সকালবেলা সারা বাড়ি খুঁজেও অরূপকে কোত্থাও পেলাম না ৷ এই ছেলেটা প্রত্যেকদিন সকালে যায় টা কোথায়? রুমের মধ্যে বিছানায় বসে এসব ভাবছি আর পা দুলাচ্ছি ৷ গতকাল রাতের তুলনায় আজ শরীর অনেকটা ভালো ৷ হঠাৎ রুমে ঢুকলো আশা ৷ ওকে দেখে ওর দিকে তাকালাম আমি ৷ ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে হালকা হেসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ৷ তারপর ওর হাতের গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,,,,,,,,
“শেষ করো ৷”
আমি চোখ মুখ কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,,,,,,,
“দুধ? আমাকে কেন দিচ্ছো? তুমি নিজেই খাও না!”
“আমি তো তোমার জন্য এনেছি ৷ আমি কেন খাবো? ধরো তো!”
“আরে তাহলে রেখে আসো আমি খেতে পারবো না ৷”
“ভাইয়া যাওয়ার আগে বলে গেছে তুমি উঠলে তোমাকে দুধ দিতে ৷ এখন না খেলে কি হবে আমি কিন্তু কিছু জানি না ৷”
আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললাম,,,,,,,,,
“উনি কি করবেন আমার? আমি ভয় পাই নাকি ওনাকে ৷ কিন্তু উনি কোথায় গিয়েছেন?”
“বলে যায় নি ৷ ধরো তুমি শেষ করলে করো নাহলে নাই ৷ ভাইয়া আসলে আমি বলে দিব ভাইয়াকে ৷”
বলেই আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে গ্লাসটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল ৷ কি একজন আমাকে খেতে বললো আর আমি খেয়ে নিব? এতোই যখন খাওয়ানোর ইচ্ছা নিজ হাতে দিতে পারলেন না ৷ অসহ্যকর ৷ গ্লাসটা টেবিলে রেখে হাত পা গুটিয়ে বিছানায় বসলাম ৷ ঠিক তখনি আমার ফোন বেজে উঠলো ৷ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি আননৌউন নাম্বার ৷ কিছুক্ষন বাজার পর রিসিভ করে বললাম,,,,,,,,,,,,,
“হ্যালো কে?”
ওপাশ থেকে ভেসে এলো,,,,,,,,,
“শ্রেয়া কোথায় তুই?”
পরিচিত একটা কন্ঠ শুনে বুকটা ধুক করে উঠলো ৷ ফোনের স্ক্রিনের দিকে আবার তাকালাম ৷ না এটা তো তার নাম্বার না ৷ তাহলে এতো সেইম গলা কি করে হতে পারে? পরক্ষনেই ভাবলাম হতেই পারে ৷ কিন্তু মনটা এক অজানা ভয়ে খচখচ করছে ৷ ওপাশ থেকে আবার ভেসে এলো,,,,,,,,,,
“কথা বলছিস না কেন? কথা বল না ৷”
কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,,,,,,,,,
“মায়া আপু কোথায় তুই?”
“শ্রেয়া আমি এখানে কি করে এলাম? আমি তো বাড়িতে ছিলাম না? কিন্তু এখানে এলাম কি করে?”
“তুই কেন পালিয়ে গেলি বিয়ের দিন? জানিস সবাই কত রেগে আছে তোর উপর ৷ শেষ মূহুর্তে এসে এরকম কেন করলি?”
“আমি পালিয়ে কেন যাবো? আমি তো নিজেই বুঝতে পারছি না যে আমি বাড়ির বাহিরে এলাম কি করে ৷”
“মানে? তুই পালিয়ে যাস নি? কোথায় তুই এখন?”
“জায়গাটা চিনি না আমি ৷ একটা অন্ধকার বন্ধ রুমে আটকে রাখা হয়েছে আমাকে ৷ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ৷ শ্রেয়া প্লিজ আমাকে বের কর এখান থেকে ৷”
“তুই কোথায় না জানলে আমি কি করবো? সবাই জানে তুই পালিয়ে গিয়েছিস ৷”
“অরূপ ভুল বুঝেছে আমাকে?”
মায়া আপুর মুখে অরূপের নাম শুনে আরো ভয় করছে এখন ৷ যদি জানে আমাদের বিয়ে হয়েছে তো কি করবে ও? আমার ভাবনার মাঝেই আপু আবার বলে উঠলো,,,,,,,,,,
“শ্রেয়া কিছু বল প্লিজ ৷”
“জজজানি নাহ ৷”
“আমাকে এখান থেকে বের কর প্লিজ ৷ দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার ৷”
“কার মোবাইল দিয়ে ফোন করেছিস তুই?”
“মোবাইলটা নিচে বন্ধ অবস্থায় পরা পেয়েছি অামি ৷ কিছু একটা কর প্লিজ ৷”
“আচ্ছা দেখছি আমি ৷”
বলেই ফোন রেখে দিলাম ৷ কি করবো আমি? আপুকে কোথায় খুঁজবো? কি করে খুঁজবো আমি? বিছানা থেকে নামতেই পিছনে ঘুরে অরূপকে দেখে চমকে উঠলাম আমি ৷ উনি কি মায়া আপুর সঙ্গে বলা সব কথাই শুনে নিয়েছেন? তাহলে তো ভুল বুঝবেন আমাকে ৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,,,,,,,
“কার সাথে কথা বলছিলে তুমি?”
“অঅআমার ফ্রেন্ডের সাথে ৷”
বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আমার হাত চেপে ধরে সামনে এনে বললেন,,,,,,,,,,,
“তোমার ফোনটা দাও ৷”
ফোন সমেধ হাতকে পিছনে নিয়ে বললাম,,,,,,,,
“আমার ফোন দিয়ে আপনি কি করবেন? আমি তো বললাম ৷ এখন ছাড়ুন আমায় ৷”
“ফোনটা দাও ৷”
ওনার ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি ৷ উনি আমাকে আরো চেপে ধরে ওনার হাত আমার পিছনে নিয়ে আমার হাত থেকে ফোনটা একটানে নিয়ে ছেড়ে দিলেন আমাকে ৷ ফোনের কললিস্ট চেক করে ৷ কাকে যেন কল করলেন ৷ কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না দেখে ঝাঝালো গলায় আমাকে বললেন,,,,,,,,,,
“ফোন বন্ধ কেন এখন? এতোক্ষন তো কথা বলছিলে অনেক ৷ কার সাথে কথা বলছিলে?”
“এখন যদি আমি বলি আপনি কোথায় গিয়েছিলেন বলবেন আমাকে?”
“না ৷”
“সেইম ভাবে আমিও বলবো না ৷”
রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই উনি পেছন থেকে বলে উঠলেন,,,,,,,,,,
“কার সাথে কথা বলছিলে যে বলা যাবে না?”
“আমাকে অাপনি ভুল বুঝলেও আমার কিছু করার নেই ৷ জানেন? ভুল কাদেরকে বোঝা যায়? যারা তার খুব আপন ৷ খুব! আচ্ছা মায়া আপু যে বিয়ের দিন পালিয়ে গেল ৷ তাকে কি ভুল বুঝেছেন আপনি? উহু তার পরিবর্তে আপনি তো আমায় ভুল বুঝেছেন ৷ কিন্তু কেন? আমি কি আপনার কেউ হই? তাহলে কেন আমার কাছে আপনার সব প্রশ্নের কৈফিয়ত চাইবেন? আপনি যেমন বাধ্য নন আমার কাছে ৷ আমিও তেমন আপনার কাছে বাধ্য নই ৷”
কিছুক্ষন ওনার দিকে তাকিয়ে থেকে রুমের বাহিরে চলে এলাম ৷ একবারও তাকালেন না উনি আমার দিকে ৷ মায়া আপুকে খুঁজে বের করবো আমি ৷ আপনাকেও মুক্তি দিয়ে দিবো ৷ আমাকে তো আপনার ঘাড়ে চাপানো হয়েছে ৷ আর অন্যের ঘাড়ে চেপে থাকতে চাই না অামি ৷ সব প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো আমি ৷
____________________
রাত ০৯ টা বাজে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি ৷ চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার ৷ আকাশে এক ফালি চাঁদও নেই ৷ সব তারা গুলোও মেঘের আড়ালে ঢাকা পরে গেছে ৷ চারপাশ জুড়ে শুধু দমকা বাতাস বয়ে চলেছে ৷ অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমি একা ৷ কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না ৷ মায়া আপুকে কোথায় খুঁজবো আমি? আর কে-ই বা মায়া আপুকে সরালো ৷ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে তাকালাম ৷ ভালো মা দাঁড়িয়ে আছে ৷ সে আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,,,,,,,,,,
“মন খারাপ?”
শূন্য আকাশে চোখ রেখে বললাম,,,,,,,,,,
“আম্মু আব্বুর কথা মনে পরছে ৷ তাদের ছাড়া তো থাকি নি কখনো ৷ তারা কেমন আছে জানিও না আমি ৷ খুব ইচ্ছে করছে তাদের কাছে চলে যেতে ৷”
“তাহলে যা ৷”
কপাল কুচকে তাকালাম ৷ মা হালকা হেসে বলতে লাগলো,,,,,,,,,,
“অরূপকে বলে দিব আমি ৷ ও নিয়ে যাবে তোকে ৷ কয়েকদিন ঘুরে আসিস মন হালকা হবে ৷”
“আমি একাই যেতে পারবো ওনাকে যাওয়া লাগবে না৷”
“তাহলে তো সবাই খারাপ ভাববে ৷ অরূপকে মানিয়ে নিব আমি চিন্তা করিস না তো ৷”
আমি বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম,,,,,,,
“মায়া আপুর সঙ্গে কথা হয়েছে আজ ৷”
মা চমকে বলে উঠলো,,,,,,
“কককিই?”
“হুম ৷ কেউ মায়া আপুকে বিয়ের দিন সরিয়ে দিয়েছিল ৷ কিন্তু কে? সেটা জানি না ৷ এখন আমায় ওকে খুঁজে বের করতে হবে ৷”
“এসব ঝামেলায় নিজেকে জড়াস না ৷ অরূপ জানলে তোকে ভুল বুঝবে ৷”
“যেটা আমি করি নি সেটার জন্য কেন ভয় পাবো মা? ভয় তাড়াই পায় যারা অপরাধী ৷ আমি তো তেমন কিছুই করি নি ৷ আমি কেন ভয় পাবো?”
“তো কি করবি এখন?”
“জোর করে কিছু হয় না ৷ অরূপ কখনোই মেনে নিবেন না আমাকে ৷”
“তাহলে তুই চলে যাবি?”
আমি চুপ করে রইলাম ৷ সে আবার বললো,,,,,,,
“তুই কি করবি সেটা তুই জানিস ৷ আমি আটকাবো না তোকে ৷ কিন্তু ভুল কিছু করিস না ৷ আমাদেরও ভুল বুঝিস না ৷”
“তোমরা তো কিছু করো নি যে ভুল বুঝবো ৷ যাইহোক কাল আমি আমার বাড়িতে যাবো ৷ অরূপ না গেলেও আমি যাবো ৷”
“আচ্ছা আমি ছেলেটাকে বলে দিবো ৷ চিন্তা করিস না আর ৷”
আমার মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে চলে গেল সে ৷ আমি আবার আগের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম ৷
এদিকে অরূপের মা অরূপের রুমে এসে দেখে ও ফোনে টিপছে ৷ সে দরজা বেজিয়ে ওর কাছে এসে বললো,,,,,,,,,,,
“কাল শ্রেয়াকে নিয়ে তুই ওর বাসায় যাবি ৷”
ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে অরূপ বললো,,,,,,,
“কিন্তু কেন?”
“শ্রেয়ার মন ভালো নেই ৷ ওখান থেকে একটু ঘুরে আসলে মনটা ভালো হয়ে যাবে ৷ তুই যাবি ওর সাথে ৷”
“ও যাক আমি কেন যাবো?”
“আমি বলেছি তাই ৷ কয়েকদিন থেকে আসবি ৷ কোনো কথাই শুনতে চাই না আমি ৷ ওই বাড়ি গিয়ে সবার সঙ্গে ভালো ভাবে কথা বলবি ৷ আমার কথার এদিক ওদিক যেন না হয় ৷ শ্রেয়াকে নিয়ে নিচে খেতে আয় ৷”
বলেই অরূপকে কিছু বলতে না দিয়ে চলে গেলেন তিনি ৷ অরূপ রেগে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বের হতে গেলেই শ্রেয়ার সাথে ধাক্কা খেলো ৷ সামনে তাকিয়ে শ্রেয়াকে দেখে এক প্রকার চেঁচিয়ে বললো,,,,,,,,,
“ইডিয়ট! চোখ কি মাথায় তুলে হাঁটো? একটু দেখে শুনে হাঁটতে পারো না? এটা আমার বাড়ি তোমার বাড়ি না যে সব জায়গায় নাঁচতে নাঁচতে ঘুরে বেড়াবে ৷ উফ জ্বালিয়ে খেলো আমায় ৷”
বলেই হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ৷ অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো শ্রেয়া ৷ এতো টুকু একটা ব্যাপারে এই ভাবে রিয়্যাক্ট করলো? ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো এক ফোঁটা পানি ৷
“আমি আপনাকে অনেক জ্বালাই তাই না অরূপ ভাইয়া! এমন একদিন আসবে সেদিন আমার এই জ্বালানো গুলোই পাগলের মতো খুঁজে বেড়াবেন আপনি! কিন্তু আপনাকে জ্বালানোর মতো তখন কেউ থাকবে না!”
অরূপের বাবার বলা সব কথাই শুনেছি আমি ৷ উনি ঠিক ওনার দিক থেকে ৷ অরূপও ঠিক তার দিক থেকে ৷ কাউকে ভালোবাসলে কি তাকে ভুলে যাওয়া এতোই সহজ? মায়া আপু কোথায় তুই? সত্যি কি তুই বিয়ের দিন পালিয়ে গিয়েছিলি? নাকি তোকে সরানোর পিছনেও কেউ আছে? শুধু শুধু তুই কেন পালাবি? কোথায় তুই? উফ কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না আমার ৷ গতকাল থেকে কোনো খোঁজ খবর নেই ওর ৷ গেলটা কই? তখনি রুমের মধ্যে অরূপ আসলো ৷ আমাকে একপলক দেখে একটা ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে কাজ করতে লাগলো ৷ আহা কি ভাব? যেন সব কাজ ওনার কপালেই আছে ৷ সকালে কই গেলো? আবার এখন এখানে এসে কাজ শুরু করে দিলো ৷ একটু ভালো করেও কথা বলে না আমার সাথে ৷ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে খাটে ধপ করে বসে পরলাম ৷
উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মন দিলেন ৷ আমি একটু জোরে কেশে বললাম,,,,,,,,
“সকালে গিয়েছিলেন কোথায়?”
ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখেই বললেন,,,,,,,
“কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি ৷”
আমি কিছু বলবো তার আগেই আমার ফোনটা বেজে উঠলো ৷ অরূপের থেকে চোখ সরিয়ে ফোন রিসিভ করে কোনো কথা বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,,,,,,,,,,,,
“তুমি বিয়ে করে ফেলেছো সেটা জানানোর কোনো প্রয়োজনবোধ করলে না? এটা কি করলে শ্রেয়া? আমি তো জানতাম তোমার বোনের বিয়ে সেখানে তোমার বিয়ে কীভাবে কি? শ্রেয়া কি করলে এটা?”
আমি কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম ৷ কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না ৷ ননসেন্স মার্কা সব কথা বার্তা এই ছেলের মুখ থেকেই শুনতে হবে আমায় ৷ অর্ধেকটা জেনে আসছে এখন গোয়েন্দাগিরি করতে ৷ আমি বিরক্তি সুরে বলে উঠলাম,,,,,,,,,,
“কি করেছি আমি? বিয়ে তো সবারই হয় ৷ আমারও হয়েছে ৷ এখানে এতো প্রশ্নের কি আছে? ভালো লাগছে না রাখি আমি ৷”
বলেই ফোন কেটে দিলাম ৷ সামনে তাকিয়ে দেখি অরূপ আড়াআড়ি ভাবে ভ্রু উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ৷ এভাবে তাকানোর কি হলো? তার মধ্যে আবার ফোন বেজে উঠলো ৷ উফ কি এক জ্বালা ৷ না ধরা পর্যন্ত দিতেই থাকবে ৷ রিসিভ করে একপ্রকার ঝাঝালো গলায় বললাম,,,,,,,,,,
“তুহিন আপনার সমস্যাটা কি?”
“তুমি বিয়ে করেছো এটাই আমার বিরাট সমস্যা ৷”
এই ছেলের সাথে পরিচয় হয় আমার মায়ের মাধ্যমে ৷ আমার মায়ের বান্ধবীর ছেলে ৷ বেশ ভালো আর ভদ্র স্বভাবের কিন্তু মাঝেমধ্যে উদ্ভট সব কথা বার্তা বলে ৷ যার জন্য একে পুরাই বিরক্ত লাগে আমার কাছে ৷ নিজেকে শান্ত করে বললাম,,,,,,,,,,
“আমার বিয়ে হয়েছে এখন এক কাজ করুন আপনিও বিয়ে করে নিন ৷”
“তুমি কোথায় আছো বলো? এক্ষুনি আসছি আমি ৷”
কিসের মধ্যে কি বলছে ৷ রেগে বললাম,,,,,,
“বিয়ে করবেন আপনি ৷ সেখানে আমাকে দিয়ে কি করবেন?”
” বা রেহ যাকে বিয়ে করবো তাকে লাগবে না?”
“কিইই?” (চেঁচিয়ে)
অরূপের দিকে তাকালাম আমি ৷ সেইম স্টাইলে তাকিয়ে আছেন উনি ৷ চোখ সরিয়ে তুহিনকে আবার বললাম,,,,,,,,
“নেশা টেশা করেছেন নাকি? পাগলের মতো কি বলছেন এসব? ধূর একদম আর ফোন দিবেন না আমায় ৷”
বলেই ফোনটা কেটে ফোন বন্ধ করে দিলাম ৷ রুম থেকে চলে যেতেই পিছন থেকে অরূপ ডেকে বলে উঠলো,,,,,,,,,,
“কার সাথে কথা বলছিলে?”
আমি পিছনে একবার ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে তাকে ব্যাঙ্গ সুরে বললাম,,,,,,,,,,,
“কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি ৷”
বলেই রুম থেকে বাইরে চলে এলাম ৷ এখন দেখুক কেমন লাগে হুহ!
___________________
রাত ০৮ বাজে ৷ অরূপ বাহির থেকে নিজের রুমে এসে দেখে রুমের চারপাশ পুরো অন্ধকার ৷ আলোর কোনো ছিটফোঁটাও নেই ৷ ওর বাবার সাথে ঘন্টা খানিক আগে অফিসের বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিল ৷ ওর বাবা ওকে অফিসে জয়েন হতে বলেছে ৷ সেই ব্যাপারেই কথা বলছিলো ৷ কিন্তু রাতের বেলা রুমের মধ্যে অন্ধকার দেখে অবাক হলো ও ৷ ভিতরে গিয়ে লাইট অন করলো অরূপ ৷ কিন্তু আশেপাশে কোত্থাও শ্রেয়াকে দেখতে পেল না ৷ রুমের চারপাশে চেক করে ওয়াশরুম চেক করেও পেল না শ্রেয়াকে ৷ রুম থেকে বের হতেই ওর চোখ গেলো ব্যালকনির দিকে ৷ কিছু একটা আছে মনে হচ্ছে ৷ সামনে এগিয়ে গিয়ে ব্যালকনির গ্লাস খুলে দেখে শ্রেয়া নিচে শুয়ে আছে ৷ মেঝেতে একটা চাদর বিছিয়ে বালিশের উপর মাথা রেখে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে ৷ খানিকটা অবাক হলো ও ৷
‘এতো তাড়াতাড়ি তাও এখানে এভাবে ঘুমানোর কি হলো? পরক্ষনেই ভাবলো যা ইচ্ছা করুক গিয়ে তাতে আমার কি? এখানে ঘুমিয়েছে ভালোই করেছে আমাকে কিছু বলতে হয় নি ৷’ ঘুরে যেতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে শ্রেয়ার সামনে এসে এক হাঁটু ভাজ করে বসলো ৷ ভালোভাবে ওকে দেখে ডাকতে লাগলো,,,,,,,,,,
“শ্রেয়া? এই শ্রেয়া? শ্রেয়া?”
কিন্তু ও একটু নড়াচড়া অবধি করলো না ৷ অরূপ শ্রেয়ার হাত ঝাকিয়ে ডাকতে গেলেই বুঝলো ওর গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে অতিরিক্ত ৷ ওর গালে হাত দিয়ে ওকে ডাকতে লাগলো ৷ তবুও কোনো রেসপন্স করলো না ও ৷ চারপাশে একবার তাকিয়ে অরূপ শ্রেয়াকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ডাক্তারকে কল করে আসতে বললো ৷ তারপর ও নিচে গিয়ে একটা বাটি করে পানি আর ছোট্ট কাপড়ের টুকরা নিয়ে আসলো ৷ পানিতে কাপড় ভিজিয়ে শ্রেয়ার পাশে বসে ওর কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো ৷ হঠাৎ ওর নজর যায় শ্রেয়ার হাতের দিকে ৷ ওর হাতটা নিয়ে ধরে দেখে ওর হাতের তালুতে বেশ গভীর ভাবে কাঁটা একটা দাগ রয়েছে ৷ রক্ত জমাট বেঁধে পুরো জায়গাটা কালো হয়ে রয়েছে ৷ ধবধবে ফর্সা হাতের তালুতে কাঁটা জায়গাটা একদম চোখে লাগছে ৷ অরূপ ওর হাত দিয়ে শ্রেয়া কাঁটা জায়গায় হাত বুলিয়ে দিল ৷ না চাইতেও কষ্ট হচ্ছে ওর ৷
দরজায় নক করার আওয়াজ পেয়ে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয় ও ৷ ডাক্তার ভিতরে এসে শ্রেয়ার চেকআপ করিয়ে দিল ৷ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে একটা কাগজে ওষুধের নাম লিখতে লিখতে অরূপকে বলতে লাগলো,,,,,,,,,,,
“হাতের কাঁটাটা কিন্তু একটু আগের মনে হচ্ছে না ৷ তবে এটা বেশ পুরাতনও না ৷ আজ কালের মধ্যেই কেঁটেছে ৷ তোমার উঁচিত ছিল ওর হাতটা ক্লিন করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া ৷ নাহলে ইনফ্যাকশান হতে পারতো ৷ এতোটা কেয়ারলেস কীভাবে হলে অরূপ?”
বলেই উনি অরূপের দিকে তাকালেন ৷ অরূপ আমতা আমতা করে বললো,,,,,,,
“আআসলে আঙ্কেল আমি তো জানতামই না ৷ মাত্র দেখলাম ৷”
“তোমার ওয়াইফ আর তুমি জানবে না? দেখা উচিত ছিল তোমার ৷ আর মেয়েটা দুই একদিন যাবত ঠিক মতো খাচ্ছে না ৷ তাই ও অনেকটা দুর্বল ৷ আর সেই জন্যেই ঘুমের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে ৷ সঙ্গে জ্বরও এসেছে ৷ একটা ঘুমের ইনজ্যাকশান দিয়ে দিয়েছি আমি ৷ একটু পর ওকে জাগিয়ে খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিবে তুমি ৷ আর খেয়াল রাখবে ওর ৷”
“আচ্ছা ৷”
“হুম আমি আসছি এখন ৷ কোনো প্রবলেম হলে বলো ৷”
বলেই উনি মেডিসিনের পেপারটা অরূপের হাতে দিয়ে চলে গেলেন ৷ অরূপ একটা ছেলেকে ডেকে সেই ওষুধ গুলো আনতে বলে দিলো ৷ তারপর ও নিজে নিচে গিয়ে একটা প্লেটে খাবার বেড়ে সেই প্লেটটা নিয়ে রুমে চলে এলো ৷ পানিতে কাপড় ভিজিয়ে উল্টে পাল্টে শ্রেয়ার কপালে দিতে লাগলো ৷ শ্রেয়ার জ্ঞান ফিরেনি এখনো ৷ তবে ফেরাতে হবে এখন ৷ নাহলে না খেয়েই সারা রাত কেঁটে যাবে ৷ ও শ্রেয়াকে হালকা ভাবে ডাকতে লাগলো ৷ বেশকিছুক্ষন এরকম করার পরও চোখ খুললো না ৷ হালকা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পরলো ৷ অরূপ শ্রেয়াকে ধরে ধরে বেডের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসালো ৷ শ্রেয়া বসা অবস্থায়ই ঢলে পরছে বারবার ৷
টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে শ্রেয়ার মুখে কয়েকটা ছিটা দিয়ে ওকে পানি খাওয়ালো ৷ হালকা চোখ খুলে আবার চোখ বুজে নিলো শ্রেয়া ৷ অরূপ আবার ঝাকাতে শ্রেয়া বলে উঠলো,,,,,,,,
“সমস্যাটা কি? ঘুম পাচ্ছে তো ৷”
“আগে খেয়ে নাও ৷ তারপর মন ভরে ঘুমিও ৷ তোমার জন্য আঙ্কেল আমাকে কেয়ারলেস বললো ৷”
বলেই খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে ভাত মাখতে শুরু করলো ৷ শ্রেয়া কিছু বলবে তার আগেই ও শ্রেয়ার মুখে খাবার ঢুকিয়ে বললো,,,,,,,,,
“চুপচাপ খাও ৷”
“এভাবে কেউ কাউকে খাওয়ায়? একটু আদর করেও তো খাওয়াতে পারে নাকি? গোমরামুখো একটা ৷”
কথাগুলো বিড়বিড় করে বললেও অরূপ শুনতে পেলো ৷ কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো শ্রেয়ার দিকে ৷ শ্রেয়া হালকা হেসে খাবার চিবাতে চিবাতে লাগলো ৷ বাকিটা খাবার চুপচাপ শেষ করলো শ্রেয়া ৷ অরূপের হাতে খেতে খারাপ লাগে নি বরং ভালোই লেগেছে ৷ এই প্রথম ও একটা ছেলের হাতে খেলো ৷ আর সেই ছেলেটাই ওর স্বামী ৷ তৃপ্তি নিয়ে পুরো খাবারটা শেষ করলো ও ৷ অরূপ হাত ধুয়ে এসে শ্রেয়ার সামনে একটা গ্লাস ধরলো আর ওর হাতে কয়েকটা ট্যাবলেট দিয়ে বললো সেগুলো খেতে ৷ চোখ মুখ কুচকে পানিসহ ওষুধ গুলো গিলে ফেললো ও ৷ ওর কাছে ওষুধ খাওয়ার চেয়ে দ্বিতীয় কোনো কঠিন কাজ পৃথিবীতে নেই ৷ শ্রেয়াকে এমন করতে দেখে অরূপ বললো,,,,,,,,,,
“এতো বড় মেয়ে এখনো ট্যাবলেট খেতে পারো না ৷ তোমার জন্য সিরাপের ব্যবস্থা করবো?”
শ্রেয়া পানির গ্লাস পাশে রেখে মুখ ফুলিয়ে বললো,,,,,,,,,,,
“অপমান করবেন না একদম ৷ নিজে বুঝি সব কিছু পারেন ৷”
বলেই মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পরলো শ্রেয়া ৷ অরূপ চলে যেতে নিলেই শ্রেয়া ওর হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,,,,,,,,,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
অরূপ ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,,,,,,,,,,
“তুমি ঘুমাও ৷ আমার কাজ আছে ৷”
“এখন আবার কি কাজ আপনার?”
“তুমি অসুস্থ তাই তোমাকে কিছু বলছি না ৷ এই জন্য ভেবো না যে তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি আমি ৷”
“সেটা তো হতেই পারেন… না? প্রবলেম কি তাতে?”
অরূপ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,,,,,,,,
“অনেক প্রবলেম আমার ৷ আর সব প্রবলেম হচ্ছো তুমি ৷ সব প্রবলেমের কারনও তুমি ৷ আজ দয়া করেছি দেখে ভেবো না সারাজীবন এভাবেই দয়া করবো ৷ চুপচাপ ঘুমাও ৷”
বলেই উনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন ৷ অামি একটা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম ৷ এই ছেলেটা কখনো বুঝবে না আমায় ৷ কেন বুঝে না আমায়? আমি কি সত্যিই অনেক খারাপ? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? ভাগ্যই আমাদের এক করলো ৷ আর এই ভাগ্যই আমাদের দূরে করে দিবে ৷ কপালে কারো ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলে তাকালাম ৷ অরূপ আমার কপালে ভেজা কাপড় উল্টে পাল্টে দিচ্ছেন ৷ মুচকি হাসলাম আমি ৷ যতই দূরে সরে যেতে চান না কেন আমার ভালোবাসার টানে ঠিকই একদিন আমার কাছে চলে আসবেন আপনি ৷ সেই দিনটারই অপেক্ষা করছি আমি ৷ অধীর আগ্রহে বসে আছি আপনার মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শোনার জন্য ৷ মরার আগে অন্তত এটুকু শুনলেই শান্তি ৷
আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন,,,,,,,
“তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করো ৷”
“আমি ঠিক আছি ৷ আপনি শুয়ে পরুন ৷ আমার জন্য কষ্ট করতে হবে না আপনাকে ৷”
“এতো কথা বলতে বলেছি আমি তোমায়? এটা আমার দ্বায়িত্ব ৷ তুমি চুপচাপ ঘুমাও এখন ৷”
আমি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,,
“হুম ৷ আমাদের সম্পর্কটা শুধু মাত্র একটা দ্বায়িত্বের, কোনো ভালোবাসার নয় ৷”
গাঁয়ের মধ্যে ঠান্ডা কিছু পরতেই ধরফরিয়ে উঠে বসলাম ৷ আশেপাশে তাকাতেই বুঝলাম সকাল হয়ে গিয়েছে ৷ নিজের দিকে একবার তাকিয়ে আবার পাশে তাকালাম ৷ সঙ্গে সঙ্গে অবশিষ্ট পানি আবার পুরোটা ঢেলে দিলেন আমার গাঁয়ে ৷ তারপর অরূপ ভাইয়া বিরক্তির সাথে বলতে লাগলেন,,,,,,,,,,,,,,
“তোমাকে এখানে সকাল ১০ টা পর্যন্ত ঘুমানোর জন্য আনা হয় নি ৷ যাও কাজে যাও ৷”
আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,,,,,,,,
“সকাল বেলা আমার গাঁয়ে পানি কেন ঢাললেন?”
“সেটা আমার ইচ্ছা ৷ পানি না ঢেলে কি ধরে ধরে তোমাকে ঘুম থেকে ওঠাবো? তোমার এরকম মনে হওয়াটা একটা বোকামো ৷ কারনটা হয়তো তুমি জানো ৷ এখন যাও ৷”
বলেই সামনে থেকে সরে গেলেন ৷ আমি কিছু না বলে ভিতরে চলে এলাম ৷ ভেজা অবস্থায় থাকতে খারাপ লাগছে এখন ৷ সামনে গিয়ে আলমারি খুলে দেখি বেশ কয়েকটা মেয়েদের জামা কাপড় রয়েছে ৷ সেখানে হাত দিতে গেলেই অরূপ ভাইয়া এসে হাত টেনে ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে রেগে বলতে লাগলেন,,,,,,,,
“আলমারি খোলার সাহস কোথায় পাও তুমি?”
“আমি তো…”
“অধিকার ফলাতে আসবে না বুঝেছো? এই রুম আমার এই রুমের সব জিনিস আমার ৷ আমার জিনিসে হাত দেয়ার পার্মিশানও দেই নি আমি তোমায়৷”
আমাকে বলতে না দিয়ে অরূপ ভাইয়া কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলেই আমি বললাম,,,,,,,,,
“অধিকার তো আছেই আমার ৷”
উনি ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন ৷ আমি আবার বললাম,,,,,,,,,,
“তিন মাস আপনি না চাইলেও তো আমাকে আপনার বউ হয়ে থাকতে হবে ৷ সেখানে অধিকার কেন থাকবে না?”
“কারণ আমি তোমাকে সেই অধিকার দেই নি ৷ আর কখনো দিবও না ৷ তুমি অন্যের সামনে বউ সেজে থাকলেও আমার সামনে তার কোনো দরকার নেই ৷”
আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে ৷ উনি আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল আচড়ে বলে উঠলেন,,,,,,,,,,
“এই খানে দাঁড়িয়ে কি দেখছো? চেঞ্জ করে নিচে গিয়ে বাড়ির কাজ করো ৷”
“চেঞ্জ করবো কীভাবে? আপনি তো একটা জামাও নিতে দিলেন না ৷ তাহলে কি পরবো আমি?”
“নিজে কি পরবে তার ব্যবস্থা তুমি নিজেই করো ৷ আমি কেন টেনশান করবো এসব বিষয় নিয়ে? যা ইচ্ছা করো ৷ আর হ্যাঁ আজ বাড়ির সব রান্না তুমি করবে ৷”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি ৷ উফ কি অসহ্যকর একটা ছেলে ৷ এই ছেলেটাকে ভালোবেসেছি আমি? নিজের উপরই রাগ উঠছে এখন ৷ রুম থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলাম ৷ হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,,,,,,,,,
“কাকে খুঁজছো?”
পিছনে তাকিয়ে আশাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম ৷ ওকে দেখে বললাম,,,,,,,,,
“শোনো আমাকে কোনো ড্রেস এনে দিতে পারবে? চেঞ্জ করবো তাই ৷”
আশা আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে বললো,,,,,,,,,,,
“তোমার এরকম অবস্থা কেন? আর এভাবে ভেজা অবস্থায় ঘুরছো কেন?”
“চেঞ্জ করবো দেখেই তো ড্রেসের কথা বললাম ৷ তুমি একটু ব্যবস্থা করো না ৷ এভাবে থাকতে ভালো লাগছে না আমার ৷”
“আচ্ছা ওয়েট আসছি আমি ৷”
বলেই আশা চলে গেল ৷ কিছুক্ষন পর আমার হাতে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বললো,,,,,,,,,
“তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিচে আসো ৷”
আমি মাথা নাড়িয়ে রুমে চলে এলাম ৷ চেঞ্জ করে এলোমেলো করে রাখা রুমটা গুছিয়ে নিচে চলে গেলাম ৷ আশেপাশে কোথাও অরূপকে দেখতে পেলাম না ৷ না জানি কোথায় আছে ৷ বলে তো গেলো আমাকে রান্না করতে ৷ কিন্তু করবো টা কীভাবে? কিচেনের দিকে যেতেই দেখি নয়না আন্টি কাজ করছে ৷ আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে উনি আমাকে এক পলক দেখে বলতে লাগলেন,,,,,,,,,
“তুই এখানে কেন? যা একটু কষ্ট করে নিয়ে খেয়ে নে ৷ আচ্ছা দাঁড়া আমি আশাকে বলছি ৷”
বলেই উনি আশাকে ডাকতে নিলে আমি বললাম,,,,,,,,,
“আরে থাক না ৷ আমি খাবো না ৷ ইচ্ছে করছে না প্লিজ৷”
“এটা বললে হবে বল?”
“আই সোয়ার আমার একটুও খিদে পায় নি ৷ প্লিজ আন্টি জোর করো না ৷”
উনি একপলক আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে কাজ করতে করতে বললেন,,,,,,,,
“আমি তোর এখনো আন্টি হই?”
দাঁত দিয়ে জিভ কেটে একটু হেসে বললাম,,,,,,,
“ওহ সরি সরি মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে ৷ আর বলবো না ৷ কিন্তু কি বলে ডাকবো?”
“আমি কি তোর মা হতে পারি না?”
“সেটা কেন হবে? তুমি তো আমার ভালো মা ৷”
বলেই তাকে একসাইড দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ৷ মা হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,,,,,,,,,,
“অরূপ কোথায় রে?”
“উনি কোথায় আমি তো জানি না ৷”
“সে কি তোকে বলে যায় নি?”
“তোমার ছেলে আমাকে বলে যাবে? এতো ভালো সে? আমাকে তো পাত্তাই দেয় না ৷ বলবে কি?”
