহরণ। এসেই সোজা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ছোঁয়ার ফোন পেয়ে শিহরণ নিজেও ব্যাকুল হয়ে পড়ল। সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করল সে। ছোঁয়ার কাছ থেকে যতটুকু শুনেছে তাতেই
তার ব্যাকুলতা, আর অস্থিরতা আন্দাজ করতে খুব একটা কষ্ট হলো না, তাই সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বেরিয়ে পড়ল ছোঁয়ার বাসার উদ্দেশ্যে। পেছন থেকে সাবিহা সাবরিন ডাকলেও সে তাতে সায় দিতে পারেনি। শুধু লম্বা পদক্ষেপ ফেলে হেঁটে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, ‘মা, আমি খুব জরুরি কাজে যাচ্ছি। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিও না।’

সাবিহা সাবরিন পেছন থেকে ডেকে বলে উঠলেন, ‘এত রাতে আবার কোথায় যাচ্ছ সেটা তো বল।’

শিহরণ সে কথা শুনতে পেল না। সে ততক্ষণে গাড়ির কাছে চলে এসেছে। ফরিদ নেই, তাই সে নিজেই ড্রাইভ করবে আজ। আর থাকলেও অবশ্য নিয়ে যেত না। কারণ কখন ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই।

শিহরণ যখন ছোঁয়াদের বাসায় পৌঁছাল ঠিক তখন ঘড়িতে সময় রাত নয়টা। সে সোজা উপরে চলে আসলো। হিয়া তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। ছোঁয়া পাশে বসে বলছে, ‘তোর কিচ্ছু হবে না বোন, আমরা সবাই আছি তো তোর সাথে।’

ফাহমিদা বেগম সোফায় বসে মাথা নিচু করে আঁচলে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন। ঘরের পরিবেশ দেখে শিহরণ স্তব্ধ হয়ে গেল। শিহরণকে দেখে ছোঁয়া হিয়ার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। অতি সন্তর্পণে এসে দরজা আটকে দিল। তারপর ছোঁয়ার মোবাইলটা এগিয়ে দিলো শিহরণের দিকে। মেসেজটা পড়ে শিহরণ একটুও ঘাবড়াল না। শিহরণ হিয়ার পাশে এসে বসে মুচকি হেসে বলল, ‘এইটুকুতেই ভয় পেয়ে গেলে তুমি হিয়া? তোমাকে খুব সাহসী ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু তুমি দেখছি একটা ভীতুর ডিম।’

হিয়া ছলছল চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। তার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব, ভয়, শঙ্কা আর নির্ভরতা খুঁজে পাবার এক আকুল আবেদন। শিহরণ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘এই মানসিক রুগীটাকে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। এর ব্যবস্থা আমি করব। ভাই হিসেবে আমার উপর তো ভরসা করতেই পারো, তাই না?’

হিয়া নির্বাক। তার শব্দ করতেও যেন ভয় হচ্ছে। হিয়া কোনো প্রত্যুত্তর না করাতে শিহরণ হিয়ার দু’বাহু ধরে মৃদু ঝাঁকিয়ে বলল, ‘বোন আমার, ভাইয়ের উপর এইটুকু ভরসা তো করতেই পারো। আমি পুরো বিষয়টা দেখছি। এবার কি আমি আমার বোনের ভরসা অর্জন করতে পেরেছি?’

হিয়া চোখ তুলে তাকাল। শিহরণের দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। হয়তো ভরসা খুঁজে ফিরছে। শিহরণের কুঞ্চিত ভ্রু’যুগল দেখে হিয়া মাথা উপর নিচে ঝাঁকাল। তাই দেখে শিহরণ মৃদু হেসে বলল, ‘তাহলে একটু হাসো তো এখন।’

হিয়া হাসার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল। সেই হাসিতে মালিনতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ছোঁয়া বলল, ‘এবার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।’

হিয়া ম্লান কণ্ঠে বলল, ‘ঘুম আসছে না।’

‘আচ্ছা, মা তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।’

হিয়া আঁতকে উঠে বলল, ‘না, মাকে চাই না আমার। মাকে চাই না। এই সবকিছু মায়ের জন্য হয়েছে। সব দোষ মায়ের। কিন্তু আমার সাথে কেন এমনটা হলো?’

হিয়ার প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। সবাই নির্বাক, নিস্তব্ধ। মায়া আর সাইফ হিয়াকে ধরে তার রুমে নিয়ে গেল। ফাহমিদা বেগমও নিজের রুমে চলে গেলেন।

শিহরণ ছোঁয়ার বিছানার উপরে পা তুলে আরাম করে বসে বলল, ‘আন্টির উপর এই লোকটাই এট্যাক করেছিল, তাই না?’

ছোঁয়া মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম।’

শিহরণ চিন্তিত সুরে বলল, ‘এই লোকের সাজা তো শেষ হয়নি, ছাড়া পেল কীভাবে?’

ছোঁয়া বলল, ‘যেভাবেই পাক না কেন, ওকে এবার উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।’

‘তা তো অবশ্যই। এখন লোকটার সম্পর্কে আমার কিছু ইনফরমেশন লাগবে। তুমি তার সম্পর্কে যা জানো তার সবটাই আমাকে বলো।’ শিহরণ বলল, গম্ভীর কণ্ঠে।
_______________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪১

অতল নিজ থেকেই একের পর এক করে জড়িয়ে ধরল ছোটোবেলার সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুদেরকে। সকলের মাঝের এতদিনের দূরত্ব ঘুচে গেল অবশেষে। সবচাইতে অবাক করার বিষয়টা হলো ছোঁয়া আর শিহরণের এক হওয়ার বিষয়টাতে অতল দারুণ খুশি হয়েছে। সকলের পরিবর্তনে সে ভীষণ অবাক হয়েছে। সবচাইতে বেশি অবাক হয়েছে রাদিদ আর ছোঁয়ার পরিবর্তন দেখে। ছোঁয়াকে এখন আর সেই অসহায় মেয়েটার মতো মনে হয় না বরং এক আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা, সাবলম্বী নারী মনে হলো তার। আর এই বিষয়টিতেই অতল দারুণ আনন্দ পেয়েছে। এক সময় যে মেয়েটাকে সবাই অবহেলা করত; তাকে এখন আর কেউ অবহেলা করার কোনো সুযোগ তো পাবেই না বরং তার সান্নিধ্য লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। অতল খুব করে খেয়াল করল ছোঁয়াকে দেখে তার কোনো অদ্ভুত বা বিশেষ কোনো ধরনের অনুভূতিই হলো না। যতটুকু অনুভূতি হলো তা শুধু ভালোলাগা, যা এই মুহূর্তে সকলের জন্যই কাজ করছে।

তবে রাদিদের পরিবর্তনে সে আকাশচুম্বি আশ্চর্যান্বিত হলো। রাদিদের ব্যাপারে মোটামুটি যে ধারণা পেল তাতে সে এতটুকু নিশ্চিত যে সে খুব ভালো একজন মানুষ যে মানুষটা নিজের কথা ভাবার আগে নিজের পরিবারের কথা ভাবে। রাদিদের এমন বিশাল পরিবর্তনে অতল বেশ মজাও পেল। ভাবল এই ব্যাপারে তার সাথে একটু মজা করা যাক।

যেই ভাবনা সেই কাজ। অতল রাদিদের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘দোস্ত, তুই তোর চিরায়ত অভ্যাস ভুলে সাধু পুরুষ হলি তাতে আমার কোনো অভিযোগ নাই। আমার অভিযোগ শুধু এক জায়গায় তুই তোর প্লে বয় তকমাটা আমার মধ্যে ট্রান্সমিট করলি ক্যামনে?’

রাদিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল, ‘আমি আবার কখন ট্রান্সমিট করলাম?’

অতল হেসে বলল, ‘বাদ দে, ওসব তুই আর বুঝবি না।’

রাদিদ হতবিহ্বল হয়ে অতলের দিকে তাকিয়ে থাকল। অতল তাতে বেশ মজা পাচ্ছে। গম্ভীর গলায় আবারও বলল, ‘জানিস, আমি না একজনকে খুব মিস করছি?’

‘কাকে?’ রাদিদ কৌতূহল সহকারে জনতে চাইল।

‘ইটস্ অবভিয়াসলি আওয়ার প্লে বয় রাদিদ।’ অতল হাসতে হাসতে ফাহমির গায়ের উপর গড়িয়ে পড়ল।

রাদিদ জবাবে হাসল। অতলকে হাসতে দেখে তার ভীষণ ভালো লাগল। এই বন্ধুটিকে সে খুব কমই হাসতে দেখেছে। জীবনকে উপভোগ করতে দেখেনি। সেই ছোট্টবেলা থেকেই সে দেখেছে এই বন্ধুটির চিন্তা জগতের মধ্যে তীব্র জীবনবোধের প্রবেশ। তাই আজ তার নিজের সেই ছোট্ট বেলার পাগলামির জন্য জীবনে প্রথম একটুও আফসোস হচ্ছে না বরং মনে হচ্ছে ভালোই তো ছিল সেসব। পরক্ষণেই তার খুব করে বলতে মন চাইল তার সকল বন্ধুদেরকে, ‘আজ কেন যেন আমার রাগ হচ্ছে না আমার চরিত্রের পুরনো বৈশিষ্ট্য মনে করিয়ে দেওয়াতে। আমার সেই বৈশিষ্ট্য যদি কারো মুখে হাসির উদ্রেক করতে পারে তবে তাই হোক। এই যে এই চশমা পরা ছেলেটা হাসছে সেটা তো আমার ছোটোবেলার প্লে বয় স্বভাবের জন্যই।’

কিন্তু মুখে খুব ভাব নিয়ে বলল, ‘অবশ্য তুই চাইলে আমি আবার সেই রূপে ফিরে যেতে পারি। তখন আবার আমার তকমাটা আমাকেই ফিরিয়ে দিতে হবে।’

শিহরণ এবার মুখ খুলল। সে রাদিদের ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ‘ওটা তুই আর পারবি না দোস্ত। ভুলে যা। এখন যেমন আছিস তেমনই থাকিস আজীবন। এই রাদিদকে আমরা বন্ধুরা বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।’

মোহনা, ফাহমি আর প্রিয় সমস্বরে বলল, ‘শিহরণ একদম ঠিক বলেছে।’ প্লিয় রাদিদের একটা হাত ধরে বলল, ‘থ্যাঙ্কস দোস্ত।’

‘থ্যাঙ্কস কেন?’ রাদিদ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইল।

‘ফর এভরিথিং।’ প্রিয় হাসিমুখে বলল।
__________________

রাফি সকাল থেকেই সুযোগ খুঁজছিল বহ্নির সাথে আলাদা একটু সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই সুযোগ করতে পারছিল না। অবশেষে বহ্নিকে একা দেখে তার পিছু নিয়েছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে সে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে গেল বহ্নির উপর। আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও তাকে সে পাত্তা দেয় না অথচ চশমা পরা চারচোখা ছেলেটার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল। তার গা ঘেঁষে বসে ছিল। এমনকি তাকে জড়িয়ে ধরতেও দ্বিধাবোধ করেনি। আর সে শুধুমাত্র হাত ধরতে চাইতেও অগ্নিমূর্তির ন্যায় ভষ্ম করে দিতে চায়। এইসব কিছুর কারণেই রাফি বহ্নির উপর প্রচণ্ড রেগে আছে।

বহ্নি আর অতল যখন ফিরল তখন অতল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। একে একে শিহরণসহ তার সকল বন্ধুদের জড়িয়ে ধরেছিল। এইসব দেখেই রাফি বুঝে নিয়েছে যে ছেলেটার সাথে তাদের পুরনো পরিচয় সূত্র আছে।

রাফি বহ্নিকে একা পেয়ে সুযোগ বুঝে ওকে হাত ধরে টানতে টানতে আশ্রমের পেছনে নিয়ে গেল। ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘বেশ ভালোই তো প্রেম করছ?’

রাফির এমন আচরণে বহ্নির মেজাজ পুরোটাই খারাপ হয়ে গেল। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমাকে কতোবার বলেছি আমার সাথে এই ধরনের বাজে আচরণ করবে না? নেক্সট আমার সাথে অসভ্যতা করার আগে একশবার ভেবে নিবে। নয়তো আমার বাবা আর ভাইয়া তোমার কী অবস্থা করবে তা তুমিও ভাবতেও পারবে না!’

রাফি হো হো করে বিদ্রুপাত্মক হেসে উঠল। অনুযোগের সুরে বলল, ‘সামান্য একটা মেয়ে হয়ে এত দেমাগ তোমার? আজ যদি আমি তোমার সাথে কিছু করে বসি তাহলে? কী করবে তোমার ভাই ? কী করতে পারবে তোমার বাবা?’ রাফি দম নিয়ে আবারও বলতে শুরু করল, ‘যাই করুক না কেন তোমার উপর যেই কলঙ্ক লাগবে সেটা মুছতে পারবে?’ রাফি আবারও হাসতে লাগল। বলল, ‘পারবে না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে তোমাকে আমার গলাতেই ঝুলিয়ে দেবে। আমার আসলে এই কাজটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল।’ শেষ কথাটা বলেই রাফি বহ্নির দিকে এগিয়ে এসে ওর দু’বাহু চেপে ধরল।

বহ্নি নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রাফিকে দূরে ঠেলে বলল, ‘অসভ্যতা করছ কেন? আর এসব অসভ্য ছেলের মতো আচরণ করছ কেন? তোমার মন-মানসিকতা এতটা নোংরা! ছিঃ। আমার ভাবতেও লজ্জা লাগছে তুমি আমার আব্বুর ভাইয়ের ছেলে।’

‘আমি অসভ্য?’ রাফি আবারও তেড়ে এলো বহ্নির দিকে। চেঁচিয়ে বলল, ‘আজকে না হয় সত্যিই কিছুটা অসভ্যতা করেই ফেলি! আর ওই চারচোখার সাথে যখন ছিলে তখন লজ্জা লাগেনি তোমার? সমস্ত লজ্জা শুধু আমার সাথে?’

রাফি বহ্নির দিকে আবারও এগিয়ে আসতে থাকল। যখনই বহ্নির গায়ে হাত দিবে ঠিক তখন অতল পেছন থেকে ওর শার্টের কলার ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে জোরে সোরে এক ঘা বসিয়ে দিল রাফির নাক বরাবর । ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল রাফি। প্রচণ্ড বিরক্তির সুরে বলল, ‘হু দ্যা ফাক ইউ আর?’

রাফি ডান হাত দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে যেই না
অতলের দিকে তাকাল তার পর পরই অতল আরও একটা ঘুসি বসিয়ে দিল তার ডান গাল বরারবর। এরপরেই এলোপাথাড়ি কয়েকটা লাথি মারল। মুখ বরাবর ক্রমাগত ঘুসি মারার কারণে রাফির ঠোঁট কেঁটে গিয়ে সেখান থেকে রক্ত বের হতে থাকল।

শেষবারের মতো শাসানোর জন্য অতল রাফির ডান হাতটা বাঁকিয়ে ধরে বলল, ‘আর কখনও যেন আমার আগুণমনিকে বিরক্ত করতে না দেখি তোকে। দেখলে কিন্তু তোর ডান হাতটা আর থাকবে না। ভেঙ্গে তোর বাম হাতে ধরিয়ে দেব। মনে থাকে যেন।’

বহ্নি রাফির এমন উগ্র আচরণে কিছুটা মিইয়ে গেল। কাঁপতে শুরু করেছে সে। অতল ওর কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি আছি তো, আগুনমণি। তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?’

বহ্নি সহসা অতলকে জড়িয়ে ধরল। মৃদু শব্দে কাঁদতে লাগল। অতল তাকে ধরল না। কেমন যেন সংকোচ লাগছে তার। এদিকে বহ্নির কান্না বেড়েই চলেছে। কান্না ভেজা কণ্ঠে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে আর কখনও যাবে না তো?’

অতল কোনোকিছু না ভেবেই বলল, ‘কক্ষণো যাব না।’

‘প্রমিস করো।’ কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, বহ্নি ।

অতল বহ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাচ্চাদের মতো জেদ করছিস কেন?’

‘তুমি প্রমিস করবে না?’ বহ্নি অসহায় কণ্ঠে বলল।

‘আচ্ছা, প্রমিস।’ অতল পরাস্ত হয়ে বলল।

‘এই প্রমিসের কথা কখনও ভুলে যেও না। তাহলে কিন্তু…!’ বহ্নি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অতলকে।

‘তাহলে কিন্তু কি?’ অতল পাল্টা প্রশ্ন করল। বহ্নি নিরুত্তর। অবশেষে সমস্ত সংকোচ ফেলে অতল বহ্নিকে জড়িয়ে ধরল।

ছোঁয়া দূর থেকেই পুরো ঘটনাটা দেখল। তার এতদিনের সন্দেহ সত্যি হয়ে গেছে। এখন শুধু আর একটা স্টেপ বাকি এই সন্দেহ পুরোপুরি সত্যি কি না তা বোঝার জন্য।
___________________

ছোঁয়া আর শিহরণ ওয়েটিং রুমে বসেছিল। শিহরণ তার পাশে বসে বিড়বিড় করে বলছে, ‘তোমার হঠাৎ সাইকিয়াট্রিস্ট এর প্রয়োজন পড়ল কেন?’

‘আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই না এসে উপায় ছিল না।’ ছোঁয়া দুষ্টুমির স্বরে বলল।

শিহরণ নড়ে চড়ে বসল। ছোঁয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ছোঁয়া, তুমি এসব কী বলছ? তোমার কী হয়েছে আমাকে বলো? আমার কিন্তু খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’

‘আমি ঠিক জানি না আমার কী হয়েছে? কিন্তু কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছে।’

শিহরণ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘এক্ষুণি ভেতরে চলো। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তোমার কী হয়েছে আমার এক্ষুণি জানতে হবে।’

‘একদম চুপচাপ বসে থাকো। আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি একটা কাজে এসেছি। তোমার আসাটাও জরুরী ছিল তাই তোমাকেও সাথে আনলাম।’

ছোঁয়ার কথা শুনে শিহরণ আর কথা বাড়াল না। কিছুক্ষণ পরে ছোঁয়ার ডাক পড়তেই সে শিহরণকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল।

ছোঁয়া আর শিহরণকে দেখে প্রশস্ত হেসে ডাক্তার ইলিয়ানা বলল, ‘কেমন আছ তোমরা?’

‘পাগলকে নিয়ে আর কতটুকুই বা ভালো থাকা যায়?’ ছোঁয়ার ত্যাড়ছা উত্তর।

শিহরণ ভ্রু কুঁচকে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘কে পাগল?’

‘কে আবার?’ পাল্টা প্লশ্ন ছোঁয়ার।

‘আমি মোটেই পাগল না। পাগলামি তুমি করছ আজ এক সপ্তাহ যাবৎ। তোমার পাগলামির কারণে আমার ঠিকমতো ঘুম হয় না। সারারাত তোমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি।’ শিহরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল।

‘তুমি আমার চিন্তায় ঘুমাতে পারছ না?’ ছোঁয়া বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘প্রতিদিন তাহলে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয় কেন যদি তুমি জেগেই থাকো?’

‘ভোরের দিকে দু’চোখের পাতা একটু এক হয় ওটাই আরকি।’ শিহরণ নিজের সাফাই গাইতে যেন বদ্ধপরিকর।

ছোঁয়া আর শিহরণের এমন বাচ্চামো দেখে ইলিয়ানা পেপার ওয়েটটা টেবিলের উপরে সজোরে বাড়ি দিয়ে দু’জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘কাম টু দ্যা পয়েন্ট। ঝগড়া বাসায় গিয়ে করিও। এখন আমার কথা শুনো।’

ছোঁয়া আর শিহরণ দু’জনেই ভীষণ লজ্জা পেল। একদম মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় ইলিয়ানার দিকে তাকিয়ে দুজনেই সমস্বরে বলল, ‘শুনছি, আমরা।’

ইলিয়ানা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ছোঁয়া তোমার সন্দেহ ঠিক ছিল। আমি তোমার দেওয়া সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এটাই বুঝেছি যে অতল মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকার কারণেই সে তার নিজের অনুভূতি ধরতে পারেনি। আর তোমার প্রতি থাকা সিমপ্যাথিকে বা সমবেদনাকে সে ভালোবাসা বলে ভুল করেছিল।’

শিহরণ অবাক হয়ে বলল, ‘ছোঁয়া, তুমি অতলের ব্যাপারে জানতে এখানে এসেছ?’

ছোঁয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। বলল, ‘তোমার বারবার গিল্টি ফিলিংস দেখতে আমার ভালো লাগছিল না। এই ব্যাপারে আমি আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলাম তবুও ইলির কাছে আসার কারণ হলো ইলির কথা তুমি বিশ্বাস করতে বাধ্য কারণ সে এই শহরের একজন বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্ট যে কি না পেশেন্টের সাথে কথা না বলেও শুধুমাত্র তথ্যের উপর নির্ভর করেই একজন মানুষের মানসিক দিকের সম্পূর্ণ ব্যখ্যা করতে পারে।’

ছোঁয়া থামল। শিহরণের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সে। শিহরণ নিরুত্তর । চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ছোঁয়া পুনরায় বলতে শুরু করল,
‘তোমার বন্ধু রেহানকেও তো ইলিই ঠিক করেছে। এটা কি ভুলে গেছ শিহরণ?’

শিহরণ এবারও কিছু বলল না। সে যেন অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছে। তাই ছোঁয়া পুনরায় বলল, ‘শিহরণ, তোমার কি মনে নেই রেহান কী পরিমাণ বদ্ধ উন্মাদ ছিল? এই ইলিই কিন্তু ওকে বাগে এনেছে। আজ ওকে দেখ কেমন শান্ত হয়ে গেছে। ইলিকে কতোটা ভালোবাসে।’

রেহানকে বদ্ধ উন্মাদ বলাতে ইলির যেন গায়ে লাগল। সে বলল, ‘ছোঁয়া, রেহান উন্মাদ নয়। তার একটু ভালোবাসার দরকার ছিল শুধু।’

ছোঁয়া স্মিত হেসে বলল, ‘এখনও সে উন্মাদ।’

‘ছোঁয়া!’ ইলিয়ানা খানিকটা রেগে উঠল।

‘রেগে যাচ্ছ কেন? আগে তো উন্মাদ ছিলই এখন তোমার ভালোবাসার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে।’ ছোঁয়া ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল।

ছোঁয়ার কথায় হাসল ইলিয়ানা। শিহরণ ও এবার স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। ইলিয়ানা যখন ছোঁয়া আর শিহরণের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ঠিক তখনই কোনো প্রকার নক না করেই রেহান ঢুকে পড়ল। তেজী গলায় বলল, ‘তুমি আমার ফোন ধরছ না কেন, ইলি? আমার তোমাকে নিয়ে কতোটা দুশ্চিন্তা হয় জানো না তুমি?’

ইলিয়ানা লজ্জা পেল রেহানের এমন কাণ্ডে। রেহানকে দেখে শিহরণ উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।।বলল, ‘সিমস্ ইউ আর ম্যাডলি ইন লাভ উইথ ইলি।’

‘ইউ সিমস্ টু। তারপর ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে রেহান প্রশ্ন করল,’রাইট ছোঁয়া?’

ছোঁয়া হাসল। রেহান আর একটুও দেরি করল না। ইলিয়ানার পাশের চেয়ারটাতে বসেই তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘আর কখনও আমাকে এভাবে অপেক্ষা করাবে না। নয়তো এর জন্য শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।’ এটুকু বলেই সে টুক করে চুমু খেল ইলিয়ানার অধর যুগলে।

ছোঁয়া আর শিহরণ তৎক্ষণাৎ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইলিয়ানা লজ্জায় ছোঁয়া আর শিহরণের দিকে তাকাতেই পারছে না। তাই দেখে রেহান বলল, ‘দে আর লাভ বার্ডস টু, ইলি। তুমি এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন?’

ছোঁয়া কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রেহান যে ইলিয়ানাকে নিয়ে মারাত্মক রকমের পজেসিভ তা তাদের অজানা নয়। তবুও সবার সামনে কিস করার ব্যাপারটা সত্যিই কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকে তার কাছে। শিহরণ ছোঁয়ার কোল থেকে তার হাতটা নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলল, ‘আমি ভাবছি আমি রেহানের কাছ থেকে ট্রেনিং নিব।’

ছোঁয়া চকিতে তাকাল শিহরণের দিকে। বলল, ‘কিসের ট্রেনিং?’

শিহরণ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, ‘হাউ টু কিস পাবলিকলি।’

রেহান বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এটা মোটেই কোনো পাবলিক প্লেস নয়। আর আমার ওয়াইফকে আমি যেখানে খুশি সেখানেই কিস করতে পারি। তাই নয় কি?’

শিহরণ রেহানের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘অফ কোর্স ব্রো। আই ডোন্ট হ্যাভ এনি অবজেকশন এট অল।’ কিন্তু পরক্ষণেই বিড়বিড় করে বলল, ‘কিন্তু এই কাজটা আমি করলে ছোঁয়া আমার সাথে মৌনব্রত পালন তো করবেই পাশাপাশি আমার আস্ত রাখবে না।’

ছোঁয়া সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে কিছু বললে?’

