ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৬৫+৬৬+৬৭

0
1419

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৬৫

অতল আর বহ্নিকে একসাথে বাগানে দেখার পর থেকেই সাবিহা সাবরিন ভীষণ ব্যাকুল হয়ে আছেন। অস্থির লাগছে তার। বিষয়টা কোন দিকে যাচ্ছে তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। এটার একটা সুরাহা করা দরকার।

একদিকে ছেলের বিয়েটাও নিজের পছন্দমতো দিতে পারলেন না। অপরদিকে মেয়েটা যে কী শুরু করেছে তা তিনি বুঝতেই পারছেন না। সাব্বির আহমেদের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার পর বহ্নিকে ডাকা হলো। বহ্নিকে প্রশ্ন করতেই সে প্রতিটা প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিল। সাব্বির আহমেদ বিশ্বাস করেন মেয়ের উপরে। তারপরেও খোঁজখবর নেওয়া আবশ্যক। অবশেষে শিহরণও জেনে গেল বহ্নি আর অতলের ব্যাপারে। প্রথমদিকে খুবই রাগান্বিত হয়ে গেল সে। পরে ছোঁয়া পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলার পরেই শান্ত হলো। এমন একটা বিষয় তার কাছ থেকে গোপন করার জন্য ছোঁয়ার উপরেও তার ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু ছোঁয়ার এই অবস্থায় সে নিজের রাগটাও প্রকাশ করতে পারছে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো তার। তারপরেও অতলের সাথে কথা বলা দরকার। তাই সে অতলকে সাথে সাথেই কল করে ডাকল।

অতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শিহরণ দু’হাত দিয়ে তার চুলগুলো চেপে ধরে ফ্রাস্ট্রেশন দূর করার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর শিহরণ রেগে গিয়ে বলল, ‘আমাকে জানাসনি কেন? এত লুকোচুরি করার কী কোনো দরকার ছিল?’

অতল আগের মতো মাথা নিচু করেই রইল। ছোটোবেলায় এমন একটা আশঙ্কায় নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়েই তো তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অতল তা ভুলেনি, ভুলতে পারে না। অতল কখনোই ভুলতে পারে না তার জীবনটা ভিন্ন ধারার। প্রচলিত স্রোতে সে কখনোই খা ভাসাতে পারেনি। সে জানে তার ভালোবাসার মানুষগুলো তার কাছ থেকে হারিয়ে যায় কারণে কিংবা অকারণে! খারাপ ভাগ্য বোধহয় একেই বলে। কথায় আছে, ‘অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়’ কথাটা মিথ্যে নয়। শতভাগ সত্য। অতল নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছে এই তিক্ত সত্য। তাই সে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে সবকিছু থেকে, সবার কাছ থেকে, জীবনের অনেকটা সময়। ভুল পথে হেঁটেছে, নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে, তবুও শান্তি মেলেনি। অবশেষে যা একটু শান্তি পেল তাও সেই বন্ধুদের ছায়াতলে জায়গা পেয়েই তো। এই বন্ধুরা তার অনেকটা জুড়ে আছে। ছোটোবেলার সমস্ত অবহেলা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য সমস্ত ছাপিয়ে সে এক টুকরো সুখ খুঁজে পেয়েছে বন্ধুদের মাঝে, বহ্নি আর শিহরণ ছিল তার মধ্যে অন্যতম। তাই সে আবারও ভয়ে তটস্থ, পাছে সবকিছু হারিয়ে ফেলে।

অতলকে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিহরণ বলল, ‘এখনো চুপ করে থাকবি? তুই কি বহ্নিকে ভালোবাসিস না-কি টাইমপাস? এত দিন তো এটাই করে এসেছিস, তাই না?’

অতল এবার মুখ তুলল। তার চেহারা শক্ত হয়ে গেল। কঠিন স্বরে এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘আমি ভালোবাসি বহ্নিকে। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা যে কোনো কিছুর উর্ধ্বে, এতে কোনো ছলনা নেই, এখানে কোনো ভ্রান্তি নেই, এটা সম্পূর্ণ সত্য দিনের আলোর ন্যায়।’

‘তোর বলা কথা আমি কেন বিশ্বাস করব? বিশ্বাস করার পেছনে কোনো শক্ত যুক্তি আছে তোর কাছে?’

‘যুক্তিতত্ত্ব দিয়ে ভালোবাসা যায় না। তাই বহ্নিকে ভালোবাসার পেছনে আমার কাছে কোনো যুক্তি নেই। আর আমাকে বিশ্বাস করাটা জরুরী নয় তবে জরুরী নয় বলেই তা মিথ্যা তাও নয়। বিশ্বাস অবিশ্বাস মানুষের মনের উপর নির্ভর করে। প্রমাণ সাপেক্ষে মস্তিষ্ক বিশ্বাস করে। এখন এটা সম্পূর্ণ তোর উপরে তুই কোন দিকে থেকে আমার বিচার করতে চাইছিস। আমি প্রমাণ দিতে প্রস্তুত তা বলব না। আমি যে ভালোবাসি, সত্যিই ভালোবাসি সেই সত্যটা ঢেকে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলতে চাই, আমার পক্ষে আর কাউকে হারানো সম্ভব নয়। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি হারাতে হারাতে, নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে। আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তুই কী প্রমাণ চাস বল? তোকে বিশ্বাস করানোর ক্ষমতা হয়তো আমার কাছে নেই, তবে সত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মতো আত্মবিশ্বাস আমার আছে।’

অতলের মুখ থেকে এমন সব কথা শুনে শিহরণ স্তব্ধ হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। ছোঁয়া বহ্নিকে নিয়ে এলো। শিহরণ এবার বহ্নিকে প্রশ্ন করল, ‘তুই বল ওকে আমি কী পরীক্ষা নিতে পারি?’

বহ্নি এক পলক তাকাল অতলের দিকে। এতক্ষণ যাবৎ অতল যা কিছু বলেছে তার সবটাই সে শুনেছে। তার বুকের ভেতরটা বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠেছে কেবল। একটা গভীর শ্বাস ফেলে সে বলল, ‘আমি জানি সে সত্য বলছে। তাই কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে তুমি যাই বলো না কেন, আমি বিশ্বাস করি ও কোনো প্রকার বাক্যব্যয় না করে তা মেনে নিবে।’

‘ওকে, ডান।’ শিহরণ জহুরি চোখে অতলকে পরখ করে বলল, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’

অতল তাকাল শিহরণের দিকে। শিহরণ মুখে কাঠিন্য বজায় রেখে বলল, ‘তোকে বহ্নির জীবন থেকে সরে যেতে হবে, চিরতরে।’

অতল আর বহ্নি দুজনেই বিস্ফোরিত চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। ছোঁয়াও বাকরুদ্ধ। হঠাৎ করেই অতল অদ্ভুত হাসল। তারপর একটু আগে বহ্নির বলা কথাটা ভেবেই সে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। বহ্নির চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