“দেখ অরূপের সাথে তোর বিয়ে হয়েছে তাই সবকিছু ঠিক করে নেওয়ার দায়িত্বও তোদের ৷ অরূপকে বোঝা ৷ ছেলেটা জেনে শুনে কেন বিপদ বাড়াতে চাচ্ছে বুঝছি না ৷”
“আচ্ছা ওসব বাদ দাও তো ৷ আর বলো আজ বাড়িতে কী কী রান্না হবে?”
“কেন তুই রাঁধবি নাকি?”
“হুম চেষ্টা করবো ৷ ভাইয়া বলেছে যে ৷”
আমি আনমনেই বলে উঠলাম ৷ মা শব্দ করে হেসে বলে উঠলো,,,,,,,,
“পাগলি মেয়ে ৷ স্বামীকে ভাইয়া বলছিস?”
“উফ তোমরা না ৷ একটু তো সময় লাগবে আমার নাকি? আর তোমার ওই গুণধর ছেলে আমাকে তো মানেই না যে আমি তার বউ ৷”
“মেনে যাবে একদিন দেখিস ৷ আর শোন তোকে রাঁধতে হবে না ৷ হাত পা কেঁটে পরে বসে থাকবি ৷ তার থেকে ভালো তুই নিজের রুমে যা ৷”
“না আমি রান্না করবো ৷ তুমি বলোই না ৷ পারবো বললাম তো ৷ কেন এরকম করছো?”
“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে ৷ নে এপ্রোনটা পরে নে ৷ তারপর আমি দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি ৷”
বলেই একটা কুকিং এপ্রোন আমার দিকে এগিয়ে দিলো ৷ আমিও পরে নিলাম ৷
“বউ ভাতের আয়োজন করতে পারি নি ৷ অরূপ মানা করে দিয়েছে ৷ রাগ করিস না মা ৷”
“রাগ করবো কেন? আমার ভাগ্যে যা আছে তাই তো হবে ৷ বাদ দাও তো তুমি ৷ কি কি করতে হবে বলে দাও আমায় ৷”
সে বেশ কয়েকটা খাবারের নাম বলে দিলো তারপর যা যা লাগবে সেগুলোও এগিয়ে দিলো আমার দিকে ৷ কীভাবে কি করবো সবটা বলে দিলো আমাকে ৷ সে অনুযায়ী কাজ করতে লাগলাম আমি ৷ বাড়িতে কখনোই নিজের হাতে পানির গ্লাস অবধি নিয়ে খাই নি আমি আর সেই আমাকে আজ এতোগুলা রান্না করতে হচ্ছে ৷ সত্যি মূহুর্তের মধ্যেই সব কিছু বদলে যায় ৷ কাল সকাল পর্যন্ত আমি ছিলাম অবিবাহিত ৷ কিন্তু আজ হয়ে গেছি এই বাড়ির বউ ৷
বেখেয়ালী ভাবে কাজ করতে গিয়েই হাতের এক প্রান্তে ছুরি লেগে কেটে গেল ৷ শাড়ির আঁচল দিয়ে সেই জায়গাটা চেপে ধরলাম ৷ তারপর আবার কাজে মন দিলাম ৷ হাতে বেশি সময়ও নেই অলরেডি ০১ টা বেজে গেছে ৷ রান্নাগুলা তো শেষ করতে হবে আগে ৷ তাই হাতের বিষয়টা নিয়ে সময় নষ্ট না করে কাজ করতে লাগলাম ৷
_______________________
রান্না শেষে রুমে এসে বিছানায় বসে পরলাম ৷ মাথাটা প্রচুর ঘুরাচ্ছে ৷ কেটে যাওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতটা ধুয়ে নিলাম ৷ এই বাড়িতে ফার্স্ট এইড বক্স আদো আছে কি না জানা নেই আমার ৷ ভালো মাকে বলতে গেলে ব্যস্ত হয়ে পরবে ৷ তার দরকার নেই ৷ নিচে যেতেই দেখি অরূপ বাড়িতে এসে পরেছেন ৷ কিন্তু ছিলটা কোথায় এতোক্ষন? কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই পাশ কাঁটিয়ে চলে গেলেন ৷
একটু পর নিচে নেমে উনি চেয়ার টেনে টেবিলে বসে পরলো ৷ আমি এক সাইডে দাঁড়িয়ে রইলাম ৷ একে একে সবাই এসে বসলো ৷ দীপ্ত আঙ্কেল মানে বাবা, অরূপের চাচী মানে ছোট মা আর আশা ৷ ভালো মা আমাকে চেয়ারে বসতে বললে অরূপ বলে উঠলেন,,,,,,,,
“ও কেন বসবে?”
“কেন বসবে মানে? খাবে না ও?”
মায়ের কথায় উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,,,,,,,
“ওভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে সবাইকে খাবার সার্ভ করে গিলতে বসো ৷”
সবার সামনে এভাবে না বললেও পারতেন ৷ তবুও কিছু বললাম না আমি ৷ মাকে ইশারায় বসতে বলে একে একে সবাইকে খাবার বেড়ে দিলাম ৷ অরূপ আমার দিকে তাকালেনও না একবারো ৷ নিচের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছেন উনি ৷ সবাইকে খাবার দেয়া শেষ হলে মা আমাকে টেনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললো,,,,,,,,,,,,,,
“খেয়ে নে ৷ সকালে কিছু খাস নি ৷ অসুস্থ হয়ে পরবি ৷”
আমি একপলক অরূপের দিকে তাকালাম ৷ উনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন ৷ চোখাচোখি হয়ে গেল এতে ৷ সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ৷ আলতো হাতে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করে যাচ্ছি ৷ তখনি একটা কথা শুনে চোখ তুলে তাকালাম অরূপের দিকে ৷ উনি আবার বললেন,,,,,,,,
“খাবার কে বানিয়েছে?”
“কে আবার? তোর বউ ৷ তুই বলে গেছিস আর ভাবি তোর কথা অমান্য করবে সেটা হয়?”
আশা বললো ৷ ওর কথায় উনি বললেন,,,,,,,,,
“তুই চুপ করে খা ৷ তোকে জিজ্ঞেস করি নি ৷ আর শ্রেয়া রান্না করেছে? এতো ভালো খাবার ও কীভাবে রাঁধবে?”
আমি চোখ মুখ কুচকে বললাম,,,,,,,,
“কেন না পারার কি আছে? আমি রান্না করতে পারি না? যদি সেটা ভেবে থাকেন তো দেখিয়ে দিলাম ৷”
“একা একা করো নি জানা আছে সেটা ৷”
বলেই খাওয়াতে মনোযোগ দিলেন ৷ আমি চুপ করে রইলাম ৷ কাঁটা হাতের জন্য খেতেও পারছি না ৷ শুধু সাদা ভাত নাড়াচ্ছি ৷ আবার খেতেও ইচ্ছা করছে না ৷ তাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেই সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো ৷ আমি একটা শুকনো হাসি দিয়ে বললাম,,,,,,,,,,
“পেট ভরে গেছে তাই ৷”
বলেই উপরে রুমের দিকে চলে এলাম ৷
এদিকে অরূপ শ্রেয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে খেতে লাগলো ৷ ওকে এরকম শান্ত থাকতে দেখে ওর বাবা ওকে বললো,,,,,,,,,,,,,
“তোমার মাথায় কি চলছে বলো তো?”
অরূপ মাথা তুলে ওর বাবার দিকে তাকালো ৷ কিছু বুঝতে না পেরে বললো,,,,,,,,,
“মানে? কী চলবে?”
“সেটা তো তুমি বলবে ৷ কোথায় গিয়েছিলে সকালে? আর বউ ভাতের আয়োজনও করতে দিলে না ৷ কি চাও তুমি?”
অরূপ রেগে বলে উঠলো,,,,,,,,,,,,
“তোমাদের কথা মেনে চলতে বাধ্য নই আমি ৷ আমার চাওয়ার কোনো গুরুত্ব দিয়েছো তোমরা? ওই মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছো ৷ আর কি করতে হবে আমায়?”
“ঠিক ভাবে কথা বলো ৷ ও এই বাড়ির বউ তোমার বউ ৷ তাই এভাবে লাগাম ছাড়া কথা দ্বিতীয়বার মুখে আনবে না ৷ আরেকটা কথা কি যেন বললে? তোমার চাওয়ার কোনো গুরুত্ব দেই নি আমরা তাই না? তো মায়ার সাথে তোমার বিয়েতে রাজি কেন হয়েছিলাম?”
অরূপ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে রাগে ফুসতে লাগলো ৷ অরূপের বাবা খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,,,,,,,,,,
“যা ইচ্ছা করো ৷ কিন্তু মায়াকে এই বাড়িতে আমি আর এলাউ করবো না ৷”
সবসময় শুনেছি বিদায়ের সময় মেয়েরা তার পরিবারের সবাইকে ধরে প্রচুর কান্নাকাটি করে ৷ কিন্তু আমি তার উল্টা ৷ কেন জানি না কান্না ভেতর থেকে আসছে না ৷ জোর করেও আনাতে পারছি না ৷ আম্মু আব্বু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ৷ কখনো কোনো জায়গায় আমি তাদেরকে ছাড়া একা থাকিনি ৷ জোর করে হলেও আমার সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম তাদের ৷ না যেতে চাইলে কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলতাম ৷ সেই আমি কিনা তাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি তবুও চোখে পানি নেই? বিষয়টা হয়তো কারো কাছে বোধগম্য হলো না ৷ আবার তো ফিরে আসবো এই বাড়িতেই ৷ কেঁদে আর লাভ কি? অরূপ ভাইয়া তো আমায় ডিভোর্স দিয়েই দিবেন ৷ কেননা আমি নিজে ডিভোর্স চেয়েছি ৷
গাড়ি এসে থামলো একটা বাড়ির সামনে ৷ গাড়ি থামতেই ভাইয়া আমাকে ফেলে গাড়ি থেকে নেমে একা একাই ভিতরে চলে গেলেন ৷ একবার ফিরেও তাকালেন না আমার দিকে ৷ চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা হাত দিয়ে আড়াল করে নিলাম ৷ দুইটা মেয়ে এসে আমাকে বলতে লাগলো,,,,,,,,
“আরে ভাবি চলো! ভাইয়া তো চলেই গেলো ৷ উফ আজকের দিনেও ভাইয়ার রাগ দেখাতে হবে ৷ কি হলো নামো?”
আমাকে টেনে গাড়ি থেকে বের করলো আশা ৷ অরূপ ভাইয়ার ছোট বোন আশা ৷ আশার পাশের মেয়েটা হয়তো ওর বান্ধবী ৷ আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল ওরা ৷ বাড়িটার বাহিরে আর ভেতরে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ৷ সব নিয়ম কানুন মেনে বাড়ির ভিতরে পা রাখলাম ৷ আজ আমি এই বাড়ির বউ ৷ তবে সেটা ক্ষনিকের জন্য ৷ ভাবতেই চোখ ভিজে আসছে ৷ পাশ থেকে নয়না আন্টি (অরূপের মা) আমাকে একটা মহিলার দিকে ইশারা করে বললো,,,,,,,,,
“উনি অরূপের চাচী ৷ যা সালাম করে হালকা কথা বলে নে ৷ বেশি কিছু বলিস না ৷ উনি আবার শান্ত শিষ্ট গ্রাম্য মেয়ে বেশি পচ্ছন্দ করেন ৷”
আমি হালকা মাথা নাড়ালাম ৷ আন্টির সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পরিচিত আমি ৷ উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখে ৷ তাই সবচেয়ে মধুর ভাষা ‘তুই’ করে সম্বোধন করে আমায় ৷ সামনে তাকিয়ে দেখি একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা সোফায় বসে আছেন ৷ মনে হচ্ছে বয়সে আন্টির থেকে অনেক বড় কিন্তু সম্পর্কে হয়তো তার ছোট ৷ দেখেই বেশ ধার্মিক মনে হচ্ছে ৷ ওনার সামনে গিয়ে আমি একটু নিচু হয়ে তার পা ধরে সালাম করলেই উনি আমাকে ধরে তার পাশে বসালেন ৷ উনি এক পলক সবার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,,,,,,
“তো এই হলো রূপের বউ?”
নয়না আন্টি মাথা ঝুলালেন ৷ মহিলাটি আমার মুখটা উঁচু করে ধরে বললেন,,,,,,,,,,
“বাহ! বেশ লক্ষীমন্তর বউ এসেছে তোর ঘরে ৷ তো মা নাম কি তোমার?”
হালকা শব্দে আমি বললাম,,,,,,,,,,
“শ্রেয়া”
“নয়ন বউমাকে দেখে রাখিস ৷ তোর ছেলের যা রাগ কি করবে, না করবে সে নিজেও জানে না ৷ কোন দিক দেখে যে ওই মেয়েটা (মায়া) কে ওর মনে ধরেছে…কে জানে? মেয়েটা চলে গিয়ে ভালোই করেছে আমার রূপের জন্য ৷”
বলেই মহিলাটি তার গলা থেকে একটা মোটা হার আমার গলায় পরিয়ে দিতে গেলেই আমি মাথা নিচু করে বলে উঠলাম,,,,,,
“কি করছেন? লাগবে না আমার এসব ৷”
“তুমি নতুন বউ ৷ আমাদের বংশের বড় বউ তুমি ৷ লাগবে না বললেই কি হবে বলো? এটা আমার আশীর্বাদ হিসেবে দিচ্ছি তোমায় ৷ ফিরিয়ে দিতে হয় না ৷ মন থেকে গ্রহণ করে নিতে হয় ৷”
বলেই তিনি আমার গলায় হারটা পরিয়ে দিয়ে বললেন,,,,,,,,
“বেশ মানিয়েছে ৷ শোনো তুমি আমাকে এখন থেকে ছোট মা বলে ডাকবে কেমন?”
আমি মাথা নাড়ালাম ৷ বেশ কিছুক্ষন এভাবে কথা বলার পর আশা আমাকে একটা রুমের সামনে নিয়ে এসে বললো,,,,,,,,,,
“এটা ভাইয়ার রুম ৷ আর এখন আজ থেকে এটা তোমারও রুম ৷ তুমি ভিতরে গিয়ে বসো ৷ আমি যাই হ্যাঁ?”
আমি মাথা নাড়াতেই ও দৌঁড়ে অন্যদিকে চলে গেল ৷ মেয়েটা একটু ছটফটানি টাইপের ৷ তবুও মনের দিক থেকে অনেক ভালো আর মিশুকে ৷ এই বাড়ির সবাই অনেক ভালো ৷ সহজ সরল আর শান্ত স্বভাবের ৷ কিন্তু অরূপ ভাইয়া কার মতো হয়েছে? কি জানি! এই বাড়ির মানুষের ব্যবহার দেখে বোঝাই যাচ্ছে না যে বিয়ের আসরে কনে বদল হয়ে গেছে ৷ তাদের দেখে একদম স্বাভাবিক মনে হচ্ছে ৷ তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে ৷ কিন্তু ভাইয়া তো মেনে নিবে না আমাকে ৷ রুমের দরজা খুলে ভিতরে চলে গেলাম ৷ বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ৷ চারপাশে ফুল, ক্যান্ডেল আর বেলুন দিয়ে রুমটাকে অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ৷ কিন্তু এই রুমটা তো আমার জন্য না সাজানো হয়েছে মায়া আপুর জন্য ৷ কিন্তু আজ মায়া আপুর জায়গায় আমি ৷ যদি ওনার সঙ্গে আজ আপুর বিয়ে হয়ে যেত তাহলে তো মায়া আপু আজ আমার জায়গায়ই থাকতো ৷ ভাবতেই বুকটা ধুক করে উঠলো ৷
হালকা করে রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম ৷ তারপর বিছানার ঠিক মাঝখানে গিয়ে বসলাম ৷ ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি ১০ টার বেশি বাজে ৷ চোখ বুজে আসছে আমার কিন্তু নয়না আন্টি বারবার করে বলে দিয়েছে ভাইয়া রুমে না আসা পর্যন্ত যেন জেগে থাকি ৷ তবে এভাবে বসে থাকতেও প্রচুর বিরক্ত লাগছে ৷ কিন্তু কিছু করার নেই ৷ জানিনা অরূপ ভাইয়া আসলে কি বলবে বা করবে! মাঝেমাঝে মনে হয় আজকের অরূপ আর আমার দেখা সেই প্রথম দিনের অরূপের মধ্যে কোনো মিলই নেই ৷ মনে পরে গেল সেদিনের কথা যেদিন প্রথম দেখা মাত্রই ভালো লেগে গিয়েছিল আমার উনাকে ৷
৷
৷
৷
৷
৷
“আরে আপনি কি কানা? আমার বই খাতা গুলো ফেলে দিয়ে মজা নিচ্ছেন আমার সাথে? একটু দেখে শুনে চলতে পারেন না?”
বলেই সামনে থাকা ছেলেটার দিকে তাকাতেই হা হয়ে গেলাম ৷ ছেলেটা ভ্রু কুচকে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এক এক করে সব বইগুলো তুলে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,,,,,,,,,,,,
“একটু দেখে শুনে চলাফেরা করবেন ওকে? এটা আপনার বাসা না এটা একটা রাস্তা ৷ সো আশেপাশে তাকিয়ে চলাফেরা করবেন ৷”
ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গাঁয়ের জ্যাকেট ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,,,,,,
“ইনডিরেক্টলি কেন বলবো? ডিরেক্টলি -ই বলেছি ৷ যদি মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছু থেকে থাকে তো বোঝার কথা ৷”
আমি বইগুলো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম,,,,,,,,,,
“গোবর আমার মাথায় না আছে আপনার মাথায় ৷ আপনি কি দেখে শুনে হাঁটতে পারেন নাই? মেয়ে দেখলেই গাঁয়ে পরতে মন চায়?”
“ও হ্যালো? বলুন ছেলে দেখলেই আপনার মতো মেয়েদের তাদের গাঁ ঘেষাঘেষি করতে মন চায় ৷ তাও আবার ছেলেটা যদি হয় আমার মতো এতো হ্যান্ডসাম৷”
নিজের জ্যাকেটের কলার ঝাকাতে ঝাকাতে কথাটা বললো ছেলেটা ৷ আমি একটা ভেংচি কেটে বললাম,,,,,,,,
“জিরাফের মতো লম্বা আর ভেড়ার মতো সাদা হলেই তাকে হ্যান্ডলাম বলে না ওকে?”
“হোয়াট?” (চেঁচিয়ে)
“ইয়াপ! আমার ক্লাস আছে পরে আবার ঝগড়াটা কন্টিনিউ করবো ৷ আপাততো এখানেই স্টপ থাকুক ৷”
বলেই ছেলেটাকে কিছু বলতে না দিয়ে দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে এলাম আমি ৷ ক্লাসে ঢুকতেই মায়া আপুর সামনে পরলাম ৷ আমাকে দেখে বলতে লাগলো,,,,,,,,,,
“এতোক্ষন লাগে এই কয়টা বই আনতে?”
“সরি ইয়ার! খুঁজতে খুঁজতে টাইম লেগে গেল ৷ তুই তোর ক্লাসে চলে যা ৷ পরে কথা হবে ৷”
“আচ্ছা ৷”
বলেই সে চলে গেল ৷ তখন আমি পড়ি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে আর মায়া আপু হচ্ছে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে ৷ ক্লাস শেষে রুম থেকে বের হতেই সকালের সেই ছেলেটার সামনে পরলাম ৷ আমাকে দেখেই পাশ কাটিয়ে চলে গেল ৷ ঠিক তখনি পেছন থেকে একটা আওয়াজ কানে এলো,,,,,,,
“অরূপ?”
পিছনে তাকিয়ে দেখি মায়া আপু ৷ সে আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে সেই ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,,,,,,,,,,,,,
“একটু তো দাঁড়াবে নাকি? সেই কখন থেকে খুঁজে যাচ্ছি তোমায় ৷”
তাদের কথা শুনে মনে হলো একে অপরকে চিনে তারা ৷ এটাও মনে হলো তারা নিজেদের মধ্যে অনেকটাই ক্লোজ ৷ কেন জানিনা এই বিষয়টা খারাপ লাগলো আমার ৷ তবুও পেছন থেকে মায়া আপুকে ডাক দিলাম ৷ ওরা দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরে আমার দিকে তাকালো ৷ আমি ওদের সামনে গিয়ে মায়া আপুকে বলতে লাগলাম,,,,,,,,,,,,,
“কোথায় যাচ্ছিস? বাড়ি যাবি না এখন?”
মায়া আপু কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটা বলে উঠলো,,,,,,,,,
“তোমরা দুজন দুজনকে চিনো? মায়া কে এটা?”
মায়া আপু হালকা হেসে বললো,,,,,,,,,
“ওহ ও আমার চাচাতো বোন শ্রেয়া ৷ এই কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছে ফার্স্ট ইয়ারে ৷ আর শ্রেয়া ও অরূপ ৷ আমার বন্ধু ৷ অনার্সের স্টুডেন্ট ও ৷”
‘বন্ধু’ শব্দটা শুনে হালকা সন্দেহ হলো আমার ৷ তবুও বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটালাম না ৷ স্বাভাবিকভাবেই বললাম,,,,,,,,,,,
“সরি ভাইয়া তখন আসলে…”
“বুঝেছি আমি সমস্যা নেই ৷ হতেই পারে ৷ মায়া তুমি কি বাসায় চলে যাবে?”
আমাকে না বলতে দিয়ে অরূপ ভাইয়া কথাটা বলে মায়া আপুর দিকে তাকালেন ৷ মায়া আপু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললো,,,,,,,,,,,
“না শ্রেয়া তুই চলে যা ৷ আমি পরে চলে যাবো ৷ ঠিক আছে?”
“আচ্ছা ৷”
ওনারা দুজন কথা বলতে বলতে সামনের দিকে চলে গেলেন ৷ আমি তাদের দিকে একবার তাকিয়ে থেকে বাড়ি যাওয়ার দিকে রওনা দিলাম ৷
ওই দিনের পর থেকেই প্রতিদিন অরূপ ভাইয়ার সাথে কথা হতো আমার ৷ তবে তার সাথে মায়া আপুকে দেখে খারাপও লাগতো ৷ উনি সবসময় আমার সঙ্গে নরমাল বিহেভ করতেন ৷ হেসে হেসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মজা করে কথা বলতেন ৷ দেখতে দেখতে ছয় মাস চলে যায় ৷ আর এই ছয় মাসে ওনার প্রতি আমার ভালোলাগা গুলো গভীর থেকে গভীর হয়েছে ৷ একসময় ভালোবেসে ফেলেছি আমি ৷ ওনার ব্যবহার দেখে মনে হতো উনি আমায় ভালো না বাসলেও হয়তো পচ্ছন্দ করেন ৷ কিন্তু আমার ভাবনা গুলো ভুল প্রমানিত হয় সেদিন ৷
যেদিন আমি নিজের মনের কথা গুলো সাহস করে অরূপ ভাইয়াকে বলতে চেয়েছিলাম ৷ কলেজে গিয়ে ওই দিন ভাইয়াকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে তার বন্ধুদের কাছ থেকে উনি কোথায় তা জেনে নিয়েছিলাম ৷ কলেজ বিল্ডিংয়ের ছাদে চলে গেলাম আমি ৷ ছাদে গিয়ে দেখি অরূপ ভাইয়া হাতে গোলাপের তোড়া নিয়ে মায়া আপুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন ৷ আমি স্তব্ধ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে ৷ তারপর দৌঁড়ে কলেজের বাহিরে চলে গেলাম ৷
সেদিনের পর থেকেই তাদের দুজনের মধ্যে থেকে সরে গিয়েছিলাম আমি ৷ কোনো কথা বলতাম না তাদের সাথে ৷ দেখাও করতাম না ৷ সবসময় এড়িয়ে চলতাম ৷ মায়ার আপুর ইন্টারের এক্সাম শেষ হলে অরূপ ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ের ডেট ফিক্সড হয় ৷ আমিও বাঁধা হয়ে দাঁড়াই নি তাদের মাঝে ৷ কিন্তু তবুও কেন ভাইয়া আমাকে খালি দোষী করে সেটার কারণও জানা নেই আমার ৷ আপুও বা কেন পালিয়ে গেল সেটাও জানি না ৷
৷
৷
৷
৷
৷
রাত ০২ টার উপরে বাজে ৷ কিন্তু অরূপ ভাইয়ার আসার কোনো নাম নেই ৷ একটু নড়েচড়ে স্থির হয়ে বসলাম ৷ হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকালাম ৷ বুকের মধ্যে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে ৷ যদিও উনি আমাকে কখনোই মেনে নিবেন না ৷ আর এখন হয়তো রাগারাগি করবেন উনি ৷ আমি বিছানা থেকে নেমে তার কাছে এগিয়ে যেতেই উনি আমার মুখের উপর একটা কাগজ ছুড়ে মারলেন ৷ আমি চোখ মুখ কুচকে তাকালাম তার দিকে ৷ তার চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে মনে হচ্ছে ৷ এতোটাই রেগে আছেন উনি ৷ নিচের দিকে তাকিয়ে কাগজটা হাতে তুলে নিতেই অরূপ ভাইয়া বলে উঠলো,,,,,,,,,,,,,
“ডিভোর্স চেয়েছিলে না? এই নাও তোমার ডিভোর্স পেপার ৷”
চমকে তাকালাম তার দিকে ৷ চোখ জোড়া ভিজে আসছে বারবার ৷ উনি আবার বললেন,,,,,,,,
“কিছু কিছু কাজ আমি আগে থেকেই করে রাখি ৷ বিয়েতে তো এমনি এমনি রাজি হই নি ৷ ডিভোর্স পেপার রেডি করে তার পরেই হ্যাঁ বলেছি ৷ আর দেখো এটা এখন পেয়েও গেলে তুমি ৷ কী বলো তো? কোনো কাজ ফেলে রাখা পচ্ছন্দ না আমার ৷ এখন বের হও আমার রুম থেকে ৷”
বলেই আমার হাত ধরে টেনে রুম থেকে বের করে দিলেন ৷ মুখের উপর দরজা লাগাতে গেলেই আমি হাত দিয়ে দরজা আটকে ধরলাম ৷ উনি ভ্রু কুচকে চেয়ে রইলেন আমার দিকে ৷ আমি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বলতে লাগলাম,,,,,,,,,,,
“ডিভোর্স পেপার দিয়েছেন দেখে কি হয়েছে? ডিভোর্স কি হয়েছে? হয় নি তো? না হওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো ৷”
“শুধু তিন মাস ৷ তিন মাস পর ডিভোর্স দিব আমি তোমায় ৷ এমনকি তুমিও ৷ এই তিন মাস আমার প্রত্যেকটা অত্যাচার সহ্য করার জন্য তৈরী থাকো ৷ পারলে আরো তাড়াতাড়ি করতাম কিন্তু এসব বিষয়ে একটু হলেও সময় লাগে ৷ সময় শেষ হয়ে গেলে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে তুমি ৷ আর এই তিন মাসের মধ্যে মায়াকেও খুঁজে বের করবো আমি ৷ তোমাকেও দোষী প্রমানিত করবো ৷”
বলেই উনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ব্যালকনিতে নিয়ে গেলেন ৷ তারপর মুখের উপর ব্যালকনির গ্লাস লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন ৷ খাটের মধ্যে সাজানো সব ফুলগুলো ছিড়ে ফেলে দিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পরলেন উনি ৷ হয়তো আজ থেকেই ভালো থাকার দিন শেষ আমার ৷ ব্যালকনির এক কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে রইলাম ৷ বাহির থেকে ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠছি আমি ৷ বারবার চোখ ভিজে আসছে আমার ৷ ভালোবাসার মানুষটার এতো কঠিন রূপ আমাকে শেষ করে দিচ্ছে ৷ তিন মাস সময় আমার কাছে ৷ এই তিন মাস আমি এই বাড়ির বউ হয়ে থাকবো ৷ অরূপের স্ত্রী হয়ে থাকবো ৷ তারপর তো আমরা আলাদা হয়ে যাবো ৷ তখন অরূপের থেকে দূরে চলে যেতে হবে আমায়!! হয়তো অনেক দূরে!!
৷
৷
৷
৷
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
“তোর মতো একটা মেয়েকে বিয়ে করবো আমি? সিরিয়াসলি? জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিস? নাকি বিপদের সময় সাহায্য করে নিজেকে মহান প্রমাণিত করছিস, কোনটা? তোর কাছ থেকে এর বেশি আর কি-ই বা পাওয়া যেতে পারে? আর কত নিচে নামবি তুই? ছিহহ তোকে দেখলেই প্রচুর ঘৃণা হয় আমার ৷”
অরূপ ভাইয়ার মুখে এসব কথা শুনে পাথরের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি ৷ তার চোখে মুখে আমার জন্য ঘৃণা দেখে নিজেকে নিজেরই শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে ৷ অরূপ ভাইয়া আমাকে ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে বললো,,,,,,,
আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে অরূপ ভাইয়া বলতে লাগলো,,,,,,,,,
“তোর মতো বোন থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো ৷ নিজের বোনের বিয়ের দিন নিজের বোনকে কিডন্যাপ করে এসব বড় বড় কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? ওহ তোর তো লজ্জা নামক জিনিসটাই নাই ৷ থাকলে কি তুই অন্য ছেলেদের সাথে বেড…”
“চুপ! একদম চুপ! আমার ব্যাপারে আপনাকে নাক গলাতে বলেছে কে? আমার যা ইচ্ছা তাই করবো আমি ৷ তাতে আপনার কি?”
তাকে বলকে না দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম আমি ৷ অরূপ ভাইয়া তাচ্ছিল্য স্বরে বললো,,,,,,,,,,,
“তোর যা ইচ্ছা কর ৷ তাতে আমার কোনো কিছুই যায় আসে না ৷ তাই বলে তুই মায়াকে আজকের দিনে সরিয়ে দিবি?”
“কত বার বলবো? মায়া আপুকে সরাই নি আমি ৷ আমি জানি না আপু কোথায় আছে?”
অরূপ ভাইয়া পাশের টেবিল থেকে একটা ফুলদানি নিয়ে ঠাস করে ফেলে দিলেন ৷ তারপর আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন,,,,,,,,,,
“তোকে দেখে নিব আমি ৷ মায়াকে তুই কিডন্যাপ করিয়েছিস সেটা প্রুভ করে দিব আমি ৷ আর হ্যাঁ বিয়ে করবো? তাও তোকে? মরে গেলেও না ৷”
বলেই হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি ৷ বিছানায় ধপ করে বসে পরলাম আমি ৷ সব মিথ্যা অপবাদ কেন আমার ঘাড়েই পরে? কিছু না করেও কেন সবকিছুর দোষী আমিই হই? এই মানুষটা কেন ঘৃণা করে আমায়? একটুও কি বুঝতে চায় না? ভালোবাসি বলেই কি এত অত্যাচার সহ্য করে নিতে হবে আমায়? নিজের ভালোবাসা অন্যের হাতে তুলে দিতে গিয়েও সেই আমিই খারাপ হয়ে গেলাম? কেন হচ্ছে আমার সাথে এসব?
আজ মায়া আপুর বিয়ে ছিল ৷ সম্পর্কে ও আমার চাচাতো বোন ৷ মায়া আপুর মা অনেক আগেই মারা গেছে ৷ আর ওর বাবা দেশের বাইরে কাজের জন্য থাকে ৷ আমার ০১ বছরের বড় ও ৷ সবসময় নিজের বোনের মতোই ভেবেছি ওকে ৷ কিন্তু ও ভাবতে পারে নি ৷ এতো বড় একটা বিপদে আমায় একা ফেলে চলে গেল ৷ অরূপ ভাইয়া আর মায়া আপু দুজন দুজনকে ভালোবাসে ৷ আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াইনি তাদের মাঝে ৷ সরে এসেছিলাম ৷ তবুও দোষী হতে হলো আমাকেই ৷
বিয়ের দিন বিয়ের আসর থেকে যে এভাবে পালিয়ে যাবে কে জানতো? আর তার দোষও যে আমায় নিতে হবে ভাবতেও পারি নি আমি ৷ নিচে চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে দ্রুত নিচে চলে গেলাম ৷ নিচে গিয়ে দেখি অরূপ ভাইয়া আর তার বাবা ঝগড়া করছে নিজেদের সাথে ৷ আমি দৌঁড়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম ৷ অরূপ ভাইয়া রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,,,,,,,
“শ্রেয়াকে বিয়ে করবো না আমি ৷ তোমাদের মান সম্মানের জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করতে পারবো না ৷ আমি মায়াকেই বিয়ে করবো ৷”
দীপ্ত আঙ্কেল (অরূপের বাবা) তার ছেলের কথার উত্তরে বললেন,,,,,,,,,,
“তোমার মত জানতে চাই নি আমি ৷ খুব তো বলেছিলে মায়াকে বিয়ে করবে ৷ কি হলো শেষমেষ? আমাদের পরিবারকে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল সে ৷ ওই মেয়েটার নাম তোমার মুখে শুনতে চাইনা আমি ৷”
অরূপ ভাইয়া রেগে বললেন,,,,,,,,
“মায়া চলে যায় নি ৷ এই শ্রেয়াই ওকে কিডন্যাপ করিয়েছে ৷ তুমি…”
“তোমাকে বলেছি না…?”
দীপ্ত আঙ্কেলের কথার মাঝেই আমি বলে উঠলাম,,,,,,,,,
“আঙ্কেল? আমার ওনার সঙ্গে কিছু কথা আছে ৷ আলাদা কথা বলতে পারি আমরা?”
“তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই ৷”
চোখ মুখ কুচকে রাগী স্বরে কথাটা বললো অরূপ ৷ আমি বললাম,,,,,,,,
“আপনাকে জিজ্ঞেস করি নি আমি ৷ আঙ্কেল?”
দীপ্ত আঙ্কেল অরূপের দিকে তাকিয়ে বললো,,,,,,,,,
“যাও শ্রেয়ার সাথে ৷”
“যাবো না আমি ৷” (অরূপ)
আমি অরূপ ভাইয়ার হাত ধরে সবার মাঝেই টেনে নিয়ে এলাম একটা রুমে ৷ তাকে রুমে ঢুকিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি বললাম,,,,,,,,,
“সমস্যা কি আপনার?”
“হু দ্যা হেল আর ইউ? আমাকে টেনে আনার মানে কি? সরো সামনে থেকে ৷”
হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বললাম,,,,,,,
“বিয়েটা করবেন কি করবেন না?”
উনি শান্ত স্বরে বললেন,,,,,,,,,
“করবো না!”
“বিয়েটা না করলে আমি মায়া আপুকে মেরে ফেলতে বাধ্য হবো ৷”
“ওহ এখন আসো আসল কথায় ৷ খুব তো বলছিলে মায়াকে কিডন্যাপ করো নি তুমি ৷ তাহলে এখন বলছো কেন যে মায়াকে মেরে ফেলবে তুমি?”
আমি আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বলে উঠলাম,,,,,,,,,,
“ইয়েস বিয়েটা না করলে আপনার সো কল্ড প্রেমিকাকে মেরে দিব আমি ৷ এখন ইচ্ছেটা আপনার ৷ তো কি করবেন?”
“বাইরে গিয়ে বলে দিব সবাইকে ৷”
“ওহ রিয়্যালী বিশ্বাস করবে কেউ? করবে না তো? তাহলে রাজি হয়ে যান ৷ নিজের পরিবারের সম্মান বাঁচাতে ৷”
আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রুমের বাহিরে যেতে নিলেই আমি বললাম,,,,,,,
“রাজি হয়ে যান ৷ বিয়ের পরে নাহয় ডিভোর্স দিয়ে দিয়েন আমাকে ৷ আপাততো এখন বিয়েটা করতেই হবে আপনাকে ৷”
অরূপ ভাইয়া একবার আমার দিকে তাকিয়ে রেগে চলে গেলেন বাহিরে ৷ ফ্লোরে বসে পরলাম আমি ৷ দুই পরিবারের সম্মান বাঁচাতে আজ আমায় আবার মিথ্যা কথা বলতে হলো ৷ সবার ভালো করতে গিয়ে নিজেকেই খারাপ প্রমানিত করতে হচ্ছে আমায় বারবার ৷ ভালোবাসার মানুষটার মুখে ‘ঘৃণা’ নামক শব্দটা বুকে সোজা তীরের মতো লাগে ৷ কেন এতো ঘৃণা করে আমাকে অরূপ ভাইয়া?