শিহরণ ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে বলল, ‘বললেই কি তুমি শুনবে না-কি?’ ছোঁয়ার চোখ রাঙানো দেখে শিহরণ বলল, ‘না মানে তেমন কিছু না। আসলে রেহানের কথা বলছিলাম। দেখছ না কেমন ভদ্র হয়ে গেছে। আর ইলিয়ানা তো রেহানের সব কথা শুনে। রেহান সত্যিই খুব লাকি।’

‘হুম।’ ছোট্ট করে জবাব দিল ছোঁয়া ।

রেহান চকিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়া দিয়ে বলল, ‘ওকে ইউ টু ক্যান গো নাউ। আই ওয়ান্ট ইলি টু গো উইথ মি, রাইট নাও।’

___________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪২

কফিশপে বসে অতলের জন্য অপেক্ষা করছে ছোঁয়া। ছেলেটাকে বলেছে ঠিক বিকাল চারটায় আসার জন্য। ছোঁয়া কফি শপে অপেক্ষা করছে প্রায় বিশ মিনিট হতে চলল কিন্তু অতলের দেখা এখনও মেলেনি। অতলের দেরি দেখে ছোঁয়া ওয়েটারকে ডেকে এক কাপ কফি অর্ডার করেছিল। সেই কফিটাও শেষ হয়ে গেছে। তবুও অতলের দেখা মিলছে না। ছোঁয়া অতলের নাম্বারে কল করার জন্য নিজের মোবাইলটা বের করল। নাম্বার ডায়াল করতে যাবে ঠিক তখনই ছোঁয়া শুনতে পেল অপরাধীর সুরে বলা একটা কণ্ঠস্বর, ‘স্যরি, জ্যামের কারণে দেরি হয়ে গেল।আমাকেই কল করছ তাই না?’

ছোঁয়া মোবাইল থেকে মুখ তুলে তাকাল। অতলকে দেখে প্রশস্ত হেসে বলল, ‘ফাইনালি তোমার দেখা মিলল তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম আজ দেখা না করেই আমাকে চলে যেতে হবে। এর পর আবার এপয়েন্টমেন্ট নিতে হতো। হাজার হোক ব্যস্ত মানুষ বলে কথা।’

ছোঁয়ার খোঁচাটা ধরতে পেরে অতল বলল, ‘বাহ্! এই গুণটা কবে অর্জন করলে?’

ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ‘একদম বেপরোয়া হয়ে গেছ।’ অতলকে পাল্টা আক্রমণ করে বলল, ‘এত্ত পরিবর্তন আর দারুণ সব গুণ তুমি যেভাবে অর্জন করলে?’

‘আই স্যারেন্ডার।’ অতল দু’হাত উপরে তুলে আত্ম সমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার পরিবর্তনের চাইতেও তোমার পরিবর্তন বেশি স্ট্রং।’ কথাটা বলেই অতল মাথা ঝাঁকাল। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে চশমাটা ঠিক করে আবারও বলল, ‘কী যেন বলবে বলেছিলে?’

‘কথা তো বলবই। আগে বলো কেমন ছিলে?’

‘আমি কখনোই খারাপ থাকি না। তুমি?’

‘আমি সবসময় ভালো থাকাদের দলে।’

‘হুম।’ অতল খাবার অর্ডার দেবার জন্য ওয়েটারকে ডেকে ছোঁয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তা তো তোমাকে দেখেই বেশ বুঝতে পারছি। যাইহোক, কী খাবে বলো?’

‘আমার কিছু লাগবে না। আমি তো মাত্র কফি শেষ করলাম । তোমার জন্য অর্ডার করো।’

‘খাবে না বললেই কি হবে? কিছু তো খেতেই হবে।’ অতল স্যুপ আর কফি অর্ডার দিয়ে ছোঁয়ার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল।

‘এবার বলো কী বলতে তলব পাঠিয়েছ?’ স্মিতহাস্যে প্রশ্ন করল, অতল।

ছোঁয়া অতলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘চশমাতে কিন্তু তোমাকে বেশ মানিয়েছে।’

অতল মৃদু হাসল। বলল, ‘হুম, সবাই বলে।’

কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে ছোঁয়া বলতে শুরু করল, আমি এখন তোমাকে যা বলতে যাচ্ছি তা তোমার কাছে উদ্ভট মনে হতে পারে। কিংবা অন্যকিছুও তুমি মনে করতে পারো। তবে তোমার কাছে একটাই অনুরোধ আমার সম্পূর্ণ কথা শুনবে তুমি।’

অতল এক মুহূর্তের জন্য কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

ছোঁয়া ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি কি একবার চোখ বন্ধ করবে?’

অতল ভ্রু কুঁচকাল। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘চোখ বন্ধ করব কেন?’

ছোঁয়া বিরক্ত গলায় বলল, ‘আরে বাবা করোই না একবার।’

অতল দ্বিধান্বিত হয়ে চোখ বন্ধ করল। ধৈর্যহীন হয়ে প্রশ্ন করল, ‘হয়েছে?’ সাথে সাথেই আবার চোখ খুলে ফেলল।

ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এত অধৈর্য কেন তুমি? চোখ বন্ধ করতে বলেছি যখন করো।’ অতলকে সতর্ক করে বলল, ‘আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।’

উপায়ান্তর খুঁজে না পেয়ে অতলকে আবারও চোখ বন্ধ করতে হলো। ছোঁয়া বলল, ‘কাকে দেখছ?’

‘চোখ বন্ধ করলে কি কেউ দেখতে পায়?’

‘উফফো! তুমি তো দেখছি মারাত্মক ঘাড়ত্যাড়া হয়ে গেছ। তুমি একটু স্থির হয়ে বসে বন্ধ চোখের পাতায় প্রথমেই কার ছবি ভেসে আসছে তা দেখ।’ এক নাগাড়ে কথাটা বলে থামল ছোঁয়া।

অতল বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। ছোঁয়া ঠিক কী করতে চাইছে তা সে একটুও বুঝতে পারছে না।

নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থেকে উদাস গলায় বলল, ‘আমি কাউকে দেখছি না, ছোঁয়া।’

ছোঁয়া দ্বিগুণ জোর কণ্ঠে ঢেলে বলল, ‘তুমি অবশ্যই দেখবে।’ পরক্ষণেই অনুনয় করার ভঙ্গিতে বলল, ‘ প্লিজ একবার ট্রাই করো।’

‘ওকে।’ অতল মনোযোগ দিল। সাথে সাথেই তার চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো সোনালি পাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিত এক তরুণী। যে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তরুণীর চেহারা ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। চেহারা স্পষ্ট হতেই অতল ঝট করে চোখ খুলে ফেলল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল । বিড়বিড় করে বলতে থাকল, ‘এটা কী করে হলো? আমি তো কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না। এটা সম্ভব নয়। কোনোভাবেই নয়।’

ছোঁয়া এবার মুচকি হাসল। ভ্রু উঁচিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে অতলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কার চেহারা দেখলে?’

অতল জবাবে তৎক্ষণাৎ বলল, ‘কারো না। আমি কাউকে দেখিনি।’

ছোঁয়া যেন নাছোড়বান্দা হবার পণ করেই এসেছে। সে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আমি জানি তুমি কাকে দেখেছ। বিশ্বাস করো অতল, এই মুহূর্তে তুমি যাকে দেখেছ, সেই মানুষটাকেই তুমি ভালোবাসতে, ভালোবাসো আর আজীবন ভালোবাসবে।’

ছোঁয়ার কথা শুনে অতলকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। এমন একটা ব্যাপার কী করে হতে পারে সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না।

ছোঁয়া একটু দম নিল। তারপর বলল, ‘আমার প্রতি তোমার যে ফিলিংসটা ছিল সেটা কখনোই ভালোবাসা ছিল না। সেটা ছিল সিমপ্যাথি। অর্থাৎ সমবেদনা। এর পেছনেও অবশ্যই যুক্তি আছে।’

কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ছোঁয়া পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘ছোটোবেলায় তোমার আর আমার অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। আমরা দুজনেই ছিলাম ভালোবাসার কাঙ্গাল। নিজেদের পরিবারের দিক থেকে আমরা দুজনেই ছিলাম দুঃখী। অবশ্য তোমার চেয়ে আমি একটু বেশি দুঃখী ছিলাম। কারণ আমার তো আপন বলতে কেউ ছিল না। সেদিক থেকে তোমার মা আর ছোটোবোন তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। অথচ সেই ভালোবাসার চাইতে দ্বিগুণ কষ্ট তুমি তোমার বাবা আর ভাইয়ের কাছ থেকে পেতে। তাই তুমি যেই ভালোবাসা পেতে তা হয়ে যেত ম্লান। যে কারণে তুমি নিজেকে দুঃখী ভাবতে সবসময়।
আর আমাদের স্কুলে সব থেকে অসহায় ছিলাম আমি। দু-একজন ছাড়া সবাই আমাকে নিয়ে উপহাস করতো। এতে তুমি ব্যথিত হতে। নিজের কষ্টের কারণে তুমি আমার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারতে। যেটাকে তুমি ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিলে। কিন্তু তোমার ভালোবাসা ছিল অন্য কেউ; যার উপর তুমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে, ছোটো বড়ো বিপদে অথবা কারণে-অকারণে ছুটে যেতে তার কাছে। আমি জানি এখন তুমি তার মুখটাই দেখেছ।’ অবশেষে ছোঁয়া অতলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘কী! আমি ঠিক বললাম তো?’

অতলের চোখের দৃষ্টিতে বিভ্রম। ভেতরটাতে এক অন্যরকম তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। নিজের রাগটাকে সে বহুকষ্টে দমিয়ে রেখেছে। দমফাটা চিৎকার দিয়ে তার বলতে ইচ্ছে করছে ছোঁয়ার সব কথা ভুল। সব ধারণা ভুল। এভাবেই ছোঁয়া হুট করে এসে তার সমস্ত কিছু ভুল প্রমাণ করে দিতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে অতল খেয়াল করল সে ছোঁয়াকে কিছুই বলতে পারছে না।

নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে অতল একগুঁয়ে উত্তর দিয়ে বলল, ‘আমি তোমার বলা একটা কথাও বিশ্বাস করি না। এই সবকিছু বানোয়াট। মিথ্যা বলছ তুমি।’

প্রত্যুত্তরে ছোঁয়া হাসল। তা দেখে অতলের রাগ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করল। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘এভাবে হাসছ কেন?’

অতলের চেঁচানোর কারণে রেস্টুরেন্টে থাকা মানুষগুলো তাদের দিকে তাকাচ্ছে বারংবার। তা দেখে অতলের মেজাজটা আরও বেশি বিগড়ে গেল।

ছোঁয়া শীতল গলায় বলল, ‘এতটা বেপরোয়া হয়ো না অতল। তুমি এমন ছিলে না। এটা তুমি নও। আর কতো মুখোশ পরে থাকবে বলো?’

‘আমাকে যেতে হবে। তোমার কথাগুলো মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ এটুকু বলেই অতল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

ছোঁয়া হিম শীতল গলায় বলল, ‘আমার কথা শেষ হয়নি এখনও, অতল। আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলে সেটার কথা তোমার মনে আছে?’

অতল পুনরায় চেয়ারে বসল। বলল, ‘হুম।’

‘ওই চিঠিটা তুমি নিজে লেখোনি। লিখার চেষ্টা করেছিলে কিন্তু পারোনি। ব্যর্থ হয়েছিলে। অথচ সেই কথাগুলো অনায়াসেই অন্য একজনকে বলেছিলে। ঠিক বললাম তো?’

অতল ভাবার চেষ্টা করল। মনে পড়ে গেল তার সেদিনের পুরো ঘটনা। এই মুহূর্তে অতল অনুধাবন করতে পারছে যেই কথাগুলো অনায়াসেই সে বহ্নিকে বলতে পেরেছিল সেই একই কথা সে ছোঁয়াকে শত চেষ্টা করেও পারেনি। দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে তার। এটা কী করে হতে পারে! এই কথাটাই তার মাথায় আসছে না।

অতল আচমকা এলোমেলোভাবে বলল, ‘না, এটা কখনোই হতেই পারে না।’

‘এটাই হয়েছে।’ প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘কখনোই না।’ অতল ছোঁয়ার দিকে আঙ্গুল তুলে তাকে অভিযোগ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি নিজেকে সেইভ করার জন্য আমাকে আকাশ-পাতাল বুজাচ্ছ! তাই না?’ ছোঁয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করেই অতল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে পুনরায় বলল, ‘ভয় পেও না। আমি তোমাদের মধ্যে আসব না।’

ছোঁয়া এবার প্রশস্ত হাসল। প্রাণখোলা সেই হাসি। সেই হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখেই বলল, ‘আমাদের মধ্যে তো কখনোই কেউ ছিল না, অতল।’

‘তাহলে আমাকে এসব বলার মানে কি?’ দ্বিধান্বিত দেখাল অতলকে।

‘সেদিন রাফি যখন বহ্নিকে স্পর্শ করেছিল তখন তোমাকে দেখতে অমন লাগছিল কেন? আর যখন সে তার সাথে অসভ্যতা করেছিল তখন তাকে ওভাবে মেরেছিলে কেন?’

‘কী!’ অতল ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ‘ওই বেয়াদপ আমার আগুনমণির সাথে অসভ্যতা করবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব। এটাই বলতে চাইছ তুমি?’

‘একদম না।’ ছোঁয়ার হাসি আরও প্রশস্ত হলো। বলল, ‘তোমার আগুনমাণির ক্ষতি তুমি থাকতে কখনোই হবে না এটা আমাকে নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই।’

‘তুমি কি বলতে চাইছ?’ অতল ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, ‘
বিনা অনুমতিতে ওকে স্পর্শ করবে কেন? আর ওর দৃষ্টিটা ছিল নোংরা। তাই আমি ওদের পিছু নিয়েছিলাম। শেষমেশ আমার আশঙ্কাই তো ঠিক হয়েছিল। ওর সাথে অসভ্যতা করছে আর তাই ওকে মেরেছি। ওর জায়গায় তুমি হলেও আমি এমনটাই করতাম। ইনফ্যাক্ট অন্য কোনো মেয়ে হলেও এমনটাই করতাম।’

‘ওকে ফাইন।’ ছোঁয়া পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘অনুষ্ঠানে তূর্ণ যখন ওর হাত ধরল তখন কেন তুমি তোমার হাত মুষ্টিবদ্ধ করলে?’

অতল চোখ বন্ধ করে বলল, ‘কীসব আবোল তাবোল বলছ?’

ছোঁয়া শান্ত কণ্ঠে অনুনয় করে বলল, ‘এডমিট ইট অতল। তুমি জানো আমি কী বলছি।’

‘না, আমি জানি না তুমি কী বলতে চাইছ।’

ছোঁয়া এবার বলেই ফেলল, ‘তুমি কেবল এবং কেবলই বহ্নিকে ভালোবাসো।’

অতল চিৎকার করে বলল, ‘না।’

‘হ্যাঁ।’ ছোঁয়া অতলকে আশ্বস্ত করল।

‘অবশ্যই না। তুমি আসলে ভয় পাচ্ছ। আমি যদি তোমার আর শিহরণের মাঝে এসে আবার কোনো ঝামেলা করে বসি সেই জন্য।’

‘মোটেই না।’ ছোঁয়া আবারও প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘তুমি যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতে তবে তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে। কিন্তু তুমি তার কোনোটাই করোনি। ঢাকায় আসার পরেও তোমার কখনও মনে হয়নি আমার সাথে একবারের জন্যও দেখা করার কথা। অথচ আমরা কত কাছাকাছি ছিলাম। তুমি চাইলেই দেখা হয়ে যেত। সবচাইতে মজার ব্যাপার কি জানো? তুমি আমাকে বিগত দশ বছরে কখনও মনেও করোনি। অথচ শিহরণ আর বহ্নিকে তুমি ভুলতে পারোনি একটা মুহূর্তের জন্যেও।’

‘আমার কখনও দেখা করার ইচ্ছে হয়নি। তাই দেখা করিনি।’ অতল ভেবে দেখল, ছোঁয়ার বলা কথাগুলো আসলেই ঠিক কি না। অতীতের পাতা উল্টিয়ে সে ছোঁয়ার বলা কথাগুলোর সত্যতা ছাড়া আর কিছুই পেল না।

অতলকে নিশ্চুপ দেখে ছোঁয়া বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা সত্যি করে বলবে?’

অতল মাথা ঝাঁকাল। ছোঁয়া বলল, ‘বিগত দশ বছরে কার কথা তোমার সবচাইতে বেশি মনে পড়েছে?’

ছোঁয়ার প্রশ্নে স্তব্ধ হয়ে গেল অতল। এই প্রশ্নটার উত্তর তার জানা থাকলেও ছোঁয়ার ইঙ্গিত সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। এটা কীভাবে হতে পারে তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না!

ছোঁয়ার প্রশ্ন এড়াতে অতল বলল, ‘আমাকে যেতে হবে এখন।’

ছোঁয়া ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এখনও বুঝতে পারলে না! শীঘ্রই তুমি বুঝতে পারবে। যখনই বুঝতে পারো, এটাকে এডমিট করবে। মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না। শী লাভস ইউ মোর দ্যান এনিথিং।’

অতল আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্রুত পদক্ষেপ ফেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।

_________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৩

দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে বসে আছে অতল। পুরোপুরি অন্ধকার রুমটা। তানিয়া বার কয়েক ডাকলেও অতল সাড়া দেয়নি। তারপর অনেকক্ষণ যাবৎ দরজা ধাক্কাল তাতেও কোনো সুবিধা হলো না। আতল কোনো সাড়া শব্দ করেনি। শেষমেশ মেহেরুন নাহার এসে ডাকলে সে ঘুমিয়ে থাকার বাহানায় রুম থেকে বের হয়নি। তবে মাথার মধ্যে এখনও ছোঁয়ার বলা প্রতিটা কথা ঘুর্ণিপাকের মতো করে ঘুরপাক খাচ্ছে। কানের মধ্যে বেজে চলেছে কথাগুলো, ‘
তোমার ভালোবাসা ছিল অন্য কেউ; যার উপর তুমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে, ছোটো বড়ো বিপদে অথবা কারণে-অকারণে ছুটে যেতে তার কাছে। আমি জানি এখন তুমি তার মুখটাই দেখেছ।’

ছোঁয়ার কথা মনে পড়তেই অতল সাথে সাথে চোখ বন্ধ করল। গাঢ় কালো অন্ধকার। সেই অন্ধকার ভেদ করে পূর্বের সেই চেহারা ক্রমশই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। সেই মুখাবয়বের দর্শনমাত্র অতল ঝট করে চোখ খুলে ফেলল। তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। হৃদপিন্ড যেন অস্বাভাবিক গতিতে দৌড়াচ্ছে। সাথে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোও ভাবনাতে মশগুল হলো নিবিষ্ট চিত্তে।

বারবার; অনেকবার ভেবেও অতল কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না এটা কীভাবে সম্ভব! অতল আবারও চোখ বন্ধ করল। বন্ধ চোখের পাতায় এবারও প্রথমেই ভেসে উঠল তার চিরচেনা সেই মুখটা। এক এক করে অতলের মনে পড়ছে বিগত দশ বছরে অতল একটিবারের জন্যেও বহ্নির কথা ভুলেনি। প্রতিদিন তার কথা মনে পড়েছে। যখনই কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে তার জীবনে তখনই মনে হয়েছিল বহ্নির সাথে বিষয়টা শেয়ার করতে পারলে তার কষ্টটা কমে যেত। কিন্তু শিহরণের প্রতি জমানো অভিমানের কারণে তা কখনোই হয়ে উঠেনি। এখন তার কাছে স্পষ্ট বহ্নি তার ভরসার স্থল, নির্ভরতার এক অনন্য উৎস। কিন্তু ভালোবাসা কী করে সম্ভব! সে বহ্নিকে কী করে ভালোবাসতে পারে। কিন্তু এটা হয়ে গেছে। এবার কী করবে সে? সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণেই তো শিহরণ আর তার বন্ধুত্ব ভেঙ্গে গিয়েছিল। এখন আবার যদি এমন হয় তাহলে সে তো আবারও সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে।

অতলের হাঁসফাঁস লাগছে। ভালো যখন বাসলোই তার অবাধ্য বেয়াড়া মনটা তা ভালোবাসার জন্য আর কাউকে পেল না। বন্ধুর বোনের প্রেমেই পড়তে হলো। এটা ভাবতেই নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছে।

এবার তার ছোঁয়ার বলা শেষ কথাটা মনে পড়ল, ‘শী লাভস্ ইউ মোর দ্যান এনিথিং।’

তার মানে বহ্নিও তাকে! উফ্! অতল আর ভাবতেই পারছে না। সম্পর্কগুলো এত জটিল কেন? কেন এত অসহ্য লাগছে তার সবকিছু। অতলের এবার এক এক করে সবকিছু মনে হতে থাকল। আয়মানও এই কথাটা ওকে বলেছে। কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি। এবার সম্পূর্ণ বিষয়টা অতলের কাছে পরিস্কার। কিন্তু শিহরণ কি এই বিষয়টা মেনে নিবে? অতল ভাবল অনেকক্ষণ। সমস্ত ভাবনা চিন্তার পরে সে ভাবল সে এবার কোনোভাবেই তার ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। কোনোভাবেই না। এই বিষয়টা একজনকে জানানো খুব জরুরি বলে মনে করল সে। সাথে সাথে তার নাম্বারটা ডায়াল করল। ওপাশের মানুষটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অতল বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছিলে।’

সাথে সাথেই কলটা কেটে দিল সে। এবার তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করা দরকার। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল অতল। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর বেরিয়ে পড়ল। মেহেরুন নাহার পেছন থেকে ডাকলেও সে জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়ে গেল।

চারিদিকে স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। অতল উদাস চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে বসে আছে বহ্নি। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। আধাঘন্টা যাবৎ নদীর কোল ঘেসে এ ছায়াশীতল জায়গাটাতে বসে আছে তারা। এই আধাঘন্টার মধ্যে অতল একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। বহ্নি কয়েকবার প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পায়নি। তাই শেষমেশ সে নিজেও হাল ছেড়ে দিয়ে অতলের পাশে বসে ছিল। বারকয়েক চোরা চোখে তাকাল অতলের দিকে। অতল এখনও নির্বিকার। কী ভাবছে তা বোঝার উপায় নেই। অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল বহ্নির। হঠাৎ অতলের চোখে চোখ পড়তে তার মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। অতলের চোখ দুটো কেমন যেন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। বহ্নির ভয় হতে লাগল। সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’

অতল এবার সরাসরি চোখ তুলে চাইল বহ্নির দিকে। এই দৃষ্টি বহ্নির অচেনা। তার কেমন যেন অদ্ভুত লাগল । সে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল, ‘এমনভাবে কী দেখছ?’

‘তোকে।’ অতলের অকপট স্বীকারোক্তি।

অতলের এমন কথায় বহ্নি হেসে ফেলল। খানিকটা কৌতুক মেশানো গলায় প্রশ্ন করল, ‘আমাকে কি আজ প্রথম দেখছ?’

‘আচ্ছা, তোর কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?’

‘বয়ফ্রেন্ড?’ বহ্নি চমকে উঠল, ‘হঠাৎ বয়ফ্রেন্ডের কথা কেন আসছে?’

‘রাফিকে বলতে শুনলাম সে নাকি তোকেই বিয়ে করবে। তাই জানতে চাইছি।’ অতল দিকভ্রান্ত হয়ে এলোমেলো প্রশ্ন করতে শুরু করল।

বহ্নির চোখ জ্বলে উঠল। বসা থেকে দুম করে উঠে পড়ে বলল, ‘ওই বেয়াদপ ছেলেটার নাম না নিলেই কি হতো না।’

‘তাহলে তুই কি তূর্ণকে ভালোবাসিস?’ এবারও অতল অপ্রাসঙ্গিক কথায় মত্ত হলো।

‘তূর্ণ?’ বহ্নি চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ও শুধুই আমার বন্ধু। এর বেশি কিছু না।’

‘তাহলে তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?’

‘হ্যাঁ!’ বহ্নি ভীষণভাবে চমকে তাকাল অতলের দিকে। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘না, মানে কী বলছ এসব?’

‘হ্যাঁ না-কি না?’ অতল ভ্রু কুঁচকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল বহ্নির দিকে। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘সত্যিটা বলবি।’

বহ্নি সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলল। তার ঠোঁট কাঁপছে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠল মুহূর্তেই। অতল বহ্নির হাত ধরে তাকে তার পাশে বসাল। একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘প্লিজ, আগুনমণি। আমি না খুব হাঁপিয়ে উঠেছি। আর পারছি না। সত্যিটা জানা আমার জন্য খুব দরকার।’

বহ্নি উপর নিচে মাথা দুলাল। বলল, ‘এটা তুমি কেন বুঝতে পারোনি?’

‘ভালোবাসা হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে জটিল বিষয় এই বিষয়টা বুঝে নেবার আগে জেনে নেওয়াটা অধিক জরুরি।’ বিজ্ঞের মতো করে বলল, অতল।

‘তাহলে বলো তুমি কাকে ভালোবাস?’

ঠিক তখনই অতলের মোবাইলটা বেজে উঠল। মোবাইল হাতে নিতেই তৃণার নাম্বারটা দেখতে পেল অতল। অতল কলটা কেটে দিল। পরক্ষণেই আবার কল আসলো। এবার অতল মোবাইলটাই সুইচড অফ করে দিল। বহ্নি প্রশ্ন করল, ‘কে কল করেছে?’

‘বাদ দে ওসব। জরুরী কল না।’

‘তোমার গার্লফ্রেন্ড নয় তো?’

অতল বলল, ‘আজ থেকে আমার এক জনই গার্লফ্রেন্ড আর সে আমার সামনে বসে আছে। তাকে ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই এখন থেকে আমার জীবনে।’

‘কথাগুলো মনে না রাখলে কিন্তু তোমার খবর আছে।’ গম্ভীর গলায় সতর্ক করতে চাইল বহ্নি।

‘মারবি না-কি?’ খানিকটা কৌতুকের ছলে বলল অতল।

‘প্রয়োজন হলে তাই করব।’ স্মিত হাসল বহ্নি।

‘বাব্বাহ! তাহলে তো বোধহয় আমি ভুল করলাম।’

‘ভুল যখন করেছ তখন ভুলের মাশুল তো দিতেই হবে।’

পরক্ষণেই অতল খুব সিরিয়াস হয়ে বহ্নির দিকে ঘুরে বসে তাকে প্রশ্ন করল, ‘শিহরণ কীভাবে নিবে ব্যাপারটা?’