অতল চোখের সীমানায় অদৃশ্য হবার আগেই শিহরণ ওকে ডাকল। অতল ঘুরে দাঁড়াল। শিহরণ ওর কাছে এসে বলল, ‘ওর চোখে যেন কখনো এক ফোঁটা অশ্রুও না আসে। এবং কোনোভাবেই যেন আমার বার্বি ডলের অশ্রু কিংবা কষ্টের কারণ তুই না হোস। তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। বলে রাখলাম।’

কথাগুলো বলা শেষ করেই শিহরণ অতলকে জড়িয়ে ধরল। বহ্নির চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল।
___________________________

শিহরণ বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে বাবা-মা দুজনকে রাজী করাল। আশরাফ হোসেনও রাজী না হয়ে থাকতে পারলেন না। অতলের চাকরি না থাকায় বেশ আপত্তি তুলেছিলেন সাবিহা সাবরিন। কিন্তু শিহরণ দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘ওর জব হয়ে যাবে এবং তা বিয়ের আগে আগেই হবে বলেই আশা করা যাচ্ছে। রেজাল্ট হয়ে হওয়া পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে তো হবেই। ওর মতো মেধাবি ছাত্রের জব না হলে আর কার হবে।’

অবশেষে বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। অতল আর বহ্নির বিয়ের খবরটা মোটামুটি তারায় তারায় রটে গেল। আতিক, রাদিদ কিংবা নীরা কারো কাছেই এই খবর অজানা থাকল না।

_____________________________

কুমিল্লা থেকে আসার পর থেকেই বেশ উৎফুল্ল মেজাজে আছে আশফাক। আমিরাহ এই উৎফুল্লতার পেছনের কারণ কি তা কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। অবশ্য এতে তার কোনো মাথাব্যথাও নেই। তবে অবাক হচ্ছে এই ভেবে–যে মানুষটা এই তো কিছু দিন আগেও বিমর্ষ, বিষণ্ন মুখে ঘুরে বেড়াত সে আজ হাওয়ায় ভাসছে। আশফাক তার চোখে-মুখে উদ্ভাসিত উচ্ছ্বাস লুকিয়ে সেখানে কৃত্রিম কষ্টের আবরণ মেখে আমিরাহকে বলল, ‘আমি আসলে অনেক ভেবেছি। তোমাকে এভাবে কষ্ট দেওয়াটা আমার অন্যায় হচ্ছে। আমি এভাবে তোমাকে কষ্ট দেবার কোনো অধিকার রাখি না।’

আমিরাহ ভীষণ অবাক হলো। এই লোক কী বলছে! সে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? কোন বিষয়ে কথা বলছ?’

‘তুমি আমার কাছ থেকে বারবার ডিভোর্স চেয়েছ কিন্তু আমি তোমাকে জোর করে আটকে রেখেছি। এটা আমি ঠিক করিনি। আমাকে মাফ করে দিও, প্লিজ। আসলে নিজের কথা ভাবতে ভাবতে আমি তোমার সুখ-দুঃখের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তবে এখন আর না। আমি তোমাকে মুক্তি দেব। আমাদের সন্তানের দোহাই দিয়ে তোমাকে আর আটকে রাখব না।’

আমিরাহ এতটাই শক খেল যে সে কথা বলতে ভুলে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আশফাকের দিকে। আশফাক আবারও বলতে শুর করল, ‘তোমার ব্রাইট ফিউচার নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই।’

কথাগুলো বলতে বলতে সে একটা কাগজ আমিরাহের দিকে এগিয়ে দিয়ে আবারও বলল, ‘এটা আমাদের ডিভোর্স পেপার। এটাতে একটা সাইন করলেই তুমি মুক্ত। এর পর থেকে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। তোমাকে বাধা দেবার মতো কেউ থাকবে না।’

আমিরাহ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘সত্যি বলছ?’ পরক্ষণেই সন্ধিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘তাহলে তুমি কি আবার বিয়ে করবে?’

আশফাক অতি শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার মতো করে অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘কী বলছ তুমি? আমি বিয়ে করব মানে? আমার জন্য আমার মেয়েই যথেষ্ট। তুমি তোমার ফিউচার নিয়ে ভাবো।’

আমিরাহের চিন্তা এবার তার চাকচিক্যময় ভবিষ্যতের দিকে ঘুরে গেল। আর তাতেই সে দুম করে সাইন করে দিল।

আশফাকের বুকের উপর থেকে বিশাল একটা পাথর সরে গেল। সে নিজেও কোনো প্রকার কালবিলম্ব না একটা সাইন করল। বাকি কাজ তার উকিল করে নিবে। এই অভিনয়টুকু করা তার জন্য খুব জরুরী ছিল। যদি এরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নীলাকে সে ফিরে পেয়েছে তবে আমিরাহ তাকে কখনোই ডিভোর্স দেবে না। এতটুকু সে খুব ভালোভাবেই জানে। আর তার বাবা-মা সোনার ডিম পারা হাঁস হাত থেকে ফসকে যেতে দেবেন না। আমিরাহকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে তাকে নীলার প্রতি আগ্রাসী করে তুলতেও পিছপা হবেন না। তাই দ্রুততার সাথে ডিভোর্সের ব্যাপারটা চুপিচুপি সেরে ফেলতে চাইছে সে। তাছাড়া নীলা কিংবা পিউকে এখনি কারো সামনে আনা যাবে না। এতটুকু সতর্কতা তাকে অবলম্বন করতে হবে।

____________________________

আতিক বেশ অবাক হলো যখন জানতে পারল তার বাবা অতলের পছন্দের মেয়েটাকে তার বউ করে আনছেন। যেখানে সে নিজের পছন্দ সম্পর্কে বলতেই পারেনি সেখানে অতলের ইচ্ছে পূরণ করতে কোনো প্রকার বাধা দিচ্ছেন না বরং কোনো প্রকার ঝামেলা ব্যতিরেকে তা মেনে নিয়েছেন। এই ব্যাপারটা আতিককে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। সে এখনও ভুলতে পারেনি কীভাবে তার আর আফরিনের মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাকে কটু কথা বলতে তার বাবা একবারও ভাবেননি। সবকিছু অতলের জন্য হয়েছে। এই সমস্ত কিছুর জন্যই অতল দায়ী। আতিক নির্বাসনে থাকবে আর অতল থাকবে সুখে রাজপ্রাসাদে। এটা আর কেউ মানুক আর না মানুক আতিক কখনোই মেনে নিবে না।

অতলের বিয়ের খবরটা শোনার পর থেকেই তার মাথাটা বেঁকে বসেছে। তার মস্তিষ্ক তাকে শান্তিতে না বসতে দিচ্ছে, না একটু শান্তিতে ঘুমোতে দিচ্ছে। সে বুঝে গেল এতদিন ধরে বুকের মধ্যে চেপে রাখা সত্যটা বাহিরে আনার যথোপযুক্ত সময় চলে এসেছে। সুযোগ বুঝে তাকে একবার বাসায় যেতে হবে, আর তার ট্রাম্পকার্ড কাজে লাগানোর সময় চলে এসেছে।
_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৬৬