“শ্রেয়া?”
কারো গলার আওয়াজে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম ৷ পিছনে তাকিয়ে দেখি আম্মু দাঁড়িয়ে আছে ৷ অামার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,,,,,,
“কাঁদছিস কেন?”
“আআসলে… ও কিছু না ৷ ভাইয়া রাজি হয়েছে?”
“হ্যাঁ রে মা ৷ রাজি তো হয়েছে কিন্তু তুই সত্যি এই বিয়েটা করবি?”
“না করার কি আছে আম্মু?”
“না কিছু নাহ ৷ রেডি হয়ে নে ঝটপট ৷ এক্ষুনি তো আবার নিচে নিয়ে যেতে হবে তোকে ৷ হাতে সময়ও নেই বেশি ৷”
“হুম ৷”
“মায়া কেন এরকম করলো বল তো?”
“বাদ দাও আম্মু ৷ আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি ৷”
আম্মু চলে গেলে দুইটা মেয়ে এসে আমার গায়ের গয়না গুলো খুলে ভারী কয়েকটা গয়না পরিয়ে দিল ৷ চোখে কাজলের কালি যেটা লেপ্টে গিয়েছিল সেটা ঠিক করে দিল আর কপালে একটা টিপ দিয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া হলো ৷ মেরুন কালারের লেহেঙ্গা পরেছিলাম আমি ৷ সেটা আর চেঞ্জ করা হয়নি ৷ একটু পর নিচে নিয়ে গিয়ে আমাকে অরূপ ভাইয়ার পাশে বসানো হলো ৷ ওনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি রাজি নন এই বিয়েতে ৷ কিন্তু ভাগ্যের জোরে বিয়েটা একপ্রকার বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে ওনাকে ৷ জানিনা এই ভাগ্য আবার আমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে!!
#ছোঁয়া_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
শেষ পর্ব (১ম অংশ)
অতলের সাথে দেখা করতে রাদিদের তেমন কষ্ট হলো না। অতল নিজেই ওকে ফোন করে দেখা করতে চাইল। অতলের অবস্থা দেখে রাদিদ একটা ধাক্কা খেল। এতোটা পরিবর্তন! চোখের নিচে কালি, উস্কখুস্ক চুল, বিধ্বস্ত চেহারা। এমন অবস্থায় সে বলার জন্য কোনো কথাই খুঁজে পেল না।
অনেকক্ষণ পর জানতে চাইল, ‘এ কেমন অবস্থা করেছিস নিজের?’
অতল হেসে বলল, ‘আমি তো এটারই যোগ্য তাই না? আমার তো এরকম অবস্থা হবারই ছিল।’
রাদিদ তখন অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘প্লিজ অতল, ভাই আমার। তুই নিজেকে কষ্ট দিস না আর বহ্নিকে একা ছেড়ে দিস না। ও তোকে অনেক ভালোবাসে।’
রাদিদ চোখ নিচু করে ফেলল সাথে সাথেই। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কে বলেছে আমি ওকে ভালোবাসি?’
‘তোর দৃষ্টি।’
রাদিদ অতলকে অনেকভাবে বুঝাতে চাইল কিন্তু অতল রাদিদের কোনো কথাই শুনতে চাইল না। সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। রাদিদ যাই বলছে অতল তার বিপরীতে উল্টো যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে।
রাদিদ রেগে গিয়ে বলল,
‘এসব আবোল-তাবোল কথা বাদ দে তো। আমি তোকে যা বলছি তা শোন একবার।’
‘তুই আমার কথা শোন। বহ্নিকে কখনও কষ্ট দিস না। আমি জানি ও তোর কাছে ভালো থাকবে।’ কথাটা বলেই অতল চলে গেল। এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। অতলের দু’চোখ ভরা বিষাদ রাদিদের চোখে এড়ার না।
_______________________
অতলের সাথে বহ্নির মানসিক দূরত্ব বাড়তেই থাকল, সাথে বাড়তে থাকল বহ্নির জেদ আর অতলের পাগলামো। একদিকে ভাঙছে, অপরদিকে অভিমানের পাহাড় গড়ছে। যে বহ্নি এতোদিন অতলকে বিয়ে করবে বলে অনড় ছিল। সেই এবার বিয়ে কোনোভাবেই ভাঙবে না বলে অনড় অবস্থান করল, তবে বর হিসেবে এবার থাকবে অন্যকেউ। নির্ধারিত দিনেই সে বিয়ে করবে। মূলত অতলের সাথে তৃণা নামের মেয়েটাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখার পর থেকেই বহ্নির মাথায় আগুন ধরে গেল। ঠিক তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে রাদিদকেই বিয়ে করবে। সবাই ওকে বুঝাল কিন্তু ও কারো কথাই শুনল না। শিহরণ আর ছোঁয়া অনেক বোঝাল, তাতেও কাজ হলো না। সে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকল। নিজের ভেতরে থাকা একগুঁয়ে সত্তাটা বেরিয়ে এসেছে, যাকে দমন করা তার নিজের পক্ষেও সম্ভব নয়।
অতল নিজের ব্যর্থতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। সে আর পারছে না। নিজের উপরে থাকা অবশিষ্ট বিশ্বাসটুকু হতাশায় পরিণত হলো। অবশেষে সে হার মানল, নিজের ব্যর্থ ভাগ্যের কাছে।
বিয়ের দিন অতলকে কল করল বহ্নি। অতল কল রিসিভ করল না। অবশেষে বহ্নি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাথে করে নিয়ে গেল অতলের দেওয়া নীল শাড়ি আর নীল চুড়ি। বহ্নি জানে অতল কোথায় থাকতে পারে। গাড়ি থেকে নেমে নদীর কাছাকাছি এসেই অতলকে বেঞ্চে বসে থাকতে দেখল। অতলকে দেখে বহ্নি ভীষণ চমকে গেল। বিধ্বস্ত অতল, বিধ্বস্ত তার বাহ্যিক অবয়ব।
অতলের সামনে দাঁড়িয়ে বহ্নি শেষবারের মতো একবার বলল, ‘এখনও সময় আছে। যদি আমাকে বলার মতো কিছু থেকে থাকে তবে জানাও।’
‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি।’
‘ঠিক আছে, আমিও আমার সিদ্ধান্ত জানাতেই এলাম।’
‘কীসের সিদ্ধান্ত?’
‘আমি রাদিদ ভাইয়াকে বিয়ে করছি।’
অতলের মনে হলো তার বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা কেউ ছুরি দিয়ে কেটে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। তবুও বহ্নির ভালোর জন্য সে এই কষ্টটা মেনে নিল।
বহ্নি অতলের দেওয়া সবস্ত উপহার তাকে ফিরিয়ে দিয়ে চলে গেল। একটা বারও পেছন ফিরে তাকাল না। রাস্তার সকলেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বহ্নির দিকে। এরকম বিয়ের সাজে একটা মেয়ে রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে দেখে সকলের মনেই কৌতূহল।
অতল নীল শাড়িটা বুকের সাথে চেপে ধরল। শাড়ি আর চুড়িগুলো নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। এসেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। সে জানে আজ থেকে বহ্নি রাদিদের হয়ে যাবে। শাড়িটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। বিয়ের সাজে বহ্নিকে সত্যিকারের পরীর মতো দেখাচ্ছে। পরীদের কষ্টে থাকতে নেই, তারা কষ্ট সহ্যও করতে পারে না, অতলের সাথে থাকা মানেই কষ্টকে জেনেশুনে আলিঙ্গন করা, বহ্নি তা চাইলেও অতল তা হতে দিতে পারে না।
এটাই বহ্নির জন্য বেস্ট। একজন ব্যর্থ মানুষের সাথে থেকে নিজের জীবন ধ্বংস করে ফেলুক তা অতল চায় না। তাই মুক্তি দিল বহ্নিকে, তার ব্যর্থ ভালোবাসা থেকে, তার ব্যর্থ জীবন থেকে!
_______________________
অবশেষে অনাড়ম্বরভাবে রাদিদ আর বহ্নির বিয়েটা হয়ে গেল। এই বিয়েতে কেউ রাজী ছিল না। কিন্তু বহ্নির জেদের কাছে সবাইকে হার মানতে হলো। কবুল বলার সময় বহ্নির চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
শিহরণ জানতে চাইলেও বহ্নি বলল না তার অতলকে ছেড়ে রাদিদকে বিয়ে করার কারণ। সে চায় না তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হউক। তাই সবকিছুই শিহরণের কাছ থেকে চেপে গেল। বহ্নি আর রাদিদ যখন গাড়িতে করে কুমিল্লা রওনা দিল তখন ভূতগ্রস্তের মতো রাস্তার এক কোণে ল্যাম্পপোস্টের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অতল তাকিয়ে থাকল। অন্ধকারের অতলে ডুবে যাচ্ছে সে। কারো নজর তার উপরে পড়ল না। কেউ দেখল না, উস্কখুস্ক চুল, কুঁচকে যাওয়া কাপড় পরে অতল তার প্রিয়তমার শেষ বিদায়ের বেলা তাকে অগোচরে বিদায় জানাতে এলো। কোনো কারণ ছাড়াই বহ্নি একবার গাড়ির কাচের বাইরে মাথাটা বের করে এদিক সেদিক তাকাল। অতল শেষবারের মতো তার পরীর মুখটা দেখল, কী ভয়ংকর সুন্দর লাগছে তাকে! আর সে ভয়ংকরভাবে ভেঙে পড়ছে।
পৃথিবী নামক গ্রহে বোধহীন মানুষের সবচাইতে বড়ো শত্রু তার শঙ্কা, অবিশ্বাস আর ভয়। অতল সেই ভয়, শঙ্কা আর অবিশ্বাসের কারণেই সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল। ডুবে গেল অন্ধকারের অতলে নিঃশব্দে, কেউ জানতেই পারল না তার বুকের গহীনের কষ্টের গভীরতা কতটুকু! তবুও ভালোবাসার ভালো থাকাকে বেছে নিল অবলীলায়, নিজ ক্ষতের পরোয়া না করেই। পৃথিবীতে এই শ্রেণীর মানুষ বিরল, যে কজন আছে তারা কেবল দুঃখ বয়ে বেড়ায়। তাদের দুঃখের ফেরিওয়ালা বলা যায় নির্দ্বিধায়!
___________________
অতল কারো সাথেই কোনো যোগাযোগ রাখল না। একা ঘরে নিজেকে বন্ধী করে রেখেছে। তার মানসিক অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে সে আরও অনেক বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। নিজের উপর যেটুকু বিশ্বাস, ভরসা বাকি ছিল তার সবটুকু শেষ হয়ে গেছে। এখন তার পুরোটা জুড়ে কেবল হতাশা। খাওয়া-দাওয়ার চরম অনিয়ম করা শুরু করেছে। এর মধ্যে সে তিনবার সুইসাইড এটেম্পটও করে ফেলেছে। একবার অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছে, একবার বিষ খেয়ে ফেলেছিল। মেহেরুন নাহার যখন কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘এমন কেন করছিস তুই? আমরা কি তোর কেউ না? আমাদের জন্য কি তুই নিজেকে একটু ভালো রাখতে পারিস না?’
অতল তখন অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় বলেছিল, ‘আমি ঘুমাতেই চাই মা, আমার না ঘুম আসে না। সারা রাত শুধু মাকে মনে পড়ে। মনে হয় আমিও আমার বাবার মতো হয়ে যাব না তো?’ তারপর পরই কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ‘দেখো না, আমিও বাবার মতো হয়ে যেতে পারি বলে আমি আমার এঞ্জেলকে হারিয়ে ফেললাম। তার বাবা-মা আমাকে ভরসা করতে পারেনি। আমি নিজেও ভরসা করতে পারছি না নিজেকে। যদি আমি আমার এঞ্জেলকে কষ্ট দিয়ে ফেলি। যদি ও আমার মায়ের মতো হয়ে যায়। এতো বড়ো ঝুঁকি নিতে পারিনি আমি মা। তার চাইতে বরং ও ভালো থাকুক। আমি জানি রাদিদ ওকে ভালো রাখবে। ভালোবাসলে পেতেই হবে এমন কোনো নিয়ম পৃথিবীতে এখনও সৃষ্টি হয়নি, আমি না হয় দূর থেকেই ভালোবেসে যাব আমার এঞ্জেলকে। আমি জানি আমার ভাগ্য এতোটাও সুপ্রসন্ন নয় যে, আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।’
‘আমার নিজের উপরে ভরসা নেই। ভালোবাসার মানুষের ভালো থাকাটাই তো মুখ্য তাকে পাওয়া তো নয়।’
‘তাহলে এখন এরকম মরে যেতে চাইছ কেন?’
‘আমার নিজেকে নিঃস্ব লাগে। মার কথা, বহ্নির কথা এতো বেশি মনে পড়ে যে আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। আমার নিজের উপরে তখন আমার কোনত নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’
শেষ বার সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অতল ভয়ংকর কাজ করে ফেলেছিল। সে ধারালো ব্লেড দিয়ে নিজের হাতের রগ কেটে ফেলেছিল। তানিয়া অতলের খাবার দিতে এসে ডাকতে ডাকতে যখন তার কোনো সাড়া পেল না তখন এলাকার কয়েকজন বড়ো ভাইয়ের সহায়তায় দরজা ভেঙে ফেলে। দরজা ভাঙার পরে দেখে রুমের অবস্থা ভয়াবহ। পুরো ফ্লোর জুড়ে রক্তের স্রোত। সবাই মিলে ওকে ধরে বের করে হাসপাতালে এডমিট করে। অনেক ব্লাড দিতে হয়েছিল।
তানিয়া তখন কী মনে করে বহ্নির সাথে যোগাযোগ করল। বহ্নির মনে তখনও অতলের জন্য এক আকাশ অভিমান জমেছিল। কিন্তু তানিয়ার কাছ থেকে অতলের ব্যাপারে সবটা শুনে সে আর না এসে থাকতে পারল না। রাদিদও তার সাথে এলো।
বহ্নি আসার পরে তানিয়া তাকে সবকিছু জানিয়ে দিল। তৃণাকে দিয়ে অভিনয়, তার মায়ের অতলের কাছে করা অনুরোধ, জব না হওয়া, একদম সবকিছু বলে ফেলল। বহ্নির তখন নিজের উপরে রাগ হচ্ছিল। কেন সে রাগ করল, রাগের বশে সে নিজেই সবটা শেষ করে দিয়েছে। একটু অপেক্ষা করলে কি এমন ক্ষতি হতো!
অতলের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে বহ্নির বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। এতোটা করুণ অবস্থা হয়েছে! এভাবে কষ্ট পাচ্ছে। তিন বার সুইসাইড এটেম্পট! অতলের এমন অবস্থার জন্য সে নিজেও কী দায়ী নয়?
বহ্নি একটা চিরকুট লিখল অতলের জন্য।
প্রিয় তুমি,
সব ভালোবাসা কি পূর্ণতা পায়?
তোমার আমার ভালোবাসাও হয়তো পূর্ণতা পাবে না। তবুও তোমায় ভালোবেসেই যাব। তোমার স্থানটুকু তোমার জন্যই বরাদ্দ থাকবে।
একটা কথা বলবে?
আমার উপর এতটুকুও কি বিশ্বাস জন্মায়নি তোমার? আমাকে একবারও জানাতে ইচ্ছে হয়নি তোমার? সারাজীবন সব সম্পর্ক থেকে তুমি পালিয়ে এসেছ। আমার কাছ থেকেও পালিয়ে বেঁচে গেছ। এখন নিজের জীবন থেকেও পালাতে চাইছ? বাহ! অতল, বাহ্! একটাবারও সেই মায়ের কথা ভাবলে না, যেই মা তোমার জন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে, বোনের কথা মনে হলো না, যে তোমার জন্য নিজের ভাইয়ের সাথেও যুদ্ধ করতে চায়!
কারা পালাতে চায় জানো তো? কাপুরুষরা? তুমি কি কাপুরুষ?
অপরাজিতা না-কি তোমার প্রিয় ফুল? অথচ সম্পর্কের কাছে তুমি বারবার পরাজিত। এ তোমার কেমন পছন্দ? বলবে আমায়?
একটা অদ্ভুত বিষয় দেখেছ, জীবনের পথচলায় তুমি আমাকে একা ছেড়ে দিলে, আমার উপর একটুও বিশ্বাস রাখোনি। তুমি ভাবছ-তোমাকে ছাড়াই আমার ভালো হবে! কে ভাবতে বলেছে আমার ভালো? আমার ভালোটা আমাকেই বুঝতে দিতে।
যদি আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা সত্যিই হয়ে থাকে তবে তুমি অপরাজিত হও ঠিক তোমার জন্য রেখে যাওয়া আমার শেষ স্মৃতির মতো। তোমার জন্য নিজ হাতে এই অপরাজিতা ফুলগুলো তুলেছি। যত্ন করে রেখো। নিজের খেয়াল রেখো।
কিছু মানুষকে ভোলার চেষ্টা করতে নেই, তুমি তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু যখনই তোমার কথা আমার মনে পড়বে তখন যেন আমার এটা মনে না হয় যে আমি একজন ভীরুকে ভালোবেসেছিলাম। যে ছিল পলাতক। আমি এই ভাবনাতে ভীষণ কষ্ট পাব। আমি ভাবতে চাই, আমার ভালোবাসার অতল নীল অপরাজিতার মতোই অপরাজিত, তাকে রুদ্ধ করার সাহস কারো নেই ,নেই কোনো ক্ষমতা।
পৃথিবীতে কেউ পারফেক্ট হয় না, অপূর্ণতাটুকু পুর্ণ করে নিতে হয়। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে, স্বপ্ন দেখে। পৃথিবীতে কেউ পরিপূর্ণ হয় না। আমি চাই তুমি তোমার সমস্ত অপূর্ণতার মাঝে থেকে পরিপূর্ণ হও।
ইতি
তোমার কেউ না।
অতলের জ্ঞান ফেরার পূর্বেই বহ্নি চলে গেল। রাদিদ বুকে পাথর রেখে বহ্নিকে বলল, ‘তুমি চাইলে ওর কাছে ফিরে যেতে পারো।’
জবাবে বহ্নি মৃদু হাসল। তারপর রাদিদের একটা হাত শক্ত করে ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। তানিয়া নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকল তাদের গমনপথে।
অতলের জ্ঞান ফেরার পর সে বহ্নির রেখে যাওয়া চিঠি আর অপরাজিতা ফুলগুলো পেল। চিঠিটা বার বার পড়ল। মনে হলো সেই চিঠিতে বহ্নির স্পর্শ লেগে আছে, বহ্নির ভালোবাসার শেষ চিহ্নটুকু সে যত্ন করে রেখে দিল নিজের কাছে। সেদিন সারা রাত সে ঘুমাতে পারেনি। সারা রাত শুধু বহ্নির চিঠিটা বারবার পড়েছে আর অপরাজিতা ফুলগুলো বুকের সাথে চেপে ধরেছিল।
___________________
প্রকৃতিতে ফাগুনের হাওয়া লেগেছে। গাছে গাছে সবুজ পাতা গজেছে। চারদিক থেকে ফুলের ঘ্রাণ বাতাসের ভেলায় ভর করে ভেসে আসছে। ছোঁয়া হুইল চেয়ারে বসে আছে। শিহরণ তার থেকে দুই তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাকুল হয়ে বলছে, ‘ইউ ক্যান ডু ইট, ছোঁয়া। ডু বিলিভ অন ইউ। ডোন্ট লুজ ইওর পেশেন্স।’
ছোঁয়া কম্পিত বুক নিয়ে কম্পমান হাতে হুইলচেয়ারের হাতল ধরে রেখেছে শক্ত করে। তার পায়ের পাতা মাটিতে রাখল, বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। একটু একটু করে ওঠার চেষ্টা করছে সে। শিহরণ দূরে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। মনের মধ্যে শত ডানার প্রজাপতিরা উড়ছে, এই বুঝি ছোঁয়া হাঁটতে শুরু করবে। এই প্রত্যাশা আর ইচ্ছে নিয়ে দীর্ঘ ছ’মাস চেষ্টা করছে শিহরণ। ফিজিওথেরাপিস্টের ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি সে নিজেও ছোঁয়ার হাঁটার চেষ্টায় সফলতার স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে, চেষ্টা করে গেছে মুহুর্মুহু। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ছোঁয়া হাঁটতে পারবে। পৃথিবীতে যেকোনো ধরনের সফলতার পূর্বশর্ত বিশ্বাস। বিশ্বাসহীন চাওয়া ঠুনকো বৈ আর কিছুই নয়। ছোঁয়া দাঁড়িয়েছে, এটা ছ’মাসের অক্লান্ত চেষ্টার ফল। শিহরণ চেঁচিয়ে বলল, ‘কাম অন ছোঁয়া, ইউ ক্যান ডু ইট। ট্রাস্ট মি ইউ উইল বি সাকসিডেড।’
শিহরণের কথায় ছোঁয়া যেন জোর পেল। সে দুরু দুরু বুক নিয়ে কম্পমান পা ফেলছে।পড়ে যেতে চাইছে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিচ্ছে। ঠিক যেমন করে নতুন শিশু প্রথম হাঁটতে শেখে।
ছোঁয়া যখন হাঁটতে হাঁটতে শিহরণকে ধরে ফেলল তখন সে এক ঝটকায় ছোঁয়াকে কোলে তুলে নিল। তারপর আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘুরতে লাগল। ছোঁয়া বলল, ‘আরে করছটা কী? সবাই দেখছে তো?’
‘দেখলে দেখুক। আমি নিজের বিয়ে করা বউকে কোলে তুলেছি, অন্য কাউকে তো নয়।’
বেশ কিছুক্ষণ পরে তাদের চারপাশে একটা জটলা মতন পেকে গেছে। সবার মধ্যে কৌতূহল কাজ করছে। হলোটা কী? সকলের উৎসুক চোখ ব্যাকুল হয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। একটা সময় পরে শিহরণ ছোঁয়াকে কোল থেকে নামাল।
ছোঁয়াকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখে ফাহমিদা বেগম খুশিতে কেঁদে ফেললেন। অহনা আর হিয়াও অনেক খুশি হলো। ফাহমিদা বেগম শিহরণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমার অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই আজকে আমার মেয়েটা হাঁটতে পারছে। অনেক ভালো থাকো বাবা।’
হিয়া হেসে বলল,’জিজু, এই খুশিতে আমাদের কিন্তু ট্রিট দিতে হবে। কি দেবে না?’
শিহরণ মৃদু হেসে বলল,’কেন দেব না? এবার বিশাল পার্টি হবে। কী বলো প্রিয়তা?’
ছোঁয়া মিষ্টি হেসে বলল,’তোমাকে নিষেধ করলেও কি তুমি তা শুনবে? তোমার যা ইচ্ছে হবে তা-ই তো করবে। তাহলে আমাকে শুধুশুধু প্রশ্ন করছ কেন?’
‘এরকম অপবাদ সহ্য করার মতো নয়।’ শিহরণ কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’আমি তো তোমার কথা সবসময় শুনি। তবুও এই অপবাদ!’
ছোঁয়া বলল, ‘যথেষ্ট হয়েছে। এখন আর নাটক না করলেও চলবে। বাসায় চলো। অফিসে যেতে হবে না?’
‘আজকে নো অফিস। আজকে আমরা সবাই মিলে সেলিব্রেট করব। ঠিক আছে না অহনা, হিয়া?’
অহনা আর হিয়া সম্মতি জানিয়ে বলল,’হুম, একদম ঠিক।’
ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বলল,’অফিসে না হয় যাবে না। এবার অন্তত বাসায় তো চলো।’
আকাশে তারাদের মেলা বসেছে। রাত বাড়ছে। এতোদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে আজ। পুরো রুমটা নানা রকমের ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বধুবেশে ছোঁয়াকে মোহনীয় লাগছে। শিহরণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুগ্ধতার রেশ না কাটতেই তার মনে পড়ল ছোঁয়াকে সারপ্রাইজ দেবার কথাটা।
ছোঁয়াকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য শিহরণ যেন এক যুগ অপেক্ষা করেছে। আজ তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে। ছোঁয়াকে চোখ বন্ধ রাখতে বলে শিহরণ ড্রয়ার থেকে একটা লাল রঙের ছোট বক্স আর একটা ডায়েরি বের করল।
লাল রঙা বক্স থেকে একটা লকেট বের করে সেটা ছোঁয়ার গলায় পরিয়ে দিল। তারপর বলল,’এবার চোখ খুলতে পারো, প্রিয়তা।’
ছোঁয়া দেখল তার গলায় খুব চমৎকার একটা লকেট। সে খুশি হওয়ার পাশাপাশি অনেক বেশিই অবাক হলো কারণ সে লকেটটা তার মায়ের। সে ছলছল চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। শিহরণ চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে ডায়েরিটা তার দিকে এগিয়ে দিল। ছোঁয়া ডায়েরি দেখে আরও বেশি চমকে গেল। বলল,’এটা তোমার কাছে কী করে?’
‘তুমি ভুল করে স্কুলে ফেলে গিয়েছিলে। আমার নজর পরার পরে আমি ওটা সাথে করে নিয়ে আসি। তোমাকে ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ডায়েরির প্রতিটা পাতা আমি না চাইতেও আত্মস্থ করে ফেলেছিলাম। তাই আর দিতে পারিনি। যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম আজকের এই দিনে তোমাকে উপহার দেব বলে।’
ছোঁয়া ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগল। কৈশোরের সমস্ত পাগলামো ভরা আবেগে ভরপুর এই ডায়েরি। সবকিছু এখনও জীবন্ত, যেন হাত বাড়ালেই সবকিছু ধরা যাবে, অনুভব করা যাবে। মনের মধ্যে একটা চাওয়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে, সেই দিনগুলি ফিরে পাওয়ার জন্য।
‘আমি তো এমন সব অদ্ভুত কাজ করতেই ভালোবাসি। এতোদিন ধরে এগুলো নিজের কাছে আমানত হিসেবে রেখেছি। কই খুশি হয়ে আমাকে পুরস্কার দেবে তা না করে…!’
ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ শিহরণকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল,’অনেক ভালোবাসি।’
শিহরণ কিছু বলল না। সব কথা বলতে হয় না। রাত গভীর হচ্ছে পাশাপাশি দুটো হৃদয়ে জমিয়ে থাকা একে অপরের প্রতি ভালোবাসাও একীভূত হচ্ছে। নিশাচর পাখিরা ডাকছে তারস্বরে। ঝিঁঝিঁপোকারা দল বেঁধে ডেকে চলেছে এমনতরভাবে যেন তারা আজ কোনো উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি!
__________________
আমিরাহকে ডিভোর্স দেবার পরে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আশফাক নীলাকে তার বাড়িতে তুলল। আশফাকের বাবা আর মা কোনোভাবেই রাজী হলেন না। অবশেষে আশফাক আলাদা থাকার কথা বলার পরে তারা বাধ্য হন নীলাকে মেনে নেওয়ার জন্য। টিয়া এখন আর মুখ গোমড়া করে থাকে না। নীলাকে সে মা বলে ডাকে। পিউ ছোট বোন পেয়ে দারুণ খুশি। পিউ তো টিয়ার জন্য পাগলপ্রায়, টিয়াও পিউ বলতে অজ্ঞান।
দুই মেয়েকে নিয়ে আশফাক আর নীলার সংসার বেশ ভালোই যাচ্ছে। আশফাকের বাবা-মা নীলাকে পছন্দ না করলেও সামনাসামনি কিছু বলতে পারেন না।
________________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
শেষ পর্ব (২য় অংশ)
পাঁচ বছর পর…
বছরের সেরা ঔপন্যাসিকের অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে রাদিদ ইবনে ইফতেখার। এই সংবাদটা শোনার পর থেকে রাদিদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছে। সে কোথাও এক দন্ড বসছে না। কেবল অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। তার একান্ত গোপন মনের কথাগুলো আজ হাজার হাজার পাঠক হৃদয়ে ঠাই পেয়েছে! অপ্রত্যাশিত যেকোনো কিছুই অতুলনীয় আনন্দ দেয়। তাই রাদিদ আজ ভীষণ খুশি।
রাদিদের এখনও মনে হয় এই তো সেদিনকার কথা। হঠাৎ করেই একজন প্রকাশক তাকে ফোন করে তার লেখা প্রকাশ করতে চাইল। রাদিদ কোনোভাবেই বুঝতে পারল না, তার লেখালেখির কথা প্রকাশকের কানে গেল কীভাবে! এই কথা খুব কম লোকই জানে!
অবাক করার বিষয় ছিল রাদিদ তার উপন্যাসের খাতাটা যেখানে রেখেছিল সেখানে পায়নি। পরে পুরো ঘর সে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। অবশেষে খাতাটা পেল তাদের গোয়াল ঘরের ছাদে। কিন্তু খাতাটা কীভাবে যে সেখানে পৌঁছাল তা সে এখনও অবধি জানে না!
আর এখন আশ্চর্যজনকভাবে সে সেরা ঔপন্যাসিক হয়ে গেল। এটা কি চাট্টিখানি কথা!
বহ্নি কিচেনে রান্না করছিল। রাদিদ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে খবরটা দিল। বহ্নি প্রশস্ত হেসে বলল, ‘এ আর নতুন কী! আমি তো আগে থেকেই জানতাম। এটা তোমারই প্রাপ্য ছিল।’
রংধনু দৌড়ে এসে বলল, ‘পাপা, আমাকেও মামুণির মতো করে আদর করে দাও।’
রাদিদ তাড়াতাড়ি বহ্নিকে ছেড়ে দিল। রংধনুকে যেই কোলে নিতে গেল ও পুরো ঘরময় দৌড়াতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত রংধনুকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে রাদিদ বহ্নিকে বলল, ‘আমাকে ঘোড় দৌড় দৌড়িয়ে ছাড়ল তোমার মেয়ে।’
বহ্নি হেসে বলল, ‘হুম, তা ও কি শুধু আমার মেয়ে না-কি তোমারও মেয়ে?’
‘কিন্তু ও তো একদম আমার মতো হয়নি। হয়েছে তোমার মতো দুরন্তপনা।’
রংধনু বলে উঠল, ‘পাপা, আবার।’
রাদিদ বলল, ‘পাপা আজকে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আবার কালকে, ঠিক আছে?’
ফাইজা বেগম ফোড়ন কেটে বললেন, ‘ও বড়ো খোকা, তুই কি নিজের ছোটোবেলার কথা একদম ভুলতে বসেছিস? তোর মেয়ে একদম তোর মতোই দুরন্তপনা হয়েছে। কী যে দুষ্ট ছিলি তা আর বলতে!’
শাশুড়ির কথা শুনে বহ্নি ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল। রাদিদ মনে মনে আফসোস করে বলল, ‘কেন যে এমন সময় তার মা তোর পোলটা খুলতে গেল!’
ফাইজা বেগমকে এখন আর কোনো কাজই করতে হয় না। বহ্নি নিজেই সব কাজ সেরে ফেলে। পাশাপাশি একটা কলেজের প্রভাষক সে। রাদিদের জীবনে এভাবে সুখপাখিরা হানা দেবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তবে শয়নে-স্বপনে কিংবা জাগরণে সৃষ্টিকর্তার কাছে কেবল প্রার্থনা করে গেছেন যেন সমস্ত সুখ থেকে বঞ্চিত তার ছেলেটার জীবন যাতে একদিন সুখে-শান্তিতে ভরে যায়। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেছেন। রাদিদের জীবনে বহ্নি আসার পর থেকেই সবকিছু ম্যাজিকের মতো করে পরিবর্তন হয়ে গেল। বহ্নিকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। আবির আর সাবরিনা এখন রাদিদকে ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় না বরং তারা তাদের বন্ধুদের কাছে ঔপন্যাসিক রাদিদের ভাই-বোন হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এতেই তিনি শান্তি পান। নীলার বলা কথাগুলো সত্যি প্রমাণ হলো।
ফাইজা বেগমকে দেখে রংধনু খুশিতে লাফ দিয়ে উঠতে চাইল। রাদিদ দ্রুত ধরে ফেলল ওকে। এমন দুরন্ত মেয়েটা! রংধনু বলে উঠল, ‘দাদুর কাছে যাব।’
রাদিদ রংধনুকে ফাইজা বেগমের কাছে দিল। কিন্তু সে আবারও দৌড়াতে শুরু করল, এভাবেই প্রতিটা দিন সে পুরো ঘর মাথায় তুলে ফেলে। খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলতে থাকল,’দাদু, দেখি আমাকে ধরতে পারো কি না?’
রাদিদ হাসে মেয়ের চালাকি দেখে। বহ্নি মুচকি হেসে তার কাজে মনোযোগ দিল। রাদিদ বলল, ‘আজকে কি স্পেশাল কোনো আয়োজন করা হচ্ছে?’
‘জি, জনাব। আপনি অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন তাই ভালোমন্দ কিছু খাওয়ানোর জন্যই আমার পক্ষ থেকে এই ছোট্ট আয়োজন।’
‘এই অ্যাওয়ার্ডটা আসলে কার পাওয়া উচিত জানো?’
‘কার?’
রাদিদ জবাব দিল না। বহ্নি পুনরায় প্রশ্ন করল,’উত্তর দিলে না যে?’
রাদিদ বহ্নির কপালে চুমো দিয়ে তার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,’দেব। সময় আসুক।’ একটু থেমে রাদিদ আবারও বলল, ‘এসব অ্যাওয়ার্ড আমার জন্য খুব একটা মাইনে রাখে না, বহ্নি। আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো পুরস্কার তুমি। তুমি না থাকলে এসব আনন্দ আমার কাছে আনন্দ বলেই মনে হতো না। আমি বেঁচে থাকতাম, হয়তো তোমার জায়গায় অন্য কেউ আমার পাশে দাঁড়াত। তবে এটা সারাজীবন চিরসত্যের ন্যায় অম্লান হয়ে থাকত আমার সাহিত্য রচনার একমাত্র অনুপ্রেরণা তুমি, কেবলই তুমি। পাঠকরা ভালোবেসে আমাকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারা গ্রহণ না করলেও আমার কাছে এইসব সৃষ্টি অমূল্য থাকত।’
বহ্নি জবাবে হাসল। হাসছে রাদিদের চোখ জোড়াও। তার মন কৃতজ্ঞ সেই মানুষটার প্রতি যে অগোচরে থেকে তার এতো বড়ো উপকার করেছে।
_____________________
বিকেলের দিকে পশ্চিমাকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিল শিহরণ। একটু আগেই বৃষ্টি থেমেছে। রংধনু উঠেছে আকাশের বুকে। শিহরণ সেদিকেই তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ সতেজ বাতাস শরীরে আঁচড় কাটছে। সেই সমীরণের ছোঁয়ায় বারান্দায় লাগানো ফুলের গাছগুলোতে ফুটন্ত ফুলগুলো দোল খাচ্ছে।
ছোঁয়া এসে তার কাঁধে হাত রাখল । শিহরণ সেই হাতে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘ছোঁয়া, দেখ না আকাশটা কেমন মনমরা হয়ে আছে? আর রংধনুটা দেখেছ? বিবর্ণ লাগছে না তোমার কাছে? অতল আর আমার বোনটার সাথে এমন কেন হলো? মা কেন অতলকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দিল না!’
ছোঁয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আকাশের মন খারাপ নয়, শিহরণ। আর রংধনুটা মোটেই বিবর্ণ নয়। রংধনুটা তার গায়ে সাতটা রঙই ধারণ করে রেখেছে। বহ্নি, অতলকে হারিয়েছে কিন্তু রাদিদকে তো পেয়েছে। তাই না? মানুষ হিসেবে দু’জন-ই মূল্যবান। আর দুজনেই বহ্নিকে পাগলের মতো ভালোবাসে, সেই ছোটোবেলা থেকে। কেন ভাবছ শিহরণ, কেন নিজেকে এতো কষ্ট দিচ্ছ? বহ্নি ভালো আছে তো। আর অতল সে তো রূপকথার রাজকুমারের থেকে কম কিছু নয়! ও তো হেরে গিয়েও জিতে গেল! কজন পারে এমন জেতা জিততে?’