‘ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমি সব সামলে নিব।’ বহ্নি অতলকে আশ্বাস দিল।

‘সামলে তো নিতেই হবে। আমি কিন্তু কখনোই তোর পিছু ছাড়ব না। মরে গেলেও ছাড়ব না। কথাটা যেন মনে থাকে।’

বহ্নি অতলের কথা শুনে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘মরার কথা আর একবার বলেছ তো তোমার সাথে আমি আর কখনও কথাই বলব না।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আর কখনও বলব না। কিন্তু যদি কখনও আমি না থাকি তবে কি তুই আমাকে ভুলে যাবি?’ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল অতল।

‘ভুলে যাবার জন্য দশটা বছর কি পর্যাপ্ত ছিল না?’

অতল বলল, ‘তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। ভুলে যাসনি। তুই ভুলবিও না। আচ্ছা, যদি আমি তোকে ভুলে যাই তো?’

বহ্নি জহুরি চোখে তাকাল অতলের দিকে। যেন দৃষ্টি দিয়ে অতলের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছে। পরক্ষণেই সহাস্যে বলল, ‘তোমাকে আমি ভুলতে দিলে তো ভুলবে।’

বিকেলের আলোটা মরে এসেছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে ধরণীর বুকে। পশ্চিম দিগন্তে লাল রক্তিম আলোর ছটা একসময় আকাশের বুকে মিলিয়ে গিয়ে ঝুপ করেই নেমে পড়বে রাতের অন্ধকার। পাখির ঝাঁক একসাথে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নীড়ে ফেরার তাড়া করছে। বহ্নি আর অতল দুজনেই হাতে হাত রেখে সেই পার্থিব মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের মাঝে নিজেদের হারাল। এক অপার্থিব আনন্দে ভরে গেছে বহ্নির মন।
____________________

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে রাদিদ। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। মনের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছে। কিছুটা আফসোসও হচ্ছে বৈ কি! কেন যে সে নিজের শহর ছেড়ে এই শহরে এলো সেই চিন্তাটাই মনের মধ্যে বারবার ঝড় তুলছে। বহ্নি অতলকে ভালোবাসে এই কথাটা তার অজানা ছিল না। কিন্তু তারপরেও মেয়েটাকে দেখলে তার মনে জমিয়ে রাখা ভালোবাসার অনুভূতিগুলো আবারও দুর্বার গতিতে জেগে উঠে, পূর্ণতা পাবার আকাঙ্ক্ষায়। সবচাইতে কষ্টের ছিল দশ বছর পরে আবারও অতলের সাথে বহ্নিকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখাটা। কী ভীষণ কষ্ট হয়েছিল রাদিদের তা কেবল সেই জানে!

‘আমি হেরে গেলাম বাজিতে। তোমার কথাই ঠিক হলো শেষমেশ।’

নীরার বিষণ্ণ কণ্ঠ শুনে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল রাদিদের। ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে নীরা। অপরাধবোধ তার চোখে স্পষ্ট দৃশ্যমান।

রাদিদ হাসল। নিষ্প্রাণ সেই হাসি। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘এখানে হেরে যাবার মতো কিছু হয়নি। সত্যটা কেবল দেখেছিস।’ রাদিদ প্রাণবন্ত হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘এখন তো আর আমাকে এই বিষয়টা নিয়ে খোঁচাতে পারবি না। এটাই ঢের বেশি।’

‘তোমার কষ্ট হচ্ছে না?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল নীরা।

‘কষ্ট হবে কেন পাগলি বোন আমার?’ রাদিদের পাল্টা প্রশ্ন ।

‘আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল বলল, নীরা।

‘তুই ভুল জানিস। ভালোবাসলেই পূর্ণতা পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি চাই বহ্নি ভালো থাকুক সেটা যেকোনো মূল্যেই হোক না কেন। আমার বিশ্বাস অতল ওকে ভালো রাখবে।’ হিমশীতল গলায় বলল, রাদিদ।

‘আর তোমার ভালো থাকার কি হবে?’

‘আমি তো কখনোই খারাপ ছিলাম না।’

‘মিথ্যা বলছ কেন?’

‘সত্যি বলছি।’

রাদিদ আবারও অন্তরীক্ষে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। মেঘলা আকাশ। ঘন কালো মেঘের ভেলা উড়ে যাচ্ছে আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সেই ঘন কালো মেঘ মন খারাপের চাদরে বারবার আলোকিত পূর্ণ চাঁদটাকে ঢেকে ফেলছে। কিন্তু পরক্ষণেই চাঁদটা আবারও মেঘের চাদর ভেদ করে উঁকি দিয়ে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।

ঘন কালো মেঘগুলোর ছুটোছুটি দেখে রাদিদের মনে হলো আজ তার মনের মতো আকাশেরও ভীষণ মন খারাপ। মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে ফেলবে আর সেই কষ্টগুলো টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটার আকারে ঝরে পড়বে আকাশের বুক থেকে। শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে রাদিদের শরীরটা। কিন্তু মনটা ভীষণ আনচান করছে; ভীষণ যত্নে মনের মধ্যে পুষে রাখা ভালোবাসা না পাবার কারণে। অথচ সেই ভালোবাসা পাবার আশা সে কখনোই করেনি। তবুও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে এমন? রাদিদের জানা নেই।

নীরা চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল রাদিদের পাশে। তার ইচ্ছে ছিল অনেককিছু বলার। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। তার কি-ই-বা বলার আছে। তাই নিশ্চুপ প্রস্থান করাটাই ভালো মনে করল।

মোবাইল বেজে উঠাতে রাদিদের ধ্যান ভাঙল। কল রিসিভ করতেই মায়ের উদ্বিগ্নতা আর ভালোবাসায় ভরা কণ্ঠে রাদিদের বিষণ্ন মনটা কিছুটা শান্ত হলো। মায়ের সাথে কথা বলার পরে রাদিদের মনের সমস্ত বিক্ষিপ্ত অনুভূতি কোনো এক অদৃশ্য কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হলো। তার কষ্টগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মা হয়তো এমনই প্রশান্তি প্রদানকারী এক শক্তির নাম। আর পরিবার হলো প্রতিটা মানুষের জন্য এক অন্যতম শক্তিশালী রক্ষাকবচ তুল্য এক অনন্য বন্ধনের নাম।

_________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৮

বহ্নি, তূর্ণ, সায়মা আর রিয়া আশ্রমের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল। আলোচনা শেষে বহ্নি তার বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই তোরা কি ভেতরে যাবি না-কি বাইরেই থাকবি?’

তূর্ণ, সায়মা আর রিয়া বাইরেই থাকবে বলার কারণে বহ্নি আশ্রমের ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। বহ্নি যখন একা একা ভেতরে ঢুকছিল। ঠিক তখন আরাভ গেটের ভেতর ঢুকলো। বহ্নিকে দেখেই ‘পুতুল’ বলে চিৎকার করতে করতে দিল ভোঁ দৌড়। বহ্নির কাছাকাছি এসে দু’হাঁটুর উপরে দুহাত রেখে দম নিল। তারপর বলল, ‘পুতুল! আমি যে তোমাকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না?’

বহ্নি আরাভের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। অপরাধীর সুরে বলল, ‘বিগ ব্রো! স্যরি। একদম শুনতে পাইনি। শুনলে কি আর আমার বিগ ব্রোকে অবহেলা করতে পারতাম?’

‘ঠিক আছে। এবারের মতো মাফ করলাম।’ আরাভ
মাফ করার ভঙ্গিতে ডান হাতটা উপরে তুলে বলল, ‘পুতুল! তোমার সাথে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’

‘বাব্বাহ! খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা! বহ্নি অবাক হবার ভান করে বলল, ‘তাহলে ভেতরে বসে কথা বলি?’

‘না। ভেতরে বলা যাবে না। ওখানে আমার প্রতিপক্ষ আছে।’ ভীষণ জরুরী গলায় বলল, আরাভ।

‘তোমার আবার প্রতিপক্ষও আছে না-কি?’ বহ্নি চূড়ান্ত অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

‘প্রতিপক্ষ কে সেটা জানতে পারলে আরও বেশি অবাক হবে।’ আরাভ দুঃখী গলায় টেনে টেনে বলল।

‘তাই না-কি?’ বহ্নি ভীষণ অবাক হবার ভান করে বলল, ‘কী সাংঘাতিক ব্যাপার! তা কে সে?’

‘কে আবার?’ রাজ্যের অনীহা কণ্ঠে ঢেলে বলল আরাভ, ‘শিহরণ ভাইয়া। ভাইয়াকে সাবধান করে দিও। আমি কিন্তু ভাইয়া কী করছে না করছে সব জানি।’

বহ্নি বিস্ময়াভূত হয়ে বলল, ‘শিহরণ ভাইয়া তোমার প্রতিপক্ষ!’ বহ্নি হাঁটা থামিয়ে আরাভের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তো কী করেছে শিহরণ ভাইয়া?’

‘পুতুল! আই থিংক তুমিও জানো। তাও বলছি। শিহরণ ভাইয়া ইদানিং আমার রোজের পেছনে ঘুরঘুর করছে। যেটা আমি কোনোভাবেই মানতে পারছি না।’
মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আরাভ।

‘ওকে, বিগ ব্রো। আমি মনে হয় ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। আচ্ছা তোমার রোজ কি ছোঁয়া আপু?’

আরাভ মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ‘ইয়েস, শী ইজ মাই লাভলি রোজ।’

বহ্নি অবিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘এবার বুঝতে পারলাম। কিন্তু তুমিই তো তাকে সাবধান করে দিতে পারো। আমার প্রয়োজন কেন হচ্ছে?’

‘সাবধান তো করেছি।’ আরাভ তার চেহারায় দুঃখী ভাব এনে ভীষণ হতাশ গলায় বলল, ‘কিন্তু আমার কথা শুনলে তো।’

‘আচ্ছা, আমি আল্টিমেটাম দিয়ে দিব।’

‘কড়াভাবে দিবে কিন্তু।’

বহ্নি আরাভের হাত ধরে বলল, ‘এবার ভেতরে চলো। আন্টি বকবে না একা একা চলে এসেছ যে?’

‘বলে এসেছি তো।’

‘তোমার তো বিকেলে আসার কথা। সকালে আসলে কেন?’

‘আমার রোজকে দেখতে।’

‘বাব্বাহ! এতটাই দেখতে মন চাইছিল তোমার?’

‘হুম। দেখতে তো সবসময় ইচ্ছে করে। আমার রোজ কী যে কিউট! তুমি তো দেখোনি। তোমারও খুব পছন্দ হবে। আমি নিশ্চিত।’

‘কে বলেছে আমি দেখিনি। আমি দেখেছি তো। আমার ভাবিকে আমি দেখব না তো কে দেখবে?’

‘ভাবি মানে?’ আরাভ কোমরে দু’হাত রেখে বহ্নির দিকে চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তার মানে তুমি কি কোনোভাবে শিহরণ ভাইয়ের পক্ষ নিচ্ছ?’

‘আরে না। আমি তো সব সময় তোমার পক্ষে।’

‘তাহলে ভাবি বলছ কেন?’

‘তুমি আমার বিগ ব্রো। তুমিই তো বলেছিলে তোমার রোজকে বিয়ে করবে। তাহলে আমার ভাবি হলো না?’

‘আচ্ছা, এবার বুঝেছি।’ আরাভ মিষ্টি হাসল।

ছোঁয়া বাচ্চাদের কস্টিউম রেডি করে দিচ্ছিল। আরাভ আর বহ্নি তার পাশে এসে বসল। আরাভকে দেখে ছোঁয়া বলল, ‘কেমন আছ বাবু?’

আরাভ মুখ গোমড়া করে বলল, ‘আমি কোনো বাবু নই। প্লিজ ডোন্ট কল মি দ্যাট।’

বহ্নি কৌতুক মেশানো গলায় বলল, ‘ছোঁয়া আপু! নিজের হবু বরকে কেউ বাবু ডাকে?’

‘ওকে, স্যরি আরাভ।’ ছোঁয়া মুখটা কাঁচুমাচু করে অপরাধীর গলায় বলল।

‘নেক্সট টাইম যেন এমন না হয়।’ আরাভ সতর্ক গলায় বলল।

ছোঁয়া আর বহ্নি দুজন মিলে আশ্রমের বাচ্চাদের কস্টিউম ঠিক করে দিল। আশ্রমের বাচ্চারা মিলে একটা নাটক মঞ্চায়ন করবে বলে সকলের মধ্যে চাপা আনন্দ বিরাজ করছে।

ছোঁয়াকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখে বহ্নি মৃদু হাসল। তার ভাইয়ের পছন্দ নিয়ে তার কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না। ছোঁয়াকে দেখে এই বিষয়ে সে আরও বেশি নিশ্চিত হলো। ছোঁয়া বহ্নিকে মুচকি হাসতে দেখে বলল, ‘বহ্নি! তোমার হাসি খুব মিষ্টি ।’

ছোঁয়ার কথা শুনে বহ্নি প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘হুম, তবে তোমার হাসির চাইতে কম মিষ্টি। কী ঠিক বললাম তো, বিগ ব্রো?’

আরাভ বহ্নির সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘আ’ম এগ্রি উয়িথ ইউ।’ তারপর বহ্নির কানে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘অ্যান্ড শী ইজ মাইন। আই উইল ম্যারি হার ওয়ান ডে।’

বহ্নি আরাভের কথা শুনে নিজের হাসি আটকাতে পারল না। আরাভ চোখ রাঙিয়ে তাকাল বহ্নির দিকে। বহ্নি হাসি আটকালো বহু কষ্টে। বলল, ‘স্যরি, ব্রো।’ এবার বহ্নিও আরাভের কানে নিজের মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কিন্তু বিগ ব্রো! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার রোজকে তুমি বিয়ে করার আগেই অন্য কেউ উঠিয়ে নিয়ে যাবে।’

আরাভ এবার গাল ফুলিয়ে বলল, ‘ইউ আর নট আ গুড ফ্রেন্ড এট অল।’

‘ওকে, স্যরি।’ বহ্নি আবারও বলল, ‘কিন্তু তুমি তো ছোঁয়া আপুর চাইতে অনেক ছোটো। তুমি বড়ো হতে হতে তার তো বিয়ে হয়ে যাবে।’

‘আমি একদমই ছোটো নয়।’ চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি এনে আরাভ বলল, ‘শুধু আম্মুই আমাকে বাবু বাবু বলে ডাকে।’ আরাভ এবার কোমরে হাতে রেখে বলল, ‘আচ্ছা, পুতুল! তুমি বলো তো আমি কি বাবু? আমি তো বড়ো হয়েছি। তাই না?’

বহ্নি ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল, ‘একদম। তুমি তো বড়ো বাবু।’

‘তুমিও আমাকে বাবু বলছ?’ চোখ বড়ো বড়ো করে ভ্রু উঁচিয়ে সাবধানী গলায় বলল, ‘আর একবার বাবু বলে ডাকলে তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব কিন্তু শেষ হয়ে যাবে!’

‘ওকে, স্যরি ব্রো।’ বহ্নি নিজের কান ধরে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করে বলল।

ছোঁয়া ওদের মধ্যেকার ফিসফিসানি শুনে বলল, ‘এত গোপন কথা কিসের? আমাকেও বলো। আমিও শুনি এত কীসের গোপন কথা চলছে তোমাদের মধ্যে।’

বহ্নি হেসে বলল, ‘আমার বিগ ব্রো বলছে যে তোমাকে আজ প্রিন্সেসের মতো লাগছে।’

‘তাই?’ ছোঁয়া আরাভের দিকে জিজ্ঞাসু চাউনিতে জানতে চাইল, ‘তোমার ফ্রেন্ড সত্যি বলছে?’

শিহরণ আচমকা এসে বলল, ‘একদম না। আজ তোমাকে রানীর মতো লাগছে। কার রানী সেটা নিশ্চয়ই বলার প্রয়োজন নেই?’

আরাভ উঠে শিহরণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কার আবার? আমার।’

‘উঁহু! একদম না।’ শিহরণ আরাভের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘এখানে রাজা এক জনই আছে। আর রানী কেবল রাজাদেরই থাকে। আর বাবুদের তো খেলতে খেলতেই দিন কাটে।’

আরাভ গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে ছোঁয়া বলল, ‘আমি কিন্ত জানি আমার রাজা কেবল এবং কেবল কেবলই আরাভ।’

ছোঁয়ার কথাতে আরাভের মুখে হাসি ফুটল। সাথে সাথে সবাই সমস্বরে হেসে উঠল।
___________________________________

চারিদিক চাকচিক্যময়। আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে পুরো প্রাঙ্গণ। স্টেজে আশ্রমের কয়েকজন বাচ্চা মিলে কোরাস গাইছে। শিহরণ, মোহনা আর ফাহমির সাথে কথা বলছে আশ্রমের পেছনে দাঁড়িয়ে। প্রিয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথাই বলছে না। শিহরণ ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল, ‘এখন নিশ্চয়ই খুব ভালো আছিস?’

প্রিয় আচমকা মুখ তুলে তাকাল শিহরণের দিকে। পরক্ষণেই চোখ নিচে নামিয়ে ফেলল। তার চোখ ভিজে এলো হুট করেই। ফাহমি শিহরণের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আজকের জন্য বাদ দে না ওসব।’

প্রিয় কী বলবে বুঝতে পারছে না! তার নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত মনে হচ্ছে এই অনুষ্ঠানে। তার পার্সে রাখা চিঠি কীভাবে শিহরণকে দিবে তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। কোনোরকমে বলল, ‘আ’ম রিয়েলি স্যরি, দোস্ত।’

শিহরণ হেসে উড়িয়ে দিল। বিদ্রূপাত্মক হেসে বলল, ‘তোর এই স্যরি বলাতে কী সব ঠিক হয়ে যাবে?’

প্রিয় কোনোকিছু না ভেবেই শিহরণের জন্য লেখা চিঠিটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। বলল, ‘প্লিজ, এই চিঠিটা পড়। তারপর যা খুশি তাই বলিস আমাকে। যা খুশি তাই শাস্তি দিস।’

শিহরণ চিঠিটা না পড়েই ছিঁড়ে ফেলতে গেলে মোহনা বাধা দিল। বলল, ‘পড়ার পরে ছিঁড়ে ফেলিস কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এখন এটা তোকে আজ পড়তেই হবে।’

একান্ত বাধ্য হয়ে শিহরণ চিঠিটা পড়ল। চিঠিটা পড়া শেষ হতেই শিহরণ যে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আচমকা নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গাছটাতে ঘুসি বসিয়ে ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, ‘তোর আজকের এই সত্য স্বীকারোক্তি কি আমাদের কৈশোরের সেই বিষাদময় দিনগুলি পরিবর্তন করতে পারবে? অতল আর আমার মধ্যের সম্পর্ক কী ঠিক হয়ে যাবে?’

শিহরণের এমন মারমুখো আচরণে ভয়ে গুটিয়ে গেল প্রিয়। থুতনিটা একদম বুকের কাছে লাগিয়ে ফেলল। মোহনা বলল, ‘মাফ করে দে না দোস্ত। সব ভুলে আমরা আবার এক হয়ে যাই।’

বহ্নি বলল, ‘মোহনা আপু ঠিক বলছে ভাইয়া। ভুলে যাও সব। আবার নতুন করে শুরু করো সবকিছু।’

হঠাৎ তার সেলফোনটা বেজে উঠল। মোবাইলের স্ক্রিনে থাকা নামটা দেখে সে বলল, ‘আমি আসছি। তোমরা এখানে অপেক্ষা করো।’

বহ্নিকে এগিয়ে আসতে দেখে অতল মুচকি হাসল। কাছে আসতেই বহ্নি অতলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তুমি আসাতে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। আজকে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’

অতল ডান হাতের তর্জনী দিয়ে চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘কী সারপ্রাইজ?’

বহ্নি হেসে বলল, ‘এখন বলে দিলে কি আর সেটা সারপ্রাইজ থাকবে?’

অতল খেয়াল করল ছোট্ট বহ্নি আজ অনেক বড়ো হয়ে গেছে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো তাকে শাড়ি পরা দেখল সে। হাত ভর্তি নীল রঙের কাচের চুড়ি আর নীল রঙা শাড়িতে তাকে নীল পরীর মতো লাগছে। অতল বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বহ্নির দিকে। তারপর আচমকা বলেই ফেলল, ‘আগুনমণি! এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো তোকে শাড়ি পরা দেখছি।’

অতলের মুখে হঠাৎ সেই ছোট্টবেলার ডাকটা শুনে বহ্নি স্তব্ধ হয়ে গেল। চশমার আড়ালে থাকা ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল নির্বিকার ও অনুভূতি শুন্য হয়ে ।

‘খুব সুন্দর লাগছে তোকে।’ অতলের চেহারা ভাবলেশহীন কিন্তু কণ্ঠে মুগ্ধতা।

অতলের মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনে বহ্নি কিছুটা লজ্জা পেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ।’

আয়মান দাঁড়িয়ে থেকে দুজনকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে মনে মনে একটা কিছু আশঙ্কা করছে। তবে সেটা কতটুকু ঠিক তা জানার জন্য তাকে কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে তা সে বেশ বুঝতে পারছে।

নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বহ্নি বলল, ‘আমার সাথে আসো।’

অতলকে দেখে বহ্নি মনে মনে অনেক বেশি খুশি হয়েছে। তার কথা রেখেছে ভাবতেই তার মনের মধ্যে একরাশ সুখানুভূতি হলো। বহ্নির সাথে অতলকে দেখতেই অন্য বন্ধুরা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকল।

শিহরণের দিকে চোখ পড়তেই অতল থমকে দাঁড়াল। আয়মান তার হাত ধরে টেনে বলল, ‘কী রে! থেমে গেলি কেন? চল।’

অতল নড়ছে না। স্তম্ভিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ঝাঁকড়া চুল আর সবুজাভ চোখের অধিকারী ছেলেটার দিকে। শিহরণও নিষ্পলক তাকিয়ে আছে চশমা পরা ছেলেটার দিকে। তার ভাবনায় এলো বহ্নির বলা কথাগুলো। আর একটু আগে প্রিয়র দেওয়া চিঠি পড়ে তার যেইটুকু অভিযোগ ছিল সেটুকুও নেই। কিন্তু অতল! অতল কি তাকে মাফ করবে?

শিহরণ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে গেল অতলের দিকে। অতলের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘চশমা পরা শুরু করেছিস কবে থেকে?’

অতল নির্বিকার। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো শিহরণের দিক থেকে। শিহরণ ওর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ওইদিকে কি দেখছিস? আমার দিকে তাকা।’

অতল সরে যেতে চাইলে শিহরণ ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাই বলেছিলি কিন্তু মন থেকে মানিসনি। এই জন্যেই তো পর করে দিয়েছিস। তাই না?’

মোহনা, ফাহমি, প্রিয়, বহ্নি, আয়মান চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে দুই বন্ধুর মান অভিমানের দৃশ্য। সকলেই মনে মনে প্রার্থনা করছে এবার যেন এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা অভিমানের বরফটা গলে যায়।

অতলকে কিছু বলতে না দেখে শিহরণ পুনরায় বলল, ‘
এতদিন পরেও রাগ ভাঙেনি? এত্ত অভিমান তো আগে ছিল না তোর? সামান্য কারণেই আমাদের সবার কাছ থেকে দূরে সরে গেলি?’

অতল এবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল শিহরণকে। উল্টো ঘুরে দ্রুত পায়ে হাঁটা দিল। পেছন থেকে বহ্নি ডাকলেও সেই ডাকে সে সাড়া দিল না।

অতল এভাবে চলে যাওয়ায় শিহরণ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। দু’হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে বিড়বিড় করে ব্যথাতুর কণ্ঠে আওড়াতে লাগল, ‘ও আমাকে আজও ক্ষমা করেনি। ওর অভিমান হয়তো কখনোই ভাঙবে না!’

মোহনা আর ফাহমি এসে তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকল। প্রিয় ভয়ে গুটিশুটি মেরে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আয়মান ছুটল অতলের পেছনে। বহ্নিও পেছন পেছন গেল।
__________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৯

রদিদ দুপুরে ঘুমিয়েছিল। নীরা বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেল রাদিদ ঘুম থেকে উঠেছে কি না। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসতেই নীরার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সে রাদিদের কাছে গিয়ে তার কানের কাছে এসে বিকট একটা চিৎকার দিল। রাদিদ ধরফড়িয়ে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ কী হলো তা বুঝতেই পারেনি! হতভম্ব হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে বারবার। কিছুটা ধাতস্থ হতেই নীরাকে দেখতে পেল। নীরা তখন রাদিদের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে রাজ্যের বিরক্তি মুখের উপর এনে তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল।

রাদিদকে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে নীরা বলল, ‘তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ো। তোমাকে তো আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে বলছিলাম। অথচ তুমি কুম্ভকর্ণের ঘুম দিচ্ছ। এবার এক লাফ দিয়ে উঠো আর ঝটপট রেডি হও।’

হুট করেই রাদিদ ইয়া বড়ো বড়ো চোখ করে নীরার দিকে তাকাল। যেন চোখ দিয়েই নীরাকে শেষ করে ফেলবে! নীরার এই কাণ্ডে রাদিদের মাথাটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে নীরার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘বান্দর মেয়ে! এভাবে কী কেউ কাউকে ঘুম থেকে তুলে?’