সাবিহা সাবরিন থম ধরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। অতলের ব্যাপারে এতসবকিছু জানার পর তিনি কোনোভাবেই এই ছেলের কাছে নিজের মেয়ে বিয়ে দেবেন না। প্রত্যেক বাবা-মাই চান তাদের সন্তানকে একটা নির্ভরযোগ্য হাতে তুলে দিতে। তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। অতলের পুরাতন রেকর্ডকে তিনি অদেখা করলেও বর্তমানটা তিনি কোনোভাবেই অদেখা করতে পারছেন না। একজন বাবা যে একটা মেয়েকে বিয়ে করার পর তার অনাগত সন্তানসহ তাকে রাস্তায় ছেড়ে দিলো। এমনকি তার বন্ধুদেরকে দিয়ে নিজের স্ত্রীর ক্ষতি করাতেও পিছপা হয়নি সেই বাবার রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে অতলের শরীরে। অতল তো সেই নোংরা আর বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষটারই সন্তান। তাই অতল ও যে তা করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সবকিছু জেনেশুনে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি নিজের মেয়েকে ছেড়ে দিতে পারেন না। তার স্বামী মেয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে হার মানতে পারে, কিন্তু তিনিও যদি হার মানেন তবে মেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে। তিনি তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবেন না। দরকার হলে মেয়ের চোখে খারাপ হতেও তিনি পিছপা হবেন না। যাই করা লাগে লাগুক তিনি নিজের আদরের মেয়েটাকে ওই ছেলের হাতে দিবেন না। এটাই তার ফাইনাল ডিসিশন। তাছাড়া অতল আসলে ঠিক কার সন্তান–সেই বিষয়েও সন্দিহান তিনি। যদিও তিনি বার্থ সার্টিফিকেট দেখেছেন, তবুও সব তথ্য জানার পরে একটা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে!

নিজের সাথে মানসিক দ্বন্দ্বে দ্বন্দ্বে বহুক্ষণ পার করার পর সাবিহা সাবরিন নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। বহ্নিকে নিজের বোনের বাসায় জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছেন বেশ কিছুক্ষণ আগে। শিহরণ ছোঁয়াকে নিয়ে ব্যস্ত আছে।
কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে কল করার পরে তিনি সোফায় মাথা এলিয়ে দিলেন। কাটল বেশ কিছুক্ষণ সময়। তারপর মিষ্টিকে ডেকে বললেন তাকে কড়া লিকার দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে। মিষ্টি চা এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘মাথা ব্যথা করছে আন্টি? চা-টা খেয়ে নেন। ভালো লাগবে।’

সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘তুই এখন যা আমি চা খেয়ে নেব।’

মিষ্টি গেল না। বলল, ‘আমি কি মাথা টিপে দেব আন্টি?’

‘না, তোকে যেতে বলেছি না। একদম আমার আশেপাশে থাকবি না। আমি না ডাকলে আমার আশেপাশে আসবি না এটা আমার আদেশ। বুঝেছিস?’ সাবিহা সাবরিন রেগে গিয়ে বললেন।

মিষ্টি আর দাঁড়াল না। সে চলে গেল ধীর পায়ে হেঁটে। সাবিহা সাবরিন অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন।

অতল ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেই সালাম দিল। সাবিহা সাবরিন মাথা তুলে দেখলেন অতলকে। তিনি তাকে ইশারায় বসতে বললেন। অতল কালবিলম্ব না করেই একটা সোফায় বসে পড়ল। সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘বহ্নিকে বিয়ে করার যোগ্যতা কি তোমার আছে?’

অতল এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাকে বিভ্রান্ত দেখাল। একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে সে বলল, ‘আমার যোগ্যতা আছে কি নেই তা আপনার যোগ্যতা পরিমাপের মানদণ্ডের উপর নির্ভর করবে।’

সাবিহা সাবরিন অবাক হলেন অতলের স্পর্ধা দেখে। এই ছেলেকে যতটা আলাভোলা মনে করেছিলেন সে তেমনটা নয়। তিনি তা মুহূর্তেই বুঝে গেলেন। বললেন, ‘প্রত্যেক পিতা-মাতা তাদের কন্যার জন্য পাত্র সন্ধানে যে মাপকাঠি অনুসরণ করে থাকেন তা তো একই হয়ে থাকে। তাই না?’

অতল দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলল, ‘জি, না। সবার মাপকাঠি একই হয় না।’

অতলের দৃঢ়তায় সাবিহা সাবরিন ভাবলেন, ‘এইটা তার ধূর্ততা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে এই পুঁচকে ছেলেটা।’

তিনি মুখে বললেন, ‘কেন মনে হলো তোমার? আর কোন বেসিসে বলছ এটা?’

অতল একটু নড়েচড়ে বসল। সে ভালোই বুঝতে পারছে, তার সামনে বসে থাকা মহিলাটি তার ভালোবাসার মানুষটিকে তার হাতে হস্তগত করতে ভীষণ নারাজ। তাই তাকে নাস্তানাবুদ করে মেয়ের জীবন থেকে সরাতে বদ্ধপরিকর। সে বলল, ‘সত্যের অস্তিত্ব মনে করার উপর নির্ভর করে না। বরং সত্য নিজ গুণেই সত্য। আমার কোনোকিছু মনে করা কিংবা না করাতে কোনো সত্য যেমন পরিবর্তন হয়ে মিথ্যে হয়ে যাবে না। ঠিক তেমনি কোনো মিথ্যে সত্যও হয়ে যাবে না।’

সাবিহা সাবরিন ব্যঙ্গাত্মক হাসলেন। বললেন, ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না কথাটাও সত্য। তাই না?’

‘এক্স্যাক্টলি, আমিও আপনাকে এটাই বুঝাতে চাইছি। অথচ মানুষ সবসময় চকচক করলেই সোনা মনে করে তার পেছন পেছন ছুটতে মরিয়া হয়ে উঠে।’ ভাবলেশহীন গলায় বলল, অতল।

সাবিহা সাবরিন এবার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। ছেলেটাকে নিতান্ত শান্তগোছের মনে করলেও এইটা অত্যন্ত বেয়াড়া ধরনের ছেলে। নিজের সিদ্ধান্ত যে সঠিক তার প্রমাণ তিনি প্রতিমুহূর্তে পাচ্ছেন।

তিনি এবার তার হাতের কাছে থাকা ডকুমেন্টগুলো ছুঁড়ে দিলেন অতলের দিকে। বিক্ষিপ্ত কাগজগুলোর দিকে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অতল। সাবিহা সাবরিন তাড়া দিয়ে বললেন, ‘কাগজগুলো দেখো।’

বাধ্য ছেলের মতো করে অতল মাথা নুইয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলোর মধ্যে একটা কাগজ হাতে নিল। চোখ বুলাতেই দেখল সেটা বার্থ সার্টিফিকেট। কাচের টেবিলে রেখে দিতে চাইলে সাবিহা সাবরিন সতর্ক গলায় বললেন,’পুরোটা পড়ে দেখো। তোমার জানা দরকার সবটা।’