‘শুধু কি তাই। ও একা জেতেনি। ও জিতিয়েছে আরও হাজারও মানুষকে। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিত এমন একজন মানুষ তোমার বন্ধু বলে।’
‘ঠিক, আমার সত্যিই গর্ব হয় অতলের জন্য।’
‘বাবা, মা, বাবা মা, তোমরা কোথায়?’ হাতের মুঠোয় একগাদা চকলেট নিয়ে বর্ণ দৌড়ে আসল ছোঁয়া আর শিহরণের কাছে।
‘কী হয়েছে আমার বাবাটার?’ ছোঁয়া বলল আদুরে গলায়।
বর্ণ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘পাপা, আমাকে কোলে নাও। আমি রংধনু দেখব। দাদু বলেছে আকাশে এখন রংধনু উঠেছে।’
শিহরণ বর্ণকে কোলে তুলে নিয়ে আকাশের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখাল। বর্ণ অবাক গলায় বলল, ‘পাপা, এটা তো খুব সুন্দর।’ তারপর ছোঁয়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘মাম্মা, এই চক্কেতগুলো একটু রাখো তো।’
ছোঁয়া চকলেটগুলো হাতে নিতেই বর্ণ দু’হাত দিয়ে তালি দিতে শুরু করল। তারপর টুক করে চুমো খেল শিহরণের গালে। ছোঁয়া তখন গাল ফুলিয়ে বলল, ‘মাম্মাকে দেবে না?’
‘দেব তো মাম্মা, এক এক জন করে দেব। আমার একটা বোন চাই, মামনি। আমাকে একটা বোন এনে দাও না। আমি খেলব ওর সাথে।’
ছোঁয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,’আজকে তো তোমার বোন আসবে। রংধনু আসবে, সাথে আর কে কে আসবে বলো তো?’
‘ফুফু আর ফুফা আসবে। ইয়ে…কী মজা, রংধনু আসবে আকাশ থেকে!’ বর্ণ শিহরণের কোল থেকে নেমে দিল ভোঁ দৌড়।
বর্ণের কথা শুনে ছোঁয়া আর শিহরণ দুজনেই হেসে ফেলল। শিহরণ বলল,’কোথায় যাচ্ছ, বাবা?’
ছোঁয়া আর শিহরণ দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাতে হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আকাশের দিকে।
________________
সাব্বির আহমেদ এখন নাতিকে নিয়ে অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেন। শিহরণকেই অফিসের সমস্ত কাজ একা সামলাতে হয়।
বর্ণ এসে দাদুর কোলে বসে বলল,’দাদু, জানো আজ রংধনু আসবে।’
‘জানি তো দাদুভাই।’
সাবিহা সাবরিন অবাক হয়ে বললেন, ‘বহ্নি আসবে অথচ আমাকে কেউ একটু জানাল না পর্যন্ত।’
সাবিহা সাবরিনের কথার উত্তর দিলেন না সাব্বির আহমেদ। বহ্নি মায়ের সাথে এখনও ঠিক করে কথা বলে না। তাদের সম্পর্কে একটা অদৃশ্য দেওয়াল উঠে গেছে। যেটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। হয়তো কোনো একদিন সেটার অস্তিত্ব থাকবে না। এই আশাতেই দিন পার করছেন সাবিহা সাবরিন। শিহরণও খুব বেশি কথা বলে না। বাসার সবাই যেন তার সাথে ফর্মালিটি মেইনটেইন করে। তবুও তিনি মানিয়ে নেন এই বিরূপ অবস্থার সাথে। এইটা ভেবে স্বস্তি পান যে তার মেয়ে ভালো আছে।
বহ্নি, রাদিদ আর রংধনু আসার খবর শুনেই তিনি কিচেনে চলে গেলেন মেয়ের প্রিয় খাবার বানানোর জন্য।
_____________________
কলিং বেলের শব্দ শুনে তানিয়া দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। আশরাফ হোসেন পত্রিকা হাতে নিয়ে বসেছিলেন। তানিয়া দরজা খুলে অতলের নামে আসা চিঠি নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ‘ম্যাজিশিয়ান ভাইয়া’ বলে ডাকতে শুরু করল।
তানিয়ার ডাকে অতল নিজের রুম থেকে বেরিয়ে
ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল। তানিয়া আহ্লাদিত কণ্ঠে বলল,’ভাইয়া, আজকে তো পাঁচটা চিঠি এসেছে রে।’
অতল মাথা নাড়ল। মেহেরুন নাহার রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। তানিয়ার ডাক শুনে নাস্তার ট্রে হাতে দ্রুত ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে তানিয়াকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি পড়ে শোনা তো।’
তানিয়া অতলের দিকে তাকিয়ে অনুমতি নেবার ভঙ্গিতে বলল,’ভাইয়া, পড়ব?’
তবে সে প্রশ্ন করলেও অতলের জবাবের অপেক্ষা না করে পাঁচটা চিঠির মধ্যে একটা চিঠি খাম খুলে পড়তে শুরু করল।
দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান,
এই সম্বোধনটাই যথার্থ বলে মনে হয়েছে আমার। আমি তাসনিম। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে আমার। মেয়ে বলে হয়তো দ্রুত বোঝাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন আমার বাবা-মা আর ভাইয়েরা।
বিয়ের পরে নতুন সংসারে এসেই আমি প্রতিটি পদে পদে বুঝতে পারলাম মেয়েদের জীবন কতোটা কঠিন! বিয়েতে যৌতুক দিতে গিয়েই বাবার আবস্থা নাজেহাল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতেও ক্ষুধা মেটেনি আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের। এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই। শাশুড়ির অকারণ অত্যাচারের কারণ প্রথমদিকে বুঝতেই পারতাম না। স্বামীর অন্যায়ভাবে গায়ে হাত তোলার অর্থ হিসেবে নিজের ত্রুটি খুঁজে ফিরতাম। তাদের প্রচ্ছন্নভাবে পুনরায় অর্থের দাবীর ব্যাপারটা আমি ধরতেই পারলাম না। কী বোকাটাই না ছিলাম আমি! এত অত্যাচার স্বত্ত্বেও যখন আমি মুখ বুজে পড়ে রইলাম তখন তাদের চাওয়া আর প্রচ্ছন্ন থাকল না। প্রকাশিত হয়ে গেল আরও জঘন্যতমভাবে। বাবা-মা আর ভাইদেরকে জানালেও তাদের কিছুই করার ছিল না, তাদের অবস্থাও নুন আনতে পানতা ফুরায় মতন। একটা সময় শ্বশুড়বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে চাইলাম নিজের বাবার বাড়ি। তখন জানতে পারলাম বিয়ের দিন ফেলে আসা বাড়িটা আর আমার নেই। সেখানে আমার আর জায়গা হবে না। এদিকে শ্বশুরবাড়িতে আমার উপর করা শারীরিক আর মানসিক অত্যাচার বাড়তেই থাকল। এতোটাই বাড়ল যে আমি নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। বারবার মরার চেয়ে একবার মরাটাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হলো!
ঠিক তখনই আপনার একটা স্পিচ শুনলাম। কী অদ্ভুত সম্মোহন করলেন আপনি! আমি মৃত্যুর পথ বেছে নেবার কথা ভুলে গেলাম। যদিও
আমি খুব করে চাইছিলাম আপনার কথাগুলোকে গুরুত্ব না দিতে তবুও মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। আপনার বলা প্রতিটা কথা আমাকে ভাবতে বাধ্য করল। আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম
আপনার প্রতিটা কথাই সত্য। যে কষ্টের হাত থেকে বাঁচতে আমি মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছি সেই কষ্ট থেকে তো পিছু ছাড়বে না। অবশেষে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলাম। আপনি যো সবসময় বলেন, বি ইউ, বি বোল্ড। এই কথাটা খুব কাজে দিয়েছে। আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছি। আপনার কারণেই আমি বুঝতে পেরেছি আমার নিজের ভরণপোষণের জন্য আমার না স্বামীর উপর নির্ভর করতে হবে, না আমার বাবা কিংবা ভাইয়ের উপর। ঠিক তখনই জীবনে প্রথমবারের মতো আমি স্বনির্ভর হবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলাম। হ্যান্ডিক্রাফটসের কাজ খুব ভালো পারতাম, অনেকটা খেলার ছলেই শিখেছিলাম। তাই সেটাকেই বেছে নিলাম নিজেকে স্বনির্ভর করার সম্বল হিসেবে। এখন আমি কারও উপর বোঝা নই।
জানেন, একটা অদ্ভুত বিষয় ঘটে গেছে, এই তো কদিন আগে। আমার স্বামী আবার আমার কাছে ফিরে আসতে চায়। সে না-কি তার ভুল বুঝতে পেরেছে! আমি আজ স্বনির্ভর হবার কারণে হয়তো সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে! যদিও আমি জানি আপনার উত্তর কি হবে তবুও প্রশ্ন করছি, আমি কি তাকে দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিব?
ইতি
তাসনিম
চিঠি পড়া শেষে তানিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘এই জানোয়ারকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। কি বলো ভাইয়া?’
অতল জবাবে কিছুই বলল না। মেহেরুন নাহার বললেন, ‘একটা সুযোগ দেওয়া উচিত তাকে।’
আশরাফ হোসেন এতক্ষণে নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘ওকে আর একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। কী বলিস বাবা?’
অতল স্মিত হাসল। ওর সবাই বুঝেছে ওর উত্তর কী হতে পারে। তবুও এ নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ আলোচনা চলবে। এ নিত্যদিনের নিয়ম। অতল হাসে ওদের কাণ্ড দেখে। অতল উঠে যাচ্ছিল তখন তানিয়া আবারও ডেকে বলল, ‘ভাইয়া আরও চারটা চিঠি আছে তো। শুনবে না?’
ব্যস্ত ভঙ্গিতে অতল বলল,’না, এখন সময় নেই। আমার রুমে রেখে দিস। রাতে পড়ব।’
তৃতীয়বার সুইসাইড এটেম্পট করার পরেই অতলের জীবনের সবচাইতে বড়ো টার্নিং পয়েন্ট আসে। নিজের জীবন শেষ করার সেটাই ছিল সর্বশেষ প্রয়াস। তারপর থেকে অতল কেবল জিতেছে, হারেনি। অতল এখন ভাবে, ভাগ্যিস বিধাতা তাকে সুযোগ দিয়েছিলেন তিন তিন বার! যেখানে মানুষ তাকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দেয়নি, সেখানে বিধাতা তাকে তিনবার পৃথিবীর বুকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ দিয়েছেন। সত্যিই তিনি মহান, মহামহিম, অন্তর্যামী। আর শেষবার তার জন্য আলোকবর্তিকা হাতে দাঁড়িয়েছিল তারই এঞ্জেল, বহ্নি। বহ্নির লেখা চিঠি অতলের ভাবনাকে অন্য স্রোতে ভাসিয়েছিল। তার রেখে যাওয়া অপরাজিতাগুলো থেকে সে শক্তি সঞ্চয় করেছিল।
অফিসে বসে অতল তার জীবনের অতীত অধ্যায়ের পাতাগুলোতে উঁকি দিল। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ পাবার পরে অতল যখন বহ্নির রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরল তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে ঘুরে দাঁড়াবে।
‘আমার কিছুই নেই, আমি নিঃস্ব, আমাকে কেউ ভালোবাসে না।’ এমন আস্ফালন কেবল দুর্বল, মেরুদণ্ডহীন মানুষেরাই করে থাকে। অতল মেরুদণ্ডহীন নয়।
সে প্রথমেই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয়। দীর্ঘ নয় মাস ধরে কাউন্সেলিং করে। অবশেষে তার মানসিক অবস্থা উন্নত হয়। আগে যেসব চিন্তা তাকে অন্ধকারের অতলে ডুবিয়ে রাখত, কাউন্সেলিং শেষে সেসব চিন্তার কারণে সে শক্তি পেত। তিনবছর পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোনোদিকেই মনোযোগ দেয়নি। কারণ সে বুঝেগিয়েছিল ফেইস ভ্যালু কী জিনিস!
মানুষের কর্ম মূল্যায়নের পূর্বে তার ফেইস ভ্যালু মূল্যায়ন করা হয়। এটাই বাস্তবতা। তাই সে নিজের পরিচয় তৈরী করার পেছনে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছে। যেদিন গেজেট হবে বলে সম্ভাব্য ডেট দিলো সেদিন সে তার পুরনো মোবাইল নাম্বারটা সচল করে রেখেছিল। কারণ সে জানত-সে জিতবেই। হলোও তাই। সেদিন পরিচিত-অর্ধপরিচিত-অপরিচিত সকলের কাছ থেকে ফোন পেয়েছিল অতল।
প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম হয়ে রেকর্ড করেছে সে। ব্যর্থতার ট্যাগ পাওয়া ছেলেটা ফার্স্ট হয়ে গেল! সেদিন থেকে শুরু হলো তার অন্য অন্যজীবন। জয়েন করার পূর্বে সে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করা শুরু করল, বিশেষ করে সমাজে পাগল উপাধিখ্যাত মানুষদের জন্য সে কাজ করা শুরু করেছে। যখনই কোনো পাগল মহিলাকে দেখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। ভাবে, এই বুঝি তার মা। শত চেষ্টাতেও সে তার চোখকে সিক্ত হওয়া থেকে এড়াতে পারে না। এ এক ভীষণরকমের জ্বালা । এটা থেকে বাঁচার জন্য সাথে একটা কালো গ্লাস রাখে সে। সে জানে, সবার কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতেই নেই।
আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পথটা মানুষ কেন বেছে নেয় অতলের কাছে তা আর অজানা নয়। তাই সে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে আত্মহত্যা বিষয়ক স্পিচ দিয়েছিল। যাতে কেউ কখনও সেই পথে পা না বাড়ায়। তার স্পিচটা এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে শেষপর্যন্ত মোটিভেশনাল স্পিকারের খাতায় তার নাম উঠে গেল। অতল সবচাইতে বেশি শান্তি পায় তখন–যখন কেউ তার স্পিচ শুনে আত্মহত্যা থেকে ফিরে এসেছে জানিয়ে তাকে চিঠি লিখে। অনেকে তাদের সমস্যার কথা জানিয়েও অতলকে চিঠি লিখে। অতল সেসব সমস্যার সমাধান করে দেয়।
রাত যখন গভীর হয় তখন অতল সবার চিঠিগুলো পড়ে। প্রতিটা চিঠি পড়ার পরে একটা মিশ্র অনুভূতিতে তার মন ভরে যায়। যখন মানুষের সমস্যাগুলো পড়ে তখন নিজের অতীতে ফিরে যায় সে। সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তাদের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করে সে।
এতো ব্যস্ততা শেষেও একসময় একাকীত্ব ভর করে তার উপরে। আর তখনই তার অবাধ্য মন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার জীবনে দেখা নীল পরীর কথা। তবে মনটা প্রশান্তিতেছেয়ে যায় যখন দেখে একটা যোগ্য হাতেই সে তার এঞ্জেলকে সমর্পণ করেছে! এর থেকে বেশি কিছুই চাওয়ার নেই, পাওয়ারও নেই।
__________________________
নওশীন হক ভীষণ খুশি হয়েছেন রাদিদের জন্য। নীরা শুধু রাদিদ আর অতলের গল্প বলে বেড়ায় সবার কাছে। আফরিনের স্বভাবে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। সে এখন নীলাভ্রকে চাপ দেয় শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু নীলাভ্র সেসব কথা পাত্তা দেয় না। যেই অতলের পিছনে লেগেছিল সে সারাজীবন আজ তার আকাশচুম্বী সফলতা। এসব দেখে তার অস্বস্তি হয়, ঈর্ষা হয়। তার বাবাও নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। এতে তার আরও বেশি রাগ হয়। যাকে সে হারাতে চেয়েছিল। সে হেরে গিয়েও জিতে গেল । এটা তার সহ্য হয় না।
______________
চারিদিকে আলোকিত হয়ে আছে। চারপাশে কত শত মানুষ। বহ্নি আর রাদিদ যখন গেইট দিয়ে ঢুকছিল তখন অনেকেই অটোগ্রাফের জন্য ভিড় জমাল। ভেতরে ঢুকেই আশফাক, নীলা, পিউ আর টিয়াকে দেখতে পেল তারা। তাদের পাশের দুটো সিটে পাশাপাশি বসল রাদিদ আর বহ্নি। পিউ তার বড়ো মামাকে দেখে বাবার পাশ থেকে উঠে গিয়ে মামার পাশে বসল। নীলা হেসে বলে উঠল, ‘এমন মামা পাগল মেয়েটা।’
পিউকে দেখে টিয়াও উঠে গিয়ে রাদিদের পাশে বসল। আশফাক তখন হাসতে হাসতে বলল, ‘আর টিয়া হলো বোন পাগল।’
রংধনু বাবার কোলে বসে ইচ্ছেমতো প্রশ্ন করেই চলেছে। বহ্নি অবাক হয়ে রাদিদের ধৈর্য দেখছে। মেয়েটা এত বেশি প্রশ্ন করে যে অন্য যে কেউ হলে বিরক্ত হয়ে যেত। অথচ রাদিদ মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
শিহরণ বহ্নিকে বলল, ‘কেমন আছে আমার বার্বি ডলটা?’
বহ্নি হেসে বলল, ‘ভালো আছি, ভাইয়া। বর্ণ কোথায়?’
বর্ণ লাফিয়ে উঠে বলল, ‘এই তো আমি আগুন ফুপ্পি!’
বর্ণের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। শিহরণ ছোঁয়া, বহ্নি আর রাদিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি জানতাম, এই অ্যাওয়ার্ডটা রাদিদই পাবে।’
শিহরণের কথায় ওরা মাথা নাড়ল। বহ্নি রংধনুকে নিয়ে উঠে তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চলে গেল।
ছোঁয়ার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্য এক অসাধারণ মানুষকে। বর্ণ মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘মা, তুমি কাকে খুঁজছ?’
অতল হেসে ফেলল। বলল, ‘তোর ওই এক কথা। আমাকে আর কত শুনতে হবে কে জানে!’
বর্ণ আদুরে গলায় বলল, ‘চাচ্চু, তুমি এখন বাসায় আসো না কেন?’
অতল বর্ণকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল, ‘এখন থেকে আসব চাচ্চু।’
অ্যাওয়ার্ড রিসিভ করার জন্য রাদিদের নাম অ্যানাউন্স করা হলে সে মঞ্চে গিয়ে অ্যাওয়ার্ডটা রিসিভ করে বলল,’আই ওয়ান্ট টু ডেডিকেট দিস অ্যাওয়ার্ড টু মাই বেটার হাফ, রিতিকা আহমেদ বহ্নি। এই মানুষটিকে স্মরণ করেই আমি আমার সমস্ত লেখা লিখেছি, তাই এই মানুষটিই আমার অণুপ্রেরণা ছিল, এখনও এই অসাধারণ মানুষটিই আমার সমস্ত লেখার পেছনের অনুপ্রেরণা। আ’ম গ্রেটফুল টু হার, আ’ম গ্রেটফুল টু মাই ফ্যানস ফর দ্যা লাভ দে হ্যাভ গিভেন মি। থ্যাংক্স আ লট ট ইউ অল।’
বহ্নি রংধনুকে এক হাতে ধরে স্টেজে গেল। রাদিদ অ্যাওয়ার্ডটা বহ্নির হাতে তুলে দিল। রংধনু তালি দিচ্ছিল। বর্ণও ছোঁয়ার কোল থেকে নেমে গিয়ে দৌড়ে স্টেজে উঠে পড়ল। বহ্নির দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। সাথে সাথেই অশ্রুসিক্ত হলো শিহরণ, ছোঁয়াসহ আরও অনেকের চোখ। অতল তখন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল। তার চোখ থেকে কালো গ্লাসটা খুলে সকলের অগোচরে একটা টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছে নিল।
অনুষ্ঠানে প্রায় শেষের দিকে অনেকেই যখন চলে যাচ্ছিল ঠিক তখন অতলের দিকে নজর পড়ল বহ্নির। অতলকে দেখে বহ্নির এক অদ্ভুত অবর্ণনীয় অনুভূতি হলো। সে চট করে একটা কাগজে কিছু একটা লিখে আয়মান ডেকে চিরকুটটা অতলকে দিতে বলল।
ছোঁয়া, শিহরণ, মায়া আর ফায়াজ এক কোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। অতল সেখানে যোগ দিয়ে
কৌতুকের স্বরে বলল, ‘আমার দোয়া তাহলে কাজে লেগেই গেল। কী বলো?’
মায়া বুঝতে পারল না অতল কী বলতে চাইছে। সে বলল, ‘মানে?’
‘ছোটোবেলায় একবার দোয়া করেছিলাম।তুমি যেন খুব ভালো বর পাও। আমার দোয়া তো ফলে গেল।’ কথাটা শেষ করেই অতল হাসতে লাগল। ছোঁয়া আর শিহরণও ওর হাসির সাথে যোগ দিল।
ফায়াজ তখন মজা করে বলল, ‘ভাগ্যিস দোয়া করেছিলে ভাই। তাই তো এমন রত্ন খুঁজে পেলাম অবশেষে।’
প্রিয় যেন আকাশ ফুঁড়ে এসে পড়ল। বলল, ‘এই তুই মনে হয় আমাকে বদদোয়া দিছস!’ সাইফের দিকে ইশারা করে বলল, ‘নাহলে এমন হাবাগোবা কেউ আমার কপালে আসলো ক্যামন করে।’
প্রিয়র কথা শুনে ছোঁয়া, শিহরণ, অতলসহ বাকি সবাই আবারও হাসতে থাকল। মোহনা আর ফাহমি বিদেশে থাকায় তারা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারল না। শিহরণ তবুও ফোন করে বলেছিল চেষ্টা করে দেখার জন্য। কিন্তু দুজনের আসা একসাথে ম্যানেজ করা হয়ে উঠেনি। সবাই যখন গল্পে মশগুল এমন সময় আয়মান এসে অতলকে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। চিরকুটটা হাতে নিয়ে অতল বন্ধুদের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে চিরকুটটা পড়তে শুরু করল।
‘এখনও কি গোধূলী দেখো তুমি? শেষ বিকেলের রংধনুতে এখন ঠিক কয়টা রং দেখতে পাও?
তোমার দেখা রংধনু কি এখনও রঙিন না-কি বিবর্ণ?’
বি.দ্র. এঞ্জেল এমনি এমনিই বলতে, মন থেকে কখনও বিশ্বাস করোনি। না হলে এঞ্জেলকে এতোটা দুর্বল ভাবতে না। জানো না, এঞ্জেলরা সবকিছু জাদু দিয়ে ঠিক করে ফেলতে পারে। তোমার এঞ্জেল এখন সবসময় হাসতে শিখে গেছে, সমস্ত কষ্ট বুকে চেপে রেখেও সে হাসে। এবার বিয়েটা করেই ফেলো।
চিরকুটটা পড়া শেষ করে এক কোণায় গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকল অতল। তারপর পকেট থেকে একটা প্যাড বের করে লিখতে শুরু করল। ঠিক সে সময় রংধনু এসে ওর সামনে মাথা ঝুঁকে দাঁড়াল। অতল চিরকুটটা লেখা শেষ করে রংধনুকে আদর করে বলল, ‘কিছু বলবে মামুণি?’
রংধনু হাসল শুধু। অতল ওকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করল। সে জানে বাচ্চা মেয়েটা রাদিদ আর বহ্নির অংশ। কেমন মায়াভরা চাহনি মেয়েটার। ঠিক যেন বহ্নির স্মল ভার্সন! অতল পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরি চকলেট বের করে রংধনুকে দিল।
তারপর তার লেখা চিরকুটটা আয়মানকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল বহ্নির কাছে। বহ্নি এক মুহূর্তও দেরি না করে পড়তে শুরু করল।
‘আমার এঞ্জেলকে ছাড়া কি গোধূলীকে ভালো লাগতে পারে? জানিস, আমার আকাশে এখন আর রংধনু উঠে না। মাঝে মধ্যে একটা দুইটা রংধনু উঠলেও তা হয় বিবর্ণ। বিবর্ণ রংধনু দেখতে কার ভালো লাগে বল তো?’
বি.দ্র. আমার জীবন্ত নীল পরীটাকে এখনও ভীষণ ভালোবাসি। হারিয়ে ফেলেছি তাকে। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা কখনোই ভাবিনি, ভাবতেও পারি না। বুকের বাঁ পাশটাতে চিন চিন করে ব্যথা করে। আমি আবার সাধারণ কোনো মানুষকে বিয়ে করতে পারব না। আমার এঞ্জেলই চাই। এঞ্জেল পেলে ঠিক বিয়ে করে নেব, দেখে নিস।
অতলের লেখা চিরকুটটা পড়া শেষ হতেই বহ্নি দেখতে পেল অতল চলে যাচ্ছে। তার পাশেই আয়মান। সবাই অতলকে ছেড়ে চলে গেলেও আয়মান ছেড়ে যায়নি। সবসময় তার পাশে থেকেছে। অতল ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়তে বলল। গাড়ি চলেছে অজানা কোনো গন্তব্যে।
হঠাৎ করেই অতল গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থেকে নেমেই অতল দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে থাকে আকাশের বুকে ওঠা রংধনুটা। আয়মান তার পাশে দাঁড়াতেই সে প্রশ্ন করল, ‘আয়মান, দেখতো রংধনুটাতে আজকে কয়টা রঙ আছে? আমার কাছে বিবর্ণ লাগছে কেন? আমি কি কালার ব্লাইন্ড হয়ে যাচ্ছি?’
__________________________
ছোঁয়া, শিহরণ, রাদিদ, বহ্নি, আশফাক, নীলা সাব্বির আহমেদ আর সাবিহা সাবরিন সবাই ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে একটা প্রশাসনিক কাজের অনুষ্ঠান দেখছে।
অনুষ্ঠানে এক অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছে অতল।
সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সেটা দেখে সাবিহা সাবরিন হিসাব মেলাতে পারেন না। পিউ তার মোবাইলে ভিডিয়ো দেখছে। টিয়া রংধনু আর বর্ণ মিলে ওকে ডিস্টার্ব করতে লাগল। তাদের আবদার হলো তাকে তাদের সাথে খেলতে হবে। কিন্তু পিউ কোনোমতেই খেলবে না। সে এখন স্পিচের ভিডিয়ো দেখবে। ওদের বিরক্তিতে থাকতে না পেরে সে সাবিহা সাবরিনের পাশে এসে বসল।
পিউ অতলের একটা স্পিচের ভিডিয়ো দেখছিল। সাবিহা সাবরিন আনমনেই পিউর মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে ভিডিয়োটা দেখতে লাগলেন।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে অতল বলে চলেছে,
‘জীবনে একবার ব্যর্থ হওয়া মানেই বারবার ব্যর্থ হওয়া নয়। বারবার ব্যর্থ হওয়া মানে কখনোই জিতবেই না এমনও নয়। ব্যর্থতা সবসময় আমাদেরকে দুর্বল করতে আসে না, মাঝেমধ্যে ব্যর্থতা আমাদেরকে শক্ত, মজবুত করতেও আসে। এক একটা ব্যর্থতা এক একটা অভিজ্ঞতা।’
কথাগুলো বলার পরপরই চারিদিকে হাততালি পড়তে শুরু করল। অতল বলতে শুরু করল,
‘এই কথাগুলো আমি আমার জীবন দিয়ে শিখেছি। উত্তরাধিকার সূত্র সবসময় বর্তায় না। মাঝেমধ্যে পূর্বপুরুষ ভালো হওয়া সত্ত্বেও উত্তরসূরি অধঃপতনে যায়। আমাকে বিচার করার ক্ষেত্রে আমাকেই বিচার করতে হবে।’
‘Everyone deserves a second chance. No matter who is he or what is he! Get them prove at least. Don’t cumber your thoughts upon them. It destroys their’s potentiality. So keep you and your thoughts safely , so that it can’t harm anyone.’
সাবিহা সাবরিনের মনে হলো অতল শেষ কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। তিনি চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না এই ছেলেটার দিকে। এত আত্মবিশ্বাস, এত আভিজাত্য, এতোটা সাফল্য অর্জন করাটা কীভাবে সম্ভব হলো এই ছেলেটার পক্ষে! এটা তার জন্য বিস্ময়! হতাশা, হীনমন্যতা, নিজের বাবা-মায়ের কালো অতীত কীভাবে ভুলতে পারল ছেলেটা! কীভাবে সমস্ত বাধা পেরিয়ে এতোটা জনপ্রিয় হলো সে। এই ছেলেটাকে দেখে কে বলবে-একটা সময় সে বারংবার সুইসাইড করতে চেয়েছে!
অতলের এতোটা পরিবর্তন দেখে আজ সাবিহা সাবরিন অনুতপ্ত। তিনি এইটাও জানেন রাদিদের লেখা উপন্যাস প্রকাশিত হবার পেছনেও এই ছেলেটার হাত আছে। একা হাতে সবকিছু সামলানোর এক অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে এই ছেলেটা। যে ছেলেটা একসময় হতাশায় ডুবে মরেছে সেই আজ হতাশাগ্রস্ত মানুষকে আলোর পথে আহ্বান করছে! অথচ কী অদ্ভুত, মানুষ তার আহ্বানে সাড়াও দিচ্ছে! এতোসব উপাধি, এতোসব অর্জন!
অতলের বলা শেষ কথাটা সাবিহা সাবরিনের কানে বেজে চলেছে, ‘Everyone deserves a second chance. No matter who is he or what is he.’
সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না, পূর্ণতাহীনতা ভালোবাসার গভীরতা বা সৌন্দর্য কমাতে পারে না, পারে না বিশুদ্ধ ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কিংবা মিথ্যে প্রমাণ করতে। কিছু কিছু ভালোবাসা অপূর্ণ হয়েও পূর্ণতার সাক্ষর রেখে যায়। অতলের দেখা বিবর্ণ রংধনুর রঙ হয়তো রঙিন হবে কোনো এক সময়।
শিহরণ প্রতিনিয়ত এক অবর্ণনীয় যুদ্ধ করে যাচ্ছে ছোঁয়াকে পুনরায় নিজের পায়ে হাঁটতে দেখার জন্য। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছোঁয়াকে নিয়ে পার্কে চলে যায় তারপর অফিসে। এটা তার নিত্যকার রুটিন। ও অফিসে থাকলে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট ছোঁয়ার দেখভাল করে। সাবিহা সাবরিনের সাথে ছোঁয়ার সম্পর্ক এখনও স্বাভাবিক হয়নি। তবে ধীরে ধীরে তার রাগটা হয়তো প্রশমিত হচ্ছে। আজকেও ছোঁয়াকে নিয়ে পার্কে এসেছে শিহরণ। ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী শিহরণ প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ছোঁয়া হাল ছেড়ে দেয়। হতাশ গলায় বলে, ‘আমার দ্বারা হাঁটতে পারা সম্ভব নয় শিহরণ।’
শিহরণ তখন রেগে যায়। পরক্ষণেই শান্ত হয়ে ছোঁয়ার পাশে বসে তার হাত দুটো নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে বলে,’আমার বিশ্বাস তুমি হাঁটতে পারবে। আমার এই বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণ করার জন্য কি তুমি আমার সঙ্গ দেবে না?’
ছোঁয়া তখন অবাক বিস্ময়ে শিহরণের দিকে তাকায়। তার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। সে নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে শিহরণকে জড়িয়ে ধরে চোখের নোনা জলে শিহরণের বুক ভিজিয়ে দেয়। আবেগে ধরে আসা গলায় কোনোমতে বলে, ‘আমি যে এতোটা লাকি তা আজকের এই অক্ষমতা না থাকলে হয়তো কখনোই বুঝতে পারতাম না।’
শিহরণ তখন দুষ্টুমির স্বরে বলে, ‘উহুঁ, এতোটা লাকি তুমি নও, প্রিয়তা। এখন আমি তোমার সেবা করছি কারণ ইন ফিউচার তোমার সেবার আমার খুব প্রয়োজন হবে। ননস্টপ টুয়েন্টি ফোর আওয়ার, মাইন্ড ইট!’
ছোঁয়া তখন সোজা হয়ে বসে লজ্জাবনত কণ্ঠে বলে, ‘আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার!’ পরক্ষণেই পরাস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে, ‘ঠিক আছে, জাহাপনা, আপনার ইচ্ছে শিরোধার্য! আপনার সেবাতেই এই জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’
শিহরণ হাসে। তারপর আবার শুরু হয়ে যায় ছোঁয়াকে ধরে ধরে হাঁটানোর চেষ্টা। ছোঁয়ার কষ্ট হয় তবুও শিহরণের মুখের দিকে তাকিয়ে সে জোর চেষ্টা চালায়। শিহরণের বিশ্বাসকে সম্মান করে সে নিজের সর্বোচ্চটুকু দেয়।
পার্কের প্রতিটা মানুষ শিহরণের নিত্যকার এই চেষ্টাতে মুগ্ধ হয়, কখনও আফসোস করে এই ভেবে–অযথা কষ্ট করছে ছেলেটা, মেয়েটা কখনোই হাঁটতে পারবে না। কেউ কেউ বলে এতো বড়ো পরিবারের ছেলের কি দরকার ছিল একটা পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করার! কেউ কেউ বলে ছেলেটা হাঁটতে না পারা মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর মনে মনে প্রার্থনা করে যেন তাদের ভালোবাসার জয় হয়।
_____________________
মায়ের করুণ অবস্থার কথা জানার পর থেকে অতল অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় আচরণ শুরু করেছে। সারাটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিল। তার অশ্রুসিক্ত দু’চোখের পাতা কোনোভাবেই এক হতে চাইছে না।
একটা সময় শেষে সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। একদিকে মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বাবার চরিত্র সম্পর্কে জেনে তার মধ্যে একটা ভয় জেগে উঠেছে। সে কী তার বাবার মতো হয়ে যাবে? দুশ্চরিত্র! লম্পট! মাদকাসক্ত! যদি হয়ে যায় তবে তার এঞ্জেলের কী হবে? তার এঞ্জেলও কি তার মায়ের মতো পাগল হয়ে যাবে? না, এটা সে কিছুতেই হতে দিবে না! কখনও না। তবে কি সে সরে যাবে তার এঞ্জেলের জীবন থেকে?
আজানের সুর ভেসে আসছে। ভোর হতে শুরু করছে। অতল তার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল। এটাই ঠিক হবে সবার জন্য। সকাল সকাল ফ্রেশ হয়ে কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই অভুক্ত অবস্থাতেই অতল বেরিয়ে গেল।
রাস্তায় বেরিয়ে অতল বিক্ষিপ্তভাবে পা ফেলছে। তার নিজেকে দিশেহারা লাগছে। তার বোকা মা টা এতোটা কষ্ট করেছে কেবল তাকে পৃথিবীর মুখ দেখাবে বলে! অতলের ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, ‘মা, মা, আমার বোকা মা, আমার সহজ-সরল মা! কেন তুমি আমাকে একা ছেড়ে গেলে, মা? কেন তুমি চলে গেলে আমাকে একা ছেড়ে? কেন, মা? তুমিই আসলেই বোকা, তবুও তো তুমি আমার মা! আমার তো তোমাকেই দরকার ছিল, মা। আমরা দুজন মিলে কি ওই নরপিশাচটার সাথে লড়তে পারতাম না?’
হঠাৎ করেই অতলের মনে হলো সে বহুদূরে চলে যাবে। সবার কাছ থেকে সে দূরে চলে যাবে। অনেক দূরে! কিন্তু কোথায়?