তার পর মুহূর্তেই রাদিদ ধরমড় করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল মারমুখো হয়ে। নীরা বুঝতে পেরে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না; দিল ছুট। রাদিদও পেছন পেছন ছুটতে লাগল। নীরা পুরো ঘরময় দৌড়াতে থাকল; আর রাদিদ তার পিছু পিছু। একটা সময় নীরা
নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাদিদ
ধরাম ধরাম শব্দ করে দরজা ধাক্কাল। তারপর প্রচণ্ড রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে নওশীন হকের কাছে গিয়ে বলল, ‘ফুফু, আমি আর এখানে আসব না। নীরা বান্দর আজকে আমার কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলেছে।’ মুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আমি আর কানে শুনতে পাব কি না জানি না।’

নওশীন হক উদ্বেগ নিয়ে বললেন, ‘সে কী! কানে শুনতে পাবি না কেন? কী হয়েছে? নীরা কী করেছে?’

রাদিদ জবাব দিল না। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ততা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। অবশেষে নিজের রাগকে বহুকষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের রুমে চলে এলো। নওশীন হক বুঝতে পারলেন রাদিদের রাগ করার কারণটা। তাই তাকে আর ঘাটালেন না।

রাদিদের রাগ কমে আসতেই নীরা তার মাকে ম্যানেজ করে ফেলল। অবশ্য কিছুটা বকা শুনতে হয়েছে বৈ কি। কিন্তু তাতে কী! তার তো অভ্যাস হয়ে গেছে।

নীরা আর রাদিদের এমন কাণ্ড দেখে আফরিন মহাবিরক্ত। নিজের ভেতরে এক চাপা কষ্টের উপস্থিতি টের পেল সে যা তার ভেতরে থেকে প্রচণ্ড এক চিৎকার দিয়ে ক্রমশ অগ্নিফুলকি স্বরূপ বেরিয়ে আসতে চাইছিল। তার পর মুহূর্তেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত গলায় সে বলল, ‘এত্ত নাটক এই ঘরে চলতে পারে। অথচ আমি কিছু করলেই সবার সমস্যা হয়ে যায়।’

নওশীন হক আফরিনকে ধমকে বললেন, ‘তুই চুপ থাক। ওরা কি প্রতিদিন তোর মতো কাণ্ড বাঁধায় না-কি? আর বাঁধালেও তোর মতো অবাধ্য না ওরা।’

আফরিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘মা, তোমার জন্য তো আমিই সবসময় বেশি। আমি যাই করি না কেন সবকিছুতেই তোমার সমস্যা।’

এটুকু বলেই সে নিজের রুমে চলে গেল। নওশীন হক সোফায় বসে পড়লেন। তার মাথা ঘুরাচ্ছে। আফরিন কেন যে অল্পতেই এত গণ্ডগোল বাঁধায় তা তিনি বুঝতেই পারেন না। নিজেকে এই মুহূর্তে ভীষণ অসহায় লাগছে তার।
_______________________

নীরা আর রাদিদ যখন গেটের কাছাকাছি পৌঁছাল ঠিক তখন বহ্নির সাথে দেখা হয়ে গেল। বহ্নি আর অতলের পিছু পিছু যেতে পারল না। নীরা আর রাদিদকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া অবাঞ্ছিত ঘটনার কথা ভুলে যাওয়াটা সহজ কিছু নয় তার জন্য। তারপরেও নিজেকে সহজ স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল, ‘রাদিদ ভাইয়া, তুমি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি।’

রাদিদ তখন মোহগ্রস্ত। সামনে দন্ডায়মান তরুণীর দু’চোখে তার অবাধ্য চোখ জোড়া হারিয়ে গেল তার শত সহস্র নিষেধ অমান্য করেই। বহ্নির কথাতেই হুঁশ ফিরে আসতেই তার সেই মুগ্ধতার রেশ কেটে গেল। বাস্তবতার বেড়াজাল তাকে ঘিরে ধরল। আর ঠিক তখনই আজকের দিনে দ্বিতীয়বারের মতো করে নীরার উপর তার প্রচণ্ড রাগ হলো।

রাদিদকে চুপ থাকতে দেখে বহ্নি স্মিত হেসে প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার, রাদিদ ভাইয়া? তুমি কি এখন খুব কম কথা বলো?’ রাদিদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বহ্নি আবারও বলল, ‘আমার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিচ্ছ না। তোমার কি কোনো কারণে মন খারাপ?’

নীরা একগাল হেসে বলল, ‘আরে আপু ও কিছু না। রাদিদ ভাইয়া আমাকে মারতে না পেরে গাল ফুলিয়েছে।’ ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘ভাইয়াকে বলো গাল ফুলালে তাকে দেখতে একদম ভালো লাগে না। একদম পেঁচার মতো দেখায়।’

বহ্নি হেসে ফেলল নীরার কথায়। রাদিদ ত্যাড়ছা চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার কিন্তু তুই খুব বাড়াবাড়ি করছিস নীরা। এর পর থেকে তোর সাথে আমি আর কোথাও যাব না।’

‘হুহ্! বললেই হলো না-কি? তুমি না তোমার ঘাড়সুদ্ধ যাবে।’ নীরা এটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসল।

বহ্নি বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার আসো আমার সাথে।’

হাঁটতে হাঁটতে বহ্নি রাদিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাইয়ার সাথে তো এর আগে দেখা করোনি। আজকে তো দেখা করতেই হবে। শুধু ভাইয়া কেন আজ সবার সাথেই দেখা করবে। সবাইকে একসাথে দেখে তুমি আজ নিশ্চিত সারপ্রাইজড হবে।’

রাদিদ মনে মনে ভীষণ অশান্ত হয়ে গেল বহ্নির কথা শুনে। এতদিন পরে সবার সাথে দেখা হবে; বন্ধুরা একে অপরের মুখোমুখি হবে ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল।

রাদিদকে দেখেই শিহরণ জড়িয়ে ধরল দৃঢ় বন্ধনে কিন্তু রাদিদ ধরল না। সে প্রথমদিকে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও পরমুহূর্তেই একদম স্বাভাবিক হয়ে গেল। রাদিদ অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করল তার মধ্যের জড়তা কেটে গেছে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করল সে। সাথে সাথেই সে নিজেও শিহরণকে জড়িয়ে ধরল। দুই বন্ধুর চোখেই জলের আনাগোনা এলো একই সাথে; একই সময়ে।

শিহরণ বলল, ‘এবার দূরে সরে যাবার চিন্তা করলেই তোর নামে কেইস ফাইল করব।’

শিহরণের কথা শুনে রাদিদ হেসে ফেলল। সাথে হাসল তার চোখ দুটোও। শিহরণ তা দেখে বলল, ‘নাউ, ইটস লুকস লাইক মাই ব্রাদার রাদিদ।’

‘একদম ঠিক।’ মোহনা অভিযোগের সুরে বলল, ‘জানিস তো শিহরণ, এই রাদু কিন্তু পালাতে চাইছিল আমাকে আর ফাহমিকে দেখে। আমার ধারণা সে আমাদের সবার কাছ থেকেই পালিয়ে পালিয়ে থাকতে চেয়েছিল।’

ফাহমি মোহনার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘কিন্তু প্লে বয় রাদিদ সেটা আর পারল না।’

রাদিদ মাথা নিচু করে ফেলল। কিছুটা লজ্জিত স্বরে বলল, ‘আমাকে আর না ঘাটালে কি হয় না?’ পর মুহূর্তেই নিজের দু’হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর পালাব না। এবার তো আমাকে পচানো বন্ধ করে দে।’

শিহরণ কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘ফাহমি একটা কথা কিন্তু তুই ভুল বলেছিস।’

ফাহমিসহ সবাই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তাকাল শিহরণের দিকে। সকলেই সমবেত অতি উৎসাহিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কোন কথাটা?’

রাদিদের কাঁধে নিজের হাতটা রেখে শিহরণ বলল, ‘রাদিদ ইজ নট আ প্লে বয়। রাইট?’

সবাই উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘ইয়াহ্! হি ইজ সো নাইভ।’

রাদিদ এবার মিনমিনে কণ্ঠস্বরে বলল, ‘এরকম করলে কিন্তু আমি গেলাম।’ সাথে সাথেই পেছন ফিরে চলে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।

শিহরণ পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যেতে চাইলেই কি যেতে দেব আমরা? এই তোরা কি বলিস?’

‘না।’ সকলে পুনরায় সমস্বরে বলল, ‘উই ওয়ান্ট ব্যাক দ্যা চার্মিং রাদিদ।’

_______________________

অতল হাঁটুর উপর দু’হাত রেখে দু’হাতের তালু দিয়ে মুখটা ঢেকে রেখেছে। আয়মান তার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখল। বলল, ‘ওভাবে চলে এলি কেন?’

অতল যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। একটুও নড়ল না। আয়মানও আর প্রশ্ন করল না। এভাবে কাটল অনেকটা ক্ষণ; নীরবে। দূরে কোথাও ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল ডাকছে ব্যাকুল হয়ে; সেই সুর যেন ব্যথার বাহক।

আয়মান এবার প্রিয়র দেয়া চিঠিটা অতলের হাতের মুঠোয় পুরে দিল। বলল, ‘চিঠিটা পড়। তাহলেই তোর অভিমানের পাহাড়টা হয়তো এবার ভেঙে পড়বে।’

অতল মুখ তুলে চাইল। চিঠির ভাঁজ খুলে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে ঝরতে কবে যে গালটাই ভিজে গেল তা অতল টেরই পেল না।
চিঠি পড়া শেষে চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে মুষ্টিবদ্ধ করে হাতের মুঠোয় রেখে দিল অনেকক্ষণ। তারপর বসা থেকে উঠে পড়ল। আয়মান অতলকে দেখে কিছুটা ভয় পেল। অতলকে দেখতে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে। যেন সবকিছু নিমিষেই ধ্বংস করে ফেলবে। চোখ দুটোও কেমন যেন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। খানিক বাদে ভূতগ্রস্তের মতো এদিক সেদিক পায়চারি করতে লাগল।

আয়মান উঠে দাঁড়াল। অতলের দু’বাহু শক্ত করে ধরে বলল, ‘এরকম করছিস কেন? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর। এরকম পাগলামো করিস না।’

অতল নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে এক ঝটকায় আয়মানের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল, ‘প্রিয় এটা কেন করল? কেন?’

চিৎকার করেই মাটিতে বসে পড়ল। আবারও কণ্ঠের সেই আগের ক্রোধ বজায় রেখে বলল, ‘আমি প্রিয়কে কখনোই ক্ষমা করব না। কখনোই না।’

আয়মান অতলের পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ক্ষমা করতে হবে না তোর। আগে নিজেকে ঠিক কর। তারপর অন্যকিছু ভাবা যাবে।’

অতল ব্যথাতুর কণ্ঠে পুনরায় আওড়াল, ‘কেন করেছে বল তো? প্রিয় এটা কেন করেছে?’

আয়মান অসহায় ভঙ্গিতে বসে রইল। তার কাছে কোনো শব্দ অবশিষ্ট নেই সান্ত্বনা দেবার, নেই কোনো আশ্বাসবাণী। অতল কতটা সেনসিটিভ তা সে জানে। আর সে কারণেই তার ভীষণ ভয় হয় অতলের জন্য।

আয়মান মনে মনে ভাবল, ‘পৃথিবীতে কিছু মানুষ অকারণে কষ্ট পায়। কিছু মানুষের মন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় কোনো প্রকার অপরাধ না করেই। অতল তাদের মধ্যে একজন।’
_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪০

সবাই যখন রাদিদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঠিক তখন বহ্নি চুপিচুপি সেখান থেকে সরে পড়ল। অতলের সাথে কথা বলা খুব জরুরী তার জন্য। কী না করছে সেই চিন্তাতেই বহ্নির ভীষণ অস্থির লাগছে। আয়মান যদিও আছে, তবুও তার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে অতলের জন্য।

শাড়ি পরাতে দ্রুত হাঁটতে পারছে না সে। এদিক সেদিক সবদিকে খুঁজেও অতলকে কোথাও দেখতে পেল না সে। পেছন ঘুরে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই একটা চাপা আর্তনাদ কানে এলো। তখনই কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল অতলকে। আয়মানও পাশেই বসা ছিল। বহ্নি যেতেই আয়মান উঠে দাঁড়াল। বহ্নি অতলের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘অতল ভাইয়া! এমন করে কাঁদছ কেন?’

অতল মুখ তুলে তাকাল। তার অশ্রুসিক্ত চোখ, কান্নাভেজা গাল আর এলোমেলো চুল বহ্নিকে মুহূর্তেই ভীষণ রকমের এলোমেলো করে দিল। অতলের জন্য তার ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করল। সান্ত্বনা দেবার ভাষাটুকুও সে হারিয়ে ফেলল। তার চোখদুটোও অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। সে বলল, ‘এভাবে ভেঙে পড়ার মতো তো কিচ্ছু হয়নি।’

অতল নিরুত্তর। বহ্নি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘এমন কিছু তো হয়নি যে তুমি বেঁচে থাকাটাই ভুলে যাবে। তুমি তো এমন ছিলে না! আমি আগের তোমাকে ফিরে পেতে চাই। যেই তুমি তোমার মনের সমস্ত কথা অনায়াসেই আমাকে বলে ফেলতে পারতে।’

অতল তার কাঁধে রাখা বহ্নির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমার সাথেই কেন সবসময় এমন হয় বলতে পারিস? সবাই আমাকেই কেন দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়? কেন?’

অতল করুণ চোখে তাকিয়ে রইল বহ্নির দিকে। দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা, মনের মধ্যে হাজারও প্রশ্নের দাপাদাপি। বহ্নি অসহায় বোধ করল। অতলের কোনো প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।

নিজেকে সামলে নিয়ে অবিচলিত কণ্ঠে বহ্নি বলল, ‘সব ভুলে যাও। আজকে তোমার সব বন্ধুরা আছে ওদের সাথে কথা বলো দেখবে তোমার মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা সমস্ত অভিমান আজকের এই আনন্দের জোয়ারে হারিয়ে যাবে।’

‘আমি খুব খারাপ। খুব খারাপ। এজন্যই আমার সাথে এরকম হয়। তাই না?’ অতল পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল বহ্নির দিকে, স্থির অথচ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

বহ্নি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। সামনে বসে থাকা চশমা পরা ছেলেটার প্রতি তার মন ও মস্তিষ্ক উভয়েই প্রচণ্ড রকমের দুর্বল। সে মুহূর্তেই চোখ বন্ধ করে অতলকে জড়িয়ে ধরল। ম্লান কণ্ঠে বলল, ‘তুমি মোটেই খারাপ নও। আমার দেখা সবচাইতে ভালো মানুষ তুমি।’

অতল ধরা গলায় বলল, ‘মিথ্যা বলছিস কেন? আমি আসলেই খুব খারাপ। তাই কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কেউ না। যাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম তাদের ভালোবাসাও কেড়ে নিল আমার দুর্ভাগ্য।’ অতল চাপা আর্তনাদ করে বলল, ‘এরকম দুর্ভাগা কি কেউ হয়, আগুনমণি? হয় না। কেউ হয় না।’

অতল উঠে দাঁড়াল। চোখের পানি মুছে চশমাটা ঠিক করে পরে নিল। বহ্নির ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। সেও বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। অতলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি মোটেও দুর্ভাগা নও। যারা তোমাকে বুঝতে পারে না তারাই দুর্ভাগা। যারা তোমাকে ভালোবাসতে পারে না তারাই দুর্ভাগা।’

অতল এবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস? এটা করিস না প্লিজ।’ ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বুকের বাম দিকটাতে দেখিয়ে বলল, ‘ঠিক এই খানটাতে লাগে। খুব কষ্ট হয় তখন।’

বহ্নি এবার অতলের দু’হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে তেজী গলায় বলল, ‘তোমার অনুভূতি শক্তি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। এই জন্য তুমি শুধু কষ্ট অনুভব করছ। সত্যি বলতে তুমি বোধহয় কষ্টের প্রেমে পড়ে গেছ তাই কষ্টরা তোমার সমস্ত সত্তা জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। এখানে তোমার দোষও আছে। তুমি নিজের মনের কথা কাউকে বলো না। সত্যি বলতে কী জানো, তুমি নিজেই কাউকে আপন ভাবো না! আর তাই তোমার মন আর মস্তিষ্ক সবসময় নেতিবাচক দিকটাই গ্রহণ করে। যা আমার মোটেই পছন্দ না। এখন থেকে আমি…!’ শেষের কথাটা সম্পূর্ণ শেষ না করেই বহ্নি থামল।

অতল ভ্রু কুঁচকে বহ্নির দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এখন থেকে তুই কি?’

‘কিছু না।’ বলেই মুখ ঘুরাল বহ্নি ।

‘কথা শেষ কর।’ অতল নাছোড়বান্দার মতো করে বলল ।

‘কিছু না বললাম তো।’ দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল, বহ্নি ।

‘কথা পুরোটা শেষ করতে বলেছি তো।’ চেঁচিয়ে বলল, অতল।

‘বলতে পারি একটা শর্তে। রাজী?’

‘কী শর্ত?’

‘এখন থেকে আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।’

‘এটা কেমন শর্ত?’

‘কেমন জানি না। ব্যস এটাই শর্ত। মানা না মানা তোমার ব্যাপার। কিন্তু শর্ত এটাই।’ বহ্নি হাসল। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই হাসি। ঠোঁটের কোণে সেই হাসির রেখা ধরে রেখেই বলল, ‘আর এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি কি তোমাকে আগুনে ঝাপ দিতে বলেছি না-কি তোমার কিডনি চেয়েছি?’

‘আমার কিডনি দিয়ে তুই কি করবি?’ অতল দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

অতলকে বিভ্রান্তিতে রেখে বহ্নি হাঁটা শুরু করল। অতল বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকল ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে । পরক্ষণেই লম্বা পদক্ষেপে বহ্নির সামনে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসু চাউনিতে তাকিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার?’

বহ্নি কিছুই হয়নি এমন ভাব ধরে বলল, ‘কোথায় কী ব্যাপার?’

অতল প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘এসব কী শুরু করেছিস?’

‘কী শুরু করেছি?’ বহ্নি পাল্টা প্রশ্ন করল।

অতল হাল ছেড়ে দিল এবার। তাই দেখে বহ্নি ঠোঁট টিপে হাসল। যা অতলের চোখ এড়াল না। রাগান্বিত হয়ে সে বলল, ‘আমাকে কি তোর জোকার মনে হচ্ছে?’

‘একটু তো বটেই।’ বহ্নি প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি রেগে যাও কেন? মজা করছিলাম। এখন চলো।’

দুজন একসাথে পাশাপাশি হাঁটতে থাকল। বহ্নি আবারও বলল, ‘আমার সব কথা শুনবে বলে কথা দিয়েছ। মনে থাকে যেন।’

‘আমি কোনো কথা দিইনি। আর তোর কথা কেন শুনব? আমি পিচ্চিদের কথা শুনি না।’ বহ্নির দিকে ত্যাড়ছাভাবে তাকিয়ে বলল, অতল।

অতলের মুখ থেকে আবারও পিচ্চি শব্দটা শুনে বহ্নির মুখের হাসি উবে গেল। ক্রোধিত কণ্ঠে অতলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোমরে দু’হাত রেখে বলল, ‘আমি মোটেই পিচ্চি না।’

‘আমার কাছে তো তুই এখনও সেই পিচ্চিই আছিস।’
অতল বলল দৃঢ়তার সাথে।

‘আমি পিচ্চি হলে তুমি তার থেকেও বড়ো পিচ্চি। সেজন্য যার যা খুশি তাই তোমাকে বুঝিয়ে চম্পট দিতে পারে।’ তেজস্বী কণ্ঠে বলল, বহ্নি ।

অতল চুপ হয়ে গেল। বহ্নি বলল, ‘স্যরি।’

অতল মলিন হাসল। বলল, ‘স্যরি কেন বলছিস? কথাটা মোটেই ভুল বলিসনি।’

দুজন আবারও পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল। অতলের মনে হলো এই মুহূর্তে তার ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করেছে। মনে হলো তার বুকের উপর থেকে এক বিশাল বোঝা সরে গেল। নিজেকে হালকা অনুভব করছে সে। সে মনে মনে ভাবতে লাগল তার আগুনমণির মধ্যে কী এমন আছে যা তার সমস্ত কষ্ট ফিকে করে দিল মুহূর্তেই। কেন সে এতটা নির্ভরশীল এই পিচ্চিটার উপর। কেন?
কিছু কিছু প্রশ্ন যেমন জটিল হয়ে থাকে ঠিক তেমনি সেই জটিল প্রশ্নের উত্তর আরও বেশি জটিল হয়ে থাকে। অতলের মনের প্রশ্নগুলো সেই জটিলতায় মোড়ানো কিছু প্রশ্ন। যার উত্তর তার জানা নেই। শুধু অনুভূতি শক্তির মাধ্যমে সে অনুভব করতে পারছে তার আগুনমণির বলা প্রতিটা কথা সত্য।
___________________

শিহরণ তখনও গাছটার পাশেই বসে ছিল নিচের দিকে তাকিয়ে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে। অতল তার পাশে গিয়ে বসল। ইতস্তত কণ্ঠে বলল, ‘স্যরি, শিহরণ।’

শিহরণ সাথে সাথেই মুখ তুলে তাকাল। অতলের দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পারল অতল তার উপর রেগে নেই। সাথে সাথেই শিহরণ অতলকে জড়িয়ে ধরল। আবেগে আপ্লুত কণ্ঠে বলল, ‘থ্যাঙ্কস, অতল। তোকে আমি বুঝাতে পারব না আজ আমি কতটা খুশি।’

অতল স্মিত হেসে বলল, ‘বিশ্বজয় করার মতো খুশি হয়েছিস। তাই না?’

‘একদম। তোকে পেয়ে আমার সত্যিই মনে হচ্ছে আমি বিশ্ব জয় করেছি।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’ প্রশস্ত হেসে বলল, অতল।

ফাহমি ব্যঙ্গ করে বলল, ‘বাব্বাহ! শিহরণ-ই তোর জন্য সব। তাই না অতল? ভাই আমাদেরকেও একটু জড়িয়ে-টড়িয়ে ধর।’

অতল ফাহমিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘জড়িয়ে তো আমি ধরেছি। এবার টড়িয়ে কীভাবে ধরতে হয় আমাকে শিখিয়ে দে।’

অতলের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ফেলল। রাদিদকে দেখে অতল ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘রাদিদ। রাইট?’

রাদিদ জবাবে হাসল। অতল রাদিদকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সামথিং ইজ মিসিং। কী মিসিং বল তো?’

মোহনা আর ফাহমি সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘ইটস্ প্লে বয় ট্যাগ।’

‘হোয়াট?’ অতল বিস্ময়াভূত হয়ে বলল, ‘কীভাবে হলো এসব?’

রাদিদ মাথা নিচু করে লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘ইটস্ দ্যা ম্যাজিক অফ টাইম অর সিচুয়েশন।’

অতল সম্মতি জানাল। বলল, ‘দারুণ বলেছিস। সিরিয়াসলি টাইম ইজ দ্যা রিয়েল ম্যাজিশিয়ান।’

সব বন্ধুদের মান অভিমানের পালা শেষ হওয়াতে সব বন্ধুরা আজকে দারুণ খুশি। এ যেন এক মহোৎসবের মেলা বসেছে। সাইফ ছোঁয়াকে বলল, ‘সত্যি বন্ধুদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হলে জীবন দুর্বিসহ মনে হয়।’

মায়া সাইফের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছিস।’

প্রিয় তখনও গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণায় । ছোঁয়া ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে অপর বন্ধুদের পাশে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘এবার প্রিয়কেও মাফ করে দেওয়া হোক। ছোটোবেলায় করা ভুলের শাস্তি আজীবন দেওয়া হলে সেটা ঘোর অন্যায় হয়ে যাবে।’

প্রিয় মুখ তুলে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। তার চোখে স্পষ্ট কৃতজ্ঞতা। অতল আর শিহরণ প্রিয়র দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ছোঁয়া শিহরণকে বলল, ‘কী আশ্চর্য! এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছ কেন?’

একটু দম নিয়ে ছোঁয়া পুনরায় বলল, ‘তুমিও তো ছোটোখাটো কতো ভুল করেছ। তার শাস্তি যদি তোমাকে আজীবন দেওয়া হয় তোমার কেমন লাগবে?’

শিহরণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়র দিকে। তারপর ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে একগুঁয়ে স্বরে বলল, ‘ও যা করেছে তা কোনো ছোটোখাটো ভুল ছিল না।’

অতল শিহরণের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘আমিও শিহরণের সাথে একমত।’

প্রিয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আমি জানতাম ওরা দুজন আমাকে মাফ করবে না। তাই আমি এখানে আসতে চাইনি।’

রাদিদ, শিহরণ আর অতলকে উদ্দেশ্য করে প্রিয়র স্বপক্ষে বলল, ‘আমরা কি সবকিছু ভুলে যেতে পারি না। আমিও তো কতো অন্যায় করেছিলাম। আমাকে তো তোরা মাফ করে দিয়েছিস।’

শিহরণ তেজী গলায় বলল, ‘তুই কোনো অপরাধ করিসনি। মিথ্যা বলছিস কেন?’

রাদিদ অদ্ভুত হাসল। হেসে বলল, ‘আমার ক্ষেত্রে ম্যাজিকের মতো একটা ব্যাপার ঘটেছিল বলে আজকের এই আমি। নয়তো আমি হয়তো আজও প্লে বয় ট্যাগ নিয়ে ঘুরতাম। মানুষকে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে মূল্যায়ন না করে তার সামাজিক স্ট্যাটাস দিয়ে মূল্যায়ন করতাম। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি কারণ বাবার অসুস্থতা ছাড়াও বেশ কিছু ঘটনা আমার চিন্তা জগতে বেশ ভালো রকমের প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাই আজকের এই আমি। আজ আমি যদি প্লে বয় হয়েই থাকতাম তবুও কি তোরা আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারতি? আমাকে পর করে দিতে পারতি?’