অতল পুরো সার্টিফিকেটে নজর বুলাল। দেখল বার্থ সার্টিফিকেটে লেখা বাচ্চাটার নাম তার নামের সাথে হুহবু মিল। কিন্তু মায়ের নামের জায়গায় লেখা শান্তা সুলতানা। বাবার নামের জায়গায় লেখা নাবিল রহমান। এই সার্টিফিকেট দেখে অতল ভীষণ অবাক হলো। তার চেহারার রং পাল্টে গেল। হতবিহ্বল অতল করুণ চোখে তাকাল সাবিহা সাবরিনের দিকে। সাবিহা সাবরিন বুঝে গেলেন সার্টিফিকেটর তথ্য অতলের জানা হয়ে গেছে। তিনি বললেন,’বাকিগুলোও দেখো। জলদি করো।’

অতল সবগুলো কাগজ দেখল। একটাও বাদ রাখল না। তার চোখে-মুখে শ্রাবণের মেঘ জমেছে। অতল শুধু একটাবার অস্ফুট স্বরে আওড়াল, ‘এটা হতে পারে না। এটা কখনোই হতে পারে না। এটা কী করে সম্ভব? কী করে?’

সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘এবার বলো তো তোমার কাছে কি আমার সোনার টুকরো মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়া উচিত হবে? মা হিসেবে এই কাজটা কি আমি করতে পারি? আমার কি তোমার উপর ভরসা করা উচিত?’

অতল কোনো উত্তর দিতে পারল না। সমস্ত কগজপত্র হাতে নিয়ে সে উদভ্রান্তের মতো করে হেঁটে বেরিয়ে গেল। বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটছে সে যেন পথহারা কোনো পথিক।
___________________

সব কাগজপত্র হাতে নিয়ে অতল বাসায় গেল। মায়ের মুখোমুখি হতে হবে তার। মেহেরুন নাহার উদ্ভ্রান্ত অতলকে দেখে ভীষণ অবাক হলেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে তোর? অসুখ করেছে বাবা?’

অতল কোনো উত্তর দিল না। মেহেরুন নাহার ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অতলের কাছাকাছি এসে তিনি অতলের কপালে হাত রেখে বললেন, ‘জ্বর তো আসেনি। খারাপ লাগছে? কী হয়েছে বল মাকে?’

‘মা!’ অতল ব্যথাতুর গলায় বলল, ‘আমার মা কে?’

‘কীসব বলছিস? তোর মা আবার কে? আমিই তো।’

অতল দ্বিরুক্তি না করে তার হাতে থাকা কাগজগুলো এগিয়ে দিল মায়ের দিকে। মেহেরুন নাহার কাগজগুলো হাতে নিতেই ভীষণভাবে চমকে গেলেন।

অতল নির্বিকার গলায় প্রশ্ন করল,’এবার তো অন্তত সত্যি কথাটা বলো আমাকে!’

‘তুই এসব কোথা থেকে পেলি? এইসব তো আমার রুমে ড্রয়ারে তালাবদ্ধ ছিল।’

‘এই সব ডকুমেন্ট আমি কোথায় পেয়েছি সেটা এখন আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমাকে সত্যিটা বলো, মা।’

মেহেরুন নাহার নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। অতলকে এমন বিধ্বস্ত তিনি কখনোই দেখেননি। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভেতরটা ভাঙচুর হচ্ছে, নিঃশব্দে।

অতল বসে পড়ল মায়ের পদতলে। মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘আমার কাছে আর কিছু লুকিয়ে রেখো না, মা। আমাকে সবটা জানাও। আমি বুঝতে পারছি তোমরা আমার বাবা-মা নও। তবুও আমি সবকিছু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। প্লিজ, মা, প্লিজ। আমাকে আর অন্ধকারে রেখো না।’

মেহেরুন নাহার গভীরভাবে শ্বাস নিলেন। পুরনো অতীতটাকে ধামাচাপা দিয়েছিলেন সযত্নে, বহুকষ্টে। ভেবেছিলেন যতকিছুই হয়ে যাক না কেন, এই কালো অতীতটাকে আর কখনোই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দিবেন না। কিন্তু জীবন সত্যিই কণ্টকাকীর্ণ! মেহেরুন নাহার একটা গম্ভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, ‘ঠিক ধরেছিস, আমি তোর মা নই। বাবাকে বলে যাকে জানিস তিনি তোর মামা, আর আমি তোর মামী। তোর জন্মদাত্রী মায়ের নাম শান্তা। আমার ছোট্ট শান্তা তার নামের মতোই শান্ত ছিল। সবার সাথে মিশতে পারত না। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল কুয়োর ব্যাঙের মতো। মানুষের সাথে না মিশতে পারার এই অদক্ষতাটার জন্য বরাবরই তোর বাবা দায়ী। তিনি বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশা পছন্দ করতেন না। শান্তা যখন ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলো তখন থেকেই তার মধ্যে বিস্তর পরিবর্তন খেয়াল করতে শুরু করলাম। তবে পুরোপুরি বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। ততদিনে শান্তা নাবিল নামের এক ছেলের প্রতি আসক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন বুঝতে পারলাম তখন শান্তাকে সাবধান করলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাই আমি ছেলেটার সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করলাম। যা জেনেছি তাতে আমি শিউরে উঠেছিলাম। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা , যে করেই হোক শান্তাকে এই মাদকাসক্ত, লম্পট ছেলের কাছ থেকে রক্ষা করতে হবে। তাই অবশেষে বিষয়টা তোর বাবাকে জানালাম। তোর বাবা রেগেমেগে আগুন হয়ে গেল। শান্তাকে ইচ্ছেমতো মেরেছিল সেদিন। আমি চেয়েও থামাতে পারিনি। তোর মামা কিছুদিনের মধ্যেই শান্তার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। শান্তাও খুব শান্ত হয়ে গেল। আমরা ভেবেছিলাম ও বোধহয় মেনে নিয়েছে। এই ধারণাটাই ভুল হলো আমাদের। বিয়ের দিন টাকা-পয়সা, গহনা নিয়ে শান্তা পালিয়ে গেল ওই ছেলের সাথে। এলাকায় তোর বাবার খুব বদনাম হলো। ঘর থেকে বের হতে পারতাম না আমরা। লোকে পাথর ছুঁড়ে মারত, কেউ কেউ ছেঁড়া জুতো পর্যন্ত ছুঁড়ে মেরেছিল তোর বাবার দিকে। বহুকষ্টে তোর বাবা সেই গ্রাম থেকে পোস্টিং নিয়ে শহরে চলে এলো।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন মেহেরুন নাহার। কাঁদছেন তিনি। অতীতটা এভাবে অতলকে জানাতে হবে তা তিনি ভাবেননি। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন। অতল তীর্থের কাকের ন্যায় মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অপেক্ষা করছে নিজের অস্তিত্বের সবটুকু জানার জন্য। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর ধারা।