একসময় অতলের মনে হলো সে রাদিদের বাসায় চলে যাবে। ব্যস, টিকিট কেটে বাসে উঠে গেল।
________________
কুমিল্লা পৌঁছে অতল রাদিদকে ফোন দিল। রাদিদ ভীষণ অবাক হলো। দোকানে কাজের ছেলেরা না থাকায় সে দোখান বন্ধ করে রাদিদকে রিসিভ করতে গেল। স্টেশনে এসে অতলকে এরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ভীষণ অবাক হলো রাদিদ। তবে কারণটুকু জিজ্ঞেস করার সাহসও পেল না। অতলের এমন বিধ্বস্ত হবার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো শক্তপোক্ত কারণ আছে-তা আন্দাজ করতে পারাটা রাদিদের জন্য খুব কঠিন কিছু নয়।
ফাইজা বেগম অতলকে দেখেই আন্দাজ করতে পারলেন তার মনের উপর দিয়ে একটা বড়ো-সড়ো ঝড় বয়ে গেছে। ভীষণ মায়া হচ্ছে তার ছেলেটার উপর। একটা সময় রাদিদও এই ছেলেটার মতোই বিধ্বস্ত ছিল। দিন-রাত খেটে তাদের ভরণপোষণ করেছে, ভাইবোনদের লেখাপড়া করার অর্থের যোগান দিয়েছে। স্বামীর মৃত্যর পর থেকে তিনি প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন কেবল রাদিদ আর নীলা ছিল। রাদিদ দোকান শেষে রাত জেগে তার সেবা করেছে। আজ এতোটা বছর পরে তিনি যেন অতলের মাঝে রাদিদের ছায়া দেখলেন। তার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠতে চাইছে। তিনি বহুকষ্টে তা সংবরণ করে আদুরে গলায় অতলকে কাছে ডাকলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কেমন আছ বাবা? ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি খাবার দিচ্ছি।’
তারপর রাদিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বড়ো খোকা, তোর কাপড় তো আমার এই খোকার গায়ে খুব সহজেই ফিট হয়ে যাবে। ওকে তোর থেকে কিছু কাপড় বের করে দে পরার জন্য।’
ফাইজা বেগমের এমন কথাতে অতলের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। সে অনেককিছু বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারল না।
বাথরুমে ঢুকে অতল পানির কল ছেড়ে দিয়ে এতক্ষণ অবধি চেপে রাখা কষ্টটা বের করে দিল। তার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। মাকে খুব মনে পড়ছে! মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে! ইশ, কেন মায়ের একটা ছবি চাইল না সে! এখান থেকে শীঘ্রই চলে যাবে। তারপর মায়ের একটা ছবি নেবে সে। ছবিটা সর্বক্ষণ নিজের সাথে রাখবে। কখনও নিজের কাছ থেকে আলাদা করবে না, কখনোই না।
অতলের দেরি দেখে রাদিদ দরজায় করাঘাত করে বলল, ‘অতল, তোর হয়েছে? মা তোর জন্য খাবার রেডি করে বসে আছে।’
অতল কণ্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলল, ‘এইতো এক্ষুনি আসছি।’
খেতে বসে অতল শুধু খাবার নাড়াচাড়া করছে। খাচ্ছে না। অথচ পেটে ভীষণ খিদে! গতকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি তার। পিউ ইশারায় তার নানুকে দেখাল। নীলাও দেখল তার সামনে বসা ছেলেটার চোখ দুটো কেমন যেন রক্তশূন্য-চোখে থাকা চশমাটাও সেই রক্তশূন্য চোখ দু’টো আড়াল করতে পারল না, চেহারাটা বড্ড ফ্যাকাশে হয়ে আছে, চুলগুলো উস্কখুস্ক। নীলা বলল, ‘কী হলো ভাই, তুমি খাচ্ছ না কেন?’
ফাইজা বেগম বললেন,’তুই হচ্ছিস আমার বড়ো খোকার বন্ধু। তার মানে তুইও আমার আরেকটা খোকা। মায়ের হাতে খেতে কি কোনো আপত্তি আছে আমার খোকাটার?’
ফাইজা বেগম প্রশ্ন করলেন বটে তবে কোনো উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। অতলের খাবারের প্লেটটা নিজের কাছে নিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন আতলকে। অতল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল রাদিদের মায়ের দিকে। কে জানে, হয়তো রাদিদের মায়ের মাঝে তার নিজের মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!
খাবার শেষ হতেই ফাইজা বেগম আদেশ দেবার ভঙ্গিতে অতলকে বললেন, ‘এবার সোজা ভাত ঘুম দিবি। রাতে যে ঘুমাসনি সেটা আমাকে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি তোকে দেখেই বুঝতে পেরেছি।’
অতলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পিউর দিকে তাকিয়ে বললেন,’পিউমণি, নতুন মামাকে বিরক্ত করবে না কেমন?’
পিউ নানুর কথায় উপর-নিচে মাথা দুলাল। তারপর মায়ের সাথে ঘুমাতে গেল।
রাদিদ দোকানে যাবার আগে অতলকে বলল, ‘তুই আমার রুমে শুয়ে বিশ্রাম নে। কিছু লাগলে মা অথবা আপাকে বলিস।’
মাকে উদ্দেশ্য করে রাদিদ বলল, ‘আমি আসছি, মা।’
ফাইজা বেগম রাদিদের কপালে চুমো খেয়ে বললেন, ‘আমার লক্ষ্মী বাবা, দেখে শুনে যাস। রাতে বেশি দেরি করিস না।’
ফাইজা বেগম অতল ঘুমিয়েছে কি না তা দেখার জন্য রাদিদের ঘরে উঁকি দিতেই দেখতে পেলেন অতল বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ছেলেটাকে দেখে তার কেবলই রাদিদের কথা মনে হচ্ছে! রাদিদের কষ্টের দিনগুলোতে সে কেবলই দিয়ে গেছে বিনিময়ে কিছুই পায়নি। তিনি এসে বিছানায় বসে অতলকে বললেন, ‘কী রে এখনও ঘুমাসনি কেন? আচ্ছা, আমিই ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। তুই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়।’
অতল দ্বিরুক্তি না করেই শুয়ে পড়ল। ফাইজা বেগমের অতলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর মনে মনে ভাবছেন আহা রে আমার বড়ো খোকা! বাবাকে হারিয়ে যখন সবাই বিধ্বস্ত তখন সেই সকলের ঢাল হয়ে দাঁড়াল। অথচ রাদিদের ঢাল হিসেবে কেউ ছিল না। যে বিনাশর্তে, বিনা পারিশ্রমিকে সবার খেয়াল রাখে, তার খেয়াল রাখার জন্য ও কারো প্রয়োজন হয়। এটা আমরা প্রায় ভুলে যাই।
পিউর কোনোভাবেই ঘুম আসছিল না। পাশ ফিরে মায়ের দিকে একবার তাকাল। নীলা ঘুমিয়ে পড়েছে।
তাই সে বিড়ালের মতো করে পা টিপে টিপে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। সে সচরাচর নতুন কোনো মানুষকে দেখলে প্রথমে দূর থেকেই পর্যবেক্ষণ করে। তারপর একটু একটু করে কাছে যায়। অতল যখন রাদিদের বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে বিশ্রাম করছিল। ঠিক তখন পিউ পা টিপে টিপে ঢুকল তার বড়ো মামার রুমে। ঢুকেই অতলের মুখের দিকে ঝুকে তাকিয়ে থাকল। অতল ঝট করে চোখ খুলে ফেলল। পিউ দৌড়ে পালাতে চাইলেও পারল না। অতল ধরে ফেলল । বলল, ‘কী করা হচ্ছিল, লিটল চ্যাম্প?’
পিউ মিনমিনে স্বরে বলল, ‘এই নামে তো বড়ো মামা ডাকে। তুমি কি করে জানলে?’
‘আমি তো আরও অনেক কিছুই জানি।’
পিউ তখন বলল, ‘তাহলে তুমি কি এটাও জানো যে, বড়ো মামা তার লেখার খাতায় একটা পরীকে লুকিয়ে রাখে কেন? পরীটা ছবির মধ্যেই থাকে কেন? সত্যি সত্যি আসে না কেন?’ প্রশ্ন শেষেই পিউ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, ‘জানো, পরীটা ভীষণ সুন্দর।’
অতল বুঝতে পারল না পিউর কথা। সে বলল, ‘কোন পরীর কথা বলছ, পিউমণি?’
‘দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’ বলেই পিউ ড্রয়ার খুলে একটা খাতা বের করে সেটা অতলের দিকে এগিয়ে দিল। পিউ খুব সন্তর্পণে খাতার ভেতর থেকে ছবিটা বের করল। ছবিটা দেখার পরেই অতলের দুনিয়া উল্টেপাল্টে গেল। তারপর সে পিউকে এটা সেটা বুঝিয়ে আবারও ঘুমোতে পাঠিয়ে দিল।
অতল খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখল। এক বসাতেই রাদিদের লেখাগুলোর কয়েক পাতা পড়ে দেখল। কয়েক পাতা পড়ার পরে অতলের কাছে অনেককিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। রাদিদ কেন অন্য কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না তা এখন তার কাছে স্পষ্ট। পড়া শেষ করতেই তার রাদিদের উপর ভীষণ রাগ হলো। পৃথিবীতে কি এই একজনই ছিল!
রাদিদের খাতার ভেতরে লুকানো ছবিটা আবারও চোখের সামনে ধরে রাখল। তার বুকটা উঠানামা করছে অস্বাভাবিক গতিতে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বড্ড অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। তার চিন্তাশক্তি যেন ক্রমশ লোপ পাচ্ছে!
একটু স্বাভাবিক হতেই সে রাদিদের খাতাটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে তখনই রওনা দিল। কাউকে কিচ্ছু না জানিয়েই!
সাবিহা সাবরিন অতলের ব্যাপারে সবকিছুই জানালেন সাব্বির আহমেদকে। সবটা জানার পর তিনি নিজেও ভরসা পাচ্ছেন না। পিতা-মাতাকে আবেগী হলে চলে না। তাদের দেখে-শুনে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেকোনো আবেগ বা সন্তানের চাওয়া পূরণ করার পূর্বে সন্তানের মঙ্গলের কথাই ভাবতে হয় তাদের। এতে সন্তান সাময়িকভাবে তাদের উপর রাগ করলেও তাদের সন্তানের জন্য যেটা ভালো সেটাই গ্রহণ করতে হয়।
কিন্তু বিয়ের ইনভাইটেশন করা হয়ে গেছে। সবকিছুই মোটামুটি কনফার্ম। এই মুহুর্তে বিয়ে ক্যানসেল করতে হবে! সমাজের মানুষ কানাঘুষো করবে, তাদের অনেক বদনামও হবে। এমনিতেই কম কানাঘুষো হয়নি ছেলের বিয়ে নিয়ে। লোক এখনও কথা শোনাতে পিছপা হয় না।
বহ্নিকে সবকিছু বলার পরেও সে অতলের কাছ থেকে দূরে সরতে চাইল না। তার কথা হলো, অতল ওর বাবার মতো হবে না। কখনোই হবে না। সেই বিশ্বাস তার আছে।
সাব্বির আহমেদ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘মামুণি, তুমি আবেগ দিয়ে ভাবছ। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া জীবনের সবকিছু না হলেও অনেককিছু, তবুও জীবনের নিরাপত্তাটাই সবার আগে। সবকিছুর আগে নিজের ভালো থাকা। ভালোবাসা ধুলোমলিন হয়ে গেলে সেখানে বেঁচে থাকা দুঃসহ।’
বহ্নি তবুও তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ল না। অবশেষে বাবা-মা দুজনকেই বহ্নির কাছে হার মানতে হলো। তবে সাবিহা সাবরিন মানতে পারলেন না। মেয়ের হঠকারিতায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। মনে মনে চিন্তা করতে থাকলেন কী করা যায়! অপরদিকে সাব্বির আহমেদ খুব অসহায় বোধ করতে লাগলেন। এরকম তো হবার কথা ছিল না। কেন হচ্ছে এমন! জীবন ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে।
_________
ফাইজা বেগম যখন দেখলেন অতল চলে গেছে তখন তিনি, নীলা আর পিউ মিলে সবখানে খুঁজলেন অতলকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না। ছেলেটার জন্য তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। তিনি সাথে সাথেই রাদিদকে কল করে জানালেন। রাদিদ নিজেও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। রাদিদের সাথে কথা শেষ করে বড়ো আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘আহা! ছেলেটার মনে বড্ড কষ্ট।’ পরক্ষণেই প্রার্থনা করার মতো করে বললেন, ‘আল্লাহ তুমি ওর মনের সমস্ত কষ্ট দূর করে দাও।’
পিউ বলল, ‘নানু, মামা কি আমার সাথে রাগ করে চলে গেছেন?
ফাইজা বেগম পিউকে কোলে নিয়ে আদর করে বললেন, ‘না, নানুভাই।’
নীলা তার মাকে বলল, ‘মা, ছেলেটাকে খুব বিষণ্ন মনে হলো। কী এমন হয়েছে ওর যে হুট করে এখানে আসলো আবার হুট করেই চলে গেল!’
_________________________
সাবিহা সাবরিন যখন দেখলেন সবকিছু প্রতিকূলে যাচ্ছে। তখন তিনি অতলের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
সাবিহা সাবরিনকে দেখেই অতলের ভেতরটা কেমন জ্বলে উঠল। তার ভেতরের সমস্ত হতাশা, সমস্ত কষ্ট, সমস্ত রাগ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভার ন্যায় বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘বাহ্! আপনি আমার কাছে এলেন যে!’
সামনে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার ব্যঙ্গাত্মক স্বর বুঝতে সাবিহা সাবরিনের একটুও কষ্ট হলো না। তিনি তেজী গলায় বললেন,
‘আসতে হলো। বাধ্য না হলে কখনোই আসতাম না। আমার মেয়েটা তো তোমার মতো অকর্মণ্যের দোষ-ত্রুটি কিছুই দেখছে না। আমার স্বামীও মেয়ের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আছেন। তাই সবকিছু আমাকেই ভাবতে হচ্ছে।’
‘তবে কি এই অকর্মণ্যকে করিতকর্মা বানানোর তাগিদে আপনার আগমন?’ বলেই অতল তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল।
‘সে সাধ্য আমার নেই। আমি তা করতেও চাই না। আমার জন্য কেবল এবং কেবলই আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ গুরুত্বপূর্ণ ।’
‘এই অধম কি আপনার কোনো কাজে আসতে পারে? মানে আপনি ঠিক কোন কাজে নিয়োগ করতে চাইছেন আমায়?’
‘তোমার দ্বারা কি কোনো কাজ সত্যিই ঠিকমতো হয়, অতল? একটু ভেবে দেখো তো। আমি জানি তোমার রেজাল্ট আউট হবে কিছুদিনের মধ্যে এবং এটাও জানি যে, সেখানেও তুমি বরাবরের মতোই অকৃতকার্য হবে। আমার মেয়ের ভরণপোষণের জন্য তোমাকে তোমার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। তাছাড়া, তুমিও যে তোমার আসল বাবার মতো আমার মেয়েকে কষ্ট দিবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তুমি কি চাও তোমার মায়ের মতো করে আমার মেয়েটাও কষ্ট পাক? এটাই তোমার ভালোবাসা? যদি তুমি সত্যিই বহ্নিকে ভালোবেসে থাকো তবে ওর জীবন থেকে সরে যাও। তার জন্য তোমার যা দরকার হয় করো কিন্তু ওকে নিজের এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়িও না। আমি তোমার কাছে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ ভিক্ষা চাইছি। তুমি এই মাকে নিরাশ করো না, অতল।’
কথাগুলো বলেই সাবিহা সাবরিন চলে যেতে উদ্যত হলো। অতল বলল, ‘যদি আমার বিসিএস হয়ে যায় তাহলে?’
সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘তাহলে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি তুমি সেখানে অকৃতকার্য হবে।’
অতল দৃঢ়ভাবে বলল, ‘সেটা সময়ের হাতেই ছেড়ে দিন না। আমার ভাগ্যকে আপনি নিজের হাতে কেন নিতে চাইছেন?’
‘ঠিক আছে। সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলাম।’
সাবিহা সাবরিন চলে যেতেই অতল যেন স্বগোতোক্তি করল,’বিষয়টা খুব অদ্ভুত না আমার ভালোবাসা সত্য না-কি মিথ্যে তা একটা সরকারী চাকরির হওয়া বা না হওয়ার উপরে নির্ভর করছে! শুধু কি তাই, আমার চারিত্রিক সার্টিফিকেটও দেবে এই চাকরী! বাহ্, দারুণ! সত্যিই দারুণ!’
____________________
বেশ কয়েক সপ্তাহ পরের কথা, এতদিনে অতল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। সারাটাদিন হন্যে হয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু কোথাও শান্তি মেলেনি। শুধুই খুঁজে ফিরেছে একটু শান্তি, কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম হয়তো এই যে, যে যাহা চাহে সে তাহা পায় না, যে যাহা চায় না সে তাহা বড়ো বাধাহীনভাবে পেয়ে যায়।
একটা পার্কে বসে নীরবে নিভৃতে বসে ছিল সে। আজও বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। রাদিদের বাসা থেকে আসার পরদিন মেহেরুন নাহারের কাছে মায়ের একটা ছবি চেয়েছিল। মেহেরুন নাহার অনেক খোঁজাখুঁজির পরে একটা ছবি বের করে দিলেন। পুরনো দিনের ছবি, এইচ.এস.সির ফর্ম ফিলাপের আগে শান্তা তুলেছিল ছবিটা। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবুও তার মায়ের চোখ দুটো যেন তাকে তার উপর হওয়া অত্যাচারের কথা বলছে। এই কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ছবিটার দিকে তাকিয়েই সে দিন রাত পার করেছে। অতলের কানে কেবল আর্তনাদের সুর বাজছে। আজও অতল নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মায়ের ছবিটা দেখছে। ছবিটা ডান হাত দিয়ে চোখের সামনে ধরে রেখেছে। ছবিটাতে হাস্যোজ্জ্বল মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে অতল। অথচ এই হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা কী নিদারুণ কষ্টটাই না পেয়েছে!
রাত দশটার দিকে আয়মান ফোন করল। অতল কারো কলই রিসিভ করছে না। কারো সাথে কথা বলার মতো অবস্থা তার নেই। অতলকে ফোনে না পেয়ে আয়মান তাকে মেসেজ করল। মেসেজের টুংটাং আওয়াজ শুনে অতল মেসেজটা চ্যাক করে দেখল আজকে তার রেজাল্টের দিন। একে তো ভয়াবহ অবস্থা তার উপর রেজাল্ট! সাবিহা সাবরিনের দেওয়া শর্তের কথা তার মনে পড়ে গেল।
এই রেজাল্টের হওয়া না হওয়ার উপরে অনেককিছু নির্ভর করছে। অতল কম্পিত হাতে ওয়েবসাইটে ঢুকল। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে সে। লিস্টে তার নামটা থাকবে তো! কিন্তু সার্ভার লোড হতে দেরি হচ্ছে। নেটওয়ার্কের জ্যামের কারণেই এটা হচ্ছে। অতল অপেক্ষা করতে লাগল। জীবনের সবচাইতে কঠিন অপক্ষা। অবশেষে সার্ভার ফ্রি হতেই লিস্টটা দৃষ্টিগোচর হলো। অতল শেষ থেকে চ্যাক করা শুরু করল, একটা সময় লিস্টের প্রথম দিকটাও চ্যাক করা হয়ে গেল। না, কোথাও তার রোল নেই। সে এবারও ব্যর্থ। বহ্নির মা হয়তো ঠিক বলেছেন সে আসল জীবনেও একজন ব্যর্থ মানুষ।
সাথে করে নিয়ে আসা রাদিদের খাতাটা সামনে পড়ে আছে। একবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রাখছে তো একবার রাদিদের খাতার উপরে। এভাবে কাটল বেশ কিছুক্ষণ সময়। তার মস্তিষ্ক জুড়ে বহ্নির মায়ের বলা কথাগুলো ক্রমাগত ঘুরছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সে তার বাবার মতোই হবে। রক্ত তার রক্তের রং দেখাবেই। তিনি হাত জোর করে নিজের মেয়েকে তার কাছ থেকে ভিক্ষা চেয়েছেন।’
অতল তবুও রাজী হতে পারছিল না। যাকে সে ভালোবাসে তাকে কী করে হারাতে রাজী হবে! একটা সময় তার মনে হলো তারও তার মায়ের কাছে চলে যাওয়া উচিত। তার সত্যিই আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। কেন বাঁচবে সে? কার জন্য বাঁচবে?
বহ্নির মায়ের বলা কথাগুলো তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে । তার মধ্যে ভয় জেকে বসেছে- যদি সে তার বাবার মতো হয়ে যায়! তবে? তবে তো সে বহ্নিকেও আঘাত করতে পিছপা হবে না। না, সে কোনোভাবেই তার এঞ্জেলকে সে কোনোভাবেই হার্ট করতে পারে না। সে তার এঞ্জেলকে একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে টানতে পারে না। তাই সে অবশেষে কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। এতোদিন বহ্নির সাথে তার মানসিক দূরত্ব কেবল বেড়েছে বৈ কমেনি। অতল প্রহর গুনছিল অতি আকাঙ্ক্ষিত রেজাল্টের। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হলো না। তাই সে মুক্তি দিবে–তার ভালোবাসাকে!
________________
বহ্নিকে বিষণ্ন মুখে দেখেই অতল বলল, ‘আমাকে মাফ করে দিস আগুনমণি। আমার পক্ষে তোকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।’
বহ্নি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকল অতলের দিকে। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে চারিদিক। অতল পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। বহ্নি বলল, ‘এসব কী বলছ তুমি?’
‘আমি ঠিকই বলছি। আমি তোকে বিয়ে রতে পারব না।’
‘কেন পারবে না?’
‘আমি তোর যোগ্য নয়।’
‘কে বলেছে? আমি কখনও বলেছি? অতীতে কী ছিল তা আমার জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমার জন্য শুধু তুমিই গুরুত্বপূর্ণ।’
‘আমার জন্য তুই গুরুত্বপূর্ণ না । তাই আন্টি যা বলছে তাই কর। আমি তোকে বিয়ে করতে পারব না।’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর আমি এই বিয়েটা ভাঙব না। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’
‘আমি আর কতোবার বলব যে তোকে বিয়ে করতে পারব না।’ অতল রেগে গিয়ে বলল।
‘কেন? উপযুক্ত কারণ তো বলো আমাকে।’
‘কারণ খুব সহজ। আমি তোকে ভালোবাসি না। যাকে ভালোবাসি না তাকে নিশ্চয়ই আমি বিয়ে করব না।’
‘এতোদিন ওসব কী ছিল?’
‘সব অভিনয় ছিল।’
‘অভিনয়?’ বহ্নি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
‘হুম, অভিনয়। আমি শিহরণের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম। আমার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে। এখন বিয়ে বিয়ে খেলাটা চালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘না, সব মিথ্যে। তুমি মিথ্যে বলছ।’
‘একদম সত্যি। আমি তোকে নয় তৃণাকে ভালোবাসি। শুধুই তৃণাকে।’
ঠিক তখন তৃণা এসে দাঁড়াল তার পাশে। অতল তার হাত ধরে বলল, ‘এই হলো তৃণা। যাকে আমি ভালোবাসি। আমি তৃণাকেই বিয়ে করব।’
বহ্নি ছলছল চোখে কেবল তাকিয়ে ছিল অতল আর তৃণার দিকে। সে কিছুই ভাবতে পারছে না। কিছুই বলেনি অতলকে। একটা অবাধ্য, তেজী জেদ তার মনের মধ্যে জেকে বসেছে। এখন সে জানে তাকে কী করতে হবে। এই জেদ তাকে অবাধ্য, অভাবনীয় কিছু করতে উস্কানি দেয়। বহ্নি নিশ্চিত এবার সে কোনো একটা অভাবনীয় কাজ করে বসবে। যেটা এক লহমায় সবকিছু তছনছ করে দিবে।
________________
রাদিদ ঢাকায় আসার পরে অতলের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু অতল কারো সাথেই কোনো যোগাযোগ করছে না। তার কাছে সবকিছুই বিষাক্ত লাগছে। কারো সিমপ্যাথি তার কাছে হ্যামলকের ন্যায় বিষাক্ত ঠেকছে। রাদিদ শেষ পর্যন্ত আশফাকের সাথে বহ্নিদের বাসায় গেল। বহ্নির সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছে। কিন্তু কোনোভাবেই প্রসঙ্গ তুলতে পারছে না। অবশেষে এক বুক সাহস সঞ্চার করে প্রশ্ন করেই বসল, ‘আচ্ছা, অতলের কী হয়েছে বল তো?’
বহ্নি প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তার খবর আমার কাছে নেই। আমার খবর জানতে চাইলে বলতে পারি।’
রাদিদ একটু ভড়কে গেল বহ্নির কথার ধরন শুনে। ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘আচ্ছা, তুই কেমন আছিস?’
রাদিদ চমকাল। স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘এখনও সেরকম কাউকে পাইনি তাই।’
‘তোমার পছন্দ কি বিশেষ কেউ। মানে তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?’
রাদিদ ঘোরের বশে বলেই ফেলল, ‘হুম।’
‘কাকে?’
‘কী?’
‘তুমি কাকে পছন্দ করো?’
‘সেটা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। সেসব না জানাই ভালো।’
‘বলেই দেখো না।’
রাদিদ উঠে দাঁড়াল। বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তার ভালো থাকা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমার সাথে তার থাকা নয়।’
‘এতোটা ভালোবাসো!’
‘হুম, সে তো এমনই। তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।’
‘তুমি অনেক পাল্টে গেছ।’
‘সে তো কবেই।’
‘হুম।’ নীরবতা ভেঙে করে বহ্নি আবারও প্রশ্ন করল, ‘তুমি যাকে ভালোবাসো সে যদি তোমাকে বিয়ে করতে চায় তবে কি তুমি রাজী হবে?’
রাদিদ আশ্চর্যান্বিত হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বহ্নির দিকে তাকিয়ে থাকল। বহ্নি পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘কী হলো বলো?’
‘সে কখনোই রাজী হবে না।’
‘এতোটা নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছ?’
‘সে অন্য কাউকে ভালোবাসে।’
‘তবুও সে যদি তোমার কাছে আসতে চায়। তবে?’
‘সেটা কখনোই হবে না।’
‘যদি হয় তবে তুমি কী করবে?’
‘আমার না করা উচিত, তবে আমি হয়তো না করতে পারব না।’
একটা পাখি চিউ চিউ করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল তাদের চোখের সামনে থেকে। তারপর একটা গাছের ডালে বসে পড়ল। নাচতে নাচতে এক ডাল থেকে অপর ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে অবলীলায়। রাদিদের দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হয়ে রইল।
‘আমি অনেকে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি রাজী থাকলেই হলো।’
‘অতলের কী হবে?’
‘অতলকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তাকে নিয়ে কিছুই ভাবতে চাই না।’
‘এটা তুই ভুল করছিস, বহ্নি।’
‘জীবনে অনেক ভুল করে ফেলেছি। আরও একটা ভুল করে ফেললে খুব বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।’
‘যদি অতল তোর কাছে আবার ফিরে আসে তখন?’
‘সে ফিরবে না। আমিও তার কাছে ফিরে যাব না। এই বিষয়ে তুমি কোনো সন্দেহ পোষণ করো না।’
‘তুই কি কখনও আমাকে ভালোবাসতে পারবি?’
‘জানি না। তবে চেষ্টা করব। শুনেছি একসাথে থাকলে একটা অভ্যস্ততা তৈরী হয়ে যায়। সেখান থেকেই এক সময় ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। হয়তো আমাদের মধ্যে ও একসময় ভালোবাসা তৈরী হয়ে যাবে।’ একটু থেমে বহ্নি হাসতে হাসতে বলল, ‘ডেভিড হার্বার্ট লরেন্স কী বলেছিলেন জানো?
In every living thing there is the desire for love. মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত ভালোবাসা চায় যতক্ষণ পর্যন্ত তার দেহে প্রাণ থাকবে। আমরা কেউই এই নিয়মের ব্যতিক্রম নই। তাই না?’
রাদিদ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল। বহ্নির কথা সে ফেলতে পারে না। তবে সে অতলের সাথে একবার দেখা করবে। যাতে অতল বহ্নিকে ফিরিয়ে না দেয়। যাতে অতল ওর ভালোবাসাকে গ্রহণ করে। ও নিজেকে নিয়ে ভাবে না। ভালোবাসা মানে পেতেই হবে এমন নীতিতে সে বিশ্বাসী নয়। এতোটা বছর বহ্নির একটা ঝলকও সে দেখেনি তবুও ওর মনে বহ্নি দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আর এখনও যদি সে না থাকে তাতে তার ভালোবাসা কমবে না। হয়তো অন্য কাউকে নিয়ে জীবন শুরু করবে, কিন্তু বহ্নির প্রতি তার ভালোবাসা অক্ষত, অম্লান থেকে যাবে। কিছু কিছু ভালোবাসা চির অম্লান, ভাস্বর থেকে যায়। না-ই-বা পাক পূর্ণতা, না-ই-বা থাকুক স্বর্ণাক্ষরে লেখা তাতে কী-ই-বা এসে যায়! না-ই-বা জানুক এই পৃথিবীর কোনো মানুষ, লোক দেখানো সমস্ত কিছুই তো ভ্রম, মিথ্যে, ছলনা।
‘Everything is fair in love and war.’ রাদিদ এই নীতিতে বিশ্বাসী নয়। ভালোবাসার মানুষের সুখেই তার সুখ। ভালোবাসা মানে পাশে থাকা, কাছে থাকা নয়। অনেকে কাছে থেকেও পাশে থাকতে পারে না। আবার অনেকে দূরে থেকেও পাশে থাকতে পারে।
অতল আর বহ্নিকে একসাথে বাগানে দেখার পর থেকেই সাবিহা সাবরিন ভীষণ ব্যাকুল হয়ে আছেন। অস্থির লাগছে তার। বিষয়টা কোন দিকে যাচ্ছে তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। এটার একটা সুরাহা করা দরকার।
একদিকে ছেলের বিয়েটাও নিজের পছন্দমতো দিতে পারলেন না। অপরদিকে মেয়েটা যে কী শুরু করেছে তা তিনি বুঝতেই পারছেন না। সাব্বির আহমেদের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার পর বহ্নিকে ডাকা হলো। বহ্নিকে প্রশ্ন করতেই সে প্রতিটা প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিল। সাব্বির আহমেদ বিশ্বাস করেন মেয়ের উপরে। তারপরেও খোঁজখবর নেওয়া আবশ্যক। অবশেষে শিহরণও জেনে গেল বহ্নি আর অতলের ব্যাপারে। প্রথমদিকে খুবই রাগান্বিত হয়ে গেল সে। পরে ছোঁয়া পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলার পরেই শান্ত হলো। এমন একটা বিষয় তার কাছ থেকে গোপন করার জন্য ছোঁয়ার উপরেও তার ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু ছোঁয়ার এই অবস্থায় সে নিজের রাগটাও প্রকাশ করতে পারছে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো তার। তারপরেও অতলের সাথে কথা বলা দরকার। তাই সে অতলকে সাথে সাথেই কল করে ডাকল।
অতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শিহরণ দু’হাত দিয়ে তার চুলগুলো চেপে ধরে ফ্রাস্ট্রেশন দূর করার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর শিহরণ রেগে গিয়ে বলল, ‘আমাকে জানাসনি কেন? এত লুকোচুরি করার কী কোনো দরকার ছিল?’
অতল আগের মতো মাথা নিচু করেই রইল। ছোটোবেলায় এমন একটা আশঙ্কায় নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়েই তো তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অতল তা ভুলেনি, ভুলতে পারে না। অতল কখনোই ভুলতে পারে না তার জীবনটা ভিন্ন ধারার। প্রচলিত স্রোতে সে কখনোই খা ভাসাতে পারেনি। সে জানে তার ভালোবাসার মানুষগুলো তার কাছ থেকে হারিয়ে যায় কারণে কিংবা অকারণে! খারাপ ভাগ্য বোধহয় একেই বলে। কথায় আছে, ‘অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়’ কথাটা মিথ্যে নয়। শতভাগ সত্য। অতল নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছে এই তিক্ত সত্য। তাই সে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে সবকিছু থেকে, সবার কাছ থেকে, জীবনের অনেকটা সময়। ভুল পথে হেঁটেছে, নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে, তবুও শান্তি মেলেনি। অবশেষে যা একটু শান্তি পেল তাও সেই বন্ধুদের ছায়াতলে জায়গা পেয়েই তো। এই বন্ধুরা তার অনেকটা জুড়ে আছে। ছোটোবেলার সমস্ত অবহেলা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য সমস্ত ছাপিয়ে সে এক টুকরো সুখ খুঁজে পেয়েছে বন্ধুদের মাঝে, বহ্নি আর শিহরণ ছিল তার মধ্যে অন্যতম। তাই সে আবারও ভয়ে তটস্থ, পাছে সবকিছু হারিয়ে ফেলে।
অতলকে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিহরণ বলল, ‘এখনো চুপ করে থাকবি? তুই কি বহ্নিকে ভালোবাসিস না-কি টাইমপাস? এত দিন তো এটাই করে এসেছিস, তাই না?’
অতল এবার মুখ তুলল। তার চেহারা শক্ত হয়ে গেল। কঠিন স্বরে এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘আমি ভালোবাসি বহ্নিকে। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা যে কোনো কিছুর উর্ধ্বে, এতে কোনো ছলনা নেই, এখানে কোনো ভ্রান্তি নেই, এটা সম্পূর্ণ সত্য দিনের আলোর ন্যায়।’
‘তোর বলা কথা আমি কেন বিশ্বাস করব? বিশ্বাস করার পেছনে কোনো শক্ত যুক্তি আছে তোর কাছে?’
‘যুক্তিতত্ত্ব দিয়ে ভালোবাসা যায় না। তাই বহ্নিকে ভালোবাসার পেছনে আমার কাছে কোনো যুক্তি নেই। আর আমাকে বিশ্বাস করাটা জরুরী নয় তবে জরুরী নয় বলেই তা মিথ্যা তাও নয়। বিশ্বাস অবিশ্বাস মানুষের মনের উপর নির্ভর করে। প্রমাণ সাপেক্ষে মস্তিষ্ক বিশ্বাস করে। এখন এটা সম্পূর্ণ তোর উপরে তুই কোন দিকে থেকে আমার বিচার করতে চাইছিস। আমি প্রমাণ দিতে প্রস্তুত তা বলব না। আমি যে ভালোবাসি, সত্যিই ভালোবাসি সেই সত্যটা ঢেকে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলতে চাই, আমার পক্ষে আর কাউকে হারানো সম্ভব নয়। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি হারাতে হারাতে, নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে। আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তুই কী প্রমাণ চাস বল? তোকে বিশ্বাস করানোর ক্ষমতা হয়তো আমার কাছে নেই, তবে সত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মতো আত্মবিশ্বাস আমার আছে।’
অতলের মুখ থেকে এমন সব কথা শুনে শিহরণ স্তব্ধ হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। ছোঁয়া বহ্নিকে নিয়ে এলো। শিহরণ এবার বহ্নিকে প্রশ্ন করল, ‘তুই বল ওকে আমি কী পরীক্ষা নিতে পারি?’