মোহনা আর ফাহমি বলল, ‘রাদিদ একদম ঠিক বলছে। আসলেই আমরা আমাদের বন্ধুকে পর করে দিতে পারতাম না।’

অতল আর শিহরণ যেন নাছোড়বান্দা হয়ে গেল। প্রিয়র প্রতি তাদের রাগ যেন কোনোভাবেই কমছে না।
রাদিদ আবারও বলতে শুরু করল, ‘এখন যখন সব ঠিক হয়ে গেছে তখন আমাদের এক বন্ধুকে পর করে দেওয়াটা বোকামি হবে বলেই আমার ধারণা। তাছাড়া প্রিয় তার কাজের জন্য অনুতপ্ত। এটাই তো তার সবচাইতে বড়ো শাস্তি।’

বহ্নি এবার মুখ খুলল। শিহরণকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কী রে ভাইয়া? জেদ বেড়েছে না তোমার? সবাই এত করে বলছে তাও তুমি প্রিয় আপুকে মাফ করে দিচ্ছ না। এখন এসব একগুঁয়েমি ছেড়ে দাও।’ একটু থেমে
ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘আসলে তোমাদের দুজনের এত ঢং না করলে চলছে না। এটাই হলো আসল কথা।’

মোহনা আর ফাহমি বহ্নির সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘একদম। দুই জিগরি দোস্ত এক হইছে তো এখন আরও কতো ঢং যে দেখা লাগবে সেটাই ভাবতেছি।’

বহ্নি অতলের পাশে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘শর্তের কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে তা তো ভাবিনি।’

অতল পরাস্ত হয়ে শিহরণকে বলল, ‘আমার মনে হয় প্রিয়কে মাফ করে দেওয়াটাই ভালো হবে।’

‘বলছিস?’ শিহরণ জিজ্ঞাসু চাউনিতে তাকাল অতলের দিকে।

অতল চোখের ইশারায় সম্মতি জানাল। প্রিয় তখন খুশিতে বাকবাকুম হয়ে গেছে। দৌড়ে এসে দুই বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাংক ইউ দোস্ত। আর কখনও এরকম ভুল হবে না। আমার এখন খুব ভালো লাগছে। তোরা আমার উপর অনেক দয়া করেছিস। আমি এ ঋণের কথা কখনোই ভুলব না।’

অনুষ্ঠানের আনন্দ ছাপিয়ে বন্ধুদের মিলনমেলার এক অনন্য উৎসবমুখর আনন্দে চারিদিক মুখরিত হয়ে গেল। বাচ্চাদের সমস্বরে গাওয়া কোরাসের স্বর ভেসে আসছে বাতাসের ভেলায় চড়ে।

দু’জোড়া চোখ মিলিত হচ্ছে বারেবারে, কারণে-অকারণে, কৃতজ্ঞতায়। কারণ অজানা একজনের কাছে তো অন্যজনের কাছে তা স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার। এই দুই জোড়া চোখের দৃষ্টির মিলন ছোঁয়ার চোখ এড়াল না। পুরো বিষয়টা তার কাছে এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। মনে মনে সে ভীষণ খুশি হলো।
___________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৫

রাদিদের মনে হলো মেয়েটা তার সাথে উদ্ধত আচরণ করছে। তারপরেও সে নম্রভাবে বলল, ‘আমি রাদিদ। আপনার দাদুর সাথে দেখা করতে এসেছি।’

মেয়েটা রাদিদের সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে ভালো করে খেয়াল করে মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘রাদিদ! মানে তুমি কি আমাদের প্লে বয় রাদিদ?’

রাদিদের মনে হলো সে আকাশ থেকে পড়ল। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে সামনের মেয়েটার এমন সম্বোধনে। এইভাবে তাকে অপমান না করলেও পারতো! এই মেয়েটাকে চেনার ব্যাপারটা এতক্ষণ পর্যন্ত তার ভাবনাতে না থাকলেও এখন একে চেনাটা খুব জরুরি মনে হলো।

রাদিদ বিস্ময়াভূত হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা যে কে তা সে বুঝতে পারছে না। প্রিয় রাদিদের দ্বিধান্বিত অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, ‘আরে দোস্ত আমি প্রিয়। চিনতে পারছিস না?’

‘কী!’ রাদিদ ভীষণ অবাক হলো। বলল, ‘তোকে তো একদম চেনা যাচ্ছে না। চুল বড়ো করেছিস। আগের চাইতে স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আগে ছিলি পাটকাঠি। এখন তো দেখে মনে হচ্ছে কোনো মডেল।’

‘হয়েছে। হয়েছে। আর কোনো প্রশংসা করার দরকার নেই।’ পরক্ষণেই মন খারাপ করে আফসোসের সুরে বলল, ‘আমার জন্য সবকিছু নষ্ট গেল রে।’

‘আচ্ছা, চল আমার রুমে আয়। আর কারো সাথে তো কথা বলার সাহস হয় না আমার। তোর সাথে কথা বলে মনটা হালকা করতে চাই।’

রাদিদ একা থাকতে থাকতে নিজের মধ্যে একটা সঙ্কোচ নামক পাহাড় তৈরী করে ফেলেছে। সেই বিশাল পাহাড় ভেঙ্গে ফেলা তার পক্ষে কঠিন বৈ সহজ কিছু নয়। তাই সে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গির কারণে প্রিয়র সাথে আড্ডা দিতে চাইছিল না বলে প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,
‘তোর সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো। কিন্তু আমার যে এখন তাড়া আছে। আমি না হয় পরে আসব। আজকে যাই। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দেখছিসই তো।’

‘আমি তোর কোনো কথাই শুনব না। আজকে তোকে আমার সব কথা শুনতে হবে। আর আমার হাতের তৈরী কফিও খেয়ে যাবি।’ প্রিয় জোর গলায় বলতে বলতে রাদিদের হাত ধরে টানতে থাকল।

রাদিদ নিতান্ত বাধ্য হয়ে প্রিয়র হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার পিছুপিছু তার রুমে গেল। রাদিদকে বসতে বলে প্রিয় কিচেন থেকে দুজনের জন্য দু’কাপ কফি আর পপকর্ন নিয়ে রুমে গেল। সেন্টার টেবিলে কফি আর পপকর্ন রেখে রাদিদকে খেতে বলল।

রাদিদ খেয়াল করল এত বছর ধরে বন্ধুদের সাথে দূরত্ব থাকায় তার মধ্যে জড়তা কাজ করছে অথচ প্রিয় কেমন সহজভাবে তার সাথে মিশে গেল। কথা শুনেও বোঝার উপায় নেই যে দশটা বছর পরে তার সাথে কথা হচ্ছে! রাদিদ আলতোভাবে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, ‘কেমন আছিস?’

‘এই তো ভালো আছি। তবে তোদের কথা মনে পড়লেই আমার ভালো থাকা হয়ে উঠে না। আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়।’

‘কী হয়েছে? কেন নিজেকে অপরাধী মনে হয় তোর?’

ঠিক তখনই মেইন ডোরের বেলটা বেজে উঠল। রাদিদ বলল, ‘কেউ এসেছে মনে হয়।’

‘ওসব বাদ দে। এখন তুই শুধু আমার কথাই শুনবি।’

প্রিয় রাদিদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হতে চাইল। কিন্তু আবারও বেলটা বেজে উঠল। প্রিয় এবার খুব বিরক্ত হলো। তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘এই ঘরে কি কেউ নাই না-কি? দরজাটা কেউ এখনও খুলছে না কেন?’

সাথে সাথেই দারোয়ান ইন্টারকমে কল করল। প্রিয় রিসিভ করতেই দারোয়ান বলল, ‘প্রিয় আপা। আপনের লগে দেখা করবার লাইগা আপনের বন্ধু আইছে।’

প্রিয় ভাবল তার সাথে দেখা করার জন্য আবার কে আসল। দারোয়ানকে বলল, ‘আচ্ছা, আমি আসছি ।’

প্রিয় রাদিদকে বলল, ‘তুই কফি খা। আমি দেখে আসছি কে আসলো।’

ড্রয়িং রুমে এসে মোহনা আর ফাহমিকে দেখে প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেল প্রিয়। বিদেশে পড়াশুনা করলেও মোহনা তার সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। প্রিয় অবাক হয়ে বলল, ‘আমি যে বাংলাদেশে এসেছি জানলি কি করে?’

মোহনা প্রিয়র দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমার কাছ থেকে লুকানো এত সহজ কিছু কি?’

‘কেন এসেছিস? আবারও কথা শোনাতে এসেছিস?’ ব্যথাতুর কণ্ঠে প্রিয় বলল, ‘ঠিক আছে বল। কোনো সমস্যা নেই।’

‘কে বলেছে আমি তোকে কথা শোনাতে এসেছি? কে বলেছে?’ মোহনা বলল, অনুযোগের সুরে।

‘বলতে হবে কেন?’ প্রিয় ছলছল চোখে বলল, ‘আমি জানি। ছোটোবেলায় করা ভুলের শাস্তি আমি এখনও পাচ্ছি। তোরা কেউ আমাকে ক্ষমা করিসনি। অবশ্য সবচাইতে বেশি যাদের ক্ষতি করেছি তাদের কাছে আমি এখনও ক্ষমা চাইতে পারিনি।’ একটু থেমে প্রিয় আবারও বলল, ‘অবশ্য আমিই কখনও সাহস করে তাদের সামনে দাঁড়াইনি।’

প্রিয়র দেরি দেখে রাদিদ নিচে নেমে এলো। প্রিয় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত মেয়ে ও ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। অবশেষে চিনতে পারল। চিনতে পারার পরে তার ভেতরের একটা সত্তা আনন্দিত হলো কিন্তু একইসাথে অপর একটা সত্তা আহত হলো। সে চায় না আবার বন্ধুত্বের বেড়াজালে আটকাতে। তার পক্ষে তা আর কখনোই সম্ভব নয়। তার আর তার বন্ধুদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। যা কখনোই ঘুচবার নয়।

তবে রাদিদের জন্য সবচাইতে বেশি শকিং ছিল প্রিয়র কথা। প্রিয়র বলা কথার কোনো মানেই সে বুঝতে পারছে না। তাই সে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কার ক্ষতি করেছিস তুই?’

ভরাট স্বরের কৌতূল মিশ্রিত কণ্ঠের করা প্রশ্নের মানুষটির প্রতি চোখ গেল প্রিয়, মোহনা আর ফাহমির। মোহনা আর ফাহমি স্তম্ভিত হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ সময়। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে চেনার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে তাদের উভয়ের মস্তিষ্ক। মোহনার খুব বেশি সময় লাগল না রাদিদকে চিনতে। তার ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ‘রাদিদ!’

আর সাথে সাথেই আনন্দ উল্লাসে নৃত্যে মশগুল হয়ে মাদল বেজে উঠার মতো শব্দ করে উঠল। মোহনার মনে উদয় হলো একটি সহজ অথচ সময়ের তরে সবচাইতে কঠিন প্রশ্নটা;
বন্ধুরা কি সবাই আবার এক হতে চলেছে! ফাহমিও এবার চিনতে পারল। উভয়ে সমস্বরে বলে উঠল, ‘রাদিদ! তুই এখানে?’

‘হুম।’ ছোট্ট করে জবাব দিল রাদিদ।

ফাহমি গিয়ে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিল রাদিদকে। রাদিদের মধ্যে স্পষ্ট সঙ্কোচ। ফাহমি অভিযোগের সুরে বলল, ‘তুই খুব নিষ্ঠুর! আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিসনি!’

মোহনা গাল ফুলিয়ে বলল, ‘একদিন তোর গার্লফ্রেন্ডদের একটু বকেছিলাম । আর তাই তুই এতো বড়ো শাস্তি দিলি?’ মোহনার চোখে স্পষ্ট জলের উপস্থিতি।

রাদিদ এবার নিজে খুব অসহায়বোধ করছে। প্রসঙ্গ এড়াতে সে প্রিয়র পুরো বিষয়টা জানার জন্য ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘আমি না তোদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু খুলে বল তো।’

মোহনা তাকে সংক্ষেপে পুরোটা বলল। সবটা শোনার পর সে থম ধরে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তার বন্ধুদের মধ্যে এত কিছু হয়ে গেল অথচ সে এসবের কিছুই জানে না! তার নিজস্ব কিছু কারণ অবশ্য ছিল। তবুও সে বন্ধুদের একটাবার খোঁজ নেয়নি। এই বিষয়টা তাকে আজ বড্ড কষ্ট দিচ্ছে।

‘রাদিদ! তুইও এখন আমাকে ক্ষমা করবি না। তাই না?’ প্রিয় কান্না করতে করতে বলল, ‘আমি জানি তোরা সবাই আমাকে পর করে দিবি। তাইতো আমি দেশে আসতে চাই না। আমার দাদু সুস্থ হলে আমি আবার ফিরে যাব। তোদের সকলের ঘৃণা ভরা চোখের দিকে আমি তাকাতে পারব না। আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট।’

মোহনা প্রিয়র কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘শুধু তুই একা কষ্ট পাচ্ছিস কে বলেছে? তুই জানিস তোর ওই কান্ডের জন্য আমাদের বন্ধুত্ব তো নষ্ট হলোই। আরও কত ক্ষতি হয়েছে তা তুই ধারণাও করতে পারবি না। সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের অতল।’

প্রিয় আর রাদিদ মোহনার দিকে তাকিয়ে প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কী বলছিস?’

‘হুম। একদম ঠিক বলছি।’ মোহনা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘অতলের ফ্যামিলিতে কী হয় তা তো আমাদের অজানা নয়। ছেলেটা বাসায় কারো কাছ থেকে ভালোবাসা পেত না। যতটুকু ভালোবাসা পেত তা শুধু তার মায়ের কাছ থেকে। এর বাইরে শিহরণ আর তার বোন ছিল ওর দুনিয়া। শিহরণকে সে তার ভাই ভাবতো। আর বহ্নির সাথে সে তার সমস্ত কিছুই শেয়ার করতো। সবকিছু। বলতে গেলে অতল শিহরণের থেকেও বেশি কাছে ছিল বহ্নির। অথচ তোর করা একটা ভুলের কারণে ওর দুনিয়াটাই মিথ্যে হয়ে গেল। শান্ত অতল আজ কতটা বেপরোয়া হয়ে গেছে তা তুই ধারণাও করতে পারবি না।’

‘তুই এসব কী করে জানলি? অতলের সাথে তো তোর কোনো যোগাযোগ ছিল না।’

‘এসবকিছু জেনেছি বহ্নির কাছ থেকে।’

‘বহ্নি কী করে জানলো?’ প্রিয়র পাল্টা প্রশ্ন।

‘বহ্নি সবসময় তার ভাইয়ের বন্ধুদের একসাথে দেখতে চেয়েছে। সেই প্রয়াস মেয়েটা আজও করছে। সেই চেষ্টার বদৌলতে সবার বিষয়ে খোঁজ রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। আর অতলকে বহ্নি কতটা পছন্দ করে তা নিশ্চয়ই তোর অজানা নয়? অতলের সমস্ত খবর
জেনেছে অতলের বন্ধু আয়মানের কাছ থেকে।’

প্রিয়র চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। বিবেকের দংশনে পুড়ছে সে। প্রিয় আজ অনুতপ্ত।

রাদিদের চোখে জমেছে অনাকাঙ্ক্ষিত অশ্রুবিন্দু। মনে মনে সে ভীষণ অবাক হচ্ছে বহ্নির কথাটা ভেবে। এতটা করেছে সে! তার বুকের ভেতরে কষ্টগুলো মোচড় দিয়ে উঠতে চাইছে। কেন যেন মনটা অবাধ্য হয় বারেবারে। যা কখনোই পাবার নয় তা কেন পেতে চায় অবাধ্য মন বারেবারে! বহ্নি তার কৈশোরের তাড়নায় মনের গহীনে পোষণ করা এক অনভিপ্রেত অভিলাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। যেই অভিলাষ থেকে তাকে মুক্তি পেতেই হবে।

ফাহমি এবার মুখ খুলল। বলল, ‘এবার সব দোষ স্বীকার করে নে অন্ততপক্ষে। অতল তো ভুল বুঝে আছে শিহরণকে। শিহরণের ভুলটাও পুরোপুরি ভাঙ্গেনি।’

মোহনা প্রিয়র দু’হাত ধরে অনুনয় করে বলল, ‘চল না আমরা সব বন্ধুরা আবার এক হয়ে যাই। মনের মধ্যে এত রেষারেষি পোষণ করে আমরা কি খুব সুখে ছিলাম? তুই সত্যি করে বল তো তুই কি খুব আনন্দ পেয়েছিস তোর করা ভুলের জন্য? আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবার কারণে তোর কি কখনো অনুতাপ হয়নি? কখনও কি মনে হয়নি যে তুই ভুল করেছিস?’

‘বারবার মনে হয়েছে। বারবার। কিন্তু আমি কখনও সাহস যুগিয়ে উঠতে পারিনি। নিজের ভুলটা মনে মনে স্বীকার করলেও ক্ষমা চাওয়ার সাহসটা কেন যুগাতে পারিনি।’ প্রিয় কান্না ভেজা কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল।

রাদিদের সবকিছু বিষাক্ত মনে হচ্ছে। এমনিতেই তার জীবনে এত যন্ত্রণা। তার উপর এখন এসব শোনার পর তার নিজেকে দিশেহারা লাগছে।
সে তিক্ত গলায় বলল, ‘তোরা থাক। আমি যাচ্ছি।’

ফাহমি তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাহ্! তুই দেখছি দিব্যি ভুলে গেছিস আমাদেরকে। একবার জানতেও চাইলি না কেমন আছি!’

এটুকু বলেই ফাহমি রাদিদকে আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘তোকে ভীষণ মিস করেছি দোস্ত।’ পরক্ষণেই কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,’বিশেষ করে কোন ব্যাপারটার জন্য জানিস?’ ফাহমি রাদিদকে প্রশ্ন করলেও তার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বলতে শুরু করল, ‘যখনই কোনো সুন্দর মেয়ে দেখতাম তখনই মনে হতো; ইশ! এখন যদি রাদিদ থাকত তাহলে এখনই মেয়েটাকে পটিয়ে চুটিয়ে প্রেম করত।’

রাদিদ হাসল। প্রাণখোলা হাসি। তার মনে হলো অনেকদিন পরে সে হেসেছে। স্মিত হেসে বলল, ‘রাদিদ এখন নাইভ হয়ে গেছে। প্রে বয় ট্যাগ কেড়ে নিয়েছে সময়।’

মোহনা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল, ‘সে কী রে! তোর ট্যাগ কেড়ে নেওয়া হয়েছে আমাদের একবার জানালি না পর্যন্ত। আচ্ছা আমরা নিজেরাই না হয় তোকে আবার সেই ট্যাগ দিব। চলবে তো?’

রাদিদ সহাস্যে বলল, ‘উঁহু! সময় কেড়ে নিয়েছে। আর আমি ইচ্ছকৃতভাবে বর্জন করেছি সেই ট্যাগ। তাই বর্জনকৃত ট্যাগ আমার আর চাই না।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তোকে এই ফালতু ট্যাগ আর দিব না। এখনকার রাদিদকেই আমাদের ভীষণ ভালো লাগছে।’ প্রিয় বলল, মৃদু হেসে।

‘এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো সব বন্ধুরা একসাথে হওয়া। আর যত প্রকার ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে তার অবসান করা। এই কাজে কোনো প্রকার ইগো যেন কেউ না দেখায়। এটা আমার অনুরোধ।’ মোহনা প্রিয়র দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এই অনুরোধটা স্পেশালি তোর কাছে করছি। প্লিজ একটু কো-অপারেট কর আমাদের সাথে। ঠিক আছে?’

প্রিয় মাথা নিচু রেখেই বলল, ‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আমার কারণে যেসব ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো কখনোই ঠিক হবে না। তবে ভুল বোঝাবুঝির অবসানের জন্য আমার যতটুকু করা লাগে তা আমি অবশ্যই করব। কথা দিলাম।’

প্রিয়র কথা শুনে মোহনা প্রিয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই আমাকে অনেকটা রিলিফ দিয়েছিস। অনেক ধন্যবাদ তোকে।’

রাদিদকে উদ্দেশ্য করে ফাহমি ফিসফিস করে বলল, ‘দেখছিস, বান্ধবীকে কেমন করে জড়িয়ে ধরেছে। অথচ আমার ফাটা কপাল আমার বউ হয়েও তার হাতে পায়ে ধরতে হয় শুধু একবার জড়িয়ে ধরার জন্য।’

রাদিদের এবার আরেক দফা অবাক হবার পালা। সে সবিস্ময়ে ফাহমির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোরা বিয়ে করেছিস?’

‘শুধু কি বিয়ে করেছি? বিয়ের আগে চুটিয়ে প্রেম করেছি দুজনে মিলে।’

‘কীভাবে হলো?’ রাদিদ এখন চূড়ান্ত অবাক।

রাদিদের বিস্ময়াভূত চেহারা দেখে ফাহমি যেন ভীষণ মজা পেল। বলল, ‘প্রেম কী শুধু তুই করতে পারিস? আমিও করে দেখালাম।’ ফাহমি তার শার্টের কলার উঁচু করে গর্ব করার ভঙ্গিতে বলল, ‘শুধু কি প্রেম করে দেখালাম? বিয়েটাও সবার আগেই করে দেখিয়েছি। এখন শুধু আমার বাবুর অপেক্ষায় দিন কাটে আমার!’

‘তোর বাবুটা আবার কে?’

‘দূর! তুই দেখি কিচ্ছু বুঝিস না। প্রেম করা ছেড়ে দেবার পরে তুই নিভৃতবাসী হয়ে গেছিস না-কি?’

ফাহমির বলা কথার মানে বুঝতে পেরে রাদিদের নিজেকে মহাবেকুব মনে হতে লাগল। সে
বুঝল তার মাথা আজ একদিনেই এত লোড নিতে পারছে না। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল সে। আজকে আর কোনো প্রশ্ন করবে না বলে মনে মনে পণ করল। মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে থাকল বন্ধুদের পাশে।

____________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৬

অন্ধকার জেঁকে বসেছে পুরো ছাদ জুড়ে। গিটার হাতে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে শিহরণ। অনেকদিন পরে গিটার হাতে নিল সে। তবে আজ শত চেষ্টাতেও গিটারে কোনো সুর তুলতে পারল না। কণ্ঠ দিয়েও কোনো গান বের হতে চাইছে না। অগত্যা বিশাল অন্তরীক্ষে দৃষ্টি নিবন্ধ করে চেয়ে রইল নিবিষ্টচিত্তে। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের ছুটোছুটি, জমানো আবেগগুলো শব্দবন্দী হবার অপেক্ষায়…! অথচ আজ তার নিজেকে শব্দহীন কোনো এক আগন্তুকের মতো মনে হচ্ছে। হঠাৎই বহ্নি আর তার মধ্যের সেদিনের কথাগুলো রোমন্থন করতে লাগল।

‘তুই আমাকে না বলে ওর সাথে কেন দেখা করেছিস? কেন?’ ক্রোধান্বিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল, শিহরণ।

আচমকা শিহরণের এভাবে রেগে যাওয়ায় বহ্নি থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। হিমশীতল গলায় প্রতিবাদের সুরে বলল,
‘ভাইয়া! তুমি আমার কথা তো শুনো। আমি কি বলতে চাই তা তো একবার শুনবে না-কি?’

‘আমি এটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না তুই আমাকে না জানিয়ে অতলের সাথে দেখা করেছিস। আর আমাকে জানাচ্ছিস এত দিন পরে। তুই আমাকে হতাশ করেছিস। আমি তোর কাছ থেকে এটা আশা করিনি।’ শিহরণ আশাহত হয়ে বলল।

বহ্নি হাল ছাড়ল না। সে আগের মতো কণ্ঠের তেজ বহাল রেখে বলল, ‘ভাইয়া! তুমি মাঝেমধ্যে এত শর্ট টেম্পার্ড কেন হয়ে যাও বলো তো? আমি কী বলতে চাই একটা বার শুনো!’

শিহরণ বহ্নির কথা শুনে কিছুটা শান্ত হলো। অস্থির পায়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর বলল, ‘বল কি বলতে চাস?’

‘অতল ভাইয়া যেমন তোমাকে ভুল বুঝেছে তেমনি তুমিও অতল ভাইয়াকে ভুল বুঝেছ। অতল ভাইয়াকে তুমি যতটা খারাপ ভাবছ সে তেমন খারাপ মোটেও নয়। অতল ভাইয়ার জায়গায় যদি আমি হতাম বা তুমি হতে তবে বোধহয় আমরা আরও বেশি খারাপ হয়ে যেতাম। নিজেদের কষ্ট কমাতে হয়তো অন্যের ক্ষতি করে বসতাম। অতল ভাইয়া তেমন বড়ো ধরনের কোনোকিছুই করেনি। আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছে কারণ তুমি অতল ভাইয়াকে বুঝলে না।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বহ্নি হাঁপিয়ে উঠল। তার চোখে পানি। সে আবারও বলতে শুরু করল, ‘জানো ভাইয়া! অতল ভাইয়া কী পরিমাণ মানসিক কষ্ট ভোগ করেছে তুমি তার ধারণাও করতে পারবে না। তার ভাই, বাবা প্রতিনিয়ত তাকে মানসিক কষ্ট দিয়েছে। এতকিছু সহ্য করে সে যে এখনও স্বাভাবিক আছে সেটাই তো অনেক। আমি হলে এটা কখনোই পারতাম না,ভাইয়া। আমরা সবকিছু পেয়ে ভালো আছি। অতল ভাইয়া কিছু না পেয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভালো থাকার অভিনয় করে বেড়াচ্ছে।’

বহ্নির কথা শুনে শিহরণের অনুভূতি সম্পর্কে বোঝা গেল না। তবে সে মরিয়া হয়ে জানতে চাইল, ‘তুই এত কিছু কীভাবে জানলি? অতল বলেছে?’