মেহেরুন নাহার দম নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,’শান্তাকে আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো অন্যকিছুই চেয়েছিল। তাই আবারও শান্তার সাথে দেখা হয়ে গেল। আতিকের বয়স তখন দুই বছর। একদিন আতিকের বাবার অফিসের কলিগের বাসা থেকে বের হবার পরে পাগলের বেশে তোর মাকে দেখলাম। উনাকে দেখালেও তিনি কোনো ভ্রুক্ষেপই করলেন না। আমি অনেক কাকুতি-মিনতি করে তোর মাকে বাসায় নিয়ে আসি। ওকে বাসায় এনে গোসল করিয়ে ভালো কাপড় পড়তেই সেই আগের মতো রূপসী ছোট্ট মেয়েটিকে কাছে পেয়ে গেলাম মনে হলো আমার। তারপর আমিই ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার চেক আপ করে জানাল শান্তা প্রেগনেন্ট। ছয় কি সাত মাস চলছিল ওর। তুই বুঝতে পারছিস, তুই তখন ওর গর্ভে।’

মেহেরুন নাহার থামলেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন তিনি। অতল তাড়া দিয়ে বলল, ‘তারপর কী হলো?’

মেহেরুন নাহার বলতে শুরু করলেন, ‘শান্তা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওর নিজের উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ওর এমন পাগলামো দেখে ওকে একটা রুমে বন্ধী করে রাখতে হয়েছিল। আতিকের বাবার সাথে এই নিয়ে আমার প্রায় ঝগড়া হতো। তিনি শান্তার উপর রেগে ছিলেন। তাই তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে চাইছিলেন।
কিন্তু আমি কোনোভাবেই শান্তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে রাজী হলাম না। শান্তা হুটহাট ধারালো কিছু পেলেই নিজেকে আঘাত করার চেষ্টা করত। তাই সমস্ত ধারালো জিনিস ওর নাগালের বাইরে রেখেছিলাম। একসময় তুই এই পৃথিবীর বুকে এলি। শান্তা তখন একদম শান্ত হয়ে গেল। আমরা ভেবেছিলাম এই বুঝি শান্তা সুস্থ হয়ে গেল। তোকে খুব আদর করতে দেখে আমি মনে মনে বিশ্বাস করতে শুর করেছিলাম যে শান্তার মানসিক সমস্যা দূর হয়েছে।’

অতল অধৈর্য গলায় বলল, ‘তারপর?’

‘একদিন শান্তা তোকে আমার কোলে দিয়ে বলল, ‘ভাবি, এই নাও তোমার ছেলেকে। আজ থেকে ও তোমার সন্তান।’ আমি অবাক হতে চেয়েও সেদিন অবাক হইনি। তোকে কোলে নেওয়ার পর মনে হয়েছিল তুই আমারই সন্তান। এর পর থেকে শান্তার মানসিক স্বাস্থ্যের ভয়ানক অবনতি ঘটল। সে পুনরায় সুইসাইড এটেম্পট করা শুরু করল। তাই ওকে আবারও একটা রুমের মধ্যে বেঁধে রাখতে হলো। কিন্তু তাতেও ওকে বাঁচানো গেল না। ওকে যে রুমে আটকে রেখেছিলাম সেই রুমেই সে ঝুলে পড়ল বিদায়ের লন্ঠন হাতে নিয়ে।’

অতল নিজেকে শান্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এতটা কষ্টে ছিল তার মা! তার বাবা নামক প্রাণীটা তার মাকে এতো কষ্ট দিয়েছে যে শেষমেশ নিজের প্রাণ নিজেকেই শেষ করতে হলো তার মাকে!

‘শান্তা মারা যাবার পরেই ওর হাতে লেখা চিঠি পেলাম। যেখানে সে তোর তথাকথিত বাবার করা অত্যাচারের বর্ণনা লিখে রেখেছিল। কী ভয়ংকর সেই বর্ণনা! আমার পক্ষে তোকে সেসব বলা সম্ভব নয়। তুই চাইলে চিঠিটা নিজেই পড়ে নিস।’ মেহেরুন নাহার আর্তনাদ করে বললেন।

অতল তখন মায়ের পায়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই কারণে বাবা আমাকে দেখতে পারে না, তাই না মা?’

মেহেরুন নাহার আঁচল মুখে দিয়ে কান্না রোধ করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজের রুমে ছুটে চলে গেলেন। অতল একটা ব্যাগের মধ্যে সমস্ত কাগজ ঢুকিয়ে রাখল। নিজের রুমে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে দিল। অন্ধকার নেমে আসছে ধরণীতে। অতল সেই অন্ধকারের অতলে ডুবে যাচ্ছে। মায়ের লেখা সেই চিঠিটা পড়তে শুরু করল। কী ভয়ংকর তার বাবা নামের লোকটা! এই চিঠিটা পড়ার পরে সে আর বহ্নির মাকে কোনো দোষ দিতে পারছে না। এরকম বাবার সন্তানকে কেউ বিশ্বাস করতেই পারে না। তবে কি বহ্নিকেও সে হারিয়ে ফেলবে? তার কি ভালোবাসা পাবার কোনো অধিকার নেই? সে কি শুধু হারাবার জন্যে এই পৃথিবীতে এসেছে? মায়ের লেখা চিঠিটা বুকে আঁকড়ে ধরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ল অতল। তার বুকটাতে বয়ে যাচ্ছে এক ভয়ংকর ঝড়। সেই ঝড় সমস্তকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। অন্ধকারের অতলে ডুবন্ত ঘরটাতে কেবলই অতলের অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ব্যতীত আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এক অস্বাভাবিক ছন্দে উঠানামা করছে তার বুক!
_______________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৬৭

নীরা যখন জানতে পারল অতল আর বহ্নির বিয়ের খবরটা তখন থেকেই তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। তার সমস্ত চিন্তা চেতনা জুড়ে কেবল একটাই চিন্তা, রাদিদ ভাইয়ার কী হবে! রাদিদ ভাইয়ার বিষয়টা বহ্নিকে জানানোর জন্য সে বহ্নির আইডি খুঁজে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল। সাথে একটা লম্বা মেসেজ দিয়ে বহ্নির জন্য রাদিদের গোপন ভালোবাসাটাও প্রকাশ করে দিয়েছিল। এর পর থেকেই নীরার অপেক্ষার পালা শুরু হয়েছিল। ‘এই বুঝি বহ্নি তার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করল আর সবটা জেনে গেল’ এই আশাতেই সে প্রতিদিন ফেসবুকে ব্রাউজ করতে করতে চ্যাক করে দেখে তার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করা হয়েছে কি না। কিন্তু প্রত্যেকবারই সে আশাহত হয়। তার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করা হয়নি!

নওশীন হক নীরাকে বিষণ্ন দেখে বললেন, ‘কী হয়েছে তোর?’

‘কিছু না মা।’ নীরা হাসার চেষ্টা করে বলল।

‘মায়ের কাছ থেকে লুকাচ্ছিস?’