বহ্নি এক পলক তাকাল অতলের দিকে। এতক্ষণ যাবৎ অতল যা কিছু বলেছে তার সবটাই সে শুনেছে। তার বুকের ভেতরটা বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠেছে কেবল। একটা গভীর শ্বাস ফেলে সে বলল, ‘আমি জানি সে সত্য বলছে। তাই কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে তুমি যাই বলো না কেন, আমি বিশ্বাস করি ও কোনো প্রকার বাক্যব্যয় না করে তা মেনে নিবে।’
‘ওকে, ডান।’ শিহরণ জহুরি চোখে অতলকে পরখ করে বলল, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’
অতল তাকাল শিহরণের দিকে। শিহরণ মুখে কাঠিন্য বজায় রেখে বলল, ‘তোকে বহ্নির জীবন থেকে সরে যেতে হবে, চিরতরে।’
অতল আর বহ্নি দুজনেই বিস্ফোরিত চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। ছোঁয়াও বাকরুদ্ধ। হঠাৎ করেই অতল অদ্ভুত হাসল। তারপর একটু আগে বহ্নির বলা কথাটা ভেবেই সে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। বহ্নির চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
অতল চোখের সীমানায় অদৃশ্য হবার আগেই শিহরণ ওকে ডাকল। অতল ঘুরে দাঁড়াল। শিহরণ ওর কাছে এসে বলল, ‘ওর চোখে যেন কখনো এক ফোঁটা অশ্রুও না আসে। এবং কোনোভাবেই যেন আমার বার্বি ডলের অশ্রু কিংবা কষ্টের কারণ তুই না হোস। তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। বলে রাখলাম।’
কথাগুলো বলা শেষ করেই শিহরণ অতলকে জড়িয়ে ধরল। বহ্নির চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল।
___________________________
শিহরণ বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে বাবা-মা দুজনকে রাজী করাল। আশরাফ হোসেনও রাজী না হয়ে থাকতে পারলেন না। অতলের চাকরি না থাকায় বেশ আপত্তি তুলেছিলেন সাবিহা সাবরিন। কিন্তু শিহরণ দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘ওর জব হয়ে যাবে এবং তা বিয়ের আগে আগেই হবে বলেই আশা করা যাচ্ছে। রেজাল্ট হয়ে হওয়া পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে তো হবেই। ওর মতো মেধাবি ছাত্রের জব না হলে আর কার হবে।’
অবশেষে বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। অতল আর বহ্নির বিয়ের খবরটা মোটামুটি তারায় তারায় রটে গেল। আতিক, রাদিদ কিংবা নীরা কারো কাছেই এই খবর অজানা থাকল না।
_____________________________
কুমিল্লা থেকে আসার পর থেকেই বেশ উৎফুল্ল মেজাজে আছে আশফাক। আমিরাহ এই উৎফুল্লতার পেছনের কারণ কি তা কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। অবশ্য এতে তার কোনো মাথাব্যথাও নেই। তবে অবাক হচ্ছে এই ভেবে–যে মানুষটা এই তো কিছু দিন আগেও বিমর্ষ, বিষণ্ন মুখে ঘুরে বেড়াত সে আজ হাওয়ায় ভাসছে। আশফাক তার চোখে-মুখে উদ্ভাসিত উচ্ছ্বাস লুকিয়ে সেখানে কৃত্রিম কষ্টের আবরণ মেখে আমিরাহকে বলল, ‘আমি আসলে অনেক ভেবেছি। তোমাকে এভাবে কষ্ট দেওয়াটা আমার অন্যায় হচ্ছে। আমি এভাবে তোমাকে কষ্ট দেবার কোনো অধিকার রাখি না।’
আমিরাহ ভীষণ অবাক হলো। এই লোক কী বলছে! সে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? কোন বিষয়ে কথা বলছ?’
‘তুমি আমার কাছ থেকে বারবার ডিভোর্স চেয়েছ কিন্তু আমি তোমাকে জোর করে আটকে রেখেছি। এটা আমি ঠিক করিনি। আমাকে মাফ করে দিও, প্লিজ। আসলে নিজের কথা ভাবতে ভাবতে আমি তোমার সুখ-দুঃখের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তবে এখন আর না। আমি তোমাকে মুক্তি দেব। আমাদের সন্তানের দোহাই দিয়ে তোমাকে আর আটকে রাখব না।’
আমিরাহ এতটাই শক খেল যে সে কথা বলতে ভুলে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আশফাকের দিকে। আশফাক আবারও বলতে শুর করল, ‘তোমার ব্রাইট ফিউচার নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই।’
কথাগুলো বলতে বলতে সে একটা কাগজ আমিরাহের দিকে এগিয়ে দিয়ে আবারও বলল, ‘এটা আমাদের ডিভোর্স পেপার। এটাতে একটা সাইন করলেই তুমি মুক্ত। এর পর থেকে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। তোমাকে বাধা দেবার মতো কেউ থাকবে না।’
আমিরাহ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘সত্যি বলছ?’ পরক্ষণেই সন্ধিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘তাহলে তুমি কি আবার বিয়ে করবে?’
আশফাক অতি শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার মতো করে অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘কী বলছ তুমি? আমি বিয়ে করব মানে? আমার জন্য আমার মেয়েই যথেষ্ট। তুমি তোমার ফিউচার নিয়ে ভাবো।’
আমিরাহের চিন্তা এবার তার চাকচিক্যময় ভবিষ্যতের দিকে ঘুরে গেল। আর তাতেই সে দুম করে সাইন করে দিল।
আশফাকের বুকের উপর থেকে বিশাল একটা পাথর সরে গেল। সে নিজেও কোনো প্রকার কালবিলম্ব না একটা সাইন করল। বাকি কাজ তার উকিল করে নিবে। এই অভিনয়টুকু করা তার জন্য খুব জরুরী ছিল। যদি এরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নীলাকে সে ফিরে পেয়েছে তবে আমিরাহ তাকে কখনোই ডিভোর্স দেবে না। এতটুকু সে খুব ভালোভাবেই জানে। আর তার বাবা-মা সোনার ডিম পারা হাঁস হাত থেকে ফসকে যেতে দেবেন না। আমিরাহকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে তাকে নীলার প্রতি আগ্রাসী করে তুলতেও পিছপা হবেন না। তাই দ্রুততার সাথে ডিভোর্সের ব্যাপারটা চুপিচুপি সেরে ফেলতে চাইছে সে। তাছাড়া নীলা কিংবা পিউকে এখনি কারো সামনে আনা যাবে না। এতটুকু সতর্কতা তাকে অবলম্বন করতে হবে।
____________________________
আতিক বেশ অবাক হলো যখন জানতে পারল তার বাবা অতলের পছন্দের মেয়েটাকে তার বউ করে আনছেন। যেখানে সে নিজের পছন্দ সম্পর্কে বলতেই পারেনি সেখানে অতলের ইচ্ছে পূরণ করতে কোনো প্রকার বাধা দিচ্ছেন না বরং কোনো প্রকার ঝামেলা ব্যতিরেকে তা মেনে নিয়েছেন। এই ব্যাপারটা আতিককে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। সে এখনও ভুলতে পারেনি কীভাবে তার আর আফরিনের মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাকে কটু কথা বলতে তার বাবা একবারও ভাবেননি। সবকিছু অতলের জন্য হয়েছে। এই সমস্ত কিছুর জন্যই অতল দায়ী। আতিক নির্বাসনে থাকবে আর অতল থাকবে সুখে রাজপ্রাসাদে। এটা আর কেউ মানুক আর না মানুক আতিক কখনোই মেনে নিবে না।
অতলের বিয়ের খবরটা শোনার পর থেকেই তার মাথাটা বেঁকে বসেছে। তার মস্তিষ্ক তাকে শান্তিতে না বসতে দিচ্ছে, না একটু শান্তিতে ঘুমোতে দিচ্ছে। সে বুঝে গেল এতদিন ধরে বুকের মধ্যে চেপে রাখা সত্যটা বাহিরে আনার যথোপযুক্ত সময় চলে এসেছে। সুযোগ বুঝে তাকে একবার বাসায় যেতে হবে, আর তার ট্রাম্পকার্ড কাজে লাগানোর সময় চলে এসেছে।
_________________________
সাবিহা সাবরিন থম ধরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। অতলের ব্যাপারে এতসবকিছু জানার পর তিনি কোনোভাবেই এই ছেলের কাছে নিজের মেয়ে বিয়ে দেবেন না। প্রত্যেক বাবা-মাই চান তাদের সন্তানকে একটা নির্ভরযোগ্য হাতে তুলে দিতে। তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। অতলের পুরাতন রেকর্ডকে তিনি অদেখা করলেও বর্তমানটা তিনি কোনোভাবেই অদেখা করতে পারছেন না। একজন বাবা যে একটা মেয়েকে বিয়ে করার পর তার অনাগত সন্তানসহ তাকে রাস্তায় ছেড়ে দিলো। এমনকি তার বন্ধুদেরকে দিয়ে নিজের স্ত্রীর ক্ষতি করাতেও পিছপা হয়নি সেই বাবার রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে অতলের শরীরে। অতল তো সেই নোংরা আর বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষটারই সন্তান। তাই অতল ও যে তা করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সবকিছু জেনেশুনে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি নিজের মেয়েকে ছেড়ে দিতে পারেন না। তার স্বামী মেয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে হার মানতে পারে, কিন্তু তিনিও যদি হার মানেন তবে মেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে। তিনি তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবেন না। দরকার হলে মেয়ের চোখে খারাপ হতেও তিনি পিছপা হবেন না। যাই করা লাগে লাগুক তিনি নিজের আদরের মেয়েটাকে ওই ছেলের হাতে দিবেন না। এটাই তার ফাইনাল ডিসিশন। তাছাড়া অতল আসলে ঠিক কার সন্তান–সেই বিষয়েও সন্দিহান তিনি। যদিও তিনি বার্থ সার্টিফিকেট দেখেছেন, তবুও সব তথ্য জানার পরে একটা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে!
নিজের সাথে মানসিক দ্বন্দ্বে দ্বন্দ্বে বহুক্ষণ পার করার পর সাবিহা সাবরিন নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। বহ্নিকে নিজের বোনের বাসায় জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছেন বেশ কিছুক্ষণ আগে। শিহরণ ছোঁয়াকে নিয়ে ব্যস্ত আছে।
কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে কল করার পরে তিনি সোফায় মাথা এলিয়ে দিলেন। কাটল বেশ কিছুক্ষণ সময়। তারপর মিষ্টিকে ডেকে বললেন তাকে কড়া লিকার দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে। মিষ্টি চা এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘মাথা ব্যথা করছে আন্টি? চা-টা খেয়ে নেন। ভালো লাগবে।’
সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘তুই এখন যা আমি চা খেয়ে নেব।’
মিষ্টি গেল না। বলল, ‘আমি কি মাথা টিপে দেব আন্টি?’
‘না, তোকে যেতে বলেছি না। একদম আমার আশেপাশে থাকবি না। আমি না ডাকলে আমার আশেপাশে আসবি না এটা আমার আদেশ। বুঝেছিস?’ সাবিহা সাবরিন রেগে গিয়ে বললেন।
মিষ্টি আর দাঁড়াল না। সে চলে গেল ধীর পায়ে হেঁটে। সাবিহা সাবরিন অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন।
অতল ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেই সালাম দিল। সাবিহা সাবরিন মাথা তুলে দেখলেন অতলকে। তিনি তাকে ইশারায় বসতে বললেন। অতল কালবিলম্ব না করেই একটা সোফায় বসে পড়ল। সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘বহ্নিকে বিয়ে করার যোগ্যতা কি তোমার আছে?’
অতল এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাকে বিভ্রান্ত দেখাল। একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে সে বলল, ‘আমার যোগ্যতা আছে কি নেই তা আপনার যোগ্যতা পরিমাপের মানদণ্ডের উপর নির্ভর করবে।’
সাবিহা সাবরিন অবাক হলেন অতলের স্পর্ধা দেখে। এই ছেলেকে যতটা আলাভোলা মনে করেছিলেন সে তেমনটা নয়। তিনি তা মুহূর্তেই বুঝে গেলেন। বললেন, ‘প্রত্যেক পিতা-মাতা তাদের কন্যার জন্য পাত্র সন্ধানে যে মাপকাঠি অনুসরণ করে থাকেন তা তো একই হয়ে থাকে। তাই না?’
অতল দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলল, ‘জি, না। সবার মাপকাঠি একই হয় না।’
অতলের দৃঢ়তায় সাবিহা সাবরিন ভাবলেন, ‘এইটা তার ধূর্ততা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে এই পুঁচকে ছেলেটা।’
তিনি মুখে বললেন, ‘কেন মনে হলো তোমার? আর কোন বেসিসে বলছ এটা?’
অতল একটু নড়েচড়ে বসল। সে ভালোই বুঝতে পারছে, তার সামনে বসে থাকা মহিলাটি তার ভালোবাসার মানুষটিকে তার হাতে হস্তগত করতে ভীষণ নারাজ। তাই তাকে নাস্তানাবুদ করে মেয়ের জীবন থেকে সরাতে বদ্ধপরিকর। সে বলল, ‘সত্যের অস্তিত্ব মনে করার উপর নির্ভর করে না। বরং সত্য নিজ গুণেই সত্য। আমার কোনোকিছু মনে করা কিংবা না করাতে কোনো সত্য যেমন পরিবর্তন হয়ে মিথ্যে হয়ে যাবে না। ঠিক তেমনি কোনো মিথ্যে সত্যও হয়ে যাবে না।’
সাবিহা সাবরিন ব্যঙ্গাত্মক হাসলেন। বললেন, ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না কথাটাও সত্য। তাই না?’
‘এক্স্যাক্টলি, আমিও আপনাকে এটাই বুঝাতে চাইছি। অথচ মানুষ সবসময় চকচক করলেই সোনা মনে করে তার পেছন পেছন ছুটতে মরিয়া হয়ে উঠে।’ ভাবলেশহীন গলায় বলল, অতল।
সাবিহা সাবরিন এবার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। ছেলেটাকে নিতান্ত শান্তগোছের মনে করলেও এইটা অত্যন্ত বেয়াড়া ধরনের ছেলে। নিজের সিদ্ধান্ত যে সঠিক তার প্রমাণ তিনি প্রতিমুহূর্তে পাচ্ছেন।
তিনি এবার তার হাতের কাছে থাকা ডকুমেন্টগুলো ছুঁড়ে দিলেন অতলের দিকে। বিক্ষিপ্ত কাগজগুলোর দিকে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অতল। সাবিহা সাবরিন তাড়া দিয়ে বললেন, ‘কাগজগুলো দেখো।’
বাধ্য ছেলের মতো করে অতল মাথা নুইয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলোর মধ্যে একটা কাগজ হাতে নিল। চোখ বুলাতেই দেখল সেটা বার্থ সার্টিফিকেট। কাচের টেবিলে রেখে দিতে চাইলে সাবিহা সাবরিন সতর্ক গলায় বললেন,’পুরোটা পড়ে দেখো। তোমার জানা দরকার সবটা।’
অতল পুরো সার্টিফিকেটে নজর বুলাল। দেখল বার্থ সার্টিফিকেটে লেখা বাচ্চাটার নাম তার নামের সাথে হুহবু মিল। কিন্তু মায়ের নামের জায়গায় লেখা শান্তা সুলতানা। বাবার নামের জায়গায় লেখা নাবিল রহমান। এই সার্টিফিকেট দেখে অতল ভীষণ অবাক হলো। তার চেহারার রং পাল্টে গেল। হতবিহ্বল অতল করুণ চোখে তাকাল সাবিহা সাবরিনের দিকে। সাবিহা সাবরিন বুঝে গেলেন সার্টিফিকেটর তথ্য অতলের জানা হয়ে গেছে। তিনি বললেন,’বাকিগুলোও দেখো। জলদি করো।’
অতল সবগুলো কাগজ দেখল। একটাও বাদ রাখল না। তার চোখে-মুখে শ্রাবণের মেঘ জমেছে। অতল শুধু একটাবার অস্ফুট স্বরে আওড়াল, ‘এটা হতে পারে না। এটা কখনোই হতে পারে না। এটা কী করে সম্ভব? কী করে?’
সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘এবার বলো তো তোমার কাছে কি আমার সোনার টুকরো মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়া উচিত হবে? মা হিসেবে এই কাজটা কি আমি করতে পারি? আমার কি তোমার উপর ভরসা করা উচিত?’
অতল কোনো উত্তর দিতে পারল না। সমস্ত কগজপত্র হাতে নিয়ে সে উদভ্রান্তের মতো করে হেঁটে বেরিয়ে গেল। বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটছে সে যেন পথহারা কোনো পথিক।
___________________
সব কাগজপত্র হাতে নিয়ে অতল বাসায় গেল। মায়ের মুখোমুখি হতে হবে তার। মেহেরুন নাহার উদ্ভ্রান্ত অতলকে দেখে ভীষণ অবাক হলেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে তোর? অসুখ করেছে বাবা?’
অতল কোনো উত্তর দিল না। মেহেরুন নাহার ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অতলের কাছাকাছি এসে তিনি অতলের কপালে হাত রেখে বললেন, ‘জ্বর তো আসেনি। খারাপ লাগছে? কী হয়েছে বল মাকে?’
‘মা!’ অতল ব্যথাতুর গলায় বলল, ‘আমার মা কে?’
‘কীসব বলছিস? তোর মা আবার কে? আমিই তো।’
অতল দ্বিরুক্তি না করে তার হাতে থাকা কাগজগুলো এগিয়ে দিল মায়ের দিকে। মেহেরুন নাহার কাগজগুলো হাতে নিতেই ভীষণভাবে চমকে গেলেন।
‘তুই এসব কোথা থেকে পেলি? এইসব তো আমার রুমে ড্রয়ারে তালাবদ্ধ ছিল।’
‘এই সব ডকুমেন্ট আমি কোথায় পেয়েছি সেটা এখন আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমাকে সত্যিটা বলো, মা।’
মেহেরুন নাহার নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। অতলকে এমন বিধ্বস্ত তিনি কখনোই দেখেননি। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভেতরটা ভাঙচুর হচ্ছে, নিঃশব্দে।
অতল বসে পড়ল মায়ের পদতলে। মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘আমার কাছে আর কিছু লুকিয়ে রেখো না, মা। আমাকে সবটা জানাও। আমি বুঝতে পারছি তোমরা আমার বাবা-মা নও। তবুও আমি সবকিছু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। প্লিজ, মা, প্লিজ। আমাকে আর অন্ধকারে রেখো না।’
মেহেরুন নাহার গভীরভাবে শ্বাস নিলেন। পুরনো অতীতটাকে ধামাচাপা দিয়েছিলেন সযত্নে, বহুকষ্টে। ভেবেছিলেন যতকিছুই হয়ে যাক না কেন, এই কালো অতীতটাকে আর কখনোই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দিবেন না। কিন্তু জীবন সত্যিই কণ্টকাকীর্ণ! মেহেরুন নাহার একটা গম্ভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, ‘ঠিক ধরেছিস, আমি তোর মা নই। বাবাকে বলে যাকে জানিস তিনি তোর মামা, আর আমি তোর মামী। তোর জন্মদাত্রী মায়ের নাম শান্তা। আমার ছোট্ট শান্তা তার নামের মতোই শান্ত ছিল। সবার সাথে মিশতে পারত না। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল কুয়োর ব্যাঙের মতো। মানুষের সাথে না মিশতে পারার এই অদক্ষতাটার জন্য বরাবরই তোর বাবা দায়ী। তিনি বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশা পছন্দ করতেন না। শান্তা যখন ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলো তখন থেকেই তার মধ্যে বিস্তর পরিবর্তন খেয়াল করতে শুরু করলাম। তবে পুরোপুরি বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। ততদিনে শান্তা নাবিল নামের এক ছেলের প্রতি আসক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন বুঝতে পারলাম তখন শান্তাকে সাবধান করলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাই আমি ছেলেটার সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করলাম। যা জেনেছি তাতে আমি শিউরে উঠেছিলাম। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা , যে করেই হোক শান্তাকে এই মাদকাসক্ত, লম্পট ছেলের কাছ থেকে রক্ষা করতে হবে। তাই অবশেষে বিষয়টা তোর বাবাকে জানালাম। তোর বাবা রেগেমেগে আগুন হয়ে গেল। শান্তাকে ইচ্ছেমতো মেরেছিল সেদিন। আমি চেয়েও থামাতে পারিনি। তোর মামা কিছুদিনের মধ্যেই শান্তার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। শান্তাও খুব শান্ত হয়ে গেল। আমরা ভেবেছিলাম ও বোধহয় মেনে নিয়েছে। এই ধারণাটাই ভুল হলো আমাদের। বিয়ের দিন টাকা-পয়সা, গহনা নিয়ে শান্তা পালিয়ে গেল ওই ছেলের সাথে। এলাকায় তোর বাবার খুব বদনাম হলো। ঘর থেকে বের হতে পারতাম না আমরা। লোকে পাথর ছুঁড়ে মারত, কেউ কেউ ছেঁড়া জুতো পর্যন্ত ছুঁড়ে মেরেছিল তোর বাবার দিকে। বহুকষ্টে তোর বাবা সেই গ্রাম থেকে পোস্টিং নিয়ে শহরে চলে এলো।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন মেহেরুন নাহার। কাঁদছেন তিনি। অতীতটা এভাবে অতলকে জানাতে হবে তা তিনি ভাবেননি। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন। অতল তীর্থের কাকের ন্যায় মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অপেক্ষা করছে নিজের অস্তিত্বের সবটুকু জানার জন্য। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর ধারা।
মেহেরুন নাহার দম নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,’শান্তাকে আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো অন্যকিছুই চেয়েছিল। তাই আবারও শান্তার সাথে দেখা হয়ে গেল। আতিকের বয়স তখন দুই বছর। একদিন আতিকের বাবার অফিসের কলিগের বাসা থেকে বের হবার পরে পাগলের বেশে তোর মাকে দেখলাম। উনাকে দেখালেও তিনি কোনো ভ্রুক্ষেপই করলেন না। আমি অনেক কাকুতি-মিনতি করে তোর মাকে বাসায় নিয়ে আসি। ওকে বাসায় এনে গোসল করিয়ে ভালো কাপড় পড়তেই সেই আগের মতো রূপসী ছোট্ট মেয়েটিকে কাছে পেয়ে গেলাম মনে হলো আমার। তারপর আমিই ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার চেক আপ করে জানাল শান্তা প্রেগনেন্ট। ছয় কি সাত মাস চলছিল ওর। তুই বুঝতে পারছিস, তুই তখন ওর গর্ভে।’
মেহেরুন নাহার বলতে শুরু করলেন, ‘শান্তা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওর নিজের উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ওর এমন পাগলামো দেখে ওকে একটা রুমে বন্ধী করে রাখতে হয়েছিল। আতিকের বাবার সাথে এই নিয়ে আমার প্রায় ঝগড়া হতো। তিনি শান্তার উপর রেগে ছিলেন। তাই তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে চাইছিলেন।
কিন্তু আমি কোনোভাবেই শান্তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে রাজী হলাম না। শান্তা হুটহাট ধারালো কিছু পেলেই নিজেকে আঘাত করার চেষ্টা করত। তাই সমস্ত ধারালো জিনিস ওর নাগালের বাইরে রেখেছিলাম। একসময় তুই এই পৃথিবীর বুকে এলি। শান্তা তখন একদম শান্ত হয়ে গেল। আমরা ভেবেছিলাম এই বুঝি শান্তা সুস্থ হয়ে গেল। তোকে খুব আদর করতে দেখে আমি মনে মনে বিশ্বাস করতে শুর করেছিলাম যে শান্তার মানসিক সমস্যা দূর হয়েছে।’
অতল অধৈর্য গলায় বলল, ‘তারপর?’
‘একদিন শান্তা তোকে আমার কোলে দিয়ে বলল, ‘ভাবি, এই নাও তোমার ছেলেকে। আজ থেকে ও তোমার সন্তান।’ আমি অবাক হতে চেয়েও সেদিন অবাক হইনি। তোকে কোলে নেওয়ার পর মনে হয়েছিল তুই আমারই সন্তান। এর পর থেকে শান্তার মানসিক স্বাস্থ্যের ভয়ানক অবনতি ঘটল। সে পুনরায় সুইসাইড এটেম্পট করা শুরু করল। তাই ওকে আবারও একটা রুমের মধ্যে বেঁধে রাখতে হলো। কিন্তু তাতেও ওকে বাঁচানো গেল না। ওকে যে রুমে আটকে রেখেছিলাম সেই রুমেই সে ঝুলে পড়ল বিদায়ের লন্ঠন হাতে নিয়ে।’
অতল নিজেকে শান্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এতটা কষ্টে ছিল তার মা! তার বাবা নামক প্রাণীটা তার মাকে এতো কষ্ট দিয়েছে যে শেষমেশ নিজের প্রাণ নিজেকেই শেষ করতে হলো তার মাকে!
‘শান্তা মারা যাবার পরেই ওর হাতে লেখা চিঠি পেলাম। যেখানে সে তোর তথাকথিত বাবার করা অত্যাচারের বর্ণনা লিখে রেখেছিল। কী ভয়ংকর সেই বর্ণনা! আমার পক্ষে তোকে সেসব বলা সম্ভব নয়। তুই চাইলে চিঠিটা নিজেই পড়ে নিস।’ মেহেরুন নাহার আর্তনাদ করে বললেন।
অতল তখন মায়ের পায়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই কারণে বাবা আমাকে দেখতে পারে না, তাই না মা?’
মেহেরুন নাহার আঁচল মুখে দিয়ে কান্না রোধ করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজের রুমে ছুটে চলে গেলেন। অতল একটা ব্যাগের মধ্যে সমস্ত কাগজ ঢুকিয়ে রাখল। নিজের রুমে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে দিল। অন্ধকার নেমে আসছে ধরণীতে। অতল সেই অন্ধকারের অতলে ডুবে যাচ্ছে। মায়ের লেখা সেই চিঠিটা পড়তে শুরু করল। কী ভয়ংকর তার বাবা নামের লোকটা! এই চিঠিটা পড়ার পরে সে আর বহ্নির মাকে কোনো দোষ দিতে পারছে না। এরকম বাবার সন্তানকে কেউ বিশ্বাস করতেই পারে না। তবে কি বহ্নিকেও সে হারিয়ে ফেলবে? তার কি ভালোবাসা পাবার কোনো অধিকার নেই? সে কি শুধু হারাবার জন্যে এই পৃথিবীতে এসেছে? মায়ের লেখা চিঠিটা বুকে আঁকড়ে ধরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ল অতল। তার বুকটাতে বয়ে যাচ্ছে এক ভয়ংকর ঝড়। সেই ঝড় সমস্তকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। অন্ধকারের অতলে ডুবন্ত ঘরটাতে কেবলই অতলের অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ব্যতীত আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এক অস্বাভাবিক ছন্দে উঠানামা করছে তার বুক!
_______________
নীরা যখন জানতে পারল অতল আর বহ্নির বিয়ের খবরটা তখন থেকেই তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। তার সমস্ত চিন্তা চেতনা জুড়ে কেবল একটাই চিন্তা, রাদিদ ভাইয়ার কী হবে! রাদিদ ভাইয়ার বিষয়টা বহ্নিকে জানানোর জন্য সে বহ্নির আইডি খুঁজে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল। সাথে একটা লম্বা মেসেজ দিয়ে বহ্নির জন্য রাদিদের গোপন ভালোবাসাটাও প্রকাশ করে দিয়েছিল। এর পর থেকেই নীরার অপেক্ষার পালা শুরু হয়েছিল। ‘এই বুঝি বহ্নি তার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করল আর সবটা জেনে গেল’ এই আশাতেই সে প্রতিদিন ফেসবুকে ব্রাউজ করতে করতে চ্যাক করে দেখে তার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করা হয়েছে কি না। কিন্তু প্রত্যেকবারই সে আশাহত হয়। তার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করা হয়নি!
নওশীন হক নীরাকে বিষণ্ন দেখে বললেন, ‘কী হয়েছে তোর?’
‘কিছু না মা।’ নীরা হাসার চেষ্টা করে বলল।
‘মায়ের কাছ থেকে লুকাচ্ছিস?’
‘রাদিদ ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে, মা।’
‘কল করে ডেকে নিলেই তো হয়।’
‘মা, ভাইয়ার কাজ আছে তো। আবির ভাই তো একটা কাম চোরা। সব কাজ রাদিদ ভাইয়াকেই করতে হয়।’
‘এভাবে বলছিস কেন? তাহলে চলে যা কুমিল্লায়।’
‘সত্যি বলছ মা?’
‘একদম সত্যি। ঠিক আছে, এবার আমিও না হয় যাব তোর সাথে।’
নীরা খুশিতে গদগদ হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মাহফুজ হক বললেন, ‘তোমাদের সাথে আমিও যাব। অনেকদিন হয়ে গেলো গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না।’
নীলভ্রকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। আফরিন প্রশ্ন করবে না করবে না করেও করেই ফেলল, ‘নীল, এত খুশির কারণ কি জানতে পারি?’
নীলাভ্র হেসে বলল, ‘বহুদিনের পুরনো একটা হিসেব চুকেবুকে গেছে। তাই আজ নিজেকে প্রশান্তির সাগরে খুঁজে পেলাম। এই কারণেই আজ মনটা ভীষণ আনন্দিত।’
‘তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, নীল।’
‘এসব কথা তোমার বুঝার দরকারও নেই। কথা হচ্ছে, তোমার নীল আজ ভীষণ খুশি।’ নীলাভ্র একটু থেমে আফরিনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,’চলো, আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। কোথায় যাবে বলো?’
আফরিন খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, ‘সত্যি বলছ?’
‘একদম।’
‘তাহলে চাইনিজ খেতে যাব আর লেকের পাশে কিছুক্ষণ হাঁটব। ঠিক আছে?’ আফরিন হঠাৎ কোনোকিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে পুনরায় বলল, ‘ও হ্যাঁ, বিয়ের পর থেকে আমার কিছুই কেনা হয়নি। তাই আজকে শপিং ও করাতে হবে কিন্তু!’
নীলাভ্র মাথা দুলিয়ে বলল,’ঠিক আছে। আজকে তোমার সব ইচ্ছেই পূরণ করা হবে।’
___________________
রাত গভীর হচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অতলের বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট। তবুও মায়ের চিঠিটা সে চোখের সামনে ধরে রাখল। কালো অক্ষরগুলোতে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি ফেলছে সে।
প্রিয় ভাবি,
তোমার আর ভাইয়ার কথা না শুনে আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল করেছিলাম। কিছু কিছু ভুলের মাশুল দিতে হয় জীবন দিয়ে। আমিও তেমনটাই দিতে যাচ্ছি। নাবিল খুব ভয়ংকর একজন মানুষ। সে শুধুমাত্র তার নেশার খোরাক মেটানোর জন্য আমাকে মিথ্যে ভালোবাসার জালে আবদ্ধ করেছিল। আমিও কী বোকাটাই না ছিলাম! চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিলাম তার উপর। জানো ভাবি, ও শুধু আমার কাছ থেকে টাকা আর গহনা হাতানোর জন্য বিয়ে করেছিল। ও যখন নেশায় মাতাল হয়ে পড়েছিল তখন তার বন্ধুরাও আমার সাথে…! আমি যে কী পরিমাণ মানসিক আর শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো শব্দ আমার কাছে নেই। একদিন আমি জানতে পারলাম আমার ভেতরে আর একটা অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যখন আমি এক বুক সাহস যোগাড় করে ওকে জানালাম আমি মা হতে চলেছি তখন সে সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। শুধু তাতেই ক্ষান্ত হলো না, আমাকে সে বেল্ট দিয়ে মেরেছিল সেদিন।
এতে আমি শারীরিক আর মানসিকভাবে আরও বেশি ভেঙ্গে পড়ি। উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকুও আমার ছিল না।
এক সময় আমার সাথে করে নিয়ে যাওয়া টাকা শেষ হয়ে গেল তখন সে আমাকে তোমাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। আমি না করতেই আমার উপর তার অত্যাচার আরও বেশি বেড়ে গেল। আমার বাচ্চাটা তখন আমার পেটে, সে তার প্রতিও কোনো করুণা করল না। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, ও আমাকে সাথে রেখেছে কেবলই টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করার জন্য। পরে আমি বহুকষ্টে সেখান থেকে পালালাম। এর পরে আমি আসলে ঠিকভাবে কিছুই মনে রাখতে পারতাম না। কখনো রাস্তায় ঘুমিয়েছি, কখনও কোনো অফিসের বারান্দায়, কখনও জঙ্গলে, কখনও গাছের নিচে, কখনও ভিক্ষা করেছি, কুকুরের মুখ থেকে পড়ে যাওয়া খাবারও খেয়েছি। সবাই আমাকে পাগল ভাবত, আমাকে দেখতে অবশ্য পাগলের মতোই লাগত। ঠিক বলেছি তো ভাবি? ছোটো ছোটো বাচ্চারা আমাকে দেখলেই ‘পাগলি পাগলি’ বলে চিৎকার করত আর পাথর ছুঁড়ে মারত। জানো ভাবি, ওই পাথরগুলো যখন গায়ে পড়ত তখন খুব কষ্ট হতো। আমি জানি, আমার বাচ্চাটাও কষ্ট পেত। মায়ের কষ্ট কি সন্তানকে স্পর্শ না করে থাকতে পারে? এও কি সম্ভব? এইসব বাচ্চাদের তাদের বাবা-মা কখনও নিষেধ করত না। এটা দেখে খুব কষ্ট পেতাম। পাগলি বলে কি আমি মানুষ ছিলাম না? আমার কি অনুভূতি ছিল না? আমার কি কষ্ট হতো না? পাগলি হলেও আমি তো মানুষই ছিলাম, তাই না, ভাবি? শুধু বাচ্চা নয় বয়স্ক লোকেরাও পাগলি বলে খ্যাপাত, পাথর ছুঁড়ে মারত। পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মই হয়তো এই যে, সবলেরা দুর্বলের উপরে অত্যাচার করে এক পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে, এইটা বুঝি এখন।
পাগলি নামক ট্যাগটা একদিক থেকে আমার অঘোষিত নিরাপত্তা দিয়ে দিল। যদিও এখন আমি জানি নারীরা পাগল হলেও পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রেহাই পায় না। আমার উপরেও যে পড়েনি তা নয়, তবে আমি সবসময় হাতে একটা ধারালো ছুরি রাখতাম।
জানো, ভাবি, ওই ছুরিটা কেন রেখেছিলাম? ওটা সাথে রেখেছিলাম নিজেকে শেষ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু যখনই নিজেকে শেষ করতে চাইতাম, আমার মধ্যে একটা ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব আছে, এটা কী করে যেন টের পেয়ে যেতাম! তখন শুধু কাঁদতাম, হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতাম। পাগলরা তো ওভাবেই কাঁদে, তাই না ভাবি? এজন্য নিজেকে শেষ করতে চেয়েও পারিনি। আল্লাহ হয়তো চেয়েছিলেন, আমার বাচ্চাটা আসুক পৃথিবীতে। তাই ওর আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভেবেছিলাম কোথাও ওকে রেখে পালিয়ে যাব এই পৃথিবীর বুক থেকে, নিজের ঘৃণ্য অতীত থেকে! এই পথটা সহজ হয়ে গেলো যখন তুমি আমাকে খুঁজে পেলে। আমি জানি তুমি আমার বাচ্চাটাকে নিজের বাচ্চার মতোই ভালোবাসবে। তবুও তোমার কাছ থেকে কথা নিয়েছিলাম। তোমার নিজেরও তো একটা সন্তান আছে। তাই ভরসা করতে কষ্ট হচ্ছিল।
জানো, ভাবি, যখন জানতে পারলাম আমার মাঝে আর একটা প্রাণের অস্তিত্ব তখন থেকেই আমার ভয় লাগতে শুরু করল। ও যদি কোনোভাবে ওর বাবার মতো হয়, ও যদি ওর মায়ের মতো বোকা হয়! তাই আমি চাইনি ওর মাথার উপরে আমার কিংবা তার বাবার ছায়া পড়ুক। তুমি ওকে কখনও জানতে দিও না, ওর মা টা খুব বোকা ছিল। তুমি ওকে কখনও জানিও না ওর বাবা একটা পিশাচ ছিল। তুমি আর ভাইয়া ওর বাবা-মা হয়ে থেকো। আমার এই শেষ ইচ্ছেটা তুমি রেখো, ভাবি।
ইতি
তোমার বোকা শান্তা
চিঠিটা পড়ার পরে অতল অঝোরে কাঁদল। এতোটা কষ্ট সহ্য করেছে তার মা, শুধু তাকে পৃথিবীতে আনার জন্য! মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে অতলের। কেন চলে গেল তাকে একা রেখে? কেন? অতল চিৎকার করে কাঁদতে থাকল ‘মা মা’ বলে। অতল চিঠিটা বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে বলতে থাকল, ‘আমার বোকা মা, কেন তুমি আমাকে একা রেখে চলে গেল? কেন মা? আমাকে ভালোবেসে কি তুমি থাকতে পারতে না এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে?’
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঝংকার দিয়ে উঠল মোবাইল নামক যন্ত্রটা। অতল তা দেখার প্রয়োজন বোধ করল না। সে জানে এত রাতে তাকে কে খুঁজতে পারে! এত রাতে তাকে কে মনে করতে পারে! আজ সারাদিন ধরে বহ্নির সাথে কোনো কথা হয়নি। আর এই মুহুর্তে অতলের কাছে সবকিছু বিষাদের নীলে বিষাক্ত!