‘না।’ দৃঢ়তার সাথে বলল, বহ্নি, ‘তোমার কী মনে হয় সে এই ব্যাপারে কিছু বলবে আমাকে?’

‘তাহলে তুই এইসব কীভাবে জেনেছিস?’ শিহরণের পাল্টা প্রশ্ন, অধৈর্য গলায়।

‘সে অনেক কাহিনি ভাইয়া। তবে আমার ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় তা জানতে পেরেছি। কারণ সায়মার কাজিন আয়মান হচ্ছে অতল ভাইয়ার বন্ধু। আমি এই সবকিছু তার কাছ থেকেই জেনেছি।’

বহ্নি শিহরণের দিকে চাইল আরেকবার। তার অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছে সে। তবে এই মুহূর্তে শিহরণের অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা করা যাচ্ছে না।

শিহরণকে চুপ থাকতে দেখে বহ্নি আবারও বলতে শুরু করল, ‘ভাইয়া! অতল ভাইয়ার সাথে কথা বলার সুযোগ এবার পেতে চলেছ। আমি জানি অনেক দেরি হয়েছে। কিন্তু সব বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত থাকার চাইতে সবকিছু ঠিক করে নেওয়াটাই উত্তম নয় কি?’

বহ্নির বলা শেষ কথাটাই শিহরণের কানে বেজে চলেছে ক্রমাগত। হুম, সবকিছু ঠিক করে নেওয়াই উত্তম । সে তো এতোদিন তাই চেয়েছে। তবে আজ আবারও কেন কোনো এক অব্যক্ত দ্বিধা তাকে গ্রাস করে ফেলল! বহ্নি নিজে অতলের সাথে দেখা করেছে; এটাই কি এই দ্বিধার কারণ? না-কি ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া সেই দুঃস্বপ্ন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তার মনে এখনও তার বিষাক্ত প্রভাব রেখে দিয়েছে? শিহরণ আপনমনেই নিজেকে বারংবার প্রশ্ন করে চলেছে। দমবন্ধ অনুভূতি হতে লাগল তার।

এমন সময় তার একজনের কথা ভীষণ মনে পড়ল। গিটারটা এক পাশে রেখে মোবাইলটা হাতে নিল। ফোনের গ্যালারি থেকে সেদিনকার ছবিটা বের করল সে। পিয়াসী মনের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে এই ছবিই এখন উত্তম পন্থা। তবে হৃদয় বাস্তবিক মানুষের সঙ্গ পেতে মরিয়া হয়ে উঠল।

প্রিয়তমা
তোমাতেই আমি মরেছি
তোমাতেই আমি হারিয়েছি
নিজেকে বারংবার!

প্রিয়তমা
শ্রাবণের বারিধারা দেখা হয়নি
কাশফুলের শুভ্রতা ছোঁয়া হয়নি
একসাথে হাতে হাত রেখে
দুজনে মিলে ছুঁয়ে দেব বলে।

প্রিয়তমা
আকাশের নীলে তাকিয়েছি
অগণিতবার, ক্ষণে ক্ষণে
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছি
একসাথে হারাব বলে।

প্রিয়তমা
তোমাতে মোহাবিষ্ট হয়েছি বলেই
আমি মুগ্ধ হয়নি কোনোকিছুতেই
সৌন্দর্যে ভরা কোনো পুষ্প দেখেও
মৌতাত হয়ে ডুবতে যাইনি
তোমাতে মৌতাত হয়ে ডুব দেব বলে।

‘প্রিয়তা! আজ যে তোমার সঙ্গ পেতে অবাধ্য মন মরিয়া হয়ে উঠছে বারেবারে!’ শিহরণ যেন স্বগতোক্তি করল।

বহ্নি সারা ঘরে শিহরণকে খুঁজতে লাগল। শিহরণের রুমে গিয়ে তাকে খুঁজেও পেল না। ওয়াশরুম, ব্যালকনি সবখানে দেখেও তাকে না পেয়ে শেষমেশ ছাদে আসল। ছাদে এসেই অন্ধকারে বসে থাকতে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বহ্নি। শিহরণ তার ভাবনাতে এতটাই মশগুল ছিল যে বহ্নির আসাটা অনুভব করতে পারল না।

বহ্নি শিহরণের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ভাইয়া! কী ভাবছ?’

শিহরণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বহ্নিকে তার পাশে দেখে স্মিত হেসে বলল, ‘কই কিছু না।’

‘সত্যি বলছ?’

শিহরণ নিরুত্তর। বহ্নি অবিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া!
তুমি ছোঁয়া আপুকে তোমার মনের কথা জানিয়ে দাও।’

শিহরণ সবিস্ময়ে তাকাল বহ্নির দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘তুই কি মন পড়তে পারিস?’

বহ্নি হেসে বলল, ‘উঁহু! তবে আমার ভাইয়ের মনে কী চলতে পারে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।’

শিহরণ হাসল। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘এখন বলাটা কি ঠিক হবে?’

‘তাহলে কখন বলবে?’ জিজ্ঞাসু চাউনিতে তাকাল বহ্নি। পরক্ষণেই শীতল গলায় বলল, ‘এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছ। আর দেরি করার কোনো মানে আমি দেখছি না।’

শিহরণ সাত পাঁচ না ভেবে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। শিহরণকে এভাবে আচমকা উঠে দাঁড়াতে দেখে
বহ্নি বলল, ‘কী হয়েছে? কোথায় যাচ্ছ?’

শিহরণ প্রশস্ত হেসে বহ্নিকে বলল, ‘বার্বি ডল! আমি এখনই যাচ্ছি আমার প্রিয়তার কাছে।’

কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না শিহরণ।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ছোঁয়াদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামাল। তারপর ছোঁয়ার রুমের ব্যালকনির দিকে চাতক পাখির ন্যায় তাকাল। রুমের আলো নিভানো। শিহরণ হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকল।

বিড়বিড় করে হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছ কেন, প্রিয়তা?’ মুখে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘তোমাকে আজ ঘুমোতে দিলে তো।’

শিহরণ মোবাইলটা বের করে ছোঁয়াকে কল দিল। প্রথম তিনবারই কল রিসিভ হলো না। পরের বার কল রিসিভ করতেই ছোঁয়া ঘুম জড়ানো গলায় বলল, ‘হ্যালো!’

কল রিসিভ করাতে শিহরণ বেশ খুশি হলো। খুশিতে গদগদ হয়ে সে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল, ‘একবার ব্যালকনিতে আসবে? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’

ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে শিহরণ কলটা কেটে দিয়ে পুনরায় কল করল।

এবারও ছোঁয়া ঘুমো ঘুমো চোখে কলটা রিসিভ করল।
শিহরণ বলল, ‘একবার ব্যালকনিতে আসবে? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’

এবার শিহরণের কণ্ঠ শুনে ছোঁয়া লাফিয়ে উঠে বসল। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইল। চোখ পিটপিট করে মোবাইলের স্ক্রিনে থাকা নাম্বারটা বারবার চেক করছে। ঘটনা সত্যি কি মিথ্যা তা বোঝার প্রাণপণ প্রচেষ্টা করছে। অবশেষে নিজের হাতে নিজেই চিমটি কাটল। মনে মনে বলল, ‘শিরহণ সত্যি এসেছে?’
দ্রুত বিছানা থেকে উঠে ঘরের লাইটটা জ্বালাল।

শিহরণ অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। ব্যালকনির দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে ছোঁয়ার নাম্বারে আবারও কল করল। রুমের আলো জ্বালাতে দেখে শিহরণের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল।

ঠিক তখন ছোঁয়াকে ব্যালকনি খুলে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে দেখল। শিহরণ হাত নাড়ল। ছোঁয়া হাতের ইশারায় জানতে চাইল, ‘এত রাতে এখানে কী?’

শিহরণ হাতের ইশারায় বলল, ‘কলটা রিসিভ করো।’

ছোঁয়া কল রিসিভ করতেই শিহরণ বলল, ‘একবার নিচে আসবে?’

‘কী আশ্চর্য! তুমি এত রাতে এখানে কী করছ?’

‘বললাম না একটু আগে। তোমাকে দেখতে মন চাইছিল। ছবি দেখেও মন ভরছিল না তাই চলে এলাম আমার প্রিয়তাকে দেখতে।’

‘ওয়েট! ছবি মানে? কার ছবি দেখছিলে?’

‘তোমার ছবি। আর কার ছবি আমি দেখতে পারি?’

‘আমার ছবি তোমার কাছে কীভাবে?’

‘উফফো! এত প্রশ্ন করছ কেন? তুমি কি নিচে আসবে না-কি আমি দেয়াল টপকে আসব?’

‘এত রাতে তুমি এসব কী শুরু করেছ? কাল তো এমনিতেই দেখা হতো।’

‘তুমি আসবে কি না বলো?’

‘আচ্ছা, আসছি।’

ছোঁয়া গেটের কাছাকাছি এসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কী বলতে এসেছ বলো।’

শিহরণ তেজী গলায় বলল, ‘গেট খুলে দাও। আমি ভেতরে আসব।’

‘ভেতরে আসা লাগবে কেন? যেখানে আছ সেখান থেকেই বলো।’

‘তুমি গেট না খুললে কি আমি ভেতরে আসতে পারব না ভেবেছ?’ শিহরণ ভ্রু কুঁচকে বলল।

ছোঁয়া এবার তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘কেন এসেছ বলে বিদেয় হও না। এত রাতে আমাকে কেন শুধু শুধু জ্বালাচ্ছ?’

‘গেট খুলো। তারপর কারণ বলব।’ শিহরণ বিরক্ত গলায় বলল।

ছোঁয়া বাধ্য হয়ে রাগে গজগজ করতে করতে গেট খুলল। শিহরণ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’ তুমি তোমার রুমে যাও। আমি তোমার ব্যালকনিতে আসছি। আর হ্যাঁ নুডলস আর কফি নিয়ে আসবে। আমার খুব খিদে পেয়েছে।’

ছোঁয়া এবার চূড়ান্ত অবাক। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল, ‘কী বলবে বলে বিদেয় হও তো। আমি এত রাতে কিছুই করতে পারব না।’

‘পারব না বললে তো হবে না। ড্রাইভ করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এবার আমার কিছু খাওয়া দরকার।’ শিহরণ বাঁকা হেসে বলল।

‘তোমাকে কি আমি ড্রাইভ করে এখানে আসতে বলেছি?’ ছোঁয়া শিহরণের সামনে এসে এক হাত কোমরে রেখে অপর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে প্রতিবাদের সুরে প্রশ্ন করল।

‘আমাকে বলতে হবে কেন? তুমি মনে মনে এটাই চাইছিলে তাই কষ্ট করে চলে এলাম।’ শিহরণ পূর্বের হাসি ঠোঁটে রেখে বলল।

‘এই আমি চাইছিলাম কে বলেছে?’

‘কাউকে বলতে হবে কেন? তোমার আর আমার মধ্যের ট্যালিপ্যাথির মাধ্যমে জেনেছি।’

‘কী জ্বালা! আমি কিন্তু মাকে ডেকে তুলব।’

শিহরণ প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘এই কাজটা তুমি করবে না। আমার জায়গায় তোমার পাণিপ্রার্থী পিচ্চি আরাভ হলেও তোমার এই বাচ্চামো মার্কা কথাটা বিশ্বাস করতো না।’ ঠোঁট টিপে হেসে শিহরণ বলল, ‘তাড়াতাড়ি যাও।’

ছোঁয়া চলে যেতেই শিহরণ বাগান থেকে বেশ কয়েকটা গোলাপ ফুল ছিঁড়ে নিল। ছেঁড়ার সময় বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল, ‘স্যরি! এই রাতে তোমাদের বিরক্ত করছি। আমি আপারগ, ক্ষমা করো।’

তারপর ফুলগুলো পেছনে রেখে পাইপ বেয়ে ছোঁয়ার ব্যালকনিতে পৌঁছাল। পৌঁছেই আরাম করে আধশোয়া হয়ে বসে রইল বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে। বিড়বিড় করে বলল, ‘আর পারছি না নিজের মধ্যের জমানো আবেগ জমা রাখতে । তাই আজ আমার মনের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে জমিয়ে রাখা আবেগগুলো শব্দবন্দী করে তোমায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।’

ছোঁয়া কিচেনে গিয়ে চোরের মতো করে ধীর পদক্ষেপে কোনো প্রকার শব্দ যাতে না হয় তাই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে নুডলস তৈরী করল। তারপর এক কাপ কফি বানিয়ে নিল। মনে মনে শিহরণকে আচ্ছামতো বকা দিল এই রাতে তাকে বিরক্ত করার জন্য। তার ঘুমটাও নষ্ট করে দিল।

ব্যালকনিতে আসতেই শিহরণ ছোঁ মেরে ছোঁয়ার হাত থেকে নুডলসের বাটি নিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্কস, প্রিয়তা।’

ছোঁয়া কফির কাপটা নিজের হাতে ধরে রাখল। শিহরণ গপাগপ খেতে খেতে বলল, ‘বাহ্! তুমি তো খুব ভালো রাঁধতে পারো। না-কি আমার জন্য স্পেশাল করে রেঁধেছ বলে আমার ভালো লাগছে? কিছু মিশিয়েছ?’

‘হুম, মিশিয়েছি তো। আমাদের বাসায় এখন ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে। তাই মাঝেমধ্যে অনাকঙ্ক্ষিত কেউ এলে তাদের খাবারের সাথে ইঁদুর ফ্রাই মিশিয়ে দিই।’

‘ইয়াক! এত জেলাস কেন তুমি?’

‘এখন আবার জেলাসির কী করলাম?’

‘ভেবেছিলে আমি একা খাব। তাই না? ধরো এবার তুমি খাও। ইঁদুর ফ্রাই আমি একা খাব কেন? তোমাকেও খেতে হবে।’ শিহরণ ছোঁয়ার হাত ধরে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি নিজেই খাইয়ে দিচ্ছি।’

‘কেন এসেছ?’

‘বললাম তো একবার।’

‘আমি আবার প্রশ্ন করেছি। এবার ঠিকঠাক উত্তর দাও।’

‘তোমাকে দেখতে।’

‘আমাকে কেন দেখতে হচ্ছে তোমার?’

‘কারণটা বুঝতে পারছ না?’

‘আমি বুঝতে চাই না। জানতে চাই।’

‘জানাতেই তো এলাম।’

আকাশে আজ তারার মেলা। পূর্ণ চাঁদটা যেন তার রুপালি আলো ছড়িয়ে আকাশের মাঝে থাকা সমস্ত তারাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। শিহরণ অনেকটা জোর করেই খাইয়ে দিল ছোঁয়াকে। তারপর আয়েশ করে কফি খেল। এদিকে ছোঁয়া প্রচণ্ড রাগে মনে মনে ইচ্ছেমতো বকছে তাকে ।

কফি শেষে শিহরণ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বকা দেওয়া শেষ? না-কি আরও কিছু বাকি আছে?’

ছোঁয়া চমকে উঠে দাঁড়াল। শিহরণ তার সাথে করে আনা ফুলগুলো ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলো তোমার জন্য। আমার মনের ভিতরের জমানো আবেগ শব্দবন্দি করে তোমাকে জানাতে এলাম ভালোবাসার প্রতীকের মাধ্যমে।’

ছোঁয়া হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল সহসা। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম আওয়াজ হচ্ছে ক্রমাগত। মস্তিষ্কে ছুটোছুটি করছে অসংখ্য প্রশ্নের ঝাঁক। এতদিনের চাওয়া কি তবে পূর্ণতা পেতে চলেছে? তার মাথা ধরে এলো মুহূর্তেই। নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুটা সময় লাগল তার। পরক্ষণেই নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করল, ‘কী বলতে চাইছ তুমি?’

_____________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৭

শিহরণ ছোঁয়ার দু’হাত আলতো করে ধরে বলল, ‘ভালোবাসি।’

শিহরণের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে ছোঁয়ার চোখ ভিজে এলো। এত দীর্ঘ অপেক্ষার পরে এই শব্দটা শিহরণের মুখ থেকে শুনতে পেয়ে সে দিশেহারা হয়ে পড়ল। আচমকাই কাঁদতে শুরু করল সে। শিহরণ প্রশ্ন করল, ‘কাঁদছ কেন?’

শিহরণের প্রশ্ন শুনে ছোঁয়ার কান্নার দমক যেন বেড়ে গেল। তাতে শিহরণ কিছুটা ভড়কে গেল। তার মনে বেশ কিছু অযাচিত প্রশ্নের উদয় হলো। প্রথমেই উদয় হলো, ‘তবে কি তার এত দিনের ধারণা ভুল ছিল? তবে কি ছোঁয়া অতলকে ভালোবাসে?’

মস্তিষ্কে এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উদয়ে শিহরণ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল মুহূর্তেই। সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন?’ পরক্ষণেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করো?’

ছোঁয়ার কান্নার বেগ আরও একধাপ বেড়ে গেল। শিহরণের ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে। তিরিক্ষি মেজাজে নিয়ে অধৈর্য গলায় সে বলল, ‘কী হলো! তোমাকে তো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করা মেয়েদের মতো মনে হয়নি কখনও। কাঁদছ কেন সেটা তো বলো।’

ছোঁয়া নিরুত্তর। শিহরণ এবার নিজের চোয়াল শক্ত করে আড়ষ্ট গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি অতলকে ভালোবাসো?’

ছোঁয়া ক্ষুব্ধ চোখে শিহরণের দিকে চাইল। তারপর আচমকাই শিহরণের বুকের উপর কয়েক দফা কিল ঘুসি বসিয়ে দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি কাকে ভালোবাসি জানো না তুমি?’

শিহরণের মনে হলো তার বুকের উপর থেকে বিশাল এক পাথর সরে গেল। তার মনটা আনন্দে নেচে উঠল মুহূর্তেই। হৃদয়ের গহীনে লুকানো সমস্ত বিষাদ আনন্দে পরিণত হয়ে গেল। মেঘবতী আকাশের জমানো মেঘ যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল আর তার হৃদয় এক অব্যক্ত ও দুর্জ্ঞেয় প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল হাসির রেখা। নিজের ভালোলাগার সমস্ত অনুভূতি লুকিয়ে কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে সে বলল,
‘আরে বাবা! না বললে জানবো কী করে?’

‘ডায়েরিটা পেয়েছ না? ডায়েরি পড়েও জানতে পারোনি?’ অভিযোগের সুরে বলল, ছোঁয়া।

‘আমি আবার কবে তোমার ডায়েরি পেলাম?’ শিহরণ লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল।

‘মিথ্যুক কোথাকার। সবসময় মিথ্যা কথা বলো। আমি তো জানি আমার দিকে চুপিচুপি নজর রাখা মানুষটা তুমি ছিলে।’

শিহরণ চরম বিস্ময়াভূত হলো। বলল, ‘কে বলেছে এসব?’

‘তুমি নিজেকে কি ভাবো? আমি কিছুই বুঝতে পারি না, কিছুই জানতে পারব না ভেবেছ।’

শিহরণ মনে মনে মায়াকে এক প্রস্থ বকা ঝকা করল। বিড়বিড় করে বলল, ‘এটা নিশ্চয়ই মায়ার কাজ হবে।’
তারপর ধৈর্যচ্যুত হয়ে বলল, ‘আমার উত্তর পেলাম না তো।’

ছোঁয়া শিহরণকে ছেড়ে দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘আমি তো তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। আবার বলো তারপর ভেবে দেখব।’

শিহরণ আবারও গোলাপফুলগুলো ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভালোবাসি প্রিয়তা। অনেক বেশি ভালোবাসি।’

ছোঁয়া এবার ফুলগুলো হাতে নিয়ে আবারও শিহরণকে জড়িয়ে ধরল। ইচ্ছেমতো কাঁদতে শুরু করল। শিহরণ বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে তার বাহুবন্ধনে অবদ্ধ করল ছোঁয়াকে। ছোঁয়ার চোখের জলে এদিকে শিহরণের শার্টের উপরের অংশ খানিকটা ভিজে গেছে। তা অনুভব করতে পেরে শিহরণ দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘তোমার চোখের জল দিয়েই কি আমাকে গোসল করিয়ে দিবে?’

ছোঁয়া শিহরণের কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘আমি তোমার উপর খুব রাগ করেছি।’

‘কেন?’

‘এতদিন দূরে ছিলে কেন?’

‘এতদিন ভালোবাসতাম না তো।’

ছোঁয়া মুখ তুলে চাইল শিহরণের দিকে। আবছা আলোতে তার অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না। ছোঁয়া আবারও কয়েকটা কিল ঘুসি বসিয়ে দিল শিহরণের বুকে। শিহরণ তার হাত দুটো নিজের হাতে ধরে বলল, ‘আমি কি এখানে তোমার মাইর খেতে আসছি? সেই কখন থেকে মেরেই চলেছ। আমি ব্যথা পাই না বুঝি?’

ছোঁয়া কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, ‘মিথ্যুক। মিথ্যা কথা বলার উপর পি.এইচ.ডি করেছ। তাই না? তোমাকে আরও বেশি করে মারা উচিত। এত অল্পতে তোমার কিছুই হবে না।’

‘আমি কোথায় মিথ্যা বললাম?’

‘একদম চুপ থাকবে তুমি। আর কোনো কথা বলতে হবে না।’

‘যথাআজ্ঞা, প্রিয়তা।’

‘যথাআজ্ঞা না ছাই!’ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল ছোঁয়া, ‘ আমার কথা একটা বারও ভাবলে না!’

‘কে বলল ভাবিনি?’

‘এই ভাবার কোনো দাম আছে?’ জিজ্ঞাসু চাউনিতে তাকাল ছোঁয়া শিহরণের দিকে। বলল, ‘ সবসময় ফিলোসফি মার্কা কথাবার্তা। আজকে দয়া করে নিজের কাছেই রাখো তোমার ফিলোসফি। এই ধরনের ফিলোসফি কার থেকে শিখেছ?’

‘ফিলোসফি আসলো কোথা থেকে?’ শিরহণ না বুঝার ভান করল।

‘এতদিন তুমি অনেক ফিলোসফি ঝেড়েছ। আসলে তুমি একটা স্টুপিড। অন্য সবার কাছে তোমার এইসব বক্তব্য ফিলোসফি হতে পারে আমার কাছে এই সবকিছু হলো তোমার স্টুপিডিটি।’

শিহরণ ছোঁয়ার কথায় আহত হবার ভান করে মুখটা অসহায়ের মতো করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলল,
‘আর কতো অপেক্ষা করতে হবে আমায়? এবার তো বলো, ভালোবাসো কি না?’

‘তুমি মোটেই অপেক্ষা করোনি। অপেক্ষা করেছি আমি। এবার তোমার অপেক্ষার পালা।’

‘তার মানে তুমি বলবে না?’

‘একদম না।’ ছোঁয়ার একগুঁয়ে উত্তর।

‘ঠিক আছে। তাহলে আমিও আজকে তোমার বাসা থেকে যাচ্ছি না। এখানেই থাকব আজকে।’ শিহরণও নাছোড়বান্দার মতো করে বলল।

‘ঠিক আছে থাকো। আমার কোনো অসুবিধা নাই। এতক্ষণ নুডলস খেয়েছ। এখন বারান্দায় বসে বসে মশার কামড় খাবে।’ এটুকু বলে ছোঁয়া রুমে ঢুকে পড়ল।

‘উত্তর না শুনে আমি আজ কোথাও যাব না। বলে দিলাম কিন্তু।’ জেদী গলায় বলল, শিহরণ।

‘আমিও উত্তর দেব না। অপেক্ষা করাব তোমায়। এতদিন আমাকে অপেক্ষা করিয়েছ এবার তোমার পালা।’ মৃদু চেঁচিয়ে বলল, ছোঁয়া।

‘একটা নিষ্ঠুর মেয়েকে আমি ভালোবেসেছি।’ ব্যথিত কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

ছোঁয়া এবার ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে দিল। শিহরণ কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কাল। ছোঁয়া এবারও চেঁচিয়ে বলল, ‘কোনো লাভ নেই। অপেক্ষা তোমায় করতেই হবে।’

‘তুমি যে এত নিষ্ঠুর, হৃদয়হীনা তা তো জানা ছিল না।’ আহত কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

‘আজ তো জানলে। তাই না? আমার চাইতে তুমি অনেক বেশি নিষ্ঠুর, নির্দয়, হঠকারী, একটা স্টুপিড।’

‘আর কিছু বাকি থাকলে সেগুলোও বলে ফেল। সবটা একবারে শুনেই যাই।’

‘আজকে আর বলতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম পাচ্ছে আমার। একে তো আমার সুন্দর ঘুমটা নষ্ট করছ তার উপর আবার নিজের স্টুপিড মার্কা ফিলোসফি ঝাড়তে আসছে। হুহ্! এসবে আমি গলে যাব না। বলে দিলাম।’

শিহরণ বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল বারান্দায়। বিড়বিড় করে নিজের ভাগ্যকে গালি দিল। মায়াকেও বকল কিছুক্ষণ। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রইল বেশকিছুক্ষণ। হঠাৎ পরপর কয়েক দফা মশার কামড়ে লাফিয়ে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, ‘ব্যাটা, মশা! তোরাও দেখছি খুব নিষ্ঠুর। অসহায় কাউকে দেখতেই ঝাপিয়ে পড়লি!’