‘রাদিদ ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে, মা।’

‘কল করে ডেকে নিলেই তো হয়।’

‘মা, ভাইয়ার কাজ আছে তো। আবির ভাই তো একটা কাম চোরা। সব কাজ রাদিদ ভাইয়াকেই করতে হয়।’

‘এভাবে বলছিস কেন? তাহলে চলে যা কুমিল্লায়।’

‘সত্যি বলছ মা?’

‘একদম সত্যি। ঠিক আছে, এবার আমিও না হয় যাব তোর সাথে।’

নীরা খুশিতে গদগদ হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মাহফুজ হক বললেন, ‘তোমাদের সাথে আমিও যাব। অনেকদিন হয়ে গেলো গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না।’

নীলভ্রকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। আফরিন প্রশ্ন করবে না করবে না করেও করেই ফেলল, ‘নীল, এত খুশির কারণ কি জানতে পারি?’

নীলাভ্র হেসে বলল, ‘বহুদিনের পুরনো একটা হিসেব চুকেবুকে গেছে। তাই আজ নিজেকে প্রশান্তির সাগরে খুঁজে পেলাম। এই কারণেই আজ মনটা ভীষণ আনন্দিত।’

‘তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, নীল।’

‘এসব কথা তোমার বুঝার দরকারও নেই। কথা হচ্ছে, তোমার নীল আজ ভীষণ খুশি।’ নীলাভ্র একটু থেমে আফরিনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,’চলো, আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। কোথায় যাবে বলো?’

আফরিন খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, ‘সত্যি বলছ?’

‘একদম।’

‘তাহলে চাইনিজ খেতে যাব আর লেকের পাশে কিছুক্ষণ হাঁটব। ঠিক আছে?’ আফরিন হঠাৎ কোনোকিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে পুনরায় বলল, ‘ও হ্যাঁ, বিয়ের পর থেকে আমার কিছুই কেনা হয়নি। তাই আজকে শপিং ও করাতে হবে কিন্তু!’

নীলাভ্র মাথা দুলিয়ে বলল,’ঠিক আছে। আজকে তোমার সব ইচ্ছেই পূরণ করা হবে।’

___________________

রাত গভীর হচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অতলের বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট। তবুও মায়ের চিঠিটা সে চোখের সামনে ধরে রাখল। কালো অক্ষরগুলোতে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি ফেলছে সে।

প্রিয় ভাবি,

তোমার আর ভাইয়ার কথা না শুনে আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল করেছিলাম। কিছু কিছু ভুলের মাশুল দিতে হয় জীবন দিয়ে। আমিও তেমনটাই দিতে যাচ্ছি। নাবিল খুব ভয়ংকর একজন মানুষ। সে শুধুমাত্র তার নেশার খোরাক মেটানোর জন্য আমাকে মিথ্যে ভালোবাসার জালে আবদ্ধ করেছিল। আমিও কী বোকাটাই না ছিলাম! চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিলাম তার উপর। জানো ভাবি, ও শুধু আমার কাছ থেকে টাকা আর গহনা হাতানোর জন্য বিয়ে করেছিল। ও যখন নেশায় মাতাল হয়ে পড়েছিল তখন তার বন্ধুরাও আমার সাথে…! আমি যে কী পরিমাণ মানসিক আর শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো শব্দ আমার কাছে নেই। একদিন আমি জানতে পারলাম আমার ভেতরে আর একটা অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যখন আমি এক বুক সাহস যোগাড় করে ওকে জানালাম আমি মা হতে চলেছি তখন সে সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। শুধু তাতেই ক্ষান্ত হলো না, আমাকে সে বেল্ট দিয়ে মেরেছিল সেদিন।
এতে আমি শারীরিক আর মানসিকভাবে আরও বেশি ভেঙ্গে পড়ি। উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকুও আমার ছিল না।

এক সময় আমার সাথে করে নিয়ে যাওয়া টাকা শেষ হয়ে গেল তখন সে আমাকে তোমাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। আমি না করতেই আমার উপর তার অত্যাচার আরও বেশি বেড়ে গেল। আমার বাচ্চাটা তখন আমার পেটে, সে তার প্রতিও কোনো করুণা করল না। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, ও আমাকে সাথে রেখেছে কেবলই টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করার জন্য। পরে আমি বহুকষ্টে সেখান থেকে পালালাম। এর পরে আমি আসলে ঠিকভাবে কিছুই মনে রাখতে পারতাম না। কখনো রাস্তায় ঘুমিয়েছি, কখনও কোনো অফিসের বারান্দায়, কখনও জঙ্গলে, কখনও গাছের নিচে, কখনও ভিক্ষা করেছি, কুকুরের মুখ থেকে পড়ে যাওয়া খাবারও খেয়েছি। সবাই আমাকে পাগল ভাবত, আমাকে দেখতে অবশ্য পাগলের মতোই লাগত। ঠিক বলেছি তো ভাবি? ছোটো ছোটো বাচ্চারা আমাকে দেখলেই ‘পাগলি পাগলি’ বলে চিৎকার করত আর পাথর ছুঁড়ে মারত। জানো ভাবি, ওই পাথরগুলো যখন গায়ে পড়ত তখন খুব কষ্ট হতো। আমি জানি, আমার বাচ্চাটাও কষ্ট পেত। মায়ের কষ্ট কি সন্তানকে স্পর্শ না করে থাকতে পারে? এও কি সম্ভব? এইসব বাচ্চাদের তাদের বাবা-মা কখনও নিষেধ করত না। এটা দেখে খুব কষ্ট পেতাম। পাগলি বলে কি আমি মানুষ ছিলাম না? আমার কি অনুভূতি ছিল না? আমার কি কষ্ট হতো না? পাগলি হলেও আমি তো মানুষই ছিলাম, তাই না, ভাবি? শুধু বাচ্চা নয় বয়স্ক লোকেরাও পাগলি বলে খ্যাপাত, পাথর ছুঁড়ে মারত। পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মই হয়তো এই যে, সবলেরা দুর্বলের উপরে অত্যাচার করে এক পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে, এইটা বুঝি এখন।

পাগলি নামক ট্যাগটা একদিক থেকে আমার অঘোষিত নিরাপত্তা দিয়ে দিল। যদিও এখন আমি জানি নারীরা পাগল হলেও পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রেহাই পায় না। আমার উপরেও যে পড়েনি তা নয়, তবে আমি সবসময় হাতে একটা ধারালো ছুরি রাখতাম।