তানিয়া দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে
অতল আর তার মায়ের সমস্ত কথা শুনেছে। তার ভেতরটা হাহাকার করছে তার এই হতভাগা ভাইটার জন্য। অতল তার আপন ভাই না হলেও আপন ভাইয়ের চাইতেও বেশি। অতল দরজা বন্ধ করে রাখায় সে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কিছু উল্টাপাল্টা করে বসলে, সেই চিন্তাতেই সে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তাই শেষমেশ দরজায় করাঘাত করল। ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তানিয়া আবারও ডাকল, ‘অতল ভাইয়া, দরজাটা খুলো প্লিজ।’
অতল এবারও সাড়া দিল না। তানিয়াও থামল না। সে ক্রমাগত দরজা ধাক্কাতেই থাকল। শেষ পর্যন্ত অতল ধমকে বলল, ‘এখন যা তুই। পরে কথা বলব।’
তানিয়া সাহস করে বলেই ফেলল, ‘ভাত খাবে না ভাইয়া?’
‘না।’ অতলের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
তানিয়া আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। মেহেরুন নাহার তানিয়াকে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘ওকে একটু সময় দে। এত বড়ো শক সে নিতে পারবে না আমি জানতাম!’ কথাটা বলেই তিনি আবারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন,’এত লুকিয়ে রেখেও কোনো লাভ হলো না। শেষমেশ ছেলেটা এইসব তিক্ত কথা জেনেই গেল।’
‘আমি জানি মা, এইসব কারসাজি আতিক ভাইয়ের। সেই এসব কিছু করেছে। আমি আতিক ভাইয়াকে কোনোদিন ক্ষমা করব না।’ কথাগুলো বলেই তানিয়া কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল।
___________________
অতলের সাথে কথা না হলেই ভীষণ অস্বস্তি আর অস্থিরতায় ভুগে বহ্নি। খুব কষ্ট হয় তার। দিনের মধ্যে বারংবার কল দিয়ে বিরক্ত করা ছেলেটা আজ সারাটাদিন এক বারের জন্যেও তাকে স্মরণ করল না-এটা ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরেটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছে বারেবারে! কোনোকিছুতেই তার মন বসছে না। তাই বই নিয়ে বসল সে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকেও মন বসছে না তার। অবশেষে মোবাইল হাতে নিয়ে ডাটা অন করে ফেসবুকে অযথাই স্ক্রল করতে শুরু করল। ডাটা অন করতেই মেসেজের টুংটাং আওয়াজ আসতে শুরু করল। অনেকদিন যাবৎ তার ফেসবুকে আসা হয় না। তাই অনেক মেসেজ ইনবক্সে জমা পড়েছে, রিকুয়েস্ট ও চ্যাক করা হয় না। তাই আজকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টগুলোও চ্যাক করতে শুরু করল। নীরার আইডিটা দেখে তাকে চিনতে কষ্ট হলো না কারণ আইডিতে তার একটা সুন্দর প্রোফাইল পিক দেওয়া আছে। সাথে সাথেই এক্সেপ্ট করল সে। এরপর ওর আইডি থেকে পাঠানো মেসেজটা চোখে পড়ল। কালবিলম্ব না করেই সে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পড়তে শুরু করল।
প্রিয় বহ্নি আপু,
একটা বিষয় তোমাকে জানানো খুব জরুরী মনে হলো। আসলে নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারছি না। রাদিদ ভাইয়ার পরিবর্তন দেখে অবাক হয়নি এমন কেউ আসলে নেই। তবে তার পরিবর্তনের পিছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা কারণ তুমি। হুম, আমি সত্যি বলছি। তোমাকে ভেবে ভেবেই ভাইয়া কত শত কবিতা লিখে ফেলেছে তার কোনো হিসেব নেই। তোমাকে ভেবে ভেবেই ভাইয়া উপন্যাস পর্যন্ত লিখে ফেলেছে। সবার অগোচরে যেমন তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল ঠিক তেমনি সবার অগোচরে এখনও কেবল তোমাকেই ভালোবাসে। তাই তোমাকে দেখলেই পালিয়ে বেড়ায়। তোমার চোখে চোখ রাখতে ভয় পায়। তুমি প্লিজ রাদিথ ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিও না। আইম জানি, আমি খুব অন্যায় আবদার করছি। তবে কী করি বলো তো, আমার ভাইয়ার কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। এই মানুষটা পরিবারের জন্য নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত নিজের কথা ভাবে না। একমাত্র তুমিই পারো ওর জীবনটা সুন্দর করে সাজাতে। প্লিজ, তুমি আমার রাদিদ ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিও না, প্লিজ।
ইতি
নীরা
মেসেজটা পড়ার পর থেকেই বহ্নি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। এটা কীভাবে হতে পারে তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। রাদিদ ভাইয়া তাকে ভালোবাসে? কই সে তো সেরকম কোনো কিছু লক্ষ্য করেনি তার মধ্যে! এটা যদি সত্যিই হয়ে থাকে তবে তার কি-ই-বা করার আছে? সে তো অপারগ! সে চাইলেও কিছু করতে পারবে না। এতোটা বছর ধরে কেউ কী করে এরকমভাবে ভালোবাসতে পারে! বহ্নি এক বিস্ময়ের মধ্যে ঢুকে গেল। তার চিন্তাশক্তি লোপ পেতে শুর করেছে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না!
____________________
বি.দ্র. বাচ্চারা না বুঝে ভুল করতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বরং পিতা-মাতা যখন সেই বাচ্চাদের অন্যায় কাজ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে কিংবা বাচ্চার অন্যায় কাজকে অন্যায় বলেই মনে করে না সেটাই অস্বাভাবিক। এতে করে তারা তাদের সন্তানদেরকে অন্যায় করার তথা দুর্বলের উপর অত্যাচার করার প্রশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে এক অঘোষিত অনুমতি দিয়ে দেয়। দুর্বল-সবল, ধনী-গরীব, সুস্থ-অসুস্থ, হিন্দু-মুসলিম, ক্ষমতাসম্পন্ন-ক্ষমতাহীন, নারী-পুরুষ, পাগল-সুস্থ মানুষ, সাদা-কালো সবকিছু নির্বিশেষে পৃথিবী নামক গ্রহে জীবন আছে, বোধশক্তি বর্তমান আছে , কিংবা আঘাতের কারণে বোধশক্তি লোপ পেয়েছে এদের সবার একটাই পরিচয়, এরা মানুষ। আপনি সবল বলে দুর্বলকে আঘাত করে বাহাদুরি প্রকাশ করতে চাইলে তাতে আপনার নৈতিকতার অবক্ষয় ব্যতীত অন্যকিছু প্রকাশ পায় না। বিশ্বাস করুন, এটাই সত্য। আপনি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বলে আপনি একজন পাগলকে বিরক্ত, উত্যক্ত কিংবা আঘাত করার লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন না কিংবা আপনার সন্তানও সেই লাইসেন্স পেয়ে যায় না। কে বলতে পারে বলুন, মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত কিংবা বোধশক্তি হারিয়ে আপনিও কিন্তু কোনো একদিন পাগল হয়ে যেতে পারেন! আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না, আগামীকাল আমাদের জীবনে কী হতে চলেছে!
সবচাইতে বেশি কষ্ট লাগে যখন দেখি–বাচ্চাদের সাথে বয়স্ক ব্যক্তিরাও এই ধরনের পাগল খ্যাত মানুষগুলোকে কষ্ট দেয়, উত্যক্ত করে! তাদের ব্যপারে আমার কিচ্ছু বলার নেই, সত্যিই নেই।
যখনই বাচ্চাদের এমন আচরণ করতে দেখবেন তখন তাদের বুঝিয়ে বলুন যে, সেও মানুষ, তারও অনুভূতি আছে, তারও কষ্ট হয়, তারও আহারের প্রয়োজন হয়। দেখবেন বাচ্চারা খারাপটাকে বর্জন করে ভালোটাকে গ্রহণ করবেই। বাচ্চারা তো সেটাই শিখবে যা আপনারা তাদের শেখাবেন। আপনাদের মৌনব্রত থাকাটা তাদের অন্যায় কাজে সম্মতি দেয়। তাই বাচ্চাকে অন্যায় করতে দেখলে চুপ করে থাকবেন না। এটা আমার অনুরোধ।
অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়াটা আমাদের স্বভাব। কিন্তু এতে তো আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব, তাই না? কে বলতে পারে, আজকের নির্যাতিত, নিপীড়িতের জায়গায় আগামীকাল আমার কিংবা আপনার অবস্থান হবে না!
আর পুরুষরা নারীর শরীর দেখলেই লালসা চরিতার্থ করার জন্য ঝাপিয়ে পড়বেন না। এটা পৃথিবীর সবচাইতে জঘন্য, নিকৃষ্ট, ন্যক্কারজনক কাজ। একবার নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করে দেখুন না। আমিও কীসব বলছি, বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষদের তো বিবেকই নেই, এরা প্রশ্ন করবেই বা কী করে! তবে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষরা তো প্রতিবাদ করতে পারে, তাই না? অন্য এক ভাইয়ের বোনের নিরাপত্তা আপনি দিলে আপনার বোনের নিরাপত্তা অন্য কোনো এক ভাই নিশ্চয়ই দেবেন।
দুর্বলকে মারার মধ্যে বীরতা নেই, এতে ভীরুতা ব্যতীত অন্যকিছু প্রকাশ পায় না। কে যেন বলেছিলেন, বন্দুক হাতে পেলে অসহায় প্রাণীটিও ঘাতক হয়ে উঠে! বন্দুক হাতে থেকেও বিনয়ী থাকাতেই আপনার উত্তম চরিত্রের প্রকাশ।
🌵এতসবকিছু বলার কারণ একটাই, এসব আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা। আমি দেখেছি একজন পাগলিকে মা হতে, আমি দেখেছি একজন পাগলিকে বাচ্চারা দলবেঁধে মিলে পাথর মারতে–পিতা-মাতা নির্বিকার!
আমি দেখেছি বোধশক্তিহীন পাগলিটাকে কাপড়-চোপড় ঠিক না করেই হেঁটে বেড়াতে। এদিকে তার গর্ভের সন্তানটি বেড়ে উঠছে তার গর্ভের ভেতরে কখনও শব্দে, কখনও বা নিঃশব্দে। কিন্তু পাগলি মা-টা কিছুই বুঝতে পারছে না, নিজের যত্নই নিতে পারে না, সন্তানের যত্ন নিবে কী করে? অবশেষে সেই পাগলি মাও হয়েছিল! তার সন্তান পৃথিবীর বুকে এসেছিল! কিন্তু ওই শিশুটি কখনোই জানতে পারবে না তার নরপিশাচ বাবাটা কে! সে কার লালসার ফল!
আমার জীবনে বাস্তবে দেখা এই পাগলি চরিত্রকে কেন্দ্র করে আমার একটা উপন্যাস আছে। জি, উপন্যাসটার নাম বলেই দিই, কী বলেন? মেঘদূত! হুম, উপন্যাসটার নাম হচ্ছে মেঘদূত। আর বাচ্চা মেয়েটার নাম হলো আশা!
________________
টিয়া যখন বাবার মুখে শুনল তার শিহরণ চাচ্চু নতুন বউ নিয়ে এসেছে তখন থেকেই গাল ফুলিয়ে বসে ছিল। তবে সেটা খুব বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। নতুন বউ দেখতে যাওয়ার তাগিদ নেই কারো মধ্যেই না দেখতে পেয়ে সে ভীষণ দুঃখ পেল। বাবা কিংবা মায়ের মধ্যে কোনো হেলদোল না দেখতে পাওয়ায় সে একটা পর্যায়ে কান্না জুড়ে দিল। সেই কান্না যেই সেই কান্না নয়, একেবারে গগণবিদারী চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল সে। অবশেষে আশফাক মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, ‘কাঁদে না মামুণি। আমরা এখনই যাব তোমার নতুন চাচিকে দেখতে।’
আমিরাহ বেশ কতক্ষণ হম্বিতম্বি করলেও সাজগোজ যথাসময়ে শেষ সম্পন্ন করে আশফাকের পেছন পেছন গাড়িতে উঠে বসল।
গন্তব্যে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই টিয়া বাবার কোল থেকে নেমে গেল। তারপরেই দিল ভোঁ দৌড়। আশফাক মেয়েকে দেখে গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আপাত দৃষ্টিতে সুখের সাগরে ভাসমান মনে হওয়া মানুষগুলোও বুকের গহীনে এক সমুদ্র বিষাদ নিয়েও হাসিমুখে ঘুরে বেড়াতে পারে। বাইরের চাকচিক্য কিংবা হাসি নামক মুখোশ তা প্রকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, বিষাদের নীলকে ঢেকে দেয় এক সমুদ্র খুশির চাদরে। যার দরুণ দুঃখী মানুষগুলোর বিষাদের নীলে গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করা হৃৎপিন্ড চারপাশের মানুষগুলোর নিকট অদেখাই রয়ে যায় চিরকাল।
বহ্নিকে দেখেই তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে
টিয়া আদুরে গলায় বলল, ‘আগুন, নতুন চাচি কোথায়?’
ছোঁয়ার সহাস্যে বলা কথাতে টিয়া খুব খুশি হয়ে গেল। তাই সে শিহরণের সেই কথার উত্তর না দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল, ‘চাচ্চুর সাথে রাগ করেছি আমি। আমাকে না জানিয়েই নতুন চাচিকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু চাচি খুব ভালো। খুব মিষ্টিও।’
আমিরাহ এক অদ্ভুত ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। এক মুহূর্তেই টিয়া ছোঁয়ার সাথে এভাবে মিশে যাওয়ায় তার খুব রাগ হলো। সে শিহরণের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘তো শেষমেশ এই মেয়েটাকে বিয়ে করলে। এই পঙ্গু মেয়েটার জন্য মান্নাতকে বিয়ে করোনি।’
শিহরণ বুঝতে পারল মান্নাতকে বিয়ে না করাতে ভাবির খুব রাগ তার উপর। তবে সে ভাবির রাগকে পাত্তাই দিল না। সবসময় সবকিছুকে পাত্তা দিতে নেই। কারণ কিছু মানুষ আজীবন ভুল করে বেড়ানোর প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে। আমিরাহ তাদের মধ্যে একজন।
আশফাক প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘অন্তত এখানে তোমার নিজের তামাশা বানিও না।’
আমিরাহের কথা শুনে ছোঁয়া মাথা নিচু করে ফেলল। চোখের কোণে অবাধ্য অশ্রুকণা এসে সিক্ত করতে করে দিতে চাইছে। ছোঁয়া প্রাণপণে তা আটকাল। ভেঙ্গে পড়ার মতো কিছুই হয়নি। তাছাড়া মানুষ সব থেকে বেশি কষ্ট পায় আপনজন অবহেলা করলে। আমিরাহ তার আপনজন নয়। তাই তার কথায় কষ্ট পাওয়া বোকামি বৈ কিছুই নয়। এমনই এক অন্তর্দ্বন্দ্বে পড়ে গেল ছোঁয়া। শিহরণ ছোঁয়ার হাত ধরে হালকা চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করল। এই আশ্বাসটুকুই তার দরকার ছিল। আর এতে সে নিজেকে খুব দ্রুতই সামলে নিতে পারল।
শিহরণ আশফাককে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থাক, ভাইয়া। সবার সব কথাকে পাত্তা দিতে হয় না।’
তারপর উৎফুল্ল কণ্ঠে ছোঁয়াকে বলল, ‘এই সেই ভাই। যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।’
ছোঁয়া বিস্ময় নিয়ে তাকাল আশফাকের দিকে। আশফাক অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, ‘আমার কথা আবার কী বলেছিস? আমার ব্যাপারে বলার মতো কিছু আছে না-কি?’
‘কী সব বলো না ভাইয়া?’ শিহরণ গর্বের সাথে বলল, ‘আমার ভাইয়ের ব্যাপারে বলার মতো অসংখ্য বিষয় আছে। এটা তো আমার ব্যর্থতা যে আমি ঠিকমতো কিছুই ব্যক্ত করতে পারি না।’
‘যথেষ্ট হয়েছে। আর অতিরঞ্জিত করার দরকার নেই।’ আশফাক নিজেকে প্রকাশে ভীষণ অনীহা প্রকাশ করল।
______________
রাদিদ নিজেকে খুব কষ্টে সামলে রেখেছে। দু’হাতই মুষ্টিবদ্ধ। দাঁতে দাঁতে চেপে রেখে নিজের রাগকে সংবরণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছে সে। আশফাককে দেখার পর থেকেই তার মেজাজ সপ্তমে চড়েছে। আশফাক শিহরণের সাথে কথা বলছে। রাদিদ সেদিকেই অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার ইচ্ছে করছে এখনি লোকটাকে মেরে মাটিতে লুটিয়ে দিতে।
হঠাৎ করেই বহ্নির চোখ গেল রাদিদের উপর। অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে। ভীষণ রাগান্বিত। কিন্তু রাগের উৎস কী হতে পারে তা সে ভেবে পেল না! তাছাড়া এরকম একটা পরিবেশে রাগ হবেই বা কেন? রাদিদকে সে এরকম দেখেনি কখনও। তাই সে কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে, রাদিদ ভাইয়া?’
এতক্ষণ যাবৎ চোখ-মুখ কুঁচকে রাখা রাদিদ দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুই হয়নি এমন ভাব করে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আমি ঠিক আছি। কিছুই তো হয়নি।’
‘কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে।’ বহ্নি জোর গলায় বলল, ‘তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে কারও উপরে ভীষণ ক্ষেপেছ!’
রাদিদ মুহূর্তেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আসলে মাথাটা একটু ধরেছে। অস্থির লাগছে। এক কাপ চা পেতে পারি?’
রাদিদের বলার ভঙ্গি দেখে বহ্নি হেসে ফেলল। বলল, ‘কেন পাবে না? আমি এখনই দিচ্ছি।’
বহ্নি চলে যেতেই রাদিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিড়বিড় করে নিজেকে প্রবোধ দেবার মতো করে বলল, ‘স্যরি, বহ্নি। তোকে মিথ্যে কথা বলতে হলো।’
__________
সবাই যখন গল্পে মশগল ঠিক তখন অতল বহ্নির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাগানে। বহ্নি তৎপর হয়ে বলল, ‘করছটা কী? বাড়িতে এত মানুষ দেখছ না?’
অতল বহ্নির কথা শুনেও যেন শুনল না। সে বাগানের একটা চেয়ারে বসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
‘আগুনমণি, আমার কেমন যেন লাগছে!’
রাদিদ যেই সুযোগটা খুঁজেছিল এতক্ষণ ধরে। সেই সুযোগটা শেষমেশ পেয়েই গেল। তার হাত মুষ্টিবদ্ধই আছে এখনও। যেন প্রাণপণে নিজের ক্রোধ, ক্ষোভ আটকে রেখেছে সে।
আশফাক ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র। তার কিছুই ভালো লাগছে না। ভীষণ কষ্টে কাটছে তার প্রতিটি মুহুর্ত। পছন্দের মানুষ সঙ্গী হলে জীবন যতোটা রঙিন হয়, অপছন্দের মানুষ সঙ্গী হলে জীবন ততোটাই রঙহীন হয়ে যায়। ঠিক যেন একটা বিবর্ণ রংধনুর মতো! আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তার। তবুও যেন সে কিছুই দেখছে না। পুরো অন্তরীক্ষে জ্বলন্ত সমস্ত নক্ষত্ররাজি যেন তার দিকে তাকিয়ে উপহাস করছে। নক্ষত্রের মিটিমিটি জ্বলতে থাকা যেন সেই উপহাসের নামান্তর।
‘এত বড়ো অন্যায়টা কেন করেছেন আপনি?’
হঠাৎ পেছন থেকে কারও আওয়াজ পেয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল একটা ছেলে তার দিকে মারমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ। যেন বহুকষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে।
আশফাক দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি আমাকে কিছু বলছ?’
‘এখানে আপনি ছাড়া তো আর কেউ নেই। তাই না?
‘তা নেই। তবে তোমাকে তো আমি চিনতে পারলাম না।’
‘মানুষ অন্যের উপরে অন্যায় করে তা ভুলে যেতেই ভালোবাসে। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।’
‘ঠিক বুঝলাম না। পরিষ্কার করে বলো তো।’
রাদিদ তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। তারপর গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে আশফাকের দিকে এগিয়ে দিল। আশফাক রাদিদের হাত থেকে মোবাইলটা প্রায় ছিনিয়ে নিল। সেই মুখ, সেই চোখ আবারও তার সামনে আসবে তা সে কখনও ভাবেনি। নীলার ছবি দেখে আশফাকের চোখের কোণে জল জমে গেল। সে ছবিটা দেখে ঘোরের মধ্যে চলে গেল। তারপর আচমকা মোবাইলটাকে বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ বুকের সাথে চেপে ধরে রাখল। এসব দেখে রাদিদের গা জ্বলে যাচ্ছে। সে বলল,’ এসব নাটক বন্ধ করুন তো। আপনার নাটকের কারণে আমার বোনের আজ করুণ অবস্থা।’
আশফাক একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকাল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির দিকে। তার গায়ে অ্যাশ কালারের শার্ট, ব্লু জিন্স। শার্টের হাতা ফোল্ড করে রাখা, বুকের সামনে তিনটে বোতাম খুলে রাখা। তবে চোখ দুটোতে সে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড দেখতে পাচ্ছে। যেন ধপ করে সেই অগ্নি জ্বলে উঠে ভস্ম করে দিবে সবকিছু।
আশফাক মনে করার চেষ্টা করছে তার অতীতের সমস্ত স্মৃতি। চোখ বন্ধ করে ভাবল সে কিছুক্ষণ। তারপর মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘নীলা তোমার কি হয়?’
রাদিদ মুখেতাচ্ছিল্যের হাসি দেখা দিল। সে তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল,’নামটা ভুলেননি তাহলে? পুরো মানষটাকেই তো ভুলে গেছেন নাম মনে রাখলেন কেন?’
‘হেঁয়ালি বাদ দিয়ে আমার কথার উত্তর দাও।’
‘আমার বোন হয়। এবার তো বলুন তাদের ছেড়ে নতুন বিয়ে করে সুখে শান্তিতে থাকার কারণ।’
‘তুমি কি রাদিদ? নীলার সেই পিচ্চি?’
রাদিদ অনীহা সত্ত্বেও বলল, ‘হুম, আমিই রাদিদ।’
আশফাক ডুকরে কেঁদে ফেলল। সহসা জড়িয়ে ধরল রাদিদকে। এই রকম একজন লোক এভাবে কাঁদতে পারে তা জানা ছিল না রাদিদের। সে না চাইতেও দূরে সরে গেল না।
আশফাক রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘নীলার জন্য এখনও আমার মন কাঁদে। ও এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তা আমি ভাবিনি, রাদিদ। তোমরা সবাই কেমন আছ? আম্মার স্বাস্থ্য কেমন আছে?’
রাদিদের রাগ যেন হুট করেই আবার বেড়ে গেল। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি আপনার এইসব সস্তা নাটক বন্ধ করুন তো। আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’
রাদিদ এতক্ষণ যাবৎ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। আচমকা সে আশফাকের বলা কথা খেয়াল করে বলল, ‘আপু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে মানে কী বলতে চাইছেন আপনি?’
আশফাক রাদিদকে ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘নীলার এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার কথা বলছি। আমি যখন তোমাদের খোঁজ করলাম তখনই জানতে পেরেছি। তবুও তোমাদের অনেক খুঁজেছি কিন্তু…!’
‘কীসব আবোল তাবোল বকছেন?’
‘কেন?’
‘আপু বেঁচে আছে।’
এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল আশফাককে পাথরের মূর্তির ন্যায় অবিচল করে দেওয়ার জন্য।
বেশ অনেকক্ষণ অতিবাহিত হবার পরে সে বলল, ‘নীলা বেঁচে আছে?’
‘আপু বেঁচে আছে। এখনও আপনার পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে সে। আর পিউ সে তো আপনার জন্য প্রতিটা দিন চিঠি লিখে। আপনার একটা মাত্র ছবি নিয়ে কত বায়না যে করে। অথচ আপনি তো দিব্যি ভালো আছেন। নতুন বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করছেন।’
‘এখন তো ভালোবাসার অভিনয় বন্ধ করুন। এখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ নেই। নিজে আসল রূপটা দেখাতে কেন ভয় পাচ্ছেন? কী হারানোর ভয় পাচ্ছেন। অর্থ-সম্পদ না-কি মান-সম্মান?’
আশফাক এবার সবকিছু বুঝতে পেরে বহুকষ্টে বলল, ‘কোনোটার ভয়ই আমি পাচ্ছি না। আমার বাবা-মা ষড়যন্ত্র করে আমাদের আলাদা করে দিয়েছে।’
তারপর হুট করেই রাদিদের হাত ধরে ফেলল আশফাক। ব্যথাতুর গলায় বলল, ‘আমাকে নিয়ে যাবে আমার নীলা আর পিউর কাছে। প্লিজ, আমি ওকে সবকিছু জানাতে চাই।’
‘জানিয়ে কি হবে বলুন তো? আপনি কি আমার বোনকে নিজের পরিচয় দিতে পারবেন? তাকে
সম্মান দিতে পারবেন? পিউকে বাবার পরিচয় দিতে পারবেন?’ রাদিদে কণ্ঠ উপচে পড়ছে এক সমুদ্র কষ্ট।
আশফাক রাদিদের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘সবকিছুই ফিরিয়ে দিতে পারব শুধু হারানো সময়টুকু ছাড়া। আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমি সবটা ঠিক করে দিব।’
_________
সবাই যখন নিজ গন্তব্যে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখন প্রিয় হুট করে সাইফের সামনে এসে দাঁড়াল। আচমকা এভাবে সামনে আসাতে সাইফ দু এক কদম পিছনে চলে গেল। প্রিয় হাঁপাতে হাঁপাতে অবাক বিস্ময়ে বলল, ‘আপনি প্রিন্স অফ ওয়েলস না?’
সাইফ এবার আরও অবাক হয়ে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কী?’
‘বাংলা বুঝেন না?’
‘কেন বুঝব না?’
‘তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন?’ প্রিয় বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, ‘আপনি কি প্রিন্স অফ ওয়েলস?’
সাইফ এবার প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে গেল। বলল, ‘সরেন তো। আপনি একটা পাগল। পাগলের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না।’
প্রিয় রেগেমেগে বলল,’কী! আমি পাগল?’
‘তা নয়তো কী?’
‘আমি বড়ো জোর পাগলি হতে পারি। পাগল কী করে হই বলুন তো?’ বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল প্রিয়।
সাইফ এবার হেসে ফেলল। কণ্ঠস্বর নম্র করে বলল, ‘আচ্ছা, বলুন কী বলতে এসেছেন?’
‘আপনার ধারণা ঠিক।’ প্রিয় কথাটা বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। হুট করেই সাইফের চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সাইফকে এবার আরও বেশি বিভ্রান্ত দেখাল। সে ভাবতেই থাকল। এই মেয়েটাই তাকে প্রপোজ করেছিল! তার চিনতে ভুল হয়নি।
_____________________
এত বছর পরে আশফাককে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীলা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। তার দম বন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির পরশ পেলে যেমন প্রকৃতির সতেজ হতে কিছু সময় লাগে নীলার ও বেশ কিছুক্ষণ সময় নেবে আশফাককে সামনে দেখার পর। এই বিষয়টা আশফাকের কাছে অজানা নয়। তাই সে বেশ কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নীলার ঘোর কাটার অপেক্ষা করতে লাগল। অনেক্ষণ পরে সে স্নিগ্ধ শীতল স্বরে বলল, ‘নীলু, আমি এসেছি।’
এতক্ষণ পরে নীলার ঘোর কাটল। আশফাক দু’হাত বাড়িয়ে দিল। নীলা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। সে ছুটে এসে আছড়ে পড়ল আশফাকের প্রশস্ত বুকে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল বিরহের তপ্ত স্রোতের ধারা, যা এতদিন রুদ্ধ ছিল, তার আজ বয়ে যেতে নেই কোনো বাধা।
সময় থেমে থাকে না, বয়ে যায় নিজ ছন্দে, নিজ প্রবাহে। সময়ের দ্রুততা কিংবা ধীরগামীতা সবটাই মানুষের অনুভূতি কেবল। সুখের অনুভূতিটুকু মানুষ সর্বক্ষণ অনুভব করতে চায় বিধায় তা দ্রুত বয়ে যায় বলেই ধারণা করে। আর দুঃখ কিংবা কষ্টানুভূতির সময়টুকু মানুষ যতটা দ্রুত সম্ভব কাটিয়ে উঠতে চায় বিধায় তা ধীরে কাটে বলেই ধারণা করে। অথচ দ্রুততা কিংবা ধীরতায় সময়ের কোনো হাত নেই। সবটাই অনুভূতিপ্রবণ মানুষের ধারণা।
আশফাক তার বলিষ্ঠ বাহু দ্বারা আবদ্ধ করে নিল নীলাকে। নীলা তার পরম আশ্রয় খুঁজে পেল অবশেষে। অশ্রুরও বাঁধ ভেঙ্গে গেছে, এই পরম সুযোগ লাভের কারণে। বেশ কিছুক্ষণ পরে নীলা দূরে সরে দাঁড়াল। ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলল, ‘কোথায় ছিলে এতদিন?’
আশফাক নীলার দু’বাহু ধরে বলল, ‘আমি জানতাম না তুমি আছ, নীলু! আমাকে মাফ করে দাও।’
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘বলব তোমাকে সবকিছু। আগে আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাই।’
ঠিক তখনই তিড়িং বিড়িং করে নাচতে নাচতে পিউ ঘরে ঢুকল। ঘরের মধ্যে অপরিচিত মানুষ দেখে মায়ের পেছনে লুকিয়ে বলল, ‘মা, এই আঙ্কেলটা কে?’
আশফাক ইশারায় পিউকে কাছে ডাকল। পিউ এক বিন্দু পরিমাণও নড়ল না। নীলা বলল, ‘তোমার বাবা, পিউ। বাবা ডাকছে তো, যাও।’
পিউ ভীষণ অবাক হলো। সে ঘরে ঢোকার আগে একটা দামী কার দেখে এসেছে। তাই সে বলে বসল, ‘বাইরের গাড়িটা কি আপনার?’
আশফাক মেয়ের বাচ্চামো দেখে হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ, মামুণি।’
‘ওটা আনতেই কি এত দেরি হয়েছে, বাবা?’
আশফাক মাথা নাড়ল। মৃদুস্বরে বলল, ‘হুম।’
পিউর চোখে-মুখে খুশি উপচে পড়ছে। সে তৎক্ষণাৎ দৌড়ে বাবার কোলে উঠল। বলল, ‘বাবা, আমরা কি প্রতিদিন গাড়িতে চড়ব? আমাকে তুমি প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাবে তো?’
বোনের আবেগ ভরা কণ্ঠে উপচে পড়া আনন্দ দেখে রাদিদ খুশি হলো কি না তা বোঝা গেল না। তাকে নির্বিকার দেখা গেল। আবির আর সাবরিনা অবাক হয়ে দেখছে। ফাইজা বেগম আশফাককে দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে গেলেন। রাদিদ তার মাকে সামলে নিল। শান্ত স্বরে বলল, ‘আগে সবটা শুনো, আম্মা।’
আশফাক বলল, ‘তোমার কথা বাবা-মাকে জানানোর পরে তারা না করে দিল। তখন আমি জেদের বশেই তোমাকে বিয়ে করে ফেলি। তারপর বাবা-মাকে আমাদের বিয়ের কথা জানালামও। আমি ভেবেছিলাম, বিয়ে করে ফেললে বাবা-মা আর কোনো আপত্তি করবে না। কিন্তু তাদের লোভটা ছিল উচ্চতর পর্যায়ের। তারা আমাকে সাফ জানিয়ে দিল তোমাকে মেনে নেবে না বলে। আমিরাহ তখন আমার জন্য পাগল প্রায়। ওর ফ্যামিলি আমাদের আত্মীয়ের মধ্যেই পড়ে। ধনী ঘরের মেয়ে হওয়ায় বাবা-মা আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন আমাকে আমিরাহকেই বিয়ে করতে হবে। কিন্তু বাবা-মায়ের কথাতে আমি কোনোভাবেই রাজী হলাম না। অবশেষে বাবা-মা দুজনেই আমার সাথে একটা গেম খেলল।’ একটু থেমে আশফাক ব্যাঙ্গাত্মক হাসল, ‘আমি বিশ্বাস করে ফেললাম। আমার লোভী বাবা-মাকে বিশ্বাস করাটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়াল। বাবা আমাকে বলল তারা তোমাকে মেনে নিবে। তবে কিছুদিন পরে একেবারে অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলতে চায়। বাবা আমাকে এটাও বলেছিল যে, তারা দুজনেই তোমার বাসায় আসবে। তবে তার আগে আমাকে একটা প্রজেক্টের জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। আমিও বোকা বনে গেলাম। আপনজনদের দেওয়া ধোঁকা মানুষ ধরতে পারে না, বিশ্বাসের স্তম্ভ সেখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে গেল। আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বাবা এতোটাই পাকাপোক্ত প্ল্যান করেছিলেন যে আমি ফ্লাইটে ওঠার আগে তোমার সাথে দেখাও করতে পারলাম না। তোমাকে জানাতেও পারলাম না কিছু। বাইরে থেকে আসার পরে বাবা আমাকে জানাল তুমি মারা গেছ এক্সিডেন্টে। আর তোমার পরিবার অন্য কোথাও চলে গেছে। আমি বাবার কথা বিশ্বাস করতে চাইনি। তোমাদের অনেক খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাইনি। তোমরা ছিলে না। আশেপাশের সবার মুখ বন্ধ করে দিল বাবা। আমিও এক সময় বিশ্বাস করে বসলাম, বাবার সজানো ঘটনা। যাদের কাছ থেকে আমি তোমার সম্পর্ক জানতে পারতাম তাদের সবার মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’
নীলার চোখে পানি। সে ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলল, ‘এর পরের ঘটনা আমি বলছি।’
সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে নীলার দিকে। নীলা বলতে শুরু করল, ‘বাবার অফিসে আগুন লেগে যাওয়ার খবর পেলাম মাঝরাতে। কিন্তু সেদিনই অফিসে পৌঁছানোর আগেই বাবার এক্সিডেন্ট হলো। খবর পেয়ে আমরা সবাই ছুটে গেলাম। বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করালেও বাবা আর ফিরলেন না আমাদের মাঝে।’ নীলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। রাদিদের একটা হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘তারপর থেকে আমার এই ছোট্ট ভাইটা তার জীবনের সমস্ত আনন্দ বিসর্জন দিয়ে আমাদের পরিবারের হাল ধরেছে। আমরা আশ্রয় নিলাম গ্রামের জরাজীর্ণ এই বিল্ডিং এ। এখানেও চাচা-চাচীরা হস্তক্ষেপ করেছিল। যার কারণে আমরা শুধুই উপরের এই ফ্লোরটাতে কোনোরকমে থাকছি। অন্য ফ্লোর চাচা দখল করে ফেলেছে। অথচ এইটাতে তাদের কোনো অবদান নেই। সমস্ত কিছু আমার বাবার কষ্টের উপার্জনে তৈরী। তবুও আমরা তা থেকে বঞ্চিত।’
ফাইজা বেগম নিঃশব্দে কাঁদছেন, কাঁদছে ছোট্ট পিউও। আশফাকের চোখ জোড়াও সিক্ত হয়ে উঠছে বারেবারে। আবির আর সাবরিনার চোখে কেবলই বিস্ময়, সেখানে অনুতাপ আছে কি না তা বোঝার উপায় নেই। রাদিদ মায়ের একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে।
নীলার চোখের পানি মুছে নিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘সবার জীবনই ঠিক আছে, শুধু আমার মায়ের বড়ো খোকার জীবনটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। আবির, সাবরিনা ওরা আমাদের নিজের রক্তের হয়েও আমার ভাইটার কষ্ট কোনোদিন বুঝল না। সবসময় ওকে আর আমাকে অবহেলা করেছে, আবহেলা করেছে আমার ছোট্ট মেয়েটাকেও। বন্ধুদের সামনে ওরা আমাদের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। তোমাকে খুঁজে না পাওয়ায় আমিও দুর্বল ছিলাম। নয়তো ওরা আমাদের কী পরিচয় দেবে? আমি নিজেই ওদের ভাই-বোন হিসেবে অস্বীকার করি। ওরা কোনোভাবেই আমাদের বাবা-মায়ের সন্তান হতে পারে না। রাদিদের বন্ধুরা সবাই কত ভালো ভার্সিটিতে পড়াশুনা করে কত শত ডিগ্রি অর্জন করেছে। অথচ আমার ভাইটা কোনোমতে একটা ডিগ্রি কলেজে পড়ে পড়াশুনা শেষ করল, তাও আমার আর মায়ের জোরাজুরিতে। এই রাদিদকে তার বন্ধুরা কেউ পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে না। অথচ তার নিজের ভাইবোন লজ্জা পায়।’ নীলা হাসল। তাচ্ছিল্য ভরা সেই হাসি।
রাদিদের চোখেও জল এলো। সে অশ্রু সংবরণ করে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আপা, এসব কী শুরু করেছিস? এসবকিছুই তোর ভুল ধারণা। বাদ দে তো ওসব কথা। ওরা দুজন আমাদেরই ভাই-বোন তা ভুলে গেলে চলবে না।’
নীলা বলল, ‘বাদ তো দেবই।’ আবির আর সাবরিনার দিকে জহুরি চোখে তাকিয়ে তাদের অভিব্যক্তি পরখ করে নীলা আবারও বলতে শুরু করল, ‘তবে ওদের কাছে একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই। একদিন তোরা আমার এই ভাইটার পরিচয় নিজেরা যেচেপড়ে সবার কাছে বলে বেড়াবি। কথাটা মনে রাখিস।’
রাদিদ আশফাককে ইশারা করল। নীলা তা দেখে বলল,’তোরা ইশারায় কী বলছিস?’