মশার জ্বালায় বসে থাকতে না পেরে উঠে পায়চারি শুরু করল। তারপর ছোঁয়ার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু যাইনি।’

ছোঁয়া নিরুত্তর। শিহরণ আবার বসে পড়ল। দু’হাতে নিজের চুল টেনে ধরল। তারপর আবার উঠে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল, ‘আজ বরফ গলবে না মনে হচ্ছে।’ রেলিং বেয়ে নামার চেষ্টা করার সময় তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সাথে সাথেই তা বাস্তবায়িত করার কাজে লেগে পড়ল।

রেলিংয়ের বাইরে এসে এক পা নিচে রেখে ব্যথা পাবার ভান করে আহ্ শব্দে চিৎকার করে উঠল। আর্তনাদ করে বলল, ‘আহ্! আমার পা-টা আজ গেল রে! নির্দয়, নিষ্ঠুর প্রাণীর কারণে আজ আমার পা-টা আহত হলো!’

শিহরণের আর্তনাদ শুনতে পেয়ে ছোঁয়া সাথে সাথে দরজা খুলে বলল, ‘কী হয়েছে? কোথায় ব্যথা পেয়েছ?’

শিহরণ মুখে হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে থাকল ছোঁয়ার দিকে। মনে মনে ভাবল, ‘বাহ্! এই নিঞ্জা টেকনিক তো বেশ কাজে আসল।’

‘এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছ?’

‘আমার উত্তর?’ তারপর ডান পা-টা উঠানোর সময় আহ্ শব্দ করে পুনরায় আর্তনাদ করে উঠল।

ছোঁয়া বলল, ‘সাবধানে করো না। এতটা কেয়ারলেস কেন তুমি?’

‘এবার তো বলো।’

‘এই উত্তর কি দিতেই হবে? তুমি বুঝতে পারো না?’

‘তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’

‘আগে এখান থেকে নামো। চেয়ারে বসে কোথায় ব্যথা পেয়েছ আমাকে দেখাও।’

‘আগে উত্তর শুনতে চাই প্রিয়তা।’

‘ভালোবাসি তো। এবার হয়েছে?’

‘মনে হলো আমি তোমার মাথায় গান পয়েন্ট রেখে ভালোবাসি কথাটা বলালাম।’ মুখ বাঁকিয়ে কথা বলেই শিহরণ মুখটা ঘুরিয়ে নিল।

‘ভালোবাসতাম, ভালোবাসি এবং ভবিষ্যতেও তোমাকেই ভালোবাসব।’

শিহরণ প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘তাহলে আমাকে বকতে কেন? ডায়েরিতে আমার কত শত বিচ্ছিরি ছবি এঁকেছ। তোমার আঁকার হাত জঘন্য, প্রিয়তা। আমার সুন্দর মুখটাকে কি এক বিচ্ছিরি কার্টুন হিসেবে এঁকেছ।’

‘তুমি আমার ডায়েরি নিয়েছ?’

‘একদম না। আমি কেন ডায়েরি নিতে যাব?’ হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ ওয়েট, তারমানে সত্যিই তুমি আমার ছবি একেছ?

‘ওসব তো রাগের মাথায় আঁকা।’ ছোঁয়া বলেই জিহ্বায় কামড় দিল।

‘হুম, চুরি ধরা পড়েছে। আর লুকিয়ে লাভ নেই। এই না-কি ভালোবাসা! ভালোবাসায় মানুষ প্রিয়জনের সুন্দর ছবি আঁকে আর তুমি আমার সুকুমার মুখশ্রীকে কী যে বানিয়েছ আল্লাহ মালুম!

‘অতটাও তো খারাপ হয়নি।’

শিহরণ মনে মনে বলল,’উঁহু! তোমাকে পুরস্কৃত করার মতো আর্ট হয়েছে।’

___________________________________

মোহনা, ফাহমি, আর রাদিদ চলে যাবার পরে প্রিয় নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকল অনেকক্ষণ। তার মাথায় আসছে না সে কীভাবে সবকিছু কনফেস করবে। শিহরণ আর অতল ওকে ক্ষমা করবে কি না সেই বিষয়েও সে যথেষ্ট সন্দিহান হয়ে পড়েছে।

এমন দ্বিধান্বিত অবস্থায় তার বন্ধু জিহানের কথা মনে পড়ল। সে ঝটপট জিহানকে ভিডিয়ো কল করল।

‘হেই! হোয়াটস আপ?’

‘আমি কী করব বুঝতে পারছি না, জিহান!’

‘হেই! হোয়াট হ্যাপেন্ড? টেল মি।’

‘জিহান, তুমি তো সবকিছুই জানো। আমি হঠকারিতা করে আমার বন্ধুদের জীবন বিশৃঙ্খল করে ফেলেছিলাম। এখন আমি সবকিছু কীভাবে ঠিক করব? প্লিজ হেল্প মি।’

‘ইয়াহ্! বিপদে পড়ে জিহানকে কল করা হয়েছে? এর আগে আমার কল কিন্তু রিসিভ করা হয়নি।’

‘জিহান, আমি সিরিয়াস। আমার সত্যিই তোমার সাহায্য লাগবে।’

‘তুমি ওদের সাথে দেখা করে সব কথা এক নিঃশ্বাসে বলে ফেল। তোমাদের বন্ধুদের সম্পর্কে তুমি আমাকে যা বলেছিলে তাতে আমার মনে হয় তারা তোমাকে মাফ করে দেবার সম্ভাবনাই বেশি।’

‘আমি ওদের সামনে কী করে দাঁড়াব? আমার খুব ভয় হচ্ছে জিহান।’

‘উগ্র আচরণ আর হঠকারিতা করার সময় মনে থাকে না?’

‘ঠিক আছে। তুমিও আমাকে সাহায্য করবে না। বুঝতে পেরেছি।’

‘হেই! আই ওয়াজ জাস্ট কিডিং।’

‘বাট ইট ওয়াজ ট্রু।’

‘লেট মি থিংক, ডিয়ার।’

‘মেক ইট ফাস্ট।’

‘এক কাজ করো। তুমি চিঠি লিখেও জানিয়ে দাও।’

‘সিমস্ বেটার।’

‘কার বুদ্ধি দেখতে হবে না?’

‘জিহান, আই মিসড ইউ আ লট।’

‘মি টু, প্রিয়।’

‘জিহান, তুমি কি আসবে?’

‘নো, আ’ম বিজি উয়িথ মাই বিজনেস ইস্যুস। ইউ নো রাইট?’

‘ইয়াহ্! থ্যাঙ্কস আ লট।’

প্রিয় জিহানের সাথে কথা শেষ করে চিঠি লিখতে বসে গেল। শিহরণ আর অতল দুজনের জন্যই দুটো চিঠি লিখল সে। চিঠি লিখা শেষে আবারও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল সে। তার ভাবনাতে বারবার আসছে অতল আর শিহরণ কি তাকে ক্ষমা করবে?
___________________________________

ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩২

ভীষণ ক্লান্ত থাকায় সকালে ঘুম থেকে উঠতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল রাদিদের। আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। ফাইজা বেগম নিজের রুমে আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন। সকালের নামাজ শেষে মর্নিং ওয়াক করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। তার শরীরটা এই ভালো তো এই খারাপ। তবে ইদানিং মর্নিং ওয়াকটা বেশ কাজে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে তার। এছাড়া বিশ্রামই এখন তার নিত্যসঙ্গী। বিশ্রাম না নিলে তার বড়ো খোকা ভীষণ কষ্ট পায় তিনি তা বুঝতে পারেন। সেই কারণেই শুয়ে বসে কাটান তিনি। কিন্তু কাজ ছাড়া তার ভালো লাগে না। তাও ছেলে যাতে খুশি থাকে সেই প্রচেষ্টায় ছেলের সামনে কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। ঘুমো ঘুমো চোখে হাঁটতে হাঁটতে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে রাদিদকে ব্রাশ করতে দেখে ফাইজা বেগম শোয়া থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে এলেন। তারপর একটা চেয়ার টেনে বসে শান্ত স্বরে বললেন, ‘বড়ো খোকা! আজ না হয় দোকানে যাস না। আরেকটু ঘুমিয়ে নে। আজকে আবির দোকান সামলাবে।’

আবির টেবিলে বসে নাস্তা করছিল। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে তার সকালের আমুদে মনটা মুহূর্তেই বিষণ্ন হয়ে গেল। মায়ের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘আমার কলেজ আছে, আম্মু। আমি দোকান সামলাতে পারব না।’

রাদিদ ব্রাশ করা শেষে নিজের রুমে চলে গেল। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তাই দ্রুত একটা শার্ট গায়ে চাপিয়ে দোকানের জন্য ছুটতে হবে।

পিউ একটা পাউরুটির টুকরোতে কামড় দিয়ে প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘কেন পারবে না? বড়ো মামা তো সবসময় একা হাতে সবকিছু সামলায়। তুমি না হয় একদিন করলে। তাতে এমন কী ক্ষতি হবে তোমার?’ আবির ওর দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। পিউ সেই দৃষ্টির তোয়াক্কা না করে হাত নেড়ে নেড়ে বিজ্ঞের মতো করে বলল, ‘একদিন কলেজে না গেলে তেমন ক্ষতি হয় না। দেখো না যখন আমার জ্বর হয় তখন আমিও একদিন দুইদিন স্কুলে যাই না।’

সাবরিনা আর আবির পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। পিউকে চোখ রাঙিয়ে আবির বলল, ‘এই তুই বাচ্চা মেয়ে এতো পাকনা পাকনা কথা বলিস কেন? তোকে এখানে কথা বলতে কে বলছে?’

পিউ বলল, ‘আমি তো খারাপ কথা বলিনি।’ ফাইজা বেগমের হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, ‘ও নানু! নানু, আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’

সাবরিনা পিউর পাশেই বসেছিল। নীলা রান্নাঘরে চুলায় চা চড়িয়েছে। সাবরিনা নীলাকে উদ্দেশ্য করে
মৃদু চেঁচিয়ে বলল, ‘মেয়েকে এগুলো শেখাচ্ছ? মেয়েটাকে আমাদের দু’জনের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছ। আমরা কি কিছু বুঝতে পারি না? সবকিছুই দেখছি আর বুঝতেও পারছি।’

নীলা চায়ের ট্রে হাতে আসতে আসতে পিউর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পিউ! তোমাকে না বলেছি বড়োদের মাঝে কথা বলবে না?’

মায়ের কথা যেন পিউর কানেই ঢুকল না। সে অনুযোগের সুরে সাবরিনাকে বলল, ‘খালামণি! তুমিও ছোট মামার মতো খুব পচা। বাসার সব কাজ মা করে । তুমি একটা কাজও করো না। মাকে একটু সাহায্যও করো না।’

সাবরিনা ক্রোধান্বিত হয়ে পিউর পিঠে একটা কিল দিল। পিউ তারস্বরে কেঁদে উঠল । তার কান্নার স্বরে শুনে রাদিদ নিজের রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। পিউ কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল রাদিদের রুমের দিকে। পিউ দরজার কাছাকাছি যেতেই রাদিদ পিউকে কোলে তুলে নিল। পিউকে শান্ত করার জন্য বলল, ‘কী হয়েছে, পিউ? আমার চ্যাম্প কাঁদছে কেন? কে মেরেছে? কেউ কি বকেছে?’

নীলা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি ভাই। আমি একটু ধমকে বলেছি তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করতে তাই কাঁদছে।’

রাদিদ পিউর মুখটা তুলে প্রশ্ন করল, ‘পিউ! মা কি সত্যি বলছে?’

পিউ এপাশ ওপাশ মাথা দুলাল। পিউর কান্নার দমক এবার আরও বেড়ে গেল। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘খালামণি মেরেছে।’ এটুকু বলেই পিউ আবারও কাঁদতে শুরু করল।

রাদিদ চোখ রাঙিয়ে তাকাল আবির আর সাবরিনার দিকে। তারা মাথা নিচু করে আছে। রাদিদ পুরো ঘটনা আন্দাজ করে ফেলল। বলল,’তোরা কী আমাকে গাধা ভাবিস?’

আবির আর সাবরিনা থতমত খেয়ে গেল। মাথা উঁচু করে একবার চাইল রাদিদের দিকে। পরে আবার মাথা নিচু করে ফেলল। রাদিদ আবারও বলল, ‘যদি আমাকে গাধা ভেবে থাকিস তাহলে ভুল ভাবছিস। তোদের সবকিছুই আমি জানি। আমি জানি তোরা দু’জন বাসায় কেমন আচরণ করিস। আমি জানি তোরা দুজন আপাকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলিস। আমি এটাও জানি তোরা আপাকে বারবার খোঁটা দিস। এটাও আমার কাছে অজানা নয় যে যে মাকে তোরা ভালোবাসিস না।’

‘এসব কী বলছিস ভাইয়া?’ বিস্ময়াভূত হয়ে সমস্বরে প্রশ্ন করল আবির ও সাবরিনা।

‘আমি ঠিকই বলছি। আজকে তোরা সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিস। একটা বাচ্চাকে কীভাবে তোরা ধমকাতে পারিস? কীভাবে ওকে মারতে পারলি? একটুও মায়া হলো না ওর প্রতি? আমি সত্যিই ভেবে পাই না। আর আপা কি শুধু আমার আপা? মা কি শুধু আমার মা? মা আর আপা কি তোদের কেউ না? নিজেকে ভালোবাসাটাই কি জীবন? একবার আশেপাশের মানুষগুলোকে ভালোবেসে দেখ তোদের এই সব তুচ্ছ ও অকারণে করা অভিযোগ আর থাকবে না। ভালোবাসতে না পারিস চেষ্টা তো করে দেখতে পারিস। একবার চেষ্টা করেই দেখ না।’ একসাথে এত কথা বলাতে রাদিদ যেন হাঁপিয়ে উঠল। তাকে বড়ো বেশি বিপন্ন দেখাল।

ফাইজা বেগম নীরবে চোখের জল ফেলছেন। শাড়ির আঁচলে মুছেই চলেছেন অবাধ্য অশ্রু ধারা। নীলার চোখেও অনভিপ্রেত অশ্রু। আবির আর সাবরিনা আগের মতোই মাথা নিচু করেই আছে।

রাদিদ আবারও বলতে শুরু করল, ‘আপাকে যেই বিষয়টা বলে বারবার হেয় করিস। সেটা যদি কখনও তোদের সাথে হয় তখন কী করবি? একজন বিপন্ন, অসহায়, কষ্টে জর্জরিত মানুষকে বিচার করার আগে সেই মানুষটার জায়গায় নিজেকে রেখে বিচার করবি। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। আমি তো একসময় তোদের মতোই ছিলাম। তাই না? আমি বদলে যেতে পারলে তোরা কেন পারবি না? আব্বা আর আম্মার শিক্ষাটাকে মিথ্যা করে দিস না। এটা তোদের দুজনের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ।’

পিউ এতক্ষণ রাদিদের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ রাদিদ তার গালে পিউর ছোট্ট হাতের স্পর্শ পেল। সে বুঝতে পারল নিজের অজান্তেই চোখের আয়না মনের আয়নাকে প্রদর্শন করে ফেলেছে।হৃদয়ের রক্তক্ষরণের রক্তিম লাল বর্ণ, বর্ণহীন জলের ন্যায় গড়িয়ে পড়ার চেষ্টায় তৎপর হয়ে আছে।

পিউর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে রাদিদ বলল, ‘চ্যাম্প!
দেখ বকে দিয়েছি। এবার একটু ম্যাজিক দেখা তো।’

পিউ মিষ্টি হাসল। রাদিদের মনে হলো পিউর ওই হাসিটা পৃথিবীর সবচাইতে দামী উপহার তার জন্য। ওই হাসির জন্য ও সব করতে পারে। সব! ওই হাসিটা চিরদিন অম্লান রাখার জন্য তাকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। এই হাসিটাই তার জন্য ম্যাজিক স্বরূপ।
_______________
সকাল থেকেই ব্যস্ত সাব্বির আহমেদ। অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল বলে সব দায়িত্ব শিহরণকে দিয়েছিলেন। শিহরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন কতটুকু করেছে তা দেখতেই সকাল সকাল আশ্রমের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আসার পরে তিনি বিস্ময়াভূত হয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। শিহরণ তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। বাবাকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। জানতে চাইল, ‘কোনো সমস্যা হয়েছে আব্বু?’

সাব্বির আহমেদ জবাব দিলেন না। নিশ্চুপ থেকে সমস্ত আয়োজন নিজে পর্যবেক্ষণ করলেন। অবশেষে এখানের সমস্ত আয়োজন এত নিখুঁত ও পরিপাটি দেখে তিনি তার নিজের পুত্রের উপর গর্ববোধ করে সহাস্যে বললেন, ‘আ’ম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ মাই সান।’

শিহরণের চোখ আর মুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছিল বাবার সন্তুষ্টিতে সে দারুণ খুশি হয়েছে। স্মিত হেসে বলল, ‘আব্বু! এটা আমরা সবাই মিলে করেছি। তাই এই প্রশংসার যোগ্য শুধু আমি না বরং আমরা সবাই। এমনকি তুমিও।’

সাব্বির আহমেদ গলা খাঁকারি দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, সব না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমি কীভাবে এই প্রশংসার যোগ্য তা তো বুঝলাম না!’

শিহরণ বাবার পাশে বসে বলল, ‘আব্বু! কোনো একটি কাজে সফলতা পাবার প্রধান শর্ত আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস না থাকলে একজন যোগ্য ব্যক্তিও হেরে যেতে পারে। আত্মবিশ্বাস থাকলে জীবনে জেতার জন্য অন্যসব গুণ অর্জন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমার আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিকারী তুমি আব্বু। আমার আত্মবিশ্বাস তৈরীতে তোমার ভূমিকা অন্যতম এবং অনন্য। আমার প্রতি তোমার আস্থার কারণে আমি সবসময় ভালো কিছু করার চেষ্টায় থাকি। আর তোমার দেওয়া অনুপ্রেরণা ও সেই অনুপ্রেরণার বদৌলতে আমার মধ্যে জাগ্রত করা আত্মবিশ্বাসের দরুণ আমি কাজে সফলতা লাভ করতে পারি।’

শিহরণ একটু থেমে বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘আব্বু! তোমার মনে আছে সপ্তম শ্রেণীতে থাকাকালীন তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলে?’

‘কোন কথাটার কথা বলছ আব্বু?’ সাব্বির আহমেদ মনে করতে না পেরে জানতে চাইলেন।

‘আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম তখনকার কথা। সেবার ম্যাথ পরীক্ষাটা খুব খারাপ হয়েছিল। আমি বাসায় আসার পরে খুব মন খারাপ করে ছিলাম। সারাদিন কিচ্ছু খাইনি। এমনকি রাতের খাবারও না খেয়ে নিজের রুমে বসেছিলাম। সেদিন তুমি আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলে আমি পাশ করব। অথচ আমি সেই পরীক্ষাতে মাত্র চল্লিশ মার্ক উত্তর করতে পেরেছিলাম। কী দারুণ সব যুক্তি দিয়েছিলে তুমি আমাকে আশ্বস্ত করতে। তোমার সেই আশ্বাস আমার মনের মধ্যে বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। এর পর থেকেই আমি সবকিছুকে ইতিবাচকভাবে দেখতে শুরু করেছিলাম। ব্যস! সবকিছু সহজ হয়ে গেল আমার জন্য।’

‘হুম। এবার মনে পড়েছে।’ সাব্বির আহমেদ প্রদীপ্ত কণ্ঠে বললেন।

শিহরণ মুচকি হাসল। সাব্বির আহমেদ বেশ কিছুক্ষণ চেয়ারে ঝিম মেরে বসে থাকলেন। তারপর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আচমকা শিহরণকে বুকে টেনে নিলেন । পিঠে আলতোভাব হাত চাপড়ে বললেন, ‘আমার ছেলেটা যে এত বড়ো হয়ে গেছে তা তো খেয়ালই করলাম না।’

_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৩

মেহেরুন নাহার নিজের রুমে শুয়ে ছিলেন। অতল মায়ের রুমে ঢুকে মাকে বিশ্রাম নিতে দেখেই আবার বের হবার জন্য উদ্যত হতে গেলেই মেহেরুন নাহার ডেকে বললেন, ‘আম্মুর সাথে দেখা না করেই চলে যাচ্ছিস?’

অতল মায়ের কথা শুনে ঘুরে দাঁড়াল। মেহেরুন নাহার উঠে বসেছেন। অতল বাচ্চাদের মতো সোজা গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখল। বিষণ্ন কণ্ঠে বলল, ‘আম্মু! আমাকে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? আমার না এখন ঘুম আসে না, আম্মু। প্রায় রাতে দেরি করে ঘুমাতে হয়। একটু ঘুম আসলেও আবার ঘুমটা ভেঙে যায়। এমন কেন হচ্ছে আমার সাথে আম্মু? আমি কার কী ক্ষতি করেছি?’

মেহেরুন নাহার অতলের কথা শুনেই বুঝতে পারলেন সবকিছু। তার ছেলেটার সবকিছু থেকেও নেই। বড্ড একা ছেলেটা। আর এই একাকীত্ব আর কষ্ট চেপে রাখার স্বভাবের কারণে ছেলেটা ডিপ্রেশনে ভুগছে তা তার কাছে স্বচ্ছ জলের ন্যায় স্পষ্ট।

তিনি ছেলেকে আশ্বস্ত করতে বললেন, ‘আমি এখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দেখবি ঠিক ঘুম চলে আসবে।’

‘আব্বু চলে আসলে তো তোমাকে আর আমাকে দু’জনকেই বকা দিবে!’ এটুকু বলেই অতল মায়ের কোল থেকে নিজের মাথাটা তুলে মায়ের হাত ধরে টেনে তুলতে চেয়ে বলল, ‘আমার রুমে চলো। তুমি আমার মাথাতে হাত বুলিয়ে দেবে আর আমি ঘুমাব।’

‘তোর আব্বু আজকে বাসায় আসবে না। তার বন্ধুর বাসায় গিয়েছেন কোনো একটা কাজের জন্য। আজকে সম্ভবত সেখানেই থাকবেন। আর আসলেও সমস্যা নাই। তুই ঘুমিয়ে পড়। আমি তোকে ডেকে তুলব।’

অতল পুনরায় মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ব্যথাতুর গলায় প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, আম্মু! আব্বু আমাকে ভালোবাসে না কেন?’

অতলের প্রশ্ন শুনে মেহেরুন নাহারের বুকটা ধ্বক করে উঠল। তিনি ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, ‘কে বলেছে ভালোবাসে না? অবশ্যই ভালোবাসে। তোর আব্বু উপর থেকে শক্ত হলেও ভেতর থেকে খুব নরম। তুই তো জানিস । তাই না?’

‘না, আম্মু! আব্বু সত্যিই আমাকে ভালোবাসে না। তিনি আমাকে অপছন্দ করেন।’ অতল নিজেকে সংশোধন করে বলল, ‘ঠিক অপছন্দ নয় আম্মু আসলে আব্বু আমাকে ঘৃণা করেন। মনে হয় আমি তার উপর একটা বোঝা ছাড়া আর কিছু না।’

মেহেরুন নাহার অতলকে ধমক দেবার সুরে বললেন,
‘এসব অবান্তর চিন্তা কেন করছিস? এজন্যই তোর ঘুম আসে না। উল্টাপাল্টা চিন্তার কারণে তোর ঘুম কম হচ্ছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিস।’

‘আচ্ছা, আম্মু! আমি কি সত্যিই খুব খারাপ?’

‘আমার আব্বুর চাইতে ভালো কোনো ছেলে আর নেই। তুই পৃথিবীর সবচাইতে বেশি ভালো সন্তান।’

‘আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ আম্মু?’ অতল মায়ের দিকে চাইল। মলিন কণ্ঠে বলল, ‘আমার না সান্ত্বনা লাগবে না আম্মু। আমি সত্যিটা জানতে চাই। তোমরা সবাই মিলে আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছ। আমার তা জানতে হবে। জানতেই হবে।’

এটুকু বলে অতল মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার এখন একা থাকতে হবে। সে কারও সামনে নিজের দুর্বলতা দেখাতে চায় না। কারও সামনেই নয়।

মেহেরুন নাহার চেঁচিয়ে বললেন, ‘অতল! আমার কথা তো শুনে যা।’

অতল শুনল না। একবার ফিরেও তাকাল না। পৃথিবীর সবকিছুই তার কাছে বিষাক্ত লাগছে।
_______________________

নওশীন হক ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে মাথায় আইসপ্যাক দিচ্ছেন। তিনি তার বড়ো মেয়েটাকে
আর সামলাতে পারছেন না । মেয়েটাকে শাসন করতে করতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। গতকাল সারাদিন আফরিন ঘরের বাইরে ছিল। এমনকি বাসায় এসেছে রাত দশটায়। সারাদিন কল করেও কোনো খোঁজ পেলেন না। প্রথমে কল কেটে দিয়েছে পরে মোবাইলটাই অফ করে রেখেছে। তার স্বামীকে এই বিষয়ে জানালেও তার কোনো হেলদোল ছিল না। অথচ মেয়ের কিছু হলেই তার স্বামী তাকেই দোষারোপ করবেন। এই বিষয়টাতে তিনি শতভাগ নিশ্চিত।

কী এক অসহ্য যন্ত্রণাতে তিনি দিন পার করছেন তা বলার বাইরে! আজকেও তিনি রান্নাঘরে থাকাকালীন আফরিন চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। মাথাটা ঠিক তখনই খারাপ হয়ে গেল। এখন মাথা ঠান্ডা করতেই আইসপ্যাকের শরণাপন্ন হলেন। নীরা মায়ের অবস্থা দেখে কলেজে যায়নি। মায়ের পাশে বসে নীরা বলল, ‘আম্মু! আপুর সাথে তুমি মাথা ঠান্ডা করে কথা বলো।’

‘তোর বোন কি আমার কথা শুনে? তোরা কেউ আমার কথা শুনিস না। আমি সারা জীবন কামলা খাটলাম। আর কিছু না। তোদের বাবাই যখন নিশ্চিতে আছে তখন আমি আর কিচ্ছু বলব না। সব চিন্তা কি আমার একার?’ ব্যথাতুর কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললেন, নওশীন হক।

নীরা বলল, ‘আম্মু! এসব কেন বলছ শুধু শুধু?’