জানো, ভাবি, ওই ছুরিটা কেন রেখেছিলাম? ওটা সাথে রেখেছিলাম নিজেকে শেষ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু যখনই নিজেকে শেষ করতে চাইতাম, আমার মধ্যে একটা ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব আছে, এটা কী করে যেন টের পেয়ে যেতাম! তখন শুধু কাঁদতাম, হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতাম। পাগলরা তো ওভাবেই কাঁদে, তাই না ভাবি? এজন্য নিজেকে শেষ করতে চেয়েও পারিনি। আল্লাহ হয়তো চেয়েছিলেন, আমার বাচ্চাটা আসুক পৃথিবীতে। তাই ওর আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভেবেছিলাম কোথাও ওকে রেখে পালিয়ে যাব এই পৃথিবীর বুক থেকে, নিজের ঘৃণ্য অতীত থেকে! এই পথটা সহজ হয়ে গেলো যখন তুমি আমাকে খুঁজে পেলে। আমি জানি তুমি আমার বাচ্চাটাকে নিজের বাচ্চার মতোই ভালোবাসবে। তবুও তোমার কাছ থেকে কথা নিয়েছিলাম। তোমার নিজেরও তো একটা সন্তান আছে। তাই ভরসা করতে কষ্ট হচ্ছিল।

জানো, ভাবি, যখন জানতে পারলাম আমার মাঝে আর একটা প্রাণের অস্তিত্ব তখন থেকেই আমার ভয় লাগতে শুরু করল। ও যদি কোনোভাবে ওর বাবার মতো হয়, ও যদি ওর মায়ের মতো বোকা হয়! তাই আমি চাইনি ওর মাথার উপরে আমার কিংবা তার বাবার ছায়া পড়ুক। তুমি ওকে কখনও জানতে দিও না, ওর মা টা খুব বোকা ছিল। তুমি ওকে কখনও জানিও না ওর বাবা একটা পিশাচ ছিল। তুমি আর ভাইয়া ওর বাবা-মা হয়ে থেকো। আমার এই শেষ ইচ্ছেটা তুমি রেখো, ভাবি।

ইতি
তোমার বোকা শান্তা

চিঠিটা পড়ার পরে অতল অঝোরে কাঁদল। এতোটা কষ্ট সহ্য করেছে তার মা, শুধু তাকে পৃথিবীতে আনার জন্য! মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে অতলের। কেন চলে গেল তাকে একা রেখে? কেন? অতল চিৎকার করে কাঁদতে থাকল ‘মা মা’ বলে। অতল চিঠিটা বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে বলতে থাকল, ‘আমার বোকা মা, কেন তুমি আমাকে একা রেখে চলে গেল? কেন মা? আমাকে ভালোবেসে কি তুমি থাকতে পারতে না এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে?’

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঝংকার দিয়ে উঠল মোবাইল নামক যন্ত্রটা। অতল তা দেখার প্রয়োজন বোধ করল না। সে জানে এত রাতে তাকে কে খুঁজতে পারে! এত রাতে তাকে কে মনে করতে পারে! আজ সারাদিন ধরে বহ্নির সাথে কোনো কথা হয়নি। আর এই মুহুর্তে অতলের কাছে সবকিছু বিষাদের নীলে বিষাক্ত!

তানিয়া দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে
অতল আর তার মায়ের সমস্ত কথা শুনেছে। তার ভেতরটা হাহাকার করছে তার এই হতভাগা ভাইটার জন্য। অতল তার আপন ভাই না হলেও আপন ভাইয়ের চাইতেও বেশি। অতল দরজা বন্ধ করে রাখায় সে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কিছু উল্টাপাল্টা করে বসলে, সেই চিন্তাতেই সে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তাই শেষমেশ দরজায় করাঘাত করল। ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তানিয়া আবারও ডাকল, ‘অতল ভাইয়া, দরজাটা খুলো প্লিজ।’

অতল এবারও সাড়া দিল না। তানিয়াও থামল না। সে ক্রমাগত দরজা ধাক্কাতেই থাকল। শেষ পর্যন্ত অতল ধমকে বলল, ‘এখন যা তুই। পরে কথা বলব।’

তানিয়া সাহস করে বলেই ফেলল, ‘ভাত খাবে না ভাইয়া?’

‘না।’ অতলের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

তানিয়া আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। মেহেরুন নাহার তানিয়াকে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘ওকে একটু সময় দে। এত বড়ো শক সে নিতে পারবে না আমি জানতাম!’ কথাটা বলেই তিনি আবারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন,’এত লুকিয়ে রেখেও কোনো লাভ হলো না। শেষমেশ ছেলেটা এইসব তিক্ত কথা জেনেই গেল।’

‘আমি জানি মা, এইসব কারসাজি আতিক ভাইয়ের। সেই এসব কিছু করেছে। আমি আতিক ভাইয়াকে কোনোদিন ক্ষমা করব না।’ কথাগুলো বলেই তানিয়া কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল।
___________________

অতলের সাথে কথা না হলেই ভীষণ অস্বস্তি আর অস্থিরতায় ভুগে বহ্নি। খুব কষ্ট হয় তার। দিনের মধ্যে বারংবার কল দিয়ে বিরক্ত করা ছেলেটা আজ সারাটাদিন এক বারের জন্যেও তাকে স্মরণ করল না-এটা ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরেটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছে বারেবারে! কোনোকিছুতেই তার মন বসছে না। তাই বই নিয়ে বসল সে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকেও মন বসছে না তার। অবশেষে মোবাইল হাতে নিয়ে ডাটা অন করে ফেসবুকে অযথাই স্ক্রল করতে শুরু করল। ডাটা অন করতেই মেসেজের টুংটাং আওয়াজ আসতে শুরু করল। অনেকদিন যাবৎ তার ফেসবুকে আসা হয় না। তাই অনেক মেসেজ ইনবক্সে জমা পড়েছে, রিকুয়েস্ট ও চ্যাক করা হয় না। তাই আজকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টগুলোও চ্যাক করতে শুরু করল। নীরার আইডিটা দেখে তাকে চিনতে কষ্ট হলো না কারণ আইডিতে তার একটা সুন্দর প্রোফাইল পিক দেওয়া আছে। সাথে সাথেই এক্সেপ্ট করল সে। এরপর ওর আইডি থেকে পাঠানো মেসেজটা চোখে পড়ল। কালবিলম্ব না করেই সে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পড়তে শুরু করল।

প্রিয় বহ্নি আপু,

একটা বিষয় তোমাকে জানানো খুব জরুরী মনে হলো। আসলে নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারছি না। রাদিদ ভাইয়ার পরিবর্তন দেখে অবাক হয়নি এমন কেউ আসলে নেই। তবে তার পরিবর্তনের পিছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা কারণ তুমি। হুম, আমি সত্যি বলছি। তোমাকে ভেবে ভেবেই ভাইয়া কত শত কবিতা লিখে ফেলেছে তার কোনো হিসেব নেই। তোমাকে ভেবে ভেবেই ভাইয়া উপন্যাস পর্যন্ত লিখে ফেলেছে। সবার অগোচরে যেমন তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল ঠিক তেমনি সবার অগোচরে এখনও কেবল তোমাকেই ভালোবাসে। তাই তোমাকে দেখলেই পালিয়ে বেড়ায়। তোমার চোখে চোখ রাখতে ভয় পায়। তুমি প্লিজ রাদিথ ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিও না। আইম জানি, আমি খুব অন্যায় আবদার করছি। তবে কী করি বলো তো, আমার ভাইয়ার কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। এই মানুষটা পরিবারের জন্য নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত নিজের কথা ভাবে না। একমাত্র তুমিই পারো ওর জীবনটা সুন্দর করে সাজাতে। প্লিজ, তুমি আমার রাদিদ ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিও না, প্লিজ।