রাদিদ পিউকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘ভাইয়া তোকে সব বলবে। উনাকে তোর রুমে নিয়ে যা। আমি আর পিউ বাইরে থেকে ঘুরে আসছি।’
পিউ কান্নার সুরে বলল, ‘আমি বাবার কাছে থাকতে চাই বড়ো মামা।’
আশফাক বলল, ‘সত্যি বলছি। তবে আমাকে একটা কথা দিতে হবে তোমার।’
‘কী কথা?’
‘পিউকে যেমন ভালোবাসো ঠিক তেমনিভাবেই টিয়াকেও ভালোবাসতে হবে। মেয়েটা জানেই না মায়ের ভালোবাসা কী! ওর মা ওকে ভালোবাসে না।
পারবে না আমার ছোট্ট মেয়েটাকে মায়ের ভালোবাসা দিতে?’
নীলা মাথা নেড়ে বলল, ‘পারব। তুমি পাশে থাকলে আমি সব পারব।’
নীলার সম্মতিতে আশফাক স্বস্তি অনুভব করল। এতদিন ধরে বুকের উপরে চেপে থাকা পাথরটা সরে গেল। হয়তো তার জীবনে শুভদিন আসছে…।
ফাহমিদা বেগম মলিন মুখে সঙ্কোচ চিত্তে বসে আছেন। অশ্রুতে টলমল চোখজোড়ায় কৃতজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট দৃশ্যমান। বেশ কিছুক্ষণ দৃষ্টি নত রাখার পরে তিনি সাব্বির আহমেদের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালেন।
সাব্বির আহমেদ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছেন ফাহমিদা বেগমের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন শেষে ফাহমিদা বেগম শাড়ির আঁচলের খুটে চোখের জল মুছে বললেন, ‘ভাই, এটা যে আপনার মহত্ত। তবে এই অবস্থায় বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?’
‘এখানে কোনো মহত্ত্ব নেই আপা। মহত্ত্ব তো সেখানে থাকে যেখানে নিজের কোনো স্বার্থ থাকে না আমার তো স্বার্থ আছে। তাই না?’
ফাহমিদা বেগম অবাক হয়ে সন্ধিহান দৃষ্টিতে তাকালেন সাব্বির আহমদ দিকে। এই মুহূর্তে তাকে হতবিহ্বল দেখাচ্ছে। সাব্বির আহমেদ হেসে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। স্বার্থ আছে। তবে সব স্বার্থ ভয়ংকর হয় না। কিছু স্বার্থ মধুরও হয়। সেসব স্বার্থ রক্ষা করলে পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আমার ছেলের খুশিই আমার স্বার্থ।’ সাব্বির আহমেদ থামলেন। ফাহমিদা বেগমের বুক থেকে একটা ভারী পাথর যেন সরে গেল।
ফাহমিদা বেগম বললেন,’ঠিক বলেছেন, ভাই।’
সাব্বির আহমেদ পুনরায় বলতে শুরু করলেন, ‘ছেলে মেয়ে দুটোর পাগলামি সম্পর্কে তো নিশ্চয়ই জানেন। এই পাগল দুটো একসাথে না থাকলেই খারাপ হবে। এরা যত বেশি একসাথে থাকবে, ছোঁয়ার ভাল হবার চান্স তত বেশি বাড়বে।’ একটু থেমে মুচকি হেসে বললেন, ‘এই পাগল দুটো একে অপরের শক্তি স্বরূপ।’
ফাহমিদা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন তার সামনে বসা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষটির দিকে। তিনি মনে মনে ভাবছেন কী অসাধারণ তার বাচন ভঙ্গি, কী অসাধারণ তার চিন্তা-চেতনা! ছেলের অনুভূতিকে কী দারুণভাবেই না বুঝতে পেরেছেন। শিহরণের অনুভূতি কিংবা ছোঁয়ার প্রতি তার ভালোবাসা ফাহমিদা বেগমের চোখ এড়ায়নি। শিহরণ যে মাঝেমধ্যে ছোঁয়ার সাথে দেখা করতে আসতো তা তিনি জানতেন। তবে তাদের বুঝতে দিতেন না। এই ছেলেটার উপর তার কেন যেন কখনও অবিশ্বাস জন্মেনি। ছোটো থেকেই তো দেখেছেন। পার্থক্য শুধু একটাই তখন তার দেখার নজর ভিন্ন ছিল, বিচার করার মানদণ্ড ছিল অতি নিম্নমানের!
সাব্বির আহমেদ বাম হাতে পরে থাকা ঘড়িতে সময় দেখলেন। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনার মতামত তো জানা হলো না। আপত্তি থাকলে বলুন। পারস্পরিক সমঝোতায় সমাধানে আসা যাবে।’
‘কীসের আপত্তি ভাই!’ ফাহমিদা বেগম লজ্জাবনত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনার ঘরে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে পারা তো আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।’
‘নিজের মেয়ে’ শব্দটা কানে বাজতে থাকল ফাহমিদা বেগমের কানের কাছে। তিনি পরক্ষণেই ভাবলেন সবকিছু জানানো উচিত। পরে কোনো সমস্যা হোক তা তিনি চান না। অপরাধীর ভঙ্গিতে তিনি বললেন,’ছোঁয়া কিন্তু আমার নিজের মেয়ে নয়।’
সাব্বির আহমেদ স্মিত হেসে বললেন, ‘বিষয়টা খুব গোপনীয় কিছু নয়। এই বিষয়টা আমার কাছে অজানাও নয়। যেহেতু ওর মা বেঁচে নেই তাই এখন আপনিই ওর মা। আর ও আপনার নিজের মেয়ে। এই তথ্য প্রকাশে কোনো প্রকার সঙ্কোচ করবেন না।’
ফাহমিদা বেগম বললেন, ‘আপনার কাছে ঋণী করে গেলেন। আপনার এই ঋণ কখনো ভুলব না।’
‘এইটা কিন্তু বাড়াবাড়ি বেয়ান। আপনাকে একটু আগেই তো বলেছি স্বার্থ আমার আছে। যেখানে স্বার্থ থাকে সেখানে ঋণী হবার সুযোগ নেই।’ স্মিত হাস্যে আবারও বললেন, ‘ভালোবাসাহীন জীবন ধুকে ধুকে মরে যাবার শামিল। আমি চাই না আমাদের সন্তানরা ধুকে ধুকে মরুক।’
_____________
শিহরণ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘প্রিয়তা, আমরা শীঘ্রই আমাদের কাঙ্ক্ষিত বৈধ সম্পর্কর বাঁধনে আবদ্ধ হতে চলেছি।’
শিহরণের মুখ থেকে খবরটা শুনে ছোঁয়ার চোখ জোড়া ক্ষণিকের জন্য খুশিতে চকচক করে উঠলেও পরক্ষণেই সে বেঁকে বসল। তেজী গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না শিহরণ।’
কথাটা বলেই ছোঁয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
শিহরণ অবাক হল না। এইটা চরম প্রত্যাশিত ছিল। এই কঠিন পরিস্থিতিতেও সুযোগ পেয়ে সেও একটু মজা নিতে ভুল করল না। সে দুঃখী ভাব নিয়ে বলল, ‘বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ করার জন্য তো আমি তোমাকে জোর করতে পারব না। তোমার পরিবর্তে অন্য কাউকেই না হয় নিজের সঙ্গী বানিয়ে নেব। আব্বুর ফাইনাল ডিসিশন বলে কথা। মানতে তো হবেই।’
ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ মুখটা শিহরণের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে শিহরণের দিকে তাকাল। শিহরণ ততক্ষণে মুখটা গম্ভীর করে ফেলেছে। ছোঁয়া জহুরি চোখে পরখ করছে তার সামনে বলিষ্ঠভাবে বসে থাকা ছেলেটির সবুজাভ চোখ জোড়া। সেই চোখ জোড়াতে কৌতুকের ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে না পেয়ে সে মুখটা আবার ফিরিয়ে নিল। ব্যথাতুর গলায় বলল, ‘তোমাকে কে বেঁধে রেখেছে? যাও যাকে খুশি তাকে বিয়ে করো। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। ব্যস, আমার কথা শেষ।’
ছোঁয়ার কথা শুনে শিহরণ হাসছে। হাসতে হাসতেই বলল, ‘সকাল থেকে পেটে নিশ্চয়ই কিছু পড়েনি। তাই মেজাজ চড়ে গেছে। তাই না?’
ছোঁয়া উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। শিহরণ বেড উঁচু করে তার চোখ বরাবর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘আমি তোমার ভালোবাসা পেয়েছি, এবার সম্পূর্ণ তোমাকে চাই, তোমার উপর আমার অধিকার চাই।’
ছোঁয়া শিহরণের চোখে চোখ রাখছে না। ও চোখেই তো তার সর্বনাশ হয়েছিল, সেই স্কুল জীবন থেকেই। আবার সেই চোখের দিকে তাকালে সে যে তার এই করুণ পরিস্থিতিতেও নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। শিহরণ ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘আমার চোখের দিকে তাকাও, প্রিয়তা।’
ছোঁয়া মুখটা কোনোভাবেই সোজা করছে না। শিহরণ এবার ব্যাথাতুর গলায় বলল, ‘এখন বুঝি এই চোখের প্রতিও তোমার বিতৃষ্ণা চলে এসেছে? একটা দুর্ঘটনা এক মুহূর্তেই সব পরিবর্তন করে দিয়ে গেল! আমাদের এত বছরের ভালোবাসা কি তবে এতোটাই ঠুনকো ছিল?’
ছোঁয়ার চোখ জোড়া অশ্রুতে টলমল করছে। সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। বুক চিরে হাহাকার বেরিয়ে এলো। কান্না ভেজা গলায় বলল,’আমি আর হাঁটতে পারব না, শিহরণ। প্লিজ এক্সেপ্ট দ্যা ফ্যাক্ট।’
‘আই ডু, প্রিয়তা।’ শিহরণ চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ঠুনকো নয় যে তোমার হাঁটতে না পারার করণে তা কর্পূরের মতো উবে যাবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার হাঁটার ক্ষমতা দেখে তো তোমাকে ভালোবাসিনি কিংবা তোমার সৌন্দর্যের মোহেও পড়িনি।’
শিহরণের হাতে টিফিন বক্সটা দিয়ে বহ্নি বলল, ‘ভাইয়া, ভাবির জন্য আমি নিজের হাতে স্যুপ বানিয়েছি। তুমি খাইয়ে দিও।’
শিহরণকে কথাটা বলেই বহ্নি বেরিয়ে গেল। তার অতলের সাথে দেখা করা দরকার। এই ছেলেটা ভীষণ আবেগী। যত্তসব বায়না সব তার কাছে। কে বলবে এই ছেলেটা যে এখনও বাচ্চাদের মতো অভিমান করে তার সাথে। বহ্নি জানে, ছোটোবেলা থেকে আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছেলে-মেয়েরাই বড়ো হয়ে যখন কারও কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পায় তখন তারা আরও একটু ভালোবাসা পাবার জন্য নানান ধরনের বায়না করে থাকে। একদম বাচ্চাদের মতো। কেননা তাদের ছোটোবেলার সেই বাচ্চামো টাইপ আচরণ প্রস্ফুটিত হতে বাঁধা পাওয়ায় তা অসময়ে এসে প্রকাশিত হয়। বহ্নির অতলের করা সমস্ত পাগলামি ভাল লাগে। অতল তার জন্য এক আকাশ ভালোবাসা, এক সমুদ্র নীল জলে। যেখানে সে নিঃশব্দে ডুবে যাচ্ছে। যেখানে ডুবে যেতে তার নেই কোনো আক্ষেপ, নেই কোনো দ্বিধা। সেখানে আছে কেবলই ভালোলাগা আর ভালোবাসার সংমিশ্রণের এক গভীর ভাবাবেগ, এক সুগভীর অনুভূতি। বহ্নি অতলের অতলেই তো থাকতে চায়!
ছোঁয়া এই সম্বোধনে লজ্জা পেল। সে লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?’
সাব্বির আহমেদ রসিকতা করে বললেন, ‘তোমাদের বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমার ভাল থাকা হবে না, বউমা।’
সাবিহা সাবরিন খুব ভাল করে জহুরি চোখে পরখ করছেন ছোঁয়াকে। ছোঁয়ার এই অবস্থা দেখে তিনি মনে মনে কষ্ট পেলেন কিন্তু মেয়েটাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না, হয়তো পারবেনও না। হয়তো তাই তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আছেন স্বামীর উপর। এরকম হাঁটতে পারার সম্ভাবনা না থাকা একটা মেয়েকে কোন আক্কেলে যে ছেলের বউ বানাচ্ছে তা তিনি কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছেন না।
_____________________
সাব্বির আহমেদ ভেবেছিলেন ছোঁয়া পুরোপুরি হাঁটতে পারলে তখনই অনুষ্ঠান করা হবে, আপাতত বিয়েটা হয়ে যাক। এত তাড়াহুড়ো করার পেছনে অবশ্য বিশাল একটা কারণও আছে।
তখন তিনি শান্ত কণ্ঠে সাবিহা সাবরিনকে জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমি আমার বউমাকে যত দ্রুত সম্ভব ঘরে তুলতে চাই। ছেলেকে এভাবে দেবদাসের মতো ঘুরে বেড়াতে দেখতে কোনো বাবা-মায়ের কি ভালো লাগতে পারে, সাবিহা?’
শিহরণ আর ছোঁয়ার বিয়ের কথা শুনে তাদের বন্ধুরা সবাই দারুণ খুশি হলো। সাব্বির আহমেদ কোনো প্রকার আয়োজন ব্যতিরেকে বিয়ে সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। তবে শিহরণ আর ছোঁয়ার বন্ধুরা তা মানল না। তারা সবাই মিলে ছোটোখাটো একটা আয়োজনও করে ফেলল তারা নিজ থেকেই। অদ্ভুত একটা বিয়ে হওয়ার কারণেই হয়তো সবার মধ্যেই উৎসাহ অনেক বেশি। হাসপাতালেই বিয়ের আয়োজন করা হলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করা কঠিন কিছুই ছিল না সাব্বির আহমেদের জন্য। তবে, ছোঁয়ার বিয়েতে ডাক্তার আর নার্সরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিল। পুরো হাসপাতাল জুড়ে একটা ধুম পড়ে গেল। কৌতূহলী চোখের শেষ ছিল না। তবে কোলাহল এড়িয়ে চলার নির্দেশনা ছিল। ছোঁয়ার কেবিনের মধ্যেই সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়ে গেল। সকলের মধ্যেই দারুণ উচ্ছ্বাস।
সবচাইতে অধিক উৎসাহী মনে হলো অতল আর বহ্নিকে। রাদিদ সবকিছুতে থেকেও যেন নেই। তার কারণ দুটো। এক. তার এতদিনের কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা পেয়েও হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া। দুই. বহ্নি আর অতলের মাঝের খুনসুটি এখন স্পষ্ট দৃশ্যমান। এই জিনিসটা রাদিদের মনকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। তবুও সে নিজেকে প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করছে। এটা তো তাকেই করতেই হতো।
বহ্নি আর অতল হেসে হেসে তার সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলছে। অতলকে এভাবে প্রফুল্ল দেখে তার ভীষণ ভাল লাগছে। রাদিদ মনে মনে ভাবল, ‘বহ্নি সত্যিই হয়তো জাদু জানে। বিধ্বস্ত অতলকে অন্ধকারের অতল থেকে ঠিক টেনে তুলল। ভালোবাসার মায়াজালে আটকে তার কষ্ট ভুলিয়ে দিল। তাকে হাসতে শেখাল।’ এক অন্যরকম ভালোলাগায় ছেয়ে গেল রাদিদের মন। পরক্ষণেই সে বিড়বিড় করে বলল, ‘ওহে প্রিয়া, তুই কি তবে জাদুনগরীর রাজকন্যা? একবার সেই জাদুর কাঠি আমায় স্পর্শ করিয়ে দে না, আর ভুলিয়ে দে আমায় আমার হৃদয় মন্দিরের প্রাঙ্গণে তোর লাগি স্তুপাকাকারে জমানো সমস্ত ভালোবাসা।’
বহ্নি কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। অতল এসে তাকে উদ্ধার করল। বলল, ‘ওই তোর মন্ত্র পড়া লাগবে ক্যান? আমার আগুনমণিকে আমি কবুল বলে নিজের করে নেব।’ কথাটা শেষ করেই অতল মুগ্ধ চোখে তাকাল বহ্নির দিকে।
রাদিদ কয়েকবার মুখ খুলল আবার বন্ধ করল। কিন্তু বলার মতো কোনো কথাই সে খুঁজে পেল না। অবশেষে সেখান থেকে সরে দাঁড়াল। ভীষণ অসহায় বোধ করছে সে।
পৃথিবীর সবাই ভালোবাসা পায় না। নশ্বর এই পৃথিবীতে সবার সব চাওয়া পূর্ণতা পায় না। কিছুকিছু মানুষের ভালোবাসা পূর্ণতা না পেয়েও অবিনশ্বর হয়ে থাকে। রাদিদের ভালোবাসা না হয় সেই না পাওয়ার দলেই থাকল। ক্ষতি কী তাতে?
রাদিদ নিজেকে প্রবোধ দিল। অথচ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটার প্রতি সে দুর্বার আকর্ষণে বারেবারে মোহিত হয়, বারেবারে এই অধরা মানবীর প্রেমে পড়ে!
রাতের দিকেই কাজী ডেকে আনা হলো। কোনোপ্রকার আনুষ্ঠানিকতা ব্যতিরেকেই অনাড়ম্বরভাবে ছোঁয়া আর শিহরণের বিয়েটা হয়ে গেল। তবে ছোঁয়াকে আরও বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার নির্দেশ দিয়েছে ডাক্তার।
কবুল বলার সময় এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ছেয়ে গেছে ছোঁয়ার মন। সে কখনোই ভাবেনি, এভাবে তার বিয়ে হবে। তবুও সে আজ ভীষণ খুশি। সবুজাভ চোখ আর ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা যাকে সে চোরাচোখে দেখেই মনে মনে চেয়ে এসেছে, যার নামে হৃদয়ের মধ্যেখানে ভালোবাসার প্রাসাদ বানিয়েছে, সেই ছেলেটা এখন তার নিজের একান্ত আপনজন। এই ভাবনা ভাবতেই তার মনের মধ্যে ভালোলাগার প্রজাপতিরা গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করল যেন। কবুল বলার সময় চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল নির্দ্বিধায়, প্রাপ্তির আনন্দে।
শিহরণ সেই যে ছোঁয়ার হাত ধরেছিল, এখনও ছাড়েনি। মনে মনে সে বাবার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ। আজ সে একটা অধিকার লাভ করেছে, একটা বৈধ অধিকার। এই মুহূর্তে নিজেকে আর ছোঁয়াকে তার আলাদা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে তারা যেন ভিন্ন দুটি দেহের এক ও অভিন্ন সত্তা।
খুব সাদাসিধে সাজে বধূ সাজানো হয়েছে ছোঁয়াকে। লাল বেনারসি, মুখে হালকা ক্রিম, চোখে কাজল আর চুল বাঁধা ছাড়া অতিরিক্ত কোনো প্রসাধন বা জাঁকজমক নেই। তবুও এই সাজেই তাকে দেখতে অপরূপা লাগছে, শিহরণের কাছে। ভালোবাসার সবচাইতে বড়ো সৌন্দর্য হয়তো এটাই যে, ভালোবাসা দৃষ্টির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দেয়। ভালোবাসার মানুষ যেমন তাকে তেমনিভাবেই গ্রহণ করার সাহস যোগায়। ছোঁয়ার হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এমনই আকাশ পাতাল ভাবছিল শিহরণ। তার কেন যেন এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ছোঁয়া এখন তার, শুধুই তার।
মায়া শিহরণের কাণ্ড দেখে হেসে বলল, ‘শিহরণ, ছোঁয়াকে কেউ নিয়ে যাবে না তো। সে তোমারই ছিল, তোমারই আছে, তোমারই থাকবে।’ একটু থেমে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,’ফাইনালি, তোদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল। আ’ম সো হ্যাপি ফর বোথ অফ ইউ।’
সাইফ কী বলবে ভেবে পেল না। সে মুখ হাসি হাসি করে দাঁড়িয়ে আছে। মোহনা ছোঁয়াকে বলল, ‘ছোঁয়া, ইউ আর ভেরি লাকি টু হ্যাভ সাচ আ লাইফ পার্টনার লাইক শিহরণ।’
ফাহমি মোহনার সাথে সুর মিলিয়ে বলল, ‘আই এগ্রি উয়িথ ইউ।’
প্রিয়র কথায় সবাই হেসে ফেলল। বহ্নি কাছে এসে বলল, ‘আমি প্রিয় আপুর সাথে একমত।’
অতল আর রাদিদও প্রিয়র কথায় সম্মতি জানাল। অতল বলল, ‘তাহলে কি এখন থেকেই তোমাকে ভাবি ডাকা শুরু করে দেব আমরা?’
বহ্নি সহাস্যে বলল, ‘আমি তো আরও আগেই শুরু করে দিয়েছি।’ তারপর শিহরণের দিকে তাকিয়ে বলল,’ভাইয়া মনে আছে তোমার? ছোঁয়া আপুকে ভাবি ডাকার কারণে আরাভ আমার সাথে ভীষণ রাগ করেছিল। পরে কোনোমতে বুঝালাম যে, তার বউ হলে সে তো আমার ভাবিই হয়। এটা বলার পরে তার রাগ কমল।’
বহ্নির কথা শুনে সবার মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। একজন নার্স এসে তাদের নিষেধ করতেই সকলে থেমে গেল। হিয়া ছোঁয়ার পাশে বসে বলল, ‘আ’ম সো হ্যাপি ফর ইউ, ছোঁয়াপু।’
অহনা ছোঁয়ার অপর হাতটা ধরে বলল, ‘আমারও খুব ভাল লাগছে তোমার জন্য আপু।’
হিয়া আর অহনা দুজনেই শিহরণকে বলল,’আমাদের আপুর যাতে কোনো কষ্ট না হয়। চকোলেট বয়, ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব এখন থেকে আপনার।’
শিহরণ হেসে ফেলল। বলল, ‘চকোলেট বয় বলে সম্বোধন করলে তো চলবে না, শালিকা মহোদয়ারা। এখন তো সম্বোধন পরিবর্তন করতেই হবে।’
ফাহমিদা বেগম কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন,’এখন থেকে আমার মেয়েটার সমস্ত দায়িত্ব তোমার বাবা। ওকে দেখে রেখো।’
শিহরণ মাথা নেড়ে সায় দিল। রুদ্ধশ্বাসে বলল,’আপনি বিশ্বাস করতে পারেন আমায়। আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা হবে না।’
সাব্বির আহমেদ এসে সবাইকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দেওয়াতে সকলের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ল। তিনি ছোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বউমা, আমার পাগল ছেলেটাকে বলো যে এত চিন্তা করার কিছু নেই। তোমাকে কালকেই ডিসচার্জ করে দিবে। রিস্ক নেই। একেবারে শ্বশুরবাড়িতে থেকেই তোমার ট্রিটমেন্ট নেওয়ার ব্যবস্থা করে এসেছি।’
হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ পাওয়ার পর ছোঁয়াকে শিহরণের বাসায় নিয়ে আসা হলো। ছোঁয়া কম্পিত বুক নিয়ে প্রথম পদক্ষেপ ফেলল তার সবচাইতে প্রিয় মানুষটির ঘরে। শিহরণের রুমেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট ঠিক করা হয়েছে তার চিকিৎসার জন্য।
ছোঁয়া আসার পর থেকে সাবিহা সাবরিন তার সাথে একটা কথাও বলেননি। সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে চলেছেন তিনি। এই উপেক্ষা বুঝতে ছোঁয়ার কষ্ট হলো না। তাই বিষণ্ন মুখে ব্যালকনিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। শিহরণ পাশে এসে বসে বলল, ‘আমি জানি আমার প্রিয়তার মন খারাপের কারণ।’
ছোঁয়া তার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করল, ‘কী কারণ?’
শিহরণ তার পাশে বসে স্মিত হেসে বলল, ‘ আম্মুকে নিয়ে চিন্তা করো না। আম্মুর অভিমান হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে তোমার ভালোবাসার উষ্ণতা পেলে সেই অভিমানের বরফ ঠিক গলে যাবে।’
ছোঁয়া কৃতজ্ঞচিত্তে তাকাল শিহরণের দিকে। এই অসাধারণ চিন্তার ছেলেটি এখন তার স্বামী, তার একান্ত আপনজন। এই ভাবনা হৃদয়ে প্রশান্তির পরশ দিয়ে যাচ্ছে। শিহরণ হুট করেই ছোঁয়ার কপালে তার ভালোবাসার পরশ ছুঁয়ে দিল। ছোঁয়া চোখ বন্ধ রেখে পরম আবেশে ঠিক সেইখানটাতে চেপে ধরে রাখল বেশ কিছুক্ষণ।
শিহরণ তখন মুচকি হেসে রসিকতা করে বলল, ‘তুমি চাইলে আমি ঠিক ওইখানটাতে আমার অধরদ্বয় চেপে রাখতে পারি। আমার অবশ্য কোনো অসুবিধা হবে না। বরং ভীষণ ভালো লাগবে। তুমি শুধু অনুমতি দিলেই হবে।’
ছোঁয়া লজ্জা পেয়ে হাত নামিয়ে ফেলল। তারপর লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘মুখে কি কিছু আটকায় না তোমার?’
‘আটকাবে কেন?’ শিহরণ ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমার বউয়ের কাছে কোনো কিছুই গোপনীয় থাকবে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গোপনীয়তা শোভনীয় নয় প্রিয়তা।’
শিহরণ তার চেয়ারটা ঘুরিয়ে ছোঁয়ার আরও একটু কাছে টেনে বসল। সে ছোঁয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘যেদিন তুমি পায়ে হাঁটতে পারবে সেদিন আমরা দুজন ছাদে জ্যোৎস্না বিলাস করব এবং সেদিনই হবে আমাদের দুজনের একসাথে চলার প্রথম রজনী। আমার এই সিদ্ধান্তে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?’
ছোঁয়া কী বলবে ভেবে পেল না। শুধু করুণ চোখে তাকিয়েই থাকল শিহরণের সবুজাভ চোখের দিকে।
শিহরণ শান্ত স্বরে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আকাশের বুকের এই চাঁদের আলো সাক্ষী সেইদিনটা আমাদের জীবনে আসবে এবং তা খুব শীঘ্রই। তুমি শুধু বিশ্বাস রেখো। মনের জোর রেখো।’
ছোঁয়া শিহরণের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। তার চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রু মুক্তোর মতো চিকচিক করছে। শিহরণ তা খুব যত্নের সাথে নির্দ্বিধায় মুছে দিল। ছোঁয়া শিহরণের কাঁধে মাথা রাখল। চাঁদের রুপালি আলো ঠিকরে পড়ছে তাদের অঙ্গে।
অবশেষে এই নিস্তব্ধ রাত্রিতে পূর্ণ চাঁদের রুপালি আলো গায়ে মেখে দুজন কপোত-কপোতী তাদের অনাগত ভবিষ্যতে এক বিশুদ্ধ প্রেমের আখ্যান রচনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো।
________________
শিহরণদের পুরো বাড়ি জুড়ে কোলাহলের আমেজ। খুব সাদামাটা বিয়ে হলেও শিহরণের বন্ধুরা সেই সাদামাটা ভাবটা একদম ভ্যানিশ করে দিয়েছে। সাবিহা সাবরিন কোনোভাবেই সহজ হতে পারছেন না ছোঁয়ার সাথে। তিনি ফরমাল কথাবার্তা ছাড়া আর কোনো কথাই বলেননি ছোঁয়াকে। সেটুকুও সাব্বির আহমেদের জোরাজুরিতে করেছেন।
ছোঁয়া সোফায় বসে ছিল, শিহরণ তার পাশেই তার হাত ধরে চুমটি মেরে বসে আছে আর সকলের কাণ্ড দেখে হাসছে। ফাহমি হুট করে এসেই বলল, ‘তুই তো দেখছি বউ পাগলা রে শিহরণ। সেই যে হাত ধরেছিস, ছাড়ার নাম নেই। মনে হচ্ছে হাত ছাড়লেই অন্য কেউ এসে নিয়ে যাবে তোর বউকে।’
শিহরণ ও কম যায় না। সেও বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘হাত তো ছাড়ার জন্য ধরি নাই রে দোস্ত। আর তোদের বিশ্বাস নাই, নিয়ে ও তো যেতে পারিস।’
প্রিয় এই সুযোগটা ছাড়তে চাইল না। সে ফাহমিকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘বাব্বাহ! ভূতের মুখে রাম নাম। তুই নিজেই তো মোহনার সাথে ফেবিকলের মতো চিপকাইয়া থাকিস। আবার আসছিস আমার বন্ধুরে খোঁচা মারতে।’
ফাহমি মারমুখো হয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘এই প্রিয়র বাচ্চা! আমি তোর বন্ধু না? খালি কি শিহরণ তোর বন্ধু? আমার আর শিহরণের মধ্যে তুই ক্যান কথা বলতেছিস? আমার বন্ধুরে আমি যা ইচ্ছা তাই বলব। তোর কোনো সমস্যা?’
‘সত্য কথা বললেই সব দোষ প্রিয়র, হুহ্!’ প্রিয় মুখ ঝামটা মেরে বলল।
মায়া, সাইফ আর মিষ্টি মিলে সবাইকে খাবার সার্ভ করছিল। প্রিয় আর ফাহমি ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু করে দেয়ায় সে এসে তাদের দুজনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বলল, ‘আরে থামো তোমরা। কী শুরু করেছ?’ তারপর কোল্ড ড্রিঙ্কসের দুইটা গ্লাস দু’জনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’ধরো, ঠান্ডা খেয়ে আগে মাথা ঠান্ডা করো।’
ফায়াজ শিহরণ আর ছোঁয়াকে অভিনন্দন জানানোর পরে সাব্বির আহমেদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। কথা শেষ করার পর থেকেই সোফায় চুপ করে বসে আছে। মায়ার শান্ত স্বভাব দেখে তার খুব ভালো লাগছে। তাকে সবকিছু খুব সুন্দর করে সামলাতে দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। এক পর্যায়ে সে প্রিয়কে ডেকে বলল, ‘প্রিয়, মেয়েটা কে রে?’
প্রিয় চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে বলল, ‘কোন মেয়েটা?’
ফায়াজ প্রিয়র ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুরানোর ব্যাপরটা বুঝে ফেলল। সে বলল, ‘ওই যে তোকে একটু আগে যে মেয়েটা ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করল সেই মেয়েটার কথা বলছি।’
প্রিয় কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ওহ্ হো, খুব মনে ধরেছে নিশ্চয়ই?’
ফায়াজ চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘প্রিয়!’
‘ওহ্, স্যরি ব্রো। ও হচ্ছে মায়া। ছোঁয়ার বেস্টি।’
ফায়াজ তখন বিড়বিড় করে বলল, ‘মেয়েটা
দেখতে ভীষণ মিষ্টি।’
‘আরে ভাইয়া মিষ্টি তো শিহরণের বাসায় কাজ করে। শেষমেশ বুঝি তোমার ওকে পছন্দ হলো?’
ফায়াজ এবার রেগে গিয়ে বলল, ‘তুই এখনও সেই বেয়াদপের হদ্দ-ই আছিস তাহলে! একটুও বদলাসনি।’
প্রিয় অনুতপ্ত হবার ভান করে বলল,’অনেক বেশিই বদলে গেছি। তুমি তো আমার ভালো গুণগুলো চোখেই দেখো না। সে যাই হোক, মায়া শুধু দেখতে না সে খেতেও মিষ্টি।’
‘কী!’ ফায়াজ মৃদু চিৎকার করে বলল, ‘কী যা তা বলছিস?’
প্রিয় কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি বলতে চাইছি মায়ার কথাও তার মতো মিষ্টি।’
কথা শেষ করেই সে ফায়াজের পাশে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ধূমকেতুর মতো হুট করেই গায়েব হয়ে গেল ফায়াজের সামনে থেকে।
ফাহমির সাথে গলায় গলায় ঝগড়া করার সময় প্রিয়কে এক ঝলক দেখছিল সাইফ। মেয়েটাকে এক ঝলক দেখার পর থেকেই তার মনে হলো সে এই মেয়েটাকে আগে কোথাও দেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরে তার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ার পর থেকেই সে তার মধ্যে এক ধরনের উৎসুকতা টের পেল। প্রিয়র সাথে কথা বলার উৎসুক ভাব নিয়ে নিজেকে আটকে রাখা তার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। তাই সে প্রিয়কে চোখে চোখে রাখছে। এই মুহূর্তে প্রিয়কে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে যেতে দেখে সে প্রিয়র পিছু নিল।
হঠাৎ করেই প্রিয় পেছন ফিরতেই সাইফকে দেখে বলল, ‘কী ব্যাপার? পেছন পেছন আসছ কেন? অনেকক্ষণ আগে থেকেই লক্ষ্য করছি তুমি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছ। ভেবেছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ পরক্ষণেই কোমরে হাত রেখে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,’সমস্যা কী তোমার?’
প্রিয়র কাছে এমন এনকাউন্টার হওয়ায় সাইফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে কী বলবে ভেবে পেল না। প্রিয় তাড়া দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সাইফকে শাসানোর মতো করে বলল, ‘এই যে মিস্টার কিছু বলার থাকলে জলদি বলে ফেলো। আমার হাতে অত সময় নেই। কিছু না বললে এখনই আমার পিছু ছাড়ো। এর পর থেকে পিছু নিলে কিন্তু খবর আছে। মনে রেখো।’
শাসানোর পরেও প্রিয়কে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাইফ মনে হালকা একটু জোর পেল।
ইতস্তত করতে করতে সাইফ বলল, ‘তুমি সেই মেয়েটা না?’
প্রিয় ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,’ কোন মেয়েটা?’
‘ওই যে কয়েক মাস আগে আমাকে প্রপোজ করা মেয়েটা!’
প্রিয় চেঁচিয়ে বলল, ‘এই ছেলে, নিজেকে কী মনে করো তুমি? তুমি কি প্রিন্স অব ওয়েলস যে আমি তোমাকে দেখা মাত্র প্রপোজ করতে যাব?’
সাইফ বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তার স্পষ্ট মনে হচ্ছে এই সেই মেয়ে। কিন্তু প্রিয়র কথার দৃঢ়তা দেখে সে আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল। ভাবতে থাকল, সত্যিই কি তবে তার দেখার ভুল? কিন্তু তার মন বলছে এই সেই মেয়ে। মেয়েটার গলার স্বর, চোখ, চুল সব তো একই!