নীরার কথা শুনে নওশীন হক আরও বেশি তেতে উঠে বললেন, ‘এই তুই চুপ কর। আমার মাথা আর গরম করিস না। আমাকে এবার একটু শান্তিতে থাকতে দে।’

নীরা অসহায় বোধ করল। নীরবে প্রস্থান করল মায়ের সামনে থেকে। রুমে ঢুকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাবাকে কল করল। মাহফুজ হক তখন মিটিং এ ব্যস্ত থাকায় কল রিসিভ করলেন না। নীরা কী করবে বুঝতে না পেরে শেষমেশ রাদিদকে কল করল। রাদিদও বারবার কল কেটে দিচ্ছে। নীরাও কম যায় না। রাদিদ যতবার কল কেটে দিচ্ছে সে ততবারই
জেদ করে কল করছে। অবশেষে রাদিদ কলটা রিসিভ করেই ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘তোর কি জীবনেও বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না? আমি এতবার কল কেটে দিচ্ছি তারপরেও বারবার কল দিয়েই যাচ্ছিস। আমি রাখছি। এখন দোকানে আছি। পরে সময় পেলে কল করব।’

‘আরেহ্! আমার কথাটা তো একবার শুনবে না-কি?’

রাদিদ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। আমার সময় নাই।’

‘আম্মু কেমন যেন করছে রাদিদ ভাইয়া। আমি আম্মুকে সামলাতে পারছি না। প্লিজ তুমি একবার আসো। আপু খুব বিরক্ত করছে আম্মুকে। আম্মুর কথা একদম শুনে না।’ নীরা এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে ফেলল।

‘ফুফা কোথায়?’

‘আব্বু তো অফিসে। আব্বুকে বলেও কোনো লাভ হয় না। তারপরেও কল করেছি। মনে হয় মিটিং এ আছে এখন। তাছাড়া আব্বুর তো আদরের মেয়ে আফরিন আপু। আমি খুব ভালো করেই জানি আব্বু আপুকে কিছুই বলবে না।’

‘সমস্যাটা কী?’ রাদিদ বলল, ব্যস্ত গলায়।

‘আম্মু বলেছে আপুর বিয়ে দিবে। সমস্যা তখন থেকেই শুরু। আপু কোনোভাবেই আম্মুর পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে না। এখন প্রচণ্ড উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেছে আপু। আমিও কথা বলতে পারছি না। আম্মুও কোনো কথাই বলতে পারছে না। কিছু বলতে গেলেই জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে।’

‘আফরিন নিশ্চয়ই কোনো ছেলেকে পছন্দ করে। যাকে পছন্দ করে তার সাথে বিয়ে দিতে বল। তাহলেই তো ঝামেলা শেষ।’

‘ঝামেলা শেষ না ভাইয়া। আপু তো কিছু বলছেই না। খুব সমস্যা করছে বাসায়।’ এটুকু বলে থামল নীরা। তারপর অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘ভাইয়া, প্লিজ তুমি একবার আসো। আম্মু যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন আমি কী করব?’

রাদিদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে ভাবল। তারপর বলল, ‘আমাকে একটু সময় দে। একটু ভাবতে হবে আমার।’

‘এখন ভাবাভাবির সময় নাই ভাইয়া। তুমি প্লিজ আসো।’

‘আচ্ছা, তুই শান্ত হ। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করব।’

নীরা খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। দেখো তোমার উপকারের কথা আমি কখনোই ভুলব না।’

রাদিদ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি আসলেই তো আর ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে না। এখানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কিছুই হয়নি। আমি ফুফুর জন্য আসছি।’

নীরা মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি জানি তুমি কার জন্য আসছ।’

ফোনে কথা শেষ করে কিচেনে গেল নীরা। কফি মেকারে কফি বানাতে বানাতে বিড়বিড় করে বলল, ‘রাদিদ ভাইয়া, তুমি জানো তুমি আম্মুর জন্য আসছ। কিন্তু আমি তোমাকে এখানে আসতে বলার পেছনে আম্মুই একমাত্র কারণ নয়। আরও কারণ আছে। আশা করছি সেই কারণটা তোমার খুব পছন্দ হবে।’
__________________________

‘তোর শাড়ি পরা হয়েছে?’ ফাহমি প্রশ্ন করল, দরজায় হেলান দিয়ে।

মোহনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গলার হারটা পরার চেষ্টা করছিল। আয়নাতে ফাহমির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সে মিষ্টি হাসল। বলল, ‘শাড়ি তো পরা হয়েছে। কিন্তু গয়নার হুকটা লাগাতে পারছি না।’

ফাহমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মোহনার কাছে। প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ওটা তো তুই পারবি না। এই কাজটা শুধুই আমার।’

মোহনা বলল, ‘এত কথা বলছেন কেন? গয়নাটা পরতে সাহায্য করুন।’

ফাহমি গয়নাটা পরিয়ে দিয়েই মোহনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধের উপর মুখ রেখে বলল, ‘তোর মুখ থেকে আপনি সম্বোধনটা শুনলে আমার কেন যেন নিজেকে পর পর মনে হয়। মনে হয় তোর আর আমার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে তাই তুই আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলছিস! তবে এই আপনি সম্বোধনটা শুনতে আমার বেশ লাগে যদিও কদাচিৎই তা আমার ভাগ্যে জুটে। সারাক্ষণ তো তুই তুকারি করেই বলিস।’

মোহনা ফাহমির কথা শুনে প্রশস্ত হাসল। ফাহমির চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘বিয়ে যখন হয়েছে তখন একটু আধটু সম্মান না দিলে কি চলে?’

‘এটা কি করলি? আমার চুল এলোমেলো করলি ক্যান? এখন কিন্তু আমি আবার চুল আঁচড়াতে পারব না। এই এলোমেলো চুল নিয়েই বেরোব।’

‘আমি যখন এলোমেলো করেছি তখন আমিই ঠিক করে দিব।’

‘কেমন অনুভূতি হচ্ছে?’ ফাহমি প্রশ্ন করল।

‘কোন বিষয়ে?’

‘এটাও আমাকে বলে দিতে হবে?’

‘দুর্জ্ঞেয়। আমি জাস্ট তোকে বলে বুঝাতে পারব না। আমার সত্যিই অনেক বেশি ভালো লাগছে। তুই যদি আম্মু আর আব্বুকে রাজী না করাতি তো আমাদের দেশে আসা সম্ভব হতো না।’

‘আমাকে তো এমনিতেই আসতে হতো। তো তোকে না নিয়ে চলে আসব সেটা ভাবলি কি করে?’

‘তোর এখানে আসার জন্য বিজনেস ইস্যু ছিল কিন্তু আমার তো ছিল না। তাই একটু টেনশনে ছিলাম আরকি। তবে তুই যে আমার চাওয়াকে প্রাধান্য দিবি
তা আমি জানতাম।’

‘মিথ্যে কথা এখন আর না বললেও হবে। আমার উপরে বিশ্বাস থাকলে মুখটাকে ওরকম শত বছরের দুঃখী মানুষের মতো বানাই রাখছিলি ক্যান?’

‘ওই আরকি একটু আধটু কষ্ট হচ্ছিল। তোরা সবাই আমাকে রেখে মজা করবি ভাবতেই আমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল।’

ফাহমি ব্যঙ্গ করে বলল, ‘এই তোর বিশ্বাস? হুহ্!’

মোহনা ফাহমির একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আরে ওটা বাদ দে তো। অনেকদিন পরে সবার সাথে দেখা হবে ভাবতেই মনে প্রাণে এক ধরনের শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছে। ‘

‘শিহরণ! ওহ্, শিহরণের কারণেই তো আমাদের বাংলাদেশে আসা হলো। কত রিকুয়েস্ট করল সে। তারপর বাবা-মাকে রাজী করাল। পারেও বটেও সে। কনভিন্সিং পাওয়ার দারুণ! মাঝেমধ্যে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই ওর মানুষকে কনভিন্স করার ক্ষমতা দেখে।’ ফাহমি বলল, বিস্ময়ের সুরে।

‘দেখতে হবে না কার বন্ধু!’ মোহনা বলল, গর্ব করার ভঙ্গিতে।

‘উঁহু! একদম ঠিক বলিসনি। দেখতে হবে না কাদের বন্ধু! এরকম বলা উচিত ছিল।’ ফাহমি মোহনাকে সংশোধন করে দিল।

‘আচ্ছা, তোর কেমন লাগছে?’ মোহনা জানতে চাইল, ফাহমির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

‘আমার এখনও তেমন কিছু অনুভব হচ্ছে না। সবার সাথে দেখা করার পরে যদি কিছু ফিল হয় তবে তোকে জানাব। আর জানাতে হবেই বা কেন? তুই বুঝে নিতে পারবি না?’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বুঝে নিব। এখন চল বের হই।’

মোহনা বের হতে নিলেই ফাহমি তার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছাকাছি এনে বলল, ‘একটা জিনিস কম আছে।’

‘কী?’

‘তোর না টিপ খুব পছন্দ? আজকে পরিসনি কেন?’

মোহনা চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘ইয়ার্কি করছিস আমার সাথে? তুই জানিস না আমি এখন আর টিপ পরি না?’

‘ওপস্! ভুলে গেছিলাম।’

মোহনা আবারও বের হতে নিলে ফাহমি আবারও তার পথ আটকে দাঁড়ায়। মোহনা ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, ‘আবার কী হলো?’

‘সকাল থেকেই আমি কিছু একটা মিস করছি। তুই মিস করছিস না?’

‘না তো। সব তো ঠিকই আছে।’

‘কিচ্ছু ঠিক নেই।’

‘কী ঠিক নেই?’

‘জানিস না তুই?’

‘জানি না বলেই তো জানতে চাইছি।’

‘আমার মর্নিং কিসেস পাইনি আজকে!’ ফাহমি অভিযোগের সুরে বলল।

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘রাখ তোর মর্নিং কিস। এখন আর মর্নিং নাই। ভুলে যা।’

‘ভারি অন্যায় হচ্ছে এই অধমের প্রতি!’

‘মাঝেমধ্যে একটু অন্যায় না করলে তো তুই আমাদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ছাড়াও যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে সেটা ভুলতে বসবি।’

‘আহা! কেন যে বন্ধুর প্রেমে পড়লাম!’ ফাহমি আক্ষেপ করে বলল, ‘আজ এরেঞ্জ ম্যারেজ করলে আমার বউ আমাকে আপনি আপনি করে করে দিন-রাত শুধু আমার ফারমায়েশ খাটতো।’

‘ঠিক আছে। তোর যখন এতই ইচ্ছে আরেকটা বিয়ে করে নিলেই পারিস।’

‘তোর কী হবে তখন?’

‘তুই আরেকটা বিয়ে করলে আমিও না-হয় তোর বিয়ে দেখে খুশি হয়ে আরেকটা বিয়ে করব।’

‘কী!’ ফাহমি বিস্মায়াভূত হয়ে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?’

‘বাহ্ রে! তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারবি আর আমি পারব না?’

ফাহমি মোহনার একটা হাত ধরে নিজের কাছে এনে সাবধানী গলায় বলল, ‘আর কক্ষণো আমাকে ছেড়ে যাবার কথা মুখে আনবি না। তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।’

মোহনা হাসল। ফাহমির দিকে বেশ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। মোহনা লজ্জা পেয়ে ফাহমির বুকে মুখ লুকাল।

মোহনাকে লজ্জা পেতে দেখে ফাহমি বলল, ‘আরে আমার লজ্জাবতী বউ রে! তুই এত লজ্জা পাস জানতাম না তো।’

মোহনা ফাহমির আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলে ফাহমি আরও দৃঢ়ভাবে তাকে আবদ্ধ করে ফেলল তার বাহুবন্ধনে। মোহনা হাল ছেড়ে দিয়ে বাধ্য বউ হয়েছে মনে করে ফাহমি তার বাহুবন্ধন একটু হালকা করতেই মোহনা সুযোগ পেয়ে ইচ্ছেমতো কিল ঘুসি বসিয়ে দিল তার বুকের উপর।

ফাহমি তখন দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘ভালোবাসার অত্যাচার! খারাপ না।’

__________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৪

পরদিনই রাদিদ ফুফুর বাসায় এসে পৌঁছাল। নওশীন হক তার এই দুঃসময়ে রাদিদকে কাছে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ‘তুই এসেছিস? খুব ভালো করেছিস।’

রাদিদ ফুফুর কাছে বসল। নওশীন হক অভিযোগের সুরে বললেন, ‘এই পরিবারে কেউই আমার কথা শুনে না। আমি এখন কী করব বল তো?’

‘কী হয়েছে ফুফু? তুমি আমাকে পুরো ব্যাপারটা একটু বলো তো।’

‘কী আর হবে তোর বোন যা ইচ্ছে তাই করছে। আর তোর ফুফা আছে বিজনেস নিয়ে। সারা জীবন শুধু টাকা কামানোর ধান্দায় পরে থাকল। এদিকে বড়ো মেয়েটা যে উচ্ছন্নে যাচ্ছে তার কোনো খবর নাই।’

‘ফুফু, ফুফা তো সবকিছু তোমাদের জন্যই করছেন। এত রাগারাগি করো না। হালকা বিষয়টাকে গম্ভীরভাবে নিচ্ছ বলেই এতো ঝামেলা হচ্ছে।’

‘এই বিষয়টা তোর হালকা মনে হচ্ছে?’ চরম বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন নওশীন হক ।

‘অবশ্যই হালকা।’ রাদিদ জোর দিয়ে বলল।

‘কোন দিক থেকে তোর হালকা মনে হচ্ছে? আফরিনকে তুই চিনিস না। কার না কার পাল্লায় পড়ছে আল্লাহ জানে। কেমন পরিবারের ছেলের পাল্লায় পড়েছে সেটাও জানি না।’

‘এক্সেক্টলি! জানো না। জানো না তাই জানতে হবে। আফরিনের সাথে কথা বলতে হবে মাথা ঠান্ডা রেখে । যেরকম ছেলেই হবে হোক না কেন আগে তো জানতে হবে ছেলেটার সম্পর্কে। তারপর খোঁজখবর নিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও। ব্যস! ঝামেলা শেষ।’

‘চিনি না জানি না এমন একটা ছেলের সাথে ধুম করে বিয়ে দিয়ে দিতে বলছিস?’

‘ফুফু! তুমিও না মাঝেমধ্যে একদম অবুঝের মতো আচরণ করো। চিনো না বলেই তো খোঁজ নিতে বলছি।’

‘মেয়েটা আমাকে কিছু জানালে তো!’

‘একটু মাথা ঠান্ডা করে কথা বলো। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি মাথা ঠান্ডা রেখেই কথা বলব। তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার দিচ্ছি। দুপুরের খাবারের টাইম তো প্রায় শেষ হতে চলল।’

ফুফুর বাসায় প্রায় সময় যাতায়াত করার সুবাদে রাদিদের জন্য একটা রুম বরাদ্দ আছে। রাদিদ তার রুমে গিয়ে ওয়্যারড্রব থেকে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে গেল শাওয়ার নিতে।

বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোলে নীরা মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘এই নীরাকে তুমি পাত্তা দিচ্ছ না তো । একদিন আমার কাছেই সবচাইতে বেশি কৃতজ্ঞ থাকবে। দেখে নিও।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। থাকব। কৃতজ্ঞ থাকা ভালো মানুষের লক্ষণ। আমি ভালো মানুষ হবার চেষ্টা করছি। সেটা সফল হলে তো আমিই বেশি খুশি হব।’ হাসতে হাসতে বলল, রাদিদ।

‘আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে তোমায়। রেডি থেকো। কোনো প্রকার বাহানা চলবে না।’ রাদিদকে আদেশ দেবার ভঙ্গিতে বলল, নীরা।

‘আরে আমার কাজ আছে তো। আমি কি এখানে এমনি এমনি এসেছি? হাতে আনেক কাজ নিয়ে এসেছি।’ রাদিদ মাথার চুল মুছতে মুছতে বলল।

‘আমি জানি তুমি একগাদা কাজ নিয়ে আসো সাথে করে। মানুষ এক ঢিলে বড়ো জোর দুই পাখি মারতে চায় আর তুমি এক ঢিলেই বহুপাখি মারতে চাও। কোনো বাহানাতেই কাজ হবে না। যেতেই হবে।’ নীরা হনহন করে বেরিয়ে গেল রাদিদের রুম থেকে।

‘আরে পাগলী আমার কথাটা তো শুনে যা।’ রাদিদ পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকলেও সে শুনল না।

কিছুক্ষণ পর নীরা আবার আসল রাদিদের রুমে। বলল, ‘আজকে জার্নি করে এসেছ। খাও, দাও, আরাম করো। আজকেই তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। আমি জাস্ট তোমাকে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছি।’

নীরা রুম থেকে চলে যাবার পর রাদিদ রুমে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করল। সে প্রতিবারই ঢাকায় আসে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। এবারও ভিন্ন নয়। হঠাৎ করেই তার নজরে পড়ল এর আগেরবার বৃদ্ধ দাদুটার কাছ থেকে নেওয়া ছাতাটা। কাজ ব্যস্ত থাকার দরুণ এই ছাতাটা আর দেওয়া হয়নি। রাদিদ ভাবল আজকেই ছাতাটা দেবার জন্য দাদুটার বাসায় যাবে।
_______________________________

প্রিয় বাংলাদেশে এসেছে বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। পড়াশোনা করার জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছিল। পোস্ট গ্রাজুয়েট শেষে তার ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেলেও শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ছোটোবেলা থেকেই তার ফ্যাশন ডিজাইনিং এর উপর ভীষণ দুর্বলতা থাকায় পড়ালেখা শেষ করে ফ্যাশন ডিজাইনিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে।দেশে আসবার কারণ তার দাদু। দাদুর না-কি তাকে দেখতে খুব মন চাইছিল। দাদুর অসুস্থতার কারণে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছে সে। অবশ্য নিজ ইচ্ছায় পা রেখেছে বলার উপায় নেই। নিতান্ত বাধ্য হয়েই এসেছে। সবার কথা অগ্রাহ্য করতে পারলেও দাদুর প্রসঙ্গে প্রিয় খুবই দুর্বল। দাদুর অসুস্থতার কথা শুনে দেশের বাইরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই শেষমেশ সাহস যুগিয়েছে দেশের মাটিতে পা রাখার।

প্রিয়র দাদু করিমুল ইসলাম বিছানায় শুয়ে আছেন। তার ছেলে ওয়াহিদুল ইসলাম তার পাশেই বসে আছেন। প্রিয় দাদুর রুমে প্রবেশ করতেই করিমুল ইসলাম ভাঙা গলায় ডাকলেন প্রিয়কে, ‘আমার কাছে আসো দাদু ভাই।’

দাদুকে এরকম অসুস্থ দেখে প্রিয়র খুব খারাপ লাগছে সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে দাদুর পাশে বসল। বলল, ‘হ্যাঁ, দাদু বলো।’

‘কেমন আছ, দাদু ভাই?’

‘আমি ভালো আছি। কিন্তু আমি তার সাথে খুব রাগ করেছি।’

‘সে কী! কেন দাদু ভাই?’

‘তুমি হাসপাতালে যেতে চাইছ না তাই।’

‘হাসপাতালে যেতে হবে না। তুমি এসেছ এখন দেখবে আমি একদম সুস্থ হয়ে যাব।’

‘দাদু! আমি কি ওষুধ যে আমি আসার কারণে তুমি ভালো হয়ি যাবে?’

‘হ্যাঁ, তোমাকে না দেখতে পেয়েই তো আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’

‘বলি কি দাদু ভাই এবার আর বাইরে যাবার দরকার নেই। এখন থেকে তুমি দেশেই থাকো। কি দাদুর কথা রাখবে না?’

‘দাদু! জেদ করো না। তুমি তো জানো আমি দেশের বাইরে সবকিছু সামলে নিয়েছি। এখন আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমার এদেশে ভালো লাগে না।’

‘দাদু ভাই! তুমি চলে গেলে দাদু কিন্তু খুব কষ্ট পাব। যে কয়টা দিন বেঁচে আছি আমি চাই তুমি আমার কাছেই থাকো।’

‘দাদু! এরকম কথা আর কক্ষণো বলবে না। আমি কিন্তু খুব রাগ করব এরকম কথা যদি আর শুনি।’

জাহেদা খানম এসে বললেন, ‘এবার আর কোথাও যেতে দিচ্ছি না। এত বছর পড়ালেখার অযুহাতে থেকেছ বলে মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন আর কোনো অবস্থাতেই দেশের বাইরে যেতে দিচ্ছি না।’

প্রিয় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ঠিক এই কারণে আমি দেশে আসতে চাই না। তোমরা সবাই মিলে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করবে বলে।’ প্রিয় মাথা নিচু করে থম ধরে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হুট করে মাথা উঁচু করে ছলছল চোখে বলল, ‘মা! তুমি জানো আমি কেন দেশে থাকতে চাই না। আমার সবকিছু মনে পড়ে যায়। আমার ভীষণ কষ্ট হয় মা। ভীষণ কষ্ট!’

‘কী হয়েছে দাদু ভাই? আমাকে বলো।’

‘কিছু হয়নি দাদু। এসব মা আর আমার কথা। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।’ একথা বলেই প্রিয় তার দাদুর রুম থেকে চলে গেল।

_____________________________

রাদিদ বিকেলের দিকে ছাতা হাতে বৃদ্ধ দাদুর বাসায় পৌঁছাল। বাসার দারোয়ান নানা প্রশ্নবাণে তাকে জর্জরিত করল। অবশেষে মাহফুজ হকের ভাগ্নে পরিচয় দেবার পরে ভেতরে ঢুকতে দিল। ভেতরে প্রবেশ করার পর বাড়ির কাজের মেয়ে তাকে একটা সোফায় বসতে দিয়ে জাহেদা খানমকে ডাকতে গেল।

রাদিদ অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে শেষমেশ ছাতাটা রেখেই চলে আসতে চাইল। কিন্তু পেছন থেকে একজন ভদ্রমহিলার আওয়াজে থমকে দাঁড়াল।

‘তুমি কি নওশীন ভাবির ভাগ্নে?’

রাদিদ ঘুরে দাঁড়াল। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাকে সে চিনে না। সে বলল, ‘জি, আন্টি। আসলে আমি দাদুকে ছাতা দিতে এসেছি।’

‘আরে বসো। দাঁড়িয়ে আছ কেন? আব্বার সাথে তোমার দেখা হলো কখন?’

‘সে অনেক আগের কথা। আমি আসলে আমার বাড়িতে চলে যাবার কারণে ছাতাটা ফেরত দেবার কথা ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘আচ্ছা। মনে পড়েছে। বাবা তোমার খুব প্রশংসা করেছিলেন।’ জাহেদা খানম রাদিদের দিকে তীক্ষ্ম চোখ তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার নামটা তো জানা হলো না।’

‘আমি রাদিদ।’

‘আচ্ছা, রাদিদ। তুমি একটু বসো।’

‘আসলে আন্টি আমার তাড়া আছে। দাদু কোথায়? আমি কি উনার সাথে একবার দেখা করতে পারি?’

‘বাবা তো অসুস্থ।’ এটা বলেই কী যেন ভাবলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘দেখা করতে পারবে না কেন? আসো আমার সাথে।’

‘কবে থেকে অসুস্থ?’

‘এই তো সপ্তাহখানেক হবে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। তবে এখন দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে। বাবার ভালোহবার ওষুধ হচ্ছে তার নাতনী। নাতনীকে কাছে পেয়েছে তো এখন আর কোনো অসুখই বাবাকে বশ করতে পারবে না।’ জাহেদা খানম সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে বলতে থাকলেন। রাদিদ তার পিছু পিছু হেঁটে চলেছে।

রাদিদকে দেখে প্রিয়র দাদু করিমুল ইসলাম বেশ খুশি হলেন। রাদিদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কেমন আছ, দাদু?’

‘আমি এখন খুব ভালো আছি। আমার দাদু ভাই চলে এসেছে। এখন কী আর খারাপ থাকতে পারি?’
করিমুল ইসলাম বলতে বলতে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।

রাদিদ তাকে উঠতে নিষেধ করল। বলল, ‘দাদু! তোমাকে উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো। তোমার বিশ্রাম দরকার।’

রাদিদকে করিমুল ইসলামের রুমে বসিয়ে দিয়ে জাহেদা খানম বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় বললেন, ‘তোমার জন্য নাস্তা পাঠাচ্ছি। না খেয়ে যাবে না কিন্তু।’

রাদিদ যখন রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিচে নেমে এলো। ঠিক তখনই তার সামনে পড়ল ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা একটা মেয়ে। রাদিদ তাকে ক্রস করে মেইন দরজার কাছে চলে এলো। মেয়েটা চিৎকার করে বলল, ‘এক মিনিট। একটু দাঁড়ান।’

রাদিদ থমকে দাঁড়াল। পেছন থেকে ঘুরে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে ভালো করে দেখল। চেনা চেনা লাগলেও কিন্তু চিনতে পারছে না। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা মেয়েটাকে সে জীবনে প্রথম দেখছে মনে হলো। তবে মনে মনে একটা ধারণা করেছে তবে তার ধারণা কতটুকু ঠিক সে বিষয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে থতমত খাওয়ার মতো করে সে বলল, ‘জি, আমাকে বলছেন?’

‘হুম, কে আপনি? এখানে কার কাছে এসেছেন?’

________________________