ইতি
নীরা

মেসেজটা পড়ার পর থেকেই বহ্নি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। এটা কীভাবে হতে পারে তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। রাদিদ ভাইয়া তাকে ভালোবাসে? কই সে তো সেরকম কোনো কিছু লক্ষ্য করেনি তার মধ্যে! এটা যদি সত্যিই হয়ে থাকে তবে তার কি-ই-বা করার আছে? সে তো অপারগ! সে চাইলেও কিছু করতে পারবে না। এতোটা বছর ধরে কেউ কী করে এরকমভাবে ভালোবাসতে পারে! বহ্নি এক বিস্ময়ের মধ্যে ঢুকে গেল। তার চিন্তাশক্তি লোপ পেতে শুর করেছে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না!
____________________

বি.দ্র. বাচ্চারা না বুঝে ভুল করতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বরং পিতা-মাতা যখন সেই বাচ্চাদের অন্যায় কাজ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে কিংবা বাচ্চার অন্যায় কাজকে অন্যায় বলেই মনে করে না সেটাই অস্বাভাবিক। এতে করে তারা তাদের সন্তানদেরকে অন্যায় করার তথা দুর্বলের উপর অত্যাচার করার প্রশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে এক অঘোষিত অনুমতি দিয়ে দেয়। দুর্বল-সবল, ধনী-গরীব, সুস্থ-অসুস্থ, হিন্দু-মুসলিম, ক্ষমতাসম্পন্ন-ক্ষমতাহীন, নারী-পুরুষ, পাগল-সুস্থ মানুষ, সাদা-কালো সবকিছু নির্বিশেষে পৃথিবী নামক গ্রহে জীবন আছে, বোধশক্তি বর্তমান আছে , কিংবা আঘাতের কারণে বোধশক্তি লোপ পেয়েছে এদের সবার একটাই পরিচয়, এরা মানুষ। আপনি সবল বলে দুর্বলকে আঘাত করে বাহাদুরি প্রকাশ করতে চাইলে তাতে আপনার নৈতিকতার অবক্ষয় ব্যতীত অন্যকিছু প্রকাশ পায় না। বিশ্বাস করুন, এটাই সত্য। আপনি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বলে আপনি একজন পাগলকে বিরক্ত, উত্যক্ত কিংবা আঘাত করার লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন না কিংবা আপনার সন্তানও সেই লাইসেন্স পেয়ে যায় না। কে বলতে পারে বলুন, মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত কিংবা বোধশক্তি হারিয়ে আপনিও কিন্তু কোনো একদিন পাগল হয়ে যেতে পারেন! আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না, আগামীকাল আমাদের জীবনে কী হতে চলেছে!

সবচাইতে বেশি কষ্ট লাগে যখন দেখি–বাচ্চাদের সাথে বয়স্ক ব্যক্তিরাও এই ধরনের পাগল খ্যাত মানুষগুলোকে কষ্ট দেয়, উত্যক্ত করে! তাদের ব্যপারে আমার কিচ্ছু বলার নেই, সত্যিই নেই।

যখনই বাচ্চাদের এমন আচরণ করতে দেখবেন তখন তাদের বুঝিয়ে বলুন যে, সেও মানুষ, তারও অনুভূতি আছে, তারও কষ্ট হয়, তারও আহারের প্রয়োজন হয়। দেখবেন বাচ্চারা খারাপটাকে বর্জন করে ভালোটাকে গ্রহণ করবেই। বাচ্চারা তো সেটাই শিখবে যা আপনারা তাদের শেখাবেন। আপনাদের মৌনব্রত থাকাটা তাদের অন্যায় কাজে সম্মতি দেয়। তাই বাচ্চাকে অন্যায় করতে দেখলে চুপ করে থাকবেন না। এটা আমার অনুরোধ।

অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়াটা আমাদের স্বভাব। কিন্তু এতে তো আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব, তাই না? কে বলতে পারে, আজকের নির্যাতিত, নিপীড়িতের জায়গায় আগামীকাল আমার কিংবা আপনার অবস্থান হবে না!

আর পুরুষরা নারীর শরীর দেখলেই লালসা চরিতার্থ করার জন্য ঝাপিয়ে পড়বেন না। এটা পৃথিবীর সবচাইতে জঘন্য, নিকৃষ্ট, ন্যক্কারজনক কাজ। একবার নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করে দেখুন না। আমিও কীসব বলছি, বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষদের তো বিবেকই নেই, এরা প্রশ্ন করবেই বা কী করে! তবে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষরা তো প্রতিবাদ করতে পারে, তাই না? অন্য এক ভাইয়ের বোনের নিরাপত্তা আপনি দিলে আপনার বোনের নিরাপত্তা অন্য কোনো এক ভাই নিশ্চয়ই দেবেন।

দুর্বলকে মারার মধ্যে বীরতা নেই, এতে ভীরুতা ব্যতীত অন্যকিছু প্রকাশ পায় না। কে যেন বলেছিলেন, বন্দুক হাতে পেলে অসহায় প্রাণীটিও ঘাতক হয়ে উঠে! বন্দুক হাতে থেকেও বিনয়ী থাকাতেই আপনার উত্তম চরিত্রের প্রকাশ।

🌵এতসবকিছু বলার কারণ একটাই, এসব আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা। আমি দেখেছি একজন পাগলিকে মা হতে, আমি দেখেছি একজন পাগলিকে বাচ্চারা দলবেঁধে মিলে পাথর মারতে–পিতা-মাতা নির্বিকার!
আমি দেখেছি বোধশক্তিহীন পাগলিটাকে কাপড়-চোপড় ঠিক না করেই হেঁটে বেড়াতে। এদিকে তার গর্ভের সন্তানটি বেড়ে উঠছে তার গর্ভের ভেতরে কখনও শব্দে, কখনও বা নিঃশব্দে। কিন্তু পাগলি মা-টা কিছুই বুঝতে পারছে না, নিজের যত্নই নিতে পারে না, সন্তানের যত্ন নিবে কী করে? অবশেষে সেই পাগলি মাও হয়েছিল! তার সন্তান পৃথিবীর বুকে এসেছিল! কিন্তু ওই শিশুটি কখনোই জানতে পারবে না তার নরপিশাচ বাবাটা কে! সে কার লালসার ফল!

আমার জীবনে বাস্তবে দেখা এই পাগলি চরিত্রকে কেন্দ্র করে আমার একটা উপন্যাস আছে। জি, উপন্যাসটার নাম বলেই দিই, কী বলেন? মেঘদূত! হুম, উপন্যাসটার নাম হচ্ছে মেঘদূত। আর বাচ্চা মেয়েটার নাম হলো আশা!
________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে